আরও বেশ কিছুক্ষণ পর তিনজনেই একসঙ্গে পায়ের নীচে মাটি পেয়ে দাঁড়াল। ঢালু, পিছল জমি। সামনে নিকষ কালো অন্ধকার। এত অন্ধকার যে মনে হয়, চোখ বুঝি অন্ধই হয়ে গেছে। হঠাৎ।
ধীরে-ধীরে তিনজন ঢালু বেয়ে উঠল। অবসন্ন, দুর্বল। চলচ্ছক্তিহীন।
নবীন মায়াভরে বলল, “আর ভয় নেই, পথ এবার পাবই, বসে একটু জিরিয়ে নাও।”
অনু, বিলু ধপধপ করে বসে পড়ল।
নবীন একটু দম নিয়ে বলল, “কেটেরহাটে অনেক কিংবদন্তি আছে। আমি সেগুলো এতকাল মোটেই বিশ্বাস করিনি। আজকের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছি, সবটাই কিংবদন্তি নয়। পিছনে কিছু সত্যও আছে।”
বিলু সোৎসাহে বলে উঠল, “কিংবদন্তির গল্পগুলো বলবে আমাদের নবীনদা?”
নবীন একটু হাসল। বলল, “বলব। আগে তো তোমাদের এই অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার করি।”
অনু কিন্তু দিব্যি হাসি-মাখানো গলায় বলল, “তুমি আমাদের কথা ভেবে এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন বলো তো নবীনদা? আমি কিন্তু একটুও দুশ্চিন্তা করছি না। রং অ্যাডভেঞ্চারটা বেশ ভাল লাগছে। আমি একবার বড়ধেমো কয়লাখনিতে নেমেছিলাম। আমার এক মেলোমশাই চাকরি করেন ওখানে। একটুও ভয় করেনি। এটাকেও তেমন একটা খনিগর্ভ বলে মনে হচ্ছে।”
নবীন চিন্তিতভাবে বলল, “কে জানে কী! হতেও পারে কোনও পুরনো আমলে ইংরেজরা হয়তো খনি-টনি খুঁড়েছিল। তার পর কাজ আর এগোয়নি। এখন চলল, ওঠা যাক।”
টর্চ নেই। সামনে নিবিড় অন্ধকার। ভরসা শুধু নবীনের লাঠিগাছ। নবীন লাঠিটা সামনে বাড়িয়ে ঠুকে-টুকে রাস্তার আন্দাজ করে চলতে লাগল। পিছনে অনু আর বিলু।
বেশ কিছুটা চলার পর নবীন টের পেল, পায়ের তলার জায়গাটা যেন শান বাঁধানো।
আরও খানিকটা এগোনোর পরই লাঠিটা একটা দেওয়ালে ঠেকে গেল। হয় রাস্তা বন্ধ, না হলে গলিটা বাঁক নিয়েছে।
নবীন বলল, “দাঁড়াও। সামনে বাধা আছে।”
অনু-বিলু দাঁড়িয়ে গেল। নবীন দেওয়ালটা হাতড়ে দেখল। চৌকো পাথরের দেওয়াল। চার দিক হাতড়াতে গিয়ে হঠাৎ সে টের পেল, দেওয়ালের গায়ে একটা দরজা রয়েছে। কাঠের দরজা, নবীন দরজাটা ঠেলল।
বহু পুরনো কাঠে ঘুণ ধরে একেবারে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে।
এক ঠেলাতেই দরজাটা ভেঙে পড়ে গেল।
“কী হল নবীনদা?” অনু আর বিলু একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।
“একটা দরজা। তোমরা এখানেই দাঁড়াও, আমি ঘরের ভিতরটা আগে দেখে নিই।”
নবীন ভিতরে ঢুকল। ঘরের মধ্যে সেই পুরনো বদ্ধ বাতাসের সোঁদা গন্ধ। ইঁদুরের দৌড়োদৗড়ি তো আছেই। নবীন হাতড়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ একটা পুজোর ঘণ্টা পেয়ে গেল। বেশ ভারী আর বড়সড়। নাড়তেই চমৎকার ঠুনঠুন শব্দ হল।
সভয়ে বিলু চেঁচিয়ে উঠল, “ঘণ্টা বাজছে কেন নবীনদা?”
নবীন অভয় দিয়ে বলল, “ভয় নেই। আমিই বাজিয়েছি। এটা একটা মন্দির।”
“আমরা ঢুকব?”
“এসো। মাটির নীচে এ রকম একটা মন্দিরের কথা আমরা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি। আজ বিশ্বাস হল। সিদ্ধিনাথও এই মন্দিরটা বহুকাল ধরে খুঁজছে।”
অনু আর বিলুও অন্ধকারে চার দিক ঘুরে দেখতে লাগল। অন্ধকারে তারা মন্দিরের মধ্যে আরও কিছু জিনিস আবিষ্কার করল। একটা মস্ত পিতলের প্রদীপ, একটা পাথরের সিংহাসনে একটা বিগ্রহ, কয়েকটা পুজোর বাসনকোসন, কোষাকুষি, একটা লোহার সিন্দুক।
সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আবিষ্কারটা অবশ্য করল বিলু। দুটো পাথর। একটা জরাজীর্ণ কাঠের বাক্স হাতড়াতে গিয়ে দুটো পাথর আর কয়েকটা লম্বা সরু কাঠির মতো বস্তু পেয়ে গেল সে।
“নবীনদা, এগুলো কী বলল তো? দুটো পাথর, আর কয়েকটা কাঠি!”
নবীন বলল, “দাও, ওগুলো আমার হাতে দাও। কপাল ভাল থাকলে ও-দুটো চকমকি পাথরই হবে।”
নবীন পাথর দুটো সামান্য ঠুকতে চমৎকার স্ফুলিঙ্গ দেখা গেল। কাঠির মাথায় বারুদ বা ওই জাতীয় কোনও সহজ-দাহ্য বস্তু লাগানো। খুব সাবধানে কয়েক বারের চেষ্টায় নবীন একটা কাঠি ধরিয়ে ফেলতে পারল।
.
প্রদীপের সলতে বা তেল নেই। কাঠির সামান্য আগুনটা অবশ্য বেশ কিছুক্ষণ জ্বলল। নবীন খুঁজে-পেতে একটা পেতলের ছোট কলসি পেয়ে গেল। থাকারই কথা। কেটেরহাটের বিখ্যাত শীতলা মন্দিরেও এ রকমই কলসিতে প্রদীপের ঘি রাখা হয়। মুখবন্ধ কলসির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নবীন দেখল, তলানি ঘি এখনও আছে। তবে জমাট আর শক্ত। খামচে-খামচে তাই তুলে প্রদীপে দিল নবীন। নিভস্ত কাঠি থেকে আর-একটা ধরিয়ে নিল। পকেট থেকে ভেজা রুমালটা বের করে অনুকে দিয়ে বলল, “চটপট এটা পাকিয়ে সলতের মতো করে দাও।”
সামান্য পরেই প্রদীপ জ্বলে উঠল। এতক্ষণ অন্ধকারে কাটানোর ফলে সামান্য প্রদীপের আলোতেই তিনজনের চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
তার পর অবাক বিস্ময়ে তারা ভূগর্ভের মন্দিরটা ভাল করে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
৯. মাঝারি একটা চৌকোনা ঘর
বেশি বড় নয়, মাঝারি একটা চৌকোনা ঘর। পাথর দিয়ে তৈরি। পাথরের সিংহাসনে কালো পাথর দিয়ে তৈরি একটা দেড় হাত লম্বা বিষ্ণুমূর্তি। ভারী চমৎকার মূর্তিটার গঠন। তবে ময়লা পড়েছে বিস্তর।
অনু বলল, “বাঃ, কী সুন্দর!”
নবীন লোহার সিন্দুকটার কাছে গিয়ে দেখল, পুরনো তালা মরচে পড়ে ঝুরঝুরে হয়ে আছে। লাঠির একটা ঘায়ে তালাটা ভেঙে পড়ে গেল।
নবীন ডালা খুলে দেখল, ভিতরে সোনা ও রুপোর কয়েকটা বাসনকোসন রয়েছে। সন্দেহ নেই যে, ঠাকুরের ভোগের জন্যই
এই সব বাসন-কোসন।
ডালাটা আবার বন্ধ করে দিল নবীন।।