Site icon BnBoi.Com

ছোটদের যত লেখা – হুমায়ূন আহমেদ

ছোটদের যত লেখা - হুমায়ূন আহমেদ

আলাউদ্দিনের চেরাগ

নান্দিনা পাইলট হাইস্কুলের অঙ্ক শিক্ষক নিশানাথ বাবু কিছুদিন হলো রিটায়ার করেছেন। আরো বছরখানেক চাকরি করতে পারতেন, কিন্তু করলেন না। কারণ দুটো চোখেই ছানি পড়েছে। পরিষ্কার কিছু দেখেন না। ব্ল্যাক বোর্ডে নিজের লেখা নিজেই পড়তে পারেন না।

নিশানাথ বাবুর ছেলেমেয়ে কেউ নেই। একটা মেয়ে ছিল। খুব ছোটবেলায় টাইফয়েডে মারা গেছে। তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন গত বছর। এখন তিনি একা-একা থাকেন। তাঁর বাসা নান্দিনা বাজারের কাছে। puran আমলের দুকামরার একটা পাকা দালানে তিনি থাকেন। কামরা দুটির একটি পুরান লক্কর জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা। তাঁর নিজের জিনিস নয়। বাড়িওয়ালার জিনিস। ভাঙা খাট, ভাঙা চেয়ার, পেতলের তলা নেই কিছু ডেগচি, বাসন-কোসন। বাড়িওয়ালা নিশানাথ বাবুকে প্রায়ই বলেন–এইসব জঞ্জাল দূর করে ঘরটা আপনাকে পরিষ্কার করে দেব। শেষ পর্যন্ত করে না। তাতে নিশানাথ বাবুর খুব একটা অসুবিধাও হয় না। পাশে একটা হোটেলে তিনি খাওয়া-দাওয়া সারেন। বিকেলে নদীর ধারে একটু হাঁটতে যান। সন্ধ্যার পর নিজের ঘরে এসে চুপচাপ বসে থাকেন। তার একটা কোরোসিনের স্টোভ আছে। রাতের বেলা চা খেতে ইচ্ছা হলে স্টোভ জ্বালিয়ে নিজেই চা বানান।

জীবনটা তার বেশ কষ্টেই যাচ্ছে। তবে তা নিয়ে নিশানাথ বাবু মন খারাপ করেন না। মনে মনে বলেন, আর অল্প কটা দিনই তো বাঁচব, একটু না হয় কষ্ট করলাম। আমার চেয়ে বেশি কষ্টে কত মানুষ আছে। আমার আবার এমন কী কষ্ট।

একদিন কার্তিক মাসের সন্ধ্যাবেলায় নিশানাথ বাবু তার স্বভাবমতো সকাল সকাল রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে বেড়াতে বেরুলেন। নদীর পাশের বাঁধের উপর দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটলেন। চোখে কম দেখলেও অসুবিধা হয় না, কারণ গত কুড়ি বছর ধরে এই পথে তিনি হাঁটাহাঁটি করছেন।

আজ অবশ্যি একটু অসুবিধা হলো। তার চটির একটা পেরেক উঁচু হয়ে গেছে। পায়ে লাগছে। হাঁটতে পারছেন না। তিনি সকাল সকাল বাড়ি ফিরলেন। তার শরীরটাও আজ খারাপ। চোখে যন্ত্রণা হচ্ছে। বাঁ চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে।

বাড়ি ফিরে তিনি খানিকক্ষণ বারান্দায় বসে রইলেন। রাত নটার দিকে তিনি ঘুমুতে যান। রাত নটা বাজতে এখনো অনেক দেরি। সময় কাটানোটাই তার এখন সমস্যা। কিছু-একটা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলে হতো। কিন্তু হাতে কোনো কাজ নেই। বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চটির উঁচু হয়ে থাকা পেরেকটা ঠিক করলে কেমন হয়? কিছুটা সময় তো কাটে। তিনি চটি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। হাতুড়ি জাতীয় কিছু খুঁজে পেলেন না। জঞ্জাল রাখার ঘরটিতে উঁকি দিলেন। রাজ্যের জিনিস সেখানে, কিন্তু হাতুড়ি বা তার কাছাকাছি কিছু নেই। মন খারাপ করে বের হয়ে আসছিলেন, হঠাৎ দেখলেন ঝুড়ির ভেতর একগাদা জিনিসের মধ্যে লম্বাটে ধরনের কী একটা যেন দেখা যাচ্ছে। তিনি জিনিসটা হাতে নিয়ে জুতার পেরেকে বাড়ি দিতেই অদ্ভুত কাণ্ড হলো। কালো ধোঁয়ায় ঘর ভর্তি হয়ে গেল।

তিনি ভাবলেন চোখের গণ্ডগোল। চোখ দুটো বড় যন্ত্রণা দিচ্ছে।

কিন্তু না, চোখের গণ্ডগোল না। কিছুক্ষণের মধ্যে ধোয়া কেটে গেল। নিশানাথ বাবু অবাক হয়ে শুনলেন, মেঘগর্জনের মতো শব্দে কে যেন বলছে, আপনার দাস আপনার সামনে উপস্থিত। হুকুম করুন। এক্ষুনি তালিম হবে।

নিশানাথ বাবু কাঁপা গলায় বললেন, কে? কে কথা বলে?

জনাব আমি। আপনার ডান দিকে বসে আছি। ডান দিকে ফিরলেই আমাকে দেখবেন।

নিশানাথ বাবু ডান দিকে ফিরতেই তার গায়ে কাঁটা দিল। পাহাড়ের মতো একটা কী যেন বসে আছে। মাথা প্রায় ঘরের ছাদে গিয়ে লেগেছে। নিশ্চয়ই চোখের ভুল।

নিশানাথ বাবু ভয়ে ভয়ে বললেন, বাবা তুমি কে? চিনতে পারলাম না

আমি হচ্ছি আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য। আপনি যে জিনিসটি হাতে নিয়ে বসে আছেন এটাই হচ্ছে সেই বিখ্যাত আলাউদ্দিনের চেরাগ।

বলো কি!

সত্যি কথাই বলছি জনাব। দীর্ঘদিন এখানে-ওখানে পড়ে ছিল। কেউ ব্যবহার জানে না বলে ব্যবহার হয় নি। পাঁচ হাজার বছর পর আপনি প্রথম ব্যবহার করলেন। এখন হুকুম করুন।

কী হুকুম করব?

আপনি যা চান বলুন, এক্ষুনি নিয়ে আসব। কোন জিনিসটি আপনার প্রয়োজন?

আমার তো কোনো জিনিসের প্রয়োজন নেই।

চেরাগের দৈত্য চোখ বড় বড় করে অনেকক্ষণ নিশানাথ বাবুর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, জনাব, আপনি কি আমায় ভয় পাচ্ছেন?

প্রথমে পেয়েছিলাম, এখন পাচ্ছি না। তোমার মাথায় ঐ দুটো কী? শিং নাকি?

জি, শিং।

বিশ্রী দেখাচ্ছে।

চেরাগের দৈত্য মনে হলো একটু বেজার হয়েছে। মাথার লম্বা চুল দিয়ে সে শিং দুটো ঢেকে দেবার চেষ্টা করতে করতে বলল, এখন বলুন কী চান?

বললাম তো, কিছু চাই না।

আমাদের ডেকে আনলে কোনো একটা কাজ করতে দিতে হয়। কাজ করা পর্যন্ত চেরাগের ভেতর ঢুকতে পারি না।

অনেক ভেবেচিন্তে নিশানাথ বাবু বললেন, আমার চটির পেরেকটা ঠিক করে দাও। অমনি দৈত্য আঙুল দিয়ে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে পেরেক ঠিক করে বলল, এখন আমি আবার চেরাগের ভেতর ঢুকে যাব। যদি আবার দরকার হয় চেরাগটা দিয়ে লোহা বা তামার উপর খুব জোরে বাড়ি দেবেন। আগে চেরাগ একটুখানি ঘষলেই আমি চলে আসতাম। এখন আসি না। চেরাগ পুরান হয়ে গেছে তো, তাই।

ও আচ্ছা। চেরাগের ভেতরেই তুমি থাকো?

জি।

করো কী?

ঘুমাই। তাহলে জনাব আমি এখন যাই।

বলতে বলতেই সে ধোয়া হয়ে চেরাগের ভেতর ঢুকে গেল। নিশানাথ বাবু স্তম্ভিত হয়ে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। তারপর তার মনে হলো–এটা স্বপ্ন স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। বসে ঝিমাতে ঝিমাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছেন।

তিনি হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লেন। পরদিন তাঁর আর এত ঘটনার কথা মনে রইল না। তাঁর খাটের নিচে পড়ে রইল আলাউদ্দিনের বিখ্যাত চেরাগ।

মাসখানেক পার হয়ে গেল। নিশানাথ বাবুর শরীর আরো খারাপ হলো। এখন তিনি আর হাঁটাহাঁটিও করতে পারেন না। বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে-বসে থাকেন। এক রাতে ঘুমুতে যাবেন। মশারি খাটাতে গিয়ে দেখেন একদিকের পেরেক খুলে এসেছে। পেরেক বসানোর জন্য আলাউদ্দিনের চেরাগ দিয়ে এক বাড়ি দিতেই ঐ রাতের মতো হলো। তিনি শুনলেন গম্ভীর গলায় কে যেন বলছে–

জনাব, আপনার দাস উপস্থিত। হুকুম করুন।

তুমি কে?

সে কী! এর মধ্যে ভুলে গেলেন? আমি আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য।

ও আচ্ছা, আচ্ছা। আরেক দিন তুমি এসেছিলে।

জি।

আমি ভাবছিলাম বোধহয় স্বপ্ন।

মোটেই স্বপ্ন না। আমার দিকে তাকান। তাকালেই বুঝবেন–এটা সত্য।

তাকালেও কিছু দেখি না রে বাবা। চোখ দুটা গেছে।

চিকিৎসা করাচ্ছেন না কেন?

টাকা কোথায় চিকিৎসা করাব?

কী মুশকিল! আমাকে বললেই তো আমি নিয়ে আসি। যদি বলেন তো এক্ষুনি এক কলসি সোনার মোহর এনে আপনার খাটের নিচে রেখে দেই।

আরে না, এত টাকা দিয়ে আমি করব কী? কদিনইবা আর বাঁচব।

তাহলে আমাকে কোনো একটা কাজ দিন। কাজ না করলে তো চেরাগের ভেতর যেতে পারি না।

বেশ, মশারিটা খাঁটিয়ে দাও।

.

দৈত্য খুব যত্ন করে মশারি খাটাল। মশারি দেখে সে খুব অবাক। পাঁচ হাজার বছর আগে নাকি এই জিনিস ছিল না। মশার হাত থেকে বাচার জন্যে মানুষ যে কায়দা বের করেছে তা দেখে সে মুগ্ধ।

জনাব, আর কিছু করতে হবে?

না, আর কী করবে! যাও এখন।

অন্য কিছু করার থাকলে বলুন, করে দিচ্ছি।

চা বানাতে পারো?

জি না। কীভাবে বানায়?

দুধ-চিনি মিশিয়ে।

না, আমি জানি না। আমাকে শিখিয়ে দিন।

থাক বাদ দাও, আমি শুয়ে পড়ব।

দৈত্য মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আপনার মতো অদ্ভুত মানুষ জনাব আমি এর আগে দেখি নি।

কেন?

আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে পেলে সবার মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়। কী চাইবে, কী না চাইবে, বুঝে উঠতে পারে না, আর আপনি কিনা…

নিশানাথ বাবু বিছানায় শুয়ে পড়লেন। দৈত্য বলল, আমি কি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব? তাতে ঘুমুতে আরাম হবে।

আচ্ছা দাও।

দৈত্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নিশানাথ বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙলে মনে হলো, আগের রাতে যা দেখেছেন সবই স্বপ্ন। আলাউদ্দিনের চেরাগ হচ্ছে রূপকথার গল্প। বাস্তবে কি তা হয়? হওয়া সম্ভব না।

দুঃখে-কষ্টে নিশানাথ বাবুর দিন কাটতে লাগল। শীতের শেষে তার কষ্ট চরমে উঠল। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না এমন অবস্থা। হোটেলের একটা ছেলে দুবেলা খাবার নিয়ে আসে। সেই খাবারও মুখে দিতে পারেন না। স্কুলের পুরান স্যাররা মাঝে মাঝে তাকে দেখতে এসে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন–এ যাত্রা আর টিকবে না। বেচারা বড় কষ্ট করল। তাঁরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে তিনশ টাকা নিশানাথ বাবুকে দিয়ে এলেন। তিনি বড় লজ্জায় পড়লেন। কারো কাছ থেকে টাকা নিতে তার বড় লজ্জা লাগে।

এক রাতে তাঁর জ্বর খুব বাড়ল। সেই সঙ্গে পানির পিপাসায় ছটফট করতে লাগলেন। বাতের ব্যথায় এমন হয়েছে যে, বিছানা ছেড়ে নামতে পারছেন না। তিনি করুণ গলায় একটু পরপর বলতে লাগলেন–পানি। পানি। গম্ভীর গলায় কে একজন বলল, নিন জনাব পানি।

তুমি কে?

আমি আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য।

ও আচ্ছা, তুমি।

নিন, আপনি খান। আমি আপনাতেই চলে এলাম। যা অবস্থা দেখছি, না এসে পারলাম না।

শরীরটা বড়ই খারাপ করেছে রে বাবা।

আপনি ডাক্তারের কাছে যাবেন না, টাকা-পয়সা নেবেন না, আমি কী করব, বলুন?

তা তো ঠিকই, তুমি আর কী করবে!

আপনার অবস্থা দেখে মনটাই খারাপ হয়েছে। নিজ থেকেই আমি আপনার জন্যে একটা জিনিস এনেছি। এটা আপনাকে নিতে হবে। না নিলে খুব রাগ করব।

কী জিনিস?

একটা পরশপাথর নিয়ে এসেছি।

সে কি! পরশপাথর কি সত্যি সত্যি আছে নাকি?

থাকবে না কেন? এই তো, দেখুন। হাতে নিয়ে দেখুন।

নিশানাথ বাবু পাথরটা হাতে নিলেন। পায়রার ডিমের মতো ছোট। কুচকুচে কালো একটা পাথর। অসম্ভব মসৃণ।

এইটাই বুঝি পরশপাথর?

জি। এই পাথর ধাতুর তৈরি যে কোনো জিনিসের গায়ে লাগালে সেই জিনিস সোনা হয়ে যাবে। দাঁড়ান, আপনাকে দেখাচ্ছি।

দৈত্য খুঁজে খুঁজে বিশাল এক বালতি নিয়ে এলো। পরশপাথর সেই বালতির গায়ে লাগাতেই কাফেরঙের আভায় বালতি ঝকমক করতে লাগল।

দেখলেন?

হ্যাঁ দেখলাম। সত্যি সত্যি সোনা হয়েছে?

হ্যাঁ, সত্যি সেনা।

এখন এই বালতি দিয়ে আমি কী করব?

আপনি অদ্ভুত লোক, এই বালতির কত দাম এখন জানেন? এর মধ্যে আছে কুড়ি সের সোনা। ইচ্ছা করলেই পরশপাথর ছুঁইয়ে আপনি লক্ষ লক্ষ টন সোনা বানাতে পারেন।

নিশানাথ বাবু কিছু বললেন না, চুপ করে রইলেন। দৈত্য বলল, আলাউদ্দিনের চেরাগ যেই হাতে পায় সেই বলে পরশপাথর এনে দেবার জন্যে। কাউকে দেই না।

দাও না কেন?

লোভী মানুষদের হাতে এসব দিতে নেই। এসব দিতে হয় নির্লোভ মানুষকে। নিন, পরশপাথরটা যত্ন করে রেখে দিন।

আমার লাগবে না। যখন লাগবে তোমার কাছে চাইব।

নিশানাথ বাবু পাশ ফিরে শুলেন।

পরদিন জ্বরে তিনি প্রায় অচৈতন্য হয়ে গেলেন। স্কুলের স্যাররা তাঁকে ময়মনসিংহ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ডাক্তাররা মাথা নেড়ে বললেন

অবস্থা খুব খারাপ। রাতটা কাটে কি-না সন্দেহ।

নিশানাথ বাবু মারা গেলেন পরদিন ভোর ছটায়। মৃত্যুর আগে নান্দিনা হাইস্কুলের হেডমাস্টার সাহেবকে কানে কানে বললেন–আমার ঘরে একটা বড় বালতি আছে। ঐটা আমি স্কুলকে দিলাম। আপনি মনে করে বালতিটা নেবেন।

নিশ্চয়ই নেব।

খুব দামি বালতি…।

আপনি কথা বলবেন না। কথা বলতে আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে। চুপ করে শুয়ে থাকুন।

কথা বলতে তাঁর সত্যি সত্যি কষ্ট হচ্ছিল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। বালতিটা যে সোনার তৈরি এটা তিনি বলতে পারলেন না।

.

হেডমাস্টার সাহেব ঐ বালতি নিয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন–বাহ, কী সুন্দর বালতি! কী চমৎকার ঝকঝকে হলুদ! পেতলের বালতি, কিন্তু রঙটা বড় সুন্দর।

দীর্ঘদিন নারিন্দা হাইস্কুলের বারান্দায় বালতিটা পড়ে রইল। বালতি ভর্তি থাকত পানি। পানির উপর একটা মগ ভাসত। সেই মগে করে ছাত্ররা পানি

তারপর বালতিটা চুরি হয়ে যায়। কে জানে এখন সেই বালতি কোথায় আছে!

একটি ভয়ঙ্কর অভিযানের গল্প

চৈত্র মাসের সন্ধ্যা।

সারা দিন অসহ্য গরম গিয়েছে, এখন একটু বাতাস ছেড়েছে। গরম কমেছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কে জানে হয়তোবা বৃষ্টিও নামবে। অনেক দিন বৃষ্টি হচ্ছে না। এখন হওয়া উচিত।

মশাদের জন্যে এর চেয়ে আনন্দজনক আবহাওয়া আর হতে পারে না। অল্প-স্বল্প বৃষ্টি হবে। খানাখন্দে খানিকটা পানি জমবে। সেই পানিতে ডিম পাড়া হবে। ডিম থেকে তৈরি হবে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা। পিন পিন করে গান গাইতে গাইতে তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।

এ-রকম এক সন্ধ্যায় এক মা-মশা তাঁর ছেলেমেয়েদের কাছে ডাকলেন। তাঁর তিন মেয়ে এক ছেলে। মেয়েদের নাম যথাক্রমে–পিঁ, পিঁপিঁ এবং পিঁপিঁপিঁ। ছেলেটার নাম টে।

মা-মশা বললেন, আদরের সোনামণিরা, তোমরা লাইন বেঁধে আমার সামনে দাঁড়াও। তোমাদের সঙ্গে কথা আছে।

পিঁ বলল, মা এখন তো আমরা খেলছি। এখন কোনো কথা শুনতে পারব না।

মা-মশা বিরক্ত গলায় বললেন, বেয়াদবি করবে না মা। বড়রা যখন কিছু বলেন তখন শুনতে হয়। সবাই আস।

মশার ছেলেমেয়েরা মাকে ঘিরে দাঁড়াল। শুধু পিঁর মন একটু খারাপ। খেলা ছেড়ে উঠে আসতে তার ভালো লাগে না। সে যখন খেলতে বসে তখনই শুধু মার জরুরি কথা মনে হয় কেন কে জানে।

মা-মশা বললেন, আমার সোনামণিরা, আজ তোমাদের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। আজ তোমাদের নিয়ে আমি এক অভিযানে বের হব।

টে বলল, কী অভিযান মা?

রক্ত খাবার অভিযান। আজ আমরা মানুষের রক্ত খেতে যাব। কী করে রক্ত খেতে হয় শেখাব।

টে আনন্দে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, মা, আমি কিন্তু সবার আগে রক্ত খাব।

মা-মশা বিরক্ত মুখে বললেন, বোকার মতো কথা বলবে না টে। তুমি হলে ছেলে-মশা। ছেলে-মশারা কখনো রক্ত খায় না। মেয়ে-মশারা খায়। তোমার বোনরা রক্ত খাবে— তুমি তাদের সাহায্য করবে।

টে মুখ কালো করে বলল, ওরা সবাই খা্বে। আর আমি বুঝি বসে বসে দেখব। আমি রক্ত খেলে অসুবিধা কী?

অসুবিধা আছে। মেয়ে-মশাদের পেটে ডিম আসে। সেই ডিমের পুষ্টির জন্যে মানুষের রক্ত দরকার। ছেলেদের পেটে তো আর ডিম আসে না ওদের সেই জন্যেই রক্ত খেতে হয় না।

টে রাগী গলায় বলল, আমার পেটে ডিম আসুক আর না আসুক, আমি খাবই।

খাবে কীভাবে? রক্ত খাবার জন্যে যে শুঁড় দরকার–সেটাই তো ছেলে মশাদের নেই। .

টে বলল, আমি যদি নাই খেতে পারলাম— তাহলে শুধু শুধু তোমাদের সঙ্গে কেন যাব?

আমাদের সাহায্য করার জন্যে যাবে। মানুষের রক্ত খাওয়া তো কোনো সহজ ব্যাপার না। কঠিন ব্যাপার। ভয়ঙ্কর কঠিন।

মশা-মার সবচেয়ে ছোট মেয়ে পিঁপিঁপিঁ একটু বোকা ধরনের। সে অবাক হয়ে বলল, রক্ত খাওয়া কঠিন কেন হবে মা? আমরা যাব, চুমুক দিয়ে ভরপেট রক্ত খেয়ে চলে আসব।

মা, তুমি সব সময় বোকার মতো কথা বলো। তুমি বড় হচ্ছ কিন্তু তোমার বুদ্ধি বড় হচ্ছে না। এটা খুব দুঃখের কথা! তুমি যেভাবে কথা বলছ তাতে মনে হয় মানুষরা বাটিতে করে তোমার জন্যে রক্ত সাজিয়ে রেখেছে। ব্যাপার মোটেই তা না। মানুষের রক্ত খাওয়া ভয়ঙ্কর কঠিন ব্যাপার। জীবন হাতে নিয়ে যেতে হয়।

জীবন হাতে নিয়ে যেতে হবে কেন মা?

তোমরা তাদের রক্ত খাবে আর তারা তোমাদের ছেড়ে দেবে? কক্ষনো না। মানুষের বুদ্ধি তো সহজ বুদ্ধি না, জটিল বুদ্ধি।

টে বলল, মা, ওদের বুদ্ধি কি আমাদের চেয়েও বেশি?

না রে বাবা। আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধি কী করে হবে? ওরা যেমন মোটা। ওদের বুদ্ধিও মোটা। আমরা যেমন সরু আমাদের বুদ্ধিও সরু। আমাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে ওরা যা করে তা দেখে হাসি পায়।

কী করে মা?

দরজা-জানালায় নেট লাগায়। শক্ত তারের নেট। কিন্তু ওরা জানে না যে যখন দরজা খোলা হয় তখন আমরা হুড় হুড় করে ঢুকে পড়ি। তা ছাড়া নেটের ফুটা দিয়েও সহজে ঢোকা যায়। পাখা গুটিয়ে টুপ কক্ষে ঢুকে যেতে হয়। তোদের শিখিয়ে দেব। ওটা কোনো ব্যাপারই না।

মেজ মেয়ে পিঁপিঁ বলল, ওরা আর কি বোকামি করে না?

ওদের কাজকর্মের সবটাই বোকামিতে ভরা। মশারি বলে ওরা একটা জিনিস খাটায় জালের মতো। ছোট ছোট ফুটা। ওদের ধারণা সেই ফুটা দিয়ে আমরা ঢুকতে পারব না। হি হি হি

আমরা কি ঢুকতে পারি?

অবশ্যই পারি। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে আমরা করি কি, কয়েক জন মিলে ফুটা বড় করে ভেতরে ঢুকি। রক্তটক্ত খেয়ে ঐ ফুটা দিয়ে বের হয়ে চলে আসি। ওরা ভাবে, আমাদের হাত থেকে খুব বাঁচা বেঁচেছে।

আসলে বাঁচতে পারে না, তাই না মা?

হুঁ। এখন তোমরা সবাই তৈরি হয়ে নাও আমার সঙ্গে যাবে এবং মানুষদের কামড়ানোর সাধারণ নিয়মকানুন শিখবে।

এটার আবার নিয়মকানুন কী?

কঠিন কঠিন নিয়ম আছে সোনামণিরা। নিয়ম না মানলে অবধারিত মৃত্যু। তোমাদের বাবা তো নিয়ম না মানার জন্যেই মারা গেল। শুনবে সেই গল্প?

পিঁ বলল, না শুনব না। বাবার মৃত্যুর গল্প শুনতে ভালো লাগবে না। মন খারাপ হবে।

মন খারাপ হলেও তোমাদের শোনা দরকার। এর মধ্যে শেখার ব্যাপারও আছে। পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখময় ঘটনা থেকেই শিক্ষা নেয়া যায়।

ঠিক আছে মা বলো আমরা শুনছি।

তোমাদের তখনও জন্ম হয়নি। আমার সবেমাত্র তোমাদের বাবার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। তোমাদের বাবা আমাকে বলল–চলো মানুষের রক্ত খাবে। আমার যেতে ইচ্ছা করছিল না। তবু তার উৎসাহ দেখে গেলাম। তোমাদের বাবা বলল–তুমি নির্ভয়ে রক্ত খাবে, আর আমি লোকটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখব। সে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। তোমাকে দেখতেই পাবে না। আমি তোমাদের বাবার কথামতো একটা মানুষের রক্ত খেতে শুরু করেছি। তোমাদের বাবা তাকে ব্যস্ত রাখার জন্যে তার চোখের সামনে খুব নাচানাচি করছে। একবার এদিকে যায়, একবার ওদিকে যায়। মাঝে মাঝে কানের কাছে গিয়ে গান গায়—

তিন তিন তিন
পিন পিন পিন।

বাহ্ বাবার তো খুব সাহস!

হ্যাঁ তার সাহস ছিল। কিন্তু এইসব হলো বোকামি সাহস। বাহাদুরি দেখানোর সাহস। মশাদের যেসব নিয়মকানুন আছে তামধ্যে প্রথম নিয়ম হলো–বাহাদুরি করবে না। বাহাদুরি করেছ কি মরেছ।

দ্বিতীয় নিয়ম— লোভী হয়ো না। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। সাধু-সন্ন্যাসীর মতো নির্লোভ হতে হবে।

কীভাবে হব মা?

রক্ত যখন খাওয়া শুরু করবে তখন লোভীর মতো খাবে না। যতটুকু তোমার প্রয়োজন তার চেয়ে এক বিন্দুও বেশি খাবে না। বেশি খেয়েছ কি মরেছ। শরীর ভারি হয়ে যাবে। উড়তে পারবে না। রক্ত খেয়ে ঐ জায়গাতেই বসে থাকতে হবে। তখন যার রক্ত খেয়েছ সে চড় দিয়ে মেরে ফেলবে।

পিঁপিঁ আঁতকে উঠে বলল, কী ভয়ঙ্কর!

মা-মশা বললেন, এই ব্যাপারটা সবাইকে প্রথমেই শেখানো হয়। তারপরেও অনেকের মনে থাকে না। লোভীর মতো রক্ত খেতে শুরু করে। ফল হলো মৃত্যু।

সবচেয়ে ছোট মেয়ে পিঁপিঁপিঁ বলল, আমি কখনো লোভীর মতো রক্ত খাব। অল্প একটু খেয়েই উড়ে চলে আসব। শুধু ঠোট ভেজাব।

সবাই এই কথা বলে কিন্তু কাজের সময় আর কারোর কিছু মনে থাকে না।

রক্ত খেতে কি খুব মজা মা?

অসম্ভব মজা। একবার খাওয়া শুরু করলে ইচ্ছা করে খেতেই থাকি, খেতেই থাকি, খেতেই থাকি।

মা, আমার খুব খেতে ইচ্ছা করছে।

চল যাওয়া যাক। শুধু একটা কথা তোমরা মনে রাখবে— আমরা কিন্তু বেড়াতে যাচ্ছি না, আমরা যাচ্ছি এক ভয়ঙ্কর অভিযানে। আমাদের যেতে হবে খুব সাবধানে।

মা-মশা তার চার পুত্র-কন্যা নিয়ে এলিফ্যান্ট পার্ক এপার্টমেন্টের আট তলায় শীলাদের বাসায় এসে উপস্থিত হলো। শীলারা তিন বোন তখন টিভি দেখছে। তাদের ছোট ভাইটা খাটে ঘুমুচ্ছে। শীলার বাবা চেয়ারে বসে কী যেন, লিখছেন। শীলার মা ছোট বাবুর পাশে বসে গল্পের বই পড়ছেন।

পি ফিসফিস করে বলল, মা, আমরা কাকে কামড়াব? বড় মেয়েটাকে কামড়াব মা? ও দেখতে সবচেয়ে সুন্দর।

মা-মশা বললেন, প্রথমেই কামড়াবার কথা ভাববে না। প্রথমে পরিস্থিতি দেখে অবস্থা বিবেচনা করবে।

পরিস্থিতি কীভাবে দেখব? ওদের কাছ থেকে ঘুরে আসব?

অসম্ভব। ওদের কাছে গিয়ে ভনভন করলেই ওরা সজাগ হয়ে যাবে। ওরা বুঝবে যে ঘরে মশা আছে। বলা যায় না মশার ওষুধও দিয়ে বসতে পারে। ওদের কিছুতেই জানতে দেয়া যাবে না যে আমরা আছি।।

পিঁ বলল, আমি কাকে কামড়াব তা তো তুমি এখনো বললে না। তিন বোনের কোন বোনটাকে কামড়াব?

ওদের কাউকেই কামড়ানো যাবে না। দেখছ না–ওরা জেগে আছে, টিভি দেখছে? টিভির প্রোগ্রামও বাজে। কেউ মন দিয়ে দেখছে না। ওদের কামড়ালেই ওরা টের পেয়ে যাবে। সবচেয়ে ভালো ঘুমন্ত কাউকে কামড়ানো।

বড় মেয়ে বলল, মা, ওদের ছোট ভাইটা ঘুমুচ্ছে। ওকে কামড় দিয়ে আসি?

মা-মশা গম্ভীর গলায় বললেন, ভুলেও এই কাজ করবে না। বাচ্চার মা পাশে বসে আছে— বাচ্ছাকে কামড়ালেই মা টের পাবে। মায়েরা কিভাবে কিভাবে যেন টের পেয়ে যায়। একটা কথা খেয়াল রেখো, মা পাশে থাকলে ছোট শিশুর গায়ে কখনো বসবে না।

মাকে কামড়ে আসি মা?

হ্যাঁ, তা পারা যায়। মা বই পড়ছেন–খুব মন দিয়ে পড়ছেন। তাঁর এক হাতে বই, কাজেই এই হাতটা আটকা আছে। অন্য হাতটা খালি। এমন জায়গায় বসতে হবে যেন খালি হাত সেখানে পৌঁছতে না পারে। আমাদের আদরের বড় মেয়ে পিঁ তুমি যাও–ঐ মার রক্ত খেয়ে আস। খুব সাবধান। লোভী হবে না। মনে থাকবে?

মনে থাকবে মা।

কোথায় বসবে বলে ঠিক করেছ?

তার বাঁ হাতে।

ভালো, খুব ভালো চিন্তা। শীলার মার ডান হাতে বই ধরা আছে। এই হাতে সে তোমাকে মারতে পারবে না। বাঁ হাত দিয়ে তো আর বাঁ হাতের মশা মারতে পারবে না। আমার ধারণা, কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই তুমি রক্ত খেয়ে চলে আসতে পারবে। যাও মা…

বড় মেয়ে পিঁ উড়ে গেল এবং রক্ত খেয়ে চলে এলো। শীলার মা কিছু বুঝতেও পারলেন না। একসময় শুধু বিরক্ত হয়ে হাত ঝাঁকালেন।

মা-মশা বললেন, আমার বুদ্ধিমতী বড় মেয়ে কী সুন্দর রক্ত খেয়ে চলে এসেছে! কিছু বুঝতেও পারেনি। এবার মেজ মেয়ের পালা…

মা-মশা কথা শেষ করবার আগেই পিঁপিঁ উড়ে গেল। তার আর তর সইছিল। সে শীলার মাকে দুবার চক্কর দিয়ে বসল তাঁর ঘাড়ে। এবার শীলার মা টের পেলেন। মশা মারার জন্যে বাঁ হাত উঁচু করলেন— মশা এমন জায়গায় বসেছে যে বাঁ হাত সেখানে পৌঁছে না। কাজেই মেজ মেয়ে পিঁপিঁও নির্বিঘ্নে রক্ত খেয়ে চলে এলো।

মা-মশা বললেন, তোমার কাজেও আমি খুশি, তবে তুমি দুটা চক্কর দিলে কেন? এটা উচিত হয়নি। শুধু গায়ে বসলেই যে মানুষ মশা মারে তা না— আশপাশে উড়তে দেখলেও মেরে ফেলে। তুমি বাহাদুরি করতে গিয়েছ। বাহাদুরি করাও নিষেধ। ভবিষ্যতে আরো সাবধান হবে। এবার সবচেয়ে ছোটজনের পালা…

বলতে না বলতেই পিঁপিঁপিঁ উড়তে শুরু করল। মা-মশা চিৎকার করে ডাকলেন, ফিরে এসো, ফিরে এসো।

পিঁপিঁপিঁ ফিরে এলো। মা-মশা বললেন, তুমিও কি ঐ শীলার মাকে কামড়াতে যাচ্ছিলে?

হ্যাঁ।

এত বড় বোকামি কি করতে আছে? এর আগে দুজন তার রক্ত খেয়ে গেছে। এখন সে অনেক সাবধানী। তার কাছে যাওয়াই ঠিক হবে না।

তাহলে কি শীলার বাবার রক্ত খাব মা?

হ্যাঁ, তা খাওয়া যেতে পারে। উনি গভীর মনোযোগে লেখালেখি করছেন। তার গা থেকে এক চুমুক রক্ত খেলে উনি বুঝতেও পারবেন না।

উনি কী লিখছেন মা?

মনে হয় গল্প লিখছেন।

সুন্দর গল্প?

সুন্দর গল্প না পচা গল্প তা তো জানি না–এখন মা, তুমি মন দিয়ে শোনো আমি কী বলছি–তুমি উনার হাতে বসবে। বসেই রোমকূপ খুঁজে বের করবে। যেখানে-সেখানে সুচ ফুটিয়ে দেবে না। সুচ ভেঙে যেতে পারে। সুচ ভাঙলে তীব্র ব্যথা হয়। মনে থাকবে?

হ্যাঁ মা, মনে থাকবে।

মানুষের শরীরে দুধরনের রক্ত আছে— শিরার রক্ত। এই রক্ত কালো, স্বাদ নেই। আর হলো ধমনির পরিষ্কার ঝকঝকে রক্ত। খুব স্বাদ। ধমনির রক্ত খাবে। মনে থাকবে?

হ্যাঁ থাকবে।

লোভীর মত রক্ত খাবে না। মনে রাখবে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।

মা, আমার মনে থাকবে।

তুমি তো একটু বোকা— এইজন্যেই তোমাকে নিয়ে আমার ভয়।

মা, একটুও ভয় পেও না। দেখ না আমি যাব আর চলে আসব। মা যাই?

মা-মশা চিন্তিত মুখে বললেন, আচ্ছা যাও।

পিঁপিঁপিঁ শীলার বাবার হাতে বসেছে। রোমকূপ খুঁজে বের করে তার শূড় নামিয়ে দিয়েছে। শূড় বেয়ে রক্ত উঠে আসছে। পিঁপিঁপিঁর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল— কী মিষ্টি রক্ত! কী মিষ্টি! মনে হচ্ছে, আহ, সারাজীবন ধরে যদি এই রক্ত খাওয়া যেত! সে খেয়েই যাচ্ছে, খেয়েই যাচ্ছে, তার পেট বেলুনের মতো ফুলছে… তার কোনোই খেয়াল নেই।

মা-মশা চিৎকার করে কাঁদছেন— বোকা মেয়ে, তুই কী সর্বনাশ করছিস! তুই উঠে আয়। এখনো সময় আছে। এখানে হয়তো কষ্ট করে উড়তে পারবি…

পিঁপিঁপিঁ মার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। সে রক্ত খেয়েই যাচ্ছে। পিঁপিঁপিঁর দুই বোন এখন কাঁদছে, আর ভাইও কাঁদছে।

মা-মশা ফোঁপাতে বললেন, ও রে বোকা মেয়ে, শীলার বাবা তো এক্ষুনি তোকে দেখবে। পিষে মেরে ফেলবে–তুই উড়ে পালিয়েও যেতে পারবি না। তোকে এত করে শিখিয়ে দিলাম, তারপরেও তুই এত বড় বোকামি কী করে করলি…!

মা-মশার কথা শেষ হবার আগেই শীলার বাবা মশাটাকে দেখলেন–রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। নড়াচড়া করতে পারছে না। ঝিম মেরে হাতের ওপর বসে আছে। তিনি মশাটাকে তার লেখার কাগজের ওপর ঝেড়ে ফেললেন। মশাটা অনেক কষ্টে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক বার উড়ার চেষ্টা করল। পারল না। শীলার বাবা বললেন, আমার মামণিরা কোথায়? মজা দেখে যাও।

মজা দেখার জন্যে তিন মেয়েই ছুটে এলো। দেখ, এই দেখ। মশাটাকে দেখ, রক্ত খেয়ে কেমন হয়েছে। উড়তে পারছে না।

শীলা বলল, এর মধ্যে মজার কী আছে বাবা? তুমি কী যে পাগলের মতো বলো! মশাটাকে মেরে ফেল।

মেরে ফেলব?

অবশ্যই মেরে ফেলবে। সে তোমার রক্ত খেয়েছে, তুমি তাকে ছেড়ে দেবে কেন? তোমার হয়ে আমি মেরে দেই?

না না, মারিস না। মারিস না— থাক না।

মারব না কেন?

তুচ্ছ একটা প্রাণী শুধু শুধু মেরে কী হবে?

তোমার রক্ত খেয়েছে তো!

বেচারার খাবারই হচ্ছে রক্ত। না খেয়ে করবে কী? আমরা হাঁস-মুরগি এইসব মেরে মেরে খাচ্ছি না? আমাদের যদি কোনো দোষ না হয় ওদেরও দোষ হবে না।

পিঁপিঁপিঁ খানিকটা শক্তি ফিরে পেয়েছে অনেকবারের চেষ্টায় সে একটু উড়তে পারল। খানিকটা উড়ল— ওমনি তাকে সাহায্যের জন্যে তার মা, ভাই ও দুই বোন ছুটে এল। তারা তাকে ধরে ধরে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

পিঁপিঁপিঁ বলল, মা, আমারা যে চলে যাচ্ছি ঐ ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে গেলাম না তো। উনি ইচ্ছা করলে আমাকে মেরেও ফেলতে পারতেন কিন্তু মারেননি।

উনাকে ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই মা। উনি আমাদের ধন্যবাদ বুঝবেন না। তা ছাড়া যারা বড় তারা কখনো ধন্যবাদ পাবার আশায় কিছু করে না।

মা, তবু আমি উনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই।

তুমি তো উড়তেই পারছ না। ধন্যবাদ কী করে দেবে?

আমি এখন উড়তে পারব। আমি পারব।

পিঁপিঁপিঁ শীলার বাবার চারদিকে একটা চক্কর দিয়ে বিনীত গলায় বলল–আমি অতি তুচ্ছ ক্ষুদ্র একটি পতঙ্গ। আপনি আমার প্রতি যে মমতা দেখিয়েছেন তা আমি সারাজীবন মনে রাখব। আমার কোনোই ক্ষমতা নেই। তারপরও যদি কখনো আপনার জন্যে কিছু করতে পারি আমি করব। পিঁপিঁপিঁর মা, ভাই এবং বোনরা একটু দূরে তার জন্যে অপেক্ষা করছে। সে উড়ে যাচ্ছে তাদের দিকে। তার চোখ বারবার পানিতে ভিজে যাচ্ছে। কিছু-কিছু মানুষ এত ভালো হয় কেন এই ব্যাপারটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

একটি মামদো ভূতের গল্প

আজ নীলুর জন্মদিন।

জন্মদিনে খুব লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে হয়। তাই নীলু সারা দিন খুব লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকল। ছোট কাকু তাকে রাগাবার জন্যে কতবার বললেন :

নীলু বড় বোকা
খায় শুধু পোকা

তবু নীলু একটুও রাগ কল না। শুধু হাসল। বাবা বললেন নীলু মা টেবিল থেকে আমার চশমাটা এনে দাও তো। নীলু দৌড়ে চশমা এনে দিল। হাত থেকে ফেলে দিল। কুলপি মালাইওয়ালা বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে হেঁকে ডাকল, চাই কুলপি মালাই। কিন্তু নীলু অন্য দিনের মতো বলল না, বাবা আমি কুলপি মালাই খাব–জন্মদিনে নিজ থেকে কিছু চাইতে নেই তো, তাই।

কিন্তু সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। তখন নীলুর অঙ্ক স্যার এসেছেন, নীলু বইখাতা নিয়ে বসেছে মাত্র। পড়া শুরু হয়নি। নীলুর ছোট কাকু এসে বললেন, আজ তোমার পড়তে হবে না নীলু।

কেন কাকু?

তোমার মার খুব অসুখ। তুমি দোতলায় যাও।

নীলু দোতলায় উঠে দেখে চারদিক কেমন চুপচাপ। কালো ব্যাগ হাতে একজন ডাক্তার বসে আছেন বারান্দায়। নীলুর বাবা গম্ভীর হয়ে শুধু সিগারেট টানছেন। কিছুক্ষণ পর মস্ত গাড়ি করে একজন বুড়ো ডাক্তার এলেন। খুব রাগী চেহারা তার। এইসব দেখে নীলুর ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। সে এখন বড় হয়েছে। বড় মেয়েদের কাঁদতে নেই, তবু সে কেঁদে ফেলল। বাবা বললেন, নীলু, নীচে যাও তো মা। কাঁদছ কেন বোকা মেয়ে? কিন্তু নীলুর এত খারাপ লাগছে যে না কেঁদে কী করবে? আজ ভোরবেলায়ও সে দেখেছে মার কিছু হয়নি। তাকে হাসতে হাসতে বলেছেন, জন্মদিনে এবার নীলুর কোনো উপহার কেনা হয়নি। কী মজা! কিন্তু নীলু জানে মা মিথ্যে বলছেন। সে দেখেছে বাবা সোনালি কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট এনে শেলফের উপর রেখেছেন। লাল ফিতে দিয়ে প্যাকেটটা বাধা। নীলু  ছুঁয়ে দেখতে গেছে। বাবা চেঁচিয়ে বলেছেন এখন নয়, এখন নয়। রাত্রিবেলা দেখবে।

এর মধ্যে কী আছে বাবা? বলবে না, কার জন্যে এনেছ, আমার জন্যে?

তাও বলব না।

এই বলেই বাবা হাসতে শুরু করেছেন। তার সঙ্গে সঙ্গে মাও। নীলু বুঝতে পেরেছে এখানেই লুকোনো তার জন্মদিনের উপহার। মা যদি ভালো থাকতেন তাহলে এতক্ষণে কী মজাটাই না হতো। ছাদে চেয়ার পেতে সবাই গোল হয়ে বসত। সবাই মিলে চা খেত, নীলু এমনিতে চা খায় না। কিন্তু জন্মদিন এলে মা তাকেও চা দিতেন। তারপর মা একটি গান করতেন। (মা যা সুন্দর গান করেন।), নীলু একটা ছড়া বলত। সবশেষে বাবা বলতেন, আমাদের আদরের মা, মৌটুসকী মা, টুনটুনি মার জন্মদিনে এই উপহার। এই বলে চুমু খেতেন নীলুর কপালে। আর নীলু হয়তো তখন আনন্দে কেঁদেই ফেলত। সোনালি কাগজে মোড়া প্যাকেটটি খুলত ধীরে ধীরে। সেই প্যাকেটে দেখত ভারি চমৎকার কোনো জিনিস!

কিন্তু মার হঠাৎ এমন অসুখ করল! নীলুর কিছু ভালো লাগছে না। ছোট। কাকু বললেন, এসো মা, আমরা ছাদে বসে গল্প করি।

উহুঁ।

লাল কমল নীল কমলের গল্প শুনবে না?

উহুঁ।

নীলু ফ্রকের হাতায় চোখ মুছতে লাগল।

একটু পরে এলেন বড় ফুফু। নীলু যে একা একা দাঁড়িয়ে কাঁদছে তা দেখেও দেখলেন না। তরতর করে উঠে গেলেন দোতলায়। তখনই নীলু শুনল তার মা কাঁদছেন। খুব কাদছেন। মাকে এর আগে নীলু কখনো কাঁদতে শোনেনি। একবার মার হাত কেটে গেল বঁটিতে। কী রক্ত কিন্তু মা একটুও কাদেননি। নীলুকে বলেছেন, আমার হাত কেটেছে তুমি কেন কাঁদছ? বোকা মেয়ে।

আজ হঠাৎ করে তার কান্না শুনে ভীষণ ভয় করতে লাগল তার। ছোট কাকু বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে ছিলেন, নীলু তার কাছে যেতেই নীলুকে তিনি কোলে তুলে নিলেন। নীলু ফোপাতে ফোপাতে বলল, মার কী হয়েছে ছোট কাকু?

কিছু হয়নি।

তবে মা কাঁদছে কেন?

অসুখ করেছে। সেরে যাবে।

অসুখ করলে সবাই কাঁদে, তাই না?

হ্যাঁ।

আবার অসুখ সেরেও যায়। যায় না? যায়।

কাজেই অসুখ করলে মন খারাপ করতে নেই বুঝলে পাগলি?

হু।

নীলুর কন্ন থেমে গেল ছোট কাকুর কথা শুনে। কিন্তু ঠিক তক্ষুনি পো পো শব্দ করতে করতে হাসপাতালের গাড়ি এসে করে তার মাকে নিয়ে তুলছে। সেই গাড়িটিতে। ছোট কাকু শক্ত করে নীলুর হাত ধরে রেখেছেন। নইলে সে চলে যেত মার কাছে।

বাবাও যাচ্ছেন সেই গাড়িতে। যাবার আগে নীলুর মাথায় হাত রেখে বললেন, কাঁদে না লক্ষ্মী মা, ছোট কাকুর সঙ্গে থাকো। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। নীলু বলল, মার কী হয়েছে?

কিছু হয়নি।

মাকে গাড়িতে তুলে লোকগুলো দরজা বন্ধ করে দিল। পো পো শব্দ করতে লাগল গাড়ি। বাবা উঠলেন ফুফুর সাদা গাড়িটায়। গাড়ি যখন চলতে শুরু করেছে, তখন জানালা দিয়ে মুখ বের করে তিনি নীলুকে ডাকলেন।

নীলু, ওমা নীলু।

কী বাবা?

নীলুর ইচ্ছে হলো চেঁচিয়ে বলে, চাই না উপহার। আমার কিছু লাগবে না। কিছু বলার আগেই ছোট কাকু নীলুকে কোলে করে নিয়ে এলেন দোতলায়।

তাকে সোফায় বসিয়ে নিয়ে এলেন সোনালি রঙের প্যাকেটটি।

দেখি লক্ষ্মী মেয়ে, প্যাকেটটা খোলো দেখি।

না।

আহা খোলো নীলু, দেখি কী আছে। নীলুর একটুও ভালো লাগছিল না। তবু সে খুলে ফেলল। আর অবাক হয়ে দেখল চমৎকার একটি পুতুল। ছোট কাকু চেটিয়ে উঠলেন, কী সুন্দর। কী সুন্দর।

ধবধবে সাদা মোমের মতো গা। লাল টুকটুকে ঠোঁট। কোঁকড়ানো ঘন কালো চুল। আর কী সুন্দর তার চোখ নীল রঙের একটি ফ্রক তার গায়ে, কী চমৎকার মানিয়েছে। নীলুর এত ভালো লাগল পুতুলটা। ছোট কাকু বললেন, কী নাম রাখবে পুতুলের?

নাম রাখতে হবে এ কথা নীলুর মনেই ছিল না। তাই তো, কী নাম রাখা যায়?

তুমি একটা নাম বলো কাকু।

এ্যানি রাখবে নাকি? মেম পুতুল তো, কাজেই বিলিতি নাম।

এটা মেম পুতুল কাকু?

হু। দেখছ না নীল চোখ। মেমদের চোখ থাকে নীল।

আরে তাই তো এতক্ষণ লক্ষই করেনি নীলু। পুতুলটির চোখ দুটি ঘন। নীল। সেই চোখে পুতুলটি আবার মিটমিট করে চায়।

ছোট কাকু, আমি এর নাম রাখব সোনামণি।

এ্যা ছিঃ সোনামণি তো বাজে নাম। তার চে বরং সুস্মিতা রাখা যায়।

উহুঁ, সোনামণি রাখব।

আচ্ছা বেশ বেশ। সোনামণিও মন্দ নয়।

নীলু সাবধানে সোনামণিকে বসাল টেবিলে। কী সুন্দর। কী সুন্দর। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।

রাতের বেলা খেতে বসল তারা, তিনজন। নীলু ছোট কাকু আর সোনামণি। সোনামণি তো খাবে না, শুধু শুধু বসেছে।

ছোট কাকু খেতে খেতে মজার মজার গল্প করতে লাগলেন। বেকুব বামুনের গল্প শুনে নীলু হেসে বাঁচে না। ছোট কাকু যা হাসাতে পারেন। একসময় নীলু বলল, এবার একটা ভূতের গল্প বলো।

না, ভূতের গল্প শুনে তুমি ভয়ে কেঁদে ফেলবে।

ইস, আমি বুঝি ছোট মেয়ে বলে কাকু।

মামদো ভূতের গল্প বলব নাকি তবে?

মামদো ভূত কি মানুষ খায় কাকু?

খায় না আবার সুবিধামতো পেলেই কোৎ করে গিলে ফেলে।

ধড়াস করে উঠল নীলুর বুকটা। ছোট কাকু বললেন, তবে যে বলেছিলে ভয় পাবে না? এখন দেখি নীল হয়ে গেছ ভয়ে। কী সাহসী মেয়ে আমাদের নীলু।

একটুও ভয় পাইনি আমি, সত্যি বলছি।

নীলুর অবশ্য খুব ভয় লাগছিল। তবু সে এমন ভান করল, যেন একটুও ভয় পায়নি।

ছোট কাকু, দেখবে, আমি একা একা বারান্দায় যাব?

ছোট কাকু কিছু বলার আগেই ঝন ঝন করে টেলিফোন বেজে হাসপাতাল থেকে টেলিফোন করেছে। ছোট কাকু নীলুকে কি ছুঁই বললেন না। তবু নীলু বুঝল মায়ের অসুখ খুব বেড়েছে। সে ভয়ে ভয়ে বলল, গল্পটা বলবে না কাকু?

কোন গল্প?

ঐ যে, মামদো ভূতের গল্প? ছোট কাকু হাত নেড়ে বললেন, আরে পাগলি, ভূত বলে আবার কিছু আছে। নাকি! সব বাজে কথা।

বাজে কথা?

হ্যাঁ, খুব বাজে কথা। ভূত–প্রেত বলে কিছু নেই। সব মানুষের বানানো গল্প।

তুমি ভূত ভয় করো না কাকু?

আরে দূর। ভূত থাকলে তো ভয় করব!

এই বলেই ছোট কাকু আবার গম্ভীর হয়ে পড়লেন।

নীলুকে সবাই বলে ছোট মেয়ে ছোট মেয়ে। কিন্তু সে সব বুঝতে পারে। ছোট কাকুর হঠাৎ গম্ভীর হওয়া দেখেই সে বুঝতে পারছে মায়ের খুব বেশি অসুখ। নীলুর খুব খারাপ লাগতে লাগল। এত খারাপ যে, চোখে পানি এসে গেল। ছোট কাকু অবিশ্যি দেখতে পেলেন না–কারণ তার কাছে আবার টেলিফোন এসেছে। নীলু শুনতে পেল ছোট কাকু বললেন–

হ্যালো। হ্যাঁ হ্যাঁ।

এ তো দারুণ ভয়ের ব্যাপার।

হ্যাঁ, নীলু ভাত খেয়েছে।

দিচ্ছি, এক্ষুনি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।

আচ্ছা আচ্ছা।

টেলিফোন নামিয়ে রেখেই ছোট কাকু বললেন, ঘুমুতে যাও নীলু।

নীলু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, মার কী হয়েছে কাকু?

কিছু হয়নি রে বেটি।

মা কখন আসবে?

কাল ভোরে এসে যাবে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুম ভাঙতেই দেখবে মা এসে গেছেন।

নীলুর ঘরটি মার ঘরের মধ্যেই। শুধু পারটেক্সের দেয়াল দিয়ে করা। নীলু এখন বড় হয়েছে, তাই একা শোয়। তার একটুও ভয় করে না। তা ছাড়া সারা রাত মা কতবার এসে খোঁজ নিয়ে যান। নীলুর গায়ের কম্বল টেনে দেন। কপালে চুমু খান। কিন্তু আজ নীলু একা। ছোট কাকু বললেন, ভয় লাগবে না তো মা? মাথার কাছের জানালা বন্ধ করে দেব?

দাও।

মন? তোমার মার কোনো খবর আসে। যদি, সে জন্যে। আচ্ছা?

আচ্ছা।

তুমি পুতুল নিয়ে ঘুমুচ্ছ বুঝি নীলু?

হ্যাঁ কাকু।

ভয় পেলে আমাকে ডাকবে, কেমন?

ডাকব।

ছোট কাকু ঘরের পর্দা ফেলে চলে গেলেন। নীলুর কিন্তু ঘুম এলো না। সে জেগে জেগে ঘড়ির শব্দ শুনতে লাগল। টিক টিক টিক টিক। কিছুক্ষণ পর শুনল ছোট কাকু রেডিও চালু করে কী যেন শুনছেন। বক্তৃতাটতা হবে। তারপর আবার রেডিও বন্ধ হয়ে গেল। বারান্দার বাতি জ্বলল একবার। আবার নিভে গেল। রাত বাড়তে লাগল। নীলুর একফোঁটাও ঘুম এলো না। একসময় খুব পানির পিপাসা হলো তার। বিছানায় উঠে বসে ডাকল, ছোট কাকু, ছোট কাকু?

কেউ সাড়া দিল না। ছোট কাকুও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। নীলুর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। আর ঠিক সেই সময় নীলুর মাথার জানালায় ঠক ঠক করে কে যেন শব্দ করল। আবার শব্দ হলো। সে সঙ্গে কে যেন ডাকল।

নীলু নীঈঈঈলুউউ।

নীলুর ভীষণ ভয় লাগলেও সে বলল, কে?

আমি। জানালা খোলো।

নীলু দারুণ অবাক হয়ে গেল। জানালার ওপাশে কে থাকবে? সেখানে তো দাঁড়াবার জায়গা নেই। নীলু বলল,

কে আপনি?

আমি ভূত। জানালা খোলো মেয়ে।

নীলুর একটু একটু ভয় করছিল। তবু সে জানালাটা খুলে ফেলল। বাইরে ফুটফুটে জ্যোস্না। গাছের পাতা চিকমিক করছে। নীলু অবাক হয়ে দেখল ফুটফুটে জ্যোস্নায় লম্বা মিশমিশে কালো কী একটা জিনিস যেন বাতাসে ভাসছে। ওমা, ভূতের মতোই তো লাগছে। ভূতটি বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি মা?

নীলু কোনোমতে বলল, না, পাচ্ছি না তো।

বেশ বেশ। বড় মানুষেরা ভূত দেখলে যা ভয় পায়? এতক্ষণে হয়তো ফিট হয়ে উল্টে পড়ত। তুমি তো বাচ্চামেয়ে। তাই ভয় পাওনি।

নীলু গম্ভীর হয়ে বলল, কে বলল আমি বাচ্চামেয়ে? আমি অনেক বড় হয়েছি।

ভূতটি খলবল করে হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না। একসময় হাসি থামিয়ে বলল, অনেক বড় হয়েছ তুমি, হা হা।

নীলু বলল, ভেতরে আসো তুমি। বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? নীলুর এই কথায় ভূতটি রেগে গিয়ে বলল, তুমি করে বলছ কেন আমাকে? বড়দের আপনি করে বলতে হয় না?

নীলু লজ্জা পেয়ে বলল, ভেতরে আসুন আপনি।

ভূতটি সুট করে ঢুকে পড়ল ঘরে। ওমা কী লম্বা, আর কী মিশমিশে কালো। রঙ! এত বড় বড় চোখ।  দাঁত বের করে খুব খানিকক্ষণ হেসে সে বলল, আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছ না তো মা?

নীলুর তখন একটুও ভয় লাগছে না। ভূতটি অবিশ্যি দেখতে খুব বাজে। গল্পের বইয়ে যেসব ভূত-প্রেতের ছবি থাকে, তার চেয়েও বাজে। তবু ভূতটা এমন আদর করে কথা বলতে লাগল যে নীলুর ভয়ের বদলে খুব মজা লাগল। নীলু বলল, আমি ভয় পাইনি, সত্যি বলছি, একটুও না। আপনি ওই চেয়ারটায় বসুন।

ভূতটা আরাম করে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। পকেট থেকে কলাপাতার রুমাল বের করে ঘাড় মুছতে মুছতে বলল, খুব পরিশ্রম হয়েছে। বাতাসের উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম কিনা, তাই। তোমার ঘরে কোনো ফ্যান নেই মা? যা গরম।

জ্বি না, আমার ঘরে নেই। মার ঘরে আছে।

ভূতটা রুমাল দুলিয়ে হওয়া খেতে লাগল। একটু ঠাণ্ডা হয়ে বলল, তোমার কাছে একটা জরুরি কাজে এসেছি গো মেয়ে।

কী কাজ?

আর বোলো না মা। আমার একটি বাচ্চামেয়ে আছে, ঠিক তোমার বয়সী। কিন্তু তোমার মতো লক্ষ্মী মেয়ে নয় সে। ভীষণ দুষ্ট। দুদিন ধরে সে শুধু কান্নাকাটি করছে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ।

নীলু অবাক হয়ে বলল, ওমা, কী জন্যে?

সে চায় মানুষের মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে। এমন কথা শুনেছ কখনো? মেয়েটার মাথাই খারাপ হয়ে গেছে বোধ হয়। ভূতটা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়তে লাগল। নীলু বলল,

আহা, তাকে নিয়ে এলেন না কেন? আমার সঙ্গে ভাব করতে পারত।

ভূতটা বিরক্ত হয়ে বলল, এনেছি তাকে। তার আবার ভীষণ লজ্জা। ভেতরে আসবে না।

কোথায় আছে সে?

জানালার ওপাশে বাতাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেই তখন থেকে।

ভূতটা গলা উচিয়ে ডাকল, হইয়ু, হ-ই-যু।

জানালার ওপাশ থেকে কে একজন চিকন সুরে বলল, কী বাবা?

ভেতরে আয় মা।

না, আমার লজ্জা লাগছে।

নীলু বলল, লজ্জা কী, এসো। আমার সঙ্গে ভাব করবে।

জানালার ওপাশ থেকে ভূতের মেয়ে বলল,

তুমি এসে নিয়ে যাও।

নীলু জানালা দিয়ে  উঁকি দিয়ে দেখে ভূতের ছোট্ট মেয়েটি একা একা বাতাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তার এমন লজ্জা যে নীলুকে দেখেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। নীলু হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে এসে মিষ্টি করে বলল, তোমার নাম কী ভাই ভূতের মেয়ে?

হইয়ু আমার নাম। তোমার নাম নীলু, তাই না?

উহুঁ, আমার নাম নীলাঞ্জনা। বাবা আদর করে ডাকেন নীলু।

হইয়ুর বাবা বললেন,

কী রে পাগলি, ভাব হলো নীলুর সঙ্গে?

হ্যাঁ।

মানুষের মেয়েকে কেমন লাগল রে বেটি?

খুব ভালো। বাবা একটা কথা শোনো?

বল।

নীলুকে আমাদের বাসায় নিয়ে চলো বাবা।

বলিস কী! কী আজগুবি কথাবার্তা।

না বাবা, নিয়ে চলো। আমাদের সঙ্গে তেতুলগাছে থাকবে।

কী রকম পাগলের মতো কথা বলে!

হইয়ু ফিচফিচ করে কাঁদতে শুরু করল। হইয়ুর বাবা রেগে গিয়ে বলল,

আরে পাগলি মেয়ে, মানুষের মেয়ে বুঝি আমাদের মতো তেতুলগাছে থাকতে পারে? বৃষ্টি হলেই তো ভিজে সর্দি লেগে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।

হোক নিউমোনিয়া, ওকে নিতে হবে।

হইয়ুর কাঁদা আরও বেড়ে গেল। নীলু খুব মিষ্টি করে বলল,

আমি চলে গেলে আমার মা যে কাঁদবে ভাই।

এই কথায় মনে হলো হইয়ুর মন ভিজেছে। সে পিটপিট করে তাকাল নীলুর দিকে। হইয়ুর বাবা বলল, আহ্লাদি করিস না হইয়ু। নীলুর সঙ্গে খেলা কর।

নীলু বলল, কী খেলবে ভাই ভূতের মেয়ে? পুতুল খেলবে? নীলু তার জন্মদিনের পুতুল বের করে আনল। হইয়ুকে বলল, এর নাম সোনামণি, তুমি সোনামণিকে কোলে নেবে হইয়ু?

হইয়ু হাত বাড়িয়ে পুতুল নিল। হইয়ু নেজে কখনও এত সুন্দর পুতুল দেখেনি। সে হা করে পুতুলের দিকে তাকিয়ে রইল। হইয়ুর বাবাও মাথা নেড়ে বারবার বলল, বড় সুন্দ! বড় সুন্দর! দেখিস হইয়ু, ভাঙিস না আবার।

এই কথায় হইয়ু জিভ বের করে তার বাবাকে ভেংচি কাটল। হইয়ুর বাবা বলল, দেখলে নীলু, কেমন বেয়াদব হয়েছে? এই হইয়ু, থাপ্পড় খাবি। পাজি মেয়ে।

হইয়ু তার বাবার দিকে ফিরেও তাকাল না। পুতুল নিয়ে তার কী আনন্দ অন্যদিকে মন দেয়ার ফুরসত নেই। হইয়ুর বাবা বলল, নীলু মা, তোমরা গল্পগুজব করো। আমি পাশের ঘরে একটু বসি। দারুণ ঘুম পাচ্ছে।

নীলু চমকে উঠে বলল, ওমা, ওই ঘরে ছোট কাকু বসে আছে যে! আপনাকে দেখে ছোট কাকু ভয় পাবে।

ভয় পাবে নাকি?

নীলু মাথা নেড়ে বলল, হু, পাবে। ছোট কাকু অবশ্য বলে, ভূত-টুত কিছু নেই। মানুষের বানানো সব। তবু আমি জানি আপনাকে দেখে সে ভয় পাবে।

ভূত এ কথা শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইল।

শেষে বলল, তোমার ছোট কাকু ভূত বিশ্বাস করে না?

জি না।

একটুও না?

উহুঁ।

আচ্ছা দেখাচ্ছি মজা।

নীলু ভয়ে পেয়ে বসল, না না, ছোট কাকু খুব ভালো। সত্যি বলছি।

ভূতটা হাসিমুখে বলল, বেশি ভয় দেখাব না নীলু। অল্প, খুব অল্প। দেখবে কেমন মজা হয়।

নীলু কী আর করে। খানিকক্ষণ ভেবেটেবে রাজি হয়ে গেল। ভূতটা হইয়ুকে বলল, হইয়ু মা, নীলুর খাটের নীচে বসে থাক। নীলুর কাকা যদি ভয় পেয়ে এ ঘরে আসেন তবে তোকে দেখে আরও ভয় পাবেন।

এই বলে ভূত পর্দা সরিয়ে চলে গেল পাশের ঘরে। আর হইয়ু বলল, নীলু, তোমার পুতুলটা নিয়ে যাই সঙ্গে?

আচ্ছা যাও।

নীলুর কথা শেষ হবার আগেই ও-ঘর থেকে একটা চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ হলো। তারপর শোনা গেল ছোট কাকু চেঁচিয়ে বললেন,

এটা কী আরে এটা কী!

ধড়মড় করে শব্দ হলো একটা। আর ছোট কাকু হাপাতে হাপাতে দৌড়ে এলেন নীলুর ঘরে। চেঁচিয়ে ডাকলেন, নীলু, ও নীলু।

কী হয়েছে কাকু?

ন, কিছু না। কিছু না।

ছোট কাকু রুমাল দিয়ে ঘন ঘন ঘাড় মুছতে লাগলেন। তারপর পানির জগটা দিয়ে ঢকঢক করে এক জগ পানি খেয়ে ফেললেন। নীলু খুব কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, ভয় পেয়েছ কাকু?

ছোট কাকু থতমত খেয়ে বললেন, ভয়? হ্যা তা …। না না ভয় পাব কেন?

নীলু খিলখিল করে হেসে ফেলল। ছোট কাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, হাসছ কেন নীলু?

নীলু হাসি থামিয়ে বলল, কাকু তুমি কখনো ভূত দেখেছ? কাকু দারুণ চমকে বললেন, ভূতের কথা এখন থাক নীলু।

এই বলেই তিনি ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। আর তখনই টেলিফোন বেজে উঠল। কাকু বললেন,

হাসপাতাল থেকে টেলিফোন এসেছে রে নীলু। আমি যাই।

নীলু শুনল কাকু বলছেন, হ্যালো, কী বললেন? অবস্থা ভালো না? তারপর? ও আচ্ছা। এ-গ্রুপের রক্ত পাচ্ছেন না? হ্যালো হ্যালো!

এতক্ষণ নীলুর মার কথা মনেই পড়েনি নীলুর। এখন মনে পড়ে গেল। আর এমন কান্না পেল তার হইয়ুর বাবা ঘরে ঢুকে দেখে নীলু বালিশে মুখ গুঁজে খুব কাঁদছে। হইয়ুর বাবা খুব নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা?

নীলু কথা বলল না আরো বেশি কাঁদতে লাগল।

কী হয়েছে লক্ষ্মী মা? হইয়ু তোমাকে খামছি দিয়েছে?

নীলু ফোফাতে ফোফাতে বলল, নো।

পেটব্যথা করছে?

উহুঁ। তবে কী হয়েছে মা?

বলো লক্ষ্মী মা।

নীলু ফোফাতে ফোফাতে বলল, মার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।

কোথায় তোমার মা? হাসপাতালে।

নীলু তার মার অসুখের কথা বলল। ভূতটি নীলুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বারবার বলতে লাগল, আহা, বড় মুশকিল তো! কী করা যায়।

সে রুমাল দিয়ে নীলুর চোখ মুছিয়ে দিল।

ব্যাপার দেখে হইয়ু খুব ভয় পেয়ে গেল। সে আর খাটের নীচ থেকে বেরুলই না। একবার মাথা বের করে নীলুকে কাঁদতে দেখে সুড়ৎ করে মাথা নামিয়ে ফেলল নীচে। পুতুল নিয়ে খেলতে লাগল আপন মনে।

হইয়ুর বাবা কিছুতেই নীলুর কান্না থামাতে না পেরে বলল, এক কাজ করা যাক, আমি দেখে আসি তোমার মাকে, কেমন?

আপনাকে দেখে যদি মা ভয় পায়?

ভয় পাবে না। আমি বাতাস হয়ে থাকব কিনা! দেখতে পাবে না আমাকে। বলতে বলতেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নীলু চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, হইয়ু, আমার একা একা একটুও ভালো লাগছে না। তুমি আসো।

হইয়ু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নীচ থেকে বেরুল। নীলু অবাক হয়ে দেখে তার সুন্দর পুতুলটা হইয়ুর হাতে। কিন্তু পুতুলটার মাথা নেই। শুধু শরীর আছে। নীলু ভীষণ অবাক হয়ে বলল, হইয়ু ভাই, আমার পুতুলের মাথাটা কোথায়?

হইয়ু কোনো কথা বলে না। এদিক-ওদিক চায়। নীলু বলল, বলো হইয়ু। ভেঙে ফেলেছ?

না।

তবে কী হয়েছে?

হইয়ু লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলল। কোনোমতে ফিসফিস করে বলল, খুব খিদে লেগেছিল, তাই খেয়ে ফেলেছি। তুমি রাগ করেছ নীলু?

নীলুর অবিশ্যি খুব রাগ লাগছিল। কিন্তু হইয়ুর মতো ভালো ভূতের মেয়ের উপর কতক্ষণ রাগ থাকে। তার উপর নীলু দেখল, হইয়ুর চোখ ছলছল করছে। তাই বলল, বেশি রাগ করিনি, একটু করেছি।

ওমা, এই কথাতেই হইয়ুর সে কী কান্না নীলু তার হাত ধরে তাকে এনে বসাল পাশে। তারপর বলল, কী কাণ্ড হইয়ু বোকা মেয়ের মতো কাঁদে।

এ কথাতেই হেসে উঠল হইয়ু।

খুব ভাব হয়ে গেল তাদের, সেকী হাসাহাসি দুজনের। আর হইয়ুর ডিগবাজি খাওয়ার ঘটা যদি তোমরা দেখতে নীলুকে খুশি করার জন্যে সে বাতাসের মধ্যে হেঁটে বেড়ালো খানিকক্ষণ। তারপর দুজন দুটি কোলবালিশ নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলল। কিন্তু নীলুর হলো মুশকিল। সে কোলবালিশ দিয়ে হইয়ুকে মারতে যায় আর সে বাতাস হয়ে মিলিয়ে যায়। নীলু রাগ করে বলল, উহুঁ, বাতাস হওয়া চলবে না।

নীলু তাকে দেখাল তার ছবির বই। ফুফু তাকে যে রঙপেন্সিল দিয়েছেন তা দিয়ে সে হইয়ুর চমৎকার একটি ছবি আঁকল। লাল কমল আর নীল কমলের গল্প বলল। তারপর বলল

ভাব ভাব ভাব
ভাব ভাব ভাব
নীল রঙের সিন্ধু
আমি তুমি বন্ধু

অর্থাৎ দুজন সারা জীবনের বন্ধু হয়ে গেল।

হইয়ুর বাবা যখন এলো তখন দুজনে হাত-ধরাধরি করে বসে আছে। হইয়ুর বাবা খুব খুশি হয়ে বলল, নীলু, আমার লক্ষ্মী মা কোথায়?

এই তো, এখানে। খুব ভালো খবর এনেছি তোমার জন্যে। তোমার মা ভালো হয়ে গেছেন। এখন ঘুমুচ্ছেন দেখে এসেছি।

নীলুর মনে হলো আনন্দে সে কেঁদে ফেলবে। হইয়ুর বাবা আপন মনে খানিকক্ষণ হেসে বলল, তোমার একটা ফুটফুটে ভাই হয়েছে নীলু। সেও শুয়ে আছে তোমার মার পাশে।

নীলুর কী যে ফুর্তি লাগল! এখন সে একা থাকবে না। এখন তার একটা ভাই হয়েছে। ভাইকে নিয়ে নীলু শুধু খেলবে।

দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো। গাছে কাক ডাকতে শুরু করেছে।

হইয়ুর বাবা বলল, ও হইয়ু, লক্ষ্মী মনা, ভোর হয়ে আসছে। চল আমরা যাই।

কিন্তু হইয়ু কিছুতেই যাবে না। সে ঘাড় বাকিয়ে বলতে লাগল, আমি যাব না। আমি মানুষের সঙ্গে থাকব। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।

হইয়ুর বাবা দিল এক ধমক।

হইয়ু কাঁদতে কাঁদতে বলল, তেঁতুলগাছে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব, আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।

কিন্তু সকাল হয়ে আসছে। হইয়ুর বাবাকে চলে যেতেই হবে। সে হইয়ুকে কোলে করে নিয়ে গেল আর হইয়ুর সেকী হাত পা ছোঁড়াছুড়ি, সেকী কান্না!

আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।

আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।

নীলুর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। কান্না পেতে লাগল।

তারপর কী হয়েছে শোনো। নীলুর মা কয়েক দিন পর একটি ছোটমতো খোকা কোলে করে বাসায় এসেছেন। মা হাসি মুখে বললেন, ভাইকে পছন্দ হয়েছে নীলু?

হয়েছে।

বেশ, এবার ছোট ভাইকে দেখাও, জন্মদিনে কী উপহার পেয়েছ। যাও নিয়ে। এসো।

নীলু কী আর করে, নিয়ে এলো তার মাথা নেই পুতুল। মা ভাঙা পুতুল দেখে খুব রাগ করলেন। নীলুকে খুব কড়া গলায় বললেন, নতুন পুতুলটির এই অবস্থা! দুদিনেই ভেঙে ফেলেছ? ছি ছি বলো নীলু, কী করে ভেঙেছ বলো?

নীলু কিছুতেই বলল না, চুপ করে রইল। কারণ সে জানে হইয়ু আর হইয়ুর বাবার কথা বললে মা একটুও বিশ্বাস করবেন না। শুধু বলবেন, এইটুকু মেয়ে কেমন বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলছে।

বড়রা তো কখনো ছোটদের কোনো কথা বিশ্বাস করেন না।

পানি-রহস্য

মবিন সাহেব বাগানের ফুল গাছে পানি দিচ্ছিলেন। তাঁর সামনে জয়নাল দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরেই আছে, মাঝে মাঝে খুকখুক করে কাশছে, পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে নকশা কাটছে, মুখে কিছু বলছে না। মবিন সাহেব বললেন, কিছু বলবি নাকি রে জয়নাল? জয়নাল লজ্জিত মুখে হাসল। সে অল্পতেই লজ্জা পায়।

মবিন সাহেব বললেন, আজ কাজকর্ম নেই?

জে না।

জয়নালের বয়স চল্লিশের ওপরে। বিয়ে-টিয়ে করেনি। একা মানুষ। এক কামারের দোকানে কাজ করে। হাপর চালায়, কয়লায় ফুঁ দেয়। রাতে ঐ দোকামের একপাশে চট বিছিয়ে ঘুমিয়ে থাকে।

মবিন সাহেব বছরখানিক আগে কামারের দোকানে একটা শাবল বানাতে দিয়েছিলেন। জয়নাল তাকে বসিয়ে রেখে শাবল বানিয়ে নিল। নামমাত্র দাম দিল। সেই সূত্রে পরিচয়। মবিন সাহেবের মনে হয়েছে জয়নাল অতি ভদ্র, অতি সজ্জন একজন মানুষ। একটু বোধহয় বোকা। তাতে কিছু যায়-আসে না। চালাক বদলোকের চেয়ে বোকা সজ্জন ভালো। সে ছুটিছাঁটার দিনে মবিন সাহেবের বাড়িতে আসে। কিছু বলে না, মাথা নিচু করে মেঝেতে চুপচাপ করে থাকে। মবিন সাহেব তাঁর নাতনিদের সঙ্গে গল্প-গুজব করেন, সে গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনে। আজও বোধহয় গল্প শোনার লোভেই এসেছে। মবিন সাহেব গাছের গোড়ায় পানি ঢালতে ঢালতে বললেন, কি রে জয়নাল, কিছু বলবি?

জয়নাল মাথা চুলকাতে লাগল। পায়ের বুড়ো আঙুলে নকশা কাটা আরো দ্রুত হলো। বার কয়েক খুকখুক করে কাশল।

কিছু বলার থাকলে বলে ফেল। এত লজ্জা কীসের?

ঐ গল্পটা আবার শুনতে আইছি।

মবিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন গল্প?

পানির উপরে দিয়া যে হাঁটে…

একবার তো শুনেছিস, আবার কেন?

মনটা টানে।

মবিন সাহেব তাঁর নাতনিদের টলস্টয়ের বিখ্যাত একটা গল্প বলেছিলেন। যে গল্পে কয়েক জন বেঁটে ধরনের সাধুর কথা আছে। তারা এক নির্জন দ্বীপে বাস করতো, নিজেদের মতে করে আল্লাহর নাম-গান করতো। সমুদ্রের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে যাবার অদ্ভুত ক্ষমতা তাদের ছিল। এই গল্প জয়নালও শুনেছে। বোকা মানুষ, হয়তো ভালো করে বুঝতে পারেনি। এখন ভালোমতো বুঝতে চায়।

মবিন সাহেব বললেন, বস আমার সামনে, গল্পটা আবার বলি।

জয়নাল বসল। মবিন সাহেবের কাছ থেকে খুরপাই টেনে নিয়ে মাটি কুপাতে লাগল। তাকে নিষেধ করে লাভ হবে না। সে কাজ না করে থাকতে পারে না। সে যতবার আসে এটা-সেটা করে দেয়।

মবিন সাহেব গল্প শুরু করলেন। জয়নাল নিবিষ্ট মনে শুনছে। গল্প শেষ হবার পর সে নিশ্বাস ফেলে বলল, উনারা সাধু ছিলেন?

হ্যাঁ, সাধু ছিলেন। সাধারণ মানুষ তো আর পানির ওপর হাঁটতে পারে না।

পারে না কেন স্যার?

মানুষের ওজন পানির চেয়ে বেশি। আর্কিমিডিসের একটা সূত্র আছে। তুই তো বুঝবি না। লেখাপড়া না জানলে বুঝানো মুশকিল।

জয়নাল বিনীত গলায় বলল, আমি লেখাপড়া জানি। ক্লাস থিরি পাস করছিলাম। পাঁচের ঘরের নামতা জানি।

পাঁচের ঘরের নাম জানলে হবে না, আরো পড়াশোনা জানা লাগবে।

জি আচ্ছা। স্যার আইজ উঠি।

আচ্ছা যা।

জয়নাল উঠে দাঁড়াল তবে চলে গেল না। আবারো খুকখুক করে কাশতে লাগল। মনে হচ্ছে সে আরো কিছু বলতে চায়। মবিন সাহেব বললেন, কিছু বলবি?

জয়নাল বিব্রত গলায় বলল, সাধু হওয়ার নিয়মটা কী?

কেন, তুই কি সাধু হতে চাস নাকি?

জয়নাল মাথা নিচু করে ফেলল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে সাধু হতে চায়।

মবিন সাহেব বললেন, সাধু হওয়া বড়ই কঠিন। নির্লোভ হতে হয়। পরের মঙ্গলের জন্যে জীবন উৎসর্গ করতে হয়। তারা কখনও মিথ্যা বলে না। সাধারণ মানুষ মিথ্যা না বলে থাকতে পারে না। সামান্য হলেও মিথ্যা বলতে হয়।

জয়নাল প্রায় ফিসফিস করে বলল, স্যার, আমি মিথ্যা বলি না।

ভালো। খুব ভালো।

আমার কোনো লোভও নাই।

মবিন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তুই তো তাহলে সাধুর পর্যায়ে চলেই গেছিস।

জয়নাল লজ্জা পেয়ে বলল, স্যার যাই?

আচ্ছা যা। আরে শোন শোন, একটু দাঁড়া।

মবিন সাহেব ঘর থেকে একটা পুরনো কোট এনে দিলেন। কোটের রঙ জ্বলে গেছে, হাতের কাছে পোকায় কেটেছে। তবু বেশ গরম। জয়নাল ব্যবহার করতে পারবে। মবিন সাহেব লক্ষ করেছেন এই শীতেও জয়নাল পাতলা একটা জামা পরে থাকে। খালি পায়ে হাঁটে।

জয়নাল কোট পেয়ে অভিভূত হয়ে গেল। তার চোখে পানি এসে গেল। সে নিচু হয়ে মবিন সাহেবকে কদমবুসি করল।

কোট যেদিন দিলেন সেদিন সন্ধ্যাতেই মবিন সাহেবের সঙ্গে জয়নালের আবার দেখা। কোট গায়ে দিয়ে জয়নাল একেবারে ফিটফাট বাবু। সে রাস্তার মোড়ে উবু হয়ে বসে একটা কুকুরকে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে। ফিসফিস করে কুকুরকে বলছে, খা বাবা খা। কষ্ট কইরা খা। পরের বার তোর জন্যে গোস্ত যোগাড় করব। না খাইলে শইল্যে বল হইব না।

মবিন সাহেব ধমকে দাঁড়ালেন।

কী করছিস রে জয়নাল?

কিছু না স্যার।

কুকুরকে পাঁউরুটি খাওয়াচ্ছিস, ব্যাপারটা কী?

এ স্যার হাঁটাচলা করতে পারে না। দুইটা ঠেং ভাঙা, লুলা হইয়া আছে। ঠেং-এর ওপর দিয়া গাড়ি চইল্যা গেল।

তুই কি রোজ একে খাইয়ে যাস?

মবিন সাহেব দেখলেন কুকুরটার আসলেই অন্তিম দশা। মনে হচ্ছে শুধু পা, কোমরও ভেঙেছে। নিম্ন শ্রেণীর বলেই এখনও বেঁচে আছে। মানুষ হলে মরে যেত।

জয়নাল কিছু বলল না। হাসল। মবিন সাহেব বললেন, পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে তুলে দেবার দরকার কী? সামনে ফেলে দে— নিজেই খাবে।

জি আচ্ছা।

জয়নাল পাউরুটি ফেলে মবিন সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল। মবিন সাহেব বললেন, কোটে শীত মানে?

জে স্যার, মানে।

কোট গায়ে দিয়ে খালি গায়ে হাঁটাহাঁটি ভালো দেখায় না। এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে নিস।

জে আচ্ছা।

বাসায় আসিস। পুরনো এক জোড়া জুতা দিয়ে দেব। তোর পায়ে লাগলে হয়। তোর যা গোদা পা!

জয়নাল হেসে ফেলল। গোদা পা বলায় সে মনে হলো খুব আনন্দ পেয়েছে। মবিন সাহেব বললেন, তুই আমার পেছনে পেছনে আসছিস কেন?

স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব।

জিজ্ঞেস করা।

উনাদের নাম কী স্যার?

কাদের নাম কী? পরিষ্কার করে বল।

সাধু। যারা পানির ওপর দিয়ে হাঁটে।

এখনও সেই গল্প মাথায় ঘুরছে? সাধুদের কোনো নাম দেয়া নেই, তবে যিনি এই গল্প লিখেছেন তাঁর নাম টলস্টয়। মস্ত বড় লেখক।

বড় তো স্যার হইবই। সত্য কথা লেখছে। পানির উপরে হাঁটা সহজ ব্যাপার তো না। আচ্ছা স্যার, এই দুনিয়ায় সর্বমোট কয়জন লোক আছে যারা পানির উপরে হাঁটতে পারে?

মবিন সাহেব উত্তর দিলেন না। বোকা লোকদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। উত্তর দিতে গেলে ঝামেলায় পড়তে হবে। জয়নালও উত্তরের জন্যে চাপাচাপি করল না। মবিন সাহেবকে তাঁর বাড়ির গেট পর্যন্ত আগিয়ে দিল।

এতদিন ঠাণ্ডায় চলাফেরা করে জয়নালের কিছু হয়নি। গরম কোর্ট পাবার তিন দিনের মাথায় তার ঠাণ্ডা লেগে গেল। প্রথমে সর্দি-জ্বর, তারপর একেবারে শয্যাশায়ী। খবর পেয়ে মবিন সাহেব দেখতে গেলেন। খুপড়ি ঘরের এক কোনায় সে চটের ওপর পড়ে আছে। তার গায়ে কোট। কোট পেয়েই সে যে গায়ে দিয়েছে আর বোধহয় খুলেনি। অন্যপাশে হাপরের গনগনে আগুন। এরকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পশুও থাকতে পারে না। মবিন সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, কেমন আছিস রে?

জয়নাল হাসিমুখে বলল, খুব ভালো আছি স্যার।

এই বুঝি তোর ভালো থাকার নমুনা? গায়ে জ্বর আছে?

জে না।

মবিন সাহেব জয়নালের কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন, গা পুড়ে যাচ্ছে!

চিকিৎসা কি হচ্ছে?

জয়নাল জবাব দিল না। তার মানে চিকিৎসা কিছু হচ্ছে না। অবস্থা যা তাতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। মবিন সাহেবের পক্ষে রোগী নিয়ে টানাটানি করাও সম্ভব না। তার নিজের কাজকর্ম আছে।

তোর আত্মীয়স্বজন এখানে কে আছে?

কেউ নাই স্যার।

খাওয়া-দাওয়া কে দিয়ে যায়?

চায়ের দোকানের একটা ছেলে আছে, ইয়াকুব নাম, হে দেয়। বড় ভালো ছেলে। অন্তরে খুব মুহব্বত।

ছেলেটাকে বলবি আর সঙ্গে যেন দেখা করে।

জি আচ্ছা।

চিন্তা করিস না তোর চিকিৎসার ব্যবস্থা আমি করব।

জয়নালের চোখে পানি এসে গেল। মানুষ এত ভালো হয়! সে শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বলল, স্যারের কাছে একটা আবদার ছেল।

বল কী আবদার?

ঐ গল্পটা যদি আরেকবার বলতেন। গল্পটা শোনার জন্যে মন টানতাছে।

কোন গল্প?

পানির উপরে দিয়ে যে হাঁটতো।

ঐ গল্প তো শুনেছিস, আবার কেন?

শুনতে মন চায়।

জ্বরে মরে যাচ্ছিস, গল্প শুনতে হবে না। বিশ্রাম কর। ঘুমুতে চেষ্টা কর।

জে আচ্ছা।

পরে দিয়া গুম না স্যার, ঘটনা

মবিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, জয়নাল বলল, স্যার, আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারার জন্যে পানির উপরে দিয়া হাঁটা কি আল্লাপাক নিষেধ কইরা দিছে?

নিষেধ-টিষেধ কিছু না। মানুষ পানির ওপর দিয়ে হাঁটতে পারে না, কিন্তু মাকড়সা পারে। আবার মানুষ উড়তে পারে না কিন্তু পাখি উড়তে পারে। একেক জনের জন্যে একেক ব্যবস্থা এই হলো ব্যাপার।

জয়নাল চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলল, কিন্তু স্যার, কেউ-কেউ পানির উপরে দিয়া হাঁটতে পারে।

মবিন সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, না তো। মানুষ আবার পানির ওপর দিয়ে হাঁটবে কি! তা ছাড়া তার দরকারইবা কি? মানুষের জন্যে নৌকা আছে। জাহাজ আছে।

তারপরও স্যার কেউ-কেউ পানির উপরে হাঁটে। আপনে নিজেই বলছেন।

আরে গাধা, আমি যা বলেছি সেটা হলো গল্প।

জয়নাল বিছানায় উঠে বসল। উত্তেজিত গলায় বলল, গল্প না স্যার, ঘটনা সত্য। কোনো কোনো মানুষ পানির উপরে দিয়া হাঁটতে পারে, কিছু হয় না, খালি পায়ের পাতাটা ভিজে।

চুপ করে ঘুমা তো, গাধা।

জয়নাল কাতর গলায় বলল, হাত জোড় কইরা আপনেরে একটা কথা বলি স্যার। আমি নিজেই পানির উপর দিয়ে হাঁটতে পারি। সত্যই পারি। এই কথা কোনো দিন কেউরে বলি নাই, আইজ আপনেরে বললাম। স্যার, ঘটনাটা আপনেরে বলি?

মবিন সাহেব অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, আচ্ছা আজ থাক, আরেক দিন শুনব।

আমার খুব শখ বিষয়টা আপনেরে বলি। আপনে হইলেন জ্ঞানী মানুষ, আপনে বুঝবেন। বড়ই আচানক ঘটনা।

ঘটনা আরেক দিন শুনব। আজ সময় নেই। রাতের ট্রেনে নেত্রকোনা যাব। জি আচ্ছা, স্যার।

মবিন সাহেব জয়নালের কথার কোনো গুরুত্ব দিলেন না। প্রবল জ্বরে মাথা চড়ে গিয়েছে। আবোল-তাবোল বকছে। মবিন সাহেব বললেন, জয়নাল, আমি যাচ্ছি, চায়ের দোকানের ছেলেটা আসলে পাঠিয়ে দিস। রাত দশটার আগেই যেন আসে। দশটার সময় আমি চলে যাব।

জি আচ্ছা, স্যার।

চায়ের দোকানের কোনো ছেলে মবিন সাহেবের কাছে এলো না। তিনি চলে গেলেন নেত্রকোনা। তিন দিন পার করে ফিরলেন। এসেই জয়নালের খোঁজ নিলেন। সে আগের জায়গায় নেই। জ্বর প্রবল হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

কামারশালার মালিক সতীশ বলল, অবস্থা সুবিধার না। শ্বাসকষ্ট হইতেছে।

মবিন সাহেব বললেন, ডাক্তার কী বলল? ওর হয়েছে কী?

নিওমোনিয়া। খুব খারাপ নিওমোনিয়া। ডাক্তার বলছে বাঁচে কিনা বাঁচে ঠিক নাই। তবে চিকিৎসা হইতেছে।

বলো কি!

স্যার, জয়নাল হইল গিয়া আফনের পাগলা কিসিমের মানুষ। শইলের কোনো যত্ন নাই। আমার এইখানে আছে দশ বছর। এই দশ বছরে তারে গোসল করতে দেখি নাই। পানির বিষয়ে তার নাকি কি আছে। সে পানির ধারে কাছে যায় না।

যায় না কেন?

কিছু বলে না, খালি হাসে। তবে স্যার, পাগল কিসিমের লোক হইলেও মানুষ ভালো। ধরেন, আমার এইখানে পইড়া ছিল পেটেভাতে। ব্যাবসাপাতি নাই, তারে কী দিমু কন। নিজেই চলতে পারি না। কিন্তু স্যার, এই নিয়া কোনো দিন একটা কথা সে আমারে বলে নাই। আমারে না জানাইয়া সে মাঝে মাঝে ইস্টিশনে কুলির কাম করতো। হেই পয়সা দিয়া তর্ক করতো জানেন স্যার?

কী করতো?

দুনিয়ার যত কাউয়ারে পাঁউরুটি কিন্যা খাওয়াইতো।

কেন?

বললাম না স্যার, পাগল কিসিমের লোক। তয় মনটা পানির মতো পরিষ্কার।

মবিন সাহেব তাকে হাসপাতালে দেখতে গেলেন। বিছানায় মরার মতো পড়ে আছে। জ্বরে আচ্ছন্ন। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুক কামারের হাপরের মতোই ওঠানামা করছে। মবিন সাহেব বললেন, কেমন আছিস রে জয়নাল?

জয়নাল অনেক কষ্টে চোখ মেলে বলল, স্যার, ভালো আছি।

ভালো আছি বলছিস কোন আন্দাজে? তুই তো মরতে বসেছিস রে গাধা।

জয়নাল থেমে থেমে বলল, আপনারে একটা ঘটনা বলব স্যার। ঘটনাটা না বললে মনটা শান্ত হইব না।

কী ঘটনা?

পানির উপরে দিয়া হাঁটনের ঘটনা। আমি স্যার সাধু না, পির-ফকিরও না, কিন্তু আমি…।

জয়নাল হাঁপাতে লাগল। তার কপাল দিয়ে টপটপ করে ঘাম পড়তে লাগল। মবিন সাহেব বললেন, এখন বিশ্রাম কর তো। তোর ঘটনা সবই শুনব।

আপনে স্যার জ্ঞানী মানুষ, আপনে শুনলে বুঝবেন। যা বলব সবই সত্য। আমি জীবনে মিথ্যা বলি নাই। আমি স্যার পানির উপরে দিয়া হাঁটতে পারি। খালি পায়ের পাতা ভিজে আর কিছু হয় না। বিরাট রহস্য স্যার…।

শুনব, তোর বিরাট রহস্য মন দিয়ে শুনব। এখন ঘুমুতে চেষ্টা কর। তোর শরীরের যে অবস্থা দেখছি…

কুত্তাটার জন্যে মনটা টানে স্যার। পাও ভাঙা, নিজে যে হাঁইট্যা-চইড়া খাইবে সেই উপায় নাই। কেউ দিলে খায়, না দিলে উপাস থাকে। বোবা প্রাণী, কাউরে বলতেও পারে না।

আচ্ছা, আমি কুকুরটার খোঁজ নিব।

আপনের অসীম মেহেরবানি।

তুই নাকি কাকদের পাউরুটি ছিঁড়ে খাওয়াস, এটা সত্যি নাকি?

জয়নাল লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। মবিন সাহেব বললেন, কাককে পাঁউরুটি খাওয়ানোর দরকার কী? ওদের তো আর খাবারের অভাব হয়নি। ওদের ডানাও ভাঙেনি।

জয়নাল বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, কাউয়ারে কেউ পছন্দ করে না। আদর কইরা কাউয়ারে কেউ খাওন দেয় না। এই ভাইব্যা…

আচ্ছা, ঠিক আছে। তুই আর কথা বলিস না। শুয়ে থাক। আমি কাল এসে আবার খোঁজ নেব।

আপনের মতো দয়ার মানুষ আমি আর এই জীবনে দেখি নাই। জয়নালের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।

.

মবিন সাহেব পরদিন তাকে আবার দেখতে গেলেন। অবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়েছে। চোখ লাল। বুক যেভাবে ওঠা-নামা করছে তাতে মনে হয় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। রাতে ডাক্তাররা অক্সিজেন দেবার চেষ্টা করেছেন। তাতে তার খুব আপত্তি। কিছুতেই সে নাকের ওপর বাটি ধরবে না। আমি বললাম, কেমন আছিস রে জয়নাল?

জয়নাল ফ্যাঁসফ্যাঁস গলায় বলল, খুব ভালো আছি স্যার। খুব ভালো। ঘটনাটা বলব?

কী ঘটনা?

পানির উপরে দিয়া হাঁটনের ঘটনা। না বইল্যা যদি মইরা যাই তা হইলে একটা আফসোস থাকব। বলি—? কাছে আইস্যা বসেন। আমি জোরে কথা বলতে পারতেছি না।

মবিন সাহেব কাছে এসে বসলেন। জয়নাল ফিসফিস করে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলতে লাগল–

ছোটবেলা থাকাই স্যার আমি পানি ভয় পাই। বেজায় ভয়। আমি কোনো দিন পুসকুনিতে নামী নাই, নদীতে নামী নাই। একবার মামারবাড়ি গিয়েছি, মামার বাড়ি হলো সান্দিকোনা–বাড়ির কাছে নদী। খুব সুন্দর নদী। আমি সন্ধ্যাকালে নদীর পাড় দিয়া হাঁটাহাঁটি করি। একদিন হাঁটতেছি— হঠাৎ শুনি খচমচ শব্দ। নদীর ঐ পাড়ে একটা গরুর বাচ্চা পানিতে পড়ে গেছে। গরু-ছাগল এরা কিন্তু স্যার জন্ম থাইক্যা সাঁতার জানে। এরা পানিতে ডুবে না। কিন্তু দেখলাম, এই বাচ্চাটা পানিতে ডুইব্যা যাইতেছে। একবার ডুবে, একবার ভাসে। পায়ের মধ্যে দড়ি পেঁচাইয়া কিছু একটা হইছে। বাচ্চাটা এক একবার ভাইস্যা উঠে আমার দিকে চায়। আমাকে ডাকে। তার ডাকের মধ্যে কী যে কষ্ট। আমার মাথা হঠাৎ আউলাইয়া গেল। আমি যে সাঁতার জারি ঘা, পানি ভয় পাই কিছুই মনে রইল না দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে বাচ্চার কাছে গিয়া উপস্থিত। পানি থাইকা বাচ্চাটারে টাইন্যা তুইল্যা দেহি আমি নিজে পানির উপরে দাঁড়াইয়া আছি। আমি নদী পার হইছি হাইট্যা, আমার পায়ের পাতাটা খালি ভিজছে। আর কিচ্ছু ভিজে নাই–এখন স্যার আপনে আমারে বলেন বিষয় কী? ঘটনা কী?

মবিন সাহেব বললেন, এরকম কি আরো ঘটেছে?।

জে না, সেই প্রথম, সেই শেষে। আর কোনো দিন আমি পানিতে নামী নাই। এখন আপনে যদি বলে আরেকবার পানিতে নাইম্যা দেখব। তয় আমি তো সাধুও না— পীর-ফকিরও না…

মবিন সাহেব বলেলেন, কে বলতে পারে! তুই হয়তো বিরাট সাধু–তুই নিজে তা জানিস না।

জয়নাল কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি স্যার সাধারণ মানুষ। অতি সাধারণ, তয় স্যার, সাধু হইতে আমার ইচ্ছা করে। খুব ইচ্ছা করে।

মবিন সাহেব বললেন, আর কথা বলিস না জয়নাল। তোর কষ্ট হচ্ছে, শুয়ে থাক।

আমার কুত্তাটারে পাইছিলেন?

খোঁজ করছি— এখনও পাইনি। পেলে ভাত খাইয়ে দেব। চিন্তা করিস না। রাতে এসে খোঁজ নিয়ে যাব।

জয়নাল হাসল। তৃপ্তির হাসি, আনন্দের হাসি।

রাতে খোঁজ নিতে এসে মবিন সাহেব শুনলেন জয়নাল মারা গেছে। মবিন, সাহেব অত্যন্ত মন খারাপ করে হাসপাতালের বারান্দায় এসে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন রাজ্যের কাক বারান্দায় লাইন বেঁধে বসে আছে। তাদের চেয়ে একটু দূরে বসে আছে কোমরভাঙা কুকুর। কীভাবে সে এতদূর এসেছে কে জানে?

মবিন সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। এই জগতে কত রহস্যই না আছে! কোনো দিন কি এইসব রহস্যভেদ হবে?

ভূত মন্ত্র

বাবলুকে একা বাসায় রেখে তার বাবা-মা ভৈরবে বেড়াতে গেছেন। সকালের ট্রেনে গেছেন, ফিরবেন রাত নটায়। এই এত সময় বাবলু একা থাকবে। না, ঠিক একা না, বাসায় কাজের বুয়া আছে।

বাবলুর খুব ইচ্ছা ছিল সেও ভৈরব যাবে। অনেক দিন সে ট্রেনে চড়ে না। তার খুব ট্রেনে চড়তে ইচ্ছা করছিল। তা ছাড়া ভৈরবে ছোট খালার বাড়িতেও অনেক মজা হবে। ছোটখালার বাড়িটা নদীর ওপরে। নিশ্চয়ই নৌকায় চড়া হবে। বাবলু অনেক দিন নৌকাতেও চড়ে না। তাকে ইচ্ছে করলেই নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু বাবলুর বাবা মনসুর সাহেব তাকে নেবেন না। তিনি চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, নো নো নো। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেড়ানো আমি পছন্দ করি না। তুমি বাসায় থাক। হোম ওয়ার্ক শেষ কর।

বাবলু ক্ষীণ গলায় বলল, হোম ওয়ার্ক শেষ করে রেখেছি।

শেষ করলে অন্য কাজ কর। দেখি অঙ্ক বই নিয়ে আস, দাগিয়ে দেই। অঙ্ক করে রাখ–ভৈরব থেকে ফিরে এসে দেখব।

বাবলু অঙ্ক বই নিয়ে এলো। মনসুর সাহেব বিশটা অঙ্ক দাগিয়ে দিলেন।

সব করবে। একটা বাদ থাকলে কানে ধরে চড়কিপাক খাওয়াব। সারা দিন আছেই শুধু খেলার ধান্ধায়।

বাবলুর চোখে পানি এসে গেল। সারা দিন সে তো খেলার ধান্ধায় থাকে। খেলাধুলা যা করার স্কুলেই করে। বাসায় ফিরে বাবার ভয়ে চুপচাপ বই নিয়ে বসে থাকে। বাবলু তার বাবাকে অসম্ভব ভয় পায়। বাবাদের কোনো ছেলেই এত ভয় পায় না–বাবলু পায়, কারণ মনসুর সাহেব বাবলুর আসল বাবা না, নকল বাবা।

বাবলুর আসল বাবার মৃত্যুর পর তার মা এঁকে বিয়ে করেন। তবে লোকটা যে খুব খারাপ তাও বলা যাবে না। বাবলুকে তিনি প্রায়ই খেলনা, গল্পের বই এইসব কিনে দেন। কিছুদিন আগে দামি একটা লেগোর সেট কিনে দিয়েছেন।

তবে বাবলুর সব সময় মনে হয় তার আসল বাবা বেঁচে থাকলে লক্ষ গুণ বেশি মজা হতো। বাবা নিশ্চয়ই তাকে ফেলে ভৈরব যেতেন না। বাবলু কোথাও যেতে পারে না। বেশির ভাগ সময় সোবহানবাগ ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলাতেই তাকে বন্দী থাকতে হয়। মাঝে মাঝে তার এমন কান্না পায়। তার কান্না দেখলে মা কষ্ট পাবেন বলে সে কাঁদে না। তার খুব যখন কাঁদতে ইচ্ছা করে তখন সে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদে। বের হয়ে আসার সময় চোখ মুছে এমনভাবে বের হয় যে, কেউ কিছু বুঝতে পারে না।

বাবলু বসার ঘরে অঙ্ক বই নিয়ে বসেছে। মনসুর সাহেব বিশটা অঙ্ক দাগিয়ে দিয়ে গেছেন। এর মধ্যে সে মাত্র একটা অঙ্ক করেছে। অঙ্কগুলি এমন কঠিন। বুয়া গ্লাস ভর্তি দুধ রেখে গেছে। দুধ খেতে হবে না খেলে সে নালিশ করবে। গ্লাসটার দিকে তাকালেই বাবলুর বমি আসছে। সে অঙ্ক করছে গ্লাসটার দিকে না তাকিয়ে। এই সময় দরজায় খট খট শব্দ হলো। বাবলু দরজা খুলে দিল। সাতআট বছর বয়েসি দুষ্টু দুষ্ট চেহারার একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। খালি পা। পরনে সাইজে বড় একটা প্যান্ট। প্যান্ট খুলে পড়ার মতো হচ্ছে আর সে টেনে টেনে তুলছে। তার গায়ে রঙিন শার্ট। শার্টের একটা বোতাম নেই। বোতামের জায়গাটা সেফটি পিন দিয়ে আটকানো। ছেলেটা বাবলুর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে বলল, এই, তুই আমার সঙ্গে খেলবি?

বাবলু কথা বলল না। ছেলেটাকে সে চিনতে পারছে না। ফ্ল্যাটেরই কারো ছেলে হবে। তবে বাবলু আগে দেখেনি। অপরিচিত একটা ছেলে তাকে তুই তুই করছে, এটাও বাবলুর ভালো লাগছে না।

কথা বলছিস না কেন? খেলবি?

না।

আমি অনেক মজার মজার খেলা জানি।

আমি খেলব না। অঙ্ক করছি।

সকালবেলা কেউ অঙ্ক করে? আয় কিছুক্ষণ খেলি— তারপর অঙ্ক করিস।

আমাকে তুই তুই করে বলছ কেন?

বন্ধুকে তুই তুই করে বলব না? বন্ধুকে বুঝি আপনি আপনি করে বলব?

আমি তোমার বন্ধু না।

বন্ধু না! এখন হবি। ঐ গ্লাসটায় কি দুধ নাকি?

হুঁ।

তোকে খেতে দিয়েছে?

হুঁ। খেতে ইচ্ছা করছে না?

না।

দুধটাকে পেপসি বানিয়ে তারপর খা।

পেপসি কীভাবে বানাব?

মন্ত্র পড়লেই হয়। এর মন্ত্র আছে। মন্ত্র জানিস না?

রাগে বাবলুর গা জ্বলে যাচ্ছে। কী রকম চালবাজের মতো কথা! মন্ত্র পড়লেই দুধ নাকি পেপসি হয়ে যাবে। মন্ত্র এতই সস্তা?

আমি মন্ত্র জানি। মন্ত্র পড়ে পেপসি বানিয়ে দেব?

দাও।

যদি দেই তাহলে কি তুই খেলবি আমার সঙ্গে?

হুঁ।

ছেলেটা ঘরে ঢুকল। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী যেন বলে গ্লাসে ফুঁ দিল— বাবলু দেখল, দুধ দুধের মতোই আছে। আগের মতোই কুৎসিত। সর ভাসছে।

ছেলেটা বলল, দেখলি দুধ কেমন পেপসি বানিয়ে দিলাম, কঠিন মন্ত্র— তোকে শিখিয়ে দেব। এই মন্ত্র দিয়ে খাবার জিনিস বদলে ফেলা যায়। মনে কর তোকে ছোট মাছ দিয়ে ভাত দিয়েছে। ছোট মাছ খেতে ইচ্ছা করছে না। মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিবি ছোট মাছ হয়ে যাবে মুরগির রান। তুই মুরগির রান খাস, না বুকের মাংস?

বাবলু বলল, দুধ তো আগের মতোই আছে। একটুও বদলায়নি।

দেখাচ্ছে দুধের মতো কিন্তু এর স্বাদ এম পেপসির মতো। খুব ঝাঁঝ। এক চুমুক খেলেই টের পাবি। একটা চুমুক দিয়ে দেখ।

ছেলেটা কি তাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে? বাবলুর রাগ লাগছে। কেউ তাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করলে তার রাগ লাগে। ছেলেটা বলল, আমার দিকে এমন রাগী চোখে তাকিয়ে আছিস কেন? একটা চুমুক দিয়ে দেখ।

বাবলু দুধের গ্লাস হাতে নিল। এক চুমুক খেয়ে দেখা যাক। ক্ষতি তো কিছু নেই। ছেলেটা যেভাবে বলছে তাতে দুধ বদলে গিয়ে পেপসি হয়েও তো যেতে পারে!

বাবলু চুমুক দিল। চুমুক দিয়েই থু করে ফেলে দিল। দুধ দুধের মতোই আছে তার মুখের ভেতর দুধের সঙ্গে এক গাদা সরও ঢুকে গেছে। এই ছেলে দেখি মহাত্যাদড়। তাকে খুব বোকা বানাল।

ছেলেটা বলল, পেপসি হয়নি?

না।

সময় লাগবে। দিনের বেলা মন্ত্র চট করে লাগে না। দুধের গ্লাসটা এক কোণােয় রেখে দে কিছুক্ষণ পর দেখবি দুধ বদলে পেপসি হবে। এখন আয় আমরা খেলি। বেশিক্ষণ খেলব না। অল্প কিছুক্ষণ খেলে আমি চলে যাব।

আমি খেলব না। আমাকে অঙ্ক করতে হবে। তা ছাড়া তুমি মিথ্যাবাদী, মিথ্যাবাদীর সঙ্গে আমি খেলি না।

আমি মিথ্যাবাদী তোকে কে বলল? দুধটা বদলাতে সময় লাগছে— বললাম না, গরমের সময় মন্ত্র সহজে ধরে না।

তুমি চলে যাও। আমার অঙ্ক শেষ করতে হবে।

কঠিন অঙ্ক?

হুঁ কঠিন।

খুব কঠিন?

হুঁ। খুব কঠিন।

কঠিন অঙ্ক সহজ করার একটা মন্ত্র আছে। সেটা শিখিয়ে দিব? যে-কোনো কঠিন অঙ্কের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রটা পড়ে দুবার ফুঁ দিলেই অঙ্ক সহজ হয়ে যাবে, চট করে করতে পারবি। দেব শিখিয়ে?

তুমি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছ কেন? তুমি কি ভেবেছ আমি বোকা? আমি মোটেই বোকা নই।

মন্ত্র শিখবি না?

না শিখব না। আর শোনো আমাকে তুই তুই করবে না।

ছেলেটা ফিসফিস করে বলল–তুই এমন রেগে আছিস কেন? রাগ করা তো ভালো না। আচ্ছা শোন, রাগ কমাবার মন্ত্র আমার কাছ থেকে শিখবি? এই মন্ত্রটা খুব সহজ। হাত মুঠো করে এই মন্ত্র একবার পড়লেই রাগ কমে যায়। নিজের রাগ তো কমেই আশপাশে যারা আছে তাদের রাগও কমে। মনে কর তোর বাবা খুব রাগ করেছেন—তুই হাত মুঠো করে একবার মন্ত্রটা পড়বি–দেখবি মজা। তোর বাবার সব রাগ পানি হয়ে যাবে। তাকে হাসি মুখে কোলে তুলে নিবে।

বাবলু বলল, তুমি যাও তো।

চলে যাব?

হ্যাঁ চলে যাবে এবং আর কোনো দিন আসবে না।

আচ্ছা চলে যাচ্ছি। একটা খাতা আর কলম আন—চট চট করে মন্ত্রগুলি লিখে ফেল। আমি একবার চলে গেলে আর আমাকে পাবি না।

তোমাকে আমার দরকারও নেই।

সত্যি চলে যাব?

হ্যাঁ চলে যাবে।

আচ্ছা চলে যাচ্ছি। তুই মন খারাপ করে বসেছিলি দেখে এসেছিলাম— আমি কে জানিস?

জানতে চাই না।

আমি হচ্ছি ভূত রাজার ছেলে। ভূতদের সব মন্ত্র আমি জানি। খাতাটা দে–অদৃশ হবার মন্ত্রটা লিখে রেখে যাই। চোখ বন্ধ করে তিনবার এই মন্ত্রটা পড়লেই অদৃশ্য হয়ে যাবি। আর কেউ তোকে দেখতে পাবে না।

তুমি যাও তো।

ছেলেটা মন খারাপ করে চলে গেল। বাবলু দরজা বন্ধ করে আবার অঙ্ক নিয়ে বসল। কী যে কঠিন সব অঙ্ক! বাবলু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। অঙ্ক সহজ করার কোনো মন্ত্র থাকলে ভালোই হতো।

রান্নাঘর থেকে বুয়া চেঁচিয়ে বলল, দুধ খাইছ?

বাবলু বলল, না।

তাড়াতাড়ি খাও। না খাইলে তোমার আব্বার কাছে নালিশ দিমু।

নালিশ দিতে হবে না, খাচ্ছি।

বাবলু দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। দুধ কোথায়? গ্লাস ভর্তি পেপসি। বরফের দুটা টুকরাও ভাসছে। বাবলু ভয়ে ভয়ে একটা চুমুক দিল।

হ্যাঁ সত্যি সত্যি পেপসি। কী ঝাঁঝ! মন্ত্র তাহলে সত্যি আছে?

বাবলু ছুটে ঘর থেকে বের হলো। ছেলেটাকে কোথাও পাওয়া গেল না। ফ্ল্যাটের দারোয়ান বলল, লাল শার্ট পরা একটা ছেলেকে সে শিস দিতে দিতে রাস্তার ফুটপাত ধরে এগিয়ে যেতে দেখেছে। এর বেশি সে আর কিছু জানে না।

মোবারক হোসেনের মহাবিপদ

ছেলেটা বড় যন্ত্রণা করছে।

মোবারক হোসেন হুংকার দিলেন, এ্যাঁও।

এটা তাঁর বিশেষ ধরনের হুংকার। বাচ্চারা খুব ভয় পায়। শব্দটা বেড়ালের ডাকের কাছাকাছি, আবার ঠিক বেড়ালের ডাকও নয়, বাচ্চাদের ভয় পাবারই কথা।

তবে এই বাচ্চা ভয় পাচ্ছে না। আগের মতোই লাফালাফি করছে। মনে হচ্ছে তার ধমক শুনতে পায়নি। এ যুগের টিভি-ভিসিআর দেখা বাচ্চা, এরা সহজে ভয় পায় না।

গত মাসে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলেন। সময় কাটে না। এইজন্যেই যাওয়া, অন্য কিছু না। সত্তর বছরের বুড়োরা চিড়িয়াখানায় যায় না। খানিকক্ষণ বাঁদরের লাফঝাঁপ দেখে গেলেন বাঘের খাঁচার সামনে। আলিশান এক রয়েল বেঙ্গল। দেখে যে-কোনো মানুষের পিলে চমকে যাবার কথা। আশ্চর্য কাণ্ড! ছোট বাচ্চাকাচ্চারা কেউ ভয় পাচ্ছে না। একটা আবার কান্না শুরু করে দিয়েছে, সে বাঘের লেজ ধরতে চায়। বাবা- মা শত চেষ্টাতেও কান্না সামলাতে পারছেন না। মিষ্টি মিষ্টি করে মা বুঝানোর চেষ্টা করছে।

বাঘমামার লেজে হাত দিতে নেই। বাঘমামা রাগ করবে।

হাত দেব। হাত দেব। উঁ উঁ।

মোবারক হোসেন সাহেব সত্তর বছর বয়সে একটা জিনিস বুঝে গেছেন— এ যুগের ছেলেমেয়ে বড়ই ত্যাঁদর। এরা ভূতের গল্প শুনলে হাসে। রাক্ষসের গল্প শুনলে হাসে। এরা ধমকেও পোষ মানে না। আদরেও পোষ মানে না।

এই যে ছেলেটা তখন থেকে তাঁকে বিরক্ত করছে একে ধমক-ধামক দিয়ে কিছু হবে বলে মনে হয় না। মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে লাফ-ঝাঁপ দিয়েই যাচ্ছে। তিনি পার্কে এসেছেন বিশ্রামের জন্যে। শীতকালের রোদে পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকতে বড় ভালো লাগে। শীতকালে পার্কে বিশ্রামের নিয়ম হলো, শরীরটা থাকবে রোদে, মাথাটা থাকবে ছায়ায়। ঘুম ঘুম তন্দ্রা অবস্থায় কিছুক্ষণ গা এলিয়ে পড়ে থাকা।

তাঁর যে বাড়িতে জায়গা নেই তা না। নিজের দোতলা বাড়ি আছে মগবাজারে কিন্তু সেই বাড়ি হলো মাছের বাজার। দিনরাত ক্যাঁও ক্যাঁও ঘ্যাঁও ঘ্যাঁও হচ্ছেই। একদল শুনছে ওয়ার্লড মিউজিক। একদল দেখছে জিটিভি। এখন আবার বড় মেয়ে এসেছে তার আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে। দুটা ছেলেমেয়ে কিন্তু অসীম তাদের ক্ষমতা। দেড়শ ছেলেমেয়ে যতটা হইচই করতে পারে, এই দুজন মাশাআল্লাহ তার চেয়ে বেশি পারে। আর কী তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা! এক ভাই খাটের ওপর চেয়ার বসিয়ে তার ওপর মোড়া দিয়ে অনেক কষ্টে তার ওপর উঠে সিলিং ফ্যান ধরে ঝুলে পড়েছে, অন্য ভাই ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়েছে। এটা নাকি একটা খেলা। এই খেলার নাম, হেলিকপ্টার খেলা। যে বাড়িতে হেলিকপ্টার খেলা হচ্ছে সবচেয়ে কম বিপজ্জনক খেলা সে বাড়িতে দুপুরে বিশ্রাম নেয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তিনি কদিন ধরেই পার্কের বেঞ্চিতে এসে কাত হচ্ছেন। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এখানেও বিশ্রাম নেয়া যাবে না। এই পিচকা বড়ই যন্ত্রণা করছে!

মোবারক হোসেন সাহেব উঠে বসলেন। কঠিন গলায় ডাকলেন, এই পিচকা, এদিকে শুনে যা।

ছেলেটা চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে। তুই করে বলায় রাগ করেছে বলে মনে হয়। একালের ছেলেপুলের আত্মসম্মান জ্ঞান আবার টনটনে। তুই বলে পার পাবার উপায় নেই। ক্যাঁও করে ওঠার কথা।

ছেলেটা নরম গলায় বলল, আপনি কি আমাকে ডাকছেন?

হুঁ।

সে এগিয়ে এলো। বেঞ্চিতে তার পাশে বসল। বাহ, স্মার্ট ছেলে তো! এ যুগের ছেলেদের একটা গুণ আছে। এরা স্মার্ট। মোবারক হোসেন সাহেব লক্ষ করলেন ছেলের চেহারা খুব সুন্দর। দুধে-আলতায় রঙ বলতে যা বোঝায়, তাই। কোঁকড়ানো চুল। বড় বড় চোখ। চোখে মা বোধহয় কাজল দিয়েছে। সুন্দর লাগছে। এ-রকম সুন্দর একটা ছেলেকে তুই বলা যায় না। মোবারক হোসেন ঠিক করলেন তুমি করেই বলবেন। প্রথম খানিকক্ষণ ছোটখাটো দু’ একটা প্রশ্ন-টশ্ন করে শেষটায় কড়া করে বলবে, দুপুরবেলায় পার্কে ঘোরাঘুরি করছ কেন? বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে হোমটাস্ক কর। কিংবা মার পাশে শুয়ে ঘুমাও। এখন খেলার সময় না। খেলতে হয় বিকেলে।

ছেলেটা পা দুলাতে দুলাতে বলল, আমাকে কী জন্যে ডেকেছেন?

তোমার নাম কী?

আমার নাম হলো শীশী।

শীশী!

মোবারক হোসেন সাহেবের মুখটা তেতো হয়ে গেল। আজকালকার বাবামারা ছেলেমেয়েদের নাম রাখার ব্যাপারে যা শুরু করেছে কহতব্য নয়। শীশী কোনো নাম হলো? আধুনিক নাম রাখতে হবে, আনকমন নাম রাখতে হবে। এমন নাম যে নামের দ্বিতীয় কোনো বাচ্চা নেই। কাজেই শীশী ফীফী।

মোবারক হোসেন সাহেব বললেন, কে রেখেছে এই নাম? তোমার মা?

জি না, আমার বাবা।

মোবারক হোসেন সাহেব এই আশঙ্কাই করেছিলেন। উদ্ভট নাম রাখার ব্যাপারে মাদের চেয়ে বাবাদের আগ্রহই বেশি। অন্যদের দোষ দিয়ে কি হবে, তাঁর নিজের বাড়িতেই এই অবস্থা। তাঁর মেজ মেয়ের ছেলে হয়েছে। নাম রেখেছে নু। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী রকম নাম?

মেয়ে বলল, ছেলের বাবা শখ করে রেখেছে।

এর অর্থ কী?

অর্থ আমি জানি না বাবা। তুমি তোমার জামাইকে জিজ্ঞেস কর।

তিনি ঠিকই জিজ্ঞেস করলেন। কঠিন গলায় জানতে চাইলেন, তুমি এই নামটা আমাকে ব্যাখ্যা কর। কী ভেবে তুমি এই নাম রাখলে?

তাঁর মেয়ে-জামাই খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল, ন হচ্ছে একটা কোমল বর্ণ। সেই কোমল বর্ণ ব্যবহার করে এক বর্ণের একটা নাম রেখেছি নু। সবাই দু অক্ষরের তিন অক্ষরের নাম রাখে। আমার ভালো লাগে না। নু নামটা আপনার কাছে ভালো লাগছে না?

তিনি কোনো উত্তর দিলেন না, তবে মনে-মনে বললেন, ন ছাড়াও তো আরো সুন্দর সুন্দর বর্ণ আছে। গ ও তো সুন্দর বর্ণ। গ দিয়ে গু রেখে ফেললে আরো ভালো হতো। মানুষের নাম হিসেবে খুব আনকমন হতো। এর আগে এই নাম কেউ রাখেনি। তবে মুখে কিছু বললেন না। এমনিতেই জামাইরা তাঁকে পছন্দ করে না। কী দরকার।

শীশী তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এখনো তার পা দুলছে। মনে হয় স্থির হয়ে বসতে পারে না। এখনই একে একটা কড়া ধমক দেবেন কিনা মোবারক হোসেন সাহেব বুঝতে পারছেন না। ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলবে কিনা কে জানে। কাঁদলে সমস্যা হবে।

ছেলেটা বলল, আপনি আমার সঙ্গে খেলবেন?

মোবারক হোসেন ছেলের স্মার্ট ভঙ্গি দেখে মুগ্ধ হলেন।

আমার সঙ্গে খেলতে চাও?

হুঁ।

কী খেলা?

আপনি যে খেলা জানেন সেই খেলাই খেলব। আপনি কোন কোন খেলা জানেন।

আমি অনেক খেলাই জানি, যেমন ধর হেলিকপ্টার খেলা…

মজার খেলা?

মনে হয় বেশ মজার। আমি সিলিং ফ্যান ধরে ঝুলে পড়ব, আর তুমি ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দেবে।

ছেলেটা মহাউৎসাহের সঙ্গে বলল, আসুন খেলি।

এখানে সিলিং ফ্যান নেই, এই খেলা খেলা যাবে না।

ছেলেটা হতাশ গলায় বলল, আর কী খেলা জানেন?

প্যারাসুট খেলা বলে একটা খেলা আছে। আমার দুই নাতি একবার খেলেছে। এটাও মন্দ না। এই খেলাতে একটা ভোলা ছাতার হাতল ধরে গ্যারাজের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামতে হয়।

খুব মজার খেলা?

মোটামুটি মজার তবে সামান্য সমস্যা আছে। হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে কিছুদিন থাকতে হয়। বড় নাতিটা প্রায় এক মাসের মতো ছিল।

ছেলেটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। মোবারক হোসেন সাহেবের একটু মায়া হলো। বাচ্চা মানুষ খেলতে চাচ্ছে, খেলার বন্ধু পাচ্ছে না।

শোন খোকা! বিকেলে আসবে, তখন বাচ্চাকাচ্চারা থাকবে, ওদের সঙ্গে খেলবে। দুপুরবেলা খেলার সময় না।

দুপুরবেলা কীসের সময়?

দুপুর হচ্ছে হোম ওয়ার্ক করার সময়, কিংবা মার পাশে শুয়ে ঘুমুবার সময়।

ছেলেটা গম্ভীর হয়ে অবিকল বড়দের মতো বলল, ও আচ্ছা, আমি জানতাম না। আমি তো মানুষের ছেলে না, আমি হচ্ছি পরীদের ছেলে। এইজন্যে মানুষের নিয়মকানুন জানি না।

তুমি পরীদের ছেলে?

জি।

মোবারক হোসেন এই ছেলের বানিয়ে কথা বলার ক্ষমতায় চমৎকৃত হলেন। এ ছেলে বড় হলে নির্ঘাৎ কোনো রাজনৈতিক দলের লিডার হবে। দিব্যি বলে যাচ্ছে— আমি মানুষের ছেলে না, আমি হচ্ছি পরীদের ছেলে। ফাজিলের ফাজিল।

তুমি যখন পরীদের ছেলে তখন নিশ্চয়ই উড়তে পার।

জি পারি।

পাখা তো দেখছি না। পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে এসেছ বোধহয়।

মার কাছে রেখে এসেছি।

মার কাছে রেখে আসাই ভালো। তুমি বাচ্চা মানুষ, হারিয়ে ফেলতে পার। কিংবা ময়লা করে ফেলতে পার। তুমি থাক কোথায়? পরীর দেশে?

ছেলে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। বানিয়ে বানিয়ে কথা যে বলে যাচ্ছে তার জন্যে তার মধ্যে কোনো রকম বিকার দেখা যাচ্ছে না। মোবারক হোসেনের ইচ্ছা করছে মিথ্যা কথা বলার জন্যে ঠাস করে এর গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে।

তোমার পায়ের জুতা তো মনে হচ্ছে বাটা কোম্পানির। পরীর দেশেও তাহলে বাটা কোম্পানি দোকান খুলেছে?

জুতা আমার মা এখান থেকে কিনে দিয়েছে। পরীর দেশের ছেলেমেয়েরা জুতা পরে না। তারা তো আকাশে আকাশেই ওড়ে, তাদের জুতা পরতে হয় না।

মোবারক হোসেন সাহেব ছেলের বুদ্ধি দেখে অবাক হলেন। সুন্দর করে নিজেকে কাটান দিয়ে যাচ্ছে। এই ছেলে রাজনৈতিক দলের নেতা হবে না, নেতাদের এত বুদ্ধি থাকে না।

তুমি তাহলে পরীদের ছেলে, এখানে বেড়াতে এসেছ?

মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে এসেছি। ওরা কত সুন্দর সুন্দর খেলা জানে।

তুমি তাহলে প্রথম পরীর বাচ্চা যে মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে এসেছে।

না তো, আমরা সব সময় আসি।

সব সময় আস?

জি। ওদের সঙ্গে খেলি তারপর চলে যাই। ওরা বুঝতে পারে না।

তাই নাকি?

জি। যখনই দেখবেন একদল ছেলেমেয়ে খেলছে তখনই জানবেন ওদের মধ্যে অতি অবশ্যই দু-একজন পরীর ছেলেমেয়ে আছে।

পাখা ছাড়া আস কী করে?

আমাদের উড়তে পাখা লাগে না। পাখাটা হচ্ছে আমাদের এক ধরনের পোশাক। জন্মদিনে আমরা নতুন পাখা পাই। আবার দুষ্টুমি করলে মারা আমাদের পাখা নিয়ে নেন। আমার কটা পাখা আছে জানেন? সব মিলিয়ে সাতটা—সেভেন।

তুমি ইংরেজিও জানো? পরীর দেশে ইংরেজি চালু আছে?

আপনি আমার সঙ্গে এমন রেগে রেগে কথা বলছেন কেন?

মোবারক হোসেন সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, দেখ খোকা–কী যেন নাম তোমার?

শীশী।

দেখ শীশী। তোমার কথা শুনে রাগে আমার শরীর রি রি করছে। এই বয়সে তুমি যে মিথ্যা শিখেছ…

আপনার ধারণা আমি মিথ্যা কথা বলছি?

অবশ্যই মিথ্যা কথা বলছ। এই মিথ্যা বলার জন্যে তোমাকে কানে ধরে উঠবস করানো দরকার।

বাহ আপনাদের মিথ্যা বলার শাস্তিটা তো খুব মজার?

কানে ধরে উঠবস তোমার কাছে মজা মনে হলো?

অবশ্যই মজার। আমরা মিথ্যা বললে কী শাস্তি হয় জানেন? আমরা মিথ্যা বললে আমাদের পাখায় কালো দাগ দিয়ে দেয়া হয়। যে যত মিথ্যা বলে তার পাখায় ততই কালো দাগ পড়ে।

মোবারক হোসেন এই ছেলের গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতায় আরো মুগ্ধ হলেন। ছেলেটা পড়াশোনায় কেমন কে জানে। ভালো হওয়া তো উচিত।

শোন খোকা— তোমার রোল নাম্বার কত? রোল নাম্বার মানে কী?

ক্লাসে যে পড় তোমার রোল কত?

আমি ক্লাসে যাই না তো। পরীর বাচ্চাদের স্কুলে যেতে হয় না। আমাদের যা শেখার আকাশে উড়তে উড়তে বাবামার কাছ থেকে শিখি…।

আমি অনেক মিথ্যুক দেখেছি, তোমার মতো দেখিনি। এই দেশের যেকোনো রাজনৈতিক নেতাকে তুমি মিথ্যা বলায় হারিয়ে দিতে পারবে।

আমি মিথ্যা বলছি না তো। এই দেখুন আমি উড়ছি…।

বলতে বলতে ছেলে তিন-চার ফুট উপর উঠে গেল। শূন্যে কয়েক বার ঘুরপাক খেল। আবার নেমে এলো নিজের জায়গায়। হাসিমুখে বলল, দেখেছেন?

মোবারক হোসেন কিছু বললেন না। তিনি দ্রুত মনে করতে চেষ্টা করলেন, সকালে কী নাশতা খেয়েছেন। অনেক সময় বদহজম হলে মানুষের দৃষ্টি বিভ্রম হয়।

আমার কথা কি আপনার বিশ্বাস হচ্ছে?

মোবারক হোসেন সাহেব এবারও জবাব দিলেন না। তার কপাল ঘামছে। পানির পিপাসা পেয়ে গেছে। শীশী বলল, আপনার সঙ্গে তো খেলা হলো না, আরেক দিন এসে খেলব। আজ যাই।

মোবারক হোসেন সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, যাবে কীভাবে? উড়ে চলে যাবে?

হুঁ।

তিনি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। তাঁর হতভম্ব চোখের সামনে দিয়ে ছেলে উড়ে চলে গেল।

বাসায় ফিরতেই তাঁর দেখা হলো বড় মেয়ের সঙ্গে। তিনি তাকে পুরো ঘটনা বললেন। বড় মেয়ে বলল, বাবা, তুমি বিছানায় শুয়ে থাক। আমি আসছি। তোমার মাথায় পানি ঢালব।

কেন?

রৌদে ঘুরে ঘুরে তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে, এইজন্যে।

তুই আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?

ওমা! কে বলল বিশ্বাস করছি না? করছি তো।

রাতের মধ্যে সবাই জেনে গেল মোবারক হোসেন সাহেবের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনে বাড়ি ভরে গেল। ডাক্তার এলেন, সাইকিয়াট্রিস্ট এলেন। হুলস্থুল ব্যাপার।

মোবারক হোসেন সাহেবের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসায় তেমন উন্নতি হচ্ছে। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন ঐদিন এক পরীর ছেলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। দুপুর হলেই তিনি পার্কে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠেন। মাঝে মাঝে চিৎকার-চেঁচামেচিও করেন। তাঁকে যেতে দেয়া হয় না। ছোট্ট একটা ঘরে তাঁকে সব সময়ই তালাবদ্ধ করে রাখা হয়।

Exit mobile version