‘আমি জিনদের সাহায্য নিতে চাইনি। কিন্তু রেহানাকে বাঁচানোর জন্য আমি খান্নাসের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়েছি। এই সুযোগে সে নিজের মুক্তির ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এখন আমার আগের সেই মানসিক দৃঢ়তা নেই যে, খান্নাসকে কথা শুনতে বাধ্য করব। তা ছাড়া, আমি এখন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখে ভুগছি। প্রায়ই আমার হাত এবং গলা কাঁপতে থাকে। দোয়া-দরূদও ভুলে যাই অনেক সময়। তাই আমি যদি খান্নাসকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই, তা হলে আমাকে ও মেরে ফেলবে।’
‘আচ্ছা, আমি কি খান্নাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব?’
‘আপনি!’
‘হ্যাঁ। আমি চেষ্টা করতে চাই।’
‘এটা অনেক বড় ঝুঁকির কাজ। খান্নাসকে ডেকে এনে আপনি যদি ওকে নিজের আয়ত্তে না আনতে পারেন, তা হলে কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য। আর ভাল মানুষ ছাড়া কেউ এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’
‘আমি তবু ঝুঁকিটা নিতে চাই। আর মানুষ হিসাবে আমি একদম খারাপ নই।’
‘আপনাকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অসহায় একটা মেয়েকে সাহায্য করতে চাইছেন বলে, না বলতে পারছি না। আচ্ছা, আপনি শুদ্ধভাবে কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করতে পারেন?’
‘ছোটবেলায় খুব ভালভাবে পারতাম। এখন অনেক নিয়ম-কানুন ভুলে গেছি।’
‘ও, আচ্ছা। একটু বিরতি দিয়ে লোকমান ফকির আবার বললেন, ‘খান্নাসকে ডেকে আনার জন্য আপনি রেহানাদের বর্তমান বাসায় যাবেন। সেই বাসার নির্জন কোনও জায়গা বেছে নেবেন। বাসার ছাদ হলে সবচেয়ে ভাল হয়।’
‘ঘটনাচক্রে আমি এখন রেহানাদের বাসায়ই আছি।’
‘তা হলে তো ভালই। রেহানাদের বাসার নির্জন জায়গায় পাক পবিত্র হয়ে বসে আপনি সূরা জিন পড়া শুরু করবেন। সূরাটা পুরোপুরি মাখরাজ অনুসরণ করে পড়তে হবে। আপনাকে আমি গুন্নাহ, টান সহ কোরআন মাজিদ পড়ার নিয়ম-কানুনগুলো আবার মনে করিয়ে দেব।’
‘জী, অবশ্যই।’
‘সূরা পাঠ ঠিকভাবে করতে পারলে খান্নাস আপনার আশপাশে চলে আসবে কোনও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। আপনার একটা জিনিস সবসময় মনে রাখতে হবে, কোনও পরিস্থিতিতেই আপনার ভয় পাওয়া চলবে না। ভয় পেলেই খান্নাস আপনার উপর প্রভাব বিস্তার করবে। আপনাকে মেরে ফেলবে কিংবা আপনার বড় কোনও ক্ষতি করবে। আপনার অবশ্য একটা সুবিধা আছে।’
‘কী সুবিধা?’
‘খান্নাস আসলে অন্ধ।’
‘অন্ধ!’
‘হ্যাঁ। তবে জিনদের গন্ধশক্তি দৃষ্টিশক্তির চেয়েও তীক্ষ্ণ। তাই আপনি ওর সাথে একটা চাতুরি করতে পারেন।’
‘কী চাতুরি?’
‘আমি একটা আতর তৈরি করেছি। একমাত্র আমিই এই আতরটা ব্যবহার করি। গন্ধটা একদম অন্যরকম। এবং এই গন্ধটা খারাপ জিনদের পছন্দ নয়। খান্নাস যখন আমার অধীনে ছিল, তখন সে বলত, এই আতরের গন্ধ শুঁকে সে আমাকে চিনতে পারে। তাই আমি ভাবছি আপনাকে এই আতরটা দেব। আপনি আতরটা মেখে ডেকে আনবেন খান্নাসকে। গন্ধ শুঁকে খান্নাস ভাববে, ওর সামনে বসে আছে লোকমান ফকির। ও আমাকে ভয় পায়। তাই ওকে কথা শোনানো অনেক সহজ হবে। কিন্তু যদি একবার বুঝতে পারে, ওকে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে, তবে কিন্তু আরও বাড়বে আপনার বিপদ। আপনি ভয় পেতে শুরু করলেই খান্নাস সত্যটা বুঝে ফেলবে। আবারও বলছি, খান্নাসকে নিয়ন্ত্রণের একটাই উপায়: কোনও অবস্থাতেই ভয় পাওয়া চলবে না।’
‘আমার মধ্যে ভয় জিনিসটা একেবারে কম। জীবনে অনেকবার জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়াতে হয়েছে। তাই আমার মনে হয়, আমি পারব।’
‘খান্নাসকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আরও বেশ কিছু নিয়ম-কানুন মানতে হবে আপনাকে। আজ থেকে নামাজ ঠিকমত পড়বেন, সবসময় পবিত্রতা বজায় রাখবেন। মুখে গন্ধ হয় এমন কিছু খাবেন না। আপনাকে আরও বেশ কিছু দোয়া- দরূদ শিখতে হবে। সূরা জিন সঠিকভাবে তেলাওয়াত শিখতে হবে। তাই আমার মনে হয়, কালকের দিনটা আপনি আমার সাথে থাকলে ভাল হবে।’
‘জী, অবশ্যই।’
‘এখানে আপনার খাবার কষ্ট হবে। আমি দরিদ্র মানুষ। মূলত একবেলা ভাত খাই। আর একবেলা গুড়-মুড়ি। মেহমানকে সেবা করার বিশেষ সামর্থ্য আমার নেই।’
‘আমার কোনও সমস্যা হবে না।’
‘চলুন, এশার নামাজ পড়তে হবে। এরপর ভাত রান্না করব। রাতের খাওয়া শেষে আপনাকে কিছু দোয়া শেখাব। আজ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজও পড়তে হবে।’
আনোয়ার মাথা নাড়ল। কেমন যেন ক্লান্তি লাগছে, বমি আসছে।
লোকমান ফকির বলল, ‘আমাকে সবসময় একা থাকতে হয়। সবাই আমাকে ভয় পায়। সবাই ভাবে, আমার বাড়ি হয়তো জিন-ভূতে পূর্ণ। আপনাকে পেয়ে মনে আনন্দ হচ্ছে।’ লোকমান ফকির হাত ধরে আনোয়ারকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, কোনও মানুষকে স্পর্শ করলে বুঝতে পারি, মানুষটা ভাল না মন্দ।’
আনোয়ার হেসে বলল, ‘আমাকে স্পর্শ করে কী মনে হচ্ছে?’
‘আপনি মানুষ হিসাবে অনেক ভাল। আপনার মনে কলুষতা নেই বললেই চলে। তবে আপনি ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে বেশ উদাসীন।’
একজন পবিত্র মানুষ যখন এভাবে প্রশংসা করেন, সত্যিই আরও ভাল হতে ইচ্ছা করে। লোকমান ফকির হাসলেন। আনোয়ারের মনে হলো, তাঁর হাসিটাও পবিত্র।
সাত
লোকমান ফকিরের কাছে একদিন নয়, দু’দিন নয়, তিন দিন থাকল আনোয়ার। তিনি আনোয়ারকে ধ্যান করা, শরীর পবিত্র রাখার বিভিন্ন বিষয় শিখিয়ে দিলেন সূরা জিন সহ প্রয়োজনীয় দোয়া-দরূদও সঠিকভাবে পড়ার নিয়ম-কানুন শিখে নিল আনোয়ার। ওর আরবি উচ্চারণ শুনে খুশি হলেন লোকমান ফকির। বললেন, ‘আপনার কোরআন তেলাওয়াত খুব চমৎকার লেগেছে। আল্লাহ্ আপনার মঙ্গল করুন।’