Site icon BnBoi.Com

বিবিধ/অগ্রন্থিত গল্প – হুমায়ূন আহমেদ

বিবিধ অগ্রন্থিত গল্প - হুমায়ূন আহমেদ

অসুস্থতা নাকি অন্য কিছু?

গুলশান এলাকায় মুক্তি নামের একটা ক্লিনিক আছে৷ মানসিক রোগী, ড্রাগ অ্যাডিক্ট ধরনের সমস্যার চিকিৎসা করা হয়৷ মুক্তি ক্লিনিকের একজন চিকিৎসক (ঢাকা মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগের প্রফেসর) একদিন আমাকে ক্লিনিকে ডেকে পাঠালেন৷ তার কিছু বিশেষ ধরনের রোগীর চিকিৎসায় আমার সাহায্য প্রয়োজন৷

আমি অবাক হয়েই গেলাম৷ ভদ্রলোক অভিযোগের মতো করে বললেন, আপনি এসব কী করছেন? লেখার মাধ্যমে সমাজে অসুস্থতা ছড়াচ্ছেন? হিমু আবার কী?

আমি বিনীত ভঙ্গিতে হিমু কী ব্যাখ্যা করলাম৷ প্রফেসর সাহেব ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হলেন না৷ গলা কঠিন করে বললেন, হিমু উপন্যাসের কোনো চরিত্র না৷ হিমু হলো একটা ব্যাধির নাম৷ তা কি আপনি জানেন?

আমি জানি না৷

হিমু ছোঁয়াচে ধরনের ব্যাধি৷ কনটেজিয়াস ডিজিজ৷ এই ডিজিজ আপনি ছড়াচ্ছেন৷ আপনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন৷ অবশ্যই আপনার লেখালেখি বন্ধ করে দেওয়া দরকার৷ লেখকরা সমাজের উপকার করেন৷ আপনি করছেন অপকার৷ ইজ ইট ক্লিয়ার?

এখনো ক্লিয়ার না৷ আপনি ব্যাখ্যা করলে বুঝব৷

ডাক্তার সাহেবের কাছে জানলাম, মুক্তি ক্লিনিকে অনেক বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের চিকিৎসার জন্য পাঠান যারা হিমু নামক অদ্ভুত অসুখে ভুগছে৷ এরা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে৷ গভীর রাতে কাউকে কিছু না বলে হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়৷ কয়েকদিন কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না৷ তারা মনে করে, ঐশ্বরিক কিছু ক্ষমতা তাদের হয়েছে৷ তারা যা বলবে তাই হবে৷

আমি বললাম, এই মুহূর্তে আপনার ক্লিনিকে কি কোনো হিমু আছে যার চিকিৎসা চলছে? ডাক্তার সাহেব দু:খিত গলায় বললেন, তিনজন ছেলে হিমু আছে৷ একটা আছে মেয়ে হিমু৷ মেয়ে হিমুর কী আলাদা নাম আছে?

আমি বললাম, মেয়ে হিমুর আলাদা কোনো নাম নেই৷ মেয়ে হিমুও হিমু৷ যদিও কেউ কেউ বলেন হিমি৷ আমার হিমি পছন্দ না৷

ডাক্তার সাহেব বললেন, যে তিন ছেলে হিমু আছে তার দুটা হিমু হওয়ার পরে ড্রাগ ধরেছে৷ ভয়ঙ্কর একডিলিউশনে ভুগছে৷ আসুন আপনার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেই৷ কী প্রচণ্ড ডিলিউশনে যে এরা ভুগছে দেখে আপনারই খারাপ লাগবে৷

আমি ওদের দেখতে গেলাম৷ সত্যি মনটা খারাপ হলো৷ জীবনের আনন্দে এদের ঝলমল করা উচিত ছিল৷ তা না, স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ক্লিনিকে৷ চোখের দৃষ্টিতে ঘোর৷ জীবন থেকে বিতাড়িত কিছু যুবক৷ আমি তাদেরকে ব্যাখ্যা করলাম যে, হিমু ফিকশন ছাড়া কিছু না৷ হিমুর চিন্তাভাবনা বা হিমুকে নিয়ে লেখকের চিন্তাভাবনা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার কিছু নেই৷ যেহেতু হিমুকে নিয়ে বইগুলো আমি লিখেছি, আমি জানি৷

যুবকদের ভেতর একজন চাপা গলায় বলল, হিমুর বিষয়ে আমরা যা জানি আপনি তা জানেন না৷ আমি চমৎকৃত হয়ে বললাম, তোমরা কী জানো?

যুবক গলা আরও নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, প্রতিটা বড় শহরে একজন প্রধান হিমু থাকেন৷ তিনি শহর কন্ট্রোল করেন৷ অনেক রাতে হাঁটাহাঁটি করলে উনার দেখা পাওয়া যায়৷

উনি কী পীর টাইপ কেউ?

উনি পীরের বাবা!

যারা পীরের বাবার দেখা পেয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন৷ আমি চুপ করে গেলাম৷ একটা বিষয় আমাকে অবাক করল, হিমুর লেখককে নিয়ে তাদের নিস্পৃহতা৷ হিমুর যে জগৎ তারা তৈরি করেছে সেখানে আমার স্থান নেই৷

চিকিৎসাধীন মহিলা হিমুকে দেখতে গেলাম৷

কলেজ পড়া বাচ্চা একটা মেয়ে৷ সে কোনো এক হিমুর বইতে পড়েছে গভীর রাতে নির্জন রাস্তাগুলো সব নদী হয়ে যায়৷ হিমুরা সেই নদী দেখতে পায়৷ কাজেই এই মেয়ে রাস্তার নদী হওয়ার দৃশ্য চাক্ষুষ দেখার জন্য এয়ারপোর্ট চলে গেল৷ অনেক দূর দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে চলে গেল রানওয়েতে৷ গভীর রাতে রানওয়ের মাঝখানে ঘাপটি মেরে বসে রইল৷

কোনো এক বিমানের পাইলট ল্যান্ড করতে এসে এই দৃশ্য দেখে প্রায় ভিরমি খেলেন৷ জানালেন কন্ট্রোল টাওয়ারকে৷ পুলিশ এসে মেয়েটিকে গেপ্তার করল৷ মেয়ের মা উপায় না দেখে তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করলেন৷

মেয়েটি এখন সুস্থ৷ মেয়ের মা মেয়েকে নিয়ে নুহাশ পল্লীতে এসেছিলেন৷ আমি তাকে দিয়ে মিউজিক ভিডিওতে কিছু কাজও করিয়েছি৷ হিমুর এই ব্যাপারে আমি বুঝতে পারছি না৷ কেন কিছু মানুষ হিমুকে সত্যি ভাববে? এদের সাইকি কি আলাদা?

নিউইয়র্কের এক মহিলার কথা বলি৷ বাঙালি মহিলা৷ স্বামীর সঙ্গে বাস করেন৷ স্বামী ট্যাক্সি চালান৷ তিনি নিজেও ইন্ডিয়ান শাড়ির দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করেন৷ ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা হচ্ছে৷ এক পর্যায়ে তিনি বললেন, হুমায়ূন ভাই, হিমু নিউইয়র্কে বেড়াতে এসেছে এরকম একটা উপন্যাস লিখুন৷

আমি বললাম, লেখা যেতে পারে৷

ভদ্রমহিলা বললেন, হিমুর আসা-যাওয়ার খরচ আমি দেব৷ সে আমাদের বাসায় থাকবে৷

এবার আমি চমকালাম৷ উপন্যাসের একটি চরিত্রের জন্য আসা-যাওয়ার খরচ দিতে হয় না৷ তার ঘুমুবার জন্য খাট লাগে না৷ আমি বললাম, হিমু আপনার বাড়িতে থাকবে?

তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ৷ তার সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে৷ সে যে কদিন আমার সঙ্গে থাকবে আমি কাজ করব না৷ ছুটি নেব৷

আমি বললাম, আপনি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন হিমু বলে কেউ নেই৷ হিমু আমার কল্পনার একটি চরিত্র৷

ভদ্রমহিলা রাগত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি তাকে নিউইয়র্কে আনতে রাজি না সেটা সরাসরি বললেই হয়৷ অযুহাত দেওয়া শুরু করেছেন৷

আমি চুপ করে গেলাম৷ কিছুক্ষণের জন্য আমার মধ্যেও বিভ্রম তৈরি হলো৷ আসলেই হিমু বলে কেউ আছে না কি?

একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম-মৃত্যু

অধ্যাপক ইউনূস সাহেবের এক যুগ আগে বর্তমান চলমান রাজনীতিতে হতাশ হয়ে আমরা একটা রাজনৈতিক দল করেছিলাম৷ দলের নাম হিমু দল, ইংরেজিতে হিমু পার্টি৷ দলের জন্য হলুদ কাগজে প্যাড ছাপানো হলো৷ রাত জেগে গঠনতন্ত্র লেখা হলো৷ তিনটি স্তম্ভের ওপর দল৷ প্রথম স্তম্ভ সততা৷ দ্বিতীয় স্তম্ভ সততা৷ তৃতীয় স্তম্ভ সততা৷

অসৎ রাজনীতিবিদদেরও দলে আনার বিধান ছিল৷ তারা প্রথমে যাবে বায়তুল মোকাররমে৷ সেখানকার খতিব তাদের তওবা পড়াবেন৷ এরপর আসবেন শহীদ মিনারে৷ সেখানে তাদের সততার পরিমাণ অনুযায়ী কানে ধরে উঠবস করবেন৷ তারপর সোনা-রুপার পানি দিয়ে তাদের গোসল করিয়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরিয়ে দেওয়া হবে৷ দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যদি কেউ অন্যায় করেন, সঙ্গে সঙ্গে জাহাজে করে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে নিঝুম দ্বীপে৷ দ্বীপে পাঠানোর আগে কপালে সিল দিয়ে দেওয়া হবে৷ সিলে বাংলা এবং ইংরেজিতে লেখা থাকবে – অসৎ – Dishonest৷

সৎ মানুষের খোঁজে আমাদের লোকজন ঘুরে বেড়াবে৷ জীবনে কখনো কোনো অন্যায় করেননি এবং মিথ্যা কথা বলেননি – এমন লোককে বানানো হবে প্রেসিডেন্ট৷ সাংসদদের সাইকেল চালনায় পারদর্শী হতে হবে৷ কারণ তারা সাইকেলে করে অঞ্চল ঘুরে বেড়াবেন৷ সংসদ চলাকালীন সময়ে তারা শুধু ঢাকায় আসবেন, বাকি সময়টা থাকতে হবে অঞ্চলে৷ মন্ত্রীরা মন্ত্রীপাড়ায় থাকবেন না৷ তাদের জন্য লম্বা টিনের চালা করে চৌকি পেতে দেওয়া হবে৷ হোস্টেলের মতো ব্যবস্থা৷ তারা সচিবালয়ে হেঁটে যাতায়াত করবেন৷

আলাদা কিছু মন্ত্রণালয় খোলার পরিকল্পনা আমাদের ছিল, যেমন ভিক্ষুক মন্ত্রণালয়৷ এই মন্ত্রণালয় শুধু যে দেশের ভিক্ষুকদের সমস্যা দেখবে তা না৷ বিদেশ থেকে ভিক্ষা আনার ব্যাপারটাও তারা দেখবে৷ হাসি মন্ত্রণালয়৷ এই মন্ত্রণালয় দেখবে দেশের মানুষ যেন হাসতে পারে ইত্যাদি৷

হিমু পার্টি গঠনের পর সপ্তাহে একদিন পার্টির বৈঠক বসতে লাগল৷ আমরা চাঁদাবাজিও শুরু করলাম৷ পার্টির জন্য চাঁদা তোলা হতে লাগল৷ মেম্বাররা প্রতি সপ্তাহে যার যা মন চায় চাঁদা একটি কাঠের বাক্সে জমা করতে লাগলেন৷ মাসের শেষে দেখা গেল, নয় শ টাকা হয়েছে৷ এই টাকায় পার্টির কাউন্সিল মেম্বাররা একটা করে হলুদ পাঞ্জাবি এবং চাদর কিনলেন৷ দলের টাকা ব্যক্তিগত হলুদ পাঞ্জাবির পেছনে খরচ করার কারণে কাউন্সিল মেম্বাররা আজীবনের জন্য হিমু রাজনীতি থেকে বহিষ্কৃত হলেন৷ সঙ্গে সঙ্গে হিমু দলও বাতিল হয়ে গেল৷

কত না অশ্রুজল

১৬ ডিসেম্বর, ভোর। ১৯৭১।
আমার বুক ধক ধক করছে। বাজিছে বুকে সুখের মতো ব্যথা। বিশ্বাসই হচ্ছে না, আমরা স্বাধীন। এখন আর
মাথা উঁচু করে হাঁটতে সমস্যা নেই।… ‘নিজের দেশের মাটি/দবদবাইয়া হাঁটি।’
আমি দবদবিয়ে হাঁটার জন্যে বের হলাম। প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে আমার ছোট ভাইকে (জাফর ইকবাল)। শুনেছি, সে যাত্রাবাড়ীতে আছে। গর্তে বাস করে। যাত্রাবাড়ীতে আমার দূরসম্পর্কের এক মামা বাড়ির পেছনে গর্ত করেছেন। তিনি তাঁর স্ত্রী এবং দুই ছেলে নিয়ে গর্তে বাস করেন। জাফর ইকবাল যুক্ত হয়েছে তাদের সঙ্গে। পরিবারটি দরিদ্র। গত ঈদে সে বাসায় পোলাও রান্না হয়নি। মামা তার বাচ্চাদের বলেছেন, দেশ যেদিন স্বাধীন হবে, সেদিন পোলাও-কোর্মা রান্না হবে। আজ হয়তো সে বাড়িতে পোলাও রান্না হচ্ছে।
আমার সঙ্গে আছেন আনিস ভাই (আনিস সাবেত)। আমরা দু’জন এতদিন জিগাতলার এক বাড়িতে বাস করেছি। বাড়ির গৃহকর্তা এবং গৃহকর্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অচেনা দুই যুবককে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আজ এই মহানন্দের দিনে তাদের ছেড়ে যাচ্ছি কেন? জানি না, কেন। আজ ঘরের ভেতর থাকতে ইচ্ছা করছে না। অনেকদিন তো বন্দি থাকলাম। আর কেন!
বিজয়ের দিনটা কেমন ছিল? ঘোরলাগা দিনের স্মৃতি কখনও স্পষ্ট থাকে না। জলরঙে আঁকা ছবি পানিতে ভিজিয়ে রাখলে সব ঝাপসা হয়ে যায়। একটা রঙের সঙ্গে অন্যটা মিশে কুয়াশা কুয়াশা ভাব হয়। সেদিন কিন্তু কুয়াশাও ছিল। কুয়াশার ভেতর থেকে হুট করে একটা জিপগাড়ি উদয় হলো। গাড়িভর্তি মুক্তিযোদ্ধা। আশেপাশের বাড়ি থেকে ছুটে আসছে মহিলারা, শিশুরা। সবার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। তাদের গলায় বিস্ময় ধ্বনি_ মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযোদ্ধা। গোপন যোদ্ধারা আজ প্রকাশিত। আহা কী আনন্দ!
মুক্তিযোদ্ধারা ভালোবাসার প্রতিদানে গলা ফাটিয়ে জয়ধ্বনি করল, জয়বাংলা! উপস্থিত সবাই গলা মিলাল, জয়বাংলা! কুয়াশার ভেতর থেকে জিপগাড়ি এসেছিল, সেই গাড়ি মিলিয়ে গেল কুয়াশায়। রাস্তার মাথায় একটা চায়ের দোকান খুলেছে। আনিস ভাই বললেন, চলো, স্বাধীন দেশে প্রথম চা খাই।
আমরা এগিয়ে গেলাম। চা খাওয়া হলো না। চায়ের পানি গরম হয়নি। আনিস ভাই বললেন, দু’টা ক্যাপস্টেন সিগারেট দাও। আজ সিগারেট খাব। দু’জনই গম্ভীর ভঙ্গিতে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগলাম। আমার জীবনের প্রথম সিগারেট খাওয়া। দিনটাকে মনে রাখার জন্যে নতুন কিছু করা। অদ্ভুত কিছু করা। কী করলে আনন্দ প্রকাশ করা যায়, তাও মাথায় আসছে না।
জিগাতলার বাজারের গলির ভেতর দিয়ে আসছি, হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলো। আটকেপড়া বিহারিরা গুলি ছুড়ছে। গলি দিয়ে লোক চলাচল বন্ধ। আনিস ভাই বললেন, আজ আমাদের গায়ে গুলি লাগবে না, চলো যাই।
সেদিন গোলাগুলির ভেতর দিয়ে গিয়েছিলাম, নাকি গুলি থামার জন্যে অপেক্ষা করেছি, তা আর মনে করতে পারছি না। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এসে দু’জন থমকে দাঁড়ালাম। রাস্তা এবং ফুটপাতে একটি পুরো পরিবারের মৃতদেহ। এরা বিহারি। ছোট শিশু আছে। একটি কিশোরীও আছে। কিশোরীর মুখশ্রী কত না সুন্দর! আমার বুকের ভেতর প্রচণ্ড হাহাকার তৈরি হলো। সেই হাহাকারের কিছুটা আমি এখনও বহন করি।
এই স্বাধীন দেশের পেছনে কত না অশ্রুজল। আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি এই ব্যাপারটা বুঝবে? ১৯৭১-এর কথা এলেই রক্তের কথা চলে আসে। ‘রক্তস্নাত বাংলা’, ‘রক্তের ঋণ’ এইসব। অশ্রুর কথা সেভাবে আসে না।
আমার বাবাকে মিলিটারিরা গুলি করে মেরেছিল। সেই ভয়ঙ্কর দিনে তাঁর শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। একই সঙ্গে গত আটত্রিশ বছর ধরে তাঁর স্ত্রী, তাঁর ছেলেমেয়ে চোখের পানি ফেলছে। তারা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিনই অশ্রু বর্ষণ করবে। শুধু রক্তের হিসাব রাখব, অশ্রুর হিসাব রাখব না_ তা কি হয়?
মহান বিজয় দিবসে আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতর গভীর বেদনাবোধও তৈরি হয়। বারবার মনে হয়, ‘কত না অশ্রুজল।’
‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে/কত প্রাণ হল বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে’

জলিল সাহেবের পিটিশন

তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘আমি দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাবা। সেভেনটি ওয়ানে আমার দুটি ছেলে মারা গেছে। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ভদ্রলোকের চেহারা বিশেষত্বহীন। বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়। সে তুলনায় বেশ শক্ত-সমর্থ। বসেছেন মেরুদণ্ড সোজা করে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ। চশমা-টশমা নেই। তার মানে, চোখে ভালোই দেখতে পান। আমি বললাম, আমার কাছে কী ব্যাপার?
ভদ্রলোক যেভাবে বসেছিলেন, সেভাবেই বসে রইলেন। সহজ সুরে বললেন, ‘একজনের ডেডবডি পেয়েছিলাম। মালিবাগে কবর দিয়েছি। আমার ছোট মেয়ের বাড়ি আছে মালিবাগে।’
:তাই নাকি?
:জি, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া।
:আমার কাছে কেন এসেছেন?
:গল্পগুজব করতে আসলাম। নতুন এসেছেন এ পাড়ায়। খোঁজ-খবর করা দরকার। আপনি আমার প্রতেবেশী।
ভদ্রলোক হাসি মুখে বসে রইলেন। আমার সন্দেহ হলো, তিনি সত্যি সত্যি হাসছেন না। তার মুখের ফাটাটাই হাসি হাসি। ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমি আপনার পাশের গলিতেই থাকি।’
:তাই নাকি?
:জি। ১৩/২, বাসার সামনে একটা নারিকেল গাছ আছে, দেখেছেন তো?
আমি দেখিনি। তবু মাথা নাড়ালাম। ভদ্রলোকের চরিত্র স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সম্ভবত অবসর জীবন যাপন করেছেন। কিছুই করার দরকার নেই। সময় কাটানোই বোধ হয় তার এখন সমস্যা। যার জন্য ছুটির দিনে প্রতিবেশী খুঁজতে হয়।
:আমার নাম আব্দুল জলিল।
আমি নিজের নাম বলতে গেলাম। ভদ্রলোক বলতে দিলেন না! উঁচু গলায় বললেন, ‘চিনি, আপনাকে চিনি।’
:চা খাবেন? চায়ের কথা বলি?
:জি না। আমি চা খাই না। চা-সিগারেট কিছুই খাই না। নেশার মধ্যে, পান খাই।
:পান তো দিতে পারব না। এখানে কেউ পান খায় না।
:পান আমার সঙ্গেই থাকে। ভদ্রলোক কাঁধের ঝোলাতে হাত ঢুকিয়ে পানের কৌটা বের করলেন। বেশ বাহারি কৌটা। টিফিন কেরিয়ারের মতো তিন-চারটা আলাদা বাটি আছে। আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করলাম। ভদ্রলোক লম্বা পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন। সারা সকালটাই হয়তো এখানে কাটাবেন। দুঃখ-কষ্টের গল্প অন্যকে শোনাতে সবাই খুব পছন্দ করে। ভদ্রলোক একটু ঝুঁকে এসে বললেন, ‘প্রফেসার সাহেব, আপনি একটা পান খাবেন?’
:জি না।
:পান কিন্তু শরীরের জন্য ভালো। পিত্ত ঠান্ডা রাখে। যারা পান খায়, তাদের পিত্তের দোষ হয় না।
:তাই নাকি?
:জি। পানের রস আর মধু হলো গিয়ে বাতের খুব বড় ওষুধ।
আমি ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে দশটা। আজ ইউনিভার্সিটি নেই। থাকলে ভালো হতো। বলা যেত, ‘কিছু মনে করবেন না, এগারটার সময় একটা ক্লাস আছে, আপনি অন্য আরেক দিন সময় হাতে নিয়ে আসুন।’ ছুটির দিনে এ রকম কিছু বলা যায় না।
ভদ্রলোক তার পানের কৌটা খুলে নানা রকম মসলা বের করলেন। প্রতিটি শুঁকে শুঁকে দেখলেন। পান বানালেন অত্যন্ত যত্নে। যিনি পান বানানোর মতো তুচ্ছ ব্যাপারে এতটা সময় নষ্ট করেন, তিনি যে আজ দুপুরের আগে নড়বেন না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু আশ্চর্য, ভদ্রলোক পান মুখে দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। হাসি মুখে বললেন, ‘যাই, আমি অনেকটা সময় নষ্ট করলাম।’ বিস্ময় সামলে আমি আন্তরিকভাবেই বললাম, ‘বসুন, এত তাড়া কিসের?’ তিনি বললেন, ‘না।’ আমি তাঁকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ফেরার পথে দেখি, বাড়িওয়ালা ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘প্রফেসর সাহেবকে ধরেছে বুঝি? সিগনেচার করেছেন?’
:কী সিগনেচার?
:জলিল সাহেবের পিটিশনে সিগনেচার করেননি?
:পিটিশনটা কিসের?
:আমাকে বলতে হবে না। নিজেই টের পাবেন। হাড় ভাজা করে দেবে। কোনো প্রশ্রয় দেবেন না।
অস্পষ্ট একটা অস্বস্তি নিয়ে ঘরে ফিরলাম। নতুন পাড়ায় আসার অনেক বিরক্তিকর ব্যাপার আছে। নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে হয়। সে পরিচয় অনেক সময়ই সুখকর হয় না। তবে জলিল সাহেব প্রসঙ্গে ভয়টা বোধ হয় অমূলক। এরপর তাঁর সঙ্গে দুবার দেখা হলো। বেশ সহজ-স্বাভাবিক মানুষ। একবার দেখা গ্রিন ফার্মেসির সামনে। তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এলেন,—প্রফেসর সাহেব না? ভালো আছেন?
:জি, ভালো। আপনি ভালো আছেন? কই, আর তো আসলেন না?
:সময় পাই না। খুব ব্যস্ত পিটিশনটার ব্যাপারে।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ক্লাসের দোহাই দিয়ে রিকশায় উঠে পড়লাম। দ্বিতীয়বার দেখা হলো নিউ মার্কেটের একটা নিউজ স্ট্যান্ডের সামনে। দেখি, তিনি উবু হয়ে বসে একটির পর একটি পত্রিকা খুব দ্রুত পড়ে শেষ করছেন। হকার ছেলেটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাঁকে দেখছে।
:কী জলিল সাহেব, কী পড়ছেন এত মন দিয়ে?
জলিল সাহেব আমার দিকে তাকালেন। মনে হয়, ঠিক চিনতে পারছেন না। তাঁর চোখে চশমা।
:চশমা নিয়েছেন নাকি?
:জি। সন্ধ্যা হলে মাথা ধরে। প্লাস পাওয়ার। ভালো আছেন, প্রফেসার সাহেব?
: জি, ভালো।
:যাব একদিন আপনার বাসায়। পিটিশনটা দেখাব আপনাকে। চৌদ্দ হাজার তিন শ সিগনেচার জোগাড় হয়েছে।
: কিসের পিটিশন?
:পড়লেই বুঝবেন। আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ, আপনাদের বুঝতে কষ্ট হবে না।
আমার ধারণা ছিল, সরকারের কাছে কোনো সাহায্য চেয়ে পিটিশান করা হয়েছে। সেখানে চৌদ্দ হাজার সিগনেচারের ব্যাপারটা বোঝা গেল না। আমি নিজে থেকেও কোনো আগ্রহ দেখালাম না। জগতে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা কম নয়। সিগনেচার সংগ্রহ যদি কারও নেশা হয়, তা নিয়ে আমার উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু উদ্বিগ্ন হতে হলো। জলিল সাহেব এক সন্ধ্যায় তাঁর চৌদ্দ হাজার তিন শ সিগনেচারের ফাইল নিয়ে আমার বাসায় উপস্থিত হলেন। হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘ভালো করে পড়েন, প্রফেসর সাহেব।’ আমি পড়লাম। পিটিশনের বিষয়বস্তু হচ্ছে—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দশ লাখ ইহুদি মারা গিয়েছিল। সেই অপরাধে অপরাধীদের প্রত্যেকের বিচার করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কিন্তু এ দেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষ মেরে অপরাধীরা কি করে পার পেয়ে গেল? কেন এ নিয়ে আজ কেউ কোনো কথা বলছে না। জলিল সাহেব তাঁর দীর্ঘ পিটিশনে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন, যেন এদের বিচার করা হয়।
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমার দুটি ছেলে মারা গেছে। সেই জন্যই যে আমি এটা করছি, তা ঠিক না। আমার ছেলে মারা গেছে যুদ্ধে। ওদের মৃত্যুর জন্য আমি কোনো বিচার চাই না। আমি বিচার চাই তাদের জন্য, যাদের ওরা ঘরে থেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। আমার কথা বুঝতে পারছেন?’
:পারছি।
:জানি পারবেন। আপনে জ্ঞানী-গুণী মানুষ। অনেকেই পারে না। বুঝলেন ভাই, অনেকে মানবতার দোহাই দেয়। বলে, বাদ দেন। ক্ষমা করে দেন। ক্ষমা এত সস্তা? অ্যাঁ, বলেন সস্তা?
আমি কিছু বললাম না। জলিল সাহেব পানের কৌটা বের করে পান সাজাতে বসলেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘আপনি কি মনে করেছেন, আমি ছেড়ে দেব? ছাড়ব না। আমার দুই ছেলে ফাইট দিয়েছে। আমিও দেব। মৃত্যু পর্যন্ত ফাইট দেব। দরকার হলে বাংলাদেশে প্রতিটি মানুষের সিগনেচার জোগাড় করব। ত্রিশ লক্ষ লোক মরে গেল, আর কেউ কোনো শব্দ করল না? আমরা মানুষ না অন্য কিছু, বলেন দেখি?’
আমি সিগনেচার ফাইল উল্টে দেখতে লাগলাম। খুব গোছানো কাজ-কর্ম। সিগনেচারের পাশে বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা। স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহত আত্মীয়-স্বজনের নাম-ঠিকানা।
:অনেকেই মনে করে, আমার মাথা ঠিক নাই। এক পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম, সম্পাদক সাহেব দেখাই করলেন না। ছোকরা মতো একটা ছেলে বলল, ‘কেন পুরোনো কাসুন্দি ঘাটছেন? বাদ দেন, ভাই।’ আমি তার দাদার বয়সী লোক, আর আমাকে বলে ‘ভাই’।
:আপনি কী বললেন?
:আমি বললাম, তুমি চাও না এদের বিচার হোক? ছেলেটি কিছু বলে না। সরাসরি না বলারও সাহস নাই। অথচ এই ছেলেরা কত সাহসে সাথে যুদ্ধ করেছে। করে নাই?
:জি, করেছে।
:আপনার বাড়িওয়ালার কথাই ধরেন। তার এক শালাকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে। অথচ এই লোক সিগচেনার করেনি। ত্রিশ লক্ষ লোক মরে গেল। কোনো বিচার হলো না। মনে হলেই বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা হয়। আমি অত্যন্ত অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটি পান মুখে পুরে বললেন, ‘সরকারি লোকজনদের সাথে দেখা করেছি। তারা আমি কী বলতে চাই, সেটাই ভালো করে শুনতে চায় না। একজন আমাকে বলে, আপনি একটা পরিত্যক্ত বাড়ির জন্য দরখাস্ত করেন। আপনার দুটি ছেলে মারা গেছে। বাড়ি পাওয়ার হক আছে আপনার।’
:আপনি কী বললেন?
:আমি আবার কী বলব? বাড়ির জন্য পিটিশন করেছি নাকি? বাড়ি দিয়ে আমি করবটা কী? আমার দুই ছেলের জীবন কি সস্তা? একটা বাড়ি দিয়ে দাম দিতে চায়? কত বড় স্পর্ধা, চিন্তা করেন। আমি চাই—একটা বিচার হবে। একটা বিচার চাই। আর কিছুই না। সভ্য সমাজের নিয়মমতো বিচার হবে। বুঝলেন?
:জি, বুঝলাম।
:আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আপনাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। অন্যরা কেউ বুঝতে চায় না। একেকটা সিগনেচারের জন্য তিনবার করে যেতে হয়। তাতে অসুবিধা নাই। আমি ছাড়বার লোক না।
আমার সিগনেচার নিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন। তারপর অনেক দিন তাঁর সাথে দেখা হলো না। একটা কৌতূহল জেগে রইল। রাস্তাঘাটে দেখা হলে জিজ্ঞেস করেছি, কী ভাই, কত দূর কী করলেন?
:চালিয়ে যাচ্ছি, প্রফেসার সাহেব। দোয়া রাখবেন।
:লোকজন দস্তখত দিচ্ছে তো?
:সবাই দেয় না। ভয় পায়।
:কিসের ভয়?
:ভয়ের কি কোনো মা-বাপ আছে? ভয় পাওয়া যাদের স্বভাব, তারা ভয় পাবেই। বুঝলেন না, আমি আছি লেগে। আদালতে হাজির করে ছাড়ব। কী বলেন, প্রফেসর সাব?
:তা তো ঠিকই।
:ডিস্টিক্টে ভাগ করে ফেলছি। এখন সব ডিস্টিক্টে যাব। কষ্ট হবে, উপায় তো নাই। আপনি কী বলেন?
:ভালোই তো।
তা ছাড়া শুধু দস্তখত জোগাড় করলেও হবে না। কেইস চালানোর মতো এভিডেন্স থাকতে হবে। বিনা কারণে নিরাপরাধ লোকজন ধরে ধরে মেরেছে, এটা প্রমাণ করতে হবে না? ওরা ঘাগু ঘাগু সব ল-ইয়ার দেবে। দেবে না?
:তা তো দেবেই।
: আপনার জানা মতে কোনো ভালো ল-ইয়ার আছে?
:আমি খোঁজ করব।
:তা তো করবেনই। আপনি তো অন্ধ না। অন্যায়টা বুঝতে পারছেন। বেশির ভাগ লোকই পারে না। মূর্খের দেশ।
অনেক দিন আর জলিল সাহেবের দেখা পাই নাই। হয়তো সত্যি সত্যি জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছেন। বগলে ভারী ভারী ফাইল। দস্তখতের সংখ্যা হয়তো বাড়ছে। বারো হাজার থেকে পনের হাজার। পনের থেকে বিশ। এমনকি, সত্যি সত্যি হতে পারে যে চল্লিশ পঞ্চাশ লাখ দস্তখত জোগাড় করে ফেলবেন তিনি। পঞ্চাশ লক্ষ লোকের দাবি অত্যন্ত জোরালো দাবি।
বর্ষার শুরুতে খবর পেলাম, জলিল সাহেব অসুখে পড়েছেন। হাঁপানি, সেই সঙ্গে রিউমেটিক ফিবার। বাড়িঅলা বললেন, ‘পাগলা মানুষ। শরীরের যত্ন তো আর কোনো দিন করে নাই। এ যাত্রা টিকবে না।’
:বলেন কী?
:হ্যাঁ, গ্রিন ফার্মেসির ডাক্তার সাহেব বললেন। আমি নিজেও গিয়েছিলাম দেখতে।
:অবস্থা কি বেশি খারাপ?
:বর্ষাটা টিকে কি না…
:বলেন কী?
:খুবই খারাপ অবস্থা।
বর্ষাটা অবশ্যি টিকে গেলেন। ফাইলপত্র বগলে দিয়ে ঘুরতে বেরোলেন। আমার সঙ্গে দেখা হলো দুপুরে। আমি চিনতেই পারি না, এমন অবস্থা। তিনি এগিয়ে এলেন, ‘প্রফেসার সাহেব না?’
:আরে, কী ব্যাপার ভাই? একি অবস্থা আপনার?
: বাঁচব না বেশি দিন।
: না বাঁচলে চলবে? এত বড় একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন।
:ওইটার জন্য টিকে আছি।
: সিগনেচার কত দূর জোগাড় হয়েছে?
:পনের হাজার। মাসে তিন-চার শয়ের বেশি পারি না। বয়স হয়েছে তো। তবে ছাড়ার লোক না আমি।
: না, ছাড়বেন কেন?
: কাঠগড়ায় দাঁড় করাব শালাদের। ইহুদিরা পেরেছে, আমরা পারব না কেন? কী বলেন?
: তা তো ঠিকই।
:ত্রিশ লাখ লোক মেরেছে বুঝলেন, একটা-দুইটা না। বাংলাদেশের মানুষ সস্তা না? মজা টের পাইয়ে দেব।
আজিমপুরের ওই পাড়ায় আমি প্রায় দু-বছর কাটালাম। এই দু-বছরে জলিল সাহেবের সঙ্গে মোটামুটি ঘনিষ্টতা হলো। মাঝে-মধ্যে যেতাম তার বাসায়। ভদ্রলোকের নিজের বাসা। দোতলাটা ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়ার টাকায় সংসার চলে। স্ত্রী নেই। বড় ছেলের বউ তাঁর সঙ্গে থাকে। ফুটফুটে দুটি মেয়ে আছে সেই বউটির। যমজ মেয়ে বোধ করি। খুব হাসি-খুশি। ভালোই লাগে ও বাড়িতে গেলে। বউটি খুবই যত্ন করে।
পিটিশন সম্পর্কে বাচ্চা দুটির ধারণাও দেখলাম খুব স্পষ্ট। একটি মেয়ে গম্ভীর গলায় আমাকে বলল, ‘দাদার খাতা লেখা শেষ হলে যারা আমার বাবাকে মেরেছে, তাদের বিচার হবে।’ এই টুকু মেয়ে এত সব বোঝার কথা নয়। জলিল সাহেব নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ওদের বুঝিয়ে বলেছেন।
ওপাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও মাঝেমধ্যে যেতাম। এরপর ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে গেল। এক সময় দীর্ঘ দিনের জন্য দেশের বাইরে চলে গেলাম।
যাওয়ার আগে দেখা করতে গিয়েছি। শুনলাম, তিনি ফরিদপুর গিয়েছেন সিগনেচার জোগাড় করতে। কবে ফিরে আসবেন, কেউ বলেতে পারে না। তার ছেলের বউ অনেক দুঃখ করল। দুঃখ করার সঙ্গত কারণ আছে। একমাত্র পুরুষ যদি ঘর-সংসার ছেড়ে দেয়, তাহলে জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে।
বাইরে থাকলে দেশের জন্য অন্য রকম একটা মমতা হয়। সেই কারণেই বোধ হয় জলিল সাহেবের কথা মনে পড়তে লাগল। মনে হতো, ঠিকই তো, ত্রিশ লক্ষ লোক হত্যা করে পার পেয়ে যাওয়া উচিত নয়। জলিল সাহেব যা করেছেন, ঠিকই করেছেন। এটা মধ্যযুগ না। এ যুগে এত বড় অন্যায় সহ্য করা যায় না।
উইকেন্ডগুলোতে বাঙালিরা এসে জড়ো হতো আমার বাসায়। কিছু আন্ডাগ্র্যাজুয়েট ছেলে, মুরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির অংকের প্রফেসর আফসার উদ্দিন সাহেব। সবাই একমত, জলিল সাহেবের প্রজেক্টে সাহায্য করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে প্রয়োজন হলে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। বিদেশি পত্রিকায় জনমতের জন্য লেখালেখি করা হবে। আমেরিকার ফার্গো শহরে আমরা এক সন্ধ্যাবেলায় ‘আব্দুল জলিল সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে ফেললাম। আমি তার আহ্বায়ক। আফসার উদ্দিন সাহেব সভাপতি। বিদেশে বসে দেশের কথা ভাবতে বড় ভালো লাগে। সব সময় ইচ্ছা করে, একটা কিছু করি।
দেশে ফিরলাম ছয় বছর পর।
ঢাকা শহর অনেকখানি বদলে গেলেও জলিল সাহেবের বাড়ির চেহারা বদলায়নি। সেই ভাঙা পলেস্তাঁরা ওঠা বাড়ি। সেই নারিকেল গাছ। কড়া নাড়তেই চৌদ্দ-পনের বছরের ভারী মিষ্টি একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে।
:তুমি কি জলিল সাহেবের নাতনি?
:জি।
:তিনি বাড়ি আছেন?
:না, দাদু তো মারা গেছেন দু-বছর আগে।
:ও। আমি তোমার দাদুর বন্ধু।
:আসুন, ভেতরে এসে বসুন।
আমি বসলাম কিছুক্ষণ। মেয়েটির মায়ের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা ছিল। ভদ্রমহিলা বাসায় ছিলেন না। কখন ফিরবেন, তারও ঠিক নেই। উঠে আসার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার দাদু যে মানুষের সিগনেচার জোগাড় করতেন, সেই সব আছে?’
:জি, আছে। কেন?
:তোমার দাদু যে কাজটা শুরু করেছিলেন সেটা শেষ করা উচিত, তাই না?
মেয়েটি খুব অবাক হলো। আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আমি আবার আসব, কেমন?’
:জি-আচ্ছা।
মেয়েটি গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে নরম গলায় বলে, ‘দাদু বলেছিলেন, একদিন কেউ এই ফাইল নিতে আসবে।’
আর যাওয়া হলো না।
উত্সাহ মরে গেল। দেশের এখন নানা রকম সমস্যা। যেখানে-সেখানে বোমা ফোটে। মুখ বন্ধ করে থাকতে হয়। এর মধ্যে পুরানো সমস্যা টেনে আনতে ইচ্ছে করে না।
আমি জলিল সাহেব নই। আমাকে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়। মিরপুরে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি কেনার জন্য নানা ধরনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়। জলিল সাহেবের মতো বত্রিশ হাজার দরখাস্তের ফাইল নিয়ে রাস্তায় বেরোনোর আমার সময় কোথায়?
জলিল সাহেবের নাতনিটা হয়তো অপেক্ষা করে আমার জন্য। দাদুর পিটিশনের ফাইলটি ধুলো ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রাখে। এই বয়সী মেয়েরা মানুষের কথা খুব বিশ্বাস করে।

জলিল সাহেবের পিটিশন

তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘আমি দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাবা। সেভেনটি ওয়ানে আমার দুটি ছেলে মারা গেছে। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ভদ্রলোকের চেহারা বিশেষত্বহীন। বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়। সে তুলনায় বেশ শক্ত-সমর্থ। বসেছেন মেরুদণ্ড সোজা করে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ। চশমা-টশমা নেই। তার মানে, চোখে ভালোই দেখতে পান। আমি বললাম, আমার কাছে কী ব্যাপার?

ভদ্রলোক যেভাবে বসেছিলেন, সেভাবেই বসে রইলেন। সহজ সুরে বললেন, ‘একজনের ডেডবডি পেয়েছিলাম। মালিবাগে কবর দিয়েছি। আমার ছোট মেয়ের বাড়ি আছে মালিবাগে।’
:তাই নাকি?
:জি, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া।
:আমার কাছে কেন এসেছেন?
:গল্পগুজব করতে আসলাম। নতুন এসেছেন এ পাড়ায়। খোঁজ-খবর করা দরকার। আপনি আমার প্রতেবেশী।

ভদ্রলোক হাসি মুখে বসে রইলেন। আমার সন্দেহ হলো, তিনি সত্যি সত্যি হাসছেন না। তার মুখের ফাটাটাই হাসি হাসি। ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমি আপনার পাশের গলিতেই থাকি।’
:তাই নাকি?
:জি। ১৩/২, বাসার সামনে একটা নারিকেল গাছ আছে, দেখেছেন তো?

আমি দেখিনি। তবু মাথা নাড়ালাম। ভদ্রলোকের চরিত্র স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সম্ভবত অবসর জীবন যাপন করেছেন। কিছুই করার দরকার নেই। সময় কাটানোই বোধ হয় তার এখন সমস্যা। যার জন্য ছুটির দিনে প্রতিবেশী খুঁজতে হয়।
:আমার নাম আব্দুল জলিল।
আমি নিজের নাম বলতে গেলাম। ভদ্রলোক বলতে দিলেন না! উঁচু গলায় বললেন, ‘চিনি, আপনাকে চিনি।’
:চা খাবেন? চায়ের কথা বলি?
:জি না। আমি চা খাই না। চা-সিগারেট কিছুই খাই না। নেশার মধ্যে, পান খাই।
:পান তো দিতে পারব না। এখানে কেউ পান খায় না।
:পান আমার সঙ্গেই থাকে। ভদ্রলোক কাঁধের ঝোলাতে হাত ঢুকিয়ে পানের কৌটা বের করলেন। বেশ বাহারি কৌটা। টিফিন কেরিয়ারের মতো তিন-চারটা আলাদা বাটি আছে। আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করলাম। ভদ্রলোক লম্বা পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন। সারা সকালটাই হয়তো এখানে কাটাবেন। দুঃখ-কষ্টের গল্প অন্যকে শোনাতে সবাই খুব পছন্দ করে। ভদ্রলোক একটু ঝুঁকে এসে বললেন, ‘প্রফেসার সাহেব, আপনি একটা পান খাবেন?’
:জি না।
:পান কিন্তু শরীরের জন্য ভালো। পিত্ত ঠান্ডা রাখে। যারা পান খায়, তাদের পিত্তের দোষ হয় না।
:তাই নাকি?
:জি। পানের রস আর মধু হলো গিয়ে বাতের খুব বড় ওষুধ।

আমি ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে দশটা। আজ ইউনিভার্সিটি নেই। থাকলে ভালো হতো। বলা যেত, ‘কিছু মনে করবেন না, এগারটার সময় একটা ক্লাস আছে, আপনি অন্য আরেক দিন সময় হাতে নিয়ে আসুন।’ ছুটির দিনে এ রকম কিছু বলা যায় না।

ভদ্রলোক তার পানের কৌটা খুলে নানা রকম মসলা বের করলেন। প্রতিটি শুঁকে শুঁকে দেখলেন। পান বানালেন অত্যন্ত যত্নে। যিনি পান বানানোর মতো তুচ্ছ ব্যাপারে এতটা সময় নষ্ট করেন, তিনি যে আজ দুপুরের আগে নড়বেন না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু আশ্চর্য, ভদ্রলোক পান মুখে দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। হাসি মুখে বললেন, ‘যাই, আমি অনেকটা সময় নষ্ট করলাম।’ বিস্ময় সামলে আমি আন্তরিকভাবেই বললাম, ‘বসুন, এত তাড়া কিসের?’ তিনি বললেন, ‘না।’ আমি তাঁকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ফেরার পথে দেখি, বাড়িওয়ালা ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘প্রফেসর সাহেবকে ধরেছে বুঝি? সিগনেচার করেছেন?’
:কী সিগনেচার?
:জলিল সাহেবের পিটিশনে সিগনেচার করেননি?
:পিটিশনটা কিসের?
:আমাকে বলতে হবে না। নিজেই টের পাবেন। হাড় ভাজা করে দেবে। কোনো প্রশ্রয় দেবেন না।

অস্পষ্ট একটা অস্বস্তি নিয়ে ঘরে ফিরলাম। নতুন পাড়ায় আসার অনেক বিরক্তিকর ব্যাপার আছে। নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে হয়। সে পরিচয় অনেক সময়ই সুখকর হয় না। তবে জলিল সাহেব প্রসঙ্গে ভয়টা বোধ হয় অমূলক। এরপর তাঁর সঙ্গে দুবার দেখা হলো। বেশ সহজ-স্বাভাবিক মানুষ। একবার দেখা গ্রিন ফার্মেসির সামনে। তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এলেন,—প্রফেসর সাহেব না? ভালো আছেন?
:জি, ভালো। আপনি ভালো আছেন? কই, আর তো আসলেন না?
:সময় পাই না। খুব ব্যস্ত পিটিশনটার ব্যাপারে।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ক্লাসের দোহাই দিয়ে রিকশায় উঠে পড়লাম। দ্বিতীয়বার দেখা হলো নিউ মার্কেটের একটা নিউজ স্ট্যান্ডের সামনে। দেখি, তিনি উবু হয়ে বসে একটির পর একটি পত্রিকা খুব দ্রুত পড়ে শেষ করছেন। হকার ছেলেটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাঁকে দেখছে।
:কী জলিল সাহেব, কী পড়ছেন এত মন দিয়ে?
জলিল সাহেব আমার দিকে তাকালেন। মনে হয়, ঠিক চিনতে পারছেন না। তাঁর চোখে চশমা।
:চশমা নিয়েছেন নাকি?
:জি। সন্ধ্যা হলে মাথা ধরে। প্লাস পাওয়ার। ভালো আছেন, প্রফেসার সাহেব?
: জি, ভালো।
:যাব একদিন আপনার বাসায়। পিটিশনটা দেখাব আপনাকে। চৌদ্দ হাজার তিন শ সিগনেচার জোগাড় হয়েছে।
: কিসের পিটিশন?
:পড়লেই বুঝবেন। আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ, আপনাদের বুঝতে কষ্ট হবে না।
আমার ধারণা ছিল, সরকারের কাছে কোনো সাহায্য চেয়ে পিটিশান করা হয়েছে। সেখানে চৌদ্দ হাজার সিগনেচারের ব্যাপারটা বোঝা গেল না। আমি নিজে থেকেও কোনো আগ্রহ দেখালাম না। জগতে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা কম নয়। সিগনেচার সংগ্রহ যদি কারও নেশা হয়, তা নিয়ে আমার উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

কিন্তু উদ্বিগ্ন হতে হলো। জলিল সাহেব এক সন্ধ্যায় তাঁর চৌদ্দ হাজার তিন শ সিগনেচারের ফাইল নিয়ে আমার বাসায় উপস্থিত হলেন। হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘ভালো করে পড়েন, প্রফেসর সাহেব।’ আমি পড়লাম। পিটিশনের বিষয়বস্তু হচ্ছে—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দশ লাখ ইহুদি মারা গিয়েছিল। সেই অপরাধে অপরাধীদের প্রত্যেকের বিচার করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কিন্তু এ দেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষ মেরে অপরাধীরা কি করে পার পেয়ে গেল? কেন এ নিয়ে আজ কেউ কোনো কথা বলছে না। জলিল সাহেব তাঁর দীর্ঘ পিটিশনে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন, যেন এদের বিচার করা হয়।

আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমার দুটি ছেলে মারা গেছে। সেই জন্যই যে আমি এটা করছি, তা ঠিক না। আমার ছেলে মারা গেছে যুদ্ধে। ওদের মৃত্যুর জন্য আমি কোনো বিচার চাই না। আমি বিচার চাই তাদের জন্য, যাদের ওরা ঘরে থেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। আমার কথা বুঝতে পারছেন?’
:পারছি।
:জানি পারবেন। আপনে জ্ঞানী-গুণী মানুষ। অনেকেই পারে না। বুঝলেন ভাই, অনেকে মানবতার দোহাই দেয়। বলে, বাদ দেন। ক্ষমা করে দেন। ক্ষমা এত সস্তা? অ্যাঁ, বলেন সস্তা?

আমি কিছু বললাম না। জলিল সাহেব পানের কৌটা বের করে পান সাজাতে বসলেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘আপনি কি মনে করেছেন, আমি ছেড়ে দেব? ছাড়ব না। আমার দুই ছেলে ফাইট দিয়েছে। আমিও দেব। মৃত্যু পর্যন্ত ফাইট দেব। দরকার হলে বাংলাদেশে প্রতিটি মানুষের সিগনেচার জোগাড় করব। ত্রিশ লক্ষ লোক মরে গেল, আর কেউ কোনো শব্দ করল না? আমরা মানুষ না অন্য কিছু, বলেন দেখি?’

আমি সিগনেচার ফাইল উল্টে দেখতে লাগলাম। খুব গোছানো কাজ-কর্ম। সিগনেচারের পাশে বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা। স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহত আত্মীয়-স্বজনের নাম-ঠিকানা।
:অনেকেই মনে করে, আমার মাথা ঠিক নাই। এক পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম, সম্পাদক সাহেব দেখাই করলেন না। ছোকরা মতো একটা ছেলে বলল, ‘কেন পুরোনো কাসুন্দি ঘাটছেন? বাদ দেন, ভাই।’ আমি তার দাদার বয়সী লোক, আর আমাকে বলে ‘ভাই’।
:আপনি কী বললেন?
:আমি বললাম, তুমি চাও না এদের বিচার হোক? ছেলেটি কিছু বলে না। সরাসরি না বলারও সাহস নাই। অথচ এই ছেলেরা কত সাহসে সাথে যুদ্ধ করেছে। করে নাই?
:জি, করেছে।
:আপনার বাড়িওয়ালার কথাই ধরেন। তার এক শালাকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে। অথচ এই লোক সিগচেনার করেনি। ত্রিশ লক্ষ লোক মরে গেল। কোনো বিচার হলো না। মনে হলেই বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা হয়। আমি অত্যন্ত অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটি পান মুখে পুরে বললেন, ‘সরকারি লোকজনদের সাথে দেখা করেছি। তারা আমি কী বলতে চাই, সেটাই ভালো করে শুনতে চায় না। একজন আমাকে বলে, আপনি একটা পরিত্যক্ত বাড়ির জন্য দরখাস্ত করেন। আপনার দুটি ছেলে মারা গেছে। বাড়ি পাওয়ার হক আছে আপনার।’
:আপনি কী বললেন?
:আমি আবার কী বলব? বাড়ির জন্য পিটিশন করেছি নাকি? বাড়ি দিয়ে আমি করবটা কী? আমার দুই ছেলের জীবন কি সস্তা? একটা বাড়ি দিয়ে দাম দিতে চায়? কত বড় স্পর্ধা, চিন্তা করেন। আমি চাই—একটা বিচার হবে। একটা বিচার চাই। আর কিছুই না। সভ্য সমাজের নিয়মমতো বিচার হবে। বুঝলেন?
:জি, বুঝলাম।
:আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আপনাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। অন্যরা কেউ বুঝতে চায় না। একেকটা সিগনেচারের জন্য তিনবার করে যেতে হয়। তাতে অসুবিধা নাই। আমি ছাড়বার লোক না।
আমার সিগনেচার নিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন। তারপর অনেক দিন তাঁর সাথে দেখা হলো না। একটা কৌতূহল জেগে রইল। রাস্তাঘাটে দেখা হলে জিজ্ঞেস করেছি, কী ভাই, কত দূর কী করলেন?
:চালিয়ে যাচ্ছি, প্রফেসার সাহেব। দোয়া রাখবেন।
:লোকজন দস্তখত দিচ্ছে তো?
:সবাই দেয় না। ভয় পায়।
:কিসের ভয়?
:ভয়ের কি কোনো মা-বাপ আছে? ভয় পাওয়া যাদের স্বভাব, তারা ভয় পাবেই। বুঝলেন না, আমি আছি লেগে। আদালতে হাজির করে ছাড়ব। কী বলেন, প্রফেসর সাব?
:তা তো ঠিকই।
:ডিস্টিক্টে ভাগ করে ফেলছি। এখন সব ডিস্টিক্টে যাব। কষ্ট হবে, উপায় তো নাই। আপনি কী বলেন?
:ভালোই তো।
তা ছাড়া শুধু দস্তখত জোগাড় করলেও হবে না। কেইস চালানোর মতো এভিডেন্স থাকতে হবে। বিনা কারণে নিরাপরাধ লোকজন ধরে ধরে মেরেছে, এটা প্রমাণ করতে হবে না? ওরা ঘাগু ঘাগু সব ল-ইয়ার দেবে। দেবে না?
:তা তো দেবেই।
: আপনার জানা মতে কোনো ভালো ল-ইয়ার আছে?
:আমি খোঁজ করব।
:তা তো করবেনই। আপনি তো অন্ধ না। অন্যায়টা বুঝতে পারছেন। বেশির ভাগ লোকই পারে না। মূর্খের দেশ।

অনেক দিন আর জলিল সাহেবের দেখা পাই নাই। হয়তো সত্যি সত্যি জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছেন। বগলে ভারী ভারী ফাইল। দস্তখতের সংখ্যা হয়তো বাড়ছে। বারো হাজার থেকে পনের হাজার। পনের থেকে বিশ। এমনকি, সত্যি সত্যি হতে পারে যে চল্লিশ পঞ্চাশ লাখ দস্তখত জোগাড় করে ফেলবেন তিনি। পঞ্চাশ লক্ষ লোকের দাবি অত্যন্ত জোরালো দাবি।

বর্ষার শুরুতে খবর পেলাম, জলিল সাহেব অসুখে পড়েছেন। হাঁপানি, সেই সঙ্গে রিউমেটিক ফিবার। বাড়িঅলা বললেন, ‘পাগলা মানুষ। শরীরের যত্ন তো আর কোনো দিন করে নাই। এ যাত্রা টিকবে না।’
:বলেন কী?
:হ্যাঁ, গ্রিন ফার্মেসির ডাক্তার সাহেব বললেন। আমি নিজেও গিয়েছিলাম দেখতে।
:অবস্থা কি বেশি খারাপ?
:বর্ষাটা টিকে কি না…
:বলেন কী?
:খুবই খারাপ অবস্থা।

বর্ষাটা অবশ্যি টিকে গেলেন। ফাইলপত্র বগলে দিয়ে ঘুরতে বেরোলেন। আমার সঙ্গে দেখা হলো দুপুরে। আমি চিনতেই পারি না, এমন অবস্থা। তিনি এগিয়ে এলেন, ‘প্রফেসার সাহেব না?’
:আরে, কী ব্যাপার ভাই? একি অবস্থা আপনার?
: বাঁচব না বেশি দিন।
: না বাঁচলে চলবে? এত বড় একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন।
:ওইটার জন্য টিকে আছি।
: সিগনেচার কত দূর জোগাড় হয়েছে?
:পনের হাজার। মাসে তিন-চার শয়ের বেশি পারি না। বয়স হয়েছে তো। তবে ছাড়ার লোক না আমি।
: না, ছাড়বেন কেন?
: কাঠগড়ায় দাঁড় করাব শালাদের। ইহুদিরা পেরেছে, আমরা পারব না কেন? কী বলেন?
: তা তো ঠিকই।
:ত্রিশ লাখ লোক মেরেছে বুঝলেন, একটা-দুইটা না। বাংলাদেশের মানুষ সস্তা না? মজা টের পাইয়ে দেব।

আজিমপুরের ওই পাড়ায় আমি প্রায় দু-বছর কাটালাম। এই দু-বছরে জলিল সাহেবের সঙ্গে মোটামুটি ঘনিষ্টতা হলো। মাঝে-মধ্যে যেতাম তার বাসায়। ভদ্রলোকের নিজের বাসা। দোতলাটা ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়ার টাকায় সংসার চলে। স্ত্রী নেই। বড় ছেলের বউ তাঁর সঙ্গে থাকে। ফুটফুটে দুটি মেয়ে আছে সেই বউটির। যমজ মেয়ে বোধ করি। খুব হাসি-খুশি। ভালোই লাগে ও বাড়িতে গেলে। বউটি খুবই যত্ন করে।

পিটিশন সম্পর্কে বাচ্চা দুটির ধারণাও দেখলাম খুব স্পষ্ট। একটি মেয়ে গম্ভীর গলায় আমাকে বলল, ‘দাদার খাতা লেখা শেষ হলে যারা আমার বাবাকে মেরেছে, তাদের বিচার হবে।’ এই টুকু মেয়ে এত সব বোঝার কথা নয়। জলিল সাহেব নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ওদের বুঝিয়ে বলেছেন।

ওপাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও মাঝেমধ্যে যেতাম। এরপর ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে গেল। এক সময় দীর্ঘ দিনের জন্য দেশের বাইরে চলে গেলাম।

যাওয়ার আগে দেখা করতে গিয়েছি। শুনলাম, তিনি ফরিদপুর গিয়েছেন সিগনেচার জোগাড় করতে। কবে ফিরে আসবেন, কেউ বলেতে পারে না। তার ছেলের বউ অনেক দুঃখ করল। দুঃখ করার সঙ্গত কারণ আছে। একমাত্র পুরুষ যদি ঘর-সংসার ছেড়ে দেয়, তাহলে জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে।

বাইরে থাকলে দেশের জন্য অন্য রকম একটা মমতা হয়। সেই কারণেই বোধ হয় জলিল সাহেবের কথা মনে পড়তে লাগল। মনে হতো, ঠিকই তো, ত্রিশ লক্ষ লোক হত্যা করে পার পেয়ে যাওয়া উচিত নয়। জলিল সাহেব যা করেছেন, ঠিকই করেছেন। এটা মধ্যযুগ না। এ যুগে এত বড় অন্যায় সহ্য করা যায় না।

উইকেন্ডগুলোতে বাঙালিরা এসে জড়ো হতো আমার বাসায়। কিছু আন্ডাগ্র্যাজুয়েট ছেলে, মুরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির অংকের প্রফেসর আফসার উদ্দিন সাহেব। সবাই একমত, জলিল সাহেবের প্রজেক্টে সাহায্য করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে প্রয়োজন হলে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। বিদেশি পত্রিকায় জনমতের জন্য লেখালেখি করা হবে। আমেরিকার ফার্গো শহরে আমরা এক সন্ধ্যাবেলায় ‘আব্দুল জলিল সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে ফেললাম। আমি তার আহ্বায়ক। আফসার উদ্দিন সাহেব সভাপতি। বিদেশে বসে দেশের কথা ভাবতে বড় ভালো লাগে। সব সময় ইচ্ছা করে, একটা কিছু করি।

দেশে ফিরলাম ছয় বছর পর।

ঢাকা শহর অনেকখানি বদলে গেলেও জলিল সাহেবের বাড়ির চেহারা বদলায়নি। সেই ভাঙা পলেস্তাঁরা ওঠা বাড়ি। সেই নারিকেল গাছ। কড়া নাড়তেই চৌদ্দ-পনের বছরের ভারী মিষ্টি একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে।
:তুমি কি জলিল সাহেবের নাতনি?
:জি।
:তিনি বাড়ি আছেন?
:না, দাদু তো মারা গেছেন দু-বছর আগে।
:ও। আমি তোমার দাদুর বন্ধু।
:আসুন, ভেতরে এসে বসুন।

আমি বসলাম কিছুক্ষণ। মেয়েটির মায়ের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা ছিল। ভদ্রমহিলা বাসায় ছিলেন না। কখন ফিরবেন, তারও ঠিক নেই। উঠে আসার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার দাদু যে মানুষের সিগনেচার জোগাড় করতেন, সেই সব আছে?’
:জি, আছে। কেন?
:তোমার দাদু যে কাজটা শুরু করেছিলেন সেটা শেষ করা উচিত, তাই না?

মেয়েটি খুব অবাক হলো। আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আমি আবার আসব, কেমন?’
:জি-আচ্ছা।

মেয়েটি গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে নরম গলায় বলে, ‘দাদু বলেছিলেন, একদিন কেউ এই ফাইল নিতে আসবে।’
আর যাওয়া হলো না।
উত্সাহ মরে গেল। দেশের এখন নানা রকম সমস্যা। যেখানে-সেখানে বোমা ফোটে। মুখ বন্ধ করে থাকতে হয়। এর মধ্যে পুরানো সমস্যা টেনে আনতে ইচ্ছে করে না।

আমি জলিল সাহেব নই। আমাকে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়। মিরপুরে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি কেনার জন্য নানা ধরনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়। জলিল সাহেবের মতো বত্রিশ হাজার দরখাস্তের ফাইল নিয়ে রাস্তায় বেরোনোর আমার সময় কোথায়?

জলিল সাহেবের নাতনিটা হয়তো অপেক্ষা করে আমার জন্য। দাদুর পিটিশনের ফাইলটি ধুলো ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রাখে। এই বয়সী মেয়েরা মানুষের কথা খুব বিশ্বাস করে।

ডাংগুলি

ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের এক গ্রামের ক্রিকেট মাঠে খেলার দৃশ্য বাংলাদেশের অতি প্রাচীন খেলার একটির নাম ‘ডাংগুলি’। আমি ডাংগুলিকে বলি ক্রিকেটের আদি পিতা। কেন বলি তা খেলা ব্যাখ্যা করলেই বোঝা যাবে। ডাংগুলিতে একজন ব্যাটসম্যান লম্বা ডান্ডা (ব্যাট) হাতে মাঝখানে দাঁড়ায়। এর নাম ডাং। তার সঙ্গে থাকে ছয় ইঞ্চি লম্বা কাঠি (বল)। কাঠিটাকে বলে গুলি। ডাং আর গুলির খেলার নাম ডাংগুলি। খেলোয়াড় মাটিতে খানিকটা উঁচু করে রাখা গুলিকে ডাং-এর খোঁচায় শূন্যে তুলে সজোরে বাড়ি দিয়ে দূরে পাঠায়। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডাররা চেষ্টা করে কাঠিটা লুফে নিতে অর্থাৎ ক্যাচ ধরতে। ক্যাচ ধরকে পারলেই ব্যাটসম্যান আউট। ক্রিকেটের সঙ্গে ডাংগুলির অমিল হলো, এখানে কোনো বোলার নেই। যে ব্যাট করে সে-ই বোলার। স্ট্যাম্প আউট বলে কিছু নেই, ক্যাচ আউটই একমাত্র আউট। ভারতবর্ষের ডাংগুলি খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশরা ক্রিকেট খেলা শুরু করল—এমন মনে হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।
শৈশবের কথা। দাদার বাড়িতে বেড়াতে গেছি, জুটে পড়েছি ডাংগুলি খেলার দলে। মহাউৎসাহে খেলা চলছে। আমাকে খেলতে দেখে দাদাজানের (মৌলানা আজিমউদ্দিন আহমেদ, মাদ্রাসাশিক্ষক) মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, যাবতীয় খেলার পেছনে থাকে ইবলিশ শয়তানের উৎসাহ এবং ইন্ধন। একে বলে শয়তানের ওয়াসওয়াসা। খেলতে গিয়ে খেলোয়াড়েরা অন্য কাজ ভুলে যায়, নামাজের ওয়াক্ত ভুলে যায়, শয়তান এই জিনিসই চায়। কাজেই তোমাকে আর যেন কোনো খেলাধুলায় না দেখি।
আমি বললাম, আচ্ছা।
দাদাজান বললেন, যে খেলে সে যেমন শয়তানের প্রভাবে থাকে, যে দেখে সেও থাকে। খেলা দেখবেও না।
আমি আবারও হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম।
দাদাজানের কথায় মনে হতে পারে ইসলাম ধর্মে খেলাধুলা নিষিদ্ধ। তা মোটেও না। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যাঞ্জেলর ড. ইউসুফ আল কারদাভি ফতোয়া দিয়েছেন, বাজি নেই এমন সব শারীরিক এবং মানসিক খেলা ইসলাম ধর্মে বৈধ।
আমাদের নবীজি (দ.) নিজেও হজরত আয়েশা (রা.)-র সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন।
শয়তানের প্রভাবেই হয়তো আমাদের খেলোয়াড়েরা যখন চার-ছয় মারে, আমি চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেলি। ক্রিকেট বিষয়ে আমার প্রবল উত্তেজনা দেখে একজন পত্রিকার রিপোর্টার আমার ইন্টারভিউ নিতে এলেন এবং ক্রিকেট বিষয়ে নানা প্রশ্ন করলেন। আমি কোনোটারই জবাব দিতে পারলাম না। গুগলি কী বস্তু, বলতে পারলাম না। রিভার্স সুইং কী, তাও জানি না। ক্রিকেট বিষয়ে আমার মূর্খতায় সাংবাদিক হতাশ হলেন, একপর্যায়ে বললেন, আপনি যে ক্রিকেট কিছুই বোঝেন না। এটা কি লিখতে পারি?
আমি বললাম, অবশ্যই লিখতে পারো।
সাংবাদিক বললেন, কিছু না বোঝেও ক্রিকেট কেন পছন্দ করেন, তা কি ব্যাখ্যা করবেন?
আমি বললাম, ক্রিকেট পছন্দ করি কারণ আমি একজন গল্পকার, ফিকশন রাইটার।
স্যার, বুঝিয়ে বলুন।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ক্রিকেটে এক ওভারে ছয়টি করে বল করা হয়। বল করা মাত্র গল্প শুরু হয়। নানান সম্ভাবনার গল্প। ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার সম্ভাবনা, ছক্কা মারার সম্ভাবনা, শূন্য পাওয়ার সম্ভাবনা। ছয়টা বল হলো ছয়টি সম্ভাবনা গল্পের সংকলন। এখন বুঝেছ?
সাংবাদিক হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। আমি বললাম, সারা পৃথিবীতে কবিদের একটা বড় অংশ ক্রিকেট পছন্দ করেন। কেন করেন, জানো? কবিদের কাজ হচ্ছে ছন্দ নিয়ে। ক্রিকেট ছন্দময় খেলা বলেই কবিদের পছন্দের খেলা।
ক্রিকেটপাগল কবি নির্মলেন্দু গুণের ক্রিকেট আবহে লেখা একটি কবিতা পড়লে কেমন হয়?

শব্দের স্পিনার
গ্যারি সোবার্স, চন্দ্র-প্রসন্ন-বেদী ও আবদুল কাদিরের মতোন
আমি শব্দকে স্পিন করি। তাদের কাছেই আমি শিখিয়াছি এই
ঘূর্ণিবলের জাদু। আপেলের মতো লাল বলটিকে ট্রাউজারে ঘষে
ঘষে, তাতে কপালের ঘাম মাখিয়ে আবদুল কাদির যে রকম
নৃত্যের ভঙ্গিতে এসে স্ট্যাম্প লক্ষ্য করে তার বলটিকে ছোঁড়ে,
আমিও তেমন প্রতিটি শব্দের কানে মন্ত্র পাঠ করি, তারপর
‘যাও পাখি’ বলে তারে ভালোবেসে তোমার উদ্দেশে ছুঁড়ে দেই।

আদি ক্রিকেটে মুখ ভর্তিদাড়ির একটা ব্যাপার ছিল। হাস্যকর লাগছে? কথা সত্যি! ক্রিকেট খেলার যেকোনো প্রাচীন ছবিতে দেখা যাবে মুখভর্তি দাড়ি নিয়ে ব্রিটিশ লর্ডরা ক্রিকেট খেলছেন। বঙ্গদেশে ক্রিকেটের সূচনা করেন সত্যজিৎ রায়ের দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, তাঁর ভাই এবং বন্ধুরা। কাকতালীয় হলেও সত্যি, তাঁদেরও মুখভর্তি দাড়ি ছিল।
দাড়ি ট্র্যাডিশন কিছুটা হলেও আমাদের ক্রিকেট টিমেও আছে। আমাদের একজন ক্রিকেটারের মুখ ভর্তি দাড়ি (সোহরাওয়ার্দী শুভ)।
আজ আয়ারল্যান্ডকে বাংলাধোলাই দেওয়া হবে। আসুন, সেই প্রস্তুতি নিই। আমরা তো খেলব না, গলা ফাটিয়ে চেঁচাব। গার্গল করে গলা পরিষ্কার করা দরকার না?
রয়েল বেঙ্গল টাইগার খানিকটা ঝিমুনির মধ্যে আছে। তাকে জাগাতে হবে। তার বিকট হালুমধ্বনি শোনার অপেক্ষা।

পাদটীকা: পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রথম ক্রিকেট খেলা হয় বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ গ্রামের এক ঈদগাঁ মাঠে। গ্রামের নাম মশুয়া। ক্রিকেট খেলার আয়োজন করেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং তাঁর ভাইয়েরা।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১১

তিনি এসেছিলেন

পুত্র নিষাদ ‘ভয়ংকর’ বলতে পারে না। সে বলে ‘ভয়মকর’। যে বাড়িতে এখন সে বাধ্য হয়ে বাবার সঙ্গে বাস করছে, সেখানে তার কাছে ‘ভয়মকর’ একটি ঘর আছে। ঘরটি বেসমেন্টে, অর্থাৎ মাটির নিচে। সেখানে হিটিং সিস্টেমের যন্ত্রপাতি বসানো। উত্তপ্ত জলীয় বাষ্প যন্ত্রপাতিতে তৈরি করে সারা বাড়িতে ছড়ানো হয়। যন্ত্রপাতি থেকে সারাক্ষণ ভৌতিক শব্দ আসে।
আমেরিকানরা বেসমেন্ট ব্যবহার করে প্রয়োজনীয়(?) আবর্জনা জমা করে রাখার জন্য। আমেরিকান সব ভূতের ছবিতে বেসমেন্টের ভূমিকা থাকবেই।
আমি ঠিক করেছি, অন্তত একটি গল্প এই বেসমেন্টে বসে লিখব। লেখার সময় সম্পূর্ণ একা থাকব। কেউ উঁকি দিতে পারবে না। ভৌতিক গল্পের নাম দিয়েছি ‘আদর’। প্রথম কয়েকটি লাইন: ‘মিস রাকার কুকুরের নাম “আদর”। নামের সঙ্গে কুকুরের ভাবভঙ্গি যায় না। তাকে দেখেই মনে হয় সে মিস রাকার ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ার মতলব আঁটছে।’
গল্প নিয়ে আমি এগোতে পারছি না। যখনই বসি, তখনই খবর আসে অতিথি এসেছে। অতিথি কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলবেন।
বাংলাদেশি এই সামাজিকতা আমার কাছে (নিষাদের ভাষায়) ‘ভয়মকর’। এই সামাজিকতায় রোগী দেখতে যাওয়া বাধ্যতামূলক। শুধু দেখতে গেলে হবে না, দেখতে যাওয়ার বিষয়টি অন রেকর্ড থাকতে হবে। রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনকে জানাতে হবে—অমুক দেখতে এসেছিল। এতক্ষণ ছিল। পথ্য হিসেবে এসব বস্তু এনেছে।
মরণাপন্ন রোগী। ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন, দর্শনার্থী তাঁকে ডেকে তুলে বলবেন, ঘুমাচ্ছিলেন? আহা, উঠলেন কেন? আপনার ঘুম দরকার। ডাক্তার কী বলেছেন বলুন তো, শুনি। আপনার নিজের মুখে না শুনলে আমার মন শান্ত হবে না। ভালো কথা ভাই সাহেব, পরে ভুলে যাব। এক হালি কচি ডাব এনেছি। আপনার বেডের নিচে রেখেছি, মনে করে খাবেন। শরীর শুদ্ধির জন্য কচি ডাব অত্যন্ত উপকারী…
আমেরিকা নানান সংস্কৃতির মানুষের জগাখিচুড়ি বলেই আলাদা আমেরিকান কালচার বলে কিছু তৈরি হয়নি। তবে হাসপাতাল এটিকেট মনে হয় তৈরি হয়েছে। চিকিৎসার জন্য অপেক্ষায় থাকা রোগীরা কারও সঙ্গেই কথা বলে না। বেশির ভাগ রোগীকে একা আসতে দেখা যায়। রোগী সঙ্গে নিয়ে নিয়ে ঘুরবে, এত সময় তাদের কোথায়? এক বৃদ্ধকে দেখলাম নিজের অক্সিজেন সিলিন্ডার নিজেই টেনে টেনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসছে না।
বাংলাদেশি রোগ-সংস্কৃতি এই দিক দিয়ে ভালো। আমরা কিছু করতে পারি বা না পারি, উদ্বিগ্ন গলায়, অপরিচিত গলায় রোগীর সঙ্গে দুটা কথা বলি।
এই সংস্কৃতি অবশ্যই এশিয়ান। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে দেখেছি, রোগী দেখতে দুনিয়ার আত্মীয়স্বজন আসছে। রোগীর ঘরে সারাক্ষণ ক্যাওম্যাও শব্দ।
আমেরিকায় আমাকে কঠিন নির্দেশাবলি দিয়ে দিয়েছে, তার মধ্যে আছে—
এক. কারও কাছ থেকে ফুল বা ফুলের তোড়া গ্রহণ করা যাবে না। (কেমো নেওয়ার সময় শরীরের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ-ক্ষমতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে যায় বলেই এই সতকর্তা।)
দুই. কারোর কাছাকাছি যাওয়া যাবে না, পাশে বসা যাবে না।
দুই নিষেধাজ্ঞা আমি মেনে চলছি। শুধু একবারই নিষেধ ভেঙেছি। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ফুলের তোড়া নিয়েছি, তাঁর পাশে বসেছি।
কোনো প্রধানমন্ত্রীর এত কাছে বসা এ-ই আমার প্রথম, এ-ই নিশ্চয়ই শেষ।
প্রধানমন্ত্রীর আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা আমার কাছে এতই স্বাভাবিক বলে মনে হলো, আমি বলেই ফেললাম, আপনার কথাবার্তা তো মোটেই প্রধানমন্ত্রীর মতো লাগছে না।
যাঁরা দেশ চালান, তাঁরা ইচ্ছা থাকলেও স্বাভাবিক আচরণ করতে পারেন না। সারাক্ষণ তাঁদের ক্যামেরা অনুসরণ করে, সিকিউরিটির লোকজন অনুসরণ করে। তাঁরা জানেন, তাঁদের প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসও লক্ষ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিক থাকা শুধু মহাপুরুষদের পক্ষেই সম্ভব। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে—মহাপুরুষদের বইপত্রে পাওয়া যায়, বাস্তবে পাওয়া যায় না।
প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের মানুষদের সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করেন তাঁর অতি কাছের লোকজন। এঁরা এমন এক মানববন্ধন তৈরি করেন যে, বন্ধন ভেদ করে কারও পক্ষেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এই মানববর্মের প্রধান (এবং হয়তো বা একমাত্র) কাজ হলো নিজের অবস্থান ঠিক রাখা, প্রধানমন্ত্রীর কাছের মানুষ হয়ে থাকা। এ কাজটি করার জন্য তাঁরা প্রধানমন্ত্রী পছন্দ করবেন, এমন কথাগুলোই শুধু তাঁকে শোনান। এমন একটি বাক্যও বলেন না, যা শুনে প্রধানমন্ত্রীর ভালো লাগবে না, অথচ তাঁর শোনা উচিত।
কী সর্বনাশ! আমি দেখি রাজনীতির কচকচানি শুরু করেছি। এও বাঙালি কালচার, সুযোগ পেয়ে কোনো বাঙালি রাজনীতির কপচাবে না, তা হবে না। আমি আমার প্রগলভতার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী অনেক ব্যস্ততার ভেতর বাংলাদেশের একজন লেখকের জন্য আলাদা সময় বের করেছেন, এটা অনেক বড় ব্যাপার। তাঁর নিজের আসার দরকার ছিল না। একজন কাউকে দিয়ে আমার খোঁজ নেওয়ালেই আমি আনন্দিত হতাম। তাঁর কাছ থেকে ১০ হাজার ডলারের চেকটি নিতে আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমি এখনো নিজের খরচ নিজে চালাতে পারছি। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের অর্থ যারা অর্থকষ্টে আছে তাদের জন্য থাকাই বাঞ্ছনীয়।
আমার অস্বস্তি দেখে শাওন বলল, তুমি চেকটা হাতে নাও। এখানে আছে তোমার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের মানুষের দোয়া। আমি সঙ্গে সঙ্গে অতি বিনয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে চেক গ্রহণ করলাম।
পাদটীকা:
প্রধানমন্ত্রী চলে গেছেন। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ। আমার পুত্র নিষাদ বলল, আমি উনার উপর ‘লাগ’ করেছি। (সে ‘র’ বলতে পারে না, লাগ করেছি অর্থ হলো রাগ করেছি)
আমি বললাম, কার ওপর রাগ করেছ? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর?
হুঁ।
কেন, বলো তো?
উনি আমার জন্য কোনো খেলনা আনে নাই।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক যন্ত্রণা। সবাইকেই তুষ্ট রাখতে হয়। সেই সবার মধ্যে পাগল এবং শিশুরাও আছে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১১, ২০১১

নয় নম্বর বিপদ সংকেত

পাঠকরা ভুলেও ভাববেন না ময়ূরাক্ষী বের হওয়ার পর পরই যুবক শ্রেণীর বিরাট অংশ হলুদ পাঞ্জাবী পরে রাস্তায় নেমে গেল৷ আমিও মনের আনন্দে একের পর এক হিমু বাজারে ছাড়তে লাগলাম৷ পাশ বইয়ের খাতায় টাকা জমা হতে লাগল৷ শুরুতে হিমুকে আমি মোটেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করিনি৷ তখন আমার প্রিয় চরিত্র মিসির আলি৷ আমি লিখছি মিসির আলি৷ এই ভদ্রলোকের লজিকে এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ৷

এর মধ্যে আমার অর্থনৈতিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে৷ বন্ধু-বান্ধব, ব্যাংক এবং প্রকাশকদের কাছ থেকে ধার করে এলিফ্যান্ট রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছি৷ পনেরশ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট ফ্ল্যাট৷ তাতে কী, দুটো বেডরুম আছে৷ একটা বারান্দা আছে৷ বারান্দায় বসলে সুন্দর কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাই না৷ জুতার দোকান দেখতে পাই৷ ছয়তলা থেকে জুতার দোকান দেখা খারাপ কিছু না৷

বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে আমি জুতার দোকান দেখি এবং পরের লেখাটা কী হবে ভাবি৷ আমার তিন মেয়ে তখন সামান্য বড় হয়েছে৷ বড় মেয়েটি ক্লাস সিক্সে পড়ে, মেজোটি পড়ে ক্লাস ফোরে৷ ভোরবেলা স্কুলের পোশাক পরে তারা কিছুক্ষণ ধবল রঙের ডিপফ্রিজের সামনে দাঁড়ায়৷

কারণ তাদের বাবা রাতে যা লিখেছে তা ডিপফ্রিজের উপর সাজানো থাকে৷ আমার এই দুই কন্যা বাবার লেখার সর্বশেষ অংশ না পড়ে স্কুলে যাবে না৷ আমার লেখক জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছি বলে মনে পড়ে না৷ আমার এই দুই কন্যার কোনো একজন, খুব সম্ভব বড়জন আমাকে একদিন বলল, বাবা ময়ূরাক্ষীর মতো আরেকটা বই লেখ৷ হিমুর বই৷

হিমুকে নিয়ে কন্যার আগ্রহে লিখে শেষ করলাম দরজার ওপাশে৷ বই প্রকাশিত হলো৷ আমি পড়লাম মহাবিপদে৷ হাইকোর্টে বিচারকদের সমিতি আছে৷ সমিতির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো, এই বইটি লিখে আমি মহা অন্যায় করেছি৷ মহান বিচারকদের সম্মান ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছি৷ কারণ আমি লিখেছি জজ সাহেবরা ঘুষ খান৷

উপন্যাসে ঘটনাটা এ রকম – হিমুর মাতুল বংশ পিশাচ শ্রেণীর৷ তারা হেন দুষ্কর্ম নাই যা করে না৷ তাদের ধারণা যেকোনো কাজ টাকা দিয়ে করানো সম্ভব৷ তাদেরই একজন জজ সাহেবকে ঘুষ দিয়ে এই কাজটা করাতে চাচ্ছে৷ জজ সাহেবরা ঘুষ খান – এটি হিমুর ধান্ধাবাজ মামার কথা৷ বইতে কিভাবে এসেছে দেখা যাক৷

মামা গোসল করে জায়নামাজে বসে গেলেন৷ দীর্ঘ সময় লাগল নামাজ শেষ করতে৷ তার চেহারা হয়েছে সুফি সাধকের মতো৷ ধবধবে সাদা লম্বা দাড়ি৷ মোনাজাত করার সময় টপটপ করে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল৷ আমি অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখলাম৷
তারপর বল, কী ব্যাপার?

একজন লোক জেলখানায় আছে মামা৷ ওর সঙ্গে দেখা করা দরকার, দেখা করার কায়দা পাচ্ছি না৷ দরখাস্ত করেছি, লাভ হয়নি৷

খুনের আসামি? তিনশ বারো ধারা?

কোন ধারা তা জানি না, তবে খুনের আসামি৷

এটা কোনো ব্যাপারই না৷ টাকা খাওয়াতে হবে৷ এই দেশে এমন কোনো জিনিস নেই যা টাকায় হয় না৷

টাকা তো মামা আমার নেই৷

টাকার চিন্তা তোকে করতে বলছি নাকি? আমরা আছি কী জন্য? মরে তো যাই নাই৷ টাকা সঙ্গে নিয়ে আসছি৷ দরকার হলে জমি বেঁচে দেব৷ খুনের মামলাটা কী রকম বল শুনি৷ আসামি ছাড়ায়ে আনতে হবে৷

তুমি পারবে না মামা৷ তোমার ক্ষমতার বাইরে৷

আগে বল, তারপর বুঝব পারব কী পারব না৷ টাকা থাকলে এই দেশে খুন কোনো ব্যাপারই না৷ এক লাখ টাকা থাকলে দুটো খুন করা যায়৷ প্রতি খুনে খরচ হয় পঞ্চাশ হাজার৷ পলিটিক্যাল লোক হলে কিছু বেশি লাগে৷

আমি মোবারক হোসেন সাহেবের ব্যাপারটা বললাম৷ মামা গালে হাত দিযে গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনলেন৷ সব শুনে দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে বললেন, পুলিশের সাজানো মামলা, পেছনে আছে বড় খুঁটি৷ কিছু করা যাবে না৷ ট্রাইব্যুনাল করলে কোনো আশা নাই, সিভিল কোর্ট হলে আশা আছে৷ জজ সাহেবদের টাকা খাওয়াতে হবে৷ আগে জজ সাহেবরা টাকা খেত না৷ এখন খায়৷ অনেক জজ দেখেছি কাতলা মাছের মতো হাঁ করে থাকে৷ কেইস সিভিল কোর্টে উঠলে আমারে খবর দিয়ে নিয়ে আসবি৷

মামলা মোকদ্দমা বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই৷ সব সময় শুনেছি মামলা লোয়ার কোর্ট থেকে হাইকোর্টে যায়, তারপর সুপ্রিম কোর্টে৷ আমার বেলায় সরাসরি হাইকোর্ট থেকে তলব৷ শুধু আমি একা আসামি তা কিন্তু না৷ আমাকে নিয়ে বিচারকরা মামলা করেছেন এই বিষয়টি যেসব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তারাও আসামি৷ তাতে আমার সুবিধা হলো, পত্রিকার সম্পাদকরা বড় বড় ব্যারিস্টার দিলেন৷ এই মুহূর্তে ড. কামাল হোসেন এবং ভাষাসৈনিক গাজিউল হকের নাম মনে পড়ছে৷

পত্রিকার সম্পাদকরা উপস্থিত হয়ে ক্ষমা চাইলেন এবং পার পেয়ে গেলেন৷ অ্যাটর্নি জেনারেল তার অফিসে আমাকে ডেকে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বললেন৷ তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে, ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং বিতর্কিত বইটি বাজার থেকে উঠিয়ে নিলে আমার আর কোনো ঝামেলা হবে না৷

আমি বললাম, ভুল করলেই ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্ন আসে৷ আমি ভুল করিনি৷ উপন্যাসের একটি দুষ্ট চরিত্র কী বলছে তার দায়ভার লেখকের না৷ তারপরেও যদি দায়ভার আমার থাকে তাহলে আমি জজ সাহেবরা ঘুষ খান এই মন্তব্য থেকে সরে আসব না৷ সব জজ সাহেবের কথা এখানে বলা হয়নি৷ জজ সাহেবরা ভিনগ্রহ থেকে আসেননি৷ মানুষের সাধারণ ত্রুটি তাদের মধ্যেও থাকবে৷ একজন লেখক হিসেবে আমি তা লিখব৷ আমাদের সংবিধান মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে৷

অ্যাটর্নি জেনারেল বললেন, আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন৷

আমি বললাম, কী আর করা৷ না হয় একটু বিপদে পড়লাম৷

মামলা শুরু হলো৷ আমি হাইকোর্টে যাই৷ সঙ্গে আমার তিন কন্যা এবং তাদের মা৷ তারা ভয়ে অস্থির, এই বুঝি আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে৷ মামলার এক পর্যায়ে তিন বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের একজন বললেন, তিনি বিব্রত৷ মামলায় থাকবেন না৷ কিছুদিন পর আরেকটি বেঞ্চ তৈরি হলো৷

সেই বেঞ্চের এক বিচারকও বললেন তিনি বিব্রত৷ পনেরো ষোল বছর তো হয়েই গেল, বিচারকরা আমার বিষয়ে বিব্রত রয়েই গেলেন৷ আমার খুব ইচ্ছা করে মামলাটা শেষ পর্যন্ত দেখতে৷ মামলায় আমি যদি জিতে যাই তাহলে প্রমাণ হবে জজ সাহেবরা সাধারণ লোভ লালসার ঊর্ধ্বে না৷ আর যদি হেরে জেলে যাই ততেও ক্ষতি নেই৷

অতীতে এই পৃথিবীতে লেখার মাধ্যমে মত প্রকাশের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷ আমি না হয় কিছুদিন জেলে থাকলাম৷ আমাকে জেলখানার মেঝেতে শুয়ে থাকতে হবে না৷ একুশে পদক পাওয়ার কারণে ডিভিশন দেওয়া হবে৷ বিছানায় ঘুমাব৷ ভাগ্য ভালো হলে মাথার উপর ফ্যান ঘুরবে৷ ফ্যান না ঘুরলেও ক্ষতি নেই, চোখ বন্ধ করে ময়ূরাক্ষী নদীকে জেলের ভেতর নিয়ে আসা কঠিন কোনো কাজ না৷

পুত্র নিষাদ

আমার বয়স ষাট। আমার পুত্র নিষাদের বয়স ষোল মাস। আমি ষাটটা বর্ষা দেখেছি, সে মাত্র দু’টি দেখেছে। জীবনের দু’প্রান্তে দু’জন দাঁড়িয়ে আছি। আমি শুনছি বিদায় সঙ্গীত, সে শুনছে আগমনী সঙ্গীত।

একজন লেখকের প্রধান কাজই হচ্ছে বিশেষভাবে দেখা। সেই দেখার বস্তু যদি নিজের পুত্র হয়, তাহলে তো পুরো ব্যাপারটা আরো বিশেষ হয় দাঁড়ায়। নিষাদের মা তার ছেলের জন্যে একটা বেবি বুক কিনেছে। সেখানে শিশুর বড় হওয়ার বিভিন্ন পর্ব লেখার ব্যবস্থা আছে। যেমন-

শিশুর প্রথম গড়াগড়ি খাওয়া
প্রথম নিজে নিজে উঠে বসা
প্রথম হামাগুড়ি
প্রথম দাঁড়ানো

সব মায়েরাই এই ধরনের বই কেনেন। শুরুর দিকে প্রতিটি ঘটনা আগ্রহ নিয়ে লেখেন। ছয় মাসের মধ্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। শিশু বুকে নতুন কিছু যুক্ত হয় না। আমি যেহেতু সবকিছু স্মৃতিতে ধরে রাখি, মাথার ভেতর আমার লেখা চলতেই থাকে। আমি গভীর আগ্রহে নিষাদকে দেখি। তার অনেক কর্মকাণ্ড আমার গল্প-উপন্যাসে চলে আসে। উদাহরণ দেই-

নিষাদ কথা বলতে শিখে প্রথম শব্দটা বলল- ‘কাক!’ এত শব্দ থাকতে ‘কাক’ কেন? রহস্য উদ্ধার হলো। সে কান্নাকাটি করলেই কাজের মেয়ে তাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় যায় এবং ‘কাক’ দেখিয়ে বলে।। ‘কাক! কাক!’ কাকরা উড়াউড়ি করে। শিশু মহানন্দ পায়। সে প্রথম শব্দ ‘কাক’ শিখবে এটাই তো স্বাভাবিক।

অন্যদিন পত্রিকায় ‘কাকারু’ নামে একটা গল্প লিখলাম। গল্পের শুরুটা-

আশরাফুদ্দিন কাঁটাবন পাখির দোকানে গিয়েছেন কাক কিনতে। তাঁর মেয়ে সুমির জন্মদিনে তিনি একটা ‘কাক’ উপহার দেবেন।

আশরাফুদ্দিন তাঁর মেয়েকে কাক উপহার দিতে চাচ্ছেন, কারণটা হলো আমার পুত্র নিষাদ। সুমিও নিষাদের মতো প্রথম শব্দ বলতে শেখে কাক।

নিষাদের আগেও আমার চারটি সন্তান চোখের সামনেই বড় হয়েছে। তবে তাদেরকে সেভাবে দেখা হয়নি। তখন শিক্ষকতা করি। টাকা-পয়সার বিরাট ঝামেলা। যখনই সময় পাই লেখালেখি করি। বাড়তি কিছু রোজগারের চেষ্টা। মাথা গুঁজে পরীক্ষার খাতা দেখি। সন্তানদের দিকে তাকাবার সময় কোথায়?

আজ আমার অনেক অবসর। ঘরকুনো গর্তজীবী টাইপ মানুষ বলেই ঘর থেকে বের হই না। নিষাদকে সব সময়ই চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখি। একটি শিশুর মানসিকতা তৈরি হবার প্রক্রিয়াটি দেখি। তার মানসিকতা গঠনের প্রক্রিয়ায় আমার ভূমিকা কি ঠিক আছে তা নিয়ে ভাবি। যে ভাবনা আমি অন্য সন্তানদের সময় ভাবতে পারিনি।

ভাবনার নমুনাটা বলি। নিষাদ কোথাও পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে ঐ জায়গাটাকে চড়-থাপ্পড় দিলে তার মুখে হাসি ফোটে। সে নিজেও চড়-থাপ্পড় দেয় এবং বলে- মার! মার!

একদিন মনে হলো, এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমরা কি ছেলেকে প্রতিশোধপরায়ণ হতে শেখাচ্ছি? সে যখন বড় হবে কেউ তাকে ব্যথা দিলে, সে কি শৈশবের শিক্ষা থেকে তাকে ব্যথা দিতে চাইবে? সেটা কি ঠিক হবে?

কেউ ব্যথা দিলেই প্রতিশোধ নেয়া যাবে না- এই তথ্য শেখালে সে যদি বড় হয়ে ভ্যাবদা টাইপ হয় তখন? মার খাবে, কিন্তু প্রতিবাদ করবে না। এটা তো আরো খারাপ।

কী করব বুঝতে না পেরে অস্থির লাগে।

প্রকৃতির সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়েও ঝামেলা। একদিন ঝুম বৃষ্টিতে তাকে ঘাড়ে নিয়ে ছাদে গেলাম। বৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মহানন্দে সে বৃষ্টিতে ভিজল। তার ফল হলো ভয়াবহ। প্রচণ্ড জ্বর, কাশি। ডাক্তার-হাসপাতাল ছোটাছুটি। নিষাদের মা ঘোষণা করল।। আমি শিশু পালনে অক্ষম। আমার কাছে কখনোই নিষাদকে ছাড়া যাবে না।

নিষাদের যে সব কর্মকাণ্ডে আমি আনন্দ পাই, তার মা পায় না। বরং সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়। একদিন দেখি, সে আমার সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছে। হাতে দেয়াশলাই-এর বাক্স। আমি হো হো করে হাসছি। তার মা রেগে অস্থির। সে কঠিন গলায় বলল, ঘরে সিগারেটের প্যাকেট থাকতে পারবে না। সিগারেট খাওয়া জন্মের মতো ছাড়তে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

একদিন শোবার ঘরে লেখালেখি করছি, হঠাৎ দেখি নিষাদ টয়লেটের দিকে রওনা হয়েছে। টয়লেটে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে শুরু করল কান্না। কিছুতেই সে দরজা খুলতে পারছে না। সে কাঁদছে, আমি কান্না শুনছি। নিজে উঠে গিয়ে দরজা খুলছি না। কান্না শুনে এক সময় তার মা এসে দরজা খুলে তাকে বের করল। আমাকে বলল, তুমি ওর কান্না শুনতে পাচ্ছিলে না?

আমি বললাম, অবশ্যই শুনতে পাচ্ছি। আমার সামনে দিয়েই তো সে বাথরুমে ঢুকল।

তাহলে দরজা খুলছিলে না কেন?

আমি বললাম, তোমার পুত্রের ধারণা এ বাসার সবাই সারাক্ষণ তাকে দেখে রাখছে। তার প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখছে। সত্যিকার পৃথিবী এমন না। সেখানে বিপদ আছে। সমস্যা আছে। আমি তাকে সমস্যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

দয়া করে তুমি তাকে কোনো কিছুর সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দেবে না। একটা অবোধ শিশু ভয় পেয়ে এতক্ষণ ধরে কাঁদছে, আর তুমি থিওরি কপচাচ্ছ!

আমি থিওরি ফলানো বন্ধ করে এখন শুধুই তার বড় হওয়া দেখছি।

তেলাপোকা দেখে একবার তাকে ভয়ে চিৎকার দিতে দেখলাম। আমি খুশি, ভয় নামক অনুভূতির সঙ্গে তার পরিচয় হলো।

পাশের বাসার তার সমবয়েসী অন্বয়কে একদিন সে ধাক্কা দিয়ে ফেলে খামচে ধরল। আমি খুশি, রাগ নামক বিষয়টি তৈরি হচ্ছে। ভেজিটেবল হয়ে কঠিন পৃথিবীতে সে টিকতে পারবে না।

ছোট্ট একটা মেয়ে বাসায় বেড়াতে এসেছে। মেয়েটির হাতে চকলেট। নিষাদ ছুটে গিয়ে মেয়েটির চকলেট কেড়ে নিয়ে মুখে দিয়ে ফেলল। পরের ধন আত্মসাৎ। এর প্রয়োজন কি আছে? বড় হয়ে নিষাদ যদি রাজনীতি করার কথা ভাবে তাহলে অবশ্যই প্রয়োজন আছে। আমি চাচ্ছি না সে ঐ পথে যাক। কাজেই তাকে হা করিয়ে মুখ থেকে চকলেট বের করে বলা হলো- ঘড়, ঘড়, ঘড়.

ছোট শিশু এবং কুকুর ছানাকে ‘না’ বলা হয় ইংরেজিতে। এর কারণ কী কে জানে।

একবার পুত্র নিষাদ আমাকে বড় ধরনের একটা শিক্ষা দিয়েছিল। সেই গল্প বলে ব্যক্তিগত উপাখ্যান শেষ করি।

আমি সিলেট থেকে মাইক্রোবাসে করে ফিরছি। সায়েদাবাদে এসে বিশাল জটে পড়ে গেলাম। সেটা কোনো সমস্যা না। ঘণ্টার পর ঘন্টা এক জায়গায় বসে থাকার অভ্যাস আমার আছে। সমস্যা অন্যখানে। নিষাদের দুধ শেষ। সে ক্ষুধার যন্ত্রণায় শুরু করেছে কান্না। বাসায় না পৌঁছানো পর্যন্ত তাকে দুধ দেয়া যাচ্ছে না। ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না বাবা-মা’র বুকে কীভাবে লাগে সেদিন প্রথম বুঝলাম। তার কান্না আমার কলিজার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে।

আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম।

ঠিক এই সময় হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, ছোট্ট নিষাদ বাসায় গেলেই খাবার পাবে। তার খাবারের অভাব হবে না। কিন্তু এই দেশের অসংখ্য শিশু ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদে। তাদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের কান্না দেখে কেমন লাগে তাদের বাবা-মা’র?

নিষাদের কথা না, ক্ষুধার্ত শিশুদের বাবা-মা’র কথা ভেবে হঠাৎ করেই আমার চোখে পানি এসে গেল। তাতে কী যায় আসে! ক্ষুধার্ত শিশুদের কাছে একজন মানুষের সাময়িক অশ্রুর মূল্য কী?

বসন্ত বিলাপ

তখন চিটগং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ি। ক্লাসটিচার বড়ুয়া স্যার আমাদের বাংলা পড়ান। স্যার একদিন ক্লাসে এসে বললেন, ‘রচনা লেখো “আমার প্রিয় ঋতু”।’ এই বলেই চেয়ারে পা তুলে তিনি ঘুমের প্রস্তুতি নিলেন। আমাদের সময়ে ক্লাসওয়ার্ক দিয়ে শিক্ষকদের ঘুমানো এবং ঝিমানো স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এটাকে কেউ দোষের ধরত না। ছাত্ররা তো ক্লাসওয়ার্ক করছেই।
খাতা খুলে বসে আছি, আমার প্রিয় ঋতু কী বুঝতে পারছি না। শীত হওয়ার সম্ভাবনা কি আছে? শীতের সময় আমরা নানাবাড়ি মোহনগঞ্জে যাই। তখন লেপ নামানো হয়। লেপের ভেতর হুটোপুটি। রাতের উঠানে আগুন জ্বেলে চারদিকে গোল হয়ে বসে ভূতের গল্পের আসর। দিনের বেলা ডোবা সেঁচে মাছ ধরা।
প্রিয় ঋতু ‘শীত’ নিয়ে রচনা লেখা শেষ হলো। ক্লাস শেষ হয়ে গেছে, এক্ষনি ঘণ্টা পড়বে। এ অবস্থায় কারোর রচনাই স্যারের পড়ার সময় নেই। আমরা আনন্দিত। হঠাৎ স্যার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘দেখি কী লিখেছিস?’
আমি ভয়ে ভয়ে খাতা দিলাম। স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, ‘প্রিয় ঋতু হবে ঋতুরাজ বসন্ত। তুই লিখেছিস শীত। গাধা, কানে ধর।’
আমি কানে ধরতেই ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ল। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় রচনা ছিল ‘তোমার প্রিয় ঋতু’। এইবার আর ভুল হলো না, লিখলাম ঋতুরাজ বসন্ত। রচনার ফাঁকে ফাঁকে কোটেশন ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। কোটেশন দেওয়া মানেই ছাঁকা নম্বর।
ঋতুরাজ বসন্ত নিয়ে লেখা কারও কোনো কবিতা মনে না পড়ায় নিজেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলাম। লিখলাম—ঋতুরাজ বসন্তের রূপে মুগ্ধ হইয়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘কত অপূর্ব পুষ্পরাজি ঋতুরাজ বসন্তে ফুটিয়াছে।’
বালক বয়সে কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসন্তবিষয়ক একটি উদ্ধৃতি (আমার অতি প্রিয়) এখন দিচ্ছি—
‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।’
তিনটি মাত্র লাইনে বসন্ত উপস্থিত। বাঁশি বাজার শব্দও কানে আসা শুরু হয়েছে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ঋতু কি বসন্ত? তাঁর বসন্তবিলাস দেখে আমি অবাকই হই। এই ব্যাকুলতার কারণ কী? বঙ্গদেশে শীত প্রায় নেই বলেই বসন্তও নেই। আমাদের অল্প কিছু পাতাঝরা বৃক্ষ, পত্রহীন গাছে বসন্তকালে নতুন পাতা আসার ব্যাপারটা সে জন্যই অনুপস্থিত বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন শালবনের ভেতর। শালবনে বসন্তকালে নতুন পাতা আসে—এই দৃশ্য অবশ্যই সুন্দর। তখন কিন্তু পুরোনো পাতা ঝরতে থাকে। এই দৃশ্য অতি বিরক্তিকর।
এমন কি হতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের বসন্তবিলাসের পরোক্ষ কারণ পশ্চিমের দেশ? যৌবনে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের দেশে কাটিয়েছেন। তিনি দেখেছেন ভয়ংকর শীতের পর আনন্দময়ী বসন্তের আগমনের সর্বজনীন উচ্ছ্বাস। এই থিওরি বাতিল। রবীন্দ্রসাহিত্য পশ্চিমের প্রভাবমুক্ত। অবশ্যি সমালোচকেরা বলেন, ছোটগল্প লেখার প্রেরণা তিনি পেয়েছেন পশ্চিমা ছোটগল্প পড়ে। তাঁর প্রিয় ছোটগল্পকার এডগার এলেন পো।
সমালোচকেরা কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে কোনো লেখকের ওপর অন্যের প্রভাব প্রমাণ করতে পারলে বিমলানন্দ উপভোগ করেন। আমি সমালোচক নই বলেই কারও লেখার ওপরই অন্যের প্রভাব পাই না। আর রবীন্দ্রনাথ তো সবার ঊর্ধ্বে। তাঁর কত কবিতায় বৃষ্টির বন্দনা আছে। তিনি অসংখ্যবার পশ্চিম দেশের অপূর্ব তুষারপাত দেখেও এই নিয়ে কাব্য রচনা করেননি।
অন্যদিকে আমাদের জীবনানন্দ দাশের পশ্চিমা সাহিত্যের মুগ্ধতা চলে এসেছে তাঁর কাব্যে। তিনি হয়ে গেছেন হেমন্তের কবি। তাঁর হেমন্ত বঙ্গদেশের হেমন্তও না, পশ্চিমা হেমন্ত। ফুল ও পাখির বসন্ত জীবনানন্দকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি।
বসন্ত এসেছে—এই খবর আমি পাই নুহাশপল্লীতে। খবরটা আমাকে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। নুহাশপল্লীতে তাঁর অতিপ্রিয় ফুল নীলমণিলতা ফোটে বসন্তকালে। নীলমণিলতা নাম রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। বোটানিক্যাল নাম Patraea volobilis. নুহাশপল্লীতে বাগানবিলাস বসন্তেই হেসে ওঠে। বাগানবিলাস রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। অন্য নাম Bougain Villea. রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা মাধুরীর নামে একটি লতানো গাছের নাম রেখেছেন মাধুরীলতা। এই গাছে ফুল বর্ষাকালে আসে কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে নুহাশপল্লীতে বসন্তকালে মাধুরীলতা ফুলে ফুলে ভরে যেতে দেখেছি। মাধুরীলতার ইংরেজি নাম Quisquallis Indica.
বসন্ত মানেই পাখির গান (‘এত পাখি গায়’), মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো করে ডাকে বউ কথা কও পাখি। এক্ষুনি বউ কথা না বললে সে মারা যাবে অবস্থা। এ কারণেই ‘বউ কথা কও’ পাখির আরেক নাম ব্রেইন ফিভার বার্ড। নজরুলের গানে এই পাখি বারবার এসেছে। বউ কথা কও নামে না, পাপিয়া নামে। বসন্তকালেই শিস দিতে শুরু করে কুটুম পাখি। বনফুল বলেন, ‘খোকা হোক পাখি।’ শ্যামা পাখির গান গাওয়ার সময়ও বসন্তকাল। কোকিল ও দোয়েলের কথা তো বলাই হলো না। এরাও বসন্তের পাখি। (যেসব পাঠক বসন্তের পাখি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে চান, তাঁরা পক্ষীবিশারদ সাদত সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট, ঢাকা ক্লাব। বসন্তকালে তিনি পাখির গান শোনার জন্য ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘোরেন।)
নুহাশপল্লীতে বসন্তের দিন হলো পাখিদের জলসার দিন। কাঠঠোকরা পাখি যে ঠকঠক শব্দের বাইরে গানও করতে পারে, তা আমি নুহাশপল্লীতে এক বসন্তে প্রথম শুনি। এই পাখি দেখতে যেমন সুন্দর, তার গানের গলাও অদ্ভুত। কাক বসন্তকালে চুপ করে যায়। কা কা কম করে। মনে হয় অন্য পাখিদের বিশেষ করে তার চিরশত্রু কোকিলের হইচইয়ে বিরক্ত হয়ে চুপ করে যায়। বসন্তে কাকের নীরবতার তথ্যটা মজার না?
রবীন্দ্রনাথকে যদি তাঁর প্রিয় ঋতু নিয়ে রচনা লিখতে বলা হতো, তিনি কি বসন্ত নিয়ে লিখতেন? বসন্ত নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস দেখে এ রকম মনে হওয়া স্বাভাবিক। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বঙ্গদেশের প্রতিটি ঋতুর প্রতিই ছিল তাঁর সীমাহীন উচ্ছ্বাস। যিনি লেখেন, ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান’, তাঁর প্রিয় ঋতু তো বর্ষা। বর্ষার বর্ণনায় তিনি সেই সব পাখির নাম নিয়েছেন, যারা জলচর এবং শুধু বর্ষাতেই গান করে (ডাহুক, মাছরাঙা, সারস, বকপক্ষী)। তাঁর তীক্ষ পর্যবেক্ষণের বাইরে যাওয়ার উপায় এ দেশের প্রকৃতির ছিল না, আর ছিল না বলেই তিনি লিখতে পেরেছেন, “ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।”

পাদটীকা
এক চৈত্র মাসে আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। রোদের তাপে প্রকৃতি ঝলসে যাচ্ছে। মাটি ফেটে চৌচির, আকাশ পিঙ্গল। হঠাৎ দেখি একটা শিমুলগাছ। গাঢ় লাল রঙের ফুল এমনভাবে ফুটেছে যে মনে হয় রোদের তাপে গাছে আগুন লেগে গেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে গাছের নিচে দাঁড়ালাম। অবাক হয়ে শুনি, পটকা ফোটার মতো শব্দ হচ্ছে। শিমুল ফুলগুলোর মতো শব্দ করে ফাটে এবং বীজ থেকে বের হয়ে ছোট্ট মেঘের মতো তুলা বাতাসে উড়তে থাকে। এই দৃশ্য প্রথম দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম। বসন্ত! তোমাকে অভিবাদন।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৮, ২০১১

বালক হিমু

পাঁচ-ছয় বছর আগে আমি অতি দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ একা একা থাকি দখিন হাওয়ার এক ফ্ল্যাটে৷ নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন৷ মাঝে মধ্যে নুহাশ আসে৷ হোটেল থেকে খাবার এনে দুজন মিলে খাই৷ সে কিছুক্ষণ থাকে৷ দুজন নানা বিষয়ে গল্প করি৷ একদিন সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে উপস্থিত৷ আমি বললাম, বাবা পাঞ্জাবিটা সুন্দর তো!

সে খুশি খুশি গলায় বলল, মেজপা (শীলা) নিজের হাতে বানিয়েছে৷

আমি বললাম, ভালো বানিয়েছে৷

নুহাশ বলল, বাবা এটা হিমু পাঞ্জাবি৷ আমি হিমু হয়েছি৷

আমি হিমুর পিঠে হাত রাখলাম৷ তাকিয়ে থাকলাম জানালার দিকে৷ কারণ চোখে পানি এসে যাচ্ছে৷ আমি চাচ্ছি না বালক হিমু পিতার চোখের পানি দেখুক৷

দিন পনেরো আগের কথা৷ লেখালেখি করছি৷ হঠাৎ ধুপ করে আমার কোলে কী যেন পড়ল৷ তাকিয়ে দেখি, সর্বকনিষ্ঠ পুত্র নিষাদ হুমায়ূন৷ বয়স দুই মাস৷ তার মা তাকে সাজিয়ে এনে আমার কোলে ছেড়ে দিয়েছে৷ শাওন বলল, ছেলেকে দেখে কিছু কি বোঝা যাচ্ছে?

আমি বললাম, না৷

ভালো করে তাকিয়ে দেখ৷

আমি ভালো করে দেখলাম, কপালে কাজলের ফোঁটা ছাড়া আলাদা কিছু পেলাম না৷

শাওন বলল, সে যে হিমু হয়েছে, এটা বুঝতে পারছ না? হলুদ পাঞ্জাবি, খালি পা৷

আমি বললাম, আরে তাই তো!

দুই মাসের শিশু হিমু মহানন্দে হাত-পা ছুড়ছে৷ তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, রাস্তায় ছেড়ে দিলেই সে হাঁটতে শুরু করবে৷ একবারও পেছন ফিরে তাকাবে না৷ হিমুরা কখনো পেছনে তাকায় না৷ হিমু আইনে পেছনে ফিরে তাকানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তারা তাকিয়ে থাকবে ভবিষ্যতের দিকে৷

ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি৷ লেকচারার থেকে অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হয়েছি৷ বেতন বাড়েনি, যন্ত্রণা বেড়েছে৷ আমাকে দূর-দূরান্তরে পরীক্ষা নিতে পাঠানো হচ্ছে৷ পটুয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর৷ কলেজগুলোতে পড়াশোনা হয় না বললেই চলে৷ প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের সুযোগ-সুবিধাও নেই৷ ছাত্ররা কিছুই পারে না৷ অতি সহজ প্রশ্নে মাথা চুলকায়, ঘাড় চুলকায়৷ মাথা এবং ঘাড় থেকে প্রশ্নের উত্তর আসে না৷

অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছে এমন ছেলেকে যখন জিজ্ঞেস করি, পানির ফর্মূলা কী? সে আমতা আমতা করে বলে, H2O৷ যেন তার সন্দেহ আছে আসলেই H2O কিনা৷ তারপর জিজ্ঞেস করি, D2O কী? যারা কেমিস্ট্রি জানেন না তাদের বলছি, D2O হচ্ছে হেভি ওয়াটার৷ হাইড্রোজেন অ্যাটমে প্রটোন থাকে একটা, এখানে দুটা৷ D হলো হাইড্রোজেনের একটা Isotope৷ অতি সহজ এই প্রশ্নে পরীক্ষার্থী পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে বলে, স্যার হচ্ছে D2O ঢাকার পানি৷ তাহলে রাজশাহীর পানির ফর্মূলাটা কী? স্যার R2O৷ বরিশালের পানি? স্যার B2O৷ বরগুনার পানি? এইবার ছাত্র উৎসাহী৷ সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে৷ সে হাসিমুখে জবাব দেয়, বরগুনার পানিরও স্যার একই ফর্মূলা B2O৷

আমি হতাশ চোখে পরীক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে থাকি৷ ইন্টারনাল একজামিনার হাত কচলাতে কচলাতে বলেন, পাস করিয়ে দিতে হবে স্যার৷ গরিবের ছেলে৷ কষ্ট করে লেখাপড়া করছে৷ ভাবটা এ রকম যে, ধনীর ছেলেমেয়েদের কেমিস্ট্রি জেনে পাস করতে হবে৷ গরিবের ছেলের পাসটা প্রয়োজন৷ কেমিস্ট্রি জানা প্রয়োজন না৷

বাইরে পরীক্ষা নিতে গেলে ভাইভা বিষয়ক অতি ক্লান্তিকর অবস্থার ভেতর যেতে হয়৷ ছাত্রদের ফেল করাতে ইচ্ছা করে না, আবার পাস করাতেও ইচ্ছা করে না৷ ভাইভা নিতে কষ্ট৷ থাকা-খাওয়াতেও কষ্ট৷

এক্সটারনাল শিক্ষকদের থাকার জায়গা হয় সাধারণত ল্যাবরেটরির লাগোয়া ঘরে৷ উদাহরণ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ৷ সেখানে পরীক্ষা নিতে গিয়ে ওই ঘরে অনেকদিন থেকেছি৷ একবার ভূতও দেখেছিলাম৷ যেসব কলেজে এ রকম কোনো ঘর নেই সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয় কোনো শিক্ষকের বাসায়৷ ভদ্রলোক হয়তো পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করছেন, সেখানে মূর্তিমান উপদ্রবের মতো অচেনা অজানা একজন মানুষ থাকতে আসেন৷ যাকে আপন করে নেওয়া যায় না, আবার দূরেও ঢেলে রাখা যায় না৷

এক্সটারনাল ভদ্রলোক ইচ্ছা করলেই ভাইভায় প্রচুর ফেল করিয়ে ঝামেলা করতে পারেন৷ একবার কেমিস্ট্রির এক শিক্ষকের বাসায় আমার থাকার জায়গা হলো৷ ভদ্রলোকের বাসায় একটা বাথরুম৷ সেই বাথরুম স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘরের সঙ্গে এটাচড৷ আমার আবার রাতে কয়েক দফা বাথরুমে যেতে হয়৷ ভদ্রলোক অবশ্য খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, আমার শোবার ঘরের দরজা খোলা থাকবে৷ আপনার যতবার ইচ্ছা বাথরুমে যাবেন৷ কোনো সমস্যা নেই৷

দীর্ঘ ভূমিকা দিলাম, এখন মূল গল্পে আসি৷ আমি পরীক্ষা নিতে গেছি পটুয়াখালীতে৷ ল্যাবরেটরির পাশের টিচার্স রুমে খাট পেতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ গরমকাল৷ বেশির ভাগ সময় ইলেকট্রিসিটি নেই৷ ফ্যান চলে না৷

প্রথম রাতে একফোঁটা ঘুম হলো না৷ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি৷ রাত তিনটায় মশারির ভেতর থেকে বের হলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে শত শত মশা আমাকে ছেঁকে ধরল৷ আবার মশারির ভেতর ঢুকলাম৷ গরমে টিকতে না পেরে আবার বের হলাম৷ মশাদেরকে বললাম, তোমরা যারা এখানে আছ তারাই আমার রক্ত খাও, বাইরে থেকে কাউকে ডেকে এনো না৷ ঘরটাকে আমার মনে হলো হাজতখানা৷ এই হাজতে সাতটা রাত পার করতে হবে ভেবে খুবই দমে গেলাম৷ এর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় কীভাবে? হঠাৎ করে মনে হলো একটা নদী কল্পনা করলে কেমন হয়?

নদীর পাড়ে একটা গাছের নিচে আমি বসে আছি৷ উথাল পাতাল হাওয়া নদীর উপর দিয়ে উড়ে আসছে৷ এমন হাওয়া যে আমার সামান্য শীত শীত ভাব হচ্ছে৷ আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মশক বানিহীকে সম্পূর্ণ অগ্রহ্য করে নদী কল্পনা শুরু করলাম৷ নদীর একটা সুন্দর নামও দিলাম – ময়ূরাক্ষী৷ যারা আমার লেখা পড়ছেন তারা হয়তো পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন না যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার গরম লাগা কমে গেল৷ নদীর প্রবল হাওয়ায় মশারা উড়ে গেল৷ আমার খানিকটা শীত শীতও করতে লাগল৷

এভাবেই তৈরি হলো হিমু, যে যেকোনো অবস্থায় কল্পনার নদী ময়ূরাক্ষীর কাছে চলে যেতে পারে৷ হিমুকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম উপন্যাসটির নাম ময়ূরাক্ষী৷ ময়ূরাক্ষীর হিমু আমি নিজে৷ প্রথম লেখা হিমু বিষয়ক বইয়ে ময়ূরাক্ষী নদী কীভাবে চলে এল, একটু দেখা যাক৷

ছোটবেলার কথা৷ ক্লাস সিক্সে পড়ি৷ জিওগ্রাফি পড়ান মফিজ স্যার৷ তিনি ক্লাসে ঢুকলে চেয়ার-টেবিলগুলো পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে৷ স্যার মানুষটা ছোটখাটো, কিন্তু হাতের থাবাটা বিশাল৷ আমাদের ধারণা ছাত্রদের গালে চড় বসাবার জন্য আল্লাহতালা স্পেশালভাবে স্যারের এই হাত তৈরি করে দিয়েছেন৷ স্যারের চড়েরও নানা নাম ছিল – রাম চড়, শ্যাম চড়, যদু চড়, মধু চড়৷

এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চড় হচ্ছর রাম চড়, সবচেয়ে নরমটা হচ্ছে মধু চড়৷ স্যার সেদিন পড়াচ্ছেন – বাংলাদেশের নদ-নদী৷ ক্লাসে ঢুকেই আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এই একটা নদীর নাম বল তো৷ চট করে বল৷ মফিজ স্যার কোনো প্রশ্ন করলে কিছুক্ষণের জন্য আমার মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়৷ কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে৷ মনে হয় মাথার খুলির ভেতর জমে থাকা কিছু বাতাস কানের পর্দা ফাটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে৷

কী ব্যাপার চুপ করে আছিস কেন? নাম বল৷ আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, আড়িয়াল খাঁ৷ স্যার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলেন৷ খুব সম্ভব রাম চড়৷ হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এত সুন্দর সুন্দর নাম থাকতে তোর মনে এল আড়িয়াল খাঁ? সব সময় ফাজলামি? কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক৷ আমি কানে ধরে সারাটা ক্লাস দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ঘন্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক আগে পড়ানো শেষ করে স্যার চেয়ারে গিয়ে বসলেন৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে আয়৷

আরেকটি বড় খাবার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেলাম৷ তিনি বিষন্ন গলায় বললেন, এখনো কানে ধরে আছিস কেন? হাত নামা৷ আমি হাত নামালাম৷ স্যার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, তোকে শাস্তি দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে, খুবই অন্যায়৷ তোকে নদীর নাম বলতে বলেছি, তুই বলেছিস৷ আয় আরও কাছে আয়, তোকে আদর করে দেই৷

স্যার এমন ভঙ্গিতে মাথায় এবং পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন যে আমার চোখে পানি এসে গেল৷ স্যার বিব্রত গলায় বললেন, আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম, আর তুই বললি আড়িয়াল খাঁ৷ আমার মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে৷ আচ্ছা এখন সুন্দর একটা নদীর নাম বল৷ আমি শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললাম ময়ূরাক্ষী৷

ময়ূরাক্ষী? এই নাম তো শুনিনি৷ কোথাকার নদী?

জানি না স্যার৷

এই নামে আসলেই কি কোনো নদী আছে?

জানি না স্যার৷

স্যার হালকা গলায় বললেন, আচ্ছা থাক৷ না থাকলে নেই৷ এটা হচ্ছে তোর নদী৷ যা জায়গায় গিয়ে বস৷ এমনিতেই তোকে শাস্তি দিয়ে আমার মনটা খারাপ হয়েছে৷ তুই তো দেখি কেঁদে কেঁদে আমার মন খারাপটা বাড়াচ্ছিস৷ আর কাঁদিস না৷

রহস্য

রহস্য জাতীয় ব্যাপারগুলিতে আমার তেমন বিশ্বাস নেই। তবু প্রায়ই এ রকম কিছু গল্প-টল্প শুনতে হয়। গত মাসে ঝিকাতলার এক ভদ্রলোক আমাকে এসে বললেন, তার ঘরে একটি তক্ষক আছে – সেটি রোজ রাত ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকে। আমি বহু কষ্টে হাসি থামালাম। এ রকম সময়নিষ্ঠ তক্ষক আছে নাকি এ যুগে? ভদ্রলোক আমার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে বললেন, কি ভাই বিশ্বাস করলেন না?
জ্বি না।
এক রাত থাকেন আমার বাসায়। নিজের চোখে দেখেন তক্ষকটা। ঘড়ি ধরে বসে থাকবেন। দেখবেন ঠিক ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকবে।
আরে দুর! কি যে বলেন?

ভদ্রলোক মুখ কালো করে উঠে গেলেন। চারদিন পর তার সঙ্গে আবার দেখা। পৃথিবীটা এরকম, যার সঙ্গে দেখা হবার তার সঙ্গে দেখা হয় না। ভুল মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। আমাকে দেখেই ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি কি দৈনিক বাংলার সালেহ সাহেবকে চেনেন?
হ্যাঁ চিনি।
তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি নিজের কানে শুনেছেন। বলেছেন একটা নিউজ করবেন।
ভালই তো। নিউজ হবার মতই খবর।
আপনি আসেন না ভাই, থাকেন এক রাত।
আমাকে শোনালে কি হবে?
আরে ভাই আপনারা ইউনিভার্সিটির টিচার। আপনাদের কথার একটা আলাদা দাম।
তাই নাকি?
আপনারা একটা কথা বললে কেউ ফেলবে না।
এই জিনিসটা নিয়ে খুব হৈ-চৈ করছেন মনে হচ্ছে?
না, হৈ-চৈ কোথায়? অনেকেই অবশ্যি শুনে গেছেন। বাংলাদেশ টিভির ক্যামেরাম্যান নাজমুল হুদাকে চেনেন?
জ্বি না।
উনিও এসেছিলেন। খুব মাইডিয়ার লোক। আপনি আসুন না।
আচ্ছা ঠিক আছে, একদিন যাওয়া যাবে।

ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি মুখভর্তি করে হাসলেন। টেনে-টেনে বললেন, চলেন চা খাই।
না, চা খাব না।
আরে ভাই আসেন না। প্রফেসর মানুষ, আপনাদের সঙ্গে থাকাটা ভাগ্যের ব্যাপার।
ভদ্রলোক হা হা করে হাসতে লাগলেন। যেতে হল চায়ের দোকানে।
চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন? চপ?
না।
আরে ভাই খান না। এই এদিকে দু’টো চা দে তো। এখন ভাই বলেন, কবে যাবেন?
আপনার সঙ্গে তো প্রায়ই দেখা হয়, বলে দেব একদিন।

চা খেতে খেতে ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটা রহস্যের কথা শুরু করলেন। নাইনটিন সিক্সটিতে তিনি বরিশালের পিরোজপুরে থাকতেন। তার বাসার কাছে বড় একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। অমাবস্যার রাতে নাকি সেই কাঁঠাল গাছ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসত। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, সেই কান্নারও কি কোন টাইম ছিল? নির্দিষ্ট সময়ে কাঁদত? আপনার তক্ষকের মত?
ভদ্রলোক আহত স্বরে বললেন, আমার কথা বিশ্বাস করলেন না?
বিশ্বাস করব না কেন?
আমি কান্নার শব্দ গোটাটা টেপ করে রেখেছি। একদিন শোনাব আপনাকে।
ঠিক আছে।

বরিশালের ডিসি সাহেবও শুনেছেন। চেনেন উনাকে? আসগর সাহেব। সি এস পি। খুব খান্দানী ফ্যামিলি।
না, চিনি না।
ডিসি সাহেবের এক ভাই আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। বিরাট অফিসার।
তাই বুঝি?
জ্বি। উনার বাসায় একদিন গিয়েছিলাম। খুব খাতির-যত্ন করলেন। গুলশানের বাসা। তিন তলা। উনি থাকেন এক তলায়। ওপরের দুটো তলা ভাড়া দিয়েছেন।
ভদ্রলোক আমার প্রায় এক ঘন্টা সময় নষ্ট করে বিদায় হলেন। আমার মায়াই লাগলো। ইন্ডেন্টিং ফার্মে সামান্য একটা চাকরি করেন। দেখেই বুঝা যায় অভাবে পর্যুদস্ত। চোখের দুষ্টি ভরসাহারা। বয়স এখনো হয়তো ত্রিশ হয়নি কিন্তু বুড়োটে দেখায়। বিচিত্র চরিত্র।

মাস খানেক তার সঙ্গে আমার দেখা হল না। তার প্রধান কারণ, যে সব জায়গায় তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা সে সব জায়গা আমি এড়িয়ে চলতে শুরু করেছি। নিউমার্কেটে আড্ডার জায়গাটিতে যাই না। কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে? এই লোকটি পিচ্ছিল পদার্থ, সে গায়ের সঙ্গে সেঁটে যাবে। আর ছাড়ানো যাবে না। কিন্তু তবু দেখা হল। একদিন শুনলাম সে ইউনিভার্সিটি ক্লাবে এসে খোঁজ নিচ্ছে। ক্লাবের বেয়ারা বলল, গত কিছুদিন ধরে নাকি সে নিয়মিতই আসছে। কি মুসিবত।

একদিন আর এড়ানো গেল না। ভদ্রলোক বাসায় এসে হাজির।
কি ভাই আপনি তো আর এলেন না?
কাজের ব্যস্ততা …
আজকে আপনাকে নিতে এসেছি।
সে কি?
কবি শামসুল আলম সাহেবও আসবেন।
তাই বুঝি?
জ্বি। চিনেত তো শামসুল আলম সাহেব কে? দু’টো কবিতার বই বেরিয়েছে। পাখির পালক আর অন্ধকার জ্যোত্স্না।
তাই বুঝি?
জ্বি। আমাকে দু’টো বই-ই দিয়েছেন। খুবই বন্ধু মানুষ। বাড়ি হচ্ছে আপনার ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা।
ও।
উনার ছোট ভাইও গল্প টল্প লেখেন। আরিফুল আলম।

গেলাম তার বাসায়। ঝিকাতলার এক গলিতে ঘুপসি মত দু’কামরার বাড়ি। মেজাজ খুবই খারাপ। রাত দেড়টা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে সময়নিষ্ঠ তক্ষকের ডাক শোনার জন্য। কত রকম যন্ত্রণা যে আছে পৃথিবীতে!

ভদ্রলোক আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে ভেতরে চলে গেলেন। বসার ঘরটি সুন্দর করে সাজানো। মহিলার হাতের সযত্ন স্পর্শ আছে। ভদ্রলোক বিবাহিত জানতাম না। এ নিয়ে তার সঙ্গে কখনো কথা হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্ত্রী ঘরে এসে ঢুকলেন। খুবই অল্প বয়েসী তরুণী এবং অসম্ভব রূপসী। আমি প্রায় হকচকিয়ে গেলাম।

আমার স্ত্রী লীনা। আর লীনা, উনি হুমায়ূন আহমেদ। এর কথা তো তোমাকে বলেছি।
লীনা হাসি মুখে বললো, জ্বি আপনার কথা প্রায়ই বলে।
লীনা একটু চায়ের ব্যবস্থা কর।

লীনা চলে গেল ভেতরে। ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, লীনার গল্প-উপন্যাস লেখার শখ আছে। কয়েক দিন আগে সাপ নিয়ে একটা গল্প লিখেছে। মারাত্মক গল্প ভাই। আপনাকে পড়ে শোনাতে বলবো। আমি বললে পড়বে না। আপনিও কাইন্ডলি একটু বলবেন।
আমি বললাম, গুণী মহিলাতো!
ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
তা ভাই, কথাটা অস্বীকার করব না। গানও জানে। নজরুল গীতি। ভালো গায়। বাড়িতে টিচার রেখে শিখেছে।
তাই নাকি?
জ্বি, শোনাবে আপনাকে। একটু প্রেসার দিতে হবে আর কি। আপনি একটু রিকোয়েস্ট করলেই শোনাবে। কাইন্ডলি একটু রিকোয়েস্ট করবেন।
ঠিক আছে, করব।

চা এসে পড়ল। চায়ের সঙ্গে বড়া জাতীয় জিনিস। বেশ খেতে। আমি বললাম, কিসের বড়া এগুলি? ডালের নাকি?
ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হাসলেন, নারে ভাই, কুলের বড়া। হা-হা-হা। কত রকম অদ্ভুত রান্না যে জানে! মাঝে মাঝে এত সারপ্রাইজ হই। খেতে কেমন হয়েছে বলেন? চমত্কার না?
ভাল, বেশ ভাল।
আরেক দিন আসবেন, চাইনীজ সুপ খাওয়াবো। চিকেন কর্ন সুপ। চাইনীজ রেস্তোরাঁর চেয়ে যদি ভালো না হয় তাহলে কান কেটে ফেলবেন। হা-হা-হা।

আমি মেয়েটার লেখা একটা ছোট গল্প শুনলাম, দু’টি কবিতা শুনলাম। ভদ্রলোক মুগ্ধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। বার বার বললেন, ইস শামসুল আলম সাহেব আসলেন না। দারুণ মিস্ করলেন, কি বলেন ভাই?
রাত এগারোটার দিকে বললাম, তা হলে আজ উঠি?
তক্ষকের ডাক শুনবেন না?
আরেক দিন শুনব।
আচ্ছা, ঠিক আছে। ভুলবেন না যেন ভাই। আসতেই হবে।

ভদ্রলোক আমাকে এগিয়ে দিতে এলেন। রাস্তায় নেমেই বললেন, আমার স্ত্রীকে কেমন দেখলেন ভাই?
ভাল, গুণী মহিলা।
ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ধরা গলায় বললেন, বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা। ঠিক না ভাই?
আমি কিছু বললাম না। ভদ্রলোক কাঁপা গলায় বললেন, গরীব মানুষ, স্ত্রীর জন্যে কিছুই করতে পারি না। কিন্তু এই সব নিয়ে লীনা মোটেই মাথা ঘামায় না। বড় ফ্যামিলির মেয়ে তো। ওদের চাল চলনই অন্য রকম।

আমি রিকশায় উঠতে উঠতে বললাম, খুব ভাগ্যবান আপনি।
ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরলেন। যেন আবেগে কেঁদে ফেলবেন।
ভাই, আরেকদিন কিন্তু আসতে হবে। তক্ষকের ডাক শুনতে হবে। আসবেন তো? প্লীজ।

তক্ষকের ডাকের মত কত রহস্যময় ব্যাপারই না আছে পৃথিবীতে!

লীলাবতীর মৃত্যু

একটি পুকুরের মধ্যস্থলে একটি জলপদ্ম ফুটিয়াছে। জলপদ্মটি পানির পৃষ্ঠদেশ হইতে এক ফুট উপরে। এমন সময় দমকা বাতাস আসিল, ফুলটি তিন ফুট দূরে সরিয়া জল স্পর্শ করিল। পুকুরের গভীরতা নির্ণয় করো। (লীলাবতী)
এ ধরনের প্রচুর অঙ্ক আমি আমার শৈশবে পাটিগণিতের বইয়ে দেখেছি। অঙ্কের শেষে ‘লীলাবতী’ নাম লেখা। ব্যাপারটা কী? লীলাবতী মেয়েটা কে? তার সঙ্গে জটিল এই সব অঙ্কের সম্পর্ক কী?
যা জানলাম, তা হচ্ছে_সপ্তম শতকের বিখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ শংকরাচার্যের একমাত্র কন্যার নাম লীলাবতী। মেয়েটির কপালে বৈধব্যযোগ আছে, এই অজুহাতে কন্যা সম্প্রদানের আগে আগে বরপক্ষ মেয়েটির বিয়ে ভেঙে দেয়। লীলাবতী যখন গভীর দুঃখে কাঁদছিল তখন শংকরাচার্য বললেন, ‘মাগো, তোমার জন্যে কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই। তবে পৃথিবীর মানুষ যেন বহু যুগ তোমাকে মনে রাখে, আমি সেই ব্যবস্থা করে যাব।’ তিনি গণিতের একটা বই লেখেন। বইটির নাম দেন কন্যার নামে_’লীলাবতী’।
গল্পটি আমাকে এতই অভিভূত করে যে এক রাতে লীলাবতীকে আমি স্বপ্নেও দেখি। গোলগাল মুখ। দীর্ঘ পল্লবের বড় বড় চোখ। দৃষ্টিতে অভিমান। মাথাভর্তি লম্বা কোঁকড়ানো চুল।
গায়ের বর্ণ শঙ্খের মতো সাদা।
খুব ইচ্ছা হলো স্বপ্নের মেয়েটিকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার। শংকরাচার্যের গণিতের বইয়ের নামের মতো উপন্যাসের নামও হবে ‘লীলাবতী’।
উপন্যাস শেষ পর্যন্ত লিখেছি। উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। কোনো লেখা ছাপা হয়ে বের হওয়ার পর লেখার বিষয়ে আমার কোনো উৎসাহ থাকে না। বইয়ের কাহিনী, পাত্র-পাত্রীদের নাম এবং অনেক সময় বইয়ের নাম পর্যন্ত ভুলে যাই। ‘লীলাবতী’র ক্ষেত্রে ভিন্ন ঘটনা ঘটল, নামটা ভুললাম না। প্রায়ই মনে হতো আমার তিনটা পরীর মতো মেয়ে, তাদের কারোর জন্যে এই সুন্দর নামটা মাথায় এলো না কেন?
আমি আমার তিন কন্যার নাম হেলাফেলা করে রেখেছি। ভেবেচিন্তে রাখা হয়নি। বড় মেয়েটির নাম নোভা। কার্ল সেগান আমেরিকার টিভিতে ‘কসমস’ নামে একটি অনুষ্ঠান করতেন। সেখানে নোভা, সুপারনোভা নিয়ে নানান কথা থাকত। নোভা নামটি এসেছে সেখান থেকে। শীলা নামটা নিয়েছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘শৈলজ শীলা’ থেকে। সবচেয়ে ছোট মেয়ে বিপাশার নাম তারাশংকরের ‘বিপাশা’ নামের উপন্যাস থেকে নেওয়া।
অন্য লেখকদের গল্প-উপন্যাস থেকে নাম নিয়েছি, অথচ নিজের কোনো উপন্যাস থেকে নাম নিলাম না, এটা কেমন কথা?
এই ভেবে সান্ত্বনা পেলাম যে লীলাবতী নাম রাখার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়নি। আমার মেয়েদের বিয়ে হবে। ছেলেমেয়ে হবে। তারা নিশ্চয়ই লেখক বাবার কাছে পুত্র-কন্যাদের নামের জন্যে আসবে, তখন একজনের নাম দিয়ে দেব লীলাবতী। ঘটনা সেভাবে ঘটল না। হঠাৎ করেই আমি আমার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়লাম। কারণ আমি গায়িকা এবং অভিনেত্রী শাওনকে বিয়ে করে ফেলেছি।
কী প্রচণ্ড ঝড়ই না উঠল। পত্রপত্রিকায় কত না কুৎসিত লেখা। যার যা ইচ্ছা লিখছে। যেমন ইচ্ছা গল্প ফাঁদছে। আমার মা-ভাইবোনরা আমাকে ত্যাগ করল। আত্মীয়স্বজনরা ত্যাগ করল। একই ঘটনা ঘটল শাওনের ক্ষেত্রে। সেও বাড়ি থেকে বিতাড়িত। শাওনের বিবাহিত জীবন শুরু হলো চোখের জলে। এই বয়সের মেয়ের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন থাকে। হৈচৈ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শাড়ি-গয়না, পারলারে সাজ। তার কপালে কিছুই নেই। সে একা একা পারলারে সাজতে গেল। একা একাই নিউ মার্কেটে ঘুরতে লাগল, বিয়ে উপলক্ষে এক জোড়া স্যান্ডেল কিনবে।
আমার ভাইবোনরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সমাজে প্রতিষ্ঠিতরা সমাজপতির ভূমিকায় অভিনয় করতে পছন্দ করেন। তারা সবাই সমাজপতি। শাওনকে বিয়ে করার আগে আমি দীর্ঘ চার বছর একা একা কাটিয়েছি। উত্তরায় একটি বাড়ি ভাড়া করে প্রায় এক বছর থেকেছি, পরে উঠে এসেছি ‘দখিন হাওয়া’য়। আমার একা থাকার ব্যবস্থাও সমাজপতিরা মিটিং করে করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ দুষ্ট মানুষ। সে পরিবারে থাকবে না। আলাদা থেকে সংশোধিত হবে। যখন হবে তখন ফিরতে পারবে সংসারে।
আলাদা বাস করছি। উত্তরার একটা বিশাল বাড়িতে একা থাকি। রাতে সব ক’টা বাতি জ্বালিয়ে রাখি। চেষ্টা করি রাতে না ঘুমাতে, কারণ ঘুমের মধ্যে আমাকে ‘বোবায়’ ধরে। এটা একধরনের রোগ। রোগের লক্ষণ_ঘুমের মধ্যে মনে হবে কেউ বুকের উপর বসে গলা চেপে ধরে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। ভয়ংকর কষ্টের ব্যাপার।
মানসিক এই অবস্থায় খবর পেলাম আমার ভাইবোনরা মাকে সঙ্গে নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনের ব্যবস্থা করছে। সেই সংবাদ সম্মেলনে আমার অনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করা হবে। মূল পরিবারের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক নেই, তা বলা হবে। এবং সাংবাদিকদের বলা হবে, আমার কোনো বিষয় নিয়ে যেন তাদেরকে এবং আমার ছেলেমেয়ে ও তাদের মাকে বিরক্ত বা বিব্রত না করা হয়।
খবরটা শুনে মনে কষ্ট পেলাম। ছুটে গেলাম মা’র কাছে। জানতে চাইলাম, এটা কি সত্যি? তিনি স্বীকার করলেন, সত্যি।
আপনি নিজে কি থাকবেন সংবাদ সম্মেলনে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, থাকব।
আমি হতভম্ব হয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে আছি।
সেদিন মাকে আমি কী কথা বলেছিলাম আজ আর তা মনে নেই। শুধু মনে আছে, মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলাম। মা শেষপর্যন্ত সংবাদ সম্মেলনটি তাঁর ছেলেমেয়েদের করতে দেননি। হয়তো পুত্রস্নেহের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
আমাদের বিয়ের তিন মাসের মাথায় শাওনের মা তাঁর কন্যাকে হয়তো বা ক্ষমা করলেন। তিনিও কন্যাস্নেহের কাছে পরাজিত হলেন। শাওন তাঁর অতি আদরের ধন। তাঁর কাছে সমস্ত পৃথিবী একদিকে আর শাওন আরেক দিকে। এই অন্ধ ভালোবাসার কারণ আমি জানি। তবে এই লেখায় সেই কারণ ব্যাখ্যার সুযোগ নেই। কন্যাকে ক্ষমা করার লক্ষণ হিসেবে তিনি তাঁর পুত্রবধূর হাতে শাওনের জন্যে এক সেট গয়না পাঠালেন। শাওন তার বিয়ের একমাত্র উপহার পেয়ে কেঁদেকেটে অস্থির। রাতে সে মায়ের দেওয়া প্রতিটি গয়না পরে বসে থাকল এবং কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলল। শাওনের বাবা কঠিন অবস্থানে গেলেন। তিনি বললেন, শাওন বিয়ে করে ফেলেছে ভালো কথা, তার যেন সন্তান না হয়। তাকে আমি অবশ্যই আবার বিয়ে দেব। ছেলেমেয়ে হলে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে।
হায় রে কপাল! শাওন কনসিভ করে ফেলল। তার কী যে আনন্দ! সন্তানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সে সারা রাত পাগলের মতো আচরণ করল। এই কাঁদছে, এই হাসছে। আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছি। একসময় সে আমাকে বলল, এই, আমার ছেলে হবে, না মেয়ে? আমি বললাম, তোমার মেয়ে হবে। মেয়ের নাম_লীলাবতী।
দিন কাটে, আমি অবাক হয়ে শাওনকে দেখি। সন্তান নিয়ে তার এত আনন্দ! এত অস্থিরতা! এত উত্তেজনা! প্রায় রাতেই কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে দেখি, সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাই, কাঁদছ কেন? সে বলে, আনন্দে কাঁদছি। একটি শিশু আমাকে মা ডাকবে, এই আনন্দ।
আমার আগের চারটি সন্তান আছে। তাদের মা’র মধ্যে মা হওয়ার আনন্দের এত তীব্রতা দেখিনি। কিংবা হয়তো ছিল, আমি লক্ষ করিনি। অভাব-অনটনে আমি তখন পর্যুদস্ত। গর্ভবতী মাকে ভালো খাবার খাওয়াতে হয়, ফলমূল খাওয়াতে হয়। আমার সেই সামর্থ্য নেই। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির লেকচারার। অতি সামান্য বেতন। সব ভাইবোন নিয়ে একসঙ্গে থাকি। বাবর রোডে বাসা। ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরি হেঁটে। রিকশায় করে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। বাসে ঠেলাঠেলি করে উঠতে পারি না। বাসায় ফেরার পথে নিউ মার্কেট থেকে দুটো পেয়ারা কিনি। গর্ভবতী মায়ের ফল এই পেয়ারাতে সীমাবদ্ধ।
শীলার জন্ম আমেরিকায় হয়েছে। তখন তার মা’র খাওয়া খাদ্যের অভাব হয়নি। দেশে ফিরে আবার অভাবে পড়লাম। বিপাশা তখন মায়ের পেটে। তখনো একান্নবর্তী সংসার। বিপাশার জন্ম হলো সরকারি হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম বলেই এই ব্যবস্থা। আমি অস্থির, জীবনযাপনের চিন্তায়।
এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। জীবনধারণের অস্থিরতায় এখন আমি অস্থির নই। দীর্ঘপথ হাঁটতে হয় না। ফলমূল কেনার টাকা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন আমার হাতে সময় আছে সন্তানসম্ভবা একটি মায়ের মানসিকতার পরিবর্তন আগ্রহ নিয়ে দেখার। আমি আগ্রহ নিয়ে দেখি। বড় মায়া লাগে।
একজন নর্তকী যখন মাথায় জলের ঘড়া নিয়ে নাচে তখন সে নাচের ভঙ্গিমায় হাত-পা নাড়লেও তার চেতনা থাকে জলের ঘড়ায় কেন্দ্রীভূত, যেন মাথার ঘড়াটা ঠিক থাকে। শাওন এ রকম হয়ে গেল। তার ভুবন হলো লীলাবতীময়। সেখানে অন্য কারো স্থান নেই।
লীলাবতীর জন্ম হবে গরমে। তখন সে মোটা কাপড় পরতে পারবে না। কাজেই ইংল্যান্ড এবং কানাডায় টেলিফোন করে করে সে পাতলা সুতির কাপড়ের ব্যবস্থা করল।
কার কাছে যেন শুনল ডায়াপার পরালে বাচ্চাদের র্যাশ হয়। কাজেই সে কাঁথা বানাতে বসল। সারা রাত জেগে নিজে কাঁথা বানায়। সেই সব কাঁথাও সহজ কাঁথা নয়। জসীমউদ্দীনের নকশিকাঁথা। পাখি, ফুল, লতাপাতার বিপুল সমারোহ।
এর মধ্যে ৪উ আলট্রাসনোগ্রাফি বলে এক যন্ত্র বাজারে চলে এসেছে। এই যন্ত্রে পেটের সন্তানের চেহারা স্পষ্ট দেখা যায়। সেই যন্ত্রে বাচ্চার চেহারা দেখার পর তার একটাই কথা_’আমার মেয়ে এত সুন্দর কেন?’ আহলাদি মায়ের এই প্রশ্নের আমি কী জবাব দেব?
ঘর ভর্তি হয়ে গেল ৪উ আলট্রাসনোগ্রাফিতে পাওয়া লীলাবতীর ছবিতে। শাওন অষ্টম মাসে পড়ল। আর মাত্র এক মাস। তার পরেই সে তার কন্যা কোলে নেবে।
আমি নুহাশপল্লীতে। নাটকের শুটিং করছি। শাওন তার মা’র কাছে গুলশানে। হঠাৎ শাওন টেলিফোন করল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাচ্চা নড়াচড়া করছে না। আমার খুব ভয় লাগছে।
আমি বললাম, এক্ষুনি ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করো।
যোগাযোগ করতে পারছি না। উনি টেলিফোন ধরছেন না। রাত দশটায় তিনি শুয়ে পড়েন। টেলিফোন রিসিভ করেন না। তুমি চিন্তা করবে না। আমার এক ভাই আছেন ডাক্তার। উনাকে খবর দেওয়া হয়েছে। উনি চলে আসছেন।
Murphys law বলে একটি Law আছে। এই Law বলে-ওভ a thing can go wrong, it will go wrong. ঘটনা সে রকম ঘটল। শাওনের ডাক্তার ভাই এলেন না। আমি যতবারই টেলিফোন করি, ততবারই শুনি_এই উনি আসছেন। তারপর শুনলাম, শাওনদের বাসায় গাড়ি আছে কিন্তু ড্রাইভার নেই।
গাজীপুর থেকে আমি ঢাকার দিকে রওনা হলাম। গাড়ি চলছে ঝড়ের মতো। মাজহার গাড়ি চালাচ্ছে। একই সঙ্গে টেলিফোনে শাওনের ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে।
শাওনের ডাক্তারের নাম…। আচ্ছা, নাম না-ই বললাম। জনসেবার মোড়কে তিনি যে ব্যবসা করছেন আমার লেখায় সেই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা চাই না। ব্যবসা একটা মহৎ পেশা, স্বয়ং নবীজি (সা.) বলে গেছেন।
এই ডাক্তার একজন নামি ডাক্তার। রোগী দেখে কূল পান না। তখনো আমি জানি না এই ডাক্তারের নামে কয়েকটি মামলা আছে। তাঁর অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রোগীর আত্মীয়স্বজনরা মামলা করেছেন।
এই মহান চিকিৎসকের ক্লিনিক একসময় টেলিফোন ধরল এবং জানালো_রোগীকে ক্লিনিকে নিয়ে আসুন।
আমি বললাম, ক্লিনিকে রোগী পাঠাতে পারি, তবে ডাক্তার সাহবে কি এসে তাকে দেখবেন?
উনি ভোরে আসবেন।
আমি অনুনয় করে বললাম, উনি কি আমার সঙ্গে পাঁচটি মিনিট কথা বলবেন? আমি বাংলাদেশের লেখক হুমায়ূন আহমেদ। উনি আমাকে চেনেন।
ক্লিনিক থেকে বলা হলো, উনি কথা বলবেন না।
আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ডাক্তারি পেশা এই ডাক্তার নিজের ইচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। আমরা তাঁকে হাতেপায়ে ধরে ডাক্তারি পড়াতে রাজি করাইনি। বরং হতদরিদ্র একটি দেশ তাঁর পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তাঁকে ডাক্তার বানিয়েছে। এই পেশার দায়দায়িত্ব অবশ্যই তাঁকে নিতে হবে। একজন কেউ যখন সৈনিকের পেশা বেছে নেন, তখন যুদ্ধকালীন সময়ে জীবন দেওয়ার জন্যে তাঁকে তৈরি থাকতে হয়।
একজন ডাক্তারি পেশা বেছে নেবেন অথচ অতি দুঃসময়ে রোগীর কথা শুনবেন না, তার পাশে দাঁড়াবেন না, তা কী করে হয়?
ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে আমি শাওনকে বললাম, সে যেন এক্ষুনি অ্যাপোলো হাসপাতালে চলে যায়। এক মুহূর্তও যেন দেরি না করে।
আমি হাসপাতালে পৌঁছলাম রাত একটায়। ডাক্তার বললেন, আপনার বাচ্চাটা হাসপাতালে আসার আগেই মারা গেছে। আমরা এই দুঃসংবাদ আপনার স্ত্রীকে দিইনি। আপনি খবরটা দেবেন।
আমার হাত-পা জমে গেল।
শাওনকে একটা ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে তার মা। আমাকে দেখেই শাওন ভরসা ফিরে পাওয়া গলায় বলল, এই, আমাদের বাচ্চাটার হার্ট বিট নাকি কম। তুমি দোয়া করো। তুমি দোয়া করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে। এমন একটা ভয়ংকর খবর তাকে কিভাবে দেব? আমি তার হাত ধরলাম। সে বলল, জীবনের বিনিময়ে জীবন চাওয়া যায়। আমি আমার মায়ের জীবনের বিনিময়ে লীলাবতীর জীবন আল্লাহর কাছে চেয়েছি। আমার নিজের জীবনের বিনিময়ে চাইনি। আমি আমার বাচ্চাটাকে দেখব না? আর তোমার জীবনের বিনিময়েও চাইতে পারিনি।
শাওনের মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তোমার সন্তানের জীবনের বিনিময়ে আমি যেকোনো সময় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত আছি গো মা।
এই মেয়েকে আমি কী বলব? কী বোঝাব?
দু’দিন দু’রাত মৃত বাচ্চা পেটে নিয়ে সে শুয়ে রইল। কী কষ্ট, কী কষ্ট। শারীরিক কষ্টের কাছে মানসিক কষ্ট গৌণ হয়ে দাঁড়াল। আমাকে জানানো হলো, তার জীবন সংশয়। তার কষ্ট আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। আমি তাকে ফেলে বাসায় চলে এলাম। আমার অতি দুঃসময়ে মা এসে পাশে দাঁড়ালেন, ছুটে গেলেন হাসপাতালে।
এক গভীর রাতে আমাকে জানানো হলো, শাওন মৃত সন্তান প্রসব করেছে।
হাসপাতালে তার ঘরে ঢুকলাম। হাসিখুশি ভাব দেখিয়ে বললাম, হ্যালো।
সেও ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যালো।
খুব চেষ্টা করছি কোনো একটা রসিকতা করে তাকে হাসিয়ে দিতে। কিছুই মনে পড়ছে না। শেষপর্যন্ত হাসপাতাল নিয়ে একটা রসিকতা করলাম। সে হেসে ফেলল। সে হাসছে, একই সঙ্গে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অদ্ভুত দৃশ্য।
ঘরের এক কোনায় সবুজ টাওয়েলে মুড়ে কী যেন রাখা। অনেকেই সেখানে যাচ্ছেন। ফিরে আসছেন। শাওনের দৃষ্টি ওই দিকে। সে হঠাৎ বলল, ওইখানে আমাদের লীলাবতী। যাও, দেখে এসো।
হাসপাতালের সবুজ টাওয়েলের ভেতর লীলাবতী শুয়ে আছে। মেয়েটি মৃত, আমার মনে রইল না। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম। কী সুন্দর! কী সুন্দর! পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে সে রাজকন্যাদের মতো ঘুমিয়ে আছে।
আমার প্রথম পুত্রও হাসপাতালে মারা গিয়েছিল। সেও এসেছিল পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে। পরিষ্কার মনে আছে, আমার মা সেই শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন এবং মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন_তোমরা সবাই দেখ, আমার কোলে পদ্মফুল ফুটে আছে।
লীলাবতীর কবরের ব্যবস্থা হলো বনানী গোরস্তানে। হঠাৎ মনে হলো, বিরাট ভুল হচ্ছে। লীলাবতীর কবর হবে আজিমপুর গোরস্তানে। সেখানে তার বড় ভাই আছে। বোন খেলবে ভাইয়ের হাত ধরে। পিতৃ-মাতৃস্নেহ বঞ্চিত এই দেবশিশু আর নিঃসঙ্গ বোধ করবে না।
আমি প্রায়ই আজিমপুর গোরস্তানে যাই। আমি আমার পুত্র-কন্যার জন্যে কোনো প্রার্থনা করি না। কেন প্রার্থনা করব? তারা তো ভুল করার বা অন্যায় করার কোনো সুযোগই পায়নি। তাদের প্রার্থনার প্রয়োজন নেই, আমি কবরস্থানে ঢুকেই বলি_এই, তোমরা কোথায়? তোমাদের মজা হচ্ছে তো? ভাই-বোন হাত ধরাধরি করে খুব খেলা হচ্ছে?
নিতান্তই ব্যক্তিগত কাহিনী লিখে ফেললাম। লেখকদের কাজই তো ব্যক্তিগত দুঃখবোধ ছড়িয়ে দেওয়া। এই লেখার মাধ্যমেই যাঁরা আমাদের প্রবল দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। শাওনের বাবা ও মাকে। কন্যার শোকে পাথর হয়ে যাওয়া জনক-জননীর করুণ ছবি এখনো চোখে ভাসছে। শাওনের মা হাসপাতালের মেঝেতে গড়াগড়ি করে কাঁদছিলেন। আহারে! আহারে!
অ্যাপোলো হাসপাতালের একজন নার্স লীলাবতীর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছিল। অপরিচিত সেই নার্স মেয়েটিকেও ধন্যবাদ। তার চোখের জলের মূল্য দেওয়ার সাধ্য আমার নেই, থাকলে দিতাম।
রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যাই। তিনি লিখেছেন—

শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা
শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, পীতগন্ধ-ভরা;
বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,
আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো

আমাদের লীলাবতী পৃথিবীর সৌন্দর্য এক পলকের জন্যেও দেখতে পেল না,— এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি?

হিমু সড়ক

হিমুদের প্রধান কর্মকাণ্ড রাস্তায় রাস্তায় হাঁটা৷ কাজেই যুক্তিসঙ্গতভাবেই তাদের নামে একটা রাস্তার নাম হতে পারে৷ হিমু সড়ক কিংবা হিমু এভিনিউ৷ সেই সম্ভাবনা কীভাবে তৈরি হলো তার গল্প বলি৷

আমার মাথায় একবার ভূত চাপল অতি আধুনিক রেসিডেন্সিয়াল স্কুল করার৷ স্কুলটা হবে কুতুবপুরে আমার গ্রামের বাড়িতে৷ আদর্শ স্কুল – যা হবে এ দেশের রোল মডেল৷ আমি বেলাল বেগ নামের এক উদ্যোগী এবং স্বপ্নস্রষ্টা মানুষকে যাবতীয় দায়িত্ব দিলাম৷ স্কুলের জন্য জমি কিনতে শুরু করলাম৷

বেলাল বেগ ঢাকা-কুতুবপুর ছোটাছুটি করতে লাগলেন৷ মেহের আফরোজ শাওন স্কুলের ডিজাইন করতে বসল৷ আমাদের সবার মধ্যে বিপুল উৎসাহ৷ এর মধ্যে বেলাল বেগ আমাকে নিয়ে গেলেন এলজিইডি অফিসে৷ সেই অফিস প্রধান কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীও একজন কর্মযোগী মানুষ৷ তাকে বলেকয়ে স্কুলের রাস্তাটা পাকা করানো যায় কি না৷

কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী সাহেব আমাদের বসিয়ে রেখে বেশ কিছু মিটিং সারলেন৷ বসে থাকতে থাকতে আমি নিজে ক্লান্ত এবং কিছু পরিমাণে বিরক্ত৷ যতবার চলে আসতে চাই বেলাল বেগ আমার হাত চেপে ধরেন৷ নিচু গলায় বলেন, আরেকটু অপেক্ষা করুন৷ আমাদের কন্যাদায়৷

এক সময় অতি ক্লান্ত মুখে সিদ্দিকী সাহেব এলেন৷ বেলাল বেগ নানা যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝাচ্ছেন স্কুলের জন্য পাঁচ কিলোমিটার পাকা রাস্তা যে কত জরুরি৷ সিদ্দিকী সাহেব খুব যে মন দিয়ে তার কথা শুনছেন এরকম মনে হলো না৷ এক সময় তিনি বেলাল বেগের কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হিমু ব্যাপারটা কী বলুন তো?

আমি গেলাম হকচকিয়ে৷ সিদ্দিকী সাহেব বললেন, আমার বড় ছেলেটা কিছুদিন হলো হিমু হয়েছে৷ হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘুরছে৷

আমি হেসে ফেললাম৷ হিমু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলাম৷ সিদ্দিকী সাহেব বললেন, আপনারা খাবার না খেয়ে যেতে পারবেন না৷ বাসা থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে আমার জন্য খাবার আসে আসুন তিনজন মিলে খাব৷ হয় যদি সুজন তেঁতুল পাতায় নয়জন৷

খাবার টেবিলে সিদ্দিকী সাহেব বললেন, এক মাসের মধ্যে যদি রাস্তাটা পাকা করে দেই তাহলে কি চলবে?

আমি হতভম্ব৷ এক মাসে রাস্তা৷ এও কি সম্ভব? ভদ্রলোক সম্ভব করলেন৷ এক মাসের আগেই রাস্তা পাকা হয়ে গেল৷ আমি ঠিক করলাম, রাস্তার নাম দেব হিমু সড়ক৷ কারণ রাস্তা পাকা করার পেছনে হিমুর সামান্য হলেও ভূমিকা আছে৷

হিমু সড়ক নাম রাখা হলো না৷ অঞ্চলের লোকজন মিটিং করে রাস্তার নাম রাখল ফয়জুর রহমান আহমেদ সড়ক৷ ফয়জুর রহমান আহমেদ আমার বাবা৷ সেই অর্থে রাস্তা হলো হিমুর দাদাজানের নামে৷ এইটাই বা খারাপ কী?

হিমু হওয়ার নিয়মাবলি

বইমেলার ওই ঘটনার পর আমি হিমু হওয়ার নিয়মকানুন নিয়ে ভেবেছি৷ কিছু নিয়ম এখানে দিয়ে দিলাম৷ আরও কিছু মনে এলে সংশোধনী দেওয়া হবে৷

হিমু হওয়ার নিয়মাবলি :

১৷ বয়স আঠারোর উপর হতে হবে৷ আঠারোর নিচে হিমু হওয়া যাবে না৷ বিশেষ ব্যবস্থায় আঠারোর নিচেও হিমু হওয়া যাবে, তখন বাবা-মা এবং স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের অনুমতি লাগবে৷

২৷ হলুদ পাঞ্জাবি বাধ্যতামূলক৷ শীতকালে হলুদ চাদর পরা যেতে পারে৷ বাংলাদেশের সীমানার বাইরের হিমুরা হলুদ পাঞ্জাবির বদলে হলুদ শার্ট বা জ্যাকেট পরতে পারবে৷

৩৷ খালি পা বাধ্যতামূলক না৷ কম দামি চামড়ার স্যান্ডেল পরা যেতে পারে৷ শীত প্রধান দেশের হিমুরা জুতা-মোজা পরতে পারবে৷

৪৷ প্রতি পূর্ণিমায় পূর্ণচন্দ্রের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকা বাধ্যতামূলক৷ মেঘ-বৃষ্টির কারণে চাঁদ দেখা না গেলে কল্পনায় চাঁদ দেখতে হবে৷

৫৷ বৃষ্টি বাদলার দিনে ছাতা ব্যবহার করা যাবে না৷ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যেতে হবে৷ ঠাণ্ডা লেগে গেলে চিকিৎসা নিতে হবে৷ হিমুরা শরীর ঠিক রাখার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারে৷ এতে কোনো বাধা নেই৷

৬৷ রাতে নির্জন রাস্তায় হাঁটার বিধান শিথিলযোগ্য৷ বইপত্রে দেখা যায়, হিমুরা সন্ত্রাসী এবং পুলিশের সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করে৷ নব্য হিমুদের এই কাজ করতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হচ্ছে৷ র‌্যাবের হাত থেকে শত হস্ত দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়৷

৭৷ হিমুরা কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সমর্থনকারী হতে পারবে না৷ তাদের একটাই নীতি হিমুনীতি, রাজনীতি নয়৷

৮৷ হিমুদের জন্য সপ্তাহে দুইদিন নিরামিষ আহার বাধ্যতামূলক৷ বাকি দিনগুলোতে মনের সুখে খাওয়া-দাওয়া করা যাবে৷

ঌ৷ হিমুদের পাঞ্জাবিতে পকেট থাকে না৷ তবে কেউ যদি পকেট রাখেন তবে দোষ হবে না৷

১০৷ হিমুরা কখনোই মানিব্যাগ ব্যবহার করতে পারবে না৷

১১৷ তারা সব সময় হাস্যমুখে থাকবে, সবার সঙ্গে ঠাট্টা ফাজলামি ধরনের কথা বলবে, তবে পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্যদের সঙ্গে কখনো না৷ তারা ঠাট্টা ফাজলামি বুঝে না৷

১২৷ আদি হিমুর পিতা যেসব নীতিমালা হিমুর জন্য লিখে গেছেন সেইসব নীতিমালা নিয়মিত পাঠ করতে হবে৷ সেই মতো জীবনচর্যাও পরিচালিত করতে হবে৷

১৩৷ হিমুরা কখনোই কোনো তরুণীর সঙ্গে হৃদয়ঘটিত ঝামেলায় জড়াবে না৷ একসঙ্গে ফুচকা খাওয়া, ফাস্টফুড খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ৷

১৪৷ এক হিমু অন্য হিমুকে আপন ভাইয়ের মতো দেখবে৷

১৫৷ বিশেষ বিশেষ উৎসবে, যেমন পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারিতে সব হিমুরা একত্রিত হয়ে হিমু সঙ্গীত গাইবেন৷ হিমু সঙ্গীত এখনো লেখা হয়নি৷ সঙ্গীত লেখা এবং সুর দেওয়া হিমু গেজেটে প্রকাশ করা হবে৷

হিমুর পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণ

কলকাতা থেকে দেশ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত হয়৷ একটা পত্রিকা কতদূর ক্ষমতাধর তা দেশ পত্রিকা না দেখলে আমি জানতাম না৷ বলা হয়ে থাকে যেকোনো অগা মগা বগা লেখককে এই পত্রিকা আসমানে তুলে দিতে পারে৷ মহান লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে৷ আবার সত্যিকারের মহান কোনো লেখককেও ধরাশায়ী করতে পারে৷ এই পত্রিকায় কারও লেখা ছাপা হওয়ার মানে (বিশেষ করে শারদীয় সংখ্যায়) লেখক হিসেবে কপালে স্থায়ী সিল পড়ে যাওয়া৷ এই সিলের কালি অলেপনীয়, ধুলেও যাবে না৷ কপালে জ্বলজ্বল করতে থাকবে৷

এক সকালে দেশ পত্রিকার এক প্রতিনিধি আমার বাসায় উপস্থিত৷ তার সঙ্গে নানা গল্প হচ্ছে৷ গল্প তিনি করছেন আমি শুনছি৷ আমি ক্লাসে যাব, দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ ভদ্রতার খাতিরে বলতেও পারছি না৷ হাজার হলেও বিদেশি মেহমান৷ এক পর্যায়ে ভদ্রলোক বললেন, আমরা আপনার একটা উপন্যাস শারদীয় সংখ্যায় ছাপাব৷ তবে দেশে ছাপাব নাকি আনন্দবাজারে ছাপাব, নাকি সানন্দায় ছাপাব তা বলতে পারছি না৷ সাগরময়দা ঠিক করবেন৷

ভদ্রলোক হয়তো ধারণা করেছিলেন তার কথা শুনে আনন্দে আমি এমন লাফ দেব যে সিলিংয়ে মাথা ঠেকে যাবে৷ আমি তা না করে শুকনো গলায় বললাম, হুঁ৷ ভেবে দেখি৷

কী ভাববেন? পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কত বড় সুযোগ৷

আমি ঠাণ্ডা মাথায় বললাম, ভাই আমি সুযোগ সন্ধানী মানুষ না৷ আমি লেখক৷ লেখক কখনো সুযোগের সন্ধান করে না৷ সুযোগ লেখকদের সন্ধান করে৷

তার মানে আপনি লিখবেন না?

আমি বললাম, শুধুমাত্র দেশ পত্রিকা যদি তার শারদীয় সংখ্যায় লেখা ছাপে তাহলেই পাণ্ডুলিপি পাঠাব৷ দেশ পত্রিকা ছাড়া না৷

ভদ্রলোক মোটামুটি হতভম্ব অবস্থাতেই উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, যাই৷ নমস্কার৷

আমি ধরেই নিয়েছিলাম এই বিষয়ে আর কিছু শুনব না৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, পনেরো দিনের মাথায় দেশ পত্রিকার সম্পাদক চিঠি দিয়ে জানালেন তারা আমার একটি উপন্যাস শারদীয় দেশ পত্রিকায় ছাপাতে চান৷ হিমুকে নিয়ে লেখা একটা উপস্যাস পাঠালাম৷ ছাপা হলো৷ পরের বছর আবার চিঠি এবারও তারা একটি উপন্যাস ছাপাবেন৷ পাঠালাম আরেকটা হিমু৷

পর পর ছয় বছর কিংবা সাত বছর আমি শারদীয় দেশ পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছি৷ বেশির ভাগই হিমুবিষয়ক রচনা৷ পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা আমার সাহিত্য প্রতিভা (?) সম্পর্কে কোনো ধারণা পেয়েছেন কি না জানি না৷ হিমু বিষয়ে ভালোই ধারণা পেয়েছেন৷ তার প্রমাণও পেলাম৷

কলকাতায় গিয়েছি কোনো এক বইমেলায়৷ সে দেশে চেহারা দেখে আমাকে কেউ চিনবে না, কাজেই লেখকসুলভ নকল গাম্ভীর্য নিয়ে হাঁটাহাঁটি করার প্রয়োজন নেই৷ আমি মনের সুখে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে একজন আমার পা ছুঁয়ে বলল, দাদা আমি হিমু৷

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ধুতি পরা হিমু দেখছি৷ পাঞ্জাবি হলুদ রঙের৷ পায়ে জুতা নেই – খালি পা৷ লক্ষণ বিচারে হিমু তো বটেই৷

আপনি কত দিন ধরে হিমু?

দুই বছরের উপর হয়েছে দাদা৷

আমি বললাম, পাঞ্জাবির কি পকেট আছে?

পকেট নেই৷

টাকা-পয়সা রাখেন কোথায়?

ভদ্রলোক পাঞ্জাবি উঠিয়ে দেখালেন, কেমারের কালো ঘুনসির সঙ্গে কাপড়ের ব্যাগ লাগানো – টাকা-পয়সা সেখানেই থাকে৷

দাদা, আমি দুজনের ভক্ত৷ আপনার এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের৷ আপনাদের দুজনের ছবি ঠাকুরঘরে আছে৷

আমি চমৎকৃত৷ সাত বছর দেশ পত্রিকায় লেখালেখির কারণে যদি কারও ঠাকুরঘরে ঢুকে যেতে পারি সেটা কম কী? গলায় সুর থাকলে গাইতাম অকত অধম জেনেও তো তুমি কম করে কিছু দাওনি৷

বিদেশে বেশ কিছু হিমুর দেখা পেয়েছি৷ বিদেশের হিমুরা কঠিন প্রকতির৷ একশ পার্সেন্ট খাঁটি ভেজালবিহীন হিমু৷ জার্মানির ফ্রাংকফুর্টের হিমুর কথা বলি৷ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা৷ বরফ পড়বে পড়বে করছে, এখনো পড়া শুরু করেনি৷ এই ঠাণ্ডায় খালি পায়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে একজন উপস্থিত৷ গাল ভর্তি হাসি দিয়ে বলল, স্যার আমি হিমু৷

কতদিন ধরে?

তিন বছরের বেশি হয়েছে৷ দেশেও হিমু ছিলাম৷

ছেলেটা এমনভাবে কথা বলছে যে হিমু একটা ধর্ম৷ সে ধর্ম পালন করছে৷ এর বেশি কিছু না৷ আমি হিমু ধর্ম প্রচারক৷

গত বইমেলায় এক কাণ্ড ঘটল৷ মধ্যবয়স্ক একজন ভিড় ঠেলে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, স্যার, আমি ঠিক করেছি মার্চের তিন তারিখ থেকে হিমু হব৷ হিমু হওয়ার নিয়মকানুন কী?

আমি বললাম, মার্চের তিন তারিখ থেকে কেন?

আমার জন্মদিন মার্চের তিন৷ এখন স্যার নিয়মকানুন বলেন৷

আমি নিয়মকানুন কী বলব? ভদলোকের দিকে তাকিয়ে আছি৷ কী বলব ভেবে পাচ্ছি না৷ আমাকে উদ্ধারের জন্য অন্যপ্রকাশের কমল এগিয়ে এল৷ সে গম্ভীর গলায় বলল, নিয়মকানুন সব বইয়ে দেওয়া আছে৷ বই পড়ে জেনে নিন৷ হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হাঁটবেন৷ এইটাই প্রাথমিক বিষয়৷

প্রতি পূর্ণিমায় জোছনা দেখতে জঙ্গলে যেতে হবে?

গেলে ভালো হয়, তবে দু-একটা মিস হলেও ক্ষতি হবে না৷

হিমুর বিয়ে

আমাদের দখিন হাওয়ার ছাদে অনুষ্ঠান হচ্ছে৷ আমার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র নিষাদ হুমায়ূনের নামকরণ অনুষ্ঠান৷ হৈচৈ হচ্ছে, গান-বাজনা হচ্ছে৷ হঠাৎ আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার৷ তিনি ঢাকায় এসেছেন এটা জানি৷ কোথায় উঠেছেন জানতাম না বলেই নিমন্ত্রণ করা হয়নি৷ অনেকদিন পর তাকে দেখে ভালো লাগল৷ আমি তার হাত ধরতেই তিনি ধমকের গলায় বললেন, আপনি নাকি হিমুকে বিয়ে দিয়েছেন৷ এটা তো আপনি করতে পারেন না৷ হিমু কেন বিয়ে করবে?

আমি হিমুর বিয়ে দেইনি৷ একটা বই লিখেছি – আজ হিমুর বিয়ে৷ বইটিতে হিমু বিয়ে করে ফেলে জাতীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়৷ বইটির প্রকাশক অন্যপ্রকাশ৷ প্রায় নিয়মিতই তারা বইমেলা উপলক্ষে হিমু বিষয়ক একটা বই পায়৷ বইটির প্রকাশনা উপলক্ষে নানা আয়োজন করে৷ এইবার বিয়ের আয়োজন করে ফেলল৷ একজন পাগড়ি মাথায় বর সাজল, আরেকটি মেয়ে সাজল বউ৷ বর-কনে অন্যপ্রকাশের স্টলে বসে রইল৷ দর্শকদের আগ্রহ এবং কৌতূহল তুঙ্গ স্পর্শ করল৷ চারদিকে দারুণ উত্তেজনা৷ বইমেলায় এমন মজার দৃশ্য আগে হয়নি৷ দু-একজন অবশ্য গম্ভীর গলায় বললেন, বইমেলার শুচিতা নষ্ট হচ্ছে৷ মহান একুশের ঐতিহ্য ভুলুন্ঠিত হচ্ছে ইত্যাদি৷

হিমুর বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম না৷ টেলিভিশনে দেখেছি৷ আমার কাছে মনে হয়েছে, মেলা মানেই আনন্দ৷ মেলার পবিত্রতা রক্ষার জন্য সবাই অজু করে মেলায় আসবেন এবং ফিসফিস করে কথা বলবেন তা কেন হবে? একজন প্রকাশক যদি বুক প্রমোশনের জন্য কিছু করেন তাতেই বা দোষ কোথায়?

ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় দেখেছি, রান্নার বই প্রকাশনা উপলক্ষে রান্নার বিপুল আয়োজন৷ বইয়ের রেসিপি দেখে রান্না হচ্ছে৷ সবাই মহানন্দে খাচ্ছে৷ একদিকে নাচের জলসা হচ্ছে৷ একদল ছেলেমেয়ে উদ্দাম নৃত্যে মেতেছে৷ বইমেলার ভেতরই বিয়ারের দোকান খোলা৷ প্রচুর বিয়ার খাওয়া হচ্ছে৷

থাক এসব কথা, বিবাহ অনুষ্ঠানে ফিরে যাই৷ হিমু যে হয়েছে সে মৈনাক পর্বতের কাছাকাছি৷ কনে লাক্স সুন্দরী৷ যথেষ্টই রূপবতী৷ একদল হিমু গেল রেগে৷ তারা মৈনাক পর্বতকে হিমু মানতে রাজি না৷ পাল্টা মিছিল শুরু হলো – হিমুর বিয়ে, মানি না মানি না৷

অনেকদিন আগে বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা হেরে গিয়েছিল৷ আমি তখন ময়মনসিংহে অয়োময় নাটকের শুটিংয়ে ব্যস্ত৷ আর্জেন্টিনার পরাজয়ে বিশাল মিছিল বের হলো৷ স্লোগান – আর্জেন্টিনার পরাজয়, মানি না মানি না৷

তারা জানে মানি না মানি না বলে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেললেও কিছু হবে না৷ তারপরেও স্লোগান দিতে হবে৷ জাতিগতভাবে আমরা স্লোগান দিতে ভালোবাসি৷ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধ করার জন্য স্লোগান দিয়েছিল৷ হিমুর বিয়ে বন্ধ করার জন্যও স্লোগান৷

বেচারা হিমু কি কোনোদিনই বিয়ে করতে পারবে না? তার সুখী সুন্দর সংসার হবে না? কোনো শিশু হিমুকে বাবা বলে ডাকবে না? এত নিষ্ঠুর কেন আমরা?

Exit mobile version