শার্দুল নামকরা শিকারি। তার যে কত বন্দুক পিস্তল ছিল তার লেখাজোখা নেই। সাতটা তেজী ঘোড়া ছিল, পাঁচটা গ্রে-হাউন্ড ব্লাড-হাউন্ড কুকুর, বাড়িতে বাগান, পুকুর, দারোয়ান ছিল। তা ছাড়া শার্দুলের চেহারাটাও ছিল পাহাড়ের মতো বিশাল; আর মনটা ছিল আকাশের মতো উদার। মুঠো মুঠো টাকা যেমন ওড়াত তেমনি বিলিয়ে দিত।
তবে একটা কারণে শার্দুলকেও ভজবাবু দেখতে পারেন না। শার্দুল বাজারে গিয়ে কখনও দরদাম করে না। দোকানদাররা যা দাম চায় তাই হাসিমুখে দিয়ে দেয় আর রাশি রাশি তরিতরকারি, মাছ, ডিম, মাংস কিনে ফেলে। শার্দুল যেদিন বাজারে যায় সেদিন দোকানদারদের পোয়াবারো, আর ভজবাবুর কপালে দুঃখ। সেদিন ভজবাবু যে-দোকানদারের কাছেই গিয়ে বাবা, বাছা বলে দু পয়সা কমানোর চেষ্টা করেন সেই দোকানদারই তাঁকে না-চেনার ভান করে, পাত্তাই দিতে চায় না। কানাই মাছওলা একবার তো বলেই ১০২
ফেলল, “বাজাড়দের মধ্যে ভ ভদ্রলোক দেখলাম একমাত্র ওই শার্দুলবাবুকেই। আর তো সব ছ্যাঁচড়া।”
সেই থেকে ভজবাবুর রাগ। শার্দুল চৌধুরীর অবশ্য আর সেই বাঘ-সিংহী মারার দিন নেই। অমিতব্যয়ের ফলে তার পয়সাকড়ি সব চলে গেছে, বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। বন্দুক, ঘোড়া, কুকুর সবই বেহাত। শার্দুলের সে চেহারাও আর নেই। রোগাটে লম্বা মানুষটাকে দেখলে মনে হয় বুঝি শার্দুলের বাবা। অত বুড়ো দেখায়।
শার্দুল ভজবাবুকে দেখে চোখ নাচিয়ে বলল, “কী খবর হে ভজু শিকারি?”
ভজবাবু জন্মেও কিছু শিকার করেননি। তবে কিনা ভাল বাজার করেন বলে শাল তাঁকে মুনাফা-শিকারি বলে ডাকে। সংক্ষেপে শিকারি।
ভজবাবুর ব্যাপারের তলায় তৈরি পিস্তল। কিন্তু যখন-তখন সেটা ব্যবহার করতে তো আর পারেন না। সতর্কতার একান্ত প্রয়োজন। তাই ভালমানুষের মতো বললেন, “ভিতরে চলুন শার্দুলবাবু, আপনার সঙ্গে কথা আছে।”
শার্দুল ব্যস্ত হয়ে বলে, “কথা বলার সময় নেই। বাড়িতে আজ জলসা বসিয়েছি, লখনউ থেকে এক বড় ওস্তাদ এসেছে। তাকে মুজররা দিতে হবে বলে একটা সোনার পকেটঘড়ি বাঁধা দিয়ে গেলাম। জোর খানাপিনাও হবে।”
ভজবাবু দাঁত কিড়মিড় করলেন। অমিতব্যয়ী আর কাকে বলে। এই লোকটার এই দেদার টাকা খরচ করে ফুর্তি করা আর বাজারের দোকানদারদের আশকারা দেওয়া আজ বের করতে হবে। ভজবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কথাটা একান্তই জরুরি। বেশি সময়ও লাগবে না।”
এই বলে শালকে একরকম ঠেলে দরজার ভিতরে এনে ভজবাবু দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে পিস্তল বের করে বললেন, “হ্যান্ডস আপ।”
শার্দুল বলে উঠল, “উ-হুঁ-হুঁ, আজ থিয়েটার দেখার সময় নেই। ওস্তাদজি বসে আছেন। তোমাদের পূর্বপল্লী কি এবার গোয়েন্দা-নাটক করছে নাকি?”
ভজবাবু হাসলেন, তারপর বিনাবাক্যে পিস্তলের মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ঘোড়া টিপে দিলেন।
প্রচণ্ড শব্দ, আগুনের ঝলক আর ধোঁয়ার ভিতরে দাঁড়িয়ে ভজবাবুর নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বীর বলে মনে হল।
পিস্তলের শব্দে শার্দূল তিন হাত ছিটকে গেল। চোট্টা গোবিন্দ সিন্দুকের চাবি ট্যাকে খুঁজতে যাচ্ছিল, ঝনাত করে চাবির গোছাটা পড়ে গেল মেঝেয়।
ভজবাবু বললেন, “হ্যান্ডস আপ।”
এবার আর শার্দুলও চোট্টা গোবিন্দর হাত ওপরে তুলতে বেশি দেরি হল না। তবে কিনা চোট্টা গোবিন্দ ইংরিজি জানে না, ‘হ্যান্ডস আপ’ কথাটার মানে বুঝতে পারেনি বলে তার কিছু দেরি হয়েছিল। শার্দুল চৌধুরী কথাটার মানে বলে দিল তাকে; তখন সে তড়িঘড়ি হাত তুলে বলল, “বাবা ভজু, দোহাই তোমার। পাঁজিটা একটু দেখতে দাও।”
ভজবাবু হেসে বললেন, “পাঁজি দেখবেন? না পাঁজি দেখতে চান? পাঁজি দেখতে চাইলে একটা আয়না নিয়ে নিজের মুখখানা দেখুন, সবচেয়ে বড় পাজিকে দেখতে পাবেন।”
চোট্টা গোবিন্দ কাকুতি-মিনতি করে বলতে থাকে, “লক্ষ্মী ছেলে ভজু, অমন করে না, ছিঃ! আটটা কত মিনিটে যেন অমৃতযোগ আছে। যদি মারতেই হয় তবে সময়টা একটু দেখে মেয়েরা বাপ। নইলে কোন নরকে গিয়ে পচব।”
“হাঃ হাঃ,” হাসলেন ভজবাবু, তারপর ডাকলেন, “শার্দুল চৌধুরী।”
ভজবাবুর গলায় ডাকটা বাঘের ডাকের মতো শোনাল। শব্দে কেঁপে ওঠে শার্দুল। আর ভজবাবু অবাক হয়ে নিজের গলায় হাত রেখে ভাবেন, “এও কি পিস্তলের গুণ? নইলে এরকম বাঘের আওয়াজ আমার গলায় এল কোত্থেকে?”
ভজবাবু পিস্তলটার গায়ে আদরে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “শুনুন শার্দুলবাবু আর গোবিন্দবাবু, আপনাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। গোবিন্দবাবু, আপনি সুদখোর, বন্ধকী মহাজন, মানবতার শত্রু, পৃথিবীর পঙ্কিলতম জঘন্যতম কী যেন! কী যেন! থাকগে। আর শার্দুলবাবু, আপনি আড্ডাবাজ, ফুর্তিবাজ, বেহিসাবি। দরিদ্রের রক্ত শোষণ করে, পৃথিবীর সম্পদ লুণ্ঠন করে, বাজারে গিয়ে নিজের ধনসম্পদের অপপ্রয়োগের দ্বারা মূল্যমানকে জঘন্যতম উর্ধ্বে তুলে দিয়ে যে অহমিকার ধ্বজা–এত কথারই বা কাজ কী! ওঠবোস করুন। দশবার।”
শার্দুল খুব মন দিয়ে ভজবাবুর কথা শুনছিল, ভজবাবু, থেমে যেতেই চোট্টা গোবিন্দর দিকে চেয়ে বলে উঠল, “পার্ট ভুলে গেছে?”
ভজবাবু ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েগ বললেন, “ভুলিনি। আরো শুনতে চান? আপনাদের লজ্জা হয় না শুনতে? ওঠবোস করুন, ওঠবোস করতে থাকে।