Site icon BnBoi.Com

ছোটগল্প সংকলন – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

ছোটগল্প সংকলন - আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

দুধভাতে উৎপাত
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

একটু বেলা হলে বৃষ্টি ধরে এলো। তবে আবুল মাস্টারের উত্তরপাড়ার জমিতে পাট কাটা শুরু হয়েছে, শালার মাস্টার আজ আসবে না। ইস্কুলে গেলে জুত করে ভেলায় চাপা যায়। ইস্কুলের নিচে এবাদত মুন্সির বড় ভেলাটা বাঁধাই রয়েছে, লগির ১২-১৪টা ঠেলা দিলেই একেবারে ধলেশ্বরীর তীর। সাড়ে ১০টার লঞ্চে উঠে কাপড়ের গাঁটের ওপর বসে থাকা প্যাসেঞ্জারদের সামনে সুর করে ‘মা ফাতেমা কাইন্দা বলে বাপ কোথায় আমার/হায়রে নবীজির এন্তেকালে দুনিয়া জারজার’ গাইতে গাইতে বাঁ পাটা খুঁড়িয়ে হাঁটলে দুই-আড়াই টাকা জোগাড় করা এমন কিছু নয়। তারপর রামেশ্বরদী ঘাটে নেমে কদম আলীর দোকানে বসে চায়ে ভিজিয়ে বনরুটি খাও, পেয়ারা খাও, গাব খাও, পয়সা থাকলে চাই কি মেঘনা সিগ্রেটও একটা জুটে যায়। ১টা ৫০-এর লঞ্চে বাড়ি ফিরলে মায়ের সাধ্য কী ধরে যে ছেলে তার আধখানা পেটে জামিনের বন্দোবস্ত করে এসেছে।
কিন্তু ওদিকে আকাশ থামে তো জয়নাবের পাড়া ফাটানোর বিরতি নেই। এই মিনিট দশেক হলো একটু জিরান দিয়েছে। এটাই সুযোগ, জয়নাব ফের শুরু করলে তাকে বোঝানো যাবে না। ঝাঁপ তুলে উঠানের কোণে মানকচুর ঝোপ থেকে বড় দেখে একটা মানপাতা ছিঁড়ে মাথার ওপর ধরে এক হাতে স্লেট ও মলাট-ছেঁড়া ধারাপাত নিয়ে ওহিদুল্লা পা বাড়াল। অমনি অনেকক্ষণ একটানা চ্যাঁচানোর পর ক্লান্তিতে হাঁপাতে-থাকা জয়নাব কাতরায়, ‘ওইদুল্লা! ইস্কুলে যাইস না!’
‘আইজ আমাগো পরীক্ষা। না গেলে মাস্টারে মারবো!’
জয়নাব কথা না বলে হাত নাড়ে, এর মানে, মারে মারুক। একটু হাঁপিয়ে, ফের হাত নাড়ে, এর মানে, তবুও যাস না। তারপর হাজেরার হাত থেকে হাতপাখা নিয়ে কোঁকায়, ‘কাগজির পাতা লইয়া আয় তো মা। খালি বমি বমি লাগে। মরার বমি আয়ও না!’ বিছানা থেকে মুখ নামিয়ে সে বমি করার উদ্যোগ নেয়। কেবল শব্দই সার, এক ফোটা রসও বেরোয় না। তখন চিৎ হয়ে শুয়ে কাতরাতে থাকে। এখন হাজেরার পালা। এই ছেমড়িটা আরেক মুরবি্ব। ছনের চালের ফুটো দিয়ে ঝরা পানি সরাতে সরাতে সে ঘরময় কাদাকাদা করে ফেলে আর উপদেশ ঝাড়ে, ‘আম্মা বলে অহন-তহন, তুমি যাও বেড়াইতে?’
ওহিদুল্লাকে তাই মাচার ওপর বিছানায় মায়ের কাছে বসে থাকতে হয়। আম্মার পেট ব্যথা হলে তার কী করার আছে? ব্যথার সঙ্গে স্বর, জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, বুকের ভেতর হাঁসফাঁস, এর ওপর ২৪ ঘণ্টা বমি ভাব—না, তার কিছু করার নেই। তার বাবা গতবার এসে প্রায় দিন পনেরো বাড়ি ছিল। পেটব্যথা, বুকের হাঁসফাঁস তখন ছিল কোথায়? বাজানকে বলে তখন যদি এক বোতল পানি পড়িয়ে রাখে তো তাই দিয়েই একটা বছর শরীরটাকে দিব্যি হাতের মধ্যে রাখা যায়। বাবা তার মৌলবি সাহেব, হাফেজ না হলেও কোরান শরিফ পড়ে পাখির মতো। দোয়া-দরুদ যে কত জানে, তার লেখাজোকা নেই। গাছ লাগানোর সময় গাছ বাঁচিয়ে রাখার দোয়া, ধান-পাটের জমিতে পোকামাকড় মারার দোয়া, বাচ্চাদের পায়খানা হওয়ার দোয়া, পায়খানা বন্ধ করার দোয়া, বাঁজা মেয়েমানুষের বাচ্চা হওয়ার দোয়া, আবার শত্রুদুশমনের বিমারি করার দোয়া—এক দোয়া পড়ে দিলে দুশমন শালা রক্তবমি করতে করতে পাল্টা দোয়া জোগাড় করার সময় পাবে না—আর মায়ের এসব রোগ তো বাজানোর কাছে জলভাত। এখানে, এই বিল এলাকায়, কসিমুদ্দিনের দাম বোঝার মতো লোক কোথায়? বাজান ঠিকই বলে, যেখানে তিন দিন বৃষ্টি হলো তো ডাঙ্গা ও নদীর কোনো ভেদচিহ্ন রইল না, সেখানে মানুষ বাস করে? আর সেখানে? সেই উত্তরে, ইছামতি, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে তিস্তাতীরের গ্রাম খোলামহাটি। গ্রামে আজমত আলী প্রধানের আটচালা টিনের ঘর, তার পাটের গুদাম, তামাকের চাষ। কসিমুদ্দিনের কত দাপট সেখানে। প্রধানের বাড়িতে থাকে, বাড়ির মক্তবে গ্রামের ছেলেমেয়েদের আমপারা-সেপারা পড়ায়, মসজিদে আজান দেয়, ইমাম সাহেব এদিক-ওদিক জেয়াফতে গেলে নামাজও পড়ায়। বকরি ঈদের সময় সেখানে ঘরে ঘরে কোরবানির ধুম, তার বারো আনা জবাই হয় কসিমুদ্দিনের হাতে। এক বছর পর বকরি ঈদের সপ্তাহখানেক বাদে কসিমুদ্দিন বাড়ি ফেরে তখন তার হাতে মস্ত বড় অ্যালুম্যুনিয়ামের ডেকচি বোঝাই জ্বাল-দেওয়া ৮-১০ সের খাসির গোশ্ত, গোরুর গোশ্ত। মৌলবি বাড়ি এলে জয়নাবের পায়ে পাখা গজায়, তখন খালি ওড়ে, খালি ওড়ে। একটু মনে করে তখন পানি-পড়া রেখে দিলে এত কষ্ট পায়? মা হাজার হলেও আস্ত মেয়েমানুষ, ডেকচি ভরা গোশ্ত দেখলে হুঁশ থাকে না। বছরের একটা মাস গোশ্তের ঝোলের, গোশ্তের ভুনার, কলেজি-গুর্দার সুবাসে এই ছনের ঘরে দালানের চেকনাই আসে। গোশ্তের মৌসুম তখন, গোশ্তের উৎসব! ওহিদুল্লা তার নিজের গোশ্ত-ঝরা চিমসে পেটে আদরে ও করুণায় হাত বুলাতে বুলাতে উঠে দাঁড়ায়। আদর পেয়ে বেতমিজ পেটের ভেতরটা ফোঁস ফোঁস করে।—নাঃ সাড়ে ১০টার লঞ্চ এখনো যায়নি। লঞ্চে ঠাসাঠাসি করে বসা কাপড়ের ব্যাপারিদের কাছ থেকে দুই টাকা-আড়াই টাকা না হোক এক টাকা-দেড় টাকা পেলেও বনরুটি-চা না হোক, এক হালি গাব কী আমড়া খেয়ে মুখ মুছে বাড়ি ফিরলে কেউ কী ধরতে পারে? কিন্তু দাঁড়ানোর সঙ্গে জয়নাবের চিঁহি চিঁহি স্বরে বল আসে, ‘যাইস না!’ ‘মাস্টারে আইজ পাট কাটবো, হ্যায় লগে থাকতে কইছিল!’
জয়নাব হাত নাড়ে, মানে, কউক।
‘না গেলে মাস্টারে মাইর দিব!’
‘মৌলবি মাইনষের পোলা তুই পাট কাটবি ক্যান?’ গোঙাতে গোঙাতে জয়নাব নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য মনোযোগী হয়। কয়েকদিন থেকে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করতে তার খুব পরিশ্রম হচ্ছে। চেষ্টা না করলে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। অনেকক্ষণের জন্য বাতাস টেনে নিয়ে কথা বলতে বলতে শ্বাস ছাড়ে, কথাও বলে মিনমিন করে, পাছে আবার বেশি বাতাস বেরিয়ে যায়; তখন ফের নতুন করে বুক ভরানোর মেহনত করবে কে?
‘ওইদুল্লা, বাবা আমার কালা গাইটা আনতে পারলি না? হাশমত মউরির পোলায় দড়ি ধইরা টাইনা লইয়া গেল, একডা বছর পার হইয়া গেল, একটা দিন দুগা ভাত মাখাইতে পারলাম না।’ এত কথা বলায় তার বাতাসের স্টক শেষ হয়ে যায়, সে ফের হাঁপায়। ওহিদুল্লা তার কথার জবাব দেয় না। এই তো মেয়েমানুষের বুদ্ধি! কাল থেকে শুরু হয়েছে দুধের বায়না। গরু বিক্রি করে দিয়েছে আজ এক বছরের ওপর, সেই গরুর শোক কাল থেকে নতুন করে উথলে উঠছে। এত হাহাকারের আছে কী? গরু যখন ছিল তখনি কী এই মা মাগী ওদের দুধভাত দিত? প্রত্যেক দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হাশমত মুহরির বড় ছেলে ঢ্যাঙা আশরাফ বা তার ঘরজামাই বোনাই হারুন মৃধা এসে দুধ দুইয়ে নিয়ে গেছে। এর বদলে সাত দিন পর পর বাজারে হারুন মৃধার দোকান থেকে ওহিদুল্লা চাল-ডাল নিয়ে আসত। খালি বছরে একবার কসিমুদ্দিন বাড়ি এলে সেই কটা দিন পোয়া দেড়েক দুধ ঘরে রাখার রেওয়াজ ছিল। ‘হেইখানে কি দুধ পাও?’—স্বামীকে এই কথা বলে জয়নাব ওই কয়েকটা দিন রাতে দেড় পোয়া দুধের সঙ্গে দেড় সের চালের ভাত দিয়ে, গুড় দিয়ে ও একটা শবরি কলা দিয়ে মাখাতো, সেই মাখানো ভাত খেত বাপেবেটা-ঝিয়ে মিলে ছয়জনে। শেষ দুটো লোকমা বরাদ্দ ছিল জয়নাবের জন্য। দুধভাতের হাত ধুয়ে তার গোনাগুনতি ছাগলা দাড়ি কটায় হাত বুলাতে বুলাতে কসিমউদ্দিন মাঝেমধ্যে হাসত, ‘এই শ্যাষ দুইডা লোকমার মদ্যেই ব্যাক সোয়াদ। তুমি খাইতে চাও না, তুমি নিজে না খাইলে এত মজা কইরা মাখাইবা?’ দুধভাত খেয়ে বাজানের মুখ থেকে কী সুন্দর সুন্দর কথা বেরোয়, ‘আল্লাপাকে তোমার হাতের মইদ্যে বরকত দিছে! দেড় সের চাইলের ভাত তুমি দেড় পোয়া দুধ দিয়া মাখাইয়া ব্যাকটির জান ঠাণ্ডা করো! আলহামদোলিল্লা!’
সেই কত দিন আগে-খাওয়া দুধভাতের বাসি গন্ধ চোখা কঞ্চির মতো পেটে ঢুকে পাকস্থলীতে খোঁচাখুঁচি শুরু করলে সে ফের উঠে দাঁড়ায়। টিপটিপ পানি মাথায় করে ঘরে ঢোকে বড়আম্মা আর হাজেরা। এতক্ষণ ঘরে না থাকার জন্য হাজেরাকে কষে একটা চড় মারার সুযোগ ঘটে যাওয়ায় ওহিদুল্লার হাতের তালু খুশিতে নিশপিশ করে, পেটের মধ্যে কঞ্চির তৎপরতার বিরতি ঘটে। কিন্তু হামিদা বিবি এসে বসল জয়নাবের গা ঘেঁষে, তার পাশে হাজেরা। এ অবস্থায় মারধর করাটা মুশকিল। পেট ও হাতের চাপা তৎপরতা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়ে ওহিদুল্লা নাক খুঁটতে শুরু করে।
জয়নাব কী ঘুমিয়ে পড়ল? হামিদা বিবি তার কপালে হাত রাখতেই সে বিড়বিড় করে দুধের কথা বলে। হামিদা বিবির হাত জয়নাবের কপালেই থাকে, ‘মাইজা বৌ, দুধ তো পাই না! তামান গাঁও তালাস কইরা আলার বাপে হপায় আইছে। উত্তরপাড়ার করিম সিকদারের গাইটা দুই একের মদ্যেই বিয়াইবো। নুইলা আমিনুদ্দির গাই বলে কয়দিন থাইকা খালি দাপায়, দানাপানি ছাড়ছে। আলার বাপে ঝাইড়া দিয়া আইল। কী করে, ধরছে, ঝাইড়া দিয়া যাও। তাই দেরি হইল।’
‘দাপাইবো না?’ আলার বাপ দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলে। সে হলো জয়নাবের ভাসুর, ঘরে ঢোকার নিয়ম নেই। ‘গাভীন গাই দিয়া কয়দিন হাল বোয়াইছে, অহন গাইয়ের কী দোষ? আল্লায় ক্যামনে সয়?’
ভাসুরের কণ্ঠস্বর শুনে জয়নাব গায়ের কাঁথা আরো জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তার পায়ের কাছে বৃষ্টির পানিতে ভেজা জায়গাটা আঙুলে লাগলে সমস্ত শরীর শিরশির করে ওঠে। এতে কথা বলার বল পাওয়া যায়, ‘অ বুজান, হাশমত মউরির গোয়ালের মইদ্যে আমাগো কালা গাইটা আছে!’
কিন্তু হাশমত মুহুরির বাড়িতে যাওয়া আলার বাপের পক্ষে অসম্ভব। গতবার খরার সময় হারুন মৃধার দোকান থেকে পাঁচ সের চাল নিয়েছিল, সেই ধার আজও শোধ হয়নি। সে তাই ওহিদুল্লাকে ডাকে, ‘ওইদুল্লা!’
ওহিদুল্লা বেরিয়ে দেখে তার জ্যাঠা টিপটিপ বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে আর পরনের গামছা বারবার নিঙড়ে নিচ্ছে।
‘ওইদুল্লা, কোষাখান লইয়া মালখাপাড়া যা, হাশমত মউরির তিনটা গাই, দুধ লইয়া বাজারে অহনো যায় নাই। মউরিরে হাতে-পায় ধইরা কইস, আমার মায়ের অহন-তহন অবস্থা, একখানা হাউস করছে, আপনের না কওন চলবো না!’
সারা পাড়ায় একটিমাত্র কোষা, সেটা নিয়ে গেল কে? ওহিদুল্লার ভেলাই ভালো। হাশমত মুহরির বাড়ির পৈঠায় ভেলা ঠেকানোর আগেই দেখা যায় পরিষ্কার জামাকাপড় পরা কয়েকটি ছেলেমেয়ে পানিতে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিচ্ছে। সবাই এক সঙ্গে কথা বলে, দেখেই বোঝা যায় শহরের পয়দা, এদের কথা বোঝা যায় না। ওহিদুল্লা ভেলা ঠেকিয়ে ডাঙ্গায় নামে। হাশমত মুহুরির ঘর অনেক উঁচুতে, পা ঠেলে ঠেলে ওপরে উঠতে হয়।
হাশমত মুহুরি বাড়ি নেই, ভোরে উঠে বৃষ্টি মাথায় করে সে গেছে থানায়, কাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তদবির করতে। হাশমত মুহুরির বড় ছেলে ঢ্যাঙা আশরাফ থাকলেও কাজ চলে, তো সে গেছে বাজারে। এই তো কোষা নিয়ে বেরোলো, অহিদুল্লার সঙ্গে তার দেখা হয়নি? হাশমত মুহুরির চাকরিজীবী প্রবাসী ছেলে আলতাফ অনেকদিন পর বাড়ি ফিরেছে, বাজারে না গিয়ে ঢ্যাঙা আশরাফের উপায় ছিল না। ওহিদুল্লা বাড়ির ভেতরে উঠানে দাঁড়ায়। ঘরের পাকা বারান্দায় শহরবাসী ছেলে মস্ত মুড়ির বাটি নিয়ে জলচৌকিতে বসেছে। খাঁটি সর্ষের তেলের ঝাঁজ বড় বারান্দা পেরিয়ে ওহিদুল্লার নাকে ঝাপটা মারে এবং সেই ধ্যাবড়া নাকের সুড়ঙ্গপথে পেটে ঢুকে সুড়সুড়ি দেয়। মুহুরির বৌ ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা অ্যালুম্যুনিয়ামের থালা থেকে গম ছিটিয়ে দিচ্ছে উঠানে।
ওহিদুল্লার আবদার শুনে মুহুরির বৌ অবাক হলো, ‘হায়রে আল্লা!’ তর মায়ের না প্যাটের ব্যারাম? চিরকালের সুতিকার রুগী? হ্যারে তুই দুধ খাওয়াইবি? পাগলা হইছস?’ কিন্তু এই বিস্ময়বোধে তার গম ছড়ানোর কাজ একটুও ব্যাহত হয় না, দাঁতের গোড়ায় পানে-ভারী জিভ ঠেকিয়ে সে ‘টি টি টি টি’ আওয়াজ করলে এক পাল মুরগি এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গম খায়। মুরগির হাঁটা কি! পেটে দানা পড়ায় শালাদের দেমাক কত! ইচ্ছা হয় সব কটার ঠোঁট কামড়ে গমের টুকরা নিয়ে দাঁতে চিবিয়ে ফেলে। কিন্তু এই সাধ পূর্ণ করার জন্য কোনোরকম প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই মুহুরির জামাই হারুন মৃধা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জামার বোতাম লাগায় আর বলে, ‘তর মায়ের প্যাট খারাপ, তগো হইছে মাথা খারাপ!’
ওহিদুল্লা মিনমিন করে, ‘না, হ্যার হাউস হইছে দুধভাত খাইব, মায়ে বলে বাঁচবো না!’ তার গলা কাঁদো কাঁদো করার চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা হয় না। মুহুরির শহরবাসী ছেলের কথা বরং সর্ষের তেলের ঝাঁঝে খোনা শোনায়, ‘দুধভাত খাইলে তর মায়ে ফাল পাইড়া উঠব, না?’
শহরবাসীর স্কুলে-পড়া ফ্রক-পরা কন্যা কামড়ে কামড়ে পেয়ারা খাচ্ছিল, মুখে পেয়ারা নিয়েই সে বলে, ‘দুধ আমার ভাল্লাগে না! দুধ আবার মানুষ সখ করে খেতে চায়? মাগো!’
মুহুরির জামাই তার দোকানে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে বাড়াতে বলে, ‘পয়সা লইয়া ডাক্তার দেখা। ওষুধ দে, ওষুধ দে! তর চাচা না? ওই যে আলোর বাপে তর চাচা লাগে না? আমার চাউলের দামটা অহনো দিল না। অর কাছে থাইকা ট্যাহা লইয়া ডাক্তার দেখা।’
গলাটা কাঁদো-কাঁদো করার জন্য ওহিদুল্লা আরেকবার প্রচেষ্টা চালায়, ‘মায়ের এ্যাট্টা হাউস হইছে, কালা গাইয়ের দুধ দিয়া, গুড় দিয়া, কলা দিয়া’—বলতে বলতে জিভ দিয়ে শব্দগুলো সে চাখে। কিন্তু হারুন মৃধা কালো গরুর কথায় চটে গেল; ‘যা যা! এক কথা!—প্যাচাল পাড়িস না!’ মুহুরির বৌ বলে, ‘কইলাম আমার মাইজা পোলায় আইছে, নাতিপুতিগুলি আইছে বলে দুই বচ্ছর বাদ, দুগা পিঠা করুম, দুধ লাগে আমার চাইর স্যার! আইজ বাজার থাইকা দুধ আরো খরিদ করা লাগে! তর মায়ে—বুইড়া মাগীটার ঢঙের হাউস হইছে দুধভাত খাইব!’ শহরের পয়দা মেয়েটি পেয়ারা কামড়ানো স্থগিত রেখে বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে বলে, ‘নেই কোনো উৎপাত, খায় শুধু দুধভাত!’
শহরে থাকলে পোলাপান কত রঙই না শেখে! কথাবার্তা শুনে কে বলবে যে এরা হাশমত মুহুরির নাতিপুতি?
কালো গরুর কথাটা হারুন মৃধা ভুলতে পারে না, ‘এইগুলির উপকার করতে নাই। খাওন জোটে নাই, চাউলের দাম হইল আগুন, ভাইজানে গরুটা কেনে তয় হ্যাগো চাউল আসে! দানাপানি জোটে! হাটে-বাজারে অহন আলার বাপে কইয়া বেড়ায়, হ্যার ভাই বাড়িত থাকে না, মউরির পোলায় হ্যার গাইগরু লইয়া গেছে। গরু লইছে মাগনা? ক্যারে, গরু তর মায়ে মাগনা বেছছে?’
ওহিদুল্লা ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি একেবারে থেমে গেল। আলার বাপ কাদার পাশে একটা কাঠের গুঁড়িতে হাঁটু ভেঙে বসে আরো দুজন জ্ঞাতির সঙ্গে ভ্রাতৃবধূর রোগ বিষয়ে গুরুগম্ভীর পরামর্শ করে। ওহিদুল্লাকে দেখে আলার বাপ চোখের প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি করলে ওহিদুল্লা বলে, ‘মউরি নাই।’
‘হারুন মিরধা আছিল?’
‘হ্যাগো ইষ্টি আইছে, দুধ লাগব।’ এই খবরে অবশ্য তাদের আলোচনা ব্যাহত হয় না। ‘ডাক্তার আছিলো আমাগো অমরেশ ডাক্তার। খালি জিগাইছে, কও সে বাবা তোমার রুইদ ভালা ঠ্যাহে, না ছ্যাওয়া ভালো ঠ্যাহে? কেউরে কইছে, রাইতে আরাম পাও, না দিনে আরাম পাও? জবাব শুনছে, শুইন্যা ওষুধ দিছে। কী দিছে? চাইরটা-পাঁচটা বড়ি, মধুর লাহান মিঠা, খাইতেও মজা, দুইবার-তিনবার খাও, জ্বরজারি কৈ যাইব, দিশা পায় নাই!’
শহরে-পয়দার পেয়ারা কামড়ানো দেখেও যা হয়নি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের স্বাদের কথা শুনে ওহিদুল্লার পেটে ও বুকে কোলাহল শুরু হলো। জীবনে কোনোদিন মধু চেখেও দেখেনি, অথচ ফোঁটাফোঁটা মধু বা মধুর মতো মিষ্টি বড়ির এক-আধটা দানা শূন্য উদরে পড়ে, শব্দ করে পড়ে আর সেখানে ঘায়ের ওপর সুচের মতো বেঁধে।
একে এই সুচ-বেঁধার কষ্ট, আবার পাটখড়ির বেড়ার পাশ দিয়ে ঘরে ঢোকার মুখে ওখানে কে রে? —খাদিজা। দেখো, ভরা-বর্ষার বাড়ির মানুষ উপোস করে মরে, আর ছেমড়িটা কেমন তারিয়ে তারিয়ে শসা চিবায়। দেখতে এতটুকু হলে কী হবে, বাড়ে নাই বলে কী তার বয়স থেমে আছে? তার আক্কেলটা দেখো! কানের কাঠি-বেঁধা ও একটু পুঁজ-মাখা লতি ধরে ওহিদুল্লা তার গালে গোটা তিনেক চড় মারলো। ‘শয়তানী! চুন্নীটা! কচুর ঝোপে পলাইয়া শসা খাস? শরম নাই?’ একাগ্রচিত্তে ও নিবেদিত উদরে শসা খেতে খেতে মিঞাভায়ের এই অতর্কিত আক্রমণে বিচলিত হয়ে খাদিজা কাদার ওপর পড়ে যায়; তার পায়জামাটা ছেঁড়া, সেটা একেবারে ফাঁক হয়ে গেল। তবে সুখের বিষয় শসার অভুক্ত অংশের সবটাই তার আটা মুঠিতে অচঞ্চল বিরাজ করে।
জয়নাবের তখন খুব বাড়াবাড়ি। বড়আম্মা বসে আছে স্যাঁতসেঁতে বিছানায়। হাজেরা হাত দিয়ে মায়ের পায়ের পাতা ঘষে দিচ্ছে। জয়নাবের ছোট ছেলেটি আহমদউল্লা পাছা ও উরুতে পাতলা গু নিয়ে এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়ায়, তার দিকে কারো নজর নেই। এর বড়টা কানা বয়তুল্লা মায়ের পাশে শুয়ে অসময়ে ঘুমাচ্ছিল, সে জেগে উঠে এক চোখে ফোঁৎ-ফোঁৎ করে কাঁদছে। হাজেরা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে, ‘ভাইজান, মায়ে তোমারে কত তালাশ করলো। মায়ে আর কথা কয় না, অ মা, তোমার জবান বন্ধ হইল ক্যান? অ মা!’ এসব দেখেশুনে ওহিদুল্লার পেটের কোলাহল মাথায় ওঠে। সমস্ত পেট মাথার ভেতর সেঁধে যাওয়ার খুলিটা ঘিঞ্জি ও ঝাপসা ঠেকে। বড়আম্মা বিড়বিড় করে কোরআন শরিফের আয়াত পড়ে। জয়নাব তার বন্ধ চোখ দিয়ে ওহিদুল্লার খোলা নোনা দুই চোখে অদৃশ্য সব ছবি এবং অনেক আগে সম্পন্ন গতিবিধি প্রকাশ করে দেয়। ওহিদুল্লা দেখতে পায়, প্রখর ঠাঠা রোদে জয়নাব মাখন ঘোষের পোড়ো-ভিটায় মেটে আলুর খোঁজে মাটি খুঁড়ছে। আবার এক বছর পর কসিমুদ্দিন বাড়ি ফিরেছে তাও দেখা যায়। বাপের হাতে গোশতের হাঁড়ি দেখে তারা সব কটা ভাইবোন অস্থির। কসিমুদ্দিন তার নবতম শিশুটিকে নিরীক্ষণ করছে। লাজুক লাজুক ও বোকা বোকা মুখে ঘোমটা দিয়ে জয়নাব হঠাৎ কত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বদনা ভরে পানি নিয়ে একবার উঠানে রাখে, পুরনো কাঠের তোরঙ্গ থেকে কবেকার পুরনো রঙ-জ্বলা পাতলা ফরসা গামছা বারান্দায় বিছিয়ে রাখে জায়নামাজের মতো। আবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে তখনো নামাজের সময় হয়নি—এই খবর জেনে নিয়ে ফের জায়নামাজ গুটিয়ে রাখে। ঘরে তার ডেকচি ভরা গোশ্ত। সেই গোশ্ত ছোট ছোট মাটির হাঁড়িতে গুছিয়ে রাখতে হয়। সেসব জ্বাল দেওয়া, বেছে বেছে গুর্দা ও কলেজি আলাদা করা—তার কাজের কী হিসাব আছে? কসিমুদ্দিন বাড়ি এসেই কালো গরুটাকে নিয়ে মাখন ঘোষের ভিটা ও বিলের ধারের মাঠে একটুখানি চরিয়ে আসে। আবার স্বামীকে গরুর কাছে যেতে দেখে আড়চোখে সেদিকে দেখে আর মুখ টিপে হাসে। কসিমুদ্দিন বলে, ‘গাইয়ের প্যাট ওঠে না? গাই মনে হয় দুবলা হইয়া গেছে!’ মুখে আঁচল দিয়ে জয়নাব জবাব দিত, ‘আপনেরে না দেইখা! এইডো আমার হতীন তো!’ নিজের রসিকতায় সে নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ত। এই হাসিটা তার ঠোঁটজুড়ে চুপচাপ এলানো থাকে সারা পৌষ মাস। নতুন চাল উঠলে ছেলেমেয়েদের জয়নাব একদিন দুধভাত খাওয়ায়। কসিমুদ্দিন অবশ্য তখন তিস্তাতীরের গ্রামে। উঠানে ছেলেমেয়েদের সার করে বসিয়ে জয়নাব হাত দিয়ে মুখে মুখে ভাত তুলে দেয়। দুধ দিয়ে, ভাত দিয়ে, কলা দিয়ে, গুড় দিয়ে।
ওহিদুল্লা দুধভাতকলাগুড়ের মিলিত দৃশ্য ভালো করে দেখার আগেই জয়নাব চোখ মেলে। কালচে লাল চোখে সে হামিদা বিবির দিকে তাকায়। ডাকে, ‘বুবু!’ কথা শোনার জন্য হামিদা বিবি মাথা এগিয়ে দিলে জয়নাব বলে, ‘দুধভাত মাখছো?’ এই পর্যন্ত সবাই শুনতে পারে কারণ এটুকু তাদের আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সব বাক্য অস্পষ্ট। বড়আম্মা তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে সব শুনছে। তার চোখ ছলছল করে। ‘হায়রে, পোলাপানের দুধভাত খাওয়াইবার হাউস করছে!’ বলতে বলতে বড়আম্মার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। এসব দেখে ওহিদুল্লার একটু রাগমতো হয়।—এতে কান্নাকাটির কী হলো? জয়নাব এতক্ষণে বিবেচকের মতো কথা বলছে। গত কয়েকটা দিন তার কেবল পেট ব্যথা করে আর বমি বমি ভাব হয় আর বমি না হওয়া বুক হাঁসফাঁস করে আর পেটের ও বুকের ব্যথায় সে মাঝেমধ্যে তড়পায়। ছেলেমেয়েদের খাওয়া-দাওয়ার দিকে তার নজর নেই। দুই দিন থেকে কারো খাওয়া হয় না, ঘরে যা ছিল হাজেরা কোনোমতে কয়েকটা দিন চালিয়ে নিয়েছে। কাল থেকে ভরা বর্ষা, কোথায় কী পাওয়া যাবে? এ সময় মায়ের এই ইচ্ছাপ্রকাশে বড়আম্মার এত কান্নাকাটির কী হলো?
হামিদা বিবি বলে, ‘তরা বয়, আমি এট্টু আহি।’ জয়নাব তার চোখের কপাট বন্ধ করে বর্তমান থেকে নিজেকে আড়াল করে নিল। কলা-গাব, চা-বনরুটি, মধুর মতো হোমিওপ্যাথিক বড়ি ও দুধভাত বারবার ভাবতে ভাবতে ক্লান্তিতে ওহিদুল্লার চোখও ভারী হয়ে আসে। চোখ মেলে অদৃশ্য বস্তু দেখতে বড় খাটনি হয়। ঝিমুনিতে তার মাথা নুয়ে নুয়ে পড়ে। ঝিমুনির ছোট্ট একটি পলকে তার গায়ে আগুন ফোটে, ভরা-বাদলের আকাশ হঠাৎ করে খরায় ফেটে পড়ে। দেখা যায়, সেই খরায় কে একজন, তাকে চেনা যায় না, তাদের কালো গরুর দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লোকটা ঢ্যাঙা আশরাফ হতে পারে, হারুন মৃধাও হতে পারে। ওহিদুল্লা জয়নাবকে ডেকে বলছে, ‘মা, অ মা, আমাগো গাই লইয়া যায়, তুমি দেহো না?’ জয়নাব বলছে, ‘হ্যাগো কাছে রাখবার দিলাম। তর বাপে ট্যাহা পাঠাইলে চাইলের দাম শোধ কইরা গাই লইয়া আহুম!’ দুবার এই বাক্যের পুনরাবৃত্তি করতেই মায়ের চোখের খরা কেটে লোনা বাদল নামে, ‘তর বাপে কৈ থন ট্যাহা পাঠাইব? মোল্লায় খাইয়াদাইয়া প্যাটটিরে বানাইছে গোশ্তের কালাপাতলা, হ্যায় ট্যাহা পাঠাইব ক্যান?’
মাটির সানকি হাতে বড়আম্মা ঘরে ঢুকলে ওহিদুল্লার এই বাসি-ছবি দেখা শেষ হলো, শিথিল চোখ-কাল ফের চাঙা হয়ে উঠল।
‘বড়আম্মা দুধভাত লইয়া আইছো?’ প্রায় চিৎকার করে হাজেরা উঠে দাঁড়ায়, ‘বড়আম্মা, দুধভাত কই পাইলা?’
‘পাইছি! আল্লায় দিছে!’ ঈশ্বরের প্রদত্ত খাদ্য নিয়ে বড়আম্মা জয়নাবের শিয়রে বসল। জয়নাবের কপালে, গায়ে ও চুলে হাত বুলিয়ে হামিদা বিবি জিগ্যেস করে, ‘মাইজা বৌ, পোলাপানের মুখে দুধভাত দিবি না?’ কিন্তু জয়নাবের মুখচোখ অপরিবর্তিত। ‘অ মাইজা বৌ, পোলাপানের দুধভাত খাওয়াইতে চাইছিলি, অ বৌ?’
মায়ের পদসেবা ছেড়ে হাজেরা এসে দাঁড়িয়েছে হামিদা বিবির হাতের সানকির ধার ঘেঁষে। খাদিজা তার শসা সম্পূর্ণ খেয়ে বা অভুক্ত অংশটি কোনো ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে রেখে এখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। আহমদউল্লার মুখ থেকে অর্থহীন ধ্বনি ও লালা গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু খাদিজার হাঁটুর পেছনে ছেঁড়া পায়জামার ঝুলে-পড়া কাপড় ধরে সেও মুখ তুলে গোল ও কালো সানকিটা দেখছে। স্যাঁতসেঁতে কাঁথার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হামিদা বিবি জয়নাবের ডান হাত টেনে আনে। রোগা ও পাতলা এই হাত সানকিতে রাখলে আঙুলগুলোতে স্পন্দন বোঝা যায়। এক মুঠি দুধমাখা ভাত সেই হাতে পুরে দিলে হাতটা নিজে নিজেই ছেলেমেয়েদের দিকে এগিয়ে আসে। সবচেয়ে বেশি এগিয়ে সাড়া দিয়েছিল খাজিদার মুখ। কয়েক কামড় শসা তার পেটটাকে বড্ড খুঁচিয়ে দিয়েছিল। তবে হাঁ সবচেয়ে বড় হয়েছিল হাজেরার, যদিও একটু পিছিয়ে পড়ায় জয়নাবের হাত ঘেঁষে সে দাঁড়াতে পারেনি। এক চোখ কানা হলেও এবং মায়ের উল্টোদিকে থাকা সত্ত্বেও কানা রহমতউল্লা তার ভালো চোখটা দিয়ে সব দেখে ফেলেছে, সেও মায়ের কাছাকাছি বিছানার ওপর উঠে বসতে চেষ্টা করছিল। কনিষ্ঠটির আবোল-তাবোল বকা শেষ, তখন তার জিভে কোনো ধ্বনি নেই, কেবল লালা গড়িয়ে পড়ছে।
হামিদা বিবি নিজের ডান হাত দিয়ে জয়নাবের দুধভাত-ভরা হাতটা ধরে পঞ্চাননের মাঝখানে এনে একটু উঁচুতে শূন্যে স্থাপন করে। ভাতের গন্ধে, গুড়ের গন্ধে ওহিদুল্লার পেটের প্রসার এখন দ্বিগুণ। সে একেকটি শূন্য ঢোঁক গেলে আর উদরের মস্ত গহ্বরে তার ঢক ঢক প্রতিধ্বনি বাজে। মুখ বাড়িয়ে ভাতের প্রথম গ্রাসটি সে নিজেই তুলে নিতে পারত, তা আর হয়ে ওঠে না, তার, আগেই হাজেরা তার বসন্তের দাগ-ভরা মুখ এগিয়ে হলদে ছ্যাতলাওলা দাঁতে মায়ের হাত কামড়ে দুধ-ভাত তার নিজের জিভে চালান করে নিয়েছে। বেতমিজ আওরৎ! মেয়েমানুষের বুদ্ধি মানে ইবলিসের উস্কানি।
দেখতে দেখতে জয়নাবের হাত ধপাস করে পড়ে যায় বিছানার প্রান্তে। খাজিদা সেই হাত নিয়ে আঙুলগুলো চুষতে আরম্ভ করে। পারে তো আঙুল চুষে চুষে সবটাই খেয়ে ফেলবে। ধাড়ি ছুঁড়ির মায়ের আঙুলে স্তনচোষার কাণ্ড দেখে ওহিদুল্লার ইচ্ছা হয় ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দেয়। তা আর হয়ে ওঠে না। জয়নাবের মাথা কাঁপতে শুরু করে এবং তার গলা থেকে ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ এই রকম গরুর গাড়ির চলন্ত চাকার আওয়াজ শোনা যায়। তার ঠোঁট জোড়াও এখন বেশ ফাঁক হয়েছে; মরচে ধরা গোঙানি, ফাঁক-করা ঠোঁট ও মাথার মৃদু কাঁপুনি দেখে হামিদা বিবি ভয় পায় এবং ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহম্মদুর রসুলাল্লাহ্! মাইজা বৌ, মাইজা বৌ!’ বলতে বলতে নিজের হাতে আর এক মুঠ দুধভাত তোলে হাজেরা, ওহিদুল্লা, খাজিদা, রহমতউল্লা ও আহমদউল্লাকে থ করে দিয়ে নিজের মুখের কাছে নিয়ে আসে এবং ঠোঁটে প্রায় ছুঁয়ে দারুণ থতমত খেয়ে জয়নাবের মুখের কাছে নিয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে জয়নাবের গোঙানিরত মুখ হাঁ করাই ছিল, হামিদা বিবি অনায়াসে সেই হাঁর মধ্যে এক গ্রাস ভাত গুঁজে দেয়। ভাতের বেশ অনেকটা অংশ তার মুখের মধ্যে চলে গেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে খানিকটা তার কষ বেয়ে বাইরে গড়িয়ে পড়েছে।
তারপর পানিতে ডোবা মানুষের মতো জয়নাব কয়েকটা ঢোক গেলে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার গলায় ও মুখে প্রবল রকম ঝাঁকুনি শুরু হলো। কালো চামড়ার নিচেও কাঁপনের মোটা ও চিকন কারুকাজগুলো স্পষ্ট ধরা পড়ে। গলায় মাংসপেশি তার কুঁচকে ওঠে; কপাল ও কপালের নিচে, চোখের পাতায় ও নাকের দুই উপত্যকায় প্রবল আলোড়ন ওঠে এবং সে ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে শুরু করে। তার বমির আওয়াজ ও ভঙ্গি খুব জমজমাট, এই বিনীত ও ভাঙাচোরা ঘরে ঠিক মানায় না।
জয়নাব অবিরাম বমি করে। প্রথমে বের হলো ঘোলাটে সাদা ভাত ও পানি। তারপর কেবল পানি। বিবর্ণ পানির ধারা বেরিয়ে আসে প্রবল তোড়ে। মাঝেমধ্যে অল্পক্ষণের বিরতি দিচ্ছে। বিরতির পরপরই দ্বিগুণ বেগে বমি আসে। বমির পানিতে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। ওহিদুল্লা অবাক হয়ে বমির পরিমাণ দেখে, মায়ের ভেতরকার সব কিছুই পানি হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে? জয়নাবকে যারা অনেকদিন থেকে চেনে তাদেরও এ রকম মনে হতে পারে। এ পর্যন্ত খাওয়া যাবতীয় খাদ্যদ্রব্য ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য সে কী পাগল হয়ে গেল? আজ থেকে ৩৬ বছর আগে তার আকিকার গোশ্ত থেকে শুরু করে কিছুই তার পেটে থাকছে না। বমির পরিমাণ দেখে মনে হয় তার বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে যা খেয়েছে, নিজের বিয়ের খাবার, বিভিন্ন বকরি ঈদের পর তার স্বামীর নিজের হাতে হালাল করা কোরবানির গোশ্ত, কালো গরুর দুধ দিয়ে, কলা দিয়ে, গুড় দিয়ে মাখা মোটা ও রাঙা চালের ভাত, খরার সময় মাখন ঘোষের পোড়া ভিটা থেকে খুঁড়ে-আনা মেটে আলু, এমনকি কসিমুদ্দিনের পড়া-পানি পর্যন্ত উগরে দিয়ে সে নিঃশেষিত হচ্ছে। তার বমির মাঝেমধ্যে ১০-১২ সেকেন্ডের বিরতি থাকে। এ রকম একটি বিরতির সময় হামিদা বিবি জয়নাবের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে চিৎকার করে ওঠে, ‘আরে করস কী? বমি লাগতাছে তো!’
কে শোনে কার কথা? বিছানার ওপর থেকে মাটির সানকিটা কখন যে পাচার হয়ে গেছে ঘরের পূর্ব কোণে, এমনকি ওহিদুল্লাও টের পায়নি। কাদাকাদা মেঝেতে একমাত্র সে ছাড়া আর সবাই লেপ্টে বসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মাটির সানকির ওপর। হাজেরা তার ডান হাত দিয়ে খাচ্ছে বটে, কিন্তু সানকির সঙ্গে তার মুখের তফাত ২-৩ ইঞ্চির বেশি নয়। ইচ্ছা করলে সরাসরি মুখ দিয়েই সে ভাত তুলে নিতে পারে। খাদিজা বসেছে অর্ধেক সেজদার ভঙ্গিতে। বাপ-সোহাগী মেয়ে, বাপ এলে বাপের পেছনে তার নামাজ পড়া নকল করে, তার মহড়া চলছে এখন। হাত দিয়ে দুধ-ভাত টেনে টেনে নিজের মুখে তোলার ভঙ্গি থেকে মনে হয় যে মস্ত একটা কালো আরশোলা শুঁড় দিয়ে খাবার টেনে নিচ্ছে। কানা রহমতউল্লা এক চোখে যা দেখে, পুরো সানকিটা দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে তাই যথেষ্ট। এখান থেকে তার কানা চোখটা দেখা যায়। মনে হয় খাওয়ার সুখে চোখটা বুজে এসেছে। আর কনিষ্ঠ আহমদউল্লা দুই হাতে ভাত খাচ্ছে, তার নাকের প্রবাহিত সিকনি মিশে যাওয়ায় তার লোকমাগুলোর তরলতা বাড়ে। তার সমস্যা তার দুই বছর বয়সসুলভ মন্থরতা। একেকবারে দুটো হাত মুখে তোলে তো অনেকক্ষণ নামাতে পারে না।
ওহিদুল্লার সর্বশরীর এখন কেবল পেটেরই সম্প্রসারণ। এই সব জানোয়ারের ওপর রাগে তার সর্বশরীর অর্থাৎ সমস্ত পেট জ্বলে ওঠে, ইচ্ছা করে সানকিটা কেড়ে নিয়ে দুধভাতসমেত চিবিয়ে চিবিয়ে খায়। কিন্তু জয়নাবের গমকে গমকে নিঃসারণ, তার মুখচোখ কপালের শিরা-উপশিরায় ভাঙাচোরার দৃশ্য কঠিন হয়ে তার মাথায় দারুণভাবে চেপে বসেছে। এ অবস্থায় সানকি কেড়ে নেওয়া কী করে সম্ভব? মা মাগী বমি করার আর সময় পায় না!
জয়নাবের বমির ভেতরকার বিরতির সময় আস্তে আস্তে বাড়ে। বমির জন্যে মুখের, গলার, পেটের, এমনকি মাথার মাংসপেশি, হাড়হাড্ডি, রগ, শিরা-উপশিরার যথেচ্ছ ও প্রচণ্ড ব্যবহারের ফলে জয়নাব খুব ক্লান্ত হয়ে মাথা এলিয়ে শুয়ে রয়েছে। বমি বোধহয় শেষ হয়ে এলো। তাকে দেখে মনে হয় তার ভার অনেক কমে এসেছে, সে বোধহয় নিজের শরীরকে অনুভব করতে পারে, তার মুখের অভিব্যক্তি এখন আর তার ইচ্ছানিরপেক্ষ নয়। খুব ক্ষীণকণ্ঠে সে বিড় বিড় করে, ‘বুবু, পোলাপানরে তুমি কী খাওয়াইলা?’
হামিদা বিবি মাথা নিচু করে থাকে। হাত দুটো তার নিজের কোলের ওপর আলগোছে রাখা। ওই অবস্থায় আস্তে আস্তে বলে, ‘কী করি? পোলাপানের খালি দুধভাত খাওয়াইতে চাস। কী করি? চাইলের গুঁড়ি জ্বালা দিয়া দিলাম!’ বলতে বলতে তার গলা চড়ে এবং সরাসরি জয়নাবের দিকে তাকায়, ‘ক্যান বৌ? চাইলের গুঁড়ি পোলাপানের কুনোদিন খাওয়াস নাই? দুধ দিছস কয়দিন? দুধের স্বাদ তর পোলাপানে জানে কি?’ ঘুম কিংবা তন্দ্রা কিংবা আচ্ছন্নতার মধ্যে থেকে উঠে আসার জন্যে খাটতে খাটতে জয়নাব বিড়বিড় করে, ‘কালা গাইটারে ধইরা আনলে, কালা গাইটারে ধইরা আনলে—। হামিদা বিবি তার কথা শেষ করতে দেয় না, তার গলা আরো চড়ে, ‘গাই না তুই বেইচা দিছস বৌ! হারুন মিরধার দোকান থাইকা চাইল লইছিলি, মিরধায় আইয়া গাই লইয়া গেল, খালি গরুর প্যাচাল পাড়স!’
কিন্তু আধমণ চালের দাম শোধ না করা পর্যন্ত গরু পাওয়া যাবে না—হারুন মৃধার এই শর্তটিও কী জয়নাব তার বমির সঙ্গে উগরে ফেলল? বেড়ার দিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ ফিক করে হাসে, বলে, ‘আপনে কী যে কন?’ জায়ের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘ওহিদুল্লার বাপের কথা শুনছেন? হ্যায় কয়, গরু বিদায় করছো? গরু আমার আরেক বিবি?—হার কথা হুইন্যা আমি বলে হাইস্যা মরি! কন সে, ঘরের মইদ্যে চিকার গাত, চিকায় বলে গরুর ব্যাক কয়টা ওলান খাইয়া হালাইল! অ ওহিদুল্লা!’—প্রলাপ বকতে বকতে জয়নাব ক্লান্ত হয়, আর কথা একবার চড়ায় ওঠে তো পরপরই খাদে নেমে আসে। তার বোধ হয় গরম লাগছে, শরীর থেকে কাঁথা সরে গেছে, গায়ের কাপড় শিথিল। চোখজোড়া ঢুলঢুলু। ঠোঁটের কোণে, চিবুকের ডৌলে বমির পানির লালচে ফোঁটা, নীলচে ফোঁটা। এরি মধ্যে ওহিদুল্লার দিকে ডান হাতের তর্জনী তুলে ইঙ্গিত করলে সে এক পা এগিয়ে আসে। কিন্তু মায়ের প্রলাপ ক্রমেই দুর্বোধ্য হয়ে আসছে। জয়নাবের উকুনভরা লালচে চুল মাথার চারদিকে ছড়ানো, ঘরে হাওয়া নেই, বাতাস নেই, তবু সেগুলো একটু একটু কাঁপে। ওহিদুল্লার বুক ছমছম করে, মা বোধহয় তাকে চিনতে পারছে না। মায়ের ভয়ে একবার ‘মা’ বলে চিৎকার করার জন্য ওহিদুল্লা শক্তি সঞ্চয় করছে, এমন সময় জয়নাব হুঙ্কার ছাড়ে ‘বুইড়া মরদটা! কী দেহস? গরু লইয়া যায়, খাড়াইয়া খাড়াইয়া কী দেহস!’—জয়নাবের শ্যাওলা-পড়া চোখজোড়া দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল, মনে হয় ঘরের স্যাঁতসেঁতে শূন্যতার হঠাৎ ভেসে-ওঠা কোনো দৃশ্য প্রাণভরে দেখবে বলে চোখজোড়া সম্পূর্ণ ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। ওহিদুল্লার গলা থেকে ফিসফিস আওয়াজ বেরোয়, ‘যাই মা।’ কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে জয়নাবের মাথা বালিশের পাশে ঢলে পড়ে এবং প্রথমে হামিদা বিবি এবং ক্রমান্বয়ে হাজেরা, খাজিদা, কানা রহমতউল্লা, এমনকি আহমদউল্লার এলোমেলো চিৎকার ও বিলাপের বৃষ্টিভেজা বেড়া নিয়ে খড়ের চালের হুমড়ি খেয়ে পড়ার দশা হয়। ওহিদুল্লার পায়ের পাতা বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য শিরশির করে। এত বমির পর নির্ভার মায়ের মুখের যে কঠিন চেহারা হয়েছে তাতে তা হুকুম তামিল না করে ওহিদুল্লার কি রেহাই আছে?

প্রেমের গপ্পো – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

মাগো। তুমি এতো মজা করে কথা বলতে পারো। তারপর? মেয়েটা তোমাকে কি বললো? বুলার হাসি আর থামে না, স্বামীর প্রাক-বিবাহ প্রেমের গল্প শোনে আর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, খিলখিল এবং খিকখিক আওয়াজ বন্ধ হবার পরেও গোলগাল ফর্সা মুখের এ কোণে ও কোণে হাসির কুচি কিচিক করে। উৎসাহে জাহাঙ্গীরের ঠোঁট উপচে পড়ে, আমাকে বলে পুরুষমানুষ তার বডি হবে পুরুষ মানুষের মতো। হেঁটে গেলে মাটি কাঁপবে।

ধ্যাৎ। বুলা ফের হাসে, মেয়েরা এভাবে কথা বলে নাকি?

বললাম না, অন্য কিসিমের মাল। বলেই জাহাঙ্গীর তার ভাষা ঠিক করে, অন্য ধরনের মেয়ে। বুঝলে না? সব সময় খেলাধুলা নিয়ে থাকে আমার সঙ্গে আলাপ হয় স্টেডিয়ামে। আমি তখন ডিসকাস থ্রো প্রাকটিস করতে যাই, তো একদিন শাহীন বললো,

শাহীন কে? পরশু না নাম বললে শাহনাজ।

ঐ তো ভালোনাম শাহনাজ। ডাকনাম শাহীন। জাহাঙ্গীর একটু থেমে বলে, মানুষের দুটো নাম থাকে না? তোমার নাম–।

বুঝেছি। শাহীন না শাহনাজ। কি বললো?

আমার থ্রো দেখে বলে আপনার হাতের মুভমেন্ট খুব ম্যাজেস্টিক, আবার খুব ফাস্ট।–ওর বড়ভাই ভালো জিমন্যাস্ট ছিলো, আমাকে একদিন বলে, আপনি যদি শাহীনকে একটু দেখিয়ে দিতেন তো ভালো হয়। এবার মেয়েদের মধ্যে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন না হলে পাগল হয়ে যাবে।

তারপর?

গাড়ি করে ওদের বাড়ি নিয়ে গেলো। গুলশানের বাড়ি। বিরাট বাড়ি, সামনে লন, পেছনে মাঠ। মনে হয় হাফ স্টেডিয়াম। বাড়িতে টেনিস থেকে শুরু করে ক্রিকেট বলল, বাস্কেটবল বলো—সব কিছুর ফুল এ্যারেঞ্জমেন্ট। সুইমিং পুল পর্যন্ত আছে। একটা সাইডে শট পুট প্র্যাকটিসের জায়গা করা হলো, আমি সপ্তাহে চারদিন যাই আর। কায়দা টায়দাগুলি দ্যাখাই।

তুমি ছাড়া আর কে যেতো?

বিকাল হইলো আর লাইন দিলো মনে হয় কসকরের দুধ ছাড়তাছে।

বুলা ফের হাসে, আবার ঢাকাইয়া ল্যাঙ্গুয়েজ।

কিন্তু জাহাঙ্গীরের তখন ফ্লো এসে গেছে, এক্কেরে লাইন। বনানী,গুলশান, ধানমণ্ডির বড়োলোকের বাচ্চাগুলি গাড়ি হাঁকাইয়া আসতো। ইস্কাটন থাইকাও মনে হয় একজন আসতো।

তোমার শাহীন বোধহয় সবাইকে নাচাতো? বুলার কথায় একটু ঈর্ষার খোঁচা থাকায় জাহাঙ্গীর আরো চাঙা হয়, আরে সেগুলির একেকজনের শালা একেকরকম হুলিয়া, একেকরকম নকশা। জাহাঙ্গীর এবার অঙ্গভঙ্গি করে শাহীন বা শাহনাজের প্রেমপ্রার্থীদের চেহারা ও হাঁটবার বৈশিষ্ট্য দ্যাখায়, একটা আসতো, চিকনা, হাঁটতে গেলে হাড্ডিগুলি বাজে, চশমার আড়াল থাইকা কুকুতাইয়া চায়। শুনি সেইটা নাকি ইউনিভার্সিটিতে পড়াইতো, এইবার পরীক্ষা দিয়া ফরেন সার্ভিস পাইছে। আমি কই, এইটা ফরেন সার্ভিস দিবো। আরেকটা হোঁকা মোটা, সোজা হইয়া হাঁটতে পারে না। টেনিস র‍্যাকেট দুলাইতে দুলাইতে আসতো, শুনি সেটা নাকি কোনো সেক্রেটারি জয়েন্ট সেক্রেটারির পোলা। তা যতো বড় মানুষ আসুক, আমরা কি?–আমি এসবের মধ্যে নাই। আমার ডিউটি আমি করি, শর্টপুট দ্যাখাইয়া দেই। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন করা চাই।

হয়েছিলো? সেবার ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো?

ক্যামনে হয়? আমিই তো কাইটা পড়লাম।

আবার তোমার ঢাকাইয়া শুরু হলো! বুলার এই আঁঠালো ধমকে জাহাঙ্গীর এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলে বুলা নিজেই অপ্রস্তুত হয়, হ্যাঁ, কেটে পড়লে কেন?

এর আগেও একবার বলা গল্পটার উপসংহার টানে জাহাঙ্গীর, মাঝে মাঝে গ্যাপ গেলেই স্টেডিয়ামে লোক পাঠায়। সেবার আগাখান টুর্নামেন্ট নিয়ে আমি খুব ব্যস্ত, কয়েকদিন যেতে পারিনি। তো যেদিন গেলাম, ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছি, এসে আমাকে দেখে আর কথা বলে না। কথাই বলে না। আমি বলি, চলেন প্র্যাকটিস আরম্ভ করি। হঠাৎ আমরা পাশে এসে দাঁড়ালো। জিগ্যেস করে, আচ্ছা সত্যি করে বলেন তো আপনাকে কেউ কিছু বলেছে? আমাকে? না। কেন?–না আপনি প্রায়ই আসেন না কেন? আপনাকে কে কেউ থ্রেট করেছে। আমি তো অবাক! আমাকে কি বলবে? আমার সঙ্গে লাগতে আসবে কে? বলতে বলতে জাহাঙ্গীর নিজের হাতের মাসল ফুলিয়ে দ্যাখায়। বুলা গদগদ গলায় বলে, তারপর?

‘আমি বললাম, নাঃ আমাকে কে কি বলবে?—তা শাহীন বলে, না আপনি জানেন না, এরা আপনাকে হিংসা করে—আমাকে? কেন?— বোঝেন না? এই রাতদিন বকবক করা ছাড়া ওদের আছে কি? খালি প্যাচাল, খালি প্যাচাল। বড়ো-বড়ো কথা, খালি বড়বড় কথা। নিজেদের সব ইন্টারন্যাশনাল ফিগার মনে করে। আমিও বলে দিচ্ছি এখানে লাস্টিং করবেন শুধু আপনি, আর সব আউট হয়ে যাবে।–মানে? লাস্টিং করবো মানে? —বোঝেন না? দূর, আপনি না একেবারে একটা ইসে।

ইসে কি? ইয়ে বলল। বুলার এই ভাষাশুদ্ধির প্রচেষ্টা জাহাঙ্গীরের বাক্য-প্রবাহে এতোটুকু বিয়ের সৃষ্টি করতে পারে না, শাহীন বা শাহনাজ নামে মেয়েটির উক্তিকে সে বুলার কাছে প্রতিষ্ঠিত করে ছাড়বে, ঠিক বলেনি। বুলা ঠিক বলেনি? খালি চাপাবাজি করলে পুরুষমানুষ হইতে পারে?

আচ্ছা মেয়েটা ঐভাবেই বললো?

আরে বড়লোকের মেয়ে, ওদের কথাবার্তার ধরন অন্যরকম।

তুমি কি করলে? বুলা জানতে চায়, তবে জানা-জবাব শোনবার আগেই হাসতে শুরু করে।

আমি তো ঘাবড়াইয়া গেছি। বললাম, মাথাটা ধরছে, যাই। বলে, যাবেন মানে? ওষুধ দিচ্ছি, মাথা টিপে দিই। আমি কি আর থাকি? শাহীন ডাকে, আরে দাঁড়ান, ড্রাইভারকে বলি, গাড়ি করে দিয়ে আসুক। গড়িগুঁড়ির গুলি মারি, স্লামালেকুম— খোদা হাফেজ কইয়া করাইয়া একেবারে ছয়নম্বর বাস ধরছি, জিন্দেগিতে আর বনানী যাই নাই।

হাসতে হাসতে বুলা হাঁপায়। জাহাঙ্গীর তেলতেলে চোখ করে বৌকে দ্যাখে। বুলাটা একেবারেই ছেলেমানুষ! অথচ এতোবড় মেয়ে, কলেজে পড়ছে আজ তিন বছর, ছাত্রীও ভালো, এসএসসি, এইচএসসি দুটোতেই সেকেণ্ড ডিভিশন। ওদের কলেজে নাকি চোথাও চলে না। অথচ দেখ কি রকম সাদাসিধা মেয়ে, যা বলা যায় তাই গোগ্রাসে গেলে। স্বামীকে বিশ্বাস করার জন্য একেবারে উদগ্রীব হয়ে আছে, শুধু কথা বলার অপেক্ষা। বিশবাইশদিন হলো বিয়ে হয়েছে, অথচ মনে হয় একে ছাড়া এতোদিন ছিলো কি করে? হাসি এবং আঁচল সামলে বুলা জিগ্যেস করে, তুমি চলে এলে তোমার মোটর সাইকেল?

জবাব দিতে জাহাঙ্গীরের এক মিনিটও দেরি হয় না, সেদিন বললাম না মাথা ধরেছিলো। মোটর সাইকেল রেখে গিয়েছিলাম।

তা তুমি ওরকম পালিয়ে এলে কেন? গুলশানে বাড়ি, গাড়ি সবই পেতে। এতো বড়োলোকের মেয়ে!

আল্লায় বাঁচাইছে! নিজের নাক ও কানে আঙুল ছুঁয়ে জাহাঙ্গীর তওবা করার ভঙ্গি করে, বড়লোকের মাইয়া বিয়া কইরা তারে কৈ রাখুম, কি খাওয়ামু। গাড়ি বাড়ির আমার দরকার নাই বাবা।? তার শেষ বাক্যটি সে আবার সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করে, গাড়ি-বাড়ি আমি নিজে করতে পারি না? হবে না? ম্যানেজিং ডিরেক্টর এইতো পরশু কইলো, জাহাঙ্গীর, অর্ডার তত ভালোই আনতাছে। গুড। দুইদিন পর পাখনা গজালেই অন্য ফার্মে যাবার তাল উঠবে। এখানেই ভালো করে কাজ করো, ফার্মটারে তোলো, তোমরাও উঠতে পারবা। এখানে সিনসিয়ারলি কাজ করলে তোমার গাড়ি বাড়ি সবই হবে। বেশিদিন লাগেনা, বুঝলা, আমাদের ইসেকে দেখলাম।

এই হলো তার স্বামীর আরেকটা দোষ। কথা বলতে বলতে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে এলো তো মূল বিষয় তার মাথায় উঠলো। এখন কোথায় গিয়ে যে থামবে। বুলা তাই স্বামীর মনোযোগ ঠিক করার জন্যে তাড়াতাড়ি বলে, তা মেয়েটার সঙ্গে তোমার আর দ্যাখা হয়নি?

পাগল। আমি আর ওদিকে যাই?

ও, এই মেয়ে তাহলে সেই পুলিশের মতো ধাওয়া করেনি, না?

পুলিশ? পুলিশ আমারে কি করবে? জাহাঙ্গীরের আত্মসম্মানবোধ আহত হয়, আরে পুলিশ আমারে বাপ ডাকছে, বুঝলা? কলেজের এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি। আছিলাম, কলেজ তো কলেজ, কলেজের চারপাশে যতোটি মহল্লা আছে এর কোনো জায়গায় কোনো গ্যানজাম হইলে ওসি নিজে আসছে। কি ব্যাপার ওসি সাব?—জাহাঙ্গীর ভাই, কেসটা ট্যাকল করেন। আবার আমার কলেজের একটা হোস্টেলের লগে একটা সিনেমা হল আছে, পোলাপানে দুই একদিন শয়তানি কইরা মাগনা বই দেখতে চায়। ওসি আবার আসছে। এইবার কি?না জাহাঙ্গীর ভাই আপনার পোলাপানরে সামলান। আমি উল্টা ধামকি দিছি, আরে রাখেন। সিনেমার মালিক মালপানি বহুত কামাইছে, আমর পোলাপান মাগনা দুইটা সো দেখবো তো এতো হাউকাউ কিসের? —শুইনা পুলিশে কথা কয় নাই। শোনো, পুলিশের কথাই যখন তুলো তো কই।

অরে না, না! বুলা অধৈর্য হয়ে বলে, তোমায় পুলিশের ভয়ের কথা কে বললো? ঐ যে এক মহিলা-পুলিশ তোমার প্রেমে পড়ছিলো, যে সেদিন বললে না?

ও! এতোক্ষণে জাহাঙ্গীর থিতু হলো, তুমি হিপ হিপ হ্বরের কথা কও?

কি নাম বললে? বুলা হাসে, হিপ হিপ হ্বরে। মেয়েছেলের নাম?

আরে নাম না, টাইটেল, উপাধি!

ও মা! বুলা অবাক হয়, পুলিসের নাম দিয়েছিলো হিপ, হিপ হুররে?

পুলিশ তো হইলে অনেক পরে। কলেজে আমাদের সঙ্গে পড়তো। তখনি ওর হিপ দুইটা, মানে পাছা ছিলো খুব প্রমিনেন্ট, তাই দেইখা ছেলেরা টাইটেল দিলো হিপ হিপ হুররে।

মাগো! তোমরা কি অসভ্য ছিলে। ক্লাসমেটের এই নাম দিতে? এই ধিক্কার দিলেও বুলার ফের হাসির একটা ধমক আসে, কোনো রকমে নিশ্বাস টেনে নিতে নিতে বলে, তোমরা সব ভারি অসভ্যতা করতে, না?

কেন, তোমাদের কলেজের ছেলেরা তোমারে নিউ ইয়ারের টাইটেল দেয় না? ঐগুলি মনে হয় ম্যাদামার্কা খ্যাত না? বলে জাহাঙ্গীর নিজেই তার বিবৃতি সংশোধন করে, ও হো। তোমার তো উইমেন্স কলেজ, পদা-টাঙানো হারেম শরীফ। তোমাদেরটা আবার ডবল প্রোটেকটেড জোন। যা উঁচু দেওয়াল।

আব্বা আবার কো-এডুকেশন পছন্দ করে না।

তোমার বাবা একেবারে উডেন মোল্লা।

মানে?

কাঠ মোল্লা আর কি? মেয়েকে ছেলেদের সঙ্গে পড়তে দেয়নি ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়নি কে-এডুকেশনের ভয়ে, তাই না?

বুলার গলা একটু ভারি হয়, আমার বাবা কি তোমার কেউ নয়? সঙ্গে সঙ্গে জাহাঙ্গীরের আফসোস হয়, বৌ-দের কাছে তাদের বাবা-মা সম্বন্ধে একটু সাবধানে কথা বলা দরকার। ওরে আমার পিছু রানী, রাগ করলে? বুলার মাথা সামনে টেনে জাহাঙ্গীর তার গালে দুটো চুমু খায়। দুটো চুমুর পর খ্যান্ত দেওয়ার বান্দা সে নয়। তবে এখন গল্পবলার বেগ এসেছে, চুমু-টুমুর ব্যাপার পরে দেখলেও চলবে। বুলা মাথা নিচু করে বলে, আব্বা কিন্তু মোটেই কনজারভেটিভ নয়। তাহলে কি আমাকে গান শেখাতো? পাড়ার কলেজ, পড়াশোনা ভালো হয়, তাই ওখানে দিয়েছে। আচ্ছা, আমার ভুল হয়ে গেছে। এই মাপ চাইলাম। জাহাঙ্গীর হাত জোড় করে এমনভাবে তাকায় যে বুলা হেসে ফেলে। বুলা আসলে ঠিকই বুঝেছিলো। বিয়ের পর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই স্বামীটিকে সে চিনে ফেলেছে, লোকটা একেবারে খোলামেলা, মানুষ এতো ফ্রাঙ্ক হতে পারে। বাপ-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি যার সম্বন্ধে যা মনে হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলছে। আবার দ্যাখো, বাপ-মা তো বটেই শ্বশুর সম্বন্ধেও সিরিয়াসলি কেউ খারাপ কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে রুখে দাঁড়ায়। কোথাও কোনো রাখোটকো নেই, যা বলার অকপটে বলে ফেলে। মিষ্টি-মিষ্টি মুখ করে বুলা স্বামীর দিকে তাকায়, আমি এমনি বলেছি। যাক, তারপর? তোমাদের হিপ হিপ হুররের কথা বলো।

হ্যাঁ, শোনো। জাহাঙ্গীর নতুন উদ্যমে শুরু করে, সব সময়তার বুক উঁচু করে বলা, কাউকে কেয়ার না করা—এইসব দেখে ছেলেরা মাঝে মাঝে সাউন্ড দিতো।

সাউন্ড দিতো মানে?

আঃ। তুমি কিছু বোঝে না। স্ত্রীর অজ্ঞতায় জাহাঙ্গীরের উৎসাহ বাড়ে, সাউন্ড দিতো মানে। একটু রিমার্ক পাস করতো। তো হিপ-হিপও চেইতা যাইতো, একদিন কয় আপনাদের বাড়িতে মা বোন নেই? পোলাপান কি কম? কয়,আছে কিন্তু বাপেরা আর দুলাভায়েরা সেইগুলি দখল কইরা রাখছে।

ছি ছি! এরকম বলে, এ্যাঁ?

বুলার বিস্ময় ও ধিক্কারে জাহাঙ্গীর হাসে, যাই কও পোলাপানে ভালোই জবাবটা দিছিলো, না? হিপ-হিপ হ্বরে মেয়েটি সম্বন্ধে গল্প তার অব্যাহত থাকে। ছেলেরা একদিন করলো কি, হিপ হিপের গায়ে কলম ঝাড়ে, এবার হিপ-হিপ নালিশ করলো প্রিন্সিপালের কাছে। প্রিন্সিপ্যাল আর কি করতে পারে? ঐ ক্লাসে নিজে গিয়ে ছেলেদের খুব বকেদিলে। ছুটির পর মেয়েটির অবস্থা সেদিন খুব খারাপ ছেলেরা সব এখান থেকে সাউন্ড মারে, ওখান থেকে সাউন্ড মারে। জাহাঙ্গীর তো এসবের মধ্যে কখনো যায় না। ক্লাসও করে না, মেয়েদের পেছনে ঘোরাঘুরিও করে না। সে আছে। তার নিজের ও কলেজের খেলাধুলা নিয়ে, তার কাজ হলো কলেজের খেলাধুলার। মানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা, এই ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে তাদের কলেজের খ্যাতি যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়। আর কি করে? কলেজে কোনো বিচিত্রানুষ্ঠান এলে জানপ্রাণ দিয়ে খাটা এবং স্টেজে একবার দাঁড়িয়ে শরীরচর্চা প্রদর্শন করা। যাক, সে সেদিন ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলো, মেয়েটা কাঁদো কাদো গলায় এসে বলে, দ্যাখোন তো। সবাই কি করছে আমার সঙ্গে? জাহাঙ্গীর বুলার কাছে তার সেদিনকার প্রতিক্রিয়ার কথা বলে, বুঝলা বুলা, আমি হাঁক দিয়া কই কি তোমরা পাইলা কি? ক্লাসমেটের সঙ্গে ইয়ার্কি মারো, রাস্তায় দেখলে তারে সাউন্ড দাও, এইগুলি কি? কলেজের বেইজ্জিতি না?

বুলা বলে তোমার সাহস তো কম না। এতোগুলো ছেলেকে বললে, সবাই মিলে তোমাকে যদি ধরতো? তোমাদের কলেজের না নামডাক।

আরে, আমারে কে কি কইবো? কলেজের আমি এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি। মহল্লা কনেট্রাল করি আমি। ফের শুরু হলো। বুলা বলে তারপর?

তারপর কয়েকটা ছেলে এগিয়ে এসে তাকে বলে, জাহাঙ্গীর ভাই, আমাদের ধরার আগে বিচার চাই।—বিচার কিসের বিচার? তাদের অভিযোগ খুব স্পষ্ট। তাদের ক্লাসমেট প্রিন্সিপ্যালের কাছে গেলো কেন? প্রিন্সিপ্যাল সবাইকে অপমান করলো, এর বিচার করবে কে? জাহাঙ্গীর ভেবে দেখলো, তাও বটে। মেয়েটাকে সে ধমকায়, আপনে স্যারেরে কইলেন ক্যান? আমরা নাই? মেয়েটি ভ্যাবাচ্যাকা খায়, দারুণ দাপটের ডাকু টাইপের লড়কি, তার গলা কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়ে, আপনিও তাই বললেন?

বুলা জিগ্যেস করে, মানে তোমাকে আলাদা করে দ্যাখে?

আরে আমি কি ঐ বিচ্ছুগুলির লগে হাউকাউ করি? আমি ক্লাসও করতাম না, জানিই না কোন ছেমরি কি পড়ে!

ক্লাস করোনি তো বি এ পাস করেছে কিভাবে? বুলার প্রশ্নের ভঙ্গিতে জাহাঙ্গীর একটু থতমতো খায়। সাতদিন আগেও পরীক্ষার হলে ওর নকল করার বাহাদুরি নিয়ে খুব গল্প করেছে। স্যাররা ওর ভয়ে হলের ভেতর ঢুকতো না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করে তিনটে ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে। কিন্তু এখন ঐ গল্প করতে তার একটু বাধোবাধো ঠেকছে সে তার পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যায়, আমি কই আপনে স্যারেরে কইয়া কামটা ভালো করেন নাই। পোলাপানে কয় আর জাহাঙ্গীর ভাই, আপনার কাছে কইলেও তো পারতো।

কি করি? ছেমরিটা কাঁদতে আরম্ভ করলো। আমি নিয়া রিকশায় উঠাইয়া দিলাম, তো কয়, আপনারেও যাইতে হইবো। পাগল নাকি? এক রিকশায় তার বাড়ি যাই আর একটা কেলেঙ্কারি। আমি তখন কলেজের এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি, বুঝলা না?

গল্পটা কেবল জমে উঠেছে, এমন সময় এসে পড়ে বুলার বড়ো ভাই। হাফিজটা পুরু লেন্সের চশমা পরে। ছাত্রও খুব ভালো ফিজিক্সে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে এ্যাটমিক। এনার্জিতে ঢুকেছে, এ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটিগুলোতে একটার পর একটা দরখাস্ত পাঠাচ্ছে, লেগে গেলেই উড়াল দেবে। এমনিতে লোকটা ভালো, যখনি আসে হাতে জাহাঙ্গীরের প্রিয় মিষ্টির প্যাকেট। তবে গভীর টাইপের এই লোকটার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের ঠিক জমে না। সম্বন্ধীর সামনে জাহাঙ্গীর সব সময় উসখুস করে। হাফিজ আজ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তার এক বন্ধুকে। এটার নকশা অবশ্য অন্যরকম, রোগা ও লম্বা, পাজামা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা নাই। মুখে পান। হাতে সিগারটে জ্বলছে। ড্রয়িং রুমে বসেছিলো দু’জন। জাহাঙ্গীর ঢুকতেই লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ায়। বুলার ভাই নাম বলে পরিচয় করিয়ে দেয়, আমার বন্ধু, নাম শুনেছেন নিশ্চয়। সরোদ বাজায়–।

জাহাঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গে বলে, টিভিতে প্রায়ই দেখি।

হাফিজ হেসে বলে, কি মুশতাক, তুমি কি আজকাল জনগণের মনোরঞ্জনে মগ্ন নাকি?

মুশতাক ভাইকে রেগুলার প্রোগ্রাম দিলে পাবলিক চটে যাবে না? বুলা যে কখন এসেছে কেউ টের পায়নি। তার কথা শুনে মুশতাক চমকে ওঠে, একটা ঢোক গিলে হাসতে হাসতে বলে, আমাকে প্রোগ্রাম দেয় কোন শালা? তার চাকরি যাবে না?

লোকটাকে জাহাঙ্গীরের ভালোই লাগছে। আসতে না আসতে কেমন সহজ হয়ে উঠেছে।

আহা, টেলিভিশনে প্রোগ্রাম পায় না। মাঝে মাঝে প্রোগ্রামের ব্যবস্থা তো সে-ই করে দিতে পারে। চেনা জানা কয়েকজন আছে, একটু ধমক দিলে বাপ বাপ করে প্রোগ্রাম দেবে। কিন্তু কথায় কিভাবে পাড়বে ভাবতে ভাবতেই মুশতাক বলে, বুলা, কেমন আছো? তোমার বিয়েতে আসতে পারলাম না। কুমিল্লা গিয়েছিলাম। জানো বোধহয় সুনীলদার শরীর খুব খারাপ।

হ্যাঁ, শুনেছিলাম। এখন কেমন?

ভালো না।

শুনে বুলার মুখটা ঝুলে পড়ে। জাহাঙ্গীর এদিক ওদিক দেখে। কে এই সুনীলদা যার শারীরিক অসুস্থতার খবরে বুলা এভাবে ভেঙে পড়ে। জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে মুশতাক, সুনীল সেনগুপ্ত। জানেন বোধহয় আমাদের দু’জনের হাতেখড়ি হয় সুনীলদার হাতে। হারমোনিয়াম ধরতে শেখায় সুনীলদা। তখন কি রাগি ছিলো, না? একটু এদিক-ওদিক হলে কিরকম ধমক দিতো মনে আছে?

আমাদের দুজনের বলতে মুশতাক কি বোঝাচ্ছে?—মানে মুশতাক আর বুলা?

–জাহাঙ্গীর একটু অস্বস্তিবোধ করে,–বুলা গানবাজনার চর্চা করে—এখবর সে জানে, কিন্তু এই ব্যাপারে তার আবার সঙ্গীও আছে একজন, সে আবার তার ভাইয়ের বন্ধু-না বুলা তো কোনদিন বলেনি। কেন বলেনি?

ধমক দেয়ার কথা কি বলছো? কিঞ্চিৎ উত্তম মধ্যম পিঠে পড়তো, সে কি ভুলে গিয়েছো? হাফিজের মাইনাস পাঁচ লেন্স ও ভাঙাচোরা গাল পেরিয়ে এই রসিকতা পড়তে না পড়তে বুলা খিলখিল করে হাসে, সেটা মুশতাক ভাইয়ের পিঠে। সুনীলদা আমাকে কখনো মারেনি।

তোমার পিঠটা অক্ষত থাকতো কারণ সুনীলদা তোমার ব্যাপারে বেশিরকম উইক। এবারে বার বার জিগ্যেস করে, বুলা রেওয়াজ করে তো? বলতে বলতে মুশতাক নিজেই প্রশ্নটা করে, রেওয়াজ করো না? আমি বললাম বুলা কি ছাড়তে পারে?

জাহাঙ্গীর উসখুস করে। হাফিজ বলে, আর গানবাজনা? মেয়েদের ব্যাপার, বোঝো না? বিয়েও হলো, গান বাজনা, পড়াশোনা সব মাথায় উঠলো। সেরকম পরিবেশ পেলে অবশ্য।

জাহাঙ্গীর এবার উঠে দাঁড়ায়, আপনারা বসেন। আমি একটু আসি। এই যাব আর আসবো, পাঁচ মিনিট।

হাফিজ বলে, বসেন। আমাদের জন্য কিছু আনতে হবে না। বুলা চা করুক। বুলার সঙ্গে জাহাঙ্গীরও রান্নাঘরে ঢোকে। এই মেয়েটাকে একটু আগে মনে হচ্ছিলো নিজেরই হাত পা নাক কানের মতো। এখন এরকম অপরিচিত মনে হচ্ছে কেন? বুলা বলে, কোথায় যাবে? ভাইয়া তো মিষ্টি নিয়েই এসেছে।

তাই হয়? মেহমানের খাবার দিয়া মেহমানদারী চলে? দেখি হায়ানের দোকানে যাই। পাঁচটা মিনিটও লাগবে না।

বাদ দাও। আমি চা করি, তুমি বরং ওদের সঙ্গে গল্প করো। গল্পে সুবিধা করতে পারছে না বলেই জাহাঙ্গীর তাড়াতাড়ি বাইরে যেতে চাইছে। তুমি চা পরে কইরো। আমি দেখতে-দেখতে ব্যাক করুন। বলে জাহাঙ্গীর আরো একবার বাথরুমে যায়। তারপরে বসার ঘরে ঢুকে ঠুক চুক শব্দ করে ক্যাসেট বদল করে টেপরেকর্ডার চালিয়ে দিয়ে বলে, গান শোনেন। মাহমুদ শাহেদের এই রেকর্ড খুব হিট করেছে। আমার ফ্রেন্ড। টিভিতে উইকে দুইটা তিনটা প্রোগ্রাম করে। বাংলা ভাষায় পপ গান বিকট জোরে বাজে; পা পাছা পিঠ ও ঘাড় দোলাতে দোলাতে জাহাঙ্গীর উঠে বাইরে। যায় তার ভেসপায় স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ এই উচ্চকণ্ঠ ধ্বনি সমষ্টিতে একটুও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না।

কাঁঠাল-পাতার ঠোঙা থেকে মোরগ পোলাও প্লেটে সাজানো হয়। জাহাঙ্গীর নিজেও বুলাকে সাহায্য করে। এখন কি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা শুরু করবে ভাবতে-ভাবতে জাহাঙ্গীর খেয়াল করলো যে টেপরেকর্ডারটা বন্ধ। কি ব্যাপার? মাহমুদ শাহেদের এতোগুলো গান।–কি ব্যাপার? বন্ধ কইরা দিছেন?

হ্যাঁ, কথা বলছিলাম। বুলার ভাইয়ের এই কৈফিয়ৎ জাহাঙ্গীরের আরো খারাপ লাগে। কথা বলছিলো তো আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো কেন? মুশতাক বলে, মাহমুদ শাহেদ আপনার বন্ধু? এখন তো টপে আছে, না? এবার জাহাঙ্গীরের জড়তা কাটে, হ্যাঁ। অনেকদিনের বন্ধু। আমরা এক সঙ্গে একই ক্লাবে খেলাধুলা করছি। এখন এতো ফেমাস হইয়াও পুরানো ফ্রেন্ডদের ভোলে নাই। কলেজে আমি এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি ছিলাম তো, আরে দুইবার ফাংশানে নিয়া গেছি। অরে দেইখা আর সব গান ক্যান্সেল করতে হইলো। পোলাপানে আর কিছু শুনতে চায় না। অর গান শুইনা সমস্ত হল নাচতে শুরু করলো। উই নিজেও নাচে, আমরাও নাচি। আরে অর গান শুনলে আমি তো চেক দিতে পারি না। নাচতেই হয়। মুশতাক বলে, অনেক কষ্ট করে গান করে। বেচারাদের কোমরে ব্যথা হয়ে যায়।

তা তো করেই। তবে কিনা অভ্যাস হইয়া গেছে। জাহাঙ্গীর তার প্রিয় গায়কের নৈপুণ্যে একটু গর্ববোধ করে বৈ কি!

বেচারাদের গলায় তো তেমন পরিশ্রম হয় না, সুর তালের জন্যেও কোনো পরোয়া না করলেও চলে। বেচারাদের খাটনি সব শরীরে।

হাফিজ হো-হো করে হেসে ওঠে। জাহাঙ্গীরের থতমত খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু সামলাবার চেষ্টা করে, কেন? টিভিতে তো দেখি বেশির ভাগই আজকাল শরীর দুলিয়ে গান করে।

সেজন্যেই ওদের গান বন্ধ করা উচিত নয়। গলা বা সুর তো এদের কাছে মাইনর ব্যাপার। তবে ধরেন গান বন্ধ করলে এদের বাত ধরে যেতে পারে।

বাত? জাহাঙ্গীর অবাক হয়, কিন্তু হাফিজ ও বুলা দুজনেই হাসতে শুরু করে। মুশতাক গম্ভীর মুখ করে বলে, ওদের গান মানে তো ফিজিক্যাল মুভমেন্ট। গান বন্ধ হলে বাত হবে না? রিকশাওয়ালাদের শেষ জীবনে কি হয়?

সবাই হাসে। জাহাঙ্গীরও হাসে, তবে ঠোঁটে হাসির দাগটা ফুটিয়ে তুলতে ওর জান বেরিয়ে যাবার দশা হয়। রাত্রে বিছানায় শুয়ে বুলা বলে, মুশতাক ভাইয়ের কথাবার্তা খুব ফ্রাঙ্ক, ঠিক তোমার মতো, না? যা মনে হয় তাই বলে। কেমন হাসালো, আজ, দেখলে না?

বহুত মজা করলো, গান বাজনা করে না?

হ্যাঁ। সরোদ বাজায়। সুনীল সেনগুপ্তের খুব প্রিয় ছাত্র। মুশতাক ভাই খুব ফিনসিয়ার আর্টিস্ট। ক্ল্যাসিক্যালের নিচে নামবে না। দেখলে না টিভির ওপর কেমন চটা?

প্রোগ্রাম না পাইলে চেতবো না? আরে একটা প্রডিউসারকে কইলেই তো প্রোগ্রাম দেয়। উনার পুরা নামটা কও তো।

না, না, উনি ইচ্ছা করেই প্রোগ্রাম নেন না। এইসব ন্যাকামো বাঁদরামো ঘাবলামো মুশতাক ভাই সহ্য করতে পারে না।

জাহাঙ্গীরের কাছে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় না। হাজার হাজার নরনারীর সামনে নিজেকে দ্যাখাবার এরকম সুযোগ কি কেউ ইচ্ছা করে হারায়? বুলা তো মিথ্যা কথা বলে না। তাহলে সে নিশ্চয়ই ঠিকঠাক জানে না। জাহাঙ্গীর বলে, একটা দুইটা প্রোগ্রাম পাইলেই দেখবা মুশতাক ভাইও নাচতে শুরু করবো, টিভির পর্দা ফাটাইয়া ফালাইবো।

বললাম তো মুশতাক ভাই অন্য ধরনের লোক। সঙ্গীত উনার রক্তের মধ্যে, তা ইয়ার্কি মারা সহ্য করতে পারে না। বুলার কথা শুন জাহাঙ্গীর একেবারে চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর বলে, তোমার আসলে বিয়ে হওয়া উচিত ছিলো ঐসব হাই-থটের গান বাজনা করা লোকের সঙ্গে। আমি ঐগুলি বুঝি না।

বুলার যেন চৈতন্য ফিরে আসে। জাহাঙ্গীরের পিঠে হাত রেখে বলে, তুমি রাগ করলে?

না, না। রাগ করিনি। গলা খাঁকরে সমস্ত এক্সট্রা রসালো ভাব ঝেড়ে ফেলে জাহাঙ্গীর, রাগ করবো কেন? মানে আমি তো এইসব ঠিক বুঝি না। তোমাদের ঐসব গান বাজনায় আমার ইন্টারেস্ট নাই। ধরো ঐ লাইনের মানুষকে বিয়ে করলে তোমাকে হেলপ করতে পারতো। মানে একই লাইনের হাজব্যান্ড-ওয়াইফ হলে।

এসব কথা আর বলবে না। বলতে বলতে বুলা ডান হাতের চারটে আঙুল দিয়ে জাহাঙ্গীরের ঠোঁট চাপা দেয়। একটু আগে পাঙ্গাশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছে, বুলার হাতের আঁশটে নাকে থাপ্পড় মারলে নিশ্বাস বন্ধ করে জাহাঙ্গীর বুলার আদর নেয়। বুলা বলে, আমি ঠিক এই রকম লোকই চেয়েছি। এইরকম হাসিখুশি, এইরকম কাজের লোক, এইরকম ফিগার, হেঁটে গেলে মাটি কাঁপে—এই আমার ভালো।

তবে ধরো আমার পক্ষে গান বাজনার ব্যাপার–।

আবার? চোপ! বুলার হাত আরো চেপে বসে, ঐ সব লোক গুণীলোক, ওদের খুব শ্রদ্ধা করি, কিন্তু ওদের ভালোবাসা মুশকিল। বুঝলে না, রাত দিন বিছানার ওপর বসে খালি রেওয়াজ করে, বাইরে যায় না—এসব পুরুষ মানুষের সঙ্গে ঘর করা যায়?

জাহাঙ্গীরের কোনো সাড়া না পেয়ে বুলা ফের বলে, একই লাইনের হাজব্যান্ড ওয়াইফের কথা বলছো? তুমি তাহলে গুলশানের মেয়েটাকে বিয়ে করলে না কেন? এইবার বলো তো?

জাহাঙ্গীর কি বলবে? গুলশানের মেয়েটিকে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে ওরকম কোনো মেয়ের সঙ্গে সত্যি সত্যি আলাপ থাকলে মাঝে মাঝে যাওয়া যেতো। বুলাকে বলে, বোল তো, এসিব গুণীলোক কি তোমার মতো এরকম বেপরোয়া মোটর সাইকেল চালাতে পারে?

বুলার আঙুলে জাহাঙ্গীর চুমু খায়। এমন কি তার তর্জনী নিয়ে একটু একটু চুষতেও শুরু করে। বুলা ফের বলে, বলো ওরা পারে?

জাহাঙ্গীর এবার আত্মসমর্পণ করে, আমাদের হিপ-হিপরেও আমার ভেসপা চালাবার ভঙ্গি দেখেও ধরে ফেললো।

ও হ্যাঁ, গল্পটা শেষ করলে না? ভাইয়ারা এসে সব মার্ডার করলো।

মহা উৎসাহে হিপ-হিপের গল্প শুরু করলেও এবার তেমন জমে না। সেই যে সাউন্ড মারা ছেলেদের হাত থেকে উদ্ধার করে জাহাঙ্গীর তাকে রিকশায় উঠিয়ে দিলো এরপর থেকে

তা মেয়েটার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ কেটে গেলো কি করে? গল্পটা তো আগেও শোনা হয়েছে। সেই স্মৃতি থেকে বুলা এই প্রশ্ন করে।

কিন্তু জাহাঙ্গীর এবার অন্যরকম কথা বলে, যোগাযোগ বন্ধ হইবো ক্যান? না মানে ধরো, একই ক্লাসে পড়ি, রোজ দ্যাখা হয়। আবার কোনো অসুবিধা হইলে আমারেই ধরতো। বলতে বলতে জাহাঙ্গীর একটু লাজুক মতো হাসে, ছেলেরা একটু ঠাট্টাও করতো। একবার পিকনিক করতে গেলাম চন্দ্রা, আমরা কয়জন হাঁটতে হাঁটতে একটু নির্জন ঝোঁপের দিকে গেছি তো হঠাৎ দেখি, বুঝলা আমাগো দুইজনের একলা ফালায়া বিচ্ছুগুলি কৈ ভাগছে। আমরা হাসি। ইসে কয়, আরে বসোনা।

তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগলো? বুলা প্রায় উঠে বসে।

তা অস্বীকার করতে পারবো না, একটু ভালো তো লাগতোই।

সতি? ডুবে ডুবে জল খেয়েছে, না? বুলা আরো শোনবার জন্য উদগ্রীব। এই গল্পের আগেকার ভার্সনে কিন্তু জাহাঙ্গীরের সঙ্গে হিপ-হিপের এতোটা মাখামাখি বা পিকনিক—এইসব ব্যাপার ছিলো না।

আমাকে বলে, আমাদের বাসায় তো আসলেন না। আমার মা আর বড়োআপা আপনাকে দেখতে চায়।

মানে মেয়েটি তাহলে বাড়িতে ওসব বলেছে? বুলার এই উদ্বিগ্ন জবাবে জাহাঙ্গীর বলে, মনে হয়।

তুমি ওদের বাসায় গেছো?

আমি? জাহাঙ্গীর একটু ভেবে বলে, বাসায় টাসায় যাইতে ভালো লাগে না। মেয়েদের বাসায় বাসায় ঘোরা, কার্পেটের উপরে বইসা হারমোনিয়াম একখান লইয়া প্যাঁ প্যাঁ করা আমার পোষায় না।

বুলা কিছু বলে না। জাহাঙ্গীরের কথায় এ ধরনের ঝাঁঝ আগে কখনো দ্যাখেনি। জাহাঙ্গীর বলতেই থাকে, মেয়ে ক্লাসমেটের বাড়ি গিয়ে ডাক দিমু, ও মিনু, ও ডলি, একটা গান ধরো তো? তারপর শিঙাড়া, চানাচুর, চা খাইয়া ঘরে ফেরা—এইগুলি পুরুষ মানুষের কাম না, বুঝলা? এইগুলি করে হিজড়ারা, বুঝলা? হঠাৎ বেড-সুইচে খুট করে শব্দ হয়, ঝলমলে আলোয় জাহাঙ্গীর কুঁকে বুলার মুখ দ্যাখে। ফর্সা মুখ কাগজের মতো ফ্যাকাস কি হলো?

তোমার মুখটা দেখতে ইচ্ছা করলো। বুলার জন্যে তার মায়া হয়, হাজার হলেও মেয়েমানুষ, এভাবে কথা না বললেই পারতো। কিন্তু তাকে চুমুও খায়না। মেরামত করার চেষ্টা করে এইভাবে, তোমার গালের রঙ এতো সুন্দর।

চোখ বন্ধ করে বুলা হাসে, তারপর?

জাহাঙ্গীর একটানা কথা বলে। মেয়েটির সঙ্গে সে দু’একবার চাইনিজও খেয়েছে। কিন্তু মেয়েদের মন বুঝে চলা তার স্বভাবে নেই। সে ছিলো কলেজের এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি, কতো ছেলে কতো মেয়ের সঙ্গে তার মেলামেশা করতে হয়। একটি মেয়েকে নিয়ে হিপ-হিপ তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে। অথচ দ্যাখো মেয়েটোর সঙ্গে এমন কিছু মাখামাখি হয়নি। তার বড়ো ভাই ছিলো জাহাঙ্গীরের বন্ধু, একদিন এসে বলে, দ্যাখ তো আমার বোনটা ভর্তি হতে পাচ্ছে না, দেরি করে ফেলেছে, দে না তোদের কলেজে ম্যানেজ করে। তা সে হলো কলেজের এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি, প্রিন্সিপ্যালকে গিয়ে বলে সার, খেলাধুলা করে, এই মেয়েটাকে চাই। নাজমা তো অবাক। জাহাঙ্গীরকে ডেকে ‘আমি খেলাধুলা করি আপনাকে কে বললো?’ জাহাঙ্গীর বলে, নাজমা

সেদিন না বললে পারভীন? বুলা হঠাৎ বাধা দিলে জাহাঙ্গীর দমে যায়।

পারভীন? ও এর কথা বলছি?

বলোনি? বলোছো। আগে তোমার হিপ-হিপের কথা বলো। আমার ঘুম পাচ্ছে।

এইসব গল্প শুনতে তার ঘুম পায়? জাহাঙ্গীর একটু থেমে ফের শুরু করে। তারপর অনেকদিন কোনো যোগাযোগ ছিলো না। মাস তিনেক আগে জাহাঙ্গীর খুব স্পীডে ভেসপা চালিয়ে রামপুরা যাচ্ছে, মালীবাগে পুলিশ বক্সের ভেতর থেকে একদল মহিলা-পুলিশ ট্রাকে ওঠার জন্যে বেরিয়ে আসছে। এদের একজন হঠাৎ তার দিকে বাঁশি বাজিয়ে হাত তোলে। ভেসপার ব্রেক কষতেই সামনে এসে বলে, এতো ওভারটেক করতে চান কেন? দেখি লাইসেন্স। দেখি। মহিলা-পুলিশের ধৃষ্টতা দেখে জাহাঙ্গীরের মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। কি সাহস। চোখমুখ লাল করে জাহাঙ্গীর তার দিকে তাকালে পুলিশ ফিক করে হেসে ফেলে। আরে এ তো শালার সেই হিপ-হপ হ্বরে।—কি জাহাঙ্গীর, কোথায় যাবে?— বুলা একটু সংশোধন করার জন্যে উসখুশ করে। কারণ এর আগে গল্পটা বলার সময় সংলাপে মেয়েটি জাহাঙ্গীরকে জাহাঙ্গীর ভাই বলে সম্বোধন করেছিলো এবং তাকে আপনি করে বলেছিলো। কিন্তু জাহাঙ্গীরের বাক্যবেগে বাধা দেওয়া যায় না। তার বাক্যধারা তুমুল প্রবাহিত হয়, আমি জিগাই তুমি?—আমি তো পুলিশে ভর্তি হইছি। খুব ভালো। তুমি কৈ যাও? জানো তোমারে আমি এক্ষুণি এ্যারেস্ট করতে পারি।–তা তো পারোই, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে এ্যালিগেশন কি? —চলল, তোমার সঙ্গে যাবো, যাইতে-যাইতে বলবো। — তারপর সে করেলা কি আমার পেছনে উইঠা আমারে জাপটাইয়া ধরলো। বুলা এখানেও তাকে একবার থামাতে পারতো। পরশুদিন বলার সময় এই পর্যন্ত ছিলো, চলেন, আপনার সঙ্গে যাবো। কিন্তু জাহাঙ্গীর তাকে নেয়নি, না, আজ একটু কাজ আছে, আরেকদিন আসবো। জাহাঙ্গীর তাকে রেখেই স্পিডে মোটর সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন জাহাঙ্গীরকে থামানো অসম্ভব।

আমারে কয় তোমার বিরুদ্ধে এ্যাবস্কণ্ডিং হওয়ার এ্যালিগেশন। তোমাকে আমি সব জায়গায় খুঁজি।–কেন? কেন আবার কি? তোমাকে চাই। আবার কি আলো জ্বালাবে? বুলার মুখটা দ্যাখা যেতো। কিন্তু সুইচে হাত দেয়ার আগেই বুলার মিহি স্বরের নিশ্বাস শোনা যায়। আরে, এ তো ঘুমিয়ে পড়েছে তার পাতলা ফর্সা রোগা হাতটা জাহাঙ্গীরের ঘোড়ের ওপর আলগোছে রাখা। হাতটা ধরে জাহাঙ্গীর পাশে রেখে দেয়, নিজেও শোয় একটু দূরে সরে। এই মেয়েটা স্বামীর প্রেমের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে কি তার কোনো মনোযোগ নেই। জাহাঙ্গীরকে সে কি কোনো পাত্তাই দেয় না। তার ধারণা কি এই যে জাহাঙ্গীর সব বানিয়ে বানিয়ে বলছে?–কেন, জাহাঙ্গীর কি মিথ্যাবাদী? চাপাবাজ? কেন, এরকম ভাববে কেন? জাহাঙ্গীর কি প্রেম করতে পারতো না? কিংবা কোনো মেয়েই তার প্রেমে পড়বে না? জাহাঙ্গীর উঠে বাথরুমে যায়। ফের এসে খাটের ধারে বসে থাকে। মনে হয় একা একা শুয়ে থাকাটা অনেক আরামের। এইটুকু সেমি-ডবল খাট, সেখানে দুজন ঘুমানো? বিশি।–কাল ভোরবেলা বেরিয়ে যাবে, সারাদিন, এমন কি রাত্রি পর্যন্ত অফিসের কাজ করবে। কতো কাজ বাকি পড়ে আছে। বায়তুল মোকাররম-গুলিস্তান এলাকার বড়ো দোকানদাররা দেশি ফার্মের ওষুধ রাখতে চায় না। তাদের কনভিন্স করা দরকার। ম্যানেজিং ডিরেক্টর দিন দিন তার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছে, অর্ডার আসেনা কেন? কবীর অর্ডার আনে, বেলাল অর্ডার আনে, তুমি করো কি? কবীর কি বেলাল তো তার মতো এরকম এলিয়ে পড়েনি। সকাল নেই বিকাল নেই রাত নেই—বৌয়ের সঙ্গে ম্যাদামার্কা ছেলেদের মতো দিনরাত কেবল ফুসুর ফাসুর করবে তোতা অর্ডার আনবে ওর কোন বাবা?— তাও যদি মেয়েটা ওকে বিশ্বাস করত। তা বুলা ওকে বিশ্বাস না করলে সে কি করত পারে? দোষ তো শালার মহিলা পুলিশের। হিপ-হিপ-হ্বরে যদি সত্যি-সত্যি ওকে ডেকে একটু কথা বলতো তা হলে বুলা কি অবিশ্বাস করে এতো সহজে পার পায়। হিপ-হিপ-হুররে কি তার সঙ্গে পড়তো না? তার কি এই মেয়েটিকে হিপ-হিপহুররে উপাদি দেয়নি? তবে? —অবশ্য কলেজে পড়তে কোনো মেয়ের সঙ্গেই জাহাঙ্গীরের কথাবার্তা হয়নি।, হিপ-হিপের সঙ্গেও হয়নি। তো, পুলিসে পরিণত হওয়ার পর কথা বললে মেয়েটার কি এমন ক্ষতি হতো?

সকালে ঘুম ভাঙে তার বেশ দেরিতে। মুখ ধুয়ে এসে দ্যাখে চা টা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে বুলা। এর মধ্যেই বুলার গোসল-টোসল সারা। তার ভোলা ভিজে কালো চুলের মধ্যে ফর্সা মুখটা ভারি কচি ও নিষ্পাপ। কি সুন্দর, না? ভেসপায় স্টার্ট দিতে দিতে জাহাঙ্গীর ঠিক করে, বিকাল বেলার আগেই ঘরে ফিরবে? বুলাকে ধরে ঠেসে চুমু খাবে। তারপর ওকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে অনেক দূর ঘুরে আসবে। মালীবাগের ওদিকেটাও যাবে। পুলিশবক্সে মেয়েটা থাকলে চোখজোড়া মেলে একটু দেখবে। দ্যাখানো দরকার।

কিন্তু বিকালবেলা ভেসপার আওয়াজে বুলা বেরিয়ে এলে ওর মুখটা ভার-ভার ঠেকে। কি ব্যাপার? মুশতাক ভাই এসেছিলে। আবার মুশতাক ভাই? দূর! ফার্মেসিগুলো একবার ঢু মেরে এলে হতো, কিছু না কিছু অর্ডার কি আর পেতো না?–কেন, মুশতাক ভাই কেন? সুনীলদাকে আজ সকালে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে, মেডিক্যাল কলেজে আছে। বুলা এক্ষুণি দেখতে যাবে। জাহাঙ্গীরকেও যেতে হবে— আবার সুনীলদা। আবার মুশতাক ভাই।

আমি কি করবো? তুমি যাও।

ওমা। তাই কি হয়। সুনীলদা তোমাকে দেখবে না? আমাদের ছোটোবেলার গানের ওস্তাদ। আমাকে কি আদর করতো।

যাবো। জাহাঙ্গীর চা খেতে খেতে বলে, কিন্তু আমার তো অফিরে খুব জরুরি কাজ। তোমারে রং মেডিক্যালে নামাইয়া দিয়া যাই।

ফিরবো কি করে?

একলা আসতে পারবা না? মুশতাক সাহেব পৌঁছাইয়া দিতে পারবো না।

থাক। আমার আর গিয়ে কাজ নেই। বুলার একটু ভিজে গলার মিষ্টি স্বর ও একটু ঝাঁপসা নোনতা চোখের কোঁচকানোটা এতো সুস্বাদু লাগে যে জাহাঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গে কাৎ হয়, আচ্ছা চলো

ভেসপার পেছনে বসে বুলা কবক করে যাচ্ছিলো, কথা একবার শুরু করলে মেয়েটা থামতে পারে না। কথাও বলে এতো মিষ্টি করে, এর আগে এ রকম মিষ্টি ভাষায় কথা বলা মেয়ের সঙ্গে জাহাঙ্গীর কোনোদিন আলাপ করেনি। জাহাঙ্গীর সিনা টান করে, মাথা সোজা রেখে ভেসপা চালায়। বুলা একনাগাড়ে কতো কথা বলে। বেশির ভাগই তাদের ছেলেবেলার কথা। খুব ছেলেবেলায় তারা কুমিল্লায় থাকতো। সুনীল সেনগুপ্ত না থাকলে তার গান শেখাই হতো না।–মুশতাক থাকতো তাদের পাশের বাড়ি। তারা একসঙ্গে গান শিখেছে।–কুমিল্লা কি সুন্দর শহর, ঢাকার মতো এ রকম মানুষ গিজগিজ করে না। ঢাকায় সুনীলদার মতো তোক একটাও নেই। বেচারা বিয়েথা করেনি। এখন বয়স ষাটের কোঠায় পড়েছে, দ্যাখার লোক নেই একটাও–দ্যাখো, বিধবা বড়োবোন ও ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্যেই বিয়ে করলো না, অথচ ভাগ্নে-ভাগ্নিগুলো চাকরি নিয়ে বিয়ে করে ব ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলো ইণ্ডিয়ায়, এখন তাকে দেখবে কে? বুলাকে এতো ভালোবাসতো, এতো যত্ন করে গান শিখিয়েছে, বলতো, তুই কোনো দিন গান ছাড়িস না–সুনীলদা যদি শোনে যে বুলা গান ছেড়ে দিয়েছে তো এতো কষ্ট পাবে। জাহাঙ্গীর ভাবে, কেন? বুলা গান ছাড়বে কেন? বুলাকে তার বলতে ইচ্ছা করে, তুমি গান শিখতে চাও, শেখো। যতো টাকা লাগে আমি রোজগার করে আনবো। দরকার হলে কোথাও পার্ট টাইম কাজ নেবো। দেশের বেস্ট ওস্তাদকে রেখে দেবে। তোমার কথা এতো মিষ্টি, এই কথায় সুর দিলে না জানি কি সৃষ্টি হবে। কিন্তু এসবকথা বলাটা মুশকিল। এ ছাড়া মেডিকাল কলেজের গেট এসে পড়ে। দোতলায় ওয়ার্ডের এক কোণে নাকে অক্সিজেনের পাইপ গোঁজা রোগা সুনীল সেনগুপ্তকে দেখে জাহাঙ্গীরের বুক উথলে ওঠে হায় রে, মানুষটা একেবারে নিঃসঙ্গ শুয়ে রয়েছে। বুলা পায়ে হাত রেখে সালাম করলে জাহাঙ্গীরও নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে। সুনীল সেনগুপ্ত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে মুশতাক এসে পড়ে, তার হাতে ফ্ল্যাক্স। মুশতাক বুকে বলে, দাদা, বুলার হাজব্যান্ড, চিনতে পেরেছেন? সুনীলদার ঠোঁট কাপে, ঠোঁটে হারি কিন একটি রেখা তৈরির চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়।

নার্স এসে টেম্পারেচার নেয়, খাটের মাথায় ঝোলানো চার্টে লেখে। স্ট্যান্ড থেকে নল বেয়ে ফোঁটা-ফোঁটা স্যালাইন কছে সুনীলদার হাতের শিরায়। জাহাঙ্গীর টুলে বসে চুপচাপ দ্যাখে। অন্য হান্দ্রে তালুতে জাহাঙ্গীর একটা হাত রাখে। সুনীলদার হাত ও আঙুল একটু একটু কাপে। আঙুল দিয়ে লোকটা জাহাঙ্গীরকে কি বলছে? হয়তো বলছে, বুলার গলা একেবারে তৈরি, গান ওর রক্তের মধ্যে। তুমি দেখো। জাহাঙ্গীরে চোখ ছলছল করে। আস্তে আস্তে উঠে দ্যাখে, বুলা কিংবা মুশতাক ঘরে নেই। কোথায় গেলো? মস্ত বড়ো ওয়ার্ডের এ-মাথা ওমাথা—কোথাও নেই। পেছনের দিককার বারান্দায় বুলার শাড়ি দ্যাখা যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর বারান্দায় যায় রেলিঙে ঝুঁকে দুজনে কাঁদছে। জাহাঙ্গীরকে দেখে বুলা কাঁদতে কাঁদতে বলে, সুনীলদার গলায় ক্যান্সার। বাঁচবে না। মুশতাকও রুমাল দিয়ে চোখ মোছে, ক্যান্সার, প্রথম দিকে ধরা পড়লেও ট্রিটমেন্ট করা যেতো। বোর কুমিল্পা গেলাম, কতো বললাম, সুনীলদা, ঢাকায় চলেন। ভালো করে ডাক্তার দ্যাখান না। একটা ভালো ছেলে পাওয়া গেছে, গলাটা এতো মিষ্টি। ওকে একটু দেখিয়ে দিয়ে তারপর যাবো।–এখন এসে কি লাভ হলো? বুলাও কাঁদতে কাঁদতে বলে, কেন? আমাদের একটা দিন কামাই দিতে দিতো না। মুশতাক ভাই, মনে নাই? জাহাঙ্গীরের ছলছল চোখ থেকে জল বাষ্প হয়ে উঠে যায়, চোখ বড়ো বড়ো করে সে এদের একই বেদনা ও একই স্মৃতির ছোঁয়াছুঁয়িটা দ্যাখে, তার চোখ খটখটে হয়ে আসে। হঠাৎ পর একটা হাত দিয়ে কি মনে পড়ে তার, বলে, বুলা, ভুল কইরা আমার অফিরে চাবি নিয়া আসছি। যাই, পিওনটারে দিয়া আসি। না হইলে কাল ওরা বিপদে পড়বে।

মুশতাক ও বুলার নীরব কান্না অব্যাহত থাকে। জাহাঙ্গীর ফের বলে, মুশতাক সাহেব, আপনি কষ্ট কইরা বুলারে একটু পৌঁছাইয়া দেবেন?

বুলা বলে, চলো, আর দশ-পনেরো মিনিট পরে একসঙ্গে যাই।

‘না, না’ উনারে একলা ফালাইয়া যাইবা? থাকো না কিছুক্ষণ থাকো।

ছ’টার পরে থাকতে দেবে না। চলো।

আরে রাখো। কে থাকতে দেবে না? জাহাঙ্গীরের আবার কলেজের এ্যাথলেটিক সেক্রেটারি হয়ে যাবার উপক্রম হয়, ক্যাঠায় কি কইবো, আমি মেট্রনরে বইলা যাই।

ভেসপায় স্টার্ট দিতে দিতে জাহাঙ্গীর শিস দেয়, হাম নোম এক কামরেমে বন্ধ হায় আওর চাবি খো যায় হাতের মুঠোয় স্পিড দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে আসে মতিঝিল। অফিরে কথাটা যখন বলেছে এদিকে একবার ঘুরে যাওয়াটা উচিত অফিরে সামনে একটা চক্কর দিয়ে বাঁদিকে গিয়ে স্টেডিয়ামের পেছন দিয়ে বায়তুল মোকাররেম পেছনটাকে বাঁয়ে রেখে জাহাঙ্গীরের ভেসপার চাকাজোড়া মোড় নিলো বিজয়নগরের রাস্তায়। এই রাস্তার শেষ মাথা ট্রাফিক সিগন্যালের লাল আলো জ্বলে উঠলে জাহাঙ্গীর ভেসপা থামায়। এটার দরকার ছিলো না, কারণ সে তো যাচ্ছে বাঁদিকে। তবে ধীরেসুস্থে যাওয়াই ভালো। কাকরাইলের মোড় ঘুরে শান্তিনগর চৌরাস্তা এসে সিগন্যালে নীল আলো থাকা সত্ত্বেও ওর স্পিড একেবারে জিরোতে নামে বু মালীবাগের পুলিশ বক্স এসে পড়ে। পুলিশ বক্সে একটা সামনে গিয়ে জাহাঙ্গীর ভেসপা থামিয়ে রাস্তায় নামে। পুলিশ বক্সের বারান্দায় কেউ নেই। ভেতরে?, ভেতর কোনো মহিলা-পুলিশ নেই। তার শরীর স্বস্তির হাওয়া খেলে। লু ভালো করে দ্যাখা দরকার। বারান্দায় উঠলে একজন পুলিশ বলে, কি ভাই? জাহাঙ্গীর বলে, টেলিফোন করবো। টেলিফোন নষ্ট। জানলা দিয়ে ভেত্রটা ভালো করে দেখে জাহাঙ্গীর ভেসপায় ফেরে। নাঃ ভালোই হলো। মেয়েটা থাকলেই বা কি হতো? ওর সঙ্গে জীবনে কোনোদিন সে কথাও বলেনি। এর মধ্যে একদিন এদিক দিয়ে যাবার সময় দ্যাখে কি, আরো কয়েকজন মহিলা-পুলিশের সঙ্গে ট্রাকে ওঠার সময় তার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। তা তো হতেই পারে। যারা কলেজে তাকে হিপ হুপরে বলে সাউন্ড মারতো জাহাঙ্গীর তাদের একজন গৌণসদস্য ছিলো। তো, এখন দ্যাখা হলেই বা তাকে কি বলতো? কলেজে থাকতেই কথা বলা হোল না, আর এ্যাদ্দিন পর এখন সে কি বলবে? তা বলতে পারতো, আমাকে চিনলেন না? এখনো কি মস্তান পোলাপানের দলে পেছনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের টিটকারি দেন নাকি? এখন কিন্তু আমি এ্যারেস্ট করতে পারি, জানেন? তা এ্যারেস্টেড হতে ওর আপত্তি কি? তার ওরা না হয় ট্রাকের ওপর উঠেই কিছুক্ষণ গল্প করতো। আর কিছু না হোক বাংলার ইয়াসিন স্যারের তোতলামো নিয়ে হাসাহাসি করতে পারতো। না, এতোকাল পর ইয়ার্কি-ফাজলামি ভালো না। —ঠিক আছ, তাহলে ওদের হিস্ট্রি পড়ালে আজম সাহেব, খুব ভালো পড়াতেন, লোকও খুব ভালো, বছর খানেকহলো মারা গেছেন, তাঁকে নিয়ে মন খারাপ করে কি আপত্তি ছিলো? আজম সাহেব কিভাবে মারা গেছেন? মনে হয় ক্যান্সার হয়েছিলো। ক্যান্সার? কোথায় বোধহয় গলায়— ট্রাকের রেলিঙে ঝুঁকে দুজন কথা বলতে, দু’জনের চোখে জল, নিজের শরীরের দিকে স্যারের কোনো খেয়াল ছিলো না। তোমার মনে নাই হিপ-হিপ দূর, নামটাও মনে নেই। নাঃ! হলো না। তারা একসঙ্গে মন খারাপ করবে কি নিয়ে?–জাহাঙ্গীরের ভেসপা চলছে ভো ভো করে। রেলগেট বন্ধ বলে ব্রেক কষতে হয়। আরে মহাখালি এসে গেছে। তাহলে গুলশান বনানীটা একবার ঘুরে আসা যায়।–গুলশান নানীর ছোটোবড়ো রাস্তাগুলো ছব্বি মতো পেছনে সরে যায়। কিন্তু শাহীন না শাহনাজ — বুলাকে সে কোন নামটা যেন বলেছে?— তার বাড়ি তো তার চেনা নেই। মেয়েটাকে একদিন দেখেছিলো স্টেডিয়ামে। একদিন কি দুদিন খালেক ভাই দেখিয়ে দিয়েছিলো, শর্টপুটে এবার মেয়েদের মধ্যে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান হবে, দেখিস। আরেকদিন খালেক ভাই আর কাউকে, না তাকে নয়, বলছিলো, আরে ওরা বাড়িতেই প্র্যাকটিস করে। গুলশানে বিরাট বাড়ি, বরকম খেলার এ্যারেজমেন্ট আছে। তা কোন বাড়ি, কার বাড়ি, কত নম্বর রোড, কতো নম্বর প্লট —কিছুই জানে না। দাঁড়াবে কোথায়? সুতরাং এ্যাবাউট টার্ন— দুই নম্বর মার্কেটের সামনে ছয়নম্বর বাস। এই বাসে করেই না জাহাঙ্গীর পালিয়ে গিয়েছিলো ওর নাছোড়বান্দা প্রেমিকার বাড়ি থেকে। সূরাং এই বাসের পেছনে সে ভেসপা চালায়। বাস যেখানে। দাঁড়ায়, সেও একটু দাঁড়ায়। কিন্তু পুরনো এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এসে ধৈর্য থাকে না। বাসটাকে ওভারটেক করে চলে যায়। একটু দূর থেকে ফার্মগেটের ওভারব্রিজের গায়ে লেখা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। কিন্তু একটি বর্ণও তার মাথায় ঢোকে না। হঠাৎ করে স্পীড বাড়িয়ে মগবাজার দিয়ে মালীবাগ এসে পড়ে। না, পুলিস বক্সের সামনে। দাঁড়িয়ে লাভ কি? মেয়েটার নামটাও যদি মনে রাখতো? তবে? সুরাং ভেসপার চাকাজোড়া তার কেবল গড়িয়েই চলে।

Exit mobile version