Site icon BnBoi.Com

প্রিয়পদরেখা – হুমায়ূন আহমেদ

প্রিয়পদরেখা - হুমায়ূন আহমেদ

অচিন বৃক্ষ

ইদরিশ বলল, ভাইজান ভালো কইর‍্যা দেহেন। এর নাম অচিন বৃক্ষ।

বলেই থু করে আমার পায়ের কাছে একদলা থুতু ফেলল। লোকটির কুৎসিত অভ্যাস, প্রতিটি বাক্য দুবার করে বলে। দ্বিতীয়বার বলার আগে একদলা থুতু ফেলে।।

ভাইজান ভালো কইরা দেহেন, এর নাম অচিন বৃক্ষ।

অচিন পাখির কথা গানের মধ্যে প্রায়ই থাকে, আমি অচিন বৃক্ষের কথা এই প্রথম শুনলাম এবং দেখলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা সবাই বৃক্ষ শব্দটা উচ্চারণ করছে শুদ্ধভাবে। তৎসম শব্দের উচ্চারণে কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে না। অচিন বৃক্ষ না বলে অচিন গাছও বলতে পারত, তা বলছে না। সম্ভবত গাছ বললে এর মর্যাদা পুরোপুরি রক্ষিত হয় না।

ইদরিশ বলল, ভালো কইরা দেহেন ভাইজান, ত্রিভুবনে এই বৃক্ষ নাই।

তাই নাকি?

জে। ত্রিভুবনে নাই।

ত্রিভুবনে এই গাছ নাই শুনেও আমি তেমন চমৎকৃত হলাম না। গ্রামের মানুষের কাছে ত্রিভুবন জায়গাটা খুব বিশাল নয়। এদের ত্রিভুবন হচ্ছে আশেপাশের

আট-দশটা গ্রাম। হয়তো আশেপাশে এরকম গাছ নাই।

কেমন দেখতেছেন ভাইজান?

ভালো।

এইরকম গাছ আগে কোনোদিন দেখছেন?

না।

ইদরিশ বড়ই খুশি হল। থু করে বড় একদলা থুতু ফেলে খুশির প্রকাশ ঘটাল।

বড়ই আচানক, কী বলেন ভাইজান?

আচানক তো বটেই।

ইদরিশ এবার হেসেই ফেলল। পান খাওয়া লাল দাত প্রায় সব কটা বের হয়ে এল। আমি মনে-মনে বললাম, কী যন্ত্রণা! এই অচিন বৃক্ষ দেখার জন্যে আমাকে মাইলের উপরে হাঁটতে হয়েছে। বর্ষা কবলিত গ্রামে দুমাইল হাঁটা যে কী জিনিস, যারা কোনোদিন হাঁটেন নি তারা বুঝতে পারবেন না। জুতা খুলে খালিপায়ে হাঁটতে হয়েছে। হুক ওয়ার্মের জীবাণু যে শরীরে ঢুকে গেছে সে বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।

গাছটা দেখতাছেন কেমন কন দেহি ভাইজান?

আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। এরা শুধু গাছ দেখিয়ে খুশি নয়, প্রশংসাসূচক কিছুও শুনতে চায়। আমি কোনো বৃক্ষ-প্রেমিক নই। সব গাছ আমার কাছে একরকম মনে হয়।

আশেপাশে মানুষদেরই আমি চিনি না, গাছ চিনব কী করে? মানুষজন তাও কথা বলে, নিজেদের পরিচিত করার চেষ্টা করে। গাছেরা তেমন কিছুই করে না।

অচিন বৃক্ষ কেমন দেখলেন ভাইজান?

আমি ভালো করে দেখলাম। মাঝারি সাইজের কাঠালগাছের মতো উঁচু, পাতাগুলি তেঁতুলগাছের মতো ছোট-ছোট, গাছের কাণ্ড পাইনগাছের কাণ্ডের মতো মসৃণ। গাছ প্রসঙ্গে কিছু না বললে ভালো দেখায় না বলেই বললাম, ফুল হয়?

ইদরিশ কথা বলার আগেই, পাশে দাঁড়ানো রোগা লোকটা বলল, জে না— ফুল ফুটনের টাইম হয় নাই। টাইম হইলেই ফুটবে। এই গাছে ফুল আসতে মেলা টাইম লাগে।

বয়স কত এই গাছের?

তা ধরেন দুই হাজারের কম না। বেশিও হইতে পারে।

বলেই লোকটা সমর্থনের আশায় চারদিকে তাকাল। উপস্থিত জনতা অতি দ্রুত মাথা নাড়তে লাগল। যেন এই বিষয়ে কারো মনেই সন্দেহের লেশমাত্র নেই। আমি অত্যন্ত বিরক্ত হলাম। গ্রামের লোকজন কথাবার্তা বলার সময় তাল ঠিক রাখতে পারে না। হুট করে বলে দিল দু-হাজার বছর। আর তাতেই সবাই কেমন মাথা নাড়ছে। আমি ইদরিশের দিকে তাকিয়ে বললাম, ইরিশ মিয়া, গাছ তো দেখা হল, চল যাওয়া যাক।

আমার কথায় মনে হল সবাই খুব অবাক হচ্ছে।

ইদরিশ হতভম্ব গলায় বলল, এখন যাইবেন কী? গাছ তো দেখাই হইল না। তার উপরে, মাস্টার সাবরে খবর দেওয়া হইছে। আসছে।

আমার চারপাশে সতেরো-আঠারোজন মানুষ আর একপাল উলঙ্গ শিশু। অচিন বৃক্ষের লাগোয়া বাড়ি থেকে বউ-ঝিরা উঁকি দিচ্ছে। একজন এক কাঁদি ডাব পেড়ে নিয়ে এল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, কালো রঙের বিশাল একটা চেয়ারও একজন মাথায় করে আনছে। এই গ্রামের এটাই হয়তো একমাত্র চেয়ার। অচিন বৃক্ষ যারা দেখতে আসেন তাদের সবাইকে এই চেয়ারে বসতে হয়।

অচিন বৃক্ষের নিচে চেয়ার পাত হল। আমি বসলাম। কে-একজন হাতপাখা দিয়ে আমাকে প্রবল বেগে হাওয়া করতে লাগল। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব চলে এলেন। বয়স অল্প, তবে অল্প বয়সেই গালটাল ভেঙে একাকার। দেখেই মনে হয় জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন মানুষ। বেঁচে থাকতে হয় বলেই বেঁচে আছেন। ছাত্র পড়াচ্ছেন। হেডমাস্টার সাহেবের নাম মুহম্মদ কুদ্দুস। তার সম্ভবত হাঁপানি আছে। বড়-বড় করে শ্বাস নিচ্ছেন। নিজেকে সামলে কথা বলতে অনেক সময় লাগল।

স্যারের কি শইল ভালো?

জি ভালো।

আসতে একটু দেরি হইল। মনে কিছু নিবেন না স্যার।

না মনে কিছু নিচ্ছি না।

বিশিষ্ট লোকজন শহর থাইক্যা অচিন বৃক্ষ দেখতে আসে, বড় ভালো লাগে। বিশিষ্ট লোকজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়।

আপনি ভুল করছেন ভাই। আমি বিশিষ্ট কেউ নই।

এই তোমরা স্যারকে হাত-পা ধোয়ার পানি দেও নাই, বিষয় কী?

হাত-পা ধুয়ে কী হবে? আবার তো কাদা ভাঙতেই হবে।

হেডমাস্টার সাহেব অত্যন্ত বিস্মিত হলেন, খাওয়াদাওয়া করবেন না? আমার বাড়িতে পাক-শাক হইতেছে। চাইরটা ডালু-ভাত, বিশেষ কিছু না। গেরাম দেশে কিছু জোগাড়যন্ত্রও করা যায় না। বিশিষ্ট মেহমানরা আসেন। গত বৎসর ময়মনসিংহের এডিসি সাহেব আসছিলেন। এডিসি রেভিন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। অচিন বৃক্ষের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে এক হাজার টাকা দেওয়ার ওয়াদা করলেন।

তাই নাকি?

জি। অবশ্যি টাকা এখনো পাওয়া যায় নাই। এরা কাজের মানুষ। নানান কাজের চাপে ভুলে গেছেন আর কী। আমাদের মতো তো না যে কাজকর্ম কিছু নাই। এদের শতেক কাজ। তবু ভাবতেছি একটা পত্র দিব। আপনে কী বলেন?

দিন। চিঠি দিয়ে মনে করিয়ে দিন।

আবার বিরক্ত হন কি-না কে জানে। এরা কাজের মানুষ, চিঠি দিয়ে বিরক্ত করাও ঠিক না। এই চায়ের কী হইল?

চা হচ্ছে না-কি?

জি, বানাতে বলে এসেছি। চায়ের ব্যবস্থা আমার বাড়িতে আছে। মাঝে-মধ্যে হয়। বিশিষ্ট মেহমানরা আসেন। এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসার সাহেব এসেছিলেন, বিরাট জ্ঞানী লোক। এদের দেখা পাওয়া তো ভাগ্যের কথা, কী বলেন স্যার?

তা তো বটেই।

চা চলে এল।

চা খেতে-খেতে এই গ্রামের অচিন বৃক্ষ কী করে এল সেই গল্প হেডমাস্টার সাহেবের কাছে শুনলাম। এক ডাইনি না-কি এই গাছের উপর ‘সােয়ার’ হয়ে আকাশপথে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার পানির পিপাসা হয়। এইখানে সে নামে। পানি খেয়ে তৃষ্ণা নিবারিত করে। পানি ছিল বড়ই মিঠা। ডাইনি তখন সন্তুষ্ট হয়ে গ্রামের লোকদের বলে— তোমাদের মিঠা পানি খেয়েছি, তার প্রতিদানে এই গাছ দিয়ে গেলাম। গাছটা যত্ন করে রাখবে। অনেক অনেক দিন পরে গাছে ফুল ধরবে। তখন তোমাদের দুঃখ থাকবে না। এই গাছের ফুল সর্বরোগের মহৌষধ। একদিন উপাস থেকে খালিপেটে এই ফুল খেলেই হবে।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আপনি এই গল্প বিশ্বাস করেন?

হেডমাস্টার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস না করার তো কিছু নাই।

যে যুগে মানুষ চাঁদে হাঁটাহাঁটি করছে সেই যুগে আপনি বিশ্বাস করছেন গাছে চড়ে ডাইনি এসেছিল?

জগতে অনেক আচানক ব্যাপার হয় জলাব। যেমন ধরেন ব্যাঙের মাথায় মণি। যে মণি সাত রাজার ধন। অন্ধকার রাতে ব্যাঙ এই মণি শরীর থেকে বের করে। তখন চারদিক আলো হয়ে যায়। আলো দেখে পোকারা আসে। ব্যাঙ সেই পোকা ধরে ধরে খায়।

আপনি ব্যাঙের মণি দেখেছেন?

জি জনাব। নিজের চোখে দেখা। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র।

আমি চুপ করে গেলাম। যিনি ব্যাঙের মণি নিজে দেখেছেন বলে দাবি করেন তাঁর সঙ্গে কুসংস্কার নিয়ে তর্ক করা বৃথা। তাছাড়া দেখা গেল ব্যাঙের মণি তিনি একাই দেখেন নি আমার আশেপাশে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের অনেকেও দেখেছে।

দুপুরে হেডমাস্টার সাহেবের বাসায় খেতে গেলাম। আমি এবং ইদরিশ। হেডমাস্টার সাহেবের হতদরিদ্র অবস্থা দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। প্রাইমারি স্কুলের একজন হেডমাস্টার সাহেবের যদি এই দশা হয় তখন অন্যদের না-জানি কী অবস্থা। অথচ এর মধ্যেই পোলাও রান্না হয়েছে। মুরগির কোরমা করা হয়েছে। দরিদ্র মানুষটির অনেকগুলি টাকা বের হয়ে গেছে এই বাবদে।

আপনি এসেছেন বড় ভালো লাগতেছে। আজ পাড়াগাঁয়ে থাকি। দু একটা জ্ঞানের কথা নিয়ে যে আলাপ করব সেই সুবিধা নাই। চারদিকে মূর্খের দল। অচিন বৃক্ষ থাকায় আপনাদের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসেন। বড় ভালো লাগে। কিছু জ্ঞানের কথা শুনতে পারি।

বেচারা জ্ঞানের কথা শুনতে চায়। কোনো জ্ঞজ্ঞানের কথাই আমার মনে এল না। আমি বললাম, রান্না তো চমৎকার হয়েছে। কে বেঁধেছে, আপনার স্ত্রীর

জি না জনাব। আমার কনিষ্ঠ ভগ্নী। আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী।

সে-কী?

হার্টের বাল্বের সমস্যা। ঢাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তাররা বলেছেন, লাখ দুই টাকা খরচ করলে একটা-কিছু করা যাবে। কোথায় পাব এত টাকা বলেন দেখি।

আমি চুপ করে গেলাম। হেডমাস্টার সাহেব সহজ ভঙ্গিতে বললেন, আপনি যখন আসছেন আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিব। সে শহরের মেয়ে। মেট্রিক পাস।

তাই নাকি?

জি। মেট্রিক ফাস্ট ডিভিশন ছিল। টোটেল মার্ক ছয়শ এগারো। জেনারেল অঙ্কে পেয়েছে ছিয়াত্তর। আর চারটা নম্বর হলে লেটার হত।

হেডমাস্টার সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

ওর আবার লেখালেখির শখ আছে।

বলেন কী!

শরীরটা যখন ভালো ছিল তখন কবিতা লিখত। তা এই মূখের জায়গায় কবিতার মতো জিনিস কে বুঝবে বলেন? গ্লাপনি আসছেন দু-একটা পড়ে দেখবেন।

জি নিশ্চয়ই পড়ব।

মহসিন সাহেব বলে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি একটি কবিতার কপি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন অনেক পত্রিকার সাথে তার যোগাযোগ আছে, ছাপিয়ে দিবেন।

ছাপা হয়েছে?

হয়েছে নিশ্চয়ই। কবিতাটা ভালো ছিল, নদীর উপরে লেখা। পত্রিকা-টত্রিকা তো এখানে কিছু আসে না। জানার উপায় নাই। একটা পত্রিকা পড়তে হলে যেতে হয় মশাখালির বাজার। চিন্তা করেন অবস্থা। শেখ সাহেবের মৃত্যুর খবর পেয়েছি দুদিন পরে, বুঝলেন অবস্থা।

অবস্থা তো খারাপ বলেই মনে হচ্ছে।

ও অচিন বৃক্ষ থাকায় দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ আছে। আসে ভাইসাব, আমার স্ত্রীর সঙ্গে একটু কথা বলেন। সে শহরের মেয়ে। ময়মনসিংহ শহরে পড়াশোনা করেছে।

আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। অপরিচিতি অসুস্থ একজন মহিলার সঙ্গে আমি কী কথা বলব? ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে অচিন বৃক্ষ দেখতে যারা আসেন তাদের সবাইকে এই মহিলার সঙ্গেও দেখা করতে হয়।

মহিলার সঙ্গে দেখা হল।

মহিলা না বলে মেয়ে বলাই উচিত। উনিশ-কুড়ির বেশি বয়স হবে না। বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। মানুষ নয় যেন মিশরের মমি। বিশিষ্ট অতিথিকে দেখে তার মধ্যে কোনো প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল না। তবে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। হেডমাস্টার সাহেব তার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়লেন। পরক্ষণেই হাসিমুখে বললেন, আপনাকে সালাম দিচ্ছে।

আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। কিছু-একটা বলতে হয় অথচ বলার মতো কিছু পাচ্ছি না। মেয়েটি আবার বিড়বিড় করে কী যেন বলল, হেডমাস্টার সাহেব বললেন–রেনু বলছে আপনার খাওয়াদাওয়ার খুব কষ্ট হল। ওর কথা আর কেউ বুঝতে পারে না। আমি পারি।

আমি বললাম, চিকিৎসা হচ্ছে তো? নাকি এমনি রেখে দিয়েছেন?

হেডমাস্টার সাহেব এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। মেয়েটি বিড়বিড় করে বোরো কী যেন বলল। হেডমাস্টার সাহেব বুঝিয়ে দিলেন— ও জিজ্ঞেস করছে অচিন বৃক্ষ দেখে খুশি হয়েছেন কিনা।

আমি বললাম, হয়েছি। খুব খুশি হয়েছি। মেয়েটি বলল, ফুল ফুটলে আরেকবার আসবেন। ঠিকানা দিয়ে যান। ফুল ফুটলে আপনাকে চিঠি লিখবে।

মেয়েটি এই কথাগুলি বেশ স্পষ্ট করে বলল, আমার বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না। আমি বললাম, আপনি বিশ্রাম করুন। আমি যাই।

হেডমাস্টার সাহেব আমাকে এগিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। আমি রাজি হলাম না। এই ভদ্রলোকের এখন উচিত তার স্ত্রীর কাছে থাকা। যত বেশি সময় সে তার স্ত্রীর পাশে থাকবে ততই মঙ্গল। এই মেয়েটির দিনের আলো যে নিকে এসেছে তা যে, কেউ বলে দিতে পারে।

 

আমি এবং ইদরিশ ফিরে যাচ্ছি।

আসার সময় যতটা কষ্ট হয়েছিল ফেরার সময় ততটা না। আকাশে মেঘ করায় রোদের হাত থেকে রক্ষা হয়েছে। তার উপর ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। ইদরিশের সঙ্গে গল্প করতে-করতে এগুচ্ছি।

আমি বললাম, হেডমাস্টার সাহেব তার স্ত্রীর চিকিৎসা করাচ্ছে না?

করাইতাছে। বিষয়-সম্পত্তি যা ছিল সব গেছে পরিবারের পিছনে। অখন বাড়িভিটা পর্যন্ত বন্দুক।

তাই নাকি?

জি। এই মানুষটা পরিবারের জন্যে পাগল। সারারাতই ঘুমায় না। স্ত্রীর ধারে বইস্যা থাকে। আর দিনের মধ্যে দশটা চক্কর দেয় অচিন বৃক্ষের কাছে।

কেন?

ফুল ফুটেছে কিনা দেখে। অচিন বৃক্ষের ফুল হইল অখন শেষ ভরসা।

আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম।

খেয়াঘাটের সামনে এসে আমাকে থমকে দাঁড়াতে হল। দেখা গেল হেডমাস্টার সাহেব ছুটতে-ছুটতে আসছেন। ছুটে-আসাজনিত পরিশ্রমে খুবই কাহিল হয়ে পড়া একজন মানুষ, যার সারা শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। ছুটে আসার কারণ হচ্ছে স্ত্রীর কবিতার খাতা আমাকে দেখাতে ভুলে গিয়েছিলেন। মনে পড়ায় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।

আমরা একটা অশ্বথ গাছের ছায়ার নিচে বসলাম। হেডমাস্টার সাহেবকে খুশি করার জন্যেই দু-নম্বরি খাতার প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ে বললাম, খুব ভালো হয়েছে।

হেডমাস্টার সাহেবের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, এখন আর কিছু লিখতে পারে না। শরীরটা বেশি খারাপ।

আমি বললাম, শরীর ভালো হলে আবার লিখবেন।

হেডমাস্টার সাহেব বললেন, আমিও রেনুকে সেইটাই বলি, অচিন বৃক্ষের ফুল ফুটারও বেশি বাকি নাই। ফুল ফুটার আগে পচা শ্যাওলার গন্ধ ছাড়ার কথা। গাছ সেই গন্ধ ছাড়া শুরু করেছে। আর কেউ সেই গন্ধ পায় না। আমি পাই।

আমি গভীর মমতায় ভুদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম।।

তিনি ইতস্তত করে বললেন, প্রথম কবিতাটা আরেকবার পড়েন স্যার। প্রথম কবিতাটার একটা ইতিহাস আছে।

কী ইতিহাস? | হেডমাস্টার সাহেব লাজুক গলায় বললেন, রেনুকে আমি তখন প্রাইভেট পড়াই। একদিন বাড়ির কাজ দিয়েছি। বাড়ির কাজের খাতা আমার হাতে দিয়ে দৌড় দিয়া পালাইল। আর তো আসে না। খাতা খুইল্যা দেখি কবিতা। আমারে নিয়া লেখা। কী সর্বনাশ বলেন দেখি। যদি এই খাতা অন্যের হাতে পড়ত, কী অবস্থা হইত বলেন?

অন্যের হাতে পড়বে কেন? বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে দিবে আপনার হাতেই।

তা ঠিক। রেনুর বুদ্ধির কোনো মা-বাপ নাই। কী বুদ্ধি, কী বুদ্ধি! তার বাপ-মা বিয়ে ঠিক করল— ছেলে পুবালী ব্যাংকের অফিসার। চেহারাসুরত ভালো। ভালো বংশ। পান-চিনি হয়ে গেল। রেনু চুপ করে রইল। তারপর একদিন তার মারে গভীর রাতে ঘুম থেকে ডেকে বলল, মা তুমি আমারে বিষ জোগাড় কইরা দেও। আমি বিষ খাব। রেনুর মা বললেন, কেন? রেনু বলল— আমি একজনরে বিবাহ করব কথা দিছি, এখন অন্যের সঙ্গে বিবাহ হইতেছে। বিষ ছাড়া আমার উপায় নাই। কতবড় মিথ্যা কথা, কিন্তু বলল ঠাণ্ড গলায়। ঐ বিয়ে ভেঙে গেল। রেনুর মা-বাবা তাড়াহুড়া করে আমার সঙ্গে বিয়ে দিলেন। নিজের ঘরের কথা আপনাকে বলে ফেললাম, আপনি স্যার মনে কিছু নিবেন না।

না–আমি কিছু মনে করি নি।

সবাইরেই বলি। বলতে ভালো লাগে।

হেডমাস্টারের চোখ চকচক করতে লাগল। আমি বললাম, আপনি ভাববেন না। আপনার স্ত্রী আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন।

তিনি জড়ানো গলায় বললেন, একটু দোয়া করবেন স্যার। ফুলটা যেন তাড়াতাড়ি ফুটে।

পড়ন্ত বেলায় খেয়া নৌকায় উঠলাম। হেডমাস্টার সাহেব মূর্তির মতো ওপারে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর দাড়িয়ে থাকার মধ্যেই একধরনের প্রতীক্ষার ভঙ্গি আছে। সেই প্রতীক্ষা অচিন বৃক্ষের অচিন ফুলের জন্যে যে প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে। হতদরিদ্র গ্রামের অন্যসব মানুষরাও। এবং কী আশ্চর্য, আমার মতো কঠিন নাস্তিকের মধ্যেও সেই প্রতীক্ষার ছায়া। নদী পার হতে-হতে আমার কেবলি মনে হচ্ছে— আহা ফুটুক। অচিন বৃক্ষে একটি ফুল হলেও ফুটুক। কত রহস্যময় ঘটনাই তো এ পৃথিবীতে ঘটে। তার সঙ্গে যুক্ত হোক আরও একটি।

হেডমাস্টার সাহেবও পাড়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন। তার হাতে হাতির ছবি আঁকা দু-নম্বরি একটা কবিতার খাতা। দূর থেকে কেন জানি ভাঁকে অচিন বৃক্ষের মতো লাগছে। হাতগুলি যেন অচিন বৃক্ষের শাখা। বাতাস পেয়ে দুলছে।

একজন ক্রীতদাস

কথা ছিল পারুল নটার মধ্যে আসবে।

কিন্তু এল না। বারোটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম একা একা। চোখে জল আসবার মতো কষ্ট হতে লাগল আমার। মেয়েগুলি বড খেয়ালি হয়।

বাসায় এসে দেখি ছোট্ট চিরকুট লিখে ফেলে গেছে। সন্ধ্যায় ৬৯৭৬২১ নম্বরে ফোন করো—পারুল। তাদের পাশের বাড়ির ফোন। আগেও অনেকবার ব্যবহার করেছি। কিন্তু আজ তাকে ফোনে ডাকতে হবে কেন? অনেক আলাপআলোচনা করেই কি ঠিক করা হয় নি আজ সোমবার বেলা দশটায় দুজন টাঙ্গাইল চলে যাব। সেখানে হারুনের বাসায় আমাদের বিয়ে হবে।

সারা দুপুর শুয়ে রইলাম। হোটেল থেকে ভাত এনেছিল। সেগুলি স্পর্শও করলাম না। ছোটবেলায় যেরকম রাগ করে ভাত না-খেয়ে থেকেছি আজও যেন রাগ করবার মতো সেরকম একটি ছেলেমানুষি ব্যাপার হয়েছে। পারুলের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়েছে— এই ভাবতে-ভাবতে নিজেকে খুব তুচ্ছ ও সামান্য মনে হতে লাগল। সন্ধ্যাবেলা টেলিফোন করবার জন্যে যখন বেরিয়েছি তখন অভিমানে আমার ঠোট ফুলে রয়েছে। গ্রিন ফার্মেসির মালিক আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, অসুখ নাকি ভাই?

আমি শুকনো গলায় বললাম, একটা টেলিফোন করব।

পারুল আশেপাশেই ছিল। রিনরিনে ছয়-সাত বছর বয়েসের ছেলেদের মতো গলা যা শুনলে বুকের মধ্যে সুখের মতো ব্যথা বোধ হয়।

হ্যালো শোন, কিন্ডারগার্টেনের মাস্টারিটা পেয়েছি। শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? বডড ডিস্টার্ব হচ্ছে লাইনে।

পারুলের উৎফুল্ল সতেজ গলা শুনে আমি ভয়ানক অবাক হয়ে গেলাম। তোতলাতে তোতলাতে কোনোরকমে বললাম, আজ নটার সময় তোমার আসর কথা ছিল…।

মনে আছে, মনে আছে। শোন তারিখটা একটু পিছিয়ে দাও। এখন তো আর সে রকম ইমার্জেন্সি নেই। তা ছাড়া…।

তা ছাড়া কী? তোমার ব্যবসার এখন যা অবস্থা বিয়ে করলে দুজনকেই একবেলা খেয়ে থাকতে হবে।

হড়বড় করে আরো কী কী যেন সে বলল। হাসির শব্দও শুনলাম একবার! আমি বুঝতে পারলাম পারুল আর কখনোই আমাকে বিয়ে করতে আসবে না। কাল তাকে নিয়ে ঘর সাজাবার জিনিসপত্র কিনেছি। সারা নিউমার্কেট ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সে কেনাকাটা করেছে। দোকানিকে ডবল বেডশিট দেখাতে বলে সে লজ্জায় মুখ লাল করেছে। এবং আজ সন্ধ্যাতেই খুব সহজ সুরে বলছে, তোমার ব্যবসার এখন যা অবস্থা। আঘাতটি আমার জন্যে খুব তীব্র ছিল। আমার সাহস কম, নয়তো সে রাতেই আমি বিষ খেয়ে ফেলতাম কিংবা তিনতলা থেকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়তাম। আমি বড় অভিমানী হয়ে জন্মেছি।

সে বৎসর আরো অনেকগুলি দুর্ঘটনা ঘটল। ইরফানের কাছে আমার চার হাজার টাকা জমা ছিল। সে হঠাৎ মারা গেল। রামগঞ্জে এক ওয়াগন লবণ বুক করেছিলাম। সেই ওয়াগনটি একেবারে উধাও হয়ে গেল। পাথরকুঁচি সাপ্লাইয়ের কাজটায় বড় রকমের লোকসান দিলাম। দ্রভাবে থাকবার মতো পয়সাতেও শেষপর্যন্ত টান পড়ল। মেয়েরা বেশ ভালো আন্দাজ করে। পারুল সত্যি-সত্যি আমার ভবিষ্যণ্টা দেখে ফেলেছিল। পারুলের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেল। আমি নিজে কখনো যেতাম না তার কাছে। তবু তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যেত। হয়তো বাসস্টপে দুজন একসঙ্গে এসে দাঁড়িয়েছি। পারুল আমাকে দেখামাত্রই আন্তরিক সুরে বলেছে, কী আশ্চর্য, তুমি! একী স্বাস্থ্য হয়েছে তোমার? ব্যবসাপত্র কেমন চলছে?

চলছে ভালোই।

ইশ বড় রোগা হয়ে গেছ তুমিচা খাবে এক কাপ? এস তোমাকে চা খাওয়াব।

দুপুরবেলা সিনেমা হলের সামনে একদিন দেখা হয় গেল। আমি তাকে দেখতে পাই নি এরকম একটা ভান করে রাস্তায় নেমে পড়লাম। কিন্তু সে পেছন থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, এই এই। সিনেমা দেখতে এসেছিলে নাকি?

না।

শোন, একটা কথা শুনে যাও।

কী?

আমার এক বান্ধবীর ছেলের আজ জন্মদিন। প্লিজ একটা উপহার আমাকে চয়েস করে দাও। চল আমার সাথে।

পারুলকে যতবার দেখি ততবারই অবাক লাগে। তিনশ টাকার স্কুল মাস্টারি তাকে কেমন করে এতটা আত্মবিশ্বাসী আর অহংকারী করে তুলেছে, ভেবে পাই না। ভুলেও সে আমাদের প্রসঙ্গ তুলে না। এক সোমবারে আমরা যে একটি বিয়ের দিন ঠিক করেছিলাম তা যেন বান্ধবীর ছেলের জন্মদিনের চেয়েও অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার। তার উজ্জ্বল চোখ, দ্রুত কথাবলার ভঙ্গি স্পষ্টই বুঝিয়ে দেয় জীবন অনেক অর্থবহ ও সুরভিত হয়ে হাত বাড়িয়েছে তার দিকে।

এপ্রিল মাসের তেরো তারিখে পারুলের বিয়ে হয়ে গেল। নিমন্ত্রণের কার্ড পাঠিয়ে সে যে আমাকে তার একটি নিষ্ঠুরতার নমুনা দেখায় নি সেইজন্যে আমি তাকে প্রায় ক্ষমা করে ফেললাম। সেদিন সন্ধ্যায় আমি একটি ভালো রেস্টুরেন্টে খেয়ে অনেকদিন পর সিনেমা দেখতে গেলাম। সিনেমার শেষে বন্ধুর বাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত হৃষ্টমনে গল্প করতে লাগলাম। এমন একটা ভাব করতে লাগলাম যেন পারুলের বিয়েতে আমরি বিশেষ কিছুই যায় আসে না। একজনের সঙ্গে বিয়ের কথা ঠিক করে অন্য একজনকে বিয়ে করা যেন খুব একটা সাধারণ ব্যাপার—অহরহই হচ্ছে।

সে রাতে ঘরের বাতাস আমার কাছে উষ্ণ ও অর্জি মনে হতে লাগল। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এল না। শুয়ে-শুয়ে ক্রমাগত ভাবলাম ব্যবসার অবস্থাটা অল্প একটু ভালো হলেই একটি সরল দুঃখী-দুঃখী চেহারার মেয়েকে বিয়ে করে ফেলব। এবং সেই মেয়েটির সঙ্গে পারুলের হৃদয়হীনতার গল্প করতে-করতে হা-হা করে হাসব।

কিন্তু দিনদিন আমার অবস্থা আরো খারাপ হল। একটা ছোটখাটো কনট্রাক্ট নিয়েছিলাম। তাতে সঞ্চিত টাকার সবটাই নষ্ট হয়ে গেল। একেবারে ডুবে যাবার মতো অবস্থা। চাকর ছেলেটিকে ছাড়িয়ে দিতে হল। দু-একটি শৌখিন জিনিসপত্র (একটি থ্রি ব্যান্ড ফিলিপস্ ট্রানজিস্টার, একটি ন্যাশনাল রেকর্ড প্লেয়ার, একটি দামি টেবিল ঘড়ি) যা বহু কষ্ট করে কৃপণের মতো পয়সা জমিয়ে-জমিয়ে কিনেছি, বিক্রি করে দিলাম। এবং তারপরও আমাকে একদিন শুধু হাফ-পাউন্ডের একটি পাউরুটি খেয়ে থাকতে হল।

সহায়-সম্বলহীন একটি ছেলের কাছে এ শহর যে কী পরিমাণ হৃদয়হীন হতে পারে তা আমার চিন্তার বাইরে ছিল। নিষ্ঠুর এবং অকরুণ এই শহরে আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম । সে সময় সারাক্ষণই খিদের কষ্ট লেগে থাকত। ফুটপাতের পাশে চটের পর্দার আড়ালে ভাতের দোকানগুলি দেখলেই মন খারাপ হয়ে যেত। দেখতাম রিকশাঅলা শ্রেণীর লোকরা উবু হয়ে বসে গ্রাস পাকিয়ে মহানন্দে ভাত খাচ্ছে। চুম্বকের মতো সেই দৃশ্য আমাকে আকর্ষণ করত। আহ ওরা কী সুখেই আছে।—এইরকম মনে করে আমার চোখ ভিজে উঠত। আমি বেঁচে থাকার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে লাগলাম। নিউ ইংক কালি কোম্পানির সেলসম্যানের চাকরি নিলাম একবার। একবার কাপড়কাচা সাবানের বিজ্ঞাপন লেখার কাজ নিলাম। পারুলকে আমার মনেই রইল না। বেমালুম ভুলে গেলাম।

একদিন সন্ধ্যাবেলী মোহাম্মদপুর বাজারের কাছ দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি পারুল্ল । সঙ্গে ফুটফুটে একটি বাচ্চা। পায়ে লাল জুতো, মুখটি ডল-পুতুলের মতো গোলগাল। পারুলের শাড়ির আঁচল ধরে টুকটুক করে হাঁটছে। পারুল যাতে আমাকে দেখতে না পায় সেইজন্যেই আমি সুট করে পাশের গলিতে ঢুকে পড়লাম । অথচ তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। পারুলের সমস্ত ইন্দ্রিয় তার মেয়েটিতে নিবদ্ধ ছিল। মাত্র এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল এই চমৎকার ডল-পুতুলের মতো মেয়েটি আমার হতে পারত। কিন্তু পরক্ষণেই সোবহান মিয়া হয়তো আমাকে কাজটা দেবে না— এই ভাবনা আমাকে অস্থির করে ফেলল।

আমার ভাগ্য ভালো। কাজটা হয়ে গেল । রোজ সকালে সেগুনবাগিচা থেকে হেঁটে হেঁটে মোহাম্মদপুরে আসি। সমস্ত দিন সোবহান মিয়ার ইন্ডেন্টিং ফার্মের হিসাব-নিকাশ দেখে অনেক রাতে সেগুনবাগিচায় ফিরে যাই। নিরানন্দ একঘেয়ে ব্যবস্থা। গভীর রাতে মাঝে-মধ্যে ঘুম ভেঙে গেলে মরে যেতে ইচ্ছে করে। রাস্তায় আমি মাথা নিচু করে হাঁটি। পরিচিত কেউ আমাকে উচ্চস্বরে ডেকে উঠুক তা এখন আর চাই না। কিন্তু তবু পারুলের সঙ্গে আরো দুবার আমার দেখা হয়ে গেল। একবার দেখলাম হুড-ফেলা রিকশায় সে বসে, চোখে বাহারি সানগ্লাস। তারপাশে চমৎকার চেহারার একটি ছেলে (খুব সম্ভব এই ছেলেটিকেই সে বিয়ে করেছে কারণ সফিকের কাছে শুনেছি পারুলের বর হ্যান্ডসাম এবং বেশ ভালো চাকরি করে)। দ্বিতীয়বার দেখলাম অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে হাসতে-হাসতে যাচ্ছে। কোনোবারই সে আমাকে দেখতে পায় নি। অবিশ্যি দেখতে পেলেও সে আমাকে চিনতে পারত না । অভাব, অনাহার ও দুর্ভাবনা আমার চেহারাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিল । তাছাড়া পুরনো বন্ধুদের করুণা ও কৌতূহল থেকে বাঁচবার জন্যে আমি দাড়ি রেখেছিলাম। লম্বা দাড়ি ও ভাঙা চোয়ালই আমার পরিচয়কে গোপন রাখবার জন্যে যথেষ্ট ছিল। তবু আমি হাত দুলিয়ে অন্যরকম ভঙ্গিতে হাঁটা অভ্যাস করলাম। যার জন্যে সফিক (যার সঙ্গে এক বিছানায় অনেকদিন ঘুমিয়েছি) পর্যন্ত আমাকে চিনতে পারে নি। চেহারা পরিচিত মনে হলে মানুষ যেরকম পিটপিট করে দুএকবার তাকায় তাও সে তাকায় নি।

আমি নিশ্চিত, পারুলের সঙ্গে কোনো একদিন চোখাচোখি হবে। এবং সেও চিনতে না পেরে সফিকের মতো ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে যাবে। কিন্তু পারুল আমাকে এক পলকে চিনে ফেলল। আমাকে দেখে সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দু এক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারল না। আমি খুব স্বাভাবিক গলায় বললামভালো আছ পারুল? অনেকদিন পরে দেখা। আমার খুব একটা জরুরি কাজ আছে। যাই তাহলে কেমন?

পারুল আশ্চর্য ও দুঃখিত চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি যখন চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছি তখন সে কথা বলল, তোমার এমন অবস্থা হয়েছে?

আমি অল্প হাসির ভঙ্গি করে হালকা সুরে বলতে চেষ্টা করলাম, ব্যবসাটা ফেল মেরেছে পারুল। আচ্ছা যাই তাহলে?

পারুল সে কথার জবাব দিল না। আমি বিস্মিত হয়ে দেখি তার চোখে পানি এসে পড়েছে। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল।

পারুলকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। যে জীবন আমার শুরু হয়েছে সেখানে প্রেম নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু সামান্য কয়েক ফোঁটা মূল্যহীন চোখের জলের মধ্যে পারুল্ল নিজেকে আবার প্রতিষ্ঠিত করল। সমস্ত দুঃখ ছাপিয়ে তাকে হারানোর দুঃখই নতুন করে অনুভব করলাম।

আমার জন্যে এই দুঃখটার বড় বেশি প্রয়েজন ছিল।

একটি নীল বোতাম

বারান্দায় এশার বাবা বসেছিলেন।

হাঁটু পর্যন্ত ভোলা লুঙি, গায়ে নীল রঙের গেঞ্জি। এই জিনিস কোথায় পাওয়া যায় কে জানে? কী সুন্দর মানিয়েছে তাঁকে। ভদ্রলোকের গায়ের রঙ ধবধবে শাদা। আকাশি রঙের গেঞ্জিতে তাঁর গায়ের রঙ ফুটে বেরুচ্ছে। সব মিলিয়ে সুখী-সুখী একটা ছবি। নীল রঙটাই বোধহয় সুখের। কিংবা কে জানে ভদ্রলোকের চেহারাটাই বোধহয় সুখী-সুখী। কালো রঙের গেঞ্জিতেও তাঁকে হয়তো সুখী দেখাবে।

তিনি আমাকে দেখতে পান নি। আমি ইচ্ছা করেই গেটে একটু শব্দ করলাম। তিনি আমাকে দেখলেন। সুন্দর করে হাসলেন। ভরাট গলায় বললেন, আরে রঞ্জু,

তুমি? কী খবর? ভালো আছ?

জি ভালো।

গরম কী রকম পড়ছে বল দেখি?

খুব গরম।

আমার তো ইচ্ছা করছে চৌবাচ্চায় গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকি।

তিনি তাঁর পাশের চেয়ারে আমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। হাসি-হাসি মুখে বললেন, বসো। তোমার কাছ থেকে দেশের খবরাখবর কিছু শুনি।

আমার কাছে কোনো খবরাখবর নেই চাচা।

না থাকলে বানিয়ে-বানিয়ে বল। বর্তমানে চালু গুজব কী?

আমি বসলাম তার পাশে। এশার বাবার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। মাঝে-মাঝে এ-বাড়িতে এসে শুনি এশা নেই— মামার বাড়ি গেছে। রাতে ফিরবে না। তার মামার বাড়ি ধানমণ্ডিতে। প্রায়ই সে সেখানে যায়। আমার খানিকটা মন-খারাপ হয়। কিন্তু এশার বাবার সঙ্গে কথা বললে আমার মন-খারাপ ভাবটা কেটে যায়।

এই যে এখন বসলাম উনার পাশে এখন যদি শুনি এশা বাসায় নেই, মামার বাড়ি গিয়েছে— আমার খুব খারাপ লাগবে না।

তারপর রঞ্জু নতুন কোনো গুজবের কথা তাহলে জানো না?

জি না।

বল কী তুমি? শহর ভর্তি পুজব। আমি তো ঘরে বসে কত কী শুনি। চা খাবে?

জি না।

খাও এক কাপ। তোমার সঙ্গে আমিও খাব। তুমি আরাম করে বসো। আমি চায়ের কথা বলে আসি।

আপনাকে বলতে হবে না, আমি বলে আসছি। এশা কি বাসায় নেই?

আছে। বাসাতেই আছে।

বলেই তিনি চায়ের কথা বলতে উঠে গেলেন। কী চমৎকার তার এই ভদ্রতা। আমি কে? কেউ না। অতি সামান্য একজন। একটা এ্যাড ফার্মে কাজ করি। অল্প যে কটা টাকা পাই তার প্রতিটির হিসাব আমার আছে। আর এঁরা? আমার ধারণা, এদের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান আমার চেয়ে বেশি টাকা পায়। নিতান্ত ভাগ্যক্রমে এঁদের এক আত্মীয়ের সঙ্গে এ-বাড়িতে এসেছিলাম। প্রথমদিনেই এশার কী সহজ সুন্দর ব্যবহার যেন সে অনেকদিন থেকেই আমাকে চেনে। সেদিন কেমন হাসিমুখে বলল, আপনি তো বেশ লম্বা। আসুন একটা কাজ করে দিন। চেয়ারে দাঁড়ান দাঁড়িয়ে খুব উঁচুতে একটা পেরেক লাগিয়ে দিন। আমি বললাম, এত উঁচুতে পেরেক দিয়ে কী করবেন?

আজ বলব না। আরেকদিন এসে দেখে যাবেন।

দ্বিতীয়বার এ বাড়িতে আসার কী চমৎক্তার অজুহাত তৈরি হল। অথচ অজুহাতের কোনো প্রয়েজন ছিল না। এদের বাড়ি— দুয়ারখোলা বাড়ি। যে-কেউ যে-কোনো সময় আসতে পারে। কোনো বাধা নেই। অথচ মনে আছে দ্বিতীয়বার কত ভয়ে-ভয়ে এসেছি। গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সাহস হয় নি। যদি আমাকে কেউ চিনতে না পারে। যদি এশা বিস্মিত হয়ে বলে, আপনি কাকে চান?

সে রকম কিছুই হল না। এশার বাবা আমাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, কী বাপার রঞ্জ, গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আস, ভেতরে আস।

আমি খানিকটা বিব্রত ভঙ্গিতেই ঢুকলাম। তিনি হাসিমুখে বললেন, দেশের খবরা-খবর বল। নতুন কী গুজব শুনলে?

এশা বোধহয় বাইরে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, বেছে বেছে আজকের দিনটিতেই আপনি এলেন? এখন বেরুচ্ছি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না। চট করে আসুন তো, পেরেকটা কী কাজে লাগছে দেখে যান।

আমি ইতস্তত করছি। এশার বাবার সামনে থেকে উঠে যাব, উনি কী মনে করেন কে জানে। উনি কিছুই মনে করলেন না। সুখী-সুখী গলায় বললেন, যাও দেখে আস। জিনিসটা ইন্টারেস্টিং।

পেরেক থেকে হলুদ দড়ির মতো একটা জিনিস মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। এশা বাতি নিভিয়ে একটা সুইচ টিপতেই অদ্ভুত ব্যাপার হল। হলুদ দড়ি আলোয় ঝিকমিক করতে লাগল। সেই আলো স্থির নয়। যেন পড়িয়ে-গড়িয়ে নিচে নামছে। আলোর ঝরনা।

অপূর্ব।

কী, অবাক হয়েছেন তো?

হ্যাঁ, হয়েছি।

এ অদ্ভুত জিনিস এর আগে কখনো দেখছেন?

জি না।

আমার বড়বোন পাঠিয়েছেন। নেদারল্যান্ড থাকেন যিনি, তিনি। এখন যান। বসে বসে বাবার গল্প শুনুন। বাবা কি আপনাকে তার কচ্ছপের গল্পটা বলেছে?

জি না।

তাহলে হয়তো আজ বলবে। বাবার গল্প বলার একটা প্যাটার্ন আছে। কোটির পর কোন্ গল্প আসবে আমি জানি।

এশা হাসল। কী সুন্দর হাসি। আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম— না জানি কোন্ ভাগ্যবান পুরুষ এই মেয়েটিকে সারাজীবন তার পাশে পাবে।

এশার বাবা সেদিন কচ্ছপের গল্প বললেন না। পরের বার যেদিন গেলাম সেদিন বললেন। কচ্ছপ কোথায় ডিম পাড়ে জানো তো রঞ্জু? ডাঙায়। সে নিজে থাকে কিন্তু পানিতে। চলাফেরা, জীবনযাত্রা সবই পানিতে অথচ তার মন পড়ে থাকে তার ডিমের কাছে ডাঙায়। ঠিক না?

জি ঠিক।

বুড়ো বয়সে মানুষেরও এই অবস্থা হয়। সে বাস করে পৃথিবীতে কিন্তু তার মন পড়ে থাকে পরকালে। আমার হয়েছে এই দশা।

এই পরিবারটির সঙ্গে পরিচয় হবার পর আমার মধ্যে বড় ধরনের কিছু পরিবর্তন হল। আগে বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে চমৎকার লাগত। এখন আর লাগে না। একসময় মেয়েদের নিয়ে কেউ কোনো কুৎসিত কথা বললে বেশ মজা পেতাম। এখন ভয়ংকর রাগ লাগে। মনে হয় এই কুৎসিত কথাটি কোনো-না-কোনো ভাবে এশাকে স্পর্শ করছে। যে খুপরি ঘরটায় থাকি সেই ঘর আমার আর এখন ভালো লাগে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। নোনাধরা বিশ্রী দেয়াল। একটি ছোট জানালা যা দিয়ে আলো-বাতাস আসে না, রাতের বেলা শুধু মশা ঢুকে। চৈত্র মাসের গরমে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। নানান রকম কল্পনা মাথায় আসে। কল্পনায় আমার এই ঘর হয়ে যায় পদ্মানদীর নৌকায় একটা ঘর। জানালা খুললেই নদী দেখা যায়। সেই নদীতে জোছনা হয়েছে। চাঁদের আলো ভেঙে-ভেঙে পড়ছে। ঘরের দরজায় টোকা পড়ে। আমি জানি কে টোকা দিচ্ছে। তবু কাঁপা গলায় বলি, কে? এশা বলে, কে আবার? আমি। এরকম চমৎকার রাতে আপনি ঘরটর বন্ধ করে বসে আছেন। পাগল নাকি? আসুন তো।

কোথায় যাব?

কোথায় আবার, নৌকার ছাদে বসে থাকব।

আমরা নৌকার ছাদে গিয়ে বসি। মাঝি নৌকা ছেড়ে দেয়। এশা গুনগুন করে গায়ঃ যদি আমায় পড়ে তাহার মনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে। অজি জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।

সবই খুব সুন্দর সুখের কল্পনা। তবু এক-এক রাতে কষ্টে চোখে জল আসে। সারারাত জেগে বসে থাকি। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাবি, আমার এই জীবনটা আমি কি কিছুতেই বদলাতে পারি না?

বন্ধুবান্ধব সবাইকে অবাক করে এক সন্ধ্যায় জগন্নাথ কলেজের নাইট সেকশনের এম এ. ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাই। ধার-টার করে আমার ঘরের জন্যে নতুন পর্দা, বিছানার নতুন চাদর, নেটের মশারি কিনে ফেলি। অনেক ঘোরাঘুরি করে একটা ফুলদানি কিনি। একশ টাকা লেগে যায় ফুলদানিতে। তা লাগুক, তবু তো একটা সুন্দর জিনিস। একগুচ্ছ রজনীগন্ধা যখন এখানে রাখব তখন হয়তো এই ঘরের চেহারা পাল্টে যাবে। আমার এক আর্টিস্ট বন্ধুর কাছ থেকে একদিন প্রায় জোর করে জলরঙা একটা ছবিও নিয়ে আসি। নোনাধরা দেয়ালে সেই ছবি মানায় না। নিজেই চুন এনে দেয়ালে চুনকাম করি।

চুন দেয়ালে আটকায় না, ঝরে-ঝরে পড়ে। তবু আমার ঘর দেখে বন্ধুরা চোখ কপালে তুলে।

করছিস কী তুই? ইন্দ্রপুরী বানিয়ে ফেলেছিস দেখি। আবার দেখি খুশবুও আসছে। বিছানায় আতর ঢেলে দিয়েছিস নাকি? মাই গড! মেয়েমানুষ ছাড়া এই ঘর মানায় না। এক কাজ কর একশ টাকা দিয়ে একটা মেয়েমানুষ এক রাতের জন্য নিয়ে আয়। ফুর্তি কর। আমরা পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখি।

রাগে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। কিছু বলি না। কী হবে বলে। আমার বন্ধুরা গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়। সিগারেটের টুকরা দিয়ে মেঝে প্রায় ঢেকে ফেলে। একজন আমার নতুন কেনা বিছানায় চায়ের কাপ উল্টে দিয়ে বলে, যা শালা, চাঁদে কলঙ্ক লেগে গেল।

আমি কিছু বলি না। দাঁতে–দাঁত চেপে থাকি। আর মনে-মনে ভাবি— এই মূর্খদের সঙ্গে কী করে এতদিন কাটিয়েছি। কী করে এদের সহ্য করেছি?

ইরফান বলল, প্রেম করেছিস কিনা বল। তোর হাবভাব যেন কেমন রঙ্গিলা।

আমি জবাব দেই না। ইরফান পান-খাওয়া লাল দাত বের করে হাসতে-হাসতে বলে, জিনিস কেমন বল। টিপেটুপে দেখেছিস তো?

সবাই হো হো করে হাসে। কোন্ অন্ধকার নরকে এরা পড়ে আছে? এদের কী কোনোদিন মুক্তি ঘটবে না? আমার ইচ্ছা করে এশাকে একদিন ওদের সামনে উপস্থিত করি। সেটা নিশ্চয়ই খুব অসম্ভব নয়। বললেই সে আসবে। তবে আমার বলতে সাহস করে না।

প্রথম যেদিন তাকে তুমি বললাম কী প্রচণ্ড ভয়ে-ভয়েই না বললাম। সে গোলাপগাছের ডাল ছেটে দিচ্ছিল। আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ কী হল, নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম— কাঁচিটা আমার হাতে দাও, আমি হেঁটে দি। বলেই মনে হল—এ কী করলাম আমি? আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। অমাির মনে হল সে এবার চোখে চোখে তাকিয়ে শীতল গলায় বলবে, আমাকে তুমি করে বলবেন না। এত ঘনিষ্ঠতা তো আপনার সঙ্গে আমার নেই।

এশা সে-রকম কিছুই বলল না। কাঁচি আমার হাতে দিয়ে বলল, তিন ইঞ্চি করে কাটবেন। এর বেশি না। আর আপনি কি চা খাবেন?

হ্যাঁ খাব।

চা নিয়ে আসছি। শুনুন, এরকম কচকচ করে কাটবেন না, ওরা বাধা পায়। গাছেরও জীবন আছে। জগদীশ চন্দ্র বসুর কথা।

এশা ঘরে ঢুকে গেল। চৈত্র মাসের বিকেলে আমি গোলাপ হাঁটতে লাগলাম। আমার ত্রিশ বছর জীবনের সেটা ছিল শ্রেষ্ঠতম দিন। বিকালটাই যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। শেষ বিকেলের রোদকে মনে হল লক্ষ-লক্ষ গোলাপ, বাতাস কী মধুর। এশার বাবা যখন বাইরে এসে বললেন— তারপর রঞ্জু দেশের খবর কী বল? নতুন কী গুজব শুনলে?—কী যে ভালো লাগল সেই কথাগুলি! মনে হল। এরকম সুন্দর কথা এর আগে আমাকে কেউ বলে নি।

গোলাপের ডাল ছাঁটছ মনে হচ্ছে। জি চাচা।

এর একটা ফিলসফিক আসপেকট আছে। সেটা লক্ষ্য করেছ? ফুল ফোটাবার জন্যে গাছকে কষ্ট দিতে হচ্ছে। হা-হা-হা।

তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও হাসলাম। এশা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকতে-চুকতে বলল, এত হাসাহাসি হচ্ছে কেন? আমি যোগ দিতে পারি?

ওদের বাড়ি থেকে ফিরলাম সন্ধ্যার পর। এশা গেট পর্যন্ত এল। হাসিমুখে বলল, আবার আসবেন।

এই কথাটি কি পৃথিবীর মধুরতম কথার একটি নয়? আমি আবার আসতে পারি এ বাড়িতে। যতবার ইচ্ছা আসতে পারি। আমাকে কোনো অজুহাত তৈরি করতে হবে না। তবুও ছোটখাটো কিছু অজুহাত আমি তৈরি করেই রাখি। যেমন একবার আমার একটা হ্যান্ডব্যাগ ফেলে এলাম যাতে পরদিন গিয়ে বলতে পারি, জরুরি কিছু কাগজপত্র ছিল। যাক পাওয়া গেল। সবচে বেশি যা করি তা হচ্ছেগল্পের বই নিয়ে আসি। তারপর সেই বই ফেরত দিতে যাই।

গল্পের বই আমি পড়ি না। ভালো লাগে না। কোনোকালেও ভালো লাগে নি। তবু রাতে শুয়ে-শুয়ে বইয়ের ঘ্রাণ নেই, পাতা ওল্টাই। এশার স্পর্শ এই বইগুলির পাতায়-পাতায় লেগে আছে ভাবতেই আমার রোমাঞ্চ বোধ হয়। গা শিরশির করে। গভীর আনন্দে চোখ ভিজে উঠে। বই ওল্টাতে-ওল্টাতে একরাতে অদ্ভুত এক কাণ্ড হল। টুক করে বইয়ের ভেতর থেকে কী যেন পড়ল। তাকিয়ে দেখি ছোট একটা নীল রঙের বোতাম। যেন একটা নীল অপরাজিতা। নাকের কাছে নিয়ে দেখি সত্যি গন্ধ আসছে। আমি গভীর মমতায় বোতামটা বালিশের নিচে রেখে দিলাম। সারারাত ঘুম হল না। কেবলি মনে হল একদিন-না-একদিন এশা আসবে এ বাড়িতে। আমি তাকে বলব, তুমি যে ফুলটি আমাকে দিয়েছিলে সেটা এখনো ভালো আছে। কী সুন্দর গন্ধ। সে অবাক হয়ে বলবে, আমি আবার ফুল দিলাম কবে?

এর মধ্যে ভুলে গেলে? একটা নীল ফুল দিয়েছিলে না?

বলেন কী! নীল ফুল আমি কোথায় পাব?

আমি বালিশ সরিয়ে বোতামটা বের করে আনব। এশা বিস্মিত হয়ে বলবে— এটা বুঝি আপনার নীল ফুল? আমি বলব, বিশ্বাস না হলে গন্ধ শুঁকে দেখ।

এশার বাবা নিজেই দুকাপ চা নিয়ে ঢুকলেন। আমার বড় লজ্জা লাগল। আমি বললাম, ছিঃ ছিঃ আপনি কেন?

তিনি হেসে বললেন, তাতে কী হয়েছে। খাও, চা খাও। চিনি হয়েছে কিনা বল।

হয়েছে।

গুড। চিনি আমি নিজেই দিয়ে এনেছি। কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত।

কোনো উৎসব নাকি?

না, উৎসব কিছু না। মেয়েলি ব্যাপার। এশার বিয়ে ঠিক হল। ওরা দিন পাকা করতে আসবে। রাত আটটায় আসবে। এখনো তিন ঘণ্টা দেরি অথচ ভাব দেখে মনে হচ্ছে …।

আমি নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগলাম। এশার বাবা বললেন, ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ সাহেবের ছেলে। তুমি চিনবে নিশ্চয়ই। ইমতিয়াজ চৌধুরী, জিয়ার আমলে হেলথ মিনিস্টার ছিলেন। ছেলেটা খুব ভালো পেয়েছি। জার্মানি থেকে পিএইচ. ডি. করেছে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। এখন দেশে কী সব ইন্ডাস্ট্রি দেবে। রঙ তৈরি করবে। আমি ঠিক বুঝিও না।

চা শেষ করবার পরও আমি খানিকক্ষণ বসে রইলাম। যাবার আগে এশা বেরিয়ে এল। কী চমক্কার করেই না আজ তাকে সাজিয়েছে। তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হয়। এশা হাসিমুখে বলল, বেছে বেছে আপনি ঝামেলার দিনগুলিতে আসেন কেন বলুন তো?

আমি ফিরে যাচ্ছি আমার খুপরি ঘরে। অন্যসব রাতের মতো আজ রাতেও হয়তো ঘুম হবে না। বালিশের নিচ থেকে নীল বোতাম বের করে আজো নিশ্চয়ই দেখব। এই পরিবারটির কাছ থেকে একটা নীল বোতামের বেশি পাওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না। এই সহজ সত্যটি আজ রাতেও আমার মাথায় ঢুকবে না। আজ রাতেও বোতামটিকে মনে হবে একটি অপরাজিতা ফুল।

কল্যাণীয়াসু

ট্রেটয়াকভ আর্ট গ্যালারিতে ছবি দেখতে গিয়েছিলাম। পুরনো দিনের মহান সব শিল্পীদের আঁকা ছবি। দেখতে-দেখতে এগুচ্ছি। হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হল। সঙ্গের রাশিয়ান গাইড বলল, কী হয়েছে?

আমি হাত উঁচিয়ে একটি পেইনটিং দেখালাম। প্রিন্সেস তারাকনোভার পেইনটিং। অপূর্ব ছবি!

জরী, ছবিটি দেখে তোমার কথা মনে পড়ল। গাইড বলল, সেন্ট পিটার্সবার্গ জেলে প্রিন্সেসের শেষ দিনগুলি কেটেছে। ঐ দেখ সেল-এর অন্ধকূপে কী করে বন্যার পানি ঢুকছে। দেখ, প্রিন্সেসের চোখে-মুখে কী গভীর বিষাদ। প্রগাঢ় বেদনা।

আমি কথা বললাম না। অভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। গাইড বলল, এস পাশের কামরায় যাই।

আমি নড়লাম না। মৃদু গলায় বললাম, মি. যোখভ আজ আর কিছু দেখব না। চল, কোথাও বসে চা খাওয়া যাক।

দুজনে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম। ভীষণ শীত বাইরে। রাস্তাঘাট ফাঁকা-ফাঁকা। ঠা কনকনে হাওয়া মোটা ওভারকোট ভেদ করে শরীরে বিধছে। আমার সঙ্গী হঠাৎ জানতে চাইল, তোমার কি শরীর খারাপ করছে?

না।

আর্ট গ্যালারি কেমন দেখলে?

চমৎকার। অপূর্ব!

আমি চায়ে চিনি মেশাতে-মেশাতে বললাম, তোমাদের প্রিন্সেস তারাকনোভাকে দেখে আমার এক পরিচিত মহিলার কথা খুব মনে পড়ছে।

গাইড কৌতূহলী হয়ে বলল, কে সে? নাম জানতে পারি?

জরী তার নাম।

যোখভ বিস্মিত হয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি মনে মনে বললাম, প্রিন্সেস জরী। প্রিন্সেস জরী।

জরী, রাজকুমারীর ছবি দেখে আজ বড় অভিভূত হয়েছি। হঠাৎ করে তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছা করছে। বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে মন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে। ক্রমাগতই নস্টালজিক হয়ে পড়ছি। ঘুম কমে গেছে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। ঘনঘন কফি খাই। চুরুটের গন্ধে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। শেষরাতের দিকে ঘুমুতে গিয়ে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। পরশু রাত্রে কী স্বপ্ন দেখলাম জানো? দেখলাম, আমাদের নীলগঞ্জে যেন খুব বড় একটা মেলা বসেছে। বাবার হাত ধরে মেলা দেখতে গিয়েছি (ইশ! কতদিন পর বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম)। বাবা বললেন, খোকা নাগরদোলায় চড়বি? আমি যতই না করি তিনি ততই জোর করেন। তারপর দেখলাম, ভয়ে আমি থরথর করে কাপছি আর শী-শা শব্দে নাগরদোলা উড়ে চলছে। চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারকা ছাড়িয়ে দূরে-দূরে আরো দূরে। ঘুম ভেঙে দেখি চোখের জলে বালিশ ভিজে গেছে। চল্লিশ বছর বয়সে কেউ কি এমন করে কাঁদে?

আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি জরী। আজকাল খুব নীলগঞ্জে চলে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে আগের মতো সন্ধ্যাবেলা পুকুরঘাটে বসে জোনাকি পোকার আলো জ্বালা দেখি।

মস্কোতে আজ আমার শেষ রাত। আগামীকাল ভোর চারটায় রওনা হব রুমানিয়ায়। খুব কষ্ট করে এক মাসের ভিসা জোগাড় করেছি। এই এক মাস খুব ঘুরে বেড়াব। তারপর ফিরে যাব মন্ট্রিলে নিজ আস্তানায়। বেশ একটা গতির জীবন বেছে নিয়েছি, তাই না? অথচ ছোটবেলায় এই আমিই হোস্টেলে যাবার সময় হলে কী মন খারাপ করতাম। হাসু চাচা আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে এসে লাল গামছায় ঘনঘন চোখ মুছত। ধরা গলায় বলত, বড় মিয়া চিঠি দিয়েন গো।

আমার মনে হত—দুর ছাই, কী হবে পড়াশুনা করে। বাবা, হাসু চাচা এদের ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারব না।

প্রবল ঘরমুখো টান ছিল বলেই আজ হয়তো যাযাবর বৃত্তি বেছে নিতে হয়েছে। তাই হয়। তোমার জন্য প্রবল তৃষ্ণা পুষেছিলাম বলেই কি তোমাকে পাই নি? টেনটেলাসের গল্প জানো তো? তার চারদিকে পানির থইথই সমুদ্র অথচ তাকেই কিনা আজীবন তৃষ্ণার্ত থাকতে হল।

জরী, তোমার কি মনে আছে বিয়ের পরদিন তোমাকে নিয়ে যখন নীলগঞ্জে আসি তুমি ট্রেনের জানালায় মুখ রেখে খুব কেঁদেছিলে। তখন কার্তিকের শুরু। ধানীরঙের রোদে ঝলমল করছে চারদিক। হালকা হিমেল বাতাস। মনে আছে সেসব কথা আমি বলেছিলাম, মাথাটা ভেতরে টেনে নাও জরী। কয়লার গুঁড়ো এসে চোখে পড়বে। তুমি বললে, পড়ক।

কামরায় আমরা দুটি মাত্র প্রাণী। বরযাত্রীরা আমাদের একা থাকবার সুযোগ দিয়ে অন্য কামরায় উঠেছে। ট্রেন ছুটে চলেছে ঝিকঝিক করে। বাতাসে তোমার লালচে চুল উড়ছে।

কী-একটা সেন্ট মেখেছ। চারপাশে তার চাপা সৌরভ। আমি গাঢ় স্বরে বলেছিলাম, ছিঃ জরী এত কাঁদছ কেন? কথা বল। আমার কথায় তুমি কী মনে করেছিলে কে জানে। লজ্জা পেয়ে দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেললে। সেইদিন কী গভীর আনন্দ আমাকে অভিভূত করেছিল। মনে হয়েছিল রহস্যমণ্ডিত এই রমণীটিকে পেয়েছি।

গৌরীপুরে গাড়ি অনেকক্ষণ হল্ট করল। একজন অন্ধ ভিখারি একতারা বাজিয়ে আমাদের কামরার সামনে খুব গান গাইতে লাগল, ও মনা এই কথাটি না জানলে প্রাণে বাঁচতাম না।

তুমি অবাক হয়ে বললে, কী সুন্দর গান। তারপর দুটি টাকা বের করে দিলে। ট্রেন ছাড়তেই জানালা দিয়ে অনেকখানি মাথা বের করে বললে, দেখুন দেখুন, কতগুলি বক একসঙ্গে উড়ে যাচ্ছে।

বক নয়। শীতের শুরুতে ঝাঁক বেঁধে বালিহাস উড়ে আসছিল। আগে দেখ নি কখনো, তাই খুব অবাক হয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, বক নয় জরী। ওগুলি বালিহাঁস। আর শোন, আপনি আপনি করছ কেন? আমাকে তুমি করে বলবে।

ঐ হাঁসগুলি কোথায় যাচ্ছে?

বিলের দিকে।

আপনাদের নীলগঞ্জে বিল আছে?

আবার আপনি?

তুমি হেসে বললে, নীলগঞ্জে বিল আছে?

আমি বললাম, বল, তোমাদের নীলগঞ্জে বিল আছে?

তুমি মুখ ফিরিয়ে হাসতে শুরু করলে। আমার মনে হল সুখ কোনো অলীক বস্তু নয়। এর জন্যে জীবনব্যাপী কোনো সাধনারও প্রয়েজন নেই। প্রভাতের সূর্যকিরণ বা রাতের জোছনার মতোই এও আপনাতেই আসে।

কিন্তু প্রিন্সেস তারাকনোভার ছবি দেখতে গিয়ে উল্টো কথা মনে হল। মনে হল সুখটুখ বলে কিছু নেই। নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ নিয়ে আমাদের কারবার। চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম হতাশ রাজকুমারী পিটার্সবার্গের নির্জন সেলে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন। হু-হু করে বন্যার জল ঢুকছে ঘরে। রাজকুমারীর ঠোটের কোনায় কান্নার মতো অদ্ভুত এক হাসি ফুটে রয়েছে।

ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় মনে হল রাজকুমারীকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। জরীর মুখের আদল আসছে নাকি? পরমুহর্তেই ভুল ভাঙল।, জরীর সঙ্গে এ মুখের কোনো মিল নাই। জরীর মুখ গোলগাল। একটু আদুরে ভাব আছে। আর রাজকুমারীর মুখটি লম্বাটে ও বিষণ্ণ। মনে আছে জরী, একবার তোমার একটি পোট্রেট করেছিলাম। কিছুতেই মন ভরে না। ব্রাশ ঘসি আবার চাকু দিয়ে চেঁছে রঙ তুলে ফেলি। দু-মাসের মতো সময় লাগল ছবি শেষ হতে। পোট্রেট দেখে তুমি হতভম্ব। অবাক হয়ে বললে, ও আল্লা চোখে সবুজ রঙ দিয়েছ কেন? আমার চোখ বুঝি সবুজ? আমি বললাম, একটু দূর থেকে দেখ।

তুমি অনেকটা দূরে সরে গেলে এবং চেঁচিয়ে বললে, কী সুন্দর! কী সুন্দর!

ছবি আঁকিয়ে হিসেবে জীবনে বহু পুরষ্কার পেয়েছি। কিন্তু সেদিনকার সেই মুগ্ধ কণ্ঠ এখনো কানে বাজে।

সেই পোট্রেটটি অনেকদিন আমার কাছে ছিল। তারপর বিক্রি করে দিলাম। ছবি দিয়ে কী হয় বল? তার উপর সেবার খুব টাকার প্রয়েজন হল। মিলানে গিয়েছি বন্ধুর নিমন্ত্রণে। গিয়ে দেখি বন্ধুর কোনো হদিশ নেই। কদিন আগেই নাকি বিছানাপত্র নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে। কী করি, কী করি! সঙ্গে সম্বলের মধ্যে আছে ত্রিশটি আমেরিকান ডলার আর মনট্রিলে ফিরে যাবার একটি টুরিস্ট টিকিট। এর মধ্যে আবার আমার পুরানো অসুখ বুকে ব্যথা শুরু হল। শস্তা দরের এক হোটেলে উঠলাম। তবুও দুদিন যেতেই টাকাপয়সা সব শেষ। ছবি বিক্রি ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।

এক সন্ধ্যায় বড় রাস্তার মোড়ে ছবি টাঙিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে লাগলাম। কারোর যদি পছন্দ হয় কিনবে। ছবির মধ্যে আছে দুটি ওয়াটার কালার আর তেলরঙা আঁকা তোমার পোট্রেট। ছবিগুলির মধ্যে নীলগঞ্জের জোছনা নামের অপূর্ব একটি ওয়াটার কালার ছিল। আমাদের বাড়ির পেছনে চার-পাঁচটা নারকেল গাছ। দেখ নি তুমি? ঐ যে পুকুরপাড়ে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়েছিল। এক জোছনা রাত্রিতে পুকুরের কালো জলে তাদের ছায়া পড়েছিল— তারই ছবি। চোখ ফেরানো যায় না এমন। অথচ বিক্রি হল শুধু তোমার পোট্রেটটি। এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা কিনলেন। তিনি হৃষ্টচিত্তে বললেন, কেন এই পোট্রেটটা কিনলাম জানো?

না ম্যাডাম।

আমি যখন কিশোরী ছিলাম তখন এই ছবিটিতে যে মেয়েটিকে তুমি এঁকেছ তার মতো সুন্দর ছিলাম, তাই কিনলাম।

আমি হেসে বললাম, আপনি এখনো সুন্দর।

ভদ্রমহিলা বললেন, এসো না আমার ঘরে। কফি করে খাওয়াব। এমন কফি সারা মিলান শহরে খুঁজেও পাবে না।

ভদ্রমহিলা আশাতীত দাম দিলেন ছবির। শুধু কফি নয়, রাতের খাবার খাওয়ালেন। তার অল্পবয়সী নানান ছবি দেখালেন। সবশেষে পিয়ানো বাজিয়ে খুব করুণ একটি গান গাইলেন যার ভাব হচ্ছে— হে প্রিয়তম, বসন্তের দিন শেষ হয়েছে। ভালোবাসাবাসি দিয়ে সে দিনকে দূরে রাখা গেল না।

নিজের হাতে তোমার ছবি টানালাম। কোথাকার ইটালির মিলান শহরের এক বৃদ্ধা মহিলা, তার ঘরে তোমার হাসিমুখের ছবি ঝুলতে লাগল। কেমন অবাক লাগে ভাবতে।

একশ বছর পর এই ছবিটি অবিকৃতই থাকবে। বৃদ্ধার নাতি-নাতনিরা ভাববে, এইটি কার পোট্রেট? এখানে কীভাবে এসেছে?

ফেরার পথে বৃদ্ধার হাতে চুমু খেলাম। মনে-মনে বললাম, আমার জরী যেন তোমার কাছে সুখে থাকে।

আমরা সবসময় সুখে থাকার কথা বলি। যতবার নীলগঞ্জ থেকে ঢাকার হোস্টেলে যেতাম— বাবা বলতেন, সুখে থাকো। তুমি যখন লাল বেনারসীতে মুখ ঢেকে ট্রেনে উঠলে তোমার মা কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, সুখে থাকো।

জরী, আমার কাছে তুমি সুখে ছিলে না? কিসে একটি মানুষ সুখী হয়? নীলগঞ্জে আমাদের প্রকাণ্ড বাড়ি দেখে তোমার কি মন ভরে উঠে নি? তুমি কি অবাক হয়ে চেঁচিয়ে ওঠ নি— ওমা এ যে রাজপ্রাসদি! জোছনা রাত্রিতে হাত ধরাধরি করে যখন আমরা পুকুরপাড়ে বেড়াতে যেতাম তখন কি গভীর আবেগ তোমাকে এতটুকু আচ্ছন্ন করে নি? তোমাকে আমি কী দেই নি জরী? নিরবচ্ছিন্ন ভালোবাসার দেয়ালে তোমাকে ঘিরে রেখেছিলাম। রাখি নি?

তবু এক রাত্রিতে তুমি বিছানা ছেড়ে চুপিচুপি ছাদে উঠে গেলে। আমি দেখলাম, তুমি পাথরের মূর্তির মতো কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছ। বুকে ধ্বক করে একটা ধাক্কা লাগল। বিস্মিত হয়ে বললাম, কী হয়েছে জরী?

তুমি খুব স্বাভাবিক গলায় বললে, কই কিছু হয় নি তো। তারপর নিঃশব্দে নিচে নেমে এলে।

তোমার মধ্যে গভীর একটি শূন্যতা ছিল। আমি তা ধরতে পারি নি। শুধু বুঝতে পারছিলাম তোমার কোনোকিছুতেই মন লাগছে না। সে সময় এসে নীপবনে নাম দিয়ে আমি চমৎকার একটি পেইনটিং করছিলাম। আকাশে আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ। একটি ভাঙা বাড়ির পাশে একটি প্রকাণ্ড ছায়াময় কদম গাছ। এই নিয়ে আঁকা। আমার শিল্পীজীবনের ভালো কটি ছবির একটি। ভেবেছিলাম বিয়ের বছরটি ঘুরে এলে তোমাকে এই ছবি দিয়ে মুগ্ধ করব। কিন্তু ছবি তোমাকে এতটুকুও মুগ্ধ করল না। তুমি ক্লান্ত গলায় বললে, এক বছর হয়ে গেছে বিয়ের? ইশ কত তাড়াতাড়ি সময় যায়!

তোমার কণ্ঠে কি সেদিন একটি চাপা বিষাদ ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল? ক্রমে-ক্রমে তুমি বিষণ্ণ হয়ে উঠতে লাগলে। প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখতাম তুমি জেগে বসে আছ। অবাক হয়ে বলেছি, কী হয়েছে জরী?

কই? কিছু হয় নি তো।

ঘুম আসছে না?

আসছে।

বলেই তুমি আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লে। কিন্তু তুমি জেগে রইলে। অথচ ভান করতে লাগলে যেন ঘুমিয়ে আছ। আমি বললাম, জরী সত্যি করে বল তো তোমার কী হয়েছে?

কিছু হয় নি।

কোথাও বেড়াতে যাবে?

কোথায়?

কক্সবাজার যাবে? হোটেল ভাড়া করে থাকব।

উহুঁ, ভাল্লাগে না।

আরো অনেকদিন পর এক সন্ধ্যায় ঘন ঘোর হয়ে মেঘ করল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল ঝড়। দড়াম শব্দে একেকবার আছড়ে পড়ছে জানালার পাই। বাজ পড়ছে ঘনঘন। ঘরের লাগোয়া জামগাছে শোঁ-শোঁ শব্দ উঠছে। দুজনে বসে আছি চুপচাপ। তুমি হঠাৎ একসময় বললে, তোমাকে একটা কথা বলি, রাখবে?

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কী কথা?

আগে বল রাখবে?

নিশ্চয়ই রাখব।

তুমি তখন আমাকে তোমার আনিস স্যারের গল্প বললে। যিনি কলেজে তোমাদের অঙ্কের প্রফেসর ছিলেন। খামখেয়ালির জন্যে যার কলেজের চাকরিটি গেছে। এখন খুব খারাপ অবস্থায় আছেন। কোনোরকমে দিন চলে। তুমি আমাকে অনুরোধ করলে নীলগঞ্জে নতুন যে কলেজ হচ্ছে সেখানে তাঁকে একটি চাকরি জোগাড় করে দিতে।

তুমি উজ্জ্বল চোখে বললে, আনিস স্যার মানুষ নন। সত্যি বলছি ফেরেশতা। তুমি আলাপ করলেই বুঝবে।

আমি বললাম, নীলগঞ্জের কলেজের এখনো তো অনেক দেরি। মাত্র জমি নেয়া হয়েছে।

হোক দেরি। আনিস স্যার ততদিন থাকবে আমাদের এখানে। নিচের ঘর তো খালিই থাকে। একা মানুষ কোনো অসুবিধা হবে না।

একা মানুষ?

হুঁ। মেয়ে আর বউ দুজনের কেউই বেঁচে নেই। একদিনে দুজন মারা গেছে কলেরায়। আর মজা কী জানো? তার পরদিনই আনিস স্যার এসেছেন ক্লাস নিতে। প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন, আজ বাড়ি যান। ক্লাস নিতে হবে না। আনিস স্যার বললেন, বাড়িতে গিয়ে করবটা কী? কে আছে বাড়িতে?

আমি বললাম, চিঠি লিখলেই কি তোমাদের স্যার আসবেন এখানে?

হ্যাঁ, আসবেন। আমি লিখলেই আসবেন। লিখব স্যারকে?

বেশ, লেখ।

তুমি সঙ্গে-সঙ্গে চিঠি লিখতে উঠে গেলে। সে চিঠি শেষ হতে অনেক সময় লাগল। বসে-বসে দেখলাম অনেক কাটাকুটি করলে। অনেক কাগজ ছিড়ে ফেললে। এবং এক সময় চিঠি শেষ করে হাসিমুখে উঠে এলে। তোমাকে সে রাতে ভীষণ উৎফুল্ল লাগছিল।

আহ, লিখতে-লিখতে কেমন যেন লাগছে। এখন প্রায় মধ্যরাত্রি। তবু ইচ্ছে হচ্ছে রাস্তায় একটু হেঁটে বেড়াই। নিশি রাতে নির্জন রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে আমার বেশ লাগল। তুমি কি দস্তয়েভস্কির রূপালী রাত্রি পড়েছ? রূপালী রাত্রিতে আমার মতো একজন নিশি-পাওয়া লোকের গল্প আছে।

জরী, তোমাদের স্যার কবে যেন উঠলেন আমাদের বাড়িতে? দিন-তারিখ এখন আর মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে মাঝবয়েসী একজন ছোটখাটো মানুষ ভোরবেলা এসে খুব হইচই শুরু করেছিলেন। চেঁচিয়ে রাগী ভঙ্গিতে ডাকছিলেন—সুলতানা, সুলতানা। তুমি ধড়মড় করে জেগে উঠলে। ও আলু, কী কাণ্ড, স্যার এসে পড়েছেন—এই বলে খালি পায়েই ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে গেলে। আমি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম তুমি পা ছুঁয়ে সালাম করছ, আর তোমার স্যার বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। খানিক পরে দেখলাম তিনি খুব হাসছেন। সেই সঙ্গে লাজুক ভঙ্গিতে তুমিও হাসছ।

তুমি খুশি হয়েছিলে তো? নিশ্চয়ই হয়েছিলে। আমি স্টুডিওতে বসে তোমার গভীর আনন্দ অনুভব করতে পারছিলাম। একটি তীব্র ব্যথা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সেদিন আমার আত্মহত্যার কথা মনে হয়েছিল।

অথচ তোমার স্যার ঋষিতুল্য ব্যক্তি ছিলেন। এমন সহজ, এমন নির্লোভ লোক আমি খুব কমই দেখেছি। কোনোকিছুর জন্যেই কোনো মোহ নেই। এমন নির্লিপ্ততা কল্পনাও করা যায় না। জরী, তুমি ঠিক লোকের প্রেমেই পড়েছিলে। এমন মানুষকে ভালোবেসে দুঃখ পাওয়াতেও আনন্দ। তোমার স্যার ফেরেশতা ছিলেন কিন্তু জরী আমি তো ফেরেশতা নই। আমার হৃদয়ে ভালোবাসার সঙ্গে-সঙ্গে গ্লানি ও ঘৃণা আছে। আমি সত্যি একজন সাধারণ মানুষ।

সময় কাটতে লাগল। আমি শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। অনেকগুলি ছবি আঁকলাম সে সময়। তোমার পোট্রেটটিও সে সময় করা। পোট্রেটে সিটিং দেবার জন্যে ঘণ্টাখানিক বসতে হত তোমাকে। তুমি হাসিমুখে এসে বসতে কিন্তু অল্পক্ষণ পরই ছটফট করে উঠতে, এই রে, স্যারকে চা দেয়া হয় নি। একটু দেখে আসি। এক মিনিট, প্লিজ। আমি তুলি হাতে তোমার ফেরার প্রতীক্ষা করতাম। এক কাপ চা তৈরি করতে প্রচুর সময় লাগত তোমার।

মাঝে-মাঝে আসতেন তোমার স্যার। অর্ধ-সমাপ্ত ছবিগুলি দেখতেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এবং বলতেন, ছবি আমি ভালো বুঝি না। কিন্তু আপনি যে সত্যিই ভালো আঁকেন তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

তাঁর প্রশংসা আমার সহ্য হত না। আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম। তিনি বলতেন, আপনি আঁকুন। আমি দেখি কী করে ছবি আঁকা হয়।

আমি কারো সামনে ছবি আঁকতে পারি না।

তবু তোমার স্যার বসে থাকতেন। তীব্র ঘৃণায় আমি কতবার তাঁকে বলেছি, এখানে বসে আছেন কেন? বাইরে যান।

কোথায় যাব?

নদীর ধারে যান। জরীকে সঙ্গে নিয়ে যান। কাজের সময় বিরক্ত করছেন কেন আপনি?

 

অপমানে তোমার মুখ কালো হয়ে উঠত। থমথমে স্বরে বলতে, চলুন স্যার আমরা যাই।

ক্রমে ক্রমেই তুমি সরে পড়তে শুরু করলে। পরিবর্তনটা খুব ধীরে হচ্ছিল। সে জন্যেই ঠিক বলতে পারব না কখন থেকে তুমি আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করলে। ব্যক্তিগত হতাশা ও বঞ্চনা— এই দুই মিলিয়ে মানসিক দিক দিয়ে অনেক আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সে অসুখ ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। একনাগাড়ে জ্বর চলল দীর্ঘদিন। ঘুম হয় না, বুকের মধ্যে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করি। তীব্র যন্ত্রণা।

অসুখ বিসুখে মানুষ খুব অসহায় হয়ে পড়ে। সে সময় একটি সুখকর স্পর্শের জন্যে মন কাঁদে। কিন্তু তুমি আগের মতোই দূরে-দূরে রইলে। যেন ভয়ানক একটি ছোঁয়াচে রোগে আমি শয্যাশায়ী। ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে না চললে সমূহ বিপদ।

তোমার স্যার আসতেন প্রায়ই। আমি তাঁর চোখে গভীর মমতা টের পেতাম। তিনি আমার কপালে হাত রেখে নরম গলায় বলতেন, একটি গল্প পড়ে শুনাই আপনাকে আপনার ভালো লাগবে।

আমি রেগে গিয়ে বলতাম, একা থাকতেই আমার ভালো লাগবে। আপনি নিচে যান। কেন বিরক্ত করছেন?

এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আমি একটু বসি এখানে। কথা বলি আপনার সঙ্গে?

না, না অসহ্য। আপনি জরীর সঙ্গে কথা বলুন।

আমার অসুখ সারে না কিছুতেই। বাবার বন্ধু শশধর ডাক্তার রোজ দু-বেলা আসেন আর গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়েন। বারবার জিজ্ঞেস করেন, হাঁপানির টান উঠে নাকি বাবা? হাঁপানি তোমাদের বংশের অসুখ। তোমার দাদার ছিল, তোমার বাবারও ছিল। শ্বাস নিতে কোনো কষ্ট টের পাও?

একটু যেন পাই।

ডাক্তার চাচা একটি মালিশের শিশি দিলেন। শ্বাসের কষ্ট হলে অল্প-অল্প মালিশ করবে। সাবধান, মুখে যেন না যায়। তীব্র বিষ। ছোট্ট একটি শিশিতে ঘন কৃষ্ণবর্ণ তরল বিষ। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই শিশিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ডাক্তার চাচা চলে যেতেই তোমাকে ডেকে বললাম, জরী এই শিশিটিতে কী আছে জানো?

জানি না কী আছে?

তীব্র বিষ! সাবধানে তুলে রাখো।

তোমাকে কেন বললাম এ-কথা কে জানে। কিন্তু বলবার পর দারুণ আত্মপ্রসাদ হল। দেখলাম তুমি সরু চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলে আমার দিকে। কী ভাবছিলে?

অসুখ সারল না। ক্রমেই বাড়তে থাকল। চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়ল। জন্ডিসের রুগীর মতো গায়ের চামড়া হলুদ হয়ে গেল। দিনরাত শুয়ে থাকি। কত কী মনে হয়। কত সুখ-স্মৃতি, কত দুঃখ-জাগানিয়া বাথা। শ্লথ সময় কাটে। এক-এক রাতে ঘন ঘোর হয়ে বৃষ্টি নামে। ঝমঝম শব্দে গাছের পাতায় অপূর্ব সঙ্গীত ধ্বনিত হয়? শুয়ে-শুয়ে শুনি তুমি নিচের ঘরে বৃষ্টির সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান করছ। আহ্, কীসব দিন কেটেছে।

একটি প্রশস্ত ঘর। তার একপ্রান্তে প্রাচীন কালের প্রকাও একটি পালঙ্ক। সেখানে শয্যা পেতে রাতদিন খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা। কী বিশ্রী জীবন। ডাক্তার চাচা কতবার আমার মুখের উপর ঝুকে পড়ে বলেছেন, কেন তোমার অসুখ সারে না? বল, কেন?

আমি কী করে বলব?

যাও হাওয়া বদল করে আস। বউমাকে নিয়ে ঘুরে আস কক্সবাজার থেকে।

আচ্ছা যাব।

আচ্ছা নয়, কালই যাও! সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ এক্সপ্রেসে।

এত তাড়া কিসের?

তাড়া আছে। আমি বলছি বউমাকে সব ব্যবস্থা করতে।

ডাক্তার চাচা সেদিন অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে ডাকলেন, ও বউমা, বউমা।

তুমি তো প্রায় সময় থাকতে না, সেদিনও ছিলে না।

ডাক্তার চাচা অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন সেদিন।

শুধু কি তিনি? এ বাড়ির সবকটি লোক কৌতূহলী হয়ে দেখত আমাকে। আবুর মা গরম পানির বোতল আমার বিছানায় রাখতে রাখতে নেহায়েত যেন কথার কথা এমন ভঙ্গিতে বলত, বিবি সাহেব নদীর পাড়ে বেড়াইতে গেছেন।

আমি বলতাম না কিছুই। অসহ্য বোধ হলে বিষের শিশিটির দিকে তাকাতাম। যেন সেখানে প্রচুর সান্ত্বনা আছে।

জরী, আমাদের এ বংশে অনেক অভিশাপ আছে। আমার দাদা তার অবাধ্য প্রজাদের হাতে খুন হয়েছিলেন। আমার মার মৃত্যুও রহস্যময়। লোকে বলে তাকে নাকি বিষ খাইয়ে মারা হয়েছিল। আমার সারাক্ষণ মনে হত পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে হবে।

জরী, আমার জরী, আহ! কতদিন তোমাকে দেখি না। তোমার গোলগাল আদুরে মুখ কি এখনো আগের মতো আছে? না, তা কি আর থাকে? জীবন তো বহতা নদী। মাঝে মাঝে তোমার জন্যে খুব কষ্ট হয়। ইচ্ছে হয় আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে। ট্রেনে করে তুমি প্রথমবারের মতো নীলগঞ্জে আসছ সেখান থেকে। ঐ যে গৌরীপুরে ট্রেন থেমে থাকল অনেকক্ষণ। একজন অন্ধ ভিখিরি একতারা বাজিয়ে করুণ সুরে গাইল:

ও মনা
এই কথাটি না জানলে
প্রাণে বাঁচতাম না।
ও মন ও মনা।

তুমি ভিখিরিকে দুটি টাকা দিলে।

তোমার কথা মনে হলেই কষ্ট হয়। ভালোবাসার কষ্ট আমার চেয়ে বেশি কে আর জানবে বল? তোমার ব্যথা আমি সত্যি-সত্যি অনুভব করেছিলাম।

তোমার স্যার যেদিন নিতান্ত সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, সুলতানা, আমার স্যুটকেসটা গুছিয়ে দাও। আমি ভোরে যাচ্ছি। তখন তোমার চোখে জল টলমল করে উঠল। তোমার স্যার সেদিকে লক্ষ্যও করলেন না। সহজ ভঙ্গিতে এসে বসলেন আমার বিছানার পাশে। গাঢ়স্বরে বললেন, আপনি জরীকে নিয়ে সমুদ্রের তীরে কিছুদিন থাকুন। ভালো হয়ে যাবেন।

আমি বললাম, না-না আমি যাব না। সমুদ্র আমার ভালো লাগে না। আপনারা দুজনে যান। সমুদ্রতীরে সব সময় দুজন করে যেতে হয়। এর বেশিও নয়, এর কমও নয়।

তোমার স্যার তৃপ্তির হাসি হাসতে লাগলেন। তুমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলে। একটি কথাও বললে না। আমি দেখলাম, খুব শান্তভঙ্গিতে তুমি তোমার স্যারের স্যুটকেস গুছিয়ে দিলে। রাস্তায় খিদে পেলে খাবার জন্যে একগাদা কী-সব তৈরি করে দিলে। তিনি বিদায় নিলেন খুব সহজভাবেই। ঘর থেকে বেরিয়ে একবারও পিছনে ফিরে তাকালেন না। তুমি মূর্তির মতো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলে।

জরী, তুমি ভুল লোকটিকে বেছে নিয়েছিলে। এইসব লোকের কোনো পিছুটান থাকে না। নিজ স্ত্রী-কন্যার মৃত্যুর পরদিন যে ক্লাস নিতে আসে তাকে কি আর ভালোবাসার শিকলে বাঁধা যায়?

তোমার স্যার চলে যাবার দিন আমি তোমাকে তীব্র অপমান করলাম। বিশ্বাস কর, ইচ্ছে করে করি নি। তোমার স্যার যখন বললেন, আপনার কাছে একটি জিনিস চাইবার আছে।

আমি চমকে উঠে বললাম, কী জিনিস?

আপনার আঁকা একটি ছবি আমি নিতে চাই। হাতজোড় করে প্রার্থনা করছি।

নিশ্চয়ই। আপনার পছন্দমতো ছবি আপনি উঠিয়ে নিন। যে-কোনো ছবি। যেটা আপনার ভালো লাগে।

তিনি ব্যস্ত হয়ে আমার স্টুডিওর দিকে চলে গেলেন। আমি তোমার চোখে চোখ রেখে বললাম, স্যার কোন্ ছবিটি নেবেন জানো তুমি?

না।

স্যার নেবেন তোমার পোট্রেট।

তিনি কিন্তু নিলেন অন্য ছবি। জলরঙে আঁকা এসো নীপবনে। তাকিয়ে দেখি অপমানে তোমার মুখ নীল হয়ে গেছে। তীব্র ঘৃণা নিয়ে তুমি আমার দিকে তাকালে।

সেইসব পুরানো কথা তোমার কি মনে পড়ে? বয়স হলে সবাই তো নস্টালজিক হয়, তুমি হও নি? কুটিল সাপের মতো যে ঘৃণা তোমার বুকে কিলবিল করে উঠেছিল তার জন্যে তোমার কি কখনো কাঁদতে ইচ্ছা হয় না? তুমি কাঁদছ— এই ছবিটি বড় দেখতে ইচ্ছে করে। তোমার স্যার চলে যাবার পর তুমি কী করবে তা কিন্তু আমি জানতাম জরী। তোমার তো এ ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। মিছিমিছি তুমি সারাজীবন লজ্জিত হয়ে রইলে।

আমি তোমাকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে যেতে চেয়েছি। তুমি বলেছ, না। তোমাকে কিছুদিন তোমার বাবা-মার কাছে রেখে আসতে চেয়েছি। তুমি কঠিন স্বরে বলেছ, না। কতবার বলেছি, বাইরে থেকে ঘুরে এলে তোমার মন ভালো থাকবে। তুমি শান্তস্বরে বলেছ, আমার মন ভালোই আছে।

আমি জানতাম ঘৃণার দেয়ালে বন্দি হয়ে একজন মানুষ বেশিদিন থাকতে পারে। তোমার সামনে দুটি মাত্র পথ। এক মরে যাওয়া, আর দুই…। কিন্তু মরে যাওয়ার মতো সাহস তোমার ছিল না। কাজেই দ্বিতীয় পথ যা তুমি বেছে নেবে তার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। এও একধরনের খেলা। আমি জানতাম তুমি এবারও পরাজিত হবে। পরাজয়ের মধ্যেই আসবে জয়ের মালা। উৎকণ্ঠায় দিন কাটতে লাগল। কখন আসবে সেই মুহূর্তটি? সেই সময় আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারব তো?

সেই মুহূর্তটির কথা তোমার কি মনে পড়ে কখনো? ঘন হয়ে শীত পড়ছে। শরীর খানিক সুস্থ বোধ হওয়ায় আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছি।

সন্ধ্যা মিলাতেই ঘরে আলো দিয়ে গেল। তারও কিছু পর তুমি এলে চা নিয়ে। চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিতে গিয়ে চা ছলকে পড়ল মেঝেতে। বিড়বিড় করে তুমি কী যেন বললে। আমি তাকালাম টেবিলের দিকে। বিষের সেই শিশিটি নেই। তুমি অপলকে তাকিয়েছিলে আমার দিকে। আমি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলাম চায়ের পেয়ালার জন্যে। তুমি জ্ঞান হারিয়ে এলিয়ে পড়লে মেঝেতে। হেরে গেলে জরী।

তোমাকে এরপর খুব সহজেই জয় করা যেত। কিন্তু আমি তা চাই নি, সব ছেড়েছুড়ে চলে এলাম। অল্প কদিন আমরা বাঁচি। তবু এই সময়ে কত সুখ-দুঃখ আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। কত গ্লানি, কত আনন্দ আমাদের চারপাশে নেচে বেড়ায়। কত শূন্যতা বুকের ভেতরে হা হা করে।

জরী, এখন গভীর রাত্রি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পোর্টার এসে দরজায় নক করবে। বিমান কোম্পানির মিনিবাস এসে দাঁড়াবে দোরগোড়ায়। আবার যাত্রা শুরু।

আবার হয়তো কোনো এক পেইন্টিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে তোমার কথা মনে পড়বে। আবার এরকম লম্বা চিঠি লিখব। কিন্তু সে সব চিঠি কখনো পাঠাব না তোমাকে। যৌবনে হৃদয়ের যে উত্তাপ তোমাকে স্পর্শ করতে পারে নি, আজ কি আর তা পারবে? কেন আর মিছে চেষ্টা!

গোপন কথা

আজ আমার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।

আলো তখনো ভালো করে ফোটে নি। এখনো অন্ধকার গাঢ় হয়ে আছে। আকাশে ক্ষীণ আলো-আঁধারিতে মন অন্যরকম হয়ে যায়। পৃথিবীর সবাইকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।

আমি পৃথিবীর সবাইকে ভালোবেসে ফেল্লাম। আমার পাশের চৌকিতে বাকের সাহেব ঘুমিয়ে। অন্ধকারে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। তবু আমি নিশ্চিত জানি তিনি একটি কুৎসিত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছেন। মুখের লালায় তাঁর বালিশ ভিজে গেছে। লুঙি উঠে গেছে কোমরে। তাতে কিছু যায় আসে না। আজ আমার চোখে অসুন্দর কিছু পড়বে না, বাকের সাহেবকেও আমি ভালোবাসব।

বৎসরের অন্য দিনগুলি আজকের মতো হয় না কেন?—-ভাবতে-ভাবতে আমি সিগারেট ধরালাম। হিটার জ্বালিয়ে চায়ের কেতলি বসিয়ে দিলাম। সমস্ত ব্যাপারটা ঘটল নিঃশব্দে। তবু বাকের সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি জড়ানো গলায় বললেন, চা হচ্ছে নাকি?

হ্যাঁ।

আজ এত ভোরে উঠলেন যে, ব্যাপার কী? শরীর খারাপ নাকি?

জি না। চা খাবেন বাকের সাহেব?

দেন এক কাপ।

এই বলেই মাথা বের করে তিনি নাক ঝাড়লেন। নাক মুছলেন মশারিতে— কী কুৎসিত ছবি। আজ চমৎকার সব ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি প্রাণপণে ভাবতে চেষ্টা করলাম বাকের সাহেব নামে এ ঘরে কেউ থাকে না এবং এটা যেনতেন ঘরও নয়। এটাই হচ্ছে মহিমগড়ের রাজবাড়ি এবং আমি এসেছি মহিমগড়ের রাজকন্যার অতিথি হয়ে। আর আমিও কোনো হেজিপেজি লোক নই। আমি একজন কবি। আজ সন্ধ্যায় মহিমগড়ের রাজকন্যাকে আমি কবিতা শোনাব।

মঞ্জু সাহেব।

জি বলুন।

এরকম লাগছে কেন আপনাকে কিছু হয়েছে নাকি?

না, কী হবে?

দেখি, একটা সিগারেট দেন দেখি।

বাকের সাহেব তাঁর সাপের মতো কালো রোগী হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। একটা সিগারেট দিলাম। অথচ আমি নিশ্চিত জানি, বালিশের নিচে তাঁর নিজের সিগারেট আছে। বাকের সাহেব নিজের সিগারেট কমই খান। আহ, কী সব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ভাবছি। আজ আমি একজন অতিথি-কবি। আমার চিন্তাভাবনা হবে কবির মতো। আমি নরম স্বরে ডাকলাম, বাকের সাহেব।

জি।

আজ আমার কেন জানি বড় ভালো লাগছে।

ভালো লাগার কী হল আবার?

বার্কের সাহেব বড়ই অবাক হলেন। তার কাছে আজকের দিনটি অন্য সব দিনের মতোই। সাধারণ। ক্লান্তিকর। আমি মৃদুস্বরে ডাকলাম, বাকের সাহেব।

বলেন।

আজ আমার জন্মদিন।

তাই নাকি?

জি। এগারোই বৈশাখ।

আম-কাঁঠালের সিজনে জন্মেছেন রে ভাই।

এই বলেই বাকের সাহেব চায়ের কাপ নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। আজ আমি রাগ করব না। চমৎকার একটি সকালকে কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। সন্ধ্যাবেলা যাব নীলুদের বাড়ি। সন্ধ্যা হবার আগে পর্যন্ত শুধু ওর কথাই ভাবব।

বাকের সাহেব বাথরুম থেকে ফিরে এসে বললেন, পাইখানা কষা হয়ে গেছে ভাই।

আমি শুনেও না-শোনার ভান করলাম। আজ আমি অসুন্দর কিছুই শুনব না। আজ আমার জন্মদিন। আজ নীলুদের বাসায় যাব এবং তাকে গোপন কথাটি বলব।

ঝড় হোক। বৃষ্টি হোক। কিংবা প্রচণ্ড টর্নেডো হোক। কিছুই আসে যায় না। আজ সন্ধ্যায় আমি ঠিকই যাব নীলুদের বাসায়। নীলুর বাবা হয়তো বসে থাকবেন বারান্দায়। তিনি আজকাল বেশিরভাগ সময় বারান্দাতেই থাকেন। অপরিচিত কাউকে দেখলে কপালের চামড়ায় ভঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান। আমার দিকেও তাকাবেন। আমি হাসিমুখে বলব, নীলুফার কি বাসায় আছে? ওর সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল। আমি উত্তেজিত অবস্থায় ঠিকমতো কথা বলতে পারি না। কথা গলায় আটকে যায়। কিন্তু আজ আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আজ কথা বলব অভিনেতাদের মতো।

চা শেষ করেই বাকের সাহেব ঘুমুবার আয়েজন করলেন। গল টেনে বলেন, নটা পর্যন্ত ঘুমাব। তারপর উঠে নাশতা খেয়ে আবার ঘুম। ছুটির দিনের ঘুম কাকে বলে, দেখবেন। ম্যারাথন ঘুম। হা-হা-হা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এল। বারান্দায় এসে দেখি আলো ফুটছে। আকাশ হালকা নীল। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। গোপন কথা বলার জন্যে এরচে সুন্দর দিন অর হবে না।

সকাল এগারোটায় টেলিফোন করলাম। নীলুকে টেলিফোনে কখনো পাওয়া যায় না। আজ পাওয়া গেল। নীলু কিশোরীদের মতো গলায় বলল, কে কথা বলছেন?

আমি মঞ্জু।

ও, মঞ্জু ভাই। আপনি কেমন আছেন?

ভালো। তুমি কেমন আছ নীলু?

আমিও ভালো।

কী করছিলে?

পড়ছিলাম। আবার কী করব? আমার অনার্স ফাইনাল না?

ও তাই তো। আচ্ছা শোন নীলু, তুমি কি আজ সন্ধ্যায় বাসায় থাকবে?

থাকব না কেন?

আমি একটু আসব তোমাদের ওখানে।

বেশ আসুন।

একটা কথা বলব তোমাকে।

কী কথা।

গোপন কথা।

আপনার আবার গোপন কথা কী?

নীলু খিলখিল করে হাসতে লাগল। কী সুন্দর সুরেলী হাসি। কী অদ্ভুত লাগছে শুনতে।

হ্যালো নীলু।

বলুন শুনছি। আজ সন্ধ্যায় আসব।

বেশ তো আসুন। রাখলাম এখন। নাকি আরো কিছু বলবেন?

না, এখন আর কিছু বলব না।

নীলু রিসিভার নামিয়ে রাখার পরও আমি অনেকক্ষণ রিসিভার কানে লাগিয়ে রইলাম।

মাত্র এগারোটা বাজে। আরো আট ঘণ্টা কাটাতে হবে। কোথায় যাওয়া যায়? কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। নিউমার্কেটে কিছুক্ষণ হাঁটলাম একা একা। এবং একসময় দামি একটা শার্ট কিনে ফেললাম। অন্যদিন হলে শার্টের দাম আমার বুকে বিধে থাকত। আজ থাকল না। দামের কথা মনেই রইল না।

দশটি ফাইভ ফাইভ কিনলাম এ্যালিফেন্ট রোড থেকে। অন্তত আজকের দিনটিতে দামি সিগারেট খাওয়া যেতে পারে। নীলুর জন্য কিছু-একটা উপহার নিয়ে গেলে হয় না? কী নেয়া যায়? সুন্দর মলাটের একটা কবিতার বই। সেখানে খুব গুছিয়ে একটা কিছু লিখতে হবে যেমন, নীলুকে দেখা হবে চন্দনের বনে। বইটি দেয়া হবে ফিরে আসার সময়। নীলু নিশ্চয়ই আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসবে। তখন বলব, নীলু, আজ কিন্তু আমার জন্মদিন। নীলু বলবে, ওমা আগে বলবেন তো?

আগে বললে কী করতে?

কোনো উপহার টুপহার কিনে রাখতাম।

কী উপহার?

কবিতার বইটই।

আমি তো কবিতা পড়ি না।

না পড়লেও বই উপহার দেয়া যায়। ঠিক এই সময় আমি মোড়ক খুলে বইটি হাতে দিয়ে অল্প হাসব। হাসতে-হাসতেই বলব, আমি তোমার জন্য একটা কবিতার বই এনেছি নীলু।

সন্ধ্যাবেলা আকাশে খুব মেঘ করল। এবং একসময় শোঁ-শোঁ শব্দে বাতাস বইতে শুরু করল। নীলুদের বারান্দায় পা রাখামাত্র সত্যি-সত্যি ঝড় শুরু হল। কারেন্ট চলে গেল। সমস্ত অঞ্চল ডুবে গেল অন্ধকারে। নীলু আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এসেছেন? ভিজে গেছেন দেখি। আসুন, ভেতরে আসুন। কী যে কাণ্ড করেন? কাল এলেই হত।

বসার ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। একজন বুড়োমতো ভদ্রলোক বসে আছেন। তার পাশে বিলু। বিলু আমাকে দেখেই হাসিমুখে বলল, স্যার ভূতের গল্প বলছেন। উফ যা ভয়ের। তারপর স্যার বলুন।

নীলু বলল, দাঁড়ান স্যার আমি এসে নেই। চায়ের কথা বলে আসি।

নীলু চায়ের কথা বলে এল। একটা তোয়ালে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, মাথা মুছে ফেলুন। তারপর স্যারের গল্প শুনুন। প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স। বানানো গল্প না।

তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল নীলু।

দাঁড়ান গল্প শুনে নেই।

আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

তাই নাকি?

কৃষি ব্যাংকে একটা চাকরি হয়েছে। ফিফথ গ্রেড অফিসার।

বাহ্ বেশ তো। আসুন এখন গল্প শুনুন।

নীলু আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল–স্যার ইনি হচ্ছেন আমার বড়ভাইয়ের বন্ধু। যে ভাই ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে থাকেন তার।

নীলুর স্যার বললেন, বসুন। আমি বসলাম। ভদ্রলোক সঙ্গে-সঙ্গে গল্প শুরু করলেন : পথ-ঘাট অন্ধকার। শ্রাবণ মাস। আকাশে খুব মেঘ করেছে। আমি আর আমার বন্ধু তারাদাস পাশাপাশি যাচ্ছি। এমন সময় একটা শব্দ শুনলাম। যেন কেউ একজন ছুটতে-ছুটতে আসছে। তারাদাস বলল, কে? কে? তখন শব্দটা থেমে গেল।

ভদ্রলোক ভালোই গল্প করতে পারেন। নীলু-বিলু মুগ্ধ হয়ে শুনছে। নীলু একটা শাড়ি পরেছে। পরার ভঙ্গিটির মধ্যে কিছু একটা আছে। তাকে বিলুর চেয়েও কমবয়স্ক লাগছে। যেন সিক্স-সেভেনে পড়া বালিকা শখ করে শাড়ি জড়িয়েছে।

গল্প শেষ হতে অনেক সময় লাগল। নীলু উঠে গিয়ে চা নিয়ে এল। আমি বললাম, তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।

নীলু অবাক হয়ে বলল, একবার তো বলেছেন।

কী বললাম?

কৃষি ব্যাংকে চাকরি নিয়ে ময়মনসিংহ যাচ্ছেন।

এ কথা না। অন্য একটা কথা।

ঠিক আছে বলবেন। দাঁড়ান স্যারের কাছ থেকে আরেকটা গল্প শুনি। স্যার আরেকটা গল্প বলুন।

ভদ্রলোক গল্প বলার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছেন। সঙ্গে-সঙ্গে তার দ্বিতীয় গল্প শুরু করলেন। গল্প হতে-হতে অনেক রাত হয়ে গেল। বৃষ্টিও কিছুটা কমে এসেছে। নীলু ব্যস্ত হয়ে তাদের ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলল।

আমি স্যারের পাশে বসলাম। নীলু হালকা গলায় বলল, আবার আসবেন মঞ্জু ভাই।

গাড়ি চলতে শুরু করতেই বিলুর স্যার বললেন, আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন? আমি তার জবাব দিলাম না। ভূতে বিশ্বাস করি কি না করি তাতে কিছুই যায় আসে না। আমি পরশু দিন চলে যাব। অনেকদিন আর ঢাকায় আসা হবে না। আর এলেও গোপন কথা বলার ইচ্ছা হবে না হয়তো। বিলুর স্যার বললেন, পৃথিবীতে অনেক স্ট্রেঞ্জ ঘটনা ঘটে বুঝলেন মঞ্জু সাহেব, নাইনটিন সিক্সটিতে একবার কী হয়েছে শুনেন …।

আরেক দিন শুনব। আজ আমার মাথা ধরেছে।

 

আমাদের এদিকেও বাতি নেই। অন্ধকার ঘরে বাকের সাহেব শুয়ে আছেন। আমাকে ঢুকতে দেখেই ক্লান্ত স্বরে বললেন, শরীরটা খারাপ করেছে ভাই। বমি হয়েছে কয়েকবার। একটু সাবধানে আসেন, পরিষ্কার করা হয় নাই।

সব পরিষ্কার করে ঘুমুতে যেতে আমাদের অনেক রাত হল। বাইরে আবার মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাকের সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, ঘুমালেন নাকি ভাই?

জি না।

আপনার জন্মদিন উপলক্ষে এক প্যাকেট সিগারেট এনেছিলাম। গরিব মানুষ, কী আর দিব বলেন।

বাকের সাহেব অন্ধকারে এগিয়ে দিলেন সিগারেটের প্যাকেটটি। আমি নিচু স্বরে বললাম, একটা কথা শুনবেন?

কী কথা?

গোপন কথা। কাউকে বলতে পারবেন না।

বাকের সাহেব বিছানায় উঠে বসলেন। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আজ বোধহয় পৃথিবী ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। যে গোপন কথাটি বলা হয় নি সেটি আমি বলতে শুরু করলাম। আমার ভালোই লাগল।

চোখ (গল্প)

ভোর ছটায় কেউ কলিং বেল টিপতে থাকলে মেজাজ বিগড়ে যাবার কথা। মিসির আলির মেজাজ তেমন বিগড়াল না। সকাল দশটা পর্যন্ত কেন জানি তাঁর মেজাজ বেশ ভালো থাকে। দশটা থেকে খারাপ হতে থাকে, চূড়ান্ত রকমের খারাপ হয় দুটার দিকে। তারপর আবার ভালো হতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে অসম্ভব ভালো থাকে, তারপর আবার খারাপ হতে শুরু করে। ব্যাপারটা শুধু তাঁর বেলায় ঘটে, না সবার বেলায়ই ঘটে, তা তিনি জানেন না। প্রায়ই ভাবেন। একে-ওকে জিজ্ঞেস করবেন-শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না। তাঁর চরিত্রের বড় রকমের দুর্বল দিক হচ্ছে পরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারেন, কথা বলতে ভালোও লাগে। সেদিন রিকশা করে আসতেআসতে রিকশাওয়ালার সঙ্গে অতি উচ্চ শ্রেণীর কিছু কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন।

রিকশাওয়ালার বক্তব্য হচ্ছে—পৃথিবীতে যত অশান্তি সবের মূলে আছে মেয়েছেলে।

মিসির আলি বললেন, এই রকম মনে হওয়ার কারণ কি?

রিকশাওয়ালা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল, চাচামিয়া, এই দেহেন আমারে। আইজ আমি রিকশা চালাই। এর কারণ কি? এর কারণ বিবি হাওয়া। বিবি হাওয়া যদি কুবুদ্ধি দিয়া বাবা আদমরে গন্ধম ফল না খাওয়াইত, তা হইলে আইজ আমি থাকতাম বেহেশতে। বেহেশতে তো আর রিকশা চালানির কোনো বিষয় নাই, কি কন চাচামিয়া? গন্ধম ফল খাওয়ানির কারণেই তো আইজ আমি দুনিয়ায় আইসা পড়লাম!

মিসির আলি রিকশাওয়ালার কথাবার্তায় চমৎকৃত হলেন। পরবর্তী দশ মিনিট তিনি রিকশাওয়ালাকে যা বললেন, তার মূল কথা হল–নারীর কারণে আমরা যদি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে থাকি তাহলে নারীই পারে আবার আমাদের স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।

রিকশাওয়ালা কী বুঝল কে জানে। তার শেষ বক্তব্য ছিল, যাই কন চাচামিয়া, মেয়েমানুষ আসলে সুবিধার জিনিস না।

 

কলিং বেল আবার বাজছে।

মিসির আলি বেল টেপার ধরন থেকে অনুমান করতে চেষ্টা করলেন-কে হতে পারে।

ভিখিরি হবে না। ভিখিরিরা এত ভোরে বের হয় না। ভিক্ষাবৃত্তি যাদের পেশা তারা পরিশ্রান্ত হয়ে গভীর রাতে ঘুমুতে যায়, ঘুম ভাঙতে সেই কারণেই দেরি হয়। পরিচিত কেউ হবে না। পরিচিতরা এত ভোরে আসবে না। তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে পারে এমন ঘনিষ্ঠতা তাঁর কারো সঙ্গেই নেই।

যে এসেছে, সে অপরিচিত। অবশ্যই মহিলা। পুরুষরা কলিং বেলের বোতাম অনেকক্ষণ চেপে ধরে থাকে। মেয়েরা তা পারে না। মেয়েটির বয়স অল্প তাও অনুমান করা যাচ্ছে। অল্পবয়স্ক মেয়েদের মধ্যে এক ধরনের ছটফটে ভাব থাকে। তারা অল্পসময়ের মধ্যে কয়েক বার বেল টিপবে। নিজেদের অস্থিরতা ছড়িয়ে দেবে কলিং বেলে।

মিসির আলি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে দরজা খুললেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, তাঁর অনুমান সম্পূর্ণ ভূল প্রমাণ করে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। বেঁটেখাটো একজন মানুষ। গায়ে সাফারি। চোখে সানগ্লাস। এত ভোরে কেউ সানগ্লাস পরে না। এই লোকটি কোন পরেছে কে জানে!

স্যার, স্নামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

আপনার নাম কি মিসির আলি?

জ্বি।

আমি কি আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি?

মিসির আলি কী বলবেন মনস্থির করতে পারলেন না। লোকটিকে তিনি পছন্দ করছেন না, তবে তার মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস লক্ষ করছেন-যা তাঁর ভালো লাগছে। আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারটা আজকাল আর দেখাই যায় না।

লোকটি শান্ত গলায় বলল, আমি আপনার কিছুটা সময় নষ্ট করব ঠিকই।–তবে তার জন্যে আমি পে করব।

পে করবেন?

জ্বি। প্রতি ঘন্টায় আমি আপনাকে এক হাজার করে টাকা দেব। আশা করি আপনি আপত্তি করবেন না। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?

আসুন।

লোকটি ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে বলল, মনে হচ্ছে আপনার এখনো হাত-মুখ ধোয়া হয় নি। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, আমি অপেক্ষা করছি।

মিসির আলি বললেন, ঘন্টা হিসেবে আপনি যে আমাকে টাকা দেবেন—সেই হিসেবে কি এখন থেকে শুরু হবে? নাকি হাত-মুখ ধুয়ে আপনার সামনে বসার পর থেকে শুরু হবে?

লোকটি খানিকটা অপ্ৰস্তুত হয়ে বলল, টাকার কথায় আপনি কি রাগ করেছেন?

রাগ করি নি, মজা পেয়েছি। চা খাবেন?

খেতে পারি। দুধ ছাড়া।

মিসির আলি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, এক কাজ করুন।–রান্নাঘরে চলে যান। কেতলি বসিয়ে দিন। দু কাপ বানান। আমাকেও এক কাপ দেবেন।

ভদ্ৰলোক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, আমাকে ঘন্টা হিসেবে পে করবেন বলে যেভাবে হকচাকিয়ে দিয়েছিলেন, আমিও ঠিক একইভাবে আপনাকে হকচাকিয়ে দিলাম। বসুন, চা বানাতে হবে না। সাতটার সময় রাস্তার ওপাশের রেস্টুরেন্ট থেকে আমার জন্যে চা-নাশতা আসে। তখন আপনার জন্যেও চা আনিয়ে দেব।

থ্যাংক ইউ স্যার।

আপনি কথা বলার সময় বারবার বা দিকে ঘুরছেন, আমার মনে হচ্ছে আপনার বী চোখটা নষ্ট। এই জন্যেই কি কালো চশমা পরে আছেন?

ভদ্রলোক সহজ গলায় বললেন, জ্বি। আমার বা চোখটা পাথরের।

ভদ্রলোক সোফার এক কোণে বসলেন। মিসির আলি লক্ষ করলেন, লোকটি শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছে। চাকরির ইন্টারভ্যু দিতে এলে ক্যান্ডিডেটরা যে-ভঙ্গিতে চেয়াতে বসে অবিকল সেই ভঙ্গি। মিসির আলি বললেন, আজকের খবরের কাগজ এখনো আসে নি। গত দিনের কাগজ দিতে পুরি? যদি আপনি চোখ বোলাতে চান।

আমি খবরের কাগজ পড়ি না। এক-একা বসে থেকে আমার অভ্যাস আছে। আমার জন্যে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। শুরুতে টাকা দেওয়ার কথা বলে যদি আপনাকে আহত করে থাকি, তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

মিসির আলি টুথব্রাশ হাতে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। লোকটিকে তাঁর বেশ ইস্টারেষ্টিং বলে মনে হচ্ছে। তবে কোনো গুরুতর সমস্যা নিয়ে এসেছে বলে মনে হয়। না। আজকাল অকারণেই কিছু লোকজন এসে তাঁকে বিরক্ত করা শুরু করেছে। মাসখানেক আগে একজন এসেছিল ভূতবিশারদ। সে নাকি গবেষণাধর্মী একটি বই লিখছে—যার নাম বাংলার ভুত। এ-দেশে যত ধরনের ভূত-পেত্নী আছে সবুর নাম, আচার-ব্যবহার বইয়ে লেখা। মেছো ভূত, গেছে ভূত, জলা ভূত, শাকচুন্নি, স্কন্ধকাটা, কুনী ভূত, কুত্তি ভূত, আঁধি ভূত সর্বমোট এক শ ছ রকমের ভূত।

মিসির আলি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ভাই, আমার কাছে কেন? আমি সারা জীবন ভূত নেই এটাই প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি।

সেই লোক মহা উৎসাহী হয়ে বলল, কোন কোন ভূত নেই বলে প্রমাণ করেছেন—এটা কাইন্ডলি বলুন। আমার কাছে ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। আমি টেপ করে নেব।

সানগ্লাস-পরা বেঁটে ভদ্রলোক সেই পদের কেউ কি না কে বলবে?

তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে-মুছতে মিসির আলি বললেন, ভাই, বলুন কী ব্যাপার।

প্রথমেই আমার নাম বলি-এখনো আমি আপনাকে আমার নাম বলি নি। আমার নাম রাশেদুল করিম। আমেরিকার টেক্সাস এম অ্যান্ড এন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের আমি একজন অধ্যাপক। বর্তমানে এক বছরের স্যাঘাটিক্যাল লীভে দেশে এসেছি। আপনার খোঁজ কীভাবে এবং কার কাছে পেয়েছি তা কি বলব?

তার দরকার নেই। কী জন্যে আমার খোঁজ করছেন সেটা বলুন।

আমি কি ধূমপান করতে পারি? সিগারেট খেতে-খেতে কথা বললে আমার জন্যে সুবিধা হবে। সিগারেটের ধোঁয়া এক ধরনের আড়াল সৃষ্টি করে।

আপনি সিগারেট খেতে পারেন, কোনো অসুবিধা নেই।

ছাই কোথায় ফেলব? আমি কোনো অ্যাশটে দেখতে পাচ্ছি না।

মেঝেতে ফেলুন। আমার গোটা বাড়িটাই একটা অ্যাশট্রে।

রাশেদুল করিম সিগারেট ধরিয়েই কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর গলার স্বর ভারি এবং স্পষ্ট। কথাবার্তা খুব গোছানো। কথা শুনে মনে হয় তিনি কী বলবেন তা আগেভাগেই জানেন। কোন বাক্যটির পর কোন বাক্য বলবেন তাও ঠিক করা। যেন ক্লাসের বক্তৃতা। আগে থেকে ঠিকঠাক করা। প্রবাসী বাঙালিরা এক-নাগাড়ে বাংলায় কথা বলতে পারেন না–ইনি তা পরছেন।

 

আমার বয়স এই নভেম্বরে পঞ্চাশ হবে। সম্ভবত আমাকে দেখে তা বুঝতে পারছেন না। আমার মাথার চুল সব সাদা। কলপ ব্যবহার করছি গত চার বছর থেকে। আমার স্বাস্থ্য ভালো। নিয়মিত ব্যায়াম করি। মুখের চামড়ায় এখনো তাঁজ পড়ে নি। বয়সজনিত অসুখবিসুখ কোনোটাই আমার নেই। আমার ধারণা, শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে আমার কর্মক্ষমতা এখনো একজন পয়ত্রিশ বছরের যুবকের মতো। এই কথাটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। আজ আমার গায়ে-হলুদ। মেয়েপক্ষীয়রা সকাল নটায় আসবে। আমি ঠিক আটটায় এখান থেকে যাব। আটটা পর্যন্ত সময় কি আমাকে দেবেন?

দেব। ভালো কথা, এটা নিশ্চয়ই আপনার প্রথম বিবাহ না। এর আগেও আপনি বিয়ে করেছেন?

জ্বি। এর আগে এক বার বিয়ে করেছি। এটি আমার দ্বিতীয় বিবাহ। আমি আগেও বিয়ে করেছি, তা কী করে বললেন?

আজ আপনার গায়ে-হলুদ, তা খুব সহজভাবে বললেন দেখে অনুমান করলাম। বিয়ের তীব্ৰ উত্তেজনা আপনার মধ্যে দেখতে পাই নি।

সব মানুষ তো এক রকম নয়! একেক জন একেক রকম। উত্তেজনার ব্যাপারটি আমার মধ্যে একেবারেই নেই। প্রথম বার যখন বিয়ে করি, তখনো আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র উত্তেজনা ছিল না। সেদিনও আমি যথারীতি ক্লাসে গিয়েছি। গ্রুপ থিওরির ওপর এক ঘন্টার লেকচার দিয়েছি।

ঠিক আছে, আপনি বলে যান। রাশেদুল করিম শান্ত গলায় বললেন, আপনার ভেতর একটা প্রবণতা লক্ষ করছি—আমাকে আর দশটা মানুষের দলে ফেলে বিচার করার চেষ্টা করছেন। দয়া করে তা করবেন না। আমি আর দশ জনের মতো নাই।

আপনি শুরু করুন!

অঙ্কশাস্ত্রে এম.এ. ডিগ্ৰী নিয়ে আমি আমেরিক যাই পিএইচ. ডি. করতে। এম.এ.- তে আমার রেজাল্ট ভালো ছিল না। টেনেটুনে সেকেণ্ড ক্লাস। প্রাইভেট কলেজে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখন বন্ধুদের দেখাদেখি জি.আর.ই. পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম। জি.আর.ই. পরীক্ষা কী, তা কি আপনি জানেন? গ্যাজুয়েট রেকর্ড একজামিনেশন। আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েট ক্লাসে ভরতি হতে হলে এই পরীক্ষা দিতে হয়।

আমি জানি।

এই পরীক্ষায় আমি আশাতীত ভালো করে ফেললাম। আমেরিকান তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার কাছে আমন্ত্রণ চলে এল। চলে গেলাম। পিএইচ ডি করলাম প্রফেসর হোবলের সঙ্গে। আমার পিএইচ. ডি. ছিল গ্রুপ থিওরির একটি শাখায়-নন এবেলিয়ান ফাংশানের ওপর। পিএইচ. ডি.-র কাজ এতই ভালো হল যে আমি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলাম। অঙ্ক নিয়ে বর্তমানকালে যাঁরা নাড়াচাড়া করেন, তাঁরা সবাই আমার নাম জানেন! অঙ্কশাস্ত্রের একটি ফাংশান আছে, যা আমার নামে পরিচিত। আর.কে. এক্সপোনেনশিয়াল। আর.কে. হচ্ছে রাশেদুল করিম।

পিএইচ. ডি.-র পরপরই আমি মন্টানা ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার কাজ পেয়ে গেলাম। সেই বছরই বিয়ে করলাম। মেয়েটি মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টসের ছাত্রী-স্প্যানিশ আমেরিকান। নাম জুডি বার্নার।

প্রেমের বিয়ে?

প্রেমের বিয়ে বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। বাছাবাছির বিয়ে বলতে পারেন। জুডি অনেক বাছাবাছির পর আমাকে পছন্দ করল।

আপনাকে পছন্দ করার কারণ কী?

আমি ঠিক অপছন্দ করার মতো মানুষ সেই সময় ছিলাম না। আমার একটি চোখ পাথরের ছিল না। চেহারা তেমন ভালো না হলেও দুটি সুন্দর চোখ ছিল। আমার মা বলতেন-রাশেদের চোখে জন্মকাজল পরানো। সুন্দর চোখের ব্যাপারটা অবশ্য ধর্তব্য নয়। আমেরিকান তরুণীরা প্রেমিকদের সুন্দুর চোখ নিয়ে মাথা ঘামায় না।–তারা দেখে প্রেমিক কী পরিমাণ টাকা করেছে এবং ভবিষ্যতে কী পরিমাণ টাকা সে করতে পারবে। সেই দিক দিয়ে আমি মোটামুটি আদর্শ– স্থানীয় বলা চলে। ত্রিশ বছর বয়সে একটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকান্টি পজিশন পেয়ে গেছি! ট্যানিউর পেতেও কোনো সমস্যা হবে না। জুডি স্বামী হিসেবে আমাকে নির্বাচন করল। আমার দিক থেকে আপত্তির কোনো কারণ ছিল না। জুডি চমৎকার একটি মেয়ে। শত বৎসর সাধনার ধন হয়তো নয়, তবে বিনা সাধনায় পাওয়ার মতো মেয়েও নয়।

বিয়ের সাত দিনের মাথায় আমরা হানিমুন করতে চলে গেলাম সানফ্রান্সিসকো। উঠলাম হোটেল বেডফোর্ডে। দ্বিতীয় রাত্রির ঘটনা। ঘুমুচ্ছিলাম। কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি জুডি পাশে নেই, ঘড়িতে রাত তিনটা দশ বাজছে। বাথরুমের দরজা বন্ধ। সেখান থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। আমি বিস্মিত হয়ে উঠে গেলাম। দরজা ধাক্কা দিয়ে বললাম, কী হয়েছে জুডি, কী হয়েছে? কান্না থেমে গেল। তবে জুডি কোনো জবাব দিল না।

অনেক ধাক্কাধাব্ধির পর সে দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, কী হয়েছে?

সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ভয় পেয়েছি।

কিসের ভয়?

জানি না কিসের ভয়।

ভয় পেয়েছ তো আমাকে ডেকে তোল নি কেন? বাথরুমে দরজা বন্ধ করে ছিলে কেন?

জুড়ি জবাব দিল না। একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, ব্যাপারটা কি আমাকে খুলে বল তো?

সকালে বলব।।না, এখুনি বল। কী দেখে ভয় পেয়েছ?

জুডি অস্পষ্ট স্বরে বলল, তোমাকে দেখে।

আমাকে দেখে ভয় পেয়েছ মানে? আমি কী করেছি?

জুডি যা বলল তা হচ্ছে–রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। হোটেলের ঘরে নাইট লাইট জ্বলছিল, ওই আলোয় সে দেখে, তার পাশে যে শুয়ে আছে সে কোনো জীবন্ত মানুষ নয়, মৃত মানুষ–যে-মৃত মানুষের গা থেকে শবদেহের গন্ধ বেরুচ্ছে। সে তয়ে কাঁপতে থাকে, তবু সাহসে হাত বাড়িয়ে মানুষটাকে স্পর্শ করে। স্পর্শ করেই চমকে ওঠে, কারণ মানুষটার শরীর বরফের মতোই শীতল। সে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যায় যে আমি মারা গেছি। তার জন্যে এটা বড় ধরনের শক হলেও সে যথেষ্ট সাহস দেখায়-টেবিল-ল্যাম্প জ্বেলে দেয় এবং হোটেল ম্যানেজারকে টেলিফোন করবার জন্যে টেলিফোন সেট হাতে তুলে নেয়। ঠিক তখন সে লক্ষ করে, মৃতদেহের দুটি বন্ধ চোখের একটি ধীরে-বীরে খুলছে। সেই একটিমাত্র খোলা চোখ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জুডি টেলিফোন ফেলে দিয়ে ছুটে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। এই হল ঘটনা।

রাশেদুল করিম কথা শেষ করে সিগারেট ধরলেন। হাতের ঘড়ি দেখলেন। মিসির আলি বললেন, থামলেন কেন?

সাতটা বেজেছে। আপনি বলেছেন, সাতটার সময় আপনার জন্যে চা আসে। আমি চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। চা খেয়ে শুরু করব। আমার গল্প শুনতে আপনার কেমন লাগছে?

ইন্টারেষ্টিং। এই গল্প কি আপনি অনেকের সঙ্গে করেছেন? আপনার গল্প বলার ধরন থেকে মনে হচ্ছে অনেকের সঙ্গেই এই গল্প করেছেন।

আপনার অনুমান সঠিক। ছ থেকে সাত জনকে আমি বলেছি। এর মধ্যে সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। পুলিশের লোক আছে।

পুলিশের লোক কেন?

গল্প শেষ করলেই বুঝতে পারবেন পুলিশের লোক কী জন্যে।

চা চলে এল! চায়ের সঙ্গে পরোটা-ভাজি। মিসির আলি নাশতা করলেন। রাশেদুল করিম সাহেব পরপর দু কাপ চা খেলেন।

আমি কি শুরু করব?

জ্বি, শুরু করুন।

আমাদের হানিমুন মাত্র তিন দিন স্থায়ী হল। জুডিকে নিয়ে পুরনো জায়গায় চলে এলাম। মনটা খুবই খারাপ। জুডির কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। রোজ রাতে সে ভয়ংকর চিৎকার করে ওঠে। ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আমি যখন জেগে উঠে তাকে সন্তুনা দিতে যাই, তখন এমনভাবে তাকায়, যেন আমি একটা পিশাচ কিংবা মূর্তিমান শয়তান। আমার দুঃখের কোনো সীমা রইল না। সেই সময় নন এবেলিয়ান গ্রুপের ওপর একটা জটিল এবং গুরুত্বপূৰ্ণ কাজ করছিলাম। আমার দরকার ঠাণ্ডামাথায় চিন্তা করার মতো পরিবেশ, মানসিক শান্তি। সব দূর হয়ে গেল। অবশ্য দিনের বেলায় জুডি স্বাভাবিক। সে বদলাতে শুরু করে সূর্য ডোবার পর থেকে। আমি তাকে একজন সাইকিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম।

সাইকিয়াটিস্ট প্রথমে সন্দেহ করলেন সমস্যা ড্রাগঘটিত। হয়তো জুডি ড্রাগে অভ্যস্ত! সেই সময় বাজারে হেলুসিনেটিং ড্রাগ এল.এস.ডি. প্রথম এসেছে। শিল্পসাহিত্যের লোকজন শখ করে এই ড্রাগ খাচ্ছেন। বড়গলায় বলছেন–মাইন্ড অলটারিং ট্রিপ নিয়ে এসেছি। জুডি ফাইন আর্টস-এর ছাত্রী। ট্রিপ নেওয়া তার পক্ষে খুব অস্বাভাবিক নয়।

দেখা গেল, ড্রাগঘটিত কোনো সমস্যা তার নেই। সে কখনো ড্রাগ নেয় নি। সাইকিয়াট্রিস্টরা তার শৈশবের জীবনে কোনো সমস্যা ছিল কি না তাও বের করতে চেষ্টা করলেন। লাভ হল না। জুডি এসেছে গ্রামের পরিবার থেকে। এ-ধরনের পরিবারে তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। তাদের সহজ এবং স্বাভাবিক।

সাইকিয়াটিস্ট জুডিকে ঘুমের অষুধ দিলেন। কড়া ডোজের ফেনোবাৰ্বিটন! আমাকে বললেন, আপনি সম্ভবত লেখাপড়া নিয়ে থাকেন। স্ত্রীর প্রতি, বিশেষ করে নববিবাহিত স্ত্রীর প্রতি যতটা সময় দেওয়া দরকার তা দিচ্ছেন না। আপনার প্রতি আপনার স্ত্রীর একধরনের ক্ষোভ জন্মেছে। সে যা বলছে, তা ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।

 

জুডির কথা একটাই-আমি ঘুমুবার পর আমার দেহে প্ৰাণ থাকে না। একজন মৃত মানুষের শরীর যেমন অসাড় পড়ে থাকে, আমার শরীরও সে-রকম পড়ে থাকে। ঘুমের মধ্যে মানুষ হাত নাড়ে, পা নাড়ে- আমি তার কিছুই করি না। নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফুেলি না। গা হয়ে যায় বরফের মতো শীতল। একসময় গা থেকে মৃত মানুষের শরীরের পচা গন্ধ বেরুতে থাকে এবং তখন আচমকা আমার বা চোখ খুলে যায়, সেই চোখে আমি একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই চোখের দৃষ্টি সাপের মতো কুটিল।

জুডির কথা শুনে—শুনে আমার ধারণা হল, হতেও তো পারে। জগতে কত রহস্যময় ব্যাপারই তো ঘটে। হয়তো আমার নিজেরই কোনো সমস্যা আছে। আমিও ডাক্তারের কাছে গেলাম। ক্লিপ অ্যানলিস্ট। জানার উদ্দেশ্য একটিই-ঘূমের মধ্যে আমার কোনো শারীরিক পরিবর্তন হয় কি না! ডাক্তাররা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করলেন। একবার নয়, বারবার করলেন। দেখা গেল আমার ঘুম আর দশটা মানুষের ঘুমের চেয়ে আলাদা নয়। ঘুমের মধ্যে আমিও হাত-পা নাড়ি। অন্য মানুষদের যেমন ঘুমের তিনটি স্তর পার হতে হয়, আমারও হয়। ঘুমের সময় আর দশটা মানুষের মতো আমার শরীরের উত্তাপও আধ ডিগ্ৰী হ্রাস পায়। আমিও অন্য সবার মতো স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন দেখি! জুডি সব দেখেশুনে বলল, ডাক্তাররা জানে না। ডাক্তাররা কিছুই জানে না। আমি জানি। তুমি আসলে মানুষ না দিনের বেলা তুমি মানুষ থাক—সূৰ্য ডোবার পর থাক না।

আমি কী হই?

তুমি পিশাচ বা এই জাতীয় কিছু হয়ে যাও।

আমি বললাম, এইভাবে তো বাস করা সম্ভব নয়। তুমি বরং আলাদা থাক। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার-জুডি তাতে রাজি হল না। অতি তুচ্ছ কারণে আমেরিকানদের বিয়ে ভাঙে। স্বামীর পছন্দ হলুদ রঙের বিছানার চাদর স্ত্রীর পছন্দ নীল রঙ। ভেঙে গেল বিয়ে। আমাদের এত বড় সমস্যা, কিন্তু বিয়ে ভাঙল না। আমি বেশ কয়েক বার তাকে বললাম, জুডি, তুমি আলাদা হয়ে যাও! ভালো দেখে একটা ছেলেকে বিয়ে করা। সারা জীবন তোমার সামনে পড়ে আছে। তুমি এইভাবে জীবনটা নষ্ট করতে পার না।

জুডি প্রতিবারই বলে, যাই হোক, যত সমস্যাই হোক, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না, I love you. I love you.

……আমি গল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শেষ অংশটি বলার অ্যাগে আমি আপনাকে আমার চোখের দিকে তাকাতে অনুরোধ করব। দয়া করে আমার চোখের দিকে তাকান।

রাশেদুল করিম সানগ্লাস খুলে ফেললেন। মিসির আলি তৎক্ষণাৎ বললেন, আপনার চোখ সুন্দর। সত্যি সুন্দর। আপনার মা যে বলতেন চোখে জন্মকাজল, ঠিকই বলতেন।

রাশেদুল করিম বললেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ কার ছিল জানেন?

ক্লিওপেট্রার?

অধিকাংশ মানুষের তাই ধারণা। এ-ধারণা সত্যি নয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ ছিল বুদ্ধদেবের পুত্ৰ কুনালের। ইংরেজ কবি শেলির চোখও খুব সুন্দর ছিল। আমার স্ত্রীর ধারণা, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে চোখ আমার। জুডি বলত—এই চোখের কারণেই সে কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।

রাশেদুল করিম সানগ্লাস চোখে দিয়ে বললেন, গল্পের শেষ অংশ বলার আগে আপনাকে ক্ষুদ্র ধন্যবাদ দিতে চাচ্ছি।

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী জন্যে বলুন তো? কাউকে যখন আমি আমার চোখের দিকে তাকাতে বলি, সে আমার পাথরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনি প্রথম ব্যক্তি-যিনি একবারও আমার পাথরের চোখের দিকে তাকান নি। আমার আসল চোখের দিকে তাকিয়ে-ছিলেন। Sonice of you, Sir.

রাশেদুল করিমের গলা মুহূর্তের জন্যে হলেও ভারি হয়ে গেল। তিনি অবশ্যি চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, আটটা প্ৰায় বাজতে চলল, গল্পের শেষটা। বলি-জুডার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগল। কড়া ডোজের ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমুতে যায়, দু-এক ঘন্টা ঘুম হয়, বাকি রাত জেগে বসে থাকে। মাঝে-মাঝে চিৎকার করে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে।…..

এমনি একরাতের ঘটনা। জুলাই মাস। রাত সাড়ে তিনটার মতো হবে। জুডির মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল-সে আমার বা চোখটা গেলে দিল।…

আমি ঘুমুচ্ছিলাম, নারকীয় যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। সেই ভয়াবহ কষ্টের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।

রাশেদুল করিম চুপ করলেন। তাঁর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।

মিসির আলি বললেন, কী দিয়ে চোখ গেলে দিলেন?

সুঁচালো পেনসিল দিয়ে। আমার মাথার বালিশের নিচে প্যাড এবং পেনসিল থাকে। তখন গ্রুপ থিওরি নিয়ে গভীর চিন্তায় ছিলাম। মাথায় যদি হঠাৎ কিছু আসে তা লিখে ফেলার জন্যে বালিশের নিচে প্যাড় এবং পেনসিল রাখতাম।

আপনার স্ত্রী ঘটনা প্রসঙ্গে কী বক্তব্য দিয়েছেন?

তার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে কিছুই বলে নি। শুধু চিৎকার করেছে। তার একটিই বক্তব্য-এই লোকটা পিশাচ। আমি প্রমাণ পেয়েছি। কেউ বিশ্বাস করবে: না। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ আছে।

কী প্রমাণ আছে তা কি কখনো জিজ্ঞেস করা হয়েছে?

না। একজন উন্মাদকে প্রশ্ন করে বিপর্যস্ত করার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া আমি তখন ছিলাম হাসপাতালে। আমি হাসপাতালে থাকতে—থাকতেই জুডির মৃত্যু হয়।

স্বাভাবিক মৃত্যু?

না। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সে মারা যায় ঘুমের অষুধ খেয়ে। এইটুকুই আমার গল্প। আমি আপনার কাছে একটাই অনুরোধ নিয়ে এসেছি, আপনি সমস্যাটা কী, বের করবেন। আমাকে সাহায্য করবেন। আমি যদি পিশাচ হই, তাও আমাকে বলবেন। এই ফাইলের ভেতর জুডির একটা স্কেচবুক আছে। স্কেচবুকে নানান ধরনের কমেন্টস লেখা আছে। এই কমেন্টসগুলি পড়লে জুডির মানসিক অবস্থা আঁচ করতে আপনার সুবিধা হতে পারে! আটটা বাজে, আমি তাহলে উঠি?

আবার কবে আসবেন?

আগামীকাল ভোর ছটায়। ভালো কথা, আমার এই গল্পে কোথাও কি প্ৰকাশ পেয়েছে, জুডিকে আমি কতটা ভালবাসতাম?

না, প্ৰকাশ পায় নি।

জুডির প্রতি আমার ভালবাসা ছিল সীমাহীন।

আমি এখন উঠছি।।

ছিল বলছেন কেন? এখন কি নেই?

ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। রাশেদুল করিম চলে যাবার পর মিসির আলি ফাইল খুললেন। ফাইলের শুরুতেই একটা খাম। খামের ওপর মিসির আলির নাম লেখা।

মিসির আলি খাম খুললেন। খামের ভেতর ইংরেজিতে একটা চিঠি লেখা। সঙ্গে চারটি এক শ ডলারের নোট। চিঠি খুবই সংক্ষিপ্ত।

প্রিয় মহোদয়, আপনার সার্ভিসের জন্যে সন্মানী বাবদ সামান্য কিছু দেওয়া হল। গ্ৰহণ করলে

খুশি হব।

বিনীত
আর, করিম।

 

০২.

মিসির আলি স্কেচবুকের প্রতিটি পাতা সাবধানে ওন্টালেন। চারকেল এবং পেনসিলে স্কেচ আঁকা। প্রতিটি স্কেচের নিচে আঁকার তারিখ। স্কেচের বিষয়বস্তু অতি তুচ্ছ, সবই ঘরোয়া জিনিস-এক জোড়া জুতো, মলাট-ছোড়া বই, টিভি, বুকশেলফ। স্কেচ বুকের শেষের দিকে শুধুই চোখের ছবি। বিড়ালের চোখ, কুকুরের চোখ, মাছের চোখ এবং মানুষের চোখ। মানুষের চোখের মডেল যে রাশেদুল করিম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। না বললেও ছবির নিচের মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে মন্তব্যগুলি বেশ দীর্ঘ। যেমন একটি মন্তব্য :

আমি খুব মন দিয়ে আমার স্বামীর চোখ লক্ষ করছি। মানুষের চোখ একেক সময় একেক রকম থাকে। ভোরবেলার চোখ এবং দুপুরের চোখ এক নয়। আরো একটি জিনিস লক্ষ করলাম-চোখের আইরিশের ট্রান্সপারেন্সি মুডেরু ওপর বদলায়। বিষাদগ্ৰস্ত মানুষের চোখের আইরিশ থাকে অস্বচ্ছ মানুষ যতই আনন্দিত হতে থাকে তার চোখের আইরিশ ততই স্বচ্ছ হতে থাকে। আমার এই অবজারভেশন কতটুকু সত্য তা বুঝতে পারছি না।

মেয়েটি মাঝে-মাঝে তার মনের অবস্থাও লিখেছে–অনেকটা ডায়েরি লেখার ভঙ্গিতে। মনে হয়। হাতের কাছে ডায়েরি না-থাকায় স্কেচবুকে লিখে রেখেছে। সব লেখাই পেনসিলে। প্রচুর কাটাকুটি আছে। কিছু লাইন রাবার ঘষে তুলেও ফেলা হয়েছে।

১৮.৫.৮২

আমি ভয়ে অস্থির হয়ে আছি। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি—এই ভয় অমূলক। বোঝাতে পারছি না। আমি আমার স্বামীকে ভয় পাচ্ছি, এই তথ্য স্বভাবতই স্বামী বেচারার জন্যে সুখকর নয়। সেনানানভাবে আমাকে সত্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। কিছুকিছু চেষ্টা বেশ হাস্যকর। আজ আমাকে বলল, জুড়ি, আমি ঠিক করেছি-এখন থেকে রাতে ঘুমুব না। আমার অঙ্কের সমস্যা নিয়ে ভািবব। লেখালেখি করব। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাও। আমি দিনের বেলায় ঘুমুব। একজন মানুষের জন্যে চার ঘন্টা ঘূমই যথেষ্ট। নেপোলিয়ান মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমুতেন।

আমি এই গম্ভীর, স্বল্পভাষী লোকটিকে ভালবাসি। ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। আমি চাই না, আমার কোনো কারণে সে কষ্ট পাক। কিন্তু সে কষ্ট পাচ্ছে, খুব কষ্ট পাচ্ছে। হে ঈশ্বর, তুমি আমার মন শান্ত কর। আমার ভয় দূর করে দাও।

২১.৮.৮২
যে-জিনিস খুব সুন্দর তা কত দ্রুত অসুন্দর হতে পারে—বিস্মিত হয়ে আমি তা-ই দেখছি। রাশেদের ধারণা আমি অসুস্থ। কি অসুস্থ? আমার মনে হয় না। কারণ, এখনো ছবি আঁকতে পারছি। একজন অসুস্থ মানুষ আর যা-ই পারুক-ছবি আঁকতে পারে না। গত দু দিন ধরে ওয়াটার কালারে বাসার সামনের চেরি গাছের ফুল ধরতে চেষ্টা করছিলাম। আজ সেই ফুল কাগজে বন্দি করেছি। অনেকক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম! ভালো হয়েছে। রাশেদ ছবি তেমন বোঝে বলে মনে হয় না-সেও মুগ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দেখল। তারপর বলল, আমি যখন বুড়ো হয়ে যাব, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেব, তখন তুমি আমাকে ছবি আঁকা শিখিয়ে দেবে! এই কথাটি সে আজ প্রথম বলে নি, আগেও বলেছে। আন্তরিক ভঙ্গিতে বলেছে। কেউ যখন আন্তরিকভাবে কিছু বলে তখন তা টের পাওয়া যায়। আমার মনে হয় না সে কোনোদিন ছবি আঁকবে। তার মাথায় অঙ্ক ছাড়া কিছুই নেই।

২১.৫.৮২
আমি ছবি আঁকতে পারছি না। যেখানে নীল রঙ চড়ানো দরকার, সেখানে গাঢ় হলুদ রঙ ব্যসাচ্ছি। ডাক্তার সিডেটিভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ মাথা ঝিম ধরে থাকে। কেন জানি খুব বমি হচ্ছে।

আজ দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমুলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সুন্দর একটা স্বপ্নও দেখে ফেললাম। সুন্দর স্বপ্ন আমি অনেক দিন দেখি না, অনেক দিন দেখি না, অনেক দিন দেখি না। অনেক দিন দেখি না? অনেক দিন দেখি না। আচ্ছা, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? শুনেছি পাগলরাই একই কথা বারবার লেখে। কারণ তাদের মাথায় একটি বাক্যই বারবার ঘুরপাক খায়।

 

বৃহস্পতিবার কিংবা বুধবার
আজ কত তারিখ আমি জানি না। বেশ কয়েক দিন ধরেই দিন-তারিখে গণ্ডগোল হচ্ছে। আজ কত তারিখ তৈা জানার কোনো রকম আগ্ৰহ বোধ করছি না। তবে মনের অবস্থা লেখার চেষ্টা করছি, যাতে পরবর্তী সময়ে কেউ আমার লেখা পড়ে বুঝবে যে মাথা খারাপ হবার সময় একজন মানুষ কীভাবে কী চিন্তা করে।

মাথা খারাপের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে, আলো অসহ্য হওয়া! আমি এখন আলো সহ্য করতে পারি না। দিনের বেলায় দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি। ঘর অন্ধকার বলেই প্ৰায় অনুমানের ওপর নির্ভর করে আজকের এই লেখা লিখছি। দ্বিতীয় লক্ষণ হচ্ছে, সারাক্ষণ শরীরে একধরনের জ্বালা অনুভব করা। মনে হয়, সব কাপড় খুলে বাথটাবে শুয়ে থাকতে পারলে ভালো লাগত। আমার আগে যারা পাগল হয়েছে তাদেরও কি এমন হয়েছে? জানার জন্যে পাবলিক লাইব্রেরিতে টেলিফোন করেছিলাম। আমি খুব সহজভাবে বললাম, আচ্ছা, আপনাদের এখানে পাগলের লেখা কোনো বই আছে?

যে-মেয়েটি টেলিফোন ধরেছিল। সে বিস্মিত হয়ে বলল, পাগলের লেখা বই বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

মানসিক রুগীদের লেখা বই?

মানসিক রুগীরা বই লিখবে কেন?

কেন লিখবে না? আমি তো লিখছি, বই অবশ্যি নয়-ডায়েরির আকারে লেখা।

ও, আচ্ছা। ঠিক আছে, আপনার বই ছাপা হোক। ছাপা হবার পর অবশ্যই আমরা আপনার বইয়ের কপি সংগ্রহ করব।

আমি মনে-মনে হাসলাম। মেয়েটি আমাকে উন্মাদ ভাবছে। ভাবুক উন্মাদকে উন্মাদ ভাববে না তো কী ভাববে?
রাত দুটো দশ
আমার মা এই কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করলেন। দুপুররাতে তাঁর টেলিফোন করার বদঅভ্যাস আছে। আমার মার অনিদ্রা রোগ আছে। কাজেই তিনি মনে করেন। পৃথিবীর সবাই অনিদ্রার রুগী। যাই হোক, আমি জেগে ছিলাম। মা বললেন, জুডি, তুই আমার কাছে চলে আয়।

আমি বললাম, না, রাশেদকে ফেলে আমি যাব না।

মা বললেন, আমি তো শুনলাম ওকে নিয়েই তোর সমস্যা।

ওকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই মা। I love him. I love him.। ove him.

চিৎকার করছিস কেন?

চিৎকার করছি না। মা, টেলিফোন রাখি। কথা বলতে ভালো লাগছে না।

আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। রাশেদকে ফেলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। আমার ধারণা, রাশেদ নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেও এখন রাতে ঘুমায় না। গ্রুপ থিওরির যে-সমস্যাটি নিয়ে সে ভাবছিল, সেই সমস্যার সমাধান অন্য কে নাকি বের করে ফেলেছে। জার্নালে ছাপা হয়েছে। সে গত পরশু ঐ জার্নাল পেয়ে কুচিকুচি করেছিঁড়েছে। শুধু তাই না-বারান্দার এক কোণায় বসে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করেছে। সত্ত্বনা দেবার জন্যে তার কাছে গিয়ে চমকে উঠলাম। সে কাঁদছে ঠিকই, কিন্তু তার বা চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, ডান চোখ শুকনো।

আমি তাকে কিছু বললাম না। কিন্তু সে আমার চাউনি থেকেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। নিচু গলায় বলল, জুডি, ইদানীং এই ব্যাপারটা হচ্ছে—মাঝে-মাঝেই দেখছি বা চোখ দিয়ে পানি পড়ে।

কথাগুলি বলার সময় তাকে এত অসহায় লাগছিল! আমার ইচ্ছা করছিল তাকে জড়িয়ে ধরে বলি-I love you. I love you. I love you.

হে ঈশ্বর! হে পরম করুণাময় ঈশ্বর। এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে তুমি আমাদের দু জনকে উদ্ধার করা।

 

স্কেচবুকের প্রতিটি লেখা বারবার পড়ে মিসির আলি খুব বেশি তথ্য বের করতে পারলেন না, তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা জানা গেল তা হচ্ছে-মেয়েটি তার স্বামীকে ভালবাসে, যে-ভালবাসায় একধরনের সারল্য আছে।

স্কেচবুকে কিছু স্প্যানিশ ভাষায় লেখা কথাবার্তাও আছে। স্প্যানিশ ভাষা না— জানার কারণে তার অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হল না। তবে এই লেখাগুলি যেভাবে সাজানো তাতে মনে হচ্ছে–কবিতা কিংবা গান হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন ল্যাংগুয়েজ ইনষ্টিটিউটে স্কেচবুক নিয়ে গেলেই ওরা পাঠোদ্ধারের ব্যবস্থা করে দেবে-তবে মিসির আলির মনে হল তার প্রযোজন নেই। যা জানার তিনি জেনেছেন। এর বেশি কিছু জানার নেই।

 

০৩.

রাশেদুল করিম ঠিক ছটায় এসেছেন। মনে হচ্ছে বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক ছটা বাজার পর কলিং বেলে হাত রেখেছেন। মিসির আলি দরজা খুলে বললেন, আসুন।

রাশেদুল করিমের জন্যে সামান্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তাঁর জন্যে টেবিলে দুধছাড়া চা। মিসির আলি বললেন, আপনি কাঁটায়-কাঁটায় ছটায় আসবেন বলে ধারণা করেই চা বানিয়ে রেখেছি। লিকার কড়া হয়ে গেছে বলে-আমার ধারণা। খেয়ে দেখুন

রাশেদুল করিম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ধন্যবাদ।

মিসির আলি নিজের কাপ হতে নিতে-নিতে বললেন, আপনাকে একটা কথা শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার। আমি মাঝে-মাঝে নিজের শখের কারণে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করি। তার জন্যে কখনো অর্থ গ্রহণ করি না। আমি যা করি তা আমার পেশা না-নেশা বলতে পারেন। আপনার ডলার আমি নিতে পারছি না। তা ছাড়া অধিকাংশ সময়ই আমি সমস্যার কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারি না। আমার কাছে পাঁচ শ পৃষ্ঠার একটা নোট বই আছে। ঐ নোট বই ভর্তি এমন সব সমস্যা-যার সমাধান আমি বের করতে পারি নি।

আপনি কি আমার সমস্যাটার কিছু করেছেন?

সমস্যার পুরো সুমাধান বের করতে পারি নি—আংশিক সমাধান আমার কাছে আছে। আমি মোটামুটিভাবে একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছি। সেই সম্পর্কে আপনাকে আমি বলব, আপনি নিজে ঠিক করবেন—আমার হাইপোথিসিসে কী কী ত্রুটি আছে। তখন আমরা দু জন মিলে ত্রুটিগুলি ঠিক করব।

শুনি আপনার হাইপোথিসিস।

আপনার স্ত্রী বলেছেন, ঘুমুবার পর আপনি মৃত মানুষের মতো হয়ে যান। আপনার হাত-পা নড়ে না। পাথরের মূর্তির মতো বিছানায় পড়ে থাকেন। তাই না?

হ্যাঁ, তাই।

স্লিপ অ্যানালিস্টরা আপনাকে পরীক্ষা করে বলেছেন-আপনার ঘুম সাধারণ মানুষের ঘুমের মতোই। ঘুমের মধ্যে আপনি স্বাভাবিকভাবেই নড়াচড়া করেন।

জ্বি,  কয়েকবারই পরীক্ষা করা হয়েছে।

আমি আমার হাইপোথিসিসে দুজনের বক্তব্যই সত্য ধরে নিচ্ছি। সেটা কীভাবে সম্ভব? একটিমাত্র উপায়ে সম্ভব-আপনি যখন বিছানায় শুয়ে ছিলেন তখন ঘুমুচ্ছিলেন না। জেগে ছিলেন।

রাশেদুল করিম বিস্মিত হয়ে বললেন, কী বলছেন আপনি!

মিসির আলি বললেন, আমি গত কালও লক্ষ করেছি, আজও লক্ষ করছি।– আপনার বসে থাকার মধ্যেও একধরনের কাঠিন্য আছে। আপনি আরাম করে বসে নেই-শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছেন। আপনার দুটো হাত হাঁটুর ওপর রাখা। দীর্ঘ সময় চলে গেছে, আপনি একবারও হাত বা পা নাড়ান নি। অথচ স্বাভাবিকভাবেই আমরা হাত-পা নাড়ি। কেউ-কেউ পা নাচান!

রাশেদুল করিম চুপ করে রইলেন। মিসির আলি বলল, ঐ রাতে আপনি বিছানায় শুয়েছেন।–মূর্তির মতো শুয়েছেন। চোখ বৃন্ধ করে ভাবছেন আপনার অঙ্কের সমস্যা নিয়ে। গভীরভাবে ভাবছেন। মানুষ যখন গভীরভাবে কিছু ভাবে তখন একধরনের টেন্স ষ্টেটে ভাবজগতে চলে যায়। গভীরভাবে কিছু ভাবা হচ্ছে একধরনের মেডিটেশন। রাশেদুল করিম সাহেব

জ্বি।

অঙ্ক নিয়ে ঐ ধরনের গভীর চিন্তা কি আপনি এই করেন না?

জ্বি, করি।

আপনি কি লক্ষ করেছেন এই সময় আশেপাশে কী ঘটছে তা আপনার খেয়াল থাকে না?

লক্ষ করেছি।

আপনি নিশ্চয়ই আরো লক্ষ করেছেন যে, এই অবস্থায় আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিচ্ছেন। লক্ষ করেন নি?

করেছি।

তাহলে আমি আমার হাইপোথিসিসে ফিরে আসি। আপনি বিছানায় শুয়ে আছেন। আপনার মাথায় অঙ্কের জটিল সমস্যা। আপনি ভাবছেন, আর ভাবছেন? আপনার হাতপা নড়ছে না। নিঃশ্বাস এত ধীরে পড়ছে যে মনে হচ্ছে আপনি মৃত!

রাশেদুল করিম সাহেব সানগ্লাস খুলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মিসির আলি বললেন, ভালো কথা, আপনি কি লেফট হ্যানডেড পার্সন? ন্যাটা?

ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?

আমার হাইপোথিসিসের জন্যে আপনার লেফট হ্যানডেড পার্সন হওয়া খুবই প্রয়োজন।

কেন?

বলছি। তার আগে—শুরুতে যা বলছিলাম সেখানে ফিরে যাই। দৃশ্যটি আপনি দয়া করে কল্পনা করুন। আপনি একধরনের টেন্স অবস্থায় আছেন। আপনার স্ত্রী জেগে আছেন-ভীত চোখে আপনাকে দেখছেন। আপনার এই অবস্থার সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে গেলেন। তাঁর ধারণা হল আপনি মারা গেছেন। তিনি আপনার গায়ে হাত দিয়ে আরো ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ আপনার গা হিমশীতল।।

গা হিমশীতল হবে কেন?

মানুষ যখন গভীর ট্রেন্স স্টেটে চলে যায় তখন তার হার্টবিট কমে যায়। নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস ধীরে বয়। শরীরের টেম্পরেচার দুই থেকে তিন ডিগ্ৰী পৰ্যন্ত নেমে যায়। এইটুকু নেমে যাওয়া মানে অনেকখানি নেমে যাওয়া। যাই হোক, আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি তাকালেন।–তাকালেন। কিন্তু এক চোখ মেলে। বী চোখে। ডান চোখটি তখনো বন্ধ।

কেন?

ব্যাখ্যা করছি। রাইট হ্যানডেড পার্সন যারা আছে, তাদের এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে তাকাতে বললে তারা বা চোখ বন্ধ করে ডান চোখে তাকবে। ডান চোখ বন্ধ করে বা চোখে তাকানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা সম্ভব শুধু যারা ন্যাটা তাদের পক্ষেই। আপনি লেফট হ্যানডেড পার্সনা-আপনি একধরনের গভীর টেন্স ষ্টেটে আছেন। আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত রেখেছেন। আপনি কী হচ্ছে জানতে চাচ্ছেন। চোখ মেলছেন। দুটি চোখ মেলতে চাচ্ছেন না। গভীর আলস্যে একটা চোখ কোনোমতে মেললেন-অবশ্যই সেই চোখ হবে-বী চোখ। আমার যুক্তি কি গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?

রাশেদুল করিম হা-না কিছু বললেন না।

মিসির আলি বললেন, আপনার স্ত্রী আরো ভয় পেলেন। সেই ভয় তাঁর রক্তে মিশে গেল। কারণ শুধুমাত্র একবার এই ব্যাপার ঘটেনি। অনেকবার ঘটেছে। আপনার কথা থেকেই আমি জেনেছি, সেই সময় অঙ্কের একটি জটিল সমাধান নিয়ে আপনি ব্যস্ত। মুড়ার সমগ্ৰ চিন্তা-চেতনায়য় আছে–অঙ্কের সমাধান-নতুন কোনো থিওরি। নয় কি?

হ্যাঁ।

এখন আমি আমার হাইপোথিসিসের সবচেয়ে জটিল অংশে আসছি। আমার হাইপোথিসিস বলে, আপনার স্ত্রী আপনার চোখ গেলে দেন নি। তাঁর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তিনি আপনার চোখের প্রেমে পড়েছিলেন। একজন শিল্পীমানুষ কখনো সুন্দর কোনো সৃষ্টি নষ্ট করতে পারেন না। তবুও যদি ধরে নিই তাঁর মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গিয়েছিল এবং তিনি এই ভয়াবহ কাণ্ড করেছেন—তাহলে তাঁকে এটা করতে হবে ঝোঁকের মাথায়, আচমকা। আপনার চোখ গেলে দেওয়া হয়েছে পেনসিলে-যে পেনসিলটি আপনার মাথার বালিশের নিচে রাখা। যিনি ঝোঁকের মাথায় একটা কাজ করবেন। তিনি এত যন্ত্রণা করে বালিশের নিচে থেকে পেনসিল নেবেন না। হয়তো-বা তিনি জানতেনও না বালিশের নিচে পেনসিল ও নোটবই নিয়ে আপনি ঘুমান!

রাশেদুল করিম বললেন, কাজটি তাহলে কে করেছে?

সেই প্রসঙ্গে আসছি—আপনি কি আরেক কাপ চা খবেন। বানিয়ে দেব?

না।

অ্যাকসিডেন্ট কীভাবে ঘটল তা বলার আগে আপনার স্ত্রীর লেখা ডায়েরির প্রতি আপুনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি—এক জায়গায় তিনি লিখেছেন-আপনার বা চোখ দিয়ে পানি পড়ত। কথাটা কি সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

কোন পানি পড়ত? একটি চোখ কেন কাঁদত? আপনার কী ধারণা?

করিম বললেন, আমার কোনো ধারণা নেই। আপনার ধারণা বলুন। আমি অবশ্যি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ডাক্তার বলেছেন এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। যে-ফ্ল্যাণ্ড চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে, সেই গ্ল্যাণ্ড বা চোখে বেশি কর্মক্ষম ছিল।

মিসির আলি বললেন, এটা একটা মজার ব্যাপার! হঠাৎ কেন বঁ। চোখের গ্ল্যাণ্ড কর্মক্ষম হয়ে পড়ল। আপনি মনে-মনে এই চোখকে আপনার সব রকম অশান্তির মূল বলে চিহ্নিত করার জন্যেই কি এটা হল? আমি ডাক্তার নই। শারীরবিদ্যা জানি না। তবে আমি দু জন বড় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন এটা হতে পারে। মোটেই অস্বাভাবিক নয়। গু্যাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। একটি চোখকে অপছন্দও করছে মস্তিষ্ক।

তাতে কী প্রমাণ হচ্ছে?

মিসির আলি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, তাতে একটি জিনিসই প্রমাণিত হচ্ছে-আপনার বা চোখ আপনি নিজেই নষ্ট করেছেন।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে রাশেদুল করিম ভাঙা গলায় বললেন, কী বলছেন আপনি?

কনশ্যাস অবস্থায় আপনি এই ভয়ংকর কাজ করেন নি। করেছেন। সাবকনশ্যাস অবস্থায়। কেন করেছেন তাও বলি—আপনি আপনার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালবাসেন। সেই স্ত্রী আপনার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। কেন দূরে সরে যাচ্ছেন? কারণ তিনি ভয় পাচ্ছেন। আপনার বা চোখকে। আপনি আপনার স্ত্রীকে হারাচ্ছেন বা চোখের জন্যে। আপনার ভেতর রাগ, অতিমান জমতে শুরু করেছে। সেই রাগ আপনার নিজের একটি প্রত্যঙ্গের ওপর। চোখের ওপর। এই রাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচণ্ড হতাশা। আপনি যে— বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সেই গবেষণা অন্য একজন করে ফেলেছেন। জার্নালে তা প্রকাশিত হয়ে গেছে। আপনার চোখ সমস্যা তৈরি না-করলে এমনটা ঘটত না। নিজেই গবেষণাটা শেষ করতে পারতেন। সবকিছুর জন্যে দায়ী হল চোখ।

মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, আমার এই হাইপোথিসিসের পেছনে আরেকটি শক্ত যুক্তি আছে। যুক্তিটি বলেই আমি কথা শেষ করব।

বলুন।

আপনার স্ত্রী পুরোপুরি বিকৃত মস্তিষ্ক হবার পরে যে-কথাটা বুলতেন।–তা হল, এই লোকটা পিশাচ। আমার কাছে প্রমাণ আছে। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু প্রমাণ আছে। তিনি এই কথা বলতেন, কারণ-পেনসিল দিয়ে নিজের চোখ নিজে গেলে দেওয়ার দৃশ্য তিনি দেখেছেন। আমার হাইপোথিসিস আমি আপনাকে বললাম। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।

রাশেদুল করিম দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন। মিসির আলি আরেক বার বললেন, ভাই, চা করব? চা খাবেন?

তিনি এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন। চোখে সানগ্লাস পরলেন। শুকনো গলায় বললেন, যাই?

মিসির আলি বললেন, মনে হচ্ছে। আমি আপনাকে আহত করেছি-কষ্ট দিয়েছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। নিজের ওপরেও রাগ করবেন না। আপনি যা করেছেন-প্ৰচণ্ড ভালবাসা থেকেই করেছেন।

রাশেদুল করিম হাত বাড়িয়ে মিসির আলির হাত ধরে ফেলে বললেন, আমার স্ত্রী বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতাম।–আপনি দেখতেন, সে কী চমৎকার একটি মেয়ে ছিল! এবং সেও দেখত-আপনি কত অসাধারণ একজন মানুষ!

ঐ দুর্ঘটনার পর জুডির প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে আমি বেঁচে ছিলাম। আপনি এই অন্যায় ঘৃণা থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছেন। জুডির হয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ভদ্রলোকের গলা ধরে এল। তিনি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বললেন, মিসির আলি সাহেব, তাই দেখুন—আমার দুটি চোখ থেকেই এখন পানি পড়ছে। চোখ পাথরের হলেও চোখের অশ্রাগ্রন্থি এখনো কার্যক্ষম। কুড়ি বছর পর এই ঘটনা ঘটল। আচ্ছান্ন ভাই যাই।

 

দু, মাস পর আমেরিকা থেকে বিমান-ড়াকে মিসির আলি বড় একটা প্যাকেট পেলেন। সেই প্যাকেটে জলরঙে আঁকা একটা চেরি গাছের ছবি। অপূর্ব ছবি।

ছবির সঙ্গে একটি নোট। রাশেদুল করিম সাহেব লিখেছেন: আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম। এই ছবিটির চেয়ে প্রিয় কিছু এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। কোনোদিন হবে বলেও মনে হয় না।

দ্বিতীয় জন

প্রিয়াংকার খুব খারাপ ধরনের একটা অসুখ হয়েছে।

অসুখটা এমন যে কাউকে বলা যাচ্ছে না। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, কিংবা বিশ্বাস করার ভান করে আড়ালে হাসাহাসি করবে। একজনকে অবিশ্যি বলা যায়–জাভেদকে। জাভেদ তার স্বামী। স্বামীর কাছে কিছুই গোপন থাকা উচিত নয়। অসুখ-বিসুখের খবর সবার আগে স্বামীকেই বলা দরকার।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে জাভেদের সঙ্গে প্রিয়াংকার পরিচয় এখনো তেমন গাঢ় হয় নি। হবার কথাও নয়। তাদের বিয়ে হয়েছে একুশ দিন আগে। এখনো প্রিয়াংকার তুমি বলা রপ্ত হয় নি। মুখ ফসকে আপনি বলে ফেলে। এরকম গম্ভীর, বয়স্ক একজন মানুষকে তুমি বলাও অবিশ্যি খুব সহজ নয়। মুখে কেমন বাধো-বাধে ঠেকে। প্রিয়াংকা চেষ্টা করে আপনি তুমি কোনোটাই না বলে চালাতে, যেমন— তুমি চা খাবে? না বলে— চা দেব? এইভাবে দীর্ঘ আলাপ চালানো যায় না, তার চেয়েও বড় কথা— মানুষটা খুব বুদ্ধিমান। ভাববাচ্য কিছুক্ষণ কথা বলার পরই সে হাসিমুখে বলে, তুমি বলতে কষ্ট হচ্ছে, তাই না?

তুমি বলতে কষ্ট হওয়াটা দোষের কিছু না। প্রিয়াংকার বয়স মাত্র সতেরো। তাও পুরোপুরি সতেরো হয় নি। জুন মাসে হবে। এখনো দুমাস বাকি। আর ঐ মানুষটার বয়স খুব কম ধরলেও ত্রিশ। তার বয়সের প্রায় দ্বিগুণ। সারাক্ষণ গম্ভীর থাকে বলে বয়স আরো বেশি দেখায়। বরের বয়স বেশি বলে প্রিয়াংকার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। বরদের চেংড়া দেখালে ভালো লাগে না। তাছাড়া মানুষটা অত্যন্ত ভালো। ভালো এবং বুদ্ধিমান। কমবয়েসী বোকা বরের চেয়ে বুদ্ধিমান বয়স্ক বর ভালো।

বিয়ের রাতে নানা কিছু ভেবে প্রিয়াংকা আতঙ্কে অস্থির হয়েছিল। ধ্বকধ্বক করে বুক কাঁপছিল। কপাল রীতিমতো ঘামছিল। মানুষটা সঙ্গে-সঙ্গে তা বুঝে ফেলেছিল। কাছে এসে ভারী গলায় বলল, ভয় করছে? ভয়ের কী আছে বল তো?

প্রিয়াংকার বুকের ধ্বকধ্বকানি আরো বেড়ে গেল। সে হ্যাঁ না কিছুই বলল না। একবার মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। মানুষটা তখন নরম গলায় বলল, ভয়ের কিছু নেই। ঘুমিয়ে পড়। বলেই প্রিয়াংকার গায়ে চাদর টেনে দিল। তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। প্রিয়াংকার ভয় পুরোপুরি কেটে গেল এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। অনেক রাতে একবার ঘুম ভেঙে দেখে লোকটি অন্যপাশ ফিরে ঘুমুচ্ছে। খানিকক্ষণ জেগে থেকে প্রিয়াংকা আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। লোকটি তখন পাশে নেই।

একটা মানুষকে চেনার জন্যে একুশ দিন খুব দীর্ঘ সময় নয়। তবু প্রিয়াংকার ধারণা মানুষটা ভালো, বেশ ভালো। এরকম একজন মানুষকে তার অসুখের কথাটা অবশ্যই বলা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অসুখটার সঙ্গে এই মানুষটার সম্পর্ক আছে। এই কারণেই তাকে বলা যাবে না। কিন্তু কাউকে বলা দরকার। খুব তাড়াতাড়ি বলা দরকার। নয়তো সে পাগল হয়ে যাবে। কিছুটা পাগল সে বোধহয় হয়েই গেছে। সারাক্ষণ অস্থির লাগে। সন্ধ্যা মেলাবার পর শরীর কাঁপতে থাকে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে। গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেলেও তৃষ্ণা মেটে না। সামান্য শব্দে ভয়ংকর চমকে উঠে। সেদিন বাতাসে জানালার কপাট নড়ে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে ভয়ে অস্থির হয়ে গোঙানির মতো শব্দ করল প্রিয়াংকা। হাতের চায়ের কাপ থেকে সবটা চা ছলকে পড়ল শাড়িতে। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ ছিল না। কেউ থাকলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হত। প্রিয়াংকার ছোটমামা যেমন অবাক হলেন।

তিনি প্রিয়াংকাকে দেখতে এসেছিলেন। তার দিকে তাকিয়েই বিস্মিত গলায় বললেন, তোর কী হয়েছে রে?

প্রিয়াংকা হালকা গলায় বলল, কিছু হয় নি তো। তুমি কেমন আছ মামা?

আমার কথা বাদ দে। তোকে এমন লাগছে কেন?

কেমন লাগছে?

চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ শুকনো। কী ব্যাপার?

কোনো ব্যাপার না মামা।

গালটাল ভেঙে কী অবস্থা! তুই কথাও তো কেমন অন্য রকমভাবে বলছিস।

কী রকমভাবে বলছি?

মনে হচ্ছে তোর গলাটা ভাঙা।

ঠাণ্ডা লেগেছে মামা।

প্রিয়াংকা কয়েকবার কাশল। মামাকে বুঝাতে চাইল যে তার সত্যি-সত্যি কাশি হয়েছে, অন্য কিছু না। মামা আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। শীতল গলায় বললেন,

আর কিছু না তো?

না।

ঠিক করে বল।

ঠিক করেই বলছি।

প্রিয়াংকার কথায় তার মামী খুব আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হল না। সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। চায়ের কাপে দুটা চুমুক দিয়েই রেখে দিলেন। যাইরে মা। বলেই কোনোদিকে না তাকিয়ে হনহন করে চলে গেলেন। মামা চলে যাবার এক ঘণ্টার ভেতরই মামি এসে হাজির। বোঝাই যাচ্ছে মামা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

মামি প্রিয়াংকাকে দেখে আঁতকে উঠলেন। প্রায় চেঁচিয়েই বললেন, এক সপ্তাহ আগে তোকে কী দেখেছি আর এখন কী দেখছি? কী ব্যাপার তুই খোলাখুলি বল তো? কী সমস্যা?

প্রিয়াংকা শুকনো হাসি হেসে বলল, কোনো সমস্যা না।

মামি কঠিন গলায় বললেন,

তুই বলতে না চাইলে আমি কিন্তু জামাইকে জিজ্ঞেস করব। জামাই আসবে কখন?

ও আসবে রাত আটটার দিকে। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না মামি। আমি বলছি।

বল। কিছু লুকুবি না।

প্রিয়াংকা প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমি ভয় পাই, মামি।

কিসের ভয়?

কী যেন দেখি।

কী দেখিস?

নিজেও ঠিক জানি না কী দেখি।

ভাসা-ভাসা কথা বলবি না। পরিষ্কার করে বল কী দেখিস।

প্রিয়াংকা এক পর্যায়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, মামি আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি। আমি কী সব যেন দেখি।

সে কী দেখে তা তিনি অনেক প্রশ্ন করেও বের করতে পারলেন না। প্রিয়াংকা অন্য সব প্রশ্নের জবাব দেয় কিন্তু কী দেখে তা বলে না। এড়িয়ে যায় বা কাঁদতে শুরু করে।

তোর কি বর পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ।

সে কি তোকে ভয়-টয় দেখায়?

কী যে তুমি বল মামি, আমাকে ভয় দেখাবে কেন?

রাতে কি তোরা একসঙ্গে ঘুমাস?

প্রিয়াংকা লজ্জায় বেগুনি হয়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁ।

সে কি তোকে অনেক রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখে?

কী সব প্রশ্ন তুমি কর মামি?

আমি যা বলছি তার জবাব দে।

না জাগিয়ে রাখে না।

মামি অনেকক্ষণ থাকলেন। প্রিয়াংকাদের ফ্ল্যাট ঘুরে-ঘুরে দেখলেন। কাজের মেয়ে এবং কাজের ছেলেটির সঙ্গে কথা বললেন। কাজের মেয়েটির নাম মরিয়ম। দেশ খুলনা। ঘরের যাবতীয় কাজ সে-ই করে। কাজের ছেলেটির নাম জীতু মিয়া। তার বয়স নয়-দশ। এদের দুজনের কাছ থেকেও খবর বার করার চেষ্টা করা হল।

আচ্ছা মরিয়ম তুমি কি ভয়-টয় পাও?

না। ভয় পামু ক্যা?

রাতে কিছু দেখটেখ না?

কী দেখুম?

আচ্ছা ঠিক আছে–যাও।

প্রিয়াংকার মামি কোনো রহস্য ভেদ করতে পারলেন না। তার খুব ইচ্ছা ছিল জাভেদের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবেন, পরামর্শ করবেন। প্রিয়াংকার জন্যে পারা গেল না। সে কঁদো-কঁদো গলায় বলল, মামি তুমি যদি তাকে কিছু বল তাহলে আমি কিন্তু বিষ খাব। আল্লাহর কসম বিষ খাব। নয়তো ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ব।

তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কারণ, প্রিয়াংকা সত্যি বিষ-টিষ খেয়ে ফেলতে পারে। আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়—এই কথা লিখে একবার সে এক বোতল ডেটল খেয়ে ফেলেছিল। অনেক ডাক্তার-হাসপাতাল করতে হয়েছে। এই কাণ্ড সে করেছিল অতি তুচ্ছ কারণে। তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ঝগড়া করে। এই মেয়ের পক্ষে সবই সম্ভব। তাকে কিছুতেই ঘটানো উচিত নয়।

জাভেদ এল রাত সাড়ে আটটার দিকে। জাভেদের সঙ্গে খানিকক্ষণ টুকটাক গল্প করে প্রিয়াংকার মামি ফিরে গেলেন। তার মনের মেঘ কাটল না। হল কী প্রিয়াংকার? সে কী দেখে?

প্রিয়াংকা নিজেও জানে না তার কী হয়েছে। মামি চলে যাবার পর তার বুক ধ্বক-ধ্বক করা শুরু হয়েছে। অল্প-অল্প ঘাম হচ্ছে। অসম্ভব গরম লাগছে। কিছুক্ষণ পরপর মনে হচ্ছে বোধহয় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

তারা খাওয়াদাওয়া করে রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘুমুতে গেল। জাভেদ বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ে। আজো তাই হল। জাভেদ ঘুমুচ্ছে। তালে-তালে নিশ্বাস পড়ছে। জেগে আছে প্রিয়াংকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পানির পিপাসা পেল। প্রচণ্ড পানির পিপাসা। পানি খাবার জন্য বিছানা ছেড়ে নামতে হবে। যেতে হবে পাশের ঘরে কিন্তু তা সে করবে না। অসম্ভব। কিছুতেই না। পানির তৃষ্ণায় মরে গেলেও না। এই পানি খেতে গিয়েই প্রথমবার তার অসুখ ধরা পড়েছিল। ভয়ে ঐদিনই সে মরে যেত। কেন মরল না? মরে গেলেই ভালো হত। তার মতো ভিতু মেয়ের মরে যাওয়াই উচিত।

ঐ রাতে সে বেশ আরাম করে ঘুমুচ্ছিল। হঠাৎ বৃষ্টি হবার জন্যে চারদিক বেশ ঠাণ্ডা। জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে। ঘুমুবার জন্যে চমকার রাত। এক ঘুমে সে কখনো রাত পার করতে পারে না। মাঝখানে একবার তাকে উঠে পানি খেতে হয় কিংবা বাথরুমে যেতে হয়। সেই রাতেও পানি খাবার জন্যে উঠল। জাভেদ কাত হয়ে ঘুমুচ্ছে। গায়ে পাতলা চাদর দিয়ে রেখেছে। অদ্ভুত অভ্যাস মানুষটার। যত গরমই পড়ক গায়ে চাদর দিয়ে রাখবে। প্রিয়াংকা খুব সাবধানে গায়ের চাদর সরিয়ে দিল। আহা, আরাম করে ঘুমুক। কেমন ঘেমে গেছে।

স্বামীকে ডিঙিয়ে বিছানা থেকে নামল। স্বামী ডিঙিয়ে উঠানামা করা ঠিক হচ্ছে না–হয়তো পাপ হচ্ছে। কিন্তু উপায় কী! প্রিয়াংকা ঘুমায় দেয়ালের দিকে। খাট থেকে নামতে হলে স্বামীকে ডিঙাতেই হবে।

তাদের শোবার ঘর অন্ধকার, তবে পাশের ঘরে বাতি জ্বলছে। এই একটা বাতি সারারাতই জ্বলে। ঘরটা জাভেদের লাইব্রেরি ঘর। এই ঘরেই জাভেদ পরীক্ষার খাতা দেখে, পড়াশোনা করে। ঘরে আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। একটা বুক-শেলফে কিছু বই, পুরনো ম্যাগাজিন। একটা বড় টেবিলের উপর রাজ্যের পরীক্ষার খাতা। একটা ইজিচেয়ার। ইজিচেয়ারের পাশে সাইড টেবিলে টেবিলে ল্যাম্প।

দরজার ফাঁক দিয়ে স্টাডি রুমের আলোর কিছুটা প্রিয়াংকাদের শোবার ঘরেও আসছে। তবুও ঘরটা অন্ধকার স্যান্ডেল খুঁজে বের করতে অনেকক্ষণ মেঝে হাতড়াতে হল। স্যান্ডেল পায়ে পরামাত্র পাশের ঘরে কিসের যেন একটা শব্দ হল।

ভারী অথচ মৃদু গলায় কেউ একজন কাশল, ইজিচেয়ার টেনে সরাল। নিশ্চয়ই মনের ভুল। তবু প্রিয়াংকা আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। না, আর কোনো শব্দ নেই। শুধু সদর রাস্তা দিয়ে দ্রুতবেগে ট্রাক যাওয়া-আসা করছে। তাহলে একটু আগে পাশের ঘরে কে শব্দ করছিল? অবিকল নিশ্বাস নেবার শব্দ। প্রিয়াংকা দরজা ঠেলে পাশের ঘরে ঢুকেই জমে পাথর হয়ে গেল। ইজিচেয়ারে জাভেদ বসে আছে। হাতে বই। জাভেদ বই থেকে মুখ তুলে তাকাল। নরম গলায় বলল, কিছু বলবে?

কতটা সময় পার হয়েছে? এক সেকেন্ডের একশ ভাগের এক ভাগ না অনন্তকাল? প্রিয়াংকা জানে না। সে শুধু জানে সে ছুটে চলে এসেছে শোবার ঘরে— ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিছানায়। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। সে কি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। ঘর দুলছে। চারদিকের বাতাস অসম্ভব ভারী ও ঊষ্ণ। জাভেদ জেগে উঠেছে। সে বিছানায় পাশ ফিরতে-ফিরতে বলল, কী?

প্রিয়াংকা বলল, কিছু না। জাভেদ ঘুম জড়ানো স্বরে বলল, ঘুমাও! জেগে আছ কেন? বলতে-বলতেই ঘুমে জাভেদ এলিয়ে পড়ল। জাভেদকে জড়িয়ে ধরে সারারাত জেগে রইল প্রিয়াংকা। একটি দীর্ঘ ও ভয়াবহ রাত। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়াংকা শুয়ে আছে। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় পাশের ঘরে। সে স্পষ্টই শুনছে ছোটখাটো শব্দ আসছে পাশের ঘর থেকে। নিশ্বাস ফেলার শব্দ, বইয়ের পাতা ওল্টাবার শব্দ, ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালে যেমন ক্যাচক্যাচ শব্দ হয় সেরকম শব্দ, গলায় শ্লেষ্ম পরিষ্কার করার শব্দ। শেষ রাতের দিকে শোনা গেল বারান্দায় পায়চারির শব্দ। কেউ-একজন বারান্দায় এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। এইসব কি কল্পনা? নিশ্চয়ই কল্পনা। রাস্তা দিয়ে ট্রাক যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ আসছে না।

ফজরের আজানের পর প্রিয়াংকার চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল। ঘুম ভাঙল বেলা সাড়ে নটায়। ঘরের ভেতর রোদ ঝলমল করছে। জাভেদ চলে গেছে কলেজে। মরিয়ম, জীতু মিয়ার সঙ্গে তারস্বরে ঝগড়া করছে। প্রিয়াংকার সব ভয় কপূরের মতো উড়ে গেল। রাতে সে যে অসম্ভব ভয় পেয়েছিল এটা ভেবে এখন নিজেরই কেমন হাসি পাচ্ছে। সে স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। মানুষ কত রকম দুঃস্বপ্ন দেখে। এও একটা দুঃস্বপ্ন। এর বেশি কিছু না। মানুষ তো এরচেয়েও ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে। যে, নিজেই কতবার দেখেছে। একবার স্বপ্নে দেখেছিল—সম্পূর্ণ নগ্ন পায়ে বাসে করে কোথায় যেন যাচ্ছে। ছিঃ ছিঃ কী ভয়ংকর স্বপ্ন!

প্রিয়াংকা বিছানা থেকে নামতে-নামতে ডাকল, মরিয়ম।

জে আম্মা।

ঝগড়া করছ কেন মরিয়ম?

জীতু কাচের জগটা ভাইঙ্গা ফেলছে আম্মা।

চিৎকার করলে তো জগ ঠিক হবে না। চিল্কার করবে না।

জিনিসের উপর কোনো মায়া নাই … মহব্বত নাই …

ঠিক আছে, তুমি চুপ কর। তোমার স্যার কি চলে গেছেন?

জে।

বাজার করে দিয়ে গেছেন?

জে।

কখন আসবেন কিছু বলে গেছেন?

দুপুরে খাইতে আসবেন।

আচ্ছা যাও। তুমি আমার জন্য খুব ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে আনে।

নাশতা খাইবেন না আম্মা?

না। তোমার স্যার নাশতা করেছে?

জে।

মরিয়ম চা আনতে গেল। প্রিয়াংকা মুখ ধুয়ে চায়ের কাপ নিয়ে বসল। এখন তার করার কিছুই নেই। দুজন মানুষের সংসার। কাজ তেমন কিছু থাকে না। এসংসারে কাজকর্ম যা আছে সবই মরিয়ম দেখে এবং খুব ভালোমতোই দেখে। চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া প্রিয়াংকার কোনো কাজ নেই। এই ফ্লাটে অনেক গল্পের বই আছে— গল্পের বই পড়তে প্রিয়াংকার ভালো লাগে না। ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার জন্যে পড়াশোনা করা দরকার। পড়তে ভালো লাগে না, কারণ প্রিয়াংকা জানে পড়ে লাভ হবে না। সে পাস করতে পারবে না। কোনো একটা কলেজেই তাকে বি. এ. পড়তে হবে। কে জানে হয়তো জাভেদের কলেজেই। যদি তাই হয় তাহলে জাভেদ কী তাকে পড়াবে? ক্লাসে তাকে কী ডাকবে— স্যার?

চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই মরিয়ম তাকে একটা চিঠি দিল।

কিসের চিঠি মরিয়ম?

স্যার দিয়া গেছে।

চিঠি না— চিরকুট। জাভেদ লিখেছে— প্রিয়াংকা, তোমার গা-টা গরম মনে হল। তৈরি হয়ে থেকো। আমি দুপুরে তোমাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

প্রিয়াংকার মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। মানুষটা ভালো। হৃদয়বান এবং বুদ্ধিমান। স্বামীদের কতরকম অন্যায় দাবি থাকে তার তেমন কিছু নেই। অন্যদের দিকেও খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। প্রিয়াংকা কেন, আজ যদি জীতু মিয়ার জ্বর হয় তাকেও সে সঙ্গে-সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। জাভেদ এমন একজন স্বামী যার উপর ভরসা করা যায়।

যে যাই বলুক, এই মানুষটাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে তার খুব লাভ হয়েছে। জাভেদের আগে একবার বিয়ে হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। বেচারার স্ত্রী মারা গেছে বিয়ের আট মাসের মাথায়। স্ত্রীর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে সে বিয়ে করার জন্যেও অস্থির হয়ে পড়ে নি। দুবছর অপেক্ষা করেছে। মামা-মামি যে তাকে দোজবর একটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন এই নিয়েও প্রিয়াংকার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। মামা দরিদ্র মানুষ। তিনি আর কত করবেন। যথেষ্টই তো করছেন। মামি নিজের গয়না ভেঙে তাকে গয়না করে দিয়েছেন। কজন মানুষ এরকম করে? আট নটা নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছেন। এর মধ্যে একটা শাড়ি আছে বারোশ টাকা দামের।

জাভেদের আগের স্ত্রীর অনেক শাড়ি এই ঘরে রয়ে গেছে। ঐ মেয়েটির শাড়ির দিকে তাকালেই মনে হয় খুব শৌখিন মেয়ে ছিল। ড্রেসিং টেবিল ভর্তি সাজগোজের জিনিস। কিছুই ফেলে দেয়া হয় নি। বসার ঘরে মেয়েটির বড় একটি বাঁধানো ছবি আছে। খুব সুন্দর মুখ। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

এই ডাক্তার জাভেদের বন্ধু।

কাজেই ডাক্তার অনেক আজেবাজে রসিকতা করল—যেমন হাসিমুখে বলল, ভাবীকে এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? সংসারে নতুন কেউ আসছে নাকি? হা-হাহা। বুদ্ধিমান হয়ে ঠিক কাজটি করে ফেলেন নি তো?

দুসপ্তাহও হয় নি যার বিয়ে হয়েছে তার সঙ্গে কী এরকম রসিকতা করা যায়? রাগে প্রিয়াংকার গা জ্বলতে লাগল।

ডাক্তার তাকে একগাদা ভিটামিন দিলেন এবং বললেন, ভাবীকে মনে হচ্ছে রাতে ঘুমুতে-টুমুতে দেয় না? দুপুরে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেবেন। নয়তো শরীর খারাপ করবে—হা-হা-হ।

প্রিয়াংকা বাড়ি ফিরল রাগ করে। সন্ধ্যা মেলাবার পর সেই রাগ ভয়ে রূপান্তরিত হল। সীমাহীন ভয় তাকে গ্রাস করে ফেলল। এ-ঘর থেকে ও-ঘর যেতে ভয়। বারান্দায় যেতে ভয়। হাতমুখ ধুতে বাথরুমে গিয়েছে—বাথরুমের দরজা বন্ধ করার সঙ্গে-সঙ্গে মনে হল আর সে দরজা খুলতে পারবে না। দরজা আপনাআপনি আটকে গেছে। সে দরজা খোলার চেষ্টা না করেই কঁপা গলায় ডাকতে লাগল-মরিয়ম, ও মরিয়ম। মরিয়ম।

রাতে আবার ঐদিনের মতো হল। জাভেদ পাশেই প্রায় নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে আর প্রিয়াংকা স্পষ্টই শুনছে স্যান্ডেল পরে বারান্দায় কে যেন পায়চারি করছে। প্রিয়াংকা নিজেকে বুঝল— ও কেউ না, ও হচ্ছে মরিয়ম। মরিয়ম হাঁটছে। ছোট-ছোট পা ফেলছে। মরিয়ম ছাড়া আর কে হবে। নিশ্চয়ই মরিয়ম। স্যান্ডেলে কেমন ফটফট শব্দ হচ্ছে। জাভেদ যখন স্যান্ডেল পরে হাঁটে তখন এরকম শব্দ হয় না। একবার কি বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখবে? কী হবে উঁকি দিলে? কিছুই হবে না। ভয়টা কেটে যাবে। রাত একটা বাজে— এমন কিছু রতি হয় নি। রাত একটায় ঢাকা শহরের অনেক দোকান-পাট খোলা থাকে। এই তো পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাটা কঁদছে। এখন নিশ্চয়ই বারান্দায় যাওয়া যায়।

খুব সাবধানে জাভেদকে ডিঙিয়ে প্রিয়াংকা বিছানা থেকে নামল। তার হাত-পা কাঁপছে, তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে, কানের কাছে কেমন আঁ-আঁ শব্দ হচ্ছে। সব অগ্রাহ্য করে বারান্দায় চলে এল। আর তার সঙ্গে-সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়ানো মানুষটা বলল, প্রিয়াংকা এক গ্লাস পানি দাও তো।

বিছানায় যে মানুষটা শুয়ে আছে এই মানুষটাই সেই জাভেদ। আর পরনে জাভেদের মতোই লুঙি, হাতকাটা গেঞ্জি। মুখ গম্ভীর ও বিষণ্ণ।

প্রিয়াংকা ছুটে শোবার ঘরে চলে এল। কোনোমতে বিছানায় উঠল— ঐ তো জাভেদ খুমুচ্ছে–গায়ে চাদর টানা। এতক্ষণ যা দেখেছি ভুল দেখেছি। যা শুনেছি তাও ভুল। কিছু-একটা আমার হয়েছে। ভয়ংকর কোনো অসুখ। সকাল হলে আমার এই অসুখ থাকবে না। আল্লাহ, তুমি সকাল করে দাও। খুব তাড়াতাড়ি সকাল করে দাও। সব মানুষ জেগে উঠুক। সূর্যের আলোয় চারদিকে ভরে যাক। সে জাভেদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। জাভেদ ঘুম-ঘুম গলায় বলল, কী হয়েছে?

সকালবেলা সত্যি-সত্যি সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। রাতে এরকম ভয় পাওয়ার জন্যে লজ্জা লাগতে লাগল। জাভেদ কলেজে চলে যাবার পর সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মরিয়মকে তরকারি কাটায় সাহায্য করতে গেল। মরিয়ম বলল,

আফার শইল কী খারাপ?

না।

আফনের কিছু করণ লাগত না আফা। আফনে গিয়া হুইয়া থাকেন।

এইমাত্র তো ঘুম থেকে উঠলাম এখন আবার কী শুয়ে থাকব?

চা বানায়া দেই?

দাও। আচ্ছা মরিয়ম, তোমার আগের আপাও কি আমার মতো চা খেত?

হ। তয় আফনের মতো চুপচাপ থাকত না। সারাদিন হইচই করত। গানবাজনা করত।

মারা গেলেন কীভাবে?

হঠাৎ মাথা খারাপ হইয়া গেল। উল্টাপাল্টা কথা কওয়া শুরু করল–কী জানি দেখে।

প্রিয়াংকা শঙ্কিত গলায় বলল, কী দেখে?

দুইটা মানুষ না-কি দেখে। একটা আসল একটা নকল। কোনটা আসল কোনটা নকল বুঝতে পারে না।

তুমি কী বলছ তাও তো আমি বুঝতে পারছি না।

পাগল মাইনষের কথার কি ঠিক আছে আফা? নেন চা নেন।

প্রিয়াংকা মাথা নিচু করে চায়ের কাপে ছোট-ঘোট চুমুক দিচ্ছে। একবারও মরিয়মের দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তার ধারণা, তাকালেই মরিয়ম অনেক কিছু বুঝে ফেলবে। বুঝে ফেলবে যে প্রিয়াংকারও একই অসুখ হয়েছে। সে চায়

মরিয়ম কিছু বুঝুক। কারণ তার কিছুই হয় নি। অসুখ করেছে। অসুখ কি মানুষের করে না? করে। আবার সেরেও যায়। তারটা সারবে।

রাত গভীর হচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটুপ করে। খোলা জানালায় হাওয়া আসছে। প্রিয়াংকা জাভেদকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। তার চোখে ঘুম নেই।

পাশের ঘরে বইয়ের পাতা ওল্টানোর শব্দ হচ্ছে। এই যে সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। ইজিচেয়ার থেকে উঠল—কঁাচক্যাচ শব্দ হচ্ছে ইজিচেয়ারে।

প্রিয়াংকা স্বামীকে সজোরে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় ডাকল—এই-এই।

ঘুম ভেঙে জাভেদ বলল, কী?

প্রিয়াংকা ফিসফিস করে বলল, না কিছু না। তুমি ঘুমাও।

নন্দিনী

মজিদ বলল, চল্ তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।

বেশ রাত হয়েছে। চারদিকে ফিনফিনে কুয়াশা। দোকানপাট বন্ধ। হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। পাড়াগাঁর শহরগুলিতে আগেভাগে শীত নামে। মজিদ বলল, পা চালিয়ে চল। শীত কম লাগবে।

কোথায় যাবি?

চল না দেখি। জরুরি কোনো কাজ তো তোর নেই। নাকি আছে?

না নেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় রাস্তা ছেড়ে ইট বিছানো সরু রাস্তায় এসে পড়লাম। শহর অনেক বদলে গেছে। আগে এখানে ডালের কারবারিরা বসত। এখন জায়গাটা ফাঁকা। পিছনেই ছিল কার্তিকের মডার্ন সেলুন। সেখানে দেখি একটা চায়ের স্টল। শীতে গুটিশুটি মেরে লোকজন চা খাচ্ছে। আমি বললাম, এক দফা চা খেয়ে নিবি নাকি মজিদ

উহুঁ, দেরি হয়ে যাবে।

শহরটা বদলে গেছে একেবারে। মহারাজের চপের দোকানটা এখনো আছে?

আছে।

হাঁটতে-হাঁটতে ধর্মতলা পর্যন্ত চলে এলাম। ধর্মতলার গা ঘেঁষে গিয়েছে হাড়িখাল নদী। আমি আর মজিদ গোপনে সিগারেট টানবার জন্যে কতবার হাড়িখালের পাড়ে এসে বসেছি। কিন্তু এখন নদীটদী কিছু চোখে পড়ছে না।

নদীটা কোথায় রে মজিদ? হাড়িখাল এইদিকেই ছিল না?

ঐ তো নদী। সাবধানে আয়।

একটা নর্দমার মতো আছে এখানে। পা পিছলে পড়েই গিয়েছিলাম। সামলে উঠে দেখি নদী দেখা যাচ্ছে। আমরা নদীর বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। সরু ফিতের মতো নদী অন্ধকারেও চিকমিক করছে। আগে এখানে এরকম উঁচু বাঁধ ছিল না। নদীর ঢালু পাড়ে সরষের চাষ হত। মজিদ চুপচাপ হাঁটছিল।

আমি বললাম, আর দূর কত?

ঐ দেখা যাচ্ছে।

কার বাড়ি?

আয় মা চুপচাপ। খুব সারপ্রাইজড হবি।

একটি পুরনো ভাঙা দালানের সামনে দুজন থমকে দাঁড়ালাম। বাড়ির চারপাশ ঝোপঝাড়ে অন্ধকার হয়ে আছে। সামনের অপরিচ্ছন্ন উঠোনে চার-পাঁচটা বড়-বড় কাগজি লেবুর গাছ। লেবুর গন্ধের সঙ্গে খড়-পোড়ানো গন্ধ এসে মিশেছে। অসংখ্য মশার পিনপিনে আওয়াজ। মজিদ খটখট করে কড়া নাড়তে লাগল। ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় কেউ একজন বলল, কে?

মজিদ আরো জোরে কড়া নাড়তে লাগল। হারিকেন হাতে একটি লম্বা নোগামতো শ্যামলা মেয়ে দরজা খুলে দিল। মজিদ বলল, কাকে নিয়ে এসেছি দেখ।

আমি কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। মেয়েটি হাসিমুখে বলল, আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন তো? আমি নন্দিনী।

আমি মাথা নাড়লাম।

আপনি কবে দেশে ফিরেছেন?

দু-মাস হবে। এতদিন ঢাকায় ছিলাম। এখানে এসেছি গতকাল।

মজিদ বিরক্ত হয়ে বলল, ভিতরে আয় না। ভিতরে এসে বস্।

ঘরের ভিতরটা বেশ গরম। একটি টেবিলে কাচের ফুলদানিতে গন্ধরাজ ফুল সাজানো। চৌকিতে ধবধবে শাদা চাদর বিছানো। ঘরের অন্য প্রান্তে প্রকাণ্ড একটা ইজিচেয়ার। মজিদ গা এলিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়ল। হালকা গলায় বলল, চিনি এনেছি। একটু চা বানাও।

নন্দিনী হারিকেন দুলিয়ে চলে গেল। আমরা দুজন অন্ধকারে বসে রইলাম। মজিদ ফস করে বলল, সারপ্রাইজড় হয়েছিস নাকি?

হুঁ।

কেমন দেখলি নন্দিনীকে?

ভালো।

শুধু ভালোং ইজ নট শী ওয়ান্ডারফুল?

আমি সে কথার জবাব না দিয়ে বললাম, এই বাড়িতে আর কে থাকে?

সবাই থাকে।

সবাই মানে?

মজিদ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুই একবার নন্দিনীকে প্রেমপত্র লিখেছিলি না? অনেক কবিতাটবিতা ছিল সেখানে। তাই না?

আমি শুকনো গলায় বললাম, বাদ দে ওসব পুরানো কথা।

মজিদ টেনে-টেনে হাসতে লাগল।

পরের দশ মিনিট দুজনেই চুপ করে রইলাম। মজিদ একটির পর একটি সিগারেট টানতে লাগল। মাঝে-মাঝে হাসতে লাগল আপন মনে।

অনেকক্ষণ আপনাদের অন্ধকারে বসিয়ে রাখলাম। ঘরে একটা মোটে হারিকেন। কী যে করি!

নন্দিনী চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল।

চিনি হয়েছে চায়ে?

কাপে চুমুক দিয়ে মজিদ বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। আমি বললাম, অাপনাদের এদিকে খুব হওয়া তো।

হুঁ নদীর উপরে বাড়ি। হাওয়ার জন্যে কুপি জ্বালানোই মুশকিল।

ভেতর থেকে কে একজন ডাকল, বউ ও বউ।

নন্দিনী নিঃশব্দে উঠে গেল। আমি বললাম, তুই প্রায়ই আসিস এখানে?

আসি।

ব্যাপার কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।

আমি চুপ করে রইলাম। মজিদ বলল, রাত হয়ে যাচ্ছে, এইবার ফিরব। নন্দিনীকে কেমন দেখলি বল্ না শুনি।

ভালো। আগের মতোই, একটুও বদলায় নি।

নন্দিনী আমাদের ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ততক্ষণে চাঁদ উঠে গেছে। স্নান জোছনায় চারদিক কেমন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। মজিদ বলল, যাই নন্দিনী।

নন্দিনী কিছু বলল না। হারিকেন উঁচু করে বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে রইল। আমরা ধর্মতলা পর্যন্ত নিঃশব্দে হাঁটলাম। একসময় মজিদ বলল, কলেজের ফেয়ারওয়েলে নন্দিনী কোন্ গানটা গেয়েছিল মনে আছে?

না মনে নেই।

আমার আছে।

মজিদ গুনগুন করে একটা গানের সুর ভাজতে থাকল। হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, জানিস, নন্দিনীকে আমিই এ বাড়িতে এনে তুলেছিলাম।

তাই নাকি?

ওর বাবাকে তখন মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে।

সুরেশ্বর বাবুকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছিল নাকি?

মারবে না তো কী করবে? তুই কী যে কথা বলিস। মেরে তো সাফ করে ফেলেছে এদিকে।

আমি বললাম, সুরেশ্বর বাবু একটা গাধা ছিলেন। কত বললাম— মিলিটারি আসবার আগেই পালান। না পালাবেন না, একটামাত্র মেয়ে সঙ্গে নিয়ে হুস করে চলে যাবে, তা না ….।

মজিদ একদলা থুতু ফেলে বলল, নন্দিনী তখন এসে উঠেছে হারুনদের বাসায়। হিন্দু মেয়েদের সে সময় কে জায়গা দেবে বল? কী যে মুশিত হল। কতজনের বাড়িতে গিয়ে হাতজোড় করে বলেছি, এই মেয়েটিকে একটু জায়গা দেবেন। এর বড় বিপদ। কেউ রাজি হয় না। শেষকালে আজিজ মাস্টার রাজি।

আজিজ মাস্টার কে?

এখানকার মিউনিসিপ্যালিটি স্কুলের টিচার।

মজিদ একটি সিগারেট ধরাল। ঘন-ঘন ধোয়া টেনে কাশতে লাগল। আমি বললাম, পা চালিয়ে চল, বেশ রাত হয়েছে।

মজিদ ঠাণ্ডী সুরে বলল, নন্দিনী আজিজ মাস্টারের কাছে কিছুতেই থাকতে চায় নি। বারবার বলেছে— আপনি তো ইন্ডিয়া যাবেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান। পায়ে পড়ি আপনার। আমি ধমক দিয়ে বলেছি, তুমি হিন্দু মেয়ে মুসলমান ছেলের সঙ্গে যাবে, পথেঘাটে গিজগিজ করছে মিলিটারি। নন্দিনী কী বলেছিল জানিস?

কী?

আন্দাজ করতে পারিস কিছু?

আমি কথা বলার আগেই মজিদ চাপা গলায় বলল, নন্দিনী বলেছে, বেশ তাহলে আপনার বউ সেজে যাই। নাহয় আপনি আমাকে বিয়ে করুন।

মজিদ একদলা থুতু ফেলল। আমি বললাম, আজিজ খাঁ বুঝি বিয়ে করেছে একে?

হ্যাঁ।

আজিজ খাঁ কোথায়? তাকে তো দেখলাম না।

ও শালাকে দেখবি কী করে? ও মুক্তিবাহিনীর হাতে মরেছে। দালাল ছিল শালা। হিন্দু মেয়েকে মুসলমান বানিয়ে বিয়ে করেছে। বুঝতে পারছিস না? আর নন্দিনী কিনা তার বাড়িতেই মাটি কামড়ে পড়ে রইল। হারামজাদী।

আমি চুপ করে রইলাম। মজিদ দাঁড়িয়ে পড়ল। অকারণেই গলা উঁচিয়ে বলল, মেয়ে মানুষের মুখে থুতু দেই। তুই হারামজাদী ঐ বাড়িতে পড়ে আছিস কীজন্যে? কী আছে ঐ বাড়িতে? জোর করে তোকে বিয়ে করেছে, আর তুই কিনা ছিঃ ছিঃ!

দুজনে বাঁধ ছেড়ে শহরের প্রশস্ত পথে উঠে এলাম। বড় রাস্তাটা বটগাছ পর্যন্ত গিয়ে বেঁকে গেছে ডানদিকে। এদিকেই সুরেশ্বর বাবুর বাড়ি ছিল। আমি আর মজিদ সেই বাড়ির সামনে শুধুমাত্র নন্দিনীকে এক নজর দেখবার জন্যে ঘুরঘুর করতাম। কোনো কোনো দিন সুরেশ্বর বাবু অমায়িক ভঙ্গিতে ডাকতেন— আরেআরে তোমরা যে। এসো, এসো চা খাবে। মজিদ হাতের সিগারেট কায়দা করে লুকিয়ে ফেলে বলত, আরেক দিন আসব কাকা।

মজিদ নিঃশব্দে হাঁটছিল। আমি ডাকলাম, এই মজিদ।

কী?

চুপচাপ যে?

শীত করছে।

সে কান পর্যন্ত চাদর তুলে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, জানিস আমি আর নন্দিনী একটা গোটা রাত নৌকায় ছিলাম। রাতের অন্ধকারে আজিজ খার বাড়িতে নৌকা করে ওকে রেখে এসেছিলাম। খুব কাঁদছিল সে। আমি ওর ঘাড়ে একটা চুমু খেয়েছিলাম। মজিদ হঠাৎ কথা থামিয়ে কাশতে লাগল। আমি চারদিকের গাঢ় কুয়াশা দেখতে লাগলাম।

নিশিকাব্য

পরী মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে বাইরে এসে দেখে চমৎকার জোছনা হয়েছে। চিকমিক করছে চারদিক। সে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল। এরকম জোছনায় মন খারাপ হয়ে যায়।

বেশ রাত হয়েছে। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকেছে অনেক আগে। চারদিক ভীষণ চুপচাপ। শুধু আজিজ, সাপ-খেলানো সুরে পরীক্ষার পড়া পড়ছে। পরীর এখন আর কিছুই করার নেই। সে একাকী উঠোনে দাঁড়িয়ে রইল।

কী করছ ভাবী?

পরী ঘাড় ফিরিয়ে দেখল হারিকেন হাতে রুনু এসে দাঁড়িয়েছে। সে হালকা গলায় বলল, ঘুমুবে না ভারী?

ঘুমুব। দাঁড়া একটু। কী চমঙ্কার জোছনা দেখবি?

হুঁ।

আয় রুনু, তোকে একটা জিনিস দেখাই।

কী জিনিস?

ঐ দেখ জামগাছটার কেমন ছায়া পড়েছে। অবিকল মানুষের মতো না? হাত-পা সবই আছে।

ওমা, তাই তো। রুনু তরল গলায় হেসে উঠল।

পরী বলল, কুয়েতলায় একটু বসবি নাকি রে রুনু? চল্ বসি গিয়ে।

তোমার মেয়ে জেগে উঠে যদি?

বেশিক্ষণ বসব না, আয়।

কুয়েতলাটা বাড়ি থেকে একটু দূরে। তার দুপাশে দুটি প্রকাণ্ড শিরীষ গাছ। জায়গাটা বড় নিরিবিলি। রুনু বলল, কেমন অন্ধকার দেখেছ ভাবী? ভয় ভয় লাগে।

দূর, ভয় কিসের। বেশ হাওয়া দিচ্ছে, তাই না?

হ্যাঁ।

দুজনেই কুয়ের বাঁধানো পাশটায় চুপচাপ বসে রইল। ঝিরঝির বাতাস বইছে। বেশ লাগছে বসে থাকতে। পরী কী মনে করে যেন হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল।

হাসছ কেন ভাবী?

এমনি। রাস্তায় একটু হাঁটবি নাকি।

কোথায়?

চল্ না, হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ের দিকে যাই। বেশ লাগছে না জোছনাটা?

রুনু সে-কথার জবাব না দিয়ে ভয়-পাওয়া গলায় বলল, দেখ ভাবী, কে যেন দাঁড়িয়ে আছে ঐখানটায়

শিরীষ গাছের নিচে যেখানে ঘন হয়ে অন্ধকার নেমেছে, সেখানে শাদামতো কী-একটি যেন নড়ে উঠল।

কে ওখানে? কথা বলে না যে, কে?

কেউ সাড়া দিল না। রুনু পরীর কাছে সরে এল। ফিসফিস করে বলল, ভাবী, ছোট ভাইজানকে ডাক দাও।

তুই দাঁড়া না, আমি দেখছি। ভয় কিসের এত?

সাহস দেখাতে হবে না ভাবী, তুমি ছোট ভাইজানকে ডাকো।

শিরীষ গাছের নিচের ঘন অন্ধকার থেকে একটা লোক হেসে উঠল। হাসির শব্দ শুনেই রুনু বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল–বড় ভাইজান এসেছে। বড় ভাইজান এসেছে।

পর মুহূর্তেই সে ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়িতে খবর দিতে।

আনিস স্যুটকেস কুয়েতলায় নামিয়ে পরীর পাশে এসে দাঁড়াল। পরী কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। তার কেন জানি চোখে পানি এসে পড়ল।

টুকুন ভালো আছে, পরী?

হুঁ।

আর তুমি?

ভালো। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?

তোমাদের আসতে দেখে দাঁড়ালাম। কী মনে করেছিলে— ভূত?

পরী তার জবাব না দিয়ে হঠাৎ নিচু হয়ে কদমবুসি করল। আনিস অপ্রস্তুত হাসল।

কী যে কর তুমি পরী, লজ্জা লাগে।

ততক্ষণে হারিকেন হাতে বাড়ির সবাই বেরিয়ে এসেছে। পরী বলল, তুমি আগে যাও। সুটকেস থাক, রশীদ নিয়ে যাবে।

আনিস হাসিমুখে হাঁটতে লাগল।

বাড়ির উঠানে আনিস এসে দাঁড়াতেই আনিসের মা কাঁদতে লাগলেন। তার অভ্যাসই এরকম। যে-কোনো খুশির ব্যাপারে মরাকান্না কঁদতে বসেন। কেউ ধমক দিয়ে না-থামলে সে কান্না থামে না। আনিসের বাবা চেঁচিয়ে বললেন, একটা জলচৌকি এনে দে না কেউ, বসুক। সবগুলি হয়েছে গাধা। রুনু হাঁ করে দেখছিস কী? পাখা এনে হাওয়া কর।

আনিসের ছোটভাই আজিজ বলল, খবর দিয়ে আসে নাই কেন দাদা? খবর দিলেই ইস্টিশনে থাকতাম।

আনিস কিছু বলল না। জুতার ফিতা খুলতে লাগল। আনিসের মার কান্না তখনো থামে নি। এবার আজিজ ধমক দিল।

আহ্ মা, তোমার ঘ্যানঘ্যানানি থামাও।

সঙ্গে-সঙ্গে তার কান্না থেমে গেল। সহজ ও স্বাভাবিক গলায় তিনি বললেন, তোর শরীরটা এত খারাপ হল কী করে রে আনিস? পেটের ঐ অসুখটা সারে নি? চিকিৎসা করাচ্ছিস তো বাবা?

সবাই লক্ষ্য করল আনিসের শরীর সত্যি খারাপ হয়েছে। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে। গলি ভেতরে বসে গেছে। আনিসের বাবা বললেন, স্বাস্থ্য খারাপ হবে না? মেসের খাওয়া। পাঁচ বছর মেসে থাকলাম, জানি তো সব। বুঝলে আনিসের মা, মেসে খাওয়ার ধারাই ঐ।

পরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। আনিসের জন্য নতুন করে রান্না চড়াতে হবে। তবু তার ভেঁতরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। পরীর শাশুড়ি একসময় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ও কী বউমা, সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন? রান্না চড়াও গিয়ে। তার আগে আনিসকে চা দাও এক কাপ।

পরী অপ্রস্তুত হয়ে রান্নাঘরে চলে এল। রুনু এল তার পিছু-পিছু।

রুনু হেসে বলল, আমি চা বানিয়ে আনছি, তুমি ভাইজানের কাছে থাকো ভাবী। পরী লজ্জা পেয়ে হাসল।

তুই তো ভারী ফাজিল হয়েছিস রুনু।

হয়েছি তো হয়েছি। তোমাকে একটা কথা বলি ভাবী।

কী কথা?

রুনু ইতস্তত করতে লাগল। পরী অবাক হয়ে বলল, বল না কী বলবি।

বাবা আমার যেখানে বিয়ে ঠিক করেছেন সেটা আমার পছন্দ না ভাবী। ভাইজানকে বুঝিয়ে বলবে তুমি। দোহাই তোমার।

পরী আশ্চর্য হয়ে বলল, পচ্ছন্দ হয় নি কেন রুনু? ছেলেটা তো বেশ ভালোই। কত জায়গা জমি আছে। তার উপর স্কুলে মাস্টারি করে।

করুক। আমার একটুও ভালো লাগে নি। কেমন ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসছিল দেখতে এসে। না-না ভাবী, তোমার পায়ে পড়ি।

আচ্ছা-আচ্ছা, পায়ে পড়তে হবে না। আমি বলব।

রুনু খুশি হয়ে বলল, তুমি বড় ভালো মেয়ে ভাবী।

তাই নাকি?

হুঁ। ভাইজান হঠাৎ আসায় তোমার খুব খুশি লাগছে তাই না?

পরী জবাব না দিয়ে মুখ নিচু করে হাসতে লাগল।

বল না ভাবী খুব খুশি লাগছে?

লাগছে।

রুনু ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল! থেমে বলল, ভাইজানের চাকরিটা বড় বাজে। বৎসরে দশটা দিন ছুটি নেই। গত ঈদে পর্যন্ত আসল না।

পরী কিছু বলল না। চায়ের কাপে চিনি ঢালতে লাগল।

রুনু বলল, এবার তুমি বাসা করে ভাইজানের সঙ্গে থাকো ভাৰী। মেসের খাওয়া খেয়ে তার শরীর কী হাল হয়েছ দেখেছ?

পরী মৃদুস্বরে বলল, দুই জায়গায় খরচ চালানো কি সহজ কথা? অল্প কটা টাকা পায়। চা হয়ে গেছে, নিয়ে যা রে রুনু।

রুনু চা নিয়ে এসে দেখে তার বিয়ে নিয়েই আলাপ হচ্ছে। বাবা বলছেন, ছেলে হল তোমার বি.এ. ফেল। তবে এবার প্রাইভেট দিচ্ছে। বংশটংশ খুবই ভালো। ছেলের এক মামা ময়মনসিংহে ওকালতি করেন। তাঁকে এক ডাকে সবাই চিনে।

আনিসের মা বলেছেন, ছেলে দেখতে-শুনতে খারাপ না—রঙটা একটু মাজা। পুরুষমানুষের ফরসা রঙ কী আর ভালো ভালো না।

আনিস বলল, রুনুর পছন্দ হয়েছে তো? তার পছন্দ হলে আর আপত্তি কী?

পাশের বাড়ি থেকে আনিসের ছোটচাচা এসেছেন খবর পেয়ে। তিনি বললেন, রুনুর আবার পছন্দ-অপছন্দ কী? আমাদের পছন্দ নিয়ে কথা।

আনিস রুনুর দিকে তাকিয়ে হাসল। লজ্জা পেয়ে রুনু চলে এল রান্নাঘরে।

আনিসের বাবা বললেন, কাল বিকালে না হয় ছেলেটাকে খবর দিয়ে আনি। তুই দেখ।

কাল বিকাল পর্যন্ত তো থাকব না বাবা। আজ শেষরাতেই যাব।

সে কী!

ছুটি নিয়ে আসি নি তো। কোম্পানি একটা কাজে পাঠিয়েছিল ময়মনসিংহ। অনেকদিন আপনাদের দেখি নাই। কাজটাও হয়ে গেল সকাল-সকাল। তাই আসলাম।

একটা দিন থাকতে পারিস না?

উঁহু। কাল অফিস ধরতেই হবে। প্রাইভেট কোম্পানি, বড় ঝামেলার চাকরি।

আনিস একটা নিশ্বাস ফেলল। সবাই চুপ করে গেল হঠাৎ। চার মাস পর এসেছে আনিস। আবার কবে আসবে কে জানে। আনিসের মা কাঁপা গলায় বললেন, তোর বড় সাহেবকে একটা টেলিগ্রাম করে দে না।

আনিস হেসে উঠল। গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে বলল, বড়কর্তা যদি কোনোমতে টের পায় আমি বাড়িতে এসে বসে আছি তাহলেই চাকরি নষ্ট হয়ে যাবে। গোসল করব মা, গা কুটকুট করছে।

কুয়োয় করবি? পানি তুলে দেবে?

উঁহু, পুকুরে করব। পুকুরে মাছ আছে রে আজিজ?

আছে ভাইজান। বড়-বড় মৃগেল মাছ আছে।

আনিসের পিছু-পিছু পুকুরপাড়ে সবাই এসে পড়ল। আনিসের বাবা আর মা পাড়ে বসে রইলেন। আজিজ ভীষণ গরম লাগছে এই বলে আনিসের সঙ্গে গোসল করতে নেমে গেল। ঝুনু ঘাটের উপর তোয়ালে আর সাবান নিয়ে অপেক্ষা করছে। আনিসের সবচেয়ে ছোটবোন ঝুনু, ঘুমিয়ে পড়েছিল। আনিস ভোর রাত্রে চলে যাবে শুনে তার ঘুম ভাঙানো হয়েছে। সেও এসে চুপচাপ রুনুর পাশে বসেছে। শুধু পরী আসে নি। দুটি চুলোয় রান্না চাপিয়ে সে আগুনের আঁচে বসে আছে একাকী।

খাওয়াদাওয়া শেষ হতে-হতে অনেক রাত ইল। আনিসকে ঘিরে গোল হয়ে সবাই বসে গল্প করতে লাগল। উঠোনে শীতল পাটিতে বসেছে গল্পের আসর। এর মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে রুনু ঘুমুচ্ছে। চমত্তার চাদনি, সেইসঙ্গে মিষ্টি হাওয়া। কারুর উঠতে ইচ্ছে করছে না। পরীর কাজ শেষ হয় নি। সে বাসনকোসন নিয়ে ধুতে গেছে ঘাটে। এক সময় রুনু বলল, ভাইজান এখন ঘুমোতে যাক মা। রাত শেষ হতে দেরি নেই বেশি। আনিসের বাবা বললেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা রে তুই ঘুমুতে যা। রুনু তুই বউ-মাকে পাঠিয়ে দে। বাসন সকালে ধুলেই হবে।

ঘরের ভিতর হারিকেন জ্বলছিল। আনিস সলতে বাড়িয়ে দিল। টুকুন কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। আনিস চুমু খেল তার কপালে। পরীর দিকে তাকিয়ে বলল, জ্বর নাকি টুকুনের?

হুঁ।

কবে থেকে?

কাল থেকে। সর্দি জ্বর। ও কিছু না। ঘাম দিচ্ছে, এক্ষুনি সেরে যাবে।

আনিস পরীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। পরীর লজ্জা করতে লাগল। পরী বলল, হাসছ কেন?

এমনি। পরী তোমার জনো শাড়ি এনেছি একটা। দেখ তো পছন্দ হয় কিনা।

পরী খুশি-খুশি গলায় বলল, অনেকগুলি পয়সা খরচ করলে তো।

শাড়িটা পর, দেখি কেমন তোমাকে মানায়।

রুনুর জন্যে একটা শাড়ি আনলে না কেন? বেচারির একটাও ভালো শাড়ি নেই।

পয়সায় কুলোলে আনতাম। আরেকবার আসার সময় আনব।

পরী ইতস্তুত করে বলল, আমার একা একা শাড়ি নিতে লজ্জা লাগবে। এইটি রুনুর জন্যে থাক! আরেকবার নিয়ে এসো আমার জন্যে।

আনিস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেশ থাক তবে, আজ রাতের জন্য পর না দেখি?

শাড়ির ভাঁজ ভেঙে যাবে যে। রুনু মনে করবে আমার জন্যে এনেছিলে পরে তাকে দিয়েছ।

আচ্ছা, তাহলে থাক।

পরী লজ্জিত স্বরে বলল, বিয়ের শাড়িটা পরব? যদি বল তাহলে পরি।

পরী লজ্জায় লাল হয়ে ট্রাঙ্কের তালা খুলতে লাগল। আনিস বলল, টুকুন দেখতে তোমার মতো হয়েছে, তাই না?

হ্যাঁ, আব্বা তাকে ছোট পরী ডাকে। আচ্ছা টুকুনের একটা ভালো নাম রাখ না কেন?

জরী রাখব তার নাম।

জরী আবার কেমন নাম?

তোমার সঙ্গে মিলিয়ে রাখলাম। পরীর মেয়ে জরী।

পরী হেসে উঠল। হাসি থামলে বলল, অন্যদিকে তাকিয়ে থাক, শাড়ি বদলাব।

কী হয় অন্য দিকে তাকালে?

আহ্ শুধু অসভ্যতা।

আনিস মাথা নিচু করে টুকুনকে আদর করতে লাগল। পরী হালকা গলায় বলল, দেখ তো কেমন লাগছে?

একেবারে লাল পরী।

ইশ, শুধু ঠাট্টা।

 

রান্নাঘর থেকে ধুপধাপ শব্দ উঠছে।

আনিস বলল, এত রাতে ধান কুটছে কেন?

ধান কুটছে না চাল ভাঙছে। তোমার জন্যে পিঠা তৈরি হবে।

নিশ্চয়ই রুনুর কাণ্ড।

আনিস পরীর হাত ধরে তাকে কাছে টানল। পরীর চোখে আবার পানি এসে পড়ল। গাঢ়স্বরে বলল, আবার কবে আসবে?

জুলাই মাসে।

কতদিন থাকবে তখন?

অ-নে-ক দিন।

তুমি এত রোগা হয়ে গেছে কেন? পেটের ঐ ব্যথাটা এখনো হয়?

হয় মাঝে-মাঝে।

টুকুন কেঁদে জেগে উঠল। পরী বলল, জ্বর আরো বেড়েছে। ও টুকুন সোনা, কে এসেছে দেখ। দেখ তোমার আব্ব এসেছে।

আনিস বলল, আমার কোলে একটু দাও তো পরী। আরে-আরে মেয়ের একটা দাঁত উঠেছে দেখছি। কী কাণ্ড! ও টুকুন, ও জরী, একটু হাস তো মা। ও সোনামণি, দেখি তোমার দাঁতটা?

টুকুন তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। তাই দেখে আনিস ও পরী দুজনেই হাসতে লাগল।

আমার জরী সোনা কথা শিখছে নাকি, পরী? হুঁ। মা বলতে পারে। আর পাখি দেখলে বলে, ফা ফা।

আনিস হো-হো করে হেসে উঠল যেন ভীষণ একটা হাসির কথা। হাসি থামলে বলল, আমার জরী তোমার চেয়েও সুন্দর হবে। তাই না পরী?

আমি আবার সুন্দর নাকি?

না, তুমি ভীষণ বিশ্রী।

আনিস আবার হেসে উঠল। তার একটু পরেই বাইরে কাক ডাকতে লাগল। আনিসের বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। ও আনিস, ও আনিস।

জি বাবা।

এখন রওনা না দিলে ট্রেন ধরতে পারবি না বাবা।

আনিস টুকুনকে শুইয়ে দিল বিছানায়। পরী কোনো কথা বলল না।

আনিস বাইরে বেরিয়ে দেখল চাদ হেলে পড়েছে। জোছনা ফিকে হয়ে এসেছে। বিদায়ের আয়েজন শুধু হল। ঘুমন্ত ঝুনুকে আবার ঘুম থেকে টেনে তোলা হল। সে হঠাৎ বলে ফেলল, ভাবী আজ বিয়ের শাড়ি পরেছে কেন?

কেউ তার কথার কোনো জবাব দিল না। মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী আকাশের চাদ। পরীকে অহেতুক লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্যেই হয়তো একখণ্ড বিশাল মেঘের আড়ালে তার সকল জোছনা লুকিয়ে ফেলল।

লম্বা-লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চলল আনিস। শেষরাতের ট্রেনটা যেন কিছুতেই মিস না হয়।

পিশাচ

স্যার, আমি পিশাচ-সাধনা করি।

আমি কৌতূহল নিয়ে পিশাচ সাধকের দিকে তাকালাম। মামুলি চেহারা। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় চুল নেই। শরীরের তুলনায় মাথা বেশ ছোট। সেই মাথা শারীরিক কোনো অসুবিধার কারণেই হয়তো সারাক্ষণ বামদিকে ঝুঁকে আছে। তার হাতে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা পাখির খাঁচা। খাঁচায় যে পাখিটা আছে সেটা খুব সম্ভব কাক। পা ছাড়া পাখিটার আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কাকের পা বলেই মনে হচ্ছে।

লোকটার বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। গ্রামের অভাবী মানুষের বয়স চট করে ধরা যায় না। দুঃখ ধান্দায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরেই তাদের মধ্যে বুড়োটে ভাব চলে আসে। আমার কাছে মনে হলো, লোকটার বয়স চল্লিশের বেশি হবে না। মাথার চুল অবিশ্যি বেশির ভাগই পাকা। মুখের চামড়াও ঝুলে পড়েছে।

লোকটার পরনে টকটকে লাল রঙের নতুন লুঙ্গি। গলায় একই রঙের লাল চাদর উড়নির মতো ঝোলানো। এটাই সম্ভবত পিশাচ-সাধকদের পোশাক। সব ধরনের সাধকদের জন্যে পোশাক আছে— ড্যানসিং দরবেশরা আলখাল্লা পরেন, সন্ন্যাসীরা গেরুয়া পরেন, নাগা সন্ন্যাসীরা নগ্ন থাকেন। পিশাচ-সাধকরা লাল লুঙ্গি এবং লাল চাদর কেন পরবে না? আমি পিশাচ-সাধকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, তুমি তাহলে পিশাচের সাধনা করো?

পিশাচ-সাধক সব কটা দাঁত বের করে হাসল। আনন্দিত গলায় বলল, কথা সত্য।

লোকটার দাঁত ঝকঝকে সাদা। গ্রামের মানুষরা পান-সিগারেট খেয়ে দাঁত কুৎসিতভাবে নোংরা করে রাখে, এর বেলায় তা হয়নি।

নাম কী তোমার?

মকবুল। স্যার, আমি পিশাচ-সাধক মকবুল। যদি অনুমতি দেন আপনেরে কদমবুসি করি।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, অনুমতি দিলাম।

সে অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, পায়ে হাত দিবো না স্যার। ভয়ের কিছু নাই।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, পায়ে হাত দিলে ভয়ের কী?

পিশাচ-সাধনা যারা করে তারা কারোর শইল্যে হাত দিলে বিরাট ক্ষতি হয়।

ক্ষতিটা কার হয়— তোমার, তুমি যার গায়ে হাত দিবে তার?

আমি যার শইল্যে হাত দিবো তার। আপনের শইল্যে হাত দিলে আপনার বিরাট ক্ষতি হইবো। যেখানে হাত দিবো সেখানে ঘা হইবো।

পায়ে হাত দাও। দেখি ক্ষতি কী হয়। ঘা হয় কি-না।

ছি-ছি! কন কী আপনে? আপনের ক্ষতি হবে এমন কাজ পিশাচ-সাধক মকবুল করব না।

সে আমার পা থেকে এক-দেড় হাত দূরে মাটিতে হাত দিয়ে ভক্তিভরে কদমবুসি করল। কদমবুসির পর দুহাত জোড় করে চোখবন্ধ অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করল। কে জানে পিশাচ-সাধকদের কদমবুসি করার এটাই হয়তো নিয়ম। বিপুল বিশ্বের কতই বা আমি জানি।

তোমার খাঁচায় কী? কাক না-কি?

জি স্যার কাক। আমরা বলি কাউয়া।

তোমার কাকের ব্যাপারটা কী বলো তো?

সাধনার জন্যে লাগে স্যার।

ও আচ্ছা।

গ্রাম বেড়াতে এলে এ-জাতীয় যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়। দুতিন দিনের জন্যে যাই। নানান ধরনের মানুষ এর মধ্যে আসে। মূল উদ্দেশ্য অর্থভিক্ষা। সরাসরি ভিক্ষা চাইতে সংকোচ হয় বরেই নানান কিচ্ছা-কাহিনীর ভেতর দিয়ে তারা যায়। একবার এক মওলানা সাহেব এসেছিলেন। তাকে নাকি আমাদের নবী-এ করিম স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছেন–তোর ছেলেকে আমার রওজা মোবারকে এসে দোয়া করে যেতে বল। সে যে দোয়া করবে ইনশাল্লাহ তা-ই কবুল হবে। মওলানা সাহেব এসেছেন ছেলের মদিনা-ভ্রমণের টাকা সংগ্রহ করতে।

এইসব ক্ষেত্রে আমি কোনো তর্কে যাই না। টাকা দিয়ে দেই। তেমন বেশি কিছু না, সামান্যই। তাতেই তারা খুশি হয়। তাদের প্রত্যাশাও হয়তো অল্পই থাকে।

আমি ঠিক করেছি পিশাচ-সাধককে পঞ্চাশ টাকা দেবো। পিশাচ-সাধক যে এই টাকা পেয়েই মহাখুশি হবে সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তার আনন্দ আরো বাড়বে যদি কিছুক্ষণ তার সঙ্গে গল্প করি। আমাদের অঞ্চলের গ্রামের মানুষ অলস প্রকৃতির। অলস মানুষের আনন্দ-বিলাস গল্পগুজব। হাসিমুখে কিছুক্ষণ গল্প করলেই তারা খুশি। আমি গল্প শুরু করলাম।

তুমি তাহলে পিশাচ-সাধক?

জি স্যার।

জিন-সাধনার কথা গুনেছি, পিশাচ-সাধনার কথা শুনি নি।

পিশাচ-সাধনা আরো জটিল। পিশাচ নিয়া কারবার। এরা ভয়ঙ্কর। সাধনাও কঠিন।

এমন ভয়ঙ্কর সাধনার দিকে গেলে কী জন্যে

মন ওইদিকে টানছে। মনের উপরে তো হাত নাই। কপালগুণে ভালো ওস্তাদও পেয়েছিলাম।

ওস্তাদের নাম কী?

উনার নাম কলিমুল্লাহ দেওয়ানি।

নাম তো জবরদস্ত।

উনি মানুষও জবরদস্ত ছিলেন। আলিশান শরীর। কথা যখন বলতেন মনে হইতো মেঘ ডাকর্তেছে এক বৈঠকে দুইটা কাঁঠাল খাইতে পারতেন।

মারা গেছেন না-কি?

জি, উনার ইন্তেকাল হয়েছে। বড়ই দুঃখের মৃত্যু। ঘটনাটা বলব?

বলো।

এক মঙ্গলবার সন্ধ্যাকালে তিনি ঘর থাইক্যা বাইর হইছেন। মনের বেখেয়ালে শরীর বন্ধন দেন নাই। পিশাচ আইসা ধরল। মট কইরা একট শব্দ হইল। মাথায় মোচড় দিয়া দিল ঘাড় ভাইঙ্গা।

পিশাচ-সাধনা দেখি খুবই বিপদজনক ব্যাপার।

বিপদ বলে বিপদ! চিন্তায় চিন্তায় অস্থির থাকি। ভুলভ্রান্তি হইলে বাচনের উপায় নেই।

পিশাচ-সাধককে দেখে অবিশ্যি আমার মনে হলো না সে কোনোরকম চিন্তায় আছে। তাকে বরং আনন্দিতই মনে হলো।

খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?

জি-না, খাওয়া হয় নাই।

খাওয়া-দাওয়াতে কোনো বাছ বিচার আছে?

জি-না, আমরা সবই খাইতে পারি। তবে টক খাওয়া নিষেধ। টক ছাড়া সবই চলে। মাছ-মাংস ডিম-দুধ … অসুবিধা কিছু নাই।

আমি মানিব্যাগ খুলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে খুবই আগ্রহের সঙ্গে নোটটা নিল। আবারো কদমবুসি। আবারো হাত জোড় করে চোখবন্ধ অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়ানি। খাচায় বন্ধি কাকও এইসময় ডানা ঝাঁপটাতে শুরু করল। কফ লাগা গলায় কয়েবার বলল, কা-কা। মোটামুটি রহস্যময় দৃশ্য।

মকবুল বলল, স্যারের সঙ্গে কথা বইল্যা আরাম পাইছি। জমানা খারাপ, মানুষের সাথে কথা বইল্যা এই জামানায় কোনো আরাম নাই। এই জামানা হইল অবশ্বিাসের জমানা। কেউ কারো কথা বিশ্বাস করে না। আমারে নিয়া হাসাহাসি করে। স্যার, আমারে চাইরটা ভাত দেওনের হুকুম দিয়া দেন। আপনে হুকুম না দিলে এরা ভাত দিবো না। একবাটি মুড়ি খাওয়াইয়া বিদায় কইরা দিবো।

ভালোমতো যাতে খাওয়া-দাওয়া করতে পারো সে ব্যবস্থা করছি।

খাওয়া-খাদ্য না পাইলেও আমরার চলে। পিশাচের সাধনা করি, আমরার স্বভাব-চরিত্রও পিশাচের মতো। তিন-চাইর দিন না খাইলেও আমরার কিছু হয় না। আবার ধরেন, মরা লাশ পইড়া আছে, প্রয়োজনে লাশের মাংসও খাইতে পারব, অসুবিধা নাই।

খেয়েছ কখনো?

জি-না।

খাওনি কেন?

প্রয়োজন পড়ে নাই। তা ছাড়া লাশ পাওয়াও যায় না। হিন্দুরা লাশ পুড়ায়ে ফেলে। মুসলমানরা দেয় কবর। কবর থাইক্যা লাশ বাইর কইরা খাওয়া বিরাট দিকদারি। ঠিক না স্যার?

ঠিক তো বটেই। তোমার সাধনার ফলাফল কী? পিশাচ বশ মানবে?

অবশ্যই। আমি নিজেও পিশাচের মতো হয়ে যাব। দিলে মায়া-মুহব্বত কিছু থাকব না। ইচ্ছা হইল খুন করলাম, থানা-পুলিশ কিছু করতে পারব না।

খুন করতে ইচ্ছা করে?

জে-না। করে না।

তাহলে এত কষ্ট করে এই সাধনা করছ কেন? সাধনা করে পিশাচ হবার দরকারইবা কী! আমাদের সমাজে পিশাচের তো অভাবও নেই। সাধনা ছাড়াই অনেক পিশাচ আছে?

কথা সত্য বলেছেন। তবে স্যার ঘটনা হইল পিশাচ-সাধনা থাকলে লোকজন ভয় পায়। সমীহ করে। একজন পিশাচ-সাধকরে কেউ তুই-তুকারি করবে না। আপনে আপনে করবে। কারোর বাড়িতে গেলে মাটিতে বসতে হবে না। চিয়ার দিবে। যার চিয়ার নাই সে জলচৌকি দিবে। মুড়ি খাওয়াইয়া বিদায় দিবে না, গরম ভাত দিবে। সালুন দিবে। দিবে কি-না বলেন?

দেওয়া তো উচিত।

বিপদে-আপদে সবেই ছুইটা আসবে আমার কাছে। এরে বান মারতে হবে। তারে বশীকরণ মন্ত্র দিতে হবে। বান ছুটাইতে হবে। পিশাচ-সাধকের কাজের কী শেষ আছে? ঠিক বলেছি না স্যার?

ঠিকই বলেছ।

টাকাপয়সা ধনদৌলতেরও তখন সমস্যা নেই। জমি-জিরাত করব। ঘরবাড়ি করব। শাদি করব। আমি স্যার অখনো শাদি করি নাই। ঘর নাই, দুয়ার নাই। খাওয়া-খাদ্য নাই। আমার কাছে মেয়ে কে দিবো কন।

পিশাচ-সাধকের কাছেও কি আর মেয়ে দিবে? মেয়ের বাবা-মার কাছে পিশাচ পাত্র হিসাবে ভালো হবার কথা না।

মকবুল দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, সেইটা কোনো বিষয় না স্যার। সাধনার শেষে যারে ইচ্ছা তারে আমি বিবাহ করতে পারব। পিশাচই ব্যবস্থা কইরা দিবে। আমার কিছু করতে হবে না।

তাই না-কি?

অত কষ্ট কইরা সাধনা যে করতেছি বিনা কারণে তো করতেছি না। আমি তো বেকুব না। এই যে আপনার সঙ্গে এত গল্প করলাম, আপনার কি মনে হয়েছে আমি বেকুব?

তা মনে হয় নাই।

পিশাচ-সাধনায় যারা পাশ করে, তারা ইচ্ছা করলে অন্যের বিবাহিত ইসতিরিরেও বিবাহ করতে পারে। যেমন মনে করেন, এক লোক তার পরিবার নিয়া সুখে আছে। তার দুইটা ছেলেমেয়েও আছে। আমি পিশাচ-সাধনায় পাশ করা মকবুল যদি সেই লোকের পরিবাররে বিবাহ করতে চাই, তাইলে সঙ্গে সঙ্গে তারার সুখের সংসারে আগুন লাঘব। ছাড়াছাড়ি হইয়া যাইব। আমি আপসে সেই মেয়েরে বিবাহ করব। সেই মেয়েও আমার জন্যে থাকবে দিওয়ানা।

এ-রকম কোনো পরিকল্পনা কি আছে? পিশাচ-সাধক মকবুল মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো, এটাই তার পিশাচ-সাধনার মূল প্রেরণা। ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা যাচ্ছে।

কাকে বিয়ে করতে চাও। মেয়েটা কে?

আমার মামতো বোন নাম কইতরি। তার বিবাহ হয়ে গেছে। নবীনগরের কাঠমিস্ত্রি ইসমাইলের সঙ্গে বিবাহ হয়েছে। তারার দুইটা পুত্রসন্তানও আছে। সুখের সংসার। অন্যের সুখের সংসার ভাঙলে বিরাট পাপ হয়। আমি পিশাচ, আমার আবার পাপপুণ্য কী? ঠিক বলেছি না স্যার?

আমি জবাব দিলাম না। মানুষটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কাকের খাচা নিয়ে আমার সামনে যে উবু হয়ে বসে আছে, সে কোনো সাধারণ মানুষ না। পিশাচ-সাধনা করুক বা না করুক, সে বিরাট প্রেমিকপুরুষ।

মকবুল গলা নামিয়ে বলল, কইতরির চেহারা এমন কিছু না। গায়ের রং শ্যামলা। মাথার চুল অল্প। সন্তান হওনের পরে বেজায় মোটা হয়েছে। কিন্ত স্যার তার জন্যে সব সময় কইলজা পুড়ে। বুক ধড়ফড় করে। রাইতে ঘুম হয় না। আমি থাকি নবীনগরে। একদিনের জন্যেও নবীনগর ছাইড়া যাইতে পারি। এই যে আপনের কাছে আসছি, একটা দিন থাকলে আপনের ভালোমন্দ দুইটা কথা শুনতে পারি–সেই উপায় নাই। আমার নবীনগর যাইতেই হবে।

কইতরির সঙ্গে তোমার কথাবর্তা হয়?

জে-না। তার বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করি। ক্বচিৎ তারে দেখি। একদিন দেখেছি তার ছেলেটারে নিয়া পুসকুনির দিকে যাইতেছে। সে আমারে দেখে নাই। ছেলে দুইটাও সুন্দর হয়েছে মাশাল্লাহ। বড়টার নাম গোলাপ, ছোটটার নাম সুরুজ।

সব খবরই দেখি রাখ।

কী বলেন স্যার, রাখব না! আপনে একটু দোয়া কইরেন, পিশাচ-সাধনা যেন তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারি।

তুমি সাধনার কোন পর্যায়ে আছ?

মাত্র শুরু করেছি, সময় লাগব। পানিতে চুবাইয়া দশটা কাউয়া মারণ লাগব। এইটা এখনো পারি নাই। এই কাউয়াটা সাথে নিয়া ঘুরতেছি ছয় মাসের উপরে হইছে। দুইবাৰ্ব প্ৰসকুনিতে নামছি এরে চুবাইয়া মারার জন্যে, দুইবারই উইঠা আসছি। জীবন্ত একটা প্রাণী পানিতে চুবাইয়া মারা তো সহজ কথা না। একবার পানিতে ডুবাইয়াই টান দিয় তুললাম। কাউয়া কিছু বুঝে নাই। হে ভাবছে আমি তারে গোসল দিছি। পশুপাখির বুদ্ধি তো আমরার মতো না। তারার বুদ্ধি কম।

কাকটা ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরার দরকার কী?

কাউয়ার উপরে মুহব্বত জন্মাইছে। ছাইড়া দিতে মন চায় না। ছাড়লেও হে যায় না। মুহব্বতের মর্ম পশুপাখিও বুঝে। এই দেখেন ছাড়তাছি। সে যাবে না।

মকবুল খাঁচার দরজা খুলে দিল। কাকটা বের হয়ে এসে মকবুলের চারপাশে গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবারো খাঁচায় ঢুকে গেল।

স্যার, আমার জন্যে খাস দিলে দোয়া কইরেন, যেন পিশাচ-সাধনা শেষ করতে পারি।

কাক মারতে পারবে?

উপায় কী! মারতে হবে। যে সাধনার যে নিয়ম। দিল শক্ত করার চেষ্টা নিতাছি। হবে, দিল শক্ত হবে। সময় লাগবে। লাগুক। তাড়াহুড়ার তো কিছু নাই। কী বলেন স্যার?

খাঁচার ভেতর থেকে কাক আবারো কা-কা করে দুবার ডাকল। মকবুল বিরক্ত গলায় বলল, খাওন তো দিবোরে বাপ। তরে খাওন না দিয়া আমি খাব? তুই আমারে ভাবস কি! চুপ কইরা থাক, স্যারের সাথে মূলবান আলাপ করতেছি।

কাক চুপ করে গেল।

আমি তাকিয়ে আছি। অবাক হয়ে এমন একজনকে দেখছি যে হৃদয়ে ভালোবাসার সমুদ্র ধারণ করে পিশাচ হবার সাধনা করে যাচ্ছে।

বিভ্রম

মিলির হঠাৎ মনে হলো তার সামনে বসে থাকা যুবকটা বিরাট চোর। এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। তারা দুজন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে এসেছে। কোনার দিকের একটা টেবিল তাদের জন্যেই বুক করা। মিলির বড় খালা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মালিকের সঙ্গেও কথা বলে রেখেছেন— কোনার দিকের একটা টেবিল দেবেন। বেয়ারারা যেন ঘনঘন বিরক্ত না করে। ওঁরা দুএক থাকবে।

ঘটনাটা হচ্ছে–মিলির সামনে বসে থাকা ছেলেটার নাম সুজাত আলি। নিউইয়র্কে থাকে। দেশে এসেছে বিয়ে করতে। মিলির বড়খালা সালেহা বেগম খুব চেষ্টা করছেন যেন ছেলেটার সঙ্গে মিলির বিয়ে হয়ে যায়। মিলির বিয়ে নিয়ে খুব ঝামেলা হচ্ছে। একটার পর একটা বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। মিলির চেহারা মোটেই অসুন্দর না। গায়ের রঙ চাপা। নাকটা মোটা। মোটা নাকে তাকে খারাপ লাগে না। মিলির নিজের ধারণা মোটা নাকের কারণে তার চেহারায় মায়া ভাব বেড়েছে। কয়েক দিন আগে HBO-তে টাইম মেশিন নামে সে একটা ছবি দেখেছে। ছবির নায়িকার সঙ্গে তার মিল আছে। নায়িকার গায়ের রঙ কালো। নাক থ্যাবড়া। তারপরেও এত মিষ্টি চেহারা।

হ্যান্ড ব্যাগে রাখা মিলির মোবাইল টেলিফোন বাজছে। নিশ্চয়ই তার বড় খালা। উনার টেনশান বাতিক আছে। এই নিয়ে দশ মিনিটের মাথায় তিনবার টেলিফোন করলেন।

মিলি।

হুঁ।

ছেলে এসেছে?

হুঁ।

এখন তোর সামনে?

না। সিগারেট কিনতে গেছে।

তোর সঙ্গে কথা হয়েছে?

না। শুধু বলেছে সিগারেটের প্যাকেট ফেলে এসেছে। কিনতে গেছে।

ছেলেকে দেখে কেমন মনে হলো? তোর ফার্স্ট ইমপ্রেশন কী?

চেহারায় চোর ভাব আছে।

চেহারায় চোর ভাব আছে মানে?

দেখেই মনে হয়েছে বিরাট চোর। খালা আমি রাখি। চোরটা আসছে।

মিলি মোবাইল পুরোপুরি অফ করে দিল। বড় খালা একটু পরপর টেলিফোন করবেন। লাইন না পেয়ে বিরক্ত হবে। বিরক্ত হলেই ভালো–একটা চোরের সঙ্গে তিনি বিয়ের কথাবার্তা চলাচ্ছেন।

সুজাত আলি চেয়ারে বসতে বসতে আনন্দিত গলায় বলল, বাংলাদেশে সিগারেট তো খুবই সস্তা। মাত্র ৭৫ টাকা নিল। নিউইয়র্কে এই প্যাকেট কিনতে লাগত চার ডলার। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় আড়াইশ টাকা।

মিলি বলল, দেশ থেকে বেশি করে সিগারেট কিনে নিয়ে যান।

এক কার্টনের বেশি নিতে দে না।

চুরি করে নিয়ে যাবে। স্যুটকেস ভর্তি থাকবে সিগারেট।

সুজাত আলি শব্দ করে হাসছে। মিলি প্রায় শিউরে উঠল। লোকটার কালো মাড়ি বের হয়ে এসেছেন। কালো মাড়ির উপর ঝকঝকে ধারালো দাঁত। সে দুই হাত টেবিলে রেখেছে। মোটা মোটা আঙুল। হাত ভর্তি হলাম। লোকটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, খাবারের অর্ডার দিয়ে দাও।

মিলি একবার ভাবল বলে, আমার সঙ্গে আজ আপনার প্রথম দেখা। আমি কোনো বাচ্চা মেয়ে না। এই বৎসর ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করেছি। প্রথম দেখাতেই আমাকে তুমি তুমি করে কেন বলছেন? সে কিছু বলল না।

লোকটা এখন নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। মিলির কী বলা উচিত দয়া করে নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়বেন না। ঠেলাওয়ালারা বিড়ি খেয়ে নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।

মিলি।

জি।

স্যুপের অর্ডার দিবে না। আমি স্যুপ খাই না।

পানি খেয়ে পেট ভর্তি।

অর্ডারটা আপনিই দিন।

ঠিক আছে।

সিগারেট শেষ করে নেই।

মিলি বলল, নিউইয়র্কে আপনি কী করেন?

অড জব করি।

অড জব কী?

যখন যেটা পাই। উইক এন্ডে ক্যাব চালাই।

মিলি বলল, বড় খালা বলেছিলেন আপনি কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছেন।

সুজাত আলি বলল, আত্মীয়স্বজনরা এইটা ছড়ায়েছে। যাতে আমাকে বিয়ে দিতে পারে এইজন্যে। ট্যাক্সি ড্রাইভার শুনলে তো কেউ মেয়ে বিয়ে দিবে না। ঠিক না?

মিলি বলল, কেউ-কেউ হয়তো দিবে। যারা মহা বিপদ আছে তারা। আপনি তো অনেক মেয়ে দেখেছেন। তাদের অবস্থা?

বেশি মেয়ে দেখি নাই। তুমি থার্ড। এর আগে দুইজনকে দেখেছি। ওনলি টু।

সবই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে?

উহুঁ। একজনকে দেখলাম বসুন্ধারা বলে একটা বড় শপিং কমপ্লেক্স যে করেছে সেখানে। সেখানে নয়তলায় ফুডকোর্ট করেছে। ফুডকোর্টে আমি একটা বার্গার খেয়েছি আর মেয়েটা কোক খেয়েছে।

মেয়েটার নাম মনে আছে?

নামটা ভুলে গেছি। আচ্ছা দাঁড়াও তোমাকে জেনে দিব। তালিব্যশ দিয়ে নাম। নাম।

মিলি বলল, মেয়েকে পছন্দ হয়েছিল?

সুজাত আলি ঝলল, পছন্দ হয়েছে। মেয়ের গায়ের রঙ ভালো। মুখের কাটিং ভালো। শুধু শর্ট। উঁচা হাই হিল পরে এসেছে তারপরেও শর্ট। মেয়েটার নাম এখন মনে পড়েছে। শায়লা।

মেয়েটাকে বাতিল করে দিলেন?

আরে না। আমি বাতিল করব কেন? সত্যি কথা বলতে কি শর্ট মেয়ে আমার পছন্দ। আমার মা ছিল শর্ট। বাবা বিরাট লম্বা। লম্বা বাবার পাশে শর্ট মা গুটুর গুটুর করে হাঁটতো। দেখতে ফাইন লাগত।

বিয়ে মেয়ে পক্ষ বাতিল করে দিল?

হুঁ।

কেন?

আছে ঘটনা। বলতে চাই না। খাবারের অর্ডার দিয়ে দেই? ভালো ভুখ লেগেছে।

দিন। আপনার একার জন্যে দেবেন। আমি শুধু একটা কোক কিংবা পেপসি। খাব।

সুজাত আলি বলল, শুধু কোক পেপসি কেন?

মিলি বলল, শায়লা মেয়েটাও তো শুধু কোকই খেয়েছিল।

সে আর তুমি কি এক?

হ্যাঁ, এক। আপনি খাবারের অর্ডার দিন। ভালো কথা আপনার পড়াশোনা কী?

ইন্টারে পড়ার সময় গিয়েছিলাম— পরে আর পড়াশোনা হয় নাই। চেষ্টাও করি নাই। ঐ সব দেশে পড়াশোনা না-জানা লোকের চাকরির সুবিধা বেশি। পড়াশোনা জানা লোক তো আর অড জব করতে পারবে না। লজ্জা লাগবে। ঠিক বলেছি না?

মিলি জবাব দিল না। লোকটা মিলির জবাবের জন্যে অপেক্ষা করল না। এক গাদা খাবারের অর্ডার দিল। মিলি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কুস্তিগীর চেহারার একজন মানুষ। কুস্তিগীরদের যেমন শরীরের তুলনায় মাথা ছোট হয়। এরও সে-রকম। সবচেয়ে কুৎসিত হচ্ছে লোকাটার ছোট ছোট কান। কানভর্তি লোম শজারুর কাঁটার মতো বড় হয়ে আছে। মিলির কি লোকটাকে বলা উচিত— আপনি পরের বার যখন চুল কাটাতে যাবেন তখন অবশ্যই দয়া করে কানের চুলগুলোও কাটাবেন। লোকটা এখন দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁচাচ্ছে। দাঁত থেকে ময়লা কেরে ন্যাপকিনে মুছছে। মিলির কি উচিত না উঠে চলে আসা?

মিলি বলল, আপনাকে কি উচিত না দাঁত খুঁচানো বন্ধ রাখা? দৃশ্যটা দেখতে ভালো না। দাঁত খুঁছনো, দাঁত ব্রাশ এই কাজগুলা আমারা বাথরুমে করি। সেইটাই শোভন।

সুজাত আলি এই কথায় লজ্জা পেল কি-না তা বুঝা গেল না। তবে সে দাঁত খুঁচানো বন্ধ করল। সে আরেকটা সিগারেট বের করেছে। মনে হয় খাবার আসার আগে আগে সে আরেকটা সিগারেট খাবে। সে মিলির দিকে ঝুঁকে এসে বলল, বাংলাদেশের এই এক মজা রেস্টুরেন্টে সিগারেট খেতে দেয়। আমেরিকায় অসম্ভব।

মিলি বলল, বাংলাদেশে অনেক কিছুই সম্ভব যেটা বাইরে সম্ভব না। এই যে আপনি মনের আনন্দে বিয়ের জন্যে একের পর এক মেয়ে দেখে যাচ্ছেন, এই কাজটা কি অন্য কোথাও পারবেন?

সুজাত জবাব দিল না। খাবার চলে এসেছে। সে মনের আনন্দে নিজেই হাত বাড়িয়ে খাবার নিচ্ছে। এখন আবার প্রতিটি খাবার নিচু হয়ে এঁকে শুকে দেখছে। মিলির গা গুলিয়ে উঠছে। সে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, দ্বিতীয় যে মেয়েটাকে দেখলেন তার অবস্থা কী?

সুজাত বলল, খুব ভালো মেয়ে। যেমন চেহারা তেমন স্মার্ট। ফড়ফড় করে ইংরেজি বলে, নাম সীমা। লম্বা চুল। মেয়েও লম্বা।

তাকে বিয়ে করলেন না কেন?

সে রাজি হলো না। কথাবর্তা অনেক দূর এগিয়েছিল। তাকে ডায়মন্ডের আংটিও দিয়েছিলাম। আংটি সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। বিদেশে ডায়মন্ড সস্তা। মাঝে মাঝে সেল হয়। আমি সেল থেকে হাফ প্রাইসে কিনেছিলাম। দুইশ পঁচিশ ডলার।

বিয়ে ভাঙার পর আংটি ফেরত পেয়েছেন?

জি। আমার সঙ্গেই আছে। দেখবে?

না।

আমি শুরু করে দিলাম। তুমি সত্যি খাবে না? চিকেনের একটা ড্রামস্টিক খাও?

আপনি খান। আমি আপনার খাওয়া দেখি।

মিলি সত্যি সত্যি আগ্রহ নিয়ে খাওয়া দেখছে।

লোকটা খাবারের উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মুখ থেকে হুম হাম জাতীয় শব্দও হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাড় ভাঙার কড়মড় শব্দ। মিলি বলল, এদের রান্না কি ভালো?

হুঁ। আমার কাছে কানো রান্নাই খারাপ লাগে না। আমি সবই খাই। শুধু তিতা করলা খাই না। তুমি খাও?

হ্যাঁ খাই।

তোমার সাথে এই একটা অমিল হয়ে গেল।

তাই তো দেখছি। পাত্রী হিসেবে কি আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?

হুঁ। তুমি খুবই সুন্দর।

শায়লা, সীমা ওদের চেয়েও?

হুঁ। শুধু একটা সমস্যা।

বলুন কী সমস্যা।

তোমার পিতা-মাতা নাই। তারা তোমার অল্প বয়সে গত হয়েছে। তুমি বড় হয়েছে তোমার খালার কাছে। তোমাকে বিবাহ করলে শ্বশুর-শাশুড়ির আদর পাব না। আমি আবার আদরের কাঙাল।

আপনি আদরের কাঙাল?

হুঁ। আমার পিতা-মাতাও তোমার মতো আমি ছোট থাকতেই বেহেশতে নসিব হয়েছেন। এর তার বাড়িতে বড় হয়েছি। সারা জীবন কষ্ট করেছি। সবচেয়ে বড় যে কষ্ট সেটা করেছি।

সবচেয়ে বড় কষ্ট কোনটা?

না খাওয়ার কষ্ট। এই কষ্টের সীমা নাই। তুমি কি কোনোদিন না খেয়ে কাটায়েছ?

না।

তুমি বিরাট ভাগ্যবতী।

তাইতো দেখছি।

আমার বিষয়ে আর কিছু জানতে চাইলে বল। বিয়ের আগে দুই পক্ষের সব পরিষ্কার থাকা ভালো।

মিলি ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনি তো মনে হয় মোটামুটি নিশ্চিত যে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে। তা কিন্তু হচ্ছে না। আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি। আমার পরেও নিশ্চয়ই আরও অনেক মেয়ে দেখবেন। তাদের কোনো একজনকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যান।

সুজাত বলল, আর দেখব না।

বিয়ে না করেই ফেরত যাবেন?

হুঁ।

আর মেয়ে দেখবেন না–কারণটা কী?

লজ্জা লাগে।

কীসের লজ্জা?

সবকিছু মিলায়ে লজ্জা। নিজেকে নিয়ে লজ্জা লাগে–না আছে চেহারা, না আছে পড়াশোনা। যোগ্যতা একটাই বিদেশে থাকি। তোমার মতো যেসব মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কথা বলি তাদের জন্যেও লজ্জা লাগে। সুন্দরী, বিদ্যাবতী মেয়ে ক্যাব ড্রাইভার বিয়ে করার জন্যে তৈরি।

মিলি কঠিন গলায় বলল। আপনি ভুল করছেন আমি কিন্তু জানতাম না আপনি ক্যাব ড্রাইভার। আমাকে বলা হয়েছে আপনি কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করছেন।

ও আচ্ছা।

মিলি তার গলায় কাঠিন্য কিছুমাত্র না কমিয়ে বলল, আপনার সম্পর্কে আমি অনেক খারাপ খারাপ কথা বলতে পারি কিন্তু বলব না।

সুজাত বলল, একটা বল।

আপনার চেহারায় চোর ভাব আছে। আচ্ছা আপনি কি কখনো চুরি করেছেন?

সুজাত সহজ গলায় বলল, একবার চুরি করেছি। দেশ ছেড়ে বিদেশ যাব। টাকা শর্ট। পরে ছোট মামির গয়না চুরি করলাম। পরে অবশ্য সব শোধ করেছি।

আপনার খাওয়া শেষ হয়েছে না?

হুঁ।

বেয়ারাকে বিল দিতে বলুন। আমি বিল দেব।

তুমি কেন বিল দিবে?

আমি দেব। আপনাকে এই বিল কিছুতেই দিতে দেব না।

আর শুনুন আমাকে তুমি করেও বলবেন না।

তুমি তো বয়সে আমার ছোট।

বয়সে ছোট হলেও তুমি বলবেন না।

তুমি রেগে গেছ কেন?

রেগে যাওয়ার অনেক কারণ আছে আপনি বুঝবেন না। এত বুদ্ধি আপনার নেই।

এটা অবশ্য সত্য কথা বলেছ। আমার বুদ্ধি খুবই কম। তোমার বুদ্ধি ভালো। বুঝা যায়।

আবার তুমি?

অনেকক্ষণ ধরে তুমি তুমি বলেছি অভ্যাস হয়ে গেছে। মানুষ অভ্যাসের দাস।

মানুষ অভ্যাসের দাস না। অভ্যাস মানুষের দাস। প্লেটে হাত ধুচ্ছেন কেন?

অসুবিধা কী?

অসুবিধা অবশ্যই আছে। আপনি কি জীবনে কখনো ভালো রেস্টুরেন্টে খাননি।

খেয়েছি। সবচেয়ে বেশি খেয়েছি ম্যাগডোনাল্ডে। ঐখানে কাজ করতাম। ফ্লোর পরিষ্কার করতাম।।

ঝাড়ুদার ছিলেন।

তারা বলে ক্লিনার।

আপনার লজ্জা করত না?

লজ্জা করবে কী জন্যে? আমার সঙ্গে একজন ছিল— নাম ক্লিফর্ড। সে ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করত। এখন সে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির লেকচারার।

আপনি তো নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির লেকচারার হননি। আপনি এখনো ঝাড়ুদার।

সুজাত বিব্রত গলায় বলল, এখন কিন্তু ঝাড়ুদার না।

মিলি বলল, আপনার একমাত্র যোগ্যতা আপনি অন্য দেশের নাগরিক। ডলার রোজগার করেন। যে দেশের নাগরিক সেই দেশের কিছুই জানেন না। শুধু রাস্তাঘাট চেনেন। ক্যাব চালাতে হয় রাস্তা না চিনলে হবে না।

সেই দেশের কিছুই চিনি না তা ঠিক না। চিনি তো।

রবার্ট ফ্রস্টের নাম শুনেছেন?

না। উনি কে?

মিলি কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে।

বেয়ারা বিল নিয়ে এসেছে। দুই হাজার তিন শ টাকা বিল। মিলির ব্যাগে আছে সতেরো শ টাকা। লজ্জায় তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সুজাত বলল, টাকা কি কম পড়েছে?

মিলি কিছু বলল না। হতাশ গলায় ব্যাগের দিকে তাকিয়ে রইল। সুজাত বলল, কত কম পড়েছে বল বাকিটা আমি দিয়ে দেই? পরে আমাকে রিটার্ন করলেই হবে।

মিলির চোখে পানি এসে গেল। সে চোখের পানি নিয়েই বাসায় ফিরল।

মিলির বড় খালা বললেন, তোকে বুদ্ধিমতী জানতাম, তুই তো বিরাট গাধা। ছেলে তোর সঙ্গে আগাগোড়া ফাজলামি করে গেছে তুই বুঝলি না? এই ছেলে অড জব করে, ক্যাব চালায় সবই সত্যি কিন্তু তার ফাঁকে পড়াশোনা করে কম্পিউটার সায়েন্সে MS করেছে। সে এখন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির লেকচারার। আমি কোনো কিছু না জেনে শুনে এমন আয়োজন করব? তুই বোকা হতে পারিস আমি তো বোকা না।

তুই রেস্টুরেন্টের বিল দিতে গেলি ছয়শ টাকা কম পড়ে গেল। সেই টাকা দিল সুজাত। আবার বলল বাকি টাকা রিটার্ন করতে। তখনও কিছু বুঝতে পারলি না? তুই রেস্টুরেন্ট থেকে কেঁদে-কেটে বের হলি সঙ্গে সঙ্গে সুজাত আমাকে টেলিফোন করল। সে হাসতে-হাসতে মারা যাচ্ছে। মিলি শোন, সুজাতের তোকে খুবই পছন্দ হয়েছে। সে আমাকে অনুরোধ করেছে যেভাবেই হোক তোকে যেন রাজি করাই। প্রয়োজন সে না-কি বাড়ির সামনে অনশন করবে। এখন তাকে বলবটা কী?

মিলি কাঁদতে কাঁদতে ফল, তাকে অনশন করতে বল।

সুজাত সত্যি সত্যি মিলিদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাসিমুখে হাঁটাহাঁটি করছে। মিলি তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে। সে অবাক হয়ে লক্ষ করল ছেলেটার চেহারা তার কাছে সুন্দর লাগছে। বুদ্ধিমান, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর একজন যুবক। যার চোখে মায়াভাব প্রবল।

ভালোবাসার গল্প

নীলু কঠিন মুখ করে বলল, কাল আমাকে দেখতে আসবে।

রঞ্জু নীলুর কথা শুনল বলে মনে হল না। দমকা বাতাস দিচ্ছিল। খুব কায়দা করে তাকে সিগারেট ধরাতে হচ্ছে। কথা শুনবার সময় নেই।

নীলু আবার বলল, আগামী কাল সন্ধ্যায় আমাকে দেখতে আসবে।

কে আসবে?

মাঝে-মাঝে রঞ্জুর বোকামিতে নীলুর গা জ্বালা করে। এখনো তাই করছে।

রঞ্জু আবার বলল, কে আসবে সন্ধ্যাবেলা?

নীলু থেমে থেমে বলল, আমার বিয়ের কথা হচ্ছে। পাত্র দেখতে আসবে।

রঞ্জুকে এ খবরে বিশেষ উদ্বিগ্ন মনে হল না। সে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, আসুক না।

আসুক না মানে? যদি আমাকে পছন্দ করে ফেলে?

রঞ্জু গম্ভীর হয়ে বলল, পছন্দ করবে না মানে? তোমাকে যেই দেখবে সেই ট্যারা হয়ে যাবে।

নীলু রেগে গিয়ে বলল, তোমার মতো যারা গাধা শুধু তাদের চোখই ট্যারা হবে।

রঞ্জু রাস্তার লোকজনদের সচকিত করে হেসে উঠল। নীলু বলল, আস্তে হাঁটো না, দৌড়াচ্ছ কেন?

রঞ্জু এ-কথাতেও হেসে উঠল। কী কারণে জানি তার আজ খুব ফুর্তির মুড দেখা যাচ্ছে। গুনগুন করে গানের কী একটা সুর ভাজল। সচরাচর এরকম দেখা যায় না। রাস্তায় সে ভারিক্কি চালে হাঁটে।

নীলু সিনেমা দেখবে নাকি একটা?

না।

চল না যাই।

নীলু চুপচাপ হাঁটতে লাগল।

কথা বল না যে? দেখবে?

উহুঁ। বাড়িতে বকবে।

কেউ বকবে না। মেয়েদের বিয়ের কথাবার্তা যখন হয় তখন মায়েরা তাদের কিছু বলে না।

কে বলেছে তোমাকে?

আমি জানি। তখন মায়েদের মন খুব খারাপ থাকে। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। এইসব সেন্টিমেন্টের ব্যাপার তুমি বুঝবে না। চল একটা সিনেমা দেখি।

না।

বেশ তাহলে চল কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে বসে চা খাওয়া যাক।

নীলু সৰু চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, খুব পয়সা হয়েছে দেখি।

রঞ্জু আবার হেসে উঠল, পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে বলল, কী ভেবেছ তুমি? রোজ তোমার পয়সায় চা খাব? এই দেখ।

দুটি পঞ্চাশ টাকার নোট বের হল। নীলু কোনো কথা বলল না।

তুমি এত গম্ভীর কেন নীলু?

তোমার মতো শুধু-শুধু হাসতে পারি না। বাসায় যাব, এখন চা-টা খাব না।

প্লিজ নীলু, এরকম কর কেন তুমি?

রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই বড়-বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। রঞ্জু ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে বলল, বেশ হয়েছে। যতক্ষণ বৃষ্টি না থামবে ততক্ষণ বন্দি।

সে এবার আরাম করে আরেকটি সিগারেট ধরাল। নীলু বলল, এই নিয়ে কটি সিগারেট খেলে?

এটা হচ্ছে ফিফথ।

সত্যি?

হুঁ।

গা ছুঁয়ে বল।

আহ কী সব মেয়েলি ব্যাপার। গা ছুঁয়ে বললে কী হয়?

হোক না হোক তুমি বল।

রঞ্জু ইতস্তত করে বলল, আর সিগারেট খাব না। ওয়ার্ড অব অনার। মরদক বাত হান্তিকা দাঁত।

তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুল সন্ধ্যার ঠিক আগে-আগে। বৃষ্টি নেই। নিয়ন আলোয় ভেজা রাস্তা চিকমিক করছে।

রঞ্জু বলল, রিকশা করে একটু ঘুরবে নীলু?

উঁহু।

বেশ। চল রিকশী করে তোমাকে ঝিকাতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

হ্যাঁ, পরে কেউ দেখুক।

সন্ধ্যাবেলা কে আর দেখবে? একটা রিকশা ডাকি?

আচ্ছা ডাকো।

রিকশায় উঠতে গিয়ে রঞ্জু দেখল নীলুর চোখ দিয়ে জল পড়ছে।

সে দারুণ অবাক হয়ে গেল।

কী ব্যাপার নীলু?

খুব খারাপ লাগছে। কাল যদি ওরা আমাকে পছন্দ করে ফেলে?

রঞ্জু দরাজ গলায় হেসে উঠল— করুক না পছন্দ, আমরা কোর্টে বিয়ে করে ফেলব।

তারপর আমাকে তুলবে কোথায়, খাওয়াবে কী? দুটি টিউশনি ছাড়া আর কী আছে তোমার?

এম.এ. ডিগ্রিটা আছে। সাহস আছে। আর …

আর কী?

আর আছে ভালোবাসা।

নীলু এবং রঞ্জু দুজনেই এবার একত্রে হেসে উঠল। রঞ্জু অত্যন্ত উৎফুল্ল ভঙ্গিতে আরেকটি সিগারেট ধরাল। নীলু মৃদুস্বরে বলল, এই তোমার সিগারেট ছেড়ে দেয়া? ফেল এক্ষুনি।

এটাই লাস্ট ওয়ান।

উহুঁ।

রঞ্জু সিগারেট ছুড়ে ফেলল রাস্তায়।

পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে সন্ধ্যাবেলা কিন্তু তোড়জোড় শুরু হল সকাল থেকে। নীলুর বড়ভাই এই উপলক্ষে অফিসে গেলেন না। নীলুর ছোটবোন বিলুও স্কুলে গেল না। এই বিয়ের যিনি উদ্যোক্তা— নীলুর বড়মামা, তিনিও সাতসকালে এসে হাজির। নীলু তার এই মামাকে খুব পছন্দ করে কিন্তু আজ যখন তিনি হাসিমুখে বললেন, কী রে নীলু বিবি, কী খবর? তখন নীলু শুকনো মুখে বলল, ভালো।

মুখটা এমন হাঁড়ির মতো করে রেখেছিস কেন? তোর জন্যে একটা শাড়ি এনেছি। দেখতে পছন্দ হয় কি না।

শাড়ি কীজন্যে মামা?

আনলাম একটা ভালো শাড়ি। এই শাড়ি পরে সন্ধ্যাবেলা যখন যাবি ওদের সামনে …।

নীলু নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে এল।

রান্নাঘরে নীলুর ভাবী রেহানা মাছ কুটছিল। কলেজ যেদিন ছুটি থাকে সেদিন নীলু রান্নায় সাহায্য করার নামে বসে-বসে গল্প করে। আজ নীলু দেখল রেহানা ভাবীর মুখ গম্ভীর। নীলু পাশে এসে বসতেই সে বলল, তোমার ভাই কাল রাতে আমাকে একটা চড় মেরেছে। তোমার বিশ্বাস হয় নীলু?

নীলু স্তম্ভিত হয়ে গেল। রেহানা বলল, তুমি বিয়ে হয়ে চলে গেলে আমার কেমন করে যে দিন কাটবে।

নীলু বলল, দাদাটা একটা অমানুষ। অভাবে-অভাবে এরকম হয়েছে ভাবী। তুমি কিছু মনে করো না।

না, মনে করব কী? আমার এত রাগটাগ নেই।

দুজনে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। রেহানা একসময় বলল, তোমার ভাই পাঁচ টাকা মানত করেছে। তোমাকে যদি ওদের পছন্দ হয় তবে পাঁচ টাকা ফকিরকে দিবে।

নীলু কিছু বলল না। রেহানা বলল, পছন্দ তো হবেই। তোমাকে পছন্দ না করলে কাকে করবে? তুমি কি আর আমার মতো? কত মানুষ যে আমাকে দেখল নীলু, কেউ পছন্দ করে না। শেষকালে তোমার ভাই পছন্দ করল। সুন্দরটুন্দর তো সে বুঝে না।

নীলু হেসে উঠল। রেহানা বলল, চা খাবে?

নীলু জবাব দিল না।

তোমাকে চা খাওয়াবার সুযোগ কি আর হবে? বড়লোকের বউ হবে। মামা বলেছিলেন ওদের নাকি দুটি গাড়ি। একটা ছেলেরা ব্যবহার করে, একটা বাড়ির মেয়েরা।

নীলু চুপ করে রইল। রেহানা বলল, ছেলের এক চাচা হাইকোর্টের জজ।

হাইকোর্টের জজ দিয়ে আমি কী করব ভাবী?

তুমি যে কী কথা বল নীলু, হাসি লাগে।

দুপুর থেকে নীলুর দাদা গম্ভীর হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তাঁকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হল। নীলু ভেবে পেল না এই সামান্য ব্যাপারে দাদা এত চিন্তিত হয়ে পড়েছে কেন। একটি ছেলে মোটা মাইনের একটা চাকরি করলে এবং ঢাকা শহরে তার ঘরবাড়ি থাকলেই এরকম করতে হয় নাকি?

অকারণে রেহানা নীলুর দাদার কাছে ধমক খেতে লাগল।

বললাম একটা ফুলদানিতে ফুল এনে রাখতে।

এই বুঝি ঘর পরিষ্কারের নমুনা?

টেবিলক্লথটাও ইস্ত্রি করিয়ে রাখতে পার নি?

নীলুর বড়মামা অনেকবার তাকে বুঝালেন কী করে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। নম্র ভঙ্গিতে চা এগিয়ে দিতে হবে। কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব কম কথায় উত্তর দিতে হবে। নীলুর রীতিমতো কান্না পেতে লাগল। সাজগোজ করাবার জন্যে মামি এলেন বিকেলবেলা। সন্ধ্যা হবার আগেই নীলু সেজেগুজে বসে রইল।

সমস্ত ব্যাপারটি যেরকম ভয়াবহ মনে হয়েছিল সেরকম কিছুই হল না। ছেলের বাবা খুব নরম গলায় বললেন, কী নাম মা তোমার?

নীলাঞ্জনা।

খুব কাব্যিক নাম। কে রেখেছে?

বাবা।

তিনি আর কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে নীলুর মামার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। ছেলে নিজেও এসেছিল। নীলু তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারল না। চা-পর্ব শেষ হবার পর নীলু যখন চলে আসছে তখন শুনল একজন ভদ্রমহিলা বলছেন, খুব পছন্দ হয়েছে আমাদের। আগস্ট মাসে বিয়ে দিতে আপনাদের কোনো অসুবিধা আছে?

নীলুর কান ঝা ঝা করতে লাগল। রেহানা রান্নাঘরে বসে ছিল। নীলুকে দেখেই বলল, টিপটা ভেঙে দু-টুকরা হয়েছে। তোমার ভাই শুনলে কী করবে ভেবে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কী অলক্ষণ। ওমা কাঁদছ কেন, কী হয়েছে?

নীলু প্রায় দৌড়ে এসে তার ভাবীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল— ভাবী আমি রঞ্জু ভাইকে বিয়ে করব। আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়। তুমি দাদাকে বল ভাবী।

আমি? আমার সাহস হয় না। হায় রে কী করি। চুপ নীলু চুপ। ভালো করে সব ভাব। এক্ষুনি জানাজানির কী দরকার।

আমি ভাবতে পারি না ভাবী।

 

নীলু এ কয়দিন কলেজে যায় নি। দিন সাতেক পর যখন প্রথম গেল, ক্লাসের মেয়েরা অবাক হয় বলল, বড় রোগা হয়ে গেছিস তুই। অসুখবিসুখ নাকি?

সে চুপ করে রইল।

কেমন গোলগাল মুখ ছিল তোর, এখন কীরকম লম্বাটে হয়ে গেছে। কিন্তু বেশ লাগছে তোকে ভাই।

ক্লাসে মন টিকল না নীলুর। ইতিহাসের অনিল স্যার ঘুমপড়ানো সুরে যখন গুপ্ত ডায়ানিস্টি পড়াতে লাগলেন তখন ছাত্রীদের স্তম্ভিত করে নীলু উঠে দাঁড়াল।

স্যার আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে। বাসায় যাব।

অনিল স্যার অতিরিক্ত রকম ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বেশি খারাপ? সঙ্গে কোনো বন্ধুকে নিয়ে যাবে?

না স্যার, একাই যাব।

নীলু ক্লান্ত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে কলেজ গেটের সামনে রঞ্জু দাঁড়িয়ে আছে। শুকনো মুখ। হাতে একটা কাগজের ঠোঙা।

গত তিনদিন ধরে আমি রোজ একবার করে আসি তোমাদের কলেজে।

নীলু বলল, এই কদিন আসি নি, শরীর ভালো না।

দুজন পাশাপাশি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হটল। তারপর রঞ্জু হঠাৎ দাঁড়িয়ে থেমে বলল, আগস্ট মাসের ৯ তারিখে তোমার বিয়ে?

কে বলল?

কার্ড ছাপিয়েছ তোমরা। রেবার কাছে তোমার বিয়ের কার্ড দেখেছি।

নীলু চুপ করে রইল। রঞ্জু এত বেশি উত্তেজিত ছিল যে, সহজভাবে কোনো কথা বলতে পারছিল না। কোনোমতে বলল, কার্ড দেখেও আমার বিশ্বাস হয় নি। তুমি নিজের মুখে বল।

নীলু মৃদুস্বরে বলল, না সত্যি না। তোমাকেই বিয়ে করব আমি।

কবে?

আজই।

রঞ্জু স্তম্ভিত হয়ে বলল, তোমার মাথা ঠিক নেই নীলু।

মাথা ঠিক আছে। কোর্টে মানুষ কীভাবে বিয়ে করে আমি জানি না।

রঞ্জু বলল, চল আমার মেসে। কী হয়েছে সবকিছু শুনি।

সে নীলুর হাত ধরল।

 

রঞ্জুর নয়া পল্টনের মেসে নীলু আগে অনেকবার এসেছে। দুপুরের গরমে বসে অনেক সময় গল্প করে কাটিয়েছে কিন্তু আজকের মতো কুলকুল করে ঘামে নি কখনো। রঞ্জু বলল, তোমার শরীর খারাপ হয়েছে নীলু, বড় ঘামছ।

আমার কিছু হয় নি।

চা খাবে? চা দিতে বলব?

উহুঁ। পানি খাব।

রঞ্জু পানির গ্লাস নিয়ে এসে দেখে নীলু হাত-পা এলিয়ে বসে আছে। চোখ ঈষৎ রক্তাভ। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে সে ভাঙা গলায় বলল,

রেবা তোমাকে আমার বিয়ের কার্ড দেখিয়েছে?

হুঁ।

আর কী বলেছে সে?

বলেছে, তোমাকে নাকি ফরসা মতন রোগা একটি ছেলের সঙ্গে দেখেছে।

নীলু বলল, ওর নাম জমশেদ। ওর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার।

রঞ্জু কিছু বলল না।

নীলু বলল, ঐ ছেলেটির সঙ্গে আমার বিয়ে হলে তুমি কী করবে?

কী করব মানে?

নীলু ভীষণ অবাক হয়ে বলল, কিছু করবে না তুমি?

তোমার শরীর সত্যি খারাপ নীলু। তুমি বাসায় যাও। বিশ্রাম কর।

নীলু রিকশায় উঠে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

আমি তোমার সঙ্গে আসব? বাসায় পৌঁছে দেব?

উহুঁ।

নীলু বাসায় পৌঁছে দেখে অনেক লোকজন। হিরণপুর থেকে খালার এসেছেন। বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে তুমুল হইচই। নীলু আলগাভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সন্ধ্যায় চা খেতে বসে সেজো খালার হাসির গল্প শুনে উঁচু গলায় হাসল। কিন্তু রাতের বেলা অন্যরকম হল। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নীলু গিয়ে তার দাদার ঘরে ধাক্কা দিল। রেহানা বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে নীলু?

নীলু ধরা গলায় বলল, বড় কষ্ট হচ্ছে ভাবী।

রেহানা নীলুর হাত ধরল। কোমল স্বরে বলল, ডাকব তোমার দাদাকে? কথা বলবে তার সাথে?

ডাকো।

নীলুর দাদা সঙ্গে-সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে এলেন। অবাক হয়ে বললেন, কী রে নীলু কিছু হয়েছে?

নীলু বলল, কিছু হয় নি দাদা। তুমি ঘুমাও।

তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

রূপা

‘ভাই, আপনি কি একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনতে চান?”

আমি ভদ্রলোকের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। কিছুক্ষণ আগে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে– তাও এমন কোন আলাপ না। আমি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি কিনা জানতে চাইলেন। আমি বলাম ‘হ্যাঁ’ এবং ভদ্রতা করে জানতে চাইলাম আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি আমার স্ত্রীকে রিসিভ করতে এসেছি। ও চিটাগাং থেকে আসছে। ট্রেন দু’ঘন্টা লেট। ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাসায় যাব আবার আসব, ভাবলাম অপেক্ষা করি।

তার সঙ্গে এইটুকু আমার আলাপ। এই আলাপের সুত্র ধরে কেউ যখন বলে,  ভাই আপনি কি একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনতে চান, তখন খানিকটা হলেও বিস্মিত হতে হয়। অপরিচিত লোকের কাছ থেকে গল্প শোনার আগ্রহ আমার কম।  তাছাড়া আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় লক্ষ করেছি- ইন্টারেস্টিং গল্প বলে যে গল্প শুরু হয়, সে গল্প কখনোই ইন্টারেস্টিং হয় না।

আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোক বুদ্ধিমান হলে আমার চুপ করে থাকার অর্থ বুঝতে পারতেন। বুদ্ধিমান না হলে এই গল্প আমার শুনতেই হবে।

দেখা গেল ভদ্রলোক মোটেই বুদ্ধিমান নন। পকেট থেকে পানের কৌটা বের করে পান সাজাতে সাজাতে গল্প শুরু করলেন-

“আপনি নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হয়ে আমার কথা শুনছেন। নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ হড়বড় করে গল্প বলা শুরু করেছে। বিরক্ত হবারই কথা। কিন্তু সমস্যাটা কি জানেন- আজ আমার একটা বিশেষ দিন। এই বিশেষ দিনে আমার মজার গল্পটা কাউকে-না-কাউকে বলতে ইচ্ছে করে। যদি অনুমতি দেন- গল্পটা বলি।”

“বলুন।”

“আপনি কি পান খান?”

“জি-না।”

“একটা খেয়ে দেখুন, মিষ্টি পান। খারাপ লাগবে না।”

“আপনি কি বিশেষ দিনে গল্পের সঙ্গে-সঙ্গে সবাইকে পানও খাওয়ান?”

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। আন্তরিক ভঙ্গিতেই হাসলেন। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের মত হবে। অত্যন্ত সুপুরুষ। ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবিতে তাকে চমৎকার মানিয়েছে। মনে হচ্ছে তিনি স্ত্রীর জন্য খুব সেগেগুজেই এসেছেন।

“প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স করছি- পদার্থবিদ্যায়। এখানে অন্ধকার বলে আপনি হয়ত আমাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন না। আলো থাকলে বুঝতেন আমি বেশ সুপুরুষ। কুড়ি বছর আগে দেখতে রাজ পুত্রের মত ছিলাম। ছাত্রমহলে আমার একটা নাম ছিল-‘দ্যা প্রিন্স’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েমহলে আমার কোন পাত্তা ছিল না। আপনি ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন কি না জানিনা- পুরুষদের রূপের প্রতি মেয়েরা কখনো আকৃষ্ট হয় না। পুরুষদের সবকিছুই তাদের চোখে পড়ে-রূপ চোখে পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোন মেয়ে আমার সাথে ভাব করার জন্য কিংবা কথা বলার জন্য এগিয়ে আসে নি। আমিও নিজে থেকে এগিয়ে যাই নি। কারন আমার তোতলামি আছে। কথা আটকে যায়।”
আমি ভদ্রলোককে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমিতো কোন তোতলামি দেখছি না। আপনি চমৎকার কথা বলে যাচ্ছেন।

“বিয়ের পর আমার তোতলামি সেরে যায়। বিয়ের আগে প্রচণ্ড রকম ছিল। অনেক চিকিৎসাও করছি। মার্বেল মুখে নিয়ে কথা বলা থেকে শুরু করে হোমিওপ্যাথি ওষুধ, পীর সাহেবের তাবিজ- কিছুই বাদ দেই নাই। যাই হোক- গল্পে ফিরে যাই, আমার সাবসিডিয়ারি ছিল ম্যাথ এবং কেমিস্ট্রি। কেমিস্ট্রি সাবসিডিয়ারিতে একটা মেয়েকে দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবার মত অবস্থা হল। কি মিষ্টি চেহারা! দীর্ঘ পল্লব, ছায়াময় চোখ। সেই চোখ সবসময় হাসছে। ভাই, আপনি কি কখনো প্রেমে পড়েছেন?”

“জি-না।”

“প্রেমে না পড়লে আমার সেই সময়কার মানসিকতা আপনাকে বুঝাতে পারব না। আমি প্রথম দিন মেয়েটিকে দেখেই পুরপুরি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। সারা রাত ঘুম হল না। প্রচণ্ড পানির পিপাসায় একটু পরপর গলা শুকিয়ে যায়। পানি খাই আর মহসিন হলের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করি।

সপ্তাহে আমাদের  দু’টা মাত্র সাবসিডিয়ারি ক্লাস। রাগে-দুঃখে আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে। প্রতিদিন একটা করে সাবসিডিয়ারি ক্লাস থাকলে কি ক্ষতি হত? সপ্তাহে দু’টা ক্লাস মানে পঞ্চাশ মিনিট করে একশ মিনিট। এই একশ মিনিট চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়। তা ছাড়া মেয়েটা খুব ক্লাস ফাঁকি দেয়। এমন হয়েছে সে পরপর দু-সপ্তাহ কোন ক্লাস করল না। তখন আমার ইচ্ছে করে লাফ দিয়ে মহসিন হলের ছাদ থেকে নিচে পরে সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণার অবসান ঘটাই। সে কি ভয়াবহ কষ্ট আপনি বুঝবেন না। কারন আপনি কখনো প্রেমে পরেন নি।”

“মেয়েটার নাম তো বললেন না, তার নাম কি?”

“তার নাম রূপা। সে সময় আমি অবিশ্যি তার নাম জানতাম না। নাম কেন- কিছুই জানতাম না। কোন ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী তাও জানতাম না। শুধু জানতাম তার সাবসিডিয়ারিতে ম্যাথ আছে এবং সে কাল রঙের একটা মরিস মাইনর গাড়িতে করে আসে। গাড়ির নম্বর- ভ৮৭৮১।”

“আপনি তার সম্পর্কে কোনোরকম খোঁজ নেন নি?”

“না। খোঁজ নেই নি। কারন আমার সব সময় ভয় হত খোঁজ নিতে গেলেই জানব- মেয়েটির হয়তোবা কারো সঙ্গে ভাব আছে। একদিনের একটা ঘটনা বললেই আপনি বুঝতে পারবেন- সাবসিডিয়ারি ক্লাস শেষে হঠাত লক্ষ্য করলাম মেয়েটা হেসে-হেসে একটা ছেলের সঙ্গে গল্প করছে। আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো। মনে হল আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। ক্লাস বাদ দিয়ে হলে এলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে আমার জ্বর এসে গেল।”
“আশ্চর্য তো।”

“আশ্চর্য তো বতেই। পুরু দু বছর আমার এভাবেই কাটল। পড়াশোনা মাথায় উঠল। তারপর একদিন অসীম সাহসের কাজ করে ফেললাম। মরিস মাইনর গাড়ির ড্রাইভারের কাছ থেকে বাড়ীর ঠিকানা জেনে নিলাম। তার পর মেয়েটিকে সম্বোধনহীন একটা চিঠি লিখলাম। কি লিখলাম এখন আর মনে নেই। তবে চিঠির বিষয় বস্তু হচ্ছে- আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। তাকে রাজি হতেই হবে। রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি তাদের বাড়ীর সামনে না খেয়ে পড়ে থাকব। যাকে পত্রিকার ভাষায় বলে ‘আমরন অনশন’। গল্পটা কি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে?”

“হ্যাঁ হচ্ছে। তারপর কি হল বলুন। চিঠি ডাকে পাঠিয়ে দিলেন?”

“না। নিজের হাতে করে নিয়ে গেলাম। ওদের বাড়ীর দারোয়ানের কাছে দিয়ে বললাম, এ বাড়ীর একজন আপা আছেন না- ইউনিভার্সিটিতে পরেন- তার হাতে দিয়ে এসো। দারোয়ান লক্ষ্মী ছেলের মত চিঠি নিয়ে চলে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে বলল, আপা বলেছেন তিনি আপনেরে চিনেন না। আমি বললাম তিনি ঠিকই বলেছেন, তবে আমি তাকে চিনি। এটাই যথেষ্ট।

এই বলে আমি গেটের বাইরে খুঁটি গেরে দাঁড়িয়ে গেলাম। বুঝতেই পারছেন- নিতান্তই পাগলের কাণ্ড। সেই সময়ে মাথা আসলেই বেঠিক ছিল। লজিক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, সকাল ন’টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত কোনোরকম ঘটনা ছাড়াই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। লক্ষ্য করলাম দু’তালার জানালা থেকে মাঝে মাঝে কিছু কৌতূহলী চোখ আমাকে দেখছে। বিকেল চারটায় এক ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বের হয়ে কঠিন গলায় বললেন, যথেষ্ট পাগলামি হয়েছে। এখন বাড়ি যাও।

আমি তার চেয়েও কঠিন গলায় বললাম, যাব না।

পুলিশে খবর দিচ্ছি। পুলিশ এসে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।

কোন অসুবিধা নেই, খবর দিন।

ইউ রাস্কেল, মাতলামি করার জায়গা পাও না?

গালাগালি করছেন কেন? আমিতো আপনাকে গালি দিচ্ছি না।

ভদ্রলোক রাগে জ্বলতে জ্বলতে বাড়ীর ভেতর চলে গেলেন। তার পরপরই শুরু হল বৃষ্টি। ঢালাও বর্ষণ। আমি ভিজছি নির্বিকার ভঙ্গিতে। সঙ্গে-সঙ্গে বুঝছি যে জ্বর এসে যাচ্ছে। সারাদিন রোদে পোড়ার পড়ে এই ঠাণ্ডা বৃষ্টি সহ্য হবে না। তখন একটা বেপরোয়া ভাব চলে এসেছে- যা হওয়ার হবে। ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।
ইতোমধ্যে আমি আশেপাশের মানুষদের কৌতূহলী দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছি। বেশ কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? এখানে দাঁড়িয়ে ভিজছেন কেন? আমি তাদের সবাইকে বলেছি, আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আমি একজন পাগল মানুষ।
মেয়েটির বাড়ি থেকেও হয়ত টেলিফনে এই ঘটনার কথা কাউকে কাউকে জানানো হয়েছে। তিনটি গাড়ি তাদের বাড়িতে এল। গাড়ির আরোহীরা রাগি ভঙ্গিতে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন।

রাত ন’টা বাজল বৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও থামল না। জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। দারোয়ান এসে আমাকে ফিসফিস করে বলল, সাহেব পুলিশ আনতে চাইতেছেন, বড় আফা রাজি না। বড় আফা আপনের অবস্থা দেইখ্যা খুব কানতাছেন। টাইট হইয়া বইসা থাকেন।

আমি টাইট হয়ে বসে রইলাম।

রাত এগারটা বাজল। ওদের বারান্দায় বাতি জ্বলে উঠল। বসার ঘরের দরজা খুলে মেয়েটি বের হয়ে এল। মেয়েটির পেছন-পেছন ওদের বাড়ীর সব ক’জন মানুষ। ওরা কেউ বারান্দায় নামল না। মেয়েটি একা এগিয়ে এল। আমার সামনে এসে দাঁড়াল এবং অসম্ভব কোমল গলায় বলল, কেন এমন পাগলামি করছেন?

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কারন এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। অন্য একটি মেয়ে। একে আমি কোনদিন দেখি নি। মরিস মাইনর গাড়ির দ্রাইভার আমাকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে। হয়ত ইচ্ছে করেই দিয়েছে।

মেয়েটি নরম গলায় বলল, আসুন, ভেতরে আসুন। টেবিলে খাবে দেয়া হয়েছে। আসুন তো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। বলতে চেষ্টা করলাম, কিছু মনে করবেন না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনি সেই মেয়ে নন। আপনি অন্য একজন। মেয়েটির মমতায় ডুবানো চোখের দিকে তাকিয়ে এই কথা বলা সম্ভব হল না। এত মমতা নিয়ে কোন নারী আমার দিকে তাকায় নি।

জ্বরের ঘোরে আমি ঠিকমতো পা ফেলতে পারছিলাম না। মেয়েটি বলল, আপনার বোধয় শরীর খারাপ। আপনি আমার হাত ধরে হাঁটুন। কোন অসুবিধা নেই।

বাসার সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কঠিন চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সবার কঠিন দৃষ্টি উপেক্ষা করে মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিল। যে গভীর ভালোবাসায় হাত বাড়াল সে গভীর ভালোবাসা উপেক্ষা করার ক্ষমতা ঈশ্বর মানুষকে দেন নি। আমি তার হাত ধরলাম। এই কুড়ি বছর ধরে ধরেই আছি। মাঝে-মাঝে একধরনের অস্থিরতা বোধ করি। ভ্রান্তির এই গল্প আমার স্ত্রীকে বলতে ইচ্ছে করে। বলতে পারি না। তখন আপনার মতো অপরিচিত কাউকে খুঁজে বের করি। গল্পটা বলি। কারন আমি জানি- এই গল্প কোন দিন আমার স্ত্রীর কানে পৌঁছাবে না। আচ্ছা ভাই, উঠি। আমার ট্রেন এসে গেল।”

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। দূরে ট্রেনের আলো আলো দেখা যাচ্ছে। রেললাইনের ঘড়ঘড় শব্দ উঠছে। ট্রেন সত্যি-সত্যি এসে গেল।

লিপি

জাংক মেইল বলে একটা ব্যাপার আছে যা চরিত্রগত দিক দিয়ে ১০০ ভাগ আমেরিকান। একমাত্র আমেরিকাতেই মেইল বক্স খুললে হাতভর্তি চিঠিপত্র পাওয়া যায়। যার ভেতর একটা বা দুটো কাজের চিঠি, বাকি সবই অকাজের বা আমেরিকান ভাষায়— জাংক মেইল।

জাংক চিঠিগুলি চট করে আলাদা করাও মুশকিল। খাম দেখে মনে হবে খুব জরুরি কিছু চিঠি। চিঠি শেষ পর্যন্ত পড়লে ভুল ভাঙবে। একটা নমুনা দেই—

প্রিয় হুমায়ুন,

তুমি কি জানো তুমি একজন অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তি? টেলিফোন ডাইরেক্টরি থেকে এক মিলিয়ন র‍্যানডম নাম্বার নিয়ে একটি সুইপস্টেক করা হয়েছে। যার বিশ জন ফাইন্যালিস্টের মধ্যে তুমি এক জন। প্রথম পুরস্কার এক সপ্তাহ বিশ্বভ্রমণের জন্যে দুটি প্রথম শ্রেণীর বিমানের টিকিট। দ্বিতীয় পুরস্কার চার দিনের জন্যে ফ্লোরিডা প্যাকেজ।

আমাদের নিয়মানুসারে বিশ জন ফাইন্যালিস্টকে আমাদের কোম্পানির একটি করে প্রোডাক্ট কিনতে হবে। আমরা ক্যাটালগ পাঠালাম তুমি কোনটি কিনতে চাও তাতে টিক মার্ক দিয়ে সেই পরিমাণ ডলার আমাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে।

আশা করি তুমি এই সুযোগ হারাবে না। তোমাকে সুইপস্টেকের ফাইন্যালিস্টদের একজন হবার জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ।

…..

জাংক মেইলগুলি প্রথম লাইন পড়ে ফেলে দেয়াই নিয়ম। আমি তা করি। কেন জানি খুব আগ্রহ নিয়ে প্রতিটি চিঠি শেষ পর্যন্ত পড়ি। যা বলে তা বিশ্বাসও করি। আমেরিকানরা চিঠি লিখে মিথ্যা কথা বলবে এটা ভাবতেও আমার কাছে খারাপ লাগে। এই গল্পটি জাংক মেইল নিয়ে। প্রস্তাবনা অংশ শেষ হয়েছে, এখন মূল গল্পে আসি।

১৯৮০ সালের জুন-জুলাই মাসের ঘটনা। আমি তখন নর্থডেকোটায়। স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছি। হঠাৎ একদিন মেইল বক্সে একটা চিঠি পেলাম। চিঠিটা এ রকম—

ড. আহমেদ,

আমি জেনেছি তুমি লুপ্ত প্রাচীন ভাষার বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। আমার কাছে লুপ্ত ভাষায় লেখা একটি কাগজ আছে। তুমি যদি ভাষার পাঠোদ্ধারে আমাকে সাহায্য করো আমি খুশি হব। তুমি দয়া করে নিম্নলিখিত পোস্ট বক্স নাম্বারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো। ভালো কথা, তোমার পরিশ্রমের জন্যে যথাযোগ্য পারিশ্রমিক দেয়া হবে।

বলাই বাহুল্য, এটা একটা জাংক চিঠি। পোস্ট বক্সের ঠিকানায় উত্তর দিলেই ধরা খেতে হবে। প্রাচীন ভাষাবিষয়ক কোলে সোসাইটির সদস্য হতে হবে যার জন্যে মাসিক চাঁদা বিশ ডলার বা এই জাতীয় কিছু। চিঠি আমি ফেলেই দিতাম কিন্তু আমার নামের আগে ড. পদবিটি আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিল। তখনও ডক্টর ডিগ্রি পাইনি। পাব পাব ভাব। কিউমিলিটিভ একজাম পাস করেছি। থিসিস লিখছি। এই সময় কেউ যদি ড. লিখে চিঠি পাঠায় মন দুর্বল হতে বাধ্য। কাজেই আমি চিঠির জবাব পাঠালাম। আমি লিখলাম—

জনাব,

আপনার চিঠি পেয়েছি। প্রাচীন লুপ্ত ভাষা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না আমার পড়াশোনার বিষয় পলিমার রসায়ন। আপনাকে সাহায্য করতে পারছি না বলে দুঃখিত। আমি প্রাচীন ভাষা জানি এই তথ্য কোথায় পেলেন জানালে খুশি হব।

বিনীত
হুমায়ুন আহমেদ

পুনশ্চ ১ : আমি এখনো Ph. D. ডিগ্রি পাই নি। আপনার এই তথ্যটিও ভুল।

পুনশ্চ ২ : আপনার চিঠিটি যদি জাংক মেইল জাতীয় হয় তা হলে জবাব দিবেন না।

আমি এই চিঠির জবাব আশা করি নি। কিন্তু সাত দিনের মাথায় জবাব পেলাম। জবাবটা হুবহু তুলে দিলাম—

প্রিয় আহমেদ,

আমার চিঠিটি জাংক মেইল নয়, সে কারণেই জবাব দিচ্ছি। তুমি প্রাচীন লুপ্ত ভাষা নিয়ে গবেষণা করো এই তথ্য তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান আমাকে জানিয়েছে।

আমি আমেরিকার প্রায় সব বড় লাইব্রেরিকে একটি আবেদন পাঠিয়েছিলাম। সেখানে জানতে চেয়েছি লাইব্রেরির পাঠকদের মাঝে এমন কেউ কি আছেন যারা প্রাচীন ভাষা নিয়ে পড়াশোনা বা গবেষণা করেন?

তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি তোমার নাম পাঠিয়েছে এবং তোমার নামের আগে ড. পদবি তারাই দিয়ে দিয়েছে।

তুমি লিখেছ তোমার বিষয় পলিমার রসায়ন। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে পলিমার রসায়ন তোমার বিষয় হলে তুমি লুপ্ত প্রাচীন ভাষা বিষয়ে আগ্রহী। তা না হলে তুমি আমার চিঠি জবাব দিতে না। তুমি কি দয়া করে একটি প্রাচীন ভাষা উদ্ধারে আমাকে সাহায্য করবে? লিপিটির পাঠোদ্ধার করা সামোয় খুবই প্রয়েজন।

বিনীত

এরিখ স্যামসন

সিনোসিটা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি আমার নাম কেন পাঠিয়েছে ভেবে বের করতে গিয়ে মনে পড়ল— গত সামারে লাইব্রেরি থেকে রোসেটা স্টোনের উপর একটি বই আমি ইস্যু করেছিলাম।

প্রাচীন মিশরীয় হিরোলোগ্রাফির পাঠোদ্ধারে রোসেটা স্টোন বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। ঘটনাটা কী জানার জন্যে বইটি পড়া। বইটি পড়ে আরেকটি বই ইস্যু করি অশোকের শিলালিপি। অশোকের শিলালিপি অনেক দিন ধরে পাঠোদ্ধার করা যাচ্ছিল না— এক ইংরেজ সাহেব শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেন। এই দুটি বই পড়ার পর আমি মায়াদের ভাষা পাঠোদ্ধারের চেষ্টাবিষয়ক আরেকটি বই ইস্যু করি। এই থেকেই কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ানের ধারণা হয়েছে আমি প্রাচীন ভাষার একজন গবেষক?

আমি যদি প্রাচীন ভাষার গবেষক হইও বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান আমার অনুমতি ছাড়া আমার নাম-ঠিকানা কাউকে দিতে পারে না। এসব বিষয়ে আমেরিকায় নিয়মকানুন খুব কঠিন। আমি ঠিক করলাম লাইব্রেরিয়ানকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করব।

জিজ্ঞেস করা হলো না। কারণ, আমি তখন খুবই ব্যস্ত। মানুষ তার এক জীবনে নানান ধরনের ব্যস্ততায় জড়িয়ে যায়। পিএইচ.ডি. থিসিস প্রস্তুতকালীন ব্যস্ততার সঙ্গে অন্য কোনো ব্যস্ততার তুলনা চলে বলে আমি মনে করি না। একটা চ্যাপ্টার লিখে প্রফেসরকে দেখাই, তিনি পুরোটা কেটে দেন। আবার লিখে নিয়ে যাই, আবারও কেটে দেন। আমি ল্যাবরেটরি রেজাল্টের যে ব্যাখ্যা দেই সেগুলি তার পছন্দ হয় না। তিনি যেসব ব্যাখ্যা দেন তা আমার পছন্দ হয় না। চলতে থাকে ধারাবাহিক কাটাকুটি খেলা।

মাঝে মাঝে রাগারাগিও হয়। যেমন, একদিন আমার প্রফেসর বললেন, আহমেদ, তোমাকে তো বেশ বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবেই জানতাম। এখন তোমার থিসিস পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে তোমার আই কিউ এবং মিডিয়াম সাইজের কড মাছের আই কিউ কাছাকাছি। মাছেরটা বরং কিছু বেশি হতে পারে।

প্রফেসরের এই ধরনের কথাবার্তায় খুবই মন খারাপ হয়। এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করি। ভাত না খেয়ে থালা-বাসন ছুঁড়ে মারি। থিসিস লেখার সময় পিএইচ.ডি, স্টুডেন্টদের এই আচরণ খুবই স্বাভাবিক। আমেরিকার ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের এই বিষয়ে একটি স্টার্টির্সটিকসও আছে। তারা দেখিয়েছে–বিবাহিত ছাত্রদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার পিএইচ. ডি. করার সময়ে সবচেয়ে বেশি— শতকরা ৫৩। এই ৫৩-এর ভেতর ৯৭% বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে যখন ছাত্ররা তাদের থিসিস লেখা শুরু করে।

প্রতিদিন যে হারে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছে তাতে মনে হয় আমি ওই স্টেজে দ্রুত চলে এসেছি। একদিন ঝগড়া চরমে উঠল। আমার কন্যার মাতা আমাকে হতভম্ব করে কন্যার হাত ধরে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলো। সে নাকি নিউইয়র্কের দুটো টিকিট কাটিয়ে রেখেছে। আসছে দু মাস সে নিউইয়র্কে তার মামার কাছে থাকবে। আমার থিসিস লেখা শেষ হবার পর ফিরবে। যদি কোনো কারণে থিসিস লেখা শেষ না হয় তা হলে আর ফিরবে না।

আমি রাগ দেখিয়ে বললাম, খুবই ভালো কথা। তোমাদের আরও আগেই যাওয়া উচিত ছিল। হু কেয়ারস? গো টু হেল।

গো টু হেল গালিটা তখন নতুন শিখেছি। যখন-তখন ব্যবহার করি এবং অত্যন্ত ভালো লাগে। বাংলা ভাষায় জাহান্নামে যাও–এর চেয়েও লাগসই মনে হয়।

ব্যাচেলর জীবন হচ্ছে সর্বোত্তম। এই জীবনে আছে মুক্তির আনন্দ— এ ধরনের অতি উচ্চ ভাব নিয়ে প্রথম রাতটা কাটল। দ্বিতীয় রাত আর কাটতে চায় না। আমি সময় কাটাবার জন্যে রাত এগারোটায় এরিথ স্যামসনকে টেলিফোন করলাম।

হ্যালো এরিখ।

ইয়েস। মে আই নো, হু ইজ স্পিকিং?

আমি নাম বললাম। আমার মনে হলো অপর প্রান্তে এরিখ আনন্দের আতিশয্যে শূন্যে লাফ দিল। যেন দীর্ঘদিনের অদর্শনের পর হারানো বন্ধুকে ফিরে পেয়েছে। উচ্ছ্বাস বাঁধ মানছে না। আমেরিকানদের এ ধরনের উচ্ছ্বাসের সবটাই সাধারণত মেকি হয়ে থাকে। আমার মতো বোকা বিদেশীরা এতে বিভ্রান্ত হয়। যাই হোক আমাদের কথাবার্তা যা হলো তা মোটামুটি এ রকম—

আহমেদ তুমি কেমন আছ?

খুবই ভালো আছি। তবে এই মুহূর্তে মনটা একটু খারাপ।

কেন জানতে পারি কী? যদি কোনো অসুবিধা না থাকে।

কোনো অসুবিধা নেই। রাগ করে আমার স্ত্রী নিউইয়র্কে চলে গেছে। যাবার আগে জানিয়েছে দু মাসের ভেতর সে ফিরবে না।

তুমি নিশ্চিত থাক দিন তিনেকের ভেতরই তোমার স্ত্রী ফিরে আসবে। মন খারাপের কারণেই তুমি আমাকে টেলিফোন করেছ নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?

তোমার প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধারের কিছু হয়েছে কি না জানার আগ্রহ হচ্ছে।

এখনো কিছু হয় নি।

চেষ্টা নিশ্চয়ই চালিয়ে যাচ্ছ?

সাঙ্কেতিক কোড ভাঙতে পামেন একটা সফটওয়্যারের সন্ধান পেয়েছি। দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে কিনতে পারছি না। তবে মনে হয় কিনে ফেলব। তোমার কি ধারণা কেনা উচিত?

তুমি যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হও যে সফটওয়্যার তোমার লিপির পাঠোদ্ধার করবে তা হলে কিনে ফেলো। আর যদি সন্দেহ থাকে তা হলে কেনা ঠিক হবে না। কারণ, এই সফটওয়্যারের তখন আর কোনো উপযোগিতা নেই।

আমিও তা-ই ভাবছি। তোমাকে তোমার মূল্যবান মতামতের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।

এই পর্যন্ত কথাবার্তার পর আমি টেলিফোন রেখে ঘুমাতে গেলাম। তার পাঁচ মিনিটের মাথায় এরিখের টেলিফোন পেলাম।

হ্যালো আহমেদ।

হ্যাঁ বলো।

তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি বলে দুঃখিত। কথাটা হচ্ছে আমি সিয়াটলে যাব। ফার্গো সিটি পার হয়ে যেতে হবে। তোমার হাতে যদি অবসর থাকে তা হলে ভাবছি এক রাত থাকব ফার্গো সিটিতে। তোমার সঙ্গে গল্প করা হবে এবং তুমি প্রাচীন লিপিটা ইচ্ছা করলে দেখতেও পারো।

আমি বললাম, প্রাচীন লিপি দেখার জন্যে আমি ছটফট করছি।

কথাটা আমেরিকানদের মতো বললাম। আমেরিকানরা অতিরিক্ত উৎসাহ দেখানোটা ভদ্রতার অংশ বলে মনে করে। কোনো আমেরিকান মা যদি বলে আমার বাচ্চাটা এবারে ভালো গ্রেড পেয়েছে তখন যাকে এই কথাটা বলা হবে তার দায়িত্ব হবে বিকট চিৎকার দিয়ে বলা, ওয়ান্ডারফুল! হোয়াট এ গ্রেট নিউজ।

সত্যি কথাটা হলো প্রাচীন লিপি বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। আজ পর্যন্ত এমন কোনো প্রাচীন লিপি পাওয়া যায় নি যেখানে রাজাদের যুদ্ধজয়ের কাহিনী এবং পুরোহিতদের মন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু লেখা। রাজা-বাদশা এবং পুরোহিতদের বিষয়ে আগ্রহী হবার কোনো কারণ থাকার কথা না।

এরিখ স্যামসনের সঙ্গে ফার্গো হোটেলে দেখা হলো। তার গলার স্বর শুনে মনে হয়েছিল যুবক মানুষ। এখন দেখি প্রৌঢ়। আমেরিকান প্রৌঢ়দের বয়স বোঝা মুশকিল, ৫০ থেকে ৭০ হতে পারে। বেশিও হতে পারে।

সে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমেরিকান কায়দায় অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। গিফট র্যাপে মুড়ে সে আমার জন্যে একটা গিফটও নিয়ে এসেছে। আমি সেই গিফট নিলাম। চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরি। আমি সেই গিফট হাতে নিয়ে আমেরিকান কায়দায় অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলাম। এ-রকম একটা ডায়েরি আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছিলাম। কয়েক বার দোকানে দেখেছি কিন্তু কেন জানি শেষ পর্যন্ত কেনা হয় নি। এ-ধরনের রুটিন কথাবার্তা বললাম।

আমার অতিথি সেই হিসেবে আমি তাকে রাতে আমার এ্যাপার্টমেন্টে খেতে নিয়ে গেলাম। এবং বললাম তুমি খাওয়াদাওয়া করো। তারপর আমরা গল্পগুজব করব। সবচেয়ে ভালো হয় রাতে তুমি যদি হোটেলে ফিরে না যাও। আমার এ্যাপার্টমেন্ট পুরো খালি। তুমি রাতে থেকে যাবে। প্রয়োজনে সারারাত আমরা গল্প করতে পারব।

বাঙালিরা হোটেল পছন্দ করে না–তারা যেখানেই যায় বন্ধুবান্ধব খুঁজে বেড়ায়, বন্ধুবান্ধব না পেলে দেশের মানুষ খোঁজে। হোটেল খোঁজে না। আমেরিকানদের স্বভাব উল্টো, তারা প্রথমেই খোঁজে হোটেল। তার পরেও এরিখ স্যামসন আমার ঘরে থাকতে রাজি হয়ে গেল। আমার রাঁধা অখাদ্য ডাল-ভাত এবং ডিম ভাজা তৃপ্তি করে খেল। ডাল খেয়ে বলল, এত চমৎকার স্যুপ সে অনেকদিন খায় নি। তাকে যেন এই স্যুপের রেসিপি দেয়া হয়।

খাওয়া শেষ করে আমরা গল্প করতে গেলাম। কথক এরিখ স্যামসন, আমি শ্রোতা। আমেরিকানরা গল্প ভালো বলতে পারে না। কিন্তু এরিখ দেখলাম ভালোই গল্প করে। সাউথের উচ্চারণে তার ইংরেজি বুঝতে মাঝে মাঝে সমস্যা হচ্ছে। আমাকে প্রায়ই বলতে হচ্ছে— Please say it again. তারপরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি— কোনো আমেরিকানের মধ্যে আমি গল্প বলার এমন স্টাইল দেখি নি।

আহমেদ, তোমাদের পূর্বদেশীয় ভদ্রতার কথা আমি বইপত্রে পড়েছি। বাস্তবে দেখার সুযোগ আগে হয় নি। আজ দেখলাম। তুমি আমার জন্যে রান্নাবান্না করেছ। হোটেল থেকে আমাকে নিয়ে এসেছ এবং তোমার এ্যাপার্টমেন্টে আমাকে রাতে থাকতে বলছ–আমি খুবই আনন্দ পেয়েছি। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এ ধরনের আদরে আমরা আমেরিকানরা অভ্যস্ত না। আমার খানিকটা অস্বস্তি অবিশ্যি লাগছে। কিন্তু ভালো লাগছে অনেক বেশি। যাই হোক আমি প্রাচীন লিপিবিষয়ক গল্পটা এখন তোমাকে বলব। এবং মূল লিপিটা তোমাকে দেখাব। এই লিপি বিষয়ে আমার এত আগ্রহ কেন তা গল্পটা শুনলেই তুমি ধরতে পারবে। এই গল্পের প্রায় সবটা জুড়েই আছে আর স্ত্রী কেরোলিন। কাজেই এখন আমি যা করব তা হলো কেরোলিনের গল্প বলব।

পৃথিবীর সব দেশেই বন্ধুবান্ধবের কাছে স্ত্রীর গল্প বলা অরুচির পর্যায়ে পড়ে। তারপরেও বাধ্য হয়ে আমাকে তার গল্প করতে হচ্ছে।

আমি কেরোলিনকে বিয়ে করি যখন আমার মাত্র তেইশ। আমেরিকান পুরুষরা দুই ভাগে বিভক্ত, এক ভাগ বিয়ে করে খুব অল্প বয়সে আর এক ভাগ বিয়ে করে মধ্যবয়স পার করে আমি প্রথম দলের।

কেরোলিন ইউনিভার্সিটিতে আমার সঙ্গে পড়ত। আমরা ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা তাকে খুব ভয়ের চোখে দেখতাম। কারণ, সে ছিল ভয়াবহ ধরনের ভালো ছাত্রী। শুধু আমরা ছাত্রছাত্রীরা না, শিক্ষকরাও তাকে খুব সমীহের চোখে দেখতেন। অথচ সে ছিল খুবই বিনয়ী। ক্লাসে এসে শেষের সারির চেয়ারের একটিতে মাথা নিচু করে বসে থাকত। শিক্ষকরা কোনো প্রশ্ন করলে সে কখনো জবাব দেবার জন্যে হাত তুলত না। তাকেও শিক্ষকরা কখনো প্রশ্ন করতেন না, কারণ তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, এমন কোনো প্রশ্ন তাকে করা যাবে না যার উত্তর তার জানা নেই।

এ-ধরনের মেয়েদের সঙ্গে আগবাড়িয়ে কেউ কথা বলে না। তাদের সঙ্গে ডেট করা তো অকল্পনীয় ব্যাপার। কেরোলিনের প্রসঙ্গে অনেক রসিকতাও আমাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। যেমন একবার নাকি বাজি ধরে কোনো এক সিনিয়র ছাত্র কেরোলিনকে ডেট-এ নিয়ে গিয়েছিল। চাইনিজ ডিনার। ডিনার শেষে স্পিলবার্গের ছবি। কেরোলিন নাকি পুরো সময়টায় তার ডেটকে শুধু ফিজিক্সের প্রশ্ন করেছে। ডেট একবার শুধু বলেছে–কেরোলিন তোমার চোখ

তো খুব সুন্দর। কালো চোখ।

তার উত্তরে কেরোলিন বলেছে–চোখের কালোটা হয় টিনডেল এফেক্টের জন্যে। তারপরই টিনডেল এফেক্ট এবং টিনডেল ফেনোমেনার ওপর তিন মিনিট বক্তৃতা দিয়েছে।

ডেটের শেষে ছেলেটা বাড়িতে ফিরেছে জ্বর এবং প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে।

কেরোলিনকে আমরা দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। আমেরিকান সোসাইটি অতি স্মার্ট তরুণী পছন্দ করে না। স্মার্ট শব্দটি আমি মেধা অর্থে ব্যবহার করছি।

যাই হোক, একদিন কী হয়েছে বলি। টার্ম পেপার জমা দিতে হবে— আমি পেপার লেখার জন্যে লাইব্রেরিতে গিয়েছি। হঠাৎ দেখি লাইব্রেরির এক কোনায় কেরোলিন মাথা নিচু করে বসে আছে। তার সামনে বেশ কিছু বই। একটা পেপার কাপে কফি। ন্যাপকিনের ওপর একটা স্যান্ডউইচ রাখা। স্যান্ডউইচের পাশে একটা আপেল। তার দুপুরে খাবার। আমি কী মনে করে যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, হ্যালো কেরোলিন। সে চমকে উঠে দাঁড়াল। তার হাতের ধাক্কা লেগে কফির কাপ উল্টে গেল। চারদিকে কফি ছড়িয়ে বিশ্রী অবস্থা! আমি বললাম, তোমাকে চমকে দেয়ার জন্যে দুঃখিত। কেরোনি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ইটস ওকে। ইটস ওকে।

আমি বললাম, তুমি বোধহয় আমাকে চিনছে পারছ না। তুমি তো ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ড ছাড়া কোনোদিকে তাকাও না। আমি যেহেতু ব্ল্যাকবোর্ড না, আমাকে চেনার কথাও না।

কেরোলিন মাথা নিচু করে বলল আমি তোমাকে চিনি। তোমার নাম এরিখ। তুমি গত কাল একটা নীল ব্লেজার পরে ক্লাসে এসেছ। তার আগের দিন ইয়েলো স্ট্রাইপের ফুলহাতা শার্ট পরেছ। তার আগের দিন সাদা জাম্পার…

আমি হতভম্ব হয়ে কেরোলিনের দিকে তাকালাম। নিজের বিস্ময়ের ধাক্কা একটু সামলে নিয়ে বললাম, ক্লাসে কোন ছাত্র কী পরে আসে তা তুমি জানো?

কেরোলিন নরম গলায় বলল, জানি।

পেপার কাপ থেকে কফি গড়িয়ে পড়ে টেবিল নষ্ট করছিল। কেরোলিন টেবিলে রাখা বইপত্র সরাতে গিয়ে সব এলোমেলো করে দিল। তার স্যান্ডউইচ এবং আপেল মেঝেতে পড়ে গেল। আমি বললাম, আমি খুবই দুঃখিত, তোমার লাঞ্চ নষ্ট করে দিয়েছি।

সে আগের মতো বলল, ইটস ওকে। ইটস ওকে।

আমি বললাম, যেহেতু তোমার দুপুরের খাবার আমি নষ্ট করেছি, রাতের ডিনারটা কি আমি কিনে দিতে পারি? Can I ask you for a date?

কেরোলিন চুপ করে রইল। আমি বললাম, তোমার যদি অন্য কোনো পরিকল্পনা না থাকে তাহলে এস রাতে আমরা একসঙ্গে ডিনার করি।

কেরোলিন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

আমি বললাম, ঠিক সাতটায় তুমি কান্ট্রি কিচেন রেস্তরাঁয় চলে এসো। কান্ট্রি কিচেন চেন তো–সাউথ বুলেভার।

কেরোলিন বিড়বিড় করে বলল, আমি চিনি।

তা হলে সন্ধ্যা সাতটায় তোমার সঙ্গে দেখা হবে।

আমি লাইব্রেরি থেকে চলে এলাম এবং সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নিজের ওপর খুব রাগ হতে লাগল। কেন হঠাৎ মাথায় ভূত চাপল? কেন মেয়েটাকে ডেট-এ নিতে চাচ্ছি? যে মেয়ে তার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কে কবে কোন কাপড় পরছে তা হড়হড় করে বলে দিতে পারে তার কাছ থেকে পাঁচ শ হাত দূরে থাকা দরকার। জেনেশুনে আমি এত বড় ভুল কী করে করলাম? এমন তো না যে আমার ডেট পেতে সমস্যা হচ্ছে।

কান্ট্রি কিচেন রেস্তরাঁয় আমি সাতটার সময় উপস্থিত হলাম। কোনো মেয়েকে ডেটে ডেকে যথাসময়ে উপস্থিত না হওয়া বড় ধরনের অন্যায়। সেই অন্যায় আমি করতে পারি না। আমি ভেবেছিলাম পৌঁছেই দেখব কেরোলিন রেস্টুরেন্টের বাইরে জবুথবু হয়ে খানিকটা কুঁজো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে। মেঝের ডিজাইন জ্যামিতির কোনো সূত্রের সঙ্গে ফেলা যায় কি না তা-ই ভাবছে।

ঘটনা সে রকম হলো না।

আমি কেরোলিনকে দেখে হোঁচটের মতো খেলাম। সে খুবই সেজেগুজে এসেছে। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। সুন্দর করে চুল বাঁধা। লাল স্কার্ট এবং সবুজ টপসে তাকে লাগছে ইন্দ্রাণীর মতো। এই মেয়ে যে সাজতে পারে এবং এতটা সেজে রেস্তরাঁয় আসতে পারে আমি তা কল্পনাও করি নি। আমি বললাম, কেরোলিন তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।

কেরোলিন লজ্জা পেয়ে হাসল।

আমি বললাম, তোমাকে এই পোশাকটায় চমৎকার লাগছে।

কেরোলিন ফিস করে বলল, থ্যাংক য়্যু।

ডিনার খেতে সৈতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানলাম। যেমন—

১. কেরোলিন বড় হয়েছে হোমে। তার বাবা-মা কে সে জানে না।

২. আজ যে পোশাক সে পরে এসেছে ওটা আজই কেনা হয়েছে। স্কার্ট টপস এবং জুতা কিনতে লেগেছে তিন শ এগারো ডলার।

৩. আজ সে জীবনের প্রথম ডেটে এসেছে। তাকে কখনো কোনো ছেলে ডেটে আসার জন্যে নিমন্ত্রণ করে নি।

৪. পড়াশোনা করতে তার একেবারেই ভালো লাগে না। কিছু করার নেই বলেই সে পড়াশোনা করে। যদি কিছু করার থাকত তা হলে অবশ্যই পড়াশোনা করত না।

৫. তার সঙ্গে আমার মতো Softly কোনো ছেলে এর আগে কথা বলে নি।

আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। ডিনারের মাঝামাঝি এসে আমার মনে হলো, এই মেয়েটি সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে না থাকলে আমি বাঁচব না। আমি আমার বাকি জীবন এই মেয়েটির লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারব। আমি পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী মেয়েটি যেন আমার সামনে বসে আছে। যেন তাকে আমি শুধু আজ রাতের ডিনারের সময়টুকুর জন্যে পেয়েছি। ডিনার শেষ হলে সে চলে যাবে। আর তাকে পাব না।

এরিখ দম নেবার জন্যে থামল। আমি বললাম, এ পৃথিবী একবার পায় তাকে, কোনোদিন পায় নাকো আর।

এরিখ বলল, তার মানে?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোমার অবস্থার কথা ভেবেই হয়তো আমাদের দেশের এক বাঙালি কবি এই লাইনগুলি লিখেছিলেন।

কবির নাম কী?

কবির নাম জীবনানন্দ দাশ।

তুমি অবশ্যই সেই কবিকে আমার এপ্রিসিয়েশন পৌঁছে দেবে।

তিনি জীবিত নেই। কবিতার লাইনগুলি তাঁর জন্যও প্রযোজ্য হয়ে গেছে। যাই হোক তুমি গল্প শেষ করো। আমার ধারণা সেই রাতেই তুমি মেয়েটিকে প্রপোজ কর।

তোমার ধারণা এক শ ভাগ সত্যি। আমেরিকান ছেলেরা মাঝেমধ্যে খুব নাটকীয় কায়দায় প্রপোজ করে। যেমন মেয়েটির সামনে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে। দু হাত মুঠো কয়ে প্রার্থনার ভঙ্গি করে বলে, আমি তোমাকে আমার জীবনসঙ্গিনী হবার জন্যে প্রার্থনা করছি।

তুমি তা-ই করলে?

হ্যাঁ। ডিনার শেষ করেই তা-ই করলাম। কেরোলিনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। আমাদের চারদিকে লোক জমে গেল। হাততালি পড়তে লাগল। এবং কান্ট্রি কিচেন রেস্তরাঁর মালিক রবার্ট উঁচুগলায় বলল–এই আনন্দময় ঘটনা স্মরণীয় করে রাখার জন্যে কান্ট্রি কিচেনে উপস্থিত সবাই এক গ্লাস করে ফ্রি রেডওয়াইন পাবে। আনন্দের একটা জোয়ার শুরু হয়ে গেল।

তোমরা পরদিন বিয়ে করলে?

আমেরিকায় হুট করে বিয়ে করা যায় না। বিয়ের লাইসেন্স করতে হয়। সেই লাইসেন্সের জন্যে ডাক্তারি পরীক্ষা লাগে। আমরা ঠিক এক মাস দশ দিনের মাথায় বিয়ে করলাম। বিয়ে মানেই বিরাট ঘটনা। আমার জন্যে তা ছিল অস্তিত্ব ভুলিয়ে দেবার মতো ঘটনা। আমার আনন্দের সীমা রইল না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করত হ্যান্ডমাইক নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি, সবাইকে বলি হ্যালো হ্যালো কেরোলিন নামের মেয়েটি আমার। শুধুই আমার। মাঝে মাঝে রাতে ঘড়িতে এ্যালার্ম দিয়ে রাখতাম। ঘুম ভাঙলে কী করতাম জানো? কেরোলিনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তার ঘুম ভাঙাতাম না। শুধুমাত্র তার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যে জেগে থাকতাম। আমার পাগলামির গল্প কেমন লাগছে?

ভালো লাগছে। কেরোলিনকে দেখতে ইচ্ছা করছে।

আমার কাছে তার ছবি আছে। গল্পটা শেষ হোক তোমাকে দেখাব।

থ্যাংক য়্যু।

আমার পাগলামি দেখে কেরোলিন খুব হাসলেও সে নিজেও কিন্তু কম পাগলামি করে নি। যেমন ধরো সে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিল। তার মতো ছাত্রী পড়াশোনা ছাড়তে পারে এটা ভাবাই যায় না। তার যুক্তি হচ্ছে পড়াশোনা চালিয়ে গেলে সে আমার দিকে নজর দিতে পারবে না। এটা তার পক্ষে সম্ভব না। তার কাছে আমি ছাড়া পৃথিবীর সবকিছুই গুরুত্বহীন। তার বিষয়ে খুব মজার ব্যাপার আছে। সেটা বলছি। প্লিজ হাসতে পারবে না।

তুমি নিশ্চিত থাকো আমি হাসব না।

ও ঘুমাত খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে। সে তার পা দিয়ে আমায় পা পেঁচিয়ে একটা গিট্টুর মতো করে ফেলত। হা-হা-হা।

মজার তো।

আমি তার নাম দিয়েছিলাম Princess Knot.

বাংলা ভাষায় এটা হবে গিট্টু কুমারী। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে— তোমরা আমেরিকার সবচেয়ে সুখী দম্পতি।

শুধু আমেরিকায় বলছ কেন? আমরা ছিলাম এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী স্বামী-স্ত্রী।

ছিলাম মানে? কেরোলিন কোথায়?

বিয়ের দু বছরের মাথায় সে মারা যায়।

আই অ্যাম সরি।

বিয়ের এক বছর আট মাসের দিন তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। খারাপ ধরনের স্নায়ুতন্ত্রের ক্যান্সার। কী কষ্ট যে সে করেছে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না! শেষের দিকে এমন হলো আমি চার্চে গিয়ে বলতে বাধ্য হলাম, হে ঈশ্বর তুমি কেরোলিনের প্রতি করুণা করো। যেখানে থেকে সে এই পৃথিবীতে এসেছে তাকে সেখানে নিয়ে যাও। রোগযন্ত্রণা থেকে তাকে মুক্তি দাও। রোগটা তার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে গেল। সে কাউকে চিনতে পারত না। আমাকেও না। তার কাছে গিয়ে কেরোলিন কেরোলিন বলে ডাকলে সে শুধু চোখ তুলে তাকাত, সেই দৃষ্টিতে পরিচয়ের আভাস মাত্র থাকত না।

এরিখ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আহমেদ আমার গল্প শেষ হয়েছে। এখন ভালো করে কফি বানাও। কফি খেয়ে শুয়ে পড়ব। ঘুম পাচ্ছে।

আমি বললাম, লুপ্ত প্রাচীন লিপির ব্যাপারটা কিন্তু এখনো আসে নি।

এরিখ বলল, যে লিপির কথা বলছি ওটা কেরোলিনের লেখা। মৃত্যুর দুদিন আগে ইশারায় জানালো সে কিছু লিখতে চায়। আমি তাকে কাগজ-কলম দিলাম। সে সারা দিন শুয়ে শুয়ে লিখল। সন্ধ্যাবেলা লেখা শেষ হলো। আমাকে লেখা কাগজটা দিয়ে কোথায় চলে গেল। তার দুদিন পর তার মৃত্যু হয়।

সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা কোনো চিঠি?

হ্যাঁ।

সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখার দরকার পড়ল কেন?

আহমেদ সে-ই তো আমি বলতে পারব না। ক্যান্সারের আক্রমণে তার মস্তিষ্ক এ্যাফেকটেড হয়েছিল, তার কারণে হতে পারে। কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে। লিপির পাঠোদ্ধার করা গেলেই ব্যাপারটা জানা যাবে। কিংবা এমনও হতে পারে যে, এটা আসলে কোনো লিপিটিপি নয়। কাগজে আঁকাবুকি কাটা। কেরোলিন আমাকে দিয়ে গেছে যেন এই লেখার রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে আমার জীবন কেটে যায়। আমি তাকে হারানোর কষ্ট ভুলে থাকতে পারি। কেরোলিন মারা গেছে একুশ বছর আগে। এই একুশ বছর ধরে আমি চিঠিটার রহস্য উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। মানুষ ক্লান্ত হয়, আমি ক্লান্ত হই না। কেন ক্লান্ত হই না বলো তো?

বলতে পারছি না।

ক্লান্ত হই না। কারণ, আমার মনে হয় কেরোলিন একটু দূরে দাঁড়িয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখছে আমি তার রহস্য ভাঙ্গার চেষ্টা করছি কি না। হাল ছেড়ে দিচ্ছি কি না।

তুমি আর বিয়ে করো নি?

না, বিয়ে করি নি

আমি বললাম, যদি কখনো তুমি এই সাঙ্কেতিক লিপির অর্থ বের করতে পারো তা হলে কি আমাকে জানাবে? কী লেখা আছে আমি জানতে চাচ্ছি না, আমি শুধু জানতে চাই তোমার সাধনা সফল হয়েছে। তুমি সঙ্কেতের অর্থ ধরতে পেরেছ।

এরিখ বলল, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তুমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো আমি যদি পাঠোদ্ধার করতে পারি তুমি তা জানবে।

পিএইচ. ডি. ডিগ্রি নিয়ে আমি দেশে ফিরি ১৯৮৪ সালে। দশ বছর একনাগাড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করি। লেখালেখির ব্যস্ততা খুব বেড়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করি। ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটির ঠিকানায় চিঠিপত্র জমা হয়— আমি আনতে যাই না। গত ফেব্রুয়ারি মাসে পেনশনসংক্রান্ত জটিলতার জন্যে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছি। দেখি কয়েক বছরের চার-পাঁচ শ চিঠি। বিদেশ থেকে আসা চিঠিগুলি আলাদা করে বাসায় নিয়ে এলাম। একটি চিঠি এসেছে এরিখ স্যামসনের আইনজীবীর কাছ থেকে। আইনজীবী জানাচ্ছেন— তাঁর ক্লায়েন্ট এরিখ স্যামসন নিউমোনিয়ায় মারা গেছেন। ক্লায়েন্টের নির্দেশমতো আমাকে জানাচ্ছেন যে, এরিখ স্যামসন মৃত্যুশয্যায় লিপির পাঠোদ্ধার করেছেন।

শঙ্খমালা

অনেক রাতে খেতে বসেছি, মা ধরা গলায় বললেন, খবর শুনেছিস ছোটন?

কী খবর?

পরী এসেছে।

আমি অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। মা থেমে-থেমে বললেন, পরীর একটা মেয়ে হয়েছে।

মায়ের চোখে এইবার দেখা গেল জল। আমি বললাম, ছিঃ মা, কাঁদেন কেন?

মা সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, না কাঁদি না তো; আর দুটি ভাত নিবি?

আমি দেখলাম মার চোখ ছাপিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মায়েরা বড় দুঃখ পুষে রাখে।

ছবছর আগের পরী আপাকে ভেবে আজ কি আর কাঁদতে আছে? হাত ধুতে বাইরে এসে দেখি ফুটফুটে জোছনা নেমেছে। চারদিকে কী চমৎকার আলো। উঠোনের লেবু গাছের লম্বা কোমল ছায়া সে আলোয় ভাসছে। কতদিনের চেনা ঘরবাড়ি কেমন অচেনা লাগছে আজ।

বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন আমার অন্ধ বাবা। তার পাশে একটি শূন্য টুল। ঘরের সমস্ত কাজ সেরে আমার মা এসে বসলেন সেখানে। ফিসফিস করে কিছু কথা হবে। দুজনেই তাকিয়ে থাকবেন বাইরে। একজন দেখবেন উথাল-পাথাল জোছনা, অন্যজন অন্ধকার।

বাবা মৃদু স্বরে ডাকলেন, ছোটন, ও ছোটন!

আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি তাঁর অন্ধ চোখে তাকালেন আমার দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বললেন, পরী এসেছে শুনেছিস?

শুনেছি।

আচ্ছা যা।

আজ আমাদের বড় দুঃখের দিন। পরী আজ এসেছেন। কাল খুব ভোরে তাদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই হয়তো দেখা যাবে তিনি হাসি-হাসি মুখে শিমুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। শিমুল তুলো উড়ে এসে পড়ছে তার চোখেমুখে। আমাকে দেখে হয়তো খুশি হবেন। হয়তো বা হবেন না। পরী আপাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে।

আমরা খুব দুঃখ পুষে রাখি। হঠাৎ-হঠাৎ এক-একদিন আমাদের কত পুরনো কথা মনে পড়ে। বুকের ভেতর আচমকা ধাক্কা লাগে। চোখে জল এসে পড়ে। এমন কেন আমরা?

দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছি, আমার মা হাত ধুতে কলঘরে যাচ্ছেন। মাথার কাপড় ফেলে তিনি একবার আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর অনেক সময় নিয়ে অজু করলেন। একসময় এসে বসলেন শূন্য টুলটায়। বাবা ফিসফিস করে বললেন, খাওয়া হয়েছে তোমার?

হুঁ। তোমার বুকে তেল মালিশ করে দেব?

না।

তারপর দুজন নিঃশব্দে বসেই রইলেন, বসেই রইলেন। লেবু গাছের ছায়া ক্রমশ ছোট হতে লাগল। এত দূর থেকে বুঝতে পারছি না কিন্তু মনে হচ্ছে আমার মা কঁদছেন। বাবা ভঁর শীর্ণ হাতে মার হাত ধরলেন। কফ-জমা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, কাঁদে না, কাঁদে না।

বাবা তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে আজ আবার তিরিশ বছর আগের মতো ভালবাসুক। আমার মার আজ বড় ভালোবাসার প্রয়েজন। আমি তাঁদের ভালোবাসার সুযোগ দিয়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়। মা ব্যাকুল হয়ে ডাকলেন, কোথায় যাস ছোটন?

এই একটু হাঁটব রাস্তায়।

দেরি করবি না তো?

না।

মা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, ছোটন তুই কি পরীদের বাসায় যাচ্ছিস? আমি চুপ করে রইলাম। বাবা বললেন, যেতে চায় যাক না। যাক।

রাস্তাটি নির্জন। শহরতলীর মানুষরা সব সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ে। তারস্বরে ঝিঝি ডাকছে চারপাশে। গাছে-গাছে নিশি-পাওয়া পাখিদের ছটফটানি। তবু মনে হচ্ছে চারপাশ কী চুপচাপ।

রাস্তায় চিনির মতো শাদা ধুলো চিকমিক করে। আমি একা একা হাঁটি। মনে হয় কত যুগ আগে যেন অন্য কোনো জন্মে এমন জোছনা হয়েছিল। বড়দা আর আমি গিয়েছিলাম পরী আপাদের বাসায়। আমার লাজুক বড়দা শিমুলগাছের আড়াল থেকে মৃদুস্বরে ডেকেছিলেন, পরী ও পরী ।

লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে এসেছিলেন পরীর মা। হাসিমুখে বলছিলেন,

ওমা তুই? কবে এলি রে? কলেজ ছুটি হয়ে গেল?

ভালো আছেন খালা? পরী ভালো আছে?

খবর পেয়ে পরী হাওয়ার মতো ছুটে এসেছিল ঘরের বাইরে।

এক পলক তাকিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে বলেছিল, ইশ! কতদিন পর কলেজ ছুটি হল আপনার।

আমার মুখচোরা লাজুক দাদা ফিসফিসিয়ে বলছিলেন—পরী, তুমি ভালো আছ?

হ্যাঁ। আপনি কেমন আছেন?

ভালো। তোমার জন্য গল্পের বই এনেছি পরী।’

এসব কোন্ জন্মের কথা ভাবছি? হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে এসব কি সত্যিসত্যি কখনো ঘটেছিল? একজন বৃদ্ধা মা, একজন অন্ধ বাবা-— এরা ছাড়া কোনোকালে কি কেউ ছিল আমার?

পরী আপার বাড়ির সামনে থমকে দাড়ালাম । খােলা উঠোনে চেয়ার পেতে পরী আপা চুপচাপ বসে আছেন। পাশে একটি শূন্য চেয়ার। পরী আপার বর হয়তো উঠে গেছেন একটু আগে। পরী আপা আমাকে দেখে স্বাভাবিক গলায় বললেন, ছোটন না?

হ্যাঁ।

উহ! কতদিন পর দেখা। বোস এই চেয়ারটায়।

আপনি ভালো আছেন পরী আপা?

হ্যাঁ, আমার মেয়ে দেখবি? বেস নিয়ে আসছি।

লাল জামা গায়ে উল-পুতুলের মতো একটি ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে করে ফিরে আসলেন তিনি।

দেখ, অবিকল আমার মতো হয়েছে। তাই না?

হ্যাঁ, কী নাম রেখেছেন মেয়ের?

নীরা। নামটা তোর পছন্দ হয়? চমৎকার নাম।

অনেকক্ষণ বসে রইলাম আমি। একসময় পরী আপা বললেন, বাড়ি যা ছোটন। রাত হয়েছে।

বাবা আর মা তেমনি বসে আছেন। বাবার মাথা সামনে ঝুঁকে পড়েছে। তার সারা মাথায় দুধের মতো শাদা চুল। মা দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে। পায়ের শব্দে চমকে উঠে বাবা বললেন, ছোটন ফিরলি?

জি।

পরীদের বাসায় গিয়েছিলি?

হ্যাঁ। অনেকক্ষণ আর কোনো কথা হল না। আমরা তিনজন চুপচাপ বসে রইলাম।

এক সময় বাবা বললেন, পরী কিছু বলেছে?

না।

মার শরীর কেঁপে উঠল। একটি হাহাকারের মতো তীক্ষ্ণস্বরে তিনি ফুঁপিয়ে উঠলেন, আমার বড় খোকা। আমার বড় খোকা।

এনড্রিন খেয়ে মরা আমার অভিমানী দাদা যে প্রগাঢ় ভালোবাসা পরী আপার জন্যে সঞ্চিত করে রেখেছিলেন তার সবটুকু দিয়ে বাবা আমার মাকে কাছে টানলেন। ঝুঁকে পড়ে চুমু খেলেন মার কুঞ্চিত কপালে। ফিসফিস করে বললেন, কাঁদে না, কাঁদে না।

ভালোবাসার সেই অপূর্ব দৃশ্যে আমার চোখে জল আসল। আকাশ ভরা জোছনার দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বললুম–পরী আপা, আজ তোমাকে ক্ষমা করেছি।

সঙ্গিনী (গল্প)

মিসির আলি বললেন, গল্প শুনবেন নাকি?

আমি ঘড়ির দিকে তাকলাম। রাত মন্দ হয় নি। দশটার মতো বাজে। বাসায়

ফেরা দরকার। আকাশের অবস্থাও ভালো না। গুড়গুড করে মেঘ ডাকছে। আষাঢ় মাস।

যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।

আমি বললাম, আজ থাক, আরেক দিন শুনব। রাত অনেক হয়েছে। বাসায় চিন্তা করবে।

মিসির আলি হেসে ফেললেন।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, হাসছেন কেন?

মিসির আলি হাসাতে-হাসতেই বললেন, বাসায় কে চিন্তা করবে? আপনার স্ত্রী কি বাসায় আছেন? আমার তো ধারণা তিনি রাগ করে বাচ্চাদের নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেছেন।

মিসির আলির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং সামান্য সূত্র ধরে সিদ্ধান্তে চলে যাবার প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার সঙ্গে আমি পরিচিত। তবুও বিস্মিত হলাম। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আজ দুপুরেই বড় ধরনের ঝগড়া হয়েছে। সন্ধ্যাবেলায় সে সুটকেস গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে। এক-একা খালি বাড়িতে থাকতে অসহ্য বোধ হচ্ছিল বলে মিসির আলির কাছে এসেছি, তবে এই ঘটনার কিছুই বলি নি। আগ বাড়িয়ে পারিবারিক ঝগড়ার কথা বলে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না।

আমি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললাম, ঝগড়া হয়েছে বুঝলেন কী করে?

অনুমানে বলছি।

অনুমানটাই-বা কী করে করলেন?

আমি লক্ষ করলাম, আপনি আমার কাছে কোনো কাজে আসেন নি। সময় কাটাতে এসেছেন। গল্প করছেন এবং আমার গল্প শুনছেন। কোনো কিছুতেই তেমন আনন্দ পাচ্ছেন না। অর্থাৎ কোনো কারণে মন বিক্ষিপ্ত। আমি বললাম, ভাবি কেমন আছেন? আপনি বললেন, ভালো! কিন্তু বলার সময় আপনার মুখ কঠিন হয়ে গেল। অর্থাৎ ভাবির সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। আমি তখন নিশ্চিত হবার জন্যে বললাম, আমার সঙ্গে চারটা ভাত খান। আপনি রাজি হয়ে গেলেন। আমি ধরে নিলাম।–রাগারগি হয়েছে এবং আপনার স্ত্রী বাসায় নেই। আপনার এক-এক লাগছে বলেই আপনি এসেছেন আমার কাছে। এই সিদ্ধান্তে আসার জন্যে শার্লক হোমস হতে হয় না। একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই বোঝা যায়।

আমি কিছু বললাম না। মিসির আলি বললেন, চা চড়াচ্ছি। চা খেয়ে গল্প শুনুন, তারপর এইখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। খালি বাসায় এক-একা রাত কাটাতে ভালো লাগবে না। তা ছাড়া বৃষ্টি নামল বলে।

এটাও কি আপনার লজিক্যাল ডিডাকশান?

না—এটা হচ্ছে উইশফুল থিংকিং। গরমে কষ্ট পাচ্ছি–বৃষ্টি হলে জীবন বাঁচে। তবে বাতাস ভারি, বৃষ্টির দেরি নেই বলে আমার ধারণা।

বাতাসের আবার হালকা-ভারি কী?

আছে। হালকা-ভারির ব্যাপার আছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ যখন বেড়ে যায় বাতাস হয় ভারি। সেটা আমি বুঝতে পারি মাথায় চুলে হাত দিয়ে। জলীয় বাষ্পের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে মাথার চুল নরম বা শক্ত হয়। শীতকালে মাথার চুলে হাত দিয়ে দেখবেন একরকম, আবার গরমকালে যখন বাতাসে হিউমিডিটি অনেক বেশি, তখন অন্যরকম।

আমার কাছে তো সবসময় একরকম লাগে।

মিসির আলি ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। ভাবটা এ-রকম, যেন এর চেয়ে মজার কথা আগে শোনেন নি। আমি বোকার মতো বসে রইলাম। অস্বস্তিও লাগতে লাগল। খুব বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে গল্প করার মধ্যেও একধরনের অস্বস্তি থাকে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়।

মিসির আলি ক্টোড়ে চায়ের পানি বসিয়ে দিলেন। শৌ-শোঁ শব্দ হতে লাগল। এই যুগে ক্টোভ প্রায় চোখেই পড়ে না। মিসির আলি এই বস্তু কেথেকে জোগাড় করেছেন। কে জানে! কিছুক্ষণ পরপর পাম্প করতে হয়। অনেক যন্ত্রণা।

চায়ের কপি হাতে বিছানায় এসে বসামাত্র বৃষ্টি শুরু হল। তুমুল বর্ষণ। মিসির আলি বললেন, আমার বেহেশতে যেতে ইচ্ছা করে না কেন জানেন?

জানি না।

বেহেশতে যেতে ইচ্ছা করে না-করণ সেখানে ঝড়-বৃষ্টি নেই। এয়ারকুলার বসানো একটা ঘরের মতো সেখানকার আবহাওয়া। তাপ বাড়বেও না, কমবেও না! অনন্ত কাল একই থাকবে। কোনো মানে হয়?

আপনি কি বেহেশত-দোজখ এইসব নিয়ে মাথা ঘামান?

না, ঘামাই না।

সৃস্টিকর্তা নিয়ে মাথা ঘামান? হ্যাঁ, ঘামাই। খুব চিন্তা করি, কোনো কুল-কিনারা পাই না। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মগ্রন্থ কী বলে, জানেন? বলে—সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর পারেন না এমন কিছুই নেই। তিনি সব পারেন। অথচ আমার ধারণা তিনি দুটো জিনিস পারেন না, যা মানুষ পারে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, উদাহরণ দিন।

সৃস্টিকর্তা নিজেকে ধ্বংস করতে পারেন না-মানুষ পারে। আবার সৃস্টিকর্তা দ্বিতীয় একজন সৃষ্টিকর্তা তৈরি করতে পারেন না। মানুষ কিন্তু পারে, সে সন্তানের জন্ম দেয়।

আপনি তাহলে একজন নাস্তিক?

না, আমি নাস্তিক না। আমি খুবই আস্তিক। আমি এমন সব রহস্যময় ঘটনা আমার চারপাশে ঘটতে দেখেছি যে বাধ্য হয়ে আমাকে অস্তিক হতে হয়েছে। ব্যাখ্যাতীত সব ঘটনা। যেমন স্বপ্নের কথাটাই ধরুন। সামান্য স্বপ্ন, অথচ ব্যাখ্যাতীত একটা ঘটনা।

ব্যাখ্যাতীত হবে কেন? ফ্লয়েড তো চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন বলে শুনেছি।

মোটেই চমৎকার ব্যাখ্যা করেন নি। স্বপ্নের পুরো ব্যাপারটাই তিনি অবদমিত কামনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে লিখলেন—Interpretations ofdream। তিনি শুধু বিশেষ একধরনের স্বপ্নই ব্যাখ্যা করলেন। অন্য দিক সম্পর্কে চুপ করে রইলেন। যদিও তিনি খুব ভালো করে জানতেন মানুষের বেশ কিছু স্বপ্ন আছে, যা ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি এই নিয়ে প্রচুর কাজও করেছেন, কিন্তু প্রকাশ করেন নি। নষ্ট করে ফেলেছেন! তাঁর ছাত্র প্রফেসর ইয়ুং কিছু কাজ করেছেন—মূল সমস্যায় পৌঁছতে পারেননি,বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, কিছু-কিছু স্বপ্ন মানুষ কেন দেখে তা বলা যাচ্ছে না। যেমন-একটা লোক স্বপ্ন দেখল, হঠাৎ মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়ে গেল। স্বপ্ন দেখার দু দিন পর দেখা গেল। সত্যি-সত্যি সিলিং ফ্যান খুলে পড়ে গেছে। এই ধরনের স্বপ্নকে বলে প্রিগগ্‌নিশন ড্রীম (Precognition dream)। এর একটিই ব্যাখ্যা—স্বপ্নে মানুষ ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে—যা সম্ভব নয়। কাজেই এ-জাতীয় স্বপ্ন ব্যাখ্যাতীত।

আমি বললাম, এমনো তো হতে পারে যে, কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে।

হতে পারে। প্রচুর কাকতালীয় ব্যাপার পৃথিবীতে ঘটছে। তবে কাকতালীয় ব্যাপারগুলিকেও একটা স্ট্যাটিসটিক্যাল প্রবাবিলিটির ভেতর থাকতে হবে।। Precognition dream- এর ক্ষেত্রে তা থাকে না।

বুঝতে পারছি না।

বোঝানো একটু কঠিন। আমি বরং স্বপ্ন সম্পর্কে একটা গল্প বলি-শুনতে চান?

বলুন শুনি-ভৌতিক কিছু?

না–ভৌতিক না।–তবে রহস্যময় তো বটেই। আরেক দফা চা হয়ে যাক।

হোক।

কী ঠিক করলেন? থেকে যাবেন? বৃষ্টি বাড়ছে। আমি থেকে যাওয়াই ঠিক করলাম। মিসির আলি চা নিয়ে বিছানায় পা তুলে বসলেন। গল্প শুরু হল।

 

ছোটবেলায় আমাদের বাসায় খাবনামা নামে একটা স্বপ্নতত্ত্বের বই ছিল! কোন স্বপ্ন দেখলে কী হয় সব ঐ বইয়ে লেখা। আমার মা ছিলেন বইটার বিশেষ ভক্ত। ঘুম থেকে উঠেই বলতেন, ও মিসির, বইটা একটু দেখ তো। একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের মানে কি বল!

আমি বই নিয়ে বসতাম।

দেখ তো বাবা, গরু স্বপ্ন দেখলে কী হয়।

আমি বই উল্টে জিজ্ঞেস করলাম, কী রঙের গরু, মা? সাদা না কালো?

এই তো মুশকিলে ফেললি, সাদা না কালো খেয়াল নেই।

সাদা রঙের গরু হলে—ধনলাভ। কালো রঙের গরু হলো-বিবাদ!

কার সঙ্গে বিবাদ? তোর বাবার সাথে?

লেখা নেই তো মা!

মা চিন্তিত হয়ে পড়তেন। স্বপ্ন নিয়ে চিন্তার তাঁর কোনো শেষ ছিল না। আর কত বিচিত্র স্বপ্ন যে দেখতেন—একবার দেখলেন দুটো অন্ধ চড়ুই পাখি। খাবনাময় অন্ধ চড়ুই পাখি দেখলে কী হয় লেখা নেই। কবুতর দেখলে কী হয় লেখা আছে। মার কারণেই খাবনামা ঘাঁটতে-ঘাঁটতে একসময় পুরো বইটা আমার মুখস্থ হয়ে গেল। স্বপ্নবিশারদ হিসেবে আমার নাম রটে গেল! যে যা দেখে আমাকে এসে অর্থ জিজ্ঞেস করে। এই করতে গিয়ে জানলাম কত বিচিত্র স্বপ্নই না মানুষ দেখে। সেই সঙ্গে মজারমজার কিছু জিনিসও লক্ষ করলাম। যেমন-অসুস্থ মানুষরা সাধারণত বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখে। বোকা মানুষদের স্বীপুগুলি হয়। সরল ধরনের। বুদ্ধিমান মানুষরা খুব জটিল স্বপ্ন দেখে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখে, সেটা হচ্ছে কোনো একটি অনুষ্ঠানে সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে উপস্থিত হয়েছে। সবার গায়ে ভালো পোশাকআশাক, শুধু সে-ই পুরোপুরি নগ্ন কেউ তা লক্ষ করছে না!

মিসির আলি সাহেব কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই জাতীয় স্বপ্ন কি আপনি কখনো দেখেছেন?

আমি বললাম, না। একটা স্বপ্নই আমি বারবার দেখি-পরীক্ষা হলে পরীক্ষা দিতে বসেছি। খুব সহজ প্রশ্ন, সবগুলির উত্তর আমার জানা। লিখতে গিয়ে দেখি কলম দিয়ে কালি বেরুচ্ছে না। কলামটা বদলে অন্য কলম নিলাম।–সেটা দিয়েও কালি বেরুচ্ছে না। এদিকে ঘন্টা পড়ে গেছে।

এই স্বপ্নটাও খুব কমন। আমিও দেখি। একবার দেখলাম বাংলা পরীক্ষা- প্রশ্ন দিয়েছে অঙ্কের। কঠিন সব অঙ্ক। বান্দরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার অঙ্ক! একটা বঁদরের জায়গায় দুটো বাঁদর। একটা খানিকটা ওঠে, অন্যটা তার লেজ ধরে টেনে নিচে নামায়া-খুবই জটিল ব্যাপার। বাঁশের সবটা আকার তৈলাক্ত না, কিছুটা তেল ছাড়া…..

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, সত্যিই কি এমন স্বপ্ন দেখেছেন?

জ্বি-না-ঠাট্টা করে বলছি।–জটিল সব অঙ্ক ছিল, এইটুকু মনে আছে। যাই হোক, ছোটবেলা থেকেই এইসব কারণে স্বপ্নের দিকে আমি ফুকলাম। দেশের বাইরে যখন প্যারাসাইকোলজি পড়তে গেলাম।–তখন স্পেশাল টপিক নিলাম ট্রম। স্ট্রীম ল্যাবোরেটরিতে কাজও করলাম। আমার প্রফেসর ছিলেন ডঃ সুইন হার্ন, দুঃস্বপ্নের ব্যাপারে যাকে পৃথিবীর সেরা বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে। দুঃস্বপ্ন অ্যানালিসিসের তিনি একটা টেকনিক বের করেছেন, যার নাম সুইন হার্ন অ্যানালিসিস। সুইন হার্ন অ্যানালিসিসে ব্যাখ্যা করা যায় না। এমন সব দুঃস্বপ্নের একটা ফাইল তাঁর কাছে ছিল। সেই ফাইল তিনি তাঁর গ্রাজুয়েট ছাত্রদের দিতেন না। আমাকে তিনি খুবই পছন্দ করতেন, সম্ভবত সে-কারণেই সেই ফাইল ঘাঁটার সুযোগ হয়ে গেল। ফাইল পড়ে আমি হতভম্ব। ব্যাখ্যাতীত সব ব্যাপার। একটা উদাহরণ দিই-নিউ ইংল্যাণ্ডের একটি তেইশ বছর বয়েসী মেয়ে দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করল। তার নাভিমূল থেকে একটা হাত বের হয়ে আসছে। স্বাভাবিক হাতের চেয়ে সরু-লম্বা-লম্বা আঙুল হাতটার রঙ নীলচে-খুব তুলতুলে। দুঃস্বপ্নটা সে প্রায়ই দেখতে লাগল! প্রতিবারই স্বপ্ন ভাঙত বিকট চিৎকারে। তাকে ড্রীম ল্যাবোরেটরিতে ভর্তি করা হল। প্রফেসর সুইন হার্ন রোগিণীর মনোবিশ্লেষণ করলেন। অস্বাভাবিক কিছুই পেলেন না। মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হল নিউ ইংল্যাণ্ডে। তার কিছুদিন পর মেয়েটি লক্ষ করল তার নাভিমূল ফুলে উঠেছে-একধরনের ননম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ হচ্ছে। একমাসের মধ্যে সেই টিউমার মানুষের হাতের আকৃতি ধারণ করল। টিউমারটির মাথায় মানুষের হাতের আঙুলের মতো পাঁচটি আঙুল…

আমি মিসির আলিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই, এই গল্পটা থাক! শুনতে ভালো লাগছে না। ঘেন্না লাগছে!

ঘেন্না লাগার মতোই ব্যাপার। ছবি দেখলে আরো ঘেন্না লাগবে। মেয়েটির ছবি ছাপায়ুছািট ইংল্যাও জার্নাল অব ডেসিনে। ছবি দেখতে চান?

জি-না।

পিএইচ. ডি. প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম, পিএইচ. ডি. না-করেই ফিরতে হল! প্রফেসরের সঙ্গে ঝামেলা হল। যে-লোক আমাকে এত পছন্দ করত, সে-ই বিষনজরে দেখতে লাগল। এম. এস. ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট টাইম টীচিং-এর একটা ব্যবস্থা হল। ছাত্রদের অ্যাবনরম্যাল বিহেভিয়ার পড়াই। স্বপ্ন সম্পর্কেও বলি। স্বপ্নের সঙ্গে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণের একটা সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করি। ছাত্রদের বলি, তোমরা যদি কখনো কোনো ভয়ংকর স্বপ্ন দেখ, তাহলে আমাকে বলবে।

ছাত্ররা প্রায়ই এসে স্বপ্ন বলে যায়। ওদের কোনো স্বপ্ৰই তেমন ভয়ংকর না। সাপে তাড়া করছে, আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে-এই জাতীয় স্বপ্ন। আমার ইচ্ছা ছিল দুঃস্বপ্ন নিয়ে গবেষণার কিছু কাজ করব। সেই ইচ্ছা সফল হল না। দুঃস্বপ্ন দেখছে এমন লোকজনই পাওয়া গেল না। আমি গবেষণার কথা যখন ভুলে গেলাম, তখন এল লোকমান ফকির।

লোকমান ফকিরের বাড়ি কুমিল্লার নবীনগরে। বয়স ত্রিশ-পয়ত্রিশ। শিপিং করপোরেশনে মোটামুটি ধরনের চাকরি করে। দু-কামরার একটা বাড়ি ভাড়া করেছে। কাঁঠালবাগানে। বিয়ে করে নি। তবে বিয়ের চিন্তা-ভাবনা করছে। তার এক মামাতো বোনের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে মেয়েটিকে তার পছন্দ নয়। তবে অপছন্দের কথা সে সরাসরি বলতেও পারছে না। কারণ তার এই মামা তাকে পড়াশোনা করিয়েছেন।

ছেলেটি এক সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। আমি তাকে দেখে চমকে উঠলাম। মুখ পাণ্ডুর বর্ণ, মৃত মানুষের চোখের মতো ভাবলেশহীন চোখ। যৌবনের নিজস্ব যে-জ্যোতি যুবক-যুবতীর চোখে থাকে তার কিছুই নেই। ছেলেটি হাঁটছে খুঁড়িয়ে-খুড়য়ে, কিছুক্ষণ পরপরই চমকে উঠছে। সে ঘরে ঢুকেই বিনা ভূমিকায় বলল, স্যার, আপনি আমাকে বাঁচান।

আমি ছেলেটিকে বসালাম। পরিচয় নিলাম! হালকা কিছু কথাবার্তা বলে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। তাতে খুব লাভ হল বলে মনে হল না। তার অস্থিরতা কমল না। লক্ষ করলাম, সে স্থির হয়ে বসতেও পারছে না। খুব নড়াচড়া করছে। আমি বললাম, তোমার সমস্যাটা কী?

ছেলেটি রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে-মুছতে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, স্যার, আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন।

আমি বললাম, দুঃস্বপ্ন দেখে না। এমন মানুষ তুমি খুঁজে পাবে না! সাপে তাড়া করছে, বাঘে তাড়া করছে, আকাশ থেকে নিচে পড়ে যাওয়া—এগুলি খুবই কমন স্বপ্ন। সাধারণত হজমের অসুবিধা হলে লোকজন দুঃস্বপ্ন দেখে। ঘুমের অসুবিধা হলেও দেখে! তুমি শুয়ে আছ, মাথার নিচ থেকে বালিশ সরে গেল, তখনো এ-রকম স্বপ্ন তুমি দেখতে পার। শারীরিক অস্বস্তির একটা প্রকাশ ঘটে দুঃস্বপ্নে। আগুনে পোড়ার স্বপ্ন। মানুষ কখন দেখে জানা? যখন পেটে গ্যাস হয়, সেই গ্যাসে বুক জ্বালাপোড়া করে— তখন সে স্বপ্ন দেখে তাকে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

স্যার, আমার স্বপ্ন এ-রকম না। অন্য রকম।

ঠিক আছে, গুছিয়ে বল। শুনে দেখি কী রকম।

ছেলেটি সঙ্গে-সঙ্গে কথা শুরু করল। মুখস্থ বলে যাবার মতো বলে যেতে লাগল! মনে হয় আগে থেকে ঠিকঠাক করে এসেছে এবং অনেক বার রিহার্সেল দিয়েছে।

কথা বলার সময় একবারও আমার চোখের দিকে তাকাল না। যখন প্রশ্ন করলাম তখনো না।

প্রথম স্বপ্নটা দেখি বুধবার রাতে। এগারটার দিকে ঘুমুতে গেছি! আমার ঘুমের কোনো সমস্যা নেই! শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়তে পারি। সে-রাতেও তাই হল! বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়েছি। সঙ্গে-সঙ্গেই স্বপ্নটা দেখেছি।

কী করে বুঝলে শোয়ামাত্র স্বপ্ন দেখেছ?

জেগে উঠে ঘড়ি দেখেছি, এগারটা দশ।

স্বপ্নটা বল।

আমি দেখলাম খোলামেলা একটা মাঠের মতো জায়গা। খুব বাতাস বইছে। শোশোঁ শব্দ হচ্ছে। রীতিমতো শীত লাগছে। আমার চারদিকে অনেক মানুষ, কিন্তু ওদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না! ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি। হাসির শব্দ শুনছি? একটা বাচ্চা ছেলে কাঁদছে-তাও শুনছি। বুড়োমতো একটা লোকের কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে আবছাভাবেও দেখতে পাচ্ছি না। একবার মনে হল আমি বোধহয় অন্ধ হয়ে গেছি। চারদিকে খুব তীক্ষ্ণ চোখে তোকালাম–মাঠ দেখতে পাচ্ছি, কুয়াশা দেখতে পাচ্ছি-কিন্তু মানুষজন দেখছি না, অথচ তাদের কথা শুনছি। হঠাৎ ওদের কথাবার্তা সব থেমে গেল। বাতাসের শো-শোঁ শব্দও বন্ধ হয়ে গেল! মনে হল কেউ যেন এসেছে। তার ভয়ে সবাই চুপ করে গেছে। আমার নিজেরও প্রচণ্ড ভয় লাগল। একধরনের অন্ধ ভয়।

তখন শ্লেষ্মাজড়িত মোটা গলায় একজন বলল,  ছেলেটি তো দেখি এসেছে। মেয়েটা কোথায়?

কেউ জবাব দিল না। খানিকক্ষণের জন্যে বাচ্চা ছেলেটির কান্না শোনা গেল, সঙ্গেসঙ্গে থেমেও গেল। মনে হল কেউ যেন তার মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করছে। ভারি গলার লোকটা আবার কথা বলল, মেয়েটা দেরি করছে কেন? কেন এত দেরি? ছেলেটিকে তো বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। এর ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে। ও জেগে যাবে।

হঠাৎ চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। একসঙ্গে সবাই বলে উঠল,  এসেছে, এসেছে, মেয়েটা এসেছে। আমি চমকে উঠে দেখলাম আমার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব রোগা একটা মেয়ে। অসম্ভব ফরাসা, বয়স আঠার-উনিশ। এলোমেলোভাবে শাড়ি পরা। লম্বা চুল! চুলগুলি ছেড়ে দেওয়া, বাতাসে উড়ছে। মেয়েটা ভয়ে থারথার করে কাঁপছে। আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। সে অসংকোচে আমার হাত ধরে কাপা গলায় বলল, আমার ভয় করছে। আমার ভয় করছে!

আমি বললাম, আপনি কে?

সে বলল, আমার নাম নাগিন্স। আপনি যা দেখছেন তা স্বপ্ন। ভয়ংকর স্বপ্ন! একটু পরই বুঝবেন। আগে এই স্বপ্নটা শুধু আমি একা দেখতাম। এখন মনে হয় আপনিও দেখবেন।

মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। আতঙ্কে অস্থির হয়ে আমার গা ঘেষে দাঁড়াল। কাঁদতেকাঁদতেই বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না, আমার ভয় লাগছে বলেই আমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছি। এরা প্রতি মাসে একবার করে আমাকে এই স্বপ্নটা দেখায়।

আমি বললাম, এরা কারা?

জানি না। কিছু জানি না। আপনি থাকায় কেন জানি একটু ভরসা পাচ্ছি। যদিও জানি আপনি কিছুই করতে পারবেন না। কিছুই না, কিছুই না, কিছুই না।

মেয়েটি হাঁপাতে শুরু করল আর তখন সেই ভারি এবং শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠ চিৎকার করে বলল, সময় শেষ। দৌড়াও, দৌড়াও, দৌড়াও!

সেই চিৎকারের মধ্যে ভয়ংকর পৈশাচিক কিছু ছিল। আমার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু থরথর করে কাঁপতে লাগল। চোখের সামনে কুয়াশা কেটে যেতে লাগল-চারদিকে তীব্র আলো! এত তীব্র যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যাদের কথা শুনছিলাম। অথচ দেখতে পাচ্ছিলাম না, এই আলোয় সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম-এ।রা এরা এরা…

এরা কী?

এরা মানুষ না, অন্য কিছু-লম্বাটে পশুর মতো মুখ, হাত-পা মানুষের মতো। সবাই নগ্ন। এরা অদ্ভুত একধরনের শব্দ করতে লাগল! আমার কানে বাজতে লাগল-দৌড়াও দৌড়াও … আমরা দৌড়াতে শুরু করলাম। আমাদের পিছনে সেই জন্তুর মতো মানুষগুলিও দৌড়াচ্ছে।

আমরা ছুটছি মাঠের ওপর দিয়ে। সেই মাঠে কোনো ঘাস নেই। সমস্ত মাঠময় অযুত নিযুত লক্ষ কোটি ধারাল ব্লেড সারি-সারি সাজান। সেই ব্লেডে আমার পা কেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে-তীব্র তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। চিৎকার করে উঠলাম, আর তখনই ঘুম ভেঙে গেল। দেখি ঘামে সমস্ত বিছানা ভিজে গেছে!

এই তোমার স্বপ্ন?

জ্বি।

দ্বিতীয় স্বপ্ন কখন দেখলে?

ঠিক একমাস পর।

সেই মেয়েটিও কি দ্বিতীয় স্বপ্নে তোমার সঙ্গে ছিল?

জ্বি।

একই স্বপ্ন, না একটু অন্য রকম?

একই স্বপ্ন।

মায় বারও কিছুই মেটের হাত ধরে দৌড়ালে।

জ্বি।

প্রথম বার যেমন তার সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল, দ্বিতীয় বারও হল?

জ্বি।

দ্বিতীয় বারও কি মেয়েটি পরে এসেছে? তুমি আগে এসে অপেক্ষা করছিলে?

জ্বি-না।–দ্বিতীয় বারে মেয়েটি আগে এসেছিল, আমি পরে এসেছি।

দ্বিতীয় বারের স্বপ্ন তুমি রাত কটায় দেখেছ?

ঠিক বলতে পারব না, তবে শেষরাতের দিকে। ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান হল।

দ্বিতীয় বারও স্বল্প মোটা গলার লোক কথা কাল।

জ্বি।

লোকমান ফকির রুমালে কপালের ঘাম মুছতে লাগল। সে অসম্ভব ঘামছে। আমি বললাম, পানি খাবে? পানি এনে দেব?

জ্বি স্যার, দিন।

আমি পানি এনে দিলাম, সে এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করে ফেলল। আমি বললাম, স্বপ্ন ভাঙার পর তুমি দেখলে, তোমরা দুটি পা-ই ব্লেডে কেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।–তাই না?

লোকমান হতভম্ব হয়ে বলল, ত্ত্বি স্যার! আপনি কী করে বুঝলেন?

তুমি খুঁড়িয়ে-খুড়িয়ে ঘরে ঢুকলে, সেখান থেকে অনুমান করেছি। তা ছাড়া তোমার পা স্বপ্ন দেখার পর কেটে যাচ্ছে বলেই স্বপ্নটা ভয়ংকর। পা যদি না-কাটত তাহলে স্বপ্নটা ভয়ংকর হত না, বরং একটা মধুর স্বপ্ন হত। কারণ স্বপ্নে একটি মেয়ের সঙ্গে তোমার দেখা হচ্ছে, যে তোমার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। আঠার-উনিশ বছরের রূপবতী একটি মেয়ে, হাত ধরে তোমার সঙ্গে দৌড়াচ্ছে।

আমার কথার মাঝখানেই লোকমান ফকির পায়ের জুতো খুলে ফেলল, মোজা খুলল। আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম, পায়ের তলা ফালা-ফালা করে কোটা! এমন কিছু সত্যি-সত্যি ঘটতে পারে। আমি ভাবি নি।

লোকমান ক্ষীণ গলায় বলল, এটা কী করে হয় স্যার?

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে স্বপ্নের ব্যাপারে পড়াশোনা যা করেছি। তার থেকে তোমাকে একটা কথা বলতে পারি—Iunvert reaction বলে একটা ব্যাপার আছে। ধরা, তোমার একটা আঙুল পুড়ে গেল-সেই খবর স্নায়ুর মাধ্যমে যখন তোমার মস্তিষ্কে পৌঁছবে, তখন তুমি তীব্র ব্যথা পাবে। Invertreaction-এ কী হয় জান? আগে মস্তিষ্কে আঙুলটি পোড়ার অনুভূতি পায়, তারপর সেই খবর আঙুলে পৌঁছে তখন আঙুলটি পোড়া-পোড়া হয়ে যেতে পারে। স্বপ্নের পুরো ব্যাপারটা হয় মস্তিকে। সেখানে থেকে Invert reaction-এ শরীরে তার প্রভাব পড়তে পারে।

এক লোক স্বপ্নে দেখত, তার হাতে কে যেন পিন ফোটাচ্ছে। ঘুম ভাঙার পর তার হাতে সত্যি-সত্যি পিন ফোটার দাগ দেখা যেত! তোমার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই ঘটেছে। তবে এমন ভয়াবহভাবে পা কাটা অভিশণর ব্লণটাৰ্ডধমভ- এ সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।

তাহলে কী?

আমি বুঝতে পারছি না।

লোকমান ক্লান্ত স্বরে বলল,  এক মাস পরপর আমি স্বপ্নটা দেখি। কারণ পায়ের ঘা শুকাতে এক মাস লাগে।

আমি লোকমান ফকিরের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, তুমি এখন থেকে একটা কাজ করবে-ঘুমুতে যাবে জুতো পায়ে দিয়ে। স্বপ্নে যদি তোমাকে দৌড়াতেও হয়-তোমার পায়ে থাকবে জুতো! ব্লেড তোমাকে কিছু করতে পারবে না।

সত্যি বলছেন?

আমার তাই ধারণা। আমার মনে হচ্ছে জুতো পরে ঘুমুলে তুমি স্বপ্নটাই আর দেখবে না।

লোকমান ফকির চলে গেল। খুব ভরসা পেল বলে মনে হল না। আমি তাকে বলে দিয়েছিলাম এক মাস পর স্বপ্ন দেখা হয়ে গেলে সে যেন আসে। সে এল দেড় মাস পর।

তার মুখ আগের চেয়েও শুকনো, চোখ ভাবলেশহীন। অথর্ব মানুষের মতো হাঁটছে। আমি বললাম, স্বপ্ন দেখেছ?

জ্বি-না।

জুতো পায়ে ঘুমুচ্ছ?

জ্বি স্যার। জুতো পায়ে দেওয়ার জন্যেই স্বপ্ন দেখছি না।

আমি হাসিমুখে বললাম, তাহলে তো তোমার রোগ সেরে গেল। এত মন-খারাপ কেন? মনে হচ্ছে বিরাট সমস্যায় পড়েছি। সমস্যাটা কী?

লোকমান নিচু গলায় বলল, মেয়েটার জন্যে মন খারাপ স্যার। বেচারি একাএক স্বপ্ন দেখছে। এত ভালো একটা মেয়ে কষ্ট করছে। আমি সঙ্গে থাকলে সে একটু ভরসা পায়। নিজের জন্যে কিছু না। মেয়েটার জন্যে খুব কষ্ট হয়।

লোকমানের চোখে প্ৰায় পানি এসে গেল। আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম-সে বলে কী।

স্যার, আমি ঠিক করেছি। জুতো পরব না। যা হবার হবে। নার্গিসকে এক-একা যেতে দেব না। আমি থাকব সঙ্গে। মেয়েটার জন্যে আমার খুব কষ্ট হয় স্যার। এত চমৎকার একটা মেয়ে! আমি স্যার থাকব তার সঙ্গে।

সেটা কি ভালো হবে?

জ্বি স্যার হবে। আমি তাকে ছাড়া বাঁচব না।

সে কিন্তু স্বপ্নের একটি মেয়ে।

সে স্বপ্নের মেয়ে নয়! আমি যেমন, সেও তেমন। আমরা দু জন এই পৃথিবীতেই বাস করি। সে হয়তো ঢাকাতেই কোনো এক বাসায় থাকে। তার পায়ে ব্লেডের কাটা। আমি যেমন সারাক্ষণ তার কথা ভাবি, সেও নিশ্চয়ই ভাবে। শুধু আমাদের দেখা হয় স্বপ্নে।

মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে বললেন, গল্পটি এই পর্যন্তই।

আমি চেঁচিয়ে বললাম, এই পর্যন্ত মানে? শেষটা কী?

শেষটা আমি জানি না। ছেলেটি ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে একবার এসেছিল। সে বলল, জুতো খুলে ঘুমানোমাত্রই সে আবার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে মেয়েটির দেখা পায়। তারা দু জন খানিকক্ষণ গল্প করে। দু জনকে জড়িয়ে ধরে কাব্দে। এক সময় মানুষের মতো জন্তুগুলো চেঁচিয়ে বলে–দৌড়াও, দৌড়াও! তারা দৌড়াতে শুরু করে।

ছেলেটি আপনার কাছে আর আসে নি?

জ্বি-না।

ছেলেটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?

না, জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। ছেলেটি জানে জুতো পায়ে ঘুমুলে এই দুঃস্বপ্ন সে দেখবে না, তার পরেও জুতো পায়ে দেয় না। কারণ মেয়েটিকে একা ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রেমের ক্ষমতা যে কী প্রচণ্ড হতে পারে, প্রেমে নাপড়লে তা বোঝা যায না। ছেলেটির পক্ষে এই জীবনে তার স্বপ্নসঙ্গিনীর মায়া কাটানো সম্ভব না। সে বাকি জীবনে কখনো জুতো পায়ে ঘুমুবে না। সে আসলে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি চায় না। দুঃস্বপ্ন হলেও এটি সেইসঙ্গে তাঁর জীবনের মধুরতম স্বপ্ন।

আপনার কি ধারণা, নার্গিস নামের কোনো মেয়ে এই পৃথিবীতে সত্যি-সত্যি আছে?

মিসির আলি নিছু গলায় বললেন, আমি জানি না। রহস্যময় এই পৃথিবীর খুব কম রহস্যের সন্ধানই আমি জানি। তবে মাঝে-মাঝে আমার কেন জানি এই মেয়েটির হাত ধরে একবার দৌড়াতে ইচ্ছা করে- আরেক দফা চা হবে? পানি কি গরম করব?

সম্পর্ক

মোবারক হোসেন ভাত খেতে বসে তরকারির বাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা কী? তাঁর গলার স্বরে দূরবর্তী ঝড়ের আভাস। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যাবে।

মনোয়ারা দূরবর্তী ঝড়ের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে স্বাভাবিক গলায় বললেন, কী হয়েছে?

এটা কীসের তরকারি?

কৈ মাছের ঝোল।

কৈ মাছের ঝোলে তরকারি কী?

চোখে দেখতে পাচ্ছ না কী দিয়েছি! ফুলকপি, শিম।

তোমাকে কতবার বলেছি—ফুলকপির সঙ্গে শিম দেবে না। ফুলকপির এক স্বাদ, শিমের আলাদা স্বাদ। আমার তো দুটা জিভ না যে একটায় শিম খাব আর অন্যটায় ফুলকপি?

মনোয়ারা হাই তুলতে তুলতে বললেন, যে তরকারি খেতে ইচ্ছা করে সেটা নিয়ে খেলেই হয়। খেতে বসে খামাখা চিৎকার করছ কেন?

এই তরকারি তো আমি মরে গেলেও খাব না।

না খেলে না খেয়ো। ডাল আছে ডাল খাও।

শুধু ডাল দিয়ে খাব?

মনোয়ারা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এটা তো হোটেল না যে চৌদ্দ পদের রান্না আছে।

মোবারক হোসেনের প্রচণ্ড ইচ্ছা হচ্ছে তরকারির বাটি ছুঁড়ে মেঝেয় ফেলে দিতে। এই কাজটা করতে পারলে রাগটা ভালো দেখানো হয়। এতটা বাড়াবাড়ি করতে সাহসে কুলাচ্ছে না। মনোয়ারা সহজ পাত্রী না। তার চীনামাটির বাটি ভাঙবে আর সে চুপ করে থাকবে এটা হবার না। মোবারক হোসেন কৈ মাছের ঝোলের বাটি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধাক্কাটা হিসাব করে দিলেন, যেন তরকারি পড়ে যায় আবার বাটিটাও না ভাঙ্গে।

মনোয়ারা বললেন, কী হলো? খাবে না?

মোবারক হোসেন কিছু না বলে ভাতের থালায় হাত ধুয়ে ফেললেন। থালায় ভাত বাড়া ছিল। কিছু ভাত নষ্ট হলো। হাত ধোয়ার দরকার ছিল না। তার হাত পরিষ্কার— খাওয়া শুরুর আগেই গণ্ডগোল বেধে গেল।

মনোয়ারা বললেন, ভাত খাবে না?

মোবারক হোসেন বললেন, না। তোমার ভাতে আমি ইয়ে করে দেই।

বাক্যটা খুব কঠিন হয়ে গেল। রাগের সময় হিসাব করে কথা বলা যায় না। তবে কঠিন বাক্যেও কিছু হলো না। মনোয়ারা খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তরকারির বাটি, ডালের বাটি তুলে ফেলতে শুরু করলেন। যেন কিছুই হয়নি। মোবারক হোসেন স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। পরিবারের প্রধান মানুষটা রাগ করে বলছে-ভাত খাবে না, তাকে সাধাসাধি করার একটা ব্যাপার আছে না? মনোয়ারা কি বলতে পারত না— ভুল হয়েছে, ভবিষ্যতে আর কখনও শিম আর ফুলকপি একসঙ্গে রাঁধা হবে না। কিংবা বলতে পারত-~~ দু মিনিট বোস, চট করে একটা ডিম ভেজে দেই। শুকনা মরিচ আর পেঁয়াজ কচলে মরিচের ভর্তা বানিয়ে দেই। মরিচের ভর্তা তার অত্যন্ত প্রিয়। এই জিনিসটা বানাতে কতক্ষণ লাগে? তা-না, ভাত তরকারি তুলে ফেলছে! ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের এই হলো ফসল।

মোবারক হোসেনের তীব্র ইচ্ছা হলো বাড়িঘর ছেড়ে গৌতম বুদ্ধের মতো বের হয়ে পড়েন। এ রকম ইচ্ছা তার প্রায়ই হয়। বাড়ি থেকে বেরও হন। রেলস্টেশনে গিয়ে ঘণ্টাখানেক বসে থাকেন। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। তাঁর দৌড় রেলস্টেশন পর্যন্ত। মোবারক হোসেন নান্দাইল রোড রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার। রাত নটায় একটা আপ ট্রেন ছেড়ে দিয়ে খেতে এসেছিলেন। খেতে এসে এই বিপত্তি— শিম আর ফুলকপির ঘোঁট বানিয়ে বসে আছে।

মোবারক হোসেন মাফলার দিয়ে কান ঢাকতে শুরু করলেন। এটা হলো তাঁর ঘর ছেড়ে বাইরে যাবার সঙ্কেত। অতি সহজে তাঁর কানে ঠাণ্ডা লেগে যায় বলে সব সময় মাফলার দিয়ে কান ঢাকতে হয়। আর এ বছর তুন্দ্রা অঞ্চলের শীত পড়েছে। আগুনের ওপর বসে থাকলেও শীত মানে না।

মনোয়ারা বললেন, যাচ্ছ কোথায়?

তিনি জবাব না দিয়ে গায়ে চাদর জড়ালেন।

স্টেশনে যাচ্ছ?

তিনি এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। হাতমোজা পরতে লাগলেন। হাতমোজা পরা ঠিক হচ্ছে না। মনোয়ারা মাত্র কিছুদিন আগে হাতমোজা বুনে দিয়েছেন। তার উচিত হাতমোজা জোড়া নর্দমায় ফেলে দেয়া কিন্তু বাইরে মাঘ মাসের দুর্দান্ত শীত। খোলা মাঠের ওপর রেলস্টেশন। শীত সহ্য হবে না। গৌতম বুদ্ধ কপিলাবস্তুতে না থেকে যদি নান্দাইল রোডে থাকতেন এবং মাঘ মাসে গৃহত্যাগ করতেন তা হলে তিনিও হাতমোজা পরতেন। গলায় মাফলার বাঁধতেন।

রাতে ফিরবে? না ফিরলে বলে যাও। দরজা লাগিয়ে দেব।

যা ইচ্ছা করো।

আমি কিন্তু শুয়ে পড়লাম। রাতদুপুরে ফিরে এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করবে না।

তোর বাপের দরজা? সরকারি বাড়ির সরকারি দরজা। আমার যখন ইচ্ছা ধাক্কাধাক্কি করব।

তুই তোকারি করবে না। আমি তোমার ইয়ার বন্ধু না। চুপ।

একদম চুপ। No talk.

মোবারক হোসেন অগ্নিদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টির অর্থ— তুমি জাহান্নামে যাও। তিনি ঘরের কোনায় রাখা ছাতা হাতে বের হয়ে গেলেন। তিনি বের হওয়ামাত্র দরজা বন্ধ করার ঝপাং শব্দ হলো। মোবারক হোসেন ফিরে এসে বন্ধ দরজায় প্রচণ্ড লাথি বসালেন। এতে তাঁর রাগ সামান্য কমল। তিনি রেলস্টেশনের দিকে রওনা হলেন।

রাত নিশুতি। ভয়াবহ ঠাণ্ডা পড়েছে। রক্ত-মাংস ভেদ করে শীত হাড়ের মজ্জায় চলে যাচ্ছে। কুয়াশায় চারদিক ঢেকে গেছে। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। অথচ শুক্লপক্ষ, আকাশে চাঁদ আছে। মোবারক হোসেনের পকেটে দুই ব্যাটারির টর্চও আছে। টর্চ জ্বালাতে হলে ছারের ভেতর থেকে হাত বের করতে হয়। তিনি তার প্রয়েজন বোধ করছেন না। গত দশ বছর তিনি এই রাস্তায় যাতায়াত করছেন। চোখ বেঁধে দিলেও চলে আসতে পারবেন।

রেলস্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে। পয়েন্টসম্যান হেদায়েত স্টেশনেই ঘুমায়। সে মনে হয় আছে। আজ তার বোনের বাড়িতে যাবার কথা। মনে হয় যায় নি। যে শীত নেমেছে যাবে কোথায়? মোবারক হোসেন স্টেশনের বাতি দেখে খানিকটা স্বস্তিবোধ করলেন। হেদায়েত থাকলে তাকে দিয়ে চিড়া-মুড়ি কিছু আনানো যাবে। খিদেয় তিনি অস্থির হয়েছেন। উপোস অবস্থায় রাত পার করা যাবে না। বিকেলেও কিছু খান নি। বিকেলে নাশতা হিসেবে মুড়ি এবং নারিকেলকোরা দিয়েছিল। এমন গাধা মেয়েছেলে! নারিকেলকোরা হলো ভেজা ন্যাতনাতা একটা জিনিস। মুড়িকে সেই জিনিস মিয়ে দেবে এটা তো দুধের শিশুও জানে। দুই মুঠ মুখে দিয়ে তিনি আর খান নি। এখন অবিশ্যি মনে হচ্ছে ন্যাতন্যাতা মুড়িই তিনি এক গামলা খেয়ে ফেলতে পারবেন। তবে শীতের রাতের আসল খাওয়া হলো আগুনগরম গরুর গোশত তার সঙ্গে চালের আটার রুটি। এই গরুর গোশত ভুনা হলে চলবে না। প্রচুর ঝোল থাকতে হবে। মনোয়ারাকে বললে সে ইচ্ছা করে করে ঝোল শুকিয়ে ভুনা করে ফেলবে। চালের আটার রুটি না করে আটার রুটি করবে এবং পরে বলবে…

মোবারক হোসেনের চিন্তার সূত্র হঠাৎ জট পাকিয়ে গেল। কারণ, তাঁর চোখে ধক করে সবুজ আলো এসে পড়ল। তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলালেন। আলোটা এসেছে স্টেশনঘর থেকে। কেউ মনে হয় টর্চ ফেলেছে। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ বা এ রকম কিছু। হঠাৎ চোখে পড়েছে বলে সবুজ রঙ মনে হয়েছে। টর্চের আলো সবুজ হবার কোনো কারণ নেই।

নান্দাইল রোড রেলস্টেশনটা এই অঞ্চলের মতোই দরিদ্র। একটি ঘর। সেই ঘরে জানালা নেই। টিকিট দেয়ার জন্যে যে ফাঁকটা আছে তাকে জানালা বলার কোনো কারণ নেই। মোবারক হোসেন যখন এই ঘরে বসে টিকিট দেন তখন তাঁর মনে হয় তিনি কবরের ভেতর বসে আছেন। মানকের নেকের তাঁর সওয়াল জওয়াব করছে। সওয়াল জবাবের ফাঁকে ফাঁকে তিনি টিকিট দিচ্ছেন। সব স্টেশনে একটা টিউবওয়েল থাকে। যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে পানি খায়। ফ্লাস্ক ভরতি করে পানি নিয়ে ট্রেনে ওঠে। এই স্টেশনে কোনো টিউবওয়েল নেই। যাত্রীদের বসার জায়গা নেই। বছর তিনেক আগে দুটা প্রকাণ্ড রেইনট্রি গাছ ছিল। গাছ দুটোর জন্যে স্টেশনটা সুন্দর লাগত। আগের স্টেশনমাস্টার গাছ কাটিয়ে এগারো হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। এতে পরে তার সমস্যা হয়েছিল তাকে বদলি করে দেয়া হয়, তার জায়গায় আসেন মোবারক হোসেন। তার চাকরি এখন শেষের দিকে। এই সময় কপালে কোনো ভালো স্টেশন জুটল না। জুটল ধ্যাদ্দাড়া নান্দাইল রোড। স্টেশনের লাগোয়া কোনো চায়ের স্টল পর্যন্ত নেই। হঠাৎ চা খেতে ইচ্ছা হলে কেরামতকে পাঠাতে হয় ধোয়াইল বাজার। চা আনতে আনতে ঠাণ্ডা পানি। মুখে দিয়েই থু করে ফেলে দিতে হয়। রেলস্টেশনের সঙ্গে চায়ের দোকান থাকবে না এটা ভাবাই যায় না। এর আগে তিনি যে স্টেশনে ছিলেন সেখানে দুটো চায়ের দোকান ছিল। হিন্দু টি স্টল, মুসলিম টি স্টল। দুটো চায়ের দোকানের মালিকই অবিশ্যি মুসলমান।

মোবারক হোসেন স্টেশনঘরের মাথায় এসে দাঁড়ালেন। চারদিক ধু-ধু করছে। জনমানব নেই। স্টেশনঘরের সামনে থেকে তাঁর চোখে যে আলো ফেলেছিল তাকেও দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় কুয়াশার কারণে দেখা যাচ্ছে না। মোবারক হোসেন ঠিক করলেন লোকটাকে দুএকটা কঠিন কথা বলবেন, মানুষের চোখে টর্চ ফেলা অসম্ভব বেয়াদবি। মহারানি ভিক্টোরিয়াও যদি কারও চোখে টর্চ ফেলেন সেটাও বেয়াদবি।

স্টেশনঘরে বাতি জ্বলছিল বলে তিনি দূর থেকে দেখেছেন। এটা সত্যি না। স্টেশনঘরে বাতি জ্বলছে না। হেদায়েত নিশ্চয়ই বোনের বাড়ি চলে গেছে। মোবারক হোসেন তালা খুলে স্টেশনঘরে ঢুকলেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ঘরটা বাইরের মতো হিমশীতল না। উত্তুরে বাতাস তাঁকে কাবু করে ফেলেছিল। বাতাসের হাত থেকে জীবন রক্ষা পেয়েছে। তিনি হারিকেন জ্বালালেন। তাঁর ভয় ছিল হারিকেনে তেল থাকবে না। দেখা গেল তেল আছে। সারা রাত জ্বলার

মতোই আছে।

স্টেশনঘরে তার বিছানা আছে। তোশক, লেপ, চাদর, বালিশ। খাওয়া এবং ঘুমানোর ব্যাপারে তাঁর কিছু শৌখিনতা আছে বলে লেপ-তোশক ভালো। বিছানার চাদরটাও ভালো। যদিও মোবারক হোসেনের ধারণা মাঝেমধ্যে হেদায়েত নিজের বিছানা রেখে তার বিছানায় শুয়ে থাকে। কারণ, তিনি হঠাৎ হঠাৎ বিছানা চাদরে উৎকট বিড়ির গন্ধ পান। হেদায়েতকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে চোখ কপালে তুলে বলেছে, আমার কি বিছানার অভাব হইছে? ব্যাটাকে একদিন হাতেনাতে ধরতে হবে।

মোবারক হোসেন বিছানা করতে শুরু করলেন। শীত যেভাবে পড়ছে অতি দ্রুত লেপের ভেতর ঢুকে যেতে হবে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ঘুম আসবে না— কী আর করা! নিজের বোকামির ওপর তার এখন প্রচণ্ড রাগ লাগছে। রাগ করে ভাত না খাওয়াটা খুব অন্যায় হয়েছে। তারচেয়েও অন্যায় হয়েছে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে আসা। তিনি কেন বাড়ি ছাড়বেন? এক কাপ গরম চা পাওয়া গেলে এই ভয়ঙ্কর রাতটা পার করে দেয়া যেত। মোবারক হোসেন ঠিক করে ফেললেন-~~ এবারের বেতন পেয়েই একটা কেরোসিনের চুলা কিনবেন। একটা সসপেন, চা-পাতা, চিনি। যখন ইচ্ছা হলো নিজে চা বানিয়ে খেলেন। মুড়ির টিনে কিছু মুড়ি থাকল। মুড়ির সঙ্গে খেজুর গুড়। শীতের রাতে মুড়ি আর খেজুর গুড় হলো বেহেশতি খানা। ডিম থাকলে সসপেনে পানি ফুটিয়ে একটা ডিম সেদ্ধ করে ফেলা। গরম ভাপ ওঠা ডিমসিদ্ধ লবণের ছিটা দিয়ে খাওয়া… উফ! মোবারক হোসেনের জিভে পানি এসে গেল।

মোবারক হোসেনের খাদ্যসংক্রান্ত চিন্তার সূত্রটি আবারও জট পাকিয়ে গেল। আবারও তার চোখে সবুজ আলো ঝলসে উঠল। এমন কড়া আলো, যে আলো নিভলে চারদিক কিছুক্ষণের জন্যে অন্ধকারে ডুবে যায়। হারিকেনের আলো সেই অন্ধকার দূর করতে পারে না। চিকাদের কিচকিচ জাতীয় কিছু শব্দ শুনলেন। শব্দটা আসছে দরজার কাছ থেকে। ছায়ামূর্তির মতো কিছু একটা দরজায় দাঁড়িয়ে। সবুজ আলোর ঝলক চোখ থেকে না গেলে ছায়ামূর্তির ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। ভূতপ্রেত না তো? আয়াতুল কুরসিটা পড়া দরকার। সমস্যা হচ্ছে এই সুরাটা তাঁর মুখস্থ নাই। মনোয়ারার আছে। সে কারণে-অকারণে আয়াতুল কুরসি পড়ে। কে জানে এখনও হয়তো পড়ছে। খালি বাড়ি মেয়েছেলে একা আছে। ভয় পাবারই কথা। শীতকালে আবার ভূতপ্রেতের আনাগোনা একটু বেশি থাকে।

মোবারক হোসেনের চোখে আলো সয়ে এসেছে। তিনি হাঁ করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। চিৎকার কিচকিচ শব্দটা সেখান থেকেই আসছে। দরজা ধরে একজন মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিচকিচ শব্দ সেই করছে। যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর যাই হোক ভূতপ্রেত না। ভূতপ্রেত হলে টর্চলাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না। ভূতের পায়ে বুটজুতা থাকবে না। মাথায় হ্যাটজাতীয় জিনিসও থাকবে না। চোখে রোদচশমাও থাকবে না। মোবারক হোসেন বিড়বিড় করে বললেন, আপনার পরিচয়?

বলেই মোবারক হোসেন মেয়েটির দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। কারণ, তাঁর ভয় হতে লাগল মেয়েটি বলে বসবে আমি মানুষ না, অন্য কিছু। এখন তাঁর মনে হচ্ছে ভূতপ্রেতের হাতে টর্চলাইট থাকতেও পারে। এটা বিচিত্র কিছু না। একবার তিনি একটা গল্প শুনেছেন, রাতে এক ভূত সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে সাইকেলের চাকা রাস্তায় ছিল না। রাস্তা থেকে আধা ফুটের মতো উপরে। ছিল। ভূত যদি সাইকেল চালাতে পারে তা হলে টর্চলাইটও হাতে নিতে পারে। চোখে রোদচশমাও পরতে পারে। চিৎকার মতো কিচকিচও করতে পারে।

আমার নাম এলা। আপনি কি আমার কথা এখন বুঝতে পারছেন?

মোবারক হোসেন আবারও বিড়বিড় করে বললেন, জি।

পরিষ্কার বুঝতে পারছেন?

জি। বাংলা ভাষায় কথা বলছেন বুঝব না কেন?

না, আমি বাংলা ভাষায় কথা বলছি না। আমি আসলে কোনো ভাষাতেই কথা বলছি না। আমার চিন্তাগুলো সরাসরি আপনার মাথায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি যে ভাষায় কথা বলছেন সেই ভাষাও আমি বুঝতে পারছি না, তবে আপনার মস্তিষ্কের চিন্তা বুঝতে পারছি।

মোবারক হোসেন ক্ষীণ স্বরে বললেন, জি আচ্ছা। ধন্যবাদ।

আপনি এই ক্ষমতাকে দয়া করে কোনো টেলিপ্যাথিক বিদ্যা ভাববেন না। এই ক্ষমতা আমার নেই। আমি এই কাজটার জন্যে ছোট্ট একটি যন্ত্র ব্যবহার করছি। যন্ত্রটার নাম এল জি ৯০০০।

মোবারক হোসেন আবার যন্ত্রের মতো বললেন, জি আচ্ছা, ধন্যবাদ।

আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?

জি না।

আয়াতুল কুরসি ব্যাপারটা কী? আপনি মনে মনে সারাক্ষণ আয়াতুল কুরসির কথা ভাবসেন। সে কে?

এটা একটা দোয়া। আল্লাহ্পাকের পাক কালাম। এই দোয়া পাঠ করলে মন থেকে ভয় দূর হয়। জিন-ভূতের আশ্রয় থেকে আল্লাহপাক মানব জাতিকে রক্ষা করেন।

তার মানে আপনি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?

মোবারক হোসেন শুকনো গলায় বললেন, জি না।

ভয় না পেলে ভয় কাটানোর দোয়া পড়ছেন কেন?

মোবারক হোসেন কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি ভয় পাচ্ছেন এবং বেশ ভালো ভয় পাচ্ছেন। মেয়েটা কথা বলছে, কিন্তু তার ঠোট নড়ছে না। ভয় পাবার জন্যে এইটাই যথেষ্ট। তার উপর এমন রূপবতী মেয়েও তিনি তাঁর জীবনে দেখেন নি। পরীস্থানের কোনো পরী না তো? নির্জন রাতে পরীরা মাঝে মাঝে পুরুষদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে পরীস্থানে নিয়ে যায়। নানান কুকর্ম করে পুরুষদের ছিবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেয়। এই জাতীয় গল্প তিনি অনেক শুনেছেন। তবে পরীরা যুবক এবং সুদর্শন অবিবাহিত ছেলেদেরই নিয়ে যায়। তার মতো আধবুড়োকে নেয় না। তাকে ছিবড়া বানাবার কিছু নেই। তিনি ছিবড়া হয়েই আছেন।

মোবারক হোসেন।

জি।

আমি আপনাকে আমাদের দেশে নিতে পারব না। ইচ্ছা থাকলেও পারব না। আমার সেই ক্ষমতা নেই। আমি এসেছি ভবিষ্যত পৃথিবী থেকে, পরীস্থান থেকে নয়। আপনাকে ছিবড়া বানানোরও কোনো ইচ্ছা আমার নেই।

সিস্টার আপনার কথা শুনে খুব ভালো লেগেছে। থ্যাংক য়্যু।

আজকের তারিখ কত দয়া করে বলবেন?

মাঘ মাসের ১২ তারিখ।

ইংরেজিটা বলুন, কোন সন?

জানুয়ারির ৩, ১৯৯৭।

আমি আসছি ৩০০১ সন দেখে।

আসার জন্যে ধন্যবাদ। সিস্টার ভিতরে এসে বসুন। দরজা বন্ধ করে দেই। বাইরে অত্যধিক ঠাণ্ডা।

মেয়েটি ভেতরে এসে দাঁড়াল। মোবারক হোসেন দরজা বন্ধ করলেন। তারপর মনে হলো কাজটা ঠিক হয় নি। দরজা খোলা রাখা দরকার ছিল, যাতে প্রয়েজনে খোলা দরজা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারেন। মনোয়ারার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হওয়াটাই ভুল হয়েছে।

দরজা বন্ধ করার পর এলা টেবিলের দিকে এগিয়ে এল। মোবারক হোসেন চেয়ার এগিয়ে দিলেন। এলা বসতে বসতে বলল, মনোয়ারা কে? আপনি সারাক্ষণ এই নামটি মনে করছেন।

জি, আমার স্ত্রী।

এলা বিস্মিত হয়ে বলল, স্ত্রী! আপনার স্ত্রী আছে! কী আশ্চর্য!

মোবারক হোসেন তাকিয়ে আছেন। তার স্ত্রী থাকা এমন কী বিস্ময়কর ঘটনা যে মেয়েটা চোখ কপালে তুলল। রাস্তায় ভিক্ষা করে যে ফকির, তারও একটা ফকিরণী থাকে। তিনি রেলে কাজ করেন। ছোট চাকরি হলেও সরকারি চাকরি। কোয়ার্টার আছে।

স্ত্রীর উপর কি কোনো কারণে আপনি বিরক্ত হয়ে আছেন?

ইয়েস সিস্টার। তার ওপর রাগ করেছি বলেই স্টেশনে এসে একা একা বসে আছি।

খুবই ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট, এল জি ৯০০০ এই পয়েন্ট নোট করছে। বিজ্ঞান কাউন্সিলে আমরা আপনার কথা বলব। র‍্যানডম সেম্পলের আপনি সদস্য হচ্ছেন। আশা করি আপনার বা আপনার স্ত্রীর এই বিষয়ে কোনো আপত্তি হবে না।

কোনো কিছু না বুঝেই মোবারক হোসেন খুবই বিনীত গলায় বললেন, জি না ম্যাডাম।

এতক্ষণ সিস্টার বলছিলেন এখন ম্যাডাম বলা শুরু করলেন।

সিস্টার ডেকে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। সিস্টার ডাকের মধ্যে হাসপাতালের গন্ধ আছে। হাসপাতাল মানেই অসুখবিসুখ। সেই তুলনায় ম্যাডাম ডাকটা ভালো।

স্ত্রীর ওপর যখন রাগ করেন তখন আপনি স্টেশনে থাকার জন্যে চলে আসেন। আর যখন স্টেশনে আসেন না তখন স্ত্রীর প্রতি থাকে আপনার ভালবাসা?

জি না। রাগ করেও অনেক সময় বাসায় থাকি। গত কাল রাগ করেছিলাম, তার পরেও বাসায় ছিলাম।

কী কারণে রাগ করেছেন বলতে কি কোনো বাধা আছে?

জি না ম্যাডাম। বলতে বাধা নেই।

তা হলে বলুন।

আজ রাগ করেছি—কারণ, আজ সে ফুলকপি আর শিম একসঙ্গে দিয়ে কৈ মাছের ঝোল রান্না করেছে।

এটা কি বড় ধরনের কোনো অন্যায়? শিম এবং ফুলকপি একসঙ্গে রান্না করলে কি কোনো ফুড পয়জনিং হয়? আমি জানি না বলে জিজ্ঞেস করছি। আমার অজ্ঞতা ক্ষমা করবেন৷

শিম এবং ফুলকপি একসঙ্গে রান্না করা যায়। অনেকে পছন্দ করে। আমি করি না। অনেককে দেখবেন সব তরকারির সঙ্গে ডাল দিচ্ছে। মাছ ভাজা নিয়েছে, তার সঙ্গেও ডাল। মাছ ভাজার এক রকম টেস্ট, ডালের আরেক রকম টেস্ট। দুটাকে কি মেশানো যায়? তা হলে দুধ দিয়ে আর মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে মাখিয়ে খেলেই তো হতো! আমার পয়েন্টটা কি সিস্টার ধরতে পারলেন?

ধরার চেষ্টা করছি। আপনি আমাকে একেক সময় একেকটা ডাকছেন— কখনো সিস্টার, কখনো ম্যাডাম। আপনি সরাসরি আমাকে এলা ডাকতে পারেন।

ধন্যবাদ।

রাগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গতকাল কী নিয়ে রাগ করেছেন?

চা দিতে বলেছি। চুমুক দিয়ে দেখি ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডাই যদি খাই তা হলে চা খাবার দরকার কী? শরবত খেলেই হয়! শুধু ঠাণ্ডা হলেও কথা ছিল। দেখি এলাচের গন্ধ। চা কি পায়েস নাকি যে এলাচ দিতে হবে। ম্যাডাম ঠিক বলেছি না।

আমি বলতে পারছি না। কারণ, চা নামক বস্তুটি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই।

শীতের সময় খুবই উপকারী। নেক্সট টাইম যদি আসেন ইনশাল্লাহ আপনাকে চা খাওয়াব। চা-চিনি-দুধ–সব থাকবে।

আর কখনও আসব বলে মনে হচ্ছে না। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আর যেসব কারণে রাগারাগি হয় সেটা কি বলবেন? আপনাদের সব রাগারাগির উৎস কি খাদ্যদ্রব্য?

জি না ম্যাডাম। ওর খাসিলত খারাপ। সবকিছুর মধ্যে উল্টা কথা বলবে। আমি যদি দক্ষিণ বলি–আমার বলাটা যদি তার অপছন্দও হয় দক্ষিণ না বলে তার বলা উচিত পূর্ব বা পশ্চিম— তা বলবে না। সে সোজা বলবে উত্তর।

আপনি বলতে চাচ্ছেন বিপরীত?

এক শ দশ ভাগ বিপরীত।

এক শ দশ ভাগ বিপরীত মানে কী? এর শ ভাগের বেশি তো কিছু হতে পারে না।

আপা কথার কথা।

আপা বলছেন কেন?

আপনাকে বড় বোনের মতো লাগছে এইজন্যে আপা বলেছি। দোষ হয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।

দোষ-ত্রুটি না, আপনার কথাবার্তা সামান্য এলোমেলো লাগছে। যাই হোক পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই–আপনার এবং আপনার স্ত্রী সম্পর্ক তা হলে ভালো না।

আপনিই বলুন ম্যাডাম ভালো হবার কোনো কারণ আছে?

আপনারা কি একে অন্যকে কোনো গিফট দেন?

একেবারে যে দেই না, তা না— ঈদে-চান্দে দেই। না দেওয়াই উচিত। তারপরেও দেই এবং তার জন্যে যেসব কথা শুনতে হয়–উফ!

একটা বলুন শুনি।

ঘরের কিচ্ছা বাইরে বলা ঠিক না। তারপরেও জানতে চাচ্ছেন যখন বলি—গত রোজার ঈদে আমি নিজে শখ করে একটা শাড়ি কিনে আনলাম। হালকা সবুজের ওপর লাল ফুল। বড় ফুল না, ছোট ছোট ফুল। সে শাড়ি দেখে মুখ বাঁকা করে বলল, তোমাকে শাড়ি কে কিনতে বলেছে! লাল শাড়ি আমি পরি। আমি লম্বা মানুষ। বহরে ছোট জাকাতের শাড়ি একটা কিনে নিয়ে এসেছ?

জাকাতের শাড়ি ব্যাপারটা বুঝলাম না।

গরিব-দুঃখীকে দানের জন্যে দেওয়া শাড়ি। শাড়ি বলা ঠিক না, বড় সাইজের গামছা।

শেষ প্রশ্ন করি, আপনার স্ত্রীর প্রতি আপনার এখন তা হলে কোনো ভালোবাসা নেই?

ভালোবাসা থাকবে কেন বলুন। ভালোবাসা থাকলে এই শীতের রাতে আমি স্টেশনে পড়ে থাকি?

এলা নামের মহিলা হাতের টর্চলাইট জ্বালিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে চারদিক সবুজ আলোয় ছয়লাপ করে আবার বাতিটা নেভাল। মোবারক হোসেনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, আপনি স্টেশনে থাকতে আসায় আমার জন্যে খুব লাভ হয়েছে।

কী লাভ?

আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আপনার মতামত পেয়েছি। মতামত রেকর্ড করা থাকবে।

ম্যাডাম কি এখন চলে যাবেন?

হ্যাঁ চলে যাব।

তেমন খাতির-যত্ন করতে পারলাম না, দয়া করে কিছু মনে নেবেন না। নিজগুণে ক্ষমা করবেন।

খাতির-যত্ন যথেষ্টই করেছেন এবং আমি আপনার ভদ্রতায় মুগ্ধ। আপনাকে একটা সুসংবাদ দিতে যাচ্ছি। আমি মনে করি এই সুসংবাদ শোনার অধিকার আপনার আছে।

জি ম্যাডাম সুসংবাদটা বলেন। দুঃসংবাদ শুনে শুনে কান ঝালাপালা। একটা সুসংবাদ শুনে দেখি কেমন লাগে।

আপনার ভালো লাগবে। ভবিষ্যত পৃথিবী, যেখান থেকে আমি এসেছি সেই পৃথিবীতে পুরুষ সম্প্রদায় নেই। শুধুই নারী।

মোবারক হোসেনের মুখ হাঁ হয়ে গেল। ভবিষ্যত পৃথিবীতে পুরুষ নেই। শুধুই নারী! এর মধ্যে সুসংবাদটা কোথায় মোবারক হোসেন ধরতে পারলেন না। ভবিষ্যত পৃথিবীতে শুধুই পুরুষ, নারী নেই এটা শুনলেও একটা কথা ছিল।

এলা বলল, পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার শতকরা আশি ভাগ ছিল নারীপুরুষঘটিত সমস্যা। প্রেমঘটিত সমস্যা। একসঙ্গে জীবনযাপনের সমস্যা। ইতিহাসে এমনও আছে যে শুধুমাত্র একটি নারীর জন্যে একটি নগরী ধ্বংস হয়ে গেছে। আছে না?

জি আছে। ট্রয় নগরী।

গ্যালাকটিক ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে সংঘটিত অপরাধের শতকরা ৫৩ ভাগ নারীঘটিত।

মোবারক হোসেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, খাঁটি কথা বলেছেন। ধর্ষণ, এ্যাসিড মারা, নাবালিকা হত্যা— পত্রিকা খুললেই এই জিনিস। আল্লাহপাক দয়া করেছেন, এখানে পত্রিকা আসে না।

এলা বলল, মানুষকে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে বিজ্ঞান কাউন্সিল একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে পৃথিবীতে পুরুষ এবং মহিলা বলে দু ধরনের মানব সম্প্রদায় থাকবে না। হয় থাকবে শুধু পুরুষ অথবা শুধু মহিলা। যুক্তিসঙ্গত কারণেই শুধু মহিলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কারণ, মহিলাদের ভেতরই দু রকমের ক্রমোজোম x এবং y আছে। বুঝতে পারছেন তো?

কিছু না বুঝেই মোবারক হোসেন বললেন, জি। আপনার কথাবার্তা পানির মতো পরিষ্কার। দুধের শিশুও বুঝবে।

বংশবৃদ্ধির জন্যে একসময় পুরুষ এবং রমণীর প্রয়েজন ছিল। এখন সেই প্রয়েজন নেই। মানব সম্প্রদায়ের বংশবৃদ্ধি এখন মাতৃগর্ভে হচ্ছে না। ল্যাবরেটরিতে হচ্ছে। শিশুপালনের যন্ত্রণা থেকেও মানব সম্প্রদায়কে মুক্তি দেয়া হয়েছে।

ও।

এলা বলল, বর্তমান পৃথিবী সুন্দরভাবে চলছে। সমস্যাহীন জীবনযাত্রা। তারপরেও বিজ্ঞান কাউন্সিলে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন ওঠে–পুরুষশূন্য পৃথিবীর এই ধারণায় কোনো ত্রুটি আছে কি না। তখনই তথ্য সংগ্রহের জন্যে প্রাচীন পৃথিবীতে স্কাউট পাঠানো হয়। আমরা তথ্য সংগ্রহ করি। আমাদের পাঠানো তথ্য দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে—পুরুষশূন্য পৃথিবী আদর্শ পৃথিবী।

মোবারক হোসেন ভয়ে ভয়ে বললেন আমরা পুরুষরা কি খারাপ?

আলাদাভাবে খারাপ না, তবে পুরুষ যখন মহিলার পাশে থাকে তখন খারাপ।

সবুজ আলো আবারও চোখ ধাঁধিয়ে দিল। আলো নিভে যাবার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত মোবারক হোসেন চোখে কিছু দেখতে পেলেন না। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর তিনি দেখলেন–ঘরে আর কেউ নেই। তিনি একা। মোবারক হোসেন সিগারেট ধরালেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চিত হলেন এতক্ষণ যা দেখেছেন সবাই চোখের ধান্দা। মন মেজাজ ছিল খারাপ, শীতও পড়েছে। ভয়াবহ। সব মিলিয়ে চোখে ধান্দা দেখেছেন। একা একা স্টেশনে থাকা ঠিক না। আবার চোখে ধান্দা লাগতে পারে। স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে বের হয়ে এসে আবার ফিরে যাওয়াটাও অত্যন্ত অপমানকর। কিন্তু কী আর করা। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে বারবার অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বাসায় ফিরে গেলেও খাওয়াদাওয়া করা যাবে না। কিছুটা রাগ তাতে দেখানো হবে।

মোবারক হোসেন বাড়িতে ফিরলেন। মনোয়ারা বলমাত্র হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলেন। মনোেয়ারা এর মধ্যেই ফুলকপি দিয়ে কৈ মাছের ঝোল করেছেন। এবং সেই ঝোল এত সুস্বাদু হয়েছে যা বলার না! রান্নাবান্নার কোনো ইতিহাসের বই থাকলে কৈ মাছের এই ঝোলের কথা স্বর্ণাক্ষরে সেই বইয়ে লেখা থাকার কথা। মোবারক হোসেনের খুব ইচ্ছা করছে এই কথাটা স্ত্রীকে বলা। শুনলে বেচারি খুশি হবে। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। কারণ, মনোয়ারার চোখ লাল এবং ফোলা। সে এতক্ষণ কাঁদছিল। মোবারক হোসেন যতবারই রাগ করে বাইরে চলে যান ততবারই মনোয়ারা কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেন। এই তথ্যটা মোবারক হোসেনের মনে থাকে না। মোবারক হোসেন নরম গলায় বললেন, বউ ভাত খেয়েছ?

মনোয়ারা ভেজা গলায় বললেন, না।

মোবারক হোসেন ভাত মাখিয়ে নলা করে স্ত্রীর মুখের দিকে এগিয়ে বললেন, দেখি হাঁ করো তো।

মনোয়ারা বললেন, ঢং করবে না তো। তোমার ঢং অসহ্য লাগে।

অসহ্য লাগলেও এ-ধরনের ঢং মোবারক হোসেন প্রায়ই করেন। এলা নামের মেয়েটাকে এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলা হয় নি।

মোবারক হোসেন মনোয়ারার দিকে তাকিয়ে বল নকই খাও! ভাত হাতে কতক্ষণ বসে থাকব!

মনোয়ারা বললেন, বুড়ো বয়সে মুখে ভাত! ছিঃ!

ছিঃ বললেও তিনি এগিয়ে এলেন। তাঁবু খর্তি লজ্জামাখা হাসি।

মোবারক হোসেন ভাত খেতে বসে তরকারির বাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা কী? তাঁর গলার স্বরে দূরবর্তী ঝড়ের আভাস। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যাবে।

মনোয়ারা দূরবর্তী ঝড়ের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে স্বাভাবিক গলায় বললেন, কী হয়েছে?

এটা কীসের তরকারি?

কৈ মাছের ঝোল।

কৈ মাছের ঝোলে তরকারি কী?

চোখে দেখতে পাচ্ছ না কী দিয়েছি! ফুলকপি, শিম।

তোমাকে কতবার বলেছি—ফুলকপির সঙ্গে শিম দেবে না। ফুলকপির এক স্বাদ, শিমের আলাদা স্বাদ। আমার তো দুটা জিভ না যে একটায় শিম খাব আর অন্যটায় ফুলকপি?

মনোয়ারা হাই তুলতে তুলতে বললেন, যে তরকারি খেতে ইচ্ছা করে সেটা নিয়ে খেলেই হয়। খেতে বসে খামাখা চিৎকার করছ কেন?

এই তরকারি তো আমি মরে গেলেও খাব না।

না খেলে না খেয়ো। ডাল আছে ডাল খাও।

শুধু ডাল দিয়ে খাব?

মনোয়ারা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এটা তো হোটেল না যে চৌদ্দ পদের রান্না আছে।

মোবারক হোসেনের প্রচণ্ড ইচ্ছা হচ্ছে তরকারির বাটি ছুঁড়ে মেঝেয় ফেলে দিতে। এই কাজটা করতে পারলে রাগটা ভালো দেখানো হয়। এতটা বাড়াবাড়ি করতে সাহসে কুলাচ্ছে না। মনোয়ারা সহজ পাত্রী না। তার চীনামাটির বাটি ভাঙবে আর সে চুপ করে থাকবে এটা হবার না। মোবারক হোসেন কৈ মাছের ঝোলের বাটি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধাক্কাটা হিসাব করে দিলেন, যেন তরকারি পড়ে যায় আবার বাটিটাও না ভাঙ্গে।

মনোয়ারা বললেন, কী হলো? খাবে না?

মোবারক হোসেন কিছু না বলে ভাতের থালায় হাত ধুয়ে ফেললেন। থালায় ভাত বাড়া ছিল। কিছু ভাত নষ্ট হলো। হাত ধোয়ার দরকার ছিল না। তার হাত পরিষ্কার— খাওয়া শুরুর আগেই গণ্ডগোল বেধে গেল।

মনোয়ারা বললেন, ভাত খাবে না?

মোবারক হোসেন বললেন, না। তোমার ভাতে আমি ইয়ে করে দেই।

বাক্যটা খুব কঠিন হয়ে গেল। রাগের সময় হিসাব করে কথা বলা যায় না। তবে কঠিন বাক্যেও কিছু হলো না। মনোয়ারা খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তরকারির বাটি, ডালের বাটি তুলে ফেলতে শুরু করলেন। যেন কিছুই হয়নি। মোবারক হোসেন স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। পরিবারের প্রধান মানুষটা রাগ করে বলছে-ভাত খাবে না, তাকে সাধাসাধি করার একটা ব্যাপার আছে না? মনোয়ারা কি বলতে পারত না— ভুল হয়েছে, ভবিষ্যতে আর কখনও শিম আর ফুলকপি একসঙ্গে রাঁধা হবে না। কিংবা বলতে পারত-~~ দু মিনিট বোস, চট করে একটা ডিম ভেজে দেই। শুকনা মরিচ আর পেঁয়াজ কচলে মরিচের ভর্তা বানিয়ে দেই। মরিচের ভর্তা তার অত্যন্ত প্রিয়। এই জিনিসটা বানাতে কতক্ষণ লাগে? তা-না, ভাত তরকারি তুলে ফেলছে! ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের এই হলো ফসল।

মোবারক হোসেনের তীব্র ইচ্ছা হলো বাড়িঘর ছেড়ে গৌতম বুদ্ধের মতো বের হয়ে পড়েন। এ রকম ইচ্ছা তার প্রায়ই হয়। বাড়ি থেকে বেরও হন। রেলস্টেশনে গিয়ে ঘণ্টাখানেক বসে থাকেন। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। তাঁর দৌড় রেলস্টেশন পর্যন্ত। মোবারক হোসেন নান্দাইল রোড রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার। রাত নটায় একটা আপ ট্রেন ছেড়ে দিয়ে খেতে এসেছিলেন। খেতে এসে এই বিপত্তি— শিম আর ফুলকপির ঘোঁট বানিয়ে বসে আছে।

মোবারক হোসেন মাফলার দিয়ে কান ঢাকতে শুরু করলেন। এটা হলো তাঁর ঘর ছেড়ে বাইরে যাবার সঙ্কেত। অতি সহজে তাঁর কানে ঠাণ্ডা লেগে যায় বলে সব সময় মাফলার দিয়ে কান ঢাকতে হয়। আর এ বছর তুন্দ্রা অঞ্চলের শীত পড়েছে। আগুনের ওপর বসে থাকলেও শীত মানে না।

মনোয়ারা বললেন, যাচ্ছ কোথায়?

তিনি জবাব না দিয়ে গায়ে চাদর জড়ালেন।

স্টেশনে যাচ্ছ?

তিনি এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। হাতমোজা পরতে লাগলেন। হাতমোজা পরা ঠিক হচ্ছে না। মনোয়ারা মাত্র কিছুদিন আগে হাতমোজা বুনে দিয়েছেন। তার উচিত হাতমোজা জোড়া নর্দমায় ফেলে দেয়া কিন্তু বাইরে মাঘ মাসের দুর্দান্ত শীত। খোলা মাঠের ওপর রেলস্টেশন। শীত সহ্য হবে না। গৌতম বুদ্ধ কপিলাবস্তুতে না থেকে যদি নান্দাইল রোডে থাকতেন এবং মাঘ মাসে গৃহত্যাগ করতেন তা হলে তিনিও হাতমোজা পরতেন। গলায় মাফলার বাঁধতেন।

রাতে ফিরবে? না ফিরলে বলে যাও। দরজা লাগিয়ে দেব।

যা ইচ্ছা করো।

আমি কিন্তু শুয়ে পড়লাম। রাতদুপুরে ফিরে এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করবে না।

তোর বাপের দরজা? সরকারি বাড়ির সরকারি দরজা। আমার যখন ইচ্ছা ধাক্কাধাক্কি করব।

তুই তোকারি করবে না। আমি তোমার ইয়ার বন্ধু না। চুপ।

একদম চুপ। No talk.

মোবারক হোসেন অগ্নিদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টির অর্থ— তুমি জাহান্নামে যাও। তিনি ঘরের কোনায় রাখা ছাতা হাতে বের হয়ে গেলেন। তিনি বের হওয়ামাত্র দরজা বন্ধ করার ঝপাং শব্দ হলো। মোবারক হোসেন ফিরে এসে বন্ধ দরজায় প্রচণ্ড লাথি বসালেন। এতে তাঁর রাগ সামান্য কমল। তিনি রেলস্টেশনের দিকে রওনা হলেন।

রাত নিশুতি। ভয়াবহ ঠাণ্ডা পড়েছে। রক্ত-মাংস ভেদ করে শীত হাড়ের মজ্জায় চলে যাচ্ছে। কুয়াশায় চারদিক ঢেকে গেছে। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। অথচ শুক্লপক্ষ, আকাশে চাঁদ আছে। মোবারক হোসেনের পকেটে দুই ব্যাটারির টর্চও আছে। টর্চ জ্বালাতে হলে ছারের ভেতর থেকে হাত বের করতে হয়। তিনি তার প্রয়েজন বোধ করছেন না। গত দশ বছর তিনি এই রাস্তায় যাতায়াত করছেন। চোখ বেঁধে দিলেও চলে আসতে পারবেন।

রেলস্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে। পয়েন্টসম্যান হেদায়েত স্টেশনেই ঘুমায়। সে মনে হয় আছে। আজ তার বোনের বাড়িতে যাবার কথা। মনে হয় যায় নি। যে শীত নেমেছে যাবে কোথায়? মোবারক হোসেন স্টেশনের বাতি দেখে খানিকটা স্বস্তিবোধ করলেন। হেদায়েত থাকলে তাকে দিয়ে চিড়া-মুড়ি কিছু আনানো যাবে। খিদেয় তিনি অস্থির হয়েছেন। উপোস অবস্থায় রাত পার করা যাবে না। বিকেলেও কিছু খান নি। বিকেলে নাশতা হিসেবে মুড়ি এবং নারিকেলকোরা দিয়েছিল। এমন গাধা মেয়েছেলে! নারিকেলকোরা হলো ভেজা ন্যাতনাতা একটা জিনিস। মুড়িকে সেই জিনিস মিয়ে দেবে এটা তো দুধের শিশুও জানে। দুই মুঠ মুখে দিয়ে তিনি আর খান নি। এখন অবিশ্যি মনে হচ্ছে ন্যাতন্যাতা মুড়িই তিনি এক গামলা খেয়ে ফেলতে পারবেন। তবে শীতের রাতের আসল খাওয়া হলো আগুনগরম গরুর গোশত তার সঙ্গে চালের আটার রুটি। এই গরুর গোশত ভুনা হলে চলবে না। প্রচুর ঝোল থাকতে হবে। মনোয়ারাকে বললে সে ইচ্ছা করে করে ঝোল শুকিয়ে ভুনা করে ফেলবে। চালের আটার রুটি না করে আটার রুটি করবে এবং পরে বলবে…

মোবারক হোসেনের চিন্তার সূত্র হঠাৎ জট পাকিয়ে গেল। কারণ, তাঁর চোখে ধক করে সবুজ আলো এসে পড়ল। তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলালেন। আলোটা এসেছে স্টেশনঘর থেকে। কেউ মনে হয় টর্চ ফেলেছে। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ বা এ রকম কিছু। হঠাৎ চোখে পড়েছে বলে সবুজ রঙ মনে হয়েছে। টর্চের আলো সবুজ হবার কোনো কারণ নেই।

নান্দাইল রোড রেলস্টেশনটা এই অঞ্চলের মতোই দরিদ্র। একটি ঘর। সেই ঘরে জানালা নেই। টিকিট দেয়ার জন্যে যে ফাঁকটা আছে তাকে জানালা বলার কোনো কারণ নেই। মোবারক হোসেন যখন এই ঘরে বসে টিকিট দেন তখন তাঁর মনে হয় তিনি কবরের ভেতর বসে আছেন। মানকের নেকের তাঁর সওয়াল জওয়াব করছে। সওয়াল জবাবের ফাঁকে ফাঁকে তিনি টিকিট দিচ্ছেন। সব স্টেশনে একটা টিউবওয়েল থাকে। যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে পানি খায়। ফ্লাস্ক ভরতি করে পানি নিয়ে ট্রেনে ওঠে। এই স্টেশনে কোনো টিউবওয়েল নেই। যাত্রীদের বসার জায়গা নেই। বছর তিনেক আগে দুটা প্রকাণ্ড রেইনট্রি গাছ ছিল। গাছ দুটোর জন্যে স্টেশনটা সুন্দর লাগত। আগের স্টেশনমাস্টার গাছ কাটিয়ে এগারো হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। এতে পরে তার সমস্যা হয়েছিল তাকে বদলি করে দেয়া হয়, তার জায়গায় আসেন মোবারক হোসেন। তার চাকরি এখন শেষের দিকে। এই সময় কপালে কোনো ভালো স্টেশন জুটল না। জুটল ধ্যাদ্দাড়া নান্দাইল রোড। স্টেশনের লাগোয়া কোনো চায়ের স্টল পর্যন্ত নেই। হঠাৎ চা খেতে ইচ্ছা হলে কেরামতকে পাঠাতে হয় ধোয়াইল বাজার। চা আনতে আনতে ঠাণ্ডা পানি। মুখে দিয়েই থু করে ফেলে দিতে হয়। রেলস্টেশনের সঙ্গে চায়ের দোকান থাকবে না এটা ভাবাই যায় না। এর আগে তিনি যে স্টেশনে ছিলেন সেখানে দুটো চায়ের দোকান ছিল। হিন্দু টি স্টল, মুসলিম টি স্টল। দুটো চায়ের দোকানের মালিকই অবিশ্যি মুসলমান।

মোবারক হোসেন স্টেশনঘরের মাথায় এসে দাঁড়ালেন। চারদিক ধু-ধু করছে। জনমানব নেই। স্টেশনঘরের সামনে থেকে তাঁর চোখে যে আলো ফেলেছিল তাকেও দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় কুয়াশার কারণে দেখা যাচ্ছে না। মোবারক হোসেন ঠিক করলেন লোকটাকে দুএকটা কঠিন কথা বলবেন, মানুষের চোখে টর্চ ফেলা অসম্ভব বেয়াদবি। মহারানি ভিক্টোরিয়াও যদি কারও চোখে টর্চ ফেলেন সেটাও বেয়াদবি।

স্টেশনঘরে বাতি জ্বলছিল বলে তিনি দূর থেকে দেখেছেন। এটা সত্যি না। স্টেশনঘরে বাতি জ্বলছে না। হেদায়েত নিশ্চয়ই বোনের বাড়ি চলে গেছে। মোবারক হোসেন তালা খুলে স্টেশনঘরে ঢুকলেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ঘরটা বাইরের মতো হিমশীতল না। উত্তুরে বাতাস তাঁকে কাবু করে ফেলেছিল। বাতাসের হাত থেকে জীবন রক্ষা পেয়েছে। তিনি হারিকেন জ্বালালেন। তাঁর ভয় ছিল হারিকেনে তেল থাকবে না। দেখা গেল তেল আছে। সারা রাত জ্বলার

মতোই আছে।

স্টেশনঘরে তার বিছানা আছে। তোশক, লেপ, চাদর, বালিশ। খাওয়া এবং ঘুমানোর ব্যাপারে তাঁর কিছু শৌখিনতা আছে বলে লেপ-তোশক ভালো। বিছানার চাদরটাও ভালো। যদিও মোবারক হোসেনের ধারণা মাঝেমধ্যে হেদায়েত নিজের বিছানা রেখে তার বিছানায় শুয়ে থাকে। কারণ, তিনি হঠাৎ হঠাৎ বিছানা চাদরে উৎকট বিড়ির গন্ধ পান। হেদায়েতকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে চোখ কপালে তুলে বলেছে, আমার কি বিছানার অভাব হইছে? ব্যাটাকে একদিন হাতেনাতে ধরতে হবে।

মোবারক হোসেন বিছানা করতে শুরু করলেন। শীত যেভাবে পড়ছে অতি দ্রুত লেপের ভেতর ঢুকে যেতে হবে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ঘুম আসবে না— কী আর করা! নিজের বোকামির ওপর তার এখন প্রচণ্ড রাগ লাগছে। রাগ করে ভাত না খাওয়াটা খুব অন্যায় হয়েছে। তারচেয়েও অন্যায় হয়েছে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে আসা। তিনি কেন বাড়ি ছাড়বেন? এক কাপ গরম চা পাওয়া গেলে এই ভয়ঙ্কর রাতটা পার করে দেয়া যেত। মোবারক হোসেন ঠিক করে ফেললেন-~~ এবারের বেতন পেয়েই একটা কেরোসিনের চুলা কিনবেন। একটা সসপেন, চা-পাতা, চিনি। যখন ইচ্ছা হলো নিজে চা বানিয়ে খেলেন। মুড়ির টিনে কিছু মুড়ি থাকল। মুড়ির সঙ্গে খেজুর গুড়। শীতের রাতে মুড়ি আর খেজুর গুড় হলো বেহেশতি খানা। ডিম থাকলে সসপেনে পানি ফুটিয়ে একটা ডিম সেদ্ধ করে ফেলা। গরম ভাপ ওঠা ডিমসিদ্ধ লবণের ছিটা দিয়ে খাওয়া… উফ! মোবারক হোসেনের জিভে পানি এসে গেল।

মোবারক হোসেনের খাদ্যসংক্রান্ত চিন্তার সূত্রটি আবারও জট পাকিয়ে গেল। আবারও তার চোখে সবুজ আলো ঝলসে উঠল। এমন কড়া আলো, যে আলো নিভলে চারদিক কিছুক্ষণের জন্যে অন্ধকারে ডুবে যায়। হারিকেনের আলো সেই অন্ধকার দূর করতে পারে না। চিকাদের কিচকিচ জাতীয় কিছু শব্দ শুনলেন। শব্দটা আসছে দরজার কাছ থেকে। ছায়ামূর্তির মতো কিছু একটা দরজায় দাঁড়িয়ে। সবুজ আলোর ঝলক চোখ থেকে না গেলে ছায়ামূর্তির ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। ভূতপ্রেত না তো? আয়াতুল কুরসিটা পড়া দরকার। সমস্যা হচ্ছে এই সুরাটা তাঁর মুখস্থ নাই। মনোয়ারার আছে। সে কারণে-অকারণে আয়াতুল কুরসি পড়ে। কে জানে এখনও হয়তো পড়ছে। খালি বাড়ি মেয়েছেলে একা আছে। ভয় পাবারই কথা। শীতকালে আবার ভূতপ্রেতের আনাগোনা একটু বেশি থাকে।

মোবারক হোসেনের চোখে আলো সয়ে এসেছে। তিনি হাঁ করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। চিৎকার কিচকিচ শব্দটা সেখান থেকেই আসছে। দরজা ধরে একজন মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিচকিচ শব্দ সেই করছে। যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর যাই হোক ভূতপ্রেত না। ভূতপ্রেত হলে টর্চলাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না। ভূতের পায়ে বুটজুতা থাকবে না। মাথায় হ্যাটজাতীয় জিনিসও থাকবে না। চোখে রোদচশমাও থাকবে না। মোবারক হোসেন বিড়বিড় করে বললেন, আপনার পরিচয়?

বলেই মোবারক হোসেন মেয়েটির দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। কারণ, তাঁর ভয় হতে লাগল মেয়েটি বলে বসবে আমি মানুষ না, অন্য কিছু। এখন তাঁর মনে হচ্ছে ভূতপ্রেতের হাতে টর্চলাইট থাকতেও পারে। এটা বিচিত্র কিছু না। একবার তিনি একটা গল্প শুনেছেন, রাতে এক ভূত সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে সাইকেলের চাকা রাস্তায় ছিল না। রাস্তা থেকে আধা ফুটের মতো উপরে। ছিল। ভূত যদি সাইকেল চালাতে পারে তা হলে টর্চলাইটও হাতে নিতে পারে। চোখে রোদচশমাও পরতে পারে। চিৎকার মতো কিচকিচও করতে পারে।

আমার নাম এলা। আপনি কি আমার কথা এখন বুঝতে পারছেন?

মোবারক হোসেন আবারও বিড়বিড় করে বললেন, জি।

পরিষ্কার বুঝতে পারছেন?

জি। বাংলা ভাষায় কথা বলছেন বুঝব না কেন?

না, আমি বাংলা ভাষায় কথা বলছি না। আমি আসলে কোনো ভাষাতেই কথা বলছি না। আমার চিন্তাগুলো সরাসরি আপনার মাথায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি যে ভাষায় কথা বলছেন সেই ভাষাও আমি বুঝতে পারছি না, তবে আপনার মস্তিষ্কের চিন্তা বুঝতে পারছি।

মোবারক হোসেন ক্ষীণ স্বরে বললেন, জি আচ্ছা। ধন্যবাদ।

আপনি এই ক্ষমতাকে দয়া করে কোনো টেলিপ্যাথিক বিদ্যা ভাববেন না। এই ক্ষমতা আমার নেই। আমি এই কাজটার জন্যে ছোট্ট একটি যন্ত্র ব্যবহার করছি। যন্ত্রটার নাম এল জি ৯০০০।

মোবারক হোসেন আবার যন্ত্রের মতো বললেন, জি আচ্ছা, ধন্যবাদ।

আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?

জি না।

আয়াতুল কুরসি ব্যাপারটা কী? আপনি মনে মনে সারাক্ষণ আয়াতুল কুরসির কথা ভাবসেন। সে কে?

এটা একটা দোয়া। আল্লাহ্পাকের পাক কালাম। এই দোয়া পাঠ করলে মন থেকে ভয় দূর হয়। জিন-ভূতের আশ্রয় থেকে আল্লাহপাক মানব জাতিকে রক্ষা করেন।

তার মানে আপনি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?

মোবারক হোসেন শুকনো গলায় বললেন, জি না।

ভয় না পেলে ভয় কাটানোর দোয়া পড়ছেন কেন?

মোবারক হোসেন কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি ভয় পাচ্ছেন এবং বেশ ভালো ভয় পাচ্ছেন। মেয়েটা কথা বলছে, কিন্তু তার ঠোট নড়ছে না। ভয় পাবার জন্যে এইটাই যথেষ্ট। তার উপর এমন রূপবতী মেয়েও তিনি তাঁর জীবনে দেখেন নি। পরীস্থানের কোনো পরী না তো? নির্জন রাতে পরীরা মাঝে মাঝে পুরুষদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে পরীস্থানে নিয়ে যায়। নানান কুকর্ম করে পুরুষদের ছিবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেয়। এই জাতীয় গল্প তিনি অনেক শুনেছেন। তবে পরীরা যুবক এবং সুদর্শন অবিবাহিত ছেলেদেরই নিয়ে যায়। তার মতো আধবুড়োকে নেয় না। তাকে ছিবড়া বানাবার কিছু নেই। তিনি ছিবড়া হয়েই আছেন।

মোবারক হোসেন।

জি।

আমি আপনাকে আমাদের দেশে নিতে পারব না। ইচ্ছা থাকলেও পারব না। আমার সেই ক্ষমতা নেই। আমি এসেছি ভবিষ্যত পৃথিবী থেকে, পরীস্থান থেকে নয়। আপনাকে ছিবড়া বানানোরও কোনো ইচ্ছা আমার নেই।

সিস্টার আপনার কথা শুনে খুব ভালো লেগেছে। থ্যাংক য়্যু।

আজকের তারিখ কত দয়া করে বলবেন?

মাঘ মাসের ১২ তারিখ।

ইংরেজিটা বলুন, কোন সন?

জানুয়ারির ৩, ১৯৯৭।

আমি আসছি ৩০০১ সন দেখে।

আসার জন্যে ধন্যবাদ। সিস্টার ভিতরে এসে বসুন। দরজা বন্ধ করে দেই। বাইরে অত্যধিক ঠাণ্ডা।

মেয়েটি ভেতরে এসে দাঁড়াল। মোবারক হোসেন দরজা বন্ধ করলেন। তারপর মনে হলো কাজটা ঠিক হয় নি। দরজা খোলা রাখা দরকার ছিল, যাতে প্রয়েজনে খোলা দরজা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারেন। মনোয়ারার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হওয়াটাই ভুল হয়েছে।

দরজা বন্ধ করার পর এলা টেবিলের দিকে এগিয়ে এল। মোবারক হোসেন চেয়ার এগিয়ে দিলেন। এলা বসতে বসতে বলল, মনোয়ারা কে? আপনি সারাক্ষণ এই নামটি মনে করছেন।

জি, আমার স্ত্রী।

এলা বিস্মিত হয়ে বলল, স্ত্রী! আপনার স্ত্রী আছে! কী আশ্চর্য!

মোবারক হোসেন তাকিয়ে আছেন। তার স্ত্রী থাকা এমন কী বিস্ময়কর ঘটনা যে মেয়েটা চোখ কপালে তুলল। রাস্তায় ভিক্ষা করে যে ফকির, তারও একটা ফকিরণী থাকে। তিনি রেলে কাজ করেন। ছোট চাকরি হলেও সরকারি চাকরি। কোয়ার্টার আছে।

স্ত্রীর উপর কি কোনো কারণে আপনি বিরক্ত হয়ে আছেন?

ইয়েস সিস্টার। তার ওপর রাগ করেছি বলেই স্টেশনে এসে একা একা বসে আছি।

খুবই ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট, এল জি ৯০০০ এই পয়েন্ট নোট করছে। বিজ্ঞান কাউন্সিলে আমরা আপনার কথা বলব। র‍্যানডম সেম্পলের আপনি সদস্য হচ্ছেন। আশা করি আপনার বা আপনার স্ত্রীর এই বিষয়ে কোনো আপত্তি হবে না।

কোনো কিছু না বুঝেই মোবারক হোসেন খুবই বিনীত গলায় বললেন, জি না ম্যাডাম।

এতক্ষণ সিস্টার বলছিলেন এখন ম্যাডাম বলা শুরু করলেন।

সিস্টার ডেকে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। সিস্টার ডাকের মধ্যে হাসপাতালের গন্ধ আছে। হাসপাতাল মানেই অসুখবিসুখ। সেই তুলনায় ম্যাডাম ডাকটা ভালো।

স্ত্রীর ওপর যখন রাগ করেন তখন আপনি স্টেশনে থাকার জন্যে চলে আসেন। আর যখন স্টেশনে আসেন না তখন স্ত্রীর প্রতি থাকে আপনার ভালবাসা?

জি না। রাগ করেও অনেক সময় বাসায় থাকি। গত কাল রাগ করেছিলাম, তার পরেও বাসায় ছিলাম।

কী কারণে রাগ করেছেন বলতে কি কোনো বাধা আছে?

জি না ম্যাডাম। বলতে বাধা নেই।

তা হলে বলুন।

আজ রাগ করেছি—কারণ, আজ সে ফুলকপি আর শিম একসঙ্গে দিয়ে কৈ মাছের ঝোল রান্না করেছে।

এটা কি বড় ধরনের কোনো অন্যায়? শিম এবং ফুলকপি একসঙ্গে রান্না করলে কি কোনো ফুড পয়জনিং হয়? আমি জানি না বলে জিজ্ঞেস করছি। আমার অজ্ঞতা ক্ষমা করবেন৷

শিম এবং ফুলকপি একসঙ্গে রান্না করা যায়। অনেকে পছন্দ করে। আমি করি না। অনেককে দেখবেন সব তরকারির সঙ্গে ডাল দিচ্ছে। মাছ ভাজা নিয়েছে, তার সঙ্গেও ডাল। মাছ ভাজার এক রকম টেস্ট, ডালের আরেক রকম টেস্ট। দুটাকে কি মেশানো যায়? তা হলে দুধ দিয়ে আর মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে মাখিয়ে খেলেই তো হতো! আমার পয়েন্টটা কি সিস্টার ধরতে পারলেন?

ধরার চেষ্টা করছি। আপনি আমাকে একেক সময় একেকটা ডাকছেন— কখনো সিস্টার, কখনো ম্যাডাম। আপনি সরাসরি আমাকে এলা ডাকতে পারেন।

ধন্যবাদ।

রাগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গতকাল কী নিয়ে রাগ করেছেন?

চা দিতে বলেছি। চুমুক দিয়ে দেখি ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডাই যদি খাই তা হলে চা খাবার দরকার কী? শরবত খেলেই হয়! শুধু ঠাণ্ডা হলেও কথা ছিল। দেখি এলাচের গন্ধ। চা কি পায়েস নাকি যে এলাচ দিতে হবে। ম্যাডাম ঠিক বলেছি না।

আমি বলতে পারছি না। কারণ, চা নামক বস্তুটি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই।

শীতের সময় খুবই উপকারী। নেক্সট টাইম যদি আসেন ইনশাল্লাহ আপনাকে চা খাওয়াব। চা-চিনি-দুধ–সব থাকবে।

আর কখনও আসব বলে মনে হচ্ছে না। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আর যেসব কারণে রাগারাগি হয় সেটা কি বলবেন? আপনাদের সব রাগারাগির উৎস কি খাদ্যদ্রব্য?

জি না ম্যাডাম। ওর খাসিলত খারাপ। সবকিছুর মধ্যে উল্টা কথা বলবে। আমি যদি দক্ষিণ বলি–আমার বলাটা যদি তার অপছন্দও হয় দক্ষিণ না বলে তার বলা উচিত পূর্ব বা পশ্চিম— তা বলবে না। সে সোজা বলবে উত্তর।

আপনি বলতে চাচ্ছেন বিপরীত?

এক শ দশ ভাগ বিপরীত।

এক শ দশ ভাগ বিপরীত মানে কী? এর শ ভাগের বেশি তো কিছু হতে পারে না।

আপা কথার কথা।

আপা বলছেন কেন?

আপনাকে বড় বোনের মতো লাগছে এইজন্যে আপা বলেছি। দোষ হয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।

দোষ-ত্রুটি না, আপনার কথাবার্তা সামান্য এলোমেলো লাগছে। যাই হোক পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই–আপনার এবং আপনার স্ত্রী সম্পর্ক তা হলে ভালো না।

আপনিই বলুন ম্যাডাম ভালো হবার কোনো কারণ আছে?

আপনারা কি একে অন্যকে কোনো গিফট দেন?

একেবারে যে দেই না, তা না— ঈদে-চান্দে দেই। না দেওয়াই উচিত। তারপরেও দেই এবং তার জন্যে যেসব কথা শুনতে হয়–উফ!

একটা বলুন শুনি।

ঘরের কিচ্ছা বাইরে বলা ঠিক না। তারপরেও জানতে চাচ্ছেন যখন বলি—গত রোজার ঈদে আমি নিজে শখ করে একটা শাড়ি কিনে আনলাম। হালকা সবুজের ওপর লাল ফুল। বড় ফুল না, ছোট ছোট ফুল। সে শাড়ি দেখে মুখ বাঁকা করে বলল, তোমাকে শাড়ি কে কিনতে বলেছে! লাল শাড়ি আমি পরি। আমি লম্বা মানুষ। বহরে ছোট জাকাতের শাড়ি একটা কিনে নিয়ে এসেছ?

জাকাতের শাড়ি ব্যাপারটা বুঝলাম না।

গরিব-দুঃখীকে দানের জন্যে দেওয়া শাড়ি। শাড়ি বলা ঠিক না, বড় সাইজের গামছা।

শেষ প্রশ্ন করি, আপনার স্ত্রীর প্রতি আপনার এখন তা হলে কোনো ভালোবাসা নেই?

ভালোবাসা থাকবে কেন বলুন। ভালোবাসা থাকলে এই শীতের রাতে আমি স্টেশনে পড়ে থাকি?

এলা নামের মহিলা হাতের টর্চলাইট জ্বালিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে চারদিক সবুজ আলোয় ছয়লাপ করে আবার বাতিটা নেভাল। মোবারক হোসেনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, আপনি স্টেশনে থাকতে আসায় আমার জন্যে খুব লাভ হয়েছে।

কী লাভ?

আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আপনার মতামত পেয়েছি। মতামত রেকর্ড করা থাকবে।

ম্যাডাম কি এখন চলে যাবেন?

হ্যাঁ চলে যাব।

তেমন খাতির-যত্ন করতে পারলাম না, দয়া করে কিছু মনে নেবেন না। নিজগুণে ক্ষমা করবেন।

খাতির-যত্ন যথেষ্টই করেছেন এবং আমি আপনার ভদ্রতায় মুগ্ধ। আপনাকে একটা সুসংবাদ দিতে যাচ্ছি। আমি মনে করি এই সুসংবাদ শোনার অধিকার আপনার আছে।

জি ম্যাডাম সুসংবাদটা বলেন। দুঃসংবাদ শুনে শুনে কান ঝালাপালা। একটা সুসংবাদ শুনে দেখি কেমন লাগে।

আপনার ভালো লাগবে। ভবিষ্যত পৃথিবী, যেখান থেকে আমি এসেছি সেই পৃথিবীতে পুরুষ সম্প্রদায় নেই। শুধুই নারী।

মোবারক হোসেনের মুখ হাঁ হয়ে গেল। ভবিষ্যত পৃথিবীতে পুরুষ নেই। শুধুই নারী! এর মধ্যে সুসংবাদটা কোথায় মোবারক হোসেন ধরতে পারলেন না। ভবিষ্যত পৃথিবীতে শুধুই পুরুষ, নারী নেই এটা শুনলেও একটা কথা ছিল।

এলা বলল, পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার শতকরা আশি ভাগ ছিল নারীপুরুষঘটিত সমস্যা। প্রেমঘটিত সমস্যা। একসঙ্গে জীবনযাপনের সমস্যা। ইতিহাসে এমনও আছে যে শুধুমাত্র একটি নারীর জন্যে একটি নগরী ধ্বংস হয়ে গেছে। আছে না?

জি আছে। ট্রয় নগরী।

গ্যালাকটিক ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে সংঘটিত অপরাধের শতকরা ৫৩ ভাগ নারীঘটিত।

মোবারক হোসেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, খাঁটি কথা বলেছেন। ধর্ষণ, এ্যাসিড মারা, নাবালিকা হত্যা— পত্রিকা খুললেই এই জিনিস। আল্লাহপাক দয়া করেছেন, এখানে পত্রিকা আসে না।

এলা বলল, মানুষকে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে বিজ্ঞান কাউন্সিল একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে পৃথিবীতে পুরুষ এবং মহিলা বলে দু ধরনের মানব সম্প্রদায় থাকবে না। হয় থাকবে শুধু পুরুষ অথবা শুধু মহিলা। যুক্তিসঙ্গত কারণেই শুধু মহিলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কারণ, মহিলাদের ভেতরই দু রকমের ক্রমোজোম x এবং y আছে। বুঝতে পারছেন তো?

কিছু না বুঝেই মোবারক হোসেন বললেন, জি। আপনার কথাবার্তা পানির মতো পরিষ্কার। দুধের শিশুও বুঝবে।

বংশবৃদ্ধির জন্যে একসময় পুরুষ এবং রমণীর প্রয়েজন ছিল। এখন সেই প্রয়েজন নেই। মানব সম্প্রদায়ের বংশবৃদ্ধি এখন মাতৃগর্ভে হচ্ছে না। ল্যাবরেটরিতে হচ্ছে। শিশুপালনের যন্ত্রণা থেকেও মানব সম্প্রদায়কে মুক্তি দেয়া হয়েছে।

ও।

এলা বলল, বর্তমান পৃথিবী সুন্দরভাবে চলছে। সমস্যাহীন জীবনযাত্রা। তারপরেও বিজ্ঞান কাউন্সিলে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন ওঠে–পুরুষশূন্য পৃথিবীর এই ধারণায় কোনো ত্রুটি আছে কি না। তখনই তথ্য সংগ্রহের জন্যে প্রাচীন পৃথিবীতে স্কাউট পাঠানো হয়। আমরা তথ্য সংগ্রহ করি। আমাদের পাঠানো তথ্য দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে—পুরুষশূন্য পৃথিবী আদর্শ পৃথিবী।

মোবারক হোসেন ভয়ে ভয়ে বললেন আমরা পুরুষরা কি খারাপ?

আলাদাভাবে খারাপ না, তবে পুরুষ যখন মহিলার পাশে থাকে তখন খারাপ।

সবুজ আলো আবারও চোখ ধাঁধিয়ে দিল। আলো নিভে যাবার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত মোবারক হোসেন চোখে কিছু দেখতে পেলেন না। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর তিনি দেখলেন–ঘরে আর কেউ নেই। তিনি একা। মোবারক হোসেন সিগারেট ধরালেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চিত হলেন এতক্ষণ যা দেখেছেন সবাই চোখের ধান্দা। মন মেজাজ ছিল খারাপ, শীতও পড়েছে। ভয়াবহ। সব মিলিয়ে চোখে ধান্দা দেখেছেন। একা একা স্টেশনে থাকা ঠিক না। আবার চোখে ধান্দা লাগতে পারে। স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে বের হয়ে এসে আবার ফিরে যাওয়াটাও অত্যন্ত অপমানকর। কিন্তু কী আর করা। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে বারবার অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বাসায় ফিরে গেলেও খাওয়াদাওয়া করা যাবে না। কিছুটা রাগ তাতে দেখানো হবে।

মোবারক হোসেন বাড়িতে ফিরলেন। মনোয়ারা বলমাত্র হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলেন। মনোেয়ারা এর মধ্যেই ফুলকপি দিয়ে কৈ মাছের ঝোল করেছেন। এবং সেই ঝোল এত সুস্বাদু হয়েছে যা বলার না! রান্নাবান্নার কোনো ইতিহাসের বই থাকলে কৈ মাছের এই ঝোলের কথা স্বর্ণাক্ষরে সেই বইয়ে লেখা থাকার কথা। মোবারক হোসেনের খুব ইচ্ছা করছে এই কথাটা স্ত্রীকে বলা। শুনলে বেচারি খুশি হবে। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। কারণ, মনোয়ারার চোখ লাল এবং ফোলা। সে এতক্ষণ কাঁদছিল। মোবারক হোসেন যতবারই রাগ করে বাইরে চলে যান ততবারই মনোয়ারা কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেন। এই তথ্যটা মোবারক হোসেনের মনে থাকে না। মোবারক হোসেন নরম গলায় বললেন, বউ ভাত খেয়েছ?

মনোয়ারা ভেজা গলায় বললেন, না।

মোবারক হোসেন ভাত মাখিয়ে নলা করে স্ত্রীর মুখের দিকে এগিয়ে বললেন, দেখি হাঁ করো তো।

মনোয়ারা বললেন, ঢং করবে না তো। তোমার ঢং অসহ্য লাগে।

অসহ্য লাগলেও এ-ধরনের ঢং মোবারক হোসেন প্রায়ই করেন। এলা নামের মেয়েটাকে এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলা হয় নি।

মোবারক হোসেন মনোয়ারার দিকে তাকিয়ে বল নকই খাও! ভাত হাতে কতক্ষণ বসে থাকব!

মনোয়ারা বললেন, বুড়ো বয়সে মুখে ভাত! ছিঃ!

ছিঃ বললেও তিনি এগিয়ে এলেন। তাঁবু খর্তি লজ্জামাখা হাসি।

Exit mobile version