Site icon BnBoi.Com

সুহানের স্বপ্ন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সুহানের স্বপ্ন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 ০১. দ্রুমান ইঞ্জিন

রিশি মনিটরে একটা গ্রহকে স্পষ্ট করতে করতে বলল, আমি আমার জীবনে যতগুলো গ্রহ দেখেছি তার মাঝে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে এই গ্রহটা।

টিরিনা তার অবাধ্য চুলগুলোকে পিছনে সরিয়ে বলল, কেন? তুমি হঠাৎ এই গ্রহটার বিপক্ষে প্রচার শুরু করছ কেন? একটা গ্রহ হচ্ছে গ্রহ-তার মাঝে আবার ভালো খারাপ আছে নাকি?

থাকবে না কেন? একশবার থাকবে।

টিরিনা মুখ টিপে হেসে বলল, কী রকম?

মনে কর যে গ্রহে খোলা আকাশ, নিশ্বাস নেবার মতো বাতাস আর পানিতে ঢাকা বিশাল বিশাল সাগর বা হ্রদ আছে সেটা হচ্ছে ভালো গ্রহ। যে গ্রহে সেগুলো নেই সেটা হচ্ছে খারাপ গ্রহ।

টিরিনা খিলখিল করে হেসে বলল, তার মানে তুমি আসলে পৃথিবীকে ধরে নিয়েছ আদর্শ গ্রহ—যে গ্রহ যত বেশি পৃথিবীর কাছাকাছি সেই গ্রহ তোমার কাছে তত ভালো।

রিশিকে এক মুহূর্তের জন্য একটু বিভ্রান্ত দেখায়, সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সেটা কি খুব অযৌক্তিক ব্যাপার হল? এখন না হয় আমরা সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছি—কিন্তু একসময় তো আমরা সবাই পৃথিবীতেই থাকতাম। আমাদের শরীরের বিবর্তন হয়েছে পৃথিবীর পরিবেশের উপযোগী হয়ে কাজেই পৃথিবীর মতো গ্রহকে ভালো বললে তোমার এত আপত্তি কেন?

টিরিনা হাসল। বলল, মোটেও আপত্তি নেই। আমি শুধু বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছি।

রিশি টিরিনার মুখে সূক্ষ্ম হাসি আবিষ্কার করে মুখটা অকারণে কঠোর করে বলল, উহুঁ, তুমি বোঝার চেষ্টা করছ না।

তা হলে আমি কী করছি?

তুমি আমার সাথে কৌতুক করার চেষ্টা করছ।

টিরিনা আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল, ঠিক আছে সেটাই না হয় হল—এটাও কি খুব বড় অপরাধ? আমরা দুইজন একটা মহাকাশযানে করে প্রায় আস্ত একটা গ্যালাক্সি পার হয়ে যাচ্ছি। বেশিরভাগ সময় কাটে আমাদের হিমঘরে। লিকুইড হিলিয়াম তাপমাত্রায় জমে পাথর হয়ে থাকি। দশ-বারো বছরে এক-আধবার আমাদের জাগিয়ে তোলা হয়। কিছুদিন আমরা জেগে থাকি তখন তোমার সাথে আমি কৌতুকও করতে পার না?

রিশি বলল, না সেটা আমি বলি নি। কৌতুক করতে পারবে না কেন, অবশ্যই পারবে। মানুষের যদি কৌতুকবোধ না থাকত তা হলে তারা মনে হয় এখনো বিবর্তনের উল্টো রাস্তায় গিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত।

টিরিনা চোখ বড় বড় করে রিশির দিকে তাকিয়ে বলল, তা হলে তোমার ধারণা বিবর্তনে আমরা ঠিক দিকেই এগুচ্ছি?

রিশি বলল, কেন? তোমার কি সন্দেহ আছে নাকি?

কী জানি? টিরিনা কাধ কঁকিয়ে বলল, এই আমাদের ছোটাছুটি দেখে মনে হয় বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালেই বুঝি ভালো ছিল। তুমি দেখেছ আমরা এখন এক মুহূর্ত বিশ্রাম নিই না। দিশ-বারো বছরে একবার আমাদের হিমঘর থেকে বের করে, আমরা তখন ছোটাছুটি করতে থাকি। ইঞ্জিন পরীক্ষা করি, জ্বালানি পরীক্ষা করি, ট্রাজেক্টরি পরীক্ষা করি, মনিটরের আসনে বসে থাকি—তোমার কি ধারণা এটা খুব চমৎকার একটা জীবন?

রিশি একটু অবাক হয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে টিরিনা? আমি ভেবেছিলাম তুমি খুব আগ্রহ নিয়ে এই স্পেসশিপে এসেছিলে! হঠাৎ করে খেপে গেলে কেন?

টিরিনা হাসল। বলল, না খেপি নি। এগুলোও বিবর্তনের ফল, মেয়েদের শরীরে অন্যরকম হরমোন থাকে—তোমরা ছেলেরা সেটা বুঝবে না। ছেলেরা এসব বিষয়ে একটু ভোতা হয়

এবারে রিশি হা হা করে হেসে উঠল, বলল, তোমার কপাল ভালো মহাকাশযানে শুধু আমি আর তুমি! অন্য কেউ হলে পুরুষ জাতির বিরুদ্ধে অশোভন উক্তি করার জন্য তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করে দিত, পঞ্চম মাত্রার অপরাধ হিসেবে তোমার এতক্ষণে বিচার হয়ে যেত।

ভারি তোমার বিচার—তোমার এই বিচারকে আমি ভয় পাই নাকি? বড়জোর এক বেলা কফি খেতে দেবে না।

শাস্তি হচ্ছে শাস্তি। কী পরিমাণ শাস্তি পেয়েছ সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। শাস্তি পেয়েছ কি না সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

মহাকাশযানের এই লম্বা যাত্রাগুলোতে যারা কোনো শাস্তি পায় না, উল্টো তাঁদেরই শাস্তি হওয়া দরকার বুঝতে হবে তাদের ভেতরে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই। আনন্দ স্ফূর্তি নেই।

ভালোই বলেছ। বলে হাসতে হাসতে রিশি আবার মনিটরের দিকে তাকাল এবং তার মুখের হাসি মিলিয়ে সেখানে এবারে একটা বিতৃষ্ণার ভাব ফুটে ওঠে। সে মাথা নেড়ে বলল, ছি! এটা একটা গ্রহ হল নাকি?

টিরিনা একটু এগিয়ে যায় গ্রহটা দেখার জন্য, মনিটরে কদাকার গ্রহটিকে একনজর দেখে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, এটা ভালো গ্রহ না। বিচ্ছিরি একটা গ্রহ।

এর মাঝে বাতাস আছে কিন্তু সেই বাতাস হালকাভাবে বিষাক্ত। এই গ্রহ শীতল নয় কিন্তু তাপমাত্রা এমন যে তুমি কখনোই অভ্যস্ত হবে না। আলো আছে কিন্তু ঠিক ভুল তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের, সবকিছুকে দেখাবে লালচে পচা ঘায়ের মতো।

টিরিনা গ্রহটাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে দেখতে বলল, গ্রহটার কোনো নাম আছে নাকি?

না। এই পচা গ্রহকে কেউ নাম দিয়ে সময় নষ্ট করবে ভেবেছ? এর কোনো নাম নেই—এটার কপালে জুটেছে শুধু একটা সংখ্যা, সাত সাত তিন দুই নয়।

টিরিনা তথ্যকেন্দ্রের মডিউলটি টেনে নামাতে নামাতে বলল, দেখি আমাদের তথ্যকেন্দ্রে এর সম্পর্কে কোনো তথ্য আছে নাকি।

মডিউলের সাথে যোগাযোগ করার এক মুহূর্ত পরেই টিরিনা চিৎকার করে বলল, কী আশ্চর্য!

রিশি এগিয়ে আসে, কী হয়েছে?

টিরিনা উত্তেজিত গলায় বলল, তুমি এটা বিশ্বাস করবে না, কিছুতেই বিশ্বাস করবে।

কী বিশ্বাস করব না?

তোমার এই ভয়ংকর পচা গ্ৰহটাতে কোনো একজন মানুষ আটকা পড়ে আছে। সে বিপদ সংকেত পাঠাচ্ছে!

রিশি চোখ কপালে তুলে বলল, কী বলছ তুমি?

আমি ঠিকই বলছি, এই দেখ। টিরিনা তথ্যকেন্দ্রের মডিউলটি রিশির সামনে খুলে দিল। সত্যি সত্যি সেখানে দেখা যাচ্ছে এই গ্রহটি থেকে কোনো একজন মানুষ চতুর্থ মাত্রার একটা বিপদ সংকেত পাঠাচ্ছে। বিপদ সংকেতটি কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে আসছে না। তার মাঝে বিপদ সংকেতের বিভিন্ন পর্যায়ের কোড রয়েছে, সেটি নিখুঁতভাবে নিরাপত্তাসূচক সংকেত ব্যবহার করছে। বিপদ সংকেতটি খুব দুর্বল। যে পাঠাচ্ছে সে তার শক্তিটুকু অপচয় করছে না, যে পরিমাণ সংকেত না পাঠালেই নয় তার বেশি কিছু পাঠাচ্ছে না।

রিশি আর টিরিনা বিপদ সংকেতটি বিশ্লেষণ করল, যে এখালে আটকা পড়ে আছে তার ভয়াবহ সংকট। খাবার এবং পানীয় শেষ হয়ে গেছে, কোনোরকম জ্বালানি নেই, সঞ্চিত শক্তিও শেষ হয়ে যাচ্ছে। টিরিনা কিছুক্ষণ তথ্যকেন্দ্রের মডিউলটির দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, একটা জিনিসের হিসাব মিলছে না।

কী জিনিস?

এই গ্রহে কোনো মানুষের বেঁচে থাকার কথা নয়।

পরিষ্কার সিগন্যাল পাঠাচ্ছে—

সিগন্যাল পাঠানোর কথা নয়।

কেন?

এই গ্রহ থেকে প্রাকৃতিকভাবে কোনো শক্তি আসবে না যতখানি শক্তি নিয়ে শুরু করবে সেটাই সম্বল।

হ্যাঁ। রিশি মাথা নাড়ল, বলল, প্রায় কুড়ি বছর আগে প্রথম দলটা গিয়েছে। তাদের সাথে যে সাপ্লাই ছিল সেটা খুব বেশি হলে চার বছরের। চার বছরের আগেই ঠিক করা হল গ্রহটা ছেড়ে চলে আসা হবে–।

টিরিনা উত্তেজিত গলায় বলল, এই এখানেই হিসেব মিলছে না—যতবার তাদেরকে উদ্ধার করতে পাঠানো হয়েছে ততবারই অভিযাত্রী দল রয়ে গিয়েছে—ফিরে আসে নি। কিন্তু যে পরিমাণ রসদ জাছে সেটা দিয়ে কিছুতেই তাদের চলার কথা নয়।

রিশি মাথা নাড়ল, কিন্তু চলছে। এই দেখ একজন হলেও সে কোনোভাবে বেঁচে আছে। সে পাগলের মতো বিপদ সংকেত পাঠিয়ে যাচ্ছে।

তার মানে কিছু বুঝতে পারছ?

রিশি বলল, না। তুমি বুঝতে পারছ?

হ্যাঁ।

কী?

আমাদের এই গ্রহে গিয়ে এই উন্মাদ মানুষটাকে উদ্ধার করতে হবে।

রিশি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কেমন করে জান মানুষটা উন্মাদ?

এরকম জঘন্য একটা গ্রহে কোনোরকম খাবার পানীয় ছাড়া একা একা কুড়ি বছর থাকতে হলে যে কোনো মানুষ পাগল হয়ে যাবে।

রিশি বলল, ঠিকই বলেছ। আমি হলে আত্মহত্যা করে ঝামেলা চুকিয়ে দিতাম।

এই মানুষ করে নি, সেই জন্যই বলছি মানুষটা নিশ্চয়ই উন্মাদ। এই গ্ৰহটাকে মোটামুটিভাবে ভালবেসে ফেলেছে।

যে মানুষটা আছে তার পরিচয়টা কী? বের করা যাবে?

উহুঁ। এখন পর্যন্ত অনেকে গিয়েছে, যে কেউ হতে পারে।

রিশি বলল, যাবার আগে মানুষগুলো সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিয়ে যেতে হবে।

হ্যাঁ। আমি তথ্যকেন্দ্র থেকে বের করছি।

আমি তা হলে স্কাউটশিপটা রেডি করি। রিশি কন্ট্রোল রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বলল, একটু আগে তুমি অভিযোগ করেছিলে শুধু হিমঘরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় কাটাতে হয়, জীবনে কোনো উত্তেজনা নেই! এখন কী মনে হচ্ছে জীবনে উত্তেজনা এসেছে?

টিরিনা হাসল। বলল, হ্যাঁ খানিকটা উত্তেজনা এসেছে। মানুষটা একটু খ্যাপা টাইপের মতো হলে উত্তেজনাটুকু আরেকটু বাড়বে।

 

দূর থেকে গ্রহটাকে যত কদাকার মনে হচ্ছিল কাছে এসে সেটা তার চাইতে অনেক বেশি কদাকার মনে হল। রিশি ঠিকই বলেছিল এই গ্রহের প্রাকৃতিক আলোটা লালচে, পুরো গ্রহটাকে কেমন যেন পচা ঘায়ের মতো মনে হয়। স্কাউটশিপ দিয়ে গ্রহটার ভেতরে নামতে নামতে টিরিনা এক ধরনের বিতুল্লা নিয়ে গ্রহটার দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো একজন মানুষ যদি একা একা এখানে কুড়ি বছর কাটিয়ে দেয় তার নিশ্চিতভাবেই পাগল হয়ে যাবার কথা।

বিপদ সংকেতের সিগন্যালটি খুঁজে বের করে কিছুক্ষণেই তারা একটা বিধ্বস্ত আবাসস্থল খুঁজে বের করে ফেলল। স্কাউটশিপ দিয়ে আবাসস্থলের উপরে দুপাক ঘুরে তারা কাছাকাছি নেমে আসে। বৈরী গ্রহটায় টিকে থাকার উপযোগী মহাকাশচারীর পোশাক পরতে পরতে টিরিনা বলল, রিশি, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা নিতে ভুলো না।

কেন?

যে মানুষটা আছে সে কেমন মানুষ আমরা জানি না। যদি বাড়াবাড়ি খ্যাপা ধরনের হয় তা হলে একটু সাবধান থাকা ভালো।

হুঁ। রিশি মাথা নেড়ে বলল, এটাই এখন বাকি আছে একটা মানুষকে উদ্ধার করতে এসে আমরা তাকে খুন করে যাই।

আমি বলি নি তাকে খুন করে যাও। বলেছি একটু সাবধান থাক।

রিশি হাসল। বলল, আমি জানি টিরিনা। তোমার সাথে ঠাট্টা করছি। একটু পরে যখন এই মানুষটার সাথে দেখা হবে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তখন কোনো ঠাট্টা-তামাশা করা যাবে না!

মহাকাশচারীর প্রায় আধা কিম্ভূতকিমাকার পোশাক পরে দুজনে পা টেনে টেনে প্রায় বিধ্বস্ত আবাসস্থলের কাছে হাজির হল। পুরোটা প্রায় ধসে আছে—সত্যিকার অর্থে কোনো দরজা নেই। কিছু ইট-পাথর সরিয়ে একটা সুড়ঙ্গ মতন করে রাখা আছে—এটাকেই মনে। হয় দরজা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রিশি গিয়ে সেই দরজায় ধাক্কা দিল, একটু পেছনে। টিরিনা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে রইল। বার কয়েক শব্দ করার পর ঘড়ঘড় করে শব্দ করে একটা গোলাকার দরজা খুলে যায়। রিশি সতর্কভাবে ভেতরে ঢুকল, পেছনে পেছনে টিরিনা। ভেতরে আবছা অন্ধকার, চারপাশে একটা মলিন বিবর্ণ ভাব, দেখেই কেমন যেন অসুস্থ-অশুভ বলে মনে হয়। ঘড়ঘড় শব্দ করে আবার দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়, তারা শুনতে পারল একটা দুর্বল পাম্প ভেতরের বিষাক্ত বাতাস সরিয়ে নিশ্বাস নেবার উপযোগী বাতাস দিয়ে ভরে দিচ্ছে। সহজ কাজটুকু করতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল, যে মানুষটি এখানে থাকে সে তার সঞ্চিত শক্তি বাচিয়ে রাখার জন্য কোথাও এতটুকু বাজে খরছ করতে রাজি নয়।

একসময় ভেতরে বাতাসের চাপ গ্রহণযোগ্য হয়ে এল এবং তখন ঘড়ঘড় শব্দ করে ভেতরের দরজা খুলে গেল। রিশি এবং টিৰিনা হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি ধরে রাখে। দরজার অনাপাশে উসকোখুসকো চুলের মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটিও দুই হাতে একটি টাইটেনিয়ামের রড ধরে রেখেছে, তার চোখ দুটো অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো জ্বলজ্বল করছে। রিশি একটু ইতস্তুত করে বলল, আমরা তোমার বিপদ সংকেত পেয়ে তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি।

মানুষটা হাতের টাইটেনিয়ামের রডটি ধরে রেখে সতর্ক গলায় বলল, এল। ভেতরে এস। মানুষটির গলার স্বর শুষ্ক এবং কঠিন।

রিশি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আমার নাম রিশি। আর আমার সাথে আছে টিরিনা।

মানুষটি বলল, আমার নাম মান। তোমাকে অভিবাদন ধ্রুমান।

তোমাদেরকেও অভিবাদন। আমাকে উদ্ধার করতে আসার জন্য তোমাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা।

রিশি একটু অবাক হয়ে দেখল, মানুষটি মুখে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে কিন্তু হাতে শক্ত করে টাইটেনিয়ামের বন্ডটি ধরে রেখেছে। মানুষটি বলল, তোমরা ইচ্ছে করলে এই পোশাক খুলে ফেলতে পার। আমার এই ঘর দেখে খুব বিবর্ণ মনে হলেও এটি পুরোপুরি নিরাপদ।

রিশি এবং টিরিনাও সেটা লক্ষ করেছে। মহাকাশচারীর পোশাকের নিরাপত্তাসূচক আলোটি অনেকক্ষণ থেকেই সবুজ হয়ে আছে। টিরিনা তার পোশাকটি খুলতে গিয়ে থেমে গেল, জিজ্ঞেস করল, মান! তুমি হাতে এই টাইটেনিয়ামের রডটি অস্ত্রের মতো করে ধরে রেখেছ কেন?

মান নিজের হাতের দিকে তাকাল এবং মনে হল ব্যাপারটি প্রথমবার লক্ষ করল। সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে হাতের টাইটেনিয়ামের রঙটি একটা শেলফে রেখে বলল, তোমরা কিছু মনে করো না। আমি বিশ বছর একা একা এই হটাতে আছি। আমার আচার-ব্যবহারে নানা ধরনের অসঙ্গতির জন্ম হয়েছে—তোমরা কিছু মনে করো না।

টিরিনা হেলমেটটা খুলে হাতে নিয়ে বলল, না আমরা কিছু মনে করব না। একা একা থাকার জন্য বিশ বছর খুব দীর্ঘ সময়।

রিশি বলল, কোনো রকম খাওয়া, পানীয়, জ্বালানি ছাড়া তুমি কেমন করে এতদিন এখানে বেঁচে আছ?

কষ্ট করে।

কিন্তু শুধু কষ্ট করে তো এটি সম্ভব নয়।

দ্রুমান একটু হাসার চেষ্টা করল, সব মানুষকেই হাসলে সুন্দর দেখায় কিন্তু যে কোনো কারণেই হাসিমুখে দ্রুমানকে মুহূর্তের জন্য কেমন জানি ভয়ংকর দেখাল। সে তার এই ভয়ংকর হাসিটি বিস্তৃত করে বলল, আমাকে বেঁচে থাকার জন্য অনেক ফন্দিফিকির করতে হয়েছে।

রিশি তার পোশাক খুলতে খুলতে বলল, হ্যাঁ, ফিরে যাবার আগে আমরা তোমার ফন্দিফিকির দেখতে চাই।

দ্রুমান আবার ভয়ংকর হাসিটি হেসে বলল, দেখবে। নিশ্চয়ই দেখবে।

টিরিনা বলল, তোমার এখানে দেখছি নিয়মিত ইলেকট্রিক সাপ্লাই আছে। তার মানে কোনো এক ধরনের জেনারেটর আছে।

দ্রুমান মাথা নাড়ল, হঁ আছে।

সেটা তুমি কী দিয়ে চালাও? আমাদের মহাকাশযানের তথ্যকেন্দ্রে দেখেছি এই গ্ৰহটাতে বাইরের কোনো শক্তি নেই। খুব বাজে গ্রহ।

দ্রুমান বিচিত্র একটি দৃষ্টিতে টিরিনার দিকে তাকাল। বলল, আমার কাছে এখন এটাকে আর বাজে গ্রহ মনে হয় না। মানুষ যখন দীর্ঘদিন কোনো রোগে ভোগে তখন সেই রোগটার জন্য মায়া পড়ে যায়। আর এটা একটা আস্ত গ্রহ।

টিরিনা চোখ কপালে তুলে বলল, তার মানে এই হটার জন্যও তোমার একটু মায়া পড়ে গেছে।

দ্রুমান একটা নিশ্বাস ফেলল। বলল, গ্রহটার থেকে বেশি মায়া পড়েছে আমার এই জায়গাটার জন্য। এর প্রত্যেকটা পাথরের টুকরো আমার নিজের হাতে বানো। বেঁচে থাকার জন্য কী না করেছি। শেষ পর্যন্ত যখন ইলেকট্রিসিটির ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে পারলাম তখন মনে হল হয়তো বেঁচে যাব।

রিশি বলল, তোমাকে অভিনন্দন দ্রুমান—এরকম একটা পরিবেশে বেঁচে থাকা প্রায় অলৌকিক একটা ব্যাপার।

দ্রুমান মাথা ঘুরিয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, আসলেই এটা অলৌকিক।

টিরিনা ঘরটির ভেতরে ঘুরে দেখে। দেয়ালে আলোর সুইচ ছিল। প্রায় অন্যমনস্কভাবে সে একটা সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিল, সাথে সাথে পুরো ঘরটি উজ্জ্বল আলোতে ভরে যায়। দ্রুমান হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, না।

না? টিরিনা অবাক হয়ে বলল, কী না?

দ্রুমান কঠিন গলায় প্রায় ছুটে এসে আলোটা নিভিয়ে দিতেই পুরো ঘরটি আবার আবছা অন্ধকারে ঢেকে গেল। দ্রুমান কঠিন গলায় বলল, তুমি আলো জ্বালবে না। শক্তির অপচয় করবে না।

টিরিনা একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝে তোমাকে আমরা নিয়ে যাব। তোমাকে এখানে থাকতে হবে না। এতদিন যেভাবে শক্তি বাচিয়েছ তোমাকে আর সেভাবে শক্তি বাঁচাতে হবে না!

হ্যাঁ। নিশি বলল, তুমি দুই-তিন বছরে যে পরিমাণ শক্তি খরচ কর আমাদের স্কাউটশিপে তার থেকে বেশি শক্তি জমা আছে?

থাকুক। তার মানে এই নয় যে তুমি শক্তির অপচয় করবে।

রিশি আর তর্ক করল না। বলল, ঠিক আছে। এটা তোমার জায়গা, তুমি যেটা বলবে সেটাই নিয়ম।

হ্যাঁ। দ্রুমান মাথা নেড়ে বলল, সেটা সব সময় মনে রাখবে। এটা আমার জায়গা। আমার অনুমতি ছাড়া এখানে তোমরা কিছু স্পর্শ করবে না। বুঝেছ?

রিশি মাথা নাড়ল। বলল, বুঝেছি!

মানুষটি একা একা থেকে পুরোপুরি অসামাজিক হয়ে গেছে, স্বাভাবিক ভদ্রতার বিষয়গুলোও পুরোপুরি ভুলে গেছে।

শুধু যে স্বাভাবিক ভদ্রতার বিষয়গুলো ভুলে গেছে তাই নয় রিশি আর টিরিনা একটু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, মানুষটির আরেকটি বিচিত্র অভ্যাসের জন্ম হয়েছে। সে সব সময় নিজের সাথে কথা বলে। বেশিরভাগ সময় বিড়বিড় করে কিন্তু প্রায় সময়েই বেশ জোরে জোরে। তার এই ঘর, থাকার জায়গা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, শক্তি, শক্তির অপচয়, খাবার আর পানীয়ের সঞ্চয় এইসব বিষয় নিয়ে সব সময় নিজের সাথে পরামর্শ করছে। মানুষটি আবার দুর্ব্যবহার করবে এ ধরনের একটা ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও টিরিনা জিজ্ঞেস করল, দ্রুমান, তুমি নিশ্চয়ই দীর্ঘদিন সত্যিকারের খাবার খাও নি?

না। আমার সব খাবার পুনরুজ্জীবিত খাবার।

শরীর থেকে যে বর্জ্য বেরিয়ে আসে সেটাকে পরিশোধন করে আবার খাবার তৈরির পদ্ধতিটি অনেক পুরোনো কিন্তু তার পরেও একজন মানুষ দিনের পর দিন এরকম খাবার খেয়ে যাচ্ছে চিন্তা করে বিশির শরীর কেমন জানি গুলিয়ে এল। টিরিনা বলল, আজকে তোমার সম্মানে এখানে একটি আনুষ্ঠানিক ভোজের আয়োজন করতে পারি।

দ্রুমান রু কুঁচকে বলল, তোমাদের কাছে কী কী খাবার আছে?

মেষ শাবকের মাংস থেকে শুরু করে সমুদ্রের মাছ, যবের রুটি থেকে শুরু করে ভুট্টা দানা, সত্যিকার ফলের কাস্টার্ড থেকে শুরু করে স্নায়ু উত্তেজক পানীয় সবকিছু আছে।

দ্রুমানের চোখ কেমন জানি চকচক করে ওঠে, সে সুড়ুৎ করে জিবে লোল টেনে বলল, শ্চমৎকার।

রিশি বলল, আমাদের হাতে খুব সময় নেই। আমার মনে হয় আমরা আমাদের ভোজটি দ্রুত সেরে নিয়ে রওনা দিয়ে দিই।

দ্রুমান রিশির কথার কোনো উত্তর দিল না। অবিশ্বাস্য ব্যাপার কিন্তু তাকে দেখে মনে হয় এই অভ গ্রহের অসুস্থ পরিবেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। রিশি বলল, মান। তোমার কি প্রস্তুত হতে সময় লাগবে? স্কাউটশিপ দিয়ে মহাকাশযানে পৌঁছাতে বেশ সময় লাগবে—সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?

মান কোনো উত্তর দিল না, বিড়বিড় করে বর্জ্য পরিশোধনের সময় নিয়ে সে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা বলল। রিশি মোটামুটি নিশ্চিত হতে শুরু করেছে এই মানুষটি সম্ভবত খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ।

ঘরটিতে তিন জন মানুষের বসে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। দুটি এলুমিনিয়ামের বাক্স এনে ব্রিশি এবং টিরিনার বসার জায়গা করা হল। যে টেবিলটাকে খাবারের টেবিল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে টিরিনা তার উপর একটা নিও পলিমারের চাদর বিছিয়ে দিল। তার উপর নানা রকম খাবার, গরম করে রাখা হয়েছে। দ্রুমান লোভাতুর চোখে খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে—সে শেষবার কবে এরকম একটি ভোজে অংশ নিয়েছিল নিশ্চয়ই মনে করতে পারবে না।

টিরিনা স্নায়ু উত্তেজক পানীয়ের বোতলটি খুলে দ্রুমানকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কাছে গ্লাস আছে?

দ্রুমান মাথা নাড়ল, বলল, ছে। তারপর উঠে একটা ড্রয়ার খুলে তিনটা ক্রিস্টালের গ্লাস নিয়ে এল। টিরিনা গ্লাসে পানীয় ঢালতে ঢালতে বলল, কী সুন্দর গ্লাস।

দ্রুমান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। বিশেষ বিশেষ দিনে আমি এই গ্লাস ব্যবহার করি।

টিরিনা তার গ্লাসটি উঁচু করে বলল, মান, এই গ্রহে তোমার শেষ দিনটি উপলক্ষে

রিশি মাথা নাড়ল, বলল, শেষ দিন উপলক্ষে।

দ্রুমান কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। যখন এক-দুটি কথা বলা ভদ্রভা তখন সে চুপ করে থাকে, কিন্তু যখন প্রয়োজন নেই তখন সে নিজের সাথে বিড়বিড় করে কথা বলে।

টিরিনা পানীয়টিতে চুমুক দিয়ে বলল, চমৎকার পানীয়।

রিশিও পানীয়তে চুমুক দিয়ে বলল, হ্যাঁ। চমৎকার।

দ্রুমান বিড়বিড় করে বলল, নিহিলিয়ান ডাবল ডোজ।

স্নায়ুকে আক্রমণ করার এক ধরনের ভয়ংকর বিষের নাম নিহিলিয়ান। দ্রুমান হঠাৎ করে এই বিষটির নাম উচ্চারণ করছে কেন ভেবে টিরিনা খুব অবাক হল। সে ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি নিহিলিয়ানের কথা কী বলছ?

গ্লাসের ভেতরে আমি দিয়ে রাখি। শুকিয়ে থাকে দেখে বোঝা যায় না।

রিশি আর টিরিনা ভয়ংকরভাবে চমকে উঠল, টিরিনা আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে বলল, কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ চমৎকার বিষ। আমার সবচেয়ে পছন্দের।

রিশি লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, হঠাৎ করে তার হাত-পা অবশ হয়ে গেছে। সে দাড়াতে পারছে না। নড়তে পারছে না।

দ্রুমান একদৃষ্টে রিশি আর টিরিনার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তোমরা আর নড়তে পারবে না। আরো কিছুক্ষণ তোমার জ্ঞান থাকবে, তারপর তোমরা অজ্ঞান হয়ে যাবে।

রিশি অনেক কষ্ট করে কোনোভাবে বলল, কেন?

কারণ তোমরা হবে আমার শক্তির সঞ্চয়। আমি একা একা এখানে কীভাবে এতদিন বেঁচে আছি তোমরা বুঝতে পারছ না? বেঁচে আছি কারণ আমি শক্তির কোনো অপচয় করি নি। আমি আমার জেনারেটরের জন্য কী ইঞ্জিন ব্যবহার করেছি জানতে চাও? ব্যবহার। করেছি সৃষ্টিজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ইঞ্জিন। তোমরা জান সেটা কী?

রিশি ফিসফিস করে বলল, মানুষের শরীর?।

হ্যাঁ। মানুষের শরীর। দ্রুমান জিব দিয়ে পরিতৃপ্তির একটা শব্দ করে বলল, বির্তনে লক্ষ লক্ষ বছরে মানুষের শরীরকে নিখুত করা হয়েছে, সৃষ্টি জগতে এর চাইতে ভালো কোনো ইঞ্জিন তৈরি হয় নি। আমি সেই ইঞ্জিনকে ব্যবহার করেছি আমার জেনারেটরে।

রিশি জিজ্ঞেস করতে চাইল সেই ইঞ্জিনগুলো কারা কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না, হঠাৎ করে তার হাত-পা অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে, সে দেখতে পাচ্ছে শুনতে পাচ্ছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না।

দ্রুমান বিড়বিড় করে বলল, নিহিলিয়ান হচ্ছে বিষের রাজা। একটু হিসেব করে দিতে হয়, বেশি দিলে কোমাতে চলে যাবে—কম দিলে ঘণ্টা খানেকের মাঝে শরীর মেটাবলাইজ করে ফেলবে, শরীর সচল হয়ে যাবে। মাঝামাঝি একটা পরিমাণ আছে যেটা দিলে তোমরা প্রথমে সবকিছু দেখবে, বুঝবে কিন্তু কিছু করতে পারবে না। আস্তে আস্তে জ্ঞান হারাবে। সেই জন্য এটা আমার প্রিয় বিষ।

দ্রুমান ঘর থেকে বের হয়ে একটা ট্রলি নিয়ে এল। ট্রলিটা রিশির পাশে রেখে আবার নিজের সাথে কথা বলতে থাকে, এখন তোমাদের আমি ইঞ্জিন ঘরে নিয়ে যাব। এত সুন্দর করে ডিজাইন করেছি, তোমাদের এটা দেখা উচিত। মানুষ যখন একটা সুন্দর সঙ্গীত রচনা করে তখন সে চায় এটা দশজন শুনুক, সুন্দর ভাস্কর্য করলে চায় দশজন দেখুক।

দ্রুমান রিশিকে টেনে ট্রলির উপরে শুইয়ে বলল, এইখানেও সেই একই ব্যাপার। একজন মানুষ একা একা বিশ বছর থেকে এখানে আছে, সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনকে ব্যবহার করছে জেনারেটর চালানোর জন্য, শক্তির কোনো অপচয় নেই। একেবারে নিখুত একটা প্রক্রিয়া, আমি কীভাবে করেছি এটা তোমাদের দেখা দরকার। এইজন্য আমি নিহিলিয়ান বিষটা পছন্দ করি। তোমাদের শরীর পুরোপুরি অচল, কিন্তু তুমি দেখতে পাচ্ছ, তুমি শুনতে পাচ্ছ, বুঝতে পারছ। কী চমৎকার!

দ্রুমান প্রথমে রিশিকে তারপর টিরিনাকে ট্রলিতে করে ঠেলে ঠেলে এক পাশে একটা বন্ধ ঘরের সামনে নিয়ে আসে। ঘরের বড় তালা খুলতেই একটা বোটকা গন্ধ পেল রিশি। সে তার মাথা ঘুরাতে পারছে না, তাই এখনো কিছু দেখতে পাচ্ছে না। দ্রুমান রিশি আর টিরিনাকে ভেতরে ঢুকিয়ে ঠুলিটা ভাজ করে তাদেরকে আধশোয়া অবস্থায় নিয়ে আসতেই তারা পুরো দৃশ্যটি দেখতে পেল, একটা ভয়ংকর আতঙ্কে তারা চিৎকার করে উঠত কিন্তু তাদের শরীর পুরোপুরি অবশ বলে তারা শুধু নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।

ঘরের মাঝামাঝি জেনারেটরটি দাঁড় করানো আছে তার চারপাশে প্রায় পঞ্চাশ জন নগ্ন মানুষ শুয়ে আছে। মানুষগুলো নিশ্চয়ই অচেতন, কারণ তাদের কোথাও প্রাণের স্পন্দন নেই, শুধু তাদের পাগুলো জেনারেটরের মূল শ্যাফটটাকে যন্ত্রের মতো ঘুরিয়ে যাচ্ছে। প্রমান এক ধরনের উচ্ছসিত গলায় বলল, দেখেছ আমার ইঞ্জিন? আমি এটার নাম দিয়েছি দ্রুমান ইঞ্জিন।

সে কাছাকাছি একজন মানুষের কাছে গিয়ে বলল, ভালো করে তাকিয়ে দেখ, এই যে এই টিউব দিয়ে তার জন্য পুষ্টিকর তরল আসছে। এই টিউবটা নাকের ভেতর দিয়ে সরাসরি ফুসফুসে চলে গেছে। আমি এটা দিয়ে একেবারে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সাপ্লাই দিই। শরীরের যা বর্জ্য সেগুলো এই টিউব দিয়ে আমি বের করে নিয়ে আসি। ডান দিকে তাকিয়ে দেখ আমার সিনথেজাইজার বর্জ্য থেকে সবগুলো যৌথমূল আলাদা করে আবার নূতন করে পুষ্টিকর তরল তৈরি করা হয় সেটা আবার তাদের শরীরে চলে আসছে। একটা পরিপূর্ণ সিস্টেম, বাইরে থেকে বলতে গেলে আমার কিছুই লাগছে না।

দ্রুমান তার জেনারেটর ঘরের ভেতর ঘুরতে থাকে, কোনো কোনো মানুষের চোখের পাতা তুলে পরীক্ষা করে সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে আবার রিশি আর টিরিনার কাছে ফিরে আসে, তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ মানুষগুলো এটা কেন করছে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। দ্রুমান নিজেই তার চোখে-মুখে প্রশ্ন করার ভঙ্গি নিয়ে এসে বলল, আর এই প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে আমার সাফলা! আমার আবিষ্কার।

দ্রুমান কাছাকাছি এসে একজনের হাতটা একটু উপরে তুলে আবার ছেড়ে দিতেই সেটা নির্জীবের মতো পড়ে যায়, ঈমান বলল, দেখেছ? হাতগুলো পুরোপুরি অচল। আস্তে আস্তে শুকিয়ে কাঠির মতো হয়ে গেছে। জেনারেটরের শ্যাফটটা ঘোরানো হচ্ছে পা দিয়ে, হাতের কোনো প্রয়োজন নেই তাই আস্তে আস্তে হাতগুলো অচল হয়ে যাচ্ছে। এই জেনারেটর চালানোর জন্য আমার দরকার একেবারে সুস্থ সবল নীরোগ মানুষ। এখানে সবাই সুস্থ সবল। আর নীরোগ। শুধু সুস্থ সবল আর নীরোগ নয়, তারা অসম্ভব সুখী মানুষ। তোমরা দেখতে পাচ্ছ তাদের মুখে এক ধরনের পরিতৃপ্তির হাসি? দেখেছ?

খুব ধীরে ধীরে রিশির চেতনা লোপ পেয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার ভেতরেও সে দেখতে পেল কাছাকাছি শুয়ে থাকা নগ্ন মেয়েটির মুখে সূক্ষ্ম এক ধরনের হাসি, সেই মুখে কোনো যন্ত্রণার চিহ্ন নেই। দ্রুমানের নিজের মুখেও এক ধরনের পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল, সে বলল, দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনা এর সবই তো আসলে আমাদের মস্তিস্কের এক ধরনের প্রক্রিয়া। আমি সেই প্রক্রিয়াটাকেই নিয়ন্ত্রণ করছি। এদের মস্তিষ্কের কিছু কিছু জায়গা পাকাপাকিভাবে নষ্ট করে দিয়েছি যেন তারা আর কোনো দিন জেগে উঠে কারো কাছে অভিযোগ করতে না। পারে। কিছু কিছু জায়গা একটু পরিবর্তন করে দিয়েছি যার কারণে তাদের মুখে এরকম আনন্দের হাসি। তারা খুব আনন্দের সাথে এই কাজটা করছে। তাদের ভেতরে কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই, হিংসা নেই, রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, তারা খুব সুখে আছে। মাঝে মাঝে তাদেরকে দেখলে আমার এক ধরনের হিংসা হয়। মনে হয় আহা আমিও যদি তাদের মতো সুখী হতে পারতাম, আনন্দিত হতে পারতাম।

দ্রুমানের মুখে সত্যিই এক ধরনের বিষণ্ণতাব ফুটে ওঠে। তাকে দেখে মনে হতে থাকে সত্যি বুঝি এই মানুষগুলোর মতো সুখী হবার জন্য তার ভেতরে এক ধরনের ব্যাকুলতার জন্ম হয়েছে। সে রিশির চোখের পাতা টেনে চোখের মণিটা একনজর দেখে বলল, নিহিলিয়ানের কাজ শুরু করেছে। এখন তোমরা অচেতন হয়ে গেছ। তোমরা আর আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমি একা একা কথা বলতে পারি। আমি বিশ বছর থেকে নিজের সাথে কথা বলছি। নিজের সাথে কথা বলার থেকে চমৎকার ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। এর মাঝে কোনো বিরোধ নেই, তর্কবিতর্ক নেই। তোমরা ব্যাপারটা চেষ্টা করে দেখলে পারতে। এখন অবিশ্যি দেরি হয়ে গেছে, কারণ তোমরা আর কোনো দিন চেতনা ফিরে পাবে না। এক ধরনের ঐশ্বরিক আনন্দ দিয়ে আমি তোমাদের প্রমান ইঞ্জিন তৈরি করে ফেলব।

দ্রুমান টিরিনার ট্রলিটা ঠেলে ঘরের এক কোনায় নিতে নিতে বলল, আমার এই ইঞ্জিন ঘরেই সবকিছু। অস্ত্রোপচারটাও এই ঘরে করি। অবিশ্যি অস্ত্রোপচারের কাজটা খুব সহজ। আমি এই হেলমেটটা তোমাদের মাথায় পরিয়ে দেব  মান একটা হেলমেট তুলে দেখাল, তারপর বলল, হেলমেটের নয়টা জায়গায় নয়টা ভ্রু আছে সেগুলো ঘুরিয়ে টাইট করতে হয়, বাস সাথে সাথে কাজ শেষ। ভিতরে কয়টা লিভার আছে, সেগুলো মস্তিষ্কের ঠিক ঠিক জায়গায় ফুটো করে কিছু পরিবর্তন করে দেয়। অত্যন্ত চমৎকার একটা যন্ত্র! এটা আমাকে তৈরি করে দিয়েছে ডক্টর নিশিনা–ঐ দেখ ডান দিক থেকে তিন নম্বর জায়গায় শুয়ে নগ্ন দেহে হাসিমুখে সে কাজ করে যাচ্ছে। বেচারা বুঝতেই পারে নি আমি তার ওপরে সেটা প্রথমবার ব্যবহার করব। কিছু কিছু মানুষ জীবনের জটিলতাগুলো বুঝতে পারে না।

দ্রুমান টিরিনার ট্রলিটা তার কাজ চালানোর মতো অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে উপরের উজ্জ্বল আলোটা জ্বেলে দিয়ে বলল, এই আলোটা জ্বালানোর জন্য আমার বাড়তি কিছু শক্তি ক্ষয় হচ্ছে কিন্তু আমি সেজন্য আজকে মোটেও চিন্তিত নই। আমি একটু বাড়তি আলো আজকে ব্যবহার করতেই পারি কারণ আমার জেনারেটরে আজকে দুটো নতুন দ্রুমান ইঞ্জিন লাগাতে যাচ্ছি। তোমরা দুজন। আমার বিদ্যুৎ শক্তি কয়েক শতাংশ বেড়ে যাবে আজ থেকে। কী চমৎকীর!

দ্রুমান টিরিনার অচেতন দেহের দিকে তাকিয়ে জিব দিয়ে একটা শব্দ করে বলল, তোমার পোশাকটা আগে খুলে নিই! কিছুক্ষণের ভেতরেই তুমি বেঁচে থাকার জন্য যেসব বাহুলা করতে হয় তার সবকিছু থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। তোমার শরীরে যে পোশাক আছে বা নেই তুমি সেটাও জানবে না। দ্রুমান টিরিনার পোশাকের জিপ টেনে খুলতে খুলতে বলল, তোমার এই সুন্দর সুগঠিত শরীর অন্যরকম হয়ে যাবে, হাতগুলো আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাবে, ঘাড় আর বুকের মাংসপেশি অকেজো হয়ে যাবে। তবে পা দুটো আরো সুগঠিত হয়ে যাবে। কোমরের মাংসপেশিগুলো হবে শক্ত–

দ্রুম্মান টিরিনার পোশাকের জিপ টেনে নিচে নামিয়ে এনে বলল, আমি তোমাকে এভাবে নগ্ন করে ফেলছি, তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?

ঠিক তখনই একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, টিরিনার চোখ দুটো খুলে যায়। সে একদৃষ্টে দ্রুমানের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, হ্যাঁ আপত্তি আছে।

দ্রুমান ইলেকট্রিক শক খাওয়া মানুষের মতো ছিটকে পেছনে সরে যায়। তার চোখেমুখে বিস্ময় এবং তার থেকে বেশি আতঙ্ক। সে একটা হাত সামনে বাড়িয়ে অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো বলল, তু-ত-তুমি-তুমি-

আমি। টিরিনা তার ট্রলিতে উঠে বসল তারপর পোশাকের খুলে ফেলা জিপটি টেনে আবার বন্ধ করে দিয়ে বলল, তুমি দীর্ঘদিন একা একা আছ তাই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির কী কী উন্নতি হয়েছে তার খবর রাখ না।

প্রমান এদিক-সেদিক তাকিয়ে ছুটে গিয়ে স্টেইনলেস স্টিলের একটা ধারালো সার্জিক্যাল চাকু হাতে নিয়ে চাপা গলায় চিৎকার করে বলল, খবরদার। খবরদার বলছি—

টিরিনা ট্রলি থেকে তার পা দুটো নিচে নামিয়ে বলল, তুমি শুধু শুধু উত্তেজিত হয়ে না মান।

খুন করে ফেলব আমি, তোমাকে খুন করে ফেলব।

আমার জন্য এই শব্দটা ব্যবহার করায় একটা সমস্যা আছে। টিরিনা হাসি হাসি মুখ করে বলল, একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে খুন করতে পারে। আমি তো ঠিক মানুষ নই।

দ্রুমান ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি তা হলে কী?

সেটি আমিও পুরোপুরি নিশ্চিত নই। খুব স্থূলভাবে যদি বলতে চাও রোবট বা এনরয়েড বলতে পার। কেউ কেউ আবার সাইবর্গ বলে। তুমি কোনটা বলতে চাও সেটা আমি জানি না। টিরিনা উঠে দাঁড়িয়ে মানের দিকে অগ্রসর হয়ে বলল, তবে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না। যে জিনিসটা তোমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে তোমার জেনে রাখা ভালো যে তুমি যে চাকুটা হাতে নিয়েছ সেটা দিয়ে আমার চামড়ায় আঁচড়ও দিতে পারবে না। কাটার কোনো প্রশ্নই আসে না।

দ্রুমান বিড়বিড় করে বলল, মিথ্যা কথা বলছ। তুমি মিথ্যা কথা বলছ।

টিরিনা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, তোমাকে কোনো কিছু বিশ্বাস করানোর জন্য আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে আমি চাই না তুমি নতুন করে কোনো বোকামি কর। আমি খালি হাতে তোমার মাথাটা গুড়ো করে ফেলতে পারব।

মিথ্যা কথা বলছ তুমি—

আমার চোখের দিকে তাকাও দ্রুমান।

দ্রুমান টিরিনার চোখের দিকে তাকায় এবং আতঙ্কে থরথর করে কাপতে থাকে। টিরিনার দুটি চোখ জ্বলছে, তীব্র আলোতে ঝলসে উঠছে দুটি চোখ।

টিরিনা ফিসফিস করে বলল, আমি মানুষ নই। কিন্তু আমার ভাবনা-চিন্তা মানুষের মতো। আরেকজন মানুষ এখন যা করত এখন আমিও তোমাকে তাই করব।

কী করবে তুমি?

টিরিনা এক পা এগিয়ে হঠাৎ খপ করে দ্রুমানের হাত ধরে ফেলল, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় প্রমান আর্তনাদ করে ওঠে, তার হাত থেকে ধারালো চাকুটা পড়ে যায়। টিরিনা ফিসফিস করে বলল, তুমি তোমার এই জেনারেটরে আরো একটি দ্রুমান ইঞ্জিন হয়ে থাকবে।

দ্রুমান কাতর গলায় বলল, না!

নগ্ন দেহে পা দিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে তুমি তোমার বন্ধু ডক্টর নিশিনার পাশাপাশি শুয়ে থাকবে। তোমার বন্ধু ভক্টর নিশিনার মুখে যেরকম প্রশান্তির হাসি ফুটে আছে তোমার মুখেও

সেরকম হাসি ফুটে থাকবে।

না-না–

টিরিনা তার যান্ত্রিক হাত দিয়ে মুহূর্তে দ্রুমানকে ট্রলিতে চিৎ করে শুইয়ে ফেলল। দ্রুত হাতে নিও পলিমারের স্ট্যাপ দিয়ে ট্রলিতে বেঁধে ফেলে বলল, তুমি একটু আগে বলেছ তোমার এককালীন সহকর্মী, তোমাকে উদ্ধার করতে আসা মহাকাশচারীদের দেখে মাঝে মাঝে তোমার হিংসা হয়। তোমার আর হিংসা হবে না। তুমি এখন তাদের একজন হয়ে যাবে।

দ্রুমান মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি তাদের একজন হতে চাই না।

টিরিনা শেলফের ওপর রাখা হেলমেটটা হাতে নিয়ে মানের দিকে এগিয়ে আসে, তার মাথায় পরিয়ে নিচু গলায় বলল, চুপ করে শুয়ে থাক দ্রুমান। শক্তির অপচয় করো না।

 

স্কাউটশিপের মৃদু কম্পনে রিশির জ্ঞান ফিরে আসে। সে ঘোলাটে চোখে টিরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কোথায়?

তুমি স্কাউটশিপে।

রিশি প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করে, কিছু একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটেছিল মানুষের শরীর নিয়ে। নগ্ন দেহে অসংখ্য মানুষ কোথায় জানি শুয়ে আছে, কিন্তু সে মনে করতে পারছে না। টিরিনা তার মাথায় হাত রেখে বলল, তুমি ঘুমাও রিশি। তোমার কোনো ভয় নেই। কেউ তোমার ক্ষতি কতে পারবে না।

রিশি কয়েক মুহূর্ত টিরিনার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে ফেলল। স্মৃতি মুছে ফেলার যে ওষুধটা দেওয়া হয়েছে সেটা কাজ করতে শুরু করেছে।

টিরিনা এক ধরনের গভীর ভালবাসা নিয়ে রিশির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটিকে নিরাপদে পৌঁছে দেবার জন্য সে এসেছে। সে নিশ্চয়ই তাকে রক্ষা করবে। বুক আগলে রক্ষা করবে।

মানুষের মতো অসহায় আর কে এই জগতে?

» ০২. ঘৃণার সঙ্গে বসবাস

নিশি গোল কোয়ার্টজের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নির্দিষ্ট জিনের কিছু বেস পেয়ারকে পরিবর্তন করে আজকাল যে কোনো মানবীকে সুন্দরী করে দেওয়া যায় বলে সৌন্দর্যের গুরুত্বটি কমে এসেছে-তারপরও একটু ভালো করে লক্ষ করলেই বোঝা যায় নিশির। সৌন্দর্যটি অন্যরকম। তার কিশোরীর মতো ছিপছিপে দেহ, সেখানে চলাচলে এক ধরনের। লাবণ্য, আকাশের মতো নীল চোখ, লালচে চুল এবং কোমল ও মসৃণ তুক। তার ভেতরে এক ধরনের সতেজ আত্মবিশ্বাস, যেটি সব সময়েই চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে থাকে। তার। অনুভূতি সব সময়েই খুব চড়া সুরে বাঁধা থাকে, এই মুহূর্তে যেটি উত্তেজনায় প্রায় আকাশছোঁয়া হয়ে আছে। তার সমস্ত মুখমণ্ডল প্রচণ্ড ক্রোধে রক্তাভ এবং অপ্রতিরোধ্য এক ধরনের আক্রোশে তার শরীর অল্প অল্প কঁপছে। নিশি এক ঝটকা মেরে তার মুখের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলোকে পেছনে সরিয়ে ঘরের মাঝামাঝি বসে থাকা অণ্ডনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার এবং আমার মাঝে যে সম্পর্ক সেটা সম্ভবত পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক।

অশুন নিশির আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করা স্বামী। অশুন সুদর্শন-শক্ত-সমর্থ এক যুবক। তার বয়স নিশির বয়সের কাছাকাছি, মানসিক কাঠামো, বুদ্ধিমত্তা, আত্মবিশ্বাস এমনকি কথা বলার ভঙ্গিও দুজনের প্রায় একই রকম। দুজন এত কাছাকাছি ধরনের মানুষ হবার পরও কোনো একটি বিচিত্র কারণে একজন আরেকজনকে গ্রহণ করতে পারে নি। এই গ্রহণ করতে না পারাটুকু যুদি মৃদু অপছন্দের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকত তা হলে একটি কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি, তারা একজন আরেকজনকে সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে। প্রাচীনকালে পরিবারের কাঠামোটির খুব গুরুত্ব ছিল, পরিবার হিসেবে টিকে থাকার একটি বড় শর্ত ছিল সন্তান পালন করা। তখন একজন পুরুষ ও রমণীর পক্ষে পরস্পরকে এত তীব্রভাবে ঘৃণা করে একসাথে বসবাস করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন পরিবেশটি অন্যরকম। নিশি এবং অশুন যে একসাথে স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে বসবাস করছে তার একটিমাত্র কারণ হচ্ছে পরস্পরের প্রতি অকল্পনীয় এক ধরনের ঘৃণী। এই ঘৃণা এত তীব্র এবং গভীর যে নিজের অজান্তেই তারা সেই ঘৃণাকে ভালবাসতে শুরু করেছে, লালন করতে শুরু করেছে। দুজন দুজনকে ছেড়ে গেলে এই তীব্র ঘৃণাটুকু হারিয়ে যাবে বলেই হয়তো ভারা আর আলাদা হয়ে যেতে পারছে না।

নিশি তীব্র দৃষ্টিতে অণ্ডনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে তোমাকে আমি একদিন বিয়ে করেছিলাম।

অশুন একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, কেন? বিশ্বাস না করার কী আছে?

তুমি বলতে চাও তোমাকে সত্যি আমি একসময় পছন্দ করতাম? তোমাকে আমি কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভালবেসেছিলাম?

না। অশুন মাথা নাড়ল, বলল, তুমি আমাকে কোনো দিন ভালবাস নি, আমি এই ব্যাপারটি তোমাকে নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।

নিশি তার সুন্দর রু দুটি কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই ব্যাপারটিতে এত নিশ্চিত কেমন করে হলে?

কারণ আমাকে বা অন্য কোনো মানুষকেই তোমার ভালবাসার ক্ষমতা নেই। প্রকৃতপক্ষে তোমার মস্তিষ্কের গঠনে কাউকে ভালবাসা সম্ভব নয়।

নিশি কষ্ট করে নিজের ক্রোধকে সংবরণ করে বলল, তাই যদি সত্যি হয় তা হলে তোমাকে কেন আমি একদিন বিয়ে করেছিলাম?

কৌতূহল। অশুন মাথা নেড়ে বলল, তুমি একজন মেয়ে, পুরুষ কেমন করে আচরণ করে সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা ছিল না। তাই তুমি কৌতূহলী হয়ে আমাকে বিয়ে করেছিলে।

আর তুমি? নিশি তীব্র স্বরে বলল, আর তুমি কেন আমাকে বিয়ে করেছিলে?

অশুন আনন্দহীন এক ধরনের হাসি হেসে বলল, ভুল করে। আমি তোমাকে ভুল করে বিয়ে করেছিলাম। এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে তোমার ভেতরে এক ধরনের সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল, সে কারণে আমি তোমার প্রতি এক ধরনের জৈবিক আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম।

এখন সেই সম্মোহনী ক্ষমতা নেই? সেই জৈবিক আকর্ষণ নেই?

না নেই। অশুন প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। আমার কাছে তুমি আর একটি ঘিনঘিনে বিষাক্ত সাপের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। একটা বিষাক্ত সাপকে আমি যেরকম বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পিষে মেরে ফেলতে পারি ঠিক সেরকম তোমাকে পিষে মেরে ফেলতে অামার একটুও দ্বিধা হবে না।

নিশি নিচু গলায় হিসহিস করে বলল, তা হলে মেরে ফেলছ না কেন?

অশুন হা-হা করে হেসে বলল, আইনের ভয়ে। যদি আইনের কোনো বাধা না থাকত তা হলে এতদিনে আমি নিশ্চয়ই তোমাকে খুন করে ফেলতাম। আজ থেকে এক শ বছর আগে হলে আমি নিশ্চিতভাবে তোমাকে শারীরিকভাবে আঘাত করতাম! তোমার খুব সৌভাগ্য যে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বাবহার করে মহিলাদের শারীরিক শক্তি পুরুষের সমান করে ফেলা হয়েছে। তা না হলে আমি নিশ্চয়ই তোমাকে নির্দয়ভাবে আঘাত করতাম।

নিশি বিস্ফারিত চোখে অশুনের দিকে তাকিয়ে রইল। অশুন মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার প্রিয় ফ্যান্টাসি কী জান?

কী?

তোমাকে জনসমক্ষে অপমান করে একটি শারীরিক শাস্তি দিচ্ছি।

নিশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি এখন একটু একটু বুঝতে পারছি কেন তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। তুমি ঠিকই বলেছু, কৌতূহল এবং সম্ভবত এই কৌতূহলের কারণেই আমি তোমাকে এখনো স্বামী হিসেবে রেখে দিয়েছি। রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেই নি। কিছু একটাকে কেউ যখন খুব ঘেন্না করে তখন মানুষের সেটাকে নিয়ে এক ধরনের কৌতূহল হয়। শরীরের কোথাও যদি ঘা হয় তখন বারবার সেটা দেখার কৌতূহল হয়–অনেকটা সেরকম। তুমি হচ্ছ আমার জীবনের সেই দগদগে ঘা। লাল হয়ে পেকে থাকা খুঁজে ভরা বিষাক্ত ঘা।

অশুন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে নিশির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিশি থামতেই সে মাথা নেড়ে বলল, তুমি এখনো খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারি নিশি।

এর মাঝে গুছিয়ে বলার কিছু নেই। সত্যি কথা গুছিয়ে বলতে হয় না—উচ্চারণ করলেই হয়। তোমার সাথে বিয়ে না হলে ঘৃণা ব্যাপারটি কী সেটা আমি কোনো দিন জানতে পারতাম না। আমার জীবনটা এক অর্থে অসম্পূর্ণ থেকে যেত।

ঘৃণা একটা পারস্পরিক ব্যাপার। অশুন মাথা নেড়ে বলল, এটা কখনো একপক্ষীয় হতে পারে না। নিশি, আমিও তোমাকে ঘৃণা করি। ভয়ংকর ঘৃণা করি। সত্যি কথা বলতে কী মেয়েমানুষ কত খারাপ হতে পারে সেটা তোমাকে না দেখলে আমি কখনো জানতে পারতাম না।

নিশির মুখে বিগ্রুপের একটা হাসি ফুটে উঠল। বলল, চমৎকার! তোমার মতো নিচু শ্রেণীর মানুষের কাছে আমি এর থেকে ভালো কোনো কথা আশা করি নি।

কেন? আমি নতুন কী বলেছি?

তুমি ঘৃণা কর আমাকে অথচ সেজন্য পুরো নারী জাতিকে নিয়ে একটা কুৎসিত কথা বললে!

অশুন এতক্ষণ ঘরের মাঝামাঝি বসে ছিল, এবারে সে খানিকটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাভলি এবং নিশির কাছাকাছি হেঁটে এসে বলল, তুমি একটা জিনিস জান? আমি কিন্তু তোমাকে তুমি হিসেবে ঘৃণা করি না। নিশি নামক একটি নির্বোধ মহিলা হিসেবে তুমি কিন্তু খুব খারাপ নও। বলা যেতে পারে একটা নির্বোধ মহিলার পক্ষে যতটুকু ভালো হওয়া সম্ভব তুমি মোটামুটি তাই। আমি তোমাকে ঘৃণা করি একটি মেয়ে হিসেবে। তোমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে তুমি একজন মেয়ে। বড় ধরনের সার্জারি না করে তুমি এর থেকে মুক্তি পাবে না। মেয়েমানুষ বিবর্তনের খুব বড় একটি ক্রটি।।

নিশির চোখ থেকে আগুন বের হতে থাকে। সে জোরে জোরে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমি অনেক কষ্ট করে নিস্ত্রেকে শান্ত রাখছি। একটা লোহার রড দিয়ে আঘাত করে তোমার খুলি গুড়ো করে দেওয়া উচিত।

অশুন হালকা পায়ে একটা নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বলল, তুমি না হয়ে অন্য কোনো মেয়ে হলে সম্ভবত তাই করত। আমার ধারণা নির্বোধ মেয়ে প্রজাতির তুমি মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্য সদস্য।

নিশি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, অশুন, তুমি কোনো দিন প্রাচীন ইতিহাস পড়েছ?

হ্যাঁ। কিছু পড়েছি।

তুমি জান আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে পৃথিবীর সব পুরুষ তোমার মতো চিন্তা করত? তাদের সবাই ভাবত পৃথিবীতে পুরুষ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ? নারী হচ্ছে দুর্বল? তুমি যে একজন আদিম মানুষ সেটি কি জান?

অশুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ জানি। আমি একজন প্রাচীন মানুষের মতো চিন্তা করি। প্রাচীন সবকিছু কিন্তু ভুল নয়, প্রাচীন অনেক কিছু সত্যি। অনেক কিছু খুঁটি। প্রাচীনকালে মানুষ অনেক কিছু অভিজ্ঞতা থেকে আবিষ্কার করেছিল, তার বেশিরভাগ ছিল সত্যি। এটিও তাই। মেয়ে হচ্ছে নিকৃষ্ট জীব। সত্যি স্বীকার করে নাও নিশি।

নিশি তীব্র দৃষ্টিতে অশুনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি জান এই কথাগুলো বলে তুমি প্রমাণ করেছ যে তুমি একটি আকাট নির্বোধ? আহাম্মকঃ বুদ্ধিহীন জড়পদার্থ? অশিক্ষিত মূর্খ? জংলি ভূত?

অশুন শব্দ করে হেসে বলল, অপ্রিয় সত্যি কথা সবার ভালো নাও লাগতে পারে।

তুমি কি হিটলারের নাম শুনেছ? যে মনে করত একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। তুমি কি জান তার কী অবস্থা হয়েছিল? ইতিহাস তাকে কীভাবে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলেছিল তুমি জান?

জানি।

তোমার মতো একটা মূখ আহাম্মক বুদ্ধিহীন জড়পদার্থ অশিক্ষিত জংলি ভূতের সেই একই অবস্থা হবে। চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই জানি তবুও আমি চেষ্টা করে দেখি তোমাকে খানিকটা জ্ঞান দেওয়া যায় কি না! তুমি কি জান মায়ের গর্ভে প্রতিটি সন্তান প্রকৃতপক্ষে মেয়ে হয়ে বড় হতে থাকে, ওয়াই ক্রমোজম শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে গড়ে ওঠাকে বন্ধ করে দেয়। আর সেই ব্যাপারটিকে বলা হয় পুরুষ। তুমি কি জান পুরু বলে আসলে কোনো প্রজাতি নেই? যারা মেয়ে হয়ে বড় হতে পারে নি সেটাই হচ্ছে পুরুষ–তুমি কি এটা জান?

অশুন মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ। আমি শুনেছি।

শুনেছ। কিন্তু বিশ্বাস কর নি।

আমি বিশ্বাস করলেই কী আর না করলেই কী আসে যায়?

অনেক কিছু আসে যায়। তুমি কি আসলেই গর্দভ নাকি শুধু গর্দভের ভান করছ সেটা আমার জানা দরকার।

অশুন ক্রুদ্ধ চোখে নিশির দিকে তাকাল। নিশি তার মুখে শ্লেষের হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি জান মানব প্রজাতির অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য আসলে পুরুষ মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই? তুমি জান শুধুমাত্র মেয়েদের দিয়ে মানুষের অস্তিত্ব বাচিয়ে রাখা যায়? তুমি জান মানুষের ক্লোন করার জন্য পুরুষের প্রয়োজন হয় না শুধুমাত্র নারীদের দিয়েই ক্লোন করা সম্ভব।

হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু এটা দিয়ে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?

নিশি মাথা নেড়ে বলল, আমি কী বোঝাতে চাইছি সেটা যদি তুমি এখনো বুঝতে না পার তা হলে আমি নিশ্চয়ই আমার সময় নষ্ট করছি। তোমার বুদ্ধিমত্তা যদি শিম্পাঞ্জির কাছাকাছি হয়ে থাকে তা হলে আমার সম্ভবত তোমার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোনো অর্থ হয় না!।

অশুন মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বলল, এমনও তো হতে পারে যে তুমি মেয়েদের স্বভাবসুলভ জড়তার, বুদ্ধিহীনতার কারণে সহজে একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে পারছ না।

না, সেটা হতে পারে না। কিন্তু তবু তুমি যদি চাও আমি তোমাকে আরো পরিষ্কার কথা বলতে পারি। আমি বলতে চাইছি এটি বিজ্ঞানের পরীক্ষিত সত্য যে পুরুষ হচ্ছে বাহুল্য। অশুন, তোমার ভাগ্য খুব ভালো যে তুমি এই সময়ে পুরুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছ। আজ থেকে কয়েকশ বছর পর পুরুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার চেষ্টা কর নি। তা হলে তোমার জন্ম হত না। কারণ বসন্ত রোগের জীবাণুকে যেভাবে পৃথিবী থেকে অপসারণ করা হয়েছে প্রকৃতি ঠিক সেভাবে তোমাদের মতো পুরুষকে পৃথিবী থেকে অপসারণ করত।

অন অবাক হয়ে নিশির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি সত্যিই এটা বিশ্বাস কর, নাকি আমার সাথে ঝগড়া করার জন্য এটা বলছ?।

নিশি বলল, এর মাঝে বিশ্বাস করা না করার কী আছে? এটি বিজ্ঞানের পরীক্ষিত সত্য বিশ্বাস করা না করার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞান বলেছে বংশ বৃদ্ধি করার জন্য পুরুষ মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই। প্রকৃতি বাহুল্যকে সহ্য করে না–প্রকৃতি পুরুষকেও সহ্য করবে না!

অন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে নিশির দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি বিজ্ঞানের পরীক্ষিত সত্যের কথা বলছ কিন্তু বিজ্ঞানের অবদানের কথা বলছ না?

বিজ্ঞানের কোন অবদান?

মানুষের জন্ম প্রক্রিয়ার ব্যাপারটি। পুরুষ আর মহিলার এক ধরনের জৈবিক প্রক্রিয়া দিয়ে শিল্প জন্ম হত। শিশুর জন্ম নিশ্চিত করার জন্য প্রকৃতি সেই জৈবিক প্রক্রিয়ার মাঝে এক ধরনের আনন্দের ব্যবস্থা রেখেছিল। তুমি কি জান মানুষের মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন দিয়ে এখন কৃত্রিমভাবে তার থেকে এক শ গুণ বেশি আনন্দ দেওয়া সম্ভব? তুমি কি জান শিশুর জন্ম দেওয়ার জন্য সেই জৈবিক প্রক্রিয়া এখন সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়? তুমি কি জান যে এখন একটি শিশুর জন্ম দেওয়ার জন্য পুরুষ কিংবা মহিলা কিছুরই প্রয়োজন নেই? হিসাব করে সাজিয়ে রাখা কিছু ডিএনএ দিয়ে একটা জৈব ল্যাবরেটরিতে এখন যে মানুষের জন্ম দেওয়া যায় সেটা তুমি জান?

জানি।

অশুন এক ধরনের উত্তেজনা নিয়ে বলল, ত্রা হলে ভবিষ্যতে যে মানব শিশুর জন্ম হবে ল্যাবরেটরিতে, তাদের যে বড় করা হবে কমিউনে সেটা কি তুমি অনুমান করতে পারছ না? এখন মেয়েদের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানকে গর্ভধারণ করা এবং সন্তানের জন্ম দেওয়া। জন্ম দেওয়ার সেই প্রক্রিয়াটিই যখন উঠে যাবে তখন এই পৃথিবীতে মেয়েদের যে কোনো প্রয়োজনই থাকবে না তুমি কি সেটা জান না?

নিশি কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে অন্তনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি সত্যিই আমাকে এটা বিশ্বাস করতে বলো?

হ্যাঁ বলি। অশুন কঠিন মুখে বলল, সত্যকে স্বীকার করে না, কারণ সত্য তোমাকে মুক্তি দেবে।

নিশি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, মানুষ নির্বোধ হলে খুব সুবিধা। তখন তাদের খুব ছোট একটা জগৎ হয় আর সেই বোকার জগতে তারা মহানন্দে বেঁচে থাকতে পারে। তুমিও সেরকম বোকার একটা স্বর্গে মহানন্দে বেঁচে আছ। কৃমি যেরকম বিষ্ঠায় বেঁচে থাকে অনেকটা সেরকম! কী আশ্চর্য, এই যুগে একজন মানুষ বলছে ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতে থাকবে শুধু পুরুষ!

অগুন জোরগলায় বলল, অবিশ্যি থাকবে শুধু পুরুষ। পুরুষ মানুষ শক্তিশালী, ভাদের বুদ্ধিমত্তা বেশি, তারা বেশি সৃজনশীল, তারা কর্মঠ, তাদের রসবোধ তীক্ষ্ণ, তারা ত্যাগী, তারা আত্মবিশ্বাসী তারা সবদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। প্রকৃতি কেন তা হলে এই শ্রেষ্ঠ প্রজাতিকে বেছে নেবে না? মেয়েদের একমাত্র দায়িত্ব সন্তান জন্ম দেওয়া, সেটিই যখন তাদের হাতে থাকবে না তখন তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনটা কোথায়? তারা তখন সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল। তারা নোংরা আবর্জনা।

নিশি তীব্র দৃষ্টিতে অশুনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার ধারণাটা সত্যি কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখতে চাও?

অশুন ভুরু কুঁচকে বলল, সেটা কীভাবে করা হবে?

আমি তোমাকে একটা চ্যালেঞ্জ দেব। সেই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ কর।

কী চ্যালেঞ্জ?

তুমি জান প্রযুক্তি এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ইচ্ছে করলে একজন মানুষকে শীতলঘরে কয়েক হাজার বছর রেখে দেওয়া যায়।

অশুন ভুরু কুঁচকে বলল, হ্যাঁ জানি।

তোমাকে আমি চ্যালেঞ্জ করছি যে আমার সাথে এরকম একটি শীতলঘরে এক হাজার বছর থেকে বের হয়ে এসে দেখবে কার কথা সত্যি। তোমার না আমার?

অশুন অবাক হয়ে নিশির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে কি ঠাট্টা করছে নাকি সত্যি কথা বলছে। কিন্তু নিশির চোখে-মুখে ঠাট্টার কোনো চিহ্ন নেই। সে ইতস্তত করে বলল, কিন্তু এটি বেআইনি কাজ। পৃথিবীতে এভাবে ভবিষ্যতে যাওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে।

নিশি শব্দ করে হেসে বলল, এই আইনকে ফাঁকি দেওয়ার অনেক উপায় আছে অসুন।

কিন্তু–

অশুনকে বাধা দিয়ে নিশি বলল, আমি জানি আমার এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সাহস তোমার নেই। অশুন তুমি আর দশটা পুরুষ মানুষের মতো ভীতু, দুর্বল এবং কাপুরুষ। সবচেয়ে বড় কথা তুমি খুব ভালো করে জান তুমি যদি আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এক হাজার বছর ভবিষ্যতে যাও তা হলে হিমঘর থেকে কের হয়ে দেখবে সারা পৃথিবীতে শুধু মেয়ে, পুরুষ মানুষের কোনো চিহ্ন নেই। তোমাকে যখন দেখবে আমি নিশ্চিত তোমাকে চিড়িয়াখানায় উলঙ্গ করে রেখে দেবে। ভবিষ্যতের মেয়েরা টিকিট কেটে তোমাকে দেখতে আসবে চিড়িয়াখানায়! সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এই মানব প্রাণীটি কেমন করে পৃথিবীতে এসেছিল সেটা নিয়ে কথা বলে তারা সম্ভবত হাসতে হাসতেই মারা যাবে!

অশুন মুখে শ্লেষের হাসি ফুটিয়ে বলল, আর যদি ঠিক তার উল্টো হয়? যদি দেখা যায় সবাই পুরুষ মহিলা বলে কিছু নেই এবং তোমাকেই যদি উলঙ্গ করে চিড়িয়াখানায় রেখে দেয়?

নিশি মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, সেটাই যদি তুমি বিশ্বাস কর তা হলে আমার চ্যালেঞ্জটুকু গ্রহণ করার সাহস তোমার নেই কেন?

কে বলেছে সাহস নেই?

তা হলে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ কর।

অশুন কঠোর মুখে বলল, অবশ্যই গ্রহণ করব। কেন গ্রহণ করব জান?

কেন?

যখন আমরা হিমঘর থেকে বের হয়ে আসব, তখন তোমাকে যেভাবে টেনেহিচড়ে ধ্বংস করে প্রকৃতিকে ত্রুটিমুক্ত করবে সেই দৃশাটি দেখার জন্য। এই দৃশ্যটি দেখে আমি যে আনন্দ পাব পৃথিবীর আর কেউ সে আনন্দ কোনো দিন পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

নিশি মাথা নাড়ল। বলল, আমি তোমার মনের ভাবটি ঠিক ঠিক বুঝতে পারছি অশুন। আমি ঠিক জানি তুমি কী ভাবছ—কারণ আমিও ঠিক একই জিনিস ভাবছি। তোমাকে ধ্বংস হতে দেখার চাইতে বেশি আনন্দ পৃথিবীতে আর কিছুতে নেই। এই পরিচিত জগৎ থেকে এক হাজার বছর ভবিষ্যতের অনিশ্চিত জ্বগতে যেতে আমার কোনো দ্বিধা নেই শুধু এই একটি কারণে, আমি এই তীব্র আনন্দটুকু পেতে চাই। এই আনন্দটুকুর জন্য আমি সবকিছু দিতে পারি।

চমৎকার।

নিশি শীতল গলায় বলল, তুমি তা হলে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলে?

হ্যাঁ করছি।

নিশি এবং অশুন একজন আরেক জনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে এত ভয়ংকর ঘৃণা প্রকাশ পেতে থাকে যে নিজের অজান্তেই দুজনের বুক কেঁপে ওঠে।

* * * * *

স্টিল ভন্টের দরজা খুলে নিশি এবং অশুন হিমঘর থেকে বের হয়ে এল। পৃথিবীতে এর মাঝে এক হাজার বছর পার হয়ে গেছে, যদিও এই দুজনের কাছে মনে হচ্ছে মাত্র কিছুক্ষণ আগে তারা এর মাঝে প্রবেশ করেছে।

নিশি অণ্ডনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী আশ্চর্য! আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তোমার মতো একটি নর্দমার কীটের সাথে আমি এক হাজার বছর কাটিয়ে দিয়েছি!

হ্যাঁ। অশুন একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, ভাগ্যিস আমার দেহ কয়েক ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় ছিল, তোমার কাছে অচেতন না হয়ে থাকার কথা কল্পনা করা যায়?

নিশি ছটফট করে বলল, আমার আর অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই। আমি এই মুহূর্তে বের হয়ে যেতে চাই। দেখতে চাই পৃথিবীতে শুধু মেয়ে আর মেয়ে। আমি চাই তারা মুহূর্তে তোমাকে ধরে নিয়ে যাক, তোমাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলুক।

হ্যাঁ। অশুন মাথা নেড়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমিও আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমরা যখন বের হব তারপর আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না। তোমাকে শেষ একটি কথা বলে যাই।

কী কথা?

তোমাকে যখন ধ্বংস করতে নিয়ে যাবে তখন তুমি একটি জিনিস ভেবে আনন্দ পাবার চেষ্টা করো।

নিশি জিজ্ঞেস করল, কী জিনিস?

তোমার মৃত্যুটি আমাকে অপূর্ব এক ধরনের আনন্দ দেবে। অচিন্তনীয় আনন্দ। তোমার কারণে আমি এই আনন্দটি পেতে পেরেছি।

সেটি নিয়ে কথা না বলে পরীক্ষা করেই দেখা যাক। চল আমরা বাইরে যাই। মানুষ খুঁজে বের করি।

হ্যাঁ চল। অশুন বলল, আর কিছুক্ষণ পর তোমাকে আর কখনোই দেখতে হবে না ব্যাপারটি চিন্তা করেই আনন্দে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।

নিশি মুচকি হেসে বলল, দেখা যাক কে সত্যিই নাচে।

নিশি এবং অশুন বাইরে এসে আবিষ্কার করল চারপাশের পৃথিবীটি তারা যেরকম কল্পনা করেছিল প্রায় সেভাবেই গড়ে উঠেছে। মানুষ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ না করে তার সাথে সহাবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে চারপাশে এক ধরনের শান্ত কোমল পরিবেশ বড় বড় গাছ, নির্মেঘ আকাশ, হ্রদে টলটল জলরাশি। তারা যেখানে আছে সেটি একটি বনাঞ্চল। চারপাশে বিচিত্র বুনোফুল, সেখানে প্রজাপতি খেলা করছে। গাছের ডালে পাখির কিচিরমিচির শব্দ, বাতাসে হেমন্তকালের শীতল বাতাসের স্পর্শ।

দুজনে প্রায় আধাঘণ্টা হেঁটে প্রথমবার একটি লোকালয়কে খুঁজে পেল। ছবির মতো সুন্দর বাসার সামনে নানা বয়সী মানুষ একটি আনন্দমুখর পরিবেশে হইচই করছে। নিশি এবং অশুন নিশ্বাস বন্ধ করে মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। প্রথমে একটি শিশু তাদের দেখে হঠাৎ আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে এবং অন্যরা তাদের দিকে এগিয়ে আসে, কিছুক্ষণের মাঝেই নানা বয়সী মানুষ এক ধরনের বিস্ময়াভিভূত চোখ নিয়ে তাদের ঘিরে পাড়ায়। নিশি এবং অশুন মানুষগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করে এরা কি পুরুষ নাকি নারী? কিন্তু তারা বুঝতে পারে না। মানুষগুলো অবোধ্য ভাষায় কথা বলছে, তারা কিছু বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণের মাঝেই একজন একটি ভাষা অনুবাদক যন্ত্র নিয়ে আসে। মধ্যবয়স্ক মানুষটি সেটি মুখে লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কী? তোমরা কোথা থেকে এসেছ?

নিশি এবং অন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, এটি কী ধরনের প্রশ্ন? অন বলল, আমরা মানুষ। আমরা সুদূর অতীত থেকে এসেছি।

কী আশ্চর্য! কম বয়সী একজন আশ্চর্যধ্বনি করে বলল, তোমরা দুজন দেখতে দুরকম কেন?

নিশি এবং অশুন এই প্রথমবারের মতো নিজেদের ভেতর সূক্ষ্ম এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। নিশি কঁপা গলায় বলল, আমরা দুজন দেখতে দুরকম কারণ আমাদের একজন নারী অন্যজন পুরুষ।

নিশির কথা শুনে আতঙ্কের একটা শব্দ করে সবাই এক পা পিছিয়ে যায়। মানুষগুলো ফিসফিস করে ভয় পাওয়া গলায় বলে, সর্বনাশ! পুরুষ নারী!

মানুষগুলো একটু দূর থেকে তাদের ভয় পাওয়া চোখে দেখতে থাকে। ছোট ছোট শিশুগুলো বড়দের পেছনে লুকিয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক মানুষটি কঁপা গলায় বলল, সর্বনাশ হয়েছে। প্রাচীনকালের পুরুষ আর নারী চলে এসেছে! এক্ষুনি নিরাপত্তাকর্মীদের ডাক।

নিশি অবাক হয়ে বলল, তোমরা এত অবাক হচ্ছ কেন? তোমরা কি নারী না পুরুষ?

মানুষগুলো কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিশি এবং অশুন বুঝতে পারে মানুষগুলোর চেহারা পুরুষ বা নারী দুইই হতে পারে। তারা আগে কখনো এরকম চেহারার মানুষ দেখে নি। অশুন বলল, তোমরা কথা বলছ না কেন? তোমরা কি পুরুষ না নারী?

মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, নারী-পুরুষ এইসব আদিম বিভাজন বহুঁ আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন এখানে নারী-পুরুষের মতো কোনো ভাগ নেই। এখানে সবাই মানুষ!

কিন্তু—কিন্তু–

কিন্তু কী?

নারী আর পুরুষ যদি না থাকে তা হলে শিশুদের জন্ম হয় কেমন করে?

শিশুদের জন্ম হয় না। ডিজাইন করে তৈরি করা হয়।

কে তৈরি করে।

আমাদের ল্যাবরেটরিতে।

নিশি কাঁপা গলায় বলল, তোমরা তোমাদের শিশুদের ভালবাস?

কেন ভালবাসব না? আমাদের সবাইকে নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছে। বুদ্ধি দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে, স্বপ্ন দিয়ে। তোমরা সেটা বুঝবে না।

কেন বুঝব না? নিশি প্রশ্ন দৃষ্টিতে বলল, না বোঝার কী আছে?

আমরা জানি প্রাচীনকালে মানুষের মস্তিষ্ক অপরিণত ছিল। তারা পুরুষ-মহিলা, সাদাকালো, জাতি-ধর্ম-ভাষা এসব নিয়ে মাথা ঘামাত। এখন আমরা তার ঊর্ধ্বে এসেছি।

কিন্তু–অশুন বলল, কিন্তু–

তোমরা বুঝবে না। মধ্যবয়স্ক মানুষটি এক ধরনের ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমার মনে হয় তোমাদের এখনই নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নিয়ে যাওয়া দরকার।

নিশি এবং অশুন ঠিক তখন এক ধরনের চাপা যান্ত্রিক শব্দ শুনতে পেল। তারা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল, আকাশপথে নিরাপত্তাকর্মীরা আসছে। নিশি এবং অন একজন। আরেকজনের দিকে তাকাল, তাদের দৃষ্টিতে ঘৃণার সাথে সাথে এই প্রথমবারের মতো আতঙ্কের ছায়া ফুটে ওঠে।

* * * * *

ভবিষ্যতের পৃথিবীতে নিশি এবং অশুন দীর্ঘদিন বেঁচে ছিল। তাদেরকে একটা ছোট ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি একজনের প্রতি অন্যজনের প্রচণ্ড ঘৃণা তাদেরকে এই দীর্ঘসময় বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিল।

০৩. সুহানের স্বপ্ন

১.

সুহান চিঠিটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল, সোনালি রঙের চতুষ্কোণ বড় খাম, খামের ডান পাশে হলোগ্রাফিক সরকারি সিল। সাধারণ মানুষের মতো তার যদি একটা ভিডিফোন থাকত তা হলে নিশ্চয়ই এরকম বড় একটা খামে করে তার কাছে চিঠি পাঠাত না সরাসরি ভিডিফোনে কথা বলত। ভিডিফোন নেই বলে তার কাছে এরকম একটা চিঠি পাঠাতে হয়েছে, নিশ্চয়ই কত জায়গা ঘুরে ঘুরে তার কাছে চিঠিটা এসেছে। রুরাক কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে চোখ বড় বড় করে বলল, এটা কী?

সুহান বলল, চিঠি। সরকার থেকে এসেছে।

রুরাক অবাক হয়ে বলল, চিঠিঃ কী আশ্চর্য! তারপর আশ্চর্য হবার ভঙ্গি করার চেষ্টা করতে লাগল।

সুহান রুরাকের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে জানে রুরা আসলে আশ্চর্য হয় নি, তার অপরিণত মস্তিস্কের আশ্চর্য হবার ক্ষমতা নেই, সে শুধু স্বাভাবিক মানুষের মতো আশ্চর্য হবার, খুশি হবার এবং দুঃখ পাবার ভঙ্গি করে। রুদ্রাক আরেকটু কাছে এসে বলল, চিঠিটা খোলো, দেখি কী আছে ভেতরে।

সুহান বলল, খুলতে হবে না, আমি জানি ভেতরে কী আছে। রুককে এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত দেখায়, সে ঠিক বুঝতে পারছে না সুহান কী বলছে। আমতা-আমতা করে বলল, না খুলেই তুমি জান?

হ্যাঁ। আমি একটা চাকরি পেয়েছি।

চাকরি পেয়েছ? তুমি? রুরাকের মুখে প্রথমে এক ধরনের অবিশ্বাস তারপর হঠাৎ আনন্দের ছাপ পড়ল, সত্যি, তুমি চাকরি পেয়েছ?

হ্যাঁ। চাকরি না দিলে এরকম সরকারি চিঠি আসে না। সুহান একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমি কত দিন কত জায়গায় চাকরির জন্য চিঠি লিখেছি—এর আগে কেউ কোনো চিঠির উত্তর দেয় নাই। এই প্রথম চিঠি এসেছে, তার মানে একটা চাকরি।

রুরাককে এবারে সত্যিই উত্তেজিত দেখায়, সে জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি সবাইকে গিয়ে বলি?

দাঁড়াও, আগে খামটা খুলে সত্যি সত্যি দেখে নিই!

রুরাক ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইল, খামের ভেতর হালকা নীল রঙের একটা চিঠি, উপরে সরকারি সিল, স্মারক নম্বর, হলোগ্রাফিক চিহ্ন, নিচে গোটা গোটা টাইপে লেখা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি। রুরাক দুই একটা অক্ষরের বেশি পড়তে পারে না তারপরও সে চিঠির ওপর ঝুঁকে পড়ল। সুহান চিঠিটা পড়ে মাথা নাড়ল, বলল, । আসলেই আমি চাকরি পেয়েছি।

রুরাক বিস্ময়াভিভূতভাবে সুহানের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তার মানে তোমার একটা ভিডিফোন হবে, গাড়ি হবে?

সুহান হেসে ফেলল। একটা বড় ডাটাবেস অফিসে সিকিউরিটির চাকরি, যে বেতনের কথা লিখেছে সেটা দিয়ে ভালো করে খেতে-পরতে পারবে কিনা সেটাই সন্দেহ! কিন্তু রুরাককে এসব বলে লাভ নেই, তার অপরিণত মস্তিষ্কের জন্য সেটা খুব বেশি হয়ে যাবে,

সে বলল, একদিনে তো হবে না। আস্তে আস্তে হবে।

রুস্রাক উত্তেজিত গলায় বলল, তোমার যখন ভিডিফোন হবে তখন আমাকে সেটা দিয়ে কথা বলতে দেবে?।

সুহান হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, কার সাথে কথা বলবে?

রুরাক বলল, এখন বলব না।

আমি জানি তুমি কার সাথে কথা বলবে।

রাক একটু শঙ্কিত হয়ে বলল, কার সাথে?

নাতালিয়ার সাথে।

রুরাকের চোখে-মুখে প্রথমে অবিশ্বাস এবং হঠাৎ করে এক ধরনের ছেলেমানুষি হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, আমি আসলে নাতালিয়ার সাথেই কথা বলতে চাই। একটু ইতস্তত করে বলল, তোমার কী মনে হয় সুহান, নাতালিয়া কি আমার সাথে কথা বলবে?

নাতালিয়া টেলিভিশনের একটা সস্তা বিনোদন অনুষ্ঠানের নায়িকা, সে সত্যিকার চরিত্র নয়, এনিমেশন করে তৈরি করা হয়েছে কিন্তু রুরা সেটা কখনো ধরতে পারে না। এই কাল্পনিক কমবয়সী মেয়েটার জন্য তার অনুরাগের কথা অনাথাশ্রমের সবাই জানে। সুহান রুককে আশ্বস্ত করে বলল, বলবে না কেন অবশাই বলবে!

নাতালিয়ার সাথে সে ভিডিফোনে কথা বলছে ব্যাপারটা কল্পনা করে রুকু পরিতৃপ্ত মুখে একটা নিশ্বাস ফেলল। সে কোনো বিষয় নিয়েই বেশি সময় চিন্তা করতে পারে না, এবারেও পারল না। আবার সে আগের বিষয়ে ফিরে এসে বলল, এবার তা হলে আমি সবাইকে গিয়ে বলি যে তোমার চাকরি হয়েছে?

তোমার ইচ্ছে রুরাক!

কিছুক্ষণের মাঝেই অনাথাশ্রমের সবাই জেনে গেল যে সুহান একটা চাকরি পেয়েছে। কী চাকরি, কোথায় চাকরি, কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না, সে চাকরি পেয়েছে সেটাই বড় কথা। এই অনাথাশ্রমে যারা থাকে তাদের সবাই জিনেটিক দিক দিয়ে ক্যাটাগরি-বি. গ্রুপের। অনেকেই অপরিণত-বুদ্ধির মানুষ, পৃথিবীর জটিল বিষয়গুলো তারা বুঝতে পারে না, কিন্তু তারপরও এটুকু জানে যে চাকরি পেয়ে এখান থেকে চলে যাওয়া বিষয়টা খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। যারা এই অনাথাশ্রম থেকে বাইরে যেতে পারে। না তাদের জীবনটা খুব দুঃখের জীবন। যারা এখানে থাকে তারা সেই জীবন নিয়ে কথা। বলতে চায় না। তাই একজন একজন করে অনাথাশ্রমের সবাই সুহানের কাছে এল, তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। যারা খুশি হয়েছে তারা যেরকম তাদের আনন্দটুকু গোপন রাখে নি, ঠিক সেরকম যারা ঈর্ষান্বিত হয়ে আছে তারাও তাদের ঈর্ষাটুকু গোপন রাখল না। সবাই চলে যাবার পর সুহান সরকারের সোনালি রঙের খামটা হাতে নিয়ে বের হয়। অনাথাশ্রমের দেয়ালঘেরা কম্পাউন্ডের এক কোনায় ছোট একটা বাসায় অনাথাশ্রমের ডিরেক্টর লারার বাসা। লারা মধ্যবয়সী হাসিখুশি মহিলা, সুহানকে খুব স্নেহ করে, তাকে খবরটা দেওয়া দরকার।

ঘরের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে লারা ভিডিফোনে কার সাথে জানি কথা বলছিল, সুহানকে দেখে ভিডিফোনটা ভাঁজ করে সরিয়ে রেখে বলল, কী খবর সুহান?

লারা, আমি একটা চাকরি পেয়েছি।

সত্যি? লারার চোখে-মুখে আনন্দের ছায়া পড়ল, কী চমৎকার!

সুহান কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইল। লারা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, কী হল সুহান—তুমি খুশি হও নি?

সুহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর ফিসফিস করে বলল, ডাটাবেসের একটা অফিসে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি। বেতন তিন শ বিশ ইউনিট। দুই বছর অবেক্ষণ।

লারা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নরম গলায় বলল, সুহান, আমি খুব দুঃখিত যে তুমি তোমার ক্ষমতার উপযুক্ত একটা কাজ পেলে না। আমি জানি তুমি একটা কলেজের শিক্ষক হবার ক্ষমতা রাখ, ইচ্ছে করলে তুমি ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার হতে পারতে

সুহান মাথা নাড়ল, বলল, না লারা, আমি পারতাম না। আমি জিনেটিক গ্রুপে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। এই পৃথিবীতে ক্যাটাগরি-বি. মানুষের কোনো জায়গা নেই।

লারা চুপ করে রইল, কারণ কথাটা সত্যি। মানুষের জিনেটিক প্রোফাইল দেখে তাদেরকে জিনেটিক-এ, এবং বি, এই দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে।

এ ক্যাটাগরির মানুষেরা দেশের প্রকৃত নাগরিক। তাদেরকে লেখাপড়ায় সুযোগ দেওয়া হয়, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। নির্বাচনের সময় তারা ভোট দিতে পারে, সরকারি চাকরি পেতে পারে, ক্যাটাগরি-বি. গ্রুপের মানুষের কোনো সুযোগ নেই। শোনা যাচ্ছে আইন করে ক্যাটাগরি-বি. গ্রুপের মানুষকে অবমান নামে একটা গোষ্ঠীতে ফেলা হবে, তখন তাদের জীবনের কোনো মূল্য থাকবে না। তাদেরকে বিপজ্জনক কাজের মাঝে ঠেলে দেওয়া হবে, গবেষণার কাজে তাদেরকে ব্যবহার করা যাবে, এমনকি তাদেরকে কেউ খুন করে ফেললেও কোনো বিচার হবুে না।

সুহান বলল, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ-—আমাকে এই চাকরিটা দেবার পেছনে কোনো একটা কারণ আছে।

কী কারণ?

নিশ্চয়ই এই চাকরিটা মানুষের জন্য খুব বিপজ্জনক তাই এটা আমাকে দিয়েছে। নিশ্চয়ই ছয় মাসের ভেতর আমি মারা পড়ব?

লারা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, কেন তুমি আগেই এরকম করে ভাবছ? হয়তো চাকরিটা ভালো। হয়তো যাদের সাথে কাজ করবে তারাও চমৎকার মানুষ—

সুহান লারাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, হতে পারে, কিন্তু আমি কাটাগরি-বি, মানুষ, আমার সাথে চমৎস্কার হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।

লারার মুখে বেদনার একটা ছায়া পড়ল। সে নিচু গলায় বলল, এই ক্যাটাগরি-এ, আর ক্যাটাগরি-বি.-এর পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে এক ধরনের পাগলামি, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা সত্যিই ঘটে গেছে। তোমার উদাহরণটাই দেখ আমি তো তোমার মতো চমৎকার বুদ্ধিমান মানুষ আগে দেখি নি, অথচ সরকারিভাবে তুমি ক্যাটাগির-বি, মানুষ! রসিকতার তো একটা মাত্রা থাকা দরকার।

সুহান জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ লারা আমার সম্পর্কে এরকম একটা সুন্দর কথা বলার জন্য।

তোমাকে খুশি করার জন্য তো বলি নি। সত্যি জেনেই বলেছি। লারা সুর পাল্টে বলল, এস, ভেতরে এস এক কাপ কফি খাও।

সুহান ম্লান মুখে বলল, সত্যি তুমি কফি খেতে ডাকছ?

লারা অবাক হয়ে বলল, কেন সত্যি ডাকব না?

তুমি জান না ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে বাসার ভেতরে আনা তৃতীয় মাত্রার অপরাধ?

লারা স্থির দৃষ্টিতে সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে এই ক্যাটাগরির বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে হবে সুহান। যখন কেউ তোমাকে নিজের মানুষ বলে গ্রহণ করতে চাইবে তখন তোমাকে সেটা গ্রহণ করতে হবে। মনে রেখ এই ভাগাভাগিটা কৃত্রিম, মানুষের সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। সরকার এটা করে ফেললেও সত্যিকার অর্থে মানুষ। ভাগাভাগি হয় নি।

সুহান লারার বেদনাহত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি দুঃখিত লারা, আমি আসলে তোমাকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে চাই নি।

আমি জানি সুহান। লারা ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আমার মনে হয় তুমি খুব চমৎকার একটা সুযোগ পেয়েছ। যদি তুমি এই চাকরিটা না পেতে তোমাকে হয়তো সামনের বছরেই ইউরিনিয়াম খনিতে যেতে হত। কিংবা কে জানে তোমার এই সুস্থ সবল শরীর দেখে তোমাকে হয়তো মহাকাশ গবেষণার কোনো পরীক্ষায় ঢুকিয়ে দিত।

সেটা এখনো করতে পারে।

তা হয়তো পারে–কিন্তু তারপরও তুমি এই সুযোগটা পেয়েছ। সামনাসামনি কারো প্রশংসা করতে হয় না, কিন্তু তবু করছি। তুমি অসম্ভব বুদ্ধিমান, তুমি উৎসাহী আর পরিশ্রমী। তুমি যত তুচ্ছ কাজ দিয়েই শুরু কর না কেন, তুমি উপরে উঠে আসবে। আমি তোমার সাথে বাজি রেখে এ কথাটা বলতে পারি।

সুহান কোনো কথা বলল না, তার মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসি এক মুহূর্তের জন্য উঁকি দিয়ে গেল। লারা ভুরু কুঁচকে বলল, কী হল তুমি ওভাবে হাসছ কেন?

সুহান মাথা নেড়ে বলল, তোমার কথা শুনে। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি বুঝি একজন সত্যিকারের মানুষ।

লারা মাথা ঘুরিয়ে তীব্র স্বরে বলল, সুহান তোমাকে জানতে হবে যে তুমি সত্যিই একজন মানুষ। তুমি ক্যাটাগরি-বি হতে পার, কিন্তু ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। অন্য কিছু নও। নিজের ওপরে সেই বিশ্বাসটা রাখতে হবে। বুঝেছ?

সুহান মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। আমি দুঃখিত লারা, আমি এরকমভাবে কথা বলছি। আমি আসলেই দুঃখিত।

ব্যস অনেক হয়েছে। এখন আমাকে কফির কৌটাটা নামিয়ে দাও। উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এই কফিটা এসেছে-ভারি চমৎকার খেতে। এর মাঝে দুই ফেঁটা স্নায়ু উত্তেজক নির্যাস দিয়ে দেব, দেখ খাওয়ার সাথে সাথে তোমার মনটা কত ভালো হয়ে যায়।

সুহান মুখে হাসি টেনে বলল, তা হলে দুই ফোটা কেন, বেশি করেই দাও। পারলে পুরো বোতলটাই ঢেলে দাও!

সুহানের কথা বলার ভঙ্গি শুনে লারা হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল—হাসি খুব চমৎকার একটা ব্যাপার, হঠাৎ করে এই ঘরের ভেতরকার গুমট এবং অবরুদ্ধ যন্ত্রণা ও হতাশাটুকু কেটে সেখানে এক ধরনের স্নিগ্ধ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে।

 

সুহান একটা পাইন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অনাথাশ্রমের বড় দালানটার দিকে তাকিয়ে রইল। শ্রীহীন নিরানন্দ এই কংক্রিটের দালানটার জন্য সে হঠাৎ এক ধরনের বেদনা অনুভব করে, তার জীবনের বড় একটা অংশ সে এই কংক্রিটের দেওয়ালের ভেতরে কাটিয়ে এসেছে। এখানে আসার আগে সে আরো দুই একটা অনাথাশ্রমে বড় হয়েছে কিন্তু সেগুলোর কথা সে স্পষ্ট মনে কতে পারে না। নিষ্ঠুর ভালবাসাহীন কিছু মানুষের সাথে দীর্ঘ নিরানন্দ দিন, চাপা ভয় এবং আতঙ্ক ছাড়া তার আর কিছু মনে পড়ে না। যে বয়সে শিশুরা মা-বাবার আশ্রয়ে, পরিবারের ভালবাসায় বড় হয় সেই বয়সে সে শিখে গিয়েছিল এই পৃথিবী অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং স্বার্থপর। সে জেনে গিয়েছিল এখানে সে অপাঙক্তেয় এবং অনাকাক্ষিত। তাকে বোঝানো হয়েছিল সে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ, তার কোনো ভবিষ্যৎ নেই, একটা পশুর জীবনের সাথে তার জীবনের কোনো পার্থক্য নেই, তার থেকে বেশি স্বপ্ন দেখার তার কোনো অধিকার নেই। তবু সে স্বপ্ন দেখেছে, তার চারপাশে তার চাইতেও হতভাগ্য যে মানুষগুলো ছিল সে তাদেরকেও স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছিল। খুব যে আহামরি স্বপ্ন তা নয়, কিন্তু আজকের দিন থেকে আগামী দিনটা যে আরো সুন্দর হবে সেই বিশ্বাসের স্বপ্ন।

সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে কুশ্রী কংক্রিটের দালান্টার দিকে এগিয়ে আসে। রাতের অন্ধকারও এই দালানটার দীনতা ঢাকতে পারছে না, কিন্তু তারপরও হঠাৎ করে সুহান এই কদাকার কংক্রিটের দালানটার জন্য এক ধরনের গভীর মমতা অনুভব করে। তার সুদীর্ঘ জীবনের এই আবাসস্থল ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে, সে সম্ভবত আর কখনোই এখানে আসবে না। এই অনাথাশ্রমের মানুষগুলোকে সে আর কখনোই দেখবে না। কিশোর রুদ্রাকের পুরোপুরি অর্থহীন যুক্তিতর্ক তাকে আর শুনতে হবে না। অপরিণত-বুদ্ধি তরুণী দিনিয়ার অর্থহীন হাসির শব্দ শুনে সে আর ঘুম থেকে জেগে উঠবে না। গভীর রাতে কোনো এক দুঃখী মেয়ের ইনিয়েবিনিয়ে কান্নার শব্দ শুনে সে নিদ্রাহীন চোখে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে না। অপ্রকৃতিস্থ দ্রুমার উন্মত্ত ক্রোধকে সংবরণ করার জন্য তাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে স্নায়ু শীতল করার ইনজেকশন দিতে হবে না। সুহান এই দালানের ভেতর থেকে কত দিন বাইরে যাবার স্বপ্ন দেখেছে, শেষ পর্যন্ত যখন তার স্বপ্নটা সত্যি হবার সময় এসেছে হঠাৎ করে মনে হচ্ছে এই নিরানন্দ দালানটাই বুঝি তার সত্যিকারের আশ্রয়, এখানকার অপরিণত-বুদ্ধি মানুষগুলোই বুঝি তার সত্যিকারের আপনজন।

সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে করিভোর ধরে হাঁটতে থাকে। কাল ভোরে সে তার এই অনাথাশ্রম ছেড়ে চলে যাবে। আনুষ্ঠানিকভাবে সে কারো কাছ থেকে বিদায় নেবে না। ছোট একটা ব্যাগে তার কিছু কাপড়, দুই একটা বই, কিছু তথ্য—ক্রিস্টাল, দৈনন্দিন ব্যবহারের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে সে এখান থেকে বের হয়ে যাবে। ক্যাটাগরি-বি. মানুষ বলে সে এই অনাথাশ্রম থেকে খুব বেশি বের হয় না, শহরের কোথায় কী আছে সে খুব ভালো করে জানে না। কিন্তু সে খুঁজে বের করে নেবে। তার কাছে কিছু ইউনিট আছে, লারা জোর করে তার একাউন্টে আরো এক শ ইউনিট প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। আগামী কয়েক সপ্তাহ তার থাকা-খাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। লারা বলেছে তার সরকারি চিঠিটা দেখালে তাকে কোনো ইউনিট ছাড়াই ট্রেনে উঠতে দেবে, স্বল্পমূল্যের হোটেলে থাকতে দেবে, এমনকি রেস্টুরেন্টে খেতেও দেবে। সরকারি চিঠিতে যে তারিখ দেওয়া আছে যে করেই হোক তার ভেতরে অবিশ্যি তাকে সেই তথ্যকেন্দ্রে পৌঁছাতে হবে। সুহান নিশ্চয়ই তার ভেতরে পৌঁছে যাবে। সে অনাথাশ্রমে একা একা বড় হয়েছে, বাইরের পৃথিবী নিয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু সে জানে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই সে সবকিছু সামলে নিতে পারবে। সে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ হতে পারে কিন্তু সে জানে সে অনা সবার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। সেটা কাউকে বোঝানো যাবে না সত্যি, কিন্তু সুযোগ পেলে সুহান সেটা প্রমাণ করে দিতে পারবে। সুহান জানে হয়তো সে জীবনে কখনোই সেই সুযোগ পাবে না, হয়তো কেউ তাকে সে সুযোগটা দেবে না। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, জীবনটা তার কাছে যেভাবে আসবে সে সেভাবেই গ্রহণ করবে, সেভাবেই চেষ্টা করবে। সে কখনো চেষ্টা করা ছেড়ে দেবে না। কোনো একটা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে সে পড়েছে সফল হওয়া বড় কথা নয় সফল হওয়ার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে বড় কথা। প্রাচীনকালে মানুষ যখন ধর্মকে বিশ্বাস করে সবকিছু কোনো প্রশ্ন না করে মেনে নিত তখন কি জীবনটা অনারকম ছিল? সুহান বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ঠিক এই সময় হঠাৎ সে কান্নার শব্দ শুনতে পেল। কেউ একজন ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছে।

আহা! এই চার দেওয়ালের মাঝখানে কত দুঃখই না জানি লুকিয়ে আছে।

 

০২.

অফিসের দরজা বন্ধ। লোকজন তাদের কার্ড ঢুকিয়ে ভেতরে যাচ্ছে এবং আসছে, সুহানের কোনো কার্ড নেই, সে কেমন করে ঢুকবে বুঝতে পারল না। অন্য একজনের পিছু পিছু ঢুকে যাবার চেষ্টা করাটা নিশ্চয়ই একটা বেআইনি কাজ হবে, সে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ এরকম একটা কাজের ঝুঁকি নেওয়া মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মোটামুটি সদয় চেহারার একজন মানুষকে দেখে সে এগিয়ে গেল, এই যে একটু শুনুন।

মানুষটা ভুরু কুঁচকে তাকাল এবং মুহূর্তে সদয় মানুষটাকে অত্যন্ত কঠিন চেহারার রূঢ় একজন মানুষ বলে মনে হতে থাকে। সুহান হড়বড় করে বলল, আমার একটু এই অফিসের ভেতরে যাওয়া দৰ্বকার।

দরকার হলে যাও। তোমাকে তো কেউ নিষেধ করছে না।

সুহান ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আমার কাছে কোনো কার্ড নেই।

কার্ড নেই? মানুষটার কথা শুনে মনে হল সে যদি বলত আমার মাথা নেই তা হলে সে আরো কম অবাক হত। খানিকক্ষণ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে বুঝতে না পেরে বলল, কার্ড নেই কেন?

সূহান বিব্রত হয়ে বলল, আমি আসলে কাটাগরি-বি. মানুষ।

ক্যাটাগরি-বি? সুহান লক্ষ করল মানুষটা সাবধানে একটু পিছিয়ে গেছে যেন ক্যাটাগরি-বি. মানুষের এক ধরনের ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগ রয়েছে। তুমি যদি ক্যাটাগরি বি, মানুষ হয়ে থাক তা হলে এখানে ঢোকার চেষ্টা করছ কেন?

সুহান তাড়াতাড়ি পকেট থেকে সরকারের হলোগ্রাম দেওয়া চিঠিটা বের করে বলল, এই যে, সরকার এই চিঠিতে আমাকে এখানে এসে যোগাযোগ করতে বলেছে।

মানুষটা চিঠিটা না ছুঁয়ে মাথাটা এগিয়ে দিয়ে চিঠিটা একনজর দেখে বলল, ও!

আপনি যদি ভেতরে সিকিউরিটির একজনকে বলেন একটু আমাকে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিতে–

ঠিক আছে। বলব। মানুষটা আরেকবার সুহানকে আপাদমস্তক দেখে ভেতরে ঢুকে গেল।

সুহান আবার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, সে কিছুতেই অসহিষ্ণু হবে না, ধৈর্য ধরে সে অপেক্ষা করবে। সমস্ত পৃথিবী একটা অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতির মাঝে ঢুকে গেছে, সে দুর্ভাগা তাই সে এর বাইরে। তাই যতবার সে এই পদ্ধতির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে ততবার ধাক্কা খেতে হচ্ছে। অনাথ আশ্রম থেকে এই পর্যন্ত আসতে তার কি কম ঝামেলা হয়েছে? প্রতিটা পদক্ষেপে তার কাউকে না কাউকে কিছু একটা জবাবদিহি করতে হয়েছে। সম্পূর্ণ অকারণে তাকে নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে। সে হাসিমুখে সব সহ্য করবে, কারণ সে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ হয়ে সত্যিকারের মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে চায়। অকারণেই সুহান তার মুখ শক্ত করে যখন চতুর্থবার বিল্ডিংটার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আবার উপরে উঠে এলো তখন হঠাৎ করে একটা দরজা খুলে যায়। হালকা-পাতলা একজন মানুষ বের হয়ে বলল, এখানে কে ক্যাটাগরি-বি.?

সুহান তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়, আমি।

হালকা-পাতলা মানুষ ভুরু কুঁচকে বলল, কী হয়েছে?

সুহান পকেট থেকে হলোগ্রাম দেওয়া চিঠিটা বের করে আবার পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, কিন্তু মানুষটা তার আগেই বলল, এস। ভেতরে এস।

ভেতরে চারদিকে খোপ খোপ অফিস এবং তার ভেতরে মানুষ কাজ করছে। হালকাপাতলা মানুষটা তাকে একটা খোপের দিকে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে সোনালি চুলের একজন মহিলা ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাল। সুহান তাকে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার কাছে এই চিঠিটা এসেছে, আমাকে বলেছে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে।।

মহিলাটা সবিস্ময়ে বলল, চিঠি? মহিলার কথা শুনে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকে মাথা ঘুরিয়ে সুহানের দিকে তাকাল। চিঠি একটা প্রাগৈতিহাসিক বিষয়, আজকাল কোনো কাজেই চিঠি ব্যবহার করা হয় না। মহিলাটা বলল, চিঠি কেন? তোমাকে ভিড়িফোনে জানাল না কেন?

আমার ভিডিফোন নেই।

অতান্ত দরিদ্র মানুষ বা হতভাগা ধরনের মানুষের কখনো কখনো ভিডিফোন থাকে না, তাকেও সেরকম একজন ধরে নিয়ে মহিলাটা বলল, কেন? ভিডিফোন নেই কেন?

সুহান বিষয়টাকে আরো জটিল করে না ফেলে সোজাসুজি বলে দিল, আমি আসলে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ।

মহিলাটা এবারে রীতিমতো চমকে উঠে সোজা হয়ে বসে বলল, ক্যাটাগরি-বি.?

হ্যাঁ। তা হলে তুমি এই চিঠি কেমন করে পেয়েছ?

এ প্রশ্নের উত্তর সুহানের জানার কথা নয় কাজেই সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মহিলাটা সরকারি চিঠিটা স্ক্যান করিয়ে নেয়, সুহান দেখতে পায় স্ক্রিনে তার ছবি বের হয়ে এসেছে। মহিলাটা কিছুক্ষণ ছবিটা পরীক্ষা করে তার দিকে ডিএনএ প্রোফাইল বের করার ছোট যন্ত্রটা এগিয়ে দেয়। সুহান টিউবে তার আঙুলটা প্রবেশ করাতেই মৃদু একটা খোঁচা অনুভব করে। তার শরীরের টিস্যু নিয়ে সেটা বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়ে নেয় যে এই চিঠির বাহক আসলেই যাকে উদ্দেশ করে চিঠি পাঠানো হয়েছে সেই একই মানুষ।

মহিলাটা এবারে সুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখন এই সাদা বৃত্তের ভেতরে দাড়াও। এখন তোমার ছবি নেওয়া হবে। এগুলো হলোগ্রাফিক ছবি, কাজেই তুমি নড়বে না।

মহিলাটা কথা বলল ধীরে ধীরে বেশ স্পষ্ট করে, ছোট বাচ্চাদের সাথে একজন বড় মানুষ যেভাবে কথা বলে অনেকটা সেভাবে। মহিলাটা ধরে নিয়েছে সে যেহেতু ক্যাটাগরিবি, মানুষ কাজেই সে নির্বোধ এবং স্বল্পবুদ্ধির, তাকে সবকিছু আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বলে না দিলে সে বুঝবে না। সুহান ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে এবং শেষ পর্যন্ত মহিলাটা তার হাতে ছোট একটা কার্ড ধরিয়ে দেয়।

সুহান কার্ডটা হাতে নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে, তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে যে, দেশের সত্যিকার নাগরিকের মতো তার একটা পরিচয় আছে। পথেঘাটে যদি কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে তোমার পরিচয় তখন তাকে আমতা-আমতা করে কৈফিয়ত দিতে হবে না। সে ইচ্ছে করলে অন্য দশজনের মতো মিউজিয়ামে যেতে পারবে, লাইব্রেরিতে যেতে পারবে এমনকি বড় কোনো দোকানে গিয়ে কিছু উত্তেজক পানীয় কিনতে পারবে। কার্ডের এক কোনায় বেশ বড় বড় করে ক্যাটাগরি-বি. কথাটা লেখা আছে কিন্তু লেখা থাকলেও এটা সত্যিকারের একটা কার্ড।

মহিলাটা বলল, এই কার্ডটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা সব সময় তোমার কাছে রাখবে। কার্ডটা যদি হারিয়ে যায় সাথে সাথে সেটা নিরাপত্তা দপ্তরে জানাবে। এই কার্ডে তোমার হলোগ্রাফিক ছবি, ডিএনএ প্রোফাইল দেওয়া আছে, কাজেই অন্য কেউ এটা ব্যবহার করতে পারবে না। এই কার্ড সাত শ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে, পানিতে ভিজলে নষ্ট হবে না, পিএইচ দুই থেকে বারো পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। মেডিকেল ইমার্জেন্সির সময়…।

মহিলাটা তোতাপাখির মতো মুখস্থ বলে যেতে থাকে, তবে কথাগুলো বলল ধীরে ধীরে বেশ স্পষ্টভাবে যেন সুহানের বুঝতে অসুবিধা না হয়! মহিলাটার কথা শেষ্য হওয়ার পর সুহান তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে আসে। ভেতরে ঢোকার জুনা তার অনেক ঝামেলা করতে হয়েছিল বের হল খুব সহজে। দরজায় কার্ডটা স্পর্শ করানোর সাথে সাথে দরজাটা খুলে যায়, সুহান মাথা উঁচু করে বের হয়ে আসে।

সুহান শহরে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। মানুষজন বাস্তু হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় অফিস। মাঝে মাঝে খানিকটা জায়গা ঘিরে ঘিরে সুদৃশ্য দোকানপাট। পাতাল ট্রেন এসে থামছে—ওপরে মনোরেল, টাক্সি এবং বাস। সুহান ইচ্ছে করলে এসব জায়গায় এখন ঢুকতে পারবে কেউ তাকে থামাবে না। সে ছোট একটা খাবার দোকানে ঢুকে অর্ধেক ইউনিট খরচ করে এক বাটি সুপ আর প্রোটিনে মোড়ানো দুই টুকরো রুটি খেয়ে নেয়। একটা যোগাযোগ কেন্দ্রে ঢুকে আধা ইউনিট খরচ করে সে নিজের জন্য একটা ভার্চুয়াল ঠিকানা তৈরি করে নিল। এখন সে যে কোনো মানুষের কাছে এখান থেকে যোগাযোগ করতে পারবে। রাতটা কোথায় কাটাবে সে জানে না, তবে আগামী দুদিনের মাঝে তার তথ্যকেন্দ্রে। গিয়ে উপস্থিত হওয়ার কথা। সুহান সাত-পাঁচ ভেবে এখনই তার কাজে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। পাতাল ট্রেন স্টেশন থেকে বের হয়ে তাকে প্রায় কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হল। জায়গাটা শহরের বাইরে এবং বেশ নির্জন। পাশাপাশি কয়েকটা নিচু দালানের একটা তার তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিন। সে ঠিকানা মিলিয়ে নিশ্চিত হয়ে দরজায় তার কার্ডটা প্রবেশ করাতেই একটা এলার্ম বাজতে থাকে। কিছুক্ষণেই ঘড়ঘড় শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল এবং সুহান দেখল দুজন সশস্ত্র মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সুহান ভয়ে ভয়ে বলল, আমি একটা সরকারি চিঠি পেয়েছি যেখানে আমাকে বলা হয়েছে–

সশস্ত্র প্রহরী দুজনের একজন তার অস্ত্রটা নাড়িয়ে বলল, এস আমার সাথে।

একজন সুহানের সামনে আরেকজন পেছনে থেকে তাকে নানা করিডোর হটিয়ে একটা ঘরে এনে জির করল। সেখানে রাগী চেহারার একজন মহিলা সুহানের হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে তার যোগাযোগ মডিউলে প্রবেশ করিয়ে দিতেই স্ক্রিনে তার ছবি ফুটে ওঠে। রাগী মহিলাটা ছবির সাথে সুহানের চেহারা মিলিয়ে নিয়ে চোখের রেটিনা স্ক্যান করার জন্য যন্ত্রটা তার দিকে এগিয়ে দেয়, সুহান যন্ত্রটাতে তার চোখ লাগিয়ে তাকিয়ে রইল, নিশ্চয়ই অবলাল আলোতে স্ক্যান করিয়েছে কারণ কখন স্ক্যান করা হয়ে গেল সে কিছু বুঝতেই পারল না। রেটিনা স্ক্যান করার পর সুহানের শরীর থেকে এক বিন্দু রক্ত নিয়ে ডিএনএ প্রোফাইল করা হল। হাত এবং পায়ের আঙুলের ছাপ রাখা হল, শরীরের ছবি নেওয়া হল, এক্স-রে করা হল এবং পুরো শরীরের অভ্যন্তরীণ ত্রিমাত্রিক ছবি নেওয়া হল। সব শেষ করে রাগী চেহারার মহিলাটা সুহানের কার্ডটা ফেরত দিয়ে বলল, তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিন-এ তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

সুহান বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। একটু ইতস্তত করে যোগ করল, আমি এই প্রথম কোথাও কাজ করতে এসেছি সেজন্য একটু ভয় ভয় করছে।

রাগী চেহারার মহিলাটার মুখের কাঠিন্য হঠাৎ একটু শিথিল হয়ে আসে, সে নরম হয়ে বলল, জীবনে সবকিছুই কখনো না কখনো প্রথমবার শুরু করতে হয়। তোমার ভয় পাবার কিছু নেই সুহান।

আজ এই প্রযুম কেউ সুহানকে তার নাম ধরে সম্বোধন করল এবং সুহান প্রথমবার নিজেকে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে অনুভব করল। সে কৃতজ্ঞ গলায় বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

আমার নাম কিরিনা।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কিরিনা।

কিরিনা সুহানের হাতে একটা ছোট প্যাকেট দিয়ে বলল, তুমি এখন তিন শ বারো নম্বর ঘরে রিপোর্ট কর। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান রিগা সেখানে আছে। সে তোমাকে তোমার কাজ বুঝিয়ে দেবে।

সুহান আবার কিরিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে আসে। সুহানের এখনো বিশ্বাস হয় না যে সে এখন তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিন-এর একজন নিরাপত্তাকর্মী, সে এখন এখানে স্বাধীনভাবে হেঁটে বেড়াতে পারে। সুহান কিছুক্ষণের মাঝেই আবিষ্কার করল একটা দরজার সামনে আসতেই তার পকেটে রাখা কার্ড থেকে সিগন্যাল পেয়ে করিডোরের দরজাগুলো নিজের থেকে খুলে যাচ্ছে। সুহান হাঁটাহাঁটি করে তিন শ বারো নম্বর ঘরটা খুঁজে বের করে দরজাটা একটু খুলে ভেতরে উঁকি দেয়। বড় একটা টেবিলের এক পাশে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বসে নির্মমভাবে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষের সাথে কথা বলছে। এই মানুষটা নিশ্চয়ই রিগা, সুহানকে দরজা খুলে উঁকি দিতে দেখে বলল, কে?

আমি সুহান। আমি আজকে এখানে কাজে যোগ দিয়েছি।

এস। ভেতরে এস।

সুহান ভেতরে ঢুকল। মানুষটা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি তো দেখি একটা কচি খোকা, এখানে কাজ করবে কেমন করে?

এটা সত্যিকার অর্থে কোনো প্রয়োজনীয় কথা নয় তাই সুহান কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সে যদি এখানে কাজের উপযুক্ত মানুষ না হত তা হলে নিশ্চয়ই। তাকে এখানে কাজ করতে পাঠাত না। মানুষটা আবার নির্মমভাবে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, তোমার নাম কী বলেছ?

সুহান দ্বিতীয়বার তার নাম বলল, সুহান।

আগের কোনো কাজের অভিজ্ঞতা আছে?

না, নেই।

মানুষটা খুব বিরক্ত হবার ভান করে কাছাকাছি রাখা মনিটরে সুহানের প্রোফাইলটা দেখতে শুরু করে। স্ক্রিনে তার ছবি এবং পরিচয় দেখে হঠাৎ সে প্রায় চিৎকার করে উঠল, আরে! তুমি দেখি ক্যাটাগরি-বি.!

সুহান মাথা নাড়ল। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান রিগা খানিকক্ষণ চোখ বড় বড় করে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মুখ বিকৃত করে বলল, তুমি এখানে কীভাবে এসেছ?

সুহান দাতে দাঁত চেপে অপমানটুকু সহ্য করে বলল, আমি নিজে থেকে এখানে আসি নি। আমাকে সরকারি দপ্তর থেকে এখানে পাঠানো হয়েছে।

মানুষটা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, ভুল হয়েছে। নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে। তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিন হাই সিকিউরিটি তথ্যকেন্দ্র, এখানে বানর-শিম্পাঞ্জি দিয়ে কাজ হবে না। আমার সত্যিকারের মানুষ দরকার।

অপমানে সুহানের কানের গোড়া পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল। সে তবুও অনেক কষ্ট করে অপমানটুকু সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষটা আবার স্ক্রিনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখে বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে বলল, সত্যিই দেখি তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে। কী আশ্চর্য!

মানুষটা বেশ কিছুক্ষণ সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আগে কখনো ক্যাটাগরি-বি. মানুষ দেখি নি।

এটাও কোনো প্রশ্ন নয়, সুহানকে নিশ্চয়ই এর উত্তর দিতে হবে না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। যে কারণেই হোক, সুহানের চুপ করে থাকার জন্য এই মানুষটা আরো রেগে ওঠে। তার মুখে বিষাক্ত এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল, চোখ ছোট ছোট করে বলল, আমি শুনেছি ক্যাটাগরি-বি. মানুষ আসলে পশুর কাছাকাছি। শুধু আইনগত জটিলতার জন্য তাদেরকে মানুষ বলা হয়।

এত বড় একটা কথা সুহানের পক্ষে চুপ করে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, সে মাথা নেড়ে বলল, এটা সত্যি নয়।

মানুষটা সুহানের কথা শুনে রীতিমতো চমকে উঠল, সে কখনো কল্পনা করে নি সুহান এরকম একটা পরিবেশে তার কথার প্রতিবাদ করবে। রিগা এটাকে তার প্রতি ব্যক্তিগত অপমান ধরে নিয়ে চিৎকার করে বলল, তুমি বলতে চাও আমি মিথ্যা কথা বলছি? আমি নিরাপত্তা দপ্তরের প্রধান লেফটেন্যান্ট রিগা তোমার মতো নগণ্য একটা ক্যাটাগরি-বি. মানুষের সাথে মিথ্যা কথা বলব?

সুহান একটু বিপন্ন অনুভব করতে থাকে। রিগার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জিব দিয়ে শুকনো ঠোট ভিজিয়ে বলল, আমি সেটা বলি নি। তবে ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে শুধু আইনগত জটিলতার জন্য মানুষ বলা হয় এটা ভুল তথ্য।

আমি নিজে পড়েছি যে তারা বিবর্তনে মানুষ থেকে অনেক পেছনে। তাদের পশু প্রবৃত্তি আছে। এমনকি তাদের শরীরে এখনো পর চিহ্ন আছে।

সুহানের পক্ষে এটাও সহ্য করা সম্ভব হল না, রিগার দিকে তাকিয়ে বলল, পর চিহ্ন বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ?

তাদের বেশিরভাগেরই নাকি এখনো ছোট লেজ আছে।

সুহান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না যে সত্যিই এখনো এরকম মানুষ আছে যারা মনে করে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ আসলে পণ্ডর কাছাকাছি। সুহান হঠাৎ করে প্রতিবাদ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলুল। এই অমার্জিত এবং ঐ মানুষটার সাথে কথা বলে কী লাভ, সে তো কোনোভাবেই তার সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন করতে পারবে না। সুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল এবং তার নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকাটাকে রিমা আবার এক ধরনের বেয়াদবি হিসেবে বিবেচনা করল। রিগা ভয়ানক মুখভঙ্গি করে বলল, আমরা এখনই সেই পরীক্ষা করে ফেলতে পারি।

সুহান একটু অবাক হয়ে তাকাল, কী পরীক্ষা?

তোমার শরীরে পশুর চিহ্ন আছে কি না।

সুহান তখনো ঠিক বুঝতে পারল না রিগা কী বলতে চাইছে। রিগা কঠোর মুখে বলল, তুমি তোমার কাপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে দাড়াও।

সুহানের মনে হল তার মাথার ভেতরে একটা ছোট বিস্ফোরণ ঘটে গেল, সে হিংস্র চোখে রিগার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কখনো একজন মানুষকে এরকম নির্দেশ দিতে পার না।

রিগা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, পারি। তুমি আমার আদেশে, আমার নির্দেশে তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে কাজ করবে।

সেটা হবে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজ। আমার সম্মান নষ্ট করে তুমি আমাকে কোনো নির্দেশ দিতে পারবে না। আমাদের সংবিধান প্রত্যেকটা মানুষের সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে।

সত্যিকারের মানুষের। তোমার মতো ক্যাটাগরি-বি. শিম্পাঞ্জির নয়।

সুহন কঠোর মুখে বলল, আমি ক্যাটাগরি-বি. শিম্পাঞ্জি নই। আর্মি ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। একজন মানুষের যত অধিকার থাকার কথা তার অনেক কিছু আমাদের নেই। কিন্তু আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারটা এখনো আছে।

রিগা হুঙ্কার দিয়ে বলল, সেই অধিকারটাও থাকবে না। সেজন্য নতুন আইন পাস করা হচ্ছে।

সুহান একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, যখন সেই আইনটা পাস হবে তখন তুমি বলতে এস। এখন বলো না।

রিগা হঠাৎ চোখ ছোট ছোট করে বলল, তুমি মনে করেছ আমাদের সেই আইনটা পাস করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে? তুমি মনে করেছ আমি এখনই তোমাকে উলঙ্গ করতে পারব না?

সুহান পাথরের মতো মুখ করে বলল, না পারবে না।

রিগা হঠাৎ তার ড্রয়ারের তলা থেকে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বের করে নিয়ে বলল, পারব না?

সুহান তার শেষ বাক্যটা সংশোধন করে বলল, প্রাণ থাকতে পারবে না।

তুমি জান আমি যদি এই ঘরে তোমাকে গুলি করে হত্যা করে বলি আত্মরক্ষার। জন্য আমার তোমাকে হত্যা করতে হয়েছে তা হলে কেউ আমাকে অবিশ্বাস করবে না?

সুহান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, এই ঘরে আরো একজন মানুষ আছে। একই ঘরে একইসাথে ঠিক তোমার মতো চরিত্রের দুই জন মানুষকে পেয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব কম। সে তোমার কথার প্রতিবাদ করতে পারে। সে কাটাগরি-বি, মানুষ নয়, কাজেই সে তোমার মিথ্যে কথা শুনতে বাধা নয়।

তুমি তাই মনে কর? রিগা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা সুহানের দিকে তাক করে ধরে বলল, ঠিক আছে তা হলে সেই পরীক্ষাটাই হয়ে যাক।

সুহান রিগার চোখের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ সেখানে নিশ্চিত মৃত্যুকে দেখতে পায়। মানুষটা সত্যিই তাকে খুন করে ফেলবে, এই মানুষটা উন্মাদ। সুহান হঠাৎ অসহায় অনুভব। করে—তার জীবনটা দ্রুত এত অর্থহীনভাবে শেষ হয়ে যাবে সে কখনো কল্পনা করে নি। সে কি কিছু করতে পারবে না? শুধু মানুষের সম্মান পাবার জন্য তাকে এভাবে মারা পড়তে হবে?

সুহান দেখতে পেল রিগা ট্রিগারে আঙুল রেখে বলল, কেউ তোমাকে রক্ষা করতে আসবে না!

সুহান শেষ চেষ্টা করল, শুধু বেঁচে থাকার জন্য সে শেষ চেষ্টা করল, সম্পূর্ণ আন্দাজের ওপর ভরসা করে বলল, আশা করি, আমাকে খুন করার জন্য তোমার কারণটা যেন যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়। সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে যখন একজন ক্যাটাগরি-বি. মানুষ আনা হয় তার পেছনে একটা কারণ থাকে।

রিগাকে এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত দেখা গেল, সুহান সত্যি কথা বলছে না মিথ্যে কথা বলছে সেটা খুব সহজে রিগা বুঝতে পারবে না। রিগা বলল, তোমাকে সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে আনা হয়েছে?

আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি খোঁজ নিতে পার?

সুহান ভেবেছিল মানুষটা খোঁজ নেবে না, কিন্তু সে আতঙ্কিত হয়ে দেখল রিগা মনিটরে ঝুঁকে পড়েছে। সুহান বুঝতে পারল সে ধরা পড়ে গেছে, স্বয়ংক্রিয় অন্ত্রের গুলি নাকি মিথ্যে কথা বলে ধরা পড়ার অপমান—কোনটা বেশি যন্ত্রণাদায়ক হবে?

রিগা মনিটরের দিকে আরো ঝুঁকে পড়ল। হঠাৎ করে তার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়, সে যখন মাথা ঘুরিয়ে সুহানের দিকে তাকিয়েছে তখন সেখানে এক ধরনের বিচিত্র দৃষ্টি, খানিকটা ভয় এবং অনেকখানি বিস্ময়। রিগা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা ড্রয়ারের ভেতরে রেখে তার। গালটা নির্মমভাবে চুলকাতে থাকে। তারপর সুহানের পাশে দাড়ানো মানুষটাকে বলল, কিরি, তুমি এই ছেলেটাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও।

সুহান প্রথমবার তার পাশে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকাল, সোনালি চুল এবং নীল চোখ। মানুষটা সুদর্শন, চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য রয়েছে কিন্তু কোনো নিষ্ঠুরতা নেই। মানুষটা বলল, ঠিক আছে রিগা।

তুমি তোমার কাজটা এই ছেলেকে বুঝিয়ে দাও। এখন থেকে তোমরা দুই জন। একসাথে থাকবে। বুঝেছ?

হ্যাঁ রিগা। বুঝেছি।

 

০৩.

কিরি বলল, তুমি আমাকে একটু ছুঁয়ে দাও তো।

সুহান একটু অবাক হয়ে বলল, আমি? তোমাকে ছুঁয়ে দেব?

কিরি বলল, হ্যাঁ।

কেন?

আমার খুব কপাল খারাপ। তুমি ছুঁয়ে দিলে হয়তো আমার কপালটা একটু ভালো হবে।

সুহান মাথা ঘুরিয়ে কিরির দিকে তাকাল, সে তার সাথে ঠাট্টা করছে কি না বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু না, তার চোখে-মুখে ঠাট্রার কোনো চিহ্ন নেই।

সুহান বলল, তোমার কেন ধারণা হল আমি ছুঁয়ে দিলে তোমার কপাল ভালো হবে?

কারণ আমি আমার জীবনে তোমার চাইতে সৌভাগ্যবান কোনো মানুষ দেখি নি।

সুহান অবাক হয়ে বলল, আমার চাইতে সৌভাগ্যবান কোনো মানুষ দেখ নি?

না। কিরি মাথা নেড়ে বলল, তোমার খুন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তোমার লাশ এখন পলিমারের প্যাকেট করে হিমঘরে নেওয়া উচিত ছিল। তার বদলে তুমি এখন হাঁটছু। কিরি তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও আমাকে ছুঁয়ে দাও।

সুহান কিরির হাতটা ছুঁয়ে বলল, এই যে ছুঁয়েছি। এখন কি তোমার নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে?

কিরি একটু হাসল, বলল, সেটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

আমি জানতাম না সৌভাগ্য চর্মরোগের মতো ছোঁয়াচে। ছুঁয়ে দিলে ঘটে যায়।

আমিও জানতাম না। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি।

সুহানের এই মানুষটাকে বেশ পছন্দ হল। তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে এই মানুষটার সাথে থাকবে ভেবে হঠাৎ করে তার মনটা ভালো হয়ে যায়। একটু আগে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান রিগার সাথে তার যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা এখনো সে ভুলতে পারছে না।

একটা লিফটে করে দুজনে উপরে উঠে এল। বড় করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিরি বলল, আমি জানতাম না তুমি এত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। সারা পৃথিবী থেকে তোমাকে বেছে আনা হয়েছে।

আমিও জানতাম না।

কিরি অবাক হয়ে বলল, তুমিও জানতে না? তার মানে? তুমি না রিগাকে সেটা বললে?

বাঁচার জন্য বানিয়ে বলেছিলাম।

বানিয়ে বলেছিলে?

সুহান বলল, হ্যাঁ। তুমি আমাকে যতটা সৌভাগ্যবান মনে কর আমি নিজেকে ততটা সৌভাগ্যবান মনে করি না। তাই জান বাঁচানোর জন্য আমাকে মিথ্যে কথা বলতে হয়।

কিন্তু এটা তো মিথ্যা কথা নয়। তোমার সামনেই তো রিগা পরীক্ষা করে দেখল আসলেই তোমাকে সারা পৃথিবী থেকে বেছে আনা হয়েছে।

সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, সেটা দেখেই তো এখন আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। ভেবে পাচ্ছি না কেন আমাকে এনেছে।

কিরি অন্যমনস্কভাবে বলল, ভারি আশ্চর্য!

সুহান বলল, তুমি যদি খুব ভালো করে চিন্তা কর তা হলে দেখবে এটা সেরকম আশ্চর্য নয়।

কেন?

আমার কী মনে হয় জান? সুহান একটু চিন্তা করে বলল, আমার মনে হয় এই তথ্যকেন্দ্রে হয়তো খুব বিপজ্জনক কিছু একটা ঘটার আশঙ্কা আছে। কেউ হয়তো মারা পড়তে পারে। তাই আমাকে এনেছে, বিপজ্জনক কাজে ব্যবহার করবে, মারা যদি যেতেই হয় তা হলে একটা ক্যাটাগরি-বি. মানুষ মারা যাক।

মারার ন্যই যদি আনতে হয় তা হলে তো সারা পৃথিবী খুঁজে আনতে হয় না। কিরি হঠাৎ করে সুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, আমাকে একটা জিনিস বল, তুমি কি খুব প্রতিভাবান?

সুহান একটু ইতস্তত করে বলল, সেটা আমি নিজের সম্পর্কে কেমন করে বলি? আমি তো অনাথাশ্রমে বড় হয়েছি কখনো পড়াশোনা করার সুযোগ পাই নি। নিজে নিজে পড়েছি, ঘরে বসে পরীক্ষাগুলো দিয়েছি।

কেমন হয়েছে পরীক্ষা?

সুহান হাসল, বলল, খুব ভালো। আমি যদি ক্যাটাগরি-বি. মানুষ না হয়ে তোমাদের মতো একজন হতাম তা হলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যেতাম।

সত্যি? কিরির দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, তুমি সত্যি বলছ?

হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি।

কী ভয়ংকর অন্যায়। তোমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার কথা, জ্ঞানী মানুষদের সাথে কথা বলার কথা, তার বদলে তুমি আমার মতো একজন হতভাগার সাথে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করছ।

সুহান বলল, কিন্তু তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে কিরি। আমার মনে হয় গোমড়ামুখী বুড়ো প্রফেসরদের সাথে জ্ঞানের কথা বলা থেকে তোমার সাথে কাজ করা। অনেক বেশি আনন্দের হবে।

কিরি বলল, সেটা তুমি আমাকে খুশি করার জন্য বলেছ, সেজন্য অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে যে অন্যায় করা হয়েছে সেটা তো চলে যাচ্ছে না।

সুহান বলল, ওসব নিয়ে আর কথা না বললাম।

ঠিক আছে তুমি যদি না চাও তা হলে বলব না।

আমাকে তা হলে বলে দাও আমার কী করতে হবে। আমি আগে কখনো কোনো ধরনের কাজ করি নি।

সেটা সমস্যা হবার কথা না। এই তথ্যকেন্দ্রে নিরাপত্তার সকল কাজ করা হয় ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করে। যন্ত্রপাতি, ক্যামেরা, কম্পিউটার, নেটওয়ার্ক এগুলোই সব কাজ করে। আমাদের রাখা হয়েছে একটা বাড়তি স্তর হিসেবে। যন্ত্রপাতির চোখ এড়িয়ে যেতে পারে এরকম কিছু যদি ঘটে যায় সেগুলো দেখার জন্য।

সেরকম কিছু কি ঘটেছে?

কিরি একটু ইতস্তত করে বলল, আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানানো হয় নি কিন্তু আমার মনে হয় ঘটেছে। কয়েকদিন আগে দুর্ঘটনায় দুজন মারা গেছে, কিন্তু আমার মনে হয় সেগুলো দুর্ঘটনা নয়। আমার মনে হয় দুজন মানুষ বাইরে থেকে এই তথ্যকেন্দ্রে ঢুকে গিয়েছিল।

সুহান অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?

আমার তাই ধারণা। যাই হোক ওসব পরের ব্যাপার, এখন কাজের কথায় আসি।

তুমি কি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করতে পার?

সুহান হাসল, বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র কোথায় পাব?

বুলেট প্রুফ জ্যাকেট কখনো চোখে দেখ নি?

না।

শরীরের কোথায় খালি হাতে আঘাত করে একজন মানুষকে বেশ কিছুক্ষণের জন্য অচেতন করে রাখা যায় সেটা সম্পর্কেও তোমার নিশ্চয়ই কোনো ধারণা নেই।

তুমি যদি জিজ্ঞেস কর তা হলে আমি অনুমান করার চেষ্টা করতে পারি।

এর মাঝে অনুমানের কোনো জায়গা নেই।

তা হলে তোমার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, না।

কিরি কলল, ঠিক আছে তা হলে তোমার ট্রেনিং শুরু হয়ে যাক।

কখন?

এখন থেকেই। তার আগে চল তোমাকে তোমার থাকার জায়গা দেখিয়ে দিই। মাঝে মাঝে তোমাকে এখানে একনাগাড়ে কয়েক দিন থাকতে হতে পারে তখন এখানে ঘুমাতে পারবে।

চমৎকার।

 

সুহান তথ্যকেন্দ্র থেকে যখন বের হয়েছে তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। তাকে এখন কিছু খেয়ে রাতে ঘুমানোর একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। ছোট একটা রেস্টুরেন্টে কিছু একটা খেয়ে সে ঘুমানোর জন্য একটা সস্তা হোটেল খুঁজতে থাকে। একটু গুছিয়ে নেবার পর তাকে একটা এপার্টমেন্ট বা ঘর খুঁজে নিতে হবে। সুহান আলোকোজ্জ্বল রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশের দালানগুলো দেখতে থাকে। একটা হোটেলকে মোটামুটিভাবে বেশ ভালোই মনে হল। সে একটু ইতস্তুত করে ভেতরে ঢুকে যায়। লবিতে ছোষ্ট যন্ত্রটার মাঝে কার্ডটা প্রবেশ করিয়ে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইল, কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট একটা জানালা খুলে একজন মহিলার মাথা উঁকি দেয়, সুহান?

হ্যাঁ, আমি সুহান।

তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনের নিরাপত্তাকর্মী?

হ্যাঁ। আমি আজ থেকে সেখানে কাজ করছি।

চমৎকার। মহিলাটা মুখে একেবারে মাপা একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার জন্য আমি কী করতে পারি?

আজ রাতে থাকার জন্য আমার একটা রুম দরকার।

মনিটরের স্ক্রিনে চোখ রেখে কিছু একটা দেখতে দেখতে বলল, আমাদের কাছে তিন ধরনের রুম আছে–সুলত, সাধারণ আর ডিলাক্স। সুলভ রুমের ভাড়া— হঠাৎ মেয়েটা থেমে গেল। বলল, তুমি কাটাগরি-বি, মানুষ?

সুহান হঠাৎ অসহায় বোধ করে। সে ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ।

ক্যাটাগরি-বি. মানুষ হয়ে তুমি সাধারণ মানুষের হোটেলে কেন এসেছ?

আমি বাইরে থেকে এসেছি। এই শহরে আমার কোনো থাকার জায়গা নেই। আমাকে আজ রাতে কোথাও থাকতে হবে।

মহিলাটার মুখটা হঠাৎ খুব কঠোর হয়ে উঠল, বলল, তুমি পৃথিবীতে কী ঘটছে তার কোনো ঘেঁজ রাখ না?

আমার পক্ষে যেটুকু রাখা সম্ভব সেটা রাখার চেষ্টা করি।

ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে আইন করে মানুষের স্থান থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে সেটা জান না?

সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আইনটা পাস হয় নি। যতদিন পাল না হচ্ছে আমাদের মৌলিক কিছু অধিকার আছে। মানুষের মৌলিক অধিকার। সুহানের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে। না যে একই দিনে দ্বিতীয়বার তাকে একই জিনিস ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে।

মহিলাটা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ছেলে, তুমি বিষয়টা বুঝতে পারছ না। আমাদের এই হোটেলটা একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তোমাকে আমরা এখানে রাখতে পারব না। যদি জানাজানি হয়ে যায় তা হলে আমার ব্যবসার ক্ষতি হবে।

সুহান আবিষ্কার করল, সে একেবারে নির্বোধের মতো জিজ্ঞেস করে বসেছে, কেন?

আমাদের রান্নাঘরে যদি তেলাপোকা পাওয়া যায়, বাথরুমে যদি ইঁদুর পাওয়া যায় তা হলে যে কারণে ব্যবসার ক্ষতি হয় সেই একই কারণে। বুঝেছ?

সুহান মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। সে স্লট থেকে কার্ডটা বের করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে বলল, বিষয়টা বুঝিয়ে দেবার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

সুহান হোটেলের জা খুলে বের হতে যাচ্ছিল তখন মহিলাটা তাকে ডাকল, বলল, শোন।

সুহান কোনো কথা না বলে মাথা ঘুরে দাঁড়াল। মহিলাটা বলল, শহরের বাইরে ক্যাটাগরি-বি. মানুষদের একটা বস্তির মতো এলাকা গড়ে উঠেছে। আমি নিশ্চিত তুমি সেখানে রাত কাটানোর মতো একটা জায়গা পেয়ে যাবে। সাত নম্বর পাতাল রেল দিয়ে যদি শেষ মাথায় নেমে যাও, বাকিটুকু হেঁটে চলে যেতে পারবে।

ধন্যবাদ। সুহান হোটেলের দরজা খুলে বের হয়ে এল।

সুহান দীর্ঘসময় শহরের মাঝে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। যতদিন অনাথাশ্রমে ছিল ক্যাটাগরি-বি. মানুষের যন্ত্রণাটা সে বুঝতে পারে নি। অনাথাশ্রমের বাইরে এসে হঠাৎ করে সে এর প্রকৃত গুরুত্বটা বুঝতে পারছে। তার ভেতরে এক ধরনের যন্ত্রণা হতে থাকে, এক ধরনের ক্রোধ দানা বেঁধে উঠতে থাকে। ইচ্ছে হয় কোনো একটা কিছু ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো করে ফেলে, ধ্বংস করে দেয়, গুঁড়িয়ে দেয়।

সুহান অবিশ্যি তার কিছুই করল না, সে সাত নম্বর পাতাল ট্রেনে করে একেবারে শেষ স্টেশনে নেমে যায়। স্টেশন থেকে বের হয়েই সে বুঝতে পারে সে সম্ভবত ঠিক জায়গাতেই এসেছে। আধো অন্ধকারে ঢাকা জরাজীর্ণ শহর। বিধ্বস্ত দালানের উপরে সস্তা নিয়ন আলো, রাস্তার পাশে নেশাসক্ত মানুষ। সুহান অন্যমনস্কভাবে কয়েক পা হেঁটে যায়, একটা ছোট দোকানের বাইরে একজন মানুষ বসে আছে, এক ধরনের নিরাসক্ত দৃষ্টিতে মানুষটা সুহানের দিকে তাকাল। সুহান জিজ্ঞেস করল, এখানে এক রাত থাকার মতো কোনো হোটেল আছে?

মানুষটা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, নতুন এসেছ বুঝি?

হ্যাঁ।

কী কর?

সুহান একটু ইতস্তত করে বলল, নিরাপত্তা প্রহরীর একটা চাকরি পেয়েছি।

সাবধান। তুমি নতুন এসেছ, এখনো কিছু জান না। তোমার গুদাম লুট করে নেবার জন্য এরা যা কিছু করতে পারে। মানুষটা ধরেই নিয়েছে সে কোনো একটা গুদামের দারোয়ান। সে যে আসলে একটা সরকারি তথ্যকেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রহরী, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে শুরু করে স্টান্ট বোমা পর্যন্ত ব্যবহার করা শিখছে প্রয়োজনে রাত কাটানোর জন্য তার যে নিজ্বস্ব একটা ঘর রয়েছে, সেই ঘরটাতে পৃথিবীর সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে–—এই বিষয়গুলো মানুষটা চিন্তাও করতে পারবে না। সুহান মানুষটাকে এগুলো জানানোর কোনো চেষ্টা করল না, আবার জিজ্ঞেস করল, আছে কোনো হোটেল?

হোটেল তুমি কোথায় পাবে? মিলিনা একটা সরাইখানার মতো চালায়, তার কাছে একটা ঘর থাকতে পারে। তবে বুড়ির মেজাজ খুব গরম, ব্যবহার খুব খারাপ।

আজকে এখন পর্যন্ত সে যেরকম ব্যবহার পেয়ে এসেছে তার তুলনায় এখানকার যে কোনো ব্যবহারই মনে হয় মধুর মতো মনে হবে! সুহান জিজ্ঞেস করল, মিলিনার সরাইখানাটা কোথায়?

সোজা চলে যাও। ল্যাম্পপোস্টের ওখানে গিয়ে ডানদিকে যাও, আধ কিলোমিটারের মতো গেলে একটা ছোট বাজারের মতো পাবে। সেখানে কাউকে জিজ্ঞেস করলে তোমাকে দেখিয়ে দেবে।

ধন্যবাদ তোমাকে।

মানুষটা সুহানের কথার উত্তর দিল না। ভতাসূচক অর্থহীন কথাগুলোর মনে হয় এর কাছে খুব বেশি গুরুত্ব নেই।

সুহান ল্যাম্পপোস্টের দিকে হাঁটতে থাকে। রাস্তাটা খানাখন্দে ভরা, ফুটপাতটাও সেরকম। আবছা অন্ধকারে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে, ফুটপাতে ভাঙা বোতল আর এলুমিনিয়াম ক্যান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মাঝে মাঝে দুই একজন মানুষ কথা বলতে বলতে তাকে পাশ কাটিয়ে যায়, মানুষগুলোর কথার মাঝে এক ধরনের আঞ্চলিকতার টান। ল্যাম্পপোস্টের কাছাকাছি গিয়ে সে ডানদিকে হাঁটতে থাকে। দুই পাশে ঘিঞ্জি বাড়িঘর, ভেতরে মানুষের কথাবার্তা, মহিলাদের হাসি আর ছোট বাচ্চাদের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ করে একটা বাসা থেকে একজন মানুষ কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করতে করতে বের হয়ে এল, পেছনে একটা মেয়ের কান্নার শব্দ শোনা যেতে থাকে। নিজের ভাগ্যকে অভিশাপ দিয়ে বিলাপ করতে করতে মেয়েটা ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছে।

সুহান শেষ পর্যন্ত বাজারের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। জায়গাটা মোটামুটি আলোকিত, অনেকগুলো দোকানপাট, নাইট ক্লাব এবং রেস্টুরেন্ট। একটা বড় হলঘরের ভেতর থেকে গানবাজনা এবং মানুষের হৈ-হুল্লোড় শব্দ ভেসে আসছে। সুহান কাছাকাছি একটা দোকানের ভেতর ঢুকে জিজ্ঞেস করল, মিলিনার সরাইখানাটা কোথায় বলতে পারবে?

দোকানি মানুষটা ব্যস্তভাবে একটা কার্ড বোর্ডের বাক্স থেকে ছোট ছোট শুকনো খাবারের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, সামনে ডানদিকে তিনটা দোকান পরে। বাইরে দেখবে বগনভিলা গাছ।

সুহান মানুষটাকে ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে এল। রাস্তায় লোকজনের ভিড় পাশ কাটিয়ে সে কয়েক মিনিটে মিলিনার সরাইখানা পেয়ে যায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই একটা খাবার জায়গা, মানুষ বসে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে খাচ্ছে। পেছনে একটা কাউন্টারে মোটাসোটা মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হয় সে বুঝি এখনই কারো ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। হলঘরের এক পাশে একটা বড় ভিডিস্ক্রিনে একটা সস্তা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হচ্ছে এবং একন ভাড়ের স্থূল রসিকতার সাথে শব্দ করে একসাথে অনেকে হেসে উঠছে। সুহান টেবিলগুলো পাশ কাটিয়ে কাউন্টারের সামনে দাড়াল, মধ্যবয়স্ক মহিলাটা চোখ পাকিয়ে সুহানের দিকে তাকাল যেন সে একটা বড় অপরাধ করে ফেলেছে। সুহান ইতস্তত করে বলল, রাত কাটানোর জনা আমার একটা ঘর দরকার।

মধ্যবয়স্ক মহিলাটা সুহানের আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল, আমি তোমাকে রুম দিই আর তুমি সবকিছু নিয়ে চুরি করে পালাও!।

কথাটা এত অবিশ্বাস্য এবং বিচিত্র যে সুহানের হাসি পেয়ে যায়, সে হাসি আটকে বলল, তোমার ভয় নেই আমি কিছু চুরি করে নিয়ে পালাব না।

তুমি কোথা থেকে এসেছ? কী কর?

সুহান বলল, আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। এক জায়গায় নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ পেয়েছি।

কোনোরকম নেশা-ভাং কর না তো?

না, করি না।

মধ্যবয়স্ক মহিলাটা একটা মোটা খাতা বের করে খালি একটা পৃষ্ঠা বের করে বলল, নাও লিখ।

সুহান নিজের নাম-ঠিকানা রাত কাটানোর উদ্দেশ্য লিখতে খাকে। দেয়ালে ঝোলানো চাবিগুলো থেকে একটা চাবি বের করে নিয়ে বলল, তিন শ আট নম্বর রুম। এক রাতের জন্য দুই ইউনিট।

সুহান তার কার্ডটা বের করল না, এখানে এই কার্ডটা ব্যবহার করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হল না। সে খুচরো দুটি ইউনিট বের করে টেবিলে রাখে, মুদ্রাগুলো চোখের কাছে নিয়ে পরীক্ষা করে মিলিনা বলল, সাতটার সময় নাস্তা দেওয়া হবে। দশটার মাঝে ঘর খালি করে দেবে।

ঠিক আছে।

তিন তলার তিন শ আট নম্বর ঘরটা ছোট। জানালা খুলতেই অন্য পাশে আরেকটা বড় বিল্ডিঙের পেছনের অংশ দেখা গেল। সেখানে লাগানো উজ্জ্বল নিয়ন আলো জ্বলছে এবং নিতছে, ঘরের ভেতরে সেই আলোর ছটা এসে পড়েছে। সুহান কিছুক্ষণ মন খারাপ করা এই কুশ্রী দৃশাটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর টেবিলে রাখা ব্যাগ খুলে তার পরিষ্কার কাপড় বের করতে শুরু করে।

গরম এবং ঝালো জীবাণু নিরোধক পানিতে গোসল করে সুহানের নিজেকে খানিকটা সতেজ মনে হয়। সে পরিষ্কার একপ্রস্ত পোশাক পরে রুমে তালা দিয়ে বের হল, নিচে রেস্টুরেন্টে বসে কোনো এক ধরনের উত্তেজক পানীয় খেয়ে একটু সময় কাটিয়ে আসবে।

বড় একটা গ্লাসে সে ঝাঁজালো একটা উষ্ণ পানীয় নিয়ে এসে একটা কাউন্টারে বসে সেটাতে চুমুক দিতে দিতে মানুষগুলোকে দেখে। মানুষগুলো দরিদ্র, তাদের চোখে-মুখে জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাবার চিহ্ন স্পষ্ট। বেশিরভাগ মানুষ মধ্যবয়স্ক মহিলার সংখ্যা কম। উৎকট পোশাক পরা দু-একজন মহিলা অকারণে হাসাহসি করছে এবং উত্তেজক পানীয়ের কারণে একজন আরেকজনের ওপর টলে পড়ছে। বড় ভিডিস্ক্রিনে পণ্ডে রক্ত সঞ্চালন বাড়ানো সংক্রান্ত ওষুধের একটা বিজ্ঞাপন হচ্ছে এবং বিজ্ঞাপনটা শেষ হতেই সংবাদ বুলেটিন শুরু হয়ে গেল। সংবাদ বুলেটিনে কী প্রচারিত হচ্ছে সুহানের জানার ইচ্ছে ছিল কিন্তু মানুষের হট্টগোলে সুহান পরিষ্কার শুনতে পেল না। সুহান আবার তার চারপাশের মানুষগুলোকে দেখতে থাকে। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা মিলিনা একজনের সাথে ঝগড়া করছে, দেখে মনে হয় সে তাকে মেরে বসবে? এক কোনায় কমবয়সী একজন তরুণ এবং তরুণী খুব কাছাকাছি মাথা রেখে নিছু গলায় কথা বলছে, মনে হচ্ছে চারপাশে কী হচ্ছে তার কিছুই তারা জানে না। তাদের পাশেই মোটা একজন মানুষ চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে—সম্ভবত নেশাগ্রস্ত। ঘরের মাঝামাঝি একটা হট্টগোলের মতো হল তখন একজন বাজখাই গলায় চিৎকার করে উঠল, চুপ। সবাই চুপ।

রেস্টুরেন্টে নীরবতা নেমে আসে এবং একজন ভিডিস্ক্রিনের ভলিউম বাড়িয়ে দেয়, সেখানে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ নিয়ে একটা আলোচনা হচ্ছে। একজন খুব গুরুত্বপূর্ণ চেহারার মানুষকে কিছু সাংবাদিক ঘিরে রেখেছে, তাদের প্রশ্নের উত্তরে মানুষটা বলল, আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিই নি। এত বড় একটা বিষয়ে আমরা কোনো চিন্তাভাবনা না করে সিদ্ধান্ত নেব না।

একজন সাংবাদিক বলল, আমরা শুনতে পেয়েছি আইনটার ড্রাফট করা হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ চেহারার মানুষটা বলল, আমি সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

লাল চুলের একজন মহিলা সাংবাদিক গুরুত্বপূর্ণ চেহারার মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, ক্যাটাগরি-বি. মানুষ আসলেই মানুষের সম্মান পাবার যোগ্য কি না সেই বিষয়টা বের করার জন্য বিজ্ঞানীদের একটা টিম দীর্ঘদিন গবেষণা করে একটা রিপোর্ট দিয়েছেন, সেই রিপোর্টে কী ছিল?

গুরুত্বপূর্ণ চেহারার মানুষটা বলল, যথাসময়ে এই রিপোর্টটা প্রকাশ করা হবে।

শোনা যায় বিজ্ঞানীদের কমিটির আহ্বায়ক একটা রহস্যজনক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন?

গুরুত্বপূর্ণ চেহারার মানুষটা শব্দ করে হেসে বলল, এটা একটা গুব। এ ধরনের কিছু ঘটে নি।

বয়স্ক একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল, ক্যাটাগরি-বি. মানুষ সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত মতামত কী?

গুরুত্বপূর্ণ চেহারার মানুষটা বলল, আমরা সবাই জানি পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে সাধারণ মানুষরা প্রতিপালন করছে। হয় ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে কর্মক্ষম করে তোলা প্রয়োজন এবং যদি সেটা সম্ভব না হয় তা হলে তাদের কথা ভুলে গিয়ে শুধু সত্যিকারের মানুষদের নিয়ে পৃথিবীটাকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত।

শুয়োরের বাচ্চা হারামখোর— বলে কে একজন ভিডিস্ক্রিনের দিকে একটা বোতল ছুড়ে দেয়, গ্লাস ভাঙার একটা তীক্ষ্ণ শব্দ হয় এবং একসাথে অনেক মানুষ চিৎকার করে গালাগালি করতে থাকে। সবার গলা ছাপিয়ে মিলিনার গলা শোনা গেল, সে বলল, যদি এত সাহস থাকে তা হলে যাও, গিয়ে এই হতভাগা কমিশনারের টুটি চেপে ধর আমার রেষ্টুরেন্টে কোনো মাতলামো চলবে না।

যে বোতলটা ছুড়ে মেরেছিল সে গলা উঁচিয়ে বলল, শুয়োরের বাচ্চা কমিশনারের কথা তোমরা শোন নি? পরিষ্কার বলে দিয়েছে ক্যাটাগরি-বি. মানুষদের কথা ভুলে যেতে হবে। শুনেছ?

শুনেছি।

তা হলে? আমরা খালি ঘরে বসে থাকব? কিছু একটা করব না?

মিলিনা গর্জন করে বলল, করতে হলে বাইরে গিয়ে কর। আমার বেস্টুরেন্টে বোতল ছোড়াছুড়ি করতে পারবে না। অপদার্থ কোথাকার!

মানুষটা গজগজ করতে করতে সুহানের পাশের টেবিল এসে বসে। হিংস্র চোখে চারদিকে তাকায়। সুহান কোনার টেবিলে বসে থাকা তরুণ এবং তরুণীটার দিকে তাকাল, এখনো তারা মাথা দুটি কাছাকাছি রেখে বসে আছে। তারা এখন কথা না বলে অন্যদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে বেদনার চিহ্ন। বেদনা এবং আতঙ্ক। আতঙ্ক এবং হতাশা। মানুষের স্বপ্ন দেখার অধিকারটুকু সরিয়ে নেওয়া হলে তাদের জীবনে আর বাকি থাকে কী? শুধুমাত্র ক্যাটাগরি-বি. মানুষ হিসেবে জন্ম নেবার কারণে একজন মানুষ তার জীবন নিয়ে স্বপ্নও দেখতে পারবে না?

 

০৪.

সপ্তাহখানেকের মাঝে সুহান মোটামুটিভাবে তার কাজগুলো শিখে নেয়। তার দায়িত্বের সবগুলোই যে সে পছন্দ করেছে তা নয়। ডিউটিতে থাকার সময় তাকে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়, সে এখনো এই বিষয়টাতে অভ্যস্ত হতে পারে। নি। মানুষকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে খুন করার জন্য মানুষেরাই একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছে এবং সেটা সে ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ব্যাপারটা মাঝে মাঝে তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়।

তবে তার কাজটা খারাপ নয়। এই তথ্যকেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য অসংখ্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, শুধু সেগুলোর ওপরে ভরসা না করে কিছু মানুষকেও বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা ইতস্তত এই তথ্যকেন্দ্রে ঘুরে বেড়ায়। সুহান সেরকম একজন মানুষ–যদিও সে পুরো দলের মাঝে একেবারেই নিচের সারিতে। বলা যেতে পারে অন্যদের ফাইফরমাশ খাটাই হচ্ছে তার আসল কাজ, কিন্তু সেটা নিয়ে সুহানের এতটুকু ক্ষোভ নেই। বিল্ডিঙের সব জায়গায় সে যেতে পারে না, তাকে সে অধিকার দেওয়া হয় নি। কিন্তু যেখানে তার যাবার অধিকার আছে সেখানে সে খুব উৎসাহ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। নিরাপত্তা বাহিনীর অন্য সদস্যদের কাছে তার এই বাড়াবাড়ি উৎসাহ এক ধরনের কৌতুকের বিষয়। সুহান সেটা নিয়ে কিছু মনে করে না–প্রথমদিন রিগার সাথে সেই ভয়ংকর সাক্ষাতের পর তার সাথেও সুহানের আর দেখা হয় নি। এখানে তার সময় মোটামুটি খারাপ কাটছে না। এই সপ্তাহের বেতন পাওয়ার পর সে কিছু উপহার কিনে তার অনাথাশ্রমে পাঠিয়েছে। লারার জন্য একটা পারফিউম, কুরাকের জন্য গানের অ্যালবাম, অন্যদের কারো জন্য শুকনো ফল, কারো কারো জন্য চকোলেট আর হালকা পানীয়। উপহারগুলো পৌঁছানোর পর সেখানে কেমন আনন্দের বান ডেকে যাবে সেটা সে এখানে বসেই দেখতে পায়।

থাকার জন্য সে আর কোনো বাসা বা অ্যাপার্টমেন্ট খোঁজ করছে না, মিলিনার সরাইখানাতেই একটা রুম পাকাপাকিভাবে নিয়ে নিয়েছে। মিলিনা যদিও কোনোভাবেই প্রকাশ করে না কিন্তু সুহানের ধারণা এই মধ্যবয়স্ক বদমেজাজি মহিলাটা তাকে পছন্দই করে। স্থানীয় অনেকের সাথে তার পরিচয় হয়েছে, কেউ কেউ বুদ্ধিমান, কেউ কেউ হিংসুটে, কেউ কেউ উদাসী আবার কেউ কেউ ভয়ংকর হতাশাগ্রস্ত। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নিয়ে সবার ভেতরে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক, কিন্তু সেটা নিয়ে কিছু করা যাবে কি না সে ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না। কোনো কিছু অর্জন করতে হলে সংগঠিত হতে হয়, কিন্তু এখানে কেউ সংগঠিত নয়, সংগঠিত হবার মতো তাড়না কারো ভেতরে নেই। তবে পুরোটাই যে হতাশাব্যঞ্জক তা নয়, মনে হয় এর ভেতরেও কোথায় জানি আশার আলোর আছে। পৃথিবীর অনেক মানুষ জিনেটিক কোড দিয়ে মানুষকে বিভাজন করার বিরুদ্ধে। সবাই জানে একদল বিজ্ঞানী এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছিলেন। বিজ্ঞানীদের সেই রিপোর্টটাতে কী আছে তাই সেটা নিয়ে সবার খুব কৌতূহল। এখানে সবার ধারণা বিজ্ঞানীদের প্রকৃত রিপোর্টটা প্রকাশ করা হবে না এবং বিজ্ঞানীদের দলনেতাকে এর মাঝে মেরে ফেলা হয়েছে। আসলে কী হয়েছে কেউ সেটা জানে না। সুহান ঠিক নিশ্চিত হতে পারছে না কিন্তু তার মনে হয় কিছু কিছু মানুষ খুব গোপনে সংগঠিত হচ্ছে তারা খুব বড় একটা কিছু করতে চাইছে। কিন্তু কারা কীভাবে এটা করছে কিংবা আসলেই কেউ এটা করছে কি না সুহান কোনোভাবেই সেটা নিশ্চিত হতে পারছে না। যতদিন সে ধরনের কিছু না হচ্ছে সে কঁাধে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে থাকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে ঘুরতে থাকবে। যদি কখনো তাদের বিরুদ্ধে আইন পাস করে নেওয়া হয় সে তার কাজ ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর অন্যসব ক্যাটাগরি-বি. মানুষের সাথে চলে যাবে। আবার নতুন করে তাদের জীবন শুরু করবে। নতুন করে তাদের সভ্যতা তৈরি করতে শুরু করবে। তার কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার ক্ষমতা ছিল, সে কি আর ক্যাটাগরি-বি. শিশুদের পড়াতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে, একটা জীবন সে দেখতে দেখতে কাটিয়ে দেবে।

যতদিন সেটা না হচ্ছে ততদিন সে এই তথ্যকেন্দ্রে ঘুরে বেড়াবে। পুরো তথ্যকেন্দ্রের নিরাপত্তার বিষয়টাকে সে একটা ধাধা হিসেবে বিবেচনা করছে। কোথায় কোথায় ক্যামেরাগুলো আছে, মোশান ডিটেক্টরগুলো আছে সে পরীক্ষা করে দেখে। কোন সিগন্যালটা থেকে কোন সিগন্যালটা শুরু হয় সে বোঝার চেষ্টা করে। এর মাঝেই সে কিছু কিছু ভুল বের করে ফেলেছে কিন্তু সেটা কিরি ছাড়া আর কাউকে বলে নি। কিরি শুনে হা হা করে হেসে বলেছে, সিস্টেমে ভুল থাকলে থাকুক সেটা যাদের ঠিক করার কথা তারা ঠিক করবে। তুমি কি ভেবেছ আমরা সেটা রিপোর্ট করলে তারা বিশ্বাস করবে? সত্যি সত্যি যদি সিস্টেমে গোলমাল থাকে আর তুমি সেটা বের করে ফেল তা হলে চেপে যাও! ওরা জানতে পারলে তোমার চাকরি চলে যাবে।

সুহান বলল, আমার কেন চাকরি যাবে? আমি কী করেছি?

তুমি ভুলটা বের করেছ। গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ভুল বের করা খুব বড় অপরাধ। বুঝেছ?

সুহান মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।

কিন্তু সে যে আসলেই ব্যাপারটা ঠিক ঠিক বুঝতে পারে তা নয়। যারা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তারা কেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখবে না? প্রথম দিন রিশার সাথে তার যখন দেখা হয়েছিল তখন সে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছিল কারণ রিগাকে সে বুঝিয়েছিল সে নিজে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে খুঁজে তাকে বের করা হয়েছে–আর কী কাকতালীয় ব্যাপার সেটা সত্যি বের হয়ে গেছে! কীভাবে হল ব্যাপারটা? আসলেই কি সে গুরুত্বপূর্ণ? কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? কী করা হবে তাকে দিয়ে? একজন ক্যাটাগরি-বি. মানুষ কেমন করে গুরুত্বপূর্ণ হয়? সুহান কিছু ভেবে পায় না—তখন সে একসময় হাল ছেড়ে দেয়, এই মুহূর্তে তার যেটা দায়িত্ব সেটা নিয়েই মাথা ঘামায়। কাধে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝুলিয়ে সে তথকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনের করিডোরে করিভোরে ঘুরে বেড়ায়। যেসব জায়গায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা দুর্বল সেসব জায়গায় সে একটু বেশি সময় দেয়। হঠাৎ করে কেউ যদি তথ্যকেন্দ্রে চলে আসে সে তাকে ধরে ফেলতে চায়, ধরে ফেলে প্রমাণ করতে চায় ক্যাটাগরি-বি. মানুষ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মানুষ নয়। তাদেরকে হেলাফেলা করা যায় না।

সুহান প্রকৃত অর্থে কখনো বিশ্বাস করে নি সত্যি সত্যি সে একজন দুবৃত্তকে ধরে ফেলবে, পুরো ব্যাপারটাই ছিল তার একটা কল্পনা। তাই যখন একদিন মাঝরাতে সে দোতলায় নিরাপত্তার অবলাল রশ্মিটাকে অকেজো দেখতে পেল সে খুব দুশ্চিন্তিত হল না, ইলেকট্রনিক্স এবং যন্ত্রপাতি যত নিখুঁতভাবেই তৈরি করা হোক সেগুলো কখনো না কখনো অকেজো হয়ে যায়। এটাও নিশ্চয়ই সেরকম একটা কিছু। কাছাকাছি সার্কিট ব্রেকারের কাছে গিয়ে দেখল সেটাও বন্ধ হয়ে আছে। পরপর দুটো স্বল্প সম্ভাবনার ঘটনা ঘটে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম এবং তখন সে দুশ্চিন্তিত হয়ে চারতলায় ছুটে গেল এবং বড় করিডোরে গিয়ে দেখতে পেল টেলিভিশন ক্যামেরাটা ছাদের দিকে মুখ করে রাখা আছে—এই করিডোের দিয়ে গোপনে কোনো মানুষ যেতে চাইলে ক্যামেরাটা এভাবে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। সুহান করিডোরের শেষ মাথায় তাকাল এবং আবিষ্কার করল দরজার ফাঁক দিয়ে আলো বের হচ্ছে। এটা তথ্যকেন্দ্রের একটা মূল কক্ষ, বিশেষ প্রয়োজন না হলে কেউ এখানে ঢোকে না। এবং সারাক্ষণই এই ঘরের জালো নেভানো থাকে। কেউ ভেতরে থাকলে এর ভেতরে আলো জ্বলার কথা কিন্তু এর ভেতরে এখন কেউ নেই। সুহান কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না, নিরাপত্তা কেন্দ্রে ব্যাপারটা জানানোর আগে সে দরজাটা একটু ধাক্কা দিয়ে আসতে চায়–দরজাটা নিশ্চিতভাবেই বন্ধ থাকার কথা। সুহান নিঃশব্দে দরজাটার কাছে গিয়ে খুব আস্তে দরজাটায় ধাক্কা দিল, কারণ একটু জোরে চাপ পড়লেই এলার্ম বেজে উঠবে। সুহান বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল যখন তার হাতের স্পর্শে খুব ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে গেল। সুহান নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না যে এই গভীর রাতে কোনো একজন মানুষ তথ্যকেন্দ্রে ঢুকে পড়েছে। সুহান দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল, উঁকি দিয়ে বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে দেখল, ঘরের মাঝামাঝি একটা চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে একজন মানুষ কাজ করছে। কী-বোর্ডে তার হাত দ্রুত নড়ছে। তাকে দেখে মনে হতে পারে সে এখানেই থাকে এবং এখানেই কাজ করে। সুহান বজ্রাহত মানুষের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে রইল, হাতে অস্ত্রটা নিতেও মনে থাকল না। মানুষটা মুখ তুলে সুহানের দিকে তাকাল এবং একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার, তাকে দেখে মানুষটা চমকে উঠল না। এমনভাবে তার দিকে তাকাল যেন এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, সুহানের মনে হল মানুষটা যেন খুব পরিচিত। একজনের মতো তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। সুহানের হঠাৎ সাংবিৎ ফিরে এল, সে চোখের পলকে হাতে অস্ত্রটা নিয়ে সেটা মানুষটার মাথার দিকে তাক করে বলল, তুমি কে?

মানুষটা হাসার চেষ্টা করে আবার মনিটরে চোখ নামিয়ে নিয়ে কী-বোর্ডে কাজ করতে থাকে। কী-বোর্ডে কাজ করতে করতে বলল, আমি কে শুনে তুমি কী করবে? তুমি কি আমাকে চিনবে?

তুমি এখানে কেমন করে এসেছ?

মানুষটা চোখ না তুলে কী-বোর্ডে কাজ করতে করতে বলল, একটু ফন্দিফিকির করে এসেছি।

মানুষটা পরিচিত মানুষের মতো কথা বলছে যেন অনেকদিন থেকে তার সাথে পরিচয়। সুহানের এখন রেগে যাওয়া উচিত, কাজেই সে খুব রেগে যাবার ভঙ্গি করে বলল, তুমি কেন এখানে এসেছ? মানুষটা সুহানের দিকে চোখ না তুলে কী-বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দ্রুত কাজ করতে করতে বলল, সেটা তোমাকে বোঝানো খুব সহজ হবে না!

সুহান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটায় একটা ঝাকুনি দিয়ে বলল, তুমি এখনই এখান থেকে বের হয়ে আস, তা না হলে কিন্তু আমি গুলি করতে বাধা হব।

মানুষটা মাথা নেড়ে ভালো মানুষের মতো বলল, উহুঁ। আমার সেটা বিশ্বাস হয় না। গুলি করার হলে তুমি এতক্ষণে গুলি করে দিতে। আমার ধারণা তুমি আগে কখনো কাউকে গুলি কর নি।

আমি সেই তথ্যটা তোমাকে দিতে বাধ্য নই। তুমি এখনই তোমার দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও।

মানুষটা সুহানের কথা পুরোপুরি উপেক্ষা করে কাজ করে যেতে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় সে মোটামুটিভাবে কারে একটা পর্যায় শেষ করে ফেলেছে। তার মুখে বেশ পরিতৃপ্তির একটা ভাব ফুটে ওঠে, মনিটরে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে সে বেশ আনন্দের একটা ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে থাকে। সুহান চিৎকার করে বলল, তুমি এখনই হাত তুলে দাড়াও তা না হলে কিন্তু গুলি করে দেব।

মানুষটা আবার কী-বোর্ডে ঝুঁকে বলল, তুমি গুলি করবে না। কারণ তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখান থেকে গুলি কলে পেছনের মূল্যবান সার্ভারের বারোটা বেজে যাবে। তোমার সেই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।

সুহান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, সত্যি সত্যিই একজন মানুষ মধ্যরাতে একটা গোপন তথ্যকেন্দ্রের ভেতরে এসে এভাবে কাজ করে যাচ্ছে? যার বুকের ভেতর বিন্দুমাত্র ভয় নেই? পুরো ব্যাপারটাকে একটা তামাশা হিসেবে নিয়েছে?

সুহান কী করবে বুঝতে না পেরে ওয়্যারলেস সেটের বোতাম চাপ দিয়ে কিরির সাথে যোগাযোগ করল, কিরি।

কী ব্যাপার সুহান?

পাঁচ তলার মূল সার্ভার রুমে একজন মানুষ।

কিরি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তুমি ঠাট্টা করছ, তাই না?

না।

মানুষটা কী করছে?

সার্ভারের ইন্টারফেসে কাজ করছে?

তুমি কী করছ?

আমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তার দিকে তাক করে রেখেছি।

কিরি নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, তুমি তাক করে রাখ, আমি ব্যবস্থা করছি।

সুহান অস্ত্রটা শক্ত করে ধরে রেখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণের মাঝেই এলার্ম বেজে উঠতে থাকে। চারপাশে উজ্জ্বল আলো জ্বলে ওঠে এবং অনেক মানুষের পদক্ষেপ শোনা যায়। কী-বোর্ডে ঝুঁকে থাকা মানুষটাকে প্রথমবার একটু বিচলিত হতে দেখা গেল, একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সময় তা হলে শেষ। কী বলো?

সুহান কোনো কথা বলল না, মানুষটি আবার তার কী-বোর্ডে ঝুঁকে পড়ে শেষ মুহূর্তের মতো কিছু কাজ করতে শুরু করে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই অনেকগুলো সশস্ত্র মানুষ ছুটে আসে, সুহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তারা ভেতরে ঢুকে যায়, সবার সামনে রয়েছে। বিগা, তার হাতে একটা ছোট আগ্নেয়াস্ত্র। রিগা কোনো রকম দ্বিধা না করে মানুষটার কাছে এগিয়ে যায় এবং একটা কথাও না বলে মানুষটাকে গুলি করল। পরপর অনেকবার।

সুহান এর আগে কখনো কোনো মানুষকে হত্যা করতে দেখে নি, দৃশ্যটা তার কাছে ভয়ংকর অমানবিক এবং পৈশাচিক বলে মনে হল। নিজের অজান্তেই সে চিৎকার করে ছুটে যায় এবং গুলিবিদ্ধ মানুষটাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে। মানুষটার রক্তে তার হাত মাখামাখি হয়ে যায়, সে চিৎকার করে বলতে থাকে, না! না! না!

কে একজন হ্যাচকা টান দিয়ে সুহানকে সরিয়ে নেয়। বেশ কয়েকজন মানুষ গুলিবিদ্ধ মানুষটাকে ঘিরে দাড়ালে তার ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা পরীক্ষা করতে থাকে। সুহান শুনতে পেল, কেউ একজন বলছে, না। কোনো পরিচয় নেই।

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, সার্ভার থেকে কী তথ্য বের করেছে?

জানি না। শেষ মুহূর্তে সবকিছু মুছে দিয়েছে।

কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, মুছে দেবার সময় পেয়েছে?

হ্যাঁ। অনেক সময় পেয়েছে।

আরো আগে গুলি করা উচিত ছিল।

সুহান ফ্যালফ্যাল করে মানুষগুলোর দিকে তাকাল তার ক্লারো আগেই গুলি করা উচিত ছিল? একজন মানুষকে গুলি করা কি এতই সহজ?

সুহানকে কে যেন হাত ধরে টানছে। সুহান মাথা ঘুরিয়ে দেখল কিরি। কিরি বলল, চলে এস সুহান। তোমার এখন আর করার কিছু নেই।

সুহান হতচকিতের মতো কিরির দিকে তাকিয়ে বলল, ম্মানুষটাকে মেরে ফেলল?

কিরি বলল, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। চল। এখান থেকে চল। সুহান কিরির পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে, তার তখনো পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না। সে যদি এভাবে মানুষটাকে খুঁজে বের না করত তা হলে হয়তো তার এভাবে মারা যেতে হত না। সুহান জোর করে পুরো ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পারে না। ঘুরেফিরে বারবার হত্যা-দৃশ্যটা তার মাথায় আসতে থাকে, মনে হয় এটা দীর্ঘদিন তাকে তাড়না করিয়ে বেড়াবে। করিডোরের মোড়ে কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে অপেক্ষা করছে। যারা যাচ্ছে কিংবা আসছে তাদের সবার পরিচিতি পরীক্ষা করে দেখছে। সুহান তার কার্ড দেখিয়ে যখন তার জিনেটিক মাপিঙের জন্য ছোট যন্ত্রটার ভেতরে ভার আঙুল প্রবেশ করিয়েছে তখনই একটা বিপদ সংকেত শুনতে পেল। যন্ত্রের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা হাতের অস্ত্র উদ্যত করে বলল, তুমি কে? এখানে কোথা থেকে এসেছ? তোমার কার্ডের সাথে পরিচয় মিলছে না কেন?

সুহান অবাক হয়ে বলল, পরিচয় মিলছে না?

না। এই দেখ!

সুহান অবাক হয়ে দেখল, সত্যি সত্যি মনিটরে কিছু বিদঘুটে সংখ্যা এবং তথ্যকেন্দ্রে তথ্য নেই বলে একটা লেখা বড় বড় করে ফুটে উঠেছে। সুহান যন্ত্রটা থেকে তার হাত বের করে হঠাৎ করিণটা বুঝতে পারল। বলল, বুঝেছি। আমি গুলিবিদ্ধ মানুষটাকে ধরেছিলাম বলে আমার হাতে তার রক্ত লেগেছে। সেই রক্ত থেকে জিনেটিক কোডিং করে ফেলেছে–আমার টিস্যু দিয়ে নয়।

যন্ত্রের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বলল, তুমি তোমার আঙুলটা পরিষ্কার করে আবার পরীক্ষা কর।

সলভেন্ট দিয়ে আঙুল পরিষ্কার করে সুহান আবার তার জিনেটিক কোডিং বের করল, এবারে কোডিংটুকু তার কার্ডের তথ্যের সাথে মিলে গেল। উদাত অস্ত্র হাতের মানুষটা তার অস্ত্র নামিয়ে বলল, চমৎকার। এবারে তুমি যেতে পার।

সুহান বলল, ধন্যবাদ।

কিরি আর সুহান হাঁটতে থাকে। কিরি কিছু একটা বলছে, সুহান ঠিক ভালো করে শুনছে। তার মনটা হঠাৎ করে খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। গুলিবিদ্ধ মানুষটার রক্ত থেকে ভুল করে জিনেটিক কোডিং বের করা তথাটা সে একনজর দেখেছে। সেখানে কিছু বিদঘুটে সংখ্যা ছিল, বড় করে লেখা ছিল তথ্যকেন্দ্রে তথ্য নেই কিন্তু তার সাথে আরো একটা জিনিস লেখা ছিল। লেখা ছিল ক্যাটাগরি-বি. মানুষ! এই মানুষটা কে তার পরিচয় কেউ জানে না, শুধু জানে যে সে একজন ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। সুহান কিছুতেই বুঝতে পারে না একজন ক্যাটাগরি-বি. মানুষ কেমন করে এত সুরক্ষিত একটা তথ্যকেন্দ্রে চলে এসেছিল? মানুষটা এত সহজে কেমন করে মৃত্যুকে গ্রহণ করেছে? সে যদি কোনো গোপন তথ্য সগ্রহ করতে এসে থাকে তা হলে একবারও সে সেই তথ্য নিয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করল না কেন?

তোমার কী মনে হয়েছে?

সুহান হঠাৎ করে চমকে উঠে লক্ষ করুল কিরি তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছে, প্রশ্নটা পুরোপুরি শুনতে পায় নি। সে লজ্জা পেয়ে বলল, আমি ঠিক খেয়াল করি নি তুমি কী জিজ্ঞেস করেছ?

আজকে রিগাকে দেখে তোমার কী মনে হয়েছে?

মনে হয়েছে মানুষটা একটা পেশাদার খুনি।

সেটা তো সবাই জানে। আর কিছু মনে হয় নি?

না, আমার আর কিছু মনে হয় নি। শুধু–

শুধু কী?

শুধু মনে হয়েছে আমি যেন কখনো তার মতো না হয়ে যাই। এত সহজে মানুষ দূরে থাকুক আমি যেন একটা পতঙ্গকেও কখনো হত্যা করতে না পারি।

কিরি কোনো কথা না বলে একবার সুহানের দিকে তাকাল তারপর নিচু গলায় বলল, পৃথিবী বড় কঠিন একটা জায়গা সুহান।

 

০৫.

পাতাল ট্রেনের স্টেশন থেকে বের হয়ে সুহান আধো অন্ধকার রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ক্যাটাগরি-বি. মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা এই এলাকাটাকে তার অত্যন্ত নিরানন্দ মনে হত, ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ইদানীং সারা দিন কাজ করার পর সে ভেতরে ভেতরে তার নিজের জায়গায় ফিরে আসার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই এলাকার মানুষজনের সাথে পরিচয় হয়েছে, কারো কারো সাথে তার আন্তরিক সম্পর্কও হয়েছে। আধো অন্ধকার রাস্তায় ভাঙা কাচ, কাচের বোতল বাচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।

দাড়াও। বাজখাই গলায় একটা ধমক শুনে সুহান থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার সামনে প্রায় পাহাড়ের মতো উঁচু একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। অবিশ্যি দাঁড়িয়ে আছে কথাটা বলা হয়তো একটু ভুল হবে, বলা উচিত দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে, মানুষটা জড়িত গলায় বলল, আমি কোনো কথা শুনতে চাই না, ঝটপট একটা ইউনিট বের করে দাও দেখি।

সুহান খুব বিরক্ত হল, সত্যি সত্যি একটা ইউনিট দিয়ে দেবে নাকি এই নেশাগ্রস্ত মানুষের নেশার খোরাক না যুগিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে সেটা একবার চিন্তা করল। মানুষটা বিশাল, ইচ্ছে করলে তাকে জাপটে ধরে নতুন আরেকটা সমস্যা করতে পারে তাই সে একটা ইউনিট দিয়ে দেওয়াই ঠিক করল। ইউনিটটা বের করার জন্য সে যখন পকেটে হাত ঢুকিয়েছে ঠিক তখন সে অবাক হয়ে দেখল আরো তিন জন মানুষ তাকে ভিন্ন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।

এই তিন জন মানুষ নেশাগ্রস্ত মানুষষ্টার মতো টলছে না, তারা কেউ নেশাগ্রস্ত নয়। সুহান হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। ভয় পাওয়া গলায় বলল, তোমরা কারা?

তিন জন মানুষ কোনো উত্তর দিল না, তারা আরো কাছাকাছি এগিয়ে এল এবং তখন সে তাদের হাতে ছোট আগ্নেয়াস্ত্রগুলো দেখতে পেল। এ ধরনের বিপদের মুখোমুখি হলে কী করতে হয় সে গত কয়েক সপ্তাহ থেকে কিরির কাছে শিখছে, সেই বিদ্যেটুকু কাজে। লাগানোর জন্য সে লাফ দিয়ে সামনের মানুষটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই কানের কাছে একজন তাকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেছে। মুহূর্তে তার সামনে পুরো জগৎটুকু অন্ধকার হয়ে যেতে থাকে। সে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল তার আগেই একজন তাকে ধরে ফেলল, সুহান জ্ঞান হারানোর আগে এক মুহূর্তের জন্য মানুষটাকে দেখতে পায় এই মানুষটাকে সে আগে কোথায় জানি দেখেছে।

পাহাড়ের মতো মানুষটা ব্যাকুল গলায় আরো একবার বলল, আমার ইউনিট?

কিন্তু সুহান তখন সেটা শুনতে পেল না। অন্য তিন জন মানুষ যে তার অচেতন দেহটাকে নিয়ে কাছাকাছি একটা কালো ট্যাক্সিতে তুলে নিয়েছে সেটাও সে জানতে পারল না।

মিলিনার সরাইখানায় মিলিনা অনেক রাত পর্যন্ত সুহানের জন্য অপেক্ষা করল। সুহান নামের এই ছেলেটার জন্য তার ভেতরে এক ধরনের মমতার জন্ম হয়েছে ছেলেটি ফিরে

আসায় সে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের আশঙ্কা অনুভব করতে থাকে। কিন্তু সে জানে। তার কিছু করার নেই। পুলিশ বা হাসপাতালে ক্যাটাগরি-বি. মানুষের খোঁজ নেওয়া যায় না।

 

সুহানের জ্ঞান ফিরে এল ছাড়া ছাড়া ভাবে। তার মনে হতে লাগল অসংখ্য মানুষ তার সাথে কথা বলছে, সেই কথাগুলো সে মাঝে মাঝে পরিষ্কার বুঝতে পারে আবার মাঝে মাঝে তার কাছে পুরোপুরি দুর্বোধ্য মনে হয়। কথাগুলো কে বলছে সে বুঝতে পারে না। কখনো কখনো মনে হয় সে নিজেই এই কথা বলছে। যে কথাগুলো তার মাথার মাঝে ঘুরপাক খায় তার মাঝে ক্যাটাগরি-বি., অস্তিত্ব, ভবিষ্যৎ, গোপনীয় রিপোর্ট এ ধরনের বিষয়গুলোই বেশি। জ্বরাক্রান্ত মানুষের মাথার মাঝে কোনো একটা ভাবনা যেরকম ঘুরপাক খেতে থাকে অনেকটা সেরকম, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি জীবন্ত।

সুহান ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাতেই তার ওপর একজন ঝুঁকে পড়ল, মানুষটা একজন ডাক্তার। সুহান ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায়?

তুমি হাসপাতালে। শহরতলি এলাকায় তোমাকে কজন নেশাগ্রস্ত মানুষ আক্রমণ করেছিল।

সুহান বলতে চাইল, না, আমাকে নেশাগ্রস্ত মানুষ আক্রমণ করে নি, যারা আক্রমণ করেছিল তারা প্রফেশনাল, তাদের হাতে অস্ত্র ছিল এবং তাদের একজনকে আমি আগে কোথাও দেখেছি। কিন্তু তার কিছুই বলার ইচ্ছে করল না, সে নিঃশব্দে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল। ডাক্তার বলল, তোমার মাথায় আঘাত লেগেছিল এবং তোমাকে বাঁচানোর জন্য তোমার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।

সুহান হতচকিতের মতো ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে? সে একজন ক্যাটাগরি-বি. মানুষ, তাকে বাচানোর জন্য তার মাথায় অস্ত্রোপচার করেছে? কেন?

মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার একটা জটিল বিষয়। ডাক্তার তার ওপর ঝুঁকে পড়ে মৃদুস্থার বলল, প্রথম প্রথম সেজন্য তোমার বিচিত্র কিছু অনুভূতি হবে, তুমি সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।

সুহান ফিসফিস করে বলল, দুশ্চিন্তা করব না?

না! তোমার কেমন লাগছে, কী হচ্ছে, কী রকম অনুভব করছ সবকিছু আমাদের বলবে। আমরা তোমাকে সাহায্য করব।

ধন্যবাদ। সুহান হঠাৎ এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে, তার আর কথা বলার ইচ্ছে করে না। সে চোখ বন্ধ করল। ডাক্তার বলল, তোমার এখন বিশ্রাম নেওয়া দরকার। আমি একটা ইনজেকশন দিই, তুমি ঘুমিয়ে যাও।

সুহান গভীর ঘুমে ঢলে পড়ার আগে শুনতে পেল কে যেন তার মস্তিষ্কের মাঝে বলছে, সাবধান। সুহান তুমি সাবধান! তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ভয়ংকর ষড়যন্ত্র।

কে তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে, কীসের ষড়যন্ত্র কিছু বোঝার আগেই সুহান গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।

সুহান তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে তাকে ঘিরে বেশ কয়েকজন মানুষ। তাদের সবাই যদিও সাদা পাউন পরে আছে কিন্তু বোঝা যায় সবাই ডাক্তার নয়। কেউ কেউ নিশ্চয়ই নিরাপত্তা বাহিনীর। মধ্যবয়স্ক একজন বলল, তোমার এখন কেমন লাগছে আমাদেরকে বলো।

আমার মাথার মাঝে মনে হয় অনেক মানুষ কথা বলছে।

মানুষগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, মনে হল তারা এটা শুনে খুব আশ্বস্ত বোধ করছে। কিন্তু কথায় সেটা প্রকাশ করল না, খুব দুশ্চিন্তার ভঙ্গি করে একজন বলল, মাখার ভেতরে কথা বলছে? কী আশ্চর্য!

আরেকজ্জন একটু এগিয়ে এসে বলল, কী নিয়ে কথা বলে?

সুহান মানুষটার মুখের দিকে তাকাল, কেউ একজন তার মাথায় তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, ভয়ংকর একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাকে খুব সাবধান থাকতে হবে। সে সাবধানে থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত না হচ্ছে ততক্ষণ সে কিছুই বলবে না। কিন্তু তাকে কথা বলতে হবে তা না হলে তাকে সন্দেহ করবে। কথা বলতে হবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যা কথা বলা সোজা, সেটা হতে হয় সত্যের খুব কাছাকাছি। কাজেই সে সত্যের কাছাকাছি মিথ্যা কথা বলবে। মানুষটা আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, কী নিয়ে কথা বলে তোমার সাথে?

সেটা বুঝতে পারি না। সুহান মাথা নাড়ল, বলল, অবিশ্যি বোঝার চেষ্টাও করি না। এমন তো না যে বাইরে থেকে কেউ আমার সাথে কথা বলছে–তাই কথাটা বোঝার দরকার আছে। আমি যে কথাগুলো শুনি সেটা নিশ্চয়ই আমার নিজের মস্তিষ্কের একটা প্রতিক্লিয়া, আমার অবচেতন মনের কথা। এটা শুনেই কী আর না শুনেই কী?

ডাক্তারের পোশাক পরা মানুষটাকে এবারে খানিকটা বিপন্ন মনে হল, আমতা-আমতা করে বলল,  হলে তুমি কথাগুলো বোঝার চেষ্টা কর না?

না! সুহান সরল মুখ করে বলল, কেন করব? আমি তো আর পাগল না যে নিজের সাথে নিজে কথা বলব। তাই চেষ্টা করি না শুনতে।

কিন্তু—কিন্তু–মানুষটাকে হঠাৎ কেমন যেন বিপদগ্রস্ত মনে হয়, কিন্তু সেই কথাটা যদি ডাক্তার না জানে সে তা হলে তোমার চিকিৎসা করবে কেমন করে? মানুষটা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না ডাক্তার?

ডাক্তার অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

তুমি তা হলে চেষ্টা কর শুনতে। তোমার মস্তিষ্কে কী কথা হচ্ছে সেটা শুনে ডাক্তারকে জানাবে। সাথে সাথে জানাবে। একেবারেই দেরি করবে না।

সুহান মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে? মানুষটার কথা বলার ভঙ্গি, আচার-আচরণটা অত্যন্ত সন্দেহজনক। এদের উদ্দেশ্য কী পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কিছুতেই তাদেরকে কোনো কিছু জানানো যাবে না। কোনোভাবেই না। সুহান ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার কী হয়েছে? আমি কেন এরকম মানুষের কথা শুনতে পাই?

ডাক্তার মানুষটা সুহানের চোখ এড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত জটিল একটা বিষয়। বিজ্ঞানের এত উন্নতির পরেও মানুষ মস্তিষ্ককে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে নি। তোমার সেই মস্তিষ্কে আঘাত লেগেছ, সেখানে রক্তক্ষরণ হয়েছে, সেখানে একটা চাপের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই চাপটা কমানোর জন্য অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে, অস্ত্রোপচারের সময় মস্তিষ্কের কোনো কোনো অংশে কোনো ধরনের পরিবর্তন হতে পারে, তার জন্য সাময়িক কোনো প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

তা হলে আমি যেটা শুনছি সেটা কোনো সত্যি ব্যাপার নয়—সেটা পুরোপুরি আমার কল্পনা?

না মানে ইয়ে. ডাক্তারকে কেমন যেন বিপন্ন দেখায়। মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত জটিল একটা বিষয় সেটা কীভাবে কাজ করে আমরা এখনো ঠিক জানি না। মস্তিষ্ক নিয়ে অনেক বিচিত্র ব্যাপার ঘটে।

সুহান ব্যাপারটি নিয়ে আর কিছু বলল না। সে বুঝে গেছে তার প্রশ্নের সত্যিকার উত্তর আর পাবে না। সে তাই অন্য প্রসঙ্গে এল, বলল, আমাকে কবে যেতে দেবে?

আরো দুই-তিন দিন পর্যবেক্ষণে রেখে আমরা তোমাকে ছেড়ে দেব। আমাকে কি এই কয়েকদিন সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে? না, সারাক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে না। তবে তোমার মাথায় কিছু সেন্সর লাগানো আছে, শুয়ে না থাকলে আমরা সেই সেন্সরগুলো লক্ষ করতে পারব না। কাজেই আপাতত তোমার জন্য শুয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সুহানের কেবিন থেকে সবাই বের হয়ে গেলে সুহান তার চোখ বন্ধ করল এবং হঠাৎ করে মনে হল কেউ একজন তাকে বলল, চমৎকার! ভারি চমৎকার।

সুহান অবাক হয়ে লক্ষ করল সে আবার মনে মনে কথা বলতে শুরু করেছে। নিজেকে নিজে বলছে, কে আবার কথা বলছে?

তুমি। তুমি তোমার সাথে কথা বলছ।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সুহান ছটফট করে বলল, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

না তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ না।

তা হলে?

সুহান তুমি ধৈর্য ধর। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখ–তুমি সবকিছু বুঝতে পারবে।

কখন বুঝতে পারব?

সময় হলেই বুঝতে পারবে।

কখন সময় হবে?

তুমি সেটা জানবে। এখন তুমি উত্তেজিত হয়ো না। ব্যস্ত হয়ো না। তোমার ওপর খুব বিপদ। তোমাকে নিয়ে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র হচ্ছে, কাজেই তুমি খুব সাবধানে থেকো। তোমার চারপাশে যারা আছে তারা তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের থেকে সাবধান।

সুহান অসহায়ের মতো নিজেকে বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

তার মস্তিষ্কের ভেতরে কেউ একজন বলল, তুমি সব বুঝতে পারবে। একসময় তুমি সবকিছু বুঝতে পারবে। এখন তুমি বিশ্রাম নাও।

আমার মাথার ভেতরে শত শত মানুষ কথা বললে আমি কেমন করে বিশ্রাম নেব?

তোমাকে বিশ্রাম নেওয়া শিখতে হবে। শত মানুষের কথার মাঝে বিশ্রাম নেওয়া শিখতে হবে। আমরা তোমাকে সাহায্য করব।

তোমরা কারা?

আমরা আর তুমি এক। কী বলছ তুমি?

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

বুঝতে পারবে। একসময় বুঝতে পারবে। তুমি ডাক্তারকে বোলো তোমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।

সুহান চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, ডাক্তার।

একজন ডাক্তার তার কাছে এগিয়ে আসে। সুহান ক্লান্ত গলায় বলল, আমাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারবে?

কেন?

আমার মাথার মাঝে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

কেউ কি তোমার সাথে কথা বলছে?

হ্যাঁ।

ডাক্তার চকচকে চোখে তার দিকে এগিয়ে আসে, কী বলছে তোমার মাথার ভেতরে?

বলছে ঘুমের ওষুধ দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।

ও। ডাক্তারের এক ধরনের আশাভঙ্গ হল। সে ওষুধের কেবিনেটের কাছে ফিরে গেল, একটা ছোট সিরিঞ্জ নিয়ে ফিরে এসে সুহানের হাতে সিরিঞ্জটা ঢুকিয়ে দিতেই তার সারা শরীরে একটা আরামদায়ক আলস্য ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে সুহানের সারা শরীরে ঘুম নেমে আসতে থাকে।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সুহান দীর্ঘ সময় ধরে বিয়ানা নামের একটা মেয়েকে স্বপ্নে দেখল। কমবয়সী হালকা-পাতল? তেজস্বী একটা মেয়ে, মাথার অবাধ্য চুলকে উজ্জ্বল লাল রঙের একটা স্কার্ফ দিয়ে বেঁধে রেখেছে। মেয়েটার বড় বড় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, রোদে পোড়া ত্বক। প্রসাধনহীন মুখে এক ধরনের অগোছালো সৌন্দর্য। ছটফটে চঞ্চল এবং খানিকটা বেপরোয়া, হাসিটা খুব সুন্দর কারণ মেয়েটার মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁত। স্বপ্নটি শুরু হল এভাবে, শহরের মাঝামাঝি অতলান্ত সড়ক নামে যে ব্যস্ত ছোট রাস্তাটা আছে সেখানে কিশলয় ক্যাফের ভেতর থেকে বিয়ানা নামে মেয়েটি বের হয়ে বলল, এই যে শোন, তুমি এদিকে তাকাও।

সুহান তাকিয়ে মেয়েটাকে দেখতে পেল। মেয়েটা বলল, আমার নাম রিয়ানা! নামটা তোমার মনে থাকবে তো?

সুহান বলল, কেন থাকবে না? রিয়ানা তো মনে রাখার জন্য এমন কোনো কঠিন নাম নয়।

রিয়ানা হাসল, বলল, । একেবারেই কঠিন নাম নয়। খুব সাধারণ নাম, মনে রাখা খুব সহজ। কিন্তু তুমি তো এখন স্বপ্ন দেখছ। মানুষ যেটা স্বপ্নে দেখে জেগে ওঠার পর সেটা ভুলে যায়। তুমিও যদি ভুলে যাও?

সুহান বলল, স্বপ্নের কথা মনে রাখতে হবে কেন?

মাঝে মাঝে মনে রাখতে হয়। তোমাকে এই স্বপ্নটার কথা মনে রাখতে হবে।

কেন? এই স্বপ্নটা কেন মনে রাখতে হবে?

সেটা আমি তোমাকে এখন বোঝাতে পারব না। বোঝালেও তুমি বুঝবে না।

কেন বুঝব না?

কারণ এটা স্বপ্ন। স্বপ্নে সবকিছু বোঝা যায় না। রিয়ানা নামে মেয়েটা বলল, তোমার খানিকক্ষণ সময় আছে?

তা অাছে।

তা হলে এস আমার সাথে। এই ফুটপাত ধরে হাঁট। চেষ্টা কর সবকিছু মনে রাখতে। প্রথমে একটা ছোট ফুলের দোকান তারপর একটা ক্রিস্টালের দোকান। মনে থাকবে তো?

হ্যাঁ মনে থাকবে।

চমৎকার। রিয়ানা সুহানের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, তোমার নাম কী?

সুহান।

সুহান! রিয়ানা হাসল এবং হাসির সাথে সাথে তার মুক্তার মতো দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল।

সুহান বলল, তোমার দাতগুলো খুব সুন্দর।

রিয়ানা হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে থাকে। সুহান বলল, তুমি কেন হাসছ?

তোমার কথা শুনে হাসছি।

আমি কি কোনো হাসির কথা বলেছি?

ন। বল নি। আমি হাসছি অন্য কারণে।

কী কারণে?

একটা মেয়ের সাথে তোমার দেখা হয়েছে এক মিনিটও হয় নি, তুমি সেই মেয়েটাকে বলছ তার পঁতগুলো খুব সুন্দর। কেন বলছ জান?

কেন?

কারণ এটা স্বপ্ন। স্বপ্নে মানুষের কোনো ভান থাকে না। যেটা সত্যি সেটা বলে দেয়। সেটা করে ফেলে।

কী আশ্চর্য!

কোন জিনিসটা তোমার আশ্চর্য মনে হচ্ছে সুহান?

এই পুরো ব্যাপারটা। এই স্বপ্নটা এত বাস্তব যে মনে হচ্ছে এটা সত্যি সত্যি ঘটছে।

মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে তখন তার কাছে সেটা সব সময় সত্যি মনে হয়।

কিন্তু এটা অন্যকরম।

রিয়ানা হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ঠিক আছে তা হলে তুমি মনে রেখ তোমার এই স্বপ্নটা একটু অন্যকরম। মনে থাকবে?

হ্যাঁ। মনে থাকবে। সুহান রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, রিয়ানা।

বলো।

তোমার চোখগুলোও খুব সুন্দর।

রিয়ানা এবারে আগের মতো খিলখিল করে হেসে উঠল না, কিছুক্ষণ সুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ভালবাসার কোনো মেয়ে আছে সুহান?

না নেই।

কেন নেই?

আমি ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। ক্যাটাগরি-বি. মানুষের খুব দুঃখ। তাদের স্বপ্ন দেখতে নেই। ভালবাসার মেয়ে থাকতে নেই। কারো স্বপ্নকে নষ্ট করতে নেই।

রিয়ানা চোখ বড় বড় করে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান বলল, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি রিয়ানা?

না সুহান, আজকে নয়। তুমি আমাকে কী প্রশ্ন করবে আমি জানি। আরেকদিন জিজ্ঞেস করো।

কিন্তু এটা তো একটা স্বপ্ন। আরেকদিন তো এই স্বপ্ন আমি দেখব না। সেই স্বপ্নে তুমি থাকবে না।

তুমি যদি চাও তা হলে তুমি আবার এই স্বপ্ন দেখতে পাবে।

সেটা কীভাবে সম্ভব?

সেটা সম্ভব। কারণ এটা অন্যরকম স্বপ্ন।

সত্যি?

সত্যি। রিয়ানা সুন্দর করে হাসল, বলল, এটা হবে তোমার আর আমার স্বপ্ন। তুমি দেখতে চাইলেই এই স্বপ্নটা দেখতে পারবে।

তুমি আমাকে কথা দিচ্ছ?

হ্যাঁ আমি কথা দিচ্ছি। রিয়ানার চোখে-মুখে হঠাৎ এক ধরনের ব্যস্ততার ছাপ ফুটে ওঠে, সে সুহানের হাত ধরে বলল, সুহান আমাদের সময় নেই। তাড়াতাড়ি এস।

কোথায়?

এস আমার সাথে।

সুহান রিয়ানার সাথে হাঁটতে থাকে। একটা পোশাকের দোকান, তার পাশে একটা ভাস্কর্যের দোকান, তারপরে একটা ক্যাফে। বাইরে টেবিল, টেবিলকে ঘিরে ছোট ছোট চেয়ার। সেখানে তরুণ-তরুণীরা বসে কফি খাচ্ছে, নিচু গলায় কথা বলছে, হাসছে। রিয়ানা বলল, ওই ক্যাফেটার নাম ক্যাফে অর্কিড়। নামটা মনে থাকবে?

হ্যাঁ।

এই যে খালি টেবিলটা দেখছ, তুমি এখানে বস সুহান।

সুহান খালি টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসল। রিয়ানার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি? তুমি বসবে না?

হ্যাঁ বসব। কিন্তু তোমার সাথে না। অন্যখানে।

কেন রিয়ানা? আমার সাথে নয়, কেন?

কারণ আছে সুহান।

কী কারণ?

সেই কারণটি আরেকদিন বলব।

সুহান ব্যাকুল হয়ে বলল, আরেকদিন কেন? আজকে কেন নয়?

ঠিক তখন সুহানের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল, তার কাছাকাছি একন ডাক্তার এবং দুজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার তার ওপর ঝুঁকে বলল, তুমি স্বপ্ন দেখছিলে?

হ্যাঁ দেখছিলাম। তুমি কেমন করে জান?

তোমার আর.ই.এম. হচ্ছিল। মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে তখন তার আর.ই.এম. হয়।

ও।

ডাক্তার আরো একটু ঝুঁকে পড়ল, বলল, তুমি কী স্বপ্ন দেখছিলে সুহান?

সুহান ডাক্তারের দিকে তাকাল, হঠাৎ করে এই মানুষটার কৌতূহলটাকে তার অত্যন্ত আপত্তিকর মনে হতে থাকে। তার ভেতরে বিচিত্র একটা ক্রোধ জেগে উঠতে থাকে কিন্তু তাকে তার ক্রোধটাকে গোপন রাখতে হবে। ভেতরকার সত্যি কথাটাও তার গোপন রাখতে হবে। ডাক্তার তার কথা শোনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, কিছু একটা তাকে বলতে হবে। সুহান বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি একটা সার্কাস।

সার্কাস?

হ্যাঁ। সার্কাস।

কী হচ্ছে সেই সার্কাসে?

সার্কাসে একটা মানুষ অনেকগুলো সিংহকে নিয়ে খেলছে।

স্বপ্নে কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?

হ্যাঁ বলেছে।

কে বলেছে? কী বলেছে? ডাক্তারের চোখ হঠাৎ চকচক করে ওঠে।

সিংহগুলো। সিংহগুলো আমাকে বলেছে।

ডাক্তারের চোখ-মুখের উৎসাহ একটু থিতিয়ে যায়, ইতস্তত করে বলে, সিংহ কি কখনো কথা বলে?

সুহান হাসার ভঙ্গি করল, বলল, স্বপ্নের ব্যাপার! স্বপ্নের কি কোনো মাথামুণ্ডু আছে নাকি? স্বপ্নে সিহুঁ কথা বলে। হাতি ওড়ে।

তা ঠিক।

সুহান বলল, সিংহগুলো কী বলছে শুনতে চাও?

ডাক্তারের উৎসাহ এতক্ষণে অনেক কমে এসেছে, তবুও জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে?

বলেছে, আমরা সকালে ক্যাটাগরি-বি. মানুষের কলজে চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। দুপুর বেলা খাই তাদের কিডনি।

ডাক্তার এক ধরনের বিতৃষ্ণা নিয়ে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান বলল, সিংহগুলো ডিনারের সময় কী খেতে চায় জান?

ডাক্তার মাথা নাড়ল, বলল, নাহ! শুনে কাজ নেই। তুমি বরং একটু বিশ্রাম নেবার চেষ্টা কর।

সুহান আবার চোখ বুজল। তার মাথার মাঝে আবার অসংখ্য মানুষের কথার শব্দ ভেসে আসে। সে জোর করে তার মাথা থেকে কথাগুলো সরিয়ে দেয়। হঠাৎ করে তখন তার রিয়ানার কথা মনে হল। কী অসম্ভব বাস্তব এই স্বপ্নটুকু। এখনো মনে হচ্ছে স্বপ্ন নয় সত্যি।

কী বিচিত্র এই স্বপ্নটুকু। কী আশ্চর্য!

সুহান রিয়ানার কথা ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে গেল।

 

০৬.

সুহানকে তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল। কিন্তু তাকে তার নিজের জায়গায় ফিরে যেতে দিল না–তাকে শহরের ভেতরে একটা ছোট অ্যাপার্টমেনে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। সে একজন তুচ্ছ ক্যাটাগরি-বি. মানুষ, তার জন্য এত আয়োজনের কারণটুকু সে জানতে চেয়েছিল, সঠিক উত্তরটুকু কেউ দিতে পারল না। ভাসা ভাসা ভাবে শুনতে পেল যে তথ্যকেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রহরীর এই দায়িত্বটার একটা অন্য ধরনের গুরুত্ব রয়েছে—তাকে সঠিক নিরাপত্তা দেওয়া এখন সরকারের দায়িত্বের মাঝে এসে পড়েছে।

সুহান খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাল না। সে এখনো দূর্বল। মাথার ভেতরে সব সময়ে মানুষের কোলাহল, তার কী হয়েছে সে এখনো বুঝতে পারে নি। মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছে। শুধু যে মানুষের কথা শুনতে পায় তা নয়, সে আবিষ্কার করেছে সে অন্যরকম একটা মানুষ হয়ে গেছে। ধীরলয়ের সঙ্গীত সে একেবারেই পছন্দ করত না, এখন মাঝে মাঝে সেটা শুনতে তার বেশ ভালো লাগে। হঠাৎ হঠাৎ তার মাঝে খুব বড় পরিবর্তন হয়, সে কিছুক্ষণের জন্য একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যায়। একদিন সকালে হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করল—সে মধ্যযুগের সকল চিত্রশিল্পীর নাম জানে। কিছুক্ষণ পর সে নামগুলো ভুলে গেল। মাঝখানে একবার তার মনে হল সে মানুষের রোগের চিকিৎসা করতে পারবে—সব রোগের চিকিৎসা সবকিছুই সে জানে। এই অনুভূতিগুলো তার আসে এবং যায় কিন্তু একটা ব্যাপার মোটামূটি পাকাপাকিভাবে ঘটে গেছে। সেটা হচ্ছে তার স্মৃতিশক্তি সেটা অসম্ভব বেড়ে গেছে, কোনো একটা কিছু একবার দেখলেই সে খুঁটিনাটি সবকিছু মনে রাখতে পারে। এটা কেমন করে ঘটেছে সে কিছুতেই ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না।

নিজের ছোট অ্যাপার্টমেন্টে আসার একদিন পর সে ঘর থেকে ঘটতে বের হল। সে এখনো দুর্বল, কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে ক্লান্তি অনুভব করতে থাকে তখন ফুটপাতে একটা ছোট্ট বেঞ্চে বসে সে বিশ্রাম নিতে থাকে। অন্যমনস্কভাবে সামনে তাকিয়ে সে হঠাৎ চমকে ওঠে, এই জায়গাটা সে আগে দেখেছে—বাস্তবে নয় স্বপ্নে, এই রাস্তাটার নাম অতলান্তে সড়ক, ছোট কিন্তু ব্যস্ত একটা রাস্তা আজকে নিজের অজান্তেই সে এদিকে হেঁটে চলে এসেছে। একদিন সে এই রাস্তাটাকেই স্বপ্ন দেখেছিল। সে ডানে এবং বামে তাকাল এবং অবাক হয়ে দেখল সত্যিই সেখানে কিশলয় ক্যাফে নামে একটা ক্যাফে রয়েছে।

মুহূর্তের মাঝে সুহান তার ক্লান্তি ভুলে উঠে দাড়াল। সে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ক্যাফেটার দিকে হাঁটতে থাকে। ক্যাফেটার সামনে গিয়ে সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কী আশ্চর্য! সে সত্যি সত্যি স্বপ্নে এই ক্যাফেটা দেখেছিল।

ঠিক তখন ক্যাফেটার দরজা খুলে গেল, সুহান নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল, ভেতর থেকে একটা মেয়ে বের হয়ে এসেছে, মেয়েটি তার মাথার অবাধ্য চুলগুলোকে একটা লাল স্কার্ফ দিয়ে বেঁধে রেখেছে। মেয়েটার গায়ের রঙ রোদে পোড়া তামাটে, চোখগুলো বুদ্ধিদীপ্ত এবং উজ্জ্বল। মেয়েটা ঠোট চেপে মুখ বন্ধ করে রেখেছে কিন্তু সুহান নিশ্চিতভাবে জানে যখন এই মেয়েটা হাসবে তখন দেখা যাবে তার পঁাতগুলো মুক্তার মতো। ঝকঝকে। সুহান চিৎকার করে ডাকতে যাচ্ছিল বিয়ানা, তুমি? কিন্তু ঠিক তখন কেউ একজন তার মাথার ভেতরে ফিসফিস করে বলল, খবরদার সুহান, তুমি আমাকে ডেকো। না। আমাকে চেনার ভান করো না। কিছুতেই না।

কেন নয়? সুহান অবাক হয়ে দেখল একটা কথা উচ্চারণ না করে সে রিয়ানার সাথে কথা বলছে।

তোমার আশপাশে নিরাপত্তা বাহিনীর লোক কিলবিল করছে।

সত্যি?

সুহান দেখল তার পাশ দিয়ে রিয়া অপরিচিতের মতো হেঁটে চলে গেল। যাবার সময় তার মস্তিষ্কে ফিসফিস করে বলল, তুমি জান কোথায় যেতে হবে?

হ্যাঁ জানি।

এস। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

বেশ।

আমার পিছু পিছু নয় একটু সময় নাও। তারপর এস।

ঠিক আছে রিয়ানা। সুহান অবাক হয়ে দেখল কী অবলীলায় সে একটা শব্দ মুখে উচ্চারণ না করে শুধু চিন্তা করে কথা বলে ফেলছে। কেমন করে সে পারছে।

সুহান মাথা ঘুরিয়ে না তাকিয়েও বুঝতে পারল তার আশপাশে কিছু মানুষ তাকে লক্ষ করছে। নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষ। তাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে, সে কী করে সেটা লক্ষ করছে। কিশলয় ক্যাফের সামনে সে থমকে দঁাড়িয়েছে তাই এর ভেতরেই তার ঢোকা উচিত। সুহান ক্যাফেটাতে ঢোকে, ভেতরে বেশ ভিড়। খালি টেবিল নেই। দূরে একটা টেবিল খালি হয়েছে, সে সেখানে গিয়ে বসে। এখানে খানিকক্ষণ সময় কাটাবে সে, স্নায়ুকে শীতল করার জন্য একটা পানীয় খাবে তারপর হেঁটে হেঁটে যাবে ক্যাফে অর্কিডে। ঠিক যেরকম সে স্বপ্নে দেখেছিল।

মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ সুহানকে জিজ্ঞেস করল, আমি তোমার টেবিলে বসতে পারি? ক্যাফেতে খালি টেবিল নেই তাই তার এখানে বসতে চাইছে। সূহান মাথা নাড়ল। মানুষটার ধৈর্য নেই, সে বসেই উচৈঃস্বরে ওয়েট্রেসকে ডাকতে শুরু করে। ওয়েট্রেস এলে দুজনেই পানীয়ের অর্ডার দিল, একজন স্নায়ু শীতল অন্যজন স্নায়ু উত্তেজক পানীয়।

সুহান স্বায়ু শীতল করার পানীয়টা চুমুক দিয়ে চোখের কোনা দিয়ে মানুষটাকে লক্ষ করে। এই দুপুর বেলা সে যে পানীয়টা খাচ্ছে সেটা দুপুরে খাবার কথা নয়। মানুষটা সম্ভবত উত্তেজক পানীয়তে নেশাগ্রস্ত। সুহান একটু শঙ্কিত হয়ে বসে থাকে, একই টেবিলে বসার কারণে মানুষটা যদি হঠাৎ করে তার সাথে কথা বলতে রু করে সেটা একটা অহেতুক বিড়ম্বনা হবে। তার এখন কথা বলার ইচ্ছে করছে না, একটু আগে যে ব্যাপারটা ঘটেছে সেটা সে এখনো পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারে নি। নেশাগ্রস্ত মানুষটা অবিশ্যি কথা বলার উৎসাহ দেখাল না। গভীর মনোযোগ দিয়ে তার পানীয়তে চুমুক দিতে থাকল।

কিশলয় ক্যাফে থেকে বের হয়ে সুহান ডানদিকে হাঁটতে থাকে। প্রথমে একটা ফুলের দোকান, তার পাশে ক্রিস্টালের দোকান। রিয়ানা চাইছে একটু সময় নিতে, তাই সে ক্রিস্টালের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ক্রিস্টালগুলো দেখতে থাকে। খানিকটা অন্যমনস্ক ছিল বলে সে লক্ষ করল না, কিশলয় ক্যাফে থেকে উত্তেজক পানীয় নেশাসক্ত মধ্যবয়স্ক মানুষটাকে নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষটা ভয়ার্ত গলায় বলছে, কী করেছি আমি? কী করেছি? উত্তেজক পানীয় খাবার জন্য ঘটনাক্রমে সুহানের টেবিলটা বেছে নিয়ে সে যে নিজের ওপর কী ভয়ানক দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছে সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

সুহান ফুটপাত ধরে হেঁটে হেঁটে যায়। ডানদিকে হেঁটে সে পোশাকের দোকানটা পার হল। তার পাশে ভাস্কর্যের দোকান—তার পাশে ক্যাফে অর্কিড। ইতস্তত তরুণ-তরুণীরা বসে আছে, নিচু গলায় কথা বলছে, হাসছে। সুহান সেদিকে হেঁটে যায়, তাকে কোথায় বসতে হবে সে জানে, তার টেবিলটা খালি।

সুহান টেবিলটাতে বসার সময় শুনতে পেল রিয়ানা তার মস্তিষ্কের ভেতর বলছে, আমি তোমার কাছাকাছি আছি, কিন্তু তুমি কোনোভাবেই আমাকে চেনার ভান করবে না।

করব না রিয়ানা।

চমৎকার।

তোমার সাথে সাথে এখানে অসংখ্য নিরাপত্তাকর্মী চলে এসেছে।

সত্যি?

হ্যাঁ। তোমার ডান দিকে যে মোটা মানুষটা বসেছে সে একজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। পিছনে যে দুজন বসেছে তারাও। ভাস্কর্যের দোকানের সামনে যে মহিলা দুজন দাঁড়িয়েছে তারাও। এইমাত্র রাস্তার পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল, সেটাও নিশ্চয়ই নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি। কাজেই সাবধান।

সুহান একটা শব্দও উচ্চারণ না করে বলল, রিয়ানা আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা ঘটছে। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা সত্যি।

এটা সত্যি। আমি তোমার দুই টেবিল সামনে বসেছি। আমার সাথে আরো দুজন আছে। আমরাও একটা উত্তেজক পানীয় খেতে খেতে তর্ক করছি। পুরোটা একটা অভিনয়। আমরা এসেছি তোমার জন্য। তোমার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করার জন্য।

সুহান চেয়ারে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, সত্যি সত্যি তার টেবিল থেকে দুই টেবিল সামনে রিয়ানা বসে আছে, তার দুই পাশে দুজন সুদর্শন তরুণ।

সুহান তার মস্তিষ্কে ফিসফিস করে রিয়ানাকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা রিয়ানা আমি কেমন করে তোমার সাথে কথা বলছি? স্বপ্নে কেমন করে আমার তোমার সাথে পরিচয় হল?

বলব, তোমাকে আমি সব বলব। কিন্তু তার আগে তুমি একটু সহজ ভঙ্গিতে বস্। কিছু একটা খাবার অর্ডার দাও। খাবার খেতে খেতে একা একা মানুষ যা করে তাই কর, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কাগজে কিছু আঁকাআঁকি কর। আঁকাআঁকি করতে করতে সেখানে লিখবে ৩৭ নেপচুন এভিনিউ। তারপর এই কাগজটা এখানে ফেলে যাবে।

কেন রিয়ানা?

নিরাপত্তা বাহিনীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য। আমরা ৩৭ নেপচুন এভিনিউতে কিছু গোপন লিফলেট, বেআইনি কাগজ ফেলে রাখব। তারা সেগুলো উদ্ধার করবে। তোমাকে তখন আরো বেশি বিশ্বাস করবে।

সুহান চেয়ারে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে দূরে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না রিয়ানা। আমাকে কে বিশ্বাস করবে? কেন বিশ্বাস করবে?

বলছি। রিয়ানা নরম গলায় বলল, সবকিছু বলছি। তার আগে তোমার অন্য একটা প্রশ্নের উত্তর দিই। স্বপ্নে তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করতে চেয়েছিল মনে আছে? আমি বলেছিলাম প্রশ্নটা তুমি এখন করো না, পরে করো। মনে আছে?

সুহান অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! আমি স্বপ্নে কী প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম তুমি সেটা জান?

হ্যাঁ। জানি। কারণ সেই স্বপ্নটা আমি তৈরি করেছিলাম।

কেমন করে তৈরি করেছিলে?

তার আগে তুমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর জানতে চাও না?

হ্যাঁ জানতে চাই।

রিয়ানা নরম গলায় বলল, তুমি প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিলে আমি কি সাধারণ মানুষ নাকি ক্যাটাগরি-বি. তাই না?

হ্যাঁ।

তোমার সেই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য তোমাকে আমরা এখানে এনেছি। রিয়ান নিচু গলায় বলল, আমরা তোমার মতো ক্যাটাগরি-বি. মানুষ। আমরা তোমার মতোই সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছি।

সুহান বলল, আমিও তাই ভেবেছিলাম।

মানুষকে ক্যাটাগরি-বি. হিসেবে ভাগ করে দিয়ে তাদেরকে উপেক্ষা করার ব্যাপারটা আসলে একটা খুব বড় হীন ষড়যন্ত্র। ক্যাটাগরি-বি. মানুষ কোনোভাবেই দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ নয়। মানুষের মাঝে যে স্বাভাবিক বৈচিত্র্য আছে এটা তার ভেতরের একটা অংশ।

আমিও সেটা বিশ্বাস করি।

আমরা সবাই সেটা বিশ্বাস করি। রিয়ানা বলল, সেই বিশ্বাসের পেছনে যুক্তি আছে। বিজ্ঞানীদের একটা টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেটা গবেষণা করে একটা রিপোর্ট দিতে। তারা অত্যন্ত সুন্দর একটা রিপোর্ট দিয়েছিলেন।

সুহান জানতে চাইল, সেই রিপোর্টটা কোথায়?

তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে।

সুহানকে ঘিরে অনেক নিরাপত্তাকর্মী বসে আছে, নিশ্চয়ই তাকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছে, তাই অনেক কষ্ট করে সে তার মুখের বিশ্বয়টুকু গোপন করার চেষ্টা করল। ফিসফিস করে বলল, তোমরা সেই রিপোর্টটা উদ্ধার করার চেষ্টা করছ?

হ্যাঁ।

কিছুদিন আগে একজন মানুষকে তথ্যকেন্দ্রে খুন করা হয়েছিল, আমি তখন সেখানে ছিলাম, সে কি তোমাদের একজন?

হ্যাঁ, সে আমাদের একজন। সে আমাদের তোমার কথা বলেছে।

সুহান অনেক কষ্ট করে মুখের বিময়টুকু গোপন করে রেখে বলল, সে কেমন করে বলল? আমি নিজের চোখে দেখেছি তাকে রিগা গুলি করে মেরেছে—সে বের হতে পারে নি।

সে জানত সে কখনো বের হতে পারবে না। সে জানত তাকে গুলি করে মারা হবে। কিন্তু তবুও তোমার সাথে তার কী কথা হয়েছে আমরা সেটাও জানি।

কেমন করে জান?

আমি এখন তোমার সাথে যেভাবে কথা বলছি, ঠিক সেভাবে তার সাথেও কথা বলছিলাম। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কথা বলছিলাম।

সুহান অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। রিয়ানা বলল, আমরা তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। নিরাপত্তার অনেকগুলো স্তর পার হয়ে গেছি। আর একবার তথ্যকেন্দ্রের ভেতরে যেতে পারলে আমরা বিজ্ঞানীদের দেওয়া সত্যিকার রিপোর্টটা বের করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু ঠিক তখন হঠাৎ করে তুমি এসে হাজির হয়েছ। আমাদের সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গেছে।

কেন? সুহান অবাক হয়ে বলল, আমি কী করেছি?

আমাদের অসম্ভব বড় একটা সৌভাগ্য যে তুমি এরকম বুদ্ধিমান একটা ছেলে, জেনে জেনে এখন পর্যন্ত কোথাও তুমি একটা ছোট ভুলও কর নি। কিন্তু তোমার কারণে আমরা খুব বিপদের ভেতরে আছি। যে কোনো মুহূর্তে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।

আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছি না।

কুলছি তোমাকে। আমাদের হাতে কিন্তু খুব বেশি সময় নেই, আমরা ঝুঁকি নেব না–আমরা কিছুক্ষণের মাঝে উঠে যাব। তুমি আরো কিছু সময় বসে থেকে তারপর ফিরে যেও।

ঠিক আছে। সুহান বলল, এখন বলো আমি কীভাবে তোমাদের বিপদের মাঝে ফেলেছি।

রিয়ানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, পৃথিবীর ক্যাটাগরি-বি. মানুষরা যখন বুঝতে পারুল তাদের বিরুদ্ধে খুব একটা অন্যায় ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তখন তাদের একটা ছোট দল অত্যন্ত বিচিত্র উপায়ে সংঘবদ্ধ হয়েছে।

সেটা কী রকম?

আমরা প্রত্যেকেই আলাদা। প্রত্যেকটা মানুষের মস্তিষ্ক আলাদা, তাদের ভাবনা-চিন্তা আলাদা। মাঝে মাঝে অনেকে একসাথে বসে চিন্তা-ভাবনা করে পরামর্শ করে কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে করে। আমাদের ভেতরে একজন বড় বিজ্ঞানী আছেন তিনি ঠিক করলেন আমাদের অনেকের মস্তিষ্ক একসাথে জুড়ে দেবেন। তখন আমরা আর আলাদা আলাদা মানুষ থাকব না, আমরা সবাই মিলে একজন মানুষ হয়ে যাব। আমাদের সবার মস্তিষ্ক মিলে একটা মস্তিষ্ক হয়ে যাবে। তাতে কী লাভ হবে বুঝতে পেরেছ?

হ্যাঁ। কাউকে না জানিয়ে নিজেরা যোগাযোগ রাখতে পারব। অত্যন্ত নিরাপদ।

হ্যাঁ। সেটা একটা কারণ। যেমন এই মুহূর্তে কয়েক ডজন নিরাপত্তাকর্মীদের নাকের ডগায় বসে আমরা কথা বলছি। তারা কিছু করতে পারছে না। কিন্তু সেটা বড় কারণ নয়।

বড় কারণটা কী?

বড় কারণটা হচ্ছে অনেক মানুষের মস্তিষ্ক যখন একসাথে কাজ করে তখন সবাই মিলে একটা সমন্বিত মানুষ হয়ে যায়। এই সমন্বিত মানুষটা আসলে একটা অতিমানব। তার বুদ্ধির কাছে কেউ আসতে পারে না। তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিন নিরাপত্তা ভেদ করে সাধারণ কোনো মানুষের যাওয়া অসম্ভব একটা ব্যাপার, কিন্তু আমরা গিয়েছি। তুমি নিজের চোখে দেখেছ। ক্যাটাগরি-বি. মানুষের এই অসম্ভব ক্ষমতার সামনে ষড়যন্ত্রকারীরা অসহায় হয়ে পড়েছিল, কিন্তু তখন বিপদের শুরু হল। তোমাকে দিয়ে–

আমাকে দিয়ে?

হ্যাঁ। আমরা মানুষের মস্তিষ্ককে সমন্বিত করার জন্য ছোট একটা ইন্টেগ্রেটেড সার্কিট তৈরি করেছি। সেটা এমনভাবে কোড় করা আছে যে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ না হলে কাজ করবে না। মস্তিষ্কের ভেতর সেটা বসাতে হয়। সেটা বলানোর খুব দীর্ঘ পদ্ধতি আছে। আমরা মানুষটাকে পুরোপুরি আলাদা রেখে তার সাথে একজন একজন করে সমন্বয় করি। সেজন্য বিশেষ ড্রাগ রয়েছে সেগুলো ব্যবহার করি। মানুষটা নিজে প্রস্তুত থাকে বলে সেও সহযোগিতা করে। খুব ধীরে ধীরে একজন অভ্যস্ত হয়ে ওঠে আমাদের একজন হয়ে ওঠে।

সুহান ফিসফিস করে বলল, আমার মাথার ভেতরে সেরকম একটা ইন্টেগ্রেটেড সার্কিট বসিয়ে দিয়েছে?

হ্যাঁ তথ্যকেন্দ্র চার চার শূনা তিনে যাকে খুন করেছে তার মস্তিষ্কের ইন্টগ্রেটেড সার্কিটটা এখন তোমার মাথায়। এটা যে কী ভয়ঙ্কর একটা কাজ তুমি জান না।

আমি অনুমান করতে পারি।

না তুমি অনুমান করতে পারবে না। যে প্রক্রিয়াটাতে অভ্যস্ত করার জন্য আমরা কয়েক মাস সময় নিই তোমাকে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সেখানে ঠেলে দেওয়া হল। তোমার পাগল হয়ে যাবার কথা ছিল।

সুহান বলল, হ্যাঁ। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

তোমার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা এবং বিপদ হচ্ছে একটা ব্যাপার। আমাদের নিরাপত্তা হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাপার। হঠাৎ করে তাদের একজন মানুষ আমাদের সবচেয়ে গোপন

সার্কিটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না, অথচ তোমার মস্তিষ্ক আমাদের মস্তিষ্কের সাথে সমন্বিত, তুমি চিন্তা করতে পার?

হ্যাঁ। সেটা নিশ্চয়ই খুব বিপজ্জনক।

আমাদের এই সমন্বিত সত্তাটা হচ্ছে ক্যাটাগরি-বি. মানুষের একমাত্র আশা। আমরা। পুরো ব্যাপারটাকে নেতৃত্ব দিই, আমরা সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি এই সময় সবাই যদি ধরা পড়ে যেতাম কী ভয়াবহ ব্যাপার হত তুমি চিন্তা করতে পার?

সুহান কিছু না বলে চুপ করে রইল। রিয়ানা বলল, আমাদের খুব সৌভাগ্য আমরা ধরা পড়ি নি—তুমি আমাদের রক্ষা করে। তোমার প্রতি আমাদের সবার কৃতজ্ঞতা।

কৃতজ্ঞতা জানাবার কিছু নেই। আমি যা করছি সেটা নিজের জনা করেছি।

তুমি প্রথমে ছিলে আমাদের সবার সবচেয়ে বড় বিপদ। এখন তুমি হচ্ছ আমাদের সবচেয়ে বড় সুযোগ।

কীভাবে?

তুমি তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনের নিরাপত্তা প্রহরী। যেখানে ঢোকার জন্য আমাদের কয়েক মাস পরিকল্পনা করতে হয়, দু-একজনকে প্রাণ দিতে হয়, তুমি সেখানে যখন খুশি চুকতে পার এবং সবচেয়ে বড় কথা তুমি এখন আমাদের একজন। তুমি কি আমাদের সাহায্য করবে?

সেই বিষয়টি নিয়ে তোমার কি কোনো সন্দেহ আছে রিয়ানা?

না নেই। তবুও আনুষ্ঠানিকভাবে জানার একটা ব্যাপার আছে। এতক্ষণ যদিও শুধু আমি তোমার সাথে কথা বলছি কিন্তু আসলে সবাই আছে এখানে। আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকি, অনেক দূরে থাকি কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক একটা, আমাদের অস্তিত্ব একটা, ক্যাটাগরি বি, মানুষদের রক্ষা করার জন্য আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে সমন্বিত অস্তিত্বকে গ্রহণ করেছি। আজ থেকে তুমি আমাদের সমন্বিত অস্তিত্বের একজন। তোমাকে আমরা গভীর ভালবাসা দিয়ে গ্রহণ করছি সুহান।

তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।

এখন আর এখানে আমি এবং তুমি নেই। আমরা সবাই এক।

সুহান হঠাৎ প্রথমবার তৃতীয় একজন মানুষের কণ্ঠস্বর নিজের মস্তিষ্কে শুনতে পেল, সুহান, আমি ফিরু। তোমাকে আমাদের মাঝে সত্যিকার অর্থে সমন্বয় করার জন্য আমাদের আরো একটা জিনিস দরকার হবে।

সেটা কী থিরু?

তোমার জিনেটিক কোভিং। সেটা বের করার জন্য আমাদের দরকার তোমার মাথার একটা চুল কিংবা এক ফোটা রক্ত।

আমি সেটা কীভাবে দেব?

তুমি তোমার টেবিলে মাথার একটা চুল ফেলে যেও। সেটাই সহজ। আমরা তুলে নেব।

ঠিক আছে থিরু।

সুহান আবার রিয়ানার কথা শুনতে পেল, আমরা এখন যাচ্ছি সুহান।

ঠিক আছে।

আমরা নিশ্চয়ই একদিন পাশাপাশি বসব—একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকাব, মুখ দিয়ে কথা বলব, কান দিয়ে শুনব, একজন আরেকজনকে স্পর্শ করব।

নিশ্চয়ই করব রিয়ানা। নিশ্চয়ই করব।

 

০৭.

সুহান খুব ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করে নিরাপত্তা বাহিনীকে ধোকা দেওয়া শুরু করল। প্রথমে সে তার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে জানতে চাইল সে কয়েকজন মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছে তার কোনো গুরুত্ব আছে কি না। ডাক্তার জানতে চাইল কথাগুলো কী। সুহান বলল কথাগুলো ব্যক্তিগত কথা অর্থ নেই, মনে হয় কয়েকজনের কথোপকথন। তবে কয়েকবার নেপচুন এভিনিউ কথাটা শুনতে পেয়েছে। ডাক্তার জানতে চাইল কত নম্বর নেপচুন এভিনিউ। সুহান যদিও খুব ভালো করে জানে তার বলার কথা ৩৭ নেপচুন এভিনিউ তারপরও সে ইতস্তত করে বলল তার ভালো করে মনে নেই সেটা ২৭ কিংবা ৩৭ কিংবা অন্য যে কোনো সংখ্যা হতে পারে।

এই তথ্যটা পৌঁছে দেওয়ার পরদিন থেকে সুহানের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল। নিরাপত্তা বাহিনীর বড় বড় কর্মকর্তারা তার সাথে দেখা করতে এলে তাকে একটা শক্তিশালী ভিডিফোন দিয়ে বলে গেল যে কোনো প্রয়োজনে সে এটা ব্যবহার করতে পারবে। হঠাৎ কবে সে যদি তার মস্তিষ্কের ভেতর কোনো কথা শুনতে পায় এবং সেটা ডাক্তারকে জানাতে হয় সে যেন এটা ব্যবহার করতে কোনো দ্বিধাবোধ না করে।

শক্তিশালী ভিডিফোনটা হাতে নিয়ে তার অনাথাশ্রমের রুরাকের কথা মনে পড়ল। তার খুব ভিডিফোনের শখ ছিল—যদি তাদের কারো কাছে ব্যক্তিগত ভিডিফোন থাকত তা হলে সে এখন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারত। এখন করতে হলে সেটা করতে হবে। অফিসের মাধ্যমে তার যন্ত্রণা অনেক। হঠাৎ করে সে তার অনাথাশ্রমের বন্ধুদের অভাব অনুভব করতে থাকে। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্রই সে তাদের সাথে দেখা করতে যাবে।

সুহান দুদিন পর আবার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করল। ঘণ্টা দুয়েক আগে রিয়ানা মস্তিষ্কের ভেতরে খবর দিয়ে গেছে ডাক্তারকে কী বলাতে হবে। অতলান্ত স্ট্রিটে একটা সুপার মার্কেটে সি ফুডের দোকানের সামনে রিহা আর কিলি নামে দুজন থাকবে। সুহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, দুজন মানুষকে ধরিয়ে দেব?

হ্যাঁ। রিয়ানা বলেছিল, আমরা যেভাবে সম্ভব তোমাকে সন্দেহের বাইরে রাখতে চাই। দরকার হলে আমাদের একজন মানুষকে ধরিয়ে দিয়েও।

সুহান জিজ্ঞেস করল, যাদেরকে ধরিয়ে দিচ্ছি তারা জানে?

হ্যাঁ তারা স্বেচ্ছায় ধরা দিতে রাজি হয়েছে।

তাদের কী করবে?

রিয়ানা বলেছিল, আমরা জানি না। যদি ভাগ্য ভালো থাকে বেঁচে থাকবে।

সুহান আর কথা বাড়ায় নি, সে বিশাল একটা পরিকল্পনার অংশ। তাকে যেটা করতে হবে সে সেটা করবে, এ ছাড়া উপায় কী?!!

ভিডিফোনে যোগাযোগ করতেই ডাক্তার উদগ্রীব গলায় বলল, কী হয়েছে সুহান?

আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারছি না। আমি কি একটু ঘুমের ওষুধ খেতে পারি?

তার আগে শুনি কেন ঘুমাতে পারছ না। কী হয়েছে?

একজন মানুষ ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।

কী নিয়ে কথা বলছে?

দুজন মানুষের সাথে দেখা করা নিয়ে মানুষটা খুব দুশ্চিন্তা করছে।

মানুষটা কে?

সুহান অধৈর্য গলায় বলল, আমি কেমন করে বলব? আমার মস্তিষ্কে কি আর বাইরের মানুষ কথা বলতে পারে? নিশ্চয়ই আমার অবচেতন মন আমার সাথে কথা বলছে।

ডাক্তার তাড়াতাড়ি বলল, তা ঠিক। তা ঠিক। নিশ্চয়ই তোমার অবচেতন মন।

আমাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিন। খেয়ে অবচেতন এবং চেতন মন দুটোকেই কাবু করে ঘুমিয়ে থাকি।

দেব। নিশ্চয়ই দেব। ডাক্তার বলল, তার আগে শুনি তোমার অবচেতন মন কার সাথে দেখা করা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে।

দুজন মানুষ। একজনের নাম রিহা আরেকজন কিলি।

তুমি কি বিহা আর কিলি সম্পর্কে আর কিছু জান?

হ্যাঁ। অনেক কিছু জানি—কিন্তু তার কি কোনো গুরুত্ব আছে? পুরোটা নিশ্চয়ই আমার কল্পনা।

ডাক্তার গম্ভীর গলায় বলল, কিন্তু তবু ডাক্তার হিসেবে আমার শুনে রাখা উচিত।

সুহান গলার স্বরে এক ধরনের বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, রিহা আর কিলি নাকি অতলান্ত স্ট্রিটে একটা সুপার মার্কেটে সি ফুডের দোকানে যাচ্ছে।

ও আচ্ছা।

আমি এখন কী করব ডাক্তার।

তুমি বিশ্রাম নাও। তোমার জন্য আমি যে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি তার দুটি খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।

সুহান দুটি ঘুমের ওষুধ টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমানোর জন্য তার কখনোই ঘুমের ওষুধের দরকার হয় না।

 

সুহান খুব ধীরে ধীরে তার মাথার ইন্টেগ্রেটেড সার্কিট অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। যে মানুষগুলোর সাথে তাকে সমন্বয় করেছে সে একজন একজন করে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে শিখেছে। একসাথে তাদের সবার সাথে কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে পারে, জটিল কোনো সমস্যার সমাধান বের করতে পারে। তার জন্য সবচেয়ে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হচ্ছে নোর চোখ দিয়ে দেখা। ঠিক কী কারণ জানা নেই, সবার সাথে সে সমান দক্ষতা দিয়ে কাজ করতে পারে না। খিরু নামের তরুটার সাথে তার সবচেয়ে ভালো সমন্বয় হল খুব মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করলে সে থিরুর চোখে দেখতে পায়। প্রথমবার যখন দেখতে পেল তখন থিরু একটা মনিটরের সামনে বসে কাজ করছে। সুহান এক মুহূর্তের জন্য আবছাভাবে মনিটরটা দেখতে পেল এবং হঠাৎ করে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সুহান ফিসফিস করে বলল, আমি দেখতে পাচ্ছি থিরু।।

থি বলল, চমৎকার। তুমি আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য—-তোমাকে অন্যের চোখে দেখা শিখতে হবে। জুনোর মস্তিষ্কে ভাবতে হবে।

আমি চেষ্টা করব।

যখন তুমি পুরোপুরি অন্য মানুষ হয়ে যেতে পারবে তখন বুঝতে পারবে যে তুমি সমন্বিত মানুষ হতে পেরেছ। সেজনা তোমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে।

সুহান তাই চেষ্টা করে যেতে থাকে। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকরা তাকে এখন অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। রিহা আর কিলিকে ধরিয়ে দেবার পর তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। সে কবে ভার কাজে ফিরে যেতে পারবে জানতে চেয়েছে, নিরাপত্তা দৃপ্তর থেকে জানিয়েছে খুব শিগগিরই।

সুহান সেজন্য অপেক্ষা করে আছে। তাকে যেদিন কাজে যেতে দেবে সেদিনই তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে শেষবার হানা দেবার কথা। সুহান তার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সম্ভবত তাকেই হানা দিতে হবে—তথ্যকেন্দ্রটা তার চাইতে ভালো করে আর কেউ জানে না। অন্য সবার সাথে সমন্বিত হয়ে থাকবে সে, তাকে কী করতে হবে সবাই বলে দেবে। তথ্যকেন্দ্রের শেষ কোডটা ভেঙে তাকে বিজ্ঞানীদের সেই রিপোর্ট নেটওয়ার্কে দিয়ে দিতে হবে। মুহূর্তের মাঝে পৃথিবীর সবাই জেনে যাবে ক্যাটাগরি-বি. নামের ধারণাটা আসলে একটা বিশাল প্রতারণা, একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র।

 

সুহান ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। তাকে পুরোপুরি সুস্থ হবার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী অপেক্ষা করছে। ক্যাটাগরি-বি. মানুষের সমন্বিত দলটাও অপেক্ষা করছে সেজন্য।

এর মাঝে একদিন সুহান তার জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজটা করল। সে অবিশ্যি একা একা করল না, তাকে সবাই মিলে সাহায্য করল। সে ভোরবেলা ঘর থেকে বের হচ্ছে ঠিক তখন সে তার মস্তিষ্কে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, সুহান।

কে? রিয়ানা?

হ্যাঁ।

আজকে তুমি আমাদের কাছে আসবে? তোমার সাথে আমাদের সবার দেখা হবে।

সুহান অবাক হয়ে বলল, আজকে?

হ্যাঁ।

কিন্তু সেটি কীভাবে সম্ভব? নিরাপত্তাকর্মীরা আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।

রিয়ানা শব্দ করে হাসল। বলল, সেটা তুমি আমাদের হাতে ছেড়ে দাও। ঠিক আছে?

সুহান একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আমি যে একেবারেই প্রস্তুত নই। যদি একদুই দিন আগে বলতে–

আমরা ইচ্ছে করে তোমাকে এক-দুই দিন আগে বলি নি। আমরা অনেক দিন থেকে প্রস্তুতি নিয়েছি, তোমার প্রস্তুতি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। একটু পরেই তুমি দেখবে।

সুহান বলল, ঠিক আছে।

চমৎকার।

আমি তা হলে কী করব?

প্রত্যেকদিন যা কর ঠিক তাই করবে। ঘর থেকে বের হয়ে লিফটে উঠবে। লিফটে তোমার সাথে একজনের দেখা হবে—চমকে উঠো না তাকে দেখে—ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

এখন ঘর থেকে বের হও সুহান।

সুহান ঘর থেকে বের হল। লম্বা করিডোর ধরে হেঁটে সে লিফটের সামনে গিয়ে দাড়ায়। লিফটের বোতাম স্পর্শ করে সে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে। লিফটটি প্রায় নিঃশব্দে এসে দাড়াল, দরজা খুলতেই সে ভেতরে এসে ঢুকল, একজন মানুষ তাকে পেছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লিফটটি চলতে শুরু করতেই মানুষটি ঘুরে তার দিকে তাকাল। সুহান ভয়ানক চমকে ওঠে, মানুষটি হুঁবহুঁ তার মতো। মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাদের হাতে সময় নেই। এই লিফটা নিচে পৌঁছানোর আগে আমি যেরকম করে সুহান হয়েছি, তোমাকে সেরকমভাবে থিরু হয়ে যেতে হবে!

সুহান ইতস্তত করে বলল, কিন্তু–কিন্তু–

মানুষটি একটি রবারের মাস্ক হাতে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দেয়, এটা মুখে লাগিয়ে নাও! ঠিক তোমার মুখের মাপে তৈরি করা হয়েছে।

আমি আগে কখনো মাস্ক পরি নি–

সুহানের মতো মানুষটি নরম গলায় বলল, আমরা কেউই আগে অনেক কিছু করি নি। এখন করি। করতে হয়।

সুহান মাস্কটি মুখে লাগিয়ে নেয়, চটচটে এক ধরনের আঠালো জিনিস তার মুখের সাথে লেগে যায়। সুহানের মনে হতে থাকে তার নিশ্বাস বুঝি বন্ধ হয়ে আসবে। মানুষটি বলল, তুমি নার্ভাস হয়ো না, এক্ষুনি অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

কথাটি সত্যি, কিছুক্ষণেই সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। মানুষটি নরম গলায় বলল, এখন তোমার জ্যাকেটের সাথে আমার জ্যাকেট পাল্টে নিতে হবে। তোমার জ্যাকেটের পকেটে তোমার কার্ডটা আছে তো?

আছে।

চমৎকার।

মানুষটি জ্যাকেট পাল্টে নিতে নিতে বলল, তোমার যা যা দরকার সব তোমার পকেটে পাবে।

সুহানের হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। উদ্বিগ্ন মুখে বলল, সকাল সাড়ে দশটার সময় মেডিক্যাল কিটে আমার রক্ত পরীক্ষা করা হয়–

মানুষটি তাকে বাধা দিয়ে বলল, জানি। এজন্য তোমার একটু রক্ত নেব।

সুহান দেখল লোকটা তার পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করেছে। কিছু বোঝার আগেই সুহান তার কনুইয়ের কাছে একটা খোঁচা অনুভব করল। মানুষটি হাসি হাসি মুখে বলল, আমরা নিচে নেমে গেছি। আমি আগে বের হব। তুমি একটু পরে।

আমি এখন কী করব?।

সেটা নিয়ে চিন্তা করো না। রিয়ানা তোমাকে বলে দেবে। শুধু একটা জিনিস মনে রেখো।

কী?

তুমি এখন সুহান নও। তুমি এখন থিরু।

নিঃশব্দে লিফটের দরজা খুলে গেল। কয়েকজন মানুষ পঁড়িয়ে আছে, তাদের মাঝে কেউ নিশ্চয়ই নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষ। সুহান লিফট থেকে বের হয়ে এল। তার বুকের ভেতর সুপও ধকধক করতে থাকে। সুহানের মতো মানুষটি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে ঠিক যেভাবে সুহান হেঁটে যায়। সুহান চোখের কোন দিয়ে লক্ষ করল মানুষটি কফি হাউসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যে কফি হাউসে সুহান যায়। খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ তাকে অনুসরণ করছে।

সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে দুই পা অগ্রসর হতেই সে তার মস্তিষ্কে একটা পরিষ্কার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, সুহান।

বলা রিয়ানা।

আমরা একটা হলুদ রঙের ট্যাক্সিতে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

কোথায়?

ডান দিকে কয়েকশ মিটার সামনে। তুমি এস।

ঠিক আছে।

সুহান রাস্তায় নেমে ডান দিকে হাঁটতে থাকে। মানুষজন যাচ্ছে–আসছে। রাস্তায় বাল, ট্রাম, গাড়ি এবং ট্যাক্সি। সুহান ফুটপাত ধরে এগিয়ে যায়, সামনে রাস্তার পাশে একটা হলুদ রঙের ট্যাক্সি অপেক্ষা করছে, সে কাছে আসতেই তার দরজা খুলে গেল। সুহান রিয়ানার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ভেতরে ঢুকে যাও, সুহান।

সুহান ভেতরে ঢুকে গেল। পেছনের সিটে রিয়ানা বসে আছে, তার দিকে তাকিয়ে সে মুখ টিপে হাসল, বলল, কেমন আছ সুহান?

ভালো।

ট্যাক্সিটা গর্জন করে ছুটে যেতে শুরু করতেই রিয়ানা বলল, এর ভেতর আমরা নিরাপদ কিন্তু তবু আমরা কোনো ঝুঁকি নেব না।

তার অর্থ আমরা মুখে কথা বলব না?

ঠিক ধরেছ। আগে আমরা নিজেদের আস্তানায় চলে যাই। রিয়ানা ট্যাক্সির ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, জেরিকো, তুমি আমাদের পিয়ারে নিয়ে যাও।

ড্রাইভার রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি?

হ্যাঁ।

রিয়ানা, সেখানে কিন্তু গার্ড বসিয়েছে।

সেজন্যই যেতে চাইছি। জায়গাটা আজ নিরাপদ হবে।

ড্রাইভার ট্যাক্সিটা ঘুরিয়ে সমুদ্রোপকূলের দিকে নিতে থাকে। রিয়ানা সুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার পকেটে কিছু রক্তের প্যাচ পাবে। আঙুলের মাঝে লাগিয়ে নাও। গার্ড যদি জিনেটিক কোডিং করার জন্য তোমার রক্ত নিতে চায় তা হলে থিরুর রক্ত পাবে।

সুহান তার পকেটে স্টিকারের মতো ছোট ছোট প্যাচগুলো খুঁজে পেল। তার আঙুলের ডগায় সেগুলো লাগিয়ে নেয়—দেখে বোঝার উপায় নেই কিন্তু রক্ত পরীক্ষা করার জন্য রক্ত নেওয়া হলে সুহানের রক্তের বদলে থিরুর রক্ত পাবে। সুহান একটু অবাক হয়ে বলল, তোমরা খুঁটিনাটি সবকিছু ভেবে রেখেছ?

হ্যাঁ। যে মানুষটি আজকে সুহান হয়ে তোমার বাসায় থাকবে তাকে দেখে বুঝতে পার নি?

পেরেছি। গলার স্বরটা পর্যন্ত আমার মতো।

হ্যাঁ। রিয়ানা বলল, শুধু রেটিনাটা তোমার মতো করতে পারি নি। তোমাকে তো আগে পাই নি–এই প্রথমবার পেয়েছি। এখন তোমার সব ধরনের প্রোফাইল নিয়ে নেব।

ট্যাক্সির ড্রাইভার নিচু গলায় বলল, সামনে গার্ড, রিয়ানা।

ঘাবড়ানোর কিছু নেই জেরিকো।

রিয়ানা সুহানের দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গি করে একটু হাসল।

স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কঠোর চেহারার একজন ট্যাক্সিটি দাঁড়াতেই রিয়ানা জানালার কাচ নামিয়ে দিয়ে মাথা বের করল। কঠোর চেহারার গার্ডটা ভাবলেশহীন মুখে বলল, কার্ড।

রিয়ানা এবং রিয়ানার দেখাদেখি সুহান তার কার্ডটি বের করে দেয়। কার্ডটি স্ক্যান করে গার্ডটি তীক্ষ্ণ চোখে তাদের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

পিয়ারে।

কেন?

আমরা সেখানে কাজ করি।

গার্ড রক্ত পরীক্ষা করার ছোট যন্ত্রটা তাদের দিকে এগিয়ে দেয়, রিয়ানা ভেতরে আঙুল প্রবেশ করে গার্ডের সাথে অনেকটা খোশগল্প করার ভঙ্গি করে বলল, আজ অনেক কড়াকড়ি, কিছু হয়েছে নাকি?

গার্ড তার নাক দিয়ে একটা শব্দ করে বলল, সব সময় কিছু না কিছু হচ্ছে।

সুহানের বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটি ধকধক করে শব্দ করছে। গার্ড তার দিকে যন্ত্রটা এগিয়ে দিয়েছে, যদি ঠিক ঠিক রক্ত না নিতে পারে সে এক্ষুনি ধরা পড়ে যাবে। সুহান ফ্যাকাসে মুখে গার্ডের দিকে তাকাল। ঠিক তখন শুনল তার মস্তিষ্কে রিয়ানা কথা বলছে, কোনো ভয় নেই সুহান, তোমার আঙুলটা ঢোকাও।

সুহান কাঁপা হাতে আঙুলটি যন্ত্রের ভেতর প্রবেশ করাল, সূক্ষ্ম একটা খোঁচা অনুভব করল সাথে সাথে। গার্ড ভুরু কুঁচকে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে, ঘুরে একবার সুহানের দিকে তাকাল, তারপর হাত নেড়ে তাদের চলে যেতে বলল। ট্যাক্সিটি চলতে শুরু করা মাত্র সুহান তার বুকের ভেতর আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দেয়। রিয়ানা তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, খুব ভয় পেয়েছিলে। তাই না?

সুহান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

তোমার কোনো ভয় নেই সুহান। তুমি হচ্ছ আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সদস্য আমরা কিছুতেই তোমাকে ধরা পড়তে দেব না।

যদি কিছু একটা গোলমাল হয়ে যেত গার্ডের ওখানে?

সেজন্য আমাদের প্ল্যান বি. রেডি আছে।

সেটি কী?

আমরা রক্তপাত পছন্দ করি না তাই প্ল্যান বি. রক্তপাতহীন পরিকল্পনা। সেটাও যদি গোলমাল হয়ে যায় তখন প্ল্যান সি কাজে লাগাতে হয়। সেখানে খানিকটা রক্তপাত আছে।

সুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকে।

 

ট্যাক্সিটা খামার পর দরজা খুলে রিয়ানা এবং রিয়ানার পিছু পিছু সুহান বের হয়ে আসে। একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দুজন উপরে উঠে যায়। একটা দীর্ঘ করিডোর ধরে দুজন হেঁটে বড় একটা হলঘরে এসে পৌঁছাল। হলঘরের একপাশে খোলা জানালা। সেদিকে আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র এবং সমুদ্রের নোনা বাতাস ঘরের ভেতরে লুটোপুটি খাচ্ছে। হলঘরের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেশ কিছু মানুষ বসে আছে। সুহান এবং রিয়ানাকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়াল।

রিয়ানা অনেকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, আমার প্রিয় কমরেডস—তোমাদের সবার সামনে উপস্থিত করেছি আমাদের সবচেয়ে নতুন সদস্য সুহানকে!

মধ্যবয়স্কা একজন মহিলা রহস্য করে বলল, আগে মাস্ক খুলুক তারপর বিশ্বাস করব। তোমাদের আমি বিশ্বাস করি না!

রিয়ানা হাসতে হাসতে সুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, মাস্কটা খোলো সুহান।

আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে না?

ফিরে যাবার সময় তোমাকে আবার আমরা থিরু বানিয়ে দেব। তোমার সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

সুহান তার ঘাড়ের কাছে খিমচে ধরে মাস্কটা টেনে খোলার চেষ্টা করতে থাকে। কমবয়সী একজন তরুণ এসে তাকে সাহায্য করল, পাতলা মাস্কটি খুলে এল সহজেই।

উপস্থিত সবাই একটা আনন্দের শব্দ করল। সুহান কী করবে বুঝতে না পেরে সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল।

একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এসে সুহানের হাত স্পর্শ করে বলল, এস সুহান, এতদিন আমরা তোমার কথা শুনেছি, আজ চোখে দেখতে পেলাম। বয়স্ক মানুষটি সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে বলল, আমার নাম পিরান। ডক্টর পিরান।

রিয়ানা বলল, ঢক্টর পিরান আমাদের মূল মস্তিষ্ক। আমাদের মস্তিষ্ক সমন্বয়ের পুরো ব্যাপারটি ডক্টর পিরানের পরিকল্পনা।

ডক্টর পিরান বলল, বুঝলে সুহান, এখন সবাই মস্তিষ্ক সমন্বয়ের কথায় একেবারে আবেগে আপ্লুত। প্রথম যখন বলেছিলাম তখন কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না।

কমবয়সী তরুণটি বলল, বিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল? আমার মাথা ফুটো করে সেখানে একটা ইন্টেগ্রেটেড সার্কিট বসানো হবে সেটা মেনে নেওয়া কি এত সোজা?।

রিয়ানা বলল, ঠিক আছে কুরু। তোমাদের ঝগড়াঝাটি-হইচই পরে হবে। সুহান প্রতিদিন সকালে বের হয়ে কফি হাউসে গিয়ে এক মগ কফি খায়। আজ তার জায়গায় কফি খেয়েছে থিরু। সুহানের এখনো কফি খাওয়া হয় নি—তাকে এক কাপ কফি খাওয়ানো যাক।

মধ্যবয়স্কা মহিলাটি বলল, শুধু কফি নয়, কফির সাথে খাওয়ার জন্য চমৎকার কিছু প্যাষ্ট্রি আনিয়ে রেখেছি। এস সবাই।

পেষ্ট্রি এবং কফি খেতে খেতে সবার সাথে হালকা কথাবার্তা হল। সুহানের সবার সাথে পরিচয় হল মস্তিষ্কের সমন্বয় হয়ে আছে বলে তাদের সবার চিন্তাভাবনার সাথে সে জড়িয়ে আছে, এই প্রথমবার তাদেরকে সে দেখছে। খাওয়া শেষ হবার সাথে সাথেই সবাই কাজে লেগে যায়। সুহানের শরীরের মাপ নেওয়া হয়, চোখের আইরিস, রেটিনার ছবি নেওয়া হয়। মস্তিষ্কের স্ক্যান করা হয়, শরীরের ভেতরকার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ত্রিমাত্রিক ছবি নেওয়া হয়। মস্তিস্কের ভেতরে বসানো ইন্টেগ্রেটেড সার্কিটের ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। গলার স্বরে নিখুঁত প্রোফাইল বের করা হয়। সবকিছু যখন শেষ করা হয়েছে তখন অপরাহ্ন হয়ে এসেছে।

রিয়ানা বলল, সুহান, তোমার ফিরে যাবার সময় প্রায় হয়ে এসেছে।

সুহান খোলা জানালা দিয়ে বাইরে আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত।

রিয়ানা সুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি ফিরে যাবার আগে সমুদ্রের বালুবেলায় একটু হাঁটতে চাও?

সুহান উজ্জ্বল চোখে বলল, সময় হবে আমাদের?

অবশ্যই হবে। এস।

সুহান সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিয়ানার সাথে সাথে একটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সমুদ্রের বালুবেলায় নেমে এল। দুজনে হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, সমুদ্রের ঢেউ এসে ছিঁড়ে পড়ছে, সুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু পর বিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আগে কখনো সমুদ্র দেখি নি।

রিয়ানা নরম গলায় বলল, জীবনে প্রথমবার সমুদ্র দেখা অত্যন্ত বড় একটা অভিজ্ঞতা।

আমি একটা অনাথাশ্রমে বড় হয়েছি। তথ্যকেন্দ্রের এই চাকরিটা না পেলে হয়তো অনাথাশ্রমের দেয়ালে কিংবা কোনো একটা ইউরেনিয়াম খনি ছাড়া আর কিছু দেখতামই না।

রিয়ান কোনো কথা না বলে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান নিচু গলায় বলল, অনাথাশ্রমে আমার যেসব বন্ধুবান্ধব আছে তারা কেউ কোনো দিন সেখান থেকে বের হয় নি। পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্য দেখে নি। পৃথিবী যে কত সুন্দর তারা জানে না। কারণ তারা ক্যাটাগরি-বি. মানুষ।

রিয়ানা সুহানের কাধ স্পর্শ করে বলল, আমরা তার পরিবর্তন করব সুহান।

সুহান ঘুরে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বলল, কিন্তু কেন পরিবর্তন করে সেটা ঠিক করতে হবে? কেন সেটাই হল না? সুহান হাত দিয়ে সমুদ্রটাকে দেখিয়ে বলল, দেখ এই সমুদ্রষ্টাকে দেখ—কী বিশাল! এই পৃথিবীটা দেখ—কী বিশাল! আর তার মাঝে আমাদের মতো মানুষের কোনো জায়গা নেই—এটা কি হতে পারে?

রিয়ানা একটা নিশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। বলল, না, সুহান এটা হতে পারে না। এটা হবে না।

কিন্তু সেটাই তো হচ্ছে। আইন করে ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে—

 

কিন্তু আমরা কি সেটা হতে দেব? তথ্যকেন্দ্র থেকে আমরা যখন বিজ্ঞানীদের সেই রিপোর্ট বের করে পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রকাশ করে দেব তখন এক মুহূর্তে পুরো অবস্থাটা পাল্টে যাবে।

সুহান রিয়ানার দিকে তাকাল, আমরা কি পারব রিয়ানা?

রিয়ানা একটু হাসার চেষ্টা করল। বলল, সব এখন তোমার ওপর নির্ভর করছে সুহান।

কিন্তু–কিন্তু—

কিন্তু কী?

আমি যে তথ্যকেন্দ্র, সার্ভার, নেটওয়ার্ক এসব কিছুই জানি না। আমি কি পারব প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে?

পারবে। কারণ আমরা সবাই তোমার মস্তিষ্কের সাথে সমন্বিত হয়ে থাকব। আমরা সবাই তোমাকে সাহায্য করব।

সুহান বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দেয়। পারবে সে নিশ্চয়ই পারবে। সে যদি না পারে তা হলে ক্যাটাগরি-বি. মানুষেরা কখনোই মানুষের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না।

রিয়ানা সুহানের হাত স্পর্শ করে বলল, চলো সুহান আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

চলো।

তোমার মাস্কটা পরে নিয়ে তোমাকে আবার থিরু হয়ে যেতে হবে।

সুহান মাথা নাড়ল। বলল, । চলো আবার থিরু হয়ে যাই।

দুজনে বালুবেলা ধরে হাঁটতে থাকে। সমুদ্রের ঢেউ একটু পরপর আছড়ে পড়ছে কিন্তু সুহান সেটি আর গুনছে না, সে হঠাৎ কেমন জানি আনমনা হয়ে ওঠে।

 

০৮.

শেষ পর্যন্ত ডাক্তার সুহানকে তার কাজে ফিরে যাবার অনুমতি দিল। তার শরীরের রক্ত, ত্বক, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, মস্তিষ্ক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বলল, তুমি এখন পুরোপুরি সুস্থ সুহান। তুমি এখন তোমার কাজে ফিরে যেতে পার।

কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে সুহানের বুকের ভেতর রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। সে বলল, আমি কাজে ফিরে যেতে পারব?

হ্যাঁ।

কখন যেতে পারব ডাক্তার?

ইচ্ছে করলে কালকেইআমি তোমার সুস্থ দেহের সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছি।

অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার।

তোমার মস্তিষ্কের কাগুলোর খবর কী?

এখনো হয়। তবে আমি সেগুলো নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখে গেছি! মাথার ভেতরে কথা হলে আমি সেগুলো শুনেও শুনি না!

ও আচ্ছা। ও আচ্ছা। ডাক্তার একটু ইতস্তত করে বলল, তবুও তুমি যদি কখনো মনে কর আমাদের জানানো দরকার তা হলে আমাদের জানিও।

অবশ্যই জানাব। সুহান সরল মুখ করে হেসে বলল, তুমি এত বড় ডাক্তার, আমার জীবন বাঁচিয়েছ, তোমাকে যদি না জানাই তা হলে কাকে জানাব?

সুহানের কথায় কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে ডাক্তার মানুষটা খুব সঙ্কুচিত হয়ে গেল।

 

সুহান বাসায় এসে দীর্ঘ সময় চুপচাপ জানালার কাছে বসে থাকে। সে আগামীকাল কাজে ফিরে যাবে, আগামীকাল হবে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। সে কি পারবে তার ওপর দেওয়া এত বড় দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে? সে কি সেখান থেকে বেঁচে আসতে পারবে? তার চোখের সামনে বারবার একটি দৃশ্য ভেসে আসে, একজন মানুষ শান্তি মুখে কী-বোর্ডের সামনে বসে কাজ করছে, আর রিগা একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে তাকে গুলি করছে—একবার দুইবার অনেকবার। সুহান নিজের অজান্তেই শিউরে ওঠে, জোর করে সে চিন্তাটা মাথা থেকে দূর করে দেয়।

সুহান উঠে দাঁড়াল, ঘরের ভেতরে কয়েকবার পায়চারি করে সে তার ভিডিফোনটা তুলে নেয়, তার হঠাৎ কোনো একজন আপনজনের সাথে কথা বলার ইচ্ছে করছে। সে ভিডিফোনে ডায়াল করল, তার অনাথাশ্রমের ডিরেক্টর লারার সাথে সে কথা বলবে। ডায়াল করতেই স্ক্রিনে লারার ছবি ভেসে ওঠে, সুহানকে দেখে তার মুখ আনন্দোজ্জ্বল হয়ে ওঠে, প্রায় চিৎকার করে বলে, সুহান! তুমি?

হ্যাঁ লারা, আমি।

এতদিন পরে তোমাকে দেখে কী ভালো লাগছে আমার!

সুহান বলল, আমারও খুব ভালো লাগছে।

তুমি নিশ্চয়ই খুব ভালো করছ সুহান। লারা আনন্দিত গলায় বলল, তোমার নিজের ভিডিফোন হয়েছে।

সুহান ম্লান মুখে বলল, সেটা এমন কিছু নয়। তোমাদের কথা বলো লারা। সবাই কেমন আছ?

সবাই—সবাই–লারা একটু ইতস্তত করে বলল, আছে একরকম।

রুরা কেমন আছে সারা?

ভালোই আছে। একটু চুপচাপ হয়ে গেছে আজকাল।

দিনিয়া? দ্রুমা?

দিনিয়া আগের মতোই আছে। কিন্তু দ্রুমা–

সুহান উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে দ্রুমার?

কিছুদিন আগে তার আবার অ্যাটাক হল, মস্তিষ্কের একটা ধমনি ফেটে গিয়েছিল। দু দিন কোমায় ছিল।

সুহান নিচু গলায় বলল, ও।

তুমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না সুহান। নিজের কাজ করে যাও।

করব। সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, লারা।

বলো।

তুমি রুরাক দিনিয়া কিশি সবাইকে আমার ভালবাসা জানিয়ে দিও।

দেব। নিশ্চয়ই দেব।

তোমার জন্যও অনেক ভালবাসা লারা।

লারা সুন্দর করে হাসল, বলল, তোমার জন্যও সুহান।

ভিডিফোনটা রেখে দিয়ে সুহান আবার নিজের ভেতরে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করে। নিঃসঙ্গতাকে জোর করে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে যখন তার জানালার সামনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল তখন সে তার মস্তিষ্কের ভেতর রিয়ানার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, সুহান।

বলো রিয়ান।

কালকে আমাদের সেই দিন।

হ্যাঁ।

তোমার ভয় করছে সুহান?

সুহান একটু হাসল, বলল, আমাদের মস্তিষ্ক সমন্বিত, তুমি তো জান রিয়ানা আমার কেমন লাগছে।

হ্যাঁ, জানি। পুরোটুকু জানি না, অনেকখানি জানি ভয়ের কিছু নেই সুহান। আমরা সবাই তোমার সাথে একসাথে আছি।

সুহান কোনো কথা বলল না। রিয়ানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কাল তোমার সবচেয়ে গভীরভাবে সমন্বয় করতে হবে থিরুর সাথে। থিরু আমাদের সার্ভার, নেটওয়ার্ক, ডাটাবেস আর সিকিউরিটি এক্সপার্ট।

আমি চেষ্টা করব।

আমার মনে হয় এখন থির সাথে তুমি একটা সেশন কর।

ঠিক আছে। সুহান ডাকল, থিরু। থিরু তুমি কোথায়?

এই যে, আমি এখানে। থিরু তার স্বাভাবিক শান্ত গলায় বলল, আমি তোমার চোখ দিয়ে দেখতে চাই সুহান।

আমি চেষ্টা করছি।

সুহান তার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে, কয়েক মুহূর্তের মাঝে থিরুর সাথে সে পুরোপুরি সমন্বিত হয়ে যায়। সুহান দেখতে পায় সে একটি মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনিটরে নানা ধরনের সংখ্যা খেলা করছে। তার সামনে কী-বোর্ড, কী-বোর্ডে তার আঙুলগুলো যন্ত্রের মতো ছোটাছুটি করছে। সে থিরুর মতো দেখছে, থিরুর মতো শুনছে, থিরু মতো নিশ্বাস নিচ্ছে। নিজের অজান্তেই সে থিরুর সাথে পুরোপুরি একাত্ম হয়ে যায়।

 

পরদিন সুহান তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হল খুব ভোরে। আগে সে পাতাল ট্রেনে যাতায়াত করেছে, এখন দীর্ঘদিন সে ঘরে বসে আছে, খরচ নেই কিন্তু বেতনের ইউনিটগুলো নিয়মিত তার অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে, বেশ কিছু ইউনিট হয়ে গেছে ভার, ইচ্ছে করলে একটা ট্যাক্সিতে যেতে পারে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সে যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ঠিক তখন তার কাছাকাছি একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। খুট করে দরজা খুলে যায় এবং সুহান শুনতে পেল তার মস্তিষ্কে কেউ একজ্জন বলল, উঠে যাও।

সুহান চমকে উঠে বলল, উঠে যাব?

হ্যাঁ।

যদি কেউ দেখে ফেলে?

দেখবে না। কেউ নেই। তোমাকে তথ্যকেন্দ্রে নামিয়ে দিই।

সুহান ট্যাক্সিতে উঠতেই মৃদু গর্জন করে সেটা এগিয়ে যায়।

তথ্যকেন্দ্রের সামনে নামিয়ে দেবার পরও সুহান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এর আগে কতবার সে এখানে এসেছে, ভেতরে ঢুকেছে। কাজ করেছে কাজ শেষে বের হয়ে এসেছে। আজ সম্পূর্ণ অনা ব্যাপার, সে ভেতরে ঢুকবে কিন্তু সে জানে না সে বের হতে পারবে কি না। সুহান জোর করে মাথা থেকে চিন্তা দূর করে দিল, বের হতে না পারলে নেই, কিন্তু তার ওপরে যে দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে সে সেটা শেষ করবে। সুহান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে তার কার্ডটা হাতে তথ্যকেন্দ্রের দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

দরজায় কার্ডটা দেওয়ার সময় হঠাৎ তার হাত কেঁপে উঠল। আজ কি দূরজা খুলবে তার জন্য নিরাপত্তাকর্মীরা কি কোনোভাবে তার মনের কথা জেনে গেছে? কিন্তু না, তারা কেউ জানে না। ঘড়ঘড় শব্দ করে দরজা খুলে গেল, সুহান দেখতে পেল জিনেটিক কোডিং করার জন্য যন্ত্রটা নিয়ে নিরাপত্তা প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে। সুহান একটু এগিয়ে গিয়ে যন্ত্রের ভেতরে আঙুলটা প্রবেশ করিয়ে দিতেই একটা মৃদু খেচা অনুভব করে, প্রায় সাথে সাথে মনিটরে সুহানের চেহারা ফুটে ওঠে। উপরে একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে—

নিরাপত্তা প্রহরী তীক্ষ্ণ চোখে সুহানের দিকে তাকাল, বিড়বিড় করে বলল, অনেক দিন পরে?

সুহান মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। অনেক দিন পর।

অক্সিডেন্ট?

সুহান বলল, , অ্যাক্সিডেন্টের মতোই। সুহান ভেতরে ভেতরে এক ধরনের আতঙ্কবোধ করে, তার গলার স্বরটি কি আজ একটু অন্যরকম শোনাচ্ছে, নিরাপত্তাকর্মীটি কি তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে? না, সেরকম কিছু না, শেষ পর্যন্ত সে হাত নেড়ে তাকে ভেতরে যেতে বলল, বুকের ভেতরে আটকে থাকা একটি নিশ্বাসকে বের করে দিয়ে সুহান ভেতরে ঢুকে গেল।

আর কোনো ভয় নেই। এই তথ্যকেন্দ্রটাকে সুহান হাতের তালুর মতো চেনে। সে একেবারে নিচু পর্যায়ের নিরাপত্তাকর্মী, কাজেই তার সব জায়গায় যাবার অনুমতি নেই। কিন্তু যেখানে যেখানে যাবার অনুমতি আছে সে জায়গাগুলোর কোথায় কোন ত্রুটি আছে সেটি তার মুখস্থ। সেই ত্রুটিগুলো ব্যবহার করে কীভাবে একটার পর আরেকটা নিরাপত্তা ব্যহ ভেদ করে একেবারে সার্ভার রুমে যেতে হয় সেটাও সে জানে। আজকে তাকে সেগুলো ব্যবহার করে একেবারে ভেতরে ঢুকে যেতে হবে। সুহান ঘড়ির দিকে তাকাল, তার হাতে অল্প কিছু সময় আছে। এখন তার নিজের ঘরে গিয়ে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তুলে নেবার কথা। সেটা হাতে নিয়ে তার নিচে যাবার কথা। সেখানে তাকে আজকের ডিউটি বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তখন তাকে ডিউটিতে যেতে হবে। কিন্তু সে এখন নিচে যেতে চায় না, নিচে গেলেই সবার সাথে দেখা হবে, সবার সাথে তার কথা বলতে হবে, সে এখন কথা বলতে চায় না। সে এখন কারো সাথে দেখা করতে চায় না। ডিউটিতে রিপোর্ট করতে যাবার আগে তার হাতে অল্প কয়েক মিনিট সময় আছে, সে সেই সময়টাই ব্যবহার করতে চায়। এই সময়ের ভেতরেই নিরাপত্তা ব্যুহ ভেদ করে সে ভেতরে ঢুকে যেতে চেষ্টা করবে। এখনই সবচেয়ে ভালো সময়, সবচেয়ে বড় সুযোগ। একটু পর সে সুযোগ আর নাও পেতে পারে।

সুহান তার ঘরে গিয়ে অস্ত্রটা তুলে নেয়, ভাগ্যিস সেখানে এখন রিকি নেই। রিকি থাকলে এখন তার কিছুক্ষণ রিকির সাথে কথা বলতে হত—বিকি তার অ্যাক্সিডেন্টের খোঁজ নিত। কোন হাসপাতালে ছিল, ডাক্তাররা কী বলেছে—সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে

চাইত। রিকি খুব চমৎকার একজন মানুষ, তার সাথে কথা বলতে সুহানের খুব ভালো লাগে কিন্তু এই মুহূর্তে সে কারো সাথে কথা বলতে চায় না।

সুহান অস্ত্রটা কাঁধে ঝুলিয়ে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে, করিডোরের একেবারে শেষ মাথায় লিফট। লিফটে করে সুহান তিন তালায় উঠে এল। সামনে এক শ মিটার পর্যন্ত নিরাপদ এলাকা, এইটুকু সে যেতে পারবে, এরপর নিষিদ্ধ এলাকা, সেখানে কারো যাবার অনুমতি নেই। কেউ যেন ভুল কৱে চলে না যায় সে জন্য দুটো অদৃশ্য অবলাল আলোর রশ্মি বাম থেকে ডান দিকে গিয়েছে, একটি মেঝে থেকে আধামিটার ওপর দিয়ে অন্যটি দেড় মিটার ওপর দিয়ে। অসতর্ক কেউ এখানে চলে এলে অবলাল রশ্মিটি বাধাপ্রাপ্ত হয়, সাথে সাথে কর্কশ স্বরে এলার্ম বাজতে শুরু করে। সুহান সেটা জানে তাই সে খুব সাবধানে একটা রশির ওপর দিয়ে অন্যটির নিচে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল, কোনো এলার্ম বাজল না। সুহান তখন দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে। শ খানেক মিটার দূরে এই তথ্যকেন্দ্রের প্রথম ত্রুটিপূর্ণ লেজার, সুহান এটা আবিষ্কার করেছে। লেজারটি বন্ধ করে দেবার সাথে সাথে নিরাপত্তা সার্কিট অন হয়ে যাবার কথা। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে সেটি অন হয় না এবং অমূল্য দুই মিনিটের সময় পাওয়া যায়, এই দুই মিনিটে যদি মূল করিডোরের ক্যামেরাটি একটু ঘুরিয়ে দেওয়া যায় তা হলে ক্যামেরার দৃষ্টিসীমার বাইরে দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়া যায়।

সুহান লেজারটির কাছে গিয়ে ক্ষিপ্র হাতে সেটা বন্ধ করে প্রায় ছুটতে ছুটতে মূল করিডোরে ফিরে এল, ক্যামেরাটা এখন কাজ করছে না, আগের ছবিটা এখানে ফ্রিজ হয়ে আছে। দুই মিনিট সময়ের ভেতর ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে দিতে হবে, বেশি ঘোরালে ধরা পড়ে যাবে, কম ঘোরালে কাজ করবে না, এর মাঝামাঝি একটা জায়গায় আটকে দিতে হবে। সুহান নিশ্বাস বন্ধ করে ক্যামেরাটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুরিয়ে লেজারটির কাছে ফিরে গেল, এখনো কর্কশ স্বরে এলার্ম বাজতে শুরু করছে না, তার মানে এখনো সে ধরা পড়ে যায় নি। সুহান নিশ্বাস বন্ধ করে লেজারটি আবার চালু করে দিল, কোথাও এবারও এলার্ম বেজে উঠছে না, কাজেই সবকিছু পরিকল্পনা মতো কাজ করছে। চমৎকার!

সুহান ঘড়ির দিকে তাকাল, কাজ শুরু করার পর মাত্র দুই মিনিট পার হয়েছে অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে বুঝি কয়েক যুগ কেটে গেছে। সুহান পিঠে ঝুলিয়ে রাখা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রী পরীক্ষা করে এবারে মূল করিডোরের দিকে হাঁটতে থাকে। ক্যামেরাটা একটু অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, সুহান দেয়াল ঘেঁষে ভেতরে ঢুকে গেল, ক্ষিপ্র পায়ে সে ছুটে যায়, সামনে সার্ভার রুম। সুহান সার্ভার রুমের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, দরজায় গোপন সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। সুহান গোপন সংখ্যাটি জানে না, তার এখন সাহায্যের দরকার। তাকে সাহায্য করার জন্য এখন তাদের সমন্বিত সত্তা অপেক্ষা করছে। সুহান বলল, সংখ্যাটি কি বের করা হয়েছে?

হ্যাঁ।

বলো আমাকে।

বলছি। খুব সাবধান—একটি ভুল সংখ্যা প্রবেশ করালেই কিন্তু ধরা পড়ে যাবে।

ঠিক আছে।

প্রথম দুটি হচ্ছে সংখ্যা। তারপর তিনটি অক্ষর তারপর চারটি সংখ্যা। বুঝেছ?

বুঝেছি। তোমরা বলো।

সুহান দরজার নিরাপত্তা প্যানেলে একটি একটি সংখ্যা আর অক্ষর প্রবেশ করাতে থাকে। শেষ সংখ্যাটি প্রবেশ করানোর সাথে সাথে খুট করে দরজাটি খুলে গেল।

চমৎকার! সুহান বিড়বিড় করে বলল, এখন আমার দরকার দশ মিনিট সময়। মাত্র দশ মিনিট।

রিয়ানা চাপা গলায় বলল, । সেই দশ মিনিট সময় তুমি পাবে। তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাক। আমরা সবাই তোমার সাথে সমন্বিত হয়ে আছি। তুমি এখানে একা নও।

জানি। সুহান বলল, আমি সেটা জানি।

যাও, তুমি কাজ শুরু করে দাও।

সুহান পিঠ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা খুলে নিচে নামিয়ে রাখল তারপর বড় সার্ভারের সামনে গিয়ে তার দরজাটা খুলে নেয়। কী-বোর্ডটি বের করে নিয়ে আসে, সুইচ স্পর্শ করতেই সেটি অবলাল রশি দিয়ে সার্ভারের সাথে যোগাযোগ করে। সুহান একটা চেয়ারে বসে কী-বোর্ডের ওপর ঝুকে পড়ে। তার হাত হঠাৎ করে জীবন্ত প্রাণীর মতো কী-বোর্ডের ওপর ছুটতে থাকে। ঠিক তিন মিনিট পর সুহান একটা লম্বা নিশ্বাস নিল। সে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের প্রতিবেদনটা খুঁজে পেয়েছে। বিশাল প্রতিবেদন, প্রথমে সব বিজ্ঞানীদের পরিচিতি। দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন বয়স্ক সমাজবিজ্ঞানী, হাসিখুশি মানুষ। এই রিপোর্টটি তৈরি করার অপরাধে তাকে নাকি খুন করে ফেলা হয়েছে। মনিটরে হাসিখুশি। মানুষটিকে দেখে সেটি বিশ্বাস করতে মন চায় না। দলটিতে আরো অনেক বিজ্ঞানী রয়েছেন, সবাই মিলে পুরো ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করেছেন, অসংখ্য মানুষকে পরীক্ষা করেছেন, তাদের বুদ্ধিমত্তা আর সৃজনশীলতা পরিমাপ করেছেন। তাদের একজনের সাথে আরেকজনের তুলনা করেছেন। ক্যাটাগরি-বিমানুষের বিশেষ জিনগুলো অন্য মানুষের ওপর প্রতিস্থাপন। করেছেন, তাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। দীর্ঘ গবেষণা শেষে তারা প্রতিবেদনটি তৈরি করে মানুষের ভেতরে বিভাজন করার এই পুরো ব্যাপারটিকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন। প্রতিবেদনটি দেখার সময় নেই, সুহান তাই দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হতে চায় এখানেই পুরোটা রয়েছে কি না। প্রতিবেদনের শেষ অংশটা সুহানের চোখে পড়ে যায়, কিছু মানুষকে ক্যাটাগরি-বি হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকে পৃথিবীর সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার এই উদ্যোগটা ষড়যন্ত্রমূলক, অন্যায়, অমানবিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণােদিত। এই মুহূর্তে মানুষের মাঝে ক্যাটাগরি-বি হিসেবে বিভাজন বন্ধ করে যারা এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে এমন একটি কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন যেন

ভবিষ্যতে কখনো কেউ এরকম হীন ষড়যন্ত্র করার সাহস না পায়।

সুহান প্রতিবেদন থেকে চোখ সরিয়ে এনে নেটওয়ার্কের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করার কাজে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল। একজন মানুষের পক্ষে এটি করা সম্ভব নয়, কিন্তু সে একজন মানুষ নয়। সে অনেক মানুষের সমন্বিত একটি অস্তিত্ব। দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা করে সবাই মিলে এর প্রস্তুতি নিয়েছে, সে নিশ্চয়ই নেটওয়ার্কের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে বাইরের পৃথিবীতে বিজ্ঞানীদের এই প্রতিবেদনটি পাঠিয়ে দিতে পারবে। নিশ্চয়ই পারবে।

সুহান দাতে দাঁত চেপে তার কী-বোর্ডের ওপর ঝুঁকে পড়ল। ঝড়ের বেগে তার হাত কী-বোর্ডের ওপর ছোটাছুটি করতে থাকে। অনেকগুলো প্রতিরক্ষা ব্যুহ রয়েছে, একটি ভেদ করেই শুধুমাত্র পরের কূহে যেতে পারে। প্রথম ব্যুহ থেকে পরেরটি কঠিন, তার পরেরটি আরো কঠিন। শেষ বৃহগুলোর সাথে হার্ডওয়্যারের সংযোগ আছে, সেগুলো স্পর্শ করা মাত্রই তীব্র স্বরে এলার্ম বেজে উঠবে, সাথে সাথে শত শত সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মী ছুটে আসবে এই সার্ভার ঘরে। এলার্ম বাজার পর থেকে এই ঘরে তাদের আসতে বড়জোর তিন থেকে চার মিনিট সময় নেবে, তার ভেতরে তার শেষ বৃহটা ভেদ করে প্রতিবেদনটি মূল নেটওয়ার্কে পৌঁছে দিতে হবে। সে কি সত্যিই পারবে সেটা করতে? সুহান জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা দূর করে দেয়, এই মুহূর্তে সে শুধু কাজ করে যাবে। সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করবে নিরাপত্তা ব্যুহ ভেদ করার কাজে। একটু একটু করে সে ক্যাটাগরি-বি. মানুষকে পৃথিবীতে মুক্ত মানুষ হিসেবে পৌঁছে দেবার কাজে এগিয়ে যাচ্ছে।

চতুর্থ ব্যূহটি ভেঙে নেটওয়ার্কের কাছাকাছি পৌঁছে যাবার সাথে সাথে সমস্ত তথ্যকেন্দ্র কঁপিয়ে কর্কশ এলার্ম বেজে উঠল, সুহানের সারা শরীর হঠাৎ আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে ওঠে। তার হাতে আর মাত্র কয়েক মিনিট সময়, দেখতে দেখতে নিরাপত্তাকর্মীরা চলে আসবে এর মাঝে সে যদি শেষ ব্যুহটা ভেদ করতে না পারে তা হলে ক্যাটাগরি-বি. মানুষ আর কখনোই সত্যিকারের মানুষ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

সুহান তার কী-বোর্ডের ওপর ঝুঁকে পড়ল। দ্রুত কিছু সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে মনিটরের দিকে তাকায়, সঠিক সংখ্যাগুলো প্রবেশ করাতে পেরেছে কি? সুহান নিশ্বাস বন্ধ করে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে, হ্যাঁ, সে সঠিক সংখ্যাগুলো প্রবেশ করেছে, শেষ বৃহটা ভেঙে যাচ্ছে। দুর্বোধ্য সংখ্যা মনিটরের স্ক্রিনটা প্লাবিত করে রেখেছে কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে অনেক বেশি সময় নিচ্ছে এই শেষ বৃহটা। সুহান এবারে পায়ের শব্দ শুনতে পেল, নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষেরা চলে এসেছে। দরজায় হাত রেখেছে তারা, এখনো ব্যহটা ভেদ হয় নি। আতঙ্কে সুহানের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে কি সে পারবে না? তার একটু সময় দরকার, বেশি নয়, মাত্র কয়েক মিনিট।

ঠিক তখন তার আগ্নেয়াস্ত্রটির কথা মনে পড়ল। নিচু হয়ে সেটি তুলে নিয়ে দরজার দিকে লক্ষ করে এক পশলা গুলি করল। বাইরে নিরাপত্তাকর্মীদের ভ্রাতঙ্কিত চিৎকার শুনতে পায় সে, এগিয়ে আসতে সাহস করছে না কেউ। আরো কিছুক্ষণ সময় পেয়েছে সে। আবার সে ঝুঁকে পড়ল কী-বোর্ডের ওপর।

খুব ধীরে ধীরে নিরাপত্তা ব্যূহটি সরে যাচ্ছে। সুহান বিস্ফারিত চোখে দেখতে পায় ধীরে ধীরে নেটওয়ার্কটি উন্মুক্ত হয়ে আসছে তার সামনে। আর অল্প কিছু সময় পেলেই সে বিজ্ঞানীদের প্রতিবেদনটুকু পাঠিয়ে দিতে পারবে বাইরে।

দরজায় আবার সে হুঁটোপুটি শুনতে পায়, নিরাপত্তাকর্মীরা আবার এগিয়ে আসছে তার কাছে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সুহান আবার এক পশলা গুলি করার চেষ্টা করল, মাঝপথে হঠাৎ গুলি থেমে যায়, গুলি শেষ হয়ে গেছে। তার কাছে বাড়তি ম্যাগজিন নেই, বিষয়টি বুঝতে বেশি সময় লাগল না, সাথে সাথে নিরাপাকর্মীরা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল।

চোখের কোনা দিয়ে সুহান দেখতে পেল নিরাপত্তাকর্মীরা এগিয়ে আসছে। সবার সামনে রিগা, তার হাতে ছোট আগ্নেয়াস্ত্র, যেটা দিয়ে সে এর আগে আরো একজনকে হত্যা

করেছিল।

সুহানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, কী হবে এখন? ঠিক সেই মুহূর্তে মনিটরে দুর্বোধ্য সংখ্যার প্লাবন বন্ধ হয়ে একটা লেখা ফুটে ওঠে নিরাপত্তা ব্যহ অপসারিত, উন্মুক্ত নেটওয়ার্ক।।

নেটওয়ার্ক উন্মুক্ত হয়েছে, তার আর মাত্র একটি মুহূর্ত সময় দরকার। মাত্র একটি মুহূর্ত। সুহান কাপা হাতে কী-বোর্ডের তিনটা অক্ষর স্পর্শ করল, সাথে সাথে বিজ্ঞানীদের গোপন প্রতিবেদনটি পৃথিবীর মূল নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে যায়, কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সেটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি আর সেটি আটকে রাখতে পারবে না।

সুহান মাথা ঘুরিয়ে রিগার দিকে তাকাল, তার মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি। রিগা উন্মুক্ত মানুষের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে, দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ক্যাটাগরি-বি. জানোয়ার। প্রথম দিনেই তোকে আমার খুন করা উচিত ছিল।

সুহান হাসল, বলল, সেজন্য এখন খুব দেরি হয়ে গেছে।

রিগা হিংস্র গলায় বলল, না। হয় নি। তারপর সে তার ছোট আগ্নেয়াস্ত্রটা তুলে গুলি করল, মস্তিষ্ক চূর্ণ হয়ে গেল সুহানের রক্ত ছিটকে এসে লাগল রিগার চোখে-মুখে। প্রাণহীন দেহটা চেয়ার থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়, উন্মুক্ত রিগা তবু থামে, হিংস্র দানবের মতো গুলি করতে থাকে তার মৃতদেহকে।

নিরাপত্তাকর্মীদের ঠেলে কিরি হঠাৎ ছুটে এল। চিৎকার করে বলল, থাম। খাম রিগা–

কেন? কী হয়েছে?

কিরি এগিয়ে এসে মৃতদেহের পাশে ঝুঁকে পড়ে সেটা পরীক্ষা করে বলল, এটা সুহান।

রিগা চিৎকার করে উঠল, সুহান না?

না। সুহানের মতো দেখতে একটা রবারের মাস্ক পরেছে—খুলে এসেছে এখন।

রিগাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়। তা হলে ভেতরে ঢুকল কেমন করে?

সুহানের কার্ডটা নিয়ে এসেছে। জিনেটিক কোডিং করার জন্য আঙুলে একটা কৃত্রিম ত্বক তৈরি করেছে, এই দেখ সুহানের রক্ত আছে সেখানে, সুহানের মতো কণ্ঠস্বর করার জন্য ভোকাল কর্ডে একটা ইমপ্লন্ট!

বিগ বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কী করতে এসেছে এখানে?

কিরি মনিটরে তাকিয়ে বলল, কী একটা ফাইল নেটওয়ার্কে পাঠিয়ে দিয়েছে।

কিসের ফাইল?

কিরি বলল, আমি জানি না। আমি এসব বুঝি না। মনে হয় দশম মাত্রার গোপনীয়।

রিগা হুঙ্কার দিয়ে বলল, বের কর কী ফাইল।

কেমন করে বের করতে হয় আমি জানি না।

রিগা চিৎকার করে বলল, সিস্টেমের লোক কোথায়? এক্ষুনি আসতে বলে। এক্ষুনি।

 

সেটা বের করার তখন কোনো প্রয়োজন ছিল না, সারা পৃথিবীতে ততক্ষণে বিজ্ঞানীদের গোপন প্রতিবেদনটা পৌঁছে গেছে। ক্যাটাগরি-বি. মানুষের বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করা। হয়েছিল সেটা প্রচারিত হতে শুরু করেছে। পৃথিবীর মানুষ হতবিহ্বল হয়ে মাত্র বুঝতে শুরু করেছে মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ কী ভয়ংকর একটি ষড়যন্ত্র করেছিল, কী অমানবিক এবং নিষ্ঠুর সেই ষড়যন্ত্র।

 

সুহান থরথর করে তার চেয়ারে বসে কাঁপছিল। রিয়ানা তাকে ধরে রেখে বলল, শান্ত হও সুহান। শান্ত হও।

সুহান বলল, কেমন করে শান্ত হব। আমি স্পষ্ট দেখেছি রিগা আমার মাথায় গুলি করল, মস্তিষ্ক চূর্ণ হয়ে গেল আমার।

তোমার নয়, থিরু। তোমার মতো একটা রবারের মুখোশ পরে তথ্যকেন্দ্র চার চার শূন্য তিনে গিয়েছে। তুমি এখানে বসে তার সাথে নিজেকে সমন্বিত করেছ। খিরু নিজেকে সুহান ভেবেছে। সুহান হয়ে তথ্যকেন্দ্রে ঢুকে গেছে।

সুহান শূন্য দৃষ্টিতে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সব জানি রিয়ানা, সব জানি কিন্তু তারপরেও বিশ্বাস হয় না। তুমি বিশ্বাস করবে না রিয়ানা কী ভয়ংকর সেই অনুভূতি।

মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কী ভয়ংকর একটি শূন্যতা এসে গ্রাস করে—

কিন্তু সেটি সত্যি নয় সুহান। তুমি বেঁচে আছ—

সুহান রিয়ানার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, মি আমার নিজের কথা বলছি না রিয়ানা। আমি থিরুর কথা বলছি! মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তার বুকের ভেতর যে ভয়াবহ শূন্যতা ছিল, যে দুঃখ ছিল সেটি তুমি কল্পনা করতে পারবে না। পৃথিবীর কেউ পারবে না।

রিয়ানা মাথা নেড়ে একটা নিশ্বাস ফেলল, নরম গলায় বলল, আমাদের কিছু করার ছিল না সুহান। তোমাদের দুজনের একজনকে আমরা হারাতাম। আমরা ভেবেছিলাম তোমার কথা, থিবু কিছুতেই রাজি হল না, সে বলল নেটওয়ার্কের ভেতরে ঢুকে যাবার বিষয়টি সে অন্য কারো সাথে সমন্বিত করে করতে চায় না, নিজে করতে চায়।

সুহান বলল,  এখন বুঝতে পারছি।

তুমি সমন্বিত হয়েছিলে শেষ মুহূর্তে যখন একটু বাড়তি সময় লাগল, তুমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করে খানিকটা সময় নিলে

আমি জানি। কী ভয়ংকর বাস্তব সেই অনুভূতি—

তোমাদের দুজনের সমন্বয় ছিল অসাধারণ—আমরা তা না হলে কিছুতেই পারতাম। কিছুতেই না–

আমি সব বুঝতে পারছি রিয়ানা কিন্তু তবু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। সুহান মাথা নেড়ে বলল, কিছুতেই না।

সুহান, অমিরা সবাই একসাথে সমন্বিত হয়ে ছিলাম। থিরুর মাঝে আমরা বেঁচে ছিলাম, আমাদের মাঝে থিরু বেঁচে ছিল। থিরু চিরদিনের জন্য আমাদের মাঝে সমন্বিত হয়ে গেছে। আমাদের সবার মাঝে থির একটা অংশ বেঁচে আছে। বেঁচে থাকবে।

সুহান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক এরকম সময় লাল চুলের একটা ছেলে ছুটে এল, চিৎকার করতে করতে বলল, তোমরা এস। তাড়াতাড়ি এস। দেখ ভিডিস্ক্রিনে কী দেখাচ্ছে।

রিয়ানা আর সুহান বের হয়ে এল। বাইরে বিশাল ভিডিস্ক্রিনের সামনে সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কালো চুলের একটি মেয়ে উত্তেজিত গলায় কথা বলছে সেখানে, মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমাদের সবার হাতে বিজ্ঞানীদের একটি প্রতিবেদন এসে পৌঁছেছে। এটি কেমন করে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে সেটি এখনো রহস্যাবৃত। আমাদের বিশেষজ্ঞরা এই মুহূর্তে সেটি বিশ্লেষণ করছেন, আমরা ইতোমধ্যে এর ভেতরের সতটুকু জেনে গেছি। যে বিষয়টি নিয়ে পৃথিবীর সত্যানুসন্ধানী মানুষেরা কথা বলে আসছিল সেটি সত্য প্রমাণিত হয়েছে। মানুষের মাঝে কোনো বিভাজন নেই।

কালো চুলের মেয়েটি তার অবাধ্য চুলকে পেছনে সরিয়ে উত্তেজিত গলায় বলল, পৃথিবীর সকল মানুষ এক। তাদের সবার দেহে একই রক্ত। তাদের মাথার চুল, গায়ের রং, মুখের ভাষা কিংবা ক্রোমোজম ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু তারা একই মানুষ। মানুষে মানুষে কোনো বিভাজন নেই। আগেও ছিল না ভবিষ্যতেও থাকবে না।

মেয়েটি হাতের মাইক্রোফোনটা হাতবদল করে বলল, সারা পৃথিবী থেকে আমাদের কাছে খবর এসে পৌঁছাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে এসেছে। তারা রাজপথে মিছিল করে তথাকথিত ক্যাটাগরি-বি. ছেলেমেয়েদেরকে এই মুহূর্তে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পাশাপাশি পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের কাছে খবর এসেছে শহরতলিতে নির্বাসিত তথাকথিত ক্যাটাগরি-বি. মানুষদের আবাসস্থলে হাজার হাজার মানুষ গিয়ে ভিড় করেছে। সেখানে মানুষের একটি অপূর্ব মিলনমেলার সৃষ্টি হয়েছে।

ভিডিস্ক্রিনে সবাই দেখতে পেল হাজার হাজার মানুষ একজন আরেকজনকে আলিঙ্গন করছে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত ছোট ছোট দুস্থ শিশু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, নানা বয়সী মানুষ তাদের গভীর মমতায় বুকে চেপে ধরছে। যে মানুষদের এতদিন ক্যাটাগরিবি, মানুষ হিসেবে অবহেলা করে এসেছে, সেই দুঃখী-অসহায় মানুষগুলোকে সাধারণ মানুষ জড়িয়ে ধরেছে গভীর ভালবাসায়।

যে ভালবাসা পৃথিবীর মানুষের সবচেয়ে পুরাতন অনুভূতি, সবচেয়ে অকৃত্রিম অনুভূতি, সবচেয়ে খাঁটি অনুভূতি।

যে অনুভূতি পৃথিবীর মানুষকে মানুষের পরিচিতি দিয়েছে।

Exit mobile version