Site icon BnBoi.Com

সব ভুতুড়ে – ইশতিয়াক হাসান

সব ভুতুড়ে

সব ভুতুড়ে

 

ভূমিকা

হবিগঞ্জের দেবনগরে নানাবাড়িতে ঢোকার মুখেই পাশাপাশি দুটো গাছ-একটা তেঁতুল আর একটা বট। রাতের বেলা গাছগুলোর নীচ দিয়ে কখনও একা যাওয়ার সাহস হতো না। অনেকেই এখানে অপ্রাকৃত কিছুর উপস্থিতি টের পেয়েছেন। কেউ রহস্যময় ছায়ামূর্তি দেখেছেন, কেউ শুনেছেন চিৎকার। গ্রাম বা মফস্বল তো বটেই, খোদ ঢাকা শহরেও ভৌতিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন অনেকে। আমার নিজেরও সেগুনবাগিচার এক পুরানো বাড়িতে এমন এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ওই বাড়িরই একজনের সঙ্গেই বসে আছি তিন তলায়, হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়া নানান ধরনের শব্দ হতে লাগল পাশের কামরাগুলো থেকে। মনে হচ্ছে যেন কেউ জোরে জোরে জানালা, দরজা আটকাচ্ছে, খুলছে। অথচ আমরা দুজন ছাড়া ওখানে আর কেউ ছিল না। বাতাসও ছিল না একরত্তি।

পৃথিবীর এমন কোনো জায়গা সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে এ ধরনের ভৌতিক, অপ্রাকৃত ঘটনার মুখে পড়েননি মানুষ। অনেকে সেগুলোকে যুক্তি দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করেন, কেউ আবার মনে করেন স্বাভাবিকের বাইরে অন্য কোনো শক্তি এসব ঘটনার জন্য দায়ী। ভূত-প্রেত আছে, না নেই-এই তর্কে যাব না। তবে পৃথিবীতে যে ব্যাখ্যার অতীত অনেক ঘটনাই ঘটে তা অস্বীকার করতে পারবেন না ঘোর যুক্তিবাদীও। এই বইটিতে হাজির করেছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু ভৌতিক, অতিপ্রাকৃত ঘটনা এগুলোর কোনো কোনোটা রীতিমত শরীরের রোম খাড়া করে দেবে, কোনোটা আবার করবে বিস্মিত। এসব ঘটনার অনেকগুলোই এমন মানুষদের মুখ থেকে এসেছে যারা বানিয়ে গালগপ্পো করার লোক না।

আমাদের দেশে ভূত, হরর বা অতিপ্রাকৃত কাহিনি নিয়ে এখন প্রচুর বই লেখা হচ্ছে। বেশিরভাগই গল্প, উপন্যাস। অবশ্য দু’একজন নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়েও বই লিখেছেন। তবে আমার জানা মতে এক মলাটের মধ্যে এতগুলো সত্যি ঘটনা নিয়ে বই এই প্রথম। পাঠকদের সুবিধার জন্য বইটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছি। প্রচুর বিদেশি বই, ম্যাগাজিন ঘেঁটে তৈরি করা হয়েছে এই বই। সব কষ্ট সার্থক হবে যদি পাঠকদের এটা ভাল লাগে, আরও পরিষ্কারভাবে বললে তাঁদের শরীরে শিরশিরে একটা অনুভূতি এনে দিতে পারে। এ ধরনের প্রচুর সত্য কাহিনি আমাদের সংগ্রহে আছে। তবে সেগুলো আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নির্ভর করছে আপনারা কীভাবে বইটি নিচ্ছেন তার উপর। আর মোটামুটি যাচাই-বাছাই করে কাহিনিগুলো দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে এর অনেক কাহিনিই এক-দেড়শো বছর কিংবা তারও আগের। এত বছরে কিছুটা এদিক-সেদিক হতেই পারে। তা ছাড়া কোনও কোনও কাহিনিতে লোক-কাহিনির ছোঁয়া লাগা কিংবা একটু রং চড়াটা অস্বাভাবিক নয়।

শেষ করার আগে, নতুন ধরনের একটি বই লেখায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য শাহনূর ভাইকে ( কাজী শাহনূর হোসেন) ধন্যবাদ।

 

হানাবাড়ি

যত অপ্রাকৃত ঘটনার কথা শোনা যায় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্ভবত ভুতুড়ে বাড়ির কাহিনি। এমন অনেক বাড়ি থেকে শেষমেশ পাততাড়ি পর্যন্ত গুটাতে বাধ্য হয়েছে অনেক বাসিন্দা। ভুতুড়ে বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম কামিয়েছে সম্ভবত অ্যামিটিভিলের বাড়ি। অ্যামিটিভিলের আতংক’ নামে সেবা প্রকাশনী থেকে একটি বইও বের হয়েছে। ‘হানাবাড়ি’ শিরোনামে রইল তেমন কিছু বাড়িরই অভিজ্ঞতা।

১. জর্জিয়ার আতংক

জর্জিয়ার আতংক

সাভানাহ নদীর ধারের ওকভিলের বাড়িটায় থাকতেন ওয়ালসিংহাম নামের এক কৃষক। ওটা পড়েছে আমেরিকার জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে। ওয়ালসিংহাম মোটেই কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না। কাজেই শুরুতে বাড়িকে ঘিরে যেসব ছোটখাট ঘটনা ঘটতে লাগল, ওগুলোকে বদ প্রতিবেশিদের সাজানো নাটক বলে ধরে নিলেন। তবে যতই দিন গড়াতে লাগল অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। পরিবারের লোকেরা রাতে বিছানায় যেতে না যেতেই অত্যাচার বাড়ে। ঘরের দরজায় করাঘাত হয়, বেল বাজে আর বিনা কারণে চেয়ার উল্টে পড়তে থাকে। বাড়িতে একটা কুকুর আছে। বুদ্ধিমান ম্যাস্টিফ কুকুরটাকে সবাই ডাকে ডন সিজার নামে। এক দিন দেখা গেল হল ঘরে ঢোকার মুখের করিডোরে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড চেঁচাচ্ছে সে, রাগে শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেছে, আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দেয়ালের দিকে। তারপরই লাফ দিয়ে সামনে এগুল। কিন্তু ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার করে মাটিতে পড়ল ওটা। মনে হলো যেন নিষ্ঠুর এক জোড়া হাত তাকে ধরে আছাড় মেরেছে। পরীক্ষা করে দেখা গেল কুকুরটার ঘাড় ভেঙে গেছে।

এদিকে বাড়ির বিড়ালটার সঙ্গে যেন অশরীরীটার একটা চমৎকার বোঝাপড়া হয়ে গেছে। ঘর ঘর শব্দে আনন্দ প্রকাশ করে সদরদরজা দিয়ে ঢোকে সে, মনে হয় যেন কোনো আগন্তুককে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে, যে তার পিঠে আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তারপর দেখা যায় লাফিয়ে একটা চেয়ারে উঠে, আনন্দে তাতে শরীর ঘষছে।

যতই দিন গড়াতে লাগল রাতের বেলা ততই বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগল অশরীরীটা। ওটার যন্ত্রণায় ঘুমানো অসম্ভব হয়ে উঠল বাড়ির বাসিন্দাদের পক্ষে। চেঁচামেচি, গোঙানি, উৎকট হাসি, বীভৎস চিৎকার এমনই নানা শব্দে অস্থির হয়ে উঠলেন তারা। কখনো শব্দ আসে বাড়ির নীচ থেকে আবার কখনো শোনা যায় ছাদ থেকে। এক রাতে বাড়ির ছোট্ট মেয়ে এমেলিয়া টয়লেটে গিয়েছে। হঠাৎ মনে হলো আলতোভাবে একটা হাত রেখেছে কেউ তার কাঁধে। হাতটা মা কিংবা বড় বোনের মনে করে সামনে আয়নার দিকে তাকাল। কিন্তু সেখানে কারো প্রতিবিম্ব পড়ল না সে ছাড়া। কিন্তু চোখের কোন দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেল প্রশস্ত, পুরুষালি একটা হাত তার কাঁধের ওপর বিশ্রাম নিচ্ছে। মেয়েটির চিৎকারে বাড়ির বাকি সবাই ছুটে এল। কিন্তু তারা যখন এল হাতের কোনো চিহ্ন নেই।

আরেকদিন হালকা বৃষ্টির পর মি, ওয়ালসিংহাম বাগানে হাঁটছিলেন। হঠাৎ পাশেই কারো পায়ের ছাপ নজরে পড়ল। খালি পায়ের একজন লোকের পায়ের ছাপগুলো এভাবে এগিয়েছে, মনে হয় অদৃশ্য কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে।

স্বাভাবিকভাবেই ওয়ালসিংহামরা বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কথা-বার্তা বলছিলেন। তবে এর মধ্যে এক রাতের একটা ডিনার পার্টির মাঝখানে এমন একটা ঘটনা ঘটল, স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ হলো তাদের জন্য। চড়া একটা গোঙানির শব্দ শোনা গেল ওপর থেকে। তবে এসব এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, ওয়ালসিংহামরা কিংবা তাঁদের অতিথিরা কেউই একে গুরুত্ব দিলেন না। কিন্তু তারপরই একজনের নজর পড়ল টেবিলের সাদা চাদরটার ওপর রঙিন একটা বিন্দু বড় হচ্ছে আস্তে আস্তে। মনে হচ্ছে যেন ছাদ থেকে ফোটায় ফোঁটায় কোনো তরল পদার্থ টেবিলটার ওপর পড়ছে। তরলটা দেখতে রক্তের মত হওয়াতে আতংক নিয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে রইলেন সবাই। দু-তিনজন তোকসহ মি. ওয়ালসিংহাম ওপরের তলার কামরাটার দিকে উঠে গেলেন, বীভৎস এই তরল পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে। কামরাটায় ঢুকে যেখান থেকে তরল পড়ছে মনে হচ্ছে সেখানকার কার্পেট সরিয়ে নীচের কাঠের মেঝে উন্মুক্ত করলেন। জায়গাটা একেবারেই শুকননা, পাতলা ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে। কিন্তু নীচের টেবিলে রক্তের মত তরলটা ঝরে যাচ্ছে আগের মতই। একসময় টেবিলের ওপর গোলাকার একটা প্লেটের আকার নিল লাল পদার্থটা। তারপর বন্ধ হয়ে গেল, তরল পড়া। পরের দিন রসায়নবিদরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন রঙিন তরলটা মানুষের রক্তই ছিল।

এরপর আর এই বাড়িতে থাকার মত অবস্থা থাকল না ওয়ালসিংহামদের। দেরি না করে পাততাড়ি গুটালেন তাঁরা। এরপর রীতিমত বিখ্যাত তথা কুখ্যাত হয়ে গেল বাড়িটা। নানা জায়গা থেকে লোকজন, আসতে লাগল ওটাকে দেখতে। তবে কেউই ওটাতে উঠতে রাজি হলো না। প্রথম যিনি এখানে রাত কাটানোর সাহস দেখালেন তিনি সাভানাহর হোরেস গান। বন্ধুরা বাজি ধরে, এই বাড়িতে তিন-চার ঘণ্টা থাকতে পারবেন না তিনি কোনোমতেই। আর তাদের শিক্ষা দিতে গিয়েই নিজের বিপদ ডেকে আনলেন ভদ্রলোক।

পরদিন অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হলো গানকে। বেশ কষ্ট করে জ্ঞান ফিরানো হল তার। কিন্তু স্বাভাবিক হলেন না তিনি। বিছানায় পড়ে রইলেন। আর দুর্বল কণ্ঠে ঘোষণা করলন যদি আবার হাঁটা-চলা করার অবস্থায় ফেরেন তবে পৃথিবীর সব সম্পদ দিলেও ওই অভিশপ্ত বাড়িতে আর কোনো রাত কাটাতে রাজী নন।

ধীরে ধীরে তার অভিজ্ঞতাটা বলার মত সুস্থ হয়ে উঠলেন হোরেস গান।

আঁধার নামার পর একটা কামরায় বাতি ধরানোর জন্য আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু দেখলেন সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবারই শীতল একটা দমকা হাওয়া ম্যাচের কাঠি নিভিয়ে দিচ্ছে। এসময় একবার তার ইচ্ছা হলো বাজিটাজির গুষ্টি কিলিয়ে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে। কিন্তু তারপরই মাথায় এল এতে বন্ধুদের কী পরিমাণ ঠাট্টা-মস্করা সইতে হবে তাকে। আর এটা মনে পড়তেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।

কিছুটা সময় নিরুপদ্রবে কাটল। এমনকী একটু তন্দ্রাভাবও চলে এল তাঁর।এসময়ই হঠাৎ বাড়ির নীচ থেকে জোর একটা চিল্কারে সচকিত হয়ে উঠলেন। যন্ত্রণায় নাকি ক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকারটা করেছে কেউ বুঝতে পারলেন না। তারপরই সিঁড়ি বেয়ে কারো ওঠা-নামার, আর এক কামরা থেকে আরেক কামরায় ছুটে বেড়ানোর পদশব্দ পেলেন। মোটামুটি ঘণ্টাখানেক থাকল আওয়াজটা। তারপর যেমন শুরু হয়েছে তেমনি হঠাৎ থেমে গেল। সব কিছু এখন একেবারে শান্ত। হোরেস গ্রেনের শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। তারপরই তাঁর উল্টো পাশের দেয়ালে সাদা একটা বিন্দু দেখলেন। ওটা বড় আর উজ্জ্বল হতে হতে সাদা আগুনের একটা চাকতির আকার নিল। তারপরই আতংক নিয়ে আবিষ্কার করলেন আলোটা আসছে একজন মানুষের মাথা থেকে। কিন্তু মাথাটার নীচে কোনো শরীর নেই। একজন মানুষের মাথা সাধারণত যে উচ্চতায় থাকে এই উচ্চতায় দেয়াল ঘেঁষে ধীরে ধীরে চলেছে ওটা। বিকট মাথাটা একজন বুড়ো মানুষের মনে হলো, যদিও ওটা নারীর না পুরুষের তা বোঝা মুশকিল। লম্বা, ধূসর চুল জবজব করছে, গাঢ় রক্তে। কপালের গভীর,দগদগে একটা ঘা থেকে বের হচ্ছে ওগুলো। গালগুলো বসা। গোটা চেহারাটা যেন অবর্ণনীয় কষ্ট আর যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে মুখটা। চোখের মণি জোড়া যেন তাকিয়ে আছে মি. গানের দিকে। আতংকে বাক্যহীন হয়ে পড়েছেন তিনি, এমনকী চিৎকার করে কেঁদে উঠতেও পারছেন না। একসময় মাথাটা অদৃশ্য হলো, তবে শব্দ চলতে লাগল। মনে হচ্ছে যেন কয়েকজন লোক মিলে চিল্কার করছে আর এর চোটে বাড়িটা কাঁপতে শুরু করেছে। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে গোঙানি আর চিৎকার। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে কানে পীড়া দেওয়া ঝনঝন শব্দ। যেন ওপরতলা থেকে টিনের জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে নীচে।

আর সহ্য করা সম্ভব না। এবার পালাতে হবে, ভাবলেন গান। অপার্থিব জিনিসগুলোকে এড়ানোর আশায় আস্তে আস্তে দেয়ালের পাশ ধরে এগুতে লাগলেন। দরজার কাছে প্রায় পৌঁছে গেছেন এমন সময় কে যেন তাঁকে পায়ের গোড়ালি ধরে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল। তারপর বরফশীতল এক জোড়া হাত চেপে বসল তাঁর গলার ওপর। অদৃশ্য হামলাকারীর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মরণপণ লড়লেন গান। কিন্তু জোরে ওটার সঙ্গে পেরে উঠলেন না, উল্টো গলার ওপর চাপ বাড়ল।

পরদিন সকালে হোরেস গানকে যখন বন্ধুরা খুঁজে পেল তখন তার গলা কালো হয়ে আছে, সেখানে ধারাল নখের লম্বা লম্বা আঙুলের ছাপও ফুটে আছে।

জর্জিয়ার এই বাড়ি নিয়ে আরো নানান রকম ভীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে মানুষের। কেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে মি. ওয়ালসিংহাম পরে মনে করতে পেরেছিলেন যখন প্রথম বাড়িতে আবাস গাড়েন তখন কিছু হাড়গোড় খুঁজে পেয়েছিলেন। তবে ওগুলো জন্তু-জানোয়ারের হাড় মনে করে ফেলে দিয়েছিলেন আস্তাকুঁড়ে। কারো কারো ধারণা ওই হাড়গুলোর মালিকের আত্মাই এখন এই বাড়িটায় এত সব কাণ্ড ঘটাচ্ছে। তবে তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার লোকেরও অভাব হয়নি। আর তাই। জর্জিয়ার এই ভুতুড়ে বাড়ির রহস্যও ভেদ হয়নি।

২. শয়তানের বাড়ি

শয়তানের বাড়ি

সিংগাপুর শহরে রহস্যময় একটা বাড়ি আছে, যেটা অনেক সিংগাপুরিয়কেই দারুণ আকর্ষণ করে। তারা একে শয়তানের বাড়ি নামে পরিচয় করিয়ে দিতেই পছন্দ করে। পাহাড়ের চূড়ায় একটা বাংলো এটি। সরু একটা রাস্তা উঠে গেছে বাংলোটার দিকে। যতদূর জানা যায়, বাড়ির মালিক পরিবারের সবাইকে কুঠার দিয়ে খুন করে, পরে নিজে আত্মহত্যা করেছিলেন। তারপর থেকেই এটা পরিণত হয় হানাবাড়িতে। পাশেই ঘোড়ার একটা আস্তাবল। লোকে বলে বাড়ির মত আস্তাবলটাও অভিশপ্ত আর ভুতুড়ে। কখনো সিংগাপুর বেড়াতে গিয়ে যদি বাড়িটার কাছে যান তবে দেখবেন, রোমাঞ্চপ্রিয় সিংগাপুরিয়দের কেউ কেউ নুড়ি বিছানো পথ ধরে গাড়ি নিয়ে চলেছে ওটাকে এক নজর দেখার জন্য। তবে সাধারণত গাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে কিছুটা দূর থেকে বাড়িটা দেখে চলে আসে তারা। তবে সবাই তাদের মত বুদ্ধিমান নয়। এদের একজনেরই কাহিনি এটি।

এক রাতে দারুণ উত্তেজনাকর একটা পার্টি শেষে বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণী ঠিক করল শয়তানের বাড়িটাতে একটা চক্কর দেবে। নুড়ি বিছানো রাস্তা দিয়ে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি দাঁড় করাল তারা। তারপর গাড়ির হেডলাইট জ্বেলে, বাড়িটা দেখতে লাগল। একপর্যায়ে ভিতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না তা নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হলো তাদের মধ্যে। ক্রমেই চেঁচামেচিতে রূপ নিল তর্ক। শেষমেশ বাড়িটাতে ঢোকাই স্থির হলো।

হৈ হল্লা আর চিৎকার করতে করতে গাড়ির থেকে বের হয়ে এল তারা। তারপর দৃঢ় পায়ে এগুলো সদর দরজার দিকে। এসময় দলের মেয়েদের সাহস একটু একটু করে টলতে শুরু করল। গাড়িতে ফিরে যেতে চাইল তারা। তবে ওটাকেও যেন এখান থেকে অনেক দূরে মনে হলো।

আর তাদের ভয় পেতে দেখে ছেলেরা আরো দৃঢ়সংকল্প হয়ে উঠল। ছেলেদের একজন হঠাৎ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ল। তারপরই তার পিছনে দরজাটা আটকে গেল।

বেশ কিছুক্ষণের জন্য মৃত্যুনীরবতা নেমে এল। আকস্মিক এই ঘটনায় বাকি দুটো মেয়ে আর ছেলেটা কী করবে বুঝতে না পেরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

তারপরই চিৎকার শুনল।

কী করবে বুঝে উঠতে পারল না তারা। ও কি তাদের ভয় দেখাতে এমনটা করছে?

আবার চিৎকারটা শোনা গেল। এবার পরিষ্কার হয়ে গেল আতংকিত মানুষের টানা চিৎকার এটা।

দৌড়ে ভিতরে ঢুকল তারা। দরজাটা শুধু ভেজানো ছিল। তারপরই দেখল তাদের বন্ধুটি মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর শরীর মোচড়াচ্ছে, মনে হয় যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে তার। মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়ে এসেছে। তাদের দেখে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, সাহায্য করো। আমি তলিয়ে যাচ্ছি। দয়া করে আমাকে তোল! তলিয়ে যাচ্ছি।

দ্রুত তাকে তুলে গাড়িতে নিয়ে আসা হলো। আতংকে চেঁচামেচি শুরু করেছে সবাই। ভাগ্য ভাল তাদের একজনের এক পাদ্রীর খবর জানা ছিল।

পাদ্রীকে পাওয়া গেল। তিনি বন্ধুটিকে অশুভ প্রভাব মুক্ত করতে পারলেন। তবে পুরোপুরি না। কারণ এরপর থেকেই আচার-আচরণ কেমন যেন বদলে যায় তার।

কারো কারো ধারণা কোনো একটা দল কালো জাদুর চর্চা করে শয়তানের বাড়িতে। সপ্তাহের কোনো রাতে প্রার্থনা আর নানান খারাপ জিনিসের চর্চা হয় এখানে। তবে কাউকেই ওই বাড়িতে যেতে বাধা দেওয়া হয় না। এদের একজন জানিয়েছে একবার এমন কৌতূহলের বশে এর ভিতরে ঢুকে আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। ভিতরে পা দিয়েই নজরে পড়ে বাড়ির প্রধান হলে জ্বলন্ত মোমবাতির মাঝখানে আলখেল্লা পরা এক লোক বসে আছে। খুব সম্ভব সেই দলটির নেতা। আর দেখার সাহস হয়নি তার, দ্রুত বেরিয়ে আসে শয়তানের বাড়ি থেকে।

৩. রক্তাক্ত চড়

রক্তাক্ত চড়

এই অভিজ্ঞতাটি হয় ইংল্যাণ্ডের সম্রান্ত পরিবারের বিবাহিত এক নারীর। উনিশ শতকের শেষদিকে ঘটনা এটা। ঘটনাটি ঘটার বেশ কয়েক বছর পরে এটা বর্ণনা করেন তিনি। তবে জানান এটা এতটাই দাগ কেটেছে মনে যে এক বিন্দু মলিন হয়নি এর স্মৃতি। তার সবসময়ই মনে হয়েছে কেবল গত রাতেই এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটি হয়েছে। ভদ্রমহিলার ভীতিকর এই অভিজ্ঞতা শুনব আমরা তার মুখ থেকেই।

একবার আমার এক বান্ধবীর বাড়ি গেলাম বেড়াতে। পুরানো ধাচের একটা বাড়িতে থাকে তারা। আলো-বাতাস ঢুকতে পারে

এমন বিশাল সব হল আর করিডোর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর সবখানে। কী একটা অনুষ্ঠান ছিল। ইতিমধ্যে তাই অতিথিতে ভরে গেছে বাড়িটা। তাই আমার জন্য বরাদ্দ হলো এক তলার বিশাল একটা কামরা। লম্বা, টানা বারান্দার শেষে ওটা। কামরাটা বেশ আরামদায়ক। বিশাল আর উষ্ণ। তবে কেন যেন পরিবেশটা ভাল লাগল না। সত্যি কথা বলতে গোটা বাড়িটাই আমার মধ্যে ভয়ের একটা অনুভূতির জন্ম দিল। কী কারণে তা বলতে পারব না।

খুব তাড়াতাড়ি যেন শোবার সময় হয়ে গেল। বান্ধবী মোমবাতিসহ আমার যা যা দরকার সব ঠিকমত আছে দেখে শুভরাত্রি জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলায় উঠে গেল।

পোশাক কেবল অর্ধেক বদলেছি এমন সময় দেখলাম কামরার দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। যেন একটা হাত চুপিসারে সতর্কভাবে চাপ দিচ্ছে এতে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখের সামনে পুরোপুরি মেলে গেল দরজাটা, কিন্তু ওপাশে কেউ নেই। স্বস্তির একট নিঃশ্বাস ফেললাম। নিশ্চয়ই দমকা হাওয়া। হলওয়ে দিয়ে নেমে এসেছে। ভাবলাম আমি। ঘাবড়ে যাওয়ার জন্য মনে মনে নিজেকে আচ্ছাসে শাসন করলাম। আবার দরজা লাগিয়ে কাপড় ছাড়তে শুরু করলাম।

বেশিদূর এগুতে পারলাম না, তার আগেই আমাকে চমকে দিয়ে আবার খুলে গেল দরজাটা। আগেরবারের মতই ধীর ও শান্তভাবে। আবার দোর লাগিয়ে পোশাক ছাড়তে লাগলাম। এবার কাজটা শেষ করে রাত্রিবাসটা গায়ে চাপাতে পারলাম। আর এসময়ই আতংকিত হয়ে আবিষ্কার করলাম তৃতীয়বারের মত খুলতে শুরু করেছে দরজাটা। আগের মতই নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে। একসময় পুরোপুরি খুলে গেল। একটু একটু ভয় লাগলেও ঘটনাটা তদন্ত করে দেখা স্থির করলাম। মোমবাতিটা হাতে নিয়ে হল-এ বের হয়ে এলাম। তারপর সদর দরজার দিকে রওয়ানা হলাম। বড়জোর তিন কি চার কদম এগিয়েছি এমন সময় আমার হাতের মোমবাতিটা নিভে গেল। মনে হলো যেন হঠাৎ কোনখান থেকে একটা দমকা বাতাস ছুটে এসেছে ওটাকে নিভিয়ে দেওয়ার জন্যই। খুব একটা খুশি হতে পারলাম না। কারণ ম্যাচ রেখে এসেছি আমার কামরায়। কিন্তু রোখ চেপে গেছে আমার। অন্ধকারেই এটার একটা শেষ দেখার প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। কাজেই অন্ধকার পথ ধরে এগুতেই লাগলাম। বাম হাতে ধরা নেভা মোমবাতি, আর ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছি পাথরের দেয়ালের স্পর্শ পাওয়ার জন্য।

মোটামুটি অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছি এমন সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড হলো। মনে হলো যেন শীতল, ভেজা একটা কিছু আমার বাম গালে চড় কষেছে। হাত দিয়ে গাল স্পর্শ করতেই ভেজা ভেজা ঠেকল। একমুহূর্তের জন্য দোটানায় পড়লাম। তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম। একসময় সদর দরজার সামনে চলে এলাম। ওটা বন্ধ এবং তালা আটকানো। তারপর অন্ধকারে পুরো হলটা ঘুরে কিছু পেলাম না। ফিরে চললাম আমার কামরার দিকে। এখনো আগের মতই এক হাতে মোমবাতি, এবং আরেক হাত বাড়িয়ে দেয়ালের স্পর্শ পাচ্ছি। হলের মোটামুটি অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েছি এমন সময় আবার মুখে সেই শীতল, ভেজা হাতের চড় খেলাম। এবার চড়টা পড়ল ডান গালে। গাল স্পর্শ করতেই আগের মতই দেখলাম ওটা ভেজা।

আতংক পেয়ে বসল আমাকে। অন্ধকারে যত দ্রুত সম্ভব পা চালালাম নিজের কামরাটার দিকে। পৌঁছেই দরজা আটকে ওটার সামনে একটা চেয়ার রাখলাম বাড়তি নিরাপত্তা হিসাবে। এবার হাতড়ে হাতড়ে ম্যাচ বাক্সটা খুঁজে নিলাম। তারপর মোমবাতি জ্বেলে আয়নার দিকে তাকালাম, মুখের কী অবস্থা দেখার জন্য।

আয়নায় যা দেখলাম তা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। আমার দু-গালে রক্তের দুটো লম্বা রেখা। ভয়ে, আতংকে কিছুক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। পরের ঘটনা পরিষ্কার মনে নেই। শুধু আবছাভাবে মনে আছে আমার চারপাশ ঘিরে আছে উদ্বিগ্ন কিছু চেহারা আর ফিসফাস শব্দ। তারপরই জ্ঞান হারালাম।

এই রাতের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল আমার।

৪. অবাঞ্ছিত অতিথি

অবাঞ্ছিত অতিথি

এক সিংগাপুরিয় কিণ্ডারগার্টেন শিক্ষিকার জীবনের অভিজ্ঞতা শুনব এবার আমরা।

তোয়া পেয়োহর যে ফ্ল্যাটটাতে আমরা থাকতাম সেখানে বেশ কয়েকবার এক অশরীরীর সঙ্গে দেখা হয় আমার। গোড়ার দিকে ওটা রীতিমত আতঙ্কিত করে ফেলে আমাকে। তবে পরে অবশ্য আর ওটাকে খুব একটা কেয়ার করিনি।

প্রথম এর উপস্থিতি ফাঁস হয় আমার কাছে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি। মাঝারি আকারের একটা বাসায় থাকতাম আমরা। ভিতরের কামরা আর ডাইনিং রুমটার থেকে হল রুমটা আলাদা করা। আমার ছোটবোনেরও তখন ওলেভেল পরীক্ষার বেশি বাকি নেই। দুজনে ডাইনং রুমে পড়তাম। একদিনের ঘটনা। রাত প্রায় একটা পর্যন্ত পড়ালেখা আর গল্পগুজবে মশগুল থাকলাম আমরা। আমাদের ব্লকের সামনেই একটা সরু রাস্তা আর পিছনে একটা কার পার্কিং। কাজেই মাঝে মাঝে গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া রাতটা মোটামুটি সুনসানই বলা চলে।

পড়ালেখা শেষ করতে করতে দেখা গেল টেবিল মোটামুটি বই-পত্র আর অন্য সব জিনিসের পাহাড় জমে গেছে। সাধারণত আমার বোনই বেশি তৎপর। দেখা যায় আমাদের চারপাশে জমা হওয়া জিনিসগুলো ও-ই পরিষ্কার করছে। কিন্তু এই রাতে দুজনেই এতটা ক্লান্ত হয়ে পড়লাম যে বই-পত্র টেবিলের ওপর রেখেই, যে শোবার ঘরটায় থাকি সেটায় চলে গেলাম।

ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। মনে হলো হলরুমে একটা শব্দ শুনেছি। তবে ঘরের কেউ শব্দটা করেছে ভেবে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল ছয়টার দিকে বিছানা থেকে উঠলাম। শুরুতে কিছু টের পেলাম না। কিন্তু একটু পরেই আমার বোন বলল, ধন্যবাদ। যাক জীবনে অন্তত একবার আমার অপেক্ষায় না থেকে জিনিস-পত্তরগুলো গোছগাছ করে ফেলেছ তুমি।

সে কী বলছে বুঝতে পারলাম না। যখন তার কথার মানে জানতে চাইলাম তখন ডাইনিং রুমের খালি টেবিলটা দেখিয়ে দিল। একবার ভাবলাম প্রশংসাটা হজম করে ফেলব। তারপরই কৌতূহল জাগল। তাহলে কাজটা করল কে? পরে আব্দু-আম্মু ঘুম থেকে উঠলে জানতে চাইলাম তারা কেউ করেছে কিনা। তবে যা ভেবেছিলাম তাই, তারাও বইগুলো সরায়নি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম এর মাধ্যমে রহস্যময় ঘটনাগুলোর শুরু হলো কেবল।

কিছু দিন পরের কথা। এক রাতে আব্দু-আম্মু আর বোনসহ বাড়ি ফিরছি। এসময়ই ওপরে আমাদের ফ্ল্যাটের দিকে দৃষ্টি চলে গেল। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কালো, লম্বা একটা ছায়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। মাথার ওপরে হাত জোড়া, গ্রিল ধরে রেখেছে। বোনের দিকে তাকিয়ে বললাম সম্ভবত ভাইয়া বাসায় আছে, আমাদের দেখছে সে। কিন্তু আমার বোন ওপরে তাকিয়ে বলল, কই, আমি তো কিছুই দেখছি না।

কিন্তু আমি তাকিয়ে ঠিকই তাকে দেখতে পেলাম। এটা বলতেই আম্মু বলে উঠলেন, আজে-বাজে কথা বোলো না। আলো না জ্বেলে রান্না ঘরের জানালায় কেন তোমার ভাই দাঁড়িয়ে থাকবে?

যখন বাসায় পৌঁছলাম সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। প্রতিটি কামরা খুঁজে দেখলাম আমি আর আমার বোন, যদি ভাইয়া লুকিয়ে আমাদের সঙ্গে মজা করার চেষ্টা করে এই ভেবে। সে বাসায় ফিরল বেশ রাত করে। কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞেস করলে বলল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বের হয়েছিল। কয়েকদিন বাদে তার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ঠিকই বলেছে ও।

আরেকদিনের কথা। বাসায় আমি একা। ফ্ল্যাটের মাঝখানের ডিভাইডারের দেরাজ পরিষ্কার করতে লাগলাম। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই মনে হলো কে যেন আমাকে দেখছে। কী কারণে জানি না ওপরে তাকালাম। জায়গামতই তাকিয়েছি। কারণ মুহূর্তের জন্য ওটাকে দেখলাম। ডিভাইডারটার ওপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে একটা গাঢ় ছায়া।

চেঁচিয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে শোবার ঘরের দরজা দিয়ে ছুটে অদৃশ্য হলো ওটা, যেন আমাকে ভয় পেয়েছে। এখানে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে পাশের বাসায় চলে এলাম। ফিরলাম বাড়ির অন্যরা আসার পর। ঘটনাটি খুলে বলতেই আমাকে নিয়ে রীতিমত হাসাহাসি শুরু করল তারা। বলল সবই নাকি আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা।

তবে তাদের ধারণা পাল্টাল যখন আমার খালাতো বোন মালয়েশিয়ায় থাকা তার এক বান্ধবীকে নিয়ে আমাদের বাসায় এল। তার বান্ধবীটি একজন সাইকিক। আর এসেই বললেন এই বাড়িতে একটা অশরীরী আছে। অথচ তাকে আমার অভিজ্ঞতাগুলো বলিনি আমরা কেউই।

বললেন এখন ওটাকে দেখেছেন তিনি। হল রুমের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য আমাদের চোখে কিছুই নজরে এল না। তারপর জানতে চাইলেন আমরা এমন কোনো নারীকে চিনতাম কিনা, যিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় সবসময় সাদা কাপড় পরতেন।

শুরুতে ভাবলাম আব্দুর ফুপুর কথা বলছেন। যখন আব্দুর বয়স কম ছিল তখন তিনিই তাঁর দেখাশুনা করতেন। কিন্তু তখনই জানা গেল বাবার ফুপু কখনোই সবসময় সাদা কাপড় পরতেন না। কাজেই রহস্যময় অশরীরীর পরিচয় বের করা গেল না। খালাতো বোনের বান্ধবীটি জানালেন আত্মাটা হল ঘরের অপর কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে সে সামনে আসতে নারাজ। পাছে আবার তিনি ওটাকে চলে যেতে বলেন। তবে এটাও বললেন আত্মাটা খারাপ স্বভাবের না। আর ওটা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু কে চায় বাড়িতে একটা আত্মা পুষতে, তা সে ভাল হোক, কি মন্দ?

তবে এটা ঠিক যতদিন ওই বাড়িতে ছিলাম সে আসলেই তেমন কোনো ঝামেলা করেনি। আমি ওটাকে দেখেছি সবচেয়ে বেশি। তবে ধীরে ধীরে বাড়ির অন্য সদস্যরাও অশরীরীটার অস্তিত্ব টের পেতে শুরু করল। কারণ তাকে নিয়ে তাদেরও কিছু অভিজ্ঞতা হয়।

এক রাতে কিচেনের দিকে মুখ করে পড়ছিল আমার বোন।

বাড়ির বাকিরা তখন ঘুমিয়ে কাদা। এসময় শুনল কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। শুরুতে খুব চাপা গলায়। যদিও সে নিশ্চিত ডাকটা শুনেছে, তারপরও এই বলে নিজেকে বোঝাল, এটা নিশ্চয়ই তার কল্পনা। আবার পড়ায় মন দিল সে।

তারপর আবার শুনল। এবার চড়া গলার, কর্কশ একটা কণ্ঠ। ঠিক পিছনেই ওটা। আর তার নাম ধরে ডাকছে। পিছনে না

তাকিয়ে এক ছুটে বেড রুমে চলে এল আমার বোন। রাতে ঘুমাল সে মাথার ওপর বেডশিট চাপিয়ে।

আব্দু-আম্মুও একসময় ওটার উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হলেন। মাঝে মাঝে রাতে হল ঘর থেকে আওয়াজ আসলেও এটাকে তেমন পাত্তা দেননি তাঁরা। কিন্তু এক রাতে এমন পরিষ্কার শব্দ শোনা গেল যে সন্দেহ রইল না সেখানে কেউ আছে।

সে রাতে শোবার ঘরেই রইলেন তাঁরা। ওটা কী দেখতে বের হলেন না। কারণ আমরা সবাই গিয়েছিলাম আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায়। তার মানে বাড়িতে তারা ছাড়া আর কেউ থাকার কথা নয়। আর তাই অযথা হল ঘরে গিয়ে অশরীরীর মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি নেননি।

আমি সাইকিক নই। কিংবা আমার এ ধরনের কোনো ক্ষমতাও নেই। আর ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর এ ধরনের কিছু ঘটেছে কমই। তারপরও এখন যদি বলি অস্বাভাবিক কিছু টের পেয়েছি কংবা অদ্ভুত কোনো কাহিনি শুনেছি, আব্দু-আম্মু তা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।

৫. অশরীরীর আতংক

অশরীরীর আতংক

১৮৯১ সালের বসন্তে ফ্রান্সের লি পোর্টের এক বাড়িতে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় এক অশরীরী। খনি এলাকার কাছেই বাড়িটার অবস্থান। অনেক সময় এই এলাকাটায় হাজার দুয়েক লোকেরও সমাগম হয়। তবে প্রেতাত্মাটা নানান কাণ্ড-কীর্তি করে বেড়ালেও ওটাকে দেখেছে এমন দাবি করেননি কেউ। বাড়ির বাসিন্দাদের এভাবে পিটিয়েছে ওটা যে চেহারায় কালশিটে পড়ে গিয়েছিল কারো কারো। পুলিশকেও বিষয়টি জানানো হয়। ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এমন অনেকের মুখ থেকে ঘটনাটা শোনেন তাঁরা। আঁটঘাট বেঁধে রহস্যের সমাধানেও নামে। মানুষের হাত থাকতে পারে এমন সব ধরনের সম্ভাবনা যাচাইবাছাই আর অনুসন্ধান করেন। কিন্তু এর পিছনে রক্ত-মাংসের কোনো মানুষ জড়িত এটা বের করতে ব্যর্থ হন।

একটি ঘটনা বলা যাক। বাড়ির আলোকিত তিনটি কামরায় তেরোজন লোক বসে ছিলেন। এদের কয়েকজন বেশ কিছুটা সময় ধরে সময় কাটানোর জন্য তাস খেলছিলেন। তবে তাদের শান্তিতে থাকতে না দেওয়ার পণ করেছিল কিছু একটা। কারণ পুরো সময়টা জুড়ে বাড়ির নানা প্রান্ত থেকে অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসতে লাগল। একবার মনে হলো বাড়ির প্রধান সিঁড়ি পথ ধরে সেনাদের একটা দল হুড়মুড় করে নেমে আসছে। দেয়ালে ঝুলানো ছবিগুলো গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই ভয়ানকভাবে দুলতে শুরু করল। তারপর দেয়ালে প্রচণ্ড ধাক্কার শব্দ শোনা গেল। আবার মনে হলো বন্ধ দরজা আর জানালাগুলোর ওপর কিছু দিয়ে দুম দুম করে বাড়ি দিচ্ছে কেউ। শব্দটা অনেকটা কাপড়ে পেঁচিয়ে বিশালাকার কোনো হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে যেমন মনে হবে তেমন।

দু-বার একতলার একটা কামরা কালিগোলা অন্ধকারে ডুবে গেল, অথচ বাইরে সূর্য অবিরাম আলো ঢেলে যাচ্ছে। আরেকবার কয়েকজন মানুষ এখানে উপস্থিত হলেন আসলেই ভৌতিক কোনো ব্যাপার ঘটে নাকি পরীক্ষা করে দেখার জন্য। মাঝরাতের ঠিক আগে বাড়ির সব বাতি হঠাৎ নিভে গেল। সেই সঙ্গে চারপাশ থেকে শোনা যেতে লাগল চিল্কার আর বিকট হাসি। বিশেষ করে খালি কামরাগুলো থেকে আওয়াজ এল সবচেয়ে বেশি। যারা তখন বাড়িতে উপস্থিত থাকলেন তাঁর অদৃশ্য কারো হাতে বেদম মার খেলেন। শুধু তা-ই না, সিঁড়ি থেকে কালির বিশাল একটা বোতল ছুঁড়ে মারা হলো।

এই অস্বাভাবিক ঘটনার উৎস আবিষ্কারের জন্য সব ধরনের চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। মাঝখানে কয়েক মাসের জন্য এই ধরনের অস্বাভাবিক কীর্তি-কলাপ বন্ধ ছিল। তারপর আবার শুরু হয়। এরপর থেকে বিরতি দিয়ে চলতেই থাকে। কি একবার ঢুঁ মেরে আসবেন নাকি ফ্রান্সের এই ভুতুড়ে বাড়িতে?

৬. টু লেট

টু লেট

বেশ অদ্ভুত এই বাড়িটার কাহিনি শুনিয়েছেন আয়ারল্যাণ্ডের মি. ই, বি. লেসি। বালক বয়সে তিনি থাকতেন শহরতলীতে। প্রতিদিন সকালে ডাবলিন শহরের স্কুলে আসতে হত তাকে। এসময় এমন একটা রাস্তা দিয়ে আসতে হত যেখানে নিঃসঙ্গ একটা বাড়ি পড়ে। ওটা খালি পড়ে থাকত অনেক সময়ই। কোনো ভাড়াটে আসার পর কয়েক মাস পরেই দেখা যেত বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা। তারপর বাড়ি ভাড়ার নোটিশ ঝুলত। এভাবে কয়েক মাস খালি থাকার পর হয়তো নতুন ভাড়াটে আসত। তবে কাউকেই পাকাপাকিভাবে খুব বেশিদিন থাকতে দেখেননি এখানে। আট-ন বছর এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটল। মাঝে মাঝেই তার মনে প্রশ্ন জাগত বাড়িটাতে ভাড়াটে থাকে না কেন? একদিন এক বন্ধুকে প্রশ্নটা করতে সে জানাল এটা হানাবাড়ি হিসাবে বদনাম কামিয়েছে।

কয়েক বছর পরের কথা। একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন লেসি। এসময়ই একদিন এমন একজন মহিলার সঙ্গে ব্যবসায়িক কাজে দেখা করার প্রয়োজন পড়ল, যিনি ওই মুহূর্তে হানাবাড়িটাতে বসবাস করছেন। ব্যবসা নিয়ে আলাপের এক পর্যায়ে মহিলাটি জানালেন বাড়িটি ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। এমনিতেই এই বাড়িটা নিয়ে লেসির আগ্রহের শেষ নেই। কাজেই এমন একটা সুযোগ পায়ে ঠেলবেন তা কী করে হয়। ভদ্রমহিলাকে অনুরোধ করলেন এই বাড়িটার ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর যতটুকুন জানা আছে, বললে হেসির কৌতূহল মিটত। ভদ্রমহিলা খুশি মনেই বললেন। কাহিনির মূল রস অক্ষুন্ন রাখার জন্য মহিলাটির বর্ণনাই আমরা তুলে ধরছি পাঠকদের সামনে।

বছর চল্লিশেক আগে উইল করে এক ভদ্রলোককে দেওয়া হয় বাড়িটা। এখানে খুব বেশিদিন থাকতে পারেননি। কারণ তারপরই হঠাৎ পাগল হয়ে যান। একটা পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। তারপর ভদ্রলোকের এজেন্ট এক মহিলাকে ভাড়া দিলেন বাড়িটা। গোড়ার দিকে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটল না। কয়েক মাস পর এক সকালে রান্নাঘরের পিছনের কামরাটায় ঢুকে আবিষ্কার করলেন বাড়ির ছাদের হুকে একটা দড়িতে ঝুলছে রাঁধুনি। এর কিছুদিনের মধ্যে মহিলাটি বাড়ি ছেড়ে চলে যান।

তারপর কিছুদিন খালি পড়ে থাকে বাড়িটা। তারপর আবার টু লেট ঝুলানো হয়। আর একজন মহিলা তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয়। একরাতে, একটার মত বাজে তখন, একজন কনস্টেবল টহল দিচ্ছেন, এমন সময় বাড়ির ভিতর থেকে সাহায্য চেয়ে চিৎকার শুনলেন। তারপরই দেখলেন হানাবাড়ির নারী তত্ত্বাবধায়ক জানালার কড়িকাঠ যত শক্ত করে সম্ভব আঁকড়ে ধরে আছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ তাকে পিছন থেকে টানছে। কনস্টেবল মহিলাটিকে বললেন ভিতরে গিয়ে হলের দরজা খুলে তাঁকে ঢুকতে দিতে। কিন্তু মহিলাটি আবার কামরাটায় ঢুকতে অস্বীকৃতি জানাল। এবার কনস্টেবল বেশ শক্তি প্রয়োগ করে দরজা খুলে ফেলতে পারলেন। তারপর মহিলাটিকে টানতে টানতে হলরুমে নিয়ে এলেন। কিন্তু তখনই আবিষ্কার করলেন পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে তত্ত্বাবধায়ক।

আবার খালি হলো বাড়িটা। ঝুলল টু-লেট। এবার এক মহিলা ভাড়া নিলেন পাঁচ বছরের জন্য। কিন্তু কয়েক মাস থেকেই তালা লাগিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। বন্ধুরা কেন ওটা ছেড়ে দিলেন জানতে চাইলেন তাঁর কাছে। জবাবে ভদ্রমহিলা বললেন নিজে এখানে থাকা কিংবা অন্য কাউকে এখানে থাকতে দেওয়ার চেয়ে বরং এর পাঁচ বছরের ভাড়া পরিশোধ করতে রাজি আছেন তিনি। তবে কেন এই বাড়ি ছাড়লেন এ সম্পর্কে কিছুই বললেন না।

আমার মনে হয় এরপর এই বাড়িতে উঠি আমি। আঠারো মাস আগে তিন বছরের জন্য এটা লিজ নিই। ইচ্ছা ছিল ভাড়া দিয়ে কিছু রোজগার করব। কিন্তু এখন এই আশা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ কেউই এক-দু সপ্তাহর বেশি থাকে না। কেন বাড়িটা ছেড়ে যাচ্ছে এ সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো কারণ দেখায় না কেউই। তবে এটা বলেছেন, আমার দিক থেকে কোনো ধরনের ত্রুটি খুঁজে পাননি তারা। বরং কী কারণে যেন বাড়ির কামরাগুলো পছন্দ করতে পারছেন না। অথচ কমরাগুলো, আপনি চাইলে দেখতে পারেন, বড়সড় আর আলো-বাতাসপূর্ণ। আমি নিজেও ভূতে বিশ্বাস করি না। এখানে কিংবা অন্য কোথাও অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি আমি। তবে যদি জানতাম এর হানাবাড়ির দুর্ণাম আছে তবে কখনো এটা ভাড়া করতাম না।

৭. বেয়াড়া আত্মা

বেয়াড়া আত্মা

পনেরো বছরের ফিলিপ নিজের জন্য এক কাপ কফি এবং দাদি সারাহর জন্য এক কাপ চা বানিয়েছে। দুই হাতে কাপ দুটো নিয়ে দাদির কামরায় ঢুকল সে। আর ঢুকেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা ধূসর-সাদা ধোয়ার মেঘ যেন দাদিকে ঘিরে আছে। আজকের আবহাওয়াটা চমৎকার হলেও কামরার ভিতরে খুব শীত শীত লাগছে। বাইরে রোদ, তবে এই কামরাটা এত ঠাণ্ডা হলো কীভাবে, অবাক হয়ে ভাবল ফিলিপ। পায়ের শব্দ পেয়ে দাদি মুখ তুলে তাকিয়েছেন। অপার্থিব একটা মেঘ চারপাশ থেকে তাঁকে ঘিরে আছে দেখে থ হয়ে গেলেন সারাহও। চট করে উঠে দাঁড়ালেন, তবে ধোঁয়ার মেঘটা ঘিরেই থাকল।

এখানেই শেষ হলো না। বাড়ির সব কিছুর উপর সাদা গুঁড়োর একটা স্তর পুরু হয়ে পড়ে থাকতে দেখল তারা। এমনকী নিজের কফি এবং দাদির চায়ের ওপরও ওই একই গুঁড়ো আবিষ্কার করল ফিলিপ। তার ফুপু মেরি রান্না ঘরে ঢুকলেন আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করতে। কিন্তু এখানে মেঝের ওপর প্রচুর পানি জমে আছে। কিন্তু রান্না ঘরের কোনো কল খোলা নেই। এত পানি তবে এল কোথা থেকে, অবাক হয়ে ভাবলেন মেরি। এদিকে মেঝেতে আরো পানি আসছে। কিন্তু মেঝেটাতে কোনো গোলমাল নেই। আশপাশে কোনোখান থেকে পানি চুইয়েও পড়ছে না। পানির কাজ করা লোকেদের খবর দিয়ে আনা হলো। কিন্তু তারাও পানির উৎস খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়ে চলে গেল।

এই ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৬ সালের আগস্টের কোনো এক দিনে। ইংল্যাণ্ডের ইয়র্কশায়ারের পনটারাক্ট নামের এক গ্রামে। খুব পুরানো, ছোট্ট একটি গ্রাম এটি।

এদিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে আরো অদ্ভুত সব কাণ্ড-কীর্তি শুরু হল বাড়িতে। ফিলিপ আর তার দাদি টিভি দেখছে তখন। রান্না ঘরে চা পাতা আর চিনি ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল। তারা যখন অবাক হয়ে দৃশ্যটি দেখছে তখন আপনাআপনি চা পাতার বাক্স মেঝেতে পড়ে গেল। বাড়ির কোনোখান থেকে বিস্ফোরণের চড়া একটা শব্দ শোনা গেল। বিষয়টা কী তদন্ত করতে হলের দিকে দৌড়ে গেল ফিলিপ। সেখানে কাউকেই দেখতে পেল না। তবে আরেকটা আশ্চর্য বিষয় নজর কাড়ল তার। সিঁড়িতে রাখা মাটির টবটা খালি, আর এর গাছটা শূন্যে ভাসছে। সাড়ে নটার দিকে ফিলিপকে নিয়ে তার কামরায় ঢুকলেন দাদি। এখানকার জিনিসপত্র রাখার খোপ, কাপড় সব কিছু যেন মাতালের মত টলছে।

গ্রামের সবচেয়ে নামকরা ওঝা অলিভার ডোনাল্ডকে ডেকে আনা হলো রাত দুটোর দিকে। কিছুই নজরে পড়ল না তার। বললেন, যদি সত্যি কোনো ভূত বাড়িতে আস্তানা গেড়ে থাকে তবে এর কোনো না কোনো চিহ্ন থাকবে, যেমন কিছু ছবি আপনা আপনি ছিঁড়ে যেতে পারে। তার কথা শেষ হতে না হতেই প্রিচার্ড দম্পতির ছবি দেয়াল থেকে মাটিতে পড়ে গেল। ছবিটা ঠিক মাঝখান থেকে দু-ভাগ হয়ে গেল, মনে হয় যেন ধারাল কোনো ছুরি দিয়ে দু-টুকরো করে ফেলা হয়েছে।

মেয়ে ডায়নাসহ মি. ও মিসেস প্রিচার্ড যখন একটা বনভোজন থেকে বাড়িতে ফিরে এলেন তখন বাড়িতে এমন সব কাণ্ড-কীর্তি ঘটে গেছে বিশ্বাসই করতে চাইলেন না তারা। পরের দু-বছর কিছুই ঘটল না। সব কিছু চলল স্বাভাবিক নিয়মেই।

অচেনা এই ভূত বা আত্মা যখন আবার সরব হয়ে উঠল তখন ফিলিপের বয়স সতেরো, আর ডায়নার চোদ্দ। বছরটা বদলেছে, তবে মাসটা সেই আগের মতই আগস্ট।

শুরুতে ফিলিপ আর ডায়নার কামরার জিনিসপত্র মাটিতে পড়তে লাগল। পরের চোটটা গেল মাটির টবগুলোর ওপর দিয়ে। একটার পর একটা ভাঙতে লাগল ওগুলো। বাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র কোনো কারণ ছাড়াই লাফিয়ে ওপরে উঠে, তারপর নীচে পড়তে লাগল। ডায়নার কামরার জানালাটা আপনা আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ল। রুমে রাখা একটা বুরুশ উড়ে এসে মেয়েটির নাকে লাগল। তবে নাকে একটা দাগও পড়ল না। সবচেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপার হলো অশুভ আত্মাটা সমস্ত ঘটনা ঘটাতে লাগল যখন ডায়না বাড়িতে থাকে তখনই। ঘরের বাতিগুলো আপনা আপনি নিভে যায় মাঝে মাঝেই।

স্থানীয় গির্জার এক পাদ্রীকে ভূতটাকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হলো প্রিচার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে। ওই ভদ্রলোক, রেভারেণ্ড ডেভি যখন বাড়িটাতে এলেন এসব ঘটনাকে গাল-গপ্পো বলেই ধরে নিলেন। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসব ভুতুড়ে কাজ কারবারে বিশ্বাস না রেখে উপায় থাকল না। একপর্যায়ে পাদ্রী নিজেই ভয় পেয়ে গেলেন। কামরার কোনায় থাকা বাতির স্ট্যাণ্ডটা হঠাৎ বিনা কারণে লাফিয়ে উঠল। ভিতরের একটা কামরা থেকে ধপাস একটা শব্দ হলো। মনে হলো যেন ভারি কোনো টেবিল উল্টে পড়েছে। যখন কামরাটায় ঢুকল সবাই, দেখল কাপ, পিরিচ মেঝেতে পড়ে আছে। তবে একটাও ভাঙেনি।

বাড়িটাকে ভূতের কবল থেকে মুক্ত না করেই চলে যেতে বাধ্য হলেন রেভারেণ্ড ডেভি। এই ঘটনার পর আরো বেশি জ্বালাতন শুরু হলো। সম্ভবত পাদ্রী ডেভির ব্যর্থতা একে আরো উৎসাহী করে তুলেছে। এদিন রাতে ডায়না যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, কামরার বাতি নিভে গেল। সেলাইয়ের একটা মেশিন রাখা ছিল হলরুমে। স্ট্যাণ্ডসহ উড়ে এসে ডায়নার বুকের ওপর বসে গেল ওটা। অনেক চেষ্টা করেও নড়ানো গেল না। তবে ডায়না যন্ত্রটার কোনো ওজন অনুভব করছে না বুকে। কিছু সময় পর ওজনটা টের পেল সে, এবার যন্ত্রটাকে সরানো গেল।

অশুভ এসব কাণ্ড-কারখানা চলল টানা অনেকগুলো দিন। কখনো গোটা বাড়িটা অদ্ভুত একটা সুগন্ধে ভরে যায়, কখনো পাওয়া যায় বদ গন্ধ। প্লেট, পিরিচ চড়া শব্দে মাটিতে পড়ে। গোটা বাড়িতে শোনা যায় ড্রামের দ্রিম দ্রিম শব্দ, আশপাশের লোকেরাও আতঙ্কে তটস্থ হয়ে উঠল। বেশ কয়েকবার ডায়নাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো তার বিছানা থেকে।

১৯৬৮ সালে আশ্চর্য এই ঘটনার খবর এল সংবাদপত্রে। শুধু ইয়র্কশায়ার নয় ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকেরা গ্রামটিতে ছুটে আসতে লাগল, ভূতটার কাজ-কারবার দেখার জম্য। এমনকী তারা ওটার একটা নামও দিয়ে ফেলল, মি, নোবডি। আর প্রিচার্ডরা একে ডাকেন ফ্রেড নামে।

যতদূর বোঝা যায় বাড়ির সব কিছু উল্টে দেওয়া দারুণ পছন্দ মি. ফ্রেডের। জিনিসপত্র শূন্যে ভাসিয়ে ভারি মজা পায় সে। আর সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ডায়না। তাকে জ্বালাতন করতে পারলেই যেন খুশি হয় সবচেয়ে বেশি। তবে মন্দের ভাল, কখনো আঘাত করেনি ওটা ডায়নাকে।

আরেকবার প্রিচার্ডদের গোটা পরিবার একত্র হয়ে ভূতটার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল। এর জবাবে ফ্রেড ওপরের তলা থেকে সমানে জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারতে লাগল নীচে। মনে হলো যেন বৃষ্টির মত জিনিস পড়ছে ওপর থেকে।

আরেকটা ঘটনা ঘটল একজন অতিথির সামনে। ডায়নার ফুপু মউডি পিয়ার্স এসেছিলেন তাদের সঙ্গে থাকতে। তবে ভূত বা আত্মা-ফাত্মায় তার বিশ্বাস নেই। সময়টা শীতকাল, আর ঘরের সবাই একটা আগুনের চারপাশ ঘিরে বসে ছিল। হঠাৎ ঘরের বাতিগুলো নিভে গেল। আগুনের আলোতে সবাই দেখল ফ্রিজের দরজা খুলে গিয়ে দুধ ভর্তি একটা জগ শূন্যে ভেসে ভেসে আসছে। তারপর নিজে নিজে জগটা খালি হলো মিসেস মউডি পিয়ার্সেও মাথায়।

এর একটু পরেই মিসেস পিয়ার্সের হাতের দস্তানা জোড়া অদৃশ্য হলো। যখন ঘুমাতে গেলেন, কোনখান থেকে যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে হাঁজির হলো দস্তানাদুটো। স্তোত্র গাইতে শুরু করলেন মিসেস পিয়ারস। দস্তানাজোড়া এভাবে নড়তে শুরু করল, যেন কোনো অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করছে অদৃশ্য কেউ। কয়েকদিন বাদে যেটা ঘটল এমন ঘটনার নজির আর পাবেন কিনা সন্দেহ। এক সন্ধ্যায় প্রিচার্ডদের গোটা পরিবারটাই বারান্দায় বসে গল্পে-সল্পে মশগুল হয়ে আছেন। এমন সময় বন্ধ দরজা দিয়ে একটা ডিম এভাবে বেরিয়ে এল, যেন বা এখানে কোনো দরজার অস্তিত্বই নেই। শূন্যে কিছুক্ষণ ভেসে থাকার পর মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল ডিমটা। তবে ওটা থেকে এমন একটা গন্ধ বের হতে লাগল, মনে হলো জিনিসটা ডিম না সেন্টের বোতল। উঠে গিয়ে ফ্রিজের দরজা খুললেন মিসেস প্রিচার্ড। একটা ডিম খোয়া গেছে। ফ্রিজ থেকে সবগুলো ডিম বের করে একটা ঝুড়িতে রাখলেন তিনি। তারপর ঝুড়িটার ওপর বসে পড়লেন। তবে এতে কোনো কাজ হলো না। একটু পর আরেকটা ডিম উপস্থিত হলো বারান্দায় এবং মাটিতে পড়ে ভাঙল। আরো একটা ডিম নিখোঁজ হলো ঝুড়ি থেকে। একটার পর একটা ডিম শূণ্যে ভেসে এসে মাটিতে আছড়ে পড়তে লাগল। একসময় খালি হতে হতে ঝুড়িতে আর একটা ডিমও রইল না।

কাছের এক চার্চের পাদ্রী ফাদার হাড়সনের কাছ থেকে পবিত্র পানি আনাল প্রিচার্ডরা। তারপর পুরো বাড়িতে ছিটিয়ে দেওয়া হলো ওই পানি। ভূতটাকে বাড়ি ছাড়া করার জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হলো। কিন্তু এর ফলাফল হিসাবে ছাদ থেকে বৃষ্টির ফোটার মত পানি পড়তে লাগল নীচে। সম্ভবত ভূতটা এটা করে বাড়ির লোকেদের দেখিয়ে দিল পবত্র পানিকে ভয় পায় না সে।

এদিন আরো দুটো ঘটনা ঘটল। ডায়না চুল আঁচড়াচ্ছিল। টেবিল থেকে একটা ড্রয়ার বেরিয়ে এসে কামরার এক কোণের দিকে ছুটে গেল। হলে ঝুলানো ধাতব ক্রসটা উড়ে এসে ডায়নার কোমরে লেগে রইল। মনে হলো যেন ডায়নার কোমরটা একটা চুম্বক, যেটা ক্রসটাকে আকর্ষণ করেছে। ওটাকে ছাড়ানোর জোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো ডায়না। আতংকিত হয়ে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। তবে সে বের হওয়ার আগেই ক্রসটা মাটিতে পড়ে গেল। ক্রসটা কোমরের সঙ্গে আটকে থাকার চিহ্ন অনেক দিন পর্যন্ত থাকল তার শরীরে।

আগস্ট, ১৯৬৬ থেকে মে, ১৯৬৯ পর্যন্ত ভুতুড়ে এসব কাজকারবার হয় প্রিচার্ডদের বাড়িতে। এসময়টায় তাদের প্রতিবেশীরা বাড়িটাকে একটা আলো ঘিরে থাকতে দেখে। কিন্তু আলোটাকে মোটেই সাধারণ আলো মনে হয়নি। এসময়টায় আশপাশের বাড়িগুলোর থেকে বিদ্যুতের বিলও অনেক কম এসেছে তাদের।

আরেকদিনের ঘটনা। ডায়না কিচেনে কফি বানাচ্ছে। হঠাৎ বাতি নিভে গেল। মিসেস প্রিচার্ড একটা টর্চ আনতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এর পরপরই ডায়নার আতংকিত চিৎকার শুনলেন। দৌড়ে এসেই ভয়াবহ একটা দৃশ্য দেখলেন। সিঁড়িতে পড়ে আছে ডায়না। তার সোয়েটার এমনভাবে কেঁটে-ছিঁড়ে গেছে মনে হচ্ছে যেন শক্তিশালী কিছু একটা ওপরতলা থেকে টেনেহিচড়ে নীচে নামিয়েছে তাকে। বাড়ির সবাই দৌড়ে এল তার সাহায্যে। ডায়নার পাশেই সিঁড়িতে হুড়মুড় করে পড়লেন তারা। পরে মেয়েটার গলায় পাওয়া গেল রহস্যমৃয় আঙুলের চিহ্ন।

১৯৬৯-এর মে মাসের শেষ সপ্তাহে শেষবারের মত দেখা দিল, ভূতটা। কিচেনের মেঝেতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সময় একে পরিষ্কার দেখলেন বাড়ির লোকেরা। প্রতিবেশীরা বাড়ির সব জায়গায় রসুনের কোয়া ছড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিল প্রিচার্ডদের। তারা তাই করলেন। এরপর থেকে আর দেখা দেয়নি ভূতটা।

এই অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো নিয়ে অনেক তদন্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন গ্রামটার যেখানটায় এখন প্রিচার্ডদের বাড়ি ১০৯০-১৫৩৯ সাল পর্যন্ত এখানে একটা গির্জা ছিল। ওই গির্জার এক পাদ্রীকে রাজা অষ্টম হেনরির নির্দেশে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। আট বছরের এক বালিকাকে ধর্ষণ করার অপরাধে এই শাস্তি হয় পাদ্রীর। পাদ্রীকে ফাঁসিতে ঝুলানোও হয় এখন যেখানটতে প্রিচার্ডদের বাড়ি এর সীমানার মধ্যে।

তবে পনটারফ্রাক্ট গ্রামের এই ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তি নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তারা কোনোভাবেই হিসাব মিলাতে পারেননি, এত দিন বাদে ১৯৬৬ সালে কেন পাদ্রীর আত্মা হঠাৎ সরর হয়ে উঠল। আর একটা প্রশ্নেরও উত্তর মিলল না। সেটা হলো, ওটা পবিত্র পানিতে ভয় পেল না একটুও, অথচ রসুনের কোয়া ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা ছেড়ে দিল। কী এর কারণে কে জানে?

 

অশুভ রাস্তা

কোনো কোনো রাস্তা আছে যেখানে ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা অতি সাধারণ ব্যাপার। আবার কিছু রাস্তা আছে যেগুলো সে অর্থে কুখ্যাতি অর্জন না করলেও এখানে অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে মানুষকে। এমন কিছু রাস্তার গল্প নিয়ে ‘অশুভ রাস্তা’।

১. ভয়ঙ্কর দুই হাত

ভয়ঙ্কর দুই হাত

২৮ বছর বয়স্কা ফ্লোরেন্স ওয়ারওইক রাস্তার পাশে গাড়িটা দাঁড় করালেন। মনোযোগ দিয়ে এলাকার মানচিত্রটা দেখতে লাগলেন। আঁধার নেমে এসেছে। গাড়ির ভিতরের আলোতে একাগ্রচিত্তে মানচিত্রটার দিকে তাকিয়ে আছেন ভদ্রমহিলা। পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়িগুলোর হেডলাইট মাঝেমাঝে উজ্জ্বল আলো উপহার দিচ্ছে। হঠাৎই আবিষ্কার করলেন গাড়ির ভিতরটা ঠাণ্ডা বাতাসে ভরে গেছে। সময়টা মে,১৯৭৬। বছরের এ সময় আবহাওয়া হঠাৎ এমন শীতল হয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে পেলেন না ফ্লোরেন্স। এসময়ই মনে হলো কে যেন একদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। গাড়ির সামনের কাচ ভেদ করে বাইরে তাকালেন। বিশাল আকারের দুটো হাত চোখে পড়ল তার। মনে হলো উইণ্ডস্ক্রীনে চাপ দিচ্ছে। হাতের আঙুলগুলো কাঁচের ওপর যেন তবলা বাজাচ্ছে। তিনি ওগুলোকে দেখতেই আঙুলগুলোকে ব্যবহার করে হাতগুলো চলাফেরা করতে লাগল কাঁচের ওপর।

ফ্লোরেন্সের শরীর বেয়ে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। আতংকে চোখ বড় বড় করে হাত-দুটোর ভীতিকর কাজ-করবার দেখছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল হাত জোড়া।

তবে এই রাস্তায় এমন ঘটনাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। ফ্লোরেন্সেরই প্রথম এই অভিজ্ঞতা হয়নি। পোস্টব্রিজ থেকে ডর্টমুরের দিকে চলে যাওয়া রাস্তার এই জায়গাটিতে যে-ই গাড়ি দাঁড় করিয়েছেন তাকেই পৈশাচিক এই হাত জোড়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ লোজনকে সতর্ক করে জায়গায় জায়গায় বোর্ড টাঙিয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে কারো যদি পেট্রোলে টান পড়ে বা গাড়ি মেরামতির প্রয়োজন হয় তবে রাস্তার আরেকটু সামনে এগুলেই তা মিলবে। চালকদের পরামর্শ দেওয়া হয় এই এলাকায় গাড়ি দাঁড় না করানোর আর এদিকটা অতিক্রমের সময়ই প্রয়োজনীয় সব কিছু পর্যাপ্ত পরিমাণে সঙ্গে রাখার জন্য। তারপরও অনেক আগন্তুক আগে থেকে বিষয়টি সম্পর্কে জানা না থাকায় মুখোমুখি হয়ে যান ভীতিকর দুই হাতের। এ ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা চলে আসছে আশি বছর হলো, যখন থেকে ভৌতিক সব ঘটনার শুরু তখন থেকে। যত বিপদই হোক গাড়ি চালকরা চান এই এলাকা দ্রুত অতিক্রম করে যেতে।

টরবেতে ফিরে এলেন ফ্লোরেন্স। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে এখানে থাকেন তিনি। ত্রিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে আসলেও কীভাবে আবার গাড়িটা চালানো শুরু করেছেন আর কীভাবেই বা, ফিরে এসেছেন নিজেও জানেন না। টরবেতে পরিচিত জনদের এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বললেন। মনে মনে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন, বন্ধুরা নিশ্চয়ই এটা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করবে। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে তারা জানাল রাস্তায় মাঝে মাঝেই এমনটা ঘটে। এটাও বলল রাস্তার এই অংশটাতে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকেরই। আর অপ্রত্যাশিতভাবে দুই হাতের উপস্থিতিতে আতংকিত হয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছেন অনেক গাড়ি চালকই।

যতদূর জানা যায় ১৯২০ সাল কিংবা তার আশপাশের সময় থেকে এ ধরনের অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড-কারখানা শুরু হয় এই রাস্তায়। তখন তো এই রাস্তায় বেশি দেখা যেত ঘোড়া। প্রায়ই আতংকিত হয়ে সাওয়ারিদের ছুঁড়ে ফেলে দিত ঘোড়ারা। পোষা গবাদিপশু এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ভয় পেয়ে জোরে দৌড়তে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ত। সাইকেল চালকরা অস্বাভাবিক কিছু দেখে আতংকিত হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাহাড়ের খাদে পড়ত। একবার এক চিকিৎসক তাঁর মটর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পাশেই সাইড কারে তার বাচ্চা দুটো। হঠাৎ মটর সাইকেলটা উল্টে পড়ল। তবে সৌভাগ্যই বলতে হবে চিকিৎসক আর তার দুই বাচ্চা সে অর্থে কোনো আঘাত পাননি।

১৯৪৫ সালের পর থেকে এই রাস্তায় অনেক চালকই গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য হাত দুটোকে দায়ী করেছেন। হাত দুটো কখনো কখনো, গাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। এসময় গুডলোকে দেখে মনে হতে পারে কোনো আনাড়ী গাড়ি চালানো শেখার চেষ্টা করছে। আর গাড়ির ভিতরে ভুতুড়ে হাত দেখে কোন চালকেরই বা মাথা ঠিক থাকে! বেশিরভাগ সময়ই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারান তাঁরা। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জেকব পিটার এক সাংবাদিককে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, মসৃণভাবে আমার গাড়িটা চলছিল। পোস্টব্রিজের কাছে দুটি ছোট সেতু পেরোনোর পর আশ্চর্য একটা অনুভূতি হয় আমার। তারপরই দেখলাম দুটো হাত আমার হাতের ওপর চেপে বসেছে। ভয় পেয়ে গেলাম। এগুলো কার হাত কিছুই বুঝতে পারলাম না, কারণ হাত ছাড়া শরীরের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উল্টো দিক থেকে আসা একটা গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে এক পাশে নিয়ে গেলাম গাড়িটা। হাতদুটো তখন আরো দ্রুত উল্টো দিকে ঘুরানোর চেষ্টা করল ওটাকে। বড় কোনো দুর্ঘটনা এড়ানো গেলেও জোরে রাস্তার ওপর লাফিয়ে পড়ল গাড়িটা।

একের পর এক দুর্ঘটনায় বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ বিকল্প রাস্তা তৈরি করল। কিন্তু মনে হয় গোটা এলাকাটাই শাসন করছে অশুভ হাত জোড়া। কারণ নতুন বিকল্প রাস্তাতেও সে ভড়কে দিতে লাগল চালকদের।

১৯৫৫ সালের ঘটনা। নব বিবাহিত এক দম্পতি গাড়ি নিয়ে এই রাস্তায় যাচ্ছিলেন। হঠাৎ প্রচণ্ড কুয়াশায় ঢেকে গেল চারপাশ। কুয়াশার কারণে একটু দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না, তারপর আবার সময়টা শীতকাল। রাস্তার পাশেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা। সঙ্গে আনা খাবার খেয়ে গাড়ির পিছনের অংশে শুয়ে পড়লেন দুজনে। রাতে মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেল। তার মনে হলো কেউ একজন গাড়ির দরজার কাঁচে টোকা দিচ্ছে। প্রথমে ভাবলেন এটা নিশ্চয়ই পাড়া বেড়ানো কুকুরের কাজ। শীতের থেকে বাঁচার জন্য ভিতরে আশ্রয় পাবার আশায় নখ দিয়ে দরজা আঁচড়াচ্ছে। স্বামীর দিকের দরজার কাচে চোখ পড়তেই পাথর হয়ে গেলেন। দুটো ভয়ঙ্কর হাত চলাফেরা করছে কাচের ওপর। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন। তারপরই অদৃশ্য হয়ে গেল হাত জোড়া।

এই অশুভ হাত জোড়া নিয়ে প্রচুর গল্প ছড়িয়ে আছে। এর কোনোটা সত্যি, কোনোটা আবার লোকের বানানো। তবে ১৯৬০ সালের একটা ঘটনা ভয়াল হাত দুটোর ব্যাপারে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে ঘোরতর অবিশ্বাসীকেও বাধ্য করল।

রাস্তার অভিশপ্ত অংশটাতে নিজের গাড়ির ধবংস্তুপের নীচে পাওয়া গেল এক চালকের মৃতদেহ। গাড়িটা উল্টে গেছে। কিন্তু রাস্তায় অন্য কোনো গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষের চিহ্ন নেই। গাড়ির এঞ্জিনও চমৎকার অবস্থায় ছিল। এমনকী অন্য কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটিরও আভাস মিলল না। ড্রাইভিং লাইসেন্স নিশ্চিত করছে ভদ্রলোক পাকা চালক। কারণ বারো বছর ধরে তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মাতাল ছিলেন এমন কোনো তথ্যও পাওয়া গেল না।

পুলিশ আবিষ্কার করে মৃত ব্যক্তির হাত জোরে স্টিয়ারিংয়ের ওপর চেপে বসে আছে। আঙুল ভেঙে গেলেও স্টিয়ারিং থেকে হাত শিথিল করেননি ভদ্রলোক। ডিক কেলি নামের এই ভদ্রলোকের হাতে বল প্রয়োগের চিহ্নও মিলল। আতংকে বড় বড় হয়ে আছে তার চোখ। গলা নীচের দিকে বেঁকে আছে- যতদূর বোঝা যাচ্ছে ভীতিকর কোনো কিছুর দিকে কেন্দ্রীভূত ছিল তাঁর সমস্ত মনোযোগ।

২. তাহিরা-রহস্য

তাহিরা-রহস্য

আবদুর রউফ গাড়ির একটা গ্যারেজের মেকানিক। কাজ শেষ করে সেদিন যখন বাড়ি ফিরছেন বেশ রাত হয়ে গেছে। এসময়ই দেখলেন এক তরুণী রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব বিপদে পড়েছে। রউফ ভাবলেন এত রাতে বাড়ি ফেরার মত কিছু না পেয়ে আতংকিত হয়ে পড়েছে মেয়েটা।

স্কুটারের পিছনে মেয়েটাকে নিয়ে নিলেন। একট রাস্তার সামনে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল মেয়েটি। তারপরই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটল। কয়েক কদম এগিয়েই ভোজবাজির মত তার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। পরদিন সকালে বন্ধুবান্ধব আর তাঁর সহকর্মীদের ঘটনাটি খুলে বললেন রউফ। তবে কেউ এটাতে কান দিল না। ঠিক চারদিন পর, ১৯৭৯ সালের ২২ জুলাই প্রচণ্ড জ্বরে মারা গেলেন আবদুর রউফ।

ঘটনার উৎস খুঁজতে দু-বছর পিছনে যেতে হবে আমাদের। বন্ধুর বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরছিল তাহিরা নামের একটি মেয়ে। গাড়ির চালকের আসনে ছিল তার ভাই। হঠাৎ গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারাল। তারপর গিয়ে ধাক্কা খেল একটা বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে। এতে উল্টে পড়ল গাড়িটা। ঘটনাস্থলেই মারা গেল তাহিরা।

যতদূর জানা যায় দুশ্চরিত্র এক শিল্পপতি ছিলেন ঘটনার পিছনে। এক মেকানিক আর পুলিশ কর্মকর্তার সাহায্যে দুর্ঘটনার নাটকটি সাজান তিনি। তবে পরিকল্পনা ছিল দুর্ঘটনাটায় চালকের, আসনে বসা ভাইটি মারাত্মক আহত হবে। তখন তাহিরাকে অপহরণ করা সহজ হবে। কিন্তু মারা গল উল্টো তাহিরাই।

এর ঠিক এক বছর পর ওই শিল্পপতিও মারা গেলেন দুর্ঘটনায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন নীল রঙের শাড়ি পরা এক নারীকে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে তারা গাড়িটা যখন বৈদ্যুতিক খুঁটিতে আঘাত হানে তখন। অপর দিকে পুলিশের একটা টহল দল দাবি করেছে গাড়ির ভিতরে নীল শাড়ি পরা একজন নারীকে দেখেছেন তাঁরা।

কিন্তু একটা মেয়ে একই সঙ্গে গাড়ির ভিতরে আর বাইরে থাকে কীভাবে? সম্ভবত এই একই জিনিস শিল্পপতিকে আতংকিত করে তুলেছিল। হয়তো পাশের সিটে আর গাড়ির বাইরে একই নারীকে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেননি ভদ্রলোক। আর তাই ব্রেকের বদলে অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। যতদূর জানা যায় রাতের একটা পার্টি শেষে বাড়ি ফিরছিলেন শিল্পপতি।

আগের বছর যে সময় তাহিরা মারা যায় ওই একই সময় মৃত্যু হয় শিল্পপতির। শুধু তাই না দুর্ঘটনার জায়গাও ছিল একই।

পরের বছর একই দিন মারা যান আবদুর রউফ। অবশ্য কোনো কোনো সূত্র দাবী করে জ্বরে নয়, সাগরে ডুবে মরেছেন আবদুর রউফ। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি কখনোই।

এর ঠিক এক বছর পরের ঘটনা। জুলাইয়ের ১৭ কি ১৮ তারিখ। শুল্ক বিভাগের সঙ্গে জড়িত এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা শিকারে পরিণত হলেন তাহিরার। বাড়ি ফেরার পথে মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। গাড়ি থামাবার ইশারা করে মেয়েটা। তারপর পুলিশ কর্মকর্তাকে বলে একটা দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে সে। তাকে যেন তিনি দয়া করে বাড়ি পৌঁছে দেন।

মেয়েটার গলায় তাজা ক্ষতচিহ্ন দেখে আর্দ্র হয়ে ওঠে ওই কর্মকর্তার মন। তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে চান। কিন্তু মেয়েটি বলে বাড়িতেই যাবে সে। কি আর করা তাকে তার বাংলোর সামনে নামিয়ে দেন। কিন্তু তার চোখের সামনে বাড়িতে ঢোকার আগেই অদৃশ্য হয়ে যায় মেয়েটি। এর মাত্র দু-দিন বাদে আফিম কারবারীদের একটা দলের গোপন আস্তানায় হামলা চালানোর সময় গুলিতে মারা পড়েন পুলিশ কর্মকর্তা।

তারপর থেকে অনেকগুলো বছর রাস্তার ধারে নীল শাড়ি পরা, কোনো মেয়েকে দেখলে আর গাড়ি দাঁড় করাতেন না চালকেরা। বিশেষ ক্লরে জুলাই মাসের ১৭ কিংবা ১৮ তারিখ আরো বেশি সতর্ক থাকতেন চালকেরা। তবে তাহিরার এই কাহিনি ছড়িয়ে আছে পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায়। শহর ভেদে এর মধ্যে কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে। তবে পুরো সত্যি জানা যায়নি কখনোই। তাই তাহিরা রয়ে গেছে এক রহস্যই।

৩. জিপানি ভ্রমণ

জিপানি ভ্রমণ

এই অভিজ্ঞতাটি বর্ণনা করেছেন ফিলিপাইনের ম্যাথু। চলুন তাঁর মুখ থেকেই শুনি।

এটি আমার এক বান্ধবী আর তার জিপানি ভ্রমণের সত্যি ঘটনা। আপনারা যারা জিপানি চেনেন না তাদের বলছি জিপানি হল ফিলিপাইনের সাধারণ মানুষ পরিবহনের জনপ্রিয় একটা যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহার করা আমেরিকান পরিত্যক্ত সামরিক জীপগুলোকে ঠিকঠাক করে জিপানিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এ ধরনের গাড়ি জাকাল সাজসজ্জা আর প্রচুর লোক উঠানোর জন্য বিখ্যাত।

আমার বান্ধবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজেক্টের কাজ শেষে বাসার পথে রওয়ানা হতে হতে বেশ দেরি হয়ে যায় এদিন। কিছুদিন আগে থেকে ইউনিভার্সিটি অভ দ্য ফিলিপিন্সের ডিলিমান ক্যাম্পাসে থাকতে শুরু করেছে সে। আর এত রাতে ট্যাক্সির চেয়ে জিপানি ব্যবহার করাই নিরাপদ মনে হয় তার কাছে। যখন জিপানিতে উঠল তখন বেশ রাত। একটু পরেই অস্বস্তি শুরু হলো তার। চালক গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে তাকে দেখছে একটু পর পরই। শুধু তাই না মাঝে মাঝে পিছন ফিরেও তাকাচ্ছে। কিন্তু এত রাতে গাড়িতে একা থাকায় কিছু করাও সম্ভব হলো না তার পক্ষে। এখন প্রতিটি জিপানির নির্দিষ্ট রুটে আছে। রাস্তা বদলে অন্য পথে কোনো শর্টকাট কোনোভাবেই ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ সেক্ষেত্রে পুলিশের রোষানলে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু এই চালক যে শুধু তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তা না। একটু পরপরই রাস্তা বদল করছে সে। চালকের মতিগতি বুঝতে না পেরে চিন্তায় পড়ে গেল আমার বান্ধবী। এদিকে আবার রাস্তার মোটামুটি মাঝপথে চলে এসেছে। এই : অবস্থায় নেমে গিয়ে আরো বিপদে পড়তে পারে। তাই গাড়িতেই বসে রইল। শেষ বাঁকটা ঘোরার পর আবিষ্কার করল চালক আবার মূল পথে ফিরে এসেছে।

বাস স্টেশনে পৌঁছার আগে চালক আমার বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে যদি ভয় পাইয়ে দিয়ে থাকি তবে দুঃখিত। আসলে আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। আর বাসায় ফিরে অবশ্যই পরনের কাপড়গুলো পুড়িয়ে ফেলবে। এবার রীতিমত অবাক হয়ে আমার বান্ধবীটি তার এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জানতে চাইল। জিপানির চালক তখন ব্যাখ্যা করল, আমি তোমার দিকে তাকিয়েছিলাম, কারণ গাড়ির পিছনের ভিউ মিররে যখন দেখছিলাম, তোমার শরীরের সঙ্গে মাথা ছিল না। তখনই আমার সন্দেহ হয় এর মধ্যে অশুভ কিছু একটার কারসাজি আছে। তাই গাড়ির রাস্তা বদলে ফেলছিলাম। আশা করেছিলাম এতে ওই এলাকাটায় যে পিশাচটা আছে ওটার আওতার বাইরে চলে যেতে পারব। আর তোমার কাপড় পুড়িয়ে ফেলতে বলছি কারণ আমার মনে হচ্ছে ওটা এখনো তোমার কাপড়ের মধ্যে থেকে যেতে পারে।

আমার বান্ধবী যখন বাড়িতে পৌঁছল তখনও সে আতংকে কাঁপছে। তারপরও এই অবস্থাতেই যত দ্রুত সম্ভব পোশাকগুলো পুড়িয়ে ফেলল। এর কয়েকদিন পরেই সে খবর পেল সেদিনের ঘটনার পরদিনই ওই জিপানি চালক মারা গেছে। হায়! দুর্ভাগা চালক আমার বান্ধবীর জন্য ভয় পেলেও অশুভ জিনিসটার নজর পড়েছিল আসলে তার ওপর।

৪. সেতুর ধারের নারী

সেতুর ধারের নারী

এবারের অভিজ্ঞতাটি হয় মানস্টার অ্যাণ্ড লেইনস্টার ব্যাংকের মি. জে. জে. উলির। আয়ারল্যাণ্ডের ক্লনমেলের বাইরে, একটা

সড়ক চলে গেছে পর্বতের ধারে পুরানো এক বসতির দিকে। এই রাস্তা ধরেই ক্রউলি যাচ্ছিলেন তার দুই বন্ধুর বাসায়। বন্ধু দুজনও চাকরি করেন ব্যাঙ্কে। রাত আটটার মত বাজে তখন। আকাশে চাঁদ নেই। একসময় একটা সেতুর পোয়া মাইলের মধ্যে চলে এলেন। ছোট্ট একটা ঝরণার ওপরে সেতুটা। ওটার ধারেই তাঁর বন্ধুদের বাড়ি। এসময়ই একটা মেয়েকে দেখলেন। পরনে সাদা পোশাক, তবে কালো একটা কাপড় ঝুলছে কাঁধ থেকে, দীঘল চুল। আস্তে আস্তে সেতুতে উঠছে। তারপরই সেতুর অপর পাশ দিয়ে নীচে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। অবাক হয়ে ক্রউলি ভাবলেন এত দূর থেকে চাঁদহীন রাতে কাঠামোটা এত পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়ার কারণ কী তাঁর? মনে হলো নিশ্চয় কোনো ধরনের আলো মেয়েটির ওপর পড়েছে, কিংবা আশপাশে অন্য কেউ আছে, যে একটা ম্যাচ জ্বেলে। সেতুর কাছে পৌঁছলেন যখন, চারপাশে ভালভাবে খুঁজে কাউকে পেলেন না।

বন্ধুদের বাড়িতে পৌঁছে কী দেখেছেন বললেন। এসময় তাঁদের একজন একটা ঘটনা বললেন। কয়েক রাত আগে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায়। তারপরই দেখেন বিছানার ধারে একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটার পরনের পোশাক আর গঠন ক্রউলির বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। ভয়ে বন্ধুটি তখনই এই কামরা ছেড়ে দৌড়ে বের হয়ে যান। রাতে কাটান বাড়ির অন্য এক ভাড়াটের সঙ্গে। ঘটনাটি বাড়িওয়ালীকে জানান পরে। ভদ্রমহিলা তখন বললেন নারীমূর্তিটিকে এই এলাকায় মাঝেমাঝেই দেখা যায়। এটা তারই এক মেয়ের আত্মা। বছর কয়েক আগে বেশ কম বয়সে মারা যায় মেয়েটা। আর মারা যাওয়ার আগে তার পরনে ছিল তারা যে পোশাকে রাত নারীমূর্তিটিকে দেখেছেন ঠিক সেই পোশাক। মেয়েটার কাঠামো আর আকার-আকৃতিরও রাতে দেখা দেওয়া রহস্যময় নারীর সঙ্গে মিল আছে। ক্রাউলি ছায়ামূর্তিটিকে দেখার আগে বাড়িওয়ালীর মেয়ের ভূত সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। কাজেই এটা তার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা কিংবা দৃষ্টিবিভ্রম, এমনটা হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

৫. পিছনে কে?

পিছনে কে?

এই অভিজ্ঞতাটি ভারতীয় তরুণ হরিহরের। বছর কয়েক আগের ঘটনা। বেড়াতে গিয়েছিলেন কর্নাটকের ছোট্ট শহর কামতাতে, খালার বাসায়। তাঁর বাসাটা গজনির কাছে। এখানে বেশ কিছু ছোট্ট লেকের দেখা পাওয়া যায়। প্রথমবার এই এলাকায় বেড়াতে আসায় জায়গাটাতে ঘুরে আসার ব্যাপারে একটা কৌতূহল ছিল তাঁর। বাকি অংশটা বরং হরিহরের জবানীতেই শোনা যাক।

খালা বেশ ধার্মিক মহিলা। কেন যেন ওই লেকগুলোর দিকে যাওয়ার জন্য পই পই করে বারণ করে দিলেন। কারণ জানতে চাইলে শুধু বললেন জায়গাটা ভাল না। তারপর এখানেই এই বিষয়টার ইতি টানলেন।

রাত সাড়ে নটার দিকে খাওয়া-দাওয়া শেষে হাঁটতে বের হলাম। এখনো মনে আছে রাতটার কথা। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। লেকের জলে তার রূপালি ছটা পড়ছে। আর এতে গজনিকে আরো মোহনীয় মনে হচ্ছে, ঠাণ্ডা বাতাস আমাকে যেন জোর করে ওদিকেই নিয়ে যেতে লাগল। গজনির রাস্তার আলোগুলোও এখান থেকে মোহনীয় মনে হচ্ছে।

গজনির দিকে মোটামুটি আধমাইলটাক এগিয়েছি। এমন সময় কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি শুরু হলো। শীতল বাতাস শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। শান্ত, নিশূপ উপত্যকা দিয়ে এগুনোর সময় হঠাৎ পিছনে বেশ কয়েক জন মানুষের পায়ের আওয়াজ পেলাম। মনে হলো যেন আমার পিছনে একটা দল আসছে, আর তাদের হাসি, কথা-বার্তার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। তবে সব কিছুই কেমন অস্পষ্ট। হঠাৎ কী মনে করে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরলাম। বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলাম সেখানে একজন অশীতিপর বৃদ্ধা দাড়িয়ে আছে, আর কেউ নেই।

মনে হলো জ্ঞান হারাব। এতজন লোকের পায়ের আওয়াজ, কণ্ঠ পেলাম। আর ভোজবাজিতে সব অদৃশ্য হয়ে হাজির হলো এক বুড়ি। এলোমেলো, লম্বা চুল তার, হাতে লাঠি; সামনের দাঁত নেই। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু একটা হাসি দিল। কেন যেন আঁতকে উঠে চেঁচিয়ে উঠলাম। মনে হলো বিদ্যুতের একটা প্রবাহ বয়ে গেছে শরীরের ভিতর দিয়ে। নড়তে পারছি না, পা জোড়া কাঁপতে শুরু করেছে। এভাবে মনে হয় দশ-পনেরো সেকেণ্ড থাকলাম। তারপরই বড় রাস্তার দিকে দৌড়তে শুরু করলাম। যখন সেখানে পৌঁছে ফিরে তাকালাম, গজনির দিকে কাউকে দেখতে পেলাম না।

বাসায় ফিরে খালাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম। গজনিতে যাওয়ার জন্য ইচ্ছামত বকাবাদ্য করলেন খালা আর খালাতো বোন। তারপর ঘুমাতে পাঠিয়ে দিলো। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো যেন কে আঠা দিয়ে শরীরটা বিছানার সঙ্গে আটকে দিয়েছে। মাথা এপাশ-ওপাশ করতে এমনকী মুখ দিয়ে একটা শব্দও করতে পারলাম না। খুলতে পারলাম না চোখও।

কাঁদার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, সেটা পারলাম। আর কান্নার শব্দ শুনে আমার খালাতো বোন দৌড়ে এল আর খালাকে ডেকে নিয়ে এল। বিছানায় বসিয়ে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলেন তাঁরা। কিছু না বলে শুধু কাঁদতেই থাকলাম। আমার মাথায়, বুকে আর পায়ে অ্যাপাতিসাল নামের এক ধরনের ভেষজ মলম লাগিয়ে দিলেন তারা। আস্তে আস্তে ভাল লাগতে শুরু করল আমার। তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দু-দিন জ্বর থাকল খুব। তবে দ্রুতই ভাল হয়ে উঠলাম।

৬. রহস্যময় সেই লোকটা

রহস্যময় সেই লোকটা

এই কাহিনিটি পাওয়া গেছে রেভারেণ্ড এইচ.আর.বি. গিলেসপির কাছ থেকে। ঘটনাটা যাঁরা দেখেছেন তাঁদের একজনই এটা বলেন তাঁকে। এটা উনিশ শতকের শেষদিকের ঘটনা।

চন্দ্রালোকিত এক রাতে আয়ারল্যাণ্ডের লেইট্রিমের এক গ্রাম্য রাস্তা ধরে ঘোড়ার গাড়িতে আসছিলেন এক লোক, তার দুই মেয়ে আর ভদ্রলোকের এক বন্ধু। একসময় খাড়া একটা পাহাড়ের কাছে এলেন। ঘোড়াটার বোঝা কমাতে চালক ছাড়া বাকিরা নেমে হাঁটা শুরু করলেন রাস্তা ধরে। মেয়েদের একজন সামনে, তার পিছনে বাকি দুজন। খুব বেশিদূর এগোননি এমন সময় পিছনের দুজন দেখলেন সামনের মেয়েটার পাশেই জীর্ণ, ছেঁড়াখোড়া পোশাকের এক লোক হাঁটছে। তবে মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে না পাশের লোকটার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন সে। লোকটা কে হতে পারে ভেবে, তাকে ধরার জন্য জোরে পা চালালেন পিছনের দুজন। কিন্তু যখনই প্রায় ধরে ফেলেছেন এমন সময় দৌড়ে রাস্তার পাশের একটা পরিত্যক্ত কামারশালার ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা। ঘোড়াটা, যেটা এতক্ষণ খুব শান্ত ছিল, প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠল। এদিকে যে মেয়েটার পাশে রহস্যময় লোকটা হেঁটেছে সে কিছু দেখেনি এমনকী কোনো শব্দও শুনতে পায়নি। রাস্তার কিনারায় গাছপালার সারি কিংবা কোনো ঝোপ-জঙ্গল নেই। তাই চাঁদের আলোয় দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছে এটাও বলা যাবে না। মেয়েদের একজন পরে স্থানীয় এক শ্রমিককে ঘটনাটি খুলে বললে এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। শ্রমিকটা জানায়, এটা সম্ভবত সেই কামার, ছমাস আগে যাকে মৃত অবস্থায় ওই কামারশালায় পাওয়া যায়।

৭. শিকল পায়ে কে যায়?

শিকল পায়ে কে যায়?

এই কাহিনিটি বলেছেন আয়ারল্যাণ্ডের ডাবলিনের এক মহিলা। মোটামুটি সোয়াশো বছর আগের ঘটনা এটি।

চমৎকার এক রাতে দুই বোন থিয়েটার থেকে বাড়ি ফিরছেন। কিমেজ রোডের খুব নির্জন একটা অংশ পার হচ্ছেন তারা। গল্প আর হাসি-ঠাট্টায় এতটাই মশগুল যে অন্য দিকে তেমন একটা নজর নেই। এসময়ই তাদের দিকে শিকল পরা কারও এগিয়ে আসার শব্দ পেলেন। ক্লিক, ক্লিনক। প্রথমে ভাবলেন এটা নিশ্চয়ই কোনো ছাগল কিংবা গাধা। ছুটে গিয়ে, শিকল মাটিতে হেঁচড়ে হেঁচড়ে তাদের দিকে আসছে। কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছেন

তারা। শিকলের শব্দ ছাড়া কানে আসছে না অন্য কোনো আওয়াজও। কিন্তু রাস্তাটা পরিষ্কার আর সোজা চলে গেছে। শব্দটা ক্রমেই কাছে আসছে, সেই সঙ্গে চড়ছে। যখন তাদের পাশ কাটাল, একটা দমকা বাতাস এসে লাগল গায়ে। অজানা একটা আতংকে যেন নড়াচড়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন তাঁরা। তারপর খুব কষ্টে বাকি পোয়া মাইল পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছলেন। এদের মধ্যে বড় জনের স্বাস্থ্যের অবস্থা এমনিতেই খারাপ। তাকে বলতে গেলে বয়ে নিয়ে আসতে হলো ছোটজনকে। বাড়িতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে বড় বোন শরীর ছেড়ে দিলেন। ব্র্যাণ্ডি খাইয়ে তাঁকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলো।

পরে জানা গেল, রাস্তার যেখানে বোনদের এই অভিজ্ঞতা হয় এর ধারেই এক বুড়ো মহিলাকে অর্থ-কড়ি হাতাবার জন্য খুন করে এক ভবঘুরে। ধারণা করা হয় কিমেজ রোডে ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তির সঙ্গে ওই মহিলার কোনো সম্পর্ক আছে।

৮. দৌড় শুধু দৌড়

দৌড় শুধু দৌড়

এবারের ভৌতিক অভিজ্ঞতাটি হয়েছে সিংগাপুরের এক তরুণীর। এটা বরং তার মুখ থেকেই শুনি।

গত বছর জীবনের সবচেয়ে ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে। আরেকটু হলেই মরতে বসেছিলাম।

আমার ষান্মাসিক পরীক্ষার দু-মাস আগের ঘটনা। ক্লাসের শিক্ষক ক্রস-কান্ট্রি দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য বাছাই করলেন আমাকে। অনেক গাঁইগুই করেও পার পেলাম না। কারণ গত বছরও এতে অংশ নিয়েছিলাম আমি।

অনেক দিন ধরে দৌড়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। প্রস্তুতিটা ঠিকমত হওয়ার জন্য নিয়মিত দৌড় অনুশীলনের সিদ্ধান্ত নিলাম, কয়েকজন বান্ধবীর সঙ্গে। ঠিক হলো ম্যাকরিটচি রিজার্ভে অনুশীলন করব আমরা।

পরের শনিবার একদম সকালে সেখানে হাজির হয়ে গেলাম। তখনও খুব একটা আলো হয়নি। তবে দুটো মেয়ে ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়ে গেছে। এখনও এসে না পৌঁছননা তিনটা মেয়ের জন্য অপেক্ষা না করে দৌড়নো শুরু করে দিলাম আমরা।

কয়েকশো গজ এগুবার পরই বুঝে গেলাম অনেক দিন না দৌড়নোতে আর আগের মত সাবলীল নেই আমি। বান্ধবীরা আমার থেকে অনেক ফিট এখন। তারা যেন বুনো খরগোশের মতই দৌড়চ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ পিছনে পড়ে গেলাম। মনে মনে আমার শিক্ষককে, দু-পাশের এই জঙ্গলকে আর নির্বাচিত হওয়ার জন্য নিজের কপালকে অভিশাপ দিতে দিতে একা একা ধীর গতিতে ছুটতে লাগলাম।

দৌড়বার সময় বানরদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। বনের যেখানটায় এখন আছি এদিকে গাছপালা বেশ গভীর। সকালের সূর্যের আলো ভালমত ভিতরে ঢুকতে পারছে না। এ কারণেই ম্যাকরিটচি রিজার্ভকেই, যেটাকে লোকে পোষ মানানো একটা বাগান বলে, গভীর জঙ্গল বলে মনে হতে লাগল।

চারপাশের গাছপালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দৌড়চ্ছি, যদি একটা বানরের দেখা পেয়ে যাই এই আশায়। এসময়ই হঠাৎ বাম গালে জ্বালা ধরানো একটা ব্যথা অনুভব করলাম। মনে হলো যেন নিচু হয়ে ঝোলা কোনো ডালের বাড়ি খেয়েছি। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে এমন কোনো ডাল-পালা নজরে এল না। মনে মনে বললাম, তবে নিশ্চয় কোনো পোকামাকড় কামড়েছে।

আর কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই এরপর দৌড় চালিয়ে যেতে পারলাম। শেষমেশ পাহাড়ের ওপরের ক্যান্টিনে বান্ধবীদের সঙ্গে মিলিত হলাম আবার। এখানে কফি পান করতে করতে ওপর

থেকে পুরো সংরক্ষিত বনটা দেখতে লাগলাম।

এসময়ই একজন বান্ধবী আমার মুখের দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই, কী হয়েছে? তোমার বাম গাল কি কেটে ফেলেছ নাকি?

কী খুব বেশি কেটেছে? সচকিত হয়ে উঠলাম। খুব নয়। তবে একেবারে হেলাফেলা করার মতও না। বলল সে।

সম্ভবত কোনো পোকা কামড়েছে। বললাম আমি। অন্যরাও একমত হলো।

বাসায় ফিরে পরে একটা মলম লাগালাম গালের ক্ষতে। তারপর পড়তে বসলাম। আমার মা-ও ক্ষতটা দেখে জানতে চাইলেন কীভাবে ওটা হয়েছে। সামান্য একটা পোকার কামড় বলে আশ্বস্ত করতে চাইলাম। কিন্তু তাঁর দুশ্চিন্তা গেল না।

কিন্তু কাটাটা বেশ খারাপ মনে হচ্ছে, মা। বললেন তিনি।

আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম এটা আগের চেয়ে আরো বেশি নজরে পড়ছে। ঠিক চোখের নীচেই ক্ষতটা। তবে কোনো ধরনের যন্ত্রণা বা চুলকানি হচ্ছে না। তাই মলমটা কাজ করে কিনা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করা স্থির করলাম।

মোটামুটি বেশ রাত পর্যন্ত পড়ালেখা করার অভ্যাস আমার। সাধারণত সাড়ে বারটার আগে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠি না, বিশেষ করে শনিবারে। আসলে গত বছর পরীক্ষায় ভাল না করায়

এবার শুরু থেকেই পড়ালেখায় খুব মনোযোগ দিয়েছি।

এগারোটার দিকে গালের যে জায়গাটায় কিছু একটার কামড় খেয়েছি মনে হয়েছে সেখানটায় ব্যথা শুরু হলো। বারোটার দিকে এসে ব্যথাটা রীতিমত অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেল। ব্যথার চোটে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করল আমার। কিন্তু এত রাতে কিছুই করার নেই। মনে হলো কোনো মতে ব্যথা চেপে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কাল সকালে কোনো চিকিৎসকের কাছে যাওয়া যাবে।

শুরুতে এই যন্ত্রণার কারণে মোটেই ঘুম আসতে চাইল না। তারপর যেমন আরম্ভ হয়েছে তেমনি হঠাৎই ব্যথাটা চলে গেল। এতটাই ভারমুক্ত মনে হলো নিজেকে, সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই একটা ধাক্কা খেলাম। বাসার বাকি সবাই দেখেও ভয় পেয়ে গেল। ক্ষতটার চেহারা বেশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, গালটা ফুলে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় একটুও যন্ত্রণা নেই।

দ্রুত নাস্তা সারলাম। তারপরই আমাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন মা দেখে চিকিৎসক ভদ্রলোকও বললেন কোনো পোকামাকড়ের কামড়ে এই অবস্থা হয়েছে, চিন্তার কিছু নেই। তারপর একটা অয়েন্টমেন্ট দিয়ে বললেন দিন দুয়েকের মধ্যে ফোলা কমে যাবে।

সারাটা দিন এমনকী রাতের শুরুটা ভালই কাটল। গতকালের মতই এগারোটা বাজতেই আবার ব্যথা শুরু হলো, ঠিক একই জায়গায়। এবার যন্ত্রণার পাশাপাশি একটা চিন্তাও উদয় হলো মনে। শুধু রাতে কেন জায়গাটায় ব্যথা করে? মলমটাও কোনো কাজই করছে না। রাত গভীর হলে এক সময় আগের মতই হঠাৎ ব্যথাটা অদৃশ্য হলো।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলাম গাল আরো ফুলে গেছে। এতটাই যে বাম চোখে ভালমত দেখতে পর্যন্ত পাচ্ছি না। তবে অদ্ভুত ব্যাপার কোনো ব্যথা নেই। এবার সত্যি চিন্তায় পড়ে গেল আমার বাসার লোকেরা। মা স্কুলে যেতে মানা করলেন। বললেন আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন।

ডাক্তারের কথা শুনে ভয় আরো বাড়ল। তিনি বললেন, কী কারণে এটা হচ্ছে বুঝতে পারছেন না। মলমটা আরো কয়েকবার লাগিয়ে আগামীকাল আবার আসতে বললেন।

তবে ভাগ্যই বলতে হবে মা ডাক্তারের এই পরামর্শ মেনে না নেওয়া স্থির করলেন। আমার এক আন্টিকে ফোনে ঘটনাটি খুলে বললেন তিনি। নানান বিষয়ে বেশ ভাল অভিজ্ঞতা আছে তাঁর।

বাসায় এসে আমাকে দেখেই চমকে উঠলেন তিনি। দেরি না করে আমাকে আর মাকে তার পরিচিত একজন ওঝা বা মেডিসিন ম্যানের কাছে নিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওঝা। তারপর কীসব আওড়ালেন। একসময় মাকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলেন, তোমার মেয়ের ভাগ্য খুব ভাল। কোনো দুষ্ট আত্মা তাকে একটা চিমটি কেটেছে কেবল। কিন্তু যদি ওটা ওকে ভালমত একটা চড় দিত তাহলে সম্ভবত সে মারা যেত। তবে এখন আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমি এটা ঠিক করে দিচ্ছি।

আমাকে কিছু তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে ফু দিলেন। তারপর জায়গাটায় লাগানোর জন্য একটা মলম দিয়ে কিছু খাবার আপাতত বেছে চলতে বললেন।

ভাগ্য ভাল তার চিকিৎসায় কাজ হলো। কয়েকদিনের মধ্যে ফোলা কমে গেল। সবচেয়ে বড় কথা, যেদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে সে রাত থেকেই ব্যথা একদম চলে গেল।

এখনও ম্যাকরিটচি রিজার্ভে ক্রস কান্ট্রি দৌড়ের প্রশিক্ষণ নিই আমি। যদিও মা বিষয়টা খুব একটা পছন্দ করেন না। তবে এখন সবসময়ই বান্ধবীদের সঙ্গেই থাকি দৌড়নোর সময়।

 

তাহলে কে

একই সময় কাউকে দু-জায়গায় দেখা গেছে এমন কিছু ঘটনার বর্ণনাও পেয়েছি আমরা। সাধারণত কেউ মারা যাওয়ার মুহূর্তে তাকে অন্য একটা জায়গায় দেখা যাওয়ার উদাহরণই বেশি। অথচ মৃত্যুশয্যায় থেকে কোনো অবস্থাতেই তার পক্ষে অন্য জায়গাটিতে উপস্থিত হওয়া সম্ভব ছিল না। এমন সব ঘটনা নিয়েই ‘তাহলে কে?’

১. সকাল বেলার আগন্তুক

সকাল বেলার আগন্তুক

রিভিও অভ রিভিওস-এ আশ্চর্য একটা ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন ডব্লিও.টি.স্টিড। ইংল্যাণ্ডের নিউক্যাসলের একটি স্টুডিওতে এটা ঘটে। এই কাহিনিটার সত্যতা সম্পর্কে তিনি জোর গলায় বলতে পারার কারণ ছিল একাধিক মানুষ এতে সাক্ষী হিসাবে ছিলেন। আর একটা নষ্ট ছবিও এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসাবে কাজ করে।

৪৩ গ্রেইনজার স্ট্রীটের এই দোকানটির মালিক ছিলেন মি. ডিকিনসন।

১৮৯১ সালের ৩ জানুয়ারি। সকাল আটটার একটু আগেই দোকানে পৌঁছে গেলেন ডিকিনসন। আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন, কারণ যে ছেলেটার কাছে সাধারণত চাবি থাকে সে অসুস্থ। বাইরের লোহার গেটটার তালা খুলে ভিতরের ছোট গেটটাও খুললেন। তারপর দোকানে ঢুকে গ্যাস বাতি জ্বাললেন। এসময়ই বুঝলেন একজন আগন্তুক এসেছেন দোকানে। কোট আর মাথায় টুপি পরা একজন মানুষ। রোগা আর দুর্বল মনে হওয়া ছাড়া অতিথির মধ্যে আর কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ল না ডিকিনসনের।

আমার ছবিগুলো কি নিতে পারব? জানতে চাইলেন আগন্তুক।

আপনি কে? আমরা এখনও দোকান খুলিনি। একটু রূঢ়ভাবেই বললেন মি. ডিকিনসন। আগন্তুক জানালেন তার নাম থম্পসন। ডিসেম্বরে ৬ তারিখ এখানে ছবি তোলেন তিনি। পরীক্ষা করে ডিকিনসন দেখলেন ভদ্রলোকের কথা ঠিকই আছে। ৬ ডিসেম্বর ১৮৯০, শনিবার হেপবার্ন কুয়ারির মি. জে.এস.থম্পসনের নাম লিপিবদ্ধ আছে। ছয় কপি ছবির দামও পরিশোধ করেছেন ভদ্রলোক। ছবিগুলো তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। তাই তাঁকে কয়েক ঘণ্টা বাদে যোগাযোগ করতে বললেন।

পুরো রাত ভ্রমণ করে এসেছি। আবার আসা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে হতাশ কণ্ঠে বললেন মি. থম্পসন। যখন দোকান ছেড়ে যাচ্ছেন তখন দোকান মালিক জানতে চাইলেন ছবিগুলো কী তারা ডাকে পাঠিয়ে দেবেন কিনা। কিন্তু কোনো উত্তর এল না অপর তরফ থেকে।

ডিকিনসনের তরুণী, বুদ্ধিমতী সহকারী মিস.সিমন এল নয়টার দিকে। মি. থম্পসনকে অস্বাভাবিক রকম মনমরা লাগছিল। তাই শুরুতেই এই বিষয়টা দেখতে, বললেন মেয়েটাকে।

কেন? গতকালই তো একজন বুড়ো মানুষ গুলোর খোঁজে এসেছিলেন। জবাব দিল সে, আমি তাকে বলেছি খারাপ আবহাওয়ার কারণে এই সপ্তাহে ওগুলো তৈরি হবে না। খারাপ আলো মোটামুটি তিন সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়েছে আমাদের সব কাজ। পাঠকদের অনেকেরই হয়তোবা ধারণা আছে আবহাওয়া ছবির একটা ডার্ক রুমের ওপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে। তাও আজ থেকে সোয়াশো বছর আগে। তারপরও সন্তুষ্ট হতে পারলেন না ডিকিনসন। মেয়েটাকে প্লেটটা দেখাতে বললেন তিনি। ওটা উল্টে থাকলেও আজ সকালের আগন্তুককে চিনতে কষ্ট হলো না তার। যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন নেগেটিভ প্রিন্ট করা হত গ্লাস পেটে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রিন্টগুলো নেওয়ার আগেই প্লেটটা ভেঙে গেল। মি. ডিকিনসন দেরি না করে দুঃখ প্রকাশ করে থম্পসনকে চিঠি লিখলেন। সেই সঙ্গে কষ্ট করে আরেকবার এসে ছবি তুলে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। তবে নতুন করে এর জন্য আর খরচ গুণতে হবে না তাকে। তারপরই বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে, অন্য কাজে, মনোযোগ দিলেন।

৯ জানুয়ারি, ১৮৯১। মিস সিমন এসে জানাল একজন ভদ্রলোক এসেছেন ওই নেগেটিভটার খোঁজে।

কোন্ নেগেটিভ? জানতে চাইলেন তিনি।

গত সপ্তাহে যেটা আমরা ভেঙে ফেলেছি সেটা। বলল মিস. সিমন।

আমি এই মুহূর্তে ব্যস্ত, তাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারছি না। তবে তুমি আমার প্রস্তাবটা জাগে। তাই যত দ্রুত সম্ভব মি. থম্পসনের সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করো।

কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন।

দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এলেন ডিকিনসন। সেখানে বয়স্ক একজন লোকের সঙ্গে দেখা হলো তাঁর। বিষাদ মাখা কণ্ঠে মি. থম্পসনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করলেন তিনি। কিন্তু এটা খুবই অপ্রত্যাশিত, বললেন ডিকিনসন। গত শনিবারই মাত্র তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।

আপনি ভুল করছেন, স্যর। বললেন বুড়ো মানুষটি। গত শনিবার মারা গেছে সে।

বুড়ো লোকটি থম্পসনের বাবা। গত শুক্রবার তাঁরই মিস. সিমনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাঁর ছেলে ছবির জন্য খুব চেঁচামেচি করতে থাকায় বাধ্য হয়েই এখানে এসেছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন ছবি পেলে হয়তো ছেলেটা একটু শান্তি পাবে।

শনিবার সকালে মি. ডিকিনসনের সঙ্গে তবে কে দেখা করেছে তা এক রহস্যই রয়ে গেল। বুড়ো ভদ্রলোক নিশ্চিত করেছেন শরীরের ওই অবস্থায় বিছানা ছেড়ে এখানে আসা তাঁর ছেলের পক্ষে ছিল এবারেই অসম্ভব। ও এখানে আসেনি। বললেন তিনি। কারণ ছেলে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি আর তাঁর স্ত্রী সবসময়ই তার পাশে বসে ছিলেন। ডিকিনসন যে সময় তাঁর এখানে মি. থম্পসন এসেছেন বলছেন তখন সে আসলে এখান থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে নিজের বাড়িতে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে।

ঘটনাটিকে যদি আপনি সত্যি হিসাবে মেনে নেন তবে এর যুক্তিসংগত কোনো ব্যাখ্যা নেই। কারণ আর কেউ মি. থম্পসনের ছবি নিতে আসার কোনো কারণ নেই। আর প্লেট দেখে এবং পরে সারাই করা প্লেট থেকে বের করা ছবি দেখে থম্পসনকে চিনতে কোনো ভুল হয়নি দোকান মালিকের। আপনি হয়তো বলতে পারেন সকালে ওভারকোট আর টুপি পরা একজন লোককে দেখে ডিকিনসন ভুল করতে পারেন। হ্যাঁ, এটা হতেই পারে। তবে প্রায় কাছাকাছি চেহারার একজন মানুষ কোন্‌খান থেকে মি. থম্পসনের ছবি দাবি করতে আসবে সে প্রশ্ন রয়েই গেল।

২. উদ্ধার

উদ্ধার

এখন যে কাহিনিটি বলব এটা একটা সময় তুমুল সাড়া ফেলেছিল। বিখ্যাত এই বর্ণনাটা পাওয়া গেছে মি. রবার্ট ডেল ওয়েনের কাছ থেকে। এবার তাহলে মূল কাহিনিতে চলে আসা যাক।

কোবার্ট ব্রুস এক স্কটিশ পরিবারের সন্তান। আঠারো শতকের শেষভাগে ইংল্যাণ্ডের দক্ষিণে টরবেতে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। ছোটকাল থেকেই সাগরের প্রতি টান তাঁকে জাহাজের চাকরিতে যোগ দিতে উৎসাহ জোগায়। ১৮২৮ সালে, ত্রিশ বছর বয়সে একটা বারকু্যর ( তিনটার বেশি মাস্তুল আছে এমন জাহাজ) ফাস্ট মেট হন তিনি। মূলত লিভারপুল আর নিউ ব্রান্সউইকের সেন্ট জোনসের মধ্যে যাতায়াত করে জাহাজটা।

এক অভিযানে পশ্চিমে মোটামুটি, পাঁচ-ছ সপ্তাহ চলার পর নিউ ফাউণ্ডল্যাণ্ডের পুব তীরের কাছাকাছি চলে এলেন তাঁরা। দুপুরের দিকে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে সূর্যের অবস্থান দেখলেন ক্যাপ্টেন আর মেট। তারপর দিনের কাজের হিসাব-নিকাশ করার জন্য সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন দুজনে। ক্যাপ্টেনের ছোট্ট কেবিন জাহাজের স্টার্নের কাছেই। এদিকে মেটের স্টেট রুমটা খুব দূরে নয় কেবিন থেকে। স্টেটরুমের টেবিলটা দরজা লাগোয়া। ওখানে বসে কেউ কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে কেবিনের ভিতরটা দেখতে পাবে।

এদিকে মেট তার রুমে বসে হিসাব মিলাতে গিয়ে মোটামুটি গলদঘর্ম অবস্থায় পড়ে গেছেন। জাহাজের অবস্থানের যে ফলাফল পাচ্ছেন তা মোটেই সন্তুষ্ট করতে পারছে না তাকে। কাজেই এটা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে ক্যাপ্টেনের দিকে নজর নেই তাঁর। যখন হিসাব শেষ করলেন, না ঘুরেই চেঁচিয়ে উঠলেন, বার বার ল্যাটিচিউড আর ল্যাঙ্গিচিউড নিচ্ছি। এটা কি ঠিক আছে? আপনার হিসাব কী বলে, স্যর?

কিন্তু অপর তরফের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার একই প্রশ্ন করে ঘুরে তাকালেন। যা ভেবেছেন, ক্যাপ্টেন তার স্লেট নিয়ে ব্যস্ত। কী যেন লিখছেন। তবে এবারও কোনো উত্তর মিলল না। উঠে দাঁড়িয়ে কেবিনের দরজার দিকে এগুলেন মেট ব্রুস। এবার যাকে ক্যাপ্টেন ভেবেছেন সেই ভদ্রলোেক মাথা তুললেন। অবাক হয়ে মেট আবিষ্কার করলেন একেবারেই অচেনা একজন লোকের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।

ব্রুসকে মোটেই ভীতু বলা চলে না। কিন্তু যখন দেখলেন ক্যাপ্টেনের জায়গায় বসে কস্মিনকালেও দেখেননি এমন একজন মানুষ সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে, আর ওখানে থাকার সাহস করলেন না। আগন্তুককে কোনো ধরনের প্রশ্ন না করেই ডেকের দিকে ছুটলেন। তাঁর মনে হলো সবার আগে এটা ক্যাপ্টেনের নজরে আনা উচিত।

তা, মি. ব্রুস, কী সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছ তুমি? জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন।

সমস্যা, স্যর? আপনার ডেস্কে কে? আমার জানা মতে ওখানে কারও থাকার কথা নয়।

কিন্তু আছে। শুধু তাই না একেবারে অপরিচিত একজন মানুষ। উত্তেজনায় গলা রীতিমত কাঁপছে ব্রুসের।

একজন আগন্তুক! আমার মনে হয় তুমি স্বপ্ন দেখছ। সন্দেহ নেই স্টুয়ার্ড কিংবা সেকেণ্ড মেটকে দেখেছ সেখানে। আর আমার নির্দেশ ছাড়া কারই বা সেখানে যাওয়ার সাহস হবে।

কিন্তু, স্যর, লোকটা দরজার দিকে ফিরে আপনার চেয়ারে বসে আছে। আপনার স্লেটে কী যেন লিখছে। তারপর সরাসরি আমার দিকে তাকাল। আর তাঁকে জীবনে কখনও দেখিনি আমি।

তুমি পাগল হয়ে গেছ, মি. ব্রুস। আমরা ডাঙা ছেড়েছি প্রায় ছসপ্তাহ। এখন জাহাজে একজন অপরিচিত লোক কীভাবে দেখতে পাও?

তারপর আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন ক্যাপ্টেন। মেট তাকে অনুসরণ করলেন। কিন্তু কেবিনে কেউ নেই। স্টেট রুমেও ঢুকলেন তাঁরা। কিন্তু এখানেও কারও অস্তিত্ব পাওয়া গেল না।

তাহলে, মি ব্রুস, আমি বললাম না তুমি স্বপ্ন দেখেছ? কিন্তু, স্যর, তাকে স্লেটে কিছু লিখতেও দেখেছি আমি!

স্লেটে লিখেছে? তাহলে অবশ্যই ওই লেখা এখানে থাকা উচিত। এই বলে ক্যাপ্টেন ওটা হাতে নিলেন। তারপরই বিস্মিত হয়ে বললেন, হায় খোদা! এখানে আসলেই কিছু লেখা আছে। এটা কি তোমার হাতের লেখা, মি. ব্রুস?

স্লেটটা হাতে নিলেন মেট। এটার লেখা বুঝতে একটুও সমস্যা হলো না তার। এখানে বলা হয়েছে, উত্তর-পশ্চিমে জাহাজ চালাও।

তাঁর ডেস্কে বসে আছেন ক্যাপ্টেন। স্লেটটা সামনে। গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। তারপর স্লেটটাকে উল্টে দিয়ে ব্রুসের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, এখানে লেখো, উত্তর-পশ্চিমে জাহাজ চালাও।

মেট লিখলেন। এবার দুটো হাতের লেখা মিলিয়ে দেখে ক্যাপ্টেন সেকেণ্ড মেটকে ডেকে আনতে বললেন। তিনি আসলে ক্যাপ্টেনের অনুরোধে ওই একই কথা লিখলেন স্লেটে। তারপর লিখলেন স্টুয়ার্ড। একে একে জাহাজের প্রত্যেক কর্মকর্তা আর নাবিকই কথাগুলো লিখলেন। কিন্তু একজনের হাতের লেখাও রহস্যময় সেই লেখার সঙ্গে মিলল না।

নাবিকরা সবাই চলে গেলে আবারও এক মনে চিন্তা করতে লাগলেন ক্যাপ্টেন। একসময় কথা বলে উঠলেন আনমনে, তবে কি কেউ জাহাজে লুকিয়ে আছে? দেরি না করে গোটা জাহাজ তল্লাশির নির্দেশ দিলেন তিনি।

জাহাজের প্রতিটি কোনা-কানাচ, অন্ধিসন্ধি খোঁজা হলো। কিন্তু লুকিয়ে উঠেছে এমন কারো খোঁজ মিলল না।

তারপরই জাহাজের গতিপথ বদলাবার সিদ্ধান্ত নিলেন ক্যাপ্টেন। যাই থাকে কপালে, স্লেটের নির্দেশিত পথেই জাহাজটা নিয়ে যাওয়া স্থির করেছেন তিনি। একজন লোককে সামনে কিছু আছে নাকি তা নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হলো। একটু পরেই সে একটা আইস বার্গের খবর নিয়ে এল। তার একটু পরেই প্রহরী জানাল একটা জাহাজও নজরে এসেছে তার।

কর্নেলের দূরবীন বিধ্বস্ত একটা জাহাজ আবিষ্কার করল। আস্তে আস্তে বরফ ওটার দখল নিয়ে নিচ্ছে। কাছে পৌঁছতেই নিশ্চিত হওয়া গেল জাহাজটা যাত্রী নিয়ে কানাডার কুইবেক থেকে লিভারপুলের দিকে যাচ্ছিল। এখন ওটা পুরোপুরি বরফে আটকা পড়ে আছে। কয়েকটা সপ্তাহ খুব খারাপ অবস্থাতেই কেটেছে ওটার। এমনকি খাবার শেষ হয়ে পানিও প্রায় শেষ হওয়ার পথে ছিল। জাহাজের নাবিক আর যাত্রীরা বাঁচার সব আশা ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছে এমন সময়ই এল সাহায্যটা।

বিধ্বস্ত জাহাজটা উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। নৌকাতে করে সেখান থেকে লোকদের নিয়ে আসা হতে লাগল এই জাহাজে। তৃতীয় নৌকাটা সবে এসে ভিড়েছে জাহাজের কিনারে। একজন একজন করে লোক উঠছে জাহাজে। এমন সময় একটা লোকের চেহারার দিকে দৃষ্টি চলে গেল ফার্স্ট মেটের। ভয়ে শিউরে উঠলেন তিনি। এটাই সেই মুখ। তিন-চার ঘণ্টা আগেই যেটা দেখেছেন, ক্যাপ্টেনের ডেস্কে বসে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এক মুহূর্ত দেরি না ক্যাপ্টেনকে বিষয়টি জানালেন।

বিধ্বস্ত জাহাজের যাত্রীরা একটু সুস্থির হওয়ার পর রহস্যময় সেই আগন্তুকের দিকে ফিরলেন ক্যাপ্টেন। তারপর বললেন, আশা করি, স্যর, আমার আচরণে ব্রিত হবেন না আপনি। কিন্তু দয়া করে যদি এই স্লেটটাতে কয়েকটি শব্দ লিখতেন তবে দারুণ উপকৃত হতাম।  তারপর স্লেটের যেদিকটায় রহস্যময় লেখাটা নেই সেদিকটা ওপরে দিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

আপনি যেটা বলবেন সেটাই লিখতে রাজি আছি আমি। বললেন আগন্তুক, কিন্তু কী লিখতে হবে?

লিখুন, উত্তর-পশ্চিমে জাহাজ চালাও।

সন্দেহ নেই এমন অনুরোধে যাত্রীটি বেশ অবাক হয়েছেন। তবে কিছু না বলে হেসে শব্দগুলো লিখলেন।

এবার ক্যাপ্টেন স্লেটটা টেনে নিয়ে ভালমত পরীক্ষা করলেন লেখাটা। তারপর একপাশে সরে গিয়ে যাত্রীটির থেকে আড়াল করে ওটা উল্টে তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

তাহলে, ওটা আপনার হাতের লেখা? জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন।

মনে হয় না এর জবাব দেওয়ার প্রয়োজন আছে। কারণ আপনিই আমাকে লিখতে দেখেছেন। উত্তর দিলেন যাত্রীটি।

আর এটা। এবার স্লেটটা উল্টে দেখালেন ক্যাপ্টেন।

লোকটা প্রথমে একটা লেখা দেখলেন, তারপর আরেকটা। সন্দেহ নেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছেন। একসময় কথা বলে উঠলেন, এর মানে কী? আমি কেবল একটা লিখেছি। বাকি লেখাটা তবে কার?

এটা আমারও প্রশ্ন। আমার মেট আজ দুপুরে আপনাকে এটা লিখতে দেখেছে, এই ডেস্কে বসে।

বিধ্বস্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন আর যাত্রী অবাক দৃষ্টিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। তারপরই প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে জিজ্ঞেস করলেন, এই স্লেটে লিখছেন, এমন কোনো স্বপ্ন কি আপনি দেখেছেন?

না, স্যর, তেমন কিছু মনে পড়ছে না।

আপনি স্বপ্নের কথা বলছেন। আজ দুপুরের দিকে এই ভদ্রলোক কী করছিলেন? জানতে চাইলেন উদ্ধারকারী জাহাজের ক্যাপ্টেন।

ক্যাপ্টেন, গোটা বিষয়টাই খুব রহস্যময় আর অদ্ভুত বলতে শুরু করলেন বিধ্বস্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন, আরেকটু ধাতস্থ হওয়ার পর ওটা আমি আপনাকে খুলে বলতে চেয়েছিলাম। এই যাত্রীটির শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে গভীর ঘুমে ডুবে যান তিনি, ওটা দুপুরের কিছু সময় আগের কথা। এক ঘণ্টা কিংবা তার কিছুটা পরে ঘুম থেকে উঠে আমাকে বললেন, ক্যাপ্টেন আজই আমরা উদ্ধার পাব। তিনি কীভাবে এটা বলছেন জানতে চাইলে জবাব দিলেন, স্বপ্নে দেখেছেন একটা বারকুতে আছেন। আর ওটা আমাদের উদ্ধারে আসছে। তারপর জাহাজটা এবং ওটার পাল-মাস্তুল এসবের বর্ণনা দিয়ে গেলেন। আর কী আশ্চর্য, যখন আপনার জাহাজটা দেখা গেল, আমরা আবিষ্কার করলাম তাঁর বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে সব। শুরুতে তাঁর কথার ওপর খুব একটা আস্থা ছিল না আমাদের। তারপরও আশা করেছি এর মধ্যে কিছু একটা আছে। জানেনই তো ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায়। তবে সত্যি যখন তার কথা হুবহু ফলে গেল তখন আর সন্দেহ রইল না অদৃশ্য কোনো শক্তির খেয়ালেই এটা হয়েছে।

কোনো সন্দেহ নেই। বললেন বারকুর ক্যাপ্টেন, স্লেটের এই লেখাই আপনাদের জীবন বাঁচিয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমে চলছিল জাহাজ। এই লেখা দেখেই জাহাজের গতি পথ বদলে উত্তরপশ্চিমে চলার নির্দেশ দিই আমি। আর সামনে কী আছে দেখার জন্য একজন প্রহরী দাঁড় করিয়ে দিই। তারপর যাত্রীটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু স্লেটে কিছু লেখার স্বপ্ন দেখেননি আপনি?

না, স্যর। কীভাবে এটা হলো সে সম্পর্কে কিছুই বলতে পারব না আমি। আমার কেবল মনে হয়েছে স্বপ্নে যে জাহাজটা দেখেছি সেটা আমাদের উদ্ধর করতে আসবে। কিন্তু এটা কেন মনে হয়েছে এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আর একটা আশ্চর্য বিষয় হলো, এখানের সব কিছু কেমন পরিচিত ঠেকছে আমার। কিন্তু এতে সন্দেহ নেই আগে কখনও আপনার জাহাজে উঠিনি আমি। পুরো বিষয়টাই বিস্ময়কর। কিন্তু আপনার মেট কী দেখেছে?

মি. ব্রুস এবার তার দেখা পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন।

৩. রাতের অতিথি

রাতের অতিথি

এবারের অভিজ্ঞতাটি লিমেরিকের আর্চডিকন রেভারেণ্ড জে. এ. হেইডেনের। ১৮৭৯ সালের দিকে অ্যালারির একটা চমৎকার গ্রামে বাস করতেন এক ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর। আমার বাসার থেকে তাঁরা যেখানে থাকতেন তার দূরত্ব আট-ন মাইল। ভদ্রলোকের সঙ্গে দারুণ একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার। যখনকার কথা বলছি তখন তার স্ত্রী তৃতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার অপেক্ষা করছেন। ছোটখাট, হ্যাংলা-পাতলা একজন ভদ্রমহিলা তিনি। আসন্ন ঘটনাটা নিয়ে মানসিকভাবেও খুব দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আমার বাড়িতে প্রচুর সময় কাটিয়েছেন। এমনকী এর প্রতিটি কামরা, অন্ধিসন্ধিও তাঁদের খুব ভাল চেনা।

১৮৭৯ সালের ১৭ অক্টোবর, বুধবার। বন্ধুর কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। চিঠিটা পড়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই গতকাল আবার বাবা হয়েছেন তিনি। আর সব কিছু ঠিকঠাকভাবেই এগুচ্ছে। কয়েকটা দিন কেটে গেল। পরের বুধবার রাত দশটার দিকে বিছানায়, গেলাম। আমার স্ত্রী, বাচ্চা আর ভৃত্য দুজন ওপরতলায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এক তলায় স্টাডিতে ছোট্ট একটা বিছানা আছে। কখনও কখনও এখানেই ঘুমাই। অন্ধকারের চাদরে মুড়ি দিয়েছে গোটা বাড়িটা। রাতের নীরবতায় ছেদ টানছে কেবল হলরুমের ঘড়িটার টিক টিক শব্দ।

ঘুম আসবে আসবে করছে এমন সময় হালকা,দ্রুত একটা পায়ের আওয়াজ পেলাম। মনে হলো পলকা দেহের কোনো নারী হল ঘরের দরজা পেরিয়ে ঘরের ভিতর দিয়ে আসছে। তারপর মনে হলো যেন একটু দ্বিধা করল। এবার স্টাডির দিকে আসা বারান্দা ধরে হেঁটে দরজার সামনে এসে থামল। পাতলা, চঞ্চল একটা হাত দরজার হাতল হাতড়াবার আওয়াজ পেলাম। ইতিমধ্যে আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছি, আমার স্ত্রী নীচে নেমে এসেছে। সম্ভবত হঠাৎ কোনো দরকার পড়েছে। বিছানায় উঠে বসে নাম ধরে ডেকে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে। কিন্তু অপর তরফ থেকে কোনো সাড়া পেলাম না। বরং মৃদু শব্দটা থেমে গেল। কৌতূহলী হয়ে ম্যাচ ধরিয়ে একটি মোম জ্বাললাম। কিন্তু মোম হাতে দরজা খুলে কাউকে পেলাম না। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে দেখলাম সবগুলো দরজা লাগানো, অথৈ ঘুমে তলিয়ে আছে সবাই। বিস্মিত হয়ে স্টাডিতে ফিরে এলাম। দোর টেনে মোমটা জ্বেলে রেখেই আবার বিছানায় গেলাম। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টের পেলাম তার উপস্থিতি। আগের ঘটনাটারই পুনরাবৃত্তি ঘটল যেন। তবে এবার দরজার হাতল চেপে ধরেছে অদৃশ্য হাতটা। অর্ধেক ঘুরালও, তারপর থেমে গেল। বিছানা থেকে নেমে আগের মতই খোঁজাখুঁজি করলাম। কিন্তু একটা জনপ্রাণীর দেখাও পেলাম না। ঘড়িতে এগারোটা বাজল। তারপর সব কিছু থেমে গেল।

শুক্রবার একটা চিঠি পেলাম। এটা পড়েই জানতে পারলাম আমার বন্ধু পত্নীটি বুধবার রাতে মারা গিয়েছেন। দেরি না করে অ্যাডারিতে হাজির হলাম। প্রিয় বন্ধুকে সান্ত্বনা দিলাম, তার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললাম। তবে আলাপচারিতার একটা অংশ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরব। তিনি জানালেন বুধবার সকাল থেকে তাঁর স্ত্রীর অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। রাতে রীতিমত প্রলাপ বকতে শুরু করেন। অসংলগ্নভাবে এমন ভাবে কথা বলতে থাকে যেন একসময়ে খুব পরিচিত আর চেনা জায়গাগুলোতে আবার হাজির হয়েছে। ভাবছিল ও তোমার বাসায়। বললেন বন্ধুটি, মনে হলো যেন তোমার সঙ্গে কথাও হয়েছে তার। কারণ কখনও কখনও কথায় বিরতি টানছিল, যেন তোমার কথা বা জবাব শুনছে। আমার মাথায় তখন অন্য একটা চিন্তা ঢুকে পড়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক কোন সময় আমার সঙ্গে তার এই কাল্পনিক আলাপচারিতার ঘটনা ঘটেছে বলতে পারবেন কিনা? বন্ধুটি জানালেন সময়টা নির্ভুলভাবেই বলতে পারবেন। কারণ ওসময় তাঁর ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়েছিলেন। ওটা সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মাঝখানে। তাহলে আমার অনুমানই ঠিক, ভাবলাম। ওই সময়ই আমার বাসায় পাতলা শরীরের একজন নারীর উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম।

৪. রহস্যময় আলো

রহস্যময় আলো

আয়ারল্যাণ্ডের এক নারী তার নিজের এই অভিজ্ঞতাটি পাঠিয়েছিলেন। এটা উনিশ শতকের শেষদিককার ঘটনা। চলুন মহিলাটির মুখ থেকেই শুনি।

আমার এক বোন ছিল। আমার বাসা থেকে বেশ দূরে তার বাসা। শরীর কখনওই খুব একটা ভাল থাকত না তাঁর। একবার বেশ কিছুদিন দেখা না হওয়ায় আমাকে যাওয়ার জন্য লিখলেন। আমিও সম্মতি জানিয়ে দিলাম। কোন দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব তাও স্থির করে ফেললাম। তখন ফেব্রুয়ারি মাস। যেদিন যাব তার আগের দিন সন্ধ্যায় ছোট্ট বসবার কামরাটায় আগুনের ধারে বসে আছি। ঘড়িতে দেখলাম পাঁচটা বাজে। ফায়ারপ্লেসের আগুন ছাড়া কামরায় আর কোনো আলো নেই। ওটার পাশেই একটা আরাম কেদারা। আমার বানটি যখন এ বাড়িতে আসেন তখন সাধারণত ওখানেই বসে সময় কাটান। এসময়ই হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠল আরামকেদারাটা। আলোটা এত উজ্জ্বল যে মনে হলো যেন ওটার ঠিক নীচে একটা বাতি রেখে দিয়েছে কেউ। অথচ ওটা ছাড়া গোটা কামরাটাতেই আলো আঁধারির খেলা। অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, কী হলো চেয়ারটার? পরমুহূর্তেই আলোটা অদৃশ্য হলো। চেয়ারটা আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল।

পরদিন সকালে জানতে পারলাম গত সন্ধ্যায় আমার বোন পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। আর মারা গেছেন ঠিক ওইসময়ই যখন রহস্যময় আলোটা দেখা গিয়েছিল আরাম কেদারাটায়।

৫. দরজার সামনের লোকটা

দরজার সামনের লোকটা

এই কাহিনিটি প্রকাশ করেছেন গ্রিন পার্কের মিস গ্রীন। আর এটা তাঁকে বলেছিলেন তাঁর পরিচিত এক অভিজাত নারী।

ভদ্রমহিলা তখন তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ডাবলিনের শহরতলীর এক বাড়িতে থাকতেন। বাড়ির সামনেই ঘাসে ঢাকা জমি। একে দু-ভাগ করে দিয়েছে কাঁকর বিছানো একটা পথ। রাস্তার দিকে মুখ করা গেটটা পর্যন্ত চলে গেছে পথটা।

সেদিন বাড়ির সামনের দিকের একটা কামরায় বসে সেলাইয়ের কাজ করছেন মহিলা দুজন। এসময়ই গেট খোলার শব্দ পেলেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে পরিচিত একজন বয়স্ক মানুষকে পথটা দিয়ে হেঁটে আসতে দেখলেন। তিনি যখন দরজার দিকে এগিয়ে আসছেন দুজনেই উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলেন, ওহ

কী সৌভাগ্য, তিনি আমাদের দেখতে এসেছেন।

কিন্তু কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পরও তাঁকে বসবার কামরায় আসতে না দেখে তাদের একজন বেল বাজালেন। পরিচারিকা মহিলাটি এলে বললেন, তাদের পরিচিত ভদ্রলোকটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে বলা হলো সে যেন তাড়াতাড়ি তাঁকে ভিতরে নিয়ে আসে। পরিচারিকাটি হলঘরের দরজার দিকে গেল। কিন্তু একটু পরেই সে ফিরে এসে জানাল সেখানে কেউ নেই। পরদিন বান্ধবী দুজন জানতে পারলেন গতদিন যে সময় পথটা ধরে হেঁটে আসতে দেখেছেন ভদ্রলোকটিকে, সেসময়ই মারা গেছেন তিনি।

 

ভুতুড়ে প্রাণী

মানুষের ভূত বা অতৃপ্ত আত্মা থাকতে পারলে অন্য প্রাণীদের থাকবে না? ‘ভুতুড়ে প্রাণী’তে রোমাঞ্চিত হবেন এমন প্রাণীদের নিয়ে কিছু ভৌতিক ঘটনার বর্ণনা শুনে।

অশুভ সাদা বাঘ

চার্লস দ্য সিলভা নামের এক লোক ভারতের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। পূর্ণিমা না হলেও চাঁদের বেশ আলো আছে। এসময়ই পিছন থেকে ট্যাপ, ট্যাপ, ট্যাপ শব্দ শুনলেন। চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়েই অসহায় একটা লোককে দেখলেন। সে শুধু যে অন্ধ আর খোড়া তাই নয় তার শরীরে বাসা বেঁধেছে ভয়ঙ্কর কুষ্ঠ। এদিকে বেচারা চার্লস দ্য সিলভা, জঙ্গলকে যতটা ভয় পান তার চেয়েও বেশি ভয় পান কুষ্ঠকে। দ্রুত বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলেন। তবে অন্ধ লোকটার লাঠির ট্যাপ, ট্যাপ, ট্যাপ তাঁকে অনুসরণ করতে লাগল। ধীরে ধীরে যেন তাদের মধ্যে ব্যবধান আরও কমতে লাগল। লোকটার শরীরে মাখা তেলের, যেটা কুষ্ঠে রঞ্জিত হয়ে সাদা হয়ে গেছে, গন্ধও যেন পাচ্ছেন সিলভা।

সাহেব, তুমি যেই হও, দাঁড়াও। অনুনয় করল অসহায় লোকটা।

কিন্তু সিলভা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলেন। এসময়ই হঠাৎ সামনের ঝোপ ফাঁক করে একটা শিয়ালকে আবির্ভূত হতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। প্রাণীটা এমনভাবে তাকাল যে শরীরে কাঁপন ধরে গেল সিলভার। তারপরই যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল ওটা। তারপর আরও একটা শিয়াল এল। তবে, ওটা আগেরটার মত অদ্ভুতুড়ে না। তাকে দেখে ছুটে পালাল শিয়ালটা।

ট্যাপ, ট্যাপ, ট্যাপ। আবার কাছাকাছি হলো কুষ্ঠরোগী। তবে এবার আশপাশে একটা বাঘের উপস্থিতির আশংকা করায় লোকটার উপস্থিতিতে অখুশি হওয়ার বদলে বরং কৃতজ্ঞতা অনুভব করলেন সিলভা। লোকে বলে শিয়াল নাকি বাঘ ডেকে নিয়ে আসে। আর ভারতের জঙ্গলে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক শিকারীরই।

কুষ্ঠরোগী অনুনয় করে বলল, খোদার দোহাই, সাহেব, থামো! শিয়ালগুলোকে দেখনি? গন্ধ তাদের পরিচয় ফাস করে দিয়েছে আমার কাছে। দয়া করে আমার সঙ্গে হাঁটো, সাহেব।

কিন্তু তাকে সাহায্য করার বদলে সিলভা যে কাজটা করলেন এর জন্য তাকে সারা জীবন ভুগতে হলো। সিলভা ওই মুহূর্তে নিজের বিবেককে বুঝালেন তিনি তাঁর স্ত্রীকে গভীরভাবে ভালবাসেন। অপর দিকে এই কুষ্ঠরোগীর না আছে কোনো স্ত্রী, সন্তান আর ভবিষ্যৎ। যেদিকে বাঘটা ঘাপটি মেরে আছে বলে সন্দেহ করছেন সেদিকে একটু এগিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে সরে পড়লেন সিলভা। এদিকে অন্ধ লোকটা আস্তে আস্তে তাকে পেরিয়ে গেল। যাবার সময় লাঠিটা এক চুলের জন্য সিলভার পা স্পর্শ করল না। রাস্তাটা যেখানে দু-ভাগ হয়েছে সেখানে দাঁড়াল অন্ধ কুষ্ঠরোগী। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় তাকে খুব ফ্যাকাসে আর অসুস্থ দেখাচ্ছে। দৃষ্টিহীন দুই চোখ চারদিকে ঘুরাচ্ছে, পথের দিশা পাচ্ছে না। এসময়ই অন্ধকার জঙ্গল থেকে বিশাল একটা প্রাণী লাফ দিল। এক মুহূর্তের জন্য সিলভা ভাবলেন তার জীবনের অন্তিম সময় উপস্থিত। তারপরই কুষ্ঠরোগীর আতংকিত চিৎকার শুনতেই বুঝে গেলেন এ যাত্রা রেহাই পেয়ে গেছেন। ওদিকে তাকাতেই দেখলেন বিশাল একটা বাঘ হতভাগা লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

কয়েক ঘণ্টা পরের ঘটনা। সিলভা নিরাপদেই বাড়ি পৌঁছেছেন। এসময় হঠাৎ আবার যেন ভয়ঙ্কর সেই চিৎকারটা শুনতে পেলেন। আর এর সঙ্গে যেন মৃত লোকটার তাঁকে অভিশাপ দেওয়ার শব্দও কানে এসে বাজল। তাঁর স্ত্রীকে এটার কথা বললেন না সিলভা। এমনকী ঘটনাটা বললেন অনেক রেখেঢেকে।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তুমি বেঁচে গেছ। বললেন ভদ্রমহিলা, তবে দুর্ভাগা কুষ্ঠ রোগীর জন্য খুব মন খারাপ হচ্ছে আমার। আমার ধারণা তোমারও কিছু করার ছিল না।

আমার রাইফেলটা সঙ্গে রাখতে পারতাম। অপরাধবোধে ভুগছেন এমন ভাব করলেন সিলভা, তবে তাতেও মনে হয় না লোকটাকে বাঁচানো যেত।

তবে আলাদাভাবে ব্যক্তিগত পরিচারক কুসাইকে কুষ্ঠরোগীর অভিশাপের বিষয়টা বললেন।

ওহ খোদা! ওটা মনে হয় নাহরা। বলল সে। আপনাকে যদি অভিশাপটা সে দিয়ে থাকে, তবে সাবধান! সে কালো জাদু জানে। একটা প্রার্থনা করে পেটের ব্যামো সারিয়ে দিতে পারত, আবার চাইলে যে কারও শরীরে জ্বর নামাতে পারত।

ভয়ে কেঁপে উঠলেন চার্লস দ্য সিলভা। ভারতে অনেক বছর ধরেই আছেন তিনি। তার এটাও জানা আছে এখানকার কোনো কোনো লোক অস্বাভাবিক আর অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। কুসাইকে তার ছোট্ট ছেলেটার দিকে নজর রাখতে বললেন। স্ত্রীকে বাঘটা না মারা যাওয়া পর্যন্ত তাঁর কোনো আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে থাকতে বললেন। কিন্তু ভদ্রমহিলা রাজী হলেন না।

শুকনো মৌসুম পার হলো, বর্ষা এল। তবে সিলভারা তাঁদের পুরানো বাসস্থানেই আছেন। জঙ্গলের সেই ভয়ঙ্কর রাতের অভিজ্ঞতার এক বছর পর ভয়াবহ একটা মানুষখেকো বাঘের খবর এল সিলভার কাছে। তবে তার আত্মা পানি করে দিল খবরের যে অংশটা তা হলো, যে-ই বাঘটার আক্রমণের শিকার হয়ে বেঁচে ফিরছে সে-ই কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সিলভা কুসাইয়ের কাছে জানতে চাইলেন বাঘটাকে সবাই, সাদা বাঘ বলে কেন?

কারণ, সাহেব, কুষ্ঠ রোগ হয়েছে। মানুষের মত ওটার শরীরও এই রোগে সাদা হয়ে গেছে। তবে আমি লোকেদের আপনার গল্পটা বলিনি। তারা শুধু জানে বাঘটার কুষ্ঠ হয়েছে।

কপালে যা থাকে, সাদা বাঘটার একটা হেস্তনেস্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন সিলভা। তাঁর উইনচেস্টার রিপিটার রাইফেলটা নিয়ে বাঘটার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। হন্যে হয়ে ঘুরলেন কয়েকটা দিন। তারপরই ভয়াল প্রাণীটার মুখোমুখি হলেন। এক লোককে মেরে পৈশাচিক একটা ভোজের মাঝপথে তখন ওটা। পর পর দুটো গুলি করলেন সিলভা। দ্বিতীয় গুলিটা বাঘটার কপালে ঢুকল। মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে গেল প্রাণীটা।

অভিশাপে এখন আর কিছু আসে যায় না আমার, কুসাই, হাসতে হাসতে বললেন সিলভা। সাদা বাঘটাকে মেরে ফেলেছি। আমি।

এত তাড়াতাড়ি হাসবেন না, সতর্ক করল কুসাই। নাহরা খুব ধূর্ত।

কিছু দিন পরের ঘটনা। রেলওয়ের একটা ভবন তৈরির কাজ তদারকি করছেন সিলভা। এসময়ই হঠাৎ সাদা বাঘের ভয়াবহ গর্জন শুনলেন। রড, শাবল ফেলে শ্রমিকরা চম্পট দিল। দ্রুত রাইফেলটা হাতে নিয়ে, গজ পঞ্চাশেক দূরে আবির্ভূত হওয়া সাদা প্রাণীটার দিকে নিশানা করলেন সিলভা। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর, কেবল কয়েক দিন আগে যে প্রাণীটাকে মারলেন সেটা আবার ফিরে এল কীভাবে? নিঃশব্দে, ধীরে-সুস্থে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে ওটা। দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা করার জন্য দৃঢ়সংকল্প সে। এসময় হঠাৎ সিলভার মনে হলো তার স্ত্রী আজ এখানে তাঁদের ছেলে এরিককে নিয়ে এসেছে। বাঘটার মনোযোগ নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ছুট লাগালেন। তারপরই যে দৃশ্যটা দেখার আশঙ্কা করেছেন সেটাই দেখলেন। লাফ দেওয়ার ভঙ্গিতে রয়েছে বাঘটা। আর তার স্ত্রী, ছেলে আর আয়া আতংকে পাথরের মত জমে গিয়েছে। প্রাণীটা জীবিত নাকি এটা ওটার প্রেতাত্মা জানেন না সিলভা। শুধু দেখলেন তার ছেলে এরিকের দিকে তাকিয়ে থাকা প্রাণীটার শরীর কাঁপছে। আর এক মুহূর্ত, তারপরই বাঘটা কিংবা তার প্রেতাত্মাটা লাফিয়ে পড়বে। লাফ দিল ওটা। গুলি করলেন সিলভা। কিন্তু তখনই দেখলেন বাঘ না, তাকে ভেংচি কাটছে নাহরা। পাথরে গুলি লাগার শব্দ হলো, ব্যাং। দ্রুত দৌড়ে গেলেন। তাঁর স্ত্রী আর ছেলে ভাল আছে, তবে আমার জ্ঞানহীন দেহ মাটিতে পড়ে আছে। এদিকে বাঘ আর নাহরা দুজনেই অদৃশ্য হয়েছে।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললেন সিলভা। এটা কেবল একটা প্রেতাত্মা ছিল। তবে জীবনে এত ভয় কখনও পাইনি।

ভয়ংকর, হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন তার স্ত্রী। তবে আমার একে সত্যি মনে হয়েছে। যেমন এরিক, যেমন…এসময়ই আয়ার দিকে দৃষ্টি গেল তাঁর। তারপরই আবিষ্কার করলেন সে মারা গেছে। ভয়েই মারা গেছে ভারতীয় মেয়েটা।

এসময়ই সিলভা তার স্ত্রীকে বললেন নাহরার অভিশাপের কথা। তারপর এটাও বললেন বাঘটাকে আসল মনে করে ছেলেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টায় আয়াকে মাঝখানে ঠেলে দিয়েছিলেন তিনি। পরে বাসায় ফিরে এরিকের গালে লাল, চিকন ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ল তাদের। দেখে মনে হলো বাঘের নখের আঘাতে এটা হয়েছে। কিছুদিন পরেই কুষ্ঠ রোগ ধরল এরিককে। এক মাস পরে মারা গেল ছেলেটি। ভারত ছেড়ে ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশে যাত্রা করলেন সিলভা আর তার স্ত্রী। তবে রওয়ানা হওয়ার আগে কুসাই সিলভাকে বলল, আমি জানি একটা ফাঁড়ায় পড়েছিলেন আপনারা। নাহরা চমৎকার একজন মানুষ। আর এখন তার অভিশাপ পূরণ হয়েছে। এবার নিশ্চিন্ত হতে পারেন, আর কোনো ক্ষতি আপনাদের হবে না। আজ সকালে স্বপ্নে নাহরাকে দেখেছি আমি। নাহরা বলেছে সে আর সাদা বাঘের আত্মা দুজনেই এখন শান্ত হয়ে গেছে। আপনারও আর কোনো ক্ষতি তারা করবে না।

কিন্তু প্রেতাত্মার নিশ্চয়তা এল অনেক পরে, ছেলেকে হারিয়ে তাঁদের আর তখন কিছুতেই কিছু আসে যায় না।

কালো কুকুরের আতংক

ইংল্যাণ্ড, আয়ারল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কালো কুকুর নিয়ে প্রচলিত আছে নানান ধরনের ভৌতিক কাহিনি। তবে এদের অনেকগুলোতেই রং চড়েছে। আমাদের এবারের সংকলনে এসব কাহিনি থেকে একটি তুলে ধরছি পাঠকদের সামনে।

অভিজ্ঞতাটি চার্চ অভ ইংল্যাণ্ডের এক যাজকের। নিশ্চিত কোনো প্রমাণ না থাকলেও তাঁর এই কাহিনিটিতে ফাঁক-ফোকর নেই সে অর্থে। তাঁর মুখ থেকেই আমরা এখন শুনব এটি।

আমার কিশোর বয়সের ঘটনা। বাবা-মার সঙ্গে মফস্বল এলাকায় থাকি। বাবা তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অবসরে কিছু চাষ-বাস করতেন। তাঁর নিয়মিত কোনো কামলা ছিল না। তবে যখন দরকার হয় রোজ হিসাবে কিছু কামলা কাজে লাগান। এসময় এই মজুরদের সঙ্গে খেতে কাজ করে বেশ মজা পেতাম আমিও। মনোযোগ দিয়ে শুনতাম তাদের কথা-বার্তা। একদিন এই কাজের সময় শুনলাম একজন মজুর বলছে সে একবার শয়তান দর্শন করেছে। কৌতূহলী হয়ে তাকে ঘটনাটি খুলে বলতে বললাম। লোকটা বলল একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল সে। হাঁটতে হাঁটতে এমন একটা জায়গায় চলে এল যেখানে একটা ব্যক্তিগত এলাকার শুরু। ঢোকার মুখে বিশাল একটা গেট (জায়গাটা আমার নিজেরও খুব পরিচিত)। এসময়ই রাস্তার ধারে একটা কালো কুকুরকে বসে থাকতে দেখল। শুরুতে এটাকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করল না। ভাবল এটা সাধারণ একটা রিট্রিভার। কিন্তু দুই কি তিনশো গজ এগোনোর পর দেখল কীভাবে যেন ওটা তার পাশে চলে এসেছে। কুকুরটার চোখ রক্তের মত টকটকে লাল। ওটাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্য ঝুঁকে কিছু পাথর তুলে নিল সে। কিন্তু একটার পর একটা পাথর ছুঁড়ে মেরেও ওটাকে বিন্দুমাত্র আহত করতে পারল না, এমনকী ওগুলো ওটার গায়ে লাগছে বলেই মনে হলো না। তারপর হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেল প্রাণীটা।

মজুরের গল্পটা এখানেই শেষ। কয়েক বছর পরের ঘটনা। ইতিমধ্যে তার বলা কাহিনিটা একবারেই ভুলে গেছি। এসময়ই আমার এক বন্ধুর পরিবার, যে বাড়িটার প্রবেশদ্বারের সামনে ঘটনাটি ঘটেছে ওই বাড়িটা কিনে নিল। তারা সেখানে বসবাস শুরু করার পর বাড়িটাতে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলাম। এখানে আসার পর থেকেই একটা কালো কুকুর নিয়ে ঝামেলায় পড়ে তারা। সত্যি বলতে আমি কখনও দেখিনি ওটাকে। তবে বন্ধুর পরিবারের অনেকের সামনেই দেখা দিয়েছে ওটা। বাড়ির দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা বেশ লম্বা। আর হঠাৎ হাজির হয়ে ললাকেদের রাস্তার বড় একটা অংশ সঙ্গ দেওয়ার বদভ্যাস গড়ে ওঠে অশুভ কুকুরটার। শেষমেশ ওটার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে আমার বন্ধুরা এই বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় বসবাস শুরু করে। আর তাদের এই অভিজ্ঞতা যেন বেশ কয়েক বছর আগে বলা মজুরের কাহিনিটিরই সত্যতা প্রমাণ করে।

আয়ারল্যাণ্ডের ভৌতিক বিড়াল

আয়ারল্যাণ্ডের ডাবলিনের উপকূলের কাছে কিলাকি হাউস নামে একটি বাড়ি আছে। বিশালাকায় একটা কালো বিড়াল এখানে দেখে গেছে অনেকবারই। বিশেষ করে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে এই বিড়ালটা নানান ধরনের অঘটনের জন্ম দেয়। এমনকী এখনও হঠাৎ হঠাৎ হাজির হয়ে লোকজনকে ভয় পাইয়ে দেয় ওটা।

মিসেস মারগারেট ওব্রেইন নামের এক মহিলা আইরিশ আর্ট সেন্টার স্থাপনের জন্য কিলাকি হাউস কিনবার পর থেকেই মূলত বিড়ালটাকে দেখা যেতে শুরু করে। সেসময় অট্টালিকাটির সংস্কার কাজ চলছিল। আর তখনই প্রথম ওটাকে দেখা যায়। যদিও এ ধরনের একটি ভৌতিক কালো বিড়ালের উপস্থিতির গুজব এই এলাকায় ছড়িয়ে ছিল অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে।

নামী চিত্রকর টম ম্যাকাসে মিসেস ওব্রেইনের সঙ্গে বাড়িটার সাজ-সজ্জায় ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। দুজন শ্রমিকও সাহায্য করছিল কাজে। এক রাতে একটা দরজা লাগিয়ে ছয় ইঞ্চি লম্বা একটা স্কু দিয়ে ভালভাবে আটকে দেন তারা। কিছুটা সময় পেরোনোর পরই ওটা অদৃশ্য হয়। আপনা আপনি যেন দরজাটা খুলে গেল। শ্রমিক দুজন সহ গ্যালারিতে হাজির হলেন ম্যাকাসে, কী ঘটেছে দেখতে। অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না ঠিকমত। এসময়ই এক কোনায় কালো ছায়ার মত একটা জিনিস নজরে পড়ল। ম্যাকাসে ভাবলেন কেউ তাদের সঙ্গে মজা করছে। জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন, যেই থাক বেরিয়ে এসো। আমরা তোমাকে দেখতে পেয়েছি।

কর্কশ কণ্ঠে কেউ জবাব দিল, তুমি কখনওই আমাকে দেখতে পাবে না। দরজা খোলা রাখো। তা না হলে, আমার জানা আছে কীভাবে বেরোবার পথ খুঁজে নিতে হয়।

এরপর আর সেখানে দাঁড়াবার সাহস করল না শ্রমিক দুজন। এই কামরা থেকে পালাল তারা। দরজা লাগিয়ে সরে এলেন ম্যাকাসেও। তারপর আঁর চোখের সামনে নিজে থেকেই খুলে গেল দরজাটা। বড়সড় কুকুরের আকারের একটা কালো বিড়াল হলরুমে হাজির হলো, পরমুহূর্তেই অদৃশ্য হলো।

আয়ারল্যাণ্ডের পোল ভোল্ট চ্যাম্পিয়ান ভাল ম্যাকগান অনেকবারই রহস্যময় এই কালো বিড়ালটিকে দেখেছেন। এমনকী একবার নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে গুলিও ছোঁড়েন ওটার দিকে। তবে এতে বিড়ালটার কোনো ক্ষতি হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

নীল চোখের বানর

এবারের কাহিনিটি বলেছেন আমেরিকার মিসৌরির ক্যারলিন নামের এক নারী। আমরা বরং এটা তার মুখ থেকেই শুনি।

বছর তিনেক আগের একটা দিন। তখন মোটামুটি ভোর সাড়ে পাঁচটার মত বাজে। আমি এবং আমার স্বামী আমাদের শোবার ঘরে ঘুমাচ্ছিলাম। আর বাচ্চাদুটো তাদের নিজেদের কামরায়। এসময়ই হঠাৎ আমার বড় ছেলে জেমস আমাদের ঘরে ঢুকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল আমাকে। বলল একটা কিছু তাকে ঘুম থেকে তুলে ফেলেছে। ভাবলাম কোনো স্বপ্ন-টপ্ন দেখেছে। তাই বললাম আবার বিছানায় গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে। সকালে নাস্তার সময় হলে তাকে জাগিয়ে দেব। কী মনে করে আমার কথা মেনে নিল ও। তারপর কামরাটা থেকে বের হয়ে হলওয়ে ধরে তার শোবার ঘরের দিকে চলে গেল।

কিন্তু একটু পরই জেমসকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুনলাম। আমি এগোবার আগেই জোরে দৌড়ে আসার শব্দ শুনলাম ওর। আমার রুমে ঢুকেই বিছানার ওপর লাফিয়ে পড়ল। কী হয়েছে বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। ও কেবল বলল আমার বিছানায় ওটা উঠেছে। বার বার একই কথা বলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত বুঝিয়ে-শুনিয়ে অনেক কষ্টে শান্ত করা গেল ওকে। এবার বললাম পুরো ঘটনা ধীরে-সুস্থে খুলে বলতে। তারপর সে যেটা বলল সেটা হজম করা কঠিনই হলো আমার জন্য।

জেমস যখন নিজের কামরায় দরজা দিয়ে ঢুকছে তখন অবাক হয়ে দেখে বানরের মত, তবে অনেক বড় একটা জিনিস তার বিছানায় বসে আছে। শুধু তাই না একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে ওটা। এত জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল যে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিল সে। তারপরই বলল, ওটার চোখের রং তার চোখের রংয়ের মত। কিন্তু জেমসের চোখের রং নীল। একটা বানরের চোখের রং নীল হবে এটা বিশ্বাস করি কীভাবে? জিজ্ঞেস করলাম কেমন করে বুঝল ওটা বানরই ছিল। জবাবে চেহারাটার বর্ণনা দিল। আর বলল ওটার দিকে সে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল যে প্রাণীটার পায়ের লোমও দেখতে পাচ্ছিল।

জেমস যা বলছে তা বিশ্বাস করা কঠিন। আশপাশে কোনো বন নেই। কথা নেই বার্তা নেই, একটা বানরের মত দেখতে প্রাণী হাজির হবে কীভাবে। তারপর আবার ওটার চোখ নাকি নীল। কিন্তু ঘটনা হলো ওর বয়স খুব কম নয়। আর কখনও বানিয়ে বা মিথ্যা কিছু বলার অভ্যাস নেই তার। ওর সঙ্গে কামরাটায় গেলাম। সেখানে গিয়ে একটা ধাক্কা খেলাম। বিছানার যে কোনাটায় ওটা বসেছিল বলছে সে জায়গাটা গভীরভাবে দেবে গেছে। মনে হয় যেন ভারি কিছু বসেছিল। এবার আমিও নিজে আতংকিত হয়ে পড়লাম। তারপর থেকে এই কামরাটায় থাকতে জেমসকে মানা করে দিয়েছি। এখন সে তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে একই কামরায় থাকে।

 

ভুতুড়ে কামরা

বিশেষ কোনো কামরাকে ঘিরেও ঘটতে থাকে ব্যাখ্যার অতীত নানান আজগুবি কাণ্ডকীর্তি। ‘ভুতুড়ে কামরা’য় পাবেন এসব কামরার কাহিনি ‘সব ভুতুড়ে’।

১. আলমারিতে কঙ্কাল

আলমারিতে কঙ্কাল

এই কাহিনিটি শুনিয়েছেন সিঙ্গাপুরের এক ব্যাংক কর্মকর্তা। তাঁর এক বান্ধবীর অভিজ্ঞতা এটা।

আমার বান্ধবী তার মার সঙ্গে থাকে। আন্টি আবাসিক একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান দেখভাল করেন।

মধ্যবয়স্ক এক মহিলা ওখানের একটা কামরায় থাকতেন। একদিন হঠাৎ মারা গেলেন তিনি। কামরাটা পরিষ্কার করতে গিয়েই আলমারির মধ্যে একটা কংকাল আবিষ্কার করলেন আন্টি আর অন্যরা। কঙ্কালটা কীভাবে আসল সেখানে তা কেউই বলতে পারবে না।

এরপর থেকে মহিলাটির মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে ওই কামরাটা থেকে অদ্ভুত একটা বদ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। প্রথম বছর ওটার কারণ খুঁজতে আন্টি গিয়েছিলেন ভিতরে। কিন্তু ওটা এতটাই তীব্র যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় তার। কোনো মতে পালিয়ে বাঁচেন। পরের বছর থেকে গন্ধটা একটু হালকা হয়, কিন্তু মৃত্যুবার্ষিকীর দিন নিয়ম করে ওটার উপস্থিতিতে কোনো ছেদ পড়েনি।

গত বছর মহিলাটির মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে আমার বান্ধবী ওই কামরার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে যাবে এমন সময় মনে হলো পিছন থেকে তার নাম ধরে ডাকছে কেউ। কণ্ঠটা তার মায়ের আর ওটা আসছে ওই ভুতুড়ে কামরাটার ভিতর থেকে!

কিন্তু সে নিশ্চিত মিনিট কয়েক আগেও তার মা ছিলেন নীচের তলায়। আবার বান্ধবীটির নাম ধরে ডাকল। সন্দেহ নেই। কামরাটার ভিতর থেকেই আসছে ওটা। ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সে। তাকে যেন কেউ টেনে নিয়ে চলেছে। যতই কাছে যাচ্ছে গন্ধটা তত তীব্র হচ্ছে। এসময়ই শুনল তার মা তাকে ডাকছেন। কণ্ঠটা চড়া আর পরিষ্কার।

তবে আসছে নীচের তলা থেকে!

সঙ্গে সঙ্গে ঘোর কেটে গেল। দৌড়ে নীচে নেমে মাকে সেখানে পেল। তাকে ঘটনাটা খুলে বলতেই দারুণ একটা ধাক্কা খেলেন। তবে যতটা না ভয় পেলেন তার চেয়ে বেশি রেগে গেলেন। কিন্তু অশরীরীর বিরুদ্ধে কী-ই বা করার আছে তাঁর।

যতদূর বোঝা যাচ্ছে মৃত মহিলাটি সেদিন ওই কামরার মধ্যে ঢুকাতে চেয়েছিল আমাকে। আমার বান্ধবীটি আমাকে বলল, ভাগ্য ভাল। একেবারে ঠিক সময়ে মা আমাকে ডাকটা দিয়েছেন।

২. রুশ ভূত

রুশ ভূত

এবার যে কাহিনিটি বলব এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন মি. ডব্লিউ. ডি. এডিসন। আর এটা তিনি পাঠান মি. ডব্লিউ. টি. স্টিডকে, যিনি এটা প্রকাশ করেন বর্ডারল্যাণ্ডে।

১৮৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়াতে মি. এডিসনের বাসায় ঘটনাটি ঘটে। মাত্র সপ্তাহ পাঁচেক আগে তাঁদের প্রথম সন্তানটি পৃথিবীতে এসেছে। তাই ড্রইং রুমে পাতা একটা বিছানায় আপাতত ঠাই হয়েছে এডিসনের। খুব একটা বড় না হলেও বাসাটা বেশ খোলামেলা আর আলো-বাতাস ঢোকার বেশ ভাল সুযোগ আছে।

ঘটনার রাতে দশটার একটু পর পরই বিছানায় চলে গেলেন এডিসন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তলিয়ে গলেন গভীর ঘুমে। সাধারণত সকাল পর্যন্ত টানা ঘুম হয় তাঁর। তবে এই রাতে স্বপ্নহীন ছোট্ট একটা ঘুমের পরেই জেগে উঠলেন। কেন যেন মনে হয়েছে কেউ মাম ধরে ডেকেছে তাঁকে। উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা ভেবে চিন্তাটা ঝেটিয়ে বিদায় করে দেবেন এমন সময় আবার শুনলেন শব্দটা। ফিসফিস করে সত্যি কেউ তার ডাক নাম ধরে ডাকছে, উইলি। এখন যে নার্সটি বাচ্চাটার দেখাশুনা করে আর শোবার ঘর লাগোয়া ডাইনিংয়ে থাকে, কয়েক দিন হলো সে অসুস্থ। গত সন্ধ্যায়ও তার স্ত্রী এডিসনকে ডেকে নিয়ে গেছেন সাহায্য করার জন্য। কাজেই যখন ফিসফিস শব্দটা শুনলেন প্রথমেই তার মনে হল, ওহ! বাবুটা যন্ত্রণা করছে আবার।

কামরাটায় জানালা আছে তিনটা। আকাশে চাদনেই তবে তারারা ঝলমল করছে। এদিকে তুষার পড়ার কারণে এতে প্রতিফলিত আলোও আছে। কাজেই ঘরের ভিতরটা অন্ধকার বলা যাবে না।

মাথা ঘুরিয়ে বিছানার কিনারায় একটা নারী মূর্তি আবিষ্কার করলেন এডিসন। কোনো ধরনের চিন্তা ছাড়াই ধরে নিলেন ওটা তার স্ত্রী।

কী ঘটনা? জানতে চাইলেন।

কিন্তু ছায়ামূর্তিটা নীরব আর স্থিরই রইল। ইতোমধ্যে অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে এডিসনের। লক্ষ করলেন, নারীদেহটার কাঁধ আর মাথা ধূসর একটা শালে ঢাকা। তারচেয়ে বড় কথা কাঠামোটা তাঁর স্ত্রীর তুলনায় আরও বেঁটে। একদৃষ্টিতে ছায়ামূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভাবছেন কে হতে পারে এটা?

এবার এখানকার ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী চাও?

কিন্তু উত্তর মিলল না। এসময়ই মনে হলো এটা মনে হলো তাঁদের কাজের মেয়েটা। ওর ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়াবার বদভ্যাস আছে। এডিসনের শয্যার কাছেই একটা টেবিল আছে। ছায়ামূর্তিটার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই ম্যাচবাক্সটা নেওয়ার জন্য টেবিলের কাছে পৌঁছলেন। ম্যাচবাক্সটা হাতে নিলেন। কিন্তু কাঠিটা জ্বালার আগেই তাকে চমকে দিয়ে কাঠামোটা যেন মেঝে থেকে শূন্যে উঠে গেল। তারপর পিছু হটতে হটতে কামরার শেষ প্রান্তের জানালাটার দিকে সরে পড়ল। ধীরে ধীরে মলিন হতে হতে জানালায় যখন পৌঁছল, ঝাপসা একটা ধূসর অবয়বে পরিণত হয়েছে। ম্যাচের কাঠি ধরাতে ধরাতে পুরোপুরি অদৃশ্য হলো। মোমবাতি জ্বেলে লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে দৌড়ে গেলেন এডিসন। ওটা লাগানো। ড্রইং রুমের পাশেই একটা সাজঘর আছে। কামরা দুটোকে আলাদা করেছে কেবল একটা পর্দা। এই কামরাটাও খালি, আর দরজাটার দোর আটকানো।

রীতিমত বিস্মিত হয়ে গেছেন এখন এডিসন। চোখ ডললেন কয়েকবার। এসময়ই প্রথমবারের মত একটা কথা খেয়াল হলো তাঁর, কাঠামোটা একটু অস্পষ্ট ছিল। এদিকে একমাত্র তার স্ত্রীই তাকে উইলি নামে ডাকেন, আর কেবল তিনিই নামটা ইংরেজ উচ্চারণে বলেন। আরেকবার ভালমত ড্রইং রুম আর সাজঘরটা পরীক্ষা করলেন। তারপর দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। এবার স্ত্রীর কামরার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাতলেন। বাচ্চাটা কাঁদছে আর তাঁর স্ত্রী সজাগই আছেন। আস্তে আস্তে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন। তাঁর স্ত্রী, বেশ সাহসী মহিলা-এটা জানা থাকায় পুরো ঘটনাটি খুলে বললেন তাকে। শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তারপর জানতে চাইলেন তিনি কি কামরাটায় ফিরতে ভয় পাচ্ছেন কিনা? এডিসনও বেশ সাহসী মানুষ। কাজেই এখনই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ দেখলেন না। কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের কামরায় ফিরে এলেন। খুব শান্তভাবে পুরো বিষয়ুটা নিয়ে ভাবলেন। কিন্তু এটার কোনো ব্যাখ্যা বের করতে পারলেন না। এদিকে দু-চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। মোমবাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

আবারও স্বপ্নহীন ছোট্ট একটা ঘুমের পর জেগে উঠলেন। এবার তার মুখটা মাঝখানের জানালার দিকে। ওটার কাছেই আবার দেখলেন ছায়ামূর্তিটাকে। বাইরে থেকে আসা আলোর পটভূমিতে বেশ কালো মনে হলো কাঠামোটাকে।

তড়িঘড়ি ম্যাচের জন্য হাত বাড়ালেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে টেবিলটাকেই উল্টে দিলেন। মোমবাতি, চাবি, ঘড়িসহ আরও নানান জিনিসপত্র নিয়ে বিকট শব্দে মাটিতে পড়ল ওটা। তবে তাঁর চোখ সেই গাঢ় কাঠামোটার দিকেই। তারপরই লক্ষ করলেন, জিনিসটা যাই হোক, এই মুহূর্তে সরাসরি তার দিকেই এগিয়ে আসছে। এক মুহূর্ত পরে দরজার দিকে যাবার পথও আটকে দেবে। আঁধারে অজানা একটা জিনিসের মুখোমুখি হওয়া মোটেই আনন্দের বিষয় নয়। মুহূর্তের মধ্যে বিছানার চাদরটা তুলে দুই কোনা দুই হাত দিয়ে ধরলেন শক্ত করে। তারপর সরাসরি ছায়ামূর্তিটার দিকে লাফ দিলেন। ভাবছেন চাদরটা দিয়ে ওটার মাথা, চোখ-মুখ ঢেকে ফেলে আক্রমণের প্রথম ঝাপটাটা সামলাবেন। পর মুহূর্তেই জানালার সামনের একটা সোফার ওপর গিয়ে পড়লেন। হাতদুটো গিয়ে ঠেকল জানালার গরাদে। তারপরই আঁতকে উঠলেন। ওটাকে অতিক্রম করে গেছেন। ছায়ামূর্তি এখন তার পিছনে। ঝটিতি ঘুরে দাঁড়ালেন। পরমুহূর্তেই গাঢ় অন্ধকারের একটা জালে যেন আটকা পড়লেন। ওটাকে স্পর্শ করা যায় না। আবার একই সঙ্গে এতটাই ঘন যে মনে হলো যেন তার ওপর ভারি একটা কিছু চড়ে বসেছে। চারপাশ থেকে প্রচণ্ড একটা চাপ অনুভব করলেন। নড়তে-চড়তে পারছেন না একটুও। বিছানার চাদরটা তার বাম বাহুতে ঝুলছে, আর ডান হাত মুক্ত। কিন্তু ওজনদার কিছু একটা যেন ওটাকে চেপে ধরেছে। সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে চাইলেন। মনে হলো যেন তার জিভটা শুকিয়ে গেছে, আর কয়েক ইঞ্চি পুরু হয়ে তালুতে আটকে গেছে। একটা শব্দও বের হলো না মুখ থেকে। তারপরই প্রচণ্ড চেষ্টার পর কিছু একটা বের হলো মুখ দিয়ে। আধা প্রার্থনা, আধা ভয়মিশ্রিত অসংলগ্ন কিছু শব্দ ওগুলো। সমস্ত মানসিক আর শারীরিক শক্তি এক করে শেষ চেষ্টা চালালেন। এতেই ভয়াল ওই জিনিসটার কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন। পরের কয়েক সেকেণ্ডে দরজার নাগাল পেলেন, ওটা খুলে বের হয়ে আসতে পারলেন বারান্দায়। নিজের হৃৎপিণ্ড বাড়ি খাওয়ার ধপ ধপ শব্দ শুনতে পাচ্ছেন পরিষ্কার। ভয়টা দূর হয়ে গেল মন থেকে। তবে মনে হলো যেন জীবন বাঁচাতে মাইলের পর মাইল দৌড়েছেন। আর একটু সুযোগ পেলেই ওটা তাঁকে শেষ করে দিত।

আবার স্ত্রীর কামরার সামনে চলে এলেন। আওয়াজ শুনে বুঝলেন জেগে আছেন তিনি আর বাচ্চাটাকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন। দরজা ধাক্কাতেই তিনি খুলে দিলেন। এডিসনের চেহারার হালই তার কাছে পরিষ্কার করে দিল কিছু একটা ঘটেছে। মুখ দিয়ে ফোটায় ফোঁটায় ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, চুল ভেজা। আর কয়েক গজ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে তাঁর হৃৎপিণ্ডের দ্রিম দ্রিম।

সেই রাতে কী ঘটেছে তার কোনো ব্যাখ্যা এডিসন বের করতে পারেন নি কখনই। তবে ঘটনাটা যখন তাদের আগে এই বাড়িতে যারা ছিলেন তাঁরা শুনলেন তখন একটা ঘটনা বললেন। এক রাতে বাড়িতে আসা এক অতিথির এই কামরায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু ওই ভদ্রলোক কামরাটায় থাকতে অস্বীকার করে বলেছিলেন ওটা ভুতুড়ে।

৩. ভয়াল মুখ

ভয়াল মুখ

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের দারুণ গরম একটা দিন। হঠাৎই কর্ডোভার বেলমিজ গ্রামের এক কৃষকের বাড়িতে খুব শশারগোল শোনা গেল। এই এলাকাটা পড়েছে স্পেনের আন্দালুসিয়া প্রদেশে। বুড়ি দাদি ফিলোমেনা রান্না করছেন। রান্নাঘরের মেঝের ওপর বসে আছে ছেলে-মেয়েরা। আপাত কোনো কারণ ছাড়াই যেন তারা উত্তেজিত হয়ে উঠল আর নিজেদের মধ্যে চিৎকারচেঁচামেচি জুড়ে দিল। মেজাজ খিচড়ে গেল বুড়ি দাদির। রাগত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ হৈচৈ বাধিয়ে দিলি কেন?

বাচ্চারা উত্তর দিল না। তবে আঙুল দিয়ে রান্না ঘরের মেঝে দেখিয়ে দিল। ফিলোমেনা যখন দেখলেন ওগুলোকে তখন রক্ত জল হয়ে গেল তার, মুখে ফুটে উঠল আতংকের রেখা। একটার পর একটা বেশ অনেকগুলো মুখ গজিয়ে উঠছে গোলাপি মেঝেতে।

ছেলে-মেয়েগুলোকে সাহস দেওয়ার জন্য একটা ডাস্টার তুলে মুখগুলো মোছা শুরু করলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু তো হলোই না, উল্টো চোখ বড় বড় করে এভাবে হাসির ভঙ্গি করল মুখগুলো, যে সবচেয়ে সাহসী মানুষেরও আত্মা শুকিয়ে যাবে।

দেরি না করে বাড়িটা খালি করে সরে পড়লেন ওর বাসিন্দারা। আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। প্রশাসনের কর্মকর্তা আর পুলিশ পিলে চমকে দেওয়া এই ঘটনার তদন্ত শুরু করলেন। কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও এই মুখগুলোর আবির্ভাবের কোনো বাস্তবসম্মত কারণ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলেন। অতএব বাড়ির মালিককে নতুন একটা মেঝে বানানোর পরামর্শ দিলেন তাঁরা। পুরো মেঝে খুঁড়ে কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে তারপর নতুন মেঝে বনাননা হলো। এবার রেহাই মিলবে অদ্ভুতুড়ে এই মুখেদের কবল থেকে, এই ভেবে নিশ্চিন্ত হলেন সবাই। কয়েকটা দিন শান্তিতেই কাটল। তারপর একের পর এক নতুন সব চেহারা ভেসে উঠতে লাগল নতুন মেঝেতে।

আবার ডাক পড়ল তদন্ত কর্মকর্তাদের। এবার গোটা এলাকাটা গভীর করে খুঁড়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন তাঁরা। এবার কিন্তু বেশ কিছু সমাধি পাওয়া গেল এখানকার মাটির নীচে। ধরে নেওয়া হলো মধ্যযুগে একটা গোরস্থান ছিল জায়গাটা। আবারও নতুন একটা মেঝে বানানো হলো। পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে নতুন নতুন মুখ আবির্ভূত হতে লাগল মেঝেতে। এখন এমনকী মুখগুলো পুরুষ না মহিলার এটাও বোঝা যাচ্ছে।

বাড়িটাতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে অদ্ভুত এই ঘটনার রহস্য উদ্ধারে জোর তদন্ত শুরু হলো। এমনকি মৃদুতর শব্দও রেকর্ড করার জন্য অত্যাধুনিক আর স্পর্শকাতর সব যন্ত্রপাতি পাতা হলো। ফলাফল পেতেও দেরি হলো না। গোটা এলাকটাতে অবাক করা কণ্ঠ, গোঙানি আর অপরিচিত ভাষায় কথা রেকর্ড করা হলো।

এবার এসব অতৃপ্ত আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনার ব্যবস্থা করলেন গ্রামবাসীরা। আর এরপরই বন্ধ হয়ে গেল ভৌতিক সব মুখ দেখা দেওয়া। অনেক বিশেষজ্ঞই পরে বেলমিজ গ্রামের এই আশ্চর্য ঘটনা তদন্ত করে দেখেছেন। তাঁরা সবাই একমত হয়েছেন এর পিছনে কোনো ধরনের ছলচাতুরি বা মানুষের হাত ছিল না।

৪. রক্তচিহ্ন

রক্তচিহ্ন

এবারের অভিজ্ঞতাটি চার্চ অভ ইংল্যাণ্ডের এক যাজকের। তিনি তখন ইতালির ফ্লোরেন্সে ব্রিটিশ দূতাবাসের গির্জার যাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁর মুখ থেকেই শুনব কাহিনিটি।

১৮৫৬ সালে স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমুদ্রতীরবর্তী একটা জায়গায় ছুটি কাটাচ্ছি। এসময়ই ব্যক্তিগত একটা কাজে তিন-চারদিনের জন্য তাদের ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আগস্টের আট তারিখ সন্ধ্যায় অপ্রত্যাশিত এক অতিথি হিসাবে একটি বাড়িতে হাজির হলাম। এই বাড়ির যিনি কর্তা তাঁর সঙ্গে কিছুদিন আগে পরিচয় হয়েছে আমার। আর ওই মুহূর্তে কোনো একটি কারণে আমার বোনও ওই বাড়িতেই থাকছে।

পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেছে। তারপর আবার ভ্রমণে ক্লান্ত। খাওয়া-দাওয়া শেষে দেরি না করে বিছানায় চলে গেলাম। অল্প সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। তিন-চার ঘণ্টা পর ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর ঘুম আসছে না দেখে খুব একটা অবাক হলাম না। কারণ অপরিচিত জায়গায় কখনওই ভাল ঘুম হয় না আমার। আরও কিছুক্ষণ ঘুমাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দিনের পরিকল্পনা সাজাতে লাগলাম মনে মনে। এভাবে কিছুটা সময় পার হলো। তারপরই হঠাৎ খেয়াল করলাম কামরায় একটা আলো দেখা যাচ্ছে। ঘুরেই একটা নারীর অবয়ব দেখতে পেলাম। আরেকটা বিষয় লক্ষ করলাম এসময়ই। যে আলোয় নারীটিকে দেখেছি সেটা যেন কোনো উৎস ছাড়া আপনা আপনি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। স্থির দৃষ্টিতে কাঠামোটার দিকে তাকালাম। কিন্তু অবয়বটা পরিষ্কার হলো না। একটু দূরত্ব পেরিয়ে যেভাবে এসেছে সেভাবে হঠাৎ অদৃশ্য হলো।

শুরুতে আমার মনে হলো এর মধ্যে কোনো কৌশল খাটানো হয়েছে। বিছানা থেকে নেমে একটা বাতি জ্বাললাম। দেখলাম শোবার কামরাটার দরজা আটকানোই আছে। সাবধানে দেয়ালগুলো দেখতে লাগলাম, যদি গোপন কোনো দরজা থাকে। কিন্তু এ ধরনের কিছু খুঁজে পেলাম না। পর্দা সরিয়ে, জানালার পাল্লা খুলে দেখলাম। কিন্তু বাইরেটা নিশ্ৰুপ আর অন্ধকার। চাঁদও নেই আকাশে। বিছানায় ফিরে বিষয়টি নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম। কী দেখলাম? আর এটা কেনই বা আমার সামনে হাজির হলো?

সকালে ঘুম থেকে উঠে পোশাক পরে আমার বোনকে কী দেখেছি তা খুলে বললাম। সে জানাল বাড়িটার ভুতুড়ে বলে বদনাম আছে। এখানে একটা খুন হয়। তবে সে যতদূর জানে, আমি যে কামরাতে ছিলাম তাতে খুনটা হয়নি। সেদিন এই বাড়ি ছাড়ার সময় আমার বোনকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালাম, রহস্যটা ভেদ করার জন্য যতটুকু সম্ভব সে করবে।

বুধবার সকালে বোনের একটা চিঠি পেলাম। এতে জানাল আমি চলে আসার পর আরও খোঁজখবর নিয়েছে সে। আর জানতে পেরেছে যে কামরাটায় আমি ছিলাম খুনটা হয়েছে সে কামরাতেই। আরও বলল, আগামীকাল আমার এখানে আসার পরিকল্পনা করেছে। আর আমাকে সে রাতের ঘটনাটি বিস্তারিত লিখে রাখার পাশাপাশি ওই কামরাটার একটা নকশা এঁকে, যেখান থেকে রহস্যময় কাঠামোটা দেখা দেয় আর অদৃশ্য হয় সে জায়গা দুটো চিহ্নিত করে রাখার অনুরোধ করল।

দেরি না করে তার কথামত কাজ করলাম। পরদিন যখন এল, জানতে চাইল আমি কী তার অনুরোধ মত কাজ করেছি। কিনা? জবাবে ড্রইং রুমের টেবিলের ওপর রাখা কাগজটার দিকে ইশারা করে বললাম, হ্যাঁ, এখানেই ঘটনার বর্ণনা আর কামরার নকশাটা আছে।

বোন যখন ওটা পরীক্ষা করতে এগোল তখন বাধা দিয়ে বললাম, তোমার যা বলার আছে খুলে না বলে ওটার দিকে তাকিয়ো না। কারণ ওটা পড়ে অবচেতনভাবেই তোমার কাহিনিটার মধ্যে রং চড়িয়ে ফেলবে।

এবার সে জানাল, যে কামরাটায় আমি রাত কাটিয়েছি তার গালিচাটা উঠিয়ে দেখেছে। মেঝের একটা নির্দিষ্ট অংশে খুন হওয়া মানুষটির রক্তের চিহ্ন পেয়েছে সে। আমার অনুরোধে কামরাটার একটা নকশা এঁকে যেখানে-যেখানে রক্তের ছোপ আছে তা চিহ্নিত করল। এবার আমার আর বোনের আঁকা নকশা দুটো মিলালাম। কী আশ্চর্য! বোনের নকশায় যেখান থেকে রক্তের চিহ্ন শুরু আর শেষ দেখানো হয়েছে এর সঙ্গে আমার নকশায় দেখানো মহিলার মূর্তিটা দেখা দেওয়ার আর অদৃশ্য হওয়ার জায়গা একেবারেই মিলে গেছে।

৫. কাটামুণ্ডু

কাটামুণ্ডু

মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ঘটে আয়ারল্যাণ্ডের ডাবলিনের উত্তর অংশে। দুইশো বছরের বেশি আগের কথা। তরুণ এক সরকারী কর্মকর্তাকে ডাবলিনে পাঠানো হয়। ভদ্রলোক একটা বাড়ি ভাড়া করেন নিজের আর পরিবারের জন্য। শুরুতেই স্ত্রী আর দুই সন্তানকে ওখানে পাঠিয়ে দেন। কয়েক দিন পর নিজে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবেন।

একজন নার্স আর ছেলেমেয়ে দুটোসহ তাঁর স্ত্রী ওখানে গিয়ে দেখলেন বাড়িটাতে একজন বুড়ো আয়া ছাড়া আর কেউ নেই। তারা এখানে পৌঁছার একটু পরেই আয়াটি বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনতে নার্স বাড়ি থেকে বের হয়। কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফিরে এসে মহিলাটির কাছে জানতে চায় বাচ্চারা ঠিক আছে কিনা। কারণ ভুভুড়ে দুটো কাঠামো দরজার দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখেছে সে। মহিলাটি জানালেন তার ধারণা বাচ্চারা ভালই আছে। কিন্তু তাদের কামরাটায় গিয়ে দেখলেন দুটো বাচ্চারই গলা কেটে রেখে গেছে কেউ। খুনিকে কখনওই খুঁজে বের করা যায়নি। এমনকী কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে তারও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। হতভাগী মা পাগল হয়ে যান বাচ্চাদের শোকে। বলা হয় এর পরে অনেক বছর পর্যন্ত এই বাড়িটাতে ঢুকলেই অজানা একটা আতংক আর অস্বস্তি পেয়ে বসত লোকেদের। এমনকী যে কামরাটায় হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে। তার জানালায় নাকি মাঝেমাঝেই দেখা যেত ছোট্ট দুটো মাথা।

৬. পর্দার ফাঁকে কার মুখ?

পর্দার ফাঁকে কার মুখ?

শ দেড়েক বছর আগের ঘটনা এটি। একটি স্কুল ঘরে ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা হয় এক পাদ্রীর। তিনি ছিলেন ডাবলিনের একটা গির্জার যাজক। কিন্তু ভদ্রলোক থাকতেন বাবা-মার সঙ্গে শহর থেকে বেশ দূরে, মালাহাইডের দিকে। কখনও কখনও দেখা যেত সন্ধ্যায় কোনো কাজ পড়ে গেছে তার কিংবা কোনো সভায় উপস্থিত থাকতে হচ্ছে। এদিকে তাদের বাড়িটা বেশ দূরে। তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থাও এখনকার মত উন্নত হয়নি। কাজেই সে বিশেষ দিনগুলোতে একটা স্কুল ঘরে রাত কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে যান। বিশাল, আসবাবশূন্য এই কামরাটিতেই সাধারণত সভাগুলো হয়। যেহেতু মাঝেমাঝে রাত কাটাতে হয় কামরাটায়, তাই এক পাশে নিজের শোবার জন্য একটু জায়গা আলাদা করে নিলেন। একটা দণ্ড টাঙিয়ে এর মধ্যে দুটো পুর্দা ঝুলিয়ে দিলেন, টান দিলে মাঝখানে এসে মিলে যায় পর্দ দুটো।

এক রাতে একটা সভা শেষে খালি স্কুলঘরটার দরজার খিল আটকে দিলেন যাজক। তারপর বিছানায় গেলেন। চন্দ্রালোকিত রাত হওয়াতে ভিতরের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

বিছানায় যাওয়ার একটু পরেই অদৃশ্য কিছু একটার উপস্থিতি অনুভব করলেন। পরমুহূর্তেই পর্দা দুটো নড়তে দেখলেন, যেন ওপাশ থেকে কেউ গুডলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারপরই আতংকে শিউরে উঠলেন, এক জোড়া হাত ওপাশ থেকে পর্দা টানছে। পর্দা দুটো মাঝখানে এসে মিলল। এবার একটু ফাক হলো ওগুলো, আর এর মাঝখানে উঁকি দিল ভয়ঙ্কর একটা মুখ। ওটার চেহারায় এমন একটা পৈশাচিক ভঙ্গি আর নির্দয় দৃষ্টি খেলা করছে যে, গা কাঁটা দিয়ে উঠল যাজকের। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকল মুখটা, তারপর পর্দার আড়ালে সরে পড়ল। পর্দা দুটোও জোড়া লেগে গেল আবার। যাজক বেশ সাহসী মানুষ। ওটা অদৃশ্য হতেই বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে পুরো কামরা তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। যা ভেবেছেন, কাউকে পেলেন না। যত দ্রুত সম্ভব কাপড় পরে এখান থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর অন্ধকারে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন। এই স্কুল ঘরে আর কখনও রাত কাটাননি তিনি।

 

প্রত্যাবর্তন

কেউ মারা যাওয়ার পর তার ভূত হাজির হওয়ার রেকর্ড আছে আকছার। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদেরই দেখা দেয় মৃত ব্যক্তির আত্মা। এমন ঘটনাগুলো পাবেন ‘প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে।

১. সাগর থেকে ফিরে

সাগর থেকে ফিরে

টম পটারকে সে অর্থে দুষ্ট ছেলে বলতে পারবেন না আপনি। কিন্তু সে দারুণ অস্থির, যেখানেই থাকবে একটা একটা না গোলমাল, ঠিক পাকাবে। কখনও কোনো পড়শির জানালা ভাঙতে চায় না সে। কিন্তু যখনই একটা বলে লাথি মারে কীভাবে না কীভাবে ওটা কাঁচের জানালার দিকেই ছুটে যায়।

ওহ, টম পটার! তোমাকে নিয়ে আমরা কী করব? লোকেরা বলে। টম কেবল দুষ্টুমি মাখা ঝকঝকে একটা হাসি দেয়। আর এটাই মন জয় করে নেয় সবার, মাফ পেতেও সময় লাগে না তার।

১৮৬০ সালের কথা। টমের বাবা নেই। কাজেই মা-ছেলে দুজনের ভরণপোষণের জন্য চাকরি করতে হয় টমের মাকে। এসময়ই হাওয়ার্ড নামের এক ভদ্রলোকের বাড়িতে চাকরি হলো তাঁর। ইংল্যাণ্ডের গ্রিনউইচে বিশাল এক বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন মি. হাওয়ার্ড।

বাড়ির ওপরের তলার একটা কামরায় আপনি থাকতে পারেন, নতুন মালিক বললেন মিসেস পটারকে। আর টম যদি কাছের কোনো স্কুলে ভর্তি হয়, তবে সম্ভবত সে একটু স্থির হবে।

ধন্যবাদ, স্যর, খুশি হয়ে বললেন মিসেস পটার। টম আসলে চমৎকার একটা ছেলে। আমার মনে হয় স্কুলে সে ভাল করবে, আর আপনার অনুগ্রহের মর্যাদা দেবে।

টমের মাথা ভাল। সে দারুণ চটপটে আর বুদ্ধিমানও। স্কুলে তার দিনগুলো ভালই কাটতে লাগল। কখনও কখনও যে সে দুষ্টুমি করে না তা না, তবে ওই আগের মতই মাফও পেয়ে যায়।

টম যে স্কুলটাতে পড়ে সেটা চালায় একটা রোমান ক্যাথলিক এতিমখানা। এই এতিমখানাটার দায়িত্বে আছেন নরম মনের একজন পাদ্রী, ফাদার টড। শুরুতেই টমের সঙ্গে পাদ্রীর দারুণ ভাব হয়ে গেল। কয়েকটা বছর বেশ শান্তিতেই কাটল। টম পড়ালেখাও করছে মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু কৈশোরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আবার দুরন্তপনা পেয়ে বসল তাকে। টমকে বাগ মানানো রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়ল তার মার পক্ষে।

টম পটারকে নিয়ে আমরা কী করব? একদিন ফাদার টডের কাছে জানতে চাইলেন মি. হাওয়ার্ড।

টমের বয়স এখন চোদ্দ, পাদ্রী জবাব দিলেন। তাকে ভাল একটা কাজে লাগিয়ে দেওয়ার এটা চমৎকার সময়। দেখি কী করতে পারি।

অতএব কাজ করতে গেল টম। সুতির কাপড় বানায় ম্যনচেস্টারের এমন একটা বড় খামারে পাঠানো হলো তাকে। এখানে কিছু দিন আরামেই থাকল। তারপরই আবার অস্থিরতা পেয়ে বসল তাকে। মা আর ফাদার টডকে লিখে জানাল তার খুব ইচ্ছা সাগরে যাবে। এতটাই আবেগের সঙ্গে আর গুছিয়ে লিখল কথাগুলো, মনে-মনে আশঙ্কা চেপে বসলেও তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন তার মা আর ফাদার টড।

১৮৬৪ সালে উলউইচের একটা প্রশিক্ষণ জাহাজে চাকরি পেল টম। এখান থেকে তাকে পাঠানো হলো রাণীর একটা যুদ্ধ জাহাজে। প্রথম কিছু অভিযান দারুণ উপভোগ করল টম। তারপর আবার সক্রিয় হয়ে উঠল তার সেই অস্থির মন। নৌ বাহিনীর কড়া নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল সে। কয়েকজন বন্ধুসহ জাহাজ ছেড়ে পালাল। কঠিন পরিশ্রম আর নিয়মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে যেন হাতে চাঁদ পেল ছেলেরা। দুষ্টু বুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তাদের। বোকার মত কিছু অঘটন ঘটাল। আর এগুলোই তাদের ঝামেলায় ফেলল।

একদিন টম হাজির হলো গ্রিনউইচে মি. হাওয়ার্ডের বাসায়। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, পরনে শতচ্ছিন্ন কাপড়। প্রচণ্ড অসুস্থ সে। মার সেবায় যখন সুস্থ হয়ে উঠল তখনই জানা গেল জাহাজ থেকে পালানোর অপরাধে তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে।

মন ভেঙে গেল হতভাগী মার। টম, তোমাকে নিয়ে আমরা কী করব? হতাশায় কাঁদতে-কাঁদতে বললেন তিনি।

এদিকে এবার মি, হাওয়ার্ডেরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। টমকে আর এখানে জায়গা দিতে নারাজ তিনি। মিসেস পটারকে বললেন, আমার মনে হয় ফাদার টডের পরমর্শ নেওয়া উচিত আপনার।

দয়ালু পাদ্রী কথা দিলেন এই বিপদ থেকে টমকে উদ্ধার করার জন্য তাঁর পক্ষে যতটুকু সম্ভব করবেন। জাহাজের ক্যাপ্টেন আর নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাদের টমের, পক্ষ নিয়ে বুঝালেন তিনি। টম মন থেকে খারাপ ছেলে নয় মোটেই, বললেন পাদ্রী। আমি তাকে ভালমত চিনি। সে দুষ্ট স্বভাবের আর একটু স্বেচ্ছাচারী। কিন্তু আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত ভালই করবে টম।

পাদ্রীর কথায় মন গলল নৌ কর্তাদের। টমকে আবার জাহাজে ফিরিয়ে নিতে আর তার শাস্তি হালকা করে দিতে রাজি হলেন তারা। এবার টমকে পাঠানো হলো পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জগামী রণতরী ডরিসে।

তার চাকুরিদাতা আর পাদ্রী দুজনের প্রতিই কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মিসেস পটারের মন। যখন খবর পলেন সব ঠিক আছে আর টম আবার সাগরে বেরিয়ে পড়েছে, সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া এক মহিলায় রূপান্তরিত হলেন। এদিকে জন কুপার নামের এক লোক মি. হাওয়ার্ডের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। একদিন তিনি টমের মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, ভদ্রমহিলাও রজি হয়ে গেলেন। যেদিন চাকরি ছাড়লেন, মি. হাওয়ার্ড করমর্দন করে বললেন, আপনি চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ায় এক দিক থেকে ভালই হলো। আপনাকে মিসেস কুপার বলে ডাকার অভ্যাস কখনওই করতে পারতাম না আমি। আশা করি সুখী হবেন। ওই দুরন্ত ছেলেও আর কখনও দুশ্চিন্তার কারণ হবে না আপনার।

টমের মার জায়গায় নতুন একটা মেয়ে কাজ নিল মি. হাওয়ার্ডের বাসায়, নাম মেরি স্নেইক।

কয়েক মাস পরের ঘটনা। তারিখটা ১৮৬৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। কেউ একজন মি. হাওয়ার্ডের বাড়ির সদর দরজার বেল বাজাল। মেরি স্লেইক গেল দরজা খুলতে। মিসেস হাওয়ার্ড ছিলেন উপরে তার বেডরুমে। দরজা খোলার শব্দ পেলেন, তারপরই কণ্ঠ শুনতে পেলেন। কথাবার্তা চলল অল্প কিছুক্ষণ, কিন্তু আগন্তুকের কণ্ঠটা কানে আসতেই কেমন যেন পরিচিত ঠেকল মিসেস হওয়ার্ডের।

আমি এটা চিনি, নিজেকে বললেন তিনি, হঁা, সন্দেহ নেই এটা টম পটারের কণ্ঠ।

দরজা বন্ধ হয়ে যেতে নীচে হলে দাঁড়ানো মেয়েটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছিল, মেরি?

ওপরে তার বেডরুমে উঠে এল মেরি। জাহাজে কাজ করা একটা ছেলে, ম্যাম। তার মাকে খুঁজছিল। আমি বলেছি তাঁকে আমি চিনি না, তারপর ছেলেটাকে চলে যেতে বলি।

সে দেখতে কেমন ছিল? চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস হাওয়ার্ড।

পোশাক-আশাকে খুব ফিটফাট। তবে খালি পায়ে ছিল। আমি তাকে দেখলে আবার চিনতে পারব। তার মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল, চোখে-মুখে হতাশার একটা ছাপ ফুটে উঠেছিল।

সে কি কিছু বলেছে?

তেমন কিছু না, ম্যাম। যখন আমি তাকে বললাম তার মা এখানে নেই তখন কেবল মাথায় হাত রেখে বলল, এখন আমি কী করব?

ধন্যবাদ, মেরি। আবার ও আসলে আমাকে ডাক দিতে ভুল করবে না।

মি. হাওয়ার্ড বাড়ি ফিরলে দেরি না করে তাঁকে ঘটনাটা খুলে বললেন তাঁর স্ত্রী। তারপর যোগ করলেন, আমার মনে হয় আবার জাহাজ থেকে পালিয়েছে সে।

মাথা ঝাঁকিয়ে মি.হাওয়ার্ড বললেন, টম পটারকে নিয়ে আমরা কী করব! কখনওই ঝামেলা ছাড়া থাকতে পারল না ছেলেটা।

ছেলেটা এভাবে বাড়ির দুয়ার থেকে ফিরে যাওয়াতে অপরাধবোধে ভুগছিলেন হাওয়ার্ডরা। তারা তাই টমের মার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ভদ্রমহিলার সঙ্গে টমের দেখা হয়েছে কিনা জানতে। যখন তিনি জানালেন টমের সঙ্গে অনেকদিন কোনো যোগাযোগ নেই, আরও হতাশ হয়ে পড়লেন তারা। সম্ভবত ছেলেটার কোনো ধারণাই নেই তার মা কোথায় আছে। আর এখন নিশ্চয় লণ্ডনের পথে-পথে ঘুরছে।

মি. হাওয়ার্ড ফাদার টডের সঙ্গে দেখা করলেন। ঘটনাটা শুনে অবাক হলেন তিনিও। টম আবার জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছে এটা বিশ্বাস হয় না আমার, ঘোষণা দিলেন তিনি। মাত্র মাস দুয়েক আগে ওর একটা চিঠি পেয়েছি। তখনও সেখানে চমৎকার ছিল সে। আমার মনে হয় আপনাদের বাড়িতে কাজ করা সেই মেয়েটা, মেরির সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার আমার। তাহলে নিশ্চিত হওয়া যেত আসলেই ছেলেটা টম পটারই ছিল কিনা।

আমি এখনই ওকে নিয়ে আসছি। বলে বেরিয়ে গেলেন মি. হাওয়ার্ড।

মেরি এসে পৌঁছতেই পাদ্রী তাকে ডজন খানেক ছেলের ছবি দেখালেন, যাদের মধ্যে টমও ছিল। তারপর বললেন, আমি দেখতে চাই সেদিন যে ছেলেটা এসেছিল তাকে তুমি এদের মধ্যে থেকে খুঁজে বের করতে পার কিনা।

একটু সময় তাকিয়েই একটা ছবি তুলে নিয়ে মেয়েটা বলল, এটাই সেই ছেলেটা। দিব্যি দিয়ে বলতে পারি আমি।

আর ছবিটা টম পটারেরই। অর্থাৎ এখন আর কোনো সন্দেহ রইল না সেদিনের সেই রহস্যময় আগন্তুক আর কেউ না টম পটার। তাহলে কোথায় গেল সে? কেন আর ফিরে এল না? আর যদি কেউ তাকে তার মায়ের ঠিকানা দিয়ে থাকে, তবে সে কেন সেখানে গেল না? এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। আর এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই।

বেশ কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। তারপর অক্টোবরের এক দিনে নৌ সদরদপ্তর থেকে একটা চিঠি এল ফাদার টডের কাছে। খাম ছেড়ার সময় পাদ্রী মনে-মনে বললেন, সন্দেহ নেই টম পটারের খবর আছে। ছেলেটা এখন কোথায় আছে?

চিঠিটা পড়তে-পড়তে হাঁফাতে লাগলেন পাদ্রী, চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে তাঁর। তড়িঘড়ি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।

ভাগ্য ভাল তিনি যখন পৌঁছলেন তখনও বেরিয়ে পড়েননি মি. হাওয়ার্ড। মিসেস হাওয়ার্ড আর মেরিকে ডেকে আনা হলো। তারপর চারজন জড় হলেন বাড়ির স্টাডিতে।

আপনারা কি প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করেন? হঠাৎই জানতে চাইলেন পাদ্রী।

চমকে উঠলেন তাঁরা। তারপরই মি. হাওয়ার্ড বলে উঠলেন, না, প্রশ্নই ওঠে না। আপনি কেন এটা জিজ্ঞেস করছেন?

তাঁর কথায় কান না দিয়ে পাদ্রী জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস হাওয়ার্ড, আপনি?

স্বামীর দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে জবাব দিলেন ভদ্রমহিলা, আমি কখনও এমন কিছু দেখিনি। তবে তবে ওরা থাকতেই পারে।

সবশেষে মেরির দিকে তাকালেন পাদ্রী, আর তুমি, মেরি? হ্যাঁ। সোজাসাপ্টা জবাব দিল মেয়েটা।

তাহলে তুমি নিশ্চয়ই অবাক হবে না, যদি আমি বলি একটা প্রেতাত্মার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে।

স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল মেয়েটা। মি. হাওয়ার্ড এবার পাদ্রীর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?

টম পটার কবে এসেছিল এখানে? জিজ্ঞেস করলেন পাদ্রী।

ওটা ছিল সেপ্টেম্বরের আট তারিখ। জবাব দিলেন মিসেস হওয়ার্ড।

এর দু-দিন আগেই জ্যামাইকায় মারা গেছে টম।

মি. হাওয়ার্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর স্ত্রী মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন, আর মেরি কাঁদতে শুরু করল।

পাদ্রী নৌ দপ্তরের চিঠিটা নাড়িয়ে বললেন, চিঠিতে বলা হয়েছে, রণতরী ডরিসে বড় রকমের একটা দুর্ঘটনায় পড়ে টম। সেটা ছিল ১৮৬৬ সালের ২৪ জুলাই। এতে ভয়ঙ্করভাবে আহত হয় ছেলেটা। কয়েকটা সপ্তাহ যমে-মানুষে টানাটানি হয় তাকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ মারা যায়। মারা যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তেও মাকে দেখতে চাচ্ছিল সে। তারপর সবাইকে এটা হজম করার একটু সময় দিয়ে ফাদার টম আবার বলতে শুরু করলেন, এই বাড়িতেই টম তার মাকে শেষ দেখেছে। আর এই কারণেই টমের প্রেতাত্মা এখানে আসার আকর্ষণ অনুভব করেছে। একটা আত্মা কেবল সেসব ঘটনা জানে যা সে জীবদ্দশায় জানত। বেঁচে থাকা অবস্থায় সে কখনওই জানত না তার মা বাসা বদল করেছে। আর তাই এখানে ফিরে এসেছে, প্রিয় মাকে শেষবারের মত দেখবার জন্য…

ফাদার টম কথা বলা বন্ধ করতেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল গোটা কামরাটা। তারপর শোনা গেল মেরির কান্নার শব্দ। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। কাঁদতে-কাঁদতেই সে বলল, আমিই নাবিক ছেলেটার হতভাগ্য আত্মাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সে কেবল তার মাকে খুঁজছিল। ইস, আমি যদি জানতাম…

২. ব্রাউন লেডি

ব্রাউন লেডি

গত দেড়শো বছরে ইংল্যাণ্ডের নরফোকের রেইনহ্যাম পার্কে ব্রাউন লেডি বা বাদামি বসনাকে দেখা গিয়েছে অনেকবার।

সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে ওঠা-নামা করে সে, কখনও করিডর ধরে হেঁটে বেড়ায়। তার পরনে থাকে বাদামি-হলুদ একটা পোশাক আর গলায় পশমের গলাবন্ধ। তার চোখের জায়গায় থাকে অন্ধকার গর্ত, মুখটা মোমের মত সাদা। এমনিতে কোনো কথা বলে না, কারও ক্ষতি করে না, এমনকী কিছু চায়ও না। তবে কখনও কখনও তার ঘুরে বেড়াবার মধ্যে অশুভ, ভয়ঙ্কর কী যেন একটা থাকে, এমনকী তাকে দেখে সবচেয়ে দুঃসাহসী মানুষটিরও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

রেইনহ্যাম ছিল মারকুইজ অব টাউনশেদের বাড়ি। খুব প্রাচীন একটা বাড়ি এটি। ১৮৩৫ সালের দিকে এটা কিনে সংস্কার করান টাউনশেন্ডরা। এ উপলক্ষে বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত দেন লর্ড এবং লেডি চার্লস টাউনশেণ্ড। এদের একজন ক্যাপ্টেন ফ্রেডেরিক মারিয়াট। ছোটদের জন্য গল্প লিখে তখন খুব নাম কামিয়েছেন ভদ্রলোক। ফ্রেডেরিক পৌঁছার পরপরই লর্ড চার্লস তাঁকে এক পাশে টেনে এনে নিজের স্টাডির দিকে নিয়ে চললেন।

দুজনের জন্য গ্লাসে মদ ঢেলে কথা বলা শুরু করলেন. লর্ড চার্লস। মুখে চিন্তার ছাপ। ফ্রেডেরিক, এখানে কিছু একটা সমস্যা তৈরি করছে। তোমার সাহায্য দরকার আমার। বাড়িতে একটা ভূত আছে এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আমি এটাকে পাত্তা দিতে চাইনি। কিন্তু কোনো চাকর-বাকর কিংবা অতিথিই দু-চার রাতের বেশি থাকতে পারে না এখানে। তারা ব্রাউন লেডি নামে পরিচিত একজন মহিলাকে দেখেছে। এই তথাকথিত ভূত নাকি বারান্দা এমনকি শোবার ঘরগুলোর ভিতরে আর আশপাশে ঘুরে বেড়ায়।

চার্লস, তিরস্কার করলেন ক্যাপ্টেন, এ ধরনের আজগুবি গল্পে তুমি কেন বিচলিত হচ্ছ এটা মাথায় আসছে না আমার। আমি ওসব ভূত, প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করি না। যদি আসলেই কাউকে দেখা যায়, তবে ধরে নিতে পার কেউ তোমার সঙ্গে চালাকি করছে। তুমি কিনে নেওয়ার আগে কিছুদিন বাড়িটা খালি পড়ে ছিল। ঠিক না?

হ্যাঁ।

এই এলাকার একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে আমি জানি, আবার কথা বলা শুরু করলেন ক্যাপ্টেন ম্যারিয়াট, এদিকটায় বেশ ভাল পরিমাণ চোরাচালানি আর চোরাশিকার হয়। এসব চোরাচালানির লুকানোর জায়গা হিসাবে যে বাড়ি আর আস্তাবলগুলো ব্যবহার করা হত এটি সম্ভবত তার একটা। এখন তোমাদের উপস্থিতির কারণে একটা নিরাপদ আত্মগোপনের জায়গা হাতছাড়া হওয়ার অবস্থা হয়েছে তাদের। তারাই গ্রামে ভূতের গল্প ছড়িয়ে তোমাকে তাড়াতে চাইছে।

লর্ড চার্লস উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার চোখ। আমার ধারণা তুমি আসল জায়গায় হাত দিয়েছ। তুমি জান আমার কুকুর আছে। আর এদের চেঁচামেচিতে রাতে এই বাড়ি কিংবা আস্তাবলের ধারে-কাছে ঘেঁষা কঠিন কারও কারও জন্য। তারাই আমাকে তাড়াতে চাচ্ছে। সন্দেহ নেই চোরাচালানি কিংবা চোরাশিকারীদের বানানো চরিত্র এই বাদামি বসনা নারী।

কোন্ কামরাটায় এই মহিলাকে দেখেছে লোকেরা? হালকা চালে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন। তার বুদ্ধির প্রতি বন্ধুর আস্থা দেখে মনে-মনে খুশি হয়ে উঠেছেন।

আস্তাবলের দিকে মুখ করা দ্বিতীয় তলার একটা কামরা ওটা, জবাব দিলেন লর্ড চার্লস। বেশ বড়সড়, চমৎকার একটা কামরা এটা। চারপাশে সিডার কাঠের প্যানেল দেওয়া। দেয়ালে একজন মহিলার প্রতিকৃতি আছে। তার পরনে একটা বাদামিহলুদ পোশাক, গলায় একটা গলা বন্ধনী। সম্ভবত এটাই সেই ব্রাউন লেডি, যার কথা লোকে বলে।

তাহলে তোমার অনুমতি পেলে আমি সেখানে রাতে ঘুমাতে চাই, ঘোষণা করলেন ক্যাপ্টেন। এখান থেকে আস্তাবলের দিকে চোখ রাখতে পারব। আর তোমার ওই ব্রাউন লেডি যদি চেহারা দেখায় তার কুশলও জিজ্ঞেস করতে পারব, যদিও সে আসবে কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ আছে আমার।

কোনো সমস্যা নেই। তোমার জন্য কামরাটা ঠিক করে দিতে বলছি। মনে হয় না রাতে কোনো অনাহূত অতিথি ব্যাঘাত ঘটাবে তোমার ঘুমে।

বালিশের নীচে গুলি ভরা একটা রিভলভার রেখে. পর পর দুরাত ভুতুড়ে কামরাটায় কাটালেন ক্যাপ্টেন ম্যারিয়াট। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই নজরে এল না। তৃতীয় রাতটাই এখানে তাঁর শেষ রাত। ক্যাপ্টেনের ধারণা এ রাতটাও কাটবে ঘটনাবিহীনভাবে।

মাঝরাতের ঠিক আগে। হাতে মোমবাতি নিয়ে, বাদামী সিল্কের পোশাক পরা তরুণী মহিলার প্রতিকৃতিটা পর্যবেক্ষণ করছেন ক্যাপ্টেন। মহিলার চেহারায় কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। মাথাটা একবার ঝাকিয়ে ভূতের চিন্তা-ভাবনা মন থেকে বিদায় করে এক পা পিছিয়ে এলেন। মোমবাতির শিখাটা কেঁপে উঠল। এখান থেকে মোমবাতির আলো যে ছায়া তৈরি করছে তাতে বদলে গেল চেহারাটা। ওটাকে এখন সাধারণ আর নিস্পাপ মনে হচ্ছে না। বরং ভীতিপ্রদ আর পৈশাচিক লাগছে। চোখ দুটো কোটরের ভিতরে ঢুকে গেছে, চামড়ার ভেতর থেকে হাড় ফুটে বেরোচ্ছে। ক্যাপ্টেনের কেন যেন মনে হলো তিনি একটা খুলির দিকে তাকিয়ে আছেন।

আবার সামনে এগুলেন, আগের সেই শান্ত, সুন্দর চেহারাটা ফিরে এল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, পাশের টেবিলে রাখলেন ম্যারিয়ট মোমবাতিটা। এবার ঘুমাতে যাবেন। ঠিক এমন সময় দরজায় ধাক্কা দিল কেউ। ভিতরে আসুন, বলার সময় মহিলার ছবিটার দিকে দৃষ্টি দেওয়া এড়াতে পারলেন না।

তবে কোনো ভূত কিংবা প্রেতাত্মা ঢুকল না ঘরে। লর্ড চার্লসের দুই ভাতিজা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, করিডোরের শেষ মাথার একটা কামরা ভাগাভাগি করছে তারা। সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে ক্যাপ্টেনের, তখন শিকারী কুকুর আর বন্দুক নিয়ে আলাপ করছিল তারা।

যাক বাবা! আপনি ঘুমিয়ে পড়েননি। বলল কিশোরদের একজন। আপনি কি আমাদের রুমে একবার আসবেন? লণ্ডন থেকে কেনা একটা বন্দুক এই মাত্র খুলেছি। ওটা সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছিলাম।

মোমবাতিটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগুলেন ক্যাপ্টেন। মনে হলো যেন ছবির মহিলাটি তাঁর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। তারপর জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে রিভলভারটা তুলে নিয়ে বললেন, এটা নেব আমি। ব্রাউন লেডির সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়!

তিনজন করিডোর ধরে হেঁটে ছেলেদের কামরায় চলে এলেন। ক্যাপ্টেন অস্ত্রটার প্রশংসা করে বললেন, আগামীবার লণ্ডনে গেলে নিজেও এমন একটা কিনবেন। আরও কয়েক মিনিট আলাপের পর ক্যাপ্টেন হাই তুলতে তুলতে বললেন, এখন বিছানায় যেতে হবে আমাকে। আগামীকাল আবার লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।

আপনাকে বরং আমরা পৌঁছে দিয়ে আসি, হাসতে-হাসতে বলল চার্লসের এক ভাতিজা, ব্রাউন লেডি যদি আবার আপনাকে অপহরণ করে ফেলে।

একসঙ্গে কামরা থেকে বের হয়ে লম্বা, অন্ধকার করিডোরটা ধরে হাঁটা ধরলেন তাঁরা। গোটা বাড়িটাই অন্ধকারে ঢেকে আছে, তাদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। মাত্র কয়েক গজ এগিয়েছেন এমন সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন।

দেখো! ফিসফিস করে বললেন তিনি।

করিডোরের অপর পাশ থেকে একটা কাঠামো এগিয়ে আসছে, হাতে লণ্ঠন। একজন মহিলা, হাঁটার সময় তার পোশাকটা খসখস শব্দ করছে। তবে ছায়ায় ঢাকা পড়ায় চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না।

তিনি নিশ্চয় মহিলা অতিথিদের একজন, সম্ভবত পথ হারিয়েছেন। ম্যারিয়াট বিড়বিড় করলেন, কিংবা কেউ বাগানের দিকে যাচ্ছেন।

কিন্তু মহিলাটি কে? ছেলেদের একজন বলল, তাকে অতিথিদের কারও মত লাগছে না আমার।

কাঠামোটা তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তাপমাত্রাটা হঠাৎ করেই বেশ কয়েক ডিগ্রী নেমে গেল, মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ করেই শীতকাল চলে এসেছে। তিনজন শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলেন। হঠাই সামনের একটা খালি কামরার খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে ছেলেদেরও টেনে নিলেন ম্যারিয়াট। তারপর একটু ফাঁক রেখে দোর টেনে দিলেন। এবার এই ফাঁকে চোখ রাখলেন সবাই, হৃৎপিণ্ডে দ্রিম দ্রিম বাড়ি খাচ্ছে।

মহিলাটি এখন দরজার কাছাকাছি চলে এসেছেন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ক্যাপ্টেন। লণ্ঠনের আলোয় চেহারাটা ধরা দিল তাঁর সামনে, পরনে সেই সিল্কের বাদামি পোশাক। সন্দেহ নেই ছবির সেই মহিলা আর ইনি একই ব্যক্তি। করিডোর ধরে আস্তেআস্তে হেঁটে চলেছেন। পোশাক খস খস শব্দ তুললেও পা ফেলার কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। লণ্ঠনের আলোয় তার চোখে, মুখে অশুভ কিছু নজর পড়ল না।

দরজার ঠিক উল্টো পাশে যখন চলে এলেন তখন দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাতিটা মুখের সামনে ধরলেন। আর তখনই চেহারাটা পাল্টে গেল। চামড়া-মাংস ভেদ করে স্পষ্ট হয়ে উঠল হাড়গুলো। মনে হলো যেন একটা কংকাল হেঁটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। গর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে চোখ জোড়া, ঠোটহীন মুখটাকে লাগছে যেন একটা গোরস্থানের প্রবেশদ্বারের মত।

ধীরে-ধীরে দরজাটা মেললেন ক্যাপ্টেন। ব্রাউন লেডির ভয়ঙ্কর মুখটা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠল তাঁদের চোখের সামনে। জোর খাটিয়ে নিজের মনটাকে স্থির করলেন কাপ্টেন। তারপর একেবারে কাছ থেকে গুলি করলেন প্রেতাত্মাটার দিকে।

বদ্ধ জায়গায় শব্দটা কানে তালা লাগিয়ে দিল। যখন ধোঁয়া অদৃশ্য হলো মেঝের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। আশা করছেন মাটিতে একটা দেহ পড়ে থাকতে দেখবেন। কিন্তু এখানে কিছুই নেই। এমনকী কিছু ছিল তা প্রমাণ করার মত কোনো চিহ্নও না। তিনজন পুরুষ আর বাতাসে ভেসে চলা হালকা ধোঁয়ার রেখা ছাড়া করিডোরে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই।

পাগলের মত একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলেন তারা। এখানে কিছু একটা ছিল, তাই না? আমার চোখ নিশ্চয় বেঈমানি করেনি? বললেন ক্যাপ্টেন। ছেলেদের একজন কাঁপতে-কাপতে বলল, আমি যা দেখেছি আপনিও যদি তা দেখে থাকেন তবে তা ভয়ঙ্কর। তারপর উল্টো পাশের দরজার দিকে ইশারা করে বলল, দেখুন, বুলেটের গর্ত। এখানে যা ছিল বুলেটটা তাকে ভেদ করে গেছে।

এবার ক্যাপ্টেন গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, আমরা যাকে দেখেছি সে কোনো চোরাচালানী বা পোচার নয়, রেইনহ্যামের ব্রাউন লেডি, ছবির থেকে যে জীবন পেয়ে গেছে। তারপরই হঠাৎ একটা চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার। আমার সঙ্গে চলো। বলে দ্রুত নিজের কামরার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

দেয়ালের যেখানে বাদামি বর্সনার ছবি ঝুলছে সেখানে চলে এলেন ক্যাপ্টেন। মোমটা উঁচু করে ধরলেন। ব্রাউন লেডি যেন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখটাতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে বাদামি পোশাকটা। হঠাৎই ক্যাপ্টেনের শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। মহিলার হৃৎপিণ্ডের কাছটায় কি একটু রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে? আলো পড়ে চিক চিক করছে? নাকি তার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা এটা?

ব্রাউন লেডিকে নিয়ে ক্যাপ্টেনের এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর মেয়ে ফ্লোরেন্সের লেখা একটি বইয়ে। ১৮৯৯ সালে মারা যান ভদ্রমহিলা। তবে ক্যাপ্টেন ছাড়াও আরও অনেকেই বাদামি বসনাকে দেখেছেন। ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন ডরোথি ওয়ালপল, ১৭২২ সালে ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা রবার্ট ওয়ালপলের বোন। লোকে বলে ব্রাউন লেডি তার বাচ্চাদের খুঁজে ফিরছেন। ভদ্রমহিলা জীবিত থাকার সময় স্বামী দ্বিতীয় ভিসকন্ট টাউনশেণ্ডের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর বাচ্চাদের তাদের দাদির হেফাজতে রাখা হয়েছিল।

১৯৩৬ সালে বাদামি বসনার একটা ছবি তোলার চেষ্টা করেন একজন আলোকচিত্রী। তবে যে ছবিটি একটা ম্যাগাজিনে ছাপা হয় সেটা খুব স্পষ্ট।

৩. বিমানে ভূত

বিমানে ভূত

আকাশে উড়ছে ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স কোম্পানির ট্রিস্টার-৩১৮ বিমানটি। বিমানকর্মীরা ছাড়াও ১৮০ জন যাত্রী আছেন বিমানে। নিউইয়র্ক থেকে ফ্লোরিডা যাচ্ছে বিমানটি। এয়ার হোস্টেস ফে মেরিওয়েদার তার সিট ছেড়ে উঠে স্টোরের দিকে রওয়ানা হলেন। যাত্রীদের জন্য সকালের নাস্তার তদ্বির করতে হবে তাঁকে। জায়গামত পৌঁছে খাবার গরম করার ওভেনটার দিকে হাত বাড়ালেন ফে। এ সময়ই একটা জিনিস দেখে আপনা আপনি চিৎকার বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। ওভেনের দরজার ওপাশ থেকে একটা মুখ উঁকি দিচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব-ভাবলেন ফে। আতঙ্কে চোখ বুজলেন। যখন আবার চোখ খুললেন ওভেনের ভেতর কাউকে পেলেন না। যেই নাস্তা ভরা ট্রেটা বের করার জন্য দরজা খুলবেন, এমন সময় আবার মুখটা দেখা দিল ওভেনের ভিতর। মুখটা ঠোট নাড়ছে, মনে হয় যেন কিছু একটা বলছে সে। কিন্তু কথাগুলো বুঝতে পারলেন না তিনি।

কোনো মতে দৌড়ে ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার মুরে যেখানে বসেন সেখানে পৌঁছতে পারলেন। বিমানবালার সঙ্গে ওভেনের কাছে এলেন তিনি। মুখটা এখনও আছে। এবার মুরে আর ফে বুঝলেন সে কী বলছে। বলছে, সাবধান! বিমানে আগুন লাগতে চলেছে। এবার মুরে মুখটাকে চিনতে পারলেন। এটা আগের ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার ডন রেপোর মুখ, একটা দুর্ঘটনায় যিনি মারা গেছেন।

এসময় কেউই ডন রেপোর ভূতের কথাগুলো বিশ্বাস করল। তবে ঘণ্টা দুয়েক পর ওড়ার সময় কিছু সমস্যা দেখা দিল বিমানটায়। কাজেই মেরামতের জন্য নিউইয়র্কে ফিরিয়ে আনা হলো ওটাকে। ত্রুটি সারাবার পর পরীক্ষামূলকভাবে আকাশে উড়ানো হয় বিমানটা। এসময়ই আকাশে বিস্ফোরিত হয় বিমানটার জেট এঞ্জিন।

ডন রেপোর ভূতের সাবধানবাণী সত্যি ছিল। আমেরিকান বিমান পরিচালনা কর্তৃপক্ষের তদন্তে বেরিয়ে আসল যদি বিমানটিকে ত্রুটি সারানোর জন্য নিউইয়র্ক ফিরিয়ে আনা না হত, তবে সম্ভবত পৌনে দুশোর বেশি যাত্রী নিয়ে ফ্লোরিডা পৌঁছবার আগেই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ত ট্রিস্টার-৩১৮।

১৯৭২ সালে ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স-এর ফ্লাইট নম্বর ৪০১ বিধ্বস্ত হয়। ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় ডন রেপোর সঙ্গে পাইলট বব লফট এবং ৯৭ জন যাত্রী নিহত হন। মৃত্যুর পর অনেকবার পাইলট বব লফটকেও দেখা গেছে বিভিন্ন ফ্লাইটে।

মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা কবলিত বিমানটির যেসব অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয় সেগুলো পরবর্তীতে নতুন তৈরি করা কয়েকটি বিমানে ব্যবহার করা হয়। ট্রিস্টার-৩১৮ বিমানটার কিচেনসহ আরও কিছু অংশ ছিল দুর্ঘটনা কবলিত সে বিমানটার অংশ।

এই ভৌতিক ঘটনার শুরু ১৯৭৩ সালে। এসময় ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ট্রিস্টার-৩১৮ বিমানটায় ভ্রমণ করছিলেন। দস্তুরমত ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের পোশাক পরা একজন ক্যাপ্টেন বসেছিলেন তাঁর পাশে। হঠাৎ ক্যাপ্টেনের চেহারার দিকে ভালভাবে তাকালেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। আঁতকে উঠলেন তিনি। এটা কীভাবে সম্ভব? এক বছর আগে পাইলট বব লফট মারা গেছেন, তাহলে কীভাবে তাঁর পাশে বসে আছেন এখন। দৌড়ে ককপিটে চলে এলেন ভদ্রলোক। বিষয়টা কী? খতিয়ে দেখতে বিমানের অন্যান্য কর্মীরা দৌড়ে এল। তবে ততক্ষণে বব লফটের ভূত অদৃশ্য হয়েছে।

আরেকবার ট্রিস্টার-৩১৮ এর ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার ককপিটে ঢোকেন আকাশে ওড়ার আগে সব কিছু ঠিক আছে কিনা দেখে নেয়ার জন্য। এসময়ই চমকে উঠে দেখেন ডন রেপোর ভূত সিটে বসে আছে ইউনিফর্ম পরে। যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করছে সে। অপর ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ারকে সব যন্ত্রপাতি ঠিক আছে জানিয়ে অদৃশ্য হয় সে।

বিমানটির আরেক অফিসার ডন রেপোর যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করার এই গল্প শুনেছিলেন। মায়ামি থেকে আটলান্টার দিকে ফিরতি ফ্লাইটের আগে যন্ত্রপাতিগুলো ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আর কাজটা করতে ককপিটে ঢুকতেই দেখেন ডন রেপোর ভূত খুব মনোযোগের সঙ্গে বিমানের সব যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করছে।

১৯৭৪ সালে ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স-এর পাইলটদের নিরাপত্তার কিছু নির্দেশনা দেয়। এতে বিমানে ডন রেপো আর বব লফটের উপস্থিতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। এটা করা হয় কারণ বিমানের কর্মীরা যেন তাদের দেখে চমকে না ওঠেন সেজন্য। তবে এই ভূতেরা কখনও কারও ক্ষতি করেনি। বরং নিজেদের মত করে সাহায্য করার চেষ্টাই করেছে। তবে যত যাই হোক ভূত বলে কথা। ক্ষতি করে না জানার পরও মনে-মনে ঠিকই এদের প্রতি একটা আতংক ঠিকই থাকত সবার।

ডন রেপো এবং বব লফটের মারা যাওয়ার আঠারো মাস পর তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয় ট্রিস্টার-৩১৮তে। এরপর থেকে আর তাদের ভূতকে দেখা যায়নি বিমানে। অবশ্য বিমান সংস্থাটির কর্তৃপক্ষ এমনকী বিমানের কর্মীরাও এই বন্ধুভাবাপন্ন কর্মকর্তাদের আত্মার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই প্রার্থনা আয়োজন করতে চাননি। কিন্তু যাত্রীরা আতঙ্কে বিমানে চড়া বন্ধ করে দেওয়া শুরু করলে এটা করতে বাধ্য হন তারা।

আশ্চর্য ঘটনা, ১৯৭২ সালের সেই দুর্ঘটনায় রেপো আর লফটের সঙ্গে ৯৭ জন যাত্রীও মারা যান। কিন্তু ট্রিস্টার-৩১৮ বিমানে কেবল তাদের দুজনের ভূতেরই আনাগোনা ছিল। তাহলে বাকি যাত্রীদের ভূত কেন দেখা দিত না এটা একটা রহস্য। অবশ্য কে না জানে এ ধরনের ভৌতিক ঘটনা কোনো নিয়ম মেনে চলে না। তবে এমন হতে পারে রেপো আর লফট কোনোভাবেই তাদের পুরানো বিমান আর পেশার মায়া কাটাতে পারছিলেন না। বাকি যাত্রীদের তো আর এর প্রতি এত দরদ থাকার কথা নয়।

৪. রাঁধুনির ভূত

রাঁধুনির ভূত

একজন যাজক এই কাহিনিটি জানান। তবে কারও নাম প্রকাশ না করার শর্ত ছিল তার। আর আমরা যে সূত্র থেকে লেখাটি পেয়েছি তাতেও কারও নাম ছিল না। এটা এখন শুনব যাজকের জবানীতে।

আমার স্ত্রীর বাবার বাড়িতে বেশ কয়েকজন মহিলা চাকরবাকর ছিল। বিয়ের আগে এদের সব কিছু দেখভালের দায়িত্ব ছিল আমার স্ত্রীর। একবার বাড়ির মহিলা রাঁধুনির অ্যাপেণ্ডিসাইটিসে ব্যথা শুরু হয়। এসময় একটা হাসপাতালের গির্জার যাজকের দায়িত্ব পালন করছি আমি। মহিলাটিকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করে দিই। সেখানে অপারেশন করা হলেও বাঁচানো যায়নি তাকে। তার বন্ধুরা মহিলাকে কবর দিয়ে দেয়।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কয়েক দিন পরের ঘটনা। আমার স্ত্রী রান্নাঘরের একটা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছে। এখান থেকে দরজা খোলা থাকলে সামনের বারান্দা দিয়ে যে-ই যাবে নজরে পড়বে তার। তখন সকাল এগারোটার মত বাজে। মাসটা ফেব্রুয়ারির শেষ কি মার্চের শুরু। একটা কেকের ওপর চিনির প্রলেপ দিচ্ছে তখন সে। এসময়ই কাজ থেকে চোখ তুলে খোলা দরজা পথে বারান্দাটার দিকে তাকাল সে। বাড়ির ভৃত্যদের বসবার ঘরের পাশ দিয়ে অন্য একটা কামরার দিকে গেছে বারান্দাটা। এসময়ই পরিষ্কার দেখল কিছুদিন আগে মারা যাওয়া সেই রাঁধুনিটিকে। বারান্দা ধরে ওই কামরাটার দিকে যাচ্ছে। সকালের দিকে সাধারণত যে ধরনের পোশাক পরে তাই পরনে। পরিস্থিতিটা এতটাই স্বাভাবিক মনে হলো যে শুরুতে আমার স্ত্রীও খুব একটা ভয় পেল না। তবে মহিলাটির পিছু নিল সে। বারান্দা থেকে কামরাটায় তার স্কার্টের ঝুলটা অদৃশ্য হতে দেখল। কিন্তু ভিতরে ঢুকে কাউকেই দেখতে পেল না সেখানে।

 

মৃত্যু সংকেত

অতিপ্রাকৃত ঘটনার মধ্যে উপরের সারিতে থাকবে মৃত্যু সংকেতের ব্যাপারটা। কখনও মৃত্যু সংকেত আসে যিনি মারা যাবেন তাঁর কাছে। আবার অনেক সময় মৃত্যুর আভাস পান অন্য কেউ। অনেক সময়ই কোনো নারী মূর্তি হাজির হন সংকেত দেওয়ার জন্য। স্বপ্নেও পাওয়া যায় কখনও কখনও মৃত্যুর বার্তা। এসব কিছু নিয়েই ‘মৃত্যু সংকেত’।

বানশি (প্রথম পর্ব)

আয়ারল্যাণ্ডের সব ধরনের ভূত, প্রেত, পেত্নীর মধ্যে সাধারণ লোকেদের কাছ সবচেয়ে পরিচিত বানশি। কখনও কখনও একে বহিস্থা কিংবা বানকিস্থা নামেও ডাকা হয়। বানশি এখানকার লোকদের দেখা দিয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। তবে তার ইতিহাস কতটা প্রাচীন এটা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।

বানশির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো সে মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করে। তবে তার এই মৃত্যুসংকেত দেওয়ার রীতি আগের জমানা থেকে এখন বদলেছে। পুরানো দিনে আইরিশ গল্পে মানুষের মাথাঅঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা রক্তরঞ্জিত পোশাক ধুতে দেখা যেত বানশিকে। যতক্ষণ না পানি পুরোপুরি রক্তে লাল হয়ে যেত ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধোয়াধুয়ি চলত। তবে ইদানিং কালে সাধারণত চিল্কার করতে করতে হাত আঁকিয়ে বা তালি দিয়ে মৃত্যুর বার্তা দেয় বানশি।

এদিকে তার পোশাক-আশাক আর চেহারার নানান ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। কখনও কখনও সে তরুণী, সুন্দরী। কখনও আবার বুড়ো, কদাকার। একজন লেখক যেমন তার বর্ণনা দিয়েছেন, লম্বা, কৃশ এক নারী। যার মাথার খোলা লম্বা চুল নেমে এসেছে কাঁধের চরপাশে। পরনে সাদা আলখেল্লা। সেই সঙ্গে আছে কাপা, টানা চিৎকার। আবার এক কোচোয়ান তাকে এক সন্ধ্যায় একটা বাড়ির আঙিনায় বসে থাকতে দেখেছে। তরে তখন সে নীল চোখের ছোটখাট এক মহিলা। ঘাড় বেয়ে নেমে এসেছে লম্বা পাতলা চুল। আর পরনে লাল আলখেল্লা। তবে এখন যে কাহিনিগুলো আমরা পাঠকদের শোনাব তাতে মিলবে তার আরও নানান ধরনের বর্ণনা।

পুরানো আর বিখ্যাত বানশি কাহিনিগুলোর একটি পাওয়া যায় লেডি ফানশর স্মৃতিকথায়। ১৬৪২ সালে স্বামী রিচার্ডের সঙ্গে এক ব্যারন বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যান তিনি। পরিখা ঘেরা পুরানো ধরনের একটা দুর্গবাড়িতে থাকেন ভদ্রলোক। রাতে কলজে চরা, অতিপ্রাকৃত একটা চিৎকারের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল লেডি ফানশর। বিছানা থেকে তাকাতেই জানালার ওপাশে একটি নারীর মুখ আর শরীরের কিছু অংশ ভাসতে দেখলেন, চাঁদের আলোয়। মাটি থেকে জায়গাটার উচ্চতা আর পরিখার উপস্থিতি বলে দিল, তাঁর দেখা এই চেহারাটা মোটেই এই পৃথিবীর কারও নয়। মুখটা তরুণী, সুন্দর চেহারার এক নারীর। তবে বড় ফ্যাকাসে, লালচে চুলগুলো আলুথালু। আতংকে ফানশ ওটার পরনের পোশাক খুঁটিয়ে খেয়াল করলেন না। তবে পুরানো, আইরিশ পোশাক মনে হলো। কিছুক্ষণ ওভাবেই ঝুলে থাকল নারীমূর্তিটা। তারপর শুরুতে যেমন চিৎকারে লেডি ফানশর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে সেরকম দুটো তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে অদৃশ্য হল।

সকালে আতংকে প্রায় কাঁপতে-কাঁপতে গৃহকর্তাকে কী দেখেছেন তা খুলে বললেন। তাঁকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক তাঁর কথা পুরোপুরি মেনে নিলেন। শুধু তাই না, এর ব্যাখ্যা হিসাবে নিজের পরিবারের অবিশ্বাস্য এক কাহিনি শোনালেন।

আমার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় গত রাতে এই দুর্গে মারা গেছেন, বললেন তিনি। এমনটা ঘটতে পারে এটা জানা সত্ত্বেও আপনার কাছে এটা গোপন করেছিলাম। কারণ মনে হয়েছে আপনি যে হাসি-আনন্দে মেতে থাকার জন্য এখানে এসেছেন, তাতে এটা কালো ছায়া ফেলতে পারে। আমাদের পরিবারে কিংবা দুর্গে কারও মৃত্যুর আগে সবসময়ই আপনি যাকে দেখেছেন সেই নারী মূর্তিটি দেখা দেয়। ধারণা করা হয় নিম্নগোত্রের একজন মহিলার আত্মা সে। আমার এক পূর্বপুরুষ জাত-পাতের বাইরে গিয়ে তাকে বিয়ে করেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হন। আর পরিবারের প্রতি যে অসম্মান করেছেন তা ঢাকতে স্ত্রীকে পরিখায় ফেলে মারেন। এর পর থেকেই এই মহিলা বানশি হয়ে দেখা দেওয়া শুরু করেন।

বানশির পরের যে কাহিনিটি বলব সেটি পাঠিয়েছেন টি.জে.ওয়েস্ট্রপ। চলুন, তবে সরাসরি গল্পতে চলে যাওয়া যাক।

আমার নানী এটা শোনেন তাঁর মা রস-লিউইনের কাছ থেকে, যিনি নিজেই ছিলেন ঘটনাটির সাক্ষী। তাদের বাবা মি. হ্যারিসন রস-লিউইন আইন ব্যবসার কাজে তখন ডাবলিনের বাইরে গিয়েছেন। তাঁর অবর্তমানে বাড়ির ছেলে-মেয়েরা কয়েক মাইল দূরে বাস করা এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যান।

সেটি ছিল চমৎকার একটি রাত। চঁদের আলোও পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর। তবে কিলক্রিস্টের পুরানো গির্জাটার পশ্চিমে গাছপালা আর ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যখন এগিয়েছে তখন রাস্তাটার বেশ একটা অংশে অন্ধকারের রাজত্ব। গির্জাটা পুরানো দিনের ধবংসপ্রাপ্ত অন্য অট্টালিকাগুলোর মতই আয়তাকার একটা অট্টালিকা। চারপাশে লম্বা পাঁচিল। তবে এই মুহূর্তে পাঁচিল ভেঙে-চুরে যাওয়ায় গির্জা আর এর ধারের সমাধি দুটোই উন্মুক্ত। লম্বা, অন্ধকার পথটা ধরে যাবার সময় দূর থেকে তীক্ষ্ণ কান্না আর হাততালির শব্দ শুনতে পেলেন তারা। সাধারণত মৃত্যুর সময় আয়ারল্যাণ্ডবাসীরা এভাবে শোক করে। দ্রুত এগিয়ে গির্জার কাছে চলে এলেন তাঁরা। এখানে এসেই চমকে উঠলেন। গির্জার পাঁচিলের ওপর ধূসর চুলের ছোট্ট একজন মহিলা, যার পরনে গাঢ় একটা আলখেল্লা, দৌড়াদৌড়ি করছে। আর চিৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে হাত ছুঁড়ছে। মেয়েরা ভয় পেয়ে গেলেন। তবে ছেলেরা সামনে এগিয়ে গেলেন, তাদের দুজন গির্জার সীমানায় ঢুকে পড়লেন। তবে তখনই নারীমূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেল। চারপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কারও হদিস পেলেন না তাঁরা। ইতোমধ্যে অজানা একটা ভয় চেপে ধরেছে সবাইকে। যত দ্রুত সম্ভব বাড়ির দিকে ছুটলেন। বাড়িতে পৌঁছতেই তাদের মা দরজা খুললেন। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার চেহারা। আতংকিত কণ্ঠে বললেন স্বামীর জন্য ভয় পাচ্ছেন তিনি। কারণ চাঁদের আলোয় জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছেন এমন সময় একটা ঘটনা ঘটে। আগুনে চোখের বিশাল একটা কাক এসে জানালার চৌকাঠের ওপর বসে পর পর তিনবার কাঁচে ঠকঠক শব্দে টোকা দিয়ে গেছে। তাদের অভিজ্ঞতাটা মাকে বললে ভদ্রমহিলা আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এসময়ই আবার কাছের জানালাটায় ট্যাপ ট্যাপ শব্দ হলো। তাকাতেই তাঁরা দেখলেন পাখিটা ফিরে এসেছে। কয়েক দিন পরে তাঁরা খবর পেলেন, মি. রস-লিউইন ডাবলিনে মারা গিয়েছেন। এটা ছিল ১৭৭৬ সাল।

.

এবারের অভিজ্ঞতাটি একজন রোমান ক্যাথলিক বিশপের বোনের। তাঁর কিশোরী বয়সের ঘটনা এটি। এক সন্ধ্যায় আরও কিছু ছেলে-মেয়ের সঙ্গে হাঁটতে বের হন তিনি। রাস্তা ধরে হাঁটতে-হাঁটতে একটা বাড়ির গেট অতিক্রম করে গেলেন। রাস্তার ধারেই বিশাল একটা পাথর আছে এই জায়গাটায়। পাথরটার ওপর কিছু একটাকে বসে থাকতে দেখলেন তারা। কাছাকাছি হতেই ছোট্ট, গাঢ় পোশাকের একজন বুড়ো মহিলা বলে চিনতে পারলেন ওটাকে। হঠাৎ করেই কাঁদতে শুরু করল সে, আর হাততালি দিচ্ছে। সাহসী দু-একজন মহিলাটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে উল্টো ঘাবড়ে গেলেন। তারপর যত দ্রুত সম্ভব ওখান থেকে কেটে পড়লেন সবাই। পরদিন জানা গেল যে বাড়ির সামনে নারী মূর্তিটিকে কাঁদতে দেখা গেছে সেই বাড়ির কর্তা মারা গিয়েছেন। শুধু তাই না তিনি মারা গেছেন ওই সময় যখন মহিলাটিকে দেখেছে ছেলে-মেয়েরা।

ভয়ঙ্কর মুখ

ফ্রান্সে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ভবিষ্যৎ এক দুর্ঘটনার সংকেত পেয়েছিলেন। যদিও কেবল একটা ইংগিত ছিল ওটা, তবে আসলে এর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ভবিষ্যতের একটি মর্মান্তিক ঘটনার কাহিনি। অশুভ সংকেত দেওয়া চেহারাটা এতই ভয়ঙ্কর ছিল যে তা ভুলতে পারেননি রাষ্ট্রদূত। আর এটাই জীবন বাঁচিয়ে দেয় তার।

১৮৭৯ সাল। ফ্রান্সে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড ডাফেরিন এক বন্ধুর সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছেন। তাঁর বন্ধু থাকেন আয়ারল্যাণ্ডে।

এক রাতে হঠাৎ গভীর ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন ডাফেরিন। স্বপ্নে অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখেছেন। তবে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অন্য কোনো একটা কারণ আছে। অস্বস্তি নিয়ে কিছুটা সময় বিছানায় বসে রইলেন। তারপর বিছানা থেকে উঠে লন আর ফুল বাগনের দিকে মুখ-করা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলেন একজন লোক পিঠে একটা কফিন নিয়ে হেঁটে চলেছে।

লর্ড ডাফেরিন দুঃসাহসী মানুষ। বেরিয়ে এসে লোকটাকে থামিয়ে জানতে চাইলেন, কফিনের ভিতরে কী?

মুখ তুলে তাঁকে দেখল লোকটা। গা কাঁটা দিয়ে উঠল ডাফেরিনের। ভয়ঙ্কর একটা চেহারা। চোখের নীচের হাড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। মুখ আর শরীরের চামড়া মনে হচ্ছে বহু পুরানো আর শুকনো, খসখসে। যেন একটা কংকালের শরীরে চামড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রথমে আতংকে জমে গেলেন লর্ড ডাফেরিন। তবে সাহস সঞ্চয় করে আবার লোকটার কাছে জানতে চাইলেন, এত রাতে কফিনটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তুমি?

জবাবে লোকটা তার দিকে এগিয়ে এল। তারপরই ডাফেরিনের ভিতর দিয়েই যেন গলে বেরিয়ে গেল এবং অদৃশ্য হলো।

সকালে এখানকার বন্ধুদের ঘটনাটি খুলে বললেন ডাফেরিন। ভুতুড়ে বিয়য়ে ভাল জানাশোনা আছে এমন কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বললেন। তবে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের এই রাতের অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না কেউই। ধীরে-ধীরে ঘটনাটি মুছে গেল সবার মন থেকে।

চার বছর পরের ঘটনা। লর্ড ডাফেরিনের নিজের মনেও সেই রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার স্মৃতি ফিকে হতে শুরু করেছে। প্যারিসের গ্র্যাণ্ড হোটেলে এক আমন্ত্রণে গিয়েছেন লর্ড।

তাঁর সেক্রেটারি, সহকারি আর ব্যক্তিগত পরিচারকও সঙ্গে গিয়েছেন। লিফটে ঢোকার মুহূর্তে স্থির হয়ে গেলেন লর্ড। হঠাৎই তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল চার বছর আগের এক রাতে আয়ারল্যাণ্ডে দেখা লর্ড ডাফেরিন সেই অশুভ মুখটার কথা। লিফটম্যান ওই একই ব্যক্তি। কোনো সন্দেহ নেই তাঁর।

সেক্রেটারি আর সহকারীকে সে রাতের ঘটনা বর্ণনা শুরু করলেন। ইতোমধ্যে লিফটটা তাদের রেখেই চলে গেছে। লর্ড তখনও ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা বলা শেষ করেননি। এমন সময় চড়া একটা শব্দ হলো। পুরো হোটেলে হৈচৈ পড়ে গেল। লিফটটা যখন পঁচতলায় পৌঁছে তখন দড়ি ছিঁড়ে যায় ওটার, আর নীচে পড়ে ধপাস করে। লিফটে যে কয়েকজন লোক ছিলেন মারা গিয়েছেন সবাই। লর্ড ডাফেরিন দেখলেন হোটেলের কর্মচারীরা মৃত লোকদের সরিয়ে নিচ্ছে লিফটের ধ্বংস্তুপ থেকে। তবে যার কারণে তার লিফটে ওঠা হয় নি, সেই লোকটাকে দেখা গেল না লিফটে।

পরে লর্ড জনতে পারলেন সেদিন হোটেলের লিফটম্যান ডিউটিতেই আসেনি। তবে এই লোকটা এল কোথা থেকে? তার পরিচয়ই বা কী? এই কাহিনিটি লিপিবদ্ধ আছে ব্রিটিশ সোসাইটি অভ সাইকিক রিসার্চ বইয়ে। তবে সেখানে একে দেখানো হয়েছে অমীমাংসিত এক রহস্য হিসাবে। এমনকী এর কোনো সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি।

কফিনে কে?

এবারের ঘটনাটিতে আগের ঘটনাটির সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন। এটি বর্ণনা করেছেন ইংল্যাণ্ডের ক্ল্যাপটনের ব্লারটন রোডের মিসেস ক্রফটস।

তাঁর স্বামীর মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা এটি। মিসেস ক্রফটস, আর তাঁর স্বামী ঘুমাতে গিয়েছেন বিছানায়। কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ঘুম এল না ভদ্রমহিলার। কিছুক্ষণ এপাশওপাশ করে উঠে বসলেন। এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরই অদ্ভুত একটি বিষয় নজর কাড়ল তাঁর। হঠাত্র সদর দরজাটা খুলে গেল। এখান থেকে ওটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। কারণ তাঁদের শোবার ঘরের দরজা খোলাই থাকে সবসময়। দরজা খোলার একটু পরই দুজন লোক ঢুকল বাড়িতে। তবে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো একটা কফিন বয়ে আনছে তারা। অবাক হলেও কেন যেন সেরকম ভয় হলো না মিসেস ক্রফটসের। তারপরই কফিনটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল লোক দুজন। মি. আর মিসেস ক্রফটস যে কামরায় আছেন সেখানে চলে এল তারা। ফ্লায়ারপ্লেসের মেঝেতে নামিয়ে রাখল ওটা। তারপর নীচে নেমে সামনের দরজা ভেজিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। পুরো সময়টায় একটা কথাও বেরোল না মিসেস ক্রফটসের মুখ থেকে। তারপরই যেন একটা ঘোর থেকে বের হয়ে এলেন মিসেস ক্রফটস। কফিনটারও কোনো নাম-নিশানা পেলেন না।

রাতে আর ঘুমাতে পারলেন না। সকালে নাস্তার টেবিলে স্বামীকে খুলে বললেন গোটা ঘটনাটা। মি. ক্রফটস হেসে স্ত্রীকে বললেন, স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। ভদ্রমহিলাও মন থেকে ঝেড়ে ফেললেন ওটাকে। এক সপ্তাহ পর হঠাৎ মারা গেলেন তার স্বামী। সন্ধ্যার পর ওপর তলার একটা কামরায় কাজ করছিলেন মিসেস ক্রফটস। এসময় দরজায় টোকা পড়ল। তিনি ওপরে কাজ করতে থাকায় তার মা দরজা খুলে দিলেন। তারপরই দরজায় পদশব্দ শুনলেন। মুখ তুলে চাইতেই শিউরে উঠলেন। কফিন হাতে দুজন লোক, আর তিনি এক সপ্তাহ আগে যে লোকদুজনকে দেখেছেন তারাই। তারপর এগিয়ে এসে যেখানে আগেরবার রাখতে দেখেছিলেন মিসেস ক্রফটস সেখানেই নামিয়ে রাখল কফিনটা। মিসেস ক্রফটস শুধু আতংক আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন কফিনটার দিকে।

মৃত্যু পরোয়ানা

টমাস, লর্ড লিটলটনের কাছে রাতে যে এসেছিল, আর ভয়ঙ্কর সতর্কসংকেত দিয়েছিল, সে কি ভূত ছিল নাকি স্বপ্নের কোনো চরিত্র, তা কখনও জানতে পারব না আমরা। এ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে বিস্তর। কিছু লোক ভূতে বিশ্বাস করেন, আবার অনেকে করেন না। এমনকি যখন ভবিষ্যদ্বাণীটা এল তারপরও মনে হয়েছিল ওটা আসলে কিছুই না। এমনকী মৃত্যুর আধ ঘণ্টা আগে লর্ড লিটলটন নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলেন ভুতুড়ে অতিথি স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নন। আসলেই কি তাই?

১৭৭৯ সালের নভেম্বরের এক সন্ধ্যা। লর্ড লিটলটন তাঁর খাস ভৃত্যকে ডেকে বললেন তিনি ঘুমাতে যাবেন। ভুরু কুঁচকে উঠল ভৃত্যের। এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস নেই তার মালিকের। সাধারণত বিছানায় যান মধ্যরাতের পরে, কখনও কখনও বাড়িতে অতিথি থাকলে তো ভোর পর্যন্ত আড্ডা চলে। কাজেই কামরা ছাড়ার আগে একটু দ্বিধা করল সে।

আশা করি, আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েননি? বলল সে।

না, উইলিয়াম। সেরকম কিছু না। আমি বেশ ভাল আছি। তবে আমার মনে হয় এখন ঘুমাতে যাওয়া উচিত। ক্লান্তি লাগছে, তাছাড়া আবহাওয়াটা কেমন দেখেছ তো। ভারি আর স্যাঁতস্যাঁতে। মনে হচ্ছে যেন একটা ঝড় আসতে চলেছে।

স্নায়ুগুলোকে শান্ত করার জন্য একটা ওষুধ খেলেন লর্ড লিটলটন। তারপর বিশাল খাটটায় শুয়ে পড়লেন। উইলিয়াম খাটের চারধারের পর্দা টেনে দিল। তারপর বাতি নিভিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। একটার পর একটা মিনিট পেরিয়ে যেতে লাগল। বাইরের গুমোট আবহাওয়ায় হঠাৎ করেই দমকা বাতাস বইল। বাগানের গাছগুলোতে খস খস শব্দ তুলে বয়ে গেল, আর জানালায় ডালপালা বাড়ি খাওয়ার শব্দ হলো। আর এই শব্দ নিরুদব একটা ঘুমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে লাগলেন লর্ড লিটলটন। মাথায় নানান চিন্তা এসে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি। এর সঙ্গে তাকে জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে প্যারিস চার্চের ঘড়ির ঢং ঢং শব্দ।

এভাবে মনে হয় কয়েকটা ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। আস্তে-আস্তে ঘুমে জড়িয়ে আসছে লিটলটনের চোখ। এসময়ই একটা অন্যরকম শব্দে তন্দ্রা ভাব কেটে গেল। মনে হয় যেন দড়িতে টার্ন পড়েছে এভাবে বিছানায় উঠে বসলেন, আর অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলেন। শব্দটাকে বিশাল কোনো পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজের মত লাগল। তবে এটা আসছে কামরার ভিতর থেকে। কিন্তু কোনো পাখি ঘরের ভিতর ঢুকবে কীভাবে, ভাবলেন তিনি। হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হলো তাঁর। ওটা কী? সাহস করে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখবেন? নাকি উইলিয়ামকে ডাকবেন?

এসময়ই ডানা ঝাপটানোর শব্দ থেমে গেল। নীরব হয়ে গেল চারপাশ। এটা আরও ভয়াবহ। কামরায় তিনি ছাড়া আরও একটা অশুভ উপস্থিতির আভাস পাচ্ছেন লর্ড। সাহায্যের জন্য জোরে চিৎকার করার তাগিদ অনুভব করলেন। চেষ্টা চালালেন, কিন্তু মুখ ফুটে কোনো আওয়াজ বেরোল না।

খাড়া হয়ে বসা লিটলটনের দৃষ্টি চলে গেল বিছানার কিনারার পর্দার দিকে। তারপরই তাঁর আতঙ্কিত চোখের সামনে ওটা নড়তে শুরু করল। একসময় সরে গেল। দেখা গেল সেখানে অপার্থিব একটা আলোয় দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক। তাঁর সারা জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী, মোহনীয় এক নারী সে। আবার কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো বোল বেরোল না। তিনি কেবল জায়গাতেই স্থির হয়ে বসে, তাকিয়ে থাকলেন দীঘল শরীরের রহস্যময় নারীটির দিকে।

তারপরই কথা বলে উঠল নারীটি, টমাস, লর্ড লিটলটন, আমার কথাগুলো মনে গেঁথে নাও। মিষ্টি একটা কণ্ঠ, তবে অবশ্যই মানুষের গলার শব্দ না। কণ্ঠটা শুনলে বাতাস আর ঢেউয়ের কথা মনে পড়ে। আবার হালকা একটা প্রতিধ্বনি হয় এর, মনে হয় একই সঙ্গে সব দিক থেকে আসছে। শব্দটা যেন শোনার সঙ্গে সঙ্গে অনুভবও করছেন তিনি।

আমার কথাটা মনে রাখো আর নিজে নিজে প্রস্তুত হও। তিন দিন সময়, তৃতীয় দিন রাত ঠিক বারোটার সময় তুমি মারা যাবে।

প্রস্তুত হও…

আতংকে শিউরে উঠলেন লিটলটন। মুখ বেয়ে ঘাম নামছে টপটপ করে, যখন তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন এই ভবিষ্যত্বক্তাকে প্রশ্ন করার। কিন্তু দুর্বোধ্য একটা কর্কশ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরোল না তাঁর মুখ থেকে।

প্রস্তুত হও…প্রস্তুত হও… আস্তে-আস্তে মিলিয়ে গেল রহস্যময় নারীর কণ্ঠস্বর, সেই সঙ্গে গায়েব হয়ে যেতে শুরু করল সে-ও। পর্দাটা ফিরে এল আগের জায়গায়। আবার নীরব হয়ে গেল চারধার। ভয়ে, যন্ত্রণায় বিহ্বল লিটলটন শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিলেন, তারপর নিস্তেজ ভাবে পড়ে রইলেন সেখানে।

সকালে উইলিয়াম এল লর্ডকে ঘুম থেকে জাগাতে। বিছানায় মড়ার মত পড়ে থাকা কাঠামোটাকে দেখে তার মনে হলো, মালিকের নিশ্চয়ই রাতে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত লর্ডকে জাগিয়ে তুলতে পারল উইলয়াম। কিন্তু তাকে মোটেই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। উইলিয়াম বুঝে উঠতে পারল না কী করবে। সে কি এখনই একজন ডাক্তারের কাছে যাবে? কিন্তু তাহলে বিধ্বস্ত এই মানুষটাকে একা রেখে যেতে হবে। বিছানায় পড়ে আছেন এখন তিনি, চোখ বড় বড়, শরীর এমনভাবে কাঁপছে যেন জ্বর এসেছে। উদ্বিগ্ন উইলিয়ামের প্রশ্নেরও কোনো ভাল উত্তর দিতে পারলেন না। না, তিনি অসুস্থ নন, তবে ভাল নেই। নানান ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলতে লাগলেন। একবার বলেন পুরো কামরাটা খুঁজে দেখতে, একবার জানালা বন্ধ করতে বলেন তো আবার তার পরেই জানালা খোলার আদেশ দেন। এই বলেন ডাক্তর ডাকো, পরমুহূর্তেই ডেকো না।

তবে ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে শুরু করলেন লিটলটন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উইলিয়াম বলল সে বরং মালিকের জন্য এক বাটি গরুর মাংসের স্যুপ নিয়ে আসছে। তার মনে হয় এখন এটাই লর্ডের জন্য সবচেয়ে দরকারি। ফ্যাকাসে আর বিধ্বস্ত চেহারার লিটলটন সম্মতি জানালেন, হ্যাঁ, মনে হয় স্যুপটা ভাল লাগবে আমার। তাঁর কণ্ঠটা এখন বেশ স্বাভাবিক।

আর মালিক, একজন ডাক্তার ডাকব. কি?

না, এখন আমি ঠিক আছি। খুব সম্ভব আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। এর কোনো ওষুধ ডাক্তারের জানা আছে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমার। তবে আমার কিছু বন্ধুকে আমি দেখতে চাই। মি.এজ, মি. এইসকফ, মি পিগউ-এদের খবর পাঠাতে হবে। যেসব বন্ধুদের পাশে পেতে চাই তাদের সবার নাম আমি তোমাকে পরে বলছি। এখন স্যুপটা নিয়ে এসো। তারপর আমি বিছানা ছাড়ব।

একা হয়ে যেতেই বার-বার রাতের ঘটনাটা নিয়ে ভাবলেন। এটা কি একটা স্বপ্ন? ঘটনাটা সত্যি বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু এটাও ঠিক-স্বপ্ন সত্যিই মনে হয়। বিছানা থেকে নেমে সাবধানে পর্দাগুলো পরীক্ষা করলেন। গত রাতের রহস্যময় মহিলাটি এখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার কোনো প্রমাণই নজরে এল না। তবে এখনও মনের ভিতর জ্বলজ্বল করছে সে। তার চেহারা, কণ্ঠ এমনকী তার বলা কথাগুলো-সব কিছু।

আর স্মৃতিটা মনে পড়তেই কেঁপে উঠলেন। তিনি মরতে চান। এখনও বয়স বেশি হয়নি তার। জীবনটা উপভোগ করছেন। এখন একটা কাজই করার আছে তা হলো বন্ধুদের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলা।

সকাল হতেই লিটলটনের ডাকে একজনের পর একজন বন্ধু হাজির হতে লাগলেন হিল স্ট্রীটের বাড়িটায়। তাদের প্রত্যেককে গত রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার গল্প শোনালেন লিটলটন। মনেমনে আশা করেছিলেন হেসে উড়িয়ে দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করবেন তাঁরা। ঘটলও তাই। সবাইই গল্পটায় দারুণ মজা পেলো।

সে কি সুশ্রী ছিল, টমাস? জানতে চাইলেন মাইলস এণ্ড্রুজ।

সুশ্রী নয়, সুন্দরী। জবাব দিলেন লিটলটন।

হেসে গড়িয়ে পড়লেন বন্ধুরা। সুন্দরী? সুন্দরী নারীর স্বপ্ন দেখেছ? যতদূর বোঝা যাচ্ছে তিন দিনের মধ্যে তোমার বিয়ে হবে, মরবে না। সন্দেহ নেই এটা একটা স্বপ্নই। আশা করব কুসংস্কার তোমাকে পেয়ে বসবে না।

আর বন্ধুদের কথা-বার্তা আর যুক্তি শেষ পর্যন্ত লিটলটনকে আশ্বস্ত করল তাঁদের কথাই ঠিক। মন মরা ভাব কেটে যেতে লাগল তার। যদিও যখনই একা হন মহিলার চেহারা আর কথাগুলো হামলে পড়ে স্মৃতিতে। তাই ঠিক করলেন দুশ্চিন্তাটা ঝেটিয়ে মাথা থেকে দূর করে দেবেন, অন্তত তিন দিন পার না হওয়া পর্যন্ত। বাড়িটা তাই লোকজনে ভরপুর করে রাখলেন। সকালের নাস্তা, দুপুরের লাঞ্চ আর রাতের খাবার খেলেন বন্ধুবান্ধবদের নিয়েই।

পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত কাজে লাগল। ধন্যবাদ অবশ্য পাবেন লিটলটনের চমৎকার বন্ধুরা। তারা এমন হাসি-ঠাট্টায় লর্ডকে মাতিয়ে রাখলেন যে, আবার আগের সেই লিটলটন হয়ে উঠেছেন তিনি। হাসি-খুশি, প্রাণবন্ত।

তৃতীয় দিন সকালে খুব ধীরে হেঁটে ডাইনিংয়ে ঢুকলেন লিটলটন। ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা। খুব শান্তভাবে ইতোমধ্যে এখানে উপস্থিত হওয়া বন্ধুদের স্বাগত জানালেন। তার শরীর কেমন জিজ্ঞেস করা হলে কেবল মাথা ঝাকলেন। অন্য বন্ধুদের সঙ্গে উপস্থিত আছেন জনাথন গ্রেভস নামের এক জাদুকর এবং চার্চের অর্গান বাজিয়ে। লর্ডকে নিয়ে আবার দুশ্চিন্তাটা পেয়ে বসেছে তাঁকে। কারণ তাঁর জাদু কিংবা অর্গান বাজানো লিটলটনের ওপর কোনো প্রভাবই ফেলছে না। আবার মন মরা হয়ে গেছেন লর্ড।

তবে রাতের খাবারের সময় মেঘ কেটে গেল লিটলটনের চেহারা থেকে। খাওয়া শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অতিথিদের তাকিয়ে হেসে বললেন, বন্ধুরা, আমি আবার আগের আমি হয়ে গেছি। তোমাদের ধন্যবাদ।

কিন্তু একটু পরেই আবার বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন লর্ড। তিনি যখন কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন তখন গ্রেভস বললেন, কথা বলে আর ঠাট্টা-মস্করা করে তাকে আর খুশি রাখতে পারব না আমরা। বরং আমার মনে হয় এখন একটা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রতারণা? বললেন মি.এইসকফ, তুমি কী বোঝাতে চাচ্ছ?

একবার দরজার দিকে তাকালেন গ্রেভস, তাঁদের আমন্ত্রণদাতা কথাগুলো শুনতে পাবেন না এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। এটা তেমন কিছু না, খুব নিচু কণ্ঠে বলে চললেন, টমাস মনমরা হয়ে আছে, কারণ সে ভাবছে মাঝরাতে মারা যাবে সে। তার মনে হবে বাড়ির প্রতিটি ঘড়ি তার দিকে তাকিয়ে আছে, বলছে রাত বারোটায় তোমার বারোটা বাজাব আমরা। চার ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা এভাবে সময় গুণতে গুণতে তার অবস্থা আরও কেরোসিন হয়ে যাবে। মাঝরাত যখন আসবে তখন দেখা যাবে হতভাগা লিটলটন দুশ্চিন্তাতেই মরেই গেছে। কিন্তু যদি এমন হয় যখন মাঝরাত আসবে, তখন সে যদি শান্তিতে বিছানায় ঘুমায়, তখন বিপদ কেটে যাবে।

কিন্তু কীভাবে মধ্যরাতের আগেই দুশ্চিন্তামুক্ত করতে পারব তাঁকে? জানতে চাইলেন মি. এইসকফ।

অন্যদের দিকে ঝুঁকে পড়ে গ্রেভস বললেন, বাড়ির প্রতিটি ঘড়িকে আমরা আধ ঘণ্টা এগিয়ে দেব। এই বলে নিজের ঘড়িটা পকেট থেকে বের করে সাবধানে ওটার সময় আধ ঘণ্টা এগিয়ে দিলেন। কিছু সময় তর্ক-বিতর্কের পর সবাই মেনে নিলেন বুদ্ধিটা ভালই কেঁদেছেন গ্রেভস। তা ছাড়া এতে তাদের বন্ধুকে চূড়ান্ত সময়ে আধ ঘণ্টা কম দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে। তারপর সবাইই নিজেদের ঘড়ি আধ ঘণ্টা করে এগিয়ে দিলেন। এবার জনাথন গ্রেভস বেল টিপে উইলিয়ামকে ডেকে আনলেন। তারপর তাকে পুরো পরিকল্পনাটা খুলে বলে জানতে চাইলেন সে কি বাড়ির সবগুলো ঘড়ির সময় পাল্টে দিতে পারবে কিনা।

হ্যাঁ, স্যর। চিন্তা করবেন না একটুও। এমনকী ড্রেসিং টেবিলের ওপর মালিকের নিজের যে ঘড়িটা আছে, ওটার সময়ও কেমন সুন্দর পাল্টে দিই দেখুন। বলল উচ্ছ্বসিত পরিচারক।

তারপরই লর্ড লিটলটন ফিরে এলেন। আলাপ চলতে লাগল। সাড়ে এগারোটার দিকে লর্ড লিটলটন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন এখন ঘুমাতে যাবেন তিনি। সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে শান্তভাবে কামরা ছাড়লেন।

তিনি চলে যাওয়াতে হাঁফ ছাড়লেন বন্ধুরা। এবার মনের ভিতরের কথাগুলো খোলাখুলি আলাপ করতে পারলেন তাঁরা। একটা প্রেতাত্মা লর্ড লিটলটনকে সতর্ক করে দিয়েছে এটা বিশ্বাস করতে বাধছে সবারই। এটা স্বপ্ন ছিল, এর চেয়ে ভাল ব্যাখ্যাও কেউ দিতে পারলেন না।

আমার মনে হয় আমাদের ঘড়ির সময় এবার ঠিক করে নিতে পারি। মন্তব্য করলেন জনাথন গ্রেভস। ও, ঈশ্বর, এখন বাড়ি ফিরব আমি। বুঝতে পারলেন এখন প্রায় মধ্যরাত +

আমিও, বললেন মি. এইসরুফ। আর আমার বন্ধু শান্তিতে ঘুমাচ্ছে এটা জেনে খুশিমনে বাড়ি ফিরছি।

তাই যেন হয়, বললেন আরেকজন অতিথি। তাঁরা সবাই চললেন তাদের কোট যেখানে রাখা হয়েছে সেই ক্লোকরুমের দিকে।

এসময়ই হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত একটা ঘণ্টা পড়ার শব্দ হলো। নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন তাঁরা, আতংক নিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। আরেকটা ঘণ্টা পড়ল।

এই একটা ঘড়ির সময় বদলাতে পারিনি আমরা, ফিসফিস করে বললেন গ্রেভস। প্যারিস চার্চের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম…

একটার পর একটা ঘণ্টা বেজেই চলল, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত…আর ঠিক তখনই ওপর থেকে একটা চিৎকার শোনা গেল।

তাড়াতাড়ি আসুন, মালিক মারা যাচ্ছেন…।

আট, নয়, ঘণ্টা বেজেই চলেছে। সিঁড়ি বেয়ে পড়িমরি করে ছুটলেন তারা, দেখলেন লর্ড লিটলটনের বেডরুমের দরজার সামনে ফ্যাকাসে চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে উইলিয়াম। দশ, এগারো… ঘরের ভিতর ঢুকে গ্রেভস, এইসকাফ আর অন্যরা দেখলেন যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছে লিটলটনের দেহ। বারো, মধ্যরাতের শেষ ঘণ্টা বাজল। আর তাদের চোখের সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন লর্ড।

পরে লাইব্রেরিতে জড় হওয়া অতিথিদের পুরো ঘটনাটা খুলে বলল উইলিয়াম।

মালিক তার কামরায় ঢুকে ঘুমানোর জন্য তৈরি হতে শুরু করলেন। তার কাপড় সরাবার সময় দেখলাম বার-বার নিজের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। আমি চাচ্ছিলাম যতক্ষণ সম্ভব এখানে থাকতে। কারণ খুব আস্তে-ধীরে সব কিছু করছিলেন। বিছানায় গিয়ে বললেন লাগোয়া পর্দাগুলো টেনে দিতে। তারপর আবার নিজের ঘড়ির দিকে তাকালেন, বারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। এবার আমার ঘড়িটা দেখতে বললেন, যখন সময়টা মিলে গেল তখন আশ্বস্ত হলেন। এবার দুটো ঘড়িই কানের কাছে নিয়ে নিশ্চিত হলেন দুটোই চলছে। ওগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, মাঝরাত পার হওয়া পর্যন্ত। এবার আমার ঘড়িটা ফিরিয়ে দিয়ে তাঁর ওষুধ তৈরি করতে বললেন। যখন গ্লাস নিয়ে ফিরে এলাম তখন সোয়া বারোটা ( আসলে পৌনে বারোটা)। জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, রহস্যময় নারী মোটেই ভাল ভবিষ্যত্বক্তা নন। আর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। আমার ওষুধ দাও। ওটা খেয়ে ঘুমানোর তদ্বির করব।

ধীরে-সুস্থে ওষুধটা পান করে আমাকে শুভরাত্রি জানালেন। কিন্তু যখনই ঘুমাতে যাবেন গির্জার ঘড়ি বাজতে শুরু করল। এসময়ই মালিকের দমবন্ধ হয়ে এল। আমাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। কী বলতে চেয়েছিলেন তা বলতে পারব না, দরজার দিকে দৌড়ে গেলাম আপনাদের, তাঁর বন্ধুদের ডাকতে।

ওহ! রহস্যময় নারী আসলেই ভবিষ্যতে জানত, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন জনাথন গ্রেভস, আর সে তার কথা রেখেছে…

ফলকে কার নাম?

এবারে একটা স্বপ্নের বর্ণনা দেব। তরে সাধারণ কোনো স্বপ্ন নয়, আর এর পর যে কাকতালীয় ঘটনাটি ঘটে তা চিন্তার খোরাক জোগানোর জন্য যথেষ্ট। এটি পাঠিয়েছেন আইরিশ একটি প্রকাশনীর প্রতিনিধি। তবে নাম গোপন করার শর্ত ছিল তাঁর। আর যেখান থেকে এটি সংগ্রহ করেছি আমরা সেখানেও তার নাম ছিল না। যাক সরাসরি মূল কাহিনিতে চলে যাওয়া যাক।

এই গল্পের নায়িকা আমার এক দাদী। আর সাক্ষীদের একজন আমার বাবা। যখনকার ঘটনা তখন বাবা তার ফুপু (আমার সেই দাদী) এবং আরও কিছু আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে থাকেন।

একদিন সকালে নাস্তার টেবিলে দাদী ঘোষণা করলেন কাল রাতে আশ্চর্য একটা স্বপ্ন দেখেছেন। বাবার সবসময়ই অদ্ভুত বিষয়ের প্রতি একটা মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ ছিল। তাই পুরো ঘটনাটি তাঁর নোট বইয়ে লিখে রাখেন। সেখান থেকেই এটা বলছি।

দাদী স্বপ্ন দেখেছেন তিনি একটা গোরস্থানে আছেন। ওটাকে গ্লাসনেভিনের কবরস্থানটা বলে চিনতে পারেন তিনি। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মৃতদের নাম, পরিচয় লেখা অনেক ফলক চোখে পড়ল তাঁর। কিন্তু ওগুলোর একটা দৃষ্টি কেড়ে নিল। কী আশ্চর্য! সাদা মার্বেল পাথরে পরিষ্কারভাবে খোদাই করা তার নিজেরই নাম।

ক্লেয়ার এস.ডি.
মৃত্যু ১৪ মার্চ, ১৮৭৩।
সবার ভালবাসার পাত্রী, সবসময় তাকে মনে রাখব আমরা।

আরও আশ্চর্য ব্যাপার, পাথরে খোদাই করা তারিখটা তাঁর স্বপ্ন দেখার দিন থেকে ঠিক একবছর সামনের। তবে আমার দাদী বেশ সাহসী মহিলা। এটাকে খুব একটা পাত্তা দিলেন না। একসময় স্বপ্নটা পুরোপুরি মুছে গেল তাঁর মন থেকে। সময় গড়াতে লাগল। একদিন সকালে নাস্তার টেবিলে তাঁকে দেখা গেল না। সবাই ধরে নিল দাদী গির্জায় গেছেন। তবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও আসতে না দেখে বাবা একজনকে তাঁর কামরায় খোঁজ করতে পাঠালেন, যদি ভিতরে থেকে থাকেন এই মনে করে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে কোনো সাড়া না পেয়ে দরজাটা খোলা হলো। বিছানার পাশেই নতজানু হয়ে পড়ে আছেন দাদী। মারা গেছেন আগেই। আর তারিখটা ১৮৭৩ সালের ১৪ মার্চ। ঠিক এক বছর আগে স্বপ্নে যে তারিখটা দেখেছিলেন। দাদীকে কবর দেওয়া হলো গ্লাসনেভিনে। সাদা পাথরের সমাধিফলকে লিখে দেওয়া হলো সেই কথাগুলো, স্বপ্নে দেখা ফলকে যা পড়েছিলেন।

 

দূরদৃষ্টি

কোনো কোনো মানুষ অনেক দূরের কোনো ঘটনা বা জায়গা দেখার দাবি করেন। কখনও স্বপ্নে কখনও আবার হঠাৎ করেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যখন দৃশ্যটা দেখেন তখন ওগুলোর কোনো কোনোটা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁদের। কিন্তু পরে দেখা যায় তাঁর দেখা জায়গাটি আসলেই আছে কিংবা তিনি যে ঘটনাটি ঘটার কথা বলেছেন তা আসলেই ঘটেছে। এমন কাহিনিগুলোকে পাবেন ‘দূরদৃষ্টি’তে।

১. হিণ্ডহেডের সেই বাড়ি

হিণ্ডহেডের সেই বাড়ি

ইংল্যাণ্ডের সারের হিহেডের এক হাউসকিপার এবারের কাহিনিটি বলেন। বেশ সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী এক মহিলা তিনি। তখন ভদ্রমহিলা থাকেন পশ্চিমের উপকূলীয় এলাকায়। এসময়ই হঠাৎ একদিন দেখলেন, মনে হলো যেন স্বপ্নে, পরের বছর হিহেডের যে বাড়িটাতে উঠলেন সেটিকে। অথচ তখন পর্যন্ত জীবনে কখনও সারে আসেননি, তিনি। তাঁর জানাও ছিল না কখন সারেতে আসবেন। এমনকী তার চোখের সামনে ভেসে ওঠা জায়গাটা যে সারেতে এটাও জানা ছিল না।

তিনি দেখলেন কেবল একটা লঞি বা কাপড় পরিষ্কারের দোকান। ওটার ভিতরে দাঁড়িয়ে আছেন। কী অদ্ভুত আর বিশাল লাগছিল ওটাকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। একটা বাড়ি এবং চারপাশের জিনিস পরিষ্কার নজরে এল। তারপরই আস্তেআস্তে সব মিলিয়ে গেল। কেন এসব দেখলেন কিছুই বুঝতে পারলেন না। তাঁর শুধু মনে হলো সাবেকি ধাঁচের ছোট্ট একটা বাড়ির কাছে অস্বাভাবিক বড় একটা লঞি দেখেছেন। আর এই জায়গাটায় জীবনে কখনওই আসেননি।

ছয় মাস পেরিয়ে গেল। মহিলা ও তাঁর স্বামী পশ্চিমের এলাকা ছাড়বেন স্থির করলেন। হাউসকিপার আর বাগানবিদের চাকরি খুঁজতে লাগলেন দুজনে। তারপরই একটা বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে চাকরির জন্য আবেদন করেন। নিয়োগ পাওয়ার পর যখন হিণ্ডহেডে এলেন তখন শীতকাল। আর এখানে এসেই মহিলাটি অবাক হয়ে দেখলেন এটা তো ছয় মাস আগে দেখা সেই জায়গাটি। এই লণ্ডিটা দেখে ভুল হওয়ার কোনো কারণ নেই। এমন বিশাল লঞ্জি সারের আর কোথাও নেই। আর লরি ভিতর থেকে যে বাড়িটা দেখেছেন সেটাই তাঁর গৃহস্বামীর বাড়ি, যেটার তত্ত্বাবধায়ক হয়ে এসেছেন। এমনকি লঞ্জি থেকে চারপাশের সব কিছু যেমন দেখেছেন এখানেও হুবহু তাই দেখলেন। অবাক হয়ে ভাবলেন, ছয় মাস আগেই কীভাবে তাঁর নতুন বাড়ি, লণ্ড্রি এসব দেখে ফেললেন?

২. দুর্ঘটনা

দুর্ঘটনা

স্কটল্যাণ্ডের এডিনবার্গের মি. এডওয়ার্ড ব্রাফটনের স্ত্রী এবং কর্নেল ব্লাঙ্কলির মেয়ে মিসেস এলিজাবেথ ব্রাফটন এই অভিজ্ঞতাটি জানান। ঘটনাটি ঘটে ১৮৪৪ সালে।

এক রাতে ঘুম থেকে উঠেই স্বামীকে জাগিয়ে তুললেন ভদ্রমহিলা। বললেন ফ্রান্সে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে। দুঃস্বপ্ন দেখেছেন ভেবে তার স্বামী বিরক্ত না করে ঘুমাবার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু এলিজাবেথ দিব্যি দিয়ে বললেন এটা কোনো স্বপ্ন নয়। বরং হঠাৎ করেই যেন দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।

দুর্ঘটনার ঠিক পর পর একটা বিধ্বস্ত ঘোড়ার গাড়ি দেখেছেন তিনি। বেশ কিছু মানুষ উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। একটা শরীরকে তুলে কাছের বাড়িটাতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরই দেখেছেন একটা বিছানায় একজন মানুষ শুয়ে আছে। তখনই লোকটাকে চিনতে পারলেন, ডিউক অভ অরলিনস। আশপাশে ডিউকের বন্ধুদের জড় হতে দেখা গেল। এদের মধ্যে রাজা, রাণীসহ ফরাসী রাজ পরিবারের কিছু সদস্যও আছেন। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে-ফেলতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা ডিউককে দেখছেন তাঁরা। একজন চিকিৎসককেও দেখা যাচ্ছে। তবে পিছনের অংশ দেখা যাওয়াতে তাঁকে চিনতে পারলেন না। ডিউকের ওপর ঝুঁকে পড়ে নাড়ীর স্পন্দন দেখছেন, অন্য হাতে তাঁর ঘড়ি। তারপরই সব শেষ হয়ে গেল। এলিজাবেথও আর কিছু দেখলেন না। দিনের আলো ফুটতেই যা দেখেছেন তার জার্নালে তা লিখে রাখলেন। যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ ছিল না। এর দুই কি তিনদিন পর টাইমসে এল ডিউক অভ অরলিন্সের মৃত্যু সংবাদ। কিছুদিন পর প্যারিসে বেড়াতে গিয়ে দুর্ঘটনার জায়গাটা দেখে চিনতে পারলেন এলিজাবেথ। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে চিকিৎসক মৃত্যুপথযাত্রী ডিউকের পাশে উপস্থিত ছিলেন তিনি এলিজাবেথের এক পুরানো বন্ধু। আর যখন ডিউকের বিছানার পাশে ছিলেন তখন কেন যেন এলিজাবেথ আর তার পরিবারের কথাই ভাবছিলেন তিনি।

এডিনবার্গের একজন নারী কীভাবে প্যারিসের একটা বাড়ির ভিতরে কী ঘটছে তা পরিষ্কার দেখলেন তা এক রহস্য। যেখানে ঘটনাটা অন্য কোনোভাবে জেনে প্রভাবিত হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না, কারণ ওটা সংবাদপত্রেই আসে তার দেখার দুতিন দিন পর। কেউ বলেন প্রকৃতির একটা লুকানো ক্যামেরা আছে। ওই ক্যামেরাতেই আমাদের দৃষ্টির বাইরে ঘটা নানান কিছু ধরে হাজির করা হয় চোখের সামনে। হয়তোবা এক্ষেত্রে এলিজাবেথের জন্য চিকিৎসক বন্ধুর ভালবাসাই প্রকৃতির রহস্যময় ওই ক্যামেরার চাবিকাঠি হিসাবে কাজ করেছে।

৩. রাফ মারা গেছে

রাফ মারা গেছে

এবারের কাহিনিটি বলেছেন ইংল্যাণ্ডের পশ্চিম ডালউইচের ওয়াডহাসেঁর এক ভদ্রমহিলা। তাঁর জবানীতেই এটা শুনব।

আমার মৃত স্বামী তার ভাইকে নিয়ে একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর ভাই মি. রাফ হলডেন তখন আফ্রিকা ভ্রমণ করছেন। ১৮৬১ সালের জুন কি জুলাইয়ের এক সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে ঘোষণা করলেন, রাফ মারা গেছে। আমি বললাম, ওটা নিছকই একটা দুঃস্বপ্ন। আমার কথায় কর্ণপাত না করে ও বলল সে পরপর দু-বার দেখেছে মাটিতে পড়ে আছে রাফ। আর একজন মানুষ তাকে ধরে আছে। পরে তারা খবর পেলেন ঠিক যে সময়ে স্বপ্নে রাফের ভাই তাকে মারা যেতে দেখেছেন তখনই মারা গেছেন ভদ্রলোক। আর একটা বিশাল গাছের নীচে বিশ্বস্ত আফ্রিকান পরিচারকটির হাতে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। ওখানেই সমাহিত করা হয়েছে তাকে। হলডেনের পরিবার ওই গাছটি আর চারপাশের এলাকার স্কেচ পাঠায়। ওটা দেখে আমার স্বামী বলেন ঠিক ওখানেই স্বপ্নে মৃত্যুপথযাত্রী কিংবা মৃত রাফকে দেখেছিল।

৪. অশুভ ঝড়

অশুভ ঝড়

এবারের কাহিনিটি জানিয়েছেন একজন ভদ্রমহিলা। তবে তাঁর নাম প্রকাশ করেননি। তবে লেখার সঙ্গে এলাকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির চিঠি ছিল, যিনি ঘটনাটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

১৯০২ সালের ১৮ মে। আয়ারল্যাণ্ডের কিলারনির সবচেয়ে ঝঞা-বিক্ষুব্ধ ভোরগুলোর একটা এল। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রবল গতিতে ঝড়ো হাওয়া বইছে। লাফ লিনের তীরে আছড়ে পড়ছে সাদা চূড়ার বিশাল সব ঢেউ। তারপর শুরু হলো ভয়ঙ্কর শিলাবৃষ্টি। মার্বেলের আকারের শিলাগুলো এত দ্রুত আর জোরে পড়ছে, প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে যে কামরাটায় দাঁড়িয়ে আছি তার জানালার কাচগুলো ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে লেকের ফুসতে থাকা পানির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কখনও মুষলধারে বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাসের কারণে কুয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে। যখন কুয়াশা সরে যাচ্ছে তখন দূরের দ্বীপগুলো নজরে আসছে।

এরকম একটা বিরতির সময়, সাড়ে বারোটার মত বাজে তখন, জিনিসটা নজরে পড়ল আমার। আমার পাঁচজন বন্ধুও এই কামরাটাতেই পড়ালেখা করছিল। এই তাড়াতাড়ি এসো, একটা নৌকা উল্টে গেল নাকি? আতংকিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলাম। আমার বন্ধুরা দৌড়ে এল জানালার কাছে। কিন্তু কিছু নজরে পড়ল না তাদের। কিন্তু আমি এখনও পরিষ্কার দেখছি ওটাকে। বললাম, ওটা কাত হয়ে আছে। তলাটা এখন আমাদের দিকে ফিরানো, তবে এ মুহূর্তে নৌকাটা খালি। কিন্তু এবারও আমার বন্ধুরা কিছু দেখতে পেল না। দৌড়ে গিয়ে একজন পরিচারককে বললাম গেটের কাছে গিয়ে লেকে কোনো নৌকা আছে কিনা দেখতে। ওখান থেকে লেকটা বেশ কাছে। শক্তিশালী একটা দূরবীন চোখে লাগিয়ে ঝড়ের মধ্যে রীতিমত যুদ্ধ করে কয়েক মিনিট থাকল সে। কিন্তু কিছুই নজরে এল না তার। সে ফিরে এলে তার বদলে আরেকজন লোককে পাঠানো হলো। কিন্তু তারও কিছু চোখে পড়ল না।

আমার অস্থিরতা দেখে বন্ধুরা সামনে-পিছনে এসে নানাভাবে জানালা দিয়ে লেকটা পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর তাদের একজন আমি যে নৌকাটি দেখেছি তার আকৃতি জানতে চাইল। আমি নৌকাটা কত বড় তা দেখলাম। এবার তারা আমাকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল, এত ঝড়ের মধ্যে আমি যে বর্ণনা দিয়েছি, তেমন একটা পার্টি বোট কোনোভাবেই লেকে নামবে না। তবু তর্ক করে গেলাম, যেমন বলেছি, তেমন একটা নৌকা সত্যি দেখেছি।

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা এল। আমি বাদে ঘটনাটা মোটামুটি বাকি সবার মন থেকেই মুছে গেল। রাতটাও কাটল আমার অস্থিরতার মধ্যে। সকাল আটটার দিকে পরিচারিকাটি চা নিয়ে এল। সে প্রথম যে কথাটি বলল তা হল, আহ, মিস! কী মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, কী দুর্ঘটনা, মেরি?

একটা নৌকা ডুবে গত সন্ধ্যায় তেরোজন মানুষ মারা গেছে, জবাব দিল সে। খোঁজখবর নিতেই পরিষ্কার হয়ে গেল সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার দিকে ডারবি গার্ডেনের নৌকা দুর্ঘটনার দৃশ্যটাই পাঁচ ঘণ্টা আগে, সাড়ে বারোটায় দেখে ফেলি আমি।

মে-র আঠারো তারিখ সন্ধ্যায় সাগরে হারিয়ে যাওয়া নৌকাটা ডোবার স্থান, আকার সব কিছুই আমার দেখার সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।

৫. ট্র্যাথমোরের দুর্ঘটনা

ট্র্যাথমোরের দুর্ঘটনা

ক্লাইড থেকে যাত্রা করেছিল জাহাজ স্ট্র্যাথমোর। জাহাজের এক নাবিকের বাবা এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন বিশাল সব ঢেউয়ে ডুবে যাচ্ছে স্ট্রাথমোর। আর আরও কিছু লোকের সঙ্গে তাঁর ছেলে দুর্ঘটনাস্থলের কাছের একটা মরুময় দ্বীপে নিরাপদে আশ্রয় নিতে পেরেছে। ঘটনাটা তাকে এতটাই নাড়া দিল যে স্ট্র্যাথমোরের মালিককে একটা চিঠি লিখে পুরো বিষয়টা জানালেন। শুরুতে তাঁর এই দাবিকে হেসেই উড়িয়ে দিল মালিক ভদ্রলোক। কিন্তু জাহাজের বন্দরে পৌঁছার সময় যখন পার হয়ে গেল তখন অস্বস্তি শুরু হলো তার। একটার পর একটা দিন পেরিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু স্ট্রাথমোরের কোনো সংবাদ নেই। জাহাজটা যেন হওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

এসময়ই জাহাজের এক নাবিকের বাবার চিঠি আর তাতে লেখা দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ল মালিকের। জাহাজটা অদৃশ্য হওয়ার একটা যুক্তিযুক্ত কারণের দিকে অন্তত নির্দেশ করছে এটা, ভাবল সে। সঙ্গে সঙ্গে সাগরে থাকা জাহাজগুলোকে স্বপ্নে বা দূরদৃষ্টিতে দেখা যে দ্বীপের কথা বলা হয়েছে তার খোঁজ করার অনুরোধ করা হলো। সাগরে ভেসে বেড়ানো জাহাজের ক্যাপ্টেনদের নানান ধরনের অভিজ্ঞতাতেই পড়তে হয়। কাজেই অনুরোধটা গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন তারা। স্ট্র্যাথমোরের বেঁচে যাওয়া লোকেদের সত্যি পাওয়া গেল,আর তাঁদের পাওয়া গেল মরুময় একটা দ্বীপে।

 

গোরস্থানে সাবধান!

রাতের বেলা গোরস্থানের পাশ দিয়ে একা-একা যাবার বুকের পাটা আছে কম লোকেরই। এমনকী রাতে গোরস্থানে যাবার কথা শুনলেই চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া কিংবা শরীরে শিরশির করা খুব সাধারণ ঘটনা। কবরস্থান নিয়ে কাহিনিগুলো পাবেন ‘গোরস্থানে সাবধান’ অধ্যায়ে।

১. রাতে, গোরস্থানে

রাতে, গোরস্থানে

এবারের কাহিনিটি সনজু ভাট নামের এক ভারতীয় যুবকের। ২০০৯ সালের দিকে পুরানো চাকরি ছেড়ে নতুন একটা চাকরিতে ঢোকে সে। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অফিস হলো ব্যাঙ্গালুরুতে। এমনিতে তার পোস্টিং পুনেতে হলেও ছোট্ট একটা কর্মশালা আর কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য তার ডাক পড়ল। ব্যাঙ্গলুরুতে। মোটমাট পাঁচদিন থাকতে হবে তাকে ওখানে। ব্যাঙ্গালুরুতে পৌঁছে আবিষ্কার করল এখানে তার মত আরো আটজন নবীন কর্মকর্তা উপস্থিত হয়েছে। অফিসের কাছেই কোম্পানির একটা বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তাদের। সকাল নটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত চলে প্রশিক্ষণ আর কর্মশালা। কাজেই নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিয়ে নতুন পরিচয়টা ঝালাই করে নেওয়ার বেশ ভাল সময় পায় তরুণেরা। তবে এই আটজনের মধ্যে বিশেষ করে অজয়, শৈলেশ আর নবীনের সঙ্গে বেশ জমে গেল সনজুর। অজয় একজন পাঞ্জাবি। শৈলেশ মুম্বাইয়ের আর নবীন ব্যাঙ্গালুরুতেই থাকে।

এক রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর কথা-বার্তার মাঝখানেই নবীন জানাল এই বাংলোর কাছেই একটা গোরস্থান আছে। বাংলোর কেয়ারটেকার তাকে জানিয়েছে ওখানে নানান ধরনের অদ্ভুত কাণ্ড-কারখানা হয়। কবরস্থানের দিকে চলে-যাওয়া রাস্তাটা নির্জন। আর রাতে লোকজন সাধারণত ওই রাস্তা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। কেয়াটেকার নবীনকে বলেছে, সে যেন রাতের বেলা গোরস্থানের দিকটা, না মাড়ানোর জন্য সাবধান করে দেয় অন্যদের। এদিকে ভূত-প্রেত কিংবা অতিপ্রাকৃত ঘটনায় অজয়ের মোটেই বিশ্বাস নেই। তবে বাকিরা কৌতূহলী হয়ে উঠল বিষয়টা নিয়ে। কিন্তু নবীন এর চেয়ে বেশি কিছু জানে না। কেয়ারটেকারও আর কিছু বলতে রাজি হলো না। কাজেই তখনকার মত চাপা পড়ে গেল বিষয়টি।

দেখতে-দেখতে ব্যাঙ্গালুরুতে শেষ দিন এসে গেল তাদের। রাতে নতুন কর্মকর্তাদের সম্মানে এক হোটেলে চমৎকার নৈশভোজের আয়োজন ছিল। তবে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করল অজয়। পানটাও বোধহল একটু বেশিই করে ফেলল। বাংলোতে ফিরে গোছগাছ, শুরু করে দিল সবাই। কারণ বেশ সকাল-সকালই ব্যাঙ্গালুরু ছাড়বে তারা।

গোছগাছ শেষে এই কয়েক দিনের স্মৃতিচারণায় মেতে উঠল। এসময়ই আবার পুরানো গোরস্থানটার প্রসঙ্গ টানল নবীন। অজয়কে এটা নিয়েঠাট্টা-মস্করা করতে দেখে বলল, এতই যদি সাহস থাকে তাহলে এই রাতের বেলা এক ঘণ্টা ওখানে থেকে আসতে। অজয়েরও কী হলো! মুহূর্তের মধ্যে চ্যালেঞ্জটা নিয়ে নিল। তারপরই আর কোনো কথা না বলে বাংলো থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরল। এবার অন্যরা তাকে থামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কাজ হলো না একটুও। এদিকে অ্যালকোহলে কখনওই আসক্তি নেই সনজুর। মাথাটাও ঠাণ্ডা। এই রাতে অজয়কে একা ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না মনে করে, সঙ্গী হলো তার।

সমাধির দিকে চলে-যাওয়া রাস্তাটা আসলেই নির্জন। মোটামুটি এক কিলোমিটারের মত হাঁটার পর সেখানে পৌঁছল তারা। তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে বারোটা। বেশ পুরানো একটা গোরস্থান এটা। এখন লোকেরা খুব কমই লাশ কবর দেয় এখানে।

বেশ শীত পড়েছে। সময়টা শীতকাল, আর ব্যাঙ্গালুরুতে শীতে যে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে যারা সেখানে থাকেন কিংবা ঘুরতে গিয়েছেন তারা ভালই বলতে পারবেন। গোরস্থানের গেটে তাদের আটকালেন এক বুড়ো। বললেন তিনি আবু চাচা, কবরস্থানের কেয়ারটেকার। কৌতূহল নিয়ে এত রাতে এখানে আসার কারণ জানতে চাইলেন আবু চাচা। অজয় যেন এমন একটা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুতই ছিল। বলল এখানে তার একজন আত্মীয়কে গোর দেওয়া হয়েছে। অল্প সময়ের জন্য ব্যাঙ্গালুরুতে এসেছে সে। কাল সকালেই আবার লণ্ডনে উড়াল দেবে। তাই রাতে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আবু চাচা সমবেদনা জানিয়ে তাড়াতাড়ি দেখা শেষ করে ফিরতে বললেন।

ধীরে-ধীরে সমাধির ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল দুজনে। সাধারণ গোরস্থানের মতই মনে হচ্ছে। সিমেন্ট বাঁধানো পথের দুপাশে সারবেঁধে সমাধি। চারপাশে ভুতুড়ে নীরবতা। অবশ্য কখনও-সখনও নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানো পাখি, শিয়াল কিংবা অন্য কোনো বন্যপ্রাণীর ডাক শোনা যাচ্ছে। সামনেই বসার একটা আসন। অজয় বলল এখানে কিছুক্ষণ বসে নীরবতাটা উপভোগ করতে চায়।

একটু অস্বস্তিবোধ করলেও অজয়ের পীড়াপীড়িতে না করতে পারল না সনজু। একটু পরেই পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল অজয়। জায়গাটার পবিত্রতা নষ্ট হবে এই ভেবে, তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করল সনজু। কিন্তু তার কথায় কান না দিয়ে কাজ চালিয়ে গেল অজয়। আরও কয়েকটা মনিট পার হলো। সনজুর কাছে মনে হলো যেন অনন্তকাল ধরে এখানে বসে আছে। তারপরই অজয় বলল আরও সামনে এগিয়ে গোটা জায়গাটা দেখতে চায়। কয়েক কদম এগিয়েই সনজুকে অবাক করে দিয়ে জানাল তার হঠাৎই দারুণ প্রস্রাব চেপেছে। এখানে এ ধরনের কিছু না করার জন্য পইপই করে তাকে নিষেধ করল সনজু। তারপর বলল তাদের দেরি না করে গোরস্থান ছাড়া উচিত। কিন্তু একগুঁয়ে স্বভাবের অজয় কর্ণপাতই করল না তার কথায়। চোখ দিয়ে একটা ইশারা করে, একটু দূরের একটা ঝোপে ঢুকে পড়ল। বেশ ঘন ঝোপটা। যেখানে আছে সেখান থেকে তাই আর অজয়কে এখন দেখতে পাচ্ছে না সনজু। হঠাৎই খুব দুর্বল মনে হতে লাগল নিজেকে তার। শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মনে হলো যেন কেউ চেপে ধরে দম বন্ধ করে মারতে চাইছে তাকে। হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে রাস্তার ওপর বসে পড়ল সে। পথের সামনে যখন চোখ গেল তখন দেখল একটা ছায়ার মত জিনিস আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল ওটা। সনজু কেঁপে উঠল, মনে হলো তার দিকে একবার ভুতুড়ে দৃষ্টিতে তাকিয়েছে ওটা। তারপরই অদৃশ্য হয়ে গেল।

সনজুর মাথা ঘুরছে। ভয়ের একটা শীতল স্রোত ছড়িয়ে পড়েছে শরীরে। পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছে না কিছুই। নিজের ওপর জোর খাটিয়ে একটু সুস্থির হলো। তারপরই মনে পড়ল অজয় এখনও ফেরেনি। নাম ধরে ডাকল। কিন্তু কোনো জবাব পেল না অপর তরফ থেকে। একটু আগে যে ঝোপটার ভিতর অদৃশ্য হয়েছে সে শরীর টেনে-টেনে সেদিকে এগুল। সেখানে পৌঁছেই আঁতকে উঠল। মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে অজয়। কী মনে করে নিচু হয়ে জোরে-জোরে ঝাকাতে লাগল তাকে। ভাগ্য ভাল এটা কাজে লাগল। আস্তে-আস্তে জ্ঞান ফিরে আসতে লাগল অজয়ের।

যখন পুরোপুরি জ্ঞান ফিরল, জানাল প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার সময় ঝোপের মধ্যে মৃদু একটা নড়াচড়া টের পায়। তারপরই মনে হলো কে যেন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর দুর্বলতা আর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়। সনজুকে চিৎকার করে ডাকবে এমন সময় পিছনে জোরে একটা আঘাত এসে লাগে। তারপরই অজ্ঞান হয়ে যায়। এখনও কাঁধের কাছে ব্যথা পাচ্ছে। পরে অজয়ের শরীরের পিছনে পাঁচ আঙুলের পরিষ্কার ছাপ ফুটে থাকতে দেখে সনজু। রক্ত জমে পুরো জায়গাটা নীল হয়ে ছিল।

এখানে আর অপেক্ষা না করে দ্রুত গেটের দিকে এগুতে লাগল তারা। এসময়ই একজন তরুণের সঙ্গে দেখা হলো। পথ আটকে জানতে চাইল এত রাতে এখানে কী করছে? তারা সঙ্গে সঙ্গে জানাল বুড়ো লোকটা মানে আবু চাচার অনুমতি নিয়েই ভিতরে ঢুকেছে। তারপর কেন এসেছে সেটাও আবার খুলে বলল, আগের মতই। কিন্তু তরুণ জানাল আবু চাচা নামে কাউকে চেনে না। আর গত পাঁচ বছর ধরে সে-ই গোরস্থানটা পাহারা দিয়ে আসছে সে। তবে কিছু লোক তাকে বলেছে গোরস্থানের আশপাশে একজন বুড়ো লোককে দেখা যায় মাঝে-মাঝে, বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে।

রাতে বাংলোয় ফিরতে-ফিরতে সাড়ে তিনটা বেজে গেল। সেখানে বাংলোর কেয়ারটেকারকে ঘটনাটি খুলে বলতেই এই বোকামির জন্য শাপ-শাপন্ত করল তাদের। বলল ভাগ্য ভাল বড় কোনো ক্ষতি ছাড়া ফিরে আসতে পেরেছে। অজয় পরের কয়েকটা দিন খুব জ্বরে ভুগল, অন্যদের সঙ্গে সেদিন ব্যাঙ্গালুরু ছাড়তেও পারল না। তবে এরপর সনজু মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করে এমন কাজ আর কখনও করবে না। কয়েক মাস পর অজয়ের সঙ্গে আবার দেখা হলে দেখল আগের সেই বেপরোয়া ভাব আর নেই তার মধ্যে। অনেক শান্ত হয়ে গেছে। আর হাতে একটা তাবিজ বাঁধা তার।

২. গোরস্থানের আগম্ভক

গোরস্থানের আগম্ভক

আমাদের ভাঁড়ারে গোরস্থান নিয়ে যেসব ভৌতিক অভিজ্ঞতা জমা আছে তার আরেকটা শোনাব এখন। এটি বলেছেন আয়ারল্যাণ্ডের এডজিওর্থস টাউনের মি. জি. এইচ. মিলার।

১৮৭৫-এর শীতকাল। পাঁচ মাইল দূরের এক জায়গায় সন্ধ্যাকালীন এক গানের আসর সেরে বাড়ি ফিরছেন মিলার। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে এগারোটা। পথে তাকে যেতে হবে অ্যাবিশরুলের ধ্বংসাবশেষ আর সমাধিক্ষেত্রের ভিতর দিয়ে। পথের দু-পাশেই সমাধি। চাঁদের আলোয় চারপাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এদিকে ঘঘাড়ার জিন আটকানোর বেল্টটা ভেঙে যাওয়ায় প্রাণীটাকে আস্তে-আস্তে হাঁটিয়ে নিচ্ছেন এখন। ধ্বংসাবশেষটা যখন পেরোচ্ছেন তখন লম্বা ওভারকোট গায়ে চাপানো একজন লোককে দেখলেন। সমাধিগুলোর মাঝখান থেকে কিনারার দিকে হেঁটে আসছেন ভদ্রলোক। মিলার আর কয়েক কদম এগুলেই দুজন মুখোমুখি হয়ে যাবেন। কিন্তু তারপরই লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আতিপাতি খুঁজেও তার কোনো নাম-নিশানা পেলেন না মিলার।

একটু পরেই একজন লোককে পাশ কাটালেন, যিনি তাঁর অনেক আগেই সন্ধ্যার অনুষ্ঠান থেকে বের হয়েছেন। ভদ্রলোকের ততা আরও এগিয়ে থাকার কথা, অবাক হয়ে ভাবলেন মিলার। কথাটা জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, পুরানো গোরস্থানটা এড়াতে অনেক ঘুরপথে এসেছেন। কারণ তিনি চাননি সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে যাক। তারপর ব্যাখ্যা করে বললেন এই গোরস্থানে মাঝে মাঝেই এক সন্ন্যাসীর ভূতকে দেখা যায়। মিলারের মনে আর সন্দেহ রইল না সন্ন্যাসীর ভূতকেই দেখেছেন তিনি।

৩. শেষ ঠিকানায়

শেষ ঠিকানায়

এবারের অভিজ্ঞতাটি রেভারেণ্ড হেনরি মর্টনের। আয়ারল্যাণ্ডের একটি গির্জার যাজক তখন তিনি। গির্জার লাগোয়া একটা পুরানো সমাধিক্ষেত্রও আছে। এক চাঁদনী রাতে একজন অসুস্থ মানুষকে দেখতে যেতে হল রেভারেণ্ড মর্টনকে। সঙ্গে তার ভাইও আছেন, যিনি আবার একজন চিকিৎসক। অসুস্থ লোকটিকে দেখে বাড়ি ফেরার সময় গির্জার সমাধিগুলোর ভিতর দিয়ে যেতে হলো তাঁদের। কথা বলতে-বলতে হাঁটছেন দুজন। এমন সময় তাঁদের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে একটি কাঠামো অতিক্রম করে গেল, দুজনেই দেখলেন একে। তারপরই রাস্তা ছেড়ে সমাধি ফলকগুলোর ভিতরে ঢুকে পড়ল লোকটা, আর একটা জায়গায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

অদ্ভুত ঘটনাটা রীতিমত চিন্তায় ফেলে দিল তাদের। আগামাথা কিছু বুঝতে না পেরে যেখানে লোকটি অদৃশ্য হয়েছে। সেদিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ভালমত খুঁজেও কাউকে পেলেন না। পরের দিন সকালে তারা জানতে পারলেন গত রাতে যে অসুস্থ লোকটিকে দেখতে গিয়েছিলেন তারা চলে আসার পরপরই তিনি মারা যান। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো লোকটিকে সমাধিস্থ করা হয়েছে ঠিক সে জায়গায়, যেখানে সেই রহস্যময় কাঠামোটিকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছেন।

৪. ভুতুড়ে নারী

ভুতুড়ে নারী

আয়ারল্যাণ্ডের লিমেরিকের একসময়কার আর্চডিকন ভেন, জে.এ. হেইডেন তার এই অভিজ্ঞতাটি বর্ণনা করেন। ১৮৭০ সালে তিনি ছিলেন অজপাড়াগাঁয়ের এক গির্জা চ্যাপেল রাসেলের যাজক। ঘটনাটা তখনকারই।

শরতের এক বৃষ্টিঝরা দিন। লাগামহীনভাবে, বেশ বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়ছে। সকাল কি রাত এটাও বোঝা মুশকিল। দিনটা বিষণ্ণ, মেঘলা। তারপর আবার বেশ কিছু সময় পড়ালেখা করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন হেইডেন। ঠিক করলেন এই বৃষ্টির মধ্যেই হেঁটে আধ মাইল টাক দূরের গির্জায় যাবেন। ওখানে আধ ঘণ্টা হারমোনিয়াম বাজিয়ে ফিরে এসে চা খাবেন।

বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে, গির্জার চাবিটা পকেটে ফেলে, হাঁটা শুরু করলেন। গির্জার চৌহদ্দিতে পৌঁছে মূল প্রবেশ পথটা ধরে হাঁটতে লাগলেন। দু-পাশেই সমাধি, পাথরের সমাধি ফলক। এদিকে হালকা বৃষ্টি ট্যাপ ট্যাপ শব্দ তুলছে গাছের পাতায় পড়ে। , একসময় গির্জার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলেন। কিন্তু চাবিটা তালায় ঢুকানোর আগেই কী একটা অস্বস্তি পেয়ে বসল তাঁকে। ওখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে কেবলমাত্র অতিক্রম করে আসা পথটার দিকে তাকালেন। বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলেন রাস্তাটার পাশের একটা নিচু সমাধি ফলকের ওপর তার দিকে পিছন ফিরে বসে আছে একজন মহিলা। তার পরনে কালো ভেলভেটের একটা জ্যাকেট। মাথার কালো চুলের বোঝা আংশিক ঢেকে আছে যে জিনিসটা দিয়ে সেটাকে একটা পাগড়ির মতই লাগল তাঁর কাছে। ওটাও কালো ভেলভেটের তৈরি। পাগড়িটার ডান পাশে তুষার-সাদা পালকের গোছা। বেশ কিছুটা সময় গভীর মনোেযোগের সঙ্গে নারীটির অবয়বের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপরই মনে হলো মহিলাটির মনোেযোগ আকর্ষণ করা দরকার। আর তা করার জন্য শব্দ করে চাবি ঢুকালেন তালার ভিতর। তারপরই শব্দ করে হঠাৎ খুললেন দরজাটা। তার এই কৌশল কাজ দিয়েছে কিনা দেখার জন্য ঘুরেই দেখলেন মহিলাটি অদৃশ্য হয়েছে। দৌড়ে যেখানটায় বসে ছিল মহিলাটি সেখানে গেলেন, দশ গজের বেশি হবে না গির্জার প্রবেশদ্বার থেকে ওটার দূরত্ব। সমাধিফলক এবং এর আশপাশের জায়গা ভালমত খুঁজলেন। কিন্তু ওখানে একজন মানুষ বসেছিল একটু আগে, এর এমনকী কোনো চিহ্নও পেলেন না। এই ঘটনাটি আজীবন এক রহস্যই থেকে যায় যাজক হেইডেনের কাছে। কারণ পরে এমন কোনো তথ্য পাননি যা দিয়ে এর কূল-কিনারা করতে পারেন।

৫. অবিবাহিতদের কবরস্থান

অবিবাহিতদের কবরস্থান

শরীরের আত্মা পানি করে দেওয়ার মত জায়গার অভাব নেই আমেরিকায়। এদের মধ্যে কোনো কোনোটা এতটাই চমকে দেবে আপনাকে যে মনে হবে ওখানটায় গিয়ে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে। আর এটা হওয়ার কারণ আতংক এভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে যে নাড়ীর স্পন্দন টের পাবেন না। এমন জায়গার উদাহরণ হিসাবে ইলিনয়েসের শিকাগোর ব্যাচেলর গ্রোভ গোরস্থানের নাম থাকবে একেবারে উপরের সারিতেই।

এই ভুতুড়ে গোরস্থান কোনো কারণ ছাড়াই পুরু কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে যায় অনেক সময়। নানা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে এখানে। চোখে পড়ে ভয়াবহ সব দৃশ্য। তাই যারা অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন আর প্রচণ্ড মানসিক শক্তির অধিকারী তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এটি। এখানে সব সময় যে কিছু দেখবেনই তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে অনুভব করবেন অশুভ কিছু একটার উপস্থিতি। কখনও কারও মৃদু স্পর্শ পাবেন, কিন্তু আশপাশে কারও চেহারা দেখবেন না। তারপর আবার কোনো কোনো জায়গায় হঠাৎ করেই তাপমাত্রা বিশ ডিগ্রী নেমে হাড়ে কাপ ধরিয়ে দেবে আপনার। এখানকার ভৌতিক কাণ্ডকীর্তির আরও কিছু বর্ণনা দেওয়ার আগে বরং এই সমাধির ইতিহাসটা একটু জেনে নেওয়া যাক। কারণ অনেকেরই ধারণা এখানকার সব অদ্ভুতুড়ে ঘটনার পিছনে এর নাটকীয় ইতিহাসেরও ভূমিকা আছে।

এই গোরস্থানে ১৮২০-২১ সালের সমাধিফলকও খুঁজে পাবেন। যদিও সরকারীভাবে এটি সমাধিস্থলের মর্যাদা পায় ১৮৪৪ সালে। ১৯৬০-এর দশকের পর থেকেই এখানে আর নতুনভাবে কাউকে গোর দেওয়া না হলেও একে ঘিরে অশুভ কাণ্ড-কীর্তি কমেনি একটুও। বরং এতে যেন এখানে আস্তানা গাড়া আত্মাদের সাহস আরও বেড়েছে। এই সমাধিস্থলের নাম ব্যাচেলার গ্রোভ হওয়ার উত্তর খুঁজে পাবেন এর ইতিহাসে। এখানে মূলত কবর দেওয়া হত এই এলাকায় আস্তানা গাড়া অভিবাসীদের। এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি ছিলেন জার্মানরা, ইলিনয়েস-মিশিগান খাল খননে কাজ করছিলেন যাঁরা। আর এদের মধ্যে অনেকেই কবর দেওয়ার সময়ও ছিলেন অবিবাহিত। আর তাই এই সমাধিস্থলটির নাম হয়ে যায় ব্যাচেলর গ্রোভ বা অবিবাহিতদের গোরস্থান।

কবরস্থানটিকে ঘিরে আছে ছোট্ট একটা লবণাক্ত পানির হ্রদ। আর এই এলাকায় রাজত্ব করা গুণ্ডাপাণ্ডাদের খুব পছন্দের জায়গা ছিল এই হ্রদ। কারণ কারও সঙ্গে গোলমাল বাধলেই মেরে. এই লেকে গুম করে ফেলত তারা। এমন অনেক মৃতদেহই এখানে ভেসে থাকতে দেখেছে লোকেরা। বলা হয় গোরস্থানে যেসব আত্মারা হানা দেয় তাদের মধ্যে হ্রদে মারা যওয়া লোকদের আত্মারাও রয়েছে।

শিকাগোর শহরতলী মিডলথিয়ানের কাছেই গোরস্থানটা। নুড়ি বিছানো একটা পথ চলে গেছে অশুভ এই কবরস্থানটির দিকে। আর এই পথ ধরে হাঁটার সময়ই বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ শুরু হয়ে যায় লোকেদের।

শিকাগোর সাইকিক রহস্যভেদী কেন মেলভয়েন-বার্গ আর শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকার এক রিপোর্টারের নাড়ীর স্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল এখানেই। ২০০৬ সালের এক রাতে হানা দিয়েছিলেন অসম সাহসী এই দুজন গোরস্থানে। ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই শুরু হয় নানা রহস্যময় ঘটনা। তারপরই ছোট্ট একটা ছেলের আত্মার মুখোমুখি হন তারা। ছেলেটার কান্নার শব্দ শুনতে পান পরিষ্কার। তার হারানো রূপার মুদ্রাটি খুঁজে বের করে দেওয়ার জন্য পই পই করে তাদের অনুরোধ করতে থাকে সে।

রিপোর্টারটি এমনিতেই বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তারপরই দেখলেন সাইকিক রহস্যভেদীটি যেন হঠাৎ একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন। সবুজ থকথকে কাদায় ভর্তি একটা পুকুরের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন। তারপরই পনিতে নেমে পড়লেন। পা হাঁটু পর্যন্ত না ডোবা পর্যন্ত এগুলেন। এবার সবুজ শৈবালে ভরা পানির মধ্যে দু-হাত চুবিয়ে দিলেন। একটু পর যখন হাত তুললেন। সেখানে কাদা লেপা ছোট্ট কী একট জিনিস। পরিষ্কার করতেই বেরিয়ে এল এটা ১৯৪২ সালের আধ ডলারের একটি রৌপ্য মুদ্রা। আরও আশ্চর্য ব্যাপার; কণ্ঠটা তাদের এখানেই খুঁজতে বলেছিল মুদ্রাটা।

ব্যাচেলর গ্রোভে হানা দেয়া কৌতূহলী অনেক লোকই গল্প করেন ভুতুড়ে একটা খামার বাড়ির। এই দেখা যায় তো পর মুহূর্তেই আবার অদৃশ্য হয়ে যায় ওটা। তবে সবার বর্ণনাতেই বাড়িটার একই আদল পাওয়া যায়। বিশাল খাম্বাসহ রোয়াকের সাদা একটি বাড়ি ওটা। পাক খেতে-থাকা মৃদু একটা আলো জ্বলতে দেখা যায় জানালায়। তবে বাড়িটাকে কখনও একই জায়গায় দেখা যায় না। কেউ ওটার কাছে যাওয়া শুরু করলেই ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে যায়। রাতে তো বটেই দিনের আলোতেও দেখা গেছে বাড়িটা। কিন্তু পুরানো দিনের দলিলদস্তাবেজ আর ফাইলপত্র ঘেঁটে এই এলাকায় এমন কোনো বাড়ির অস্তিত্বের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে দৰ্বত্তরা সমাধিফলক উপড়ে ফেলা আর চিত্রকর্ম শাভিত ভাস্কর্য নষ্ট করা আরম্ভ করলে গোরস্থান জুড়ে এক ধরনের লাল আলো দেখতে শুরু করে দর্শনার্থীরা। কখনও কখনও প্রচণ্ড গতিতে লোকেদের অনুসরণ করে, কখনও আবার বাতাস ভেদ করে চলে যায়। অভিজ্ঞ অতিপ্রাকৃত ঘটনা বিশেষজ্ঞ আর ওয়্যার্ড শিকাগোর ( শিকাগোর বিভিন্ন ভৌতিক আর রহস্যময় জায়গা ঘুরিয়ে দেখায় এই প্রতিষ্ঠানটি) লোকেরাসহ আরও অনেকে বার বরই হানা দিয়েছেন রহস্যময় এই জায়গাটিতে। এমনই এক অভিযানের সময় ক্রিঞ্জ নামের ধারাবাহিকটির একটি পর্ব ধারণ করা হয়।

নড়বড়ে, ভেঙে পড়া সব সমাধি ফলকের মাঝখানে ক্যামেরাগুলো স্থাপন করেন প্রযোজক ট্রয় টেইলরসহ অন্যান্য কর্মীরা। আর এই চিত্রগ্রহণের সময় বেশ কিছু ডিজিটাল ফুটেজ কোনো কারণ ছাড়াই নষ্ট হয়ে যায়। আতংকে অবশ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয় কর্মীদের। কারণ এ ধরনের অভিজ্ঞতা ব্যাচেলর গ্রোভে আসার আগে আর কখনও হয়নি তাদের। পরে এর দ্বিতীয় একটা পর্ব তৈরি করতে গিয়ে ক্যামেরাসহ নানান ধরনের যান্ত্রিক গোলমালের কারণে পুরোপুরি ভেস্তে যায় কাজ।

তবে এই কবরস্থানে লোকেদের সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রাখে সাদা পোশাক পরা এক নারী। অনেক মানুষই তাকে দেখেছেন। একটা সমাধি ফলকের উপরে বসে থাকেন, আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সামনের গাছপালায় ঠাসা জঙ্গুলে জায়গাটির দিকে। শিকাগো সান-টাইমসের জুড়ি ফেলজ ক্যামেরায় বন্দি করেছেন এই রহস্যময় নারীমূর্তিকে। পূর্ণিমার রাতেও মাঝেমাঝে দেখা যায় তাঁকে। সাদা পোশাক পরা নারীটি তখন একটা মৃত নবজাতককে দু-হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ঘুরে বেড়ান ইতস্তত কবরস্থানের ভিতরে-কেন কেউ জানে না।

১৮৭০-এর দশকে জমিতে লাঙ্গল টানতে থাকা এক লোক কুখ্যাত লেকটার খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন। আর এটাই তার কাল হয়। ঘোড়াটা প্রথম পানিতে পড়ে, সেই সঙ্গে টেনে নিয়ে যায় কৃষক আর লাঙ্গলকেও। কিন্তু ঘটনার একশো বছর পর বনবিভাগের দুজন রেঞ্জার আবার দেখেন ওই কৃষককে, হাল চাষ করছেন আগের মতই। কখনও আবার দেখা যায় দুই মাথাওয়ালা একটা ভূতকে।

আবার নুড়ি বিছানো পথটাতে প্রবেশের আগে গাড়ি চালকদের রাস্তায় একটা তীক্ষ্ণ মোড় নিতে হয়। এসময় কখনও কখনও কোনো কোনো চালক আচমকা প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসা একটা পাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যান। ওটাকে দেখে ১৯৪০ মডেলের গ্যাং স্টারদের গাড়ি বলে মনে হয়। তবে আশ্চর্য ব্যাপার গাড়িটার সঙ্গে সংঘর্ষের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পরই আবিষ্কার করেন কেউ আহত হননি, গাড়ির কোনো ক্ষতি হয়নি। এমনকী তীব্র বেগে হামলে পড়া গাড়িটারও কোনো নাম নিশানা নেই।

আবার কেউ-কেউ এমনও দাবি করেছেন এই গোরস্থানে যাওয়ার পর থেকেই দুর্ভাগ্য পিছু নেয় তাদের। এমনটাই ঘটে আমেরিকার ইলিনয়েসের এইডেন নামের এক যুবক আর তার বান্ধবীর ভাগ্যে। অন্তত এইডেনের দাবি তাই। গোরস্থানটা থেকে বের হয়ে আসার পর থেকেই একটার পর একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের।

তারিখটা ছিল ২০০৪ সালের অক্টোবরের পনেরো তারিখ। এক হপ্তাহ পরেই এইডেনের জন্মদিন। এমনিতেই অদ্ভুতুড়ে ঘটনার প্রতি বেশ আগ্রহ এইডেনের। তার প্রেমিকারও এটা বেশ ভালই জানা আছে। তাই সে প্রস্তাব করল জন্মদিনের একটি উপহার হিসাবে ব্যাচেলর গোরস্থানে বেড়িয়ে আসবে তারা। পরিকল্পনাটা মনে ধরল এইডেনের। দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল। উৎসাহের চোটে একটা ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার কিনে ফেলল। সঙ্গে ডিজিটাল ক্যামেরাটাও নিয়ে নিল। ঠিক মধ্যরাতে, বারোটার দিকে বের হলো তারা বাড়ি থেকে। এইডেনের বাড়ি থেকে গোরস্থানটা দেড় ঘণ্টার রাস্তা। কাছাকাছি পৌঁছে গাড়িটা বন বিভাগের জায়গায় রেখে হাঁটতে শুরু করল তারা। গোরস্থানের কাছাকাছি আসতেই অজানা একটা ভয় আঁকড়ে ধরল দুজনকে। বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। তারপরই হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। যত দ্রুত সম্ভব কিছু ছবি তুলে নিল, পাছে আবার পরে ছবি তোলা না যায়।

গোরস্থানে ঢুকতেই অস্বস্তি বাড়ল। এইডেনের মনে হলো তার ঘাড়ের পিছনে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। যদিও পিছন ফিরে কাউকে দেখা গেল না। মিনিট বিশেক থাকার পরই এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল দুজনে। ভয়ের হিমশীতল একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে শরীরে। এদিকে গোরস্থান আর এর আশপাশের এলাকায় একটা জনপ্রাণীকেও দেখা যাচ্ছে না। গোরস্থান থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত রেকর্ডারটা চালুই রাখল। গাড়িতে ঢুকেই রেকর্ডারটা প্রথম থেকে চালু করে দিল এইডেন। আর তখনই প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেল। মনে হলো যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে এখান থেকে বিদায় হও। আসল সমস্যা শুরু হলো বাড়িতে পৌঁছার পর। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড কাশি হয়ে গেল এইডেনের, সেই সঙ্গে গলায় প্রচণ্ড ব্যথা। তার স্বাস্থ্য এমনিতে বেশ ভাল, আর ঠাণ্ডায় বের হওয়ার মত পোশাকও ছিল পরনে। মাত্র বিশ মিনিট গোরস্থানে থেকে শরীরের এই হাল হলো কেন ভেবে কূলকিনারা পেল না। পরদিন সকালে যখন বান্ধবী এল তখন তার কাহিল অবস্থা। গায়ে জ্বর, সেই সঙ্গে পেট খারাপ। নড়াচড়াও করতে পারছে না ঠিকমত। তার বান্ধবী ল্যাপটপ নিয়ে এলে দুজন দেখতে বসল। কোনো কোনো ছবিতে সাদা ধোয়ার মত দেখা গেল। আবার কয়েকটা ছবিতে অস্পষ্ট মানুষের মুখও দেখা যাচ্ছে।

এক মাস পর একসঙ্গে একটা ফ্ল্যাটে উঠল দুজন। এর দুই মাস পর গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ল তারা। গাড়ি দুর্ঘটনার এক মাস পর কোনো কারণ ছাড়াই চাকরি হারাল এইডেনের বান্ধবী। তারপর চাকরি যাবার পালা এইডেনের। দুজনে কতগুলো ইন্টারভিউ যে দিল তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু চাকরি যেন সোনার হরিণ হয়ে গেল। পুরো বছরটাই খারাপ গেল। জ্বর, সর্দি-কাশি লেগেই থাকল। আর অ্যাপার্টমেন্টেও একটার পর একটা সমস্যা তৈরি হলো। এক বছরের মধ্যে অ্যাপার্টমেন্টে ছাড়তে বাধ্য হলো তারা। আবার এইডেনের বাবা-মার কাছে গিয়ে উঠল। তবে এবার শনির দশা কাটল। কয়েক মাসের মধ্যে চাকরি পেল দুজনেই। এরপর আর বড় কোনো সমস্যায় পড়তে হলো না। এইডেনের নিশ্চিত ধারণা এই গোরস্থানে ব্যাখ্যার অতীত কোনো একটা সমস্যা আছে। কারণ সেখানে যাবার আগে তারা দুজনেই ছিল সুস্থ-সবল। কিন্তু ফেরার সঙ্গে-সঙ্গেই একটার পর একটা সমস্যা শুরু হয়ে গেল। আর তাই এইডেন নিজে পণ করেছে আর কখনও এই অশুভ গোরস্থান না মাড়ানোর। তেমনি বন্ধুবান্ধবদেরও পরামর্শ দেয় ওদিকে যাওয়ার দুঃসাহস না দেখানোর। তবে, পাঠক কখনও যদি শিকাগো চলেই যান, অবিবাহিতদের এই গোরস্থানে যাবেন কিনা তা আপনার সিদ্ধান্ত। তবে গেলে যেতে হবে মনটাকে শক্ত করে, সব ধরনের অঘটনের জন্য প্রস্তুত হয়েই।

 

সব ভুতুড়ে

এমন অনেক ঘটনা আছে যেগুলো আগের নয়টি অধ্যায়ের কোনোটির মধ্যেই ফেলা যাচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে এগুলো পড়ার আনন্দ থেকে তো পাঠকদের বঞ্চিত করতে পারি না। তাই এ ধরনের কিছু অশুভ, ব্যাখ্যার অতীত ঘটনাকে আমরা একসূত্রে গেঁথেছি, ‘সব ভুতুড়ে’ নামে।

সেই বুড়ো লোকটা

এবারের কাহিনিটি ভারতীয় এক তরুণের। চলুন এটা শুনি তার মুখ থেকেই।

১৯৮৮-৮৯ সালের ঘটনা। বাবা তখন মুম্বাই থেকে লনাভালা বদলি হলেন। মুম্বাই থেকে মোটামুটি ১২০ কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি একটা স্টেশন এই নাভালা। তখন আমি পড়ি ক্লাস নাইনে। গ্রীষ্মের ছুটিতে মা, বড় ভাই আর আমি বাবার কাছে চলে যেতাম।

আমার চাচাতো ভাই পরাগ, যে আমার থেকে কয়েক বছরের বড়, থাকত লনাভালাতেই। সেখানে গেলেই তাই একসঙ্গে প্রচুর ঘোরাফেরা আর আড্ডাবাজি হত। তবে আমাদের অবসর বিনোদনের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ছিল কাছের একটা পাহাড়। একটা স্কুলের পাশেই ছিল ওটা। সাইকেলে চেপে ফ্লাস্ক ভর্তি কফি নিয়ে চলে যেতাম পাহাড়টায়। ঠাণ্ডা হাওয়া খেতে-খেতে গল্প চলত, আর তাকিয়ে থাকতাম তারার দিকে। পরাগের দু-জন বন্ধুও সাধারণত সাইকেল নিয়ে আসত আমাদের সঙ্গ দিতে।

এক রাতের ঘটনা। প্রিয় জায়গাটায় বসে কফি পান আর নানান আলাপে মশগুল আমরা। এসময়ই একজন মানুষকে আসতে দেখলাম এদিকে। কাছাকাছি হতেই দেখলাম রোগা, বুড়ো একজন মানুষ। এত রাতে এমন একজন লোককে এখানে দেখে অবাক হলাম সবাই। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তিনি এখানে কী করছেন আর তার কোনো সাহায্য লাগবে কিনা। বুড়ো জানালেন কাছের একটা গ্রামে থাকেন। আর মুম্বাইয়ের দিকে যাওয়া রাতের শেষ ট্রেনটা ধরবেন। মুম্বাইয়ে ছেলের কাছে যাবেন। লোকটার দুর্বল শরীর দেখে এমনিতেই মায়া হচ্ছে। তারপর আবার মনে হলো হেঁটে গেলে নির্ঘাত ট্রেনটা মিস করবেন। আর এসময় এদিক থেকে রেলস্টেশনে পৌঁছনোর কোনো যান পাওয়ারও সুযোগ নেই। কাজেই পরাগ তাকে তার বাই সাইকেলে করে স্টেশনে পৌঁছে দিতে চাইল। পরাগের বন্ধুর সাইকেলে চেপে আমি আর আমার ভাইও ওদের সঙ্গী হলাম। তঁকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে এসে আবারও গল্পে মেতে উঠলাম।

তারপরই যেটা ঘটল এটা মনে করে আজও শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে আমার। লোকটাকে নামিয়ে দিয়ে আসার পর আধ ঘণ্টাও পার হয়নি। সবারই ঘুম-ঘুম আসছে। বাসায় ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করলাম। এসময়ই অন্ধকারে একটা কাঠামোকে আসতে দেখলাম, একটু আগের লোকটা যেদিক থেকে এসেছেন সেদিক থেকেই। তারপরই অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম সেই পলকা দেহের বুড়ো লোকটাই এগিয়ে এল আমাদের দিকে,যাকে অল্প আগে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে এসেছি। বুড়ো কাছে এসে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করলেন।

আমরা সবাইই বড় রকমের একটা ধাক্কা খেয়েছি। মনে হলো যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। নড়তে পর্যন্ত পারছি না। মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে লোকটার পক্ষে কোনোমতেই হেঁটে এখানে আসা সম্ভব নয়। আর তিনি ফিরে এসে আবার স্টেশনেই বা যেতে চাইবেন কেন?

মনে-মনে প্রার্থনা করতে শুরু করলাম। আর এর জোরেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে হঠাৎ করেই যেন ঘোর কেটে গেল আমার। ধাক্কা দিয়ে অন্যদেরও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনলাম। তারপর সাইকেলে উঠে দ্রুত এই জায়গা ছাড়লাম, একবারও পিছু ফিরে তাকাবার সাহস করলাম না।

রাতে আমাদের একজনেরও ঘুম হলো না।

কয়েকদিন পর স্থানীয় লোকেদের সেই বুড়ো লোকটার কথা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু কেউই তার ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। এমনকী বুড়ো লোকটাকে দেখেছে এমন মানুষও পাওয়া গেল।। তবে রাতে ওই পাহাড়টার কাছে না ঘেঁষার পরামর্শ দেওয়া হলো।

এরপরও আরও অনেকবার লনাভালা গিয়েছি। কিন্তু কখনও আমাদের পুরানো আড্ডার জায়গাটায় যাওয়ার সাহস করিনি।

যখন ট্রেন এল

আমেরিকার মিনেসোটার এক তরুণের অভিজ্ঞতার কাহিনি এটি। আমরা শুনব এটা তার মুখ থেকেই।

কয়েক বছর আগের ঘটনা। সম্ভবত ২০০৫-৬ সালের দিকে হবে। আমার এবং আমার বন্ধুদের মাছ ধরার প্রবল একটা নেশা ছিল সেসময়। নিয়ম করে প্রায় প্রতি হপ্তাতেই মাছ শিকারে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। বিশেষ করে এলক নদীর একটি বিশেষ জায়গায় অনেকবার মাছ ধরতে গিয়েছি আমরা। মাছ ধরার এলাকাটা ছোট্ট একটা সেতুর নীচে। আর এদিকটায় রাস্তাও এক লেনের। সেতুর নীচে নদীটাতে একটা বাঁধ দেওয়া হয়েছে।

এই নির্দিষ্ট জায়গাটাতে পৌঁছতে হলে প্রথমে ছোটখাট একটা বাণিজ্যিক ভবনের কাছে গাড়ি রেখে নেমে পড়তে হয়। তারপর হেঁটে গাছপালার ভিতর দিয়ে ঢালু পথ ধরে নদীর কাছে পৌঁছতে হয়। নদীতে নামার জন্য সে অর্থে কোনো রাস্তা নেই। লোকজন চলাচলের ফলে একটা পায়ে চলা পথ মত তৈরি হয়েছে। তবে রাস্তার ধার থেকেই পথের দু-পাশে দুই-তিন ফুট উঁচু ঘাসের বিস্তার। কাছেই একটা রেললাইন আছে। ওটাতে খুব একটা ট্রেন চলাচল নেই। রেললাইনটা দেখিনি কখনও। তবে এর কথা জানি।

আরও অনেক রাতের মত সে বিশেষ রাতটিতেও আমাদের এই প্রিয় জায়গাটিকে মাছ শিকারের জন্য বেছে নিই। কিন্তু এদিন এখানে পৌঁছার সঙ্গে-সঙ্গেই কেন যেন অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হলো। মনে হচ্ছে যেন কেউ আমাদের দিকে নজর রাখছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝাপিয়ে পড়বে গায়ের ওপর। তবে জোর করে মনের কল্পনা বলে বিষয়টাকে উড়িয়ে দিতে চাইলাম।

আগুন জ্বেলে মাছ ধরা শুরু করলাম। কয়েক মিনিট পরেই হঠাৎ মনে হলো গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস গাড়িতে রেখে এসেছি। ওটা আনতে রওয়ানা হলাম। তবে একা না, দুজন বন্ধুকে জোর করে সঙ্গে নিয়ে নিয়েছি। লম্বা ঘাসের মধ্য দিয়ে তাদের দুজনের পিছু-পিছু এগোলাম। এসময়ই আবার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। মনে হলো কেউ যেন ঘাসের ভিতর থেকে আমাদের দেখছে। উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম, তবে অন্যদের কিছু বললাম না। কারণ আমার বন্ধু দুজনও বেশ ভীতু। আর অতিপ্রাকৃত ঘটনার প্রতি বিশ্বাসে আমার চেয়েও এক কাঠি বাড়া।

যে জিনিসটা দরকার সেটা নিয়ে আবার ফিরে এলাম। মোটামুটি আধ ঘণ্টা পর হঠাৎ একটা ট্রেন এল। তবে আশ্চর্য ঘটনা, এর আগে যতগুলো রাতে এখানে সময় কাটিয়েছি একবারের জন্যও কোনো ট্রেনের আওয়াজ শুনিনি। আর এটাও এল যেন কোনো ধরনের জানান না দিয়ে। মনে হলো যেন। নিঃশব্দে উড়ে এসেছে। তারপরই ট্রেন থেকে একটা কিছু ফেলার শব্দ হলো। গড়িয়ে-গড়িয়ে একটা গর্তে পড়ল ওটা। ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার করে উঠল জিনিসটা। আর যাই হোক, ওটা রক্তমাংসের কোনো মানুষের কণ্ঠ না।

আমার পাশেই এক বন্ধু মাছ ধরছে। দুজন দুজনের দিকে তাকালাম। তবে কেউ কোনো কথা বললাম না। কয়েক মুহূর্ত পরেই আগুনের পাশের লম্বা জংলা ঝোপের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আলোড়ন উঠল। ঝোপটা ওই গর্তটার ধারেই। মনে হচ্ছে যেন ঝড়ো বাতাস বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঝোপটার কাছে বরাবরই বসে আছে আমার বন্ধু। সে কোনো ধরনের বাতাস অনুভব করছে না। দমকা বাতাস গায়ে লাগল না আমাদের আর কারোও। গ্রীষ্মের শান্ত একটা রাত এটা। সেতুটার নীচে মাছ ধরছি আমি। এখান থেকেই জঙ্গলটার দিকে তাকালাম। বাতাস যে নাড়াচ্ছে না ওটাকে এখন পরিষ্কার, বরং মনে হলো এর ভিতরে কেউ একজন আছে, সেই খেপে গিয়ে নাড়াচ্ছে ঝোপগুলো।

এরপর আর ওখানে অপেক্ষা করার মত অবস্থা ছিল না আমাদের। নদীতে আরও কিছু লোক মাছ ধরছে। তবে তাদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কিংবা কিছু জিজ্ঞেস করার কথা চিন্তাতেও এল না। তারপরই আমার এক বন্ধু বলল, চল, দোকানে যাই। কারণ অশুভ কিছুর উপস্থিতি টের পেলে বাড়িতে যাওয়ার কথা বলতে নেই। তাহলে ওটা আপনার পিছু-পিছু বাড়ি হাজির হতে পারে।

দেরি না করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে গাড়িতে উঠলাম। তবে সোজা বাড়িতে না গিয়ে সত্যি একটা দোকানে গেলাম। পাছে আবার জিনিসটা অনুসরণ করে আমাদের কারও বাড়ি পৌঁছে যায়। পরে কথা বলে জানলাম, শুধু আমার নয়, আজ এখানে যাবার পর বেশিরভাগেরই কেমন ভয়-ভয় করছিল। ওটা কী জানি না। তবে ভয়ঙ্কর কিছু একটা যে তাতে সন্দেহ নেই। আর কিছুক্ষণ সেখানে থাকলে, হয়তো আমাদের কারও কারও ওটাই হত জীবনের শেষ মাছ শিকার।

মুরগীর খামারে আতংক

এবারের ঘটনাটি ভারতীয় এক তরুণের। আট-দশ বছর আগের কথা। হিমান তখন তার এক বন্ধু বিনোদের সঙ্গে সবে একটা মুরগীর খামার দিয়েছে।

মুম্বাইয়ের কিনারা ঘেঁষে কালিয়ান নামের একটি জায়গা আছে। তার কয়েক মাইলের মধ্যে একটা গ্রামে মাঝারি আকারের একটা জায়গা বাছাই করে তারা। আর মুরগীর খামার এতটাই পরিচিত যে যারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয় তাদেরও জানা আছে এ ধরনের খামার চালানো কী ঝক্কির ব্যাপার। যত্ন-আত্তিতে -একটু এদিক-সেদিক হলেই দেখা যাবে খামারের বারোটা বেজে গেছে। নিয়মিত খাবার, পানি দিতে হবে। তাও পরিমিত মাত্রায়। রোগ-বালাই আর মড়ক থেকে রক্ষার জন্য ওষুধও দিতে হবে পুরো নিয়ম মেনে। আর এটা এমন এক কাজ যেখানে পুরো দায়িত্ব ভাড়া করা লোকদের হাতে দিয়ে দিলে সর্বনাশ হওয়ার সম্ভাবনা ষােলো আনা।

কাজেই হিমান স্ত্রীসহ খামারেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল। তার স্ত্রী আবার এসময় বেশ কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্ত্রীকে নিয়ে এখানে যাওয়াতে আপত্তি তুলল পরিচিত অনেকেই। বলা হয় এ ধরনের খামারে অনেক সময়ই অশুভ শক্তির আনাগোনা থাকে। তারপর আবার একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার জন্য এটা আরও বিপজ্জনক জায়গা। তবে হিমানের স্ত্রী দারুণ সাহসী মেয়ে। কাজেই এসব কুসংস্কারে কান না দিয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকা স্থির করল সে।

খামারের কাজ সাহায্য করার জন্য তিন-চারজন স্থানীয় গ্রামবাসীকে নিয়োগ দিল হিমান আর তার বন্ধু বিনোদ। এদের মধ্যে দুজন মুসলমান। বলা হয় এই এলাকার মুসলমানরা এ ধরনের খামারের কাজে দারুণ দক্ষ।

শুরুর কয়েকটা মাস ঠিকঠাকমতই চলল সব কিছু। তারপর হঠাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করল পরিস্থিতি। সব ধরনের তদারকির পরেও প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যায় মুরগী মরতে লাগল। কোনো রোগ-বালাইয়ের চিহ্নও পাওয়া যাচ্ছে না। মুরগীগুলোকে নিয়মিত খাওয়ানো-দাওয়ানো হচ্ছে, ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, সর্বোচ্চ জীবাণুমুক্ত পরিবেশে রাখা হয়েছে। কিন্তু দিনকে দিন অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। এমনকী পশু চিকিৎসকও হঠাৎ এভাবে প্রাণীগুলোর মৃত্যুর কোনো কারণ আবিষ্কারে ব্যার্থ হলেন।

এদিকে হিমানের স্ত্রীর মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মাল এখানে কোনো অশুভ শক্তির উপস্থিতি আছে। আর ওটা তার বাচ্চাটার ক্ষতি করতে চায়। মাঝে-মাঝেই মূৰ্ছা যেতে লাগল সে। অথচ হিমান সবসময়ই দেখে এসেছে তার স্ত্রী সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্রী না। এই পর্যায়ে হিমানের স্ত্রী আপাতত খামার ছেড়ে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠতে রাজি হলো। ঠিক হলো বাচ্চাটা না জন্মাননা পর্যন্ত খামারে আসবে না সে।

কোনো কোনো মানুষ বিশ্বাস করে অন্তঃসত্ত্বা নারী আর বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েদের উপস্থিতি অশুভ শক্তি আর আত্মাদের উৎসাহী করে তোলে। কারণ এ ধরনের মেয়েদের মানসিক অস্থিরতা অশুভ শক্তিদের সুবিধা করে দেয়। কাজেই হিমান আশা করল তার স্ত্রী খামার ছাড়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

কিন্তু হলো উল্টোটা। নতুন ধরনের একটা ঘটনা শুরু হলো। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে-সঙ্গে বিপুল পরিমাণে পাথর পড়তে থাকল বাড়ির উপর। পাথরগুলোর উৎস কী তাও বোঝা গেল না, কারণ মনে হয় যেন ওগুলো আকাশ থেকে পড়ছে। গ্রামবাসীরা এগিয়ে এল তাদের সাহায্যে। আশপাশের ঝোপঝাড়ে আর গাছে লুকিয়ে থেকে পাথরের রহস্যভেদে তৎপর হলো সবাই। এমনকী সার্চ লাইট মারা হলো আকাশেও। কিন্তু পাথরগুলো মনে হলো যেন শূন্য থেকেই গজিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় পুলিশকে জনানো হলো বিষয়টা। কিন্তু অতিপ্রাকৃত শক্তির বিরুদ্ধে পুলিশদেরই বা কী করার আছে? তারাও ব্যর্থ হলো এটা থামাতে।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো পাথরগুলো কারও শরীরে এসে লাগে না। এমনকী যদি পাথর বৃষ্টির মাঝখানেও দাঁড়িয়ে থাকেন আপনাকে বাঁচিয়ে চারপাশে পড়তে শুরু করবে ওগুলো।

শেষমেশ আর কোনো উপায় না দেখে অতিপ্রাকৃত ঘটনা সম্পর্কে অভিজ্ঞ কারও সাহায্য নেওয়া স্থির করল হিমান আর বিনোদ। দমবিভলির একজন বিখ্যাত ওঝার কথা শুনেছে তারা। ভূত, আত্মা এসব নামাতে নাকি ওস্তাদ ভদ্রলোক। পরোপকারী হিসাবেও সুনাম আছে তাঁর। মানুষকে সাহায্য করার বিনিময়ে কোনো অর্থ-কড়িও নেন না।

হিমান আর বিনোদের কাছ থেকে সব কিছু শুনে জ্ঞানী ওঝা বুঝে গেলেন এটা শক্তিশালী কোনো কালো জাদুকরের কাজ। কিন্তু হিমান আর বিনোদ অবাক হয়ে আবিষ্কার করল বুড়ো ভদ্রলোকটি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তারপরই তিনি বললেন, এই শক্তিটি এত ক্ষমতাশালী যে তাঁর পক্ষে এর সঙ্গে টক্কর দেওয়া সম্ভব নয়। ভাল হয় যদি তারা অন্য কারও সাহায্য নেয়।

কিন্তু হিমানের বার-বার অনুরোধে টলে গেলেন বুড়ো ওঝা। আগামীকাল আসতে বললেন তাদের। পরের দিন যখন এল তখন একটা পাত্র দিলেন। কালো রং করা পাত্রটা লাল কাপড়ে ঢাকা। বেশ ভারি। ওঝা তাদের বললেন এটার মধ্যে যে জিনিসটা আছে আশা করা যায় সেটি অশুভ আত্মাটাকে বশ মানাতে পারবে।

কালিয়ান থেকে মুরগীর খামারের দিকে যেতে হলে একটা নদী পড়ে। নদীর ওপরে একটা সেতু আছে। সাধারণত রাতের বেলা খুব দরকার না হলে কেউ এই নদীর তীরে ভিড়ে না। বলা হয় এই জায়গাটাতে কালো জাদুর চর্চা হয়। রাতে সেতু পেরোনোর সময় অনেক সময়ই রহস্যজনকভাবে যানবাহনে গোলমাল দেখা দেয়।

বুড়ো ভদ্রলোক হিমান আর তার বন্ধুকে রাত বারোটার পর পটটা নদীর তীরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নদীর তীরে একটা বড় পাথর আছে, যেটায় রেখে সাধারণত নারকেল ভাঙা হয়। ওঝা পটটা ওই পাথরে ভেঙে সঙ্গে-সঙ্গে চলে আসতে বলেন। সতর্ক করে দেন কোনো অবস্থাতেই যেন ঘুরে কী ঘটেছে দেখার চেষ্টা না করে। আর জায়গাটা ছেড়ে আসার সময় দৌড়নো চলবে না, জোর কদমে হেঁটে আসতে হবে।

হিমান বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে মনে-মনে। কিন্তু কালো জাদুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এ ছাড়া আর কোনো পথও খোলা নেই সামনে। কাজেই বিনোদসহ পটটা নিয়ে বের হলো রাতের অভিযানে। নদীর ধারটা রাতের বেলা একেবারেই নির্জন থাকে। তারপর আবার দু-পাশের গভীর জঙ্গল, এমনকী প্রচণ্ড সাহসী লোকটির আত্মাও কাঁপিয়ে দেবে। কাজেই দুরুদুরু বুকে পাথরটা খুঁজে বের করল তারা। তারপর ওটার ওপরে পটটা রেখে গুঁড়িয়ে দিল ওটাকে হিমান। ঘুরে মাত্র কয়েক কদম এগিয়েছে এমন সময় একটা অট্টহাসির আওয়াজ শুনল পিছনে। তারপরই মনে হলো কে যেন পিছন থেকে ডাকছে তাদের।

হতচকিত হয়ে হিমান প্রায় মাথা ঘুরিয়ে ফেলেছিল কী ঘটেছে দেখার জন্য। কিন্তু বিনোদ এই পরিস্থিতিতেও মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে। হিমানের কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে-আস্তে তাকে দূরে সরিয়ে আনতে লাগল অভিশপ্ত জায়গাটি থেকে। বাড়ি পৌঁছেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল তারা। তারপর তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল। এখন নির্ভার। কারণ গতদিনের কাজ ঠিকমতই সমাধা করেছে, একেবারে ওঝা যেমন যেমন বলেছেন ঠিক তেমন তেমন। অর্থাৎ তাদের সমস্ত সমস্যারও সমাধান হয়ে গেছে। খুশি মনে বুড়ো ভদ্রলোকের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো তাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য।

কিন্তু বাড়িটাতে পৌঁছেই চমকে উঠল তারা। কেমন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে। বাড়িতে ঢোকার পর ওঝার ছেলের সঙ্গে দেখা হলো তাদের। এমনিতে হাসি-খুশি লোকটাকে খুব বিষণ্ণ দেখে অবাক হলো। তারপরই জানালেন তার বাবা, বৃদ্ধ ওঝা গত রাত সাড়ে বারোটায় মারাত্মক একটা হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। এর কিছুক্ষণ পরেই মারা যান তিনি।

হিমান আর বিনোদ এতটাই ধাক্কা খেয়েছে যে কিছু বলতে পারল না। মন খারাপ করে বাড়িতে ফিরে এল। তবে সন্ধ্যা নামার পরপরই শুরু হলো আবার সেই পাথর বৃষ্টি। চলতেই থাকল পরের দিনগুলোতে। ওঝার নির্দেশ অনুযায়ী সব কিছুই করেছে তারা। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। তারপর আবার ওঝার হঠাৎ মৃত্যুতে দারুণ ভেঙে পড়ল হিমান আর বিনোদ। খামারের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলল তারা।

তবে এখান থেকে যাবার সময় একটা জিনিসই বার-বার তাদের কুরে-কুরে খাচ্ছিল। ওঝার মৃত্যুটা কি নিছক স্বাভাবিক ঘটনা, নাকি ওই কালো জাদুকরের সঙ্গে লাগতে যাওয়াই কাল হয়েছে তার? ভদ্রলোকের খুব ভালই জানা ছিল শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে চলেছেন। তারপরও অসহায় দুই যুবককে সাহায্য করতে গিয়েছিলেন। তবে কি তাঁর তুলনায় অনেক শক্তিশালী কোনো শক্তির বিরুদ্ধে লাগতে যাওয়ার মূল্য দিতে হয়েছে?

বারান্দায়আমার অপেক্ষায়

কাহিনিটা শুনিয়েছেন সিংগাপুরের পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক এক অফিস সহকারী। গল্পটা বরং তাঁর মুখ থেকেই শুনি।

ফ্ল্যাটে বেশ রাত করে ফেরার অভ্যাস আমার। আর কখনও এটা নিয়ে কোনো ঝামেলায়ও পড়তে হয়নি। তবে একদিন রাত এগারোটার দিকে এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটা কোনোদিন ভুলতে পারব না।

কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার আগে সেদিন শহরের. অপর পাশের এক বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা দিতে গিয়েছি। সন্ধ্যায় আবার আমার স্ত্রী, বাচ্চাদের নিয়ে তার বাবার বাড়িতে গিয়েছে। বাসাতে তাই কেউ নেই।

বেডক সংরক্ষিত এলাকায় এসে বাস থেকে নেমে পড়লাম। তারপর যে ব্লকে থাকি সেদিকে চলে-যাওয়া রাস্তা ধরে রওয়ানা হলাম। বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় পথে খুব একটা লোকজন নেই দেখে অবাক হলাম না। তবে আমার সামনে একটা মেয়ে হাঁটছে। মেয়েটার লম্বা চুল, আর চমৎকার কাঠামো পিছন থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবেই একজন পুরুষ হিসাবে মনে কৌতূহল জেগে উঠল। পিছন থেকে যেমন দেখা যাচ্ছে সামনে থেকেও কি সে এমন সুন্দর? তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা চালালাম।

মেয়েটাকে পেরিয়ে গিয়েই চটজলদি একবার পিছন ফিরে চাইলাম দেখার জন্য। মন্দ না। তবে চেহারাটা কেমন ফ্যাকাসে। যেহেতু সামনে চলে এসেছি তাই দ্রুত আমার ব্লকের দিকে হাঁটতে লাগলাম। পাছে আবার আমি তার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছি ভেবে মেয়েটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়।

যখন আমার ব্লকে পৌঁছলাম তখন পিছনে মেয়েটার আর কোনো নাম নিশানা পেলাম না, সামনে তো নয়ই। বাড়ির সামনে এসে লিফটের অপেক্ষায় না থেকে সিঁড়ি বেয়ে পাঁচ তলায় ওঠা স্থির করলাম।

পাঁচ তলায় পৌঁছে সিঁড়ির কোনা থেকে সামনে তাকাতেই তাকে দেখতে পেলাম। এটা সেই মেয়েটা, যে আমার পিছনে ছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করছে এখন।

আমার দিকে তাকিয়ে হাসল সে।

উল্টো ঘুরেই দৌড়তে শুরু করলাম। পাশের ব্লকে বন্ধুর বাসায় পৌঁছনোর আগ পর্যন্ত থামলাম না। সেই রাতে আর বাড়ি ফিরলাম না।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এমন ঘটনা জীবনে আর ঘটেনি।

পথ হারানো আত্মা

এই কাহিনিটা শোনান সিংগাপুরের এক তরুণী ক্লার্ক। তাঁর জবানীতেই পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো এটা।

ভূত-প্রেতের ব্যাপারে আমার বড় ভাইয়ের কখনওই খুব একটা আগ্রহ ছিল না। এসবে ওর বিশ্বাস ছিল বলেও মনে হয় না। তারপরই তার জীবনে ঘটল অস্বাভাবিক একটা ঘটনা।

বছর দুয়েক আগের কথা। একদিন বাসায় ফিরল সে হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে। কপালে চিন্তার রেখা। রাতে খাবার সময় এমনকী তার পরেও তাকে বেশ বিষণ্ণ দেখাল। ঘুমানোর আগে আমি আর আমার বোন জানতে চাইলাম এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তাকে? শুরুতে কিছু বলতে চাইল না। তবে পরের দিন রইল কেন যেন মনে হচ্ছে দুটো চোখ তার মাথার পিছনে সেঁটে আছে। তার সব কিছুর ওপরই নজর রাখছে ওই দুটো চোখ। আমি আর আমার বোন হেসে উড়িয়ে দিলাম কথাটা। বিষয়টা নিয়ে বেশ কিছুটা সময় ঠাট্টা-মস্করাও করলাম। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝে গেলাম এটা মোটেই হেলাফেলা করার মত ব্যাপার নয়।

আমার ভাই সবসময়ই বেশ ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। তবে এই সপ্তাহে সে কেমন উদ্ভট আচরণ করতে লাগল। ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কী যেন বলে, আরা সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে। কখনও কখনও তার ঘুমের মধ্যে কথা বলার শব্দে আমাদেরও ঘুম ভেঙে যায়। ধীরে-ধীরে ওজন হারাতে লাগল সে। এমনকি কেউ তার সঙ্গে কথা বললেও সেদিকে নজর থাকে না। খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম আমরা। তার এক বন্ধুকে বিষয়টা জানালাম। বাসায় এসে একবার ওর দিকে তাকিয়েই বলল, এটা মোটেই সাধারণ কোনো ব্যাপার মনে হচ্ছে না।

ভাইয়ের বন্ধু তাকে দুজন লোকের কাছে নিয়ে গেল। তাদের পারিবার যে কোনো অস্বাভাবিক সমস্যার মুখোমুখি হলেই এই দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাদের একজনই ধরতে পারলেন ভাইয়ার সমস্যাটা।

যেদিন ভাইয়ার প্রথম মনে হয়েছে দুটো চোখ তার পিছনে সেঁটে আছে সেদিনই ঘটনাটি ঘটে। কাজ থেকে ফিরবার সময় একটা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জায়গার পাশ দিয়ে আসছিল সে। এসময় এমন একটা পথে পা দিয়ে বসে যেটা একটা আত্মা অন্য পৃথিবীতে যাবার জন্য ব্যবহার করে। দুর্ভাগ্যক্রমে ওই একই সময়ই অন্য পৃথিবীতে যাওয়ার পথে ছিল ওটা। ভাইয়া তার যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে আত্মাটা তার শরীরে ঢুকে পড়ে। এখন সে পথ হারিয়েছে।

আত্মাটা তার যাত্রাটা শেষ করতে চায়, আর ভাইয়াও চায় মুক্তি। এর একটাই সমাধান। তা হলো ভাইয়াকে আবার সেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জায়গাটার কাছে গিয়ে পথটার ঠিক যেখানে পা দিয়েছে সেটা খুঁজে বের করে সেখানে দাঁড়াতে হবে। আর আত্মাটাও সেক্ষেত্রে খুশি মনে তাকে ছেড়ে যাবে।

ভাইয়া লোকটির পরামর্শটা মেনে নিল। তারপর যেখানে ঘটনাটা ঘটেছে সেখানে ফিরে গেল। সৌভাগ্যক্রমে যে জায়গায় আত্মাটা তার ওপর সওয়ার হয়েছিল বলে মনে হয়েছে সেটা খুঁজে পেল। পরে সে আমাদের বলেছে ঠিক সেই মুহূর্তে তার দারুণ শান্তি লাগে। আর মনে হয় কী একটা বোঝা শরীর থেকে সরে গেছে।

ভুতুড়ে পুতুল

রবার্ট দ্য হান্টেড ডল নামেই বেশি পরিচিত সে। আমেরিকার ছোট্ট, পৈশাচিক এই মুখটিকে একবার যে দেখেছে ভুলতে পারবে না যতদিন বেঁচে থাকবে।

ভুতুড়ে পুতুল নিয়ে নানান ধরনের কিচ্ছা কাহিনি তৈরি হয়ে আসছে সম্ভবত মানুষ পুতুল বানানো শেখার পর থেকেই। তবে রবার্ট অন্যদের চেয়ে আলাদা, কারণ অনেক লোকই রবার্টকে পুতুলত্বের খোলস ছেড়ে, চলাফেরা কিংবা কাজ করতে দেখার দাবি করেছে। কেউ-কেউ আবার তার আক্রোশের শিকারও হয়েছে।

রবার্ট দ্য হন্টেড ডলের অশুভ প্রভাব বিস্তারের শুরু গত শতকের গোড়ার দিকে, যখন খেয়ালি শিল্পী রবার্ট ইউজেন অটো ফ্লোরিডা শহরের কেন্দ্রে বিখ্যাত আর্টিস্টস হাউস-এ বসবাস শুরু করেন।

প্রচুর বিত্তশালী ছিল অটো পরিবার। ফ্লোরিডার জীবনে বেশ মানিয়ে গেলেন তাঁরা। স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে এই বাড়িতে থাকত তাঁদের ছোট্ট ছেলে আর বেশ কিছু চাকর-বাকর। স্থানীয় কিংবদন্তী বলে অটোরা নিয়ম-কানুনের ব্যাপারে খুব কড়া ছিলেন। কর্মচারী আর বাড়ির চাকর-বাকরদের কাছ থেকেও পুরো আনুগত্য আশা করতেন। ছেলে গেনের দেখভালের জন্য জ্যামাইকান একটা মেয়েকে চাকরি দেন তাঁরা। অটোরা বেশিরভাগ সময় আমেরিকার বিভিন্ন জায়গাসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। এসময় এই জ্যামাইকান মহিলাই শিশুটাকে সঙ্গ দিত। কিন্তু ছোট্ট ছেলে আর জ্যামাইকান মহিলার এই চমৎকার সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হলো না।

একদিন মিসেস অটোর বিছানায় বসার জন্য চাকরি গেল জ্যামাইকান সেবিকার। তবে যাবার আগে গেনেকে সে দিয়ে গেল হাতে বোনা একটা স্টাফ করা পুতুল। লোকে বলে জ্যামাইকান এই নারী ভুডু আর কালো জাদুর কৌশল জানত। পুতুলটা বানানো হয় গেনের চেহারার আদলে। যদিও একেবারে পুরোপুরি গেনের আদল পায়নি পুতুলটা, তারপরও ওটা দারুণ মনে ধরল ছোট্ট ছেলেটির।

পুতুলটার নাম দেওয়া হল রবার্ট, গেনের নামেরই প্রথম অংশ এটা। জ্যামাইকান সেবিকার কাছ থেকে পুতুলটা নেওয়ার পর থেকে আর ওটাকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দিল না ছোট্ট গেনে। সব জায়গাতেই পুতুলটাকে নিয়ে যাওয়া চাই তার। শহরের লোকেরা প্রায়ই মিসেস অটো আর ব্যক্তিগত পরিচারকদের সঙ্গে গেনে আর রবার্টকে শহরে ঘুরে বেড়াতে দেখতে লাগল।

খাবার সময় গেনের পাশেই নিজের ছোট্ট চেয়ারটায় বসে রবার্ট। আর মা-বাবার অগোচরে কখনও কখনও পুতুলটার মুখে দু-এক দলা খাবার পুরে দেয় গেনে। গোসলের সময় পানিতে ভিজতে-ভিজতে কাঠের জাহাজ নিয়ে যখন খেলা করে গেনে, রবার্টও থাকে পাশেই, একটা শুকনো তোয়ালের আশ্রয়ে। রাতে ঘুমে ঢুলতে থাকা ছেলেটার পাশে শুইয়ে দেওয়া হয় রবার্টকে, স্বপ্নেও ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গী হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত তখন সে।

তবে ধীরে-ধীরে গেনে আর তার পুতুলের সম্পর্ক একটা অশুভ দিকে মোড় নিল। গেনেকে তার খেলার ঘরে লাফালাফি, হৈচৈ করতে দেখে যায় কিছুক্ষণ। তারপর মুহূর্তের বিরতি। এবার নিচু গলায় কথা-বার্তার আওয়াজ ভেসে আসে পরিচারকদের কানে। প্রথমে গেনের বালকসুলভ কণ্ঠ, তারপরই সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটা কণ্ঠ। কখনও কখনও গেনের কণ্ঠ কোনো কারণে চড়ে যায়। তবে অপর তরফ থেকে যেন কেবল বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করা হয় তাকে। এই সময় থেকেই অস্বস্তি শুরু হলো বাড়ির চাকর-বাকর এমনকি মিসেস অটোর মধ্যেও। কখনও কখনও উদ্বিগ্ন মা আবিষ্কার করেন ছেলেটা জড়সড় হয়ে কামরার এক কোনায় বসে আছে। আর পুতুলটা বিছানায় কিংবা নিজের চেয়ারে বসে যেন একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

বাড়ির কাঁচের আর রূপার জিনিসপত্র মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যেতে লাগল। মনে হয় যেন কেউ ওগুলো ছুঁড়ে ফেলেছে। এদিকে রাতে ঘরের চাকর-বাকররা বিভিন্ন কামরায় আটকা পড়তে লাগল। কে যেন বাইরে থেকে দোর আটকে দেয়। কাপড়-চোপড় ছেড়া অবস্থায় পাওয়া যেতে লাগল। অনেক দিন ব্যবহার করা হয় না এমনকামরার বিছানার চাদরও এলোমেলো এমনকি কখনও কখনও বিক্ষিপ্তভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেল। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ছোট্ট গেনের পছন্দের অন্য খেলনাগুলো বর্বরের মত কে যেন ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলে। আর গভীর রাতে শোনা যায় শরীরে শির শির করা ফিকফিক হাসি।

তবে দোষ পড়তে লাগল সব পিচ্চি গেনের ঘাড়ে। বাবা-মা খুব বকা-ঝকাও করলো তাকে। তবে প্রতিবারই সে সাফাই গায়, রবার্ট ওটা করেছে। যদিও তার এই কৈফিয়তে মন টলে না বাবা-মার। পুতুল নড়তে-চড়তে শিখে একটার পর একটা অকাণ্ড ঘটাচ্ছে এটা কে-ই বা বিশ্বাস করবে? এদিকে এসব আলামতের পর বাড়িতে কাজের লোকদের মন রাখতে প্রচুর অর্থ গুণতে হয় অটোদের। একপর্যায়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনরা চেষ্টা করলেন সমস্যা সমাধানের। গেনের এক দাদীর পরামর্শে রবার্টকে গেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চিলেকোঠার একটা বাক্সে বন্দি করে রাখা হলো। তার পরের রাতেই বুড়ো মহিলাকে তার বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। ধারণা করা হলো স্ট্রোক হয়েছে তাঁর। তবে ভদ্রমহিলার অপ্রত্যাশিত এই মৃত্যুর পরপরই রবার্ট আবার ফিরে পেল গেনের সঙ্গীর জায়গা।

তারপর থেকে কোনো ঝামেলা ছাড়াই ওটা থাকতে লাগল এই বাড়িতে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরও এই বাড়িতেই থাকল গেনে। এমনকী বেশ বয়স হওয়ার পরও দেখা গেল ছোটবেলার সঙ্গী পুতুলটাকে কাছছাড়া করছে না সে। পরে গেনের ঘনিষ্ঠরা মত প্রকাশ করেন পুতুলটাই প্রভাব খাটিয়ে গেনেকে ওটাকে ছাড়তে দেয়নি।

এদিকে বালক বয়সে বাড়ির কোনার যে কামরাটায় গেনে থাকত সেটা এক সময় রবার্টের আস্তানায় পরিণত হয়। ওখান থেকে সময়-অসময়ে ফিক ফিক আর পাগলাটে হাসি ভেসে আসতে লাগল। একে-একে চাকর-বাকরেরা আর্টিস্ট হাউস ছাড়তে লাগল। এমনকী সবচেয়ে দুঃসাহসী, লোকটিকেও এখানে খুব বেশিদিন রাখা যায় না। শেষমেশ দেখা গেল বাড়িতে মাত্র দুজন কাজের লোক আছে। তারা স্বামী-স্ত্রী। কয়েক ঘণ্টার জন্য আর্টিস্ট হাউসে আসে তারা। এর মধ্যে স্ত্রীটি গেনের জন্য রান্না-বান্না করে। আর স্বামীটি বাড়ির টুকটাক কাজ করে। তাও দুজনেই সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। যাই ঘটুক না কেন বাড়ির কোনার ওই কামরাটার কাছে তারা ঘেঁষে না। এমনকি গেনে বকা-বাদ্য করেও ওটায় ঢুকাতে পারেনি তাদের।

একপর্যায়ে বিয়ে করল গেনে অটো। তবে গোড়া থেকেই সুখের হলো না দম্পতির জীবন। শুরু থেকেই অপার্থিব একটা ছায়ার মত তাদের দাম্পত্য জীবনে লেগে রইল রবার্ট। যেখানেই যাবে পুতুলটাকে সঙ্গী করবে গেনে। খাবার টেবিলে একটা চেয়ার বরাদ্দ থাকে, ওটার জন্য। শুধু তাই না, নববিবাহিত দম্পতির শয্যার পাশেও তার প্রিয় চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায় পুতুলটাকে। স্বাভাবিকভাবেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরল। আর এই পরিবেশে থাকতে-থাকতে একসময় উন্মত্ত আচরণ শুরু করল মিসেস অটো। তারপর একদিন রহস্যময়ভাবে মারা গেল। লোকে বলে এখনও আর্টিস্ট হাউসে ঘুরে বেড়ায় তার প্রেতাত্মা।

একসময় মৃত্যু হলো গেনে অটোর। কিছু দিনের জন্য বাড়িতে একা হয়ে গেল রবার্ট। নতুন মালিক বাড়িটায় আসার পর আবার রবার্টের জায়গা হলো চিলেকোঠা একটা বাক্সে। কিন্তু প্রথমবারের মতই এই ব্যবস্থায় খুশি হতে পারল না অশুভ পুতুলটা। রাতগুলো দুর্বিষহ করে তুলল সে পরিবারটির জন্য। বাড়ির এখানে-সেখানে তার উপস্থিতির নজির রাখতে শুরু করল। ঘটাতে থাকল একটার পর একটা অঘটন। তারপর রান্নাঘরের ছুরি হাতে যখন ওটা নতুন মালিক-মালিকানের বিছানার কাছে হাজির হলো, আর ফিক ফিক করে হাসতে লাগল, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল তাদের। দেরি না করে বাড়ি ছাড়লেন তারা। আর রবার্টের ঠাই হলো নতুন ঠিকানা, ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টের ইস্ট মার্টেলো জাদুঘরে। যেখানে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয় তাকে।

এখনও আর্টিস্ট হাউসে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকরা বলেন, রবার্ট সম্ভবত তার নতুন বাড়ির সঙ্গে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনি। কারণ যেসব খালি ঘরে ট্যুরিস্ট গাইডরা তাদের ভয়ে নিতে যেতে চান , সেসব ঘর থেকে প্রায়ই খিলখিল হাসি আর ছোট্ট পায়ের কারও হেঁটে বেড়ানোর শব্দ শুনতে পান। কখনও কখনও ছোট শিশুরা স্কুলে যাওয়ার সময় কোনার কামরাটার জানালা গলে রবার্টকে উঁকি মারতে দেখে ভয়ে ছুটে পালায়।

তবে ইস্ট মার্টেলো জাদুঘরে এভাবে তাকে সাজিয়ে রাখায় সে যে ক্রুদ্ধ তার প্রমাণ রবার্ট রেখে চলেছে অবিরত। তাকে দেখেই শিউরে ওঠেন পর্যটকরা। এক নারী পর্যটক তার চোখের সামনে পুতুলটার মুখের ভঙ্গী দেখে আঁতকে ওঠেন। ঠিক আগের মুহূর্তে ওটা হাসছিল, তারপরই বিরক্ত হয়ে ভ্রুকুটি করে রাখল।

আবার কোনো কোনো পর্যটক এমনও দাবি করেছেন বিখ্যাত পুতুলটা ছবি তোলার পর কালো ফ্রেম ছাড়া আর কিছুই পাননি। রবার্ট যে জায়গাটায় এখন আছে সেখানে আলোর অবস্থা বেশ খারাপ। এত কম আলোতে ছবি তোলা এমনিতেই কঠিন। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জায়গাটাকে আলোকিত করার নানা ধরনের ব্যবস্থা নিলেও কী এক অজানা কারণে সুবিধা হয়নি। আবার এ ধরনের গুজবও আছে ছবি তোলার আগে পুতুলটার কাছে। ভদ্রভাবে অনুমতি চাইতে হয়। তা না হলে যে ছবি তুলবে তার উপর নেমে আসে রবার্টের অভিশাপ। আর এখনও জাদুঘরে রাতে অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে কিংবা কিছু পড়ে গেলে বলা হয়, রবার্ট এটা করেছে। রাতে শেষ ব্যক্তি হিসাবে জাদুঘর ছাড়তে চায় না কোনো কর্মচারীই।

প্রতি অক্টোবরে কি ওয়েস্টের কাস্টমস হাউসে কাঁচের ডিসপ্লেতে সাজিয়ে রাখা হয় রবার্টকে। জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়কদের মতে রবার্টের সঙ্গে দেখা করার এটাই সেরা সুযোগ। আর এসময় রবার্টের সঙ্গে নিজের পরিচয় তুলে না ধরা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তবে এই দ্রতাটুকু দেখাননি এমন লোকেরও অভাব নেই। তাদেরই একজন অরল্যাণ্ডোর এক নারী বলেন রবার্ট কিংবা তার মত দেখতে কেউ একজন কাস্টমস, হাউস থেকে বের হয়ে আসার পর তাকে বাড়ি পর্যন্ত অনুসরণ করে। শুধু তাই না ওই রাতে একটু পর পরই তার শোবার ঘরের জানালায় পুতুলটার ছায়া দেখেছেন। বাড়ির আর সবখানে বিদ্যুৎ থাকলেও সে রাতে তাঁর শোবার ঘর অন্ধকারে ডুবে ছিল।

রবার্টের পাশেই থাকে পিপারমিন্ট। যেগুলো জাদুঘরের কর্মচারীরা তার পাশে রেখে দেয়। কে জানে, ওগুলো চিবুতেচিবুতে রবার্ট হয়তো এমন কোনো পরিবারের খোঁজ করে যাদের কেবল একটি বাচ্চা আছে গেনের মত, আর তাঁরা রবার্টকে ভালবাসবে সত্যিকারের ছেলের মতই।

রাত সাড়ে তিনটা

সিঙ্গাপুর যখন ব্রিটিশদের শাসনে ছিল তখনকার ঘটনা। দুই জিগির দোস্ত ছিল। শ্রমিকের কাজ করে তারা। একজন আবার নতুন বিয়ে করেছে তখন। কাজেই সবসময় তার চিন্তা থাকে কীভাবে একটু বেশি কামাই করা যায়।

একদিন তার বন্ধু তাকে জানাল ব্রিটিশরা একটা সেতু তৈরির কাজে এক শিফটের শ্রমিকদের সাধারণ মজুরির চেয়ে বেশি টাকা দিচ্ছে। তবে সমস্যাটা হলো সময়টা একেবারেই খারাপ। এই শিফটের কাজ শুরু হয় ভোর চারটায়। বিবাহিত বন্ধুটি এক বাক্যে রাজি। কাজেই তার বন্ধু নির্মাণ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ককে বলে দুজনের কাজ পাঁকা করে ফেলল। তারপর বিবাহিত বন্ধুটিকে জানাল রাত সাড়ে তিনটার দিকে তার বাসায় আসবে সে। তারপর দুজন একসঙ্গে কাজে যাবে।

রাতে বিবাহিত পুরুষটি শুধু বিছানায় এপাশ-ওপাশ করল। তার স্ত্রীর মেজাজ চটলেও কিছু করার নেই। কারণ লোকটার ঘুম আসছে না, কাজে যাবার চিন্তায়।

এভাবে কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। এসময়ই লোকটির মনে হলো বন্ধু তার নাম ধরে ডাকছে। বউকে বলে টুকটাক জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল। এদিকে তার বন্ধুটি রাস্তার ধারের একটা ল্যাম্প পোস্টের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকায় চেহারা বোঝা যাচ্ছে না তার।

চলো, বলেই বন্ধুটি দ্রুত হাঁটা ধরল। বিবাহিত লোকটি চাইল বন্ধুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে। কিন্তু যখনই কাছাকাছি হবার চেষ্টা করে মনে হয় যেন বন্ধুটি দূরে সরে যায়।

এদিকে স্বামী চলে যাওয়ার পর স্ত্রী আবার বিছানায় যায়। একটু পরেই পারিবারিক বন্ধুটির দরজা ধাক্কানোর আর তার স্বামীর নাম ধরে ডাকার শব্দ শুনতে পেল। কী হয়েছে বুঝতে না পেরেও চিন্তিত মহিলাটি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। দেখে বন্ধুটি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

কই? ঘুমকাতুরে লোকটা কোথায়? উঠে রেডি হয়েছে তো? জানতে চাইল সে।

কী বলছেন? মাত্র আধ ঘণ্টা আগে না আপনার ডাক শুনে বেরিয়ে গেল সে? চমকে উঠে বলল মেয়েটা।

আধ ঘণ্টা আগে? আমার সঙ্গে? কিন্তু আমি তো কেবলই এলাম। এখন সাড়ে তিনটা বাজে, তাই না? অবিশ্বাসভরা কণ্ঠে বলল বন্ধুটি।

এবার ঘড়িটার দিকে তাকাল মহিলাটি। দেখল ঠিকই তো ঘড়িতে তিনটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। এবার স্বামীর জন্য ভয় হতে লাগল তার। কীভাবে একজন লোক এসে তার স্বামীকে নাম ধরে ডেকেছে আর সে উঠে চলে গেল, পুরো ঘটনাটা খুলে বলল বন্ধুটিকে।

এদিকে বন্ধুটিও এখন চিন্তায় পড়ে গেছে। নিশ্চয়ই রহস্যময় কোনো ব্যাপার আছে এর মধ্যে, ভাবল। কেউ একজন তার বন্ধুকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে। দ্রুত সেতুর কাজ যেখানে চলছে সেদিকে রওয়ানা হলো সে। বন্ধু আসলেই সেখানে পৌঁছে থাকলে তার দেখা পেয়ে যাবে।

পথেই পেল বন্ধুকে। তবে শুধু কাটা মাথাটা, রাস্তার ধারের একটা গর্তের মধ্যে। কোনো দিনই আর ধড়টা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ক্লান্ত চালক

সিংগাপুরের এক গাড়ি চালক মালয়েশিয়ান হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল। কুয়ালালামপুরে আত্মীয়ের বাড়িতে যাবে সে। পথে এক জায়গায় গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। আশপাশে কোনো বসতি চোখে পড়ল না। শুধু রাবারের বন। সাহায্যের জন্য কোথায় যাবে এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এমনকী পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটে চলা একটা গাড়িও দাঁড়াল না তার ইশারায়। চারপাশে আরও একবার ভালভাবে নজর বুলাল উপায়ন্তর না দেখে, যদি জনমানবের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়। এসময়ই রাবার বনের গভীরে একটা আলো নজরে এল। যাক, অন্তত ওখানে সাহায্য করার মত কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে, ভাবল লোকটা। সৌভাগ্যক্রমে রাবার বাগানের ভিতর দিয়ে পায়ে-চলা একটা পথ চলে গেছে। ক্লান্ত শরীরটা টেনে-টেনে আলোটার দিকে এগুতে লাগল এই পথটা ধরে।

কাছাকাছি হতেই নির্মাণ শ্রমিকদের কাঠের তৈরি দু-তলা কাঠামোটা চোখে পড়ল। সিংগাপুর, মালয়েশিয়ায় নির্মাণ প্রকল্পের এলাকায় এক সময় এ ধরনের অস্থায়ী বাড়ি বেশ দেখা যেত। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছার আগেই বৃষ্টি শুরু হলো। অল্প সময়ের মধ্যে বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেল। চালাঘরটার সামনে যখন পৌঁছল ততক্ষণে ভিজে একসা হয়ে গেছে।

জোরে দরজায় ধাক্কা দিল সে। গেঞ্জি আর পাজামা পরা একটা লোক দরজা খুলল। তার সমস্যাটা খুলে বলল সিংগাপুরের লোকটা। তারপর জানতে চাইল তাদের এখানে ফোন আছে কিনা আর সেটা সে ব্যবহার করতে পারবে কিনা। শ্রমিক লোকটা তখন বলল, গাড়িটা যদি ঠিকও করতে পার তাহলেও এই আবহাওয়ায় গাড়ি চালানো ঠিক হবে না তোমার। তার চেয়ে বরং রাতটা এখানে কাটিয়ে দাও। সকালে আমরা দেখব তোমার গাড়ির জন্য কী করতে পারি।

সিংগাপুরিয় মনে-মনে কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল লোকটার ওপর। ভিতরে তাকিয়ে আরও দুজনকে দেখতে পেল। তিনজনে মিলে তাস খেলছিল। লোকগুলো তাকে বলল ওপরতলায় উঠে বিছানায় শুয়ে পড়তে। তারা রাতভর খেলা চালিয়ে যাবে। লোকগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল সে। এখানে এসে অবাক হয়ে দেখল কিছু আসবাবপত্র এমনকি আয়নাসহ একটা ড্রেসিং টেবিলও আছে কামরাটায়। তবে ওটা নিয়ে বেশি একটা চিন্তা করল না। কাপড় ছেড়ে চারটা বিছানার একটায় শুয়ে পড়ল।

রাতের কোনো এক সময় সিংগাপুরিয় লোকটার ঘুম ভেঙে গেল। এসময়ই দেখল সাদা পোশাক পরা এক মহিলা ড্রেসিংটেবিলে বসে ধীরে-সুস্থে তার লম্বা চুল আঁচড়াচ্ছে। এক পর্যায়ে লোকটাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল মহিলাটি। চিরুনিটা নামিয়ে রেখে তার দিকে ফিরে একটা হাসি দিল। কী করা উচিত বুঝতে না পেরে পাল্টা হাসল সিংগাপুরিয় লোকটাও।

তারপরই নিজের মাথাটা ঘাড় থেকে নামিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখল মহিলাটি। আতংকে চিৎকার করতে চাইল লোকটা। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। মহিলাটি নড়ছে না। তবে টেবিলের ওপর রাখা মাথাটা তার দিকে চেয়ে হাসছে।

থর থর করে কাঁপছে লোকটা। তবে শেষ পর্যন্ত নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ খুঁজে পেল। পড়িমরি করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল সে।

দেখল নীচের তিনজন এখনও শান্তভাবে তাস পিটিয়ে যাচ্ছে। বাঁচাও, বাঁচাও, হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল সিংগাপুরিয়, ওপরে একটা মহিলা দেখে এলাম, মাথা খুলে ফেলল চোখের সামনে।

তিন তালুড়ে খেলা থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর একজন-একজন করে নিজেদের মাথা খুলে টেবিলে রাখতে লাগল।

রহস্যময় হাত

এবারের কাহিনিটা শুনিয়েছেন সিংগাপুরের ২৪ বছর বয়স্কা এক সরকারী চাকরিজীবী। আমরা এটা তাঁর মুখ থেকেই শুনব।

বাবা-মার সঙ্গে একটা দু-তলা বাড়িতে থাকি আমি। একদিন বেশ রাতে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে পড়ছি। কারণ রাতে দেরি করে ঘুমালেও কিছু আসে যায় না আমার। সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার তাগিদ নেই। পা মচকে যাওয়ার কারণে কয়েকদিন ছুটি নিয়েছি। যে গল্পের বইগুলো কিনেছি অবসর কাটানোর জন্য তার সবগুলোই পড়ে শেষ। ওগুলোর একটারই আবার পাতা উল্টাচ্ছি।

আমার বিছানাটা জানালার দিকে মুখ করা। নীচের তলার গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকটা বারোটা বাজার সংকেত দেওয়ার ঠিক সঙ্গেসঙ্গে একটা শব্দ কানে এসে বাজল। জানালার কাছে বাইরের দেয়ালে কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। তারপরই জানালার ধারে একটা মহিলার হাত দেখা গেল। হাতটাতে কয়েকটা আংটি পরা। হাতটা জানালা গলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। মহিলার জামার আস্তিনের একটা অংশও নজরে পড়ছে। কালোর ওপর গাঢ় লাল নকশা কাপড়টায়।

ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। জানালা গলে বেশ কিছুটা ঢুকে পড়েছে ইতিমধ্যে হাতটা। জামার হাতার অনেকটুকু দেখা যাচ্ছে এখন। গোড়ালির মারাত্মক ব্যথা থাকা সত্ত্বেও লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে বারান্দায় এসেই বাবার সঙ্গে ঢাক্কা খেলাম। আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে তাঁর রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

হড়বড় করে কিছু বলতে-বলতে আঙুল দিয়ে আমার কামরার দিকে দেখিয়ে দিলাম। অবাক; বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বাবা। আমার মুখ দিয়ে কেবল বেরোল, আমার রুম…আমার রুম…

সমস্যাটা কী? তোমার রুমে কী হয়েছে?জানতে চাইলেন তিনি। সন্দেহ নেই ধরে নিয়েছেন বাদুড় বা অন্য কোনো ধরনের কীট-পতঙ্গ ঢুকেছে ,কামরাটায়। আর এখানেই আমি এই কাহিনি শুরু করেছি।

পাপা, জানালা গলে কেউ আমার কামরায় ঢুকতে চাইছে। বলতে-বলতে আবারও আতংকে শিউরে উঠলাম।

কোনো কথা না বলে কামরাটার দিকে দৌড়ে গেলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর জন্য ভয় হতে লাগল আমার। অশুভ একটা কিছু দেখার জন্য মনটাকে প্রস্তুত করে কামরাটার দিকে ফিরে তাকালাম।

কিন্তু রুমটা খালি।

যেভাবে রেখে গেছি সেভাবেই আছে, তবে জানালা গলে উঁকি দেওয়া হাতটা নেই। আমার হাতের বইটা পড়ে আছে মেঝেতে। দৌড়ে পালানোর সময় হাত থেকে ফেলে দিয়েছিলাম ওটাকে।

আমার দিকে ফিরলেন বাবা। চোখে প্রশ্ন। সম্ভবত কোনো একটা ব্যাখ্যা আশা করছেন। কিন্তু বলার মত কিছু নেই আমার।

এই রোমাঞ্চের বইগুলো কল্পনার দৌড় বাড়িয়ে দিয়েছে তোমার। এখন থেকে ওগুলো দিনের বেলা পড়বে। ক্লান্ত, একই সঙ্গে কিছুটা রুক্ষ গলায় বললেন তিনি। মাথা ঝাঁকালাম, তবে চোখ আধ খোলা খালি জানালাটার দিকে। বাবার পরামর্শ মেনে বইটা সরিয়ে রাখলাম। তবে রাতে ঘুমালাম বাতি জ্বেলে।

ঘুম ভাঙল সকাল ছয়টার দিকে। মনে হলো, কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। মনে হলো যে ঘরের বাইরে গেটের কাছ থেকে আসছে। একটা নারী কণ্ঠের আওয়াজ। জানালার দিকে তাকানোর সাহস হলো না। গত রাতের কথা মনে পড়ে গেছে। বাবাকে চিৎকার দিয়ে ডাকার জন্য মনে-মনে প্রস্তুতিও নিয়ে নিয়েছি।

এদিকে কণ্ঠটা আরও তীব্র হয়েছে। মনে-মনে নিজেকে একটা গাল দিলাম। আসলে আমি একটা নির্বোধ। সম্ভবত পরিচিত কেউই ডাকছে। হয়তোবা বুয়া কিংবা তার বাড়ির কেউ জানাতে এসেছে সে আজ সকালে কাজে আসবে না। তারপরও জানালার কিনারে এগিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে কয়েক মিনিট লাগল।

নীচে গেটের সামনে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। আমার দিকে পিছন ফিরে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কি আশ্চর্য, গত রাতের জামার হাতটা যে নকশার ছিল তার পরনের কাপড়টাও সেই নকশার। এসময়ই তার হাতের দিকে নজর গেল আমার। হায় খোদা! গত রাতের হাতের আংটিগুলো এই হাতেও আছে।

পিছন ফিরে থাকায় চেহারাটা দেখতে পেলাম না। আরও ভাল মত দেখার জন্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।

এসময়ই একটা বাস এসে দাঁড়াল রাস্তায়। বাস স্টপের তিনজন মানুষ, দুজন পুরুষ আর রহস্যময় মহিলা, বাসে ওঠা শুরু করলেন। সবার শেষে উঠলেন মহিলাটি। বাসের নীচের ধাপে একটা পা দিয়ে ধীরে ধীরে আমার দিকে ঘুরলেন।

শরীরে শিরশিরে একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। মহিলাটি আমার দিকে তাকালেন। একটা হাসি দিলেন। তারপরই গাড়ির ভিতরে অদৃশ্য হলেন। আর কোনো দিন তাঁকে দেখিনি। এখনও ভাবি কখনও কি আর তাকে দেখতে পাব? আর যদি দেখা হয় কোন্ পরিস্থিতিতে?

বুড়ো ভিখারি

এবারের অভিজ্ঞতাটি বেশ নতুনই বলা চলে। এই বছর দুই-ছিন আগের কথা। অঞ্জলি নামে এক ভারতীয় তরুণীর কাহিনি এটি। বছর পাঁচেক আগেও তিনি আমেরিকা ছিলেন। এখন স্বামীর সঙ্গে থিতু হয়েছেন। চাকরি করেন মুম্বাইয়ে।

যখনকার কথা তখন তার বয়স সাতাশ, আর আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মাতৃকালীন ছুটি কাটাচ্ছেন আর প্রথম শিশুর পৃথিবীতে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঘটনার দিন স্বামী অফিস থেকে ফেরার পর দুজনে ঠিক করলেন শিবাজী পার্কে বেড়াতে যাবেন। তাদের বাসা থেকে বেশি দূরে না জায়গাটি। তখনও পার্কে প্রচুর মানুষ। কিছুক্ষণ ঘোরাফেরার পর বাসায় ফিরে আসা স্থির করলেন দুজনে। তাঁর স্বামী চালকের আসনে বসলেন। অঞ্জলি সামনের অন্য পাশের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকবেন এমন সময় একজন বুড়ো ভিক্ষুক মহিলা তার জামার হাত ধরে টান দিল। ভারতে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কাজেই এটাতে আতংকিত হওয়ার কোনো কারণ অনুভব করলেন না। মহিলাটির দিকে মুখ তুলে চাইলেন। সাধারণ এক বুড়ি ভিক্ষুকের মতই লাগল তাকে। তাকে কিছু না দিয়েই গাড়ির ভিতর ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন অঞ্জলি। বাসার দিকে রওয়ানা হলেন তাঁরা।

মোটামুটি মিনিট তিনেক গাড়ি চালাতেই বাড়ির কাছাকাছি চলে এলেন। এসময়ই লাল বাতি জ্বলায় গাড়ি থামাতে হলো। তখনই রাস্তার পাশে ভিখারি বুড়িটিকে দেখলেন আবার। অবাক হলেও আতংকিত হয়ে পড়লেন না, অঞ্জলি। বরং ওই সময় এটা নিয়ে আর কিছু চিন্তাও করলেন না। বাসায় ফিরে এলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। রাতে অস্বাভাবিক কিছু ঘটল না। পরের দিন অঞ্জলির স্বামী অফিসে গেলে বাসায় একা হয়ে পড়লেন। দুপুর আড়াইটার মত বাজে তখন। খাওয়া-দাওয়া শেষে হালকা একটা তামত চলে এসেছে তাঁর। হঠাৎ খুব শীত করতে লাগল। মনে হচ্ছে যেন শরীরে কাঁপন ধরে যাবে। চোখ মেললেন, তারপর যা দেখলেন কোনো মতেই বিশ্বাস করতে মন চাইল না। পরিষ্কার দেখলেন কাল রাতের সেই বুড়ো মহিলাটি তাঁর খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতটা বাড়িয়ে তার কাছে আসার ইশারা করছে যেন মহিলাটি। এক মুহূর্তের জন্য অঞ্জলির মনে হলো স্বপ্ন দেখছেন। চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তারপর সাহস সঞ্চয় করে আবার চোখ মেললেন। মহিলাটি এখনও আছে। এবার আর নির্জেকে সামলানো সম্ভব হলো না তার পক্ষে। বার-বার শুধু মনে হচ্ছে, বাচ্চাটার যদি কোনো ক্ষতি করে সে। দৌড়ে কামরা এবং বাসা থেকে বের হয়ে পাশের বাসার দরজায় ধাক্কা দিলেন। দরজা খুললে স্বাভাবিকভাবে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলেন। প্রতিবেশী মহিলাটিকে কিছু বললেন না, পাছে আবার ভাবেন পাগল হয়ে গেছেন কিংবা অন্তঃসত্ত্বা থাকার কারণে দুশ্চিন্তায় উল্টো-পাল্টা দেখেছেন। তখনই স্বামীকে বাসায় আসতে বললেন ফোন করে। ভদ্রলোক যখন এলেন তখনই কেবল বাসায় ঢুকলেন আবার। তবে তখন বাসায় কাউকে পেলেন না।

মায়ের পরামর্শে বাসায় বিশেষ একটা পূজা দিলেন অঞ্জলি। তারপর অবশ্য আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি। বাচ্চাটা নিয়েও কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। আর কখনও দেখা যায়নি ওই বুড়ো মহিলাকেও। তবে অঞ্জলির পীড়াপীড়িতে ওই বাসা বদলে নতুন ফ্ল্যাটে উঠে পড়েন তাঁরা।

প্রেতাত্মার প্রতিশোধ

১৭ অক্টোবর ১৯৬৩। ঘড়ির কাঁটা রাত দশটার আশপাশে ঘুরঘুর করছে। গ্রিনহা বাড়ির দিকে রওয়ানা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমেরিকার আলাবামার এই পুলিশ প্রধানকে ধরা হয় সবচেয়ে তরুণ পুলিশ চীফদের একজন হিসাবে। দারুণ যুক্তিবাদী মানুষ হিসাবে সুনাম আছে তাঁর। ভূত, অতৃপ্ত আত্মা এসবে বিশ্বাস নেই এক রত্তিও। এমনকী এসব নিয়ে ভাবাটাকেও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু মনে করেন না।

ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে সরকারি গাড়িটায় উঠলেন। তারপর ফাল্কভিলেতে তার বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। আবাসিক এলাকায় প্রবেশের ঠিক আগে রাস্তার মাঝখানে অস্বাভাবিক একটা মানুষের কাঠামো চোখে পড়ল তার। অন্তত সাত ফুট লম্বা হবে ওটা। জ্বলজ্বলে কিছুতে রঞ্জিত মনে হচ্ছে দেহটা। রূপার মত ঝিকমিক করছে। এক মুহূর্তের জন্য গ্রিনহার মনে হলো লোকটার মাথায় শিং আছে।

এই অদ্ভুত জিনিসটা কী? মনে-মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন গ্রিনহা। এটা কি তবে ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী? তবে চৌহদ্দিতে কোনো ধরনের উড়যান বা ফ্লাইং সসার দেখা যাচ্ছে না। কাজেই এটা ভিনগ্রহের প্রাণী এই সম্ভাবনাটা বাদ দিতে হলো।

দেরি না করে ক্যামেরাটা টেনে নিয়ে চারটা ছবি তুললেন অদ্ভুত জিনিসটার। যেই না এটা করলেন কাঠামোটা যেন তার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। তবে আশ্চর্য ব্যাপার, মনে হচ্ছে

যেন শূন্যে ভেসে-ভেসে কিংবা পিছলে-পিছলে আসছে।

সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ির সাইরেন বাজানো শুরু করলেন গ্রিনহা, আর ছাদের ঘুরতে থাকা বাতিটাও জ্বেলে দিলেন। এবার জিনিসটা যেন সেই অদ্ভুতভাবে পিছলে-পিছলে দূরে সরে যেতে লাগল, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।

ছবিগুলো একটা পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দিলেন গ্রিনহা। আশ্চর্য এই জিনিস বা প্রাণীটিকে নিয়ে বেশ আলোড়ন উঠল মানুষের মধ্যে। বিস্তর আলোচনাও হলো একে ঘিরে। কিন্তু এর পরপরই দুর্ভাগ্যের বেড়াজালে বন্দি হলেন গ্রিনহা। তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন। সপ্তাহ খানেক পর রহস্যজনকভাবে আগুনে পুড়ল গ্রিনহার গাড়ি।

১৯৬৩ সালের ১৫ নভেম্বর সরকারি চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হলো তাকে। অব্যাহতির কারণ জানতে চাইলে বলা হলো, আমরা এমন একজন পুলিশ প্রধান চাই না যে অকাট্য প্রমাণ ছাড়া উদ্ভট কোনো জিনিসে বিশ্বাস করে। শুধু তাই না মানুষের মনেও ভীতির জন্ম দিয়েছেন আপনি। তাই পুলিশ বিভাগের আপনাকে আর প্রয়োজন নেই।

এই ভুতুড়ে জিনিসটা আসলে কী সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি কখনও। এই এলাকায় আর কখনওই দেখা যায়নি ওটাকে। কেউ-কেউ অনুমান করলেন গ্রিনহার দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে। অতি উৎসাহী অনেকে আবার দাবি করলেন গোটা বিষয়টাই প্রাক্তন পুলিশ প্রধানের তৈরি করা গল্প। তবে একটা বিষয় এখানে জানিয়ে রাখা উচিত, ১৯৬৩ সালের ১৭ অক্টোবর আলাবামার অনেক লোকই অদ্ভুত সব শব্দ শুনেছেন, কেউ-কেউ অপার্থিব একটা আলোও দেখেছেন।

তবে সবচেয়ে বেশি লোকে যেটা বিশ্বাস করলেন তা হলো, অজানা কোনো কারণে অশরীরী কেউ একজন গ্রিনহার ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। তবে এই আশ্চর্য প্রতিষােধের কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি কেউ-এমনকী গ্রিনহা নিজেও।

খানওয়াহর সেনারা

মার্চের স্যাঁতস্যাতে একটা দিন। সম্ভবত সালটা ১৯৩৬। মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে ফিরছি আমরা। এসময়ই হঠাৎ বর্মের সঙ্গে তরোয়াল বাড়ি খাওয়ার আর সৈন্যদের যুদ্ধ করার আওয়াজ পেলাম। প্রচুর শব্দ হচ্ছে। মনে হলো যেন নরক ভেঙে পড়েছে। কিন্তু চৌহদ্দিতে কোনো জনমানব দেখা গেল না। কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী হয়েছে বোঝার চেষ্টা করছি। তারপরই ভয়ে দৌড়তে দৌড়তে গ্রামে ফিরে এলাম। সংবাদপত্রের এক প্রতিনিধিকে কথাগুলো বলেছিলেন ১১৪ বছরের বৃদ্ধ সরদার আলি। ভারতের রূপবাস এলাকার খানওয়াহ গ্রামের এই বুড়োকে এলাকার লোকেরাও দারুণ শ্রদ্ধা করে।

১১০০ বছর আগে গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেন খান মুহাম্মদ পাঠান। গোটা গ্রামটাতেই এখনও দেখতে পাবেন ঐতিহাসিক বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ। নানা ধরনের গল্প, লোককাহিনি ছড়িয়ে আছে একে ঘিরে। গ্রাম লগোয়া বিশাল এক মাঠে রাজপুতদের সঙ্গে তুমুল লড়াই বেধেছিল মোঘল সেনাদের, তাই পর্যটকদেরও আনাগোনা দেখা যায় এই গ্রামে।

সরদার আলির কাছ থেকে জানা যায় তার অনেক পূর্বপুরুষই রাতের বেলায় মরণপণ যুদ্ধের শব্দ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনেছেন। এমনকী তাঁদের কেউ-কেউ ময়দানে লড়াইয়ে মত্ত সেনাদেরও দেখেছেন। তার ছোট বয়সে বাপ-দাদারা বলেছেন রাজপুত আর মোঘল সেনাদের আত্মারা গ্রামের পশ্চিমে পাহাড়ের পিছনের সমতলে ঘোরাফেরা করে। রাজপুত আর মোঘলদের যুদ্ধে যেসব সেনা প্রাণ হারিয়েছে এরা তাদেরই আত্মা।

ইতিহাস বলে ১৫২৭ সালের ১৬ মার্চ, শনিবার রাজপুত শাসক রানা সংগা আর জহিরুদ্দিন বাবরের সেনাদের মধ্যে লড়াই হয়েছে এই এলাকায়। এর বেশিদিন আগের কথা না, ইব্রাহীম লোদীর মুখোমুখি হয়েছিলেন বাবর। ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিলে পানিপথের ওই যুদ্ধে লোদীর সেনাদের ভালমতই নাকানিচুবানি খাইয়েছিলেন বাবর।

খানওয়াহর যুদ্ধে বাবরের সেনারা অবস্থান নিয়েছিল পাহাড়ের ধারের ময়দানে। পিছন থেকে যেন রাজপুতরা আক্রমণ করে ভড়কে দিতে না পারে তাই গভীর পরিখা খনন করা হয় এলাকাটায়। এদিকে সামনে গরুর গাড়ির পিছনে বসানো হয় কামান। মার্চের ১৬ তারিখ সকাল ৯টার দিকে রানা সংগার লোকেরা আক্রমণ চালায়। লড়াই চলে দশ ঘণ্টা। এসময় কামানের গোলার আঘাতে রানা সংগার প্রচুর সেনা মারা পড়ে। রানা সংগা নিজেও মারাত্মকভাবে আহত হন। আর এই আঘাতের কারণেই মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মারা যান তিনি।

খানওয়াহর গ্রামবাসীরা আর রাজস্থানের সাধারণ লোকেরা বিশ্বাস করে পরাজিত, ক্রুদ্ধ রাজপুত সেনারা এখনও এই এলাকায় ঘুরে বেড়ায় শত্রুর খোঁজে। রাজস্থানে নিহত রাজপুতদের নিয়ে নানার ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। বলা হয় খানওয়াহর অশুভ এই যুদ্ধক্ষেত্রে রাতের বেলা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় ছায়ামূর্তিদের। কেউ জানে না কীজন্য তারা ঘুরে বেড়ায় আর কী-ই বা খোঁজে তারা?

মড়া যখন জ্যান্ত হলো

এই ঘটনাটা বেশ আগের। শ দেড়েক বছর তো হবেই। নায়ক চার্লস ডি. ব্র্যাডলাফ নামের এক তরুণ। ভূত, প্রেতাত্মা এসবের প্রতি মোটেই বিশ্বাস নেই। শুধু তাই না এ সম্পর্কে যে কোনো কাহিনি ভাঁওতাবাজি, হ্যালুসিনেশন এসব প্রমাণ করার জন্য এক পায়ে খাড়া। সে কোনো কিছুকেই ভয় পায় না, এমন কথাও বলে বেড়ায় ব্র্যাডলাফ। একদিন তার এই আচরণে খেপে গিয়ে একজন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসল, তুমি যদি এতই সাহসী হও তবে তার প্রমাণ দিতে হবে। রাতে দুয়ার আটকানো একটা গির্জার মধ্যে থাকতে হবে, সঙ্গে থাকরে কফিনে ভরা একটা লাশ।

সঙ্গে-সঙ্গে ব্র্যাডলাফ জানাল তার কোনো আপত্তি নেই এতে। কিছুদিনের মধ্যে সুযোগও মিলে গেল। গির্জায় নিয়মিত আসা ধার্মিক এক লোক মারা গেলেন। গির্জার পাতাল ঘরে রাখা হলো কফিনে ভরা মৃতদেহটা। তবে কফিনের ডালাটা খুলে দেওয়া হলো। নিভিয়ে দেওয়া হলো গির্জার সমস্ত বাতি। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে চলে গেল সবাই। গির্জায় জীবিত মানুষ বলতে থাকল কেবল ব্র্যাডলাফ।

বাইরে থেকে যখন দরজাটা লাগানো হলো গির্জার, তখনই অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তরুণটির মনে। এখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করল। মনের ভিতর জমতে শুরু করা ভয়, কুসংস্কার এগুলোকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে গির্জাটা ঘুরেফিরে দেখতে অগ্রসর হলো।

জানালা গলে উজ্জ্বল চাঁদের আলো ঢুকছে ভিতরে। তবে এতে করে নানান দিকে, বিশেষ করে গির্জার শেষ প্রান্তের সারবাঁধা বেদি আর বসার আসনগুলোর পাশে অদ্ভুত ছায়া তৈরি হয়েছে। হেঁটে-হেঁটে, কৌতূহলী দৃষ্টিতে সব কিছু দেখছে ব্র্যাডলাফ। কারণ অনেক দিন পর আবার একটা গির্জায় ঢুকেছে সে। তারপর পাতাল ঘরের দিকে এগোল সিঁড়ি ভেঙে। নীচে নেমে সাহস করে চলে এল একেবারে কফিনের ধারে। একদৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে রইল। আশা করছে ওটার সঙ্গে পরচিত হয়ে গেল মনের অস্বস্তিটা দূর হয়ে যাবে। তারপর আবার গির্জার মূল অংশে চলে এল। এখানে একটা সুবিধা মত জায়গা খুঁজে পেয়ে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই কেমন ঘুম-ঘুম আসতে লাগল। সন্দেহ নেই অল্প সময়ের মধ্যে ঘুমিয়েও যেত। কিন্তু এমন সময় পাতাল ঘর থেকে মৃদু একটা শব্দ কানে এল। কারও জোরে শ্বাস নেওয়ার আওয়াজের মত লাগল। তারপর আরও কিছু শব্দ হলো যার বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তার শুধু মনে হলো চাপা নিস্তব্ধতার মধ্যে এই মৃদু শব্দগুলোই ভয়ের শির শির অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে শরীরে। ওগুলোর অস্পষ্টতা আরও বেশি আতংকিত করে তুলল তাকে। এমন ভুতুড়ে আওয়াজ কে করছে ভেবে কূল-কিনারা পেল না। অন্ধকারে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, আবছাভাবে যদি কিছু ধরা দেয় চোখে। তারপরই প্রথমবারের মত পাতাল ঘরের সিঁড়িতে ক্ষীণ একটা পদশব্দের মত শুনল। শুরুতে ওটা মৃদুই থাকল, তবে ধীরে-ধীরে চড়ল। এখন পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। আর কোনো সন্দেহ নেই এটা পায়ের শব্দ। যেন কোনো মানুষ পাতাল ঘর থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে। কিন্ত পাতাল ঘরে আছে কেবল মড়াটা।

উঠে দাঁড়াল ব্র্যাডলাফ। মাথার পিছনের চুল খাড়া হয়ে গেছে। কাঁপুনি ধরে গেছে শরীরে। দরজার দিকে দু-কদম এগোল, কী আশা করছে নিজেও জানে না। তারপর যখন তাকাল চাঁদের আলোয় ওটাকে দেখল এগিয়ে আসতে। মড়াটা। যেটাকে পাতালে কফিনের মধ্যে দেখে এসেছে। আতংকে তখন উন্মাদ অবস্থা একদা সাহসী তরুণের। দৌড়ে গেল মড়াটার দিকে। ওটার গায়ে এখনও জড়ানো শবের সাদা কাপড়, তবে ছেড়াআলুথালু। একটা হাত তুললব্র্যাডলাফ। মড়াটাকে আবার মারতে নাকি ভয়াবহ জিনিসটাকে ঠেলা দিয়ে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে, কে জানে? কিন্তু এ সময়েই মড়ার হাত সচল হলো। চোয়ালে প্রচণ্ড এক আঘাতে ধরাশায়ী হলো ব্র্যাডলাফ।

এদিকে ভোরে যখন ব্র্যাডলাফের বন্ধুরা গির্জায় এল চমকে উঠল তারা। ব্র্যাডলাফ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আর মড়াটা ঝুঁকে ঠাণ্ডা পানির ছিটা দিচ্ছে তার মুখে। তবে এখন সে শবের সাদা পোশাক থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছে। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই রহস্য ভাঙল। সংক্ষেপে তাই, বলছি পাঠকদের।

মড়া ভেবে যাকে কফিনে পুরে গির্জার পাতালে এনে রাখা হয় সে আসলে মরেনি। বরং কোনো একটা ধাক্কায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। কিছুক্ষণের জন্য সম্ভবত শ্বাস-প্রশ্বাসও পাওয়া যায়নি। তাই সবাই ধরে নেয় লোকটা মারা গেছে। রাতে জ্ঞান ফিরে আসে তার। তারপর হেঁটে-হেঁটে গির্জার ওপরে ওঠা শুরু করে। ঠিক তখনই দোরগোড়ায় আতংকিত ব্র্যাডলাফের সঙ্গে দেখা হয়। রাতের বেলা গির্জায় একটা লোককে দেখে স্বভাবতই। দুস্কৃতিকারী ধরে নেয়। তাই দেরি না করে আঘাত হানে। শক্তিশালী একজন মানুষ সে, তারপর আবার মুষ্টিযোদ্ধা। আর তাই চোয়ালে ঘুষি খেয়ে ধরাশায়ী হয় ব্র্যাডলাফ। অবশ্য প্রাক্তন মড়া আর অন্যদের চেষ্টায় দ্রুতই জ্ঞান ফিরে আসে ব্র্যাডলাফের। তবে আর কখনও সাহসের বড়াই করেনি সে।

সান জুয়ানের আত্মারা

ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তির জন্য নাম আছে ফিলিপাইনের শহর সান জুয়ানের। শহরটির ইতিহাস বেশ পুরানো। গির্জাসহ বেশ কিছু পুরানো ইমারতের ধ্বংসস্তূপ পাবেন এখনও। এসব পুরানো ইমরাতগুলোর ধ্বংসস্তুপগুলোর মধ্যে প্রায়ই দেখা মেলে ভৌতিক আর রহস্যময় সব চরিত্রদের। অন্তত লোকে তাই বলে। এদের মধ্যে বেশ বিখ্যাত হলো মাথাহীন এক পাদ্রীর ভূত। রাতের বেলা শহরে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় সে। কখনও কাটা মাথাটা হাতে নিয়ে ইতস্তত ঘোরাফেরা করে, কখনও আবার তার মুণ্ডুহীন ধড়টাকে মাথা খুঁজতে দেখা যায়। আবার এই এলাকা দিয়ে রাতে যাওয়া কোনো কোনো লোক দাবী করেছেন পাদ্রীর মাথাটাকে চিৎকার করে ধড়ের খোঁজ করতে শুনেছেন তারা।

আবার এখানে আরেক ধরনের ভূতদের দেখা যায়, যারা পরিচিত পাস্তাসাত নামে। পাস্তাসাতের মানে করলে দাঁড়ায় যাকে ছুরি মারতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিপাইনে যেসব মানুষ মারা গিয়েছে তাদের ভূতেরা পরিচিত পাস্তাসাত নামে। এসময় কফিন ছিল খুব দুর্মূল্য। কাজেই মৃতদেহ খড়ের মাদুর দিয়ে মুড়িয়ে কবর দিতে বাধ্য হত লোকেরা। সাধারণত গোরস্থানের বদলে অন্য কোনো জায়গায় সমাহিত করা হত মৃতদের। কারণ ওই সময় প্রচণ্ড দারিদ্র্যের কারণে কবর চুরির হিড়িক পড়ে যায়। নির্জন রাস্তা কিংবা গলিতে চলার সময় নিঃসঙ্গ পথচারীদের সামনে হাজির হয়ে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার উপক্রম করে এরা। বলা হয় এই ভূতেদের কবল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ছুরি দিয়ে মাদুরটা কেটে একে মুক্ত করতে হবে। তবে মাদুর কাটার পর কোনো মৃতদেহের খোঁজ করলে হতাশ হতে হবে। মাদুর থেকে কেবল ভয়ঙ্কর একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসবে, যার সঙ্গে মিল আছে পচা মাংসের গন্ধের।

১৮৯৮ সালে, ফিলিপিনিয় বিপ্লবের শেষের দিকে, ভয়ঙ্কর এক অগ্নিকাণ্ডে গোটা সান জুয়ানের বেশিরভাগ ইমারত বিধ্বস্ত হয়। এরপর থেকেই এখানকার রাস্তা আর অলিগলিতে নানান ধরনের অশরীরী আর আত্মাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। অনেকে অস্বাভাবিক কোনো ছায়ামূর্তি কিংবা ভুতুড়ে কাঠামোর দেখা পাওয়ার দাবি করেন। কেউ আবার বলেন অদ্ভুতুড়ে সব শব্দ শোনার কথা। সন্দেহ নেই মানুষের অভিজ্ঞতা রং চড়ে আর এর সঙ্গে কিংবদন্তী মিশে দস্তুরমত এক ভুতুড়ে শহরে পরিণত হয় সান জুয়ান।

সান জুয়ানের প্রেতাত্মাদের মধ্যে বেশ বিখ্যাত হলো ডেভিল সিগার ম্যান। ঘটনার শুরু যুদ্ধের ঠিক আগে। এসময় শহরের তরুণেরা পরিত্যক্ত একটা ম্যানহোলের চারপাশে ভীড় করে ধূমপান করতে-করতে আড্ডায় মেতে উঠত। তারপরই এক মধ্যরাতে ঘটল ভয়ঙ্কর এক ঘটনা। এক আগন্তুক হাজির হলো তাদের সামনে। পরনে কালো আলখেল্লা, লম্বা চুল বিনুনি করে বাঁধা। খড়ের লম্বা কিনারাওলা একটা খড়ের টুপিতে ঢাকা মুখটা। তাদের কাছে সিগারেট ধরানোর আলো চাইল আগন্তুক। তরুণদের একজন যখন তার জ্বলন্ত সিগারেটটা দিল তাকে, নিজেরটা জ্বালবার জন্য মুখ উঁচু করল লোকটা। আর তখনই

আতংকে শিউরে উঠল উপস্থিত সবাই। লোকটার যেখানে মুখ। থাকার কথা সেখানে কেবলই একটা গর্ত। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই দেখা যেত তাকে। এমনকী এখনও রাতের বেলা সান জুয়ানের রাস্তায় একা-একা হাঁটতে বের হওয়া লোকেদের নাকি চমকে দেওয়ার অভ্যাস আছে ডেভিলম্যানের। তবে পুরানো দিনের স্থানীয় সিগারেটই তার পছন্দ। যদি তাকে আলো না দেন তবেই সর্বনাশ। বিপদ ঘনিয়ে আসবে আপনার ওপর। আবার লোকেরা গল্প করে ডেভিলম্যানের লম্বা কিনারাওলা টুপি নিয়েও। বলা হয় এ ধরনের কোনো টুপি পথের পাশে পড়ে থাকতে দেখলে কোনোভাবেই স্পর্শ করা যাবে না। আর এটা করলেই ডেভিলম্যানের দোসর বানিয়ে ফেলবেন নিজেকে। সেক্ষেত্রে নরকবাস নিশ্চিত।

সান জুয়ানের ভুতুড়ে সন্ন্যাসিনীও হাজির হয় মাঝে মাঝে। যতদূর জানা যায় জাপানিরা তার মঠ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আর অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে ধর্মভীরু এই কুমারী মহিলার মাথা কেটে নেয়। তারপর থেকেই দেখা দিতে শুরু করে সন্ন্যাসিনীর অতৃপ্ত আত্মা।

মঠের ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। দিনের বেলা এর পাশ দিয়ে যান কিংবা ঘুরে ফিরে দেখেন ইমারতগুলো, কোনো সমস্যা নেই। তবে রাত হলেই বিপদ, বিশেষ করে পূর্ণিমার রাত হলেই সেরেছে। মধ্যরাতে ভরা পূর্ণিমার সময় মন্দভাগ্য কোনো লোক মঠের ধ্বংসাবশেষকে পাশ কাটানোর সময় হঠাৎই হয়তো শুনবেন ভুতুড়ে একটা ঘণ্টার আওয়াজ। শব্দটা কোন্‌খান থেকে আসছে কেউ জানে না। তবে বুদ্ধিমান হলে এটা শোনার সঙ্গে-সঙ্গে ঝেড়ে দৌড় দেবেন। যদিও তাতেও শেষ রক্ষা হবে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না কেউ। কারণ ঘণ্টা বাজা মানে ধরে নিতে হবে সন্ন্যাসিনীর আত্মা কাছে-ধারেই কোথাও আছে। হয়তো লোকটার পিছনেই, চুপিসারে এগিয়ে আসছে আরও কাছে। মানুষের ধারণা তাকে যে মেরেছে তার কিংবা তার খুনির বংশধরের খোঁজ করে এখনও সে হন্যে হয়ে। সাধারণত পিছন থেকে এসে আচমকা বাম কাঁধে হাত রাখে ভুতুড়ে সন্ন্যাসিনী। পিছন থেকে তাকে এভাবে গায়ে হাত রাখতে দেখে ভয়ে হার্টফেল করে নাকি মারা গেছেন বেশ কয়েকজন মানুষ। বাকিরা হয়ে যায় বদ্ধ উন্মাদ।

হিসপানিয়দেরও আগের আমলের পুরানো একটা টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ আছে সান জুয়ানে। এই টাওয়ারে মাঝে-মাঝেই দেখা দেয় রহস্যময় এক সাদা পোশাকের নারী মূর্তি। সাধারণএকা হেঁটে-চলা পথচারীদেরই ভয় দেখায় নারীটি। স্তম্ভ ছাড়াও সান জুয়ানের আরও অনেক পুরনো স্থাপনাতেই ঘুরে-ফিরে হানা দেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। অনেক সময় গায়ে কাঁপন ধরানো শব্দে হেসে ওঠে সে। বলা হয় তার চোখের জায়গায় কিছুই নেই। কেউ-কেউ ভয়ঙ্কর হাসির শব্দ শুনেই আর মহিলাকে দেখার সাহস না দেখিয়ে জান বাজি রেখে পালিয়ে এসেছেন।

এদিকে গাড়িতে লিফট চাওয়া এক তরুণীর কাহিনিও বেশ প্রচলিত সান জুয়ানে। যতদূর জানা যায় তিন যুবক এক গোরস্থানের কাছ থেকে অপরূপা এক মেয়েকে গাড়িতে তুলে নেয়। তারপর তাকে একটা পার্টিতে নিয়ে যায় তারা। ফেরার পথে মেয়েটি জানায় তার খুব শীত করছে। তখন যুবকদের একজন তার জ্যাকেট ধার দেয় মেয়েটিকে। তারপরই গোরস্থানের কাছে অদৃশ্য হয় মেয়েটি। একটু খোঁজাখুঁজি করতেই জ্যাকেটটা পায় ছেলেরা। একটা সমাধিফলকের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে পরিপাটিভাবে। তারপরই তারা আবিষ্কার করে সমাধিটি মেয়েটি যে নাম বলেছে ওই নামের এক তরুণীর। কেউকেউ আবার দাবি করেছেন ওই সময় যুবকেরা একটা সদ্য খোঁড়া কবর খুঁজে পায়-যেখান একটা মৃতদেহ মাটি থেকে বের করে আংশিক খেয়ে গেছে কেউ। ধারণা করা হয় রাস্তা-ঘাটে গাড়িতে উঠতে চাওয়া এই নারীটি পিশাচীর মত কোনো প্রাণী, যার সত্যিকারের অস্তিত্ব আছে। এমনিতে পিশাচ হলো ফিলিপাইনের লোককাহিনির এক দানব, যে কিনা কবর খুঁড়ে মড়ার মাংস খায়।

অবশ্য কখনও আবার নারীর বদলে এক পুরুষকে দেখা যায় লিফট চাইতে। গন্তব্যে পৌঁছার পর লোকটা অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন তার দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে দেখা যায় একসময় এখানে ঠিকই থাকত সে, আর আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। সাধারণত যখন হাজির হয় দেখে মনে হয় কোনো দুর্ঘটনা থেকে কোনো মতে বেঁচে ফিরেছে সে, কাপড়-চোপড়ে লেগে থাকে রক্তের দাগ।

রেলের ভূত

আয়ারল্যাণ্ডের স্ট্রাবান ক্রনিকলস পত্রিকায় ছাপ হয় এই কাহিনিটি। এতে স্ট্যাবান রেলওয়ের একটা এঞ্জিন কারখানায় কাজ করার সময় কয়েকজন শ্রমিকের ভীতিকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরের পর পর দু-রাতে রহস্যময় ঘটনাগুলো ঘটে। পত্রিকাটির সাংবাদিক, জোসেফ ক্রিসান শ্রমিকদের একজন পিংকারটনের সাক্ষাৎকার নেন। আমরা এটা শুনব পিংকারটনের জবানীতেই।

মাইকেল মেডেন, ফ্রেড অলিফ্যান্ট আর আমি একটা ছাউনির ভিতর এঞ্জিন ধুচ্ছিলাম। রাত সাড়ে বারোটার দিকে ছাউনির সবগুলো দরজাতে কে বা কারা যেন ধাক্কাতে শুরু করল। সেই সঙ্গে শুরু হলো টানা একটা অপার্থিব চিৎকার। আমরা তিনজন একটা দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যেটা দেখেছি সেটা মানুষের চেহারারই, তবে গায়ে গতরে অনেক বিশাল। মনে হলো মূৰ্ছা যাব। মাথার সবগুলো চুল দাড়িয়ে গেছে আমার। সাহায্যের জন্য পাগলের মত চিৎকার শুরু করলাম তিনজনে। এসময়ই প্রহরী আৱ সিগন্যাল ম্যান দ্রুত এগিয়ে এল আমাদের সাহায্য করার জন্য। হাতের ক্রোবারটা (বাঁকানো লোহার ডাণ্ডার মত জিনিস) নিয়ে ভয়ঙ্কর জিনিসটার দিকে দৌড়ে গেল সিগন্যাল ম্যান। কিন্তু আঘাতটা যেন ওটার শরীর কেটে বেরিয়ে গেল। রাত আড়াইটা পর্যন্ত ছাউনির চৌহদ্দিতে শূন্যে ঝুলে রইল আত্মাটা চাঁদের আলোয় ওটাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা। পরে ওটা অদৃশ্য হলে একটা এঞ্জিনের ছাদে উঠে সেখানে লুকিয়ে রইলাম তিনজন, ভোর না হওয়া পর্যন্ত।

পরের রাতেও ওটা এল, এবার দেড়টার দিকে। অলিফ্যান্ট আত্মাটার দিকে এগোল। কিন্তু দুই গজের মধ্যে গিয়ে মাটিতে পড়ল ধড়াম করে। ভয়ঙ্কর শব্দে চেঁচিয়ে উঠল ওটা। কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার মুখের দিকে এভাবে তাকাল রক্ত পানি হয়ে গেল। এবার ওটাকে দেখলাম মোটমাট সাত জন। ছাউনির মধ্যে আমাদের পোশাকসহ যা কিছু ছিল সব ছুঁড়ে মারল দানবটা।

এঞ্জিনের কাজ করা অন্য শ্রমিকদেরও সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তাদের কথার সঙ্গে পিংকারটনের কথার কোনো পার্থক্য পাওয়া যায়নি। এদের একজন বলল পানির একটা ট্যাংকের দিকে-যাওয়া মই বেয়ে ওটাকে বার-বার ওঠানামা করতে দেখেছে সে। এক পর্যায়ে ওই ট্যাঙ্কের ভিতরে অদৃশ্য হয় জিনিসটা। এদিকে সিগন্যাল ম্যান জানাল কীভাবে সে ক্রোবার দিয়ে আত্মাটাকে আঘাত করে আর মনে হয় জিনিসটা ওটার শরীরের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। শেষমেশ একটা জানালা দিয়ে চলে যায় আত্মাটা।

পুরো ঘটনাটা শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এতগুলো মানুষের একসঙ্গে মতিভ্রম হওয়ার কোনো কারণ নেই। সবাই মিথ্যা বলেছে এটাও ভাবা যায় না। তবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বছর কয়েক আগে এই ছাউনির ধারে একটা লোক খুন হয়। এই ঘটনার সঙ্গে রাতের এই দানবটার আগমনের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি কখনওই।শেষ বাস (প্রথম পর্ব)

সিংগাপুরের চাঙ্গির দিকে যাওয়া শেষ বাস এটি। তানাহ মেরাহর দিকে রাস্তাটা বিপজ্জনক সব বাঁকে ভরা। তবে গাড়ির চালক খুব ওস্তাদ লোক। বেশ দ্রুতগতিতে একটার পর একটা বাঁক পেরিয়ে যাচ্ছে। তারপরই হঠাৎ বাস দাঁড় করাতে হলো তাকে। কারণ, তার নজরে পড়েছে রাস্তায় দাঁড়ানো সাদা জিন্স পরা একটা মেয়ে গাড়ি থামানোর ইশারা করছে। গাড়ির মাঝখানে দাঁড়ানো কণ্ডাক্টর আর একটু হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ত মেঝেতে।

বাসে উঠে পড়ল মেয়েটি। চালক আর কণ্ডাক্টর কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল এই রাতে একা একা কী করছে সে। কিন্তু মেয়েটা কেবল ভাড়া দিল, কোনো জবাব না। কণ্ডাক্টর তাকে একটা টিকেট ধরিয়ে দিল। তারপর তার প্রতি মনোযোগ হারাল। কারণ পুরো দিনের হিসাব-কিতাব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে।

এদিকে মনের সুখে গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে চলেছে চালক।

বাস যখন শেষ স্টেশনের কাছাকাছি চলে এল তখন কণ্ডাক্টরের মনে হলো মেয়েটা এখনও গাড়ি থেকে নামেনি। উঠেই বাসের পিছনের দিকে চলে গিয়েছিল সে। মেয়েটা কোথায় নামতে চায় জানার জন্য পিছন দিকে ঘুরল সে।

কিন্তু বাসের পিছনে কেউ নেই।

ভয় পেয়ে গেল সে। দৌড়ে গিয়ে চালককে জানাল কী ঘটেছে। অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে পিছনে তাকাল চালক। কিন্তু কণ্ডাক্টরের মতই সেখানে কাউকে দেখতে পেল না সে-ও।

বাসটা যখন দাঁড় করাল চালক, তখন কণ্ডাক্টর মেয়েটার দেওয়া কয়েনগুলো বের করার জন্য মানিব্যাগে হাত পুরল। কিন্তু মানিব্যাগের মধ্যে তার হাতে অদ্ভুত কিছু একটা ঠেকল। আর যখন বের করল, আঁতকে উঠে সঙ্গে-সঙ্গে ফেলে দিল। কী হয়েছে দেখার জন্য ঘুরল চালক। কণ্ডাক্টরের চোখ যেন গাড়ির মেঝেতে আটকে আছে। তবে তার আসন থেকে কিছু নজরে এল না চালকের।

ওটা কী? জানতে চাইল সে।

যখন কথা বলার অবস্থায় পৌঁছল কণ্ডাক্টর, সে বলল, একটা হাড়। সে বাসের ভাড়া মিটিয়েছে আঙুলের একটা হাড় দিয়ে।

শেষ বাস (দ্বিতীয় পর্ব)

সিংগাপুরের দুই বন্ধু শেষ বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। তবে মনে-মনে তাদের আশংকা ছিল ওটা চলে গেছে আগেই। কারণ এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে তাদের। যে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছে এর সামনের রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি যাচ্ছে না। আশপাশে কোনো ফোনও নেই। ( কাহিনিটি যখনকার তখনও মোবাইল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি)। বেশ চিন্তায় পড়ে গেল দুজনে। তারা এখন কী করবে?

তারপরেই দেখল একটা বাস ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে এদিকে। ওহ! শেষ বাস। যাক তাহলে ওটা চলে যায়নি, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দুই বন্ধু।

কাহিনিটা অনেক দিন আগের। তখন বাসের মাঝখানে একটা দরজা থাকত কেবল। বাসটা থামতেই হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়ল দুই তরুণ।

তারপর আবার চলতে শুরু করল বাসটা। কয়েক মিনিট পরে দুই বন্ধু বুঝতে পারল কোথাও বড় ধরনের একটা গোলমাল আছে।

প্রথম কথা, বাসটা চলছে খুব ধীরে। দ্বিতীয় কথা, ভাড়া নেওয়ার জন্য কোনো কণ্ডাক্টর নেই বাসে। তারপরই আবিষ্কার করল বাসে কোনো চালকই নেই।

আতংকে খাড়া হয়ে গেল দুজনের চুল। হৃৎপিণ্ড যেন গলার কাছে উঠে এসেছে। দুজন দুজনের দিকে তাকাল অবাক বিস্ময়ে, আতংকে চেঁচিয়ে উঠল।

তারপরই বাসটা থেমে গেল।

গাড়ির চালক আর কণ্ডাক্টর পিছন থেকে এসে হাজির হলো। তারা দুজনে নষ্ট বাসটাকে ঠেলছিল। এখন দেখতে এসেছে কী কাণ্ড ঘটেছে।

Exit mobile version