অক্ষয় সঙ্গে-সঙ্গে বলে, “আজ্ঞে, সেকথাও ঠিক। আমার কাঁকালেও কী যেন একটা লেগেছিল। সেটা লাথিও হতে পারে।”
রেমো দৃঢ় স্বরে বলে, “লাথিই। কী হে নেতাই, তুমিই বলল।”
নেতাই বলল, “লাথির মতোই মনে হয়েছিল।”
অক্ষয় সঙ্গে সঙ্গে নেতাইয়ের দিকে চেয়ে বলে, “তুমিও বাদ যাওনি নেতাইদা। তিনখানা রদ্দা তোমাকে আমি নিজের চোখে খেতে দেখেছি।”
নেতাই বলে, “তিনখানা নয় রে বাপু, দুখানা মারতে পেরেছিল, তিন নম্বরটা আমি পাশ কাটিয়ে দিয়েছি, ছুঁয়ে গেছে বলতে পারিস। তা ওই আড়াইখানাই ধর। তোর কথাও থাক, আমার কথাও থাক।”
দারোগাবাবু রোষকষায়িত লোচনে চেয়ে বললেন, “ওসব হেঁদো কথা ছেড়ে আসল কথাটা বলবি?”
অক্ষয় হাতজোড় করে বলে, “আজ্ঞে, আমরা সকলেই অল্পবিস্তর মারধর খেয়েছি। বিশের জ্যাঠামশাইয়ের মাথায় পিস্তলের বাঁট দিয়ে মেরে আলু তুলে দিয়েছে। সদানন্দের নাক ভেঙেছে। তারপর এইসব হুজ্জত করে তারা যখন গাঁ একেবারে লণ্ডভণ্ড করে ফেলছে তখন আমরা তাদের বলে দিলুম, বাপু হে, আমাদের মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে আর কী হবে! অভয় সরকার মনসাপোঁতার জঙ্গলে সেঁধিয়েছে। যদি ব্ৰহ্মদত্যির হাত থেকে বাঁচে তো বুনন কুকুরের মুখে পড়বে। তা ছাড়া নেকড়ে আছে, হাতি আছে। সেই শুনে তারা আমাদের ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।”
দারোগাবাবু অতিশয় ব্যথিত মুখে বললেন, “হ্যাঁ রে, মনসাপোঁতার জঙ্গল ছাড়া কি আর আসামিদের যাওয়ার জায়গা নেই! ওই ভয়ের জায়গাটায় গিয়ে চোর-ডাকাতরা সেঁধোলে আমিই বা কী করি! ওদের যে কবে আক্কেল হবে সেটাই বুঝি না।”
নেতাই গলা বাড়িয়ে বলে, “আজ্ঞে, সে কথা আমরাও বলাবলি করি। কলির শেষ কিনা, সবই উলটো হচ্ছে। আমার মেজোমামা তো বলেন, কলির শেষে নদী উজোনে বইবে, মেয়েমানুষ সব পুরুষ হবে আর পুরুষেরা মেয়ে, পাথরে দুব্বো গজাবে। তা দেখছি সেরকমই সব হচ্ছে।”
দারোগাবাবু একটু মনমরা হয়ে বললেন, “ভরসা একটাই। ব্যাটা ব্ৰহ্মদৈত্য যদি পাঁচটাকে ধরে চিবিয়ে খায়।”
“একটু নুন দিয়ে।” ফোড়ন কাটে নেতাই।
অক্ষয় হাতজোড় করে বলে, “আজ্ঞে, তাতে কোনও ভুল নেই। তবে কিনা বেহ্মদত্যিটার আবার জিভের খুব তার। যাকেতাকে খায় না। এই তো শ্রীপদ, হারু মল্লিক এরাও সব তেনার খপ্পরে পড়েছিল কিনা, মাথায় মুগুর মেরে ফেলে দিয়ে চেটে দেখেছে, সব কটা অখাদ্য। তারপর জঙ্গলের বাইরে টেনে ফেলে দিয়ে গেছে।”
দারোগাবাবু কৌতূহলী হয়ে বলেন, “তা হলে খায় কাকে?”
নেতাই হাতজোড় করে বলে, “অভয় দেন তো বলি। হুজুরের মতো নাদুস-নুদুস লোক পেলে বেহ্মদত্যি ব্যাটা চেটেপুটে খাবে। ছিবড়েটুকু অবধি ফেলবে না। আর ভগবানের দয়ায় হুজুর, আপনার শরীরে ছিবড়ের আঁশটুকু অবধি নেই। একেবারে নধরকান্তি জিনিস, সবটুকুই একেবারে থলথল করছে। কপাকপ খেলেই হল।”
“মুখ সামলে?” বলে একটা বাঘা হুঙ্কার দিয়ে সুদর্শনবাবু রুমালে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “নজর দিয়ে-দিয়েই ব্যাটারা আমার বারোটা বাজাল। তাই তো পিসি আমাকে এখনও কাজলের ফোঁটা দিয়ে তবে বেরোতে দেয়। আর ওরে আহাম্মক, ব্রহ্মদৈত্য আমাকে খেলে তোর কিছু সুবিধে হবে?”
নেতাই নাক কান মলে জিভ কেটে হাতজোড় করে বলে, “আপনি গেলে আমরা অনাথ হয়ে যাব। ওকথা বলবেন না, শুনলেও পাপ হয়। বাড়ি গিয়ে কানে একটু গঙ্গাজল দেব। বলছিলাম কি, হুজুর, বেহ্মদত্যির নজর খুব উঁচু। যেমন-তেমন লোক মুখে রোচে না। হুজুরের মতো মান্যগণ্য উঁচু থাকের লোক হলে তবেই সে একটু খায়।”
সুদর্শনবাবু দু চোখে নেতাইকে ভস্ম করার চেষ্টা করতে-করতে বললেন, “ফের যদি ওরকম অলক্ষুনে কথা বলবি তো তিনশো দুই ধারায় ফাটকে পুরে রাখব।”
নেতাই মাথা মেঝেয় ঠেকিয়ে নমো ঠুকে বলল, “আজ্ঞে, এবার থেকে ওরকম কথা বলার আগে আমার যেন জিভ খসে যায়। তিনশো দুই ধারাটা কীরকম হুজুর? আমাদের মতো চাষাভুষোর বেলায় খাটে?”
“সে আমিও জানি না। কতরকম ধারা আছে। তবে এই চক্ৰপুরে আমার মুখের কথাই হচ্ছে ধারা। বুঝলি?”
বিগলিত নেতাই বলে, “খুব বুঝেছি আজ্ঞে। আমরা হাড়ে-হাড়ে জানি যে, হুজুর শুধু ধারাই নন, তিনিই আমাদের আইন-আদালত, মা বাপ, তিনিই ভগবান। এ আর নতুন কথা কী?”
“কথাটা মনে রাখিস। এখন হেঁদো কথা ছেড়ে কাজের কথায় আয়। পাঁচ-পাঁচটা ডাকাত মনসাপোঁতার জঙ্গলে ঢুকে বসে আছে, এ নিয়ে তদন্ত না করলে সরকারকে আমি বলব কী? তার ওপর লাখনটা খবর দিয়ে গেল, কাল সন্ধেবেলায় চারটে লোক গোয়েন্দা-পুলিশ বলে নিজেদের জাহির করে এ-তল্লাটেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। তাদের ধরলে হয় মোট ন’জন। এতগুলো বদমাশকে ঠাণ্ডা করা কি যে-সে কথা! দারোগাদের জীবন সুখের নয় জানি, কিন্তু তা বলে এরকম নাকালও হতে হয় বাপ!”
নেতাই তগত হয়ে বলল, “আপনার কষ্ট চোখে দেখা যায় না হুজুর। শক্ত মানুষ বলেই এখনও বর্তে আছেন। তবে কিনা কুঞ্জখুড়ো এক লাখ টাকায় উঠেছে।”
একথায় সুদর্শনবাবু ঝাঁকুনি মেরে সোজা হয়ে বললেন, “বলিস কী! একথা আগে বলতে হয়। এবার তো তা হলে গতর নাড়তেই হচ্ছে।”
অক্ষয় হাতজোড় করে বলে, “হুজুর, একটা কথা আছে। কালকে যে ডাকাতটাকে ধরেছিলুম সে নিজে মুখে কবুল করেছে যে, হুকুম সিং শুখানালার সরকারদের পোড়ো বাড়িতে লুটের মালপত্র পুঁতে রেখেছে। আর সেখানেই তার ঘাঁটি।”