Site icon BnBoi.Com

ময়ূখ চৌধুরীর ছোটো গল্প

ময়ূখ চৌধুরীর ছোটো গল্প

অগ্নি পরীক্ষা

১৯৪২ সাল, ৭ নভেম্বর।

পূর্বোক্ত তারিখে মধ্য আফ্রিকার নগানচু নামে এক ফরাসি উপনিবেশকে কেন্দ্র করে শুরু হচ্ছে আমাদের কাহিনি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নরমেধ যজ্ঞ চলছে দেশে দেশে। ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার সর্বত্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আগুন সর্বগ্রাসী দাবানলের মতো। কাফ্রিদের দেশ আফ্রিকাও রণদেবতার কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হল না।

আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের ওপর ফ্যাসিস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হল দুই মিত্রপক্ষ ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড। জার্মানির ফ্যাসিস্ট বাহিনি তখন ফ্রান্সে পদার্পণ করেছে, কিন্তু আফ্রিকার বুকে ছোটো ছোটো ফরাসি সৈন্যদল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড উৎসাহে। ইংরেজ ও ফরাসির আর এক বন্ধু আমেরিকা যানবাহন ও কলকবজার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কিছু লোজন পাঠিয়ে যুধ্যমান মিত্রপক্ষকে সাহায্য করেছিল।

যাদের দেশের ওপর এই ভয়াবহ তাণ্ডব চলছিল, সেই নিগ্রো নামধারী কালো মানুষরা কিন্তু কোনো পক্ষেই যোগ দেয়নি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশের সাদা মানুষরা শোষণ করেছে আর উৎপীড়ন চালিয়েছে হতভাগ্য নিগ্রোদের ওপর, আজ তারা বুঝেছে সাদা মানুষ মাত্রেই কালো চামড়ার শত্রু

অতএব আত্মকলহে দুর্বল সাদা চামড়ার মানুষগুলোকে ঘায়েল করার এই হচ্ছে উপযুক্ত সময়।

নিগ্রোরা ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্বেতাঙ্গদের ওপর।

ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি কোনো শ্বেতকায় জাতিকেই তারা নিষ্কৃতি দিল না। বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ জাতির ওপর হানা দিয়ে ফিরতে লাগল বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিগ্রো যোদ্ধার দল।

রক্ত আর আগুনের সেই ভয়ংকর পটভূমিকায় ১৯৪২ সালের ৭ নভেম্বর মধ্য আফ্রিকার ফরাসি উপনিবেশ নগানচু নামক স্থানে উত্তোলন করলাম বিস্মৃত ইতিহাসের যবনিকা।

নগানচুতে একটি ফাঁকা মাঠের ওপর যেখানে ফরাসিদের সারি সারি শিবির পড়েছে, সেইখানে খুব সকালেই শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা গেল!

চাঞ্চল্যের কারণ ছিল—

চারজন ফরাসি সৈনিক একটি বন্দিকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে নিকটবর্তী অরণ্যের দিকে!

সেনাবাহিনীর এলাকা ছাড়িয়ে একটি গাছের কাছে তারা স্থির হয়ে দাঁড়াল।

বন্দি জার্মান নয়, স্থানীয় অধিবাসী কৃষ্ণকায় নিগ্রো।

বন্দির অপরাধ গুরুতর; বিগত রাত্রে সেনানিবাসের এক প্রহরীকে সে আক্রমণ করেছিল।

আক্রমণ সফল হয়নি। লোকটি ধরা পড়েছে।

সারারাত্রি সে ছিল বন্দি শিবিরে আজ সকালে তার বিচার।

খুব তাড়াতাড়ি শেষ হল বিচার-পর্ব।

বন্দির দু-খানা হাত কবজি থেকে কেটে ফেলে ফরাসিরা তাকে মুক্তি দিলে। অবশ্য ক্ষতস্থানে ঔষধ প্রয়োগ করে তার রক্তপাত বন্ধ করা হয়েছিল–অতিরিক্ত রক্তপাতে লোকটি যাতে মারা না যায় সেইজন্যই এই ব্যবস্থা।

আহত নিগ্রোর কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল অবরুদ্ধ ক্রন্দনধ্বনি।

স্খলিত-চরণে সে পদচালনা করলে বনের দিকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই অরণ্যের অন্তরালে অদৃশ্য হল তার দেহ।

বন্দির হস্তছেদন করেছিলেন মেজর জুভেনাক স্বহস্তে।

রক্তাক্ত তরবারি খাপে ঢুকিয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করার উপক্রম করলেন, কিন্তু হঠাৎ অদূরে দণ্ডায়মান তিনটি শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের দিকে আকৃষ্ট হল তার দৃষ্টি।

ওই তিনটি মানুষের মুখের রেখায় রেখায় ফুটে উঠেছে ক্রোধ ও ঘৃণার অভিব্যক্তি!

মেজরের বিচার তাদের পছন্দ হয়নি!

মেজর জুভেনাক ভ্রূকুঞ্চিত করলেন, তোমরা আমেরিকার মানুষ; নিগ্রোদের সম্বন্ধে তোমাদের কোনো ধারণা নেই। লোকটিকে প্রাণদণ্ড দিলে স্থানীয় বাসিন্দারা এই ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যেত। কিন্তু হাতকাটা জাতভাই-এর অবস্থা দেখে ওরা ভয় পাবে, ভবিষ্যতে ফরাসিদের আক্রমণ করতে ওরা সাহস করবে না।

জুভেনাক চলে গেলেন।

নিজের ব্যবহারের জন্য কৈফিয়ত দেওয়ার অভ্যাস মেজরের ছিল না। জুভেনাক অতিশয় দাম্ভিক মানুষ। কিন্তু ওই তিন ব্যক্তি ফরাসি গভর্নমেন্টের বেতনভোগী সৈনিক নয়, ওরা আমেরিকার নৌ-সেনা। নিকটস্থ নদীর ওপর মোটর বোট এবং ছোটো ছোটো জলযানগুলি পরিদর্শন করার মতো উপযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার বা কলাকুশলী নগানচু অঞ্চলে ফরাসিদের মধ্যে ছিল না। । তারা আমেরিকার সাহায্য চেয়েছিল।

তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে জলযানগুলির তত্ত্বাবধান করতে এসেছিল আমেরিকার নৌ-বিভাগের তিনটি সৈনিক।

নৌ-বিভাগের অন্তর্গত তিন ব্যক্তির নাম–মাইক স্টার্ন, ম্যাক কার্থি এবং হ্যারিস।

পূর্ববর্ণিত রক্তাক্ত দৃশ্যের অবতারণা যেখানে হল সেখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল ওই তিনজন নৌ-সেনা। মেজর প্রস্থান করতেই হ্যারিস বন্ধুদের জানিয়ে দিলে জুভেনাকের নিষ্ঠুর আচরণ তার ভালো লাগেনি।

হ্যারিসের অপর দুই বন্ধুও তাকে সমর্থন জানিয়ে বললে যে উক্ত ফরাসি মেজরের সান্নিধ্য তারা পছন্দ করছে না।

তিন বন্ধুর ভাগ্যদেবতা অলক্ষ্যে হাসলেন।

তাদের মনস্কামনা শীঘ্রই পূর্ণ হল বটে কিন্তু জুভেনাকের সান্নিধ্য থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের মনের ভাব হয়েছিল–

যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই।
যাহা পাই তাহা চাই না..

হস্তছেদন ঘটিত ভয়াবহ ঘটনার পর একটা দিন কেটে গেল নির্বিবাদে। দ্বিতীয় দিন সকাল বেলা তিন বন্ধু দেখল, ফরাসিরা সাজসরঞ্জাম গুটিয়ে স্থান ত্যাগ করার উপক্রম করছে।

তিন বন্ধু ছুটল মেজরের কাছে ব্যাপারটা কী?

মেজর জুভেনাক জানালেন, তাঁরা এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

তিন বন্ধুর জিজ্ঞাস্য, তাদের কী হবে?

জুভেনাক রূঢ়স্বরে জানিয়ে দিলেন, আমেরিকানদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে আসতে বলেননি, অতএব তারা কী করবে-না-করবে সে-বিষয়ে চিন্তা করে মস্তিষ্ককে ঘর্মাক্ত করতে তিনি রাজি নন–তারা যা খুশি তাই করতে পারে।

এই প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করে জুভেনাক সসৈন্যে প্রস্থান করলেন। তিন বন্ধু নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলে তাদের অবস্থা মোটেই আনন্দজনক নয়।

মাইক বললে, আমরা ফাঁদে পড়েছি। নদীর বিপরীত দিকে ঘাঁটি নিয়েছে জার্মান সৈন্য আর জঙ্গলের ভিতর ওত পেতে বসে আছে নিগ্রোরা। রক্তপিপাসু ফরাসি মেজর আর শান্তিপ্রিয় আমেরিকার মানুষের মধ্যে নিগ্রো যোদ্ধারা তফাত খোঁজার চেষ্টা করবে না সুযোগ পেলেই ওরা আমাদের হত্যা করবে। অতএব আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে, যেকোনো সময়েই নিগ্রোরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

ফরাসিদের পরিত্যক্ত শিবিরগুলো পর্যবেক্ষণ করে তারা জানতে পারল যে খাদ্য ও পানীয়ের অভাব তাদের হবে না। প্রচুর পরিমাণে শুকনো খাদ্য জমানো রয়েছে বায়ুশূন্য টিনের পাত্রে।

আর আছে বীয়ার জাতীয় সুরার অসংখ্য বোতল।

অস্ত্রশস্ত্রের অবস্থাও খুব নৈরাশ্যজনক নয়।

কলের কামান প্রভৃতি ভারি অস্ত্র না-থাকলেও রাইফেল ছিল। গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় নেই–অজস্র টোটা রেখে গেছে ফরাসি সৈন্য। তা ছাড়া আছে পিস্তল, রিভলভার ও অনেকগুলো গ্রেনেড বা হাতবোমা।

যে-ঘরটায় খাদ্য ও পানীয় ছিল সেই ঘরে তারা তালা লাগিয়ে দিলে। সন্ধ্যার পর পানাহার শেষ করে তারা আশ্রয় গ্রহণ করলে একটা ঘরের মধ্যে।

বর্তমানে ওই ঘরটাই হল তিন বন্ধুর দুর্গ।

একটা রাত্রি ভালোভাবেই কাটল। কিন্তু পরের দিন সকালেই হানা দিল নিগ্রো যোদ্ধার দল। তিন বন্ধুর রাইফেল সশব্দে অগ্নি-উগার করলে, কয়েকটি নিগ্রোর হত ও আহত দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর।

নিগ্রোরা পিছিয়ে গেল। একটু পরে ফিরে এসে আহত সঙ্গীদের তুলে নিয়ে আবার আত্মগোপন করল সবুজ অরণ্যের অন্তরালে। মৃত সঙ্গীদের তারা ছুঁড়ে ফেলে দিল নদীর জলে।

গভীর রাত্রে আবার আক্রমণ করলে নিগ্রোরা। সারারাত্রি ধরে বার বার হানা দিল নিগ্রো বাহিনী, ঘরের ভিতর থেকে অনবরত গুলি চালিয়ে আর হাতবোমা ছুঁড়ে অতি কষ্টে তিন বন্ধু তাদের ঠেকিয়ে রাখল।

পূর্বদিকের আকাশে জাগল অস্পষ্ট আলোর আভাস। নিগ্রোরা আবার গা-ঢাকা দিল বনের আড়ালে। এল প্রভাত।

প্রভাতের শীতল বায়ু তপ্ত হয়ে উঠল ধীরে ধীরে, মাথার ওপর জ্বলে উঠল মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য।

একটা ঘরের মধ্যে বড়ো বড়ো টিনের পাত্রে জল জমিয়ে রেখেছিল ফরাসিরা। ওই জলে তিন বন্ধু স্নান করলে, তারপর আহারপর্ব শেষ করে ফেলল চটপট। গতরাত্রে কেউ ঘুমাতে পারেনি। রাত্রি জাগরণ এবং উত্তেজনার ফলে তারা হয়ে পড়েছিল অবসন্ন। মাইককে পাহারায় রেখে হ্যারিস ও ম্যাক কার্থি শয্যা গ্রহণ করলে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল গভীর নিদ্রায়।

ওঠ! ওঠ! তাড়াতাড়ি!

চিৎকার করে উঠল মাইক স্টার্ন।

দুই বন্ধু বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল, তারপর মাইকের নির্দেশ অনুযায়ী দৃষ্টি সঞ্চালন করতেই তাদের চোখের সামনে ফুটে উঠল এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্য।

বাঁকের মুখে নদীর ধারে নোঙর করেছে একটি নৌকা এবং সেই নৌকা থেকে নেমে আসছে দুজন জার্মান সৈনিক!

তিন বন্ধু অবাক হয়ে দেখল একজন জার্মান সৈন্যের হাতে রয়েছে শ্বেত পতাকা! সন্ধির সংকেত!

হতভম্ব হয়ে পড়ল তিন বন্ধু–দুরন্ত জার্মান সৈন্যরা হঠাৎ এমন শান্তিপ্রিয় হয়ে পড়ল কেন, এ-কথাটা তারা বুঝতে পারল না।

মাইক জার্মান ভাষা জানত। সঙ্গীদের ঘরের মধ্যে রেখে সে পিস্তল হাতে এসে দাঁড়াল জার্মানদের সামনে, কিন্তু তার জার্মান ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন হল না।

চোস্ত ইংরেজিতে একজন জার্মান আত্মপরিচয় দিল, আমার নাম অটো গ্যটমেয়ার। আমি জার্মান সৈন্যদলের এক লেফটেন্যান্ট।

তারপর অটো যা বললে তার সারমর্ম হচ্ছে এই :

ম্যাঙ্গবেটু জাতীয় নিগ্রোরা এখন আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের নির্বিচারে আক্রমণ করছে–জার্মান, ফরাসি, ইংরেজ, আমেরিকান প্রভৃতি শ্বেতাঙ্গ জাতি তাদের শত্রু এবং অবশ্য বধ্য; অতএব জার্মানি এবং আমেরিকা বৃহত্তর পৃথিবীতে পরস্পরের শত্রু হলেও এই মুহূর্তে সেই শত্রুতা ভুলে এই দুটি ছোটো দল যদি এখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিগ্রোদের বিরুদ্ধে রুখে না-দাঁড়ায়, তাহলে খুব শীঘ্রই নিগ্রোদের আক্রমণে উভয়পক্ষই হবে নিশ্চিহ্ন–জার্মান বা আমেরিকানদের মধ্যে একটি লোকও নিগ্রোদের রোষ থেকে রেহাই পাবে না। তাই নিতান্ত সাময়িকভাবে জার্মানিদের পক্ষ থেকে অটো সন্ধির প্রস্তাব এনেছে। তার দলের আরও চারজন সৈন্য জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে, আমেরিকানরা যদি সন্ধি করতে রাজি হয় তাহলে লেফটেন্যান্টের সঙ্গী তাদের নিয়ে আসবে।

মাইক তার বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে বুঝল যে, জার্মান সেনানায়কের প্রস্তাব মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

সন্ধি হল। লেফটেন্যান্টের সঙ্গী দূর অরণ্যের গোপন স্থান থেকে চারজন জার্মান সেনাকে নিয়ে এল আমেরিকানদের আস্তানায়। আপাতত এই জায়গাটাই উভয়পক্ষের মিলিত শিবির হল।

সন্ধির একটি বিশেষ শর্ত ছিল এই যে, কোনো কারণে যদি অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তাহলেও একপক্ষ অপর পক্ষকে যুদ্ধবন্দি হিসাবে গণ্য করতে পারবে না।

শর্তটা উভয়পক্ষেরই মনঃপূত হয়েছিল।

সাময়িকভাবে নিজেদের শত্রুতা ভুলে দুই পক্ষ এইবার মিলিতভাবে নিগ্রোদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সন্ধ্যার আগেই শুরু হল আক্রমণ। নয়টি রাইফেল ঘনঘন গর্জন করে অনেকগুলো কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধার হত ও আহত দেহ শুইয়ে দিল মাটির ওপর।

নিগ্রোরা পিছিয়ে গেল… আবার আক্রমণ করলে… শ্বেতাঙ্গদের আস্তানার উপর এসে পড়ল ঝাঁকে ঝাঁকে বল্লম… রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টিও বুঝি আর নিগ্রোদের ঠেকিয়ে রাখতে পারে না…

শ্বেতাঙ্গরা এইবার গ্রেনেড (হাতবোমা) ব্যবহার করলে। নিগ্রো যোদ্ধাদের উপর ছিটকে পড়ল কয়েকটা হাতবোমা, আগুনের ঝলকে ঝলকে ধূম এবং মৃত্যু পরিবেশিত হল চতুর্দিকে, হতাহত সঙ্গীদের ফেলে সভয়ে পলায়ন করলে বর্শাধারী কালো মানুষগুলো বিজ্ঞানের মহিমায় স্তব্ধ হয়ে গেল অরণ্যের বন্য বিক্রম!

কেটে গেল কয়েকটি দিন আর কয়েকটি হাত। এর মধ্যে আবার আক্রমণ করেছে ম্যাঙ্গবেটু নিগ্রোরা, কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টির মুখে ব্যর্থ হয়েছে তাদের আক্রমণ। একজন জার্মান সেনা প্রাণ হারিয়েছে বর্শার আঘাতে। চারদিকে হাতবোমার সাহায্যে মাইন পেতে আত্মরক্ষা করতে লাগল জার্মান ও আমেরিকান সৈন্যরা।

সেদিন প্রকাশ্যে দিবালোকে দুজন নিগ্রো জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজনের অঙ্গসজ্জা দেখে শ্বেতাঙ্গরা অনুমান করল লোকটি ম্যাঙ্গবেটুদের মধ্যে প্রভাবশালী সর্দার-শ্রেণির মানুষ; অপর ব্যক্তির একহাতে শিকলে বাঁধা পাঁচটি কুকুর, অন্যহাতে একটা চামড়ার থলি। কুকুরগুলো সাগ্রহে চামড়ার থলিটা বার বার শুঁকছে। সর্দারের হাতে একটা লাঠির আগায় সাদা কাপড় বাঁধা–সন্ধির চিহ্ন সাদা নিশান!

অটো তৎক্ষণাৎ তাদের গুলি করতে চাইল, কিন্তু মাইক বলল, দাঁড়াও, আগে ওদের বক্তব্যটা শুনি। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।

মাইনের মৃত্যুফাঁদ থেকে যে পথটা মুক্ত, সেই সরু রাস্তাটার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে মাইক ম্যাঙ্গবেটুদের কাছে আসতে ইঙ্গিত করল।

সর্দারের মুখে ফুটল ধূর্ত হাসির রেখা, নিশানটা সজোরে মাটির ওপরে বসিয়ে দিয়ে সঙ্গীর থলি থেকে কয়েকটা রক্তাক্ত মাংসের টুকরো বার করে সে ছুঁড়ে দিল সাদা মানুষদের দিকে। সঙ্গীও শিকলের বাঁধন থেকে কুকুরগুলোকে মুক্তি দিল তৎক্ষণাৎ।

জার্মান ও আমেরিকান সৈন্যরা মাটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শয্যাগ্রহণ করল উপুড় হয়ে। প্রায় সঙ্গেসঙ্গে হাতবোমার তারে ধাবমান কুকুরের পা লাগল। একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ–মুহূর্ত পরেই আরও চারটি বোমা ফাটল ভীষণ শব্দে!

শ্বেতাঙ্গরা সম্মুখে দৃষ্টিপাত করল। কুকুরগুলোর মৃতদেহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নিগ্রো দুজন মাইকের নির্দিষ্ট নিরাপদ পথ ধরে সতর্ক চরণে এগিয়ে আসছে।

শ্বেতাঙ্গদের সামনে এসে হোমরাচোমরা গোছের লোকটি তার সঙ্গীকে কথা কইতে নির্দেশ দিল।

ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে নিগ্রোটি জানাল তার সঙ্গে এসেছে মহামান্য মবংগো! মবংগো ওই গ্রামের জাদুকর। তার ক্ষমতা অসীম। মবংগো বলছে, সাদা মানুষরা যদি এই ঘাঁটি এখনই ছেড়ে দিতে রাজি থাকে, তাহলে তাদের নিরাপদে যেতে দেওয়া হবে। কথা না-শুনলে মবংগোর আদেশে ম্যাঙ্গবেটুরা সাদা মানুষদের হত্যা করবে। মাটির ওপর ফেটে যাওয়া জিনিসগুলোকে তারা ভয় করে না, ওগুলোকে ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা তারা দেখে নিয়েছে।

অটো মাইকের দিকে চাইল, কী বল? ওদের প্রস্তাবে রাজি হব?

অসম্ভব, মাইক বলল, ওরা সুযোগ পেলেই আমাদের খুন করবে। বরং এখানে দাঁড়িয়ে আমরা লড়তে পারব। ঘাঁটি ছেড়ে গেলে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত।

অটো মাইকের যুক্তি মেনে নিল। তারপর নিগ্রো দোভাষীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কর্তাকে বলো আমরা এই জায়গাতেই থাকব। কোথাও যাব না।

দোভাষীর মুখ থেকে শ্বেতাঙ্গদের বক্তব্য শুনে দারুণ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল জাদুকর মবংগো। সে থুথু ছিটিয়ে দিল অটোর মুখে!

মুহূর্তের মধ্যে খাপ থেকে পিস্তল টেনে নিয়ে পর পর দু-বার গুলি ছুড়ল অটো। গুলি লাগল জাদুকরের পেটে। সঙ্গীটি দারুণ আতঙ্কে হাঁ করে চেয়ে রইল সাদা মানুষদের দিকে। তার দিকে তাকিয়ে হিংস্রভাবে দাঁত বার করে গর্জে উঠল অটো, যাও, এই হতভাগাকে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যাও।

মরণাপন্ন জাদুকরকে নিয়ে নিগ্রোটি জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল…

কয়েকটা দিন নিরুপদ্রবে কাটল। কিন্তু শ্বেতাঙ্গরা তাদের পাহারা শিথিল করল না। তারা জানত ম্যাঙ্গবেটুরা সুযোগ খুঁজছে, একটু অসতর্ক হলে আর রক্ষা নেই। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জার্মান আর আমেরিকানরা তাদের শত্রুতা ভুলে গেল। অলস মধ্যাহ্নে তারা তাস খেলে মুখোমুখি বসে, রাতের অন্ধকারে পাহারা দেয় বিনিদ্র নেত্রে।

ছোটোখাটো তুচ্ছ বিষয় থেকে অনেক সময় হয় মারাত্মক বিপদের সূত্রপাত ।

মাইক যদি জানত তার পরিচয়পত্রটি অত বড়ো বিপদ ডেকে আনবে, তাহলে বোধ হয় সে যত্ন করে ওই জিনিসটিকে মালার সঙ্গে আটকে বুকের ওপর ঝুলিয়ে রাখত না।

ওই পরিচয়পত্রের দিকে আকৃষ্ট হল কোহন নামক জনৈক জার্মান সৈনিকের দৃষ্টি।

কোহন জিনিসটা দেখতে চাইল। মালা থেকে পরিচয়পত্রটি খুলে মাইক সেটাকে কোহনের হাতে দিল। কোহনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আর একজন জার্মান নাম তার হহেনস্টিন। সঙ্গীর হাত থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে জিনিসটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সে, তার দুই চোখে ফুটে উঠল তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের আভাস!

হহেনস্টিন ক্রুদ্ধস্বরে বললে, আরে, এই লোকটা দেখছি ইহুদি! ওহে কোহন–এই নোংরা শুয়োরটা ইহুদি! ছি! ছি!

(ইহুদিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করত জার্মান জাতি। হিটলারের নির্দেশে এই সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও আক্রোশ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল জার্মান জাতির মধ্যে।)

গালাগালি শুনে চুপ করে থাকার মতো সুবোধ ছেলে নয় মাইক স্টার্ন–সে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল হহেনস্টিনের ওপর!

চোখের পলক ফেলার আগেই শুরু হয়ে গেল মারামারি!

গোলমাল শুনে সেখানে ছুটে এল জার্মান লেফটেন্যান্ট অটো। তার সঙ্গে সঙ্গে এল অন্যান্য জার্মান সৈনিক এবং মাইকের দুই বন্ধু।

মাইককে ছেড়ে দিয়ে অটোর দিকে এগিয়ে এল হহেনস্টিন, স্যার! এই শুয়োরটা ইহুদি! আমি এইমাত্র জেনেছি!

ক্রুদ্ধকণ্ঠে গর্জে উঠল মাইক, হ্যাঁ, আমি ইহুদি তাতে কী হয়েছে?

অটো বিস্মিত স্বরে বললে, তুমি ইহুদি? আশ্চর্য! তোমাকে দেখে তো মনে হয় না যে তুমি ইহুদি!

মাইক রোষরুদ্ধ স্বরে বললে, ইহুদিরা কেমন দেখতে হয়? তারা কি মানুষ নয়? তোমার মতো আমারও দুটো হাত আর দুটো পা আছে।

অটো বললে, তা ঠিক। তবে আমরা শুনেছি ইহুদিরা ভালো লোক নয়।

ভুল শুনেছ, জবাব দিল ম্যাক কার্থি, শয়তান হিটলার তোমাদের যা বুঝিয়েছে তোমরা তাই বুঝেছ। কিন্তু অটো, তোমার তো বেশ বুদ্ধি আছে–তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে,ওই হিটলারটা হচ্ছে পয়লা নম্বরের মিথ্যুক!

এক মুহূর্তে সমস্ত পরিবেশ হয়ে উঠল ভয়ংকর।

জার্মানরা এসে দাঁড়াল অটোর পাশে, তাদের চোখের দৃষ্টি থেকে মুছে গেছে বন্ধুত্বের স্বাক্ষর, চোয়ালের রেখায় রেখায় পাথরের কাঠিন্য।

একজন জার্মান গম্ভীর স্বরে বললে, লেফটেন্যান্ট! হুকুম দাও!

মাইকের দুই পাশে ছড়িয়ে পড়ল দুই বন্ধু।

ম্যাক কার্থি খাপ থেকে পিস্তল টেনে নিল।

রাইফেলের বাঁটের ওপর চেপে বসেছে জার্মান সৈনিকের কঠিন মুষ্টি, ট্রিগারের ওপর সরে এসেছে আঙুল—

আবার প্রশ্ন এল জার্মান ভাষায়, কী হুকুম? লেফটেন্যান্ট?

কিন্তু অটো মুর্খ নয়।

শান্তভাবে চারদিকে চোখ বুলিয়ে সে বললে, লড়াই করার মতো উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু। আমি লড়াই-এর হুকুম দেব না। ইহুদিরাও মানুষ, হহেনস্টিন অন্যায়। করেছে।

লেফটেন্যান্টের আদেশে হহেনস্টিন ক্ষমা চাইতে বাধ্য হল।দুইপক্ষই আবার। অস্ত্র নামিয়ে নিল।

মেঘ সরে গিয়েছে, ঝড় আর উঠবে না।

অটোর ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রতি রাত্রে পালা করে একজন পাহারা দেয়। আজ জার্মান সান্ত্রি বনামিয়েরের পালা! বনামিয়ের তার হাতঘড়ির দিকে তাকাল–এগারোটা বেজে তিরিশ মিনিট হয়েছে।

একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে আরাম করতে লাগল…

হঠাৎ কার পায়ের তলায় সশব্দে ভেঙে গেল একটা শুকনো গাছের ডাল। চমকে উঠল জার্মান প্রহরী বনামিয়ের।

আবার সেই শব্দ! শুকনো গাছের ডালগুলো ভেঙে যাচ্ছে কাদের পায়ের তলায়?

দুই চোখ পাকিয়ে শব্দ লক্ষ করে দৃষ্টি সঞ্চালিত করতেই, বনামিয়ের দেখল তার চারপাশে অন্ধকারের বুকে ভেসে উঠেছে অনেকগুলো চলমান মনুষ্যদেহ নিগ্রো যোদ্ধার দল!

দারুণ আতঙ্কে জার্মান প্রহরীর বুদ্ধিভ্রংশ হল, রাইফেলটাকে শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে সে দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো… কিছুক্ষণ পরে ভয়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে নিয়ে বনামিয়ের তার কর্তব্য স্থির করে ফেলল। খুব ধীরে ধীরে সে মাটির উপর বসে পড়ল–অন্ধকারের মধ্যে তার দেহটা এখনও নিগ্রোদের দৃষ্টিগোচর হয়নি।

মাটি থেকে একটা শুকনো গাছের ডাল তুলে নিয়ে বনামিয়ের দূরে ছুঁড়ে দিল। ডালটা সশব্দে মাটির ওপর পড়ল–সঙ্গেসঙ্গে শব্দ লক্ষ করে ছুটে এল চারটে ভূতুড়ে ছায়া গাছের আড়াল থেকে!

বনামিয়ের গুলি ছুড়ল। তারপর পিছন ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল আস্তানার দিকে। তার ধাবমান দেহের এপাশ দিয়ে ওপাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে উড়ে গেল অনেকগুলো বর্শা। বনামিয়ের একটা ঘরের খুব কাছাকাছি এসে পড়ল আর একটু গেলেই সে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবে। কিন্তু বেচারার উদ্দেশ্য সফল হল না, তার বাম ঊরুর ওপর বিদ্ধ হল একটি বর্শা বনামিয়ের মাটির ওপর ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

ইতিমধ্যে রাইফেলের শব্দে আমেরিকান আর জার্মান সৈন্যদের ঘুম গেছে ভেঙে, চটপট রাইফেল নিয়ে তারা ছুটে এসেছে অকুস্থলে নিকটবর্তী অরণ্যের ভিতর দিয়ে ঝোপঝাড় ভেদ করে আঙুলের চাপে চাপে রাইফেলের মুখ থেকে ছিটকে পড়েছে তপ্ত বুলেট বৃষ্টিধারার মতো!

সেই দারুণ অগ্নিবৃষ্টির মুখে লুটিয়ে পড়ল কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধা, বাকি সবাই তাড়াতাড়ি জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। শ্বেতাঙ্গরা এবার অদৃশ্য শত্রুদের লক্ষ করে হাতবোমা ছুড়ল ঘন জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ের ভিতর প্রচণ্ড শব্দে ফাটাতে লাগল বোমাগুলো।

নিগ্রো যোদ্ধারা পিছিয়ে গেল। অন্ধকার অরণ্যের ভিতর তাদের দেহগুলো শ্বেতাঙ্গদের চোখে পড়ল না, কিন্তু দ্রুত ধাবমান পদশব্দ তাদের জানিয়ে দিলে শত্রু এখন প্রাণ নিয়ে সরে পড়ছে।

আহত জার্মান সৈন্যের দেহটাকে ধরাধরি করে তারা একটা ঘরের ভিতর নিয়ে এল। বনামিয়েরের পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, তার ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। বনামিয়ের তখন দারুণ যাতনায় আর্তনাদ করছে, তাকে একটা মরফিয়া ইঞ্জেকশন দিতেই সে ঘুমিয়ে পড়ল–অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য আঘাতের যন্ত্রণা থেকে সে মুক্তি পেল।

এক সপ্তাহ পরের কথা। রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে স্টার্ন মাইক।

হঠাৎ পায়ের ওপর সে অনুভব করলে তীব্র দংশন!

অস্ফুট স্বরে আফ্রিকার যাবতীয় কীটপতঙ্গকে অভিশাপ দিতে দিতে মাইক তার আহত পায়ের শুশ্রূষা করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল আর সঙ্গেসঙ্গে সে বুঝতে পারল তার হাতের ওপর উঠে পড়েছে অনেকগুলো পতঙ্গ জাতীয় জীব!

মাইক অনুভব করলে তার দুই পায়ের উপরেই কামড় বসাচ্ছে অনেকগুলো পোকা–কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাতের পোকাগুলোও তাকে কামড়াতে লাগল।

তাড়াতাড়ি রাইফেলের বাঁটের ওপর হাতটাকে সজোরে ঘর্ষণ করে মাইক তার হাতটাকে পোকার কবল থেকে মুক্ত করে নিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিল চাঁদ।

ম্লান জ্যোৎস্নার আলোকধারার মধ্যে মাইকের দৃষ্টিপথে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য!

বনের ভিতর থেকে ফাঁকা মাঠের ওপর বেরিয়ে এসেছে একদল পিঁপড়ে! সেই বিপুল পিপীলিকা বাহিনীর সংখ্যা অনুমান করা অসম্ভব কারণ মাইকের সামনে যে পিঁপড়ের সারিটা এগিয়ে এসেছে তার পিছন দিকটা এখনও অদৃশ্য রয়েছে অরণ্যের অন্তরালে।

কয়েকটা অগ্রবর্তী দলছাড়া পিঁপড়ে ইতিমধ্যেই তার পায়ের ওপর উঠে কামড় বসিয়েছে। মাইকের প্রায় দশ গজ দূরে এসে পড়েছে আসল দলটা!

মাইক তাদের মিলিটারি ব্যারাকের আস্তানা লক্ষ করে ছুটল। মাঝে মাঝে নীচু হয়ে সে পা থেকে পিঁপড়েগুলোকে ছাড়িয়ে নিচ্ছিল। হাত দিয়ে ঘষে ওই মারাত্মক পোকাগুলোর কবল থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল না–দু-আঙুলে টিপে ধরে মাইক পিঁপড়েগুলোকে টেনে আনছিল তার পায়ের ওপর থেকে!

জীবজগৎ সম্বন্ধে মাইক যদি কিছু খবর রাখত তাহলে সে জানত যে ওই পিঁপড়েগুলো হচ্ছে। আফ্রিকার মারাত্মক ড্রাইভার অ্যান্ট।

এরা যেখান দিয়ে যায় সেখানে পড়ে থাকে অসংখ্য জানোয়ারের কঙ্কাল সিংহ, লেপার্ড প্রভৃতি হিংস্র পশুও এদের মিলিত আক্রমণের মুখে অসহায়ভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।

মাইক তার হাতের রাইফেল আওয়াজ করে নিদ্রিত সঙ্গীদের জাগিয়ে দিলে। সকলে ছুটে এসে দেখল, তাদের আস্তানা আর জঙ্গলের মাঝখানে অবস্থিত ফাঁকা জায়গাটার ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে অসংখ্য পিপীলিকার শ্রেণিবদ্ধ বাহিনী!

শ্বেতাঙ্গরা তাড়াতাড়ি পিঁপড়েগুলোর সামনে গ্যাসোলিন ছড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলে। পিঁপড়েরা নাছোড়বান্দা তারা জ্বলন্ত আগুনের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগল। সৈন্যরা এবার পিঁপড়ের দলের ওপর গ্যাসোলিন ছড়িয়ে অগ্নিসংযোগ করলে। অনেকগুলো পিঁপড়ে অগ্নিগর্ভে প্রাণ বিসর্জন দিলে অন্যগুলো এদিক-ওদিক সরে গেল।

আচম্বিতে নিকটবর্তী শিবিরগুলোর একটি ঘর থেকে ভেসে এল এক করুণ আর্তনাদ।

সকলেই বুঝল, ওই কণ্ঠস্বরের মালিক হচ্ছে বনামিয়ের।

কারণ সে ছাড়া ওই সময়ে ঘরের মধ্যে কেউ ছিল না। বনামিয়ের যে ঘরে শুয়েছিল সেই ঘরের দিকে সবাই ছুটল…

বীভৎস দৃশ্য!

খাটের ওপর শুয়ে ছটফট করছে আহত বনামিয়ের, তাকে আক্রমণ করেছে পিঁপড়ের দল। জীবন্ত অবস্থায় তার দেহের মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে ওই ভয়ংকর কীটগুলি, ইতিমধ্যেই পিপীলিকার দংশনে তার চক্ষু হয়েছে অন্ধ–চক্ষুহীন রক্তাক্ত অক্ষিকোটরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু পিঁপড়ে আর পিঁপড়ে!

সকলেই বুঝল, বনামিয়ের আর বাঁচবে না–হিংস্র কীটগুলো তার দেহটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, তিলে তিলে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে করতে তার মৃত্যু হবে ধীরে ধীরে।

সৈনিক মাত্রেই মরতে এবং মারতে প্রস্তুত থাকে, মৃত্যু তাদের কাছে অতি সহজ, অতি স্বাভাবিক। কিন্তু ওই বীভৎস দৃশ্য সহ্য করা যায় না।

লেফটেন্যান্ট অটো কোহনের দিকে তাকাল, কিছু একটা করো! লোকটা এভাবে মরবে?

–কী করব! কিছু করার নেই।

–কিছু করার নেই?

না।

অটো রিভলভারটা বনামিয়েরের মাথা লক্ষ করে তুলে ধরলে।

মাইক মুখ ঘুরিয়ে নিলে অন্যদিকে।

গর্জে উঠল অটোর রিভলভার–গুলি বনামিয়েরের মস্তিষ্ক ভেদ করে তাকে অসহ্য যাতনা থেকে নিষ্কৃতি দিল মুহূর্তের মধ্যে।

সকালের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গেসঙ্গে পিপীলিকা বাহিনী সৈন্যদের আস্তানা ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল জীবন্ত দুঃস্বপ্নের মতো। সবাই দেখল, পিঁপড়েরা শুধু বনামিয়েরের দেহের মাংস খেয়েই সন্তুষ্ট হয়নি, তার জুতো, রিভলভারের খাপ প্রভৃতি সব কিছুই উদরসাৎ করেছে খুদে রাক্ষসের দল।

বনামিয়েরের মাংসহীন রক্তাক্ত কঙ্কালটাকে সবাই মিলে কবরস্থ করলে।

অটো বললে, এইভাবে আমরা বেশিদিন আত্মরক্ষা করতে পারব না। যদি বাঁচতে হয় তাহলে আমাদের আক্রমণকারী ভূমিকা নিতে হবে।

মাইক বললে, তুমি কী করতে চাও?

অটোর অভিমত হচ্ছে এই যে তারা যদি ম্যাঙ্গবেটু নিগ্রোদের একটি গ্রাম অধিকার করতে পারে তবে স্থানীয় বাসিন্দারা ভীত হয়ে পড়বে, খুব সম্ভব তারা আর লড়াই করতে চাইবে না।

অটোর প্রস্তাবে সম্মত হল মাইক।

একদিন খুব ভোরে ঘন জঙ্গল ভেদ করে জার্মান ও আমেরিকানদের মিলিত বাহিনী নিকটবর্তী নিগ্রো পল্লিতে হানা দিল। এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না গ্রামবাসী।

রাইফেলের ঘন ঘন গর্জন ও হাতবোমার প্রচণ্ড বিস্ফোরণ আতঙ্কের সঞ্চার করল নিগ্রো পল্লির বুকে। ভয়ার্ত নরনারী গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিল শ্বাপদসংকুল অরণ্যের অন্তঃপুরে।

শ্বেতাঙ্গদের মিলিত বাহিনী প্রবেশ করল নির্জন গ্রামের মধ্যে।

দু-দিন পরেই সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে শ্বেতাঙ্গদের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যাঙ্গবেটুদের কয়েকজন প্রতিনিধি–তারা শান্তিতে বাস করতে চায়, লড়াই করার আগ্রহ তাদের আর নেই।

শ্বেতাঙ্গরা সম্মত হল। ম্যাঙ্গবেটুদের গ্রামের মধ্যে নিগ্রোদের পাশাপাশি বাস করতে লাগল জার্মান আর আমেরিকান সৈন্যদল! শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের জ্বলন্ত নিদর্শন।

কয়েকদিন পরে এই নাটকীয় বন্ধুত্বের রঙ্গমঞ্চে নেমে এল সমাপ্তির যবনিকা। ম্যাঙ্গবেটুদের গ্রামের কাছে নদীর বুকে আবির্ভূত হল একটি আমেরিকান সী-প্লেন বা উভচর বিমান।

মার্কিন পাইলট জার্মান এবং আমেরিকানদের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান দেখে বিস্মিত হয়েছিল। মাইকের অনুরোধে বিমানচালক জার্মানদের নিরাপদ অঞ্চলে পৌঁছে দিতে সম্মত হল। স্প্যানিশ গায়নার সীমান্তে একটি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষ পরস্পরের কাছে বিদায় গ্রহণ করলে। বিদায়ের আগে মাইকের হাত চেপে ধরেছিল অটো গ্যটমেয়ার–ঘটনাচক্রে দুই শত্রুর মধ্যে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বের বন্ধন, ভাগ্য তাদের সেই বন্ধুত্ব যাচাই করে নিয়েছিল অগ্নিপরীক্ষার ভিতর দিয়ে।

বিমানযোগে তিন বন্ধু নিরাপদে ফিরে এল মিত্রপক্ষের আস্তানায়। অটো গ্যটমেয়ার এবং অন্যান্য জার্মানদের সঙ্গে আর কোনোদিন তাদের সাক্ষাৎ হয়নি।

[ফাল্গুন ১৩৭৬]

অসুর বনাম মহিষাসুর

না না, পুরাণে বর্ণিত মহিষাসুরের কাহিনি আজ লিখতে বসিনি, আমি যে জীবটির কথা বলছি সে হচ্ছে আফ্রিকা বনরাজ্যের জীবন্ত বিভীষিকা

নাম তার কেপ-বাফেলো। আফ্রিকার মহিষাসুর!

বন্য মহিষ মাত্রেই হিংস্র ও উগ্র, এমনকী গৃহপালিত মহিষকেও নিতান্ত শান্তশিষ্ট জানোয়ার বলা চলে না। কিন্তু আফ্রিকার কেপ-বাফেলোর মতো এমন ভয়ানক জানোয়ার পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে মহিষগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় না।

মহিষ-পরিবারের অন্তর্গত সব জন্তুর প্রধান অস্ত্র শিং এবং খুর। কেপ-বাফেলো ওই দুই মহাস্ত্রে বঞ্চিত নয়, উপরন্তু শিরস্ত্রাণধারী যোদ্ধার মতো তার মাথার উপর থাকে কঠিন হাড়ের স্থূল আবরণ (ইংরেজিতে যাকে বলে Boss of the Horns)।

অস্থিময় এই কঠিন আবরণ ভেদ করে শ্বাপদের নখ দন্ত বা রাইফেলের গুপ্ত বুলেট মহিষাসুরের মস্তকে ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি করতে পারে না।

নিগ্রো শিকারিরা অনেক সময় বর্শা হাতে মহিষকে আক্রমণ করে। অনেকগুলি বর্শার আঘাতে জর্জরিত হয়ে প্রাণত্যাগ করার আগে মহিষ তার শিং ও খুরের সদ্ব্যবহার করতে থাকে বিদ্যুৎবেগে অবশেষে এই ধরনের বন্য নাটকের উপসংহারে দেখা যায় নিহত মহিষের আশেপাশে লম্বমান হয়ে পড়ে আছে কয়েকটি হত ও আহত নিগ্রো শিকারির রক্তাক্ত দেহ।

এই ভয়ানক জন্তুকে হত্যা করার একমাত্র উপযুক্ত অস্ত্র হচ্ছে শক্তিশালী রাইফেল। তবে রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টিও সবসময় কেপ-বাফেলোকে জব্দ করতে পারে না–আফ্রিকার অরণ্যে মহিষের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে বহু শ্বেতাঙ্গ শিকারি!

এমন দুর্দান্ত জানোয়ারকে টোনিও নামক নিগ্রো যুবকটি জব্দ করেছিল একখানা বর্শার সাহায্যে!

হ্যাঁ, বন্দুক নয়, রাইফেল নয়, এমনকী মহিষ বা হাতি শিকারের উপযুক্ত দীর্ঘ ফলকবিশিষ্ট বল্লমও তার হাতে ছিল না শুধুমাত্র একটি মাছমারা বর্শার সাহায্যে ক্ষিপ্ত মহিষের আক্রমণ রোধ করেছিল টোনিও নামধারী নিগ্রো যুবক!

কথাটা নিতান্ত অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে–তাই নয় কি?

নিম্নলিখিত কাহিনিটি পড়লেই বোঝা যাবে সত্য ঘটনার চেহারা অনেক সময় গল্পের চেয়ে আশ্চর্য, গল্পের চেয়ে ভয়ংকর…।

সুদান অঞ্চলের পূর্বদিকে অবস্থিত পার্বত্য অঞ্চলে হানা দিয়েছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ শিকারি–নাম তার রে ক্যাথার্লি। শিকারির ভাগ্য খারাপ, তার নিগ্রো পথপ্রদর্শক হঠাৎ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ল। জিনিসপত্র বহন করার জন্য যে লোকগুলিকে ক্যাথার্লি নিযুক্ত করেছিলেন তারা ছোঁয়াচে অসুখের ভয়ে তল্পিতল্পা ফেলে পালিয়ে গেল।

ক্যাথার্লি বিপদে পড়লেন। শিকারের সরঞ্জামগুলি বহন করার জন্য লোকজন দরকার কিন্তু এই গভীর অরণ্যে তেমন লোক কোথায়? নিরুপায় ক্যাথার্লি শেষ পর্যন্ত মডি জাতীয় নিগ্রোদের সাহায্য নিতে বাধ্য হলেন। মডিরা মৎস্যজীবী অর্থাৎ জেলে, মাছ ধরা তাদের পেশা শিকার-টিকার তারা বোঝে না কিন্তু টাকার মূল্য খুব ভালোভাবেই বুঝতে শিখেছে। টাকার লোভে কয়েকজন মডি জাতীয় ধীবর ক্যাথার্লির মোট বহন করতে রাজি হল।

মডিদের দলের মধ্যে একটি যুবকের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন ক্যাথার্লি ছয় ফুটের উপর লম্বা ওই দীর্ঘকায় মানুষটির প্রশস্ত স্কন্ধ ও পেশিবহুল দেহ যেন অফুরন্ত শক্তির আধার!

শিকারির মনে হল মানবের ছদ্মবেশে তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছে এক কৃষ্ণকায় দানব!

দানব বুঝল ক্যাথার্লি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, দন্তবিকাশ করে সে ইংরেজিতে জানিয়ে দিলে তার নাম টোনিও।

ক্যাথার্লি খুশি হলেন–টোনিও কেবল অসাধারণ দেহের অধিকারী নয়, তার মস্তিষ্কও যথেষ্ট উন্নত। মোটবাহকদের দলের মধ্যে টোনিও হচ্ছে একমাত্র লোক যে ইংরেজি ভাষা বুঝতে পারে এবং বলতে পারে।

কিন্তু সবচেয়ে যে বস্তুটি ক্যাথার্লির বিস্মিত দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিল সেটি হচ্ছে টোনিওর হাতের বর্শা। সাধারণ বর্শার মতো কাষ্ঠদণ্ডের সঙ্গে ধারালো লোহার ফলা আটকে এই অস্ত্রটি তৈরি করা হয়নি–একটি সরল লৌহদণ্ডকে বর্শার মতো ব্যবহার করেছিল টোনিও।

ওই লোহার ডান্ডার মুখটা ছিল সরু আর ধারালো। গুরুভার অস্ত্রটিকে অতি সহজেই বহু দূরে নিক্ষেপ করতে পারত টোনিও এবং তার নিশানাও ছিল পাকা, সহজে সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।

এমন একটি মনুষ্য-রত্ন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ক্যাথার্লি, তাঁর প্রধান পথপ্রদর্শকের পদে বহাল হল টোনিও….

কয়েকদিন পরেই ঘটল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

টোনিওকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাথার্লি গিয়েছিলেন পাহাড়ের দিকে শিকারের সন্ধানে। তাঁবুতে যে কয়জন মোটবাহক ছিল তারা মাছ ধরবার জন্য যাত্রা করেছিল নদীর দিকে। সন্ধ্যার সময়ে ক্যাথার্লি টোনিওকে নিয়ে তাঁবুতে ফিরে দেখলেন তাঁবু শূন্য জনপ্রাণীও সেখানে উপস্থিত নেই।

শিকারি প্রথমে বিশেষ চিন্তিত হননি। কিন্তু ঘড়িতে যখন নয়টা বাজল তখন তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন। আফ্রিকার জঙ্গলে রাত্রি ন-টা পর্যন্ত কেউ তাঁবুর বাইরে থাকে না–অন্ধকারের অন্তরালে শ্বাপদসংকুল অরণ্য তখন মৃত্যুর বিচরণভূমি…

অবশেষে তাঁবুর কাছে যে অগ্নিকুণ্ড জ্বলছিল তারই আলোতে দেখা গেল লোকগুলি ফিরে আসছে।

আসছে বটে তবে স্বাভাবিকভাবে নয়।

মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে তিনটি লোক। চতুর্থ ব্যক্তিকে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি একটা বিছানার ওপর শুইয়ে তার তিন সঙ্গী ওই শয্যাটিকে বহন করছে।

কাষ্ঠনির্মিত ওই বিছানা তারা নামিয়ে রাখল ক্যাথার্লির সম্মুখে। শয্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে চমকে উঠলেন ক্যাথার্লি

হাড়গোড়ভাঙা অবস্থায় যে রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডটা কাঠের বিছানার ভিতর পড়ে আছে তার সঙ্গে মনুষ্যদেহের কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল! ক্যাথার্লির মনে হল একটা গুরুভার বস্তুর নীচে মানুষটাকে পিষে ফেলা হয়েছে!

মডিদের ভাষা জানতেন না ক্যাথার্লি। টোনিও সঙ্গীদের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনল, তারপর কম্পিতকণ্ঠে ইংরেজি ভাষায় যে-কাহিনিটি সে পরিবেশন করল তা হচ্ছে এই

নদী থেকে মাছ ধরে মোটবাহকেরা ফিরে আসছিল। হঠাৎ একটা কেপ-বাফেলোর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়। মহিষটা খুব ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। ওই সময়ে যদি তারা চুপচাপ সরে পড়ত তাহলে বোধ হয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটত না। মহিষ কাছে এসে লোকগুলিকে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছিল। খুব সম্ভব কাছাকাছি এসে কৌতূহল নিবৃত্ত করে সে আবার প্রস্থান করত–বিনা কারণে সাধারণত কেপ-বাফেলো মানুষকে আক্রমণ করে না। দুর্ভাগ্যবশত মডিদের মধ্যে একজন মহিষটাকে লক্ষ করে বর্শা ছুড়ল। লোকটির নিক্ষিপ্ত অস্ত্র লক্ষ্য ভেদ করল বটে কিন্তু মহিষ একটুও কাবু হল না–মডিদের মাছ-মারা বর্শার খোঁচায় ওই দুর্দান্ত জানোয়ারের কী হবে!

লাঙ্গি নামক যে-যুবকটি বর্শা নিক্ষেপ করেছিল আহত মহিষ তার দিকেই তেড়ে এল।

দলের সবাই ছুটে গাছে উঠে পড়ল, কিন্তু লাঙ্গি পালাতে পারল না ক্ষিপ্ত মহিষ শিং-এর আঘাতে তার পেট চিরে ফেলল। রক্তাক্ত ও বিদীর্ণ উদর নিয়ে ধরাশায়ী হল লাঙ্গি।

মহিষের ক্রোধ তবু শান্ত হল না–সে ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর দেহের ওপর!

বিপুলবপুমহিষের পায়ের তলায় চূর্ণ হয়ে গেল হতভাগ্যের অস্থিপঞ্জর। অনেকক্ষণ ধরে অভাগার দেহের ওপর চলল মহিষাসুরের তাণ্ডবনৃত্য–অবশেষে ওই দানব অদৃশ্য হল অরণ্যের অন্তরালে…

গাছের ওপর যারা ছিল তারা অনেকক্ষণ নীচে নামতে সাহস করেনি। মহিষের প্রস্থানের পর প্রায় তিন ঘণ্টা পরে গাছ থেকে নেমে এল তিনটি ভয়ার্ত মানুষ এবং গাছের ডাল কেটে একটা বিছানা তৈরি করে মৃত সঙ্গীর দেহটাকে সেই কাষ্ঠনির্মিত শয্যায় শুইয়ে দিলে। তারপর সেই অপরূপ শবাধার বহন করে তারা তাবুতে ফিরে আসে..

পরদিন সকালে গুলিভরা রাইফেল হাতে ক্যাথার্লি ওই খুনি মহিষটার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। নিহত যুবকের বর্শার আঘাতে আহত হয়েছিল মহিষ–ক্ষতস্থান থেকে নিঃসৃত রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চললেন শ্বেতাঙ্গ শিকারি, তাঁর সঙ্গে চলল টোনিও এবং আরও দুজন মডি যুবক।

রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করতে করতে নদীর ধারে এসে সকলে দেখল একটা মস্ত বাঁশবনের শেষে ঘন পাপিরাস ঘাসের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে রক্তরেখা–

অর্থাৎ ওই ঘাসঝোপের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করেছে মহিষ।

সকলেই বুঝল ওই ঘন ঘাসঝোপের ভিতর পদার্পণ করলে পৈতৃক প্রাণটিকে ওখানেই রেখে আসতে হবে। ক্যাথার্লি সাহসী শিকারি, কিন্তু তিনি শিকার করতে এসেছিলেন, আত্মহত্যা করতে আসেননি–

বাঁশবনের সামনে ঝোপের মুখোমুখি দাঁড়ালেন শিকারি, তাঁর আদেশে টোনিও এবং তার দুই সঙ্গী পাপিরাস ঝোপে আগুন লাগিয়ে দিলে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল, ঝোপটাকে ঘিরে নেচে উঠল লেলিহান অগ্নিশিখা…।

আচম্বিতে জ্বলন্ত ঝোপ ভেদ করে তিনটি মানুষের সামনে আবির্ভূত হল ক্রুদ্ধ মহিষাসুর!

মহিষ ছুটে এল মানুষগুলির দিকে।

গর্জে উঠল ক্যাথার্লির রাইফেল। দুর্ভাগ্যবশত গুলি লাগল মহিষের মাথায়–ইস্পাতের মতো কঠিন অস্থি-আবরণের ওপর ফেটে গেল রাইফেলের টোটা!

দ্বিগুণ বেগে ধেয়ে এল মহিষ!

একজন মডি সভয়ে আর্তনাদ করে উঠল, তারপর পিছন ফিরে পা চালিয়ে দিলে তিরবেগে। অভাগা জানত না যে ধাবমান শিকারের দিকেই সর্বাগ্রে আকৃষ্ট হয় হিংস্র পশু

মহিষ তৎক্ষণাৎ লোকটিকে অনুসরণ করল।

আবার অগ্নদগার করে গর্জে উঠল ক্যাথার্লির রাইফেল উপরি-উপরি দু-বার।

গুলির আঘাতে মহিষ হাঁটু পেতে বসে পড়ল।

যে-লোকটি ছুটে পালাচ্ছিল সে ততক্ষণে প্রায় বাঁশবনের কাছে এসে পড়েছে পিছন দিকে দৃষ্টিপাত করে সে দেখল মহিষ ভূতলশায়ী, সে থেমে গেল।

সগর্জনে উঠে দাঁড়াল মহিষ, শরীরী ঝটিকার মতো ধেয়ে এল পলাতক শিকারের দিকে। মডি যুবক ছুটতে শুরু করল, বাঁশবনের অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল ধাবমান দ্বিপদ ও চতুস্পদ, শিকার ও শিকারি… ।

রাইফেল বাগিয়ে ক্যাথার্লি ছুটলেন তাদের পিছনে।

একটা বাঁক ঘুরতেই ক্যাথার্লি দেখলেন মহিষ প্রায় লোকটির ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। আবার গুলি চালালেন শিকারি, তার লক্ষ্য ব্যর্থ হল। পরক্ষণেই মহিষের নিষ্ঠুর শিং দুটো লোকটিকে মাটির ওপর ফেলে দিল–ক্যাথার্লি দেখলেন নিগ্রো যুবকের পৃষ্ঠদেশ বিদীর্ণ করে আত্মপ্রকাশ করেছে এক ভয়াবহ ক্ষতচিহ্ন!

একবার আর্তনাদ করেই লোকটি মৃত্যুবরণ করল।

মহিষ এইবার ক্যাথার্লির দিকে ফিরল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে শিকারি সভয়ে আবিষ্কার করলেন তার রাইফেলে আর একটিও গুলি নেই! কম্পিতহস্তে তিনি তাড়াতাড়ি নূতন টোটা ভরার চেষ্টা করতে লাগলেন…

ক্যাথার্লির সামনে এসে পড়ল মহিষ।

তখনও তিনি টোটা ভরার চেষ্টা করছেন–এখনই বুঝি একজোড়া ধারালো শিং-এর আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শিকারির দেহ…

অকস্মাৎ একটি দীর্ঘাকার মানুষ লাফ দিয়ে ছুটে এল মহিষের দিকে টোনিও!

পিছন দিকে শরীর দুলিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ল টোনিও–জীবন্ত বিদ্যুৎরেখার মতো শূন্যে রেখা কেটে ছুটে এল তার হাতের বর্শা এবং মুহূর্তের মধ্যে মহিষের চিবুক ভেদ করে চোয়ালের দুই দিকে ঝুলতে লাগল বর্শার লৌহদণ্ড!

মহিষ ওই আঘাত গ্রাহ্যই করল না, নীচু হয়ে ক্যাথার্লির উদ্দেশে প্রচণ্ডবেগে চালনা করল ভয়ংকর দুই শৃঙ্গ

কিন্তু ব্যর্থ হল তার আক্রমণ।

তার চোয়ালে আবদ্ধ বর্শার দুই প্রান্ত আটকে গেল দু-পাশের বাঁশগাছে।

শিং-এর পরিবর্তে তার মাথাটা ধাক্কা মারল শিকারির দেহে এবং সেই দারুণ ধাক্কায় ছিটকে। মাটির ওপর চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলেন ক্যাথার্লি।

মহিষ তার শিং দুটিকে নামিয়ে আবার শিকারির দেহে আঘাত করার চেষ্টা করল।

তার চেষ্টা সফল হল না। চোয়ালে আবদ্ধ সুদীর্ঘ লৌহখণ্ডের দুই প্রান্ত আবার আটকে গেল ধরাশায়ী শিকারির দুই পাশে অবস্থিত ঘনসন্নিবিষ্ট বাঁশগাছের গায়ে।

বার বার সজোরে ঝাঁকানি দিয়েও ক্রুদ্ধ মহিষ বর্শাটাকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারল না, তার চোয়াল বিদ্ধ করে মুখের দু-পাশে কাঁপতে লাগল টোনিওর বর্শা–এদিকে চার ফুট, ওদিকে চার ফুট!

ক্যাথার্লি তখনও প্রাণের মায়া ছাড়েননি, কম্পিত হস্তে তখনও রাইফেলের টোটা ভরতে চেষ্টা করছেন।

কিন্তু তার চেষ্টা বুঝি সফল হয় না–

মহিষ হঠাৎ পিছনের দুই পায়ে উঠে দাঁড়াল, এইবার তার সামনের দুই পা প্রচণ্ড বেগে এসে পড়বে শিকারির বুকের ওপর, সঙ্গেসঙ্গে ভেঙে যাবে শিকারীর বক্ষপঞ্জর

ঠিক সেই মুহূর্তে ছুটে এল টোনিও, তারপর মহিষের মুখের দু-ধারে বিদ্ধ বর্শাদণ্ডের এক প্রান্ত ধরে মারল হাচটা টান!

কী অসীম শক্তি সেই বন্য যুবকের দেহে দারুণ আকর্ষণে ঘুরে গেল মহিষ, আবার ব্যর্থ হল তার আক্রমণ!

ভীষণ আক্রোশে ঘুরে দাঁড়িয়ে নূতন শক্তিকে আক্রমণ করার উপক্রম করল মহিষাসুর, আর সঙ্গেসঙ্গে ক্যাথার্লির রাইফেল সগর্জনে অগ্নিবর্ষণ করল।

কর্ণমূল ভেদ করে রাইফেলের গুলি মহিষের মস্তিষ্কে বিদ্ধ হল, পরমুহূর্তেই মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ল সেই ভয়ানক জানোয়ারের প্রাণহীন দেহ।

এতক্ষণ পরে ক্যাথার্লি তার রাইফেলে গুলি ভরতে পেরেছেন!

ক্যাথার্লির মতোই আর একজন সাদা চামড়ার মানুষ স্থানীয় নিগ্রোদের অদ্ভুত সাহসের পরিচয় পেয়ে চমকে গিয়েছিলেন। ওই ভদ্রলোকের নাম কম্যান্ডার এ গন্ডি। তিনি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পূর্বোক্ত সৈনিক কিছুদিন আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন। সেই সময় আফ্রিকার অ্যাংকোল জাতীয় নিগ্রো শিকারিদের মহিষ শিকারের কৌশল স্বচক্ষে দেখেছিলেন তিনি। মানুষ যে ঠান্ডা মাথায় কতখানি সাহসের পরিচয় দিতে পারে, স্নায়ুর ওপর তার সংযম যে কত প্রবল হতে পারে, তা দেখেছিলেন কম্যান্ডার গন্ডি–ধনুর্বাণধারী এক অ্যাংকোলে শিকারির বীরত্ব তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।

তদানীন্তন বেলজিয়ান কঙ্গের যে অঞ্চলে অ্যাংকোলে জাতি বাস করত, সেই জায়গাটা প্রধানত বন্য মহিষের বাসভূমি। বামন মহিষ নয়, অতিকায় মহিষাসুর কেপ-বাফেলোর ভয়াবহ উপস্থিতি অরণ্যকে করে তুলেছে বিপজ্জনক। অ্যাংকোলে নিগ্রোদের ভাষায় পূর্বোক্ত অতিকায় মহিষের নাম জোবি। স্থানীয় মানুষ অর্থাৎ অ্যাংকোলে জাতির নিগ্রোরা খুব লম্বা-চওড়া নয়–বেঁটেখাটো, রোগা ও অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির এই মানুষগুলোকে দেখলে অপরিচিত বিদেশির পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয় যে, প্রয়োজন হলে ওই ছোটোখাটো মানুষগুলো কতখানি দুঃসাহসের পরিচয় দিতে পারে। আফ্রিকার অন্যান্য স্থানে নিগ্রোরা ফাঁদ পেতে অথবা মহিষের চলার পথে গর্ত খুঁড়ে মহিষ-শিকারের চেষ্টা করে, কিন্তু অ্যাংকোলে-শিকারি অমন নিরাপদ পন্থায় শিকারকে ঘায়েল করার পক্ষপাতী নয়। কোন বিস্তৃত যুগে অ্যাংকোলে জাতির পূর্বপুরুষ আবিষ্কার করেছিল মহিষ-চরিত্রের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য–মরা মানুষকে মহিষ আঘাত করে না। তারপর থেকেই যুগযুগান্তর ধরে অ্যাংকোলে শিকারিরা যে পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করে থাকে, সেই বিপজ্জনক পদ্ধতির অনুসরণ করার সাহস অন্য কোনো জাতিরই নেই। কম্যান্ডার গণ্ডি একবার অ্যাংকোলে জাতির মহিষ-শিকারের কায়দা দেখেছিলেন। সমস্ত ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখার পর তিনি বলেছিলেন, সাদা কিংবা কালো চামড়ার অন্য কোনো জাতির শিকারি ওইভাবে অপঘাত মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে সাহস করবে না। নিজের সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে কম্যান্ডার সাহেব জানিয়েছিলেন, পৃথিবীর সেরা লক্ষ্যভেদী শিকারি যদি কাছেই রাইফেল বাগিয়ে বসে থাকে, তাহলেও অ্যাংকোলে জাতির পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করতে তিনি রাজি নন।

ঘটনাটা এইবার বলছি। একটি ছোটোখাটো চেহারার অ্যাংকোলে শিকারি কম্যান্ডার গণ্ডিকে তাদের মহিষ-শিকারের পদ্ধতি দেখাতে রাজি হয়েছিল। অবশ্য লোকটি আগে সাহেবের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিল যে, কোনো কারণেই তিনি উক্ত শিকারিকে বাধা দিতে পারবেন না এবং শোচনীয় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা দেখলেও গুলি চালাবেন না। একটা উঁচু গাছের ওপর কম্যান্ডার সাহেব যখন বসলেন, তখনই অ্যাংকোলে-শিকারি তার কর্তব্যে মনোনিবেশ করল।

মুক্ত প্রান্তরের উপর এখানে-ওখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল ছোটো ছোটো হলুদ রং-এর ঘাসঝোপ। ওইরকম একটি ঘাসঝোপের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটি। অস্ত্রের মধ্যে তার সঙ্গে ছিল তির-ধনুক আর একটা ছোটো ছুরি।

গাছের উপর থেকে খুব মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে সাহেব আবিষ্কার করলেন, দূর প্রান্তরের সীমানায় যেখানে এক সারি সবুজ ঘাস আত্মপ্রকাশ করেছে, সেইখানে বিচরণ করছে অনেকগুলো কৃষ্ণকায় চতুষ্পদ মূর্তি–মহিষ!

প্রান্তরের বুকে তৃণভোজনে ব্যস্ত মহিষযুথের পিছনে বাঁ-দিকে অবস্থান করছে এক ভীষণদর্শন পুরুষ মহিষ। সাহেব বুঝলেন ওই জন্তুটাই হচ্ছে দলের প্রহরী এবং অ্যাংকোলে-শিকারির লক্ষিত জোবি–ওকেই হত্যা করার চেষ্টা করবে ছোটোখাটো মানুষটি।

গাছের ওপর থেকে সাহেব দেখলেন ঘাসঝোপের ভিতর থেকে হঠাৎ মহিষের খুব কাছেই আবির্ভূত হল একটি মনুষ্যমূর্তি–অ্যাংকোলে-শিকারি!

লোকটি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। গাছের ওপর থেকে তার শরীরটা সাহেবের দৃষ্টিগোচর হলেও মাটিতে দাঁড়িয়ে মহিষের পক্ষে লোকটিকে দেখা সম্ভব ছিল না। লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে চটপট ধনুক থেকে তির নিক্ষেপ করে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ধনুকের টংকার-শব্দ সাহেবের কানে এল। সঙ্গেসঙ্গে একটা সংঘাতের আওয়াজ এবং জান্তব কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি–মহিষের স্কন্ধে বিদ্ধ হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে একটা তির।

সর্বনাশ, সাহেব মনে মনে বললেন, এইবার তিরবিদ্ধ মহিষ নিশ্চয়ই হাঁক দিয়ে দলকে সংকেত জানাবে। সেই শব্দ শোনামাত্র মহিষের দলটা ছুটে আসবে অ্যাংকোলে-শিকারির দিকে।

সে-রকম কিছু হল না। আহত মহিষ একটা অস্পষ্ট আওয়াজ করল, বিরক্তভাবে দুই-একবার মাথা নাড়ল, মনে হল একটা বিরক্তিকর মাছিকে সে তাড়াতে চেষ্টা করছে–তারপর চারদিকে সঞ্চালিত করল তীক্ষ্ণদৃষ্টি যেন এক গোপন শত্রুকে সে আবিষ্কার করতে চাইছে!

উদবেগজনক কয়েকটি মুহূর্ত… মহিষযূথ সরে যাচ্ছে দূরে… সঙ্গীদের গতিবিধি লক্ষ করছে তিরবিদ্ধ মহিষ। সে এখনও বুঝতে পারছে না সঙ্গীদের অনুসরণ করা উচিত, না তাদের ফিরেআসার জন্য হাঁক দেওয়া উচিত। মহিষ তার কর্তব্য স্থির করার সময় পেল না, আংকোলে শিকারি নি মাটিতে। দ্বিতীয় তিরটা ঘাড়ের ওপর লোকটিকে সে দেখতে পায়নি বটে, তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলল তির ছুড়ল, তারপর শুয়ে পড়ল মাটিতে। দ্বিতীয় তিরটা ঘাড়ের ওপর বিঁধতেই খেপে গেল মহিষ। লোকটিকে সে দেখতে পায়নি বটে, কিন্তু শ্রবণেন্দ্রিয়ে ধরা পড়েছে ধনুকের অস্পষ্ট টংকার ধ্বনি–শব্দের দিকনির্ণয় করতেও মহিষের ভুল হল না।

যেদিক থেকে শব্দ এসেছে, সেইদিকেই ছুটল মহিষ… কিন্তু সোজা নয়–বৃত্তের আকারে গোল হয়ে ঘুরে জন্তুটা সঙ্গেসঙ্গে মাথা উঁচুকরে বাতাস থেকে শত্রুর গায়ের গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। সাহেব যে গাছটার উপর আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই গাছ আরশায়িত নিগ্রো শিকারির মধ্যবর্তী স্থানের মাঝামাঝি এসে মহিষ বোধ হয় মানুষের গায়ের গন্ধ পেল, সে থমকে দাঁড়াল, বার বার বাতাসে ঘ্রাণ গ্রহণ করল তারপর আবার কয়েক পা এগিয়ে বাতাস শুঁকতে লাগল… অবশেষে মানুষটাকে সে আবিষ্কার করে ফেলল। ঠিক যে জায়গায় নিগ্রো শিকারি, সেই দিকেই ছুটল মহিষ। দিকনির্ণয়ে তার একটুও ভুল হয়নি, পদভরে মাটি কাঁপিয়ে সে ধেয়ে এল উল্কাবেগে।

গাছের উপর থেকে সাহেবের মনে হল, ধরাশায়ী মানুষটার ওপর এসে পড়েছে একজোড়া প্রকাণ্ড শিং, এই বুঝি হতভাগ্য শিকারিকে মাটিতে গেঁথে দেয় একজোড়া জান্তব তরবারি। কিন্তু সেই রক্তাক্ত দৃশ্যে সাহেবের দৃষ্টি পীড়াগ্রস্ত হওয়ার আগেই অকুস্থল থেকে একটি ধুলোর মেঘ লাফিয়ে উঠে তার দৃষ্টিশক্তিকে আচ্ছন্ন করল। একটু পরেই জোর বাতাসের ধাক্কায় সরে গেল ধুলো। সাহেব দেখলেন, অ্যাংকোলে-শিকারি অক্ষত অবস্থায় মাটিতে আর তার সামনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে মহিষ। জন্তুটা অস্থিরভাবে মাটিতে পদাঘাত করছে এবং তার নাসিকা ও কণ্ঠ থেকে উদগীর্ণ হচ্ছে অবরুদ্ধ রোষের ভয়াবহ ধ্বনি।

কম্যান্ডার সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেখলেন মহিষ পিছন ফিরল। কিন্তু না–অত সহজে রেহাই দিল না যমদূত ক্ষণিকের জন্য লাফিয়ে সরে গিয়েছিল মহিষ, তৎক্ষণাৎ ঘুরে এসে আবার মানুষটাকে পরীক্ষা করতে লাগল সে।

লোকটি একটুও নড়ছে না, তার ধরাশায়ী দেহে কোথাও জীবনের লক্ষণ নেই। তার সর্বাঙ্গে পড়ছে মহিষের তপ্ত নিশ্বাস, কানে আসছে রক্ত-জল-করা গর্জনধ্বনি, খুরের আঘাতে কাঁপছে তার পাশের মাটি–তবু অ্যাংকোলে-শিকারির দেহ নিস্পন্দ, নিশ্চল!

সাহেব অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, নিজের ওপর কতখানি কর্তৃত্ব থাকলে ওই অবস্থায় মড়ার ভান করে পড়ে থাকা যায়!

অনেকক্ষণ পরীক্ষা করার পর মহিষ ফিরে গেল। লোকটি তখনও ধরাশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করল না। ভালোই করল, কারণ, একটু দূরে গিয়েই আবার ফিরল মহিষ। আগের মতোই শায়িত মনুষ্যদেহের চারপাশে চলল মহিষাসুরের আস্ফালন, পরীক্ষা-নিরীক্ষণ, তারপর আবার ফিরে অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করল জন্তুটা।

সাহেবের সর্বাঙ্গ দিয়ে তখন ঘাম ছুটছে। তিনি এতক্ষণে বুঝেছেন কেন অ্যাংকোলে জাতি এমন বিপজ্জনক পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করে। তিরের বিষ মহিষের দেহে প্রবেশ করার অনেক পরে তার মৃত্যু হয়। এক-শো ফুটের বেশি দূর থেকে তির ছুঁড়ে মহিষকে কাবু করা সম্ভব নয়–কারণ, দূরত্ব বেশি হলে নিক্ষিপ্ত তিরের আঘাত করার ক্ষমতা কমে যায়। এক-শো ফুটের মধ্যে গাছে উঠে মহিষকে আঘাত করাও অসম্ভব–তিরের নাগালের মধ্যে আসার আগেই মহিষের দৃষ্টি বৃক্ষে উপবিষ্ট শিকারির দিকে আকৃষ্ট হবে এবং সে সবেগে স্থান ত্যাগ করবে, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। মাটিতে দাঁড়িয়ে কোনো গোপন স্থান থেকে মহিষকে তিরবিদ্ধ করলে শিকারির মৃত্যু অনিবার্য; মহিষের তিনটি ইন্দ্রিয়ই শক্তিশালী চক্ষু-কর্ণ-নাসিকার ত্র্যহস্পর্শ যোগে মহিষ চটপট শিকারির অস্তিত্ব আবিষ্কার করে তার দিকে ধাবিত হবে এবং তিরের বিষ মহিষের রক্তে সঞ্চারিত হয়ে তার মৃত্যু ঘটানোর আগেই তীক্ষ্ণ শিং আর খুরের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত এক মাংসপিণ্ডে পরিণত হবে শিকারির দেহ! ছুটে পালানো সম্ভব নয়, মানুষ আর মহিষের দৌড় প্রতিযোগিতায় মানুষের জয়লাভের কোনো আশাই নেই!

মৃতদেহের প্রতি মহিষের অহিংস মনোভাবের সুযোগ গ্রহণ না-করলে অ্যাংকোলে-শিকারির পক্ষে অন্য কোনো উপায়ে মহিষ-মাংস সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, সেইজন্যই ধনুর্বাণ-সম্বল অ্যাংকোলে জাতি এমন বিপজ্জনকভাবে মহিষ শিকারে প্রবৃত্ত হয়।

আচ্ছা, এইবার কাহিনির পূর্ব সূত্র ধরে দেখা যাক আমাদের পরিচিত অ্যাংকোলে-শিকারির ভাগ্যে কী ঘটল। মহিষ আরও কয়েকবার শিকারির কাছে এসে ফিরে গেল–পাঁচ-পাঁচ বার ওইভাবে ছুটোছুটি করার পর মহিষ যখন আরও একবার ঘুরে আসছে, সেই সময় সাহেব দেখলেন জন্তুটা হঠাৎ হাঁটু পেতে বসে পড়ল–তারপর এক ডিগবাজি খেয়ে সশব্দে শয্যাগ্রহণ করল মাটির ওপর, আর উঠল না।

সাহেব বুঝলেন মহিষের মৃত্যু হল, এতক্ষণ পরে কার্যকরী হয়েছে তিরের বিষ!

মহিষের মৃতদেহ থেকে প্রায় পনেরো ফুট দূরে শায়িত একটা নিশ্চল মনুষ্যমূর্তি হঠাৎ সচল হয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর দূরবর্তী মহিষফুথের প্রস্থানপথের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সর্বাঙ্গ থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলল এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো টান করে আড়ষ্টভাব কাটিয়ে নিয়ে বাঁ-হাতে আটকানো খাপ থেকে ছুরিটা টেনে নিল। বৃদ্ধাঙ্গুলির উপর একবার ছুরির ধার পরখ করে নিয়ে অ্যাংকোলে-শিকারি তার পরবর্তী কর্মসূচি অনুসরণ করতে উদ্যত হল।

গাছ থেকে নেমে কম্যান্ডার সাহেব যখন লোকটির কাছে এসে পৌঁছালেন, সে তখন অভ্যস্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে জোবির মৃতদেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত। লোকটির ভাবভঙ্গি দেখে সাহেবের মনে হল সে যেন খুব সহজভাবে একটা দোকানে বসে কসাই-এর কর্তব্য করছে তার নির্লিপ্ত আচরণ দেখে কে বলবে একটু আগেই তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছিল মূর্তিমান মৃত্যুদূত।

লোকটি মাথা না-তুলেই সাহেবের উপস্থিতি অনুভব করল, নিবিষ্ট চিত্তে মৃত পশুর চামড়াতে ছুরি চালাতে চালাতে সে বলল, একটু পরেই আমার পরিবারের সবাই এখানে এসে পড়বে। সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই এই চমৎকার মাংস তারা ঘরে নিয়ে যাবে।

সাহেব বললেন, কিন্তু জোবির বদলে যদি তারা তোমার মরা শরীরটা পড়ে থাকতে দেখত, তাহলে কী হত?

নির্বিকারভাবে শিকারি উত্তর দিল, তাহলে আমার পরিবারের লোকরা ছেঁড়াখোঁড়া শরীরের টুকরোগুলো নিয়ে গ্রামের পিছনে পুঁতে ফেলত। ওইখানে কোনো খারাপ প্রেতাত্মা যায় না।

[বৈশাখ ১৩৭৬]

অস্ট্রেলিয়ার লাল আতঙ্ক

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ওয়ারুনা উপত্যকার বুকে একদিন প্রভাতের শান্ত নীরবতা ভঙ্গ করে জেগে উঠল মেষশাবকের করুণ আর্তস্বর!

পূর্ব দিগন্তে সবেমাত্র আত্মপ্রকাশ করেছে প্রভাতসূর্য, এমন সময়ে পূর্বোক্ত মেষশাবকের আর্তনাদ লক্ষ করে এগিয়ে এল এক অশ্বারোহী মেষরক্ষক।

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে মেষরক্ষক চতুর্দিক নিরীক্ষণ করল, তারপর ঘোড়া থামিয়ে সে অবতীর্ণ হল মাটির ওপর।

একটি মেষশাবক কাতর স্বরে আর্তনাদ করতে করতে তার দিকে এগিয়ে এল, কিন্তু অশ্বারোহী তার দিকে নজর দিল না–

চতুর্দিকে অবস্থিত মেষপালের দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে অশ্বারোহীর দৃষ্টি।

হ্যাঁ, ভেড়ার দলটা সেখানেই ছিল। যে বিস্তীর্ণ তৃণভূমিকে লোহার জাল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে তারই মধ্যে এককোণে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে একদল ভেড়া; হঠাৎ দেখলে মনে হয় কোনো অদৃশ্য মেষপালক জন্তুগুলিকে ওইভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

পূর্বোক্ত তৃণভূমির উপর আরও যে ভেড়াগুলির দিকে অশ্বারোহীর দৃষ্টি পড়েছে তারা কিন্তু এক জায়গায় দণ্ডায়মান নয়! ঘাসজমির উপর এখানে-ওখানে ছড়িয়ে থাকা কুড়িটা ভেড়ার মধ্যে অধিকাংশের দেহেই প্রাণের চিহ্ন নেই, দু-একটা জন্তু কেবল মৃত্যুযাতনায় ছটফট করছে! চারদিকে খালি রক্ত আর রক্ত–অদৃশ্য আততায়ী রাতের অন্ধকারে হত্যালীলা চালিয়ে আবার অন্ধকারেই আত্মগোপন করেছে।

এই রক্তাক্ত ও ভয়াবহ দৃশ্যের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে চলল তার আস্তানার দিকে…।

দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে একটু পরেই সদলবলে অকুস্থলে উপস্থিত হলেন ওয়ারুনার মেষপালের মালিক। তাঁর নির্দেশে মৃত জন্তুগুলির রোমশ চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে মাংসপিণ্ডগুলিকে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে সমর্পণ করা হল। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কে বা কারা দায়ী সে-কথা বুঝতে অবশ্য কারো অসুবিধা হয়নি; কারণ অস্ট্রেলিয়ার অরণ্যে একমাত্র বিভীষিকা হচ্ছে ডিংগো (Dingo) নামক একধরনের বুনো কুকুর–বাঘ, ভালুক, সিংহ প্রভৃতি শ্বাপদ এখানে অনুপস্থিত। ডিংগোর আক্রমণে প্রতি বৎসরই বহুসংখ্যক মূল্যবান ভেড়া প্রাণ হারায়, তাই অস্ট্রেলিয়ার মেষপালকরা বাধ্য হয়ে বিস্তীর্ণ তৃণভূমির চারদিক লোহার জাল দিয়ে ঘিরে ভেড়াগুলিকে ওই আবেষ্টনের ভিতর ছেড়ে দেয়। ওয়ারুনার মালিকও ভেড়াগুলিকে লোহার জাল দিয়ে ঘিরে নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু পূর্বোক্ত আবেষ্টনের ভিতর যে ষাঁড়টা ছিল সে একদিন তো মেরে লোহার জালের একস্থানে ছিদ্রের সৃষ্টি করল। ডিংগোটা সেই ফাঁক দিয়ে ভিতরে এসে এক রাতের মধ্যেই তেইশটা স্ত্রীজাতীয় মেষ ও মেষশাবকের প্রাণ হরণ করে। নিহত মেষগুলির দেহ পরীক্ষা করে দেখা গেছে মাত্র চারটি ভেড়ার কিডনি ভক্ষণ করেছে জন্তুটা, অন্য ভেড়াগুলিকে সে হত্যা করেছে কেবল হত্যার আনন্দ চরিতার্থ করার জন্যে।

যে-ষাঁড়টা লোহার জালে ঢুঁ মেরে বেড়া ভেঙে ফেলেছিল এবং যার জন্য এতগুলো মূল্যবান ভেড়ার প্রাণহানি ঘটল, সেই হতভাগা ষাঁড়টাকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হল। তারপর ছিদ্রটাকে ভালো করে মেরামত করিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন ওয়ারুনার মেষপালের মালিক।

কিন্তু ছয় সপ্তাহ পরেই একদিন সকালে জনৈক অশ্বারোহী মেষরক্ষক লোহার জালের গায়ে একটা ফুটো দেখতে পায়। পরীক্ষা করে দেখা গেল ধারালো দাঁতের সাহায্যে লোহার জাল কেটে ওই ছিদ্র সৃষ্টি করা হয়েছে!

অকুস্থলে এসে ছাদাটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন ওয়ারুনার মালিক। ওই শক্ত লোহার জাল দাঁত দিয়ে কেটে ফেলা ডিংগোর পক্ষে প্রায় অসম্ভব, কিন্তু এই শয়তান ডিংগোটা অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলেছে!

যে-ডিংগোটা জাল ফুটো করেছে পূর্ববর্তী হত্যাকাণ্ডের জন্য যে সেই জন্তুটাই দায়ী এ-বিষয়ে মালিকের সন্দেহ ছিল না; কারণ ডিংগো-চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যেখানে একবার সে শিকার সংগ্রহ করে সেখানে আবার সে ছয় সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসবেই আসবে। এখানেও দ্বিতীয়বার জন্তুটার আবির্ভাব ঘটেছিল ছয় সপ্তাহের মধ্যে এবং ভিতরে প্রবেশ করার জন্য সে একই উপায় অবলম্বন করেছিল। অতএব অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই অনুমান করতে পারবেন যে একটা জানোয়ার বার বার এখানে হামলা করতে আসছে এবং এই ভয়ানক ডিংগোটার কাছে লোহার জালও দুর্ভেদ্য নয়!

মালিক বুঝলেন, জন্তুটা ভয়ংকর শক্তিশালী, অবিলম্বে এই খুনিটাকে শেষ করতে না-পারলে তাঁর পোষা ভেড়াগুলিকে তিনি রক্ষা করতে পারবেন না।

জালের ফুটো মেরামত না-করে ওয়ারুনার মালিক ফুটোর মুখে একটা ইস্পাতের ফাঁদ সাজিয়ে রাখলেন। শুধু তাই নয়, কয়েকটা নিহত ভেড়ার কিডনিতে বিষ মাখিয়ে সেই বিষাক্ত কিডনিগুলোকে আশেপাশে ছড়িয়ে দেওয়া হল। মালিক সেই রাত্রে নিশ্চিন্ত হয়েই শয্যা আশ্রয় করেছিলেন, পরের দিন সকালে উঠে তিনি যে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ডিংগোটাকে দেখতে পাবেন এ-বিষয়ে তার একটুও সন্দেহ ছিল না।

কিন্তু পরের দিন সকালে ফাঁদের কাছে এসে ওয়ারুনার মালিক হয়ে গেলেন হতভম্ব!

বিষাক্ত কিডনিগুলোকে স্পর্শও করেনি জন্তুটা, কিন্তু ফাঁদের মধ্যে আটকে রয়েছে লালচে-বাদামি রং-এর একটা কুকুরের ঠ্যাং!

ব্যাপারটা কী হয়েছিল খুব সহজেই অনুমান করা যায়–ফাঁদের মধ্যে আটকে গিয়েছিল ডিংগোর একটা পা এবং প্রাণপণ চেষ্টাতেও শ্রীচরণকে ফাঁদের করাল দংশন থেকে মুক্ত করতে না-পেরে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে পা-টিকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে পলায়ন করেছে ডিংগো!

ফাঁদের মধ্যে আটকানো কাটা ঠ্যাংটার লালচে বাদামি রং দেখে স্থানীয় অধিবাসীরা জন্তুটার নাম রাখল রেড কিলার বা লাল খুনি!

কিছুদিন ধরে স্থানীয় মানুষ জন্তুটাকে নিয়ে মাথা ঘামাল; ওই লাল রং-এর খুনি জানোয়ার আবার ভেড়ার দলের উপর হানা দেবে কি না এই নিয়ে মেষরক্ষকদের মধ্যে চলল তুমুল তর্ক ও আলোচনা কিন্তু পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেও যখন কুকুরটা আর আত্মপ্রকাশ করল না তখন সকলে তার কথা ভুলে গেল…

কিন্তু হঠাৎ একদিন স্থানীয় পশুপালক ও মেষরক্ষকদের গতানুগতিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে ওয়ারুনা উপত্যকার বুকে আবার হানা দিল মূর্তিমান অভিশাপের মতো রেড কিলার!

..প্রতিদিনের অভ্যাস অনুযায়ী এক ব্যক্তি তার গোরুটাকে দোহন করে দুগ্ধ সংগ্রহ করতে এসেছিল। দুধের বালতি হাতে নিয়ে গোয়ালের দরজাটা সে খুলে ফেলল, সঙ্গেসঙ্গে স্তম্ভিত বিস্ময়ে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল–তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক ভয়াবহ দৃশ্য!

রক্তাক্ত দেহে জিভ বার করে অতিকষ্টে নিশ্বাস ফেলছে গোরুটা এবং তার সামনেই প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে আছে একটা ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত গো-বৎস!

জমি পরীক্ষা করে দেখা গেল একটা ভীষণ লড়াই হয়েছে। আক্রমণকারীর কবল থেকে গোরুটা তার বাছুরকে রক্ষা করার জন্য খুবই চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি। আক্রমণকারী জীবটি গোরুটার পিছনের পায়ের একটি শিরা কেটে তাকে অকর্মণ্য করে অসহায় বাছুরটাকে হত্যা করেছে। গোরুটা যে শুধু খোঁড়া হয়ে চলৎশক্তি হারিয়েছে তাই নয়, উপরন্তু তীক্ষ্ণ দন্তাঘাতে তার সর্বাঙ্গ হয়েছে রক্তাক্ত এবং লাঙ্গুলের অর্ধ-অংশ হয়েছে বিচ্ছিন্ন! হত্যাকারী বাছুরটার মাংস ভক্ষণ করেনি, কিন্তু নিহত গো-শাবকের হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে।

দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও গোয়ালের ভিতর হত্যাকারীর প্রবেশ ঘটল কীভাবে?

অনুসন্ধানের ফলে জানা গেল বেড়ার গায়ে ফুটো করে হত্যাকারী ভিতরে ঢুকেছিল এবং জমির উপর পদচিহ্ন পরীক্ষা করে সকলেই বুঝল, যে হিংস্র শ্বাপদ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সে মাত্র তিনটি পা-র অধিকারী; অর্থাৎ এবারের হত্যালীলার জন্যও দায়ী হচ্ছে রেড কিলার!

তিনটি মাত্র ঠ্যাং-এর ওপর ভর দিয়েই খুনি জানোয়ারটা আবার হত্যার আসরে আবির্ভূত হয়েছে।

এই ঘটনার পর স্থানীয় পশুপালক ও মেষরক্ষকরা অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ল।

অস্ট্রেলিয়ার গভর্নমেন্ট হঠাৎ ডিংগো সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠলেন। এই বুনো কুকুরগুলো প্রতি বৎসরই বহু মূল্যবান মেষ হত্যা করে, ফলে পশম রপ্তানি হয় অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এবং গভর্নমেন্টকেও বেশ কিছুটা আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়।

–অস্ট্রেলিয়ার গভর্নমেন্ট এই সময়ে প্রতি ডিংগোর মাথা পিছু তিন পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করলেন। সরকারের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্বে উল্লিখিত ওয়ারুনার পশুপালকও রেড কিলার-এর মাথার উপর পাঁচ পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করলেন। উক্ত পশুপালকের দুই প্রতিবেশীও জানালেন জন্তুটাকে যে হত্যা করতে পারবে তাকে পুরস্কার দিতে তারাও রাজি আছেন।

সব নিয়ে মোট পুরস্কারের অঙ্ক হল পনেরো পাউন্ড। টাকার অঙ্কটা খুব কম নয়।

টাকার লোভে পেশাদার শিকারিরা ডিংগোটাকে হত্যা করতে সচেষ্ট হল। কিন্তু শিকারির ফাঁদ এবং বন্দুকের গুলিকে ফাঁকি দিয়ে অদ্ভুত চাতুর্যের সঙ্গে বুনো কুকুরটা গৃহপালিত পশুদের উপর হামলা চালাতে লাগল, কিছুতেই তাকে জব্দ করা গেল না। বিষাক্ত মাংসের টোপ দিয়েও তাকে প্রলুব্ধ করা যায়নি; রাতের পর রাত জেগে গাছের উপর পাহারা দিয়েছে বন্দুক হাতে শিকারির দল, কিন্তু কুরকুরটা তাদের অনায়াসে ফাঁকি দিয়েছে বারংবার!

রেড কিলার-এর উদ্দেশে পাতা ফাঁদের মধ্যে ধরা পড়ল ক্যাঙারু, ওয়ালবি প্রভৃতি জানোয়ার, এমনকী কয়েকটা ডিংগোও শিকারিদের ফঁদে ধরা পড়েছিল কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন সেই তিন-পা-ওয়ালা শয়তানটা কোনো ফাঁদের আলিঙ্গনে বন্দি হল না, একটা পা হারিয়ে জন্তুটা অসম্ভব সতর্ক হয়ে গেছে।

হঠাৎ একদিন গা-ঢাকা দিল অস্ট্রেলিয়ার লাল আতঙ্ক। দীর্ঘদিন ধরে জন্তুটার কোনো খোঁজখবর না-পেয়ে পশুপালকরাও নিশ্চিন্ত হলেন–গোরুভেড়ার অকালমৃত্যুতে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আর রইল না।রেড কিলার নামক জন্তুটার কথা লোকে প্রায় ভুলেই গেল…

খুনি জন্তুটা আবার যেদিন নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করল সেই ভয়াবহ দিনটির কথা একটি মানুষের স্মৃতির কোঠায় চিরদিনই বিরাজ করবে ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের মতো।

ওয়ারুনার জনৈক অশ্বচালক একদিন ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে একটা মেষ-চারণভূমিতে এসে থামল এবং গাড়ি থেকে নেমে উক্ত ঘাসজমির আগাছা পরিষ্কার করতে শুরু করল।

ঘোড়ায়-টানা গাড়িটার পিছন পিছন লোকটিকে অনুসরণ করে পোষা টেরিয়ার কুকুরটিও সেখানে এসে উপস্থিত হল। কুকুরটাকে তার প্রভু খুবই ভালোবাসত, তাই জন্তুটাও সহজে প্রভুর সান্নিধ্য ত্যাগ করতে চাইত না।

হঠাৎ টেরিয়ার কুকুরটার হিংস্র গর্জন শুনে তার মালিক চমকে উঠল। লোকটি অবাক হয়ে দেখল কুকুরটার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে এবং তার সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে নিকটবর্তী ঝোপটার দিকে। লোকটি উঠে গিয়ে ঝোপের ভিতরটা দেখে এল, কিন্তু একটা গিরগিটি ছাড়া কুকুরটার ক্রোধের উদ্রেক করতে পারে এমন কোনো জীবের সাক্ষাৎ পেল না। ফিরে এসে লোকটি আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করল।

একটু পরেই আবার টেরিয়ার কুকুরটা সশব্দে মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এবার কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে ক্রোধ বা বিরক্তির আভাস ছিল না, দারুণ আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে কুকুরটা আর্তনাদ করছিল রুদ্ধস্বরে!

লোকটি অবাক হয়ে ভাবল ঝোপের ভিতর তো কিছুই নেই, তবে জন্তুটা এত ভয় পেল কেন? একবার ঝোপের ভিতর পর্যবেক্ষণ করে লোকটি কিছুই দেখতে পায়নি, তাই এবার সে কাজ ছেড়ে টেরিয়ার কুকুরটার আতঙ্কের কারণ অনুসন্ধান করতে এগিয়ে গেল না। একটু পরে কাজ শেষ করে সে ঘোড়াগুলোর মুখ ঘুরিয়ে গাড়িটাকে ঘাসজমির অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার উদযোগ করল আর ঠিক তখনই ঝোপটার দিকে হঠাৎ নজর পড়তেই সে টেরিয়ার কুকুরটার আতঙ্কের কারণটা বুঝতে পারল।

ঝোপের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে একটা অতিকায় ডিংগো! লালচে-বাদামি রং-এর ডিংগোটার জ্বলন্ত দুই চক্ষুর হিংস্র দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে টেরিয়ার কুকুরটার দিকে।

এমন বৃহৎ বপু ডিংগো-কুকুর ইতিপূর্বে অশ্বচালকের দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রায় তিন ফুট উঁচু এই সারমেয়-দানবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি ডিংগোর মতোই বটে কিন্তু ক্যাঙারু-হাউন্ড নামক অতি বৃহৎ শিকারি কুকুরের সঙ্গেও তার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে।

অশ্বচালক বুঝল এই বর্ণ সংকর ভয়াবহ জন্তুটার জন্ম হয়েছে ক্যাঙারু-হাউন্ড ও ডিংগোর সংমিশ্রণে!

জন্তুটা তিন পায়ে ভর দিয়ে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এল টেরিয়ারের দিকে। লোকটি দেখল কুকুরটার বাঁ-দিকের পা নেই। কনুই থেকে কাটা ছিন্ন অংশটা এই সারমেয়-দানবের ভয়ানক চেহারাটাকে করে তুলেছে আরও ভয়ানক!

মানুষের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অতিকায় ডিংগোটা টেরিয়ার কুকুরটার কাছে এসে দাঁড়াল এবং ছোটো জন্তুটার দেহের ঘ্রাণ গ্রহণ করতে করতে অকস্মাৎ কামড়ে ধরল তার কণ্ঠদেশ–

পরক্ষণেই ঝাঁকুনির পর ঝাঁকুনি!

কুকুরের মনিব এতক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এইবার তার সংবিৎ ফিরে এল। লোকটির কাছে স্প্যানার নামক লোহার যন্ত্র ছাড়া কোনো অস্ত্র ছিল না। পোষা কুকুরটাকে বাঁচানোর জন্য এই স্প্যানারটা নিয়েই সে ছুটে এল এবং যন্ত্রটা দিয়ে বারংবার আঘাত হানতে লাগল ডিংগোর মাথার উপর।

স্প্যানারের আঘাতে শয়তান ডিংগোটা কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না, বরং দ্বিগুণ উৎসাহে কামড়াতে কামড়াতে টেরিয়ার কুকুরটাকে সে টুকরা টুকরো করে ফেলল।

হঠাৎ ডিংগোটা যেন মানুষটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠল। টেরিয়ারের মৃতদেহটা ফেলে দিয়ে সে লোকটির কণ্ঠদেশ লক্ষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অশ্বচালক একহাত দিয়ে নিজের গলাটাকে বাঁচাতে লাগল এবং অন্য হাত দিয়ে স্প্যানারটা বাগিয়ে ধরে অনবরত আঘাত হানতে লাগল বুনো কুকুরটার মাথার উপর। অবশেষে ডিংগো পরাজয় স্বীকার করল, লৌহময় স্প্যানারের সুকঠিন অভ্যর্থনা আর সহ্য করতে না-পেরে জন্তুটা ঝোপের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

লোকটির অবস্থাও খুব ভালো ছিল না, ডিংগোর দন্তাঘাতে তার হাত ও মুখের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছিল অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সেই ক্ষতস্থানগুলো সেলাই করিয়ে লোকটি সেযাত্রা রেহাই পায়।

এই ঘটনার ফলে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল তীব্র উত্তেজনা। দলে দলে অশ্বারোহী মানুষ রাইফেল হাতে বেরিয়ে পড়ল খুনি জানোয়ারটার সন্ধানে, তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে ছিল ক্যাঙারু হাউন্ড নামক শক্তিশালী শিকারি-কুকুর। কিন্তু মানুষ ও সারমেয় বাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি ডিংগোটাকে আবিষ্কার করতে পারল না, সে হঠাৎ ওয়ারুনা উপত্যকার বুক থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন।

কিছুদিন পরেই আবার একটা ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল। উক্ত হত্যাকাণ্ডের বিবরণী থেকে জানা গেল শয়তানটা একেবারে নিঃসঙ্গ নয়, কখনো কখনো সে একাজে সঙ্গীর সাহায্য নিয়ে থাকে। ঘটনার বিবরণ নিম্নে বর্ণিত হল।

ভেড়াগুলিকে পানীয় জল সরবরাহ করার জন্য একটা কূপ নির্মাণের কাজ চলছিল। ওই কাজের পরিদর্শন ও পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন গেমেস এম ডাউনি নামক জনৈক শ্বেতাঙ্গ। একদিন সকাল বেলা ডাউনি সাহেব ঘোড়ার পিঠে চড়ে তার কর্তব্য করছিলেন, হঠাৎ তার চোখে পড়ল তৃণভূমির উপর অবস্থিত মেষপালের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য!

যে ভেড়াগুলো মাঠের উপর চরে বেড়াচ্ছিল সেই জন্তুগুলো হঠাৎ পাগলের মতো ছুটতে শুরু করল এবং মাঠের উপর শুয়ে যে ভেড়াগুলো বিশ্রাম সুখ উপভোগ করছিল তারাও যোগ দিল ধাবমান সঙ্গীদের সাথে!

তাদের উত্তেজনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রায় আধমাইল দূরে দুটো ডিংগোকে দেখতে পেলেন মি. ডাউনি। জন্তু দুটি লৌহজালের আবেষ্টনের বাইরে ঘোরাঘুরি করছিল। মি. ডাউনি বুঝলেন জালের গায়ে একটা ফুটোফাটা প্রবেশপথ আবিষ্কার করার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে ঘোড়া চালিয়ে জন্তু দুটোর দৃষ্টিসীমার বাইরে এসেই তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন মি. ডাউনি এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে উপস্থিত হলেন ওয়ারুনার সেই মালিকের কাছে, যাঁর জমির উপর প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল রেড কিলার।

মি. ডাউনির কাছে সব কথা শুনলেন ওয়ারুনার মালিক, তারপর দুজনে দুটি রাইফেল নিয়ে একটা মোটরে উঠে ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অকুস্থলে এসে তারা দেখলেন ডিংগো দুটো কোন ফাঁকে ভিতরে ঢুকে পড়েছে এবং মিলিতভাবে একটা ভেড়াকে আক্রমণ করে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে।

মি. ডাউনি গুলি চালালেন। দুটো জন্তুর মধ্যে অপেক্ষাকৃত বড়ো কুকুরটা তিনটি মাত্র পা নিয়েই অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে ছুটল লোহার জালের গায়ে অবস্থিত একটা ফোকর লক্ষ করে এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ফুটোটার ভিতর দিয়ে শরীরটা গলিয়ে দিয়ে অপর দিকে লাফিয়ে পড়ল। তবে এই যাত্রা তাকে কিছুটা শাস্তিগ্রহণ করতে হল, ডাউনির রাইফেলের গুলি তাকে মাটির উপর শুইয়ে দিল। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য জন্তুটার চৈতন্য লোপ পেয়েছিল, তারপরই সে ভূমিশয্যা ছেড়ে তিন পায়ের উপর ভর দিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে শিকারিদের দৃষ্টিসীমার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আসল আসামি হাতছাড়া হয়ে গেল দেখে শিকারিরা এইবার দুনম্বর কুকুরটার দিকে নজর দিলেন।

কুকুরটা তখন তার সঙ্গী যেদিকে গেছে তার বিপরীত দিকে ছুটছে।

দুই নম্বর কুকুরটাকে লক্ষ করে ডাউনির রাইফেল অগ্নিবৃষ্টি করল, কিন্তু অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এঁকেবেঁকে ছুটে জন্তুটা বুলেটের দংশন থেকে আত্মরক্ষা করতে লাগল।

ওয়ারুনার মালিক কিন্তু অন্য উপায় অবলম্বন করেছিলেন। গাড়িটাকে তিনি ধাবমান জন্তুটার গায়ের উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর তার চেষ্টা সফল হল–গাড়ির দুটো চাকাই সশব্দে ডিংগোটার দেহের উপর দিয়ে গড়িয়ে গেল। আহত জন্তুটা এইবার হিংস্র আক্রোশে গাড়ির আরোহীদের আক্রমণ করতে উদ্যত হল।

অব্যর্থ নিশানায় গুলি চালিয়ে মি. ডাউনি জন্তুটাকে ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে দিলেন।

কাছে গিয়ে দেখা গেল সদ্যমৃত ডিংগোটা স্ত্রীজাতীয় পশু। এইমাত্র যে তিন-পা-ওয়ালা কুকুরটা শিকারিদের ফাঁকি দিয়েছে মৃত ডিংগোটা যে সেই শয়তান রেড কিলার-এর সঙ্গিনী এ-বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র।

পরবর্তী ঘটনা থেকে জানা যায় সেইদিনই আর একবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল রেড কিলার, কিন্তু প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও সে বিপদকে ফাঁকি দিয়ে পলায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল।

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ যে, খুনি জানোয়ারটা যখন মি. ডাউনির গুলি খেয়ে আহত অবস্থায় একটা ঝোপের মধ্যে শুয়ে বিশ্রাম করছিল, সেই সময় হঠাৎ সে একটি কৃষকের নজরে পড়ে যায়। এক-ঘোড়ায়-টানা একটি গাড়ি চালিয়ে চলেছিল পূর্বোক্ত কৃষক এবং ধাবমান গাড়িটিকে অনুসরণ করে ছুটছিল কৃষকের পোষা কুকুর।

ঝোপের ভিতর শায়িত ডিংগোটাকে দেখেই কৃষক গাড়ি থামিয়ে দিল।রেড কিলার অবশ্য তৎক্ষণাৎ সরে পড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কৃষক তাকে এত সহজে ছাড়ল না–পোষা কুকুরটাকে সে লেলিয়ে দিল তিন-পা-ওয়ালা ডিংগোটার দিকে।

কৃষকের পোষা কুকুরটা ছিল শক্তিশালী ক্যাঙারু হাউন্ড, বনচারী ডিংগোর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রভুর নির্দেশে কুকুরটা ডিংগোকে আক্রমণ করল…

লড়াই চলল কিছুক্ষণ ধরে, তারপর অরণ্যের বন্য বিক্রমের কাছে পরাজয় স্বীকার করল মানুষের গৃহপালিত জীব–কণ্ঠদেশের ওপর সুগভীর দণ্ডাঘাতের চিহ্ন নিয়ে পিছিয়ে এল কৃষকের কুকুর। কৃষক এইবার গাড়িতে-জোতা ঘোড়াটাকে খুলে নিয়ে তার পিঠে উঠে বসল এবং ঘোড়া ছুটিয়ে তেড়ে গেল ডিংগোটার দিকে। কিন্তু ঘন সন্নিবিষ্ট গাছের সারির ভিতর দিয়ে ডিংগোটা কৃষকের ঘোড়াকে ফাঁকি দিয়ে পলায়ন করল…

বেশ কয়েকমাস কাটল নির্বিঘ্নে।

সকলেই নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে যে অস্ট্রেলিয়ার লাল আতঙ্ক নিশ্চয়ই পটল তুলেছে।

কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীদের এই আনন্দ স্থায়ী হল না, আচম্বিতে এক শরীরী দুঃস্বপ্নের মতো আত্মপ্রকাশ করল রেড কিলার–কয়েকদিনের মধ্যেই খুনি ডিংগোটার কবলে প্রাণ হারাল অনেকগুলো মেষ।

শিকারিরা দলে দলে এসে ভিড় করল, কিন্তু তাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ভেড়ার দলের উপর হামলা চালাতে লাগল তিন-পা-ওয়ালা খুনি জন্তুটা। রাতের পর রাত চলল এই হত্যাকাণ্ড আর রেড কিলার নামধারী জন্তুটার মাথার উপর পুরস্কারের অঙ্কটাও বেড়ে চলল অবিশ্বাস্যভাবে। পুরস্কারের লোভে আরও অনেক শিকারি এসে জুটল। কিন্তু ওই লাল রং-এর শয়তান জন্তুটার অসাধারণ ধূর্ত স্বভাব ও ক্ষিপ্রতার কাছে সকলেই হার মানতে বাধ্য হল।

ওয়ারুনার মালিক যখন হতাশ হয়ে পড়েছেন, তখন হঠাৎ একদিন অকুস্থলে আবির্ভূত হল এক ওস্তাদ শিকারি। এই লোকটি সাদা-চামড়ার মানুষ নয়, অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসী এক বর্ণসংকর। স্থানীয় শিকারিটির নামডাক ছিল যথেষ্ট, কিন্তু ওয়ারুনার মালিক তখন প্রায় সকলের উপরই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তবু স্থানীয় শিকারিটি যখন মালিকের কাছে এসে খুনি কুকুরটাকে মারার প্রস্তাব করল, তখন ওয়ারুনার মালিক তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন না।

মালিককে একটিমাত্র প্রশ্ন করলে স্থানীয় শিকারি গুড় আছে?

মালিক বললেন, আছে।

শিকারি গম্ভীরভাবে বলল, তাহলে আর ভাবনা নেই।রেড কিলার এইবার নির্ঘাত মারা পড়বে।

শিকারির নির্দেশ অনুসারে সেই রাত্রে ভেড়াগুলোকে খোঁয়াড়ের ভিতর না-রেখে প্রান্তরের। উপরই ছেড়ে দেওয়া হল। ওই প্রান্তর বা মেষচারণ ভূমির চারপাশে অবশ্য লৌহজালের বেষ্টনী ছিল, কিন্তু ওই জাল কেটে ভেড়া মারতে রেড কিলার কোনোদিনই অসুবিধা ভোগ করেনি। সেই রাতেও ভেড়াগুলোকে প্রান্তরের উপর রেখে শয্যা আশ্রয় করার আগে ওয়ারুনার মালিক ভেবেছিলেন পরের দিন সকালে উঠে নিশ্চয়ই তিনি কয়েকটা ভেড়ার মৃতদেহ দেখতে পাবেন।

হ্যাঁ, মৃতদেহ তিনি দেখেছিলেন বটে, তবে সেটা ভেড়ার মৃতদেহ নয়।

খুব ভোরেই উঠেছিলেন তিনি।

অনুসন্ধান করতে করতে লোহার-জালে-ঘেরা বেষ্টনীর বাইরে এক জায়গায় একটা ডিংগোর মৃতদেহ তার এবং অন্যান্য অনুসন্ধানকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

কাছে এগিয়ে গিয়ে তারা দেখলেন জন্তুটা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার জান্তব বিভীষিকা রেড কিলার!

শিকারি তার কথা রেখেছে!

বহু শিকারি বহুদিন ধরে চেষ্টা করেও যা করতে পারেনি, স্থানীয় মানুষটি সেই অসাধ্য সাধন করেছে–ওয়ারুনা উপত্যকার বুক থেকে তার চেষ্টাতেই বিদায় নিয়েছে শরীরী মৃত্যুর এক জান্তব অভিশাপ!

স্থানীয় শিকারির কৌশলটিও ছিল অপূর্ব।

লোহার জাল-ঘেরা বেষ্টনীর আশেপাশে অনেকখানি জায়গার উপর সে ছড়িয়ে দিয়েছিল গুড়! এমনভাবে ওই জিনিসটা সে বৃত্তাকারে ছড়িয়েছিল যে ডিংগোটার পক্ষে গুড়ের উপর পদার্পণ না-করে ভেড়ার কাছাকাছি আসার উপায় ছিল না। গুড়ের উপর পা পড়তেই চটচটে গুড় কুকুরটার পায়ে আটকে যায়। কুকুর জাতীয় জীবের স্বভাব-অনুসারে ডিংগোটা জিভ দিয়ে চেটে চেটে ওই বিরক্তিকর পদার্থটিকে পা থেকে তুলে ফেলার চেষ্টা করে। গুড়ের স্বাদ ডিংগোর ভালো লাগে, এবার সে বেশ ভালো করেই চেটে চেটে গুড়ের মিষ্ট স্বাদ গ্রহণ করতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যুযাতনায় তার চোখ-মুখ হয়ে যায় বিকৃত!

মৃত্যুর পরেও সেই বিকৃতির চিহ্ন তার মুখ থেকে মিলিয়ে যায়নি!

ওহ হো! একটা কথা বলতে ভুলে গেছি : গুড়ের সঙ্গে শিকারি আর একটি বস্তু মিশিয়ে দিয়েছিল–গ্রাউন্ড সায়ানাইড–তীব্র বিষ!

[জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯]

আঁধার রাতের পথিক

বুড়ো–একটি নাম। নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আতঙ্কের কালো ছায়া… দল নিয়ে নয়, সম্পূর্ণ এককভাবেই সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে বাস করছিল বুড়ো! দলের প্রয়োজন ছিল না, বুড়ো একাই এক-শো! বৃদ্ধ হলেও তার দেহে ছিল অসাধারণ শক্তি, পায়ে ছিল বিদ্যুতের বেগ!

বুড়োর প্রসঙ্গে গল্পের অবতারণা করতে হলে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পুমা নামক জন্তুটির বিষয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। দক্ষিণ আমেরিকার অরণ্যময় পার্বত্য অঞ্চলে পুমার প্রিয় বাসভূমি। স্থানীয় বাসিন্দারা পুমাকে বিভিন্ন নামে ডাকে; সবচেয়ে প্রচলিত নামগুলো হচ্ছে–পুমা, কুগার এবং মাউন্টেন লায়ন বা পার্বত্য সিংহ। পুমা অবশ্য সিংহ নয়, যদিও তার চেহারার সঙ্গে কেশরহীন সিংহের কিছু কিছু সাদৃশ্য আছে। পুমার গায়ের রং ধূসর, দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মস্ত বড় একটা বিড়ালের মতো। বিড়ালজাতীয় অন্যান্য জীব অর্থাৎ বাঘ, সিংহ, লেপার্ড বা নিকটস্থ প্রতিবেশী জাগুয়ারের মতো হিংস্র ও ভয়ানক নয় পুমা। নিতান্ত বিপদে পড়লে সে রুখে দাঁড়ায় বটে কিন্তু পলায়নের পথ খোলা থাকলে সে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে। যুদ্ধবিগ্রহের পক্ষপাতী সে নয়

তাকে নিরীহ আখ্যা দিলে সত্যের বিশেষ অপলাপ হয় না।

মাংসভোজী অন্যান্য শ্বাপদের তুলনায় নিরীহ হলেও পুমা মাংসাশী জীব।

গোরু, ভেড়া, ঘোড়া প্রভৃতি গৃহপালিত পশু তার খাদ্যতালিকার অন্তর্গত। সুযোগ পেলেই স্থানীয় অধিবাসীদের পোষা জানোয়ার মেরে সে শিকারের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। সেইজন্য পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছ মা হচ্ছে চোখের বালির মতোই দুঃসহ।

উপদ্রুত অঞ্চলের পশুপালকরা অনেক সময় পুমাকে দল বেঁধে শিকার করতে সচেষ্ট হয়–প্রয়োজন হলে তারা পুমার পিছনে লেলিয়ে দেয় শিক্ষিত শিকারি কুকুর।

আগেই বলেছি পুমা খুব দুর্দান্ত জন্তু নয়; বরং তাকে শান্তিপ্রিয় ভীরু জানোয়ার বলা যায়।

গৃহপালিত পশুকে সে হত্যা করে উদরের ক্ষুধা শান্ত করবার জন্য কিন্তু শিকারি কুকুরের সাহচর্য সে সভয়ে এড়িয়ে চলে। শিক্ষিত হাউন্ড কুকুর খুব সহজেই পলাতক পুমাকে আবিষ্কার করতে পারে। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রবল পুমার গায়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে সারমেয় বাহিনী তাকে অনায়োসে গ্রেফতার করে ফেলে। বেচারা পুমা গাছে উঠেও নিস্তার পায় না, কুকুরগুলো গাছের তলায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে শিকারিকে পুমার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়। কুকুরের চিৎকার শুনে অকুস্থলে উপস্থিত হয় বন্দুকধারী শিকারি–পরক্ষণেই গাছের উপর থেকে মাটির উপর ছিটকে পড়ে গুলিবিদ্ধ পুমা প্রাণহীন দেহ।

পুমা অনেক সময় গাছ থেকে নেমে চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করে। তৎক্ষণাৎ সারমেয় বাহিনীর আক্রমণে তার দেহ হয়ে যায় ছিন্নভিন্ন দলবদ্ধ শিকারি কুকুরের কবল থেকে কিছুতেই নিস্তার নেই।

কিন্তু ফ্ল্যাটহেড অঞ্চলের বুড়ো হচ্ছে নিয়মের ব্যতিক্রম। কুকুরদের সে ভয় করে না।

ওঃ! বুড়োর পরিচয় তো দেওয়া হয়নি

বুড়ো হচ্ছে আমেরিকার ফ্ল্যাটহেড নামক পার্বত্য অঞ্চলের পুরাতন বাসিন্দা–পূর্ণবয়স্ক একটি পুমা।

ওই এলাকার লোকজন তার নাম রেখেছিল বুড়ো। সমস্ত অঞ্চলটায় আতঙ্কের ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছিল বুড়ো নামধারী পুমা। গোশালার ভিতর থেকে লুট করে নিয়ে যেত নধর গো-বৎস, হত্যা করত গোরুগুলোকে।

এলাকার বিভিন্ন গোশালায় মূর্তিমান মৃত্যুর মতো হানা দিয়ে ঘুরত ওই খুনি জানোয়ার। রাতের পর রাত ধরে চলছিল মাংসাশী দস্যুর নির্মম অত্যাচার…

কুকুর লেলিয়ে দিয়েও বুড়োকে জব্দ করা যায়নি। কুকুরের দল তাকে ঘেরাও করলেই উদ্যত নখদন্ত নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর এবং চটপট থাবা চালিয়ে সারমেয় বাহিনীর ন্যূহ ভেদ করে চম্পট দেয় নিরাপদ স্থানে। পশ্চাৎবর্তী শিকারি অকুস্থলে এসে দেখতে পায় তার কুকুরগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে আর অন্যগুলো রক্তাক্ত দেহে চিৎকার করছে আর্তস্বরে!

একবার নয়, দু-বার নয়–এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে বারংবার! বুড়োর আরও একটি বদনাম ছিল–সে নাকি নরখাদক! বদনামটা অবশ্য কতদূর সত্যি সেই বিষয়ে কারো কারো সন্দেহ। ছিল পুমা নরমাংস পছন্দ করে না, পারতপক্ষে মানুষকে সে এড়িয়ে চলতে চায়।

কিন্তু ফ্ল্যাটহেড অঞ্চলে এমন একটি ঘটনা ঘটল যে স্থানীয় বাসিন্দারা সকলেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হল এই সৃষ্টিছাড়া পুমাটা সুযোগ পেলে মানুষকে হত্যা করে নরমাংস ভক্ষণ করতেও দ্বিধা বোধ করবে না।

ঘটনাটা বলছি—

হারানো গোরুর খোঁজে টহল দিতে দিতে জর্জ টেলর নামে একটি রাখাল হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। প্রতিবেশীরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে সাতদিন বাদে তার মৃতদেহটাকে আবিষ্কার করলে একটা গাছের নীচে। ছিন্নভিন্ন মৃতদেহটার ওপর নজর বুলিয়ে সকলেই বুঝল কোনো মাংসাশী পশু জর্জের দেহটাকে মনের আনন্দে চর্বণ করেছে। আশেপাশে জমির উপর রয়েছে পুমার পায়ের ছাপ।

স্থানীয় অধিবাসীরা বললে জর্জের হত্যাকারী হচ্ছে বুড়ো। অধভুক্ত দেহটা দেখে তারা স্পষ্ট বুঝল বুড়ো একটি ভয়ংকর নরখাদক পুমা।

তারপর থেকে মাঝে মাঝে দু-একটি পথিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ আসতে লাগল। সংবাদগুলো হয়তো সম্পূর্ণ সত্য নয়, হয়তো সেগুলো গুজব মাত্র কিন্তু স্থানীয় মানুষগুলির মধ্যে দারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি হল।

ইতিমধ্যে ওই এলাকায় আবির্ভূত হল একটি নতুন মানুষ। আগন্তুকের নাম অ্যালেন বর্ডার।  সে বুড়োর কথা শুনল বটে কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দিলে না। মানুষ মেরে মাংস খায় এমন পুমার গল্প তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়–নরখাদক পুমার অস্তিত্বে সে বিশ্বাস করে না।

পরবর্তী জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে অ্যালেন জেনেছিল নখদন্তে সজ্জিত মাংসাশী শ্বাপদের খাদ্যতালিকার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই–বন্যপশুর স্বভাবচরিত্র বিশ্লেষণ করতে যদি ভুল হয় তবে ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে সেই ভুলের পরিণাম মারাত্মক হতে পারে।

বার-এক্স নামক একটি র‍্যানব বা গোশালায় চাকরি করতে এসেছিল অ্যালেন বর্ডার। বিভিন্ন কাজের মধ্যে হারানো গোরু বাছুরের সন্ধান নেওয়া ছিল তার অন্যতম কর্তব্য।

সেদিন দুপুরবেলা সে এবং গোশালার মালিক ম্যাকবিল ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়েছিল কয়েকটা নিখোঁজ গোরুর সন্ধানে করার জন্য। অনেকক্ষণ ধরে একটা উপত্যকার উপর তারা নিরুদ্দিষ্ট তিনটি গোরুকে দেখতে পেল। ঘোড়ার লাগামে টান মেরে দুজনেই থমকে দাঁড়াল।

গোরু তিনটির কাছে যেতে হলে প্রায় আধমাইল লম্বা দুর্গম পাহাড়ী পথ বেয়ে যাত্রা করতে হবে। রাতের অন্ধকারে নিজের এলাকার মধ্যে গেলে তিনটি গোরুকেই হত্যা করবে বুড়ো শয়তান; অতএব সকালের জন্যে অপেক্ষা করলে চলবে না।

গোরুগুলোকে বাঁচাতে হলে এখনই তাদের উদ্ধার করা দরকার।

ম্যাকগিলকে ঘরে ফিরে যেতে বলে অ্যালেন পাহাড়ি পথের ওপর দিয়ে গোরুগুলোর দিকে অশ্বকে চালনা করলে।

আকাশে দুলে উঠল সন্ধ্যার ধূসর অঞ্চল, পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় গ্রহণ করছে দিনান্তের শেষ আলোকধারা…

আচম্বিতে হল এক বিপদের সূত্রপাত।

অ্যালেনের বন্দুকটা ঘোড়ার পিঠে বাঁধা ছিল–হঠাৎ বন্ধনরঙ্কু আলগা হয়ে সেটা পড়ে গেল মাটির উপর। সঙ্গেসঙ্গে ভরা বন্দুকের গুলি ছুটে গেল; ঘোড়ার পায়ের তলায় বন্দুকের নল থেকে সগর্জনে নির্গত হলে চকিত অগ্নিশিখা!

ঘোড়া চমকে উঠে লাফ মারল এবং টাল সামলাতে না-পেরে ঘোড়ার পিঠ থেকে অ্যালেন সশব্দে অবতীর্ণ হল কঠিন মৃত্তিকার বুকে! ধরাশয্যায় শুয়ে শুয়েই সে শুনতে পেল পাথুরে জমির উপর বেজে উঠেছে ধাবমান অশ্বের পদশব্দ–ঘোড়া পালিয়ে যাচ্ছে।

অ্যালেন উঠে বসল। তার দেহে কোথাও আঘাত লাগেনি। শরীরের কয়েক জায়গা কেটে অল্পবিস্তর রক্তপাত হয়েছে বটে কিন্তু আঘাতগুলো মোটেই মারাত্মক নয়। বন্দুকটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে অ্যালেন পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটতে লাগল। এই অঞ্চলের পথঘাট তার পরিচিত রাস্তাটা যে ভালোভাবেই চিনতে পেরেছিল।

কয়েক মাইল পথ ভেঙে পাহাড়ের নীচে নামতে পারলেই যে ঢালু জমিটার উপর পৌঁছে যাবে, সেখান থেকে গোশালায় ফিরে যেতে তার অসুবিধা হবে না। গোরুগুলোকে অবশ্য উদ্ধার করা যাবে না; কারণ ততক্ষণে অন্ধকার রাত্রির গর্ভে হারিয়ে যাবে দিবসের শেষ আলোকরশ্মি। ইতিমধ্যেই উপত্যকা আর খাদগুলোর উপর উড়েছে সুদীর্ঘ ছায়ার আবরণ–অন্ধকার হতে আর দেরি নেই।

বন্দুকটা হাতে নিয়ে অ্যালেন পাহাড়ি পথ বেয়ে পদচালনা করলে..

কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যালেনের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে দিলে ঘন অন্ধকার। তারার আলোতে অস্পষ্টভাবে পথ দেখতে দেখতে সে পা ফেলতে লাগল অতি সন্তর্পণে…

হঠাৎ চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অ্যালেন।

তার পিছন থেকে ভেসে এল একটা তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার! নারীকণ্ঠের আর্তস্বর!

এক মুহূর্তের জন্য ভুল করেছিল অ্যালেন। না, কোনো রমণীর কণ্ঠস্বর নয়–ওই ভীষণ চিৎকার ভেসে এসেছে পুমার গলা থেকে। নারীকণ্ঠের সঙ্গে পুমার কণ্ঠস্বরের কিছুটা মিল আছে। বটে কিন্তু এমন ভয়াবহ জান্তব ধ্বনি ইতিপূর্বে অ্যালেনের কর্ণগোচর হয়নি।

অ্যালেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।

নির্ভরযোগ্য কোনো অস্ত্র তার হাতে নেই, যে মস্ত ছোরাটা সে সর্বদাই সঙ্গে রাখে সেটাও আজ সে ফেলে এসেছে তার টেবিলের উপর। হাতের বন্দুকে ছিল একটিমাত্র গুলি, একটু আগের দুর্ঘটনায় সেই গুলিটাও ছুটে গেছে। তবু খালি বন্দুকটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলে অ্যালেন, টোটা না-থাকলেও বন্দুকটাকে মুগুরের মতো ব্যবহার করা যাবে।

আবার! আবার সেই চিৎকার!

অন্ধকার রাত্রির নীরবতা ভঙ্গ করে অ্যালেনের পিছন থেকে ভেসে এল সেই উৎকট শব্দের তরঙ্গ!

দারুণ আতঙ্কে অ্যালেনের ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে উঠল।

নিশ্চিত মৃত্যুর বার্তা বহন করে তার দিকে এগিয়ে আসছে হিংস্র শ্বাপদ!

দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অ্যালেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। অন্ধকারের মধ্যে সংকীর্ণ গিরিপথটা আর এখন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, তবু সে একবারও পথের দিকে দৃকপাত করলে না।

আতঙ্কে আত্মহারা হয়ে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল।

আচম্বিতে তার পায়ের তলা থেকে সরে গেল মৃত্তিকার নিরেট স্পর্শ, পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে খসে পড়ল বন্দুকটা তার হাত থেকে।

অ্যালেন অনুভব করলে তার দেহটা শূন্যপথে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে!

অন্ধের মতো দু-হাত বাড়িয়ে দিতেই তার হাতে কয়েকটা গাছের শিকড় লাগল। শক্ত মুঠিতে শিকড়গুলো চেপে ধরে পতনোন্মুখ দেহটাকে সে কোনোরকমে রক্ষা করলে।

তার পায়ের ধাক্কা লেগে কয়েকটা পাথর পাহাড়ের গা বেয়ে নীচের দিকে গড়িয়ে পড়ল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না–তবু বহুদূরে নীচের দিক থেকে স্থলিত প্রস্তরের যে পতন-শব্দ ভেসে এল সেই আওয়াজ থেকেই অ্যালেন বুঝল তার পায়ের তলায় হাঁ করে আছে গভীর খাদ। এখান থেকে পড়ে গেলে বাঁচবার আশা নেই।

অতিকষ্টে একটু একটু করে সে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল। একটু পরে একটা সংকীর্ণ জায়গায় সে পা রাখার মতো অবলম্বন খুঁজে পেল।

হঠাৎ অ্যালেনের সর্বাঙ্গে জাগল অস্বস্তিকর অনুভূতির তীব্র শিহরন। ঘন অন্ধকার ভেদ করে কোনো কিছু দৃষ্টিগোচর হওয়ার উপায় নেই কিন্তু সে অনুভব করলে শয়তান বুড়ো তার খুব কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে।

মাথার উপর হিংস্র শ্বাপদ, পায়ের তলায় অতলস্পর্শী খাদ–ভয়াবহ অবস্থা!

অকস্মাৎ দারুণ আক্রোশে পরিপূর্ণ হয়ে গেল অ্যালেনের সমগ্র চেতনা। ভয়ের পরিবর্তে জেগে উঠল ক্রোধ। বিদ্যুৎচমকের মতো তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।

বন্দুকটা তার হাত থেকে খসে পড়েছিল বটে কিন্তু অস্ত্রটা তখনও হাতছাড়া হয়নি। চামড়ার ফিতা দিয়ে বন্দুকটা আটকানো ছিল তার কাঁধের সঙ্গে, হাত থেকে খসে পড়লেও অ্যালেনের দেহলগ্ন চর্মরঙ্কুর বন্ধনে ঝুলছিল বন্দুক।

সে এইবার অস্ত্রটাকে বাগিয়ে ধরে কোট এবং টুপি খুলে ফেলল।

বন্দুকের নলের মুখে সে এমনভাবে কোট আর টুপি বসিয়ে দিল যে উপর থেকে দেখলে নির্ঘাত মনে হবে একটা মানুষ টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।

তারপর টুপি-কোট জড়ানো বন্দুকটাকে সে তুলে ধরলে খাদের মুখে।

আচম্বিতে তার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল–অন্ধকারের কালো যবনিকা ভেদ করে জ্বলছে একজোড়া প্রদীপ্ত শ্বাপদ চক্ষু!

পরক্ষণেই অন্ধকারের চেয়েও কালো এক অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল টুপি-কোট–জড়ানো বন্দুকের উপর! সেই দারুণ সংঘাতে। বন্দুকসমেত অ্যালেনের দেহটা আর একটু হলেই ছিটকে পড়ত। খাদের ভিতর কোনোরকমে টাল সামলে নিয়ে সে দেখল গিরিপথের উপর থেকে ঠিকরে এসে তার পাশেই সংকীর্ণ জায়গাটার উপর ভারসাম্য রেখে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। একটা চতুষ্পদ জীব! পুমা!

–দারুণ আতঙ্কে অ্যালেনের কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল এক ভয়াবহ চিৎকার, দু-হাতে বন্দুকটা তুলে ধরে সে আঘাত হানতে উদ্যত হল।

কিন্তু প্রয়োজন ছিল না; পুমার নখগুলো পাথরের ওপর ফসকে গেল, জন্তুটা গড়িয়ে পড়তে লাগল নীচের দিকে!

অ্যালেন দেখল পুমা বার বার নখ দিয়ে পাহাড়ের ঢালু জমি আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে। চেষ্টা সফল হল না।

মহাশূন্যে ছিটকে পড়ে অনেক নীচে অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই অতিকায় মার্জারের দেহ।

সকাল হল। নীচের দিকে তাকিয়ে ধরাশায়ী জন্তুটাকে দেখতে পেল অ্যালেন।

হ্যাঁ, বুড়োই বটে! জন্তুটা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে কিন্তু তখনও মরেনি! তার কপিশ-পিঙ্গল চক্ষু দুটি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অ্যালেনের দিকে!

অ্যালেন সবিস্ময়ে দেখল শ্বাপদের দৃষ্টিতে মৃত্যু-যাতনার চিহ্ন নেই–হিংস্র আক্রোশে দপদপ করে জ্বলছে পুমার দুই প্রদীপ্ত চক্ষু!

অ্যালেন চোখ ফিরিয়ে নিলে অন্যদিকে।

অকস্মাৎ ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো অকুস্থলে উপস্থিত হল অ্যালেনের মনিব ম্যাকগিল এবং দুজন রাখাল। ঘটনাস্থলে তাদের উপস্থিতি খুবই আকস্মিক বটে কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। যে ঘটনার সূত্র ধরে তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল তা হচ্ছে এই :

অ্যালেনের ঘোড়া গতরাত্রেই তার আস্তানায় ফিরে গিয়েছিল। আরোহীবিহীন অশ্বের শূন্য পৃষ্ঠদেশ দেখে ম্যাকগিল উদবিগ্ন হয়ে ওঠে কিন্তু রাতের অন্ধকারে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব নয় বলেই সে অপেক্ষা করতে থাকে প্রভাতের জন্য।

ভোরের আলো ফুটতেই দুজন রাখালকে নিয়ে ম্যাকগিল খোঁজাখুঁজি শুরু করল এবং তার অভিজ্ঞ চক্ষু কিছুক্ষণের মধ্যেই খুঁজে পেল অ্যালেনের জুতোর দাগ। ওই দাগ ধরে একটু যেতেই তাদের চোখে পড়ল পুমার পায়ের ছাপ। শ্বাপদের পদচিহ্ন বিশ্লেষণ করে তারা যখন বুঝল পদচিহ্নের মালিক হচ্ছে বুড়ো এবং সংকীর্ণ গিরিপথে তার লক্ষিত শিকার হচ্ছে অ্যালেন, তখনই তারা অ্যালনকে জীবন্ত অবস্থায় ফিরে পাওয়ার আশা ত্যাগ করেছিল। অক্ষত অবস্থায় নিখোঁজ মানুষটিকে দেখে তারা যেমন খুশি হয়েছিল তেমনই আশ্চর্য হয়েছিল।

ম্যাকগিল তার রাইফেল তুলে নীচের দিকে নিশানা করলে। পরক্ষণেই অগ্নি উদগার করে গর্জে উঠল রাইফেল।

ম্যাকগিলের সন্ধান অব্যর্থ, গুলি মর্মস্থানে বিদ্ধ হল, নিঃশব্দে মৃত্যুবরণ করলে বুড়ো।

ফ্ল্যাটহেড অঞ্চলে শেষ হল বিভীষিকার রাজত্ব।

[১৩৭৮]

আত্মা ও দুরাত্মা

পৃথিবীতে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে যার সঠিক অর্থ বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এই ধরনের একটি কাহিনি আমি সংগ্রহ করেছি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে।

যে ভদ্রলোক এই ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি একজন সম্পন্ন ব্যবসায়ী। ভদ্রলোকের মাতৃভূমি ইংল্যান্ড কিন্তু তার ব্যবসায়ের ক্ষেত্র ছিল আফ্রিকার উগান্ডা নামক স্থানে।

ভদ্রলোকের লিখিত বিবরণী থেকে নিম্নলিখিত কাহিনিটি পরিবেশন করছি—

আমার জমিতে কয়েকজন নিগ্রো শ্রমিক নিযুক্ত করেছিলাম। একদিন শ্রমিকদের দলপতি আমার সঙ্গে দেখা করে জানালে, গত রাত্রে তাদের দলভুক্ত একজন মজুর হঠাৎ মারা পড়েছে। নিগ্রোদের বিশ্বাস ঘরের মধ্যে কোনো লোক মৃত্যুবরণ করলে প্রতিবেশীদের অকল্যাণ হয়। এই জন্য তারা অধিকাংশ সময়ে মুমূর্ষ রোগীকে জঙ্গলের মধ্যে রেখে আসে। রুণ ব্যক্তি বনের মধ্যেই মারা যায়, মৃতদেহের সৎকার হয় না, হায়না প্রভৃতি হিংস্র শ্বাপদ তার দেহের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে, নির্দিষ্ট স্থানে পড়ে থাকে শুধু চর্বিত কঙ্কালের স্তূপ।

অসুস্থ মজুরটির সম্বন্ধেও তার সহকর্মীরা পূর্বোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে চেয়েছিল, কিন্তু দলের সর্দার বাধা দেওয়ায় তাদের পরিকল্পনা কার্যে পরিণত হয়নি। বিগত রাত্রে ওই মুমূর্ষ ব্যক্তি তার কুটিরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। মালিক এখন মৃতদেহ সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা করবেন সেই কথাই জানতে এসেছে সর্দার।

সর্দারের সঙ্গে গিয়ে মৃতদেহটাকে কুটিরের ভিতর থেকে এনে আমার গাড়িতে রাখলাম, তারপর বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম হাসপাতালের দিকে। মৃত ব্যক্তির শব ব্যবচ্ছেদ করে তার মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয় করা দরকার–সেইজন্যই আমি হাসপাতালের দিকে যাত্রা করেছিলাম।

কুটিরের মধ্যে আবছা আলো-আঁধারির লীলাখেলা আমার দৃষ্টিকে দুর্বল করে দিয়েছিল, তাই মরা মানুষটাকে তখন খুব ভালো করে দেখতে পাইনি। বাইরে উজ্জ্বল সূর্যালোকে তার মুখ দেখে আমি তাকে চিনতে পারলাম। মাত্র কিছুদিন আগেই লোকটি আমার কাছে মজুরের কাজ করতে এসেছিল। লোকটিকে আমি হালকা কাজ দিয়েছিলাম, কারণ কষ্টসাধ্য কাজ করার মতো উপযুক্ত শরীর তার ছিল না।

তার একটি পা ছিল ভাঙা, একটি চোখ ছিল অন্ধ এবং অজ্ঞাত কোনো দুর্ঘটনার ফলে তার মুখের ওপর থেকে লুপ্ত হয়েছিল নাসিকার অস্তিত্ব, নাকের জায়গায় দৃষ্টিগোচর হত দুটি বৃহৎ ছিদ্র!

তবে লোকটির দেহে বিকৃতি থাকলেও মানুষ হিসাবে সে খারাপ ছিল না। কাজকর্ম সে মন দিয়েই করত। কিন্তু অন্যান্য শ্রমিকরা তাকে এড়িয়ে চলত তাদের ধারণা ছিল বিকৃত দেহের অধিকারী ওই ব্যক্তি একজন জাদুকর!

যাই হোক, সেদিন মৃত ব্যক্তির লাশটা হাসপাতালে জমা করে দিলাম। কর্তৃপক্ষ বললেন, কয়েকদিনের মধ্যেই তার মৃত্যুর কারণ আমাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।

হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ কথা রেখেছিলেন। দিন দুই পরেই তারা আমাকে লোকটির মৃত্যুর কারণ জানিয়ে দিলেন।

উক্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে পেটের গোলমালে। মৃত ব্যক্তির পেটের ভিতর পাওয়া গেছে কয়েকটা লম্বা লম্বা লোহার পেরেক, কাঁচের টুকরো এবং অনেকগুলো পাথর! পৃথিবীতে এত রকম খাদ্য থাকতে লোকটা কাঁচ, লোহা আর পাথর খেয়ে মরতে গেল কেন? খুব সম্ভব জাদুবিদ্যার অনুশীলন করার জন্যই লোকটি ওই অখাদ্য বস্তুগুলিকে ভক্ষণ করেছিল।

তবে লোকটি জাদুকর হলেও খুব উচ্চশ্রেণির জাদুকর নয়, জাদুবিদ্যাকে হজম করতে পারেনি বলেই তার পেটে কাঁচ, লোহা আর পেরেক হজম হল না।

পূর্ববর্ণিত ঘটনার কিছুদিন পরে আমাদের এলাকায় হানা দিল এক অজ্ঞাত আততায়ী।

প্রতি রাত্রেই এলাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ভেড়ার আস্তানাগুলোতে হানা দিয়ে অজ্ঞাত হত্যাকারী যথেচ্ছভাবে হত্যাকাণ্ড চালাতে লাগল। মৃত পশুগুলির দেহে অধিকাংশ সময়ে কোনো ক্ষতচিহ্ন থাকত না, হন্তারক:শুধু ভেড়ার মাথার খুলি ভেঙে ঘিলুটা খেয়ে পালিয়ে যায়।

আমার মজুররা এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে নান্দি ভালুক নামে এক অতিকায় ভালুককে দায়ী করলে।

আফ্রিকায় ভল্লুক নেই, নান্দি ভালুক নামক জীবের অস্তিত্ব শুধু নিগ্রোদের কল্পনায়। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এই কাল্পনিক জন্তুটির কথা নিগ্রোদের মুখে মুখে ফেরে।

বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই।

আমি অনুমান করলাম, এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক হচ্ছে একটি অতিকায় হায়না। মাংসাশী শ্বপদগোষ্ঠীর মধ্যে ভেড়ার মাথার খুলি কামড়ে ভেঙে ফেলার মতো চোয়ালের জোর একমাত্র হায়নারই আছে। চোয়ালে অসাধারণ শক্তি থাকলেও হায়না খুব ভীরু জানোয়ার, তবে দুই একটি হায়না মাঝে মাঝে দুঃসাহসের পরিচয় দেয়।

আমি ঠিক করলাম মেষকুলের হন্তারক এই অজ্ঞাত আততায়ীকে যেমন করেই হোক বধ করতে হবে।

চেষ্টার ত্রুটি হয়নি। ফাঁদ পেতে রেখেছি।

খুনি ফাঁদের ধারে কাছেও আসেনি। বন্দুক হাতে প্রতি রাত্রে টহল দিয়েছি মারা তো দূরের কথা,হত্যাকারীকে চোখেও দেখতে পাইনি। অথচ প্রতিদিন সকালে খবর এসেছে এক বা একাধিক মেষ আততায়ীর কবলে মৃত্যুবরণ করেছে।

তবে চোখে না-দেখলেও হন্তারক যে একটি হায়না সেই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।

কয়েকদিন পরেই একটি ঘটনায় ২ প্রমাণ হল আমার ধারণা নির্ভুল।

আমার জন্য নির্দিষ্ট বাড়িটা তখনও তৈরি হয়নি। সবেমাত্র নির্মাণকার্য চলছিল। আমি একটা ঘাসের তৈরি কুঁড়েঘরে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

হঠাৎ একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সংকেত অগ্রাহ্য করে আবার শয্যা গ্রহণ করব কি না ভাবছি, হঠাৎ একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনলাম আমার বিছানার খুব কাছে। বালিশের তলা থেকে টর্চ নিয়ে জ্বেলে দিলাম।

পরক্ষণেই আমার চোখের সামনে তীব্র বৈদ্যুতিক আলোর মধ্যে ভেসে উঠল একটা প্রকাণ্ড হায়নার মূর্তি!

আমি স্তম্ভিত নেত্রে দেখলাম, আমার বিছানা থেকে মাত্র এক গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। জন্তুটা এত বড়ো হায়না ইতিপূর্বে আমার চোখে পড়েনি!

নিজের অজ্ঞাতসারেই আমার গলা থেকে বেরিয়ে এল এক তীব্র চিৎকার ধ্বনি, একলাফে শয্যা ত্যাগ করে ঘরের কোণ থেকে আমি বন্দুকটা টেনে নিলাম। এমনই দুর্ভাগ্য যে শুতে যাওয়ার আগে বন্দুকে গুলি ভরতে ভুলে গিয়েছিলাম। টেবিলের উপর একটা ছোটো বাক্সে টোটাগুলো রেখেছিলাম, হাত বাড়িয়ে বাক্সটা খুঁজছি, এমন সময়ে হল আর এক নূতন বিপদ! সাঁ করে ছুটে এল একটা দমকা হাওয়ার ঝটকা, আর সেই হাওয়ার ধাক্কা লেগে কুঁড়েঘরের নীচের দিকের ঝাঁপটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল!

(উগান্ডার যে অঞ্চলে আমি ছিলাম সেখানকার কুটিরগুলোর দরজায় কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। মেঝের সঙ্গে সমান্তরালভাবে উপর-নীচ লাগানো থাকত দুটি ঝপ বা দরজার পাল্লা।)

ঝাঁপের পাল্লাটা বন্ধ হয়ে যেতেই আমি চমকে উঠলাম। অত্যন্ত সঙ্গিন মুহূর্ত–পালানোর পথ বন্ধ দেখে হায়না হয়তো আমাকে এখনই আক্রমণ করবে। ঝপের নীচের অংশটা সে একলাফে টপকে যেতে পারে বটে কিন্তু পলায়নের ওই সহজ পন্থা তার মগজে ঢুকবে কি না। সন্দেহ।

বুনো জানোয়ার যদি নিজেকে কোণঠাসা মনে করে তাহলে সে সামনে যাকে পায় তার ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

জন্তুটার বিরাট দেহের দিকে তাকালাম।

সত্যি, এটা একটা অতিকায় হায়না।

যদি এক গুলিতে জন্তুটাকে শুইয়ে দিতে না-পারি তবে বন্ধ ঘরের মধ্যে হায়নার আক্রমণে, আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত। খুব সাবধানে যতদূর সম্ভব আমি বন্দুকে গুলি ভরতে লাগলাম।

হঠাৎ বন্ধ ঘরের মধ্যে হল আর এক চতুষ্পদের আবির্ভাব! আমার বুল-টেরিয়ার শ্যাম বোধ হয় দরজার কাছেই ছিল–নীচের দিকের ঝাঁপটা একলাফে ডিঙিয়ে এসে শ্যাম হায়নাকে আক্রমণ করলে!

শ্যাম সাহসী কুকুর, কিন্তু বোকা নয়।

হায়নার ভয়ংকর দাঁত আর শক্তিশালী চোয়াল সম্বন্ধে সে যথেষ্ট সচেতন–চারপাশে ঘুরে ঘুরে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুকে সে বিব্রত করে তুলল, কিন্তু হায়নার ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে নিজের জীবন বিপন্ন করলে না।

হায়নার দংশন অতি ভয়ংকর, এক কামড়েই সে শ্যামের মাথার খুলি ভেঙে দিতে পারে। বুদ্ধিমান কুকুর তাকে সেই সুযোগ দিলে না।

ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে আমি এক লাথি মেরে দরজার নীচের অংশটা খুলে দিলাম। তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে হায়নাটা দূরের ঝোপ লক্ষ করে ছুটল।

আমি ততক্ষণে বন্দুকে গুলি ভরে ফেলছি।

জন্তুটাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়লাম। নিশানা ব্যর্থ হল।

হায়নার ধাবমান দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল অরণ্যের অন্তরালে।

বেশ কয়েকটা দিন কাটল নির্বিবাদে।

আমরা ভাবলাম খুনি বোধ হয় আমাদের আর বিরক্ত করবে না। কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবার শুরু হল হত্যাকাণ্ড।

প্রতি রাত্রেই একটি কি দুটি ভেড়া হায়নার কবলে মারা পড়তে লাগল।

আমার জেদ চেপে গেল, জন্তুটাকে মারতেই হবে।

প্রতিদিন শেষরাতে ভোর হওয়ার একটু আগে আমি সমস্ত অঞ্চলটায় টহল দিতে শুরু করলাম। পরপর আটটি রাত কাটল, অবশেষে নবম রাত্রে আমার চেষ্টা সফল হল।

একটু দূরে অবস্থিত উঁচু জমির তলায় ঝোপের ভিতর, একটা কালো ছায়া যেন স্যাৎ করে সরে গেল!

হয়তো চোখের ভুল।

তবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। না, ভুল হয়নি

হঠাৎ ঝোপের ওপর উঁচু জমির ওপর আত্মপ্রকাশ করল একটা চতুষ্পদ পশু!

নীলাভ-কৃষ্ণ আকাশের পটভূমিকায় উচ্চ ভূমির ওপর দণ্ডায়মান হায়নার দেহটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার দৃষ্টিপথে–লক্ষ্য স্থির করে গুলি ছুড়লাম।

গুলি লাগল হায়নার পেটে। দারুণ যাতনায় অস্থির হয়ে জন্তুটা নিজের উদর দংশন করতে লাগল। আবার অগ্নিবৃষ্টি করলে আমার বন্দুক, হায়নার মৃতদেহ উপর থেকে আছড়ে পড়ল নীচের জমিতে গুলি এইবার জন্তুটার মস্তিষ্ক ভেদ করেছে।

মৃত হায়নার কাছে এসে তাকে লক্ষ করতে লাগলাম। বিরাট জানোয়ার। জন্তুটার দেহে কিছু খুঁত আছে।

তার পিছনের একটি পা ভাঙা, অজ্ঞাত কোনো দুর্ঘটনার ফলে তার একটি চক্ষু হয়েছে অন্ধ এবং নাসিকার কিছু অংশ লুপ্ত হয়ে গেছে মুখের ওপর থেকে!

বিদ্যুৎচমকের মতো আমার মনে একটা সন্দেহের ছায়া উঁকি মারল, মুহূর্তের জন্য আমার মানসপটে ভেসে উঠল একটি মৃত মানুষের প্রতিমূর্তি!

কিছুদিন আগে যে নিগ্রো মজুরটি মারা গেছে তার সঙ্গে এই জন্তুটা অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে। পূর্বোক্ত মানুষটিরও ছিল একটি পা ভাঙা, একটি চোখ অন্ধ এবং ভূমিশয্যায় শায়িত এই মৃত হায়নার মতো তার মুখের উপরও ছিল না নাসিকার অস্তিত্ব।

আমার সর্বদেহের ভিতর দিয়ে ছুটে গেল আতঙ্কের শীতল স্রোত। পরক্ষণেই নিজের মনকে শাসন করলাম–বিকৃত দেহ মানুষ যদি থাকতে পারে তবে তার মতো একটা হায়নাই-বা থাকবে না কেন? দৈহিক সাদৃশ্যটা নিতান্তই ঘটনাচক্রের যোগাযোগ।

আমি আস্তানায় ফিরে এসে কয়েকজন শ্রমিককে হন্তারকের মৃত্যুসংবাদ দিলাম। তারা বিলক্ষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আমি জন্তুটাকে মাটির নীচে কবর দিতে বললাম–হায়নার চামড়া কোনো কাজে লাগে না।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা মজুরদের আস্তানা থেকে একটা কোলাহল ধ্বনি আমার কর্ণগোচর হল। গোলমালের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য আমি শব্দ লক্ষ করে পা চালিয়ে দিলাম।

নির্দিষ্ট স্থানে এসে দেখলাম, মৃত হায়নার দেহটা সেইখানেই পড়ে আছে। জন্তুটার পেট চিরে ফেলা হয়েছে। মৃত পশুটার থেকে একটু দূরে বসে একদল শ্রমিক গান ধরেছে উচ্চৈঃস্বরে। সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ শব্দে বাজছে অনেকগুলো ঢাক!

ওইসঙ্গে আরও এক অদ্ভুত দৃশ্য আমার চোখে পড়ল। ভিড়ের ভিতর থেকে এক একজন এগিয়ে এসে হায়নাটার উপর জোরে জোরে ফুঁ দিচ্ছে আর সঙ্গেসঙ্গে দ্বিগুণ জোরে বেজে উঠছে। ঢাকের বাজনা এবং সমবেত কণ্ঠের ঐকতান!

একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে মজুরদের সর্দার। সর্দারের কাছে এগিয়ে গিয়ে এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জানতে চাইলাম।

ওরা হায়নার মৃতদেহ থেকে প্রেতাত্মাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, সর্দার উত্তর দিলে। এখন হায়নার দেহে আর প্রেত থাকবে না। সে চেষ্টা করবে অন্য কোনো দেহকে আশ্রয় করতে। এখানে উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে হয়তো কারো ওপর সে ভর করতে পারে।

সেইজন্য তাকে আমরা তাড়িয়ে দিচ্ছি।

মূর্খ। তোমার দলের লোকগুলো তো একেবারেই বোকা, এদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা নেই, এরা কুসংস্কারের দাস, কিন্তু

একটু হেসে আমি বললাম, কিন্তু তুমি কিছু কিছু লেখাপড়া করেছ, তুমিও কি এইসব সংস্কারে বিশ্বাস করো?

না, বাওয়ানা, সর্দার বললে, আমার কুসংস্কার নেই। তবে তবে মানে আমি আপনাকে কয়েকটা জিনিস দেখাচ্ছি।

কথা অসমাপ্ত রেখেই সে একটি মজুরকে ইশারা করলে।

মজুরটি এগিয়ে এল।

সর্দার তার হাত থেকে কতকগুলি জিনিস তুলে নিয়ে আমার চোখের সামনে ধরলে।

কয়েকটা লম্বা লম্বা লোহার পেরেক, কয়েকটা পাথর আর ভাঙা কাঁচের টুকরো রয়েছে সর্দারের হাতে!

বাওয়ানা, সর্দার বললে, এই জিনিসগুলো পাওয়া গেছে হায়নার পেটের ভিতর!

আমি কথা বলতে পারলাম না, অনুভব করলাম আমার ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে উঠেছে কাঁটার মতো!

সবই কি ঘটনাচক্র?

একটা পা ভাঙা, একটি চক্ষু অন্ধ, মুখের ওপর ছিন্ন নাসিকার অংশ

সব কিছুই কি শুধু ঘটনাচক্রের যোগাযোগ?

অবশেষে এই পাথর, পেরেক আর কাঁচ?

মৃত মানুষটা কেন ওইসব বস্তু গলাধঃকরণ করেছিল জানি না, কিন্তু এই সৃষ্টিছাড়া হায়নাটাও বিশেষ করে ওই অখাদ্য বস্তুগুলিকে উদরস্থ করলে কেন?

আমি এই ঘটনার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারিনি। তবে অশিক্ষিত আফ্রিকাবাসীর বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে আজ আর আমি কুসংস্কার বলে অবজ্ঞা করতে পারি না।

কাহিনির লেখক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। তিনি এখানেই সমাপ্তির রেখা টেনে দিয়েছেন।

আফ্রিকার অরণ্যসংকুল প্রদেশে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে যেসব শ্বেতাঙ্গ পর্যটক ও শিকারি ঘুরে বেড়িয়েছেন তাঁদের লিখিত রোজনামচায় অনেক অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। বিস্তীর্ণ আফ্রিকার বুকের ওপর ঘুমিয়ে আছে এক রহস্যময় জগৎ।

সভ্য পৃথিবী আজও সেই জাদুপুরীর দরজা খুলতে পারেনি।

পূর্ববর্ণিত ঘটনা-প্রসঙ্গে বলছি প্রেতাত্মার ভিন্ন দেহে আশ্রয় গ্রহণ করার আরও অনেক কাহিনি আফ্রিকাবাসীর মুখে মুখে শোনা যায়। অবশ্য যাবতীয় দুষ্কর্মের জন্য যে সবসময় অলৌকিক শক্তির অধিকারী জাদুকর বা প্রেতাত্মারা দায়ী হয় তা নয়–অনেক সময় পার্থিব জগতের সমাজবিরোধী দুরাত্মার দলও নির্বিচারে নরহত্যা করে অথবা পশুমাংসের লোভে প্রতিবেশীর পালিত পশুকে হত্যা করে বন্য জন্তুর ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। প্রেত-আশ্রিত পশু ছাড়া । অরণ্যচারী হিংস্র শ্বাপদের আক্রমণও একটি কঠিন সমস্যা। সিংহ, লেপার্ড প্রভৃতি মাংসাশী শ্বাপদ যখন গৃহপালিত পশু হত্যা অথবা নরমাংসের প্রতি আসক্ত হয় তখন আত্মা, দুরাত্মা ও চতুষ্পদ শ্বাপদের ত্র্যহস্পর্শ যোগের ফলে যে বিচিত্র ধাঁধার সৃষ্টি হয় তার থেকে প্রকৃত অপরাধীকে আবিষ্কার করা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে আলোচনা করতে হলে আফ্রিকার চিতামানুষ বা সিংহ মানুষ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা দরকার।

আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এক শ্রেণির দুবৃত্ত সিংহের মস্তক ও দেহচর্মের আবরণে আত্মগোপন করে নরহত্যায় প্রবৃত্ত হয়। নির্জন স্থানে অসতর্ক পথিককে দেখতে পেলে তারা হতভাগ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

নকল সিংহের হাতে আসল সিংহের মতোই বাঁকা বাঁকা নখ বসানো নকল থাবা লাগানো থাকে। নখরযুক্ত ওই নকল থাবা দিয়ে হতভাগ্য মানুষের দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করে দুবৃত্তরা তাকে হত্যা করে। কখনো কখনো হত্যাকাণ্ডের জন্য বিশেষ ধরনের ছোরা ব্যবহৃত হয়। নিহত মানুষের দেহে ক্ষতচিহ্ন দেখে মনে হয় বনবাসী সিংহের নখরাঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছে।

সিংহের ছদ্মবেশে এইভাবে যারা নরহত্যা করে তাদেরই বলা হয় লায়ন-ম্যান বা সিংহ-মানুষ।

সিংহ-মানুষের মতো চিতা-মানুষও একই উপায়ে নরহত্যা করে। তফাত শুধু এই যে লেপার্ডম্যান বা চিতা-মানুষ সিংহের ছদ্ম আবরণের পরিবর্তে চিতাবাঘের ছদ্মবেশ ধারণ করে।

আফ্রিকাবাসীদের বিশ্বাস এইসব নকল সিংহ-মানুষ বা চিতা-মানুষ ছাড়া এমন লোক আছে যারা ইচ্ছা করলেই নিজের নরদেহকে পরিবর্তিত করে হিংস্র শ্বাপদের রূপ ধারণ করতে পারে।

আফ্রিকার স্থানীয় মানুষের এইরূপ বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে কিছু কিছু ঘটনা দিয়ে বিচার করে হয়তো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব ছিল, কিন্তু আগেই বলেছি, নরখাদক শ্বাপদ, লৌকিক অপরাধী এবং অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী জাদুকরদের গোলকধাঁধার জটিলতা ভেদ করে প্রকৃত রহস্যের সমাধান করা খুব কঠিন কাজ। প্রসঙ্গত আর একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।

উল্লিখিত কাহিনিটি বলেছেন ব্রিটিশ সরকারের একজন ইংরেজ কর্মচারী, নাম তার এইচ ডবলিউ টেলর।

টেলর সাহেবের লিখিত বিবরণী থেকে সংক্ষেপে কাহিনিটি বলছি :

ইথিওপিয়ান সোমালিল্যান্ডের সীমানায় সরকারের কার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন টেলর সাহেব। রাজনৈতিক কারণে পূর্বোক্ত অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে টহল দিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ কার্য চালাতেন–ওইটি ছিল তার কর্তব্য কর্ম।

বনচারী হিংস্র পশুরা তাদের রাজ্যে মানুষের অনধিকার প্রবেশ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে রাজি হয়নি তাই গর্জিত রাইফেল আর উদ্যত নখান্তের সংঘর্ষে বনরাজ্যের শান্তিভঙ্গ হয়েছে বারংবার।

টেলর সাহেবের নিশানা ছিল অব্যর্থ; পশুরাজ সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বড়ো আনন্দ পেতেন মি. টেলর–তার রাইফেলের গুলি খেয়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে স্বর্গের দিকে প্রস্থান করেছিল অনেকগুলো সিংহ।

অন্যান্য হিংস্র জন্তুও তিনি শিকার করেছিলেন কিন্তু বিশেষভাবে তার মন এবং দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করেছিল পশুরাজ সিংহ।

টেলর যে অঞ্চলে সরকারের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন সেই এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব ছড়িয়ে বাস করছিল এক বৃদ্ধ সিংহ। স্থানীয় নিগ্রোরা তার নাম দিয়েছিল লিবা। লিবা নরখাদক। তবে গৃহপালিত পশুর মাংসেও তার অরুচি ছিল না। স্থানীয় মানুষ তাকে ভয় করত যমের মতো।

জন্তুটার পদচিহ্ন দেখে খুব সহজেই তাকে শনাক্ত করা যেত। লিবা নামক সিংহটির বাঁ-দিকের থাবায় একটা আঙুল ছিল না, খুব সম্ভব কোনো ফাঁদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার সময়ে ওই আঙুলটাকে সে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিল।

নিহত গোরু-বাছুরের কাছে লিবার পায়ের চিহ্ন দেখলে স্থানীয় নিগ্রোরা আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়ত। তারা সিংহটাকে কখনো হত্যা করার চেষ্টা করেনি। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে টেলর সাহেবকে খবর দিলে তিনি নিশ্চয়ই রাইফেল হাতে ছুটে আসতেন এবং নিহত শিকারের আশেপাশে লুকিয়ে থেকে লিবাকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করতেন।

মৃত পশুর মাংস খাওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার অকুস্থলে আবির্ভূত হলেই লিবা পড়ত সাহেবের রাইফেলের মুখে।

কিন্তু নিগ্রোরা কখনো যথাসময়ে হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সরবরাহ করত না। টেলর খবর পেতেন অন্তত দুই কি তিন দিন পরে ততক্ষণে লিবা শিকারের মাংস উদরস্থ করে সরে পড়েছে নির্বিবাদে। অনেক চেষ্টা করেও টেলর লিবার সাক্ষাৎ পাননি।

কিন্তু টেলর সাহেব লিবার সংবাদ না-রাখলেও লিবা নিশ্চয়ই সাহেবের খবর রাখত।

তখন বর্ষাকাল। বিশেষ কাজে টেলর তার দল নিয়ে টহল দিতে বেরিয়েছেন। টেলর গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই অরণ্যের বুকে উপস্থিত হল রাত্রির নিবিড় অন্ধকার। পরিশ্রান্ত টেলর তবু তাবু ফেলার আদেশ দিলেন না তিনি ভাবছেন কোনোরকমে সামনে আট মাইল পথ অতিক্রম করতে পারলেই তিনি গ্রামের মধ্যে এসে পড়বেন–তার মানসপটে ভেসে উঠেছে কুটিরের মধ্যে অবস্থিত একটি তপ্ত শয্যার লোভনীয় দৃশ্য।

হঠাৎ পিছন থেকে সশস্ত্র আস্কারিদের সর্দার তাকে জানিয়ে দিলে একটা সিংহ তাদের পিছু নিয়েছে। সাহেব ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। এখানকার বনে-জঙ্গলে অনেক সিংহ আছে–সিংহকে ভয় করলে আফ্রিকার বনভূমিতে ঘোরাফেরা করা চলে না। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আট মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার উৎসাহ আর রইল না–টেলর তাবু খাটাতে বললেন।

সেই রাতেই টেলরের আস্তানায় হল সিংহের আবির্ভাব। গভীর রাত্রে গোরু আর উটের দল দড়ি ছিঁড়ে বেড়া ভেঙে ছুটোছুটি করতে লাগল কয়েকটা জন্তু আবার বন্ধন মুক্ত হয়ে ছুটল জঙ্গলের দিকে… অরণ্যের অন্ধকার কালো যবনিকা ফেলে তাদের দেহগুলিকে ঢেকে ফেলল কিছুক্ষণের মধ্যে।

টেলর অথবা তার দলের লোকজন কোনো বন্য পশুর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলেন না, কিন্তু অনুমানে বুঝলেন একটু আগেই এখানে হয়েছিল সিংহের আবির্ভাব। গৃহপালিত জন্তুদের এই ধরনের আতঙ্কের একটিই কারণ থাকতে পারে সিংহ!

পশুরাজ অত্যন্ত ধূর্ত। সে এমনভাবে রজ্জবদ্ধ গোরু-বাছুরের কাছে এসে দাঁড়ায় যে মানুষরা সিংহের উপস্থিতি বুঝতে না-পারলেও জন্তুগুলো গায়ের গন্ধে পশুরাজের অস্তিত্ব বুঝতে পারে।

ভয়ে পাগল হয়ে জন্তুগুলো দড়ি ছিঁড়ে বেড়া ভেঙে ছুটোছুটি করতে থাকে এবং মানুষের নিরাপদ সান্নিধ্য ছেড়ে ছুটতে ছুটতে এসে পড়ে বনজঙ্গলের মধ্যে! এই সুযোগেরই অপেক্ষায় সিংহ পছন্দসই একটা মোটাসোটা গোরু অথবা বাছুরকে বধ করে শিকারের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। এখানেই সেই ব্যাপার।

অকুস্থলে লিবার মার্কামারা পায়ের ছাপ খুঁজে বার করলে আস্কারির দল। সেই রাত্রে লিবার অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল, একটি জন্তুকেও সে বধ করতে পারেনি।

রাত্রির পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা সকলেই খুব সতর্ক থাকল। কিন্তু লিবা দ্বিতীয়বার অকুস্থলে পদার্পণ করলে না।

টেলর সাহেব বিরক্ত হয়েছিলেন। পরদিন সকালে তিনি আস্কারিদের জানালেন, এখন তার কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তিন-চার দিন এখানে থেকে তিনি লিবার খোঁজ করবেন।

ওই সময়ের ভিতর অন্তত একবার তিনি নিশ্চয়ই সিংহটাকে রাইফেলের আওতার মধ্যে পাবেন। হতভাগা খোঁড়া সিংহটা এই অঞ্চলে অনেকদিন অত্যাচার করছে, কিন্তু টেলারের দলের ওপর ইতিপূর্বে সে হামলা করেনি। টেলর তাকে ছাড়বেন না।

আগে লিবাকে হত্যা করে তারপর অন্য কাজ।

টেলরের সংকল্প শুনে আস্কারিদের সর্দার কয়েকবার ঢোঁক গিলে বললে, বাওয়ানা! আমরা কর্মচারী আদেশ পালন করতে আমরা বাধ্য। কিন্তু যদি আমাদের কথা শোনেন তবে বলব লিবার পিছনে তাড়া করে কোনো লাভ নেই। ওকে মারতে পারবেন না।

ক্রুদ্ধকণ্ঠে টেলর বললেন, কেন?

কারণ লিবা সত্যি সত্যি সিংহ নয়। ও একটা জাদুকর। মন্ত্রের গুণে মাঝে মাঝে সিংহের দেহ ধারণ করে। আমরা সবাই ওকে জানি।

টেলর সকৌতুকে প্রশ্ন করলেন, ওকে জানো? কী নাম তার?

উত্তরে আস্কারিদের সর্দার বললে, এই অঞ্চলে সবাই তাকে চেনে। সে বায় বাহ জাতীয় নিগ্রো, তার নাম আলি।

টেলর বিস্মিত হলেন। আলি তার অপরিচিত নয়। লোকটি বিচক্ষণ সাহসী ও বুদ্ধিমান। গভীর রাত্রে অনেকবার আলি জঙ্গলের পথ ভেঙে এসেছে তার কাছে আবার অন্ধকারের মধ্যেই ফিরে গেছে। তার হাতে একটা ছোটো লাঠি ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র থাকত না। গভীর রাত্রে শ্বাপদসংকুল বনভূমির ভিতর দিয়ে অস্ত্র হাতে যাতায়াত করাও বিপজ্জনক নিরস্ত্র অবস্থায় অন্ধকার বনপথে পদার্পণ আত্মহত্যারই নামান্তর। কিন্তু আলি রাতের পর রাত নির্ভয়ে বনের পথে যাতায়াত করত।

সম্বল ছিল তার একটি তুচ্ছ লাঠি!

টেলর আস্কারিদের কথা বিশ্বাস করেননি।

তবে তিনি কথা দিলেন যে লিবাকে হত্যার করার চেষ্টা তিনি করবেন না।

টেলর বুদ্ধিমান মানুষ তিনি জানতেন নিগ্রোদের সংস্কার বা বিশ্বাসে আঘাত দিলে অনেক সময় পরিণাম খুব খারাপ হয়। একটা সিংহের জন্য দলের লোকের কাছে অপ্রীতিভাজন হওয়ার ইচ্ছা তাঁর ছিল না।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই দৈবক্রমে হঠাৎ আলির সঙ্গে টেলর সাহেবের দেখা হয়ে গেল। আলি তাকে খুব প্রশংসা জানিয়ে বললে যে মি. টেলর লিবাকে হত্যা করার সংকল্প ত্যাগ করে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। সাদা চামড়ার মানুষগুলো সাধারণত নির্বোধ হয় কিন্তু মি. টেলর হচ্ছেন নিয়মের ব্যতিক্রম, তার স্বদেশবাসীর মতো তিনি যে মূর্খ নন এই কথা জেনে আলি অতিশয় আনন্দিত হয়েছে।

টেলর সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, তুমিই কি লিবা?

আলি উত্তর দিলে না। বাঁ-হাতটাকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

টেলর দেখলেন আলির বাঁ-হাতের একটা আঙুল নেই!

আলি গম্ভীর স্বরে বললে, আমি আপনার কিছু উপকার করব। আমি জানি কিছুদিন আগেও সিংহের মুখে আপনার জীবন বিপন্ন হয়েছিল। তা ছাড়া সিংহের উপদ্রবে আপনি মাঝে মাঝে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এ-কথাও আমার অজানা নয়। আমার আদেশে আজ থেকে এই অঞ্চলের সিংহরা আপনাকে বা আপনার দলভুক্ত লোকজনদের কখনো আক্রমণ করবে না। সিংহের সম্মুখীন হলেও আপনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ থাকবে।

এমন গম্ভীরভাবে সে কথাগুলো বললে যে তার বক্তব্য বিষয়কে টেলর সাহেব লঘু বিদ্রূপ বলে মনে করতে পারলেন না।

টেলর অবরুদ্ধ হাস্য দমন করলেন, তারপর তিনিও গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার ঘোড়া, গোরু আর অন্যান্য পোষা জানোয়ারগুলি সম্বন্ধেও আমি নিরাপত্তার দাবি করছি।

তুমি সিংহদের নিষেধ করে দিয়ে তারা যেন আমার পোষা জন্তুগুলিকে রেহাই দেয়।

আলি প্রতিবাদ করে বললে, তা কী করে হবে? ঘোড়া, গোরু প্রভৃতি জন্তু হচ্ছে সিংহের খাদ্য। আমার সিংহরা তাহলে খাবে কী?

টেলর বললেন, পোষা জানোয়ার সিংহের খাদ্য নয়। তারা বুনো জন্তু মেরে খাবে।

অনেক তর্কবিতর্কের পর সাহেবের অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হল আলি, কিন্তু তারও একটা শর্ত ছিল–

টেলর কোনো কারণেই সিংহ শিকার করতে পারবেন না।

আলির প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন টেলর।

আস্কারিরা যখন শুনল সিংহের দলপতি আলির সঙ্গে সাহেবের সন্ধি হয়েছে তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল।

টেলর প্রথমে আলির কথার বিশেষ গুরুত্ব দেননি। কিন্তু কিছুদিন পরেই যখন তিনি লক্ষ করলেন যে সিংহরা তার দলের মানুষ ও পশু সম্বন্ধে হঠাৎ খুব উদাসীন হয়ে পড়েছে তখন আর আলির কথাগুলো তিনি উড়িয়ে দিতে পারলেন না।

সকাল বেলা উঠে অনেকদিনই তাবুর কাছে রজ্জবদ্ধ গোরুর পাল ও অশ্বদলের নিকটবর্তী জমির ওপর তিনি সিংহের পদচিহ্ন দেখেছেন।

পায়ের ছাপগুলো দেখে বোঝা যায়, সিংহরা খুব কাছে এসে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে আবার বনের আড়ালে সরে গেছে! টেলরের দলের মানুষ কিংবা পশুর ওপর তারা হামলা করেনি!

একবার নয়, দু-বার—

বারংবার হয়েছে এই ধরনের বিভিন্ন ঘটনার পুনরাবৃত্তি। টেলরের বিবরণীতে আলির বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য লিখিত নেই। ওই অঞ্চলের সিংহরা হঠাৎ তাঁর দলের মানুষ ও পশু সম্বন্ধে অহিংস হয়ে যাওয়ায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আলির অলৌকিক ক্ষমতায় তিনি বিশ্বাস করেছিলেন কি না জানি না।

তবে তিনি তার শর্ত রক্ষা করেছিলেন। টেলর সাহেব পরবর্তীকালে কখনো সিংহ শিকার। করেননি!

[ফাল্গুন ১৩৮০]

 আমেরিকার সিংহ

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরা যে বিড়াল-জাতীয় জীবটিকে পার্বত্য-সংহ নামে অভিহিত করে সেই জন্তুটি কিন্তু সিংহ নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন জানোয়ার।

পার্বত্য-সিংহ নামক জন্তুটির আরও কয়েকটি প্রচলিত নাম আছে, যেমন- পুমা, কুগার, প্যান্থার প্রভৃতি। এই নামগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত দুটি নাম হচ্ছে পুমা এবং কুগার।

সিংহের সঙ্গে পুমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কিছুটা সাদৃশ্য আছে, পুমার গায়ের রংও অনেকটা সিংহের মতো। তবে স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে বিচার করলে সিংহের সঙ্গে পুমার বিশেষ মিল নেই। নিতান্ত বিপদে না পড়লে পুমা লড়াই করতে চায় না, বরং পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে; কিন্তু পশুরাজ সিংহের রাজকীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হলে সে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দীর বিরুদ্ধে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

সিংহ, বাঘ, লেপার্ড প্রভৃতি বিড়াল-জাতীয় বড়ো বড়ো জানোয়ারের মতো হিংস্র নয় পুমা, তাকে দস্তুরমতো নিরীহ বলা যায়। মানুষকে সে পারতপক্ষে আক্রমণ করে না। তবু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশুপালকরা পুমার সম্বন্ধে অত্যন্ত বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। তার কারণ মানুষকে ভয় করলেও গৃহপালিত পশুর মাংস পুমার প্রিয় খাদ্য। প্রতি বৎসর বহু সংখ্যক গোরু, বাছুর, ভেড়া প্রভৃতি গৃহপালিত পশু পুমার আক্রমণে প্রাণ হারায়। এমনকি ঘোড়ার মতো বলিষ্ঠ জানোয়ারও পুমার কবল থেকে নিষ্কৃতি পায় না। সেইজন্য পশুপালকদের কাছে পুমা হচ্ছে। চোখের বালির মতোই দুঃসহ।

পুমাকে হত্যা করার জন্য শিকারিরা শিক্ষিত কুকুরের সাহায্য গ্রহণ করে। এই হাইল্ড বা শিকারি ককর দলবদ্ধ হয়ে পমাকে অনুসরণ করে এবং পলাতক পমার গায়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে তারা গ্রেপ্তার করে ফেলে, বেচারা পুমা কুকুরের প্রখর ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়কে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারে না। কোণঠাসা হলে পুমা সাধারণত গাছে উঠে সারমেয়-বাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে কুকুরের চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে অকুস্থলে উপস্থিত হয় বন্দুকধারী শিকারি এবং তারপরই গুলিবিদ্ধ পুমার প্রাণহীন দেহ আছড়ে পড়ে মাটির উপর। অনেক সময় শিকারিকে আসতে দেখলে পুমা গাছের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে সারমেয়-বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে ছুটে পালাতে চায়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার চেষ্টা সফল হয় না– দলবদ্ধ শিকারি কুকুরের আক্রমণে পুমার সর্বাঙ্গ হয়ে যায় ছিন্নভিন্ন।

তবে সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম আছে। ফ্ল্যাটহেড নামক যুক্তরাষ্ট্রের এক অঞ্চলে হঠাৎ একবার আবির্ভূত হল একটি পুমা এবং কিছুদিনের মধ্যে সে এমন ভয়ংকর স্বভাবের পরিচয় দিল যে শিকারিরা হয়ে গেল স্তম্ভিত, স্থানীয় মানুষ হয়ে পড়ল সন্ত্রস্ত। এই সৃষ্টিছাড়া পুমাটা সারমেয়ে-বাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকার করত না, আক্রান্ত হলেই সে অদ্ভুত সাহস ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রতি-আক্রমণ করে কুকুরের দলকে বিধ্বস্ত করে ফেলত এবং শিকারি অকুস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই চটপট পা চার্লিয়ে নিরাপদ স্থানে প্রস্থান করত। শিকারি এসে দেখত তার প্রিয় কুকুরদের মধ্যে অধিকাংশের দেহের উপরই রয়েছে পুমার ধারালো নখের রক্তাক্ত স্বাক্ষর, দটি বা একটি কুকুরের প্রাণহীন দেহ হয়েছে ধরাশয্যায় লম্বমান এবং বাকি কুকুরগুলো আতঙ্কে এমন বিহ্বল হয়ে পড়েছে যে তারা আর ওই বিপদজনক বিড়ালের পিছু নিতে রাজি নয়।

বারংবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার ফলে কুকুরের দল ঘাবড়ে গেল, ওই পুমাটার গায়ের গন্ধ পেলে তারা আর শিকারকে অনুসরণ করতে রাজি হত না কিছুতেই।

অনেক চেষ্টা করেও এই জন্তুটাকে কোনো শিকারি হত্যা করতে পারেনি, অবশেষে হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনায় পুমাটার মৃত্যু হয়।

পুমার সম্বন্ধে বিভিন্ন ধরনের পরস্পরবিরোধী মতামত শোনা যায়। অধিকাংশ শিকারি ও প্রাণিতত্ত্ববিদের অভিমত হচ্ছে পুমা নিতান্তই ভীরু জানোয়ার, মানুষকে সে কখনোই আক্রমণ করতে চায় না। কিন্তু দু-একজন শিকারি ভিন্নমত পোষণ করেন; তাঁরা বলেন, সুযোগ পেলে পুমা মানুষকে আক্রমণ করে, এমনকি নরমাংসের আস্বাদ গ্রহণ করতেও নাকি তাদের আপত্তি নেই!

এ বিষয়ে জোর করে কিছু বলা মুশকিল, তবে দু-একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণী পাঠ করে মনে হয় মাংসাশী বন্যপশুর স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।

উত্তর আমেরিকার এক গভীর অরণ্য থেকে ফিরে এসে জনৈক শিকারি ঘোষণা করল, যে সব বইতে পুমাকে নিরীহ বলে উল্লেখ করা হয় সেই সব বই অবিলম্বে অগ্নিতে সমর্পণ করা উচিত এবং যে-সব বিশেষজ্ঞ ওই জন্তুটিকে হিংস্র নয় বলেছেন, তাঁদের কথাও আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। উক্ত শিকারির বিবরণী থেকে যে ঘটনা জানা যায় তাতে অবশ্য পুমাকে নিরীহ আখ্যা দেওয়া অসম্ভব। ঘটনাটি নিম্নে বর্ণিত হল :

উত্তর আমেরিকার এক অরণ্য-আবৃত পর্বত-সঙ্কুল অঞ্চলে জনৈক শিকারি হরিণ শিকার করতে যায়। শিকারির নাম হল অ্যান্ড্র এস ফুলার। ছোটোখাটো হরিণের দিকে তার নজর ছিল না, তার প্রার্থিত জীব ছিল এ নামক মহাকায় হরিণ।

ডেভ রোজার্স নামক আর একটি শিকারি ছিল ফুলারের সঙ্গী, তাদের পথ-প্রদর্শক হল এড কেনেডি নামধারী একজন স্থানীয় অধিবাসী। শিকারিরা প্রত্যেকেই ঘোড়ার পিঠে যাত্রা শুরু করেছিল, তা ছাড়া প্রয়োজনীয় মালপত্র বহন করার জন্য তারা আরও তিনটি অতিরিক্ত ঘোড়া সঙ্গে নিয়েছিল।

শিকারিরা প্রথম দিন তাবু ফেলল একটা পাহাড়ের নীচে। জায়গাটা অত্যন্ত নির্জন। একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে একটা মস্ত বড়ো পাথরের মধ্যস্থলে অবস্থিত জমিটার উপর দাঁড়িয়ে শিকারিরা দেখল, পূর্বোক্ত পাথরের ঢালু দেয়াল নেমে গেছে একটা গভীর খাদের মধ্যে এবং সেই সুগভীর খাদের বক্ষ ভেদ করে ছুটে চলেছে এক পার্বত্য-নদীর তীব্র জলস্রোত। উপরে পাহাড়ের মাথায় দেখা যাচ্ছে তুষারের শুভ্র আস্তরণ, নীচের দিকেও যতদূর দেখা যায় চোখে পড়ে শুধু বরফ আর বরফ।

ওইখানেই শিকারিরা আস্তানা পাতল। সন্ধ্যার সময়ে ডেভকে তাবুর পাহারায় রেখে ফুলার ও এড হানা দিল নিকটবর্তী অরণ্যে। একটু পরেই তাদের গুলিতে মারা পড়ল একটা হরিণ। এই জন্তুটা অবশ্য এ হরিণ নয়, তবে মাংসের জন্যই তারা জন্তুটাকে বধ করতে বাধ্য হয়েছিল। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার জন্য তাদের টাটকা খাদ্য অর্থাৎ টাটকা মাংসের প্রয়োজন ছিল।

এল রাত্রি। শিকারিরা মৃত হরিণটাকে একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে তাঁবুর ভিতর শয্যাগ্রহণ করল। হরিণের দেহটা তারা তাঁবুর মধ্যে রাখেনি, কারণ মাংসের লোভে হয়তো কোনো বুনো জানোয়ার তাবুতে হানা দিতে পারে, কিন্তু গাছের উপর ঝোলানো মৃগ-মাংসকে শিকারিরা বন্যপশুর নাগালের বাইরে নিরাপদ বলে বিবেচনা করেছিল। পরের দিন সকালে উঠেই শিকারিদের আক্কেলগুড়ুম! গাছের উপর হরিণটা স্বস্থানে আছে বটে কিন্তু সম্পূর্ণ নেই। হরিণের দেহ থেকে বেশ কিছু মাংস হয়েছে অদৃশ্য!

গাছের নীচে জমি পরীক্ষা করে শিকারিরা পুমার পায়ের ছাপ দেখতে পেল। পদচিহ্ন পরীক্ষা করে তারা বুঝল, জন্তুটার ওজন হবে দেড়শো থেকে দুশো পাউন্ড!

হানাদার পুমাটা নেহাত ছোটোখাটো জীব নয়!

ফুলার লক্ষ করল পথ-প্রদর্শক এড কেনেডির মুখে ফুটে উঠেছে দারুণ বিস্ময়ের চিহ্ন, সে যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছে।

ফুলার প্রশ্ন করল, কি ভাবছ তুমি?

এড বলল, আমি ভাবছি জন্তুটা গাছে উঠে মাংস নিয়ে গেল অথচ এত কাছে দাঁড়িয়েও ঘোড়াগুলো পুমার উপস্থিতি টের পেল না!

সত্যি কথা। পুমাকে দেখতে পেলে বা তার গায়ের গন্ধ পেলে নিশ্চয়ই ঘোড়াগুলো চিৎকার করে শিকারিদের ঘুম ভাঙিয়ে দিত; কিন্তু এমন নিঃশব্দে, এমন ক্ষিপ্রগতিতে জন্তুটা গাছে উঠে মাংস নিয়ে গেছে যে নিকটবর্তী ঘোড়গুলির সম্মিলিত দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তি শ্বাপদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারেনি।

পুমাটা অসাধারণ চটপটে আর ধূর্ত ছিল সন্দেহ নেই, তবে ঘোড়ার মতো প্রখর অনুভূতি। সম্পন্ন জানোয়ারকে বার বার ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়দ্বিতীয় রাত্রে তীব্র হ্রেষাধ্বনিতে শিকারিদের ঘুম ভেঙে গেল।

এড এবং ডেভ শয্যাত্যাগ করার আগেই ফুলার রাইফেল হাতে তাবুর বাইরে পদার্পণ করল। অগ্নিকুণ্ডের আলোতে অস্পষ্টভাবে পুমার দেহটা ফুলারের চোখে পড়ল, চকিতে রাইফেল তুলে সে গুলি চার্লিয়ে দিল। রাইফেলের যান্ত্রিক গর্জনধ্বনিকে ডুবিয়ে দিয়ে জেগে উঠল জান্তব কণ্ঠের তীব্র ও তীক্ষ্ণ চিৎকার- পরক্ষণেই অন্ধকারের চেয়েও কালো এক চতুস্পদ ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল অন্ধকার অরণ্যের অন্তঃপুরে!

এড আর ডেভ এসে দাঁড়াল ফুলারের পাশে। এড বলল, জন্তুটার চিৎকার শুনে বোঝা যায় সে আহত হয়েছে। তার ধারণা, অবশিষ্ট মৃগ-মাংসের সন্ধানেই পুমাটা আবার তাঁবুর কাছে এসেছিল।

ফুলার কিন্তু সঙ্গীর মন্তব্যে সায় দিল না। তার ধারণা জন্তুটা শিকারির দলকে অনুসরণ করছে।

এড হেসে জানিয়ে দিল ফুলারের সন্দেহ অমূলক, একেবারে কোণঠাসা না হলে পুমা কখনও মানুষকে আক্রমণ করতে চায় না।

ফুলারের গুলিতে পুমাটা আহত হয়েছিল। সকালে উঠে ফুলার জন্তুটার পায়ের ছাপ ধরে সেটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল। পুমার একটা থাবা মাটির উপর দিয়ে ঘষে ঘষে গেছে দেখে শিকারিরা বুঝতে পারল ফুলারের গুলি জন্তুটার একটা থাবা জখম করে দিয়েছে।

একটু পরেই ফুলার আবিষ্কার করল এক ভয়াবহ তথ্য! শিকারিরা ঘুরছে পুমার পিছনে, কিন্তু পুমার পায়ের ছাপ দেখে বোঝা যায় বৃত্তাকারে ঘুরে এসে সে শিকারিদের পিছু নিয়েছে।

ফুলার সন্ত্রস্ত্র হয়ে উঠল। তার সঙ্গীরা অবশ্য ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। এড বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, বিড়াল-জাতীয় জানোয়ারের মধ্যে কৌতূহল খুব প্রবল, তাই কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্যই পুমা শিকারিদের অনুসরণ করতে উদ্যত হয়েছে।

ফুলারের অস্বস্তি দূর হল না। তার কেবলই মনে হতে লাগল পুমা জানে কে তাকে আঘাত করেছে। তাই প্রতিশোধ নেবার জন্যই জন্তুটা তাকে অনুসরণ করছে।

একটু পরেই তার সন্দেহ আরও দৃঢ় হল। ডান দিকে একটা মস্ত পাথরের উপর পুমার মাথাটা। তার নজরে পড়েছে।

পাথরটার উপর থেকে পুমা নীচের দিকে তাকিয়ে অশ্বারোহী শিকারিদের লক্ষ্য করছিল– জটার ঈষৎ হাঁ করা মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ধারালো দাঁতগুলো দেখে শিউরে উঠল ফুলার।

এড এবং ডেভ জন্তুটাকে দেখতে পায়নি। ঘোড়ার পিঠ থেকেই পুমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুডল ফুলার। পমার মুখের কাছেই একটা পাথরের উপর তীব্র সংঘাতের শব্দ তুলে গুলিটা ঠিকরে পড়ল, ভয়ার্তকণ্ঠে চিৎকার করে পুমাও গা-ঢাকা দিল তৎক্ষণাৎ!

পুমা যে তাদের অনুসরণ করছে এবং তার উদ্দেশ্য যে ভালো নয় এ বিষয়ে ফুলারের আর সন্দেহ ছিল না। ডেভ ও এড অবশ্য ফুলারের সন্দেহ অমূলক বলে উড়িয়ে দিল। এড আরও বলল যে, কয়েক মাইল দূরে যে কাঠের ঘরটা আছে শীঘ্রই তারা সেখানে পৌঁছে যাবে, কাজেই এ যাত্রায় আর মি, কুগারের সঙ্গে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ফুলারের ধারণা অবশ্য অন্যরকম, তবে সে তর্ক না করে ঘোড়া চার্লিয়ে দিল গন্তব্য পথের দিকে…

যে কাঠের ঘরটার কথা এড কেনেডি তার সঙ্গীদের কাছে বলেছিল, সেই ঘরটার সামনে তারা যখন এসে পৌঁছল তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমেরিকার বনে-জঙ্গলে এই ধরনের কাঠের ঘর দেখা যায়; ঘরগুলি কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়। ভবঘুরে শিকারিরা এগুলো তৈরি করে ভবঘুরে শিকারিদের জন্যই। এই সব ঘরের দরজা-জানালাও অনেক সময় থাকে না। এই ঘরটা অবশ্য দরজা থেকে তখনও বঞ্চিত হয়নি, তবে দু-দুটো জনালার মধ্যে একটারও পাল্লার বালাই ছিল না! খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর ছুটে আসছিল ঠান্ডা হাওয়া। হরিণের চামড়া দিয়ে জানালা দুটির ফাঁক বন্ধ করে শিকারিরা কনকনে ঠান্ডা বাতাসের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করল। এড আগুন জ্বালিয়ে খাদ্য প্রস্তুত করতে লাগল। শিকারিদের সঙ্গে কিছুটা মৃগমাংস ছিল, সেই মাংসের টুকরোটা তারা ছাদের বরগার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘরের তিনটি কোণে শয্যা প্রস্তুত করে তিন সঙ্গী যখন নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মনোনিবেশ করল, বাইরে তখন নেমে এসছে রাত্রির অন্ধকার…

গভীর রাতে হঠাৎ ডেভ-এর ডাকাডাকিতে ফুলারের ঘুম ভেঙে গেল। ডেভ ফুলারকে জানাল বাইরে তাদের ঘোড়াগুলিকে সে বেঁধে রেখেছিল বটে, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে উত্তেজিত হয়ে দুটি ঘোড়া অন্ধকার অরণ্যের গর্ভে আত্মগোপন করেছে। অতএব এডকে নিয়ে সে এখনই পলাতক অশ্ব দুটিকে গ্রেপ্তার করতে বাইরে যাচ্ছে, ফুলার যেন সাবধানে থাকে।

আচ্ছা, বলেই ফুলার আবার ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও সে কৃতকার্য হল না, তার শ্রান্ত ক্লান্ত দেহ তখন বিশ্রাম চাইছে নিদ্রাদেবীর ক্রোড়ে..

আচম্বিতে ঘুম ভেঙে ফুলার সচমকে উঠে বসল, তার শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেছে একটা ঘর্ষণ-শব্দ।

প্রথমে সে ভাবল ঘোড়াগুলো হয়তো পা ঠুকছে, কিন্তু ভালো করে কান পেতে শুনে সে বুঝতে পারল, পাহাড়ের দিকে যে জানালাটা আছে সেই জানালার সঙ্গে ঝোলানো হরিণের চামড়াটার উপর কেউ যেন নখ দিয়ে আঁচড় কাটছে।

নখের আঁচড় কাটার শব্দ!

মোটেই ভালো কথা নয়।

মুহূর্তের মধ্যে ফুলারের ঘুমের ঘোর কেটে গেল, সে শয্যাত্যাগ করার উপক্রম করল।

কিন্তু ফুলার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই হরিণের চামড়াটা কোনো অদৃশ্য হাতের ধাক্কা খেয়ে ঘরের ভিতর দিকে সরে এল এবং মুক্ত বাতায়ন-পথে মেঝের উপর সশব্দে অবতীর্ণ হল এক অতিকায় মাজারের দেহ পুমা।

দারুণ আতঙ্কে ফুলারের দেহের রক্ত যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। পুমা তার দিকে চাইল না, শ্বাপদের জ্বলন্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে সেই দিকে যেখানে ছাদের বরগা থেকে ঝুলছে একখণ্ড মৃগ-মাংস।

পুমা এইবার দৃষ্টি সঞ্চালিত করল ফুলারের দিকে সঙ্গে সঙ্গে তার কণ্ঠে জাগল অবরুদ্ধ গর্জনধ্বনি এবং উন্মুক্ত মুখগহ্বরের ভিতর থেকে উঁকি দিল ভয়ংকর দাঁতের সারি!

ফুলার ঘরের কোণে অবস্থিত রাইফেলটার দিকে সতৃষ্ণনয়নে দৃষ্টিপাত করলে এবং অস্ত্রটাকে হাতের কাছে না রাখার জন্য নিজেকে অভিসম্পাত দিল বারংবার।

পুমা ঘরের মেঝের উপর নীচু হয়ে বসে পড়ল, তার কান দুটো চ্যাপ্টা হয়ে মাথার খুলির সঙ্গে মিশে গেল বিড়াল-জাতীয় পশুর আক্রমণের নিশ্চিন্ত সংকেত। ফুলার একবার ভাবল লাফ মেরে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করবে, কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝল, পিছন থেকে আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টাই সে করতে পারবে না, অতএব পলায়নের কথা ভুলে গিয়ে সে বিছানার পাশে হাত বাড়িয়ে লম্বা ছুরিটা তুলে নিয়ে প্রস্তুত হল যুদ্ধের জন্য…

হিংস্র দন্তবিকাশ করে সগর্জনে লাফ দিল পুমা, বিদ্যুৎবেগে নীচু হয়ে ফুলার শ্বাপদের আক্রমণ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। পুমার ধারালো নখগুলি শত্রুর কাঁধের উপর এঁকে দিল সুগভীর ক্ষতচিহ্ন, তৎক্ষণাৎ শাপদের পাঁজর ভেদ করে বসে গেল শিকারির হাতের শাণিত ছুরিকা!

তীব্র আর্তনাদ করে পুমা ছিটকে পড়ল দেয়ালের উপর এবং সেখান থেকে ঠিকরে এসে মেঝের উপর গড়িয়ে পড়ল। এক লাফে ঘরের অপর প্রান্ত থেকে রাইফেলটা হস্তগত করে ফুলার প্রস্তুত হল চরম মুহূর্তের জন্য।

আহত পুমা আবার তেড়ে এল। ফুলার গুলি চার্লিয়ে দিল জন্তুটার মুখ লক্ষ্য করে। ভীষণ চিৎকারে ঘর কাঁপিয়ে পুমা পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপরই মেঝের উপর ছিটকে পড়ে ছটফট করতে লাগল। ফুলার আরও তিনবার গুলি ছুড়ল, পুমার দেহটা একবার টান হয়েই স্থির হয়ে গেল। ফুলার যখন বুঝল, জন্তুটার দেহে প্রাণ নেই, তখন রাইফেল নামিয়ে সে দেয়ালে পিঠ রেখে বসে পড়ল– দারুণ আতঙ্ক ও উত্তেজনায় তার সর্বশরীর হয়ে পড়েছে।

প্রায় এক ঘণ্টা পরে ডেভ আর এড যখন ঘরে ঢুকল তখন ফুলার কাঁধের ক্ষতটার উপর একটা ব্যান্ডেজ বাঁধার চেষ্টা করছে। ঘরের মধ্যে পুমার মৃতদেহ এবং ফুলারের রক্তাক্ত কাঁধের দিকে তাকিয়ে এড আর ডেভ সহজেই অনুমান করে নিল ব্যাপারটা কি হয়েছে।

দারুণ বিস্ময়ে এড যে শপথ বাক্যাটি উচ্চারণ করল সিধে বাংলায় তার অর্থ হচ্ছে, এ কি দেখছি! পুমা এগিয়ে এসে মানুষকে আক্রমণ করে।

হঠাৎ ফুলারের দৃষ্টি পড়ল ছাদের বরগার সঙ্গে ঝোলানো মৃগ-মাংসের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ফুলারের মনে হল হয়তো ওই মাংসের লোভেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছিল পুমা, প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা তার ছিল না–

মাংস-লোপ ক্ষুধার্ত পুমাকে হয়তো ফুলার প্রতিশোধ পরায়ণ শ্বাপদ বলে ভুল করছে, হয়তো যে সব বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিতত্ত্ববিদ পুমার নিরীহ স্বভাবের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের কথাই ঠিক, কিন্তু–

হ্যাঁ, তবু একটা কিন্তু থেকে যায়। যে কোনো কারণেই হোক এই পুমাটা মানুষের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছিল এবং জানলার খোলা পথে পালানোর উপায় থাকা সত্ত্বেও সে মানুষকে আক্রমণ করতে একটুও ইতস্তত করে নি।

উদভ্রান্ত শিকারি

কর্মোপলক্ষ্যে নিউজিল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষের বিহার অঞ্চলে জেমস ইংলিস নামে এক সাহেবের রোমাঞ্চকর একটি শিকারের অভিজ্ঞতা তোমরা কিছুদিন আগে সন্দেশ-এ পড়েছ। এবার তার আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা তোমাদের বলব।

বিশেষ কোনো কারণে কিছুদিনের জন্য মাতৃভূমি নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলেন জেমস ইংলিস। ফিরে এসে তিনি দেখেন তার কাজের জায়গা বদলে গেছে। এবার তাঁকে যেতে হবে অযোধ্যা প্রদেশের উত্তর-অঞ্চলে অবস্থিত বিশাল তৃণভূমিতে। সেখানে তাঁর বাসস্থানটিও নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে।

এলাকাটি ইংলিস সাহেবের সম্পূর্ণ অপরিচিত। ওখানকার মানুষের রীতিনীতিও তার অজানা। তা ছাড়া বাঙালি সংলাপে অভ্যস্ত থাকলেও অযোধ্যার বাসিন্দাদের ভাষা বুঝতে প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হচ্ছিল। আরো এই যে, তার প্রথম বারের জায়গা কুশীনদের তীরে বনভূমির সঙ্গে অযোধ্যার বন্য প্রকৃতির কোনো সাদৃশ্য ছিল না। এখানে শস্যের চেহারা অন্যরকম, চাষবাসের ব্যবস্থা আগের তুলনায় আদিম। বালুকাময় প্রান্তরের মধ্যে সুদীর্ঘ ঘাসজঙ্গলের পরিবর্তে অযোধ্যায় দেখা যায় ছায়া নিবিড় অরণ্যের জটিল সমাবেশ, আর সেই অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে তৃণগুল্মে আবৃত অসংখ্য প্রান্তর বহু দূর প্রশস্ত বিস্তার। কৃষ্ণসার নামে হরিণজাতীয় পশুরা দলে দলে ঘুরে বেড়ায় ওইসব প্রান্তরের বুকে।

বনভূমির সবচেয়ে কাছাকাছি শহর সাজাহানপুর অঞ্চলের দক্ষিণে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে ওই শহরটির অবস্থান। উত্তরদিকে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট, নাম সীতাপুর। সীতাপুরের মাঝখানে একটি গ্রাম আর পুলিশ স্টেশন।

ইংলিসের সঙ্গে ছিল একটি হস্তিনী, নাম মতি। সর্দানদীর ধারে জঙ্গল আছে শুনে ঘোড়ায় চড়ে জায়গাটা দেখতে গেলেন জেমস ইংলিস। তার আদেশে ঘোড়ার পিছু পিছু হাতিটাকে চালিয়ে নিয়ে এল সাহেবের ভৃত্যবর্গ। ওই জঙ্গলে শিকারের সম্ভাবনা আছে কিনা দেখার উদ্দেশ্য ছিল ইংলিসের।

জঙ্গলের ভিতর বহু হরিণ আর শুয়োরের পায়ের ছাপ দেখা গেল। শিকারের উপযোগী অন্যান্য জীবেরও অভাব ছিল না সেখানে। তবে বাঘ ভাল্লুকের মতো বড়ো জানোয়ারের কোনো চিহই চোখে পড়ল না। নিতান্ত নিরাশ হয়ে ফিরে আসছিলেন, হঠাৎ বাধা পড়ল। জগরু নামে যে সহিসটি তার সঙ্গ নিয়েছিল, সে জানাল একটু এগিয়ে গেলে বড় শিকারের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে তার ধারণা, এমন কি বাঘের খোঁজ পাওয়াও অসম্ভব নয়।

জাগরু শিকারে অভিজ্ঞ। তার কথা উড়িয়ে দিতে পারলেন না ইংলিস সাহেব।

নির্দিষ্ট দিকে জগরুর সঙ্গে এগিয়ে চললেন তিনি। উঁচু বালিজমির উপর অজস্র তিল ও শিমূল গাছের শুকনো ঝোঁপ ভেদ করে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ শিকারিরা এসে পড়লেন সবুজ পত্রপল্লব ও উদ্ভিদে পরিপূর্ণ ঘন অরণ্যের সামনে।

কোনো কারণে উঁচু জমির কিছু অংশ ধসে যাওয়ার ফলে একটা বিরাট গহ্বরের আকার নিয়ে নীচু জমির উপর হঠাৎ জেগে উঠেছে শ্যামল বনভুমি। গাছপালার ফাঁকে নদীর দিকে আকৃষ্ট হল শিকারিদের দৃষ্টি। সূর্যের আলোতে ঝক ঝক করে জ্বলছিল বালুকারাশির উপর প্রবাহিত নদীর জলধারা। বালিতে ভরা শুকনো জমি থেকে অনেক নীচে ওই বনভূমি। সাহেব বুঝলেন ওইখানেই বড়ো শিকারের খোঁজ পাওয়া যাবে। জায়গাটা বাঘের বসবাসের পক্ষে প্রশস্ত।

জগরুর দিকে তাকিয়ে ইংলিস দেখলেন তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে হাসির রেখা। সেই নীরব হাসির মর্ম সাহেবের কাছে স্পষ্ট কি সাহেব! বলেছিলাম কিনা জগরু কেমন দরের লোক এখন বুঝেছ তো?

হাতির সাহায্য ছাড়া ওই বনে শিকারের খোঁজ করা সম্ভব নয়। অতএব ইংলিস সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁর নির্দেশ অনুসারে সহিস জগরু তার ঘোড়ায় চড়ে তিরবেগে ছুটল হাতি আনার জন্য।

পাইপে আগুন ধরিয়ে ইংলিস সাহেব ধূমপানে মনোনিবেশ করলেন। তারই ফাঁকে গ্রামবাসীদের সঙ্গে গল্প-গুজবও চলল। একটি অল্পবয়সী ছোকরা মাটির ঢেলা নিয়ে নীচের জঙ্গলে ছুঁড়ে মারছিল অলস খেয়ালের বশে।

সামান্য ঘটনা থেকে অনেক সময় চমকপ্রদ ঘটনার উদ্ভব হয়। ছেলেটির হাতের তৃতীয় বা চতুর্থ ঢিলটি জঙ্গলের ভিতর পড়তেই হঠাৎ গর্জিত কণ্ঠে প্রবল প্রতিবাদ ভেসে এসে জানিয়ে দিল নীচের জঙ্গলটি বর্তমানে ব্যাঘ্রের বাসভূমি এবং ঢিল ছোঁড়ার ব্যাপারটা বাঘ মশাই মোটেই পছন্দ করছেন না।

যে লোকগুলো সেখানে দাঁড়িয়েছিল তাদের মুখ শুকিয়ে ছাই-এর মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ইংলিস সাহেব একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়েছিলেন কোনোদিকে না তাকিয়ে সেই গাছটা বেয়ে তিনি উপরে উঠে গেলেন বিদ্যুৎ বেগে। তাঁর বন্দুকটা পড়ে রইল গাছের তলায়!

পরক্ষণেই জঙ্গলের আবরণ ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করল ক্রুদ্ধ শার্দুল!

বাঘটি অল্প বয়সের জানোয়ার, তবে তাকে একবারে নাবালক বাচ্চা বলা যায় না। বয়স কম হলেও বিক্রম বড়ো কম ছিল না। তার গোঁফ খাড়া হয়ে উঠেছিল, ঘাড়ের লোম শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছিল সজারুর কাঁটার মতো, লেজ লোহার ডাণ্ডার মতো কঠিন ও আড়ষ্ট এবং চোখ হিংস্র আক্রোশে জ্বলন্ত!

সেখানে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষই চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা, এই নীতি অবলম্বন করে দৌড় মারল। যে ছোকরাটি ঢিল ছুঁড়েছিল সেও দ্রুতবেগে পা চালিয়েছিল, কিন্তু ব্যাঘ্রের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারল না। দু বার কি তিন বার লাফ মেরে বাঘ একেবারে তার পিঠে এসে পড়ে সজোরে চপেটাঘাত করল। সে কি ধাক্কা, এক থাপ্পড়ে ছেলেটির দেহ শূন্যপথে উড়ে গিয়ে ধরাশায়ী গ্রহণ করল সশব্দে!

বিড়াল যেমন ইঁদুরের পিছনে তাড়া করে ছুটে তেমনি করেই বাঘ ছুটে গেল ধরাশায়ী ছেলেটির দিকে। ভাগ্যক্রমে সে ছেলেটির গায়ে দাঁত কিংবা নখ বসাবার চেষ্টা করল না। ভূপতিত শত্রুর পাশে দাঁড়িয়ে সে তার কাধ আর ঘাড়ের মৃদু সঞ্চালনে রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করল, তার লাঙ্গল পাঁজরের উপর আছড়ে পড়তে লাগল। আক্রোশে তার কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে লাগল অবরুদ্ধ ক্রোধের চাপা গর্জনধ্বনি।

তরুণ বাঘ তার রাজত্বে অনধিকার প্রবেশকারীর উপর তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছে সদর্পে ও সগর্জনে!

ততক্ষণে ভয়ের ধাক্কা সামলে নিয়েছেন ইংলিস সাহেব। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে তিনি বন্দুকটাকে হস্তগত করলেন, তারপর চটপট বন্দুকে গুলি ভরে নিয়ে গুলি চালালেন। একটা গুলি লাগল বাঘের পিছনে, আর একটি গুলি তার বুক ভেদ করে চলে গেল। তৎক্ষণাৎ ধরাশয়ী ছেলেটির শরীরের উপর পড়ে গেল গুলিবিদ্ধ ব্যাঘ্রের মৃতদেহ। তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে বাঘের তলা থেকে টেনে আনা হল। পরীক্ষা করে দেখা গেল তার পাঁজরের উপর বাঘের নখ লেগে একটি গভীর ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে বটে, তবে আঘাত মারা যাবার মতো নয়।

আচম্বিতে নীচের ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে এল আর একটি গম্ভীর গর্জনধ্বনি। ইংলিস সাহেব আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন গাছটির দিকে। তবে এবার আর গাছে ওঠার চেষ্টা না করে আগে যেটায় চড়েছিলেন, সেটার আড়ালে আশ্রয় নিলেন। ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে আরও কয়েকটা গর্জন শোনা গেল, তবে সৌভাগ্যবশত কণ্ঠস্বরের মালিক জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করতে চাইল না।

সহেব এবং তাঁর সঙ্গীদল রীতিমত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। বারবার গর্জন শুনে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় করা মুশকিল। জঙ্গলের আড়ালে একাধিক ব্যাঘ্রের অবস্থানের সাংঘাতিক সম্ভাবনা যখন সকলকেই উদবিগ্ন করে তুলেছে, তখন হঠাৎ মুশকিল আসানের মতো দেখা দিল অশ্বারোহী জগরু এবং তার পিছনে হাতির সঙ্গে একদল গ্রামবাসী ও জেমস ইংলিসের ভৃত্যবর্গ।

ওই অঞ্চলের বাঘের মেজাজ-মরজি সম্পর্কে ইংলিস সাহেবের যে অভিজ্ঞতা হল, তাতে তিনি বুঝেছিলেন যথেষ্ট সাবধান না হলে বাঘের কবলে এক বা একাধিক মানুষের হতাহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অতএব নীচের জঙ্গলে বাঘ যেখানে আত্মগোপন করেছে, সেই জায়গাটা থেকে যথাসম্ভব দূরে দাঁড়িয়ে তিনি লোকজনদের চেঁচামেচি করে বাঘকে ভয় দেখাতে বললেন। তিনি নিজে জগরুর সঙ্গে মতির পিঠে বসলেন। তাঁর আদেশে মতির মাহুত তাকে জঙ্গলের দিকে নিয়ে চলল। হাতি অবশ্য ব্যাপারটা আদৌ পছন্দ করছিল না।

এবার প্রায় দুই মানুষ উঁচু ঘন উদ্ভিদের মধ্যে প্রবেশ করল হাতি, আর পরমুহূর্তেই গর্জে উঠল বাঘ। তৎক্ষণাৎ জঙ্গল থেকে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল হাতি। তাকে অনেক মারধর, অনেক তোয়াজ করেও কোনো ফল হল না। হাতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ঘন জঙ্গলের মধ্যে বাঘের সান্নিধ্যে আসতে সে নিতান্তই নারাজ।

বাধ্য হয়ে হাতির পিঠ থেকে মাটিতে নামলেন ইংলিস সাহেব। জগরুকে সঙ্গে নিয়ে অনেক ঘুরে তিনি নদীর ধার দিয়ে একটা খাড়া পাড় বেয়ে সমতল ভূমিতে হাজির হলেন। ওই জায়গাটা থেকে নীচের জঙ্গলের দিকে দৃষ্টি রাখা অনেক সহজ।

গহ্বরের মতো অরণ্য-সঙ্কুল নিম্নভূমি ছিল চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ একরের মতো চওড়া। জায়গাটা অতিশয় দুর্গম। অসমান মাটির উপর হাঁ করে রয়েছে অসংখ্য ফাটল, আর সেই ফেটে যাওয়া মাটির চারপাশে লতাগুল্ম ও শুষ্ক ঝোপের সমাবেশে গড়ে উঠেছে এক দুর্ভেদ্য ন্যূহ। অভিজ্ঞ শিকারি জেমস ইংলিস বুঝলেন একটি মাত্র হাতির সাহয্যে সেই উদ্ভিদের ব্যুহ ভেদ করে বাঘের সম্মুখীন হওয়া অসম্ভব।

সুতরাং তখনকার মতো বাঘের অনুসরণকার্যে ইস্তফা দিলেন জেমস ইংলিস। আশেপাশে একদল লোক মোতায়েন করে তিনি নির্দেশ দিলেন বাঘের গতিবিধির কোনো লক্ষণ দেখলে তারা যেন অবিলম্বে সেই খবর সাহেবকে পাঠিয়ে দেয়। নির্দেশ অনুসারে কাজ করলে প্রচুর পুরস্কারের আশা দিয়ে মৃত বাঘের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে সাহেব অ্যালেনগঞ্জে চলে গেলেন, আর সেখান থেকে তার ঘোড়ার সাহায্যে অশ্বারোহী দূত পাঠিয়ে দিলেন হাতি সংগ্রহের চেষ্টায়।

পরের দিন সকাল এগারোটার মধ্যে চারটি হাতি এসে হাজির। সঙ্গে এল একদল বলিষ্ঠ গ্রামবাসী তাদের হাতে বর্শা, মুগুর, তলোয়ার প্রভৃতি অস্ত্র। পাঁচটি হাতি সঙ্গে সশস্ত্র সেনাবাহিনী নিয়ে বাঘ শিকারে যাত্রা করলেন জেমস ইংলিস।

ইংলিস সাহেব ছিলেন মতির পিঠে। তাঁর একখানা বন্দুক নিয়ে আর একটি হাতির পিঠে বসেছিল জগরু, অন্যপাশে তিন নম্বর হাতির পিঠে ছিল বন্দুক হাতে জমিদার পুত্র। চতুর্থ ও পঞ্চম হাতির সঙ্গে সমবেত দল নিয়ে এবার জঙ্গল ভেঙে বাঘের অনুসন্ধান শুরু হল।

খোঁজাখুঁজিতে বেশি সময় নষ্ট করার দরকার হয়নি কারণ বাঘ নিজেই এগিয়ে এসে শিকারিদের অভ্যর্থনা জানাল।

অভিযান শুরু হতে না হতেই প্রকাণ্ড বাঘিনী সগর্জনে লাফিয়ে পড়ল একটি হাতির মাথার উপর!

হাতির মাহুত ছিটকে কাঁটাগাছের উপর পড়ে আর্তনাদ করতে লাগল তারস্বরে– আর হাতি তীব্র বৃহন-ধ্বনি চারদিক কাঁপয়ে সোজা ঝাঁপ দিল নদীর জলে। সেখানে চোরাবালির মধ্যে পড়ে তলিয়ে যেতে যেতে কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে চলৎশক্তিরহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুঁটো জগন্নাথের মতো! ওদিকে জঙ্গল-বাহিনীর দল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ছত্রভঙ্গ!

মতি আগের দিন ভয় পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আজ সে যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিল। শুড় আর কান গুটিয়ে আক্রমণকারী বাঘিনীর দিকে অগ্রসর হল। বাহনের আকস্মিক গতিবেগে ভারসাম্য হারিয়ে ইংলিস পড়ে গেলেন, কোনমতে নিজেকে সামলে বন্দুকের নিশানা ঠিক করার আগেই ধূর্ত বাঘিনী আক্রান্ত হাতির মাথার কাছে নখের আঁচড় বসিয়ে আবার জঙ্গলের ভিতর ঢুকে লুকিয়ে পড়ল।

ওই ঘটনার ফলে লোকজন এমন ঘাবড়ে গেল যে, আর জঙ্গলে গিয়ে বাঘিনীকে তাড়া দিতে রাজি হল না। পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি, তিরস্কার এবং সাহেবের প্রচণ্ড ক্রোধ অগ্রাহ্য করে তারা গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নদীর পাড়ে জমির উপর। অগত্যা সাহেব একাই বাঘিনীর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হলেন। তাঁর আদেশে মাহুত হাতিকে চালিয়ে দিল জঙ্গলের মধ্যে।

বেশি দূর যেতে হল না– ভীষণ গর্জনে চারদিক কাঁপিয়ে বাঘিনী ধেয়ে এল হাতির দিকে। সাহেব গুলি করলেন। গুলি সম্ভবত বাঘিনীর পিছনের দিকে লেগেছিল, একবার আর্তনাদ করে উঠল, পরক্ষণেই যুদ্ধের উদ্যম ভঙ্গি করে ঘন উদ্ভিদ আর আগাছার মধ্যে তিরবেগে সরে পড়ে আত্মগোপন করল।

মাথার উপর উচ্চভূমিতে দণ্ডায়মান জনতা মহা সমারোহে চিৎকার করে সাহেবকে জানাল বাঘিনী নদী পার করে পালিয়ে যাচ্ছে। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে নির্বোধের মতো বাঘিনীকে অনুসরণ করলেন! পরবর্তী ঘটনা থেকে বোঝা যায় অজানা জায়গায় ওই হঠকারিতার ফল সাহেবের পক্ষে মোটেই ভালো হয়নি। হাতির মাহুত ছিল এক অনভিজ্ঞ ছোকরা, সে হাতি অঙ্কুশের আঘাত করে আর কানের পিছনে পা দিয়ে মোচড় মেরে জোরে ছুটিয়ে দিল। জল তোলপাড় করে নদী পার হয়ে ছুটল হাতি। বাঘিনীকে দূরে এক জায়গায় দেখতে পেল, তারপরই একটা উঁচু বালির ঢিপি পেরিয়ে সে অগ্রসর হল। সাহেবের মনে হল জন্তুটা দস্তুরমতো ক্লান্ত।

আবার ছুটল হাতি। বালির ঢিপিটা পার হয়ে একবারের জন্য মহারানির দর্শন পেলেন ইংলিস, পরক্ষণেই নদীর পাশে অন্তর্ধান কলেন। বাঘিনীর ক্ষিপ্র গতিবেগ দেখে এবার কিন্তু সাহেবের মনে হল দূর থেকে গুলি করে তাকে বিশেষ কাবু করতে পারে নি।

মাহুত হাতিকে প্রাণপণে ছুটিয়ে দিল। বৃথা চেষ্টা বাঘিনী যেন জীবন্ত বিদ্যুৎশিখা, সাহেবের হাতি কিছুতেই বাঘিনীর কাছে পৌঁছাতে পারল না।

প্রায় দু-তিন মাইল পথ পেরিয়ে এসে ইংলিস বুঝলেন শিকার খুব সহজলভ্য হবে না। হয়তো তিনি সেখানে থেকেই ফিরে যেতেন, কিন্তু হতভাগা মাহুত সোৎসাহে জানাল এখন ফিরে যাওয়া অনুচিত। বিভ্রান্ত সাহেব মাহুতের কথায় সায় দিলেন।

অনেকক্ষণ ছুটোছুটি পর দেখা গেল হাতি অত্যন্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। বাঘিনীর পাত্তা নেই! সে যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। দারুণ পিপাসায় ইংলিস সাহেবের প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। জলের জন্য খোঁজাখুঁজি শুরু হল। কোথায় জল? জায়গাটাকে মরুভূমি বললেও অত্যুক্তি হয় না। কোনো জীবিত প্রাণীর চিহ্ন সেখানে নেই।

দেখতে দেখতে সূর্য অস্ত গেল। এল রাত্রি। আকাশে দেখা গেল পূর্ণচন্দ্র। জ্যোৎস্নার ম্লান আলোতে বালির ঢিপিগুলো দেখে সাহেবের মনে হল প্রেতলোকের কয়েকটা অপচ্ছায়া যেন চাঁদের আলোর সঙ্গে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। ভুতুড়ে দৃশ্যটার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই যেন তীব্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল একদল শেয়াল। একতান সঙ্গীতের সেই বীভৎস ধ্বনি যেন অপার্থিব আতঙ্কের শিহরণ ছড়িয়ে দিল সাহেব ও তার সঙ্গীর বুকের মধ্যে।

স্বভাবসুলভ বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে হাতি নিশ্চয় জলের সন্ধান পেতে পারত, কিন্তু মুখ মাহুত হাতিটাকে এদিক-ওদিক চালিয়ে ক্লান্ত করে ফেলল।

অবশেষে হাতিও বিরক্ত হয়ে উঠল। সজোরে ঝাঁকনি মেরে আরোহীদের সে পিঠ থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল বার বার।

একে তৃষ্ণা, তার উপর দারুণ রোদে সারাদিন ছুটোছুটি করার ফলে সাহেবের শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে উঠেছিল। শ্রান্তদেহে তিনি হাতির পিঠ থেকে পড়ে গেলেন মাটিতে, আর পড়ামাত্র অজ্ঞান।

কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ইংলিস দেখলেন তিনি সম্পূর্ণ একা, আর তাকে ঘিরে বসে আছে পনেরোকুড়িটা শেয়াল তাদের লুব্ধ চক্ষু ক্ষুধিত আগ্রহে জ্বলছে জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ডের মতো!

দুটি শেয়াল হঠাৎ দাঁত খিঁচিয়ে পরস্পরের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করতে শুরু করল। সঙ্গেসঙ্গে সমস্ত দলটা চিৎকার করে উঠল তীব্র কণ্ঠে। বালুকাময় নির্জন প্রান্তরে সেই চিৎকার যেন চাবুক মেরে সাহেবের আচ্ছন্ন চেতনাকে জাগিয়ে দিল। মনের জোরে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বন্দুকটা তুলে ধরলেন। তৎক্ষণাৎ তীরবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল শেয়ালের দল।

ইংলিস সাহেবের শুকনো জিভ তখন মুখের মধ্যে খর খর করছে, হাঁটু কাঁপছে, শরীর শিউরে উঠছে থেকে থেকে। বন্দুক আঁকড়ে ধরে তিনি এগিয়ে চললেন অন্ধের মতো। কিন্তু বেশি দূর যেতে হল না, কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বিতীয়বার তাকে সংজ্ঞা হারাতে হল। আবার যখন জ্ঞান হল তখন ভোর হয়ে গেছে, সর্যের আলো ঘন কুয়াশা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।

শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, তবু আচ্ছন্ন দৃষ্টিকে প্রাণপণে চালিত করে ইংলিস দেখলেন একটু দূরে অগভীর গর্তের ভিতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মিমোসা ঝোপের সারি। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা চিন্তা তার মস্তিষ্কে সাড়া দিল- ওখানে জল নেই তো?

শিকারের নিত্যসঙ্গী হান্টিং নাইফ সঙ্গেই ছিল সেই ধারাল ছোরা দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় মাটি খুঁড়ে ফেললেন জেমস ইংলিস। ধারণা নির্ভুল! জল রয়েছে বটে! ~-ময়লা ঘোলাটে জলে রুমাল ভিজিয়ে রুমাল বার বার নিংড়ে জলপান করে জেমস কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন।

সাহেব সেখানেই পড়ে রইলেন। মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য তার দেহের উপর অগ্নিবর্ষণ করল সারা দুপুর ধরে। বিকালের দিকে তার সঙ্গীরা যখন তাকে সেই ময়লা জল পরিপূর্ণ গর্তের পাশ থেকে উদ্ধার করল, তখন দারুণ জ্বরের ঝেকে প্রলাপ বকছেন জেমস ইংলিস।

আরোগ্যলাভের পর ইংলিস সাহেব বলেছেন, আমি যে কোথা দিয়ে কেমন করে আমার ফ্যাক্টরিতে ফিরে এসেছিলাম, সে কথা আজও বলতে পারি না।

ক্যারাটে মৃত্যুবাহী

কুস্তি এবং মুষ্টিযুদ্ধ বা বক্সিংকে যদিও খেলা বলেই ধরা হয়, আর কুস্তি ও মুষ্টিযুদ্ধের প্রতিযোগিতার আয়োজনও হয়ে থাকে, তবে এই দুটি খেলা হাতাহাতি লড়াইয়ের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু ক্যারাটে খেলা নয়–এটা সত্যিই লড়াই, নিরস্ত্র যুদ্ধ। জাপানে কেউ ক্যারাটে নামক রণবিদ্যা আয়ত্ত করতে পারলে, অর্থাৎ জাপানের কোনো ক্যারাটে বিদ্যালয় থেকে কোনো ছাত্রকে ক্যারাটে-বিশারদ বলে স্বীকৃতি দিলে জাপানি পুলিশের কাছে উক্ত ছাত্রের নাম রেজিস্ট্রি করতে হয় এবং এই কথা বলে মুচলেকা দিতে হয় যে, উক্ত ক্যারাটে-যোদ্ধা প্রাণ বিপন্ন না হলে কখনো মারামারি করবে না।

তবু মুচলেকা দিলেও সবসময় কি কথা রাখা যায়? আর মুচলেকা তো জাপানি পুলিশের কাছে, যদি কোনো ক্যারাটে-যোদ্ধা জাপানের বাইরে তার বিদ্যাকে হাতেনাতে প্রয়োগ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করবে কে?

দক্ষ ক্যারাটে-বিশারদ গুলি ভরতি রাইফেলের মতোই ভয়াবহ। রাইফেলের সেফটি ক্যাচ তুলে ট্রিগার টিপলেই অস্ত্রটি সগর্জনে মৃত্যু পরিবেশন করে। ক্যারাটের নীতিশিক্ষা ওই সেফটি ক্যাচ–ক্যারাটে-যোদ্ধা যদি কখনো নিজের উপর সংযম হারিয়ে তার নীতি ভুলে যায়, তবে রাইফেলের গুলির মতোই নিদারুণ আঘাত এসে পড়ে বিপক্ষের উপর। সেই আঘাতের ফলে আহত ব্যক্তির সাংঘাতিক দৈহিক ক্ষতি হতে পারে। এমনকী মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব নয়। অস্ত্রধারী মানুষের চাইতেও ক্যারাটে-বিশারদ অধিকতর বিপজ্জনক ব্যক্তি, কারণ অস্ত্র দেখে লোকে সাবধান হতে পারে কিন্তু ক্যারাটেকে চোখে দেখা যায় না–ক্যারাটে-যোদ্ধা এই প্রাণঘাতী অদৃশ্য অস্ত্রকে বহন করে সর্বাঙ্গে, মুহূর্তের মধ্যে প্রয়োগকারীর মুষ্ট্যাঘাত, পদাঘাত বা আঙুলের খোঁচায় : নির্দয় মৃত্যুর পরোয়ানা নেমে আসতে পারে কলহে নিযুক্ত বিপক্ষের উপর। ক্যারাটে নামক রণবিদ্যা যে আয়ত্ত করেছে, সে কখনো নিজের ওপর সংযম হারিয়ে ফেললে ঘটনার পরিণতি যে কতটা ভয়ানক হতে পারে নিম্নে পরিবেশিত কাহিনিটি তার প্রমাণ :

আমেরিকার এক ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক জাপানের ইয়োকোহামা নামক স্থানে দু-বছরের জন্য কার্যে নিযুক্ত হন। একটি আমেরিকান ব্যবসায়ী সংস্থা জাপান সরকারের সঙ্গে ব্যাবসায়িক চুক্তি করেছিল, ওই সংস্থার পক্ষ থেকে নিয়োগ করা হয়েছিল উল্লিখিত ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোককে। ওই আমেরিকান ভদ্রলোক অবশ্য আমাদের কাহিনির নায়ক নন, নায়কের স্থান অধিকার করেছে তার ছেলে জো লার্কিন। ছোটোবেলা থেকেই জো বেশ শক্তিশালী। কিছুদিন সে মুষ্টিযুদ্ধ অভ্যাস করেছিল। এমনকী মুষ্টিযুদ্ধকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার কথাও তার মনে হয়েছিল। পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধার উপযুক্ত শরীর ছিল তার দৃঢ় পেশি, দ্রুত গতি আর দুরন্ত সাহস। দরকার ছিল শুধু উপযুক্ত শিক্ষা আর নিয়মিত অভ্যাস।

জাপানে এসে জো মুষ্টিযুদ্ধের পরিবর্তে ক্যারাটের প্রতি আকৃষ্ট হল। কঠিন পরিশ্রমের ব্যাপার। হাতের মুঠি পাকিয়ে ঘুসি মারতে এবং তালুর পাশ দিয়ে কাটারির মার অভ্যাস করতে করতে দারুণ ব্যথায় হাত অসাড় হয়ে আসে, ঘণ্টার পর ঘন্টা কঠিন পরিশ্রমে আড়ষ্ট হয়ে যায় বাহুর পেশি, নগ্নপদে কঠিন বস্তুর ওপর লাথি মারতে মারতে ভেঙে যায় পায়ের আঙুল, আর

আর এই কষ্ট সহ্য করে টিকে থাকতে পারলেই অভ্যাসকারীর সাধনায় সিদ্ধিলাভ!

দুই বৎসর কঠিন পরিশ্রমের পর জো লার্কিন ক্যারাটে রণবিদ্যা আয়ত্ত করতে সমর্থ হল। আর তখনই ক্যারাটের বিধিনিষেধ সম্পর্কে তাকে সাবধান করে দেওয়া হল–প্রাণ বিপন্ন না হলে লড়াই করা চলবে না। অপমানিত হলেও অপমান সহ্য করতে হবে। ক্যারাটে বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাকে ক্যারাটে-যোদ্ধা বলে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে জাপানি পুলিশের খাতায় তাকে নাম লেখাতে হয়েছে রাস্তায় বা কোনো দোকানের মধ্যে মারামারি করলে ক্যারাটে-যোদ্ধা আইনত অপরাধী, তাকে শাস্তি দেওয়া হবে সরকার থেকে।

–অপমানিত হলেও সহ্য করতে হবে?

–হ্যাঁ, সেটাই নিয়ম। ক্যারাটে-যোদ্ধার মারামারি করার উপায় নেই। শুধুমাত্র জীবন বিপন্ন হলেই সে লড়াই করতে পারে।

জো লার্কিন তার আত্মজীবনীতে বলেছে, এত সব বিধিনিষেধ আছে জানলে সে ক্যারাটে শিখত কি না সন্দেহ।

তবে জোকে বেশিদিন জাপানে থাকতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই নিজের দেশ আমেরিকায় ফিরে এসেছিল সে। তার বয়স তখন উনিশ। সেই তরুণ বয়সেই জাপানি পুলিশের খাতায় ক্যারাটে-যোদ্ধা বলে তার নাম উঠে গেছে।

দেশে এসে আমেরিকার সেনাবাহিনীতে নাম লেখাল জো। আর্মি ট্রেনিং বা সামরিক শিক্ষা বেশ কঠিন, কিন্তু ক্যারাটে শিক্ষার ভয়ংকর পাঠশালায় পাঠ নেওয়ার পর সামরিক শিক্ষা জোর কাছে বাগান থেকে ফুল ভোলার মতোই সহজ মনে হয়েছিল। অতি অল্পদিনের মধ্যেই সে সার্জেন্ট হল। তারপর তাকে পাঠানো হল সমুদ্র পার হয়ে অন্য দেশে।

এতদিন তার সাংঘাতিক বিদ্যাকে হাতেনাতে প্রয়োগ করার সুযোগ পায়নি জো, এইবার ক্যাসাব্লাংকা নামক ফরাসিদের আস্তানায় সে নিজের ক্ষমতা যাচাই করার সুযোগ পেল। অবশ্য এর আগে ঝগড়া বা মারামারির সম্ভাবনা কখনো হয়নি এমন নয়। প্ররোচনা এসেছে ভীষণভাবে। কিন্তু ইয়াকোহামার প্রফেসর সাতো বার বার সাবধান করে ভয় দেখিয়েছিলেন–খুনের দায়ে পড়ার অনেক ঝামেলা। সেই ঝামেলার ভয়েই অনেক সময় অপমান সহ্য করে সরে এসেছে। জো, অপমানকারীকে আঘাত করার চেষ্টা করেনি কখনো। একবার মারামারি বাধলে মেপে মেপে ওজন বুঝে আঘাত করা সম্ভব নয়। ক্যারাটে মৃত্যুবাহী দেহের দুর্বল স্থানে ক্যারাটের আঘাত মৃত্যুকে ডেকে আনতে পারে মুহূর্তের মধ্যে। এসব কথা খুব ভালোভাবেই জানত জো, তাই ঝগড়ার সূত্রপাত হলে সে সতর্ক হয়ে যেত। সে মিষ্টি কথায় ঝগড়া এড়িয়ে যেতে শিখেছিল; তবু যখন মাথায় রাগ চড়ে যাওয়ার উপক্রম হত, তখন দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখত প্রবল ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে।

তবু মানুষ তো যন্ত্র নয়, সংযমের বাঁধন একদিন ছিঁড়ল। যাকে কেন্দ্র করে ব্যাপারটা ঘটল, সেই লোকটা জাহাজি শ্রমিক, আলজিরিয়ার মানুষ। মানুষটা প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উঁচু, বিশাল বুক, চওড়া কাঁধ, মুখের ডান দিকে চোখের তলা থেকে চিবুক পর্যন্ত ছুরিকাঘাতের শুষ্ক ক্ষতচিহ্ন–এক নজর দেখলেই বোঝা যায় সে দাঙ্গাহাঙ্গামায় অভ্যস্ত। আলজিরিয়ানটি পানাগারে মদ্যপান করতে এসেছিল। জো দেখল, সে বেশ মাতাল হয়ে পড়েছে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে লোকটা গেলাসের পর গেলাস মদ গিলছিল, তখনও পর্যন্ত কোনো গোলমাল করেনি, কিন্তু তার হাত অল্প কাঁপছিল নেশার ঝেকে।

দুর্ভাগ্যক্রমে জো দাঁড়িয়ে ছিল লোকটার খুব কাছেই। হঠাৎ আলজিরিয়ান শ্রমিকটি হাত বাড়িয়ে জো-র হাতের গেলাস ধাক্কা মেরে ফেলে দিল।

তুই একটা শুয়োর, গর্জন করে মাতাল আলজিরিয়ান, তুই একটা দুর্গন্ধ শুয়োর। তোর গাঁ থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে।

ঠিক, ঠিক, একটু হেসে ঝগড়া এড়িয়ে যেতে চাইল জো, তুমি বরং আর এক গেলাস মদ নাও।

মুখে হাসলেও জো-র মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। ক্যারাটে না-শিখলে সে নিশ্চয়ই লোকটার চোয়ালে ঘুসি বসিয়ে দিত। কিন্তু ক্যারাটের শিক্ষা তাকে প্রতিরোধ করল না, এখনও তার প্রাণ বিপন্ন হয়নি, এখনও আঘাত হানবার সময় আসেনি। কিন্তু বহুদেশের বহু লোক সেখানে জমায়েত হয়েছে, তাদের সামনে নিজেকে কাপুরুষ ভীরু প্রতিপন্ন করতে জো লার্কিনের খুবই খারাপ লাগছিল–তবু আশ্চর্য সংযমের পরিচয় দিল সে, দুই হাত তাড়াতাড়ি ঢুকিয়ে দিল প্যান্টের পকেটে।

হঠাৎ মাতালটা জো লার্কিনের মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে দিল, তারপর বুনো জানোয়ারের মতো গর্জে উঠে একটা মদের বোতল টেবিলে ঠুকে ভেঙে ফেলল। পলকের মধ্যে বোতলের তলার দিকে আত্মপ্রকাশ করল ধারালো ছুরির মতো অনেকগুলো ভাঙা কাঁচের টুকরো।

সেই ভাঙা বোতলের গলার দিকটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধারালো কাঁচগুলো সজোরে জো-র মুখের ওপর বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল মাতাল, কিন্তু জো চটপট সরে যাওয়ায় মাতালের চেষ্টা সফল হল না।

লোকজন তখন চিৎকার করে মাতালের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে, মেয়েরা আর্তনাদ করছে ভীতস্বরে।

দ্বিতীয় বার আঘাত হানল মাতাল। আবার সরে গেল জো। বোতলের ধারালো কাঁচগুলো জো-র মুখের কয়েক ইঞ্চি দূরে শূন্যে ছোবল মারল।

এবার আর জো-র হাত দুটো পকেটের ভিতর নেই, বেরিয়ে এসেছে। এখনও জো আশা করছে কেউ মাতালটাকে ধরে ফেলবে, পকেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ভয়ংকর হাত দুটো বোধ হয় ব্যবহার করার দরকার হবে না। কিন্তু ভীষণদর্শন মাতাল নিগ্রোটার সামনে কেউ এগোল না, সকলেই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটা রক্তাক্ত দৃশ্যের প্রতীক্ষা করতে লাগল।

জো লার্কিনের সহকর্মী কয়েকটি সৈন্য অবশ্য সেখানে ছিল, তারা ভয় পায়নি, ব্যাপারটা উপভোগ করছিল। জো-র মুখে তারা শুনেছে সে ক্যারাটে-যোদ্ধা, হঠাৎ খুনের দায়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে বলে সে মারামারির মধ্যে যেতে চায় না। অথচ তাদের সামনে জো কার্যকলাপে কোনো প্রমাণ রাখেনি! তাই আজ তারা নিশ্চেষ্ট–শুধু মুখের কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তারা দেখতে চায় হাতের কাজ।

পানাগারের ভিতর বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল মাতাল আর জো। কয়েকবার ভাঙা বোতল উঁচিয়ে আঘাত হানতে চেষ্টা করল মাতাল। প্রত্যেকবারই সরে গিয়ে লোকটার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল জো, ছুরির মতো ধারালো কাঁচগুলো একবারও জোর মুখ স্পর্শ করতে পারল না।

বার বার ব্যর্থ হয়ে লোকটা খেপে গেল। হঠাৎ সে বোতলটা ছুঁড়ে মারল জো-র মুখ লক্ষ করে। এবারও জো সরে গেল, কিন্তু আত্মরক্ষা করতে পারল না বোতলটা তার মাথার ওপর পড়ে ছিটকে গেল অন্যদিকে।

আঘাতের ফলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল জো… কয়েক মুহূর্তের স্তম্ভিত অনুভূতি… মাথা বেয়ে নামছে তপ্ত তরল একটা ধারা… রক্ত!

জো সামলে ওঠার আগেই মাতাল তাকে আক্রমণ করেছে। এবার তার হাতে ঝকঝক করছে। ধারালো ছুরি।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে জো-র মগজের মধ্যে কী যেন ঘটল..সেফটি ক্যাচ! ক্যারাটে শিক্ষার সেফটি ক্যাচ এখন সরে গেছে, এখন সে আক্রান্ত, তার জীবন এখন বিপন্ন, লড়াই করার অধিকার এখন তার আছে।

উদগ্র ক্রোধ এইবার মুক্তি পেল, জোর কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল ভয়ংকর চিৎকার!

জোর বাঁ-হাত কাটারির মতো পড়ল শত্রুর ছুরি ধরা পুরোবাহুর (forearm) উপর। অনভ্যাসের ফলে আঘাতের শক্তি কমে গেছে, তাই ছুরিটা মাতালের হাত থেকে খসে পড়ল, কিন্তু হাতটা অবশ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সেই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সামলে নিয়ে জো শত্রুর পরবর্তী আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে লাগল।

মাতাল জো-র পেট লক্ষ করে ছুরি চালাল। জো একপাশে সরে গেল, তারপর ডান হাত বাড়িয়ে মাতালের ছুরি ধরা হাতের কবজি চেপে ধরল। পরক্ষণেই তার বাঁ-হাত কাটারির মতো মাতালের বাহুর পেশিতে আঘাত করে ছুরি ধরা হাতটাকে অসাড় করে দিল। ..

এইবার ক্যারাটের খেলা–মাতাল ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই তার শত্রু চট করে একপাশে ঘুরে গিয়ে নিজের বাঁ-কাঁধের উপর রাখল, সঙ্গেসঙ্গে পাঁজরের ওপর নিদারুণ কনুইয়ের গুঁতো সেই আঘাত সামলে ওঠার আগেই মাতালের ছুরি সমেত হাতটা সবেগে শূন্যে উঠে প্রবল আকর্ষণে শত্রুর কাঁধের উপর পড়ল, তৎক্ষণাৎ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল কনুইয়ের হাড়!

ক্যারাটের মার–পৃথিবীর কোনো ডাক্তারই সেই হাড়কে আর জোড়া লাগাতে পারবে না!

ছুরিটা অনেক আগেই পড়ে গেছে মেঝের উপর। বিস্ময়-বিস্ফারিত ভীত দৃষ্টিতে মাতাল দেখল, তার ডান হাতটা ভাঙা অবস্থায় নড়বড় করে ঝুলছে!

তবু সে হার মানল না। বুনো জানোয়ারের মতো গর্জন করে সে শত্রুর পেট লক্ষ করে লাথি ছুড়ল। লাথি লাগল না, কিন্তু তার পায়ের গোড়ালি ধরা পড়ল শত্রুর মুঠোর মধ্যে পরক্ষণেই এক হ্যাঁচকা টান এবং মাতাল হল মেঝের উপর লম্বমান!

এইবার জো-র ভারী জুতো সমেত লাথি এসে পড়ল মাতালের তলপেটে, সঙ্গেসঙ্গে লড়াই শেষ। লোকটা হাঁফাতে হাঁফাতে আর্তনাদ করতে লাগল। হঠাৎ এক ঝলক বমি বেরিয়ে এসে তার আর্তকণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিল।

শায়িত শত্রুর দিকে মুহূর্তের জন্য দৃষ্টিপাত করল জো। তার বুকের ভিতর জেগে উঠেছে। রক্তলোভী দানবের হিংস্র উল্লাস–পলকে নীচু হয়ে মাতালের হাতটা চেপে ধরে সে মোচড় দিল, একেবারে চুরমার হয়ে ভেঙে গেল হাতটা। আবার একটা আর্ত চিৎকার। আবার এক ঝলক বমি। তারপরই অজ্ঞান হয়ে গেল লোকটা।

পানশালার মধ্যে অন্তত বারো রকমের বিভিন্ন জাতির লোক ছিল। সবাই নির্বাক, স্তব্ধ, শেষকালে ধরাশায়ী শত্রুর ওপর জো-র অমানুষিক অত্যাচার তাদের বিস্ময় ও আতঙ্কে স্তব্ধ করে দিয়েছে। জো-র সঙ্গীদের মুখেও কথা নেই, তাদের দৃষ্টি আতঙ্কে বিস্ফারিত–তারা যেন চোখের সামনে এক অপার্থিব বিভীষিকা দেখছে।

কেউ একটি কথা বলল না। জো এতক্ষণে নিজেকে বুঝতে পারছে। ক্যারাটে তার ভিতর এক রক্তলোভী হিংস্র দানবের জন্ম দিয়েছে, যে-দানব অপরকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। ভাঙা হাতটাকে মুচড়ে দিয়ে লোকটাকে যন্ত্রণা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তলপেটে লাথি না-মেরেও সে লোকটাকে কাবু করতে পারত। অবরুদ্ধ হিংসা মুক্তি পেয়েই তার প্রবৃত্তি চরিতার্থ করেছে যথেচ্ছভাবে। হঠাৎ তীব্র বিবমিষা জো-কে অস্থির করে তুলল, কোনোরকমে প্রস্রাব আগারে ঢুকে সে বমি করে ফেলল।

বেরিয়ে এসে জো দেখল, পানাগারের ভিতরে অবস্থা যেন কিছুটা স্বাভাবিক। ভিড়ের মধ্যে কেউ অ্যামবুলেন্স ডেকে পাঠিয়েছে। ফরাসি সাইরেনের উৎকট ধ্বনি কানে এল। পুলিশ আসছ। জো বিশেষ ভয় পেল না। প্রথমে ভাঙা বোতল, পরে ছুরি নিয়ে লোকটা যে তাকে আক্রমণ করেছিল, সেই দৃশ্য বহু লোক দেখেছে। সে যে মারামারি করতে চায়নি বরং এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে সেটাও প্রমাণ করা কঠিন হবে না–বহু মানুষের চোখের সামনে এসব ঘটনা ঘটেছে। না, পুলিশকে নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে না, মূৰ্ছিত লোকটির কথাই চিন্তা করছে সে। হঠাৎ পকেট থেকে অনেকগুলো ডলার বার করে সে অচেতন মানুষটার পকেটে গুঁজে দিল। আলজিরিয়ান নিগ্রোর ভাঙা হাড় আর জোড়া লাগানো যাবে না, কিন্তু ওই টাকায় অন্তত ভালোভাবে চিকিৎসা করার সুযোগ সে পাবে।

কয়েকটা দিন কাটল। সেনানিবাসের সকলেই অকুস্থলে উপস্থিত সৈনিকদের মুখ থেকে ব্যাপারটা শুনেছে। হঠাৎ একদিন জো আবিষ্কার করল সে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। কেউ তার সঙ্গে কথা কইতে চায় না। জো নানাভাবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমাতে চেষ্টা করল। বৃথা চেষ্টা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া তারা তার সঙ্গে কথা বলে না। জমাট তাসের আড্ডায় সে উপস্থিত হলে তাসের আড্ডা ভেঙে যায়। নানা ছুতোয় সকলে স্থান ত্যাগ করে। সিনেমা যাওয়ার আমন্ত্রণ এখন। কেউ তাকে করে না। বন্ধুদের মধ্যে যারা তাকে ক্যারাটের কৌশল শেখাতে অনুরোধ ছেড়ে তোষামোদ পর্যন্ত করত, তারাও এখন তাকে এড়িয়ে চলতে চায়।

ফল হল সাংঘাতিক। জো আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিল। হয়তো সে তার মারাত্মক বিদ্যাকে দ্বিতীয় বার প্রয়োগ করত না। কিন্তু সবাই তাকে এড়িয়ে চলছে দেখে সে মনে মনে ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠল। তার প্রাণঘাতী আক্রোশকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সে সুযোগের অপেক্ষায় রইল।

সুযোগ এল কিছুদিনের মধ্যেই। ছয়টি সৈন্যের সঙ্গে একদিন জো বেরিয়েছিল টহল দিতে। জো স্বয়ং ছিল দলের নেতা। নিতান্ত অভাবিতভাবেই হঠাৎ একটি জার্মান সৈন্য তাদের সামনে এসে পড়ল। সৈন্যটি তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণ করল, সে নাকি পথ হারিয়েছে। আমেরিকান সৈন্যরা অস্বস্তি বোধ করতে লাগল–নির্দিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করার জন্য তারা টহল দিতে বেরিয়েছে, এখন বন্দিকে নিয়ে আস্তানায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।

জার্মান সৈন্যটি যখন বুঝল তাকে গুলি করা হবে না, সে আশ্বস্ত হল। দেখা গেল সে ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। জো তাকে কিছু খাদ্য আর সিগারেট দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দেহটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল–হ্যাঁ, লম্বায়-চওড়ায় জার্মানটি প্রায় তারই মতো, আঁটোসাঁটো শরীরটা দেখলে মনে হয় সে ব্যায়ামে অভ্যস্ত। জো বন্দির সঙ্গে কথা বলছিল। তার সঙ্গীরা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। বন্দিকে নিয়ে যে-সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, জো যে তার সমাধান করতে চাইছে সেটা তারাও বুঝতে পারছিল। এই ভয়ংকর ক্যারাটে-যোদ্ধাটি যে কেমন করে এই সমস্যার সমাধান করবে সেটাও তারা আন্দাজ করতে পারছিল–তাই বন্দির সঙ্গে কথা বলতে তারা বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করেনি।

জো বন্দিকে প্রশ্ন করল, তুমি কখনো বক্সিং লড়েছ? জার্মান বন্দির বলিষ্ঠ দেহ আর ভাঙা নাকের গড়ন দেখেই জো-র ওই প্রশ্ন। অনুমান নির্ভুল। বন্দি জানাল ১৪ বছর বয়স থেকেই সে বক্সিং লড়ছে। তা ছাড়া ফুটবল খেলার অভ্যাসও তার আছে।

বাঃ! চমৎকার! জো বলল, শোনো, তোমার সঙ্গে একটা চুক্তি করছি। আমরা হাতাহাতি লড়াই করব। যদি আমাকে হারাতে পারো তাহলে তোমায় মুক্তি দেওয়া হবে। ঠিক আছে?

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, জার্মান বন্দি বলল। তার কণ্ঠস্বরে আতঙ্কের আভাস। সে বোধ হয় বুঝেছিল তার বিপদ আসন্ন।

তুমি ঠিকই বুঝেছ, জো বলল, নাও, তৈরি হও। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।

জো জামা খুলে ফেলল। বন্দিও তার উদাহরণ অনুসরণ করল। জো দেখল, বন্দির বুক বেশ চওড়া, হাত-পায়ের কঠিন মাংসপেশি বন্দির দৈহিক শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। জো খুশি হল। শক্তিশালী মানুষ না হলে লড়াই করে সুখ নেই।

জো-র সঙ্গীরা নীরব। তারা জানত জো ক্যারাটে-যোদ্ধা, তার ভয়াবহ খ্যাতি তাদের কানেও এসেছে। এখন তারা স্তব্ধ হয়ে জো-র কার্যকলাপ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

লড়াইয়ের শুরুতে জার্মান সৈন্যটি বিশেষ উৎসাহ দেখাল না। জো প্রতিরোধের ভঙ্গিতে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ায়নি, মুখ আর শরীর প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে উন্মুক্ত বন্দি তবুও নিশ্চেষ্ট, তার আঘাত হানা উদ্যম নেই কিছুমাত্র।

জো এবার বন্দিকে উত্তেজিত করতে সচেষ্ট হল, সে সজোরে চড় মারল বন্দির গালে, আমি জানি নাজিরা ভীরু, কাপুরুষ। তোমাদের লড়াই করার সাহস নেই। সঙ্গেসঙ্গে গালাগালি।

এবার কাজ হল। বন্দির চোখে-মুখে ফুটল ক্রোধের আভাস। সে এগিয়ে এসে সজোরে ঘুসি ছুঁড়তে লাগল। একটা ঘুসিও অবশ্য জো-কে স্পর্শ করতে পারল না। সুকৌশলে আঘাতগুলো এড়িয়ে গেল জো।

জো এবার কাজ শুরু করল, ডান হাতের বুড়ো আঙুল করতল চেপে রইল, আঙুলগুলো ছুরির মতো আড়ষ্ট, শক্ত–পরক্ষণেই সেই কঠিন আড়ষ্ট আঙুলগুলো দারুণ জোরে ছোবল মারল প্রতিদ্বন্দ্বীর পেটের মাঝখানে। দারুণ যাতনায় জার্মান বন্দির শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

আবার শ্বাস টেনে নিজেকে প্রস্তুত করার আগেই জো-র বাঁ-হাতের বজ্রমুষ্টি হাতুড়ির মতো আছড়ে পড়ল বন্দির ওষ্ঠের ওপর। কয়েকটা দাঁত ভেঙে গেল সঙ্গেসঙ্গে। ক্যারাটে-ঘুসি সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে ওই আঘাতেই দাঁতের পরিবর্তে মুখের হাড় ভাঙত, তারপর আর এক ঘুসিতে ভাঙা হাড়গুলো পৌঁছে যেত মগজের মধ্যে। ইচ্ছে করেই ভুল করেছিল জো, ক্যারাটের মরণমার মারতে চায়নি সে। লড়াইটাকে দীর্ঘস্থায়ী করে বন্দিকে যন্ত্রণা দিয়ে ধীরে ধীরে হত্যা করতে চাইছিল সে।

নাজি বন্দিটি ভীষণভাবে আহত হলেও তখন পর্যন্ত মারামারি করার ক্ষমতা হারায়নি। সে বুঝেছিল শত্রুকে পরাস্ত করতে না-পারলে তার মৃত্যু নিশ্চিত, অতএব হিংস্র আক্রোশে সে এবার জো-র ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জো শান্তভাবে অপেক্ষা করছিল তার ডান হাত তলার দিকে ঝুঁকে পড়েছে আর আঙুলগুলো খুলে ছড়িয়ে রয়েছে উপযুক্ত জায়গায় ছোবল মারার জন্য।

ক্যারাটে শিক্ষায় ওই ভঙ্গিকে বলে নাকিতে–অতি ভয়ংকর ওই খোলা আঙুলের নিষ্ঠুর আঘাত।

জো আঘাত হানল। বন্দির নাকের দু-পাশ দিয়ে সটান দুই চোখে খোঁচা মারল আঙুলগুলো। তৎক্ষণাৎ বন্দির দুই চক্ষু হল রক্তাক্ত, অন্ধ।

ওইভাবে আঘাত হানার কৌশল শিখলেও হাতেনাতে কখনো সেই শিক্ষাকে প্রয়োগ করার সুযোগ পায়নি জো। আঙুলগুলোকে লোহার মতো শক্ত করে নির্ধারিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে সে ক্যারাটে শিক্ষার বিদ্যালয়ে, কিন্তু আঘাত হানতে পারেনি কারণ, অংশীদার সহকর্মীর বিপদ ঘটতে পারে। এতদিন পরে ওই ভয়ংকর কৌশলকে বাস্তবে বাস্তবায়িত করবার সুযোগ পেল জো।

বন্দির অবস্থা তখন শোচনীয়। জো-র বন্ধুরাও তার নিষ্ঠুরতা দেখে চমকে গেছে। ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে আতঙ্ক-বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে তারা তাকিয়ে আছে জোর দিকে। যাতনাকাতর অন্ধ বন্দি তখন অসহায়ভাবে আর্তনাদ করছে অস্ফুট কণ্ঠে–হিংস্র পশুর মতো জো তার ওপর লাফিয়ে পড়ল। প্রথমে বন্দির বাঁ-হাত, তারপর ডান হাত ভাঙল জো। সঙ্গেসঙ্গে ক্রুদ্ধ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল জো-র সহকর্মী সৈনিক ছয়জন। জো বুঝল, বন্দির উপর আর অত্যাচার করলে সৈন্যরাই খেপে যেতে পারে। ছয়টি রাইফেলধারী মানুষকে উত্তেজিত করা ক্যারাটে–যযাদ্ধার পক্ষেও বিপজ্জনক, অতএব জো হাতের কাজ শেষ করতে সচেষ্ট হল। মৃত্যুবাহী ক্যারাটের এক দারুণ আঘাতে বন্দির নাকের হাড় ভেঙে মগজে প্রবেশ করল, হতভাগ্যের মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ।

ক্যারাটের নিয়ম লঙ্ঘন করেছিল জো। আত্মরক্ষার জন্যই ওই অদ্ভুত প্রাচ্যদেশীয় রণকৌশল শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু জো তার বিদ্যাকে প্রয়োগ করেছিল অন্তরে নিহিত হিংস্র উল্লাস চরিতার্থ করার জন্য। এবং সেইজন্য সে অনুতপ্ত হয়নি কিছুমাত্র।

যথাসময়ে সদরে রিপোর্ট গেল বন্দি নাকি পলায়নের চেষ্টা করেছিল, তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে। জো-র সঙ্গীরা চুপ করে রইল। জার্মানদের চাইতেও সার্জেন্ট জো লার্কিন সম্পর্কে তাদের ভীতি ছিল অনেক বেশি।

কিছুদিন পরে আবার ক্যারাটেকে কাজে লাগানোর সুযোগ পেল জো লার্কিন। একটি জার্মান ক্যাপ্টেনকে মার্কিন সেনানিবাসে বন্দি করে আনা হয়েছিল। লোকটা ঝটিকা-বাহিনীর ক্যাপ্টেন, হিটলারের অন্ধ ভক্ত, গোঁড়া নাজি–শত্রুপক্ষের প্রত্যেকটি মানুষ তার কাছে অতিশয় ঘৃণ্য।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুসারে মার্কিন বাহিনীর ক্যাপ্টেন জোন্স ওই নাজি বন্দিকে কয়েকটা প্রশ্ন করে। জোন্স আদর্শ ভদ্রলোক, প্রশ্ন করার আগে বন্দির হাতে সে এক গেলাস মদ তুলে দিয়েছিল। হতভাগা নাজি এমন ভালো ব্যবহারের মূল্য দিল না–গেলাসের মদ জোন্সের মুখে ছিটিয়ে দিয়ে সে সজোরে পদাঘাত করল তার পেটে!

আর কিছু করার আগেই প্রহরীরা তাকে ধরে ফেলল। ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে জোনস আর্তনাদ করছে রুদ্ধস্বরে, তার পেটের নাড়ি ছিঁড়ে গেছে বুটসমেত লাথির আঘাতে।

হাসপাতালে যাওয়ার আগে জো লার্কিনকে ডেকে পাঠাল ক্যাপ্টেন জোন্স। যদিও জোন্স কখনো জো লার্কিনের সঙ্গে ক্যারাটে সম্পর্কে কোনো প্রসঙ্গ তোলেনি, তবু জো সম্পর্কে কিছু গুজব তার কানে এসেছিল নিশ্চয়ই।

জো আসতেই ক্যাপ্টেন জোন্স বলল, বন্দিকে এইবারতুমি প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করবে। তারপর জো-কে কাছে আসতে ইশারা করে জোন্স মৃদুস্বরে বলল, ওই শয়তানটাকে নিয়ে তুমি যা খুশি করতে পারো। পরিণামের কথা ভেবে ভয় পেয়ো না। আমি তোমাদের ক্যাপ্টেন, আমি তোমাকে সবসময়ই সমর্থন করব।

বাঃ! চমৎকার! জো তো এইরকমই চাইছিল। তার অন্তরের অন্তস্থলে এক ঘুমন্ত দানব জেগে উঠল হিংস্র উল্লাসে।

গেস্টাপো নামে কুখ্যাত জার্মান গুপ্ত পুলিশ কাউকে গোপনে খুন করতে হলে মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে তাকে নিয়ে আসে–ঠিক সেইভাবেই মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে মার্কিন প্রহরীরা নাজি ক্যাপ্টেনকে একটা ফাঁকা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বন্দি জার্মানকে তার প্যান্ট পরার সময়ও দেওয়া হয়নি, তার পরনে ছিল শুধু ছোটো হাফ প্যান্ট। ওই অবস্থায়ই তাকে নগ্নপদে হাঁটিয়ে আনা হয়েছে।

ঘরের মধ্যে অপেক্ষা করছিল জো লার্কিন। তার পোশাকে স্ট্রাইপ চিহ্নগুলোর দিকে তাকাল বন্দি, তারপর শুদ্ধ ইংরেজিতে প্রশ্ন করল, এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কী?

হের ক্যাপিটান, জো তার শার্ট আর প্যান্ট খুলতে খুলতে বলল, তোমার ভারি বদঅভ্যাস, লোকজনকে তুমি লাথি মারো। এটা খুবই অন্যায় আর অভদ্র ব্যবহার। তোমাকে আমি আজ ভদ্রতা শিখিয়ে দেব।

হের ক্যাপিটান সঙ্গেসঙ্গে জো-র কথার আসল মানেটা বুঝতে পারল, ব্যাপারটা তার ভারি মজার মনে হল।

হো হো শব্দে হেসে সে বলল, তুমি?

স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, লোকটা হাতাহাতি মারামারিতে বেশ দক্ষ, নিজের দৈহিক শক্তি সম্পর্কে তার ধারণাও যে খুবই উঁচু সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। জো প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করল–প্রায় ছয় ফুট দু-ইঞ্চির মতো লম্বা, চওড়া বলিষ্ঠ কঁধ, কোমরের দিকটা চাপা, হাতে-পায়ে কঠিন মাংসপেশির স্ফীত বিস্তারের কোথাও এতটুক মেদের চিহ্ন নেই–হ্যাঁ, লোকটা গর্ব করার মতো দেহের অধিকারী বটে। বন্দির গায়ের রং রোদে পোড়া, নিশ্চয়ই ফাঁকা মাঠে ব্যায়াম করার অভ্যাস আছে। জো ভাবল হয়তো কিছু কিছু জুডোর কায়দা লোকটা রপ্ত করেছে।

ততক্ষণে পোশাকের আবরণ থেকে মুক্ত হয়েছে জো। তার পরনে জার্মান বন্দির মতোই একটা ছোটো হাফ প্যান্ট এমনকী পায়ের ভারী বুট দুটো খুলে ফেলা হয়েছে। জুতো পায়ে লাথি মারার সুযোগ নিতে চায় না জো, তার একমাত্র ভরসা মৃত্যুবাহী ক্যারাটে।

ঠিক আছে, মুর্খ আমেরিকান শুয়োর, নাজি গর্জন করে উঠল, আমি ভদ্রতা শেখার জন্য প্রস্তুত।

লোকটার চোখে-মুখে একটা হিংস্র দীপ্তি জ্বলে উঠল, কিন্তু সে এগিয়ে এল না, প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। জো একটু অবাক হল, লোকটার মতলব সে বুঝতে পারল না।

আচম্বিতে বিস্ময়ের চমক! ক্যারাটে! এই লোকটাও ক্যারাটে-যোদ্ধা! যেভাবে ডান পায়ের আঙুলগুলো গুটিয়ে নিয়ে সে লাথি চালাল তাতে প্রমাণ হয়ে গেল ক্যারাটের মরণ খেলায় সেও এক খেলোয়াড়।

চিবুকের উপর প্রচণ্ড পদাঘাতে ছিটকে পড়ল জো লার্কিন!

আর একটু হলেই ঘাড় ভাঙত, কোনোরকমে আত্মরক্ষা করে জো উঠে দাঁড়াল। ভালোভাবে টাল সামলে দাঁড়ানোর আগেই সে দেখতে পেল জার্মান বন্দি তাকে আক্রমণ করতে আসছে। চকিতে পিছন ফিরে পায়ের গোড়ালি দিয়ে আঘাত হানল জো। ঠিক জায়গায় সেই আঘাত লাগলে লড়াইয়ের মোড় তখনই ঘুরে যেত, তবে জো-র লাথিটা একেবারে ব্যর্থ হল না–নাজির দম বেরিয়ে গেল, সে থমকে দাঁড়াল মুহূর্তের জন্য।

লোকটা সত্যিই কঠিন ধাতুতে গড়া, আর তেমনি চটপটে। জো ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই নাজি তাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলল যে, জো দস্তুরমতো যন্ত্রণা ভোগ করল। অবশ্য জো মুহূর্তের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং তলপেট লক্ষ করে প্রাণঘাতী লাথিটা এড়িয়ে গিয়েছিল। ব্যর্থ হয়ে বন্দি আবার জোর চিবুক লক্ষ করে লাথি হাঁকাল আর একটুর জন্য ফসকে গেল। জো ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে, লোকটা ক্যারাটে জানে এবং যথেষ্ট ক্ষিপ্র, তবে সে পাকা খেলোয়াড় নয়।

সেই মুহূর্তে নাজি যেভাবে অবস্থান করছিল, তাতে জো-র পক্ষে তার চিবুকে কনুই দিয়ে আঘাত করার সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। বলাই বাহুল্য, জো সেই সুযোগ নিতে একটুও দেরি করেনি। নাজি বন্দি চোখে সর্ষে ফুল দেখতে দেখতে বসে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে জো ক্যারাটের বিশেষ পদ্ধতিতে পদাঘাত করল শত্রুর মুখে। জার্মান সৈন্যের নাক ভেঙে গেল তৎক্ষণাৎ।

আহত নাজি সেনা দারুণ আক্রোশে লাফিয়ে উঠল, তারপর ধেয়ে এল জো-কে আক্রমণ করতে। সে কিছু করার আগেই তার কণ্ঠনালীতে হাতের তালু দিয়ে কাটারির মতো আঘাত হানল জো। যন্ত্রণায় জার্মানটির মুখ নীল হয়ে গেল।

লড়াইয়ের পরবর্তী বিবরণ এমন নিষ্ঠুর যে, সেই বর্ণনা পাঠকের মনকে পীড়িত করবে। সংক্ষেপে বলছি, সৈন্যটিকে অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে অবশেষে তাকে হত্যা করেছিল জো। সকালের আলোতে জার্মান সৈন্যটির মৃতদেহের অবস্থা দেখে জো নিজেও শিউরে উঠেছিল।

লড়াইয়ের উন্মাদনা তখন কেটে গেছে, হত্যার নির্দয় লালসা তৃপ্ত হওয়ায় জো লার্কিনের বুকের মধ্যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে হন্তারক দানব অনুতপ্ত জো ক্যাপ্টেন জোন্সের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলল। কী অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে লোকটাকে সে হত্যা করেছে, তার বিশদ বিবরণ দিয়েছিল জো। সেই বিবরণ (পাঠকদের কাছে আমি যা বর্ণনা করিনি) শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ক্যাপ্টেন জোন্স।

পরবর্তীকালে সেনাবিভাগের কাজে ইস্তফা দিয়ে নাগরিকদের জীবন গ্রহণ করল জো লার্কিন। এমন একটা অফিসে সে কাজ নিয়েছিল যেখানে কারো সঙ্গে মারামারি হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

জো লার্কিনের সংক্ষিপ্ত কাহিনি এখানেই শেষ। কৌতূহলী পাঠকের মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে, ক্যারাটের অভিশাপ থেকে জো কি আজ মুক্ত? জো নিজেও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ নয়। তবে পরিশিষ্ট হিসাবে তার নিজস্ব বক্তব্য তার জবানিতেই পরিবেশন করছি :

পাঠক! একটা কথা বলে আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। আমার প্রকৃত নাম জো লার্কিন নয়। আপনি যদি শক্তিশালী হন আর গায়ের জোর দেখাতে গুন্ডামি করতে ভালোবাসেন, আর সেইজন্যই যদি কোনো রাত্রে কোনো রেস্তরাঁ বা পানাগারের মধ্যে খুব শান্তশিষ্ট একটি লোককে আপনার যাবতীয় অসভ্যতা সহ্য করে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অত্যন্ত গোবেচারার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন, তবে

তবে বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। কারণ আমার দৈহিক ক্ষমতা এখনও অটুট, আর একবার মারামারি বাধলে আমি শেষ না-দেখে থাকতে পারি না।

[১৩৮৭]

গল্পের চেয়েও ভয়ংকর

ঘুম ভেঙে গেল..

ঘুম ভেঙে যাওয়া কিছু আশ্চর্য নয়।

সেই বীভৎস চিৎকার কানে গেলে জ্যান্ত মানুষ তো দূরের কথা, বোধ হয় কবরের মড়াও বাপ রে বলে কবরের মধ্যে ধড়মড়িয়ে উঠে বসত…

ঘুমের ঘোর তখনও চোখ থেকে কাটে নি, আমার স্তম্ভিত দৃষ্টির সম্মুখে ফুটে উঠল এক ভয়ংকর দৃশ্য!

ভালো করে চোখ মুছে চাইলুম– না, দুঃস্বপ্ন নয়, নিশ্চিত মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলি চতুষ্পদ জীব- তাদের রোমশ দেহের সাদা সাদা চামড়ার উপর নাচছে অগ্নিকুণ্ডর রক্তিম আলোকধারা, জ্বলন্ত কয়লার মতো চোখে চোখে জ্বলছে ক্ষুধিত হিংসার নিষ্ঠুর প্রতিচ্ছবি!

কাফাতো হাতের বর্শা বাগিয়ে ধরে একটু ঝুঁকে দাঁড়াল, ঠান্ডা গলায় বললে, মি. ম্যাক, বাঁচার আশা রেখো না, সাদা শয়তানের দল যাকে ঘিরে ধরে তার নিস্তার নেই। তবে মরার আগে মেরে মরব।

পাশের রাইফেলটা তুলে ধরে সেফটি ক্যাচটা সরিয়ে দিলুম। সঙ্গেসঙ্গে একটা জানোয়ার অগ্নিকুণ্ডের খুব কাছে এসে চিৎকার করে উঠল অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় ঝকঝক করে উঠল তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি।

অগ্নিকুণ্ডের কাছে ও দুরে যে চতুষ্পদ জীবগুলি এতক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল।

কাফাতো বললে, মি. ম্যাক, প্রস্তুত হও এবার ওরা আক্রমণ করবে।

রাইফেলের ট্রিগারে আঙুলে রেখে চার পাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলুম। সামনে অগ্নিকুণ্ড, তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিমান যমদূতের দল, আগুনের এধারে আমি আর কাফাতো, পিছন থেকে আমাদের বাঁদিক ও ডানদিক দিয়ে উঠে গেছে খাড়া পাহাড়ের প্রাচীর।

শয়তানের দল সেই পথ বেয়ে তিরবেগে উঠে আসতে লাগল।

আমার কাছে রাইফেলের কার্তুজ খুব বেশি নেই, ভরসা খালি আগুন। কিন্তু আগুনের তেজ কমে এসেছে; জ্বালানি কাঠ, বসার টুল, এমনকি তাঁবুটাকেও আমরা জ্বালিয়ে দিয়েছি আর এমন কিছু নেই যা দিয়ে আগুনটাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবার?

কাফাতোর দিকে তাকিয়ে দেখলুম তার কালো পাথরের মতো মুখ সম্পূর্ণ নির্বিকার, শুধু শরীরের মাংসপেশীগুলি যেন এক ভয়ংকর প্রতীক্ষায় ফুলে ফুলে উঠছে…

সামনের জানোয়ারটা আরও কাছে এসে দাঁড়াল, তারপর হঠাৎ এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে আগুন ডিঙিয়ে একেবারে আমাদের সামনে এসে পড়ল। তার সঙ্গে সঙ্গে দেখলুম তাকে অনুসরণ করে আরও দুটো জানোয়ার আগুনের বেড়ার উপর দিয়ে শূন্যে লাফ মারল।

আমার হাতের রাইফেল সশব্দে অগ্নি-উদ্গার করলে, সামনের জন্তুটার মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল।

কাফাতো হাতের বর্শা চার্লিয়ে আর-একটা জন্তুকেও মাটিতে পেড়ে ফেলল; কিন্তু তিন নম্বর শয়তানটা তার দেহের উপর এসে পড়ল এবং বিকট হাঁ করে শত্রুর গলায় কামড় বসাবার উপক্রম করলে। ভীষণ আতঙ্কে আমার হাতের আঙুল অবশ হয়ে এল। গুলি চালাবার উপায় নেই, কাফাতোর গায়ে গুলি লাগতে পারে।

আড়ষ্ট দেহে চোখের সামনে এক বিয়োগান্ত নাটকের রক্তাক্ত দৃশ্যের অপেক্ষা করতে লাগলুম।

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নিজের দেহের রক্তমাংস দিয়ে কোনো উপবাসী শ্বাপদের উপবাস ভঙ্গ করাতে কাফাতো রাজি হল না- চটপট মাথা সরিয়ে সে গলটা বাঁচিয়ে নিল, কিন্তু তীক্ষ্ণধার দাঁতগুলি তার বাঁদিকের কাঁধের উপর এঁকে দিল এক গভীর ক্ষতচিহ্ন।

কাফাতোর হাতের বর্শায় আবার বিদ্যুৎ খেলে গেল তীব্র আর্তনাদ করে জন্তুটার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে আছড়ে পড়ল– সব শেষ!

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, যাক বাঁচা গেল।

কাফাতোর মুখে শুকনো হাসি খেলে গেল, মি. ম্যাক বাঁচবার আশা রেখো না- ওরা আবার আক্রমণ করবে।

সত্যিই তাই।

পর পর তিনটি সঙ্গীর মৃত্যু দেখে জন্তুগুলো একটু সরে গিয়েছিল কিন্তু একটু পরেই কয়েকটা জানোয়ার আবার আগুনের বেড়া ডিঙিয়ে আক্রমণ করল।

আবার গর্জে উঠল আমার হাতের রাইফেল, রক্তে লাল হয়ে গেল কাফালোর হাতের বর্শা আমাদের সামনে আর অগ্নিকুণ্ডর ওপাশে পড়ে রইল কতকগুলি শ্বেতকায় প্রাণহীন পশুদেহ।

কিন্তু শয়তানের দল পালিয়ে গেল না। কিছুক্ষণ পর পর তারা আক্রমণ করে, মাটিতে পড়ে থাকে কয়েকটা হতাহত জানোয়ার, ওরা পিছিয়ে আবার আক্রমণ করে…।

হঠাৎ সভয়ে দেখলুম রাইফেলের বুলেট ফুরিয়ে গেছে।

অকেজো জিনিসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোমরের রিভলভারটা টেনে নিলুম মাত্র ছয়টি বুলেট তাতে ভরা আছে, সঙ্গে আর কার্তুজ নেই!

কাফাতোর নীরস কণ্ঠ শুনতে পেলুম, মি. ম্যাক, ওরা আবার আসছে..।

আহোয়ার সাদা কুকুর সম্পর্কে কোনো কথা আগে শুনিনি। পরে যখন জানতে পারলুম তখন মনে মনে ঠিক করে ফেললুম কয়েকটা সাদা কুকুরের চামড়া জোগাড় করতেই হবে।

আমি জাত শিকারি, শিকার আমার শুধু নেশা নয়- পেশাও বটে। যেসব জানোয়ার সচরাচর দেখা যায় না তেমন বহু জন্তু আমি শিকার করেছি এবং পৃথিবীর বিখ্যাত জাদুঘরগুলি আমার কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে সেই সব বিরল পশুচর্ম সংগ্রহ করতে কুণ্ঠিত হয়নি। আমার হাতে নিহত সাদা কুকুরগুলি এখন ম্যানিলা, পাপিতি এবং হনলুলুর বিখ্যাত জাদুঘরের শোভাবর্ধন করছে।

তাদের সাদা চামড়ার শোভায় মুগ্ধ হয়ে দর্শকরা প্রায়ই চেঁচিয়ে ওঠে, বাঃ! বাঃ! কী সুন্দর! কী চমৎকার!

চমৎকারই বটে! এই চমৎকার চামড়া জোগাড় করতে গিয়ে আমার গায়ের চামড়াই শরীর-ছাড়া হওয়ার উপক্রম করেছিল। সেই কথাই বলছি…

আহোয়া উপত্যকায় যাওয়ার আগে অবশ্য এই সাদা কুকুরদের সম্বন্ধে আমার বিশেষ কিছুই জানা ছিলনা। পরে জানতে পারলুম হাঙ্গারির কোভাজ জাতের কুকুর থেকেই এদের উৎপত্তি।

এই জাতীয় কুকুরগুলি অত্যন্ত হিংস্র এবং শক্তিশালী হয় এবং এদের দেহের আয়তনও নেকড়ের চাইতে একটুও ছোটো নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হিভাওয়া দ্বীপে কোনো এক হতভাগা ইউরোপীয় নাবিক কয়েক জোড়া কোভাজ কুকুর আমদানি করে। হাঙ্গারির কোভাজ বছরের পর বছর এই দ্বীপে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে।

কিন্তু দ্বীপের মাঝখানে মানুষের হাতের তৈরি খাবার কোথা থেকে জুটবে? অতএব ক্ষুধার্ত কুকুরদের চোখ পড়ল পাহাড়ি ছাগল, বুনো মোষ ও গোরুর দিকে হিভাওয়া দ্বীপের উপর শুরু হল এক বিভীষিকার রাজত্ব।

এইভাবে সভ্য জগতের বাইরে হিভাওয়া দ্বীপের ওহিও উপত্যকায় জন্মগ্রহণ করল একদল হিংস্র রক্তলোলুপ শ্বাপদ বিপুল বপু কোভাজ বিপুলতর হয়ে উঠল বন্য প্রকৃতির সংস্পর্শে, ধূসর রঙের ছোঁয়া লাগল তার দুধসাদা চামড়ায়, স্বভাবে তারা হয়ে উঠল আরও হিংস্র, আরও ভয়ংকর।

ইউরোপীয় নাবিকদের সঙ্গে আরও দুটি জানোয়ার এই দ্বীপে পদার্পণ করেছিল–ইঁদুর এবং বিড়াল। সাদা মানুষগুলি এখন আর নেই বটে কিন্তু কুকুর বিড়াল আর ইঁদুর- এরা সবাই আছে।

কুকুরগুলি এখন বিরাটকায় নেকড়ে বাঘের আকার ধারণ করেছে, ইঁদুরগুলি প্রায় ভোঁদড়ের মতো এবং বিড়ালগুলি আমাদের পোষা বিড়ালের চাইতে অনেক বড়ো হয়ে বন্য মার্জারে পরিণত হয়েছে।

ওহিও উপত্যকার বনবিড়াল এখন বুনো ইঁদুর শিকার করে, কুকুরগুলি ইঁদুর বা বিড়াল কাউকেই রেহাই দেয় না।

আর ইঁদুরগুলি কী খায়?

ইঁদুররা সর্বভুক– ফলমূল, পাখি, গিরগিটি, রুণ কুকুর বা বিড়াল তো বটেই, এমনকি সুযোগ পেলে জাতভাই-এর রক্তমাংসে উদরপূরণ করতেও তারা আপত্তি করে না।

যে ইউরোপীয় ভবঘুরের দল এখানে প্রথম এসেছিল তাদের কী হল?

ক্ষুধার জ্বালায় সুসভ্য নরখাদকে পরিণত হল- এখনও এখানকার দেশীয় অধিবাসীদের মধ্যে কিছু কিছু লোক রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়, অনেক খোঁজাখুজি করেও তাদের পাত্তা মেলে না। এখানকার দেশি মানুষদের চেহারা ও আচার ব্যবহারে ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোনো চিহ্নই পাওয়া যায় না। মিশনারিদের কল্যাণে তারা সভ্যজগতের নিয়মকানুন কিছুটা শিখেছে বটে কিন্তু মন থেকে মেনে নেয়নি।

কাফাতো ঠিক এদের মতো নয়। তার বাপ ছিল মালয়ের অধিবাসী– সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানোই ছিল তার পেশা। ভবঘুরে নাবিকের রক্ত শরীরে থাকলেও কাফাতো তার দেশ ছেড়ে এদিক ওদিক যেতে চাইত না, বরং বর্শা আর ছুরি হাতে শিকার করতেই সে বেশি ভালোবাসত।

শিকারের হাত তার চমৎকার। কাফাতোর বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ হয়েছিল কিন্তু তার বেতের মতো পাকানো ছোটো শরীরটা বয়সের ভারে একটুও কাবু হয়নি। রক্তারক্তি আর হানাহানিতে তার বড়ো আনন্দ; তাকে ঠিক শিকারি না বলে খুনে বললেই সঠিক আখ্যা দেওয়া হয়।

হিভাওয়া দ্বীপে যেদিন এসে নামলাম সেদিনই কাফাতোর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। আমার উদ্দেশ্য জানতে পেরে সে বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে হেসে ফেলল, তুমি বুঝি কুকুরের মাংস খুব পছন্দ করো?

মাংস নয়, শুধু চামড়ার জন্য মানুষ এমন বিপদের ঝুঁকি নিতে পারে এ কথা কাফাতোর কাছে অবিশ্বাস্য। তবু যখন অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে পারলাম যে কুকুরের মাংস খাওয়ার লোভ আমার নেই তখন সে গম্ভীরভাবে বললে, ঠিক আছে, চামড়া তোমার মাংস আমার তবে সাদা কুকুরের মাংসের রোস্ট যদি খাও তাহলে জীবনে ভুলতে পারবে না…।

শিকারের অনুমতি নিতে আমায় অনেক ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়েছিল। হিভাওয়া দ্বীপটা ফরাসিরা শাসন করে, আর ফরাসিদের মতো সন্দেহপ্রবণ জাত দুনিয়ায় নেই। অনেক হাঙ্গামা-জুত করার পরে কর্তৃপক্ষ আমাকে দয়া করে দু-সপ্তাহ সময় দিলেন তার মধ্যে আমার কাজ শেষ করে বিদায় নিতে হবে।

এত অল্প সময়ের মধ্যে এক অজানা দ্বীপের অপরিচিত পরিবেশের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারব কিনা এই কথা ভেবে দস্তুরমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলুম, এমন সময় হঠাৎ কাফাতোর সঙ্গে আলাপ হওয়ায় স্বস্তি বোধ করলুম।

পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কাফাতো খুব উদার। কুকুরের মাংসের মতো লোভনীয় খাদ্যে আমি কোনো ভাগ বসাব না এতেই সে খুশি চামড়ার মতো অখাদ্য জিনিস নিয়ে তার কী লাভ?

চামড়া তোমার– মাংস আমার, এই তার শর্ত।

শর্তটা আমাদের দুজনেরই খুব ভালো লাগল।

.

সন্ধ্যার ধূসর যবনিকাকে লুপ্ত করে নেমে এল রাত্রির অন্ধকার। ক্যাম্পের সামনে আগুন জ্বালিয়ে আমি চোখ বুজে শুয়ে পড়লুম। ঠিক হল প্রথম রাত আমি নিদ্রাসুখ উপভোগ করব আর কাফাতো পাহারা দেবে, বাকি রাতটা কাফাতোকে ঘুমোবার সুযোগ দিয়ে আমি জেগে থাকব।

ক্লান্ত শরীরে ভরপেট খাওয়ার পরে চোখ বুজতেই ঘুম এসে গেল।

একটা বীভৎস চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে যে দৃশ্য চোখে পড়ল তা আগেই বলেছি।

হ্যাঁ, ওরা আসছে আসবেই। এখনই তীক্ষ্ণ দাঁতের আঘাতে টুকরো হয়ে যাবে আমাদের শরীর দুটো। নিশ্চিত মৃত্যু করাল ফঁদ মেলে ছুটে আসছে, ঘিরে ধরছে আমাদের এই ভয়ংকর মরণ-ফঁদ থেকে আমাদের নিস্তার নেই…

কিন্তু আমি এখনও আশা ছাড়িনি।

একটা উপায় আছে শেষ উপায়।

হাতের রিভলভার উঁচিয়ে ধরে উপরি উপরি ছয়বার গুলি ছুড়লাম- চার-চারটে কুকুর মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল।

বাকি জন্তুগুলো আবার দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়ল।

ফাঁকা রিভলভারটা ফেলে দিয়ে কেরোসিনের বোতল আর টিনটা তুলে নিলুম, চিৎকার করে বললাম, কাফাতো, খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে যাও- আমি পিছনে আসছি।

শুনেছিলাম এই কুকুরগুলির দৃষ্টিশক্তি অতিশয় দুর্বল, এরা নির্ভর করে ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তির উপর। জ্বলন্ত আগুনের প্রখর আভা এবং রাইফেল ও রিভলভারের অগ্নিবৃষ্টি এদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। কাজেই অন্ধকারের আড়াল দিয়ে আমরা যে পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করেছি এটা তারা বুঝতেই পারেনি। কিন্তু তাদের চোখকে ফাঁকি দিলেও কানকে ফাঁকি দিতে পারলুম না।

খানিক পরেই পাহাড়ের গায়ে আমাদের জুতোর অস্পষ্ট আওয়াজ তাদের কানে এল, পরক্ষণেই হিংস্র গর্জন করে ছুটে এল শ্বেত বিভীষিকার দল পাহাড়ের নীচে

এমন লোভনীয় শিকার হাতছাড়া করতে তারা রাজি নয়!

আমরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলুম। কুকুরগুলি যখন পাহাড়ের নীচে, আমি আর কাফাতো তখন অন্তত পঞ্চাশ ফিট উপরে উঠে গেছি।

উঁচু-নীচু পাথরের মধ্য দিয়ে সরু একটা পথ উঠে গেছে উপর দিকে পাহাড়ে উঠতে হলে ওই একটি রাস্তা ছাড়া অন্য পথ নেই। শয়তানের দল সেই পথ বেয়ে তিরবেগে উঠে আসতে লাগল। নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে কয়েকটা কুকুর ছিটকে পড়ল নীচে।

আমি কাফাতোকে ইঙ্গিত করলুম। সে সামনের কুকুরটাকে বর্শা দিয়ে চেপে ধরল পাহাড়ের গায়ে। কুকুরটার রোমশ দেহের উপর এক বোতল কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আমি একটা দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে ফেলে দিলুম। বিকট চিৎকার করে জন্তুটা পাহাড়ের উপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে গিয়ে পড়ল।

এইভাবে পর পর ছয়টা কুকুর উঠে এল আমাদের সামনে এবং তারা প্রত্যেকেই অগ্নিদেবের জ্বলন্ত আশীর্বাদ শরীরে বহন করে গড়িয়ে পড়ল পাহাড়ের নীচে।

অবশিষ্ট কেরোসিন পাহাড়ের সরু পথের উপর ঢেলে একটি জ্বলন্ত দেশলাই-এর কাঠি ফেলে দিলুম। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। সেই তরল অগ্নিস্রোতের উপর দিয়ে উঠে আসার ক্ষমতা কোনো প্রাণীর নেই।

আমরা একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসে নীচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলুম।

পাহাড়ের আগুন তখন নিভে এসেছে, কিন্তু দুরে অনেক নীচে কতকগুলি আগুনের গোলা ছুটছে, লাফাচ্ছে, গড়াচ্ছে। যে কুকুরগুলির শরীরে আগুন লেগেছে তারা অসহ্য যন্ত্রণায় দাপাদাপি করছে।

ধীরে ধীরে আগুন নিভে গেল, বাতাসে ভেসে এল দগ্ধ বোম ও মাংসের কটু গন্ধ!

অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখা গেল কয়েকটা সাদা সাদা ভুতুড়ে ছায়া মৃত কুকুরগুলির দেহ নিয়ে টানাটানি করছে ওহিওর সাদা শয়তান জাতভাই-এর মাংস খেতেও আপত্তি করে না।

.

রাত্রি প্রভাত হল।

পাহাড়ের উপর থেকে এতক্ষণ নামতে সাহস হয়নি। দিনের আলোয় যখন ভালো করে দেখলুম আশেপাশে একটিও জ্যান্ত কুকুর নেই তখন সাবধানে নীচে নেমে এলুম। প্রতি মুহূর্তে ভয় হয়েছে এই বুঝি শয়তানের দল তাড়া করে আসে। কিন্তু ভয়ের কোনো কারণ ছিল না। দিনের আলোয় কুকুরগুলি বিশ্রাম নিতে গেছে, এক রাতের অভিজ্ঞতার ধাক্কা সামলাতে তাদেরও বেশ খানিকটা সময় যাবে।

নীচে নেমে দেখলুম এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে অনেকগুলি কুকুরের মৃতদেহ। কতকগুলি কুকুরের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে বুঝলাম তাদের দেহের মাংসে তাদের স্বজাতিরাই উদর পূরণ করেছে। আবার কতকগুলির শরীর আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে।

তবে কয়েকটা চামড়া একেবারেই অটুট পেয়ে গেলুম। শুধু বুলেট এবং বর্শার ক্ষতচিহ্ন ছাড়া ওই চামড়াগুলিতে আর কোনো দাগ পড়েনি।

আমি আর কাফাতো কয়েকটা চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে একটা গ্রামে এসে পৌঁছলুম। আমার সমস্ত শরীর তখন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে কিন্তু কাফাতোর বেতের মতো পাকানো দেহে অবসাদের কোনো চিহ্ন নেই- একদল লোক নিয়ে সে হই হই করে চলল সেই পাহাড়ের নীচে যেখানে পড়ে আছে কুকুরগুলির মৃতদেহ।

কুকুরের মাংসে সেদিন রাতে এক চমৎকার ভোজ হল ঝলসানো মাংস আমিও একটু চেখে দেখলুম। বললে বিশ্বাস করবে না, কুকুরের মাংসের রোস্ট ঠিক কুকুরের মাংসের মতোই, একটুও অন্যরকম নয়!

 গ্ল্যাডিয়েটরের মৃত্যু নেই

গ্ল্যাডিয়েটরের যুগ শেষ হয়ে গেছে।

হ্যাঁ শেষ হয়ে গেছে, লুপ্ত হয়ে গেছে আজ দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চ থেকে সেই বৃষস্কন্ধ শক্তিমান মানুষগুলো অস্ত্রের শাণিত ফলকে, রুধিরের রক্তিম অক্ষরে ইতিহাস যাদের নাম রেখেছে গ্ল্যাডিয়েটর।

একখানা বর্শা বা তরবারি মাত্র সম্বল করে যারা হিংস্র শ্বাপদের সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে একটুও ইতস্তত করত না, যাদের গর্বিত পদক্ষেপে কেঁপে-কেঁপে উঠত রোম এবং গ্রিসের ক্রীড়ামঞ্চ, হাজার হাজার দর্শকের উদগ্রীব দৃষ্টির সম্মুখে যারা বারংবার আলিঙ্গন করত নিশ্চিত মৃত্যুকে গ্ল্যাডিয়েটর নামধারী সেই ভয়ঙ্কর মানুষগুলো আজ দুনিয়ার বুক থেকে মুছে গেছে, শেষ হয়ে গেছে গ্ল্যাডিয়েটরের যুগ…

কিন্তু সত্যিই কি তাই?

অতীতের কবর খুঁড়ে বিদেহী গ্ল্যাডিয়েটরের প্রেতাত্মা কি আজও হানা দেয় না বিংশ শতাব্দীর বুকে?

হ্যাঁ, হানা দেয়। ফিরে আসে গ্ল্যাডিয়েটর ভিন্ন দেহে, ভিন্ন নামে তারা আত্মপ্রকাশ করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে।

মোরদি হচ্ছে এমনই একটি লোক যাকে আমরা অনায়াসে আখ্যা দিতে পারি আধুনিক গ্ল্যাডিয়েটর।

ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে আমরা জানতে পারি যে প্রাচীন রোমের ক্রীড়ামঞ্চে মাঝে মাঝে শ্বেতাঙ্গ গ্ল্যাডিয়েটরদের সঙ্গে কালো চামড়ার যযাদ্ধারাও মৃত্যু-উৎসবে মেতে উঠত।

আমাদের বর্তমান কাহিনির নায়কও শ্বেতাঙ্গ নয়, নেহাত কালা বাদামি– বিংশ শতাব্দীর কৃষ্ণকায় গ্ল্যাডিয়েটর।

কাহিনি শুরু করার আগে আফ্রিকা সম্বন্ধে কয়েকটা কথা বলা দরকার।

এই মহাদেশের বিস্তীর্ণ তৃণভূমির বুকে বাস করে অ্যান্টিলোপ, জেব্রা, জিরাফ, হস্তী, গণ্ডার, মহিষ প্রভৃতি তৃণভোজী পশু এবং এই তৃণভোজীদের মাংসের লোভে ঘন অরণ্যের ছায়ায় ছায়ায় হানা দিয়ে ফেরে সিংহ, লেপার্ড, হায়না প্রভৃতি হিংস্র জানোয়ার।

বনচারী পশুদের শিং, দাঁত, নখ ও চামড়ার উপর শ্বেতাঙ্গদের লোভ বড়ো বেশি। ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন ভূখণ্ড থেকে আফ্রিকায় এসে শ্বেতাঙ্গরা শিকারের নামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চার্লিয়ে যায়। হত্যালীলার জন্য অবশ্য কেবলমাত্র সাদা চামড়ার মানুষদের দায়ী করা উচিত নয় আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষগুলোও এজন্য যথেষ্ট দায়ী। এখানকার কৃষ্ণকায় নিগ্রো অধিবাসীরা অতিশয় মাংস প্রিয়। তাদের তীর ধনুক ও বর্শার মুখে নিরীহ অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি পশু প্রায়ই মারা পড়ে। শক্তিশালী তৃণভোজীরা কখনো কখনো মাংস-লোলুপ নিগ্রোদের দ্বারা আক্রান্ত হয় বটে কিন্তু মহাকায় হস্তী, খঙ্গধারী গণ্ডার ও ভয়ঙ্কর মহিষাসুরকে আদিম অস্ত্রের সাহায্যে মাঝে মাঝে ঘায়েল করা সম্ভব হলেও একেবারে নির্মূল করা অসম্ভব।

তবে, শ্বেতাঙ্গদের রাইফেল এইসব শক্তিশালী জানোয়ারদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। সিংহ, লেপার্ড প্রভৃতি হিংস্র শ্বাপদের নিরাপত্তাও আজ বিপন্ন। আধুনিক রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টির মুখে দন্ত ও নখরের প্রচণ্ড বিক্রম অধিকাংশ সময়েই ব্যর্থ হয়ে যায়।

সভ্য মানুষ এক সময়ে বুঝতে পারল যে এইভাবে শিকারের নামে হত্যাকাণ্ড চললে আফ্রিকার জানোয়ার নির্মূল হয়ে যাবে। তাই বন্য প্রাণীদের রক্ষা করার জন্য এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত হল Sanctuary বা নিরাপত্তা অঞ্চল।

এই অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করার জন্য স্থানীয় গভর্মেন্ট থেকে পেশাদার শিকারিদের মোটা মাইনে দিয়ে বনরক্ষকের পদে নিয়োগ করা হয়।

নিম্নলিখিত কাহিনিটি একজন ফরাসি বনরক্ষকের লিখিত বিবরণী থেকে তুলে দেওয়া হল।

লোকটির প্রকৃত নাম আমি উল্লেখ করতে চাই না, কারণ তাতে হয়ত তার শাস্তি হতে পারে। হ্যাঁ, একথা সত্যি যে লোকটি গুরুতরভাবে আইন ভঙ্গ করেছিল। কিন্তু আমি তাকে অপরাধী ভাবতে পারছি না।

আমাদের কাহিনির নায়কের সত্যিকারের নামটা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যা-হোক একটা নাম তো দরকার– আচ্ছা আমরা বরং তাকে মোরদি নামেই ডাকব।

কঙ্গোর উত্তর দিকে যে ভয়ঙ্কর যোদ্ধা-জাতি বাস করে, যারা কেবলমাত্র বর্শা হাতে নিয়ে উন্মত্ত হস্তীকে আক্রমণ করতে ভয় পায় না মোরদি ছিল সেই জাতিরই লোক। কোনো অজানা কারণে স্বজাতির সাহচর্য ছেড়ে এই লেক এডওয়ার্ড অঞ্চলে সে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল…

আমি একটু অসুবিধায় পড়েছিলাম।

স্থানীয় অধিবাসীরা লেক এডওয়ার্ড অঞ্চলের তৃণভূমি এবং অরণ্যের মধ্যে চিরকাল শিকার করে এসেছে। এখন এই জায়গাটা হঠাৎ নিরাপত্তা অঞ্চলে পরিণত হওয়ায় এখানে পশুবধ নিষিদ্ধ। কিন্তু চিরকাল যা হয়েছে এখন আর তা চলবে না। এই সহজ কথাটা অধিবাসীরা সহজে বুঝতে চায় না। আমি এখানকার সহকারী বনরক্ষক, কাজেই আমার এলাকায় কোনও পশু নিহত হলে আইনত আমিই দায়ী; অথচ এখানকার নিগ্রো বাসিন্দাদের বাধা দেওয়াও খুব কঠিন।

সত্যি সত্যিই বনের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে হত্যাকাণ্ড চলছিল। এই অঞ্চলের কয়েকজন অসৎ ব্যবসায়ী এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলেই আমার বিশ্বাস। হাতির দাঁতের দাম বাজারে খুব বেশি, তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে হস্তী শিকার করে গজদন্তের ব্যবসা চালায়। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরনের ব্যবসা চালু আছে। একদল অসাধু ব্যবসায়ী এই অঞ্চলের নিগ্রোদের মোটা টাকা দিয়ে এমনভাবে বশ করেছিল যে তারা এখানে সেখানে বর্শার সাহায্যে হাতি মারতে শুরু করলে। এই পাজি ব্যবসায়ীরা নিজেরাও অনেক সময় রাইফেল ব্যবহার করত। শুধু হাতি নয়- খঙ্গধারী গণ্ডারের উপরেও এই শয়তানদের দৃষ্টি পড়েছে।

গণ্ডারের খড়্গ ভারতীয় ব্যবসায়ী মহলে খুব চড়া দামে বিক্রি হয়, তাই গজদন্ত ও খঙ্গের লোভে এই লোকগুলো নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে।

আমি প্রায়ই খবর পাই, ছুটে যাই এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি অপরাধীরা চম্পট দিয়েছে, কেবল অকুস্থলে দন্তবিহীন গজরাজের মৃতদেহ অথবা খঙ্গহীন খঙ্গীর প্রাণহীন শরীর রক্তাক্ত মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে মানুষের লোভের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

এই শয়তানগুলোকে ধরার জন্য আমি দারুণ ছুটোছুটি করছি, স্নানাহার প্রায় বন্ধ এমন সময়ে আরম্ভ হল এক নতুন উৎপাত।

হঠাৎ একদিন শুনলাম নিরাপত্তা-অঞ্চলের এক জায়গায় দেখা গেছে নিহত সিংহের দেহ। অর্থাৎ আর একদল শিকারি এবার লুকিয়ে সিংহ-শিকার শুরু করেছে।

একে মনসা তায় ধুনোর গন্ধ। জিপ গাড়ি নিয়ে ছুটলাম ঠিক করলাম যদি ধরতে পারি লোকগুলোকে এমন ঠ্যাঙানি দেব যে–

কিন্তু ধরব কাকে?

ঘটনাস্থলে গিয়ে কোনও সূত্ৰই খুঁজে পেলাম না। কেবল দেখলাম একটা কেশরধারী সিংহের মৃতদেহ মাটিতে পড়ে আছে। আরও একটা আশ্চর্য ব্যাপার সিংহের চমৎকার চামড়াটা সম্পূর্ণ অক্ষত, শুধু তার দেহটাকে লম্বালম্বিভাবে চিরে দু-ফাঁক করে ফেলা হয়েছে এবং গোঁফগুলিও হত্যাকারী কেটে নিয়েছে। ব্যবসায়ী মহল থেকে কেউ যদি সিংহ শিকার করে তাহলে চামড়াটাকে সে নিশ্চয় ছাড়িয়ে নেবে- আমার ধারণা হল কোনও স্থানীয় জাদুকর ওঝা (witch doctor) এই সিংহটাকে মেরেছে।

সিংহের গোঁফ, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ প্রভৃতি দিয়ে এই সব ওঝারা নানারকম ক্রিয়াকাণ্ড করে। আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম, ভাবলাম এটা একটা বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড- এই নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

কিন্তু এক সপ্তাহ পরে যে খবর এল তা শুনেই আমার চোখ কপালে উঠল– জঙ্গলের মধ্যে নাকি আর একটা সিংহের মৃতদেহ দেখা গেছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, সেই একই ব্যাপার।

রক্তাক্ত মাটির উপর পড়ে আছে আর একটা সিংহের প্রাণহীন দেহ দেহটাকে ঠিক আগের মতোই লম্বা করে চিরে ফেলা হয়েছে।…

সেদিন রাতে ঘটল আর এক কাণ্ড।

আমার কয়েকজন আস্কারি (সশস্ত্র রক্ষী) গ্রাম থেকে ফিরে এসে জানাল যে একটা পাগল তাদের সবাইকে বেধড়ক ঠ্যাঙানি দিয়ে তাদের সঙিনগুলো কেড়ে নিয়ে একেবারে গ্রামের বাইরে তাড়িয়ে দিয়েছে।

কৌতূহল হল। চার-চারজন সশস্ত্র রক্ষীকে যে পাগল ধরে মার দিতে পারে সে কেমন পাগল একবার দেখা দরকার!

আমার সার্জেন্টকে ডেকে প্রশ্ন করলাম, ব্যাপারটা কী?

সার্জেন্ট বললে, বাওয়ানা, এ লোকটা সাক্ষাৎ শয়তান! নইলে ভেবে দেখুন, আস্কারিদের গায়ে হাত তুলতে কেউ সাহস পায়!

আরও প্রশ্ন-উত্তরের ফলে সমস্ত ব্যাপারটা জানা গেল। আস্কারিরা গাঁয়ে ঢুকে লোকের জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। আস্কারি হল রাজার লোক, যে কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার তাদের আছে এই হল আফ্রিকার অলিখিত আইন। স্থানীয় অধিবাসীরা আস্কারিদের বাধা দিতে ভয় পায়।

কিন্তু এই লোকটি ভয় পায়নি। সে প্রথমে আস্কারিদের ভালো কথায় বোঝাবার চেষ্টা করে। কিন্তু আস্কারিরা চিরকাল একরকম বুঝে এসেছে, আজ তারা অন্যরকম বুঝতে রাজি হবে কেন?

তখন সবচেয়ে বড়ো এবং আদিম যুক্তির প্রয়োগ শুরু হল বলং বলং বাহু বলং!

বাহুবলের প্রতিযোগিতার পরিণাম আগেই বলেছি।

দারুণ মার খেয়ে আস্কারিরা শেষে আমার কাছে নালিশ করলে। অবশ্য নিজেদের দোষ তারা স্বীকার করলে না, কিন্তু আমার জেরায় সব কিছুই প্রকাশ হয়ে পড়ল।

আমি লোকটিকে খুব দোষ দিতে পারলাম না।

বরং মনে মনে তাকে বাহবা দিলাম– চার-চারটে জোয়ান আস্কারিকে পিটিয়ে যে লোক তাদের হাত থেকে সঙিন কেড়ে নিতে পারে সে আলবৎ মরদ-কি বাচ্চা।

লোকটিকে একবার দেখা দরকার।

আমি গাঁয়ের দিকে যাত্রা করলাম।

গ্রামের মোড়লের সঙ্গে দেখা করে আমি জানতে চাইলাম কোন লোকটি আস্কারিদের গায়ে হাত দিয়েছে।

মোরদি? মোড়ল একগাল হাসলেন, সে এখন ঝোপের মধ্যে শিকারের খোঁজ করছে। হ্যাঁ, লোকটা একটা মানুষের মত মানুষ বটে! তার গায়ে জোর আছে, মাথায় বুদ্ধি আছে আর কলজেতে সাহসের অভাব নেই- মোরদি কাউকে ভয় করে না।

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, এখন থেকে তাহলে তাকে ভয় করতে শিখতে হবে। আবার যদি সে আস্কারিদের গায়ে হাত তোলে তাহলে আমি তাকে ছাড়ব না, ঘাড় ধরে সোজা হাজতে ঢুকিয়ে দেব। কথাটা তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিও। সে ফিরলেই তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে- এইসব অসভ্যতা আমি মোটেই সহ্য করব না।

মোড়ল আমার আদেশ পালন করেছিল।

মোরদি খবর পেয়ে সোজা এল আমার কাছে। ভালো করে লোকটির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলাম।

অল্পবয়সী জোয়ান। উনিশ কুড়ি বছর বয়স হবে। বিরাট বলিষ্ঠ দেহ, সম্পূর্ণ অনাবৃত, শুধু কটিদেশের আচ্ছাদন হয়ে ঝুলছে একটা রঙিন কাপড়, দুই বাহুর জড়ানো একজোড়া লৌহ অলঙ্কার নীরবে ঘোষণা করছে অলংকারের মালিক একজন যোদ্ধা, এবং তার পেশল বক্ষদেশে আঁকা রয়েছে নানা ধরনের চিত্র-বিচিত্র নকশা।

হ্যাঁ– একটা দেখবার মতো চেহারা বটে!

মোরদির হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না।

সে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বললে, আস্কারি? কতকগুলো কুকুর? পশুরাজ সিংহের সামনে দাঁড়িয়ে কুকুর যদি ঘেউ ঘেউ করে তাহলে সিংহ তাকে ক্ষমা করে না।

আমি আশ্চর্য হলাম, তার মানে?

তার মানে, সে তেমনি দৃপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলে, আমি কাউকে ভয় করি না। মানুষ কিংবা সিংহ কাউকেই আমি ভয় করি না।

তাই নাকি? আমি নীরস স্বরে বললাম, আর একবার যদি শুনি যে তুমি গভর্মেন্টের পোশাকধারী আস্কারিদের গায়ে হাত দিয়েছ, তাহলে আমিও তোমাকে একটি নতুন ধরনের জিনিস শিখিয়ে দেব।

-বটে! বটে! কী জিনিস শেখাবে?

আমি তোমায় শেখাব কেমন করে জেলখানাকে ভয় করতে হয়। বুঝেছ?

লোকটি স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চাইল, তারপর ডান হাত তুলে অভিবাদন জানিয়ে বললে, ক্য হরি, বাওয়ানা। অর্থাৎ ঠিক আছে বাওয়ানা।

তারপর গর্বিত পদক্ষেপে সে স্থান ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমার হঠাৎ মনে হল যে দু-দুটো সিংহের হত্যালীলার সঙ্গে মোরদির একটা যোগসূত্র আছে। অবশ্য তাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই একথা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার ছিল চুপি চুপি একটি লোককে আমি মোরদিকে অনুসরণ করতে আদেশ দিলাম।

দিন তিনেক পরে আমার গুপ্তচর ফিরে এল।

তার মুখে যে সংবাদ শুনলাম তা যেমন আশ্চর্য তেমনই ভয়ঙ্কর। গুপ্তচর বললে, গ্রামের লোক মোরদিকে সিম্বা (সিংহ) বলে ডাকে। মোরদি নাকি সিংহের মাংস ভক্ষণ করে।

আমার গুপ্তচর দুদিন ধরে তার সম্বন্ধে নানারকম সংবাদ সংগ্রহ করেছে। কেবলমাত্র গত রাত্রিতে সে দূর থেকে মোরদিকে অনুসরণ করে।

চাঁদের আলোতে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিস্তীর্ণ তৃণভূমির অপরদিকে যেখানে অনেকগুলি মিমোসা গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, হালকা ঘাসজমির উপর দিয়ে মোরদি সেইদিকে এগিয়ে গেল। একটা মিমোসা গাছে উঠে সে আত্মগোপন করলে।

আমার গুপ্তচর তখন দুর থেকে মোরদির কার্যকলাপ লক্ষ করছে। গাছের ডালপালার ভিতর লতাপাতার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে হঠাৎ মোরদি জেব্রার কণ্ঠ অনুকরণ করে চেঁচিয়ে উঠল।

কয়েকটি মুহূর্ত। এবার তার কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল ন্যুর কণ্ঠস্বর।

(ন্য এক ধরনের তৃণভোজী পশু। ন্যুর মাংস সিংহের প্রিয় খাদ্য)

গুপ্তচর সবিস্ময়ে শুনতে লাগল, মোরদি একবার জেব্রার মতো চিৎকার করে উঠছে আবার তারপরেই নুর কণ্ঠ অনুসরণ করে হাঁক দিয়ে উঠছে।

কিছুক্ষণ পরেই দুর জঙ্গল ভেঙে রঙ্গমঞ্চে আত্মপ্রকাশ করলেন পশুরাজ সিংহ। বনের রাজা একা আসেননি, তাঁর সঙ্গে রানিও এসেছেন। পশুরাজ বিন্দুমাত্র ইতস্তত করলে না। যে গাছ থেকে মোরদি চিৎকার করেছিল সিংহ সোজা সেই গাছটার দিকে ছুটে এল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বর্শা বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে তার দেহটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলে।

মরণাহত সিংহ ভীষণ কণ্ঠে গর্জন করে উঠল। সিংহী পিছন ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় মারলে এবং কয়েক মুহূর্ত পরেই তার মস্ত শরীরটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

সিংহ পলায়ন করলে না। যে গাছটায় মোরদি লুকিয়ে ছিল আহত সিংহ বারবার সেই গাছ বেয়ে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। প্রায় একঘণ্টা ধরে চলল বৃক্ষারোহণের ব্যর্থ প্রয়াস, তারপর রক্তপাতে অবসন্ন পশুরাজ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, আর উঠল না।

তখন মোরদি গাছ থেকে নেমে এসে মৃত সিংহের বুকে ছোরা বসিয়ে দেহটাকে চিরে ফেললে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল- ওই ভয়ঙ্কর মানুষ সেই তপ্ত রক্তধারা আকণ্ঠ পান করলে এবং বিদীর্ণ বক্ষপঞ্জর থেকে হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে এনে কচমচ করে চিবিয়ে খেতে লাগল।

সেই পৈশাচিক ভোজ শেষ হলে মোরদি উঠে দাঁড়াল চন্দ্রালোকিত তৃণভূমির উপর শুন্যে বশী আস্ফালন করে উন্মাদের তাণ্ডব-নৃত্যে মত্ত হয়ে উঠল, তীব্র তীক্ষ্ণ স্বরে সে বারংবার ঘোষণা করলে নিজের বীরত্ব কাহিনি। তারপর ঘটনাস্থল ত্যাগ করে গ্রামের দিকে চলে গেল।

সমস্ত ঘটনা শুনে আমি চুপ করে রইলুম।

গুপ্তচর বললে : বাওয়ানা, এই লোকটা নিজের মখে চেঁচিয়ে বলেছে সে আজ পর্যন্ত ছ-টা সিংহের হৃৎপিণ্ড খেয়েছে!

গুপ্তচর তার সংবাদ পরিবেশন করে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম এই ভয়ঙ্কর নাটকের শেষ দৃশ্যটা কি হতে পারে…

কয়েকদিন পরেই অভাবিতভাবে মোরদির সঙ্গে আবার আমার দেখা হল।

একদিন সকালে অকস্মাৎ আমার গৃহে হল মোড়লের আবির্ভাব। ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে মোড়ল আমায় যা বললে তার সারমর্ম হচ্ছে, আগের দিন সন্ধ্যায় এক প্রতিবেশীর ছাগল হঠাৎ মোরদির বাগানের মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করেছিল। ছাগল যদি অনধিকার প্রবেশ করেই খুশি থাকত তাহলে হয়ত কিছু ঘটত না, কিন্তু ছাগলটা নিতান্তই ছাগল- সে মোরদির বাগানের কয়েকটা গাছ মুড়িয়ে খেয়ে ফেললে।

মোরদি ছাগলটাকে বেঁধে রাখল তার উঠানে।

প্রতিবেশী ছাগল ফেরত চাইতে এল।

মোরদি তাকে ছাগল দিলে না দিলে প্রহার।

প্রতিবেশীটি স্থানীয় লোক নয়, সে একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী নাম রণজিৎ সিং। এই লোকটিও খুব নিরীহ প্রকৃতির মানুষ নয়, বিনা প্রতিবাদে মার খেতে সে রাজি হয়নি– ফলে প্রচণ্ড মারামারি।

মোড়ল এই ব্যাপারে হাত দিতে চাইলে না, সে আমার কাছে বিচার প্রার্থনা করলে।

আমি দুজনকেই ডেকে পাঠালুম।

রণজিৎ সিং খুব মার খেয়েছে, তার মুখে এখনও প্রহারের ক্ষতচিহ্ন বর্তমান। মোরদির মুখে কোনো দাগ নেই, শুধু ডান চোখটা একটু ফুলে উঠেছে।

মোরদি এসেই দম্ভের সঙ্গে জানিয়ে দিলে যে সে হচ্ছে সাক্ষাৎ সিম্বা। তার বিরুদ্ধে লাগলে সে কাউকে রেহাই দেবে না, পশুরাজ সিংহের রক্তপান করে সে সিংহের চেয়েও বলশালী।

রণজিৎ সিং হঠাৎ বলে উঠল, হা হা গাছের উপর থেকে অস্ত্র ছুঁড়ে যে সিংহ বধ করে সে তো মস্ত বীরপুরুষ! তারপর সেই সিংহের রক্তপান করার মতো কঠিন কাজ বীরের পক্ষেই সম্ভব! কিন্তু বাওয়ানা, বীরপুরুষকে আদেশ করুন আমার ছাগলটা যেন সে ফেরত দেয়।

মোরদির মুখ চোখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। আমি ভাবলুম, এই বুঝি সে রণজিতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মোরদি সে রকম কিছু করলে না।

ভ্রূকুটি-কুটিল দৃষ্টিতে সে প্রতিপক্ষকে একবার নিরীক্ষণ করল। তারপর শুষ্ক কঠিন স্বরে বললে, ছাগল আমি এখনই দিয়ে দিচ্ছি। তবে জেনে রাখো, মোরদি মাটিতে দাঁড়িয়েও সিংহের মোকাবেলা করতে পারে… আচ্ছা, এখন আমি কিছু বলতে চাই না, তবে…

ভীষণ আক্রোশে মোরদির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল।

রণজিতের দিকে একটা জ্বলন্ত কটাক্ষ নিক্ষেপ করে সে দ্রুত পদক্ষেপে অন্তর্ধান করলে।

মোরদির উদ্দেশ্য বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হয়নি। রণজিতের বিদ্রূপ একেবারে প্রতিপক্ষের মর্মস্থলে আঘাত করেছে। আমি বুঝলাম আজ রাতে মোরদি পশুরাজ সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।

সিংহের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করে ফিরে এসেই মোরদি রণজিৎকে ধরে বেধড়ক ধোলাই দেবে এ-কথা বুঝতেও আমার বিশেষ অসুবিধা হয়নি।

কিন্তু সে তো পরের কথা এখন এই উন্মাদ মোরদিকে নিয়ে কী করি? সত্যি-সত্যি যদি সে বর্শা হাতে মাটির উপরে দাঁড়িয়ে সিংহের সম্মুখীন হয় তাহলে তার পরিণাম কি হবে সে বিষয়ে আমার একটুও সন্দেহ ছিল না। বর্শার খোঁচা খেয়ে পশুরাজ মোরদিকে ছেড়ে দেবে না– ক্ষিপ্ত শ্বাপদের আক্রমণে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে তার সর্বাঙ্গ।

আমি একজন গুপ্তচরকে ডেকে গোপনে মোরদির উপর নজর রাখতে আদেশ দিলাম।

রাত তখনও গম্ভীর হয়নি, আমার গুপ্তচর এসে জানালে, মোরদি বর্শা হাতে সিংহের উদ্দেশ্যে বনের দিকে যাত্রা করেছে।

আঃ! জ্বালালে!

এই নির্বোধটাকে বাঁচাবার জন্য বিছানা ছেড়ে এখনই আমায় ছুটতে হবে বনবাদাড়ে।

মোরদির উপর যতই রাগ হোক, জেনে শুনে একটা লোকের অপমৃত্যু ঘটতে দেওয়া যায় না।

দূরবীন এবং রাইফেল নিয়ে কয়েকজন আস্কারির সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম।

বিস্তীর্ণ তৃণভূমির বুকের উপর গলিত রজতধারার মতো জ্বলছে জ্যোৎস্নার আলো, আর সেই রুপালি আলোর চাদরের উপর ফুটে উঠেছে অনেকগুলি কালো কালো সচল বিন্দু।

সচল বিন্দুগুলি আর কিছু নয়– অনেকগুলি ধাবমান মানব দেহ। গাঁয়ের লোক আজ দল বেঁধে মোরদির সঙ্গে সিংহের লড়াই দেখতে এসেছে।

কিন্তু মোরদি কোথায়?

আমি একটা মস্ত ঢিপির উপর উঠে দূরবীনটা চোখে লাগালুম।

ওই যে মোরদি। একটা ঝোপের পাশ দিয়ে হাঁটছে আর হাতের বর্শা উঁচিয়ে ধরে চিৎকার করছে।

খুব সম্ভব তার জাতীয় ভাষায় পশুরাজকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে।

আমি তখন প্রায় সিকি মাইল দূরে।

তার নাম ধরে চিৎকার করার উপক্রম করছি, এমন সময়ে ভীষণ গর্জনে বন কাঁপয়ে ঝোপের ভিতর থেকে তীরবেগে বেরিয়ে এল এক প্রকাণ্ড সিংহ।

পশুরাজ এক মুহূর্তের জন্যও থামল না, ধনুক-ছাড়া তিরের মত দ্রুতবেগে সে মোদির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

কিন্তু দন্ত ও নখরের আলিঙ্গনে মোরদি ধরা দিলে না, ক্ষিপ্রপদে একপাশে সরে গিয়ে সে পশুরাজের আক্রমণ ব্যর্থ করলে।

পরক্ষণেই বর্শা বাগিয়ে ধরে সে সিংহের দিকে রুখে দাঁড়াল। অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে ঝকঝক করে জ্বলে উঠল বর্শার ধারালো ফলা।

আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলুম। কী করব? গুলি ছুড়লে মোরদির গায়ে লাগতে পারে।

আমার চোখের সামনে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হল এক হিংস্র মানব ও এক হিংস্র শ্বাপদ।

মোরদি বর্শাটাকে সঙিনবসানো রাইফেলের মতো বাগিয়ে ধরলে বল্লমের ধারালো ফলাটা নিচু হয়ে ঘুরতে লাগল।

সিংহ বৃত্তাকারে শত্রুকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে, আর বর্শার ফলাটাও তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে যায়।

পশুরাজের থাবাটা বার বার এগিয়ে আসে বর্শা লক্ষ্য করে কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ ইস্পাত-ফলক নখের আলিঙ্গনে ধরা দেয় না– সাঁৎ করে সরে যায় আবার সামনে থেকে এবং পরক্ষণেই দস্তভয়াল বিস্ফারিত মুখগহ্বরের সম্মুখে চমকে ওঠে জ্বলন্ত বিদ্যুৎ-শিখার মতো।

মোরদি ওস্তাদ খেলোয়াড়।

আমি দেখলাম মোরদির অধর-ওষ্ঠ কেঁপে উঠল, সে চিৎকার করছে।

চাপা গম্ভীর গর্জনে তার উত্তর এল।

সিংহ জানে ওই চকচকে ঝকঝকে জিনিসটা অতিশয় বিপদজনক। ওটাকে এড়িয়ে যদি সে মানুষটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তাহলে যুদ্ধে তার জয় অনিবার্য।

কিন্তু বর্শার ফলা যেন মোরদির হাতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঝকঝক করে জ্বলছে শাণিত ইস্পাতফলক–সূচীমুখ অস্ত্র নেচে নেচে উঠছে সিংহের মুখের সামনে নাকের সামনে একটা শাণিত বিদ্রুপের মতো।

আমি বুঝলাম সিংহের ধৈর্য এবার ফুরিয়ে এসেছে। সে এবার আক্রমণ করবে।

ক্ষিপ্ত শ্বাপদ বর্শার শাসন আর মানতে চাইছে না। ঝকড়া কেশর দুলিয়ে সিংহ মাথাটা তুলল, গম্ভীর গর্জনে প্রতিধ্বনি জাগল বন থেকে বনান্তরে।

পরক্ষণেই সিংহ ঝাঁপ দিল শত্রুর দেহ লক্ষ্য করে। মোদি সরে গেল, বর্শার ধারালো ফলা কামড় বসালো সিংহের শরীরে।

যাতনায় আর্তনাদ করে উঠল পশুরাজ, থাবা তুলে শত্রুকে আঘাত করার চেষ্টা করলে।

মোরদির বর্শা এবার সিংহের বক্ষ ভেদ করলে।

সিংহ আবার গর্জে উঠল।

অন্য কোনো জানোয়ার হয়ত ওই আঘাতে মৃত্যুবরণ করত, কিন্তু বিখ্যাত সিংহ-বিক্রম এত সহজে ঠান্ডা হয় না শাণিত ভল্লের তীব্র দংশন উপেক্ষা করে পশুরাজ অন্ধের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুই থাবার আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে শত্রুকে পেড়ে ফেলল মাটির উপর।

মোরদি উঠে দাঁড়াল।

দক্ষ মুষ্ঠিযোদ্ধার মত পাঁয়তাড়া করে সে পিছিয়ে এল। তীক্ষ্ণ বর্শাফলক এবার সঞ্চালিত হল তরবারির মতো হাতের বর্শা দিয়ে পাগলের মতো কোপ মেরে মেরে সে সিংহের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করলে।

আমি লক্ষ্য করলাম বর্শার ফলাটা আর চাঁদের আলোয় জ্বলে জ্বলে উঠছে না, জ্যোৎস্নার আলো-মাখা অন্ধকারে কালো দেখাচ্ছে ইস্পাতের শাণিত ফলক- রক্ত।

মোরদি একটু থামল, গুঁড়ি মেরে বসল; বর্শা বাগিয়ে ধরে সে সিংহের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না।

সগর্জনে ধেয়ে এল আহত সিংহ তার বিপুল বপুর অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল মোরদির ক্ষুদ্র নরদেহ।

রাইফেল তুলে আমি ছুটে গেলাম রণস্থলের দিকে। আমি যথাস্থানে উপস্থিত হওয়ার আগেই আবার মোরদি উঠে দাঁড়াল।

সিংহ তখন কাত হয়ে পা ছুড়ছে।

তীক্ষ্ণ বর্শা-ফলক তার ঘাড় ভেদ করে বসে গেছে আর সেই বর্শা-দণ্ডকে দুই হাতে চেপে প্রাণপণ শক্তিতে পশুরাজকে মাটিতে চেপে ধরেছে মোরদি।

আমি সিংহকে আর উঠতে দিলুম না। সামনে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় রাইফেলের নল ঠেকিয়ে গুলি করলুম। সিংহ তৎক্ষণাৎ মারা পড়ল।

এবার আমি মোরদির দিকে নজর দিলুম।

কি ভীষণ দৃশ্য!

সিংহের ধারালো নখ তার সমস্ত শরীরটাকে ফালা ফালা করে ছিঁড়েছে, কালো দেহের উপর ফুটে উঠেছে লাল রক্তের বীভৎস আলপনা।

রক্তরাঙা দুই চোখ মেলে মোরদি আমার দিকে তাকাল- হত্যাকারীর উন্মত্ত চাহনি।

এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল, এই বুঝি সে বর্শাটা আমার বুকে বসিয়ে দেয়।

ধীরে ধীরে তার চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এল। বক্ষ বাহুবন্ধ করে সে গর্বিত ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। উত্তেজিত গ্রামবাসীরা তখন আমাদের ঘিরে ফেলে চিৎকার করছে।

আমি রুক্ষস্বরে বললুম, যাও, এখনই হাসপাতালে চলে যাও। যদি সম্ভব হয় কাল আমার সঙ্গে দেখা কোরো।

না, সম্ভব হয়নি।

আমার সঙ্গে মোরদির আর কোনো দিন দেখা হয়নি।

মোরদি হাসপাতালে গিয়ে প্রাথমিক শুশ্রূষা গ্রহণ করেছিল বটে, কিন্তু সেই রাতেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে কোথায় সরে পড়েছে।

ভালোই করেছে; আমিও তার সঙ্গে দেখা করতে চাই না।

নিরাপত্তা অঞ্চলের মধ্যে সিংহ শিকার করে সে আইন ভঙ্গ করেছে, কাজেই আমার সঙ্গে দেখা হলে আইনত আমি তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য।

কিন্তু আইনই তো সব নয়! এমন সিংহদমন বীরপুরুষকে জেল খাটাবার ইচ্ছে আমার নেই।

এবার আমি যার কথা বলব সে আফ্রিকার বাসিন্দা বটে, কিন্তু আফ্রিকা তার স্বদেশ নয়।

নাম তার চার্লস কটার- আফ্রিকায় এসেছিল সে জীবিকার প্রয়োজনে।

আমেরিকার ওকলাহামা প্রদেশ ছিল কটারের জন্মভূমি।

আফ্রিকাতে আসার আগে সে ছিল ওখানকার শেরিফ।

ওকলাহামা বড়ো বেয়াড়া জায়গা।

কোনো আদর্শ ভদ্রলোক ওকলাহামাকে পছন্দ করবে না।

সেখানকার পথে ঘাটে ও দোকানে বাজারে যে মানুষগুলি ঘুরে বেড়ায় তারা খুব নিরীহ স্বভাবের নয়।

কথায় কথায় সেখানে ঝগড়া বাধে।

ঝগড়া বাধলে মীমাংসার প্রয়োজন।

ওকলাহামার মানুষ বেশি কথাবার্তা পছন্দ করে না, চটপট ঘুসি চার্লিয়ে তারা ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা করে নেয়।

অনেকে আবার মুষ্টিবদ্ধ হস্তের পক্ষপাতী নয়- রিভলভারের ঘন-ঘন অগ্নিবৃষ্টির মুখে তারা বিবাদের নিস্পত্তি করতে চায়।

এমন চমৎকার জায়গায় শেরিফ হয়ে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে যেমন মানুষের দরকার ঠিক তেমন মানুষ ছিল চার্লস কটার।

যে-সব মানুষ বৃহৎ দেহের অধিকারী হয় সাধারণত তাদের চালচলন হয় মন্থর এবং শ্লথ, কিন্তু ছ-ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এই নরদৈত্য ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম।

প্রয়োজন হলে মুহূর্তের মধ্যে কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে সে অব্যর্থ সন্ধানে লক্ষ্য ভেদ করতে পারত।

শেরিফের কাজ করে কটারের মনের গতি হয়েছিল খুব সহজ আর স্পষ্ট।

কোন মানুষকে সে হয় পছন্দ করবে আর নয় তো পছন্দ করবে না। এই পছন্দ অপছন্দের মাঝামাঝি কিছু নেই।

কাউকে অপছন্দ হলে সে তার উপরে প্রয়োগ করত মুষ্টিবদ্ধ হস্তের মুষ্টিযোগ চার্লস কটারের জীবন-দর্শনে একটুও জটিলতা ছিল না।

কটারের পেশীবহুল হাত দুখানা ছিল বেজায় লম্বা।

সেই অস্বাভাবিক দীর্ঘ দুই হাতে ছিল অমানুষিক শক্তি।

তার উপর তার দক্ষিণ হস্তে সর্বদাই থাকত একটা বেঁটে মোটা বাঁশের লাঠি এবং কোমরে ঝুলত গুলিভরা রিভলভার।

ওকলাহামার দুর্দান্ত গুণ্ডারা বুঝল, চার্লস কটার যতদিন শেরিফ আছে অন্তত সে কয়টা দিন তাদের আইন মেনে চলতে হবে।

কটার যখন স্বদেশের মায়া কাটিয়ে আফ্রিকাতে পাড়ি জমাল তখন নিশ্চয়ই ওকলাহামার গুণ্ডারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।

অবশ্য এটা আমার অনুমান কটারের জীবন-ইতিহাসের কোনো পাতায় ওকলাহামার অধিবাসীদের মনস্তত্ত্ব আলোচনা করা হয়নি।

আফ্রিকাতে এসে চার্লস কটার শিকারির পেশা অবলম্বন করলে। যে-সব লোকের শিকারের শখ আছে তারা দক্ষ পেশাদার শিকারির সাহায্য নিয়ে আফ্রিকার অরণ্যে প্রবেশ করে। নিয়োগকারীর সব রকম সুবিধা-অসুবিধা এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় শিকারি এবং এই কাজের জন্য সে প্রচুর অর্থ পারিশ্রমিক পায়।

এই কাজে অর্থ-উপার্জনের যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও কাজটা অতিশয় বিপদজনক। তবে চার্লস কটারের মতো মানুষের পক্ষে এই ধরনের পেশা পছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক।

কটার ছিল বিবাহিত মানুষ। তার পরিবারটিও নেহাত ছোটো ছিল না। ছয়টি কন্যা এবং দুটি পুত্রসন্তান নিয়ে কটার প্রবল পরাক্রমে শিকারির ব্যবসা চার্লিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় এইসব ব্যবসা-সংক্রান্ত কথাবার্তা চলত টেলিগ্রাফের সাহায্যে। অফিসের কেরানিদের মধ্যে একধরনের লোক দেখা যায় যারা আইনের প্যাঁচ লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোল। এই ধরনের কোনো-কোনো কেরানি যখন চিঠি লিখে চার্লস কটারকে আইন এবং শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে উপদেশ দেবার চেষ্টা করত তখনই তার মেজাজ যেত বিগড়ে বন্দুকের বদলে কলম নিয়ে সে করত যুদ্ধ ঘোষণা।

আগেই বলেছি, চার্লসের জীবন-দর্শন ছিল খুব সহজ ও স্পষ্ট। গভর্মেন্টের বেতনভোগী কর্মচারীর সঙ্গে মারামারি করা যায় না তাই মূল্যবান উপদেশপূর্ণ চিঠিকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে চার্লস কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসত।

তার চিঠির ভাষাও ছিল খুব সহজ—

মহাশয়,
আপনার চিঠিটা এইমাত্র আমার সামনে ছিল। এখন সেটা আমার পিছনে বাজে কাগজের ঝুড়ির মধ্যে অবস্থান করছে।
–চার্লস কটার।

এমন চমৎকার চিঠি পেলে কেউ খুশি হয় না।

পোস্ট অফিসের কেরানিরা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কটারের উপর খঙ্গহস্ত ছিলেন। বেয়াড়া চিঠিপত্র লেখার জন্য প্রায়ই কটারের উপর আদালতের সমন জারি হত। আদালতে দাঁড়াতে হলেই তার মেজাজ হত খাপ্পা তখনকার মত বিচারকের নির্দেশ পালন করে সে ঘরে ফিরে আসত বটে, কিন্তু মহামান্য আদালত তার চরিত্র একটুও সংশোধন করতে পারেননি। বেয়াড়া চিঠিপত্র লেখার জন্য কটারকে বহুবার আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে।

এই উদ্ধত মানুষটি তার জীবনে একাধিকবার লেপার্ডের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইতে নেমেছিল। হিংস্র শ্বাপদের শাণিত নখর তার দেহের বিভিন্ন স্থানে সুগভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সেই জীবন-মরণ যুদ্ধে প্রত্যেকবারই বিজয়লক্ষ্মীর বরমাল্য দুলেছে চার্লসের কণ্ঠে।

এই প্রসঙ্গে লেপার্ড নামক জন্তুটির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার।

ভারতবর্ষেও লেপার্ড আছে, বাংলায় তাকে চিতাবাঘ বলে ডাকা হয়। কিন্তু আফ্রিকার জঙ্গলে চিতা নামে বিড়াল-জাতীয় যে জানোয়ার বাস করে তার দেহচর্মের সঙ্গে লেপার্ডের কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও দেহের গঠনে ও স্বভাব-চরিত্রে চিতার সঙ্গে লেপার্ডের কোনোই মিল নেই– চিতা এবং লেপার্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন জানোয়ার। চিতা লাজুক ও ভীরু প্রকৃতির পশু। লেপার্ড হিংস্র, দুর্দান্ত।

জে. হান্টার, জন মাইকেল প্রভৃতি শিকারি লেপার্ডকে আফ্রিকার সবচেয়ে বিপদজনক জানোয়ার বলেছেন। সিংহের মতো বিপুল দেহ ও প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী না হলেও ধূর্ত লেপার্ডের বিদ্যুৎ-চকিত আক্রমণকে অধিকাংশ শিকারিই সমীহ করে থাকেন।

লেপার্ডের আক্রমণের কায়দা বড়ো বিশ্রী।

লতাপাতা ও ঘাসঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে সে যখন বিদ্যুৎবেগে শিকারির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে তখন আক্রান্ত ব্যক্তি অধিকাংশ সময়েই হাতের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পায় না। প্রথম আক্রমণেই লেপার্ড তার সামনের দুই থাবার তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে শিকারির চোখ দুটোকে অন্ধ করে দেবার চেষ্টা করে, সঙ্গেসঙ্গে একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের মারাত্মক দংশন চেপে বসে শিকারির কাঁধে, আর পিছনের দুই থাবার ধারালো নখগুলি ক্ষিপ্র সঞ্চালনে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় হতভাগ্যের উদরদেশ।

এই হিংস্র অথচ সুন্দর জানোয়ারকে কটার অত্যন্ত ঘৃণা করত। সে প্রায়ই বলত, আঃ! ব্যাটাদের নখে কি ভীষণ ধার- আঁচড় দিলে মনে হয় যেন খুর চালাচ্ছে! শয়তানের বাচ্চা!

হ্যাঁ, একথা অবশ্য সে বলতে পারে।

তার হাত পায়ের যে অংশগুলি পরিচ্ছদের বাইরে দৃষ্টিগোচর হয় সেদিকে একনজর তাকালেই চোখে পড়ে অজস্র ক্ষতচিহ্ন অভিজ্ঞ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে যে ক্রুদ্ধ লেপার্ডের নখের আঁচড়েই ওই গভীর ক্ষতচিহ্নগুলির সৃষ্টি হয়েছে।

একদিনের ঘটনা বলছি।

বনের মধ্যে একটা গাছের ডালে ঝুলছে মরা কুকুরের টোপ, আর খুব কাছেই ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে রাইফেল হাতে অপেক্ষা করছে কটার।

কুকুরের মাংস লেপার্ডের প্রিয় খাদ্য, কটার জানে মরা কুকুরের গন্ধে গন্ধে লেপার্ড আসবেই আসবে।

তা এল। একটু পরেই একটা লেপার্ড এসে উপস্থিত হল ঘটনাস্থলে।

জন্তুটার দিকে তাকিয়ে কটার হতাশ হল– লেপার্ডটা আকারে বেশি বড়ো নয়, তার গায়ের চামড়াটাও চার্লসের কাছে লোভনীয় মনে হল না।

গ্রামের আশেপাশে যে-সব লেপার্ড ঘোরাঘুরি করে তাদের দেহের আকার খুব বড়ো হয়না, গায়ের চামড়া হয় অনুজ্জ্বল, ফ্যাকাশে। কিন্তু ঘন জঙ্গলের মধ্যে যে লেপার্ডগুলি বাস করে সেগুলো সত্যিই বৃহৎ বপুর অধিকারী, তাদের চামড়াগুলি অতিশয় উজ্জ্বল ও সুন্দর। কটার আশা করেছিল একটি বেশ বড়োসড়ো অরণ্যচারী লেপার্ড তার ফাঁদে পা দেবে- এই জন্তুটাকে দেখে তার মেজাজ হয়ে গেল খাপ্পা।

লেপার্ড বড়ো ধূর্ত জানোয়ার।

সে কুকুরের মৃতদেহটাকে ভালো করে লক্ষ করলে, কিন্তু চট করে ভোজের জিনিসে মুখ দিলে না। কিছুক্ষণ পরে তার মনে হল এই ভোজটা বেশ নিরাপদ, এখানে কামড় বসালে বোধহয় বিপদের আশঙ্কা নেই- লেপার্ড নিচু হয়ে বসে পড়ল, এইবার একলাফে গাছে উঠে মরা কুকুরটাকে নামিয়ে আনবে।

চার্লসের মেজাজ আগেই খারাপ হয়েছিল। তবু সে আশা করেছিল জন্তুটা হয়ত চলে যেতে পারে। কিন্তু লেপার্ড যখন লাফ দিতে উদ্যত হল তখন আর তার ধৈর্য বজায় রইল না। ইচ্ছা করলে কটার অনায়াসেই গুলি করে লেপার্ডটাকে হত্যা করতে পারত, কিন্তু হাতের রাইফেল ফেলে দিয়ে সে হঠাৎ দৌড়ে এসে জন্তুটার পিছনে ঠ্যাং দুটো চেপে ধরলে।

পরক্ষণেই দুই সবল বাহুর আকর্ষণে লেপার্ডের শরীরটা শূন্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে সশব্দে ভূমিশয্যায় আছড়ে পড়ল।

লেপার্ডের ঊর্ধ্বতন চোদ্দ পুরুষে কেউ কখনও এমন ব্যবহার সহ্য করেনি। আকারে ছোটো হলেও লেপার্ড হচ্ছে লেপার্ড, তুচ্ছ মানুষের হাতে আছাড় খেয়ে মুখের গ্রাস ফেলে পালিয়ে যেতে সে রাজি হল না–

ভীষণ আক্রোশে গর্জন করে সে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কটারের অস্বাভাবিক লম্বা হাত দুটো এড়িয়ে লেপার্ড শত্রুর দেহে দাঁত বসাতে পারলে না- লোহার মতো শক্ত দু-খানা হাত লেপার্ডের টুটি টিপে ধরলে।

সামনের থাবার ধারালো নখগুলি কটারের হাত দুখানা রক্তাক্ত করে দিলে, তবু লৌহ কঠিন অঙ্গুলির বন্ধন একটুও শিথিল হল না।

ঝটাপটি করতে করতে মানুষ এবং পশু মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। লেপার্ডের পিছনের থাবাদুটিও নিশ্চেষ্ট রইল না, তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কটারের নিম্ন অঙ্গ।

কিন্তু তার অঙ্গুলিগুলি লেপার্ডের গলা থেকে সরে এল না।

অবশেষে কঠিন নিষ্পেষণে রুদ্ধ হয়ে এল জন্তুটার কণ্ঠনালী। উন্মুক্ত মুখ-গহ্বরের ভিতর থেকে উঁকি দিল দীর্ঘ দাঁতের সারি, আর সেই অবস্থায় নিঃশ্বাস নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে লেপার্ড প্রাণত্যাগ করলে।

চার্লস কটারের সর্বাঙ্গ থেকে তখন ঝরঝর ঝরছে গরম রক্তের স্রোত, টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে সেই উষ্ণ তরল ধারা মৃত লেপার্ডের দেহের উপর।

চার্লস কটার এবার কী করবে?

ক্ষতগুলিতে ওষুধ দেবার জন্য এবার ফিরে যাবে বাড়িতে?

পাগল! কটার সে জাতের মানুষই নয়।

রক্তাক্ত ক্ষতগুলিতে মোটামুটি খানিকটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সে পরবর্তী শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

একটু পরেই সেখানে এসে উপস্থিত হল আর একটি লেপার্ড। এবারের লেপার্ড আকারে খুব বড়ো, তার গায়ের চামড়াটিও খুব সুন্দর। কটার বুঝল এই জানোয়ারটা গভীর অরণ্যের বাসিন্দা নিশানা স্থির করে সে রাইফেলের ঘোড়া টিপল।

অব্যর্থ সন্ধান- একটিমাত্র গুলিতেই লেপার্ডের প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

.

এই ঘটনার পরে কয়েকটা দিন কেটে গেছে।

জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে চার্লস কটার।

আচম্বিতে গাছের উপরে ঘন লতাপাতার আড়াল থেকে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল দু-দুটো ছোটো জাতের লেপার্ড।

যে জানোয়ারটা কটারের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে নিহত হয়েছিল এই লেপার্ড দুটো তারই পরিবারভুক্ত কি না জানি না, কিন্তু ঘটনাটা শুনলে এটাকে প্রতিশোধের ব্যাপার বলেই মনে হয়।

এমন অভাবিত ও অতর্কিত আক্রমণের জন্য কটার প্রস্তুত ছিল না। সমস্ত ব্যাপারটা সে যখন বুঝতে পারল তখন লেপার্ডের দাঁত ও নখের আঘাতে তার শরীর রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে।

কিন্তু চার্লস কটার হচ্ছে চার্লস কটার।

মুহূর্তের মধ্যে সে কর্তব্য স্থির করে ফেললে।

হাতের রাইফেল আর কাজে লাগবে না বুঝে সে অস্ত্রটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে আক্রমণের মোকাবেলা করতে রুখে দাঁড়াল।

কটারের দ্রুত প্রতি-আক্রমণের জন্য লেপার্ড দুটো প্রস্তুত ছিল না, তারা ছিটকে গিয়ে শত্রুর পায়ের কাছে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। সেই সুযোগে কটার চট করে একটা জানোয়ারের গলা চেপে ধরলে। এত জোরে কটার লেপার্ডটার গলা টিপে ধরেছিল যে জন্তুটার চোখে রক্ত জমে গেল।

কটারের শরীরও অক্ষত থাকল না। ধারালো নখের আঘাতে বিদীর্ণ ক্ষতমুখ থেকে ছুটল রক্তের ফোয়ারা- সুদীর্ঘ শ্বাপদ-দন্তের হিংস্র শুভ্রতাকে লাল করে দিয়ে সেই তপ্ত রক্তধারা গড়িয়ে পড়ল আক্রান্ত জন্তুটার হাঁকরা মুখের মধ্যে।

অন্য লেপার্ডটা কটারের খপ্পরে ধরা পড়েনি।

সে এবার পিছন থেকে শত্রুর পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিলে। কটার তখন প্রথম জানোয়ারটার সঙ্গে মারামারি করতে করতে হঠাৎ ঝুঁকে পড়েছে দুনম্বর লেপার্ডের লাফটা ফসকে গেল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার জন্য সে কটারের পিঠের উপর না পড়ে ছিটকে এসে পড়ল সঙ্গীর পিছনের দুটো পায়ের উপর।

সঙ্গী তখন কটারের কবলের মধ্যে ছটফট করছে আর লাথি ছুড়ছে। সেই সনখ থাবার একটি লাথি এসে লাগল দুনম্বর লেপার্ডের পেটে– সঙ্গে সঙ্গে ধারালো নখের আঁচড়ে বিদীর্ণ হয়ে গেল তার উদরের মাংসপেশী।

কটার সেই মুহূর্তের সুযোগ নিতে ছাড়াল না।

টপ করে হাত বাড়িয়ে সে দ্বিতীয় লেপার্ডটার কণ্ঠনালী চেপে ধরলে।

এইবার সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে সে জন্তুটাকে মাটিতে চেপে ধরে গলা টিপে মারবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু লেপার্ডের দেহের মাংসপেশীগুলি শক্তিশালী স্প্রিং-এর মতে- চার্লস কটারের মতো মানুষের পক্ষেও তাদের মাটিতে চেপে রাখা অসম্ভব। জন্তুদুটো জোর করে ঠেলে উঠল, অতএব কটারও সোজা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হল। কিন্তু প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালীর উপরে তার আঙুলের চাপ একটুও শিথিল হল না।

…ধারালো নখের আঘাতে কটারের কাঁধ এবং হাত দিয়ে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। এত রক্তপাতেও কটার অবসন্ন হল না বরং রক্ত দেখে তার মাথায় খুন চেপে গেল।

ক্রুদ্ধ চার্লস কটার এবার যা করলে তা প্রায় অবিশ্বাস্য।

একটা জন্তুর মাথার সঙ্গে সে আর একটা জন্তুর মাথা সজোরে ঠুকতে লাগল।

লেপার্ড দুটো কিন্তু এমন মার খেয়েও কাবু হলনা।

তারা ক্রমাগত ছটফট করতে করতে কটারের বজ্রমুষ্টি থেকে নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টা করছে, আর তাদের থাবার ধারালো নখগুলি সমানে শত্রুর দেহে আঁচড় কেটে যাচ্ছে।

রক্তে লাল হয়ে উঠেছে কটারের সর্বাঙ্গ, লেপার্ড দুটোর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে লৌহকঠিন আঙুলের নিষ্ঠুর পেষণে।

তবু কোনো পক্ষই পরাজয় স্বীকার করছে না।

কটারের সঙ্গে যে নিগ্রো সঙ্গীরা ছিল তারা প্রথমে পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরে আবার ফিরে এসেছে। বিস্ফারিত চক্ষুর ভীত বিস্মিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে এই আশ্চর্য দৃশ্যের দিকে কিন্তু এখন আর কটারকে সাহায্য করার উপায় নেই, মানুষ ও পশু এমনভাবে পরস্পরকে

জড়িয়ে ধরে মারামারি করছে যে গুলি চালালে কটারও আহত হতে পারে।

অতএব তখন পরিস্থিতি হচ্ছে এই যে, যে পক্ষের সহ্যশক্তি বেশি সে পক্ষই জয়লাভ করবে।

চার্লস কটারের রক্তস্নাত দীর্ঘ দেহ যেন অফুরন্ত শক্তির আধার। সে হঠাৎ বুঝতে পারলে তার দুই শত্রুর দেহ অবশ হয়ে আসছে; তাদের থাবার আঁচড়ে, শরীরের আস্ফালনে আর আগের মতো জোর নেই।

মহা উল্লাসে কটার চিৎকার করে উঠল।

যে লেপার্ডটার উদর সঙ্গীর নখের আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল তার ক্ষতস্থান থেকে তখন অবিরল ধারায় রক্ত ঝরে পড়ছে। কটারের অবস্থা তো আগেই বলেছি।

মানুষ ও পশুর রক্তে পিছল হয়ে উঠল রণভূমির ঘাস-জমি।

কটার যখন বুঝল তার শত্রুরা দুর্বল হয়ে পড়েছে, সে তখন লড়াইয়ের কায়দা বদলে ফেলল। হাতদুটো সোজা করে সে জন্তু দুটোকে এমনভাবে তুলে ধরলে যে তাদের থাবাগুলো আর তার দেহ স্পর্শ করতে পারলে না।

এইবার সে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে জন্তু দুটোর মাথা ঠুকতে লাগল।

… মাথার উপর পড়ছে প্রচণ্ড আঘাত, কণ্ঠনালীর উপর শ্বাস রোধ করে চেপে বসেছে লৌহকঠিন অঙ্গুলির নিষ্ঠুর বন্ধন

নিস্তেজ হয়ে এল দুই শাপদের হিংস্র আস্ফালন…

মুমূর্য জন্তু দুটোকে মাটির উপর আছড়ে ফেলে চার্লস কটার সোজা হয়ে দাঁড়াল।

সে এক আশ্চর্য দৃশ্য!

মাটির উপর মৃত্যুযাতনায় ছটফট করছে দু-দুটো লেপার্ড, আর তাদের পাশেই ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এক মহাকায় মানুষ।

গল্পের টারজান কি কটারের চেয়েও শক্তিশালী?

কটার এখন কী করবে? বাড়ি ফিরে যাবে? ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে শয্যাগ্রহণ করবে? মোটেই নয়। চার্লস কটার হচ্ছে চার্লস কটার।

ক্ষতস্থানগুলিতে নিগ্রোদের সাহায্যে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সে আবার সঙ্গীদের নিয়ে পথ চলতে শুরু করলে।

কথায় আছে, ডানপিটের মরণ গাছের আগায়।

চার্লস কটার অবশ্য গাছের আগায় মরেনি, তবে তার মৃত্যু হয়েছিল অত্যন্ত ভয়ানকভাবে। জন্মগ্রহণ করেছিল সে সুসভ্য আমেরিকার ওকলাহাম প্রদেশে, আর তার মৃত্যু হল ঘন বন আবৃত আফ্রিকার অন্তঃপুরে।

একেই বলে নিয়তি।

হ্যাঁ, নিয়তি ছাড়া আর কি বলব।

চার্লসের মৃত্যুকে একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু বলা চলে না, আর এই দুর্ঘটনার কারণ হল একটি যন্ত্রের যান্ত্রিক ত্রুটি।

না, না, রাইফেল নয়, পিস্তল নয়, একটা ক্যামেরার দোষেই এই দুর্ঘটনা ঘটল– অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, চার্লস কটারের মৃত্যুর জন্য দায়ী একটি ক্যামেরা।

মনে হচ্ছে অবিশ্বাস্য- তাই না?

কিন্তু বাস্তব সত্য অনেক সময়ে কল্পনাকেও অতিক্রম করে যায়। আচ্ছা, ঘটনাটা খুলেই বলছি।

চার্লস কটার একদিন রাইফেলের সঙ্গে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বনের পথে যাত্রা করলে।

এই ক্যামেরার view-finder-টা খারাপ ছিল। (ক্যামেরার মধ্যে বসানো স্বচ্ছ কাঁচের মতো যে জিনিসটার ভিতর দিয়ে ক্যামেরাধারী ফোটো তোলার বিষয়বস্তুকে দেখতে পায় সেই অংশটিকে বলে view-finder)

ক্যামেরার সামান্য দোষ-ত্রুটি নিয়ে কটার মাথা ঘামায়নি, আর এইটুকু অন্যমনস্কতার জন্যই তাকে প্রাণ হারাতে হল।

জঙ্গলের পথে অকস্মাৎ কটারের চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করলে একটা মস্ত গণ্ডার।

কটার রাইফেল রেখে নিবিষ্ট চিত্তে গণ্ডারের ফোটো তুলতে লাগল। হতভাগা গণ্ডার।

সে ফটো তুলে দেওয়ার জন্য একটুও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে না, খঙ্গ উঁচিয়ে ধেয়ে এল কটারের দিকে।

আগেই বলেছি ক্যামেরার view-finder খারাপ ছিল। ক্যামেরার যান্ত্রিক চক্ষুর মধ্যে দিয়ে কটার দেখছে জন্তুটা অনেক দূরে আছে, কিন্তু আসলে তখন গণ্ডার খুব কাছে এসে পড়েছে।

কটার যখন তার বিপদ বুঝতে পারলে তখন আর সময় নেই- গণ্ডারের খঙ্গ প্রায় তার দেহ স্পর্শ করেছে।

সশব্দে অগ্নি-উদগার করলে কটারের রাইফেল সঙ্গেসঙ্গে গণ্ডারের সুদীর্ঘ খঙ্গ সেই অতিকায় নরদানবের দেহটাকে বিদীর্ণ করে দিলে।

কটারের মুখ থেকে একটা অস্ফুট আর্তনাদও শোনা গেল না, সে তৎক্ষণাৎ মারা গেল।

চালর্স কটার জীবনে কখনও পরাজয় স্বীকার করেনি, মৃত্যুকালেও জয়লক্ষ্মী তার কণ্ঠে পরিয়ে দিল জয়মাল্য।

মরার আগে কটার একবারই গুলি চালাবার সুযোগ পেয়েছিল, এবং সেই একটিমাত্র গুলির আঘাতেই কটারের আততায়ী মৃত্যুবরণ করলে।

চার্লস কটারের মৃতদেহের পাশেই লুটিয়ে পড়ল গুলিবিদ্ধ গণ্ডারের প্রাণহীন দেহ।

জনতার প্রতিনিধি

একদল হিংস্র নেকড়ের গুহার ভিতর যদি একটা বিড়াল বাচ্চা পথ ভুলে ঢুকে পড়ে তাহলে তার চালচলনটা কেমন হবে?

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না-থাকলেও অনুমান করা যায় যে মার্জার শাবক যে মুহূর্তে নেকড়েগুলোর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারবে সেই মুহূর্তে তার দেহের লোম খাড়া হয়ে উঠবে কাটার মতো এবং দুই চোখের ভীত বিস্ফারিত দৃষ্টি সঞ্চালন করে সে যে চটপট চম্পট দেওয়ার সোজা রাস্তাটা খোঁজার চেষ্টা করবে, এ-বিষয়ে ভুল নেই।

স্নেক ডলস সেলুন নামক পানশালার মেঝের ওপর দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এসে যে কিশোরটি দোকানির কাছে এক গেলাস ঠান্ডা পানীয় চাইল, তার নির্বিকার মুখ এবং স্বচ্ছন্দ গতিভঙ্গি দেখে মনে হয় না যে এই মুহূর্তে স্থানত্যাগ করার ইচ্ছা তার আছে–

যদিও তার সর্বাঙ্গে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে পানাগারের মধ্যস্থলে দৃষ্টিপাত করলেই নেকড়েবেষ্টিত মার্জার শাবকের কথা মনে পড়বে…

হ্যাঁ, নেকড়ে বই কী

কিংবা নেকড়ের চাইতেও ভয়ংকর মানুষগুলো আড্ডা জমিয়েছে পানাগারের মধ্যে।

পানশালার টেবিলের চারধারে টেবিলে টেবিলে গোল হয়ে বসে যে লোকগুলো তাস খেলছে অথবা পানভোজন করছে তাদের চোখে-মুখে মনুষ্যত্বের চিহ্ন নেই কিছুমাত্র–কঠিন চোয়ালের রেখায় রেখায় জ্বলন্ত চোখের তির্যক চাহনিতে যে বন্য হিংসার ছায়া উঁকি দিচ্ছে সেদিকে তাকালে ক্ষুধার্ত নেকড়ের কথা মনে হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।

এতগুলো সাংঘাতিক মানুষের মাঝখানে একটি নিরীহ চেহারার কিশোরকে দেখলে নেকড়েবেষ্টিত মাজার শাবকের কথাই মনে আসে।

স্নেক ডলস সেলুনের মানুষগুলো সেদিন তাই ভেবেছিল, বিড়ালছানার মতো তুচ্ছ করেছিল তারা ওই ছেলেটিকে। একটু পরেই তাদের ভুল ভাঙল ভয়ংকরভাবে–তপ্ত রক্তধারায় হল তাদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত।

তাই হয়।

রজ্জুতে সর্পভ্রম হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু সর্পতে রজ্জ্বভ্রম করলে তার ফল হয় মারাত্মক।

সেই মারাত্মক ভুলের সূচনা জানিয়ে ঘরের কোণ থেকে ভেসে এল এক বিদ্রূপ জড়িত কণ্ঠস্বর, এই ছোঁড়াটা নিশ্চয়ই এখনও মায়ের কোলে শুয়ে দুধ খায়। হা! হা! হা! এই দুধের বাচ্চা হল আমেরিকা যুক্তরাজ্যের ডেপুটি মার্শাল! হো! হো! হো!

খোঁচাখাওয়া সাপ যেমন দ্রুতবেগে আততায়ীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি বিদ্যুৎচকিত সঞ্চালনে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর ছেলেটি চেয়ারে উপবিষ্ট লোকগুলির দিকে। সকলে দেখল তার বাঁ-হাতটা সামনের টেবিলের ওপর চেপে বসেছে আর ডান হাতের সরু সরু আঙুলগুলো বাজপাখির ছোঁ মারার ভঙ্গিতে নেমে এসেছে কোমরের খাপে ঢাকা রিভলভারের খুব কাছাকাছি।

হ্যাঁ, আমি যুক্তরাজ্যের ডেপুটি মার্শাল, কিশোরকণ্ঠে শোনা গেল দর্পিত ঘোষণা, আমার নাম ড্যান ম্যাপল। কারো কিছু জিজ্ঞাস্য আছে? কোনো প্রশ্ন?

না, কারো কিছু জানার নেই।

কেউ কোনো প্রশ্ন করলে না।

যে লোকটি বিদ্রূপ করেছিল সে হাতের গেলাসটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল খুব মন দিয়ে… আশেপাশে অন্য লোকগুলিও হঠাৎ মৌনব্রত অবলম্বন করলে। একটু আগেও যেখানে হইহই হট্টগোলে কান পাতা যাচ্ছিল না, এখন সেখানে ছুঁচ পড়লে শব্দ শোনা যায়…

কয়েকটা নীরব মুহূর্ত

পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে চেয়ারের উপর যে লোকগুলো বসেছিল তারা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল, অভ্যস্ত হাতগুলো ধীরে ধীরে নেমে এল কোমরের খাপে ঢাকা রিভলভারের দিকে।

ড্যান ম্যাপল ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল।

সে হেসে উঠল, আমার সঙ্গে রিভলভারের খেলা খেলতে পারে এমন কোনো খেলোয়াড় এখানে নেই। আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি তোমরা যদি আরও কিছুদিন দুনিয়ার আলো দেখতে চাও, তবে তোমাদের হাতগুলো রিভলভারের বাঁট থেকে একটু দূরে দূরে রাখো।

ড্যান ম্যাপলের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার স্পর্শ ছিল না, খুব সহজ আর স্বাভাবিক ছিল তার গলার আওয়াজ। কিন্তু তার চোখ দুটি থেকে হারিয়ে গেল কৈশোরের প্রাণচঞ্চল আলোর দীপ্তি–সর্পিল আক্রোশে চোখের তারায় নেমে এল বিষাক্ত হিংসার ছায়া।

স্নেক ডলস সেলুনের খুনি মানুষগুলো ওই চোখের ভাষা বুঝল খুব সহজেই, তাদের হাতগুলো রিভলভারের বিপজ্জনক সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে গেল।

কোলাহলমুখর পানশালার মধ্যে নেমে এল মৃত্যুপুরীর নীরবতা।

ড্যান ম্যাপলের আবির্ভাব অতিশয় নাটকীয় বটে কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। আমেরিকা যুক্তরাজ্যের তাহলাকুই নামে যে ছোটো শহরটা পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানকার প্রতিটি বাসিন্দাই খবরটা পেয়েছিল–

খুব শীঘ্রই নাকি ওই অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য একজন ডেপুটি মার্শাল আসবে।

শহরের বাসিন্দারা খবরটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। না-দেওয়াই স্বাভাবিক। আজকের আমেরিকার কথা নয়–১৮৯২ সালে ওইসব অঞ্চলে আইন-টাইন কেউ বড়ো একটা মানত না। বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত ছোটো ছোটো জায়গায় থানা পুলিশের বিরাট ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল গভর্নমেন্টের পক্ষে, তাই শহরের শৃঙ্খলা রক্ষার ভার থাকত টাউন মার্শালদের ওপর। দুর্ধর্ষ গুন্ডারা যে মার্শালদের খুব ভয় করত তা নয়, তবে পারতপক্ষে মার্শালদের সঙ্গে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চাইত না।

তাহলাকুই শহর কিন্তু নিয়মের ব্যতিক্রম। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই পাঁচজন মার্শালকে ওই শহরের গুন্ডারা গুলি করে মেরে ফেলল। শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক গভর্নমেন্টের কাছে আবেদন জানালেন, একজন ডেপুটি মার্শালকে যেন অবিলম্বে তাহলাকুই শহরে পাঠানো হয়। ভদ্রলোক এখানে বাস করতে পারছেন না।

আবেদন গৃহীত হল। তাহলাকুই শহরে আবির্ভূত হল ডেপুটি মার্শাল ড্যান ম্যাপল।

শহরের পানাগার স্নেক ডলস সেলুন-এর ভয়াবহ খ্যাতি ম্যাপলের কানেও পৌঁছেছিল। সে জানত রাত্রিবেলা ওই পানাগারের মধ্যে ঢুকলে সে স্থানীয় গুন্ডাশ্রেণির মানুষগুলোকে দেখতে পাবে, অতএব অকুস্থলে হল ড্যান ম্যাপলের আবির্ভাব।

পরবর্তী ঘটনার কথা তো কাহিনির শুরুতেই বলছি। শুধু দেখতে নয়, কিছু দেখাতেও এসেছিল ম্যাপল। সমবেত গুন্ডাদের উদ্দেশ করে সে যখন সাবধানবাণী উচ্চারণ করলে তখন কেউ সামনে এসে তাকে চ্যালেঞ্জ জানাল না।

না, চ্যালেঞ্জ নয় কিশোর ড্যান ম্যাপলের চোখের দিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস ছিল না কারো কিন্তু গুন্ডাদের চোখে চোখে ক্রুর ইঙ্গিতে নির্ধারিত হয়ে গেল নূতন ডেপুটি মার্শালের নিয়তি।

একটি দীর্ঘাকার কুৎসিত মানুষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নাম তার নেড ক্রিস্টি।

সঙ্গে উঠে দাঁড়াল তার সহকারী–আর্চি উলফ।

নেড আর আর্চি ওই অঞ্চলের দুর্ধর্ষ গুন্ডা। নরহত্যায় তাদের দ্বিধা ছিল না কিছুমাত্র। কত লোক যে তাদের হাতে প্রাণ দিয়েছে তারা নিজেরাও বোধ হয় তার সঠিক হিসাব দিতে পারত না। এই দুই মানিকজোড় এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

পরবর্তী ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকেই শোনা যাক। ১৮৯২ সালে নভেম্বর মাসের তৃতীয় দিবসে ড্যান ম্যাপল নামে যে কিশোরটি স্নেক ডলস সেলুনে পদার্পণ করেছিল তার কীর্তিকলাপ স্বচক্ষে দেখেছিল এক বালক ভৃত্য নাম তার মাইক ম্যাকফিবেন।

কাহিনির পরবর্তী অংশ মাইকের লিখিত বিবরণী থেকে তুলে দিচ্ছি।

পানাগারের পিছন দিকে দরজা দিয়ে অন্তর্ধান করলে আর্চি আর নির্বিকারভাবে ড্যান ম্যাপলের সামনে এগিয়ে এল নেড। আমি তখনই বুঝলাম ব্যাপারটা কী ঘটতে যাচ্ছে। সেলুন-রেস্তরাঁয় পিস্তলবাজ গুন্ডারা যখন কোনো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করতে চায় তখন তারা ফঁদ পাতে। ফাঁদের নিয়মটা হচ্ছে, দুজনের মধ্যে একজন সামনে এগিয়ে এসে শিকারকে অন্যমনস্ক করে রাখে এবং সেই সুযোগে পিছন থেকে আর একজন তাকে গুলি করে।

আমি বুঝলাম আর্চি দরজার আড়ালেই দাঁড়িয়ে আছে। সুযোগ পেলেই সে গুলি চালাবে। আমার বুক কাঁপতে লাগল। খুব সহজভাবে ম্যাপলকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল নেড, তারপর হঠাৎ একটা টেবিলের ওপর হাত রেখে ঘুরে দাঁড়াল ম্যাপলের দিকে, ওঃ! তুমিই তাহলে নতুন ডেপুটি মার্শাল? রাজ্য সরকার তোমাকেই পাঠিয়েছে?

আমি রুদ্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করতে লাগলুম। এখনই পিছনের দরজার কাছে দণ্ডায়মান আর্চির রিভলভার থেকে গুলি ছুটে এসে ম্যাপলকে শুইয়ে দেবে মেঝের ওপর। শুধু আমি নই, অভিজ্ঞ মানুষগুলো সবাই বুঝেছিল ব্যাপারটা, সকলেরই মুখে-চোখে ফুটে উঠেছিল হিংস্র প্রত্যাশা উদগ্র আগ্রহে সকলেই কান পেতে অপেক্ষা করতে লাগল একটা রিভলভারের গর্জন শোনার জন্য…

হ্যাঁ, গর্জে উঠেছিল রিভলভার। কিন্তু সেটা আর্চির অস্ত্র নয়। আমরা দেখলুম দরজার কাছে। দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করছে আর্চি উলফ, তার হাতের মুঠো থেকে ছিটকে পড়েছে রিভলভার। কখন যে ম্যাপল ডান হাতের দ্রুত সঞ্চালনে কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে আর্চিকে গুলি করেছে আমরা বুঝতেই পারিনি।

আমরা শুধু শুনলাম রিভলভারের গর্জন এবং আহত আর্চির আর্তনাদ, আমরা শুধু দেখলাম ম্যাপলের ডান হাতের রিভলভারের নল থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া আর তার বাঁ-হাতের রিভলভার উদ্যত হয়েছে নেভ ক্রিস্টির দিকে।

কোণঠাসা নেকড়ের মতো হিংস্র দন্তবিকাশ করে পিছিয়ে গেল নেড। সে কোমরে ঝুলানো রিভলভারে হাত দেওয়ার চেষ্টা করলে না–চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল।

এইবার রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হল ওয়াইল্ড হ্যারি। ওই অঞ্চলের আর একটি কুখ্যাত পিস্তলবাজ গুন্ডা সে। কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে হ্যারি গুলি করার উপক্রম করলে, সঙ্গেসঙ্গে ক্ষিপ্রহস্তে গুলি চালিয়ে ম্যাপল তাকে মেঝের ওপর পেড়ে ফেলল।

তারপর ঠিক কী হয়েছিল জানি না। ওই রক্তাক্ত নাটকের মধ্যবর্তী অংশে কে কেমন অভিনয় করেছিল বলতে পারব না। কারণ, হ্যারি লুটিয়ে পড়তেই অনেকগুলো রিভলভার একসঙ্গে গর্জে উঠল এবং আমি ঝাঁপ খেলাম একটা টেবিলের নীচে। সেখান থেকে শুয়ে শুয়ে আমি শুনতে পেলাম সগর্জনে ধমকে উঠেছে অনেকগুলো রিভলভার।

প্রায় মিনিট দুই ধরে শুনলাম রিভলভারের গর্জন। তারপর হঠাৎ থেমে গেল সেই শব্দের তরঙ্গ–সব চুপচাপ। খুব সাবধানে টেবিলের তলা থেকে মাথা তুলে দেখলাম স্নেক ডলস সেলুনের মালিক ড্যান ম্যাপলের হাতে তুলে দিচ্ছে একটি পূর্ণ পানপাত্র।

পানশালা শূন্য! গুন্ডার দল সরে পড়েছে!

দোকানের মালিক আর একটা গেলাসে মদ ঢালল, এটাও টেনে নাও। এই গেলাসের দাম দিতে হবে না।

মালিকের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্যাপল বললে, হঠাৎ এই অনুগ্রহের কারণ কী?

মালিক বললে, অনুগ্রহ নয়। আমি আইরিশ–আয়ারল্যান্ডের লোক মনে করে মৃত্যুপথযাত্রীকে পানীয় পরিবেশন করলে পুণ্য হয়।

তার মানে? আমি কি মরতে বসেছি নাকি?

–নিশ্চয়। তুমি পাকা খেলোয়াড় তোমার মতো দক্ষ পিস্তলবাজ মানুষ আমি দেখিনি। কিন্তু তোমার আয়ু ফুরিয়েছে। দু-মিনিট কিংবা খুব বেশি হলে মিনিট কুড়ি তুমি বেঁচে থাকতে পারো।

বটে? এক চুমুকে গেলাসের তরল পদার্থ গলায় ঢেলে শূন্য পানপাত্র টেবিলের ওপর রাখল ম্যাপল, আচ্ছা, আজ চলি।

দরজাটা লাথি মেরে খুলে ফেলল ম্যাপল, খাপে ঢাকা রিভলভার দুটির বাঁটের ওপর নেমে এল তার দুই হাত তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে খোলা দরজা দিয়ে সে বেরিয়ে গেল… শহরের অন্ধকার পথের ওপর মিলিয়ে গেল তার দীর্ঘ দেহ।

মাইকের লিখিত বিবরণীতে আরও অনেক কিছু আছে। সব ঘটনা বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করার জায়গা এখানে নেই। খুব অল্প কথায় পরবর্তী ঘটনার বিবৃতি দিচ্ছি।

স্নেক ডলস সেলুনের মালিক যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, তা সফল হয়েছিল বর্ণে বর্ণে। ড্যান ম্যাপল পানশালা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চল্লিশ মিনিটের মধ্যে অজ্ঞাত আততায়ী তাকে আড়াল থেকে রাইফেল ছুঁড়ে হত্যা করেছিল।

ম্যাপলের হত্যাকাহিনি শুনে খেপে গেল তাহলাকুই শহরের সমস্ত মানুষ। এতদিন যারা গুন্ডাদের ভয়ে থরথর করে কাঁপত, তারাই আজ রুখে দাঁড়াল গুন্ডারাজ উচ্ছেদ করার জন্য। দলে দলে শান্তিপ্রিয় মানুষ ছুটে এল শহরের পথে।

হাতে তাদের বিভিন্ন অস্ত্র রাইফেল! পিস্তল! শটগান!

হত্যাকাণ্ডের পরদিনই আমেরিকা যুক্তরাজ্যের একজন ডেপুটি মার্শাল অকুস্থলে এসে পড়ল, নাম তার হেক ব্রুনার। তার সঙ্গে এল দুজন যোগ্য সহকারী। হত্যাকাণ্ড যেখানে ঘটেছিল সেখানে খোঁজাখুঁজি করে তারা আবিষ্কার করলে একটা ব্যবহৃত বুলেটের খোল এবং সেই খোলটার একটু দুরেই পাওয়া গেল একটা লাকি চার্ম বা কবচ জাতীয় বস্তু। স্পষ্টই বোঝা গেল যে রাইফেল। থেকে গুলি চালিয়ে ম্যাপলকে হত্যা করা হয়েছে, ওই বুলেটের খোলটা হচ্ছে উক্ত রাইফেলে ব্যবহৃত অকেজো টোটা।

ওই ধরনের বুলেট অনেকেই ব্যবহার করে, কাজেই সেটা তাকে খুনিকে শনাক্ত করা সম্ভব নয়।

কিন্তু কবৃচটা গোয়েন্দার কাছে মূল্যবান সূত্র।

ব্রুনার তার দুই সহকারীকে বললে, আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসছি। এই কবচের মালিকটিকে যদি আবিষ্কার করতে পারি তাহলেই হত্যাকাণ্ডের সমাধান হয়ে যাবে। আমার মনে হয় খুনি আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে না।

ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল হেক ব্রুনার। দু-দিন তার পাত্তা পাওয়া গেল না। আর এই দুটো দিন শহরের কোনো জায়গায় কোনো অপরাধ সংঘটিত হল না। তাহলাকুই শহরের ইতিহাসে পরপর দু-দিন কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না, এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা।

শহরের আশেপাশে পার্বত্য অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসে যেসব গুন্ডা নগরবাসীর ওপর হামলা করত তারা পরপর দু-দিন তাদের আস্তানায় গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে রইল।

ক্ষিপ্ত জনতার সম্মুখীন হওয়ার সাহস তাদের ছিল না, হাওয়া ঘুরে গেছে!

দু-দিন পরেই সকাল বেলা শহরের রাজপথে ঘোড়ার পিঠে আবির্ভূত হল ব্রুনার। এক বিরাট জনতা তাকে ঘিরে দাঁড়াল, খবর কী?

ব্রুনার বললে, কবচের মালিক হচ্ছে নেড ক্রিস্টি। যে বুড়ো রেড-ইন্ডিয়ান এই ধরনের কবচ তৈরি করে তাকে আমি ভালোভাবেই জানি। আমি ওই বুড়োর কাছে গিয়েছিলাম। কবচটা দেখেই সে জিনিসটা শনাক্ত করল–নেড ক্রিস্টি ওই কবচ নিয়েছিল বুড়োর কাছ থেকে। এই তল্লাটে ওই ধরনের কবচ বুড়ো ছাড়া আর কেউ তৈরি করতে পারে না, তাই ওর কথা নিশ্চয়ই বিশ্বাসযোগ্য। বুড়ো আমাকে বলেছিল যে যতগুলো কবচ সে তৈরি করেছিল সবগুলোতেই সে খোদাই করেছিল একটি একটি সাপের ছবি কিন্তু ক্রিস্টির কবচে সে এঁকে দিয়েছিল দু-দুটো সাপ। আমরা যে কবচটা কুড়িয়ে পেয়েছি তাতেও দুটি সাপের ছবি খোদাই করে আঁকা হয়েছে!

জনতার ভিতর থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন? চলো–ওই শয়তান নেড ক্রিস্টিকে ধরে তার গলায় একটা দড়ি লাগিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া যাক।

সমবেত জনমণ্ডলী বক্তার প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে গর্জে উঠল, ঠিক! ঠিক! নেড ক্রিস্টিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেব! চলো, দেখি কোথায় লুকিয়ে আছে সেই শয়তান।

ব্রুনার কঠোর স্বরে বললে, না। আইন তোমরা নিজেদের হাতে নিতে পারো না। আমরা সরকারের প্রতিনিধি, যা করা কর্তব্য আমরা তাই করব। নেড ক্রিস্টির আস্তানা কোথায় তোমরা জানো?

একাধিক কণ্ঠে উত্তর এল, জানি। র‍্যাবিট ট্র্যাপ।

সেটা আবার কোথায়?

মাইক নামে যে ছোকরা চাকরটি সেলুনের ভিতর ম্যাপলের কীর্তি প্রত্যক্ষ করেছিল সে এগিয়ে এসে জানাল যে র‍্যাবিট ট্র্যাপ জায়গাটা সে চেনে এবং ব্রুনার যদি অনুমতি দেয় তবে সে তার সঙ্গে গিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিতে পারে।

ছেলেটিকে নিজের ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পুলিশ দলের সঙ্গে ব্রুনার ছুটল র‍্যাবিট ট্র্যাপ-এর দিকে।

ঘন জঙ্গল আর কাঁটা ঝোপের ভিতর দিয়ে যথাস্থানে এসে পৌঁছে গেল ব্রুনার এবং তার দল। একটা ছোটো পাহাড়ের ওপর চারদিকে ছড়িয়ে আছে ঘন ঝোপঝাড় এবং তারই মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি কাষ্ঠনির্মিত ঘর বা কেবিন–ওই হচ্ছে নেড ক্রিস্টির আস্তানা।

ব্রুনারের দল ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে গর্জে উঠল একটা রাইফেল। পুলিশ বাহিনীর একজন লোক আহত হয়ে ছিটকে পড়ল মাটির ওপর। অন্যান্য পুলিশরা চটপট ভূমিশয্যায় লম্বমান হয়ে আত্মরক্ষা করলে, কেউ কেউ আশ্রয় নিলে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ছোটো-বড়ো পাথরের আড়ালে।

ঘরের ভিতর থেকে দু-দুটো রাইফেল সগর্জনে অগ্নিবৃষ্টি করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রুনারের দলের আরও দুজন লোক আহত হল। ব্রুনার বুঝল, ওই ঘরটি হচ্ছে দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো শক্ত কাঠের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে নেড এবং তার সঙ্গী (খুব সম্ভব আর্চি উলফ) পুলিশদলের নিক্ষিপ্ত বুলেট থেকে সহজেই আত্মরক্ষা করতে পারবে, কিন্তু ফাঁকা জায়গার ওপর দিয়ে গুন্ডাদের রাইফেলের সামনে এগিয়ে যাওয়া পুলিশদের পক্ষে অসম্ভব।

সে দলের মধ্যে দুজনকে ডেকে বললে, এখনই শহর থেকে জনদশেক বন্দুকবাজ মানুষ নিয়ে এসো। তারাই হবে আজ সরকারের অস্থায়ী প্রতিনিধি। এই কয়জন পুলিশ নিয়ে গুন্ডা দুটোকে শায়েস্তা করা যাবে না।

ব্রুনারের দুই সহকারী তাহলাকুই শহরের দিকে তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলে। বিকাল বেলার দিকে তাদের সঙ্গে এল দশজন রাইফেলধারী নাগরিক–তাহলাকুই শহরের দশটি লড়িয়ে মানুষ।

পুলিশ ও নাগরিকদের মিলিত বাহিনী এইবার একযোগে গুন্ডাদের আক্রমণ করলে। তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলে কাঠের ঘরটার ওপর তারা গুলি চালাতে শুরু করলে এবং গুলিবর্ষণের ফাঁকে ফাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

অসম্ভব। গুন্ডাদের নিশানা অব্যর্থ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের কয়েকজন গুলি খেয়ে ধরাশয্যায় লম্বমান হল। কাঠের ঘরটা যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী–জানালার ফাঁক দিয়ে উড়ন্ত মৃত্যুদূতের মতো ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি কার সাধ্য সেদিকে যায়?

নাঃ, এভাবে হবে না। ব্রুনার হতাশ হয়ে পড়ল।

টলবার্ট নামক একজন নাগরিক এইবার সামনে এগিয়ে এল, ব্রুনার! ওই কাঠের ঘরটাকে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

ব্রুনার বললে, কিন্তু এত দূর থেকে ঘরের ওপর ডিনামাইট ছুঁড়ে মারা সম্ভব নয়। ডিনামাইট ছুঁড়তে হলে ঘরের কাছাকাছি যেতে হবে আর ঘরের কাছে এগিয়ে গেলেই আমরা গুন্ডা দুটোর রাইফেলের সামনে পড়ব। গুলি যদি ডিনামাইটের ওপর লাগে তাহলে আর দেখতে হবে না–আমাদের পুরো দলটাই দড়াম করে উড়ে যাবে স্বর্গের দিকে! আত্মহত্যা করার অনেক ভালো ভালো উপায় আছে টলবার্ট, ডিনামাইটের মুখে প্রাণ দিতে আমি রাজি নই।

টলবার্ট বললে, আমি আর কোপল্যন্ড একটা পরিকল্পনা করেছি। আমার মনে হয় গুন্ডাদের আমরা কাবু করতে পারব।

সারারাত ধরে সবাই মিলে ঘরটাকে পাহারা দিলে কিন্তু ঘরের সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কেউ করলে না। অনর্থক প্রাণ বিপন্ন করার পক্ষপাতী নয় ব্রুনার; টলবার্ট এবং কোপল্যন্ডের উপর ভরসা করে সে রাতটা নিষ্ক্রিয়ভাবে হাত গুটিয়ে বসে রইল–দেখা যাক ওদের পরিকল্পনা কতদূর ফলপ্রসূ হয়।

পরদিন সকালে পরিকল্পনার চেহারা দেখে দলসুদ্ধ মানুষের চক্ষুস্থির! একটা ঘোড়ায়-টানা গাড়ি থেকে ঘোড়া খুলে নিয়ে গাদা গাদা কাঠের টুকরো সাজাল টলবার্ট আর কোপল্যন্ড, তারপর দুই স্যাঙাতে মিলে সেই কাঠবোঝাই গাড়িটাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল গুন্ডাদের আস্তানার দিকে।

এককুড়ি ডিনামাইটের স্টিক! ঘরের ভিতর থেকে বৃষ্টির মতো ছুটে এল গুলির পর গুলি একটা গুলি যদি কোনোরকমে ডিনামাইটের ওপর পড়ে তাহলে গাড়িসুদ্ধ মানুষ দুটো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে! দলসুদ্ধ লোকের বুক কাঁপতে লাগল, কিন্তু দুই বন্ধু সম্পূর্ণ নির্বিকার তারা গাড়ি ঠেলছে তো ঠেলছেই।

ফটফট করে উড়ে যেতে লাগল কাঠের টুকরোগুলো গুলির আঘাতে, গাড়ির একটা চাকা থেকে দুটো কাঠের ডান্ডা উড়িয়ে নিলে রাইফেলের বুলেট, কোপল্যন্ডের মাথায় আঁচড় বসিয়ে একটা গুলি তার সমস্ত মুখ রক্তে ভাসিয়ে দিলে, আর একটা গুলি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল টলবার্টের টুপি–তবু তারা নির্বিকারভাবে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলল!

দুই বন্ধু যেন আত্মহত্যার সংকল্প নিয়েছে।

আচম্বিতে পাহাড়ের বুক কাঁপিয়ে জেগে উঠল এক ভয়াবহ শব্দের তরঙ্গ, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ফলে কেঁপে উঠল মাটি ধোঁয়া আর ধুলোর ঝড়ে চারদিক আচ্ছন্ন করে পুলিশদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগল বড়ো বড়ো কাঠের টুকরো!

ধোঁয়া কেটে গেলে সবাই দেখল, কাঠের ঘরটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়েছে। একটু দূরেই গাড়ির আড়ালে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে টলবার্ট আর কোপল্যন্ড এবং ভাঙা ঘরের ভগ্নস্তূপের ভিতর রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে নেড ক্রিস্টি!

একটা রাইফেল সগর্জনে অগ্নি-উদগার করলে।

নেড ক্রিস্টির প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর।

ব্রুনার এসে দাঁড়াল কোপল্যন্ড আর টলবার্টের সামনে। গুলির আঘাতে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে কোপল্যন্ড। টলবার্টও আহত হয়েছে, কিন্তু সে জ্ঞান হারায়নি। মুখ তুলে দুর্বলভাবে সে একবার হাসল, তারপর ব্রুনারকে উদ্দেশ করে বললে–

আমার মাথায় একটা গুলি আঁচড় কেটে চলে গেছে। খুব রক্তপাত হচ্ছে বটে, কিন্তু আমি বিশেষ ভয় পাইনি। তবে ডিনামাইট যখন ফাটছিল তখন সত্যি ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি উড়ে গেলাম।

সমস্ত ঘটনাটা পরে জানা গেল। সব কিছু এত দ্রুত ঘটেছিল যে প্রত্যক্ষদর্শীরাও প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। টলবার্ট আর কোপল্যন্ড গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে গুন্ডাদের আস্তানার পনেরো গজের মধ্যে এসে পড়েছিল এবং সেইখান থেকেই ঘরের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিল ডিনামাইট স্টিকগুলো। বিস্ফোরণের আগে বুকে হেঁটে খানিকটা পিছিয়ে আসতে পেরেছিল বলেই তারা বেঁচে গেছে–কী অসীম সাহস!

হত ও আহত মানুষগুলোকে নিয়ে ব্রুনার শহরে ফিরে এল।

নেড ক্রিস্টি মারা পড়েছিল, কিন্তু আর্চি উলফকে ওখানে পাওয়া যায়নি। খুব সম্ভব কোনো গোপন পথে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে সে সরে পড়েছিল।

তাহলাকুই শহরে আর কখনো গুন্ডার উপদ্রব হয়নি। পুলিশ ও জনতার সম্মিলিত আক্রমণের মুখে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সমাজবিরোধী গুন্ডার দল।

ভদ্রলোকের বাসযোগ্য হয়ে উঠল তাহলাকুই শহর।

জনতার প্রতিনিধিকে যারা হত্যা করেছিল, ক্ষিপ্ত জনতা তাদের ক্ষমা করেনি।

[পৌষ ১৩৭৬]

জেহাদ

বহুদিন আগেকার কথা। ব্রিটিশশাসিত দক্ষিণ ভারতে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত তালাইনভু নামে গ্রামটির নিকটবর্তী অরণ্যে কয়েকটি গ্রামবাসীর অকারণ নিষ্ঠুর আচরণের ফলে সমগ্র বনাঞ্চলে ভয়াবহ সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়েছিল এবং স্বজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে প্রাণ হারিয়েছিল কয়েকটি নিরাপরাধ মানুষ

সেই অদ্ভুত এবং ভয়ংকর ঘটনার বিবরণ এখানে পরিবেশিত হল :

উক্ত তালাইনভু গ্রামের ছয়-সাতজন লোক কাবেরী নদীর তীরে বাঁশবন থেকে বাঁশ কাটতে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা বাঁশঝাড়ের নীচে তারা তিনটি প্যান্থারের বাচ্চা দেখতে পায়। বাচ্চাগুলো তাদের কোনো ক্ষতি করেনি, সেখান থেকে সরে এলেই আর কোনো ঝামেলা হত না। কিন্তু লোকগুলোর নিতান্ত দুর্মতি, তাদের মধ্যে একজন হাতের ধারালো কাটারি দিয়ে একটা বাচ্চার গায়ে কোপ বসিয়ে দিল। বাচ্চাটা প্রায় দু খানা হয়ে রক্তাক্ত শরীরে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ল। হত্যাকারীর দৃষ্টান্ত দেখে তার সঙ্গীরা মহা উৎসাহে অন্য বাচ্চা দুটিকে আক্রমণ করল। কাটারির আঘাতে আঘাতে দুটি শ্বাপদ শিশুই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে।

আচম্বিতে বনের মধ্যে জাগল ক্রুদ্ধ হুংকার ধ্বনি–পরক্ষণেই হলুদের উপর কালো কালো ছোপ বসানো একটা অতিকায় বিড়ালের মত জানোয়ার ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকগুলোর মধ্যে

মা-প্যান্থার!

মানুষ সম্পর্কে বন্য পশুর একটা স্বাভাবিক ভীতি আছে। তাই সকলের অলক্ষ্যে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মা-প্যান্থার লোকগুলোকে লক্ষ করছিল, কাছে আসতে সাহস পায়নি। কিন্তু চোখের ওপর তার বাচ্চাদের হত্যাকাণ্ড দেখে দারুণ ক্রোধে তার মন থেকে ভয়ের অনুভূতি লুপ্ত হয়ে গেল, সে ঝাঁপিয়ে পড়ল হন্তারকদের ওপর।

প্রথম ব্যক্তি ব্যাপারটা কী হল বুঝতেই পারল না, কারণ মা-প্যান্থারের থাবার আঘাতে তার দুটো চোখই অন্ধ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে! লোকটি ছিটকে পড়ল মাটিতে। সঙ্গেসঙ্গে তার ধরাশায়ী দেহ টপকে একলাফে আরেকটি লোকের বুকের উপর কামড় বসাল ক্ষিপ্তা জননী।

প্রথম ব্যক্তির মতো দ্বিতীয় ব্যক্তিও সশব্দে ধরাশায়ী হয়ে আর্তনাদ করতে লাগল।

আহত লোক দুটির সঙ্গীরা বাচ্চা তিনটির ওপর কাটারির ধার পরখ করতে ইতস্তত করেনি, কিন্তু অস্ত্র হাতে মা-প্যান্থারের নখদন্তের সম্মুখীন হওয়ার সাহস তাদের ছিল না–দারুণ আতঙ্কে আর্তনাদ করতে করতে তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পালাতে লাগল তিরবেগে।

মা-প্যান্থার পলাতকদের অনুসরণ করল না, আহত অবস্থায় যে দুটি লোক মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল, তাদের ওপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নখে দাঁতে তাদের ছিঁড়ে ফেলল টুকরো টুকরো করে।

তারপর বাচ্চা তিনটির মধ্যে যে-জন্তুটার দেহে কম ক্ষত ছিল সেটাকে মুখে তুলে নিয়ে গভীর বনের ভিতর অদৃশ্য হল।

বাঁশ কাটতে যারা গিয়েছিল, তারা গ্রামে গিয়ে বলল একটা প্রকাণ্ড প্যাস্থার সম্পূর্ণ বিনা কারণে তাদের আক্রমণ করে দুটি মানুষকে হত্যা করেছে। তারা যে বাচ্চাগুলোকে খুন করে মা-প্যান্থারকে উত্তেজিত করেছিল, এ-কথা তারা বেমালুম চেপে গেল। পরে অবশ্য আসল ব্যাপারটা জানাজানি হয়েছিল।

কিছুদিন খুব গোলমাল হল। যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেই জায়গাটা এড়িয়ে চলল স্থানীয় মানুষ। নিতান্তই ওই জায়গা দিয়ে যাতায়াত করার দরকার হলে সেখানকার মানুষ দলে ভারী হয়ে অস্ত্র নিয়ে পথ চলত।

কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেল। মা-প্যান্থারকে কেউ আর দেখতে পায়নি। লোকে তার কথা ভুলে গেল।কিন্তু শ্বাপদ জননী তার শাবকদের অপমৃত্যুর কথা ভোলেনি, সে তখন বিদ্বেষ পোষণ করছে। সমগ্র মনুষ্যজাতির ওপর। কিছুদিন পরেই আবার প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ পেল সে।

পূর্বে উল্লিখিত গ্রামটির নিকটবর্তী অরণ্যে এক কুখ্যাত চোর বনরক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে বন থেকে চন্দন কাঠ চুরি করত। অনেক চেষ্টা করেও বন বিভাগের লোকজন এবং পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

এই চোরটি তার ছেলেকে নিয়ে এক চাঁদনি রাতে জঙ্গলে প্রবেশ করল। কিছু চন্দন কাঠ কেটে নিয়ে ডিঙিতে তুলে নদীর উত্তরদিকের তীরে উঠতে পারলে আর মাদ্রাজের কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রেপ্তার করতে পারবে না–নদীর ওই দিকটা ছিল মহীশূরাজ্যের অন্তর্গত এবং সেই উদ্দেশ্যেই তারা প্রবেশ করেছিল বনের মধ্যে।

দিনের বেলা এসে একসময় তারা পছন্দমতো গাছগুলো দেখে গিয়েছিল, এখন নির্ধারিত স্থানে এসে তারা কুড়াল দিয়ে গাছ কাটতে শুরু করল। শাবকহারা মা-প্যান্থার ওই শব্দে আকৃষ্ট হয়েছিল সন্দেহ নেই। নিঃশব্দে সে হানা দিল। নরমাংসের লোভ তার ছিল না, নরহত্যাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।

বাপ বুঝতেই পারেনি ব্যাপারটা কী ঘটল, একবার আর্তনাদ করার সময়ও সে পায়নি। আচম্বিতে পিঠের ওপর একটা গুরুভার দেহের সংঘাতে সে হল ভূমিপৃষ্ঠে লম্ববান, পরক্ষণেই কণ্ঠনালীতে তীক্ষ্ণ দন্তের সাংঘাতিক নিষ্পেষণ। আঠারো বছরের ছেলে তার বাপকে বাঁচানোর চাইতে নিজের প্রাণ বাঁচাতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ল, হাতের কুড়াল ফেলে সে পলায়ন করল দ্রুতবেগে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হতভাগ্য চোর প্রাণত্যাগ করল প্যান্থারের কবলে। ছেলেটি অবশ্য শ্বাপদকে ফাঁকি দিতে পারল, তিরবেগে ছুটে গিয়ে সে নদীর ধারে রক্ষিত ডিঙির ওপর লাফিয়ে উঠল এবং প্রাণপণে দাঁড় বেয়ে নদী পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে প্রবেশ করল তার কুঁড়েঘরে। চোরের বউ স্বামীর ভয়াবহ মৃত্যুসংবাদ পেল ছেলের মুখ থেকে।

গ্রামবাসীরা অনেক আগেই শয্যাগ্রহণ করেছিল। মা আর ছেলের আর্তক্ৰন্দন শুনে তাদের ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বালিয়ে তারা চোরের কুটিরে এল, তারপর তার ছেলের মুখ থেকে সমস্ত ঘটনার বিবরণ শুনল। কিন্তু সেই রাতে কেউ কিছু করতে রাজি হল না। সকলেই জানত বাপ-ছেলে দুজনেই চোর চোরের মৃতদেহ উদ্ধার করার জন্য রাতের অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদের সম্মুখীন হওয়ার ইচ্ছা তাদের ছিল না।

পরের দিন বেশ বেলা হলে গ্রামবাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছেলেটির সঙ্গে রওনা হল এবং অকুস্থলে গিয়ে চোরের মৃতদেহ দেখতে পেল। লোকটির গলা থেকে পেট পর্যন্ত চিরে ফেলা হয়েছে, সমস্ত শরীর নখদন্তে ছিন্নভিন্ন, জায়গাটা রক্তে ভাসছে। কিন্তু প্যান্থার মৃতদেহের মাংস ভক্ষণ করেনি, হত্যাকাণ্ড সমাধা করে সে চলে গেছে।

আবার কয়েকদিন খুব শোরগোল চলল। লোকজন দল বেঁধে অস্ত্র নিয়ে পথ চলতে শুরু করল। কিন্তু বেশ কিছুদিনের মধ্যেও কোনো হত্যাকাণ্ড যখন অনুষ্ঠিত হল না, তখন স্থানীয় মানুষ আবার স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা শুরু করল। ধীরে ধীরে প্যান্থারের কথা লোকে ভুলে গেল।

কয়েকটা সপ্তাহ কাটল। আবার এল শুক্লপক্ষ। জ্যোৎস্না রাতেই জঙ্গলের মধ্যে দুবৃত্তরা যাবতীয় দুষ্কর্মে প্রবৃত্ত হয়। ওই সময়ে যেখানে হরিণরা নুন চাটতে অথবা জলপান করতে আসে, সেইসব জায়গায় ওত পেতে বসে চোরাই শিকারির দল (poachers) এবং কাঠ চোরের দল। কাঠ চোর চাঁদনি রাতে চন্দন, মাথি, বাঁশ প্রভৃতি কেটে নদীপথে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অথবা গোরুর গাড়িতে বোঝাই করে চোরাই মাল নিয়ে চম্পট দেয়।

এ ছাড়া আছে আর এক ধরনের চোর। তারা চুরি করে মাছ। এরা বঁড়শি বা জাল দিয়ে মাছ ধরে না। ঘরে তৈরি হাতবোমা জলে ফাটিয়ে মাছ ধরে। বিস্ফোরণের ফলে ছোটোবড়ো অসংখ্য মাছ মরে অথবা অজ্ঞান হয়ে জলের উপর ভেসে ওঠে। বাঁশের ডগায় বসানো জলের সাহায্যে বড়ো বড়ো মাছগুলি ধরে চোরের জল নৌকা বোঝাই করে। ছোটো ছোটো মরা মাছগুলো ভেসে যায়, পরে বড়ো মাছ আর কুমিরের খাদ্যে পরিণত হয়।

এই মাছ চুরির জন্য দুটি ডিঙি নৌকা ব্যবহার করা হয়। একটি ডিঙি থেকে বোমা ছোঁড়া হয়, আর একটি শুধু মাছ বোঝাই করার জন্য থাকে। মাছের ভারে ডিঙি যতক্ষণ ডুবে যাওয়ার উপক্রম না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত চোররা মাছ ধরে যায়। জোয়ালের জলে মাইল পাঁচেক ডিঙি ভাসিয়ে একসময়ে তারা ডিঙি থামায়, তারপর মাছগুলোকে থলিতে ভরে রাখে। প্রত্যেক চোর একটা করে থলি বহন করে। ডিঙি দুটোকে উলটো করে ফেলে এক-একটা ডিঙি দুজন করে মানুষ মাথায় তুলে হাঁটতে থাকে সেইদিকে, যেখান থেকে তারা প্রথম ডিঙি ভাসিয়েছিল।

নদীতে জোয়ারের জল ঠেলে ওই গোলাকার চামড়ায় ঢাকা ডিঙি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই এই পরিশ্রম। হালকা দাঁড়গুলো অবশ্য সমস্যা নয়। হাতে হাতে সেগুলো সবাই নিয়ে যায়। অমাপক্ষ হলে চোররা বিশ্রাম নেয়। আবার শুক্লপক্ষের আবির্ভাবে তাদের কাজকর্ম শুরু।

সেই রাতটাও ছিল শুক্লপক্ষের চাঁদনি রাত। একদল চোর চুরি করতে বেরিয়েছিল। ক্রমাগত বোমা মেরে মাছ তুলে তারা ডিঙি বোঝাই করছিল। মাছ বোঝাই করার ডিঙিতে ছিল মাত্র একটি লোক। কারণ, লোক কম হলে সংখ্যায় বেশি মাছ রাখা যায়। প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত মাছ ধরার পর যে ডিঙি থেকে বোমা ছোঁড়া হচ্ছিল, সেই ডিঙির লোকরা হাঁক দিয়ে মাছ-বোঝাই ডিঙির মালিককে বলল, অনেক হয়েছে, এবার ডাঙায় ভেড়াও। কিছু খাওয়া দরকার।

মাছ-বোঝাই ডিঙির নিঃসঙ্গ লোকটি খুশি হল, সে সতর্কভাবে খরস্রোতা নদী বেয়ে ধীরে ধীরে ডিঙিটাকে পাড়ে নিয়ে এল। ডিঙির তলায় বাঁশের সঙ্গে যে-দড়ি বাঁধা থাকে, সেইটা নিয়ে লোকটা একলাফে পাড়ে উঠল। একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে দড়িটাকে বেঁধে ডিঙিটাকে সে দাঁড় করাতে চেয়েছিল। কিন্তু তার সেই উদ্দেশ্য সফল হল না। দুই নম্বর ডিঙি থেকে তার বন্ধুরা দেখল একটা দীর্ঘ ধূসর বস্তু নদীর তীরবর্তী ঝোপ থেকে লাফিয়ে পড়ল। তাদের কানে এল একটা চাপা গর্জন, পরক্ষণেই তারা দেখল তাদের সঙ্গীটি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে এবং তার দেহের উপর রয়েছে সেই ধূসর বস্তু!

একটা কান-ফাটানো আর্ত চিৎকার–সঙ্গেসঙ্গে চোরের দল দেখল মাছভরতি ডিঙিটা খরস্রোতা নদীর জলে ছুটে চলেছে এবং তাদের সঙ্গীর হাত থেকে খসে পড়ে মোটা দড়িটাও ছুটছে ডিঙির সঙ্গে!

বোমা ছোঁড়ার ভূমিকায় যে-ডিঙিটা ছিল, সেই ডিঙির মাঝি প্রাণপণে দাঁড় চালিয়ে মাছভরতি ভেসে-যাওয়া ডিঙিটাকে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু তার ডিঙিতে অনেক লোক ছিল বলে সেটা ছিল বেজায় ভারী, তাই মাঝির চেষ্টা সফল হল না। ভেসে-যাওয়া ডিঙিটা মাঝনদীতে ছিটকে এসে কয়েকটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে উলটে গেল। সঙ্গেসঙ্গে এত কষ্টে ধরা মাছগুলো অদৃশ্য হল নদীগর্ভে। নিতান্ত দুঃখের সঙ্গে সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখল চোরের দল, তারপর তারা তীরের দিকে তাদের ডিঙিটাকে ফেরাল। যে হাঁদা লোকটা হাতের দড়ি ধরে রাখতে পারে না, তাকে এবার আচ্ছা করে ঠেঙানি দিতে হবে এই হল তাদের মনোগত বাসনা। মাছ তো গেলই, ডিঙিটাও গেল ওই ধরনের একটা ডিঙি জোগাড় করতে তাদের অন্তত এক-শো টাকা খরচ হবে, তা ছাড়া মাছের দাম তো আছেই। নির্বোধ সঙ্গীকে বেশ ভালোরকম প্রহার করার সংকল্প নিয়েই তীরে এসে তরী ভেড়াল চোরের দল।

কিন্তু নদীতীরে লোকটার কোনো চিহ্ন নেই তো! তখন হঠাৎ সেই দীর্ঘ ধূসর বর্ণ বস্তুটির কথা তাদের মনে পড়ল। হ্যাঁ, একটা গর্জনও শোনা গিয়েছিল বটে! লোকটাও যেন হঠাৎ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছে!

যে-ব্যক্তি ডিঙি চালাচ্ছিল, সে নদীর পাড়ে উঠে নিরুদ্দেশ সঙ্গীর খোঁজ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু সবাই তাকে নিষেধ করল। প্রথমে তারা ভেবেছিল তাদের সঙ্গী কোনো প্রেতাত্মার কবলে পড়েছে। একটু পরেই হঠাৎ তাদের মনে পড়ল প্যান্থারটির কথা। কিছুক্ষণ আলোচনা করে তারা স্থির করল ওই জন্তুটাই তাদের সঙ্গীকে আক্রমণ করেছিল। এতক্ষণে জন্তুটা নিশ্চয়ই লোকটাকে মেরে ফেলেছে এবং অন্ধকার নিরালা জায়গায় বসে শিকারের মাংস ভক্ষণ করছে। এই সিদ্ধান্তে আসতেই তারা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেইদিকে অর্থাৎ স্রোতের বিপরীত দিকে ডিঙি বাইতে শুরু করল। কিন্তু প্রায় আধমাইল যাওয়ার পর আর ওইভাবে ডিঙি চালানো সম্ভব হল না। তখন চোরের দল ডিঙিটাকে পাড়ের ওপর তুলে রেখে যথাসম্ভব দ্রুত পদচালনা করল গ্রামের উদ্দেশ্যে। পথ চলার সময় তারা চিৎকার করে কথা বলছিল, যাতে প্যান্থারটা ভয় পেয়ে তাদের সামনে না-আসে।

পরের দিন সূর্য যখন মাথার উপর আগুন ছড়াচ্ছে, সেই সময় সমগ্র গ্রামের লোক দল বেঁধে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিরুদ্দেশ ব্যক্তির সন্ধানে যাত্রা করল। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না, তাকে পাওয়া গেল নদীর ধারে একটা ঝোপের কাছে। জীবিত নয় মৃত–ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত। অন্যান্য বারের মতো এবারও দেখা গেল প্যান্থার মানুষটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে বটে, কিন্তু তার মাংস খায়নি।

এরপর শুরু হল হত্যার তাণ্ডবলীলা। আরও কয়েকটি মানুষ প্রাণ দিল প্যান্থারের কবলে। প্যান্থার শুধু হত্যা করে, মাংস খায় না। প্রত্যেকটি মৃতদেহকে জন্তুটা এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত করে ফেলে যে, লোকগুলোকে চিনতে পারাই কষ্টকর হয়ে ওঠে। মনে হয় দারুণ আক্রোশে জন্তুটা ক্রমাগত আঘাত করে গেছে, হত্যার পরেও মানুষগুলোর ওপর তার রাগ যায়নি।

এই সময়ে নিতান্তই ঘটনাচক্রে একটি জিপগাড়ি চড়ে অকুস্থলে এসে পড়লেন বিখ্যাত শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারসন। প্যান্থারের উপদ্রবের বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না, তিনি এসেছিলেন মাছ ধরতে। সঙ্গে ছিল তার ছেলে ডোনাল্ড ওরফে ডন, ডনের বন্ধু মারওয়ান, সেডন টাইনি নামে এক ওস্তাদ মাছ-শিকারি এবং থাংগুভেলু নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি–যে একাধারে শিকার, গাড়ি পরিষ্কার, রন্ধন, পরিবেশন প্রভৃতি সর্ব বিষয়ে সর্ব বিদ্যা বিশারদ।

বাঙ্গালোরে অবস্থিত অ্যান্ডারসন সাহেবের বাড়ি থেকে পাক্কা নিরানব্বই মাইল দূরে কাবেরী নদীর ধারে যেখানে তাদের আস্তানা ফেলা হল, সেই জায়গাটা তালাইনভু গ্রাম থেকে দশ মাইল দূরে। ওইখানেই মাছ ধরা হবে বলে স্থির হল।

রাতের খাওয়া শেষ করে সকলে বনের মধ্যে একটা জায়গা পরিষ্কার করে শুয়ে পড়ল।

ওই অঞ্চলে যে একটি নরঘাতক প্যান্থারের আবির্ভাব হয়েছে সে-কথা আগন্তুকরা জানতেন না, অতএব কারো মনে দুশ্চিন্তা ছিল না। তবে একটা বিপদের সম্ভাবনা ছিল–হাতি। তাই সারা রাত অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে রাখার ব্যবস্থা হল। কিছুক্ষণ গল্প করার পর সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল…

হঠাৎ অ্যান্ডারসন সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘড়ি দেখলেন। তিনটে বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে। আগুন প্রায় নিবে এসেছে, অন্ধকার ভেদ করে জ্বলছে কয়েক টুকরো জ্বলন্ত কাঠ। আগুনটাকে সারারাত জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব যার ছিল, সেই থাংগুভেলু গভীর নিদ্রায় মগ্ন। সাহেবের বাঁ-দিকে তার ছেলে ডোনাল্ড নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। ডান দিকে মারওয়ান আর টাইনি রাতের শিশির এবং মশার আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য মাথা-মুখ চাদর ঢাকা দিয়ে ঘুমাচ্ছে।

অ্যান্ডারসন ভাবতে লাগলেন হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল কেন? জঙ্গলের ভিতর থেকে কোনো সন্দেহজনক শব্দ ভেসে আসছে কি… কিন্তু ছেলে ডোনাল্ডের প্রচণ্ড নাসিকাগৰ্জন ছাড়া আর কিছুই তিনি শুনতে পেলেন না…

হঠাৎ তিনি জানতে পারলেন তার ঘুম ভাঙার কারণ। খুব কাছেই জেগে উঠল করাত চালানোর মতো খসখসে শ্বাপদ কণ্ঠের আওয়াজ হা-আঃ! হা-আঃ! হা-আঃ! ক্ষুধিত প্যান্থারের কণ্ঠস্বর!

সাহেব বুঝলেন নিদ্রিত অবস্থায় তার মগ্নচৈতন্য ওই শব্দে সাড়া দিয়েছে, আর সেইজন্যই তাঁর ঘুম ভেঙে গেছে।

অ্যান্ডারসন ভয় পেলেন না। শিকারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন প্যান্থার মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক নয়। প্যান্থার মানুষের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলে। অবশ্য আহত হলে বা কোনো কারণবশত নরমাংসের প্রতি আকৃষ্ট হলে ভয়ের কথা বটে। তবে নরখাদক প্যান্থার অতিশয় বিরল। মা-প্যান্থারের কাহিনি তখন পর্যন্ত জানতেন না, তাই প্যান্থারের আক্রমণের সম্ভাবনা তাকে উদবিগ্ন করেনি।

আবার জাগল শ্বাপদ কণ্ঠে অবরুদ্ধ গর্জন ধ্বনি। সাহেব শব্দ লক্ষ করে টর্চের আলো ফেললেন। জন্তুটাকে এবার স্পষ্ট দেখা গেল। নিদ্রিত থাংগুভেলুর থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে মাটির ওপর গুঁড়ি মেরে বসে রয়েছে শ্বাপদ। বসার ভঙ্গি দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় সে থাংগুভেলুর উপর লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করছে।

সাহেব রাইফেলের দিকে হাত বাড়ালেন। অস্ত্রটাতে গুলি ভরে পাশেই রেখে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রাইফেল বাগিয়ে ধরার আগেই হঠাৎ থাংগুভেলু ঘুমের ঘোরে উঠে বসল। তার পায়ের কাছে ছিল জলভরা ডেকচি, পায়ের ধাক্কা লেগে পাত্রটা সশব্দে নড়ে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে জন্তুটা একলাফে অদৃশ্য হল অন্ধকার অরণ্যের গর্ভে। থাংগুভেলু অবশ্য ততক্ষণে আবার শুয়ে পড়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।

অ্যান্ডারসন এইবার হইহই করে সকলকে ডেকে তুললেন এবং প্যান্থারের উপস্থিতির কথা বললেন। কেউ তার কথা বিশ্বাস করতে চাইল না। প্রত্যেকেরই বিশ্বাস তিনি ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন।

অ্যান্ডারসনকে একটু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে সকলেই আবার নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মন দিল। সাহেবের আর ঘুম এল না। বাকি রাতটা তিনি রাইফেল হাতে জেগে রইলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস একটা মানুষখেকো প্যান্থারকেই তিনি দেখেছেন–জন্তুটা থাংগুভেলুকে আক্রমণের উদ্যোগ করছিল।

পরের দিন মাছ ধরার পালা। টাইনি কয়েকটা মাছ ধরল। অ্যান্ডারসন আর তার ছেলে ডোনাল্ড ওরফে ডন অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাদের ছিপে একটিও মাছ উঠল না। মারওয়ান বলল সে স্নান করতে যাচ্ছে। স্নানের ফলে যাতে মাছ ধরার বিঘ্ন না হয়, সেইজন্য যেখানে মাছ ধরা হচ্ছিল তার থেকে একটু দূরে, নদীস্রোত যেদিক থেকে আসছে, সেইদিকে চলল মারওয়ান কাঁধে একটি তোয়ালে নিয়ে।

অন্য কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, গতরাত্রে প্যান্থারের উপস্থিতি সম্পর্কে অ্যান্ডারসন সাহেবের কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না এবং সেটা যে নরখাদক এ-বিষয়েও তিনি ছিলেন নিশ্চিত, অতএব তিনি মারওয়ানকে ডেকে বললেন, দাঁড়াও, আমিও আসছি।

হাতে রাইফেল আর কাঁধে রাইফেল নিয়ে মারওয়ানকে অনুসরণ করলেন কেনেথ অ্যান্ডারসন।

সেদিন বিকালের দিকে নদীর জলে বোমা ফাটার আওয়াজ শুনে অ্যান্ডারসন সাহেব ও তার দলবল শব্দ লক্ষ করে ছুটলেন। নদীর বাঁক ঘুরতেই মাছ চোরদের দুটি ডিঙি তারা দেখতে পেলেন। একটা ডিঙিতৈ মাছ বোঝাই, আর একটাতে কয়েকজন লোক অর্থাৎ চোরের দল। সাহেবদের দেখে চোররা ঘাবড়ে গেল, তাড়াতাড়ি দাঁড় বেয়ে তারা চম্পট দেওয়ার উপক্রম করল। কিন্তু অ্যান্ডারসনের সঙ্গীরা তাদের পালাতে দিল না, বন্দুক উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে তাদের তীরে ডিঙি ভেড়াতে বাধ্য করা হল। তারপর শুরু হল বাগযুদ্ধ। সাহেবের ছেলে ডন তাদের চৌর্যবৃত্তির জন্য তিরস্কার করল। চোরদের বক্তব্য হচ্ছে, মাছগুলো যখন কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, তখন মাছ ধরায় দোষ কী? সাহেবরাই-বা তাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন কোন অধিকারে? তারা কি সরকারের লোক? থাংগুভেলু এইসব আইনঘটিত প্রসঙ্গে যোগ দিল না, তার বক্তব্য হচ্ছে সবচেয়ে ভালো মাছ দুটি তাদের দিয়ে চোররা যেখানে খুশি যাক, তাদের গন্তব্য বিষয় নিয়ে শিকারিদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

অ্যান্ডারসন এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার বললেন, আচ্ছা, তোমরা বলতে পারো এই এলাকায় কোনো মানুষখেকো প্যান্থার আছে কি না?

বেশ কিছুক্ষণ সকলে স্তব্ধ। তারপর একজন মৃদুস্বরে বলল, হ্যাঁ, ভোরাই, আছে। জন্তুটা অনেক মানুষ মেরেছে। আমাদের দলেই কালু নামে একটি লোক তার কবলে মারা গেছে। কয়েকদিন আগে। আমরা তাই দিনের বেলায় মাছ ধরছি। আমরা চাঁদনি রাতেই মাছ ধরি। কিন্তু এখন সন্ধ্যার পর কেউ ঘরের বাইরে যেতে সাহস পায় না।

লোকটির কথা শুনে সাহেবের ছেলে ডন দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল, চুলোয় যাক মাছ। আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না। আমাদের কাছে এই প্যান্থার সম্পর্কে সব কিছু খুলে বলো। আমরা শিকারি, জন্তুটাকে গুলি করে মারতে চেষ্টা করব।

লোকগুলো আশ্বস্ত হয়ে তীরে নামল। তারপর তাদের মুখ থেকে সাহেব এবং তার সঙ্গীরা প্যান্থারটির সম্পর্কে সব কিছু শুনলেন। সেসব কথা আগেই সবিস্তারে বলা হয়েছে, তাই এখানে আর পুনরাবৃত্তি করলাম না।

ঘটনার বিবরণ শুনে শিকারিদের সহানুভূতির সঞ্চার হল মা-প্যান্থারের উপর। বন্য শ্বাপদের এমন প্রতিহিংসা গ্রহণের প্রবৃত্তি বড়ো একটা হয় না। ব্যাঘ্র জাতীয় পশুরা অনেক সময় মানুষের অস্ত্রে আহত হলে নরভুক হয়, কিন্তু তার কারণ স্বতন্ত্র। আহত অবস্থায় দ্রুতগামী বলিষ্ঠ বন্য পশুদের হত্যা করতে অসমর্থ হয়ে বাঘ অথবা প্যান্থার মানুষের মতো দুর্বল শিকারের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেখানে প্রতিশোধ গ্রহণের মনোভাব থাকে না, অতি সহজে ক্ষুধা নিবারণের জন্যই তারা নরখাদকে পরিণত হয়।

কিন্তু এই মেয়ে-প্যান্থারটি মানুষকে হত্যা করে, মাংস খায় না। শুধু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই সমগ্র মনুষ্যজাতির বিরুদ্ধে সে জেহাদ ঘোষণা করেছে! এমন ঘটনার কথা বড়ো একটা শোনা যায় না।

যাই হোক, মা-প্যান্থারের প্রতি সহানুভূতি থাকলেও শিকারিরা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। জন্তুটা বেঁচে থাকলে বহু নিরপরাধ মানুষ তার কবলে মারা পড়বে। অতএব মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক ওই পশুকে হত্যা করাই শিকারির কর্তব্য বলে সকলে মনে করলেন।

শিকারিরা বড়ো জানোয়ার মারতে আসেননি, এসেছিলেন মাছ ধরতে। তবে মাছ ধরার সাজসরঞ্জাম ছাড়াও তাদের সঙ্গে দুটি রাইফেল আর দুটি শটগান ছিল। পরামর্শের ফলে স্থির হল টাইনি শটগান নিয়ে নদীর স্রোত অনুসরণ করে নদীতীর ধরে হাঁটবে ঘণ্টা দুই, তারপর ফিরে আসবে শিকারিদের আস্তানায়। মারওয়ান আর একটি শটগান নিয়ে নদীস্রোতের বিপরীত দিকে নদীতীরেই অনুসন্ধান করবে। অ্যান্ডারসন ও তার ছেলে ডন প্যান্থারের সন্ধান করবেন ভিন্ন ভিন্ন দিকে জঙ্গলের মধ্যে, তাদের হাতে থাকবে রাইফেল। থাংগুভেলু একটা গাছে উঠে জিপগাড়ি আর ছড়িয়ে-থাকা সরঞ্জামের উপর নজর রাখবে। স্থির হল, প্রত্যেকেই আস্তানায় ফিরবে বিকাল ৫টার মধ্যে।

ব্যাপারটা অবশ্য খুবই বিপজ্জনক। নদীর ধারে ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থেকে প্যান্থার খুব সহজেই শিকারির গতিবিধি লক্ষ করতে পারবে, কিন্তু শিকারির পক্ষে উদ্ভিদের আবরণ ভেদ করে জন্তুটার অস্তিত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। জন্তুটা নরহত্যা করতে উগ্রীব, প্রথম আক্রমণের সময়েই তাকে গুলি চালিয়ে বোড়ে ফেলতে না-পারলে শিকারি নিজেই শিকারে পরিণত হবে সন্দেহ নেই। দলের প্রত্যেকেই বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে থাকবে, অর্থাৎ নিজেরাই টোপ হয়ে শ্বাপদকে আকৃষ্ট করবে–অতর্কিত আক্রমণের ফলে বিপন্ন সঙ্গীকে সাহায্যের সুযোগ অন্য শিকারিরা পাবে না, তাই প্রত্যেক শিকারিকেই নির্ভর করতে হবে নিজের ক্ষমতার উপর। ভুল হলে মৃত্যু নিশ্চিত।

আগের রাতে একটা শম্বর হরিণের চিৎকার শুনেছিলেন অ্যান্ডারসন সাহেব। হরিণজাতীয় পশু অনেক সময় মাংসাশী শ্বাপদের অস্তিত্ব বুঝতে পারলে চিৎকার করে বনের অন্যান্য বাসিন্দাদের সাবধান করে দেয়। অতএব যেদিক থেকে বিগত রাত্রে শম্বর হরিণের চিৎকার সাহেবের কানে ভেসে এসেছিল, সেইদিকেই তিনি যাত্রা করলেন প্যান্থারের সন্ধানে।

পার্বত্য পথ বেয়ে এগিয়ে চললেন সাহেব। চারদিকে ছড়ানো বড়ো বড়ো পাথর, ঘন ঝোপঝাড়। ওই পাথর বা ঝোপের আড়ালে প্যান্থার লুকিয়ে থাকতে পারে অনায়াসে। কিছুদূর যাওয়ার পর ছেলে ডন এবং তার সঙ্গীদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে পড়লেন অ্যান্ডারসন। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই, তিনি আশা করলেন তারাও তাঁর মতোই সতর্কতা অবলম্বন করবে।

চারদিক নিস্তব্ধ। অসহ্য গরম। পাখিদের কলকণ্ঠ সম্পূর্ণ নীরব। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে অগ্রসর হলেন সাহেব। সামনে বড়ো পাথর বা ঝোপঝাড় দেখলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে কাছে আসছিলেন সাহেব, তবে তিনি জানতেন পিছন থেকেই বিপদের ভয় বেশি–কারণ, বাঘ অথবা প্যান্থার মানুষ মারতে অভ্যস্ত হলেও মানুষকে ভয় পায় এবং সেইজন্যই অধিকাংশ সময়ে তারা মানুষকে পিছন থেকে আক্রমণ করে। অতএব সাহেবকে ক্রমাগত থামতে হচ্ছিল, কখনো সামনে কখনো পিছনে তাকাতে তাকাতে খুব ধীরে ধীরে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন। বাতাসের ধাক্কায় আন্দোলিত উদ্ভিদ এবং বৃক্ষশাখার মর্মরধ্বনি শুনে মাঝে মাঝে প্যান্থারের অস্তিত্ব কল্পনা করে রাইফেল তুলে ধরেন তিনি, একটু পরেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার অস্ত্র নামিয়ে পদচারণা করেন–এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর অ্যান্ডারসন বুঝলেন তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ছে, একেবারে অনভিজ্ঞ নতুন শিকারির মতো আচরণ করছেন তিনি।

এইবার তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠলেন, নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চললেন সামনে। আরও কিছুক্ষণ কাটল। কিছু ঘটল না। সাহেব মনে করলেন মাছ চোর প্যান্থারের ব্যাপারটা বাড়িয়ে বলেছে। নরঘাতিনী মেয়ে-প্যান্থারের অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি সন্দিহান হয়ে উঠলেন।

একটা পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠছিলেন অ্যান্ডারসন। একটু পরেই পাহাড়ের উপর উঠে তিনি নামতে শুরু করলেন ঘন বাঁশবনে ঘেরা একটি উপত্যকার দিকে…

কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর গাছের পাতা ঘর্ষণের শব্দ সাহেবের কানে এল, পরক্ষণেই গাছের ডাল ভাঙার আওয়াজ! শব্দের কারণ বুঝতে শিকারির কান ভুল করল না–গাছের পাতা আর ডালপালা দিয়ে উদর পূরণ করছে হাতি!

অ্যান্ডারসন থেমে গেলেন, যেদিক থেকে শব্দ আসছে সেইদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন। ব্যাপারটা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাতি যদি একক হয়, তাহলে কাছাকাছি মানুষ দেখলে আক্রমণ করতে পারে। একক হস্তী অধিকাংশ সময়ে দলছাড়া গুন্ডা হয়, মানুষ বা অন্য জন্তু দেখলে সে হত্যা করতে চায়। হাতির দল থাকলে বিশেষ ভয় নেই, মানুষ দেখলে তাদের সরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। শব্দ যেদিক থেকে আসছে, সাহেবের চলার পথটা গেছে সেইদিকেই। হাতিকে এড়াতে হলে ঘন বাঁশঝোপ আর কাটাবনে ঢুকতে হয়, আর সে-রকম জায়গায় ক্রুদ্ধ পান্থার বা হাতির সম্মুখীন হলে শিকারির সমূহ বিপদ–তাই সোজা রাস্তা ধরেই এগিয়ে চললেন সাহেব।

সাহেবের পিছন দিক থেকে জোর হাওয়া আসছিল। সামনে গাছের ডালপালা ভাঙার আওয়াজ হঠাৎ থেমে গেল। সাহেব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। চারদিক স্তব্ধ। অর্থাৎ হাতিও বাতাসে গন্ধ পেয়ে আহারে ক্ষান্ত হয়েছে। এখন হয় সে নিঃশব্দে সরে গেছে, অথবা মানুষটাকে চাক্ষুষ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

এই প্রকাণ্ড জন্তুগুলো নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারে, কিন্তু জঙ্গল সেখানে এমন ঘন যে, সেই নিবিড় উদ্ভিদের আবরণের ভিতর দিয়ে চলতে গেলে সামান্য একটু শব্দ হবেই হবে–সাধারণ মানুষের কান সেই তুচ্ছ শব্দের কারণ ধরতে না-পারলেও অভিজ্ঞ শিকারি সেই শব্দ থেকেই গজরাজের চলাচেলের সংবাদ জানতে পারবেন। কোনো শব্দ কানে না-আসায় সাহেব বুঝলেন হাতি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। বাতাস নিশ্চয়ই তার কাছে নিকটবর্তী মানুষের সংবাদ পৌঁছে দিয়েছে হাতির ঘ্রাণশক্তি অতিশয় প্রবল।

আরও দশ মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন সাহেব। হাতি নড়ল না। বোধ হয় ভাবছিল দু-পেয়ে আপদটা বিদায় না-হওয়া পর্যন্ত নিঃশব্দে অপেক্ষা করাই ভালো।

অবশেষে সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। হাতিটাকে ভয় দেখানোর জন্য জোরে শিস দিতে দিতে তিনি সামনে এগিয়ে চললেন সামনের পথ ধরে। ফল হল তৎক্ষণাৎ। অবশ্য সাহেব যা আশা করেছিলেন তা হল না–হাতি স্থানত্যাগ করল বটে, কিন্তু পিছন ফিরে পালাল না, ক্রোধে চিৎকার করতে করতে ছুটে এল সাহেবের দিকে! ঘন জঙ্গল ভেদ করে মুহূর্তের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল একটা প্রকাণ্ড মাথা আর হত্যার আগ্রহে উদ্যত একজোড়া সুদীর্ঘ গজদন্ত!

মহা মুশকিল! ওই এলাকায় কোনো গুন্ডা হাতির অস্তিত্ব সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়নি। জন্তুটাকে গুলি করে মারলে বন বিভাগ অ্যান্ডারসনকে নিয়ে টানাটানি করবে আর তার ফলে সাহেবের দুর্গতির সীমা থাকবে না। দৌড়ে পালাতে গেলে মৃত্যু অনিবার্য, কারণ ক্রুদ্ধ হস্তী তাহলে নির্ঘাত সাহেবকে অনুসরণ করে ধরে ফেলবে এবং হত্যা করবে–দৌড়ের প্রতিযোগিতায় মানুষের পক্ষে হাতিকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য গুলি চালিয়ে হাতির হাঁটু ভেঙে দিয়ে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, কিন্তু তাহলে জন্তুটা দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করবে–অনর্থক জানোয়ারকে কষ্ট দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না অ্যান্ডারসন সাহেব।

হ্যাঁ, আর একটা উপায় আছে, আর সেই উপায়ই অবলম্বন করলেন সাহেব। শূন্যে রাইফেল তুলে আওয়াজ করতেই হাতি চমকে থেমে গেল। তার পায়ের ধাক্কায় রাশি রাশি ঝরাপাতা আর ধুলোর ঝড় উড়ল চারদিকে। সাহেব সামনে এগিয়ে এসে আবার রাইফেলের আওয়াজ করলেন।

এইবার গজরাজ ভয় পেল। ক্রুদ্ধ বৃংহন-ধ্বনির পরিবর্তে তার কণ্ঠে জাগল ভয়ার্ত চিৎকার। ছোট্ট বেঁটে লেজটা পিছনের দুই পায়ের ফাঁকে গুটিয়ে সে দ্রুতবেগে পলায়ন করল।

সব দিক রক্ষা পাওয়ায় খুশি হলেন সাহেব। হাতি বাঁচল, তিনিও বাঁচলেন। কিন্তু নিজের উপর তিনি বিরক্ত। চুপচাপ আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে হাতিটা নিশ্চয়ই চলে যেত। রাইফেলের আওয়াজ শুনে খুনি প্যান্থার আর এদিকে আসবে না। মাত্র আধঘণ্টা হল তিনি আস্তানা ছেড়ে বনের মধ্যে এসেছেন, এখন আর এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে কি? প্যান্থারের সাক্ষাৎ আজ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিছুক্ষণ চিন্তার পর সাহেব আবার অগ্রসর হলেন। অন্তত মিনিট দশের মধ্যে প্যান্থার, হাতি বা অন্য কোনো হিংস্র জানোয়ারের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই; রাইফেলের শব্দে কাছাকাছি যেসব পশু ছিল, তারা নির্ঘাত দূরে সরে পড়েছে। পদে পদে চারদিকে নজর রাখার দরকার আর ছিল না, তাই খুব কম সময়ের মধ্যেই ঘন বাঁশবন পেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় তিনি পৌঁছে গেলেন। এখানে রয়েছে বাবুল, বোরাম, ছোটো ছোটো তেঁতুল গাছ এবং মাটির ওপর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে লম্বা লম্বা ঘাস আর ঘাস। পায়ে চলা যে-পথ ধরে সাহেব এগিয়ে চলছিলেন, সেই পথটা বিস্তীর্ণ ঘাসের সমুদ্রে হারিয়ে গেছে, তার পরিবর্তে এখানে-ওখানে তৃণাবৃত প্রান্তর ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করেছে আরও অনেকগুলো ছোটো ছোটো পায়ে-চলা পথ। হরিণদের পায়ে পায়ে ওই পথগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। জায়গাটা পরীক্ষা করে অ্যান্ডারসন বুঝলেন তিনি হরিণদের প্রিয় বাসভূমিতে এসে পড়েছেন। মাংসাশী পশুর প্রিয় খাদ্য হচ্ছে হরিণ–সুতরাং সাহেবের আশা হল এইখানে খুনি প্যান্থার হয়তো হানা দিতে পারে।

সাহেব আরও একটু এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ তার কানে এল পাখির ডাকের মতো এক বিচিত্র শব্দ! শব্দের তরঙ্গ আসছে তারই দিকে! না, ওগুলো পাখির ডাক নয়–বুনো কুকুর! একপাল বুনো কুকুর কোনো হতভাগ্য শিকারকে তাড়া করে সাহেবের দিকেই ছুটে আসছে।

সাহেব তাড়াতাড়ি একটা ছোটো তেঁতুল গাছের আড়ালে সরে দাঁড়ালেন।

ভারতীয় বুনো কুকুর অতি ভয়ংকর জীব। বনের সব জানোয়ারই তাকে ভয় পায়। এই কুকুরগুলো দল বেঁধে শিকার করে। কোনো হরিণের পিছনে যদি বুনো কুকুরের দল তাড়া করে, তবে আর রক্ষা নেই। যতই দ্রুতগামী হোক পলাতক হরিণ একসময়ে ধরা পড়বেই, আর কুকুরগুলো তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খাবে।

গাছের ডালপালার ওপর শিং-এর ঘষা লাগার আওয়াজ শুনতে পেলেন সাহেব, সঙ্গেসঙ্গে জঙ্গল ভেদ করে তার সামনে আত্মপ্রকাশ করল একটি সুন্দর শম্বর হরিণ। তার মুখ থেকে ফেনা ঝরে পড়ছে, কাঁধের ওপরও জড়িয়ে রয়েছে মুখের ফেনা, আর তার দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে দারুণ আতঙ্কে! হরিণটা থামল না, তিরবেগে ছুটে পালাতে লাগল।

আচম্বিতে জাগল বজ্রপাতের মতো ভীষণ গর্জনধ্বনি, পরক্ষণেই ডোরাকাটা একটা শরীর শূন্যপথে উড়ে এসে পড়ল ধাবমান শম্বরের পিঠের উপর!

একটা বাঘ শিকারের খোঁজে হরিণদের বিচরণ ভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে কুকুরের চিৎকার নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছিল এবং তারা যে শিকার তাড়িয়ে নিয়ে আসছে সেটাও বুঝতে পেরেছিল। সাধারণত বাঘ বুনো কুকুরদের এড়িয়ে চলে, এই বাঘটাও হয়তো তাই করত কিন্তু হরিণটা তার কাছে এসে পড়ায় সে লোভ সামলাতে পারেনি, শিকারের পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

বাঘের ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সে নিশ্চয়ই সাহেবের অনেক আগেই কুকুরগুলোর চিৎকার শুনতে পেয়েছিল এবং উৎকর্ণ হয়ে শব্দের গতি নির্ণয় করছিল, সেইজন্য সাহেবের মৃদু পদধ্বনি তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেনি।

বাঘের গুরুভার দেহ হঠাৎ পিঠের ওপর পড়তেই শম্বরের পিঠ বেঁকে গেল, তার কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল ভয়ার্ত চিৎকার, তারপরই দুটি জানোয়ার জড়াজড়ি করে পড়ে গেল মাটির উপর। লম্বা লম্বা ঘাসের আঁড়ালে ভূপতিত পশু দুটিকে আর দেখতে পাচ্ছিলেন না সাহেব কিন্তু মেরুদণ্ড ভাঙার আওয়াজ এবং শক্ত মাটিতে খুরের সংঘাতজনিত শব্দ শুনে বুঝলেন বাঘ তার শিকারকে হত্যা করছে, মাটির ওপর মৃত্যুকালীন আক্ষেপে পা ঠুকছে মরণাহত হরিণ।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে অকুস্থলে উপস্থিত হল একপাল বুনো কুকুর!

সাহেব যেখানে আত্মগোপন করেছিলেন, সেখান থেকে ঘাসের আড়ালে উপবিষ্ট বাঘকে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। সে মৃত শিকার আগলে রেখে কুকুরগুলোকে তাড়াবার জন্য ভীষণ গর্জনে বন কাঁপাতে লাগল। সেইসঙ্গে কাঁপতে লাগল সাহেবের বুক। কিন্তু কুকুরের দল নির্বিকার!

অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের চমক সামলে নিয়ে কুকুরগুলো মৃত হরিণ আর বাঘকে ঘিরে ফেলল। সাহেব গুনে দেখলেন দলে রয়েছে নয়টি কুকুর।

হঠাৎ কুকুরগুলোর কণ্ঠস্বর বদলে গেল, পাখির ডাকের মতো তীক্ষ্ণ কলধ্বনির পবির্তে তাদের কণ্ঠে জাগল এক করুণ ও বিলম্বিত শব্দের তরঙ্গ! শিকারি অ্যান্ডারসনের কাছে ওই পরিবর্তিত কণ্ঠস্বরের অর্থ অজানা ছিল না–কুকুরগুলো এখন তারস্বরে সাহায্য চাইছে। জাতভাইদের কাছে।

প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে ওই সাহায্য প্রার্থনা কখনো বিফল হয় না। আশেপাশে অবস্থিত প্রত্যেকটি বুনো কুকুর ওই করুণ কণ্ঠের আহ্বান শুনলেই ছুটে আসবে। অরণ্যের সারমেয় সমাজে এটাই। হল অলিখিত আইন। এই আইন মেনে চলে প্রত্যেকটি বনবাসী কুকুর।

বাঘ এতক্ষণ লম্বা লম্বা ঘাসের আড়ালে গুঁড়ি মেরে পড়ে ছিল, এবার সে উঠে দাঁড়াতেই তার সমগ্র শরীর সাহেবের দৃষ্টিগোচর হল। ধীরে ধীরে দেহ ঘুরিয়ে সে শত্রুপক্ষের সংখ্যা নির্ণয় করল। তার মুখ তখন ক্রোধে বিকৃত হয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, হিংস্র দন্ত বিস্তার করে সে ভীষণ শব্দে গর্জন করছে এবং তার দীর্ঘ লাঙ্গুল পাক খাচ্ছে দেহের দু-পাশে বারংবার! অভিজ্ঞ শিকারি অ্যান্ডারসন লেজ নাড়ানোর ভঙ্গি দেখে বুঝলেন বাঘ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, কিন্তু সে ভয় পেয়েছে এ-কথাও সত্যি।

কুকুরগুলো বাঘের ভীতি প্রদর্শনে বিচলিত হল না, তারা একটানা বিষণ্ণ স্বরে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে লাগল। অরণ্যের বুকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে বাজতে লাগল ব্যাঘ্রের ভৈরব গর্জন আর সারমেয় বাহিনীর উৎকট ঐকতান!

বাঘ বুঝল যত দেরি হচ্ছে, ততই তার বিপদ বাড়ছে। হঠাৎ দুই লাফে এগিয়ে গিয়ে বাঘ তার সামনে দাঁড়ানো কুকুরটাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। আক্রান্ত কুকুর চটপট সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করল। বাঘের পিছনে যে কুকুরগুলো ছিল তারা এগিয়ে এল বাঘকে আক্রমণ করতে। বাঘ এইরকমই অনুমান করেছিল, চকিতে পিছন ফিরে সে ডাইনে-বাঁয়ে থাবা চালাল বিদ্যুদবেগে। কুকুরগুলো তাড়াতাড়ি আর থাবার নাগাল থেকে সরে গেল, শুধু একটি কুকুর একটু দেরি করে ফেলল–

সনখ থাবার প্রচণ্ড আঘাতে কুকুরটা ঠিকরে শূন্যে উঠে গেল এবং তার দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পিছনের একটি পা!

কুকুরগুলো আবার পিছন থেকে বাঘকে আক্রমণ করল। আবার ঘুরে দাঁড়াল বাঘ, আবার তার সামনে থেকে সরে গেল কুকুরের দল আর বাঘ যখন আক্রমণকারী কুকুরদের সামলাতে ব্যস্ত, সেই সময়ে পিছন থেকে আর দু-পাশ থেকে অন্য কুকুরগুলো ছুটে এল কামড় বসাতে।

বাঘ একপাশে ঘুরল, তারপর আশ্চর্য কৌশলে দিক পরিবর্তন করে পিছন থেকে তেড়ে আসা কুকুরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শত্রুর এমন অভাবনীয় আচরণের সম্ভাবনা কুকুররা কল্পনা করতে পারেনি। সরে যাওয়ার আগেই বাঘের প্রচণ্ড দুই থাবা দুটো কুকুরকে মাটির উপর পেড়ে ফেলল। একটা আহত কুকুর তার বিদীর্ণ উদর নিয়ে অতিকষ্টে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বাঘ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাঁত বসিয়ে দিল।

শত্রুপক্ষকে বাঘ প্রায় বিধ্বস্ত করে এনেছিল, কিন্তু আহত কুকুরটাকে কামড়াতে গিয়েই সে ভুল করল। মুহূর্তের মধ্যে অন্যান্য কুকুরগুলো তাকে পিছন থেকে ও দু-পাশ থেকে ছেকে ধরল এবং কামড়ের পর কামড় বসিয়ে শরীর থেকে মাংস তুলে নিতে লাগল।

বাঘের ঘন ঘন গর্জনে বন কাঁপতে লাগল, কিন্তু এখন তার গর্জনে ভয়ের আভাস ফুটে উঠল

বাঘ হাঁপাচ্ছে। তার নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত। কুকুরের দল বিশ্রামে রাজি নয়। তারা নতুন উদ্যমে আক্রমণ শুরু করল চিৎকার করতে করতে। বাঘ আবার গর্জে উঠল কিন্তু তার গর্জনে তেমন জোর নেই। যুদ্ধের আগ্রহ তার কমে এসেছে। সে এখন দস্তুরমতো শঙ্কিত!

আচম্বিতে ব্যাঘ্র গর্জন আর সারমেয় কণ্ঠের ঐকতান ডুবিয়ে দিয়ে ভেসে এল এক নতুন শব্দের তরঙ্গ! দূর থেকে ভেসে আসছে বহু কুকুরের কণ্ঠস্বর–একদিক থেকে নয়, বিভিন্ন দিক থেকে এবং একইসঙ্গে!

সাহায্যের আশ্বাস! দলে দলে বুনো কুকুর ছুটে আসছে যুদ্ধে যোগদান করতে।

নাজেহাল বাঘ আর দাঁড়াল না। সভয়ে লেজ গুটিয়ে সে দৌড় দিল রণক্ষেত্র ত্যাগ করে। কুকুরগুলো নাছোড়বান্দা ক্লান্ত ও আহত দেহ নিয়েই তারা বাঘের অনুসরণ করল। দেখতে দেখতে সাহেবের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল পলাতক বাঘ আর অনুসরণকারী ছয়টি কুকুরের দল…

কিছুক্ষণ পরেই সাহায্যকারী কুকুরগুলো অকুস্থলে এসে পড়ল। প্রথমে পাঁচ, পরে আরও বারোটি কুকুর সেইখানে উপস্থিত হল। নিহত তিনটি কুকুরের দেহ থেকে ঘ্রাণ গ্রহণ করতে করতে নবাগত কুকুরের দল হঠাৎ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, তারপর ছুটে চলল সেই পথে, যে-পথ দিয়ে পালিয়েছে বাঘ এবং তার অনুসরণকারী ছয়টি কুকুর।

সব মিলিয়ে এখন প্রায় চব্বিশটি কুকুর বাঘের পিছু নিয়েছে। সাহেব বুঝলেন বাঘের আর নিস্তার নেই। কুকুরের দল একসময় বাঘকে ধরে ফেলবেই ফেলবে, তারপর সকলে মিলে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। বাঘকে শেষ করে ফিরে এসে কুকুরগুলো হরিণটাকেও যে খেয়ে ফেলবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

অ্যান্ডারসন তার আস্তানায় ফিরে এসে দেখলেন টাইনি ফিরে এসেছে। একটু পরে এসে পড়ল মারওয়ান। তারা কেউ কিছু দেখেনি বা শোনেনি। বেশ দেরি করে এল সাহেবের ছেলে ডন। সে একটা প্যান্থারের পায়ের ছাপ দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণ বনের পথে চলতে চলতে একটা গুহা তার চোখে পড়ে। গুহার মধ্যে প্যান্থর থাকতে পারে ভেবে সে কয়েকটা ঢিল ছুঁড়ে মারে। তার আশা ছিল ঢিল খেয়ে গুহার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে প্যান্থার। হ্যাঁ, বেরিয়ে এসেছিল বটে কিন্তু প্যান্থার নয়, এক ভল্লুকী! তার পিঠে ছিল দু-দুটো বাচ্চা! ভল্লুকী বাচ্চা নিয়ে অন্ধের মতো ছুটতে ছুটতে অরণ্যগর্ভে অদৃশ্য হল, ডনকে সে দেখতে পায়নি। ভাগ্যিস দেখেনি, মানুষ দেখলে হয়তো সে আক্রমণ করত আর আত্মরক্ষার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে গুলি করতে বাধ্য হত ডন।

ভল্লুক পরিবারের সঙ্গে প্যান্থারের সহাবস্থান অসম্ভব, অতএব অনুসন্ধানপর্বে ইস্তফা দিয়ে আস্তানায় ফিরে এসেছিল ডোনাল্ড ওরফে ডন।

বনের মধ্যে অ্যান্ডারসন সাহেবের অভিজ্ঞতার কাহিনি শুনে সবাই তো অবাক। বাঘ আর কুকুরের লড়াইয়ের ঘটনা সকলকেই আকৃষ্ট করল। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, হাতিকে ভয় দেখানোর জন্যে সাহেবের গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা হল। ঠিক হল দু-ঘণ্টা পর পর পালা কবে সবাই পাহারা দেবে। চটপট রাতের খানা শেষ করে সকলে গল্পগুজব আরম্ভ করল। একসময় কথাবার্তা থেমে গেল, সকলের চোখে নামল তন্দ্রার আবেশ। পালা অনুসারে প্রথম দু-ঘণ্টা পাহারা দেবে থাংগুভেলু, তারপর মারওয়ান, তারপর অ্যান্ডারসন সাহেব স্বয়ং অ্যান্ডারসনের পরে যথাক্রমে ডোনাল্ড আর টাইনি।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে অ্যান্ডারসন শুনতে পেলেন পাহাড়ের উপর থেকে ভেসে আসছে। বাঘের গর্জন। তার মনে হল যে-বাঘটিকে কুকুরের দল তাড়া করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই হত্যা করেছিল, সেই নিহত বাঘের সঙ্গিনীই পাহাড়ের উপর গর্জন করে ফিরছে…

নির্দিষ্ট সময়ে সাহেবকে ঘুম থেকে তুলে মারওয়ান বলল, একটা প্যান্থারকে সে শিকারিদের আস্তানার পিছনে পাহাড়টার উপর থেকে ডাকতে শুনেছে। আওয়াজ আসছিল অনেক দূর থেকে। হ্যাঁ, আরও একটা কথা তার মনে পড়ছে–একটা পাখি, সম্ভবত বনমোরগ, শিকারিদের শয্যার খুব কাছ থেকে হঠাৎ চিৎকার করতে করতে পাখা ঝটপটিয়ে উড়ে গেছে। ব্যাপাটা এত তুচ্ছ যে, সে ঘটনাটার কথা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিল।

মারওয়ান শুয়ে পড়ল। অ্যান্ডারসন তাকে কিছু বললেন না, কিন্তু বনমোরগের ব্যাপারটা তার কাছে আদৌ তুচ্ছ মনে হয়নি। পাখিটা হঠাৎ চিৎকার করে অন্ধকারের মধ্যে উড়ে গেল কেন? সে নিশ্চয়ই দিনের আলো থাকতে থাকতে রাতের নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে ওই জায়গাটাকে বেছে। নিয়েছিল। কোনো বিপদের সম্ভাবনা না-থাকলে পাখিটা রাতের অন্ধকারে অনিশ্চিত আশ্রয়ের জন্য অন্ধের মতো স্থানত্যাগ করে ছোটাছুটি করবে না। এই বিপদটা হয়তো শিকার-সন্ধানী পাইথন, বনবিড়াল বা ভাম হতে পারে এমনকী ক্ষুধার্ত কোনো প্যান্থারের উপস্থিতি অসম্ভব নয়। হরিণ, শুয়োর প্রভৃতি জানোয়ার প্যান্থারের প্রিয় খাদ্য হলেও পক্ষিমাংসে তার অরুচি নেই।

ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে সাহেবের মনে হল নরঘাতিনী মেয়ে-প্যান্থারটাকে দেখেও পাখিটা ভয় পেয়ে থাকতে পারে। আগের রাতে ওই প্যান্থারটাই যে নিদ্রিত শিকারিদের আস্তানায় হানা দিতে এসেছিল সে-বিষয়ে সাহেবের সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র। জন্তুটার মনুষ্যজাতির ওপর যেরকম বিদ্বেষ, আজ রাতেও নিদ্রিত শিকারিদের উপর তার হামলার সম্ভাবনা আছে বলেই সাহেবের মনে হল। অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে আরও একটা কাঠ তিনি ফেলে দিলেন, আলোটা জোর হলে নজর রাখার সুবিধা হবে। তারপর নদীর ধারে একটা মস্ত গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে রাইফেল বাগিয়ে বসলেন।

পিছনে নদী, পৃষ্ঠরক্ষা করছে গাছের গুঁড়ি–অতএব পিছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে পাহারা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন অ্যান্ডারসন…

রাত দুটো বাজল। তখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। পিছন থেকে ভেসে আসছে নদীর কল্লোলধ্বনি। মাঝে মাঝে জলচর জীবের সশব্দ আলোড়ন… মাছ, অথবা কুমির হওয়াটাও বিচিত্র নয়। বিপরীত দিকে নদীকূল থেকে ভেসে এল রাতচরা সারসের বিষণ্ণ চিৎকার। তারার মালায় সাজানো অন্ধকার আকাশের পটে আরও অন্ধকার এক উড়ন্ত ছায়া কয়েক মুহূর্তের জন্য সাহেবের দৃষ্টিপথে ধরা দিয়ে অদৃশ্য হল। অন্ধকারেও ওই উড়ন্ত ছায়ার স্বরূপ নির্ণয় করতে ভুল করেননি শিকারি, ওটা হর্নড় আটল নামক অতিকায় পেঁচা। ওই পাখি রাতের শিকারি, অন্ধকারে খরগোশ ও অন্যান্য ছোটোখাটো জীবজন্তু মেরে খায়।

পেচক অন্তর্ধান করার পরেই কাঠের ওপর করাত চালানোর মতো একটা কর্কশ চাপা আওয়াজ সাহেবের কানে এল। জলকল্লোল ভেদ করে ওই অস্পষ্ট আওয়াজ আলাদা করে ধরার মতো শ্রবণশক্তি এবং ওই শব্দের তাৎপর্য উপলব্ধি করার মতো শিক্ষা সকলের নেই কিন্তু অভিজ্ঞ শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারসন বুঝলেন শব্দটা এসেছে প্যান্থারের গলা থেকে! অর্থাৎ মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে ঘাতিনী!

আবার, আবার সেই মৃদু অথচ ভীতিপ্রদ শব্দ। এবারে খুব কাছে। নিদ্রিত মানুষগুলোর পিছনেই একটা ঘন ঝোপ থেকে শব্দ এসেছে। আক্রমণের মুখে সাহস সঞ্চয় করার জন্যই জন্তুটা চাপা গলায় গর্জন করছে। এখনই সে আক্রমণ করবে সন্দেহ নেই। শ্বাপদের উদ্দেশ্য বুঝলেও সাহেব টর্চের বোম টিপলেন না। কারণ সামনের ঝোপটাকে একটা নিরেট অন্ধকারের ভ্রুপের মতো লাগছিল, প্যান্থারকে সাহেব তখনও দেখতে পাচ্ছিলেন না। যদি এই মুহূর্তে সে ঝোপের আড়ালে থাকে, তাহলে আলো জ্বাললেও সাহেব তাকে দেখতে পাবেন না কিন্তু জন্তুটা তাকে দেখেই চম্পট দেবে, তাকে গুলি করার আর সম্ভাবনা থাকবে না। সুতরাং সাহেব আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে চাইলেন।

কিন্তু প্যান্থার অপেক্ষা করতে রাজি হল না। আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তে প্যান্থার যেরকম তীব্র ও ছোটো গর্জনে তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়, ঠিক সেইভাবে গর্জন করে জন্তুটা একলাফে ঝোপ থেকে বেরিয়ে নিদ্রিত শিকারিদের কাছাকাছি এসে পড়ল। আর একটি লাফ দিলেই সে এসে পড়বে মানুষগুলোর ওপর।

ঠিক এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন সাহেব। টর্চের আলোকরেখা অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে নির্দিষ্ট নিশানাকে সাহেবের দৃষ্টিগোচর করে দিল–নিক্ষিপ্ত আলোকে জ্বলে উঠল প্যান্থারের দুই চক্ষু!

হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে জন্তুটা থমকে গেল, সাহেব রাইফেলের নিশানা স্থির করে ট্রিগার টিপতে উদ্যত হলেন

আচম্বিতে একটা প্রচণ্ড শব্দ! তারপরই আর একটা!

সঙ্গেসঙ্গে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল সাহেবের ছেলে ডন, জানিয়ে দিল বাবা গুলি ছোঁড়ার আগেই তার রাইফেল ঘাতিনীকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিয়েছে।

জন্তুটা তখনও মরেনি। খুব ধীরে ধীরে সে শ্বাস টানছিল, তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে প্রকাশ করছিল প্রাণশক্তির শেষ স্পন্দন।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেই স্পন্দনও স্তব্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুবরণ করল ঘাতিনী।

মা-প্যান্থারের মৃত্যুতে খুশি হননি সাহেব। তবে সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে ছেলের কৃতিত্ব তাকে মুগ্ধ করেছিল।

বাস্তবিক, ঘুম-জড়ানো চোখে অন্ধকারের মধ্যে অব্যর্থ সন্ধানে লক্ষ্য ভেদ করার ক্ষমতা কয়জনের থাকে?

[১৩৮৭]

টারজানের প্রতিদ্বন্দ্বী

হুঁ, তুমি! তোমার নাম ম্যাকফারলেন?

মুখ তুলে প্রশ্ন করলেন মি. স্কেটন।

তার সামনে যে অপরূপ মূর্তিটি দাঁড়িয়ে ছিল, তার চেহারাটা সত্যি দর্শনীয় বস্তু। রোগাও নয়, মোটাও নয়, লম্বা একহারা শরীর, মাথা ভরতি আগুনের মতো লাল টকটকে আঁকড়া চুল, চুলের নীচে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ ছাড়া মুখের কোনো অংশ দৃষ্টিগোচর হয় না, কারণ চোখ দুটি ছাড়া লোকটির সমস্ত মুখের ওপর বাঁধা আছে পুরু কাপড়ের আস্তরণ বা ব্যান্ডেজ।

মি. স্কেটনের প্রশ্নের উত্তরে আগুন্তুক বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার নাম ম্যাকফারলেন।

স্কেটন বললেন, তোমার কথা আমি শুনেছি। তুমি নাকি জেল খেটেছ? যাই হোক, ভালোভাবে যদি বাঁচতে চাও আমি তোমাকে সুযোগ দিতে পারি। হুঁ, আর একটা কথা–পাথর ভাঙার কাজ সম্পর্কে তোমার কোনো অভিজ্ঞতা আছে?

পুরু কাপড়ের তলা থেকে ভেসে এল অস্ফুট হাস্যধ্বনি, আজ্ঞে হ্যাঁ, পাথর ভাঙার কাজই তো করেছি।

ম্যাকফারলেন তার জামা গুটিয়ে ডান হাতখানা তুলে ধরলে মি. স্কেটনের সামনে মি. স্কেটন দেখলেন তার বাহু বেষ্টন করে ফুলে উঠেছে দড়ির মতো পাকানো মাংসপেশি!

স্কেটন মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু বুঝলেন ওই হাতের মালিক অসাধারণ শক্তির অধিকারী।

ম্যাকফারলেন বললে, শুধু পাথর ভাঙা নয়, আমি একটু থেমে সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাইল স্কেটনের দিকে, আমি ভালো লড়াই করতেও জানি।

বেশ, বেশ, স্কেটন বললেন, তোমার মুখখানা দেখে সে-কথাই মনে হচ্ছে আমার। অত বড়ো একটা ব্যান্ডেজ কেন বাঁধতে হয়েছে সে-কথা আমি জানতে চাইব না, আমি শুধু বলব ম্যাকফারলেন! যদি ভালোভাবে বাঁচতে চাও তবে তোমাকে সেই সুযোগ দিতে আমার আপত্তি নেই। তোমাকে আমি কাজে বহাল করলুম। এখন যাও।

ম্যাকফারলেনের দুই চোখ ঝকঝক করে উঠল, হাত তুলে সে মি. স্কেটনকে অভিবাদন জানাল, তারপর তার দীর্ঘ দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল তাঁবুর দ্বারপথে।

উত্তর ক্যানাডার দুর্ভেদ্য জঙ্গল ও ঝোপঝাড় ভেঙে তৈরি হচ্ছিল একটা পথ। যে দলটা ওই রাস্তা তৈরির কাজে নিযুক্ত হয়েছিল, মি. স্কেটন সেই দলের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক।

পাথর ভেঙে রাস্তা তৈরির কাজ করতে যে লোকগুলো এগিয়ে এসেছিল, তারা বিলক্ষণ কষ্টসহিষ্ণু–তবে দলের সবাই যে খুব শান্তশিষ্ট ভালোমানুষ ছিল তা নয়। মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামা মাঝে মাঝে লাগত। মি. স্কেটন জানতেন ওটুকু সহ্য করতেই হবে। দারুণ ঠান্ডার মধ্যে পাথর। ভেঙে যারা জীবিকা নির্বাহ করতে এসেছে, তাদের কাছে একেবারে শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার আশা করা যায় না। তবু যথাসম্ভব গোলমাল এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন মি. স্কেটন। তাই যেদিন তিনি শুনলেন ম্যাকফারলেন নামে একজন জেলখাটা কয়েদি তার কাছে কাজ চাইতে এসেছে, সেদিন তিনি একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। অবশ্য মি. স্কেটন জানতেন অপরাধীকে ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ দিলে অনেক সময় তার চরিত্র সংশোধিত হয়–স্বভাব-দুবৃত্তদের কথা অবশ্য আলাদা, তারা সুযোগ পেলেই সমাজবিরোধী কাজকর্ম অর্থাৎ চুরি ডাকাতি খুন প্রভৃতি দুষ্কার্যে লিপ্ত হয়। কিন্তু ম্যাকফারলেনের কথাবার্তা শুনে স্কেটনের মনে হল লোকটি স্বভাব-দুবৃত্ত নয়, ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ পেলে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সে কুণ্ঠিত হবে না। সেইজন্যই ম্যাকফারলেনকে কাজে বহাল করলেন মি. স্কেটন।

স্কেটনের অনুমান ঠিক হয়েছিল কিনা জানতে হলে পরবর্তী ঘটনার বিবরণ জানা দরকার। সে-কথাই বলছি…

ম্যাকফারলেন যখন মি. স্কেটনের কাজে বহাল হল, তখন শীতের মাঝামাঝি। আবহাওয়া খুবই কষ্টকর। ক্যানাডা অঞ্চলে শীতকালে ঝড় হয়। ঝড়বৃষ্টির জন্য অনেক সময় সাময়িকভাবে কাজকর্ম বন্ধ রাখা হত। রাস্তা তৈরির কাজে যে লোকগুলো নিযুক্ত হয়েছিল তারা সেই সময় ভিড় করত ব্যায়ামাগারের মধ্যে। ব্যায়ামাগারটি তৈরি করে দিয়েছিলেন মি. স্কেটন দলের লোকদের জন্য। নানা ধরনের খেলা হত সেখানে। তবে দলের লোকদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল বক্সিং বা মুষ্টিযুদ্ধ। স্কেটনের দলভুক্ত শ্রমিক ছাড়া অন্যান্য লোকজনও আসত মুষ্টিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে।

সেদিন রবিবার। ব্যায়ামাগারের মধ্যে মুষ্টিযুদ্ধের আসর জমছে না। লাল পোশাক গায়ে চড়িয়ে দস্তানা পরিহিত দুই হাত তুলে সগর্বে পদচারণা করছে একটি বলিষ্ঠ মানুষ এবং চারপাশে দণ্ডায়মান জনতার দিকে তাকিয়ে গর্বিত কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বার বার। কিন্তু তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসছে না কোনো প্রতিযোগী–এর আগে যে কয়জন তার সামনে মোকাবেলা করতে এসেছিল তারা সবাই বেদম মার খেয়ে কাবু হয়ে পড়েছে।

লোকটি শুধু শক্তিশালী নয়, মুষ্টিযুদ্ধের কায়দাও সে ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছে সে পাকা বক্সার।

আমি লড়তে রাজি আছি, জনতার ভিড় ঠেলে একটি দীর্ঘকায় মানুষ এগিয়ে এল, তার মাথার ওপর লটপট করছে রাশি রাশি আগুন রাঙা চুল আর ওষ্ঠাধরে মাখানো রয়েছে ক্ষীণ হাসির রেখা–ম্যাকফারলেন!

রক্তকেশী নবাগতকে সোল্লাসে অভ্যর্থনা জানাল সমবেত জনতা—

দস্তানা লাগাও। ওর হাতে মুষ্টিযুদ্ধের দস্তানা পরিয়ে দাও।

ম্যাকফারলেনের উন্মুক্ত পুরোবাহুর (forearm) দিকে দৃষ্টিপাত করলে মুষ্টিযোদ্ধা দড়ির মতো পাকানো মাংসপেশিগুলি তার একটুও ভালো লাগল না।

নীরস কণ্ঠে মুষ্টিবীর জানতে চাইল, ইয়ে–তুমি তুমি কি বলে–মানে, বক্সিং লড়তে জান তো?

না, জানি না, ম্যাকফারলেন উত্তর দিলে, তবে শিখতে দোষ কী? আজ থেকে তোমার কাছেই বক্সিং শিখব।

লড়াই শুরু হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই বুঝল, ম্যাকফারলেন শক্তিশালী মানুষ বটে, কিন্তু মুষ্টিযুদ্ধে সে একেবারেই আনাড়ি। তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বজ্রমুষ্টি তার মুখে ও দেহে আছড়ে পড়ল বারংবার কোনোরকমে দুই হাত দিয়ে আত্মরক্ষা করতে লাগল ম্যাকফারলেন। কয়েকটি মার সে বাঁচাল বটে কিন্তু পাকা মুষ্টিযোদ্ধার সব আঘাত সে আটকাতে পারল না। তার মুখের উপর দেহের উপর আছড়ে পড়তে লাগল ঘুসির পর ঘুসি।

জনতা ওই দৃশ্য আর সহ্য করতে পারছিল না, কয়েকজন চিৎকার করে উঠল, ওহে বোকারাম, হাত চালাও, শুধু শুধু দাঁড়িয়ে মার খাও কেন?

জনতার চিৎকারে কর্ণপাত করলে না ম্যাকফারলেন, অন্যান্য মুষ্টিযোদ্ধার মতো সরে গিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টাও সে করলে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সে দু-হাত দিয়ে ঘুসি আটকাতে লাগল এবং আঘাতের পর আঘাতে হয়ে উঠল জর্জরিত।

আচম্বিতে ম্যাকফারলেনের বাঁ-হাতের মুঠি বিদ্যুদবেগে ছোবল মারল প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখে! প্রতিদ্বন্দ্বী মুষ্টিবীর মাটির ওপর ঠিকরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল!

একটি ঘুসিতেই লড়াই ফতে!

তীব্র উল্লাসে চিৎকার করে জনতা ম্যাকফারলেনকে অভিনন্দন জানাল। সেই মুহূর্তে তার নূতন নামকরণ করল রেড অর্থাৎ লাল। লাল চুলের জন্যই ওই নাম হয়েছিল তার। আমরাও এখন থেকে ম্যাকফারলেনকে রেড নামেই ডাকব।

সন্ধ্যার পরে নিজের ঘরে বসে ধূমপান করছিলেন মি. স্কেটন। হঠাৎ সেখানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এল একটি শ্রমিক। শ্রমিকটি জানাল তাদের দলভুক্ত একটি অল্পবয়সি ছেলেকে দলেরই একজন লোক স্নানের চৌবাচ্চার মধ্যে ঠেসে ধরেছিল, ছেলেটি ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, মি. স্কেটনের এখনই একবার আসা দরকার।

স্কেটন তাড়াতাড়ি ছুটলেন। অকুস্থলে গিয়ে তিনি দেখলেন, একটি অল্পবয়সি কিশোর শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে–তার দেহে কোনো বস্ত্রের আচ্ছাদন নেই, ভয়ে তার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটেছে।

স্কেটন তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে বিছানায় শুইয়ে উপযুক্ত শুশ্রূষার ব্যবস্থা করলেন। ছেলেটির নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, স্কেটনের যত্নে সেই যাত্রা বেঁচে গেল।

পূর্বোক্ত ঘটনার চার দিন পরে স্কেটনের ঘরে আবির্ভূত হল এক বিপুলবপু পুরুষ। লোকটির মস্ত বড়ো শরীর ও রুক্ষ মুখচোখ দেখলেই বোঝা যায় মানুষটি খুব শান্তশিষ্ট নয়।

লোকটি স্কেটনের বেতনভোগী শ্রমিক। তার দুর্দান্ত স্বভাবের জন্য স্কেটন তাকে পছন্দ করতেন না।

আগন্তুক কর্কশ স্বরে বললে, মি. স্কেটন, দেখুন হতভাগা রেড আমার কী অবস্থা করেছে।

মি. স্কেটন দেখলেন লোকটির দুই চোখের পাশে ফুটে উঠেছে আঘাতের চিহ্ন।

স্কেটন বললেন, রেড তোমাকে মারল কেন?

খুব মোলায়েম স্বরে লোকটি বললে, আমি কিছু করিনি স্যার। হতভাগা রেড হঠাৎ এসেই আমাকে দু-ঘা বসিয়ে দিল। আমি স্যার ঝগড়াঝাটি পছন্দ করি না। আমি আপনার কাছে নালিশ জানাতে এসেছি।

স্কেটন অবাক হয়ে ভাবলেন যে মানুষ চিরকালই দুর্বিনীত ও দুর্দান্ত স্বভাবের পরিচয় দিয়ে এসেছে, সে হঠাৎ আজ আঘাতের পরিবর্তে আঘাত ফিরিয়ে না-দিয়ে শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকের মতো জানাতে এল কেন?

মুখে বিস্ময় প্রকাশ না করে স্কেটন বললেন, তুমি যাও। যদি রেড দোষ করে থাকে আমি তাকে শাস্তি দেব।

অনুসন্ধান করে আসল খবর জানলেন মি. স্কেটন। সমস্ত ঘটনাটা হচ্ছে এই

ওই ঝগড়াঝাটি পছন্দ না-করা লোকটি কয়েকদিন আগে অল্পবয়সি ছেলেটিকে জলের মধ্যে চেপে ধরেছিল। দলের শ্রমিকরা ব্যাপারটা পছন্দ করেনি, কিন্তু সাহস করে কেউ প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। ওই লোকটা ছিল পয়লা নম্বরের ঝগড়াটে, আর তার গায়েও ছিল ভীষণ জোর–তাই সবাই তাকে ভয় করত যমের মতো।

অকুস্থলে ম্যাকফারলেন উপস্থিত ছিল না। পরে সমস্ত ঘটনাটা যখন সে সহকর্মীদের মুখ থেকে জানল, তখনই সে ঝগড়াটে লোকটির কাছে কৈফিয়ত চাইল। ফলে মারামারি। রেডের হাতে মার খেয়ে শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকটি স্কেটনের কাছে অভিযোগ করতে এসেছিল।

সব শুনে স্কেটন বললেন, রেড যা করেছে, ভালোই করেছে।

এক রাতে স্কেটন যখন শুতে যাওয়ার উদ্যোগ করছেন, সেই সময় তার সামনে কাচুমাচু মুখে এসে দাঁড়াল রেড।

স্কেটন প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে?

রেড একটু হাসল, বোকার মতো ডান হাত দিয়ে বাঁ-কানটা একটু চুলকে নিল, তারপর মুখ নীচু করে বললে, স্যার! ঘুমাতে পারছি না স্যার!

–ঘুমাতে পারছ না! কেন?

–ওরা বড়ো গোলমাল করছে স্যার। স্কেটন কান পেতে শুনলেন। শ্রমিকদের শয়নকক্ষ থেকে ভেসে আসছে তুমুল কোলাহল ধ্বনি।

মি. স্কেটন ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত্রি গভীর, যেকোনো ভদ্রলোকই এখন শয্যার বুকে আশ্রয় নিতে চাইবে।

মুখ তুলে গম্ভীর স্বরে স্কেটন বললেন, তোমার হাতে তো বেশ জোর আছে শুনেছি তবে তুমি ঘুমাতে পারছ না কেন?

রেড কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে রইল, তারপরই তার চোখে-মুখে খেলে গেল হাসির বিদ্যুৎ। স্যার! স্যার! আপনি কী বলছেন স্যার? আপনি কি

বাধা দিয়ে স্কেটন বললেন, শোনো! তাঁবুর লোকজনদের মধ্যে যাতে নিয়মশৃঙ্খলা বজায় থাকে তুমি সেই চেষ্টাই করবে। আজ থেকে তুমি হলে এই দলের পুলিশম্যান! বুঝেছ?

এক মুহূর্তের মধ্যে যেন রূপান্তর ঘটল মানুষটির। জ্বলজ্বল করে উঠল রেডের দুই চোখ, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্কেটনকে সে অভিবাদন জানাল, তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে অদৃশ্য হয়ে গেল মুক্ত দ্বারপথে।

দশ মিনিটের মধ্যেই শ্রমিকদের কোলাহলমুখর শয়নকক্ষ হয়ে গেল নিস্তব্ধ এবং নিবে গেল বৈদ্যুতিক আলোর দীপ্তি।

রেড তার কর্তব্য পালন করেছে!

মি. স্কেটন শয্যাগ্রহণ করার উপক্রম করলেন আর ঠিক সেই সময়ে বেজে উঠল টেলিফোন। যন্ত্রটাকে তুলে নিলেন স্কেটন।

টেলিফোনের তারে এক উদবেগজনক সংবাদ পেলেন স্কেটন। তাঁর আস্তানা থেকে কয়েক মাইল দূরে রাস্তা তৈরির জন্য গড়ে উঠেছিল আর একটা ঘাঁটি। এ ঘাঁটির প্রহরী টেলিফোনে জানিয়ে দিল যে, তাদের ঘাঁটি থেকে একটি অতিশয় ভয়ংকর মানুষ স্কেটনের আস্তানার দিকে যাত্রা করেছে। প্রহরীর মুখ থেকে আরও বিশদ বিবরণ জানা গেল–ওই গুন্ডাপ্রকৃতির লোকটা নাকি তাদের ঘাঁটিতে খুব উপদ্রব শুরু করেছিল, প্রহরী তাকে বাধা দিতে গিয়ে দারুণ মার খেয়েছে।

আবার ভেসে এল টেলিফোনে প্রহরীর কণ্ঠস্বর।লোকটির নাম টারজান। অন্তত ওই নামেই সে নিজের পরিচয় দেয়। বাঘের মতো ভয়ংকর মানুষ ওই টারজান। মি. স্কেটন, আপনি সাবধানে থাকবেন।

আমি সতর্ক থাকব।

স্কেটন টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।

পরের দিন সকালেই স্কেটনের ঘরে টারজান নামধারী মানুষটির শুভ আগমন ঘটল।

স্কেটন বই পড়ছিলেন। বই থেকে মুখ তুলে তিনি আগন্তুকের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।

চিতাবাঘের মতো ছিপছিপে পেশিবহুল বলিষ্ঠ দেহ, দুই চোখের দৃষ্টিতে এবং মুখের রেখায় রেখায় নিষ্ঠুর বন্য হিংসার পাশবিক ছায়া–টারজান?

গম্ভীরভাবে স্কেটন বললেন, তুমি টারজান? আগের ঘাঁটির প্রহরীকে তুমি মেরেছ?

স্কেটনের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলে আগন্তুক, কুৎসিত হিংস্র হাস্যে বিভক্ত হয়ে গেল তার ওষ্ঠাধর, হ্যাঁ, আমার থাবাগুলো বড়ো ভয়ানক।

শোনো টারজান, স্কেটন বললেন, ইচ্ছে করলে তুমি এখানে কাজ করতে পারো।

হ্যাঁ?

লোকটি অবাক হয়ে গেল। এত সহজে কাজ পেয়ে যাবে সে ভাবতে পারেনি। স্পষ্টই বোঝা গেল, মালিকের তরফ থেকে এই ধরনের প্রস্তাব আসতে পারে এমন আশা তার ছিল না।

হ্যাঁ, আর একটা কথা বলে দিচ্ছি, স্কেটন বললেন, এখানে গোলমাল করলে বিপদে পড়বে। এই ঘাঁটিতে এমন একটি মানুষ আছে যে তোমাকে ইচ্ছে করলে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে পারে।

নীরব হাস্যে ভয়ংকর হয়ে উঠল টারজানের মুখ, ও! ওই লালচুলো মানুষটার কথা বলছেন বুঝি? তার কথা আমার কানে এসেছে। আমি ওই লালচুলোর সঙ্গে একটিবার দেখা করতে চাই।

ভালো কথা। খুব শীঘ্রই তার সঙ্গে তোমার দেখা হবে টারজান।

মি. স্কেটন আবার তার হাতের বইতে মনোনিবেশ করলেন। টারজান কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু স্কেটন একবারও বই থেকে মুখ তুললেন না।

অগত্যা টারজান স্কেটনের ঘর থেকে বেরিয়ে শ্রমিকদের শয়নকক্ষের দিকে পদচালনা করলে।

স্কেটন জানতেন টারজানের সঙ্গে ম্যাকফারলেন ওরফে রেড-এর কলহ অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে তার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হবে কে জানত?

স্কেটনের কাছে যেদিন টারজান এসেছিল সেদিন রেড অকুস্থলে উপস্থিত ছিল না। কয়েক মাইল দূরে রাস্তা তৈরির কাজে সে ব্যস্ত ছিল। রাত্রিবেলা যখন সে শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট শয়নকক্ষে উপস্থিত হল, তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য–

মস্ত বড়ো ঘরটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে আর চিৎকার করছে টারজান, এইখানে এমন কোনো মানুষ নেই যে আমার সঙ্গে লড়তে পারে।

দরজার কাছে স্থির হয়ে দাঁড়াল রেড।

শয়নকক্ষের মাঝখানে মস্ত বড় থামটার ওপর সজোরে পদাঘাত করে চেঁচিয়ে উঠল টারজান, যেকোনো লোক হ্যাঁ, হ্যাঁ, যেকোনো লোককে আমি মেরে ঠান্ডা করে দিতে পারি।

তাই নাকি? যেকোনো লোককে তুমি মেরে ঠান্ডা করে দিতে পারো? হাসতে হাসতে বললে রেড, কিন্তু আমাকে তুমি ঠান্ডা করতে পারবে না।

কথা বলতে বলতে একহাত দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল রেড, এইবার ক্ষিপ্রহস্তে গায়ের গরম জামাগুলো সে খুলে ফেলল।

শার্টের আস্তিন গুটিয়ে রেড ধীরে ধীরে এগিয়ে এল টারজানের দিকে! চরম মুহূর্ত!

মিষ্টি হাসি হেসে মধু ঢালা ঠান্ডা গলায় রেড বললে, কী হে স্যাঙাত–তুমি তৈরি?

রেড স্কটল্যান্ডের অধিবাসী। সে শক্তিশালী মানুষ। তার লড়াইয়ের অস্ত্র হচ্ছে দুই হাতের বজ্রমুষ্টি।

টারজান বর্ণসংকর–তার বাপ ফরাসি, মা রেড ইন্ডিয়ান। সেও বলিষ্ঠ মানুষ। কিন্তু তার লড়াইয়ের ধরন আলাদা। ছলে-বলে-কৌশলে যেভাবেই হোক শত্রু নিপাত করতে সে অভ্যস্ত; মারি অরি পারি যে কৌশলে, এই হল তার নীতি।

দুই বিচিত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের সম্মুখীন হল।

টারজান খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। রেড-এর বলিষ্ঠ দুই হাতের কবলে ধরা পড়ার ইচ্ছা তার ছিল না–হঠাৎ বিদ্যুদবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে শত্রুর মাথায় প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করলে, প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই অপর হাতখানি সবেগে আঘাত হানল শত্রুর উদরে এবং চোখের পলক ফেলার আগেই ছিটকে সরে গেল প্রতিদ্বন্দ্বীর নাগালের বাইরে।

টারজানের চোখ দুটো এতক্ষণ ক্রোধে ও ঘৃণায় জ্বলছিল জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ডের মতো, কিন্তু এইবার তার বিস্ফারিত চক্ষুতে ফুটে উঠল আতঙ্কের আভাস।

তার একটি আঘাতেও শত্রুর দেহ স্পর্শ করতে পারেনি! রেড আক্রমণ করলে না, স্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল শত্রুর জন্য।

আবার আক্রমণ করল টারজান। চিতাবাঘের মতো দ্রুত ক্ষিপ্রচরণে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল সে, ক্রুদ্ধ সর্পের ছোবল মারার ভঙ্গিতে তার দুই হাত বারংবার আঘাত হানল শত্রুর দেহে, তারপর আবার ছিটকে সরে এসে উপস্থিত হল পরবর্তী আক্রমণের জন্য।

টারজানের চোখে এইবার স্পষ্ট ভয়ের ছায়া। শত্রুর একজোড়া বলিষ্ঠ বাহু তার প্রত্যেকটি আঘাত ব্যর্থ করে দিয়েছে! দু-খানি হাত যেন দুটি লোহার দরজা-ইস্পাত-কঠিন সে-হাত দুটির বাধা এড়িয়ে টারজানের আঘাত রেড-এর শরীর স্পর্শ করতে পারেনি একবারও!

টারজান এইবারে অন্য উপায় অবলম্বন করলে। জ্যা-মুক্ত তিরের মতো তার দেহ ছুটে এল শত্রুর উদর লক্ষ করে। ওই অঞ্চলে নদীর ধারের গুন্ডারা সাধারণত পূর্বোক্ত পদ্ধতিতে লড়াই করে, হাত দিয়ে সেই ভীষণ আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু রেড হুঁশিয়ার মানুষ, সেও অনেক ঘাটের জল খেয়েছে, অন্যান্য বারের মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সে শত্রুর আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করল না–সাঁৎ করে একপাশে সরে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীর পায়ে পা লাগিয়ে মারল এক টান!

পরক্ষণেই টারজানের দেহ ডিগবাজি খেয়ে সশব্দে আছড়ে পড়ল বন্ধ দরজার ওপর!

সমবেত জনতার কণ্ঠে জাগল অট্টহাস্য! টারজানের দুর্দশা তারা উপভোগ করছে সকৌতুকে!

টারজান উঠে দাঁড়াল। ভীষণ আক্রোশে সে ধেয়ে গেল প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে, তারপর হঠাৎ শূন্যে লাফিয়ে উঠে রেড-এর মাথায় করলে প্রচণ্ড পদাঘাত।

লাথিটা রেড-এর মাথায় চেপে পড়েনি, মুখের ওপর দিয়ে হড়কে গিয়েছিল–পলকে টারজানের একটি জুতোসুদ্ধ পা ধরে ফেলল রেড। কিন্তু শত্রুকে সে ধরে রাখতে পারল না। মাটির ওপর সশব্দে আছড়ে পড়েই আবার উঠে দাঁড়াল টারজান।

উল্লসিত জনতার চিৎকারে ঘর তখন ফেটে পড়ছে! হ্যাঁ, একটা দেখার মতো লড়াই হচ্ছে। বটে!

তবে দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিল এটা সাধারণ লড়াই নয়। প্রথম প্রথম হয়তো যোদ্ধাদের মধ্যে কিছুটা খেলোয়াড়ি মনোভাব ছিল, কিন্তু এখন তাদের মাথায় চেপেছে খুনের নেশা।

টারজানের জুতোর তলা ছিল লোহা দিয়ে বাঁধানেনা। রেড-এর মুখের ওপর সেই লৌহখণ্ড এঁকে দিয়েছে রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।

রেড-এর গালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা, চিবুকটা একপাশে বেঁকে গেছে আঘাতের বেগে।

হর্ষধ্বনি থেমে গেল। রক্তমাখা ক্ষতচিহ্ন এইবার সকলের চোখে পড়েছে।

হঠাৎ সকলের নজর পড়ল টারজানের উপর। প্রায় ২০০ মানুষের দেহের অঙ্গে অঙ্গে ছুটে গেল বিদ্যুৎ-শিহরন টারজানের হাতের মুঠিতে ঝকঝক করছে একটি ধারালো ছোরা!

জনতা নির্বাক। দারুণ আতঙ্কে তাদের কণ্ঠ হয়ে গেছে স্তব্ধ।

নিঃশব্দে বাঘের মতো গুঁড়ি মেরে টারজান এগিয়ে এল শত্রুর দিকে রেড তখন নিবিষ্ট চিত্তে ক্ষতস্থান পরীক্ষা করছে।

ভীষণ চিৎকার করে আক্রমণ করল টারজান। এক মুহূর্তের জন্য দেখা গেল চারটি হাত আর চারটি পায়ের দ্রুত সঞ্চালন, তারপরেই মৃত্যু-আলিঙ্গনে বদ্ধ হয়ে স্থির প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গেল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী!

একহাত দিয়ে টারজানের ছোরাসুদ্ধ হাত চেপে ধরেছে রেড, অন্য হাতের পাঁচটা আঙুল চেপে বসেছে শত্রুর কণ্ঠদেশে। টারজানও নিশ্চেষ্ট নয়, সে ছোরাসুদ্ধ হাতটি ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে প্রাণপণে এবং অপর হাতের আঙুলগুলো দিয়ে রেড-এর গলা টিপে ধরেছে সজোরে।

ঘরের মধ্যে অতগুলি মানুষ স্তব্ধ নির্বাক। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখেও কোনো আওয়াজ নেই। নিঃশব্দে চলছে মৃত্যুপণ লড়াই।

হঠাৎ মট করে একটা শব্দ হল–রেড-এর শক্ত মুঠির মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল টারজানের কবজির হাড়, অস্ফুট আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল টারজান।

দুই হাত কোমরে রেখে ধরাশায়ী শত্রুর দিকে দৃষ্টিপাত করলে রেড। টারজান উঠল না, সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

ভগ্নস্বরে রেড বললে, ওকে এবার একটু জল দাও। দেখছ না, মানুষটা যে অজ্ঞান হয়ে গেছে…

মি. স্কেটন ভুল করেননি। ম্যাকফারলেন ওরফে রেড সত্যিই ভালো লোক। পরবর্তী জীবনে ম্যাকফারলেন ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ পেয়েছিল এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সে কুণ্ঠিত হয়নি।

[আষাঢ় ১৩৭৬]

তাইগরেরো

প্রথম পরিচ্ছেদ

প্রথম দর্শনেই তিক্ততার সৃষ্টি!

আর্নস্ট হস্তক্ষেপ না-করলে তখনই শুরু হত মারামারি। দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়াল আর্নস্ট, ফাভেলকে মিষ্টি কথায় শান্ত করে ছোটোভাইকে সে টেনে নিয়ে গেল একপাশে, তারপর বলল, বহুদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা হল আলেক্স। দারুণ ভালো লাগছে।

দীর্ঘকাল পরে দাদার দেখা পেয়ে সাশাও খুব খুশি হয়েছিল, কিন্তু ফাভেল নামে অপরিচিত মানুষটির অভদ্র আচরণ তার মন থেকে সব আনন্দ মুছে দিয়েছিল–ক্রুদ্ধ স্বরে সে প্রশ্ন করল, লোকটা কে?

আর্নস্ট বিব্রত বোধ করল, ওর নাম ফাভেল। লোকটা ব্রেজিলের স্থানীয় বাসিন্দা, আমার সঙ্গে এক কারখানায় কাজ করে।

এমন অভদ্র মানুষের সঙ্গে তুমি কাজ কর?

ইয়ে মানে একেবারে একা নিঃসঙ্গ জীবন কাটানো যায় না। লোকজনের সঙ্গে মিশতেই হয়। এখানে ফাভেলের চাইতেও খারাপ লোক আছে। ফাভেল আমার বন্ধু নয়, সহকর্মী মাত্র। ওকে নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। তারপর তোর খবর কী?

সাশা জানাল দেশ থেকে, অর্থাৎ রাশিয়া থেকে, চিঠি পেয়ে সে আর্নস্ট সিমেলের বর্তমান ঠিকানা জানতে পেরেছে। অনেক ঝাট-ঝামেলা সহ্য করে পাসসা ফানভো শহরে এই হোটেলের ভিতর দাদাকে সে পাকড়াও করেছে। আর্নস্ট আগে ছিল ব্রেজিলের মাত্তো গ্রসো নামক অরণ্যসংকুল স্থানে, পরে স্থান পরিবর্তন করে উপস্থিত হয়েছে এই পাসো ফানডো শহরে…

আজকের ব্যাপার নয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেকার কথা। আর্নস্ট সিমেল আর সাশা সিমেল দুই ভাই। জাতে তারা রুশ। কিন্তু জন্মস্থান ল্যাটভিয়া। বড়ো ভাই আর্নস্ট ছোটোবেলা থেকেই কিছুটা খামখেয়ালি আর বেপরোয়া। কোনো বিষয়ে ঝোঁক চাপলে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না-করেই সে এগিয়ে যেত এবং অজানা বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করত না সাশা সিমেল কিছুমাত্র। কোনো এক অশুভ মুহূর্তে তার মনে হল হিরার জন্য বিখ্যাত ব্রেজিলের মাত্তো গ্রসসা নামক বনভূমিতে হিরার সন্ধান পেলে রাতারাতি অগাধ অর্থের মালিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে–সঙ্গেসঙ্গে সে রওনা হল পূর্বোক্ত স্থানের উদ্দেশে। তারপর বেশ কয়েক বছর সে নিরুদ্দেশ… দীর্ঘকাল পরে বাড়িতে তার চিঠি এল জানা গেল আর্নস্ট সিমেল এখন আর মাত্তো গ্রসসাতে নেই, রয়েছে ব্রেজিলেরই পাসো ফানডো নামক শহরে।

বড়ো ভাইকে ছোটোবেলা থেকেই দারুণ ভালোবাসত আশা সিমেল। খামখেয়ালি স্বভাবের বেপরোয়া আর্নস্ট ছিল ছোটোভাই সাশার চোখে মস্ত হিরো! কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে সাশা যখন যৌবনে পা দিয়েছে সেইসময় একটা অবাঞ্ছিত ঘটনায় সমগ্র পৃথিবী সম্পর্কে তিক্ত হয়ে উঠল সে কাজকর্মে ইস্তফা দিয়ে সে পৌঁছে গেল পাসো ফানডো শহরে এবং বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর বড়োভাই আর্নস্টের দেখা পেল সেখানকার একটা হোটেলের মধ্যে। দীর্ঘ অদর্শনের পর মিলনের আনন্দ ভালো করে উপভোগ করতে পারল না দুই ভাই–ফাভেল নামে একটি স্থানীয় মানুষ হঠাৎ অপমান করে বসল ছোটো ভাই সাশাকে। ব্যাপারটা কোনোমতে সামলে নিল আর্নস্ট। মালপত্র একটা হোটেলে রেখে পায়ে হেঁটে দাদার খোঁজে বেরিয়েছিল সাশা, পরের দিন জিনিস নিয়ে চলে এল দাদার আস্তানায়।

কলকবজার কাজ দুই ভাইয়েরই জানা ছিল। ভাঙা যন্ত্রপাতি আর অকেজো অস্ত্র মেরামতে আর্নস্ট ছিল অতিশয় দক্ষ। দাদার মতো পাকা ওস্তাদ না হলেও মোটামুটি কলকবজার কাজ জানত সাশা। দাদার সঙ্গে কথা বলে সাশা জানতে পারল আর্নস্ট এখন হিরার সন্ধান ছেড়ে স্থানীয় একটি জার্মান ব্যবসায়ীর কারখানায় যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজ করছে। দাদার খামখেয়ালি স্বভাব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকলেও হিরার সন্ধান ছেড়ে হঠাৎ একটা অখ্যাত শহরে মিস্ত্রির কাজ নিয়ে দাদাকে জীবিকানির্বাহ করতে দেখে সাশার মনে হল ব্যাপারটা অহেতুক খামখেয়ালি কাণ্ড নয়–এর ভিতর কিছু রহস্য আছে। আর্নস্ট জামা খুলতেই রহস্য কিছুটা পরিষ্কার হল–তার কাঁধের উপর দেখা গেল একটি অর্ধশুষ্ক ক্ষতচিহ্ন! মনে হয়, অস্ত্রাঘাতের ফলেই ওই চিহ্নটার সৃষ্টি হয়েছে। সাশা অনুমান করল মাত্তো গ্রসো নামক স্থানে কারো সঙ্গে বিবাদের ফলেই ওই চিহ্নটার সৃষ্টি এবং সেই সংঘর্ষের জন্যই পরবর্তীকালে হিরার সন্ধান ছেড়ে স্থানত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। আর্নস্ট। তবু ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করল না সাশা, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাশা বুঝেছিল ব্রেজিলের মানুষগুলো বিশেষ শান্তশিষ্ট নয়।ফাভেলের প্রসঙ্গে দাদার কথাটা তার মনে পড়ছিল বার বার এখানে ফাভেলের চাইতেও খারাপ লোক আছে..

আগেই বলেছি দাদার মতো ওস্তাদ মিস্ত্রি না হলেও যন্ত্রপাতির কাজ জানত সাশা। অতএব যে-কারখানায় দাদা কাজ করত, সেখানে কাজ জুটিয়ে নিতে সাশার অসুবিধা প্রবাদপুরুষ।  হল না। মালিকের ব্যবহার ভালো, সে সাশাকে পছন্দও করত, কিন্তু ফাভেলের কুনজরে পড়ে গেল সাশা সিমেল। প্রথম দিনেই যে বিরোধের সূত্রপাত ঘটেছিল, পরবর্তীকালে সেই বিরোধ এগিয়ে চলল এক ভয়াবহ সম্ভাবনার দিকে। সাশা আর আর্নস্ট প্রাণপণে বিরোধ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত, কিন্তু সহ্য করার একটা সীমা তো আছে–সাশা বুঝতে পারছিল অদূর ভবিষ্যতে একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবে, মানসিক তিক্ততা সেইদিন গড়িয়ে যাবে রক্তাক্ত সংঘর্ষের দিকে…

এইবার পাঠকদের সঙ্গে বর্তমান কাহিনির অন্যতম প্রধান চরিত্রের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে–ডম কার্লোস! ওই নামটির সঙ্গে জড়িত ছিল পাসো ফানডো শহরের যাবতীয় বাসিন্দার শ্রদ্ধা, বিস্ময় ও আতঙ্ক!

দক্ষিণ আমেরিকা তথা ব্রেজিলের বিভিন্ন অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। পাসো ফানডো শহরকেও ওই নিয়মের ব্যতিক্রম বলা চলে না। সেই প্রায়-অরাজক শহরে স্বেচ্ছায় শান্তিরক্ষকের কর্তব্য পালন করতে এগিয়ে এসেছিল একটি রেড ইন্ডিয়ান। অবশ্য সেই পবিত্র কর্তব্যপালন করার জন্য সে অর্থগ্রহণ করত জনসাধারণের কাছ থেকে। ডম কার্লোস নামক ওই ব্যক্তি রাজ্য সরকারের কাছ থেকে মাইনে পেত না। শান্তিরক্ষার কাজটাকে সে বেছে নিয়েছিল স্বাধীন পেশা হিসেবে। অত্যন্ত বিপজ্জনক পেশা সন্দেহ নেই তবে ওই পেশার উপযুক্ত মানুষ ছিল ডম কার্লোস বন্দুক, পিস্তল প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্রে তার নিশানা ছিল অব্যর্থ।

পাসো ফানডো শহরের অত্যাচারিত বা নিহত মানুষের আত্মীয়স্বজন যখন কার্লোসের কাছে। সুবিচারের আশায় উপস্থিত হত, তখনই প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হত ডম কার্লোস। সরকারি বিচারক অপরাধীকে প্রাণদণ্ড দিলে সেই দণ্ড কার্যকরী করে সরকারি জল্লাদ; কিন্তু ডম যখন অপরাধীকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করত, তখন সেই দণ্ড কার্যকরী করার ভার গ্রহণ করত স্বহস্তে। খুনিদের হত্যা করার পর তাদের কানগুলো কেটে রেখে দিত সে। ওগুলো তার যুদ্ধজয়ের স্মৃতিচিহ্ন বা স্মারক।

বন্দুক-পিস্তলের নিশানায় সিদ্ধহস্ত ডম কার্লোসের ভয়ে শহরের সমাজবিরোধী দুবৃত্তরা খুন করার আগে একটু চিন্তা করত। খুন করার পর নিজেরও খুন হয়ে যাওয়ার ভয়াবহ সম্ভাবনাকে ভয় করে না এমন খুনি পাসো ফানডো শহরেও নিতান্ত বিরল। অপরাধীরা অবশ্য আত্মরক্ষার চেষ্টা করত। দুবৃত্তের কবলে একটি চোখ হারিয়েছিল ডম কার্লোস, তবে উক্ত ব্যক্তিকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল প্রাণ দিয়ে। প্রৌঢ়বয়স্ক, একচক্ষু, রোগা চেহারার ডম কার্লোস নামক মানুষটি ছিল চোর-ডাকাত আর খুনিদের কাছে মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন। কিন্তু ওই পেশাদার শান্তিরক্ষকটি আর্নস্ট আর সাশাকে খুব ভালোবাসত। মানবচরিত্র সম্পর্কে দস্তুরমতো অভিজ্ঞ ছিল ডম কার্লোস সরল সাদাসিধে স্বভাবের জন্যই তার বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল দুই ভাই।

ফাভেলের সঙ্গে দৈনন্দিন কলহ যখন চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছে, সেইসময় একদিন পরামর্শ ও উপদেশের জন্য ডম কার্লোসের দরজায় উপস্থিত হল সাশা সিমেল…

দূর দিগন্ত থেকে অস্তায়মান সূর্যের রক্তিম রশ্মি ছড়িয়ে পড়ছিল রিও গ্র্যান্ড ডো সাল নামে উদ্ভিদ-আচ্ছন্ন প্রান্তরের বুকে। সেই প্রান্তর ছাড়িয়ে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের ভিতর দিয়ে চলে গেছে বিখ্যাত মাত্তো গ্রুসোর রহস্যময় অরণ্য, যেখানে ঘন উদ্ভিদ ও জলাভূমির বুকে অবস্থান করছে বিভিন্ন ও বিচিত্র মৃত্যুদ–শ্বাপদ, সরীসৃপ, চোরাবালি!

কিন্তু বিশাল প্রান্তর ও দূরবর্তী অরণ্যের নৈসর্গিক সৌন্দর্য বা অস্তায়মান সূর্যের আলোছায়ার খেলা দেখে মুগ্ধ হওয়ার অবকাশ ছিল না সাশার–সে সোজা এসে দাঁড়াল উম কার্লোসের সামনে।

শহরের বাইরে অরণ্য ও নগরের সীমানার উপর ডম কার্লোসের বাড়ি। বাড়িটার মধ্যে বৈশিষ্ট্য কিছুনা-থাকলেও দরজার দিকে তাকালে যেকোনো মানুষের পিলে চমকে যাবে। দরজার উপর সুতোয় বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সারি সারি মানুষের কান! যে-অপরাধীদের প্রাণদণ্ড দিয়েছে কার্লোস, ওগুলো তাদের মুণ্ড থেকে কর্তিত স্মারকচিহ্ন।বহু যুদ্ধজয়ের নীরব সাক্ষী।

কার্লোসকে ডাকাডাকি করার দরকার হল না। একটা কাঠের টুলের উপর বাড়ির সামনে বসে ছিল সে। পাশে দাঁড়িয়েলোবো নামে কুকুরটা প্রভুর আদর উপভোগ করছিল মহানন্দে। সাশাকে দেখে সাদর অভ্যর্থনা জানাল ডম কার্লোস।

সাশা বিলক্ষণ উত্তেজিত ছিল। বাজে কথায় সময় নষ্ট না-করে তৎক্ষণাৎ ফাভেল-ঘটিত সমস্যার কথা জানিয়ে সে পরামর্শ চাইল ডম কার্লোসের কাছে।

আমাদের এখানে, অর্থাৎ ব্রেজিলে আমরা একটা নীতি অনুসরণ করি, সাশার মুখের উপর একটিমাত্র চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি স্থাপন করে ডম কার্লোস বলল, আমরা অন্যের ব্যাপারে নাক গলাই না, গায়ে পড়ে কারো সঙ্গে ঝগড়াও করি না। কিন্তু আমায় যদি কেউ অপমান করে বা আক্রমণ করে, তাহলে তাকে হত্যা করতে আমি কিছুমাত্র দ্বিধা করব না। যে-লোক তোমাকে অপমান বা আক্রমণ করতে পারে, সে হচ্ছে খ্যাপা কুকুরের শামিল–তাকে তোমার খুন করাই উচিত। এই যে লোবো, ও যদি তোমাকে কামড়াতে যায়, তাহলে ওকে মেরে ফেলতে কি তুমি দ্বিধা করবে?

যাকে নিয়ে এই ভয়াবহ মন্তব্য, তার দিকে একবার সস্নেহে দৃষ্টিপাত করল কার্লোস। প্রভুর চোখে চোখ রেখে ঘন ঘন লাঙ্গুল আন্দোলিত করে প্রভুকে সমর্থন জানাল লোবো। যেমন মনিব, তেমনি কুকুর!

লোবোর উপর থেকে চোখ সরিয়ে সাশার মুখের দিকে তাকাল কার্লোস, তবে একটা কথা মনে রেখো। ফাভেলকে খুন করলে আমি আর লোবো তোমাকে অনুসরণ করব। কারণ, ফাভেলের আত্মীয়স্বজন নিশ্চয়ই আমায় টাকা দিয়ে খুনিকে হত্যা করতে বলবে, আর পেশা অনুসারে আমিও তোমাকে বা তোমার ভাইকে অথবা দুজনকেই হত্যা করতে বাধ্য হব। বন্ধুদের কান কেটে নিতে আমার খুবই খারাপ লাগবে, কিন্তু সে-রকম কিছু ঘটলে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই আমার অপ্রীতিকর কর্তব্য পালন করতে হবে। এটাই আমার পেশা যে!

ডম কার্লোসের বক্তব্য শেষ হলে সাশা বলল, তাহলে তুমি আমায় ফাভেলকে এড়িয়ে চলতে বলছ?

না, না, কার্লোস বলল, তোমার বিবেক যা বলবে, তুমি তা-ই করবে।

আমি ওই খুদে ভোঁদড়টাকে এড়িয়ে চলতে পারি না, সাশা বলল, কারণ, আমরা এক জায়গায় কাজ করি। আর আমি ওর ভয়ে পালিয়ে যেতেও চাই না। সেটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

না, তুমি ফাভেলকে এড়িয়ে যেতে পারবে না, কার্লোস হাসল, মনে হচ্ছে লোবোকে নিয়ে আমার বন্ধুদের পিছনে আমাকেই তাড়া করতে হবে, আর শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তাদের কানগুলো কেটে আনতে হবে। সিনর সিমেল, তোমায় আমি একটা উপদেশ দিচ্ছি, শোনো। এখন তুমি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছ, প্রতিপক্ষের দম্ভ তুমি সহ্য করতে পারছ না কিন্তু মাত্তো গ্রসোর প্রাকৃতিক পরিবেশ, মানুষ এবং জানোয়ার তোমায় পরিবেশের উপযুক্ত করে তুলবে। সেখানে গেলে তুমি বুঝতে পারবে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা কেমনভাবে করতে হয়।

একটু থেমে ডম কার্লোস আবার বলতে লাগল, রিও সাও লরেংকো নামে যে-জায়গাটা আছে, সেখানে গেলে সম্ভবত তুমি একজন বুড়ো ইন্ডিয়ানের দেখা পাবে। ঠিক কোথায় গেলে তাকে পাওয়া যাবে, সেটা আমি যথাসময়ে তোমাকে জানিয়ে দেব। তার নাম জোকুইম গুয়াতো। লোকটি ওস্তাদ তাইগরেরো। কারো সাহায্য না-নিয়ে বর্শা দিয়ে সে তাইগর মারতে পারে।

দক্ষিণ আমেরিকার জাগুয়ারকে স্থানীয় মানুষ তাইগর বলে। সাশা শুনেছিল রেড ইন্ডিয়ানরা বর্শা দিয়ে জাগুয়ার শিকার করে। অবশ্য তারা দলবদ্ধ হয়ে জাগুয়ারকে আক্রমণ করে। কারো সাহায্য না-নিয়ে সম্পূর্ণ এককভাবে যে নিঃসঙ্গ শিকারি বর্শা দিয়ে জাগুয়ার মারতে পারে, তাকেই তাইগরেরো আখ্যা দেওয়া হয়।

তবে তেমন কোনো মানুষ সাশার চোখে পড়েনি। তাইগরেরোর অস্তিত্ব সম্পর্কে তার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। সন্দেহ অকারণ নয়–তাইগরেরো সম্পর্কে অনেক গালগল্প শোনা যায় বটে, কিন্তু স্বচক্ষে তাইগরেরোকে শিকার করতে দেখেছে, এমন মানুষের সাক্ষাৎ পায়নি সাশা সিমেল। এই প্রথম সে জোকুইম নামে এক তাইগরেরোর কথা শুনল ডম কার্লোসের মুখে।

জোকুইম লোকটা জঙ্গলকে জানে, কার্লোস বলতে লাগল, মানুষ যেমন নিজের বৈঠকখানার প্রত্যেকটি আসবাবপত্র চেনে, ঠিক তেমনিভাবেই জঙ্গলকে চিনেছে জোকুইম গুয়াতো। সে নিজের হাতে পঁয়ত্রিশটা তাইগর বর্শা দিয়ে মেরেছে। শিকারের সময় সে কারো সাহায্য নেয় না। ব্যাপারটা যে কতখানি বিপজ্জনক, সে-বিষয়ে তোমার ধারণা নেই। জঙ্গল সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না হলে তোমার বন্দুক বা পিস্তল কোনো কাজে লাগবে না। তাইগর তোমাকে মুহূর্তের মধ্যে টুকরো টুকরো করে ফেলবে, হাতের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগই তুমি পাবে না। আমি নিজেও বন্দুক-পিস্তলের ব্যাপারে নিতান্ত আনাড়ি নই

হঠাৎ কথা থামিয়ে হাতের এক ঝটকায় অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে কোমর থেকে পিস্তল তুলে নিল কার্লোস, কিন্তু পাকা পিস্তলবাজ হলেও জঙ্গলের মধ্যে যে সবসময় আত্মরক্ষা করতে পারব, এমন আস্থা আমার নিজের উপরেও নেই। বন্ধু সিমেল–তোমার বয়স কম, লম্বায় তুমি প্রায় ছ-ফুট হবে, দেখে বোঝা যায় গায়ে বেশ জোর আছে কিন্তু তাইগরের সামনে তোমার এই গায়ের জোর কোনো কাজে লাগবে না। পূর্ণবয়স্ক তাইগর প্রায় নয় ফুট লম্বা, দেহের ওজন চারশো পাউন্ডের কাছাকাছি। তার ধারালো নখ দিয়ে সে তোমার বুক চিরে ফাঁক করে দিতে পারে। তাইগরের দৈহিক শক্তি তোমার চাইতে অনেক বেশি এবং সে দস্তুরমতো বিপজ্জনক। তুমি পারতপক্ষে ফাভেলকে খুন করতে চাইবে না কিন্তু তাইগর তোমার সূক্ষ্ম ন্যায়নীতির ধার ধারে না, সে তোমায় সুযোগ পেলেই হত্যা করবে আর সম্ভবত খেয়েও ফেলবে। সিমেল ভায়া, জীবন সম্বন্ধে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার, না হলে একদিন হয়তো প্রাণ দিয়েই তোমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আমার মনে হয় আর্নস্টকে নিয়ে এখনই জোকুইম গুয়াতের সঙ্গে তোমার দেখা করা উচিত। তার কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য তোমরা জানতে পারবে, সভ্য মানুষের অভিধানে আজ পর্যন্ত যা লেখা হয়নি।

একটু থেমে লোবোর ঘাড় চুলকে দিল কার্লোস, তারপর আবার বলতে লাগল, কয়েক বছর আগে জোকুইম গুয়াতোকে আমি তাইগর শিকার করতে দেখেছি। সেই সময় জারোয়াস নামে জলাভূমির পূর্বদিকে একটা বিশাল গোশালার রক্ষণাবেক্ষণ করতাম আমি। জায়গাটা রয়েছে রিও আরাগুয়া আর উত্তর প্যারাগুয়ের মাঝখানে। ওই অঞ্চলে বাস করে অসংখ্য তাইগর। তাদের কবলে প্রতি বৎসর হাজার হাজার গোরু-বাছুর মারা পড়ে।

জোকুইম আর আমি একদিন ভোর হওয়ার একটু আগে ঘোড়ায় চড়ে দুটো কুকুর নিয়ে একটা তাইগরের সন্ধানে যাত্রা করেছিলাম। জন্তুটা কিছুদিন ধরে ভীষণ উপদ্রব করছিল। ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গেসঙ্গে কুকুর দুটো তাইগরের পায়ের ছাপ আবিষ্কার করল একটা খাঁড়ির ধারে। পদচিহ্নের আকৃতি ও গভীরতা দেখে বুঝলাম জন্তুটা মস্ত বড়ো, দেহের ওজন সাড়ে তিনশো পাউন্ডের কম হবে না। তাইগর সাঁতার কাটতে ওস্তাদ, জলে নেমে সে কোথায় সরে পড়েছে কে জানে। কিন্তু দুপুরের দিকে কুকুর দুটো একটা দ্বীপের মতো জায়গার উপর তাইগরকে ঘেরাও করে ফেলল। দ্বীপের চারপাশে জল খুব গভীর নয়, কিন্তু কাদায় পিছল জলাভূমির মধ্যে পা রাখাই মুশকিল। জলের উপর এখানে-ওখানে বিচ্ছিন্নভাবে গুচ্ছ গুচ্ছ ঘাস আর বর্শার ফলার মতো ভাঙা গাছের ডাল প্রতিপদে আমাদের বাধা দিচ্ছিল। জলাভূমির পাড়ে ঘোড়া রেখে আমরা জলে নেমেছিলাম। আমার হাতে রাইফেল, জোকুইমের হাতে বর্শা। বর্শার দৈর্ঘ্য ছয় ফুটের মতো, তার মধ্যে ফলাটাই হবে দু-ফুট লম্বা।

জোকুইম একবার হাত নেড়ে আমাকে জলার মধ্যে নামতে বারণ করল। কিন্তু আমি তখন তাইগরটাকে শিকার করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছি, জোকুইমের নিষেধ না-শুনে রাইফেল হাতে এগিয়ে চললাম অগভীর জল ভেঙে দ্বীপটার দিকে। অভিজ্ঞ শিকারির নির্দেশ অমান্য করার ফল পেলাম হাতে হাতে জলের মধ্যে অদৃশ্য লতার ফঁসে পা জড়িয়ে সশব্দে আছড়ে পড়লাম। হাতের রাইফেল ছিটকে পড়ে অদৃশ্য হল জলাভূমির গর্ভে এবং আমার নাকে-মুখে হুড়হুড় করে ঢুকল কাদা-মাখা জল।

কোনোমতে নিজেকে সামলে দ্বীপের কাছে ডাঙার মাটিতে হাত রাখলাম, তারপর মুখ তুলেই দেখতে পেলাম জঙ্গলের রাজা তাইগরকে। একটা মস্ত গাছে পিঠ দিয়ে সে রুখে দাঁড়িয়েছে আর কুকুর দুটো জলের ধারে দাঁড়িয়ে জন্তুটার উদ্দেশে চিৎকার করছে তারস্বরে। তাইগর মাঝে মাঝে এগিয়ে এসে কুকুর দুটোকে লক্ষ করে থাবা চালাচ্ছে, সৌভাগ্যের বিষয় প্রত্যেকবারই ফসকে যাচ্ছে তার থাবার নিশানা।

সেই সময় রাইফেল হাতে থাকলে অনায়াসে জন্তুটাকে গুলি করে মারতে পারতাম। রাইফেলের খোঁজ নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই পায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল অসহ্য যন্ত্রণার শিহরন–গোড়ালি মচকে গেছে, আমার এখন দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই।

সেই অবস্থাতেই জোকুইমকে দেখলাম। সে তাইগরের খুব কাছে প্রায় দশ ফুটের মধ্যে এসে পড়েছে। আমি বুঝলাম জন্তুটা যদি এখন তাকে আক্রমণ করে, তাহলে পিছিয়ে এসে জলাভূমির মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করার সময় সে পাবে না। আমি চেঁচিয়ে তাকে সাবধান করতে গেলাম, কিন্তু কুকুরের চিৎকারে আমার কণ্ঠস্বর ডুবে গেল জোকুইম আমার গলার আওয়াজ শুনতে পেল না…

বাঁ-হাতে বর্শা ধরে ডান হাত দিয়ে একতাল কাদামাটি তুলল জোকুইম, তারপর সেই মাটির তালটাকে ছুঁড়ে মারল তাইগরের মুখে। ফল হল বিস্ময়কর প্রকাণ্ড হাঁ করে জোকুইমের দিকে ফিরল তাইগর, তার গলা থেকে বেরিয়ে এল ভীষণ গর্জনধ্বনি। জন্তুটার ফাঁক-হয়ে-যাওয়া চোয়ালের প্রকাণ্ড হাঁ দেখে আমার মনে হল জোকুইমের পুরো শরীরটাকেই সে বুঝি এক কামড়ে গিলে ফেলবে।

জোকুইম তখন জন্তুটার থেকে প্রায় দশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাইগরের ভয়ংকর বিকৃত মুখের উপর তার দৃষ্টি নেই, সে তাকিয়ে আছে জন্তুটার পায়ের দিকে।

পরে জেনেছিলাম বর্শাধারী শিকারি ওইভাবেই লড়াই করে–কারণ, তাইগর যতই দাঁত খিঁচিয়ে গর্জন করুক না কেন, শিকারিকে নাগালের মধ্যে পেতে হলে প্রথমেই তাকে পা চালাতে হবে, অর্থাৎ লাফ মারতে হবে। তাই শ্বাপদের পায়ের দিকেই নজর রাখে শিকারি, মুখের দিকে নয়।

অরণ্য-সম্রাটকে কাদা ছুঁড়ে অপমান করার পর পাঁচ সেকেন্ডের বেশি সময় যায়নি, এর মধ্যেই দুই হাতে বর্শা বাগিয়ে চরম মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হয়েছে জোকুইম–মাটির দিকে সামান্য ঝুঁকে আছে বর্শার ধারালো ফলা, ডান দিকের পাঁজর আর কনুইয়ের মাঝখানে চেপে ধরা আছে বর্শার কাষ্ঠদণ্ড।

তাইগর ঝাঁপ দিল চোখের নিমেষে। একটা কালো-হলুদ বিদ্যুৎ যেন চমকে উঠল মুহূর্তের জন্য, পরক্ষণেই কী ঘটল ঠিক বুঝতে পারলাম না শুধু দেখলাম জন্তুটা শূন্যে পাক খেয়ে মাটির উপর ছিটকে পড়ল চিত হয়ে।

আমি দেখলাম, জোকুইমের বর্শা তাইগরের বুকের মধ্যে বসে গেছে এবং সে প্রাণপণ শক্তিতে বর্শার ডান্ডাটা ধরে জন্তুটাকে মাটিতে চেপে রাখার চেষ্টা করছে। তাইগরের ওজন রেড ইন্ডিয়ান শিকারির চাইতে তিনগুণ বেশি, কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করেও জন্তুটা জোকুইমকে ঠেলে সরিয়ে নিজেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়াতে পারল না… বর্শার ফলা বুকের মধ্যে আরও গম্ভীর হয়ে ঢুকে যেতে লাগল… অবশেষে রক্তাক্ত দেহে মৃত্যুবরণ করল তাইগর…

সেই ঘটনার কথা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। ওটা শিকার নয়, লড়াই। কোনো সাদা চামড়ার মানুষ ওভাবে লড়াই করতে পারে না। ওইভাবে তাইগরকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে বধ করার ক্ষমতা রাখে কয়েকজন রেড ইন্ডিয়ান। তারাও বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে। জোকুইম ছাড়া কোনো জীবিত তাইগরের সাক্ষাৎ আমি পাইনি। সাশা, আমার কথা শোনো, যেভাবেই হোক জোকুইমের সঙ্গে দেখা করো। ব্রেজিলের মাটিতে তোমার মতো বিদেশির বেঁচে থাকা কঠিন, এখানে বাঁচার কৌশল তোমায় শেখাতে পারে একমাত্র জোকুইম।

সাশা অবশ্য ডম কার্লোসের উপদেশ শিরোধার্য করে তৎক্ষণাৎ জোকুইমের আস্তানার উদ্দেশে যাত্রা করেনি। কিন্তু কিছুদিন পরেই ফাভেলের সঙ্গে কলহ যখন রক্তাক্ত সংঘর্ষে পরিণত হল, তখন যে-ঘটনাচক্রের আবর্তে সাশা সিমেল একদিন তাইগরের সান্নিধ্যে এসে পড়েছিল এবং ব্রেজিলের জনপদ, অরণ্য ও জলাভূমির বুকে নরঘাতক দ্বিপদের ছুরি, বন্দুক আর নরখাদক শ্বাপদের শানিত নখদন্তকে যেভারে ফাঁকি দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিল সেইসব চমকপ্রদ বিবরণ পরিবেশিত হয়েছে বর্তমান কাহিনির পরবর্তী অংশের বিভিন্ন পরিচ্ছেদে…

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

খুব ছোটোবেলা থেকেই সাশা সিমেল ছিল দাদা আর্নস্টের অনুরাগী ভক্ত। আর্নস্ট চিরকালই গৃহবিমুখ, যাযাবর। সাশা যখন বারো বছরের বালক, সেইসময় আর্নস্ট গৃহত্যাগ করে দক্ষিণ আমেরিকায় চলে যায়। কিছুকাল পরে সিমেল পরিবারের সকলে জানতে পারল আর্জেন্টিনার নৌসেনাদলে যোগ দিয়েছে আর্নস্ট। তখন থেকেই সাশা ভেবে রেখেছিল বড়ো হয়ে সে দাদার কাছে চলে যাবে। কয়েক বৎসর পরে আর্জেন্টিনার একটা রেলপথ যেখানে তৈরি হচ্ছে, সেখানেই অনেক খোঁজাখুঁজি করে দাদাকে ধরে ফেলল সাশা। তখন আর সাশা নিতান্ত বালক নয়, দস্তুরমতো এক বলিষ্ঠ যুবক। যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সামর্থ্য তার হয়েছে।

আর্নস্ট আর সাশা আবার বিচ্ছিন্ন হল। আর্নস্ট চলে গেল উত্তর দিকে ব্রেজিল নামক প্রদেশে হিরার সন্ধানে, আর সাশা যেখানে গেল সেই জায়গাটার নাম হল বুয়েনস এয়ার্স।

এরপর বহুদিন দাদার দেখা পায়নি সাশা। একবার মাত্র একটা চিঠি পেয়েছিল সে দাদার কাছ থেকে। সেই চিঠির সূত্র ধরে পাসো ফানডো শহরে এসে এক জার্মান ইঞ্জিনিয়ারের কাছে অনুসন্ধান করে আর্নস্টের হদিশ পেয়ে গিয়েছিল সাশা।

জার্মানটির নির্দেশ অনুসারে একটি ভোজনাগারে ঢুকেই সাশা তার দাদাকে দেখতে পেল। কিন্তু দুই ভাইয়ের মিলনের আনন্দকে তিক্ত করে দিল ফাভেল নামে একটি লোক। আর্নস্টের সঙ্গে একই টেবিলে বসে পানভোজন করছিল ওই লোকটি। তার চেহারাটা ছোটোখাটো হলেও স্বভাব ছিল অতিশয় উগ্র। প্রথম দর্শনেই সাশাকে সে অপমান করে বসল। আর্নস্ট তৎক্ষণাৎ বাধা না-দিলে নির্ঘাত সাশার ঘুসি পড়ত ফাভেলের মুখে। দৈহিক শক্তিতে ফাভেল কোনোমতেই সাশার সঙ্গে পাল্লা দিতে সমর্থ ছিল না, হয়তো এক ঘুসিতেই সে ঠিকরে পড়ত মাটিতে। কিন্তু সে-রকম কিছু ঘটলে পরবর্তীকালে সাশার জীবন যে বিপন্ন হতে পারে, সে-বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল আর্নস্ট–সেইজন্যই ব্যাপারটাকে মুখোমুখি থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াতে দেয়নি সে।

ভোজনাগার থেকে ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে এল আর্নস্ট এবং কিছুদূর হেঁটে গিয়ে প্রবেশ করল একটি কুঁড়েঘরে। সাশা বুঝল ওই কুটিরটি এখন দাদার আস্তানা।

আলেক্স! আর্নস্ট বলল, মাত্তো গ্রসো জায়গাটাতে ছড়ানো আছে রাজার ঐশ্বর্য! শুধুমাত্র তুলে নেওয়ার অপেক্ষা।

সাশা বলল, তা তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি তাহলে ফিরে এলে কেন?

আমার মদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। জঙ্গলে তো মদ পাওয়া যায় না। তাই মদ কিনতে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু আমার ঘোড়াটা এখানে এসেই হঠাৎ মারা গেল। গায়ে হেঁটে অতদূর যাওয়া সম্ভব নয়। অথচ ঘোড়া কেনার মতন যথেষ্ট টাকাও আমার কাছে নেই। অতএব এখানেই একটা রুপার দোকানে কাজ নিলাম। তোকেও ওখানে একটা কাজ আমি জুটিয়ে দিতে পারব আলেক্স। তারপর কিছু টাকা হলে দুই ভাই আবার ফিরে যাব মাত্তো গ্রসোর জঙ্গলে বুঝেছিস? সেখানে ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি হিরা, যাকে বলে রাজার ঐশ্বর্য।

কিন্তু দাদা, সাশা বলল, ওই জার্মানটা আমায় বলছিল তুমি নাকি অসুস্থ সত্যি?

এমন কিছু গুরুতর ব্যাপার নয়, আর্নস্ট বলল, কাঁধে একটা পুরানো ক্ষত আছে।

আর্নস্ট তার শার্ট খুলে ফেলল। সাশা দেখল দাদার কাঁধে একটা শুষ্ক ক্ষতচিহ্ন ছড়িয়ে আছে।

এটা একটা শয়তানের উপহার। তবে আবার একদিন লোকটার সঙ্গে আমার নিশ্চয়ই দেখা হবে। সে আমাকে যা দিয়েছে, সেইদিনই তাকে সুদে-আসলে তা ফিরিয়ে দেব।

সাশা ভাবতে লাগল মাত্তো গ্রসো নামে জায়গাটা ছেড়ে আসার সঙ্গে ওই ক্ষতচিহ্নটার হয়তো কিছু যোগসূত্র আছে–নিতান্ত অকারণে শুধুমাত্র মদ কেনার জন্য রাজার ঐশ্বর্য ফেলে পাসো ফানডো শহরে চলে আসেনি আর্নস্ট।

অনেকদিন পরে দুই ভাই-এর দেখা কথা বলতে বলতেই রাত শেষ হয়ে গেল। নিজের মালপত্র একটা হোটেলে রেখে দাদার সন্ধানে পথে বেরিয়েছিল সাশা। এবার জিনিসগুলো নিয়ে সে দাদার কুঁড়েঘরে এসে ঢুকল। স্থির হল দুই ভাই এখন এখানেই থাকবে। হের আলবার্ট স্মিথ নামে যে জার্মান রৌপ্য-ব্যবসায়ীর দোকানে আর্নস্ট কাজ করে সেখানেই ছোটো ভাইকে একটা কাজ জুটিয়ে দেবে আর্নস্ট। কিছু টাকা জমাতে পারলেই আবার হিরার সন্ধানে মাত্তো গ্রসোতে হানা দেবে আর্নস্ট-এবার আর একা নয়, সঙ্গে থাকবে ছোটো ভাই সাশা।

পরের দিনই কাজে লেগে গেল সাশা সিমেল।

একটি প্রকাণ্ড রোলার চালিয়ে রুপোর পাতগুলিকে পাতলা চাদরে পরিণত করার জন্য সাশা এবং আরও দুটি লোককে নিযুক্ত করেছিল মালিক। সাশা তার পাশের লোকটির মুখের দিকে তাকায়নি–নিবিষ্টচিত্তে সে মালিকের নির্দেশ অনুসারে কাজ করছিল। হঠাৎ খুব ধীরে মৃদুস্বরে কেউ তাকে উদ্দেশ করে বলল, সিনর সিমেল! তুমি বুঝি মালিককে তোমার গায়ের জোর দেখিয়ে খুশি করতে চাও? তোমার দেশে যে জানোয়ারগুলো ভার বহন করে, তারা বোধ হয় কথা কয় না?

সচমকে কণ্ঠস্বর লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াল সাশা। আবার চমক! কণ্ঠস্বরের মালিক ফাভেল! ভোজনাগারের মধ্যে আগের দিন যার সঙ্গে হাতাহাতির উপক্রম হয়েছিল সেই ব্যক্তি!

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

কেটে গেছে ছয়টি মাস। ওই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সাশা। রুপোর জিনিস তৈরি করা ছাড়া আরও একটি বিদ্যা রপ্ত হয়েছে তার। সাশা এখন বন্দুক, পিস্তল প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র মেরামত করতে পারে। জার্মান মালিকটি শুধু রুপোর কারবার করে না, বিকল আগ্নেয়াস্ত্র মেরামত করার দায়িত্বও সে গ্রহণ করে উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। তার বেতনভোগী কর্মচারীর দল ওই কাজগুলি করে। বলাই বাহুল্য, সাশা এবং তার বড়োভাই আর্নস্ট উক্ত কর্মচারীদের দলভুক্ত। সাশা ভোজনাগারে আড্ডা দিতে না-গেলেও সহকর্মীদের সঙ্গে সে মেলামেশা করত, কাজেই তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে তার অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ফাভেল ছিল একটি ব্যতিক্রম, সাশার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে সে রাজি হল না।

হঠাৎ দুটি ঘটনা ঘটল পর পর। যার ফলে পাসো ফানডো শহরে দুই ভাইয়ের মানমর্যাদা বাড়ল এবং ফাভেলের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটল।

একদিন বিকালে আর্নস্ট তার ছোটোভাইকে জানাল প্যারাগুয়ে থেকে একটি বলবান মানুষ শহরে উপস্থিত হয়েছে। শহর-চত্বরে সে তার অসামান্য দৈহিক শক্তি প্রদর্শন করবে সেইদিনই সন্ধ্যায়। কৌতূহল চরিতার্থ করতে আর্নস্টের সঙ্গে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হল সাশা।

যথাস্থানে গিয়ে দুই ভাই দেখল সজ্জিত মঞ্চের চারপাশে প্রচুর জনসমাগম ঘটেছে। উক্ত বলবান মানুষটি মঞ্চের উপর ওঠেনি, নীচে দাঁড়িয়ে জনতার সপ্রশংস দৃষ্টি উপভোগ করছে। লোকটির চেহারা সত্যিই প্রশংসা করার মতন এ-কথা একনজর তাকিয়েই মেনে নিল দুই ভাই। লোকটির নামও জানা গেল–সিনর মার্সেলো ক্যাসারাস।

উক্ত মার্সেলোর কাঁধের উপর ছড়ানো ছিল একটা জাগুয়ারের চামড়া এবং ওই চামড়াটা তার কোমরে এসে আবদ্ধ হয়েছে একটা প্রশস্ত কৃষ্ণবর্ণ চর্মবন্ধনী বা বেল্ট দিয়ে। তার পা থেকে অধমাঙ্গ কালো মোজার মতন এক ধরনের আঁটোসাঁটো পোশাকে ঢাকা রয়েছে। পোশাকের ভিতর দিয়েই লোকটির জানু ও পায়ের বৃহৎ পেশিগুলি দৃশ্যমান হয়ে জনতার মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। লোকটির গায়ের রং বাদামি, পেশিস্ফিত শরীরের গঠন বুঝিয়ে দিচ্ছে শরীরের অধিকারী অসাধারণ শক্তিমান। তার চোয়াল প্রকাণ্ড, ওষ্ঠাধর পুরু, নাক বাজপাখির ঠোঁটের মতন বাঁকা। নাকের বাঁকা গড়নের জন্য মনে হয় লোকটি সর্বদাই বিরক্তির সঙ্গে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তবে মুখের গঠন যেমনই হোক না কেন, লোকটি আদৌ বদমেজাজি নয়। কারণ, জনতার অভিনন্দনকে স্বীকৃতি জানিয়ে তার ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠেছে নীরব হাসির আভাস।

মার্সেলো হচ্ছে সবচেয়ে বলিষ্ঠ মানুষ,মঞ্চের উপর থেকে হেঁকে বলল একটি বিরলকেশ খর্বকায় ব্যক্তি, এমনকী বনের জাগুয়ারও মার্সেলোকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।

বেঁটেখাটো মানুষটি নিশ্চয়ই সে মার্সেলোর ম্যানেজার আবার হাঁক দিল, ওহে আমার আদরের খোকা, এবার মঞ্চের উপর শুয়ে পড়ো। তোমার অমানুষিক শক্তির পরিচয় দাও সকলের কাছে। ভালোমানুষের ছেলেরা তোমায় দেখতে এসেছে, তাদের হতাশ কোরো না।

জাগুয়ারের চামড়াটা একটানে খুলে ফেলল মার্সেলো, পরক্ষণেই প্রকাণ্ড লাফ মেরে উঠে এল মঞ্চের উপর এবং শুয়ে পড়ল চিত হয়ে।

ম্যানেজারের ইঙ্গিতে বিপুলবপু এক নিগ্রো প্রকাণ্ড এক নেহাই এনে রাখল মার্সেলোর বুকের উপর; তারপর প্রায় এক ইঞ্চি পুরু একটি লোহার ডান্ডা ওই নেহাই-এর উপর রেখে সরে দাঁড়াল।

সিনর! তোমায় দেখে মনে হচ্ছে তুমি বেশ শক্তিমান পুরুষ, বেঁটে ম্যানেজার হঠাৎ ভিড়ের ভিতর দণ্ডায়মান সাশার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল, হাতুড়ি আর ছেনি দিয়ে ওই লোহার ডান্ডাটাকে তুমি ভেঙে ফেলতে পারো?

তৎক্ষণাৎ এক লাফে মঞ্চের উপর উঠে এল সাশা। নীচে যেখানে দাদা দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে তাকাল সে দেখল আর্নস্টের ঠোঁটে কৌতুকের হাসি–অর্থাৎ দাদা তাকে সমর্থন করছে।

বাঃ! সিনর সিমেল, তুমি যোগ্য ব্যক্তিকেই সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছ, ভেসে এল বিদ্রূপশানিত কণ্ঠস্বর, একটা ষাঁড়ের বিরুদ্ধে আর একটা ষাঁড়! বাঃ! চমৎকার!

স্বর লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াতেই সাশা কণ্ঠস্বরের মালিককে দেখতে পেল–ফাভেল!

আরও একজন ফাভেলের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল–আর্নস্ট।

এই রে! এই বুঝি দাদা ঝাঁপিয়ে পড়ে ফাভেলের উপর–সাশা ইশারায় আর্নস্টকে নিষেধ করতে উদ্যত হল। কিন্তু ঠিক সেই সময় ম্যানেজার তার জামার হাত ধরে টানল এবং বুঝিয়ে দিল সাশাকে কী করতে হবে। নেহাই-এর উপর বসানো লোহার ডান্ডার গায়ে ছেনিটাকে ধরে রাখবে বিশালদেহী নিগ্রো ওই ছেনিতে হাতুড়ি মেরে ডান্ডাটাকে ভেঙে দুই খণ্ড করার দুরূহ কর্তব্যটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব পড়েছে সাশার উপর।

আমি জোরে আঘাত করে ডান্ডা ভেঙে ফেলতে পারি, সাশা বলল, কিন্তু লোকটা যে তাহলে মারা পড়বে।

মার্সেলোর কিছু হবে না, ক্ষুদ্রকায় ম্যানেজার হাসল, তুমি সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করো।

সোজাসুজি আঘাত করবে ঠিক ছেনির উপর, তলা থেকে ভেসে এল ফাভেলের কণ্ঠস্বর, ষাঁড়েরও কিছু দক্ষতা থাকা দরকার। দেখো, যেন আঘাতটা ফসকে না যায়।

সাশা দাদার দিকে তাকাল আর্নস্ট ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, এখনই বুঝি সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফাভেলের ঘাড়ে। হাত নেড়ে দাদাকে কিছু করতে নিষেধ করল সাশা, তারপর মঞ্চের একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়াল।

সিনর ফাভেল! তুমি বোধ হয় তোমার গায়ের জোর দেখাতে চাও? সাশা ফাভেলকে উদ্দেশ করে বলল, আমি ঠিক এই কাজটা করতে উৎসুক নই। বেশ তো তুমিই উঠে এসো, দেখ এই হাতুড়িটা যদি তুলতে পারো।

ফাভেলের মুখ বিকৃত হয়ে গেল। দারুণ ক্রোধে তার দুই চোখ জ্বলে উঠল আগুনের মতো পরক্ষণেই হাতের সিগারেট মঞ্চের খুঁটিতে ঘষে নিবিয়ে দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে অদৃশ্য হয়ে গেল জনতার মধ্যে।

সাশা এবার হাতুড়িটা তুলে নিল। পরপর তিনবার সজোরে আঘাত হানল সে। দু-টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল লৌহদণ্ড। মার্সেলো এবার একহাতের বগলে নেহাইটাকে চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল। দারুণ উল্লাসে চিৎকার করে তাকে অভিনন্দন জানাতে লাগল সমবেত জনতা। মৃদুহাস্যে জনতাকে অভিবাদন জানাল মার্সেলো।

জনতার উৎসাহ এবার মার্সেলো আর সাশার মধ্যেও খেলোয়াড়ি মনোভাব জাগিয়ে তুলল। সাশাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দাঁতে কামড়ে চেয়ার সমেত সাশাকে শূন্যে তুলে ফেলল মার্সেলো। তারপর একটা মোটরগাড়ি ছুটে এসে মার্সেলোর বুকের উপর দিয়ে চলে গেল। পরপর আরও কয়েকটি খেলা দেখিয়ে দর্শকদের বিস্ময়ে স্তব্ধ করে দিল প্যারাগুয়ের বলিষ্ঠ মানুষ! রাত পর্যন্ত নিবিষ্টচিত্তে সব খেলা দেখল সাশা, তারপর ম্যানেজারকে ডেকে বলল, আমরা যদি একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করি, তাহলে বিশাল এক জনতার সমাবেশ ঘটবে।

বেঁটে ম্যানেজার হঠাৎ সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল, কীরকম প্রতিযোগিতার কথা বলছ তুমি?

কুস্তি, সাশা বলল, ওই বিদ্যাটা আমার ভালোই জানা আছে।

তুমি কেমন পারিশ্রমিক আশা কর? ম্যানেজার জানতে চাইল, অবশ্য যদি পারিশ্রমিকের অর্থ গ্রহণ করার জন্য তুমি জীবিত থাকো।

সাশা বলল, যে জিতবে, সে সমস্ত টাকা পাবে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দাদা আর্নস্ট, সে সাশার হাত চেপে ধরল। তুমি নিতান্ত নির্বোধ, আলেক্স, আনস্ট বলে উঠল, লোকটা তোমাকে দু-টুকরো করে ভেঙে ফেলবে।

তাহলে টিকিট বিক্রি যে-টাকা উঠবে, সবটাই সে নিয়ে যাবে, সাশা ম্যানেজারের দিকে তাকাল, তুমি কী বল?

মার্সেলো পাশে এসে হাসিমুখে সাশার কথা শুনছিল। ম্যানেজার কিছু বলার আগেই সে বলে উঠল, আমি খুনি নই।

তুমি যদি আমার প্রস্তাবে রাজি না হও, তাহলে স্বীকার করো তুমি ভয় পেয়েছ, সাশা বলল।

মার্সেলোর মুখের হাসি মুছে গেল, ললাটে ফুটল কুঞ্চনরেখা।

মার্সেলো কাউকে ভয় পায় না, ম্যানেজার বলল, তোমার মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী হবে।

আর্নস্ট ছেটো ভাই সাশার নিরাপত্তার কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লেও সাশার মনে দুশ্চিন্তা ছিল না একটুও। সাশা জানত মার্সেলো প্রচণ্ড শক্তিশালী পুরুষ, সে যদি চেপে ধরতে পারে, তাহলে সাশার মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলবে অনায়াসে কিন্তু ক্ষিপ্র গতি ও কৌশলের সাহায্যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে যে পরাস্ত করা যাবে, এ-বিষয়ে সাশা ছিল নিশ্চিত। মার্সেলো অমানুষিক শক্তির অধিকারী হলেও মল্লযুদ্ধ সম্বন্ধে তার যে কোনো অভিজ্ঞতা নেই, সেটাও বুঝতে পেরেছিল সাশা।

স্থানীয় একটি নাট্যশালায় পূর্বোক্ত প্রতিযোগিতার স্থান নির্ণয় করা হল। আর্নস্ট এবং সাশা ডম কার্লোসের সঙ্গে দেখা করে প্রতিযোগিতার খবর জানিয়েছিল। ডম কার্লোস বলল সে যথাসময়ে যথাস্থানে উপস্থিত থাকবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত টিকিট বিক্রি না হয়, ততক্ষণ সে টিকিটঘরের ভিতর বিক্রেতাদের সঙ্গেই অবস্থান করবে। শুধু তাই নয়–টিকিট বিক্রির সমস্ত টাকা সে নিজের কাছেই রাখবে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত।

আর্নস্টের দিকে তাকিয়ে ডম কার্লোস বলল, সিনর ফাভেল আর তোমাদের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে এটা আমি লক্ষ করেছি। যাতে কোনো অশান্তি না হয়, সেইজন্যই আমি প্রতিযোগিতা চলার সময়ে উপস্থিত থাকব।

ফাভেল যেন সতর্ক থাকে, চাপা গলায় গর্জে উঠল আনস্ট, আমি ওই ইঁদুরটার অসভ্যতা অনেকদিন সহ্য করেছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ওকে এবার উচিত শিক্ষা দেব।

নির্দিষ্ট দিনে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে সাশা দেখল মঞ্চের কিনারায় বসে আছে ফাভেল। সে একা নয়, তার আশেপাশে রয়েছে একদঙ্গল লোক, স্পষ্টই বোঝা যায় ওরা সবাই ফাভেলের স্যাঙাত সকলের মুখেই জ্বলছে সিগারেট, ধোঁয়ার আড়ালে মানুষগুলোর মুখ হয়ে গেছে অস্পষ্ট। মাঝে মাঝে লোকগুলোকে চাপা গলায় কিছু বলছিল ফাভেল। সাশা একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পেল।

প্রথম রাউন্ডে বার বার আক্রমণ করল মার্সেলো। প্রত্যেকবারই তার আক্রমণ এড়িয়ে জমিতে-পেতে-রাখা ক্যানভাসের উপর তাকে ফেলে দিল সাশা। মার্সেলো অবশ্য প্রতিবারই লম্ববান অবস্থা থেকে দণ্ডায়মান হয়েছে এবং খ্যাপা ষাঁড়ের মতন তেড়ে গেছে প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে। হঠাৎ একবার মার্সেলোর কোমর জড়িয়ে ধরে কুস্তির এক প্যাঁচে তাকে জমিতে পেড়ে ফেলল সাশা। মার্সেলো তার শরীরটাকে বাঁকিয়ে ফেলল, ঘাড়ের পেশিগুলোর প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করে কঁধ দুটোকে জমির উপর তুলে রাখল কিছুতেই সাশা তাকে চিত করতে পারল না। প্রথম রাউন্ডের লড়াই সমান সমান হল।

দ্বিতীয় রাউন্ডে সাশার শ্বাসকষ্ট শুরু হল–ফাভেল ও তার বন্ধুদের সিগারেট উদগিরণ করছে ধূম্রজাল এবং সেই ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে মঞ্চের উপর উঠে এসে বিব্রত করছে সাশাকে। মাঝে মাঝেই ধোঁয়ার আক্রমণে কেশে উঠছে সাশা।

হঠাৎ লড়াই থামিয়ে মঞ্চের ধারে এসে দাঁড়াল সাশা, নীচে ফাভেলের দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, তুমি যেভাবে সিগারেট ফুঁকছ, ওভাবে কেউ সিগারেট টানে না। ধোঁয়ার জন্যে আমাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। দর্শকরা এখানে এসেছে কুস্তি দেখতে আশা করি তাদের কথা ভেবে তোমরা আর সিগারেট টানবে না। এভাবে ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে কাশতে কাশতে কুস্তি লড়া সম্ভব নয়।

ফাভেল হাতের সিগারেট ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে আগুন নিবিয়ে দিল। তার বন্ধুরাও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করল। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল লড়াই। কৌশল ও শক্তির যুদ্ধে কৌশলই জয়ী হল। অর্থাৎ সাশার কাছে পরাজিত হল মার্সেলো।

মঞ্চের উপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে ফাভেল ও তার বন্ধুদের দেখতে পেল সাশা। ফাভেলের মুখ রক্তহীন বিবর্ণ–সাশা বুঝল ফাভেল মার্সেলোর উপর বাজি ধরেছিল, সেই বাজি সে হেরে গেছে। সাশার শরীর ও মন তখনও উত্তপ্ত, তখনও সে থেকে থেকে কাশছে, ফাভেলকে দেখেই তার মাথায় ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল। দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে এসে সে ফাভেলের সামনে দাঁড়াল।

সিনর ফাভেল! তুমি যদি আমার মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিতে চাও, সাশা বলল, তাহলে আমি যখন একা থাকব, তখনই ওই কাজটা করো। তুমি আর তোমার বন্ধুরা শুধু আমাকেই বিব্রত করোনি, প্যারাগুয়ে থেকে যে ভদ্রলোক এখানে এসেছেন জনতাকে আনন্দ দিতে তাঁকেও তোমরা যথেষ্ট জ্বালিয়েছ।

ফাভেলের জবাবের জন্য অপেক্ষা না-করে পাশের দরজা দিয়ে মঞ্চের পিছন দিকে চলে গেল সাশা। হঠাৎ কেউ তাকে স্পর্শ করল। ঘুরে দাঁড়িয়ে ডম কার্লোসকে দেখতে পেল সাশা। কার্লোসের পাশে দাদা আর্নস্ট।

এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে চলে এসো, কার্লোস বলল, জামাকাপড় ছাড়ার দরকার নেই। সমস্ত টাকাপয়সা আর তোমার পোশাক পরিচ্ছদ আমার কাছেই রয়েছে। বাইরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে একটা ঘোড়ার গাড়ি। চলে এসো চটপট, এখন আর একটা কথাও নয়।

পথে কোনো কথা হল না। ডম কার্লোস শুধু একবার বলেছিল জনতার মধ্যে অসন্তোষ আর ক্ষোভ সে লক্ষ করেছে। আর্নস্টের কুটিরে পৌঁছে তারা যখন ধূমপান করছে, সেইসময় সাশাকে লক্ষ করে কার্লোস বলল, তুমি ফাভেলকে চটিয়ে কাজটা ভালো করনি। তুমি তাকে অপমান করেছ। ফাভেল বাজি হেরে বেশ কিছু টাকা গচ্চা দিয়েছে। তার উপর তোমার কথায় উপস্থিত সকলেই বুঝেছে ফাভেল বাজি হেরেছে। টাকা আর ইজ্জত, দুটোই সে হারিয়েছে। সেইজন্য তোমাকেই সে দায়ী করবে। কিছুতেই সে তোমাকে ক্ষমা করবে না।

সাশা উদ্ধতভাবে জবাব দিল, ফাভেল আমার ক্ষতি করতে পারবে না। সে যদি আমার সঙ্গে লাগতে আসে, তাহলে সে-ই বিপদে পড়বে।

ডম কার্লোস বলল, আমার কথা তুমি বুঝতে পারছ না। আমাদের রীতিনীতি তোমাদের মতো নয়। আমরা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য জীবন বিপন্ন করতে পারি, কিন্তু অপমানিত হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। এইভাবে প্রতি মুহূর্তে ফাভেলকে ছোটো করার চাইতে তাকে খুন করলেও তার প্রতি যথেষ্ট দয়া দেখানো হত।

পূর্বোক্ত ঘটনার পর কয়েকটা মাস অতিবাহিত হল। মার্সেলোকে কুস্তিতে হারিয়ে বেশ মোটা টাকা, পেয়েছিল সাশা আর আর্নস্ট। কিন্তু তারপর যা ঘটল, তার ফলে দুই ভাইয়ের সঙ্গে ফাভেলের বিবাদ আরও জটিল এবং আরও মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়ে চলল।

ডম কার্লোস একদিন এসে সিমেল ভাইদের জানাল পাসো ফানডো শহরে লিওন বেদুইনোনামে এক দুর্ধর্ষ তুর্কি মল্লযোদ্ধা উপস্থিত হয়েছে। লোকটি সাও পাওলো শহরে যাওয়ার পথে পাসো ফানডোতে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাবে–উদ্দেশ্য, এই শহরে কুস্তি লড়ে কিছু অর্থ উপার্জন।

খবরদার,ডম কার্লোস সাশাকে বলল, তুমি বেদুইনোর সঙ্গে কুস্তি লড়তে যেয়ো না। ওই লোকটা মাংসপেশির চর্চা করে নিজেকে বলিষ্ঠ বলে প্রচার করে না। কিন্তু ওই তুর্কি মল্লযোদ্ধা ভীষণ শক্তিমান দক্ষিণ অঞ্চলে এক ইংরেজ কুস্তিগিরের সে ঘাড় ভেঙে দিয়েছে। হয়তো মানুষ খুনের অভিযোগে লোকটাকে আমি গ্রেপ্তার করতে পারি। তুমি বেদুইনোর সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা করতে গেলে তোমার জীবন বিপন্ন হবে। আমি তোমায় সতর্ক করে দিচ্ছি।

শহর-চত্বরে যেখানে মার্সেলোর সঙ্গে লড়াই করেছিল সাশা, সেইখানেই এক রবিবার সন্ধ্যায় জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল তুরস্ক-দেশীয় মল্লযোদ্ধা–লিওন বেদুইনো। লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল সাশা যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া, বৃষস্কন্ধ, কবাটবক্ষ; শালগাছের গুঁড়ির মতো পেশিস্ফীত দুই বাহুর অধিকারী বেদুইনোকে দেখলেই বোঝা যায় মানুষটা অমিতশক্তিধর। সাশার পূর্বর্তন প্রতিদ্বন্দ্বী মার্সেলো এই মল্লবীরের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ। দেহের তুলনায় বেদুইনোর মাথাটি খুবই ছোটো, নাকের তলায় বিশাল গোঁফ দুই প্রান্তে সরু হয়ে উঠে গেছে গালের দুই ধারে এবং তার স্থল ওষ্ঠাধরে যে নীরব হাসির রেখা খেলা করছে, তাতে সরল কৌতুকের পরিবর্তে ফুটে উঠেছে নিষ্ঠুর হিংসার আভাস। প্রথম দর্শনেই লোকটিকে অপছন্দ করল সাশা সিমেল।

মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে বেদুইনো চ্যালেঞ্জ জানাল–জনতার মধ্যে যদি কোনো সাহসী মল্লযোদ্ধা থাকে, তাহলে সে তার সঙ্গে কুস্তি লড়তে রাজি।

এইবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বেদুইনোর সর্বাঙ্গ জরিপ করল সাশা। লোকটার কাধ ও পৃষ্ঠদেশ বিশাল মাংসপেশিতে সমৃদ্ধ। সাশা জানত কাধ আর পিঠের বৃহৎ মাংসপেশি মল্লযুদ্ধ বা কুস্তির পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু ওই ধরনের পেশি বক্সিং মুষ্টিযুদ্ধের পক্ষে অসুবিধাজনক। কারণ, কঁধ ও পিঠের স্থূল মাংসপেশি প্রচণ্ড শক্তির আধার হলেও দ্রুত আঘাত হানতে অপারগ–অতএব যে মাংসপেশির বিস্তার কুস্তির পক্ষে অত্যাবশ্যক, সেই পেশিশক্তি বিদ্যুত্বৎ ক্ষিপ্ত বক্সার বা মুষ্টিযোদ্ধার বিরুদ্ধে একেবারেই অকেজো। সাশা বুঝে নিল কুস্তিতে বেদুইনোকে পরাস্ত করতে না-পারলেও মুষ্টিযুদ্ধে তাকে সে নির্ঘাত হারাতে পারবে।

মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে মল্লবীরকে উদ্দেশ করে সাশা বলল, বেদুইনো, আমার একটি শর্ত যদি মেনে নাও, তাহলেই আমি কাল রাতে তোমার সঙ্গে কুস্তি লড়তে রাজি আছি।

ভ্রূ কুঁচকে বেদুইনো সন্দিগ্ধকণ্ঠে বলল, শর্তটা কী?

কাল রাতে আমি তোমার সঙ্গে কুস্তি লড়ব। কিন্তু তার পরের রাতে আমার সঙ্গে তোমার দশ রাউন্ড বক্সিং লড়তে হবে। রাজি?

কয়েকটি মুহূর্ত চিন্তা করল বেদুইননা, তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, আমি রাজি আছি।

সাশার হঠকারিতায় খুব অসন্তুষ্ট হল ডম কার্লোস, কুস্তির দুই রাউন্ড যদি কোনোরকমে আত্মরক্ষা করতে পারো, তাহলে তুমি বেঁচে যাবে সাশা। তবে বেদুইনোকে তুমি কিছুতেই হারাতে পারবে না।

সাশা বলল, কথাটা ঠিক। ওই দু-রাউন্ড আমি কোনোরকমে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখব। তবে ঘুসির লড়াইতে লোকটাকে আমার কাছে হার মানতে হবে এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

মার্সেলোর সঙ্গে লড়াইতে যে নাট্যশালাটিকে নির্বাচন করা হয়েছিল, এবার বেদুইনোর সঙ্গে কুস্তির জন্য সেই জায়গাটাই নির্বাচিত হল।

এক বিশাল জনতার সমাবেশ ঘটেছিল কুস্তি দেখার জন্য। ডম কার্লোস স্বয়ং উপস্থিত ছিল অকুস্থলে, তার সঙ্গে ছিল ছয়জন শান্তিরক্ষক পুলিশ। সাশাকে কার্লোস জানাল সমাগত জনতার মধ্যে বহু লোক এসেছে পিস্তল বা রিভলভার নিয়ে।

সাশা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, কেন?

কার্লোস বলল, পিস্তলধারীদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে ফাভেলের বন্ধুবান্ধব। তবে আমি তোমার বন্ধুদেরও সতর্ক করে দিয়েছি তারাও পিস্তল নিয়ে এসেছে। ফাভেল যদি গুলি চালায়, তাহলে তাকে আমি বাধা দিতে পারব না, কিন্তু ব্যাপারটা যাতে সমানে সমানে হয় সেটা আমি দেখব।

ফাভেলের যে একটি পরিকল্পনা ছিল, সেটা পরে প্রমাণ হল। আর সেই পরিকল্পনা সাশাকে সম্ভাব্য মৃত্যু অথবা গুরুতর জখম হয়ে পঙ্গুত্বের দুর্ভাগ্য থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।

লড়াই শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সাশা বুঝতে পারল বেদুইনো লোকটা মার্সেলের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। কুস্তির কায়দাকানুনও সে ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছে। সাশা তার জীবনে কখনো এমন ভয়ংকর কুস্তিগিরের পাল্লায় পড়েনি। সে বুঝতে পারছিল তুর্কি পালোয়ান যদি তাকে একবার দুই হাতের বাঁধনে বন্দি করতে পারে তাহলে তার পরাজয় অবধারিত–এমনকী হাত-পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে যাওয়াও নিতান্ত অসম্ভব নয়। আত্মরক্ষার জন্য মাঝে মাঝে সাশা দড়ির উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ছিল। কুস্তির নিয়ম অনুসারে দড়ি ছেড়ে রিং-এর ভিতরে না-আসা পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপেক্ষা করতে হয় বেদুইনোকেও তাই ওই সময়টুকু আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে হচ্ছিল।

একবার যখন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মাথায় মাথা লাগিয়ে পরস্পরকে হাত দিয়ে কাবু করার চেষ্টা করছে, সেইসময় হঠাৎ এক ধাক্কায় সাশার মাথাটা একপাশে কাত হয়ে গেল–সঙ্গেসঙ্গে একটা তীব্র যন্ত্রণার ঢেউ উঠে এল মাথার বাঁ-দিক থেকে! তুরস্কের কুস্তিগির সাশার বাঁ-কান কামড়ে ধরেছে! সাশার ঘাড় বেয়ে গড়িয়ে নামছে লাল রক্তের ধারা!

বেদুইনোর চর্বিবহুল বিশাল উদরে প্রচণ্ড বেগে ঘুসি মারল সাশা। ফল হল তৎক্ষণাৎ দম নেওয়ার জন্য বেদুইনো হাঁ করতেই কানের উপর কামড়টা আলগা হয়ে গেল।

আবার যদি কামড়াতে চেষ্টা করো, দাঁতে দাঁত ঘষে সাশা বলল, এটা তাহলে আর কুস্তি থাকবে না, একেবারে খুনোখুনি হয়ে যাবে।

বেদুইনো চাপা গলায় গর্জন করে কিছু বলল, তার মুখের ভাব হয়ে উঠল ভয়ংকর সে আবার ঝাঁপ দিল সাশাকে লক্ষ করে। আবার দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল; সেইসময় অস্ফুট স্বরে বেদুইনো জানিয়ে দিল একবার যদি সে প্রতিদ্বন্দ্বীর গলাটা নাগালের মধ্যে পায়, তাহলে শ্বাসরোধ করে তাকে সে হত্যা করবে। হত্যার অপরাধে ক্রুদ্ধ জনতা হয়তো তাকে ফাঁসি দিতে পারে, কিন্তু সেই ঝুঁকি নিতে সে প্রস্তুত। সাশা বুঝল লোকটা ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, এই লড়াই এখন আর প্রতিযোগিতার লড়াই নয়–সাশার পক্ষে এটা এখন প্রাণ বাঁচানোর লড়াই।

আবার বেদুইনের মতো হাত ছাড়িয়ে সরে গেল সাশা। খ্যাপা ষাঁড়ের মতোই তার দিকে আবার তেড়ে এল বেদুইনো। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সাশার কানে এল ফাভেলের তীব্র চিৎকার ওহে তুর্কি যোদ্ধা! এই সাদা চামড়ার মানুষটাকে খুন করো!

সঙ্গেসঙ্গে পিস্তল তুলে শূন্যে গুলি ছুড়ল ফাভেল। তৎক্ষণাৎ চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়াল ডম কার্লোস, পরক্ষণেই তার পিস্তল সগর্জনে অগ্নিবর্ষণ করল মাথার উপর ছাতের দিকে। সেই আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আরও কয়েকটা আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে উঠল জনতার ভিতর থেকে। বেদুইনো গুলির শব্দ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর মঞ্চ থেকে নেমে অন্তর্ধান করল বিদ্যুদবেগে!

শূন্যে পিস্তল নাচিয়ে ডম কার্লোস সবাইকে শান্ত হতে বলল। সকলেই জানত কার্লোসের পিস্তল কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না, তাই যারা গুলি ছুঁড়েছিল তারা হাতের অস্ত্র পকেটে লুকিয়ে সুবোধ বালকের মতো শান্ত হয়ে দাঁড়াল। ম্যানেজার জানিয়ে দিল নাট্যশালার ভিতর এমন আচরণ করা অত্যন্ত অন্যায় এবং পরবর্তী রাত্রে মুষ্টিযুদ্ধের প্রতিযোগিতা হবে না। কিন্তু দর্শকরা তখন লড়াইয়ের নেশায় মত্ত, তারা চিৎকার করে আপত্তি জানাতে লাগল।

প্রতিযোগীদের জন্য যে-ঘরটা নির্দিষ্ট ছিল, সেই ঘরে কার্লোসকে নিয়ে প্রবেশ করল সাশা। সেখানে তখন বেদুইনো দ্রুতবেগে গায়ে জামা চড়াচ্ছে, তার চোখ মুখ থেকে মিলিয়ে গেছে হিংস্র আক্রোশের আভাস। সাশাকে দেখেই সে বলে উঠল, আমি পেশাদার কুস্তিগির। আমি মুষ্টিযোদ্ধা নই। বক্সিং আমি লড়তে জানি না। আমি এখনই এই জায়গা থেকে চলে যেতে চাই।

ডম কার্লোস তাকে আশ্বাস দিয়ে জানাল পরের রাতে ওখানে আর গুলি চলবে না। বেদুইনো বলল, টিকিট বিক্রির অর্ধেক টাকা যদি লড়াই শুরু হওয়ার আগেই তাকে দেওয়া হয়, তাহলে সে মুষ্টিযুদ্ধ লড়তে রাজি আছে। সাশা তার প্রস্তাবে সম্মতি জানাল। বেদুইনোর ব্যবহারে সাশা খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিল, মুষ্টিযুদ্ধের আসরে লোকটাকে ভালো হাতে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই সে প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিল।

মুষ্টিযুদ্ধ শুরু হল পূর্বোক্ত নাট্যশালায় রাত্রে। দেখা গেল বেদুইনো দক্ষ মল্লযোদ্ধা হলেও মুষ্টিযুদ্ধে সে নিতান্তই আনাড়ি। মুখের উপর কয়েকটা ঘুসি পড়তেই সে হঠাৎ দাঁত দিয়ে তার হাতের দস্তানার ফিতা খুলতে সচেষ্ট হল।

সর্বনাশ! সাশা বুঝল মুষ্টিযুদ্ধের দস্তানা থেকে হাত দুটিকে মুক্ত করতে পারলেই বেদুইনো তাকে আক্রমণ করবে এবং তাহলে সাশার প্রাণসংশয় অবধারিত। শরীর ঝুঁকিয়ে বেদুইনো দাঁত দিয়ে ফিতা খুলছিল, একটা হাত দস্তানা থেকে মুক্ত করে সে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চাইল সাশার দিকে। তৎক্ষণাৎ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বেদুইনোর চোয়ালে ঘুসি মারল সাশা। বেদুইনো সেই আঘাত সহ্য করতে পারল না, ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। সাশা এত জোরে ঘুসি চালিয়েছিল যে, তার কবজি প্রায় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কারো সঙ্গে করমর্দন করার অবস্থাও ছিল না তার।

সাশা জয়লাভ করাতে বিলক্ষণ খুশি হয়েছিল ডম কার্লোস। সে সাশাকে অভিনন্দন জানাতে এল প্রতিযোগীদের জন্য সংরক্ষিত ঘরে। সাশা বলল, লড়াইয়ের আগে বা পরে সে একবারও ফাভেলকে দেখতে পায়নি।

সে ছিল মঞ্চের কাছেই। তুমি তাকে দেখতে পাওনি, কার্লোস বলল, তবে আমি ছিলাম বলে সে এবার তোমায় ঘাঁটাতে সাহস পায়নি। কিন্তু ফাভেল তোমাকে ভবিষ্যতে বিপদে ফেলবে এটা জেনে রাখো। তুমি তাকে লোকের চোখে হেয় করেছ। সে ওই অপমান কখনো ভুলবে না সাশা।

বেদুইনোর সঙ্গে লড়াইতে নেমে সাশা যে-টাকা পেয়েছিল, সেই টাকায় দুটি খচ্চর ও একটি ঘোড়া কিনল সাশা আর আর্নস্ট। কিছু যন্ত্রপাতিও কিনল তারা। আর একটি খচ্চর কিনতে পারলেই দুই ভাই হিরার সন্ধানে মাত্তো গ্রুসোতে রওনা হতে পারে। একটি খচ্চরকে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য রাখল সাশা, নাম দিল বেদুইনো!

মার্সেলো আর বেদুইনোর সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়লাভ করে পাসো ফানডো শহরে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠল সাশা। বিশেষ করে রুপার কারখানার সহকর্মী শ্রমিকরা সাশার কৃতিত্বে খুবই খুশি হয়েছিল। তবে ফাভেল যে সাশা সম্পর্কে তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল প্রায়ই। অবশ্য সোজাসুজি সাশার সঙ্গে সে অভদ্র ব্যবহার করেনি একবারও।

কারখানার পিছনে একটা ঘরে শ্রমিকদের খেতে দেওয়া হত; ওই ঘরে একদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের সময়ে ভুল করে বসে পড়েছিল সাশা। ফাভেল সাশার ঠিক পিছনেই ছিল, সে হঠাৎ বলে উঠল, সরে যাও, কুত্তার বাচ্চা! এটা আমার জায়গা।

মুহূর্তের মধ্যে ঘর হয়ে গেল স্তব্ধ। সকলেই ভাবছিল এই বুঝি শুরু হয় মারামারি। কিন্তু না সাশা ভুল স্বীকার করে তার নিজের জায়গায় সরে গেল। একবার তার দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে সাশা বুঝল, আর্নস্ট রাগে আগুন হয়ে গেছে, ভাইয়ের আচরণ সে পছন্দ করেনি যেকোনো সময়ে ফাভেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে আর্নস্ট।

যাই হোক, সেদিন আর কিছু ঘটল না। সেই ঘটনার পরেই ডম কার্লোসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল সাশা। সাক্ষাৎকার হওয়ার পরে তাদের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছিল এবং যে-আলোচনার ফলে জোকুইম গুয়াতে তাইগরেরো সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল সাশা সিমেল–সেইসব কথা সবিস্তারে প্রথম পরিচ্ছদেই বলা হয়েছে, পুনরাবৃত্তি অনাবশ্যক।

ফাভেলের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চেয়েছিল আর্নস্ট। ছোটোভাই সাশার গা বাঁচিয়ে সরে যাওয়ার ব্যাপারটা তার মোটেই পছন্দ হয়নি। সে নিজেই ফাভেলকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। সাশার অনুরোধে নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে সে স্থানত্যাগ করে চলে যেতে রাজি হল। ডম কার্লোসও দুই ভাইকে স্থানত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিল, কারণ পাসো ফানডো শহরে থাকলে ফাভেলের সঙ্গে সিমেল-ভাইদের খুনোখুনি ঘটতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। দু-দিন পরে রাত থাকতেই দুই ভাই শয্যাত্যাগ করল। পরিকল্পনা অনুসারে আর্নস্ট একটি ঘোড়া আর দুটি খচ্চর নিয়ে মালপত্র সমেত উত্তর দিকে রওনা দেবে এবং তিনদিনের পথ পার হয়ে রিও উরুগুয়ে ছাড়িয়ে ভাইয়ের জন্য ক্লিভল্যন্ডিয়া নামক স্থানে অপেক্ষা করবে। হের স্মিথের রুপার কারখানার অবশিষ্ট কাজ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি শেষ করে সাশা তার বেদুইনো নামে খচ্চরটার পিঠে চড়ে যাত্রা করবে এবং দাদার সঙ্গে মিলিত হবে পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে।

আর্নস্টকে বিদায় দিয়ে হের স্মিথের কারখানার দিকে চলল সাশা বেদুইনোর পিঠে চড়ে। পথের মধ্যে ডম কার্লোসের সঙ্গে দেখা হল সাশার। একটা প্রকাণ্ড সাদা টুপি মাথায় চড়িয়ে খচ্চরের পিঠে বসেছিল ডম কার্লোস। সাশাকে দেখে হাসিমুখে টুপি খুলে অভিবাদন জানাল কার্লোস, সুপ্রভাত, সিনর সাশা। আজ সকালেই আমার কুকুর লোবো খুব চিৎকার করছিল। খুব শীঘ্রই আমি আর লোবো কোনো অপরাধীর পিছনে তাড়া করব এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। লোবোর চিৎকার হচ্ছে সেই অভিযানের পূর্বসংকেত।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কারখানার কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে সাশা মালিককে জানিয়ে দিল আর্নস্ট কাজ ছেড়ে চলে গেছে। অসমাপ্ত কাজ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি শেষ করে সাশা নিজেও কারখানা ছেড়ে চলে যাবে অন্যত্র। দু-দুজন দক্ষ কারিগর তার কারখানা ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে মালিক দুঃখপ্রকাশ করল। ফাভেল কিছু বলল না। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে সাশা বুঝল লোকটা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। হের স্মিথ তার বিদায়ভাষণ জানানোর পর সাশা হঠাৎ এগিয়ে এসে ফাভেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, আমি চিরদিনের মতো বিদায় গ্রহণ করছি, আর কখনো এখানে ফিরে আসব না। আমার উপর কারো রাগ বা বিদ্বেষ থাকলে আমি দুঃখিত হব। সিনর ফাভেল, তুমি কি আমার সঙ্গে করমর্দন করবে না?

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে নত হয়ে অভিবাদন করল ফাভেল, তারপর সাশার প্রসারিত হাত চেপে ধরল, নিশ্চয়ই সিনর। আমি সানন্দে তোমার হাতে হাত মেলাচ্ছি। তোমার মতো গুণী মানুষের বিচ্ছেদ সমগ্র কারিগর-সম্প্রদায়ের পক্ষেই দুঃখজনক।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মালিক হের স্মিথকে উদ্দেশ করে সে বলে উঠল, আমার যন্ত্রপাতিগুলো আমি একবার পরীক্ষা করব, আশা করি কেউ কিছু মনে করবে না।

ইঙ্গিতটা অত্যন্ত অপমানকর। সাশার মনে হল কেউ যেন তাকে সজোরে থাপ্পড় মারল।

হের স্মিথ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, তুমি ও-কথা বললে কেন? তোমার খুব অন্যায় হয়েছে ফাভেল।

ফাভেল বলল, ও আমার যন্ত্র নিয়ে কাজ করছিল। ও চলে যাওয়ার আগে আমার জিনিসগুলো ঠিক আছে কি না, সেটা আমি দেখে নিতে চাই।

সাশা ফাভেলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে বুঝতে পারছিল ফাভেলের দিকে তাকিয়ে থাকলে সে আর রাগ সামলাতে পারবে না। তার মনের যে অবস্থা, তাতে একবার লড়াই শুরু হলে ফাভেলকে খুন না-করে সে থামতে পারবে না। মুখ নামিয়ে সে একমনে কাজ করতে লাগল…

সারাদিন কাজ করেও হাতের কাজ শেষ করতে পারেনি সাশা, তাই রাতেও সে কাজ করছিল। একটা রুপোর তৈরি রেকাব প্রায় শেষ করে এনেছিল সাশা, এইবার শুধু কয়েকটা সূক্ষ্ম কাজ হয়ে গেলেই তার ছুটি। কারখানায় কেউ ছিল না, সাশা একাই কাজ করছিল। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে সাশা ঘুরে দাঁড়াল এবং দেখল তার পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছে ফাভেল।

প্রায় সঙ্গেসঙ্গে দরজাটা খুলে গেল, ভিতরে প্রবেশ করল হের স্মিথ। ফাভেলকে দেখে সে প্রশ্ন করল, তুমি এত রাত্রে কীজন্য এখানে এসেছ?

তীব্রস্বরে উত্তর দিল ফাভেল–সাশাকে শোনানোর জন্যই সে চেঁচিয়ে উঠেছিল, আমার যন্ত্রপাতিগুলো যথাস্থানে আছে কি না দেখতে এসেছি।

সাশা তার হাতের দিকে তাকাল। যে-ফাইলটা নিয়ে সে কাজ করছিল, সাধারণত সেইটা দিয়েই ফাভেল কাজ করে। তবে কারখানার যন্ত্রপাতিগুলোর মালিক হচ্ছে হের স্মিথ। সে ছাড়া

অপর কেউ কোনো যন্ত্রের মালিকানা দাবি করতে পারে না। . সাশা তার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গেসঙ্গে একটা ভারী লোহার যন্ত্র তুলে নিল ফাভেল। তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সাশা র্যাক থেকে তার টুপি আর কোট তুলে নিল এবং হের স্টিথকে উদ্দেশ করে বলল, বিদায় সিনর! আমার কাজ শেষ করে গেলাম। পারিশ্রমিক আমি আগেই পেয়ে গেছি। সুতরাং আমাদের মধ্যে দেনাপাওনার ব্যাপারটাও মিটে গেল।

সাশা বেরিয়ে গেল, কিন্তু জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল না। কারখানা থেকে একটু দূরে একটা গাছের ছায়ায় অন্ধকারের মধ্যে আত্মগোপন করে সে ফাভেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। যাই হোক, কারখানার মধ্যে হের স্মিথকে সাক্ষী রেখে সে কিছু করতে ইচ্ছুক ছিল না। আজকের অপমান সহ্য করা যায় না–ফাভেলকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে শিকার-সন্ধানী শ্বাপদের মতো অপেক্ষা করতে লাগল সাশা।

একটু পরে হের স্মিথের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে। ফাভেলকে গুড নাইট জানিয়ে বিদায় নিচ্ছে মালিক। তারপরেই হঠাৎ নিবে গেল কারখানার আলো। দরজা বন্ধ করে ফাভেল বাইরে এসে দাঁড়াল। এইবার এগিয়ে এল সাশা, ডাকল, ফাভেল!

কণ্ঠস্বর লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াল ফাভেল, পরক্ষণেই চিৎকার করে উঠল, ডাকাত! ডাকাত!

সাশা ছুটে এল ফাভেলের দিকে। গোলমাল শুনে যেকোনো সময়ে অকুস্থলে চলে আসতে পারে হের স্মিথ। না, এখন এখানে মালিকের উপস্থিতি চায় না সাশা। ইতিমধ্যে একটা পিস্তল বার করে ফেলেছে ফাভেল, কিন্তু অস্ত্রটা ব্যবহার করার সুযোগ পেল না সে মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটাকে ছিনিয়ে নিল সাশা। ফাভেল একহাতে সাশার মুখে নখ দিয়ে আঁচড় কাটছিল আর অন্য হাত দিয়ে চেষ্টা করছিল পিস্তলটা আবার হস্তগত করতে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল একটা দুর্বোধ্য জান্তব ধ্বনি!

কারখানার পার্শ্ববর্তী যে-বাড়িটায় হের স্মিথ বাস করে, সেখান থেকে হঠাৎ ভেসে এল তার গলার আওয়াজ, ফাভেল! কী হয়েছে? কীসের গোলমাল শুনছি ওখানে?

এখনই এখানে হের স্মিথ ছুটে আসবে–লড়াই চটপট শেষ করার জন্য অস্থির হয়ে উঠল সাশা, পিস্তলের বাঁট দিয়ে সজোরে হাতুড়ির মতো আঘাত হানল ফাভেলের মাথায়। একটা ভোঁতা ধাতব শব্দ এবং ফাভেল হল ধরাশয্যায় লম্বমান। সাশা ঝুঁকে দেখল ফাভেলের মুখ চাঁদের আলোতে ফ্যাকাশে সাদা মনে হচ্ছে, রক্তহীন সেই বিবর্ণ মুখে প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই।

সাশা সোজা হয়ে দাঁড়াল। এবার পালাতে হবে। সে ফাভেলকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল, খুন করতে চায়নি। তবে খুন যখন হয়েই গেছে, তখন পালানো ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সে স্থানত্যাগ করার আগেই নিকটবর্তী ঝোপ থেকে একটা মূর্তি উঠে দাঁড়াল–তার মাথার উপর সাদা টুপিটা দেখেই মানুষটাকে চিনতে পারল সাশা। ডম কার্লোস!

শেষ পর্যন্ত এই কাণ্ডটা ঘটালে? কার্লোস বলল, তুমি আমার কথামতো শহর ছেড়ে চলে গেলে না কেন? তাহলে এই ব্যাপারটা ঘটত না।

ধরাশায়ী ফাভেলের দিকে সে তাকাল, একবার পা দিয়ে নিস্পন্দ দেহটাকে স্পর্শ করল।

লোকটা আমায় চোর বলেছিল, সাশা বলল, ওর কাছে কৈফিয়ত না-নিয়ে আমি চলে যেতে পারি না।

চোর বলার জন্য আবার কৈফিয়ত কীসের? কার্লোস বলল, হয় তুমি চুরি করেছ, নয়তো চুরি করনি। এক্ষেত্রে আমি ধরে নিচ্ছি তুমি চুরি করনি।

আলবত আমি চুরি করিনি। সাশা ক্রুদ্ধস্বরে বলল, মুখটাকে আমি সেই কথাটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।

তুমি বেশ ভালোভাবেই সে-কথা বুঝিয়ে দিয়েছ, কার্লোস বলল, এখন আমাকে বুঝতে হবে লোকটা এখনও বেঁচে আছে কি না। তুমি এখন এখান থেকে চটপট সরে পড়ো। হের স্মিথ এখানে এসে পড়বে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে।

বাক্যব্যয় না-করে তৎক্ষণাৎ স্থানত্যাগ করল সাশা। বেদুইনোর পিঠে দীর্ঘ বনপথ অতিক্রম করে সে যখন একটা নদীর ধারে এসে পৌঁছাল, তখন ভোরের আলো দেখা দিয়েছে। নদী পার হয়ে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে অগ্রসর হল সাশা। হঠাৎ পিস্তলের আওয়াজ পেয়ে সে চমকে উঠল। শব্দ লক্ষ করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই তার চোখে পড়ল নদীর অপর তীরে উচ্চভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে ডম কার্লোস। সাশার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় ঘটতেই মাথা থেকে কার্লোস সাদা টুপিটা খুলে ফেলল এবং পিস্তল তুলে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ল।

সাশা বুঝল কার্লোস ইচ্ছা করলে পথের মধ্যেই তাকে ধরে ফেলতে পারত। মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাশা বেদুইনোকে ছুটিয়ে দিল নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পাসো ফানডোর চাইতে অনেক ছোটো শহর ক্লিভল্যন্ডিয়া। সেখানে পৌঁছে একটা ক্যান্টিনের ভিতর দাদা আর্নস্টকে খুব সহজেই খুঁজে পেল সাশা। ওই শহরে সব মিলিয়ে প্রায় ছ-শো নরনারী বাস করে। এখানে দুপুর মানেই দিবানিদ্রার সময়। ক্যান্টিনে যখন সাশা প্রবেশ করল, তখন সেখানে বসে ছিল আর্নস্ট একা, দ্বিতীয় কোনো প্রাণী সেখানে উপস্থিত ছিল না।

সাশার মুখের দিকে তাকিয়েই আর্নস্ট বুঝতে পারল একটা কিছু গোলমাল হয়েছে।

তোর নিশ্চয়ই বিপদ হয়েছিল? আর্নস্টের প্রশ্ন।

সাশা মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপর সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।

লোকটা যে মারা গেছে, সে-বিষয়ে তুই কি নিশ্চিত?

আমার মনে হয় ফাভেল মারা গেছে। না হলে ডম কার্লোস আমার পিছনে নদী পর্যন্ত ধাওয়া করত না।

ডম কার্লোস যেমন ধূর্ত, তেমনই বিচক্ষণ, আর্নস্ট বলল, খুব সম্ভব তুমি ওই এলাকা ছেড়ে চলে গেছ কি না সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল। মুখে সে যা-ই বলুক, তোমার পিছনে তাড়া করার ইচ্ছা তার কখনোই ছিল না।

কয়েক বছর পরে সাশা জানতে পেরেছিল তার দাদার অনুমান নির্ভুল। পাসোফানডো ছেড়ে ডম কার্লোস যখন সাশাকে অনুসরণ করেছিল, সেইসময় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ফাভেল মারা যায়নি। দু-দিন ধরে সাশাকে অনুসরণ করেছিল ডম কার্লোস। তার কারণ, সাশা যে উক্ত প্রদেশ ত্যাগ করেছে সে-বিষয়ে সে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হতে চেয়েছিল। অবশ্য তখন সাশা জানত না যে, ফাভেল বেঁচে আছে। সে ধরে নিয়েছিল ফাভেলের হন্তারক হিসেবে পুলিশ তাকে খুঁজছে। অতএব ক্লিভল্যন্ডিয়া ছেড়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়ার জন্য সাশা ব্যস্ত হয়ে উঠল। পরের দিন সকালেই দুই ভাই ক্লিভল্যান্ডিয়া ছেড়ে মাত্তো গ্রসোর পথে উত্তর দিকে রওনা হল।

হিরা যেখানে পাওয়া যায়, সোজাসুজি সেই জায়গাটার দিকে অগ্রসর হতে সাহস পেল না দুই ভাই। কারণ, পথ অতিশয় দুর্গম, অজস্র জলাভূমির মাঝখানে পথের দিশা হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা তো আছেই, তার উপর বনবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের কবলে পড়ার ভয় রয়েছে। তাদের খপ্পরে পড়লে সশরীরে ফিরে আসার সম্ভাবনা অতিশয় ক্ষীণ। কাজেই দেরি হলেও ঘোরাপথে–যে-পথে জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে লোকালয় দেখা যায় সেই পথে যাওয়াই নিরাপদ।

আরও একটি বিষয় সাশার মনে ঝড় তুলেছিল। জোকুইম গুয়াতো নামে যে-লোকটির কথা ডম কার্লোস তাকে বলেছিল–বাস্তবে সত্যিই তার অস্তিত্ব আছে কি না জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল সাশা। সে জানত মাত্তো গ্রসোর মালভূমিতে যে হিরা পাওয়া যায়, তার সন্ধান পাওয়ার জন্যই উগ্রীব হয়ে রয়েছে তার দাদা। কিন্তু হিরা নয়–জোকুইম নামক অসাধারণ মানুষটি সম্পর্কেই অধিকতর কৌতূহলী ছিল সাশা। যদি সত্যিই বাস্তবে ওই লোকটির অস্তিত্ব থাকে, তাহলে মার্সেলো আর বেদুইনোর সঙ্গে লড়াইয়ের চাইতেও অনেক বেশি ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে চলেছে সাশা।

দাদার কাছে মনের গোপন ইচ্ছা খুলে বলল না সে, শুধু সাও লরেংকোর দিকে যে বনপথ চলে গেছে, সেই পথ ধরতে দাদাকে পরামর্শ দিল। কার্লোসের কাহিনি যদি সত্য হয়, তাহলে ওই পথে গেলেই জোকুইমের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে।

.

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

কয়েক সপ্তাহ ধরে পূর্ব প্যারাগুয়ের আবাদ করা জমির উপর দিয়ে অশ্ব ও অশ্বতর চালিয়ে ভ্রমণ করল দুই ভাই। মাতে বা ব্রেজিলের চা এখানেই জন্মায়। যেসব জায়গায় আবাদ করা হয়নি, সেইসব জায়গাতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে নিবিড় অরণ্য। পথ চলতে চলতে যেখানে লোকালয় পাওয়া গেছে, সেইখানেই বিশ্রাম নিয়েছে আর্নস্ট আর সাশা। লোকালয় থেকে তারা খাদ্য সংগ্রহ করেছে তো বটেই, অধিকন্তু টাকা রোজগার যা করেছে, তা-ও পরিমাণে নেহাত কম নয়। ব্রেজিলের ওইসব অরণ্যবেষ্টিত স্থানে যেসব মানুষ থাকে, তারা বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র রাখলেও ওইসব অস্ত্রের যত্ন নিতে জানে না। ফলে বন্দুক, পিস্তল প্রভৃতি অস্ত্র প্রায়ই অকেজো হয়ে যায়। দুই ভাই ওই অকেজো অস্ত্রের মেরামতির কাজে খুবই দক্ষ হয়ে উঠেছিল এবং তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন গ্রামে ও শহরে। তাদের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় না-থাকলেও ভ্রাম্যমাণ পথিকের মুখে দক্ষ মিস্ত্রি হিসাবে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূরদূরান্তে।

একদিন একটা ছোটো জনবসতির মধ্যে যখন তারা ঘোড়া আর খচ্চর চালিয়ে এসে পড়েছে, সেইসময় একটি প্রবীণ পুরুষ তাদের অভিবাদন জানিয়ে বলল, আমি এই এলাকার মেয়র। আমার নাম ইউসেবিও। আমি বোধহয় দুই বিখ্যাত রুশ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলছি, যারা অকেজো বন্দুক-পিস্তল মেরামত করতে জানে এবং অসুস্থ রোগীকে সুস্থ করে তোলে?

গভীর অরণ্যের মধ্যেও যে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সে-কথা জেনে দুজনেই খুব আশ্চর্য হল, খুশিও হল। সাশা মেয়রকে বলল নানা ধরনের ওষুধ তারা সঙ্গে রাখে বটে, রোগ সারানোর চেষ্টা করে এ-কথাও মিথ্যা নয় তবে সেজন্য তারা পারিশ্রমিক গ্রহণ করে না।

জনবসতির এক পাশে বাঁশ আর পাতা দিয়ে একটা গির্জা তৈরি করা হয়েছে। গির্জার পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে একটা অগভীর নদী। ওই নদীর ধারে বয়স্ক মানুষটির নির্দেশ অনুসারে ঘোড়া আর খচ্চরদের নিয়ে গেল আর্নস্ট। উদ্দেশ্য জন্তুগুলোর পিঠ থেকে মালপত্র খুলে তাদের ভারমুক্ত করা এবং নদীর জলে তাদের তৃষ্ণা নিবারণের সুযোগ দেওয়া।

কয়েকদিনের জন্য যদি একটা ঘর ভাড়া পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের সুবিধা হয়, সাশা  বলল, যে কয়দিন আমরা থাকব, সেই কটা দিন আমরা চুপচাপ বসে থাকব না যেসব অকেজো বন্দুক-পিস্তল আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে, সেগুলোকে আমরা আবার ব্যবহারের উপযুক্ত করে দেব।

বয়স্ক মানুষটি জানাল থাকার ব্যবস্থা করতে তার অসুবিধা হবে না। তারপর সে বলল, প্রথমেই একটা গুরুতর ব্যাপারে আমি তোমাদের সাহায্য চাইব। আমার বাড়িতে একজন অতিথি আছে। তার দুই পায়ে ঘা হয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, লোকটা আর হাঁটাচলা করতে পারছে না।

আর্নস্ট গেল তাদের বহনকার্যে নিযুক্ত পশুগুলোর পরিচর‍্যা করতে নদীর ধারে, আর সাশা গেল ইউসেবিও নামে বয়স্ক মানুষটির সঙ্গে তার অতিথিকে দেখতে।

একটি কুঁড়েঘরের ভিতর শায়িত অবস্থায় লোকটিকে দেখতে পেল সাশা। লোকটি ব্রেজিলের অধিবাসী, কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। সাময়িকভাবে কোনো কার্যে নিযুক্ত হলে সেই কাজ সম্পন্ন করে এবং পরবর্তী কাজের সন্ধান করতে থাকে। বর্তমানে এই অঞ্চলে এসে বিপদে পড়েছে পোকার কামড়ে তার দুই পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে এমনভাবে বিষিয়ে উঠেছে যে, তার এখন চলাফেরা করার ক্ষমতা নেই। লোকটির নাম অ্যাপারিসিও। সে জানাল যদি তার পা দুটোকে যথাযথ চিকিৎসা করে তাকে কেউ সম্পূর্ণ সুস্থ করে দিতে পারে, তবে উক্ত চিকিৎসককে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে সন্তুষ্ট করতে সে প্রস্তুত।

গ্যারাপাটা নামক পোড়ার কামড় খুব মারাত্মক। পূর্বোক্ত পোকার কামড়েই অ্যাপারিসিওর পা দুটির অবস্থা হয়েছে অতিশয় শোচনীয়। পচনক্রিয়া প্রায় শুরু হয়ে গেছে। অক্লান্ত সেবা আর উপযুক্ত ঔষধ প্রয়োগ করে তিন সপ্তাহের মধ্যেই লোকটিকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলল সাশা। কথাবার্তার মধ্য দিয়ে ওই সময়ের ভিতর লোকটির সঙ্গে সাশার বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। কথায় কথায় সাশা জানাতে পারল সাও লরেংকো নামে জায়গাটার কাছাকাছি একজন তাইগরেরো থাকে বলে শুনেছে অ্যাপারিসিও। তবে কথাটা কতটা সত্যি তা বলতে পারল না সে। বনাঞ্চলে সত্যমিথ্যা জড়িয়ে নানা ধরনের রটনা শোনা যায় স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে। অ্যাপারিসিও জানাল। লরেংকোর কাছে অবস্থিত তাইগরেরা সম্পর্কে খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে বাস্তবে ওইরকম। কোনো শিকারির অস্তিত্ব নেই–সমস্তটাই বাজে গুজব। কিন্তু সাশা মনে মনে স্থির করল সত্যমিথ্যা সে যাচাই করবে নিজের চোখে; সেই কাজটা করতে হলে অ্যাপারিসিওকে নিয়ে তাকে যাত্রা করতে হবে নির্দিষ্ট স্থান অভিমুখে।

সাশা জানত তার দাদা কিছুতেই জঙ্গলের মধ্যে তাদের পথচলার সঙ্গী হতে চাইবে না। তাই সে আর্নস্টকে বলল তুমি এখন কোক্সিম শহরে থাকো। আমি আর অ্যাপারিসিও যাব উত্তর দিকে। তারপর পছন্দমতো একটা শহরে আবার আমরা মিলিত হব।

আর্নস্ট খুবই বিরক্ত হল, আমি জানি তুমি সেই বুড়ো ইন্ডিয়ান শিকারির খোঁজ করতে চলেছ। বেশ, যাও আমি জঙ্গলের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে রাজি নই। আমি চাই মানুষের সাহচর্য–শহর কিংবা গ্রাম, যেখানে মানুষের বসতি আছে, আমি সেখানে থাকতে চাই।

তখন স্থির হল এখন আর্নস্ট থাকবে কোক্সিম শহরে, তারপর ভাইয়ের কাছে খবর পেলে অন্য কোথাও খুব সম্ভব কুয়ারাশহরে অপেক্ষা করবে সাশার সঙ্গে আবার মিলিত হওয়ার জন্য। ইতিমধ্যে সাশা আর অ্যাপারিসিও অগ্রসর হবে বনজঙ্গল ভেদ করে সাও লরেংকো নামে জায়গাটার দিকে।

যাত্রা শুরু করার আগে বড়ো ভাই আর্নস্টের আপত্তি সত্ত্বেও তাদের পাসো ফানডো শহর ত্যাগ করার আসল কারণ, অর্থাৎ ফাভেল-ঘটিত দুর্ঘটনার বিবরণ সাশা খুলে বলল অ্যাপারিসিওর কাছে। সব শুনে অ্যাপারিসিও বলল, আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেই মাত্তো গ্রসোতে এসব ব্যাপার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। পাসো ফানডোর পুলিশ তাদের এলাকার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের নিয়ে এতই বিব্রত যে, অন্য এলাকায় গিয়ে আসামিকে পাকড়াও করার সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই তাদের নেই। অতএব ফাভেলের ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

পরের দিন তিনজন যাত্রা করল উত্তর দিকে অবস্থিত কোক্সিম শহরের দিকে।

.

সপ্তম পরিচ্ছেদ

আর্নস্ট রইল কোক্সিম শহরে। সাশা ও অ্যাপারিসিও উত্তর-পশ্চিম দিকে দুর্গম বনজঙ্গল আর জলাভূমি পেরিয়ে অগ্রসর হল সাও লরেংকো নামে জায়গাটার দিকে। সাশা শুনেছিল এইসব অঞ্চল তাইগরের প্রিয় বাসস্থান। সতর্ক হয়ে যাতায়াত না-করলে হিংস্র শ্বাপদের আক্রমণে যেকোনো সময়ে পথিকের মৃত্যু ঘটতে পারে।

একদিন সন্ধ্যায় একটা আধ-শুকনো জলাশয়ের ধারে অভিযাত্রীদের তাবু পড়ল। অ্যাপারিসিও একটা হরিণকে গুলি চালিয়ে মেরেছিল। মৃতদেহটাকে তাঁবুর কাছেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের কাছাকাছি একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হল–উদ্দেশ্য ছিল, পরের দিন ওই মাংস দিয়েই উদরের ক্ষুধাকে তৃপ্ত করা হবে।

গাছের ডালে দোলনার মতো হ্যামক টাঙিয়ে তার মধ্যে শুয়ে পড়ল সাশা আর অ্যাপারিসিও। গভীর রাত্রে হঠাৎ সাশার ঘুম ভেঙে গেল। অগ্নিকুণ্ডের আগুন প্রায় নিবে এসেছে, অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে জ্বলছে একটা গোলাপি আভা। মাথার উপর রাতের আকাশে জ্বলছে অসংখ্য তারা, নীচে অরণ্যের বুকে রাজত্ব করছে ঘনীভূত অন্ধকার।

হঠাৎ ঘুম ভাঙার কী কারণ থাকতে পারে ভাবছিল সাশা নিশ্চয়ই কোনো শব্দ তন্দ্রার আচ্ছন্নতা ভেদ করে তাকে চেতনার জগতে ফিরিয়ে এনেছে।

সাশা যখন ঘুম ভাঙার কারণটা নির্ণয় করার চেষ্টা করছে, সেইসময় একটা অত্যন্ত স্পষ্ট ও ভয়ংকর শব্দ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল–

হাড় ভাঙার আওয়াজ!

দাঁতের চাপে হাড় ভাঙার ক্ষমতা রাখে ওই অঞ্চলে একটি মাত্র জানোয়ার

তাইগর!

দারুণ আতঙ্কে সাশার শরীরের রক্ত হিম হয়ে এল। প্রথমে সে ভেবেছিল তাইগরের শিকার হয়েছে অ্যাপারিসিও, কিন্তু একটু দূরে আর একটি গাছের ডালে ঝোলানো হ্যামকের মধ্যে অ্যাপারিসিওর উপবিষ্ট দেহ অন্ধকারের মধ্যেও অস্পষ্টভাবে সাশার দৃষ্টিগোচর হল। সে বুঝতে পারল গাছের ডালে ঝোলানো হরিণের মৃতদেহটাকে মাটিতে টেনে নামিয়ে সেটাকে ভক্ষণ করছে একটি তাইগর। হরিণের হাড়গুলো কড়মড় শব্দে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তাইগরের শক্তিশালী দুই দাঁতালো চোয়ালের চাপে…

হাড় ভাঙার আওয়াজ থামল একটু পরে। তারপর শোনা গেল ঘাসের উপর দিয়ে কোনো গুরুভার বস্তু টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দ এবং কিছুক্ষণ পরে সেই শব্দও গেল মিলিয়ে। সাশা বুঝল মৃত হরিণের দেহটাকে বনের মধ্যে নিয়ে গেল তাইগর অবশিষ্ট মাংস পরবর্তীকালে কাজে লাগবে বলে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর অ্যাপারিসিওর মৃদু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সাশা, সিনর–জেগে আছ?

মাথার কাছে গাছের ডালে চামড়ার ফিতায় আটকানো খাপ থেকে পিস্তলটা হস্তগত করে নেমে এল সাশা। অ্যাপারিসিও তার ফ্ল্যাশলাইট জ্বালল–যেখানে হরিণটা ঝুলছিল, সেখানে এখন কিছুই নেই। দুজনে সারারাত্রি জেগে কাটিয়ে দিল–বলা তো যায় না, আরও একটি ক্ষুধার্ত তাইগরের আবির্ভাব যদি ঘটে এবং মৃগমাংসের অভাবে নরমাংস দিয়েই যদি উক্ত শ্বাপদ উদরের ক্ষুধাকে তৃপ্ত করতে চায়, তাহলে নিদ্রিত মানুষের পক্ষে তাকে বাধা দেওয়া অসম্ভব নিদ্রা যেখানে চিরনিদ্রায় পরিণত হতে পারে, সেখানে রাত্রি জাগরণের কষ্ট নিতান্তই তুচ্ছ…

সকালের আলোতে মধ্যরাতের অতিথির পদচিহ্ন চোখে পড়ল; হরিণটাকে গাছের ডাল থেকে টেনে নামানোর সময়ে তার নখের চিহ্ন গম্ভীর হয়ে মাটিতে বসে গেছে!

সেই রাতের অভিজ্ঞতা দুজনকেই ভীত ও সতর্ক করে দিল। তারা বুঝল নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেলে যেকোনো মুহূর্তে সেই নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিণত হতে পারে। পূর্বোক্ত অভিজ্ঞতার পর থেকে রাত্রে তারা পালা করে জেগে থাকত–একজন যখন নিদ্রাসুখ উপভোগ করত, অপর ব্যক্তি তখন জাগ্রত অতন্দ্র প্রহরায়।

একদিন অপরাহ্নে ঘোড়া আর খচ্চর চালিয়ে ঢালু জমি দিয়ে যখন তারা অগ্রসর হচ্ছে, সেইসময় সবুজ জঙ্গলের ভিতর কুণ্ডলী-পাকানো ধোঁয়া তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ওই ধোঁয়া লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে একটা লোকালয়ের সন্ধান পেল তারা। জনৈক স্থানীয় অধিবাসীকে প্রশ্ন করে তারা জানল এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি গোচারণের জন্য সংরক্ষিত; মালিকের নাম ডম জুয়ায়ো কাজাংগো। একটা সাদা বাড়ির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে স্থানীয় লোকটি জানিয়ে দিল ওই বাড়িতেই বাস করেন মালিক মহাশয়।

নির্দিষ্ট সাদা বাড়িতে গিয়ে দুজনেই মালিকের সঙ্গে পরিচিত হল। ডম জুয়ায়ো বয়স্ক ব্যক্তি, তার চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু সে এখনও যুবকের মতো শক্তসমর্থ। নিজেদের পরিচয় দিয়ে সাশা জানাল সে একজন ভ্রাম্যমাণ মিস্ত্রি, সঙ্গী অ্যাপারিসিও তার সহকারী। বন্দুক, পিস্তল থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের যন্ত্রপাতি তারা মেরামত করতে পারে সিনর জুয়ায়ো কাজ দিলেই তাদের দক্ষতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে পারবেন।

সিনর জুয়ায়োর বাড়িতে অচল হয়ে পড়ে ছিল ছয়টি সেলাইয়ের কল। ওইগুলো মেরামতের জন্য পারিশ্রমিকের অঙ্ক স্থির করতে গিয়েই সাশা বুঝল লোকটি অতিশয় কৃপণ। জুয়ায়োর পোষা গোরুর সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার, পার্শ্ববর্তী অরণ্যভূমি থেকে শুরু করে গয়াজ প্রদেশ পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ জমি তার অধিকৃত, কিন্তু একটি পয়সা খরচ করতে গেলে তার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে!

সাশার ক্যামেরাটি জুয়ায়োর মনে কৌতূহলের সৃষ্টি করল, সে জানতে চাইল এই হতচ্ছাড়া জায়গা থেকে কোন ধরনের ছবি তুলতে চায় সশা? উত্তরে সাশা জানাল তার সহকারী অ্যাপারিসিওর কাছে সে শুনেছে এই জায়গাটা তাইগারদের প্রিয় বাসস্থান, তাই সে ক্যামেরা এনেছে তাইগরের ফটো তোলার জন্য।

আমার অনেকগুলো গোয়ালের মধ্যে একটি গোয়ালে এখন একটা তাইগর আছে, ডম জুয়ায়ো বলল, তুমি ইচ্ছা করলে তার ফটো নিতে পারো।

গোয়ালের মধ্যে তাইগর! সাশা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, জানোয়ারটা কী জীবিত?

অবশ্যই না। ওটা মরে গেছে। ওর শরীর থেকে দুর্গন্ধ বার হচ্ছে। তবে ফটোতে তো আর গন্ধ পাওয়া যাবে না। ফটো তোলার জন্য আমি তোমার কাছে টাকাপয়সা চাইব না।

সাশা জানাল মালিক মহাশয়ের উদারতায় সে অভিভূত, কিন্তু সেই উদারতার সুযোগ নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়–কারণ, মৃত নয়, জীবন্ত তাইগরের ফটো তুলতেই সে উৎসুক।

উত্তরে জুয়ায়ো জানাল জীবন্ত তাইগরের ফটো তোলার জন্য যে-ব্যক্তি নিজের প্রাণ বিপন্ন করে, সে নিরেট মুখ।

সাশা অবশ্য গোয়ালে অবস্থিত মৃত তাইগরের ফটো তুলে নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমাণ করতে সচেষ্ট হল না। অতএব প্রসঙ্গটা ওখানেই চাপা পড়ে গেল।

কয়েকদিন পরের কথা–সাশা পূর্বোক্ত সেলাই-এর কলগুলোকে মেরামত করার চেষ্টা করছে, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে সেখানে উপস্থিত হল ডম জুয়ায়ো।

আমার দুই ছেলে কাল পশ্চিম দিকে শিকার করতে যাবে,জুয়ায়ো বলল, একটা তাইগর ভীষণ উৎপাত করছে। আমার অনেকগুলো গোরু জন্তুটার কবলে মারা পড়েছে। সেটাকে মারার জন্যই যাবে আমার দুই ছেলে। ইচ্ছে করলে তুমিও যেতে পারো ওদের সঙ্গে। হয়তো জ্যান্ত তাইগরের ছবি তোলার সুযোগ পাবে তুমি।

বলাই বাহুল্য, এমন সুযোগ হাতছাড়া করল না সাশা। জর্জ আর বার্নারদো নামে মালিকের দুই ছেলের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে সাশা যাত্রা করল তাইগর শিকারের উদ্দেশে। তাদের সঙ্গে চলল একদল শিকারি কুকুর। মাটিতে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কুকুরের পাল এগিয়ে যাচ্ছিল, তাদের অনুসরণ করছিল অশ্বারোহী দুই ভাই। খুব মনোযোগের সঙ্গে ব্যাপারটা লক্ষ করছিল সাশা পিছন থেকে। তার দুই সঙ্গী কুকুরের সাহায্যে শিকার করতে অভ্যস্ত হলেও ওই ধরনের শিকারে সাশা ছিল অনভিজ্ঞ।

কয়েক মিনিট ঘোড়ার পিঠেই চতুষ্পদ ও দ্বিপদ শিকারিদের অনুসরণ করতে চেষ্টা করল সাশা, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ঘন ঝোপ আর লতার বেড়াজাল ভেদ করে ঘোড়া চালানো অসম্ভব হয়ে উঠল। তখন ঘোড়াটাকে একটা গাছে বেঁধে রেখে সাশা দৌড়াতে শুরু করল। বড়ো ভাই জর্জও ঘোড়া থেকে ছেড়ে পায়ে হেঁটেই অগ্রসর হচ্ছিল। একটু পরে তাকে আর কুকুরের দলটাকে দেখতে পেল সাশা। কুকুরগুলো একটা মস্ত গর্তের সামনে তখন বৃত্তাকারে ঘুরছিল।

জর্জ গর্তটাকে দেখিয়ে ফিসফিস করে বলল, কায়তেতু! অর্থাৎ শুয়োর!

যাচ্চলে! তাইগরের পরিবর্তে শুয়োর! কুকুরগুলো প্রথমে তাইগরের পিছু নিয়ে পরে শুয়োরের গন্ধে আকৃষ্ট হয়েছিল, অথবা প্রথম থেকেই কুকুরদের চালচলন বুঝতে ভুল করেছিল দুই ভাই–সেটা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারল না সাশা। তবে তাইগরের পরিবর্তে শুয়োর শিকারের সম্ভাবনা তাকে আদৌ উৎসাহিত করতে পারেনি। কিন্তু জর্জ আর বার্নারডো শূকরমাংস ভোজনের আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠল, মহা উৎসাহে তারা আগুন ধরিয়ে দিল গর্তের মুখে। কিছুক্ষণ পরেই গর্তের ভিতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে একটা শুয়োর দৌড় দিল ঘন জঙ্গলের দিকে। তৎক্ষণাৎ গর্জে উঠল রাইফেল, লুটিয়ে পড়ল বুলেট-বিদ্ধ শূকরের মৃতদেহ।

সেই রাতে সুস্বাদুবরাহমাংস দিয়ে নৈশভোজন সমাপ্ত করল তিন শিকারি। তিনজন একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লে বিপদ ঘটতে পারে, তাই রাত্রে পালা করে জেগে থাকাই উচিত বলে বিবেচনা করল জর্জ আর সাশা। বার্নারদো বয়সে ছোটো বলে তাকে রাত জেগে পাহারা দেওয়ার কর্তব্য থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল।

পরের দিন খুব ভোরে উঠে আবার কুকুর নিয়ে তাইগরের সন্ধানে ছুটল তিন শিকারি। কিছুক্ষণ পরেই অগ্রবর্তী সারমেয়-বাহিনীর দলপতির কণ্ঠে জাগল গভীর গর্জন! কুকুরের ভাষা বুঝতে পারত জর্জ আর বার্নারদো–দলপতির কণ্ঠস্বর শুনেই তারা বুঝে নিল সারমেয়-বাহিনী এইবার তাইগরের সন্ধান পেয়েছে। শব্দ লক্ষ করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল জর্জ, অন্য দুজন তাকে অনুসরণ করল।

কিছুদূর যাওয়ার পর কর্দৰ্মাক্ত জমির উপর তাইগরের থাবার চওড়া দাগ তাদের চোখে পড়ল। পদচিহ্ন যেখানে রয়েছে, সেখানে এক ইঞ্চি গভীর কয়েকটি গর্তের সৃষ্টি করেছে তাইগরের ভয়ংকর নখগুলো!

জন্তুটা লাফ দিতে প্রস্তুত হয়েছিল, জর্জ মৃদুস্বরে বলল, না হলে মাটিতে নখের দাগ দেখাই যেত না।

এতক্ষণ পর্যন্ত সাশার কল্পনাতেই ছিল তাইগরের অবস্থান, কিন্তু এইবার সে জন্তুটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হল এবং সঙ্গেসঙ্গে তার ধমনীতে রক্তস্রোত চঞ্চল হয়ে সর্বাঙ্গে জাগিয়ে তুলল উত্তেজনার শিহরন!

কুকুরগুলো ছুটতে শুরু করল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্তর্ধান করল শিকারিদের দৃষ্টিসীমার অন্তরালে। সবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে কুকুরগুলোকে অনুসরণ করতে সচেষ্ট হল তিন শিকারি। শিকারকে তাড়া করার আগে ক্যামেরাটাকে বার্নারদোর হাতে তুলে দিয়েছিল সাশা।

আচম্বিতে ভয়ংকর শব্দে বেজে উঠল কুকুরের তীব্র কণ্ঠস্বর! ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে শব্দ লক্ষ করে ছুটল জর্জ আর সাশা। সামনেই একটা ঝোপ, সেটা পার হতেই সাশার চোখে পড়ল একটা ভয়াবহ দৃশ্য–ঝোপের পরেই যে ফাঁকা জায়গাটা রয়েছে, সেখানে মাটির উপর শুয়ে রক্তাক্ত শরীরে ছটফট করছে একটা কুকুর, তার বিদীর্ণ উদর থেকে বেরিয়ে এসেছে ভিতরের নাড়িভুঁড়ি! জন্তুটাকে যন্ত্রণা থেকে আশু মুক্তি দিতে তার মাথা লক্ষ করে গুলি ছুড়ল সাশা–সব শেষ।

ঠিক সেইসময় সামনের বনভূমির দিকে সাশার দৃষ্টি আকর্ষণ করল জর্জ। জর্জের ইঙ্গিত অনুসারে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই যে-দৃশ্যটি সাশার চোখের সামনে ফুটে উঠল–পরবর্তীকালে সেইরকম দৃশ্য বহুবার দর্শন করলেও প্রথম দিনের সেই অভিজ্ঞতা সাশা কোনোদিনই ভুলতে পারবে না

মাটি থেকে প্রায় বিশ ফুট উপরে একটা গাছের ডালে বসে শিকারিদের নিবিষ্টচিত্তে নিরীক্ষণ করছে তাইগর!

তার চোখের দৃষ্টিতে ভয় বা ক্রোধের চিহ্ন নেই, আছে শুধু কৌতূহলের আভাস!

সাশা পরে জানতে পেরেছিল বনবাসী পশুদের মধ্যে তাইগরকে ভয় করে না একটিমাত্র জানোয়ার পেকারি! ওই জন্তুটা হচ্ছে একধরনের বুনো শুয়োর; আকারে ছোটো, স্বভাবে ভয়ংকর। পেকারিরা সর্বভুক, আমিষ বা নিরামিষ কোনো খাদ্যেই তাদের আপত্তি নেই। তাইগরকে দেখলেই পেকারিরা দল বেঁধে আক্রমণ করে। দলের মধ্যে পড়ে গেলে তাইগরের আর রক্ষা নেই, কয়েকটি শত্রুকে হত্যা করলেও দলবদ্ধ পেকারির আক্রমণে মৃত্যু তার অবধারিত। তাই পেকারির দল তাইগরকে আক্রমণ করলেই সে চটপট গাছে উঠে পড়ে। গাছের তলায় অনেকক্ষণ আস্ফালন করার পর পেকারিরা যখন বুঝতে পারে তাইগরকে তারা আর ধরতে পারবে না, তখন তারা দল বেঁধে স্থানত্যাগ করে। এতক্ষণ গাছের উপর বসে সাগ্রহে দলটাকে লক্ষ করছিল তাইগর, এইবার হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে দলছুট একটা পেকারিকে মুখে তুলে নিয়ে সে বিদ্যুদবেগে সরে পড়ে দলটার নাগালের বাইরে। এই তাইগরটাও বোধ হয় কুকুর আর মানুষের মিলিত দলটাকে পেকারি-জাতীয় জীব ভেবে নিয়ে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল।

সাশা এইবার তাইগরের দিক থেকে ফিরে জর্জের দিকে চাইল। সে আশা করেছিল জর্জ গুলি চালানোর জন্য প্রস্তুত হবে, কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়েই সাশা বুঝতে পারল ছেলেটি ভীষণ ভয় পেয়েছে নিদারুণ আতঙ্কে তার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটেছে।

ফিসফিস করে অত্যন্ত মৃদুস্বরে সাশা বলল, যাও, বার্নারদোকে ডেকে নিয়ে এসো। তার কাছে আমার ক্যামেরা রয়েছে।

–জর্জ ধীরে ধীরে পা ফেলে অকুস্থল থেকে অদৃশ্য হল এবং একটু পরেই ছোটো ভাই বার্নারদোকে নিয়ে ফিরে এল যথাস্থানে। বার্নারদের হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে নিজের রাইফেলটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল সাশা, রাইফেলটা ধরো। আমি যখন ছবি তুলব, তখন যদি জন্তুটা আক্রমণ করে, তাহলে তুমি ওকে লক্ষ করে গুলি চালাবে।

তাইগরকে দেখে বার্নারদো দাদার মতোই ঘাবড়ে গিয়েছিল, তবে রাইফেলটা সে হাত বাড়িয়ে নিতে ভুলল না।

সাশা ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করে শাটার টিপে দিল। একটা অস্পষ্ট শব্দ উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তেই কুকুরগুলো হঠাৎ নীরব হয়ে পড়েছিল–শাটার টেপার ক্ষীণ শব্দ তাইগরের কানে যেতেই সে হঠাৎ ঘুরে বসে সাশার উপর তার দুই চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি স্থাপন করল।

রাইফেলটা আমার হাতে দাও, ফিসফিস করে বার্নারদোকে বলল সাশা। সে একবারও তাইগরের দিক থেকে চোখ সরায়নি। যখন রাইফেলের বাঁট তার হাত স্পর্শ করল, ঠিক সেই মুহূর্তে এক লাফ মেরে বিশ ফুট উঁচু বৃক্ষশাখা থেকে মাটির উপর এসে পড়ল তাইগর! কুকুরগুলো তৎক্ষণাৎ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাইগরের ভয়ংকর থাবার নাগাল থেকে দূরে সরে গেল; আর হঠাৎ ভীষণ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল বার্নারদো।

কুকুরগুলো আবার মিলিতভাবে আক্রমণ করতে ছুটে এল তাইগরের দু-পাশে। কিন্তু কুকুরদের দিকে ফিরেও তাকাল না অতিকায় মার্জার, তার জ্বলন্ত দৃষ্টি এখন নিবদ্ধ হয়েছে। বার্নারদোর উপর। একটি হাতের মুঠি সজোরে মুখের উপর চেপে ধরেছে বার্নারদো, যেন ভিতর থেকে ঠেলে-ওঠা একটা আর্ত-চিৎকার সে রুখে দিতে চাইছে প্রাণপণে এবং বিস্ফারিত দুই চক্ষের ভয়ার্ত দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছে অদূরবর্তী তাইগরকে।

বার্নারদোকে লক্ষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাইগর, সঙ্গেসঙ্গে অগ্নি-উদ্গার করে গর্জে উঠল সাশার রাইফেল। সাশা দেখল একটা প্রকাণ্ড থাবা বাতাস কেটে ছুটে এল, পরক্ষণেই মাটিতে ছিটকে পড়ল বার্নারদো। আবার গুলি ছুড়ল সাশা তাইগরকে লক্ষ করে। সাশার উলটোদিক থেকে তাইগরের মাথায় গুলি চালাল জর্জ। একসঙ্গে দুটি বুলেটের আঘাতে প্রকাণ্ড জন্তুটা কুণ্ডলী পাকিয়ে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পড়ল।

বার্নারদো তখন হাঁটু পেতে বসে পড়েছে। সাশা দেখল তার শার্ট অনেকটা জায়গা নিয়ে লম্বালম্বিভাবে ছিঁড়ে গেছে। প্রথমে সাশা ভেবেছিল তাইগরের ধারালো নখ বার্নারদোর পাঁজর বিদীর্ণ করেছে–পরে দেখা গেল তা নয়, তাইগরের থাবার তালু সজোরে আঘাত করে ছেলেটিকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে এবং সেই আঘাতের ফলেই ছিঁড়ে গেছে শার্ট–ভয়ংকর নখগুলো বার্নারদোর শরীর স্পর্শ করতে পারেনি, সে ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত।

ওই ঘটনার পর বহু তাইগর শিকার করেছে সাশা। ত্রিশটি বছর কাটিয়েছে সে দক্ষিণ আমেরিকার বনে জঙ্গলে। ওই সময়ের মধ্যে তিনশো তাইগর মেরেছে সে। নিহত জন্তুগুলোর মধ্যে অন্তত তিরিশটি পশুর সম্মুখীন হয়েছিল সে বর্শা হাতে। তবে দক্ষিণ আমেরিকার বনরাজ্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট তাইগরকে সে কখনো ঘৃণা করতে পারেনি ভয়াল সুন্দর ওই হিংস্র জীবটি সম্পর্কে সে পোষণ করত শ্রদ্ধামিশ্রিত এক অদ্ভুত ভালোবাসা!

.

অষ্টম পরিচ্ছেদ

তাইগর শিকারের পর কেটে গেল দুটি সপ্তাহ। ওই সময়ের মধ্যে যেসব বিকল যন্ত্র মেরামতের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল সাশা, সেই যন্ত্রগুলোকে সে সারিয়ে ব্যবহারের উপযুক্ত করে দিল। তারপর পারিশ্রমিকের অর্থ গ্রহণ করে ডম জুয়ায়োকে বিদায় জানিয়ে সাও লরেংকোর পথে রওনা হল সাশা। বলাই বাহুল্য, সঙ্গে ছিল পথের দিশারী অ্যাপারিসিও।

প্রায় মাস দুই ধরে বনজঙ্গল আর বিপজ্জনক জলাভূমি অতিক্রম করে সাও লরেংকোর কাছাকাছি সিনর শিকো পিন্টো নামে এক ভূস্বামীর গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করল সাশা ও অ্যাপারিসিও।

ওই সময়ের মধ্যে দাদা আর্নস্টের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনো উপায় ছিল না সাশার। বনের পথে সরকারি ডাকবিভাগ সম্পূর্ণ অচল, স্থানীয় মানুষ সম্পূর্ণ নির্ভর করে বেসরকারি ব্যবস্থার ওপর। এখানে আসার আগে এক র‍্যাঞ্চ মালিকের অতিথি হয়েছিল সাশা। সেখানে সে শুনল খুব শীঘ্রই একটি লোক স্থানীয় অধিবাসীদের চিঠিপত্র নিয়ে রওনা দেবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত আত্মীয়স্বজনের কাছে ওই চিঠিগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য। পূর্বোক্ত পত্রবাহকের হাতে চিঠি দিয়ে কোক্সিমে দাদা আর্নস্টকে খবর পাঠাল সাশা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কুয়াবা শহরে এসে দাদা আর্নস্টের সঙ্গে দেখা করবে সে।

সিনর শিকো পিন্টো নামে যে ভূস্বামীর আতিথ্য গ্রহণ করেছিল সাশা, সে ছিল ওই অঞ্চলের একজন চিনির কারবারি। সাশা আর অ্যাপারিসিওর সাময়িক বাসস্থান হিসাবে বরাদ্দ ছিল একটি মাটির কুঁড়েঘর। সিনর শিকোকে দুজনেই কথা দিয়েছিল চিনির কারখানার যন্ত্রপাতিগুলো তারা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবে এবং ওই কাজ শেষ না-করে তারা স্থানত্যাগ করবে না।

ডম কার্লোসের তাইগরেরো কাহিনির সত্যাসত্য নির্ণয় করার জন্য এখন বদ্ধপরিকর হল সাশা। এবার সে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসবে। না হলে এই ব্যাপারটা নিয়ে সে আর মস্তিষ্ককে ঘর্মাক্ত করবে না।

এক রাতে সে সিনর শিকোকে প্রশ্ন করল, সিনর শিকো, আপনি কি এই অঞ্চলে জোকুইম গুয়াতো নামে কোনো রেড ইন্ডিয়ান শিকারিকে জানেন? শুনেছি, ওই লোকটা শুধুমাত্র বর্শা দিয়ে তাইগর শিকার করে?

জোকুইম? সিনর শিকো একটু চিন্তা করল, হ্যাঁ, এই নামে একটি লোক আছে বটে। গুয়াতে হচ্ছে রেড ইন্ডিয়ান জাতির একটি শাখার নাম। অর্থাৎ জোকুইম ওই গুয়াতো শাখার অন্তর্গত একটি মানুষ। লোকটা আমার কাছে মাঝে মাঝে কাজ করে। কিন্তু গ্রীষ্মকালে যখন তাইগররা গোরুবাছুরের উপর হামলা করে, সেইসময় ফাজেন্দা আলেগর নামে যে বিশাল র‍্যাঞ্চ বা গোচারণ-ভূমি বহমান নদীর উত্তরদিকে কুয়াবা শহর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে সেই র‍্যঞ্চের হয়ে ভাড়াটে শিকারি হিসাবে কাজ করে জোকুইম গুয়াতো।

আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর সাশা সিনর শিকোর কাছে জানতে পারল যে, প্রায় তিরিশ বছর আগে জোকুইম এই অঞ্চলে আসে। শোনা যায় সে কুড়িটা হিংস্র তাইগরকে বর্শা দিয়ে শিকার করেছে। লোকটি কারো সাহায্য নেয় না, একাই শিকার করে অবশ্য কুকুরের দল তাকে তাইগর শিকারে সহায়তা করে।

সাশা জানতে চাইল রেড ইন্ডিয়ান জাতি কি কারো সাহায্য না-নিয়ে একা শিকার করতে অভ্যস্ত?

উত্তরে সিনর শিকো জানাল তারা এককভাবে তাইগরের মুখোমুখি হতে চায় না। তারা দল বেঁধে শিকার করে। তাদের হাতে থাকে তিরধনুক আর জাগায়া (বর্শা)। তবে রেড ইন্ডিয়ান জাতির মধ্যে দু-একজন নিঃসঙ্গ তাইগর-শিকারির কথা মাঝে মাঝে শোনা যায় বটে। কিন্তু বর্তমানে জোকুইম গুয়াতো হচ্ছে একমাত্র শিকারি যে সম্পূর্ণ এককভাবে বর্শা হাতে তাইগরের বিদ্যুত্বৎ ক্ষিপ্র আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ার সাহস রাখে। লম্বা লম্বা ঘাস আর জলাভূমির মধ্যে রাইফেল নিয়ে লক্ষ্য স্থির রাখা অসম্ভব, সেখানে বর্শা হচ্ছে একমাত্র নির্ভরযোগ্য অস্ত্র।

জোকুইম বর্শাধারী শিকারি, সিনর শিকো বলল, তার মতন নির্ভীক মানুষ আমি আর একটিও দেখিনি।

সিনর শিকো আরও বলল, আমার মনে হয় বনবাসী তাইগারদের মধ্যেও জোকুইমের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। বর্শাধারী তাইগরেরো এখন অত্যন্ত বিরল, তাদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।

কয়েকদিন পরের কথা… সিনর শিকোর নির্দেশ অনুসারে নদীর পশ্চিমদিকে অশ্বারোহণে যাত্রা করল সাশা, সঙ্গে অপরিহার্য সঙ্গী অ্যাপারিসিও। কিছুদূর যাওয়ার পরে একটা ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর তাদের চোখে পড়ল। কাছে গিয়ে তারা দেখল অধভগ্ন ও বিধ্বস্ত কুটিরের দরজাটা চামড়ার বাঁধনে আটকে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের ভিতরটা অন্ধকার, সেখানে কোনো মানুষ বাস করে বলে মনে হয় না।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সাশা হাঁক দিল, ভিতরে কেউ আছে?

দরজা ঠেলে একটি রেড ইন্ডিয়ান বাইরের উজ্জ্বল সূর্যালোকে আত্মপ্রকাশ করল। লোকটির সঠিক বয়স অনুমান করা অসম্ভব মনে হয় ষাট হবে কিন্তু তার গায়ের চামড়া এখনও টান টান, কুঁচকে যায়নি একটুও। লোকটির পরনে নীল প্যান্ট আর খাকি শার্ট শার্টের হাতা কনুইয়ের কাছে ছিঁড়ে উড়ে গেছে–পা নগ্ন, জুতো নেই।

লোকটিকে দেখেই সাশা বুঝতে পারল সে মদ্যপান করে নেশাগ্রস্ত হয়েছে। সাশার মনটা খারাপ হয়ে গেল তার দাদা আর্নস্টের কথাই সঠিক প্রমাণিত হল–বনজঙ্গল ভেঙে এত কষ্ট করে এত দূরে এসে সে আবিষ্কার করল একটি নেশাখোর মাতাল বুড়ো রেড ইন্ডিয়ানকে! কী আফশোস!

যাই হোক গাছের সঙ্গে ঘোড়া বেঁধে লোকটির ইঙ্গিতে সঙ্গীকে নিয়ে কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করল সাশা। কুঁড়েঘরের ভিতরটা খুব নোংরা আর দুর্গন্ধে পরিপূর্ণ। বেশ বোঝা যায় লোকটি এখানে একলাই বাস করে। ছোটো ঘরটার একধারে একটা ছেঁড়াখোঁড়া তাপ্লিমারা হ্যামক টাঙানো আছে। হ্যামকের তলায় একটা জাগ কাত হয়ে পড়ে ঘরের মালিকের বর্তমান অবস্থার কারণ নির্দেশ করছে!

সাশা বিনীতভাবে বলল, তুমিই কি সেই বিখ্যাত তাইগরেরো, যার কথা আমি শুনেছি?

লোকটির কালো চোখ দুটিতে বিদ্যুতের মতো জ্বলে উঠল বুদ্ধির দীপ্তি, কিন্তু তার মুখের ভাব রইল আগের মতোই অসাড়, সেখানে অনুভূতির কোনো চিহ্ন নেই। সাশা ঘরের ভিতরটা খুঁটিয়ে দেখল–কয়েকটা তির আর ধনুক ছাড়া একটা প্রকাণ্ড বর্শা তার চোখে পড়ল। বর্শাটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করল সাশা চওড়া একটা লোহার ফলা কাষ্ঠদণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ফলার দুই পাশ কোনো বস্তুকে কেটে ফেলার উপযুক্ত করা হলেও জিনিসটা তেমন ধারালো হয়নি।

বুড়ো রেড ইন্ডিয়ান সাশার সামনে এসে দাঁড়াল, তুমি আমার মনিব সিনর শিকো পিন্টোর কাছ থেকে আসছ?

সাশা জানাল বর্তমানে সে পূর্বোক্ত সিনর শিকোর কাছ থেকেই আসছে বটে; কিন্তু অনেক দূরবর্তী যে-অঞ্চলে তাইগর-শিকারি হিসাবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে, সেই রিও গ্র্যান্ড দো সাল নামে জায়গাটা থেকেই সে এসেছে কেবলমাত্র খ্যাতনামা তাইগরেরোর সঙ্গে আলাপ করতে।

আমার মনিবের কাছ থেকে তুমি কি কোনো প্রস্তাব এনেছ? বুড়ো বলল, নদীর কাছাকাছি নীচু জমিতে এখন তাইগরের দেখা পাওয়া যাবে। বর্ষা শুরু হলে তারা এই উঁচু জমির উপর উঠে আসবে। এখন এই জায়গাটাতে যে-জন্তুটার তুমি দেখা পাবে, তার নাম সাকুয়ারানা।

ব্রেজিলের স্থানীয় ভাষায় সাকুয়ারানা বলতে বোঝায় পুমা বা কুগার। তাইগরের মতোই পুমাও বিড়াল-জাতীয় পশু, তবে আকারে ছোটো এবং স্বভাবও তাইগরের মতো ভয়ংকর নয়।

জোকুইম হঠাৎ দরজার বাইরে এসে হাঁক দিল, দ্রাগাও! কয়েক মুহূর্ত পরেই একটা লালচে-বাদামি রং-এর কুকুর দৌড়ে এল সেখানে। জোকুইম কুকুরটাকে আদর করতেই সে সজোরে গা ঘষতে লাগল লোকটার দুই পায়ে।

সাও লরেংকোর মধ্যে আমার দ্রাগাও হচ্ছে সবচেয়ে পাকা শিকারি, জোকুইম বলল, সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাকে সাদরে চুম্বন করল সে, তারপর সাশার দিকে ফিরে তাকাল সে, তুমি দ্রাগাও আর আমার সঙ্গে শিকার করতে চাও, সিনর? বেশ তো, কাল সকালেই আমরা শিকারের সন্ধানে যাত্রা করব।

জোকুইম আবার তার কুটিরের মধ্যে অন্তর্ধান করল। সাশা আর অ্যাপারিসিও ঘোড়ায় চড়ে ফিরল তাদের আস্তানার দিকে। সাশা যে খুব বিরক্ত ও হতাশ হয়েছে, তার হাবভাব দেখেই বুঝতে পেরেছিল অ্যাপারিসিও। সে সাশাকে বলল, ওই বুড়ো রেড ইন্ডিয়ান সম্পর্কে চট করে কিছু ভেবে নিয়ো না। তাহলে ঠকবে।

.

নবম পরিচ্ছেদ

পরের দিন খুব ভোরে, তখনও দিনের আলো ভালোভাবে ফুটে ওঠেনি সাশা শুনতে পেল তার দরজায় কেউ ধাক্কা মারছে। দরজা খুলে সাশা দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছে জোকুইম। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন, নিম্নাঙ্গে একটা নীল প্যান্ট, প্যান্টের তলার দিকটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রকাণ্ড একজোড়া বুটজুতোর ভিতর। লোকটির চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার, হাবভাবে নেশার চিহ্নমাত্র নেই।

দ্রাগাও আর আমি প্রস্তুত। জোকুইম বলল, তুমি তৈরি হলেই আমরা যাত্রা করতে পারি।

পরক্ষণেই অন্ধকারের মধ্যে চলন্ত ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল সে!…

এমন অনাড়ম্বর শিকার অভিযান আগে কখনো সাশার চোখে পড়েনি। সাধারণত শিকারে যাওয়ার আগে শিকারিরা গরম কফি অথবা মাতে (চা) পান করে, তারপর একটি সরলরেখায় সারিবদ্ধ হয়ে তারা প্রবেশ করে বনের মধ্যে। এখানে সেসব কিছুই হল না। সাশা পোশাক পরে রাইফেল হাতে ঘরের বাইরে আসতেই হঠাৎ অন্ধকার যুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াল জোকুইম, এবার আমরা যাচ্ছি।

কথাটা বলেই সে চলতে শুরু করল। পিছনে অনুসরণরত সাশার দিকে সে ফিরেও চাইল না।

ঘর থেকে বেরিয়ে জোকুইমের সঙ্গে চলে আসার আগে অ্যাপারিসিওর ঘুম ভাঙিয়ে তাকে সঙ্গে আনেনি সাশা। পরে বুঝল কাজটা সে ভালোই করেছিল। বুড়ো জোকুইমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সাশা যখন হাঁফিয়ে পড়ছিল, সেইসময় তার মনে হল দুর্বলতার সাক্ষী হিসাবে অ্যাপারিসিওর উপস্থিতি তার ভালো লাগত না।

কিছুক্ষণ চলার পর তারা জোকুইমের কুঁড়েঘরের সামনে এসে পড়ল। একবারও না-থেমে চলন্ত অবস্থাতেই সজোরে লাথি মেরে বুট দুটোকে জোকুইম ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলল এবং নগ্ন পদেই হাঁটতে শুরু করল নিকটবর্তী অরণ্যের দিকে…।

ঘন জঙ্গলের সবুজ শ্যামলিমার বুকে রক্তাভ বিদ্যুতের মতন চমকে উঠছিল দ্রাগাওর লালচে বাদামি শরীর, পরক্ষণেই আবার অন্তর্ধান করছিল শিকারিদের দৃষ্টির অন্তরালে অরণ্যের গর্ভে। দ্রাগাওকে আর দেখতে না-পেলেও ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জোকুইমের পিঠ আর মাথা দেখতে পাচ্ছিল সাশা। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল জোকুইম, সামনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, সাকুয়ারানা।

সাশা তাকিয়ে দেখল একটা মস্ত গাছের তলায় ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়িয়ে সারমেয় ভাষায় চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে দ্রাগাও, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে পূর্বোক্ত গাছের ডালে উপবিষ্ট একটি পুমার দিকে।

পুমা সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না। কিন্তু কোণঠাসা হলে যেকোনো জানোয়ারই হিংস্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। গাছের উপর পুমার অবস্থাও সেইরকমই। যেকোনো মুহূর্তে অরণ্যের শান্তিভঙ্গ হতে পারে রক্তাক্ত যুদ্ধে। সময় থাকতে পুমার একটা ছবি তুলে না-রাখলে পরে হয়তো সেই সুযোগ আর পাওয়া যাবে না–অতএব ক্যামেরাকে বন্ধনমুক্ত করে পুমার ফটো তুলল সাশা।

জোকুইম আন্দাজেই বুঝল ক্যামেরার কাজ হয়ে গেছে, সে হাত বাড়িয়ে রাইফেলের দিকে ইশারা করল। সাশা বুঝল তাকেই এখন গুলি চালাতে হবে। সে রাইফেল তুলল, সঙ্গেসঙ্গে শূন্যে একটি নিখুঁত অর্ধবৃত্ত রচনা করে লাফ দিল পুমা এবং এসে পড়ল মাটি থেকে কয়েক ফুট মাত্র উঁচু একটা ডালের উপর। দ্রাগাও তীব্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। লক্ষ্য স্থির করে গুলি ছুড়ল সাশা। তৎক্ষণাৎ আবার লাফ মারল পুমা। গুলি লাগল তার বুকে।

মরণাহত পুমা মাটিতে পড়ল, কিন্তু তখনও তার লড়াইয়ের উদ্যম শেষ হয়নি। সে এবার ঝাঁপ দিল সাশার দিকে। একইসঙ্গে আক্রমণ করল জোকুইম আর দ্রাগাও। জোকুইমের বর্শা এবং দ্রাগাও একইসঙ্গে ছুটল পুমার কণ্ঠ লক্ষ করে বর্শা, দ্রাগাও আর পুমা মিলিত হল শূন্যপথে। দ্রাগাওর কণ্ঠভেদ করে বর্শাফলক বিদ্ধ হল পুমার কাঁধের ঠিক পিছনে। পুমার দেহ যখন মাটিতে ছিটকে পড়ল, তখন সে প্রাণহীন মৃত। তবু সাশা কোনো ঝুঁকি নিতে চাইল না, জন্তুটার মৃত্যু–সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে আবার গুলি ছুড়ল।

বর্শা ফেলে দিয়ে মরণাপন্ন দ্রাগাওকে জড়িয়ে ধরল জোকুইম। কিছুক্ষণ পরে জোকুইমের আলিঙ্গনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করল দ্রাগাও। শোকবিহ্বল জোকুইমের দিকে তাকিয়ে সাশা বুঝল এখানে তার উপস্থিতি অনাবশ্যক। ক্যামেরাটাকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে সে নিঃশব্দে স্থানত্যাগ করল…

পরের দিন সকালেই জোকুইম হাজির সাশার কুটিরে, সঙ্গে শিকলে বাঁধা দুটি কুকুর। একটি কুকুর আকারে ছোটো, কিন্তু দেহের গঠনে বোঝা যায় যে দস্তুরমতো শক্তিশালী পশু। অন্য কুকুরটি সঙ্গীর চাইতে দৈহিক আয়তনে বড়ো, দেখলে মনে হয় এই জন্তুটাও শরীরে যথেষ্ট শক্তি রাখে।

জোকুইম বলল, যতদিন আবার চাঁদ না-উঠছে, ততদিন আমি আর শিকারে যাব না। এই দুটি কুকুরের মধ্যে একটিকে তুমি রাখতে পারো, এরা দুজনেই শিকারে ওস্তাদ। অবশ্য দ্রাগাওর সঙ্গে ওদের তুলনা চলে না, কিন্তু ও-রকম কুকুর তো একটাই হয়।

জোকুইম বড়ো কুকুরটিকে দেখিয়ে বলল, ও শিকারের পিছনে তাড়া করার সময়ে মুখ দিয়ে একটুও আওয়াজ করে না। ওর সঙ্গে শিকারে গেলে ওকে ভালো করে জানা দরকার। ছোটোটার নাম ভ্যালেন্ট। আমার মনে হয় ছোটো কুকুরটি তোমার উপযুক্ত সঙ্গী হবে।

সাশা বলল, বেশ ছোটো কুকুরটিকেই আমি নিলাম। জোকুইম তার কথা রেখেছিল। সাশা যতদিন চিনির কারখানায় ছিল ততদিন সে শিকারে বার হয়নি। তবে সাশার মনে ক্ষোভ বা দুঃখ ছিল না, সে দস্তুরমতো খুশি–ডম কার্লোস তাকে যা বলেছিল, তা নিশ্চিত সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সে অবশ্য জোকুইমকে তাইগর শিকার করতে দেখেনি। তাইগর বা জাগুয়ারের সঙ্গে পুমার যথেষ্ট তফাত–কিন্তু সাশা বুঝেছিল জোকুইমের পক্ষে বর্শার সাহায্যে জাগুয়ার শিকার আদৌ অসম্ভব নয়।

কিছুদিন পর সিনর শিকোর কাছে বিদায় নিয়ে সাশা বেরিয়ে পড়ল কুয়াবা অভিমুখে, যেখানে দাদা আর্নস্ট তার জন্য অপেক্ষা করছে। সঙ্গে ছিল বিশ্বস্ত সহচর অ্যাপারিসিও।

জঙ্গলের পথে পথে সারা শীতকালটা কেটে গেল, গ্রীষ্ম যখন শুরু হচ্ছে, সেইসময় একদিন তারা এসে পৌঁছাল কুয়াবা শহরের দ্বারে। তখন সন্ধ্যা আগত, তাই শহরে না-ঢুকে প্রান্তসীমায় তাঁবু খাঁটিয়ে তারা রাত কাটাল এবং পরের দিন সকালে প্রবেশ করল কুয়াবা শহরের মধ্যে। শহর চত্বরে একটি বলিতো (ক্যান্টিন) নামক বিপণিতে তারা আর্নস্টকে দেখতে পেল। সে একটা টেবিলের সামনে বসে ছিল, ভাইকে দেখে হাত তুলে অভ্যর্থনা জানাল।

সাশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আর্নস্টকে পর্যবেক্ষণ করল। সে একইরকম আছে–সোনালি দাড়ি, বিশাল বক্ষ, দৃঢ় পেশিবদ্ধ বলিষ্ঠ বাহু–কিন্তু দেহে নয়, মনের দিক থেকে দাদা যেন বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

কয়েকটা কথা বলার পর আর্নস্ট যা বলল, তা শুনে দাদার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেল না সাশা।

আর্নস্ট বলল, আমরা যখন কোক্সিমে ছিলাম, তখন সেখানকার পুলিশ জানিয়েছিল একটি ছোটোখাটো চেহারার লোক আমাদের খোঁজ করেছিল। আমরা লোকটা সন্ধান পাইনি। ব্যাপারটা তোর মনে আছে সাশা?

তার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি বললে তাই মনে পড়ল। তা সেই লোকটার তুমি সন্ধান পেয়েছ?

মাথা নেড়ে গম্ভীরভাবে আর্নস্ট বলল, আমি তাকে শুধু খুঁজে পাইনি, স্বচক্ষে দেখেছি এই শহরে। লোকটির নাম সিনর ফাভেল!

.

দশম পরিচ্ছেদ

আর্নস্টের কথা শুনে প্রথমে খুবই আনন্দিত হয়েছিল সাশা–ফাভেল তাহলে বেঁচে আছে! খুনের দায় থেকে তাহলে সাশা অব্যাহতি পেয়েছে। যদিও ফাভেলের মতো মানুষের খুন হওয়াই উচিত।

কিন্তু একটু পরেই আনন্দের পরিবর্তে জাগল প্রচণ্ড ক্রোধ–ফাভেল তাহলে দূরদূরান্ত পেরিয়ে তাদের ধাওয়া করছে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য! সাশা স্থির করল এবার দেখা হলে ফাভেলকে সে জেনেশুনে ঠান্ডা মাথায় খুন করবে। আর্নস্টও ফাভেলকে মেরে নিশ্চিন্ত হতে চায়–তবে সাশার পরিবর্তে সে নিজেই হতে চায় হন্তারক

দুই ভাই বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও ফাভেলকে কোথাও দেখতে পেল না। প্রথম তাকে দেখেছিল আর্নস্ট, তার সঙ্গে ছিল কয়েকটি লোক সম্ভবত বন্ধুবান্ধব। অত লোকের সামনে দোকানের মধ্যে ফাভেলের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে পারেনি আর্নস্ট, সে ফাভেলকে একা পেতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রথম দর্শনের পর আর কোনোদিনই আর্নস্ট ফাভেলের সাক্ষাৎ পায়নি।

কিছুদিন কুয়াবা শহরে কাটিয়ে আগের পরিকল্পনা অনুসারে হিরার সন্ধানে যাত্রা করল দুই ভাই। তখনও অ্যাপারিসিও ছিল তাদের সঙ্গে। মাত্তো গ্রসোর বনভূমিতে হিরার লোভে ছুটেছিল আরও বহু মানুষ। শুধু স্থানীয় মানুষ নয় অনেক বিদেশিও এসে ভিড় করেছিল মাত্তো গ্রসোর খাঁড়ির ধারে ধারে হিরার লোভে।

সেই হীরক-অভিযানে বারংবার বিপদে পড়েছে দুই ভাই এবং ভাগ্যের আশীর্বাদে মরতে মরতে বেঁচে গেছে অনেকবার। সেসব কাহিনি সবিস্তারে বলার জায়গা এখানে নেই–তাই সংক্ষেপে বলছি উক্ত অভিযানে তারা সফল হয়েছিল, বেশ কিছু অর্থের মালিক হয়েছিল দুই ভাই–তারপর একদিন এই ভবঘুরে জীবনে বিরক্ত হয়ে বড়ো ভাই আর্নস্ট একটি স্থানীয় মেয়েকে বিবাহ করে সংসারী হল এবং ছোটো ভাই সাশা তার বেদুইনো নামক অশ্বতরটির পিঠে চেপে ভ্যালেন্টো নামে কুকুরটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অরণ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য।

আসলে দুই ভাইয়ের চরিত্র ছিল দুধরনের। আর্নস্ট ছিল ঘরমুখো, বনজঙ্গল ছিল তার দুই চোখের বিষ। সাশার মন ছিল বহির্মুখী–অরণ্যের স্নিগ্ধ শ্যামলিমা এবং বিপজ্জনক পরিবেশ তাকে আকর্ষণ করত সর্বদা তাই সুযোগ পেলেই ঘর ছেড়ে সে ছুটত বনের দিকে।

বেশ কয়েকমাস ধরে বন থেকে বনে আর গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে সাশা এসে উপস্থিত হল তার পুরাতন আস্তানা সিনর শিকো পিন্টো নামে চিনির কারবারির গৃহে। সিনর শিকো সাদর অভ্যর্থনা জানাল সাশাকে। অ্যাপারিসিও তখন সিনর শিকোর বাসস্থান থেকে কয়েক মাইল দূরে সিনর পেসো নামে এক ভূস্বামীর কাছে কিছু কাজের দায়িত্ব নিয়েছিল। সাশা তাকে বলেছিল চিনির কলে তার কিছু কাজ বাকি আছে, সেই কাজগুলো সারা হয়ে গেলে সে এসে দেখা করবে অ্যাপারিসিওর সঙ্গে পরবর্তী কর্তব্য তারা স্থির করবে দুজনে মিলে। কিন্তু কোনো কাজেই মন দিতে পারছিল না সাশা, সে ছটফট করছিল তাইগরেরো জোকুইম গুয়াতের সঙ্গে দেখা করার জন্য। জোকুইমের সঙ্গে আরও একবার শিকারে যাওয়ার ইচ্ছাটা তাকে অস্থির করে তুলেছিল।

ইতিপূর্বে যে-কুটিরে সাশা আশ্রয় নিয়েছিল, এইবারও সে কুঁড়েঘরটিকেই সে সাময়িক অবস্থান বলে গ্রহণ করল। সিনর শিকোর কাছে সাশা জানতে চাইল জোকুইম এখন এই অঞ্চলে আছে কি না। সিনোর শিকো বলল সে বর্তমানে এখানে না-থাকলেও আশা করা যায় দিন দুই পরেই সে উপস্থিত হবে তার নিজস্ব আস্তানায়।

নির্ভুল অনুমান ঠিক দু-দিন পরেই দুটি কুকুর নিয়ে সাশার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল জোকুইম। তখনও দেখা গেল কুকুরের আশ্চর্য স্মরণশক্তি ভ্যালেন্টো নামে যে-কুকুরটাকে জোকুইম উপহার দিয়েছিল, সেই কুকুরটা মহা উৎসাহে অভ্যর্থনা জানাল তার পুরানো মনিবকে।

চিনির কারখানাকে ঘিরে চারপাশে যে ঘন জঙ্গল অবস্থান করছিল, সেইদিকে তাকিয়ে জোকুইম বলল, তাইগররা নীচু জমি ছেড়ে এখন উঁচু জমিতে উঠে আসছে। বর্ষা নামলে তারা নীচু জমিতে থাকে না। আগামী দিনটা বাদ দিয়ে পরশুদিন খুব ভোরে আমি আসব। তুমি প্রস্তুত থেকো সিনর সাশা–আমরা দুজনে আবার একসঙ্গে শিকার করতে যাব।

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে চারটি প্রকাণ্ড কুকুর নিয়ে জোকুইম হাজির হল সাশার দরজায়। কিন্তু কুকুরদের দলপতি হিসাবে ছোটোখাটো ভ্যালেন্টকেই সে নির্বাচন করল।

দ্রাগাওর পরে ভ্যালেন্টই হচ্ছে সবচেয়ে সেরা কুকুর, জোকুইম বলল, সে কখনো ভুল করে না। অন্য কুকুরগুলো ভুল করে তোমাকে অন্যপথে চালনা করতে পারে।

এখানে বলে রাখা ভালো কুকুরদের দলপতি বলতে কী বোঝায়। সারমেয়-বাহিনীর মধ্যে দলপতি ছাড়া অন্যান্য কুকুরগুলো শিকল-বাঁধা অবস্থায় শিকারিদের সঙ্গে থাকে। দলপতি শিকারের গন্ধ বা পদচিহ্ন অনুসরণ করে অগ্রসর হয়। তার গলার শিকল সেইসময় খুলে দেয় শিকারি। দলপতির পিছনে অন্যান্য কুকুরদের শিকল ধরে শিকারি চলতে থাকে। একেবারে শেষ মুহূর্তে শিকারের কাছাকাছি এসে সব কয়টি কুকুরের গলার শিকল খুলে শিকারি তাদের ছেড়ে দেয় এবং সারমেয়-বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করে শিকারের সম্মুখীন হয়ে যথাকৰ্তব্য স্থির করে। সুতরাং শিকার-অভিযানে কুকুরদের দলপতির ভূমিকা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। শিকারের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে পারে একমাত্র দলপতি।

তিনঘণ্টা ধরে বনের পথে ছুটে চলার পর একটা জাগুয়ারের (তাইগর) পায়ের ছাপ দেখতে পেল শিকারিরা। ভ্যালেন্টোর সঙ্গে অন্যান্য কুকুরগুলোকেও শিকারিরা মুক্তি দিল–তৎক্ষণাৎ দলপতি ভ্যালেন্টোকে অনুসরণ করে তিরবেগে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল কুকুরদের দল…

হঠাৎ তীব্র হয়ে বেজে উঠল কুকুরের উল্লসিত চিৎকার। সাশা বুঝল কুকুরগুলো তাইগরকে দেখতে পেয়েছে। জোকুইমের সঙ্গে সে ঊধ্বশ্বাসে ছুটল শব্দ লক্ষ করে…

একটু পরেই তারা কুকুরগুলোকে দেখতে পেল। একটা ঘন ঝোপের বাইরে দাঁড়িয়ে তারা তারস্বরে চিৎকার করছে। সাশা বুঝতে পারল ওই ঝোপের ভিতরেই লুকিয়ে আছে তাইগর।

আচম্বিতে হলুদ আর কালো ফোঁটাফোঁটা একটা দেহ বিদ্যুতের মতো ছিটকে এল ঝোপের বাইরে–ক্রুদ্ধ জাগুয়ার এতক্ষণে শত্রুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এতক্ষণে অতিক্রম করেছে তার ধৈর্যের সীমা শত্রুর আস্ফালন শুনে আর নিশ্চেষ্ট থাকতে রাজি নয় অরণ্য-সম্রাট!

কুকুরগুলো তাইগরকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে ধরে কামড় বসানোর উপক্রম করেছিল, কিন্তু তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত থাবার নাগালের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে কামড়াতে সাহস পাচ্ছিল না। তারা জানে খুব বলিষ্ঠ কুকুরও তাইগরের নখের থাবার প্রচণ্ড চপেটাঘাত সহ্য করে বেঁচে থাকতে পারে না–তাই তাইগর থাবা চালালেই তারা ছিটকে সরে যাচ্ছিল তার নাগালের বাইরে।

জোকুইম এসে পৌঁছাল ক্রুদ্ধ তাইগরের প্রায় বিশ গজ দূরত্বের মধ্যে। জন্তুটার চেহারা তখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। যে-পুমাটাকে মেরেছিল জোকুইম, অথবা যে-জাগুয়ারটাকে বার্নারদো আর জর্জের সঙ্গে শিকার করেছিল সাশা, এই জন্তুটা একেবারেই তাদের মতন নয়–এটা যেমন হিংস্র, তেমনই নির্ভীক। অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে সে কুকুরগুলোকে আক্রমণ করার চেষ্টা করছে, সেইসঙ্গে তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে রুদ্ধ রোষের চাপা গর্জনধ্বনি।

জোকুইম ততক্ষণে পৌঁছে গেছে তাইগরের দশ গজের ভিতর। নতুন শত্রুর আবির্ভাব হতেই তার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল তাইগর, তার দুই চোখ হিংস্র আক্রোশে জ্বলে উঠল দু-টুকরো জ্বলন্ত কয়লার মতো। সে বুঝল এই হচ্ছে তার আসল শত্রু, একে নিপাত করতে পারলেই আজকের যুদ্ধে তার জয় নিশ্চিত। জোকুইমও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাইগরের দিকে দুই হাতের শক্ত মুঠিতে বর্শাদণ্ড জমির সঙ্গে সমান্তরাল, বর্শার ফলা জমি থেকে দু-ফুট উপরে স্থির হয়ে রয়েছে।

হঠাৎ জোকুইমের একটা পা মাটির উপর ধাক্কা মেরে এগিয়ে এল। একটা শুকনো মাটির ঢেলা ছিটকে এসে আঘাত করল তাইগরের মুখে। সঙ্গেসঙ্গে তাইগর ঝাঁপ দিল জোকুইমকে লক্ষ করে। শানিত বর্শাফলক চমকে উঠল, পশুর দেহ বিদ্ধ করল, পিছিয়ে গিয়ে আবার আঘাত হানল। দ্বিতীয়বারের আঘাত তাইগরকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। উদ্যত রাইফেল তুলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সাশা, কিন্তু ধরাশায়ী দেহটার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন দেখতে না-পেয়ে অস্ত্রটা নামিয়ে নিল। এই লড়াইতে অংশগ্রহণ করেনি সাশা, অরণ্যসম্রাটের সঙ্গে জোকুইমের দ্বন্দ্বযুদ্ধে সে ছিল নীরব দর্শক।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে জোকুইমের দিকে তাকিয়ে সাশা বলল, রিও গ্র্যান্ড সাল থেকে আমার বন্ধুরা যে-দৃশ্য দেখার সম্ভাবনা আছে বলে আমায় উৎসাহিত করেছিল, সেই দৃশ্যই আজ দেখার সৌভাগ্য হল আমার। তুমি তাহলে একজন তাইগরেরো!

জোকুইম বলল, আজকের দিনের স্মৃতি হিসাবে মরা জন্তুটার চামড়া তুমি ছাড়িয়ে নিয়ে যাও। এর পরে তুমি নিজের হাতেই তাইগর শিকার করে তার চামড়া ছাড়িয়ে নিতে পারবে।

পনেরো দিন পরে আবার জোকুইমের সঙ্গে কুকুরের দল নিয়ে শিকার করতে গেল সাশা। সেদিন আর রাইফেল ছিল না সাশার হাতে, ছিল একটা মজবুত জায়াগা (বর্শা) আর কোমরের খাপে ছিল পিস্তল। সেদিন শিকারিদের বেশিক্ষণ ছুটোছুটি করতে হল না। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা শিকারের সন্ধান পেল। কুকুরগুলো একটা অল্পবয়সি পুরুষ তাইগরকে ঘিরে ফেলেছিল। জন্তুটা বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে কুকুরগুলোকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু মানুষ দুটিকে দেখেই কুকুরদের ছেড়ে সে দ্বিপদ শত্রুদের দিকে আকৃষ্ট হল। প্রায় তিরিশ গজ দূর থেকে সে    ঝড়ের মতো ছুটে এল সাশার দিকে। জোকুইম যেভাবে শিখিয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই বর্শাটাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরেছিল সাশা, বর্শাফলক ছিল জমির দিকে নীচু হয়ে। জন্তুটা লাফ দিলেই তলা থেকে বর্শা চটপট উপরে তুলে জন্তুটার গলা বা বুকে বিঁধিয়ে দিতে হবে।

বুনো জানোয়ার কখন কী করবে তা আগে থেকে বলা যায় না। এই জন্তুটা ছুটে এসে সাঁৎ করে একপাশে সরে এল। মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল সাশা, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে জন্তুটার দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে–বর্শাফলকও ঘুরল তাইগরের দিকে, জমির সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল রেখায় নত হয়ে তাইগর লাফ দিলেই ফলাটা সবেগে উপরের দিকে উঠে যাবে, বিদ্ধ করবে জানোয়ারের গলা বা বুক।

কিন্তু তাইগর লাফাল না। সোজা ছুটে এল সাশাকে আক্রমণ করতে তার ক্রোধবিকৃত ভয়ংকর মুখটা প্রায় জমির সঙ্গে মিশে গেছে! দারুণ আতঙ্কে বর্শা নিয়ে আঘাত হানল সাশা তাইগরের গলা লক্ষ করে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বর্শাফলক বিধল তাইগরের কাঁধে।

আঘাতের ধাক্কা জন্তুটাকে সাশার সামান্য বাঁ-দিকে সরিয়ে দিল, ফলে নখরযুক্ত ভয়ংকর থাবার নিশানা একটুর জন্য ফসকে গেল। কিন্তু ভারসাম্য সামলাতে না-পেরে সামনের দিকে ছিটকে পড়ল সাশা, সেই অবস্থাতেই সে শুনতে পেল তাইগরের অবরুদ্ধ গর্জন প্রচণ্ড হুংকারে ফেটে পড়ছে। কোনোরকমে হাঁটুতে ভর করে নিজেকে তাইগরের নাগালের বাইরে সরিয়ে নিল সাশা।

ওই অবস্থায় তাইগর তাকে আক্রমণ করলে তার মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। কিন্তু সেই সুযোগ পেল না শ্বাপদ বিদ্যুৎচমকের মতো জন্তুটার বক্ষ বিদীর্ণ করে দিল জোকুইমের বর্শা। কয়েক মুহূর্ত ছটফট করে স্থির হয়ে গেল তাইগর। তার মৃত্যু হল।

রক্তাক্ত বর্শার ফলাটাকে তাইগরের দেহ থেকে টেনে নিয়ে সাশার দিকে তাকিয়ে হাসল জোকুইম, তুমি বড়ো তাড়াতাড়ি চার্জ করেছিলে সিনর।

সাশা বুঝল কেন তাকে জোকুইম একা একা শিকার করতে দেয়নি। ক্ষিপ্রহস্তে বর্শা চালিয়ে যেভাবে সে পুমাকে হত্যা করেছিল, সেইসঙ্গে দুর্ভাগ্যবশত মারা পড়েছিল তার প্রিয় কুকুর দ্রাগাও–এবং এইমাত্র যেভাবে সে সাশার প্রাণ বাঁচাল তাইগরকে মেরে সেই বিদ্যুৎ ক্ষিপ্ত সঞ্চালনে বর্শাকে চালিত করার ক্ষমতা কয়েকদিনের মধ্যে কোনো শিকারি আয়ত্ত করতে পারে না। নিখুঁতভাবে আঘাতের সময় নির্ধারণ এবং নির্ভুল নিশানায় আঘাত করার ক্ষমতা আয়ত্ত করা সম্ভব হয় অনেকগুলো বর্শার লড়াইতে জয়ী হওয়ার পরে শ্বাপদের নখদন্ত বনাম বর্শার লড়াইতে শিকারির মৃত্যু হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।

ওই ঘটনার পর জোকুইমের পাশে দাঁড়িয়ে আরও কয়েকটা তাইগর শিকার করল সাশা। ধীরে ধীরে তার নিজের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস গড়ে উঠল। কিন্তু তখনও তাকে এককভাবে শিকারে যেতে দিতে সম্মত হল না জোকুইম।

সিনর, তুমি অনেক বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে শিকার করতে পার, কিন্তু একমুহূর্তের জন্য তোমার ভুল হতে পারে, জোকুইম বলেছিল, আর তোমার মৃত্যু ঘটতে পারে ওই একটি মুহূর্তেই।

বর্ষা শুরু হল। প্রবল বৃষ্টিতে ডুবে গেল নীচু জমি। বৃষ্টির জল জমে গিয়ে জলাশয় আর জঙ্গল অনেক জায়গাতেই একাকার হয়ে গেল। জলস্রোতে প্লাবিত নিম্নভূমি থেকে উঠে এল সব জন্তু উচ্চভূমির শুষ্ক আশ্রয়ে। তৃণভোজীদের সঙ্গে মাংসাশী তাইগরের দলও উঠে এল নীচু জমি থেকে উঁচু জমির উপর।

আমাকে একবার উত্তর-পশ্চিম দিকে যেতে হবে, জোকুইম বলল, খবর পেয়েছি একটা তাইগর ওখানে ভীষণ উপদ্রব করছে। শুধু গোরুবাছুর নয়, তার কবলে প্রাণ হারাচ্ছে বহু মানুষ। ওই জন্তুটাকে না-মারা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।

চিনির কলে যে-কাজে হাত লাগিয়েছিল সাশা, সেই কাজটা তখনও শেষ হয়নি। তাই দূরবর্তী স্থানে শিকার-অভিযানে জোকুইমের সঙ্গী হতে পারল না সে। কিন্তু কয়েকদিন পরে যখন নিকটস্থ অঞ্চলে একটি তাইগরের উপস্থিতির সংবাদ এল এবং জানা গেল ওই জায়গাতে ঘোড়ার পিঠে পৌঁছানো যায় একদিনের মধ্যেই তখন বেদুইনো নামক অশ্বতরটির পৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে তিনটি শিকারি কুকুরের সঙ্গে পূর্বোক্ত স্থানের উদ্দেশে যাত্রা করল সাশা। বলাই বাহুল্য ওই তিনটি কুকুরের মধ্যে ভ্যালেন্টা নামে জোকুইমের জ্যান্ত উপহারটিও ছিল।

.

একাদশ পরিচ্ছেদ

একটি গোশালা থেকে ঘোড়ায় চড়ে সিনর শিকো পিন্টোর অধিকৃত জমিতে ফিরে আসার সময়ে তাইগরটাকে দেখতে পেয়েছিল। জনৈক ভৃত্যশ্রেণির লোক। দূর থেকে জন্তুটাকে কিছুক্ষণ অনুসরণ করার পর লোকটি দেখল ঘন ঘাসঝোপের ভিতর জন্তুটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন ফিরে এসে সিনর শিকোকে তাইগরের উপস্থিতির খবরটা জানিয়ে দিল লোকটি।

যেখানে তাইগরকে দেখা গিয়েছিল, বর্ণনা অনুসারে সেই জায়গাটার উদ্দেশেই কুকুর নিয়ে খচ্চরের পিঠে যাত্রা করেছিল সাশা। কিন্তু তুমুল বৃষ্টিপাতের ফলে বনপথ এমন দুর্গম হয়ে পড়েছিল যে, সময়মতো সেখানে সে পৌঁছাতে পারেনি একটা রাত তাকে বনের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল।

পরের দিন সকাল হতেই কুকুরগুলোকে নিয়ে রওনা হল সাশা। বেদুইনো নামে খচ্চরটাকে প্রথমে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে কুকুরগুলোকে নিয়ে সাশা পায়ে হেঁটেই চলেছিল তাইগরের খোঁজে কিন্তু পরে সে ভেবে দেখল ওইভাবে বেদুইনোকে বেঁধে রাখলে বেচারা বেঘোরে মারা পড়তে পারে। তাইগর যখন বুঝতে পারে শত্রু তার পিছু নিয়েছে, তখন অনেক সময় চক্রাকারে ঘুরে এসে পিছন থেকে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘাসঝোপের ভিতর কুকুর বা মানুষ চলাচলের সময় শব্দ হয়, কিন্তু তাইগর সেখানে নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারে তাই পিছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত শিকারি বিপদ বুঝে সতর্ক হওয়ার সুযোগ পায় না; মুহর্তের মধ্যে শিকারি পরিণত হয় শিকারে। এই তাইগরটাও যদি সে-রকম কিছু করে, তাহলে বেচারা বেদুইনো নিরুপায়ভাবে মৃত্যুবরণ করবে–পলায়ন বা লড়াই করার সুযোগই থাকবে না তার। তাই ঘন ঘাসঝোপের ভিতর খচ্চরের পিঠে চলাচল করতে অসুবিধা হলেও সাশা বেদুইনের বাঁধন খুলে উঠে বসল তার পিঠে এবং বাহনকে চালনা করল ধাবমান কুকুরদের পিছনে।

কুকুরগুলো ছুটতে ছুটতে সাশার দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিল। ঘন লতাগুল্ম আর ঝোপঝাড়ের বাধা ভেদ করে কুকুর যেভাবে ছুটতে পারে, সেভাবে ছুটতে পারে না খচ্চর বিশেষত পিঠের উপর আরোহীকে বহন করতে হলে তার গতিবেগ আরও কমে যায়।

কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আবার কুকুরগুলোকে দেখতে পেল সাশা। একটা ঘন ঘাসঝোপের বাইরে দাঁড়িয়ে তারা যেভাবে চিৎকার করছে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় ওই ঝোপের মধ্যেই রয়েছে তাইগর। ঘন জঙ্গলের মধ্যে তাইগরের মোকাবিলা করা বর্শাধারী শিকারির পক্ষে খুবই কঠিন। সাশার মনে পড়ল জোকুইম লড়াইয়ের জন্য সর্বদাই ফাঁকা জায়গা বেছে নিয়েছে, ঘন ঝোপঝাড়ের মধ্যে কখনোই তাইগরকে আক্রমণ করেনি।

এমন সমস্যায় আগে কখনো পড়েনি সাশা। সে যদি এখন পিছিয়ে আসতে চায়, তাহলে পিছন থেকে আক্রান্ত হতে পারে–সে-রকম কিছু ঘটলে সে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হবে না এবং তার কুকুরগুলোর জীবনও হবে বিপন্ন। আবার এগিয়ে গিয়ে ঝোপের মধ্যে আন্দাজে বর্শা দিয়ে খোঁচাখুঁচি করাও নিরাপদ নয়–হঠাৎ যদি তাইগর ঝাঁপ দেয়, তাহলে বর্শা তুলে বাধা দেওয়ার সময় পাওয়া যাবে না, নখদন্তের শানিত আলিঙ্গনে মুহূর্তের মধ্যে দেহ হবে ছিন্নভিন্ন।

কিন্তু সাশাকে বেশিক্ষণ মাথা ঘামাতে হল না। ঝোপের ভিতর থেকে কালো-হলুদ রং-এর একটা শরীরী বিদ্যুৎ সগর্জনে ছিটকে এল ফাঁকা মাঠের উপর এবং তিরবেগে ছুটে এল সাশার দিকে। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বর্শাটা তলা থেকে উপরে তুলে আক্রমণ প্রতিরোধ করল সাশা, শানিত বর্শাফলক ঢুকে গেল তাইগরের বুকে। এ-রকম ক্ষেত্রে শিকারি প্রাণপণ শক্তিতে বর্শাটা ঠেলে ধরে আর আহত তাইগর চেষ্টা করে বর্শার বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে এসে শিকারিকে নখদন্তের মৃত্যু-আলিঙ্গনে বন্দি করতে দুই পক্ষের ঠেলাঠেলির ফলে বর্শাফলক ক্রমশ গভীর থেকে আরও গম্ভীর হয়ে ঢুকে গিয়ে তাইগরকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দেয়।

কিন্তু বুনো জানোয়ার কখন কী করবে তা কেউ বলতে পারে না। এই তাইগরটাও যা করল, তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সাশা। চটপট পিছিয়ে এসে নিজের শরীরটাকে বর্শাফলকের দংশন থেকে মুক্ত করে নিল তাইগর, তারপর নতুন উদ্যমে আক্রমণের সুযোগ খুঁজতে লাগল। তার বুকের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে বটে, কিন্তু সেই রক্তপাত তুচ্ছ করেও জন্তুটা কতক্ষণ জীবিত থেকে লড়তে পারবে, সেটা বুঝতে পারল না সাশা। লড়াই যদি দীর্ঘসময় ধরে চলে, তবে তীব্র উত্তেজনা স্নায়ুর উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে সাশাকে দুর্বল করে ফেলবে এবং মানুষের শক্তি নিয়ে শ্বাপদের প্রবল জীবনীশক্তির সঙ্গে বেশিক্ষণ পাল্লা দেওয়া সম্ভব হবে না–লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হলে সাশার পরাজয় ও মৃত্যু অবধারিত। এখন তাইগর যদি ধৈর্য হারিয়ে উদ্যত বর্শাফলকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলেই মঙ্গল। কিন্তু জন্তুটার চালচলন দেখে তার মতলব কিছুই বুঝতে পারছে না সাশা শ্বাপদ জ্বলন্ত চক্ষে তাকে নিরীক্ষণ করছে, শত্রু মুহূর্তের জন্য অসাবধান হলেই সে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়বে…

হঠাৎ জোকুইমের সঙ্গে তাইগরের বিগত দ্বন্দ্বযুদ্ধের দৃশ্যটা সাশার মনে পড়ল। পা দিয়ে লাথি মেরে একটা শুকনো ঢেলাকে সে ছুঁড়ে দিল তাইগরের দিকে। ফল হল তৎক্ষণাৎ ভীষণ গর্জন করে সাশাকে লক্ষ করে ঝাঁপ দিল তাইগর। সঙ্গেসঙ্গে ক্ষিপ্রহস্তে আঘাত হানল সাশা আহত শাপদের রক্তাক্ত বুকে আরও গভীর ছিদ্র সৃষ্টি করে ঢুকে গেল বর্শার ফলা।

তাইগরের জীবনীশক্তি ফুরিয়ে এসেছিল। ধীরে ধীরে স্থিরী হয়ে এল তার অন্তিম আস্ফালন। সাশা এইবার বর্শাদণ্ডকে ঠেলে তাইগরকে চিত করে শুইয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ নিহত পশুর বক্ষে বিদ্ধ বর্শার ডান্ডায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সাশা। তার দেহে তখন অপরিসীম ক্লান্তি। সাশা বুঝতে পারল লড়াইটা যদি আর এক মিনিট স্থায়ী হত, তাহলে এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে তার মৃত্যু ছিল অবধারিত। স্নায়ুর উপর উত্তেজনার ওই অস্বাভাবিক তীব্র চাপ বহুক্ষণ ধরে সহ্য করতে পারত জোকুইম–কিন্তু তার চাইতে কম বয়স এবং অধিকতর দৈহিক শক্তি থাকলেও জোকুইমের মতো লৌহকঠিন স্নায়ুর অধিকারী হতে পারেনি সাশা।

…তাইগরের চামড়া খুলে নিল সাশা, তারপর সারমেয়-বাহিনী নিয়ে অশ্বতর-পৃষ্ঠে আরোহণ করে ফিরে গেল নিজস্ব আস্তানায়। সিনর শিকো তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল, চামড়া দেখেই বুঝতে পারছি জন্তুটা ছিল প্রকাণ্ড। দু-দুটো গভীর আঘাতচিহ্ন বুঝিয়ে দিচ্ছে তুমি বর্শা চালিয়েছিলে দু-বার। সিনর, তুমি এখন একজন তাইগরেরো!

.

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

সিনর শিকোর যেসব বিগড়ে-যাওয়া যন্ত্র মেরামত করার ভার নিয়েছিল সাশা, সেই কাজগুলো শেষ হতেই সে ফিরে গেল অ্যাপারিসিওর কাছে পূর্বনির্দিষ্ট ঠিকানায়। দেখা হওয়ামাত্র অ্যাপারিসিও জানাল তার জন্য দুটি খবর অপেক্ষা করছে একটি সুসংবাদ, আর একটি দুঃসংবাদ। সাশা বলল, সে আগে দুঃসংবাদটি শুনতে চায়।

অ্যাপারিসিও জানাল কয়েকদিন আগে মাত্তো গ্রসের একটি অধিবাসীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কথাবার্তার ফাঁকে হঠাৎ অ্যাপারিসিও বলে ফেলেছিল সাশা সিমেল ও তার বড়ো ভাই আর্নস্ট সিমেল তার পরিচিত। শোনামাত্র লোকটি রাগে আগুন হয়ে ওঠে। অ্যাপারিসিও প্রথমে ভেবেছিল মাত্তো গ্রসের লোকটি বুঝি সাশাকেই গালিগালাজ করছে, সে লোকটার গলা টিপে ধরার উপক্রম করেছিল কিন্তু একটু পরে সে যখন বুঝতে পারল সাশা নয়, লোকটির আক্রোশের উৎস হচ্ছে আর্নস্ট–তখন সে আর লোকটিকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তবে তার মনে হয় আর্নস্টকে ওই লোকটির কথা বলে সতর্ক করে দেওয়া উচিত, না হলে সে বিপদে পড়তে পারে।

সাশার মনে পড়ল পাসো ফানডো শহরে প্রথম যখন তার সঙ্গে আর্নস্টের দেখা হয়, সেইসময় আর্নস্টের কাঁধের উপর একটা ক্ষতচিহ্ন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং সেটার উৎপত্তির কারণ জিজ্ঞাসা করলে অত্যন্ত হিংস্রভাবে আর্নস্ট জানিয়েছিল ওটা তাকে উপহার দিয়েছে একটা শয়তান!

একটি নয়, আরও একটি দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল সাশার জন্য। অ্যাপারিসিও বলল, সিনর, ফাভেল নামে তোমার শত্রুটি আমোলার শহরে এসেছিল। যে-লোকটির কাছে ফাভেল তোমার খোঁজখবর নিচ্ছিল, সৌভাগ্যক্রমে সে ছিল আমার বন্ধু। আমার বন্ধুই আমাকে ফাভেলের কথা বলে দেয়, অবশ্য তোমার সম্পর্কে একবারও মুখ খোলেনি।

সাশা ক্রুদ্ধস্বরে বলল, তোমার বন্ধুর সঙ্গে অবার যদি ফাভেলের দেখা হয়, তাহলে সে যেন ফাভেলকে আমার ঠিকানা জানিয়ে দেয়। আমি কাউকে ভয় পাই না, কারো কাছ থেকে পালাতেও চাই না। আর্নস্ট এখন অ্যালবোব্রাল শহরে আছে। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। সেখান থেকে ফিরে এসেই আমি ঘোড়ার পিঠে যাত্রা করব আমোলার দিকে। আশা করি ফাভেলকে সেখানে পাওয়া যাবে।

মুচকি হেসে অ্যাপারিসিও জানাল ঘোড়া বা খচ্চরের পিঠে এখন আমোলার দিকে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ বন্যার জলে সমস্ত পথঘাট ভেসে গেছে। তবে যাতায়াত করার জন্য সে একটা নতুন উপায় মাথা খাঁটিয়ে বার করেছে। এই নতুন উপায় হচ্ছে পূর্বে উল্লিখিত সুসংবাদ! স্থানীয় এক ভূস্বামীর একটি বজরা অনেকদিন হল অকেজো হয়ে পড়ে আছে। লোকটির এখন খুব টাকার দরকার। অ্যাপারিসও উক্ত ভূস্বামীর সঙ্গে দরদাম করে অত্যন্ত কম দামে নৌকাটি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। লোকটি তো বিক্রি করতে পারলে বাঁচে, এখন সাশার সম্মতির জন্যই অপেক্ষা করছে অ্যাপারিসিও। সাশা মত দিলে খুব সুন্দরভাবে নিজের হাতে নৌকাটাকে সে সারিয়ে ফেলতে পারে। নৌকায় চড়ে সহজেই তারা বিভিন্ন গ্রাম ও র‍্যঞ্চে যাতায়াত করতে পারবে এবং অকেজো বন্দুক-পিস্তল মেরামত করে অর্থোপার্জনও হবে যথেষ্ট।

পরিকল্পনাটা খুবই পছন্দ হল সাশার। নৌকাটি কিনে নিয়ে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই সেটাকে চমৎকার করে সারিয়ে নিল অ্যাপারিসিও। সাশা ওইখানেই অ্যাপারিসিওকে অপেক্ষা করতে বলে ঘোড়ার পিঠে রওনা হল অ্যাবোব্রাল শহরের দিকে, যেখানে অবস্থান করছিল বড়ো ভাই আর্নস্ট।

আর্নস্টের সঙ্গে দেখা হল যখন, সেইসময় তার সঙ্গে অনেক লোকজন ছিল। রাত্রে নিরিবিলিতে সাশা জানাল মাত্তো গ্রসোর এক অধিবাসী আর্নস্টকে অনুসরণ করছে, তার উদ্দেশ্য ভালো নয়–এইভাবে লেগে থাকলে একসময় লোকটা আর্নস্টকে বাগে পেয়ে যাবে। বিশেষত কুয়াবা শহরটা আর্নস্টের পক্ষে মোটেই নিরাপদ নয়।

আমার সন্দেহ হচ্ছে পেদ্রো ভাকা নামে লোকটা আমাকে অনুসরণ করছে, আর্নস্ট বলল, ওই লোকটাই আমাকে পিছন থেকে গুলি করেছিল। অবশ্য পেদ্রো ছাড়া আমার আরও কয়েকজন শত্রু আছে। আমার পাঁজরে ছুরি ঢোকাতে পারলে তাদের সকলেই খুশি হবে।

শোনো আর্নস্ট সাশা বলল, আমি তোমার আগেই কুয়াবা শহরে চলে যাব, আর ওই পেদ্রো ভাকা নামে লোকটাকে খুঁজে বার করে ব্যাপারটার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করব। তারপর পাকড়াও করব ফাভেলকে, তার সঙ্গে আমার যে বোঝাঁপড়া বাকি আছে, সেটাও চুকিয়ে ফেলব। আমরা যেন পলাতক আসামি, আমাদের পিছনে সবাই তাড়া করে ফিরছে–এই ব্যাপারটা আর চলতে দেব না আমি। শিকারি-যাতে শিকারে পরিণত হয়, তাই করব।

আর্নস্ট মাথা নেড়ে বলল, আলেক্স, আমি কুয়াবাতে চলে যাব বলে ঠিক করেছি, কোনো কারণেই তার নড়চড় হবে না। অ্যাবোব্রাল শহরের চাইতে কুয়াবা অনেক ভালো শহর, ওখানে আমাদের উপার্জনও হবে অনেক বেশি।

সাশা বুঝল আর্নস্ট তার সিদ্ধান্তে অনড়। অতএব ঘোড়ায় চড়ে সে ফিরে গেল র‍্যাঞ্চ ট্রায়াম্ফ নামক স্থানে প্রিয়সঙ্গী অ্যাপারিসিওর কাছে।

ঘোড়া খচ্চর প্রভৃতি বিক্রয় করে তারা বজরা ভাসাল নদীর বুকে। ওই বৃহৎ নৌকা বা বজরার নাম তারা রেখেছিল অ্যাডভেঞ্চারিরা–পোর্তুগিজ ভাষায় যার অর্থ অ্যাডভেঞ্চারারবা ভ্যাগ্যান্বেষী!

.

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

হাতে টাকাপয়সা কম ছিল বলে কোরাম্বা শহরে কিছুদিন থেকে যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজ নিল সাশা আর অ্যাপারিসিও। ওই জায়গাটাতে ভালো কাজ-জানা মিস্ত্রির খুবই অভাব ছিল, তাই কাজ পেতে তাদের অসুবিধা হল না। বেশ ভালো উপার্জন হল তাদের।

১৯২৫ সালে বজরা চালিয়ে তারা একটা ছোটো গ্রামে এসে পৌঁছোল। পাথরের তৈরি একটা জেটি ডাঙা থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফুট এগিয়ে এসে নদীর বুকে শেষ হয়েছে। জেটির গায়ে নদীর প্রবল জলস্রোত ক্রমাগত ধাক্কা মারার ফলে গভীর নালার সৃষ্টি হয়েছিল। ওই নালার ভিতর নোঙর-করা কয়েকটা নৌকা জলের উপর দুলছিল।

বড়ো নৌকা বা ডাকবিভাগের লঞ্চ নোঙর করার জন্য জেটির গায়ে কয়েকটা বড়ো বড়ো খুঁটি পোঁতা ছিল, তারই মধ্যে দুটি খুঁটির সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারিরা নামে বজরাটিকে বাঁধা হল–তারপর প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস ক্রয় করার জন্য নদীতীরে অবস্থিত কুঁড়েঘরগুলোর দিকে অগ্রসর হল সাশা। সে আশা করেছিল ওই কুটিরগুলোর মধ্যে কোনো বলিচো (দোকান) পাওয়া যাবে, যেখান থেকে দরকারি জিনিসগুলো সে অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করতে পারবে। সাশার নিত্যসঙ্গী অ্যাপারিসিও রয়ে গেল বজরার মধ্যে জিনিসপত্র পাহারা দিতে।

কুটিরগুলোর কাছাকাছি এসে একটি ছোটোখাটো মানুষকে দেখতে পেল সাশা। লোকটির পরনে ছিল সাদ কোট আর গাঢ় রং-এর একটি প্যান্ট। নিকটবর্তী একটি কুটির থেকে বেরিয়ে লোকটি উঁচু জমির উপর দিয়ে হেঁটে জেটির ধারে এসে দাঁড়াল। প্রথমে লোকটির দিকে সাশা ভালোভাবে নজর দেয়নি, কিন্তু বারো ফুট দূরত্বের মধ্যে এসে লোকটি যখন থমকে দাঁড়াল এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাশার দিকে চেয়ে রইল, তখনই তার দিকে আকৃষ্ট হল সাশা।

সিমেল!

লোকটার মুখে নিজের নাম শুনে চমকে উঠল। ভালো করে তার দিকে তাকাতেই সাশার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল উত্তেজনার তীব্র শিহরন–ফাভেল!

প্রথম বিস্ময়ের চমক কেটে যেতেই এক প্রচণ্ড ক্রোধ সাশার চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে দিল। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে অগ্রসর হল ফাভেলের দিকে।

ফাভেল পিছিয়ে যেতে লাগল, সঙ্গেসঙ্গে চিৎকার, সিমেল! তুমি জাহান্নমে যাও। যদি সঠিকভাবে লড়াই করতে চাও, তাহলে চলে এসো!

সাশা দৃঢ়পদে এগিয়ে চলল ফাভেলের দিকে–এসপার কি ওসপার, আজকেই হয়ে যাবে চরম বোঝাঁপড়া!

পিছিয়ে এসে জেটির শেষপ্রান্তে দাঁড়াল ফাভেল, তারপর নালার মধ্যে নোঙর করা একটা নৌকায় লাফিয়ে পড়ে সে হাঁক দিল, চলে এসো সিমেল, চলে এসো। এখানেই আমি লড়ব তোমার সঙ্গে।

দোদুল্যমান নৌকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়াই করতে গেলে সাশা তার দৈহিক শক্তিকে কাজে লাগাতে পারবে না ভালোভাবে সেইজন্যই ওইখানে দাঁড়িয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ জানাল ফাভেল।

কিন্তু লড়াইটা কেমন জমত, আর ফলাফল কী হত, সেটা অজানাই রয়ে গেল–কারণ, ভারসাম্য সামলাতে না পেরে নৌকা থেকে নদীর জলে পড়ে গেল ফাভেল। সে তাড়াতাড়ি সাঁতার কেটে তীরের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সাশা। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে একটি লোক চেঁচিয়ে উঠল, কী সর্বনাশ ওরা আসছে!

শুধু ওই লোকটি আর সাশা নয়, ছোটোখাটো একটি জনতা তখন সমবেত হয়েছে নদীতীরে। তাদের সকলেরই ভয়ার্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে নদীর দিকে কর্দমাক্ত জলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে একটা অদৃশ্য ঝড় এগিয়ে আসছে ফাভেলের দিকে!

পিরানহা! রাক্ষুসে মাছ! ব্রেজিলের বিভিন্ন নদীতে বাস করে মাংসলোলুপ হিংস্র পিরানহা মাছ। তাদের কবলে পড়লে কারো রক্ষা নেই। একটা বলিষ্ঠ ষাঁড়কে কয়েক মিনিটের মধ্যে খেয়ে শেষ করে ফেলতে পারে ওই রাক্ষুসে মাছের ঝক–পড়ে থাকে শুধু তার মাংসহীন কঙ্কাল!

একটা লোক বাঁশ হাতে দৌড়ে এল ফাভেলকে উদ্ধার করতে। সাশার মন থেকে তখন ক্রোধ দুর হয়ে গেছে বিপন্ন ফাভেলকে উদ্ধার করার জন্য সে জেটির উপর এসে বাঁশটা ফাভেলের দিকে বাড়িয়ে ধরল। কিন্তু ফাভেল বাঁশটাকে ধরল না, অথবা বাঁশটাকে সে দেখতে পায়নি এমনও হতে পারে–কারণ, অন্ধের মতন সে তখন সাঁতার কাটছে তীর লক্ষ করে। দেখতে দেখতে আলোড়িত জলরাশির তরঙ্গ ধরে ফেলল ফাভেলকে রক্তে লাল হয়ে উঠল নদীর জল! কোনোরকমে তীরে উঠল ফাভেল, তার সর্বাঙ্গ দিয়ে ঝরছে লাল রক্তের ধারা, তার দেহের বিভিন্ন অংশ কামড়ে ধরে ঝুলছে অনেকগুলো নাছোড়বান্দা পিরানহা মাছ! তার বুক আর পেটের অধিকাংশ স্থানই ছিন্নভিন্ন, কোনোরকমে টলতে টলতে সে এগিয়ে গেল একটা কুঁড়েঘরের দিকে। তাকে সাহায্য করতে ছুটে এল অনেক লোক–কিন্তু তারা তার কাছে পৌঁছানোর আগেই কুটিরের দরজা ঠেলে ঢুকে গেল ফাভেল, পরক্ষণেই কুটিরের ভিতর থেকে ভেসে এল পিস্তলের আওয়াজ!

ইতিমধ্যে নৌকা থেকে নেমে এসেছে অ্যাপারিসিও। একজন বৃদ্ধ সাশার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, সিনর! লোকটা কি তোমার শত্রু? ওঃ কী ভীষণ যন্ত্রণা পেয়ে মারা গেল বেচারা!

রক্তাক্ত ও ছিন্নভিন্ন ফাভেলকে দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সাশা। অ্যাপারিসিও তাকে জড়িয়ে ধরে বজরার মধ্যে ঢুকে গেল। সাশা আর ফাভেলের মৃতদেহ দেখতে কুটিরের ভিতর প্রবেশ করেনি। যারা ভিতরে ঢুকেছিল, তারা পরে সাশাকে জানিয়েছিল যে, ফাভেলের পেটের প্রায় অর্ধেক অংশ মাছের দল খেয়ে ফেলেছিল–ফাভেল যদি তার পিস্তল থেকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা না-করত, তাহলেও সে কয়েক মিনিটের বেশি বাঁচত না। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে। জানা গিয়েছিল ওই গ্রামে বেশ কয়েকমাস ধরে বাস করছিল ফাভেল। সে যে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যই সাশার সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে ওই অঞ্চলে এসে পড়েছিল, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

অ্যাপারিসিও সাশাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, সিনর আলেকজান্দ্রা! এই ঘটনার জন্য তুমি নিজেকে দায়ী মনে করে কষ্ট পেয়ো না। লোকটার অন্তরের ঘৃণাই তার মৃত্যু ডেকে এনেছে তুমি তার মৃত্যুর জন্য দায়ী নও।

সাশা জানত ফাভেলের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী নয়। কিন্তু সে যদি নিজের হাতে ফাভেলকে হত্যা করত, সেটা অনেক ভালো ছিল–এমন বীভৎসভাবে অসহ্য যন্ত্রণাভোগ করে তাকে মরতে হত না। জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থাতেই ফাভেলের কোনো মূল্য ছিল না সাশার কাছে কিন্তু নরখাদক মাছের ভক্ষ্য হয়ে যেভাবে সে মৃত্যুবরণ করল, সেই ভয়াবহ মৃত্যুর দৃশ্য সাশাকে অত্যন্ত বিচলিত করে তুলল। অ্যাপারিসিওকে নিয়ে সে আবার বজরা ভাসাল বন্য পৃথিবীর বুকে হারিয়ে যাওয়ার জন্য…

.

পরিশিষ্ট

সাশা সিমেলের ঘটনাবহুল জীবনের কাহিনি সবিস্তারে বলতে গেলে ছোটোখাটো একটি মহাভারত সৃষ্টি হবে। তাই সংক্ষেপে শোনাচ্ছি ১৯৪২ সালের তাইগরেরোর ভূমিকা থেকে অবসর গ্রহণ করেছিল সাশা। জোকুইম গুয়াতো নামে যে রেড ইন্ডিয়ান শিকারিতাকে বর্শা হাতে লড়াই করতে শিখিয়েছিল, তার সঙ্গে জীবিত অবস্থায় আর সাশার দেখা করার সুযোগ হয়নি। একটা দুর্দান্ত জাগুয়ারের পিছনে তাড়া করার সময় নদীর ধারে নিহত জোকুইমের কঙ্কাল আর ভাঙা বর্শাটা আবিষ্কার করেছিল সাশা। তাইগরের কবলেই প্রাণ হারিয়েছিল তাইগরেরো জোকুইম গুয়াতো।

অনেকগুলো তাইগরের ভবলীলা সাঙ্গ করার পর ১৯৪০ সালে এডিথ  নামে একটি শ্বেতাঙ্গ রমণীকে বিবাহ করে সাশা সংসারী হয়েছিল। মাত্তো গ্রসোর জঙ্গলে শিকার করতে এসেছিল ওই মেয়েটি। এডিথকে শিকারে সাহায্য করার জন্যই সাশা তার সঙ্গী হয়েছিল। আক্রমণোদ্যত ক্ষিপ্ত জাগুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভুল নিশানায় তাকে গুলি চালাতে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সাশা–পরে শিকারসঙ্গিনী হয়েছিল তার জীবনসঙ্গিনী।

বড়ো ভাই আর্নস্টের সঙ্গেও আর দেখা হয়নি সাশার। আর্নস্টকে আড়াল থেকে গুলি চালিয়ে খুন করেছিল গুপ্তঘাতক। সাশার কথা শুনে সতর্ক হলে হয়তো অমন শোচনীয়ভাবে মৃত্যু ঘটত না আর্নস্টের।

দানবের অপমৃত্যু

শক্তি ও সাহসের জন্য কয়েকটি শক্তিমান মানুষ জগৎজোড়া নাম কিনেছেন। এইসব বিশ্ববন্দিত শক্তিসাধকদের নিয়ে আমি আজ প্রবন্ধ লিখতে বসিনি; আমার কাহিনির নায়ক একজন অখ্যাত মানুষ–নাম তার চার্লস কটার।

এই অখ্যাত লোকটি কোনোদিনই খ্যাতিমান হওয়ার চেষ্টা করেনি, তবে তার অমানুষিক শক্তি। ও দুর্জয় সাহস ভুবনবিখ্যাত ব্যায়ামবীরদের চাইতে কোনো অংশেই কম নয়।

এমনকী প্রসিদ্ধ টারজানের বীরত্বের কাহিনিও কটারের চমকপ্রদ কীর্তিকলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়।

কাল্পনিক টারজানের লীলাক্ষেত্র ছিল আফ্রিকার বনভূমি। আমাদের কাহিনির নায়ক আফ্রিকার বাসিন্দা বটে কিন্তু আফ্রিকা তার স্বদেশ নয়–এদিক থেকে টারজানের সঙ্গে তার কিছুটা মিল আছে।

চার্লস কটারের জন্মভূমি ছিল ওকালাহামা প্রদেশে। আফ্রিকায় আসার আগে সে ছিল ওখানকার শেরিফ।

ওকলাহামা জায়গাটা বড়ো বেয়াড়া।

কোনো ভদ্রলোকই ওকলাহামাকে পছন্দ করবে না।

সেখানকার পথেঘাটে ও দোকানে বাজারে যে মানুষগুলি ভিড় জমায় তারা খুব নিরীহ স্বভাবের নয়।

কথায় কথায় সেখানে ঝগড়া বাধে।

ঝগড়া বাধলে মীমাংসার প্রয়োজন।

ওকলাহামার মানুষ বেশি কথাবার্তা পছন্দ করে না, চটপট ঘুসি চালিয়ে তারা ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসা করে দেয়।

অনেকে আবার মুষ্টিবদ্ধ হস্তের পক্ষপাতী নয়।

রিভলভারের ঘন ঘন অগ্নিবৃষ্টির মুখেই তারা বিবাদের নিষ্পত্তি করতে চায়।

এমন চমৎকার জায়গায় শেরিফ হয়ে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে যেমন মানুষের দরকার ঠিক তেমন মানুষ ছিল চার্লস কটার।

যেসব মানুষ বৃহৎ দেহের অধিকারী হয় সাধারণত তাদের চালচলন হয় শ্লথ এবং মন্থর, কিন্তু ছ-ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এই নরদৈত্য ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম।

প্রয়োজন হলে মুহূর্তের মধ্যে কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে সে অব্যর্থ সন্ধানে লক্ষ্যভেদ করত।

ওকলাহামার মতো জায়গায় শেরিফের কাজ করে কটারের মনের গতি হয়েছিল খুবই স্পষ্ট আর সহজ।

একটা মানুষকে হয় সে পছন্দ করবে আর নয়তো পছন্দ করবে না। এই পছন্দ-অপছন্দর। মাঝামাঝি কিছু নেই।

কাউকে অপছন্দ হলেই সে তার ওপরে প্রয়োগ করত মুষ্টিবদ্ধ হস্তের মুষ্টিযোগ।

চার্লস কটারের জীবনদর্শনে একটুও জটিলতা ছিল না। কটারের অস্বাভাবিক দীর্ঘ হাত দু-খানায় ছিল অমানুষিক শক্তি। তার ওপর সর্বদাই তার ডান হাতে থাকত একটা বেঁটে মোটা বাঁশের লাঠি আর কোমরে ঝুলত গুলিভরা রিভলভার।

ওকলাহামার দুর্দান্ত গুন্ডারাও বুঝল চার্লস কটার যতদিন শেরিফ আছে অন্তত সেই কটা দিন তাদের আইন মেনে চলতে হবে।

এই ভয়ানক মানুষটি যখন স্বদেশের মায়া কাটিয়ে পূর্ব-আফ্রিকার কেনিয়া অঞ্চলে পাড়ি জমাল তখন নিশ্চয়ই ওকলাহামার গুন্ডারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। অবশ্য এটা আমার অনুমান-কটারের জীবন-ইতিহাসের কোনো পাতায় ওকলাহামার অধিবাসীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়নি।

আফ্রিকাতে এসে চার্লস কটার শিকারির পেশা অবলম্বন করল। একাজে অর্থ উপার্জনের যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও কাজটা অতিশয় বিপজ্জনক। তবে চার্লস কটারের মতো মানুষের পক্ষে এই ধরনের পেশা পছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক।

কটার ছিল বিবাহিত পুরুষ। তার পরিবারটির নেহাত ছোটো ছিল না। ছ-টি কন্যা এবং দুটি পুত্রসন্তান নিয়ে কটার প্রবল পরাক্রমে শিকারির ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছিল।

এইসব ব্যাবসা-সংক্রান্ত কথাবার্তা চলত টেলিগ্রাফের সাহায্যে। অফিসের কেরানিদের মধ্যে একধরনের লোক দেখা যায় যারা আইনের প্যাঁচ কষে সাধারণ মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।

এই ধরনের কোনো কেরানি যখন চিঠি লিখে চার্লস কটারকে আইন এবং শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে উপদেশ দিতে চেষ্টা করত তখনই তার মেজাজ যেত বিগড়ে বন্দুকের বদলে কলম হাতে নিয়ে সে করত যুদ্ধ ঘোষণা।

আগেই বলেছি চার্লসের জীবনদর্শন ছিল খুব সহজ ও স্পষ্ট।

গভর্নমেন্টের বেতনভোগী কর্মচারীর সঙ্গে মারামারি করা যায় না তাই মূল্যবান উপদেশপূর্ণ চিঠিকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে সে কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসত।

চিঠির ভাষা ছিল খুব সহজ—

মহাশয়,
আপনার চিঠিটা এইমাত্র আমার সামনে ছিল। এখন সেটা আমার পেছনে কাগজের ঝুড়ির মধ্যে আছে।
চার্লস-কটার

এমন সুন্দর চিঠি পেলে কোনো মানুষই খুশি হতে পারে না। ডাকবিভাগের কেরানিরা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কটারের ওপর খঙ্গহস্ত ছিলেন। বেয়াড়া চিঠিপত্র লেখার জন্য প্রায়ই তার ওপর আদালতের সমন জারি হত। আদালতে দাঁড়াতে হলেই তার মেজাজ হয়ে উঠত খাপ্পা তখনকার মতো বিচারকের নির্দেশ পালন করে সে ঘরে ফিরে আসত বটে কিন্তু মহামান্য আদালত তার চরিত্র একটুও সংশোধিত করতে পারেননি। বেয়াড়া চিঠিপত্র লেখার জন্য বহুবার চার্লস কটারকে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে…

এই উদ্ধত মানুষটি তার জীবনে দু-দুবার লেপার্ডের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইতে নেমেছিল। হিংস্র শ্বাপদের শানিত নখর তার দেহের বিভিন্ন স্থানে সুগভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সেই জীবন-মরণ যুদ্ধে প্রত্যেকবারই বিজয়লক্ষ্মীর বরমাল্য দুলেছে চার্লসের কণ্ঠে!

এই প্রসঙ্গে লেপার্ডের একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। ভারতবর্ষেও লেপার্ড আছে, বাংলায় তাকে চিতাবাঘ বলে ডাকা হয়। আফ্রিকার জঙ্গলে চিতা নামে বিড়াল জাতীয় যে জানোয়ার বাস করে তার দেহচর্মের সঙ্গে লেপার্ডের কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও দেহের গঠন ও স্বভাব-চরিত্রে চিতার সঙ্গে লেপার্ডের কোনো মিল নেই–চিতা এবং লেপার্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন জানোয়ার।

চিতা লাজুক ও ভীরু প্রকৃতির জন্তু।

লেপার্ড হিংস্র, দুর্দান্ত!

জে হান্টার, জন মাইকেল প্রভৃতি শিকারিরা লেপার্ডকে আফ্রিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক জানোয়ার বলে ঘোষণা করেছেন।

সিংহের মতো বিপুল দেহ অথবা প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী না হলেও ধূর্ত লেপার্ডের বিদ্যুৎচকিত আক্রমণকে অধিকাংশ শিকারি সমীহ করে চলে।

লেপার্ডের আক্রমণের কায়দা বড়ো বিশ্রী।

লতাপাতা ও ঘাস ঝোপের ভেতর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে যে যখন বিদ্যুদবেগে শিকারির ওপর লাফিয়ে পড়ে তখন অধিকাংশ সময়েই আক্রান্ত ব্যক্তি হাতের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পায় না। প্রথম আক্রমণেই লেপার্ড, তার সামনের দুই খাবার তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে শিকারির চোখ দুটোকে অন্ধ করে ফেলার চেষ্টা করে, সঙ্গেসঙ্গে একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের মারাত্মক দংশন চেপে বসে শিকারির কাঁধে আর পেছনের দুই থাবার ধারালো নখগুলির ক্ষিপ্র সঞ্চালনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় হতভাগ্যের উদরদেশ!

এই হিংস্র অথচ সুন্দর জানোয়ারটাকে কটার ভীষণ ঘৃণা করত। সে প্রায়ই বলত, আঃ! বেটাদের নখে কী দারুণ ধার! আঁচড় দিলে মনে হয় যেন ক্ষুর চালাচ্ছে! শয়তানের বাচ্চা

হ্যাঁ, এ-কথা অবশ্য সে বলতে পারে।

তার হাতপায়ের যেসব অংশ পরিচ্ছদের বাইরে দৃষ্টিগোচর হয় সেদিকে একবার তাকালেই চোখে পড়ে অজস্র ক্ষতচিহ্ন–অভিজ্ঞ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে যে ক্রুদ্ধ লেপার্ডের নখের আঘাতেই ওই গভীর ক্ষতচিহ্নগুলোর সৃষ্টি হয়েছে।

কিন্তু লেপার্ডের নখ কটারের শরীরে দাগ কাটলেও মনের মধ্যে একটুও দাগ বসাতে পারেনি। ওকলাহামা শহরে যে মানুষ গুন্ডার রিভলভারকে পরোয়া করেনি, আফ্রিকার লেপার্ডের দাঁত আর নখকেও সে সমীহ করতে শিখল না।

একদিনের ঘটনা বলছি…

বনের মধ্যে একটা গাছের ডালে ঝুলছে মরা কুকুরের টোপ আর খুব কাছেই ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করছে রাইফেলধারী কটার। কুকুরের মাংস লেপার্ডের প্রিয় খাদ্য। কটার জানত মরা কুকুরের গন্ধে গন্ধে লেপার্ড আসবেই আসবে…

একটু পরেই ঘটনাস্থলে একটা লেপার্ড আত্মপ্রকাশ করলে।

জন্তুটার দিকে তাকিয়ে কটার হতাশ হল–লেপার্ডটা আকারে বিশেষ বড়ো নয়, তার গায়ের চামড়াটাও কটারের কাছে লোভনীয় মনে হল না।

গ্রামের আশেপাশে যেসব লেপার্ড ঘোরাঘুরি করে তাদের দেহের আকার খুব বড়ো হয় না, গায়ের চামড়া হয় অনুজ্জ্বল, ফ্যাকাশে। কিন্তু ঘন জঙ্গলের মধ্যে যে লেপার্ডগুলো বাস করে সেগুলো সত্যিই বৃহৎ বপুর অধিকারী, তাদের চামড়া অতি উজ্জ্বল ও সুন্দর।

কটার আশা করেছিল একটি বেশ বড়োসড়ো লেপার্ড তার ফাঁদে পা দেবে, কিন্তু এই জন্তুটাকে দেখে তার মেজাজ হয়ে গেল খাপ্পা।

লেপার্ড ধূর্ত জানোয়ার–সে তখন কুকুরের মৃতদেহটার কাছে ঘোরাঘুরি করছে, তবে ভোজের জিনিসে মুখ দেয়নি। কিছুক্ষণ পরে তার মনে হল এই ভোজটা সম্ভবত নিরাপদ, এখানে কামড় বসালে বোধ হয় বিপদের আশঙ্কা নেই–সে নীচু হয়ে বসে পড়ল, এইবার একলাফে গাছে উঠে মরা কুকুরটাকে নামিয়ে আনবে।

চার্লসের মেজাজ আগেই খারাপ হয়েছিল, তার লেপার্ডকে ইতস্তত করতে দেখে সে আশা করলে জন্তুটা হয়তো চলে যেতে পারে। কিন্তু লেপার্ড যখন লাফ দিতে উদ্যত হল তখন তার আর ধৈর্য বজায় রইল না। ইচ্ছে করলে কটার অনায়াসেই গুলি করে লেপার্ডকে হত্য করতে পারত কিন্তু সে তা করলে না–হাতের রাইফেল ফেলে দিয়ে হঠাৎ কটার ছুটে এসে জন্তুটার পেছনের ঠ্যাং দুটো ধরে ফেললে!

পরক্ষণেই দুই সবল বাহুর আকর্ষণে লেপার্ডের শরীরটা শূন্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে সশব্দে ধরাশয্যায় আছড়ে পড়ল!

লেপার্ডের ঊর্ধ্বতন চোদ্দো পুরুষ কেউ কখনো এমন ব্যবহার সহ্য করেনি। আকারে ছোটো হলেও লেপার্ড হচ্ছে লেপার্ড; তুচ্ছ মানুষের হাতে আছাড় খেয়ে মুখের গ্রাস ফেলে পালিয়ে যেতে সে রাজি হল না।

ভীষণ আক্রোশে গর্জন করে সে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু কটারের অস্বাভাবিক লম্বা হাতগুলো এড়িয়ে জন্তুটা শত্রুর দেহে দাঁত বসাতে পারলে না। লোহার মতো শক্ত দু-খানা হাত লেপার্ডের গলা টিপে ধরল।

সামনের থাবার ধারালো নখগুলি কটারের হাত দু-খানা রক্তাক্ত করে দিলে, তবুও কটার জন্তুটা গলা ছাড়ল না।

ঝটাপটি করতে করতে মানুষ ও পশু মাটির ওপর গড়িয়ে পড়ল। লেপার্ডের পেছনের থাবা দুটিও নিশ্চেষ্ট রইল না, তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কটারের সর্ব-অঙ্গ কিন্তু লৌহকঠিন অঙ্গুলির নিষ্ঠুর বন্ধন একটুও শিথিল হল না…

অবশেষে কঠিন নিষ্পেষণে রুদ্ধ হয়ে এল জন্তুটার কণ্ঠনালী, উন্মুক্ত মুখগহ্বরের ভেতর থেকে উঁকি দিলে দীর্ঘ দাঁতের সারি আর সেই অবস্থায় নিশ্বাস নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে লেপার্ড প্রাণত্যাগ করল।

চার্লস কটারের সর্বাঙ্গ থেকে তখন ঝরছে গরম রক্তের স্রোত, টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে সেই উষ্ণ তরল ধারা মৃত লেপার্ডের দেহের ওপর।

সে এবার কী করবে?

ক্ষতগুলিতে ওষুধ দেবার জন্য কি এখন ফিরে যাবে বাড়িতে? পাগল! কটার সে জাতের মানুষই নয়!

রক্তাক্ত ক্ষতগুলিতে মোটামুটি খানিকটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সে পরবর্তী শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

একটু পরেই সেখানে এসে উপস্থিত হল আরেকটি লেপার্ড। এবারের লেপার্ডটা আকারে খুব বড়ো, তার গায়ের চামড়াটিও খুব সুন্দর। কটার বুঝল এই জানোয়ারটা গভীর অরণ্যের বাসিন্দা।

নিশানা স্থির করে সে রাইফেলের ঘোড়া টিপল।

অব্যর্থ সন্ধান! একটিমাত্র গুলিতেই লেপার্ডের প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

এই ঘটনার পরে কয়েকটা দিন কেটে গেছে।

জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে চার্লস কটার।

আচম্বিতে গাছের ওপর ঘন লতাপাতার আড়াল থেকে তার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল দু-দুটো ছোটো জাতের লেপার্ড!

যে-জানোয়ারটা কটারের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে নিহত হয়েছিল এই লেপার্ড দুটো তারই পরিবারভুক্ত কি না জানি না, কিন্তু সমস্ত ঘটনাটা শুনলে এটাকে প্রতিশোধের ব্যাপার বলেই মনে হয়।

এমন অভাবিত ও অতর্কিত আক্রমণের জন্য কটার প্রস্তুত ছিল না। সমস্ত ব্যাপারটা সে যখন বুঝল তখন লেপার্ডের দাঁত ও নখের আঘাতে তার দেহ রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে।

কিন্তু চার্লস কটার হচ্ছে চার্লস কটার।

মুহূর্তের মধ্যে সে কর্তব্য স্থির করে ফেললে!

হাতের রাইফেল আর কাজে লাগবে না বুঝতে পেরে সে অস্ত্রটাকে মাটিতে ফেলে আক্রমণের মোকাবেলা করার জন্যে রুখে দাঁড়াল।

কটারের দ্রুত প্রতি-আক্রমণের জন্য লেপার্ড দুটো প্রস্তুত ছিল না, তারা ছিটকে শত্রুর পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেতে লাগল। সেই সুযোগে কটার চট করে একটা জানোয়ারের গলা চেপে ধরলে। এত জোরে সে লেপার্ডের গলা টিপে ধরেছিল যে জন্তুটার চোখে রক্ত জমে গেল!

কটারের শরীরও অক্ষত ছিল না!

ধারালো নখের আঘাতে বিদীর্ণ ক্ষতমুখ থেকে ছুটছে রক্তের ফোয়ারা, সুদীর্ঘ শ্বাপদ-দন্তের হিংস্র শুভ্রতাকে লাল করে দিয়ে সেই তপ্ত রক্তধারা গড়িয়ে পড়ল আক্রান্ত জন্তুটার হাঁ-করা মুখের মধ্যে!

অন্য লেপার্ডটা কটারের খপ্পরে ধরা পড়েনি।

সে এবার পিছন থেকে শত্রুর পৃষ্ঠদেশ লক্ষ করে লাফ দিলে।

কটার তখন প্রথম জানোয়ারটার সঙ্গে মারামারি করতে করতে হঠাৎ সামনে ঝুঁকে পড়েছে।

দু-নম্বর লেপার্ডের লাফটা ফসকে গেল।

লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার জন্য কটারের পিঠের ওপর না-পড়ে সে এসে পড়ল সঙ্গীর পেছনের দুটো পায়ের ওপর।

সঙ্গী তখন কটারের কবলে ছটফট করছে আর লাথি ছুড়ছে। সেই সনখ থাবার একটা লাথি এসে লাগল দুনম্বর লেপার্ডের পেটে–সঙ্গেসঙ্গে ধারালো নখের আঁচড়ে বিদীর্ণ হয়ে গেল উদরের মাংসপেশি।

কটার সেই মুহূর্তের সুযোগ নিতে ছাড়ল না।

টপ করে হাত বাড়িয়ে সে দ্বিতীয় লেপার্ডটার কণ্ঠনালী চেপে ধরলে। এইবার সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে সে জন্তু দুটোকে মাটিতে চেপে ধরে গলা টিপে মারবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু লেপার্ডের মংসপেশিগুলো স্প্রিং-এর মতো। চার্লস কটারের মতো মানুষের পক্ষেও তাদের মাটিতে চেপে রাখা অসম্ভব।

জন্তু দুটো জোর করে ঠেলে উঠল। কাজেই কটারও সোজা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হল, কিন্তু প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালীর ওপরে তার আঙুলের চাপ একটুও শিথিল হল না।

নখের আঘাতে কটারের কাঁধ আর হাতে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। এত রক্তপাতেও সে কাবু হল না বরং রক্ত দেখে তার মাথায় খুন চেপে গেল। ক্রুদ্ধ কটার এবার যা করলে তা প্রায় অবিশ্বাস্য একটা জন্তুর মাথার সঙ্গে সে আর একটা জন্তুর মাথা ঠুকতে লাগল সজোরে!

লেপার্ড দুটো কিন্তু এমন দারুণ মার খেয়েও অবসন্ন হল না!

তারা ক্রমাগত ছটফট করে কটারের বজ্রমুষ্টি থেকে নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টা করছে আর তাদের থাবার ধারালো নখগুলো সমানে শত্রুর দেহে আঁচড় কেটে যাচ্ছে।

রক্তে লাল হয়ে উঠল কটারের সমস্ত শরীর। লেপার্ড দুটোর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল লৌহ-কঠিন অঙ্গুলির নিষ্ঠুর পেষণে।

তবু কোনো পক্ষই পরাজয় স্বীকার করলে না!

কটারের সঙ্গে যে নিগ্রো সঙ্গীরা ছিল তারা প্রথমে পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরে আবার ফিরে এসেছে।

বিস্ফারিত দুই চক্ষুর ভীতিবিস্মিত দৃষ্টি মেলে তারা তাকিয়ে আছে এই আশ্চর্য দৃশ্যের দিকে–কিন্তু এখন আর কটারকে সাহায্য করার উপায় নেই, মানুষ ও পশু এমনভাবে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে মারামারি করছে যে গুলি চালালে কটারও আহত হতে পারে।

এখন আর কটারকে সাহায্য করার কোনো উপায় নেই।

যে-পক্ষের সহ্যশক্তি বেশি সেইপক্ষই জয়লাভ করবে।

রক্তস্নাত চার্লস কটারের বিশাল দেহ অফুরন্ত শক্তির আধার–সে হঠাৎ বুঝতে পারলে তার দুই শত্রুর দেহ অবশ হয়ে আসছে, তাদের থাবার আঁচড়ে, শরীরের আস্ফালনে আর আগের মতো জোর নেই।

মহা-উল্লাসে কটার চিৎকার করে উঠল।

যে-লেপার্ডটার উদর সঙ্গীর নখের আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল তার ক্ষতস্থান থেকে তখন অবিরল ধারায় রক্ত ঝরে পড়ছে।

কটারের অবস্থা তো আগেই বলেছি।

মানুষ ও পশুর রক্তে পিছল হয়ে উঠল রণভূমির ঘাসজমি।

কটার যখন বুঝল তার শত্রুরা দুর্বল হয়ে পড়ছে তখন সে লড়াইয়ের কায়দা বদলে ফেললে। হাত দুটোকে সোজা করে এমনভাবে সে জন্তু দুটোকে তুলে ধরলে যে তাদের থাবাগুলো আর কটারের দেহস্পর্শ করতে পারল না।

এইবার সে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে জন্তু দুটোর মাথা ঠুকতে লাগল।

মাথার ওপর পড়ছে প্রচণ্ড আঘাত, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে লৌহকঠিন অঙ্গুলির নিষ্ঠুর পেষণে।

ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এল দুই শ্বাপদের দেহ…

মুমূর্ষু জন্তু দুটোকে মাটির ওপর আছড়ে ফেলে কটার সোজা হয়ে দাঁড়াল।

সে এক আশ্চর্য দৃশ্য ধরাশয্যায় শুয়ে মৃত্যু-যাতনায় ছটফট করছে দু-দুটো লেপার্ড আর তাদের পাশেই ক্ষতবিক্ষত রক্তস্নাত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এক মহাকায় মানুষ।

গল্পের টারজান কি কটারের চেয়েও শক্তিশালী?

কটার এবার কী করবে?

বাড়ি ফিরে যাবে?

ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে শয্যাগ্রহণ করবে?

মোটেই নয়। চার্লস কটার হচ্ছে চার্লস কটার।

নিগ্রোদের সাহায্যে ক্ষতস্থানগুলোতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সে আবার পথ চলতে শুরু করল।

কথায় আছে ডানপিটের মরণ গাছের আগায়।

চার্লস কটার অবশ্য গাছের আগায় মরেনি, তবে তার মৃত্যু হয়েছিল অত্যন্ত ভয়ানকভাবে। জন্মগ্রহণ করেছিল সে সুসভ্য আমেরিকার ওকলাহামা প্রদেশে আর তার মৃত্যু হল ঘন-বন-আবৃত আফ্রিকার অন্তঃপুরে।

একেই বলে নিয়তি!

হ্যাঁ, নিয়তি ছাড়া আর কী বলব!

চার্লস কটারের মৃত্যুকে একটা অদ্ভুত দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না আর এই দুর্ঘটনার কারণ হল একটা যন্ত্রের যান্ত্রিক ত্রুটি!

না, না, রাইফেল নয়, পিস্তল নয়।

একটা ক্যামেরার দোষেই হল সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

অর্থাৎ কটারের মৃত্যুর জন্য দায়ী একটা ক্যামেরা!

মনে হচ্ছে অবিশ্বাস্য–তাই না?

কিন্তু বাস্তব সত্য অনেক সময়ে কল্পনাকে অতিক্রম করে যায়।

আচ্ছা, ঘটনাটা খুলেই বলছি।

কটার একদিন রাইফেলের সঙ্গে ক্যামেরা ঝুলিয়ে জঙ্গলের পথে যাত্রা করলে।

ক্যামেরার view-finder টা খারাপ ছিল। (ক্যামেরার মধ্যে বসানো স্বচ্ছ কাঁচের মতো যে জিনিসটার ভেতর দিয়ে ক্যামেরাধারী বিষয়বস্তুকে লক্ষ করে সেই অংশটিকে বলে view finder)।

ক্যামেরার সামান্য ত্রুটি নিয়ে কটার বোধ হয় মাথা ঘামায়নি আর এইটুকু অন্যমনস্কতার জন্যই তাকে প্রাণ হারাতে হল।

কটার হেঁটে চলেছে জঙ্গলের পথে হঠাৎ তার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করলে একটা মস্ত গণ্ডার।

রাইফেল রেখে সে ক্যামেরা বাগিয়ে ধরলে আর নিবিষ্টচিত্তে গণ্ডারের ফটো তুলতে লাগল।

হতভাগা গণ্ডার!

ফটো তুলে দেওয়ার জন্য সে একটুও কৃতজ্ঞতা বোধ করল না, একটুও খুশি হল না।

সোজা তেড়ে এল কটারের দিকে খড়্গ উঁচিয়ে!

আগেই বলেছি, ক্যামেরার view-finder টা খারাপ ছিল। ক্যামেরার যান্ত্রিক চক্ষুর ভেতর দিয়ে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে তার ধারণা হল জন্তুটা এখনও অনেক দূরেই আছে–আসলে গণ্ডার তখন খুব কাছে এসে পড়েছে।

কটার যখন বিপদ বুঝে ক্যামেরা রেখে রাইফেল তুলে নিলে তখন আর সময় নেই।

গণ্ডারের খঙ্গ প্রায় কটারের দেহস্পর্শ করেছে।

সশব্দে অগ্নি-উদগার করলে কটারের রাইফেল।

সঙ্গেসঙ্গে গণ্ডারের সুদীর্ঘ খঙ্গ সেই অতিকায় নরদানবের দেহটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলে।

কটারের মুখ থেকে একটা আর্তনাদও শোনা গেল না। সে তৎক্ষণাৎ মারা গেল।

চার্লস কটার জীবনে কখনো পরাজয় স্বীকার করেনি, মৃত্যুকালেও জয়লক্ষ্মী তার কণ্ঠে পরিয়ে দিলেন জয়মাল্য।

মরবার আগে সে একবারই গুলি চালাবার সুযোগ পেয়েছিল আর সেই একটামাত্র গুলির আঘাতেই তার আততায়ী মৃত্যুবরণ করল।

চার্লস কটারের মৃতদেহের পাশেই লুটিয়ে পড়ল গণ্ডারের প্রাণহীন দেহ।

[১৩৭৩]

দানবের ক্ষুধা

রামায়ণে বর্ণিত কুম্ভকর্ণ ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিনই ঘুমিয়ে থাকত, আর একদিন জেগে উঠে ক্ষুধা নিবৃত্তি করে আবার আশ্রয় গ্রহণ করত নিদ্রাদেবীর ক্রোড়ে।

হ্যাঁ, সারাবছরে মাত্র একদিনই সে আহার গ্রহণ করত বটে, কিন্তু তার সেই একদিনের আহার্য সংগ্রহ করতে স্বয়ং রাবণ রাজা পর্যন্ত হিমশিম খেয়ে যেতেন–বাঘ, ভালুক, হাতি, গণ্ডার, মানুষ, বানর প্রভৃতি বিভিন্ন চতুষ্পদ ও.দ্বিপদ জীবের রক্তমাংসে ক্ষুধা তৃপ্ত করে কুম্ভকর্ণ আবার ঘুমিয়ে পড়ত এবং সারাবছর ধরে একটি লম্বা ঘুম দিয়ে পরবর্তী বছরের শেষ দিনে আবার জেগে উঠত শূন্য উদরে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে।

এই মূর্তিমান বিভীষিকার জন্ম রাক্ষস-বংশে হয়নি, কুম্ভকর্ণ ছিল ব্রাহ্মণ-সন্তান।

কিন্তু ব্রাহ্মণ-সন্তান হলেও ব্রাহ্মণের সংস্কার ছিল না কুম্ভকর্ণের রক্তে, বিপ্রসুলভ সাত্ত্বিক আহারে সে তুষ্ট থাকতে পারেনি, বিভিন্ন প্রাণীর রক্তমাংসে তৃপ্ত হত তার ভয়াবহ ক্ষুধা।

পশুজগতে সন্ধান করলে এমন অনেক পশুর সন্ধান পাওয়া যায়, যারা কুম্ভকর্ণের মতো নিদ্রাবিলাসী না হলেও আহারে-বিহারে তার মতোই পূর্বপুরুষের প্রচলিত সংস্কার মেনে চলতে রাজি হয়নি।

এইসব চতুষ্পদ কুম্ভকর্ণ শাকসবজি, ঘাসপাতা প্রভৃতি নির্জীব খাদ্যের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে হঠাৎ একদিন আহার্যতালিকা পরিবর্তন করার প্রয়োজন বোধ করেছে এবং তাদের ক্ষুধিত দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে রক্তমাংসের দেহধারী সজীব খাদ্যের প্রতি।

কেন এমন হয় বলা মুশকিল। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা করা যায় না। মানুষ যখন এইসব অর্থহীন ঘটনাগুলো ঘটতে দেখে, যুক্তি আর বুদ্ধি নিয়ে ওই ঘটনাগুলির কার্যকারণ সে যখন বুঝতে পারে না, তখন সে হয়ে পড়ে হতভম্ব।

হ্যাঁ, হতভম্ব হয়ে পড়েছিল জর্জ নুজেন্ট।

দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যামেরুন প্রদেশের এক অখ্যাত গ্রামের খুব কাছেই কয়েকটা পায়ের ছাপ তার চোখে পড়েছে, কিন্তু চার আঙুলবিশিষ্ট ওই গভীর পদচিহ্নগুলির কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সে হয়ে পড়েছে হতভম্ব।

পায়ের ছাপ চিনতে অবশ্য জর্জের অসুবিধা হয়নি।

চারটি অঙ্গুলিবিশিষ্ট ওই গভীর পদচিহ্নগুলির মালিক যে একটি জলহস্তী, সে-কথা দাগগুলো দেখেই সে বুঝতে পেরেছিল এবং পায়ের দাগগুলি ভালোভাবে পরীক্ষা করে সে জানতে পারল যে, জন্তুটা গ্রামের বাইরে ওই জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ।

কিন্তু কেন? জন্তুটা কি গ্রামবাসীদের লক্ষ করছিল?

ছাগল, গোরু, ভেড়া প্রভৃতি গৃহপালিত পশুর মাংসের লোভে গাঁয়ের আশেপাশে ঝোপঝাড়ের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে থাকে সিংহ, লেপার্ড অথবা হায়না গ্রামবাসীদের অলক্ষ্যে তারা গ্রামের মানুষ এবং পশুগুলির ওপর নজর রাখে–রাতের অন্ধকারে সুযোগ পেলেই গৃহপালিত পশুর ঘাড় ভেঙে শিকার মুখে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় অরণ্যের অন্তঃপুরে।

শুধু গৃহপালিত পশু নয়, অনেক সময় নরমাংসের লোভেও গ্রামের কাছে লুকিয়ে থাকে নরখাদক শ্বাপদ। কিন্তু জলহস্তী নিরামিষভোজী পশু, সে গ্রামের কাছে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল কেন?

জর্জ নুজেন্ট এই জন্তুটার অদ্ভুত আচরণের কোনো কারণ বুঝতে পারল না।

সত্যি, ক্যামেরুন অঞ্চলের এই জলহস্তীর আচরণ অত্যন্ত অদ্ভুত। হিপো বা জলহস্তী কখনো কখনো হিংস্র স্বভাবের পরিচয় দেয় বটে, কিন্তু সাধারণত তারা মানুষকে এড়িয়ে চলে। নির্জন নদী এবং জলাভূমি তাদের প্রিয় বাসস্থান। গভীর রাতে জলের আশ্রয় ত্যাগ করে তারা ডাঙায় উঠে আসে এবং জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ঘাস, পাতা, গাছের মূল প্রভৃতি উদ্ভিদজাত পদার্থ উদরস্থ করে ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য। জলা কিংবা নদী থেকে অনবরত বনের মধ্যে যাতায়াত করার ফলে এই গুরুভার জন্তুগুলির পায়ের চাপে চাপে বনজঙ্গল ভেঙে যায়, বিপুল বপু দানবদের পদচিহ্ন বুকে নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে নূতন অরণ্যপথ।

বনের মধ্যে যখন তারা আহারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়, তখন কোনো কারণে ভয় পেলে তারা ওই পায়ে চলা পথ ধরে ছুটে যায় জলের মধ্যে আত্মগোপনের জন্য সেই সময় কোনো মানুষ অথবা জানোয়ার যদি তাদের বাধা দেয়, তাহলে তার যে দুর্দশা হয় তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

অতিশয় গুরু দেহ নিয়েও জলহস্তী অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে ছুটতে পারে। তার বিকট মুখগহ্বরের মধ্যে যে দাঁতগুলো উদ্ভিদ জাতীয় বস্তু চর্বণ করতে অভ্যস্ত, যুদ্ধের সময় সেই দীর্ঘ দস্তগুলি মৃত্যুর করাল ফাঁদের মতো চেপে ধরে শত্রুর দেহ কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে হতভাগ্য শত্রুর শরীর রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে পরিণত হয় একজোড়া দন্তভয়াল চোয়ালের প্রচণ্ড পেষণে!

জলহস্তীর স্বভাব-চরিত্র জানত জর্জ নুজেন্ট, তাই গ্রামের সীমানার বাইরে অপেক্ষারত জন্তুটির পদচিহ্ন দেখে সে আশ্চর্য হয়েছিল–জলহস্তী মানুষের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলে, সে তো নিরামিষভোজী, অতএব পশুমাংস বা নরমাংসের লোভে গ্রামের ভিতর হানা দেওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক নয়।

কিন্তু গ্রামের বাসিন্দা বুলা জাতীয় নিগ্রোরা ভীত হয়ে পড়ল। সারারাত তারা আগুন জ্বালাতে লাগল এবং বদ্ধদ্বার কুটিরের মধ্যে প্রেতাত্মার রোষদৃষ্টি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নানারকম ক্রিয়াকলাপ করল।

এত কাণ্ড করা সত্ত্বেও পরের দিন সকালে গ্রামের কাছে আবার সেই পায়ের ছাপ দেখা গেল! অর্থাৎ পদচিহ্নের মালিক জ্বলন্ত আগুন বা মন্ত্রতন্ত্রের পরোয়া করে না কিছুমাত্র!

ভীষণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল বুলাদের গ্রামে। তাদের ধারণা হল, এটা কোনো পশুর পায়ের ছাপ নয়–পশুর দেহ ধারণ করে তাদের গ্রামে হানা দিতে চায় এক দুষ্ট প্রেতাত্মা!

বুলারা ঢাকের শরণাপন্ন হল, আফ্রিকার আদিম অধিবাসীরা ঢাকের সাহায্যে দূরদূরান্তরে খবর পাঠিয়ে দেয়। ঢাকের আওয়াজ শুনেই তারা বুঝতে পারে বাদক কী বলতে চায়।

বুলারা ঢাক বাজাতে শুরু করল।

ঢাকের আওয়াজ যেসব গ্রামে পৌঁছে গেল, সেইসব গ্রামের অধিবাসীরা বুঝল, বুলাদের গ্রামে এক প্রেতাত্মার আবির্ভাব হয়েছে। তারা আবার ঢাক বাজিয়ে দূরের গ্রামবাসীদের পাঠিয়ে দিল ওই দুঃসংবাদ বাতাসে ভর করে গ্রাম হতে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল ঢাকের টেলিগ্রাফ

সাবধান! সাবধান! বুলাদের গ্রামে হানা দিয়েছে এক প্রেতাত্মা!

জর্জ ভীত হয়ে পড়ল। সে অবশ্য বুলাদের মতো প্রেতাত্মার ভয়ে কাতর হয়নি, তার ভয়ের কারণ অন্য।

একিন নামক গ্রামে বাস করত জর্জ নুজেন্ট। সে ব্যবসায়ী, ওই অঞ্চলের গ্রামবাসীদের সঙ্গে তার ব্যাবসাবাণিজ্য চলত। ফল থেকে তৈরি নানা ধরনের খাদ্য, গজদন্ত ও উদ্ভিদজাত দ্রব্য নিয়ে আসত বিভিন্ন গ্রামের মানুষ একিন গ্রামের শ্বেতাঙ্গ অধিবাসী জর্জের কাছে এবং ওইসব জিনিসের ব্যাবসা করে জর্জের লাভের অঙ্ক কেঁপে উঠছিল ভালেভাবেই।

কিন্তু ঢাকের আওয়াজ যখন জানিয়ে দিল একিন গ্রামে প্রেতাত্মার আবির্ভাব ঘটেছে, তখন ভিন গাঁয়ের মানুষ আর জিনিসপত্র নিয়ে ওই গ্রামে আসতে রাজি হল না। অতএব আমদানির অভাবে জর্জের ব্যাবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

একদিন সকাল বেলা গ্রামের মধ্যে ভীষণ গোলমাল শুরু হল–আর্তনাদ, চিৎকার এবং ঢাকের ঘনঘন কর্কশ শব্দে চমকে উঠল জর্জ নুজেন্ট। কুঁড়েঘরের আস্তানা ছেড়ে বাইরে ছুটে এসে জর্জ দেখল, নদীতীরে অবস্থিত বাগানগুলি থেকে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে অনেকগুলি বুলা জাতীয় স্ত্রীলোক তাদের মধ্যে একজন নাকি দানবের কবলে পড়েছে!

রাইফেলটা টেনে নিয়ে জর্জ চলল বাগানের দিকে! তার সঙ্গী হল কয়েকজন বর্শাধারী যোদ্ধা।

নদীর তীরবর্তী গাছগুলির নীচে একটা সচল পদার্থ সকলের চোখে পড়ল। জর্জ গুলি চালাল। তৎক্ষণাৎ সেই সজীব বস্তুটি পলায়ন করল দ্রুতবেগে।

আর একটু এগিয়ে যেতেই জর্জ এবং যোদ্ধাদের দৃষ্টিপথে ধরা দিল এক ভয়াবহ দৃশ্য–রক্তধারার মধ্যে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে একটি তরুণীর মৃতদেহ।

দেখলেই বোঝা যায়, কর্দমাক্ত মাটিতে চেপে ধরে মেয়েটির শরীর ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। টুকরো টুকরো করে।

পৈশাচিক কাণ্ড!

জর্জের সঙ্গে ছিল বুড়ো হাফোর্ড, সে দেখিয়ে দিল মেয়েটির একটা হাত নেই, হত্যাকারী হাতটাকে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। মৃতদেহের চারপাশে কাদামাখা মাটির ওপর খালি জল আর জল–সেই ঘোলাটে জলের মধ্যে হত্যাকারীর পায়ের ছাপ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

জর্জ ভেবেছিল, হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী একটি কুমির। কিন্তু মেয়েরা আর্তকণ্ঠে জানিয়ে দিল, : কুমির নয়, স্বয়ং শয়তান ওই মেয়েটিকে হত্যা করেছে।

মেয়েদের ঘোষণা শুনে সমবেত জনতা জর্জের দিকে দৃষ্টিপাত করল।

জর্জ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। শ্বেতাঙ্গদের প্রতি বুলাদের অসীম শ্রদ্ধা। তারা আশা করছে। জর্জের রাইফেল এবার শয়তানকে শাস্তি দেবে। জনতা কথা কইছে না বটে কিন্তু তাদের চোখগুলো যেন নীরব ভাষায় বলছে, তুমি থাকতে শয়তান আমাদের গাঁয়ে হানা দেবে? নারীহত্যা করবে? বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও।

জর্জ স্থির করল, যেমন করেই হোক এই খুনে জন্তুটাকে মরতে হবে। মানুষ হিসাবে এটা তার কর্তব্যও বটে, তা ছাড়া এখানে লাভ-লোকসানের প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। জন্তুটাকে মারতে পারলে ভিন গাঁয়ের লোক জিনিসপত্র নিয়ে একিন গ্রামে আবার যাতায়াত শুরু করবে। আবার জমে উঠবে জর্জের ব্যাবসা।

তবে, ব্যাপারটা সহজ নয় খুব।

জর্জ বুঝেছিল, শয়তানকে শিকার করতে গিয়ে সে নিজেও হঠাৎ শয়তানের শিকারে পরিণত হতে পারে।

বড়ো বড়ো বঁড়শিতে পচা মাংসের টোপ গেঁথে নদীতে ফেলে দেওয়া হল। সেগুলো সাধারণ বঁড়শি নয়, এই বঁড়শি গলায় আটকালে বড়ো বড়ো কুমির পর্যন্ত ঘায়েল হয়ে যায়।

কিন্তু বঁড়শির টোপ বঁড়শিতেই রয়ে গেল, মাংসলোলুপ কোনো দানব সেই ফাঁদে ধরা দিতে এল না।

এইবার জর্জ অন্য উপায় অবলম্বন করল।

বাগানের শেষ সীমানায় নদীর কাছে গাছের সঙ্গে একটা ছাগল বেঁধে রাইফেল হাতে জর্জ সারারাত জেগে পাহারা দিল। অন্ধকার রাত্রি রাইফেলের নলের সঙ্গে বাঁধা ছিল বিশেষ। ধরনের বিজলি বাতি বা ফ্ল্যাশ লাইট।

কিন্তু জর্জের রাত্রি জাগরণই সার, কোনো জানোয়ারই ছাগমাংসের লোভে অকুস্থলে পদার্পণ করল না। পরের দিন জায়গাটা ভালো করে দেখা হল–নাঃ, আশেপাশে কোথাও নেই কোনো ভয়ংকরের পদচিহ্ন।

তখন নদীর জলে ভাসল ক্যানো (এক ধরনের নৌকা) এবং সেই ভাসমান নৌকার ওপর বসে রাইফেল হাতে সমস্ত নদীটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল জর্জ।

ওই সময়ে চারটি কুমির তার গুলিতে মারা পড়ল।

অনুসন্ধানপর্ব চলল পর পর দু-দিন। তৃতীয় দিবসে আবার বুলাদের গ্রামের কাছে দেখা দিল সেই বিরাট পদচিহ্নগুলি!

একজন স্থানীয় শিকারিকে নিয়ে জর্জ পায়ের ছাপগুলিকে অনুসরণ করল।

অসংখ্য লায়ানা লতার বেড়াজালের নীচে হামাগুড়ি দিতে দিতে পায়ের ছাপ লক্ষ করে এগিয়ে চলল জর্জ এবং নিগ্রো শিকারি।

অবশেষে স্যাঁৎসেঁতে ঝোপজঙ্গল ভেদ করে তারা এসে যেখানে থামল, সেখানে একটা মস্ত জলাভূমির উপর মাথা তুলেছে অনেকগুলো ম্যানগ্রোভ গাছ।

সেই গাছের সারির শেষ সীমানায় এসে দাঁড়ায় দুই শিকারি। জলাশয়ের তীরে এক জায়গায় অল্প জল জমেছিল নিগ্রো শিকারি হঠাৎ সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল।

জর্জ সচমকে লক্ষ করল, সেখানে অগভীর জলের ভিতর শুয়ে আছে প্রকাণ্ড কুমির! এত বড়ো কুমির কখনো তার চোখে পড়েনি! হলুদ, কালো আর গাঢ় সবুজ রঙের বিচিত্র সমাবেশ ছড়িয়ে আছে জলবাসী সরীসৃপটার সর্বদেহে, বিকট হাঁ-করা মুখটা ভেসে আছে জলের উপর, দুই চক্ষু অর্ধনিমীলিত, কিন্তু ক্রুর দৃষ্টিতে ভয়ংকর।

এটা নিশ্চয় নরখাদক–জর্জ রাইফেল তুলে নিশানা স্থির করল। সেই মুহূর্তে নিগ্রো শিকারি অস্ফুট স্বরে কিছু বলে উঠল, আর চমকে রাইফেল নামিয়ে নিল জর্জ।

জলার বুকে তখন এক ভয়াবহ নাটকের সূচনা দেখা দিয়েছে!

জলার উপর দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে একটা জলহস্তী কুমিরের দিকে। অগভীর জলাশয়ের তলদেশে মাটির উপর পা ফেলে এত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সেই বিশালকায় পশু যে, জলের উপর সামান্য দুই-একটা ঢেউ ছাড়া অন্য কোনো আলোড়নের চিহ্ন বা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

তার মস্ত বড়ড়া শরীর জলের তলায় অদৃশ্য, জলার বুকে ভেসে উঠেছে শুধু নাসিকার অগ্রভাগ, দুই কর্ণ এবং একজোড়া শূকর-চক্ষু।

ধীরে, অতি ধীরে উঠে দাঁড়াল জলহস্তী জলাশয়ের তীরে–তার বেগুনি রঙের চামড়া থেকে ঝরে পড়ছে জলের ধারা।

অতি সাবধানে, মন্থর গতিতে এগিয়ে গেল জলহস্তী কুমিরটার দিকে।

সে যখন কুমিরের থেকে প্রায় পাঁচ গজ দূরে এসে পড়েছে, তখন সরীসৃপের উন্মুক্ত মুখগহ্বর বন্ধ হয়ে গেল সশব্দে।

কুমির এবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

বিকট হাঁ করে তেড়ে এল জলহস্তী, দীর্ঘ একটি স্ব-দন্তের আঘাতে সে কুমিরকে চিত করে ফেলে দিল। কুমির সামলে ওঠার আগেই আবার সগর্জনে তেড়ে এল জলহস্তী, বর্শাফলকের মতো সুদীর্ঘ দন্ত দিয়ে খোঁচা মারতে লাগল কুমিরের দেহে এবং সামনের দুই পায়ের সাহায্যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে চেপে ধরার চেষ্টা করতে লাগল বার বার।

হঠাৎ ভয়ংকর দুই চোয়ালের ফাঁকে ধরা পড়ল জলহস্তীর সামনের একটি পা।

পরক্ষণেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল জলহস্তী, কুমিরের পেটের ওপর সামনের আর একটি পা চাপিয়ে সে এমন চাপ দিল যে সরীসৃপের শক্ত চোয়ালের বজ্ৰদংশন হয়ে গেল শিথিল।

শত্রুর উন্মুক্ত মুখত্বরের ভিতর থেকে ঝটকা মেরে নিজের পা ছাড়িয়ে নিল জলহস্তী, তারপর এক কামড়ে ছিঁড়ে ফেলল কুমিরের পিছনের একটি ঠ্যাং!

কুমিরের প্রকাণ্ড শরীর পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরতে লাগল, কাটা বসানো লোহার চাবুকের লাঙ্গুল বারংবার আছড়ে পড়ল শত্রুর উদ্দেশে। .

কিন্তু জলহস্তী কাবু হল না।

বিদ্যুদবেগে কুমিরের চারপাশে একবার ঘুরে সে আক্রমণ করল। মুহূর্তের মধ্যে কুমিরের দেহটাকে কামড়ে ধরে সে শূন্যে তুলে ফেলল।

দুই দ্বিপদ দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিল সেই ভয়ানক দ্বৈরথ যুদ্ধ।

একটা মস্ত বড়ো কুকুরের মুখে ইঁদুর যেমনভাবে ঝুলতে থাকে, ঠিক তেমনিভাবেই কুমিরটা ঝুলছিল জলহস্তীর মুখ থেকে।

জলহস্তীর দুই চোয়াল নির্মম দংশনে চেপে বসল শত্রুর দেহে। ছটফট করে উঠল কুমির। তার সমস্ত শরীর একবার ধনুকের মতো বেঁকে সিধে হয়ে গেল, ভয়ংকর মুখটা ফাঁক হয়ে আত্মপ্রকাশ করল বীভৎস দন্তের সারি।

জর্জ আর স্থানীয় শিকারি শুনতে পেল, কুমিরের গলা থেকে বেরিয়ে আসছে হিস হিস শব্দ!

কুমিরটাকে মুখে নিয়ে জলহস্তী জলার মধ্যে নেমে গেল।

দারুণ আতঙ্কে জর্জের শরীর হয়ে পড়েছিল অবশ, তার ঘামে ভেজা আঙুলগুলো শক্ত মুঠিতে আঁকড়ে ধরেছিল রাইফেল কিন্তু ট্রিগার টিপে গুলি চালানোর ক্ষমতা তার ছিল না।

খাচ্ছে! ও খাচ্ছে! ফিসফিস করে বলল নিগ্রো শিকারি।

একটু দূরেই একটা ঘন ঘাসঝোপের ভিতর থেকে ভেসে এল কড়মড় কড়মড় শব্দ যেন একটা প্রকাণ্ড জাঁতাকলের মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে এক অতিকায় দানবের অস্থিপঞ্জর!

হিপো চিবিয়ে খাচ্ছে কুমিরের শরীরটাকে!

অতি সাবধানে নিঃশব্দে পিছিয়ে এল জর্জ। ওই ঝোপের মধ্যে পদার্পণ করার সাহস তার হল না–উদ্ভিদভোজী জলহস্তী যখন মাংসলোলুপ হয়ে ওঠে, তখন তার আহারে বাধা না-দিয়ে সরে পড়াই ভালো।

গ্রামবাসীরা নিগ্রো শিকারির মুখে সব ঘটনা শুনল, তারা কোনো মতামত প্রকাশ করল না। কিন্তু নিজের ভীরুতার জন্য নিজেকেই ধিক্কার দিল। সে বুঝেছিল, জন্তুটাকে মারতে না-পারলে গাঁয়ের মানুষ তার ওপর আর শ্রদ্ধা রাখবে না। স্থানীয় অধিবাসীদের শ্রদ্ধা হারিয়ে বুলাদের গ্রামে বসে ব্যাবসা চালানো অসম্ভব।

ব্যাবসার কথা ছেড়ে দিলেও জর্জের আত্মসম্মানে ভীষণ আঘাত লেগেছিল। নিজের ভীরুতাকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিল না।

জর্জের কাছে যে রাইফেলটা ছিল, সেটা বিশেষ শক্তিশালী নয়। ও-রকম হালকা রাইফেল নিয়ে মাংসলোলুপ দানবটার সম্মুখীন হওয়া দস্তুরমতো বিপজ্জনক। তবু জর্জ স্থির করল, ওই অস্ত্র নিয়েই সে জলহস্তীর মুখোমুখি দাঁড়াবে–হয় সে জন্তুটাকে মারবে, আর না হয়তো নিজেই মরবে, জীবন বিপন্ন হলেও আর পালিয়ে আসবে না। হয় মারো, নয় মরো, এই হল তার সংকল্প।

কুমির এবং জলহস্তীর লড়াইয়ের পর পর দু-দিন কেটে গেছে। জর্জ বুঝল, এতক্ষণে জলহস্তীটা নিশ্চয় ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে। অতএব এখন সে আবার শিকারের সন্ধান করবে।

জর্জ চিন্তা করতে লাগল কেমন করে জন্তুটাকে মারা যায়। জর্জের রাইফেল খুব শক্তিশালী নয়। তাই জন্তুটাকে মারতে হলে তার দেহের সবচেয়ে দুর্বল স্থানে আঘাত হানতে হবে।

জলহস্তীর কর্ণমূলে অব্যর্থ সন্ধানে গুলি বসাতে পারলে তার মৃত্যু নিশ্চিত, শরীরের অন্যান্য স্থানে হালকা রাইফেলের গুলি চালিয়ে তাকে কাবু করা সম্ভব নয়।

ঝোপজঙ্গলের মধ্যে জন্তুটাকে গুলি করলে ফলাফল হবে অনিশ্চিত। কানের গোড়ায় গুলি করতে হলে জলহস্তীকে নদী কিংবা জলাভূমির বুকে ফাঁকা জায়গায় পাওয়া দরকার।

বুলাদের সর্দার এবং স্থানীয় শিকারি (যে লোকটি পূর্ববর্তী অভিযানে জর্জের সঙ্গী ছিল) এবারের অভিযানে জর্জের সঙ্গী হতে রাজি হল।

একটা হালকা ক্যানো নৌকা ভাসিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল শিকার অভিযানে। এই ধরনের নৌকাগুলিকে ইচ্ছা করলে খুব দ্রুত চালানো যায়।

জোয়ারের বিপরীত মুখে অনেকক্ষণ নৌকা চালিয়ে নদীর ধারে কাদার মধ্যে তারা একটা কুমির দেখতে পেল।

জর্জ কুমিরটাকে গুলি করে মারল, তারপর মৃত সরীসৃপের দেহটাকে সবাই মিলে পূর্ববর্তী জলাভূমির তীরে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেলল।

টোপ প্রস্তুত। এবার শুধু অপেক্ষা করার পালা।

নদীর স্রোত যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে গিয়ে নদীর মাঝখানে খুঁটি বসিয়ে নৌকার নোঙর করা হল। তারপর শিকারিরা অপেক্ষা করতে লাগল।

সর্দারের মাথা ঝুঁকে পড়ল নিদ্রার আবেশে, কিন্তু নিগ্রো শিকারির দুই চোখের তীব্র দৃষ্টিতে তন্দ্রার আভাস ছিল না কিছুমাত্র কাঠের মূর্তির মতো স্থির হয়ে সে বসে রইল নৌকার পশ্চাদ্ভাগে।

জর্জ তার সঙ্গে কথা কইল না। রাইফেল বাগিয়ে ধরে সে অপেক্ষা করতে লাগল নীরবে।

আফ্রিকার প্রখর সূর্য জ্বলতে লাগল মধ্যাহ্নের আকাশে, সঙ্গেসঙ্গে শুরু হল মশার উপদ্রব। কুমিরের মৃতদেহটা ফুলে উঠল, বাতাসে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল বিশ্রী দুর্গন্ধ। কয়েকটা মাংসলোলুপ টিক পাখি উড়ে বসল মরা কুমিরের উপরে–এমন চমৎকার গন্ধের কারণ অনুসন্ধান করতে বাতাসে ডানা মেলে উড়ে এল একটা মস্ত বড়ো মাছ শিকারি চিল।

শব্দহীন মৃত্যুপুরীর মতো নিস্তব্ধ নদীবক্ষে অগ্নিবৃষ্টি করতে লাগল আফ্রিকার মধ্যাহ্ন সূর্য, তরল পিতলের গলিত স্রোতের মতো জ্বলে জ্বলে উঠল রৌদ্রস্নাত জলধারা আর অসহ্য তৃষ্ণায় শুষ্ক হয়ে গেল জর্জের কণ্ঠ, পিপাসায় তার প্রাণ করতে লাগল ছটফট ছটফট…

অপরাহ্ন। দূর গ্রাম থেকে ভেসে এল মানুষের কণ্ঠস্বর। জলাভূমির বুকে উঠল আলোড়নের শব্দ, সঙ্গেসঙ্গে জাগল এক গর্জনধ্বনি। আবার সব শান্ত, নীরব।

আচম্বিতে জর্জের দেহে জেগে উঠল এক অস্বস্তিকর অনুভূতি।

ঘুমন্ত সর্দার হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসল, তার চোখে নেই তার আবেশ।

নৌকায় উপবিষ্ট নিগ্রো শিকারির দীর্ঘ দেহ টান হয়ে গেল ধনুকের ছিলার মতো।

তারা কেউ কথা কইল না, তীব্র অনুভূতি তাদের হঠাৎ জানিয়ে দিয়েছে কিছু একটা ঘটছে।

শিকারির দুই চক্ষুর স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ হল নদীর তীরে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করল জর্জের চক্ষু, সঙ্গেসঙ্গে তার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল বিদ্যুত্তরঙ্গ!

নদীর ধারে তাদের নৌকা থেকে প্রায় দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ভয়াবহ মাংসভুক জলহস্তী!

জর্জ রাইফেল তুলল।

জলহস্তী বিকট হাঁ করে গর্জে উঠল, বজ্রপাতের মতো সেই গভীর গর্জনধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে।

পরক্ষণেই অগ্নি-উদগার করল রাইফেল।

নদীর ঢালু পাড় বেয়ে ধেয়ে এল জলহস্তী। তার প্রকাণ্ড দেহ সশব্দে এসে পড়ল নদীর জলে।

আবার গুলি ছুড়ল জর্জ।

এক ঝটকায় নৌকার নোঙর খুলে ফেলল নিগ্রো শিকারি, আর তৎক্ষণাৎ সজোরে দাঁড় চালিয়ে দিল বুলাদের সর্দার। বন্ধনহীন নৌকা স্যাৎ করে পাক খেয়ে ঘুরে গেল স্রোতের মুখে।

নদীর জলে ডুব দিয়ে ভেসে উঠল হিপো, মস্ত বড়ো হাঁ করে তেড়ে এল নৌকার দিকে–হিংস্র আক্রোশে উন্মুক্ত মুখের গহ্বর থেকে উঁকি দিল বাঁকা তলোয়ারের মতো দুই দীর্ঘ স্বদন্ত।

আবার গর্জে উঠল জর্জের রাইফেল, একটা দাঁত গুলির আঘাতে ভেঙ্গে গেল সশব্দে।

জলহস্তী আবার ডুব দিল।

হঠাৎ জর্জের হৃৎপিণ্ডটা দারুণ আতঙ্কে বুকের মধ্যে লাফিয়ে উঠল–নিগ্রো শিকারি আর সর্দার ক্যানোটাকে মুহূর্তের মধ্যে টেনে আনল সেইখানে, ঠিক যেখানে ডুব দিয়েছে জলহস্তী।

কিন্তু তারা ভুল করেনি, শিকারের অভিজ্ঞতা জর্জের চাইতে তাদের বেশি ক্যানোটা যেখান থেকে সরে এসেছিল, ঠিক সেই জায়গায় রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ভেসে উঠল জলহস্তী।

এক মুহূর্ত দেরি হলে দানবটার করাল মুখগহ্বরের মধ্যে ধরা পড়ত নৌকা; তারপর কী ঘটত কল্পনা করতেই জর্জের বুক কেঁপে উঠল।

জর্জ আবার গুলি চালাল। মনে হল লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে। চটপট দাঁড় চালিয়ে ক্ষিপ্ত জলহস্তীর নাগালের বাইরে ক্যানোটাকে নিয়ে গেল সর্দার এবং নিগ্রো শিকারি কোনোমতে নিশানা স্থির করে আর একবার রাইফেলের ঘোড়া টিপল জর্জ।

গুলি লেগেছে কি না বোঝা গেল না, জন্তুটা আত্মগোপন করল জলের তলায়। জর্জ দেখল তার রাইফেলে অবশিষ্ট আছে আর একটিমাত্র টোটা। সে চিৎকার করে সঙ্গীদের সাবধান করে দিল।

কিন্তু নিগ্রোদের আদিম রক্তে তখন জেগে উঠেছে হত্যার নেশা–তারা সজোরে দাঁড় চালিয়ে নৌকা ছুটিয়ে দিল এবং মুহূর্ত পরেই নৌকাটা তীরের কাছে মাটিতে আটকে গেল।

ঠিক সেই সময়ে যদি জলহস্তী আবার আক্রমণ করত, তবে ক্যানোর আরোহীদের আর পলায়ন করার পথ ছিল না, দীর্ঘ দন্তের হিংস্র নিষ্পেষণে শিকারিদের দেহ হয়ে যেত ছিন্নভিন্ন।

একটু পরেই কর্দমাক্ত জলে রক্তর আলপনা ছড়িয়ে ভেসে উঠল জলহস্তী। মাঝ নদীতে ছিল জন্তুটা, আর নৌকাসুদ্ধ আরোহীরা তখন আটকে গেছে তীরবর্তী কর্দমাক্ত ভূমিতে–ভয়াবহ অবস্থা।

রাইফেলে একটিমাত্র গুলি ভরা থাকলেও জর্জের বুক-পকেটে কয়েকটা টোটা তখনও অবশিষ্ট ছিল। পকেট হাতড়ে টোটা খোঁজার সময় কিংবা ধৈর্য ছিল না–একটানে পকেট ছিঁড়ে জর্জ তিনটি টোটা হাতে নিল, তারপর রাইফেলে গুলি ভরে ফেলল কম্পিত হস্তে।

কিন্তু ততক্ষণে হিপো আবার অদৃশ্য হয়েছে জলের তলায়, কাজেই জর্জ গুলি চালাতে পারল না।

নৌকাটা তখন টলমল করে দুলছে।

অনেকটা জল ঢুকেছে ভিতরে, ক্যানোর তলদেশ অর্ধাংশ পরিপূর্ণ হয়ে গেছে নদীর জলে। মধ্যাহ্নের নির্জন নদীবক্ষ এখন আর নিস্তব্ধ নয়, রাইফেলের শব্দে আকৃষ্ট হয়ে অনেকগুলো ক্যানো নৌকা ছুটে এসেছে ঘটনাস্থলে ক্যানোর আরোহী স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস, সাদা মানুষের জাদুবিদ্যা নিশ্চয় নদীর দানবকে কাবু করে ফেলেছে।

হঠাৎ চিৎকার করে উঠল নিগ্রো শিকারি, জলহস্তী জল থেকে উঠেছে। একটু দূরে জলাভূমির তীরে যে মরা কুমিরটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা আছে, জন্তুটা সেইদিকেই এগিয়ে চলেছে।

খুব সাবধানে লক্ষ্য স্থির করে গুলি ছুড়ল জর্জ।

জলহস্তীর মাথার ওপর ফুটে উঠল রক্তধারার চিহ্ন, কিন্তু সে গুলির আঘাত গ্রাহ্য করল না। মাথায় একটা ঝকানি দিয়ে সে ধেয়ে গেল কুমিরের মৃতদেহটার দিকে তপ্ত বুলেটের দংশন তার কাছে মশক দংশনের চাইতে গুরুতর নয়!

জন্তুটার কর্ণ ও গণ্ডদেশের মাঝখানে নিশানা করে জর্জ রাইফেলের ঘোড়া টিপল।

এইবার বোধ হয় দানবের মর্মস্থানে রাইফেলের গুলি কামড় বসাল–পিছন ফিরে সশব্দে সে নেমে পড়ল নদীর জলে, পরক্ষণেই কর্দমাক্ত জলধারার মধ্যে লাল রক্তের ফোয়ারা ছড়িয়ে সে জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

সারারাত ধরে অনেকগুলো ক্যানো ভাসিয়ে নদীর জলে পাহারা দিল নিগ্রোরা। পরের দিন সকাল জলহস্তীর মৃতদেহ ভেসে উঠল নদীর জলে। জন্তুটাকে নৌকার সঙ্গে বেঁধে বুলারা দাঁড় চালাতে শুরু করল, কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকগুলো বলিষ্ঠ বাহুর আকর্ষণে মৃত দানবের দেহটা এসে পড়ল বুলাদের গ্রামের কাছে।

জর্জ দেখল, মৃত জলহস্তীর দেহে রয়েছে সাত-সাতটা বুলেটের ক্ষতচিহ্ন, তার মধ্যে তিনটি বুলেট জন্তুটার মস্তিষ্ক ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেছে।

এই মারাত্মক আঘাতগুলো অগ্রাহ্য করে জন্তুটা নদীর জলে আত্মগোপন করেছিল এবং তার মৃত্যু হয়েছে অনেক দেরিতে কী কঠিন জীবনীশক্তি!

জলহস্তীর পেট চিরে দেখা গেল তার মধ্যে রয়েছে চার-চারটি পিতলের ব্রেসলেট জাতীয় অলংকার ও একটি গ্রীবাবন্ধনী।

ওইসব অলংকার ব্যবহার করে বুলাদের মেয়েরা অর্থাৎ একাধিক হতভাগিনীর দেহ উদরস্থ করেছে জলবাসী দানব।

[কার্তিক ১৩৭৬]

দুঃস্বপ্নের রাত

আমি চললুম। জাঙ্গাতে থাকব এবং তোমার জন্য ওইখানেই অপেক্ষা করব। কোনো কারণেই এখানে অপেক্ষা করবে না–সোজা চলে এসো জাঙ্গাতে। সব লেখা চলে না। দেখা হলে সব কিছু খুলে বলব।

প্রায় দিন দুই আগেকার তারিখ-বসানো চিঠির উপরে বা নীচে কোনো সম্বোধন বা স্বাক্ষর নেই, মাটির দেয়ালের গায়ে পিন দিয়ে আটকানো অবস্থায় ঝুলছে!

স্বাক্ষর বা সম্বোধন না-থাকলেও হাম্বার সাহেব বুঝলেন, চিঠিটা লিখেছেন তার বন্ধু মলিনাক্স। পূর্বব্যবস্থা অনুযায়ী মাটির তৈরি এই রেস্ট হাউস বা বিশ্রাম-আগারটিতেই মলিনাক্স বাস করছিলেন এবং এখানেই তাঁর থাকার কথা।

হঠাৎ তিনি মত পরিবর্তন করলেন কেন? গ্রামের ভিতর শ্বেতাঙ্গদের উপযোগী কোনো বাসস্থান যখন নেই, তখন এমন চমৎকার বিশ্রামাগারের আরাম ছেড়ে মলিনাক্স হঠাৎ কেন জাঙ্গা গ্রামে চলে গেলেন?

চিঠিতে এই মত পরিবর্তনের কার্যকারণ কিছুই উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেননি মলিনাক্স। হাম্বারের মস্তিষ্ক তাই উত্তপ্ত হয়ে উঠল।

তবে যতই রাগ হোক, বন্ধুর সঙ্গে দেখা তো করতেই হবে। বিশ্রামাগারে একটুও বিশ্রাম না-করে হাম্বার সাহেব সেই জাঙ্গা নিগ্রো-পল্লির দিকে সবেগে পদচালনা করলেন।

সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বেরই নয়, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যের প্রশ্নও জড়িত ছিল। হাম্বার এবং মলিনাক্স নাইজিরিয়ার এই অঞ্চলে এসেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানের বেতনভোগী কর্মচারী হয়ে, অতএব রাগ হলেও দেখা না-করে উপায় ছিল না।

জাঙ্গা গ্রামে গিয়ে বন্ধুর দেখা পেলেন হাম্বার। একটা কুঁড়েঘরের ভিতর বসে মলিনাক্স বিশ্রাম করছেন। হাম্বার দেখলেন বন্ধুর চোখে-মুখে স্পষ্ট অবসাদের চিহ্ন। চিঠিতে স্থানত্যাগের কার্যকারণ না-লিখে হঠাৎ চলে আসার জন্য হাম্বার একটু বিরক্তি প্রকাশ করতেই মলিনাক্স বাধা দিয়ে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু বিশ্বাস করো, ওখানে আর একটি রাতও কাটানো সম্ভব ছিল না। সারারাত ধরে সেদিন যে কী ভীষণ উদবেগ আর দুশ্চিন্তায়

অসহিষ্ণু কণ্ঠে হাম্বার বললেন, তোমার মানসিক অবস্থার বিশ্লেষণ শুনতে চাই না। আসল কথাটা বলো। কী হয়েছিল?

-বলছি।

.

মলিনাক্সের সে-কাহিনি শোনার আগে পূর্ববর্তী ঘটনা একটু জানা দরকার। হাম্বার ও মলিনাক্স নামক এই দুজন শ্বেতাঙ্গ একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাইনিং ডিপার্টমেন্ট বা খনিজ বিভাগে কাজ করেন। খনিজ বিভাগের দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কর্মচারীরা কাজ করেন জোড়ায় জোড়ায় হাম্বার আর মলিনাক্স ছিলেন ওইরকম এক মানিকজোড়। আফ্রিকার অন্তর্গত নাইজিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে দুই বন্ধু নানারকম খনিজ দ্রব্যের অনুসন্ধান করেন। কখনো সাফল্যের আনন্দ, কখনো-বা ব্যর্থতার আক্ষেপ নিয়ে সুখে-দুঃখে তাদের দিনগুলো ভালোই কাটছিল।

নাইজিরিয়ার জারিয়া প্রদেশ পরিদর্শন করে হাম্বারের ধারণা হল, এখানে বোধ হয় অভ্রের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং তার আরও কয়েক দিন সেখানে থাকা দরকার। মলিনাক্স রওনা হলেন জাঙ্গা নামক হওসা জাতীয় নিগ্রো-পল্লির দিকে। জাঙ্গার নিগ্রো-পল্লির বাইরে একটা সুন্দর রেস্টহাউস বা বিশ্রাম-আগার আছে। দুই বন্ধুর মধ্যে ব্যবস্থা হল যে, ওখানেই আশ্রয় গ্রহণ করবেন মলিনাক্স এবং জারিয়া থেকে হাম্বারের প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত ওইখানেই অপেক্ষা করবেন।

হাম্বারের অনুমান নির্ভুল, অভ্রের সন্ধান পাওয়া গেল জারিয়াতে। তবে জমির অবস্থা দেখে তিনি বুঝলেন, ডিনামাইট, ড্রিল প্রভৃতি সাজসরঞ্জাম না হলে কাজ করা সম্ভব হবে না। প্রতিষ্ঠানের প্রধান দপ্তর তখন জাঙ্গাতে। অতএব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি সংগ্রহের জন্য হাম্বার জাঙ্গাতে ফিরে এলেন।

নির্দিষ্ট স্থানে বন্ধুর দেখা পেলেন তিনি। বিশ্রাম-আগারটিও দেখলেন। তাঁর বেশ ভালাই লাগল। মাটির তৈরি বৃত্তাকার ঘরটি বিশ ফিট জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে। জানালা-দরজা নেই, দরজার পরিবর্তে মাটির দেয়ালে দুটো মস্ত ফাঁক হাঁ করে আছে এবং ফাঁক দুটো কাটা হয়েছে। পরস্পরের বিপরীত দিকে। বাঁশের তৈরি একজোড়া মাদুর ঝুলিয়ে ফাঁক দুটিকে ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। রৌদ্রদগ্ধ নাইজিরিয়ার তপ্ত বায়ু বিশ্রাম-আবাসের মধ্যস্থলকে উত্তপ্ত করতে পারে । ঘাসপাতা আর বাঁশের আচ্ছাদনের নীচে মাটির ঘরের শীতল অভ্যর্থনা সত্যি লোভনীয়।

সব দেখেশুনে হাম্বারের ধারণা হল, মলিনাক্স সহজে এখান থেকে নড়বেন না। মলিনাক্সও জানিয়ে দিলেন, বন্ধুর অনুমান সত্য।

খুব কাছাকাছি কয়েকটা শুষ্ক নদীর বুকে কিছু মূল্যবান খনিজ দ্রব্যের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে মলিনাক্স আশা করছেন এবং ওই জায়গাগুলির উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখতে হলে এই রেস্ট-হাউসের মতো আরামদায়ক আস্তানা আর কোথায় পাওয়া যাবে?

তা ছাড়া আর একটা কারণও আছে, মলিনাক্স বললেন, কাছেই একটা সিংহ আছে। আমি দেখেছি। ওটাকে মারব।

সিংহ?হাম্বার হেসে উঠলেন, এ-অঞ্চলে সিংহ নেই। যে-জন্তুটাকে তুমি সিংহ মনে করছ, আসলে সেটা হয়তো লেপার্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।

আরে, না, না, মলিনাক্স জোর দিয়ে বললেন, আমি সিংহই দেখেছি। স্থানীয় বাসিন্দারা সবাই ওটার কথা জানে। জন্তুটা বড়োই উপদ্রব চালাচ্ছে–গাঁয়ের ভিতর থেকে কুকুর আর ছাগল নিয়ে যাচ্ছে, একটি লোককে সেদিন এমনভাবে জখম করেছে যে, সে বেচারা বাঁচে কি না সন্দেহ। জানোয়ারটাকে কোনোভাবেই মারা যাচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, ওটা কোনো জাদুর আওতায় আছে। জন্তুটাকে যদি পারি তো আমিই মারব। যেদিন ওটাকে দেখেছিলুম, সেদিন আমার কাছে বন্দুক ছিল না।

হাম্বারের আগ্রহ দেখে সেদিনের ওই সিংহ-দর্শনের ঘটনাটি খুলে বললেন মলিনাক্স।

জাঙ্গার নিগ্রো-পল্লির কাছে দুই মাইলের মধ্যে একটা নদী আছে। নদী এখন প্রায় শুকনো, সামান্য জলের ধারা দেখা যায়। একদিন সকালে নদীতীরের বালুকাময় ভূমি পর্যবেক্ষণ করে মলিনাক্সের সন্দেহ হল, বালির মধ্যে হয়তো সোনার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। বালি পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত সরঞ্জাম অর্থাৎ গোল্ডপ্যান নিয়ে তিনি বিকেল বেলার দিকে যথাস্থানে উপস্থিত হলেন। মলিনাক্সের সঙ্গী হল দুটি চাকর এবং তাঁরই পোষা কুকুর দুটো। কুকুর হিসাবে তারা কিন্তু মোটেই ফেলনা নয়। একটি হচ্ছে ভয়ংকর বুলমাস্টিফ, অপরটি বর্ণসংকর হলেও তার রক্তে ছিল বিলাতি কুকুরের আভিজাত্য।

নদীর ধারে লম্বা লম্বা ঘাস ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছেন মলিনাক্স, হঠাৎ বিপরীত দিকে নদীর পাড়ের ওপর একটি সচল বস্তু তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

সিংহ!

হ্যাঁ, সিংহই বটে!

প্রায় চল্লিশ ফিট দূরে গুঁড়ি মেরে বসে আছে একটা মস্ত সিংহ! তার জ্বলন্ত চক্ষুর হিংস্র দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে মলিনাক্সের দিকে এবং সুদীর্ঘ লাঙ্গুলটি পাক খেয়ে দুলে দুলে উঠছে দারুণ আক্রোশে।

পরক্ষণে সিংহের রক্তিম মুখগহ্বরের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করল তীক্ষ্ণ দন্তের সারি! মলিনাক্সের সর্বাঙ্গে ঘামে নেয়ে উঠল।

তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু নড়লেই সিংহ আক্রমণ করতে পারে। তার বন্দুকটাও হাতে নেই, অনেক পিছনে একটা চাকর সেটা বহন করে আনছে এবং কুকুর দুটিও রয়েছে প্রায় এক-শো গজ দূরে।

এই জীবন-মরণ সংকটে মলিনাক্স কী করবেন, স্থির করতে পারছেন না, এমন সময় আশ্চর্য ব্যাপার! সিংহটা হঠাৎ এক লাফ মেরে নদীর নিকটস্থ ঘন ঘাসঝোপের জঙ্গলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। অত্যন্ত অবাক হলেন মলিনাক্স।

আমি ভাবতেই পারিনি যে, ওখানে একটা সিংহ থাকতে পারে আর সে এমনিভাবে পালিয়ে যাবে, বন্ধুকে উদ্দেশ করে বললেন মলিনাক্স, জন্তুটার গায়ের রং নদীর তীরের বালির সঙ্গে এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে, আমি সিংহের অস্তিত্ব বুঝতেই পারিনি। শুধু লেজটা নড়ছিল বলেই তার দিকে আমার দৃষ্টি পড়েছিল। জন্তুটার কেশর নেই। প্রথমে ভেবেছিলুম ওটা সিংহী। কিন্তু ভালোভাবে নজর করে দেখলুম, নাঃ, সিংহই বটে! সঙ্গেসঙ্গে মনে পড়ল, নাইজিরিয়ার এসব অঞ্চলে সিংহদের মাথায় কেশর থাকে না।

ঘটনাটা বিবৃত করে মলিনাক্স শেষে বললেন, বুঝলে বন্ধু, একটু চেষ্টা করলে সিংহটাকে বোধ হয় আমরা মারতে পারি। কি বল?

আফ্রিকার জঙ্গলে ইতিমধ্যে তাদের গুলি খেয়ে ইহলীলা সংবরণ করেছে কয়েকটা লেপার্ড, জলহস্তী, কুমির ও অ্যান্টিলোপ। তবে বনের রাজা সিংহের উপর গুলি চালানোর সুযোগ তাদের একবারও হয়নি।

পেশাদার শিকারি না হলেও শিকারের শখ দুজনেরই আছে। তাই বন্ধুর প্রস্তাবে সঙ্গেসঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন হাম্বার। কয়েকদিন পর পর রাত্রিবেলা গ্রামের নিকটবর্তী অরণ্যে একটা ছাগল বেঁধে গাছের উপর রাইফেল হাতে সিংহের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন হাম্বার ও মলিনাক্স। কিন্তু রাত্রি জাগরণই সার হল–পশুরাজ ছাগ-মাংসের লোভে শিকারির ফাঁদে পা দিল না। এমনকী ধারেকাছেও এল বলে মনে হয় না।

এ ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দারা কিন্তু মোটেই অবাক হল না। তাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস, মায়াবী সিংহ আগে থেকেই সব জানতে পারে। দুই বন্ধু কিন্তু খুবই হতাশ হলেন। হাম্বার চলে গেলেন জারিয়ায় তার কার্যস্থলে। আর মলিনাক্স বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন পূর্বোক্ত। বিশ্রাম-আগারে। কথা রইল, কাজ শেষ হলে হাম্বার ওইখানে এসে। বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হবেন।

কিন্তু দিন কয়েক পরে যথাস্থানে। এসে মলিনাক্সের চিঠি দেখে হাম্বার : তো হতভম্ব! কী ব্যাপার?

এইবার শুরু হল মলিনাক্সের বিবরণ।

সেদিনকার দুঃস্বপ্নে ভরা রাত্রির সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ঘটনা তিনি বন্ধুকে বলতে শুরু করলেন :

বৃহস্পতিবার রাত্রি। চাকররা আলোর ব্যবস্থা করে জাঙ্গা গ্রামে ফিরে গেছে। আমি রাতের আহার সারলুম বিশ্রাম-আগারের বাইরে, কারণ ঘরের মধ্যে গরমে অস্বস্তি বোধ করছিলুম। বিশ্রাম-আগারের কাছেই যেখানে রান্না হয়, সেই কুঁড়েঘরটা তুমি দেখেছ। আমার কুকুর দুটো সেই রান্নাঘরের ভিতর তাদের বরাদ্দ খাদ্যে ক্ষুধা নিবৃত্তি করছে। আমি বিশ্রাম-আগারের ভিতর একটা বই নিয়ে বসলুম। অবশ্য বইয়ে মনোনিবেশ করার আগে বাঁশের তৈরি পর্দা ফেলে ফাঁক দুটি ঢেকে দিতে ভুলিনি…

হঠাৎ ঘরের বাইরে মাটির ওপর শুষ্ক ঝরা পাতার বুকে জাগল মর্মরধ্বনি। পরক্ষণেই পর্দার তলা দিয়ে তিরবেগে ঘরে ঢুকল আমার দুটি কুকুর!

দারুণ আতঙ্কে জন্তু দুটোর উদ্ধত লাঙ্গুল আশ্রয় নিয়েছে পিছনের দুই পায়ের ফাঁকের মধ্যে। আর কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে আসছে অবরুদ্ধ আর্তনাদ!

কুকুর দুটো ঘরের ভিতর প্রবেশ করার সঙ্গেসঙ্গেই শুনতে পেলুম একটা গুরুভার জীবের ধাবমান পায়ের আঘাতে মাটির উপর থেকে সশব্দে উড়ে যাচ্ছে ঝরা পাতার রাশি।

অদৃশ্য আগন্তুক সশব্দে পর্দা-ঝোলানো ফাঁকটার পিছনে এসে থেমে গেল। পরক্ষণেই বজ্রপাতের মতো গম্ভীর গর্জনে কেঁপে উঠল ঘরটা!

কণ্ঠস্বরেই অন্ধকারে অদৃশ্য জীবটির পরিচয় পেলুম–সিংহ!

দারুণ আতঙ্কে কুকুর দুটো ছুটে এসে ঘরের মাঝখানের খুঁটির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। রাইফেলের সন্ধান করতে গিয়েই চমকে উঠলুম। মনে পড়ল, অস্ত্রটাকে খুলে তেল দিয়ে বাক্সবন্দি করা হয়েছে এবং তৈলসিক্ত অবস্থায় আমার রাইফেল বন্ধুটি এখন চামড়ার বাক্সে বিশ্রাম করছে বিশ্রাম-আগারের বাইরে!

সর্বনাশ! এখন উপায়?

আবার, আবার জাগল সেই হিংস্র শ্বাপদকণ্ঠের ভয়াবহ গর্জনধ্বনি! বদ্ধ কুটিরের ভিতর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে সেই প্রচণ্ড শব্দতরঙ্গ নিশ্চিত মৃত্যুর কণ্ঠস্বরের মতোই আমার কানে এসে বাজল। পর্দা-ঝোলানো ফাঁকটার যেদিক থেকে গর্জনটা ভেসে এল, তার বিপরীত দিকের পর্দা লক্ষ করে ছুটল কুকুর দুটো। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, আতঙ্কে অস্থির হলেও কুকুর দুটোর বুদ্ধি-ভ্রংশ ঘটেনি।

উলটো দিকের ফাঁকটার কাছাকাছি এসেই তারা থমকে দাঁড়াল। জানোয়ারের সহজাত সংস্কারের বশেই তারা বুঝেছিল, আলোকিত ঘরের বাইরে অন্ধকারের মধ্যে বিপদের সম্ভাবনা আছে।

কুকুর দুটো ভালোই করেছিল।

মুহূর্ত পরেই বিশ্রাম-আগারের বাইরে ধাবমান পদধ্বনি জানিয়ে দিল যে, পশুরাজ উলটো দিকের ফঁক লক্ষ করে ঘুরে আসছে।

আমি এবার শটগান হাতে নিলুম। এ ধরনের বন্দুক সিংহ-শিকারের উপযুক্ত নয় সন্দেহ নেই, কিন্তু রাইফেল না-থাকায় বাধ্য হয়ে শটগানটাকেই বাগিয়ে ধরলুম। মনে করলুম, সিংহ যদি ঘরের ভিতর ঢোকে, তবে এই শটগান দিয়েই তাকে গুলি করব। মারা না-পড়লেও গুলিতে সে আহত হবে নিশ্চয়ই, তারপর যা থাকে বরাতে।

মোট কথা, বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে আমি রাজি নই…

মুখের সামনে খাদ্য আছে, কিন্তু ধরার উপায় নেই! ভিতরে ঢুকতেও বোধ হয় ভরসা হচ্ছে না, কারণ ঘরে আলো জ্বলছে। তাই অস্থির হয়ে উঠল পশুরাজ।

বুঝতে পারছি, তার প্রথম লক্ষ্য চতুষ্পদ সারমেয় দুটি। তার পরে বোধ হয় দ্বিপদ জীব। হিসাবে আমার পালা।

অবশেষে কুকুর দুটোকে ধরার জন্য পশুরাজ এক চমৎকার ফন্দি আঁটল। সে একদিকের পর্দা-ঝোলানো ফাঁকের পিছনে এসে গর্জন করেই তাড়াতাড়ি উলটো দিকের ফাঁকটার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার আশা, কুকুর দুটো যদি ভয় পেয়ে উলটো দিকের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়, তাহলেই সে তাদের ধরে ফেলতে পারবে।

কুকুর দুটো কিন্তু গর্জন শুনলেই ভয় পেয়ে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে, তার বিপরীত দিকের ফঁকটা লক্ষ করে ছুটে যাচ্ছে বটে, কিন্তু পর্দার বাইরে একবারও পদার্পণ করছে না।

একটু পরেই লক্ষ করলুম, দারুণ আতঙ্কে তারা ক্রমেই দিশাহারা হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণের মদ্যেই তাদের বুদ্ধিভ্রংশ ঘটবে এবং তখনই কুটিরের বাইরে ছুটে পালাতে গিয়ে পড়বে সিংহের কবলে।

নাঃ! আমার পোষা জন্তু দুটোকে এভাবে মরতে দিতে পারি না।

কুকুর দুটোকে টেনে এনে আমি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেললুম। তারপর হাতের বন্দুক বাগিয়ে ধরে ফাঁক দুটোকে লক্ষ করতে লাগলুম নিবিষ্ট চিত্তে…

রাতের আকাশে অন্ধকার মেঘের আবরণ সরিয়ে উঁকি দিল রুপোলি চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলোতে বাঁশের তৈরি পর্দার বুনোনির ফাঁক দিয়ে সিংহের অস্পষ্ট মূর্তি আমার দৃষ্টিগোচর হল–প্রকাণ্ড জানোয়ার!

–একবার মনে হল দিই গুলি চালিয়ে, পরক্ষণে ফিরে এল শুভবুদ্ধি। জন্তুটা এখন প্রায় পনেরো গজ দূরে আছে, এখান থেকে শটগানের গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করা যাবে না। কিন্তু আহত হলে সিংহ নিশ্চয়ই খেপে গিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে আক্রমণ করবে।

তখন অবস্থাটা কী দাঁড়াবে?

নাঃ, গুলি ছোঁড়া হবে আত্মহত্যারই নামান্তর। নিজেকে আমি সংবরণ করলুম…

গভীর অন্ধকার রাত্রি। ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছে সিংহ। মাঝে মাঝে গম্ভীর গর্জনে বিরক্তি প্রকাশ করছে। আর একটা ঠুনকো বন্দুক হাতে ঘরের ভিতর আমি বসে আছি মৃত্যুর মুখোমুখি।

রাত্রি গড়িয়ে চলে…

হঠাৎ লক্ষ করলুম, একটা লণ্ঠন ধূম উদগিরণ করছে! আলোটাও যেন কম!

তিন-তিনটে লণ্ঠনের আলোর জন্যই সিংহভিতরে আসতে সাহস পাচ্ছেনা। কিন্তু আলোর তেজ কমে গেলে আর তাকে ঠেকানো যাবেনা। জীবন্ত কুকুর-মাংসই তাকে আকৃষ্ট করেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘরের ভিতর সে একবার প্রবেশ করলে আমারও রেহাই পাবার কোনো কারণ নেই।

এইসব কথা ভাবছি, হঠাৎ খেয়াল হল, পশুরাজের বজ্রকণ্ঠ নীরব হয়ে পড়েছে। কী ব্যাপার? ও কি চলে গেছে?…

আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে সাবধান করে দিল–না, যায়নি, কাছেই আছে মূর্তিমান মৃত্যু!

আছে–আছে–আছে…

একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল। বুঝলুম, সশব্দে ঘ্রাণ গ্রহণ করছে পশুরাজ। সচমকে দেখলুম, যেদিক থেকে শব্দ ভেসে এল, সেদিকের বাঁশের পর্দাটা যেন হাওয়ার ধাক্কায় একটু দুলছে।

পরক্ষণেই বংশ-নির্মিত যবনিকার তলদেশ দিয়ে আলোকিত কুটিরের ভিতর প্রবেশ করল ভয়ংকর ভয়ংকর মস্ত বড়ো এক থাবা!

থাবা আরও একটু এগিয়ে এল, কোষমুক্ত কিরীচের মতো মাংসল খাপ খুলে থাবার ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করল বাঁকা বাঁকা ধারালো নখের সারি!

ফাঁকের পাশে দেয়ালের গায়ে সনখর থাবাটা ঘুরে ঘুরে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে!

আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা লণ্ঠন তার কর্তব্য করতে রাজি হল না। দপ করে নিভে গেল আলোটা। শটগানের ট্রিগারে সরে এল আমার আঙুল। ইচ্ছে হল, গুলি চালিয়ে ওই থাবাটাকে উড়িয়ে দিই। অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করলুম।

কুকুর দুটো তখন ছটফট করছে আর চেঁচাচ্ছে পাগলের মতো এই বুঝি গলার বকলস ছিঁড়ে তারা বেরিয়ে যায়!

একটু পরে আবার নিভে গেল আর একটা লণ্ঠন। আবার ঘর্মাক্ত দেহ থেকে জলের স্রোত বইছে।

রাত্রির প্রহর কাটে…

থাবাটা এক সময় সরে গেল ঘরের ভিতর থেকে অন্ধকারের গর্ভে। সিংহের তীব্র হুংকার-ধ্বনি আর শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ অবরুদ্ধ কণ্ঠের চাপা গর্জনে প্রকাশ পেল ক্ষুধার্ত শ্বাপদের ক্ষোভ এবং নৈরাশ্য!

কিন্তু কেন? অবাক হয়ে মনে মনে কারণ খুঁজবার চেষ্টা করছি, হঠাৎ পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে নজর পড়ল। আর সঙ্গেসঙ্গে আমার বুকে সাহস ফিরে এল, আতঙ্কের পরিবর্তে অনুভব করলুম বাঁচার নতুন ইঙ্গিত–এযাত্রা বেঁচে গেলুম বোধ হয়… একটা মাত্র লণ্ঠন তখন আলো দিচ্ছে। কিন্তু তার অবস্থাও শোচনীয় যেকোনো মুহূর্তে কম্পিত আলোকশিখাঁটি অন্ধকারের গ্রাসে লুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু না, ঘরের মধ্যে লণ্ঠনের আলোকশিখা নিভে যাওয়ার আগেই আকাশ ও পৃথিবীর অন্ধকার ভেদ করে জ্বলে উঠল চিরন্তন সেই রক্তিম আলোর ধারা…

জয়! দিনমণির জয়! এল নতুন প্রভাত!

দূর বনপথ থেকে ভেসে এল অনেকগুলি মানুষের কণ্ঠস্বর।

পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলুম, সিংহ সচমকে ফিরে দাঁড়াল এবং নিঃশব্দে আত্মগোপন করল জঙ্গলের মধ্যে।

একটু পরেই আমার লোকজন যখন ঘরের ভিতর এল, তখন আমি কঁপছি। ঘর্মাক্ত সারা দেহ। দারুণ আতঙ্কে ও উদবেগ অবসাদে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, তাদের কোনো কথাই বলতে পারলুম না। পরে সব শুনে তারা বলল সাহেব, এযাত্রা বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছ! আর থেকো না এখানে। ওকে মারবারও চেষ্টা কোরো না। তাহলে নিজের জীবনই বিপন্ন হবে।

দিনের বেলা একটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু অসম্ভব! ওই ঘরের ভিতর ঘুমানো অসম্ভব। চোখ বুজলেই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি হিংস্র ভয়াল শ্বাপদ এখনই হানা দেবে শরীরী দুঃস্বপ্নের মতো। ভালোভাবেই জানতুম, দিনের বেলা ভয় পাওয়ার কোনোই কারণ নেই। কিন্তু মন মানতে চায় না। তুমি হয়তো বলবে, এখানকার বাসিন্দাদের কুসংস্কার আমাকেও আচ্ছন্ন করেছে। হতে পারে। সে ভয়ংকর রাতের অভিজ্ঞতা তোমার হয়নি, তাই বলতে পার ও-কথা।

যাই হোক, প্রকাশ্য দিবালোকেও যেখানে আমি আতঙ্কে ঘুমাতে পারিনি, সেখানে রাত কাটানো কি সম্ভব? অতএব তোমাকে ওই চিঠি লিখে রেখে এখানে পালিয়ে এসেছি.. তুমি আমার এখন সিংহ-শিকারে আগ্রহ প্রকাশ করলে আমি ভীষণ অসন্তুষ্ট হব…

মনে রেখ বন্ধু–আমরা খনিজ দ্রব্যের বিশেষজ্ঞ, শিকারি নই বুঝেছ?

হ্যাঁ, মলিনাক্সের কথা বুঝেছিলেন হাম্বার। জাঙ্গা ছেড়ে সেইদিনই অন্যত্র যাত্রা করেছিলেন দুই বন্ধু।

[ভাদ্র, ১৩৭৭]

দুর্যোধনের গদা

কমলের পরিচয় পেয়েছিলাম অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে। পরিচয়টা অবশ্য একতরফা; যে-রাতে আমি তার প্রতিভার পরিচয় পেয়েছিলাম, সেই রাতে আমি ছিলাম তার সম্পূর্ণ অপরিচিত, এমনকী সে আমায় তখন দেখতেও পায়নি।

ব্যাপারটা খুলেই বলছি।

যে-সময়ের কথা বলছি, তখন কলকাতার বিভিন্ন স্থানে দোল-দুর্গোৎসব প্রভৃতি উপলক্ষে প্রায়ই যাত্রাগানের আসর বসত এবং কোথাও যাত্রার আসর বসার খবর পেলেই আমি যথাস্থানে হাজির হতাম প্রবল উৎসাহের সঙ্গে। এইরকম এক যাত্রার আসরেই কমলের দেখা পেয়েছিলাম।

প্রায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসর আগেকার ঘটনা। দক্ষিণ কলকাতার এক যাত্রার আসরে গিয়ে দেখি প্রচুর দর্শকের সমাগমে আসর বেশ জমজমাট। আমার একটু দেরি হয়েছিল, গিয়ে দেখি যাত্রা শুরু হয়েছে। বহুদিন আগেকার কথা, পালার নামটা ঠিক মনে নেই, তবে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ বা দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ ধরনের কোনো ব্যাপার হবে।

আগেই বলেছি আমার যথাস্থানে পৌঁছাতে একটু দেরি হয়েছিল, গিয়ে দেখি যাত্রা শুরু হয়ে গেছে–কুরুরাজ দুর্যোধন গদা হাতে এক ভয়ংকর জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন। আশেপাশে তার। স্বপক্ষের এবং বিপক্ষের রথী-মহারথীরা সকলেই উপস্থিত, আচম্বিতে রঙ্গমঞ্চ কম্পিত করে গদাহস্তে ভীমের প্রবেশ!

উক্ত গদার আকৃতি ভীমসেনের চাইতেও বেশি দ্রষ্টব্য ছিল, তাই লক্ষ্যবস্তুর চাইতেও উপলক্ষ্য, লোকের বিশেষ করে ছেলে-ছোকরাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

ভীমসেন আসরে প্রবেশ করেই সগর্জনে এক বক্তৃতা দিলেন। দুর্যোধনের চাইতে তার বক্তৃতা আরও জোরালো হয়েছিল। ভাষাটা ভালো মনে নেই, তবে গম্ভীর গর্জিত কণ্ঠের পামর, নরাধম প্রভৃতি চোখা চোখা বিশেষণগুলি কিছু কিছু মনে পড়ছে–

তারপরই এক অভাবিত ঘটনা!

ভীমসেন গদা আস্ফালন করে এদিক-ওদিক পদচালনা করছেন, সঙ্গেসঙ্গে যাত্রার আসর কাঁপয়ে উচ্চারিত হচ্ছে ভীমকণ্ঠের বাণী।

অকস্মাৎ এক দারুণ চিৎকারে ভীমসেনকে এবং সমগ্র আসরকে চমকে দিয়ে দুর্যোধন এক প্রচণ্ড লাফ মারলেন। মানুষ যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এত উঁচু লাফ মারতে পারে তা জানতাম না! তবে যে সে মানুষ তো নয়, স্বয়ং দুর্যোধন দ্বাপর যুগে মহাভারতের মহাকায় মানুষদের চমকে দিয়েছিলেন, তারই এক প্রতিনিধি কলিযুগের কলিকাতায় মানবদেহের কয়েকটি তুচ্ছ নমুনাকে চমকে দেবেন তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?

কিন্তু লম্ফ প্রদান করে ভূতলে অবতীর্ণ হয়ে তিনি যা করলেন তাতে স্বয়ং দুর্যোধনও বোধ হয় কিঞ্চিৎ ভড়কে যেতেন। মহাভারতের দুর্যোধন অস্ত্রচালনা ও বাগযুদ্ধে বিশেষ পটু ছিলেন বটে, কিন্তু নৃত্যকলায় তার পারদর্শিতার কথা বেদব্যাস কোথাও উল্লেখ করেননি কিন্তু যাত্রার দুর্যোধন আচম্বিতে এক পা শূন্যে তুলে এমন এক অদ্ভুত নৃত্য শুরু করে দিলেন যে, পেশাদার নর্তকীও সেই দৃশ্য দেখলে কুরুরাজের ভারসাম্য রক্ষার প্রশংসা না-করে থাকতে পারত না।

এই অভূতপূর্ব এবং অভাবনীয় দৃশ্যে আমরা সকলেই ভড়কে গিয়েছিলাম, এমনকী স্বয়ং ভীমসেনও হয়ে পড়েছিলেন স্তম্ভিত!

হঠাৎ নাচ থামিয়ে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ভীমের দিকে কটাক্ষ করলেন, ইস্টুপিড! পাষণ্ড! বর্বর! নরাধম! তোকে যা বারণ করেছিলাম তাই করলি? তবে এই দেখ

সঙ্গেসঙ্গে দুর্যোধনের হাতের গদা ছুটে এল ভীমের মস্তক লক্ষ করে!

এমন অতর্কিতে আক্রান্ত হলে অনেক বীরপুরুষই ধরাশায়ী হত, কিন্তু দুর্যোধনের প্রতিপক্ষও নিতান্ত সাধারণ মানুষ নন–স্বয়ং ভীমসেন।

বিদ্যুদবেগে মাথা সরিয়ে আত্মরক্ষা করে ভীম তাঁর গদা চালালেন দুর্যোধনের দিকে এবং আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে নিজের গদা দিয়ে সেই গদাকে প্রতিহত করে দুর্যোধন করলেন প্রতি-আক্রমণ!

ঠক, ঠক, ঠকাস, ঠাই প্রভৃতি ভীষণ শব্দে মুখরিত হয়ে উঠল যাত্রার আসর। এতক্ষণ বাদে দর্শকরাও আত্মস্থ হয়ে তাঁদের নিজস্ব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, অর্থাৎ ঘন ঘন হাততালি ও প্রশংসাসূচক ধ্বনিতে দুই যোদ্ধাকেই উৎসাহ দিতে শুরু করেছেন। আসরের অন্যান্য অভিনেতারা। কিন্তু ভীম ও দুর্যোধনের দ্বন্দ্বযুদ্ধে বিশেষ উৎসাহিত হতে পারেননি, বরং তারা লড়াই থামাতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দুই মহাবীরের ঘূর্ণিত গদার ঘন ঘন আস্ফালন তুচ্ছ করে কেউ এগিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ একজন (খুব সম্ভব শ্রীকৃষ্ণ, ঠিক মনে নেই) এগিয়ে এসে দুর্যোধনকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলেন এবং তৎক্ষণাৎ কুরুরাজের গদাঘাতে ঠিকরে ধরাশয্যা অবলম্বন করলেন।

নারায়ণের সাক্ষাৎ অবতার শ্রীকৃষ্ণকে ধরাশায়ী করে দুর্যোধন উৎসাহিত হয়ে উঠলেন, পরক্ষণেই তার হাতের গদা প্রচণ্ড বেগে এসে পড়ল ভীমসেনের দক্ষিণ ঊরুদেশের উপর বাপরে, বলে ভীম বসে পড়লেন দুই হাতে উরু চেপে ধরে!

ঘন ঘন হাততালিতে যাত্রার আসর সরগরম! যদিও মূল মহাভারতে কোথাও দুর্যোধনের গদাঘাতে শ্রীকৃষ্ণের পতন বা ভীমসেনের ঊরুভঙ্গ প্রভৃতি বিপর্যয়ের কথা লেখা নেই, কিন্তু সমবেত দর্শকমণ্ডলী মহাভারতের এই নতুন পালা উপভোগ করছিল অতিশয় উৎসাহের সঙ্গে। দুর্যোধন তখনও আস্ফালন করছিলেন, হতভাগা, পাজি, ইস্টুপিড! তোকে এক-শোবার সাবধান করে দিয়েছি, তবু কথা শুনলি না? এখন বোঝ ঠেলা–কেমন লাগে?

হঠাৎ কুরুপক্ষের এক যোদ্ধা বিশ্বাসঘাতকতা করল। বিকর্ণের ভূমিকায় যে লোকটি অভিনয় করছিল সে হঠাৎ দুর্যোধনের কোমর জড়িয়ে ধরল এবং সচকিত দুর্যোধন নিজেকে মুক্ত করে নেওয়ার আগেই নিতান্ত কাপুরুষের মতো পাণ্ডবপক্ষের চার মহাবীর অর্থাৎ যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল ও সহদেব দুর্যোধনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে কাবু করে গদাটি তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল! ভীমসেন অবশ্য এই অসম যুদ্ধে যোগদান করেননি; তার কারণ অবশ্য নীতিবোধ নয়, তিনি তখনও ঊরু চেপে ধরে কাতরোক্তি করছিলেন, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তার ছিল না!

সহোদর ভ্রাতার বিশ্বাসঘাতকতা এবং বিপক্ষের যোদ্ধাদের কাপুরুষের মতো হীন ব্যবহারে ক্ষুণ্ণ হয়ে দুর্যোধন যেসব বাক্যবাণ প্রয়োগ করতে শুরু করলেন সেগুলো কুরু অথবা পাণ্ডবপক্ষের কোনো মানুষের পক্ষেই আদৌ সম্মানজনক নয়! দর্শকরা কিন্তু ততক্ষণে দুর্যোধনের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে গেছে, ঘন ঘন হাততালি দিয়ে তারা কুরুরাজের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও আনুগত্য প্রকাশ করছে বারংবার!

এইবার আসরে প্রবেশ করলেন যাত্রাদলের অধিকারী, দুর্যোধনের মুখের ওপর তর্জনী আস্ফালন করে তিনি বললেন, ওরে রাসকেল! তুই কোন আক্কেলে ভীমকে গদার বাড়ি মারলি? গদাযুদ্ধ তো এখন হওয়ার কথা নয়, গদাযুদ্ধ হবে শেষ দৃশ্যে–সব ভুলে গেলি? তা ছাড়া দুর্যোধনের গদাঘাতে ভীমের ঊরুভঙ্গ কে কবে শুনেছে রে ছুঁচো?

দুর্যোধন বললেন, ও আমার পা মাড়িয়ে দিল কেন? আমি বার বার সাবধান করে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম আমার পায়ে কড়া আছে; কড়াতে যেন না লাগে। হতভাগা ভোদা বক্তিমে করতে করতে আমার পায়ের কড়ার উপরই পা চাপিয়ে দিল!

অধিকারী বললেন, তাই বলে তুই মারবি? মহাভারতের কোন অধ্যায়ে দুর্যোধনের পায়ে কড়ার কথা আছে শুনি? তুই পায়ের কড়া গজাতে দিলি কেন? কড়া কেটে ফেললি না কেন? উল্লুক! বোম্বেটে! শয়তান!

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে অধিকারী দুর্যোধনের গণ্ডদেশে করলেন প্রচণ্ড চপেটাঘাত!

দুর্যোধন তখন চার পাণ্ডবের বাহুপাশে বন্দি, তবু নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন এবং তার যে গদাটি বিশ্বাসঘাতক বিকর্ণ সম্প্রতি হস্তগত করেছিল সেই গদাটির দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন সতৃষ্ণ নয়নে!

দর্শকরা তখন প্রবল উৎসাহে দুর্যোধনকে সমর্থন জানাচ্ছে। একটি অল্পবয়সি ছেলে তারস্বরে ঘোষণা করল যে, একটিবার গদা হাতে পেলে মহাবীর দুর্যোধন যে কুরুপাণ্ডবের সম্মিলিত বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দেবেন এ-বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

কিন্তু অধিকারী ও অভিনেতারা সপ্তরথীবেষ্টিত দুর্যোধনের লড়াই দেখতে রাজি ছিলেন না, দর্শকদের একান্ত অনুরোধ সত্ত্বেও কুরুরাজকে তাঁর গদা ফেরত দেওয়া হল না, যাত্রাও গেল ভেঙে।

পূর্বোক্ত ঘটনার বৎসর কেটে গেছে। আমি তখন কলকাতার এক চিত্র-পরিবেশক অর্থাৎ ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটার অফিসে কাজ করি। অফিসের মালিক একদিন জানালেন যে উক্ত অফিসে তিনি একটি লোককে নিয়োগ করতে চান। লোকটি তার পরিচিত এক ভদ্রলোকের সুপারিশ নিয়ে এসেছিল, তাই ইচ্ছে না-থাকলেও লোকটিকে চাকরি দিতেই হবে। তবে কাজের অনুপযুক্ত বলে প্রমাণিত হলে কয়েক মাস পরে তাকে ছাঁটাই করে দেওয়া যেতে পারে। ওই লোকটিকে আমার সঙ্গেই দেখা করার নির্দেশ দিয়েছেন মালিক, আমি যেন তাকে কাজ বুঝিয়ে দিই।

যথা আজ্ঞা। মালিক যেদিন আমাকে সব কথা জানালেন তার পরের দিনই লোকটির আসার কথা। আমার অফিসে দশটার মধ্যে হাজিরা না-দিলেও চলে, অতএব নির্দিষ্ট দিনে বেরিয়ে পড়লাম বারোটার পর।

আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন ব্রিটিশ-অধিকৃত কলকাতা শহরে এত লোক সমাগম হয়নি। দুপুর বেলা ট্রামে-বাসে বিশেষ ভিড় হত না, তাই যাত্রীদের আকর্ষণ করার জন্য ট্রাম কোম্পানি মিড ডে ফেয়ার নামক অল্প মূল্যে টিকিট দেবার একটি রীতি প্রচলিত করেছিল। দুপুর বারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত ট্রামের প্রথম শ্রেণিতে ছ-পয়সার বদলে তিন পয়সা এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে চার পয়সার বদলে দু-পয়সার টিকিট কিনে যাত্রীরা ভ্রমণের অধিকার অর্জন করতে পারত।

আগেই বলেছি আমার অফিসে হাজিরা দেওয়ার সময় সম্বন্ধে বিশেষ কড়াকড়ি ছিল না, খুব কাজ না-পড়লে অধিকাংশ সময়েই অফিস যাওয়ার সময়ে আমরা মিড ডে ফেয়ার নামক প্রচলিত রীতির সুযোগ গ্রহণ করতাম।

নির্দিষ্ট দিনে বারোটার ট্রামে উঠে আমি একটি তিন পয়সার টিকিট কিনে ফেললাম। যাত্রীর সংখ্যা ছিল খুবই কম, কাজেই কনডাক্টর যখন একটি যাত্রীর সামনে গিয়ে বার বার টিকিট চাইতে লাগল তখন নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল তার দিকে।

যাত্রীটি কিন্তু কনডাক্টরের কথায় প্রথমে কর্ণপাত করলেন না। একটি খবরের কাগজ খুলে ধরে এমনভাবে তিনি মগ্ন হয়ে গেছেন যে মনে হয় কাগজের ছাপার অক্ষরের বাইরে কোনো কিছুই তিনি দেখতে বা শুনতে চান না।

খবরের কাগজের প্রতি যাত্রীটির গভীর অনুরাগ ট্রাম-কনডাক্টরের মনে বিরক্তিকর সঞ্চার করল–

ও মশাই, টিকিট নিয়ে তারপর কাগজ পড়ুন।

ভদ্রলোক খবরের কাগজ থেকে চোখ না-তুলেই বললেন, টিকিট হয়ে গেছে।

কনডাক্টর বলল, কোথায়? দেখি?

ভদ্রলোক এইবার কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে নিজের পায়ের দিকে ইঙ্গিত করলেন, ওই যে!

সবিস্ময়ে দেখলাম ভদ্রলোকের চটিপরা পায়ের দুই আঙুলের ফাঁকে ধরা রয়েছে একটি ট্রামের টিকিট!

কনডাক্টর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জানাল, টিকিটটা হাতে নিয়ে দেখাতে হবে।

ভদ্রলোক শান্তভাবে জানালেন, ট্রাম কোম্পানির আইন অনুসারে টিকিট কিনতে এবং কনডাক্টর দেখতে চাইলে সেই টিকিট তাকে দেখাতে তিনি বাধ্য; কিন্তু উক্ত টিকিট হাতে করে দেখাতে হবে কি পায়ে করে দেখাতে হবে সে-বিষয়ে ট্রাম কোম্পানির কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ নেই!

কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর কনডাক্টর ভদ্রলোকের সামনে থেকে সরে গেল। ভদ্রলোকও সেই টিকিটটা পায়ের আঙুলে ধরে রেখেই আবার খবরের কাগজে মনোনিবেশ করলেন।

অফিসে যাওয়ার পথে একটা দোকানে আমার একটু কাজ ছিল। ওই দোকানে নেমে কাজটা সেরে নিলাম, তারপর অফিসে ঢুকলাম। বেশি দেরি হয়নি, দোকানের থেকে আমার অফিস মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। অফিসে গিয়ে নিজের আসন গ্রহণ করতেই বেয়ারা এসে জানাল এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, তিনি নাকি মিনিট পাঁচেক ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কার্ডের উপর লেখা নামটা পড়লাম কমল বিশ্বাস। মালিক যে লোকটিকে সাময়িকভাবে নিয়োগ করার কথা বলেছিলেন তার নামও কমল বিশ্বাস–অতএব বেয়ারাকে ডেকে ভদ্রলোককে নিয়ে আসতে বললাম।

যে-মানুষটি আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন তাঁকে দেখে চমকে উঠলাম! আরে! এই ভদ্রলোকই তো ট্রামের ভিতর একটু আগে এক অভিনব দৃশ্যের অবতারণা করেছিলেন! একটু তাকিয়ে থাকতেই ভদ্রলোককে বেশ পরিচিত মনে হল, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না তাকে কোথায় দেখেছি।

ভদ্রলোক কাচুমাচু মুখ করে বললেন, আমার নাম স্যার কমল বিশ্বাস। আমাকে বাবু বলেছিলেন যে–

বাধা দিয়ে বললাম, ঠিক আছে। আমার নাম মহীতোষ রায়। আমাকে স্যার বলার দরকার নেই। মালিক আপনার কথা বলে গেছেন, আসুন আপনাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছি।

ভদ্রলোককে তার টেবিলে বসিয়ে আমি হঠাৎ বলে ফেললাম, আচ্ছা কমলবাবু, আপনি পা দিয়ে টিকিট দেখাচ্ছিলেন কেন? হাতে করে দেখালেই পারতেন। কনডাক্টরও মানুষ, তাকে ওভাবে অপমান করা আপনার উচিত হয়নি।

কমলবাবু চমকে উঠলেন, ও! আপনি ওই ট্রামেই ছিলেন!

একটু থেমে মুখ নীচু করে তিনি বললেন, বিশ্বাস করুন, অপমান করার ইচ্ছে আমার ছিল না। হাতে নিয়ে টিকিট দেখাতে গেলেই তিন পয়সা গচ্চা দিতে হত, তাই

তার মানে?

আজ্ঞে গড়িয়াহাটা থেকে উঠেছিলাম। হঠাৎ এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে রাসবিহারীর মোড়ে নামতে হল। সেই ট্রামের টিকিটটা সঙ্গে ছিল। অন্য একটা ট্রামে উঠে ওই টিকিটটা পায়ের আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরে কাগজ পড়তে শুরু করলাম। জানতাম, কনডাক্টর পায়ে হাত দিয়ে টিকিট দেখবে না, তাই

অবাক হয়ে গেলাম! লোকটা তো দারুণ ধূর্ত! আর ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎচমকের মতো আর একটি দৃশ্য ভেসে উঠল আমার মানসপটে এতক্ষণে মনে পড়েছে ভদ্রলোককে কোথায় দেখেছি!

হেসে বললাম, চাকরি করতে এলেন কেন? যাত্রাদলে অভিনয় করতে ভালো লাগল না?

কমলবাবু সবিস্ময়ে বললেন, আপনি আমার অভিনয় দেখেছেন বুঝি?

মাথা নেড়ে জানালাম, হ্যাঁ।

তারপর সেই ভীম ও দুর্যোধনের দ্বৈরথঘটিত যাত্রাগানের উল্লেখ করতেও ভুললাম না। হেঁ, হেঁ, হেঁ, কমলবাবু লজ্জিত হলেন, পায়ে একটা কড়া ছিল স্যার। ওটাতে লাগলেই আমার মাথা খারাপ হয়ে যেত। ভোদা–মানে, যে ভীম সেজেছিল–তাকে বার বার সাবধান করে দিয়েছিলাম, তবু হতভাগা ওই কড়ার ওপর এমনভাবে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিল যে রাগে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম…

একটু থেমে, একটু চুপ করে থেকে কমলবাবু বললেন, তারপর থেকেই আমি যাত্রার দল ছেড়ে দিয়েছি।

প্রায় একটা বছর কেটে গেল। কমল বিশ্বাস কাজকর্ম ভালোই করে, ফকিও দেয় না। আমাদের মধ্যে তখন অপরিচিতের ব্যবধান ঘুচে গেছে, কমলের সাহচর্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে দস্তুরমতো লোভনীয়।

একদিন কমল হঠাৎ বলল, ওহে মহীতোষ, চলো দিনকয়েক বাইরে থেকে ঘুরে আসি।

-কোথায়?

–মধুপুর। আমার এক বন্ধুর পরিচিত এক ভদ্রলোকের বাড়ি আছে ওখানে। বন্ধুটির নাম সুশীল, সে দিনকয়েকের জন্য হাওয়াবদল করে আসতে চায়। চলো, আমরাও ওইসঙ্গে ঘুরে আসি। বাড়িভাড়া তো লাগবে না, আর তুমি বললে মালিক ছুটি দিতে রাজি হবেন! কাজকর্ম বিশেষ নেই এখন, আর তোমার অনুরোধ মালিক ফেলতেও পারবেন না।

সত্যি কথা। আমার কাজকর্মে অফিসের মালিক আমার উপর খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন। আমি ছিলাম তাঁর বিশেষ স্নেহের পাত্র।

পনেরো দিনের ছুটি মঞ্জুর করে নিয়ে কমল এবং তস্য বন্ধু সুশীলের সঙ্গে মধুপুর চলে গেলাম। সুশীলের পুরো নাম হচ্ছে সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়। ট্রেনের মধ্যেই বেশ আলাপ জমে গেল এবং আপনি ও বাবু প্রভৃতি অধিকন্তু বিসর্জন দিয়ে আমরা বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলাম অতি অল্প সময়ের মধ্যেই।

মধুপুর গিয়ে নির্দিষ্ট বাড়িটা খুঁজে নিতে খুব বেগ পেতে হল না। পুরানো দোতলা বাড়ি, দেখাশুনা করে একটা মালি। সে আমাদের ঘরদোর খুলে সব ব্যবস্থা করে দিল। বাড়িটা বেশ বড়ো, পরিচর্যার অভাবে তার অবস্থা বেশ জীর্ণ। নীচের একটা ঘর পরিষ্কার করে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

স্টেশনের কাছাকাছি একটা হোটেলে আমরা সেদিন খেয়ে নিলাম। ঠিক করলাম, যে-কয়দিন আছি ওই হোটেলেই খাব, রান্নার হাঙ্গামা করব না। আমরা যে বাড়িটায় ছিলাম তার আশেপাশে সমস্ত জায়গাটার একটা বর্ণনা দেওয়া দরকার। তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসর আগেকার কথা, তখনকার ভৌগোলিক অবস্থার সঙ্গে বর্তমান মধুপুরের বিশেষ মিল থাকার কথা নয়। কারণ এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান মধুপুরের চেহারায় অনেক পরিবর্তন এনেছে বলেই আমার বিশ্বাস।

স্টেশনের নিকটবর্তী এলাকা অর্থাৎ শহর অঞ্চলে ছাড়িয়ে চলে গেছে একটা সুদীর্ঘ পথ। ওই পথের দু-পাশে দাঁড়িয়ে আছে বহু অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ। বিরাট বিরাট সেই প্রাসাদোপম অট্টালিকাগুলির অবস্থা নিতান্তই জীর্ণ-শীর্ণ এবং সেই অতিবৃহৎ অট্টালিকাগুলির সম্মুখবর্তী উদ্যানের স্থান অধিকার করে আত্মপ্রকাশ করেছে ঘন ঝোপজঙ্গল, এমনকী কোনো কোনো বাড়ির ভিতর থেকে ইষ্টক-অবরোধ ভেদ করে মাথা তুলেছে বট ও অশ্বথ বৃক্ষ। ওই বৃহৎ অট্টালিকা-অরণ্য ছড়িয়ে রয়েছে বড়ো পথের দু-পাশে এবং তাদের মধ্যবর্তী গলিপথগুলি বিলুপ্ত হয়েছে সবুজ প্রান্তরের উপর। আমরা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেটা ছিল একটা মাঠের উপর এবং সেখানে যেতে হলে দুটি অট্টালিকার মধ্যবর্তী একটা গলিপথ অতিক্রম করতে হত।

স্টেশনের কাছে পূর্বোক্ত হোটেলে আমরা সকালে চা ও দুপুরে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিতাম। দুপুর বেলা হোটেল থেকে ফিরে এসে আমরা দাবা খেলতাম। দুপুর পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে থাকতাম বটে কিন্তু বিকাল হতেই আমি সঙ্গীদের সাহচর্য ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তাম। কমল ও সুশীল স্টেশনে গিয়ে পরিচিত মানুষের সন্ধান করত, আর আমি যেতাম ফাঁকা মাঠের দিকে মুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্য গ্রহণ করতে। কলকাতা শহর থেকে এখানে এসে স্টেশনের জনাকীর্ণ স্থানে আবার কলকাতার মতোই শহরের পরিবেশ উপভোগ করতে আমার ভালো লাগত না। অতএব বিকাল হলেই আমি হয়ে পড়তাম নিঃসঙ্গ, একক।

অনেক সময় কবরখানায় বেড়াতে গেছি। সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে সেই জনহীন স্থানে দাঁড়িয়ে আমি যেন এক অন্য জগতের সাড়া পেতাম। ভাষার সাহায্যে সেই অদ্ভুত অনুভূতিকে প্রকাশ করার চেষ্টা করব না। সে ক্ষমতাও আমার নেই। তবে এইটুকু বলতে পারি গোরস্থানে আমি কোনোদিন ভয় পাইনি, তবে রোমাঞ্চ অনুভব করেছি বটে।

হ্যাঁ, ভয় পেয়েছিলাম

কিন্তু কবরখানায় নয়, কবরখানা থেকে ফেরার পথে।

তখন অন্ধকার হয়ে গেছে।

হাতে ঘড়ি ছিল না, মনে হয় রাত সাড়ে সাতটা কি আটটা হবে। শহরের বাইরে ওইসব জায়গায় একটু রাত হলেই মনে হয় গভীর রাত্রি। তবে রাত বাড়লেও আমার অস্বস্তির কারণ ছিল না, জ্যোৎস্নার কল্যাণে রাতের অন্ধকার আমার দৃষ্টিকে অন্ধ করে দিতে পারেনি, চাঁদের আলোতে সব কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম… দুটি বৃহৎ অট্টালিকার মধ্যবর্তী সরু পথ অবলম্বন করে এগিয়ে গেলাম, এখানেই সামনে পড়বে পরিচিত প্রান্তর এবং সেই প্রান্তর পথ অতিক্রম করলেই বাড়ি। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি, একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর হোটেলের দিকে যাত্রা করব উদরের ক্ষুধা শান্ত করার জন্য।

হঠাৎ চমকে থেমে গেলাম—

কোথায় এসেছি? ভুল হয়েছে, এ তো আমার পরিচিত পথ নয়!

বেশ কিছু দূরে মুক্ত প্রান্তরের ওপর অবস্থিত একটি জলাশয়ের অপর প্রান্তে যে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে সেটিও দ্বিতল বটে কিন্তু আমাদের পরিচিত গৃহ নয়!

একটু নজর দিয়ে দেখলাম দোতলা বাড়ি হলেও সেই বাড়ির ছাদের উপর এককোণে একটা ছোটো ঘর দেখা যাচ্ছে চিলেকোঠা।

বাড়িটি অন্ধকার, কিন্তু চিলেকোঠার একটিমাত্র জানলায় আলোর আভাস!

জ্যোৎস্না-আলোকিত উন্মুক্ত প্রান্তরের উপর সেই জলাশয় এবং নীলাভ-কৃষ্ণ রাত্রির আকাশের পটভূমিতে দ্বিতল গৃহের একটিমাত্র ঘরের আলোক-উজ্জ্বল বাতায়ন আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করল মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেইদিকে এগিয়ে গেলাম নিজেরই অজ্ঞাতসারে!

আর তৎক্ষণাৎ আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এক তীব্র অনুভূতি আমাকে সাবধান করে দিল। আমি বুঝলাম ওই বাড়িতে গেলে আর ফিরে আসতে পারব না!

একেই কি বলে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়?

জানি না। তবে এক অদম্য আকর্ষণে আমার পা দুটো যেন আমাকে বার বার ঠেলে দিতে। চাইছিল সেই বাড়ির দিকে। তবু জোর করে আত্মসংবরণ করলাম। কিন্তু স্থানত্যাগ করতে পারলাম না। পিছন ফিরতে গেলেই মনে হচ্ছিল আমি যেন এক পরম কামনার ধন ফেলে রেখে চলে যাচ্ছি, অদ্ভুত এক মানসিক যাতনাবোধ করছিলাম–মনে হচ্ছিল নিতান্ত প্রিয়জনকে যেন বিদায় দিচ্ছি আমার জীবন থেকে।

হঠাৎ মনে হল, এইখানে দাঁড়িয়ে না-থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে যদি বন্ধুদের নিয়ে আসি তাহলে তো নির্ভয়ে ওই বাড়িটার কাছে যেতে পারি আর তিনজন একসঙ্গে থাকলে ভয়ের কোনো কারণ থাকবে না, অতএব পিছন ফিরে যে পথে এসেছি সেই পথেই আবার পদচালনা করতে উদ্যত হলাম।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে ভয় পেলাম।

দারুণ আতঙ্কে আমার পা দুটি নিশ্চল হয়ে গেল!

না, কোনো ভয়ংকর দৃশ্য দেখিনি।

যে পথের উপর দিয়ে আমি মাঠে এসে পৌঁছেছিলাম, সেই পথের দু-ধারে অবস্থিত দুটি বিশাল অট্টালিকার জীর্ণ প্রাচীরের উপর দিয়ে দুই বাড়ির গাছপালা অজস্র ডালপালা হাত বাড়িয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে, তার ফলে ঘন পত্রপল্লবশোভিত বৃক্ষশাখার নীচে পথটার উপর বিরাজ করছে এমন এক ঘনীভূত অন্ধকার যে চাঁদের আলো পর্যন্ত সেই উদ্ভিদের নিবিড় আবরণ ভেদ করে পথের উপর প্রবেশ-অধিকার পায়নি।

অন্ধকার-আবৃত সেই পথ এবং মাথার ওপর ঝাকড়া গাছপালার নিবিড় সমাবেশের দিকে তাকিয়ে এক দারুণ আতঙ্ক অনুভব করলাম। আমি বুঝলাম ওই পথের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, আমার অনুভূতি আমাকে বলে দিচ্ছে ওই পথের উপর অবস্থান করছে এমন এক ভয়ংকর যার অস্তিত্ব আমি অনুভব করতে পাচ্ছি বটে, কিন্তু তাকে চোখে দেখতে পাচ্ছি না! পিছন ফিরে বাড়িটার দিকে চাইলাম। যাব নাকি? এগিয়ে যাব ওই বাড়ির দিকে? ওখানে আশ্রয় চাইব?

একটু এগিয়ে গেলাম। দারুণ আকর্ষণ বোধ করছি, মনে হচ্ছে ছুটে যাই ওই বাড়ির দিকে। কিন্তু তবু অবচেতন মনে অনুভব করলাম ওখানেই রয়েছে আমার মৃত্যু, যত মোহ যত আকর্ষণই বোধ করি না কেন, ওই বাড়ি হচ্ছে আমার মরণফাঁদ! কোনো যুক্তি নেই এমন চিন্তার, তবু বার বার মনে হতে লাগল মোহময় ওই মরণ-ভবনকে পিছনে ফেলে আমাকে এগিয়ে যেতে হবে ওই পথের দিকে ভয় দেখানো ভয়ংকরকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে পারলে ওই পথই হবে আমার প্রাণরক্ষার একমাত্র উপায়।

তবু সেদিকে পা বাড়াতে পারলাম না। যতবার পা বাড়াই ততবারই দারুণ আতঙ্কে পিছিয়ে আসি। হঠাৎ ভীষণ ক্রোধে আমার চৈতন্য যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল কেন? কেন যেতে পারব না ওই পথে? কোন অমঙ্গলের অদৃশ্য ছায়া প্রাণরক্ষার একমাত্র পথ থেকে সরিয়ে আমাকে ঠেলে দিতে চায় ওই মরণ-ভবনের দিকে?

দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আমি এগিয়ে যাই গলিপথ ধরে। একটু এগিয়ে যেতেই আবার ভয় পেলাম, দারুণ ভয়!

অপার্থিব সেই আতঙ্কের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মনে হল আমার ঠিক পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছে এক অশুভ জীব, যার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, কিন্তু যাকে চোখে দেখা যায় না! প্রতি মুহূর্তে মনে হতে লাগল এক দৌড়ে ওই পথটা পার হয়ে চলে যাই, কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে স্বাভাবিকভাবেই হাঁটতে লাগলাম। জানতাম ছুটতে গিয়ে যদি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই তাহলে আর আমার উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকবে না এবং চলৎশক্তি রহিত হয়ে যদি ওইখানে পড়ে থাকি তাহলে যে জীবটির অস্তিত্ব আমি অনুভব করতে পাচ্ছি তার কবলেই যে আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই.. আমি বলছি আর অনুভব করছি আমার ঠিক পিছনেই সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে অমঙ্গলের অদৃশ্য ছায়া… অবশেষে আর আত্মসংবরণ করতে না-পেরে ঘুরে দাঁড়ালাম–নাঃ! কেউ নেই!

আচম্বিতে দারুণ আতঙ্ক আমার চেতনাকে গ্রাস করল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি তিরবেগে ছুটলাম গলিপথ ধরে বড়োরাস্তার দিকে।

না, পড়ে যাইনি; কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই এসে পড়লাম বড়োরাস্তার ওপর আর ঠিক সেই মুহূর্তে নারীকণ্ঠের ঐকতান সংগীত প্রবেশ করল আমার শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ে।

সাঁওতাল মেয়েরা দল বেঁধে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে বড়ো রাস্তা ধরে!

আঃ! গান যে কত মধুর সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম। জীবনে অনেক ভালো ভালো গায়কের গান শুনেছি, কিন্তু কয়েকটি অশিক্ষিত সাঁওতাল রমণীর কণ্ঠসংগীত সেই রাতে আমাকে যেমন আনন্দ দিয়েছিল তেমন আনন্দ কখনো গান শুনে পাইনি। নীরব মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে সেই সংগীত যেন জীবনের অস্তিত্ব ঘোষণা করল আমার সম্মুখে!

দুই বাড়ির মাঝখানে গাছপালার আচ্ছাদনের নীচে যে অন্ধকার-আচ্ছন্ন পথটা পার হয়ে এলাম সেইদিকে দৃষ্টিপাত করে আবার সেই অশুভ ও অদৃশ্য অমঙ্গলের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। ওইসঙ্গে আমার অনুভূতিতে ধরা পড়ল আর এক সত্য :

অদৃশ্য অমঙ্গলের কায়াহীন আত্মা এই বড়োরাস্তার উপর আসতে পারে না, ওই গলিপথই হচ্ছে তার অধিকারভুক্ত এলাকা!

পিছন ফিরে সবেগে পা চালিয়ে দিলাম নিজের আস্তানার দিকে। এবার আর ভুল হল না। বাড়ি এসে দেখলাম কমল ও সুশীল দাবা খেলছে। সব কথা খুলে বলে আমি তাদের আমার সঙ্গে ওই বাড়িতে যেতে অনুরোধ করলাম। ভেবেছিলাম অ্যাডভেঞ্চার-এর আশায় দুজনেই আমার সঙ্গে ওই বাড়ির দিকে যেতে রাজি হবে, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তারা কেউ সেই, বাড়ির দিকে পা বাড়াতে রাজি নয়!

দুজনেরই অভিমত হচ্ছে, বিদেশে বেড়াতে এসে ভূতের কবলে পড়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি জানালাম ওখানে কোনো ভূত আমার দৃষ্টিগোচর হয় নি এবং আমার সম্মুখে উপবিষ্ট দুই মূর্তিমান অদ্ভুতের চাইতে বড় কোনো ভূত সেখানে থাকতে পারে বলে মনে হয় না। ওরা কোনো কথা বলল না, চুপ করে দাবা খেলতে লাগল। আমি তখন ভীরু, কাপুরুষ প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত করে দুই বন্ধুর আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করলাম। আশা ছিল, সুশীল রাজি না হলেও কুরুরাজ দুর্যোধনের আধুনিক প্রতিনিধির স্থান যে-মানুষটি অধিকার করেছিল অন্তত সেই কমল বিশ্বাস আমার ধিক্কার শুনে অপমান বোধ করে আমার সঙ্গে যেতে রাজি হবে। কিন্তু আশা সফল হল না, আমার দুর্বাক্যগুলি দুর্যোধনের একদা-প্রতিনিধি অবলীলাক্রমে হজম করলেন এবং দাবার চাল দিতে দিতে আমাকে লক্ষ করে যেসব উপদেশ বর্ষণ করলেন তার সারমর্ম হচ্ছে : কোনো বুদ্ধিমান মানুষই বিদেশে বেড়াতে এসে ভূতের সঙ্গে আলাপ করার আগ্রহ প্রকাশ করে না, অতএব আমার মতো নির্বোধের দুর্বাক্যে বিচলিত হয়ে সংকল্প ত্যাগ করার পাত্র যে কমল বিশ্বাস নন এই পরম সত্যটি উদঘাটন করে উক্ত নামধারী মানুষটি আবার দাবার চালে মনোনিবেশ করলেন।

আমি খুবই হতাশ হলাম। কিন্তু একা ওখানে যাওয়ার আমার সাহস ছিল না, তাই সেরাতে কৌতূহল দমন করে সুবোধ বালকের মতোই নৈশভোজন শেষ করে শয্যার বুকে আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

পরের দিন খুব সকাল উঠে সেই বাড়িটার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু কী আশ্চর্য! কোথাও সেই বাড়ি অথবা পূর্বদৃষ্ট জলাশয়টির অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলাম না।

এই ঘটনার পর আরও সাত দিন আমরা মধুপুরে ছিলাম। ওই সাত দিনের মধ্যে প্রত্যেক দিনই আমি অনুসন্ধান করেছি, কিন্তু ওই বাড়ি আর জলাশয় আমার দৃষ্টিপথে একদিনও ধরা দিল না! খুবই আশ্চর্যের বিষয় সন্দেহ নেই।

এলাকাটা ছিল খুব ছোটো, আর অট্টালিকাগুলির মধ্যবর্তী পথগুলি কিছু অগুনতি নয়, কিন্তু সবগুলি গলিপথ ও পথের শেষে অবস্থিত প্রান্তরগুলির উপর তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান চালিয়েও আমি ঈপ্সিত বস্তুর দর্শন পেলাম না।

যাদের কাছে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছি তাদের মধ্যে অনেকেই বলে ওটা হচ্ছে ইলিউশন বা চোখের ভুল। আমার ধারণা অন্যরকম। আমার বিশ্বাস ওই বাড়ি আর জলাশয় দিনের আলোতে আমি খুঁজে পাইনি বটে, কিন্তু রাতের অন্ধকারে যদি অনুসন্ধান করতাম, তাহলে নিশ্চয়ই ওই বাড়ির সাক্ষাৎ লাভ করতাম। নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাত্রিকালে ওই বাড়ির খোঁজ করার সাহস আমার হয়নি, তাই রহস্য আমার কাছে রহস্যই রয়ে গেল।

ইলিউশন বা চোখের ভুল প্রভৃতি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আমার মনঃপূত নয়। আমি নেশাগ্রস্ত হইনি, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে সুস্থ দেহে চাঁদের আলোতে অন্তত দশ মিনিট ধরে মরীচিকা দেখার মতো অসুস্থ মন বা চোখ আমার তখনও ছিল না, এখনও নেই।

[১৩৮৭]

দ্বীপ

বয়স হবে বছর কুড়ি, নাম জ্যাক লেতার্ক।

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সে যখন গৃহত্যাগ করে তখন তার বয়স মাত্র কুড়ি। এই বয়সেই সে জন্মভূমি ফ্রান্স ছেড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ফরাসি উপনিবেশ তাহিতি দ্বীপে পাড়ি জমিয়েছে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই দ্বীপের ফরাসি গভর্নরের সঙ্গে বিলক্ষণ ভাব জমিয়ে ফেলেছে।

ফ্রান্সের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল জ্যাক। তাহিতি দ্বীপে এসেও সে চাষ-আবাদ নিয়ে ভাবতে শুরু করে। এই বিষয়ে গভর্নরের সঙ্গেও তার কিছু কিছু আলাপ হয়েছে।

হঠাৎ একদিন গভর্নর জ্যাককে ডেকে বললেন, এখান থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে একটা দ্বীপ আছে। দ্বীপটা চমৎকার। মাটি উর্বর, যে কোনো ফসল ফলানো যায়। দ্বীপে পানীয় জলের অভাব নেই, ঝরনা আছে। আরও আছে নানা রকম ফলের গাছ। দেখ বাপু- ওখানে গিয়ে যদি স্থায়ীভাবে বসবাস করতে রাজি থাক, তাহলে সরকারের তরফ থেকে ওই দ্বীপ তোমাকে উপহার দেওয়া হবে। এক পয়সাও খাজনা দিতে হবে না।

স্তম্ভিত বিস্ময়ে জ্যাক বলল, এমন চমৎকার জায়গাটা ফরাসি সরকার আমাকে বিনামূল্যে দিয়ে দেবেন কেন?

গভর্নর বললেন, ওখানে কেউ বাস করে না। কেউ যদি ওখানে গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করতে রাজি থাকে তবে ফরাসি সরকার তাকে বিনা-খাজনায় ওই দ্বীপের স্বত্ব ও সুখ-সুবিধা ভোগ করতে দেবেন। তবে দুঃখের বিষয়, এখন পর্যন্ত কেউ ওই দ্বীপের স্বত্ব ভোগ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

জ্যাক প্রশ্ন করল, কারণ কি? খুব সংক্ষেপে উত্তর এল, ইঁদুর!

ইঁদুর! গভর্নরের উত্তর শুনে জ্যাক হতভম্ব। এমন চমৎকার জায়গা ইঁদুরের জন্য পতিত রয়ে গেছে এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য?

হ্যাঁ, ইঁদুর। গভর্নর বলতে শুরু করেন, এই দ্বীপের বুকে ঘুরে বেড়ায় বড়ো বড়ো হিংস্র ইঁদুর। একটা জাহাজডুবি হয়েছিল দ্বীপের কাছে। জাহাজের ইঁদুরগুলি তখন সাঁতার কেটে এসে আশ্রয় নিয়েছিল ওই দ্বীপের উপর। কিছু দিনের মধ্যেই জন্তুগুলো বংশবৃদ্ধি করে ফেলে। ওই দ্বীপে তখন মানুষের বসবাস ছিল। কিছু কালের মধ্যেই দ্বীপবাসীরা ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। হাঁস-মুরগি থেকে আরম্ভ করে ঘরবাড়ি দরজা-জানালা প্রভৃতি সচল-অচল যাবতীয় বস্তুর উপরেই ইঁদুররা দাঁতের ধার পরীক্ষা করতে শুরু করল। দ্বীপবাসীরা বুঝল, এ দ্বীপে মানুষ আর ইঁদুর পাশাপাশি বাস করতে পারবে না। অতএব ইঁদুর-বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষ করল যুদ্ধ। ঘোষণা! ফাঁদ, আগুন, বিষ প্রভৃতি সব রকম মহাস্ত্র প্রয়োগ করেছিল দ্বীপের বাসিন্দারা, কিন্তু ইঁদুররা কাবু হয়নি। অবশেষে মানুষগুলোই কাবু হয়ে পড়ল, দ্বীপ ছেড়ে তারা পলায়ন করল।

হাঁ করে শুনছে জ্যাক। একটু থেমে গভর্নর আবার বললেন, ওখানে এখন মানুষ নেই, ইঁদুরেরাই বসবাস করছে। জাহাজের ইঁদুররা কেমন ছিল জানি না, তবে দ্বীপের উপর যে জগুলো ইঁদুরের উপনিবেশ স্থাপন করেছে, তাদের দৈহিক আয়তন যেমন সাতিশয় বৃহৎ, তাদের স্বভাবও তেমনি অত্যন্ত হিংস্র। এখন বোধহয় বুঝতে পারছ, কেন ওখানে মানুষ থাকে না? শোনো তোমার বয়স অল্প, সাহসও আছে মনে হয়। এমন চমৎকার জায়গাটা কী তুমি ইদরের ভয়ে ছেড়ে দেবে? ভেবে দেখ। স্থায়ীভাবে বাস করতে পারলে ওই দ্বীপের সম্পূর্ণ মালিকানার স্বত্ব ফরাসি সরকার তোমাকে দিয়ে দেবেন। তবে হ্যাঁ, মনে রাখবে- স্থায়ীভাবে বাস করতে হবে।

জ্যাক ভাবল। কয়েকদিন ধরেই ভাবল। গভর্নরের প্রস্তাবটা তার কাছে মনে হল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ সে গ্রহণ করে নিল মনে মনে। দ্বীপের স্থানীয় অধিবাসীরা ইঁদুরের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে পারে, কিন্তু সুসভ্য ফ্রান্সের এক তরুণ কী পিছিয়ে যাবে ইঁদুরের ভয়ে? কখনই নয়। যেমন করে তোক দ্বীপের উপর থেকে ইঁদুরদের তাড়াতে হবে।

কিন্তু জন্তুগুলোকে বিতাড়িত করার উপায়টা কী হতে পারে? বড়ো কঠিন সমস্যা। জ্যাক চিন্তা করতে থাকে…

তাহিতি দ্বীপের রাজধানী পাপেতি। ওই পাপেতির পথে পথে একদিন ঘুরে বেড়াচ্ছে জ্যাক। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে যে অঞ্চলটায় সে এসে পড়ল, সেখানে বাস করে খুব দরিদ্ৰশ্রেণির মানুষ।

জ্যাক লক্ষ করল, এই অঞ্চলে বিড়ালের সংখ্যা খুব বেশি। তার মনে হল, প্রত্যেকটি বাড়িতেই বাস করে একাধিক মার্জার। যে দিকেই তাকায়, সেই দিকেই তার দৃষ্টিপথে ধরা দেয় শুধু বিড়াল আর বিড়াল আর বিড়াল।

জস্তুগুলোর চেহারা দেখে মনে হয়, তারা বেওয়ারিশ। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে গৃহস্থের সাহায্য তারা পায় না। নিজেরাই খেটে খায়!

অকস্মাৎ বিদ্যুৎ-চমকের মতো এক নতুন চিন্তাভোত ধাক্কা মারে জ্যাকের মস্তিষ্কের কোষে ইঁদুরের শত্রু বিড়াল!

সেই রাতে অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করল জ্যাক। পরের দিনই সে কিনে ফেলল একটা পালতোলা নৌকো।

স্থানীয় বাসিন্দা কয়েকটা কিশোর ছেলেকে ডেকে সে জানিয়ে দিল যে, তারা যদি তাকে বিড়াল এন দিতে পারে, তবে সে তাদের পুরস্কার দিতে রাজি আছে। পুরস্কারের মূল্য ধার্য হল প্রতিটি বিড়ালের জন্য এক সেনতিম (সেনতিম- স্থানীয় মুদ্রা)। তবে হ্যাঁ বিড়াল সে অনেকগুলো নিতে চায় বটে, তবে জন্তুগুলো খুব শান্তশিষ্ট হলে চলবে না, মারকুটে দাঙ্গাবাজ হাড়বজ্জাৎ বিড়ালই তার পছন্দ।

বাচ্চারা দারুণ আগ্রহের সঙ্গে জ্যাকের প্রস্তাব গ্রহণ করল। কয়েক দিনের মধ্যেই তাবৎ তাহিতি দ্বীপের সবচেয়ে পাজি আর ওঁচা বিড়ালগুলোকে পাকড়াও করে তারা জ্যাকের কাছে নিয়ে এল।

খুব চটপট হাত চালিয়ে অনেকগুলো খাঁচা তৈরি করে ফেলল জ্যাক। বিড়ালের সংখ্যাও কম নয়- একশো কিংবা তার চেয়েও কিছু বেশি জোগাড় হয়েছে। স্থানীয় একজন মাঝিকে ডেকে বিড়ালগুলিকে নিয়ে জ্যাক নৌকো ভাসিয়ে দিল। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে সে বন্দি বিড়ালদের ছেড়ে দিল বেলাভূমির উপর। খাঁচার ভিতর থেকে মুক্তি পেয়েই বিড়ালগুলো দ্রুতবেগে পা চালিয়ে দ্বীপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। জ্যাক আবার ফিরে এল তাহিতির রাজধানী পাপেতি শহরে।

বেশ কয়েক মাস পরে জ্যাক লোক আবার দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। সে আশা করেছিল এত দিনে বিড়াল বাহিনী নিশ্চয়ই ইঁদুরের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। কয়েক জন স্থানীয় অধিবাসীর সঙ্গে সে দ্বীপের উপর পদার্পণ করল। সকলেই একটু সতর্ক হঁদুরের আতঙ্ক তাদের মন থেকে মছে যায়নি। খুব সাবধানে তারা বেলাভূমির উপর দিয়ে হেঁটে দ্বীপের ভিতর প্রবেশ করল, কিন্তু একটা ইঁদুরও তাদের নজরে পড়ল না। মাঝে মাঝে দুই-একটা অত্যন্ত বদখৎ চেহারার বিড়াল অবশ্য তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তবে জন্তুগুলি মানুষ দেখেই ঘন ঝোঁপঝাড়ের ভিতর সরে গেছে লোকচক্ষুর সামনে আসতে তারা রাজি নয়।

দ্বীপের পরিবেশ চমৎকার লাগে জ্যাকের কাছে। সে এবার জায়গাটাকে বসবাসের উপযোগী করার জন্যে সচেষ্ট হল। লোকজনের সাহায্যে কিছু দিনের মধ্যেই সে দ্বীপের চেহারা ফিরিয়ে দিল। তাহিতি দ্বীপের স্থাপত্য-শিল্পের অনুকরণে এই দ্বীপের উপর আত্মপ্রকাশ করল একটি সুন্দর কুঁড়েঘর।

হাঁস-মুরগি নিয়ে এসেছিল জ্যাক নৌকো করে। এবার সেগুলিকে জাল দিয়ে ঘেরা জায়গার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হল। জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি হল নারিকেল কুঞ্জ।

পাপেতি শহরে গিয়ে জ্যাক তার সাফল্যের বিশদ বিবরণী দিল সরকারের কাছে। প্রমাণ-পত্রও পেশ করল। পূর্ব-পরিচিত গভর্নর তাকে অভিনন্দন জানালেন এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মালিক বলে স্বীকৃতি দিতেও ভুললেন না। ফরাসি সরকার তাকে স্বীকার করার পর সত্যি সত্যি কাগজে-কলমে দ্বীপের মালিক হল জ্যাক লেতার্ক।

আহ্লাদে আটখানা হয়ে জ্যাক দ্বীপের নতুন নামকরণ করল ‘লেতার্কের দ্বীপ’।

তারপর আবার সে ফিরে এল তার দ্বীপে। এবার তার সঙ্গে কেউ নেই। সঙ্গীসাথী না থাকলেও জ্যাক কিন্তু কখনই নিঃসঙ্গ বোধ করে না। গাছে গাছে অজস্র সুমিষ্ট ফল, সুপেয় ঝরনার জল, গৃহপালিত হাঁস-মুরগির ডিম এবং মাঝে মাঝে জিভের স্বাদ ফেরাবার জন্য সমুদ্রের মাছ, কঁকড়া ও কাছিম– আর কি চাই?

লোকজনের সঙ্গ জ্যাকের দরকার নেই। তার দিন কাটে মহা-আনন্দে।

তার হাতে অখণ্ড অবসর, এ কথা মনে করলে ভুল হবে। সারদিন সে কঠিন পরিশ্রম করে। নানা রকম উদ্ভিদ, ফলমূল আর শাক-সবজির চাষ করে সে। হাঁস-মুরগিগুলিকে দেখাশুনা করাও বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ভীষণ কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই জ্যাকের দিন কেটে যায়।

তবে এইভাবে সারা জীবন নিঃসঙ্গ জীবন-যাপনের পরিকল্পনা তার নেই। সে আশা করে, হাঁস-মুরগি, নারিকেলের শাঁস প্রভৃতি চালান দিয়ে সে কয়েক বছরের মধ্যেই বেশ ধনী হয়ে উঠবে, তারপর তাহিতি থেকে একটি স্থানীয় মেয়েকে বিয়ে করে এনে এই দ্বীপেই বাকি জীবনটা সুখে-স্বচ্ছেন্দে কাটিয়ে দেবে।

ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে জ্যাকের দিন কাটে…

হঠাৎ একদিন তার মনে হল, হাঁস-মুরগির সংখ্যা যেন কমে গেছে। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারে না। তার পাখিগুলো বেশ সুস্থসবল, আজ পর্যন্ত একটি পাখিকেও সে মরতে দেখে নি। পাখির সংখ্যা গণনা করেনি সে কোনো দিনই। কিন্তু আজ চোখের আন্দাজ থেকেই তার ধারণা হল, হাঁস-মুরগিদের সংখ্যা কমে গেছে এবং যাচ্ছে।

খুব আশ্চর্য হয় জ্যাক। পাখিগুলোর উপর নজর রাখতে লাগল। কয়েক দিন পরেই সে দেখতে পেল, একটা মস্ত বিড়াল ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে তারের জাল টপকে হাঁসের দলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জ্যাক বাধা দেওয়ার আগেই বিড়ালটা একটা হাঁসের বাচ্চা মুখে নিয়ে আবার তারের জাল পার হয়ে ঝোপের ভিতর মিলিয়ে গেল।

শুধু সেই দিনই নয়, জ্যাক নজর রেখে দেখল পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যেই প্রায় বারো-তেরোটা হাঁস ও মুরগির ছানা বিড়ালের আক্রমণে ইহলীলা সংবরণ করল। আক্রমণের কায়দা ওই একই রকম– তারের জাল টপকে জন্তুগুলো পাখিগুলিকে ধরে নিয়ে যায়। পাখিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার রহস্য এইবার জ্যাকের কাছে পরিষ্কার হল।

বেচারা জ্যাক! মার্জার বাহিনীর কীর্তি দেখে তো মাথায় হাত দিয়ে বসে। একটু চিন্তা করতেই তার মনে হয়, শুধু তার পোষা পাখিগুলোকে দিয়েই দ্বীপের গোটা বিড়ালগোষ্ঠী নিশ্চয় ক্ষুন্নিবৃত্তি করে না। কারণ তাহলে এত দিনে পাখির বংশ নিঃশেষ হয়ে যেতে। আজ পর্যন্ত একটা ইঁদুরও তার চোখে পড়েনি, সুতরাং মার্জার বাহিনী নিশ্চয় ইঁদুরের বংশ উজাড় করে দিয়েছে। তবে এতগুলো বিড়াল কি খেয়ে বেঁচে আছে?

জ্যাক ঠিক করল, এইবার ভালো করে বিড়ালদের হালচাল লক্ষ করতে হবে।

সব কাজকর্ম ছেড়ে জ্যাক দ্বীপটাকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। খুব ভোরবেলা এবং সন্ধ্যার সময়ে বেরিয়ে দেখলে, সমুদ্রের তীরে ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে বিড়ালগুলি বেড়াতে আসে। বালি খুঁড়ে ধরে শামুক, গুগলি, পাথর সরিয়ে টেনে আনে কাঁকড়া। কয়েকটা অতি উৎসাহী বিড়াল আবার জলে নেমে মাছ ধরছে।

হঠাৎ একদিন বিড়ালগুলোর হিংস্র স্বভাবের পরিচয় পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল জ্যাক।

বেলাভুমির কাছে অগভীর জলের ভিতর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা কচ্ছপ। হঠাৎ কয়েকটা বিড়াল একসঙ্গে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং টানাটানি করতে করতে তাকে চিৎ করে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দাঁতে নখে ছিন্ন-ভিন্ন করে তারা খেয়ে ফেলল কচ্ছপটাকে। পড়ে রইল শুধু কচ্ছপের শক্ত খোলা!

জ্যাক মনে মনে বুঝল, তাহিতি দ্বীপের বিড়াল কেন বন্য প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, ওদের সম্বন্ধে একটু সাবধান থাকা দরকার।

সে সঙ্গে বন্দুক আনেনি। আনার দরকারও মনে হয়নি। এইবার সে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রয়োজন অনুভব করল। কিন্তু বন্দুক যখন নেই, তখন আর কি করা যাবে? বুনো লতা দিয়ে সে ফঁদ পাতল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ফাঁদে একটি বিড়ালও ধরা পড়ল না।

জ্যাক বিড়ালগুলোর আস্তানা আবিষ্কার করেছিল। আগুন আর ধোঁয়ার সাহায্যে সে। জন্তুগুলোকে জব্দ করারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বিড়ালগুলো আস্তানা ছেড়ে সাময়িকভাবে সরে পড়ল।

জ্যাক এবার তাহিতির রাজধানী থেকে বিষ এবং বন্দুক নিয়ে এল। বিষ মাখানো টোপ সাজিয়ে লাভ হল না। বিড়ালগুলো অসম্ভব ধূর্ত, তারা বিষাক্ত টোপ স্পর্শও করল না। জ্যাকের বন্দুকের গুলিতে অবশ্য কয়েকটা বিড়াল মারা পড়ল, কিন্তু পাখিগুলোর উপর মার্জার বাহিনীর আক্রমণ বন্ধ করা গেল না। বিড়ালকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে অনেক সময় পাখির উপর গুলি লাগার সম্ভাবনা থাকে– কয়েকটা পাখি এইভাবে নিক্ষিপ্ত গুলিতে মারাও পড়েছিল।

জ্যাক আবার যখন তাহিতিতে গেল, তখন তার সমস্যার কথা খুলে বলল গভর্নরকে। গভর্নর তাকে ডিনামাইটের সাহায্য নিতে বললেন। গভর্নরের পরামর্শ জ্যাকের মনঃপূত হল না। ডিনামাইট বিস্ফোরণ দ্বীপের গায়ে বহু গহ্বর ও গর্তের সৃষ্টি করবে এবং যে বিড়ালগুলো বেঁচে যাবে, তারা আবার ওই সব ফাটলে আশ্রয় নিয়ে বংশবৃদ্ধি করে যাবে নির্বিবাদে।

বিড়ালগুলো জ্যাককে এখন ভালোভাবে চিনে নিয়েছে। তারা বুঝেছে, এই লোকটাই হচ্ছে দ্বীপের মধ্যে তাদের একমাত্র শত্রু। জ্যাককে দেখলে তারা সরে যায় বটে, কিন্তু খুব বেশি দূরে পালায় না– অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে কিছুটা পিছিয়ে যায় মাত্র। কয়েকটা জানোয়ার আবার পিঠটাকে ধনুকের মতো বেঁকিয়ে হিংস্রভাবে ফাঁস-ফাঁস করতে থাকে।

জ্যাক এবার ভয় পায়। তার গুলি ফুরিয়ে এসেছে। হাঁস-মুরগির আস্তানাও প্রায় শূন্য। কয়েকটা বড়ো হাঁস শক্তিশালী ডানা আর ধারালো ঠোঁটের সাহায্যে আত্মরক্ষা করছে বটে, কিন্তু তারাও বেশি দিন টিকতে পারবে কি?

জ্যাক ভাবতে থাকে, জন্তুগুলো যদি তাকে দল বেঁধে আক্রমণ করে, তা হলে সে কি করে আত্মরক্ষা করবে? বিড়ালগুলো এখন একেবারেই বন্য প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। তাদের পক্ষে সব কিছুই সম্ভব।

রাত্রিবেলা জ্যাক আর ঘরের বাইরে যায় না।

অন্ধকারের মধ্যে মার্জারকছে ক্রুদ্ধ গর্জন কানে আসে… জ্যাক বোঝে, যোদ্ধারা এখন দাঁত আর নখের বোঝাঁপড়া করছে… যুদ্ধের আওয়াজ একদিকে মিলিয়ে যায়, অন্যদিক থেকে আবার নতুন আর একদল যোদ্ধা সগর্জনে সাড়া দেয়… উৎকট, হিংস্র মাজার কণ্ঠের সেই গর্জনধ্বনি চলে সারা রাত ধরে… ঘরের মধ্যে বিনিদ্র চোখে চেয়ে থাকে জ্যাক লেতাৰ্ক… এমনকি

জানালা-দরজাও সে রাত্রে খুলতে সাহস পায় না…।

হঠাৎ এক রাত্রে জ্যাক চমকে উঠল- মাথার উপর কুঁড়ে ঘরের চালের উপর বেজে উঠেছে তীক্ষ্ণ নখরে ঘর্ষণধ্বনি! ঘরের ভিতর মাছ রান্না করছে জ্যাক। সেই মাছের গন্ধে অস্থির হয়ে কয়েকটা বিড়াল ঘরের চালে উঠে আঁচড় কাটছে পাগলের মতো!

চাল ফাঁক করে বিড়ালগুলো ভিতরে আসতে চায়! মানুষের অস্তিত্ব তারা গ্রাহ্য করতে রাজি নয়…

বিড়ালদের উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হয়নি।

কিন্তু এই ঘটনায় জ্যাকের মনোবল ভেঙে গেল। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সাজ-সরঞ্জাম গুটিয়ে সে এক দিন নৌকোয় চড়ে পাড়ি জমাল তাহিতির রাজধানীর দিকে-~

জীবনে আর কোনো দিন জ্যাক ওই দ্বীপে ফিরে যায়নি, যার নাম সে রেখেছিল লেতার্কের দ্বীপ।

দ্বৈরথ

বিলি প্যারট ছিল ইংলন্ডের মানুষ। কোনো কাজই তার বেশিদিন ভালো লাগত না, কিন্তু একটি বিষয়ে তার অনুরাগ ছিল অত্যন্ত প্রবল। সেটি হচ্ছে মল্লযুদ্ধ!

দেখতে ছোটোখাটো হলেও বিলি ছিল অসাধারণ শক্তির অধিকারী। তার পরিচিত ইংরেজ ও ভারতীয় সঙ্গীসাথির দল তার নামকরণ করেছিল লৌহমানব।

নামটা যে নিতান্ত মিথ্যার উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়নি বর্তমান কাহিনির শেষ অংশেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

পেশায় সে ছিল কামার, কিন্তু বিলি প্যারট করেনি এমন কাজ ছিল না ভূভারতে!

প্রথমে সে নাবিক হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জলপথে ভ্রমণ করল। তারপর হঠাৎ একদিন নাবিকের কাজে ইস্তফা দিয়ে সে চাকুরি গ্রহণ করল কলকাতার টাকশালে। মাইনে হল প্রায় পঞ্চাশ টাকার মতো। আমি যখনকার কথা বলছি ভারতবর্ষ তখন স্বাধীন হয়নি, তাই ইংলন্ডের মানুষ বিলি প্যারটের পক্ষে ব্রিটিশ-অধিকৃত ভারতে ট্যাকশালের কাজটা জোগাড় করতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। কিছুদিন পরে এই কাজটাও তার ভালো লাগল না। হেনরি নামক জনৈক ইংরেজ তার যন্ত্রপাতি বহন করার জন্য একটি উপযুক্ত লোকের সন্ধান করছিল–দৈবাৎ তার যোগাযোগ হয়ে গেল বিলির সঙ্গে। মাসিক এক-শো পঞ্চাশ টাকা বেতন এবং ভবিষ্যতে উন্নতিলাভের প্রলোভন দেখাতেই হেনরির কাছে চাকরি করতে সম্মত হল বিলি।

ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে ঘুরতে দুজনেই এসে উপস্থিত হল পূর্ণিয়ার অন্তর্গত তিরহাট নামক স্থানে।

ওই সময় পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের অরণ্যময় অঞ্চলে শিকার করতে এসেছিলেন বিখ্যাত শিকারি জেমস ইংলিস। বিলির সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল অনেক আগেই। মল্লযুদ্ধে তার দক্ষতা ও অসাধারণ দৈহিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তিনি বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। মধ্যে কয়েক বৎসর তাঁর সঙ্গে বিলির দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। হঠাৎ সাহেবগঞ্জ মহকুমার এক ডাকবাংলোতে জেমস সাহেব যাকে দেখে চমকে উঠলেন সেই মানুষটি হল স্বয়ং বিলি প্যারট!

বিলির তখন দারুণ দুরবস্থা। ধারদেনায় তার মাথার চুল পর্যন্ত বিকিয়ে গেছে; খুব সম্ভব হেনরির চাকরিটাও সে ছেড়ে দিয়েছিল। ছোটোখাটো এই মানুষটিকে শিকারি জেমস খুবই ভালোবাসতেন। বিলির দুরবস্থা দেখে তাকে নিয়ে তিনি স্বস্থানে চলে এলেন। ওই সময়ে স্থানীয় পুলিশ-সুপারিনটেন্ডেন্ট ভালুক শিকারের জন্য জেমস সাহেবকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। জেমসের সঙ্গে ওই শিকার-অভিযানে সানন্দে অংশগ্রহণ করল বিলি প্যারট।

জেমস আর বিলি ছাড়া আর যেসব শিকারি পূর্বোক্ত শিকার-অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন, তারা হলেন কলকাতার দুই ব্যারিস্টার, পিলার নামক জেমসের এক বন্ধু এবং স্থানীয় জেলার এক বিচারক। দলের মধ্যে একমাত্র জেমস সাহেবকেই প্রকৃত অর্থে শিকারি বলা চলে, অন্য সকলে ছিলেন শখের শিকারি–নিতান্তই শখ চরিতার্থ করতে তারা শিকারে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের নিকটবর্তী একটি অরণ্যে শিকারের আয়োজন করা হয়েছিল। জঙ্গলের মধ্যে শিকারিদের জন্য গাছে গাছে মাচা বাঁধা হল, মাচাগুলির পরস্পরের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল প্রায় পঞ্চাশ ফিট। এক একজন শিকারির জন্য নির্দিষ্ট ছিল এক একটি মাচা, কোনো মাচাতেই একাধিক মানুষ স্থান গ্রহণ করেনি। মাচার সারির একপ্রান্তে ছিল বিলি এবং অপর প্রান্তে অবস্থিত শেষ দুটি মাচায় আশ্রয় নিয়েছিলেন যথাক্রমে জেমস ইংলিশ এবং তার বন্ধু পূর্বোক্ত পুলিশ অফিসার।

একটু পরে বিট আরম্ভ হল। বিটার অর্থাৎ বনতাড়ুয়ার দল বিকট শব্দে চেঁচাতে চেঁচাতে জানোয়ার তাড়াতে শুরু করল। প্রথমেই শিকারিদের দৃষ্টিপথে ধরা দিল অসংখ্য পাখি–তারপর শেয়াল, খরগোশ প্রভৃতি ছোটো ছোটো অনেক জানোয়ার শিকারিদের চোখের সামনেই ছুটে পালাতে লাগল। ওইসব ছোটোখাটো জন্তুগুলিকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না, শিকারিরা চাইছেন বড়ো শিকার। ওই জঙ্গলের ভিতর ছোটো ছোটো গুহার মধ্যে ভালুকের অস্তিত্ব আছে শুনেই শিকারিরা উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু ভালুক যদি না দেখা দেয় তবে ভালুকের পরিবর্তে অন্য বড়ো জানোয়ার মারতেও তাদের আপত্তি ছিল না। শিকারিদের দুধের তৃষ্ণা ঘোল দিয়েই মেটাতে হল–দুটি হরিণ গুলি খেয়ে মারা পড়ল বটে, কিন্তু শিকারিদের সম্মুখে কোনো ভালুকই আত্মপ্রকাশ করতে রাজি হল না।

শিকারিদের নির্দেশ অনুযায়ী এইবার পশ্চিম দিক থেকে বিট আরম্ভ করার জন্য বনতাড়ুয়ার দল জঙ্গলের ভিতর ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। পুব দিকের জঙ্গলে তাড়া দিয়ে কোনো ফল হয়নি, কিন্তু এবার ভিন্ন দিক থেকে জঙ্গল পিটিয়ে বিট শুরু করলে হয়তো দু-একটা ভালুকের দেখা মিলতেও পারে।

নিঃশব্দ অরণ্য। বনতাড়ুয়ারা তখনও বিট অর্থাৎ জঙ্গল ঠেঙিয়ে জানোয়ার তাড়াতে শুরু করেনি। শিকারিদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে তীব্র উত্তেজনা।

আতম্বিতে জেমস এবং তার পরবর্তী সঙ্গীর মধ্যস্থলে অবস্থিত একটা ঝোপের ভিতর জাগল এক শব্দের তরঙ্গ–মট মট করে শুকনো গাছের ডাল ভাঙতে ভাঙতে কে যেন এগিয়ে আসছে।

শব্দ লক্ষ করে দুই শিকারিই রাইফেল তুলে ধরলেন, কিন্তু যে-জীবটি তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করল তাকে দেখে দুই বন্ধুই হয়ে গেলেন হতভম্ব!

বাঘ নয়, ভালুক নয় তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিলি প্যারট!

একগাল হেসে বিলি জেমস সাহেবকে যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, সে অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত এবং যেহেতু তার জলের বোতলে একটুও জল নেই, তাই বাধ্য হয়েই সে এখানে এসেছে তৃষ্ণা নিবারণ করতে–কারণ তাদের কাছে যে জলের বোতল আছে সে-কথা তার অজানা নয়।

জেমসের কাছে জলের বোতল ছিল না, জল ছিল তার বন্ধুর কাছে। কিন্তু শুধু একটু জলের জন্য বিল বিট-এর সময় মাটিতে নেমে এতদূর হেঁটে এসেছে শুনে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। জেমসের বক্তব্য হচ্ছে, কিছুক্ষণ জলপান না-করলে একটা মানুষ মরে যায় না, কিন্তু বিট-এর সময় হঠাৎ ভালুক বেরিয়ে পড়লে যে বিলের জীবন বিপন্ন হতে পারে এ-কথা কি তার জানা নেই?

বিল বলল, সে জলের জন্য এসেছে, জলপান না-করে সে এখান থেকে এক পাও নড়তে রাজি নয়।

জেমস সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন বিল সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় এসেছে, মাচার ওপর থেকে তার রাইফেলটাও সে সঙ্গে আনার প্রয়োজন মনে করেনি।

জেমসের বন্ধু অন্য গাছ থেকে দুই বন্ধুর কথা কাটাকাটি শুনছিলেন, তাড়াতাড়ি আপদ-বিদায় করার জন্য তিনি মাচা থেকে একটা নীচু ডালে নেমে এসে বিলকে ডেকে তার হাতে জলের বোতলটা সমর্পণ করলেন।

বোতলটা হাত বাড়িয়ে টেনে নিয়েই বিলি ঢক ঢক করে জলপান করতে শুরু করল। বিলিকে জলপান করতে দেখে জেমস সাহেবের মনে হল তার গলাটাও অসম্ভব শুকিয়ে এসেছে, একটু জল খেলে মন্দ হয় না। রাইফেল, ছোরা প্রভৃতি মাচার ওপর রেখে তিনি নীচে নেমে এলেন শুকনো গলাটাকে ভিজিয়ে নেবার জন্য।

ততক্ষণে বিলির তৃষ্ণা মিটে গেছে, সে পূর্বোক্ত শিকারির মাচার নীচে দাঁড়িয়ে জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়েছে এবং শিকারিও মাচার উপর শুয়ে পড়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বোতলটা হস্তগত করার চেষ্টা করছেন। অকস্মাৎ বাঁ-দিকের একটা মাচার উপর থেকে ভেসে এল বিচারক মহোদয়ের উচ্চ কণ্ঠস্বর–সাবধান! ভালুক! ভালুক!

জেমস তৎক্ষণাৎ তার মাচা-বাঁধা গাছটার দিকে দৌড় মারলেন। যে শিকারিটি বিলির হাত থেকে জলের বোতল নেবার জন্য মাচার উপর শুয়ে পড়ে হাত বাড়িয়েছিলেন তিনি তড়াক করে উঠে বসে হাত বাড়ালেন রাইফেলের দিকে। বিল জলের বোতল ফেলে দিয়ে বলে উঠল, সর্বনাশ করেছে!

পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই ঝোপজঙ্গল ভেদ করে সগর্জনে আত্মপ্রকাশ করল একটা মস্ত বড়ো ভল্লুকী।

জন্তুটার পিঠের উপর একটা বাচ্চা প্রাণপণে মাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে জেমস আবিষ্কার করলেন, তার হাতের রিভলভারটা তিনি মাচার উপরে ফেলে এসেছেন। চটপট কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে তিনি ভল্লুকীকে লক্ষ করে গুলি চালালেন।

ভল্লুকী শিকারিদের আক্রমণ করত কি না বলা যায় না, হয়তো সে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো, কিন্তু গুলিটা তার চোয়ালে লাগতেই জন্তুটা ভীষণ গর্জন করে বিলির দিকে তেড়ে এল।

যে-শিকারিটি বিলিকে জল দিয়েছিলেন, তিনি তাড়াতাড়ি মাচার উপর শুয়ে পড়ে বিলির উদ্দেশে হাত বাড়িয়ে দিলেন। কোনোরকমে হাতটা ধরে ফেলতে পারলে বিলি নিশ্চয়ই গাছের উপর উঠে ভালুকের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারত, কিন্তু বার বার চেষ্টা করা সত্ত্বেও খর্বকায় বিলের পক্ষে বন্ধুর হাতটাকে হস্তগত করা সম্ভব হল না। ভল্লুকী যখন প্রায় তার দেহের উপর এসে পড়েছে। তখন আর হাত ধরে গাছে ওঠার বৃথা চেষ্টা না-করে বিলি প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল।

বিলির দুর্ভাগ্য, আচমকা একটা শুকনো গাছের ডালে পা আটকে সে ছিটকে পড়ল মাটির উপর এবং পরক্ষণেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আহত ভল্লুকী।

জেমসের নিক্ষিপ্ত রিভলভারের গুলি জন্তুটার নীচের চোয়াল ভেঙে দিয়েছিল, তাই তার দংশন করার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু কামড়াতে না-পারলেও ভল্লুকী তার ধারালো নখের সাহায্যে বিলকে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল।

অন্য মানুষ হলে নিশ্চয়ই ভল্লুকীর নখে ছিন্নভিন্ন হয়ে ইহলীলা সংবরণ করত, কিন্তু বিলি প্যারট ছিল পাকা কুস্তিগির এবং তার দেহেও ছিল অসাধারণ শক্তি এত সহজে সে পরাজয় স্বীকার করল না।

এমন অদ্ভুত কায়দায় সে পা দিয়ে ভল্লুকীর কোমর জড়িয়ে ধরল যে জন্তুটার পিছনের থাবা দুটো হয়ে গেল অকেজো, ওই দুটো থাবা দিয়ে জন্তুটা তার শত্রুর দেহে আঁচড় বসাতে পারল না।

বাঁ-হাতের কনুইটা সে ঠেলে দিল ভল্লুকীর গলার নীচে এবং তার মুষ্টিবদ্ধ দক্ষিণ হাত হাতুড়ির মতো পড়তে লাগল শ্বাপদের নাকে, মুখে, পাঁজরে।

ভালুকটা বিলিকে জড়িয়ে ধরেছিল, তার পিছনের দুই থাবা বিলির কুস্তির প্যাঁচে অকেজো হয়ে পড়েছিল বটে কিন্তু সামনের থাবা দুটোর ধারালো নখগুলি শত্রুর কাঁধের উপর এঁকে দিল অনেকগুলো রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।

ভল্লুকী গর্জন করছিল। বিলিও নীরব ছিল না, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় যে-কয়টা গালাগালি তার জানা ছিল সবকটাই সে প্রয়োগ করছিল উচ্চকণ্ঠে!

এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে জেমস হঠাৎ হো হো শব্দে হেসে উঠলেন। হাসির আওয়াজটা বিলির কানে গিয়েছিল, সে ভল্লুকীর সঙ্গে লড়তে লড়তেই জেমসের উদ্দেশে যেসব শব্দ উচ্চারণ করতে লাগল সেগুলো কোনো ভদ্রলোকের পক্ষেই সম্মানজনক নয়।

জেমসের হাসি বন্ধ হয়ে গেল, তিনি অবস্থার গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে গেলেন। ভল্লকীর কবলে যেকোনো মুহূর্তে বিলির প্রাণ যেতে পারে, এই অবস্থায় তাঁর হেসে ওঠা উচিত হয়নি।

বন্দুক হাতে নিয়ে মাচার উপর থেকে মাটিতে নেমে এলেন জেমস। ভল্লুকীর পিঠের উপর যে-বাচ্চাটা ছিল সে অবশ্য অনেক আগেই সরে পড়েছে।

ততক্ষণে শিকারিরা সকলেই যার যার মাচা থেকে নেমে ছুটে এসেছেন, বনতাড়ুয়াদের মধ্যেও অধিকাংশ লোক এসে উপস্থিত হয়েছে অকুস্থলে।

শিকারিদের হাতে বন্দুক তো ছিলই, বনতাড়ুয়ারাও নিতান্ত নিরস্ত্র ছিল না তাদের হাতেও ছিল লাঠিসোঁটা। কিন্তু বিল এবং ভল্লুকী পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে যেভাবে মাটির উপর গড়াগড়ি দিচ্ছিল তাতে বন্দুক তো দূরের কথা, লাঠি পর্যন্ত ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। কারণ আঘাত ভল্লুকীর গায়ে না-লেগে বিলির গায়েও লাগতে পারে।

সকলে নিরুপায় হয়ে দেখতে লাগলেন, দ্বিপদ ও শ্বাপদ আলিঙ্গনে-আবদ্ধ অবস্থায় গড়াতে গড়াতে এগিয়ে চলেছে যেদিকে, সেখানে হাঁ করে রয়েছে একটা গভীর নালা বা খাত। সমবেত শিকারির দল চিৎকার করে বিলকে এই নূতন বিপদ সম্বন্ধে হুঁশিয়ার করে দিলেন, কিন্তু কোনো কাজ হল না। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গড়াতে গড়াতে এসে পড়ল খাতের কিনারে, পরক্ষণেই মৃত্যু-আলিঙ্গনে আবদ্ধ শ্বাপদ ও দ্বিপদের দেহ দুটি অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকার খাদের মধ্যে!

এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় সকলেই প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। একটু পরে সংবিৎ ফিরতেই শিকারিরা খাতের ভিতর নেমে বিলের চূর্ণবিচূর্ণ দেহটাকে উদ্ধার করতে সচেষ্ট হলেন।

কাজটা অবশ্য সহজ ছিল না। উঁচু-নীচু পাথুরে জমি, ছোটো বড়ো পাথর ও শিকড়বাকড় লতাপাতার প্রায়-দুর্ভেদ্য বেষ্টনীর ভিতর দিয়ে নামতে গেলে প্রতিমুহূর্তে পা ফসকে পড়ে গিয়ে প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। তবু ওর মধ্যেই জেমস হরিণদের পায়ে-চলা একটা পথ আবিষ্কার করে ফেললেন। অতিকষ্টে প্রাণ হাতে নিয়ে শিকারিরা নীচে নেমে গেলেন এবং অস্পষ্ট অন্ধকার-মাখা জঙ্গলের মধ্যে বিলির খোঁজ করতে লাগলেন।

হ্যাঁ, বিলিকে পাওয়া গিয়েছিল। একটা মস্ত বড়ো পাথরের পাশে ভল্লুকীর মৃতদেহের উপর উপবিষ্ট অবস্থায় যে ক্ষতবিক্ষত মানুষটি শিকারিদের অভ্যর্থনা জানাল, সে হচ্ছে স্বয়ং বিলি প্যারট!

শিকারিরা বিলিকে জীবিত অবস্থায় দেখবেন আশা করেননি, কারণ অত উঁচু থেকে পড়লে কোনো জীবের পক্ষেই বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব।

এই অসম্ভব কী করে সম্ভব হল জানাতে গিয়ে বিলি যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, ভল্লুকীই প্রথমে মাটির ওপর আছড়ে পড়ে এবং বিলি পড়েছিল তার দেহের ওপর। ভল্লুকীর অস্থিপঞ্জর একেবারে চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার শরীরের উপর পড়ার দরুন বিলি তেমন জখম হয়নি।

অবশ্য তার কাঁধের ওপর সুগভীর রক্তরেখায় বিরাজ করছে ভল্লুকীর নখরচিহ্ন এবং পতনজনিত আঘাতের ফলে দেহের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে জানুর কাছে একটা গভীর ক্ষত অনর্গল রক্ত-উদগিরণ করছে বটে, কিন্তু বিলির মতো বলিষ্ঠ মানুষের পক্ষে ওই আঘাতগুলো মারাত্মক নয়।

বিলিকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হল শিকারিদের তাঁবুতে। উপযুক্ত চিকিৎসার গুণে বিলি খুব শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করেছিল।

[শ্রাবণ ১৩৭৯]

নরকের প্রহরী

সপাং!

সিন্ধুঘোটকের চামড়ার ভারী চাবুক সশব্দে নামল বিশাল কুকুরটার পিঠে–একগোছা লোম কেটে উড়িয়ে মাংসের মধ্যে চেপে বসল চাবুক, কুকুরটা বসে পড়ল বরফের উপর, তার পেটের মাংসপেশি তখন থর থর করে কাঁপছে!

আবার! আবার! বার বার আছড়ে পড়ল চাবুক। কুকুরটার দুই কান চেপটা হয়ে মিশে গেল মাথার খুলির সঙ্গে, তুষার ভেদ করে তলার শ্যাওলার উপর চেপে বসল পায়ের নখগুলো–আক্রমণের সংকেত?…

সপাং!

আবার পড়ল চাবুক; সঙ্গেসঙ্গে কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল চাবুকধারী রেড ইন্ডিয়ানটির উপর। একটা হিংস্র চাপা গর্জন–পরক্ষণেই ছুরির মতো ধারালো দাঁতগুলো ছিঁড়ে ফেলল নরম মাংসের আবরণ, চাবুকের আস্ফালন হল স্তব্ধ। চাবুকধারী তার হাতের চাবুক ফেলে দুই হাতে গলার ক্ষতস্থান চেপে ধরে বসে পড়ল, বিদীর্ণ কণ্ঠের রক্তধারায় লাল হয়ে গেল হাতের দস্তানা।

আহত রেড ইন্ডিয়ান পেশায় ছিল স্লেজ-গাড়ির চালক। অবাধ্য কুকুরকে যেভাবে পেশাদার, চালকেরা শায়েস্তা করে, সেইভাবেই লোকটি বশ করতে চেয়েছিল বিশাল জন্তুটাকে। কিন্তু কুকুরটা চাবুকের শাসন মানল না, বিদ্রোহ করল এবং তার ফলেই রক্তাক্ত দুর্ঘটনার সূত্রপাত।

অন্যান্য রেড ইন্ডিয়ানরা আহত মানুষটির সামনে থেকে কুকুরটাকে টেনে সরিয়ে দিল। আর তখনই তার নামকরণ হল মামালুজ। আলাস্কার রেড ইন্ডিয়ানদেব ভাষায় মামালুজ শব্দটির ভাবার্থ হচ্ছে নরকের প্রহরী। রেড ইন্ডিয়ান জাতির কয়েকটি গোষ্ঠীর প্রচলিত বিশ্বাস যে, নরকের দ্বার রক্ষা করে একটি প্রকাণ্ড কুকুর। মামালুজ নামকরণ থেকেই বোঝা যায় কুকুরটা স্থানীয় মানুষের মনে দারুণ আতঙ্কের সঞ্চার করেছিল। সেখানকার মানুষ নরকের কুকুরকে আবার নরকে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অর্থাৎ তারা কুকুরটাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।

কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কার্যে পরিণত হওয়ার আগেই অকুস্থলে উপস্থিত হল এক পেশাদার স্লেজ-চালক, নাম তার লয়েড়. এ. স্মিথ।

ঘটনা যেখানে ঘটেছে, সেই আলাস্কার বিস্তীর্ণ তুষারাবৃত তুন্দ্রা অঞ্চলে কুকুর–টানা স্লেজ-গাড়ি ছাড়া অন্যান্য যানবাহন একেবারেই অচল। সেখানকার প্রচণ্ড ঠান্ডায় ঘোড়া অথবা খচ্চর খুব বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না। যে কুকুরগুলো স্লেজ গাড়ি টানে,তাদের বিশেষভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। স্লেজ-বাহক কুকুরগুলো হাস্কি নামে অভিহিত। বিশেষ জাতের ওই কুকুরগুলো অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু, কিন্তু ভীষণ হিংস্র। নেকড়ের মতো ভয়ানক ওই কুকুর দিয়ে গাড়ি চালানোর কাজটা সহজ নয়। দেহে আর মনে যথেষ্ট শক্তি না-থাকলে স্লেজ-গাড়ির চালক হওয়া যায় না। স্থানীয় ভাষায় স্লেজ-চালককে বলা হয় মশার। স্মিথ নামে যে আমেরিকান যুবকটির কথা বলা হচ্ছিল, সেও একজন মশার। ওই অঞ্চলের নানা জায়গায় ডাকবিভাগের চিঠিপত্র, টাকাপয়সা পৌঁছে দেওয়ার ভার নিয়েছিল সে।

রেড ইন্ডিয়ানদের যে-গ্রামে মামালুজ ছিল, সেইখানে হঠাৎ এসে পড়ল স্মিথ তার কুকুর টানা স্লেজ-গাড়ি নিয়ে। সে যাচ্ছিল সল্ট ওয়াটার ল্যান্ড নামে জায়গাটাতে চিঠি বিলি করতে গ্রামটা তার যাওয়ার পথে পড়েছিল। যে-লোকটি মামালুজকে গুলি করে মারতে যাচ্ছিল, সে স্মিথকে জন্তুটা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করল। ওই লোকটির বক্তব্য থেকে স্মিথ জানতে পারল কুকুরটার কাছে আদর-ভালোবাসার মুল্য নেই কিছুমাত্র; ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মধ্যে যারা আদর করে তার পিঠ চাপড়াতে গেছে, তাদের হাতে-পায়ে মামালুজের দাঁতের দাগ এখনও বর্তমান। স্লেজবাহক কুকুরদের এক দলপতি মামালুজের বরাদ্দ খাদ্যে ভাগ বসাতে গিয়েছিল। ফল হল ভয়াবহ তৎক্ষণাত দলপতিকে হত্যা করেছিল মামালুজ।

বহুদিন শিক্ষা দেওয়ার পর স্লেজবাহক কুকুরদের দলপতি হিসাবে একটি কুকুরকে গড়ে তোলা যায়। টাকার দিক থেকে ধরলেও একটি শিক্ষিত দলপতি কুকুরের দাম বড়ো কম নয়, অতএব দলের নেতা কুকুরটিকে হত্যা করে মামালুজ যে মালিককে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। তারপর রেড ইন্ডিয়ান স্লেজ-চালকের উপর আক্রমণ চালিয়ে তার গলায় কামড় বসানোর ঘটনাও জানতে পারল স্মিথ। আগন্তুকের কাছে মামালুজ সম্পর্কে যাবতীয় ভীতিপ্রদ তথ্য পরিবেশন করে গ্রামের মানুষটি জানাল কুকুরটা হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিতে তারা বাধ্য হয়েছে।

জন্তুটাকে দেখে স্মিথ আকৃষ্ট হল। এমন বলিষ্ঠ কুকুরকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারলে তাকে দিয়ে ভালোভাবেই প্রয়োজনীয় কাজ করানো যাবে।

অবশ্য কুকুরটার স্বভাবচরিত্র সুবিধের নয়, তার সাহচর্য দস্তুরমতো বিপজ্জনক–স্মিথ পাক্কা মশার, বিপদের ভয়ে এমন চমৎকার জানোয়ারটাকে হাতছাড়া করতে সে চাইল না। সুতরাং স্মিথ যখন গ্রাম ছেড়ে গন্তব্যস্থলের দিকে যাত্রা করল, তখন দেখা গেল তার সঙ্গে চলেছে কুখ্যাত নরকের প্রহরী মামালুজ!

খুনি দুর্নাম থাকা সত্ত্বেও কুকুরটার প্রতি স্মিথের আকৃষ্ট হওয়ার কারণ ছিল। মামালুজ নামে হাস্কি কুকুরটার শরীরে মেদের চিহ্ন ছিল না একটুও। আগাগোড়া শক্ত হাড় আর পেশিবদ্ধ শরীরের ওজন ছিল ১০০ পাউন্ড। বিশেষ করে তার চারটি পা ছিল অসাধারণ শক্তিশালী। যারা কুকুর চেনে, তারা মামালুজের মুখের দিকে একবার চাইলেই বুঝতে পারত জন্তুটা সাধারণ কুকুরের চাইতে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তার চোখে-মুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির আভাস অতিশয় স্পষ্ট। এমন একটা জন্তুকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারলে স্লেজ-চালকের মস্ত লাভ তাই মামালুজকে দলের নেতা হিসাবে গড়ে তোলার সংকল্প নিয়েছিল মশার স্মিথ।

যাত্রা শুরু করার পরের দিনই মামালুজ তার হিংস্র স্বভাবের পরিচয় দিল–স্মিথের একটা হাতের উপর পড়ল দন্তাঘাতের চিহ্ন! সপ্তাহটা শেষ হওয়ার আগেই তার নিতম্ব থেকে উরু পর্যন্ত আরও একটা দীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিল মামালুজের ধারালো দাঁত!

স্মিথের বন্ধুরা তার পছন্দকে তারিফ করতে পারল না। তারাও স্লেজ-চালক মশার-বরফে ঢাকা দুর্গম তুন্দ্রার পথে পথে নির্মম তুষার-ঝটিকা ভেদ করে খানাখন্দ পেরিয়ে কুকুরটানা স্লেজ-গাড়ি চালাতে তারা অভ্যস্ত কিন্তু এই নির্ভীক দুর্দান্ত মানুষগুলো মামালুজ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে লাগল। তাদের মতে এই খুনি জন্তুটাকে বিদায় না-দিলে ভবিষ্যতে স্মিথের বিপদ অনিবার্য।

স্মিথ কারো কথায় কর্ণপাত করল না। শীতের মাঝামাঝি সময়ে তার বাঁ-হাতে পুরোবাহুর উপর মামালুজ আবার তার দাঁতের চিহ্ন রাখল এবং দলের একটি কুকুর মারা পড়ল মামালুজের নিষ্ঠুর দন্তাঘাতে। স্মিথ তবুও অবিচল। মামালুজ তখন শকটবাহী কুকুরদের নেতা। তাকে নিয়ে স্মিথ গর্ব করতেও ছাড়ত না।

জন্তুটা ভীষণ বদরাগী, স্মিথ বলত, কিন্তু সে পথ চলতে জানে। আমার চাইতেও ভালোভাবে সে পথের সন্ধান করতে পারে। বরফের তলায় গভীর খাদের মরণফঁদ এড়িয়ে চলার ক্ষমতা জন্তুটার আছে। নেতৃত্ব করার জন্যেই জন্মগ্রহণ করেছে মামালুজ।

কেটে গেল জানুয়ারি মাসের শীতার্ত দিনগুলো; এল ফেব্রুয়ারির অনিশ্চিত আবহাওয়া। সুৎমা নামক দিগন্তবিস্তৃত সমতলভূমি দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে তুষার-ঝটিকার মুখে পড়ল স্মিথ। আশেপাশে সব কিছু তখন তুষারের আবরণে অদৃশ্য। মামালুজের উপরেই পথ চলার সম্পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করল নিরুপায় স্মিথ। মামালুজ তার প্রভুকে নিরাশ করেনি তার নির্ভুল নেতৃত্ব দুর্গম তুন্দ্রা অঞ্চলের বরফঢাকা মৃত্যুফাঁদ এড়িয়ে দশ মাইল রাস্তা পার হয়ে স্লেজ গাড়িটাকে পৌঁছে দিল অরণ্যের প্রবেশপথে।

কিন্তু তারপরই এল সেই বীভৎস দিন, নরকের প্রহরী যেদিন তার সম্বন্ধে যাবতীয় ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে প্রায় সত্য বলে প্রমাণ করে দিল…

স্যালকিনা হিমবাহের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে উন্মত্ত বাতাস, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতো তুষারের আবরণে দৃষ্টির অন্তরালে অদৃশ্য হয়েছে স্যালকিনার সুগভীর মরণফাঁদগুলো, মাংসের মধ্যে যেন কেটে বসতে চাইছে মেরুপ্রদেশের হিমশীতল বায়ু… শকটবাহী কুকুরদের লোমে বরফ জমে গিয়ে ঝুলছে ফিতের মতো, মুখের কালো লোম বরফে সাদা, চোখের উপর বরফ জমে জন্তুগুলোর অবস্থা প্রায় অন্ধের মতো… তাদের মালিক স্মিথের অবস্থাও তার পোষ্যদের চাইতে ভালো নয়।

হিমবাহ স্যালকিনা–

বন্ধুর গিরিখাতে পরিপূর্ণ উত্রাই-এর পথ। সেই পথ বেয়ে স্লেজ গাড়িটাকে চালিয়ে দিয়েছিল স্মিথ। স্লেজের তিন দাঁতওয়ালা গতি-নিরোধক ব্রেকটা চেপে ধরেছিল সে, কিন্তু হিমবাহের বরফ এত মসৃণ আর শক্ত যে, ব্রেকের দাঁত কিছুতেই সেই কঠিন বরফ কেটে ভালোভাবে বসতে পারছিল না। স্লেজগাড়ির রানার (ইস্পাতের সমান্তরাল ফলক, যার উপর ভর করে স্লেজ চলে) দ্রুত গতিতে বরফের উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই বরফের রং কোথাও ইবনাইটের মতো মসৃণ কালো, কোথাও-বা সমুদ্রের মতো সবুজ। কখনো কখনো গভীর গিরিখাতের কাছ ঘেঁষে গাড়িটা পার হচ্ছিল। স্মিথের তখন আতঙ্কে শ্বাসরোধের উপক্রম। একটা নড়বড়ে জীর্ণ সাঁকো বাতাসে দুলছিল; অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে কুকুর-বাহিনীর স্লেজ-গাড়ি সেটাকে পার হয়ে গেল। ধীরেসুস্থে পার হতে গেলে সেই সাঁকোটা নির্ঘাত ভেঙে পড়ত হুড়মুড় করে।

দলপতি মামালুজ সম্পর্কে একটা সশ্রদ্ধ মনোভাব গড়ে উঠেছিল স্মিথের মনে, আর ঠিক সেই সময়েই দুর্ঘটনার সূত্রপাত।

পাহাড়ের গায়ে দুটি ফাটলের সন্ধিস্থলে পৌঁছে যাত্রাপথ স্থির করতে একটু দ্বিধায় পড়েছিল মামালুজ, মুহর্তের জন্য সে থমকে গিয়েছিল। ব্লেজার নামে যে-কুকুরটা এতক্ষণ তার গা ঘেঁষে চলছিল, সে হঠাৎ মামালুজের পিছনের পায়ের উপর কামড় বসাল। ব্লেজার ছিল বর্ণসংকর, সাইবেরীয় আর এস্কিমো রক্তের সংমিশ্রণে তার জন্ম, যেমন প্রকাণ্ড শরীর তেমনই প্রচণ্ড শক্তি দলপতির দ্বিধার ভাবটা সে অমার্জনীয় ত্রুটি বলেই মনে করেছিল। কিন্তু ওই কামড়টা যে তারই মৃত্যুর পরোয়ানা বহন করে আনবে, সেটা বোধ হয় তার জানা ছিল না। আর সেই নৃশংস মৃত্যুদণ্ডকে কার্যকরী করা জন্য ওই জায়গাটার চাইতে উপযুক্ত স্থানও বোধ হয় আর পাওয়া যেত না।

কুকুরগুলোর ঝটাপটির মাঝখানে স্মিথ প্রাণপণে ব্রেক চেপে ধরেও বারো ফুট লম্বা মালপত্র-ঠাসা ভারী স্লেজটাকে সামলাতে পারছিল না–ধীরে ধীরে গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছিল পাশের অতলস্পর্শী গিরিখাদের দিকে। তবু মরিয়ার মতো স্লেজটাকে আটকে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল স্মিথ। কুকুরগুলোর লড়াই দেখার সময় বা সুযোগ ছিল না তার, তবে তাদের ভয়ংকর চিৎকার শুনে স্মিথ বুঝতে পারছিল যে, ওখানে চলছে এক মৃত্যুপণ লড়াই। মুহূর্তের মধ্যে নয়টি কুকুরের কণ্ঠে জেগেছে ক্রুদ্ধ গর্জন, শুরু হয়েছে ঝটাপটি আর রক্তাক্ত তাণ্ডব…

স্মিথ প্রাণপণে চিৎকার করে মামালুজকে ডাকল একবার। কিন্তু ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে তার গলার আওয়াজ ডুবে গেল। খুব ধীরে ধীরে স্লেজটা তখন এগিয়ে চলেছে খাতের দিকে। সারমেয় বাহিনীর যোদ্ধাদের সেদিকে দৃষ্টি নেই, তারা তখনও যুদ্ধ করছে আর তাদের সমবেত ওজনে স্লেজের সামনের দিকটা নেমে যাচ্ছে তলার দিকে। স্মিথের চোখের পাতার উপর বরফ জমে গেছে, তারই ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে অনেক কষ্টে অবস্থাটা বুঝবার চেষ্টা করছে সে। আর মাত্র ফুটখানেক এগিয়ে গেলেই স্মিথকে স্লেজ ছেড়ে লাফিয়ে পড়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে, গাড়িটাকে বাঁচানোর কোনো উপায়ই থাকবে না। এই অবস্থার মধ্যেও সে স্লেজের সঙ্গে বাঁধা কুকুরগুলোর লাগাম কেটে দেওয়া কথা ভাবল–কিন্তু পরক্ষণেই বুঝল বড়ো দেরি হয়ে গেছে, এখন লাগাম কেটে দিয়েও জন্তুগুলোকে বাঁচানো যাবে না, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই স্লেজ সমেত এক-শো ফুট নীচে আছড়ে পড়ে শেষ হয়ে যাবে তারা।

স্মিথ আবার চিৎকার করে উঠল। স্লেজটাও যেন দুলে উঠল একবার, তারপর হঠাৎ থেমে গেল। মামালুজ এবার সাইবেরীয় কুকুরটার গলায় কামড় বসিয়েছে। গিরিখাতের গা ঘেঁষে বরফের একটা উঁচু জায়গায় অবিশ্বাস্যভাবে আটকে গিয়ে স্লেজ-গাড়িটা অনিবার্য পতন থেকে বেঁচে গেছে!….

স্মিথ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে কুকুরগুলোকে চালিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে এল সে। বর্ণসংকর কুকুরটার প্রাণহীন প্রকাণ্ড দেহটা ততক্ষণে বরফের উপর শক্ত হয়ে গেছে। আরও দুটো কুকুর অতিকষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। স্মিথ তাদের বাঁধন খুলে গাড়ির উপর তুলে নিতে বাধ্য হল। অন্যান্য কুকুরগুলো তখন রক্তাক্ত ক্ষতস্থান চাটছিল আর দলপতির দাঁত-খিচানো নির্দেশের জবাব দিচ্ছিল একইভাবে দাঁত খিঁচিয়ে!

স্মিথ মশারদের উপাস্য সব সাধুসন্তদের নামে শপথ নিয়ে স্থির করল যে, রিলিফ কেবিন-এ পৌঁছেই সে মামালুজকে শেষ করবে। একটা খুনি কুকুরের সৌন্দর্যের মোহে পড়ে নিতান্ত নির্বোধের মতো বিচার-বিবেচনা বিসর্জন দিতে বসেছিল সে।

হিমবাহের পথে এই বিপর্যয় আর কুকুরগুলোর ক্ষয়ক্ষতির জন্য রিলিফ কেবিনে পৌঁছাতে তার বেশ রাত হয়ে গেল। মামালুজ ছাড়া সব কুকুরদের খেতে দিল স্মিথ। মামালুজকে খেতে দেওয়া তো দূরের কথা, তার দিকে ফিরে একটা কথাও বলল না সে। মামালুজ তার রক্তিম বাদামি চোখে প্রতিবাদ আর অনুযোগের আগুন জ্বালিয়ে বার বার নীরবে দৃষ্টিপাত করছিল স্মিথের দিকে সে বোধ হয় বুঝতে পেরেছে তার বরাতে কী ঘটতে চলেছে…

রিলিফ কেবিনের কাছে তুষার-ঝড় নেই। আকাশ পরিষ্কার। চাঁদের আলোয় রাতের পৃথিবী প্রায় দিনের মতোই স্পষ্ট। খুনি কুকুরটার চোখের দিকে তাকিয়ে স্মিথ রাইফেল তুলল। অন্য কোনো কুকুর এই অবস্থায় পড়লে ভয়ে কুঁকড়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত, কিন্তু মামালুজ বিন্দুমাত্র ভয়ের ভাব দেখাল না। জ্বলন্ত চোখে স্মিথের দিকে তাকিয়ে সে যেন বলতে চাইছে, হাতে বন্দুক না-থাকলে তোমার বীরত্বের বহর দেখে নিতাম। কুকুরটার বেপরোয়া ভাব দেখে স্মিথের মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছিল, রাইফেলের মাছির দিকে তাকিয়ে লক্ষ স্থির করার চেষ্টা করলেও তার হাত কঁপছিল–

কুকুরটা শান্তভাবে দাঁড়িয়ে চরম আঘাতের জন্য অপেক্ষা করছে, তার আচরণে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই! স্থিরদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে স্মিথের দিকে!…

স্মিথের মনে হল মামালুজ বলতে চাইছে, আমার যা কর্তব্য বলে মনে হয়েছে, তাই করেছি আমি। আমার স্বভাবটাই এমন। কী করব বল? তার জন্য যদি আমায় শেষ করে দিতে চাও, তবে তাই করো।

স্মিথের আঙুল রাইফেলের ট্রিগারে চেপে বসেছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই ট্রিগার টিপে গুলি ছুঁড়তে সে পারল না। সে স্পষ্টই বুঝতে পারছিল কুকুর হলেও মামালুজ তার চাইতে অনেক বেশি সাহসী। স্মিথ স্থির করল এবারের গন্তব্যস্থল ফোর্ট এগবার্টে গিয়ে পৌঁছানো পর্যন্ত কুকুরটার মৃত্যুদণ্ড সে মুলতুবি রাখবে। আপাতত শ্রান্ত দেহকে বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন, অতএব শয্যার আশ্রয় গ্রহণ করল স্মিথ। বিছানায় শুয়েও সহজে ঘুম এল না, সে ভাবতে লাগল তার বন্ধুরা এবার কী বিদ্রুপের হাসিই-না হাসবে এই ব্যাপারটা নিয়ে!…

হঠাৎ কুকুরদের ভয়ংকর গর্জনের আওয়াজে স্মিথের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে তার মনে হল কোনো জন্তুজানোয়ার হয়তো কুকুরগুলোর কাছে এসে পড়েছে। পরক্ষণেই ভুল ভাঙল একটি লোকের ভারী পায়ের শব্দ আর মামালুজের গম্ভীর গর্জনধ্বনি ভেসে এল তার কানে!

চটপট বিছানা থেকে উঠে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে তার টর্চটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করছিল স্মিথ, হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল ঘরের দরজা। খোলা দরজা দিয়ে চাঁদের আলো ঝাঁপিয়ে পড়তেই ঘরের অন্ধকার দূর হয়ে গেল, আর কুকুরগুলোর চিৎকারের কারণটাও তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল স্মিথ। ফারের টুপি আর ডেনিমের পার্কা পরা খুব লম্বা-চওড়া একটা লোক প্রায় সমস্ত দরজাটা জুড়ে দাঁড়াল এবং স্মিথের বুক লক্ষ করে তুলে ধরল হাতের রাইফেল। তার ঠিক পিছনেই একটা লোক সঙ্গীর কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি মেরে ঘরের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করতে লাগল। রাইফেলধারীর মুখে কালো রং-এর ছাঁটা দাড়ি, তার জ্বলন্ত দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে স্মিথের বুকের উপর। লোকটার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে স্মিথ হঠাৎ পিছন দিকে লাফিয়ে পড়ে নিজের রাইফেলটার জন্য হাত বাড়াল।

তৎক্ষণাৎ সগর্জনে অগ্নিবর্ষণ করল আগন্তুকের রাইফেল। সঙ্গেসঙ্গে কাঁধের বাঁ-দিক থেকে একটা যন্ত্রণার অনুভূতি স্মিথকে প্রায় অসাড় করে দিল। আবার গর্জে উঠল আততায়ীর আগ্নেয়াস্ত্র। দ্বিতীয়বারের আঘাত সহ্য করতে পারল না স্মিথ, অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর…

জ্ঞান ফিরে আসার পর প্রথমেই যে অনুভূতিটা স্মিথকে দংশন করল, তা হচ্ছে নিদারুণ ঠান্ডার অনুভূতি। অসহ্য শীত তাকে কাঁপিয়ে তুলেছে–কেবিনের দরজা খোলা, ঘরের কোণে অগ্নিকুণ্ডটা নিবে গেছে অনেক আগেই। প্রাণপণ চেষ্টা করে সে তার আড়ষ্ট শরীরটা মেঝে থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে কোনোরকমে পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াল। আহত দেহ প্রতিবাদ জানাল তৎক্ষণাৎ শরীরের বাঁ-দিকে, বিশেষ করে বাঁ-হাতের উপর দিয়ে তীব্র যন্ত্রণার ঢেউ খেলে গেল। ডান হাতটাও কাঁপছিল, তাই দিয়েই বাঁ-দিকের ক্ষতস্থানটা পরখ করার চেষ্টা করল স্মিথ

রাইফেলের প্রথম গুলিতে বাঁ-কাঁধের হাড় ভেঙে গেছে, জামাকাপড়ের তলায় পশমের অন্তর্বাস রক্তে ভেজা, দারুণ ঠান্ডায় রক্তসিক্ত পশমের টুকরোটাকে বরফ দিয়ে তৈরি বলে মনে হচ্ছে সমস্ত শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণায়। দ্বিতীয় গুলিটা বাঁ-হাতের উপরের অংশ ভেদ করে চলে গেছে, তবে হাড় ভাঙেনি।

খানিকটা এগিয়ে গিয়ে চুল্লির আগুনটা আবার জ্বালাতে গিয়ে তিন-তিনবার মেঝের উপর পড়ে গেল স্মিথ। ফলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে সে বাধ্য হল। শারীরিক কষ্টের উপর ছিল মানসিক দুশ্চিন্তা। রাইফেলটা নেই, পিছনে রাখা নীল-সাদা ডোরাকাটা থলেগুলো উধাও! বাইরের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে স্মিথ স্লেজ-গাড়িটাকে দেখতে পেল না, অর্থাৎ গাড়িটাকেও নিয়ে গেছে লুঠেরাগুলো!

ডাকগাড়ি লুঠ! ডাকাতরা আসলে কোন জিনিসটা নিতে এসেছিল? বেয়ারভ্যালি মাইনিং কম্পানির ঠিকানায় রেজিস্ট্রি করে পাঠানো সেই পার্সেলটাই কি?

সাধারণ ডাকে পাঠানো চিঠিপত্র লুঠ করে নেওয়ার লোভ কার হবে? এদিকে যে-ডাক আসে, তাতে খনিজ পদার্থ মেশানো মাটি বা পাথরের নমুনা থাকে না। মাথাটা অসম্ভব ঠান্ডা রেখে স্মিথ এসব কথা ভাবছিল আর সেইসঙ্গে লুঠেরাদের ফেলে-যাওয়া পুরানো ধরনের ছোটো বাক্সটার মধ্যে হাত গলিয়ে কিছু খাবার খুঁজে বার করার চেষ্টা করছিল। চুল্লির আঁচে শরীরের হাড়-কাঁপানো শীতের ভাব কিছুটা কেটে যাওয়ার পর স্মিথ তার ক্ষতস্থানগুলো পরিষ্কার করে ভালোভাবে বেঁধে নিল, তারপর কিছুক্ষণ ভেবে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করে ফেলল।

লুঠেরাগুলোকে তাড়া করে ধরে ফেলা সম্ভব নয়। স্মিথ নিরস্ত্র, তার উপর একটা হাত তার জখম। ডাকাতগুলো খুব সম্ভব ধরে নিয়েছে সে মরেই গেছে গুলি খেয়ে। কুকুরগুলো সমেত স্লেজ-গাড়িটা পেয়ে যাওয়ায় ডাকাতদের পক্ষে এখনই লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে পলায়ন-পর্ব নিতান্তই সহজ, কিন্তু আহত দেহ নিয়ে স্মিথের পক্ষে পায়ে হেঁটে তাড়াতাড়ি ফোর্ট এগবার্টে পৌঁছে নিজের চিকিৎসায় ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে।

খাবারের একটা ছোটো প্যাকেট বানিয়ে নিয়ে স্মিথ কেবিন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ফোর্ট এগবার্টের রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে যাবে বলেই মনস্থ করেছিল সে, কিন্তু বাইরে এসে বরফের উপর পায়ের ছাপগুলো দেখেই তারা চিন্তাধারা বদলে গেল।

পায়ের ছাপগুলো দেখে সে বুঝতে পারল ডাকাতগুলো ফোর্ট এগবার্টের দিকে যায়নি, গেছে। উলটো দিকে অর্থাৎ যেদিক থেকে স্মিথ এসেছিল সেই দিকে। তার চেয়েও উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটা হল যে, তার কুকুরগুলো মোটেই ঠিকভাবে পথ চলেনি। পদচিহ্ন দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যাত্রা আরম্ভের প্রথমদিকে অন্তত কুকুরদের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা বলে কিছু ছিল না।

ফোর্ট এগবার্টের পথ না-ধরে পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চলল হিমবাহের দিকে। বেশ কয়েক মিনিট ধরে কুকুরের এলোমেলো পায়ের দাগ পর্যবেক্ষণ করে স্মিথ বুঝতে পারল কুকুরগুলোকে ঠিকমতো ক্রমানুসারে সাজিয়ে গাড়িতে জোড়া হয়নি। আর একটু ভালো করে দেখে সে বুঝল মামালুজকে দলের প্রধান হিসাবে সারির প্রথমদিকে বাঁধা হয়নি–অতএব লুঠেরাদের যে বেশ ঝাটে পড়তে হবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। স্মিথের সারমেয়বাহিনী সম্পর্কে সঠিক ধারণা না-থাকলে কারো পক্ষে তাদের পর পর ঠিকমতো সাজিয়ে গাড়িতে জোড়া অসম্ভব, আর নেতৃত্বের পদটা বিনা প্রতিবাদে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র মামালুজ নয়।

স্মিথ তার আহত কাঁধকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য থেমে গিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। ডাকাতদের সঙ্গে দৈবাৎ দেখা হয়ে গেল সে কী করতে পারে? এদিকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারলে মৃত্যু অনিবার্য। ।

হঠাৎ একটু দূরে পাথরের উপর একটা চিহ্ন স্মিথের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এগিয়ে গিয়ে চিহ্নটা ভালো করে পরীক্ষা না-করেই ওখানে কী ঘটেছিল অনুমান করতে পারছিল স্মিথ। বরফের উপর ফুট দুই জায়গা জুড়ে একটা ছোটো গর্তের মতো ছিল, এলোমেলো পায়ের দাগে সেই জায়গাটা বিপর্যস্ত বেশ বোঝা যাচ্ছে ওখানে একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে। ধবধবে সাদা বরফের উপর রক্তের চিহ্ন আর গোছ গোছ কুকুরের লোম ছড়িয়ে আছে এখানে-ওখানে। মানুষের পায়ের দাগও রয়েছে। একটা লোকের কনুইয়ের দাগও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওখানে নিশ্চয়ই লোকটা উলটে পড়ে গিয়েছিল।

দাগটার ওপারে রক্তের ফোঁটাগুলো বেশি ঘন। কনুইতে ভর করে উবু হয়ে আরও ভালো করে দাগগুলো দেখে স্মিথ বুঝতে পারল দুটো কুকুর কামড়াকামড়ির ফলে আহত হয়েছে, আরও দুটো কুকুর পথ চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আগের দিন হিমবাহের পথ ধরে আসার সময়ে যে-দুটো কুকুরের পায়ে চোট লেগেছিল, এই পদচিহ্নগুলো নিশ্চয়ই তাদের।

আর একটা চিহ্ন দেখে স্মিথ সবচেয়ে খুশি হল–স্লেজ-গাড়ির রানার যাওয়ার মসৃণ দাগটার উপর ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়েছে, অর্থাৎ গাড়ির পিছনে যারা হেঁটে আসছিল সেই ডাকাত দুটোর মধ্যে অন্তত একজন জখম হয়েছে।

অনেকক্ষণ পথ চলার পর স্মিথ যখন বিপদসংকুল হিমবাহের শেষ প্রান্ত অতিক্রম করছে, বেলাশেষের স্নান আলো তখন বিদায় নিতে চাইছে পৃথিবীর বুক থেকে। একটু পরেই জ্যোৎস্নার আলোকধারা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। খাবারের প্যাকেট থেকে শুকনো মাংস নিয়ে চিবোতে চিবোতে সামনের দিকে পা ফেলে এগিয়ে চলল স্মিথ…

এ কী! ওটা কি রিলিফ কেবিন?… হ্যাঁ, রিলিফ কেবিনই বটে। ঘরের ভিতরের আলো জানালার পথে স্মিথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু ওখানে আলো জ্বলছে কেন? আরে! স্লেজ-গাড়িটাও যে দেখা যাচ্ছে দরজার কাছে! ডাকাত দুটো তাহলে ওই রিলিফ কেবিনের মধ্যেই রাত কাটাবে নাকি? স্মিথ ঠিক করল চুপি চুপি দরজার কাছে রাখা স্লেজ-গাড়িটার কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখবে তার মধ্যে বন্দুক আছে কি না। সৌভাগ্যের বিষয়, কেবিনটার যে-ঘরে আলো জ্বলছিল, কুকুরদের থাকার ঘরটা তার পিছন দিকে–অতএব কুকুরদের কাছে তার ধরা পড়ার ভয় নেই। কুকুরগুলো মনিবকে দেখে চিৎকার করলে স্মিথ ডাকাতদের চোখেও ধরা পড়ে যাবে, কিন্তু এখন আর সেই ভয় নেই বুঝে সে নির্ভয়ে অগ্রসর হল…

স্লেজ-গাড়িটা খুঁজে স্মিথ হতাশ হল। গাড়ির সব জিনিসই ভিতরে নিয়ে গেছে লোকদুটো। মনে মনে ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়ে স্মিথ কেবিনের যে-কোণ থেকে কুকুরগুলোকে দেখা যায় না, নিঃশব্দে সেই কোণটায় গিয়ে পৌঁছাল।

স্মিথের বাঁ-হাত অকেজো, ডান হাত দিয়ে খুঁড়িতে তৈরি কেবিনের দেয়ালে একটা জোড় থেকে আলগা কিছু শ্যাওলা নীচের দিকে ঝরিয়ে ফেলে দিল স্মিথ। তৎক্ষণাৎ জোড়ের ফাঁক দিয়ে বাইরে এসে পড়ল সরু এক ফালি আলো। সেই ফাটলে চোখ রেখে ঘরের ভিতরই দেখার চেষ্টা করতে লাগল স্মিথ

ঘরের এককোণে মরচে-ধরা লোহার চুল্লিতে আগুন জ্বলছে… পিছন দিকের দেয়ালে যাত্রীদের শয়ন করার জন্য যে দুটো বড়ো বড়ো তাক আছে, তার একটার উপর পশমের জামাকাপড় আর ডাকের থলেগুলো গাদা করে রাখা… ছুঁচলো-মুখে দাড়িওয়ালা লোকটা অন্য তাকটাতে বসে। পাশে-রাখা একটা ডাকের থলে থেকে চিঠিপত্র বার করে সেগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে…অন্য লোকটা একটা টেবিলে বসে আছে, সেও চিঠি দেখতে ব্যস্ত…

হঠাৎ দুটো রাইফেলের উপর স্মিথের নজর পড়ল। দুটোর মধ্যে একটা তার নিজের রাইফেল। টেবিল আর তাকের মাঝখানে দেয়ালে হেলান দিয়ে দস্যুদের হাতের খুব কাছাকাছি জায়গায় রাইফেল দুটো রাখা হয়েছে।

স্মিথ সোজা হয়ে দাঁড়াল। ঠান্ডায় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার কেঁপে উঠল। এতক্ষণ লোক দুটোকে অনুসরণ করে দ্রুত পথ চলার ফলে তেমন ঠান্ডা লাগেনি, এখন বাইরের হিমশীতল আবহাওয়া স্মিথের হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। আবার ফাটলটা দিয়ে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে স্মিথ দেখতে পেল টেবিলে-বসা লোকটা ঘুরে বসেছে, তার পরনের প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত চিরে গেছে, আর সেই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে লোকটার পায়ের উপর জড়ানো রয়েছে একটা রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ।

স্মিথ আর একবার ঘরের চুল্লিটার দিকে চেয়ে দেখল আগুন ভালোভাবেই জ্বলছে। কাছেই ঘন গাছপালায় ঘেরা একটা জায়গার মধ্যে স্মিথ গা-ঢাকা দিল… ।

একটা পাতা-ঝরা শুকনো বার্চ গাছের ছাল ছুরি দিয়ে ফুটখানেকের মতো কেটে নিয়ে স্মিথ সেটাকে উলটোদিকে গুটিয়ে সোজা করে নিল, তারপর ছালটাকে কেবিনের এককোণে রেখে দিয়ে পা টিপে টিপে কুকুরদের থাকার জায়গাটায় উপস্থিত হল।

গর্জিত কণ্ঠের ঐকতানে কুকুররা স্মিথকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল। শঙ্কিত হয়ে গলায় যতদূর সম্ভব মধু ঢেলে স্মিথ তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। চেষ্টা প্রায় সফল হল, মামালুজ ছাড়া দলের অন্য কুকুরগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই চুপ করল। মামালুজের ক্রুদ্ধ কণ্ঠ তবুও স্তব্ধ হল না।

কেবিনের পিছন দিকের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল, বাইরে ছুটে এল এক ঝলক আলো। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে স্মিথ চটপট একটা ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিল।

একটি লোক এগিয়ে এল, কুকুরগুলোর আশেপাশে চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিল, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই তার চোখে পড়ল না। কুকুরদের উদ্দেশে গালাগালি দিতে দিতে লোকটি আবার প্রবেশ করল ঘরের মধ্যে।

স্মিথের শরীরের পেশিগুলো টান টান হয়েছিল–লোকটি ঘরে ঢুকতেই সে ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এল মামালুজের দিকে। এবার তাকে শান্ত করতে বিশেষ অসুবিধা হল না। প্রথমে অবশ্য খুনি কুকুরটা স্মিথের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করেছিল, কিন্তু মিষ্টি কথায় তোয়াজ করে মাথায় দুই-একবার হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর মামালুজ আবার স্বাভাবিকভাবে উঠে দাঁড়াল। মুখ তুলে একবার যেন লোমশ লেজটাও নেড়ে ফেলল মামালুজ। ব্যস ওই পর্যন্ত আদর-সোহাগ দেখানোর ব্যাপারটা মামালুজের ধাতেই নেই আসলে। তার একজন মনিব আছে, কাজেই তাকে মনিবের কথা শুনে চলতে হয়, এইটুকুর বেশি খাতির করার কথা ভাবতেই পারে না মামালুজ।

মামালুজের গলায় বাঁধা শিকলের অন্য প্রান্ত খুঁটি থেকে খুলে নিয়ে স্মিথ গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এল কেবিনের কোণের দিকে। সেখানে তাকে বেঁধে রেখে স্মিথ ওক গাছের ছালটা নিয়ে কেবিনের ছাতে ওঠার উদ্যোগ করল। গাছের গুঁড়ি-বাঁধা দেয়ালের বাইরের দিকে বেরিয়ে-আসা অংশগুলোতে মই-এর ধাপের মতো পা রেখে সে উঠতে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাল সামনের দিকে ঝুঁকে-পড়া ছাতটার উপর। আস্তে আস্তে এগিয়ে কেবিনের চুল্লি থেকে ধোঁয়া বার স্মিথের ফস্তিস্বর–কেউ তৈরি হল রির হাত বুলিও লোক টলতেয়ার উপক্রম হওয়ার চিমনির কাছে চলে গেল স্মিথ, তারপর গাছের ছালটা মুড়িয়ে চিমনির মধ্যে ভালো করে ঢুকিয়ে দিয়ে নলের মুখ বন্ধ করে দিল। এবার ছাত থেকে নামার পালা–নিঃশব্দে প্রায় লাফ দিয়েই সে নামল এবং মামালুজকে নিয়ে এসে দাঁড়াল জানালার কাছে…

কিছুক্ষণ পরেই কেবিনের ভিতর থেকে দমফাটা কাশির আওয়াজ ভেসে এসে জানিয়ে দিল স্মিথের ফন্দিটা বিলক্ষণ কাজে লেগেছে। আবার কাশির আওয়াজ, তারপরই শোনা গেল অপরিচিত কণ্ঠস্বর–কেউ একজন জানতে চাইছে চুল্লিটার কী হল!

এইবার আক্রমণের জন্য তৈরি হল স্মিথ। তার শরীরের প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় এখন সজাগ হয়ে উঠেছে, নীচু হয়ে মামালুজের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিল সে…।

আচম্বিতে প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল কেবিনের দরজা। দুটি লোক টলতে টলতে বাইরে বেরিয়ে এল ঘরের ভিতর মুখবন্ধ চুল্লিটার ধোঁয়ায় তাদের শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ভীষণভাবে কাশতে কাশতে বাইরের খোলা হাওয়ায় তারা শ্বাসপ্রহণের চেষ্টা করতে লাগল।

এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিল স্মিথ, তার অক্ষত ডান কাঁধ দিয়ে কেবিনের পলকা জানালায় সজোরে ধাক্কা মারল সে, সঙ্গেসঙ্গে জানালাটা কাঠামো সমেত ভেঙে পড়ে গেল ঘরের মধ্যে। ডান হাত দিয়ে মামালুজকে ভেতরে ঢুকিয়ে স্মিথও ঘরের ভিতর প্রবেশ করল…

লোকদুটো যখন দৌড়ে আবার কেবিনের মধ্যে ফিরে এল, স্মিথ তখন তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, হাতে তার উদ্যত রাইফেল।

ওদের উপর নজর রাখো, মামালুজকে নির্দেশ দিল স্মিথ।

সঙ্গেসঙ্গে হিংস্র আক্রোশে দন্তবিস্তার করে গর্জে উঠল মামালুজ। কুকুরটাকে খুনের তালিম দেওয়া আছে, স্মিথ বলল, তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে লোকদুটোর দিকে, নড়াচড়া করবার চেষ্টা করলেইও তোমাদের টুটি ছিঁড়ে ফেলবে।

ডাকাত দুটো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ডাকের থলে দুটো যে-তাকটায় রয়েছে, ওটার উপর উঠে বসো দুজনে, স্মিথ কঠিন স্বরে বলে উঠল, কোণের দিকে চুপচাপ বসে থাকো।

স্মিথের হুকুম তারা তামিল করল সুবোধ বালকের মতো। মামালুজের মুখের কাছ থেকে সরে দেয়ালের দিকে যথাসম্ভব ঘেঁষে থাকার চেষ্টা করছিল তারা। স্মিথ এবার ডান হাত থেকে রাইফেলটাকে বাঁ-হাতে সরিয়ে নিল, সঙ্গেসঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণায় তার বাঁ-কাধটা যেন ছিঁড়ে যেতে লাগল। বাঁ-হাত দিয়ে রাইফেল ছোঁড়ার ক্ষমতা ছিল না তার, নিতান্ত জরুরি একটা কাজ করার জন্যই বাঁ-হাতে রাইফেল ধরেছিল স্মিথ। সেই জরুরি কাজটা হল অন্য রাইফেলটাকে অকেজো করে দেওয়া। দ্বিতীয় রাইফেলটার লম্বা বেল্ট খুলে নিয়ে সেটাকে জানালা গলিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিল স্মিথ। এইবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরের ভিতর চারদিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করে স্মিথ  আবিষ্কার করল একটা বাটি। বাটিটা শূন্যগর্ভ নয়, বরবটির তরকারিতে পরিপূর্ণ। স্মিথের দারুণ খিদে পেয়েছিল, বাটি থেকে কয়েকটা বরবটি নিয়ে সে মুখে দেওয়ার উদ্যোগ করল।

ডাকাতদের মধ্যে কালো দাড়িওয়ালা লোকটা আক্রমণের সুযোগ খুঁজছিল। স্মিথের বাঁ-হাতটা যে একেবারেই অকেজো হয়ে পড়েছে সে-কথা লোকদুটোকে বুঝতে না-দেওয়ার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু ধাপ্পায় কাজ হল না; কালো দাড়িওয়ালা যে-লোকটা স্মিথকে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল, সে হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে লাফ মেরে তাক থেকে নেমে এল এবং স্মিথের আহত বাঁ-হাতটা ধরে ফেলার চেষ্টা করল, কিন্তু মামালুজকে পেরিয়ে আসা সম্ভব হল না..

দারুণ আতঙ্ক আর যন্ত্রণায় লোকটার চোখমুখ তখন রক্তহীন, ফ্যাকাশে এবং তার কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে আসছে আর্তনাদের পর আর্তনাদ

মামালুজের নিষ্ঠুর দাঁতগুলো তার কাঁধ আর বাহুর মাংস কেটে ফালা ফালা করে দিচ্ছে!

প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে কোনোমতে মুক্ত করে ডাকাতটা যখন তাকের উপর তার সঙ্গীর পাশে উঠে বসল, তখন তার অবস্থা নিতান্তই শোচনীয়। নীচে দাঁড়িয়ে সগর্জনে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল মামালুজ, বোধ হয় সারমেয়-ভাষায় বলতে চাইছিল, আরেকবার চেষ্টা করে দেখবে না কি স্যাঙাৎ?…

সল্ট ওয়াটার ল্যান্ড থেকে ডাকগাড়িটা ফোর্ট এগবার্টে পৌঁছানোমাত্র চারদিকে দস্তুরমতো সাড়া পড়ে গেল। স্মিথ এবং তার স্নেজগাড়ির দুরবস্থা প্রথমেই যে-লোকটির চোখে পড়েছিল, সে-ই চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাইকে ঘরের বাইরে জড়ো করে দিল।

দৃশ্যটা সত্যি অদ্ভুত—

মৃতপ্রায় অবস্থায় গাড়ির সামনের দিকের হাতলটা ধরে কোনোরকমে বসে ছিল স্মিথ। গাড়িতে ঠাসা ডাকের থলে, পশমের কম্বল আর শীতবস্ত্রের স্তূপের উপর চেপে বসেছিল স্লেজ-গাড়ির সবকয়টি কুকুর। না সবাই নয়, একটি বাদে গাড়ির পাশ দিয়ে কুচকাওয়াজ করার দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে ধূসরবর্ণের এক কুখ্যাত কুকুর

খুনি মামালুজ!

কিন্তু তাহলে গাড়ি টানছে কারা?… না, কুকুর না, মানুষেই টানছে গাড়ি। স্লেজ-গাড়ির লাগামগুলো মানুষ দুটোর বাহুর তলা দিয়ে ঘুরিয়ে ঘাড়ের উপর দিকে বাঁধা রয়েছে, তাদের আর এখন দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। লোকদুটোর চোখমুখে নিদারুণ আতঙ্কের আভাস, তারা বার বার তাকাচ্ছিল মামালুজের দিকে। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন।

ফোর্ট এগবার্ট ব্যাঙ্কের ম্যানেজার একবার লোকদুটোর বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিথকে বললেন, এই লোক দুটো এক সপ্তাহ আগে আমাদের ব্যাঙ্কে হানা দিয়ে হেড টেলারকে গুলি করেছিল, তারপর পাঁচ হাজার ডলার লুঠ করে পালিয়ে গিয়েছিল। তোমার মালপত্রের মধ্যে সেই পাঁচ হাজার ডলার রয়েছে–তাই না?

দারুণ ক্রোধে চিৎকার করে উঠল স্মিথ, ওসব ব্যাপার আমি কিছু জানি না। তোক দুটো আমায় খুন করে ডাকের থলেগুলো লুঠ করার চেষ্টা করেছিল। আমার কুকুরগুলোকে প্রায় খোঁড়া করে দিয়েছিল ওরা। কাজেই আমার মনে হল কুকুরের কর্তব্য ওদেরই করা উচিত, তাই কুকুরগুলোকে গাড়িতে বসিয়ে আমি ওদের দিয়ে গাড়ি টানিয়েছি।

ওই খুনি কুকুরটা তাহলে ওদের রক্ষী হিসাবে ছিল?

হ্যাঁ, তা তো ছিলই। তা ছাড়া শয়তান দুটোকে ধরে ফেলার পর দু-দুবার ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।

কথাগুলো বলেই স্মিথ মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। ম্যানেজার তাকে ধরে ফেলে বলে উঠলেন, সাংঘাতিক আঘাত লেগেছে তোমার। চলো, আগে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।

ম্যানেজারের হাত ছাড়িয়ে স্মিথ কোনোমতে ঝুঁকে পড়ে তার অক্ষত হাতটা দিয়ে ত্রিভুজের মতো একজোড়া কানে মৃদু টান দিল, তারপর বলল, আগে মামালুজকে শহরের সবচেয়ে ভালো খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আলাস্কার সেরা কুকুর আমার মামালুজ।

নায়কের জন্ম

আজ থেকে বহু বৎসর আগেকার কথা…

ছত্রপতি শিবাজির নেতৃত্বে দাক্ষিণাত্যের বুকে জন্ম নিল দুরন্ত মারাঠা-শক্তি–দিল্লির বাদশাহি ফৌজের প্রচণ্ড আক্রমণকে বারংবার ব্যর্থ করে মহারাষ্ট্রের আকাশে উড়তে লাগল মারাঠার বিজয়-বৈজয়ন্তী গৈরিক পতাকা!

শিবাজির মৃত্যুর পরে মহারাষ্ট্রের কর্ণধার হলেন তার পুত্র শম্ভাজি। সেই সময় বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের হাবসি নৌবলাধ্যক্ষ সিঙ্গি ইয়াকুব খাঁ তার দুর্জয় নৌবহর নিয়ে কঙ্কন উপকূলে হানা দিল। উপকূলে অবস্থিত দুর্গগুলিকে দুর্ভেদ্য করে গড়েছিলেন শিবাজি মহারাজ, তবু খুব অল্প সময়ের মধ্যে সিঙ্গি অনেকগুলি দুর্গ অধিকার করে ফেলল। সিঙ্গি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, কিন্তু সে কৌশলীও বটে–প্রচুর উৎকোচ অর্থাৎ ঘুস দিয়ে সে দুর্গস্বামীদের বধ করে ফেলতে লাগল। ঘুসের মহিমায় বিনা যুদ্ধেই অনেকগুলি দুর্গ অধিকার করলে সিঙ্গি–অবশেষে অবরুদ্ধ হল সুবর্ণদুর্গ।

সুবৰ্ণ মোহরের লোভে সুবর্ণদুর্গের অধিপতি অচলাজি মোহিতে সিঙ্গির হাতে দুর্গ সমর্পণ করার উদ্যোগ করতে লাগলেন। দুর্গরক্ষী সৈন্যরা এ-কথা জানতে পারল কিন্তু তারা প্রতিবাদ করতে চাইল না। তারা বুঝেছিল যে উৎকোচের কিছু অংশ সৈন্যদের মধ্যেও ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে তাই যুদ্ধের কথা ভুলে মোটা বকশিশের লোভে তারা উদগ্রীব হয়ে উঠল। উদ্যত তরবারির সম্মুখে যারা বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে ভয় পায়নি সুবর্ণমুদ্রার প্রলোভন তারা জয় করতে পারল না। গভীর রাতে দুর্গের সৈন্যরা আসন্ন উৎকোচের স্বর্ণ নিয়ে কে কীভাবে তার সদ্ব্যবহার করবে তারই আলোচনায় মত্ত হয়ে উঠেছে ঠিক সেই সময়ে দুর্গের নীচে খাঁড়ির জলে নিঃশব্দে নেমে পড়ল এক নির্ভীক কিশোর…

খাঁড়ির জলে পাহারা দিচ্ছে সিদ্দির জাহাজ।

জাহাজের সৈন্যসামন্তরা কেউ জানল না যে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে একটি মনুষ্যমূর্তি অর্ণবপোতের প্রহরা ভেদ করে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে দূরবর্তী

অরণ্য-আবৃত তীরভূমির দিকে…।

সিদ্দির সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও জলবাসী রাক্ষসের ক্ষুধার্ত চক্ষুকে ফাঁকি দিতে পারল না কিশোর ছেলেটি মাত্র কয়েক হাত দূরে জলের উপর মাথা তুলে আচম্বিতে আত্মপ্রকাশ করলে এক বৃহৎ কুম্ভীর!

মস্ত বড়ো হাঁ করে কুমির তেড়ে এল কিন্তু শিকার ধরা পড়ল না–হতভাগা মানুষটা হঠাৎ জলের তলায় ডুব দিয়েছে।

এত সহজে কুমিরের মুখ থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। দূরে জলের উপর মানুষটা মাথা তুলতেই সরীসৃপ আবার আক্রমণ করলে এবার আর জলের উপর দিয়ে নয়, ডুব সাঁতার দিয়ে এগিয়ে গেল ক্ষুধার্ত কুম্ভীর…।

ছেলেটি অসাধারণ ধূর্ত, একবার শ্বাস গ্রহণ করেই সে আবার জলের তলায় আত্মগোপন করলে নির্দিষ্ট স্থানে ভেসে উঠে কুমির দেখল শিকার আবার তাকে ফাঁকি দিয়ে সরে পড়েছে।

… জল থেকে উঠে দাঁড়াল কিশোর ছেলেটি। কয়েক পা এগিয়ে এসে একটু থমকে দাঁড়াল, নিজের মনেই বললে, ডুব সাঁতার দিয়ে কুমিরটাকে ফাঁকি দিয়েছি কিন্তু সামনে আবার কী বিপদ আছে কে জানে! অনেকটা পথ যেতে হবে।

উপকূলে অবস্থিত, অন্ধকার অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করলে সেই রহস্যময় কিশোর–ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের উপর দিয়ে তার যাত্রা শুরু হল…

গভীর রাত্রি। অরণ্যের বুকে রাজত্ব করছে এখন ঘন অন্ধকার। শুধু একটুখানি জায়গায় আঁধারের যবনিকা ভেদ করে জ্বলে উঠেছে রক্তরাঙা আলোকধারা।

সেই আলোতে দেখা যায় একটি ক্ষুদ্র পর্ণকুটির এবং সেই কুটিরের দ্বারদেশে অগ্নিকুণ্ডের সম্মুখে পদ্মাসনে বসে ধ্যান করছেন এক গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী..

অকস্মাৎ নিস্তব্ধ অরণ্যের বুকে প্রতিধ্বনি তুলে জাগল এক ভয়াবহ হুংকারধ্বনি–আহ-অ-ন-ন-ন!

সঙ্গেসঙ্গে মনুষ্যকণ্ঠের, চিৎকার–খবরদার!

সাবধান! বালাজি!

সন্ন্যাসী ভ্রূ-কুঞ্চিত করলেন, মানুষের চিৎকার! বাঘের গর্জন! কিন্তু রাতের অন্ধকারে এই শ্বাপদসংকুল অরণ্যে পদার্পণ করেছে কোন মুখ?… ব্যাপারটা। দেখে আসি।

ধুনি থেকে একটি জ্বলন্ত কাষ্ঠ তুলে নিয়ে সন্ন্যাসী শব্দ লক্ষ করে অগ্রসর হলেন…

কিছুদূর এগিয়ে যেতেই তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি রোমাঞ্চকর দৃশ্য–

দুটি কিশোরকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে এক বিপুল বপু ব্যাঘ্র কিন্তু একজোড়া উন্মুক্ত তরবারির শানিত আস্ফালন অবজ্ঞা করে সে এগিয়ে আসতে সাহস করছে না, কেবল নিষ্ফল ক্রোধে বারংবার গর্জন করে প্রতিধ্বনি তুলছে নিস্তব্ধ বনানীর বুকে!

সন্ন্যাসী নির্ভয়ে এগিয়ে গেলেন, বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, এরা তোমার শিকার নয়। যাও–এখান থেকে চলে যাও।

সঙ্গেসঙ্গে পশ্চাত্বর্তী অরণ্যের দিকে তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।

দুটি কিশোর আশ্চর্য হয়ে দেখল যে বন্য ব্যাঘ্র নতমস্তকে সন্ন্যাসীর আদেশ পালন করলে। হিংস্র শ্বাপদ নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেল অরণ্যের অন্তঃপুরে!…

সন্ন্যাসী এবার কিশোর দুটির দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, তোমরা কারা? এই ভীষণ অরণ্যে

আরে! তিনি হঠাৎ বিস্মিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, বালাজি বিশ্বনাথ! তুমি এখানে?

একটি কিশোর সামনে এগিয়ে এল, করজোড়ে বললে,প্রভু! বিশেষ প্রয়োজনে আমার বন্ধুকে নিয়ে এমন অসময়ে আপনার কাছে এসেছি। বনের মধ্যে হঠাৎ আমাদের বাঘ আক্রমণ করেছিল।

বেশ করেছিল। তোমরা মুখের মতো এত রাতে কেন এখানে এসেছ? সকাল বেলা দিনের আলোতে কি আসা যায় না?

না প্রভু, দ্বিতীয় কিশোর এবার উত্তর দিল, দিনের আলোতে আসার উপায় ছিল না। সব কথা আপনাকে বললেই বুঝতে পারবেন।

এই কিশোরটি আমাদের পরিচিত। একটু আগেই সে খাঁড়ির জলে নেমেছিল।

সন্ন্যাসী বললেন, বেশ চলো। আমার কুঠিতে চলো। তবে আগে তোমার পরিচয় জানতে চাই। বালাজি বিশ্বনাথকে আমি জানি। এই মহারণ্যের কাছেই চিপলুন গ্রামের লবণগোলায় বালাজি কেরানির কাজ করে এবং ওই গোলা তার বাসস্থানও বটে কিন্তু তুমি কে? তোমার নাম কী?

প্রভু! আমি সুবর্ণদুর্গের একজন দুর্গরক্ষী আমার নাম কাহ্নোজি শংখপাল। বালাজি বিশ্বনাথ আমার বাল্যবন্ধু। আ,ই খাঁড়ির জল সাঁতরে জঙ্গল ভেঙে বালাজির গোলায় গিয়েছিলাম– আমার কথা শুনে সে আমাকে আপনার কাছে নিয়ে আসছিল। হঠাৎ বাঘটা ।

বুঝেছি। আমার সঙ্গে এসো।

হুঁ। দুর্গস্বামী অচলা মোহিতে স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে সিদ্দির হাতে দুর্গ সমর্পণ করতে চায়!

বিশ্বাসঘাতক! সন্ন্যাসী জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কাহ্নোজির মুখের দিকে চাইলেন, তুমি যা চাইছ তাই পাবে। কিন্তু সোনার লোভে তুমিও যদি বিশ্বাসঘাতকতা কর অর্থাৎ এই স্বর্ণ যদি আত্মসাৎ কর তাহলে? ।

প্রভু, আমি–

চুপ করো। শোনো। যদি তুমি বিশ্বাসঘাতকতা কর তাহলে আমি তোমায় অভিশাপ দেব। মনে রেখো আমার অভিশাপ অব্যর্থ।

জানি প্রভু। বালাজির মুখে শুনেছি চিপলুনের এক শ্রেষ্ঠী আপনার কাছ থেকে অর্থ নিয়ে আপনাকে ফাঁকি দিয়েছিল। আপনার অভিশাপে সে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছে! তা ছাড়া আমি স্বচক্ষে দেখেছি যে বনের বাঘও আপনার আদেশ পালন করে।

তোমরা অপেক্ষা করো। আমি আসছি।

অন্ধকার বনপথে সন্ন্যাসী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

কাহ্নোজি প্রশ্ন করলে, বালাজি! সত্যিই কি উনি আমাকে স্বর্ণমুদ্রা দেবেন? সংসারত্যাগী যোগী কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন এত সোনার মোহর?

বালাজি হাসল, ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী অজস্র অর্থের অধিকারী। উনি কৈশোর থেকেই সংসার ত্যাগী। প্রথম জীবনে জ্ঞান সাধনা করেছেন হিমালয়ে। কেউ জানে না কোথা থেকে তিনি এত অর্থ সম্পদ পেয়েছেন কোথায় থাকে এই ধনরত্ন তাও আজ পর্যন্ত কেউ জানত পারেনি! ব্রহ্মেন্দ্রস্বামীর কাছে অনেক ধনবান ব্যক্তিও বিপদে পড়লে ঋণ গ্রহণ করে। উনি ঋণ দেন কিন্তু চড়া সুদে। ওই ঋণ শোধ না-করলে, দেন অভিশাপ। সেই অভিশাপ অব্যর্থ।

কাহ্নোজি বললে, আশ্চর্য পুরুষ!… ওই যে উনি আসছেন।

গভীর অরণ্যের ভিতর থেকে নিঃশব্দে আত্মপ্রকাশ করলেন ব্রহ্মেন্দ্রস্বামী তার দুই হাতে ঝুলছে দুটি চামড়ার থলি।

ব্রহ্মেন্দ্রস্বামী সামনে এসে দাঁড়ালেন, কাহোজিকে উদ্দেশ করে বললেন, শোনো কাহোজি। আমি ঋণস্বরূপ অর্থ দিয়ে থাকি কিন্তু তোমাকে আমি এই থলি ভরতি মোহর দান করছি। দেশের জন্য সৎকার্যে এই অর্থ তুমি ব্যয় করবে। তবে যদি লোভের বশবর্তী হয়ে

প্রভু! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। স্বর্ণমুদ্রার চাইতে জন্মভূমির স্বাধীনতার মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি।

… খাঁড়ির পাড়ে এসে দাঁড়াল দুটি কিশোর—-বালাজি ও । কাহ্নোজি।

কাহ্নোজির দেহের সঙ্গে বাঁধা মোহরভরতি দুটি চামড়ার থলি।

বালাজি বললে, সাবধানে যাও কাহ্নোজি, জলে কুমিরের ভয় আছে।

কাহ্নোজি হাসল, আমার মাথার উপর আছে ব্রহ্মেন্দ্রস্বামীর আশীর্বাদ, কটিবন্ধে আছে শানিত তরবারি–কুমির আমায় গ্রাস করতে পারবে না।

পরক্ষণেই সে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল…

দুর্গের মধ্যে কোমল শয্যায় শুয়ে দুর্গস্বামী অচলাজি মোহিতে স্বপ্ন দেখছেন–

সোনার মোহর! রাশি রাশি সোনার মোহর! দুই হাত বাড়িয়ে অচলাজি মোহরগুলি আঁকড়ে ধরলেন।

হঠাৎ মোহরের স্তূপ থেকে একটি সাপ বেরিয়ে এসে তার দুটি হাত জড়িয়ে ধরলে।

অচলাজি টানাটানি করে হাত ছাড়াতে পারলেন না–তার মুখের সামনে ফণা বিস্তার করে গর্জে উঠল বিষধর সর্প!

আর্তনাদ করে উঠলেন অচলাজি মোহিতে আর সঙ্গেসঙ্গে তার ঘুম ভেঙে গেল–

না, সাপ নয়–একজোড়া লৌহবলয়ের মারাত্মক আলিঙ্গনে বন্দি হয়েছে তার দুই হস্ত এবং সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে কাহ্নোজি শংখপাল!

রাগে ফেটে পড়লেন অচলাজি, এর মানে কী? কাহ্নোজি উত্তর দিল, আপনাকে আমি বুন্দি করলুম। মহারাজ শম্ভাজির কাছে পরে আপনার বিচার হবে।

অচলাজি চিৎকার করে উঠলেন, ওরে কে আছিস এই শয়তানকে বন্দি কর। একজনকে পাঁচ পাঁচ মোহর বকশিশ দেব–সদাশিব! রঘুনাথ! পিংলে!

কেউ এল না।

কাহ্নোজি বললে, চেঁচিয়ে লাভ নেই। আপনি কত মোহর দেবেন? আমি প্রত্যেক দুর্গরক্ষীকে দশ মোহর করে দিয়েছি।

আমায় ছেড়ে দাও। আমি তোমায় এক-শো মোহর দেব।

সহস্র মোহর দিলেও আপনাকে ছাড়ব না। কাহোজি শংখপালের কাছে সুবর্ণের চাইতে জননী ভূমির মূল্য অনেক বেশি…

যথাসময়ে ঔরঙ্গজেবের নৌবলাধ্যক্ষ সিদ্দি ইয়াকুব খাঁ জানতে পারল যে কাহোজির হাতে বন্দি হয়েছে অচলাজি মোহিতে এবং সমস্ত চক্রান্ত হয়ে গেছে ব্যর্থ!

ক্রুদ্ধ সিদ্দি প্রশ্ন করলে, কে এই কাহ্নোজি?

একজন বললে, ওর বাবার নাম তুকোজি শংখ পাল! ওদের বাড়ি ছিল আঙ্গার ওয়াদি গ্রামে।

সিদ্দি গর্জে উঠল, আঙ্গারিয়া? আঙ্গার? ওই আঙ্গারিয়াকে দেখে নেব আমি!..।

সিদ্দির কথার প্রতিধ্বনি তুলে কাহ্নোজিকে আংগ্রে বা আঙ্গারিয়া নামে ডাকতে লাগল শত্ৰুমিত্র সবাই। কাহোজি শংখপাল ইতিহাসে পরিচয় লাভ করল ভিন্ন নামে–কাহোজি আংগ্রে!

সিদ্দি প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারেনি।

কাহ্নোজি আংগ্রের নেতৃত্বে দুর্জয় হয়ে উঠল মারাঠা নৌবহর। কেবল মুঘল শক্তি নয়, দুর্ধর্ষ ইংরেজও আঙ্গারিয়ার কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।

[ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৭৫]

নিশানা নির্ভুল

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ও আরিজোনার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ তৃণভূমির বুকে বর্তমান কাহিনির শুরু এবং পাত্র ও অপাত্রদের মধ্যে প্রথমেই যে ব্যক্তি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, সে হচ্ছে অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট এক বলিষ্ঠ পুরুষ।

অশ্বারোহী যেখানে অবস্থান করছে সেখান থেকে কিছুদূরে মাঠের ওপর ঘাস খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল গোরু। গোরুর পালের আশেপাশে ঘোড়ার পিঠে চেপে যে লোকগুলো টহল দিচ্ছে, তাদের মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায় তারা কেউ নিরীহ ভদ্রলোক নয়। ওরা হল আমেরিকার দুর্ধর্ষ কাউবয় বা গো-পালক।

প্রথমেই যে বলিষ্ঠ অশ্বারোহীর উল্লেখ করেছি, সেই মানুষ ওই গোরুর পালের মালিক এবং কাউবয়দের প্রভু। অশ্বারোহীর নাম জন চেসাম। ওই অঞ্চলের মানুষজনকে ভয় করত, এড়িয়ে চলত। ভয়টা অহেতুক নয়–জন অত্যন্ত ভয়ানক চরিত্রের লোক, সামান্য কারণেই নরহত্যা করতে সে অভ্যস্ত। তার লক্ষ্মীছাড়া চ্যালাচামুণ্ডারা ছিল তারই মতো, রাইফেল ও রিভলভারে সিদ্ধহস্ত, প্রভুর আদেশে গুলি চালিয়ে মানুষ খুন করতে তারা একটুও ইতস্তত করত না।

আইন? হ্যাঁ, আইন একটা ছিল বটে তবে যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে সরকারের আইন নিয়ে আমেরিকাতে কেউ মাথা ঘামাত না। শক্ত মুঠিতে নির্ভুল নিশানায় যে গুলি চালাতে পারত, আইনের প্রতিনিধিরা তাকে স্পর্শও করতে চাইত না। গৃহযুদ্ধের পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকার এই ছিল চেহারা।

সেদিন জন চেসামের মেজাজটা বেশ ভালো ছিল। কারণ, কয়েকদিন আগেই তার পোষা গুন্ডার দল পঞ্চাশটা গোরু চুরি করে এনেছে। মাঠের ওপর চেসামের নিজস্ব গোরুর পালের মধ্যে সেই চুরি করা গোরুগুলিও ছিল। পশুপালক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের নিজস্ব গোরুর গায়ে লোহা পুড়িয়ে নিজের দলের প্রতীক চিহ্ন এঁকে দিত। চুরি করা গোরুদের গায়েও অন্য প্রতিষ্ঠান র‍্যাঞ্চ-এর প্রতীক চিহ্ন ছিল। কিন্তু চেসাম খুব ভালোভাবেই জানত যে, সেই চিহ্ন দেখে তার গোরুর পালের ভিতর থেকে নিজস্ব গোরু শনাক্ত করে নিয়ে যেতে পারে এমন দুঃসাহসী মানুষ ওই অঞ্চলে নেই। অতএব, রাতারাতি পঞ্চাশটা গোরুর মালিকানা লাভ করে জন চেসাম খুব খুশি হয়ে উঠেছিল।

আচম্বিতে তৃণাবৃত প্রান্তরের বুকে জাগল অশ্বখুরধ্বনি, চেসামের ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা।

মাঠের ওপর ঘোড়ার খুরে বাজনা বাজাতে বাজাতে ধুলোর ঝড় তুলে এগিয়ে আসছে একদল অশ্বারোহী!

তীক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চেসাম বুঝতে পারল, এরা কেউ আরিজোনার মানুষ নয়, সকলেই টেক্সাসের অধিবাসী। নবাগত ঘোড়সওয়ারদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল একটি ছোটোখাটো নিরীহ চেহারার মানুষ।

গোরুর পালের দিকে এক নজরে তাকিয়েই ছোটোখাটো মানুষটি আদেশ দিল, আমাদের গোরুগুলির চিহ্ন দেখে ওদের আলাদা করে নাও।

টেক্সানরা বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোরাই গোরুগুলিকে তারা দল থেকে তাড়িয়ে আলাদা করে ফেলল।

জন চেসাম এতক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখছিল, এইবার সে সগর্জনে প্রতিবাদ জানাল।

চেসামের দলের লোকগুলি প্রস্তুত হল লড়াইয়ের জন্য। প্রত্যেকেরই কোমরে ঝুলছে রিভলভার, মালিকের আদেশ পেলেই তারা অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।

নবাগতদের আচরণে বোঝা গেল, বিনা যুদ্ধে দাবি ত্যাগ করতে তারাও রাজি নয়। তারাও সশস্ত্র। দুই দলের দুই নেতা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়াল।

জন চেসাম তার প্রতিপক্ষের মুখের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তার লম্বা-চওড়া মস্ত শরীরের তুলনায় প্রতিদ্বন্দ্বীর ছোটোখাটো চেহারাটা নিতান্তই নগণ্য। সেই নগণ্য মানুষটি গম্ভীর স্বরে বলল, চেসাম! গোরুগুলি আমার, অতএব ওগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি অনেকদিন এখানে আছ, আইন তোমার অজানা নয়।

নবাগত অশ্বারোহীর দল তাদের নিজস্ব গোরুগুলিকে তাড়িয়ে নিয়ে প্রস্থান করার উদ্যোগ, করল। জন চেসাম বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল না। প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে সে কী দেখেছিল সেই জানে, কিন্তু কোমরের রিভলভারে হাত না-দিয়ে সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিল পিছন দিকে এবং দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল অকুস্থল থেকে। চুরি যাওয়া গোরুগুলিকে নিয়ে নবাগতরা প্রস্থান করল নির্বিবাদে।

জন চেসামের মতো দুর্দান্ত মানুষও যার কাছে বিনা যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করল তার নামও জন, তবে চেসাম নয়, স্লটার।

আরিজোনার মানুষ একটি নতুন নাম শুনল–জন স্লটার।

জন স্লটার নামক মানুষটি টেক্সাস অঞ্চল থেকে আরিজোনার টম্বস্টোন শহরের দিকে যাত্রা করেছিল। ওই জায়গাটা ছিল পশুপালকদের পক্ষে আদর্শ স্থান। টেক্সাস থেকে স্লটার এসেছিল ওইখানে পশুর ব্যাবসা করতে। তার দলে ছিল অনেকগুলি গোরু। আরিজোনার বিস্তৃত অঞ্চলে যারা পশুমাংসের ব্যাবসা করতে র‍্যাঞ্চ বা গোশালা প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল অসাধু প্রকৃতির মানুষ। গোরু চুরি করে সম্পত্তি বৃদ্ধি করার নিয়মটা ছিল সেখানে নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার। প্রতিবাদ করলে আসল মালিকের মৃত্যু ছিল অবধারিত, কাজেই কেউ প্রতিবাদ জানাতে সাহস পেত না। জন স্লটার নামে মানুষটি, যে তার নিজস্ব গোরু দাবি করার সাহস রাখে, এই খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। জন চেসামের পরে আরও কয়েকটি গুন্ডা প্রকৃতির লোক স্লটারের গোরু চুরি করার চেষ্টা করল। প্রত্যেকবারই হল এক ঘটনা পুনরাবৃত্তি হারানো গোরুগুলিকে আবিষ্কার করে স্লটার সেগুলোকে আবার নিজের দলে ফিরিয়ে নিয়ে গেল, তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। একদিন স্লটারের দলের লোকরা অন্য প্রতিষ্ঠানের গোরুর পালের ভিতর থেকে এক-শোটা চুরি করা জন্তু উদ্ধার করেছিল।

ওই অঞ্চলের গুন্ডাদের কাছে স্লটার হল মূর্তিমান চ্যালেঞ্জ!

অবশেষে একদিন গোলমাল বাধল। গ্যালাঘার নামে এক ভয়ংকর দুবৃত্ত ঘোষণা করল স্লটারকে সে হত্যা করবে। কথাটা যথাসময়ে স্লটারের কানে এল। সে কোনো মন্তব্য করল না, কিন্তু সাবধান হল।

একদিন ঘোড়ার পিঠে চলতে চলতে স্লটার লক্ষ করল, গন্তব্যপথের মাঝখানে এমন একটা জায়গা আছে, যেখানে একটা মানুষ অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে। সে সন্দেহজনক জায়গাটা পরিহার করে অন্য পথে ঘোড়া চালিয়ে দিল। একটু পরেই বোঝা গেল তার আশঙ্কা অমূলক নয়। পূর্বোক্ত স্থান থেকে খোলা পথের ওপর আত্মপ্রকাশ করল এক অশ্বারোহী।

গ্যালাঘার!

গ্যালাঘারের হাতে ছিল একটা শটগান এবং কোমরের দুই দিকে ঝুলছিল দুটি রিভলভার। শটগান উঁচিয়ে ধরে গ্যালাঘার সবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল স্লটারের দিকে। স্লটার রাইফেল ছুড়ল। গ্যালাঘারের ঘোড়া আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, গ্যালাঘার নিজেও ছিটকে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল মাটির ওপর। কয়েক মুহূর্ত পরেই গ্যালাঘার উঠে পড়ে শটগান তুলে গুলি চালাল। আবার গর্জে উঠল স্লটারের রাইফেল, পেটে গুলি খেয়ে ধরাশায়ী হল গ্যালাঘার। মাত্র কয়েটি মুহূর্ত–আহত বাঘের মতোই লাফিয়ে উঠল গ্যালাঘার এবং দু-হাতে দুটি রিভলভার তুলে ঘনঘন অগ্নিবৃষ্টি করতে লাগল শত্রুর দিকে। স্লটার রাইফেল তুলল, অব্যর্থ লক্ষ্যে রাইফেলের বুলেট গ্যালাঘারের বক্ষ ভেদ করে তাকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। রাইফেল নামিয়ে জন স্লটার তার নির্দিষ্ট পথের দিকে অশ্বকে চালনা করল।

এইসবই হল পথের ঘটনা। যথাসময়ে জন স্লটার এবং তার স্ত্রী গন্তব্যস্থান টম্বস্টোন শহরে এসে উপস্থিত হল। স্লটারের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো ছিল, অতএব শহরের অনেক গুন্ডা বদমাইশের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল তার দিকে।

একদিন স্লটার স্ত্রীর সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে এক জায়গায় গোরু কিনতে গিয়েছিল। হঠাৎ স্লটারের চোখে পড়ল দুটি লোক ঘোড়া ছুটিয়ে পথের মাঝখানে একটা উচ্চভূমির অন্তরালে আত্মগোপন করল। স্লটার তৎক্ষণাৎ অন্যদিকের একটা ঢালু জমির ওপর দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়ে দিল এবং একটু পরেই এসে পড়ল খোলা রাস্তার মাঝখানে। অশ্বারোহী দুজন অন্তরালেই থেকে গেল, সামনে এসে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ তাদের হল না।

কিছুদিন পরেই স্লটার আবার নিজের আস্তানায় ফিরে এল। ফিরে আসার সঙ্গেসঙ্গে একটা গুজব শুনে তার মেজাজ গরম হয়ে উঠল–এডলিল আর ক্যাপ স্টিলওয়েল নামে দুই গুন্ডা নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে স্লটারের টাকাপয়সা তারা লুঠ করবে।

কোমরে গুলিভরা রিভলভার ঝুলিয়ে জন স্লটার পূর্বোক্ত দুই গুন্ডার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানিয়ে দিল, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তারা যদি শহর ত্যাগ না-করে তাহলে স্লটার তাদের হত্যা করবে। এডলিল বিনা প্রতিবাদে স্লটারের বক্তব্য শুনল, কিন্তু স্টিলওয়েল হাত বাড়াল কোমরের রিভলভারটার দিকে।

স্টিলওয়েলের হাত রিভলভারের বাঁট স্পর্শ করার আগেই স্লটারের কোমরের রিভলভার বিদ্যুদবেগে খাপের আশ্রয় ছেড়ে শত্রুর ললাট লক্ষ করে উদ্যত হল! স্টিলওয়েল ভাবতেই পারেনি, এত দ্রুতবেগে কোনো মানুষ খাপ থেকে রিভলভার টানতে পারে।

নিজের কোমর থেকে চটপট হাত সরিয়ে এনে স্তম্ভিত বিস্ময়ে সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল স্লটারের মুখের দিকে!

পরের দিনই দুই স্যাঙাত শহর ছেড়ে সরে পড়ল। টম্বস্টোন শহরে আর কোনোদিনই কেউ তাদের দেখতে পায়নি।

এইবার আমরা জন স্লটারের পূর্ব ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করব। ছোটোবেলায় স্লটার ছিল অত্যন্ত রুণ। শক্তির অভাব পূরণ করার জন্য সে রিভলভার ও রাইফেল প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র অভ্যাস করতে শুরু করল এবং খুব অল্প বয়সেই সে এমন নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল যে, পাকা পিস্তলবাজ মানুষও তাকে ঘাঁটাতে সাহস করত না।

পরিণত বয়সে জন স্লটার যখন কনফেডারেট আর্মিতে যোগ দিল, তখন আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এক বছর পরেই সৈন্যবাহিনী থেকে স্নটারকে ছাড়িয়ে দেওয়া হল, কারণ সে হয়েছিল যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত। ওই অবস্থায় সে ফিরে এসে যোগ দিল টেক্সাস রেঞ্জার্স নামক বেসরকারি বাহিনীতে। ওই দুর্ধর্ষ বাহিনী এক মাসের মধ্যে যতগুলি লড়াইয়ের সম্মুখীন হত, সরকারি সৈন্যদল সারাবছরের মধ্যেও ততগুলি যুদ্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারত না।

এমন ভয়ানক দলের মধ্যে ছয় বৎসর কাটিয়ে জন স্লটারের স্নায়ু হয়ে উঠল ইস্পাতের মতো কঠিন। তারপরই সে টেক্সাস ত্যাগ করে আরিজোনার টম্বস্টোন শহরের দিকে সস্ত্রীক যাত্রা করেছিল এবং পরবর্তীকালে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, পূর্বেই আমরা তা সবিস্তারে আলোচনা করেছি।

জন স্লটারের র‍্যাঞ্চ বা গোশালা বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। তার টাকাপয়সা দেখে গুন্ডারা লুব্ধ হয়ে উঠত বটে, কিন্তু স্লটারের রিভলভার ও আঙুলের যোগাযোগে যে অত্যন্ত অশুভ ঘটনার উৎপত্তি হয়, বারংবার তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে ওই অঞ্চলের দুবৃত্তেরা বুঝতে শিখেছিল, জন স্লটার নামক মানুষটির সঙ্গে যথাসম্ভব দূরত্ব বজাই রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। গুন্ডাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল স্লটারের পরিচিত, তবে স্লটার তাদের সঙ্গে কথা বলত না, বা কোনো দলীয় কলহের মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাইত না। সরকারের সেনাবাহিনীতে, রেল কোম্পানির মজুরদের মধ্যে এবং টম্বস্টোন শহরের ১৫০০০ শহরবাসীর কাছে মাংস বিক্রয় করে সে আদর্শ ব্যবসায়ীর জীবনযাপন করত, তাকে না-ঘাঁটালে সে কোনো গোলমালে নাক গলাত না।

কিন্তু গুন্ডাদের সঙ্গে সংঘর্ষ না হলেও দীর্ঘদিন নিরুপদ্রব শান্তি উপভোগ করার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি জন স্লটার। জেরোনিমো নামে এক দুঃসাহসী নায়কের নেতৃত্বে অ্যাপাচি জাতীয় রেডইন্ডিয়ানরা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। মেক্সিকো থেকে অ্যাপাচিরা টম্বস্টোন শহরের উপর হানা দিতে লাগল, বহু মানুষের সম্পত্তি ও গোরু-ভেড়া লুণ্ঠিত হল–শান্তিপ্রিয় নাগরিক তো দূরের কথা, পিস্তলবাজ দুর্ধর্ষ গুন্ডারাও ক্ষিপ্ত অ্যাপাচিদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল না। আগেই বলেছি কিশোর বয়সে জন স্লটার টেক্সাস রেঞ্জার্স নামক বাহিনীতে শিক্ষা গ্রহণ করেছিল, ওই সময়ে রেড ইন্ডিয়ানদের কম্যানচো জাতির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে সে রেড ইন্ডিয়ানদের যুদ্ধ পদ্ধতি শিখে গিয়েছিল। এইবার জেরোনিমোর বাহিনীর বিরুদ্ধে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগল।

কয়েকবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে জেরোনিমো বুঝল, জন স্লটার অতিশয় বিপজ্জনক ব্যক্তি। স্লটারের নেতৃত্বে তার দলবল অ্যাপাচিদের মেক্সিকো পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল একাধিকবার। ওই লড়াই চলেছিল প্রায় এক বৎসরেরও বেশি। অবশেষে জেরোনিমোর আদেশে অ্যাপাচিরা স্লটারের এলাকা থেকে হাত গুটিয়ে নিল। বার বার মার খেয়ে জেরোনিমো বুঝেছিল, এ বড়ো কঠিন ঠাই!

জেরোনিমোর বিরুদ্ধে এমন সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল স্লটার যে, তার দিকে সেনাবাহিনীর অধিনায়কদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে জেরোনিমো যখন আত্মসমর্পণ করে, সেই সময় জন স্লটার ছিল জেনারেল মাইলের সঙ্গী।

স্লটারের কৃতিত্ব এইবার বহু মানুষের ঈর্ষার উদ্রেক করল। অব্যর্থ নিশানার জন্য যারা খ্যাতিলাভ করেছিল, সেই বন্ধুকবাজ মানুষগুলি এইবার স্লটারের উপর খঙ্গহস্ত হয়ে উঠল। ডা. হলিডে নামে এক দন্ত চিকিৎসক সদম্ভে ঘোষণা করল, স্লটারকে সে শীঘ্রই হত্যা করবে। টম্বস্টোন শহরের মানুষ ওই ডাক্তারকে যমের মতোই ভয় করত–রিভলভার চালাতে সে ছিল অতিশয় দক্ষ এবং তার মতো ভয়ংকর খুনি সেই অরাজক যুগেও ছিল দুর্লভ।

স্লটার ও তার পত্নীর কানে এল ডা. হলিডের ভয়াবহ ঘোষণা। তা সত্ত্বেও একরাত্রে স্ত্রী ভায়োলোকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে স্লটার রওনা হল একটি নৃত্যঅনুষ্ঠানে যোগ দিতে। টম্বস্টোন শহরের খুব কাছেই ছিল ভায়োলার পিতার র‍্যাঞ্চ। অনুষ্ঠানের শেষে স্লটার তার শ্বশুরবাড়ির দিকে গাড়ি চালাল।

মেঘমুক্ত রাতের আকাশে ভাসছে পূর্ণচন্দ্র। পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল প্রতিফলনে জ্বলছে চাঁদের হাসি, তরল রজতধারার মতো। একটু আগেই শেষ-হয়ে-যাওয়া নাচের স্মৃতি, চাঁদনি রাত, স্বামীর সান্নিধ্য এবং পিতৃগৃহে সাদর অভ্যর্থনার সম্ভাবনা–সব কিছু মিলে ভায়োলার মনটা আজ ভারি খুশি, আর স্লটারের প্রাণেও লেগেছে সেই খুশির ছোঁয়া।

কিন্তু যতই আনন্দ হোক, সদা সতর্ক স্লটার এক মুহূর্তের জন্যও অসাবধান হয় না।

বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো সে কোমরের রিভলভার হস্তগত করল, কারণ, তার কানে এসেছে ধাবমান অশ্বের খুরধ্বনি!

তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে একটা ঝোপের ভিতর থেকে মুক্ত প্রান্তরের উপর আত্মপ্রকাশ করল ডা. হলিডে! ভায়োলা সভয়ে দেখল, ডাক্তারের ডান হাতের মুঠোয় চকচক করছে একটা রিভলভার!

ডাক্তারের ঘোড়া কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই স্লটারের অশ্বচালিত শকটের পাশে এসে পড়ল। মনে হল, ডাক্তার বুঝি এখনই গুলি ছুড়বে কিন্তু না, ঘোড়া আরোহীকে বহন করে সামনে এগিয়ে গেল, আরোহীর হাতের রিভলভার তবু অগ্নিবর্ষণ করল না।

ভায়োলা চেঁচিয়ে উঠল, জন! ওর হাতে রিভলভার!

শান্তস্বরে স্লটার বলল, জানি। আমার হাতেও একটা আছে।

ভায়োলা দেখল, তার স্বামীর হাতেও একটা রিভলভার রয়েছে বটে!

ডা. হলিডেও স্লটারের হাতের রিভলভার দেখেছে, আর দেখামাত্রই তার সংকল্পের পরিবর্তন ঘটেছে দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে সে স্থানত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে গেল।

টম্বস্টোন শহরের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। চারদিকে গুন্ডাদের অবাধ রাজত্ব। খুন, রাহাজানি, ডাকাতি লেগেই আছে। রাত্রিবেলা তো দূরের কথা, প্রকাশ্য দিবালোকেও ভদ্রলোকের ধনপ্রাণ নিরাপদ নয়। শেরিফ বেনহাম প্রাণপণ চেষ্টা করেও শহরের শান্তিরক্ষার কার্যে সফল হয়নি।

শহরের মানুষ তখন স্লটারকে শেরিফের পদে নির্বাচিত করল। নূতন শেরিফের কার্যকলাপে নাগরিকরা প্রথম প্রথম বিশেষ উৎসাহ বোধ করেনি। সত্যি কথা বলতে কী, তারা একটু হতাশ হয়েই পড়েছিল। কারণ, স্লটার অন্যান্য শেরিফের মতো চিৎকার করে শপথবাক্য উচ্চারণ করত না, অথবা বিরাট রক্ষীবাহিনী নিয়ে খুনির পিছনে তাড়া করার চেষ্টাও তার ছিল না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই টম্বস্টোমের মানুষ বুঝল, এই অরাজক শহরের শান্তিরক্ষা করতে হলে যে ধরনের মানুষ দরকার, ঠিক সেই ধরনের মানুষ হচ্ছে জন স্লটার। তাদের নির্বাচনে ভুল হয়নি কিছুমাত্র!

ঘোড়াচুরি বা ডাকাতির খবর পেলেই নিঃশব্দে ঘোড়ার পিঠে চেপে উধাও হয়ে যেত শেরিফ স্লটার। শহরের আশেপাশে পর্বতসংকুল অরণ্য ছিল সমাজবিরোধীদের প্রিয় বাসভূমি। কখনো কখনো সেই পর্বতবেষ্টিত বনভূমির ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেত স্লটার… কয়েকদিন পরেই আবার শহরের রাজপথের ওপর শহরবাসীর চোখের সামনে ভেসে উঠত অশ্বারোহী স্লটারের ক্ষীণদেহ, তার সঙ্গে থাকত একটি বা দুটি জিন-লাগানো ঘোড়া, কিন্তু ওই ঘোড়াগুলির পিঠে কখনোই আরোহীর অস্তিত্ব থাকত না! শহরবাসী বুঝত, ঘোড়ার মালিকরা আর কোনোদিনই শহরের রাজপথ কলঙ্কিত করবে না–এক বা একাধিক দুবৃত্ত গুলি খেয়ে অরণ্যের ভিতরই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে, তাদের ঘোড়াগুলিকে নিয়ে এসেছে শেরিফ জন স্লটার!

অনেক সময় সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে গোপনে তদন্ত চালিয়ে অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করত শেরিফ স্লটার। উপযুক্ত প্রমাণ হাতে এলেই সে অপরাধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে দশ দিনের মধ্যে শহর ত্যাগ করার আদেশ দিত। অপরাধী জানত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শহর ছাড়তে রাজি না হলে তাকে পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হবে–অতএব সুবোধ বালকের মতোই সে শেরিফের আদেশ পালন করত নির্বিবাদে!

কোনো কোনো চিন্তাশীল নাগরিক কিন্তু স্লটারের কার্যকলাপ সমর্থন করতেন না। তারা বলতেন, স্লটারকে শেরিফের পদে নির্বাচিত করা হয়েছে, কিন্তু সে অবতীর্ণ হয়েছে একাধারে বিচারক, জুরি এবং ঘাতকের ভূমিকায়!

যে যাই বলুক, টম্বস্টোন শহরে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্লটারের চেষ্টায়। ১৯২২ সালে যখন জন স্লটারের মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স প্রায় বিরাশি।

[১৩৮৭]

পলাতক গুণ্ডা

০১.

সন-তারিখের হিসাব গুণ্ডা রাখে না। আমরা রাখি। তাই পৌষমাসের এক সকালে জমিদার প্রতাপনারায়ণ চৌধুরী এবং তার বন্ধু দেবেন্দ্রবিজয় বসুর শিকারের তোড়জোড় করার কথা শুনে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কারণ, সময়টা হচ্ছে ১৯১০ সাল, ইংরেজ-অধিকৃত ভারতে তখনও জমিদারি প্রথা বর্তমান।

গুণ্ডা অবশ্য এ সব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। সত্যিকথা বলতে কি, একমাত্র খাবার-দাবারের ব্যাপার ছাড়া খুব কম বিষয়েই সে মাথা ঘামায়। একটু দূরে উঁচু জমির উপর দাঁড়িয়ে থোকাবাবু যে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঠোঁট চাটছে, সেই দৃশ্যটা গুণ্ডার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি, কিন্তু ব্যাপারটাকে সে মোটেই গুরুত্ব দেয়নি। সামনের ভিজে মাটিতে বেশ মিষ্টি মিষ্টি গাছের মুল পাওয়া গেছে, সেগুলো দিয়ে পেট ভরাতেই সে ব্যস্ত কোথাকার কে খোকাবাবু তার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে আর কি করছে তা নিয়ে চিন্তা করতে সে এখন রাজি নয়।

গুণ্ডা চিন্তা না করলেও খোকাবাবু কিন্তু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। গুণ্ডার দিকে তাকিয়ে তার জিভে জল জমছে। তবে হঠাৎ তার উপর লাফিয়ে পড়া উচিত হবে কি না বুঝতে পারছে না।

ওই যাঃ! প্রথমেই তো আসল কথাটা বলতে ভুলে গেছি! গুণ্ডা হচ্ছে একটা মস্ত দাঁতাল শুয়োর। আর আমাদের খোকাবাবু হচ্ছে একটি খোকা-চিতাবাঘ। চিতাবাঘদের সমাজে তাকে বাচ্চা মনে করা হয় বটে, কিন্তু তোমরা তাকে দেখলে কিছুতেই বাচ্চা বা খোকা বলে মানতে রাজি হবে না। মাত্র দেড় বছর বয়সেই তার কাধ আর পায়ের মাংসপেশী দস্তুরমতো পুষ্ট, থাবার নখ আর মুখের দাঁত দেখলে মস্ত বড়ো ‘হাউণ্ড’ কুকুরও তার সামনে এককভাবে এগিয়ে আসতে সাহস পাবে না।

খোকা দাঁড়িয়ে ছিল একটু উঁচু জমির উপর। এতক্ষণে সে হয়তো লাফিয়ে পড়ত, তবে কয়েকটা কথা ভেবে সে একটু ইতস্তত করছিল। খুব ছোটোবেলা থেকেই সে মায়ের কাছে শুনে এসেছে দাঁতাল শুয়োরগুলো বড়ো সাংঘাতিক জীব, ওদের সঙ্গে লাগতে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। ও সব কথার খুব বেশি দাম দেয়নি খোকা। অল্প বয়সের গরম রক্তে এখন খুনের নেশা, খোকা সুবিধা পেলেই শিকারের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে চায় বেশি বয়সের অভিজ্ঞতার দাম সে এখনও দিতে শেখেনি। তবু সে যে এতক্ষণে শিকারের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, তার কারণ মায়ের উপদেশ নয় শুয়োরের চেহারা দেখেই সে একটু ঘাবড়াচ্ছে। এর মধ্যে জন্তুটা একবার তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে, তারপর আবার মাটি খুঁড়ে শিকড় বার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিকারের এমন নির্বিকার ভাব দেখে আশ্চর্য হয়েছে খোকা। তার অভিজ্ঞতায় সে জেনেছে জন্তুরা তাকে দেখলে দৌড়ে পালায়, অথবা রুখে দাঁড়ায় কিন্তু এই জটা তাকে গ্রাহ্যই করছে না।

খোকা মনস্থির করে ফেলল। তার কাঁধের মাংসপেশী ফুলে উঠল, দুই কান চ্যাপটা হয়ে মিশে গেল মাথার খুলির সঙ্গে, লেজটা চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল মাটির উপর একবার, দুবার, তিনবার কিন্তু লাফ দেবার আগেই ঘাড়ের উপর এক দারুণ থাপ্পড় খেয়ে ছিটকে পড়ল খোকাবাবু, সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চাপা গর্জন, করছিস কি খোকা? মরবি নাকি?

মা-চিতাবাঘ যে কিছুক্ষণ আগেই ছেলের খোঁজ করতে করতে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে এবং আড়াল থেকে সবকিছু লক্ষ করছে সে কথা খোকা জানতে পারেনি- এখন আচমকা মার খেয়ে তার মেজাজ বিগড়ে গেল।

দুই চোখে আগুন জ্বালিয়ে থোকা মায়ের দিকে ফিরল, আমি মরব না, ওকে মারব। কিন্তু তুমি আমায় যখন-তখন চড় মারবে না। সাবধান!

মায়ের চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে খোকার চোখের আগুন নিবে গেল তৎক্ষণাৎ। খোকা জানে এখনও মায়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা তার হয়নি। গায়ের জোর হয়তো তার মায়ের চাইতে কম নয়, কিন্তু লড়াইয়ের কায়দা-টায়দাগুলো সে এখনও তেমন রপ্ত করতে পারেনি মা এত চটপট দাঁত আর নখ চালাতে পারে যে মারামারি করতে গেলে খোকা মার খেয়ে ভূত হয়ে যাবে।

তোমরা হয়তো ভাবছো, সে কি! ভারি অসভ্য ছেলে তো! মা মারলে কোনো ছেলে উলটে মাকে মারে নাকি?

তা মারে; চিতাবাঘদের সমাজে মাতৃস্নেহ আছে, মায়ের প্রতি ছেলের আকর্ষণও থাকে— কিন্তু সময়-বিশেষে খুনোখুনি করতে তাদের বাধে না।

আমাদের খোকাবাবু অবশ্য মায়ের গায়ে এখনও পর্যন্ত থাবা তোলেনি। তবে তার মা জানে কয়েক দিন বাদেই খোকা আর মাকে মানতে চাইবে না। সেইজন্য মা-চিতাবাঘ যে বিশেষ চিন্তিত তা নয়, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে সে ভালোভাবেই জানে এখন ছেলের অবাধ্যতার চাইতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়েই সে বিশেষভাবে চিন্তিত।

শোন খোকা, মা বলল, এখান থেকে এক লাফ মেরে শুয়োরটাকে ডিঙিয়ে চলে যা। তারপর সামনের ছোটো বিলটার মধ্যে নেমে সাঁতার কেটে উলটোদিকে গিয়ে ঢুকে যাবি পাশের বনে। আমি তোর পিছনে আসছি।

খোকা অবাক হয়ে বলল, কেন মা? শুয়োরটাকে তো আমরা দুজনে মিলে মেরে ফেলতে পারি। আর যদি ওকে না মারি তাহলেই বা শুধু শুধু ছুটোছুটি করতে যাব কেন? আমার খিদে পেয়েছে। আমি এখন খেতে চাই, ছুটতে বা সাঁতার কাটতে চাই না।

মা বলল, ওই গুণ্ডা শুয়োরটাকে আমরা দুজনে মিলেও মারতে পারব না। তবে ওকে নিয়ে এখন আমি একটুও মাথা ঘামাতে রাজি নই। ওকে না ঘটালে ও আমাদের সঙ্গে লাগতে আসবে না। তা ছাড়া, গাছে উঠে আমরা ওকে অনায়াসেই ফাঁকি দিতে পারি। কিন্তু শুয়োর নয় আমাদের পিছন দিক থেকে এগিয়ে আসছে আর এক বিপদ। গ্রাম থেকে এক দল লোক কুকুর নিয়ে বনে শিকার করতে আসছে। পাজি কুকুরগুলো গন্ধ শুঁকে আমাদের ধরে ফেলবে। গাছে উঠেও রক্ষা নেই, মানুষগুলো তলা থেকে এক রকম লাঠি থেকে আগুন ছুঁড়ে মারবে, আর সেই আগুন গায়ে লাগলেই আমরা মারা যাব। গুণ্ডা শুয়োরটা এখনো শিকারিদের খবর পায় নি। ও হয়তো আমাদের তাড়া করতে পারে। কিন্তু সেজন্য ভাবনা নেই। চিতাবাঘদের সঙ্গে দৌড়ে কোনো শুয়োর জিততে পারে না। আর কুকুরগুলো যদি ওর পিছনে তাড়া করে তাহলে তো আমরা বেঁচেই গেলাম।

খোকা প্রশ্ন করল, দলে কতগুলো কুকুর আছে তুমি জানো? মা বলল, জানি বৈকি। গাছের উপর থেকে ওদের দেখতে পেয়েই আমি এদিকে ছুটে এসেছি। দলে আছে চার-চারটি কুকুর। কুকুরদের সঙ্গে আছে অনেকগুলো মানুষ। তাদের হাতে অনেক অস্ত্রশস্ত্র। দু’জন আবার ঘোড়ায় চড়ে আসছে। নাঃ, আর দেরি করা ঠিক নয়। খোকা! এইবার টেনে এক লাফ মার, কে জানে ভাগ্যে কি আছে!

.

০২.

ভাগ্যে কি আছে ভগবানই জানেন, শান্তা দেবীর গলার স্বরে ক্ষোভ, বাবার বড় আদরের জীব ছিল ও। ওকে মারতে যাওয়া কি উচিত হবে?

প্রতাপনারায়ণ হেসে উঠলেন, বাবার আদরের জীব এখন আর আদর করার মতো নেই। হয়তো একদিন শুনবে সে মানুষ মেরে বসেছে। তা ছাড়া ওকে মারব বলেই যে শিকারে যাচ্ছি একথা ভাবছ কেন? ওই জঙ্গলে দুটো চিতাবাঘ এসেছে; বুনো খরগোশ আর ছোটো হরিণও ওখানে পাওয়া যায়।

শান্তা বললেন, তুমি যাই বলল না কেন, আমি তো জানি গুপ্তার উপর তোমার অনেক দিনের রাগ। গাঁয়ের ধারে ছোটো জঙ্গলগুলোতে আজকাল ওকে প্রায়ই দেখা যায়। আমার মনে হচ্ছে সুবিধে পেলেই তুমি ওকে মারবার চেষ্টা করবে।

কী মুশকিল, প্রতাপনারায়ণ বললেন, মারার ইচ্ছে থাকলে আমি কি আগেই ওকে মারতে পারতুম না?

সে তো আমার জন্যে, শান্তা বললেন, প্রত্যেক বার শিকারে যাওয়ার আগে আমি তোমাকে দিব্যি দিয়ে গুণ্ডাকে মারতে নিষেধ করেছি।

-তবে আর ভয় পাচ্ছো কেন?

-ভয় পাচ্ছি, কারণ, এইবার তোমার সঙ্গে আছেন দেবেনবাবু। তাকে তো আর আমি দিব্যি দিয়ে বারণ করতে পারব না। তোমার ইশারায় যদি দেবেনবাবু–

দেবেনবাবু আবার কি অপরাধ করল বৌঠান? বলতে বলতে সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রতাপনারাণের বন্ধু দেবেন্দ্রবিজয়।

শশব্যস্তে ঘোমটা টেনেশান্তা বললেন, আপনার বন্ধুকে একটা কথা বলছিলাম। পাশের জঙ্গলে একটা মস্ত শুয়োর আছে। ওটা এককালে এই বাড়িতেই ছিল, বাবা শখ করে পুষেছিলেন ওকে। বাবার মৃত্যুর পর গুণ্ডা অর্থাৎ ওই শুয়োরটা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তাই ওঁকে সাবধান করে দিচ্ছিলাম ওটার উপর যেন হামলা না হয়। আর আপনাকেও ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে বলছিলাম।

দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, আপনার শ্বশুরমশাইয়ের পোষা শুয়োরের কথা আমি আগেই শুনেছি প্রতাপের মুখে। আপনি যদি বারণ করেন তাহলে ওটাকে না হয় ছেড়েই দেওয়া হবে। তবে জঙ্গলে তো আরও দুচারটে শুয়োর থাকতে পারে, আর শুয়োরদের গায়ে নাম লেখাও থাকে না– সুতরাং অজান্তে যদি ওটাকে মেরে বসি, তাহলে অপরাধ নেবেন না। আরও একটা কথা বলছি বৌঠান– বুনো শুয়োর সাংঘাতিক জীব। গাঁয়ের এত কাছে জন্তুটা থাকে, এ ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না, কোনোদিন হয়তো তোকজনকে মেরে ফেলতে পারে।

শান্তার মুখে ক্রোধের আভাস ফুটে উঠল, কিন্তু অতিথির মর্যাদার কথা ভেবে তিনি কণ্ঠস্বর সংযত করলেন, ঠাকুরপো! গুণ্ডাকে আমি ছোটোবেলা থেকেই দেখছি। ওকে না মারলে ও কারুকে মারবে না। আর গায়ে নাম লেখা না থাকলেও ওর চেহারা দেখলেই ওকে আপনি চিনতে পারবেন। ভারতবর্ষের কোনো শুয়োরের ঘাড়ে ওরকম ঝাঁকড়া কেশরের মতো লোম হয় না, চেহারাটাও বেশ অন্য রকম– আপনি যখন ওর কাছে সব কথাই শুনেছেন, তখন এ কথাও নিশ্চয়ই জানেন যে, গুণ্ডা এখানকার জন্তু নয়।

দেবেন্দ্রবিজয় বুদ্ধিমান মানুষ, বন্ধুপত্নীর সংযত স্বর থেকেও তিনি উম্মার আভাস ধরে ফেললেন। ব্যাপারটাকে সহজ করে নেবার চেষ্টা করলেন তিনি, হ্যাঁ শুনেছি, আফ্রিকা থেকে এক সাহেব ওকে ধরে এনেছিল। আপনার শ্বশুরমশাই সেই সাহেবের কাছ থেকেই ওই শুয়োরটা উপহার পেয়েছিলেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন বৌঠান আপনার আদরের শুয়োর যদি গায়ে পড়ে মারামারি করতে না আসে, তাহলে আমরা তাকে মারতে যাব না।

প্রতাপনারায়ণ বললেন, কিন্তু অন্য জন্তু তো মারব। যদি শিকারে যাওয়ার ইচ্ছা থাকে তবে এইবার বেরিয়ে পড়া উচিত। যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে।

দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, দেরির জন্য আমি দায়ী নই। তোমরা কর্তা গিন্নি যদি শিকারে যাওয়ার আগে বরাহতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করো, তাহলে আমি কি করব?

অন্তঃপুর থেকে বাইরের দালানের দিকে পা চালাতে চালাতে প্রতাপনারায়ণ বললেন, আর সময় নষ্ট করব না। চল, ঘোড়া সাজাতে বলে দিয়েছি অনেকক্ষণ আগে।

বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে লাগলেন শান্তা দেবী। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারটে প্রকাণ্ড শিকারি কুকুর আর একদল লাঠি ও বর্শাধারী মানুষ নিয়ে দুই বন্ধু অশ্বপৃষ্ঠে অগ্রসর হলেন।

লাঠি-সোঁটা হাতে যে লোকগুলো শিকারিদের সাহায্য করতে চলল, তাদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শান্তার সুন্দর মুখে উদ্বেগের কালো ছায়া পড়ল, অস্পষ্ট স্বরে তিনি বলে উঠলেন, ও কি, হারান-সর্দার! সেও আছে দলের মধ্যে! কী জানি, আজ কী সর্বনাশ হয়?

অস্ত্রধারী মানুষগুলোর মধ্যে হারান-সর্দার নামক যে বিশেষ ব্যক্তিটি জমিদার-গৃহিণীর চিত্তে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে তার একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। ওই সঙ্গে পূর্ব কথা নিয়েও একটু আলোচনা নিতান্তই প্রয়োজন। শিকারিরা এগিয়ে যাক সেইদিকে, যেখানে খোকা-চিতাবাঘ আর তার মা গুপ্তার ঘাড়ের উপর দিয়ে লাফ মেরে চম্পট দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আমরা ততক্ষণ হারানো অতীত নিয়ে একটু আলোচনা করি।

.

০৩.

প্রতাপনারায়ণের পিতা প্রদ্যোতনারায়ণ চৌধুরী অদ্ভুত মানুষ। তখনকার দিনে অধিকাংশ জমিদারই হতেন স্বেচ্ছাচারী ও বিলাসী প্রদ্যোতনারায়ণকে সেদিক থেকে নিয়মের ব্যতিক্রম বললে সত্যের অপলাপ হয় না। তবে তিনি ছিলেন ভয়ংকর খামখেয়ালি। আর সেই খেয়ালের ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তাঁর স্ত্রী যোগমায়া দেবী।

প্রদ্যোতনারায়ণের প্রধান শখ ছিল শিকার এবং জন্তু-জানোয়ার পোষা। বই পড়তেও তিনি খুব ভালোবাসতেন। তখনকার দিনের ভূস্বামীদের মতো বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে না দিয়ে তিনি অধিকাংশ সময়েই পড়াশুনা করে সময় কাটাতেন। এই ব্যাপারে যোগমায়ার বিশেষ আপত্তি ছিল না। অবশ্য খুব দরকারি কথা বলতে এসে পাঠমগ্ন স্বামীর মুখ থেকে যখন হাঅথবা না ছাড়া আর কোনো কথা শোনা যেত না তখন জমিদারপত্নী খুবই বিরক্ত হতেন সন্দেহ নেই, তবে সেই বিরক্তিটা এমন কিছু ধর্তব্য নয়। সংসার করতে গেলে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়, স্বামীর বই পড়া বাতিকটাও যোগমায়া মেনে নিয়েছিলেন। বিভিন্ন জাতের পাখি আর জানোয়ার (কুকুর তো ছিলই) দিয়ে কর্তা যখন জমিদার বাড়িকে প্রায় চিড়িয়াখানা করে তুললেন তখনও বিশেষ আপত্তি করেননি যোগমায়া, কিন্তু একবার শিকার করে ফিরে আসার সময়ে কর্তা যখন একটা বাঘের বাচ্চা নিয়ে এলেন এবং জানালেন সেটাকে তিনি পুষবেন, সেই দিনই যোগমায়া সরোষে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন।

বাঘ যে কুকুরের মতোই পোষ মানতে পারে, এ কথা বিশ্বাস করলেন না যোগমায়া। বাঘ সম্বন্ধে জীবতত্ত্ববিদদের মূল্যবান তথ্যগুলোকে নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন মানুষখেকো জন্তুর সঙ্গে ঘর করতে তিনি রাজি নন, প্রদ্যোতনারায়ণ যদি নিতান্তই বাঘের বাচ্চা পষতে চান তবে স্ত্রী সান্নিধ্য তাঁকে ত্যাগ করতে হবে, কারণ, যোগমায়া তাহলে স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়িতেই বসবাস করবেন।

বাঘ মাত্রেই যে মানুষখেকো হয় না, এ কথা বার বার বলেও কোনো ফল হল না, গেম-কিলার আর ক্যাটল লিফটার-এর সঙ্গে ম্যান-ঈটার বাঘের তফাত বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলেন অভিজ্ঞ শিকারি প্রদ্যোতনারায়ণ–কিন্তু যোগমায়া স্বামীর কথায় কর্ণপাত করলেন না। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে সব বাঘই মানুষ খায় এবং ছেলেপুলের ঘরে এমন বিপজ্জনক জানোয়ারকে তিনি স্থান দিতে রাজি নন~ অতএব বাঘের বাচ্চা আর স্ত্রীর মধ্যে এক জনকে প্রদ্যোতনারায়ণের বেছে নিতে হবে।

প্রদ্যোতনারায়ণকে দেখলে খুব শান্ত মানুষ মনে হয়। তাকে কেউ কখনো উত্তেজিত হতে দেখেনি। মাত্র দশ হাত দূর থেকে তেড়ে-আসা বাঘকে যখন তিনি গুলি চালিয়ে মাটির উপর পেড়ে ফেলেছেন তখনো তার মুখে-চোখে সঙ্গীরা উত্তেজনার চিহ্ন দেখতে পায়নি। কিন্তু আপাতশান্ত প্রদ্যোতনারায়ণ ছিলেন ভীষণ জেদি। একবার জেদ ধরলে তাঁকে নিরস্ত করা খুবই কঠিন।

স্ত্রীর সঙ্গে অনেকক্ষণ বাদানুবাদ করার পরেও যোগমায়া যখন বাঘের বাচ্চার সান্নিধ্য সহ্য করতে রাজি হলেন না, তখ ভাবেই প্রদ্যোতনারায়ণ জানালেন কারও স্বাধীন ইচ্ছায় বাধা দিতে তিনি চান না এবং তার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করে, এটাও বাঞ্ছনীয় নয়– অতএব যোগমায়া যদি নিতান্তই বাপের বাড়ি যেতে চান তবে যাবেন, কিন্তু বাঘের বাচ্চা থাকবে।

ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কি হত বলা মুশকিল, তবে শেষ রক্ষা করল পুত্রবধূ শান্তা। খুব অল্প বয়সেই একমাত্র পুত্র প্রতাপের বিয়ে দিয়ে এই সুলক্ষণা মেয়েটিকে পুত্রবধূ করে ঘরে এনেছিলেন প্রদ্যোতনারায়ণ। কন্যাসমা এই মেয়েটির আবদার তিনি ঠেলতে পারতেন না। ঘরের বৌ নয়, ঘরের মেয়ের মতোই ব্যবহার করতে শান্তা শ্বশুরের সঙ্গে।

যোগমায়া যখন বাপেরবাড়ি যাওয়ার উদ্যোগ করছেন, এবং সেদিকেদৃকপাতনা করেপ্রদ্যোতনারায়ণ যখন ব্যাঘ্ৰশাবকের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, সেই সময় হঠাৎ এগিয়ে এল শান্তা-বাবা! এ কি হচ্ছে? মার চাইতে কি বাঘের বাচ্চা তোমার কাছে বড়ো হল?

দুই একবার ক্ষীণ প্রতিবাদ করে শান্তার কাছে হার মানলেন প্রদ্যোতনারায়ণ। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে প্রদ্যোতনারায়ণের খুবই দহরম-মহরম ছিল, হঠাৎ একটা বাঘের বাচ্চা উপহার পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ভারি খুশি হয়েছিলেন।

কিন্তু প্রদ্যোতনারায়ণ খুশি হতে পারেননি। শোনা যায়, তিনি নাকি এক মাস পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ রেখেছিলেন। শান্তা যে স্ত্রীর প্ররোচনাতেই ব্যাঘ্র শাবকের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছিল, এ বিষয়ে প্রদ্যোতনারায়ণের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না।

যাই হোক, এক সময় সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে এল। কয়েক বছর পরে যোগমায়া যখন বাঘের বাচ্চার কথা প্রায় ভুলতে বসেছেন, সেই সময় হঠাৎ একদিন কোথা থেকে একটি শূকরশাবক সঙ্গে নিয়ে কর্তা বাড়ি ফিরলেন এবং ঘোষণা করলেন ওটাকে তিনি পুষবেন। যোগমায়া এবারেও আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু তার আপত্তি ধোপে টিকল না। নোংরামির জন্য অভিযোগ করতেই প্রদ্যোতনারায়ণ জানালেন জমিদারবাড়িতে অখাদ্য-কুখাদ্য খাওয়ার কিংবা ময়লা ঘাঁটার সুযোগ জন্তুটার হবে না, অতএব সে-বিষয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। শুয়োর খুব নিরীহ জন্তু না হলেও সে যে বাঘের মতো ভয়ানক জীব নয়, এ কথা যোগমায়া দেবীও মানতে বাধ্য হলেন। তার উপর শান্তা এবার শ্বশুরের পক্ষ নিল, সে সাফ বলে দিল সব ব্যাপারে খিটখিট করলে পুরুষ মানুষের রাগ তো হবেই- বিশেষত শুয়োরটা যখন ভিতর-বাড়িতে থাকবে না, তার জন্য যখন আলাদা খোঁয়াড়ের ব্যবস্থা হচ্ছে, তখন আর মায়ের আপত্তির কি কারণ থাকতে পারে? বাড়িতে কুকুর আছে, বাঁদর আছে, হরেক রকমের পাখি আর বিড়ালও রয়েছে- শুয়োরছানা কি অপরাধ করল?

যোগমায়া কাবু হলেন। শূকর-শাবক থাকল। প্রতাপনারায়ণ কিছু বলল না, কারণ তার বলা কওয়া বাবা গ্রাহ্যই করেন না। তবু জন্তুটাকে সে বিশেষ সুনজরে দেখেনি। কিন্তু প্রতাপের ভালো না লাগলেও বালিকাবধুর সঙ্গে বাচ্চাটার ভারি ভাব হয়ে গেল। কথায় কথায় শান্তা জানতে পারল এক সাহেব শিকারির সঙ্গে মধ্যভারতের অরণ্যে শিকার করতে গিয়েছিলেন। প্রদ্যোতনারায়ণ এবং বাঙালি শিকারির হাতের টিপ দেখে মুগ্ধ হয়ে সাহেব ওই শূকর-শাবকটিকে উপহার দিয়েছে। জন্তুটা ভারতবর্ষের শূকর নয়। আফ্রিকার জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে ওই বাচ্চাটিকে ধরেছিল সাহেব– তারপর ভারতে আসার সময় জন্তুটাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে স্থানান্তরিত হয়ে আফ্রিকার ওয়ার্ট হগ প্রদ্যোতনারায়ণের গৃহেই আশ্রয় গ্রহণ করল।

বাচ্চাটার নামকরণ হল কালু। নাম রেখেছিল শান্তা নিজেই। শূকর-শাবকের নিরাপত্তার জন্য শান্তার দুশ্চিন্তা ছিল যথেষ্ট। দুশ্চিন্তা অহেতুক নয়, জমিদারবাড়িতে বাস করত অনেকগুলো শিকারি কুকুর! অবশ্য কুকুরগুলো দিনের বেলা বাঁধা থাকত, শূকর-শাবকের খোঁয়াড়টাও ছিল বেশ মজবুত। তবু শান্তার ভয় করত- দৈবাৎ যদি সারমেয়বাহিনীর কোনো একটি কুকুর বাচ্চাটার নাগাল পায় তবে শূকর-শাবকের মৃত্যু যে অনিবার্য, এ বিষয়ে শান্তার সন্দেহ ছিল না বিন্দুমাত্র।

কিন্তু আফ্রিকার ওয়ার্ট হগ যে কেমন জিনিস সেটা শান্তার জানা ছিল না। খুব অল্প বয়সেই বাচ্চাটা প্রমাণ করে দিল কারও সাহায্য ছাড়াই সে আত্মরক্ষা করতে জানে। এক রাত্রে হঠাৎ কুকুরদের চিৎকার শুনে বাড়িসুদ্ধ লোকের ঘুম ভেঙে গেল। চিৎকারের শব্দ আসছিল কালুর খোয়াড়ের দিক থেকে। সেখানে গিয়েই সকলের চোখ ছানাবড়া! খুব সম্ভব খাবার দেবার সময়ে ভৃত্য নিধিরাম খোঁয়াড়টা ভালো করে বন্ধ করেনি, ফলে শূকর-শাবক বেরিয়ে পড়েছে নৈশ-ভ্রমণে। রাতের টহলদারকুকুরগুলো বাচ্চাটাকে দেখে ফেলেছে, তারপরই লেগেছে ধুন্ধুমার কাণ্ড! পূর্ববর্তী ঘটনা কি ঘটেছে তা বলা মুশকিল, সকলের চোখে যে দৃশ্য ধরা পড়ল তা হচ্ছে এই :

খোঁয়াড়ের কাছেই একটা কোণ নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে কালু এবং তাকে ঘিরে গর্জন করছে ক্রুদ্ধ কুকুরের দল। দলের পাণ্ডা ডিক (কর্তার প্রিয় হাউন্ড) রক্তাক্ত কাঁধ নিয়ে মাটির উপর ছটফট করছে, স্পষ্টই বোঝা যায় শূকর-শাবকের দন্তাঘাতেই তার ওই দুর্দশা। অন্যান্য কুকুরগুলোর মধ্যে কয়েকটির দেহে রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে, কালু নিজেও অক্ষত নয়। কিন্তু কুকুরগুলো এখন আর শুকর-শাবকের দিকে এগোতে চাইছে না, দূরে দাঁড়িয়ে আস্ফালন। করছে পয়লা দফা লড়ায়ের পরই তারা বুঝে গেছে এ শিকার খুব নিরীহ নয়, বিশেষ করে দলপতি ডিক আহত হওয়ায় ককরবাহিনী দস্তুরমতো ঘাবড়ে গেছে। দর থেকে জাতীয় ভাষায় গালাগালি করলেও সামনে এসে মোকাবিলা করার সাহস আর কুকুরদের ছিল না।

কুকুর সামলে শূকর-শাবককে খোঁয়াড়ে পুরে ফেলা হল। কর্তা তার পোষা জন্তুর নূতন করে নামকরণ করলেন–গুণ্ডা। নামটা সার্থক হয়েছিল সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে কুকুরগুলো সাধারণ কুকুর নয়, শক্তিশালী হাউন্ড। এতগুলো শিকারি কুকুরের মহড়া নেওয়া চিতাবাঘের পক্ষেও কঠিন।

কর্তা অবশ্য খুব অবাক হননি। তিনি জানতেন ওয়ার্ট হগ কি জিনিস। আহত কুকুরগুলোর চিকিৎসা করা হল। সবচেয়ে ভীষণভাবে আহত হয়েছিল ডিক। চিকিৎসার গুণে সেও আবোগ্যলাভ করল। মাঝে মাঝে গুণ্ডার দিকে তাকিয়ে গর্জন করলেও ডিক আর শক্তিপরীক্ষায় অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেনি- এক রাতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝে গিয়েছিল এ শত্রু বড়ো ভয়ানক, দুর থেকে একে গালি দেওয়া যায় কিন্তু কাছে গিয়ে ঠোকাঠুকি করলে যে কোনো সময়ে প্রাণপাখি খাঁচাছাড়া হতে পারে।

শুধু কুকুর নয়, গুণ্ডার আরও একটি শত্রু ছিল। সে হচ্ছে পাইকদের দলপতি হারান-সর্দার। যখন-তখন জন্তুটাকে বিরক্ত করে হারান ভারি মজা পেত।

গুণ্ডার খোঁয়াড়টা ছিল মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি। একদিন ওই গুঁড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে হারান যখন একটা কলা নিয়ে শুয়োরটাকে লোভ দেখাচ্ছে, আর সে কলাতে কামড় বসাতে গেলেই সেটা চট করে টেনে নিচ্ছে সেই সময়ে হঠাৎ ব্যাপারটা দেখে ফেললেন প্রদ্যোতনারায়ণ স্বয়ং।

কঠোরভাবে তিরস্কৃত হল হারান। অনেকদিনের পুরোনো লোক বলে আর শিকার-খেলাতে খুব ওস্তাদ খেলোয়াড় বলে কর্তা তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন না; কিন্তু ভবিষ্যতে এরকম কিছু ঘটলে চাকরি তো থাকবেই না, উপরন্তু পৃষ্ঠদেশের চামড়াও যে স্থানত্যাগ করতে পারে সে কথা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রদ্যোতনারায়ণ।

বলাই বাহুল্য, এরপর আর গুণ্ডার পিছনে লাগতে সাহস পায়নি হারান-সর্দার।

শেষ পর্যন্ত গুণ্ডা হয়তো বহাল তবিয়তে জমিদারবাড়িতেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারত, কিন্তু পর পর দুটো দুর্ঘটনার ধাক্কায় সব কিছুই বদলে গেল।

প্রথমে মারা গেলেন যোগমায়া দেবী। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলেন তিনি। ডাক্তার এল, চিকিৎসাও হল, কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না।

স্ত্রীর মৃত্যুর পর অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রদ্যোতনারায়ণ। তার অসুরের মতো স্বাস্থ্যে ভাঙন ধরল। কয়েক বছর পরে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে প্রদ্যোতনারায়ণও সহধর্মিণীর পথ অনুসরণ করলেন।

পিতার মৃত্যর পর জমিদারির মালিক হল প্রতাপনারায়ণ। পূর্বোক্ত গুণ্ডা এখন সত্যিই গুণ্ডা তার দৈহিক আয়তন এবং চোয়ালের দুধারে বেরিয়ে-আসা দাঁত দুটো এখন ভয়ানক আকার ধারণ করেছে।

আগের মতো তার পরিচর্যা এখন হয় না। গৃহস্থালির অনেক দায়িত্ব নিয়ে বিব্রতা শান্তা সবসময়ে শুকরের তত্ত্বাবধান করতে পারে না। ভৃত্য তার কর্তব্যে গাফিলতি করে।

এইসব অসুবিধা বিশেষ গ্রাহ্য করে না গুণ্ডা। তার লাল লাল চোখ দুটো এদিক-ওদিক ঘুরে পরিচিত মানুষটির সন্ধান করে, তাকে দেখতে পায় না। মাঝে মাঝে শান্তাকে দেখে সে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দে আনন্দ জানায়, কিন্তু বিশালকায় গুণ্ডা যে-মানুষটিকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত তার দেখা না পেয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়ে, আফ্রিকার বুনো চোখে ভাসে বিষাদের ছায়া। শান্তা সবসময় কাছে এসে খোঁজ নিতে পারে না, খোঁয়াড়ের মধ্যে নিঝুম হয়ে শুয়ে থাকে গুণ্ডা।

বিশেষ কাজে বাপের বাড়িতে গিয়েছিল শান্তা কয়েক দিনের জন্য। ঘটনাটা ঘটল সেইদিন, যেদিন সে ফিরল স্বামীর ঘরে। পালকি তখন সিংহদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকছে, হঠাৎ কানে এল গুণ্ডার তীব্র চিৎকার। তাড়াতাড়ি পালকি থামিয়ে নেমে পড়ল শান্তা এবং ছুটে গেল বাড়ির পিছনে উঠানের দিকে ওইখানেই ছিল গুপ্তার খোঁয়াড় এবং শব্দটা আসছিল সেদিক থেকেই। অকুস্থলে গিয়ে শান্তা দেখল গুণ্ডাকে পরমানন্দে লাঠি দিয়ে খোঁচাচ্ছে হারান-সর্দার। লাঠিটাকে কামড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে খেপে উঠেছে গুণ্ডা। হারানের নাম ধরে চেঁচিয়ে ওঠার উপক্রম করল শান্তা, কিন্তু তার গলা থেকে আওয়াজ বেরিয়ে আসার আগেই অঘটন ঘটে গেল। লাঠিটাকে আক্রমণের চেষ্টা ছেড়ে হঠাৎ গুণ্ডা খোঁয়াড়ের দরজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং শাণিত ছোরার মতো এক জোড়া দাঁতের প্রচণ্ড আঘাতে দরজা ভেঙে ছুটে এল হারান-সর্দারের দিকে।

অন্য লোক হলে তখনই মারা পড়ত, কিন্তু হারান হচ্ছে পাকা লাঠিয়াল এক মুহূর্তের জন্য সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। তারপরই নিজেকে সামলে লাঠির উপর ভর দিয়ে মারল এক দারুণ লাফ। সে কী লাফ– এক লাফেই হারান পৌঁছে গেল নিকটবর্তী পাঁচিলের উপর।

একটা ক্রুদ্ধ চিৎকার ছাড়ল গুণ্ডা। তারপর ঝড়ের বেগে সিংদরজা পার হয়ে অদৃশ্য হল। শান্তার দিকে তাকিয়েও দেখল না।

হারানকে যথাসম্ভব তিরস্কার করল শান্তা। স্বামীর কাছে ব্যাপারটা জানিয়েছিল সে যথাসময়ে। প্রতাপনারায়ণ বলল হারান-সদারকে সে শাস্তি দেবে, কিন্তু শান্তার মনে হয়েছিল তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই ও কথা বলল প্রতাপ- আসলে হারানের অপরাধটা স্বামীর কাছে খুব গুরুতর নয়।

তা যাই হোক, গুণ্ডা আর জমিদারবাড়িতে ফিরল না। গাঁয়ের পাশে জঙ্গলের মধ্যে তার দেখা পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। গ্রামবাসীদের মুখে তার খবর পেত শান্তা। আফ্রিকার ওয়ার্ট হগ বাংলার জঙ্গলেই দিন কাটাতে লাগল নির্বিবাদে। না, একেবারে নির্বিবাদে নয়- গোড়ায় একটু গোলমাল হয়েছিল। তিনটে নেকড়ে, যারা ওই এলাকাতেই থাকত গুণ্ডার নধর রূপ দেখে লোভ সংবরণ করতে পারেনি, এগিয়ে এসেছিল শূকরমাংসের স্বাদ গ্রহণ করতে। গুণ্ডার দস্তাঘাতে সর্দার নেকড়ে মারা পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই, আর অন্য দুটো প্রাণপণে ছুটে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল।

তারপর থেকে আর কেউ তাকে বিরক্ত করে না। খরগোশ আর হরিণদের সঙ্গে গুণ্ডার ঝগড়া নেই। বেশ স্বচ্ছন্দেই তার দিন কাটছিল। সম্প্রতি কিছুদিন হল দুটো চিতাবাঘ এই অঞ্চলে

আস্তানা পেতেছে। গুণ্ডা জানে ওরা মা আর ছেলে। ওই ফোঁটাকাটা বিড়াল দুটোকে সে মোটেই পছন্দ করে না, তবে সে জানে ওরা তার সঙ্গে লাগতে সাহস পাবে না।

তাই মাটি খুঁড়ে গাছের মূল খেতে খেতে একটু দূরে উঁচু জমিটার উপর বসে থাকা খোকা-চিতাবাঘকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় নি গুণ্ডা। একটু পরেই যে তার মা এসে সেখানে উপস্থিত হয়েছে সেই সংবাদও গুণ্ডার অজানা নয়– বনের বাতাস তার নাকে চিতাবাঘদের খবর জানিয়ে দিয়ে গেছে।

এত কাছাকাছি জোড়া চিতাবাঘের উপস্থিতি গুণ্ডা পছন্দ করে না। মুখ তুলে একটা ধমক দেবে কি না ভাবছে, এমন সময়ে তার মাথার উপর দিয়ে হলদেকালে উদার একটা কম্বল উড়ে গেল বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। সচমকে মুখ তুলে তাকাতেই আর একটা হলদেকালো কম্বল বসানো শরীর তাকে ডিঙিয়ে দূরে ছিটকে পড়ল।

হতভম্ব হয়ে কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে রইল গুণ্ডা, তারপরই ব্যাপারটা তার বোধগম্য হল। তার দেহটাকে ডিঙিয়ে চিতাবাঘদের লং জাম্প প্র্যাকটিস গুণ্ডার বিবেচনায় খুব অপমানকর বলেই মনে হল, অতএব ধাবমান চিতাবাঘ দুটিকে পাকড়াও করে তাদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য সে ঘুরে দাঁড়াল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে

সেই মুহূর্তে তার নাকে এসে ধাক্কা মারল একটা গন্ধ। শত্রু! উপর দিকে নাক তুলে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাসগ্রহণ করেই গুণ্ডা বুঝল বনে শত্রুর আবির্ভাব ঘটেছে। এই দিকে ছুটে আসছে অনেকগুলো মানুষ আর কুকুর। মানুষেরা কুকুর সঙ্গে নিয়ে কেন জঙ্গলে আসে সে-কথা ভালোভাবেই জানে গুণ্ডা। চিতাবাঘদের লাফালাফির কারণটাও সে বুঝতে পারল।

.

০৪.

কর্তা, ওরা শিকারের গন্ধ পেয়েছে, চেঁচিয়ে উঠল হারান-সর্দার।

হ্যাঁ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। গলার শিকল নিয়ে কুকুরগুলো যেরকম টানাটানি লাগিয়েছে, তাতে বোঝা যায় তারা শিকারের গন্ধ পেয়েছে।

ওদের ছেড়ে দাও, প্রতাপনারায়ণ আদেশ করলেন

কুকুরগুলো ছাড়া পেয়ে দ্রুতবেগে সামনে এগিয়ে গেল কিছু দূর। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল দলের নেতা ডিক। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল, একটা অনুচ্চ হাঁক দিয়ে সে দিক পরিবর্তন করল।

ভ্রূ কুঁচকে প্রতাপ বললেন, হারান, ব্যাপারটা লক্ষ করেছ? আমার মনে হল একটা জানোয়ারকে অনুসরণ করেই কুকুরগুলো ছুটতে শুরু করেছিল। হঠাৎ যেন নতুন শিকারের সন্ধান পেয়ে ওরা ঘুরে গেল।

প্রতাপ ঠিক ধরেছেন। চিতাবাঘদের গায়ের গন্ধ পেয়েই জন্তু দুটোকে অনুসরণ করেছিল কুকুরের দল। হঠাৎ অন্য একটা গন্ধ নাকে যেতেই থমকে দাঁড়িয়েছে তারা। ডিকের কাছে ওই গন্ধ পরিচিত, পুরোনো শত্রুর উপর প্রতিশোধ নেবার এমন সুযোগ সে ছাড়তে চাইল না কুকুর বাহিনী নিয়ে সে গুণ্ডার গায়ের গন্ধ অনুসরণ করে ছুটতে শুরু করল। শিকারির দলও তৎক্ষণাৎ কুকুরদের পিছু নিতে একটুও দেরি করল না…।

ঝোপের ভিতর থেকে ভেসে এল কুকুরের ক্ষুব্ধ গর্জন আর ঝটাপটির আওয়াজ। ঘোড়ার রাশ টেনে বন্দুক বাগিয়ে ধরলেন প্রতাপনারায়ণ আর দেবেন্দ্রবিজয়, সবিস্ময়ে ভাবতে লাগলেন, এমন জোর ঝটাপটি করছে কোন জন্তু এতগুলো কুকুরের সঙ্গে?

সঙ্গের লাঠিসোঁটাধারী মানুষগুলো এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। কিন্তু তারা কিছু করার আগেই ঝোপের ভিতর থেকে তিরবেগে বেরিয়ে এল দুটো কুকুর। দারুণ আতঙ্কে তাদের গায়ে লোম খাড়া হয়ে উঠেছে এবং নিশানের মতো উদ্ধত লাঙ্গুল প্রবেশ করেছে পেটের তলায়! কুকুর দুটো ভীষণ ভয় পেয়েছে!

ডিক! ডিক কোথায়? চেঁচিয়ে উঠলেন প্রতাপনারায়ণ, ব্রাউনেরও তো দেখা পাচ্ছি না। চল, সবাই এগিয়ে চল।

তীব্রবেগে তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন সেইদিকে, যেদিক থেকে ছুটে এসেছে কুকুর দুটো। তার সঙ্গে ছুটল দেবেন্দ্ৰবিজয়ের ঘোড়া এবং অশ্বারোহীদের পিছন পিছন ছুটতে লাগল লাঠি আর বর্শাধারী গ্রাম্য শিকারির দল।

বেশি দূর যেতে হল না। জঙ্গল শেষ হয়ে যে ফাঁকা মাঠটা দেখা যাচ্ছে, সেই মাঠের উপর পড়ে আছে দুটো প্রকাণ্ড কুকুরের রক্তাক্ত দেহ। একটা আর নড়াচড়া করছে না, আর একটার শরীরে তখনও প্রাণের চিহ্ন বর্তমান।

এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে কুকুর দুটোর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রতাপ, তারপর উত্তেজিত স্বরে ডাকলেন, ডিক! ডিক!

যে কুকুরটা তখনও মৃত্যু-যাতনায় ছটফট করছিল, সে একবার লেজ নেড়ে প্রভুকে স্বাগত জানিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল- পরক্ষণেই তার সমস্ত শরীর ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে আবার সোজা হয়ে আছড়ে পড়ল মাটির উপর। সব শেষ!

হাঁটু পেতে মাটিতে বসে পড়লেন প্রতাপ। সঙ্গীরা চারপাশে ভিড় করে দাঁড়াল। কুকুর দুটোর মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করে দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, চিরে ফাঁক করে দিয়েছে। বুনোনা শুয়োরের কীর্তি!

হারান-সর্দার নীচু হয়ে জমিতে কি যেন লক্ষ করল, তারপর অস্ফুট স্বরে বলল, গুণ্ডার খুরের দাগ দেখতে পাচ্ছি। ওর পায়ের খোঁচ আমি চিনি।

দেবেন্দ্রবিজয় সবিস্ময়ে বললেন, গুণ্ডা! বৌ-ঠাকরুন কি এই জন্তুটার কথাই বলছিলেন প্রতাপ?

প্রতাপ মাথা নেড়ে সায় দিলেন। দাঁত কামড়ে ঠোঁট কামড়ে তিনি আবেগ সামলাতে চেষ্টা করছিলেন।

ডিক তাঁর বাপের আমলের কুকুর। প্রতাপের সঙ্গে অনেক শিকার-অভিযানের সঙ্গী হয়েছিল

হারান বলল, একলা হাতে চার-চারটে ডালকুত্তার মওড়া নিতে পারে এমন খ্যামতা গুণ্ডা ছাড়া এ তল্লাটে কোনো জানোয়ারের নেই।

দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, তবে তো মুশকিল। আমরা ওকে মারতে পারব না। এবার তাহলে ফিরে যাওয়াই ভালো।

হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো ঘুরে দাঁড়ালেন প্রতাপ, কেন? কেন? ওকে মারতে পারব না কেন? তোমার ভয় হলে তুমি ফিরে যেতে পার, আমি এই ব্যাপারের শেষ না দেখে ঘরে ফিরব না।

আমতা আমতা করে দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, না মানে আমি ঠিক ভয় পাইনি। তবে ইয়ে মানে- বৌ-ঠাকরুন বলছিলেন।

বৌ-ঠাকরুন কি বলছিলেন আমি শুনতে চাই না, বাধা দিয়ে গর্জে উঠলেন প্রতাপ, যে শয়তান জানোয়ার ডিককে এমনভাবে খুন করেছে তাকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না। হারান!

–হুজুর!

–শোনো হারান, একটু দূরে ফাঁকা মাঠের ও ধারে যে ঝোঁপটা আছে, ওইখানেই নিশ্চয় শয়তানটা লুকিয়েছে। জমিটা বাঁ দিকে ঢালু হয়ে গেছে, দেখেছ?… ঢালু জমির উপর উঁচু জায়গাটাতে কয়েকজনকে উঠে দাঁড়াতে বল। শুয়োর লাফিয়ে উপরে উঠতে পারবে না, ও ঘুরে একটা ঢাল বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করলে তোমরা উঁচু জায়গা থেকে সড়কি আর লাঠি চালিয়ে ওকে ঘায়েল করতে পারবে। নীচে জঙ্গলের বাইরে একদিকে দেবেনকে নিয়ে আমি পাহারা দেব, আর-একদিকে নজর রাখবে তুমি। দলের আর সবাই ঝোপের ভিতর ঢুকে ওকে তাড়া লাগাও।

প্রতাপনারায়ণের নির্দেশ অনুসারে কাজ শুরু হল। শুয়োরের খোঁচ (পায়ের দাগ) দেখে অভিজ্ঞ হারান-সর্দার জানিয়ে দিল জন্তুটা যে ঝোপের ভিতর রয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কুকুর দুটো কিছুতেই শিকারিদের পথ দেখাতে রাজি হল না। অতএব লাঠি-সোঁটা হাতে মানুষগুলো কুকুরের সাহায্য ছাড়াই বন ঠ্যাঙাতে শুরু করল।

…হঠাৎ ঝোপের ভিতর থেকেতিরবেগে বেরিয়ে এল গুণ্ডা। একটু দূরে খাড়া জমির একপাশে যে ঢালু জায়গাটা রয়েছে সেটাই তার লক্ষ্য বোধহয় উপরে উঠে সে আক্রমণকারীদের ফাঁকি দিতে চায়।

কিন্তু উপর থেকে তাড়া খেয়ে সে আবার নীচে নামতে বাধ্য হল। প্রথমবার সে হারানের পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল, এবার সে শত্রুকে এড়িয়ে যেতে পারল না। হারানের হাতের বর্শা ছুটে এসে বিধল তার কাঁধে। আফ্রিকার জঙ্গলে ওয়ার্ট হগের শক্ত রবারের মতো কাঁধের মাংসপেশী শাপদের সনখ থাবার আক্রমণ বহুবার ব্যর্থ করে দিয়েছে আজ হারান-সর্দারের বর্শাও গুণ্ডার কঠিন স্কন্ধদেশের উপর মারাত্মক দংশনে চেপে বসতে পারল না, এক ঝলক রক্ত ঝরিয়ে অস্ত্রটা ছিটকে পড়ল মাটির উপর। পরক্ষণেই উল্কার মতো ছুটে এল আফ্রিকার জান্তব হিংস্র হারান সর্দারের দিকে।

উপর থেকে কে যেন একটা বর্শা ছুঁড়ে মারল। বর্শা বিঁধল গুণ্ডার পিঠে, কিন্তু তার গতি রুদ্ধ হল না, গুণ্ডা ঝাঁপিয়ে পড়ল হারানের উপর। এক গুঁতো মেরে শত্রুকে ধরাশায়ী করে সে ধারালো দাঁতের সদ্ব্যবহার শুরু করল।

এর মধ্যেই গুণ্ডাকে লক্ষ্য করে ঘোড়া ছুটিয়েছেন দেবেন্দ্রবিজয় আর প্রতাপনারায়ণ। হারানের রক্তাক্ত মৃতদেহটা ছেড়ে এবার নতুন শত্রুর দিকে ঘুরে দাঁড়াল গুণ্ডা। পিঠের উপর বেঁধা বর্শাটাকে এক ঝটকায় ছিটকে ফেলে সে দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে তেড়ে গেল। দেবেন্দ্রবিজয় বন্দুক ছুঁড়লেন, গুণ্ডার রক্তাক্ত শরীরে আরও একটা লাল চিহ্নের সৃষ্টি হল- পরক্ষণেই কাতর আর্তনাদ করে ধরাশয্যা গ্রহণ করল দেবেন্দ্রবিজয়ের ঘোড়া, গুণ্ডার দস্তাঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেছে তার উদর। ঘোড়াকে ছেড়ে সওয়ারের দিকে ফিরল গুণ্ডা। ভূপতিত দেবেন্দ্রবিজয় দুহাতে ভর দিয়ে উঠে বসে সভয়ে দেখলেন বন্দুকটা তার নাগালের বাইরে ছিটকে পড়েছে এবং তাকে লক্ষ্য করে ধেয়ে আসছে মুর্তিমান মৃত্যুর মতো আহত বরাহ।

কিন্তু গুণ্ডা শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই প্রতাপের বন্দুক সশব্দে অগ্নিবর্ষণ করল। এক মুহূর্তের জন্য মাটির উপর লম্বমান হল গুণ্ডার দেহ- পরক্ষণেই রক্তাক্ত দাঁত দুটো উঁচিয়ে সে ছুটে গেল দুই নম্বর শত্রুর দিকে।

প্রতাপ আবার গুলি চালানোর উপক্রম করলেন। তার বরাত খারাপ, ঘোড়াটা হঠাৎ ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল– টাল সামলাতে না পেরে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে প্রতাপ এসে পড়লেন মাটির উপর। বন্দুক হাত থেকে খসে পড়েছিল। সেটাকে হস্তগত করার জন্য হাত বাড়ালেন প্রতাপ, কিন্তু অস্ত্রে হাত দেবার আগেই তার সামনে এসে পড়ল গুণ্ডা।

প্রতাপ দেখলেন বাঁকা ছোরার মতো এক জোড়া ভয়ংকর দাঁত তাঁর দেহ লক্ষ্য করে উদ্যত হয়েছে এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে জ্বলে জ্বলে উঠছে এক জোড়া লাল টকটকে চোখ- এক জোড়া জ্বলন্ত কয়লার মতো!-দারুণ আতঙ্কে তিনি চোখ বুজে ফেললেন।

কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত। শরীরের উপর ধারালো দাঁতের যাতনাদায়ক স্পর্শ পেলেন না প্রতাপ, ভয়ে ভয়ে তিনি আবার চোখ মেলে তাকালেন

একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে গুণ্ডা! সামনের পা দিয়ে মাটি খুঁড়ছে, কিন্তু আক্রমণের চেষ্টা করছে না।

মানুষ ও শূকর পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপরই হঠাৎ একটা অস্ফুট শব্দ করে গুণ্ডা ছুটল। না, প্রতাপের দিকে নয়– তাঁর পাশ কাটিয়ে পিছনের জঙ্গল লক্ষ্য করেই ছুটেছিল গুণ্ডা।

জঙ্গলের ভিতর থেকে তখন বন-তাড়ুয়ারা বেরিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন গুণ্ডাকে রুখতে চেষ্টা করল। শন শন শব্দে ছুটে এসে দুটো বর্শা গুণ্ডার রক্তাক্ত শরীর থেকে আরও কিছুটা রক্ত ঝরিয়ে দিল, প্রচণ্ড শব্দে পড়ল কয়েকটা লাঠি তার পিঠে আর কাঁধে কিন্তু কার সাধ্য রোধে তার গতি? গুণ্ডার গ্রাহ্যই নেই!

এক জন বর্শাধারীকে এক তোয় ছিটকে ফেলে বন-তাড়ুয়াদের ব্যুহ ভেদ করে ঝড়ের মতো ছুটে চলল গুণ্ডা ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে খুরের বাজনা বাজাতে বাজাতে!

প্রতাপের শুকনো গলায় আওয়াজ ফুটল না, কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয় এখন নিজেকে সামলে নিয়েছেন। দুহাতে ভর দিয়ে মাটির উপর উঠে বসে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, মারো! মারো! ও যে গাঁয়ের দিকেই যাচ্ছে!

সত্যি কথা! গুণ্ডার গতি গাঁয়ের দিকেই বটে!

বন-তাড়ুয়ার দল হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। প্রতাপ এবার সম্বিৎ ফিরে পেলেন, যা, যা, ওর পিছনে যা। চোট-খাওয়া জানোয়ার গাঁয়ের ভিতর ঢুকে মানুষ মারতে পারে। যেভাবেই হোক, ওকে সামাল দে।

সাধারণ বন-তাড়ুয়া হলে দলটা আর এগোতে চাইত না। কিন্তু এই দলটা শিকারের তালিম নিয়েছে প্রদ্যোতনারায়ণের কাছে, বুনো জানোয়ারের আক্রমণে অপঘাত মৃত্যু তারা অনেকবার দেখেছে, হুকুম পেলে তারা আহত বাঘের মুখেও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে হৈ হৈ শব্দে তারা ছোটো-হুঁজুরের হুকুম তামিল করতে ছুটল।

.

০৫.

আমরা দুজনেই আজ খুব বেঁচে গেছি, দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, তোমার গুলি খেয়েই জন্তুটা আমাকে ছেড়ে তোমার দিকে ফিরল। কিন্তু সামনে এসে তোমাকে ও কিছু বলল না– ভারি আশ্চর্য ব্যাপার। তাই না?

মাথা নেড়ে বন্ধুর কথায় সায় দিলেন প্রতাপ, তারপর হারানের রক্তাক্ত মৃতদেহের দিকে আঙুল তুলে বললেন, আমার অবস্থাও হত হারান-সর্দারের মতো, তবে

তবে?–

তবে আফ্রিকার বুনো শুয়োরের স্মৃতিশক্তি খুব জোরালো বলেই বোধহয় এযাত্রা বেঁচে গেলাম।

হা হা করে হেসে উঠে দেবেন্দ্রবিজয় বললেন, স্মৃতিশক্তি না ঘোড়ার ডিম। তুমি যদি ভেবে থাকো ও তোমাকে চিনতে পেরে ছেড়ে দিয়েছে তাহলে বলব তুমি একটি আস্ত হাঁদাগঙ্গারাম। বুনো জানোয়ার অনেক সময় অপ্রত্যাশিত কাণ্ড করে থাকে। শিকারি হিসাবে তুমি কি জানো না আমার কথা কতটা সত্যি?

আশেপাশে আরও লোকজন ছিল বলেই জন্তুটা ভয় পেয়েছিল, আর সেইজন্যই শেষ মুহূর্তে ওটা তোমাকে আক্রমণ করতে সাহস পায়নি।

প্রতাপ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, অস্ফুট স্বরে তিনি বললেন, হয়তো তোমার কথা সত্যি, হয়তো তোমার কথা সত্যি নয়। কিন্তু আমার মনে হয়

হঠাৎ চমকে উঠলেন প্রতাপ, উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, গাঁয়ের শিকারিদের হাতে বন্দুক নেই, আছে শুধু বর্শা আর লাঠি। গুণ্ডার কবলে যদি আবার কারও প্রাণ যায় তাহলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। দেবেন, তোমার ঘোড়াটা তো মারা গেছে, তুমি আস্তে আস্তে হেঁটে এস। আমি ঘোড়া ছুটিয়ে চললুম গুণ্ডার খোঁজে। ফিরে এসে হারানের মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা করব।

দেবেন্দ্রবিজয় মাথা নেড়ে বন্ধুকে সমর্থন জানালেন। ধুলোর ঝড় তুলে প্রতাপের ঘোড়া ছুটল গ্রামের দিকে…

সিংদরজার সামনে দণ্ডায়মান জনতা চমকে উঠল। দুই হাতে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে প্রতাপ বলে উঠলেন, তোরা এখানে কী করছিস? গুণ্ডা কোথায়?

লাঠি হাতে একজন শিকারি বলে উঠল, হুজুর! জন্তুটা ভিতরে চলে গেছে।

-বলিস কি! আর তোরা এখানে দাঁড়িয়ে সং-এর মতো তামাশা দেখছিস! ভিতরে যেতে সাহস হল না? ও যদি ঝি-চাকরদের কাউকে চোট করে? কেমন মরদ তোরা? শিকারের পিছু নিতে ভয় পাস?

একাধিক কণ্ঠ উগ্রস্বরে সাড়া দিল, ভয়? আজ্ঞে ভয় মোরা যমকেও করি না। বড়ো হুজুরের সাথে আমরা অনেকবার শিকারে গেইছি। কিন্তুক বৌ-ঠাকরুন

–বৌ-ঠাকরুন?

—আজ্ঞে হাঁ, বউ-ঠাকরুন তো আমাদের মানা করলেন ভেতরে আসতে।

–সেকি!

-আজ্ঞা হাঁ। উপর থেকে তিনি তো বলে দিলেন, তোরা ভেতরে আসবি না। তাই জন্য তো মোরা এখানে দাঁইড়ে রইচি।

-বেশ করেছ। তবে তোদর বৌ-ঠাকরুনের বুদ্ধি আছে। চোট-খাওয়া জানোয়ার উপরে গিয়ে লোকজন জখম করতে পারে সে বিষয়ে ও নিশ্চয়ই খেয়াল রেখেছে, আর লাঠি-সড়কি দিয়ে শুয়োর মারতে গিয়ে তোরা বিপদে পড়বি সেটাও বোধহয় ও চায় না– উপরে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে শান্তা বোধহয় আমার জন্যই অপেক্ষা করছে।

–আজ্ঞা না। উপরের দরজা বন্ধ হয়নি। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে বৌ-ঠাকরুন তো নেমে গেলেন নীচে।

সর্বনাশ, দারুণ আতঙ্কে চমকে উঠলেন প্রতাপ, ও সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নীচে! আরে, ওইখানেই কোথায় গুণ্ডা ঘাপটি মেরে আছে কে জানে… তোরা সব জেনেও বৌ-ঠাকরুনের কথা বেদবাক্যি ধরে নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?

বন্দুক বাগিয়ে এক লাফে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়লেন প্রতাপ, তারপর দ্রুতবেগে পা চালিয়ে দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। ঘোড়ার পিঠে ভিতরে ঢুকতে সাহস হল না, ভড়কানো-ঘোড়া যদি আবার ঘাবড়ে যায় তবে তার পিঠ থেকে গুলি চালানো মুশকিল হবে।

জনতা হঠাৎ প্রতাপের অগ্রগতিতে বাধা দিল, আমরা ভিতরে তো গেছিলাম। কিন্তু বৌ-ঠাকরুন আবার ধমকে উঠতে বেইরে এইচি। কিন্তু আপনি ভেতরে যাবেন না। বিপদ হতি পারে।

গর্দভ, রাগে ফেটে পড়লেন প্রতাপ, আমার বিপদ হতে পারে বলে খুব তত দরদ দেখাচ্ছিস! আর একটা মেয়েমানুষের কি অবস্থা হতে পারে ওই শুয়োরটার সামনে পড়লে সে খেয়াল আছে?

সমান ওজনে জবা এল, আজ্ঞা, খেয়াল থাকবে না কেনে? দেখেই তো এলাম বৌ-ঠাকরুন ওই গুণ্ডার সামনে বসে আছে। কিন্তু আপনাকে দেখলে ও নিচ্যয় মেরে দিবে।

অ্যাঁ! বলে কি! চোট-খাওয়া শুয়োরের সামনে বসে আছে শান্তা! জনতার দিকে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেউড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন প্রতাপনারায়ণ।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে তিনি অট্টালিকার পিছন দিকে এগিয়ে গেলেন। নিশ্চয় বিরাট উঠানের পিছন দিকেই রয়েছে গুণ্ডা। ওইখানেই তো ছিল ওর খোঁয়াড়। এতক্ষণে শান্তাকে মেরে ফেলেছে কি না কে জানে- প্রতাপের বুকের ভিতর কাঁপতে লাগল, কল্পনায় ভেসে উঠল শান্তার প্রাণহীন দেহ, শুকরের দস্তাঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন ও রক্তাক্ত…

রক্তের মতোই লাল টকটকে দুটি জলভরা চোখ মেলে তাকালেন শান্ত, আর কেন? ওকে শান্তিতে মরতে দাও। আধমরা জীবটার উপর গুলি চালিয়ে আর নাই বা বীরত্ব দেখালে?

গুণ্ডা তখনও মরেনি। পরিত্যক্ত খোয়াড়টার সামনে শান্তার পায়ের কাছে পড়ে সে অতি কষ্টে নিঃশ্বাস ফেলছে। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকাতে পারলেন না প্রতাপ, বলতে পারলেন না এইমাত্র জন্তুটা নরহত্যা করে এসেছে মুখ নীচু করে তিনি সরে গেলেন সেখান থেকে।

 পাঠান মুলুকের বাঘ

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ সরকারের অধীন। সেই সময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের একটি পার্বত্য অঞ্চলে একদল গোরখা সৈনিকের নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেছিলেন মেজর পি. এডওয়ার্ডস নামক জনৈক ইংরেজ।

সেনাদলের ছাউনি পড়েছে পেশোয়ার থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা ছোটো শহরের কাছে। পাহাড়ের উপর অবস্থিত ওই সেনানিবাসের নীচে পার্বত্য ভূমির উপর পাঠানদের একটি গ্রাম। পাঠান মুলুকের মানুষের সঙ্গে তখনকার ইংরেজ সরকারের সম্পর্ক ছিল অহি-নকুল সম্পর্কের মতোই মধুর। অতএব স্থানীয় বাসিন্দারা যে মেজরের গোরখা বাহিনীকে দেখে বিশেষ খুশি হয়নি, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিছু দিনের মধ্যেই স্থানীয় পাঠানদের সঙ্গে গোরখাদের কয়েকটা ছোটোখাটো সংঘর্ষ হয়ে গেল। তবে ব্যাপারটা খুব বেশি গুরুতর হওয়ার আগেই উভয় পক্ষে মিটমাট হয়ে যায় এবং সৈন্যদের দিন কাটতে থাকে বেশ শান্ত ভাবেই।

মেজর একদিন মধ্যাহ্নভোজনের জন্য প্রস্তুত হয়ে টেবিলের সামনে এসে বসেছেন, হঠাৎ তার সামনে ছুটে এল তারই অধীনস্থ এক সৈনিক ধান বাহাদুর।

উত্তেজিত ধান বাহাদুরের মুখ থেকে মেজর শুনলেন নিকটবর্তী গ্রাম থেকে খান মহম্মদ নামক জনৈক পাঠান এক চিতাবাঘের চমকপ্রদ আবির্ভাবের সংবাদ বহন করে এনেছে। উক্ত খান মহম্মদ নাকি চিতাবাঘটিকে স্বচক্ষে দেখে সেনানিবাসকে খবর দিতে এসেছে।

মেজর কথাটা বিশ্বাস করলেন না। আশেপাশে বড়ো জঙ্গল নেই, দুপুরের কাঠফাটা রোদে লোকালয়ের এত কাছে চিতাবাঘের আবির্ভাব বিশ্বাসযোগ্য নয়।

বাঘ কিংবা বাঘের জাত-ভাইদের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে আমাদের মেজর সাহেবের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, জীবনে তিনি কখনো বাঘ অথবা চিতাবাঘ দেখেন নি, কিন্তু শুনেছেন, ছোটো বড়ো কোনো বাঘই প্রকাশ্য দিবালোকে লোেকালয়ের আশেপাশে পদার্পণ করে না।

মেজর সাহেব কথাটা বিশ্বাস করতে চাইছেন না দেখে ধান বাহাদুর বাইরে বেরিয়ে গেল এবং একটু পরেই খান মহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে মেজরের সামনে উপস্থিত হল। খান মহম্মদ খুব জোরের সঙ্গে বলল যে, সে ভুল করে নি, মেজর সাহেব যদি তার সঙ্গে যেতে রাজি থাকেন তবে যেখানে সে চিতাবাঘটাকে দেখেছিল সেই জায়গাটা সে সাহেবকে দেখিয়ে দিতে পারে।

খান মহম্মদের কথা শুনে খাওয়া মাথায় উঠল মেজরের, দুপুরের খানা ফেলে খান মহম্মদের সঙ্গে অকুস্থল দর্শন করতে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে কিছু দূরে এসে খান মহম্মদ সত্যিই কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখিয়ে দিল। ছাপগুলো দেখে সাহেব বুঝলেন, সেগুলো কোনো চতুষ্পদ পশুর থাবার।

আগেই বলেছি, জন্তু-জানোয়ারের ব্যাপারে মেজর ছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ, তাই পদচিহ্নের মালিক কোন চতুস্পদ পশু, তা তিনি বুঝতে পারলেন না। কিন্তু খান মহম্মদের কছে তো তা কবুল করা যায় না। তাই তিনি অটল গাম্ভীর্যের সঙ্গে মস্তক আন্দোলন করে তাকে জন্তুটার বর্ণনা দিতে বললেন। প্রবল উৎসাহে খান মহম্মদ জন্তুটার বিশদ বর্ণনা দিল, চিতাবাঘের গায়ের উপর লম্বা লম্বা ডোরার কথাও সে উল্লেখ করতে ভুলল না। শুনে মেজরের দুই চক্ষু ছানাবড়া! অ্যাঁ! ওটা তাহলে বুটিদার চিতাবাঘ নয়, ভোরাদার বাঘ! লেপার্ড নয়, টাইগার!

যদিও পশু-জগৎ সম্বন্ধে মেজর সাহেবের ধারণা ছিল নিতান্তই সীমাবদ্ধ, তবু বাঘ সম্বন্ধে যে সব জনশ্রুতি তার কানে এসেছিল তাতে তার ধারণা হল যে, উক্ত জীবটি মোটেই সুবিধের নয়। অবশ্য চিতাবাঘের সান্নিধ্যও মানুষের পক্ষে বিশেষ আনন্দদায়ক নয়, তবে বাঘ নাকি চিতাবাঘের চাইতেও অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি ভয়ানক।

যাই হোক, এখন আর পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। বাঘের পিছু না নিলে পাঠানরা তাঁকে কাপুরুষ ভাববে, চাই কি সামনাসামনি বিদ্রূপও করতে পারে। পাঠানদের বিদ্রুপের পাত্র হতে রাজি নন মেজর এডওয়ার্ডস। তিনি খান মহম্মদকে জানিয়ে দিলেন, বাঘটাকে তিনি মারতে চেষ্টা করবেন। খান মহম্মদ খুব খুশি, সে তৎক্ষণাৎ গ্রামবাসীদের খবর দিতে ছুটল।

মেজর কিন্তু বিশেষ উৎফুল্ল হতে পারেন নি। শিকার সম্বন্ধে তার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না, এবং তার হাতের টিপ ছিল এত খারাপ যে পরিচিত ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে তিনি ছিলেন বিদ্রুপের পাত্র।

কিন্তু হাতের টিপ না থাকলেও মেজর সাহেবের সাহসের অভাব ছিল না, জীবন বিপন্ন করেও তিনি বাঘটাকে হত্যা করার সংকল্প করলেন।

সেনানিবাসে ফিরে এসে মেজর গোরখাদের সব কথা জানালেন এবং তাদের সাহায্য চাইলেন। প্রত্যেকেই সাগ্রহে বাঘ-শিকারে অংশগ্রহণ করতে চাইল। দলের ভিতর থেকে হাবিলদার শিশুপালকে ডেকে সাহেব বললেন, সে যেন তার পছন্দমতো দুজন সৈন্যকে নিয়ে তার সঙ্গে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুপাল হাবিলদারের সঙ্গে দুজন গোরখা সৈনিক মেজরকে বাঘ শিকারে সাহায্য করতে এগিয়ে এল।

অতঃপর যেখানে পায়ের ছাপগুলো দেখা গিয়েছিল, সেইখানে এসে উপস্থিত হলেন মেজর এবং তাঁর সহকারী তিন সৈনিক। শিকারের ব্যাপারে সকলেই আনাড়ি, কাজেই শক্ত মাটির উপর বাঘের পায়ের ছাপ অনুসরণ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হল না।

অগত্যা মেজর সাহেব আবার খান মহম্মদের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের সমস্যার কথা জানাতে বাধ্য হলেন। খান মুহম্মদ পাকা লোক, শক্ত পাথুরে মাটির উপরেও সে কি করে বাঘের যাতায়াতের চিহ্ন আবিষ্কার করল সে-ই জানে, কিছুক্ষণের মধ্যে একটা সঙ্কীর্ণ নালার কাছে এসে সে মেজরকে জানিয়ে দিল– ওই নালাটার ভিতরই বাঘ আশ্রয় নিয়েছে।

খান মহম্মদ এবার একা আসে নি, তার সঙ্গে এসেছিল বহু সংখ্যক গ্রামবাসী। এতগুলো নিরস্ত্র মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হলেন না মেজর, তার অনুরোধে পাঠানরা উঁচু জমির উপর দাঁড়িয়ে চারদিকে নজর রাখতে লাগল এবং মেজর তার সঙ্গীদের নিয়ে নেমে গেলেন নালাটার ভিতরে।

মেজরের সঙ্গীরা সকলেই সশস্ত্র নয়। মেজর ও হাবিলদার শিশুপাল রাইফেল হাতে এগিয়ে গেলেন। তাদের পিছনে আসতে লাগল দুজন নিরস্ত্র সৈনিক।

খানিকটা নামতে না নামতেই উপর থেকে ভেসে এল পাঠানদের উচ্চ কণ্ঠস্বর। খান মহম্মদ ও তার সঙ্গীরা চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে বাঘ পাহাড়ের অন্য দিক দিয়ে সরে পড়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে মেজর তার সঙ্গীদের নিয়ে নালার ভিতর থেকে উপরে উঠে এলেন, তার পর খান মহম্মদের নির্দেশ অনুসারে বাঘের সন্ধানে যাত্রা করলেন। খান মহম্মদ সাহেবকে জানাল, কাছেই কয়েকটা পরিত্যক্ত কুটির ও একটি গোয়ালঘর আছে, বাঘ সেইদিকেই গেছে।

ভালো কথা, মেজর বললেন, তুমি পথ দেখাও।

খান মহম্মদ মহা উৎসাহে শিকারিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। তার সঙ্গীরা অবশ্য এল না, কারণ মেজর তাদের ঘরে ফিরে যেতে বলে দিয়েছেন।

পথ-প্রদর্শক খান মহম্মদ যেখানে এসে থামল, সেখানে ঢালু জমির উপর একটা গভীর খাদের পাশে রয়েছে কয়েকটি পরিত্যক্ত কুটির ও একটি গোয়ালঘর। ওই কুঁড়ে ঘর ও গোয়ালের নীচে ঢালু পাহাড়ের গায়ে প্রায় বিশ গজ ফাঁকা জায়গার মধ্যে কোনো ঝোঁপঝাড় নেই, কিন্তু তারপরই শুরু হয়েছে ঘন ঝোঁপ-জঙ্গল আর সেই ঝোপের ভিতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো শুকনো গাছের সারি।

জানোয়ার ওইখানেই আছে।- ঝোপগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল খান মহম্মদ।

মেজর শুধু ওইটুকুই জানতে চেয়েছিলেন। খান মহম্মদকে স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে মেজর এইবার বাঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করার উদ্যোগ করলেন। তার পরিকল্পনা : দুজন নিরস্ত্র সৈনিক গোয়ালঘর ও কুটিরগুলোর বাঁ দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে ঝোপের উপর পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করবে এবং পূর্বোক্ত স্থানের ডান দিক দিয়ে ঘুরে এসে হাবিলদার ও স্বয়ং মেজর রাইফেল হাতে অপেক্ষা করবেন বাঘের জন্য। নরকণ্ঠের চিৎকার ও প্রস্তর বৃষ্টিতে বিব্রত হয়ে বাঘ নিশ্চয়ই ঝোপের আশ্রয় ছেড়ে শিকারিদের সামনে আত্মপ্রকাশ করতে বাধ্য হবে আর তৎক্ষণাৎ তাকে সগর্জনে অভ্যর্থনা জানাবে দুদুটো মিলিটারি রাইফেল।

মেজরের আদেশ অনুসারে গোয়ালঘর ও পরিত্যক্ত কুটিরগুলোর বাঁ দিক দিয়ে ঘুরে গেল দুজন নিরস্ত্র সৈনিক এবং ডান দিক দিয়ে ঘুরে এসে রাইফেল হাতে সাগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন মেজর ও হাবিলদার।

আচম্বিতে নির্জন পাহাড়ের নীরবতা ভঙ্গ করে জেগে উঠল শ্বাপদ কণ্ঠের বজ্রনাদ আর তার পরক্ষণেই নর কণ্ঠের আর্ত-চিৎকার!

মেজর বুঝলেন, আক্রান্ত হওয়ার আগেই পাঠান মুলুকের বাঘ শত্রুকে আক্রমণ করেছে। ইঙ্গিতে হাবিলদারকে অনুসরণ করতে বলে শব্দ লক্ষ্য করে ছুটলেন তিনি। অকুস্থলে পৌঁছে এক জন সৈনিককে তাঁরা দেখতে পেলেন মারাত্মক অবস্থায়। লোকটির মাথার পিছন দিক থেকে মাংসের খণ্ড ছিঁড়ে ঝুলছে এক ফালি ছেঁড়া কাপড়ের মতো এবং ক্ষতস্থান থেকে তপ্ত রক্তের ধারা গড়িয়ে নামছে তার সর্বাঙ্গ প্লাবিত করে!

ওই অবস্থাতেও টলতে টলতে সৈন্যটি এগিয়ে এল সাহেবের দিকে, একবার অস্পষ্ট স্বরে শুধু বলল, আমি আহত, জন্তুটা আমাকে মেরেছে!

তার পরই অজ্ঞান হয়ে সে পড়ে গেল মাটিতে।

মেজর ও হাবিলদার ধরাধরি করে আহত সেনাটিকে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলেন সেনাটির নাম প্রেম সিং এবং তার নিখোঁজ সঙ্গীর নাম শামশের বাহাদুর। মেজর চিৎকার করে শমশেরের নাম ধরে ডাকলেন, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

ইতিমধ্যে হাবিলদার আহত সৈনিকটির মাথায় সুন্দরভাবে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে ফেলেছে। প্রেম সিংয়ের চেতনা ফিরে এল একটু পরেই। মেজরের আদেশে আহত প্রেম সিংকে নিয়ে হাবিলদার সেনানিবাসের দিকে রওনা হল সুতরাং নিঃসঙ্গ মেজরের ঘাড়ে পড়ল গুরুদায়িত্বের ভার।

বাঘের সঙ্গে নিরুদ্দিষ্ট শামশেরকেও এখন খুঁজে বার করতে হবে। মেজরের আশঙ্কা, শামশেরও হয়তো বাঘের কবলে পড়েছে।

মেজর এডওয়ার্ডস পলাতক ব্যাঘ্রের সন্ধান কতক্ষণে পেতেন অথবা আদৌ পেতেন কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু এইবার বাঘেরই বুঝি ধৈর্যচ্যুতি হল- সে নিজেই এগিয়ে এল মেজরের সঙ্গে দেখা করতে!

ঝোপের ভিতর থেকে হঠাৎ ফাঁকা জায়গার উপর আত্মপ্রকাশ করল বাঘ!

মেজর গুলি চালানোর সময় পেলেন না, ভীষণ গর্জন করে বাঘ তার দিকে তেড়ে এল।

একটা মস্ত পাথরের পাশে সরে গেলেন মেজর। বাঘ তাকে লক্ষ্য করে মারল লাফ।

বাঘ খুব তাড়াতাড়ি লাফ মেরেছে বটে, কিন্তু মেজর সাহেব তার চেয়েও তাড়াতাড়ি সরে গেছেন। নখরে সজ্জিত একটা থাবা বোঁ করে মেজরের মুখের পাশ দিয়ে শুন্যে ছোবল মারল, পরক্ষণেই লক্ষ্যভ্রষ্ট শ্বাপদ মেজরের থেকে কয়েক হাত দূরে মাটির উপর এসে পড়ল।

বাঘ কিন্তু এবার শত্রুর দিকে ঘুরে দাঁড়াল না, সোজা ছুটল সামনের দিকে। মেজর বাঘকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন এবং তার স্বভাবসিদ্ধ নিশানায় বাঘের বদলে একটা পাথরকে ঘায়েল করল। রাইফেলের গুলি বাঘকে বিদ্ধ করতে না পারলেও রাইফেলের গর্জন বাঘের গতিবেগ বৃদ্ধি করতে বিলক্ষণ সহায়তা করল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জন্তুটা একটা ঝোপের ভিতর ঢুকে লুকিয়ে পড়ল।

এতক্ষণ পর্যন্ত মেজরের মনে অস্বস্তি ও আতঙ্কের আভাস ছিল, এইবার তিনি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন। যদিও কোনো পক্ষেরই রক্তপাত হয়নি এবং যদিও বাঘের থাবার মতো মেজরের রাইফেলও অবস্থানকেই বিদ্ধ করেছে, তবু নিজেকে বিজয়ী মনে করে মেজর উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। আক্রমণকারী বাঘ রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করেছে, কিন্তু মেজর এখনও রণস্থলে উপস্থিত; অতএব পলাতক শত্রুকে পরাজিত মনে করে মেজর যদি উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, তবে তাকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না।

মেজর এডওয়ার্ডস নতুন উদ্যমে পলাতক ব্যাকে অনুসরণ করার উপক্রম করছেন, এমন সময় তার সামনে আবির্ভূত হল নিরুদ্দিষ্ট সৈনিক শামশের বাহাদুর!

মেজর দেখলেন, সামশের সম্পূর্ণ অক্ষত, তার দেহে কোথাও আঁচড় কামড়ের দাগ নেই। তিনি খুবই খুশি হলেন। শামশের তাকে যে ঘটনার বিবরণী দিল, তা হচ্ছে এই :

মেজরের নির্দেশ অনুসারে সে এবং প্রেম সিং ঝোপের ভিতর পাথর ছুঁড়তে উদ্যত হয়। হঠাৎ প্রেম সিং বলে, বাইরে থেকে পাথর না ছুঁড়ে ঝোপের ভিতর প্রবেশ করে পাথর ছুড়লে বাঘকে তাড়াতাড়ি তাড়িয়ে আনা যায়। শামশের সঙ্গীর প্রস্তাবে সম্মত হয়নি, সে তাকে নিষেধ করে। শামশেরের নিষেধে কর্ণপাত না করে প্রেম সিং ঝোপের ভিতর প্রবেশ করে এবং একটু পরেই শামশের শুনতে পায় বাঘের গর্জন ও সঙ্গীর আর্তনাদ। ঝোপের কিনারায় এসে শামশের তখন বাঘকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে থাকে। ক্রমাগত প্রস্তর বৃষ্টির ফলে বাঘ বিব্রত হয়ে পড়ে, তাই প্রেম সিংকে জখম করলেও জন্তুটা হত্যা করতে পারেনি, মেজর সাহেব ও হাবিলদার যখন অকুস্থলে উপস্থিত হয়েছেন, বাঘ তখন প্রেম সিংকে ছেড়ে দিয়ে আহত শিকারের একটু দূরেই বসে আছে। মেজর যখন শামশেরকে উদ্দেশ করে চিৎকার করছেন, তখন শামশের তার ডাক শুনেও সাড়া দিতে সাহস পায় নি, কারণ তার কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট হয়ে বাঘ হয়তো তাকেই আক্রমণ করত।

মেজর বুঝলেন, শামশের বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করেছে। তিনি তাকে সেনানিবাসে ফিরে যেতে বললেন এবং আহত প্রেম সিং-এর পরিচর্যায় নিযুক্ত হাবিলদারকে সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন।

সানন্দে মেজরের আদেশ পালন করতে চলে গেলে শামশের। মেজর সম্পূর্ণ একক ভাবেই। বাঘের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হলেন। এবং তার পরেই যা করলেন, তা মুখ ও আনাড়ি ছাড়া কেউ করে না।

ঢালু জমি বেয়ে তিনি নীচের দিকে নেমে গেলেন সেই ঝোঁপটার দিকে, যেখানে একটু আগেই বাঘ গা-ঢাকা দিয়েছে। মেজর ঝোঁপটার কাছে আসতে-না-আসতেই বাঘ ঝোপের বাইরে এসে পূর্বোক্ত গোয়ালঘর লক্ষ্য করে দৌড় দিল। মেজর দুবার গুলি ছুড়লেন। ভাগ্যক্রমে একটা গুলি বোধহয় বাঘের গায়ে লেগে থাকবে। কারণ হঠাৎ ঘরে দাঁড়িয়ে বাঘ মেজরের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠল। মেজর ভাবলেন, বাঘ এইবার তার দিকে তেড়ে আসবে, কিন্তু জন্তুটা দাঁত খিঁচিয়ে মেজরকে এক ধমক দিয়েই গোয়ালঘরের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাকে অনুসরণ করে মেজর গোয়ালঘরের পিছনে এসে দেখেন, বাঘ অদৃশ্য!

মেজর ভাবতে লাগলেন, এখন কি করা যায়। বাঘ কোথায় আছে কে জানে! সে গোয়ালঘরের অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে, অথবা পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরগুলোর যে কোনো একটির মধ্যেই গা-ঢাকা দিলেই বা তাকে খুঁজে বার করছে কে? অন্ধকার গোয়ালঘরের ভিতর অনুসন্ধানেরও কোনো উপায় নেই। প্রত্যেকটি কুটিরের ভিতর ঘুরে ঘুরে বাঘের সন্ধান চালানোর অর্থ আত্মহত্যারই নামান্তর।

তবে? এখন কি করা যায়?…

শিকারি হিসাবে আনাড়ি হলেও এডওয়ার্ডস হচ্ছেন একজন সৈনিক পুরুষ। সাধারণ সৈনিক তিনি নন, দস্তুর মতো একজন মেজর এবং ব্রিটিশ মেজর! অতএব আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণের কায়দাকানুন তিনি ভালোই বোঝেন। মাটি থেকে পাথর কুড়িয়ে তিনি পরিত্যক্ত কুঁড়ে ঘরগুলির উপর প্রস্তরবৃষ্টি শুরু করলেন। আগেই তিনি দেখে নিয়েছেন, পরিত্যক্ত কুটিরগুলোর মধ্যে কোনোটারই দরজার বালাই নেই। দরজার পরিবর্তে যে ফাঁকগুলো হাঁ করে আছে, তারই ভিতর দিয়ে দমাদ্দম শব্দে মেজরের নিক্ষিপ্ত পাথরগুলো ভিতরে গিয়ে পড়তে লাগল।

কিন্তু বাঘের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

একে একে সব কুটিরগুলোর মধ্যেই পাথর বৃষ্টি করে যখন বাঘের সাড়া পাওয়া গেল না, তখন মেজর সাহেব গোয়ালঘর আক্রমণ করলেন। এইবার ফল হল অন্ধকার গোয়ালঘরের ভিতর থেকে ভীষণ গর্জন করে বাঘ জানিয়ে দিল, এই সব পাথর ছোঁড়াছুড়ির ব্যাপারটা সে মোটেই পছন্দ করছে না!

বাঘের সাবধানবাণীতে মেজর কিন্তু কর্ণপাত করলেন না। দ্বিগুণ উৎসাহে তিনি পাথর ছুঁড়তে লাগলেন। গোয়ালঘরের অন্ধকার গর্ভ থেকে ভেসে আসা গর্জন ধ্বনি ক্রমশ হয়ে উঠল আরও ভয়ঙ্কর, আরও তীব্র, আরও হিংস্র!

অবশেষে সম্মুখযুদ্ধে আত্মপ্রকাশ করল বাঘ। এত দ্রুতবেগে সে গোয়ালঘরের ভিতর থেকে বাইরে এল, এমন অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সে মেজরকে লক্ষ্য করে লাফ দিল যে, সমস্ত ব্যাপারটা তিনি ভালো করে বুঝতেই পারলেন না। তিনি শুধু দেখলেন, কালো-হলুদ ডোরাকাটা এক জীবন্ত বিদ্যুৎ শূন্যকে বিদীর্ণ করে উড়ে আসছে তারই দিকে!

নিশানা স্থির করার সময় নেই তখন, রাইফেল তুলে ট্রিগার টিপে দিলেন মেজর। রাইফেল গর্জে উঠল। পরক্ষণে এক প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে মেজর সাহেব ঠিকরে পড়ে গেলেন মাটির উপর। ভাগ্যক্রমে রাইফেলটা তার হস্তচ্যুত হয়নি, তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন, মাত্র কয়েক হাত দূরে তিনি ছিটকে পড়েছেন।

মেজর তখন এত উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন যে, বাঘের ধারালো নখের আঘাতে তার জামাটা যে ছিঁড়ে গেছে, সেটা খেয়ালই করেননি। পরে অবশ্য তিনি বুঝেছিলেন, একটুর জন্য তার জীবন বেঁচে গেছে- বাঘের লাফ ফসকে গেছে, দ্বিতীয় বারও সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।

মেজরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বাঘ ছিটকে পড়েছিল। সে এই বার মেজরের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চাইল, তার সর্বাঙ্গের পেশিতে জাগল মৃদু কম্পন আক্রমণের পূর্বাভাস!

মেজর এডওয়ার্ডস বাঘের মস্তক লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রকাণ্ড মাথাটা প্রসারিত দুই থাবার উপর নেমে এসে স্থির হয়ে গেল।

সব শেষ!

আনাড়ি মেজরের গুলি এইবার লক্ষ্যভেদ করেছে!

বন্ধু রবিনহুড

নটিংহ্যাম প্রদেশের নিকটস্থ আলসফোর্ড শহরের একটি সরাইখানায় বসে একজন অ্যাংলো-স্যাক্সন তরুণ ভোজন করছিল। আগন্তুকের মলিন পরিচ্ছদ দেখলেই বোঝা যায় সে অতি দরিদ্র। তার আহার্যও ছিল অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের। স্পষ্টই বোঝা যায় বেশি দাম দিয়ে ভালো খাবার খাওয়ার সামর্থ্য তার নেই।

একটু দূরে আর একটি টেবিলে তিন জন নর্মান সৈনিক পানভোজন করতে করতে নিজেদের মধ্যে কথা কইছিল এবং মাঝে মাঝে স্যাক্সন তরুণটির দিকে বক্র কটাক্ষে দৃষ্টিনিক্ষেপ করছিল। অনুমান করা যায় তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে পূর্বোক্ত স্যাক্সন তরুণ।

নর্মান সেনাদের পানভোজনের পালা প্রায় শেষ। সুরার পাত্রে শেষ চুমুক দিয়ে শুন্য পাত্র সশব্দে টেবিলের উপর নামিয়ে একজন সৈনিক কাষ্ঠাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল, তারপর সঙ্গীদের দিকে চোখের ভঙ্গিতে ইশারা জানিয়ে তরুণের পাশে এসে দাঁড়াল। অপর দুটি সৈনিকও . উঠে এসে তরুণটিকে ঘিরে দণ্ডায়মান হল।

যে সৈন্যটি প্রথমে উঠে গিয়েছিল, সে তরুণকে উদ্দেশ করে বলল, ওরে হতভাগা, তোর চেহারা দেখেই বুঝেছি তোর কাছে পয়সাকড়ি কিছু নেই। বিনা পয়সায় খাওয়ার জায়গা এটা নয়, বুঝেছিস?

তরুণ মুখ তুলে তাকাল, কথা কইল না। উত্তর না পেয়ে বক্তা খেপে গেল। সে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, কিরে, কথার উত্তর দিচ্ছিস না যে? ভদ্রলোকের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয় তাও জানিসনা? এখনই উঠে দাঁড়া। বর্বর স্যাক্সন! আমরা দাঁড়িয়ে আছি আর তুই বসে আছিস?

পার্শ্বে দণ্ডায়মান দুই সৈনিকের মধ্যে একজন হেসে বলল, ওহে রবার্ট! এই স্যাক্সনগুলো ভালো কথার মানুষ নয়। ওকে ভদ্রতা শিখিয়ে দাও। এই রোগের জন্য কড়া ওষুধ দরকার।

সঙ্গেসঙ্গে প্রথম সৈনিক তরুণের চোয়ালে সজোরে ঘুসি বসিয়ে দিল। তরুণ ছিটকে পড়ল মাটিতে। আহত চোয়ালে একবার হাত বুলিয়ে সে উঠে বসল, তারপর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল।

কিন্তু সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই দ্বিতীয় সৈনিক তার মুখের উপর প্রচণ্ড বেগে পদাঘাত করল। স্যাক্সন তরুণ রক্তাক্ত মুখে আবার লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর।

কয়েক মুহূর্ত অবসন্ন ভাবে পড়ে থেকে তরুণটি উঠে বসল। কিন্তু এবার সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল না। ভূমিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে স্থির হয়ে বসে রইল।

নর্মানরা চমকে গেল। তাদের পায়ে ছিল লোহার জুতো। সেই জুতো-পরা পায়ের লাথি সজোরে মুখের উপর পড়লে যে কোনো মানুষের পক্ষে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু এই স্যাক্সন ছোকরা অজ্ঞান হওয়া তো দুরের কথা, মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ পর্যন্ত করছে না। এমন কি তার চোখে মুখে যন্ত্রণার কোনো চিহ্নও ফুটে ওঠেনি।

যে সৈন্যটি পদাঘাত করেছিল, সে আবার লাথি মারার উদ্যোগ করল, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হল না। আচম্বিতে তার কাঁধের উপর এসে পড়ল একটি হাত, পরক্ষণেই প্রবল আকর্ষণে তার দেহটা ছিটকে এল কয়েক হাত দূরে।

তিনটি সৈনিক সচমকে দেখল, সরাইখানার মধ্যে উপস্থিত হয়েছে এক বলিষ্ঠ পুরুষ। বলা বাহুল্য, সেই নবাগত পুরুষই টান মেরে প্রহারে উদ্যত সৈনিকটিকে স্যাক্সন তরুণের সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছে।

এই অভাবিত স্পর্ধায় তিন সৈনিক স্তম্ভিত হয়ে গেল। আগন্তুকের পরনে স্যাক্সনদের মতো পোশাক। মাথায় সুন্দর টুপি। টুপি আর পোশাকের রং ঘন সবুজ। টুপির উপর সযত্নে বসানো হয়েছে একটি পাখির পালক। নাকের তলায় সরু গোঁফের দুই প্রান্ত ঔদ্ধত্যে উন্নত, চোয়াল পরিষ্কার ভাবে কামানো, শুধু চিবুকের উপর অবস্থান করছে একটুখানি ছাগল-শাড়ি! এক নজরে দেখলেই বোঝা যায়, লোকটি দস্তুরমতো শৌখিন।

তবে চেহারা ও পোশাকে বাহার থাকলেও মানুষটি যে নিতান্ত নিরীহ ফুলবাবুটি নয়, সে কথা বুঝতে কষ্ট হয় না। কারণ, তার কোমরের বাঁ দিকে ঝুলছে একটি দীর্ঘ তরবারি! কটিবন্ধের ডান দিকে একটি সুবৃহৎ শিঙাও দৃশ্যমান। শিঙাটি কোন কাজে লাগবে কে জানে, কিন্তু আপস্তুকের চোখের দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায়, তলোয়ারটা কেবল অঙ্গশোভার জন্য কটিদেশে স্থান গ্রহণ করেনি, তলোয়ারের মালিক ওই বস্তুটিকে ভালোভাবেই ব্যবহার করতে জানে।

নর্মান সেনারাও সশস্ত্র। তাদের কটিদেশেও অবস্থান করছে শাণিত তরবারি। উপরন্তু তাদের দেহ লোহবর্মে সুরক্ষিত এবং তারা দলে ভারি, একের বিরুদ্ধে তিন! তবু আগন্তুকের অতর্কিত আবির্ভাব ও উদ্ধত আচরণে তারা চমকে গিয়েছিল। বর্মধারী তিনজন সৈনিকের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ নাগরিকের এমন উদ্ধত আচরণ কল্পনা করা যায়না।

বিস্ময়ের চমক কেটে যেতেই নর্মান সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। যে সৈনিকের কাঁধে হাত দিয়ে আগন্তুক সরিয়ে দিয়েছিল, সে ঘুসি বাগিয়ে এগিয়ে এল, কে তুই? এখানে তোর কী দরকার? স্যাক্সন হয়ে তুই নর্মান সেনার গায়ে হাত দিস? তোর এত স্পর্ধা?

আগন্তুক হাসল, স্পর্ধা আমার একটু বেশি সন্দেহ নেই। আর দরকার? হ্যাঁ, দরকার একটু আছে। এইমাত্র কড়া ওষুধ দেওয়ার কথা হচ্ছিল না? আমি চিকিৎসক, রোগ বুঝে ওষুধ দিতে এসেছি।

মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই আগন্তুক হাত চালাল। স্যাক্সন তরুণকে যে সৈন্যটি লাথি মেরেছিল, মুখের উপর ঘুসি খেয়ে সে সশব্দে ধরাশয্যা গ্রহণ করল। তার দুই সঙ্গী সবিস্ময়ে দেখল লোকটি একটুও নড়াচড়া করছে না, সে অজ্ঞান হয়ে গেছে!

আগন্তুক নর্ম্যান সেনাদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে অপেক্ষা করল না। তার মুষ্টিবদ্ধ হস্ত আবার আঘাত হানল দ্বিতীয় সৈনিকের উদরে। দুই হাতে পেট চেপে দ্বিতীয় সৈনিক অসহ্য যাতনায় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তেই আগন্তুক বলল, তোমার পেট ব্যথা করছে নাকি? নিশ্চয়ই খাবার হজম হয়নি। এখন তাহলে একটু শুয়ে বিশ্রাম করা উচিত।

সঙ্গেসঙ্গে চোয়ালের উপর পড়ল আর একটি মুষ্ট্যাঘাত এবং দ্বিতীয় সৈনিকও জ্ঞান হারিয়ে লম্ববান হল ভুমিপৃষ্ঠে।

তৃতীয় ব্যক্তি ছিল সৈন্যদলের সেনাপতি, সে এতক্ষণ কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়েছিল, সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, সে মারামারিতে অংশগ্রহণ করার সময়ই পায়নি।

এবার খ্যাপা ষাঁড়ের মতো গর্জন করে সে আগন্তুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরক্ষণেই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে মাটির উপর গড়াগড়ি খেতে লাগাল। আচম্বিতে দলপতির বিশাল দেহ শূন্যে ছিটকে উঠে ঘরের দেয়ালে আছড়ে পড়ল এবং সেখান থেকে মেঝের উপর পড়ে স্থির হয়ে গেল।

আগন্তুক ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল, তারপর ডান হাতে ঘুসি বাগিয়ে এগিয়ে এসে দলপতির মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে শত্রুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। পর্যবেক্ষণের ফলাফল বোধহয় সন্তোষজনক হল। কারণ, আগন্তুকের ঘুসি পাকানো মুঠি শিথিল হয়ে এল এবং গোঁফের তলায় দেখা দিল ব্যঙ্গের হাসি। সরাইখানার মালিকের দিকে তাকিয়ে সে স্মিতমুখে বলল, খোকা ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন ও কিছুক্ষণ ঘুমাবে। বড়ো দুষ্টুমি করছিল, তাই ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।

সরাইখানার মালিক নর্ম্যান। সৈন্যদের উপর সহানুভূতি থাকলেও তাদের হয়ে কিছু বলার সাহস তার ছিল না। সমস্ত ব্যাপারটা স্বচক্ষে দর্শন করে সে বুঝেছিল, আগন্তুক মুষ্টিযুদ্ধ ও মল্লযুদ্ধে অতিশয় দক্ষ। এমন মানুষকে ঘাঁটানো বিপজ্জনক, অতএব সে বুদ্ধিমানের মতো মৌনব্রত অবলম্বন করল।

আহত স্যাক্সন তরুণকে আগন্তুক হাত ধরে তুলল। তরুণের আচরণে উত্তেজনার চিহ্ন নেই। এইমাত্র তাকে কেন্দ্র করে চারপাশে যে ঘটনা ঘটে গেল সে-বিষয়ে সে আদৌ সচেতন নয়।

আহত তরুণকে ধরে সরাইখানার বাইরে যেতে যেতে আগন্তুক বলল, আমি ঠিক সময়েই এসে পড়েছিলাম।

নিষ্প্রাণ, নিরুৎসুক স্বরে তরুণ বলল, ধন্যবাদ মহাশয়, কিন্তু আপনি না এলেও বোধহয় বিশেষ ক্ষতি ছিল না।

আরও কিছুদূর এগিয়ে এসে গাছতলায় বাঁধা একটি ঘোড়ার কাছে দাঁড়াল আগন্তুক। তারপর তরুণকে উদ্দেশ্য করে বলল, উঠে পড়ো। ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস আছে নিশ্চয়ই? না থাকলেও অসুবিধা হবে না, আমি তোমার পিছনে উঠে তোমাকে ধরে রাখব।

আগন্তুক সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এল, কিন্তু তার প্রসারিত হস্তকে উপেক্ষা করে তরুণটি মুহূর্তের মধ্যে অশ্বপৃষ্ঠে স্থান গ্রহণ করল। কিছুক্ষণ অশ্বারোহণে চলার পর আগন্তুক বলল, আমরা এখন শেরউড বনের দিকে চলেছি।

তরুণ নির্বাক। মনে হয়, কোথায় যাওয়া হচ্ছে অথবা চারপাশে কি ঘটছে সে-বিষয়ে তার কিছুমাত্র কৌতূহল নেই।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করল আগন্তুক, আমার নাম রবিনহুড। আমি মাঝে মাঝে এই অঞ্চলে টহল দিয়ে থাকি, কারণ চারপাশে কি ঘটছে সেটা জানা আমার কর্তব্য। ভাগ্যক্রমে এদিকে এসে পড়েছিলাম বলেই নর্মান সেনাদের অত্যাচার থেকে তোমাকে রক্ষা করতে পারলাম। ভালো কথা, তোমার নাম কি?

নির্জীব নিস্মাণ কণ্ঠে উত্তর এল, রোডেরিক।

তৎকালীন ইংল্যান্ডে রবিনহুডের নাম শুনেও নির্বিকার থাকতে পারে এমন মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। রবিন সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, তুমি কি কখনও আমার নাম শোননি?

না। আমি ইংল্যান্ডে ছিলাম না।

কোথায় ছিলে?

উত্তর নেই। তরুণ নির্বাক।

রবিনহুড আর কথা বলার চেষ্টা করল না। অশ্বকে সবেগে চালনা করল শেরউড বনে তার আস্তানার দিকে।

শেরউড বনে রবিনহুডের আস্তানায় কয়েকটা দিন অতিবাহিত হল। রোডেরিকের ক্ষতস্থান ধুয়ে দলের চিকিৎসক ফ্রায়ার টাক ঔষুধ প্রয়োগ করে তাকে সুস্থ করে তুলল। কিন্তু রোডেরিকের আচরণ পূর্ববৎ। সে কারও সঙ্গেই কথা বলে না। শূন্যে দৃষ্টি মেলে গাছের তলায় বসে থাকে। প্রশ্ন করলে কখনও উত্তর দেয়, কখনও দেয় না, খাওয়ার ডাক পড়লে নিঃশব্দে এসে আহার গ্রহণ করে উঠে যায়।

রোডেরিকের সম্পর্কে সব কথাই দলের লোকেদের জানিয়েছিল রবিনহুড। প্রায় এক সপ্তাহ পরে দলের সবাই মিলে গল্পগুজব করছে, এমন সময় হঠাৎ লিটল জন বলে উঠল, ওহে রবিন, এই রোডেরিক ছোকরার ব্যাপারটা কি বলো তো? ছোকরার কোনো ব্যাপারেই গা নেই। মনে হয় আদর-ভালোবাসা, অবহেলা-অপমান সব কিছুই তার কাছে সমান, কোনো কিছুতেই তার স্পৃহা নেই।

উইল স্কারলেট বলল, রবিন। তোমার কাছে যা শুনেছি, তাতে মনে হয় ছেলেটা অতিশয় ভীরু। নর্ম্যান সৈন্যরা যখন তাকে প্রহার করছিল, সে বাধা দিতেও সাহস করেনি। একেবারেই মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ!

ফ্রায়ার টাক এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, এইবার সে মুখ খুলল, ছেলেটার মনে কষ্ট আছে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রয়োজন ওর কাছে ফুরিয়ে গেছে। ওকে শান্তিতে দিন যাপন করতে দাও, এক সময়ে হয়তো সে জীবনধারণের সার্থকতা খুঁজে পাবে।

একটু দুরেই একটা গাছের তলায় চুপ করে বসেছিল রোডেরিক। তার দিকে তাকিয়ে রবিনহুড হাঁক দিল, রোডেরিক, শুনে যাও।

যন্ত্রচালিতের মতো ধীর পদক্ষেপে রোডেরিক এসে দাঁড়াল রবিনহুডের সামনে।

রবিনহুড বলল, রোডেরিক, কয়েকদিন পরেই নটিংহ্যামের বাজারে তাতি উইলফ্রেড কাপড় বিক্রি করতে আসবে। যে-সব মাল বিক্রি হবে না, সেগুলোকে ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে উইলফ্রেড যাবে ইয়র্ক শহরে। তুমিও যাবে তার সঙ্গে। ঘোড়ার গাড়ির ভিতর থাকলে নর্মানরা তোমাকে দেখতে পাবেনা। এই অঞ্চল ছেড়ে ইয়র্ক শহরে গেলে তুমি নিরাপদ। এখানেও তোমার বিপদের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এটা হচ্ছে যোদ্ধাদের আস্তানা, এখানে তুমি বেশিদিন থাকতে পারবেনা।

নির্দিষ্ট দিনে নটিংহ্যামের বাজারে এসে অপেক্ষা করতে লাগল রবিনহুড ও রোডেরিক। ঠিক দুপুর বেলায় আসবে উইলফ্রেড। রবিন ও রোডেরিক একটু আগেই এসে পড়েছিল, অতএব অপেক্ষা করতেই হবে দুপুর পর্যন্ত।

তাদের বরাত খারাপ। একদল নর্ম্যান সৈন্য বাজরের মধ্যে টহল দিচ্ছিল। তাদের মধ্যে ছিল সরাইখানার নর্মান দলপতি, এতদিনেও তার গায়ে ব্যথা যায়নি। হঠাৎ তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল রবিনহুডের দিকে।

রবিনহুড ও রোডেরিক কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে এসেছিল। কিন্তু রবিনের মাথায় কালো কাপড়ের আবারণ থাকা সত্ত্বেও শত্রুকে চিনে ফেলল দলপতি। তৎক্ষণাৎ সে চিৎকার করে। সৈন্যদের বলল, ওই যে স্যাক্সন কুকুরটা দাঁড়িয়ে আছে। মনে করেছে কালো কাপড়ে মাথা ঢাকলে ওকে কেউ চিনতে পারবেনা। সৈন্যগণ! ওকে ধর। শয়তানটা যেন পালাতে না পারে।

একপাল হিংস্র নেকড়ের মতো ছুটে এল নর্মান সৈন্যদল। সঙ্গেসঙ্গে রবিনহুডের হাতে সূর্যালোকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ঝক ঝক করে উঠল কোষমুক্ত তরবারি। কিন্তু রোডেরিক পিছন ফিরে ছুটল তিরবেগে এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

নর্ম্যানরা রোডেরিকের দিকে একবারও তাকাল না, তাদের দৃষ্টি তখন রবিনহুডের দিকে।

সংঘর্ষ শুরু হল। দুজন নর্ম্যান সেনা আহত হয়ে আর্তনাদ করতে করতে হাতের অস্ত্র ফেলে দিল। রবিনের হাতের ঘূর্ণিত অসি বারংবার ব্যর্থ করে দিল শত্রুর দলবদ্ধ আক্রমণ। কিন্তু এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে একটিমাত্র মানুষ কতক্ষণ যুদ্ধ করতে পারে? একটা কাটা বসানো লৌহমুষল সজোরে এসে পড়ল রবিনের মাথায়, সঙ্গেসঙ্গে অচৈতন্য হয়ে সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

নর্ম্যান দলপতি রূঢ়স্বরে বলল, ওকে বেঁধে ফেল। আদেশ পালিত হল তৎক্ষণাৎ। হঠাৎ একজন নর্মান সৈন্য সংজ্ঞাহীন বন্দির মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলে উঠল, আরে! আরে! এ যে দেখছি স্যাক্সন দস্য রবিনহুড! রাজদরবার থেকে রবিনহুডের ছিন্নমণ্ডের জন্য এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

অট্টহাস্য করে নর্মান দলপতি বলল, বাজারের মাঝখানে মঞ্চের উপর যে থামটা রয়েছে, সেই থামের সঙ্গে ওকে বেঁধে ফেলে শেরিফকে খবর দাও। মৃত্যুদণ্ড তার সামনেই অনুষ্ঠিত হবে। ওই সঙ্গে তিনি যেন পুরস্কারের সহস্র স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে আসেন।

রবিনহুডের যখন জ্ঞান ফিরে এল, সে দেখল তাকে থামের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। নর্ম্যান দলপতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বন্দির দিকে তাকিয়েছিল, রবিনহুডকে চোখ মেলে চাইতে দেখে সে বলে উঠল, ওরে স্যাক্সন কুকুর! তোকে এখনই হত্যা করা হবে। কিন্তু তার আগে আমি একটু হাতের সুখ করে নিতে চাই।

বলার সঙ্গেসঙ্গে হাত চলল, বন্দির মুখের উপর প্রচণ্ড বেগে এসে পড়ল দলপতির বদ্ধমুষ্টি। রবিনের মুখ থেকে একটিও শব্দ শোনা গেল না, কেবল তার চোখ দুটো দারুণ ক্রোধে জ্বলে উঠল। চারপাশে দণ্ডায়মান জনতা নর্মান দলপতির নিষ্ঠুর আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে। হয়তো তারা রবিনহুডকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসত, কিন্তু সশস্ত্র নর্মান সৈন্যদের বেষ্টনী ভেদ করে মঞ্চের সামনে যাওয়ার ক্ষমতা জনতার ছিল না।

ভীষনদর্শন এক রণকুঠার হাতে দাঁড়িয়েছিল জনৈক নর্ম্যান সৈন্য। সে কুঠার আস্ফালন করে প্রতিবাদে মুখর জনতার উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল, চুপ কর শয়তানের দল। বেশি চিৎকার করলে এই কুঠারের ধার তোদের উপর পরখ করব।

আচম্বিতে তার মুখের উপর পড়ল এক প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত, সঙ্গেসঙ্গে প্রবল আকর্ষণে তার কুঠার হল হস্তচ্যুত! যে ব্যক্তি কুঠার ছিনিয়ে নিয়েছিল, সে বিদ্যুৎবেগে কুঠার চালাল, এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ল কয়েকজন নর্মান সৈন্য। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সৈন্যদের বেষ্টনী ভেঙে কুঠারধারী মঞ্চের কাছে ছুটে গেল এবং কেউ বাধা দেবার আগেই এক লাফে উঠে পড়ল মঞ্চের উপর।

মঞ্চে দণ্ডায়মান দলপতি সভয়ে পিছিয়ে গেল বন্দির সম্মুখ থেকেতার পার্শ্বরক্ষী তিনজন নর্ম্যান সেনা উদ্যত তরবারি হাতে কুঠারধারীকে আক্রমণ করল।

বন্যার মুখে বালির বাঁধ যেমন ভেসে যায়, তেমনি ভাবেই ব্যর্থ হয়ে গেল নর্ম্যানদের প্রতিরোধের প্রয়াস, রক্তাক্ত দেহে তিন সৈনিক লুটিয়ে পড়ল মঞ্চের উপর। দলপতি একলাফে মঞ্চ ত্যাগ করে সরে গেল কুঠারের নাগালের বাইরে। একটি ভূপতিত সৈনিকের তরবারি নিয়ে কুঠারধারী ব্যক্তি রবিনের বন্ধনরঙ্কু ছিন্ন করল, তারপর তলোয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল, রবিন! অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হও। ওরা আসছে।

রবিনহুড সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, রোডেরিক, তুমি!

হ্যাঁ আমি। কিন্তু কথা বলার সময় নেই। ওই দেখ, ওরা আসছে। সত্যই তাই। ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষণেকের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়েছিল চতুর্দিকে অবস্থিত নর্মান সেনাদল। এখন সম্বিত ফিরে পেয়ে তারা অস্ত্র তুলে ছুটে আসছে মঞ্চের দিকে।

রক্তাক্ত কুঠার শূন্যে উত্তোলন করে রোডেরিক বলল, রবিন, ওরা আসছে।

ঊর্ধ্বে তরবারি নাচিয়ে রবিনহুড বলল, রোডেরিক, যারা আসছে তারা অনেকেই আর ফিরে যাবে না।

লড়াই শুরু হল। রবিনহুডের ভবিষ্যদ্বাণী বৃথা হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হতাহত সঙ্গীদের ফেলে নর্মান সৈন্যরা চম্পট দিল। তারা বুঝেছিল বেশিক্ষণ এখানে থাকলে তাদের মধ্যে একটি মানুষও জীবিত থাকবে না।

সমবেত জনতার ভিতর থেকে জাগল প্রবল উল্লাসধ্বনি, রবিনহুডের জয় হোক! শেরউড বনের রবিনহুড দীর্ঘজীবী হোক!

ধরাশায়ী নর্মান সেনাদের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে রবিনহুড বলল, এবার আমাদের এখান থেকে সরে পড়াই ভালো। একটু পরেই দলে ভারি হয়ে নর্ম্যানরা এখানে ছুটে আসবে। সম্ভবত শেরিফ মহাশয়ও তার তিরন্দাজদের নিয়ে এখানে উপস্থিত হবেন।

সায় দিয়ে রোডেরিক বলল, হ্যাঁ রবিন। ঠিক বলেছ। এই জায়গাটা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে বিশেষ ভালো হবে বলে মনে হয়না। এইবেলা সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

দুজন চটপট স্থানত্যাগ করল।

বনের পথে চলতে চলতে রবিনহুড বলল, রোডেরিক, আমি ভেবেছিলাম তুমি নিতান্ত নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিন্তু তোমার কাণ্ড দেখে আমি দস্তুর মতো চমকে গিয়েছি।

রোডেরিক বলল, অশান্তি যখন আঘাত হানে, শান্তিরক্ষার চেষ্টা তখন বিড়ম্বনা মাত্র। তাই নিরীহ মানষের ভমিকা ত্যাগ করে আমি যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলাম।

রোডেরিক, তোমার মুখে শুনেছিলাম তুমি নাকি ইংল্যান্ডে ছিলে না। কোথায় ছিলে জানতে চাইলেও তুমি উত্তর দাওনি। এখন যদি সেই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করি বোধ হয় সদুত্তর পাব।

আমি দীর্ঘকাল ইটালিতে ছিলাম, একটু ইতস্তত করে রোডেরিক বলল, রবিন তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। অত্যাচারী নর্মানদের বিরুদ্ধে তুমি ও তোমার সঙ্গীরা যেভাবে জেহাদ ঘোষণা করেছ সেটা সত্যই প্রশংসনীয়। আমিও তোমাদের দলে যোগ দিতে চাই। আশা করি শেরউড বনের আস্তানায় আমাকে স্থান দিতে এবার তুমি আপত্তি করবে না।

রবিনহুড হেসে বলল, তোমার মতো মানুষকেই তো আমরা চাই। কিন্তু দলে আসতে হলে তোমার যথার্থ পরিচয় আমাদের জানা দরকার।

ভ্রূ কুঞ্চিত করে কিছুক্ষণ নীরবে পদচালনা করল রোডেরিক, তারপর হঠাৎ মুখ তুলে বলল, সব কথাই বলব। আমার মনের মধ্যে একটা দারুণ ঝড় ছুটোছুটি করছে। কোনো একজনকে সব কথা খুলে বলতে না পারলে আমি শান্তি পাবনা। রবিন, তোমার চেয়ে উপযুক্ত শ্রোতা আর কোথায় পাব?

একটু থেমে রোডেরিক তার আত্মকথা শুরু করল, আমি পেশাদার সৈনিক, অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধ করাই ছিল আমার জীবিকা।* ইটালিতে অবস্থিত মন্টফেরাট রাজ্যের অধিপতি প্রিন্স ফেসিনোর হাত থেকে অর্থ নিয়ে আমি তাঁর বাহিনীতে ভাড়াটে সৈনিক হিসাবে লড়াই করতে সম্মত হই। [*দ্বাদশ শতাব্দীর ইউরোপের চেহারার সঙ্গে আজকের ইউরোপের কোনোই সাদৃশ্য নেই। সেই সময় ইউরোপের বহু রাজ্যই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। ওইসব রাষ্ট্রের অধিপতিগণ প্রায় সর্বদাই পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত থাকতেন। বর্তমান কাহিনিতে উল্লিখিত মন্টফেরাট ও লোগি নামক রাজ্য দুটি তৎকালীন ইটালির উত্তর অংশে অবস্থান করত।] অনেকগুলি লড়াইতে আমি অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করি। আমার বীরত্বে খুশি হয়ে প্রিন্স ফেসিনো আমাকে প্রচুর স্বর্ণ দিয়ে পুরস্কৃত করেন। প্রতিবেশী রাজ্য লোগির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ঘোষণা করলেন প্রিন্স ফেসিনো। লোগির রাজা নিকোলো সাহসী রণনিপুণ পুরুষ, তাঁর অধীনে ছিল বহুসংখ্যক বীর্যবান যোদ্ধা। বিনা প্রতিবাদে প্রিন্স ফেসিনোর হাতে রাজ্য সমর্পণ করতে রাজি হলেন না রাজা নিকোলো। যুদ্ধ ক্রমশ ভীষণ থেকে ভীষণতর হয়ে উঠল। অবশেষে একদিন প্রিন্স ফেসিনোর সৈন্যদল রাজা নিকোলোর রাজধানীর দ্বারে উপস্থিত হয়ে নগর অবরোধ করল।

সেদিন প্রভাতে প্রিন্স ফেসিনো নগর আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে প্রধান সেনানায়কদের সঙ্গে পরামর্শ করছেন, এমন সময়ে হঠাৎ নগরীর সিংহদ্বার খুলে লোগি রাজ্যের রাজদূত অশ্বারোহণে সর্বসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল, হাতে তার শান্তির প্রতীক শ্বেত পতাকা!

যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সন্ধির প্রস্তাব করার পাত্র তো রাজা নিকোলো নন। প্রিন্স ফেসিনো ক্রুদ্ধস্বরে বললনে, নিকোলো নিশ্চয়ই কোনো শয়তানি মতলব করেছে।

সেনানায়করাও প্রিন্সের কথায় সায় দিয়ে কয়েকটি মন্তব্য প্রকাশ করলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ কারও মাথা ঘামাতে হল না, অশ্বারোহী রাজদূত বজ্রগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করল, লোগি রাজ্যের অধিপতি রাজা নিকোলোর আদেশ অনুসারে ঘোষণা করছি, আমাদের নির্বাচিত যোদ্ধা প্রিন্স ফেসিনোর নির্বাচিত যোদ্ধাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে। দ্বৈরথ রণের ফলাফলের উপর দুই রাষ্ট্রের জয় পরাজয় নির্ধারিত হবে। আশা করি মন্টফেরাট রাজ্যের অধিপতি প্রিন্স ফেসিনো দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান উপেক্ষা করবেন না। এই রইল লৌহ দস্তানা

একটি লৌহ-দস্তানা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে রাজদূত বলল, যার সাহস আছে, সে এগিয়ে এসে এই দস্তানা গ্রহণ করুক।

(তখনকার দিনে ওই ভাবেই দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানানো হত। যে ব্যক্তি দ্বৈরথ রণে অংশগ্রহণ করত, সে স্বয়ং গ্রহণ করত ওই লৌহ দস্তানা।)

প্রিন্স ফেসিনো তাঁর যোদ্ধা নির্বাচন করার সময় পেলেন না, তার আগেই আমি এগিয়ে এসে দস্তানা তুলে নিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বললাম, মন্টফেরাট রাজ্যের পক্ষ থেকে আমি দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান গ্রহণ করলাম। লোগি রাজ্যের নির্বাচিত যোদ্ধার সঙ্গে আমি একঘণ্টা পরে এখানেই মিলিত হব। রাজদূত, তোমাদের যোদ্ধাকে প্রস্তুত হতে বলো।

নগর-প্রাকারের উপরে এবং নগরীর বহির্ভাগে দণ্ডায়মান পরস্পরবিরোধী দুই দল সৈন্যের কণ্ঠে জাগল তীব্র উল্লাসধ্বনি।

একঘণ্টার মধ্যেই মস্তক, মুখ ও সর্বাঙ্গ লৌহবর্মে আবৃত করে ভল্ল, ঢাল ও রণকুঠার নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করলাম, তারপর নগরকারের সম্মুখে মুক্ত প্রান্তরের উপর অপেক্ষা করতে লাগলাম প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নগরীর সিংহদ্বার দিয়ে আবির্ভূত হল আপাদমস্তক বর্মাবৃত ঢাল ও ভল্লধারী এক ব্যক্তি- রাজা নিকোলোর নির্বাচিত যোদ্ধা অর্থাৎ আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। অশ্বপৃষ্ঠ থেকে স্থানচ্যুত হলে অথবা ভল্ল ভগ্ন হলে লড়াই করার জন্য আমি নিয়েছিলাম কুঠার আর আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ধারণ করেছিল সুদীর্ঘ তরবারি।

মধ্যস্থ যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্কেত দিল। সঙ্গেসঙ্গে আমরা দুই প্রতিদ্বন্দী উদ্যত ভল্ল হাতে পরস্পরকে লক্ষ্য করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম। আমরা পরস্পরের ভল্পের আঘাত ঢালের উপর গ্রহণ করলাম এবং সংঘাতের বেগে ভারসাম্য হারিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লাম মাটির উপর। এবার আর ঘোড়ার পিঠে নয়, মাটির উপর দাঁড়িয়ে শুরু হল মৃত্যুপণ যুদ্ধ। আমি তুলে নিলাম রণকুঠার, প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে ঝক ঝক করে উঠল শাণিত তরবারি।

ঊর্ধ্বে তরবারি তুলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী কঠোর স্বরে বলল, তোর শরীর মানুষের কিন্তু মাথাটা কুকুরের। কুকুরের মাথা মানুষের দেহে শোভা পায়না। অতএব মাথাটা আমি এখনই কেটে ফেলব।

দারুণ ক্রোধে আমার রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠল, কুঠার আস্ফালন করে বললাম, আমার কুঠার তৃষ্ণার্ত হয়েছে। ওরে লোগির শূকর, তোর রক্তে কুঠারের তৃষ্ণা শান্ত করব।

প্রতিদ্বন্দী সবেগে ছুটে এসে আঘাত হানল। কুঠারে প্রতিহত হল তরবারি। আবার, আবার, আবার। বারংবার হত্যার আগ্রহে ঝাঁপ দিল তরবারি এবং প্রতিবারই কুঠার ফলকে ব্যর্থ হল আক্রমণ। তারপর আমি এক নতুন কৌশল অবলম্বন করলাম। কুঠার নামিয়ে এগিয়ে গেলাম প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে। সে তৎক্ষণাৎ আঘাত হানল আমার অরক্ষিত মস্তক লক্ষ্য করে। আমি কুঠার তুললাম, কিন্তু কুঠার ফলকের পরিবর্তে আড়াআড়িভাবে হাতলের উপর অসির আঘাত গ্রহণ করলাম। প্রচণ্ড সংঘাতে অসিধারীর হাতের মাংসপেশী ক্ষণিকের জন্য অসাড় হয়ে গেল; মুহূর্তের দুর্বলতার সুযোগ নিলাম আমি, দুই হাতে কুঠার ধরে প্রচণ্ড আঘাত হানলাম প্রতিদ্বন্দ্বীর স্কন্ধে। সেই দারুণ আঘাত সহ্য করতে পারল না লোগির যোদ্ধা, সে লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর। প্রিন্স ফেসিনোর সৈন্যদল উল্লাসে গর্জন করে উঠল। নগরকারের শত্রু সেনা স্তব্ধ নির্বাক।

আমি এগিয়ে গেলাম। লৌহ-মুখোশ উন্মোচন করে শত্রুর মুখ দেখব এবং চরম আঘাতে শেষ করে দেব তার ইহলীলা। একহাতে মুখোশ খুলে অন্য হাতে কুঠার তুলে ধরলাম।

সঙ্গেসঙ্গে হিম হয়ে গেল আমার দেহের রক্ত, এ কি! আমার ছোটো ভাই ফিলিপ! একেই আমি আঘাত করেছি। হয়তো এই আঘাতের ফলে তার মৃত্য হবে, শেষকালে ভ্রাহ্য করলাম।

কে জানত আমার ভাই ফিলিপও সৈনিকের পেশা গ্রহণ করেছে এবং নিয়তির নিষ্ঠর পরিহাসে ইটালিতে এসে আমার বিরোধীপক্ষে যোগ দিয়েছে।

দেখলাম তখনও তার দেহে প্রাণ রয়েছে। তাকে দুই হাতে তুলে নিলাম আমার বুকের উপর।

প্রিন্স ফেসিনোর সেনাদল তখন আমার নামে জয়ধ্বনি তুলে আকাশ ফাটাচ্ছে। কিন্তু আমি কোনোদিকে দৃকপাত না করে ভাইকে নিয়ে প্রবেশ করলাম আমার নিজস্ব শিবিরে এবং শুইয়ে দিলাম আমারই শয্যার উপর।

সেই শয্যাই হল তার মৃত্যুশয্যা। প্রিন্স ফেসিনোর প্রধান চিকিৎসক যথাসাধ্য চেষ্টা করেও আমার ভাইকে বাঁচাতে পারলেন না। ফিলিপের মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গে আমি ইটালি ছেড়ে মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত হলাম।

প্রিন্স ফেসিনো প্রচুর ধনদৌলত নিয়ে আমায় সাধাসাধি করলেন, বললেন, রোডেরিক, যদি তুমি আমার জন্য লড়াই করো তাহলে এই ধনদৌলত তোমার হবে। ভবিষ্যতে আমি তোমাকে আরও অর্থ দেব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

অভিবাদন জানিয়ে বললাম প্রিন্স ফিলিপ! আমি আর কোনোদিন লড়াই করব না। ভাই-এর মৃতদেহ স্পর্শ করে আমি অস্ত্রত্যাগ করার শপথ গ্রহণ করেছি। বিদায়!

সেখান থেকে এসে পৌঁছোলাম ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে ঘুরতে একদিন উপস্থিত হলাম আলসফোর্ড শহরের সরাইখানায়, তারপর যা ঘটেছে তা তুমি জানো।

রবিনহুড হেসে বলল, কিন্তু রোডেরিক, তোমার শপথ ভঙ্গ হল যে!

রোডেরিক বলল, সেজন্যে আমি কিছুমাত্র দুঃখিত নই। মহৎ কারণেই আমি শপথ ভঙ্গ করেছি। অর্থোপার্জনের জন্যে যুদ্ধের নামে নরহত্যা করা অনুচিত, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাই প্রকৃত যোদ্ধার কর্তব্য।

রবিনহুড সঙ্গীর কাঁধে হাত রেখে বলল, আমাদের দলে এসে সেই কর্তব্য করার সুযোগ তুমি নিশ্চয়ই পাবে, রোডেরিক।

অস্তায়মান সূর্য যখন পৃথিবীর কাছে বিদায় গ্রহণ করছে, সেই সময় রবিনহুড ও বোডরিক প্রবেশ করল শেরউড বনের অভ্যন্তরে।

রবিনহুডের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে আর রোডেরিকের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে উচ্ছ্বসিত আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল শেরউড বনের মুক্তিবাহিনী। উচ্ছ্বাসের কারণ ছিল; রোডেরিকের মতো দুর্ধর্ষ যোদ্ধাকে দলে পাওয়া তো ভাগ্যের কথা। কেবলমাত্র ফ্রায়ার টকের আচরণে উত্তেজনার চিহ্নমাত্র দেখা গেল না, দাড়িতে হাত বুলিয়ে শান্তস্বরে সে বলল, আমি তো আগেই বলেছিলাম।

 বাঘিনী

মানুষখেকো বাঘিনীকে মানুষ ভয় করে, ঘৃণা করে। কিন্তু সেই ভয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক ধরনের শ্রদ্ধা–এ-কথাও সত্যি।

মানুষ চিরকালই বীরত্বের পূজারি–তাই নরভুক বাঘিনীর হিংস্র স্বভাবের মধ্যেও সে যখন বীরত্বের সন্ধান পায় তখন নিজের অজান্তে তার মনে শ্রদ্ধার উদয় হয়।

আমি আজ কোনো চতুষ্পদ ব্যাঘ্রীর গল্প বলব না; আমার কাহিনির নায়িকা একটি দ্বিপদ রমণী যার সঙ্গে অনায়াসে বনচারিণী বাঘিনীর তুলনা করা যায়। শৌর্যে, সাহসে ও স্বভাবের ভীষণতায় এই মেয়েটি বাঘিনীর চাইতে কোনো অংশেই কম ছিল না।

আজকের কথা নয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে আমাদের নায়িকার কাহিনি। তবে এই কাহিনি শুরু করার আগে জুলুদের কথা একটু বলা দরকার। আফ্রিকার অধিবাসী এই জুলুজাতি সাহস ও বীরত্বের জন্য বিখ্যাত। কেবলমাত্র বর্শা ও তরবারি সম্বল করে জুলুরা আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বারংবার। রাইফেল ও মেশিনগানের কল্যাণে শ্বেতাঙ্গরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছে বটে, কিন্তু তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে জুলুদের মতো নির্ভীক যোদ্ধা ইউরোপেও নিতান্ত দুর্লভ।

এই জুলুজাতির একটি মেয়েকে নিয়েই আমাদের কাহিনি। জোয়েদি নামক এক জুলু সর্দারের গৃহিণী ছিল নজমবাজী–আমাদের বর্তমান কাহিনির নায়িকা…

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে জুলুজাতির ইতিহাসে আবির্ভূত হলেন এক প্রচণ্ড পুরুষ–রাজা উ-শকা!

একাধিক পুস্তকে তার নামটিকে সংক্ষিপ্ত করে শকা নামে অভিহিত করা হয়েছে, আমরাও তাই বলব।

এই রাজা শকার কোপদৃষ্টিতে পড়ল জোয়েদি সর্দার এবং তার স্ত্রী নজমবাজী। জোয়েদি পালিয়ে বাঁচল, কিন্তু নজমবাজীকে শকার সৈন্যরা গ্রেপ্তার করে ফেলল।

রাজা শকার তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ। যুদ্ধের পর যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন শকা। রণডঙ্কা বাজিয়ে যেদিক দিয়ে ছুটে গেছে তার সেনাবাহিনী, সেইদিকেই ধরিত্রীর বুকে লম্বমান হয়েছে অগণিত মানুষের রক্তাক্ত মৃতদেহ।

এমন একটি মানুষের সম্মুখীন হলে অনেক সাহসী পুরুষের বুকের রক্ত জল হয়ে যায়, কিন্তু নজমবাজীকে যখন বিচারের জন্য শকার সামনে নিয়ে আসা হল তার চালচলনে ভয়ের আভাস ছিল না কিছুমাত্র!

গর্বিত পদক্ষেপে রাজার সম্মুখে এসে দাঁড়াল রমণী। তার জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টিতে নেই আতঙ্কের ছায়া–রুদ্ধ আক্রোশ ও ঘৃণায় দপদপ করে জ্বলছে বন্দিনীর দুই চক্ষু

রাজার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল নজমবাজী। জুলুজাতি এবং তাদের রাজা শকাকে উচ্চৈঃস্বরে সে অভিশাপ দিতে লাগল বারংবার।

সমবেত জুলুদের মধ্যে অনেকেই ভীত হল। মারামারি কাটাকাটি করতে জুলুরা ভয় পায় না, কিন্তু ভূত প্রেত মন্ত্রতন্ত্র সম্পর্কে তাদের আতঙ্ক অপরিসীম। নজমবাজী ডাকিনীবিদ্যায় সিদ্ধ, তাই সকলেই তাকে ভয় করত যমের মতো।

কিন্তু রাজা শকা অন্য ধরনের মানুষ আততায়ীর তরবারি এবং ডাকিনীর মন্ত্র তার কাছে সমান উপহাসের বস্তু। শরীরী বা অশরীরী কোনো জীবকেই তিনি পরোয়া করতেন না।

শকা বন্দিনীকে চুপ করতে বললেন। তিক্তস্বরে নজমবাজী বললে, বিচারের রায় আগে দিয়ে দাও রাজা পরে না হয় বিচার কোরো! ফলাফল কী হবে তা তো জানা আছে, মিছামিছি সময় নষ্ট করে লাভ কী?

রাজা শান্তস্বরে বললেন, আমি তোমার বিচার করছি বটে, তবে তোমার কথাগুলো আমায় শুনতে হবে। আমি ন্যায়বিচার করতে চাই। তোমার একটি সাধারণ ছোট্ট কথার জন্য হয়তো আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারি।

বিচার শুরু হল। নজমবাজীর বিরুদ্ধে রয়েছে নরহত্যা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। একটি নয়, দুটি নয়–ত্রিশটি মানুষকে নাকি হত্যা করেছে নজমবাজী! শুধু হত্যা করেই সে খুশি হয়নি, নিহত লোকগুলির মুণ্ড নিয়ে সে ঝুলিয়ে দিয়েছে তার কুটিরের দেয়ালে দেয়ালে!

বন্দিনী অভিযোগ অস্বীকার করল না। দৃপ্তকণ্ঠে সে বললে, হ্যাঁ, আমি ওদের হত্যা করেছি, ওদের মুণ্ডগুলো নিয়ে আমার ঘর সাজিয়েছি।

শকা প্রশ্ন করলেন, কেন? উত্তর এল, ক্ষমতা লাভ করার জন্য। আমি ডাকিনীবিদ্যায় সিদ্ধ হয়েছি। ওই মুণ্ডগুলি আমার দরকার।

শকা গম্ভীর স্বরে বললেন, ভালো, ভালো। কিন্তু ওহে ডাইনি!–বলো দেখি, তোমার ডাকিনীবিদ্যা কি তোমাকে বাঁচাতে পেরেছে?… পারেনি। কারণ তোমার মন্ত্রের চাইতে আমার অস্ত্রের ক্ষমতা অনেক বেশি আর সেইজন্যই আজ তুমি আমার বন্দি। বুঝেছ?

বুঝেছি, বন্দিনীর ওষ্ঠাধরে ফুটল বিদ্রুপের হাসি, কিন্তু মহামান্য ডিশিংওয়ের মুণ্ডুটা তাহলে আমার দেয়ালে ঝুলছে কেন? বলো?

সমবেত জনতা স্তব্ধ নির্বাক। ডিশিংওয়ে রাজার প্রিয় বন্ধু। তাকে হত্যা করেছে নজমবাজী এবং রাজার সামনে দাঁড়িয়ে সেই কথা জানিয়ে বিদ্রূপ করতে সে ভয় পায় না–কী স্পর্ধা!

শকা গম্ভীর স্বরে বললেন, ওই মানুষটির মৃত্যু নিয়ে উপহাস করে তুমি খুব বুদ্ধির পরিচয় দাওনি। ডিশিংওয়ে ছিল ভালো মানুষ সে তোমার স্বামী জোয়েদি ও তোমার প্রতি উদারতা দেখিয়েছিল, তাই তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হল প্রাণ দিয়ে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। হায়নার মতো নিকৃষ্ট জীবকে যদি কেউ ভালোবাসে, বিশ্বাস করে তবে সেই হায়নার আক্রমণেই হতভাগ্যের মৃত্যু নিশ্চিত; তোমরাও হায়নার চাইতে উন্নত ধরনের জীব নও… ভালো কথা, নজমবাজী–শুনেছি হায়নাগুলি ডাকিনীদের অনুচর, ওরা নাকি ডাকিনীর আদেশ পালন করে ভৃত্যের মতো–কথাটা কি সত্যি?

–নিশ্চয়, সত্যি বই কী!

নজমবাজী ভাবল, ওই উত্তর শুনেই রাজা ঘাবড়ে যাবে।

জুলুরা সাহসী জাতি, দাঙ্গাহাঙ্গামায় ভয় পায় না কিন্তু ভৌতিক ক্রিয়াকলাপের প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা, অশেষ ভীতি!

কিন্তু রাজা শকা অন্য ধরনের মানুষ, স্থির দৃষ্টিতে নজমবাজীর দিকে তাকিয়ে তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, তুমি তো ডাইনি–তাহলে বনের হায়নারা তোমার অনুচর? তারা তোমার কথা শুনবে?

দৃঢ়স্বরে নজমবাজী বললে, শুনবে। সব কথা শুনবে।

বাঃ! বাঃ! খুব ভালো কথা, শান্ত স্বরে বললেন শকা, খুব ভালো! খুব ভালো! তাহলে তুমি তোমার কুটিরে ফিরে যাও। নরমুণ্ড সাজিয়ে যেখানে তুমি ক্ষমতার অধিশ্বরী হয়েছ, সেখানেই তুমি নিশ্চিন্তে বাস করো। আমার দেহরক্ষীরা তোমাকে খাদ্য ও পানীয় দিয়ে আসবে। একা একা তোমার খারাপ লাগতে পারে, তাই তোমাকে একটি উপযুক্ত সঙ্গীও দেওয়া হবে। আমার ভৃত্যরা কখনো তোমার কোনো ক্ষতি করবে না, তবে

-তবে?

–তবে তোমার সঙ্গীর জন্য কোনো আহার্য বা পানীয় দেওয়া হবে না। তার খাদ্যের ব্যবস্থা সে নিজেই করে নেবে।

নজমবাজী অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। রাজা কথা কইছেন খুব শান্তভাবে, কিন্তু সেই শীতল শান্ত স্বরে যেন এক ভয়াবহ ইঙ্গিত!

নজমবাজী প্রশ্ন করলে, তাহলে, তাহলে আমার শাস্তির কী ব্যবস্থা হল?

মৃদুকণ্ঠে উত্তর এল, যথাসময়ে তুমি জানতে পারবে…

.

নজমবাজীর পিছনে বন্ধ হয়ে গেল কুটিরের দরজা। হঠাৎ আলো থেকে অন্ধকারের মধ্যে এসে পড়লে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে ফেলে তার দৃষ্টিশক্তি নজমবাজীরও সেই অবস্থা হল।

বদ্ধদ্বার কুটিরের অন্ধকার তার চক্ষুকে সাময়িকভাবে অন্ধ করে দিল বটে, কিন্তু নাসিকার ঘ্রাণশক্তি অন্ধকারের কাছে পরাজিত হল না–একটা তীব্র দুর্গন্ধ তার নাকে এসে ধাক্কা মারল! পশুর গায়ের গন্ধ!

নজমবাজী সাহসী মেয়ে। কিন্তু এইবার সে ভয় পেল। যে অজানা জীবটা ঘরের মধ্যে রয়েছে। তার জান্তব চক্ষু নিশ্চয়ই অন্ধকারের মধ্যেও সব কিছু দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু নজমবাজীর দৃষ্টিশক্তি এখনও আঁধারের যবনিকা ভেদ করে তাকে আবিষ্কার করতে পারছে না–ভয়ের কথা বই কী!

পাথরের মূর্তির মতো বদ্ধ দরজায় সে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল… নিশ্চল, নীরব…

কিছুক্ষণের মধ্যে অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠল রমণীর দৃষ্টিশক্তি, আর তখনই তার নজরে পড়ল কুটিরের শেষপ্রান্তে প্রায় বিশগজ দূরে মিট মিট করে জ্বলছে একজোড়া অগ্নিময় চক্ষু! তার কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল তীব্র আর্তনাদ, কী! কী! কী ওটা?

কুটিরের বাইরে ঘন ঘাসের আবরণ সরিয়ে প্রহরীরা জানতে চাইল কী হয়েছে। ভীত ত্রস্তস্বরে নজমবাজী বার বার প্রশ্ন করলে, কী আছে? কী আছে ঘরের মধ্যে? দপ দপ করে ওই যে জ্বলছে আর জ্বলছে–ও দুটো কার চোখ?

প্রহরীরা সবিনয়ে জানিয়ে দিল কুটিরের মধ্যে একমাত্র নজমবাজী ছাড়া অন্য কোনো বস্তু বা ব্যক্তির অস্তিত্ব সম্বন্ধে তারা সচেতন নয়।

কথা বলার সময়ে প্রহরীরা কুটিরের দেয়াল থেকে ঘাসের আবরণ সরিয়ে দিয়েছিল। সেই ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো কিছুটা এসে পড়ল অন্ধকার কুটিরের মধ্যে। আবছা আলো-আঁধারিতে এবার নজমবাজীর দৃষ্টিপথে ধরা পড়ল একজোড়া জ্বলন্ত চোখের নীচে একজোড়া বীভৎস চোয়াল!

দুই চোখের তীব্র দৃষ্টি সঞ্চালন করলে রমণী–অস্পষ্ট আলোছায়ার মধ্যে দেখা গেল লালা গড়িয়ে পড়তে পড়তে ফঁক হয়ে গেল সেই চোয়াল দুটি ঝক ঝক করে উঠল দুই চোয়ালের ফাঁকে অনেকগুলো তীক্ষ্ণধার দন্ত!

হায়না!

একটা পুরুষ হায়না!

আবার আর্তনাদ করে উঠল নজমবাজী, আবার ছুটে এল প্রহরীরা, সাগ্রহে জানতে চাইল বন্দিনীর ভয়ের কারণটা কী!

আলো, আলো, আরও আলো চেঁচিয়ে উঠল নজমবাজী।

আপনার আদেশ নিশ্চয়ই পালিত হবে, উত্তর এল সসম্ভ্রমে। ছোটো ছোটো জানলাগুলোর উপর ছিল শুষ্ক ঘাসের আবরণ, প্রহরীরা সেগুলো সরিয়ে দিল…

নেমে এল রাতের কালো যবনিকা। নজমবাজীর কুটিরের বাইরে এসে দাঁড়াল আরও কয়েকজন প্রহরী। জানলার ফাঁক দিয়ে বন্দিনিকে আহার্য ও পানীয় সরবরাহ করা হল–প্রচুর মাংসের গ্রিল আর উৎকৃষ্ট বিয়ার জাতীয় সুরা।

পানাহারের রাজকীয় ব্যবস্থা দেখে খুশি হল না বলিনি আসন্ন রাত্রির অন্ধকারের ভয়ে সে বিচলিত। নজমবাজীর ভীতি অমূলক নয়, ঘন অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে যেকোনো মুহূর্তে জন্তুটা তাকে আক্রমণ করতে পারে।

নজমবাজী আগুন চাইল, কিন্তু এইবার তার অনুরোধ রক্ষিত হল না। প্রহরী সবিনয়ে জানাল আগুন দেওয়া সম্ভব নয়–রাজার নিষেধ।

প্রকৃতির কোলে মানুষ হয়েছে বনবালা নজমবাজী, হায়নার স্বভাবচরিত্র তার অজানা নয়। সে জানত হায়না ভীরু জানোয়ার–যতক্ষণ জন্তুটা ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারবে ততক্ষণ সে আক্রমণ করবে না, কিন্তু শূন্য উদরে যখন ক্ষুধার দংশন অসহ্য হয়ে উঠবে তখনই মানুষের মাংসের লোভে ঝাঁপিয়ে পড়বে ক্ষুধার্ত শ্বাপদ

অন্ধকারের মধ্যে নিরস্ত্র অবস্থায় হায়নার হিংস্র আক্রমণ রোধ করা মেয়েটির পক্ষে অসম্ভব।

নজমবাজী বুঝল হায়নাকে নিজের খাদ্য থেকে কিছু কিছু অংশ যদি দেওয়া যায়, তাহলে জন্তুটা তাকে সহজে আক্রমণ করবে না–একটুকরো মাংস নিয়ে সে ছুঁড়ে ফেলল হায়নার দিকে। হায়না একটুও দেরি করলে না। টপ করে মাংসের টুকরোটা চেপে ধরল দুই চোয়ালের ফকে–কঠিন দন্তের সংঘর্ষে শব্দ উঠল খটাস!

শিউরে উঠল নজমবাজী।

আর তৎক্ষণাৎ বাতায়ন পথে ভেসে এল প্রহরীর কণ্ঠস্বর, ওকে খাদ্য দেওয়ার হুকুম নেই। আপনি যদি আদেশ অমান্য করেন তবে আপনাকেও ভবিষ্যতে আর খাবার দেওয়া হবে না।

নজমবাজী বুঝল প্রহরীর কথা না-শুনলে উপবাস অনিবার্য। অনাহারে দুর্বল হয়ে পড়লে আরও বিপদ–সে মাংসের টুকরোগুলিতে মনোনিবেশ করলে। খাওয়ার পর আকণ্ঠ সুরাপান করলে সে। গুরু ভোজনের পর সুরার প্রভাব তার চোখে এনে দিল নিদ্রার আবেশ। কিন্তু নজমবাজী জানত অন্ধকার কুটিরের মধ্যে ক্ষুধার্ত হায়নার সামনে ঘুমিয়ে পড়লে সেই ঘুম আর ভাঙবে না কোনোদিন–

রমণী প্রাণপণে জেগে থাকার চেষ্টা করতে লাগল…

হঠাৎ তার মনে পড়ল শুধুমাত্র হাড় চিবিয়ে হায়না ক্ষুধানিবৃত্তি করতে পারে। মাংসাশী পশুদের মধ্যে হায়নাই একমাত্র জীব যে মাংসহীন অস্থি থেকে খাদ্যরস সংগ্রহ করার ক্ষমতা রাখে। কুটিরের দেয়াল থেকে নজমবাজী একটু নরমুণ্ড নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। একটু পরেই কুটিরের মধ্যে জাগল এক ভয়াবহ শব্দের তরঙ্গ–কটমট! কটমট! কটমট!

কঠিন শ্বদন্তের নিষ্পেষণে ভেঙে যাচ্ছে অস্থিসার নরমুণ্ড!

ভয়ে ভয়ে জেগে রইল নজমবাজী, একবারও সে চোখ বন্ধ করলে না। হায়না অবশ্য একবারও আক্রমণের চেষ্টা করেনি, শুকনো হাড় চিবিয়েই সে সন্তুষ্ট থাকল। ভোররাতের দিকে চক চক করে জলপানের আওয়াজ শোনা গেল–কুটিরের একধারে যে কাঠের গামলাতে জল ছিল সেইখানে এসে জন্তুটা তৃষ্ণা নিবারণ করছে…

একটা দিন কাটল। দুপুর এগারোটার সময়ে প্রহরী নিয়ে এল মাংস ও সুরা। নজমবাজী যখন বড়ো বড়ো মাংসের টুকরো চিবিয়ে খেতে শুরু করলে, তখন হায়না হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল।

মাংসের গন্ধ তার নাকে গেছে

মুখ তুলে সে ঘ্রাণ গ্রহণ করতে লাগল সশব্দে!

নজমবাজী কয়েকটা নরমুণ্ড দেয়াল থেকে তুলে নিল। এবার সে মুণ্ডগুলি নিক্ষেপ করতে লাগল জন্তুটাকে লক্ষ করে। বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে মেয়েটির নেশা চড়ে গেল।

সে চিৎকার করে হায়নার দিকে ধেয়ে গেল। জন্তুটা ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করলে। কুটিরের চারপাশে হায়না তাড়িয়ে ছুটতে লাগল নজমবাজী এবং একসময়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমের জন্য প্রস্তুত হল। শুষ্ক করোটিগুলিতে মেয়েটি মাংসের ঝোল মাখিয়ে দিয়েছিল, এমন লোভনীয় খাদ্য ফেলে হায়না নিশ্চয়ই আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়বে না–এই ছিল তার আশা…।

সূর্য অস্ত গেল। প্রহরীরা খাদ্য নিয়ে ডাকাডাকি করতে লাগল। একটি লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে বসল নজমবাজী। এবার কিন্তু খুব বেশি খাদ্যগ্রহণ করলে না সে, সুরাপান করল খুব অল্প পরিমাণে–তারপর প্রস্তুত হল রাত্রি জাগরণের জন্য।

রাত কাটল। শুষ্ক অস্থিসার নরমুণ্ড ভোজন করলে হায়না। বিনিদ্র চোখে জেগে রইল নজমবাজী। মাঝে মাঝে মেয়েটি চিৎকার করে উঠছিল, কিন্তু হায়না সম্পূর্ণ নীরব–শুধু নিক্ষিপ্ত কঙ্কাল-করোটির ওপর তার দাঁতের বাজনা বেজেছিল কড়মড় শব্দে…

পরের দিনটাও কেটে গেল এবং পার হয়ে গেল আরও একটি রাত। তার পরের দিন সকালবেলা খুব বেশি পরিমাণেই মাংস ভোজন করলে নজমবাজী, তারপর প্রচুর সুরাপান করে নিদ্রাকাতর দেহে লম্ববান হল মাটির ওপর।

সূর্য অস্ত গেল। নজমবাজীর ঘুম ভাঙল না। কুটিরের মধ্যে ঘন হয়ে এল অন্ধকার। নজমবাজী তখনও গভীর নিদ্রায় মগ্ন…

অসহ্য যাতনায় আর্তনাদ করে জেগে উঠল নজমবাজী! এক লাফে শিকারের সামনে থেকে সরে গেল হায়না, তার মুখ থেকে ঝুলছে শ্রীমতী নজমবাজীর একটি পদপল্লবের অর্ধেক অংশ!

আহত রমণী চিৎকার করে প্রহরীকে ডাকল। প্রহরী সাড়া দিতেই সে জানাল একটা গাছের ছালের ব্যান্ডেজ, কিছু মাকড়সার জাল আর জোই জাতীয় গাছের পাতা তার এখনই দরকার।

প্রহরী তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করলে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সে ফিরে এল। নজমবাজী যা যা চেয়েছিল সব কিছুই তাকে দেওয়া হল, উপরন্তু সে পেল একটি ধারালো বর্শা। প্রহরী জানাল তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে মহারাজ শকা বল্লমটা তাকে উপহার দিয়েছেন।

অস্ত্র হাতে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠল মেয়েটি। রক্তাক্ত পা-টিকে সে ভালোভাবে বাঁধল, তারপর প্রহরীর কাছে খাদ্য চাইল। অন্যদিনের মতো আজ সে পরিমিত পানাহার করলে না প্রচুর পরিমাণে মাংস উদরস্থ করে সে বিয়ারের পাত্রে চুমুক দিল। আকণ্ঠ মদ্যপান করে সে সোজা হয়ে বসল, তারপর হুকুম করল কুটিরের বাইরে যেন আগুন জ্বেলে দেওয়া হয়।

অনুরোধ রক্ষিত হল। কুটিরের পাশ থেকে ঘাসের আবরণ সযত্নে আরও কিছুটা সরিয়ে নিল প্রহরী, ফলে বাইরের জ্বলন্ত আগুনের আলোতে কুটিরের আঁধার মাখা অন্তঃপুরে জাগল অস্পষ্ট আলোর বাতাস…

নজমবাজী আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আচম্বিতে সে অনুভব করলে তার আহত পায়ের ওপর তীক্ষ্ণ দন্তের করাল স্পর্শ। হাতের বল্লম তুলে ধরার আগেই মেয়েটির পায়ের ডিম থেকে এক কামড়ে খানিকটা মাংস তুলে নিয়ে সরে গেল হায়না!

ঘরের মধ্যে তখন বিরাজ করছে নিরেট অন্ধকার। বাইরে আর আগুন জ্বলছে না। নজমবাজী চিৎকার করে প্রহরীদের আগুন জ্বালাতে বললে। আদেশ পালিত হল তৎক্ষণাৎ।

জানলার ফাঁকে ফাঁকে জ্বলন্ত মশালের আলোতে নজমবাজী তার ক্ষতবিক্ষত পা-টিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, তারপর ব্যান্ডেজ বাঁধল খুব নিপুণ হাতে। তখন তার চলার ক্ষমতা আর ছিল না, এক হাতে বর্শা উঁচিয়ে কোনোমতে সে হায়নাটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে। খুব সহজেই উদ্যত বর্শাটাকে এড়িয়ে সরে গেল হায়না। শ্রান্ত অবসন্ন দেহে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে পড়ল নজমবাজী।

তার পায়ের ক্ষত থেকে বেশ কিছু রক্ত ঝরে এক জায়গায় মাটির ওপর জমেছিল। হায়নাটা সেই রক্ত পান করল, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে নজমবাজীর মুখের ওপর ক্ষুধিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। বর্শার খোঁচা মারার উপায় ছিল না, জন্তুটা ভারি শয়তান, উদ্যত বর্শার নাগালের মধ্যে একবারও পা বাড়াল সে কেবল তার দুই জ্বলন্ত চক্ষুর নির্নিমেষ দৃষ্টি ক্ষুধার্ত আগ্রহে লেহন করতে লাগল রমণীর সর্বাঙ্গ..

অকস্মাৎ অন্ধকার রাত্রির স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কুটিরের মধ্যে জাগল এক ভয়াবহ অট্টহাস্য হা! হা! হা! হা!

হায়নার হাসি! কুটিরের মধ্যে নজমবাজীর অঙ্গে অঙ্গে ছুটে গেল আতঙ্কের বিদ্যুৎপ্রবাহ! এমনকী কুটিরের বাইরে মহারাজের নির্ভীক প্রহরীর মাথার চুলও আতঙ্কে খাড়া হয়ে উঠল! জুলু সৈনিক হাতে অস্ত্র থাকলে কারুকে ভয় পায় না, কিন্তু সেই জান্তব অট্টহাস্য তাদের অন্তরেও ভীতির সঞ্চার করলে।

হি! হি! হি! হি! কুটিরের ভিতর থেকে জাগল এবার নারীকণ্ঠে তীব্র হাস্যধ্বনি!

স্নায়ুর ওপর এতখানি চাপ সহ্য করতে পারল না নজমবাজী, সে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ল…

অতর্কিত আক্রমণ করলে হায়না। বিদ্যুৎবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে মেয়েটির পায়ে কামড় বসাল।

সজোরে বর্শা চালনা করল নজমবাজী। সাঁৎ করে সরে গিয়ে জন্তুটা আত্মরক্ষা করলে এবং মেয়েটি সাবধান হওয়ার আগেই দুই চোয়ালের বর্জ-দংশনে চেপে ধরলে বর্শাফলক–

পরক্ষণেই এক টান মেরে হায়না অস্ত্র ছিনিয়ে নিল। নজমবাজী বুঝল নিরস্ত্র অবস্থায় আর সে আত্মরক্ষা করতে পারবে না, মৃত্যু তার নিশ্চিত। সে তার আর্তনাদ করলে না, দৃঢ় স্বরে হাঁক দিল, প্রহরী!

উত্তর এল, আদেশ করুন।

–আমি আর একে ঠেকিয়ে রাখতে পারছি না। শয়তানটা এখনই আমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। রাজাকে জানিয়ো নজমবাজী জীবনে কখনো কাঁদেনি। আজও সে হাসিমুখে মরতে চায়। আমার অন্তিম অনুরোধ এই কুটিরে যেন আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। শত্রুকে যদি পুড়ে মরতে দেখি তাহলে আমিও হাসতে হাসতে মরতে পারব। যাও প্রহরী, তাড়াতাড়ি যাও।

রাজার অনুমতি আনতে একটু দেরি হল। ওই সময়ের মধ্যেই বার বার আক্রমণ চালিয়েছে হায়না। কোনোমতে দুই হাত দিয়ে জন্তুটার আক্রমণ ঠেকিয়েছেনজমবাজী। হায়নার নিষ্ঠুর দাঁত তার শরীরের মারাত্মক স্থানগুলিকে স্পর্শ করতে পারেনি বটে, কিন্তু রাজার আদেশ নিয়ে প্রহরী যখন ফিরে এল তখন হতভাগিনী মেয়েটির দুখানি পায়ের বেশির ভাগ অংশই হায়নার উদরস্থ হয়েছে।

হায়না বুঝেছে তার শিকার দুর্বল হয়ে পড়েছে। হিংস্র দন্ত বিস্তার করে সে আবার আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কুটিরের শুষ্ক আবরণ ভেদ করে উঁকি দিল জ্বলন্ত অগ্নিশিখা!

নজমবাজীর প্রার্থনা পূরণ করেছেন রাজা, প্রহরীরা আগুন লাগিয়েছে কুটিরে…।

দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন, সভয়ে আর্তনাদ করে উঠল হায়না, কুটিরের অভ্যন্তরে জাগল নারীকণ্ঠে তীব্র হাস্যধ্বনি–হি! হি! হি! হি!

কুটিরের ছাতের ওপর, দেয়ালের ওপর সগর্জনে লাফিয়ে উঠল শত শত লেলিহান অগ্নিশিখা–প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ল ছাত। অগ্নিদেবের জ্বলন্ত আলিঙ্গনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল শ্বাপদ ও রমণী…

নজমবাজীকে কেউ প্রশংসা করবে না।

বহু মানুষকে সে হত্যা করেছিল; বাঘিনীর মতো হিংসা-কুটিল তার স্বভাব, বাঘিনীর মতোই সে ভয়ংকরী অপরাধের যোগ্য শাস্তি পেয়েছে সে।

কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় সে দিয়েছিল তার জন্য তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মহারাজ শকা–বাঘিনীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি।

ওই সম্মান তার প্রাপ্য।

বাঘিনীর প্রাপ্য।

[ফাল্গুন ১৩৭৫]

বানর-সেনার বন্দি

ইথিওপিয়ার গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দ চরণে যে শ্বেতাঙ্গটি হেঁটে চলেছে তার নাম চার্লস বেনেট রেডমন্ড।

বিড়ালের মতো সতর্ক পদক্ষেপে সে এগিয়ে চলেছে বনের পথে, দুই চোখের তীব্র সন্ধানী দৃষ্টি মেলে চতুর্দিক নিরীক্ষণ করছে বারংবার। কেন? এই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে কোন মূল্যবান বস্তু খুঁজে খুঁজে ফিরছে এই সুসভ্য শ্বেতাঙ্গ? পরনে তার শিকারির পোশাক, কোমরে ঝুলছে জোড়া রিভলভার- কিন্তু হাতে নেই রাইফেল।

শুধুমাত্র রিভলভারের ভরসায় এই ভয়াবহ শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে কোনো শিকারি পা দেয় না। এখানকার জঙ্গলে বাস করে অসংখ্য লেপার্ড- ওই ধূর্ত জানোয়ারের বিদ্যুৎ-চকিত আক্রমণের বিরুদ্ধে রিভলভার চার্লিয়ে বিশেষ সুবিধা করা যায় না। লেপার্ড ছাড়া অন্য রকম বিপদের ভয়ও আছে– যদিও এই বনভূমি পশুরাজের প্রিয় বাসস্থান নয় তবুও কোনো খামখেয়ালি সিংহ-সন্তান কখনও এদিকে বেড়াতে আসবে না এমন কথা জোর করে বলা যায় না। শিকারির সঙ্গে শুভদৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি পশুরাজ নখদন্তের আপ্যায়নে মানুষটিকে অভ্যর্থনা জানাতে চায় তাহলে কেবলমাত্র রিভলভারের গুলিবৃষ্টি করে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব।

সঙ্গীবিহীন অবস্থায় দুটো রিভলভারের ভরসায় এই ভীষণ অরণ্যে প্রবেশ করার সাহস যার থাকে সে হয় নিরেট মুখ আর নয় তো বদ্ধ উন্মাদ

কিন্তু এই লোকটিকে দেখে তোবোকা কিংবা পাগল মনে হচ্ছে না! তবে? মৃত্যুপুরীর মধ্যে এমনভাবে প্রাণ বিপন্ন করার কারণ কী?

আচ্ছা আমরা বরং লোকটির ডায়েরির পাতা উল্টে দেখি–

আমি আর আমার বন্ধু টনি ঠিক করলাম যে একজোড়া লেপার্ডের চামড়া আমাদের নিতান্তই প্রয়োজন। ইথিওপিয়ার বনভূমিতে বাস করে অসংখ্য লেপার্ড। অতএব আমরা দুজনে সেদিকে যাত্রা করলাম মহা উৎসাহে। আদ্দিস আবাবা ছেড়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যে জায়গায় এসে আমরা উপস্থিত হলাম তার নাম মোগর।

এই মোগর অঞ্চলের বনভূমি হচ্ছে যাবতীয় বন্য পশুর প্রিয় বাসস্থান। সমগ্র আফ্রিকার মধ্যে বোধহয় আর কোথাও এত ভয়ানক জঙ্গল নেই, এমনকি কিনিয়ার বিখ্যাত বনভূমিও মোগরের কাছে একেবারেই নগণ্য।

চারদিকে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য রোদে-পোড়া ছোটো বড়ো পাথর, কঠিন পাথুরে জমি থেকে কি কৌশলে জানি না রস আহরণ করে দাঁড়িয়ে আছে এক সুবিশাল বনভূমি। অসংখ্য উপত্যকা, গহুর ও বৃষ্টিধারার সংঘাতে ক্ষতবিক্ষত গভীর নালাতে পরিপূর্ণ সেই মহারণ্য।

আমরা এসে উপস্থিত হলাম এই সবুজ অরণ্যের অন্তঃপুরে।

পূর্ব আফ্রিকার কিনিয়া অঞ্চলে যেমন শিকার অভিযানের সুবিধা আছে এদিকে তেমন নেই। লোকজন নিয়ে দল বেঁধে শিকারে যাওয়ার পদ্ধতি এখানে প্রচলিত হয়নি। তাই এখানকার জঙ্গলে শিকার করতে এলে নতুন শিকারিকে নির্ভর করতে হয় তার একক ক্ষমতার উপরে পেশাদার শিকারিদের সাহায্য এদিকে পাওয়া যায় না।

আমরা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম। তাদের জানিয়ে দিলাম যে যদি কোনো লেপার্ড গ্রামবাসীদের গোরু ছাগল মারতে থাকে তবে আমাদের যেন খবর দেওয়া হয়- আমরা আগ্রহের সঙ্গে হত্যা করব সেই দুরাত্মাকে।

নানারকম সংবাদ আসতে লাগল। অধিকাংশই গুজব। আমাদের শুধু ছুটোছুটি সার।

যে-সব আপত্তি ও গোলমালের খবর আমাদের কানে আসতে লাগল সেজন্য কোনো মাংসাশী পদ দায়ী নয় গ্রামবাসীদের শান্ত জীবনে মূর্তিমান অভিশাপের মতো হানা দিয়েছে একদল বানর জাতীয় জীব- হামাড্রায়াড বেবুন।

এই জন্তুগুলোর চেহারা যেমন বিশ্রী, প্রকৃতিও তেমনই ভয়ংকর। বেবুনরা বাস করে দলবদ্ধভাবে, তাদের সংখ্যাও গ্রামবাসীদের চেয়ে অনেক বেশি। বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো আচম্বিতে হানা দেয় ছ-সাতশো বেবুন গাঁয়ের মধ্যে, বেপরোয়াভাবে লুটপাট করে জিনিসপত্র ভেঙে-চুরে চলে যায় দলবদ্ধ জন্তুগুলি।

গ্রামবাসীদের তারা মোটেই ভয় করে না, উদ্যত বর্শার আক্রমণকে তারা খুব সহজেই এড়িয়ে যেতে পারে।

গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলে বেবুনরা আস্তানা বাঁধে। শুধু শস্যক্ষেত্রগুলি ধ্বংস করেই জন্তুগুলি ক্ষান্ত হয় না- কুঁড়েঘরের ভিতর প্রবেশ করে তারা জিনিসপত্র লুটে নেয়, এমনকি অনেক সময় ছোটো-ছোটো শিশুদের তুলে নিয়ে তারা পালিয়ে যায় বনের মধ্যে।

কোনো মানুষই এই কদাকার জন্তুগুলিকে পছন্দ করে না। আমরাও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম বেবুনবাহিনীর উপর, শুধু তাদের জন্যই হয়তো এ-যাত্ৰা আমাদের শূন্য হাতে ফিরতে হবে। আমাদের রাগের কারণও ছিল।

চারদিকে খালি বেবুন আর বেবুন, তাই কোনো লেপার্ডের লুব্ধ দৃষ্টি গ্রামবাসীদের ছাগল ভেড়ার দিকে আকৃষ্ট হয় না কারণ বেলুনের মাংস লেপার্ডের প্রিয় খাদ্য।

লেপার্ড যদি গ্রামের মধ্যে আসতে না রাজি হয় তবে আমাদেরই ঢুকতে হবে জঙ্গলের ভিতর দিনের পর দিন ঝোপে ঝোপে হানা দিয়ে ঘুরলাম আমি আর টনি, কিন্তু লেপার্ডের চিহ্ন পর্যন্ত কোথাও চোখে পড়ল না।

সহজে হাল ছাড়তে আমি রাজি নই। স্থানীয় বাসিন্দারা যতরকম কায়দাকানুন জানে সব কিছুই প্রয়োগ করে দেখা হল।

শুনেছিলাম লেপার্ডের কণ্ঠ অনুকরণ করে হাঁক দিলে আসল জানোয়ার অকুস্থলে উপস্থিত হয়। বারংবার চেষ্টা করে আমি ওই জানোয়ারের কণ্ঠস্বর আয়ত্ত করলাম, আমার গলা থেকে বেরিয়ে আসত অবিকল লেপার্ডের গর্জনধ্বনি।

কিন্তু কোথায় কী? নকল গর্জনে সাড়া দিয়ে কোনো লেপার্ড বন্দুকের গুলিতে আত্মবিসর্জন দিতে এগিয়ে এল না।

আর একটি মাত্র উপায় আছে- কুকুর-মাংসের টোপ।

লেপার্ড কুকুরের মাংস খুব পছন্দ করে, তাই কুকুর দিয়ে টোপ ফেললে বোধহয় ওই জানোয়ার আমাদের ফাঁদে পা দিতে পারে। আমাদের সঙ্গে অবশ্য কুকুর ছিল না, তবে শেষ পর্যন্ত হয়তো একটি কুকুর আমরা জুটিয়ে ফেলতাম কিন্তু বাধা দিল টনি।

তার মাথায় চমকে উঠেছে এক অভিনব ফন্দি।

শয়তান লেপার্ডগুলো যখন বেবুনের মাংস ছাড়া আর কিছু খেতে রাজি নয় তখন বেবুন দিয়ে একটা টোপ সাজালে কেমন হয়?

বেবুনের মাংস দিয়ে টোপ ফেললে লেপার্ড নির্ঘাত ফাঁদে পা দেবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বেবুনের সঙ্গে মানবদেহের এত সাদৃশ্য আছে যে বেবুন মারতে গেলেই মনে হয় নরহত্যা করছি। যাই হোক আমরা ঠিক করলাম মনের দুর্বলতাকে প্রশয় দিলে চলবে না, আপাতত দুটো বেবুনকে হত্যা করে আমরা লেপার্ডের টোপ সাজিয়ে ফেলব।

সঙ্কল্প করা সহজ, কিন্তু সেই সঙ্কল্পকে কাজে পরিণত করা সহজ নয়। পরের দিন সমস্ত জঙ্গলে আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু একটাও বেবুন আমাদের চোখে পড়ল না। বেবুনদের পুরোনো আস্তানায় আমরা হানা দিলাম, এমনকি যে গ্রামটার উপর কিছুদিন আগেই তারা অত্যাচার করেছিল সেখানেও খুঁজলাম কিন্তু কোথায় কী? সব ভে-ভ!

মনে হল কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন তাদের সাবধান করে দিয়েছে, না হলে এতদিন যাদের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, রাতারাতি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সেই শয়তানগুলো কোথায় সরে পড়ল!

বিকাল পর্যন্ত অনুসন্ধান-পর্বচার্লিয়ে আমরা যখন রীতিমত হতাশ হয়ে পড়েছি ঠিক সেই সময় নতুন আশার বাণী পরিবেশন করলে আমাদের পথ-প্রদর্শক, মধুর লোভ দেখালেই বেকুন আসবে।

আমাদের সম্মতি পেয়ে সে লম্বা লম্বা পা ফেলে অন্তর্ধান করল এবং ঘণ্টাখানেক পরে তিন তিনটে মৌচাক হাতে নিয়ে ফিরে এল।

তরল আঠার মতো মধু গড়িয়ে পড়ছে তিনখানা মৌচাক থেকে।

আমরা বললাম, আচ্ছা গোনরা, কাল সকাল পর্যন্ত ওটা তোমার কাছেই রেখে দাও।

না না, সাহেব! ঘন-ঘন মুণ্ড নেড়ে সে তার আপত্তি জানিয়ে দিলে। তার কণ্ঠস্বরেও ছিল ভীতির আভাস।

নোকটাকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম না, টপ করে মৌচাকগুলিকে টেবিলের উপর রেখে সে দ্রুতপদে প্রস্থান করলে।

আমি অবাক হয়ে তাকালুম টনির মুখের দিকে। টনি বললে, এসব নেটিভদের নানা ধরনের কুসংস্কার থাকে। হয়ত গোরা মনে করে মৌচাকটাকে কাছে রাখলে তার অমঙ্গল হবে।

…সেদিন রাতে তাঁবুর মধ্যে ক্যানভাসের খাটে শুয়ে চিন্তা করছি। যতই ভাবছি আমাদের অবস্থাটা ততই হাস্যকর মনে হচ্ছে। প্রথমে আমরা চাইলুম একটা লেপার্ড, সেটাকে বাগাবার জন্য দরকার হল একটা বেবুন; আবার বেবুনটাকে ধরতে গিয়ে দেখছি টোপ হিসাবে একটা মৌচাক না হলেই নয়। সুখের কথা এই যে মৌচাকটাকে ধরবার জন্য আর কিছুর দরকার হচ্ছে না, কারণ একটার বদলে তিন-তিনটে মৌচাক আমার টেবিলের উপরেই বর্তমান।

সেই মৌচাকই হল যত অনর্থের মূল… মধ্যরাত্রে আমার ঘুম ভাঙল টনির কণ্ঠস্বরে—

কে? চার্লি?

নিশ্চয়ই। আবার কে আসবে?

তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আমি উত্তর দিলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম তাঁবুর মধ্যে আমরা। ছাড়াও তৃতীয় প্রাণী আছে– ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম বিছানার উপরে।

টনি তার ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালিয়ে দিলে।

অন্ধকারের বুকে জ্বলে উঠল তীব্র আলোক-রেখা– সেই আলোতে আমরা দেখলাম একটা বেবুন টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে বাচ্চা ছেলেরা যেভাবে আইসক্রিম খায় ঠিক সেই ভঙ্গিতে একটা মৌচাক চাটছে।

অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ জ্বলন্ত আলোক রশ্মি তার চোখে আঘাত করল। চক্ষুরত্নকে তীব্র আলোর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সে ঠিক মানুষের মতোই একটা হাত তুলে ধরল চোখের সামনে।

গুলি চালাও চার্লি! টনি চিৎকার করে উঠল, লেপার্ডের টোপ তোমার সামনেই রয়েছে।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে একটা বেবুনকে তাঁবুর মধ্যে দেখে আমি হয়ে পড়েছিলাম হতভম্ব, টনির চিৎকারে আমার সম্বিত ফিরে এল।

মুহূর্তের মধ্যে রাইফেল টেনে নিয়ে আমি জন্তুটার বুক লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লাম।

এক হাত দিয়ে রক্তাক্ত বুকটা চেপে ধরে বেবুন ভূমিশয্যা গ্রহণ করল। ধরাশায়ী জন্তুটার কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল অবরুদ্ধ আর্তস্বর- পরক্ষণেই তাঁবুর মধ্যে শুরু হল তাণ্ডব নৃত্য। তাঁবুর আচ্ছাদন ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করলে একপাল বেবুন।

টনির চিৎকার শুনলাম। একটু পরেই তার কণ্ঠ হল অস্পষ্ট বুঝলাম বেবুনগুলো তার গায়ের উপর এসে পড়েছে। প্রথমে মনে করেছিলাম জন্তুগুলো বোধহয় আমাদের মেরে ফেলতে চায়; কিন্তু একটু পরেই বুঝলাম তাদের দৃষ্টি শুধু আহত সঙ্গীর উপরেই নিবদ্ধ। আমাদের হত্যা করার মতো ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য বেবুনদের নেই।

আহত বেলুনের শায়িত দেহটাকে দলের বানরগুলো ধরাধরি করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে লাগল, কর্কশ কণ্ঠের বিচিত্র স্বরলহরী জাগল তাবুর মধ্যে বেবুনরা তাদের মুমূর্ষ সঙ্গীকে উৎসাহ দিচ্ছে।

আমার নিজস্ব ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বালিয়ে এক হাতে ধরে রাখলাম। দলে দলে বেবুন তখনও ভিতরে ঢুকছে, তাদের গায়ের দুর্গন্ধে দূষিত হয়ে উঠেছে তাঁবুর হাওয়া। একহাতে আলো জ্বালিয়ে আর এক হাতে রাইফেল নিয়ে আমি ইতস্তত করতে লাগলাম।

নেহাত যদি তারা আমাকে আক্রমণ করে তাহলেই গুলি ছুড়ব, অকারণে রাইফেল চার্লিয়ে এই বানর বাহিনীকে খেপিয়ে তুলতে আমি রাজি নই…

তাবুর ভিতরে বেবুনের চিৎকার আর গর্জন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল… অকস্মাৎ হুড়মুড় করে তবু ভেঙে পড়ল আমাদের মাথার উপর, অনেকগুলো বানরকণ্ঠে জাগল গর্জন, আর্তনাদ… সশব্দে ছিঁড়ে গেল তাবুর আচ্ছাদন। ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ এসে লাগল গণ্ডদেশে… বানর বাহিনী অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের গর্ভে…

ঘটনাস্থলে পড়ে রইল শুধু ছিন্নভিন্ন তাবুর ভগ্নাবশেষ এবং দুটি বেবুন।

প্রথমটি তো আগেই আমার গুলি খেয়ে মারা পড়েছিল, দ্বিতীয়টি বোধহয় তার সঙ্গিনী। দুনম্বর বেবুনটা তখনও তার সঙ্গীকে উৎসাহ দিচ্ছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে নিশ্চিত বিপদের মুখেও সে সঙ্গীকে ফেলে পলায়ন করল না। অন্য সময় হলে এমন করুণ দৃশ্য দেখলে নিশ্চয় দুঃখিত হতাম, কিন্তু দারুণ ক্রোধ তখন আমাদের কোমল অনুভূতিগুলোকে মুছে দিয়েছে..

পরের দিন সকালেও দেখলাম বেবুন তার মৃত সঙ্গীর কাছে বসে আছে— কোনও কারণেই সে স্থান ত্যাগ করতে রাজি হল না। উপায়ান্তর না দেখে আমরা তাকে হত্যা করতে বাধ্য হলাম। অবশ্য স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে এ কাজটা আমরা নিজেদের হাতে করতে পারিনি পথ-প্রদর্শক গোবোর উপরে এই অপ্রিয় কাজের ভার দিয়ে আমরা সরে পড়েছিলাম।

এবার তাবুটাকে পরীক্ষা করে দেখলাম যে সেটাকে আর কোনমতেই সারিয়ে নেওয়া যাবে না, বানর বাহিনীর নখদন্তে জিনিসটা একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সেজন্য বিশেষ দুঃখিত হইনি, কিন্তু আমার নতুন রাইফেলটা যখন কোথাও খুঁজে পেলাম না তখন মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল। রাইফেলটা একেবারে নতুন-হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ড অস্ত্রটার জন্য আমি অপেক্ষা করেছিলাম প্রায় দুবছর, আর দামও পড়েছিল অনেক, প্রায় ২০০০ ডলার। চারদিকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন রাইফেলটার পাত্তা পাওয়া গেল না তখন বুঝলাম বেবুনগুলোই অস্ত্রটা নিয়ে পালিয়ে গেছে।

রাইফেল হারিয়ে মহা মুশকিলে পড়লাম। জিনিসপত্রের ওজন কমাবার জন্য আমরা প্রত্যেকেই এক-একখানা রাইফেল নিয়েছিলাম। আমার অস্ত্রটা চুরি গেছে, এবং যেহেতু রাইফেল ছাড়া শিকার করা সম্ভব নয় অতএব আমাকে এখন আদ্দিসআবাবায় গিয়ে একটা নতুন রাইফেল কিনতে হবে।

নাঃ! আমি ঠিক করলাম এত সহজে রাইফেলটাকে ছাড়ব না, যেমন করেই হোক বেবুনদের হাত থেকে অস্ত্রটা উদ্ধার করব।

টনি বুদ্ধি দিলে, এক কাজ করা যাক। মরা বেবুন দুটোকে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় ফেলে রাখি, দলের বানরগুলো নিশ্চয়ই সেখানে এসে জুটবে। তারপর যখন বেবুনের দল স্থানত্যাগ করবে তখন তাদের অনুসরণ করলেই হয়ত আমরা রাইফেলটাকে উদ্ধার করতে পারব।

ভালো যুক্তি– আমি বরাবরই দেখেছি টনির মাথাটা বেশ পরিষ্কার। তার বুদ্ধিমত কাজ করেই রাইফেলটাকে হারিয়েছি, আবার এখন তার মতে সায় দিয়ে আমি পড়লাম এক নতুন বিপদের মধ্যে–

যাক, সে কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।

মরা বেবুন দুটোকে জঙ্গলের ভিতর ফেলে রেখে পরপর দুদিন আমরা অপেক্ষা করলাম কিন্তু বানরের দল না-পাত্তা। সন্ধ্যার পরে আবার মৃতদেহ দুটিকে ফিরেয়ে আনতে হত, কারণ রাত্রিবেলা যদি বেবুনের দল মৃত সঙ্গীদের বহন করে নিয়ে যায় তবে জঙ্গলের পথে অন্ধকারের কালো যবনিকা ভেদ করে তাদের অনুসরণ করা সম্ভব হবে না।

দুদিন পরে বেবুন দুটোর শরীর থেকে পচা মাংসের দুর্গন্ধ ছাড়তে লাগল। খুব সম্ভব সেই দুর্গন্ধে আকৃষ্ট হয়েই তৃতীয় দিনে বেবুনের দল মরা পশু দুটোর কাছে এল। খানিকক্ষণ সঙ্গীদের প্রাণহীন দেহ দুটির চারধারে ঘুরে ঘুরে তারা ঘ্রাণ গ্রহণ করল। তারপর ঘটনাস্থল ছেড়ে সরে পড়ল।

আমরা তাদের পিছু নিলাম দূর থেকে।

অনেক সময় ঘন জঙ্গলের মধ্যে বেবুনগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু পরিত্যক্ত মলমূত্রের দুর্গন্ধে তাদের গমন-পথ নির্ণয় করতে আমাদের কোনো অসুবিধা হল না। অনেকক্ষণ ধরে চলল অনুসরণ পর্ব।

জন্তুগুলোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ইতিমধ্যেই আমাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছে, তবে তাদের হাব-ভাব দেখে মনে হল দুটো তুচ্ছ মানুষকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। মাঝে মাঝে জঙ্গলের পথে মাটি থেকে পোকা-মাকড় তুলে তারা মুখে দিচ্ছিল অথবা বড়ো বড়ো পাথরের তলা থেকে কিসব কুড়িয়ে চর্বণ করছিল পরম আনন্দে। অত দূর থেকে সব সময় তাদের খাদ্যবস্তুটা আমরা দেখতে পাইনি; তবে গাছপালা, কচি ঘাস, গাছের ফল থেকে শুরু করে পোকা-মাকড়, গিরগিটি, বৃশ্চিক প্রভৃতি অনেক কিছুই বেবুনের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ উদ্ভিদভোজী হলেও বেবুন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুব বেশি খুঁতখুঁতে নয়- সে যাহা পায় তাহাই খায়।

বেবুনদের ভোজন এবং ভ্রমণপর্ব চলল অনেকক্ষণ ধরে অবশেষে তারা এসে উপস্থিত হল একটা ছোটো নদীর ধারে।

নদীর দুই তীরে অসংখ্য মহীরূহ পরস্পরের দিকে শাখাময় বাহু প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে এবং কোথাও কোথাও দুই পারের বৃক্ষশাখা দৃঢ় আলিঙ্গনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছে। বেবুনের দল সেই ঝুলন্ত গাছের ডাল ধরে নদী পার হতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরেই তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল নীচের দিকে।

জলের উপর আত্মপ্রকাশ করেছে অনেকগুলি কুম্ভীর।

কুমিরদের মনোভাব অনুমান করা কঠিন নয়- দৈবাৎ যদি দুএকটা বেবুন হাত ফসকে জলের মধ্যে পড়ে তাহলেই ভোজের উপকরণ জোগাড় হয়ে যায়।

কুমিরদের আশা সফল হল না। বেবুনগুলো তাদের দেখেই ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে নিক্ষিপ্ত হল রাশি রাশি ডালপালা ভাসমান নকুলের উপর।

বেবুনদের অভদ্র ব্যবহারে বিরক্ত হ কুমিরের দল আবার জলের তলায় আত্মগোপন করলে…

আমরাও সেই ডালপালার সেতু আঁকড়ে নদী পার হলাম। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি শূন্যপথে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যাই নদীর জলে– ওই কুম্ভীর-সঙ্কুল নদীতে পড়লে আর নিস্তার নেই, মুহূর্তের মধ্যে শরীরটা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে জলবাসী দানবের দংশনে। ভাগ্যক্রমে সেরকম কিছু ঘটল না, আমরা দুজনে নির্বিঘ্নে নদী পার হলাম।

নদীর বিপরীত দিকে পৌঁছে দেখলাম, পথটা দুদিকে ভাগ হয়ে চলে গেছে। এবার আর বুঝতে পারলাম না বেবুনগুলো কোন পথ ধরে এগিয়ে গেছে অতএব ঠিক করলাম আমরা দুজনে দুই পথ ধরে এগিয়ে যাব, এবং রাইফেল পাই না পাই এক ঘণ্টার মধ্যে ঠিক এই জায়গায় এসে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হব।

আমার সঙ্গে ছিল মাত্র ৩৮ রিভলভার। টনির সঙ্গে রাইফেল ছিল বটে, কিন্তু এখন একা পথ চলার সময়ে যদি কোনো হিংস্র পশুর দ্বারা আক্রান্ত হই তাহলে টনির রাইফেল আমাকে সাহায্য করতে পারবে না– ভরসা শুধু কোমরের ৩৮ রিভলভার।

টনি তার কোমরবন্ধ থেকে নিজস্ব একটা ৪৫ কোল্ট রিভলভারটা আমায় খুলে দিলে। তবু ভালো~ রাইফেলের মতো শক্তিশালী অস্ত্র হাতে না থাকলেও দুটো রিভলভারের ভরসায় নিজেকে কিছুটা নিরাপদ মনে করলাম। পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমরা দুজনে এগিয়ে চললাম দুই রাস্তা ধরে…

আমি ভয় পাইনি, কিন্তু অস্বস্তি বোধ করছিলাম। প্রতি মুহূর্তে দলবদ্ধ বেবুনের আক্রমণের ভয় তো আছেই, তা ছাড়া অন্যান্য হিংস্র জানোয়ারের অভাব নেই।

বিশেষ করে লেপার্ডগুলিকে বিশ্বাস করা যায় না যে-কোনো মুহূর্তে ঝোপের আড়াল থেকে ওই ধূর্ত জানোয়ার আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে পারে।

ভাগ্যের কি পরিহাস!

এতদিন পর্যন্ত লেপার্ডের সন্ধান করছি পাগলের মতো, আর এখন তার সাহচর্য আমার কাছে দস্তুরমতো ভীতিজনক।

শুধুমাত্র রিভলভার হাতে ওই ভয়াবহ মার্জারের সম্মুখীন হওয়ার ইচ্ছা ছিল না বিন্দুমাত্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে করতে জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে চললাম।

পথের দুধারে অরণ্য ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে, দু-পাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে নানারকম স্পষ্ট ও অস্পষ্ট ধ্বনি। জানি ওই শব্দের জন্য দায়ী হচ্ছে কতকগুলি নিরীহ জন্তুর কণ্ঠস্বর, কিন্তু নির্জন আরণ্যক নীরবতার মধ্যে সেই ধ্বনিতরঙ্গগুলি আমার স্নায়ুর উপর চাপ দিতে লাগল।

আচ্ছা, এইখানে আমার ডায়েরির পাতা বন্ধ করছি। আমরা বুঝতে পারছি চার্লস বেনেট রেডমন্ড নামক মানুষটি কি কারণে পদার্পণ করেছে এই গভীর অরণ্যে আর কেনই বা রাইফেলের পরিবর্তে তার কোমরে ঝুলছে দুটো রিভলভার।

এবার আমরাও এগিয়ে চলি রেডমন্ড-এর সঙ্গে, দেখা যাক সে অপহৃত রাইফেলটাকে আবার উদ্ধার করতে পারে কি না।

ঘন জঙ্গলের শেষে খানিকটা ফাঁকা জায়গা।

সেখানে এসেই রেডমন্ড দেখল তার হারিয়ে-যাওয়া রাইফেল পড়ে আছে ফাঁকা জমিটার উপরে।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে রেডমন্ড অস্ত্রটাকে তুলে নিলে।

সত্যি কথা বলতে কি রাইফেলটা আবার ফিরে পাবে এমন আশা সে করেনি। এতক্ষণ পরে তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এল, অস্ত্রটাকে স্পর্শ করতেই নিজেকে নিরাপদ বোধ করল রেডমন্ড।

ভালোভাবে পরীক্ষা করে সে দেখল অস্ত্রটা ব্যবহারের উপযুক্ত আছে, তার কলকবজা কিছুই খারাপ হয়নি। কিন্তু রাইফেলটা এখন শূন্যগর্ভ তার দুটো নলের একটাতেও বুলেট নেই। সে বুঝল কোনো বানর-সন্তানের অঙ্গুলি-স্পর্শে ভরা রাইফেল আওয়াজ হয়ে গুলি ছুটে গেছে। কারণ, তাঁবু থেকে যখন রাইফেল চুরি যায় তখন তার দুটো ঘরেই গুলি ভরা ছিল। মনে মনে রেডমন্ড আশা করল ভরা রাইফেল ফায়ার হয়ে নিশ্চয়ই কয়েকটা বেবুন হতাহত হয়েছে শয়তান জানোয়ারগুলোর দুর্দশা কল্পনা করে রেডমন্ড একটু খুশি হল।

পকেটে রাইফেলের টোটা ছিল, অস্ত্রটাকে সে লোড করে নিলে। রাইফেলে টোটা ভরতে ভরতে হঠাৎ তার মনের মধ্যে জেগে উঠল এক অস্বস্তিকর অনুভূতি।

সে ফিরে দাঁড়াল, সঙ্গেসঙ্গে তার দৃষ্টিপথে ধরা দিল একটা মস্ত মেয়ে-বেবুন।

প্রায় ১২ গজ দুরে একটা গাছের উপর বসে আছে জন্তুটা এবং তার জ্বলন্ত চক্ষুর লক্ষ্যবস্তু। হচ্ছে রেডমন্ড।

দারুণ আক্রোশে রেড়মন্ডের চৈতন্য যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল- গত কয়েকটা দিনের তীব্র উৎকণ্ঠা আর অমানুষিক পরিশ্রমের জন্য দায়ী এই কুকুরমুখো জন্তুগুলি নিজের অজ্ঞাতসারে রাইফেল তুলে সে স্ত্রী-বেবুনটার বুকের উপর নিশানা স্থির করলে।

কয়েক মুহূর্ত পরেই তার হিতাহিত জ্ঞান ফিরে এল। স্ত্রী-পশুকে হত্যা করা উচিত নয়– সে রাইফেল নামিয়ে রাখল। ভালোই করলে– বনানীর সবুজ যবনিকা ভেদ করে তার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করল অনেকগুলি বেবুন।

রেডমন্ড অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। অস্বস্তি পরিণত হল আশঙ্কায়।

অরণ্যের বৃক্ষগুলি যেন অকস্মাৎ বানর প্রসব করতে শুরু করলে, গাছে গাছে ডালে ডালে যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই চোখে পড়ে খালি বেবুন আর বেবুন।

রেডমন্ডের সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত।

প্রায় শ-খানেক বেবুনের জ্বলন্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে তার দিকে। বৃক্ষশাখা থেকে মাটির উপর লাফিয়ে পড়ল কয়েকটা বেবুন, শব্দহীন পদসঞ্চারে এগিয়ে এল তারা, কাছে, কাছে আরও কাছে…

রাইফেলটাকে পেয়ে রেডমন্ড খুব উৎফুল্ল হয়েছিল বটে, কিন্তু এখন অস্ত্রটাকে নিতান্ত তুচ্ছ মন হল।

কলের কামান থাকলে হয়ত এই বিপুল বানর-বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা চলত, কিন্তু একটি মাত্র রাইফেলের সাহায্যে এতগুলি বেবুনের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব নয়।

হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ড শক্তিশালী দোনলা রাইফেল। কিন্তু দুবার গুলি চার্লিয়ে আবার রাইফেলের শূন্য গর্ভে টোটা ভরতে হয়- বেবুনের দল তাকে সে সুযোগ দেবে না। বড়োজোর দুটো জানোয়ারকে সে গুলি করে মারতে পারে, তারপরই তার রাইফেল হবে নীরব এবং অস্ত্রের শূন্য উদর বুলেট দিয়ে পূর্ণ করে আবার গুলি চালাবার আগেই ক্রুদ্ধ বেবুন-বাহিনীর নখদন্তে তার দেহ হবে ছিন্ন-ভিন্ন।

রাইফেল রেখে রেডমন্ড রিভলভার দুটো টেনে নিলে। রাইফেলের দুখানা শক্তিশালী বুলেটের চাইতে রিভলভারের বারোটা কম-জোরি গুলি তার বেশি কাজে লাগবে- ধারের চেয়ে ভার, শক্তির চাইতে সংখ্যার প্রয়োজনই এখন বেশি।

রেডমন্ডকে কেন্দ্র করে অর্ধবৃত্তাকারে এগিয়ে এল বেবুন-বাহিনী। ওদের অস্বাভাবিক নীরবতা সন্দেহজনক। অন্য সময় তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে কান হয়ে যায় বধির, কিন্তু এখন তাদের গর্জিত কণ্ঠ সম্পূর্ণ স্তব্ধ- শুধু কোটরগত চক্ষুগুলিতে জ্বলে জ্বলে উঠছে জান্তব হিংসা।

একটু পরেই বেবুনের হিংস্র স্বভাবের পরিচয় পেল রেডমন্ড। একটা পুরুষ-জাতীয় বেবুন হঠাৎ এসে পড়ল একটা স্ত্রী-বেবুনের কাছে। মেয়ে-বেবুনটা একটা অস্ফুট শব্দ করে জানিয়ে দিলে, পার্শ্ববর্তী পুরুষটিকে তার পছন্দ হয়েছে।

পুরুষটি ঘুরে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে আদর করতে লাগল।

মেয়েটির পিছনে যে পুরুষ-বেবুনটি দাঁড়িয়ে ছিল সে হঠাৎ সগর্জনে প্রতিবাদ জানাল। এই বেবুনটা সম্ভবত মেয়েটার আইনসঙ্গত স্বামী, পরপুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর মাখামাখি সে পছন্দ করেনি।

পূর্ববর্তী বেবুনটি এবার রুখে দাঁড়াল। হিংস্র দন্ত বিকাশ করে গর্জে উঠল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। কয়েকটি মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল দুই যোদ্ধা, তারপরই ঝাঁপিয়ে পড়ল পরস্পরের উপরে- তীক্ষ্ণ দন্তের নির্মম দংশনে ছিঁড়ে পড়ল খণ্ড-খণ্ড মাংস দুই যোদ্ধার শরীর থেকে।

দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল যুদ্ধের উত্তেজনা। প্রায় দশ বারোটা পুরুষ-বেবুন হঠাৎ নিজেদের ভিতর মারামারি শুরু করলে। এই লড়াইটা পূর্বতন যোদ্ধাদের সমর্থনে দুই পক্ষের যুদ্ধ, না নিছক হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য শুরু হল সে কথা বলা মুশকিল, তবে সেই বন্য হিংসার রক্তাক্ত নিষ্ঠুরতাকে ভাষার সাহয্যে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যোদ্ধাদের রক্তে লাল হয়ে উঠল রণভূমি। পূর্ব বর্ণিত স্ত্রী-বেবুনটা প্রথমেই মারা পড়ল। তবে এটা বোধহয় অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা, কারণ পুরুষ-বেবুন সহজে মেয়ে-বেবুনকে আক্রমণ করে না– যুদ্ধক্ষেত্রের খুব কাছাকাছি ছিল বলেই বোধহয় মেয়ে-বেবুনটা মারা পড়ল। আরও চার-চারটে পুরুষ বেবুনের প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর– তারপর হঠাৎ যেমনভাবে লড়াই শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎ শেষ হয়ে গেল সেই রক্তারক্তি কাণ্ড।

মৃত মেয়ে-বেবুনটাকে কাঁধে তুলে তার বিজয়ী স্বামী (?) গর্বভরে প্রস্থান করলে।

অন্যান্য বেবুনগুলি হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রেডমন্ডের দিকে। রেডমন্ড বুঝতে পারল তার জীবন এখন সত্যিই বিপন্ন। যুদ্ধের উন্মাদনা বেবুনদের হিংস্র স্বভাবকে করে তুলেছে আরও হিংস্র আরও ভয়ানক হত্যার নেশায় তারা পাগল হয়ে উঠেছে, এখনই তারা আক্রমণ করবে রেডমন্ডকে।

দুহাতে দুটো রিভলভার নিয়ে সে প্রস্তুত হল। একটা বেবুন তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল- একটানা কর্কশ চিৎকার। আক্রমণের সঙ্কেত।

আচম্বিতে রেডমন্ডের কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল এক উৎকট শব্দ-তরঙ্গ।

মানবকণ্ঠের চিৎকার নয়– লেপার্ডের গর্জন।

লেপার্ডের কণ্ঠ অনুকরণ করে গর্জে উঠেছে রেডমন্ড।

অগ্রবর্তী বেবুনগুলো থমকে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলে, তারপর চটপট কয়েক পা পিছিয়ে গেল।

রেডমন্ডের সাহস ফিরে এল, উৎসাহিত হয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে সে চিৎকার করে বললে, যাও, যাও, তফাত যাও।

কোনো ফল হল না। জন্তুগুলো একটুও নড়ল না। রেডমন্ড আবার লেপার্ডের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে গর্জে উঠল– সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত তীব্র আর্তনাদে বন কাঁপিয়ে বেবুনবাহিনী ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করতে শুরু করলো।

কতকগুলো লাফিয়ে উঠে বৃক্ষশাখার অন্তরালে আত্মগোপন করলে, আবার কতকগুলো মাটির উপর দিয়েই দৌড় মারলে তিরবেগে। প্রায় মিনিট খানেকের মধ্যেই বেবুন বাহিনী বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল, ঘটনাস্থলে পড়ে রইল শুধু যুদ্ধে নিহত চারটে বেবুনের মৃতদেহ।

রেডমন্ড কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে রাইফেলটাকে মাটি থেকে তুলে নিল, তারপর পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল।

একশো গজও সে যায়নি, হঠাৎ তার পিছনে শোনা গেল রাইফেলের গর্জন।

চমকে পিছন ফিরতেই সে দেখল, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে একটা চতুষ্পদ দেহ জন্তুটার গায়ে হলুদ চামড়ার উপর বসানো আছে কৃষ্ণবর্ণ চক্রচিহ্ন। লেপার্ড!

রেডমন্ড তৎক্ষণাৎ রাইফেলের ট্রিগার টিপল।

মাটি থেকে ছিটকে ধাবমান দেহটা শুন্যে ডিগবাজি খেয়ে আবার মাটির উপরেই লুটিয়ে পড়ল।

রেডমন্ড ভাবল প্রথম শব্দটা এসেছে টনির রাইফেল থেকে। খুব সম্ভব লেপার্ডকে লক্ষ্য করে টনি রাইফেল ছুঁড়েছিল এবং ভীত জন্তুটা এদিকে দৌড়ে আসতেই মারা পড়েছে রেডমন্ডের গুলিতে।

চার্লি, একটু দূর থেকে ভেসে এল টনির কণ্ঠস্বর, এদিকে এস তাড়াতাড়ি।

রেডমন্ড ঠিক করলে তার সাফল্যের কথা সে প্রথমে টনিকে জানাবে না। উনি যখন উত্তেজিতভাবে তাকে বলবে কেমন করে একটুর জন্য তার লক্ষ্য ব্যর্থ করে লেপার্ড পালিয়ে গেছে তখন সে চুপচাপ শুনবে টনির কাহিনি– তারপর লেপার্ডের মৃতদেহটাকে দেখিয়ে বন্ধুকে চমকে দেবে।

কিন্তু টনিকে চমকে দেবার আগে সে নিজেই হয়ে পড়ল হতবাক- একটা ঝোপের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে টনি।

রেডমন্ড দেখলে সেখানে পড়ে আছে আর একটা লেপার্ডের মৃতদেহ।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো রেডমন্ড শুনতে লাগল টনির কথা।

চার্লি, তোমার বরাত ভালো। আমি জঙ্গলের একটা ছোটো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি তোমায় অনুসরণ করছে একটা লেপার্ড। আমি যখন ওটাকে দেখলাম তখন জন্তুটা তোমাকে আক্রমণের উদ্যোগ করছে। গুলি ছুঁড়তে যদি আমার একটু দেরি হত, তাহলে আর তোমার রক্ষা ছিল না– ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি ঠিক সময়ে এসে পড়েছি।

হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে টনি একটা ফ্লাস্ক বার করলে—

চার্লি! এটাতে চুমুক দাও! হঠাৎ তুমি এমন কাগজের মতো সাদা হয়ে গেলে কেন? এখন। আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

সত্যি কথা এখন ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

একটু আগেই তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে এসেছিল দুদুটো লেপার্ড– কিন্তু তার সজাগ চক্ষু কর্ণ একবারও দুই শত্রুর অস্তিত্বকে আবিষ্কার করতে পারেনি।

টনি যদি ঠিক সময়ে এসে না পড়ত তাহলে বোধহয় তার দেহটা এতক্ষণে তীক্ষ্ণ নখদন্তের আঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যেত…

তবে হ্যাঁ, এখন আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

রেডমন্ডের মনে প্রশ্ন দেখা দিল- বেবুনরা পালিয়ে গেল কেন? তারা কি নকল গর্জন শুনে ভয় পেয়েছিল?

– নাকি, তার পিছনে আসল লেপার্ডকে দেখেই তারা প্রাণভয়ে পলায়ন করলে?

এই প্রশ্নের উত্তর রেডমন্ডের জানা নেই।

যতই কৌতূহল হোক, সত্যি সত্যি কি ঘটেছিল সেটা আর কোনোদিনই সে জানতে পারবে না।

বিংশ শতকে রূপকথার ড্রাগন

জাভা বা যবদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপে ড্রাগন নামে এক বিশালাকৃতি দানব-গিরগিটির সন্ধান পাওয়া যায় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। ওই সময় জাভা দ্বীপপুঞ্জ ছিল ওলন্দাজ সরকারের অধীন। শিকারিরা সন্ধান পেয়ে ড্রাগন-শিকারে উৎসাহী হলে ধরাপৃষ্ঠ থেকে এই বিরল প্রাণীটির অবলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বুঝেই ওলন্দাজ সরকার ওই সরীসৃপ-জাতীয় জীবটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হল। ওইসব শিকার হল নিষিদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সমগ্র পৃথিবী যখন আসন্ন সর্বনাশের সংকেত পেয়ে প্রস্তুত হচ্ছে, সেইসময় যবদ্বীপের বোগর শহরে উপস্থিত হল টেরি মাইকেল নামে জনৈক মার্কিন শিকারি। মাইকেল পূর্ব আফ্রিকাতে শিকার করতে গিয়েছিল, সেখান থেকে ম্যানিলা যাওয়ার পথে সে নেমেছিল যবদ্বীপে। ম্যানিলাতে যাওয়ার পথে ভ্যান এফেন নামে এক ওলন্দাজ চা-বাগানের মালিকের সঙ্গে তার আলাপ হয় এবং পূর্বোক্ত ওলন্দাজ ভদ্রলোকের অনুরোধে তারই অতিথি হয়ে তার অতিথি নিবাসে আশ্রয় গ্রহণ করে মাইকেল। একদিন সন্ধ্যার সময়ে গৃহস্বামীর সঙ্গে গল্প করতে করতে সে হঠাৎ জানতে পারল সভ্য জগতের। অজ্ঞাতসারে যবদ্বীপ বা জাভা দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপে আজও বিচরণ করে ড্রাগন নামক অতিকায় গিরগিটির দল। ড্রাগন মাংসাশী এবং অতিশয় হিংস্র। স্থানীয় মানুষ ড্রাগনের ভয়ে ওইসব দ্বীপে নামতে চায় না। ভ্যান এফেনের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে ড্রাগন নামক প্রাণীটির অস্তিত্ব ছিল মাইকেলের অজানা। যে-কোনো শিকারির পক্ষেই এমন আশ্চর্য শিকার অতিশয় লোভনীয়– যদি বন্দুকের শিকার না হয়, তবে ক্যামেরার শিকার হলেও চলবে– অতএব জাভা দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম দ্বীপ কোমোডোতে অভিযান চালাতে বদ্ধপরিকর হল টেরি মাইকেল।

কিন্তু শিকার করার জন্য ওলন্দাজ সরকারের অনুমতি দরকার। আসন্ন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত ওলন্দাজ সরকার তখন ড্রাগনের নিরাপত্তার চাইতে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে অধিকতর বিব্রত– অতএব কোমোডো দ্বীপে যাওয়ার অনুমতি পেল মাইকেল খুব সহজেই। পালো বেসর নামে একটি দ্বীপ থেকে দুজন স্থানীয় অধিবাসীকে সঙ্গে নিয়ে কোমোডো দ্বীপের উদ্দেশে নৌকা ভাসাল মাইকেল। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় মানুষ দুটি মাইকেলকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল। ওই দুজনের একজন হল আমাসি– খর্বকায়, বৃষস্কন্ধ, বলিষ্ঠ। অপর ব্যক্তির নাম বাজোড়া। সে আমাসির মতন বলবান পুরুষ নয়।

কথায় কথায় আমাসি মাইকেলকে জানাল সে কোমোডো দ্বীপে ড্রাগনদের কথা শুনেছে, তবে তাদের সে ভয় করে না। বিশেষত বন্দুকধারী সাহেব যখন সঙ্গী, তখন আর কীসের ভয়? তবে বাজোড়াকে নৌকায় রেখে যাওয়াই ভালো, কারণ ড্রাগন নামে ওই মাংসাসী সরীসৃপ সম্পর্কে বাজোড়ার আতঙ্ক অপরিসীম। ভীতু লোককে সঙ্গে না নেওয়াই ভালো। তাই বাজোড়াকে নৌকায় রেখে মাইকেল আর আমাসি কোমোডো দ্বীপে পদার্পণ করল।

ওলন্দাজ সরকার ক্যামেরার সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অনুমতি দিয়েছিল। তবে সেটা নিতান্তই আত্মরক্ষার জন্য। শর্ত ছিল সন্ধান পেলে ড্রাগনের ফটো তুলবে মাইকেল, কিন্তু জীবন বিপন্ন না হলে কখনোই বন্দুক ব্যবহার করবে না।

একটা ছোটো উপসাগরের বেলাভূমিতে এসে পৌঁছোল মাইকেল তার সঙ্গীদের নিয়ে। বাজোড়াকে নৌকাতে অপেক্ষা করতে বলে মাইকেল ও আমাসি তীরে পদার্পণ করল। সাগরতীরে বহুদূর পর্যন্ত ঘন ঘাসের রাজত্ব। ওই ঘাসজঙ্গল পেরিয়ে চোখে পড়ে পাহাড়ের সারি এবং ওইসব পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোটো ছোটো গাছ, লতাগুল্ম ও ঝোঁপঝাড়।

উপসাগরের তীরবর্তী জল ভেঙে ঘাসবনের ভিতর দিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে যাওয়ার পর মাইকেল আর আমাসি যখন দণ্ডায়মান পর্বতমালার খুব কাছে এসে পড়েছে, সেইসময় হঠাৎ ঘাসবনের মধ্যে জাগল প্রচণ্ড আলোড়ন! একদল জীব সশব্দে ছুটে চলেছে দুই শিকারির দুধার দিয়ে লম্বা লম্বা ঘসের আড়ালে চলন্ত জীবগুলিকে শিকারিদের চক্ষু আবিষ্কার করতে পারছে না। তারা কেবল দেখছে তাদের দুই পাশের ঘাসবনের ভিতর আলোড়ন তুলে কারা যেন ছুটছে আর ছুটছে এবং সেই ধাবমান জীবগুলির কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে কর্কশ ঘুৎকারধ্বনি!

আচম্বিতে মাইকেলের সামনে সুদীর্ঘ ঘাসের জঙ্গল ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করল এক বিপুলবপু বরাহ! তার মুখের দুইপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে একজোড়া ছুরির মতো একজোড়া শাণিত দন্ত এবং তার লাল চোখদুটো জ্বলে জ্বলে উঠছে ভীষণ আক্রোশে! ক্রুদ্ধ চিৎকার করে জন্তুটা ছুটে এল শিকারিদের দিকে। আমাসি তার বর্শা উঁচিয়ে ধরল, গর্জে উঠল মাইকেলের হাতের রাইফেল। গুলি খেয়ে শুয়োরটা ছিটকে পড়ল মাটির উপর। মাইকেল আবার গুলি ছোঁড়ার আগেই দৌড়ে গিয়ে শুয়োরের গলায় বর্শা বিধিয়ে দিল আমাসি…

মৃত শূকরের একটা ঠ্যাং কেটে নিয়ে আমাসি বলল, এই ঠ্যাংটা দিয়েই আজ রাতে তোফা ভোজের ব্যবস্থা করব। আর শুয়োরের শরীরটা বোধহয় ড্রাগনদের পছন্দ হবে- কী বলে?

মাইকেল বিবেচনা করে দেখল প্রস্তাবটা মন্দ নয়। পাহাড়ের উপর এক জায়গায় দুজনে মিলে টেনে নিয়ে এল শূকরের মৃতদেহ। তারপর ছুরি দিয়ে জন্তুটার পেট চিরে ফেলল তারা। বিদীর্ণ পাকস্থলী থেকে নির্গত দুর্গন্ধ মাংসলোলুপ ড্রাগনদের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে তাদের অকুস্থলে আকর্ষণ করবে- এই ছিল শিকারিদের আশা। মৃতদেহের খুব কাছেই ঝোঁপঝাড় সমেত পাথর-ঘেরা একটা জায়গা দেখেছিল তারা। ডাগনরা যদি শূকরমাংসের লোভে আকৃষ্ট হয়, তাহলে খুব সহজেই ওই ঘেরা জায়গাটার ভিতর লুকিয়ে বসে ক্যামেরার সাহায্যে তাদের আলোকচিত্র গ্রহণ করতে পারবে মাইকেল।

মাংসের টোপ ফেলে এবার জঙ্গলের কিনারাগুলি পরিদর্শন করতে গেল মাইকেল আর আমাসি। কিছুদূর গিয়ে বনের মধ্যে এক জায়গায় বালির উপর প্রকাণ্ড একটা পায়ের ছাপ দেখতে পেল তারা। পদচিহ্নের সঙ্গে একটা ভারি শরীর টেনে নিয়ে যাওয়ার ছাপও তাদের দৃষ্টিগোচর হল। পৃথিবীর বিভিন্ন অরণ্যে বিভিন্ন হিংস্র পশু শিকার করেছে মাইকেল, কিন্তু ইতিপূর্বে ওই ধরনের কোনো পদচিহ্ন মাইকেলের চোখে পড়েনি। পায়ের ছাপটা দেখলে বোঝা যায় জন্তুটার পায়ে বড়ো বড়ো নখ আছে। মাইকেল বুঝল এটা একটা ড্রাগনের পদচিহ্ন এবং উক্ত চিহ্নের সুগভীর বিস্তার জানিয়ে দিচ্ছে পদচিহ্নের মালিক বিশাল দেহের অধিকারী এক ভয়াবহ দানব!

জঙ্গল ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার সময়ে কখনও কখনও ভাঙাচোরা গাছের ডালের খোঁচা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য নিচু হয়ে, কখনও বা হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল মাইকেল সেইসময় তার পকেট থেকে কয়েকটা রাইফেলের টোটা নিঃশব্দে পড়ে গেল স্যাৎসেঁতে মাটির উপর। তখন বুঝতে না পারলেও পরে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছিল সে। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর মাইকেল ও আমাসির গতিরুদ্ধ হল– গাছের উপর থেকে লতা বেয়ে তাদের সম্মুখে অবস্থিত ফাঁকা জমির উপর অবতীর্ণ হল এক অতিকায় অজগর!

মাইকেলের রাইফেল ঘন ঘন অগ্নিবৃষ্টি করে সর্পদানবকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। রাইফেলের শূন্যগর্ভ আবার টোটা দিয়ে পূর্ণ করতে গিয়েই মাইকেল টের পেল তার পকেট ফাঁকা। সেখানে আর একটিও টোটা নেই। এই অবস্থায় আর অগ্রসর না হয়ে তারা নৌকায় ফিরে যাওয়াই উচিত বলে মনে করল। বনের পথে হাঁটতে হাঁটতে নিহত শূকরের মৃতদেহ থেকে প্রায় একশো গজ দুরে তারা যখন এসে পড়েছে সেইসময় আমাসি তার প্রকাণ্ড ছোরাটা খাপ থেকে খুলে মাইকেলের দিকে বাড়িয়ে ধরল। আমাসির মুখের দিকে তাকিয়ে মাইকেল বুঝল তার সঙ্গী ভয় পেয়েছে টোটা নেই, অতএব রাইফেলের অগ্নিবর্ষী মহিমা এখন তাদের রক্ষা করতে পারবে না।

মাইকেল নিজেও ভয় পেয়েছিল, অজানা পায়ের ছাপটা তাকে যথেষ্ট চিন্তায় ফেলেছিল, কিন্তু মুখে সাহস দেখিয়ে সে বলল, আমরা এখন নৌকাতেই ফিরে যাচ্ছি। তবে শুয়োরের ঠ্যাংটা ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া দরকার। আমার দারুণ খিদে পেয়েছে।

রক্তাক্ত শুয়োরটা যেখানে পড়েছিল, সেই জায়গাটা থেকে প্রায় ২৫ গজ দূরে এসেই থমকে দাঁড়াল মাইকেল এবং পশ্চাৎবর্তী আমাসিকে একটানে শুইয়ে ফেলে নিজেও শুয়ে পড়ল একটা ঝোপের আড়ালে। মাইকেলের মনে হল জাগ্রত অবস্থাতেই সে দেখছে একটা মারাত্মক দুঃস্বপ্ন

মৃত শুয়োরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে দুটি অদ্ভুত দানবাকৃতি সরীসৃপ; তাদের ওজন আনুমানিক ২০০ পাউন্ড, শরীরের দৈর্ঘ্য ১২ ফুটের মতন এবং চারটি পায়ে রয়েছে লম্বা লম্বা ধারাল নখ! লম্বা ঘাড়ের উপর বসানো মাথা দুটি গিরগিটির মত বাস্তব জগতে এমন অবিশ্বাস্য শরীরী বিভীষিকার অস্তিত্ব কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি মাইকেল!

শিকারিদের স্তম্ভিত দৃষ্টির সম্মুখে একটা ড্রাগন শুয়োরের দেহটাকে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল এবং কুকুর যেমন ইঁদুরকে ধরে ঝাঁকায়, তেমনিভাবেই ঝাঁকাতে শুরু করল। শক্ত চামড়া ভেদ করে ধারাল দাঁতের সারি মাংসের মধ্যে প্রবেশ করতেই নাড়িভুঁড়িগুলো ছিটকে পড়তে লাগল বিদীর্ণ দেহের ভিতর থেকে। ড্রাগন এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে গিলে ফেলল, তারপর আবার কামড়ে ধরল শুয়োরটাকে। দ্বিতীয় ড্রাগনটাও এগিয়ে এসে শূকর-মাংসের ভোজে যোগ দিল…

ভোজে মত্ত ড্রাগন দুটির চোখের আড়ালে ঝোঁপঝাড়ের ভিতর আত্মগোপন করে ঘেরা জায়গাটার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল মাইকেল আর আমাসি। ওই ঘেরা জায়গাতেই রাতের আহারের জন্য তারা রেখে গিয়েছিল শুয়োরের একটি পা। কোনোরকমে পাথর আর গাছ দিয়ে ঘেরা ওই জায়গাটার ভিতরে ঢুকে পড়তে পারলেই কিছুক্ষণের জন্য তারা নিরাপদ। যখন তারা ওই জায়গাটার পাঁচ গজের মধ্যে এসে পড়েছে, সেই সময় হঠাৎ উঠে দাঁড়াল আমাসি এবং তিরবেগে দৌড়ে গিয়ে এক লাফে বড়ো বড়ো পাথরগুলো ডিঙিয়ে ঘেরা জায়গাটার ভিতর মাইকেলের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভোজে লিপ্ত ড্রাগনদের। দৃষ্টিসীমার অন্তরালে তাড়াতাড়ি আত্মগোপন করার জন্যই ওইভাবে ছুটে গিয়েছিল আমাসি। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হল না- ঘেরা জায়গাটার ভিতর থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ ও ঘন ঘন চাপা গর্জনধ্বনি ভেসে আসতেই মাইকেল বুঝতে পারল তার চোখের আড়ালে ঘেরা-জায়গাটার ভিতর কি ঘটেছে– আমাসি ছুটে গিয়ে পড়েছে তিন নম্বর ড্রাগনের মুখে! তৃতীয় ড্রাগনটা গোপন স্থানে শুয়োরের ঠ্যাংটাকে আবিষ্কার করে মনের আনন্দে ভোজনপর্ব সমাধা করছিল, অজ্ঞাতসারে তার কবলেই গিয়ে পড়েছে বেচারা আমাসি।

ভয়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে কর্তব্য স্থির করে ফেলল মাইকেল। পৃথিবী যেন তার চোখের সামনে পিছিয়ে গেল কয়েক লক্ষ বৎসর, সেই আদিম পৃথিবীর প্রস্তরযুগে এক আদিম মানবযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে এক দানব-সরীসৃপের বিরুদ্ধে হাতে তার রাইফেলের পরিবর্তে রয়েছে মুগুর! আদিম মানুষের মতোই হাতের রাইফেলকে মুগুরের মতন বাগিয়ে ধরে পাথরের সারির উপর লাফিয়ে উঠল মাইকেল এবং দেখতে পেল ড্রাগনের গ্রাসে ছটফট করছে আমাসি!

এক লাফে ঘেরা জায়গাটার ভিতর নেমে এসে সমস্ত শক্তি দিয়ে রাইফেলের বাঁট ঘুরিয়ে ড্রাগনের মাথায় সজোরে আঘাত হানল মাইকেল। তৎক্ষণাৎ ভয়ংকর চোয়াল দুটি ফাঁক হয়ে ঝকঝক করে উঠল ধারাল দাঁতের সারি এবং সামনের একটা নখরযুক্ত থাবা বিদ্যুৎবেগে ছোবল মারল– রক্তাক্ত হয়ে গেল মাইকেলের বাঁ দিকের কাঁধ। সেই আঘাত সামলে ওঠার আগেই আবার আক্রমণ করল ড্রাগন, তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল মাইকেলের দেহে, সঙ্গে সঙ্গে মাইকেল হল ধরাপৃষ্ঠে লম্বমান। মুহূর্তের মধ্যেই ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল মাইকেল; শূন্যগর্ভ রাইফেল ফেলে দিয়ে কটিবন্ধ থেকে আমাসির ছোরাটাকে টেনে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ড্রাগনের পরবর্তী আক্রমণে জন্য।

ড্রাগন তখনই আক্রমণ করল না, তার ভাবভঙ্গি দেখে মাইকেল বুঝল রাইফেলের বাঁট সাময়িকভাবে জন্তুটাকে বিহ্বল করে দিয়েছে। ছোরা বাগিয়ে ধরে প্রস্তুত হল মাইকেল, ড্রাগন আক্রমণ করলেই সে ছোরা চালাবে মনে মনে সে প্রার্থনা করতে লাগল হতচ্ছাড়া জন্তুটা যেন পালিয়ে যায়।

কিন্তু পরক্ষণেই যা ঘটল, তার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না মাইকেল। আমাসি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হাতের বর্শাটাকে সজোরে ঢুকিয়ে দিল ড্রাগনের পাঁজরে! জন্তুটা লাফিয়ে উঠল, তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ল আমাসির দেহে ছিটকে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল আমাসি।

ছোরা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাইকেল, অন্ধের মতো আঘাত করতে লাগল ড্রাগনের ঘাড়ে, পাঁজরে এবং একসময়ে দু-হাতে ছোরাটাকে ধরে সজোরে বসিয়ে দিল দানবের মাথার খুলিতে– পরমুহূর্তেই মাইকেলের শরীরটা একটা ক্ষুদ্র পাথরের টুকরোর মতো ঠিকরে উঠে গেল শুন্যে, তারপর সশব্দে শয্যাগ্রহণ করল ধরাপৃষ্ঠে!

নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মাইকেল, আমাসির একটা পা ধরে তাকে তাড়াতাড়ি টেনে নিয়ে এল নিরাপদ দূরত্বে মরণাহত সরীসৃপ তখন ছটফট করছে মৃত্যুযাতনায়।

কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে পেল আমাসি। দুজনে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত শরীরে টলতে টলতে ফিরে চলল নৌকোর দিকে…

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাসির খোঁজ নিয়েছিল মাইকেল, কিন্তু তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ভন ইভেনের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া গিয়েছিল। বাজোড়া হয়ত আজও বেঁচে আছে, তবে কোথায় আছে কে জানে!….

অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে ড্রাগনের স্মৃতি দুঃস্বপ্নের মধ্যে হানা দেয় ঘুম ভেঙে উঠে বসে টেরি মাইকেল, দারুণ আতঙ্কে ঘর্মাক্ত হয়ে যায় সর্বাঙ্গ।

বিভীষিকার দ্বীপ

ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূল থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত একটি ছোটো নাম-না-জানা দ্বীপের কাছেই সমুদ্রের উপর দেখা দিল একটি মাছ-ধরা জাহাজ। দ্বীপের মধ্যে একটা বড়ো পাথরের উপর হঠাৎ লাফিয়ে উঠল একটি মানুষ, হাতে তার রাইফেল। শূন্যে গুলি ছুঁড়ে লোকটি জাহাজের আরোহীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। মনে হল জাহাজের গতি একটু মন্থর হয়েছে। উৎসাহিত হয়ে লোকটি এইবার হাত তুলে চিৎকার করতে লাগল। হঠাৎ লোকটি শুনতে পেল তার পিছনে একটা অস্পষ্ট গর্জনধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে শক্ত পাথুরে মাটির উপর জেগে উঠেছে ধাবমান খুরের খট খট শব্দ!

পিছন ফিরে তাকানোর আগেই লোকটি অনুভব করল তার বাঁ হাতের উপর এসে পড়েছে এক দারুণ যাতনাদায়ক আঘাত। পরক্ষণেই প্রচণ্ড ধাক্কায় তার দেহটা পাথরের উপর থেকে নীচের জমিতে ছিটকে পড়ল!

আহত মানুষটি এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণের ফলে হতভম্ব হয়ে পড়েনি, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো মাটি থেকে লাফিয়ে উঠে সে ভূমিপৃষ্ঠে লম্বমান রাইফেলটার দিকে যেভাবে হাত বাড়িয়ে দিল তাতে বোঝা গেল তার পিছনে দৃষ্টির অগোচরে যে ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে সে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। রাইফেল হাতে তুলে নিতে না নিতেই আবার জাগল খট খট খুরধ্বনি, পরক্ষণেই পাথরটার যেদিক থেকে সে উল্টে পড়েছিল তার বিপরীত দিক থেকে সংহারমুর্তিতে আত্মপ্রকাশ করল এক ধাবমান বরাহ!

চকিতে পকেট থেকে টোটা নিয়ে লোকটি ক্ষিপ্রহস্তে রাইফেলে টোটা ভরে ফেলল। আক্রমণোদ্যত শূকর তখন খুব কাছে এসে পড়েছে, এক মুহূর্তের জন্য লোকটির চোখে পড়ল রক্তলাল মুখগহ্বরের ভিতর থেকে দুই চোয়ালের বহির্ভাগে উঁকি দিচ্ছে একজোড়া সুদীর্ঘ দন্ত।

পরক্ষণেই রাইফেল সশব্দে অগ্নি-উদগার করল। শূকর আহত হল, তার ডান দিকের কাধ ভেঙে গিয়ে ডান পা বেঁকে গেল কিন্তু তবু তার গতিরুদ্ধ হল না। একেবারে শত্রুর সামনে এসে বরাহ চরম আঘাত হানতে উদ্যত হল।

গুলি ছোঁড়ার সময় ছিল না। মানুষটি এইবার রাইফেলকে লাঠির মতো ব্যবহার করল; প্রচণ্ড সংঘাতে রাইফেলের বাঁট এবং শূকরের একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল সশব্দে।

শূকর ভূমিশয্যা গ্রহণ করল। কিন্তু মুহূর্ত পরেই সে আঘাত সামলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। হাতের ভাঙা রাইফেল ফেলে লোকটি দৌড়ে পালাতে গেল কিন্তু পাথরে হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ল ভূমিপৃষ্ঠে।

মাটির উপর শুয়ে শুয়েই লোকটি সভয়ে দেখল, শূকরটা টলতে টলতে তার দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে। শূকরের দক্ষিণ স্কন্ধের অস্থি প্রথমেই গুলির আঘাতে ভেঙে গিয়েছিল। লোকটি দেখল রাইফেলের বাঁটের আঘাতে তার বাঁ দিকের পা এবং চোয়ালের নীচের অংশও জখম হয়েছে। তবু প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে আহত বরাহ।

লোকটি তাড়াতাড়ি উঠে আবার পলায়নের চেষ্টা করল এবং সভয়ে আবিষ্কার করল তার তিন দিকে অবস্থান করছে বৃহৎ পাথরের প্রাচীর আর সামনের সংকীর্ণ পথের উপর দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে জান্তব হিংসার এক শরীরী প্রতিচ্ছবি।

নিরস্ত্র মানুষটি এক পা পিছিয়ে গেল, তার পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করল কঠিন পাথরের দেওয়াল…

আচ্ছা, এইবার আমরা জানতে চাইব এই জনমানবহীন দ্বীপের উপর মানুষটা এল কোথা থেকে এবং কেন এল? আর বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে অবস্থিত এই ছোটো ভূ-খণ্ডের উপর স্থলচর বরাহই বা আবির্ভূত হল কেমন করে? এ সব কথা জানতে হলে কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা দরকার।

স্পেনের মানুষ যখন প্রথম আমেরিকাতে উপনিবেশ স্থাপন করার চেষ্টা করে তখন তারা দেখতে পায় আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে র্যাটল স্নেক নামক অসংখ্য বিষধর সর্প। সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য স্প্যানিয়ার্ডরা তাদের মাতৃভূমি স্পেন থেকে একদল শূকর আমদানি করল। শুকরগুলি সর্পভুক। সাপের দাঁত এই পশুগুলোর কঠিন রোমশ চর্ম ভেদ করে বিষ ঢালতে পারে না। এইভাবে স্পেনের শূকর আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ল। কালক্রমে স্প্যানিয়ার্ডরা বিদায় নিয়েছে, আমেরিকার ইতিহাসেও বহু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু শুকরের বংশ আমেরিকার সমগ্র অঞ্চল থেকে লুপ্ত হয়ে যায়নি। প্রশান্ত মহাসাগরের কয়েকটি দ্বীপের উপর স্প্যানিয়ার্ডরা ওই জন্তুগুলিকে ছেড়ে দিয়েছিল কারণ ওইসব জায়গা ছিল র্যাটল-স্নেক নামক বিষাক্ত সাপের প্রিয় বাসভূমি।

ওই দ্বীপগুলি থেকে ক্রমশ মানুষের বাস উঠে গেছে; কিন্তু শূকরবংশ লোপ পায়নি। বন্য প্রকৃতির সংস্পর্শে তাদের আকৃতি ও প্রকৃতি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত ভয়াবহ, মাংসাশী শ্বাপদের মতোই তারা হয়ে পড়েছে হিংস্র ও রক্তলোলুপ জীব।

এই কাহিনিতে বর্ণিত দ্বীপেও ওইরকম এক দল শূকর অবস্থান করছিল। স্থানীয় মানুষ ছাড়া বাইরের লোক এই ভয়াবহ দ্বীপের বিষয় কিছুই জানত না। হঠাৎ একদিন ক্যালিফর্নিয়াতে উপস্থিত হল বিল ব্রায়ান্ট নামক একজন শিকারি এবং দুর্ভাগ্যক্রমে ওই দ্বীপের জনশ্রুতি তাকে আকৃষ্ট করল। বিল ভাবল একবার ওই দ্বীপে ঘুরে আসতে পারলে একটা অ্যাডভেঞ্চার করা যায়। মাংসাশী শূকরের ভয়াবহ কাহিনি তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।

একটা জাহাজের অধ্যক্ষের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে ওই দ্বীপের অভিমুখে যাত্রা করল বিল। দ্বীপ থেকে একটু দূরে জাহাজ থামিয়ে একটা ছোটো জাহাজি বোট বা নৌকো চালিয়ে বিল পূর্বোক্ত দ্বীপে পদার্পণ করল। জাহাজের অধ্যক্ষের সঙ্গে বিলের কথা ছিল দিন চারেক বাদে জাহাজ আবার এইখানে আসবে এবং বিলকে নিয়ে যাবে।

যে নৌকোটায় চেপে বিল দ্বীপে এসে উঠেছিল সেটাকে সে বেলাভূমির উপর রাখল। নৌকোর ভিতর ছিল বন্দুক ছুরি, খাদ্য, তাবু খাটানোর সরঞ্জাম প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের দরকারি জিনিস।

দ্বীপে এসে পৌঁছোনোর আগে পর্যন্ত বিল খুবই উৎসাহ বোধ করছিল কিন্তু জাহাজটা যখন তার দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল তখন সে হঠাৎ খুব নিঃসঙ্গ বোধ করল। মনের নিরুৎসাহ ভাব দমন করে দ্বীপটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার জন্য সে পা চালিয়ে দিল…

দ্বীপের সামনে বেলাভুমির কাছে হালকা ঘাসজমি ভিতর দিকে ক্রমশ নিবিড় অরণ্যে পরিণত হয়েছে এবং চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ছোটোবড়ো পাথর ও পাহাড়। এক জায়গায় নরম মাটির উপর শূকরের খুরের চিহ্ন বিলের দৃষ্টিগোচর হল। এই দ্বীপে যে শূকরের অস্তিত্ব আছে সে বিষয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ রইল না। একটা পাহাড়ের উপর উঠে বিল চারদিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্জন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে সব কিছুই ভুলিয়ে দিল।

বেলাভূমির উপর আছড়ে পড়ছিল সাগরের ঢেউ আর মুক্তপ্রকৃতির বুকে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে সেই অপুর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করছিল বিল- হঠাৎ একটা পাখির দিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল।

পাখিটা হচ্ছে সী-গল নামক এক ধরনের সামুদ্রিক চিল। বালির উপর ধীরে ধীরে পা চালিয়ে ঘুরছিল পাখিটা, তার একটু দূরেই পড়েছিল কয়েকটা বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড। পাখিটা নীচু হয়ে মাটি থেকে কিছু একটা ঠোঁট দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করল আর ঠিক সেই মুহূর্তে পাথরের নীচে ছায়ায়-আচ্ছন্ন অন্ধকার যেন অকস্মাৎ জীবন্ত হয়ে ছুটে এল!

বিল সচমকে দেখল একটা ধূসর বাদামি চতুম্পদ দেহ পাথরগুলোর তলা থেকে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাখিটার উপর। একটা আর্ত চিৎকার করেই পাখিটা স্তব্ধ হয়ে গেল, এক জোড়া নিষ্ঠুর চোয়াল তাকে সজোরে চেপে ধরেছে।

বিল প্রথমে ভেবেছিল ওটা একটা নেকড়ে কিন্তু একটু পরেই তার ভুল ভেঙে গেল। নেকড়ের মতোই হালকা ছিপছিপে পেশীবহুল দেহ এবং নেকড়ের মতোই বাদামি-ধূসর দেহবর্ণের অধিকারী হলেও জন্তুটা নেকড়ে নয়- শূকর।

শূকরের এমন হিংস্র ভয়ংকর চেহারা বিল কখনো কল্পনা করতে পারেনি। দারুণ বিস্ময়ে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল জনশ্রুতি তা হলে মিথ্যা নয়।

আচম্বিতে বিলের পিছন থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত শব্দের তরঙ্গ! খট-খট-খট-খট শব্দে পাথুরে মাটিতে খুর বাজাতে বাজাতে যেন ছুটে আসছে কয়েকটা ঘোড়া তারই দিকে!

বিল পিছন ফিরে চাইল না- শব্দের উৎপত্তির কারণ যে ধাবমান অশ্বখুর নয় এটুকু বুঝতে তার একটুও দেরি হয় নি সামনে যে গাছটা ছিল চটপট হাত-পা চালিয়ে বিল সেটাতেই উঠে পড়ল।

ভালোই করেছিল, কারণ বিল গাছে উঠতে না উঠতেই সেখানে এসে উপস্থিত হল ছয়-ছয়টা শূকর!

একটা গাছের ডালে বসে পা দুটোকে বিল ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কয়েকটা মাংস-লোলুপ বরাহ সেই দোদুল্যমান পা দুটিকে লক্ষ্য করে লাফ দিল। তাদের চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হল, কারণ গাছটা খুব বড়ো না হলেও বিল শুকর বাহিনীর নাগালের বাইরে অবস্থান করছিল। কয়েকটা জন্তু ব্যর্থ আক্রোশে গাছটাকে আক্রমণ করল, দীর্ঘ দন্তের আঘাতে কয়েক জায়গায় গাছের ছাল উঠে গেল।

দারুণ আতঙ্কে বিলের বুকের ভিতর দপ দপ করছিল, নিজেকে সামলে নিয়ে সে রাইফেল বাগিয়ে ধরল।

গর্জে উঠল রাইফেল, আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল দুটি শূকর। অন্যান্য শুকরগুলি তৎক্ষণাৎ আহত সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, ধারালো দাঁতের আঘাতে আহত জন্তু দুটিকে টুকরো টুকরো করে শূকরগুলি স্বজাতির মাংসে বীভৎস ভোজসভা বসিয়ে দেওয়ার আয়োজন করল।

কিন্তু জন্তুগুলি তাদের ভয়াবহ ক্ষুধা পরিতৃপ্ত করার সুযোগ পেল না, ঘন ঘন গর্জনে বারংবার অগ্নিবৃষ্টি করল শিকারির রাইফেল, একে একে সব কয়টি শুকরই গুলি বিদ্ধ হয়ে প্রাণবিসর্জন দিল।

বিল এইবার গাছের আশ্রয় ছেড়ে মাটিতে অবতীর্ণ হল। তার অ্যাডভেঞ্চার করার শখ মিটে গিয়েছিল, অত্যন্ত সাবধানে ভয়ে ভয়ে সে নৌকোটার দিকে এগিয়ে চলল। ঘন ঘাসঝোঁপ ও জঙ্গলের রাস্তায় সে পা দিল না, যত দূর সম্ভব ফাঁকা জায়গার উপর দিয়েই সে পদচালনা করছিল।

নৌকোটা তার দৃষ্টিপথে আসতেই বিল চমকে উঠল। সাত-সাতটা শূকর হানা দিয়েছে তার নৌকোটার উপর! জন্তুগুলো চিৎকার করছে, গর্জন করছে এবং ধারালো ছোরার মতো দাঁত দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে নৌকোর উপর অবস্থিত যাবতীয় সামগ্রী!

দারুণ ক্রোধে বিল হাতের রাইফেল তুলে ধরল। কিন্তু ক্রোধ তার চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে দিতে পারে নি, ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্যস্থির করে সে গুলি চালাতে লাগল শূকরগুলির উপর।

এক-একটা শূকর গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য জন্তুগুলি আহত সঙ্গীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ছিন্ন ভিন্ন করতে থাকে।

আবার গর্জে ওঠে রাইফেল, আর একটি শূকরও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে সঙ্গীদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং গর্জিত রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টির কল্যাণে একই ঘটনার হয় পুনরাবৃত্তি।

এই ভাবে একে একে সাতটি জানোয়ারই গুলি খেয়ে মারা পড়ল। বিল তখন ছুটে এল নৌকোটার দিকে। নৌকোর দশা দেখে বিলের কান্না পেল। খাবার-দাবার, জিনিসপত্র সব কিছুই হয়ে গেছে ছিন্নভিন্ন, নৌকোটাও অব্যাহতি পায়নি– ধারালো দাঁতের আঘাতে আঘাতে নৌকোটা টুকরো টুকরো কাঠের স্তূপে পরিণত হয়েছে, সেটাকে আর নৌকো বলে চেনা যায় না!

বিল ব্রায়ানট বুঝল, সে ফাঁদে পড়ে গেছে, নৌকো ছাড়া সমুদ্রের বুকে পাড়ি দেওয়ার উপায় নেই। দ্বীপের ভিতর রয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যর মতো শুকরের দল এবং তার কাছে রাইফেলের টোটা আছে মাত্র চারটি। একটি টোটা রাইফেলে ভরা ছিল, বাকি তিনটি অবস্থান করছিল তার পকেটের মধ্যে। বিল দাঁড়িয়ে ভাবছে, হঠাৎ তার কানে এল একটা যান্ত্রিক শব্দ মোটর!

শব্দটা বিলের খুবই পরিচিত, নিকটবর্তী সমুদ্রের বুকে ধাবমান মোটর-চালিত ক্রুজারের ইঞ্জিন থেকেই যে ওই শব্দটা ভেসে আসছে এ বিষয়ে বিলের কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সে তাড়াতাড়ি ছুটে একটা বড় পাথরের উপর উঠে দাঁড়াল, তারপর রাইফেলের গুলি ছুঁড়ে আর চিৎকার করে ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে লাগল।

এই সময় হঠাৎ পিছন থেকে অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে বিল যে পাথরের উপর থেকে নীচের জমিতে পড়ে যায় সে কথা বর্তমান কাহিনির গোড়ার দিকেই বলা হয়েছে। পরবর্তী অবস্থায় আক্রমণকারী বরাহ বিলের রাইফেলের গুলিতে আহত হয়েও যখন তার দিকে তেড়ে আসে, তখন দ্বিতীয়বার গুলি চালানোর সুযোগ না পেয়ে বিল যে রাইফেলটাকে লাঠির মতো ব্যবহার করেছিল এবং অস্ত্রটার যে বাঁট ভেঙে গিয়েছিল একথাও কাহিনির প্রথম দিকেই বলা হয়েছে।

এইবার দেখা যাক নিরস্ত্র শিকারি ও আহত বরাহের দ্বযুদ্ধের পরিণাম কি হয়।

শূকরটা এগিয়ে আসার চেষ্টা করল, কিন্তু সামনের দুটি পা জখম হওয়ায় ভারসাম্য রাখতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। অবশ্য তৎক্ষণাৎ সে আবার উঠে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে বিলের মনে পড়ে গেছে কোমরের খাপে আটকানো ছোরার কথা, চট করে খাপ থেকে হান্টিং নাইফ খুলে সে প্রস্তুত হল।

শুকর আবার আক্রমণ করল। তার প্রকাণ্ড মুখটা সবেগে এগিয়ে এল শত্রুর দিকে কিন্তু ভয়ংকর চোয়াল দুটো নরদেহের পরিবর্তে শূন্যতাকেই আবিষ্কার করল।

বিল তখন বরাহের পিঠের উপর দিয়ে এক প্রকাণ্ড লাফ দিয়েছে এবং শূন্যের উপরেই শরীরটা ঘুরিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে শুকরের পৃষ্ঠদেশে!

বিল যেন হঠাৎ পাগল হয়ে গেল। এক হাতে জন্তুটাকে আঁকড়ে ধরে অন্যহাতে সে উন্মাদের মতো ছুরি চালাতে লাগল শূকরের গলায়, পাঁজরে, বুকে…

প্রাণহীন রক্তাক্ত মৃতদেহটা ফেলে দিয়ে বিল উধশ্বাসে ছুটল সমুদ্রের দিকে। দারুণ উত্তেজনায় তার সমগ্র চৈতন্য তখন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, প্রায় কোমর-জল পর্যন্ত পৌঁছে সে অনুভব করল, এক জোড়া বলিষ্ঠ বাহু তাকে জড়িয়ে ধরেছে।

ক্রুজারের আরোহীরা বিলের রাইফেলের শব্দ শুনতে পেয়েছিল এবং তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজ থামিয়ে একটা ডিঙি ভাসিয়ে আসছিল দ্বীপের দিকে। ওইডিঙি থেকে নেমে এক জন ধীবর প্রায়-অচেতন বিল ব্রায়ান্টকে জড়িয়ে ধরেছিল। পূর্বোক্ত ক্রুজার মাছ ধরার কার্যে নিযুক্ত ছিল, বিলকে তুলে নিয়ে মাছধরা ক্রুজারটি আবার তার নির্দিষ্ট পথে যাত্রা করল।

ভাসমান চিড়িয়াখানা

১৯২৮ সাল।

এস এস ফোর্সডেল নামক জাহাজটি ছুটে চলেছে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার দিকে।

জাহাজের খোলা ডেকের উপর প্রকাশ্য স্থানে কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই, কিন্তু একটু নজর করলেই দেখা যায় বিভিন্ন গোপনীয় স্থানে গা-ঢাকা দিয়ে নাবিকরা চারদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে আতঙ্কের আভাস।

আতঙ্কের কারণ খুব স্পষ্ট। জাহাজের সর্বত্র পদচালনা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক ভাল্লুক-দম্পতি এবং একজোড়া ভীষণ-দর্শনবাঘ! শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখেও নাবিকরা আশ্বস্ত হতে পারছে না, তারা দূর থেকেই উঁকিঝুঁকি মারছে কাছে এসে শ্বাপদের অহিংসায় বিশ্বাস স্থাপন করতে তারা রাজি নয়!

বাঘ-ভালুক ছাড়া আরও যে-সব জন্তু জাহাজের উপর এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একদল বাঁদর, কয়েকটি ব্যাজার নামক ভোঁদড় জাতীয় প্রাণী এবং একটি তুষার-চিতা।

সমুদ্রের উপর ভাসমান জাহাজের উপর হঠাৎ এতগুলো বন্যপশুর আবির্ভাবের কারণ জানতে হলে আমাদের পাঠ করতে হবে জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতার কাহিনি…

উক্ত প্রত্যক্ষদর্শীর লিখিত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, এস এস ফোর্সডেল নামক জাহাজটি লন্ডনের চিড়িয়াখানা থেকে অনেকগুলো বন্য পশু নিয়ে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাত্রা করে। বন্দি পশুদের মধ্যে ছিল একজোড়া বিশাল ভালুক, একটি অজগর সাপ, একটি প্যান্থার, তুষার-চিতা, কয়েকটি ব্যাজার, একদল বাঁদর, বিভিন্ন ধরনের পাখি এবং এক জোড়া ভীষণ দর্শন বাঘ।

পিঞ্জর-আবদ্ধ পশুদের পর্যবেক্ষণ করে জাহাজের ক্যাপ্টেনের ধারণা হল জন্তুগুলোকে ধরে রাখার পক্ষে খাঁচাগুলো যথেষ্ট মজবুত নয়। ক্যাপ্টেনের প্রধান সহকারীও তাঁর সঙ্গে একমত হল কিন্তু অভিজ্ঞ নাবিকরা ক্যাপ্টেনের সন্দেহ অমূলক বলে তাকে আশ্বস্ত করল। নাবিকরা ক্যাপ্টেনকে জানাল যে এই ধরনের খাঁচায় বড়ো বড়ো জানোয়ার তারা ইতিপূর্বে বহু বার চালান দিয়েছে, খাঁচা ভেঙে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে তারা কখনো দেখেনি, অতএব ক্যাপ্টেন সাহেবের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

পরবর্তীকালে অবশ্য প্রমাণ হয়েছিল যে ক্যাপ্টেনের সন্দেহ নিতান্ত অমূলক ছিল না।

গোলমাল শুরু হল প্রথমে ব্যাজারদের নিয়ে। ভোঁদড়ের মতো আকৃতিবিশিষ্ট এই ক্ষুদ্রাকায় মাংসাশী প্রাণীগুলো এক রাতে হঠাৎ খাঁচার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল এবং কোয়েল পাখির খাঁচার উপর আক্রমণ চালিয়ে খাঁচা ভেঙে অসহায় পাখিগুলোকে উদরস্থ করে ফেলল।

ব্যাজারগুলো পাখির খাঁচা ভেঙেছিল বটে, কিন্তু নিজেদের খাঁচা তারা ভাঙতে পারে নি। লোহার গরাদের ভিতর দিয়ে শরীর গলিয়ে তারা মুক্তিলাভ করেছিল। এই ঘটনা থেকেই বোঝ যায় যারা খাঁচাগুলি তৈরি করিয়েছিল, তারা সমস্ত ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করেনি।

সকাল বেলা নাবিকরা যখন দেখল ব্যাজারের শূন্য পিঞ্জর অটুট অবস্থায় বিরাজ করছে এবং কোয়েল পাখির ভাঙা খাঁচার ভিতর রাশি রাশি পালক ছাড়া একটি পাখিরও অস্তিত্ব নেই, তখনই তারা সমস্ত ব্যাপারটা অনুমান করে নিল খুব সহজেই।

হত্যাকারীদের খোঁজ পড়ল তৎক্ষণাৎ কিন্তু ব্যাপারটা যত সহজ বলে প্রথমে মনে হয়েছিল, পরে দেখা গেল সেটা তত সহজ নয়। ব্যাজার নামক জটিকে অত্যন্ত হিংস্র না বলতে পারলেও তাকে নিতান্ত নিরীহ বলা চলে না। এই ছোটোখাটো মাংসাশী জানোয়ারটিকে শ্বপদ-গোষ্ঠীর মধ্যে গণ্য করলে খুব ভুল হয় না এবং নখদন্তে সজ্জিত এই জীবটি তার অস্ত্র সম্বন্ধে অতিশয় সচেতন। অতএব ব্যাজার খুঁজতে গিয়ে নাবিকরা যে খুব অস্বস্তি বোধ করছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এরইমধ্যে জনৈক নাবিক একটা ব্যাজারকে কোণঠাসা করে ফেলল কিন্তু শয়তান জানোয়ারটা নাবিকটির মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফাঁসকরে উঠতেই লোকটি চমকে উঠে পথ ছেড়ে দিল এবং পরক্ষণেই তিরবেগে ব্যাজারটা স্থানত্যাগ করে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।

নাবিকটি আর ব্যাজারের পিছনে ছুটতে রাজি হল না, সে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিল যে ব্যাজার-শিকার নাবিকের কর্তব্য নয়।

যখন এই ঘটনা ঘটে জাহাজ তখন ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে। পরবর্তী ঘটনার সূত্রপাত হল ভারত মহাসাগরের বুকে।

ফোর্সডেল জাহাজ যখন ভারত সাগরের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে, তখন দেখা গেল ভালুক দুটি হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

ভারত সাগরের উষ্ণ আবহাওয়া জানোয়ার দুটি পছন্দ করল না, খেপে গিয়ে তার বারবার আঘাত হানতে লাগল খাঁচার উপর। জাহাজের অফিসাররা জাহাজ পরিচালনার কার্যে খুবই নিপুণ ছিলেন, কিন্তু ভাল্লুকের শক্তি ও খাঁচার দৃঢ়তা সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান ছিল নিতান্তই সীমাবদ্ধ। অতএব বারংবার আঘাতের ফলে দুর্বল খাঁচাটা যে আরও-দুর্বল হয়ে এক সময়ে ভেঙে যেতে পারে এমন ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা তাদের মনেই হয় নি…

অবশেষে এক রাত্রে ভালুকদের মিলিত আক্রমণের মুখে খাঁচা গেল ভেঙে এবং বন্দিরা মুক্তিলাভ করে পরম-আনন্দে জাহাজের বিভিন্ন স্থানে টহল দিতে শুরু করল।

জনৈক নাবিক ওই সময়ে ডেকের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, আচম্বিতে তার সম্মুখে আবির্ভূত হল দুটি চলমান ছায়া!

রাত্রির অন্ধকার যাদের ছায়ার রূপ দিয়েছে তাদের দেখে নাবিকটি ভুল করল না– ওই ছায়ার সঙ্গে দু-দুটি ভাল্লুককে অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অত্যন্ত নিরেট দুটি কায়ার অস্তিত্ব অনুমান করে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে।

ক্যাপ্টেনের এক সহকারী উপরের ডেকে বসে কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছিলেন, হঠাৎ নীচের ডেক থেকে ঝড়ের বেগে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এসে হাজির হল পূর্বোক্ত নাবিক। সহকারীটি নাবিকের মুখে ভাল্লুক-ঘটিত সমাচার শ্রবণ করলেন; তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়ল জাহাজের দিক-নির্ণয় যন্ত্র বা কম্পাসটা এই মুহূর্তে পরিদর্শন না করলে কর্তব্যের হানি হবে এবং ভালুকদের খবরে কিছুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ না করে যথাসম্ভব দ্রুতবেগে তিনি কম্পাসের প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করতে বলে গেলেন।

ইতিমধ্যে নাবিকটিকে অনুসরণ করে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে একটি ভালুক। খুব সম্ভব লোকটির সঙ্গে সে আলাপ করতেই চেয়েছিল, কারণ ভালুকের আচরণে নির্দোষ কৌতূহল ছাড়া কোনো বিরূপ-ভাব প্রকাশ পায় নি। নাবিকটি কিন্তু চতুস্পদ সহযাত্রীর সদিচ্ছায় বিশ্বাস করতে পারল না, তার চোখে-মুখে ফুটল দারুণ আতঙ্কের আভাস।

ভালুকটা বোধহয় নাবিকের ভাবভঙ্গিতে তার মনোভাব অনুমান করতে পেরেছিল; সে বুঝে নিল এই ভীরু অসামাজিক মানুষটা তার বন্ধুত্বের যোগ্য নয়। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নাবিকের সান্নিধ্য ত্যাগ করে ভাল্লুক সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল সঙ্গীর কাছে।

ইতিমধ্যে বেজে উঠেছে জাহাজের বিপদ-জ্ঞাপক ঘণ্টা এবং নাবিকরা সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছে অকুস্থলে। ভালুক দুটিকে দেখে নাবিকরা বিশেষ ভয় পায়নি, বরং তাদের মধ্যে একটা মজা দেখার মনোভাবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই এমন গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হল যে আনন্দের পরিবর্তে নাবিকদের মধ্যে সঞ্চারিত হল অস্বস্তি ও আতঙ্ক।

একটি ভালুক হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বাঘের খাঁচার উপর আক্রমণ চালাল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই খাঁচা ভেঙে গেল এবং ডোরাকাটা জানোয়ার দুটি জাহাজের সর্বত্র পায়চারি করতে লাগল। মনে হল সমুদ্রের মুক্ত বায়ু তারা দস্তুর মতো উপভোগ করছে। কিন্তু এক জোড়া ভালুক এবং দু-দুটি বাঘের সাহচর্য নাবিকদের কাছে মোটেই উপভোগ্য হয় নি শাপদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের নীতিতে তারা আদৌ বিশ্বাসী নয়।

ক্যাপ্টেনের আদেশে অফিসাররা বন্দুক-রিভলভার নিয়ে নাবিকদের নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেন।

বাঘদের মুক্তি দিয়ে ভালুকরা ক্ষান্ত হল না, চটপট আরও কয়েকটা খাঁচার উপর আক্রমণ চালিয়ে তারা অনেকগুলো জানোয়ারকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়ে জাহাজটাকে করে তুলল বন্য পশুদের বিচরণ ভূমি!…

একটা বাঘ হঠাৎ তার আশে-পাশে অবস্থিত দ্বিপদ জীবদের বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠল। ডেকের উপর দণ্ডায়মান এক অফিসার সচমকে দেখলেন তার দিকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে এক বিপুলবপু ব্যাঘ্র!

জাহাজের অফিসার বাঘের সান্নিধ্য পছন্দ করলেন না, চটপট খাপ থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে গুলি চালিয়ে দিলেন।

গুলি বাঘের দেহ স্পর্শ করল না বটে কিন্তু ভদ্রলোকের নিশানা একেবারে ব্যর্থ হয়েছে এ কথা বলা যায় না, কারণ ডেকের অপর প্রান্তে অবস্থিত বিড়ালটা গুলি খেয়ে মারা পড়ল তৎক্ষণাৎ!

রিভলভারের গর্জন এবং চকিত অগ্নিশিখার অভ্যর্থনা বাঘের ভালো লাগল না, গম্ভীর ভাবে স্থান ত্যাগ করে সে অন্যদিকে চলে গেল, ভদ্রলোকও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন।

ক্যাপ্টেন এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা এইবার জন্তুগুলোকে বন্দি করার উদযোগ করলেন। মি. দেওয়ার নামক জনৈক ইঞ্জিনিয়ার বাঘ-ভালুকদের দড়ির ফাস বা ল্যাসো দিয়ে ধরতে চাইলেন। কিন্তু জাহজের সারেং বাঘ দুটিকে ধরার জন্য যে উপায় অবলম্বন করল সেটা হচ্ছে আরও নিরাপদ আরও সুন্দর। তার পরামর্শ অনুযায়ী জাহাজের ছুতোরকে দিয়ে একটা মজবুত খাঁচা তৈরি করানো হল, তারপর খাঁচার ভিতর রেখে দেওয়া হল ভেড়ার মাংস। কিছুক্ষণের মধ্যে মাংসের লোভে দুটি বাঘই খাঁচার ভিতর প্রবেশ করল এবং নাবিকরা যে সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল সেটা অবশ্য বলাই বাহুল্য।

বাঘ দুটিকে যখন বন্দি করা হচ্ছিল তখন দুটি ভালুকই আগ্রহের সঙ্গে নাবিকদের কার্যকলাপ লক্ষ করছিল। জাহাজের ছুতোর এইবার খুব পুরু কাঠের সাহায্যে একটা উঁচু ও মজবুত পাঁচিল তৈরি করে ফেলল এবং সেই কাষ্ঠ প্রাচীরের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে নাবিকরা সবাই মিলে প্রাচীরটাকে ঠেলতে ঠেলতে অধিকাংশ জন্তুকেই কোণঠাসা করে ফেলল। সেখান থেকে জানোয়ারগুলিকে তাড়িয়ে খাঁচায় বন্ধ করতে বিশেষ অসুবিধা হয় নি। কিন্তু একটা ভালুক কাষ্ঠ প্রকারের উপর দিয়ে প্রকাণ্ড লাফ মেরে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালিয়ে গেল।

পলাতক ভালুকটাকে বন্দি করার জন্য দড়ির ফাস হাতে এগিয়ে এলেন মি. দেওয়ার। কিন্তু গলায় ফাস পড়তেই ভালুকটা ছুটতে শুরু করল এবং দড়ি হাতে মি. দেওয়ার হলেন ডেকের উপর লম্বমান!

ভালুকের প্রবল আকর্ষণে ডেকের উপর শায়িত অবস্থায় গড়াতে লাগলেন মি. দেওয়ার। ডেকের উপর গড়াগড়ি দিতে মি. দেওয়ারের ভালো লাগেনি বলাই বাহুল্য, এমন অবস্থায় পড়লে যে কোনো ভদ্রলোক যা করে তিনিও তাই করলেন অর্থাৎ দড়িটা হাত থেকে ছেড়ে দিলেন। বন্ধনমুক্ত হয়েই ভাল্লুক চতুর্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল এবং একটু দূরেই জাহাজের রাঁধুনিকে দেখে তার দিকেই তেড়ে গেল। রাঁধুনি-বেচারা মজা দেখতে এসেছিল, ভালুকটা যে মি. দেওয়ারের দড়ির ফাঁস থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে একথা তার মনেই হয়নি। রাঁধুনির হাতে ছিল এক হাঁড়ি তরল ও উত্তপ্ত সিদ্ধ চর্বি। ভালুককে তেড়ে আসতে দেখেই সে আর্তনাদ করে চর্বির হাঁড়ি ফেলে চম্পট দিল। ভালুক রাঁধুনিকে নিয়ে মাথা ঘামাল না, জাহাজের ডেকের উপর যেখানে হাঁড়ির থেকে গরম চর্বি গড়িয়ে পড়ছিল তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল সেই দিকে। জন্তুটার বোধ হয় খুব খিদে পেয়েছিল, সে এক হাঁড়ি চর্বি উদরস্থ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ইতিমধ্যে মি. দেওয়ার নিজেকে সামলে নিয়েছেন এবং দড়ির ফঁসটা নিয়ে আবার অগ্রসর হয়েছেন ভালুকের দিকে। এইবার তিনি যথেষ্ট সাবধান হয়েছিলেন, তাই ভাল্লুকটা প্রাণপণ চেষ্টা করেও নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। জন্তুটা অত্যন্ত ভীষণভাবে মি, দেওয়ারকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সমবেত নাবিকদের সাহায্যে মি. দেওয়ার তাকে খাঁচার ভিতর বন্দি করে ফেললেন।

বাঘ-ভালুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তুগুলো আবার বন্দি হল বটে কিন্তু বানরের দল তখনও ধরা পড়েনি। অনেক কষ্টে বাঁদরগুলিকেও নাবিকরা বন্দি করল বটে কিন্তু একটা হতচ্ছাড়া বাঁদর সবাইকে ফাঁকি দিয়ে জাহাজের উপর মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। কোনো রকমেই তাকে ধরতে না পেরে ক্যাপ্টেন সাহেব ঘোষণা করলেন অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে পৌঁছোনোর আগেই বাঁদরটাকে জীবিত অথবা মৃত যে কোনো অবস্থাতেই তোক ধরতে হবে। আদেশটা খুব নিষ্ঠুর মনে হলেও ক্যাপ্টেনকে দোষ দেওয়া যায় না, কারণ কোনো বন্য প্রাণীকে মুক্ত অবস্থায় জাহাজের উপর বিচরণ করতে দেখলে অস্ট্রেলিয়ার আইন জাহাজের কর্তৃপক্ষকে ক্ষমা করবে না এবং সে রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সবচেয়ে বেশি দায়ী হবেন স্বয়ং ক্যাপ্টেন।

অতএব দেখা যাচ্ছে ক্যাপ্টেন বাঁদরটার সম্বন্ধে চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে জন্তুটা অবশ্য ধরা পড়েছিল, তাকে গুলি করে মারার দরকার হয়নি। বাঁদরটাকে ধরতে গিয়ে যে সব ঘটনার সৃষ্টি হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ একটি ঘটনার বিবরণী দিয়ে এই কাহিনিটি আমি শেষ করব…

সবে ভোর হয়েছে। অন্ধকার তখনও পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় গ্রহণ করেনি, আকাশের পূর্ব প্রান্তে জেগে উঠেছে রক্তিম আলোকের আভাস…

সূর্য উঠতে তখনও বেশ দেরি আছে।

এমন সময়ে ডেকের উপর এসে দাঁড়ালেন মি. দেওয়ার এবং একজন অফিসার। তারা দুজনে নিজেদের মধ্যে নিম্নস্বরে কথাবার্তা বলছিলেন, অকস্মাৎ জাহাজের অপর প্রান্ত থেকে এল এক নিদারুণ আর্তনাদ!

কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে একটু এগিয়ে যেতেই তাদের চোখে পড়ল দ্রুতবেগে ধাবমান একটা সাদা টুপি এবং সাদা অ্যাপ্রন! প্রথমটা চমকে গেলেও খানিক পরেই তারা বুঝলেন একটি মানুষ তাদের দিকে ছুটে আসছে। লোকটির দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্ধকারের গর্ভে আদৃশ্য, দৃষ্টিগোচর হচ্ছে কেবল সাদা টুপি আর সাদা অ্যাপ্রন। ধাবমান মানুষটি নিকটবর্তী হতেই মি. দেওয়ার ও তার সঙ্গী তাকে চিনতে পারলেন।

জাহাজের বাবুর্চি!

সামনে মানুষ দেখে বাবুর্চি একটু আশ্বস্ত হল, মুখে কেবল তার একটি শব্দ ভূত! ভূত!

মি. দেওয়ার ও তার সঙ্গীটিকে বাবুর্চি যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে প্রতিদিনের মতো সেই দিনও সে প্রাতরাশ তৈরি করার জন্য রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল।

হঠাৎ অন্ধকারের ভিতর থেকে যে জীবটি আত্মপ্রকাশ করল সেটা যে একটা আস্ত ভূত সে বিষয়ে বাবুর্চির বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ভূতটা ঠিক ভূতের মতোই ব্যবহার করেছিল অর্থাৎ তেড়ে এসেছিল বাবুর্চির দিকে এবং বলাই বাহুল্য যে বাবুর্চিও তিরবেগে পা চালিয়ে দিতে একটুও দেরি করেনি। ভূত আর মানুষের দৌড় প্রতিযোগিতায় বাবুর্চিই জয়ী হয়েছে, তাই এ যাত্রা তার প্রাণটা বেঁচে গেছে কোনো রকমে।

মি. দেওয়ারের সঙ্গী অফিসার রাঁধুনির বিবরণী শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মি. দেওয়ারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভূতটাকে যে দিকে দেখা গেছে সেই দিকে পদচালনা করলেন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল পূর্বোক্ত রাঁধুনি।

একটু পরেই অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে তাদের দৃষ্টিগোচর হল একটা ছায়ামূর্তি এবং এক জোড়া জ্বলন্ত চক্ষু। ছায়ামুর্তিটা এক লাফ মেরে ডেকের উপর গিয়ে পড়ল, তারপর তরতর করে একটা মাস্তুল বেয়ে একেবারে ডগার উপর আশ্রয় গ্রহণ করল। মি. দেওয়ার বুঝলেন জীবটি মোটেই অশরীরী নয়, সে হচ্ছে অত্যন্ত নিরেট দেহের অধিকারী একটি বাঁদর! এই জন্তুটাই নাবিকদের ফাঁকি দিয়ে নিজের স্বাধীনতা এত দিন পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। মি. দেওয়ার এই পলাতক আসামীকে গ্রেপ্তার করার জন্য উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। ডেকের উপর ছড়ানো কয়েকটা কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে মি. দেওয়ার মাস্তুল বেয়ে খানিকটা উপরে উঠে গেলেন, তারপর সেই টুকরোগুলো ছুঁড়তে লাগলেন বাঁদরটার উদ্দেশ্যে। প্রথম টুকরোটা লাগল না, দ্বিতীয় বারের চেষ্টাও হল ব্যর্থ, কিন্তু তৃতীয় বারে নিক্ষিপ্ত কাষ্ঠখণ্ডটা অব্যর্থ লক্ষ্যে গিয়ে পড়ল বানরটার দেহের উপর! আঘাতটা বেশ জোরেই লেগেছিল, কারণ জন্তুটা মাস্তুলের উপর থেকে স্থানচ্যুত হয়ে পড়তে লাগল নীচের দিকে।

মি. দেওয়ার ভেবেছিলেন অত উঁচু থেকে পড়ে নিশ্চয়ই বাঁদরটার সর্বাঙ্গ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, কিন্তু জন্তুটা পড়তে পড়তে মাস্তুলের গায়ে জড়ানো একটা দড়ির সঙ্গে লেজটাকে জড়িয়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করল!

মি. দেওয়ার সবিস্ময়ে দেখলেন তিনি মাস্তুলের যে অংশে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তার একটু দুরেই ইংরেজি ক্রস চিহ্নের মতো মাস্তুলের অপর অংশে আশ্রয় নিয়েছে বাঁদরটা।

জন্তুটা এবার প্রতিআক্রমণ করল। বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এসে মাস্তুলের গায়ে আটকানো এক টুকরো কাঠ খুলে নিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করল মি. দেওয়ারের দিকে।

বাঁদুরে হাতের নিশানা ভুল হয় নি—

ঠাস করে মি. দেওয়ার সাহেবের মাথার উপর এসে পড়ল কাঠের টুকরোটা।

মি. দেওয়ার আঘাতটা সামলে নিয়ে কিছু করার আগেই বাঁদরটা সাঁৎ করে এগিয়ে এসে শত্রুর গণ্ডদেশে করল এক চপেটাঘাত।

দারুণ ক্রোধে মি. দেওয়ার সাহেবের চৈতন্য যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল, তিনি বানরটার গালের উপর বসিয়ে দিলেন প্রচণ্ড চড়!

তারপর কিছুক্ষণ ধরে চলল নর ও বানরের মধ্যে চপেটাঘাতের আদান-প্রদান।

নীচে ততক্ষণে নাবিকরা প্রায় সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু এই বিচিত্র দৃশ্যটি তারা বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারল না। মি. দেওয়ারের সঙ্গী অফিসারটি বানরের অগোচরে মাস্তুল বেয়ে উঠে তাকে চট করে জড়িয়ে ধরলেন তারপর দুজন মিলে জন্তুটাকে নামিয়ে আনলেন ডেকের উপর। তারপর আর কি? খুব সহজেই বানরটাকে একটা খাঁচার মধ্যে ভরে দেওয়া হল। জাহাজের নাবিকরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল..

কয়েক ঘণ্টা পরের কথা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ফ্রি-ম্যান্টল বন্দরে প্রবেশ করল ফোর্ডস ডেল নামক জাহাজটি।

আশা করি আপনাকে কোনো অস্বাভাবিক অবস্থায় পড়তে হয় নি?ক্যাপ্টেনকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলেন শুল্ক ভবনের জনৈক কর্মচারী।

নাঃ, তেমন আর কি! কয়েকটা জানোয়ার অবশ্য খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়েছিল, তবে সেগুলোকে আমরা আবার আটকে ফেলেছিলাম।

খুব শান্ত ও স্বাভাবিক স্বরেই উত্তর দিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন।

মরণ খেলার খেলোয়ার

সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে আজ নবজাগ্রত আফ্রিকা। যাঁরা রাজনীতির চর্চা করেন, তাদের কাছে আজ আফ্রিকা তীব্র কৌতূহল ও উদ্দীপনার বিষয়, কিন্তু শুধু আজ নয়

যুগ যুগ ধরে এই অরণ্যাবৃত মহাদেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে আর এক ধরনের মানুষ, যারা রাইফেল হাতে বারংবার হানা দিয়েছে আফ্রিকার বনভূমির বুকে–

আফ্রিকা!

বলতেই শিকারির মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে এক বিশাল অরণ্যভূমি যেখানে মদগর্বে সর্বত্র পদচারণা করে বেড়ায় বিপুলবপু হস্তিযূথ, গাছের ডালে ডালে এবং ঝোপঝাড়ে শিকারের অপেক্ষায় লুকিয়ে থাকে মহাকায় অজগর, তৃণ-আচ্ছাদিত প্রান্তরে ছুটোছুটি করে হরিণ-জাতীয় অ্যান্টিলোপ আর জেব্রার দল, লম্বা গলা তুলে গাছের মগডালের পাতা ছিঁড়ে খায় বেঢপ জিরাফ। সর্বাঙ্গ বর্মে ঢেকে নাকের ডগায় দু-দুটো খঙ্গ উঁচিয়ে হঠাৎ ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে প্রান্তরের মাঝখানে আত্মপ্রকাশ করে দ্বি-খড়গী গণ্ডার এবং মাথায় শিঙের সঙিন চড়িয়ে নির্ভয়ে বিচরণ করে যেসব ভয়ংকর কেপ বাফেলো শক্তির দম্ভে তারা দুনিয়ার কাউকে পরোয়া করে না।

গাছের ওপরে ও নীচে আহারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় হিংস্র কুকুরমুখো বেবুন-বাঁদরের দল, আর তাদের ওপর হানা দিতে সতর্ক পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে আসে আরও হিংস্র এক অতিকায় মার্জার গাছের ছায়ায় ছায়ায় অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে তার গায়ের গোল গোল দাগগুলো মিশে যায়, শুধু পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘাসের আড়ালে জ্বলতে থাকে একজোড়া ক্ষুধিত চক্ষু–

লেপার্ড!

অকস্মাৎ সমগ্র বনভূমির বুকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে জেগে ওঠে এক ভৈরব-কণ্ঠের হুংকার-সংগীত! পশুরাজ সিংহ তার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে সগর্বে!

হ্যাঁ, এই হল আফ্রিকা! শিকারির স্বর্গ!

এখানকার নদী আর জলাভূমিও অতিশয় বিপজ্জনক। জলের মধ্যে এবং জলের ধারে ঝোপের ভিতর স্থির হয়ে পড়ে থাকে যেসব কুমির, নরমাংসে তাদের মোটেই অরুচি নেই; এবং দৈত্যাকৃতি হিপোপটেমস বা জলহস্তীরা যদিও মাংসভোজী নয়, কিন্তু মেজাজ খারাপ হলে মানবদেহের ওপর দাঁতের ধার পরখ করতে তারা আপত্তি করে এমন কথা কেউ কখনো শোনেনি।

এমন চমৎকার জায়গায় যারা বাস করে তাদের আকৃতি ও প্রকৃতি যে আদর্শ ভদ্র সন্তানের উপযুক্ত হবে না এ-কথা অনুমান করতে খুব বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না; তবু ভীষণের মধ্যেও আরও-ভীষণ আছে–তাই আফ্রিকার যোদ্ধা অধিবাসীদের মধ্যেও মাসাই জাতির নাম সর্বাপেক্ষা খ্যাতিলাভ করেছে।

আজ এই মাসাইদের কথাই বলব।

পৃথিবীতে বহু ধরনের খেলা আছে, কিন্তু শিকারের মতো উত্তেজনা কোনো খেলাতেই নেই। আর সব শিকারের সেরা শিকার–সিংহ-শিকার!

এই সিংহের চামড়ার লোভে দেশ-বিদেশের শিকারিরা এসে ভিড় জমায় আফ্রিকার বনে-জঙ্গলে। ইউরোপ আর আমেরিকায় নিজের সুসজ্জিত বৈঠকখানায় লম্বমান সিংহ-চর্মের স্বপ্ন দেখেন না এমন শিকারি নেই বললেই চলে।

কিন্তু সিংহ-শিকার সহজ নয়, তাই এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করতে গিয়ে অনেক ভদ্রলোকই আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে প্রাণ হারিয়েছেন, অথবা বিকলাঙ্গ দেহ নিয়ে ফিরে গেছেন স্বদেশে, সর্বাঙ্গে বহন করেছেন শিকারি জীবনের তিক্তস্মৃতি–বীভৎস ক্ষতচিহ্ন!

গর্জনে আকাশ কাঁপিয়ে পশুরাজ সিংহ যখন শিকারির দিকে ছুটে আসে, তখন তার সমস্ত দেহ সংকুচিত হয়ে বৃত্তাকার ধারণ করে দূর থেকে মনে হয় এক দন্ত-ভয়াল ধূসর চর্মগোলক মাটির ওপর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে উড়ে আসছে শূন্যকে বিদীর্ণ করে! সেই ধাবমান বিভীষিকার দেহের ওপর লক্ষ স্থির করে গুলি চালানো অত্যন্ত কঠিন কাজ, আর একেবারে মর্মস্থানে আঘাত হানতে না-পারলে আহত সিংহ ধরাশায়ী হতে চায় না শত্রুর দেহের ওপর পড়ে তাকে দাঁতে-নখে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।

কিন্তু এই ভয়ংকর খেলাকে পেশা হিসাবে নিয়েছে এমন পেশাদার শিকারিও আছে। ওদেশে তাদের বলে হোয়াইট হান্টার বা শ্বেত শিকারি।

এই সাদা শিকারিদের সকলেই ক্ষিপ্রহস্তে গুলি চালিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারে, আক্রমণোদ্যত হিংস্র পশুর সামনে তারা কখনো আতঙ্কে আত্মহারা হয়ে পড়ে না, মাত্র সাত-আট গজ দূর থেকে নির্ভুল নিশানায় গুলি চালিয়ে মারমুখী ধাবমান সিংহকে এরা মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই।

এহেন সাদা শিকারিরাও মাসাই যোদ্ধাদের নামে মাথার টুপি খুলে শ্রদ্ধা জানাতে লজ্জা পায় না।

নিম্নলিখিত বিবরণী পড়লেই বোঝা যাবে তাদের শ্রদ্ধা নেহাত অপাত্রে ন্যস্ত হয়নি।

একজন বিখ্যাত শ্বেত শিকারির রোজনামচা থেকে এই কাহিনি তুলে দিচ্ছি–

ভোর হতেই আমরা সিংহের পায়ের চিহ্ন খুঁজে বার করলাম। আগের রাত্রে সিংহ যে ষাঁড়টা মেরেছে, তার মৃতদেহ পাওয়া গেল না। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ও রক্তমাখা পায়ের চিহ্ন ধরে দশজন বর্শাধারী মোরান এগিয়ে চলল (মাসাই যোদ্ধাদের মোরান নামে ডাকা হয়)।

আমি রাইফেল হাতে তাদের অনুসরণ করলাম। আজকের শিকারে আমি দর্শক মাত্র, মোরানরা জানিয়ে দিয়েছে আমার সাহায্য তাদের প্রয়োজন নেই।

কিছুক্ষণ পরে জানোয়ারটার সন্ধান পাওয়া গেল। ফাঁকা জায়গায় বসে সিংহ সারারাত ধরে আকণ্ঠ ভোজন করেছে, তারপর ষণ্ডমাংসে পরিপূর্ণ উদর নিয়ে ঢুকেছে একটা ঘাসঝোপের ভিতর বিশ্রামের উদ্দেশ্যে।

ঘন ঘাসঝোপের মধ্যে সিংহের সঙ্গে লড়াই চলে না। মাসাইরা ঝোপের বাইরে থেকে পাথর ছুঁড়তে লাগল। একটু দূরেই শোনা গেল ক্রুদ্ধ কণ্ঠে অস্ফুট গর্জন–পশুরাজ ক্রোধ প্রকাশ করছে! ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, মাসাই যোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহে পাথর ছুঁড়তে শুরু করল। সেই প্রচণ্ড পাথর বৃষ্টির মধ্যে স্থির হয়ে বসে থাকা সিংহের পক্ষেও অসম্ভব; ঝোপজঙ্গল কাঁপিয়ে আমাদের থেকে প্রায় এক-শো গজ দূরে পশুরাজ বেরিয়ে এল ফাঁকা জমির ওপর এবং পরক্ষণেই লাফের পর লাফ মেরে পালাতে শুরু করল।

তৎক্ষণাৎ ভীষণ চিৎকার করে মাসাইরা তার পিছু নিল। লম্বা লম্বা হলুদ রং ঘাসের ভিতর দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলল দশটি দীর্ঘাকার মনুষ্যমূর্তি–শিকার হাতছাড়া করতে তারা রাজি নয়।

ছুট, ছুট, ছুট।

সিংহের স্ফীত ও শিথিল উদর সবেগে দুলতে লাগল, একবার এদিক, একবার ওদিক।

কিন্তু ভরপেট খাওয়ার পর এত ছুটোছুটি তার বেশিক্ষণ ভালো লাগল না, হঠাৎ থেমে পশুরাজ রণং দেহি মূর্তিতে ঘুরে দাঁড়াল।

বর্শাধারী যোদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে তাকে গোল হয়ে ঘিরে ফেলল, আর বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গর্জাতে লাগল পশুরাজ সিংহ।

সেই সচল বৃত্ত ক্রমশ ছোটো হয়ে এল; সিংহের চেহারাও হয়ে উঠল ভয়ংকর। তার দুই চোখ জ্বলতে লাগল, উন্মুক্ত মুখবিবরের ফাঁকে ফাঁকে আত্মপ্রকাশ করল নিষ্ঠুর দাঁতের সারি, আর তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল দারুণ আক্রোশে মাটিতে আছড়ে পড়ল একবার, দু-বার, তিনবার।

পরমুহূর্তে সিংহ আক্রমণ করল।

সঙ্গেসঙ্গে শূন্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল উড়ে এল এক ঝাঁক বর্শা সিংহের দিকে।

একটা বর্শা তার স্কন্ধ ভেদ করে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে এল, কিন্তু সিংহের গতি রুদ্ধ হল না, সামনে যে লোকটিকে পেল তার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। আক্রান্ত মাসাই একটুও নড়ল না, ঢালের আড়াল থেকে বর্শা বাগিয়ে প্রস্তুত হল চরম মুহূর্তের জন্য।

থাবার এক আঘাতে সিংহ ঢালটাকে ফেলে দিল, তারপর পিছনের দু-পায়ে দাঁড়িয়ে সামনের থাবার সাহায্যে লোকটিকে টেনে আনতে চেষ্টা করল নিজের দিকে।

কিন্তু সেই শরীরী মৃত্যুর আলিঙ্গনে ধরা পড়ার আগেই মাসাই-যোদ্ধা ক্ষিপ্রহস্তে বর্শা চালিয়ে সিংহের বক্ষ ভেদ করে ফেলল, তবু শেষ রক্ষা করতে পারল না–পশুরাজের গুরুভার দেহের সংঘাতে ভূমিপৃষ্ঠে লম্ববান হয়ে পড়ে গেল। আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম ধারালো বর্শার ফলা বুকের পিচ্ছিল মাংসপেশি ভেদ করে অন্তত তিন ফুট ভিতরে ঢুকে গেছে এবং ক্ষতস্থান থেকে গল গল করে বেরিয়ে আসছে গরম রক্তের ফোয়ারা।

এমন দারুণ মার খেয়েও সিংহ পরাজয় স্বীকার করল না।

বজ্ৰদংশনে শত্রুর কাঁধ চেপে ধরে সিংহ পিছনের দুই থাবার সবগুলো নখ বিধিয়ে দিল শত্রুর পেটে পরক্ষণেই সনখ থাবার প্রচণ্ড আকর্ষণে বিদীর্ণ হয়ে গেল ভূপতিত যোদ্ধার উদর, রক্তাক্ত পাকস্থলীটা কাঁপতে কাঁপতে ছড়িয়ে পড়ল মাটির উপর।

বীভৎস দৃশ্য!

এবার আর বর্শা নয়–কোমরে ঝোলানো খাপ থেকে দ্বি-ধার ছুরিকা খুলে যোদ্ধারা ছুটে এল এবং বারংবার আঘাত করতে লাগল সিংহের মাথায় উন্মাদের মতো।

মাত্র কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে নাকের ডগা থেকে করোটি পর্যন্ত বিরাট কেশরযুক্ত মাথাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

মাসাইদের বিশ্বাস সিংহের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় যে-ব্যক্তি সিংহের লেজ ধরে টেনে রাখতে পারবে, সে-ই সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা। ব্যাপারটা বড়ো সহজ নয় অন্যান্য যোদ্ধারা যখন সিংহের দেহের ওপর বর্শা ও ছোরার সদ্ব্যবহার করবে, তখন একজন মাসাই সেই ক্রোধোন্মত্ত সিংহের লাঙ্গুল সজোরে টেনে রাখবে। যে-যোদ্ধা পর পর চারবার এইভাবে সিংহের লেজ ধরতে পারে, মাসাইরা তাকে মেমবুকি উপাধি দেয়। মেলমবুকি উপাধি মাসাইদের কাছে বিরাট সম্মানজনক ব্যাপার এবং এই সম্মানের লোভে বহু মোরান যুবক অকালে প্রাণ হারায়।

আমার জীবনে এমন ভয়ংকর নাটকের দর্শক হওয়ার সৌভাগ্য একবার হয়েছিল, সে-কথাই বলছি।

যোদ্ধাদের দলটা বেশ বড়ো ছিল এবং এবারও আমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হল কোনো কারণেই গুলি চালাতে পারব না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ছোটো ঝোপের ভিতর সিংহের সাড়া পাওয়া গেল। মাসাই যোদ্ধারা সঙ্গেসঙ্গে ঝোপটাকে ঘিরে ফেলল।

ঝোপটা খুব ঘন ছিল না। মাসাইরা বৃত্তাকারে এগিয়ে চলল চিৎকার করতে করতে। হঠাৎ ঝোপের মাঝখান থেকে একাধিক সিংহের গর্জন শুনতে পেলাম। তারপরই দেখলাম একটা সিংহ তিরবেগে ছুটে এসে একজন মাসাইয়ের ঢালের উপর সজোরে চপেটাঘাত করে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিল এবং অন্যান্য যোদ্ধারা কিছু করার আগেই সকলের মাথার উপর দিয়ে লম্বা লাফ মেরে অদৃশ্য হয়ে গেল পাশের জঙ্গলের মধ্যে। সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, কেউ হাতের বর্শা তোলার সময় পেল না।

যাই হোক, যে-লোকটি পড়ে গিয়েছিল সে আহত হয়নি, এটাই সান্ত্বনা।

ঝোপের ভিতর সিংহের চাপা গর্জন ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠল।

এগিয়ে গিয়ে দেখলাম মাসাইরা আর একটা সিংহকে ঘিরে ফেলেছে। কোণঠাসা পশুরাজ এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর থেকে থেকে গর্জে উঠছে, যেন বলতে চাইছে–সাবধান, আর এগিয়ো না।

সিংহের থেকে প্রায় দশগজ দূরে মাসাইরা দাঁড়িয়ে পড়ল। পরক্ষণেই বর্শা ছুটতে লাগল ঝাঁকে ঝাকে। কয়েকটা বর্শা সিংহের দেহ বিদ্ধ করে মাটিতে পড়ে গেল, কেবল একটা বর্শা দেখলাম সিংহের পেটে গম্ভীর হয়ে বসে গেছে। ভীষণ গর্জন করে জানোয়ারটা লাফিয়ে উঠল আর সঙ্গেসঙ্গে একজন মাসাই হাতের বর্শা মাটিতে ফেলে ছুটে এসে সিংহের লম্বা লেজটা দুই হাতের বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরল। (মাসাইরা কখনো সিংহের লেজের আগায় রোমশ অংশে হাত দেয় না, তারা গোড়ার দিকটা চেপে ধরে। কারণ, সিংহ তার লেজটাকে লোহার ডান্ডার মতো শক্ত করতে পারে এবং সেই আড়ষ্ট ও কঠিন লাঙ্গুলের একটি আঘাতে ঠিকরে মাতা ধরিত্রীকে আলিঙ্গন না-করে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এমন বলিষ্ঠ মানুষ দুনিয়ায় আছে কি না সন্দেহ।)

লেজ ধরামাত্র অন্যান্য যোদ্ধারা ছোরা হাতে ছুটে এসে সিংহকে আক্রমণ করল। এই চরম মুহূর্তে মাসাই যোদ্ধাদের দেহে কোনো অনুভূতি থাকে না, তারা যন্ত্রের মতো আঘাত করতে থাকে এবং যন্ত্রের মতোই নখ ও দাঁতের আঘাত গ্রহণ করে নিজেদের শরীরের ওপর ভীষণ উত্তেজনায় কিছুক্ষণের জন্য তাদের শারীরিক অনুভূতি নষ্ট হয়ে যায়।

আমি স্বচক্ষে দেখলাম সিংহ যখন নিজেকে মুক্ত করতে পারল না, তখন পিছনের দুই পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে দক্ষ মুষ্টিযোদ্ধার মতো ডাইনে-বামে থাবা চালাতে শুরু করল। প্রায় প্রতিটি আঘাতেই তার থাবার নখগুলো একাধিক শত্রুর দেহে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করল বটে, কিন্তু আমি কোনো যোদ্ধার মুখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি দেখতে পেলাম না। পরে শুনেছিলাম এই সময় তারা বেদনা বোধ করে না।

লড়াই চলল অনেকক্ষণ ধরে–তারপর অত্যধিক রক্তপাতে অবসন্ন পশুরাজ ধীরে ধীরে ধরাশয্যা গ্রহণ করল।

সূর্যের আলোয় আবার ঝলসে উঠল অনেকগুলো শানিত ছুরিকা–নিষ্ঠুর আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সিংহের বিশাল মস্তক! সব শেষ!

আহত মাসাইদের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই চোখে পড়ল বীভৎস ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে গল গল করে, কিন্তু তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই! আমি দুজন যোদ্ধার ক্ষতস্থান উঁচসুতো দিয়ে সেলাই করে দিলাম; একজন তো কথাই বলল না, আর একজন তালুতে জিভ লাগিয়ে শব্দ করল স! অর্থাৎ কী আপদ! সামান্য ব্যাপারে এত কেন?

আমি বাজি ফেলতে পারি যেকোনো শ্বেতাঙ্গ এই অবস্থায় পড়লে যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যেত।

মাসাই যোদ্ধাদের বর্শা খুব শক্ত হয় না। স্রোতস্বতী নদীর ধার থেকে মাটি-মেশানো-লোহা দিয়ে স্থানীয় কামাররা বর্শা তৈরি করে, কিন্তু সেই লোহাকে টেম্পার দিয়ে কঠিন করার বিদ্যা তারা আয়ত্ত করতে পারেনি। জোরে আঘাত পেলে বর্শার ফলা বেঁকে যায়। হাঁটুর ওপর রেখে অনায়াসেই ওই বর্শাফলক বাঁকিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মাসাই যোদ্ধা ওই বর্শা চালিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। সেই আশ্চর্য ক্ষিপ্রতা চোখে না-দেখলে বিশ্বাস হয় না। মাসাইদের দক্ষতার নমুনাস্বরূপ আর একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এই ঘটনাটি বলার আগে আফ্রিকার লেপার্ড সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা দরকার।

আফ্রিকার মতো ভারতের অরণ্যেও লেপার্ড আছে, বাংলায় তাকে চিতাবাঘ বলে ডাকা হয়। কিন্তু আফ্রিকার জঙ্গলে চিতা নামে যে জানোয়ার বাস করে, তার দেহ-চর্মের সঙ্গে লেপার্ডের কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও দেহের গঠনে আর স্বভাব-চরিত্রে চিতার সঙ্গে লেপার্ডের বিশেষ মিল নেই–চিতা এবং লেপার্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন জানোয়ার। চিতা ভীরু প্রকৃতির জীব। লেপার্ড হিংস্র, দুর্দান্ত।

জে. হান্টার, জন মাইকেল প্রভৃতি খ্যাতনামা শিকারি লেপার্ডকে আফ্রিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক জানোয়ার বলেছেন। সিংহের মতো বিপুল দেহ এবং প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী না হলেও ধূর্ত লেপার্ডের বিদ্যুৎচকিত আক্রমণকে অধিকাংশ শিকারিই সমীহ করে থাকেন।

লেপার্ডের আক্রমণের কৌশল অতি ভয়ংকর। লতাপাতা ও ঘাসঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে সে যখন বিদ্যুৎবেগে শিকারির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে, তখন আক্রান্ত ব্যক্তি অধিকাংশ সময়েই হাতের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পায় না। প্রথম আক্রমণেই লেপার্ড তার সামনের দুই থাবার ধারালো নখ দিয়ে শিকারির চোখ দুটোকে অন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে, সঙ্গে সঙ্গে একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের মারাত্মক দংশন চেপে বসে শিকারির কাঁধে, আর পিছনের দুই থাবার নখগুলোর ক্ষিপ্র সঞ্চালনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় হতভাগ্যের উদর।

বিখ্যাত শিকারি জে. হান্টার একবার তিনজন বর্শাধারী মাসাই-যোদ্ধার সঙ্গে একটা লেপার্ডকে অনুসরণ করেছিলেন। জন্তুটা কয়েকদিন ধরে মাসাই পল্লিতে ছাগল মারছিল। সিংহ ক্ষুধার্ত হলেই শিকার ধরে, অকারণে সে প্রাণীহত্যা করে না। লেপার্ড শুধু হত্যার আনন্দেই হত্যা করে। মাসাই পল্লির হানাদার লেপার্ড অনেকগুলো ছাগল মেরেছিল, কিন্তু একটিরও মাংস খায়নি।

বেশ কিছুক্ষণ পলাতক লেপার্ডের পদচিহ্ন ধরে খোঁজাখুঁজি করার পর একটা ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে তার সন্ধান পাওয়া গেল। পায়ের দাগ দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, জন্তুটা ওই ঘাসের জঙ্গলেই ঢুকেছে, তবে ঠিক কোথায় সে অবস্থান করছে সেটা অনুমান করা সহজ ছিল না। লেপার্ডের পরিবর্তে সিংহ হলে আন্দাজে কয়েকটা পাথর ঘাসঝোপের মধ্যে ছুঁড়ে দিলেই কাজ হত–পশুরাজ ছুটে এসে আক্রমণ করত অথবা তার অস্তিত্ব ঘোষণা করত সগর্জনে। কিন্তু লেপার্ড অতিশয় ধূর্ত, গায়ে ঢিল পড়লেও সে চুপ করে থাকে, শিকারিকে তার অবস্থান নির্ণয় করতে দেয় না। ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে অনেকগুলো পাথর ছোঁড়া হল। বৃথা চেষ্টা। লেপার্ডের সাড়া নেই।

হান্টার জানতেন জন্তুটা আক্রমণের সুযোগ খুঁজছে। তিনি ভেবেছিলেন ক্রুদ্ধ লেপার্ডের বিদ্যুৎচকিত আক্রমণ মাসাইদের বিভ্রান্ত করে দেবে, তার বর্শা চালানোর সুযোগই পাবে না কিন্তু সাহেব ভুল করেছিলেন, বর্শাধারী মাসাই-যোদ্ধার ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে তার ধারণা ছিল খুবই অস্পষ্ট।

সাহেবের নির্দেশ অনুসারে তার পিছনে দু-পাশে ছড়িয়ে পড়ে তিনটি মাসাই কোমরসমান উঁচু ঘাসের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল পলাতক শ্বাপদের সন্ধানে। প্রতি পদক্ষেপেই শিকারিরা একবার থমকে দাঁড়াচ্ছিল, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে আবার পা ফেলছিল অতি সন্তর্পণে। ঘাস-জঙ্গলটা খুব বড়ো নয়, কিন্তু এইভাবে চলা বড়ো কষ্টকর দারুণ উত্তেজনায় স্নায়ু যেন ছিঁড়ে পড়তে চায়।

আচম্বিত হান্টার সাহেবের ডান দিকে সম্মুখভাগে ঘাসের আবরণ ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করল এবং লাফ দিল তাকে লক্ষ করে। সাহেব রাইফেল তোলার আগেই তার ডান দিকে দণ্ডায়মান মাসাই-যোদ্ধার বর্শা শ্বাপদের দেহ বিদ্ধ করল। ঘাড় এবং কাঁধের মাঝামাঝি জায়গায় এফোঁড়-ওফোঁড় করে বর্শাটা লেপার্ডকে মাটিতে গেঁথে ফেলেছিল।

মুক্তিলাভের চেষ্টায় জন্তুটার কী আস্ফালন আর গর্জন কিন্তু নিষ্ফল প্রয়াস! এমন শক্ত আলিঙ্গনে বর্শাটা তাকে মাটির সঙ্গে গেঁথে ফেলেছিল যে, প্রাণপণ চেষ্টাতেও সে অস্ত্রটাকে ঝেড়ে ফেলে উঠে আসতে পারছিল না।

মাসাই-যোদ্ধা কোমর থেকে সিমি (বড়ো ছোরা) খুলে লাফ মেরে এগিয়ে গেল চরম আঘাত করার জন্য তাড়াতাড়ি তাকে থামিয়ে দিলেন হান্টার, কী সর্বনাশ! ছোরার কোপ মারলে অমন সুন্দর চামড়াটা নষ্ট হয়ে যাবে যে!

ক্ষিপ্রহস্তে রাইফেল তুলে গুলি চালাতেই বর্শাবিদ্ধ, লেপার্ডের ভবযন্ত্রণা শেষ হয়ে গেল।

মাসাইদের সাহস ও বীরত্বের কথা তো বললাম, এবার তাদের চেহারা ও অস্ত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে দু-একটা কথা বলছি।

মাসাইদের নাক, চোখ ও মুখের । গড়ন সুন্দর। কেউ কেউ মনে করেন । মাসাইদের দেহে রয়েছে প্রাচীন, মিশরবাসীর রক্ত।

চেহারার মতো মাসাইদের বর্শাও কিছু বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। মাসাইদের বর্শার দু-দিকেই ধারালো লোহার ফলা বসানো, মাঝখানের অংশটিতে অর্থাৎ ধরার জায়গায় কাষ্ঠদণ্ড লাগানো থাকে। ওই ধরনের বর্শা অন্যান্য জাতির নিগ্রোরা ব্যবহার করে না। যুদ্ধ বা শিকার অভিযানে যাত্রা করার সময়ে মাসাই যোদ্ধা মাথায় উটপাখির পালক গুঁজে দেয়।

মাসাই জাতি যে কেবল হানাহানি আর মারামারি করতেই দক্ষ তা নয়, তারা অতিশয় অতিথিবৎসল এবং ভদ্র। অকারণে তারা বিদেশিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে না। [চৈত্র ১৩৬৮]

মরণ-ফাঁদ

মৃত্যুর রঙিন ফাঁদ!

ভাগ্যের পরিহাস!…

দুই বন্ধু যদি জানত যে পর্দার বুকে ডোরাডো মাছের সোনামাখা দেহের রং ছড়িয়ে মৃত্যু। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে নিশ্চয়ই তারা কলোন থেকে বিমানযোগে ব্রিটিশ গায়নার হাইড পার্ক নামক অঞ্চলের দিকে যাত্রা করত না…।

ঘটনাটা খুলেই বলছি–

আমেরিকার একটি ক্লাবঘরে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হয়েছিল দুজন ইয়াংকি যুবক। উক্ত ছায়াচিত্রের প্রধান দ্রষ্টব্য ছিল অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী একটি অসাধারণ মৎস্য

গোল্ডেন ডোরাডো
বা
সোনালি ডোরাডো মাছ!

ছায়াচিত্রের পর্দায় বহুবর্ণরঞ্জিত রঙিন ফিল্মের কল্যাণে সোনার বরণ ডোরাডো মাছের অঙ্গশোভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল দুটি যুবক–তারা ঠিক করলে কয়েকটি ডোরাডো মাছকে তারা ছিপ ফেলে ধরবে। অতএব, কলোন থেকে রওনা হয়ে তারা অবতীর্ণ হল ব্রিটিশ গায়নার হাইড পার্ক অঞ্চলে। হাইড পার্ক নামক স্থানটির চতুর্দিকে বনভূমি ভেদ করে ছুটে গেছে বিভিন্ন নদীর জলধার এবং ওইসব নদীর জলে সাঁতার কেটে ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য সোনালি মাছ গোল্ডেন ডোরাডো!

হার্মান বেয়ার ও জন পিঙ্কনাম নামের মানুষ দুটি মাছের সন্ধানে যথাস্থানেই উপস্থিত হয়েছিল বটে কিন্তু তারা জানত না যে গোলাপের সঙ্গে কাটার মতো সোনারং ডোরাডোর আশেপাশে নদীর জলে হানা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় ক্ষুধিত মৃত্যুর জীবন্ত অভিশাপ

সে-কথা ক্রমশ প্রকাশ্য..

এসো কুইবো নদীর উপর দিয়ে একটি পুরাতন মোটরবোটে মৎস্য-শিকারের যাবতীয় সাজসরঞ্জাম চাপিয়ে দুই বন্ধু যেখানে এসে উপস্থিত হল সেই জায়গাটির নাম রকস্টোন। পূর্বোক্ত স্থান ছাড়িয়ে তারা আরও ভিতরের দিকে মোটরবোট চালিয়ে দিলে।

সন্ধ্যার একটু আগেই হল বিপত্তির সূত্রপাত।

মোটরবোটের ঘূর্ণায়মান প্রপেলার সবেগে ধাক্কা খেল জলের নীচে অদৃশ্য কোনো কঠিন বস্তুর সঙ্গে তৎক্ষণাৎ ঘটাং ঘট!

সশব্দে ভেঙে গেল প্রপেলারের একটি পাখা। জন চেঁচিয়ে উঠল, নিশ্চয় জলে-ডোবা কোনো পাথরে ধাক্কা লেগেছে… কী আশ্চর্য! কোনো পাথর-টাথর তো দেখতে পাচ্ছি না!

হার্মান বোটের উপর থেকে দৃষ্টিকে চালিত করলে নদীর বুকে

কয়েক ফিট নীচে পর্যন্ত যতদূর নজর যায় চোখে পড়ে শুধু জল আর জল, নিমজ্জিত কোনো প্রস্তরখণ্ডের অস্তিত্ব সেখানে নেই।

দুজনেই হতভম্ব!

কঠিন কোনো বস্তুর সঙ্গে ঘূর্ণিত প্রপেলারের সংঘাতে যে শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল তারা দুজনেই সেই আওয়াজ শুনেছে, কিন্তু স্বচ্ছ জলের মধ্যে পাথর-টাথর তো কিছুই তাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। না। দুই বন্ধু আবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে।

না কিছু নেই–মোটরবোটের প্রপেলার যতদূর নাগাল পায় ততদূর পর্যন্ত সব কিছুই দেখা যায় নদীর জলে, কিন্তু নিমজ্জিত কোনো প্রস্তরখণ্ড তাদের দৃষ্টিপথে ধরা দিল না।

রহস্যের সমাধান হল না। প্রপেলারে নূতন শেয়ার-পিন লাগিয়ে আবার তারা বোট ছুটিয়ে যাত্রা শুরু করলে। সেইদিনই তারা পৌঁছে গেল রেড-ইন্ডিয়ানদের একটি গ্রামের কাছে।

নদীর দুই ধারে এখন অরণ্যের রাজত্ব।

বন হয়ে উঠছে ক্রমশ গভীর ও দুর্গম।

অজানা জায়গায় গভীর জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু খাঁটিয়ে রাত্রিযাপন করার ইচ্ছা তাদের ছিল না; লোকালয়ের কাছে স্থানীয় অধিবাসীদের হাতে-গড়া একটা ছোটো ঘরে তারা এক রাতের জন্য আশ্রয় গ্রহণ করলে…।

পরদিন সকালে দুই বন্ধু আবার নদীর জলে মোটরবোট ভাসিয়ে দিলে। তারা শুনেছিল একটু দূরেই খরস্রোতা নদীর একটা বাঁকে ডোরাডো মাছের আড্ডা আছে। নির্দিষ্ট স্থান লক্ষ করে ছুটল মোটরবোট। কিন্তু নিশ্চিন্ত নৌবিহার তাদের ভাগ্যে ছিল না, আবার বিঘ্ন ঘটল।

কয়েক মাইল যেতে-না-যেতেই সশব্দে ভেঙে গেল প্রপেলারের শেয়ার-পিন।

মোটরযোটকে চালনা করছিল হার্মান আর জন তখন মাছ ধরার সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখছিল। দুর্ঘটনার জন্য বন্ধুকে দায়ী করে জন ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললে, তুমি কি চোখ বুজে বোট চালাও? আবার কীসের সঙ্গে ধাক্কা লাগল? শেয়ার-পিন আর কটা আছে শুনি?

হার্মান উত্তর দিলে না। মোটরবোটের গলুই-এর উবু হয়ে শুয়ে সে জলের ভিতরটা শ্যেনদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল… প্রথমে কয়েকটা বুদ্বুদ ভেসে উঠল, তারপরই নদীর জলে জাগল গাঢ় লাল রং-এর আভাস রক্ত?

লাল রং-এর তরল ধারা যেখানে জলের উপর ভেসে উঠেছে সেই জায়গায় একটা আঙুল ডুবিয়ে দিলে হার্মান–তারপর সিক্ত অঙ্গুলিটিকে সে চোখের সামনে তুলে ধরলে…হ!রক্তই বটে!

জন! হার্মান চেঁচিয়ে উঠল, আমরা কোনো জীবন্ত প্রাণীর দেহে আঘাত করেছি। এই দেখো রক্ত!

সে জনের দিকে তার আঙুল বাড়িয়ে দিলে।

জন বন্ধুর রক্তমাখা আঙুল পরীক্ষা করার চেষ্টা করলে না, তার দৃষ্টি এখন মোটরবোটের পিছনদিকে নিবদ্ধ

জলের উপরিভাগে আত্মপ্রকাশ করেছে একটা ধূসর গাছের গুঁড়ি।

হ্যাঁ, গাছের গুঁড়ি বটে কিন্তু নিশ্চল নয়!

সেই জীবন্ত বৃক্ষকাণ্ড প্রচণ্ড বেগে আলোড়ন তুলেছে নদীর বুকে–তপ্ত রক্তধারায় লাল হয়ে উঠেছে নদীর জল!

কেম্যান!

ব্রিটিশ গায়নার জলরাজ্যের বিভীষিকা এই কেম্যান হচ্ছে কুম্ভীরবংশের সবচেয়ে হিংস্র, সবচেয়ে ভয়ংকর জীব!

স্তম্ভিত নেত্রে দুই বন্ধু কেম্যান-কুম্ভীরের মৃত্যুযাতনা দেখতে লাগল। প্রপেলারের ঘূর্ণিত শেয়ার-পিন কুমিরের মাথার পিছনে ঠিক ঘাড়ের উপর আঘাত করেছে

সরীসৃপের স্থূল ও কঠিন স্কন্ধদেশ ভেদ করে গ্রীবা পর্যন্ত কেটে বসেছে প্রপেলার এবং তারপরই প্রবল সংঘাতে ভেঙে গেছে যন্ত্র।

দুই বন্ধুই বুঝল কুমিরটা বেশিক্ষণ বাঁচবে না।

শেষ দৃশ্যের জন্য তারা অপেক্ষা করলে না, কোনোরকমে প্রপেলারে নতুন শেয়ার-পিন লাগিয়ে তারা অকুস্থল ত্যাগ করে সবেগে মোটরবোট চালিয়ে দিলে…

মোটরবোট চলছে, চলছে আর চলছে। দুই বন্ধু বসে আছে বোবার মতো। কেউ কথা কইছে না। হঠাৎ চলমান মোটরবোটের উপর থেকে নদীর ধারে একটি জায়গায় তাদের চোখ পড়ল, সঙ্গেসঙ্গে তাদের মেরুদণ্ড বেয়ে ছুটে এল আতঙ্কের শীতল স্রোত

কর্দমাক্ত তীরভূমির উপর শুয়ে আছে অনেকগুলো কেম্যান-কুম্ভীর।

মোটরবোটের শব্দে আকৃষ্ট হল কুমিরগুলো–দুই বন্ধু দেখল তীরবর্তী নকুলের চোখে চোখে জ্বলে উঠেছে হিংস্র ক্ষুধিত দৃষ্টি!

একটা মস্ত বড়ো কেম্যান হঠাৎ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বোট লক্ষ করে সাঁতার কাটতে লাগল দ্রুতবেগে।

খুব সম্ভব তার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না, হয়তো নবাগত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিল সে, কিন্তু দুই বন্ধু আতিথ্যের মর্যাদা রাখল না, এত জোরে তারা মোটরবোট ছুটিয়ে দিলে যে প্রাণপণে সাঁতার কেটেও কেম্যান তাদের নাগাল পেল না..

অনেক দূর এসে একটা বাঁকের মুখে নোঙর ফেলল তারা। দুই দুইবার ব্যর্থ চেষ্টার পর তৃতীয়বার ভাগ্যদেবতার কৃপা লাভ করলে হার্মান, একটা সোনালি রেখা বিদ্যুচ্চমকের মতো জল থেকে লাফিয়ে উঠে আবার নদীগর্ভে অদৃশ্য হল–গোল্ডেন ডোরাডো!

স্বর্ণখচিত দেহের অধিকারী ডোরাডো মৎস্য কেবল অসাধারণ রূপবান নয়, সে বিলক্ষণ শক্তিশালীও বটে। ছিপের সুতো টেনে সে ছুটতে লাগল তিরবেগে হার্মান তাকে খেলিয়ে তুলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠল।

উত্তেজিত জন বন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে উৎসাহ দিতে লাগল–

এতক্ষণে তাদের চেষ্টা সফল হল, সোনা-রং-মাখা ডোরাডো মাছ এখনই এসে পড়বে তাদের হাতের মুঠোর মধ্যে…

হঠাৎ হার্মান অনুভব করলে ছিপের সুতো শিথিল হয়ে পড়েছে, ডোরাডো বুঝি সুতো কেটে তাদের ফাঁকি দিলে! হার্মান তাড়াতাড়ি ছিপ ধরে টান মারল। বঁড়শির দিকে দৃষ্টিপাত করেই দুই বন্ধুর চক্ষুস্থির!

মাছের দেহহীন মুণ্ডটা ঝুলছে বঁড়শির মুখে! গলার তলা থেকে বাকি অংশটা কে যেন কেটে নিয়েছে।

বন্ধুর দিকে ফিরে শুদ্ধস্বরে হার্মান প্রশ্ন করলে, আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই ভাবছ?

অবসন্নকণ্ঠে উত্তর এল, দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি তোমার অনুমান নির্ভুল।

জন বঁড়শি থেকে মাছের মুণ্ডটা খুলে নিয়ে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলল। তৎক্ষণাৎ জল তোলপাড় করে আবির্ভূত হল একজোড়া দন্ত-ভয়াল বীভৎস চোয়াল!

চোয়াল দুটো মুহূর্তের মধ্যেই আবার জলের ভিতর অদৃশ্য হল; হার্মানের প্রথম শিকার সোনালি ডোরাডোর দেহহীন মুণ্ডটা জলে পড়তে-না-পড়তেই সেই চোয়াল দুটির ফাঁকে অন্তর্ধান করলে! বীভৎস দৃশ্য!

মাছ ধরার উৎসাহ আর রইল না, হার্মান নোঙর খুলে বোট চালিয়ে দিলে..

..আচম্বিতে এক প্রকাণ্ড ধাক্কা খেয়ে মোটরবোট লাফিয়ে উঠল। বোটের প্রপেলার জল ছেড়ে শূন্যে উঠেও তার কর্তব্য করতে ভুলল না–প্রপেলারের পাখা বাতাস কেটে ঘুরতে লাগল প্রচণ্ড শব্দে।

মোটরবোটের দুই আরোহী আছড়ে পড়ল পাটাতনের উপর।

ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হল না তাদের জলের নীচে কোনো একটি কেম্যানের গায়ে ধাক্কা মেরেছে মোটরবোট এবং তার ফলে এই বিপর্যয়!

হার্মান তাড়াতাড়ি মোটর থামিয়ে দিলে।

প্রপেলারের আর্তনাদ বন্ধ করল, শান্তভাবে মোটরবোট ভাসতে লাগল নদীর জলে।

সঙ্গেসঙ্গে আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠল জন, আরে! আরে! করছ কী! ভগবানের দোহাই বোট চালাও!

বোটে তখন জল উঠছে।

এই ভয়ংকর জায়গায় বোট ডুবলে আর নিস্তার নেই–সাঁতার কেটে তীরে ওঠার আগেই কেম্যানের আক্রমণে তাদের মৃত্যু অবধারিত

নিকটস্থ তীরভূমি লক্ষ করে বোট চালাল হার্মান।

অসংখ্য ছিদ্রপথে তখন হুহু করে জল উঠছে বোটের মধ্যে…

তীরের খুব কাছাকাছি এসে হঠাৎ কাদার মদ্যে আটকে গেল মোটরবোট।

দুই বন্ধু তাড়াতাড়ি বোট ছেড়ে নেমে পড়ল।

প্রায় দশ ফুট দূরেই রয়েছে মৃত্তিকার আশ্রয়, এইটুকু ব্যবধান কোনোরকমে পার হতে পারলে তারা নিরাপদ–হাঁটু পর্যন্ত জল ভেঙে দুই বন্ধু তীরভূমির দিকে অগ্রসর হল।

হঠাৎ হার্মান শুনতে পেল তার পিছনেই জেগে উঠেছে একটা আলোড়ন-ধ্বনি–সঙ্গেসঙ্গে ফোয়ারার মতো জল ছিটকে এসে তার সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দিলে। হার্মান পিছন ফিরে চাইল না, সে তখন ব্যাপারটা অনুমানেই বুঝে নিয়েছে এক লাফ মেরে সে এগিয়ে গেল। পরক্ষণেই পিছন থেকে ভেসে এল কর্কশ শব্দ

একটা প্রকাণ্ড লোহার সিন্দুকের ডালা যেন সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল!

হার্মান বুঝল পিছন থেকে এক পাষণ্ড কেম্যান তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, কিন্তু শিকার করতে না-পেরে দন্তসজ্জিত দুই চোয়াল ব্যর্থ দংশনে পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে!

অগভীর জল ঠেলে সে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতে লাগল প্রাণপণে…

শক্ত মাটির উপর পা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল হার্মান আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার পায়ের উপর চেপে বসল বিকট একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের বজ্র-দংশন!

হার্মানের কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল কাতর আর্তনাদ!

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে জন দেখল কেম্যান তার বন্ধুর পা কামড়ে ধরে গভীর জলে টেনে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছে।

একলাফে এগিয়ে এসে সে চেপে ধরলে হার্মানের দুই হাতের কবজি। শুরু হল যমে মানুষে টানাটানি!…

হঠাৎ একটা পাথরের উপর হোঁচট খেয়ে পড়ে রইল জন, সঙ্গীর হাতের উপর থেকে খুলে গেল তার বজ্রমুষ্টির বন্ধন–হার্মান বুঝল আর রক্ষা নেই, নক্ৰদানব তাকে এইবার নিয়ে যাবে গভীর জলের মধ্যে।

আর ঠিক সেই সঙ্গিন মুহূর্তে তার কানে এল অপরিচিত মানুষের কণ্ঠস্বর। কথাগুলোর অর্থ সে বুঝতে পারল না–কারণ কণ্ঠস্বরের মালিক যে-ভাষায় কথা কইছে সেই ভাষা হার্মানের পরিচিত নয়।

..কেম্যান এতক্ষণ শিকারকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল জলসিক্ত ভূমির ওপর দিয়ে হঠাৎ হার্মান অনুভব করলে তার পায়ের উপর শিথিল হয়েছে কুম্ভীরের দংশন, সরীসৃপ আর তাকে আকর্ষণ করছে না!

দানবটার ভাবান্তরের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য মুখ তুলল হার্মান, সঙ্গেসঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক বিস্ময়কর দৃশ্য–

কেম্যানের পিঠের উপর বসে আছে একটি প্রায়-কৃষ্ণবর্ণ মানুষ।

পরক্ষণেই কুম্ভীর হার্মানের দেহটাকে সজোরে শূন্যে নিক্ষেপ করলে

শক্ত মাটির উপর আছড়ে পড়ল হার্মান, কঠিন মৃত্তিকার সংঘাতে এক মুহূর্তের জন্যে সে অনুভব করলে তীব্র যন্ত্রণার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে তার সর্বাঙ্গে

তারপরই লুপ্ত হয়ে গেল তার চৈতন্য…

চোখ মেলে হার্মান দেখল একটা নৌকার পাটাতনে দেহ ছড়িয়ে সে শুয়ে আছে এবং দাঁড় বেয়ে নৌকাটিকে চালনা করছে দুটি রেড-ইন্ডিয়ান। জন কাছেই ছিল, বন্ধুর জ্ঞান হয়েছে দেখে সে সামনে এগিয়ে এল।

জনের মুখ থেকেই সমস্ত ঘটনা শুনল হার্মান :

এই অঞ্চলের রেড-ইন্ডিয়ানরা কুমিরের সঙ্গে হাতাহাতি করতে অভ্যস্ত। এটা তাদের কাছে। একধরনের খেলা।

কেম্যান যখন হার্মানকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়েই অকুস্থলে আবির্ভূত হয়ে দুজন রেড-ইন্ডিয়ান শিকারি। হার্মানের অবস্থা দেখে তারা চিৎকার করে ওঠে (অজ্ঞান হওয়ার আগে তাদের কণ্ঠস্বর হার্মান শুনেছিল), তারপর মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেম্যানের উপর। একজন রেড-ইন্ডিয়ান কুমিরের চোখে বর্শা বিধিয়ে দেয়। আহত কেম্যান মুখের শিকার ছুঁড়ে ফেলে নবাগত শত্রুদের আক্রমণ করার চেষ্টা করে।

প্রায় পনেরো ফুট দূরে ছিটকে পড়ে হার্মান জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।

ইতিমধ্যে বর্শার খোঁচা খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল কেম্যান। এই অঞ্চলের রেড ইন্ডিয়ানরা জলবাসী ওই দানবকে মোটেই ভয় পায় না–জলের মধ্যে কেবল বর্শা ও ছোরার সাহায্যে তারা কুমিরগুলোকে হত্যা করে থাকে।

এমন আশ্চর্য কৌশলের সঙ্গে তারা কেম্যানের পিঠের উপর উঠে বসে যে নক্ৰদানবের দাঁতালো চোয়াল এবং লোহার চাবুকের মতো সাংঘাতিক লাঙ্গুল কিছুতেই তাদের শরীর স্পর্শ করতে পারে না–

কিন্তু পৃষ্ঠদেশে উপবিষ্ট শিকারির তীক্ষ্ণ অস্ত্র বারংবার বিদ্ধ হয় কেম্যানের দেহে অবশেষে রক্তপাতের ফলে অবসন্ন হয়ে মৃত্যুবরণ করে কেম্যান।

অদ্ভুত সাহস! আশ্চর্য বীরত্ব!…

না, ও-রকম অদ্ভুত সাহস বা বীরত্বের পরিচয় দিতে পারবে না হার্মান আর জন। ব্রিটিশ গায়নার নদীতে আর কখনো তারা মাছ ধরতে যায়নি।

জলে নেমে জলের রাজা কুমিরের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করার শখ তাদের নেই।

[শ্রাবণ ১৩৭৭]

মার্জারের অপমৃত্যু

পশ্চিম মেক্সিকোর বিশাল জলাভূমি সিনেগা গ্র্যান্ডির বুকের উপর দাঁড়িয়ে যে লোক বলতে পারে, আমি একটুও ভয় পাইনি- সে হয় ডাহা অন্ধ আর নয় তো বদ্ধ পাগল।

ডেল লী সাহসী ছেলে কিন্তু সে অন্ধও নয় পাগলও নয়। চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করেই সে বুঝে নিল– জায়গাটা মোটেই সুবিধের নয়, একটু অসাবধান হলেই প্রাণপাখি হঠাৎ খাঁচাছাড়া হতে পারে।

সামনে ঝুঁকে পড়ে ডেল বললে, গাড়ি থামাও।

ট্রাক থামল।

ডেল লী গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল, আদেশ করলে, তবু লাগাও।

তাঁবু খাটাবার সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে ট্রাক থেকে নামল দুজন স্থানীয় অধিবাসী এবং একজন শ্বেতাঙ্গ যুবক।

তারা তিনজনেই তাঁবু খাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পকেট থেকে পাইপ বার করে ডেল ধূমপানে মন দিল..

এই বুঝি সিনেগা গ্র্যান্ডি?

ডেল চমকে উঠল। শেতাঙ্গ যুবকটি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ডেল বললে, হ্যাঁ। এই হল সিনেগা গ্র্যান্ডি মেক্সিকোর বিশাল জলাভূমি। তোমার কেমন লাগছে ক্লে?

ক্লে ভ্রূকুঞ্চিত করলে, জঘন্য! চারদিকে খালি জল আর কাদা, কাদা আর জল। এর মধ্যে এই জায়গাটাই একটু শুকনো। কিন্তু কি মশা! উঃ! একেবারে পাগল করে দিল!

কথাটা সত্যি। ঝাঁকে ঝাকে মশা উড়ছে।

তাদের মিলিত আক্রমণে এর মধ্যেই ক্লে-র কপাল ও মুখ ফুলে উঠেছে। ডেল-এর মুখও অক্ষত নয়, কিন্তু সে সম্পূর্ণ নির্বিকার।

শূন্যে খানিকটা ধোঁয়া উড়িয়ে ডেল পাইপটা নামিয়ে নিল। গম্ভীরভাবে বললে, ট্রাকের ভিতর মশার প্রতিষেধক তেল আছে। ওই তেল মুখে আর হাতে লাগিয়ে নিলে মশার কবল থেকে নিষ্কৃতি পাবে। তবে, যে কাজে এসেছি তাতে কিছুটা সহ্য করতেই হবে। আমরা তো এখানে বনভোজন করতে আসিনি, আমাদের–

ঝপ! ঝপাস!

ডেল-এর বাক্যস্রোতে বাধা দিয়ে অকস্মাৎ জলের বুকে জেগে উঠল এক প্রচণ্ড আলোড়ন-ধ্বনি।

ও কী? ও কিসের শব্দ?

ক্লে চমকে উঠল। কিন্তু সন্ধ্যার আলো আর অন্ধকারের মধ্যে সে জলের উপর কিছুই দেখতে পেল না।

সঙ্গীর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লে প্রশ্ন করলে, ওটা কিসের শব্দ?

ডেল-এর মুখে হাসির রেখা ফুটল, সে কথা বললে না।

ঝপ! ঝপাস!

আবার সেই শব্দ। কিন্তু শব্দটা এবার আসছে জলার অন্য দিক থেকে।

বুঝেছি, ক্লে হেসে উঠল, জায়গাটা দেখছি ভারি চমৎকার!

হ্যাঁ, চমৎকার, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ডেল বললে, শুধু কুমির নয়ওই ঘন ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে জলের উপর ছড়িয়ে আছে বিষাক্ত মোকাসিন সাপও।

ক্লে বললে, বাঃ! খুব চমৎকার জায়গায় নিয়ে এসেছ তো! একেবারে যমের দক্ষিণ দুয়ার!

…. হ্যাঁ, যমের দক্ষিণ দুয়ার বটে।

মেক্সিকোর ভাষায় সিনেগা গ্র্যান্ডি কথাটার অর্থ হচ্ছে বিশাল জলাভূমি।

এই বিশাল জলাভূমিকে কেউ যদি যমের দক্ষিণ দুয়ার আখ্যা দেয় তবে বিশেষ ভুল হবে না।

চারদিকে খালি জল আর জল- মাঝে মাঝে কর্দমাক্ত ভূমি– তারপর আবার জল। জলের গভীরতা সব জায়গায় সমান নয়। কোথাও হয়ত এক-মানুষ জল, আবার কোথাও হয়ত হাঁটুও ডোবে না। এই বিশাল জলরাশির ধারে ধারে জল এবং মাটিকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছে অজস্র বুনো লতা ও ঘাসের ঝোঁপ, আর সেই জলজ ঘাস-জঙ্গল ভেদ করে সুর্যের আলো দেখার জন্যে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ছোটো বড়ো বিভিন্ন গাছের সারি।

গাছের ডালে ডালে কলরব করে ভিড় জমিয়েছে নানা জাতের নানা রং-এর পাখি। এই রং-বেরং-এর পাখির ঝাকের দিকে তাকিয়ে কেউ ভাবতে পারবে না যে নীচে ওত পেতে আছে সাক্ষাৎ মৃত্যু। ঘাস-ঝোপের আড়ালে অনেক সময় আত্মগোপন করে শুয়ে থাকে ভয়াবহ কুম্ভীর। এখানকার জলে মাছের অভাব নেই, কিন্তু কুমিরগুলো শুধু মৎস্যভোজী নয়, তারা মাংসাশীও বটে।

যে ছোটো ছোটো হরিণগুলো ডাঙার উপর ঘুরে বেড়ায়, সুযোগ পেলেই হিংস্র সরীসৃপ তাদের ঠ্যাং কামড়ে ধরে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অধিকাংশ বন্যজন্তু মানুষকে ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। কিন্তু এই কুমিরগুলো মৃগমাংসের পরিবর্তে নরমাংস পেলে একটুও আপত্তি করে না।

শুধু কুমির নয় এখানকার জলে-স্থলে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মোকাসিন সর্প। তাদের বিষাক্ত চুম্বন গ্রহণ করলে যে-কোনো মানুষ মৃত্যু বরণ করতে বাধ্য হবে।

এমন চমৎকার স্থানটিকে কেউ যদি যমের দক্ষিণ দুয়ার আখ্যা দেয় তবে তাকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না।

কিন্তু কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে অনেক ভালো ভালো জায়গা থাকতে এমন নরকুণ্ডে বেড়াতে আসার দরকার কী?

-হ্যাঁ, দরকার আছে।

পৃথিবীতে এক শ্রেণির লোক আছে যারা জীবনটাকে বাজি রেখে ভাগ্যের সঙ্গে জুয়া খেলতে একটুও ভয় পায় না।

কাছেই সুদূর আরিজোনা থেকে ডেল লী নামধারী মানুষটি যদি পশ্চিম মেক্সিকোর ভয়াবহ জলাভূমির উপর ছুটে আসে তাতে খুব বেশি আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তবে, বিনা প্রয়োজনে কেউ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে চায় না।

ডেল-এর একটা উদ্দেশ্য অছে বইকি। জাগুয়ারের চামড়া সংগ্রহের জন্য সিনেগা গ্রান্ডির ভয়াবহ অঞ্চলে হানা দিয়েছে সে।

এইখানে জাগুয়ার নামক জন্তুটির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। স্থানীয় অধিবাসীরা বলে El Tigre, কথাটার বাংলা অর্থ– বাঘ।

এই El Tigre বা জাগুয়ার বিড়াল জাতীয় প্রাণী।

তবে, বাঘের চাইতে প্যান্থার বা লেপার্ডের সঙ্গেই তার সাদৃশ্য বেশি। গাঢ় কমলা-হলুদ জমির উপর কালো কালো ছাপ মারা জাগুয়ারের চামড়াটা দেখতে অনেকটা বৈষ্ণবের নামাবলীর মতো।

এই চামড়ার লোভে অনেক সময় দুঃসাহসী শিকারিরা জাগুয়ারের ডেরায় হানা দেয়। তবে El Tigre বা জাগুয়ার মোটেই নিরীহ জন্তু নয়, তাকে হত্যা করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। দেহচর্মের সঙ্গে নামাবলীর যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকলেও স্বভাব-চরিত্রে তার সঙ্গে বৈষ্ণবের কোনো মিলই নেই, বরং প্রাচীনপন্থী শাক্তদের মতোই তার প্রকৃতি অতিশয় উগ্র ও ভয়ঙ্কর।

অধিকাংশ বিড়াল-জাতীয় প্রাণী জলে নামতে চায় না। জাগুয়ার সম্বন্ধে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। এই বিপুলবপু মার্জার ঠিক অলিম্পিকের দক্ষ সাঁতারুর মতো সাঁতার কাটতে পারে এবং শিকারিকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে সে বারংবার জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এমন উদাহরণও নিতান্ত বিরল নয়। এই ধূর্ত জানোয়ার যে শুধু সাঁতারেই দক্ষ তা নয়- গাছে উঠতেও সে সমান পটু। গাছের ডালে ডালে যে-সব বাঁদর ঘুরে বেড়ায় তারাও জাগুয়ারের কবল থেকে রক্ষা পায়না।

অর্থাৎ মেক্সিকোর El Tigre, ডাঙার উপর বাঘের মতোই দ্রুত ছুটতে পারে, জলে সে কুমিরের মতো সাঁতার কাটতে জানে আবার বিড়ালের মতো চটপট গাছে উঠতেও তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা নেই।

কর্দমাক্ত জলাভূমির মধ্যে এমন জানোয়ারকে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। তাই শিকারিরা জাগুয়ার মিশরের জন্য শিক্ষিত কুকুরের সাহায্য গ্রহণ করে।

এই কুকুরগুলো গন্ধ শুঁকে অতি সহজেই জাগুয়ারকে আবিষ্কার করতে পারে। সেই সময় জাগুয়ার শক্ত জমির উপর থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং জল থেকে ডাঙায় উঠে আবার ছুটতে থাকে। জলের মধ্যে জাগুয়ারের গায়ের গন্ধ হারিয়ে যায়, তাই অনেক সময় অনুসরণকারী কুকুরের দল বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তবে, সব সময় তার এই কায়দা সফল হয় না। অভিজ্ঞ কুকুর জলে সাঁতরে অপর পারে গিয়ে শিকারের গন্ধ খুঁজে বার করে এবং আবার নতুন করে শুরু হয় অনুসরণ-পর্ব।

পালাবার পথ না থাকলে অথবা খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লে কখনও কখনও সে গাছের উপর আশ্রয় নেয়। কিন্তু একবার বৃক্ষশাখা অবলম্বন করলে তার আর বাঁচার আশা থাকে না, কারণ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে পাহারা দেয় কুকুরের দল এবং তাদের তীব্র চিৎকার শুনে যথাস্থানে এসে উপস্থিত হয় বন্দুকধারী শিকারি। তারপর আর কী? নীচের থেকে গুলি চার্লিয়ে জাগুয়ারাকে হত্যা করা খুবই সহজ।

কিন্তু সব সময়ে এত সহজে সব কিছু হয় না। তাড়া-খাওয়া জাগুয়ার হঠাৎ রুখে দাঁড়িয়ে শত্রুর উপর দাঁত ও নখের ধার পরীক্ষা করতে থাকে। শিকারি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই কয়েকটি কুকুরকে ধরাশায়ী করে সে গা-ঢাকা দেয়।

শিকারি এসে দেখতে পায় শূন্য রঙ্গমঞ্চে রক্তমাখা দেহ নিয়ে শুয়ে আছে হত ও আহত অভিনেতার দল- নাটকের নায়ক অদৃশ্য।

শুধু কুকুর নয় মাঝে মাঝে কুকুরের মালিকের প্রাণ নিয়েও টানাটানি হয়। ক্ষিপ্ত জাগুয়ার অনেক সময় সারমেয় বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে শিকারির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে : তৎক্ষণাৎ নির্ভুল লক্ষ্যে একেবারে মর্মস্থানে আঘাত করতে না পারলে শিকারির মৃত্যু অনিবার্য কারণ আহত হলেও জাগুয়ার মরণকামড় বসায়, দন্ত ও নখের ভয়াল আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে শত্রুকে; শিকার ও শিকারির প্রাণহীন দেহ একই সঙ্গে মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে।

এইসব রক্ত জল করা তথ্য ডেল লী ভালোভাবেই জানত।

সে জাত শিকারি। মৃগয়াকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে তার পূর্বপুরুষ- ডেল তাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী।

ডেল জানত পশ্চিম মেক্সিকোর জলাভূমি সিনেগা গ্রান্ডি জাগুয়ারের প্রিয় বাসস্থান। মার্জারবংশের এই জন্তুটি যে গৃহপালিত বিড়ালের মতো শান্ত ও সুবোধ নয় সে কথাও তার অজানা ছিল না। তবে শিকারের নেশা বড়ো নেশা– সুদূর আরিজোনা থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে ডেল ছুটে এল এই কুখ্যাত জলাভূমির নরককুণ্ডে, তার সঙ্গে এল ছোটো ভাই ক্লে লী এবং একদল হাউন্ড জাতীয় কুকুর।

সিনেগা গ্র্যান্ডি অঞ্চলে তাদের গাড়ি যখন এসে থামল তখন সন্ধ্যার ধূসর যবনিকা দিনের আলোকে লুপ্ত করে দিয়েছে। প্রায় অন্ধকার জলাভূমির বুকে মাঝে মাঝে সশব্দ আলোড়ন উঠছে– অভিজ্ঞ মানুষ সেই শব্দ শুনেই বুঝতে পারবে কর্দমাক্ত জলে হানা দিয়ে ফিরছে ভয়াবহ কুমিরের দল।

ক্লে লী সাহসী ছেলে, বন্দুক-রিভলভার ছুঁড়তেও সে ওস্তাদ; কিন্তু বড় ভাইয়ের মতো পাকা শিকারি সে নয়।

ক্লে যখন জানতে পারলে এই জলাভূমিতে অসংখ্য কুমির ও বিষাক্ত সর্প বাস করে তখন সে রীতিমত চমকে উঠল। চমৎকার জায়গা দেখছি– একেবারে যমের দক্ষিণ দুয়ার!

ডেল হেসে বললে, মোটা হান্টিং সুট-এর আবরণ ভেদ করে সাপের দাঁত সহজে তোমার দেহ স্পর্শ করতে পারবে না। আমাদের হাতে থাকবে দু-দুটো রাইফেল, কাজেই ডাঙার উপর কুমিরকে পরোয়া করার দরকার হবে না। আমরা গভীর জলে সাঁতার কাটব না তেমন প্রয়োজন হলে হয়ত হাঁটু জলে নামতে পারি। ওই সময়ে অবশ্য বিপদ ঘটতে পারে, কিন্তু বিপদের ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে শিকার করা চলে না। তবে একটা কথা তুমি আমার কাছে শুনে রাখ–সাপ এবং কুমিরের চেয়ে জাগুয়ার অনেক বেশি বিপদজনক জানোয়ার। কোণঠাসা জাগুয়ার যদি তোমায় আক্রমণ করে তাহলে একটিমাত্র গুলিতেই তাকে ঘায়েল করতে হবে দ্বিতীয়বার গুলি ছোঁড়ার সুযোগ তুমি পাবে না। ঘাড়ে অথবা বুকে গুলি চার্লিয়ে যদি তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলতে না পার তাহলে আর তোমার নিস্তার নেই– উন্মত্ত জাগুয়ার তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তোমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়বে। ভেনেজুয়েলায় শিকার করতে গিয়ে কয়েকজন জাগুয়ার শিকারির দুর্দশা আমি নিজের চোখে দেখেছি। অভিজ্ঞ শিকারিদের কাছে শুনেছি এই অঞ্চলের জাগুয়ারগুলি নাকি আরও হিংস্র, আরও ভয়ংকর।

ডেল-এর কথাটাকে সমর্থন জানিয়ে দুর জলার বুকে এক দানবকণ্ঠে গর্জন উঠল—

অন্ হা! অন্ হা! অন্ হা!

ডেল অস্ফুটস্বরে বললে, জাগুয়ার!

ক্লে কথা বললে না, শুধু চুপ করে শুনতে লাগল।

সেই কর্কশ ধ্বনি-তরঙ্গ স্তব্ধ হওয়ার আগেই জলার অন্য দিক থেকে ভেসে এল আর এক ভৈরব-কণ্ঠের হুঙ্কার সংগীত।

আর একটা জাগুয়ার।

ডেল ভাইয়ের পিঠে সশব্দে চপেটাঘাত করলে, শুনছ ক্লে, শুনছ? এই জলাটায় অনেকগুলো জাগুয়ার ডেরা বেঁধেছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছে এখনই রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

ক্লে বললে, ইচ্ছেটা এখন মুলতুবি রাখ। কাল সকালে যা হয় করা যাবে।

ডেল হাসল, আরে তা তো বটেই, সত্যি সত্যি কি এই অন্ধকারে জলার মধ্যে পা বাড়াব নাকি? আমি শিকার করতে এসেছি, আত্মহত্যা করতে আসিনি। চল এখন তাঁবুর মধ্যে– চটপট খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়া যাক। কাল সকালে জাগুয়ারের পিছনে ছুটতে হবে।

…অন্ধকারের কালো যবনিকা ভেদ করে উঁকি দিল ঊষার আলোকধারা, গাছে গাছে কলরব করে পাখির দল বন্দনা জানাল সূর্যকে।

দিনের আলোয় জলাভূমিকে খুব বেশি ভয়ানক মনে হল না। জলাশয়গুলিতে কোনো অশুভ বিভীষিকার ইঙ্গিত নেই। বল্লমের ফলার মতো পাতা ছড়িয়ে অদ্ভুত জাতের যে-সব গাছ দাঁড়িয়ে আছে, তাদের উপর থেকে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিচিত্র বর্ণের বিভিন্ন পক্ষী। সমস্ত পরিবেশ অত্যন্ত শান্ত ও মধুর।

সুর্যের তেজ খুব বেশি প্রখর হওয়ার আগেই শিকারিদের কুকুরগুলো একটা জাগুয়ারকে কোণঠাসা করে ঘিরে ধরলে।

শিকারিরা তার ফোটো তুলল, তারপর দু-দুটো রাইফেল গর্জে উঠতেই জাগুয়ারের প্রাণহীন দেহ মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।

সমস্ত ব্যাপারটা মনে হল ছেলেখেলার মতোই সহজ।

ক্লে বড়ো ভাইকে বিদ্রূপ করে হেসে উঠল, এই নাকি তোমার সাংঘাতিক জানোয়ারের নমুনা? এ তো দেখছি হরিণ-শিকারের মতোই সহজ!

ডেল গম্ভীর স্বরে বললে, দাঁড়াও, এই তো সবে শুরু, এখনও দুপুর হয়নি। রাত্রি পর্যন্ত যদি তোমার মুখের হাসি বজায় থাকে তাহলে বুঝব তুমি বাহাদুর শিকারি। প্রত্যেকবারই যে আমাদের ভাগ্য প্রসন্ন হবে এমন আশা করো না। তাছাড়া এই জন্তুটা স্ত্রী-জাতীয় পুরুষ জাগুয়ার এত সহজে পরাজয় স্বীকার করে না।

ক্লে কোনো মন্তব্য করল না বটে, কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হল ভাইয়ের কথা সে বিশ্বাস করতে রাজি নয়।

সারা দুপুরের মধ্যে শিকারিরা আর একটিও জাগুয়ারের সন্ধান পেল না। কুকুরগুলি এদিক সেদিক ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ল।

ডেল লী তখন এক নতুন কৌশল অবলম্বন করলে। ভেনেজুয়েলায় থাকতে সে জাগুয়ারের শব্দ অনুকরণ করতে শিখেছিল। এবার সেই কায়দাটা সে কাজে লাগাতে চাইল।

একটা ফাঁপা গোরুর শিং-এ মুখ লাগিয়ে ডেল মাটির উপর ঝুঁকে পড়ল। পরমুহূর্তেই তার মুখ থেকে ঠিক জাগুয়ারের গর্জনের মতো আওয়াজ শোনা গেল।

তাঁবুর পিছনে একটা হ্রদের পাশ থেকে তৎক্ষণাৎ দুটো জাগুয়ার গর্জে উঠল। দুর পাহাড়ের নীচে আর-একটা জলাশয়ের বুক থেকে ভেসে এল তৃতীয় কণ্ঠের হুঙ্কারধ্বনি।

নকল জাগুয়ারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গর্জে উঠেছে তিন-তিনটে আসল জাগুয়ার।

শিকারিরা বুঝতে পারল শব্দ অনুসরণ করে হানা দিলে কাল সকালেই জাগুয়ারের পায়ের দাগ চোখে পড়বে। দিনের আলো প্রায় নিভে এসেছে, এমন সময়ে নেহাৎ মূর্খ এবং উন্মাদ ছাড়া কেউ জাগুয়ারের পিছনে তাড়া করে না। অতএব সকালের জন্য অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের

সকাল হল।

আজকের অভিযানের জন্য শিকারিরা দলের ভিতর থেকে বেছে নিল কয়েকটা হাউন্ড-জাতীয় কুকুর। এই জন্তুগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং শিকারের রক্তাক্ত খেলায় তারা প্রত্যেকেই ওস্তাদ খেলোয়াড়।

দলের অন্যান্য কুকুরগুলিকে তাঁবুর মধ্যে বেঁধে রেখে শুধু বাছাইকরা জন্তুগুলিকে নিয়ে দুই ভাই একটা ছোটো পাহাড়ি নদীর বাঁক ধরে যাত্রা শুরু করলে। তাঁবুর মধ্যে বাঁধা কুকুরগুলো তারস্বরে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাতে লাগল, কিন্তু শিকারিরা তাদের অভিযোগে কর্ণপাত করলে না।

যে কুকুরগুলোকে শিকারিরা সঙ্গে নিয়েছিল তারা হঠাৎ খাঁড়ির জলে নামল। এই জায়গাগুলো বিষাক্ত মোকাসিন সাপের আড্ডা– সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে ক্লে এবং ডেল জলে নেমে পড়ল।

হাঁটু পর্যন্ত জল, কিন্তু খাড়িটা গভীর না হলেও বেশ চওড়া।

খাঁড়ি পার হয়ে কুকুরগুলো হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল। শিকারিরা বুঝল ওরা জাগুয়ারের গন্ধ পেয়েছে। দলের মধ্যে যে কুকুরটার নাম বাদামি চোখ, তাকে সঙ্গে নিয়ে ডেল এগিয়ে গেল।

কুকুরগুলো এখন ভীষণ উত্তেজিত, বারবার টানে মেরে শিকারিদের হাত থেকে শিকল ছিনিয়ে নিতে চাইছে।

বাদামি চোখ হঠাৎ খাঁড়িটাকে পিছনে ফেলে বাঁ দিকে ঘুরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডেলও সেইদিকে ঘুরল; সে জানত তার কুকুর কখনো ভুল করবে না। ডেল-এর অনুমান নির্ভুল একটু পরেই তারা একটা জাগুয়ারের পায়ের চিহ্ন দেখতে পেল।

ডেল লী ঝানু শিকারি; পদচিহ্ন পরীক্ষা করে দেখে সে বুঝতে পারল এটা একটা পুরুষ জাগুয়ারের পায়ের ছাপ।

ক্লের দিকে তাকিয়ে সে বললে, অন্য কুকুরগুলিকে এখানে নিয়ে এস।

বাদামি চোখ আগেই জাগুয়ারের গায়ের গন্ধ পেয়েছিল।

অন্য কুকুরগুলো এখানে এসেই চঞ্চল হয়ে উঠল। চিৎকার করে, লাফিয়ে তারা গলার শিকল ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম করলে।

শিকারিরা এবার কুকুরগুলোর গলা থেকে শিকল খুলে নিল।

সঙ্গেসঙ্গে জন্তুগুলো খাঁড়ির বাঁক ধরে ছুটতে শুরু করলে।

দুই ভাই বুঝল জাগুয়ার কিছুক্ষণ আগে এখানেই ছিল, কারণ কুকুরগুলো মাথা নিচু করে মাটিতে শত্রুর গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করেনি, শূন্যে মাথা তুলে তারা দ্রুত ছুটে চলেছে। অর্থাৎ এখনো বাতাসে জাগুয়ারের গায়ের গন্ধ লেগে আছে।

ডেল ছোটো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল, আর বেশিক্ষণ নয়। দশ মিনিটের মধ্যেই ওই ছাপ-মারা বিড়ালটাকে আমরা ধরে ফেলব।

.

..দুর থেকে কুকুরের তীব্র চিৎকার শোনা গেল।

কিছুক্ষণ পরে সেই শব্দ থেমে গেল। শিকারিরা পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলে এই নীরবতার কারণ কী?

আবার শুরু হল ককরের চিৎকার।

শিকারিরা তখন কাদা আর জঙ্গল ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ কুকুরগুলির গলার আওয়াজ বদলে গেল। সে কি উৎকট শব্দ! ভাষা দিয়ে সেই বীভৎস স্বর-লহরীর বর্ণনা দেওয়া যায় না- রুদ্ধ আক্রোশের প্রচণ্ড আস্ফালনে যেন কুকুরগুলো সমস্ত দুনিয়াটাকেই ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে।

ডেল চিৎকার করে উঠল, ওরা জাগুয়ারকে ঘিরে ধরেছে! ক্লে, হাঁ করে কী দেখছ? তাড়াতাড়ি চল, তাড়াতাড়ি চল!

কিন্তু তাড়াতাড়ি চল বললেই কি তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়?

বল্লমের ফলার মতো শক্ত গাছের পাতা আর অজস্র গাছের সরু সরু ডালপালা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছে। সেই অসংখ্য উদ্ভিদের ব্যুহ ভেদ করে এগিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। সবচেয়ে বিশ্রী হচ্ছে ম্যানগ্রোভ গাছের ঝোঁপগুলি। এগুলো বুক পর্যন্ত উঁচু অর্থাৎ উপর দিয়ে ডিঙিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, আবার তলা দিয়ে নিচু হয়ে যাওয়াও সম্ভব না।

ডেল কিন্তু অসাধ্য সাধন করলে।

মাথার উপর রাইফেল তুলে ধরে ঘন উদ্ভিদের বেড়াজাল ছিঁড়ে সে পাগলের মতো শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল।

একটা পূর্ণবয়স্ক জাগুয়ার যদি কুকুরের দলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে কুকুরগুলোর কি অবস্থা হতে পারে ডেল তা জানে। তার পোষা জন্তুগুলোর শোচনীয় দুর্দশার কথা কল্পনা করে ডেল মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

ভাইকে পিছনে ফেলে, উদ্ভিদের দুর্ভেদ্য ফাঁদ ছিঁড়ে ডেল ছুটল শব্দ লক্ষ্য করে…

ক্লে অতি কষ্টে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। সারমেয় কণ্ঠের হিংস্র গর্জন শুনে সে বুঝতে পারলে লড়াইটা খুব জোর চলছে। কিন্তু শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণ নীরব- শুধু মাঝে মাঝে দু-একটা কুকুর তীব্র আর্তনাদ করে জানিয়ে দিচ্ছে, প্রতিপক্ষ নীরব হলেও নিশ্চেষ্ট নয়।

ছপ-ছপ-ছপাস!

হঠাৎ শিকারিদের কানে এল জলের আলোড়নধ্বনি- জাগুয়ার বোধহয় ডাঙা ছেড়ে জলের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে।

মিনিট দশেক বাদে লড়াইয়ের শব্দ অনুসরণ করে ক্লে আর একটা জলাশয়ের ধারে এসে দাঁড়াল। সামনের দিকে তাকিয়ে ডেল তার আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে এবং কুকুরগুলো হ্রদের তীরবর্তী অগভীর জলে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে। তীর থেকে একটু দূরে গভীর জলের দিকে ভেসে যাচ্ছে আর একটা কুকুরের দেহ; তার কাঁধের উপর থেকে উদর অবধি নেমে এসেছে একটা দীর্ঘ রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।

হ্রদের ঘোলাটে-হলুদ জলের উপর বৃত্তের আকারে ছড়িয়ে পড়ছে লাল রক্তের আলপনা। কুকুরটা দুর্বলভাবে পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটতে চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু তার মাথা এখনই জলের উপর ঝুঁকে পড়েছে।

ব্যাঞ্জো ওটাকে থামাতে চেষ্টা করেছিল, ডেল শান্ত স্বরে বললে, সেইজন্যেই ওর এই দুর্দশা।

হ্রদের অপরদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ডেল আবার বললে, জাগুয়ার ওইদিকে পালিয়েছে।

অন্যান্য কুকুরগুলি তখনও চিৎকার করছে। খুব সম্ভব পলাতক জাগুয়ারকে তারা সারমেয়-ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে।

শিকারি দুজন এবার হ্রদের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে। হ্রদটা যেমন প্রশস্ত তেমনি গভীর। হ্রদের বিপরীত দিকে পৌঁছতে হলে খাড়ি এবং অন্যান্য জলাশয়ের ধার দিয়ে অন্তত ঘন্টাখানেক হাঁটতে হবে। অবসন্ন দেহ মন নিয়ে জাগুয়ারের পিছনে তাড়া করার উৎসাহ শিকারিদের ছিল না। প্রিয় হাউন্ডের মৃত্যুতে দুই ভাই খুব মুষড়ে পড়েছিল।

ডেল-এর দুঃখই বেশি, কারণ ব্যাঞ্জো তার নিজস্ব কুকুর। শিকারের বিপদজনক খেলায় ব্যাঞ্জো ছিল একটি পাকা খেলোয়াড় এবং তার দক্ষতার পিছনে আছে শিকারিদের বহু বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ধৈর্যের ইতিহাস। এই ধরনের একটা শিক্ষিত কুকুরের দাম প্রায় ১০০০ ডলার। কিন্তু টাকাটাই একমাত্র প্রশ্ন নয়, প্রায় একশোটা শিকার অভিযানে ব্যাঞ্জো ছিল দুই ভাইয়ের সঙ্গী ও বন্ধু।

সেদিন রাত্রে তাঁবুতে ফিরে ডেল গোরুর শিং-এর শিঙা বার করলে। শিঙাটাকে মাটির খুব কাছে নামিয়ে ধরে শিঙায় মুখ লাগিয়ে ডেল গর্জন করে উঠল।

অবিকল জাগুয়ারের কণ্ঠস্বর।

গম্ভীর হুঙ্কারধ্বনিতে সাড়া এল হ্রদের অপর দিক থেকে, ব্যাঞ্জোর হত্যাকারী এখনও সেখানেই আছে।

আরও দু-একটা জাগুয়ার শিঙার ডাকে সাড়া দিয়ে গর্জে উঠল। কিন্তু ডেল সেদিকে কর্ণপাত করলে না।

হ্রদের উলটো দিকে আছে ব্যাঞ্জোর হত্যাকারী- ডেল চায় শুধু তাকেই।

ডেল এবং ক্লে-র কুকুর-বাহিনীতে ছিল প্রায় কুড়িটা শক্তিশালী হাউন্ড। সমস্ত দলটাকে নিয়ে তারা শিকার অভিযানে যাত্রা করলে। এই বিপুল সারমেয় বাহিনীর কবল থেকে বোধহয় কোনো জাগুয়ারই আত্মরক্ষা করতে পারবে না। উপরন্তু তাদের সঙ্গী হল আরও দু-জন স্থানীয় শিকারি অর্থাৎ আয়োজনের আর কোনো ত্রুটি রইল না।

পূর্ব বার্ণিত খাঁড়ির মধ্য দিয়ে জল, জঙ্গল এবং প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা ভেঙে শুরু হল শিকার অভিযান।

ডেল ভেবেছিল হ্রদটাকে সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করার আগে পলাতকের সন্ধান পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্রায় অর্ধেক পথ যেতে না যেতেই তাদের চোখে পড়ল জাগুয়ারের পায়ের দাগ। ডেল-এর অভিজ্ঞ চক্ষু এক নজরেই বুঝতে পারলে, এই পদচিহ্নের মালিক হচ্ছে ব্যাঞ্জোর হত্যাকারী।

পদচিহ্নের কাছাকাছি এসেই কুকুরগুলো সমস্বরে চিৎকার করে জানিয়ে দিল তারা শিকারের গায়ের গন্ধ পেয়েছে। ডেল তৎক্ষণাৎ কুকুরগুলোর গলার শিকল খুলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বিপুল সারমেয় বাহিনী চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। এবারেও দলের নেতৃত্বের ভার নিল বাদামি চোখ নামধারী কুকুরটি– আগের দিনের অভিযানে যে ছিল দলের নেতা।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সারমেয় কণ্ঠের উল্লাসধ্বনি শিকারিদের জানিয়ে দিল, জাগুয়ার আবার কোণঠাসা হয়েছে।

যে-দিক থেকে কুকুরের চিৎকার ভেসে আসছিল শিকারিরা সেইদিক লক্ষ্য করে দ্রুত পা চার্লিয়ে দিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শিকারিদের চোখে পড়ল, একটা ছোটো গাছের ডালের উপর গুঁড়ি মেরে জাগুয়ার বসে আছে। মুখব্যাদান করে নীচে পাহারা দিচ্ছে দন্ত-ভয়াল সারমেয়-বাহিনী, অতএব জাগুয়ারের নীচে নামার উপায় নেই।

ক্লে এবং ডেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জন্তুটাকে নিরীক্ষণ করলে।

সঙ্গেসঙ্গে তাদের মুখে ফুটল হতাশার অভিব্যক্তি। স্থানীয় শিকারিদের দিকে তাকিয়ে ডেল নিরাশ স্বরে বললে, এটা আমাদের আসামী নয়। তাছাড়া এটা মাদি জানোয়ার।

জাগুয়ারটার দেহ-সৌষ্ঠব কিন্তু চমৎকার।

কমলা-হলুদ জমির উপর কালো কালো বুটিদার চামড়ায় ঢাকা দেহটি যেন শক্তি ও সৌন্দর্যের আধার।

ক্যামেরা বাগিয়ে ধরে ডেল জন্তুটার ফোটো তুলল। তারপর স্থানীয় শিকারিদের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলে। একজন শিকারি এগিয়ে এসে গুলি ছুড়ল।

পরক্ষণেই বৃক্ষশাখা থেকে সশব্দে ভূমিপৃষ্ঠে লম্বমান হল জাগুয়ারের প্রাণহীন দেহ।

সেদিন আর উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটল না।

.

দু-দিন পরের কথা।

জলাভূমির শেষ প্রান্তে অবস্থিত পর্বতশ্রেণির নীচে আর একটা জাগুয়ার কুকুর বাহিনীর বেড়াজালে ধরা পড়ে প্রাণ বিসর্জন দিল।

এই জন্তুটা পুরুষ জাতীয়, তবে ব্যাঞ্জোর হত্যাকারী পলাতক জাগুয়ারটার তুলনায় নেহাত বাচ্চা।

পর-পর দুটো জাগুয়ারকে হত্যা করলেও শিকারিরা ব্যাঞ্জোর হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করতে পারলে না। ডেল-এর মাথায় খুন চড়ে গেল। গাড়ি চলার রাস্তা ধরে সে এগিয়ে গেল এবং স্থানীয় অধিবাসীদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে জোগাড় করে ফেলল একটা ভাঙা-চোরা ক্যানো নৌকা।

জলার বুকে এই ক্যানো বেয়ে চলাফেরা করতে খুব সুবিধা। এইসব ছোটো-ছোটো নৌকাতে লগি থাকে না, শুধু একখানা দাঁড়ের সাহায্যে চালাতে হয়।

ডেল স্থির করেছিল এই ক্যানোতে চড়েই তারা পলাতক আসামীকে গ্রেপ্তার করবে।

ফেরার সময়ে ডেল এবং কে মাটিতে পদার্পণ করলে না– ক্যানোটাকে জলার উপর নামিয়ে তাতে উঠে বসল। নৌকাটার অবস্থা অবশ্য খুব ভালো নয়, কিন্তু নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো- অতএব সেই ভাঙাচোরা ক্যানোটায় উঠে একখানা মাত্র বৈঠা সম্বল করে দু-ভাই জলার বুকে ভেসে পড়ল।

.

সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ।

কিন্তু কালো রাত্রির অন্ধকার আজ মানুষের দৃষ্টিকে অন্ধকার করে দিতে পারবে না। কারণ, আকাশের পটভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করেছেন শুভ্রকান্তি চন্দ্রদেব, হ্রদের জলে ছড়িয়ে পড়ছে রুপালি জ্যোৎস্নার আলোকধারা।

এমন চাঁদের আলোতে নৌকার উপর বসে জলবিহার করলে যে-কোনো মানুষেরই গান গাইতে ইচ্ছে করে।

ক্লে গুনগুন করে গান ধরলে।

কিন্তু ডেল একেবারেই কাষ্ঠরসিক– এক ধমকে কে-র গান থামিয়ে দিয়ে সে কাঁধে আটকানো চামড়ার ফিতেটা খুলে ফেলল। পরমুহূর্তেই তার হাতের মুঠোতে দেখা দিল সেই বিখ্যাত গোরুর শিং।

ক্লে আশ্চর্য হয়ে বললে, তুমি কি আবার শিঙা বাজিয়ে জাগুয়ারকে ডাকবে?

ডেল মাথা নেড়ে বললে, আলবৎ! জাগুয়ার যদি কাছাকাছি থাকে তাহলে নিশ্চয় সাড়া দেবে। আমাদের ভাগ্য যদি প্রসন্ন থাকে তাহলে হয়ত জন্তুটা জলার ধারে হাজিরা দিতেও পারে। আজ চমৎকার জ্যোৎস্না আছে- একবার রাইফেলের নাগালের মধ্যে এলে হতভাগা আর পালাতে পারবে না। শয়তানটা আমাদের অনেক ভুগিয়েছে!

ডেল শিঙায় মুখ দিল।

জলার বুকে জাগল জাগুয়ারের গর্জন। সেই নকল গর্জনের প্রতিধ্বনি শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই একটা অকৃত্রিম কণ্ঠের গম্ভীর হুঙ্কার শোনা গেল।

হ্রদের বিপরীত দিক থেকে আসল জাগুয়ার তার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।

বুঝলে ক্লে, ডেল ফিসফিস করে বললে, এটাই আমাদের আসামী। আমি ওর গলার আওয়াজ চিনতে পেরেছি।

ডেল ভুল করেনি, ওই ভাঙা-ভাঙা কর্কশ গর্জিত কণ্ঠ কে-র কাছেও অপরিচিত নয়।

বিগত কয়েকদিনের মধ্যে বহুবার তারা জন্তুটার কণ্ঠস্বর শুনেছে। ক্লে ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ভাইকে ইঙ্গিত করলে, চুপ করো।

শিঙায় মুখ লাগিয়ে ডেল আবার গর্জন করলে।

এবার খুব কাছ থেকে উত্তর এল।

জাগুয়ারের গর্জন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। কিন্তু তার গলায় আওয়াজ খুব চাপা এবং অস্পষ্ট।

ক্লে সবিস্ময়ে বললে, জস্তুটা বোধহয় জলে নেমে সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে।

ডেল বললে, আমারও তাই মনে হয়। জাগুয়ারের গলার আওয়াজ জলের মধ্যে অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

জলার উপরিভাগে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দুই শিকারি নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ নৌকার খুব কাছেই একটা গোলাকার বস্তু শিকারিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে।

হ্যাঁ, জাগুয়ার।

সচল গোলাকার বস্তুটি আর কিছু নয়- জাগুয়ারের ভাসমান মুণ্ড। জন্তুটা জলার বুকে সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে শিকারিদের দিকে। চাঁদের আলোয় তার মাথাটা দেখাচ্ছে মস্ত হাঁড়ির মতো। জাগুয়ার আরও কাছে এগিয়ে এল কাছে, কাছে, আরও কাছে…

খুব কাছে এসে পড়েছে জাগুয়ার। তার মুণ্ড ও ভাসমান পৃষ্ঠদেশের উপর কালো কালো ছাপগুলি এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

জাগুয়ার গর্জন করে উঠল– অন্ধকার মুখ-গহ্বরের আড়াল থেকে উঁকি দিল ছুরিকা-শুভ্র করাল দন্তের সারি।

ঠিক সেই চমর মুহূর্তে শিকারিরা তাদের ভুল বুঝতে পারলে।

তাদের সঙ্গে এখন কোনো অস্ত্র নেই।

দুটো রাইফেলই তারা তাবুতে ফেলে এসেছে, এমনকি যে পিস্তলটা সব সময় ডেল-এর কাছে থাকে সেটাকেও সে সঙ্গে আনতে ভুলে গেছে।

মারাত্মক ভুল!

এমন ভুল তাদের কখনো হয় না। কিন্তু আজ তারা শিকারের জন্য প্রস্তুত ছিল না শুধু নৌকাটাকে জোগাড় করার জন্যেই স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে তারা দরবার করতে এসেছিল।

এখন আর কোনো উপায় নেই।

ভরসার মধ্যে আছে ক্লে-র হাতে নৌকার একখানা বৈঠা বা দাঁড়। সেই দাঁড়টাকেই মুগুরের মতো বাগিয়ে ধরে ক্লে প্রস্তুত হল।

নিজের অস্ত্রের উপর ক্লের বিশেষ ভরসা ছিল না। ওই নড়বড়ে কাষ্ঠদণ্ডের আঘাতে জাগুয়ারের মতো বলিষ্ঠ পশুর কী ক্ষতি হবে?

ক্লে-র মনে পড়ল ব্যাঞ্জোর কথা।

জলের উপর ভাসমান অবস্থায় ছটফট করছে একটা আহত কুকুর, তার কাঁধ থেকে পেট পর্যন্ত নেমে এসেছে একটা রক্তাক্ত ক্ষতরেখা।–ব্যাঞ্জো! ক্লে শিউরে উঠল।

জাগুয়ার যদি ক্যানোর উপরে হানা দেয় তবে ভাঙা-চোরা ক্যানো নির্ঘাত উলটে যাবে। জলের মধ্যে ওই বিপুলবপু মার্জারের কবলে পড়লে তাদের দশা হবে ব্যাঞ্জোর মতোই। যে জানোয়ার একটা শক্তিশালী হাউন্ডকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে, মানুষ তো তার কাছে নস্যি–

ক্লে শিউরে উঠল।

জাগুয়ার কিন্তু এখনও তাদের আক্রমণ করছে না। শিকারিদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে কেবল ক্যানোর চারপাশে সাঁতার কেটে চক্রাকারে ঘুরছে আর ঘুরছে চাঁদের আলোয় তার সবুজ চোখ দুটো জ্বলে জ্বলে উঠছে দু-টুকরো মরকত-মণির মতো।

দারুণ আতঙ্কে হঠাৎ ক্লে-র কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল তীব্র আর্তধ্বনি। তৎক্ষণাৎ ক্লে-র সঙ্গে গলা মিলেয়ে চিৎকার করে উঠল ডেল।

জ্বলন্ত চক্ষু মেলে জাগুয়ার একবার দু-ভাইকে পর্যবেক্ষণ করলে।

সে যেন শত্রুদের ভালো করে চিনে নিতে চাইছে।

শুধু কয়েকটি মুহূর্তের জন্য জন্তুটা জলের উপর স্থির হয়ে ভেসে রইল। তারপর খুব নির্লিপ্তভাবে সাঁতার কেটে একবার ক্যানোটাকে প্রদক্ষিণ করে আবার তেমনি অলস মন্থর গতিতে সে হ্রদের দূরবর্তী তীর লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল।

একটু পরেই হ্রদের অপর পারে গাছপালার ছায়ামাখা ঘন অন্ধকারের মধ্যে সেই বিপুলবপু মার্জারের দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল।

ক্লে আর একটুও দেরি করল না, প্রাণপণে বৈঠা টেনে সে ক্যানোটাকে তাবুর দিকে চার্লিয়ে দিল…

সেদিন রাত্রে তাঁবুর মধ্যে নৈশভোজের আসরে তর্কের ঝড় উঠল। জাগুয়ারের অদ্ভুত আচরণ কারোরই ভালো লাগেনি। যে জানোয়ার কুম্ভীর-সঙ্কুল জলার বুকে নির্ভয়ে সাঁতার কাটতে পারে এবং মানুষ দেখে যে না পালিয়ে কাছে এগিয়ে আসতে চায়, তাকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ- এই হচ্ছে ক্লে-র অভিমত।

স্থানীয় শিকারিরা তাকে সমর্থন করলে।

শিকারিদের ভোট পেয়ে ক্লে উৎসাহিত হয়ে উঠল।

সে জানিয়ে দিল এই গুণ্ডা জাগুয়ারটার পিছনে তাড়া করার ইচ্ছে তার নেই।

ক্লে-র যুক্তি হচ্ছে, এই বেপরোয়া জন্তুটাকে যখন হাউন্ডগুলো ঘেরাও করবে তখন সে নিশ্চয়ই রুখে দাঁড়াবে সেক্ষেত্রে কয়েকটি মূল্যবান কুকুরের মৃত্যু অবধারিত। এত ঝামেলার দরকার কী? সিনেগা গ্র্যান্ডি অঞ্চলে জাগুয়ারের অভাব নেই- ওই শয়তান জানোয়ারটাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য জাগুয়ারের পিছু নিলে অনেক সহজেই তারা সাফল্য অর্জন করতে পারবে।

ক্লে-র যুক্তি অকাট্য।

স্থানীয় শিকারিরা এবারও ক্লে-র মতে মত দিল।

কিন্তু ডেল নাছোড়বান্দা, কারো কথায় সে কর্ণপাত করতে রাজি নয়; ওই সাঁতার কাটা হুলোবিড়ালটাকে আমি ছাড়ব না, ওকে আমি চাই! তার জন্য যদি সারা শীতকালটা এখানে কাটাতে হয় তাতেও আমার আপত্তি নেই।

ডেল একটু থামল, তারপর রুদ্ধস্বরে বললে, আমি ভুলিনি ব্যাঞ্জো কিভাবে মরেছে!

ক্লে আর তর্ক করলে না। সে বুঝলে ডেলকে নিরস্ত করা অসম্ভব।

পরের দিন সকালে ডেল সেই নড়বড়ে ক্যানোতে চারটে কুকুর নিয়ে হ্রদের অপর পারের উদ্দেশে যাত্রা করলে। এখানে ব্যাট বাধল। হ্রদের জলে যে হাঁসগুলো মনের আনন্দে জলক্রীড়া করছিল তাদের দেখে কুকুরগুলো নৌকার উপর চঞ্চল হয়ে উঠল। এই জন্তুগুলো খুব বড়ো জাতের হাউন্ড; তাদের গুরুভার দেহের নড়বড়ে ক্যানো ডোবে আর কি। প্রতি মুহূর্তে ডেল-এর ভয় করতে লাগল, এই বুঝি সবসুদ্ধ নৌকাটা জলের মধ্যে তলিয়ে যায়।

কোনো রকমে কুকুর সামলে সে ঘর্মাক্ত অবস্থায় অপর পারে পৌঁছল। দুপুরবেলার মধ্যেই ডেল আরও চারটে কুকুরকে হ্রদের অন্য ধারে পাচার করলে।

শোন ক্লে, ডেল বললে, একদল কুকুর নিয়ে আমি ওদের একদিকে থাকব, অন্যধারে আটটা কুকুর নিয়ে তুমি টহল দেবে। জাগুয়ার যে পারেই থাকুক, আমাদের মধ্যে একজন তাকে নির্ঘাত ধরে ফেলবে। যদি শয়তানটা জলে নামে তাহলেও তার নিস্তার নেই। এতগুলো শক্তিশালী হাউন্ডকে ফাঁকি দিয়ে জাগুয়ার পালাতে পারবে না।

হ্রদের দু-ধারে তাবু খাঁটিয়ে শিকারিরা সেদিন অপেক্ষা করলে।

অভিযান শুরু হল পরের দিন সকালে।

নাঃ, সকাল ঠিক নয়, বরং শেষ রাত্রি বলা চলে।

ডেল যখন তার শিঙা নিয়ে হ্রদের ধারে এসে দাঁড়াল তখনও আকাশে সূর্যদেব আত্মপ্রকাশ করেননি। তবে অন্ধকার প্রায় দূর হয়ে এসেছে, ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই।

ডেল তার শিঙায় মুখ দিলে, শেষ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ঘন ঘন বেজে উঠল নকল জাগুয়ারের নকল গর্জন।

গভীর গর্জন-ধ্বনির সঙ্গে ভাঙা ভাঙা কাসির শব্দে জাগুয়ার সাড়া দিল। আওয়াজ এল ডেল-এর উলটো দিক থেকে

অর্থাৎ হ্রদের যেদিকে ক্লে আছে জাগুয়ারটাও সেদিকের তীরেই আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকটা হাউন্ডকে ছেড়ে দিয়ে ক্লে সাগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগল।

ক্লে-র সারমেয়-বাহিনীতে যে কুকুরটা নেতৃত্ব করছিল সে হঠাৎ চিৎকার করে জানিয়ে দিল জাগুয়ারের চলাচলের রাস্তা তার অজানা নেই।

ক্লে আর দেরি করলে না, সব কুকুরগুলিকেই ছেড়ে দিল। ঝোঁপঝাড় ভেঙে কুকুরের দল তিরবেগে ছুটল। তাদের পিছু পিছু ছুটল ক্লে এবং তার সঙ্গী দু-জন স্থানীয় শিকারি।

ছুট! ছুট! ছুট!

হ্রদের পাশ দিয়ে চলে গেছে কতগুলো ছোটো-ছোটো পাহাড়ি নদী। সেই নদীগুলোর বাঁকের উপর দিয়ে শিকার তাড়িয়ে ছুটল কুকুরের দল।

জঙ্গল ভেঙে, কাদা মাড়িয়ে, খাঁড়ির অগভীর জলে ঢেউ তুলে শিকারিরা ঊর্ধ্বশ্বাসে কুকুরের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে।

দারুণ উত্তেজনায় সাপ আর কুমিরের কথা তারা খেয়ালই করলে না। সারমেয় কণ্ঠের তীব্র উল্লাসধ্বনি শুনে অভিজ্ঞ শিকারিরা বুঝতে পারল জাগুয়ার আর অদৃশ্য নেই, কুকুরগুলি তাকে দেখতে পেয়েছে…

ক্লে জাগুয়ারকে দেখতে পেল, তবু গুলি চালাবার সুযোগ হল না। কুকুরগুলি এখন তাকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু জাগুয়ার কিছুতেই এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে না সে ছুটছে আর লড়াই করছে, লড়াই করছে আর ছুটছে।

কুকুরগুলি যখনই খুব কাছে এসে পড়ে তখনই জাগুয়ার থমকে দাঁড়ায়; তার পেশিবহুল দেহ বিদ্যুদ্বেগে ঘুরতে থাকে একবার সামনে একবার পিছনে, একবার বামে একবার দক্ষিণে। দন্ত ও নখরের সেই প্রখর ঝটিকার সম্মুখীন হওয়া কুকুরের পক্ষে অসম্ভব– তারা ক্ষণিকের জন্য পিছু হটে পড়ে। মুহূর্তের সুযোগে জাগুয়ার আবার ছুট দেয়। নাছোড়বান্দা কুকুরের দল আবার তাকে তাড়া করে, আবার জাগুয়ার রুখে দাঁড়ায় এবং এই একই ঘটনার হয় পুনরাবৃত্তি।

এই ঝটাপটির মধ্যে ক্লে গুলি চালাতে সাহস করলে না, কারণ কুকুরের গায়ে গুলি লাগতে পারে। রাইফেলটা তুলে ধরে সে পিছনের শিকারি দুজনকে ইঙ্গিত করলে, তারপর ধাবমান জাগুয়ার ও কুকুরগুলির পিছনে ছুটল।

হ্রদের জল যেখানে পাশের বিরাট জলাভূমিটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ঠিক সেই জায়গায় জলের ধারে মাটির উপর মাথা তুলেছে একঝাড় ম্যানগ্রোভ গাছ।

ছুটতে ছুটতে জাগুয়ার ওই ম্যানগ্রোভ ঝোপের ভিতরে ঢুকল। কুকুরগুলি তার পিছন পিছন ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

উদ্ভিদের বেড়াজাল ভেঙে ক্লে যখন জলের ধারে উপস্থিত হল জাগুয়ার তখন আর সেখানে নেই, শুধু কিনারায় দাঁড়িয়ে পাঁচটা হাউন্ড গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।

কী হল! জাগুয়ার কি আবার ফাঁকি দিল?

ক্লে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। না, জাগুয়ার এখনও পালাতে পারেনি। জলাশয়ের অপর দিকে তীরের খুব কাছে জন্তুটা সাঁতার কাটছে, অর্থাৎ একটা সুবিধামত জায়গা দেখে সে তীরে উঠতে চায়। ক্লে শুধু তার ভাসমান মুণ্ডটা দেখতে পেল অত দূর থেকে জলের উপর শরীরের অন্য কোনো অংশ তার চোখে পড়ল না।

একটা ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড়ের উপর রাইফেল রেখে সে নিশানা স্থির করলে, তারপর ঘোড়া টিপে দিল।

ভাসমান জাগুয়ারের পিছনে প্রায় ফুট-তিনেক দূরে রাইফেলের গুলি কামড় বসাল, জলের উপর লাফিয়ে উঠল অজস্র জলকণা–

ক্লের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে।

হ্রদের বিপরীত দিকে অনুসরণের শব্দ শুনে ডেল বুঝতে পেরেছিল ক্লের কুকুর বাহিনী জাগুয়ারকে তাড়া করছে। এপার থেকে সেই শব্দের সঙ্গে সমান্তরালভাবে সে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পথের মধ্যে দুটো জলাশয় তাকে বাধা দিল। এই জলাশয় দুটো যেমন লম্বা তেমনি গভীর। অনেক খোঁজাখুঁজি এবং ঘোরাঘুরির পরে সে আবিষ্কার করলে এক জায়গায় জলের গভীরতা খুব কম, ইচ্ছে করলে হেঁটে পার হওয়া যায়।

জল ভেঙে ডেল যখন শক্ত মাটিতে পা রাখলে তখন অনুসরণের শব্দ থেমে গেছে।

হঠাৎ হ্রদের বুকে প্রতিধ্বনি তুলে গর্জে উঠল একটা রাইফেল। আওয়াজটা শুনে ডেল ভাবলে জাগুয়ার এবার নিশ্চয় মারা পড়েছে।

কিন্তু একটু পরে সে যখন কুকুরের বিভ্রান্ত চিৎকার শুনতে পেল তখনই বুঝল, মানুষের বন্দুক এবং কুকুরের দাঁতকে ফাঁকি দিয়ে জাগুয়ার আবার পালিয়েছে।

তবে, পালাবে কোথায়!

ব্যাঞ্জোর হত্যাকারীর জন্য হ্রদের দুই তীরে মরণফাঁদ সাজিয়ে রেখেছে ডেল।

হ্রদের জলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ডেল জাগুয়ারকে দেখতে পেল।

সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে প্রায় চারশো গজ দূরে জন্তুটা সাঁতার কাটছে।

ওপার থেকে তাড়া খেয়ে জাগুয়ার এপারে আশ্রয় নিতে চায়।

বুনো লতা-ঝোপের আলিঙ্গন ভেদ করে ডেল পাগলের মতো ছুটল।

জাগুয়ার তার শত্রুদের চেয়ে অনেক বেশি চালাক, অনেক বেশি চটপটে।

ডেল যথাস্থানে এসে তাকে গ্রেপ্তার করার আগেই সে জল থেকে ডাঙায় উঠে সরে পড়ল।

প্রায় মিনিট পাঁচেক বাদে কুকুর নিয়ে ডেল যেখানে এসে দাঁড়াল একটু আগেই সেখান থেকে জাগুয়ার পলায়ন করেছে।

কিন্তু মানুষকে ফাঁকি দিলেও কুকুরের ঘ্রাণশক্তিকে ফাঁকি দেওয়া যায় না।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কুকুরগুলি শত্রুর গায়ের গন্ধ পেয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ শুরু হল অনুসরণ-পর্ব।

ডেল-এর কুকুরগুলি এখন পর্যন্ত খুব বেশি ছুটোছুটি করেনি, কাজেই তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ার কোনো কারণ ছিল না। পূর্ণ উদ্যমে তারা জাগুয়ারের পিছনে ছুটল।

জাগুয়ার আর পালাতে চেষ্টা করলে না। বোধহয় সে বুঝতে পেরেছে আক্রমণই হচ্ছে আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। একটা কোপেক গাছের শিকড়ে পিঠ দিয়ে সে কোণঠাসা বিড়ালের মতো রুখে দাঁড়াল।

কুকুরের দল সামনে আসতেই সে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রক্তের নেশায় হাউন্ডগুলো খেপে রয়েছে, তারও পিছু হটল না।

অগ্রবর্তী দুটো কুকুর কিনো আর মিউজিক একেবারে জাগুয়ারের ঘাড়ের উপর এসে পড়ল।

মাত্র একটি মুহূর্ত প্রচণ্ড দংশনে মট করে ভেঙে গেল কিনোর মাথার খুলি, সনখ থাবার একটি মাত্র আঘাতে মিউজিক-এর বক্ষপঞ্জর বিদীর্ণ করে জেগে উঠল একটা রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।

দুটো কুকুরই তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করলে।

জাগুয়ার এবার অন্য কুকুরগুলির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হল…

ঘন উদ্ভিদের ফাঁক দিয়ে ডেল তার প্রিয় কুকুরদের দুর্দশা দেখতে পেল। কিন্তু সেই দুর্ভেদ্য আগাছার জঙ্গলের মধ্যে রাইফেল তুলে নিশানা করাই অসম্ভব– গুলি চালানো তো দুরের কথা।

ঝোপের শেষ বাধাটা উত্তীর্ণ করে ডেল যখন রাইফেল তুলে ধরলে তখন কুকুরগুলো আবার জাগুয়ারকে আক্রমণ করেছে।

হাতের অস্ত্র নামিয়ে ডেল সাগ্রহে দেখতে লাগল এক বন্য নাটকের হিংস্র অভিনয়।

ডেল অ্যারিজোনার অধিবাসী, আমাদের মহাভারতের সঙ্গে তার পরিচয় নেই। সে যদি মহাভারত পড়ত তাহলে নিশ্চয়ই তার সপ্তরথী-বেষ্টিত অভিমন্যর কথা মনে হত।

…জাগুয়ারকে মাঝখানে রেখে সারমেয় বাহিনী অর্ধবৃত্তাকারে এগিয়ে এল কাছে, কাছে আরও কাছে…

হিংস্র উল্লাসে কুকুরগুলো ক্রমাগত চিৎকার করছে।

জন্তুগুলোর চেহারা তখন সত্যিই ভয়ানক—

তাদের জ্বলন্ত চোখ থেকে মুছে গেছে গৃহপালিত পশুর নিরীহ অভিব্যক্তি কপিশ চক্ষুর অগ্নিময় দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে বন্য নেকড়ের ক্ষুধিত হিংসা, হত্যার উদগ্র আগ্রহে উন্মুক্ত মুখবিবরের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে নিষ্ঠুর দাঁতের সারি।

অপর পক্ষে জাগুয়ারের দেহে উত্তেজনার বিশেষ কোনো চিহ্ন নেই।

তার বজ্রকণ্ঠ সম্পূর্ণ নীরব শুধু মাটির উপর দুলে দুলে উঠছে তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল এবং থাবার নখগুলি বাইরে বেরিয়ে এসেছে কোষমুক্ত কিরিচের মতো।

ডেল রাইফেল তুলে নামিয়ে নিল, কারণ ঠিক তখনই হাউন্ডগুলো একসঙ্গে জাগুয়ারকে আক্রমণ করলে।

অস্ত্র নামিয়ে ডেল দেখতে লাগল যুদ্ধের দৃশ্য।

একটা হাউন্ড পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে জাগুয়ারের ঘাড়ে দাঁত বসাতে গেল।

জাগুয়ার নীরব হলেও নিশ্চল নয়। একটা নখরযুক্ত প্রকাণ্ড থাবা বিদ্যুৎবেগে কুকুরটার কণ্ঠ আলিঙ্গন করলে।

ডেল সবিস্ময়ে দেখল, আহত হাউন্ড মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে আর উঠল না তার বিভক্ত কণ্ঠনালী থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে তপ্ত রক্তধারা।

দারুণ আতঙ্কে কুকুরের দল ছিটকে সরে গেল। সারমেয়-বাহিনীর যোদ্ধারা এতক্ষণে বুঝেছে, এই বুটিদার বিড়াল অতি সাংঘাতিক জীব, তার সামনে গেলে মৃত্যু অবধারিত। কুকুরগুলো দূর থেকে জাগুয়ারকে লক্ষ করে জাতীয় ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলে ওই শরীরী মৃত্যুর সম্মুখীন হতে তারা রাজি নয়!

ডেল বুঝল এই তার সুযোগ, রাইফেল তুলে সে নিশানা করতে লাগল।

হঠাৎ জাগুয়ারের চোখ পড়ল ডেল-এর দিকে।

সঙ্গেসঙ্গে সে বুঝতে পারলে এই হচ্ছে তার আসল শত্রু, এই মানুষটাকে হত্যা করতে পারলেই আজকের যুদ্ধে তার জয় অনিবার্য।

জাগুয়ার খুব নিচু হয়ে বসে পড়ল, তার কান দুটো চ্যাপ্টা হয়ে মিশে গেল মাথার খুলির সঙ্গে- ডেল বুঝল জন্তুটা এবার তাকে লক্ষ্য করে লাফ মারবে।

জাগুয়ার লাফ দিল।

সঙ্গেসঙ্গে অগ্নি-উদগার করে গর্জে উঠল রাইফেল।

হাঁড়ির মতো গোল মুণ্ডটা একবার গুলির আঘাতে শিউরে উঠল, পরক্ষণেই তার প্রাণহীন দেহ অসাড় অবস্থায় লুটিয়ে পড়ল ডেল লীর পায়ের কাছে।

কুকুরগুলো এবার জাগুয়ারের জলে-ভেজা মৃতদেহটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বিক্রমে দংশন করতে লাগল।

.

এই ঘটনার পরে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বৎসর। ইতিমধ্যে লী ভাইদের রাইফেলের গুলিতে ইহলীলা সংবরণ করেছে প্রায় শ-খানেক জাগুয়ার। প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার এই বিপদজনক খেলায় লীদের ক্ষতিও হয়েছে যথেষ্ট। নিহত জন্তুগুলোর মধ্যে কয়েকটা জাগুয়ার ছিল অত্যন্ত হিংস্র ও দুর্দান্ত। রাইফেলের গুলিতে তারা মৃত্যুবরণ করেছে বটে, কিন্তু মরার আগে শিকারিদের উপহার দিয়ে গেছে অনেকগুলি মূল্যবান কুকুরের রক্তাক্ত মৃতদেহ।

শুধু তাই নয় ক্ষিপ্ত জাগুয়ারের আক্রমণে শিকারিদের জীবন বিপন্ন হয়েছে একাধিকবার।

তবে, ডেল লীর অভিমত হচ্ছে সিনেগা গ্র্যান্ডির সাঁতার কাটা জাগুয়ারটাই হচ্ছে সবচেয়ে বলিষ্ঠ, সবচেয়ে ধূর্ত, সবচেয়ে সাহসী।

মরার আগে তার লড়াইটাও হয়েছিল সত্যি দেখবার মতো।

শেরউড বনের পলাতক

০১. কালো ঘোড়ার সওয়ার

আজ থেকে বহু বৎসর আগেকার কথা। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ইংল্যান্ডের বুকে যখন প্রবল বিক্রমে শাসনকার্য চালিয়ে যাচ্ছে বিজয়ী নৰ্মান জাতি এবং তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ওই দেশেরই আদিবাসী অ্যাংলো-স্যাক্সন গোষ্ঠী- সেই সময়, অস্ত্রের শাণিত ফলকে রক্তের অক্ষরে লিখিত ইতিহাসের পটভূমিতে আমাদের কাহিনির শুরু…

গল্প আরম্ভ করার আগে তৎকালীন ইংল্যান্ডের বিষয়ে কয়েকটা কথা বলা দরকার। যখনকার কথা বলছি, সেই সময়ে ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন রিচার্ড প্ল্যান্টজেনেট ইতিহাস তাকে সিংহ-হৃদয় রিচার্ড নামে অভিহিত করেছে।

নামটা নিতান্ত বৃথা হয়নি। রিচার্ড ছিলেন সিংহের মতোই পরাক্রমশালী- যাকে বলে, পুরুষসিংহ। শোনা যায় তিনি নাকি তুলোয়ারের এক আঘাতে সওয়ার সমেত একটি ঘোড়াকে দুটুকরো করে ফেলতে পারতেন। হয়তো এটা অতিশয়োক্তি, তবে তিনি যে দেহে-মনে অসাধারণ শক্তিমান ছিলেন সে কথা ইতিহাসও স্বীকার করেছে। বিজয়ী নর্মান ও বিজিত অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতি পরস্পরকে ঘৃণা করলেও এই সাহসী রণনিপুণ নৃপতিকে তারা সকলেই শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত। কারণ, নর্মান রাজবংশে জন্মগ্রহণ করলেও রিচার্ডের কাছে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব ছিল না।

রিচার্ডের দেহের উচ্চতা ছিল ছয় ফুট চার ইঞ্চি, পরিধি ছিল দৈর্ঘ্যের অনুপাতে বিস্তৃত এবং পেশীর প্রাচুর্যে প্রচণ্ড। তার দেহ ছিল যেমন প্রকাণ্ড, অন্তঃকরণ ছিল তেমই প্রশস্ত, উদার। কয়েকটি স্বার্থান্ধ হীনচেতা মানুষ ছাড়া জাতি নির্বিশেষে সমগ্র ইংল্যান্ডবাসীর কাছে রিচার্ড ছিলেন একান্ত আপনজন, ভালোবাসার মানুষ।

কিন্তু ইংল্যান্ডবাসী তথা অ্যাংলো-স্যাক্সনদের দুর্ভাগ্য–রাজদণ্ড হাতে নিয়ে রাজ্য পরিচালনার চাইতে তরবারি হাতে রণক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনার কাজটাই ছিল রিচার্ডের কাছে অধিকতর প্রিয়। তাই যুদ্ধের সুযোগ পেলেই রাজ্য পরিচালনার ভার প্রতিনিধির হাতে দিয়ে তিনি সসৈন্যে অবতীর্ণ হতেন যুদ্ধের প্রাঙ্গণে। যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে প্যালেস্টাইনে মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের যুদ্ধ চলছিল। রিচার্ড সেই যুদ্ধে যোগদানের সংকল্প করলেন। রাজ্য পরিচালনার ভার ভ্রাতা জন-এর হাতে দিয়ে রিচার্ড সৈন্য নিয়ে চলে গেলেন প্যালেস্টাইনে এবং সেখানে উপস্থিত অন্যান্য খ্রিস্টান রাজাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধে নামলেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে।ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে ইতিহাসে খ্যাত পূর্বোক্ত যুদ্ধে রিচার্ড যে অদ্ভুত বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন, তাই নিয়ে বহু কিংবদন্তী রচিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাহিনির পটভূমি হচ্ছে ইংল্যান্ড, অতএব রিচার্ডকে প্যালেস্টাইনে রেখে আমরা ফিরে আসছি আবার ইংল্যান্ডের মাটিতে, যেখানে রিচার্ডের অবর্তমানে রাজদণ্ড ধারণ করেছেন জন।

জন ছিলেন যেমন স্বার্থপর, তেমনই খল চরিত্রের মানুষ। তার রাজত্বকালে নর্মানরা তাদের অধীন অ্যাংলো-স্যাক্সনদের উপর অত্যাচার শুরু করল। নতুন নতুন কর আর নানারকম অন্যায় দাবির দাপটে অস্থির হয়ে উঠল অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতি। ফলে, বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল কয়েকটি স্থানে। যদিও নর্ম্যানদের প্রচণ্ড তরবারি অধিকাংশ স্থানেই রক্তের স্রোতে সেই আগুনকে নিবিয়ে দিল, তবুও স্ফুলিঙ্গ একেবারে নির্বাপিত হল না। অ্যাংলো-স্যাক্সন গোষ্ঠীর ভিতর থেকে আবির্ভূত হল এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা নাম, রবিনহুড। কিছু দিনের মধ্যেই তার নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের বুকে আত্মপ্রকাশ করল এক বিদ্রোহী বাহিনী। রবিনহুডের নেতৃত্বে ওই বাহিনী সুযোগ পেলেই নম্যানদের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করত। নর্মানরা ওই বাহিনীকে দুস্য আখ্যা দিল।

বিভিন্ন অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ ওই দস্যুদল নিয়ে রবিনহুড নর্ম্যানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করল। নম্যানদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হলে রবিনহুড ও তার দুস্যদলের পরাজয় ছিল অনিবার্য। কিন্তু দস্যুরা আঘাত হানত অতর্কিতে এবং লুণ্ঠন সমাধা করেই গা-ঢাকা দিত শেরউড নামক অরণ্যের অন্তঃপুরে।

নম্যান জমিদার ও শেরিফদের মধ্যে অনেকেই বিপুল বাহিনী নিয়ে রবিনহুডকে শায়েস্তা করতে শেরউড বনের মধ্যে অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। অজানা বনপথের ভিতর দিয়ে অশ্বারোহী নর্মান সেনাদল দ্রুত চলাফেরা করতে পারত না। গাছের আড়াল থেকে নর্ম্যানদের অগোচরে তাদের উপর লক্ষ রাখত রবিনহুডের অনুচরবর্গ- তারপর সুযোগ বুঝে আক্রমণ চালাত শত্রুপক্ষের উপর। আচম্বিতে অরণ্য ভেদ করে ছুটে আসত ঝাঁকে ঝকে তির এবং ব্যাপারটা ভালোভাবে বোধগম্য হওয়ার আগেই তিরবিদ্ধ হয়ে অধিকাংশ নম্যান সৈন্য হত ধরাতলে লম্বমান। তারপর হতচকিত ও ভয়ার্ত নম্যানরা যখন পলায়নের উদ্যোগ করত, তখন তরবারি হাতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত রবিনহুড তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লড়াই শেষ হতাহত সঙ্গীদের বনের মধ্যে ফেলে রেখে নগরের দিকে পলায়ন করত হতাবশিষ্ট নর্ম্যান সৈন্য।

বারংবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পর অত্যাচারী নর্মান জমিদার, ধর্মযাজক ও শেরিফের দল সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল আর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাছা বাছা অ্যাংলো-স্যাক্সন যোদ্ধার দল এসে রবিনহুডের দলকে ভারী করে তুলল। ওই দুস্যদল শেরউড বনে সংরক্ষিত হরিণ মেরে ক্ষুধা নিবারণ করত এবং সুযোগ পেলেই ধনী নর্ম্যানদের সম্পত্তি লুঠ করত মহোৎসাহে। বার বার মার খেয়ে শেরউড বনের ভিতর নর্মানরা আর প্রবেশ করতে চাইত না, তাদের কাছে শেরউড বন হয়ে দাঁড়াল মৃত্যুপুরীর মতোই ভয়াবহ।

দেশের যখন এই অবস্থা, সেই সময়ে স্যার স্টিফেন নামে এক দুর্ধর্ষ নর্ম্যান যোদ্ধা ঘোষণা করল রবিনহুডকে সে রাজা জনের কাছে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসবে– জীবিত অবস্থায় যদি তাকে আনা সম্ভব না হয়, তবে রবিনহুডের মৃতদেহকেই সে উপস্থিত করবে রাজদরবারে।

রবিনহুড সতর্ক হল। স্যার স্টিফেন মানুষ হিসাবে খুবই খারাপ বটে, কিন্তু সে ছিল দুর্জয় যোদ্ধা।

রাজদরবারে দ্বন্দ্বযুদ্ধের যে প্রতিযোগিতা হয়, সেই প্রতিযোগিতায় পর পর ছয়বার জয়লাভ করে সে প্রমাণ করে দিয়েছিল তার সমকক্ষ যোদ্ধা রীবপ্রসবিনী ইংল্যান্ডেও নিতান্ত বিরল।

ওই ভয়ংকর যোদ্ধাকে উপযুক্ত অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত হল রবিনহুড ও তার দস্যুদল, আয়োজনের কোনো ত্রুটি রইল না। স্যার স্টিফেনের নেতৃত্বে বিরাট নমানবাহিনী শেরউড বনে ঢুকে অনুসন্ধান শুরু করল। খুব বেশিদিন খোঁজাখুঁজি করবার দরকার হল না; হঠাৎ একদিন বনের আড়াল থেকে ঝক ঝক তির এসে কয়েক জন নর্মান সেনাকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। নম্যান তিরন্দাজরাও ধনুর্বাণ ব্যবহার করতে লাগল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের লক্ষ্য হল ব্যর্থ। স্যার স্টিফেনের মৃত্যু ছিল অবধারিত শুধু উৎকৃষ্ট স্প্যানিশ বর্মের কল্যাণেই পূর্বোক্ত যোদ্ধা সেবার বেঁচে গেল। দস্যুদের তির ওই স্পেনদেশীয় বর্মের কঠিন আবরণ ভেদ করে স্যার স্টিফেনের দেহ স্পর্শ করতে পারল না।

ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ন্ত তিরের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নর্ম্যান সৈন্যরা হয়তো দিশাহারা হয়ে ছুটতে শুরু করত, আর তাহলেই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দস্যুদল তাদের কচুকাটা করে ফেলতে পারত অনায়াসে। কিন্তু স্যার স্টিফেনের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব নর্ম্যান সেনাদের ছত্রভঙ্গ হতে দিল না– শৃঙ্খলা বজায় রেখে তির ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা পিছিয়ে যেতে শুরু করল..

কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর বনের ভিতর একটা বিধ্বস্ত দুর্গের কাছে এসে পড়ল স্যার স্টিফেন ও তার সৈন্যদল। এক সময় ওই দুর্গটি জনৈক অ্যাংলো-স্যাক্সন জমিদারের অধিকারভুক্ত ছিল। উক্ত জমিদারের মৃত্যু হয়েছিল স্যার স্টিফেনেরই হাতে। হত্যাকাণ্ড সমাধা করে দুর্গটিতে আগুন ধরিয়ে স্যার স্টিফেন স্থানত্যাগ করেছিল। অর্ধদগ্ধ ভগ্নাবশেষ তখনও বিরাজ করছিল শেরউড বনের মধ্যে। দুস্যদের আক্রমণের মুখে পিছিয়ে যেতে যেতে সেই দুর্গটির সামনে এসে পড়ল স্যার স্টিফেন।

স্যার স্টিফেন অভিজ্ঞ যোদ্ধা- এক নজর দেখেই সে বুঝল দুর্গের প্রাচীর দুই-এক জায়গায় ভেঙে গেছে বটে, তবু সেখানে আশ্রয় নিলে দুস্যদের কবল থেকে সহজেই আত্মরক্ষা করা যাবে। দুর্গ-প্রাকার ও পাষাণ-স্তম্ভের সারি দস্যুদের নিক্ষিপ্ত তিরগুলিকে বিফল করে দেবে, কিন্তু দুর্গ আক্রমণ করতে গেলে সামনের ফাঁকা মাঠের উপর দস্যুরা নর্ম্যান তিরন্দাজদের তিরের মুখে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। অবশ্য দুর্গের ভিতর বেশি দিন আটকে থাকলে খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে সৈন্যরা বিপন্ন হয়ে পড়বে কিন্তু সে তো পরের কথা, এখন প্রাণ বাঁচাতে হলে ওই দুর্গই হচ্ছে একমাত্র আশ্রয়। স্যার স্টিফেন ভেবে দেখল সৈন্যদের সঙ্গে যে খাদ্য ও পানীয় আনা হয়েছে, তাই দিয়ে এখন বেশ কিছুদিন চলবে, পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। অতএব, স্যার স্টিফেন সৈন্য নিয়ে দুর্গের ভিতর প্রবেশ করার উদ্যোগ করল।

রবিনহুড বুঝল স্যার স্টিফেনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে নর্ম্যান-সেনা নাগালের বাইরে চলে যাবে– সে তাড়াতাড়ি দলবল নিয়ে নর্ম্যানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল; অধিনায়কের নির্দেশে দুস্যরা ধনুর্বান ছেড়ে তরবারি হাতে অবতীর্ণ হল সম্মুখযুদ্ধে।

কিন্তু নানদের বাধা দেওয়া গেল না। তারা বুঝেছিল ওই দুর্গই এখন তাদের প্রাণ বাঁচাতে পারে। প্রাণপণে যুদ্ধ করতে করতে তারা দুর্গের ভিতর ঢুকে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল সিংহদ্বার এবং দুর্গের ভিতর থেকে ছুটে এল এক ঝাক তির দুস্যদের লক্ষ্য করে। হতাহত সঙ্গীদের নিয়ে দুস্যরা আবার বনের আড়ালে গা-ঢাকা দিল। তারপর নজর রাখতে লাগল দুর্গের উপর। দুর্গের চুড়া ও প্রাকার থেকে নান-সৈন্যরাও চারদিকে নজর রাখছিল। বাইরে অরণ্যগর্ভে আত্মগোপন করে দস্যুদলও বসে ছিল অতন্দ্র প্রহরায়। রবিনহুড জানত কিছুদিন পরেই নর্ম্যানদের খাদ্যাভাব ঘটবে, তখন হয় তারা অনশনে মৃত্যুবরণ করবে আর নয়তো বেরিয়ে এসে যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে। সুতরাং দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকলেই দুস্যদের জয় অনিবার্য।

দুর্গ অবরোধ করে দস্যুরা খুব উল্লসিত হয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু আর একটা ভয়ংকর সম্ভাবনা সম্পর্কে রবিনহুড ছিল অতিশয় সচেতন– কোনো রকমে স্যার স্টিফেনের বিপদের খবর যদি বনের বাইরে নর্ম্যানদের কানে যায়, তাহলে তারা সৈন্যসামন্ত নিয়ে শেরউড বনে হানা দিতে পারে। সেরকম ঘটনা ঘটলে স্যার স্টিফেন তো মুক্তি পাবেই, উপরন্তু দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে দস্যুদের অবস্থা হবে শোচনীয়। অতএব, রবিনহুডের নির্দেশে বিভিন্ন অধিনায়কের নেতৃত্বে ছোটো-ছোটো দল বনের প্রবেশপথগুলির উপর ঘুরে ঘুরে নজর রাখতে লাগল..

দুর্গ অবরোদের পর প্রায় পনেরো দিন কাটল নিরুপদ্রবে। দুর্গের ভিতর থেকে নর্ম্যান-সেনা এবং বনের আড়াল থেকে দস্যুদল পরস্পরের উপর নজর রাখছে- কিন্তু কোনো পক্ষই এগিয়ে এসে তিরের মুখে আত্মপ্রকাশ করতে রাজি নয়। ঝড়ের আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত রূপ ধারণ করে তেমনই এক ভয়ংকর স্তব্ধতা বিরাজ করছে শেরউড বনের বুকে…।

একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসে রবিনহুড চিন্তা করছিল নিবিষ্ট চিত্তে অকস্মাৎ বনপথ ভেদ করে সম্মুখে আবির্ভূত হল তারই অনুগত তিন দুস্যনেতা ও এক অশ্বারোহী নর্মান যোদ্ধা।

এখানে উল্লিখিত তিন দস্যুনেতার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া দরকার। দস্যু তিনটির নাম লিটল জন, উইল স্কারলেট এবং ফ্রায়ার টাক। শেষোক্ত ফ্রায়ার টাক হচ্ছে এক পাদ্রি বা ধর্মযাজক। সে দস্যুদের কানে ভগবানের নাম পরিবেশন করত, আবার প্রয়োজন হলে অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেও তার আপত্তি ছিল না কিছুমাত্র। ফ্রায়ার টাক ছিল খর্বকায়, কিন্তু বৃষস্কন্ধ ও বিশাল বপুর বিস্তারে তার দৈর্ঘ্যের অভাব পুষিয়ে গিয়েছিল। তার মাথায় ছিল একটা মস্ত চকচকে টাক এবং দেহে ছিল প্রচণ্ড শক্তি। তিরধনুক ও তলোয়ার চালাতে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। তবে লাঠি ছিল তার প্রিয় অস্ত্র।

উইল স্কারলেট ছিল ছোটোখাটো পেশীবহুল দেহের অধিকারী। অস্ত্রশস্ত্রে সুনিপুণ এই যুবক চিতাবাগের মতোই ক্ষিপ্র এবং মল্লযুদ্ধে পারদর্শী।

এইবার লিটল জন-এর কথা বলছি। নামে লিটল বা ক্ষুদ্র হলেও লিটল জন মোটেই ছোটোখাটো মানুষ নয় তার শরীর যেমন লম্বা তেমনই চওড়া, এবং সেই লম্বা-চওড়া প্রকাণ্ড শরীরের সর্বত্র কঠিন মাংসপেশীর স্ফীতি দেখলেই বোঝা যায় মানুষটি অসাধারণ শক্তিমান। রবিনহুডের দলে তার মতো বলিষ্ঠ পুরুষ একটিও ছিল না। এই মহাবলবান মানুষটি অস্ত্রের ব্যবহার জানত ভালোভাবেই তির, তলোয়ার ও লাঠি চালাতে সে ছিল ওস্তাদ।

পূর্বোক্ত ভয়ংকর মানুষ তিনটির সঙ্গে যে নর্ম্যান অশ্বারোহীটি এসে রবিনহুডের সামনে দাঁড়াল, তার চোহারটিও দেখবার মতো। মাথা থেকে পা পর্যন্ত বর্মে ঢাকা; বর্মের তলায় যোদ্ধার নাক, চোখ, মুখ আর দেহের গঠন অদৃশ্য হলেও দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে তার শরীরটি যে লিটল জনের মতোই প্রকাণ্ড সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। যোদ্ধার বাহন অশটির দেহের আয়তনও প্রভুর মতোই সুবিশাল। যোদ্ধার বর্ম ও ঘোড়র গায়ের রং কুচকুচে কালো।

বর্মাবৃত ওই ধরনের যোদ্ধাদের ইউরোপে নাইট নাম অভিহিত করা হত; আমরাও তাই রবিনহুড ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কালো বর্মের যোদ্ধাকে ব্ল্যাক নাইট নামেই ডাকব।

রবিনহুডকে উদ্দেশ করে লিটল জন বলল, মাস্টার রবিন! এই নর্মান নাইট এই দিকেই আসছিলেন। আমরা তাকে প্রশ্ন করে জানতে পারি তিনি নাকি ইয়র্ক নগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে পথ ভুলে শেরউড বনে ঢুকে পড়েছেন। আমরা তাকে আমাদের দলপতি রবিনহুডের সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করলাম। উনি সম্মত হয়েছেন বলেই আমরা ওঁকে তোমার সামনে নিয়ে এসেছি।

ঘনকৃষ্ণ লৌহমুখোশের ভিতর থেকে ভেসে এল সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, কথাটা সত্য বটে। তবে অনুরোধ করার সময়ে তিনটি ধনুক থেকে তিনটি বাণ আমার দিকে উদ্যত হয়েছিল। আর আমার এই দীর্ঘকায় বন্ধুটি জানিয়েছিল যে, সে এবং তার বন্ধুরা সকলেই দক্ষ তিরন্দাজ অনুবোধ রক্ষায় অসম্মত হলে আমার বর্মের খাঁজের ভিতর তিরে পাঠিয়ে দিতে তাদের নাকি বিশেষ অসুবিধা হবে না। এরকম অবস্থায় অনুরোধ রক্ষা না করে আমায় উপায় ছিল না।

রবিনহুড বিনীতভাবে অভিবাদন করে বলল, ব্লাক নাইট! আপনি রাগ করবেন না। এই বনে চলাফেরা করতে হলে আমার অনুমতি নিতে হয়। কারণ, এটা হচ্ছে আমার এলাকা।

তাই নাকি? ব্ল্যাক নাইট বললেন, আমার ধারণা ছিল এটা রাজার সম্পত্তি। রাজা রিচার্ডই এই বনের মালিক। আমি বহুদিন এদেশে ছিলাম না। এসে দেখছি অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে।

নাইট মহাশয়! রবিনহুড বলল, এটা রাজার সম্পত্তি তো বটেই। রাজা রিচার্ডই এই শেরউড বনের মালকি। কিন্তু তার অবর্তমানে আমাদের উপর অর্থাৎ অ্যাংলো-স্যাক্সনদের উপর যে অত্যাচার চলছে, সেই অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার জন্যেই আমরা এই বনে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি। আমরা রাজভক্ত প্রজা, নিতান্ত বাধ্য হয়েই দুই-এক সময়ে হরিণ মেরে খেয়ে থাকি।

কী সর্বনাশ! রাজার হরিণ মারা যে বে-আইনি ব্যাপার। রিচার্ড একথা শুনলে খুশি হবেন না। তাঁর ভাই জন নিশ্চয়ই এইসব বে-আইনি কার্যকলাপের খবর রাখেন না?

রাখেন বৈকি, রহিনহুড হেসে বলল, তার অনুগত শেরিফ ও ব্যারনরা কয়েক বার সশস্ত্র প্রহরী নিয়ে এখানে হানা দিয়েছে। তবে তারা আমাকে ধরতে পারেনি। আর রাজা রিচার্ডের অসন্তোষের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব সব কথা শুনলে তিনি নিশ্চয়ই আমাদের ক্ষমা করবেন।

তারপর রবিনহুড নর্ম্যান অত্যাচারের কয়েকটি কাহিনি ব্ল্যাক নাইটকে শোনাল। রবিনহুডের দলভুক্ত কয়েকটি মানুষ এসে ঈশ্বরের নামে শপথ করে জানালো নর্ম্যান শেরিফ ও ব্যারনদের অত্যাচারে তারা আজ নিঃস্ব সর্বস্বান্ত। সব কথা শুনে ব্ল্যাক নাইটের মুখভাবের পরিবর্তন হল কি না, বোঝা গেল না, কারণ, তাঁর মুখ ছিল লোহার মুখোশে ঢাকা- কিন্তু যখন তিনি কথা বললেন, তখন কণ্ঠস্বরে ক্রোধের আভাস ছিল স্পষ্ট।

মাস্টার রবিন। ব্ল্যাক নাইট ভয়ংকর স্বরে বললেন, তোমার কথা যদি সত্য হয়, এখানে যারা নির্যাতিত হয়ে সাক্ষ্য দিল তাদের কথা যদি সত্য হয় তাহলে জেনে রেখো, অত্যাচারীদের নিস্তার নেই। পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাদের করতেই হবে।

দস্যুদল স্তম্ভিত বিস্ময়ে নির্বাক। তাদের মনে হল একটা সিংহ যেন অবরুদ্ধ রোষে গর্জন করে উঠল। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর রবিনহুড বলল, নাইট মহাশয়! আপনি দীর্ঘকাল এখানে ছিলেন না বলছেন। কোথায় ছিলেন তাহলে?

প্যালেস্টাইনে।

প্যালেস্টাইন! যুদ্ধক্ষেত্রে?

–হ্যাঁ। আমি ধর্মযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। দীর্ঘকাল পরে দেশে ফিরছি।

–নাইট মহাশয়! কিছু না দেখেও বলতে পারি সেখানে বহু মুসলমান সৈন্যই আপনার অস্ত্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে.. কিন্তু মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়েছে, আমরাও ক্ষুধার্ত; যদি অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে ভোজনে বসেন তাহলে অত্যন্ত সুখী হব।

-সানন্দে। আমিও অতিশয় ক্ষুধার্ত।

.

০২. পরীক্ষা

ভোজসভায় যোগ দেওয়ার আগে ব্ল্যাক নাইট তাঁর শিরস্ত্রাণ ও লৌহমুখোশ খুলে ফেললেন।

দস্যুদের চোখের সামনে ভেসে উঠল একজোড়া উজ্জ্বল চক্ষু, তীক্ষ্ণ নাসিকা আর দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠাধর। মাথার উপর সিংহের কেশরের মতো নিবিড় কেশরাশির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুখের নিম্নভাগে অবস্থান করছে ঘন গোঁফ-দাড়ি সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য পৌরুষের দীপ্তি জ্বলছে সেই মুখের উপর…

ভোজনপর্ব শেষ হল। খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য ছিল না– প্রচুর পরিমাণে হরিণের মাংস আর এল নামক সুর জাতীয় পানীয়। ব্ল্যাক নাইট যে খুবই ক্ষুধার্ত ছিলেন সন্দেহ নেই। যে পরিমাণ মদ্য ও মাংস তিনি উদরস্থ করলেন তা দেখে দস্যুর দল তো চমকে গেলই, এমনকী, ভোজনপটু ফ্রায়ার টাকও মনে মনে স্বীকার করল, লোকটা খেতে পারে বটে!

ভোজনপর্ব সমাধা হলে উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে অভিবাদন জানিয়ে ব্ল্যাক নাইট বললেন, মাস্টার রবিন। এমন একটি চমৎকার ভোজ খাওয়ানোর জন্য তোমাকে আর তোমার সহচরদের আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। রবিনহুড সবিনয়ে বলল, নাইট মহাশয়! আমাদের মতো গরিব মানুষ কি আপনাকে এমনভাবে ভোজ খাওয়াতে পারে? খাওয়ার খরচটা আপনাকেই দিতে হবে।

অত্যন্ত বিমর্ষভাবে ব্ল্যাক নাইট বললেন, কিন্তু আমি যে এখন একেবারেই কপর্দকশূন্য।

রবিনহুড বলল, তাতে কি হয়েছে? আর এক সময় যখন আপনার হাতে টাকা থাকবে, সেই সময় মনে করে এখানে এসে ভোজের খরচটা দিয়ে যাবেন।

কিছুক্ষণ স্থিরভাবে চিন্তা করলেন ব্ল্যাক নাইট, তারপর হঠাৎ তার ওষ্ঠাধরে ফুটল হাসির রেখা, আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না? আমাকে তোমাদের দলে ভর্তি করে নিলে তো আর খাওয়ার খরচটা দিতে হয় না। আর আমিও ঋণশোধের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাই।

রবিনহুড বলল, আপনার মতো মানুষ যদি দলে আসে, তাহলে সে তো আমাদের সৌভাগ্য। কিন্তু আমরা তো সবাই অ্যাংলো-স্যাক্সন, আর আপনি নর্মান যোদ্ধা। আপনি কি আমাদের দলে আসবেন?

-কেন আসব না? তোমরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছ। নর্ম্যান জাতির বিরুদ্ধে তোমরা তো অস্ত্রধারণ করোনি। নাইটের কর্তব্য হচ্ছে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। তাই তোমাদের দলে এলে আমি কতর্ব্য পালনের সুযোগ পাব ভালোভাবেই।

ঠিক কথা। আমাদের রাজা রিচার্ডও নর্মান বংশের মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগই নেই। আমরা লড়াই করছি কয়েকজন অত্যাচারী জমিদার, শেরিফ প্রভৃতি অত্যাচারী নৰ্মানদের বিরুদ্ধে। বর্তমানে রিচার্ডের পরিবর্তে যিনি ইংল্যান্ডের সিংহাসন অধিকার করেছেন, সেই জনকেও আমরা পছন্দ করি না।

–মাস্টার রবিন! তোমার মতে তাহলে রাজা রিচার্ডই এখন ইংল্যান্ডের সিংহাসনের যোগ্য অধিকারী!

-নিশ্চয়।

আমিও তোমাদের সঙ্গে একমত। তাহলে আমাকে এইবার তোমাদের দলে ভর্তি করে নাও।

আমাদের দলে ভর্তি হতে হলে আপনাকে পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে নিশ্চয়ই আপনাকে দলভুক্ত করা হবে।

-তোমার দলে আসতে হলে পরীক্ষা দিতে হয়?

-হয় বৈকি, নাইট মহাশয়। তা না হলে যত রাজ্যের চোর, ডাকাত আর ভিখারির দল এসে আমার দলে ভিড় করত। সেই জন্যই পরীক্ষার ব্যবস্থা। দক্ষ যোদ্ধা না হলে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন। অবশ্য আপনি যে সসম্মানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবু নিয়ম পালন তো করতেই হবে- কি বলেন?

-অবশ্যই। তা পরীক্ষাটা কি ভাবে হবে?

-তিরধনুক নিয়ে লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা আছে। সেটা পছন্দ না হলে লাঠি অথবা খেঁটে, অর্থাৎ ছোটো লাঠি দিয়েও দ্বন্দ্বযুদ্ধে শক্তির পরীক্ষা করা যায়।

–প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে কে?

আমিই অথবা আমার দলের যে-কোনো লোককে আপনি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নির্বাচন করতে পারেন।

–তিরধনুক, লাঠি বা খেটে নিয়ে আমি লড়াই করতে ভালোবাসি না। তোমাদের দলে কি এমন কেউ নেই, যে ব্যক্তি রণকুঠার, ভল্ল বা কটাবসানো লোহার গদা নিয়ে লড়াই করতে পারে?

-নাইট মহাশয়! আপনি যে অস্ত্রগুলির কথা বললেন, ওইসব অস্ত্র নিয়ে আপনার সঙ্গে যে-যোদ্ধা লড়াই করতে নামবে, সে আর পরের দিনের সূর্যোদয় দেখতে পাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আমরা হত্যাকাণ্ড দেখতে চাই না। সেই জন্যই তিরধনুকে নিশানার পরীক্ষা, অথবা লাঠি আর খেঁটের লড়াই-এর ব্যবস্থা করেছি।

ব্ল্যাক নাইট কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, রবিনহুডের লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা সম্পর্কে যে-সব কথা আমার কানে এসেছে, তাতে তিরধনুক নিয়ে তার সঙ্গে লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতায় নামতে আমার সাহস হয় না। লাঠি নিয়ে পেটাপেটি করা নৰ্মান যোদ্ধার পক্ষে সম্মানজনক নয়। তবে গেঁটে বা ছোটো লাঠি নিয়ে লড়াইটা হতে পারে। তলোয়ারের খেলা শেখার সময়ে নর্ম্যান যোদ্ধাদের ওই ছোটো লাঠির খেলা শিখতে হয়। বাল্যকালে ও কৈশোরে অসিযুদ্ধ শেখার সময়ে আমিও ছোটো লাঠির লড়াইটা শিখেছিলাম। অনভ্যাসে হাত একটু আড়ষ্ট হলেও একরকম কাজ চালিয়ে নিতে পারব বলে মনে হয়। মাস্টার রবিন! তোমার দলের মধ্যে যে-কোনো ব্যক্তি আমার সঙ্গে ছোটো লাঠি নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামতে পারে আমি প্রস্তুত।

রবিনহুড বলল, লিটল জন আর ফ্রায়ার টাক আপনার মতোই লম্বা-চওড়া, দেহের ওজন ও শক্তিতে আপনার সমকক্ষ। ওরা দীর্ঘকাল ধরে ছোটো লাঠির ব্যবহারে অভ্যস্ত, কিন্তু আপনার ছোটো লাঠিতে অভ্যাস নেই। কাজেই ওদের কারও সঙ্গে আপনাকে ছোটো লাঠি নিয়ে শক্তিপরীক্ষা করতে আমি দেব না। কারণ, তাহলে আপনার প্রতি অবিচার করা হয়। আমিই এখানে আপনার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। আমার লাঠি খেলা অভ্যাস আছে; আপনি তাতে অনভ্যস্ত হলেও দেহের ওজন ও শারীরিক শক্তি আমার চাইতে আপনার বেশি– অতএব সুবিধা অসুবিধা উভয়পক্ষে সমান সমান। আমার সঙ্গে ছোটো লাঠি নিয়ে আপনার দ্বন্দ্বযুদ্ধ হলে লড়াইটা ন্যায়সঙ্গত হবে।

দুটি শক্ত খেঁটে বা ছোটো লাঠি এসে গেল। ব্ল্যাক নাইট খাওয়ার আগে শিরস্ত্রাণ ও লোহার মুখোশ খুলে ফেলেছিলেন, কিন্তু গায়ে বর্ম ছিল। এবার বর্ম খুলে তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন।

বর্মের উপর থেকে ব্ল্যাক নাইটের দেহের উচ্চতা ও পরিধিরি কিছুটা আভাস পেলেও শরীরের সঠিক গঠন অনুমান করা যাচ্ছিল না। এইবার বর্ম খুলে ফেলতেই খাটো জামা আর অধোবাসের ভিতর থেকে যে-দেহটি আত্মপ্রকাশ করল, সেইদিকে তাকিয়ে দস্যুদের চক্ষুস্থির হয়ে গেল!

আড়েবহরে প্রকাণ্ড শরীরের সর্বত্র ঠেলে উঠেছে স্ফীত মাংসপেশীর তরঙ্গ। তুচ্ছ পরিচ্ছদের আবরণ সেই পেশীবদ্ধ বলিষ্ঠ সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখতে পারছে না। দস্যুদল বুঝল শেরউড বনে আজ মানুষের ছদ্মবেশে এক দানবের আবির্ভাব ঘটেছে।

প্রতিদ্বন্দ্বীর চেহারা দেখে রবিনহুডও দস্তুরমতো চমকে গিয়েছিল। আত্মসংবরণ করে হাতের লাঠি বাগিয়ে ধরল। দুই হাতে লাঠি ধরে এগিয়ে এল ব্ল্যাক নাইট। শুরু হল লড়াই…

রবিনহুডের হাতে লাঠি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে প্রতিপক্ষের মাথায়, ঘাড়ে, হাতে, বুকে, পায়ে সর্বত্র পড়ছে লাঠির আঘাত। সেই প্রচণ্ড মার খেলে যে-কোনো মানুষই অজ্ঞান হয়ে মাটির উপর শুয়ে পড়ত- কিন্তু ব্ল্যাক নাইট নির্বিকার, তিনি আঘাত অগ্রাহ্য করে লাঠি চালাচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ্য করে। দুঃখের বিষয়, তার লাঠি একবারও প্রতিদ্বন্দ্বীকে স্পর্শ করতে পারছে না। হঠাৎ একবার আঘাত এড়াতে লাফ দিয়ে সরে গেল রবিনহুড, লক্ষ্যভ্রষ্ট লাঠি এসে পড়ল একটা ওক গাছের উপর। সঙ্গেসঙ্গে সশব্দে ভেঙে গেল লাঠি, গাছটাও দুটুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে।

কয়েক মুহূর্ত জ্বলন্ত চক্ষে হাতের ভাঙা লাঠিটার দিকে চেয়ে রইলেন ব্ল্যাক নাইট, তারপর সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে উঠলেন, আর একটা লাঠি নিয়ে এস।

–না, না রবিনহুড সহাস্যে বলে উঠল, আর লাঠালাঠির দরকার নেই। যথেষ্ট হয়েছে।

–আমি তাহলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি?

সগৌরবে।

এই যদি অ্যাংলো-স্যাক্সনদের শক্তিপরীক্ষার রীতি হয়, ব্ল্যাক নাইট ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, তাহলে আমি বলব নিয়মটা খুবই খারাপ। কোনো সম্মানিত ব্যক্তি এইভাবে শক্তিপরীক্ষা করে না। আমার সমস্ত গা ছিঁড়ে গেছে, ফুলে গেছে অথচ, আমি একবারও প্রতিদ্বন্দ্বীর গায়ে লাঠি ছোঁয়াতে পারলাম না!

নাইট মহাশয়! রবিনহুড বলল, আপনার লাঠির এক ঘা খেলেই আমার প্রাণপাখি খাঁচা ছাড়া হয়ে যেত। আপনার দেহে অসুরের শক্তি।

ফ্রায়ার টাক বলল, এবার আমার কাজটা হয়ে যাক, কি বল মাস্টার রবিন?

রবিনহুড বলল, নিশ্চয়।

ব্ল্যাক নাইট প্রশ্ন করলেন, পাদ্রি মশাই-এর আবার কি কাজ?

রবিনহুড বলল, দলে নতুন মানুষ ভর্তি হলে ফ্রায়ার টাক তাকে স্নান করিয়ে ভগবানের নাম শোনায়।

রবিনহুডের কথা শেষ হতেনা-হতেই ফ্রায়ার টাক কোথা থেকে এক বালতি ঠান্ডা জল এনে হুড়হুড় করে ব্ল্যাক নাইটের মাথায় ঢেলে দিল, তারপর বাইবেলের শ্লোক আওড়াতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে।

আচম্বিতে এমন শীতল অভ্যর্থনা পেয়ে ব্ল্যাক নাইট চমকে গেলেন। ইংল্যান্ডের শীতে ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ মাথার উপর কনকনে ঠাণ্ডা ঢাললে যে-কোনো মানুষেরই মেজাজ খারাপ হতে পারে ব্ল্যাক নাইটের দুই চোখ আগুনের মতো জ্বলে উঠল এবং দুই হাত হল মুষ্টিবদ্ধ। সকলে ভাবল, এই রে! ফ্রায়ার টাকের এবার দুর্ভোগ আছে!

কিন্তু ফ্রায়ার টাকের ভাগ্য ভালো, কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে হেসে উঠলেন ব্ল্যাক নাইট, তোমাদের দলে যখন ভর্তি হয়েছি, তখন দলের নিয়ম মানতে হবে বৈকি!

রবিনহুড বলল, নাইট মহাশয়! আমাদের লিটল জনের পোশাক আপনার গায়ে একরকম করে হয়ে যাবে। আপনি এখন ভিজে জামা ছেড়ে লিটল জনের একটি পোশাক গায়ে চড়িয়ে ফেলুন।

ব্ল্যাক নাইট বললেন, দরকার নেই। শীত বা গ্রীষ্ম আমাকে কাবু করতে পারে না। আর একটা কথা শোন– ঠান্ডার সবচেয়ে ভালো প্রতিষেধক হচ্ছে সুরা এবং সংগীত।

দস্যুদল সোৎসাহে তার কথায় সায় দিল। সুরার অভাব সেখানে ছিল না। পাত্রের পর পাত্র পূর্ণ হল, এবং শুন্য হল তৎক্ষণাৎ। সবচেয়ে বেশি পান করলেন ব্যাক নাইট। অ্যালান-আ-ডেল নামে রবিনহুডের এক সহচর ছিল গীতবাদ্যে পারদর্শী। বীণ বাজিয়ে সে গান গাইতে শুরু করল। অ্যালানের গান শেষ হতেই হঠাৎ লিটল জন বলে উঠল, এইবার নাইট মহাশয় একটি সংগীত পরিবেশন করে আমাদের আনন্দদান করুন।

ব্ল্যাক নাইটের আপত্তি হল না। উদাত্ত কণ্ঠে তিনি গান ধরলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর অ্যালানের মতো মধুর নয়, সিংহ-গর্জনের মতো গুরুগম্ভীর। তবে দস্যুদল সেই গান শুনেই খুব খুশি।

গান শেষ হলে রবিনহুড বলল, এতক্ষণ আমরা আপনাকে ব্ল্যাক নাইট নামেই জেনেছি। কিন্তু এখন আপনি আমাদের দলের মানুষ, আপনার পরিচয় জানার অধিকার এখন আমাদের আছে। বলুন, আপনার নাম কি?

রহস্যময় হাসি হেসে ব্ল্যাক নাইট বললেন, আমার নাম যথাসময়েই তোমরা জানতে পারবে। সেজন্য ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

রবিনহুড বলল, বেশ, আমরা সেজন্য অপেক্ষা করব। কিন্তু আমাদের আর একটি সমস্যা আছে; আমরা অত্যন্ত উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন যাপন করছি। আপনি এখন আমাদের দলভুক্ত, অতএব আমাদের সমস্যা সম্পর্কে আপনার অবহিত হওয়া প্রয়োজন। আপনার পরামর্শ ও সাহায্য আমরা দাবি করতে পারি?

অবশ্যই। ব্ল্যাক নাইট বললেন, বল, কি তোমাদের সমস্যা; আমি সাধ্যানুযায়ী তোমাদের সাহায্য করব।

রবিনহুড সংক্ষেপে স্যার স্টিফেনের কিছু কিছু কুকীর্তি ও দুর্গ অবরোধের কথা ব্ল্যাক নাইটকে খুলে বলল। তিনি স্থির হয়ে সব শুনলেন, ধীরে ধীরে তার ললাটে জাগল ভ্রুকুটি-ভয়াল কুঞ্জন-রেখা…

মাস্টার রবিন! ব্ল্যাক নাইট বললেন, স্যার স্টিফেনের বহু অন্যায় ও অপরাধের কথা এর আগেই আমার কানে এসেছে। যে-দুর্গে সে অবরুদ্ধ হয়েছে, সেই দুর্গের অধিপতিকে সে এক বৎসর আগে হত্যা করেছে বলে তুমি অভিযোগ করছ- এখন বল, ওই দুর্গাধিপের নাম কি ছিল। তাকে হত্যা করার কারণ কি?

দুর্গাধিপের নাম আলফ্রেড অব শেরউড। রবিনহুড বলল, তিনি অ্যাংলো-স্যাক্সন হয়েও নমানবংশী স্যার স্টিফেনের আদেশ পালন করেননি, এই অপরাধেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।

–আদেশ পালন করেননি বলে হত্যা করা হয়েছে? আদেশটা কি ছিল?

–স্যার স্টিফেনের মনোমত পাত্রের সঙ্গে আলফ্রেড তাঁর কন্যার বিবাহ দিতে সম্মত হননি। কী! সক্রোধে গর্জন করে উঠলেন ব্ল্যাক নাইট, আলফ্রেড আমার পরিচিত। অ্যাংলো-স্যাক্সন হলেও তিনি ছিলেন রাজা রিচার্ডের অনুগত প্রজা। সামান্য কারণে তাঁকে হত্যা করেছে স্যার স্টিফেন?

সামান্য কারণে নয়, রবিনহুড বলল, স্যার স্টিফেনের নির্বাচিত পাত্রটি ছিল তারই ভ্রাতুস্পুত্র। ওই বিবাহ সম্পন্ন হলে আলফ্রডের সমুদয় সম্পত্তি হত স্যার স্টিফেনের হস্তগত।

ব্ল্যাক নাইট বললেন, স্যার স্টিফেনের পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে। এইভাবে অনির্দিষ্ট কাল দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকতে আমি রাজি নই। আর সময়ের মূল্য আছে। কালই আমি পাপীর দণ্ডবিধান করব স্বহস্তে।

কিন্তু কেমন করে?রবিনহুড বলল, দুর্গের ভিতর প্রবেশ করা অসম্ভব। সেই চেষ্টা করতে গেলে আমার দলের বহু লোক প্রাণ হারাবে। আমি দলের লোকের অপমৃত্যু দেখতে চাই না।

ব্ল্যাক নাইট বললেন, স্যার স্টিফেন অত্যন্ত দাম্ভিক যোদ্ধা। তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলে সে নিশ্চয়ই যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।

বিমর্ষকণ্ঠে রবিনহুড বলল, তা ঠিক। কিন্তু তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করার ক্ষমতা আমাদের মধ্যে কারও নেই। ছয়-ছয়বার সে রাজদরবারে দ্বন্দ্বযুদ্ধ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছে। মনে রাখবেন, ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা ওই প্রতিযোগিতাগুলিতে অংশগ্রহণ করেছিল। সমগ্র ইংল্যান্ডে তার সমকক্ষ যোদ্ধা এখন একটিও নেই।

আমি প্রমাণ করে দেব তোমার ধারণা ভুল, ব্ল্যাক নাইট দৃঢ়স্বরে বললেন, ছয়বার সে জয়ী হয়েছে বটে, কিন্তু এইবার সে পরাজিত হবে। মাস্টার রবিন! তোমাদের কারুকে যুদ্ধ করতে হবে না। আমি স্বয়ং তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করব।

.

০৩. দ্বৈরথ

দুর্গের উপর দণ্ডায়মান প্রহরীরা দেখল বনের ভিতর থেকে সাদা নিশান হাতে এগিয়ে আসছে দুটি মানুষ। সাদা নিশান হচ্ছে শান্তির প্রতীক, তাই প্রহরীরা তির না চালিয়ে প্রশ্ন করল, কি চাও? নিশানধারী মানুষ দুটি আমাদের পরিচিত– রবিনহুড ও লিটল জন। রবিনহুড বলল, আমরা স্যার স্টিফেনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সংবাদ পেয়ে দুর্গের ছাতে উপস্থিত হল স্যার স্টিফেন। হাঁক দিয়ে বলল, কি বলতে চাও তোমরা?

রবিনহুড বলল, আমি তোমার কাছে একটি প্রস্তাব জানাতে এসেছি। আমাদের দলভুক্ত এক ব্যক্তি তোমার সঙ্গে কথা কইতে চান। তার সঙ্গে আলোচনা করলে হয়তো তোমার হতে পারে।

উদ্ধত স্বরে স্যার স্টিফেন বলল, কোনো দস্যুর সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না।

যিনি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান তিনি দস্যু নন। রবিনহুড বলল, তোমার সামনে এখন তিনটি পথ খোলা আছে। দুর্গের ভিতর বসে থেকে অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে পার, বাইরে বেরিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে লড়াই করতে পার, আর সম্মানজনক শর্তে মুক্তিলাভের উপায় সম্পর্কে আমাদের নির্বাচিত ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করতে পার। বলল, কি করবে?

স্বীকার করতে বাধা নেই যে, দুর্গে খাদ্যাভাব ঘটেছে, স্যার স্টিফেন বলল, তবুও একটা কথা জেনে রাখো। যতক্ষণ আমাদের মধ্যে একটি প্রাণও বেঁচে থাকবে, ততক্ষণ তোমরা দুর্গের ভিতর প্রবেশ করতে পারবেনা। আমরা কিছুতেই আত্মসমর্পণ করবনা, শেষ পর্যন্ত লড়াই করব।

তার দরকার হবে না, রবিনহুড বলল, আমাদের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করলে হয়তো তোমাদের সম্মানজনক শর্তে মুক্তিলাভের উপায় হতে পারে।

বেশ, স্যার স্টিফেন বলল, আমি তোমাদের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা কইতে রাজি আছি।

রবিনহুড তার কটিবন্ধে আবন্ধ শিঙা তুলে নিয়ে ফুঁ দিল। শিঙার আওয়াজের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই স্যার স্টিফেনের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে অরণ্য ভেদ করে আবির্ভূত হল প্রকাণ্ড এক কালো ঘোড়ার পিঠে আপাদমস্তক বর্মাবৃত এক যোদ্ধা। যোদ্ধার বর্মের রং তার বাহনের মতোই কুচকুচে কালো। বলাই বাহুল্য, এই ঘোড়সওয়ার আমাদের পূর্ব-পরিচিত ব্ল্যাক নাইট।

তুমি দেখছি একজন নর্ম্যান নাইট, স্যার স্টিফেন বিস্মিত স্বরে বলল, নর্মান যোদ্ধা হয়ে একদল দস্যর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে লজ্জা হল না? ওরা তো ফাঁসির দডির জন্য অপেক্ষা করছে।

ওরা দীর্ঘকাল ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করতে পারে, ব্ল্যাক নাইট বললেন, তাতে তোমার বা আমার কিছু আসে যায় না।

তুমি কি বলতে চাও?

–তোমাদের খাদ্য ফুরিয়ে এসেছে। কত দিন আর এভাবে চলবে?

যত দিন চলে। বাইরে থেকে যে-কোনো সময়ে সাহায্য এসে পড়তে পারে।

তত দিনে তোমাদের অনাহারে মৃত্যু ঘটবে। তার চাইতে বরং আত্মসমর্পণ করো।

–কখনই নয়। অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি; কিন্তু দস্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করব না।

এই সমস্যা সমাধানের একটি মাত্র সম্মানজনক উপায় আছে।

–উপায়টা কি?

—দ্বন্দ্বযুদ্ধ।

স্যার স্টিফেন চিৎকার করে উঠল, তুমি আমকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছ?

–হাঁ, এই তার নিশানা।

ব্ল্যাক নাইট তাঁর ডান হাতের লৌহ-দস্তানা খুলে মাটির উপর ছুঁড়ে ফেললেন। তখনকার দিনে ওইভাবে যোদ্ধারা প্রতিপক্ষকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানাতেন।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল স্যার স্টিফেন, তারপর বলল, আমি যদি যুদ্ধে জয়লাভ করি, তাহলে সৈন্যদের নিয়ে নিরাপদে স্বস্থানে ফিরে যেতে পারব?

–নিশ্চয়।

–দস্যুকে বিশ্বাস কি?

রবিনহুড এগিয়ে এসে চিৎকার করে বলল, আমরা দস্যু হতে পারি, কিন্তু কখনো প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করি না। স্যার স্টিফেন! রবিনহুড কথা দিয়ে কথা রাখেনি, এমন একটি দৃষ্টান্ত কি তুমি দেখাতে পার?কয়েকটি নীরব মুহূর্ত। তারপর স্তব্ধতা ভেদ করে জাগল স্যার স্টিফেনের কঠোর কণ্ঠস্বর, আমি আহ্বান গ্রহণ করলাম। ব্ল্যাক নাইট! ঈশ্বরের কাছে শেষ প্রার্থনা জানাও। আমি আসছি। আজ তোমার শেষ দিন।

দুর্গচুড়া থেকে অন্তর্ধান করল স্যার স্টিফেন। ব্ল্যাক নাইটের ইঙ্গিতে রবিনহুডের এক অনুচর ভীষণদর্শন এক শূল ও ঢাল এনে তুলে দিল ব্ল্যাক নাইটের হাতে।

কিছুক্ষণ পরেই সশব্দে খুলে গেল দুর্গের সিংহদ্বার এবং অশ্বপৃষ্ঠে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল আপাদমস্তক লৌহবর্মে আবৃত জনৈক যোদ্ধা- স্যার স্টিফেন।

রোমাঞ্চকর এক রক্তাক্ত দৃশ্যের প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল রবিনহুড ও তার সঙ্গীদল। এটা অ্যাংলো-স্যাক্সনদের খেটে বা লাঠির লড়াই নয়এই লড়াই শূল ও তরবারি নিয়ে বর্মাবৃত নৰ্মান নাইটদের মৃত্যুপণ যুদ্ধ।

দুর্গ-প্রাকার ও ছাদের উপর ভিড় করে দাঁড়াল নর্ম্যান-সেনাদল। তাদের আগ্রহও কম নয়। যদিও তাদের অধিনায়কের জয়লাভ সম্পর্কে তারা ছিল নিশ্চিত, তবুও স্যার স্টিফেনের মতো দুর্জয় যোদ্ধাকে যে-নাইট দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাতে সাহসী হয়, তার রণকৌশল দেখার জন্য নৰ্মানরা ছিল অতিশয় উগ্রীব। প্রতিদ্বন্দ্বীরা দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে প্রচলিত প্রথা অনুসারে একজন মধ্যস্থ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পরিচয় ঘোষণা করে, তারপর তুর্যধ্বনি করে যুদ্ধ আরম্ভের সংকেত দেওয়া হয়।

এখানে সে-সব কিছুই হল না। স্যার জিওফ্রে ম্যালপার্ট নামে একজন নর্মান নাইট তার হাতের রক্তবর্ণ রুমাল মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে যুদ্ধের নির্দেশ দিল– সঙ্গেসঙ্গে দুই দিক থেকে উদ্যত শূল হাতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ঘোড়া ছুটিয়ে দিল পরস্পরের দিকে।

দুর্গের সামনে উচ্চভূমির উপর একটা সমতলভূমি ছিল যোদ্ধাদের লক্ষ্যস্থল। ওই জায়গাটার উপর যুদ্ধ হলে কোনো পক্ষই বিশেষ কোনো সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে না- যার রণকৌশল ও শারীরিক শক্তি বেশি, সে-ই হবে জয়ী। কিন্তু যে-যোদ্ধা প্রতিদ্বন্দ্বীর আগে সমতলভূমি অতিক্রম করে অপর পক্ষকে অক্রমণ করতে পারবে, তারই জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি। কারণ, তলা থেকে যে ব্যক্তি উপর দিকে অশ্বারোহণে উঠেছে, তার পক্ষে উপর থেকে নেমে আসা ধাবমান অশ্বের পৃষ্ঠে উপবিষ্ট যোদ্ধার শূলের আঘাত সহ্য করা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। ব্ল্যাক নাইট ও তার ঘোড়ার চাইতে বাহনসমেত স্যার স্টিফেনের ওজন অনেক কম, তাই স্যার স্টিফেনের ঘোড়া প্রতিপক্ষের তুলনায় অধিকতর ক্ষিপ্র এবং দ্রুতগামী অতএব, দেখা গেল স্যার স্টিফেনের ঘোড়া যখন সমভূমি পার হয়ে নীচের দিকে নামছে, ব্ল্যাক নাইটের কালো ঘোড়া তখন ঢালু জমি বেয়ে উপর দিকে মাত্র অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে।

প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ্য করে ঝড়ের বেগে নামতে লাগল স্যার স্টিফেনের সুশিক্ষিতি অশ্ব। তৎক্ষণাৎ দুর্গপ্রাচীর ও চুড়ার উপর জগল নৰ্মান বাহিনীর কণ্ঠে তুমুল উল্লাসধ্বনি।

শরীরী ঝটিকার মতো স্যার স্টিফেনের ঘোড়া এসে পড়ল ব্ল্যাক নাইটের সম্মুখে, পরক্ষণেই দুটি প্রকাণ্ড শূল সবেগে পরস্পরকে আঘাত করল।

ব্ল্যাক নাইটের ঢালের উপর প্রচণ্ড সংঘাত-ধ্বনি তুলে ভেঙে গেল প্রতিদ্বন্দীর শুল। সেই দারুণ আঘাতেও কিছুমাত্র বিচলতি হলেন না ব্ল্যাক নাইট, অশ্বপৃষ্ঠে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইল তাঁর বিশাল দেহ।

কিন্তু তাঁর হাতের অস্ত্র ব্যর্থ হল না প্রতিদ্বন্দ্বীর ঢাল এড়িয়ে শূল অঘাত হানল। লৌহবর্ম ভেদ করে শূল বিদ্ধ হল স্যার স্টিফেনের কণ্ঠদেশে। পরক্ষণেই ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ল স্যার স্টিফেন। অশ্বপৃষ্ঠ থেকে এক লাফে নেমে এসে শত্রুর কাছে গিয়ে তার শিরস্ত্রাণ ও মুখের আবরণ খুলে ফেললেন ব্ল্যাক নাইট, কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ভূপতিত শত্রুর দিকে, তারপর ভীষণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, নৰ্মান সৈন্যগণ! তোমাদের অধিনায়ক মৃত। দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রথা অনুসারে তোমাদের বর্তমান সেনানায়ক এগিয়ে এসে আমার হাতে তার অস্ত্র সমর্পণ করুক।

নৰ্মান-সৈন্যদল বিস্ময়ে নির্বাক। স্যার স্টিফেনের পরাজয় তাদের কল্পনাতীত।

শূন্যে বদ্ধমুষ্ঠি আন্দোলন করে ব্ল্যাক নাইট আবার বললেন, তোমরা এসে আমার কথা সত্য কি না পরীক্ষা করে দেখতে পার। আমি বলছি, স্যার স্টিফেনের দেহে প্রাণ নেই।

নর্ম্যানদের মধ্যে কেউ এগিয়ে এসে স্যার স্টিফেনের দেহ পরীক্ষা করার আগ্রহ প্রকাশ করল না। ভূপতিত দেহের অনড় অবস্থা এবং কণ্ঠনিঃসৃত রক্তধারা দেখেই বুঝতে পেরেছিল ব্ল্যাক নাইটের কথা মিথ্যা নয়- স্যার স্টিফেনের আত্মা শূলের আঘাতে দেহ ছেড়ে পরলোকের দিকে যাত্রা করেছে, পড়ে আছে শুধু মৃতদেহ।

স্যার জিওফ্রে ম্যালপাৰ্ট নামে যে নর্মান নাইট দ্বৈরথ যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছিল, স্যার স্টিফেনের অবর্তমানে সেই হল নৰ্মান বাহিনীর অধিনায়ক। প্রথা-অনুসারে সে এইবার অস্ত্র সমর্পণ করতে এগিয়ে এল ব্ল্যাক নাইটের দিকে।

ম্যালপার্টের যুদ্ধাস্ত্র ছিল তদানীন্তকালে বিখ্যাত প্রকাণ্ড এক রণকুঠার। উক্ত কুঠার ছিল অতিশয় গুরুভার। ম্যালপার্ট অস্ত্রটিকে মাথার উপর তুলে ধরতে পারত না। কিন্তু এমন ভারী আর ধারাল ছিল সেই অস্ত্রটি, যে, কিছুটা তুলে আঘাত করতে পারলেই কার্যসিদ্ধ হত।

ম্যালপার্ট এগিয়ে এসে কুঠারটি সমর্পণের ভঙ্গিতে এগিয়ে দিল ব্ল্যাক নাইটের দিকে, তারপর কম্পিত স্বরে বলল, হে বিজয়ী বীর! এই কুঠার গ্রহণ করুণ এবং প্রথা অনুসারে জনসমক্ষে আপনার নাম, ধাম ও সম্পূর্ণ পরিচয় ঘোষণা করুন।

বাঁ হাতে কুঠারটি ছিনিয়ে নিয়েই ব্ল্যাক নাইট অস্ত্রটিকে অবহেলাভরে দূরে নিক্ষেপ করলেন। সমবেত জনতা বিস্মিত নেত্রে দেখল সেই গুরুভার কুঠার শূন্যপথে আট-দশ হাত অতিক্রম করে মাটির উপর সশব্দে আছড়ে পড়ল। এই অমানুষিক শক্তির পরিচয় পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল অ্যাংলো-স্যাক্সন দস্যুদল আর নর্মান সেনাবাহিনী।

ব্লাক নাইট বললেন, হ্যাঁ, অস্ত্র সমর্পণ করার সময়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রথা অনুসারে আমার পরিচয় জানার জন্য তোমরা আগ্রহ প্রকাশ করতে পার– সে অধিকার তোমাদের আছে।

একটু থেমে ব্ল্যাক নাইট আবার বললেন, বন্ধুবর রবিনহুড এবং তার সহচরবর্গও আমার পরিচয় জানতে উদগ্রীব। আমি বলেছিলাম সময় হলেই স্বনামে আত্মপ্রকাশ করব। এবার সময় হয়েছে।

এক টান মেরে শিরস্ত্রাণ ও মুখের আবরণ খুলে ফেলে ব্ল্যাক নাইট বললেন, ম্যালপার্ট! চেয়ে দেখ– বোধ হয় আমি তোমার অপরিচিত নই।

ব্ল্যাক নাইটের আবরণমুক্ত মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই ম্যালপার্টের কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল অস্ফুট আর্তনাদ।

পরক্ষণেই ভূমিতলে জানু পেতে বসে সে বলে উঠল, রাজা রিচার্ড! আপনি আমার অভিবাদন গ্রহণ করুণ।

গর্বোন্নত মস্তক তুলে ব্ল্যাক নাইট বজ্রগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন, নান সৈন্যগণ। তোমরা শ্রবণ করো আমার নাম রিচার্ড প্ল্যান্টাজেনেট। ইংল্যান্ডের সিংহাসনের আমিই প্রকৃত অধিকারী। আমি যে প্যালেস্টাইন থেকে বহু বিপদ-আপদ অতিক্রম করে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছি, সেকথা এখনও জনসাধারণের অজ্ঞাত। কিন্তু আমার ভাই জন এবং রাজদরবারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আমার গতিবিধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সেকথাও আমি জানি। যদি সহজে জন আমাকে ইংল্যান্ডের সিংহাসন ছেড়ে দিতে রাজি না হয়, তাহলে আমি যুদ্ধ করব। সৈন্যগণ! তোমাদের মধ্যে অনেকেই এক সময়ে আমার অধীনে যুদ্ধ করেছ। তবু তোমরা যদি আমাকে সমর্থন করে আমার অনুগামী হতে অনিচ্ছুক হও, তাহলে স্বচ্ছন্দে এই স্থান ত্যাগ করে যথা ইচ্ছা গমন করতে পার; কেউ তোমাদের বাধা দেবে না।

সৈন্যদের মধ্যে জাগল অস্ফুট কোলাহল, ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল সেই শব্দের তরঙ্গ, অবশেষে সমুদ্র-গর্জনের মতো প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ল নর্ম্যান-সেনার উল্লাস, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়!

শূন্যে হাত তুলে রিচার্ড সেনাদের স্তব্ধ হতে ইঙ্গিত করলেন। জয়োল্লাস থামতেই রিচার্ড আবার উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলেন, সৈন্যগণ! তোমাদের মধ্যে যারা আমাকে অনুসরণ করতে অনিচ্ছুক, তারা নির্ভয়ে স্থান ত্যাগ করতে পার। কেউ তোমাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করবে না।

একটি প্রাণীও স্থানত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করল না। শত শত কণ্ঠে আবার জাগল জয়ধ্বনি, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়!

একটু দূরেই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল রবিনহুড। সেইদিকে একবার দৃষ্টিপাত করে রিচার্ড বললেন, মাস্টার রবিন! এদিকে এস।

রাজার সামনে এসে নতজানু হয়েই অভিবাদন জানাল রবিনহুড। তাকে উদ্দেশ্য করে রিচার্ড বললেন, রবিনহুড! দেশে এসে তোমার সম্পর্কে সত্য মিথ্যা নানারকম কথা শুনে তোমাকে দেখার আগ্রহ হয়েছিল। তাই ব্লাক নাইটের ছদ্মবেশ ধারণ করে শেরউড বনে প্রবেশ করেছিলাম। যা দেখলাম, যা জানলাম, তাতে বুঝতে পারছি।

বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে মর্মভেদী দৃষ্টিতে রবিনহুডের দিকে তাকালেন রিচার্ড। ভূমিতলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে রবিনহুড স্থির হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল রাজার অভিমত শোনার জন্য তার সহচর দস্যুদলের চোখে-মুখে ফুটল শঙ্কার আভাস।

বুঝলাম, রিচার্ড তার অসমাপ্ত বাক্য সমাপ্ত করলেন, আমার পক্ষে তোমার মতো একটি মানুষের সাহায্য নিতান্তই প্রয়োজন।

তরবারি কোষমুক্ত করে সেই তরবারির অগ্রভাগ রবিনহুডের স্কন্ধে স্থাপন করে রিচার্ড বললেন, রবিনহুড! আজ থেকে তুমি আর শেরউড বনের পলাতক নও। তোমাকে আমি নটিহাম নগরীর শেরিফের পদে নিযুক্ত করলাম। তোমার সঙ্গীরা এখন থেকে তোমার দেহরক্ষী সেনাদলে পরিণত হল। সবাইকে জানিয়ে দাও, এখন থেকে শেরউড বন রাজা রিচার্ডের সম্পত্তি- এই বনে হরিণ মারলে হরিণ-শিকারির প্রাণদণ্ড হবে।

উঠে দাঁড়িয়ে বিহ্বল কণ্ঠে রবিনহুড বলল, রাজা রিচার্ড। যতদিন বাঁচব ততদিন আমি এবং আমার সঙ্গীরা আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে রাজসেবা করব।

তারপরই কোষমুক্ত তরবারি ঊর্ধ্বে তুলে রবিনহুড চিৎকার করে উঠল, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়!

অ্যাংলো-স্যাক্সন দস্যুদল ও নর্ম্যান-সেনাবাহিনী রবিনহুডের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সমবেতভাবে গর্জন করে উঠল, জয়! রাজা রিচার্ডের জয়।

সংকেত

-না, আমরা যাব না, তুমি মালপত্রে হাত দিয়ো না।

–সে কী ঘঁসিয়ে! আপনি লাগেজ নিয়ে এসেছেন, একটু পরেই জাহাজ ছাড়বে! আপনি বলছেন কী?

–ঠিকই বলছি। আমি মত পরিবর্তন করেছি। আমার ইচ্ছে হয়েছিল এই জাহাজে যাব, এখন আমার ইচ্ছে নেই, তাই যাব না–বুঝেছ?

কুলিটি কিছুক্ষণ আশ্চর্য হয়ে মি. গিলবার্টের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর দ্রুতপদে আর একটি যাত্রীর কাছে এগিয়ে গিয়ে তার মালপত্র তুলে নিয়ে জাহাজের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

মিসেস গিলবার্ট স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন স্তম্ভিতের মতো, নিজের শ্রবণশক্তিকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না–কী বলছেন তার স্বামী?

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ত্যাগ করে আমেরিকায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সংকল্প করেছিলেন গিলবার্ট-দম্পতি আর এ নিয়ে বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের জল্পনাকল্পনারও অন্ত ছিল না। কিন্তু টিকিট বুক করে জাহাজে ওঠার কয়েক মুহূর্ত আগে হঠাৎ গিলবার্ট তার মত পরিবর্তন করলেন কেন?

যে কুলিটি তাদের মালপত্র বহন করার জন্য এগিয়ে এসেছিল তাকে উদ্দেশ্য করে মি. গিলবার্ট যা বললেন তার মর্মার্থ হচ্ছে : তারা যাত্রা স্থগিত রাখছেন; অতএব তাদের মালপত্র বহন করার জন্য কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।

কুলিকে বিদায় দিয়ে মি. গিলবার্ট এইবার তার মালপত্র গুছিয়ে প্যারিসেই ফিরে যাওয়ার উদযোগ করতে লাগলেন। মিসেস এমিলি গিলবার্ট এতক্ষণ একটিও কথা বলেননি, এইবার তিনি দারুণ ক্রোধে ফেটে পড়লেন, জেমস! তোমার এই মত পরিবর্তনের কারণ কী? আমাকে কি তুমি মানুষ বলে মনে কর না? জাহাজের টিকিট কেটে জেটিতে এসে যাত্রার পরমুহূর্তে তুমি যাত্রা স্থগিত করলে! অর্থাৎ আমাকে নিয়ে একটা নিষ্ঠুর কৌতুক করে তুমি বুঝিয়ে দিতে চাও যে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে আমাকে তোমার ঘর করতে হবে যেহেতু তুমি অগাধ অর্থের মালিক!

স্ত্রীর কঠিন তিরস্কারের উত্তরে গিলবার্ট কোনো কথা বললেন না, কেবল একটি কুলিকে ডেকে মালপত্র তুলে নিতে অনুরোধ করলেন, তারপর ধীরপদে এগিয়ে চললেন রাজপথের দিকে একটি ভাড়াটে গাড়ির উদ্দেশে।

চলন্ত গাড়ির ভিতর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন মিসেস এমিলি গিলবার্ট। তিনি যে অত্যন্ত আঘাত পেয়েছেন সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। মাত্র তিন মাস হল প্যারিসে তাদের বিবাহ হয়েছে; নববিবাহিতা তরুণী স্বামীর কাছে এমন বিসদৃশ ব্যবহার আশা করেননি। এতক্ষণ বন্দরের ভিতর আত্মসংবরণ করে থাকলেও গাড়ির ভিতর বসে মিসেস গিলবার্ট আর অবরুদ্ধ ক্রন্দনের বেগ সামলাতে পারলেন না। জেমসের নির্দেশ অনুসারে গাড়ি ছুটতে লাগল প্যারিস শহরের একটা হোটেলের দিকে। স্বামীর মুখোমুখি বসে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন তার স্ত্রী এবং নববধূর ক্রন্দনে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বসে রইলেন জেমস গিলবার্ট এক অনড় প্রস্তরমূর্তির মতো।

জাহাজ ধরতে যাওয়ার আগে যে হোটেলে গিলবার্ট-দম্পতি বাস করছিলেন, বন্দর থেকে ফিরে এসে তারা আবার সেই হোটেলেই উঠলেন। গাড়ির মধ্যে এমিলি স্বামীর সঙ্গে একটিও কথা বলেননি, হোটেলে এসেও তাঁর মৌনব্রত ভঙ্গ হল না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরাজ করতে লাগল অসহ্য নীরবতার এক অদৃশ্য প্রাচীর।

কয়েকদিন পরের কথা। কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস ক্রয় করার জন্য মার্কেটিং-এ বেরিয়েছিলেন। এমিলি, বিষাদের ছায়া তখনো মিলিয়ে যায়নি তাঁর মন থেকে। নববধূর আশাভঙ্গের বেদনাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের যে পূর্ব-ইতিহাস জানতে হবে তা হচ্ছে এই

প্যারিসের বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্য ও নিদর্শন সংগ্রহ করতে এসেছিলেন আমেরিকার প্রত্নতাত্ত্বিক জেমস গিলবার্ট। ওইখানে অর্থাৎ প্যারিস নগরীতেই এমিলির সঙ্গে জেমসের পরিচয় হয় এবং কিছুদিন পরে তারা পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন। এমিলির মাতৃভূমিও আমেরিকা, কিন্তু ঘটনাচক্রে তিনি ফ্রান্সে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিবাহের পর নববিবাহিতা তরুণী স্বামীর সঙ্গে মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন এবং সত্যি সত্যিই তাঁদের আমেরিকা যাত্রার দিন যখন স্থির হয়ে গেল তখন যে এমিলি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন সে-কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু জাহাজে ওঠার পূর্বমুহূর্তে জেমস যে ভাবে বিনা কারণে যাত্রা স্থগিত করলেন তাতে মনে হয় স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য তাঁর কাছে নেই–নিজের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য স্ত্রীকে আঘাত করতে বা অপমান করতে তার বিবেকে বাধে না।

কিন্তু তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়।

স্বামীর বিসদৃশ ব্যবহারের কোনো সংগত কারণ খুঁজে না-পেলেও জেমসকে নিতান্ত স্বার্থপর নিষ্ঠুর মানুষ বলে ভাবতে পারছিলেন না এমিলি। বিবাহের আগে ও পরে তিনি স্বামীর কাছ থেকে কোনোদিনই খারাপ ব্যবহার পাননি। বরং স্ত্রীর প্রতিটি ইচ্ছা-অনিচ্ছার মর্যাদা যে মানুষ স্নেহের সঙ্গে রক্ষা করে এসেছে সেই লোকটি হঠাৎ এমন অসংগত ব্যবহার করল কেন এই প্রশ্নই বার বার জেগে উঠেছে এমিলির মনের মধ্যে।

আচম্বিতে নববধূর চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে তার কর্ণমূলে প্রবেশ করল এক হকারের উচ্চ কণ্ঠস্বর, টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম! দারুণ খবর! লিংকন জাহাজ ডুবে গেছে! জোর খবর!

এমিলি চমকে উঠলেন।

লিংকন! ওই লিংকন জাহাজেই তো তাদের আমেরিকা যাত্রা করার কথা ছিল।

দারুণ কৌতূহলী হয়ে এমিলি একটা টেলিগ্রাম কিনে ফেললেন এবং খবরের ওপর চোখ . বুলিয়ে তিনি হয়ে পড়লেন স্তম্ভিত!

অপ্রত্যাশিতভাবে সামুদ্রিক ঝটিকার আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে ডুবে গেছে লিংকন জাহাজ! একটিমাত্র যাত্রী সাঁতরে বেঁচেছে, আর সকলেরই হয়েছে সলিলসমাধি!

জেমস চুপচাপ বসে ধূমপান করেছিলেন, হঠাৎ ঝড়ের মতো তার সামনে আবির্ভূত হলেন এমিলি! পরক্ষণেই জেমস দেখলেন তার কোলের ওপর এসে পড়েছে একটি কাগজ, সঙ্গেসঙ্গে তিনি শুনতে পেলেন স্ত্রীর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর–জেমস! জেমস! এই দেখ টেলিগ্রাম! লিংকন জাহাজ ডুবে গেছে!… আমি অকারণে রাগ করেছি, দুঃখ পেয়েছি-তুমি নিশ্চয়ই আসন্ন বিপদের কথা জানতে পেরেছিলে! কিন্তু কেমন করে জানলে জেমস! তুমি কি ভবিষ্যতের কথা জানতে পার?

টেলিগ্রামের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে জেমস স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন, ধীরকণ্ঠে বললেন, না, এমিলি, ভবিষ্যতের কথা আমি সবসময় জানতে পারি না। তবে জাহাজে ওঠার পূর্বমুহূর্তে হঠাৎ আমি অনুমান করেছিলাম ওই জাহাজে উঠলে তার পরিণাম আমাদের পক্ষে অশুভ হবে।

এমন অদ্ভুত অনুমানের কারণ? লিংকন খুব মজবুত জাহাজ। ঝড়ের আঘাতে ওই জাহাজ কখনো ডুবে যেতে পারে এমন কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। এমন অভাবিত দুর্ঘটনার কথা তুমি শুধু অনুমান করেই সাবধান হয়েছিলে?

এমিলি! লিংকন জাহাজ জলমগ্ন হবে কি না সে-কথা আমার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব ছিল না। ওই সমুদ্রযাত্রা যে আমাদের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হবে না আমি শুধু এই কথাটাই বুঝেছিলাম। যাক, এসব কথা বলতে আর ভাবতে ভালো লাগছে না। তোমার আপত্তি না-থাকলে বরং চলো–একটা নাট্যশালায় গিয়ে খানিকটা সময় কাটিয়ে আসি।

এমিলির আপত্তি ছিল না। প্যারিস শহরে একটা অপেরা-হাউস-এ তখন জনপ্রিয় প্রদর্শনী। চলছিল, স্বামী-স্ত্রী সেইখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। হোটেলের একটি ভৃত্যকে ডেকে গাড়ি আনতে নির্দেশ করলেন জেমস। একটু পরেই ভৃত্যটি এসে জানাল অশ্বচালিত একটি শকট তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে নির্দিষ্ট গাড়িটির সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন জেমস। এমিলি দেখলেন তার স্বামীর স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে অশ্বচালকের মুখের দিকে। এমিলি শুনতে পেলেন জেমস অস্ফুটস্বরে স্বগতোক্তি করছেন, সে কী! এত শীঘ্র!

গাড়ির চালক অসহিষ্ণুস্বরে বলল, সিয়ে, তাড়াতাড়ি উঠুন। শুনলাম আপনারা  নাট্যশালায় যাবেন। অভিনয় শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই, চটপট উঠুন।

জেমস চালকের কথায় কর্ণপাত করলেন না, তিনি হাত নেড়ে বললেন, আমরা যাব না, তুমি অন্য যাত্রীর সন্ধানে যাও।

বিস্মিত চালক বলল, সে কী মঁসিয়ে! আপনার চাকর যে বললে–

বাধা দিয়ে জেমস বললেন, আমার চাকর নয়, হোটেলের চাকর। সে ভুল করেছে। যাই হোক তোমার সময় নষ্ট হয়েছে সেজন্য আমি দুঃখপ্রকাশ করছি এবং যতটা সম্ভব তোমার ক্ষতিপূরণ করে দিচ্ছি–

পকেট থেকে একটি মুদ্রা বার করে জেমস বিস্মিত চালকের হাতে দিয়ে তাকে চলে যেতে ইঙ্গিত করলেন। চালকের ক্ষোভের কারণ রইল না, সে ঘোড়া ছুটিয়ে অন্য যাত্রীর সন্ধানে যাত্রা করল।

এমিলি এতক্ষণ বোবা হয়ে ছিলেন। এইবার আর তিনি ক্রোধ প্রকাশ করলেন না, লিংকন জাহাজের ঘটনা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কি আজ নাটক দেখতে যাব না?

জেমস বললেন, নিশ্চয়ই যাব। একটু অপেক্ষা করো, আর একটা গাড়ি এখনই পাওয়া যাবে।

গাড়ি পাওয়া গেল, তবে এখনই নয়। প্রায় আধঘণ্টা পরে একটা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল।

…অপেরা-হাউস-এর কাছাকাছি আসতেই স্বামী-স্ত্রীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল আকাশের দিকে। রাতের আকাশে অন্ধকার ভেদ করে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে রক্তিম আলোর বন্যা এবং দূর থেকে ভেসে আসছে বহু মানুষের কোলাহল ধ্বনি!

চালক বলল, আগুন!

বলার অবশ্য দরকার ছিল না। অন্ধকার রাত্রির কালো যবনিকা ভেদ করে আকাশের গায়ে রক্তরাঙা আলোকধারার এমন হঠাৎ আবির্ভাবের কারণ যে এক ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড ছাড়া আর, কিছু হতে পারে না, সে-কথা অনুমান করতে স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ অসুবিধা হয়নি।

একটু এগিয়ে যেতেই জনতার চাপে গাড়ির গতি রুদ্ধ হয়ে গেল। স্বামী-স্ত্রীর বিস্মিত সৃষ্টির সম্মুখে ফুটে উঠল এক ভয়াবহ অগ্নিময় দৃশ্য!

এমিলি প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বললেন, জেমস! ওই নাট্যশালাতেই আমরা সময় কাটাতে এসেছিলাম!

সত্যি কথা! তাঁরা দুজন যে নাট্যাগারের উদ্দেশে এখানে এসেছেন, সেই অপেরা-হাউস বেষ্টন করে জ্বলছে এক ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ড!

সমবেত জনতার কাছে অনুসন্ধান করে জেমস জানলেন প্রায় আধঘণ্টা আগে হঠাৎ কোনো অজ্ঞাত কারণে নাট্যশালায় আগুন ধরে যায়।এমন অতর্কিতে এক প্রচণ্ড অগ্নিবন্যা নাট্যাগারে আত্মপ্রকাশ করে যে, দর্শকরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করা সুযোগও পায় না। অনেক হতভাগ্যেরই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে; অনেকে উদ্ধার পেলেও এমনভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে যে তাদের জীবিত থাকার আশা খুব কম। কোনোরকমে প্রাণরক্ষা হলেও ওইসব নরনারীর মুখ ও দেহের ওপর থেকে আগুনের বীভৎস দংশন-চিহ্ন কোনোদিনই মুছে যাবে না। মানুষের স্বাভাবিক সৌন্দর্য থেকে তারা হবে-চিরজীবনের মতো বঞ্চিত…

স্বামীর হাত ধরে হোটেলে ফিরে এলেন মিসেস এমিলি গিলবার্ট। কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে কোনো কথাবার্তা হল না। আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ রূপ এমিলিকে প্রায় স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। জেমস তাঁর স্ত্রীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন।

অবশেষে প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করলেন এমিলি : জেমস! আজও আমরা অদ্ভুতভাবে রক্ষা পেয়েছি। প্রথম গাড়িটাতে যদি আমরা উঠে পড়তাম তাহলে যথাসময়েই আমরা পৌঁছে যেতাম নাট্যাগারে; এবং ওই ভয়াবহ আগুনের বেড়াজালে পুড়ে আমাদের মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। কিংবা প্রাণে বাঁচলেও সারাজীবন হয়ে থাকতাম মূর্তিমান বীভৎসতার এক কুশ্রী প্রতিচ্ছবি। বলো জেমস, এই অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারটা তুমি নিশ্চয় আগেই জানতে পেরেছিলে?… আমার বিশ্বাস তুমি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, তুমি নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা!… চুপ করে রইলে কেন? আমি তোমার স্ত্রী, আমার কাছে কিছুই তোমার গোপন করা উচিত নয়।

জেমস মুখ তুললেন, না, এমিলি, কিছুই গোপন করব না। তোমাকে আগে বলিনি, কারণ বললেও তুমি হয়তো বিশ্বাস করতে না। আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই তোমার এই ধারণা সত্য নয়, কিন্তু মূর্তিমান অমঙ্গল যখন মৃত্যুদূত হয়ে আমার সামনে আসে তখন আমি তাকে চিনতে পারি। না, কথাটা ঠিক হল না বরং বলতে হবে তখন তাকে চেনার ক্ষমতা আমার ছিল, কিন্তু আজ থেকে সে-ক্ষমতা আর আমার রইল না।

উৎকণ্ঠিত স্বরে এমিলি প্রশ্ন করলেন, কেন? ভবিষ্যতে আবার যদি বিপদ আসে তাহলে কি তুমি জানতে পারবে না?

না, পারব না। কিন্তু জানার প্রয়োজনও আর হবে না। মৃত্যু আরও একবার আমার কাছে আসবে, কিন্তু তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কারণ সেই মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। অবশ্যম্ভাবী স্বাভাবিক পরিণতি। তোমার উদবিগ্ন হওয়ার হেতু নেই এমিলি, আমি আরও অনেক দিন বাঁচব।

তাহলে আমার সন্দেহ সত্য? তুমি ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা রাখো?

না, আগেও বলেছি, এখনও বলছি আমি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী নই, ভবিষ্যদ্রষ্টাও নই। শোনো, সব কথা তোমায় খুলে বলছি। আজ থেকে কয়েক বৎসর আগে আমি মিশরে গিয়েছিলাম। তুমি জানো আমি প্রত্নতাত্ত্বিক, প্রাচীন মিশরের একটি কবর খুঁড়ে আমি একটি কফিন হস্তগত করি। কফিনের ভিতর ছিল একটি মমি। এমিলি, তুমি নিশ্চয় জানোমমিকাকে বলে?

জানি। প্রাচীন মিশরীয়রা কোনো অজ্ঞাত উপায়ে মৃতদেহকে সংরক্ষণ করত। বিশেষ ধরনের ঔষধ প্রয়োগ করে তারা মৃতদেহকে কবর দিত।

ওই ওষুধের প্রভাবে মড়ার চামড়া ও মাংস জীর্ণ হয়ে খসে পড়ত না, দেহে প্রাণ না-থাকলেও সেই মৃতদেহ তার জীবন্ত চেহারার প্রতিচ্ছবি হয়ে কবরের মধ্যে বিরাজ করত যুগযুগান্তর ধরে। অবিকৃত সেই মৃতদেহকে মমি বলা হয়।

ঠিক, ওই ধরনের একটা মমি হস্তগত করে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। শবাধার অর্থাৎ কফিনসুদ্ধ মমির দেহটা আমি নিউইয়র্কে নিয়ে যেতে মনস্থ করি। মমিটা যেদিন আমার হাতে এল সেই রাতেই আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের ভিতর আমার সামনে আবির্ভূত হল এক আশ্চর্য মূর্তি। সেই মূর্তির সর্বাঙ্গ বেষ্টন করে ঝুলছে প্রাচীন মিশরীয় পরিচ্ছদ। তার মুখটা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি; কারণ গোলাকার বলয়ের মতো এক তীব্র আলোকপুঞ্জ অবস্থান করছিল সেই মূর্তির কাঁধের উপর এবং সেই অপার্থিব আলোকপ্রবাহের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল মূর্তির মুখমণ্ডল। সেই অদ্ভুত মূর্তির কাঁধের ওপর থেকে জ্বলন্ত আলোর বলয় ভেদ করে ভেসে এল এক অমানুষিক কণ্ঠস্বর

হে বিদেশি! প্রাচীন মিশরের অমর্যাদা কোরো না। জীবিত মানুষের কাছ থেকে যে বিদায় নিয়েছে, তাকে শান্তিতে বিশ্রাম নিতে দাও। যে কবর খনন করে তুমি কফিনটা নিয়ে এসেছ, সেই কবরের ভিতর আবার তুমি ওটাকে রেখে এসো। আমার কথা শুনলে তোমার মঙ্গল হবে।

পরক্ষণেই মূর্তি অদৃশ্য হল আমার ঘুমও গেল ভেঙে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে আমি স্বপ্নের কথা চিন্তা করলাম। স্বপ্ন বটে, কিন্তু এমন জীবন্ত ও প্রত্যক্ষ স্বপ্নের অনুভূতি আমার জীবনে কখনো হয়নি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পরের দিন স্বপ্নে দৃষ্ট মূর্তির কথা মতো কফিনটা পূর্বোক্ত কবরের মধ্যে রেখে এলাম। সেই রাতে আবার স্বপ্নের মধ্যে সেই মূর্তি আমার সামনে আবির্ভূত হল। স্বপ্নের মধ্যেই শুনলাম সেই গভীর অপার্থিব কণ্ঠস্বর–বিদেশি! আমি খুশি হয়েছি! তোমার অন্যান্য দেশবাসীর মতো তুমি নির্বোধ নও! শোনো, তোমার ভাগ্যে অকালে মৃত্যুযোগ আছে। বার বার তিনবার মৃত্যু তোমাকে আক্রমণ করবে। কিন্তু সাবধান থাকলে অকালমৃত্যু তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। যে-মানুষের মুখের উপর তুমি শুষ্ক রক্তবর্ণ ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাবে তার থেকে সর্বদা দূরে থাকবে। জানবে, ওই রক্তবর্ণ ক্ষতচিহ্নের মানুষ হচ্ছে অশরীরী মৃত্যুর শরীরী প্রতিনিধি। আচ্ছা, আজ বিদায় গ্রহণ করছি, তোমার মঙ্গল হোক…।

আমাকে মঙ্গল কামনা জানিয়ে মূর্তি হল অদৃশ্য এবং তার অন্তর্ধানের পর আমার ঘুমও ভেঙে গেল। ওই ঘটনার কয়েক মাস পরে আমি মিশর ত্যাগ করেছিলাম। কিন্তু মূর্তির সাবধানবাণী কখনো অগ্রাহ্য করিনি। প্রথমে জেটির উপর কুলির মুখে এবং তারপর ঘোড়ার গাড়ির চালকের কপালের ওপর আমি দেখেছিলাম লাল ও শুষ্ক ক্ষতচিহ্ন, সঙ্গেসঙ্গে সাবধান হয়ে কী করেছি তা তো তুমি জান।

এমিলির দুর্ভাবনা গেল না, উদবিগ্ন কণ্ঠে তিনি বলেন, কিন্তু মাত্র তো দু-বার গেছে। এখনও একটা ফাড়াআছে।

জেমস হাসলেন, না ভয় নেই। বিপদ কেটে গেছে। মিশর ছেড়ে আসার আগে কায়রো শহরেই একদিন লিফট দিয়ে নামতে গিয়ে লিফটম্যানের মুখের ওপর দেখলাম মৃত্যুর স্বাক্ষর রক্তবর্ণ ক্ষতচিহ্ন! আমি তৎক্ষণাৎ থেমে গেলাম এবং আমার সঙ্গে যে বন্ধুটি ছিলেন তাঁকে ধরে রেখে জানালাম আমি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামব, অতএব তাঁকেও আমার সঙ্গী হতে হবে। তোমার মতো বন্ধুটিও আমার ওপর রেগে আগুন হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই এক ভীষণ শব্দ! জানা গেল লিফটের কল বিগড়ে যান্ত্রিক খাঁচাটা হঠাৎ আছড়ে পড়েছে নীচে, লিফটের মধ্যে যারা ছিল তাদের মধ্যে একটি প্রাণীও রক্ষা পায়নি! বন্ধুটি খুব আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলেন আমি কি সত্যিই দুর্ঘটনার কথা অনুমান করতে পেরেছিলাম? আমি অবশ্য তাঁর কৌতূহল নিবারণ করিনি। যাই হোক, বার বার তিনবারই আমি অকালমৃত্যুর আক্রমণ এড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি এবং আশা করছি এইবার বেশ কিছুকাল নিশ্চিন্ত হয়ে এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করতে পারব।

উপরে বর্ণিত কাহিনিটি নিছক গল্প নয়, ঘটনাগুলি বাস্তব জীবনেই ঘটেছিল। তবে স্থান, কাল ও পাত্রপাত্রীদের নাম গোপন করা হয়েছে।

[১৩৮৭]

সবজান্তার শাস্তি

বর্তমান কাহিনির পটভূমি হচ্ছে একটি মালবাহী জাহাজ এবং তরঙ্গ-গর্জিত উত্তাল সমুদ্র।

সমুদ্রযাত্রাকে ভিত্তি করে যে-কাহিনি এখানে পরিবেশিত হচ্ছে, সেটি লিখেছেন একজন খ্যাতনামা ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ও-ব্রায়ান।

ক্যাপ্টেন সাহেব বলছেন ঘটনাটি বর্ণে বর্ণে সত্য। আমরা তার কথা বিশ্বাস করতে পারি। ও-ব্রায়ানের মতো দায়িত্বপূর্ণ কার্যে নিযুক্ত মানুষ ছাপার অক্ষরে গুল মারবেন বলে মনে হয় না। ওই সামুদ্রিক নাটকে যারা অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তি আজও সশরীরে বর্তমান তাই ক্যাপ্টেন তার লেখার মধ্যে আসল নামগুলো বদলে দিয়েছেন।

–তা বদলান, লোকগুলোর সঠিক কুষ্ঠি-ঠিকুজি দিয়ে আমাদের কী দরকার? আমরা গল্প শুনতে পেলেই খুশি।

আচ্ছা, এবার কাহিনি শুরু করছি—

এক্স জাহাজটা নেহাত ছোটোখাটো নয়, পাকা ২৫০০ টন তার ওজন। ১৯০৫ সালে অক্টোবর মাসে টাকামা অঞ্চলে এসে উক্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন কয়েকজন অভিজ্ঞ নাবিকের প্রয়োজন অনুভব করলেন।

লোক নেওয়া হল।

সর্দার খালাসির পদে নিযুক্ত হল যে লোকটি, তার চেহারাটা সত্যি দর্শনীয় বস্তু–

দেহ পেশিবহুল ও দৃঢ়, মুখ পাথরের মতো কঠিন নির্বিকার, কালো চুলে ঘেরা চওড়া কপালের নীচে একজোড়া কালো চোখের উগ্র দৃষ্টিতে রূঢ়তার প্রলেপ।

নাম তার ম।

বয়স প্রায় চল্লিশ।

ম রূপবান ছিল না। কিন্তু পৌরুষের প্রভাবে ঢাকা পড়েছিল রূপের অভাব। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিল সে। সাধারণ নাবিকরা তার প্রতি আকৃষ্ট হত, উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা তাকে উপেক্ষা দেখাতে সাহস করতেন না। জাহাজের কাজকর্মে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল। সে যদি তার কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত থেকে নিজের কাজে মনোনিবেশ করত তাহলে ব্যক্তিগত জীবনে সে নিশ্চয়ই উন্নতি করতে পারত।

কিন্তু ম হচ্ছে সবজান্তা মানুষ!

সব বিষয়েই সে ভালো বোঝে এবং অন্য লোকগুলো কিছুই বোঝে না, এই ছিল তার ধারণা।

এই ধারণা পোষণ করে সে যদি ক্ষান্ত থাকত তবে কোনো অসুবিধা ছিল না, কিন্তু পৃথিবীর যাবতীয় মূর্খকে জ্ঞান দেওয়ার গুরুদায়িত্ব সে পালন করত অসীম নিষ্ঠার সঙ্গে!

এক্স জাহাজের কাজে নিযুক্ত হওয়ার পর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই সে আবিষ্কার করে ফেলল যে ডেকের সাদা রংটা মোটেই ভালো হয়নি!

মাস্তুলের উজ্জ্বল রংটাও অতিশয় আপত্তিজনক মনে হল, তা ছাড়া অন্যান্য কলকবজার বিন্যাসব্যবস্থাও তার মনঃপূত হল না।

পেনসিল কাগজ হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে যাবতীয় দোষত্রুটির বিশদ বিবরণ লিখতে লাগল সে। অবিলম্বে এইসব ত্রুটিবিচ্যুতি সংশোধন করা দরকার! ডেকের ওপর দুজন শিক্ষানবিশ সকৌতুকে তার চালচলন লক্ষ করছিল, কিন্তু কোনো মন্তব্য করার সাহস তাদের ছিল না।

ম-র চেহারার মধ্যে ছিল এমন এক বন্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ যে সাধারণ মানুষ চট করে তার আচরণের প্রতিবাদ করতে সাহস পেত না।

কিন্তু জাহাজের প্রধান মেট বা দ্বিতীয় অধ্যক্ষ বি খুব সাধারণ মানুষ ছিল না। সে যখন দেখল বিনা কারণে কতকগুলি পুরোনো দড়ি বাতিল করে ম নামধারী সর্দার-খালাসি নূতন দড়ি ব্যবহার করতে চাইছে তখন সে বাধা দিল–

মাল বাঁধার কাজ পুরানো দড়িতেই চলবে। নতুন দড়ি শুধু গিয়ার আর নোঙর বাঁধার কাজে ব্যবহার করা হয়। ভবিষ্যতে আমার অনুমতি ছাড়া তুমি নতুন দড়িতে হাত দেবে না।

নতুন দড়ির ফাঁসটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল সর্দার-খালাসি—

তুমি যদি মনে করে থাক যে কথায় কথায় তোমার কাছে আমি অনুমতি নিতে ছুটব তাহলে তুমি ভুল করেছ।

ম স্থান ত্যাগ করার উপক্রম করলে, কিন্তু তাকে বাধা দিলে বি, একটা কথা শুনে যাও। ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে কথা কইতে হলে স্যার বলবে, বুঝেছ?

বিদ্রূপ-জড়িত হাসির সঙ্গে উত্তর এল, বুঝেছি, স্যার!

উইলসন নামে যে শিক্ষানবিশ নাবিকটি সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল।

তার সহযোগীকে সে বললে, নতুন সর্দার-খালাসি আর আমাদের প্রধান মেট পরস্পরকে পছন্দ করছে না। একটা গোলমাল বাধবে মনে হচ্ছে।

উইলসনের ধারণা যে ভুল হয়নি, খুব শীঘ্রই তার প্রমাণ পাওয়া গেল।

কয়েকদিন পরের কথা। ঠিক সাড়ে ছয়টার সময়ে সর্দার-খালাসির কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল প্রধান মেট বি–

ওহে সর্দার! কাল রাতে তোমাকে যে হুকুম দিয়েছিলাম আজ সকালেই তুমি সেটা ভুলে গেছ? সকাল ছয়টার মধ্যে আমি লোকজন লাগিয়ে ডেকটাকে পরিষ্কার করে রাখতে বলেছিলাম। এখন সাড়ে ছয়টা বাজে অথচ ডেক আগের মতোই ময়লা হয়ে পড়ে আছে। ওখানে একটিও লোক নেই–ব্যাপারটা কী? কাল রাতের কথা আজ সকালেই ভুলে গেলে? তোমার স্মৃতিশক্তি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে।

ম ধূমপান করছিল।

সে নির্বিকার চিত্তে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললে, আমি কিছুই ভুলিনি। আমার স্মৃতিশক্তি নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আসল কথা হচ্ছে যে ঘুমটা ভালো হলে কাজটাও ভালো হয়। তাই আমি ওদের আরও ঘণ্টা দুই ঘুমানোর অনুমতি দিয়েছি। ঠিক আটটার সময়ে ওরা কাজে লাগবে।

তুমি অনুমতি দিয়েছ? তুমি অনুমতি দেওয়ার কে? ফের যদি তুমি ওপরচালাকি কর তাহলে তোমাকে আমি সর্দার-খালাসির পদ থেকে খারিজ করে দেব।

তুমি আমায় খারিজ করবে?সর্দার-খালাসির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, ওহে খোকা! যখন তুমি দোলনায় দুলতে দুলতে বোতলের দুধ খাচ্ছ তখন থেকে আমি জাহাজের কাজে লোকজন খাটাচ্ছি, বুঝলে?

ম আরও যেসব কথা বলতে যাচ্ছিল সেগুলো নিশ্চয়ই বি-র পক্ষে খুব সম্মানজনক হত না, কিন্তু বি তাকে আর কথা বলতে দিল না।

সর্দার-খালাসির চোয়ালের উপর সে প্রয়োগ করলে, মুষ্টিবদ্ধ হস্তের নিদারুণ মুষ্টিযোগ!

আচমকা ঘুসি খেয়ে ছিটকে পড়ল ম।

প্রথমে সে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, তারপর বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে সে উঠে দাঁড়াল এবং খেপা ষাঁড়ের মতো গর্জন করে তেড়ে এল প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে।

ম-র শারীরিক শক্তি ছিল বি-র চাইতে অনেক বেশি।

কিন্তু বি পাকা মুষ্টিযোদ্ধা, তার বাঁ-হাতের বজ্রমুষ্টি বারংবার ছোবল মারল প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখে।

দেখতে দেখতে ম-র মুখের উপর ফুটে উঠল তপ্ত রক্তধারার বিচিত্র আলপনা।

ডেকের ওপর ততক্ষণে ভিড় জমিয়েছে নাবিকের দল।ম-র রক্তমাখা মুখের অবস্থা দেখে একজন মন্তব্য করলে, সর্দার-খালাসির হয়ে এসেছে।

কিন্তু ম পোড় খাওয়া মানুষ, এত সহজে সে হার মানতে রাজি হল না।

দুই বাহু বিস্তার করে সে বি-কে জড়িয়ে ধরলে এবং চোখের পলক ফেলার আগেই প্রতিদ্বন্দ্বীর দেহটাকে নিক্ষেপ করলে জাহাজের ডেকের ওপর।

একটা লোহার যন্ত্রের গায়ে বি-র মাথাটা সজোরে ঠোক্কর খেল, দারুণ যাতনায় লুপ্ত হয়ে এল তার চেতনা।

আচ্ছন্ন অবস্থায় সে দেখতে লাগল রাশি রাশি সরষে ফুল!

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বি যখন উঠে দাঁড়াল, তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী মুখের রক্ত মুছতে–ব্যস্ত। দুই শত্রু পরস্পরকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলে, তারপর বি বললে, লড়াই শেষ হয়নি। আমরা আবার লড়ব। দুজন সহযোগী আর একজন মধ্যস্থ এখানে থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে একজন লম্বা হয়ে শুয়ে না-পড়বে ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই চলবে রাজি?

কাধ ঝাঁকিয়ে ম বললে, ঠিক আছে।

জাহাজের খালাসিরা মহা উৎসাহে কাজে লেগে গেল। বিকালের মধ্যেই ডেকের ওপর দড়িদড়া লাগিয়ে একটা সুন্দর মুষ্টিযুদ্ধের রিং বা আখড়া বানিয়ে ফেলল তারা।

সবাই প্রস্তুত। এবার লড়াইটা লাগলে হয়। অকস্মাৎ মূর্তিমান বিঘ্নের মতো অকুস্থলে উপস্থিত হলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন।

চারদিকে চোখ বুলিয়ে তিনি বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, কী ব্যাপার? সার্কাস-টার্কাস হবে নাকি?

মেট সমস্ত ব্যাপারটা ক্যাপ্টেনকে বুঝিয়ে বললে।

সব শুনে ক্যাপ্টেন সাহেব একটি বক্তৃতা দিলেন।

সেই দীর্ঘ বক্তৃতার সারমর্ম হচ্ছে যে ঘুসির জোরে যারা মানুষের ভ্রম সংশোধন করতে চায়, তাদের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারছেন না এবং তার জাহাজে এই ধরনের বর্বরতা তিনি। বরদাস্ত করবেন না কিছুতেই।

ক্যাপ্টেনের কথার ওপর কথা চলে না। লড়াই বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকদিন পরেই জাহাজের উপর হানা দিল প্রবল ঝটিকা। ক্যাপ্টেন ডেকের ওপর ছিলেন, জাহাজের একটা বৃহৎ অংশ ঝড়ের ধাক্কায় ভেঙে পড়ল তার মাথার ওপর এবং ওই ভাঙাচোরা অংশসমেত তার দেহ ছিটকে পড়ল সমুদ্রের জলে।

ক্যাপ্টেনকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। উত্তাল তরঙ্গের বুকে হারিয়ে গেলেন জাহাজের প্রধান অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন জেড।

অন্যান্য খালাসিরা ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। প্রধান মেট বি এবং তার দুই সহকারী ভয়ার্ত নাবিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে প্রাণপণে যুদ্ধ করলে ঝড়ের বিরুদ্ধে।

বি-র উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসে সেবার ভরাডুবি থেকে রক্ষা পেল এক্স জাহাজ।

ক্যাপ্টেন তো আগেই মারা গিয়েছিলেন, এখন জাহাজ পরিচালনার ভার নেয় কে?

বি নিজেই এবার পোত-অধ্যক্ষ বা ক্যাপ্টেনের স্থান অধিকার করলে। জাহাজের ভাঙাচোরা অংশগুলি মেরামত করে সে নাবিকদের ডাকল। সমবেত মাঝি-মাল্লাদের উদ্দেশ্য করে সে জানিয়ে দিলে, যদিও পূর্বনির্ধারিত ব্যবস্থা অনুযায়ী জাহাজের গন্তব্যস্থল ছিল পাগেট সাউন্ড নামক স্থান, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হওয়ায় এক্স জাহাজ এখন সেখানে যাবে না।

জাহাজ যেখান থেকে সাগরে ভেসেছিল আবার সেই বন্দরেই ফিরে যাবে, অর্থাৎ জাহাজের গন্তব্যস্থল এখন পাগেট সাউন্ড নয়–লিভারপুল।

ম হঠাৎ প্রতিবাদ জানিয়ে বললে, মেট-এর সিদ্ধান্ত তার মনঃপূত নয় এবং বি যদি তার সঙ্গীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাহলে সে বুঝবে নাবিকরা কেউ তাকে সমর্থন করছে না।

বি বললে, কারো মতামত জানতে সে এখানে নাবিকদের ডাকেনি।

তার মতামত জানানোর জন্যই সে সকলকে ডেকে পাঠিয়েছিল।

নাবিকদের ভিতর থেকে একটা মূলাটো জাতীয় বর্ণসংকর উঠে দাঁড়িয়ে বি-কে জানাল যে সে ম-র সঙ্গে একমত। জাহাজ চালানোর অভিজ্ঞতা বি-র নেই, অতএব পরিচালনার ভার ম-কে দেওয়া উচিত।

খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো ঘুরে দাঁড়াল বি, বাঃ! ক্যাপ্টেনের মৃত্যুর জন্য তুমিই তো দায়ী, এখন আবার লম্বা বক্তৃতা ঝাড়ছ?

সমবেত নাবিকমণ্ডলী চমকে উঠল–এ আবার কী কথা?

বি আবার বললে, ভেবেছিলুম কিছু বলব না। কিন্তু তুমি যখন মুখ খুলেছ তখন সত্যি কথাটা সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি। জাহাজের চাকা ঘোরানোর ভার ছিল তোমার ওপর–ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে ছিলেন তোমার পাশে। তুমি যদি চাকা ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে না যেতে তাহলে হয়তো ক্যাপ্টেনের মৃত্যু হত না। ভীরু! কাপুরুষ! নিজে দোষ করে আবার বড়ো বড়ো কথা কইতে লজ্জা করে না! হ্যাঁ, তোমার সঙ্গীদের একটা কথা জানিয়ে দেওয়া দরকার–এখন থেকে তুমি দ্বিতীয় শ্রেণির নাবিক, প্রথম শ্রেণির থেকে তোমাকে আমি খারিজ করলুম। এখন তুমি অনেক কম টাকা পাবে আর বন্দরে পৌঁছেই তোমার নামে আমি নালিশ জানাব।

মূলাটো গজগজ করতে করতে চলে গেল।

বি-র সহকারী ব্যাপারটা পছন্দ করলে না।

বর্ণসংকর মূলাটোটা পাকা গুন্ডা, ইতিপূর্বে একটি লোককে সে ছোরা মেরেছিল।

বি অবশ্য এই ধরনের লোককে পরোয়া করে না।

ছোরাছুরির ভয়ে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার মত মেরুদণ্ডহীন মানুষ সে নয়।

কিছুদিন পরে হল আর একটি দুর্ঘটনার সূত্রপাত।

একজন নাবিক হঠাৎ ডেকের ওপর থেকে সমুদ্রের জলে পড়ে গেল। তাকে উদ্ধার করার জন্য নৌকা নামাতে গিয়ে নাবিকরা দেখল, নোঙর তোলার জন্য যে কাষ্ঠ-আধারটা ব্যবহার করা হয় সেটা যথাস্থানে নেই। কোনোরকমে ব্যবস্থা করে লোকটাকে সলিলসমাধি থেকে উদ্ধার করা হল বটে কিন্তু বেশ দেরি হয়ে গেল। ইতিমধ্যে হিংস্র সামুদ্রিক পক্ষীর আক্রমণে লোকটির হাত এবং মুখ হয়ে গেছে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত।

ম বললে, যে লোকটি জলে পড়েছিল তার দুর্দশার জন্য দায়ী বি, কারণ তার আদেশেই ওই নোঙরগুলো খুলে ফেলা হয়েছিল। শুধু ওইটুকু বলে সে চুপ করলে না, তার আশেপাশে সমবেত নাবিক-বন্ধুদের সে বোঝাতে লাগল যে বি মোটেই অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করার উপযুক্ত নয়।

ম-র বক্তব্যের মধ্যে যুক্তির অভাব থাকলেও বিদ্রুপের অভাব ছিল না কিছুমাত্র।

বি একটু দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।ম-রউচ্চকণ্ঠের মন্তব্যগুলি খুব সহজেই তার শ্রবণপথে প্রবেশ করছিল। সে বুঝল, নাবিকদের উপলক্ষ্য করে ম কথাগুলো তাকেই শোনাতে চাইছে।

বি সামনে এসে ম-কে সম্বোধন করে বললে, শোনো ম, আজ থেকে তুমি আর খালাসিদের সর্দার নও। তোমাকে আমি সর্দারের পদ থেকে খারিজ করে সাধারণ মাল্লার পদে বহাল করলুম। তোমার মাইনেও কমে গেল।

ম-র মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল, দুই হাতের মুঠি পাকিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, আমার কাজ আমি জানি। তুমি আমাকে খারিজ করবার কে? তোমার হুকুম আমি মানতে রাজি নই।

বি-র কণ্ঠস্বরেও জাগল রোষের আভাস, আমার কথা না-শুনলে তোমার হাতে আমি হাতকড়া লাগাব।

সত্যি? হা-হা শব্দে হেসে উঠল ম, একবার চেষ্টা করে দেখো।

বি-র আদেশে তার সহকারী একটা হাতকড়া নিয়ে এল কেবিন থেকে।

একজন মাল্লা হঠাৎ বলে উঠল, ওহে মিস্টার! ম-র সঙ্গে বেশি চালাকি করার চেষ্টা করলে তোমাকে আমরা ছেড়ে দেব না।

বাঃ! বাঃ! ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল সেই বর্ণসংকর মূলাটো, চমৎকার! চমৎকার! ভাইসব–আমরা থাকতে ওই খোকাটা আমাদের সর্দারকে অপমান করবে? ডান্ডাগুলো একবার নিয়ে এসো দেখি, বুড়ো খোকাকে ঠান্ডা করার দাওয়াই আমি বাতলে দিচ্ছি।

সাবধান! গর্জে উঠল বি, সাঁৎ করে পকেট থেকে সে টেনে আনল একটা চকচকে রিভলভার, তোমাকে গুলি করে মারলে আমার কোনো শাস্তি হবে না। আইন আমার পক্ষে, সমুদ্রের বুকে জাহাজের ওপর বিদ্রোহের চেষ্টা আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ। বিদ্রোহীকে ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর গুলি করার অধিকার আছে। অতএব সাবধান!

সত্যি কথা। মুলাটোর উচ্চকণ্ঠ তৎক্ষণাৎ নীরব হল।

বি-র সহকারী ততক্ষণে হাতকড়া নিয়ে এসেছে।

হাতকড়াটা সহকারীর হাত থেকে নিয়ে বি সেটাকে ডেকের ওপর ছুঁড়ে দিলে, নাও, এবার ওই হতভাগা মর হাতে তোমরা লোহার বালা পরিয়ে দাও চটপট।

সামনে এগিয়ে এল এক জোয়ান খালাসি, বি-র চোখের ওপর চোখ রেখে সে বললে, হ্যাঁ, চটপট করছি। পরক্ষণেই এক লাথি মেরে সে হাতকড়াটাকে পাঠিয়ে দিলে জাহাজের নর্দমার মধ্যে! প্রকাশ্য বিদ্রোহ!

বি তার চওড়া কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে বললে, বেশ, তোমরা যা খুশি করো। তবে একটা কথা জেনে রাখো, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ম-র হাতে হাতকড়া না-লাগাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কেউ তামাক কিংবা সিগারেট পাবে না। আমার আদেশ পালন না-করলে ধূমপান বন্ধ, বুঝলে?

বি তার নিজের কেবিনে ফিরে এল।

তিন দিনের মধ্যেই অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ল।

বি-র সহকারী শিক্ষানবিশ ছেলেটিকে সবাই মিলে এমন প্রহার করল যে ছেলেটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

খবর পেয়ে লাফিয়ে উঠল বি, শয়তানগুলোকে ভালোভাবে শিক্ষা দিতে হবে।

বি সোজা এসে ঢুকল ভাড়ার ঘরে।

একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল বিদ্রোহী মাল্লার দল, তাদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করলে, কী করতে চাও মিস্টার?

বলছি, একটু অপেক্ষা করো। জাহাজের রাঁধুনিকে ভঁড়ার ঘর থেকে বাইরে এনে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলে বি, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ম-র হাতে হাতকড়া না-লাগাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের খাওয়াদাওয়া বন্ধ। ভঁড়ার ঘর আর রান্নাঘর আমি তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দিলুম।

সমবেত জনতার কণ্ঠে জাগল হিংস্র গর্জন-ধ্বনি।

সাঁ করে উড়ে এসে একটা কাঠের ডান্ডা বি-র মাথা ঘেঁষে দরজার উপর সশব্দে আছড়ে পড়ল, একটুর জন্য সে বেঁচে গেল।

বিনা বাক্যব্যয়ে পকেট থেকে রিভলভার বার করলে বি।

রিভলভার দেখে বিদ্রোহী নাবিকদের আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল। চটপট পা চালিয়ে তারা সরে পড়ল বির সামনে থেকে।বি-র ওষ্ঠাধরে জাগল তিক্ত হাসির রেখা, গরম গরম গুলি খেতে বোধ হয় তোমাদের ভালো লাগবে না, কি বলো?

তারপর পিছন ফিরে সে অকুস্থল ত্যাগ করলে।

তার সঙ্গ নিলে দুজন সহকারী।

সেদিন সন্ধ্যার পরেই আকাশের অবস্থা হয়ে উঠল শোচনীয়। ঘন মেঘের কালো ছায়া হানা দিল আকাশের গায়ে, অন্ধকার শূন্যে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে হেঁকে উঠল বজ্র–গর্জিত বাতাসের সঙ্গে নাচতে নাচতে নেমে এল প্রবল বৃষ্টিধারা।

খালাসিরা কিন্তু কেউ জাহাজ রক্ষা করতে এগিয়ে এল না।বি তার দুই সহকারীর সাহায্যে পালগুলো নামিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগল।

আচম্বিতে ছুটে এল কয়েকটা কাঠের ডান্ডা বি-র দিকে। একটা ডান্ডা বি-র পেটে লাগতেই তার হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে পড়ল। তৎক্ষণাৎ অন্ধকারের ভিতর থেকে ছুটে এসে ম রিভলভারটা তুলে নিয়ে বি-র দেহ লক্ষ করে গুলি ছুড়ল। নিশানা ব্যর্থ হল, বি লম্বা দৌড় মারল তার কেবিনের দিকে। তার পিছনে তাড়া করে ছুটে এল ক্ষিপ্ত মাল্লার দল।

বি-র দুই সহকারী এবার রঙ্গমঞ্চে ভূমিকা গ্রহণ করলে।

একজন এগিয়ে এসে জনতাকে লক্ষ করে রিভলভার ছুড়ল। একটা কাতর আর্তনাদ ভেসে এসে জানিয়ে দিল রিভলভারের গুলি লক্ষ্য ভেদ করেছে।

হঠাৎ অন্ধকারের বুকে বিদ্যুৎ হেনে উড়ে এল একটা মস্ত ছোরা। চিৎকার করে উঠল বি-র একজন সহকারী ছোরাটা তার কাঁধের ওপর বসে গেছে।

আহত ছেলেটির অবশ হাত থেকে রিভলভারটা টেনে নিয়ে বি দু-বার গুলি চালাল। জাহাজের অন্ধকার গহ্বর থেকে কাতর আর্তস্বর জেগে উঠে জানিয়ে দিলে গুলি যথাস্থানে পৌঁছে গেছে।

মাঝিমাল্লারা খেপে গেল। অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে তারা ছুঁড়তে লাগল ঝাঁকে ঝাকে কাঠের ডান্ডা আর লোহার টুকরো।

বি তার দুই সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে চার্টরুম-এর ভিতর ঢুকে দরজায় ভিতর থেকে তালা লাগিয়ে দিলে।

বন্ধ দরজার ওপর পড়তে লাগল আঘাতের পর আঘাত, কিন্তু ওক কাঠের শক্ত দরজা অত সহজে ভাঙা সম্ভব নয়।

ইতিমধ্যে নূতন বিপদের সূত্রপাত।

জাহাজের ওপর আছড়ে পড়ছে ক্ষিপ্ত ঝটিকা এবং তার তলদেশে আঘাত হেনে লাফিয়ে উঠছে তরঙ্গ-বন্ধুর উত্তাল সমুদ্র।

চালকবিহীন জাহাজের তখন যায় যায় অবস্থা, এখনই বুঝি ভরাডুবি হয়।

বিপদের গুরুত্ব বুঝে মাল্লারা লড়াই থামিয়ে জাহাজ বাঁচাতে ছুটল।

কিছুক্ষণ পরেই আবার করাঘাতের শব্দ বেজে উঠল বন্ধ দরজার গায়ে, একজন নাবিক আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, মি. বি–দরজা খোলো। জাহাজ প্রায় ডুবতে বসেছে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।

উদ্যত রিভলভার হাতে বি দরজা খুলল।

জলসিক্ত দেহে নাবিকটি চেঁচিয়ে উঠল, তাড়াতাড়ি এসো, জাহাজ ডুবছে!

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে!

বি শান্তস্বরে বললে, আমি কী করব? তোমাদের সর্দারের কাছে যাও।

সে হতভাগা জাহাজ চালাতে জানে না। এতক্ষণ ধরে সে উলটোপালটা হুকুম চালিয়ে জাহাজটাকে ডোবাতে বসেছে। তুমি ছাড়া কেউ এখন জাহাজ বাঁচাতে পারবে না–তাড়াতাড়ি চলো।

বি-র প্রধান সহকারী এগিয়ে এল, কিন্তু বি বাধা দিলে, না। আগে এই লোহার বালা দুটো নিয়ে যাও

টেবিলের টানা খুলে বি একজোড়া হাতকড়া তুলে ধরলে ওই হতভাগা ম আর ছুরিমারা গুন্ডা মূলাটোকে আগে বন্দি করে নিয়ে এসো। আমার আদেশ পালিত না হলে আমি জাহাজের ভার গ্রহণ করব না।

একটানে হাতকড়া দুটো ছিনিয়ে নিয়ে নাবিকটি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে গেল।

একটু পরেই একদল নাবিক ঘরে প্রবেশ করলে, তাদের সঙ্গে রয়েছে ম! তার দুই হাতে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে হাতকড়া।

বি বললে, আর একজন কোথায়? ওই মূলাটো গুন্ডা–তার কী হল?

একজন নাবিক বললে, পাজিটা ছুরি বার করেছিল স্যার।

হু, তারপর?

ইয়ে, মানে… ছুরিটা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমরা… মানে… ইয়ে..

বি ধমক দিলে, স্পষ্ট করে বলো কী বলতে চাও?

ইয়ে, মানে–ঝটাপটি করতে করতে মূলাটোটা হঠাৎ কেমন করে জলে পড়ে গেল।

বাঁচা গেল।

বি আর জেরা করলে না। সে বুঝল, যেভাবেই হোক গুন্ডাটা সমুদ্রগর্ভে সমাধিলাভ করেছে। সে দরজা খুলে বাইরে এসে জাহাজের ডেকের ওপর দাঁড়াল।

এক্স জাহাজ সেযাত্রা বেঁচে গেল।

বি-র নির্দেশ অনুযায়ী প্রাণপণে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে মাল্লারা জাহাজটাকে রক্ষা করলে ক্ষিপ্ত সমুদ্রের গ্রাস থেকে।

জাহাজ নিরাপদে পৌঁছে গেল তার নিজস্ব বন্দরে।

সর্দার-খালাসি ম-কে গ্রেপ্তার করে বিচারকের সামনে উপস্থিত করা হল। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টির অভিযোগ।

বিচারে অবশ্য তার শাস্তি হয়নি, উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা গেল না। বিচারক তাকে ছেড়ে দিলেন।

তবে আদালতের দরবারে শাস্তি না-পেলেও বির হাতে যথেষ্ট নিগ্রহ এবং অপমান ভোগ করেছিল ম।

সবজান্তা মানুষটির মানসপটে শুষ্ক ক্ষতচিহ্নের মতো চিরকাল জেগে থাকবে সেই লাঞ্ছনার ইতিহাস।

[বৈশাখ ১৩৭৭]

সীমান্তের বিভীষিকা

রাজ্য সরকার চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

চিন্তার কথা তো বটেই। কিছুদিন ধরে সীমান্তের সেনানিবাসে চিঠিপত্র বা খাদ্যবস্তু কিছুই এসে পৌঁছোয় না–ডাকপিয়ন নিরুদ্দেশ!

দক্ষিণ আমেরিকার যে বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমির বুকে পেরু এবং ইক্যয়াডর নামক দুই রাজ্যের সীমানা এসে মিলিত হয়েছে, সেইখানে ইক্যয়াডার রাজ্যের নিজস্ব সীমান্তে একটি ছোটো সেনানিবাস আছে।

সেনানিবাসের খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েই ইক্যয়াডরের রাজ্য সরকার খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

চিন্তার কারণ আগেই বলেছি- শহর থেকে চিঠিপত্র ও খাদ্যবস্তু নিয়ে ডাকবাহক আর সেনানিবাসে পদার্পণ করে না। চিঠিপত্র তবু না হলেও চলে, কিন্তু খাদ্যের অভাবে সীমান্তরক্ষীদের অবস্থা শোচনীয়।

শুরু হল অনুসন্ধান-পর্ব। অবশেষে জানা গেল যে, হতভাগ্য ডাকপিয়নের অনুপস্থিতির কারণ হচ্ছে একটি অতিকায় সর্প।

এক জন নয়, পর পর দুজন ডাকহরকরা সাপের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে। আপার আমাজন নামক অরণ্যময় অঞ্চলের ভিতর দিয়ে নদীপথে নৌকো চালিয়ে আসার সময় সর্পদানব নৌকোর উপর হানা দিয়ে ডাকবাহকদের হত্যা করেছে এবং নৌকোসমেত যাবতীয় খাদ্যবস্তুর হয়েছে সলিল-সমাধি।

মহা মুশকিল! সাপের উৎপাতে কি সীমান্তরক্ষী সৈন্যরা উপবাস করবে?

বিমানযোগে প্যারাশুটের সাহায্যে কিছু কিছু খাদ্যদ্রব্য সৈন্যদের প্রেরণ করা হয় বটে, কিন্তু কয়েকটি বিশেষ প্রয়োজনীয় খাদ্য ওইভাবে পাঠানো সম্ভব নয়। তাই জলপথে নৌকো চালিয়ে চিঠির সঙ্গে খাদ্যসম্ভারও নিয়ে আসে ডাকবাহক পিয়ন।

পান্তাজা, টাইগার ও কুরারে নামক তিনটি নদীর উপর দিয়ে ক্যানো জাতীয় নৌকোর সাহয্যে ডাকবিভাগের কাজকর্ম চালানো হয়। ইক্যয়াডর রাজ্যের ডাকবহনকারী পিয়নরা সভ্য জগতের সঙ্গে অরণ্যবাসী সৈনিকদের আদান-প্রদান অক্ষুণ্ণ রাখে। অতএব তাদের জীবন রাষ্ট্রের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।

পর পর তিনটি নৌকো এবং দু-দুটি পিয়ন যখন সর্পের আক্রমণে সলিল সমাধি লাভ করল, তখন রাজ্য সরকার উদবিগ্ন হয়ে পড়লেন। সাপটাকে হত্যা করার জন্য নিযুক্ত হল একটি শিকারি দল।

সীমান্তরক্ষী কয়েক জন শ্বেতাঙ্গ সৈনিক ও অরণ্যবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের নিয়ে এই ছোটো দলটি গঠিত হল। দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন সার্জেন্ট পাবলো।

গ্রামবাসীদের মধ্যে অনুসন্ধান করে ইতিমধ্যে জানা গেছে, সর্পদানব শুধু ডাকহকরাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়, তার ভয়াবহ ক্ষুধা তৃপ্ত করতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে কয়েকটি শিশু এবং তিনটি যুবক।

নদীর জলে সাঁতার কাটার সময়ে যুবক তিনটি সর্পদানবের আক্রমণে মারা পড়েছে। হত্যাকাণ্ডগুলি সংঘটিত হয়েছে বহু মানুষের চোখের সামনে।

নদীর জলে রেড-ইন্ডিয়ান মেয়েরা ময়লা কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করে। কোনো অসতর্ক জননী যদি শিশু-সন্তানকে তীরভূমির উপর রেখে কাপড় কাঁচতে বসে, তাহলেই হয় বিপদ। আচম্বিতে জলের ভিতর থেকে একটা সুদীর্ঘ লাঙ্গুল ছিটকে বেরিয়ে আসে, পরক্ষণে ডাঙার উপর অবস্থিত হতভাগ্য শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে জলের মধ্যে!

শিকারের দেহ জলের উপর এসে পড়লেই ভয়াল দানব তাকে কামড়ে ধরে। অভাগিনী মা দেখতে পায়, তার কোলের সন্তান ছটফট করছে সাপের মুখে। পরক্ষণেই নদীর জলে মিলিয়ে যায় সেই ভয়াবহ দৃশ্য।

শুধু দ্বিপদ মনুষ্য নয়, গৃহপালিত চতুষ্পদ পশুর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছে মহাসর্পের লুব্ধ দৃষ্টি। গ্রামবাসীদের বহু কুকুর, ছাগল ও শূকর স্থান লাভ করছে সর্পের উদর-গহ্বরে।

এতগুলো হত্যাকাণ্ডের নায়ক হচ্ছে একটি আনাকোন্ডা।

সর্পরাজ আনাকোন্ডা– যেমন ভয়ঙ্কর তার চেহারা, তেমনি তার আকৃতি-প্রকৃতি! অজগর সমাজে আনাকোন্ডা হচ্ছে বৃহত্তম জীব। এরা দৈর্ঘ্যে আঠারো থেকে পঁচিশ ফিট পর্যন্ত হয়। পঁয়ত্রিশ ফিট লম্বা আনাকোন্ডাও দেখা গিয়েছে।

অজগর-গোষ্ঠীর অন্যান্য সাপের মতোই আনাকোন্ডা নির্বিষ। অবশ্য তাতে কিছু যায়-আসে না। শিকারকে অতর্কিতে জড়িয়ে ধরে চাপ দিতে থাকে আনাকোন্ডা এবং সেই প্রচণ্ড পেষণে অস্থি-পঞ্জর চূর্ণ হয়ে অথবা শ্বাসরোধ ঘটার ফলে হতভাগ্য জীবটি যখন প্রাণত্যাগ করে, তখন সর্পরাজ শিকারের মৃতদেহ আস্ত গিলে ফেলে। এক বার শিকার ধরলে বেশ কয়েক দিন তার আর আহারের প্রয়োজন হয় না। এই সময় নির্জীব হয়ে শুয়ে থাকে সে। শিকারের দেহের মাংস হজম হয়ে গেলেই আবার শিকারের সন্ধানে বের হয়।

আনাকোন্ডা জল ভালোবাসে। অধিকাংশ সময়েই সে জলে থাকে, তবে ক্ষুধার্ত হলে ডাঙায় উঠে এসেও শিকারকে আক্রমণ করে। অর্থাৎ এই সর্পদানবের জাত উভচর জলে স্থলে সর্বত্রই তার অবাধ গতি। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন জলাভূমি ও নদীর নিকটবর্তী অরণ্যে এই ভয়ঙ্কর জীবদের দেখা যায়।

এমনি এই সর্পদানবের আতঙ্কে পেরু ও ইক্যয়াডরের সীমান্তভুমির দম বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে। আর তাই সাপটাকে হত্যা করার জন্য রাজ্য সরকারের তরফ থেকে নিযুক্ত হয়েছে একদল শিকারি।

শ্বেতাঙ্গ ও স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে মিলিত এই দলটির নেতা পাবলো আগুরা নামক জনৈক সার্জেন্ট। পাবলো ও তার শ্বেতাঙ্গ সঙ্গীদের নিয়ে যে শিকারির দলটি গঠিত হয়েছে তারা সকলেই সীমান্তের রক্ষীবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। আর জিভারো এবং ইয়াম্বো নামক রেড-ইন্ডিয়ান জাতির দুই দল মানুষ স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছে এই শিকার-অভিযানে।

পাবলোর নেতৃত্বে শ্বেতাঙ্গ সৈনিক ও রেড-ইন্ডিয়ানদের মিলিত বাহিনী সমগ্র অঞ্চলটা খুঁজল তন্ন-তন্ন করে। কিন্তু সর্পদানবের সন্ধান মিলল না।

পাবলো তখন সাপের জন্যে ফাঁদ পাতল। এই ফাঁদের টোপ হল কয়েকটা ছাগল। নদীর ধারে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা ছাগলকে বেঁধে রাখা হল। এই জীবন্ত টোপগুলির আশেপাশে সর্পরাজকে উপযুক্ত অভ্যর্থনা করার জন্য লুকিয়ে রইল একদল সশস্ত্র শিকারি। দ্বিপদ ও চতুষ্পদ যাবতীয় জীবন্ত খাদ্যের মধ্যে ছাগলই হচ্ছে আনাকোন্ডার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। অতএব শিকারিরা আশা করে, ছাগ-মাংসের লোভে দানব নিশ্চয় আত্মপ্রকাশ করবে…

পর পর তিনটি দিন চলে গেল, কিন্তু আনাকোন্ডার পাত্তা নেই! হয়তো সর্পরাজ শিকারিদের অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে, অথবা তখনো পর্যন্ত হয়তো পূর্ববর্তী শিকারের মাংসে উদর পূর্ণ থাকায় সরীসৃপ নতুন শিকারের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি।

অবশেষে চতুর্থ দিন ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় হঠাৎ প্রভাতের নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল একটা ছাগল কণ্ঠের কাতর আর্তনাদ!

আরাবেলা নামক একটি ছোট জলধার যেখানে কুরারে নদীর বিপুল জলস্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তার নীকটবর্তী তীরভূমির উপর থেকেই শব্দটা ভেসে আসছে। ওই অঞ্চল পাহারা দেওয়ার ভার নিয়েছে তিন জন ইয়াম্বো-জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ান এবং একজন শ্বেতাঙ্গ সৈনিক। তারা শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল।

আকুস্থলে সর্বপ্রথম যে রেড-ইন্ডিয়ানটি পদার্পণ করল, তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়ংকর দৃশ্য আনাকোন্ডার প্রচণ্ড আলিঙ্গনের মধ্যে নিশ্চল হয়ে আছে হতভাগ্য ছাগলের প্রাণহীন দেহ! আক্রান্ত হয়ে একবারই আর্তনাদ করার সময় পেয়েছিল জীবটি পর মুহূর্তে নাগপাশের নিষ্ঠুর বন্ধন তার কণ্ঠকে নীরব করে দিয়েছে। মৃত্যু এসেছে মুহূর্তের মধ্যে!

ইয়াম্বো শিকারিটি অকুস্থলে এসে পৌঁছোনোর আগে সাপটা নিশ্চয়ই তার শিকার নিয়ে জলের ভিতর আত্মগোপন করত। কিন্তু জলস্রোতের নিকটবর্তী তীরভূমির উপর অবস্থিত একটা গাছের সঙ্গে শক্ত দড়ি দিয়ে ছাগলটা বাঁধা ছিল বলেই সর্পরাজের উদ্দেশ্য সফল হয় নি। ইয়াম্বো রেড-ইন্ডিয়ানটি দেখল আনাকোন্ডা দড়ি ছিঁড়ে শিকার নিয়ে নদীর বুকে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে রেড-ইন্ডিয়ানটি তার হাতের বর্শা নিক্ষেপ করল। সাপের মোটা চামড়া ভেদ করে বসে গেল বর্শার শাণিত ফলক। ইতিমধ্যেই লোকটির চিৎকার শুনে তার সঙ্গীরা যথাস্থানে এসে পড়েছে এবং আনাকোন্ডাও বুঝতে পেরেছে, এই জায়গাটা আর তার পক্ষে নিরাপদ নয়।

ছাগমাংসের মায়া ছেড়ে সে তখুনি দ্রুতবেগে এগিয়ে গেল জলের দিকে।

একজন শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের রাইফেল উপরি-উপরি দুবার গর্জে উঠল। দুজন রেড়-ইন্ডিয়ান শিকারির হাতের বর্শা ছুটে গেল আনাকোন্ডার দেহ লক্ষ্য করে গুলি লাগল কিনা বোঝা গেল না, কারণ সর্পদানবের গতি রুদ্ধ হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও। আর বর্শা দুটিও হল লক্ষ্যভ্রষ্ট…

ঘটনাটা যেখানে ঘটছে, সেই জায়গা থেকে সিকি মাইল দূরে ছিল সার্জেন্ট পাবলোর আস্তানা। রাইফেলের গর্জন শুনেই সে বুঝল, কিছু একটা হয়েছে। তাড়াতাড়ি শয্যা ত্যাগ করে উপযুক্ত পোশাক চড়িয়ে সে যখন অকুস্থলে উপস্থিত হল, তখন আনাকোন্ডা জলের তলায় আত্মগোপন করেছে।

যে সৈন্যটি গুলি চালিয়েছিল, সে পাবলোকে জানাল যে, এত লম্বা আর এত মোটা সাপ দেখে সে হয়ে পড়েছিল হতভম্ব। তার উপর দু-দুটো গুলিতেও যখন সাপটার কিছু হল না, তখন তার এমন বুদ্ধিভ্রংশ ঘটল যে, তৃতীয়বার গুলি ছোঁড়ার কথা মনেই হয়নি। একটু পরেই অবশ্য তার সম্বিৎ ফিরে আসে। এবং তার সহযোগী রেড-ইন্ডিয়ানদের ডেকে সে একটা ক্যানো-জাতীয় নৌকো আনতে বলে

পাবলোর সহকারী রেড-ইন্ডিয়ান শিকারিরা যখন অকুস্থলে এসে উপস্থিত হল, তখন পূর্বোক্ত শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের সঙ্গীরা নৌকো নিয়ে এসেছে। দুজন সুদক্ষ সৈনিকের সঙ্গে নৌকোর উপর উঠে বসল সার্জেন্ট পাবলো। নৌকো চালানোর ভার নিল দুজন ইয়াম্বো-জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ান। জিভায়রা-জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ানরা ডাঙার উপর পা চালিয়ে নৌকোটাকে অনুসরণ করল এবং পাবলোর আদেশে তার অধীনস্থ সৈনিকরা আর একটি নৌকো আনতে ছুটল।

সকাল ছটা বেজে গেছে। নদীর মধ্যস্থল এখন দিবালোকের স্পর্শে উজ্জ্বল, অবশ্য তীরের কাছে ঘন উদ্ভিদের ছায়ায় ঢাকা অন্ধকারের নীড় ভাঙতে তখনও আধঘণ্টা দেরি…

প্রায় পঁচিশ গজ যাওয়ার পরে নৌকোর উপর উপবিষ্ট এক জন ইয়াঘো মাঝি তার হাতের দাঁড় তুলে বাঁ দিকে উঁচিয়ে ধরল। সেদিকে লক্ষ্য করে পাবলো দেখল, জলের উপর দুলছে একটা বর্শাদণ্ড!

আর একটু দূরেই নদীর জলে ভাসছে একটা কুৎসিত ও ভয়ংকর মুখ– আনাকোন্ডা।

নৌকো আর সপর্দানেবের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল আন্দাজ ৩৫ গজ। তিন-তিনটি রাইফেল নৌকোর উপর থেকে সাপের দেহ লক্ষ্য করে অগ্নি-উদ্গার করল। দোদুল্যমান নৌকোর উপর থেকে নিশানা স্থির করা খুব কঠিন। তা ছাড়া সাপটাও স্থির হয়ে নেই, সাঁতার কাটছে। তাই রাইফেলের সব কটা বুলেট লক্ষ্যভেদ করল কিনা বলা মুশকিল।

তবে অন্তত একটা গুলি নিশ্চয়ই সর্পের দেহে বিদ্ধ হয়েছিল, কারণ আগ্নেয়াস্ত্রের আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহাসর্প নদীর জলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে ছটফট করতে লাগল। আনাকোন্ডার দেহে কামড় বসিয়ে বর্শার ফলাটা এতক্ষণ দুলে দুলে উঠছিল, জলের ধাক্কায় সেই অস্ত্রটা এবার তার শরীর থেকে খসে নদীর জলে হারিয়ে গেল। পরক্ষণেই জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল মূর্তিমান আতঙ্ক! এতক্ষণ পর্যন্ত ভাসমান বর্শান্ত দেখেই শিকারিরা নদীর উপর আনাকোন্ডার অস্তিত্ব নির্ণয় করতে পেরেছে, কিন্তু বর্শাটা এখন খুলে পড়ায় জলরাশির মধ্যে তাকে আবিষ্কার করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ল।

জলের উপর কিছুটা রক্ত ভেসে উঠেছিল কিন্তু সরীসৃপ জাতীয় জীবের দেহে খুব গভীর ক্ষত হলেও ক্ষতস্থান থেকে স্তন্যপায়ী জীবের মতো প্রচুর রক্তপাত হয় না। তাই সামান্য রক্তের চিহ্ন ধরে আহত সাপটাকে অনুসরণ করা সম্ভব হল না। তীব্র স্রোতের টানে সেই রক্তের ধারাও সত্বর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

কিন্তু শিকারিরা হতাশ হল না। তারা নদীর বুকে এদিক-ওদিক নৌকো চালিয়ে অনুসন্ধান করতে লাগল…।

আচম্বিতে নৌকোর তলায় এক দারুণ ধাক্কা! ধাক্কা মেরেছে আনাকোন্ডা। পরক্ষণেই আত্মপ্রকাশ করল সে! সঙ্গেসঙ্গে নৌকো উল্টে গেল এবং সার্জেন্ট পাবলো তার দলবল নিয়ে ছিটকে পড়ল নদীর জলে!

সবাই মিলে নৌকোটাকে আবার সোজা করে উঠে পড়ল বটে, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রগুলি তখন নদীর জলে অদৃশ্য হয়ে গেছে!

সুখের বিষয়, আনাকোন্ডা এই সুযোগে শিকারিদের আক্রমণ করার চেষ্টা করেনি নৌকো উলটে দিয়ে আবার জলের তলায় গা-ঢাকা দিয়েছে।

ইতিমধ্যে অকুস্থলে আবির্ভূত হয়েছে দুই নম্বর ক্যানো। এই নৌকোটা আরও বড় এবং তার ছয় জন আরোহীর মধ্যে চার জনের হাতেই রাইফেল।

দুনম্বর নৌকো থেকে পাবলো এবং তার এক জন সঙ্গীকে একটি একটি করে দুটি রাইফেল দেওয়া হল। পাবলোর নির্দেশে দুটি ক্যানো পাশাপাশি চলতে লাগল। তাদের মধ্যে দূরত্ব প্রায় কুড়ি ফিট।

আনাকোন্ডা যে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করবে না, এমন কথা জোর করে বলা যায় না। তাই ক্যানো দুটিকে কাছাকাছি রাখার ব্যবস্থা করা হল।

বলা যায় না, মুহূর্তের অসতর্কতায় শিকারি পরিণত হতে পারে শিকারে!…।

সমস্ত সকাল ধরে চলল অনুসন্ধান। নদীর দুই দিকের তীরবর্তী অগভীর জলে বার বার খুঁজে দেখল শিকারিরা। পাবলোর বিশ্বাস, সাপটা আহত অবস্থায় গভীর জলে বেশিক্ষণ ডুবে থাকতে পারবে না, খুব সম্ভব নদীর ধারে কোনো গোপন গুহা বা গর্তের ভিতর সে লুকিয়ে আছে। পরবর্তী ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া গেল যে, পাবলোর ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নির্ভুল।

প্রভাত অতিবাহিত হল ব্যর্থ প্রচেষ্টায়… পলাতক আনাকোন্ডার সন্ধান মিলল না কোথাও।

তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্ন ভোজোনের পালা সাঙ্গ করে পাবলো এবং তার দল আবার অনুসন্ধান শুরু করল। জিভরো রেড-ইন্ডিয়ানরা এতক্ষণে নদীর এপারে সাপটার সন্ধান করছে। এইবার তারা নৌকোযোগে নদীর অপর পারে উঠে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। আর অন্যান্যেরা দুটো ক্যানো জলে ভাসিয়ে টহল দিতে শুরু করল। তাদের লক্ষ্য নদীর অগভীর জলের দিকে..

বেলা পড়ে এসেছে। অপরাহ্ন ৪টা। হঠাৎ নদীর উত্তর দিকের তীরভূমি থেকে ভেসে এল উত্তেজিত জিভারোদের উল্লাসধ্বনি?

ক্ষিপ্রহস্তে বৈঠা চালিয়ে মাঝিরা নৌকো দুটিকে যথাস্থানে নিয়ে এল। আর পরক্ষণে শিকারিদের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য!

জিরো শিকারিরা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে একটা গর্ত বা গুহার মতো জায়গায় বর্শা দিয়ে খোঁচা মারছে। পলাতক দানব জিরো শিকারিদের তীক্ষ্ণদৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে নি।

নদীর ধারে যেখানে নিমজ্জিত শিকড় ও উদ্ভিদের অরণ্যে আত্মগোপন করেছে সর্পদানব আনাকোন্ডা, সেখানে জলের গভীরতা খুব কম— চার-পাঁচ ফিটের বেশি নয়। তীরের জমিটা জলের উপর খানিকটা এগিয়ে এসে পলাতক সর্পের দেহের উপর একটা আচ্ছাদনের সৃষ্টি করেছে এবং ঘরের ছাদের মতো ওই জমির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে কয়েক জন জিরো তাদের সুদীর্ঘ বর্শা দিয়ে নীচের অন্ধকার গুহার মতো জায়গাটায় সজোরে খোঁচা মেরে চলেছে অবিরাম।

আরও কয়েকজন জলের কিনারে উচ্চভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছে উদ্যত বর্শা হাতে, এবং আর একদল অতি-দুঃসাহসী জিভারো শিকারি জলে নেমে ঘন সন্নিবিষ্ট উদ্ভিদের বেড়াজাল ভেঙে নদীর দিক থেকে সাপটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে,

হঠাৎ নদীর তীরবর্তী ছাদের মতো জমিটা ভেঙে পড়ল সশব্দে! আর–

যেখানে ঘন উদ্ভিদের জাল ও অগভীর জলের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে আনাকোন্ডা, ঠিক সেই জায়গায় অন্ধকার মাখা গুহাটার ভিতর ছিটকে পড়ল দুজন জিভারো!

এক জন চটপট তীরে উঠে পড়ল। তার সঙ্গীটিও সেই চেষ্টা করল বটে, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হল না।

বিদ্যুৎবেগে আনাকোন্ডা লোকটির পা কামড়ে ধরল। পরক্ষণেই ফঁসের দড়ির মতো দুটো মারাত্মক কুণ্ডলীর বন্ধনে বন্দি হল হতভাগ্যের দেহ… একটা কাতর আর্তনাদ শুধু… তারপর সব শেষ….

নৌকোর উপর বসে গুলি চালাতে নিষেধ করে সার্জেন্ট পাবলো। কারণ সাপটাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে নাগপাশে আবদ্ধ জিরোর গায়েও গুলি লাগার সম্ভাবনা। কিন্তু যখন দেখা গেল, হতভাগ্যের মৃত্যু হয়েছে, পাবলো তখন গুলি চালানোর আদেশ দিল। শ্বেতাঙ্গ সৈনিকদের চার-চারটে রাইফেল অগ্নি উর করে গর্জে উঠল। ইয়াম্বো মাঝিবা বৈঠা ফেলে তুলে নিল বর্শা…

রাইফেলের গুলিতে জর্জরিত সর্পদানবের দেহে বিধে যায় দুদুটো বর্শা… বিকট হাঁ করে শিকারিদের আক্রমণ করার উপক্রম করল আনাকোন্ডা। সঙ্গে সঙ্গে আবার গর্জে উঠল সব কটা রাইফেল… এইবার মর্মস্থানে আঘাত পড়েছে বোঝা গেল। দারুণ যাতনায় পাক খায় আনাকোন্ডা। নদীর বুকে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল নিষ্ফল আক্রোশে আছড়ে পড়ছে বারংবার…

ধীরে ধীরে থেমে গেল দানবের অন্তিম আস্ফালন। জিভারোরা তাদের সঙ্গীর মৃতদেহটা উদ্ধার করল সৎকারের জন্যে। আনাকোন্ডার মারাত্মক আলিঙ্গনের কঠিন পেষণে হতভাগ্যের অস্থি-পঞ্জর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে।

নিহত সাপটার মাথার একটু পিছনে একটা শক্ত দড়ি বেঁধে নৌকোর পাশে সেটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হল। এক নম্বর ক্যানো নৌকোটা পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলল আর তার পিছনে চলল দুই নম্বর নৌকো। দ্বিতীয় নৌকোটা দৈর্ঘ্যে আঠারো ফিট। আনাকোন্ডার মাথাটা বাঁধা হয়েছে এই নৌকোর সামনে, আর পিছনে নৌকো ছাড়িয়ে আর প্রায় ছয় ফিট আন্দাজ ভাসছে তার লেজের দিকটা!

সত্যিকারের এক সর্পদানব!

দুঃখের বিষয়, সাপটার শারীরিক স্থূলত্বের ও দৈর্ঘ্যের সঠিক মাপ নেওয়া শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

কারণ কী?

কারণ হচ্ছে- পিরানহা!

দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন নদীতে ঘুরে বেড়ায় এই পিরানহা নামক মাছের ঝাঁক।

অনেক পর্যটক ও শিকারি শরীরে ক্ষত থাকলে পিরানহার ভয়ে জলে নামতে সাহস করেন না। কারণ রক্তের ধারা জলে পড়লেই পিরানহা মাছ দল বেঁধে সেখানে ছুটে আসে এবং খুরের মতো ধারালো দাঁতের আঘাতে শিকারের দেহ ছিন্নভিন্ন করে বীভৎস ভোজসভা বসিয়ে দেয়।

অবশ্য শরীরে ক্ষত না থাকলে অধিকাংশ সময়ে নিরাপদে নদী পার হওয়া যায়, কিন্তু জলে রক্ত পড়লেই মুশকিল। বর্শা ও রাইফেলের গুলি আনাকোন্ডার দেহে অনেকগুলো রক্তাক্ত ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। সেই রক্তের নিশানা ধরে ছুটে এল এক ঝাক পিরানহা মাছ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আনাকোন্ডার প্রকাণ্ড শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল খুদে রাক্ষসের দল!

Exit mobile version