Site icon BnBoi.Com

শিশুসাহিত্য – হুমায়ূন আহমেদ

শিশুসাহিত্য - হুমায়ূন আহমেদ

কাক ও কাঠগোলাপ

তুহিনদের বাড়ির সামনে একটা প্রকাণ্ড কাঠগোলাপের গাছ। কাঠগোলাপের গাছ সাধারণত এত বড় হয় না। এই গাছটা হুলস্থুল বড়। ফুল যখন ফোটে তখন গন্ধে চারদিক ম ম করে। তুহিনদের বাড়ির সামনে দিয়ে যারা যেত তারা অবশ্যই কিছুক্ষণের জন্যে থমকে দাঁড়াত। গাছের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বলত, বাহ্!

এক বৈশাখ মাসে তুহিনের বাবা নাসের সাহেব নাস্তার টেবিলে বললেন, কাঠগোলাপ গাছটা কাটার ব্যবস্থা করো।

তুহিনের মা সুলতানা বললেন, কেন? এত ফুল ফোঁটায় এই গাছ কেন কাটবে?

নাসের সাহেব বললেন, দুনিয়ার কাক এসে গাছে বাসা বেঁধেছে। শেষরাত থেকে কা-কা ডাক। ঘুমায় কার সাধ্যি! বাড়িটা হয়েছে কাকদের রাজধানী। কাকের আমার দরকার নেই।

তুহিনের ইচ্ছা হলো বাবাকে বলে, যেসব কাক গাছে বাসা বানিয়েছে ওরা যাবে কোথায়? ওদের ছোট ছোট বাচ্চারা যাবে কোথায়? তুহিন কিছু বলতে পারল না; কারণ তাদের বাড়ির নিয়ম হলো, খাওয়ার টেবিলে বড়দের কথার মধ্যে ছোটরা কথা বলতে পারবে না। খুব জরুরি কোনো কথা বলার থাকলে ডান হাত তুলে অনুমতির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

সে হাত তুলল। নাসের সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, কিছু বলতে চাও?

তুহিন বলল, গাছ কেটে ফেললে, যেসব কাক গাছে বাসা বানিয়েছে ওরা যাবে কোথায়? ওদের ছোট ছোট বাচ্চারা যাবে কোথায়?

নাসের সাহেব বললেন, তুহিন, তুমি ভুলে গেছ কাকের ছেলেমেয়েরা তাদের বাসায় থাকে না। এরা বড় হয় কোকিলের বাসায়। কাক কোকিলের বাসায় ডিম পেড়ে আসে। কাজেই কাকের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

বুঝেছ?

বুঝেছি।

আরেকটা কথা তোমাকে বলি-বড়রা যে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা চিন্তা-ভাবনা করে নেয়। ছোটদের সেখানে কথা বলার কিছু নেই। বুঝেছ?

বুঝেছি।

ছোটা থাকবে ছোটদের মতো। ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

.

তুহিন স্কুলে গেল মন খারাপ করে। গাছটা সত্যি সত্যি কেটে ফেলা হবে? কাঠগোলাপ গাছের একটা ডাল তার শোবার ঘরের জানালার পাশ দিয়ে গিয়েছে। সেই ডালে মাঝে মাঝে অসংখ্য কাক এসে বসে। তুহিন পাউরুটি টুকরা করে ওদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। ওরা লাফালাফি-ঝাপাঝাপি করে পাউরুটি লুফে নেয়। এই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য আর দেখবে না?

স্কুলেও তুহিন মন দিতে পারল না। তার সারাক্ষণ মনে হলো, এই বুঝি গাছটা কাটা হচ্ছে! এই বুঝি প্রকাণ্ড শব্দ করে গাছটা মাটিতে পড়ল! এই বুঝি সব কাক একসঙ্গে কাঁদতে শুরু করল! তুহিনদের ক্লাস টিচার মিস সোমা. বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ নাকি তুহিন? তুমি ঝিম ধরে আছ!

তুহিন বলল, আমার শরীর ঠিক আছে।

আমার তো মনে হচ্ছে শরীর ঠিক নেই। দেখি কাছে আসো তো-জ্বর এসেছে কিনা দেখি। চোখ লাল হয়ে আছে।

তুহিন কাছে গেল। মিস সোমা তুহিনের কপালে হাত রেখে চমকে উঠে বললেন, তোমার অনেক জ্বর। তোমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করো।

আমি বাসায় যাব না।

বাসায় যাবে না কেন?

আজ আমাদের একটা গাছ কাটা হবে। গাছটা আমার খুব প্রিয়।

গাছ কাটা হোক বা না হোক, তুমি বাসায় যাবে। বিছানায় শুয়ে থাকবে। তোমার জ্বর এক শ’ তিনের বেশি।

.

তুহিন তার ঘরে শুয়ে আছে। তার যে খুব জ্বর এসেছে এটা সে কাউকে বলে নি। বলার মানুষও নেই। বাবা গেছেন অফিসে। মা গিয়েছেন নারায়ণগঞ্জে তাঁর মামার বাড়িতে। ফিরতে রাত হবে। তুহিন তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। প্রকাণ্ড কাঠগোলাপ গাছের বিশাল ডালটা দেখা যাচ্ছে। খুব কম করে হলেও পঞ্চাশটা কাক সেখানে বসে আছে। গাছটা তাহলে এখনো কাটা হয় নি! তবে আজ দিনের মধ্যে অবশ্যই কাটা হয়ে যাবে। বাবার হুকুম এই বাড়িতে সঙ্গে সঙ্গে পালন করা হয়।

জ্বরে তুহিনের মাথা ঝিমঝিম করছে। রোদের দিকে তাকানোর কারণে চোখ কটকট করছে। তুহিন চোখ বন্ধ করে ফেলে আবার চোখ মেলল। গাছের ডালে কয়টা কাক বসে আছে গুনতে শুরু করল। এক দুই তিন চার পাঁচ…

তুহিনকে গোনা বন্ধ করতে হলো, কারণ ছয় নম্বর কাকটা উড়ে এসে তুহিনের জানালার কাছে বসে গম্ভীর গলায় বলল, আমরা আছি সাঁইত্রিশ জন। তোমাকে কষ্ট করে গুনতে হবে না।

তুহিন অবাক হয়ে বলল, তোমরা কথা বলতে পারো?

কাক বলল, পারব না কেন? পারি। নিতান্ত বিপদে না পড়লে কথা বলি না। আজ বিপদে পড়েছি বলে কথা বলছি। তুমি বোধহয় জানো না তোমার বাবা এই গাছ কাটিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের বাচ্চা-কাচ্চারা এখনো উড়তে শিখে নাই। এরা সব মারা পড়বে-এইটাই কষ্ট। তুহিন, তুমি কি আমাদের বাচ্চা-কাচ্চার ব্যাপারটা তোমার বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারবে?

তুহিন বলল, তোমাদের বাচ্চা তো হয় কোকিলের বাসায়। তোমরা গোপনে কোকিলের বাসায় ডিম পেড়ে আসো।

কাক বলল, কী সব উদ্ভট কথাবার্তা যে মানুষেরা আমাদের সম্পর্কে বলে! আমরা কি বাসা বানাতে পারি না যে কোকিলের বাসায় ডিম পাড়তে হবে? এই গাছেই আমাদের আঠারোটা বাসা আছে।

তাহলে তোমরা কোকিলের বাসায় ডিম পাড় এমন কথা সবাই বলে কেন?

জানি না কেন বলে! হয়তো কখনো কোনো কাকের বাসা ভেঙে গিয়েছিল, উপায় না দেখে সে কোকিলের বাসায় ডিম পেড়েছে। সেই থেকে এই গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। এই শহরে হাজার হাজার কাক বাস করে। কোকিল অল্প কয়েকটা। তোমার কি ধারণা অল্প কয়েকটা কোকিলের বাসায় হাজার হাজার কাক ডিম পেড়ে আসবে? আমার কথায় যুক্তি আছে না?

তুহিন বলল, অবশ্যই আছে।

কাকটা চিন্তিত গলায় বলল, তোমার কি জ্বর নাকি?

হুঁ।

দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক জ্বর। আমরা তোমাকে খুব পছন্দ করি, সেটা কি তুমি জানো?

না।

তুমি আমাদের রোজ পাউরুটি খাওয়াও, এইজন্যেই পছন্দ করি। কাকদের তো আর কেউ আদর করে কিছু খাওয়ায় না। আমরা দেখতে অসুন্দর। আমাদের কেউ পাখি বলেই মনে করে না। শুধু তুমি করো। তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে আমাদের খারাপ লাগবে। তোমার জ্বর তো মনে হয় খুব বাড়ছে।

হুঁ।

আহারে! তোমার জন্যে কী করা যায় বলো তো?

তুহিন ক্লান্ত গলায় বলল, কিছু করতে হবে না।

তোমার বাবা-মা কেউ দেখি বাসায় নেই। তোমার খারাপ লাগছে না?

লাগছে।

টেলিফোন করে তাদের আসতে বলো।

ইচ্ছা করছে না।

তোমার অবস্থা দেখে তো চিন্তা লাগছে। কী করা যায় বলো তো।

তুহিন জবাব দিল না। তার জ্বর হু হু করে বাড়তে থাকল। সন্ধ্যাবেলা তুহিনের মা বাসায় ফিরলেন। ছেলের অবস্থা দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। চারদিকে ছোটাছুটি পড়ে গেল।

তুহিনকে বরফ মেশানো ঠান্ডা পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দেওয়া হলো। মা বললেন, বাবা, খুব খারাপ লাগছে?

তুহিন বলল, হুঁ।

তোমার শরীর এত খারাপ করেছে, তুমি বাবাকে একটা টেলিফোন করলেই তো বাবা চলে আসত।

বাবার ওপর আমি রাগ করেছি, এইজন্যে টেলিফোন করি নি।

রাগ করেছ কেন?

বাবা ভুল কথা বলেছে–এইজন্যে রাগ করেছি। কাকরা কোকিলের বাসায় ডিম পাড়ে না, তারা নিজেদের বাসাতেই ডিম পাড়ে।

কে বলেছে তোমাকে?

কাক বলেছে?

কাক বলেছে মানে? কাক কীভাবে বলবে?

কাকরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে। তারা যখন খুব বিপদে পড়ে তখন মানুষের মতো কথা বলে। এখন তারা খুব বিপদে পড়েছে। গাছ কেটে ফেলা হবে-ওরা যাবে কোথায়? এইজন্যেই তারা মানুষের মতো আমার সঙ্গে কথা বলেছে।

মা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার জ্বর এখন বেশি। তুমি চুপ করে থাকো। তোমার বাবা আসুক, তার সঙ্গে তখন কথা হবে।

তুহিনের বাবা রাত আটটার দিকে এলেন। ততক্ষণে তুহিনের জ্বর নেমে গেছে। তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাবা বললেন, তুহিন শোনো। কাঠগোলাপের গাছ কাটাটা আপাতত বন্ধ আছে। কাজেই গাছ কাটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। সবার ধারণা গাছের চিন্তায় তোমার জ্বর এসে গেছে। তুমি খুশি তো?

তুহিন বলল, হ্যাঁ।

তুমি নাকি তোমার মাকে বলেছ কাক তোমার সঙ্গে কথা বলেছে?

হ্যাঁ বলেছি।

বাবা শোনো, কাক মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। তোমার জ্বর খুব বেশি হয়েছিল। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল বলেই মনে হয়েছে কাক তোমার সঙ্গে কথা বলেছে। বুঝতে পেরেছ?

তুহিন জবাব দিল না।

বাবা বললেন, তবে তুমি যে বুদ্ধি করে বলেছ কাক তার নিজের বাসাতেই ডিম পাড়ে–এটা ঠিক। আমি পক্ষীবিশারদের কাছে খোঁজ নিয়েছি।

তিনি ছেলের পাশে বসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, পশুপাখি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না–এটা খুব দুঃখের। কথা বলতে পারলে ওরা সরাসরি ওদের সমস্যার কথা বলতে পারত।

তুহিন বিড়বিড় করে বলল, বাবা, অন্য পশুপাখিদের কথা জানি না; তবে কাকে যখন খুব বিপদে পড়ে তখন কথা বলে।

বাবা হাসলেন। কিছু বললেন না। তিনি বুঝতে পারছেন অসুস্থ ছেলের মাথায় ‘কাক কথা বলে’ এই ব্যাপারটা ঢুকে গেছে, এটা সহজে যাবে না। কিন্তু একটা খটকা তাঁর নিজের মাথাতে তৈরি হয়েছে। তুহিনের ঘরের জানালার পাশে শত শত কাক। এবং আরও কাক আসছে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এরা এসেছে তুহিনকে দেখতে।

কেমন করে সবাই তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে।

তাদের চোখে অশ্রু টলমল করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি তারা কেঁদে ফেলবে। এই রহস্যের ব্যাখ্যা কী?

বাবা কাকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুহিন ভালো আছে। তোমরা এখন যেতে পারো।

এই কথায় সব কাক একসঙ্গে নড়ে উঠল এবং একসঙ্গে উড়ে গিয়ে কাঠগোলাপ গাছে বসল। এর মানেই বা কী? এরা কি সত্যি কথা বুঝতে পারছে?

পরীর মেয়ে মেঘবতী

আজকের দিনটা অন্যসব দিনের মত না।

আজ খুব আলাদা একটা দিন। কেউ তা বুঝতে পারছে না বলে নাবিলের একটু মন খারাপ লাগছে। আচ্ছা, আজকের দিনটা যে আলাদা তা কেউ বুঝতে পারছে না কেন?

না না আজ তার জন্মদিন না। দু’মাস আগে নাবিলের জন্মদিন হয়ে গেছে। ছ’টা মোমবাতি জ্বালিয়ে সে গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিয়েছে। এক ফুঁতে সব মোমবাতি নেভাতে হবে। সহজ ব্যাপার না। এক ফুঁতে সব বাতি নেভাতে পারলে একটা সাংঘাতিক ব্যাপার হয়। তখন চোখ বন্ধ করে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। নাবিলের ভাগ্য ভালো, সে এক ফুতে সব নেভাতে পেরেছে। এর আগে কখনো পারে নি, এই প্রথম পারল। গতবার সে সব বাতি নিভিয়ে ফেলেছিল। ও আল্লাহ, ফুঁ বন্ধ করতেই ফুট করে একটা বাতি জ্বলে গেল। তার আর কিছু চাওয়া হল না।

এইবার সে পেরেছে। সব বাতি নিভে যাবার পরেও সে অনেকক্ষণ ফুঁ দিয়েছে।

যেন গতবারের মতো না হয়। সবাই এমন হাততালি দিচ্ছিল যে তার লজ্জাই লাগছিল। মা বললেন, ‘নাবিল ব্যাটা, মেক এ উইশ।’ মেক এ উইশ মানে হচ্ছে কিছু একটা চাওয়া। সে চোখ বন্ধ করে একটা জিনিস চেয়েছে। জিনিসটা হচ্ছে সে যেন আলাদা একটা ঘর পায়। সেই ঘরে সে একা থাকবে, আর কেউ থাকবে না। ঘরে থাকবে ছোট্ট বিছানা, ওয়াল্ট ডিজনির ছবি, লিটল মারমেইড, লায়ন কিং, মুগলি।

আজ সে সেই ঘরটা পেল।

সকাল থেকেই মা ঘর সাজাচ্ছেন। নাবিল একবার বলেছে, মা তোমার হেল্প লাগবে? হেল্প হল একটা ইংরেজি শব্দ। হেল্পের মানে সাহায্য। নাবিল স্কুলে অনেক ইংরেজি শব্দ শিখেছে। মা বলেছেন, হেল্প লাগবে না ব্যাটা।

মা তাকে সবসময় আদর করে ব্যাটা বলেন। ব্যাটা মানে হচ্ছে লোক। তবে ছোট বাচ্চাদের ব্যাটা বললে সেটার অর্থ লোক হয় না। সেটার অর্থ হয় আদরের চাঁদসোনা, লক্ষ্মীসোনা, পুটুস পুটুস।

ঘরটা এত সুন্দর করে সাজানো হল যে নাবিলের প্রায় কান্না পেয়ে যেতে লাগল। সে কেঁদেই ফেলত। কিন্তু ছেলেদের কাঁদতে নেই বলে কাঁদল না। ছোট মেয়েদের কাঁদলে অবশ্যি তেমন দোষ নেই। নাবিলের ছোটবোনের নাম এশা। সে খুব কাঁদে। মা যদি হাসি মুখে নাবিলকে কিছু বলেন তাতেও সে কাঁদবে। ঠোঁট বাঁকিয়ে নাকিসুরে বলবে ‘কেন তুমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলে এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ।’

বাবা প্রায়ই বলেন, এশা আসলে পেত্নীদের ছানা। তারা ভুল করে আমাদের বাসায় রেখে গেছে। পেত্নীরা নাকে কথা বলে বলেই এশাও রেগে গেলে নাকে কথা বলে। এগুলি অবশ্যি বাবার বানানো কথা। বড়রা খুব বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে।

ঘর সাজানো হয়ে যাবার পর নাবিলের মা বললেন, ‘তারপর ব্যাটা, একা একা যে ঘুমোবে, ভয় পাবে নাতো?’

নাবিল বলল, ‘না।‘

‘ভয় পাবার কিছু নেই। আমরাতো পাশের ঘরেই আছি। তোমার দরজা থাকবে খোলা। আমাদের দরজাও থাকবে ভোলা। ভয় পেলে ডাকবে।‘

‘আমি ভয় পাব না মা।‘

‘তোমার কি ঘর পছন্দ হয়েছে ব্যাটা?

‘হ্যাঁ।‘

‘বেশি পছন্দ হয়েছে না অল্প পছন্দ হয়েছে?’

‘বেশি পছন্দ হয়েছে মা। এত বেশি পছন্দ হয়েছে যে আমার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করছে।

মা হেসে ফেললেন। মাকে হাসতে দেখে এশা রেগে গিয়ে বলল, ‘মা, তুঁমি ভাঁইয়ার দিকে তাঁকিয়ে হাঁসবে নাঁ। আঁমার দিঁকে তাঁকিয়ে হাস।’

মা তখন এশার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

রাতে বাবা তাকে ঘরে শুইয়ে দিতে এলেন। মা এশাকে গল্প করে ঘুম পাড়াচ্ছেনতো তাই তিনি আসতে পারলেন না।

বাবা নাবিলের গলা পর্যন্ত চাদর টেনে দিলেন। কপালে চুমু দিলেন। তারপর চুলে আঙুল দিয়ে বিলি দিতে দিতে বললেন, কী কাণ্ড, আমার ছেলেটা এত বড় হয়ে গেছে। একা একা নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছে। তার কী সাহস! আমি তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কই আমারতো এখনো এত সাহস হয় নি। একা একা আমি ঘুমোতে পারি না। আমার সঙ্গে নাবিলের মাকে ঘুমাতে হয়, এশাকে ঘুমোতে হয়। তারপরও আমার ভয়ে শরীর কাঁপে।

নাবিল মনেমনে হাসল। সে জানে তার বাবার খুবই সাহস। তার বাবা ইচ্ছা করলেই একা ঘুমোতে পারেন। কিন্তু বড়রা ছোটদের সাথে এরকম মজা করে মিথ্যা কথা বলে। বড়রা মনে করে ছোটরা কিছু বুঝতে পারছে না। আসলে সবই বুঝতে পারে।

নাবিল বলল, ‘বাবা, একটা গল্প বলতো।’

বাবা মুখ শুকনো করে বললেন, ‘কী গল্প?’

নাবিল মনেমনে খুব হাসল। গল্প বলার কথা বলতেই বাবার মুখ শুকিয়ে গেছে। কারণ বাবা গল্প বলতে পারেন না। মা সব গল্প জানেন, বাবা কোনো গল্পই জানেন না। একবার সে বাবাকে সিনডারেলার গল্প বলতে বলল। বাবা গল্প শুরু করলেন—’এক দেশে ছিল এক সিনডারেলা। তার মনে বেজায় দুঃখ। কারণ তার কোনো ছেলেপুলে নেই। মনের দুঃখে তার সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেল।‘

নাবিল হাসতে হাসতে বাঁচে না। বাবাকে বিপদে ফেলার সবচে সহজ বুদ্ধি হচ্ছে। তাঁকে গল্প বলতে বলা। আজ নাবিলের খুব ইচ্ছা করছে বাবাকে বিপদে ফেলতে। সে আবারো বলল, ‘বাবা গল্প বলো।‘

বাবা আমতা আমতা করে বললেন, কিসের গল্প রে?

‘পরীর গল্প।’

‘ও আচ্ছা পরীর গল্প। হুঁ। পরী।‘

‘পরীর গল্প জান না বাবা?

‘জানব না কেন। অবশ্যই জানি। এক দেশে ছিল এক পরী। তারপর কী হল শোন। পরীর মনে বেজায় দুঃখ। কারণ তার কোনো ছেলেপুলে নাই। মনের দুঃখে তার সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেল।

নাবিল বলল, ‘বাবা চুপ করতো। থাক তোমার গল্প বলতে হবে না। তুমি আসলে পরীর কোনো গল্পই জান না। বলতো দেখি পরীরা কী খায়?’

‘কী আবার খাবে। ভাত-মাছ-ভেজিটেবল খায়। গাজর খায়। গাজরে আছে ভিটামিন এ। চোখের জন্য ভাল। পরীরা বেশি করে গাজর খায় বলে ওদের চোখ খুব ভাল থাকে। তারা আকাশ থেকে দেখতে পায়।‘

‘বাবা, তুমি কিছুই জান না। পরীরা ফুলের মধু খায়। আচ্ছা বলতো পরীদের জামা কাপড় কী দিয়ে তৈরি হয়?’

‘কী দিয়ে আবার, সূতা দিয়ে। ফিফটি পার্সেন্ট কটন আর ফিফটি পার্সেন্ট সিনথেটিক। শুধু সিনথেটিক কাপড় ওরা পরতে পারে না, গা কুটকুট করে।’

‘পরীদের ব্যাপারে বাবা তুমি কিছুই জান না। ওদের জামা-কাপড় তৈরি হয় চাঁদের আলোর সূতা দিয়ে।‘

‘ও আচ্ছা। চাঁদের আলো দিয়ে সূতা হয়। তাইতো জানতাম না।‘

‘চাঁদের চড়কা-বুড়ি কী করে? সূতা কাটে না?’

‘আরে তাইতো, চড়কা-বুড়ির ব্যাপারটাই ভুল মেরে বসে আছি।’

‘পরীরা পৃথিবীতে কখন আসে তা কি তুমি জান বাবা?’

‘জানি না। কখন আসে?’

‘যখন খুব জোছনা হয় তখন আসে। নির্জন পুকুরে ওরা সাঁতার কেটে গোছল করে।‘

‘পরীর দেশে পুকুর নেই?’

‘আছে বোধহয়। তবু পৃথিবীর পুকুর ওদের বেশি ভাল লাগে।‘

‘এত কিছু তুমি জানলে কী করে?’

নাবিল জবাব দিল না। মনেমনে হাসল। বড়দের ধারণা শুধু তারাই সবকিছু জানে। কিন্তু ছোটরাও যে অনেক কিছু জানে তা তারা ভুলেই যায়।

জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল, নাবিলের বাবা জানালা বন্ধ করলেন। তারপর নাবিলের মাথার চুল নিয়ে ইলিবিলি খেললেন। এক সময় নাবিল ঘুমিয়ে পড়ল।

তার ঘুম ভাঙল খুটখাট শব্দে। সে চোখ মেলে দেখে-খুবই অবাক কাণ্ড! একটা পরীর মেয়ে তার মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। নাবিলের সব খেলনা সে জড়ো করেছে। খেলছে আপন মনে। পরীরা সুন্দর হয়, নাবিল জানে। তারপরও এত সুন্দর হয়। নাবিলের ধারণা ছিল না। মনে হচ্ছে গা থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। ছোট্ট একটা ডুরে শাড়ি পরে আছে। শাড়িটাও কত সুন্দর! ঝলমল করছে। হবে না, চাঁদের আলোর সূতার তৈরি শাড়ি। আর পরী মেয়ের সোনালি পাখাদুটিও কত সুন্দর! সে আপন মনে গান করছে আর খেলছে। কী মিষ্টি গানের গলা! মাঝে মাঝে আবার গান থামিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

নাবিল যে বিছানায় উঠে বসেছে সেটা পরী মেয়েটি দেখেছে। কিন্তু সে তার খেলা বন্ধ করছে না।

নাবিল বলল, এই পরীর মেয়ে। এই। পরীর মেয়ে চোখ তুলে তাকাল। তারপর আবার আগের মতোই খেলতে লাগল।

মনে হচ্ছে মুখ টিপে হাসছে।

নাবিল বলল, ‘তুমি ঘরে ঢুকেছ কী ভাবে?’

সে হাত উঁচু করে জানালা দেখিয়ে দিল। ওমা, থাই এলুমিনিয়ামের জানালা খোলা। সে তাহলে এই খোলা জানালা দিয়েই ঢুকেছে!

বাবা জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মেয়েটা নিশ্চয়ই টেনেটুনে খুলেছে। মেয়েটাতো দুষ্টু আছে। জানালা খোলা বলেইতো নাবিলের এত শীত লাগছে। ঠাণ্ডা লেগে তার জ্বর না হলেই হয়। ঠাণ্ডা লাগলে নাবিলের আবার টনসিল ফুলে যায়।

নাবিল বলল, ‘এই, তুমি যে আমার সব খেলনা ছড়িয়ে একাকার করেছ, মা দেখলে খুব রাগ করবে। ঘর নোংরা হচ্ছে তো।’

পরীর মেয়ে মিষ্টি করে বলল, ‘যাবার সময় আমি গুছিয়ে রেখে যাব।‘

‘তোমার নাম কী?’

‘মেঘবতী।‘

‘তুমি কী আমার সঙ্গে খেলবে?’

‘না আমি একা একা খেলব।’

নাবিল বিছানা থেকে নেমে এসে মেঘবতীর সামনে বসল। সে কিছু বলল না। আশ্চর্য মেয়েতো! আপন মনে খেলেই যাচ্ছে। নাবিল মুগ্ধ হয়ে দেখছে। এত কাছে থেকে সে পরী দেখবে কোনোদিন ভাবে নি। তার খুব ইচ্ছে করছে পরীর পাখাটা একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে।

‘তোমার পাখা একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখব?’

‘না।’

মেঘবতীর মুখটা কী সুন্দর! বড় বড় চোখ। চোখের মণিগুলি একটু মনে হয় নীলচে। মেয়েটার থুতনিতে একটা কাটা দাগ।

নাবিল বলল, ‘তোমার থুতনিতে কী হয়েছে?’

‘কেটে গেছে।’

‘কীভাবে কেটেছে?’

‘এক জোছনারাতে আমরা রাজবাড়ির পুকুরঘাটে নাচ করছিলাম তখন পা পিছলে পড়ে থুতনি কেটে গেছে।‘

‘জোছনা-রাতে তোমরা নাচ কর?’

‘হুঁ। নাচ করি, গান করি, পানি ছিটা-ছিটি খেলা করি। খুব মজা করি।’

‘আমাকে একদিন নিয়ে যাবে?’

‘তোমাকে নেব কী করে? তুমি কী উড়তে পার?’

‘তুমি কোন ক্লাসে পড়?’

‘আমরাতো পড়ি না। আমরা শুধু নাচ করি আর গান করি। আর আকাশে উড়ে বেড়াই।’

‘আমি কেজি ওয়ানে পড়ি। বাংলা পড়ি, ইংরেজি পড়ি, অংক করি। এডিশান পারি। তুমি এডিশান পার? এডিশান হল যোগ।‘

‘না। তুমি ফুলের ইংরেজি কী জান?’

‘না।’

‘ফুলের ইংরেজি হচ্ছে ফ্লাওয়ার। আকাশের ইংরেজি হচ্ছে স্কাই। বিড়াল হল ক্যাট।‘

পরীমেয়েটি নিজের মনে খেলেই যাচ্ছে। একেকটা খেলনা হাতে নেয়, কিছুক্ষণ খেলে। সেটা রেখে আরেকটা খেলনা নেয়। নাবিল বলল, তুমি কী রোজ রাতে এসে খেলবে? আমার আরো খেলনা আছে।

‘না। আর আসব না।’

‘আর আসবে না কেন?’

মেঘবতী জবাব দিল না, খেলেই যেতে লাগল। সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। শোয়া মাত্রই ঘুম।

তার ঘুম ভাঙল ভোরবেলা। ঘর-ভর্তি আলো। জানালা বন্ধ। প্রতিটি খেলনা আগের জায়গায় আছে। মেঘবতী যাবার আগে সব খেলনা গুছিয়ে রেখে গেছে। ফেলে ছড়িয়ে যায় নি।

নাবিল পরীর মেয়ে মেঘবতীর গল্প সবার আগে বাবার সঙ্গে করল। নাবিলের বাবা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। নাবিল বাবার কানেকানে গল্পটা বলল। বাবা বললেন, ইশ, তুমি রাতে আমাকে ডাকলে না কেন? আমরা মেয়েটাকে বলে-কয়ে রেখে দিতাম। তারপর বড় হলে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতাম। একটা পরীবৌমার আমার খুব শখ। সে ঘরময় উড়ে বেড়াত।

নাবিলের খুব মন খারাপ হল। কারণ বাবা খুব গম্ভীর হয়ে কথা বললেও সে জানে বাবা তার গল্প মোটেই বিশ্বাস করছেন না।

নাবিলের মাও বিশ্বাস করলেন না। তিনি বললেন, ‘নাবিল, ব্যাটা তুমি রাতে স্বপ্ন দেখেছ। সেই স্বপ্নটাকেই সত্যি মনে করছ। ভূত, প্রেত, পরী, রাক্ষস, খোক্ষস এইসব পৃথিবীতে হয় না। এইগুলি সব গল্প। তোমার যদি একা ঘরে ঘুমোতে ভয় লাগে আমাদের সঙ্গে ঘুমাও।’

নাবিল বলল, ‘না। আমি একাই ঘুমোব।’ নাবিলের খুব আশা ছিল পরীমেয়েটিকে সে আবার দেখবে। মেয়েটি নিশ্চিয়ই খেলতে আসবে তার ঘরে। নাবিল অনেক বার জানালা খুলে অপেক্ষা করেছে তার জন্যে। রাতে ঘুম ভাঙলেই সে জানালা দিয়ে তাকিয়েছে আকাশের দিকে। যদি সে আসে! কোনদিন সে আসে নি।

তারপর অনেক অনেক দিন কেটে গেল। ছোট্ট নাবিল বড় হয়ে গেল। স্কুল পাশ করল। কলেজ পাশ করল। ইউনিভার্সিটি পাশ করল। একদিন সে তার বাবার মতো বড় হয়ে গেল। মা বললেন, ‘নাবিলের বিয়ে দিয়ে ঘরে টুকটুকে একটা বৌ নিয়ে এলে কেমন হয়?’

ওমা, কী অদ্ভুত কাণ্ড! একদিন তার বিয়েও হয়ে গেল। মজার ঘটনা ঘটল বিয়ের রাতে। নাবিল অবাক হয়ে দেখে তার বৌটা দেখতে অবিকল সেই পরী মেয়েটার মতো। সেই রকম গোল মুখ। হালকা নীলচে চোখ। ঢেউ-খেলানো মাথাভর্তি চুল।

নাবিল অবাক হয়ে বলল, তোমার থুতনিতে এই কাটা-দাগটা কিসের?

মেয়েটা লজ্জা-লজ্জা গলায় বলল, “ছোটবেলায় পুকুরঘাটে নাচতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে কেটে গিয়েছিল।’

নাবিল ইতস্তত করে বলল, ‘আচ্ছা শোন, তোমার ডাক নাম কী মেঘবতী?’

সে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। আমার বাবা আমাকে এই নামে ডাকতেন। আমি যখন খুব ছোট তখন বাবা মারা গেলেন। তারপর আর কেউ আমাকে এই নামে ডাকে নি। আজ প্রথম তুমি ডাকলে। আচ্ছা তুমি এই নাম জানলে কী করে?’

নাবিল যে কী করে জানল সেটা আর বলল না। সব কথা বলার দরকারই বা কী? থাকুক কিছু না-বলা কথা।

বোকাভূ

তোমাদের আজ একটা ভূতের গল্প বলি?

ভয় নেই-যে ভূতের গল্প বলব সে হলো বোকা-টাইপ ভূত। বেজায় বোকা। তার নাম হলো ‘বোকাভূ’। তার বয়স বেশি না। মাত্র সাত। মানুষ হয়ে জন্মালে সে ক্লাস টু-তে পড়ত।

বোকাভূ কেমন বোকা এখন বলি। ভূত বাচ্চাদের প্রধান কাজ হচ্ছে মারামারি খামচাখামচি করা। এ ওকে কামড়ে ধরবে, কিল-ঘুসি মারবে, কাদায় চুবাবে। বোকাভূ এইসব কিছুই করে না। সব ভূত বাচ্চারা যখন মারামারি করে সে তখন একটু দূরে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বোকাভূর বাবা তখন খুব রাগ করেন। থমথমে গলায় বলেন, বোকাভূ, তোর হয়েছেটা কী? সবাই মারামারি করছে, তুই করছিস না কেন?

বোকাভূ উদাস গলায় বলে, মারামারি করতে আমার ভালো লাগে না।

‘কী সর্বনাশ, তুই কি সারাজীবন শান্ত শিষ্ট হয়ে থাকবি?’

‘হু’।

‘লক্ষীসোনা পুটপুট, ভুটভুট তুই লাঠিটা নিয়ে যা–ঠাস করে একটা ভূতের বাচ্চার মাথায় বাড়ি দিয়ে আয়। দেখবি কত মজা পাবি।

‘উহুঁ। কাউকে ব্যথা দিলে আমার খুব খারাপ লাগে।’

‘যত দিন যাচ্ছে তুইতো ততই বোকা হচ্ছিসরে বাবা।’

‘হ্যাঁ হচ্ছি।’

‘বোকা হতে হতে শেষটায় হাবা হয়ে যাবি। তখন তোকে আর কেউ বোকাভূ ডাকবে না। ডাকবে–হাবাভূ। ভূতদের নাম হাবাভূ হলে খুব লজ্জার হয়। বাবা তোর চিকিৎসা হওয়া দরকার। চল তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।’

‘আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না বাবা। আমার শুধু চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে।’

বোকাভূর বাবা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলেন। বোকাভূ তাঁর খুব আদরের সন্তান। আজ তার একি অবস্থা। তিনি ছেলেকে ভূত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।

ভূত ডাক্তার খুবই ভয়ংকর। কটমট করে তাকান, হুম হাম শব্দ করেন, কথা বলেন পদ্যে। তিনি বোকাভূর গলা দু’হাতে চেপে ধরে বিকট হুংকার দিয়ে বললেন–

নাম বল ধাম বল
রোগের বিবরণ বল।
সর্দি কাশি, না কি জ্বর।
কোন ব্যাধি করিয়াছে ভর?

বোকাভূর বাবা বললেন, জনাব, এইসব কিছু না। এর শরীর খুব ভালো। ও শুধু বোকা। আপনি দয়া করে ওর বোকা-ব্যাধি সারিয়ে দিন।

ডাক্তার হুংকার দিয়ে বললেন–

কী রকম বোকা?
অল্প, বেজায় না মধ্যম
বোকামিটা প্রবল না কম?

বোকাভূর বাবা বললেন, বোকামি খুবই প্রবল। বোকাভূ ভূত বাচ্চাদের মতো মারামারি কামড়াকামড়ি কিছুই করে না। সবাই যখন মারামারি করে সে তখন উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ভূত ডাক্তার চিন্তিত মুখে বললেন–

কী ভয়ংকর!
বোকামিতো ঢুকেছে তার অন্তরের ভেতর।

‘জনাব, এইখানেই শেষ না। বোকাভূ যখন দেখে কেউ ব্যথা পাচ্ছে বা কষ্ট পাচ্ছে তখন–তার আনন্দে হেসে ফেলা উচিত। সে কিন্তু হাসে না। তার নাকি খুব কষ্ট হয়। তার নাকি চোখে পানি এসে যায়।’

ভূত ডাক্তার গম্ভীরভাবে মাথা দুলাতে দুলাতে বললেন–

কী ভয়ংকর!
বোকামিতো ঢুকেছে তার অন্তরের ভেতর।

এইখানেই শেষ না ডাক্তার সাহেব। ভয়ংকর কথাটাই এখনো আপনাকে বলা হয়নি। বলতে লজ্জা লাগছে। না বলেও পারছি না। আপনি চিকিৎসক মানুষ, আপনার কাছে কিছু গোপন করা উচিত না। বোকাভূ স্কুলে পড়াশোনা করতে চায়।

ভূত ডাক্তার বোকাভূর বাবার কথায় এতই অবাক হলেন যে পদ্য বলতে ভুলে গেলেন। চোখ কপালে তুলে শুধু বললেন–’সেকি!’

‘সে শুধু ভালো ভালো কাজ করতে চায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে চায়। দিনে একবার ময়লা কাদায় গোসল করবে তাও করতে চায় না।’

কী ভয়ংকর!
পরিষ্কার ঢুকেছে তার অন্তরের ভেতর।

‘সে পরিষ্কার টলটলা পানিতে গোসল করতে চায়। পরিষ্কার জামা-কাপড় পরতে চায়।

ভূত ডাক্তার দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন–

মহা সর্বনাশ!
বোকাভূকে বোকামিতে করিয়াছে গ্রাস।

বোকাভূর বাবা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন–‘আপনি আমার বাচ্চাটাকে ভালো করে দিন ডাক্তার সাহেব। ওকে সুস্থ করে দিন। আমি আপনার পায়ে পড়ি।’ বলেই তিনি ডাক্তারের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন।

ডাক্তার সাহেব অনেক চিন্তা ভাবনা করে বললেন—’তোমার ছেলের যে রোগ হয়েছে তার নাম মানুষ-রোগ। মানুষের স্বভাব তার মধ্যে চলে এসেছে।’

বোকাভূর বাবা হতাশ গলায় বললেন, ‘এখন উপায়?’

ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘উপায় একটা আছে। তোমার ছেলেকে মানুষের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে। মানুষদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। সে মানুষের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হেসে খেলে বড় হবে।’

‘তাতে লাভ কী?’

‘মানুষ সঙ্গে থেকে থেকে সে একদিন বিরক্ত হয়ে আবার ভূতদের মতো হতে চাইবে। এই এর একমাত্র চিকিৎসা। আর চিকিৎসা নেই।’

বোকাভূর বাবা কী আর করেন–একদিন ছেলেকে নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে দিলেন।

স্কুলব্যাগ কিনে দিলেন। পানির বোতল কিনে দিলেন। তারপর ভর্তি করিয়ে দিলেন মানুষদের স্কুলে।

বোকাভূ সারাদিন মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে থাকে। স্কুলে পড়ে। মানুষের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলে। শুধু রাতে নিজেদের বাসায় ফিরে আসে। নিজেদের বাসা মানে বাঁশগাছ। রাতটা বাঁশগাছে পা ঝুলিয়ে বসে কাটিয়ে দেয়। সকালবেলা মহাউৎসাহে মানুষদের স্কুলে রওনা হয়।  কে জানে সে হয়ত তোমাদের স্কুলেই পড়ে! তোমরা তাকে চেন না বলে মনে করছ সে তোমাদের মতোই একজন। তার সঙ্গে তোমরা হাসছ, খেলছ, গল্প করছ। সে দেখতে কেমন বলব? না থাক বলব না। বললে তোমরা তাকে চিনে ফেলবে।

Exit mobile version