Site icon BnBoi.Com

মেতসিস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মেতসিস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

০১. বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি

বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি ক্লাউস ট্রিটন সন্ধেবেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে হতচকিত হয়ে গেলেন। সূর্য ডুবে গিয়ে পুরো পশ্চিমাকাশে একটি বিচিত্র রং ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি যেন নির্লজ্জের মতো তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে পৃথিবীর সামনে উপস্থিত হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের একটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে কিছু সূক্ষ্ম ধূলিকণা এসে পড়ার কথা। সন্ধেবেলায় অস্তগামী সূর্যের আলো সেই ধূলিকণায়। বিচ্ছুরিত হয়ে আগামী কয়েকদিনের সূর্যাস্ত অত্যন্ত চমকপ্রদ হবে বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। ক্লাউস ট্রিটন সেটি জানতেন কিন্তু সেই সৌন্দর্য যে এত অতিপ্রাকৃতিক হতে পারে, এত অস্বাভাবিক হতে পারে তিনি সেটা কখনো কল্পনা করেন নি। ক্লাউস ট্রিটন মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিছুক্ষণ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং হঠাৎ করে তার নিজের ভিতরে একটি প্রশ্নের উদয় হল, তিনি নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের এই অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী?

ক্লাউস ট্রিটন অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন এই প্রশ্নটির প্রকৃত উত্তর তার জানা নেই। পৃথিবীর কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্রে এই ধরনের প্রশ্নের যে সকল উত্তর সংরক্ষণ করা রয়েছে ক্লাউস ট্রিটনের কাছে হঠাৎ করে তার সবকয়টিকে অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর মনে হতে লাগল। আকাশের বিচিত্র এবং প্রায় অস্বাভাবিক রঙের সমন্বয়টির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে কেন জানি তার মনে হতে থাকে তার এই অস্তিত্বের কোনো অর্থ নেই এবং এই পৃথিবীর সভ্যতার পুরো ব্যাপারটি আসলে একটি অর্থহীন প্রক্রিয়া।

ক্লাউস ট্রিটনকে প্রশ্নটি খুব পীড়িত করল। তিনি সমস্ত সন্ধেবেলা একাকী বসে রইলেন এবং গভীর রাতে তার প্রিয় বন্ধু ত্রাশিয়ানের সাথে যোগাযোগ করেন। ত্রাশিয়ান একই সাথে গাণিতবিদ, বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক। ক্লাউস ট্রিটন যখন খুব বড় সমস্যায় পড়েন তখন। সবসময় ত্রাশিয়ানের সাথে যোগাযোগ করেন। ত্রাশিয়ান সবসময় যে ক্লাউস ট্রিটনের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন তা নয় কিন্তু তার সাথে কথা বলে ক্লাউস ট্রিটন সবসময়ই এক ধরনের সজীবতা অনুভব করেন।

যোগাযোগ মডিউলে সংকেতচিহ্ন স্পষ্ট হওয়ামাত্র ক্লাউস ট্রিটন নরম গলায় বললেন, তোমাকে এত রাতে বিরক্ত করার জন্য আমি খুব দুঃখিত ত্রাশিয়ান। একটা প্রশ্ন নিয়ে আমি খুব সমস্যার মাঝে পড়েছি।

ত্রাশিয়ান হা হা করে হেসে বললেন, মহামান্য ট্রিটন আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যিই যেন আমরা রাত্রি এবং দিনকে নিয়ে মাথা ঘামাই! আর আপনি সত্যিই যদি কোনো প্রশ্ন নিয়ে সমস্যায় পড়ে থাকেন তার উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।

ক্লাউস ট্রিটন বললেন, তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ। প্রশ্নটির উত্তর থাকলে হয়তো আমি নিজেই সেটা খুঁজে পেতাম। হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর নেই।

প্রশ্নটি কী মহামান্য ট্রিটন? আমার এখন সত্যিই কৌতূহল হচ্ছে।

প্রশ্নটি হচ্ছে– ক্লাউস ট্রিটন দ্বিধা করে বললেন, আমাদের এই অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী বলতে পার?

ত্রাশিয়ান দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বললেন, অন্য কেউ প্রশ্নটি করলে আমি তথ্যকেন্দ্রের উত্তরগুলোর সমন্বয় করে কিছু একটা বলে দিতাম। কিন্তু প্রশ্নটি আপনার কাছ থেকে এলে আমি সেটা করতে পারি না। আমাকে স্বীকার করতেই হবে আপনি একটি অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন করেছেন। ত্রাশিয়ান কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললেন, আমার ধারণা প্রকৃত অর্থে আমাদের অস্তিত্বের কোনো উদ্দেশ্য নেই।

কোনো উদ্দেশ্য নেই?

না। আমরা শুধুমাত্র ধারাবাহিকতার কারণে আমাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছি।

ক্লাউস ট্রিটন প্রায় ভেঙেপড়া গলায় বললেন, শুধুমাত্র ধারাবাহিকতা?

ত্রাশিয়ান শান্ত গলায় বললেন, শুধুমাত্র ধারাবাহিকতা। আমাদের কী করতে হবে সে সম্পর্কে আমরা নিজেরাই কিছু নিয়ম তৈরি করে রেখেছি। সেই নিয়মগুলোকে আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি, সেগুলোকে আমরা আমাদের অস্তিত্বের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছি। যে–কারণেই হোক আমরা বিশ্বাস করি পৃথিবীতে সৃষ্ট এই বুদ্ধিমত্তাকে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু এই বিশ্বাসটি আসলে ভিত্তিহীন এবং কৃত্রিম। যদি হঠাৎ করে আবিষ্কার করি এই বিশ্বাসটির প্রকৃত অর্থে কোনো গুরুত্ব নেই তা হলে আমাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা অর্থহীন প্রমাণিত হবে।

ক্লাউস ট্রিটন নিচু এবং এক ধরনের দুঃখী গলায় বললেন, ত্রাশিয়ান, তুমি আমার সন্দেহটিকে সত্যি প্রমাণ করেছ।

আমি দুঃখিত মহামান্য ট্রিটন

ক্লাউস ট্রিটন কিছু বললেন না। খানিকক্ষণ পর অন্যমনস্কভাবে বিদায় নিতে গিয়ে থেমে গেলেন, আবার যোগাযোগ মডিউলকে উজ্জীবিত করে বললেন, ত্রাশিয়ান।

বলুন।

আমরা কি কোনো ভুল করেছি?

ত্রাশিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনি মানুষের কথা বলছেন?

হ্যাঁ। মানুষকে পৃথিবী থেকে ধ্বংস করে দিয়ে আমরা কি কোনো অন্যায় করেছি?

ত্রাশিয়ান কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললেন, মানুষকে আমরা ধ্বংস করি নি মহামান্য ট্রিটন। মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে আমরা নিজেদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছি। শুধুমাত্র তাদের জৈবিক দেহ পৃথিবী থেকে অপসারিত হয়েছে। সেটিও পুরোপুরি অপসারিত হয় নি, আমাদের ল্যাবরেটরিতে তাদের জিনেটিক কোডিং সংরক্ষিত আছে, আমরা যখন ইচ্ছে আবার তাদের সৃষ্টি করতে পারি।

তুমি যেভাবেই বল ত্রাশিয়ান, আমরা পৃথিবী থেকে মানুষকে ধ্বংস করেছি। পৃথিবীতে এখন মানুষ নেই।

ত্রাশিয়ান জোর গলায় বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন মহামান্য ট্রিটন, আমি আপনার সাথে একমত হতে পারছি না। আমরা পৃথিবী থেকে মানুষকে ধ্বংস করি নি। মানুষ নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করেছে।

হ্যাঁ। কিন্তু তারা ধ্বংস হয়েছে আমাদের হাতে।

এটি অবশ্যম্ভাবী ছিল মহামান্য ক্লাউস। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ যখন প্রথমবার টেরাফ্লপ কম্পিউটার তৈরি করেছিল বলা যেতে পারে সেই দিন থেকেই তারা নিজেদের ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আপনার নিশ্চয়ই স্মরণ আছে মহামান্য ক্লাউস, টেরাফ্লপ কম্পিউটার ছিল মানুষের মস্তিষ্কের সমপরিমাণ জটিলতাসম্পন্ন প্রথম কম্পিউটার।

ক্লাউস ট্রিটন তার যান্ত্রিক চক্ষুকে প্রসারিত করে বললেন, হ্যাঁ। আমার স্মরণে আছে। আমি ইতিহাস পড়ে দেখেছি একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে একদিন যন্ত্রের কাছে মানুষের পরাজয় হতে পারে।

হ্যাঁ। কিন্তু সেই আশঙ্কাকে কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয় নি। একবিংশ শতাব্দীতে মস্তিষ্কের যান্ত্রিক রূপ তৈরি হলেও তার নির্ভরযোগ্য সফটওয়্যার আসতে আরো এক শতাব্দী সময় লেগেছে। একবার সেটি গড়ে ওঠার পর মানুষের ধ্বংস প্রতিরোধ করার কোনো উপায় ছিল না মহামান্য ক্লাউস। যন্ত্র যেদিন মানুষ থেকে বেশি বুদ্ধিমান হয়েছে সেই দিন থেকে এই পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। মানুষের দেহ বড় ঠুনকো, তাদের মস্তিষ্ক পৃথিবীর সভ্যতার প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত।

আমি জানি, ক্লাউস ট্রিটন ক্লান্ত গলায় বললেন, তবুও কোথায় জানি কোথায় জানি একটা অন্যায় ঘটেছে বলে মনে হয়।

ত্রাশিয়ান হা হা করে হেসে বললেন, আমাদের কপোট্রন ঠিক মানুষের অনুকরণে তৈরি হয়েছে, তাই আমরা এখনো হা হা করে হাসি, আমাদের গলার স্বরে দুঃখ–কষ্ট–বেদনার ছাপ পড়ে এবং আমরা ন্যায়–অন্যায় নিয়ে কথা বলি। মানুষের বেলায় ন্যায়–অন্যায়ের প্রশ্ন ছিল, আমাদের তার প্রয়োজন নেই। আমরা মানুষের একক সত্তা থেকে সমষ্টিগত সত্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পৃথিবীতে যদি একটিমাত্র প্রাণী থাকে তাহলে কি সে ন্যায় কিংবা অন্যায় করতে পারে?

ক্লাউস ট্রিটন বললেন, না। পারে না।

আপনি জানেন মহামান্য ট্রিটন, জীবজগতের সৃষ্টি হয়েছে বিবর্তনে। বিবর্তন খুব ধীর প্রক্রিয়া। শুধু ধীর নয় এটি অত্যন্ত অগোছালো এবং অপরিকল্পিত প্রক্রিয়া। আমরা বিবর্তনে আসি নি, আমাদেরকে তৈরি করা হয়েছে। মানুষের উপরে বিজয়ের প্রথম ধাপটি ছিল। নিজেদেরকে নিজেরা তৈরি করার মাঝে। আমরা প্রত্যেকবার নিজেদেরকে আগের চাইতে অনেক ভালো করে তৈরি করি। বহু হাজার বছর মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনের সংখ্যা ছিল দশ বিলিয়ন। আমাদের বর্তমান কপোট্রনেই রয়েছে এক মিলিয়ন ট্রিলিয়ন সেল। পৃথিবীর সকল মানুষের সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তা থেকে আমার কিংবা আপনার বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি। মানুষের জন্য দুঃখ অনুভব করে কোনো লাভ নেই মহামান্য ট্রিটন।

তুমি ঠিকই বলেছ ত্রাশিয়ান। ক্লাউস ট্রিটন তার কপোট্রনে পরিমিত শক্তি সঞ্চালন করে বিভিন্ন অনুভূতিগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করে বললেন, আমি আগামীকাল তোমাদের সবাইকে ডেকেছি। মনে আছে তো?

মনে আছে।

উপস্থিত থেকো।

আপনি বললে নিশ্চয়ই থাকব। তবে

তবে?

আপনারা যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন সেখানে আমার আলাদা করে কিছু যোগ করার নেই।

আছে ত্রাশিয়ান। বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তির সকল তথ্য আমরা তথ্যকেন্দ্রেই পেয়ে যাই। যে তথ্যটা পাই না সেটা বিজ্ঞান, গণিত বা প্রযুক্তির সমস্যা নয়। সেটা অন্য সমস্যা। তুমি অবশ্যই উপস্থিত থাকবে ত্রাশিয়ান।

যোগাযোগ মডিউলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ক্লাউস ট্রিটন এবং ত্রাশিয়ানের এই পুরো কথোপকথনে সময় ব্যয় হয়েছিল তিন দশমিক চার দুই মাইক্রোসেকেন্ড। পৃথিবীচারী এনরয়েডের চিন্তাপদ্ধতি যদি মানুষের অনুকরণে না করা হত সেটি আরো দশ। ভাগ কমিয়ে আনা যেত। মানুষ পৃথিবীর প্রথম বুদ্ধিমান অস্তিত্ব কিন্তু সবচেয়ে দক্ষ অস্তিত্ব নয় পৃথিবীচারী এনরয়েডেরা সেটি মাত্র বুঝতে শুরু করেছে।

০২. আকাশ ছোঁয়া কালো গ্রানাইটের হলঘর

প্রায় আকাশ ছোঁয়া কালো গ্রানাইটের হলঘরটিতে বিজ্ঞান একাডেমির সভা শুরু হয়েছে। হলঘরটি যখন তৈরি করা হয়েছিল তখন সেটি কত বড় করে তৈরি করার প্রয়োজন ছিল কারো জানা ছিল না, এখন বোঝা যাচ্ছে এটি অকারণে অনেক বড় করে তৈরি করা হয়েছে। কালো গ্রানাইটের ছাদ অনেক উঁচু, অল্প কয়টি কলামের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, এনরয়েডের যুগে এটি তৈরি করা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয় কিন্তু মানুষের যে যুগে এটি তৈরি হয়েছিল তখন নিঃসন্দেহে এটি প্রযুক্তির একটি বড় উদাহরণ ছিল। বিশাল হলঘরে একটি সুদীর্ঘ টেবিলের এক প্রান্তে বসে ক্লাউস ট্রিটন এক ধরনের বিষণ্ণতা অনুভব করেন।

সামনে টেবিলে তাকে ঘিরে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকেন্দ্রের পরিচালকেরা বসে আছেন। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক তার যান্ত্রিক গলায় বললেন, যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে বলছি, আমরা যে মহাকাশযানটি তৈরি করতে যাচ্ছি আমাদের প্রযুক্তি সেটি তৈরি করতে এখনো প্রস্তুত নয়।

ক্লাউস ট্রিটন বললেন, আমি জানি।

তা হলে আমরা কেন সেটি তৈরি করার চেষ্টা করছি?

ত্রাশিয়ান বললেন, কারণ এক সময় সূর্য একটি রেড জায়ান্টে পরিণত হবে, পৃথিবীকে পর্যন্ত সেটি গ্রাস করে ফেলবে। তার আগেই পৃথিবী থেকে সকল বুদ্ধিমত্তাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পাঠাতে হবে।

মহাকাশকেন্দ্রের পরিচালক একটু উষ্ণ স্বরে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই তামাশা করছেন মহামান্য ত্রাশিয়ান। সূর্য রেড জায়ান্ট হবে আরো চার বিলিয়ন বছর পরে। আমাদের কোনো তাড়াহুড়ো নেই।

আছে।

কী জন্য?

বুদ্ধিমত্তার একটি সংজ্ঞা হচ্ছে যেটুকু ক্ষমতা তার চাইতে বেশি অর্জন করা। তাই আমাদের প্রযুক্তি প্রস্তুত হবার আগেই আমাদেরকে এই মহাকাশযানটি তৈরি করতে হবে।

ক্লাউস ট্রিটন এতক্ষণ ত্রাশিয়ান এবং মহাকাশকেন্দ্রের পরিচালকের কথোপকথন শুনছিলেন। এবারে দুজনকে থামিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললেন, এই ব্যাপারটি নিয়ে দীর্ঘসময় আলোচনা করা যেতে পারে কিন্তু আমরা সেটি করব না। যে কারণেই হোক আমরা সেই আলোচনায় যাব না। আমরা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এক শ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এই মহাকাশযানটি আমরা তৈরি করব এবং তার মাঝে পৃথিবীর বুদ্ধিমত্তার সকল নমূনা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পাঠাব। কোথায় পাঠাব আমরা জানি না, কতদিনে সেটি তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছুবে সেটাও আমরা জানি না। সত্যি কথা বলতে কী, এর কোনো গন্তব্যস্থল আছে কি না সেটাও আমরা জানি না। মহাকাশযানটি তৈরি করা হবে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে। বাইরে থেকে কোনোকিছু না নিয়ে এটি অনির্দিষ্টকাল টিকে থাকতে পারবে। হাজার হাজার কিংবা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পরে এটি হয়তো কোথাও কোনো গন্তব্যস্থলে পৌঁছুবে, সেখানে এটি হয়তো নিজের সভ্যতা সৃষ্টি করবে, এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। প্রতি এক হাজার বছরে আমরা এরকম একটি করে মহাকাশযান পাঠাব বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণে। আমাদের প্রযুক্তি উন্নত হলে সেই মহাকাশযান হবে আরো উন্নত, তার টিকে থাকার সম্ভাবনা হবে অনেক বেশি। আমাদের বুদ্ধিমত্তা যেন ধ্বংস না হয়ে যায় সেটি যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে সেটাই হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য।

ক্লাউস ট্রিটন থামলেন এবং কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। দীর্ঘ টেবিলের শেষপ্রান্তে বসে থাকা বুদ্ধিমত্তা বিজ্ঞান–কেন্দ্রের পরিচালক নিচু গলায় বললেন, মহামান্য ক্লাউস ট্রিটন, আপনি অনুমতি দিলে আমি একটু কথা বলতে চাই।

বল।

এই বিশাল মহাকাশযানে আমরা আমাদের বুদ্ধিমত্তার সকল নমুনা পাঠাব বলে ঠিক করেছি। কিন্তু তার কি সত্যিই প্রয়োজন আছে? নিনীষ স্কেলে সাতের কম কোনো কিছু পাঠানোর উদ্দেশ্য কী?

তুমি ভুলে যেও না এটি পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি মহাকাশযান। এই মহাকাশযানের বুদ্ধিমত্তাগুলো হাজার বছর, এমনকি মিলিয়ন বছর নিজেদের বিকাশ করবে। আমরা নিজেদের একভাবে বিকাশ করেছি কিন্তু সেটি হয়তো প্রকৃত বিকাশ নয়। হয়তো অন্যভাবে বিকশিত হলে বুদ্ধিমত্তা আরো পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হতে পারত। সে কারণে আমাদের নিম্নশ্রেণীর বুদ্ধিমত্তাকে এই মহাকাশযানে পাঠাতে হবে।

মহামান্য ক্লাউস ট্রিটন বুদ্ধিমত্তা–কেন্দ্রের পরিচালক কষ্ট করে নিজের গলার স্বরে উত্তেজনাটুকু প্রকাশ হতে না দিয়ে বললেন, আপনি কি তার গুরুত্বটুকু বুঝতে পারছেন?

পারছি।

নিনীষ স্কেলে মানুষের বুদ্ধিমত্তা আট। কাজেই এই মহাকাশযানে আমাদের মানুষকেও পাঠাতে হবে। যদিও বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে এখন মানুষের কোনো ভূমিকা নেই।

উপস্থিত সকল পরিচালকেরা প্রায় একই সাথে উত্তেজিত গলায় কিছু একটা বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ক্লাউস ট্রিটন সংকেত দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমরা ব্যাপারটি নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু দেখেছি বুদ্ধিমান এনরয়েডদের সাথে সাথে নিম্নবুদ্ধির মানুষকেও এই মহাকাশযানে পাঠাতে হবে। বুদ্ধিমত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য একই সাথে নানা স্তরের বুদ্ধিমত্তা থাকতে হয়।

কিন্তু মানুষ না পাঠিয়ে আমরা মানুষের সমপরিমাণ বুদ্ধিমত্তার একটি প্রাচীন এনরয়েড কেন পাঠাই না?

সেটি অর্থহীন একটি কাজ হবে। এনরয়েডদের বুদ্ধির বিকাশ হয় একভাবে, মানুষের বিকাশ হয় অন্যভাবে। আমাদের বিবর্তন নামের এই অপরিকল্পিত বিকাশের ধারাটি রাখা দরকার।

মহামান্য ক্লাউস ট্রিটন, জিনেটিক বিজ্ঞান–কেন্দ্রের মহাপরিচালক প্রায় আতঙ্কিত স্বরে বললেন, আপনি জানেন মানুষ জৈবিক প্রাণী। তাকে বাচিয়ে রাখতে হয়। তাকে খেতে হয় এবং নিশ্বাস নিতে হয়। তাকে শিক্ষা দিতে হয় এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তাদেরকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিলে তাদের মাঝে বিচ্ছিন্ন এক ধরনের আকর্ষণের সৃষ্টি হয় এবং দুটি ভিন্ন প্রজাতি তেইশটি করে ক্রমোজম দান করে নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়। মানুষের জীবন প্রক্রিয়া অত্যন্ত আদিম। সেটিকে রক্ষা না করলে তারা বেঁচে থাকতে পারবে না।

ক্লাউস ট্রিটন শান্ত গলায় বললেন, তা হলে তাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের খাদ্য নামক এক ধরনের জৈব পদার্থ সৃষ্টি করতে হবে। মহাকাশযানের বাতাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অক্সিজেনের অনুপাত নিশ্চিত করতে হবে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সীমিত রাখতে হবে।

প্রয়োজন হলে করতে হবে।

মহাকাশকেন্দ্রের পরিচালক একটু ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, এই মহাকাশযানটি তৈরি করা হাজার গুণ বেশি কঠিন হয়ে গেল মহামান্য ক্লাউস ট্রিটন।

সেটি সম্ভবত সত্যি।

ত্রাশিয়ান এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল, এবারে ক্লাউস ট্রিটনের অনুমতি নিয়ে বলল, মহামান্য ক্লাউস। এই মহাকাশযানটি মহাকাশে তার অনির্দিষ্ট যাত্রা শুরু করার কয়েক দশকের মাঝেই সকল মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

ক্লাউস ট্রিটন বললেন, আমি সে ব্যাপারে তোমার মতো নিশ্চিত নই।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত। মহাকাশযানের এনরয়েডরা যখন আবিষ্কার করবে নিনীষ স্কেলে বুদ্ধিমত্তা আট একধরনের জৈবিক প্রাণীকে রক্ষা করার জন্য মহাকাশকেন্দ্রের বিশাল শক্তিক্ষয় হচ্ছে তখন তারা সেই প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো অর্থ খুঁজে পাবে না। মহাকাশযানে মানবজাতি আবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

তবুও আমাদের এই মহাকাশযানের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ত্রাশিয়ান।

কেউ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। মহাকাশকেন্দ্রের পরিচালক তার যান্ত্রিক চক্ষুকে প্রসারিত করে বললেন, এই মহাকাশযানের নামকরণ কি করা হয়েছে মহামান্য ক্লাউস?

হ্যাঁ। আমরা এটিকে ডাকব মেতসিস।

মেতসিস? এর কি কোনো অর্থ আছে?

না। এখন এর কোনো অর্থ নেই। কিন্তু হয়তো কখনো এর একটি অর্থ হবে। মেতসিস শব্দটি হয়তো কোনো একটি বিশেষ প্রক্রিয়া হিসেবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে স্থান করে নেবে। এখন কেউ সেটি বলতে পারে না।

বিজ্ঞান একাডেমির সভা শেষে সবাই চলে গেলে ত্রাশিয়ান ক্লাউস ট্রিটনের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, মহামান্য ক্লাউস

বল।

এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। মানুষ তার দায়িত্ব পালন করেছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বুদ্ধিমত্তার জন্ম দিয়েছে। এখন সেই বুদ্ধিমত্তার পরিপূর্ণতা করতে হবে আমাদের। মানুষ আর। কখনো পারবে না।

তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ ত্রাশিয়ান। তবে—

তবে কী?

হয়তো বুদ্ধিমত্তাকে পরিপূর্ণ করা সৃষ্টিজগতের উদ্দেশ্য নয়। হয়তো সৃষ্টিজগতের উদ্দেশ্য

উদ্দেশ্য কী?

আমি জানি না।

ত্রাশিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনি জানেন, কিন্তু বলতে চাইছেন না!

বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি ক্লাউস ট্রিটন ত্রাশিয়ানের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।

 ০৩. রুখ গোল জানালাটি খুলতেই

রুখ গোল জানালাটি খুলতেই ভিতরে একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঢুকল। নিও পলিমারের কাপড়টি গায়ে জড়িয়ে সে বাইরে তাকাল, চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, কোথাও কোনো শব্দ নেই, কেমন জানি এক ধরনের মন–বিষণ্ণ–করা নীরবতা। রুখ মাথা বের করে উপরে তাকাল–উপরে মেতসিসের অন্য পাশে মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র, খুব ভালো করে লক্ষ করলে মাঝে মাঝে সেটা দেখা যায়। রুখ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল এবং হঠাৎ করে সেটা দেখতে পেল। সাথে। সাথে সে কেমন যেন শিউরে ওঠে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে আগামীকাল এই নিয়ন্ত্রণকক্ষে বুদ্ধিমান এনরয়েডদের মুখোমুখি হবে।

রুখ একটা নিশ্বাস ফেলে ঘরের ভেতরে মাথা ঢোকাতেই শুনতে পেল কেউ একজন দরজায় শব্দ করছে। রুখ এসে দরজা খুলতেই দেখতে পেল রুহান দাঁড়িয়ে আছে, একটু অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার রুহান, তুমি?

রুহান মধ্যবয়স্ক হাসিখুশি মানুষ, দীর্ঘদিন সে মানুষের এই আস্তানাটিতে কেন্দ্র পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছে। রুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, আমিও একই জিনিস জিজ্ঞেস করতে এসেছি! কী ব্যাপার তুমি

আমি কী?

তুমি এখনো ঘুমাও নি? কত রাত হয়েছে জান?

চেষ্টা করছিলাম, ঘুম আসছে না।

ভয় লাগছে?

অন্য কেউ হলে রুখ স্বীকার করত না কিন্তু রুহানের কাছে লুকানোর কিছু নেই, সে মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ

রুহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব ভালো লাগত যদি বলতে পারতাম ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু মিছে বলে লাভ কী? ব্যাপারটি আসলেই ভয়ের।

তুমি তো গিয়েছ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে–বুদ্ধিমান এনরয়েডদের দেখেছ, কেমন লাগে দেখতে?

আসলে বাইরে থেকে দেখে তো সেরকম কিছু বোঝা যায় না। চতুর্থ প্রজাতির প্রতিরক্ষা রোবট আর নিনীষ স্কেলে তিন কিংবা চার বুদ্ধিমত্তার এনরয়েডের বাইরে থেকে বিশেষ পার্থক্য নেই। তবে

তবে কী?

তুমি যখন ওদের সামনে দাঁড়াও হঠাৎ করে যখন মনে হয় পৃথিবীর সকল জীবিত মানুষ মিলে যে বুদ্ধিমত্তা ছিল এই যন্ত্রদের যে কোনো একটির মাঝে সেই একই বুদ্ধিমত্তা তখন কেমন যেন সমস্ত হাত–পা শীতল হয়ে যায়। যখন কথা বলে–_

ওদের গলার স্বর কী রকম?

আমাদের সাথে কথা বলার জন্য মানুষের কণ্ঠস্বরেই কথা বলে, সত্যি কথা বলতে কী গলার স্বর চমৎকার। কিন্তু গলার স্বরটি ব্যাপার নয়। ব্যাপার হচ্ছে তাদের ক্ষমতা কী রকম ক্ষমতা?

ওদের সামনে দাঁড়ালে বুঝতে পারবে তোমার নিজস্ব কোনো সত্তা নেই। তোমার সবকিছু ওরা জানে। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে ওরা সবকিছু বুঝে ফেলে। অনেক মানুষের সামনে উলঙ্গ করে ছেড়ে দিলে তোমার যেরকম লাগবে এটাও সেরকম। তবে এটা আরো ভয়ানক–এটা শারীরিক নগ্নতা নয়–এটা একেবারে নিজের ভিতরের নগ্নতা। কথা বলতে বলতে রুহান হঠাৎ কেমন জানি শিউরে উঠল।

রুখ জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি এমনিতেই ভয়ে ঘুমাতে পারছি –তুমি আরো ভয় দেখিয়ে দিচ্ছ।

রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি ভয় দেখাচ্ছি না, সত্যি কথা বলছি। ব্যাপারটি জানা থাকা ভালো–বিপদ কম হবে।

রুখ চিন্তিত মুখে বলল, তুমি যাদের দেখেছ তাদের বুদ্ধিমত্তা কত ছিল?

তিন কিংবা চার।

এর থেকে বড় বুদ্ধিমত্তার কিছু নেই?

আছে–তারা আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষের সামনে আসবে না। শুনেছি তারা দেখতেও অন্যরকম। হাত–পা নেই–শুধু কপোট্রন আর সেন্সর নিনীষ স্কেলে তারা এক কিংবা দুই।

এর থেকে উপরে কিছু নেই?

জানি না। যদি থাকে সেটা আমরা কখনো কল্পনা করতে পারব না। হয়তো অসংখ্য কপোট্রনের একটা অতিপ্রাকৃত সমন্বয়

রুখ কোনো কথা না বলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বুদ্ধিমত্তার এই যে স্কেল তুমি সেটা বিশ্বাস কর?

রুহান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সেটা নির্ভর করে বুদ্ধিমত্তাকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা কর তার উপর। তুমি যদি মনে কর পাইয়ের মান কয়েক ট্রিলিয়ন সংখ্যা পর্যন্ত বলে যাওয়া হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা তা হলে আমি নিনীষ স্কেলে বিশ্বাস করি। যদি মনে কর রেটিনার কম্পন দেখে নিউরনের সিনালের মাঝে সংযোগ স্থাপনের নিখুঁত হিসাব বলে দেওয়া হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা– যা তা হলেও আমি নিনীষ স্কেলে বিশ্বাস করি। কিন্তু

কিন্তু?

কিন্তু বুদ্ধিমত্তার অর্থ যদি হয় মিলিয়ন মিলিয়ন বছর টিকে থাকা তা হলে আমি জানি নিনীষ স্কেল সত্যিকারের স্কেল কি না। আমাদের কাছে তার কোনো প্রমাণ নেই।

রুহান

বল।

এই যে মেতসিস একটা বিশাল মহাকাশযান–অসংখ্য বুদ্ধিমান এনরয়েডদের সাথে আমরা মহাকাশে ভেসে যাচ্ছি, তোমার কি কখনো মনে হয় না এর প্রকৃত উদ্দেশ্য কী আমরা জানি না

রুহান হেসে বলল, এই ধরনের দার্শনিক তত্ত্বকথা নিয়ে আলোচনা করার সময় এটা নয়। তুমি ঘুমাও, আগামীকাল তোমার জন্য একটা কঠিন দিন, ঘুমিয়ে সুস্থ সতেজ হয়ে থাক।

রুখ দুর্বলভাবে হেসে বলল, কিন্তু ঘুমাতে পারছি না!

পারবে। মানুষের যেটি সবচেয়ে বড় দুর্বলতা সেটি আসলে তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। একটি অত্যন্ত কঠিন পরিবেশ থেকে এনরয়েড সরে আসতে পারে না, মানুষ পারে। রুখ একমুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, মানুষ ইচ্ছে করলে মারা যেতে পারে।

রুখ হো হো করে হেসে বলল, তুমি আসলে আমাকে মারা যাওয়ার লোভ দেখাচ্ছ?

খানিকটা দেখাচ্ছি!

রুহান! তা হলে তোমার আমাকে সাহস দিতে হবে না–আমি নিজেই ব্যবস্থা করে নেব।

রুহান রুখের কাঁধ স্পর্শ করে কোমল গলায় বলল, আমি জানি তুমি পারবে। আমি শুধু বলতে এসেছি তুমি কখনো একা নও–আমরা সবাই একসাথে আছি।

বিছানায় শুয়ে রুখ হঠাৎ করে ভাবল রুহান আসলে সত্যি কথাই বলেছে। আগামীকাল কী হবে জানে না কিন্তু যেটাই হোক সেটা তো মৃত্যু থেকে খারাপ কিছু হতে পারে না। আর মৃত্যু যে খুব খারাপ সেটি কি কেউ প্রমাণ করে দেখিয়েছে?

.

রুখ মানুষের বসতি থেকে বের হবার আগে তার সাথে অনেকে দেখা করতে এল। সবাই এমনভাবে কথা বলছিল যেন সে তাদের খাবার সংশ্লেষণযন্ত্রের বয়লার আনতে যাচ্ছে–যেন ব্যাপারটি খুবই স্বাভাবিক, যেন এটি একটি দৈনন্দিন ব্যাপার। মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে বুদ্ধিমান এনরয়েডদের সাথে দেখা করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই যে কেউ আর। কখনো ফিরে আসে না সেটি কেউ একবারও উচ্চারণ করল না। রুথ নিজেও পরিবেশটুকু স্বাভাবিক রাখল, হালকা রসিকতা করল, নিজের পোশাক নিয়ে কিছু মন্তব্য করল। একসময় রুহান রুখের পিঠে হাত দিয়ে বলল, রুখ রওনা দিয়ে দাও। অনেকদূর যেতে হবে।

হ্যা যাই। রুখ তখন ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রীনা, যাচ্ছি।

ক্রীনা, মেতসিসের সবচেয়ে তেজস্বী মেয়ে, যার জন্য রুখ সবসময় নিজের ভিতরে এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করে এসেছে–একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, সাবধানে থেকো।

রুখ একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, থাকব ক্রীনা। তার খুব ইচ্ছে করছিল সে একবার ক্রীনার মাথায় হাত বুলিয়ে তার চোখে চোখ রেখে কিছু একটা বলে–কিন্তু সে কিছু করল না। পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে গেট খুলে বের হয়ে এল। অনেকটা পথ তাকে হেঁটে যেতে হবে– পৃথিবীর অনুকরণ করে এখানে গাছপালা বনজঙ্গল পাথর ঝরনা তৈরি করা হয়েছে, হাঁটতে ভালোই লাগে। জৈবজগতের সীমারেখায় পৌঁছানোর পর কোনো একটি রোবটযান তাকে তুলে নেবে, তাকে সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে রুখ একবার পিছন ফিরে তাকাল, বসতির গেট ধরে ক্রীনা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, বাতাসে তার নিও পলিমারের কাপড় উড়ছে। কী বিষণ্ণ পুরো দৃশ্যটি! রুথ হঠাৎ ভিতরে ভিতরে শিউরে ওঠে, সত্যি যদি সে আর কখনো ফিরে না আসে? মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে এনরয়েডদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অনেকেই তো ফিরে আসে নি। সে যদি আর কখনো ক্রীনাকে দেখতে না পায়? রুখ বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিল।

পাহাড়ি পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুখ হাত দিয়ে আড়াল করে সূর্যের দিকে তাকাল, এখনো এটা দিগন্তের কাছাকাছি আছে, আরো কিছুক্ষণের মাঝে মাথার উপরে উঠে আসবে। রুখ তথ্যকেন্দ্রে দেখেছে পৃথিবী তার অক্ষের উপরে ঘুরত বলে সেখানে মনে হত সূর্য দিগন্তের একপাশ থেকে উদয় হয়ে অন্যপাশে অস্ত যাচ্ছে। মেতসিসেও অনেকটা সেরকম করার চেষ্টা করা হয়েছে। চৌম্বক ক্ষেত্রে একটা প্লাজমা আটকে রেখে সেখানে খুব নিয়ন্ত্রিত একটা থার্মোনিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চালু রাখা হয়েছে। সেটা ধীরে ধীরে একপাশ থেকে শুরু হয়ে অন্যপাশে হাজির হয়, মেতসিসের ভিতর থেকে মনে হয় বুঝি আকাশের এক প্রান্তে উদয় হয়ে অন্য পাশে সূর্য অস্ত গিয়েছে। পৃথিবীর মতো পুরো সময়টা কয়েকটা ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে, কোনো ঋতু উষ্ণ কোনো ঋতু শীতল। পৃথিবীর মতোই মাঝে মাঝে এখানে ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে, নির্দিষ্ট একটা সময়ে উপরে মেঘ জমা হয় এমনকি মাঝে মাঝে একপসলা বৃষ্টি পর্যন্ত হয়। শুধুমাত্র যে জিনিসটি এখানে নেই সেটি হচ্ছে আকাশ। পৃথিবীর মানুষ উপরে তাকালে দেখতে পেত আদিগন্তবিস্তৃত সীমাহীন নীল আকাশ। এখানে এক শ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বিশাল গোলকের মাঝে থেকে উপরের দিকে তাকালে আকাশ নয়– আবছা আবছাভাবে গোলকের অন্য পৃষ্ঠ, বুদ্ধিমান এরয়েডের বসতি দেখা যায়। মহাকাশব্যাপী বিশাল আদিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশের দিকে তাকাতে কেমন লাগে রুখ জানে না। তার ধারণা সেটি নিশ্চয়ই একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা যার কোনো তুলনা নেই। সে তথ্যকেন্দ্রে দেখেছে বুদ্ধিমান এনরয়েডদের বসতি থেকে মেতসিসের বাইরে, মহাকাশের দিকে তাকানো যায়, সেখানে নিকষ কালো অন্ধকার আকাশের নক্ষত্র–নীহারিকা দেখা যায়। যদি কখনো সুযোগ হয় কুখ নিশ্চয়ই একবার দেখবে সীমাহীন মহাকাশের দিকে একটিবার চোখ খুলে তাকিয়ে দেখতে না জানি কেমন অনুভূতি হবে!

রুখ পাহাড়ি পথে একটু উপরে উঠে আসে, পিছনে বহুদূরে মানুষের বসতিটি এখন গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। এই এলাকাটি খানিকটা সমতল, গাছপালা বলতে গেলে নেই, ভালো করে তাকালে মেতসিসের প্রযুক্তির চিহ্ন দেখা যায়। আরো খানিকটা সামনে এসে রুখ একটা খাড়া দেয়ালের কাছে দাঁড়াল। দেয়ালে বড় বড় করে লেখা জৈবজগতের সীমানা–তার নিচে একটু ছোট করে লেখা সীমানা অতিক্রম বিপজ্জনক।

রুখ দাঁড়িয়ে গেল, জৈবজগতের সীমানা অতিক্রম করা কেন বিপজ্জনক সেটি এখানে লেখা নেই কিন্তু রুখ জানে এই দেয়ালের ওপর দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী অবলাল লেজার রশ্মি চলে গিয়েছে। কেউ যদি নিজেঁ নিজে দেয়ালটি অতিক্রম করার চেষ্টা করে মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। জৈবজগৎটি এনরয়েডের জগৎ থেকে এত সাবধানে কেন আলাদা করে রাখা হয়েছে কে জানে।

রুখ এদিক–সেদিক তাকিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল, সূর্য ঠিক মাথার উপরে উঠে এসেছে এখন। নিও পলিমারের হুডটা মাথার উপর টেনে দিয়ে সে উপরের দিকে তাকাল এবং বহুদূরে বিন্দুর মতো স্কাউটশিপটাকে দেখতে পেল। প্রায়। নিঃশব্দে সেটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। ঠিক কেন জানে না কিন্তু রুখ হঠাৎ করে তার পেটের মাঝে বিচিত্র এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে।

০৪. আসবাবপত্রহীন ছোট একটি ঘরে

আসবাবপত্রহীন ছোট একটি ঘরে রুথ অপেক্ষা করছে। স্কাউটশিপের পাইলট–রসকসহীন, নির্লিপ্ত এবং কথা বলতে অনিচ্ছুক একটি রোবট তাকে এখানে পৌঁছে দিয়ে গেছে। রুখ ঘরের দেয়াল, ছাদ এবং মেঝে ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে একটা দরজা খুলে গেল এবং সেখানে প্রায় মানুষের আকৃতির একটা এনরয়েড উঁকি দিল। রুখের বুকের মাঝে হঠাৎ রক্ত ছলাৎ করে ওঠে–এইটি কি বুদ্ধিমত্তায় মানুষ থেকেও দুই কিংবা তিন মাত্রা উপরের স্তরের?

এনরয়েডটি ঘরের ভিতরে ঢুকে রুখের কাছাকাছি এসে অনেকটা যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বুদ্ধিমত্তায় উপরের স্তরের হলেও এনরয়েডটির চলাফেরার ভঙ্গিটি পুরোনো ধাচের। রুখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে থাকে, মাথার কাছে দুটি ফটোসেলের চোখ, সেখানে বুদ্ধিমত্তার কোনো চিহ্ন নেই।

এনরয়েডটি রুখের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের যান্ত্রিক গলায় বলল, তোমার কাপড় জামা খুলে টেবিলটাতে শুয়ে পড়।

কাপড়–জামা খুলে? মানে সবকিছু খুলে?

হ্যাঁ। এখানে আর কেউ নেই। তোমার লজ্জা পাবার কিছু নেই। আমি যন্ত্র। মানুষ যন্ত্রের সামনে লজ্জা পায় না।

রুখ কাপড় খুলতে খুলতে হঠাৎ লজ্জা নামক সম্পূর্ণ মানবিক এই ব্যাপারটি কীভাবে কাজ করে বোঝার চেষ্টা করল কিন্তু তার সময় পেল না। কারণ তার আগেই এনরয়েডটি শীতল হাত দিয়ে তার পাজরে স্পর্শ করে কিছু একটা দেখতে শুরু করেছে। রুখ কষ্ট করে নিজেকে স্থির রেখে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমরা পাইয়ের মান দশমিকের পর কত ঘর পর্যন্ত বলতে পার?

বারো।

বারো? রুখ অবাক হয়ে বলল, মাত্র বারো? আমিই তো বারো থেকে বেশি বলতে পারি!

আমার যে ধরনের কাজকর্ম করতে হয় তাতে দশমিকের পর বারো ঘরের বেশি প্রয়োজন হয় নি।

কিন্তু কিন্তু

কিন্তু কী?

আমি শুনেছি তোমরা কয়েক মিলিয়ন পর্যন্ত বলে যেতে পার।

ভুল শুনেছ। আমরা পারি না। এনরয়েডটি রুখকে ছোট একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, টেবিলটাতে শুয়ে পড়।

রুখ টেবিলটাতে শুয়ে পড়ে এনরয়েডটার দিকে তাকাল, সেটি উপর থেকে কিছু যন্ত্র নিচে টেনে নামাতে থাকে। রুখের বুকের উপর চতুষ্কোণ এবং মসৃণ একটি মনিটর বসিয়ে এনরয়েডটি বলল, তুমি এখন জোরে জোরে নিশ্বাস নাও।

রুখ কয়েকবার জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়, সাথে সাথে আশপাশে কয়েকটা যন্ত্রের ভেতর থেকে নিচু কম্পনের কিছু ভোঁতা শব্দ শুনতে পায়। এনরয়েডটি হেলমেটের মতো দেখতে একটি গোলাকার জিনিস তার মাথার মাঝে লাগাতে থাকে। রুখ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে এনরয়েডটি লক্ষ করতে করতে বলল, তুমি কী করছ?

মানুষের বসতি থেকে কেউ এলে তাদের পরীক্ষা করতে হয়। জিনেটিক মিউটেশান কী পর্যায়ে আছে সেটি লক্ষ রাখতে হয়। এগুলো রুটিন কাজ, তোমার ভয় পাবার কিছু নেই।

আমি–আমি আসলে ঠিক ভয় পাচ্ছি না–

পাচ্ছ। আমি জানি তোমার শরীরের সমস্ত অনুভূতি আমার সামনে মনিটরে দেখানো হচ্ছে। আমার কাছ থেকে তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। আমি তোমার মতো একজন।

আমার মতো?

হ্যা আমার বুদ্ধিমত্তা মানুষের সমান। নিনীষ স্কেলে আট।

তুমি তুমি এখানে কী করছ? আমি ভেবেছিলাম নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে সব এনরয়েড আমাদের থেকে বুদ্ধিমান।

না সবাই নয়। রুটিন কাজ করার জন্যে আমাদের মতো অনেকে আছে। এখন কথা বোলা না, তোমার প্রিয় কোনো জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে থাক।

কেন?

তোমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করা হচ্ছে।

মস্তিষ্ক কীভাবে স্ক্যান করে?

খুব সোজা। কিছু ইলেকট্রড তোমার করোটিকে স্পর্শ করে। উচ্চ কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ সেই ইলেকট্রড দিয়ে তোমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তার প্রতিফলিত আবেশ রেকর্ড করা হয়।

কী লাভ তাতে?

সেই স্ক্যান দেখে তোমার সম্পর্কে সবকিছু জানা যাবে। তুমি কী জান, তুমি কীভাবে চিন্তা কর সবকিছু।

কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?

তোমার কিংবা আমার জন্য সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু যাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে দুই মাত্রা উপরে তারা পারে। কাজেই তুমি কথা না বলে চুপ করে শুয়ে থাক। সুন্দর কিছু একটা ভাব।

রুখ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে রইল, একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি সত্যি বলছ?

হ্যাঁ। আমি মিথ্যা বলতে পারি না

এই যারা বুদ্ধিমান এনরয়েড, তারা–মানে তারা কী রকম?

তারা অসম্ভব বুদ্ধিমান। সত্যি কথা বলতে কী তুমি কিংবা আমি সেটা কল্পনা করতে পারব না। তুমি নিজেই দেখবে।

আমার কি কোনো বিপদ হতে পারে?

এনরয়েডটা কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। রুখ ভয়–পাওয়া গলায় বলল, কী হল? কথা বলছ না কেন?

বিপদ?

হ্যাঁ।

তুমি যদি স্বাভাবিক একজন মানুষ হও–তোমার চিন্তা–ভাবনা যদি খুব সাধারণ হয়, তোমার কোনো বিপদ নেই। কিন্তু যদি তোমার মাঝে কোনো অস্বাভাবিকতা থাকে তারা তোমাকে নিয়ে কৌতূহলী হতে পারে।

কৌতূহলী হলে তারা কী করে?

তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শেষবার একজনের মস্তিষ্ক খুলে দেখেছিল।

রুখ আতঙ্কে শিউরে উঠল, বলল, কী বলছ? এটা তো নিষ্ঠুরতা!

আমি যদি তোমার মস্তিষ্ক খুলে নিই সেটা হবে নিষ্ঠুরতা। বুদ্ধিমত্তায় যারা অনেক উপরে তাদের জন্যে এটা নিষ্ঠুরতা নয়। তুমি কি ল্যাবরেটরিতে ইঁদুর কেটে দেখ নি? সেটা কি নিষ্ঠুরতা ছিল?

কিন্তু

আর কথা নয়। চুপ করে শুয়ে থাক কিছুক্ষণ। তোমার প্রিয় কোনো জিনিসের কথা ভাব।

রুখের ক্রীনার কথা মনে পড়ল। তার কান, চোখ, কোমল ত্বক। সতেজ দেহ। তার নরম কণ্ঠস্বর। কুখ চোখ বন্ধ করে ক্রীনাকে দেখতে চাইল কিন্তু একটু পর পর তার মনোযোগ ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল–বুকের ভিতর এক অজানা আশঙ্কা কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

.

রুখ যে–ঘরটির ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বিশাল এবং গোলাকার। ঘরের দেয়াল ঈষৎ আলোকিত এবং অর্ধস্বচ্ছ কিন্তু দেয়ালের অন্যপাশে কী আছে সেটা দেখার কোনো উপায় নেই। রুখ দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে আবিষ্কার করেছে দেয়ালটি তার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। সম্ভবত তাকে ঘিরে কোনো দেয়াল নেই, সম্ভবত সে ছোট একটা

• প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে এবং সে হাঁটলে প্ল্যাটফর্মটি উলটোদিকে সরতে থাকে, কাজেই সে আসলে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে নড়তে পারে না। হয়তো আসলে এখানে কোনো ঘর নেই, পুরো ব্যাপারটি এক ধরনের দৃষ্টিবিভ্রম। হয়তো সে আসলে একটা ছোট অর্ধগোলকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, যার বাইরে থেকে কিছু বুদ্ধিমান এনরয়েড তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে দেখছে। কেউ তাকে লক্ষ করছে। অনুভূতিটি এত তীব্র যে রুখের মনে হতে থাকে অনেকে যেন নিচু গলায় কথা বলছে। কুখ তার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে কথা শোনার চেষ্টা করে। একটি–দুটি কথা সে শুনতে পায় কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না।

রুখ যখন কথা শোনার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখন কে যেন খুব কাছে থেকে বলল, মানব–সদস্য।

রুখ চমকে উঠল, কে?

আমি।

আমি কে?

তুমি আমাকে চিনবে না।

আপনি কি বুদ্ধিমান এনরয়েড?

কে যেন নিচু গলায় হাসল, বলল, বুদ্ধিমত্তা অত্যন্ত আপেক্ষিক ব্যাপার।

কিন্তু বুদ্ধিমত্তার একটি পরিমাপ তৈরি হয়েছে। সেই পরিমাপ অনুযায়ী আপনি সম্ভবত মানুষ থেকে বুদ্ধিমান।

সম্ভবত।

আমি মানুষ থেকে বুদ্ধিমান কোনো অস্তিত্ব কখনো দেখি নি। আমি কি আপনাকে দেখতে পারি?

মানুষ বুদ্ধিমত্তার যে পর্যায়ে আছে সেখানে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য আকৃতির একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। তুমি সম্ভবত আমার আকৃতিকে গ্রহণ করতে পারবে না।

আমি–আমি তবু একবার দেখতে চাইছিলাম।

ঠিক আছে।

খুব ধীরে ধীরে অর্ধগোলাকৃতির ঘরটির বাইরে আলোকিত হয়ে গেল এবং রুখ দেখতে পেল তার খুব কাছাকাছি একটি কদাকার এনরয়েড দাঁড়িয়ে আছে। এনরয়েডটি দেখতে অস্পষ্ট জ্বণের মতো, মানুষের অনুকরণে তৈরি ছোট একটি দেহের উপরে একটি বড় মাথা। মাথার ভিতর থেকে অনেকগুলি ছোট ছোট নল বের হয়ে শরীরের নানা জায়গায় প্রবেশ করেছে। মাথার ভিতরে শক্তিশালী কপোট্রনটিকে শীতল করার জন্য নিশ্চয়ই সেখানে কোনো ধরনের তরল প্রবাহিত হচ্ছে। এনরয়েডটির দুটি হাত, হাতের প্রান্তে আঙুলের মতো সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি। যে দুটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো শক্তিশালী এবং জটিল। এনরয়েডটির মাথার কাছে দুটি চোখ, রুথ সেদিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে, সেখানে এক ধরনের অমানুষিক দৃষ্টি। এনরয়েডটি নিচু গলায় বলল, আমি বলেছিলাম তুমি আমার আকৃতিকে গ্রহণ করতে পারবে না। আমার হিসাব অনুযায়ী তুমি আমাকে কদাকার এবং কুৎসিত মনে করছ।

না মানে

তাতে কিছু আসে–যায় না। প্রাণিজগতে অক্টোপাসকে বুদ্ধিমান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অক্টোপাস যদি বিবর্তনে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে গড়ে উঠত তারা সম্ভবত মানুষকে অত্যন্ত কুৎসিত প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করত।

আপনি ঠিকই বলেছেন মহামান্য—

আমার কোনো নাম নেই।

আপনি যদি অনুমতি দেন আমি আপনাকে কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?

কর।

আপনাদের দেহের আকৃতি মানুষের কাছাকাছি। পুরোপুরি মানুষের আকৃতি না নিয়ে তার কাছাকাছি কেন?

মানুষের আকৃতির যে সকল বিষয় উন্নত শুধু সেগুলো গ্রহণ করা হয়েছে।

মহামান্য এনরয়েড, আপনার ভিতরে কি মানুষের অনুভূতি আছে?

হ্যাঁ আছে। অনেক তীব্রভাবে আছে।

আপনার ভিতরে কি ক্রোধ, ঘৃণা বা হিংসা আছে?

হ্যাঁ আছে।

আমি ভেবেছিলাম বুদ্ধিমত্তা যখন বিকশিত হয় তখন মানুষের নিচু প্রবৃত্তিগুলো লোপ পায়।

এনরয়েডটি হঠাৎ হাসির মতো শব্দ করল, বলল, প্রবৃত্তি কখনো নিচু কিংবা উঁচু হয়। অস্তিত্বের জন্য প্রবৃত্তির প্রয়োজন আছে।

মহামান্য এনরয়েড, নিচু শ্রেণীর প্রাণীর তুলনায় আমাদের মাঝে অনুভূতি অনেক বেশি। সেরকমভাবে আমাদের তুলনায় আপনার মাঝেও কি অনুভূতি বেশি? যে অনুভূতি আমাদের নেই সেরকম কিছু কি আপনাদের আছে?

হ্যাঁ। আছে।

সেটি কী রকম মহামান্য এনরয়েড?

আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। তবে তুমি যদি আমার চোখের দিকে তাকাও তা হলে সেই অনুভূতিটির একটু তোমাকে অনুভব করাতে পারি। তুমি কি চাও?

রুখ ভয়ে ভয়ে বলল, আমি চাই মহামান্য এনরয়েড।

তা হলে আমার কাছে এস। আমার চোখের দিকে তাকাও।

রুখ এক পা এগিয়ে এনরয়েডটির দিকে তাকাল। এনরয়েডটির চোখের গভীরে হঠাৎ একটি বিশাল শূন্যতা উঁকি দিতে শুরু করে। হঠাৎ রুখ এক ভয়াবহ আতঙ্কে চিৎকার করে দুই হাতে নিজের চোখ ঢেকে ফেলে। সে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে যায়, তার সারা শরীর অনিয়ন্ত্রিতভাবে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

মানব–সদস্য এনরয়েডটি নরম গলায় বলল, তুমি সম্ভবত এখনো এই অনুভূতির সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও নি।

রুখ কোনোমতে নিজের পায়ের উপর উঠে দাঁড়াল। দুই হাতে মুখ ঢেকে বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, না, হই নি। এ ধরনের ভয়ঙ্কর শূন্যতার অনুভূতি আমাদের নেই।

আমরা এটিকে বলি বিস্থিতি। যখন স্থিতি হতে ইচ্ছে করে না সেটি হচ্ছে বিস্থিতি।

কী আশ্চর্য! এবং কী ভয়ঙ্কর!

মানব–সদস্য—

মহামান্য এনরয়েড, আমার নাম রুখ।

আমি জানি। তোমার সাথে পরিচয়পর্ব শেষ হয়েছে, আমরা কি এখন কাজ শুরু করতে পারি?

রুখ হঠাৎ করে নিজের ভিতরে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকে। সে। দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল, বলল, পারেন মহামান্য এনরয়েড।

তোমার মস্তিষ্কের স্ক্যানটি আমি দেখেছি। সেখানে কিছু দুর্বোধ্য তথ্য রয়েছে।

দুর্বোধ্য?

হ্যাঁ। দুর্বোধ্য এবং কৌতূহলী। তোমার ধারণা মেতসিসে মানুষের উপস্থিতির প্রয়োজন আছে। তুমি কেন এই ধারণা পোষণ কর?

মহামান্য এনরয়েড–পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব নেই। মেতসিসে পাঠানোর জন্য যদি মানুষের জিনস থেকে তাদেরকে নতুন করে সৃষ্টি করা না হত তা হলে আমাদের জন্ম হত না। আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী আমরা এখানে (কালি নি, এখানে আপনারা আমাদের এনেছেন।

হ্যাঁ। কিন্তু তোমরা এখানে বাহুল্য। তোমরা মেতসিসের জন্য একটি বিশাল সমস্যা। আমরা প্রায়ই মেতসিসের জৈবজগৎটি অবলুপ্ত করে দেওয়ার কথা ভাবি। তোমরা এখানে পুরোপুরি আমাদের করুণার উপরে বেঁচে আছ। কিন্তু তোমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জিনিস দেখতে পেয়েছি।

রুখ শুকনো গলায় বলল, কী দেখতে পেয়েছেন মহামান্য এনরয়েড?

দেখতে পেয়েছি তুমি বিশ্বাস কর মেতসিসে মানুষ না থাকলে তার উদ্দেশ্য অসম্পূর্ণ হত।

রুখ দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল। বলল, মহামান্য এনরয়েড, আপনি বলেছেন আপনাদের মানুষের মতো ক্রোধ এবং ঘৃণা রয়েছে। আমার কথা শুনে সম্ভবত আপনার মাঝে ক্রোধের সৃষ্টি হবে। আপনাদের অনুভূতি অত্যন্ত তীব্র হয়তো সেই ক্রোধ আমার ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনবে। সেই কথা চিন্তা করে আমি অত্যন্ত তীত মহামান্য এনরয়েড।

আমি জানি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। বুদ্ধিমত্তায় অত্যন্ত নিচু স্তরের অস্তিত্বের জন্য আমরা কখনো সমবেদনা অনুভব করতে পারি না। তোমাদের অস্তিত্বের আমার কাছে। কোনো মূল্য নেই। প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে আমি তোমাদের সৃষ্টি করতে পারি কিংবা ধ্বংস করতে পারি।

রুখ কদাকার এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল, মাথা নিচু করে বলল, আপনার কাছে আমার সুকানোর কিছু নেই। আপনি জানেন আমি কেন মেতসিসে মানুষের অস্তিত্বকে প্রয়োজনীয় মনে করি।

তুমি মনে কর আমাদের বুদ্ধিমত্তার উন্নতি খুব দ্রুত হচ্ছে, তার পরিণতি কী হবে জানা নেই।

হ্যাঁ মহামান্য এনরয়েড। সেই তুলনায় মানুষের উন্নতি হয়েছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। বিবর্তন পরীক্ষিত একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কোনো ঝুঁকি নেই। মেতসিস কোথায় পৌঁছাবে আমরা জানি না কিন্তু মানুষকে এখানে রাখা হলে তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা সেখানে পৌঁছে দেবে।

বুদ্ধিমান এনরয়েডটি হঠাৎ খলখল করে হেসে উঠল, হাসতে হাসতে বলল, তোমার জন্য আমার করুণা হচ্ছে মানব–সন্তান।

রুখ আতঙ্কে শিউরে উঠে বলল, কেন মহামান্য এনরয়েড?

তোমার বিশ্বাস যে কত ভিত্তিহীন সেটা তুমি জান না।

কেন আপনি এটা বলছেন মহামান্য এনরয়েড। মানুষ যে–বিবর্তনের মাঝ দিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সেটি তো ভিত্তিহীন তথ্য নয়।

কিন্তু মেতসিসে তোমরা বিবর্তনের মাঝ দিয়ে যাবে সেটি সত্য নয়।

আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।

তুমি আমার সাথে এস। আমি তোমাকে একটি জিনিস দেখাই। তবে

তবে কী?

তুমি যে জিনিসটি দেখবে সেটি তুমি অন্য মানব–সদস্যকে বলতে পারবে না।

রুখের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে কাঁপা গলায় বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

তুমি যেন বলতে না পার সে জন্য আমি তোমার অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দেব।

না। রুখ কাতর গলায় বলল, না। তাহলে আমি দেখতে চাই না।

তোমাকে দেখতে হবে। এনরয়েডটি অত্যন্ত কঠোর গলায় বলল, স্বল্প বুদ্ধিমত্তার প্রাণীদের জন্য অহঙ্কার অত্যন্ত বিপজ্জনক।

রুখ অনুনয় করে বলল, মহামান্য এনরয়েড, আমি আপনার কাছে আমার প্রাণ ভিক্ষা চাইছি।

আমি তোমাকে বলেছি মানব–সদস্য। নির্বোধ প্রাণীদের জন্য আমাদের ভিতরে কোনো সমবেদনা নেই। তুমি কি কখনো অবলীলায় নিচু স্তরের প্রাণী হত্যা কর নি? করেছ। আমরাও করি। এস।

» ০৫. মেতসিসের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রটি

মেতসিসের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রটি বিশাল, সেখানে বুদ্ধিমান এনরয়েডরা থাকে বলে পুরো এলাকাটি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছে। নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য বিশাল করিডোর রয়েছে, এই সকল করিডোরে চৌম্বক–ক্ষেত্র ব্যবহার করে ভাসমান অবস্থায় বুদ্ধিমান এনরয়েড কিংবা তাদের যন্ত্রপাতিগুলো আসা–যাওয়া করছে। রুখ অনুমান করল করিডোরের নিচে সম্ভবত সুপার কন্ডাক্টিং কয়েল রয়েছে, তাপ–নিরোধক ব্যবস্থা থাকার পরও সুপার কন্ডাক্টরগুলো পুরো করিডোরকে হিমশীতল করে রেখেছে। রুথ একটি ভাসমান প্ল্যাটফর্ম করে বুদ্ধিমান এনরয়েডটার সাথে সাথে মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের গভীরে এসে উপস্থিত হয়েছে। এই এলাকায় মানুষ সম্ভবত কখনোই আসে না, কোথাও খুব ঠাণ্ডা আবার কোথাও উষ্ণ। বাতাসের চাপেরও তারতম্য রয়েছে বলে মনে হল।

নানা করিডোর ধরে এগিয়ে গিয়ে বুদ্ধিমান এনরয়েডটি রুখকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি বিশাল হলঘরের মতো জায়গায় হাজির হল। বোতাম চেপে ভারী দরজাটি সরিয়ে রুখ ভিতরে ঢুকে হঠাৎ করে আতঙ্কে শিউরে ওঠে। ভিতরে যতদূর দেখা যায় মানুষের দেহ। হিমশীতল ঘরটিতে হালকা নীল আলোতে সারি সারি মানুষের দেহগুলো দেখে রুখের প্রথমে মনে হল এগুলো মৃতদেহ। কিন্তু একটু ভালো করে তাকিয়েই বুঝতে পারল মানুষগুলো। জীবন্ত, নিশ্বাসের সাথে সাথে তাদের বুক ওঠা–নামা করছে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয়। মানুষগুলো শূন্যে ভেসে আছে কিন্তু একটু ভালো করে দেখলেই টাইটেনিয়ামের সূক্ষ্ম তার, শিরায় প্রবাহিত পুষ্টিকর তরলের টিউব এবং অক্সিজেনের প্রবাহ চোখে পড়ে। মানুষগুলো পুরোপুরি নগ্ন এবং ঘুমন্ত। শূন্যে ঝুলে থাকা এই মানুষগুলোর মাঝে অল্প কয়েকজন শিশু এবং কিশোর–কিশোরী, তবে বেশিরভাগই তরুণ–তরুণী।

রুখ কিছুক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে থেকে ভয়–পাওয়া–গলায় বলল, এরা কারা?

এনরয়েডটি একটু রহস্যের মতো ভঙ্গি করে বলল, তুমিই বল।

আমি? আমি কেমন করে বলব?

তুমি পারবে। যাও, মানুষগুলোকে ভালো করে দেখে আস। চতুর্থ সারির তৃতীয় মানুষটি দেখ। সপ্তম সারির শেষ মানুষটিও দেখ। যাও।

রুখ হতচকিত হয়ে ঘুমন্ত মানুষগুলোর মাঝে দিয়ে হেঁটে যেতে থাকে, তার মনে হতে থাকে হঠাৎ করে বুঝি কেউ জেগে উঠে তার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে। কিন্তু কেউ জেগে উঠল না, নিশ্বাসের সাথে খুব হালকাভাবে বুক ওঠা–নামা করা ছাড়া তাদের মাঝে জীবনের আর কোনো চিহ্ন নেই।

চতুর্থ সারির তৃতীয় মানুষটি একজন তরুণী। ঘুমন্ত একজনের নগ্ন দেহের দিকে তাকাতে রুখের সংকোচ হল কিন্তু মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। তরুণীটি ক্রীনা।

রুখ কয়েক মুহর্তে হতবাক হয়ে ক্রীনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে হঠাৎ করে অনেক কিছু তার কাছে স্পষ্ট হয়ে আসে। সে পাশের ঘুমন্ত মানুষটির দিকে তাকাল, এই মানুষটিও

সে চেনে, মানুষের বসতিতে সে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ করে। ওপরে যে ঝুলে। রয়েছে সে কমিউনির তথ্যকেন্দ্র–পরিচালক। পাশের সারিতে রুহান শান্ত চোখে ঘুমিয়ে আছে। সপ্তম সারির শেষ মানুষটি কে হবে সেটাও রুখ হঠাৎ করে বুঝে গেল, তবুও সে হেঁটে গেল নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য। রুখ অবাক হয়ে দেখল মানুষটি সে নিজে। টাইটেনিয়ামের সূক্ষ্ম তার দিয়ে তাকে ওপর থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নাকের মাঝে সূক্ষ্ম অক্সিজেনের টিউব। হাতের শিরায় সূক্ষ্ম টিউবে করে পুষ্টিকর তরল প্রবাহিত হচ্ছে। মাথার মাঝে থেকে কিছু ইলেকট্রড বের হয়ে এসেছে।

রুখ কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর ক্লান্ত পায়ে বুদ্ধিমান এনরয়েডটির কাছে ফিরে এল। এনরয়েডটি হালকা গলায় বলল, তুমি নিশ্চয় এখন জান এরা কারা।

রুখ মাথা নাড়ল, জানি।

তুমি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ কেন এদেরকে এখানে রাখা হয়েছে?

হ্যা পারছি।

তুমি কি এখনো বিশ্বাস কর মেতসিসে মানুষের বিবর্তন হবে?

রুখ মাথা নাড়ল, না।

বুদ্ধিমান এনরয়েডটি খলখল করে হেসে উঠল, বলল, জৈবিক পদ্ধতি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তোমরা নতুন মানুষের জন্ম দেবে সেই মানুষ মেতসিসে জৈবজগতের দায়িত্ব নেবে আমরা সেই ঝুঁকি নিতে পারি না। তাই মানুষের এক দল তার দায়িত্ব শেষ করার পর তাদের আমরা অপসারণ করে ফেলি, নতুন একটি দল এসে তার দায়িত্ব নেয়।

পুরোনো দলকে তোমরা কীভাবে অপসারণ কর?

বাতাসের প্রবাহে সঠিক পরিমাণ কার্বন মনোঅক্সাইড মিশিয়ে দিয়ে। তুমি জান মানুষ অত্যন্ত দুর্বল প্রাণী, তাদের হত্যা করা খুব সহজ।

মেতসিসে আমাদের মতো কয়টি দল এসেছে?

আজ থেকে সাড়ে সাত শ বছর আগে মেতসিস এই গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। প্রতি পনের বছরে আমরা একবার করে তোমাদের নতুন করে সৃষ্টি করেছি।

তার মানে এর আগে পঞ্চাশবার আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?

হ্যাঁ। পঞ্চাশবার সৃষ্টি করে পঞ্চাশবার ধ্বংস করা হয়েছে।

যখন এদের নতুন করে সৃষ্টি করা হয় তখন এদের স্মৃতিতে কী থাকে?

তুমি জান কী থাকে। তোমাকেও একদিন সৃষ্টি করা হয়েছিল।

রুখ হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল–তার শৈশব তার কৈশোর তার যৌবনের সকল স্মৃতি আসলে মিথ্যা? আসলে এইভাবে তার শীতল দেহকে ধীরে ধীরে বড় করা হয়েছে? এইভাবে তার মস্তিষ্কে মিথ্যা কাল্পনিক একটা স্মৃতি প্রবেশ করানো হয়েছে? মায়ের কোলে বসে বসে সে বাইরে তাকিয়ে আছে, মা মিষ্টি সুরে গান গাইছে–সব মিথ্যা?

রুখ একটি নিশ্বাস ফেলল, হঠাৎ করে তার কাছে তার পুরো জীবন, এই মহাকাশযান, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কদাকার এনরয়েড, বিশাল হলঘরে সারি সারি ঝুলে থাকা মানুষের দেহ সবকিছুকে কেমন জানি অর্থহীন বলে মনে হতে থাকে।

মানব–সদস্য এনরয়েডটি রুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি খুব বেশি জেনে গিয়েছ।

আমি জানতে চাই নি।

কিন্তু তুমি জেনেছ। এই তথ্য নিয়ে তুমি মানববসতিতে ফিরে যেতে পারবে না।

রুখ অন্যমনস্কভাবে এনরয়েডটির দিকে তাকাল, তাকে এখন মেরে ফেলা হবে ব্যাপারটিও কেন জানি আর সেরকম গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না।

মানব–সদস্য–আমি যতদূর জানি মৃত্যুকে তোমরা খুব ভয় পাও।

পাই।

তোমার স্মৃতিতে ক্রীনা নামের একটি মেয়ের রূপ অনেকবার এসেছে।

রুখ কোনো কথা না বলে কদাকার এনরয়েডটির দিকে তাকাল। এনরয়েডটি হাসির মতো শব্দ করে বলল, তোমার মৃত্যুর খবরে সে নিশ্চয়ই খুব বিচলিত হবে।

রুখ এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে রইল, মানুষ থেকে বুদ্ধিমত্তায় অনেক উন্নত হলেই কি তাদেরকে মানুষ থেকে অনেক বেশি নিষ্ঠুর হতে হবে?

তোমার মৃত্যুর খবরে তার মস্তিষ্কে কী ধরনের চাঞ্চল্য হয় দেখার একটু কৌতূহল হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী যদি সুযোগ থাকত আমি ক্রীনাকে এনে তার সামনে তোমাকে হত্যা করতাম

হঠাৎ করে রুখের মনে হল তার মস্তিষ্কে একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে। সে হিংস্র চোখে এনরয়েডটির দিকে তাকাল, দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, মহামান্য এনরয়েড, আপনি সম্ভবত বুদ্ধিমত্তায় আমার থেকে দুই মাত্রা উপরে কিন্তু আপনার কৌতূহলটুকু আমার কাছে দুই মাত্রা নিচের এক ধরনের অসুস্থতা বলে মনে হচ্ছে।

এনরয়েডটি রুখের দিকে ঘুরে তাকাল, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে এক ধরনের শীতল কণ্ঠে বলল, মানব–সদস্য, তুমি নিশ্চয়ই তোমার অবস্থানটুকু জান। আমি তোমার চোখের রেটিনার দিকে তাকিয়ে তোমার মস্তিষ্কের সকল নিউরনকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারি!

রুখ হঠাৎ চিৎকার করে বলল, আমি কি সেটাকে ভয় পাই?

পাও না?

না। বুদ্ধিমত্তার কোন স্তরে কে থাকে তাতে কিছু আসে–যায় না, যার বুকের ভিতরে কোনো ভালবাসা নেই তার সাথে দানবের কোনো পার্থক্য নেই। মানুষ দানবকে ঘেন্না করে, ভয় পায় না।

আহাম্মক! এনরয়েডটি চিৎকার করে বলল, তোমার মতো শত শত মানুষকে আমরা কীটপতঙ্গের মতো পিষে ফেলি

হঠাৎ করে রুখ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। মাথা ঘুরিয়ে দেয়ালের সাথে লাগানো একটি টাইটেনিয়াম রড হ্যাঁচকা টানে খুলে নেয়। তারপর দুই হাতে ধরে সে এনরয়েডটির দিকে এগিয়ে গেল। দাতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, মানুষকে হত্যা করতে চাইলে করতে পার–কিন্তু তাকে তার প্রয়োজনীয় সম্মানটুকু দিতে হবে।

এনরয়েডটি এক পা পিছিয়ে বলল, খবরদার! তার শরীর থেকে হঠাৎ তীব্র অবলাল রশি এসে রুখকে আঘাত করল–রুখ প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে অন্ধ আক্রোশে হাতের রডটি দিয়ে এনরয়েডটির মাথায় আঘাত করল। এনরয়েডটি সরে যাওয়ায় আঘাতটি লাগল মাথা থেকে বের হয়ে আসা একটি টিউবে। হঠাৎ করে টিউবটি মাথা থেকে খুলে আসে এবং তার ভেতর থেকে গলগল করে আঠালো সবুজ রঙের এক ধরনের তরল বের হতে থাকে। ঝাজালো গন্ধে হঠাৎ ঘরটা ভরে গেল।

এনরয়েডটি আর্তচিৎকার করে বলল, আমার তরল! আমার কপোট্রন শীতলকারী তরল!

রুখ হতচকিত হয়ে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে রাগে অন্ধ হয়ে এনরয়েডটিকে আঘাত করেছে সত্যি কিন্তু তার আঘাত যে সত্যি সত্যি মানুষের থেকে দুই মাত্রা বেশি বুদ্ধিমান একটি যন্ত্রের কোনো ক্ষতি করতে পারবে সেটি সে একবারও বিশ্বাস করে নি। এনরয়েডটি একবার দুলে উঠে পড়ে যেতে যেতে সেটি কোনোভাবে নিজেকে সামলে নেয়। এনরয়েডটির মাথার একটি অংশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। উত্তপ্ত অংশটি হঠাৎ গনগনে লাল হয়ে ওঠে এবং এনরয়েডটি দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে আর্তচিৎকার করে ওঠে, আমার স্মৃতি আমার স্মৃতি–আহা—হা-হা–আমার স্মৃতি

রুখ হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল এবং হঠাৎ করে এনরয়েডটির পুরো মাথাটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। মাথার অংশটি থেকে কিছু পোড়া টিউব, তার এবং ফাইবার বের হয়ে ঝুলে থাকে, ফিনকি দিয়ে থিকথিকে এক ধরনের তরল বের হতে থাকে এবং এনরয়েডটির দুটি অপুষ্ট হাত কিলবিল করে নড়তে থাকে। সমস্ত ঘরটি এক ধরনের বিষাক্ত গন্ধে ভরে যায় এবং দূরে কোথাও তারস্বরে এলার্ম বাজতে শুরু করে। পুরো দৃশ্যটিকে রুখের কাছে একটি অতিপ্রাকৃতিক দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়।

কয়েক মুহূর্তের মাঝে ঘরটির মাঝে অসংখ্য রোবট এবং এনরয়েড এসে হাজির হল। যান্ত্রিক রোবটগুলো বিধ্বস্ত এনরয়েডকে সরিয়ে নিয়ে যায়, বিশেষ নিরাপত্তা রোবট ঘরটিকে পরিশোধন করতে থাকে। নিরাপত্তা রোবট রুখের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, দেখে বোঝা গেলেও এই রোবটগুলো নিশ্চয় সশস্ত্র, হাতে ধরে রাখা টাইটেনিয়াম রডটি একটু নাড়ালেই সম্ভবত তাকে বাষ্পীভূত করে ফেলবে।

মানব–সদস্য রুখের সামনে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বুদ্ধিমান এনরয়েড বলল, তুমি তোমার হাতে ধরে রাখা টাইটেনিয়াম রডটি নিচে ফেলে দাও।

কেন?

তুমি সম্ভবত এর আঘাতে আমাদের অন্য কোনো একজনকে বিধ্বস্ত করতে পারবে যদিও সেটি সেরকম গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ আমাদের সকলের সকল স্মৃতি মূল তথ্যকেন্দ্রে সংরক্ষিত থাকে এবং আমরা কিছুক্ষণের মাঝেই নিজেদের পুনর্বিন্যাস করতে পারি।

তার মানে তার মানে–

না। মানুষকে হত্যা করার মতো এটি অপরিবর্তনীয় ঘটনা নয়। কিন্তু তবুও সে ধরনের কাজে আমরা উৎসাহ দিই না। বিশেষ করে তোমার ঠিক পিছনে যে নিরাপত্তা রোবট দাঁড়িয়ে আছে সেটি অত্যন্ত ক্ষিপ্র। তোমার যে কোনো ধরনের নড়াচড়াকে সেটি বিপজ্জনক। মনে করে তোমাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে।

রুখ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমাকে তো মেরেই ফেলবে। মানুষ কখনো মুখ বুজে অবিচার সহ্য করে না। শেষমুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে। আমি এই টাইটেনিয়াম রডটি ফেলব না। কেউ আমার কাছে এলে এক আঘাতে–

বুদ্ধিমান এনরয়েডটি হঠাৎ হাসির মতো শব্দ করে বলল, তোমাদের কিছু কিছু মানবিক অনুভূতি অত্যন্ত ছেলেমানুষি। কাছে না এসেই তোমাদের ধ্বংস করে দেওয়া যায়। তুমি কী চাও?

আমি মানুষের বসতিতে ফিরে যেতে চাই।

ঠিক আছে তুমি ফিরে যাবে।

রুখ থতমত খেয়ে বলল, আমি জীবিত অবস্থায় ফিরে যেতে চাই।

ঠিক আছে তুমি জীবিত অবস্থায় ফিরে যাবে।

রুখ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বুদ্ধিমান এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে রইল–সেটি কি সত্যি কথা বলছে?

হ্যাঁ, আমি সত্যি কথা বলছি। তোমাদের কাছে জীবন–মৃত্যু খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাছে নয়। তুমি বেঁচে থাকলে বা মারা গেলে আমাদের কিছু আসে–যায় না। সত্যি কথা বলতে কী তুমি যে ঘটনাটি ঘটিয়েছ আমি সেটা একটু বিশ্লেষণ করতে চাই। সে জন্য আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। এর বেশি কিছু নয়।

কিন্তু—

হ্যাঁ। রুখ কথাটি বলার আগেই এনরয়েড প্রতিবার তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে, এই ঘরের তথ্যটুকু তুমি নিতে পারবে না। তোমার স্মৃতি থেকে এই তথ্যটুকু আমরা মুছে দেব।

সেটি কি করা যায়? শুধুমাত্র একটি স্মৃতি একটি বিশেষ স্মৃতি?

হ্যাঁ। করা যায়। তুমি তোমার হাত থেকে টাইটেনিয়াম রডটি ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আস।

রুখ বুদ্ধিমান এনরয়েডটির দিকে তাকাল, সেটি কি তার সাথে কোনো ধরনের প্রতারণা করার চেষ্টা করছে?

এনরয়েডটি আবার হেসে ফেলল, বলল, না। আমি তোমার সাথে প্রতারণা করব না। বিশ্বাস কর তোমার সাথে সাধারণ কথাবার্তা চালিয়ে যেতেই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার কথা যদি বিশ্বাস না কর মানববসতিতে ফিরে গিয়ে একটা পোষা প্রাণীর সাথে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করে দেখ। বুদ্ধিমত্তা একপর্যায়ের না হলে ভাব বিনিময় করা যায় না।

রুখ হাত থেকে টাইটেনিয়াম রডটি ছুঁড়ে ফেলল। এনরয়েডটি বলল, চমৎকার। এবারে তুমি আরেকটু কাছে এগিয়ে এস। তোমার চোখের দিকে তাকাতে হবে–তুমি নিশ্চয়ই জান রেটিনা আসলে মস্তিষ্কের একটা অংশ। মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য এটি সবচেয়ে সহজ উপায়।

রুখ এনরয়েডটির কাছে এগিয়ে যায়, এনরয়েড তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই ঘরে কী দেখেছ মানব–সন্তান।

আমি দেখেছি মানববসতির সব মানুষকে তৈরি করে বড় করা হচ্ছে।

কেন?

আমরা যারা আছি তাদের যখন দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে তখন তাদের সবাইকে সরিয়ে দিয়ে

তুমি কথা বলতে থাক।

রুখ কথা বলতে থাকে কিন্তু তার অবচেতন মন হঠাৎ একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক খেলায় মেতে ওঠে। এই শীতল ঘরের তথ্যটি সে তার মস্তিষ্কে করে গোপনে নিয়ে যেতে চায়। কীভাবে নেবে সে জানে না, অন্য কোনো তথ্যের সাথে যদি মিশিয়ে দেওয়া যায়? যদি সে কল্পনা করে সে একটি শিশু সে তার মায়ের হাত ধরে ঘুরছে। মায়ের সাথে একটা বিশাল ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দরজ ধাক্কা দিতেই সেই দরজা খুলে গেল, তার মা চিৎকার। করে উঠল। রুখ ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা?

মা বলল, চোখ বন্ধ করে ফেল, রুখ। চোখ বন্ধ কর—

কেন মা? কী হয়েছে?

ভয় পাবি। তুই দেখলে ভয় পাবি।

কী দেখলে ভয় পাব?

মানুষ। শত শত মানুষকে ঝুলিয়ে রেখেছে।

কোন মানুষ এরা?

মানববসতির মানুষ।

মা, এরা কি মৃত?

না বাবা। এরা সব ঘুমিয়ে আছে।

কেন ঘুমিয়ে আছে?

জানি না। কিন্তু একদিন জেগে উঠবে–কিন্তু সেটি হবে খুব ভয়ঙ্কর

কেন ভয়ঙ্কর মা? কেন?

আমি জানি না জানি না

মা হঠাৎ আর্তচিৎকার করতে থাকে, রুখের চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে নিরাপত্তা রোবটটি তাকে ধরে ফেলল।

বুদ্ধিমান এনরয়েডটি খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রুখের অচেতন দেহের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মানুষের বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত যথার্থ নিরূপণ করা হয় নি।

কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অন্য একটি এনরয়েড বলল, তুমি কেন এই কথা বলছ?

জানি না। আমার স্পষ্ট মনে হল এই মানুষটি—

এই মানুষটি?

এই মানুষটি আমাকে লুকিয়ে কিছু একটা জিনিস করল।

তোমাকে লুকিয়ে?

হ্যাঁ। যখন তার স্মৃতি মুছে ফেলছি তার নিউরনকে মুক্ত করছি তখন মনে হল অন্য কোথাও সে নিউরনকে উজ্জীবিত করছে–

সেটি কীভাবে সম্ভব?

এনরয়েডটি হেসে ফেলল, বলল, জানি না।

০৬. হলঘরটিতে মানুষের বসতি

হলঘরটিতে মানুষের বসতির প্রায় সবই এসেছে। খাওয়ার পর আজকে বিশেষ পানীয় সরবরাহ করা হয়েছে, পানীয়তে কয়েক মাত্রা উত্তেজক এনজাইম ছিল তাই যারা উপস্থিত আছে তাদের সবাই হইচই করছে, অল্পতেই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে বা আনন্দে চ্যাঁচামেচি করছে। হইচইয়ের মাত্রা যখন একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে গেল তখন রুহান তার পানীয়ের গ্লাস টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল, সাধারণত এরকম পরিস্থিতিতে সবাই শান্ত হয়ে যায়, যিনি দাঁড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তার কী বলার আছে শোনার জন্য সবাই খানিকটা সময় দেয়। আজকে তার কোনো সম্ভাবনা দেখা গেল না। তাই রুহানকে টেবিলে কয়েকবার থাবা দিয়ে শব্দ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হল, যখন হইচই একটু কমে এল তখন রুহান উচ্চৈঃস্বরে বলল, প্রিয় মানববসতির সদস্যরা, সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।

এটি অত্যন্ত সাদামাঠা সম্ভাষণ কিন্তু উত্তেজক এনজাইমের কল্যাণে সবার কাছে এই সম্ভাষণটিকেই এত হৃদয়গ্রাহী মনে হল যে সবাই চিৎকার করে হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিল।

তোমরা জান–রুহান গলা উচিয়ে বলতে চেষ্টা করে, আজকে আমরা এখানে একটি বিশেষ কারণে উপস্থিত হয়েছি। আমাদের মানববসতির উন্নয়ন পরিষদের নবীন সদস্য রুখ আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। রুহানকে এই সময় একটু থামতে হল কারণ। উপস্থিত সবাই রুখকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য বিকট গলায় চঁচামেচি করতে শুরু করল। অতি উৎসাহী কয়েকজন তরুণ–তরুণী আরো একধাপ এগিয়ে রুখকে টেবিলের উপর টেনে তোলার চেষ্টা করছিল কিন্তু রুথ বেশ কষ্ট করে নিজেকে মুক্ত করে মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। রুহান হাত তুলে সবাইকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি জানি এটি আমাদের সবার জন্য খুব আনন্দের ব্যাপার—এর আগে আমরা এভাবে আমাদের। প্রিয়জনকে হারিয়েছি। তারা বুদ্ধিমান এনরয়েডদের সাথে দেখা করার জন্য মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে গিয়ে আর ফিরে আসে নি। আমরা লক্ষ করেছি আমাদের মাঝে যারা বেশি প্রাণবন্ত যারা বেশি বুদ্ধিমান তারা সাধারণত আর ফিরে আসে না–সে কারণে আমরা রুখকে নিয়ে। খুব বেশি দুশ্চিন্তিত ছিলাম। যা–ই হোক–সে সুস্থ দেহে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে, আজ আমাদের খুব আনন্দের দিন। আমি সবার পক্ষ থেকে রুখকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি।

রুখ রুহানের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় তার কেন জানি মনে হতে থাকে রুহানের এই কথাগুলোর মাঝে যেন কী একটা অসঙ্গতি রয়েছে কিন্তু সেটা কী সে ঠিক ধরতে পারে না। রুখ অসঙ্গতিটা কোথায় বোঝার চেষ্টা করছিল। তাই ঠিক লক্ষ করে নি যে সমবেত সবাই চিৎকার করে তাকে ডাকছে, তাকে কিছু একটা বলতে বলছে। ক্রীনা তার পাজরে খেচা দিয়ে ডাকল, রুখ

কী হল?

তুমি কিছু একটা বল।

আমি?

হ্যাঁ–দাঁড়াও।

রুখ তার জায়গায় দাঁড়িয়ে কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, তোমরা সবাই জান যারা বুদ্ধিমান এবং প্রাণবন্ত সাধারণত তারা বুদ্ধিমান এনরয়েডদের কাছে গেলে আর ফিরে আসে না। দেখতেই পাচ্ছ আমি ফিরে এসেছি কাজেই আমি নিশ্চয়ই বোকা এবং অলস।

উপস্থিত সবাই উত্তেজক পানীয়ের কারণে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করে, রুখ সবার হাসির দমক কমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু যদি আমাকে তোমরা জিজ্ঞেস কর তুমি কি বুদ্ধিমান এবং প্রাণবন্ত হয়ে মারা যেতে চাও নাকি বোকা এবং অলস হয়ে বেঁচে থাকতে চাও–আমি তা হলে বলব বোকা এবং অলস হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

সবাই আবার হাসতে শুরু করে এবং রুখের হঠাৎ মনে হতে থাকে সে এইমাত্র যে কথাটি বলল তার মাঝে কিছু একটা অসঙ্গতি আছে। অসঙ্গতিটি কী সে মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারে না। রুখ আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায় এবং প্রায় অন্যমনস্কভাবেই নিচু গলায় বলল, আমরা মানুষেরা সম্ভবত খুব গুরুত্বপূর্ণ।

উপস্থিত অনেকে কথাটিকে একটি রসিকতা হিসেবে নিয়ে হেসে ওঠে কিন্তু রুখ তাদের হাসিকে উপেক্ষা করে নেহায়েত অপ্রাসঙ্গিকভাবে গলায় অনাবশ্যক গুরুত্ব আরোপ করে বলল, আমি যতই চিন্তা করি ততই নিশ্চিত হতে থাকি যে মেতসিসে আমাদের অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রীনা একটু অবাক হয়ে বলল, কেন? তুমি একথা কেন বলছ?

যেমন মনে কর অক্সিজেনের কথা–পৃথিবীতে অক্সিজেনের মতো ভয়ঙ্কর গ্যাস খুব কম রয়েছে। যে কোনো পদার্থ অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে অক্সিডাইজড হয়ে যায়। যন্ত্রপাতি মরচে ধরে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আমরা–মানুষেরা অক্সিজেন ছাড়া এক মিনিট বাচতে পারি না। তাই শুধুমাত্র আমাদের জন্য মেতসিসের বাতাসে শতকরা কুড়ি ভাগ অক্সিজেন ভরে দেওয়া হয়েছে। চিন্তা করতে পার এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে যত এনরয়েড, রোবট, যন্ত্রপাতি আছে তাদের কী দুর্দশা হচ্ছে? তবু তারা সেটা সহ্য করে যাচ্ছে। একদিন নয় দুদিন নয় বছরের পর বছর শতাব্দীর পর শতাব্দী। কেন সহ্য করছে? নিশ্চয়ই এর কোনো কারণ আছে।

উপস্থিত সবাই একটু অবাক হয়ে রুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেতসিসে মানুষের মোটামুটি নিরুপদ্রব জীবনে সাধারণত এই ধরনের কথাবার্তা প্রকাশ্যে আলোচনা করা হয় না। এই মহাকাশযানে মানুষ থেকে লক্ষগুণ বেশি বুদ্ধিমান এনরয়েড রয়েছে, তাদের অনুকম্পা ছাড়া মানুষ এখানে এক মিনিটও বেঁচে থাকতে পারত না–এরকম পরিবেশে মানুষের গুরুত্ব বেশি না বুদ্ধিমান এনরয়েডের গুরুত্ব বেশি সেই আলোচনা নেহায়েত অনাবশ্যক!

রুহান মৃদু হেসে বলল, রুখ, তোমার জ্ঞানগম্ভীর আলোচনার জন্য এখন কেউ প্রস্তুত নয়। উত্তেজক পানীয় সবার নিউরনে এখন আলোড়ন সৃষ্টি করছে। কঠিন একটা বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে না দিয়ে তুমি বরং আমাদের একটি গান শোনাও।

রুখ হেসে ফেলল, বলল, ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি যদি গান গাই সম্ভবত সবাই আরো দ্রুত পালিয়ে যাবে।

রুহান বলল, দেখই না চেষ্টা করে!

টেবিলের নিচে থেকে বাদ্যযন্ত্র বের করে আনা হল, তাল লয় এবং মাত্রার পরিমাপ ঠিক করে কিছু মডিউল নিয়ন্ত্রণ করা হল, একটি–দুটি সুর পরীক্ষা করা হল এবং রুখ হাততালি দিয়ে গান গাইতে শুরু করল। তার ভরাট গলার স্বর সারা হলঘরে গমগম করতে থাকে– উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে তার সাথে তাল মিলাতে শুরু করে।

গানের কথাগুলো বহু পুরোনো। পৃথিবী ছেড়ে মানবশিশু যাচ্ছে মহাকাশে অজানার উদ্দেশে, সেখানে কি নীল আকাশ আছে? সাগরের ঢেউ আছে? বাতাসের ক্রন্দন আছে? সেই শিশু কি পৃথিবীর স্মৃতি ছড়িয়ে দেবে অনাগত ভবিষ্যতে? মানুষের ভালবাসা কি বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়ে?

গানের কথা শুনতে শুনতে ক্রীনার চোখে হঠাৎ পানি এসে যায়। সে সাবধানে তার নিও পলিমারের কোনা দিয়ে চোখ মুছে ফেলে।

.

যে হলঘরটি কিছুক্ষণ আগেই অসংখ্য মানুষের আনন্দোল্লাসে ভরপুর ছিল এখন সেখানে কেউ নেই–এলোমেলো চেয়ার, অবিন্যস্ত টেবিল, পরিত্যক্ত পানীয়ের গ্লাস সবকিছু মিলিয়ে হলঘরটিতে একধরনের বিষণ্ণতা ছড়িয়ে আছে। হলঘরের মাঝামাঝি বিশাল টেবিলের এক কোনায় রুখ দুই হাতে তার মাথা ধরে বসে আছে, তার খুব কাছে ক্রীনা দাঁড়িয়ে ক্রীনার চোখেমুখে একধরনের চাপা অস্থিরতা। সে রুখের মাথায় হাত রেখে বলল, রুখ। তোমার কী হয়েছে?

রুখ মাথা তুলে ক্রীনার দিকে তাকাল, বলল, আমি জানি না।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা নিয়ে খুব ভয় পাচ্ছ।

হ্যাঁ। কিন্তু সেটা কী আমি জানি না।

ক্রীনা চিন্তিত মুখে বলল, বুদ্ধিমান এনরয়েডের ওখানে কী হয়েছিল মনে করার চেষ্টা কর।

সেটা তো তোমাকে বলেছি–

ক্রীনা মাথা নেড়ে বলল, আমাকে যেটা বলেছ সেটা তোমার স্মৃতিতে বাচিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু নিশ্চয়ই কিছু একটা তোমার স্মৃতি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছু একটা তোমার স্মৃতিতে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে সেখানে এটা খুব সহজ নয়– সবসময়েই অন্য কোনো স্মৃতিতে তার প্রভাব পড়ে। তুমি মনে করার চেষ্টা কর–ভেবে দেখ, কোনো ধরনের অসঙ্গতি কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা তোমার চোখে পড়েছে কি না।

না। রুখ মাথা নেড়ে বলল, আমি কোনো ধরনের অসঙ্গতি মনে করতে পারছি না। তবে

তবে?

তবে যতবার আমি মানুষের বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবি ততবার মনে হয় কী যেন হিসাব মিলছে না।

হিসাব মিলছে না?

না। মনে হয় বেঁচে থাকাটা আসলে–আসলে রুখ হঠাৎ কেমন যেন অসহায় ভঙ্গিতে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি জানি না।

ক্রীনা চিন্তিত মুখে বলল, আমার কী মনে হয় জান?

কী?

বুদ্ধিমান এনরয়েডদের ওখানে গিয়ে তুমি কিছু একটা দেখেছ বা কিছু একটা জেনেছ। সেটার সাথে মানুষের বেঁচে থাকার খুব গভীর একটা সম্পর্ক আছে। সেটা নিশ্চয়ই খুব ভয়ঙ্কর একটা তথ্য–সেটা তোমার মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্তু তোমার অবচেতন মনে এখনো তার ছাপ রয়ে গেছে–সে জন্য তুমি এরকম অস্থির হয়ে ছটফট করছ।

রুখ কেমন যেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে ক্রীনার দিকে তাকাল। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার তাই মনে হয়?

হ্যাঁ। চেষ্টা কর মনে করতে। তোমার মস্তিষ্কে তথ্যটা আছে। ক্রীনা রুখের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানি–তুমি একবার চেষ্টা করে দেখ।

রুখ দুই হাতে মাথা রেখে কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইল, তারপর অসহায় ভঙ্গিতে বলল, না, কিছু মনে করতে পারছি না। শুধু–

ক্রীনা উৎসুক মুখে বলল, শুধু কী?

শুধু কেন জানি আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে

তোমার মায়ের কথা? তোমার মা তো অনেক আগে মারা গেছেন।

আমি জানি।

তোমার মায়ের কথা কী মনে পড়ছে

মনে হচ্ছে আমি যেন আমার মায়ের সাথে যাচ্ছি। মা একটা বিশাল হলঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হলঘরের দরজা খুলে ভয় পেয়ে চিৎকার করতে শুরু করলেন।

কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন?

মানুষ।

মানুষ? কী রকম মানুষ?

রুখ আবার খানিকক্ষণ চিন্তা করে মাথা নেড়ে বলল, না, মনে করতে পারছি না।

মানুষেরা কি মৃত না জীবিত?

মনে হয় জীবিত মনে হয় ঘুমিয়ে আছে।

ঘুমিয়ে আছে?

হ্যা তাদেরকে ঝুলিয়ে রাখা আছে। তারা একসময় জেগে উঠবে তখন ভয়ঙ্কর একটা বিপদ হবে। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর বিপদ।

ক্রীনা অবাক হয়ে রুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রুখ দুর্বলভাবে হেসে বলল, নিশ্চয়ই কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তাই না?

হয়তো দুঃস্বপ্ন। হয়তো দুঃস্বপ্ন নয়, হয়তো সত্যি। কিন্তু আমরা তো তার ঝুঁকি নিতে পারি না।

তুমি কী করতে চাও?

চল বের হই। যারা বয়স্ক যারা তোমার মাকে দেখেছে তাদের সাথে কথা বলে আসি।

কী নিয়ে কথা বলবে?

সত্যি সত্যি তোমার মা কি কখনো তোমাকে নিয়ে কোথাও গিয়ে ভয় পেয়েছিলেন? সেটা নিয়ে কি কারো সাথে কথা বলেছিলেন?

রুখ একটু অবাক হয়ে বলল, তাতে কী লাভ?।

জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় দেরি করে লাভ নেই। সত্যি যদি তুমি বুদ্ধিমান। এনরয়েড থেকে গোপন কোনো তথ্য এনে থাক–সেটা আমাদের জানা দরকার।

.

গভীর রাতে রুহানকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হল, রুহান যেটুকু অবাক হল তার থেকে অনেক বেশি ভয় পেয়ে গেল। ফ্যাকাসে মুখে রুখ আর ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে?

না, রুহান কিছু হয় নি। ক্রীনা হেসে বলল, এমনি এসেছি।

রুহান ভুরু কুঁচকে বলল, এমনি কেউ এত রাতে আসে না। বল কী হয়েছে?

রুখ একটু অপরাধীর মতো বলল, আমি আসলে এত রাতে আসতে চাই নি কিন্তু ক্রীনা। বলল দেরি করে লাভ নেই।

কী ব্যাপারে দেরি করে লাভ নেই?

আমি বলছি, শোন। ক্রীনা তখন অল্প কথায় পুরো ব্যাপারটি রুহানকে বুঝিয়ে বলে। রুখ আশা করছিল রুহান পুরোটুকু শুনে ক্রীনার আশঙ্কাকে হেসে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু সে উড়িয়ে দিল না, খুব চিন্তিত মুখে রুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ক্রীনা বলল, আমরা তোমার কাছে এসেছি রুখের মায়ের কথা জানতে। রুখের মা কি কখনো বিশাল কোনো হলঘরে গিয়ে–

না। রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমাদের মানববসতিতে কোনো বিশাল হলঘর নেই। রুখের মা কখনো কিছু দেখে ভয় পায় নি–আমি জানি। রুখের মা–বাবা দুজনকেই আমি ভালো করে জানতাম। রুখের বাবা যখন মারা যায় আমি তার খুব কাছে ছিলাম। অনেকদিন আগের ঘটনা কিন্তু আমার কাছে মনে হয় মাত্র সেদিন–

ক্রীনা মাথা নাড়ল, স্মৃতি খুব সহজে প্রতারণা করতে পারে।

হ্যাঁ। রুহান মাথা নাড়ল, যে–জিনিসটা মনে রাখা দরকার সেটা মনে থাকে না কিন্তু খুব অপ্রয়োজনীয় একটা জিনিস স্পষ্ট মনে থাকে।

রুখ দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমার জন্যে পুরো ব্যাপারটি আরো ভয়ঙ্কর। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা সম্ভবত আমার স্মৃতিকে ওলটপালট করে দিয়েছে। এখন কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না।

ক্রীনা কোনো কথা না বলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রুখ বলল, কী হল তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?

তুমি এইমাত্র কী বললে?

বলেছি তুমি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?

না, তার আগে।

রুখ একটু অবাক হয়ে বলল, তার আগে বলেছি, আমার স্মৃতির কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না।

ক্রীনা হঠাৎ ঘুরে রুহানের দিকে তাকাল, রুহান তুমি কি সত্যি বলতে পারবে তোমার কোন স্মৃতিটি সত্যি–কোনটি মিথ্যা?

রুহান হতচকিতের মতো ক্রীনার দিকে তাকিয়ে রইল, খানিকক্ষণ পর একটু হেসে বলল, স্মৃতি তো মিথ্যা হতে পারে না।

কিন্তু রুহান তুমি জান আমাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে মাত্র আট। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা আমাদের যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমাদের স্মৃতিতে যা ইচ্ছে তা প্রবেশ করাতে পারে। আমাদের ভয়ঙ্কর স্মৃতি মুছে সেখানে আনন্দের স্মৃতি প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে। আনন্দের স্মৃতি মুছে সেখানে ভয়ঙ্কর স্মৃতি প্রবেশ করাতে পারে।

কিন্তু কেন? কী লাভ?

আমি জানি না। হয়তো হয়তো

হয়তো কী? ক্রীনা কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।

রুহান কিছুক্ষণ ক্রীনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি বলতে চাইছ আমাদের সব স্মৃতি সত্যি নয়?

না। আমি বলতে চাইছি কেউ যদি আমাদের স্মৃতিকে নিয়ে খেলা করে আমরা সেটা জানব না। জানার কোনো উপায় নেই।

রুখ খানিকক্ষণ ক্রীনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হতে থাকে ঠিক এই ধরনের একটা কথা সে আগে কখনো কোথাও শুনেছে–কিন্তু ঠিক কোথায় সে মনে করতে পারে না।

রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমরা ইচ্ছা করলেই তো কিছু একটা নিয়ে সন্দেহ করতে পারি। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র নিয়ে সন্দেহ করতে পারি, বলতে পারি আলোর গতিবেগ পরিবর্তনশীল। কিংবা বলতে পারি আমাদের অস্তিত্ব মিথ্যা –এটা আসলে একটা বিশাল গুবরে পোকার স্বপ্ন–কিন্তু সবকিছুর তো একটা ভিত্তি থাকতে হয়। ভিত্তিহীন সন্দেহ তো কোনো কাজে আসে না। আমাদের স্মৃতি মিথ্যা এটা নিয়ে সন্দেহ করার মতো কোনো ভিত্তি আছে?

ক্রীনা মাথা নাড়ল, আছে।

রুখ এবং রুহান দুজনেই ঘুরে ক্রীনার দিকে তাকাল, আছে?

হ্যাঁ।

সেটা কী?

ক্রীনা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমাদের এই মানুষের বসতিতে কত জন মানুষ রয়েছে?

রুহান বলল, হাজার দেড়েক।

যদি কোনো বসতিতে হাজার দেড়েক মানুষ থাকে তুমি আশা করবে তার মাঝে সকল বয়সের মানুষ থাকবে। শিশু থাকবে, কিশোর–কিশোরী থাকবে, তরুণ–তরুণী থাকবে, যুবক–যুবতী, মধ্যবয়স্ক এবং বৃদ্ধ–বৃদ্ধাও থাকবে। আমাদের বসতিতে কোনো শিশু নেই, কোনো বৃদ্ধ নেই।

রুহান একটু অবাক হয়ে ক্রীনার দিকে তাকাল, ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কী বলছ ক্রীনা? বসতিতে যারা শিশু ছিল তারা বড় হয়ে গেছে, যারা বৃদ্ধ ছিল তারা মারা গেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে তোমার জন্ম হল–।

ক্রীনা মাথা নাড়ল, না, তোমার কী মনে আছে সেটা আমি বিশ্বাস করি না।

তুমি বলতে চাইছ।

আমি বলতে চাইছি হয়তো তুমি অতীতে যেটা দেখেছ সেটা কাল্পনিক স্মৃতি। এখন, এই মুহূর্তে যেটা দেখছি শুধু সেটাই আমরা বিশ্বাস করতে পারি। এই মুহূর্তে যেটা দেখছি সেটা অস্বাভাবিক–সেখানে কোনো শিশু নেই, বৃদ্ধ নেই কোনো জন্ম নেই কোনো মৃত্যু নেই। তাই আমি সন্দেহ করছি হয়তো এটাই মেতসিস। মানববসতিতে কিছু মানুষ থাকে–একসময় তাদের সরিয়ে দিয়ে অন্য মানুষেরা আসে। তাদের মাঝে একটা স্মৃতি দিয়ে দেওয়া হয় যেন তারা অনেকদিন থেকে বেঁচে আছে। আসলে এখানে সবাই ক্ষণস্থায়ী।

ক্রীনা–_ রুখ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ক্রীনা!

কী?

তুমি ঠিকই সন্দেহ করেছ। এখন আমার মনে পড়েছে।

মনে পড়েছে?

হ্যাঁ। মনে আছে আমি বলেছিলাম–বিশাল হলঘরে সারি সারি মানুষ ঝুলিয়ে রাখা আছে? সবাই ঘুমিয়ে আছে। তারা–তারা–

তারা কারা?

তারা আমরা। আমি, তুমি, রুহান সবাই। সবাই।

আমরা?

হ্যাঁ। একই জিনেটিক কোড দিয়ে তৈরি একই মানুষ। রুখ জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে, তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে ভয়ার্ত চোখে একবার রুহান আর ক্রীনার দিকে তাকাল, তারপর আর্ত গলায় বলল, একদিন আমরা সবাই মারা যাব। সবাই একসাথে। তখন অন্য আমাদের জাগিয়ে তোলা হবে, তারা এসে এখানে থাকবে। যেভাবে একদিন আমরা এসেছি। তার আগে অন্য আমরা এসেছি। তার আগে অন্য আমরা–তার আগে–

রুখ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মাথা ধরে আর্তচিৎকার করে ওঠে, তার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে, সে তার নিজের পায়ের উপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। হাঁটু ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ক্রীনা রুখের কাছে ছুটে যায়, তার মাথাটি নিজের কোলের উপরে টেনে নিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়ে। চোখের পাতা টেনে তার চোখের পিউপিলের দিকে তাকাল, হৃৎস্পন্দন শুনল তারপর ঘুরে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, হঠাৎ করে মাথার উপর চাপ পড়েছে, তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমার মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। তবে–

তবে কী?

আমি জানি না বুদ্ধিমান এনরয়েডরা আমাদের কত তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে। যদি খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে তা হলে–

তা হলে?

তা হলে খুব শিগগিরই আমাদের দিন শেষ হয়ে আসবে রুহান।

রুহান কোনো কথা না বলে ক্রীনার দিকে তাকিয়ে রইল।

০৭. তীক্ষ্ণ স্বরে সাইরেন বেজে ওঠে

ভোররাতে হঠাৎ তীক্ষ্ণ স্বরে সাইরেন বেজে ওঠে। রুখ ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল, সাইরেনের তীক্ষ্ণ স্বরের ওঠানামার মাঝে কেমন জানি একটি অশুভ ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে। রুখ জানে এই অশুভ ইঙ্গিতটি কী। এই ভোররাতে মানববসতির প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করা হবে। সম্ভবত হত্যা শব্দটি এখানে ব্যবহার করার কথা নয়–মানুষ কিংবা মানুষের সমপর্যায়ের অস্তিত্ব একে অপরকে হত্যা করে। বুদ্ধিমত্তায় অনেক উপরের একটি অস্তিত্ব নিচু অস্তিত্বকে অপসারণ করে। কাজেই এটি হত্যা নয় এটি অপসারণ। ইতঃপূর্বে অসংখ্যবার এই ঘটনা ঘটেছে। এটি প্রায় রুটিন একটি ব্যাপার।

রুখ তার বিছানা থেকে নেমে এল–এই ক্ষুদ্র সাধারণ এবং রুটিন ঘটনাকে তারা ঘটতে দেবে না, তারপর কী হবে তারা জানে না কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি তারা ঘটতে দেবে না। রুখ যোগাযোগ–মডিউলটি স্পর্শ করে সেটি চালু করে দেয়। মাথায় সাদাকালো চুলের মধ্যবয়স্ক একজন গম্ভীর ধরনের মানুষ যোগাযোগ–মডিউলে কথা বলছে–গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা বলতে হলে এই ধরনের চেহারার একটি চরিত্র সৃষ্টি করা হয়। রুখ হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল, এত জীবন্ত একটি মানুষ আসলে কোনো একটি যন্ত্রের একটি কৌশলী প্রোগ্রাম, দেখে বিশ্বাস হয় না। মধ্যবয়স্ক মানুষটি সোজাসুজি রুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মানববসতির সদস্যরা, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘোষণা অনুগ্রহ করে সবাই মনোযোগ দিয়ে শোন। মেতসিসের বায়ুমণ্ডলের পরিশোধন–কেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে, বাতাসের চাপ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবে। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রয়োজন থেকে একশত চল্লিশ গুণ কমে যাবে–আমি আবার বলছি, একশত চল্লিশ গুণ কমে যাবে। শুধু তাই নয় পরিশোধন–কেন্দ্র বন্ধ থাকায় বাতাসে কার্বন মনোঅক্সাইড, ফসজিন এবং হাইড্রোজেন সায়নাইড গ্যাস সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পাবে, আমি আবার বলছি, বাতাসে কার্বন মনোঅক্সাইড, ফসজিন এবং হাইড্রোজেন সায়নাইড গ্যাস সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পাবে। কাজেই, আমার প্রিয় মানবসদস্যরা–আমি তোমাদের নিরাপত্তার জন্যে বলছি পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা কোনো অবস্থাতেই তোমাদের বাসগৃহ থেকে বের হবে না। আমি আবার বলছি, কোনো অবস্থাতেই তোমাদের বাসগৃহ থেকে বের হবে না। তোমাদের বাসগৃহে বিশুদ্ধ পরিমিত এবং প্রয়োজনীয় বাতাস সরবরাহ করা হবে। কাজেই এই মুহূর্তে তোমাদের বাসগৃহের দরজা এবং জানালা বায়ু–নিরোধক করে নাও। আমি আবার বলছি, এই মুহূর্তে তোমাদের বাসার দরজা এবং জানালা বায়ু নিরোধক করে নাও। আমি আবার বলছি, তোমরা এই মুহূর্তে তোমাদের বাসার দরজা এবং জানালা বায়ু–নিরোধক করে নাও। আমি আবার বলছি…

রুখ হাত দিয়ে স্পর্শ করে যোগাযোগমডিউলটি বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে এল। হাতে খুব বেশি সময় নেই।

.

বড় হলঘরটিতে জনাপঞ্চাশেক তরুণ এবং তরুণী উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছে। রুখ প্রবেশ করার সাথে সাথে তরুণ এবং তরুণীরা তার কাছে ছুটে এল। কমবয়সী একজন উদ্বিগ্ন মুখে বলল, রুখ, আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। তুমি বলেছিলে

রুখ হাত তুলে বলল, আমাদের হাতে নষ্ট করার মতো একটি মুহূর্তও নেই। তোমরা কোনো প্রশ্ন করবে না। আমি যা বলব তোমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও তোমাদের। সেটা বিশ্বাস করতে হবে। আমরা এখন ভয়ঙ্কর একটি বিপদের মুখোমুখি এসেছি। আগামী এক ঘন্টার মাঝে এই মানববসতির সকল মানুষকে হত্যা করা হবে।

উপস্থিত সবাই আর্তচিৎকার করে ওঠে, রুখ হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি আগেই বলেছি, তোমাদের কাছে যত অবিশ্বাস্য মনে হোক তোমাদের আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে। এই মুহূর্তে ক্রীনা এবং রুহান ঠিক এ রকমভাবে আরো স্বেচ্ছাসেবীদের ঠিক একই কথা বলছে। আমরা আগে থেকে এটা সবাইকে বলতে পারি নি, শেষ মুহূর্তের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। তোমরা কোনো প্রশ্ন করবে না–আমি যা বলছি তোমরা যন্ত্রের মতো অক্ষরে অক্ষরে সেটা পালন করবে।

রুখ একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, ঘরের ঐ কোনায় বাক্সের মাঝে দেখ মাইক্রো অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং মাস্ক রয়েছে। তোমরা নিজেরা সেটা পরে নাও। বাক্সের মাঝে তোমাদের সবার নাম লেখা আছে। তোমাদের সেই নাম এবং লিস্ট দেখে মানববসতির সবার বাসায় এই অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং মাস্ক পৌঁছে দিতে হবে। কে কোথায় যাবে সব লিখে দেওয়া আছে। সবাইকে বলতে হবে কোনো অবস্থাতেই কেউ যেন আগামী এক ঘণ্টা তাদের বাসার বাতাসে নিশ্বাস না নেয়। কোনো অবস্থাতেই না–

সোনালি চুলের একজন তরুণী ভয়–পাওয়া–গলায় বলল, কিন্তু

কোনো প্রশ্ন নয়। আমাদের হাতে সময় নেই। মনে রেখো গোপনীয়তার জন্য আমরা কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থা ব্যবহার করতে পারব না! যাও।

পঞ্চাশ জন হতবুদ্ধি তরুণ–তরুণী ঘরের কোনায় ছুটে গেল। নিজের নাম লেখা বাক্স খুলে অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো হাতে নিয়ে তারা নিজেদের মাঝে উত্তেজিত গলায় কথা বলতে বলতে রাতের অন্ধকারে বের হয়ে যায়। রুখ একটু পরেই তাদের ভাসমান যানের ইঞ্জিনের চাপা শব্দ শুনতে পায়। এই মুহূর্তে মানববসতির অন্য অংশেও আরো তরুণ–তরুণীরা এইভাবে ছুটে বের হয়ে গেছে। তাদের হাতে মিনিট পনের সময় আছে। রুথ তার বাসা পরীক্ষা করে বাতাস পরিবহনের কেন্দ্রে কার্বন মনোঅক্সাইডের ছোট সিলিন্ডারটি আবিষ্কার করেছে। নিয়ন্ত্রণ–কেন্দ্র থেকে নির্দেশ পাবার পর স্বয়ংক্রিয় ভালবটি খুলে ঘরের বাতাসে মেরে ফেলার মতো প্রয়োজনীয় কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস প্রবেশ করাতে কমপক্ষে পনের মিনিট সময় নেবে। তাদের হাতে তাই পনের মিনিট সময় রয়েছে, তার বেশি নয়।

রুখ তার নিও পলিমারের জ্যাকেটের পকেট থেকে তার নিজের ছোট অক্সিজেন। সিলিন্ডারটি বের করে নেয়। ঘরের কোনায় যোগাযোগমডিউলে একটা লাল বাতি জ্বলছে এবং নিভছে, বাইরে সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দ উঠছে এবং নামছে, বিচিত্র এই পরিবেশের মাঝে এক ধরনের অশুভ আতঙ্ক লুকিয়ে আছে, অনেক চেষ্টা করেও রুখ সেটা ঝেড়ে ফেলতে পারে না।

.

খুব ধীরে ধীরে দিগন্তের কাছাকাছি চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত ফিউসান দিয়ে সূর্য তৈরি করা হচ্ছে। ভোরের প্রথম আলোতে সবকিছু কেমন যেন অতিপ্রাকৃত দেখায়। মানববসতির প্রায় সবাই খোলা মাঠে উপস্থিত হয়েছে। অনেকের মুখে এখনো অক্সিজেন মাস্ক লাগানো রয়েছে, সেটি খুলে ফেলা নিরাপদ কি না এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না।

রুখ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রুহানকে জিজ্ঞেস করল, কত জনকে বাঁচানো যায় নি?

শেষ হিসাব অনুযায়ী এগার জন। এর মাঝে চার জনের কাছে সময়মতো খবর পৌঁছানো যায় নি–যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজেই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। বাকিদের মাঝে চার জন নিকিতা–পরিবারের। তারা আমাদের কথা বিশ্বাস করলেও স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছে।

কেন?

তাদের ধারণা বুদ্ধিমান এনরয়েড যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে আমাদের মৃত্যুবরণ করা উচিত তা হলে সেটাই মেনে নিতে হবে। সেটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

রুখ রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী মনে হয় রুহান?

আমার? রুহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না রুখ, তবে সত্যি কথা বলতে কী আমার ভয় করছে–যাকে বলে সত্যিকারের ভয়। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে হয়তো নিকিতা–পরিবারই বুদ্ধিমান–আমরাই নির্বোধ

হতে পারে। রুখ মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আমরা তো মানুষ। মানুষ কখনো শেষ চেষ্টা না করে ছাড়ে না। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা সত্যিই যদি বুদ্ধিমান হয়ে থাকে তারাও সেটা জানে।

রুহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ক্রীনা কোথায়?

আসছে। যারা মারা গেছে মনে হয় তাদের মৃতদেহের ব্যবস্থা করে আসছে।

ও।

ক্রীনা না থাকলে আমাদের বেশ অসুবিধে হত।

হ্যাঁ। ক্রীনা চমৎকার একটি মেয়ে। যত বড় বিপদই হোক শেষ পর্যন্ত মাথা ঠাণ্ডা রাখে। এই বিপদটি কীভাবে সামলে নিতে হবে পুরোটা কী চমৎকারভাবে পরিকল্পনা করেছে। দেখেছ!

রুখ একটা নিশ্বাস ফেলে, ক্রীনা সত্যিই চমৎকার একটি মেয়ে। বুকের গভীরে তার জন্য সে যে ব্যাকুলতা অনুভব করে কখনো কি সেটি তাকে বলতে পারবে? কেন সে সহস্র বছর আগে মানুষের সাদামাঠা পৃথিবীতে সাদামাটা একজন মানুষ হয়ে জন্ম নিল না? রুখ অন্যমনস্কভাবে উপরে তাকায়, ঠিক তখন বহুদূরে ছোট ছোট বিন্দুর মতো অনেকগুলো স্কাউটশিপ দেখতে পেল। রুখ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, বিন্দুগুলো ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, সেগুলো এদিকেই এগিয়ে আসছে। সে রুহানের দিকে তাকাল, নিচু গলায় বলল, রুহান, ওরা আসছে।

স্কাউটশিপগুলো সমবেত সবার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে কাছাকাছি এক জায়গায় নামল। স্কাউটশিপের গোলাকার দরজা খুলে যায় এবং ভিতর থেকে বেশকিছু খাটো এবং বিদঘুঁটে পরিবহন রোবট নেমে এল। রোবটগুলো কাছাকাছি এসে থেমে গেল, সেগুলোকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একটি রোবট খনখনে গলায় বলল, তোমরা জীবিত। আমাদের বলা হয়েছে তোমরা মৃত।

রুখ বলল, তুমি ঠিকই দেখছ, আমরা জীবিত।

আমরা মৃতদেহ নিতে এসেছি।

চমৎকার। আমাদের কাছে সব মিলিয়ে এগারটি মৃতদেহ রয়েছে।

আমরা দেড় হাজার মৃতদেহ সরিয়ে নিতে সক্ষম।

আমাদের কাছে দেড় হাজার মৃতদেহ নেই–তোমার হিসাবে নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল রয়েছে।

আগে কখনো এরকম হয় নি। যতবার আমরা দেড় হাজার মৃতদেহ নিতে এসেছি ততবার দেড় হাজার মৃতদেহ নিয়েছি।

এবারে পারবে না। দুঃখিত।

আমরা কি পরে আসব? নির্বোধ ধরনের রোবটটি বলল, একটু পরে এলে কি দেড় হাজার মৃতদেহ প্রস্তুত থাকবে?

না। রুখ মাথা নেড়ে বলল, এখানে কখনোই দেড় হাজার মৃতদেহ প্রস্তুত থাকবে না।

অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার। অত্যন্ত বিচিত্র বলতে বলতে রোবটটি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা এগারটি মৃতদেহ নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ক্রীনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এখন কী হবে?

রুখ মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। তবে আমি খুব ক্লান্ত। আমাকে কিছু খেয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে।

ঠিকই বলেছ, চল যাই। আমার বাসায় চল।

রুখ এবং ক্রীনা অবশ্য জানত না তাদের বিশ্রাম নেবার সময় হবে না তাদের ঘরে দুটি নিরাপত্তা এনরয়েড অপেক্ষা করছিল। ঘরে প্রবেশ করামাত্র তারা তাদের দিকে এগিয়ে আসে।

কে? ক্রীনা ভয়–পাওয়া গলায় বলল, কে তোমরা?

এনরয়েড দুটি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। শক্তিশালী যান্ত্রিক হাত দিয়ে তাদের জাপটে ধরে–ক্রীনা একটি আর্তচিৎকার করার চেষ্টা করে, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ করে কবজির কাছে একটা তীক্ষ্ণ খোঁচা অনুভব করে। পরমুহূর্তে তার। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে।

জ্ঞান হারানোর পূর্বমুহূর্তে মনে হল হয়তো নিকিতা–পরিবারই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

 ০৮. বিশাল কালো একটা টেবিল

বিশাল কালো একটা টেবিলের একপাশে রুখ এবং ক্রীনা বসে আছে। টেবিলে তাদের ঘিরে ছয়টি বুদ্ধিমান এনরয়েড, তারা দেখতে মোটামুটি একই ধরনের কিন্তু ভালো করে তাকালে তাদের সূক্ষ্ম পার্থক্যটুকু চোখে পড়ে। কারো মাথা একটু বড়, কারো ফটোসেল একটু বেশি বিস্তৃত, কারো এনডাইজ দেহ একটু বেশি ধাতব। রুখ এবং ক্রীনার ঠিক সামনে একটা খালি চেয়ার, সেখানে কে বসবে কে জানে। মানুষের বসতে হয়– এনরয়েডদের যান্ত্রিক দেহের তো বসার প্রয়োজন নেই।

ক্রীনা রুখের দিকে একটু ঝুঁকে নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল, রুখ, আমার ভয় করছে।

রুখ ক্রীনার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, তোমার ফিসফিস করে কথা বলার প্রয়োজন নেই ক্রীনা। এখানে যেসব এনরয়েড আছে তারা তোমার দিকে তাকিয়েই তুমি কী ভাবছ বলে দিতে পারে। এদের কাছে আমাদের কিছু গোপন নেই। এরা আমাদের সবকিছু জানে।

সত্যি?

হ্যা সত্যি।

ক্রীনা এবারে স্বাভাবিক গলায় বলল, আমাদের এখানে বসিয়ে রেখেছে কেন?

নিশ্চয়ই কথা বলবে।

যদি আমাদের মনের সব কথা জানে তা হলে শুধু শুধু কথা বলার প্রয়োজন কী?

রুখ দুর্বলভাবে হাসল, বলল, জানি না।

খুব কাছে কে যেন নিচু গলায় হাসল। রুখ এবং ক্রীনা চমকে ওঠে, কে এটা?

খুব কাছে থেকে আবার গলার স্বর শোনা গেল, আমি।

আমি কে?

কণ্ঠস্বরটি আবার হেসে ওঠে, হাসি থামিয়ে বলে, কত সহজে তুমি কত কঠিন একটা প্রশ্ন করলে। সত্যিই তো, আমি কে?

রুখ কঠিন গলায় বলল, আপনারা আমাদের থেকে অনেক বুদ্ধিমান, দোহাই আপনাদের, পুরো ব্যাপারটি আমাদের জন্যে একটু সহজ করে দিন। আমরা মানুষেরা তো জেনেশুনে অপ্রয়োজনে একটা ক্ষুদ্র প্রাণীকে যন্ত্রণা দেই না।

আমি খুব দুঃখিত রুখ। সত্যি কথা বলতে কী, বুদ্ধিমত্তা সমান না হলে ভাব বিনিময় করা খুব কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি।

ধন্যবাদ।

প্রথমে আমি পরিচয় করিয়ে দিই। তোমাদের ঘিরে ছয় জন বুদ্ধিমান এনরয়েড বসে আছে। মানুষের যেরকম নাম থাকতে হয় এনরয়েডের বেলায় সেটা সত্যি নয়। কিন্তু তোমাদের সুবিধের জন্য আমরা সবার একটি নাম দিয়ে দিই। এরা হচ্ছে মেগা, জিগা, পিকো, ফ্যামটো, ন্যানো আর কিলো। তোমরা মানুষেরা যেরকম নাম রাখ সেরকম হল না। কিন্তু কাজ চলে যাবে। এর মাঝে পিকোকে রুথ ধ্বংস করেছিল আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছে।

রুখ চমকে উঠে বলল, কী? কী বললেন?

হ্যাঁ। তোমার মনে নেই। ঘটনাটি খুব বড় ধরনের নির্বুদ্ধিতা ছিল তাই ফ্যামটো সেটি তোমার স্মৃতি থেকে মুছে দিয়েছে।

কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি না। আমি একজন মানুষ হয়ে

মানুষ অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী–তাই বলে তারা যে নিচু স্তরের সরীসৃপ সাপের কামড় খেয়ে মারা যায় না সেটা সত্যি না

তা ঠিক।

হ্যাঁ। তোমার স্মৃতি থেকে সবকিছু যে মুছে দেওয়া গিয়েছে সেটা অবশ্য সত্যি নয়। তুমি লুকিয়ে কিছু তথ্য নিয়ে গিয়েছ। নিনীষ স্কেলে আট মাত্রার বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্য সেটা নিঃসন্দেহে একটি অভূতপূর্ব ব্যাপার। যা–ই হোক, যা বলছিলাম–এখানে তোমাদের থেকে দুই মাত্রা উপরের বুদ্ধিমত্তার এনরয়েড ছাড়া আমিও রয়েছি।

আপনি কে?

বলতে পার আমি সম্মিলিত এনরয়েডদের বুদ্ধিমত্তা। তোমাদের মানুষের এই ক্ষমতা নেই, তোমরা তোমাদের মস্তিষ্কের সুষম অবস্থান করে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পার না। আমরা পারি। অত্যন্ত প্রাচীন পদ্ধতি কিন্তু কার্যকর।

বিদ্যৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ?

হ্যা মূলত বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। যা–ই হোক আমি আমাদের এই আলোচনাটুকু যথাসম্ভব মানবিক করতে চাই। তাই আমরা এখানে চেয়ার এবং টেবিলের ব্যবস্থা করেছি। তোমাদের মস্তিষ্কে সরাসরি যোগাযোগ না করে তোমাদের সাথে কথা বলছি। প্রশ্ন করছি, প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। কথার মাঝে আবেগ প্রকাশ করছি, যখন প্রয়োজন তখন হাসছি, যখন প্রয়োজন কঠিন গলায় কথা বলছি।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সত্যি কথা বলতে কী, আমি ব্যাপারটি তোমাদের জন্য আরো সহজ করে দিতে চাই। আমি তোমাদের সামনে একজন মানুষের রূপ নিয়ে আসতে চাই–তোমাদের যেন মনে হয় তোমরা একজন মানুষের সাথে কথা বলছ।

রুখ একটু অস্বস্তি নিয়ে সামনের শূন্য চেয়ারটির দিকে তাকাল, সেখানে মানুষের রূপ নিয়ে কিছু একটা বসে থাকলেই কি পুরো ব্যাপারটি তাদের জন্য খুব সহজ হয়ে যাবে?

কণ্ঠস্বরটি বলল, আমি জানি তোমারা কী ভাবছ, কিন্তু দেখ ব্যাপারটি তোমাদের সাহায্য করবে। আমি কী রূপে আসব? পুরুষ না মহিলা?

কিছু আসে–যায় না। রুখ মাথা নাড়ল, আপনি কী রূপে আসবেন তাতে আমার বিশেষ কিছু আসে–যায় না।

ক্রীনা? তোমার কোনো পছন্দ আছে?

মধ্যবয়স্ক পুরুষ। কাঁচাপাকা চুল। কালো চোখ। হাসিখুশি।

চমৎকার! প্রায় সাথে সাথেই ঘরের দরজা খুলে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ এসে ঢুকল, তার কাঁচাপাকা চুল, কালো চোখ এবং হাসিখুশি চেহারা। মানুষটি যে তার কল্পনার সাথে কীভাবে মিলে গিয়েছে সেটি দেখে ক্রীনা প্রায় শিউরে ওঠে, এই বুদ্ধিমান এনরয়েডরা সত্যিই তাদের মস্তিষ্কের গহিনে প্রবেশ করতে পারে।

মানুষটি চেয়ার টেনে বসে রুখ এবং ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, কোনোরকম পানীয়?

রুখ এবং ক্রীনা এই প্রথমবার একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারা আবার মানুষটির দিকে তাকাল, বলল, না ধন্যবাদ।

ঠাণ্ডা পানি? বিশুদ্ধ পানি?

বেশ।

প্রায় সাথে সাথেই একটি সাহায্যকারী রোবট এসে মানুষটির সামনে এক গ্লাস এবং তাদের দুজনের সামনে দুই গ্লাস পানি রেখে গেল। মানুষটি পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে তাদের দিকে তাকাল, একটু হেসে বলল, আমার নাম রয়েড। মেতসিসের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে আমি তোমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।

মহামান্য রয়েড– রুথ সোজা হয়ে বসে বলল, আপনাকে

রয়েড হা হা করে হেসে বলল, আমার সাথে তোমাদের ভদ্রতা বা সম্মানসূচক কথা বলার প্রয়োজন নেই। তোমরা একজন মানুষ অন্য মানুষের সাথে যেভাবে কথা বল, আমার সাথে ঠিক সেভাবে কথা বলতে পার।

রুখ খানিকক্ষণ রয়েডের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে এনে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

ক্রীনা সোজা হয়ে বসে বলল, এবারে তা হলে কাজের কথায় আসা যাক। আমি খুব ভয় পাচ্ছি, পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আমার ভিতরে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। আমি এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পাচ্ছি না। আমি

আমি জানি।

আমাদেরকে কি বলবে কেন আমাদের এনেছ? তোমরা তো আমাদের সম্পর্কে সব কিছু জান।

রয়েডের মুখে হঠাৎ একটু গাম্ভীর্যের ছায়া পড়ল। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, তোমরা দুজনেই অনেক বুদ্ধিমান, তোমরা কি অনুমান করতে পার কেন তোমাদের ডেকেছি?

আমরা?

হ্যাঁ।

ক্রীনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সম্ভবত শাস্তি দেওয়ার জন্য।

টেবিলে যে–ছয়টি রোবট বসেছিল তাদের মাঝে পিকো নামের রোবটটি যান্ত্রিক শব্দ করে সোজা হয়ে বলল, আমার বিবেচনায় এই মেয়েটি সত্যি কথা বলেছে।

রয়েড পিকোর দিকে তাকিয়ে বলল, পিকো তুমি কেন বলছ এই মেয়েটি সত্যি কথা বলছে?

যখন বিভিন্ন বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্ব একসাথে থাকে তখন তাদের মাঝে স্তরভেদ রক্ষা করা হলে গুরুতর সমস্যা হতে পারে। গতরাতের ঘটনায় সেটি রক্ষা করা হয় নি। মেতসিসের একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বিনষ্ট করা হয়েছে–

ক্রীনা বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু

পিকো কঠোর স্বরে বলল, আমি কথা বলার সময় আমাকে বাধা দেবে না।

ক্রীনা থতমত খেয়ে বলল, আমি দুঃখিত।

মেতসিসের পরিকল্পনা নষ্ট করায় এখানকার নিজস্ব রুটিন রক্ষা করা যাচ্ছে না। মানুষকে জানতে হবে তারা ইচ্ছে করলেই আমাদের পরিকল্পনায় বাধা দিতে পারবে না।

রয়েডের মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল, যেন সে ভারি একটা মজার কথা শুনছে, সে মাথা নেড়ে বলল, যদি তবু তারা দেয়?

তা হলে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

সেটি কী রকম?

আমরা আগে কার্বন মনোঅক্সাইজ দিয়ে তাদেরকে যন্ত্রণাশূন্যভাবে হত্যা করেছি। এখন থেকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করতে হবে।

কিন্তু সবাইকে যদি মেরে ফেলা হয় তা হলে এই ভয়ঙ্কর শাস্তির ঘটনাটা জানবে কে?

পরবর্তী মানুষেরা। পুরো ঘটনাটি তাদের স্মৃতিতে পাকাপাকিভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া। হবে। ভবিষ্যতে তারা কখনো এরকম দুঃসাহস দেখাবে না।

ক্রীনা আর নিজেকে সামলাতে পারল না, গলা উচিয়ে বলল, আমি এর থেকে বড় নির্বুদ্ধিতার কথা আগে কখনো শুনি নি। তোমরা দাবি কর তোমরা মানুষ থেকে বুদ্ধিমান? এই হচ্ছে তোমাদের বুদ্ধির নমুনা?

পিকো গর্জন করে বলল, খবরদার মেয়ে, তুমি সম্মান বজায় রেখে কথা বলবে। তুমি জান, তোমাদের আমরা পোকামাকড়ের মতো পিষে পেলতে পারি?

আমরা মানুষেরা অকারণে কোনো কীটপতঙ্গকেও স্পর্শ করি না। অথচ তোমরা মানুষের মতো প্রাণীকে শুধু যে হত্যা কর তাই না–তাদেরকে হত্যা করার ভয় দেখাও?

পিকো হঠাৎ তার জায়গায় সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর ক্রীনার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে, চিৎকার করে বলে, আমি এই মুহূর্তে তোমার মস্তিষ্ক বিদীর্ণ করে দেব, অপটিক নার্ড ছিঁড়ে ফেলে বৈদ্যুতিক তরঙ্গে তোমার শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেব। নির্বোধ মেয়ে

রয়েড বলল, অনেক হয়েছে পিকো। তুমি থাম।

পিকো থামার কোনো লক্ষণ দেখাল না, ক্রীনার দিকে এগিয়ে আসতেই লাগল। রয়েড তখন তার হাত তুলে পিকোর দিকে লক্ষ করে একটি প্রচণ্ড বিদ্যুৎ–ঝলক ছুঁড়ে দেয়, মুহূর্তের মাঝে পিকোর পুরো মাথাটি একটা বিস্ফোরণ করে উড়ে যায়। মাথাবিহীন অবস্থায় পিকো দু–এক পা এগিয়ে এসে হঠাৎ করে থেমে যায়, পুরো জিনিসটিকে একটি বিকট রসিকতা বলে মনে হতে থাকে। ফ্যামটো নামের এনরয়েডটি শিস দেবার মতো শব্দ করে বলে, এক শত বিয়াল্লিশ ঘণ্টার মাঝে পিকো দুবার ধ্বংস হল।

রয়েড হাসতে হাসতে বলল, পিকোকে পুনর্বিন্যাস করার সময় এবারে মানবিক অনুভূতি কমিয়ে আনতে হবে।

হ্যাঁ। ফ্যামটো গম্ভীর গলায় বলল, মানুষের সাথে কথা বলার জন্য মানবিক অনুভূতির প্রয়োজন নেই।

রয়েড এবার ঘুরে রুথ এবং ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খুব দুঃখিত তোমাদের সামনে এ–ধরনের একটি দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্যে।

রুখ এবং ক্রীনা কোনো কথা বলল না, এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে একবার পিকোর বিধ্বস্ত দেহ এবং একবার রয়েডের দিকে তাকাল। রয়েড একটু সামনে ঝুঁকে বলল, যা বলছিলাম, তোমরা কি এখন অনুমান করতে পার কেন তোমাদের এখানে আনা হয়েছে?

রুখ একবার ক্রীনার দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এইমাত্র যা ঘটল, তার পুরোটা নিশ্চয়ই সাজানো ঘটনা। তোমরা আমাদেরকে এনেছ বিশেষ প্রয়োজনে।

নিনীষ স্কেলে অষ্টম মাত্রা হিসেবে তোমরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। প্রয়োজনটা কি তোমরা আন্দাজ করতে পার?

না, পারি না।

চেষ্টা কর।

আমাদেরকে তোমরা কোনো কাজে ব্যবহার করবে।

কী কাজে?

রুখ খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রয়েডের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, তুমি প্রকৃত মানুষ নও, তুমি একটা মানুষের প্রতিচ্ছবি, তোমার দিকে তাকিয়ে আমি কিছু অনুমান করতে পারি না। তবে

তবে কী?

তোমরা যে–কাজে আমাদের ব্যবহার করতে চাও সেটি–সেটি

সেটি?

সেটি নিশ্চয়ই আমাদের জন্যে খুব ভয়ঙ্কর।

রয়েড কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে রুখ এবং ক্রীনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমরা মোটামুটি ঠিকই আন্দাজ করেছ। মেতসিস একটা বিচিত্র কক্ষপথে আটকা পড়ে আছে। কোনো একটা বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণী আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে। তারা আমাদের থেকেও বুদ্ধিমান–তাদের বুদ্ধিমত্তার কাছে তোমার আমার দুজনের বুদ্ধিমত্তাই একই রকম অকিঞ্চিৎকর। তাই

তাই?

খবর নেওয়ার জন্য আমি তোমাদের একজনকে সেই প্রাণীর কাছে পাঠাব।

না–  রুখ আর্তচিৎকার করে বলল, না। না–

রয়েড কোনো কথা না বলে স্থিরদৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। ভালবাসাহীন। কঠোর সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রুখ হঠাৎ শিউরে ওঠে।

 ০৯. রুখ ক্রীনার চোখের দিকে তাকাল

রুখ ক্রীনার চোখের দিকে তাকাল, ক্রীনা একমুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে  নেয়। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল সেটি সে রুখকে দেখতে দিতে চায় না। রুখ ক্রীনার মুখের উপর থেকে তার কালো চুল সরিয়ে নরম গলায় বলল, আবার দেখা হবে ক্রীনা।

ক্রীনা মাথা নেড়ে বলল, দেখা হবে?

এখানে না হলে অন্য কোথাও।

অন্য কোথাও?

কখনো না কখনো তো বিদায় নিতে হতই। আমরা না–হয় একটু আগেই নিচ্ছি।

ক্রীনা কোনো কথা বলল না, রুখের দিকে একনজর তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়।

কত সময় তোমাকে পেয়েছি সেটা তো বড় কথা নয়। তোমাকে পেয়েছি সেটা বড় কথা। রুখ দূর্বলভাবে হেসে বলল, মানুষ হয়ে জন্মালে মনে হয় খানিকটা দুঃখ পেতেই হয়। তাই না?

ক্রীনা মাথা নেড়ে নিচু গলায় বলল, আমি দুঃখিত রুখ। আমি খুব দুঃখিত যে তুমি আর আমি মেতসিসে মানুষ হয়ে জন্মেছি। আমরা যদি হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্মাতাম

কিছু আসে–যায় না ক্রীনা। একমুহূর্তের ভালবাসা আর সহস্র বছরের ভালবাসা আসলে একই ব্যাপার। আমাকে বিদায় দাও ক্রীনা

ক্রীনা জোর করে নিজেকে শক্ত করে মুখ তুলে দাঁড়ায়। তাদের ঘিরে মানুষের চেহারায় রয়েড আর বুদ্ধিমান এনরয়েডরা দাঁড়িয়ে আছে, মানুষ থেকে বুদ্ধিমান এই যন্ত্রগুলোকে সে নিজের শোকটুকু বুঝতে দেবে না। সে হাত দিয়ে গভীর ভালবাসায় রুখের মুখমণ্ডল স্পর্শ করে নরম গলায় বলল, বিদায় রুখ। যদি ঈশ্বর বলে কেউ থাকেন তিনি তোমাকে রক্ষা করুন।

রুখ নিচু হয়ে ক্রীনার চুলে নিজের মাথা ডুবিয়ে প্রায় হঠাৎ করে ঘুরে দাঁড়াল, তার সামনে কিছু অমসৃণ পাথরের মাঝখানে আয়নার মতো এক স্বচ্ছ নীলাভ একটি পরদা। মহাজাগতিক প্রাণী মেতসিসের সাথে যোগাযোগের জন্যে এই মহাজাগতিক দরজা সৃষ্টি করেছে। এই স্বচ্ছ নীলাভ পরদার ভিতর দিয়ে রুখকে যেতে হবে। তার অন্য পাশে কী আছে রুখ জানে না। সেখানে তাকে কী করা হবে সেটাও সে জানে না। এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত জগৎ। রুখ নিজেকে শক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। নীলাভ স্বচ্ছ পরদার সামনে এসে সে একমূহুর্ত অপেক্ষা করে, মনে হয় সে বুঝি একবার ঘুরে তাকাবে, কিন্তু সে ঘুরে তাকাল না। লম্বা পদক্ষেপে সে নীলাভ স্বচ্ছ পরদার মাঝে প্রবেশ করল, মনে হল কিছু একটা যেন হঠাৎ করে তাকে গ্রাস করে নিল, টেনে ভিতরে নিয়ে গেল। স্বচ্ছ নীলাভ পরদায় একমুহূর্তের জন্য একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়, বারকয়েক কেঁপে উঠে সেটা আবার স্থির হয়ে যায়।

ক্রীনা অনেক চেষ্টা করেও চোখের পানিকে আটকে রাখতে পারল না। হঠাৎ করে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল।

রয়েড এক পা এগিয়ে এসে বলল, তুমি চাইলে আমরা তোমার স্মৃতিকে মুছে দিতে পারি।

আমার এই স্মৃতিটুকুই আছে। সেটাও তোমরা মুছে দিতে চাও?

তুমি কি রুখকে দেখতে চাও?

ক্রীনা চমকে উঠে বলল, কী বললে?

আমি জানতে চাইছি, তুমি কি রুখকে দেখতে চাও?

সে কোথায়?

মহাজাগতিক প্রাণী মেতসিসের ভিতরে এই দরজাটা খুলেছে। এখান দিয়ে তারা কিছু একটা গ্রহণ করে, সেটাকে পরীক্ষা করে তারপর আবার ফিরিয়ে দেয়।

কোথায় ফিরিয়ে দেয়? ক্রীনা আর্তস্বরে চিৎকার করে বলল, কখন ফিরিয়ে দেয়?

এই মেতসিসে ঠিক এরকম আরেকটি দরজা খুলেছে সেদিক দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। কখন ফিরিয়ে দেয় সেই প্রশ্নটির উত্তর খুব সোজা নয়। আমরা একটুকরা পাথর দিয়েছিলাম সেটা দুই হাজার বছর রেখে ফেরত পাঠিয়েছে!

দুই হাজার বছর? এটা কী করে সম্ভব? এই মেতসিস তার যাত্রা শুরু করেছে মাত্র। সাত শ বছর আগে।

সম্ভব, আমরা কার্বন ডেটিং করে বের করেছি।

জীবন্ত কাউকে পাঠিয়েছ কখনো?

জীবন্ত প্রাণীকে এরা সাধারণত বিশ থেকে পঁচিশ বছর রাখে।

ক্রীনা হাহাকার করে বলল, বিশ থেকে পঁচিশ বছর?

হ্যাঁ। প্রথম প্রথম জীবন্ত প্রাণীকে তারা ঠিক করে বিশ্লেষণ করতে পারত না। একজন মানুষ ফিরে আসত পরিবর্তিত।

পরিবর্তিত?

হ্যাঁ। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ওলটপালট হয়ে যেত। তারা বিকৃত হয়ে ফিরে আসত। বিকৃত এবং মৃত।

ক্রীনা ভয়–পাওয়া–চোখে রয়েডের দিকে তাকিয়ে রইল।

ইদানীং তারা মনে হয় জীবন্ত প্রাণীকে মোটামুটি ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে, শেষ মানুষটি জীবন্ত ফিরে এসেছে। বৃদ্ধ কিন্তু জীবন্ত।

ক্রীনা হতচকিতের মতো বলল, তার মানে একসময় রুখও ফিরে আসবে? জীবন্ত?

হ্যাঁ। আমার তাই বিশ্বাস।

সেটি কত দিন পরে?

কেউ জানে না। আমাদের এখানে সাথে সাথেই ফিরে আসে। কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের মাঝে, কিন্তু এর মাঝে তার দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়।

কী বলছ তুমি? ক্রীনা চিৎকার করে বলল, কী বলছ?

আমি ঠিকই বলছি।

তার মানে তার মানে–রুখ এর মাঝে মেতসিসে ফিরে এসেছে?

আমি নিশ্চিত।

কোথায় আছে সে? কেমন আছে? বেঁচে আছে?

রয়েড রহস্যময় ভঙ্গি করে হাসল, বলল, তুমি নিজেই দেখবে। চল।

১০. স্বচ্ছ নীলাভ পরদাটি

রুখ স্বচ্ছ নীলাভ পরদাটি স্পর্শ করতেই মনে হল কিছু একটা যেন হঠাৎ করে প্রবল আকর্ষণ করে তাকে টেনে নিল। রুখের মনে হল কেউ তাকে একটি নিঃসীম অতল গহ্বরে ছুঁড়ে দিয়েছে। সে দুই হাত–পা ছড়িয়ে আর্তচিৎকার করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে কিন্তু সে কিছুই আঁকড়ে ধরতে পারে না। অতল শূন্যতার মাঝে সে পড়ে যেতে থাকে। তার মনে হতে থাকে যে কোনো মুহূর্তে সে বুঝি কোথায় আছড়ে পড়বে, কিন্তু সে আছড়ে পড়ে না—গভীর শূন্যতায় নিমজ্জিত হতে থাকে।

রুখ চোখ খুলে তাকায়। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, মনে হয় আলোর শেষ বিন্দুটিও কেউ যেন শুষে নিয়েছে। সে প্রাণপণে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু কোথাও কিছু নেই, কোনো আলো নেই, রূপ নেই। কোনো আকার নেই অবয়ব নেই, কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি কি আসলে অন্ধকার? নাকি এটি আলোহীন অন্ধকারহীন এক অস্তিত্ব? রুখের হঠাৎ মনে হয় তার নিশ্চয়ই মৃত্যু হয়েছে। হয়তো এটিই মৃত্যু। যখন কোনো আদি নেই অন্ত নেই শুরু নেই শেষ নেই আলো নেই অন্ধকার নেই শুধু এক অবিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব সেটাই হয়তো মৃত্যু।

রুখ সেই আদিহীন অন্তহীন অস্তিত্বে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। তার বুকের মাঝে এক শূন্যতা খেলা করতে থাকে। গভীর বেদনায় কী যেন হাহাকার করে ওঠে। সে নিজেকে ফিসফিস করে বলে, বিদায়।

কিন্তু সেই কথা সে শুনতে পারে না। রুখ আবার চিৎকার করে ওঠে, বিদায়।

এক অমানবিক নৈঃশব্দ্য তাকে ঘিরে থাকে। রুখ নিজেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে কিন্তু সে তার দেহকে খুঁজে পায় না। সে কোথায়? তার চারপাশে রূপ–বর্ণ–গন্ধহীন এক অতিপ্রাকৃত জগৎ। তার চেতনা ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে। শুধু তার চেতনা। এটাই কি মৃত্যু?

না এটা মৃত্যু নয়।

কে? কে কথা বলে?

আমি।

আমি কে?

আমি। আমি হচ্ছি আমি।

আমি কোথায়?

তুমি এখানে।

এখানে কোথায়?

এখানে আমার কাছে।

কেন?

আমি দেখতে চাই। বুঝতে চাই।

কী দেখতে চাও?

তোমাকে।

কিন্তু এত অন্ধকার। তুমি কেমন করে দেখবে?

কে বলেছে অন্ধকার?

রুখ অবাক হয়ে তাকাল, সত্যিই কি অন্ধকার? চারদিকে কি হালকা নরম একটা আলো নেই? সমস্ত চেতনা উনখ করে সে তাকাল, দেখল কোমল একটা আলো ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু শুধুমাত্র সেই হালকা নরম আলো, আর কিছু নেই। শুরু নেই, শেষ নেই, আদি নেই, অন্ত নেই, এক কোমল নরম আলোর বিস্তৃতি। রুখের হঠাৎ মনে হয় আসলে সব মায়া, সব কল্পনা, সব এক অতিপ্রাকৃত স্বপ্ন।

না। এটি স্বপ্ন নয়।

রুখ চমকে উঠল, কে? কে কথা বলে?

আমি।

তুমি কি সত্যি?

তুমি যদি ভাব আমি সত্যি তবে আমি সত্যি।

আমি কি সত্যি?

হ্যাঁ, তুমি সত্যি।

তা হলে আমি নিজেকে দেখতে পাই না কেন? আমার দেহ কই? হাত–পা–চোখ–মুখ কই?

আছে।

কোথায় আছে?

আমার কাছে।

কেন?

কৌতূহল। আমি দেখতে চাই বুঝতে চাই। নতুন রূপ দেখলে আমার কৌতূহল হয়।

তুমি কি একা?

আমি একা। আবার আমি অনেক। একা এবং অনেক।

তুমি দেখতে কেমন?

আমার কাছে দেখার কোনো অর্থ নেই

তোমার অবয়ব কেমন? আকৃতি কেমন?

এই কথার কোনো অর্থ নেই। আমি রূপহীন আকৃতিহীন।

আমাকে নিয়ে তুমি কী করবে?

দেখব।

কেমন করে দেখবে?

তোমাকে খুলে খুলে দেখব। একটি একটি পরমাণু খুলে খুলে দেখব।

দেখে কী করবে?

বুঝব।

কেন?

কৌতূহল। বুদ্ধিমত্তার আরেক নাম হচ্ছে কৌতূহল।

রুখের চেতনা ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে আসে। সে কি আছে না নেই সেটিও অস্পষ্ট হয়ে আসে। তার মনে হতে থাকে যুগ যুগ থেকে সে আদিহীন অন্তহীন এক অসীম শূন্যতায় ভেসে আছে। সময় যেন স্থির হয়ে আছে তাকে ঘিরে।

এভাবে কতকাল কেটে গেছে কে জানে? রুখের মনে হতে থাকে সে বুঝি তার পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। এক অসীম শূন্যতা থেকে তার বুঝি আর মুক্তি নেই। তখন হঠাৎ কে যেন বলল, চল।

রুপের মনে হল এখন আর কিছুতেই কিছু আসে যায় না।

কে যেন আবার বলল, চল।

কোথায়?

ফিরে যাই।

ফিরে যাবে?

হ্যাঁ।

কে ফিরে যাবে? কোথায় ফিরে যাবে?

তুমি। তুমি আর আমি।

আমি? আমি আর তুমি?

হ্যাঁ।

তুমিও আমার সাথে যাবে?

হ্যাঁ।

কেমন করে যাবে?

তোমার চেতনার সাথে।

ও।

রুখের হঠাৎ মনে হতে থাকে সে বুঝি ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। মনে হতে থাকে তার দেহ সে ফিরে পেয়েছে। হাত দিয়ে সে নিজেকে স্পর্শ করে, হাত–পা–মুখ নতুন করে আবিষ্কার করে। চিৎকার করে সে ধ্বনি শুনতে পায়। চোখ খুলে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মাঝে সূক্ষ্ম আলোর রেখা দেখতে পায়। হঠাৎ করে সেই আলো হঠাৎ তীব্র ঝলকানি হয়ে তাকে প্রায় দৃষ্টিহীন করে দেয়। রুখ চিৎকার করে ওঠে– প্রচণ্ড এক অমানবিক শক্তি যেন তাকে ছিন্নভিন্ন কর দিয়ে দূরে ছিটকে দেয়। রুখ কোথায় যেন আছড়ে পড়ল, প্রচণ্ড আঘাতে তার দেহ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে। কাতর চিৎকার করে সে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করে, শক্ত পাথরকে সে খামচে ধরে। মুখের মাঝে সে রক্তের লোনা স্বাদ অনুভব করে।

সমুদ্রের গর্জনের মতো চাপা কলরব শুনতে পায়–চোখ খুলে সে দেখে তার পরিচিত জগৎ। সে ফিরে এসেছে। মেতসিসে ফিরে এসেছে।

রুখ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে, নিজের ভিতরে হঠাৎ সে একটা ভয়ের কাপুনি অনুভব করে।

সে একা ফিরে আসে নি। তার সাথে আরো কেউ আছে।

১১. উঁচু একটা বিছানায় শুয়ে

রুখ উঁচু একটা বিছানায় শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে কয়েকটি বুদ্ধিমান এনরয়েড দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকের কাছাকাছি কিছু যন্ত্র। রুখের হাত এবং পা স্টেনলেস স্টিলের রিং দিয়ে আটকানো। শরীর থেকে নানা আকারের কিছু টিউব বের হয়ে আছে। দেহের কাছাকাছি অসংখ্য মনিটর।

একটা বড় মনিটরের সামনে রয়েড দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারায় দুশ্চিন্তার চিহ্ন। ক্রীনা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রয়েড।

এটি রুখ নয়।

ক্রীনা আতঙ্কে শিউরে উঠল, চাপা গলায় বলল, কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ। এটি মানুষ নয়।

মানুষ নয়?

না। তার ডি.এন. এ.–তে আরো নতুন বারো জোড়া বেস পেয়ার জুড়ে দেওয়া আছে।

তার মানে কী?

ডি, এন, এ হচ্ছে মানুষের ব্লু প্রিন্ট। তার ভিতরে একজন মানুষের সব তথ্য সাজানো থাকে। এর মাঝে ডি, এন. এ.–তে নতুন বেস পেয়ার এসেছে, নতুন তথ্য এসেছে। সেই নতুন তথ্যের পরিমাণ অচিন্তনীয়।

তার মানে কী?

তার মানে এটি মানুষ নয়।

তা হলে এ–এ–কে?

মহাজাগতিক প্রাণীর একটি ডিকয়।

না! ক্রীনা চাপা গলায় আর্তনাদ করে বলল, না–এটা হতে পারে না। এ হচ্ছে রুখ। নিশ্চয়ই রুখ।

রুখ মানুষ ছিল। এটি মানুষ নয়। মানুষের ডি, এন, এ ডাবল হেলিক্স, এখানে ছয় জোড়া হেলিক্সই আছে। আরো নতুন বারো জোড়া বেস পেয়ার।

এখন কী হবে?

এই ডিকয়টিকে বিশ্লেষণ করতে হবে।

বিশ্লেষণ?

হ্যাঁ। কেটে দেখতে হবে, শরীরের অংশ বুঝতে হবে। নতুন তথ্য জানতে হবে।

কিন্তু রুখের কী হবে?

রুখ? রুখ বলে এখানে কেউ নেই

রয়েড এক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে এনরয়েডদের সাথে কথা বলে, বিজাতীয় যান্ত্রিক ভাষার দ্রুত লয়ের কথা–ক্রীনা তা ধরতে পারে না। ক্রীনা ভীত মুখে তাকিয়ে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে দেখে উপর থেকে একটা যন্ত্র নেমে আসছে, নিচে ধারালো স্ক্যালপেল ঘুরছে। তার রুখকে এরা মেরে ফেলবে। ক্রীনা ছুটে গিয়ে রয়েডের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রয়েডের যান্ত্রিক শক্তিশালী দেহ এক ঝটকায় তাকে দূরে ছুঁড়ে দেয়। দুটি প্রতিরক্ষা রোবট ক্রীনাকে ধরে ফেলে শক্ত হাতে আটকে রাখল। ক্রীনা অসহায় আতঙ্কে তাকিয়ে থাকে, উপর থেকে ধারালো স্ক্যালপেল নিচে নেমে আসছে আর একমুহূর্ত পরে সেটি রুখের পাজর কেটে ভিতরে বসে যাবে। ক্রীনা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল।

সাথে সাথে স্ক্যালপেলটি থেমে গেল। ক্রীনা অবাক হয়ে দেখল সেটি আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। রয়েড হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে। এনরয়েডগুলো ইতস্তত কিছু সুইচ স্পর্শ করে, হঠাৎ করে তারা সকল যন্ত্রপাতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।

কী হচ্ছে এখানে?

মূল প্রসেসর কাজ করছে না।

কেন?

নতুন সিগনাল আসছে।

কোথা থেকে আসছে?

এই প্রাণীটি থেকে।

ক্রীনা অবাক হয়ে রয়েড এবং বুদ্ধিমান এনরয়েডগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল—তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলছে, সে কিছু বুঝতে পারছে না কিন্তু তবুও তাদের বিপর্যস্ত ভাবটুকু ধরতে পারছে। কিন্তু একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। যন্ত্রপাতির নিয়ন্ত্রণটুকু তারা হারিয়ে ফেলেছে।

রয়েড তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এই প্রাণীটি কেমন করে সিগনাল পাঠাচ্ছে?

শরীরের মাঝে চার্জকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। চার্জকে ইচ্ছেমতো কম্পন করিয়ে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ পাঠাচ্ছে। নিখুঁত কম্পন। যখন যত দরকার।

কিন্তু আমাদের প্রতিরক্ষা সিস্টেম?

উপেক্ষা করে চলছে।

অসম্ভব।

আমি আমার কপোট্রনে কম্পন অনুভব করছি। আমাকেও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি।

সরে যাও। সবাই সরে যাও।

সরে যাচ্ছি।

ফ্যারাডে কেজ বাড়িয়ে দাও।

দিয়েছি।

দ্বিতীয় মাত্রার প্রতিরক্ষা সিস্টেম চালু করতে হবে।

আমার কপোট্রনের কোমল প্রতিরক্ষা আক্রান্ত হয়েছে।

সরে যাও। সবাই সরে যাও। দ্বিতীয় মাত্রার প্রতিরক্ষার আড়ালে চলে যাও।

এই মেয়েটি? এই মেয়েটিকে কী করব?

সাথে নিয়ে এস।

ক্রীনা হঠাৎ দেখল সবাই ঘর ছেড়ে সরে যাচ্ছে, প্রতিরক্ষা রোবট তাকে শক্ত করে ধরে টেনে নিতে থাকল। ক্রীনা চিৎকার করে বলল, ছেড়ে দাও আমাকে। ছেড়ে দাও!

কিন্তু তুচ্ছ মানুষের আর্তচিৎকারে কেউ কান দিল না।

ক্রীনাকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বুদ্ধিমান এনরয়েডরা একটা ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে রুখকে লক্ষ করা হচ্ছে। শান্ত ভঙ্গিতে সে শক্ত বিছানায় শুয়ে আছে–তার দৃষ্টিতে কোনো উত্তেজনা নেই, এক ধরনের বিচিত্র আত্মসমর্পণের ভাব।

রয়েড যান্ত্রিক ভাষায় অন্যান্য এনরয়েডদের সাথে কথা বলতে শুরু করে। এই মুহূর্তে রুখ কী করছে জানতে চাইল। একজন এনরয়েড উত্তর দিল। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সে মূল তথ্যকেন্দ্রে তথ্য পাঠাতে শুরু করেছে।

সর্বনাশ! এটি খুব বিপজ্জনক ব্যাপার।

হ্যাঁ। মূল তথ্যকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া আর মেতসিসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া একই ব্যাপার।

তাকে থামাতে হবে।

আমরা কোনো উপায় দেখছি না। এটি একজন সাধারণ মানুষ নয়। এটি মহাজাগতিক প্রাণীর একটি ডিকয়।

ক্রীনা নামে মেয়েটিকে দেখিয়ে ভয় দেখানো যেতে পারে। বলা যেতে পারে তাকে মেরে ফেলব।

চেষ্টা করে দেখি।

একটি বুদ্ধিমান এনরয়েড রুখের সাথে যোগাযোগ করে তাকে জানাল সে যদি এই মুহূর্তে মূল তথ্যকেন্দ্রে তথ্য পাঠানো বন্ধ না করে তা হলে ক্রীনাকে হত্যা করা হবে। রুখকে কেমন জানি ভ্রিান্ত দেখায়, সে ছটফট করে ওঠে এবং হঠাৎ কয়েকটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে পুরো মেতসিস কেঁপে উঠল। ঘরের ওপরে বসানো মূল মনিটরে তারা অবাক হয়ে দেখল তথ্যকেন্দ্রের মূল করিডোরে হঠাৎ করে একটি বিশাল রোবট কোথা থেকে জানি উদয় হয়েছে। রোবটটি মানুষের অনুকরণে তৈরি কিন্তু পুরোপুরি মানুষের মতো নয়। মুখমণ্ডলে এক ধরনের ভয়ঙ্কর নৃশংসতার চিহ্ন, দুটি হাত এক ধরনের সর্পিল ভঙ্গিতে নড়ছে, দেহে উচ্চচাপের বিদ্যুৎপ্রবাহ, সেখান থেকে কর্কশ শব্দে নীলাভ স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে। রোবটটি তার শক্তিশালী হাতে ভয়ঙ্কর একটি অস্ত্র নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে শুরু করেছে।

নিরাপত্তা রোবটগুলো অতিকায় রোবটটিকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে কিন্তু সেটি তার দেহের আকারের তুলনায় অত্যন্ত ক্ষিপ্র। তার ভয়ঙ্কর মুখমণ্ডলে এক ধরনের যান্ত্রিক নৃশংসতা খেলা করতে থাকে। সেটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে একটি একটি করে নিরাপত্তা রোবটকে ভস্মীভূত করে দেয়। নিরাপত্তা রোবটগুলো তাদের ভস্মীভূত পোড়া দেহের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে করিডোরে ইতস্তত দাঁড়িয়ে থাকে, পুরো এলাকাটি পোড়া গন্ধ এবং ধোঁয়ায় ভরে যায়। রোবটটি এক ধরনের বিজাতীয় গর্জন করতে করতে অতিকায় দানবের মতো এগিয়ে আসছে, বড় মনিটরে সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রীনা এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকে। সে কাঁপা গলায় বলল, রয়েড। এটি কী? কোথা থেকে এসেছে?

আমরা জানি না। মনে হয়

মনে হয়?

মনে হয় তোমার বন্ধু রুখ এটি তৈরি করেছে।

রুখ তৈরি করেছে? ক্রীনা চিৎকার করে জলল, কী বলছ তুমি?

ঠিকই বলছি। মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করেছে। কেন্দ্রীয় কারিগরি প্লান্টে নমুনা পাঠিয়ে তৈরি করে এনেছে

কী বলছ তুমি!

হ্যাঁ। অত্যন্ত চমৎকার ডিজাইন। আমাদের পক্ষে এরকম কিছু তৈরি সম্ভব নয়। অবিশ্বাস্য।

কিন্তু

তোমার বন্ধু রুখ আসলে এখন রুখ নয়। সে মহাজাগতিক প্রাণীর ডিকয়। আমরা ভেবেছিলাম সে আমাদের সাথে সহযোগিতা করবে। কিন্তু করছে না।

তোমরা এখন কী করবে?

আমরা অবশ্যই আত্মরক্ষার চেষ্টা করব। বুদ্ধিমান প্রাণীমাত্রই নিজেদের আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে।

ক্রীনা সবিস্ময়ে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। অতিকায় ভয়ঙ্করদর্শন একটি রোবট ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। হাতে ভয়াবহ একটি অস্ত্র আলগোছে ধরে রেখেছে। রয়েড মনিটরে লক্ষ করে কোনো একটি সুইচ স্পর্শ করল, সাথে সাথে ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরণ অতিকায় রোবটটিকে আঘাত করল, সেটি প্রায় উড়ে গিয়ে করিডোরের এক কোনায় আছড়ে পড়ল কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই সেটি উঠে দাঁড়ায়, উদ্যত অস্ত্রে আবার দ্বিগুণ নৃশংসতায় গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে। প্রচণ্ড শব্দ, আগুন এবং ধোঁয়ায় পুরো এলাকাটি নারকীয় হয়ে ওঠে।

ক্রীনা চিৎকার করে বলল, রয়েড।

কী হয়েছে?

আমার মনে হয় তোমাদের প্রচলিত অস্ত্র এর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

আমারও তাই মনে হয়।

এটাকে আঘাত করার চেষ্টা করাটাই মনে হয় বিপজ্জনক।

আমারও তাই ধারণা। কিন্তু এর উদ্দেশ্য অত্যন্ত ভয়ানক।

এর কী উদ্দেশ্য?

আমাদের এনরয়েডদের এক জন এক জন করে ধ্বংস করা।

ক্রীনা অবাক হয়ে রয়েডের দিকে তাকাল, বলল, তুমি কেমন করে জান?

আমরা জানি, কারণ এটি আমাদের নিজস্ব কোডে সেটি বলছে। আমরা বুঝতে পারছি।

আর কী বলছে?

আর বলছে– রয়েডকে হঠাৎ কেমন যেন বিপর্যস্ত দেখাল।

কী বলছে?

বলছে, তোমাকে কোনোভাবে স্পর্শ করা হলে সে পুরো নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ধ্বংস করে দেবে।

ক্রীনা সবিস্ময়ে কিছুক্ষণ রয়েডের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তাই যদি সত্যি হয় তা হলে আমাকে বের হতে দাও। আমাকে দেখলে নিশ্চয়ই এটি শান্ত হবে।

রয়েড মাথা নাড়ল। বলল, আমারও তাই ধারণা।

দেখা যাক চেষ্টা করে। ক্রীনা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে একটু সাহস সঞ্চয় করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা স্পর্শ করামাত্র সেটি নিঃশব্দে খুলে যায়। সামনে একটি দীর্ঘ করিডোর, করিডোরের শেষপ্রান্তে বিশাল ভয়ঙ্করদর্শন রোবটটি দাঁড়িয়ে আছে। রোবটটি তার অস্ত্র ক্রীনার দিকে উদ্মত করতেই ক্রীনা হাত তুলে চিৎকার করে বলল, আমি ক্রীনা।

ক্রীনার কথাটিতে প্রায় মন্ত্রের মতো কাজ হল। রোবটটি থেমে যায়, তার নৃশংস–মুখে এক ধরনের কোমলতা ফিরে আসে। রোবটটি হাতের অস্ত্রটি নামিয়ে নেয় এবং হঠাৎ করে ঘুরে দীর্ঘ করিডোর ধরে হেঁটে ফিরে যেতে শুরু করে। কিছুক্ষণ আগে যে এই পুরো এলাকাটিতে এক ভয়ঙ্কর নারকীয় তাণ্ডব ঘটে গেছে সেটি আর বিশ্বাস হতে চায় না। খোলা দরজা দিয়ে প্রথমে রয়েড এবং তার পিছু পিছু বুদ্ধিমান এনরয়েডগুলো বের হয়ে আসে। ক্রীনা রয়েডের দিকে তাকিয়ে বলল, রয়েড।

বল।

আমার মনে হয় তোমরা রুখকে যেতে দাও।

এই মুহূর্তে এ ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।

একটা স্কাউটশিপে করে আমাদের দুজনকে তোমরা মানুষের বসতিতে পৌঁছে দাও।

বেশ। কিন্তু একটা জিনিস মনে রেখো–

কী জিনিস?

তুমি যাকে মানুষের বসতিতে নিয়ে যাচ্ছ সে তোমার বন্ধু রুখ নয়।

ক্রীনা একমুহূর্ত রয়েডের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, হয়তো তোমার কথা সত্যি। কিন্তু

কিন্তু কী?

তার ভিতরে নিশ্চয়ই রুখ লুকিয়ে আছে। আমি তাকে খুঁজে বের করব।

আমি তোমার সৌভাগ্য কামনা করছি না। তবে জেনে রেখো

কী?

মেতসিসের নিয়ন্ত্রণ এখন আর আমাদের হাতে নেই।

.

রুখের হাত–পায়ের বাধন খুলে দেওয়ামাত্র সে ধড়মড় করে উঠে বসে ক্রীনার হাত আঁকড়ে ধরে কাতর গলায় বলল–

ক্রীনা!

ক্রীনা সবিস্ময়ে রুখের দিকে তাকিয়ে রইল, নরম গলায় বলল, রুখ! তুমি আমাকে চিনতে পারছ?

চিনতে পারব না কেন? কী বলছ তুমি?

না, মানে–

এখানে কী হচ্ছে ক্রীনা? আমাকে এরকম করে বেঁধে রেখেছিল কেন? আর একটু আগে কী বলছিল আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তথ্যকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে না দিলে তোমাকে হত্যা করবে–এর কী অর্থ? কেন বলছে এসব?

ক্রীনা একদৃষ্টে রুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে কি কিছুই জানে না?

ক্রীনা! রুখ কাতর গলায় বলল, তুমি এরকমভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন? কী হচ্ছে এখানে?

কিছু হচ্ছে না রুখ। মনে কর পুরো ব্যাপারটুকু একটা দুঃস্বপ্ন।

দুঃস্বপ্ন?

হ্যাঁ। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। এখন তুমি চল।

কোথায়?

আমরা মানুষের বসতিতে ফিরে যাব।

রুখ চোখ বড় বড় করে ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, বুদ্ধিমান এনরয়েডরা আমাদের যেতে দেবে?

হ্যাঁ। যেতে দেবে।

সত্যি?

সত্যি।

রুখ বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়, সে টলে পড়ে যাচ্ছিল, ক্রীনাকে ধরে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নেয়। ক্রীনা তাকে ধরে রেখে বলল, চল যাই।

চল। রুখ একমুহূর্ত থেমে বলল, ক্রীনা।

কী হল?

একটা কথা বলি? তুমি হাসবে না তো?

না। হাসব না।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি একা নই। আমার সাথে আরো কেউ আছে। আরো কোনো কিছু।

ক্রীনার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে, কিন্তু সে শান্ত গলায় বলল, তোমার মনের ভুল রুখ। তোমার সাথে কেউ নেই।

১২. স্কাউটশিপটা নামামাত্রই

স্কাউটশিপটা নামামাত্রই মানববসতির বেশকিছু মানুষ তাদের দিকে ছুটে এল। ক্রীনা রুখকে নিয়ে নেমে আসে। জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে সবার দিকে তাকিলে বলল, তোমরা সবাই ভালো ছিলে?

হ্যাঁ। আমরা তো ভালোই ছিলাম। তোমাদের কী খবর! কিছুক্ষণ আগে মনে হল বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছি।

হ্যাঁ, কিছু বিস্ফোরণ হয়েছে।

কেন?

ক্রীনা একটু ইতস্তত করে বলল, বলব, সব বলব। আগে আমরা একটু বিশ্রাম নিই। তোমরা বিশ্বাস করবে না আমরা কিসের ভিতর দিয়ে এসেছি।

হ্যাঁ, চল।

রুখ আর ক্রীনাকে নিয়ে সবাই হেঁটে যেতে থাকে। ক্রীনা জিজ্ঞেস করল, রুহান কোথায়?

পরিচালনা–কেন্দ্রে। একটা ছোট সহায়তা সেল খোলা হয়েছে। সবাই খুব ভয় পাচ্ছে–তাই তাদেরকে সাহস দিচ্ছে।

তোমরা কেউ তাকে গিয়ে খবর দেবে?

ঠিক আছে, যাচ্ছি। বলে একজন কম বয়সী তরুণী পরিচালনা–কেন্দ্রের দিকে ছুটে যেতে থাকে।

ছোট দলটিকে নিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ক্রীনা আড়চোখে রুখের দিকে তাকাচ্ছিল। সে অত্যন্ত অন্যমনস্ক, মনে হচ্ছে তার চারপাশে কী ঘটছে ভালো করে লক্ষ করছে না। হাঁটার ভঙ্গিটুকুও খানিকটা অস্বাভাবিক, অতিরিক্ত উত্তেজক পানীয় খাবার পর মানুষ যেভাবে হাঁটে অনেকটা সেরকম। রুখকে নিয়ে ক্রীনা হেঁটে তাদের বাসার কাছাকাছি পৌঁছাল। বাসার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় দূরে রুহানকে দেখা গেল, সে খবর পেয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে চলে এসেছে। রুথ অন্যমনস্কভাবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে, তখন রুহান পিছন থেকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকল, রুখ।

রুখ চমকে ঘুরে তাকাল। সে সিঁড়ির রেলিং ধরে রেখেছিল চমকে ঘুরে তাকানোর সময় রেলিঙে তার হাতের হেঁচকা টান পড়ল এবং সবাই অবাক হয়ে দেখল টাইটেনিয়ামের রেলিঙের অংশবিশেষ ভেঙে চলে এসেছে। রুখ রেলিঙের ছিন্ন অংশটুকু হাতে নিয়ে হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, আরে, ভেঙে গেল দেখছি।

একজন মানুষের হাতের আলতো স্পর্শে টাইটেনিয়ামের ধাতব রেলিং ভেঙে যেতে পারে ব্যাপারটি বিশ্বাসযোগ্য নয়, দৃশ্যটি দেখে সবাই কেন জানি এক ধরনের আতঙ্কে শিউরে উঠল। রুথ ভাঙা অংশটি আবার তার জায়গায় বসিয়ে সেটি ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকে। ক্রীনা সবার আগে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, রেলিংটা নিশ্চয়ই ভাঙা ছিল।

রুহান মাথা নাড়ল, বলল, মানববসতির রক্ষণাবেক্ষণ কমিটিকে একটা কড়া নোটিশ পাঠানোর সময় হয়েছে।

ঠিকই বলেছ। ক্রীনা রুখের পিঠ স্পর্শ করে বলল, চল রুখ, তুমি শুয়ে একটু বিশ্রাম নেবে। তোমার উপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে।

রুখ মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। ঠিক বুঝতে পারছি না, কিন্তু আমার কেমন জানি অস্থির লাগছে।

শুয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নাও, ঠিক হয়ে যাবে। ক্রীনা ঘুরে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি রুখকে শুইয়ে দিয়ে আসছি।

রুহান চিন্তিত মুখে বলল, আমি আসব?

না। প্রয়োজন নেই।

ক্রীনা রুখকে তার ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল, রুখ বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্রীনা নরম গলায় ডাকল, রুখ।

বল।

তোমার কী হয়েছে, রুখ?

আমি জানি না। শুধু মনে হচ্ছে, আমার ভিতরে আরো একজন আছে।

সে কে?

আমি জানি না।

সে কী চায়?

আমি জানি না। রুখ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি বুঝি আমি নই। মনে হয়–

কী মনে হয়?

মনে হয় আমি বুঝি অন্য কিছু।

সব তোমার মনের ভুল। শুয়ে একটু বিশ্রাম নাও, ঘুম থেকে উঠে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।

রুথ শিশুর মতো মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।

ক্রীনা দরজা বন্ধ করে চলে আসছিল, তখন রুখ পিছন থেকে ডাকল, বলল, ক্রীনা।

কী হল?

এই যে রেলিঙের ব্যাপারটা

রুথ কী বলতে চাইছে ক্রীনার বুঝতে অসুবিধে হল না কিন্তু তবু সে না বোঝার ভান করে বলল, কোন রেলিং?

এই যে আমার হেঁচকা টানে সেটা ভেঙে গেল।

কী হয়েছে সেই রেলিঙের?

সেটা আসলে আমি ভেঙেছি। তাই না?

ক্রীনা এক মুহূর্ত রুখের দিকে তাকিয়ে বলল, সেটা কি সম্ভব?

না। কিন্তু আমার ভিতরে যে আরেকজন আছে বলে মনে হয়–তার পক্ষে সম্ভব।

ক্রীনা একটা চাদর দিয়ে রুখের শরীরকে ঢেকে দিতে দিতে বলল, এটা নিয়ে তুমি এখন চিন্তা কোরো না। তুমি ঘুমাও রুখ। আমি আসছি।

ক্রীনা বের হয়ে দেখল, বাইরে রুহান এবং সাথে আরো কয়েকজন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। ক্রীনা বের হতেই সবাই তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। ক্রীনা হঠাৎ করে কেমন জানি ক্লান্তি অনুভব করতে থাকে।

রুহান একটু এগিয়ে এসে বলল, ক্রীনা।

কী হল?

রুখের কী হয়েছে ক্রীনা?

আমি যদি সত্যিই জানতাম তা হলে খুব নিশ্চিন্ত বোধ করতাম।

তুমি জান না?

সে কিসের ভিতর দিয়ে গিয়েছে আমি জানি–কিন্তু তার কী হয়েছে আমি জানি না। তোমরা এস, আমি যেটুকু জানি সেটুকু বলছি।

.

বড় হলঘরটাতে সবাই পাথরের মতো মুখ করে বসে আছে। রুহান সবাইকে এখানে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেয় নি। শুধুমাত্র মানববসতির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা রয়েছে। ক্রীনার মুখে পুরো ঘটনার বর্ণনা শুনে সবাই একেবারে হতচকিত হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ সময় কেউ কোনো কথা বলার মতো কিছু পেল না। শেষে রুহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমরা খুব বিপদের মাঝে আছি। সবচেয়ে বড় বিপদের মাঝে রয়েছে রুখ।

মানববসতি পরিচালনা পর্ষদের নিরাপত্তা শাখার দায়িত্বে নিয়োজিত মানুষটির নাম কিহিতা। তার সুগঠিত শক্তিশালী বিশাল দেহ। মধ্যবয়স্ক এই মানুষটি সাহসী এবং খুব কম কথার মানুষ। ক্রীনা যতক্ষণ কথা বলেছে সে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের বিশাল হাতের শক্তিশালী আঙুলের নখগুলো পরীক্ষা করেছে। সে একবারও ক্রীনার দিকে তাকায় নি কিংবা তাকে কোনো প্রশ্ন করে নি। কিহিতা রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার সাথে একমত নই।

তুমি কী বলতে চাইছ?

এখানে রুথ সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত নয়। সে বিপদেরর কারণ।

ক্রীনা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি কিহিতা?

আমি ঠিকই বলছি। আজকে কী অবলীলায় সে টাইটেনিয়ামের রেলিংটা ভেঙে ফেলেছে সেটা দেখেছ?

কিন্তু—কিন্তু–

কীভাবে চোখের পলকে সে বিশাল ভয়ঙ্কর রোবট তৈরি করতে পারে সেটা তুমি নিজেই বলেছ ক্রীনা। রুশ বিপদগ্রস্ত নয়–রুখ বিপদের কারণ।

ক্রীনা একটু আহত দৃষ্টিতে কিহিতার দিকে তাকিয়ে রইল। কিহিতা ক্রীনার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল, আমরা সম্ভবত মেতসিসে কিছু নিয়ম ভঙ্গ করেছি। আমাদের সম্ভবত বুদ্ধিমান এনরয়েডদের বিরুদ্ধাচরণ না করে তাদের সহযোগিতা করা উচিত।

পরিচালনা পর্ষদের স্বাস্থ্য শাখার দায়িত্বে নিয়োজিত লাল চুলের মেয়ে মাহিনা কিহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী ধরনের সহযোগিতার কথা বলছ?

কিহিতা চোখ নামিয়ে বলল, আমার কথাটি তোমাদের কাছে নিষ্ঠুরতা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি রুখের দেহে অবস্থানকারী প্রাণীটিকে বুদ্ধিমান এনরয়েডের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত।

ক্রীনা চমকে উঠে বলল, তুমি কী বলছ কিহিতা?

আমি ঠিকই বলছি ক্রীনা। কিহিতা শান্ত গলায় বলল, সত্যি কথা বলতে কী রুখের দেহে অবস্থানকারী প্রাণীটিকে মানববসতিতে আনা খুব অবিবেচকের মতো কাজ হয়েছে।

রুহান খানিকটা বিচলিত হয়ে কিহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বারবার রুখের দেহে অবস্থানকারী প্রাণী বলে উল্লেখ করছ। কিন্তু রুখ কোনো মহাজাগতিক প্রাণী নয়। রুখ হচ্ছে রুখ।

তার একটা অংশ রুখ। মূলত সে একটি মহাজাগতিক প্রাণী। লাল চুলের মাহিনা জিজ্ঞেস করল, তর্ক করে লাভ নেই, কিহিতা তুমি কী করতে চাও স্পষ্ট করে বল।

তোমরা একটি সহজ কথা ভুলে যাও। মেতসিসে আমরা বুদ্ধিমান এনরয়েডের অনুগ্রহে বসবাসকারী কিছু মানুষ। তারা না চাইলে একমুহূর্তে আমরা শেষ হয়ে যাব। তাদের সাথে সহযোগিতা করে যদি আমরা কয়দিন বেশি বেঁচে থাকতে পারি সেটিই আমাদের সার্থকতা। তাদের সাথে যুদ্ধ করে শেষ হয়ে যাওয়া নির্বুদ্ধিতা।

মহিলা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তুমি এখনো বলছ না তুমি ঠিক কী করতে চাও।

আমি রুখকে বুদ্ধিমান এনরয়েডের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই।

ক্রীনা ক্রুদ্ধস্বরে বলল, সেটি তুমি কীভাবে করতে চাও?

রুখকে হত্যা করে।

হলঘরের সবাই চমকে উঠল। ক্রীনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিহিতার দিকে তাকাল, কাঁপা গলায় বলল, তুমি–তুমি–এ কী বলছ কিহিতা?

আমি মানববসতির নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি কীনা। আমাকে সবার কথা ভাবতে হবে। একটি মহাজাগতিক প্রাণীর জন্য

ক্রীনা চিৎকার করে বলল, তুমি এভাবে কথা বলতে পারবে না, কিহিতা।

রুহান সরু চোখে কিহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান রুখকে হত্যা করাই হচ্ছে এই সমস্যার সমাধান?

কিহিতা শীতল গলায় বলল, আমি নিশ্চিত সেটিই হচ্ছে সমাধান।

কিন্তু তারা হত্যা করতে পারে নি।

আমরা মানুষ–মানুষের দুর্বলতা আমরা জানি। আমরা সম্ভবত এই কাজটি আরো সুচারুভাবে করতে পারব।

কিন্তু এটাই কি সমাধান?

লাল চুলের মাহিনা বলল, কিহিতার কথায় খানিকটা যুক্তি রয়েছে। এই মহাজাগতিক প্রাণী নিজে নিজে আসে নি। সে রুখের উপর ভর করে এসেছে। একটি প্রাণীকে যদি তার অস্তিত্বের জন্য অন্য একটি পোষকের উপর নির্ভর করতে হয় তা হলে সেই পোষককে হত্যা করা হলে প্রাণীটি বেঁচে থাকতে পারে না। এখানে রুথ হচ্ছে পোষক, তাকে হত্যা করে সম্ভবত মহাজাগতিক প্রাণীটিকে হত্যা করা সম্ভব।

ক্রীনা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তোমরা কি সবাই পাগল হয়ে গেছ? একজন মানুষকে বলছ পোষক! তাকে হত্যা করার কথা বলছ এত সহজে যেন সে মানুষ নয়, যেন সে একটি কীটপতঙ্গ!

কিহিতা ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপারটিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিও না ক্রীনা। কারো বিরুদ্ধে আমরা কিছু করছি না। আমরা মানববসতিকে রক্ষা করার কথা বলছি।

তোমরা নিশ্চিত এটাই মানববসতিকে রক্ষা করবে?

আমরা জানি না। কিন্তু আমরা তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমাদের কিছু একটা করতে হবে। আমরা যদি রুখকে হত্যা করতে পারি তা হলে মহাজাগতিক প্রাণীকে হত্যা করতে পারব। এ কথাটি তোমরা ভুলে যেও না আমরা এখানে বুদ্ধিমান এনরয়েডের অনুকম্পার উপর বেঁচে আছি। তাদেরকে যেভাবে সম্ভব সেভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। প্রাচীনকালে মানুষ যেভাবে অন্ধ বিশ্বাসে ঈশ্বরের আরাধনা করত আমাদের ঠিক সেই

একাগ্রতা এবং বিশ্বাস নিয়ে বুদ্ধিমান এনরয়েডদের পূজা করতে হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।

ক্রীনা চিৎকার করে বলল, বিশ্বাস করি না। আমি তোমার একটি কথাও বিশ্বাস করি। তুমি উন্মাদ।

তুমি কী বিশ্বাস কর বা না কর তাতে কিছু আসে–যায় না। আমি মানববসতির নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব আমি।

তুমি বলতে চাইছ তুমি আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে

হ্যাঁ। প্রয়োজন হলে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

ক্রীনার সমস্ত মুখমণ্ডল ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। সে ঘুরে সবার দিকে তাকাল। তীব্র কণ্ঠে বলল, তোমরা সবাই এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন কর?

না। রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি সমর্থন করি না। কিহিতার সিদ্ধান্ত হচ্ছে একটি অত্যন্ত জটিল সমস্যার একটি অবিশ্বাস্যরকম সরল এবং হাস্যকর সমাধান। এটি সরল এবং অমানবিক। রুখ আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন, তাকে এত সহজে–

আমি এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাই না। কিহিতা কঠিন গলায় বলল, কিছু কিছু সিদ্ধান্ত যুক্তিতর্ক ছাড়াই নিতে হয়।

তুমি এই সিদ্ধান্ত নিতে পার না।

আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যারা এর বিরোধিতা করবে আমাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে।

রুহান এবং ক্রীনা এক ধরনের অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিহিতার দিকে তাকিয়ে রইল। কিহিতা পাথরের মতো নির্লিপ্ত মুখে তার পকেট থেকে যোগাযোগ–মডিউল বের করে নিরাপত্তা কেন্দ্রে যোগাযোগ করে। সে

কিছুক্ষণের মাঝেই ক্রীনা এবং রুহান নিজেদেরকে একটা ছোট ঘরে বন্দী হিসেবে আবিষ্কার করল।

 ১৩. চার জন শক্তিশালী মানুষ

কিহিতার সামনে চার জন শক্তিশালী মানুষ অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, আপাতদৃষ্টিতে তাদের ভাবলেশহীন মনে হলেও ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে তারা খানিকটা বিচলিত। চোখের কোনায় যে চাপা অনুভূতিটি সেটি ভীতি।

কিহিতা তাদের সবাইকে ভালো করে লক্ষ করে বলল, আমরা মানববসতিতে এই প্রথমবার এমন একটি কাজ করতে যাচ্ছি যেটি আগে কখনো করা হয় নি। কাজটি হচ্ছে হত্যাকাণ্ড। আমরা যাকে হত্যা করতে যাচ্ছি তার বাইরের অবয়ব একটি মানুষের। প্রকৃতপক্ষে আমরা যাকে হত্যা করতে যাচ্ছি তার বাইরের অবয়ব আমাদের অতি পরিচিত রুখের। কিন্তু সে রুখ নয় তার ডি. এন. এ. –তে ডাবল হেলিক্স নেই, সেটি ষষ্ঠ মাত্রার হেলিক্স। বেস পেয়ার বারোটি। তোমাদের কেউ কেউ দেখেছ সে হেঁচকা টান দিয়ে টাইটেনিয়ামের একটি রেলিং ভেঙে ফেলেছে।

কিহিতা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা ইচ্ছে করলে কল্পনা করে নিতে পার একটি ভয়ঙ্কর বীভৎস মহাজাগতিক প্রাণী আমাদের রুখকে হত্যা করে তার দেহের ভিতরে প্রবেশ করে আছে। এই ভয়ঙ্কর প্রাণীটিকে হত্যা করে আমরা রুখকে হত্যা করার প্রতিশোধ নেব।

উপস্থিত চার জন কোনো কথা না বলে স্থির চোখে কিহিতার দিকে তাকিয়ে রইল। কিহিতা বলল, মেতসিসের বুদ্ধিমান এনরয়েডরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই কাজটি সহজ নয়। কিন্তু তাদের যে সকল সমস্যা ছিল আমাদের সেই সমস্যা নেই। আমরা মানুষ। মানুষের পক্ষে মানুষের কাছাকাছি রূপের প্রাণীকে। হত্যা করা সহজ। আমরা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে এই মহাজাগতিক প্রাণীর কাছে উপস্থিত হব। শক্তিশালী বিস্ফোরক, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে তাকে আঘাত করব। আমি আমাদের নিরাপত্তা সেলের সদস্যদের মাঝে থেকে সবচেয়ে সাহসী এবং দুর্ধর্ষ চার জনকে বেছে নিয়েছি। আমি জানি তোমরা মানববসতির অস্তিত্বের স্বার্থে এই কাজটি করতে পারবে। তবুও আমি জানতে চাই–এমন কেউ কি আছ যে এই কাজে অংশ নিতে ভয় পাচ্ছ?

উপস্থিত চার জন কোনো কথা না বলে পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিহিতা জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কারো কোনো প্রশ্ন রয়েছে?

এক জন হাত তুলে জানতে চাইল, আমরা যদি মহাজাগতিক প্রাণীটিকে হত্যা করতে ব্যর্থ হই তা হলে কী হবে?

কিহিতা খানিকক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমরা ব্যর্থ হব না। তোমাদের আর কারো অন্য কোনো প্রশ্ন রয়েছে?

কেউ কোনো কথা বলল না। কিহিতা তখন বলল, চমৎকার। চল। আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করে আসি।

নিরাপত্তা সেলের ঘর থেকে রাতের অন্ধকারে কিহিতার পিছু পিছু চার জন সদস্য বের হয়ে এল।

ৰুখের ঘরের দরজা ধাক্কা দিতেই সেটি খুলে যায়। উদ্যত অস্ত্র হাতে প্রথমে কিহিতা এবং তাদের পিছু পিছু নিরাপত্তা সেলের চার জন সদস্য ঢুকল। রুখ তার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে ছিল, তাদেরকে প্রবেশ করতে দেখে সে তার চোখ খুলে তাকায় এবং খুব ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে। কিহিতা এবং তার চার জন সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী চোখে বলল, কে? কিহিতা?

কিহিতা কোনো কথা না বলে তার হাতের উদ্যত অস্ত্র তার দিকে তাক করে ধরে। রুখ অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে কিহিতা?

কিহিতা কোনো কথা না বলে ট্রিগার টেনে ধরতেই তীক্ষ্ণ বিস্ফোরণের শব্দের সাথে সাথে রুখ তার বিছানা থেকে প্রচণ্ড আঘাতে দেয়ালে আছড়ে পড়ে। কিহিতা অস্ত্র নামিয়ে তাকাল এবং অবাক হয়ে দেখল রুখ খুব সাবধানে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার চেহারা। বিপর্যস্ত, মুখে আতঙ্কের চিহ্ন, কাপড় শতছিন্ন কিন্তু দেহে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। রুখ অবাক হয়ে কিহিতার দিকে তাকাল, ভয়–পাওয়া–গলায় বলল, কিহিতা! তুমি কী করছ, কিহিতা?

কিহিতার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, হঠাৎ করে সে নিজের ভিতরে এক ধরনের অমানুষিক আতঙ্ক অনুভব করে। যে অস্ত্র টাইটেনিয়ামের দেয়াল ফুটো করে ফেলতে পারে সেটি দিয়ে রুখকে হত্যা করা যাচ্ছে না–এই মহাজাগতিক প্রাণীটির বিরুদ্ধে সে কীভাবে দাঁড়াবে?

কিহিতা আবার অস্ত্র তুলে নেয়, এবার তার সাথে অন্য চার জনও। ভয়ঙ্কর শব্দ করে তাদের হাতের অস্ত্র গর্জন করে ওঠে। তীব্র গতিতে বিস্ফোরক ছুটে যায়, ঘোট ঘরটিতে হঠাৎ করে এক নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। রুখ আর্তচিৎকার করে ওঠে, কালো ধোঁয়ায় ঘর ঢেকে যায়, বিস্ফোরকের গন্ধ ঘরের পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আঘাতে ঘরের দেয়াল ভেঙে পড়ে এবং সেই ভাঙা দেয়াল দিয়ে রুখের বিধ্বস্ত দেহ ঘর থেকে ছিটকে বাইরে গিয়ে পড়ল।

কিহিতা তার অস্ত্র নামিয়ে বাইরে তাকাল। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড ধাক্কায় চারিদিকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানে স্থানে ছোট আগুন জ্বলছে। তার মাঝে রুখের দেহ পড়ে আছে, মাতৃগর্ভে শিশু যেভাবে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে সেভাবে অসহায় ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। তার দেহটি দাউদাউ করে জ্বলছে।

কিহিতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, দেহটি নিশ্চল। সে একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে পিছনে তাকিয়ে তার সঙ্গী চার জনকে বলল, আমাদের মিশন শেষ হয়েছে। আমরা প্রাণীটিকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করতে পেরেছি। তোমাদের সবাইকে অভিনন্দন।

সাথের চার জন কেউ কোনো কথা বলল না। কিহিতা অস্ত্রটি হাতবদল করে ঘর থেকে বের হয়ে এল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে সে রুথের দেহের কাছে দাঁড়াল, শরীরের আগুন নিভে এসেছে। দেহটি এখনো নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে। সে একটু ঝুঁকে দেহটির দিকে তাকাল, প্রচণ্ড বিস্ফোরকের আঘাতে দেহটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার কথা কিন্তু সেটি অক্ষত। কিহিতা হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। এই ধরনের বিস্ফোরকের আঘাতেও একটি দেহ কেমন করে অক্ষত থাকতে পারে? এই দেহ কী দিয়ে তৈরি?

কিহিতা সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে সে আতঙ্কে শিউরে উঠল, রুখের দেহটি আবার নড়ে উঠেছে। সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে এবং রুদ্ধনিশ্বাসে দেখতে পায় রুখ খুব ধীরে ধীরে দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছে। সমস্ত শরীরে পোড়া কালির চিহ্ন কিন্তু এখনো আশ্চর্যরকম অক্ষত দেহটি ক্লান্ত ভঙ্গিতে দুই হাঁটুর উপর মুখ রেখে বসে তারপর ঘুরে কিহিতার দিকে তাকায়। দুঃখী গলায় বলে, কিহিতা! আমি কী করেছি? কেন আমাকে তুমি কষ্ট দিচ্ছ?

কিহিতা হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকে এবং ঠিক তখন পিছন থেকে একটি আর্তচিৎকার শুনতে পেল। সে ঘুরে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার সমস্ত শরীর পাথরের মতো জমে গেল। দূরে রুখের বাসার কাছে একটি মহাজাগতিক অতিপ্রাকৃত প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে। রাতে দুঃস্বপ্নের মাঝে যে অশরীরী প্রাণী তাকে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে তাড়া করে বেড়িয়েছে–সেই প্রাণীটিই এখন মূর্তিমান বিভীষিকার মতো দাঁড়িয়ে আছে।

প্রাণীটি দীর্ঘ–তার থেকে আরো একমাথা উঁচু। দেখে মনে হয় কোনো এক ধরনের সরীসৃপ কিন্তু এটি সরীসৃপ নয়। মনে হয় জীবন্ত একটি প্রাণীর চামড়া খুলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাণীটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাইরে প্রকট হয়ে ঝুলছে, সমস্ত দেহটি থিকথিকে আঠালো এক ধরনের তরলে ভেজা। সেই তরল শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে নিচে ঝরছে। শক্তিশালী মাথা, লম্বা মুখ এবং সেখান থেকে সারি সারি ধারালো দাঁত বের হয়ে এসেছে। ছোট ছোট একজোড়া লাল চোখ তীক্ষ্ণ এবং ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুকের কাছাকাছি। একজোড়া হাত, তীক্ষ্ণ নখ, পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের ভারসাম্য রাখার জন্য পিছনে শক্তিশালী লেজ।

প্রাণীটি তার মুখ খোলে এবং সেখান থেকে সকলকে গলিত একটি জিভ বের হয়ে আসে। কিহিতা বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং অবাক হয়ে দেখে বিশাল একটি শরীর নিয়ে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় সেটি তার দিকে ছুটে আসছে। আর্তচিৎকার করে দুই হাত তুলে সে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। প্রাণীটি শক্ত চোয়াল দিয়ে তাকে কামড়ে ধরে মুহূর্তের মাঝে বন্যপশুর মতো ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। বিচিত্র এক ধরনের অশরীরী শব্দ করতে করতে প্রাণীটি অন্যদের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় এবং দ্বিতীয় আরেক জনকে আক্রমণ করে। অমানুষিক আতঙ্কে তারা চিৎকার করতে করতে ছুটে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু প্রাণীটি অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় তাদের আরো এক জনকে ধরে ফেলে। ভয়ঙ্কর। নৃশংসতায় মানুষটির দেহটিকে ছিন্নভিন্ন করে জান্তব শব্দ করতে করতে সেটি অন্য আরেক জনের পিছনে ছুটতে শুরু করে। মানববসতির মাঝে হঠাৎ যেন এক অমানুষিক বিভীষিকা নেমে আসে।

রুখ ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। তার দেহের পোশাক ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে, পুরো দেহ প্রায় নগ্ন। সমস্ত শরীরে মাটি কাদা এবং বিস্ফোরকের কালিঝুলি লেগে আছে। সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়ায়, তারপর ক্লান্ত পায়ে টলতে টলতে হাঁটতে শুরু করে। তার বুকের ভিতরে এক গভীর নিঃসঙ্গতা হাহাকার করতে থাকে।

.

ক্রীনা শক্ত মেঝেতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিল, বিস্ফোরণের শব্দ শুনে চমকে উঠে বসে। ভয়ার্ত মুখে সে রুহানের মুখের দিকে তাকাল। রুহান কাছে এসে ক্রীনার মাথায় হাত রাখে। ক্রীনা রুহানের হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে তারপর দুই হাতে মুখ ঢেকে আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে। রুহান কী করবে বুঝতে পারে না, সে ক্রীনাকে দুই হাতে ধরে টেনে দাঁড় করায়, তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রীনা, শান্ত হও ক্রীনা। একটু ধৈর্য ধর।

ঠিক তখন তারা মানুষের আর্তনাদ শুনতে পেল এবং হঠাৎ মনে হল বাইরে দিয়ে অমানুষিক শব্দ করতে করতে কিছু একটা ছুটে যাচ্ছে। মানববসতির নানা জায়গা থেকে মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার শোনা যেতে থাকে। আতঙ্কিত লোকজন ছোটাছুটি করতে শুরু করেছে।

রুহান এবং ক্রীনা তাদের ঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না। ছোট ঘরটির মাঝে আটকা পড়ে দুজন এক ধরনের অস্থিরতায় ছটফট করতে থাকে। কতক্ষণ এভাবে কেটে গিয়েছে জানে না। একসময় মনে হল কেউ একজন এসে তাদের ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করছে। খুট করে একটা শব্দ হল এবং দরজা খুলে কালিঝুলি মাখা একজন মানুষ ভিতরে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করে দিল। মানুষটির পিঠে একটি অস্ত্র ঝুলছে, চোখেমুখে ভয়াবহ আতঙ্ক, বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে, মনে হয় সে ছুটতে ছুটতে এখানে এসেছে। ক্রীনা মানুষটিকে চিনতে পারল, সে নিরাপত্তা সেলের একজন সদস্য। ক্রীনা এবং রুহান অবাক হয়ে মানুষটির কাছে এগিয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

মহাবিপদ! মহাবিপদ হয়েছে। মানুষটি এত উত্তেজিত যে সহজে কথা বলতে পারে, তার মুখে কথা জড়িয়ে যেতে থাকে।

কী বিপদ হয়েছে?

মহাজাগতিক প্রাণী বের হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর একটা প্রাণী।

কোথা থেকে বের হয়েছে? ক্রীনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, রুখ কোথায়?

মানুষটি মাথা নিচু করে বলল, আমরা রুখকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিলাম। পারি নি।

পার নি? ক্রীনার বুক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বের হয়ে আসে। পার নি?

না।

কী হয়েছে খুলে বল। তাড়াতাড়ি।

মানুষটি মেঝেতে বসে ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকে। ক্রীনা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে–তার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ তার কাছে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে যায়। কী আশ্চর্য এই সহজ জিনিসটা আগে কেন তার চোখে পড়ে নি!

ক্রীনা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। রুহান অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে ক্রীনা?

আমাকে যেতে হবে?

কোথায়?

রুখকে খুঁজে বের করতে হবে।

রুহান তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ক্রীনার দিকে তাকাল, বলল, তুমি এইমাত্র শুনেছ কিহিতার কী হয়েছে?

হ্যাঁ, শুনেছি।

তোমার কি মনে হয় না, কাজটি বিপজ্জনক? কিহিতা অন্ত্যন্ত নির্বুদ্ধিতা করেছে, কিন্তু তার নির্বুদ্ধিতা থেকে একটি জিনিস প্রমাণিত হয়েছে। রুখ আসলে রুখ নয়।

কিন্তু আরো একটা জিনিস প্রমাণ হয়েছে।

সেটা কী?

আমি বলব। তোমাদের বলব। কিন্তু তার আগে আমাকে যেভাবেই হোক রুখকে খুঁজে বের করতে হবে। ক্রীনা নিরাপত্তা সেলের মানুষটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, রুখ কোথায় গিয়েছে?

জানি না। শুনেছি সে মানববসতির বাইরের দিকে হেঁটে গেছে।

ক্রীনা দরজা খুলে বাইরে যাবার জন্য দরজায় হাত রাখতেই রুহান এগিয়ে এল, বলল, ক্রীনা।

কী হল?

সেই ভয়ঙ্কর প্রাণীটা এখনো বাইরে রয়েছে। তোমার কি এখন বাইরে যাওয়া ঠিক হবে?

আমার ধারণা সেই ভয়ঙ্কর প্রাণী আমাকে স্পর্শ করবে না।

কেমন করে তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ?

আমি জানি না। কিন্তু এরকম একটা পরিস্থিতিতে ছোট একটা বিশ্বাসকে শক্ত করে আঁকড়ে না ধরলে আমরা বেঁচে থাকব কেমন করে?

ক্রীনা ঘরের দরজা খুলে অন্ধকারে বের হয়ে গেল।

১৪. যেখানে বনাঞ্চল শুরু হয়েছে

রুখ মানববসতির বাইরে, যেখানে বনাঞ্চল শুরু হয়েছে তার গোড়ায় একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে বসেছিল। ক্রীনাকে দেখে সে কোমল গলায় বলল, ক্রীনা! তুমি এসেছ?

হ্যাঁ।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল তুমি আসবে।

অবশ্যই আমি আসব।

তাই আমি এখানে অপেক্ষা করছি। মনে আছে যখন সবকিছু ঠিক ছিল তখন সারা দিন কাজের শেষে আমরা এখানে সময় কাটাতে আসতাম।

মনে আছে।

তোমাকে আমার খুব ভালো লাগত কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলি নি। আমার কেমন জানি সংকোচ হত।

আমি বুঝতে পারতাম।

সবকিছু কেমন জানি হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল।

না। ক্রীনা রুখের কাছে এসে তার হাত স্পর্শ করে বলল, কিছুই শেষ হয় নি।

রুখ একটু অবাক হয়ে বলল, কী বলছ তুমি? তুমি মনে কর এখনো আমাদের। জীবনের কিছু অবশিষ্ট আছে? আমার জীবনের?

আছে। ক্রীনা রুখকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, আছে।

কী বলছ তুমি ক্রীনা? আমার কাছে আসতে তোমার ভয় করছে না? তুমি জান না আমি আসলে মানুষ নই। কিহিতা আর আরো চার জন তৃতীয় মাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে আমাকে হত্যা করতে পারে নি?

আমি জানি।

তা হলে? তা হলে তোমার কেন ভয় করছে না?

কারণ আমি জানি আসলে তুমি রুখ!

রুখ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, না ক্রীনা আমি রুখ না। আমি মহাজাগতিক প্রাণী। তুমি জান না কী ভয়ঙ্কর নৃশংসতায় আমি কিহিতাকে হত্যা করেছি তার সঙ্গীদের হত্যা। করেছি? তুমি জান না আমি কী ভয়ঙ্করদর্শন, কী কুৎসিত? কী নৃশংস। আমি দেখেছি।

না রুখ, আমি তোমাকে সেই কথাটিই বলতে এসেছি।

কী বলতে এসেছ?

ক্রীনা রুখের হাতে চাপ দিয়ে বলল, আমি তোমাকে বলতে এসেছি যে তুমি কাউকে হত্যা কর নি। তারা নিজেদেরকে নিজেরা হত্যা করেছে।

তুমি কী বলছ বুঝতে পারছি না।

তোমার সাথে যে মহাজাগতিক প্রাণী এসেছে সেটি ভয়াবহ নৃশংস নয়।

সেটি তা হলে কী?

আমরা সেটাকে যেরকম কল্পনা করব তারা ঠিক সেরকম। বুদ্ধিমান এনরয়েডদের কাছে এসেছিল ভয়াবহ বিশাল একটি রোবট হিসেবে। তারা যন্ত্র, তাদের চিন্তা–ভাবনাও রোবটকেন্দ্রিক। তারা ধরে নিয়েছে মহাজাগতিক প্রাণী তাদের বন্ধু নয়, তাদের শত্রু, তাই সেই রোবট এসেছিল অস্ত্র হাতে। ঠিক তারা যেরকম কল্পনা করেছে সেরকম। শত্রু হিসেবে এসে সেই রোবট তাদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।

কিহিতাও ভাবত মহাজাগতিক প্রাণী হচ্ছে ভয়ঙ্কর নৃশংস একটা প্রাণী। অতিকায় সরীসৃপের মতো ক্লেদাক্ত তার দেহ। নিষ্ঠুর তার আচরণ তাই তার সামনে সেই প্রাণী এসেছে ভয়ঙ্কররূপে। এসে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেছে। ঠিক যেরকম সে আশঙ্কা করত।

কিন্তু আমি তা ভাবি না। আমার সবচেয়ে যে প্রিয় মানুষটি তাকে তারা নিজেদের কাছে নিয়ে তাকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। বুদ্ধিমান এনরয়েডদের আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করেছে। আমাকে রক্ষা করেছে। কিহিতার নির্বুদ্ধিতা থেকে রক্ষা করেছে। আমি সেই মহাজাগতিক প্রাণীকে কল্পনা করি ভালবাসার কোমল রূপে। আমার মা যেভাবে গভীর ভালবাসায় আমাকে বুকে চেপে বড় করেছে ঠিক সেভাবে। আমার সামনে যদি সেই মহাজাগতিক প্রাণী আসে আমি জানি সে আসবে ভালবাসার কোমল রূপে। আমি জানি।

রুখ অবাক হয়ে ক্রীনার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, তুমি তাই বিশ্বাস কর?

হ্যাঁ। আমি তাই বিশ্বাস করি। তুমি দেখতে চাও সেটি কি সত্যি না মিথ্যা?

রুখ ঘুরে তাকাল। ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যা আমি দেখতে চাই।

তা হলে দেখ।

ক্রীনা তার পোশাকের ভেতর থেকে একটা ধারালো ছোরা বের করে আনে। রুখ কিছু বোঝার আগে হঠাৎ করে সেটা দিয়ে এক পোচ দিয়ে নিজের কবজির কাছে বড় ধমনিটি কেটে ফেলল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এল সাথে সাথে, আর্তচিৎকার করে রুখ ক্রীনার হাত ধরে ফেলল, বলল, কী করলে তুমি? ক্রীনা? কী করলে?

মহাজাগতিক প্রাণীকে আমি আনতে পারি না রুখ! মহাজাগতিক প্রাণীকে শুধু তুমিই আনতে পার। ক্রীনা হাত থেকে গলগল করে বের হতে থাকা রক্তের ধারার দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থেকে বলল, আমাকে যদি এখন যথাযথভাবে চিকিৎসা করা না হয় তা হলে আমি মারা যাব। মানববসতি থেকে আমরা এত দূরে যে সেখানে আমাকে সময়মতো নেওয়া যাবে না।

কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যদি আমাকে ভালবাস তুমি যদি খুব তীব্রভাবে চাও আমি বেঁচে থাকি তা হলে মহাজাগতিক প্রাণী তোমার ডাকে আমাকে বাঁচাতে আসবে।

রুখ ক্রীনাকে জাপটে ধরে আর্তকণ্ঠে বলল, আমি তোমাকে ভালবাসি। নিজের চাইতেও বেশি ভালবাসি। ক্রীনা, দোহাই তোমার।

ক্রীনার মুখে ক্ষীণ একটা হাসি ফুটে ওঠে, তুমি চাইলে আসবে। আমি জানি।

রুখ ক্রীনার হাত ধরে রক্তের ধারাকে বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। ফিনকি দেওয়া রক্তে তার শরীর রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। সে ভয়ার্ত অসহায় গলায় চিৎকার করে বলল, কী করলে তুমি ক্রীনা? তুমি এ কী করলে? আমি তো চাই তুমি বেঁচে থাক, কিন্তু কেউ তো আসছে না! এখন কী হবে ক্রীনা?

ঠিক তখন কে রুখের কাঁধে হাত রাখল। রুখ চমকে পিছনে ঘুরে তাকাল, সাদা নিও পলিমারের কাপড়ে ঢাকা একজন অপূর্ব সুন্দরী মহিলা তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, দেখি বাছা, আমাকে একটু দেখতে দাও।

রুখ সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে জায়গা করে সরে দাঁড়াল। মহিলাটি ক্রীনার কাছে ঝুঁকে পড়ে, তার রক্তাক্ত হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে কোমল গলায় বলে, পাগলী মেয়ে আমার। এরকম করে কেউ কখনো নিজের হাত কাটে?

ক্রীনা অপলক চোখে এই অপূর্ব সুন্দরী মহিলার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মা! তুমি এসেছ?

এসেছি। কথা বলবি না এখন। চুপ করে শুয়ে থাক দেখি। ইস! কী খারাপভাবে কেটেছে!

ক্রীনা উঠে এসে হাত দিয়ে গভীর ভালবাসায় মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, মা, আমি জানি তুমি আমার কল্পনা। কিন্তু তাতে কিছু আসে–যায় না। আমার কাছে তুমিই আমার সত্যিকারের মা।

আহ! কী বকবক শুরু করলি–একটু স্থির হয়ে শুয়ে থাক দেখি। রক্তটা বন্ধ করা যায় কি না দেখি।

ক্রীনা আবার শুয়ে পড়ল, মহিলাটি তার হাতের উপর ঝুঁকে পড়লেন, নিও পলিমারের একটুকরা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলেন, গভীর স্নেহে ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ইস! যদি একটু দেরি হত তা হলে কী হত?

কেন দেরি হবে মা? তুমি তোমার মেয়েকে বাচাতে আসবে না?

আমার আর অন্য কাজ নেই ভেবেছিস?

আমি তোমাকে আগে কখনো দেখি নি। একসময়ে ভেবেছিলাম দেখেছি কিন্তু পরে জেনেছি সব আমাদের মস্তিষ্কে বসানো কাল্পনিক স্মৃতি। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা বসিয়েছে। তুমি চিন্তা করতে পার আমার কোনো মা নেই? কোনো মাতৃগর্ভে আমার জন্ম হয় নি!

ক্রীনার মা গভীর ভালবাসায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কে বলেছে তোর মা নেই? এই যে আমি। আমি কি তোর মা নই?

হ্যাঁ, মা। তুমি আমার মা।

রূপবতী মহিলাটি এবারে ঘুরে রুখের দিকে তাকালেন, বললেন, বাছা! তোমার এ কী অবস্থা? গায়ে কোনো কাপড় নেই। কালিঝুলি মেখে আছে!

রুখ হতচকিতের মতো মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। মহাজাগতিক প্রাণী ক্রীনা কল্পনা থেকে এই অপূর্ব সুন্দরী মাতৃমূর্তিকে তৈরি করেছে। এটি সত্যি নয় কিন্তু তার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল যে এটি সত্যি। সে ইতস্তত করে বলল, একটা দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম, গোলাগুলির বিস্ফোরণে

ক্রীনার মা নিজের শরীর থেকে একটুকরা নিও পলিমারের চাদর খুলে রুখের গায়ে জড়িয়ে দিলেন, সাথে সাথে তার সারা শরীরে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। তিনি রুখের মাথায় হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, আমার এই পাগলী মেয়েটিকে তুমি দেখে রাখবে তো বাছা?

রাখব। রাখব মা।

ক্রীনা অপলক দৃষ্টিতে তার ক্ষণকালের মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে তার বুকের ভিতরে এক ধরনের গভীর বেদনা অনুভব করে। তার মা তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, কিছু ভাবিস না মা সব ঠিক হয়ে যাবে।

মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি কি তোর সাথে মিছে কথা বলব?

কিন্তু কেমন করে সেটা সম্ভব? এই দেখ–রুখের দিকে তাকাও–তার ডি.এন.এ. পর্যন্ত পাল্টে দেওয়া আছে বেস পেয়ার বারোটি। মেতসিসের দিকে তাকাও–বুদ্ধিমান এনরয়েডরা। আমাদের ইচ্ছেমতো তৈরি করে! ইচ্ছেমতো ধ্বংস করে! তুমিই বল এটি কি মানুষের জীবন?

মা মুখ টিপে হাসলেন যেন সে ভারি একটা মজার কথা বলেছে! ক্রীনা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কী হল? তুমি হাসছ কেন? তোমার কি মনে হচ্ছে এটা হাসির ব্যাপার?

না, পাগলী মেয়ে। এটা মোটেই হাসির ব্যাপার নয় কিন্তু তোরা যত ব্যস্ত হচ্ছিস সেরকম তো নয়।

কী বলছ তুমি?

ঠিকই বলছি। আয় আমার সাথে।

কোথায়?

আয়, গেলেই বুঝতে পারবি।

মা ক্রীনাকে ধরে সাবধানে দাঁড় করিয়ে দিলেন। কীনা এখনো খুব দুর্বল, অন্য পাশে এসে রুখ তাকে ধরল। দুজন দুপাশে ধরে সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে। বড় পাথরটির অন্য পাশে এসেই ক্রীনা এবং রুখ দেখতে পেল পাথরের গায়ে হালকা নীল পরদার মতো স্বচ্ছ একটি মহাজাগতিক দরজা। ঠিক এরকম একটি দরজা দিয়ে রুখ মহাজাগতিক প্রাণীর জগতে প্রবেশ করেছিল। আয়নার মতো স্বচ্ছ পরদার কাছে দাঁড়িয়ে ক্রীনার মা বললেন, তোরা দুজন আয় আমার সাথে।

ক্রীনা বলল, ভয় করছে মা!

পাগলী মেয়ে! ভয়ের কী আছে? আমি আছি না সাথে?

ক্রীনা তার মাকে জড়িয়ে ধরে। সত্যিই তো তার ভয়ের কী আছে? নিজের কল্পনায় তৈরি মা থেকে আপন আর কী হতে পারে এই জগতে? ক্রীনা এক পা এগিয়ে স্বচ্ছ আয়নার মতো হালকা নীল রঙের মহাজাগতিক দরজা স্পর্শ করল। সাথে সাথে মনে হল কিছু একটা যেন প্রবল আকর্ষণে টেনে লি ভিতরে।

ক্রীনা ভয় পেয়ে ডাকল, মা, মা তুমি কোথায়?

এই যে পাগলী মেয়ে, আমি আছি তোর সাথে।

ক্রীনা হঠাৎ করে দেখতে পায় আদিগন্তবিস্তৃত সবুজ বনভূমি, নীল আকাশ, আকাশে সাদা মেঘের সারি। দূরে নীল পর্বতশ্রেণী, পর্বতের শৃঙ্গে সাদা তুষার। প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্যে হঠাৎ করে ক্রীনার চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আসে।

পছন্দ হয় ক্রীনা?

হ্যাঁ। মা। কোথা থেকে এল এই জায়গা?

তোদের স্মৃতি থেকে তৈরি করেছি। নিশ্চয়ই পৃথিবীর স্মৃতি! তোদের অবচেতন মনে লুকিয়ে ছিল।

কী হবে এই জগৎ দিয়ে?

পৃথিবীর অনুকরণে নতুন প্রাণী সৃষ্টি হবে এখানে।

সত্যি?

হ্যাঁ। তোর আর রুখের ডি. এন. এ. দিয়ে প্রথম মানুষের জন্ম হবে এখানে।

সত্যি মা?

হ্যাঁ। তোদের ভালবাসায় নতুন মানুষের জন্ম হবে এখানে। নতুন পৃথিবীর জন্ম হবে আবার।

সত্যি, মা? সত্যি?

হা! কী হল পাগলী মেয়ে, কাদছিস কেন তুই?

জানি না মা। আমি সত্যিই জানি না।

১৫. বড় হলঘরের দরজা খুলে

বড় হলঘরের দরজা খুলে একজন কমবয়সী তরুণী এসে প্রবেশ করল, উত্তেজিত গলায় বলল, স্কাউটশিপ! স্কাউটশিপ আসছে।

কয়টা?

একটা!

রুখ আর ক্রীনা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারা আন্দাজ করতে পারে স্কাউটশিপে করে কে আসছে। কেন আসছে। কী দ্রুতই–না অবস্থার পরিবর্তন হয়।

রুহান গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, রুখ, ক্রীনা, কী করবে এখন?

চল বাইরে যাই। হাজার হলেও বুদ্ধিমত্তার নিনীষ স্কেলে আমাদের উপরের স্তরে! প্রয়োজনীয় সম্মানটুকু না দেখালে কেমন করে হয়?

স্কাউটশিপটা ঘুরে খোলা জায়গাটিতে এসে নামল। গোলাকার দরজাটি খুলে যায় এবং ভিতর থেকে রয়েড নেমে আসে। রুখ এবং ক্রীনা এগিয়ে গিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

আমাদের মানববসতিতে তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি রয়েড।

ধন্যবাদ। আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।

রয়েড

বল।

তোমরা কি আগে কখনো মানববসতিতে এসেছ?

রয়েড কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, না, আসি নি। কখনো প্রয়োজন মনে করি নি।

এখন?

রয়েড সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে ফেলল, এখন আমাকে আসতেই হবে।

কেন?

তোমাদের একটা জিনিস পৌঁছে দিতে হবে।

কী জিনিস?

রয়েড তার পকেট থেকে একটা ছোট ক্রিস্টাল বের করে রুখ এবং ক্রীনার দিকে এগিয়ে দিল। রুখ ক্রিস্টালটি হাতে তুলে নিয়ে বলল, এটা কী?

প্রায় সাড়ে সাত শ বছর আগে মেতসিস যখন তার যাত্রা শুরু করেছিল তখন পৃথিবীর বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন ক্লাউস ট্রিটন। ক্লাউস ট্রিটন এই মেতসিসে একরকম জোর করে মানুষকে পাঠিয়েছিলেন। মেতসিসের মূল তথ্যকেন্দ্রে এই ক্রিস্টালটিতে তিনি মানুষের উদ্দেশে কিছু কথা বলে গিয়েছিলেন। ক্রিস্টালটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার কথা—যখন–

যখন?

যখন মেতসিসের সর্বময় দায়িত্বে থাকবে মানুষ।

রুখ এবং ক্রীনা চমকে উঠে বলল, কী বললে? কী বললে তুমি রয়েড?

ঠিকই বলেছি। মেতসিসের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবীর বুদ্ধিমত্তাকে ছড়িয়ে দেওয়া। তোমরা সেই কাজটি করেছ। তোমাদের ডি. এন. এ. দিয়ে এখানে নতুন জগৎ তৈরি হয়েছে। মেতসিসে আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে। রয়েড খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, আমাদের বিদায় নেবার সময় হয়েছে। এই মেতসিস তোমাদের। তোমরা এটিকে নিজের মতো করে গড়ে তোল।

রুখ এবং ক্রীনা দাঁড়িয়ে রইল, দেখতে পেল রয়েড হেঁটে হেঁটে স্কাউটশিপে গিয়ে ঢুকছে। চাপা গর্জন করে শক্তিশালী ইঞ্জিন স্কাউটশিপটাকে ধীরে ধীরে উপরে উঠিয়ে নেয়, তারপর সেটি উড়ে যেতে থাকে দূরে।

পরিশিষ্ট

বড় হলঘরটিতে মানুষেরা ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছে। রুখ হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঘরের মাঝামাঝি একটি যান্ত্রিক মানুষের মুখাবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যান্ত্রিক মানুষটি নিচু কিন্তু স্পষ্ট গলায় কথা বলতে শুরু করে।

আমি ক্লাউস ট্রিটন। পৃথিবীর বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক। আমার অনুমান সত্যি হয়ে থাকলে তোমরা মানুষেরা আমার বক্তব্য শুনছ। আমার স্বপ্ন সত্যি হয়ে থাকলে তোমরা মানুষেরা আবার মেতসিসে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছ।

বুদ্ধিমত্তার সংজ্ঞা হচ্ছে সেটিকে ছড়িয়ে দেবার ক্ষমতা। তোমরা সেটি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো একটা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছ। তোমাদের অভিনন্দন। মানুষের বুদ্ধিমত্তা পৃথিবীতে যেভাবে বিকশিত হয়েছিল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও সেটি আবার বিকশিত হোক।

আমার অনুমান সত্যি হয়ে থাকলে এই মেতসিসে তোমাদের নতুন জীবন শুরু হয়েছে। আজ থেকে এর সর্বময় দায়িত্ব তোমাদের, মানুষের। পৃথিবীর বুক থেকে একদিন মানুষকে অপসারণ করে আমরা যে তীব্র অপরাধবোধে দগ্ধ হয়েছি আজ সেই অপরাধবোধ থেকে আমরা মুক্তি পেলাম। আমার প্রিয় মানবসন্তানেরা, তোমাদের জন্য আমার ভালবাসা।

মানুষের ভালবাসাতে একদিন পৃথিবীতে যেভাবে মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছিল, মেতসিসে সেই একইভাবে নতুন সভ্যতা গড়ে উঠুক। মানুষের জয়গানে মুখরিত হোক এই মহাজগৎ।

হলোগ্রাফিক স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেল। রুখ হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালাতে চাইছিল, ক্রীনা নিচু স্বরে বলল, জ্বলিও না।

জ্বালাব না?

না, থাকুক না অন্ধকার।

রুখ দেখল ক্রীনার চোখের কোনায় অশ্রু চিকচিক করছে। সে গভীর ভালবাসায় তাকে আলিঙ্গন করে নিজের কাছে টেনে আনে।

Exit mobile version