এখন অদ্ভুত কথা বলি। লিচুতলাতেই জ্বিন নামক Entity-র সঙ্গে আমার কথা হয়। বিষয়টা আর কিছুই না, আমার হেলুসিনেশন। প্রবল শোক, মানসিক চাপ মানুষকে হেলুসিনেশনের জগতে নিয়ে যায়। সন্তানহারা পিতামাতা প্রবল মানসিক যাতনার সময় তার মৃত সন্তানকে জীবিত দেখেন। তার সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হন। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। আমার সঙ্গে জ্বিনের কথোপকথনের অংশ এই কারণেই লেখা অবান্তর মনে করছি।
মূল গল্পে ফিরে যাই। তালা ভেঙে জিন ছালামকে নিয়ে গেছে, ঘটনাটি আমি এই কারণেই চাপা দিতে চাইলাম। ‘শ্রাবণ মেঘের দিনের’ অবস্থা যেন আবার না হয়। শুটিং বন্ধ করে যেন অঞ্চলছাড়া হতে না হয়।
কঠিন বিধিনিষেধ কাজ করল। আউটডোর শুটিং ঝামেলা ছাড়াই শেষ করে ঢাকায় ফিরলাম। মাথায় গল্প ঘুরপাক খেতে লাগল। প্রবল ডিলিউশনের শিকার এক মানুষের গল্প। যে ছালামের মতো জ্বিনকন্যার প্রেমে পড়ে এবং একসময় বিশ্বাস করে, জ্বিনকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। তাদের একটি সন্তানও হয়। জ্বিনকন্যা একসময় সন্তান নিয়ে তার দেশে পালিয়ে যায়। মানুষটা তার সন্তানকে ফিরে পেতে ব্যস্ত। কী করে ফেরত পাবে তা সে জানে না। জ্বিনের দেশ কোথায়, কীভাবে সেখানে যাওয়া যায়, তাও তার কাছে অজানা।
জ্বিন-বিষয়ে আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে বলেই এ নিয়ে গল্প ফাঁদা বিপজ্জনক। এমন কিছু লিখে ফেললাম যা ধর্মগ্রন্থ স্বীকার করে না তাহলে মহাবিপদ। বায়তুল মোকাররম থেকে শুক্রবার জুমার নামাজের পর মিছিল বের হতে পারে। রগকাটা স্কোয়াড বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে পথে নামতে পারে। আমাকে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করা হতে পারে। অতীতে আমাকে একবার মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছে। বার বার মুরতাদ হওয়া কোনো কাজের কথা না। যা লিখব তা ভালোমতো জেনে লিখতে হবে।
জ্বিন-বিষয়ে কেউ আমাকে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারলেন না। যেসব তথ্য পেলাম সবই আমার জানা। যেমন, সন্ধ্যার পর জ্বিন মিষ্টির দোকানে গিয়ে মিষ্টি খায়। তারা যে নগরে বাস করে তার নাম কোহকাফ নগর।–এইসব।
জ্বিন-বিষয়ে একটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেল। আরবি ভাষায় লেখা এই জ্বিন আকরগ্রন্থের লেখক আল্লামা বদরুদ্দীন শিবলী (রহঃ)। ৭২৯ হিজরিতে লেখা বইটির নাম আকাসুল মারজানি ফী আহকামিল জ্বান। এর উর্দু তর্জমা করেন পাকিস্তানের আলেম ইমাদুল্লাহ আনোয়ার। তিনি জ্বিন-বিশ্বকোষের নাম দেন তারিখে জিতে ওয়া শায়াত্বীন। এই বইটির একটি বাংলা তর্জমা আমার হাতে আছে। জ্বিন-বিষয়ক বইটিতে নবিজীর (দঃ) যেসব হাদিস ব্যবহার করা হয়েছে তার বেশিরভাগই আমার কাছে সহি হাদিস বলে মনে হয় নি। আলেমরা ভালো বলতে পারবেন।
জ্বিন ও মানুষের মধ্যে বিয়ে একদল আলেম বলছে বৈধ, একদল বলছে মকরুহ। আবার হানাফি মাজহাব বলছে অবৈধ, কারণ মানুষ ও জ্বিন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতি।
জ্বিনের বেশ কিছু শ্রেণীবিভাগ আছে। একশ্রেণীর জ্বিন ইচ্ছামতো অন্য আকৃতি ধারণ করতে পারে।
একজন আলেম ইমাম সাআলাবী (রহঃ) কোরআন শরিফের নিচের আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেছেন, জ্বিন-মানুষের যৌনক্রিয়ায় সন্তান উৎপাদন সম্ভব।
আল্লাহ শয়তানকে বলছেন, তুই মানুষের সম্পদে ও সন্তানে শরিক হয়ে যা।
জটিল ধর্মতত্ত্বে আমি গেলাম না। জ্বিন-মানুষের বিয়ের অংশটি নিয়ে গল্প লেখা শুরু করলাম। গল্পের নাম দিলাম—
অংক শিক্ষক হাদিসউদ্দিন
এবং
জ্বিনকন্যা বিবি মোহতেরমা
একজন লেখকের মাথায় গল্প কীভাবে আসে পাঠক এখন নিশ্চয়ই খানিকটা ধারণা পাচ্ছেন। গল্পটির বীজ বোনা হয়েছিল নুহাশপল্লীতে শ্রাবণ মেঘের দিন ছবি তৈরির সময়। ছালাম সেই বীজে পানি দিল। বীজ থেকে অঙ্কুর বের করায় সাহায্য করল।
নুহাশপল্লীর একটি ঘটনা বলে এই লেখাটি শেষ করছি।
কাঠের বাড়ি ভেঙে নুহাশপল্লীতে পাকা দালান বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সবার আগে ভাঙা হলো আমার ঘর। ফলস সিলিং ভাঙতেই দুটা প্রকাণ্ড দাঁড়াস সাপ নেমে এল। কার্বলিক অ্যাসিড অগ্রাহ্য করে এরা দিব্যি বাস করছিল। আমি মশারি খাটাই না। কে জানে রাতে কতবার এরা আমার গায়ের উপর দিয়ে গিয়েছে।
মাওলানা সাহেবের কথায়, জ্বিনেরা সাপের রূপ ধরতে পছন্দ করে। তাহলে এই দুটি সাপ কি জ্বিন? নুহাশপল্লীর লোকজন যখন সাপ দুটিকে পিটিয়ে মারল তখন কি তাদের উচিত ছিল না সর্পরূপ বাদ দিয়ে জ্বিনরূপে পালিয়ে যাওয়া?
ডায়েরি
পৃথিবীখ্যাত জাপানি পরিচালক কুরাশুয়াকে জিজ্ঞেস করা হলো, একজন বড় পরিচালক হতে হলে কী লাগে?
কুরাশুয়া জবাব দিলেন, একজন ভালো অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর লাগে।
এডগার এলেন পো-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, একজন বড় লেখক হতে হলে কী লাগে?
তিনি জবাব দিলেন, একটা বড় ডাস্টবিন লাগে। লেখা নামক যেসব আবর্জনা তৈরি হবে তা ফেলে দেওয়ার জন্যে।
লেখকরা ক্রমাগতই আবর্জনা তৈরি করেন। নিজেরা তা বুঝতে পারেন না। একজীবনে আমি কী পরিমাণ আবর্জনা তৈরি করেছি ভেবেই শঙ্কিত বোধ করছি। ‘ফাউনটেনপেন’ সিরিজের লেখাগুলি কি আবর্জনা না? যখন যা মনে আসছে লিখে যাচ্ছি। চিন্তাভাবনার প্রয়োজন বোধ করছি না। লেখকে চিন্তাভাবনাহীন লেখা পাঠক যখন পড়েন তখন তারাও চিন্তাভাবনা করেন না। এই জাতীয় লেখার ভালো আশ্রয় ডাস্টবিন, পত্রিকার পাতা না। ঠিক করেছি কিছুদিন ফাউনটেনপেন বন্ধ থাকবে। ইমদাদুল হক মিলনকে বলব, ফাউনটেনপেনের কালি শেষ হয়ে গেছে।