খবর দেওয়ার কিছু নেই। শুধু জেনে আসবে কিছু লাগবে-টাগবে কি, কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না।
কিছু লাগবে না। মনের আনন্দে আছেন।
ঠিক আছে। এখন যাও।
পাগলু চলে যাওয়ার পর সুজন চুপ করে বসে রইলেন।
মিনিট দশেক ধ্যানস্থ থাকার পর উঠে ল্যাবরেটরির দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে লোহার আলমারিটা খুললেন। ভেতর থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে ডালাটা খুলে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। বাক্সের ভেতর সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সা। রোজই কিছুক্ষণ তিনি জিনিসগুলো দেখেন। সাতটা কড়ি মানে সাতকড়ি নামের কেউ একজন–এটা বুঝবার জন্য বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। কিন্তু মুশকিল হল সাতটা পয়সা নিয়ে। পয়সার ধাঁধা তিনি এখনও সমাধান করতে পারেননি। সাতটা পয়সা মানে সাত পা হাঁটার সংকেত হতে পারে, সাত ফুট দূরত্ব হতে পারে, কিংবা আরও অনেক কিছু।
সুজন বাক্সটা আবার যথাস্থানে রেখে আলমারি বন্ধ করে চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন এমন সময়ে বাইরে হেঁড়ে গলায় কে ডাকল, সুজনবাবু আছেন নাকি?
সুজন দরজা খুলে দেখলেন, গদাই নস্কর আর নগেন দারোগা দাঁড়িয়ে আছেন।
সুজন মৃদু হেসে বললেন, আসুন আসুন।
ল্যাবরেটরির এক ধারে চেয়ার-টেয়ার পাতা আছে। দুজনে বসবার পর নগেন দারোগা বলল, এসে ডিস্টার্ব করলাম নাকি? কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছিলেন না তো!
সুজন হেসে বললেন, কথাটা ঠাট্টার মতো শোনাচ্ছে। এই ল্যাবরেটারিতে কি গবেষণা হয়? যন্ত্রপাতি কোথায়? ইলেকট্রিক কোথায়? গবেষণা টবেষণা নয়, বসে বসে চিন্তা-ভাবনা করি আর কি, তা কী খবর বলুন?
নগেন দারোগা পা ছড়িয়ে বসে বললেন, এ গাঁয়ে আপনিই সবচেয়ে মান্যগণ্য লোক। অনেক লেখাপড়া করেছেন, বিলেত-বিদেশ ঘুরে এসেছেন। আপনার কাছে একটা কথা বলতে আসা।
বলুন।
হরিপুর বড় শান্তির জায়গা ছিল। কখনও কোনও গণ্ডগোল হয়নি, কিন্তু ইদানীং এসব কী হচ্ছে বলুন তো!
সুজন শান্ত গলায় বললেন, শূলপাণির নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে ভাবছেন নাকি?
শুধু শূলপাণি কেন? আমাদের পরঞ্জয়দাদারও তো একই কথা। দু-দুটো লোক গাঁ থেকে উবে গেল মশাই, এ কি সোজা কথা?
সুজন একটু চিন্তিতভাবে বললেন, ঘটনা দুটি নিয়ে আমিও ভাবছি। শূলপাণির সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ ছিল। পরঞ্জয়বাবু অবশ্য একরকম বন্ধু মানুষ। কিন্তু এঁরা কোথায় যেতে পারেন তা আমিও ভেবে পাচ্ছি না।
গদাই নস্কর বলল, এ অঞ্চল আমার চেয়ে ভাল কেউ চেনে না। একসময়ে সারা তল্লাট জুড়ে আমি ডাকাতি করে বেড়িয়েছি। সব জায়গাতেই আজও আমার পুরনো চরেরা আছে। কিন্তু তারাও কেউ কোনও হদিস দিতে পারেনি।
সুজন গম্ভীরভাবে বললেন, চিন্তার কথা।
নগেন দারোগা বলল, আপনি বুড়ো মানুষ, একা থাকেন, চোর ডাকাত জানে যে আপনি বিদেশ থেকে মেলা টাকা পয়সা নিয়ে এসেছেন। তাই আপনাকে নিয়েও আমাদের ভাবনা হচ্ছে। আপনি দুর্জয় সাহসী না হলে এভাবে একা থাকতেন না। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনার নিরাপত্তার জন্য একটা পাহারা বসাব।
সুজন চমকে উঠে বললেন, সর্বনাশ! ও কাজও করতে যাবেন না।
কেন বলুন তো!
সুজন মাথা নেড়ে বললেন, আপনাদের ধারণা ভুল। টাকা-পয়সা আমার বিশেষ কিছু নেই। বিদেশে আমি অনেক রোজগার করেছিলুম বটে, কিন্তু দেশে ফিরে একটা ব্যবসা করতে গিয়ে আমার বেশিরভাগ টাকা পয়সাই নষ্ট হয়েছে। এখন যা সামান্য আছে তা দিয়ে কোনওরকমে চলে যায়। চিন্তা করবেন না, টাকা-পয়সা আমার ঘরে থাকে না, কালীপুরের ব্যাংকে রাখা আছে।
নগেন দারোগা মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু চোর-ডাকাতরা তো আর তা জানে না, তারা হানা দিতে পারে।
সুজন একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনি প্রাক্তন দারোগা বলেই বলছি, দোষ ধরবেন না, এ-তল্লাটের চোর-ডাকাতদের আমি চিনি, কিছু ভাবসাবও আছে। আমাকে নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন হবেন না। আপনাদের কি ধরণা হয়েছে যে, শূলপাণি আর পরঞ্জয়ের পর এবার আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার পালা?
নগেন দারোগা মাথা চুলকে বলে, বলা তো যায় না।
সুজন বললেন, গুম করলে অন্যকথা, কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় হঠাৎ এ বয়সে নিরুদ্দেশ হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আর গুম করার চেষ্টা কেউ করলেও কাজটা সহজ হবে না। সত্তরেও আমি বেশ তেজী লোক। বালিশের পাশে পিস্তল নিয়ে শুই। ঘাবড়াবেন না, পিস্তলের লাইসেন্স আছে।
গদাই লস্কর চিন্তিতভাবে বলল, তবু সাবধানের মার নেই। আপনার বাড়িতে আলাদা করে পাহারা না বসালেও সারা গাঁয়ে সারা রাত পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সুজন বললেন, ভালই করেছেন। তবে আমার বিশ্বাস, এসব গুম-টুম নয়।
নগেন বলল, তাহলে কী?
সুজন একটু চিন্তিতভাবে বললেন, শূলপাণি একজন বাতিকগ্রস্ত মাথাপাগলা লোক। আমি বৈজ্ঞানিক বলে সে আমার কাছে নানা উদ্ভট প্রস্তাব নিয়ে আসত। গুপ্তবিদ্যা আর অলৌকিকের ওপর খুব ঝোঁক ছিল। আমার মনে হয় সে সেরকমই কোনও বিদ্যা অর্জনের জন্য কোথাও গেছে। কিংবা…
নগেন ঝুঁকে বসে বলে, কিংবা?
সে কথা থাক। আর একটু বিচার-বিশ্লেষণ করে ভেবে তবে বলা যাবে।
গদাই বলল, আপনি কি শুনেছেন যে তার ঘরে একটা কাঠের বাক্সে সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সা ছিল?
হ্যাঁ, শুনেছি। জিনিসগুলো সে আমাকে দেখিয়েও গেছে।
কেন দেখিয়েছিল?
মাথা নেড়ে সুজন বলল, তা জানি না, সে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল এগুলো দেখে আমি কিছু বুঝতে পারছি কি না।