খামোখা সন্দেহ করেছিস মনে হয়, আমি না বলে পারলাম না, চমৎকার ভালোমানুষের মতো চেহারা, কী সুন্দর ব্যবহার!
তোরা তো আছিস হোটেলে, দেখিস তো লোকটা সন্দেহজনক কিছু করে কি না। আবার বাড়াবাড়ি কিছু করিস না যেন।
কোনো ভয় নেই তোর, আমি মতিনকে সাহস দিই, পাকা ডিটেকটিভদের মতো কাজ করব আমরা।
সফদর আলী বললেন, ওর ঘড়িটা খুলে আমার মাইক্রোট্রান্সমিটারটা ঢুকিয়ে দিতে পারলে–
মতিন বাধা দিয়ে বলল, না না না, সর্বনাশ! ওসব জিনিসের ধারে-কাছে যাবেন, খবরদার!
সফদর আলীর একটু মন খারাপ হয়ে গেল বলে মনে হল।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর আমার বেশ খানিকক্ষণ লাগল বুঝতে আমি কোথায়। নতুন জায়গায় ঘুমালে আমার সবসময় এরকম হয়। হঠাৎ মনে পড়ল আমি কোথায়, সাথে সাথে মনে পড়ল যে আমি ছুটি কাটাতে বেড়াতে এসেছি। অনেক বেলা হয়ে গেছে, কিন্তু ওঠার কোনো তাড়া নেই, চিন্তা করেই আমার আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়, ভাবলাম আরো খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিই, কিন্তু আর ঘুম আসতে চাইল না। খানিকক্ষণ গড়াগড়ি করে শেষ পর্যন্ত উঠেই পড়লাম, পাশের বিছানাতে সফদর আলী কুণ্ডলী পাকিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো শুয়ে আছেন। তাঁকে না জাগিয়ে বাথরুমে গেলাম দাঁত মেজে গোসল ইত্যাদি সেরে ফেলতে। অনেক সময় নিয়ে সবকিছু শেষ করে যখন বের হয়ে এলাম, তখনো সফদর আলী ঘুমে। ঘড়িতে তখন দশটা বেজে যাচ্ছে। তাঁকে না জাগিয়ে আমি বেরিয়ে আসি, সামনে বিস্তীর্ণ সমুদ্র দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। হোটেলের সামনে একটা খুব আরামের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে আমাদের হোটেলের মালিক। তার হাতে দু’টি কবুতর, নিচে আরো কয়েকটি দানা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। ভদ্রলোকের খুব পাখির শখ বলে মনে হয়। আমাকে দেখে ভালোমানুষের মতো হাসলেন, আমিও দাঁড়িয়ে ভদ্রতার একটা দুইটা কথা বললাম। মতিন বলেছিল, হোটেল মালিক সন্দেহজনক কিছু করে কি না দেখতে, কিন্তু এরকম নিরীহ গোবেচারা মানুষ সন্দেহজনক কী করতে পারে আমি বুঝে পেলাম না। আমি তবুও পাকা ডিটেকটিভের মতো সবকিছু সন্দেহের চোখে দেখতে থাকি, কবুতরগুলো পর্যন্ত বাদ গেল না।
বেশ খানিকক্ষণ গল্প গুজবে কেটে গেছে, হঠাৎ শুনি জিপের শব্দ। মতিন আসছে কি না দেখার জন্যে চোখ তুলে দেখি কটা জিপভর্তি পুলিশ দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। এদিকে গাড়ির যাতায়াত কম, তাই একটা কিছু গেলেই দশজন দাঁড়িয়ে দেখে, হোটেল মালিকও ঘাড় ঘুরিয়ে জিপটাকে দেখলেন। জিপটা কোথায় কেন যাচ্ছে বুঝতে আমার একটুও দেরি হল না। এখন হোটেল মালিককে চোখে চোখে রাখলেই বুঝতে পারব সে সন্দেহজনক কিছু করছে কি না। সে যদি হেরোইন কারবারিদের এক জন হন, তাহলে তাকে এখন উঠে পড়তে হবে। ঘরের ভেতরে গোপন কোনো ওয়্যারলেসে খবর পাঠাতে হবে। পাকা ডিটেকটিভদের মতো আমি ঠিক করলাম তা হলে আমি কী করব, আমিও তাহলে সফদর আলীকে ডেকে তুলব ওয়্যারলেসের সংকেতটা ধরতে।
হোটেল মালিক জিপটাকে দূরে প্রায় অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকেন, আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলাম। চোখে চোখ পড়তেই বললেন, পুলিশ মাঝে মাঝেই ওদিকে যায়, আরাকান থেকে ডাকাত আসে কি না কে জানে।
আমি বললাম, তাই নাকি?
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বসে থাকেন। ওঠার কোনো লক্ষণ দেখালেন না। বসে বসে কবুতর নিয়ে খেলতে থাকেন। খুব শখের কবুতর নিশ্চয়ই।
প্রায় মিনিট পনের পার হয়ে গেল। ভদ্রলোক তবু চুপচাপ বসে রইলেন। হেরোইন কারবারি হলে এতক্ষণে উঠে যেতেন নিশ্চয়ই। হোটেল মালিক শুধু যে বসে আছেন তাই নয়, ওঠার জন্যে উসখুস পর্যন্ত করছেন না। কবুতর নিয়ে বসে বসে ক্লান্ত হয়ে একসময়ে কবুতরগুলো উড়িয়ে দিয়ে আরামের চেয়ারটাতে আধশোয়া হয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকেন। হোটেলের এক জন কর্মচারী এসে একবার কোন-কোন রুমের বিছানার চাদর পাল্টাতে হবে জিজ্ঞেস করে গেল। ভদ্রলোক শুয়ে শুয়েই তার সাথে কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আমি উঠে একটু এদিক-সেদিক হেঁটে আসি। হোটেল মালিককে কিন্তু সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখছিলাম। একসময় দেখি সফদর আলী বেশ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসছেন। আমার খোঁজেই সম্ভবত। সফদর আলী আমার কাছে এলে আমি তাকে পুরো ঘটনাটি বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খুলে বললাম, একেবারে পাকা ডিটেকটিভদের মতো। সফদর আলীর উৎসাহ আমার থেকে বেশি। তিনি তৎক্ষণাৎ ঘরে গিয়ে তার সেই যন্ত্র বের করে এলেন। হোটেল মালিক চেয়ার থেকে উঠে ভেতরে গেলেই তিনি সেটা চালু করে দেবেন। এই হোটেল থেকে যদি খবর পাঠানো হয় তাহলে নাকি সেটা ধরে ফেলা পানির মতো সোজা। হোটেল মালিক কিন্তু উঠলেন না, মনে হল চেয়ারে বসে বসে একসময় যেন একটু ঘুমিয়েই পড়লেন।
আমাদের সকালে নাস্তা করা হয় নি, খিদে বেশ চাগিয়েই উঠেছে। কিন্তু ডিটেকটিভের এরকম একটা দায়িত্ব ছেড়ে তো যেতে পারি না। প্রায় দু’ঘন্টা পর হোটেল মালিক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, সাথে সাথে আমরাও উঠে পড়ি। সফদর আলী গুলির মতো ঘরে চলে গেলেন, আমি হোটেল মালিকের পিছু পিছু। হোটেল মালিক ভেতরে ঢুকে কাউন্টারে বসে গুনগুন করে কী একটা সুর ভাঁজতে ভাজতে কাগজপত্র দেখতে থাকেন। সামনের সোফাতে সেদিনের খবরের কাগজ পড়ে ছিল আমি সেটা দেখার ভান করে তাঁকে লক্ষ করতে থাকি একেবারে পাকা। ডিটেকটিভদের মতো।