Site icon BnBoi.Com

আমের কুঁড়ি, জামের কুঁড়ি – শামসুর রাহমান

আমের কুঁড়ি, জামের কুঁড়ি - শামসুর রাহমান

অচিন ঘোড়সওয়ার

পেরিয়ে সবুজ পরীদের ঘাট,
পেরিয়ে অনেক জ্যোৎস্নার মাঠ
এল নির্জন বাড়িটার কাছে
অচিন ঘোড়সওয়ার।

আঁধারে জ্বলছে পাগড়ির চুড়ো,
ঘোড়ার শরীর তারাদের গুঁড়ো
বন্ধ কপাটে বল্লম ঠোকে
অচিন ঘোড়সওয়ার।

বলে না কিছুই, কাউকে ডাকে না,
এখানে তা হলে কেউ কি থাকে না?
বাড়িটাকে ঘিরে ঘোরে একা একা
অচিন ঘোড়সওয়ার।

চিকচিকে ঘাম ঘোড়ার শরীরে,
নিশ্বাস কাঁপে জোনাকির ভিড়ে,
ঘাড়ফোলা পেঁচা দ্যাখে কী যে একা
অচিন ঘোড়সওয়ার।

ভুখা চাঁদ ক্রমে হেলে পড়ে কোণে,
ঘোড়ার খুরের ধ্বনি ডোবে বনে,
ঘাসগুলি দ’লে চলে যায় দূরে
অচিন ঘোড়সওয়ার।

অচিন ফুল

ফুরফুরে এই ফটিক হাওয়ায়
উড়ছে উড়ুক চুল,
ফুটফুটে সব ফুটপাতে আজ
ফুটুক অচিন ফু্ল।

আমার কলম

আমার পিঁড়ি নৌকা হয়ে
ক্ষীর নদীতে ভাসে।
জামবাটিটা চাঁদের মতো
নীল আকাশে হাসে।

আমার টেবিল হঠাৎ করে
বাগান হয়ে যায়।
সেই বাগানে সোনার পাখি
হীরার ফল খায়।

আমার ছোট বিছানাটা
রত্নদ্বীপের মতো
সেই দ্বীপেতে নেচে বেড়ায়
পরী শত শত।

আমার খাতা ঈগল পাখি,
পাহাড়চূড়ায় থাকে,
চায় না সে তো থাকতে জানি
ছোট্র পাখির ঝাঁকে।

আমার দোয়াত সাঁতার কাটে
নিঝুম সরোবরে;
আমার কলম অস্ত্র হয়ে
দুষ্ট দমন করে।

আমার খাতা

আমার খাতা অবাক করা
তেলেসমাতি খাতা,
চমকে তুমি উঠবে জানি
দেখে হরেক পাতা।

আমার খাতায় জড়িয়ে আছে
সবুজ পরীর মায়া,
তাই সেখানে খেলা করে
পাষাণপুরীর ছায়া।

আমার খাতায় দোলে হাওয়ায়
হীরের গাছের ফল,
বাজে মধুর চম্পাবতীর
পায়ে সোনার মল।

আমার খাতায় আছড়ে পড়ে
সাত সাগরের ঢেউ,
আকাশ কালো করে আসে
সুলেমানের দেও।

আমার খাতায় সিন্দাবাদের
জাহাজ বেড়ায় ভেসে,
আকাশ-ছেঁড়া তারা ঝরে
কঙ্কাবতীর কেশে।

আমার খাতায় ডালিম কুমার
পক্ষীরাজে ওড়ে,
পক্ষীরাজের পালক পড়ে
দুয়োরানির দোরে।
আমার খাতায় রবি ঠাকুর
হাসেন রবির মতো।
কাজী কবি ঝড় হয়ে যান,
দোলেন অবিরত।

আমার খাতায় বানায় বাসা
বাবুই পাখি সুখে,
সুর ঝরিয়ে দেয় পাপিয়া
উইয়ের ঢিঁবির বুকে।
আমার খাতায় ডুকরে ওঠে
লক্ষ ভুখা লোক,
তাকিয়ে থাকে হিরোশিমার
গলে যাওয়া চোখ।

আমার খাতায় গর্জে ওঠে
ভীষণ মেশিনগান,
আমার খাতায় মিশে থাকে
ভোরের পাখির গান।

আমার খাতায় স্বাধীনতার
নিশান আছে আঁকা
আমার খাতা জুড়ে শাদা
কবুতরের পাখা।

আমের কুঁড়ি, জামের কুঁড়ি

আমের কুঁড়ি, জামের কুঁড়ি
পড়ছে ঝরে ভুঁয়ে।
তেঁতুল গাছে চালতা বাদুড়,
ডালটা আসে নুয়ে।
ঝির ঝির ঝির হাওয়া চলে
বটের ঝুরি ছুঁয়ে।
বটতলাতে দুটি বাঁদর,
ঝগড়া বাঁধে দুয়ে।
চাঁদের বুড়ি মুখটি রাখে
জ্যোৎস্না দিয়ে ধুয়ে।
কে নেভাল ঘিয়ের বাতি
ইয়া বড় ফুঁয়ে?
দেখছো নাকি একলা ঘরে
খোকন আছে শুয়ে!

ইঁদুর কাটে

ইঁদুর কাটে চাদর-বালিশ
কাটে শাড়ির খুঁট,
কাটে ওরা ঘরের বেড়া
কুটুর কুটুর কুট।

ধেড়ে ইঁদুর দেখে বিড়াল
দিচ্ছে দূরে ছুট;
চোরের দাপট বাড়ছে ক্রমে
পুলিশ পালায় হুট।

শহর-গ্রামে দিনদুপুরে
চলছে হরির লুট,
গোল করো না, নইলে পাড়ার
স্বপ্ন যাবে টুট।
রাতদুপুরে মচমচিয়ে
ওঠে হাজার বুট;
সত্য গেছে বনবাসে
রাজ্যি চালায় ঝুট!

উল্টো সুর

রোদের রেণু, চাঁদের আলো
চাই নে কিছুই চাই নে।
আঁধার ছাড়া কোনো কিছুই
নেইকো বাঁয়ে-ডাইনে।

ফুলের গন্ধ, ছড়ার ছন্দ
চাই নে কিছুই চাই নে,
বলছে কারা নাকি সুরে
‘মাটির তলায় ঠাঁই নে’।

গুণিজনের বিদ্যেবুদ্ধি
চাই নে পেতে চাই নে,
দাঁড়াই হেসে আমরা সবাই
মুরুক্ষুদের লাইনে।

পাতকুয়োতে বেশ তো আছি
অন্যকোথাও যাই নে
ময়ূরপঙ্খি নায়ে চেপে
সমুদ্দুরে বাই নে।

গায়ের কাপড় মুখের অন্ন
চাই নে কিছুই চাই নে,
বাদ দিয়েছি সব কিছু ভাই
যাচ্ছেতায়ের আইনে।

এক যে ছিল টিয়ে

এক যে ছিল কেমন টিয়ে
দেখত, কিছু বলত না।
তাকে ছাড়া শেবামণির
এক নিমেষও চলত না।

একটু আমায় বলবে তুমি
কোথায় টিয়ের জন্মভূমি,
সেই দেশে কি হীরার গাছে
একটি ফলও ফলত না?

সেই টিয়েটা দেখত কত
পাখপাখালি ফুলের গাছ,
দেখত কত হাতি ঘোড়া,
দেখত মজার পুতুলনাচ।

পণ করেছে লক্ষ্মী টিয়ে
থাকবে মুখে গিলটি দিয়ে।
তাই তো শেবার ছোট্র ঘরে
ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলত না।

খুশি, হঠাৎ খুশি

খুশি, হঠাৎ খুশি
তুই কি আমার পুষি?

চড়ে সোনার রথে
স্বপ্নপুরীর পথে
আসিস কি তুই ওরে
হঠাৎ আমার দোরে?

খুশি, হঠাৎ খুশি
তুই কি আমার পুষি?

দিনটা যখন ডাকে,
কাজলা মেঘের ফাঁকে
তুই কি রোদের উঁকি?
তুই কি সূর্যমুখী?

দুউপুর যখন চড়া,
কানায় কানায় ভরা
কালো দিঘির জলে
পদ্মপাতার তলে,
তুই কি মাছের নড়া?

এই শহরে তোকে
পাচ্ছে পাড়ার লোকে।
সবখানে তোর সাড়া;
উঠছে মেতে পাড়া।
ভাঙা ইটের ফাঁকে
তুই কি সবুজ চারা?
সে সুর ঝরে ঝুনঝুনিয়ে
ঝাঁঝাঁ দুপুর বেলায়,
মৌমাছিদের মেলায়।

সে সুর এল মাঠে পেরিয়ে
হাট পেরিয়ে
ঘাট পেরিয়ে
বালিহাঁসের পাট এড়িয়ে
হঠাৎ এল পথ ভুলে কি
প্রিয় আমার শহরে?
আনাগোনার প্রহরে?

সে সুর ওড়ে ফুরফুরিয়ে
সে সুর ঝরে ঝুরঝুরিয়ে
মস্ত বড় বাড়িতে
রিকশা, মোটরগাড়িতে।

সে সুর ঝরে পথের ধারে
ব্যস্ত মুদির চালায়,
নোংরা গলির নালায়।

ট্রাফিক আলোর হুকুম চেখে,
পথে-ঘাটে পুলিশ দেখে
থমকে দাঁড়ায় একলা,
মুখ হলো তার মেঘলা।

একটু পরে সামলে নিয়ে
বেচারামের দেউড়ি গিয়ে
সে সুর ওড়ে ফুরফুরিয়ে,
সে সুর ঝরঝুরিয়ে
দিন মজুরের খুপরিতে,
উপুড়-করা চুপড়িতে।
সেই যে সকাল হতে
শান-বাঁধানো পথে
মানুষগুলো চলে
পুতুলনাচের ছলে।

অজানা এক ঝোঁকে
ইটের গুহায় ঢোকে।

সেখানে সব ঢুকে
মাথায় মাথা ঠুকে
কাশে এবং হাঁচে,
এমনি করেই বাঁচে।

হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে
পক্ষী আসে উড়ে।
সোনার জলে ভিজে
পক্ষী বলে কী-যে।
পাখির মধুর সুরে
কাছে এবং দূরে

সত্যি সবার আগে
চম্পা পারুল জাগে।

খুশি, হঠাৎ খুশি,
তুই কি আমার পুষি?
রাখব তোকে বুকে,
চোখের তারায়, মুখে।
আমার কাছে এলে
রৌদ্রে দেব মেলে।
রাত্রে তোকে পেলে
জ্যোৎস্না দেব ঢেলে।
দুপুর হলে খাঁ খাঁ,
করব তোকে পাখা।
শীতে হলে কাবু
বানিয়ে দেব তাঁবু।

দত্যিদানোর হাঁকে,
হুতুম পেঁচার ডাকে
ডাইনি বুড়ির শাপে
বুক যদি তোর কাঁপে,
ধরব তোকে বুকে,
থাকবি শান্ত সুখে।

বল তো তোকে খুশি
কেমন করে পুষি?

খোকন যা যা করে

মাছের মতো তাকায় খোকন
পাখির মতো ওড়ে,
বাঁশির সুরে বলে কথা
ঘরে, গলির মোড়ে।

মেঘের পাড়ায় বেড়ায় ভেসে
পঙ্খিরাজের পিঠে,
কখনো ফের বসে থাকে
ক্ষীর নদীটার সিটে।

পদ্মপাতায় খায় সে খাবার
দিনে এবং রাতে;
জ্যোৎস্নারাতে এক্কাদোক্কা
খেলে পরীর সাথে।

শালিকটাকে কনে সাজায়
হবে মজার বিয়ে,
বুড়ো শেয়াল জলদি আসে
টোপর মাথায় দিয়ে।

সাত হরিণের আটাশ খুরে
জ্বলে হাজার হীরে,
খোকন সে-সব কুড়িয়ে ছড়ায়
জোনাকিদের ভিড়ে।

কত্ত চিঠি পাঠায় খোকন
হালকা মেঘের খামে,
রৌদ্র ছায়ায় ছড়া লেখে
বাংলাদেশের নামে।

খোকার খাতা

খোকার আছে মজার খাতা,
বাহা, বাহা, বাহারে।
সেই খাতাটা উঠতে পারে
মস্ত উঁচু পাহাড়ে।

খোকার খাতা পাখির মতো
উড়তে পারে আকাশে,
গোলাপ ফুলের তোড়া হয়ে
ভাসতে পারে বাতাসে।

সেই খাতাটা যেতে পারে
নীল সাগরের কিনারে,
এক নিমেষে পারে যেতে
হালকা মেঘের মিনারে।
খোকার খাতায় পরী ঘুমায়,
রৌদ্র পোহায় পৃথিবী।
বলছে খাতা, ‘কনক চাঁপা,
বল তো আমায় কী দিবি?’

 গাছের জন্য

গাছ কেটো না, গাছ মেরো না,
গাছ আমাদের ভাই।
মন দিয়ে আজ শোনো সবাই
বলতে যেটুকু চাই-
গাছের মতো এমন ভালো
বন্ধু বেশি নাই।
দেয় সে ছায়া, তারই জন্যে
শুদ্ধ হাওয়া পাই।

গাছের ডালে নানা রঙের
ফুলের বাহার দেখি,
গাছে তাজা ফলের মেলা,
নয়তো কিছুই মেকি।

গাছ লাগাতে মাটি খোঁড়ো
বাসার আশেপাশে,
চোখে-মুখে আরাম পাবে
গাছের পাতায়, ঘাসে।

গাছ লাগাতে, গাছ বাঁচাতে
চলো আমরা যাই,
গাছ চুরিতে ব্যস্ত যারা,
তাদের মুখে ছাই।

 ছড়া পালানোর পর

ছড়া কোথায়? ছড়া কোথায়?
কই পালাল ছড়া?
পাই না খুঁজে কই মিলাল
ছড়ার হাতের নড়া?
অষ্টপ্রহর ছড়ার পিছে
মিছেই ঘুরে মরা।

গাছের পাতায়, চপল রোদে
বাজত ছড়ার মল।
যখন-তখন জোছনা-রাতে
নামত ছড়ার ঢল।
গলির মোড়ে কলের জলে
বাজত ছড়ার গলা,
ফুটপাতটায় দেখত লোকে
ছড়ার জোনাক-জ্বলা!

আজকে ছড়ার শুকনো নদী
তাই পড়েছে চরা।
ছড়া কোথায়? ছড়া কোথায়?
কই পালাল ছড়া?

সবাই মিলে ষাঁড়ের মতো
করল এমন তাড়া,
প্রাণ বাঁচাতে ছাড়ল ছড়া
ছন্দমিলের পাড়া।

পাঁচজনে আজ ভাবুক বসে
দোষটা হলো কার?
এদিকে ভাই হঠাৎ দেখি
ছড়া পগারপার।

জাদুর বাসা

যাযাবরের মজার যাওয়া,
কী-যে মজার আসা,
যখন খুশি যেখানে তার
বানায় জাদুর বাসা।

তালে তালে

খট্‌ খটা খট্‌ ঘোড়া ছোটে
তেপান্তরের মাঠে,
হন্‌ হনা হন্‌ পালকি চলে
পাড়াতলির ঘাটে।
টপ্‌ টপা টপ্‌ শিশির ঝরে
টিনের ঘরের চালে,
হুম্‌ হুমা হুম্‌ ভুতুম ডাকে
রাত-জমানো ডালে।

মট্‌ মটা মট্‌ লাকড়ি ভাঙে
রাকামণি ভোরে,
ঘট্‌ ঘটা ঘট্‌ রেলগাড়িটা
চলছে বড় জোরে।

ঝম্‌ ঝমা ঝম্‌ বৃষ্টি পড়ে
খেলাঘরের ছাদে,
থম্‌ থমা থম্‌ আকাশ শুধু
ঘ্যানঘ্যানিয়ে কাঁদে।

দম্‌ দমা দম্‌ ঢোলক বাজে,
বাজনা আরো আছে।
ঝন্‌ ঝনা ঝন্‌ ঘুঙুর পায়ে
রাকামণি নাচে।

তিনটি হরিণ

দুটি হরিণ তি
জুটল হ্রদের তীরে।
হরিণ দ্যাখে হ্রদের পানি
চন্দ্রহারের হীরে।

তেপান্তরে

পক্ষীরাজের সফেদ ডানা আধখানা,
হীরামনের হীরের টুকরো সাত ছানা
কয়েক আনায় কিনতে পারো তোমরা,
কিনতে পারো পাতালপুরী ভোমরা।
কঙ্কাবতীর চোখের আলো সাচ্চা,
কিনতে পারো ওহে দু-তিন কাচ্চা।
তেপান্তরে মাঠের ধুধু নিশ্বাস
কিনতে পারো-করো আমায় বিশ্বাস।

দীপিতার খেলা

দাদা ভাইটা দুষ্টু ভারি
যতই ধরি বায়না,
আমার সাথে লুকোচুরি
খেলতে মোটেই চায় না।

পেট-মোটা সব কেতাব নিয়ে
পড়ছে বসে একা।
খেলার বেলায় একটুও তার
পাই না আমি দেখা।

সকল সময় বই পড়াটা
দেব বটে চুকিয়ে,
ফন্দি করে চশমাটা তার
রাখব দূরে লুকিয়ে।

তখন কী যে হবে মজা-
দাদাভাইয়ের হাতটা খালি।
দেখবে চোখে ধোঁয়া ধোঁয়া,
আমার হাতে বাজবে তালি।

আমার কাণ্ড বুঝে দাদু
বলবে, ‘এসো, পাজি,
চশমাটা দাও, তোমার সাথে
খেলতে আমি রাজি’।

ধুপ ধুপা ধুপ

(একটি বিদেশী ছড়া মনে পড়ে, তাই)

ধুপ ধুপা ধুপ ধাপ,
বাস রে সে কী লাফ।
ষাঁড়টা হঠাৎ জোরে
এক লাফেতে ওরে
পৌঁছে গেছে শেষে
চাঁদ মামার দেশে।

ধুপ ধুপা ধুপ ধাপ,
বাস রে সে কী লাফ।

পড়ল চাঁদে পা’টা,
খুর যেন তার ঝাঁটা।
ডাইনে-বামে ছুটল শুধু
এত্ত ধুলো উড়ল ধুধু।

ঝুপ ঝুপা ঝুপ ঝাপ,
চাঁদের মাটি সাফ।

নয়না আয়

নয়না আয় ফুল কুড়ানি
শিউলিতলায় এসে,
সেখানে ওই ফুলের গন্ধ
হাওয়ায় বেড়ায় ভেসে।
নয়না আয় নদীর পাড়ে
দেখবি নৌকো কত;
নদীর বুকে জ্বলছে রোদে
হীরে শত শত।

নয়না আয় সন্ধেবেলা
সবুজ ঝোপের কাছে,
সেখানে শোন পাতায় পাতায়
জোনাক পোকা আছে।

নয়না আয় চল না যাবি
পাড়াতলি গাঁয়,
সেখানে রোজ হরেক রকম
পাখিরা গান গায়।

নয়না তুই সোনার খাটে
চুপটি করে ঘুমো,
রাতের বেলা পরীর রানি
তোকে দেবে চুমো।

নয়না তার বোনকে বলে

নয়না তার বোনকে বলে, শোন দীপিতা,
দিচ্ছি তোকে বলে
আমার ছড়ায় কান না দিলে চিমটি খাবি,
কানটা দেব মলে।

ঐ যে দূরে নীল আকাশে উড়ছে নানা
মেঘ-পরীদের শাড়ি,
সেখানটাতে আছেরে শোন চোখ-জুড়ানো
চন্দ্রমামার বাড়ি।

চন্দ্রমামার নাম শুনিস নি হদ্দ বোকা,
চাঁদমামা তো তিনি।
তার বাগানে তারাগুলি বাজনা বাজায়
মধুর রিনিঝিনি।

পণ করেছি, রাতের বেলা উড়ে আমি
যাব চাঁদের বাড়ি।
আজব কত মণ্ডা, মিঠাই পাব খেতে
পাব মধুর হাঁড়ি।

যাবি কি তুই আমার সাথে গভীর রাতে
অত্ত দূরে উড়ে?
চাঁদমামা না খুবই ভালো, কত্ত মজার
গল্প দেবেন জুড়ে।

তুই তো আবার জানি বেজায় ঘুমকাতুরে,
ঘুম আসে তোর সাঁঝে।
তোকে নিয়ে গভীর রাতে দূর আকাশে
আমার যাওয়া সাজে?
শোন দীপিতা, বোনটি আমার রাগ করিস নে,
চাঁদের বাড়ি যাব।
তারার নূপুর, মেঘের পরী, দুধের নদী
দেখতে ঠিকই পাব।

পক্ষীরাজ

বইটা ফেলে খুকুমণি
মায়ের কাছে বায়না ধরে;
পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে
একলা যাবে তেপান্তরে।
হট্রমালার হাট পেরিয়ে
যাবে বটে অনেক দূরে।
মেঘের সাথে চলবে উড়ে,
পড়বে ছায়া সমুদ্দুরে।

কড়ির পাহাড়, পাষাণপুরী
পেছনে রইবে পড়ে,
পক্ষীরাজের সওয়ার হয়ে
খোকন যাবে তেপান্তরে।

দৈত্যদানোর নিশ্বাস লেগে
কত কিছুই গেছে উড়ে,
পক্ষীরাজের ডানাজোড়া
এক নিমেষে গেছে পুড়ে।

ঘোড়ার পা’টা আজকে কোথায়
আটকে গেছে কোন সে চরে?
তাই বলো না কেমন করে
খোকন যাবে তেপান্তরে?

বইটা খুলে খুকুমণি
ভাবছে কী যে অতশত।
নতুন কিছু খুঁজছে যেন
নয়া কলম্বাসের মতো।

ফুটফুটে ফুল

ফুটফুটে ঐ ফুল ফুটেছে
খুকির ফ্রকে কত্ত।
ফুরফুরিয়ে ফড়িঙ বলে-
সত্য এটা সত্য।

 বরষা আসে

আষাঢ় মাসে বরষা আসে,
মুষলধারে বৃষ্টি।
মোষের গায়ের রঙের মতো
মেঘ হতেছে সৃষ্টি।

বর্ষা এলে

বর্ষা এলে বিষ্টি বটে
বুটির মতো পড়ে,
কখনো বা বিষ্টিধারা
বর্শা হয়ে ঝরে।

বাঁচতে দাও

পাখা নেড়ে নেড়ে প্রজাপতি বলে-
মেরো না আমাকে, মেরো না।
আমাকে তোমরা বাঁচতে দাও।
গাছের পাতার রাঙা পোকা বলে-
মেরো না আমাকে, মেরো না।
আমাকে তোমরা বাঁচতে দাও।

নীল আকাশের পায়রাটা বলে-
মেরো না আমাকে, মেরো না।
আমাকে তোমরা বাঁচতে দাও।
ঘরে ঢুকে-পড়া চড়ুইটা বলে-
মেরো না আমাকে, মেরো না।
আমাকে তোমরা বাঁচতে দাও।

শাদা চাদরের পিঁপড়েটা বলে-
মেরো না আমাকে, মেরো না।
আমাকে তোমরা বাঁচতে দাও।
দেয়ালে-বেড়ানো টিকটিকি বলে-
মেরো না আমাকে, মেরো না।
আমাকে তোমরা বাঁচতে দাও।

ক্ষুধায় কাতর মানুষটা বলে-
মেরো না আমাকে, মেরো না।
আমাকে তোমরা বাঁচতে দাও।
খুনীকে লোকটা ভয় পেয়ে বলে-
মেরো না আমাকে, মেরো না।
আমাকে তোমরা বাঁচতে দাও।

বেলুন বৃত্তান্ত

এক যে ছিল ছোট্র গলি,
সেই গলিটার গল্প বলি।
গলির ভেতর মানুষ থাকে,
মাঝে-মাঝে কোকিল ডাকে,
গলির মোড়ে সেলুন।

গলির ভেতর রোজ বিকেলে
রোদ কিছুটা ঝিমিয়ে এলে
মাথায় রঙিন ফেটি বেঁধে
যেন সে এক মজার বেদে-
বলত-‘এ নিন বেলুন’।

নানা রঙের বেলুনগুলো
গ্যাসের দমে ফুলোফুলো
দু-চারটা চাইলে পরে
বলত হেসে মিষ্টি স্বরে-
‘আগে কড়ি ফেলুন’।

দু-চার কদম হেঁটে গিয়ে
পকেট থেকে পয়সা দিয়ে
বেলুন কিনি অবশেষে;
বেলুনঅলা বলল হেসে,
‘বেলুন নিয়ে খেলুন’।

কিন্তু এ কী বেলুন হাওয়া
আবার ফিরে যায় কি চাওয়া?
বেলুনঅলা গলির মোড়ে
বলে, চক্ষু বন্ধ করে
এবার চোখটা মেলুন।

ওমা এ যে রাস্তা জোড়া
ডানাঅলা নানান ঘোড়া
ওদের পিঠে স্বপ্ন এসে
বসে রঙিন নানা বেশে
বলে, ‘বামে হেলুন’।

বেলুনঅলা এক নিমিষে
অনেক দূরের মেঘে মেশে,
স্বপ্নগুলো ক্রমাগত
খেলা করে শিশুর মতো।
স্বপ্নগুলোই বেলুন?

ভূতের ভয়ে

ভরদুপুরে ফাঁকা ভিটায়
ভুতুম ডাকে নাকি?
ভূতের ভয়ে ভড়কে গেল
ভারিক্কি এক পাখি।

 মিলমিল খেলা

মিলের খেলা খেলবে বলে
খুলল খোকন খাতা।
খাতায় খাতায় মিল-ধরা ঐ
জাল রয়েছে পাতা।

মিল আসে না, দেয় না ধরা,
ঢুলছে খোকন বসে।
ঘুমের মাঠে মিলটা এলে
ধরবে তখন কষে।

মিল বুঝি দূর বনের হরিণ,
দৌড়ে পালায় শুধু।
মিল ছাড়া এই খাতার পাতা
করছে বেজায় ধুধু।

এই এসেছে, এই তো এল
মেঘপাহাড়ি মিল।
খোকন সোনা দিল হঠাৎ
খাতার দোরে খিল।

মেঘে মেঘে

দিনের বেলা মেঘে মেঘে
দেখি আমি কী?
দেখি কত মুখের মেলা,
দূরের পাখিটি।

মেঘে থাকে রোদের ছেলে,
বিষ্টি মেঘের ঝি।
মেঘ তো রাতে হাজার তারার,
চাঁদের পড়োশি।

মেঘের কোলে রামধনুকের
সাঁকো পেয়েছি।
সেই সাঁকোতে বসে সাধের
নাড়ু খেয়েছি।

মেঘের দিকে চেয়ে থেকে
অনেক শিখেছি,
মেঘের দেয়া বিষ্টি নিয়ে
ছড়া লিখেছি।
মেঘে মেঘে যেমন খুশি
ছবি এঁকেছি,
সত্যি আমি মেঘের বুকে
পরী দেখেছি।

মেঘের ডু্লি

মাঝরাতে ঐ মেঘের ডুলি
হাওয়ায় নড়েচড়ে
পরীর মতো মেয়ে নামে
ময়নামতীর চরে।

মৌমাছিদের পাড়া

মধু নিয়ে মাতামাতি
মৌমাছিদের পাড়ায়,
মাতাল হয় ভালুক ভায়া
মৌচাকে হাত বাড়ায়।

রাতদুপুরে

রাতদুপুরে রাঙা চাঁদের
রাংতামোড়া হাসি,
রাস্তাঘাটে রাতের পুলিশ
বাজায় জোরে বাঁশি।

লঙ্কা খেলে

লালচে লালচে লঙ্কা খেলে
গালটি যাবে পুড়ে।
লাল টুকটুক ডালিম খেও,
দুলবে মিষ্টি সুরে।

শাপলা-শালুক

শান্ত দিঘির শাপলা-শালুক
শান্তি আনে মনে,
শালপাতাটি শোলক শোনায়
নিঝুম শালের বনে।

শেবার দ্বীপ

শেবামণি ভাবছে বসে
কোথায় সে দ্বীপ বিরানা?
কোন ঠিকানায় লিখলে চিঠি
পাবে দ্বীপের ঠিকানা?

হলদে পাখি বলল ওকে-
সত্যি বলি, মিছা না;
সাত সমুদ্র তের নদীর
মাঝে দ্বীপের নিশানা।
হঠাৎ শেবা পেয়ে গেল
পাখির ঠোঁটে ঠিকানা,
বড় আপুর টিপের মতো
দ্বীপ যে চেনা বিছানা।

সন্ধ্যা হলে

সন্ধ্যা হলে সরোবরে
সারস আসে উড়ে।
সাতটি তারা সেতার বাজায়
সুনীল আকাশ জুড়ে।

সুর ফুটেছে

সুর ফুটেছে, সুর ফুটেছে
কোন সে পাখির গলায়,
বাবলা গাছের তলায়।

বাবলা-বনের টোপর ছুঁয়ে
তেপান্তরে একটু নুয়ে
সে সুর ঝরে ঝুরঝুরিয়ে
ক্ষীর নদীটির চরায়,
বুড়ো বটের গোড়ায়।

সে সুরেরই চিকন আলো
পাতায় পাতায় ঝলমলাল।
চম্পাবতীর নূপুর হয়ে
মন-জুড়োনো মধুর লয়ে

Exit mobile version