সেদিনটা দেবদর্শনের সঙ্গে গল্প করেই কাটল। ভদ্রলোক কলেজের ছাপমারা ছাত্র নন বটে, কিন্তু সাহিত্য আর ইতিহাসের খবর রাখেন প্রচুর, সেসব শুনতে আরম্ভ করলে আর থামা যায় না।
বোধহয় পরের দিন চলে যাব বলেই দুপুরে দেবদর্শন খাওয়াদাওয়ার বিপুল আয়োজন করেছেন। ওঁর আর আমার একসঙ্গেই আহারের আয়োজন করা হয়েছে ভেতরবাড়িতে রান্নাঘরের বারান্দায়। খেতে বসে আমার চক্ষুস্থির! পূজোর পরাতের মত বিশাল কাসার পদ্মকাটা বগিথালায় চূড়ো করা সাদা ধপধপে তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত। ভাতের চূড়ায় ছোট্ট কাঁসার বাটিতে গাওয়া ঘি, জমবে না—ভাতের গরমে তরল থাকবে। আলাদা রেকাবিতে নুন-লেবু-লঙ্কা। জিরে জিরে করে কাটা আলুভাজা, এঁচোড়ের ডালনা, নারকেলের কুচি দেওয়া ঘন মুগের ডাল, বাঁশসলা ধানের চিড়ে দিয়ে রান্না পাকা রুইমাছের মুড়িঘন্ট, একহাত লম্বা চিতলমাছের পেটির তেলঝাল—সে পেটির লম্বা কাঁটা দিয়ে উলবোনা যায়। তারপর এল তেলকই, এক একখানা কই একবিঘত লম্বা, তেমনটি তোমরা আজকাল আর শহরবাজারে দেখবে না। কারুকে বিশ্বাস করতে বলছি না, কিন্তু এ সমস্ত পদই আমি বেশ ভাল পরিমাণে খেয়ে ফেললাম। ভাত নিলাম দুবার। তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত খেয়েছ কখনও? তাহলে বুঝতে, এখানে রান্না করলে গলির মোড়ের লোক জানতে পারে। এই পর্ব চুকলে এল ঘনদুধের সর, ক্ষীর আর পাকা মর্তমান কলা। তাও খেয়ে ফেললাম অনেক অনেক।
মধ্যাহ্নভোজনের পর বৈঠকখানায় বসে তামাক খেতে খেতে বললাম—লোকে আপনাকে রাজাবাবু বলে সে মিথ্যে কথা নয়। রাজবাড়ি ছাড়া এমন রান্নাবান্না হয় নাকি?
দেবদর্শন বললেন—এবার তো কিছু করতে পারলাম না ঠাকুরমশাই, একটু হঠাৎ হয়ে গেল কিনা। সত্যি যদি আবার আসেন, তখন আমাদের এই অঞ্চলের কিছু ভাল রান্না আপনাকে খাওয়াব। কত রান্না তো আমরা ভুলেই গিয়েছি, বাড়ির মেয়েরা অত ঝামেলা আর করতে চায় না। পদ্মচিনি খেয়েছেন কখনও? গয়নাবড়ি ভাজা? কিম্বা তিলজাউ? সব খাওয়াব, আমার বাড়ির মেয়েরা পারে—
দু-চারবার জোরে জোরে গড়গড়ার নলে টান দিয়ে দেবদর্শন বললেন—যদি পারেন তো পূজোর সময় আসবেন। এখন অবশ্য আর সেই পুরনো দিনের জাঁকজমক কিছুই নেই, তবু নয় নয় করেও মুখুজ্যেবাড়ির দুর্গোৎসব আজ পর্যন্ত এ অঞ্চলে বিখ্যাত। বংশানুক্রমে আজ দুশো বছর ধরে একই কুমোর ঠাকুর তৈরি করে, একই পুরোহিতবংশ পূজো করে, একই ঢাকিরা ঢাক বাজায়। প্রতিমার সামনে অষ্টমীর দিন রাত্তির থেকে কবির গান, যাত্রা—এসব হয়। যদি ভাগ্য ভাল থাকে, তাহলে সন্ধিপূজোর সময় গড়ের তোপও শুনতে পাবেন–
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—গড়ের তোপ কী জিনিস?
মুখুজ্যেমশাই বললেন—এটা আমাদের পরিবারে প্রচলিত একটা পুরোনো প্রবাদ। এখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে মুকুটশিলা গ্রামে আমার মামাবাড়ি। আমার প্রপিতামহীও ওই গ্রামেরই মেয়ে ছিলেন। তার বাপেরও ছিল বিশাল ভূসম্পত্তি, নদীর ধারে চওড়া উঁচু পাঁচিল দেওয়া এতবড় বাড়ি যে লোকে বলত ‘গড়’। সে বাড়িতে বিখ্যাত দুর্গোৎসব হত, দীয়তাং ভুজ্যতাং চলত পনেরোদিন ধরে। সন্ধিপূজোর সময়ে চারদিক কাঁপিয়ে কামান দাগা হত। লোকে বলত গড়ের তোপ। বিয়ের পর আমার প্রপিতামহী বাপেরবাড়ি যাওয়ার খুব একটা সুযোগ পেতেন না, সেকালে যেমন হত আর কি। একবার সকলকে বলে রাজি করিয়ে পূজোর সময় তিনি মুকুটশিলা যাবেন স্থির হল, কিন্তু পূজোর দশবারোদিন আগে বিষম সান্নিপাতিক জুরে প্রপিতামহী একেবারে শয্যাগত হয়ে পড়লেন। সঙ্কটাপন্ন অবস্থা, এখন যান তখন যান। কিন্তু সেই বিকারের মধ্যেও একটু জ্ঞান ফিরলেই বলতেন—আমার বাপেরবাড়ি যাওয়া হল না, পূজো দেখা হল না।
দীনদয়াল ভট্টাচার্য ছিলেন সে সময় আমাদের কুলগুরু। প্রপিতামহীর আক্ষেপ শুনে তিনি বলেছিলেন—মা, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, এইখান থেকেই তুমি সন্ধিপূজোর দিন মুকুটশিলা গ্রামের গড়ের তোপ শুনতে পাবে। এইখান থেকেই তুমি প্রণাম জানিও।
সবাই ভেবেছিল দীনদয়াল মুমূর্ষ রোগীকে সান্ত্বনা দিলেন মাত্র, কিন্তু প্রপিতামহ কথাটা আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বাস করেছিলেন। সন্ধিপূজোর সময় তিনি বসে রইলেন স্ত্রীর রোগশয্যার পাশে। গভীর রাত্রিতে ঠিক সন্ধিলগ্নে বহুদূর থেকে মাঠ বন খাল বিল পেরিয়ে ভেসে এল গড়ের তোপের শব্দ। গ্রামাঞ্চল তো, তারপর সেকালের ব্যাপার, হুহু করে ঘটনাটা রটে গেল চারদিকে। এখন জিনিসটা কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁচেছে। প্রতি বছরেই নাকি কেউ কেউ শুনতে পায় গড়ের তোপের আওয়াজ–
বললাম—তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? শোনাই তো যেতে পারে–
দেবদর্শন আমার দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বললেন—না, তা যেতে পারে না। আগে বলিনি বোধহয়, জয়তলা থেকে মুকুটশিলার দূরত্ব চল্লিশ মাইল।
চুপ করে রইলাম। সত্যিই তো, যতই নির্জন আর শান্ত পরিবেশ হোক, চল্লিশ মাইল দূর থেকে কামানের আওয়াজ শুনতে পাওয়া সম্ভব নয়।
জিজ্ঞাসা করলাম–আপনি কখনো শুনেছেন?
মুখুজ্যেমশাই বললেন—বাল্যে দু-একবার শুনতে পেয়েছি বোধহয়, পরিষ্কার স্মৃতি কিছু নেই। বড় হবার পর তেমনভাবে কখনও নয়—
—তেমনভাবে নয় বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
–সেভাবে কানখাড়া করে কখনও বসে থাকিনি তো। বড় হতে আরম্ভ করলে কিছু কিছু বিশ্বাসের ভিত্তি নড়ে যায়। তবে দু-একবার যেমন আমার বিয়ের বছর-হঠাৎই শুনতে পেয়েছিলাম তোপের শব্দ। অন্যমনস্ক ছিলাম, নইলে হয়ত আরও স্পষ্ট শুনতে পেতাম। গ্রামের লোকেদের মধ্যে কিন্তু এ প্রসঙ্গে গভীর বিশ্বাস আছে, তারা অনেকেই শুনেছে গড়ের তোপ। তবে তাদের কথা আমি ধরি না, অতিরিক্ত বিশ্বাসে আর ভক্তিতে মানুষ অনেক কিছু দেখে বা শোনে যার কোনও বাস্তব মূল্য নেই।