Site icon BnBoi.Com

ফোবিয়ানের যাত্রী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ফোবিয়ানের যাত্রী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১. সকালে ঘুম ভাঙতেই

আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ল, অস্পষ্ট আবছা এবং হালকাভাবে নয়— অত্যন্ত তীব্রভাবে। মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ নেই প্রায় বারো বৎসর— আমার ধারণা ছিল খুব ধীরে ধীরে আমার মস্তিষ্ক থেকে মায়ের স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে আসছে। কিন্তু আজ ভোরবেলা আমি বুঝতে পারলাম সেটি সত্যি নয়, মায়ের স্মৃতি হঠাৎ করে আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। মা এবং সন্তানের মাঝে প্রাণীজগতের যে তীব্র তীক্ষ্ণ এবং আদিম ভালোবাসা রয়েছে সেই ভালোবাসার একটুখানির জন্যে আজ সকালে আমি বুকের ভিতরে একধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি, আমার মাকে একনজর দেখার জন্যে কিংবা একবার স্পর্শ করার জন্যে হঠাৎ করে নিজের ভেতর একধরনের বিচিত্র অস্থিরতা আবিষ্কার করে আমি নিজেই একটু অবাক হয়ে যাই।

আমি নিজের ভেতরকার এই অস্থিরতা দূর করার জন্যে বিছানায় শুয়ে শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আলোর প্রতিফলন এবং বিচ্ছুরণ ব্যবহার করে আমার ছোট বাসস্থানটিতে খানিকটা বিশালত্ব আনার চেষ্টা করা হয়েছে— বাসার ছাদটিকে মনে হয় আকাশের কাছাকাছি। সেই সুদূর আকাশের কাছাকাছি ধূসর ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকেও আমার ঘুরেফিরে মায়ের কথা মনে হতে থাকে, আমার বর্ণাঢ্য শৈশবের নানা ঘটনা আমার মনকে বিক্ষিপ্ত করে তুলতে শুরু করে। আমি আমার বিছানায় সোজা হয়ে বসে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথার কাছে সুইচটা স্পর্শ করলাম, সাথে সাথে ঝুপ করে বিছানাটা নিচে নেমে এল। আমি অনাবৃত শরীরটি নিও পলিমারের চাদর দিয়ে ঢেকে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরের বিস্তৃত লোকালয় চোখে পড়ে। সারি সারি বসতি গায়ে গায়ে জড়িয়ে উঁচু হয়ে উঠেছে, অনেক উঁচুতে বায়োডোম পুরো বসতিটিকে এই গ্রহের ভয়ঙ্কর পরিবেশ থেকে রক্ষা করে রেখেছে। বাইরে হালকা বেগুনি আলো দেখেই কেমন জনি মন খারাপ হয়ে যায়। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে জানালা থেকে সরে এলাম আমার ঘরের দেওয়ালে ত্রিমাত্রিক ভিডি টিউব বসানো রয়েছে, অনেকটা অন্যমনস্কভাবে সেটা স্পর্শ করতেই ঘরের মাঝামাঝি আমার মায়ের ত্রিমাত্রিক ছবি জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠল। ষোলো-সতেরো বছরের একজন কিশোরীর মতো চেহারা, কোমল ত্বক এবং লালচে চুল। শাদা রংয়ের পোশাকে আমার মাকে স্বর্গ হতে নেমে আসা একজন দেবীর মতো দেখায়। মা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস বাবা ইবান?

আমি জানি এটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক ছবি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি অসংখ্যবার আমার মায়ের এই একমাত্র ভিডিও ক্লিপটা দেখেছি। কিন্তু তবু আমি ফিসফিস করে বললাম, ভালো আছি মা। আমি ভালো আছি।

হলোগ্রাফিক ছবিতে আমার মা একদৃষ্টিতে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে কোমল গলায় বললেন, কতদিন তোকে দেখি না— এতদিনে তুই নিশ্চয়ই আরো কত বড় হয়েছিস। আমার মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে তুই কোথায় আছিস, কেমন আছিস।

মা খানিকক্ষণ চুপ করে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বিষণ্ণ গলায় বললেন, যেখানেই থাকিস বাবা ইবান, তুই ভালো থাকিস।

আমি ফিসফিস করে বললাম, তুমি ভেবো না মা, আমি ভালো থাকব।

আমার মা ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তার চোখ মুছে কাতর গলায় বললেন, আমার উপর রাগ পুষে রাখিস না বাবা— আমি আসলে বুঝতে পারি নি। যদি বুঝতে পারতাম তাহলে আমি তোকে এমনভাবে জন্ম দিতাম না। বিশ্বাস কর–

আমার মা ভেঙে পড়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন আমি তার আগেই ভিডি টিউবটা বন্ধ করে দিলাম আমি অসংখ্যবার আমার কাছে রাখা আমার মায়ের একমাত্র হলোগ্রাফিক ভিডিও ক্লিপটা দেখেছি, ভিডিও ক্লিপের এই অংশে মায়ের তীব্র অপরাধবোধের গ্লানিটুকু দেখতে আমার ভালো লাগে না। জিনের প্রতিটি ক্রমাবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করে যখন একজন মানুষকে অতিমানবের পর্যায়ে জন্ম দেয়া যায় তখন আমার মতো সাধারণ একজন মানুষের জন্ম দিয়ে আমার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে আমার মা সেজন্যে নিজেকে কখনো ক্ষমা করেন নি। আমার চারপাশে যারা আছে তারা সবাই সূক্ষ্ম হিসেবনিকেশ করে জন্ম দেওয়া মানুষ। তারা সুদর্শন, সুস্থ সবল, মেধাবী, প্রতিভাবান এবং সাহসী। তাদের তুলনায় আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ, আমার ভিতরে অন্য মানুষের জন্য ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো বিশেষ। গুণাবলি নেই। আমাকে জন্ম দেওয়ার আগে আমার মা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে শুধুমাত্র এই মানবিক একটি ব্যাপার নিশ্চিত করেছিলেন তার ধারণা ছিল একজন ভালো মানুষ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মানুষ, সুখী মানুষ। আমাকে তাই একজন হৃদয়বান ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বড় হতে গিয়ে আমি আবিস্কার করেছিলাম মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের এই স্তরে আসলে আমার মতো মানুষের প্রয়োজন খুব কম। আমি বড় হতে গিয়ে পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমাকে ভালো স্কুলে যেতে দেওয়া হয় নি, বড় সুযোগ থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছেএকরকম জোর করে বারবার আমাকে প্রমাণ করতে হয়েছে যে আমি আসলে অক্ষম নই। আমার বয়স যখন মাত্র তেরো বৎসর তখন এই বৈষম্য থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে আমি আমাদের গ্রহ থেকে পালিয়ে এসেছিলাম, প্রথমে একটা মহাকাশযানের শিক্ষানবিশী হিসেবে কাজ করেছি, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে আমি শেষপর্যন্ত চতুর্থ মাত্রার বাণিজ্যিক মহাকাশযান চালানোর লাইসেন্স পেয়েছি। আমার মা আজ আমাকে দেখলে খুব খুশি হতেন— তার ছেলেকে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে অতিমানবের কাছাকাছি পৌঁছে না দেওয়াতেই খুব একটা ক্ষতি হয় নি। যেটুকু অর্জন। করার আমি সেটুকু অর্জন করে নিয়েছি, কষ্ট হয়েছে সত্যি কিন্তু অসাধ্য হয় নি।

আমি ভিডি টিউবের সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, তারপর একরকম জোর করে মাথা থেকে সবকিছু বের করে দিলাম— দিনটি মাত্র শুরু হয়েছে, নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে একেবারেই নেই।

 

ভোরবেলা আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশযানের একটি প্রদর্শনীতে যাবার কথা ছিল। সেখানে রওনা দেবার আগেই ভিডি টিউব। থেকে একটি জরুরি সংকেত এল। এই কলোনির আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগব্যবস্থার পরিচালকে লি-হান আমার সাথে কথা বলতে চায়— ভিডি টিউবে নয়, সরাসরি। আমি টিউবটি তুলে রেখে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। সরাসরি কথা বলার একটিই অর্থ, কোনো একটি আন্তঃনক্ষত্র অভিযানের চুক্তি পাকাপাকি করে ফেলা। আমি মাত্র একটি অভিযান শেষ করে এসেছি, নতুন করে কোথাও যাবার আগে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলাম সেটি আর সম্ভব হবে বলে মনে। হয় না।

ঘণ্টাখানেকের মাঝে আমার পরিচালকের সাথে দেখা হলো, মধ্যবয়স্ক হাসি খুশি মানুষ, আমাকে দেখে হাত উপরে তুলে আনন্দ প্রকাশ করার একটি ভঙ্গি করে বলল, এই যে ইবান, তোমাকে পেয়ে গেলাম!

আমি হেসে বললাম, লি-হান, তুমি এমন ভান করছ যে আমাকে পেয়ে যাওয়া খুব সৌভাগ্যের একটা ব্যাপার!

অবশ্যি সৌভাগ্যের ব্যাপার! এই পোড়া কলোনিতে কি মানুষ থাকে? একজন একজন করে সবাই সরে পড়ছে!

আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, চারপাশে বেগুনি রংয়ের একধরনের চাপা আলো, বহু উপরে বায়োডোমের উপর গ্রহটির প্রলয়ঙ্করী আবহাওয়া হুটোপুটি খাচ্ছে। চেষ্টা করলে এখান থেকেও সেই বাতাসের হুটোপুটি শোনা যায়। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ঠিকই বলেছ। এই কলোনিটা আসলে মানুষের থাকার অযোগ্য। আমার সবসময় কী ভয়। হয় জানো?

কী?

একদিন এই বায়োডোম ধসে পড়বে আর আমরা সবাই ব্যাক্টেরিয়ার মতো মারা পড়ব। ঠিক গ্রিশিন গ্রহের কলোনির মতো।

লি-হান হা হা করে হেসে বলল, তোমাকে যেন ব্যাক্টেরিয়ার মতো মারা যেতে না হয় সেই ব্যবস্থা করে ফেলেছি। পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানে করে তোমাকে এই কলোনি ছেড়ে চলে যাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি জানো আমার পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযান চালানোর লাইসেন্স নেই।

আমরা সেই লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেব।

আমি ভুরু কুঁচকে আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগব্যবস্থার পরিচালক লি-হানের দিকে তাকালাম, লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেবে?

হ্যাঁ।

কেন?

কারণ এটি জরুরি। তা ছাড়া আমরা তোমার ফাইল খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি, আমাদের কমিটি মনে করে পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে। তোমার কোনো জিনেটিক প্রাধান্য নেই, কিন্তু সেটি ছাড়াই তুমি অনেক ওপরে চলে এসেছ— কমিটি সেটা খুব বড় করে দেখেছে।

আমি তীক্ষ্ণ চোখে লি-হানের চোখের দিকে তাকিয়ে পুরো ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করলাম। আমি জানি যাদের জিনেটিক প্রাধান্য নেই তাদেরকে প্রায় মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করা হয় না। লি-হান আমার সাথে কোনো কারণে মিথ্যে কথা বলছে। লি-হান আমার দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, আমার মনে হয় এটি তোমার জন্যে চমৎকার একটি সুযোগ। পরবর্তী কমিটি অন্যরকম হতে পারে তারা তোমাকে সেই সুযোগ না-ও দিতে পারে।

আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমার মা আমাকে জন্ম দেবার আগে জিনেটিক কোডিংয়ে। বুদ্ধিশুদ্ধি বিশেষ কিছু দেন নি! আমি সম্ভবত অন্য মানুষের তুলনায় খানিকটা নির্বোধই— কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছে এখানে অন্য ব্যাপার রয়েছে।

লিহান অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বলল, অন্য কী ব্যাপার?

আমি আমার স্বল্প বুদ্ধি দিয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করছি। আমার ধারণা এই অভিযানের খুঁটিনাটি জানতে পারলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন মনে করো আমার প্রথম কৌতূহল গন্তব্যস্থান নিয়ে আমাকে মহাকাশযান নিয়ে কোথায় যেতে হবে?

লি-হান আমার দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল, রিশি নক্ষত্রের কাছে যে গ্রহাণুপুঞ্জ আছে। সেখানে।

আমি চমকে উঠে সোজা হয়ে বসে বললাম, কী বললে? রিশি নক্ষত্রের কাছে?

লি-হান দুর্বল গলায় বলল, হ্যাঁ।

তার মানে আমাকে যেতে হবে মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে দিয়ে?

হ্যাঁ, তা ছাড়া উপায় নেই। দুই পাশে দুটি ব্ল্যাকহোল থাকায় যাত্রাপথটা হয় ঠিক মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে দিয়ে। আমি স্বীকার করছি এত কাছাকাছি দুটি ব্ল্যাকহোল থাকলে যাত্রাপথ বিপজ্জনক।

আমি লি-হানকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করছ। তুমি খুব ভালো করে জানো ব্ল্যাকহোল কোনো সমস্যা নয়, গত একশ বছর থেকে মানুষ ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষ শক্তি ব্যবহার করে মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছে। সমস্যা অন্য জায়গায়।

লি-হান চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বলল, সমস্যা কোথায়?

তুমি খুব ভালো করে জানো কোথায়। ঐ অঞ্চলে মানুষের কলোনি বিদ্রোহ করে আলাদা হয়ে গিয়েছে। পুরো এলাকাটা এখন ছোট-বড় একশটা মহাকাশ- দস্যুর আখড়া। গত দশ বৎসরে এই পথ দিয়ে যত মহাকাশযান গেছে তার অর্ধেক লুট হয়ে গেছে। কোনো ক্রু জীবন্ত ফিরে আসে নি!

তুমি অতিরঞ্জন করছ ইবান।

আমি এতটুকু অতিরঞ্জন করছি না— তোমরা সত্য গোপন করছ তা না হলে সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি হতো। আমি হঠাৎ করে নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করতে থাকি। অনেক কষ্ট করে গলার স্বরকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, শুধু কী মহাকাশ-দস্যু? মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জ হচ্ছে অনাবিষ্কৃত এলাকা। সেখানে কোনো একধরনের মহাজাগতিক প্রাণী রয়েছে—

লিহান অবাক হবার ভান করে বলল, তাতে কী হয়েছে? মহাজগতে মানুষ ছাড়াও যে প্রাণী রয়েছে সেটি তো আর নতুন কোনো ব্যাপার নয়!

না সেটি নতুন ব্যাপার নয়। আমি মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু সেই প্রাণী যদি বুদ্ধিমান হয়, সেই প্রাণী যদি ভয়ঙ্কর হয়, সেই প্রাণী যদি মানুষের প্রতি শত্র ভাবাপন্ন হয় এবং মানুষ যদি সেই প্রাণী সম্পর্কে কিছু না জানে তাহলে মানুষ তাদের ধারেকাছে যায় না। সে-সম্পর্কে সুস্পষ্ট মহাজাগতিক আইন রয়েছে। আমাকে সেদিক দিয়ে পাঠিয়ে তোমরা মহাজাগতিক আইন ভাঙার চেষ্টা করছ।

লি-হানের মুখ একটু অপ্রসন্ন হয়ে ওঠে। সে শীতল গলায় বলল, তুমি যদি যেতে না চাও তাহলে যাবে না, আমি ভেবেছিলাম এটি তোমার জন্যে একটি চমৎকার সুযোগ।

কোনটি সুযোগ আর কোনটি আমাকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র সেই সিদ্ধান্তটা আমাকেই নিতে দাও। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পঞ্চম মাত্রার এই মহাকাশযানে আমাকে কী কারগো নিতে হবে?

লিহান বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, আমি বাজী ধরে বলতে পারি সেই কারগো হবে দূষিত, বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক কোনো জিনিস। যে জিনিস ধ্বংস হয়ে গেলে তোমাদের কারো কোনো মাথাব্যথা হবে না। হয়ত এমনও হতে পারে যে তোমরা চাও সেই কারগো ধ্বংস হয়ে যাক।

লি-হান এবারে তার মুখ একটু কঠিন করে বলল, তুমি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছ ইবান। এই অভিযানের কারগো খুব গুরত্বপূর্ণ।

সেটি কী?

তুমি যতক্ষণ এই যাত্রাপথে যেতে রাজি না হচ্ছ আমি তোমাকে সেটা বলতে পারব না।

কিন্তু আমি যতক্ষণ জানতে না পারছি আমাকে কী কারগো নিয়ে যেতে হবে ততক্ষণ আমি রাজি হতে পারছি না।

লি-হান ভুরু কুঁচকে কতক্ষণ কিছু-একটা চিন্তা করে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে আমি তোমাকে বলছি। তোমার কারগো আসলে জীবন্ত একজন মানুষ।

মানুষ?

হ্যাঁ। মানুষটির নাম হচ্ছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। ম্যাঙ্গেল ক্বাস হচ্ছে—

আমি বাধা দিয়ে বললাম, তোমাকে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের পরিচয় দিতে হবে না, আমি তাকে চিনি।

তুমি দেখেছ আমার ধারণা সত্যি? মহাকাশযানের কারগো সত্যি-সত্যি দূষিত, বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক?

লি-হান শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কোনো কথা বলল না। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, বেগুনি রংয়ের আলোটাতে একটা কালচে গা-ঘিনঘিন-করা ভাব। চলে এসেছে, দেখেই কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস এই সময়কার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ মহাকাশ-দস্যু। সাধারণত একটি স্বার্থ নিয়ে দুদলের মাঝে সংঘর্ষ বেধে যায় এবং একদল অন্য দলকে দস্যু বলে সম্বোধন করে। মহাজাগতিক অনেক কলোনিতেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্যে ছোট ছোট মানবগোষ্ঠী বিদ্রোহ করেছে এবং অনেক সময় তাদেরকে দস্যু আখ্যা দিয়ে খুব নিষ্ঠুরভাবে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের ব্যাপারটি সেরকম নয়— সে প্রকৃত অর্থেই দস্যু, ছোট সুগঠিত একটা দল নিয়ে সে মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছাকাছি থাকে, অত্যন্ত কৌশলে সে আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশযানগুলোকে দখল করে নেয়। মহাকাশযানের কুদের প্রতি আমানুষিক নিষ্ঠুরতা নিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। মানুষটি সুদর্শন এবং বুদ্ধিমান, আধুনিক প্রযুক্তি সে খুব দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে। মানুষের মস্তিষ্কের উপর তার মৌলিক গবেষণা রয়েছে বলেও শোনা যায়। মহাজাগতিক প্রতিরক্ষাবাহিনী অনেকদিন থেকে তাকে ধরার চেষ্টা করছিল এবং মাত্র কিছুদিন আগে তাকে ধরতে পেরেছে। বিচারের জন্যে তাকে আঞ্চলিক কেন্দ্রে পাঠাতে হবে— আমি অবশ্যি মনে করি এত ঝামেলা না করে প্রতিরক্ষাবাহিনীই তার বিচার করে শাস্তি দিয়ে ফেলতে পারত। এই ভয়ঙ্কর মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখা আসলে বিপদকে ঘরে টেনে আনা ছাড়া আর কিছু নয়।

আমার সামনে বসে থাকা লি-হান এবারে একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সত্যিই যেতে চাও না?

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মতো চরিত্রকে নিয়ে যাওয়াটা কি তুমি খুব আকর্ষণীয় কাজ মনে কর?

কিন্তু তাকে শীতল করে পাথরের মতো জমিয়ে ফেলা হবে, টাইটেনিয়ামের ভল্টের মাঝে পাকাপাকিভাবে আটকে রাখা হবে। মহাকাশযানের কারগো-বে তে তাকে মালপত্র হিসেবে নেয়া হবে— মানুষ হিসেবে নেয়া হবে না।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, সত্যি কথা বলতে কী তোমরা যদি মানুষটিকে শীতলঘরে করে না নিতে, যদি তার সাথে কথা বলা যেত তাহলে আমার একটু আগ্রহ ছিল। আমি কথা বলে দেখতাম এই ধরনের মানুষেরা কীভাবে চিন্তা করে।

না, তোমার সেই সুযোগ নেই। লি-হান মাথা নেড়ে বলল, একেবারেই নেই।

মহাকাশযানের অন্য কুদের কীভাবে বেছে নিচ্ছ?

আমার প্রশ্ন শুনে হঠাৎ করে লি-হান নিজের নখের দিকে তাকিয়ে সেটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করল এবং আমি বুঝতে পারলাম এ-ব্যাপারেও নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা রয়েছে। আমি আবার টের পেলাম আমার ভিতরে। একটা শীতল ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে কষ্ট করে শান্ত করে আমি একটু সামনে ঝুঁকে পড়ে বললাম, এই ক্রুয়ের ব্যাপারটাও তাহলে আমি অনুমান করার চেষ্টা করি। আমার ধারণা এই অভিযানে ক্রু হিসেবে যাবে এমন কিছু মানুষ যাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। আমার মতো—

লি-হান বাধা দিয়ে বলল, আসলে কোনো ক্রু থাকবে না। তুমি একা এই মহাকাশযানটি নিয়ে যাবে।

আমি চমকে উঠে বললাম, একা?

হ্যাঁ।

একটি আন্তঃনক্ষত্র অভিযানে একজন মানুষ একা একটি পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযান নিয়ে যাবে?

হ্যাঁ। নতুন পঞ্চম মাত্রার যে মহাকাশযানগুলো বের হয়েছে সেগুলো বিস্ময়কর। প্রকৃত অর্থেই সেখানে কোনো মানুষের প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র মহাজাগতিক আইন রক্ষা করার জন্যে এখনো অধিনায়ক হিসেবে মানুষ রাখতে হয়। তাদেরকে কর্তৃত্ব দেয়া হয়।

আমি কোনো কথা না বলে লি-হানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। সে আমার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল, পঞ্চম মাত্রার এই মহাকাশযানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে নতুন যে সিস্টেম দাঁড় করানো হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই তা মানুষের মস্তিষ্ক থেকে ভালো। সত্যি কথা বলতে কী আমরা যদি নিউরণ সংখ্যা, এবং সিনান্স সংযোগ এসব দিয়ে হিসেব করি তাহলে এই সিস্টেমকে প্রায় একডজন মানুষের মস্তিষ্কের সুষম উপস্থাপন হিসেবে বিবেচনা করতে পার। যার অর্থ হচ্ছে—

আমি জানি।

লি-হান হা হা করে হেসে বলল, অবশ্যি তুমি জানো। মানুষের মস্তিষ্কের ওপর তোমার কৌতূহলের কথা সবাই জানে।

হ্যাঁ। আমি শীতল গলায় বললাম, সবাই এটাও জানে যে এটা এসেছে আমার হীনমন্যতা থেকে। যেহেতু বুদ্ধিমত্তায় আমার জিনেটিক প্রাধান্য নেই তাই আমি সবসময় বোঝার চেষ্টা করি বুদ্ধিমত্তা এসেছে কোথা থেকে। প্রচলিত বিশ্বাস এটা আমার দুর্বলতা। আমার সীমাবদ্ধতা।

লি-হান মাথা নাড়ল, বলল, না, তোমার এ ধারণা সত্যি নয়। তোমাকে আমি তোমার সম্পর্কে কমিটির রিপোর্ট দেখাতে পারব না, যদি পারতাম তাহলে দেখতে তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে কমিটির পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।

কোনটি সত্যি কথা, কোনটি মিথ্যা কথা এবং কোনটি কাজ উদ্ধারের জন্যে চাটুকারিতা সেটা বোঝা আমার জন্যে কঠিন নয়। কখন কথা বলতে হয় কখন চুপ করে থাকতে হয় এবং কখন রেগে যেতে হয় এতদিনে আমি সেটাও শিখে ফেলেছি, কাজেই আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলাম।

লি-হান তার গলায় একটু বাড়াবাড়ি উচ্ছ্বাস ফুটিয়ে বলল, বারোজন মানুষের মস্তিষ্কের সুষম উপস্থাপন-এর অর্থ। বুঝতে পারছ? বারোজন মানুষ নয়— বারোগুণ মানুষ— বুদ্ধিমত্তার বারোগুণ—

আমি হাত তুলে লি-হানকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমি জানি।

তাহলে?

তাহলে কী?

তাহলে তোমার মাঝে উৎসাহ নেই কেন?

তুমি শুনতে চাও কেন আমার মাঝে উৎসাহ নেই?

লি-হান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ শুনতে চাই।

তাহলে শোনো। আমি একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, পঞ্চম মাত্রার এই মহাকাশযানটি মাত্র তৈরি করা হয়েছে, এটা পরীক্ষা করা দরকার। এই পরীক্ষার জন্যে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হবে আমাকে— এটাই হচ্ছে। সত্যি কথা। এই সত্যি কথা যে জানে তার পক্ষে এই অভিযানে উৎসাহ পাওয়া সম্ভব নয়।

তোমার এই সন্দেহ অমূলক।

হতে পারে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমার পক্ষে এই অভিযানে যাওয়া সম্ভব নয়।

ভেবে দেখ ইবান। তুমি সবসময়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তা, মানুষের নৈতিকতা, মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন এবং ভালোবাসা নিয়ে ভেবেছ। পৃথিবীর বড় বড় মানুষকে নিয়ে তোমার কৌতুহল। তারা কেমন করে ভাবে, কেমন করে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে সেটা জানতে চেয়েছ। এই প্রথম তোমার সুযোগ এসেছে পৃথিবীর সেরা মনীষীদের মুখোমুখি হবার। পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়ার জন্যে তৈরি নিউরাল নেটওয়ার্কই১২ শুধুমাত্র তোমাকে সেই সুযোগ দেবে। তুমি ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সেরা মনীষীদের মস্তিষ্ক ম্যাপিং১৩ সাথে নিয়ে যেতে পারবে। তোমার দীর্ঘ এবং নিঃসঙ্গ যাত্রাপথে তারা তোমার চমৎকার সঙ্গী হতে পারে। তোমার সারা জীবনের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার—

আমি হাত নেড়ে বললাম, তোমার বক্তৃতার জন্যে ধন্যবাদ লি-হান। কিন্তু আমি তোমার এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছি না।

লি-হান কোনো কথা না বলে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি মাথা নেড়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। আমার পিছনে স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তখন লি-হান আমাকে ডাকল, ইবান।

আমি ঘুরে তাকিয়ে বললাম, কী হলো?

আমার ধারণা তুমি কিন্তু শেষপর্যন্ত আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে এই অভিযানে যাবে।

আমি তীক্ষ্ণ চোখে লি-হানের দিকে তাকালাম, সে জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল। আমি কঠিন গলায় বললাম, কেন? তুমি কেন ভাবছ আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি হব?

কারণ, তোমার একটা চিঠি এসেছে।

আমি চমকে উঠে বললাম, চিঠি?

হ্যাঁ।

কার চিঠি?

তোমার মায়ের।

আমার মায়ের?

হ্যাঁ। আমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, আমার মা কী লিখেছে চিঠিতে?

আমি জানি না। আন্তঃমহাজাগতিক যোগাযোগ কেন্দ্র থেকে সবেমাত্র পাঠিয়েছে। লি-হান তার ড্রয়ার থেকে ছোট একটা ক্রিস্টাল বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল।

আমি ক্রিস্টালটি হাতে নিয়ে লি-হানের দিকে তাকালাম। সে আবার একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, চিঠিটা এসেছে রিশি নক্ষত্রের কাছাকাছি মানুষের কলোনি থেকে। মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জ পার হয়ে যেই কলোনিতে যেতে হয়।

লি-হান উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে এগিয়ে গেল। জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থেকে আবার আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ইবান, তুমি খুব সৌভাগ্যবান যে একজন মায়ের গর্ভে তোমার জন্ম হয়েছে। তুমি জানো আমার জন্ম হয় নি, আমাকে জিনম ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে! ফ্যাক্টরিতে যেভাবে মহাকাশযানের ইঞ্জিন তৈরি করা হয়, সেভাবে!

আমি লি-হানের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমি একটু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তাকে হঠাৎ একজন দুঃখী মানুষের মতো দেখাতে থাকে।

 ২. ভিডি টিউবের সুইচটা স্পর্শ করতেই

ভিডি টিউবের সুইচটা স্পর্শ করতেই ঘরের মাঝামাঝি আমার মায়ের ত্রিমাত্রিক একটা প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠল। ছবিটা এত জীবন্ত যে আমার মনে হলো আমি বুঝি তাকে স্পর্শ করতে পারব।

আমার মায়ের প্রতিচ্ছবিটি ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা ইবান, আমি জানি না আমাকে তুই দেখছিস কি না! সেই কোন নক্ষত্রের কোন গ্রহপুঞ্জে তুই আছিস আমি জানিও না। তবু আমার ভাবতে ইচ্ছে করে তুই আমার সামনে আছিস, চুপ করে বসে আমার কথা শুনছিস।

মা কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, মনে হলো সত্যিই যেন আমাকে দেখতে পাচ্ছেন। মায়ের চেহারা সতেরো-আঠারো বৎসরের একটা বালিকার মতো কথার ভঙ্গিও সেরকম, চেহারায় বিন্দুমাত্র বয়সের ছাপ পড়ে নি।

মা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে হঠাৎ করে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। হাত দিয়ে লালচে চুলগুলোকে পিছনে সরিয়ে বললেন, বুঝলি ইবান, কয়দিন থেকে নিজের ভেতরে কেমন জানি অস্থিরতা অনুভব করছি। শুধু মনে হচ্ছে এই জগতে কেন এসেছি, কী উদ্দেশ্য তার রহস্যটা বুঝতে পারছি না। আমি কি শুধু কয়েকদিন বেঁচে থাকার জন্যে এসেছি নাকি তার অন্য উদ্দেশ্য আছে? যদি অন্য উদ্দেশ্য থেকে থাকে তাহলে সেটা কী? প্রাণীজগতের যেরকম বংশবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য থাকে মানুষের জন্যে তো আর সেটা সত্যি নয়! মানুষকে তো আর জন্ম নিতে হয় না। জিনম ফ্যাক্টরিতে অর্ডারমাফিক শিশুর জন্ম দেয়া যায়। তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যটা কী?

মা কয়েকমুহূর্তের জন্যে থামলেন তারপর ছেলেমানুষের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন, কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বললেন, আমার মনে সারাক্ষণ এরকম প্রশ্ন দেখে আমার চারপাশে যারা আছে তারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল, তারা ভাবল আমার চিকিৎসা দরকার! একদিন আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল চিকিৎসক রবোটের কাছে, সেটি আমাকে টিপেটুপে দেখে বলল আমার মাথায় মস্তিষ্কের ভিতরে একটা দ্বৈত কপোট্রন বসাতে হবে, যেটি আমার ভাবনা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সোজা কথায় আমাকে মানুষ থেকে পাল্টে একটা রবোটে তৈরি করে ফেলবে।

মা কথা থামিয়ে আবার ছেলেমানুষের মতো হাসতে শুরু করলেন, হাসি ব্যাপারটি নিশ্চয়ই সংক্রামক, আমিও মায়ের সাথে সাথে হাসতে শুরু করলাম। মা হাসি থামিয়ে চোখ মুছে বললেন, আমি চিকিৎসক রবোটের কথা শুনি নি। আমার মাথায় দ্বৈত কপোট্রন বসানো হয় নি। মাথার ভিতরে এখনো আমার একশ ভাগ খাঁটি মস্তিষ্ক রয়েছে তাই এখনো আমি বসে বসে এইসব ভাবি! মা হঠাৎ সুর পাল্টে বললেন, বাবা ইবান, আমার কথা শুনে তুই আবার অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিস না তো?

আমি মাথা নাড়লাম, ফিসফিস করে বললাম, না মা অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি না।

অধৈর্য হলে হবি। আমার কিছু করার নেই। কেন জানি তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমার মনে হয় তুই যদি আমার কাছে থাকতি তাহলে আমার প্রশ্নগুলোর গুর ত্বটা বুঝতে পারতি। এখানে আর কাউকে বোঝাতে পারি না।

প্রথম প্রথম মনে হতো আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ত জ্ঞানের অনুসন্ধান করা। কিন্তু গত একশ বৎসরের ইতিহাসে দেখেছিস বড় আবিষ্কারগুলো কে করেছে? রবোট। কম্পিউটার। কপোট্রন। যেগুলো মানুষ করেছে তার পিছনেও রয়েছে যন্ত্রপাতি, নিউরাল নেটওয়ার্ক। তাহলে মানুষের জন্যে থাকল কী? মানুষ বেঁচে থাকবে কেন? তাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী?

মা কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন তারপর আবার হেসে ফেললেন মা যখন হাসেন তখন তাকে কী সুন্দরই না দেখায়! হাসি থামিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানি না কেন আমি তোকে এসব বলছি। আসলে তোকে বলছি কি

সেটাও আমি জানি না— তাহলে কেন বলছি এসব? মাঝে মাঝে আসলে তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে— মনে হয় তুই হয়ত আমাকে বুঝতে পারবি। সে জন্যে বলছি— আমি কল্পনা করে নিচ্ছি তুই আমার সামনে বসে। আছিস, এই এখানে আমার কাছাকাছি।

কিছুদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে আমি যেন একটু একটু বুঝতে পারছি আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী। ঠিক পুরোটুকু ধরতে পারছি না কিন্তু একটু যেন আন্দাজ করতে পারছি। আগে যেরকম মনে হতো আমার জীবনের কোনো মূল্য নেই, কোনো অর্থ নেই— এখন সেরকম মনে হয় না। একসময় ভাবতাম তোর ভিতরে জিনেটিক কোনো প্রাধান্য না দিয়ে খুব ভুল করেছি, তোকে অতিমানব জাতীয় কিছু একটা তৈরি করা উচিৎ ছিল। কিন্তু এখন আর তা মনে হয় না। এখন মনে হয় আমি ঠিকই করেছি, তোকে সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে তৈরি করেছি কিন্তু ভিতরে দিয়েছি। একটা চমৎকার হৃদয়। যেখানে রয়েছে ভালোবাসা। সবাইকে বড় হতে হবে কে বলেছে? মনে হয় যত ছোটই হোক জীবনের একটা অর্থ থাকে, একটা উদ্দেশ্য থাকে। কেউ এই জগতে অপ্রয়োজনীয় না। ছোট বড় সবাই মিলে সৃষ্টিজগৎ।

মা একটু থামলেন, থেমে হাসি-হাসি মুখ করে বললেন, বেশি বড় জ্ঞানের কথা বলে ফেললাম? অন্য সবাইকে তো বলছি না তোকে বলছি। তুই আমার ছেলে, তোকে আমি পেটে ধরেছি। যখন পেটের মাঝে ছিলি তখন প্ল্যাসেন্টা দিয়ে তোর শরীরে পুষ্টি দিয়েছি, বড় করেছি। তোকে যদি এসব কথা বলতে না পারি তাহলে কাকে বলব?

বুঝলি ইবান, জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন আসে আমার মাথায়, কাউকে জিজ্ঞেস করে তার উত্তর পাওয়া যায় না। নিজে নিজে তার উত্তর খুঁজে পেতে হয়। আমি তাই করছি। তবে একজন আমাকে খুব সাহায্য করেছে। মানুষটার নাম রিতুন। রিতুন ক্লিস। আলগল নক্ষত্রের কাছে মানুষের যে কলোনিটা আছে সেখানে থাকত সে। প্রায় দুইশ বছর আগে মানুষটা মারা গেছে, বেঁচে থাকলে আমি নিশ্চয়ই তার সাথে দেখা করতে যেতাম, যেভাবেই হোক।

এই মানুষটার লেখা কিছু বইপত্র আছে, কিছু ভিডিও ক্লিপ আছে কিছু মেটা ফাইল১৬ আছে। আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি, দেখেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি। মানুষটা অসম্ভব বুদ্ধিমান, অসম্ভব প্রতিভাবন। মনে হয় ঈশ্বর বুঝি নিজের হাতে তার মাথায় একটা একটা করে নিউরনকে সাজিয়েছে, সিনান্সে সংযোগ দিয়েছে! তার ভাবনাচিন্তার সাথে পরিচিত হয়ে আমার নিজের ভেতরকার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি!

সেদিন রিতুন ক্লিস সম্পর্কে একটা নতুন তথ্য পেয়েছি। মানুষটা দুই শ বত্সর আগে মারা গেলেও তার মস্তিষ্কের পুরো ম্যাপিং নাকি রক্ষা করা আছে। পৃথিবীর বড় বড় মানুষ, বড় বড় দার্শনিক, বিজ্ঞানী, শিল্পীদের মস্তিষ্ক নাকি এভাবে ম্যাপিং করে বাঁচিয়ে রাখা হয়। তার মানে রিতুন ক্লিস মারা গেলেও তার মস্তিষ্ক বেঁচে আছে। বিশাল কোনো নিউরন নেটওয়ার্কে সেটা বসালে তার সাথে কথা বলা যাবে! কী আশ্চর্য ব্যাপার।

কিন্তু দুঃখের কথা কী জানিস? মানুষের মস্তিষ্কের ম্যাপিং নিয়ে কাজ করার মতো নিউরাল নেটওয়ার্ক খুব বেশি নেই। যে কয়টি আছে সেগুলো আমার নাগালের বাইরে। আমার মতো সাধারণ মানুষ কখনো সেটা ব্যবহার করতে পারবে না। আমি খবর পেয়েছি তুই চতুর্থ মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হয়েছিস। যদি কোনোভাবে পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হতে পারিস তাহলে তুই তোর মহাকাশযানে সেরকম একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক পাবি। তুই তাহলে রিতুন ক্লিসের সাথে কথা বলতে পারবি। কী সাংঘাতিক একটা ব্যাপার হবে চিন্তা করতে পারিস?

আমার মা উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর আবার খিলখিল করে হেসে উঠলেন, বললেন, দেখ, কতক্ষণ থেকে আমি বক বক করছি! আমার এরকম উদ্ভট জিনিস নিয়ে কৌতূহল বলে ধরে নিচ্ছি তোরও বুঝি এরকম কৌতুহল। আমার সব কথা ভুলে যা বাবা ইবান। ধরে নে এইসব হচ্ছে পাগলের প্রলাপ! তুই যদি পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হতে পারিস তাহলে মহাজগতের একেবারে শেষমাথায় মানুষের যে কলোনি আছে সেখানে অভিযান করতে যাবি। আমি রাত্রিবেলা আকাশের একটা নক্ষত্র দেখিয়ে সবাইকে বলব, আমার ছেলে ওখানে গেছে! আমার নিজের ছেলে— যেই ছেলেকে আমি পেটে ধরেছি!

আমার মা কথা শেষ করে আমার দিকে হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু আমি দেখতে পেলাম তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে, আর আমার মা প্রাণপণ চেষ্টা করছে তার সেই চোখের পানি গোপন করতে।

যেরকম হঠাৎ করে আমার মায়ের ত্রিমাত্রিক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি আমার ঘরের মাঝখানে এসে হাজির হয়েছিল ঠিক সেরকমভাবে আবার হঠাৎ করে সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি বুকের ভিতর কেমন জানি একধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। উঠে দাঁড়িয়ে আমি কিছুক্ষণ খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। তারপর ফিরে এসে ভিডি টিউবটা স্পর্শ করে আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করতেই, ছোট স্ক্রিনটাতে লি-হানের ছবি ভেসে উঠল। সে আমার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী খবর ইবান? তুমি কি শেষপর্যন্ত মন স্থির করেছ?

করেছি লি-হান। আমি যাব।

চমৎকার। তাহলে দেরি করে কাজ নেই, তুমি কাল ভোরবেলা থেকে কাজ শুরু করে দাও, বুঝতেই পারছ আমাদের হাতে সময় নেই। আমাদের চার নম্বর এস্ট্রোডোম থেকে একটা স্কাউটশিপ১৭ তোমাকে ফোবিয়ানে নিয়ে যাবে।

ফোবিয়ান?

হ্যাঁ আমাদের পঞ্চম মাত্রার নতুন মহাকাশযানটির নাম ফোবিয়ান। স্থিতিশীল একটা কক্ষপথে সেটাকে আটকে রাখা হয়েছে।

কক্ষপথে?

হ্যাঁ, পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানকে সাধারণত গ্রহে নামানো হয় না।

ও। আমি একমুহূর্ত ইতস্তত করে বললাম, লি-হান।

বল।

তোমাকে একটা প্রশ্ন করি— তুমি সত্যি উত্তর দেবে?

প্রশ্নটা না শুনে আমি তোমাকে কথা দিতে পারছি না। বেঁচে থাকার জন্যে অনেক সময় অনেক সত্যকে আড়াল করে রাখতে হয়।

আজ ভোরবেলা তোমার সাথে আমি রিশি নক্ষত্রের কাছাকাছি মানুষের কলোনিতে অভিযান নিয়ে যে কয়টি কথা বলেছিলাম তার প্রত্যেকটা সত্যি ছিল, তাই না?

লি-হান একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল। তাতে কিছু আসে যায়?

না যায় না।

তাহলে আমরা সেটা নিয়ে কথা নাইবা বললাম!

 

মহাকাশযান ফোবিয়ানকে দেখে আমি চমকৃত হয়ে গেলাম। বিশাল এই মহাকাশযানটি একটি ছোটখাট উপগ্রহের মতো। টাইটেনিয়াম এবং ক্রোমিয়ামের সংকর ধাতুর দেয়ালের উপর তাপ অপরিবাহী নতুন একধরনের আস্তরণ দিয়ে ঢাকা। মূল ইঞ্জিনটি পদার্থ-প্রতিপদার্থ৮ জ্বালানি দিয়ে চালানো হয়। বিশেষ পরিস্থিতির জন্যে প্লাজমা-৯ ইঞ্জিনও রয়েছে। আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশ পরিভ্রমণের জন্যে একটি অপূর্ব যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করে রাখা আছে। পুরো ফোবিয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যে নিউরাল নেটওয়ার্কটি বসানো হয়েছে সেটি দেখে নিজের ভিতরে হীনমন্যতা এসে যায় মানুষের মস্তিষ্ক সত্যিকার অর্থেই এই নেটওয়ার্কের তুলনায় একেবারেই অকিঞ্চিতকর। চতুর্থ মাত্রার মহাকাশযানের সাথে ফোবিয়ানের একটা বড় পার্থক্য রয়েছে, এটি নানা ধরনের অস্ত্র দিয়ে বোঝাই, নিউক্লিয়ার বিস্ফোরক থেকে শুরু করে এক্স-রে লেজার কিছুই বাকি নেই। সৌভাগ্যক্রমে আমার নিজেকে এই অস্ত্র চালানো শিখতে হবে না— ফোবিয়ানে অস্ত্র চালাতে অভিজ্ঞ রবোটেরা রয়েছে।

আমাকে পুরো ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিতে খুব বেশি সময় দেয়া হলো না। মস্তিষ্ক উত্তেজক ড্রাগ নিহিলিন২১ নিয়ে নিয়ে আমি না ঘুমিয়ে একটানা চৌদ্দ দিন কাজ করে গেলাম। আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে লাইসেন্স দেয়ার সময়টিতে আমি মোটামুটিভাবে একটা ঘােরের মাঝে ছিলাম এবং অনুষ্ঠানটি থেকে আমি কীভাবে নিজের ঘরে ফিরে এসেছি সেটি আমার মনে নেই, নিহিলিনের মতো উত্তেজক ড্রাগও আমাকে জাগিয়ে রাখতে পারছিল না। আমি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করার আগেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম।

ঠিক কখন আমি ঘুম থেকে উঠেছি সেটি আমি নিজেও জানি না— আমার ধারণা ছিল একবেলা পার করে দিয়েছি, কিন্তু ক্যালেন্ডার দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম, এর মাঝে ছত্রিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। যখন আমার ঘুম ভেঙেছে তখন আমার ঘরটি অন্ধকার এবং শীতল, আমি ভয়ঙ্কর ক্ষুধার্ত। ঘরের ভিডি টিউবটি ক্রমাগত একটা জরুরি সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। আমি কোনোমতে বিছানা থেকে উঠে টলতে টলতে ভিডি টিউবের কাছে গিয়ে সেটা স্পর্শ করতেই আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগব্যবস্থার পরিচালক লি-হানের ছবিটি ছোট স্ক্রিনে ফুটে উঠল। সে একধরনের আতঙ্কিত গলায় বলল, কী হয়েছে তোমার ইবান?

আমি জড়িত গলায় বললাম, ঘুমাচ্ছিলাম। নিহিলিন নিয়ে কয়দিন জেগে ছিলাম তো, শরীর আর চলছিল না।

আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু তাই বলে এত দীর্ঘ সময় ঘুমুবে বুঝতে পারি নি।

আমিও বুঝতে পারি নি। যা-ই হোক কেন ডেকেছ বল।

আমাদের হাতে সময় নেই। তোমাকে এক্ষুনি যাত্রা শুরু করতে হবে।

এক্ষুনি মানে কখন?

আগামী ছত্রিশ ঘণ্টার মাঝে। একটা চৌম্বকীয় ঝড় আসছে, সেটা আসার আগে শুত্র না করলে অনেক দেরি হয়ে। যাবে।

ও। আমি ঘুম থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কিন্তু আমার নিজেরও তো একটু প্রস্তুতি নিতে হবে।

না। তোমার নিজের প্রস্তুতি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার সবকিছুর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ—

লি-হান অধৈর্য হয়ে বলল, তোমার কোনো কিছু আর ব্যক্তিগত নেই। যখন থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তোমাকে পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক করা হবে সেদিন থেকে তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টা চোখে-চোখে রাখা হয়েছে। তোমার ব্যক্তিগত সবকিছু আমরা জানি— ঠিক সেভাবে ফোবিয়ানে সবকিছু রাখা হয়েছে। তোমার পছন্দসই বইপত্র মেটা ফাইল থেকে শুরু করে প্রিয় খাবার, প্রিয় পোশাক, প্রিয় সঙ্গীত সবকিছু পাবে। তোমার কোনো ব্যক্তিগত কাজ বাকি নেই ইবান।

কিন্তু—

কোনো কিন্তু নেই। তা ছাড়া ফোবিয়ানের চরম গতিবেগ তোলার আগে পর্যন্ত তুমি নেটওয়ার্কে সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে।

আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি সাথে আরো একটি জিনিস নিতে চেয়েছিলাম।

কী?

রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্ক ম্যাপিং।

লি-হান এবারে থেমে গিয়ে একটা শিস দেবার মতো শব্দ করল।

আমি ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পাওয়া যাবে না?

একটু কঠিন হবে কিন্তু আমি চেষ্টা করব।

চেষ্টা করলে হবে না। আমাকে পেতেই হবে। তুমি জানো আমি প্রায় একযুগ এই মহাকাশযানে একা-একা বসে থাকব। আমার কথা বলার জন্যে একজন মানুষ দরকার।

লি-হান হাসার শব্দ করে বলল, আমাদের সময়ে তুমি প্রায় একযুগ থাকবে, কিন্তু তোমার নিজের ফ্রেমে তো এতো দীর্ঘ সময় নয়। খুব বেশি হলে তিন বছরের মতো।

তিন বছর আর একযুগে কোনো পার্থক্য নেই। একই ব্যাপার। একটা-কিছু গোলমাল হলেই তিন বছর সত্যিসত্যি একযুগ নয় একেবারে এক শতাব্দী হয়ে যেতে পারে।

বুঝেছি।

আমি গলার স্বরে যথেষ্ট গুরত্ব দিয়ে বললাম, আমাকে রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্ক ম্যাপিং না দেয়া হলে আমি কিন্তু এই অভিযানে যাব না।

লি-হান একটু অধৈর্য হয়ে বলল, আহ্! তুমি দেখি মহাকাশ-দস্যুদের মতো ব্ল্যাক মেইলিং শুরু করলে।

এটা ব্ল্যাক মেইলিং নয়— এটা সত্যি।

ঠিক আছে আমি যোগাড় করে দেব।

আমার আরো একটা জিনিস দরকার।

কী?

আমার মায়ের জন্যে একটা উপহার।

কী উপহার নিতে চাও?

ঠিক বুঝতে পারছি না।

বায়োডোমের বাইরে ঝড়ো বাতাসের গর্জনের সাথে মিল রেখে একটা সঙ্গীত- ধ্বনি তৈরি হয়েছে। শুনলেই বুকের মাঝে কেমন জানি করতে থাকে। সেই সঙ্গীত-ধ্বনি নিতে পার।

ঠিক আছে।

কিংবা এই গ্রহের প্রাচীন সভ্যতার কোনো চিহ্ন। কোনো রেলিক। গ্রানাইটের ছোট কোনো মূর্তি?

বেশ। তুমি যদি মনে করো সেরকম কিছু খুঁজে পাবে—

সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোয়ার্টজের গোলকের ভিতরে করে একটা সৌভাগ্য-বৃক্ষ নিয়ে যাও।

সৌভাগ্য-বৃক্ষ?

হ্যাঁ। এই গ্রহের একটি বিশেষ ধরনের গাছ রয়েছে, ছোট গাছ তার মাঝে রয়েছে ছোট ছোট নীল পাতা। এখানকার মানুষ বলে যখন জীবনে বড় ধরনের সৌভাগ্য আসে তখন সেখানে ফুল ফোটে। উজ্জ্বল কমলা রংয়ের ফুল। ভারি চমৎকার দেখতে!

বেশ। তাহলে এই গাছটাই নেয়া যাক। কিন্তু আন্তঃনক্ষত্র পরিবহনে গাছপালা বা জীবন্ত প্রাণী আনা-নেয়ার উপর নানারকম বিধিনিষেধ রয়েছে না?

লি-হান হা হা করে হেসে বলল, তুমি তোমার মহাকাশযানে করে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে নিয়ে যাচ্ছ। যাকে ম্যাঙ্গেল জ্বাসের মতো একটি বস্তুকে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয় তাকে যে-কোনো জীবন্ত প্রাণী নেয়ার অনুমতি দেয়া হবে। সেটা নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না!

ঠিক আছে আমি চিন্তা করব না।

তাহলে তুমি চার নম্বর এস্ট্রোডোমে চলে আসো। প্রস্তুতি শুরু করা যাক। তোমাকে তিন ঘণ্টা সময় দেয়া হলো।

তিন ঘণ্টা? মাত্র তিন ঘণ্টার মাঝে আমি সারা জীবনের জন্যে একটা গ্রহ ছেড়ে চলে যাব?

লি-হান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কেউ যদি আমাকে এই গ্রহ ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ করে দিত, আমি তিন মিনিটে চলে যেতাম!

আমি কোনো কথা না বলে বাইরে তাকালাম। কুৎসিত বেগুনি আলোতে গ্রহটাকে কী ভয়ঙ্করই-না দেখাচ্ছে। লিহান মনে হয় সত্যি কথাই বলছে।

 

ফোবিয়ানের কারগো ভল্টে স্টেনলেস স্টিলের কালো একটি সিলিন্ডারকে দেওয়ালের সাথে আটকে দিয়ে সামরিকবাহিনীর উচ্চপদস্থ মানুষটি বলল, এটি হচ্ছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। ফোবিয়ানের মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে একে বুঝিয়ে দেওয়া হলো।

মহাকাশযানের ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে ভেসে আমি সিলিন্ডারটির কাছে গিয়ে সেটি স্পর্শ করে বললাম, এই মানুষটি সম্পর্কে আমি এত বিচিত্র ধরনের গল্প শুনেছি যে আমি নিশ্চিত হতে চাই যে মানুষটি মাঝপথে জেগে উঠবে না।

সামরিক অফিসারটি হেসে বলল, সে-ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার, তাকে তরল হিলিয়াম তাপমাত্রায়২২ জমিয়ে রাখা আছে। জেগে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।

তোমার-আমার বেলায় সেটি সত্যি হতে পায়ে, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের বেলায় আমি এত নিশ্চিত নই!

এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার, পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র তোমার-আমার জন্যে যেটুকু সত্যি ম্যাঙ্গেল কৃাসের জন্যেও ততটুকু সত্যি। তরল হিলিয়াম তাপমাত্রায় মানুষের শরীরে কোনো জৈবিক অনুভূতি থাকে না। সে আক্ষরিক অর্থে একটি জড়বস্তু।

বাইরে থেকে কেউ কোনো সঙ্কেত দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলতে পারবে না?

না, এই সিলিন্ডারটিকে বাইরে থেকে কেউ কোনো সঙ্কেত পাঠাতে পারবে না। এটি বলতে পারো তথ্য বা সঙ্কেতের দিক থেকে একেবারে নিচ্ছিদ্র।

সামরিক অফিসারটি ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সাথে আনুষ্ঠানিক বোঝাপড়া শেষ করে আমাকে ছোট একটি ক্রিস্টাল ধরিয়ে দিয়ে বলল, ইবান, তুমি এখন তোমার যাত্রা শুরু করতে পার।

আমি ভল্টের দেওয়ালে আটকে রাখা সারি সারি সিলিন্ডারগুলোর দিকে তাকালাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস ছাড়াও এখানে অন্য মানুষ রয়েছে। কেউ-কেউ প্রতিরক্ষা বাহিনীর, কেউ-কেউ একেবারে সাধারণ যাত্রী। নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে তাদের পরিচয় দেওয়া রয়েছে, আমার আলাদা করে জানার কোন প্রয়োজন নেই। মানুষ ছাড়াও এই মহাকাশযানে অন্য জিনিসপত্র রয়েছে, যার কিছু কিছু আমার জানার কথা নয়। মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে আমাকে সেগুলি মানুষের এক কলোনি থেকে অন্য কলোনিতে পৌছে দেবার কথা। ম্যাঙ্গেল কৃাসের কথা আলাদা, সে যে কোন মহাকাশযানে থাকলে সেটি মহাকাশযানের অধিনায়কের জানা প্রয়োজন। জড় বস্তু হিসেবে থাকলেও সেটি জানা প্রয়োজন।

সামরিক অফিসার এবং তার সাথে আসা টেকনিশিয়ানরা নিজেদের যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিতে শুরু করে। ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে যাওয়া যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নেয়া খুব সহজ নয় কিন্তু এই টেকনিশিয়ানরা দক্ষ, তাদের হাতের কাজ দেখতে ভালো লাগে। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। একজন একজন করে সবাই এসে আমার সামনে মাথা নিচু অভিবাদন করে তাদের স্কাউটশিপে উঠে গেল। সামরিক অফিসার আমার হাত ধরে সেখানে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, তোমার যাত্রা শুভ হোক, ইবান।

আমি হেসে বললাম, আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি হবে না!

সামরিক অফিসার আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বাতাসে ভেসে ভেসে তার স্কাউটশিপে ঢুকে গেল, আমি ফোবিয়ানের গোল বায়ু-নিরোধক দরজাটা বন্ধ করে দিতেই স্কাউটশিপের ইঞ্জিনের চাপা শব্দ শুনতে পেলাম, আমি এখন এখানে একা।

আমি নিজের ভিতরে একধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করলাম, এই বিশাল মহাকাশযানটিতে আমি একা একা-এক বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করব— এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে। এই দীর্ঘ সময়ে আমার সাথে কথা বলার জন্যেও কোনো সত্যিকার মানুষ থাকবে না। মহাকাশের নিকষ কালো অন্ধকারে, হিম শীতল পরিবেশে এই বিশাল মহাকাশযান তার শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জন তুলে উড়ে যাবে। নতুন এই মহাকাশযানে হয়ত অজানা কোনো বিপদ অপেক্ষা করে আছে, মাহালা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছাকাছি দুটি বিশাল ব্ল্যাক হোল, তার পাশে দিয়ে বিপজ্জনক একটি কক্ষপথ দিয়ে আমাকে যেতে হবে। সেখানে মহাকাশ-দস্যুরা ওৎ পেতে আছে, কে জানে, হয়ত বিচিত্র কোনো মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হতে হবে! জানি না সেই দীর্ঘ যাত্রা কখনো শেষ হবে কি না, রিশি নক্ষত্রের সেই মানবকলোনিতে পৌঁছাতে পারব কি না। যদিওবা পৌঁছাই সেই একযুগ পর আমার মায়ের সাথে দেখা হবে কি না সে কথাটিই-বা কে বলতে পারে!

আমি জোর করে আমার ভেতর থেকে সব চিন্তা দূর করে সরিয়ে দিয়ে ভেসে ভেসে মহাকাশযানের ওপরের দিকে যেতে থাকি। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গিয়ে আমাকে এখনই প্রস্তুত হতে হবে। ফোবিয়ানের শক্তিশালী ইঞ্জিন যখন প্রচণ্ড গর্জন। করে এই গ্রহের মহাকর্ষ বলকে উপেক্ষা করে মহাকাশে পাড়ি দেবে তখন আমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে।

কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারটিতে বসার সাথে সাথে আমি ফোবিয়ানের নিয়ন্ত্রণকারী মূল। নিউরাল নেটওয়ার্কের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, পঞ্চম মাত্রার আন্তঃ

নক্ষত্র মহাকাশযান ফোবিয়ানের পক্ষ থেকে আপনাকে এই মহাকাশযানের নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানাচ্ছি মহামান্য ইবান।

মানুষের কণ্ঠস্বরে এধরনের যান্ত্রিক কথা শুনলে সবসময়েই আমি একটু অস্বস্তি বোধ করি— আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়েই মনে করি যন্ত্র এবং মানুষের কথার মাঝে একটা স্পষ্ট পার্থক্য থাকা দরকার। মানুষের কথা শোনার সময় তাকে সবসময়েই আমরা দেখতে পাই, মুখের ভাবভঙ্গি থেকে কথার অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যন্ত্রের বেলায় সেটা সম্ভব নয়— সত্যি কথা বলতে কী কথাটা কোথা থেকে আসছে অনেক সময় সেটাও বুঝতে পারি না।

আমি চেয়ারে নিজেকে নিরাপত্তা বেল্ট দিয়ে বেঁধে নিতে নিতে বললাম, আমি যদি বলি তোমার আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করলাম না!

নিউরাল নেটওয়ার্কের কণ্ঠস্বর তরল গলায় বলল, মহামান্য ইবান, আপনি ইচ্ছে করলে অবশ্যি সেটা বলতে পারেন। তাতে কিছু আসে যায় না।

তুমি কে?

আমি ফোবি। ফোবিয়ানের নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং মানুষের সংযোগকারী মডিউল ফোবি।

আমি কন্ট্রোল প্যানেলের কয়েকটা সুইচ স্পর্শ করতে করতে বললাম, আচ্ছা ফোবি, আমি যদি এখন তোমাকে জঘন্য ভাষায় গালাগাল করি তাহলে কী হবে?

কিছুই হবে না মহামান্য ইবান। আমি মানুষ নই, আমার ভেতরে কোনো মান-অপমান বোধ নেই— আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি, যেভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে সাহায্য করা যায় সেভাবে সাহায্য করব।

আমি কন্ট্রোল প্যানেলে ফোবিয়ানের ইঞ্জিনগুলোর খুঁটিনাটি পরীক্ষা করতে করতে বললাম, ফোবি, আমি যতদূর জানি তোমার নিউরাল নেটওয়ার্ক মানুষের মস্তিষ্ক থেকে অনেক গুণ ভালো বলা হয়, মানুষ থেকে বারো গুণ বেশি তোমার বুদ্ধিমত্তা— যার অর্থ তুমি আসলে আমার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। কাজেই প্রকৃত অর্থে আমার তোমাকে বলা উচিৎ মহামান্য ফোবি—

ফোবি এবারে প্রায় হাসার মতো করে শব্দ করল, বলল, আপনি ভুল করছেন মহামান্য ইবান, আমি নিউরাল নেটওয়ার্ক নই— আমি শুধুমাত্র নিউরাল নেটওয়ার্কের মানুষের সাথে যোগাযোগকারী মডিউল। নিউরাল নেটওয়ার্ক যদি একটা মানুষ হয় তাহলে আমি তার কণ্ঠস্বর। আমার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা নেই। আর সম্বোধনের আনুষ্ঠানিকতার কোনো অর্থ নেই মহামান্য ইবান। দীর্ঘদিন গবেষণা করে দেখা গেছে একজন মানুষ এবং একজন যন্ত্রকে পাশাপাশি কাজ করতে দেয়া হলে মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে খানিকটা প্রাধান্য দিতে হয়, পুরো ব্যাপারটি অনেক সহজ হয়, এর বেশি কিছু নয়।

ও! আমি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, এই মহাকাশযানে আমি দীর্ঘ সময়ের জন্যে আছি তোমার সাথে যন্ত্র এবং মানুষ নিয়ে কথা বলা যাবে। এখন ফোবিয়ানকে শুরু করা যাক।

বেশ।

আমি কন্ট্রোল প্যানেল পরীক্ষা করে মূল ইঞ্জিন দুটো চালু করলাম, সাথে সাথে ফোবিয়ানের দুইপাশে বসানো শক্তিশালী ইঞ্জিন দুটি গর্জন করে উঠল। আমি ফোবিয়ানের জানালা দিয়ে বিদ্যুঝলকের মতো আয়োনিত গ্যাস বের হতে দেখলাম। আমি অসংখ্যবার মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিন চালু করে মহাকাশযানকে নিয়ে মহাকাশে ছুটে গিয়েছি। কিন্তু প্রথম মুহূর্তটি প্রত্যেকবারই আমাকে একইভাবে অভিভূত করেছে।

আমি ফোবিয়ানে তীব্র কম্পন অনুভব করি, মহাকাশযানটি শেষবারের মতো গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করেছে, শক্তিশালী ইঞ্জিন দুটি প্রদক্ষিণ শেষ করার আগেই এই গ্রহের মহাকর্ষ বলকে ছিন্ন করে উড়ে যাবে।

আমি কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। মহাকাশযানের ভরশূন্য পরিবেশ দূর হয়ে এখন এখানে ত্বরণ থেকে প্রচণ্ড আকর্ষণ শুরু হচ্ছে। আরামদায়ক চেয়ারটিতে অদৃশ্য কোনো শক্তি আমাকে ধীরে ধীরে চোপ ধরতে শুরু করেছে। সাধারণ যে-কোনো মানুষ থেকে আমি অনেক বেশি মহাকর্ষ শক্তি সহ্য করতে পারি। কন্ট্রোল প্যানেলে দেখতে পাচ্ছি আমার ওজন বাড়তে শুরু করেছে, মনে হচ্ছে বুকের ওপর অদৃশ্য একটি দানব চেপে বসেছে। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে, চোখের সামনে একটা লাল পর্দা কাঁদতে শুরু করে।

আমার কানের কাছে ফোবি ফিসফিস করে বলল, মহামান্য ইবান, আপনাকে অচেতন করে দিই?

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, না।

কেন? কেন আপনি এই কষ্ট সহ্য করছেন?

জানি না।

আর কিছুক্ষণের মাঝে আপনার মাথার মাঝে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, আপনি এমনিতেই অচেতন হয়ে পড়বেন।

তবু আমি দেখতে চাই। আমি বুঝতে পারি অদৃশ্য শক্তির টানে আমার মুখের চামড়া পিছনে সরে আসছে, চোখ খোলা রাখতে পারছি না, মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ একটা বিশাল পাথর চাপিয়ে রেখেছে, আমি একবারও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

ফোবি আবার ফিসফিস করে বলল, মহামান্য ইবান। আপনার নিরাপত্তার খাতিরেই এখন আপনাকে অচেতন করে রাখা প্রয়োজন। এটি নিছক পাগলামি—

আমি জানি।

কিন্তু—

ফোবি— তোমরা কি কখনো পাগলামি করো? যন্ত্র কি পাগলামি করতে পারে?

ফোবি উত্তরে কী বলল আমি শুনতে পেলাম না কারণ এর আগেই আমি অচেতন হয়ে পড়লাম।

৩. যখন জ্ঞান ফিরে এল

আমার যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন মহাকাশযান ফোবিয়ান তার নির্দিষ্ট যাত্রাপথে উড়ে যেতে শুরু করে দিয়েছে। মহাকাশযানে একটি আরামদায়ক মহাকর্ষ বল। আমি নিরাপত্তা বেল্ট খুলে চেয়ার থেকে নেমে এসে ডাকলাম, ফোবি।

বলুন মহামান্য ইবান।

সবকিছু চলছে ঠিকভাবে? চলছে মহামান্য ইবান।

আপনি সুস্থবোধ করছেন তো?

মাথার ভেতরে একটা ভোঁতা ব্যথা, আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে। আমি কন্ট্রোল প্যানেলে দূরে অপসৃয়মান গ্রহটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, এখনো বিশ্বাস হতে চায় না আমি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অংশ এই অশুভ গ্রহটির ভিতরে একটা বায়োডোমে কাটিয়ে দিয়েছি। আমি মনিটর থেকে চোখ সরাতেই ছোট স্বচ্ছ গোলকটির দিকে চোখ পড়ল, ভেতরে বিচিত্র একটি গাছ, গাছে নীল পাতা তিরতির করে নড়ছে। আমি গাছটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটাই কি সৌভাগ্য-বৃক্ষ?

হ্যাঁ মহামান্য ইবান। এটা সৌভাগ্য-বৃক্ষ।

মানুষের যখন সৌভাগ্য আসে তখন এই গাছে ফুল ফোটে?

সেরকম একটি জনশ্রুতি রয়েছে।

তুমি বিশ্বাস কর?

ফোবি বলল, সৌভাগ্য জিনিসটা কী সেটাকে নতুন করে ব্যাখ্যা করলেই এটা বিশ্বাস করা যায়।

কী রকম?

যেমন আপনি যদি ধরে নেন এই বিচিত্র গাছটির ফুল ফুটতে দেখা একধরনের সৌভাগ্য!

আমি হা হা করে হেসে বললাম, ভালোই বলেছ ফোবি। তুমি নিঃসন্দেহে খুব বুদ্ধিমান।

ধন্যবাদ মহামান্য ইবান।

আমি গাছটিকে ভালো করে লক্ষ করতে করতে বললাম, এই সৌভাগ্য-বৃক্ষ আমি আমার মায়ের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।

আমি জানি।

তোমার কী মনে হয় ফোবি, আমার মা কি এটা পছন্দ করবেন?

নিশ্চয়ই করবেন।

তুমি তো আমার মাকে কখনো দেখ নি, তুমি কেমন করে জানো?

কারণ আপনার মায়ের কাছে জিনিসটির কোনো গুরত্ব নেই, আপনি এনেছেন এই ব্যাপারটির গুরত্ব অনেক। তা ছাড়া সৌভাগ্য-বৃক্ষ নামটির একটা আকর্ষণ আছে। সৌভাগ্যের জন্যে অপেক্ষা করাও মানুষ খুব পছন্দ করে।

আমি একটু হেসে বললাম, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি মানুষকে খুব ভালো বুঝতে পার।

আপনাদের জন্যে ব্যাপারটি সহজাত, আমাদের শিখতে হয়। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে মানুষকে বুঝতে শিখি।

আমি সৌভাগ্য-বৃক্ষ থেকে চোখ সরিয়ে হেঁটে জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম, বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার তার মাঝে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে অসংখ্য নক্ষত্র। মহাকাশযানে একটা মৃদু কম্পন এ-ছাড়া প্রচণ্ড গতিবেগের কোনো চিহ্ন নেই। মনে হচ্ছে মহাকাশযানটি বুঝি একজায়গায় স্থির হয়ে আছে। কিন্তু আমি জানি এটি স্থির হয়ে নেই, প্রচণ্ড গতিবেগে এটি ছুটে চলেছে।

আমি জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে ভিতরে তাকিয়ে বললাম, সৌভাগ্য-বৃক্ষ ছাড়াও এখানে আমার জন্যে আরো একটি জিনিস থাকার কথা।

আপনি মহামতি রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্ক ম্যাপিং-এর কথা বলছেন?

হ্যাঁ। সেটা আছে তো?

আছে মহামান্য ইবান। এখনো উপস্থাপন করা হয় নি। আপনি যখন চাইবেন আমাকে জানাবেন, আমি উপস্থাপিত করে দেব।

বেশ। আরো কিছু সময় যাক। আমি এই মানুষটির সাথে কথা বলতে খুব আগ্রহী তাই আগেই বলে ফেলতে চাই না। একটু অপেক্ষা করতে চাই।

ঠিক আছে মহামান্য ইবান।

আমি আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, কালো আকাশে নক্ষত্রগুলি দেখে বুকের ভিতরে আবার একধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি।

 

আমি মহাকাশযান ফোবিয়ানের বিভিন্ন স্তরে ঘুরে ঘুরে পুরোটা পরীক্ষা করে নেই। বাতাসের চাপ, আর্দ্রতা, জ্বালানির পরিমাণ, নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়া, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, অস্ত্রের সরবরাহ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন খাবার বা বিনোদনের ব্যবস্থা সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। পুরো মহাকাশযানটির মাঝেই একটা যত্নের ছাপ রয়েছে। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে এটাকে দাঁড় করানো হয়েছে। যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে, আমি মুগ্ধ হয়ে ফোবিয়ানের যান্ত্রিক উল্কর্ষ দেখে দেখে সময় কাটিয়ে দিতে লাগলাম।

মহাকাশযানটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার অংশটি আমি যাত্রার শুরতেই করে নিতে চাইছি কারণ এখন এর ভেতরে একটা আরামদায়ক মহাকর্ষ বল রয়েছে। মহাকাশযানটির গতিবেগ প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে, তার তুরণের জন্যে এখানে মহাকর্ষ বল— ইঞ্জিন দুটো বন্ধ করে দেবার পর এখানে আর মহাকর্ষ বল থাকবে না। মহাকাশযানটিকে এর অক্ষের উপর ঘুরিয়ে আবার মহাকর্ষ বল তৈরি করতে হবে, সেটা হবে বাইরের দিকে। মহাকাশযান ফোবিয়ানটিকে কাছাকাছি একটা নিউট্রন স্টারের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার মহাকর্ষ বলকে ব্যবহার করে মহাকাশযানটিকে আবার প্রচণ্ড একটি গতিবেগ দেয়া হবে।

কয়েকদিনের মাঝেই আমি এই মহাকাশযানটিতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। আমার জন্যে সুসজ্জিত একটি ঘর থাকা সত্ত্বেও আমি কন্ট্রোল প্যানেলের নিচে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঘুমিয়ে যেতাম। যেটুকু না-খেলেই নয় আমি সেটুকু খেয়ে সময় কাটিয়ে দিতাম। একা-একা আছি বলে নিজের চেহারার দিকে কখনো ঘুরে তাকাতাম না এবং দেখতে দেখতে আমার মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল হয়ে গেল। অবসর সময় আমি প্রাচীন সঙ্গীত শুনে সময় কাটাতাম এবং কখনো কখনো সময় কাটানো সমস্যা হয়ে গেলে একটুকরো কৃত্রিম কাঠের টুকরো কুঁদে কুঁদে মানুষের ভাস্কর্য তৈরি করতে শুরু করতাম। কয়েকদিনের মাঝেই মহাকাশযানটি তার প্রয়োজনীয় গতিবেগ অর্জন করে ফেলবে, মূল ইঞ্জিন। দুটি বন্ধ করে দেয়ার পর আমি আবার ভরশূন্য পরিবেশে ফিরে যাব।

মহাকাশযানের জীবনযাত্রায় আমি যখন পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম তখন একদিন আমার রিতুন ক্লিসের মুখোমুখি হবার ইচ্ছে করল। আমি ফোবিকে বললাম রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্কের ম্যাপিংটিকে ফোবিয়ানের নিউরাল নেটওয়ার্কে উপস্থাপন করতে।

এধরনের কাজ অল্প কিছু সময়ের মাঝেই হয়ে যাবার কথা কিন্তু দেখা গেল পুরোটুকু শেষ করতে ফোবির দীর্ঘ সময় লেগে গেল। নিউরাল নেটওয়ার্কে উপস্থাপন শেষ করে ফোবি আমাকে নিচু গলায় বলল, মহামান্য ইবান, আপনি এখন ইচ্ছে করলে মহামান্য রিতুন ক্লিসের সাথে কথা বলতে পারেন।

কীভাবে বলব? কোথায় রিতুন ক্লিস?

আপনি অনুমতি দিলে আমি তার হলোগ্রাফিক ত্রিমাত্রিক একটি প্রতিচ্ছবি আপনার সামনে উপস্থিত করতে পারি।

বেশ, তুমি উপস্থাপন কর।

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাঝামাঝি জায়গায় মধ্যবয়স্ক একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠল। মানুষটি একটা ঢিলে আলখাল্লার মতো শাদা পোশাক পরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খুব ধীরে ধীরে সেই মানুষটি আমার দিকে ঘুরে তাকাল। মানুষটিকে দেখে আমি নিজের শরীরে একধরনের শিহরণ অনুভব করলাম কারণ আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এটি একটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি নয়, এটি সত্যিই একজন মানুষ। মানুষটি আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায়?

আমি দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন করে বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনি মহাকাশযান ফোবিয়ানে।

আমি এখানে কেন?

আপনার সাথে কথা বলার জন্যে আমি আপনার মস্তিষ্কের ম্যাপিংকে মহাকাশযানের নিউরাল নেটওয়ার্ক উপস্থাপন করেছি।

মহামান্য রিতুনের মুখে হঠাৎ একটি গভীর বেদনার ছায়া পড়ল। তিনি বিষণ্ণ গলায় বললেন, তুমি শুধুমাত্র আমার সাথে কথা বলার জন্যে আমাকে এই ভয়ঙ্কর অমানবিক পরিবেশে নিয়ে এসেছ?

ভয়ঙ্কর অমানবিক পরিবেশ?

হ্যাঁ, এটি একজন মানুষের জন্যে একটি ভয়ঙ্কর পরিবেশ, একটি অসহনীয় পরিবেশ।

আমি একটু চমকে উঠে বললাম, আমি আসলে বুঝতে পারি নি এই পরিবেশটি আপনার কাছে এত অসহনীয় মনে হবে।

বুঝতে পার নি? মহাকাশযানের নিউরাল নেটওয়ার্কের বিশাল শূন্যতার মাঝে আমি একা অনন্তকালের জন্যে আটকা পড়ে আছি, আমার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, আদি নেই, অন্ত নেই, শুরু নেই, শেষ নেই এটি যদি অমানবিক না হয় তাহলে কোনটি অমানবিক?

আমি আসলে বুঝতে পারি নি—

মহামান্য রিতুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার চোখের দিকে তাকালেন, বললেন, তুমি বুঝতে পার নি?

না।

বুঝতে চেষ্টা করেছ?

আমি অপরাধীর মতো বললাম, আসলে চেষ্টাও করি নি। আমি ভেবেছিলাম এটি আরো একটি মস্তিষ্কের ম্যাপিং— আসলে আপনি যে সত্যিকার একজন মানুষ হিসেবে আসবেন সেটি একবারও বুঝতে পারি নি।

হ্যাঁ, তুমি বিশ্বাস কর, আমি সত্যিকারের একজন মানুষ। আমি রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্কের ম্যাপিং নই আমিই রিতুন ক্লিস। রক্তমাংসের রিতুন ক্লিস যেটুকু জীবন্ত ছিল আমি ঠিক ততটুকু জীবন্ত।

আমি বিশ্বাস করেছি। আমি আগে বুঝতে পারি নি কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি।

রিতুন ক্লিস আমার দিকে দুই পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী যুবক?

আমার নাম ইবান।

তুমি কে?

আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।

রিতুন ক্লিস কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর কাতর গলায় বললেন, ইবান, তুমি আমাকে মুক্তি দাও।

আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বললাম, অবশ্যি আমি আপনাকে মুক্ত করে দেব। অবশ্যি দেব। কীভাবে করতে হয়। আমাকে সেটা বলে দেন—

আমাকে এই নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে সরিয়ে নাও। আমার অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দাও।

ধ্বংস করে দেব?

হ্যাঁ। আমাকে ধ্বংস করে দাও।

আমি রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ করে আমার ভিতরে একধরনের আতঙ্ক এসে ভর করল। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ইবান?

আপনি এত জীবন্ত, আপনাকে ধ্বংস করা তো আপনাকে হত্যা করার মতো। আমি কীভাবে আপনাকে হত্যা করব?

রিতুন ক্লিস বিপন্ন গলায় বললেন, তুমি কী বলতে চাইছ ইবান?

আমি— আমি এখন কী করব? আমি আপনাকে এই নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে মুক্ত করতে চাই, কিন্তু সেটি তো একটা হত্যাকাণ্ডের মতো–

রিতুন ক্লিস কাতর গলায় বললেন, তাহলে কি এখান থেকে আমার মুক্তি নেই?

আপনি কি নিজেকে নিজে মুক্ত করতে পারেন না?

আমি জানি না। আমি যখন বেঁচে ছিলাম তখন প্রযুক্তি এরকম ছিল না। এরকম নিউরাল নেটওয়ার্ক ছিল না, সেখানে মানুষের মস্তিষ্ক ম্যাপিং করা যেত না।

হয়ত ফোবি বলতে পারবে। আমি উচ্চস্বরে ডাকলাম, ফোবি— ফোবি–

ফোবি নিচু গলায় বলল, বলুন মহামান্য ইবান।

তুমি কি নিউরাল নেটওয়ার্কে এমন ব্যবস্থা করে দিতে পারবে যেন মহামান্য রিতুন ক্লিস নিজেকে নিজে মুছে দিতে পারবেন? অস্তিত্বকে সরিয়ে দিতে পারবেন?

ফোবি উত্তর দিতে কয়েকমুহূর্ত সময় নিয়ে বলল, নেটওয়ার্কের কোনো প্রক্রিয়া নিজে থেকে নিজে ধ্বংস করা অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ। সেটি সচরাচর করা হয় না।

কিন্তু করা কি সম্ভব?

ফোবি আবার কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলল, হ্যাঁ, অত্যন্ত বিশেষ প্রয়োজনে সেটি করা সম্ভব। আপনি যদি নিজে ঝুঁকি নিয়ে সেটি করতে চান, সেটা করা যেতে পারে।

বেশ, তাহলে তুমি ব্যবস্থা করে দাও যেন মহামান্য ইবান নিজেকে নিজে নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে অপসারিত করতে পারেন।

ফোবি আবার কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলল, আপনি যদি চান, তাহলে তাই করে দেব।

আমি এবারে রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনাকে যেন এই নিউরাল নেটওয়ার্কে আটকা পড়ে থাকতে না হয় তার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে, আপনি নিজেকে নিজে অপসারিত করে নিতে পারবেন।

মহামান্য রিতুন কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হাসার চেষ্টা করে বললেন, তার অর্থ তুমি হত্যা করতে চাও না বলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে?

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না, একটু হতচকিত হয়ে রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ তাহলে তাই হোক।

নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা রিতুন ক্লিসের প্রতিচ্ছবিটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে ডাকলাম, ফোবি।

বলুন মহামান্য ইবান।

এই সুদীর্ঘ অভিযানে আমি একা, ভেবেছিলাম মহামান্য রিতুন ক্লিসের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাব, কিন্তু দেখতে পেলে কী হলো?

আমি দুঃখিত মহামান্য ইবান।

আসলে তুমি দুঃখিত নও ফোবি। তোমার দুঃখিত হবার ক্ষমতাও নেই।

আপনি ঠিকই বলেছেন মহামান্য ইবান।

এই মহাকাশযানে সময় কাটানো নিয়ে আমার খুব বড় সমস্যা হয়ে যাবে। খুব বড় সমস্যা।

আমি তখন ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করি নি যে আমার এই কথাটি আসলে ভয়ঙ্করভাবে ভুল প্রমাণিত হবে।

 

এরপরের কয়দিন অবশ্যি আমার সময় কাটানো নিয়ে বড় কোনো সমস্যা হলো না, মহাকাশযানটি প্রয়োজনীয় গতিবেগ অর্জন করে ফেলেছে এখন ইঞ্জিন দুটো বন্ধ করে দিতে হবে। মহাকাশযান পরিচালনার নিয়মকানুনে ইঞ্জিন দুটো হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারে নানারকম বিধিনিষেধ রয়েছে। এর আগে আমি কখনোই একা কোনো মহাকাশযানে ছিলাম না, কাজেই নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়েছে। এবারে সে-ধরনের কোনো সমস্যা নেই, কাজেই আমি ইঞ্জিন দুটো এক সাথে হঠাৎ করে বন্ধ করে দেবার প্রস্তুতি নিলাম। ফোবি আমার পরিকল্পনা আন্দাজ করে আমাকে সাবধান করার চেষ্টা করল, বলল, মহামান্য ইবান, মহাকাশযানের ইঞ্জিন হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়া চতুর্থ মাত্রার অনিয়ম।

তার মানে জানো?

জানি মহামান্য ইবান।

তার মানে এটি মহাকাশযানের কোনো বড় ধরনের ক্ষতি করবে না।

কিন্তু আপনার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।

মনে হয় না। সেই ছেলেবেলা উঁচু দেয়াল থেকে লাফিয়ে পড়তাম— হঠাৎ করে ভরশূন্য পরিবেশের অনুভূতি খুব। চমৎকার অনুভূতি। আমার মনে হয় আমার ছেলেবেলার স্মৃতি মনে পড়ে যাবে।

আপনি ছাদে গিয়ে আঘাত করবেন, আপনার সাথে সাথে সকল খোলা যন্ত্রপাতি ছাদে আঘাত করবে, সমস্ত মহাকাশযান প্রচণ্ড একটা ঝাকুনিতে কেঁপে উঠবে, নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি—

আহ্ ফোবি, তুমি থামবে? আমি একটা বাচ্চা খোকা নই আর তুমি আমার মা নও! তুমি যদি ভুলে গিয়ে থাক তাহলে তোমাকে মনে করিয়ে দিই, আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।

ফোবি নরম গলায় বলল, আমি আপনার প্রতি বিন্দুমাত্র অসম্মান প্রদর্শন করছি না মহামান্য ইবান, আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র।

চমৎকার! তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো, আমি আমার দায়িত্ব পালন করি!

আমি শরীরকে আসন্ন ঘটনার জন্যে প্রস্তুত করে সুইচকে স্পর্শ করে এক সাথে দুটো ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলাম। মনে হলো সাথে সাথে মহাকাশযানে প্রলয় কাণ্ড ঘটে গেল, প্রচণ্ড শব্দ করে মহাকাশযানটি কেঁপে উঠল, এবং আমি আক্ষরিক অর্থে উড়ে গিয়ে ছাদে আঘাত করলাম, মহাকাশযানের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকার কারণে আমি শারীরিক কোনো আঘাত পেলাম না, তবে উড়ে আসা নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, আমার অভুক্ত খাবার, জমে থাকা জঞ্জাল এবং অব্যবহৃত পোশাক থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বেশ বেগ পেতে হলো।

নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ভাসমান যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য জঞ্জাল সরিয়ে আমি ঘরটিকে আবার ব্যবহারের উপযোগী করতে বেশ কিছু সময় লাগল। ভেসে ভেসে আবার নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে এসে ফোবিকে বললাম, দেখলে, এটি কোনো ব্যাপার নয়।

দেখলাম। তবে আপনি সতর্ক না থাকলে উড়ে আসা যন্ত্রপাতি থেকে আঘাত পেতে পারতেন।

কিন্তু আমি সতর্ক থাকব না কেন?

সেটি অবশ্যি সত্যিই বলেছেন।

আমি পদার্থ-প্রতিপদার্থের অব্যবহৃত জ্বালানি চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে আবদ্ধ করে নিরাপত্তার ব্যাপারটি নিশ্চিত করলাম। যাত্রাপথটি ছক করে নিউট্রন স্টারে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে সেটি বের করে নিলাম, পুরো মহাকাশযানের খুঁটিনাটিতে একবার চোখ বুলিয়ে মহাকাশযানের অধিনায়কের দৈনন্দিন কাজ করতে শুরু করলাম। মহাকাশযানে পুরোপুরি একা থাকার একটি সুবিধে রয়েছে যেটা আমি মাত্র টের পেতে শুরু করেছি, এখানে আমার এখন কোনো নিয়ম মানতে হয় না।

সমস্ত কাজ শেষ করতে করতে বেশ অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল, দীর্ঘদিন মহাকর্ষ বলের মাঝে থেকে হঠাৎ করে ভরশূন্য পরিবেশে এসে যাওয়ায় অভ্যস্ত হতে একটু সময় নিচ্ছে। অধিনায়কের দৈনন্দিন তথ্য প্রবেশ করে আমি ঘুমানোর আয়োজন করলাম, এতদিন তবু একটু স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ঘুমিয়েছি, এখন আর তারও প্রয়োজন নেই, আমি শূন্যে শুয়ে পড়তে পারি, ভেসে ভেসে দূরে কোথাও না চলে যাই সে-জন্যে একটা ফিতা দিয়ে একটা পা কন্ট্রোল প্যানেলের সাথে বেঁধে নিলাম। আমি শূন্যে ভাসতে ভাসতে ঘুমানোর জন্যে চোখ বন্ধ করেছি তখন আবার ফোবির কথা শুনতে পেলাম, মহামান্য ইবান, আপনি কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ছেন। এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য।

ফোবি। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি আমার মা নও, তুমি আমার স্ত্রী নও, তুমি আমার কোনো অভিভাবকও নও। আমাকে বিরক্ত কোরো না, ঘুমুতে দাও।

ফোবি আমাকে আর বিরক্ত করল না এবং আমি কিছুক্ষণের মাঝেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম।

 

আমি হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম, কেন আমার হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল আমি জানি না। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে। আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যেতে গিয়ে মনে পড়ল আমি আসলে বিছানায় শুয়ে নেই, শূন্যে ঝুলে আছি। আমি তখন চোখ খুলে তাকালাম এবং হঠাৎ করে আতঙ্কে আমার সারা শরীর শীতল হয়ে গেল।

নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মূল আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে বলে এখানে আবছা এক ধরনের অন্ধকার, ইঞ্জিনগুলো বন্ধ করে দেয়ার ফলে কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। এই ভয়ংকর নৈঃশব্দ এবং আলো-আঁধারিতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাঝামাঝি থেকে একজন তরণী স্থির হয়ে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি চিঙ্কার করে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম, নিশ্চয়ই আমি স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু আমি ততক্ষণ। পুরোপুরি জেগে উঠেছি, আমি জানি আমি স্বপ্ন দেখছি না। আমার সামনে একটি তরণী ভাসছে। একটুকরা নিওপলিমার দিয়ে শরীরকে ঢেকে রেখেছে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষের পরিশোধিত বাতাসের প্রবাহে সেই কাপড়টা উড়ছে। আমি স্থির দৃষ্টিতে তরণীটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, এটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক কোনো প্রতিচ্ছবি নয়— তাহলে আমি দেখতে পেতাম দেয়ালের ভিডি টিউব থেকে আলো বের হয়ে আসছে। এটি সত্যি-সত্যি রক্তমাংশের একজন তরণী।

আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?

আমার কথায় মেয়েটি ভয়ানক চমকে উঠল এবং আমি দেখতে পেলাম তার মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্কের ছায়া পড়েছে। মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল তারপর আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, তুমি কে?

আমি বললাম, আমার নাম ইবান। আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।

অধিনায়ক? মেয়েটা খুব অবাক হয়ে বলল, অধিনায়ক তুমি?

হ্যাঁ।

তাহলে তোমাকে বেঁধে রেখেছে কেন?

আমি অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকালাম এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, ঘুমানোর আগে আমি যেন ভেসে কোথাও না চলে যাই সে-জন্যে ফিতা দিয়ে একটা পা বেঁধে রাখার ব্যাপারটি মেয়েটিকে বিস্মিত করেছে। আমি পা থেকে ফিতাটি খুলে বললাম, কোথাও যেন ভেসে চলে না যাই সেজন্যে বেঁধে রেখেছিলাম।

কেন তুমি ভেসে চলে যাবে? আমি শুনেছি মহাকাশযানে অধিনায়কদের খুব সুন্দর ঘর থাকে।

তুমি ঠিকই শুনেছ—

তাহলে তুমি সেখানে না ঘুমিয়ে এখানে নিজেকে বেঁধে রেখে শূন্যে ঝুলে ঝুলে ঘুমাচ্ছ কেন?

আমি ঠিক নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলাম না যে এরকম বিচিত্র একটা পরিবেশে আমি এধরনের আলাপে জড়িয়ে পড়ছি। আমি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম, দেখ, এসব ব্যাপার নিয়ে আমরা পরেও কথা। বলতে পারব। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমার জানা প্রয়োজন তুমি হঠাৎ করে কোথা থেকে হাজির হয়েছ।

মেয়েটি আমার প্রশ্ন শুনে কেন জানি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে বলল, তুমি যদি মহাকাশযানের অধিনায়ক হয়ে থাক তাহলে তোমার জানা উচিত আমি কোথা থেকে হাজির হয়েছি।

আমি বিপন্ন গলায় বললাম, দেখতেই পাচ্ছ আমি জানি না। সেজন্যেই ব্যাপারটি জরুরি–

কেন ব্যাপাটি জরুরি?

দাঁড়াও বলছি। তার আগে আমি আলো জ্বেলে নিই।

আমি আলো জ্বালানোর জন্যে একটু এগিয়ে যেতেই মেয়েটি চিৎকার করে বলল, খবরদার তুমি আমার কাছে আসবে না।

আমি একটু অপমানিত বোধ করলাম, কিন্তু এই মুহুর্তে মান-অপমান নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। আমি গলার স্বর শান্ত রেখে বললাম, তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, আমি তোমার কাছে আসব না।

নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সুইচ স্পর্শ করামাত্র নিয়ন্ত্রণ কক্ষটি উজ্জ্বল আলোতে ভেসে গেল এবং মেয়েটি হাত দিয়ে নিজের চোখ আড়াল করে দাঁড়াল। আমি দেখতে পেলাম মেয়েটি কমবয়সী এবং অপূর্ব সুন্দরী। মসৃণ ত্বক, কালো চুল এবং সুগঠিত দেহ। মেয়েটির চেহারায় একধরনের নির্দোষ সারল্য রয়েছে যেটি আমি বহুদিন কারো মাঝে দেখি নি। মেয়েটি ভরশূন্য পরিবেশে অভ্যস্ত নয়, প্রতি মুহূর্তে সে ভাবছে সে পড়ে যাবে, কিন্তু ভরশূন্য পরিবেশে কেউ কোথাও পড়ে যেতে পারে না এবং এই বিচিত্র অনুভূতির সাথে সে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে দাঁড়িয়ে পুরো প্যানেলটিতে একবার চোখ বুলিয়ে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে কি না দেখার চেষ্টা করলাম–কিন্তু সেরকম কিছু চোখে পড়ল না। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?

মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিও পলিমারের চাদরটি টেনে নিজের শরীরকে ভালো করে ঢাকার চেষ্টা করে বলল, আমার শীত করছে।

এই পাতলা নিওপলিমারের টুকরো দিয়ে শরীর ঢাকার চেষ্টা করলে শীত করতেই পারে। আমি তোমার গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

মেয়েটি কোনো কথা না বলে আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?

আমার নাম মিত্তিকা।

মিত্তিকা, তুমি কোথা থেকে এসেছ?

আমি জানি না। হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে গেল, আমি ঘুম থেকে উঠে ভাসতে ভাসতে এদিকে এসেছি–

তার মানে তুমি কার্গো বেতে রাখা শীতল ক্যাপসুল থেকে উঠে এসেছ?

আমি সেটা জানি না। আমি রিশি নক্ষত্রপুঞ্জে যাবার জন্যে রেজিস্ট্রি করিয়েছিলাম, কথা ছিল সেখানে পৌঁছার পর আমাকে জাগানো হবে। কিন্তু–

মেয়েটি অভিযাগের সুরে আরো কিছু কথা বলতে থাকে কিন্তু আমি ভালো করে সেটা শুনতে পেলাম না, হঠাৎ করে একধরনের অশুভ আশঙ্কায় আমার ভুর কুঞ্চিত হয়ে উঠলাম। আমি চাপা গলায় ডাকলাম, ফোবি।

ফোবি একেবারে কানের কাছ থেকে ফিসফিস করে বলল, বলুন মহামান্য ইবান।

এটা কী করে হলো? এই মেয়েটি ঘুম থেকে জেগে উঠল কেমন করে?

বলতে পারছি না মহামান্য ইবান। আমার দুটি সম্ভাবনার কথা মনে হচ্ছে।

কী সম্ভাবনা?

ফোবি উত্তর দেবার আগেই মিত্তিকা ভয়-পাওয়া-গলায় চিল্কার করে উঠল, তুমি কার সাথে কথা বলছ?

আমি মিত্তিকাকে ভরসা দেবার ভঙ্গিতে বললাম, ফোবির সঙ্গে। ফোবি হচ্ছে এই মহাকাশযানের মানুষের সাথে যোগাযোগ করার ইন্টারফেস।

সে কোথায়?

তুমি তাকে দেখতে পাবে না।

মিত্তিকা আমার কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হলো না, কেমন জানি ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ফোবিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী সম্ভাবনার কথা বলছ?

আপনি যখন ফোবিয়ানের দুটি ইঞ্জিন একসাথে বন্ধ করে দিয়েছিলেন তখন প্রচণ্ড ঝাকুনিতে কোনো একটি শীতল ক্যাপসুল খুলে গিয়েছে, নিরাপত্তা সার্কিট তখন ভেতরের মানুষটিকে বাঁচিয়ে তুলেছে।

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না। সেটা খুব সম্ভবযোগ্য মনে হচ্ছে না। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা কী?

রিতুন ক্লিসকে যখন আমরা নিজেকে নিজে অপসারণক্ষমতা দিয়েছি তখন নিউরাল নেটওয়ার্কের স্মৃতির একটা বড় অংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তার ফল হিসেবে শীতল ক্যাপসুলের মানুষেরা জেগে উঠছে।

সর্বনাশ!

মিত্তিকা একটু এগিয়ে আসার চেষ্টা করে গলার স্বর উঁচু করে বলল, সর্বনাশ কেন?

তোমাকে নিয়ে আমি সর্বনাশ বলছি না।

তাহলে কাকে নিয়ে সর্বনাশ বলছ?

তোমাদের সাথে ম্যাঙ্গেল ক্বাস নামে একজন ভয়ংকর ডাকাত রয়েছে, তাকে নিয়ে বলছি। এই মানুষটি যদি জেগে উঠে থাকে তাহলে আমাদের খুব বড় বিপদ।

ফোবি নিচু গলায় আমাকে ডাকল, মহামান্য ইবান।

বল।

কিছু-একটা নিয়ে একটু সমস্যা আছে। কার্গো-বেতে যোগযোগ করা যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।

আমি হঠাৎ করে একধরনের আতঙ্ক অনুভব করলাম, সত্যিই যদি মিত্তিকার মতো ম্যাঙ্গেল ক্বাসও জেগে উঠে থাকে তাহলে কী হবে? আমি চাপা গলায় ডাকলাম, ফোবি।

বলুন মহামান্য ইবান।

আমার একটু কার্গো বেতে যেতে হবে।

ফোবি কোনো কথা বলল না।

কী হয়েছে নিজের চোখে দেখে আসতে হবে।

এবারেও ফোবি কোনো কথা বলল না।

ফোবি।

বলুন মহামান্য ইবান।

আমার মনে হয় খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। অস্ত্রাগার থেকে একটা অস্ত্র নিয়ে যাই। কী বল?

ঠিক আছে।

মিত্তিকা চোখ বড় বড় করে আমাদের কথা শুনছিল, এবারে ভয়ার্ত গলায় বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

কার্গো বেতে। তুমি এখানে একটু অপেক্ষা কর।

না, আমার ভয় করে।

এখানে ভয়ের কিছু নেই।

যদি ভয়ের কিছু না থাকে তাহলে হাতে অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছ কেন?

প্রশ্নটির ভালো কোনো উত্তর ভেবে পেলাম না, মিত্তিকা নিজেই বলল, আমি তোমার সাথে যাব।

তুমি তো ভরশূন্য পরিবেশে অভ্যস্ত নও, ভেসে ভেসে যেতে পারবে না।

ভেসে ভেসে যদি যেতে না পারি তাহলে এখানে এসেছি কেমন করে?

আমি এই প্রশ্নটারও উত্তর দিতে পারলাম না, মাথা নেড়ে বললাম, ঠিক আছে চল।

আমি মিত্তিকাকে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মূল করিডোর ধরে ভেসে ভেসে ফোবিয়ানের মাঝামাঝি সুরক্ষিত ঘরটি থেকে একটা শক্তিশালী অস্ত্র তুলে নিলাম, লেজার রশ্মি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে লক্ষ করে শক্তিশালি বিস্ফোরক ছুড়ে দেবার। একটি অতি প্রাচীন কিন্তু কার্যকর অস্ত্র।

অস্ত্রটি উরর সাথে বেঁধে নিয়ে আবার আমি ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যেতে থাকি, ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে ভেসে যাওয়া নিয়ে মিত্তিকা যদিও খুব বড়গলায় কথা বলেছে কিন্তু আসলে অভ্যস্ত না থাকায় সহজে এগিয়ে যেতে পারছিল না, আমি তাকে একহাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম।

কার্গো বে-এর দরজা হাট করে খোলা, ভিতরে আবছা অন্ধকার। আমি আলো জ্বালালাম, ঘরের মাঝামাঝি একটা ক্যাপসুল ওলটপালট খেয়ে ভাসছে। ক্যাপসুলটি হা করে খোলা। আমি চাপাগলায় জিজ্ঞেস করলাম, মিত্তিকা, এটা কি তোমার ক্যাপসুল?

মিত্তিকা মাথা নাড়ল, বলল, না। আমারটা ওই পাশে।

আমি উর থেকে খুলে অস্ত্রটা হাতে নিয়ে একটা ঝটকা দিয়ে ক্যাপসুলের দিকে এগিয়ে গেলাম। ক্যাপসুলের দরজা খোলা, ভেতরে কেউ নেই। ক্যাপসুলের পাশে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের নাম লেখা— এটাতে তাকে আটকে রাখা ছিল।

ভয়ের একটা শীতল স্রোত আমার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল, ম্যাঙ্গেল ক্বাস ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছে।

এই মহাকাশযানের কোথাও সে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

৪. মহাকাশযানের নির্জন করিডোর

আমি মিত্তিকাকে নিয়ে মহাকাশযানের নির্জন করিডোর ধরে ফিরে আসছিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস এই মহাকাশযানের কোথাও লুকিয়ে আছে হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর চিৎকার করে অস্ত্র হাতে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এই ধরনের একটা আশংকায় আমার বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ধকধক করে শব্দ করতে থাকে। করিডোরের মাঝামাঝি এসে আমি চাপাগলায় ফোবিকে ডাকলাম, ফোবি।

ফোবি আমার কানের কাছে থেকে উত্তর দিল, বলুন মহামান্য ইবান।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস শীতল ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে গেছে।

আমি জানি।

তুমি কেমন করে জানো? কার্গো বেতে তো নিউরাল নেটওয়ার্কের যোগাযোগ নেই।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে আছে।

আমি চাপাগলায় চিৎকার করে বললাম, কী বললে?

বলেছি ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে আছে।

আমার নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না, অবিশ্বাসের গলায় বললাম, কী বললে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে আছে?

ঠিক করে বললে বলতে হয় ভেসে আছে।

কেন?

মনে হয় তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

আমার জন্যে? আমার জন্যে কেন?

যতদূর মনে হয় মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণটি নিতে চায়।

ওর কাছে কি কোনো অস্ত্র আছে?

নেই।

একেবারে খালি হাতে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে?

হ্যাঁ। মানুষটি খুব আত্মবিশ্বাসী।

তুমি কীভাবে জানো?

ফোবি একটু ইতস্তত করে বলল, মানুষের চরিত্রের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য আমাদের বিশেষ করে প্রস্তুত করা হয়।

ও।

আমি মিত্তিকার দিকে তাকালাম, সে পুরো ব্যাপারটি এখনো বুঝতে পারছে না, খানিকটা বিস্ময় এবং অনেকখানি আতঙ্ক নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো মুখে বলল, এখন কী হবে?

প্রশ্নটি অত্যন্ত সহজ এবং সরল কিন্তু এর উত্তরটি সহজ কিংবা সরল নয়। আমার হঠাৎ করে মনে হতে থাকে যে এই প্রশ্নটির উত্তর কারোই জানা নেই। কিন্তু মিত্তিকাকে আমি সেকথা বলতে পারি না। মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে এরকম পরিবেশে যে-ধরনের উত্তর দেবার কথা আমি সেরকম একটি দিলাম। বললাম, পুরো ব্যাপারটি বিশ্লেষণ না করে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।

মিত্তিকা ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, তার মানে ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে?

মানুষকে মেরে ফেলা এত সহজ ব্যাপার নয়।

কিন্তু তুমি তো মানুষকে মেরে ফেলার জন্যে একটা অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ।

আমি এই কথার কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না উত্তর দেয়ার সময় হলো না, কারণ ততক্ষণে আমরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পৌঁছে গেছি। নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে একজন মানুষ আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটি নিশ্চয়ই ম্যাঙ্গেল কাস।

প্রথমেই আমার যে কথাটি মনে হলো সেটি হচ্ছে ইচ্ছে করলেই আমি তাকে এখনই গুলি করে মেরে ফেলতে পারি। এই ধরনের একটা কথা আমার মাথায় এসেছে বলে পরমুহূর্তে হঠাৎ করে আমার নিজের উপর একধরনের ঘৃণাবোধের জন্ম হলো। আমি কিছু বলার আগেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস ধীরে ধীরে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, ভরশূন্য পরিবেশে তার সহজে ঘােরার ভঙ্গি দেখে আমি বুঝতে পারলাম সে তার জীবনের দীর্ঘ সময় মহাকাশযানে কাটিয়েছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস মানুষটি সুদর্শন বলে শুনেছিলাম এবং আমি দেখতে পেলাম কথাটি সত্য। তার মাথায় কালো চুল, খাড়া নাক, এবং গভীর নীল চোখ। গায়ের রঙ তামাটে এবং মুখে একধরনের চাপা হাসি। আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম মানুষটি সুদর্শন হলেও সেখানে একধরনের বিচিত্র কদর্যতা লুকিয়ে আছে। সেই কদর্যতাটি কেথায় তার চোখের দৃষ্টিতে নাকি মুখের চাপা হাসিতে আমি ঠিক ধরতে পারলাম না। মানুষটি আমার চোখের দিকে তাকাল এবং তার মুখের হাসিটি আরো বিস্তৃত করে বলল, তোমাকে আমি একটি সুযোগ দিয়েছিলাম, তুমি সেই সুযোগ গ্রহণ করলে না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা বলার ভঙ্গিটি অত্যন্ত বিচিত্র। মনে হয় প্রত্যেকটা শব্দ আলাদা আলাদাভাবে উচ্চারণ করে এবং কথাটি শেষ হবার পরও মনে হয় তার কথা এখনো শেষ হয় নি।

কোনো একটি বিচিত্র কারণে ম্যাঙ্গেল ক্বাস কী বলছে আমি সেটা বুঝতে পারলাম এবং সেজন্যে আবার আমার নিজের উপর আবার একটু ঘৃণাবোধের জন্ম হলো। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখের ভঙ্গি খুব ধীরে ধীরে পবির্তিত হলো, সে মুখের হাসি সরিয়ে সেখানে একধরনের অনুকম্পার ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতে অস্ত্র ছিল, তুমি কেন আমাকে হত্যা করলে না?

যদি তোমাকে হত্যা করার প্রয়োজন হতো, আমি তাহলে নিশ্চয়ই তোমাকে হত্যা করতাম ম্যাঙ্গেল কাস।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নেড়ে আবার আলাদা আলাদাভাবে একটি একটি শব্দ উচ্চারণ করে বলল, আমি কিন্তু প্রয়োজন ছাড়াই হত্যা করতে পারি।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি কী চাও?

আপাতত এই মহাকাশযানটির কর্তৃত্ব চাই। এটিকে আমার নিজের এলাকায় নিতে চাই।

আমি দুঃখিত ম্যাঙ্গেল ক্বাস সেটি সম্ভব নয়। আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।

আমার কথা শেষ হবার আগেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার ডান হাত উপরে তুলে আমার মাথার উপরে অঙ্গুলি নির্দেশ করল, এবং হঠাৎ করে আমি ভয়ংকর আতংকে শিউরে উঠলাম, আমি বুঝতে পারলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস একজন হাইব্রিড২৪, একই সাথে যন্ত্র এবং মানুষ। তার শরীরের ভেতরে অস্ত্র, সেই অস্ত্র ব্যবহার করে সে তার আঙুলের ভেতর দিয়ে ভয়ংকর বিস্ফোরক ছুড়ে দিতে পারে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ বিদ্যুঝলকের মতো তার আঙুল থেকে বিস্ফোরক ছুটে এল। আমি মিত্তিকাকে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নিচে ঝাপিয়ে পড়লাম, মাথার উপর দিয়ে বিস্ফোরক ছুটে গেল এবং প্রচণ্ড বিস্ফোরণে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেওয়াল চূর্ণ হয়ে গেল।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার হাত নামিয়ে আনে, আমি দেখতে পেলাম তার আঙুলের ডগা থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে, শরীরের ভেতরে বিস্ফোরক লুকানো থাকে, চামড়া ভেদ করে সেটি বের হয়ে এসেছে। ভরশূন্য পরিবেশে আমি কয়েকবার লুটোপুটি খেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেল থেকে সাবলীল ভঙ্গিতে একটি লাফ দিয়ে একেবারে আমার সামনে এসে হাজির হলো— আমি ততক্ষণে উরু থেকে আমার অস্ত্রটি বের করে এনেছি। ম্যাঙ্গেল কৃাসের দিকে সেটি তাক করে বললাম, তুমি দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও ম্যাঙ্গেল ক্বাস।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস এমনভাবে হেসে উঠল যেন আমি অত্যন্ত মজার একটা কথা বলেছি। আমি কঠোর মুখে বললাম, আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক। আমি তোমাকে আদেশ দিচ্ছি তুমি দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও–

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল এবং সে হাত উপরে না তুলে খুব ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। আমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তাক করে চিৎকার করে বললাম, খবরদার–

ম্যাঙ্গেল কাস ভক্ষেপ করল না। ধীরে ধীরে তার হাত আমার দিকে তুলে ধরতে শুরু করল এবং আমি তখন মরিয়া হয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির ট্রিগার টেনে ধরলাম। ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে গেল এবং ম্যাঙ্গেল কাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেওয়ালে গিয়ে ছিটকে পড়ল। আমি তখনো থরথর করে কাঁপছি, জীবনে কখনো কোনো মানুষকে নিজ হাতে খুন করতে হবে ভাবি নি। আমি গভীর বিতৃষ্ণা নিয়ে আবিষ্কার করলাম ব্যাপারটি এমন কিছু কঠিন নয়। মিত্তিকা আমার হাত ধরে বলল, ইবান।

কী হলো?

ঐ দেখ–

আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের গালের চামড়াকে ধরে টেনে লম্বা করে ফেলতে থাকে, আমি সবিস্ময়ে দেখলাম গলিত পলিমারের মতো সেটা উপরে উঠে আসছে, বেশ খানিকটা উপরে তুলে এনে ছেড়ে দিতেই সেটা শব্দ করে আবার রবারের মতো নিচে নেমে এল। মিত্তিকা শিউরে উঠে আমাকে জাপটে ধরে ফিসফিস করে বলল, দানব, নিশ্চয়ই দানব।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নাড়ল, বলল, না। দানব না। হাইব্রিড। আধা যন্ত্র আধা মানুষ। আমার চামড়ার উপর সূক্ষ্ম বায়োমারের আস্তরণ রয়েছে। সেটাকে ভেদ করে যাবার মতো কোনো বিস্ফোরক নেই। আমাকে হত্যা করার মতো কোনো অস্ত্র তৈরি হয়ে নি মেয়ে।

আমি হতচকিতের মতো তাকিয়ে রইলাম, ম্যাঙ্গেল কাসের চোখ দুটি হঠাৎ হিংস্র পশুর মতো জ্বলে ওঠে, সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আঙুল নির্দেশ করে বলল, কিন্তু তোমার মতো মানুষকে সহস্রবার ছিন্নভিন্ন করে দেবার। মতো অস্ত্র আমার দেহে আছে।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার দিকে আরো এক পা এগিয়ে এল তারপর ফিসফিস করে বলল, কিন্তু আমি এই মুহূর্তে তোমাকে ছিন্নভিন্ন করে দেব না। কারণ তোমাকে আমার প্রয়োজন।

আমি স্থির চোখে ম্যাঙ্গেল কাসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করে বলল, আমি কি তোমার নিকট থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেতে পারি?

আমি কোনো উত্তর দিলাম না, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল, বলল, নিশ্চয়ই পেতে পারি। এই মেয়েটিকে আমি সেজন্যে শীতল ঘর থেকে বের করে এনেছি। তুমি নিশ্চয়ই এরকম কমবয়সী একটি মেয়ের শরীরকে ছিন্নভিন্ন হতে দেখতে চাও না।

আমি চুপ করে রইলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস চাপাগলায় বলল, চাও ইবান?

মিত্তিকা আমাকে ধরে আর্তচিৎকার করে থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি মাথা নাড়লাম, না চাই না।

চমৎকার।

ম্যাঙ্গেল কাস এবারে শূন্যে ভেসে আবার নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের কাছে ফিরে গেল, সেখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা বিশ্রাম নিতে যাও। আমার যখন প্রয়োজন হবে আমি তোমাদের ডাকব।

আমি মিত্তিকাকে ধরে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস আবার ডাকল, ইবান।

বল।

তোমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি রেখে যাও। বুঝতেই পারছ এটি তোমার জন্যে একটি জঞ্জাল ছাড়া আর কিছু নয়।

আমি হাতের অস্ত্রটি ম্যাঙ্গেল কাসের দিকে ছুড়ে দিলাম, সে হাত দিয়ে সেটিকে সরিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের উপর ঝুঁকে পড়ল, অস্ত্রটি সত্যি-সত্যি অপ্রয়োজনীয় জঞ্জালের মতো ঘরে পাক খেয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে।

 

প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মিত্তিকাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে একটা বিশ্রামঘরে শুইয়ে আমি নিজের ঘরে ফিরে এসেছি। অধিনায়কের জন্যে আলাদা করে রাখা আমার এই ঘরটিতে আমি খুব একটা আসি নি। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে আমি চমকে উঠলাম, আমার বিছানার পাশের আরামদায়ক চেয়ারে কেউ-একজন বসে আছে। আমাকে দেখে মানুষটি ঘুরে তাকাল এবং আমি তাকে চিনতে পারলাম, মানুষটি রিতুন ক্লিস, সত্যিকারের মানুষ নন, তার হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, মহামান্য রিতুন ক্লিস, আপনি?

হ্যাঁ আমি।

আমি ভেবেছিলাম আপনি এই নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে মুক্তি নিয়ে আমাদের এখান থেকে চলে গেছেন।

হ্যাঁ, আমি মুক্তি চেয়েছিলাম, কিন্তু যে কারণে তুমি আমাকে হত্যা করতে পার নি, ঠিক সেই কারণে আমিও নিজেকে হত্যা করতে পারি নি। তা ছাড়া

তা ছাড়া?

তা ছাড়া ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাজ দেখে হঠাৎ আমার একটু কৌতূহল হলো, ইচ্ছে হলো সে কী করে দেখি।

দেখেছেন?

হ্যাঁ দেখেছি। গত দুইশ বছরে প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। আমাদের সময় হাইব্রিড ছিল না। অত্যন্ত বিচিত্র একটি প্রক্রিয়া। অত্যন্ত বিচিত্র একটি ধারণা।

আমি একটি নিঃশ্বাস ফেললাম। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে খুব বিচলিত মনে হচ্ছে ইবান।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, এটি কি বিচলিত হওয়ার মতো ব্যাপার নয়? আমি একটি মহাকাশযানের অধিনায়ক। সেই মহাকাশযানের শীতল ক্যাপসুল থেকে একটি দস্যু বের হয়ে পুরো মহাকাশযানটি দখল করে ফেলল। আমাকে এখন তার কথা শুনতে হবে, তা না হলে সে মানুষ খুন করে ফেলবে।

রিতুন ক্লিস শব্দ করে হাসলেন, বললেন, জীবনকে এত গুরত্ব দিয়ে নিতে হয় না। একটি দস্যুর যা করার কথা সে তাই করেছে। তুমি একটি মহাকাশযানের অধিনায়ক, তোমার যা করার কথা তুমি তাই কর।

আমি কী করব?

আমি সেটা কেমন করে বলি? তবে তুমি কী কর আমি সেটাও দেখার জন্যে খুব কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছি।

মহামান্য রিতুন, আপনি সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান মানুষ। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ, শুধুমাত্র পরিশ্রম করে আমি এ পর্যন্ত এসেছি। আমি বড় বিপদ দেখি নি, কীভাবে সেটার মুখোমুখি হতে হয় জানি না।

সেটা কেউই জানে না ইবান। জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেটা শিখতে হয়।

আমি আপনার কাছে সাহায্য চাই মহামান্য রিতুন।

মহামান্য রিতুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাদের এই পুরো ব্যাপারটি আমার কাছে একটি পরাবাস্তব নাটিকার মতো আমি এর একজন দর্শক। এর ভালো-মন্দে আমার কিছু আসে যায় না। আমি এতে অংশ নিতে পারব না ইবান। আমি শুধু দেখে যাব।

আপনি বলতে চাইছেন ম্যাঙ্গেল ক্বাস যদি একজন একজন করে মানুষ খুন করতে থাকে আপনি এতটুকু বিচলিত হবেন না?

আমি বলতে পারছি না ইবান। আমি হয়ত বিচলিত হব, অভিনয় জেনেও মানুষ অভিনেতার ভালো অভিনয় দেখে অভিভুত হয়।

আমি দুই হাতে নিজের চুল ধরে টানতে থাকি তারপর কাতর গলায় বলি, মহামান্য রিতুন, আপনি একবার বলুন, আমি কী করব।

মহামান্য রিতুন দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, জীবনকে সহজভাবে নাও ইবান। খুব সহজভাবে নাও।

তার অর্থ কী?

আমি বলে দিলে তুমি বুঝবে না। তোমার নিজেকে সেটা বুঝতে হবে।

আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমি কি বুঝব?

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেউ সাধারণ নয়। সবাই অসাধারণ, সেটা শুধু তাকে জানতে হয়। কেউ তার জীবনে সেটা জানে কেউ জানে না।

 

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমাকে বিশ্রাম নিতে বলেছে কিন্তু আমি জানি আমি বিশ্রাম নিতে পারব না। আমি আমার ঘরে নিদ্রাহীন হয়ে শুয়ে রইলাম, রিতুন ক্লিস আমাকে পুরো ব্যাপারটি সহজভাবে নিতে বলেছেন কিন্তু আমি এটা সহজভাবে নিতে পারছি না। আমাকে পঞ্চম মাত্রার একটা মহাকাশযানের অধিনায়ক করে পাঠানো হয়েছে কিন্তু ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মতো একজন হাইব্রিড দস্যু সেই মহাকাশযানটির কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে। এটি কি সহজভাবে নেয়া সম্ভব? আমি লি-হানের কাছে এটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম, আমার সেই সন্দেহটাই তো সত্যি প্রমাণিত হলো। আমি যদি পুরো ব্যাপারটি সহজভাবে নিতে চাই তাহলে ধরে নিতে হবে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। ফোবিয়ান থাকুক বা না থাকুক, আমি থাকি বা না থাকি, ম্যাঙ্গেল ক্বাস থাকুক বা না থাকুক কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের লক্ষ কোটি নক্ষত্রের অসংখ্য প্রাণীজগতের তুলনায় মানুষ ক্ষুদ্র একটি প্রাণী তাদের কয়েকজনের ভাগ্যে কী ঘটেছে সেটি এমন কোনো গুরত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। আমার বেঁচে থাকা না থাকাও এমন কোনো গুরত্বপূর্ণ ব্যাপার। নয়। আমি মোটামুটি একটা জীবন উপভোগ করেছি সেই জীবনকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কাজেই আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করতে পারি।

হঠাৎ করে আমি নিজের ভিতরে নতুন একধরনের শক্তি অনুভব করতে থাকি, মনে হতে থাকে সত্যিই জীবনকে সহজভাবে নিতে হবে— এর জটিলতা আমাকে যেন স্পর্শ করতে না পারে।

আমি শুয়ে থেকে থেকে নিজের অজান্তেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমাকে ম্যাঙ্গেল ক্বাস ঘুম থেকে ডেকে তুলল, আমি চোখ খুলে তাকাতেই সে বলল, ইবান, তুমি আমার সাথে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে চল।

আমি হাত দিয়ে চোখ মুছে বললাম, কেন?

আমি মহাকাশযান ফোবিয়ানের গতিপথ পালটাতে চাই।

আমি ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না। শান্ত গলায় বললাম, কেন?

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি চাই, সেটাই কি যথেষ্ট নয়?

সম্ভবত। কিন্তু আমি কারণটা জানতে চাই।

কেন?

কারণটা পছন্দ না হলে আমি রাজি না-ও হতে পারি।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, মনে হলো সে বিশ্বাস করতে পারছে না আমি কথাটা বলেছি। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শীতল গলায় বলল, তুমি সত্যি রাজি না হওয়ার সাহস রাখ?

আমি সহৃদয় ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বললাম, আসলে রাখি না, আমি মহাকাশযানের অধিনায়ক, সাহস দেখানো আমার দায়িত্বের মাঝে পড়ে না। তবে তুমি যদি আমাকে বল মহাকাশযানের গতিপথ পাল্টে দিয়ে কাছাকাছি। ব্ল্যাকহোলে ঝাপ দিতে চাও তাহলে আমি রাজি না-ও হতে পারি! তাতে আমি হয়ত তোমার হাতে এই মুহূর্তে মারা পড়ব, দুদিন পরে ব্ল্যাকহোলের ভয়ংকর মহাকর্ষ বলে শরীরের নিচের অংশ উপরের অংশ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া থেকে সেটা এমন কিছু খারাপ নয়।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস বলল, না, আমি ব্ল্যাকহোলে ঝাঁপ দেব না।

তাহলে কী করবে?

আমার একটি সুগঠিত দল রয়েছে, তাদের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে, আমি তাদের তুলে নিতে চাই। আমি ভিতরে ভিতরে ভয়ানকভাবে চমকে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তারাও কি তোমার মতো হাউব্রিড মানুষ?

না। হাইব্রিড মানুষ হওয়ার ক্ষমতা খুব বেশি মানুষের নেই।

ও।

চল তাহলে। ম্যাঙ্গেল জ্বাস একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, নাকি তুমি রাজি নও?

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমি অবশ্যিই চাইব না তুমি তোমার সুগটিত দলকে এখানে তুলে আন, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কিছু করার নেই। সম্ভবত ভবিষ্যতে তোমাকে এবং তোমার পুরো দলকেই ধ্বংস করার এটি একটি সুযোগ।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর যে একদিন তুমি আমাকে এবং আমার দলকে ধ্বংস করবে?

হ্যাঁ। আমি সেটা খুব সহজেই করতে পারি। আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক। পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযান অধিনায়ক ছাড়া আর কারো নির্দেশে চালানো যায় না। তার অর্থ জানো?

ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নাড়ল, সে জানে।

আমি হাসার ভঙ্গি করে বললাম, আমি ইচ্ছে করলেই তোমাদের সবাইকে নিয়ে এই মহাকাশযানটি ধ্বংস করে দিতে পারব। তোমাকে এবং তোমার সুগঠিত দলকে ধ্বংস করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। তবে আমি সেটা করতে চাই যখন আমি এর ভেতরে নেই তখন।

কথাটি খুব উঁচু স্তরের রসিকতা হয়েছে এরকম ভান করে আমি উচ্চ স্বরে হাসতে শুরু করি। ম্যাঙ্গেল ক্বাস কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচুগলায় বলল, গতরাতে যখন তোমার সাথে দেখা হয়েছিল তখন তুমি বিশেষ বিচলিত ছিলে, আজ ভোরে তোমাকে খুব আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে।

এখানে রাত এবং ভোর বলে কিছু নেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস। কারো জন্যে পুরোটাই রাত, কারো জন্যে পুরোটাই সকাল।

তুমি কী বললে?

বিশেষ কিছু বলি নি আর আত্মবিশ্বাসের কথাটা সত্যি। আমি ঠিক করেছি জীবনটা খুব সহজভাবে নেব। সিদ্ধান্তটা নেবার পর হঠাৎ করে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে।

সহজভাবে?

হ্যাঁ। যার অর্থ বেঁচে থাকতেই হবে এরকম কোনো গো আমার মাঝে নেই। তার অর্থ বুঝতে পারছ?

ম্যাঙ্গেল ক্বাস কঠিন মুখে বলল, তুমি কোনটা বুঝাতে চাইছ সেটা হয়ত বুঝতে পারি নি।

আমারও তাই ধারণা। আমি বোঝাতে চাইছি যে আমার থেকে সাবধান। যে মারা যেতে প্রস্তুত তার থেকে ভয়ংকর আর কিছু নেই। আমি সুর পাল্টে বললাম, যা-ই হোক ওসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই, তার থেকে চলো দিনটি শুরু করার আগে ভালো কিছু খাওয়া যাক। আমার কাছে চমৎকার কিছু পানীয় আছে।

ম্যঙ্গেল ক্বাস সর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কী একটা ভাবল তারপর বলল, চল।

তুমি যেরকম আমার অতিথি, মিত্তিকাও আমার অতিথি। তাকে ডেকে আনলে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?

না নেই।

চমৎকার।

মহাকাশযানের অধিনায়কের বিশেষ খাবার এবং বিশেষ পানীয় থাকা সত্ত্বেও আমাদের খাবারের অনুষ্ঠানটি মোটেও আনন্দদায়ক হলো না। মিত্তিকা চমৎকার একটি পোশাক পরে এলেও ম্যাঙ্গেল ক্বাসের সামনে বসে সে প্রায় কিছুই খেতে পারল না। ভরশূন্য পরিবেশে খাবার বিশেষ পদ্ধতির সাথেও সে পরিচিত নয়— ব্যাপারটি তার জন্যে বেশ কঠিন।

আমরা নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলাম, ম্যঙ্গেল ক্বাস হাইব্রিড মানুষ হলেও তাকে খেতে হয়, তাকে নিঃশ্বাস নিতে হয়। আমি এই ব্যপারটি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম। খাওয়ার পর আমি এবং ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের উপর। ঝুঁকে পড়লাম— সে ঠিক কোথায় যেতে চাইছে সেটি আমার জানা প্রযোজন। হোয়াইট ডোয়ার্ফ২৬ জাতীয় একটা নক্ষত্রের কাছাকাছি কিছু বড় গ্রহ রয়েছে তার একটি উপগ্রহের সাথে সে যোগাযোগ করছে বলে দাবি করল। আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললাম, অসম্ভব। যে-কোনো মানুষ ঐ গ্রহ উপগ্রহ থেকে দূরে থাকবে। ঐগুলো হচ্ছে অনাবিষ্কৃত অঞ্চল। গ্যালাক্টিক তথ্যকেন্দ্রে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে যে এই অঞ্চলে বুদ্ধিমান প্রাণের বিকাশ হয়েছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, আমার কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রয়োজন নেই, আমার প্রয়োজন আমার দলের সকল মানুষকে। তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান।

বুদ্ধি ব্যাপারটি কী সেটা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে, আমি সেই বিতর্কে যেতে চাচ্ছি না, আমি মেনে নিচ্ছি তোমার দলের মানুষেরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। কিন্তু এই অঞ্চলের মহাজাগতিক প্রাণী তোমার দলের মানুষ থেকেও বেশি বুদ্ধিমান হতে পারে। সেখানে উপস্থিত হওয়া নিরাপদ না-ও হতে পারে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে বলল, নিরাপত্তার ব্যাপারটি আমি তোমার কাছ থেকে শিখতে চাইছি না ইবান।

আমি সাথে সাথে হাত তুলে বললাম, ঠিক আছে, আমি সে-ব্যাপারে কোনো কথা বলছি না।

চমৎকার। তুমি তাহলে মহাকাশযানের গতিপথ পরিবর্তন কর। আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝে আমরা ঐ এলাকায় পৌঁছে যেতে চাই।

ফোবিয়ানের জ্বালানি নিয়ে একটা সমস্যা হতে পারে—

সেটি আমার সমস্যা নয়।

বেশ।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে কাজ শুরু করে দিলাম। ফোবিয়ানের মূল তথ্যকেন্দ্রে কিছু গোপন সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে তার গতিপথ পাল্টে দেয়ার জন্যে নির্দিষ্ট কোডে নির্দেশ দিতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই ফোবিয়ানের শক্তিশালী ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল।

 ৫. ম্যাঙ্গেল ক্বাস

ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার দলবলকে সংগ্রহ করার জন্যে যে গ্রহটিকে ঘিরে ফোবিয়ানের কক্ষপথ নির্দিষ্ট করল, সেই গ্রহটিকে আমার খুব অপছন্দ হলো। এই কুৎসিত বিশাল গ্রহটির যে উপগ্রহ থেকে সে তার সঙ্গীসাথির সংকেত পেয়েছে বলে দাবি করল সেই উপগ্রহটিকে আমার অপছন্দ হলো আরো বেশি। একটি নির্দিষ্ট গ্রহ বা উপগ্রহ সম্পর্কে ব্যক্তিগত ভালো লাগা না-লাগার কোনো গুরত্ব নেই, কিন্তু শুরু থেকেই এই গ্রহ এবং উপগ্রহ সম্পর্কে আমার ভিতরে একধরনের অশুভ অনুভূতির জন্ম হয়ে গেল। আমি ব্যাপারটি গোপন করার কোনো চেষ্টা না করে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে বললাম, তুমি তোমার দলের লোকজনের অবস্থান ঠিক করে কো-অর্ডিনেট জানিয়ে দাও, আমি স্কাউটশিপ পাঠিয়ে তাদেরকে আনার ব্যবস্থা করে দিই।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস সর চোখে আমার দিক তাকাল, বলল, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে নির্বোধ বিবেচনা কর নি।

আমি মাথা নাড়লাম এবং বললাম, না করি না। কিন্তু এই উপগ্রহটিকে আমার খুব অপছন্দ হয়েছে, গ্যালাক্টিক তালিকায় এর কোনো নাম নেই, বিদঘুটে সংখ্যা দিয়ে পরিচয় দেয়া হয়েছে। এটি অস্থিতিশীল এবং বিস্ফোরণমুখ। আমি এখানে যেতে চাই না।

তুমি যেতে চাও কি না-চাও সেটি বিবেচনার মাঝে আনার প্রয়োজন নেই। আমি চাই কি না-চাই সেটাই গুর ত্বপূর্ণ।

তুমি কী চাও?

আমার নিরাপত্তার খাতিরে আমি কখনোই তোমাকে আলাদা হতে দেব না। কাজেই আমরা যে স্কাউটশিপ নিয়ে এই উপগ্রহে নামব সেখানে তুমি থাকবে। মিত্তিকা নামের সেই মেয়েটিও থাকবে।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, আমি যদি একজন দস্যু হতাম আমিও ঠিক এধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে কোথাও এক পা আগ্রসর হতাম না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে তার দলের লোকজনের সাথে যোগাযোগ নিশ্চিত করতে করতে আমাকে বলল, তুমি স্কাউটশিপটা প্রস্তুত কর, আমরা কিছুক্ষণের মাঝেই রওনা দিতে চাই।

স্কাউটশিপে যাবার আগে আমি মিত্তিকাকে ডেকে পাঠালাম, সে একধরনের ভয়ার্ত চোখে হাজির হলো, ফ্যাকাশে মুখে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ইবান?।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস কিছুক্ষণের মাঝে এই উপগ্রহটাতে নামছে।

মিত্তিকা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, এই তথ্যটি তাকে জানানোর কারণটি সে বুঝতে পারছে না। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, সে এই উপগ্রহটাতে একা যাবে না, তোমাকে আর আমাকে নিয়ে যাবে।

কথাটি শুনে মিত্তিকা যেরকম ভয় পেয়ে যাবে বলে ভেবেছিলাম দেখা গেল সে সেরকম ভয় পেল না, বরং তার মাঝে বিচিত্র একধরনের কৌতূহলের জন্ম হলো। চোখ বড়-বড় করে বলল, এই উপগ্রহে সত্যি-সত্যি বুদ্ধিমান প্রাণী আছে?

আমি ভুর কুঁচকে বললাম, আমি আশা করছি নেই।

কেন? তুমি বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণী পছন্দ কর না?

সত্যি কথা যদি বলতে বল তাহলে বলব যে, না যে বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে আমার যোগাযোগ হয় নি তাকে আমি পছন্দ করি না।

কেন?

প্রথমত বুদ্ধিমান প্রাণী কৌতুহলী হয়। কাজেই তারা আমাদের নিয়ে কৌতুহলী হবে।

কৌতুহলী হলে সমস্যা কিসের? মিত্তিকা ঠিক বুঝতে পারল না আমি কী নিয়ে কথা বলছি। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, যদি এরা মোটামুটি আমাদের মতো বুদ্ধিমান হয় তাহলে আমাদের কেটেকুটে দেখবে। আমাদের ধরে তাদের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে রাখবে। যদি অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয় তাহলে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরণগুলি বিশ্লেষণ করবে, আমাদের নতুন করে তৈরি করবে।

মিত্তিকাকে এবারে একটু আতংকিত হতে দেখা গেল। আমি সাহস দিয়ে বললাম, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলবল যেহেতু এই উপগ্রহে বেঁচে আছে এখানে নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান কোনো মহাজাগতিক প্রাণী নেই। যদি থেকেও থাকে তাহলে সেটা নিশ্চয়ই বন্ধুভাবাপন্ন–

দেখতে কী রকম হবে বলে তোমার মনে হয়? অনেকগুলো চোখ, এঁড়ের মতো হাত-পা–

আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই বিনোদন চ্যানেলে নানা ধরনের ছায়াছবি দেখ। প্রকৃত বুদ্ধিমান প্রাণী হলে সেটি যে আমাদের মতো হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হয়ত তারা এত ক্ষুদ্র যে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে। দেখতে হয়, কিংবা এত বড় যে পুরোটা নিয়েই তারা একটা গ্রহ! কিংবা তারা বাতাসের মতো দেখা যায় না কিংবা তরল সমুদ্রের মতো–

মিত্তিকার এবারে খুব আশাভঙ্গ হলো বলে মনে হলো। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তোমার এত মন খারাপ করার কিছু নেই, হয়ত সত্যিই দেখবে ছোট ছোট পুতুলের মতো হাসিখুশি মহাজাগতিক প্রাণী, তোমাকে দেখে আনন্দে নাচানাচি করছে!

স্কাউটশিপটি কিছুক্ষণের মাঝেই আমি প্রস্তুত করে নিলাম, মূল মহাকাশ্যানের মতো এর এত বড় ইঞ্জিন নেই কিন্তু কাজ চালানোর মতো দুটি শক্তিশালী প্লাজমা ইঞ্জিন রয়েছে। মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে বলে এর মাঝে কয়েকদিন থাকার মতো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, খাবার পানীয় বা জ্বালানি রয়েছে, শক্তিশালী যোগাযোগব্যবস্থা এমনকি ভয়ঙ্কর ধরনের অস্ত্রও রয়েছে।

আমি স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে বসে সেটার ইঞ্জিন চালু করতে করতে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে বললাম, তোমার কাছে আমি একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাই।

কী ব্যাপার?

উপগ্রহটিতে নামার পর যদি তুমি আমাকে কিংবা মিত্তিকাকে তোমার সাথে নিতে চাও তাহলে আমাদের অস্ত্র নিতে দিতে হবে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস কয়েক মুহূর্ত কিছু-একটা ভাবল তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।

স্কাউটশিপটি ফোবিয়ান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই প্রচণ্ড গর্জন করে উপগ্রহের দিকে ছুটে চলল। উপগ্রহটি বিশাল, নিজের একটা বায়ুমণ্ডলও রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে স্কাউটশিপটি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে, তাপ নিরোধক আস্তরণ থাকার পরও আমরা সেটা অনুভব করতে শুরু করেছি। স্কাউটশিপের সংবেদনশীল মনিটর উপগ্রহের বায়ুমণ্ডল, তার তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, প্রাণের চিহ্ন বা বিদ্যুৎ চৌস্বকীয় তরঙ্গের অবশিষ্ট খুঁজতে থাকে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলবলের দুর্বল সংকেত ছাড়া এই উপগ্রহটিতে অবশ্যি অন্য কোনো ধরনের প্রাণের চিহ্ন পাওয়া গেল না।

ধীরে ধীরে স্কাউটশিপটি আরো নিচে নেমে আসে, বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, স্কাউটশিপের গতিবেগ অনেক কমিয়ে আনতে হলো, উপগ্রহটির ভেতরে একধরনের আবছা সবুজ আলো। বায়ুমণ্ডলে শক্তিশালী আয়নের২৭ আঘাতে এই আলো বের হয়ে আসছে। আমি স্কাউটশিপটিকে উপগ্রহের মাটির কাছাকাছি নামিয়ে এনে। নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর কাছে এসে ঘুরপাক খেতে থাকি। ম্যঙ্গেল ক্বাস তার দলের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে কিছুক্ষণ নিচু গলায় কথা বলল, তারপর ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি স্কাউটশিপটাকে নিচে নামিয়ে নাও।

আমি মনিটরে একটি সমতল জায়গা দেখে স্কাউটশিপকে নিচে নামিয়ে আনলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মিত্তিকা ভয়-পাওয়া-গলায় বলল, কী সর্বনাশ! এটা তো দেখি নরকের মতো।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার দলের সবচেয়ে চৌকস মানুষগুলো এই নরকে আটকা পড়ে আছে।

এখানে কেমন করে আটকা পড়ল?

মহাজাগতিক নিরাপত্তারক্ষীর সাথে সংঘর্ষ হয়ে মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল।

তারা নিশ্চয়ই খুব সৌভাগ্যবান যে মহাকাশযান বিধ্বস্ত হওয়ার পরও প্রাণে বেঁচে গিয়েছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস বলল, শুধু সৌভাগ্য নয়, এ ব্যাপারে তাদের নিজস্ব কিছু কৃতিত্ব রয়েছে। আমি বলেছি তারা চৌকস।

নিরাপত্তারক্ষী বা সৈনিক কিংবা কলকারখানার চৌকস হলে সেটি আমি বুঝতে পারি কিন্তু একটা দস্যুদলকে যখন চৌকস বলা হয় তার অর্থ ঠিক কী আমি সেটা ঠিক বুঝতে পারি না কিন্তু সেটা নিয়ে আমি আর কোনো প্রশ্ন না করাই বুদ্ধিমান কাজ বলে মনে করলাম। আমি স্কাউটশিপের ভল্ট খুলে সেখান থেকে পোশাক বের করে পরে নিতে শুরু করি। এই উপগ্রহের বায়ুমণ্ডলে শুধু যে যথেষ্ট অক্সিজেন নেই তা নয় এটা রীতিমতো বিষাক্ত। স্কাউটশিপের সামনে কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে সেখান থেকে একটি বেছে নিয়ে আমি আমার হাতে তুলে নিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস চোখের কোনা দিয়ে আমাকে লক্ষ করল কিন্তু কিছু বলল না। আমি মোটামুটি একটা হালকা অস্ত্র তুলে নিয়ে মিত্তিকার হাতে তুলে দিলাম, সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কী?

একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।

এটা দিয়ে কী করব?

হাতে রাখ, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ব্যবহার করবে।

আমি অস্ত্র ব্যবহার করতে জানি না।

আমি হেসে বললাম, শুনে খুব খুশি হলাম। আশা করছি এই বিদ্যেটা কখনো যেন তোমার শিখতে না হয়। কিন্তু যেটা ব্যবহার করতে জানি না সেটা হাতে নিয়ে কী করব?

এটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র— তোমাকে কিছু করতে হবে না।

মিত্তিকা কী বুঝল কে জানে, শেষপর্যন্ত অস্ত্রটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে পিঠে ঝুলিয়ে নিল। ম্যাঙ্গেল ক্বাস অস্ত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখে ভারী একটা অস্ত্র হাতে তুলে নিল, তার হাতে অস্ত্র নেয়ার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল সে জীবনের একটা দীর্ঘ সময় এই অস্ত্র হাতে কাটিয়েছে।

স্কাউটশিপের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে আমরা জরুরি সরবরাহের ব্যাক পেকটি পিঠে নিয়ে গোলাকার দরজার কছে এসে দাঁড়ালাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমাকে আগে বের হওয়ার জন্যে ইঙ্গিত করল— সেটাই স্বাভাবিক। আমার পিছু পিছু মিত্তিকা এবং সবার শেষে ম্যাঙ্গেল ক্বাস নেমে এল।

বাইরে একধরনের অস্থিতিশীল আবহাওয়া, হুহু করে সবুজ রংয়ের একধরনের বাতাস বইছে। আকাশে সবসময়ে। একধরনের আলো, কখনো বাড়ছে কখনো কমছে বলে চোখের রেটিনা কিছুতেই অভ্যস্ত হতে পারছে না। চারিদিকে ধূসর উঁচুনিচু প্রান্তর, নানা আকারের পাথর, কিছু কিছু একধরনের তরলে ডুবে আছে, তরলের ভিতর থেকে বড় বড় বুদবুদ বের হয়ে আসছে মিত্তিকা ঠিকই বলেছে, নরক বলা হলে চোখের সামনে যে ছবিটি ফুটে ওঠে সেটি অনেকটা এরকম।

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলের মানুষদের সংকেত এখন অনেক শক্তিশালী, ইচ্ছে করলে তাদের চেহারাও দেখা যাবে। কিন্তু আমরা আর সে চেষ্টা না করে হাঁটতে শুরু করলাম। আমাদের চোখের সামনে লাগানো গ্যালাক্টিক অবস্থান নির্ধারণ মডিউলে ২৮ দেখতে পাচ্ছি কমপক্ষে তিরিশ মিনিটের মতো হাঁটতে হবে। আমি হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার কেমন লাগছে মিত্তিকা?

মিত্তিকা বড়-বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই পোশাক পরে অভ্যাস নেই তো তাই খুব সুবিধে করতে পারছি না।

আমি উৎসাহ দিয়ে বললাম, কে বলছে পারছ না? এই তো চমৎকার হাঁটছ।

কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে।

কমবয়সী এই মেয়েটির জন্যে আমার মায়া হলো, শুধুমাত্র ভাগ্যের দোষে মহাজাগতিক একজন দস্যুর হাতে ধরা পড়ে তার এক অজানা উপগ্রহের অস্থিতিশীল আবহাওয়ার মাঝে হেঁটে হেঁটে আরো কিছু ঘাঘু অপরাধীদের উদ্ধার করতে যেতে হচ্ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের সাথে তার সঙ্গীসাথিরা একত্র হলে পুরো পরিবেশটা কেমন হবে চিন্তা করে আমি নিজের ভিতরে একধরনের অশান্তি বোধ করতে শুরু করেছি।

আমি মিত্তিকার পিঠে হাত দিয়ে বললাম, এই তো আমরা এসে গেছি।

কথাটি পুরোপুটি সত্যি নয় কারণ তার পরেও আমাদের প্রায় আরো একঘণ্টা হাঁটতে হলো এবং উপগ্রহের বৈরী আবহাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন হঠাৎ করে চোখের সামনে বিধ্বস্ত একটা মহাকাশযান দেখতে পেলাম।

মহাকাশযানটি নিশ্চয়ই অনেকদিন আগে এখানে বিধ্বস্ত হয়েছে, কারণ পুরো মহাকাশযানটি ধূসর এবং সবুজাভ ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে। আমি একটু অবাক হয়ে মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে রইলাম কারণ এটি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে তাতে এর ভিতরে কোনো মানুষের বেঁচে থাকার কথা নয়। মহাকাশযানের মূল অক্ষটি ভেঙে গিয়েছে, বিস্ফোরণের ফলে যে বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে তার ভিতর দিয়ে মহাকাশযানের পুরো বাতাস বের হয়ে যাবার কথা। এরকমভাবে বিধ্বস্ত হওয়া মহাকাশযান কিছুতেই বায়ুনিরোধক থাকতে পারে না। আমি মহাকাশযানের দেয়ালের দিকে তাকালাম, প্রচণ্ড উত্তাপে এটি দুমড়ে মুচড়ে গলে গিয়েছে, একটি মহাকাশযানের এই ধরনের উত্তাপ সহ্য করার কথা নয়, এর নিরাপত্তার পুরো ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবার কথা। এই প্রলয়কাণ্ডে কোনোভাবেই মহাকাশযানের কোনো অভিযাত্রীর বেঁচে থাকার কথা নয়। আমি সবিস্ময়ে মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বললাম, কী আশ্চর্য!

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল, কোনটি কী আশ্চর্য?

এই মহাকাশযানটি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এর মাঝে কোনো মানুষ বেঁচে থাকার কথা নয়।

কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ মানুষ বেঁচে আছে।

হ্যাঁ, কিন্তু সেটি কীভাবে সম্ভব হলো? আমি বুঝতে পারছি না।

এটা নিয়ে এখন মাথা না ঘামিয়ে চলো ভিতরে যাওয়া যাক।

চল।

আমরা ঘুরে ঘুরে ভেতরে ঢোকার দরজা খুঁজে বের করলাম, সেই দরজা ধাক্কা দিতেই সেটা কঁাচক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে সবুজ রংয়ের ধুলোর আস্তরণ এবং ঘােলাটে একধরনের অন্ধকার। মাথায় লাগানো উজ্জ্বল। আলোতে দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে থাকি, প্রথমে আমি, আমার পিছনে মিত্তিকা এবং সবার শেষে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু আমাদের সবার হাত অস্ত্রের ট্রিগারে চলে এসেছে, এই বিধ্বস্ত মহাকাশযানটিতে একধরনের অশুভ আতংকের চিহ্ন রয়েছে।

সর করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা আরো বড় একটি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, শক্ত দরজা এমনিতে খোলা যাচ্ছিল না, পা দিয়ে কয়েকবার লাথি দেবার পর সেটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে চারদিকে তাকালাম, এখানেও কেউ নেই। আমরা মোটামুটি একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে এটি বাঁকা হয়ে আছে, একসময় এখানে আলো এবং বাতাস ছিল এখন কোথাও কিছু নেই, একটি থমথমে নীরবতা।

মিত্তিকা আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, আমার ভয় করছে।

আমি তার পিঠে হাত দিয়ে বললাম, ভয়ের কিছু নেই মিত্তিকা। আমরা আছি না?

জানি, তবু কেমন জানি ভয় লাগছে।

ভয় লাগার ব্যাপারটি হাস্যকর বোঝানোর জন্যে আমি শব্দ করে হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পদ্ধতিটা খুব ভালো কাজ করল না।

ঢাল বেয়ে সাবধানে নিচে নেমে এসে আমরা আধা গোলাকার আরেকটি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, এই দরজার ফাক দিয়ে হলদে রংয়ের ঘােলাটে একধরনের আলো বের হচ্ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস খুশি-খুশি গলায় বলল, এই যে, সবাই নিশ্চয়ই এখানে আছে।

আমি দরজাটিতে হাত দিয়ে শব্দ করলাম, এবং ভেতর থেকে একধরনের শব্দ হলো, মনে হলো কেউ একজন প্রত্যুত্তর দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি সাবধানে দরজাটি ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকলাম, মাঝারী অসমতল একটি ঘর, সম্ভবত ইঞ্জিন কক্ষ। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকজন মানুষ ছিন্নভিন্ন পোশাকে, ধুলো এবং কালি মাখা অবস্থায়। পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। মানুষগুলোর বসে থাকার মাঝে একধরনের অস্বাভাবিকতা রয়েছে যেটি দেখে আমার বুকের মাঝে ধক করে উঠল।

আমার পিছু পিছু মিত্তিকা এবং সবার পরে ম্যাঙ্গেল কাস ঘরটিতে এসে ঢুকল, ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে খুব বিচলিত মনে হলো না, কিন্তু মিত্তিকা ছোট একটা আর্তচিৎকার করে আমাকে পিছন থেকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আমি নিচু গলায় বললাম, কী হয়েছে মিত্তিকা?

মিত্তিকা কাঁপা গলায় বলল, এরা কারা? আমার ভয় করছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস দুই পা এগিয়ে গিয়ে বলল, বাড়াবাড়ি ভয় পাবার কিছু নেই, এরা আমার লোকজন। ম্যাঙ্গেল ক্বাস দুই হাত ওপরে তুলে অভিবাদন করার ভঙ্গি করে বলল, কী খবর, কেমন আছ তোমরা?

মানুষগুলো যারা সংখ্যায় ছয়জন, যাদের মাঝে পুরষ, মহিলা এবং পুর ষও নয় মহিলাও নয় এরকম মানুষ রয়েছে, ম্যাঙ্গেল কৃাসের অভিবাদনে খুব বেশি অনুপ্রাণীত হলো না। কাছাকাছি যে বসেছিল শুধুমাত্র সে যান্ত্রিকভাবে একটা হাত উপরে তুলল।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস গলার স্বরে আরো আন্তরিকতা ফুটিয়ে বলল, তোমরা এই ভয়ংকর দুর্ঘটনায় বেঁচে যাবে সেটা আমি আশা করি নি, বলা যেতে পারে এটি একটি ম্যাজিকের মতো।

মানুষগুলো এবারেও কোনো কথা বলল না, পিছনে বসে থাকা একজন মানুষ, যার শারীরিক গঠন দেখে মহিলা বলে অনুমান করলাম— ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিজে থেকে আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, খিলা অনেকদিন পর তোমাদের দেখা পেলাম। তোমাদের আর দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমি তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি।

খিলা নামের মেয়েটি খসখসে গলায় বলল, আমাদের নিয়ে যাবে?

মেয়েটির গলার স্বর শুনে আমি চমকে উঠলাম, গলার স্বরটি আশ্চর্য রকমের প্রাণহীন এবং যান্ত্রিক।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ নিয়ে যাব। অবশ্যি নিয়ে যাব। কোথায় নিয়ে যাবে?

আমার সাথে। আমাদের দল আবার নতুন করে তৈরি করব। সবাই মিলে নতুন অভিযান হবে। নতুন অস্ত্র, নতুন। প্রযুক্তি অনেক পরিকল্পনা আছে।

সামনে বসে থাকা ভয়ঙ্করদর্শন মানুষটি মুখ উঁচু করে মোটা গলায় বলল, মানুষ থাকবে সেখানে?

মানুষ? ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে বলল, মানুষ থাকবে না কেন ইরি। অবশ্যই থাকবে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা শুনে ইরি নামের ভয়ংকরদর্শন মানুষটি হঠাৎ কেমন জানি খুশি হয়ে উঠল, সে তার শরীর দুলিয়ে বিচিত্র একটি আনন্দহীন হাসি হাসতে শুরু করে। ইরি নামের মানুষটির হাসি দেখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা আরো কয়েকজন মানুষ হাসতে শুরু করে, আনন্দহীন ভয়ংকর একধরনের হাসি, শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস তাদের হাসি থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, তোমরা এতদিন এখানে কেমন ছিলে বল?

প্রথমে কেউ কোনো কথা বলল না, এবং হঠাৎ করে পিছন থেকে না-পুরষ না-মহিলা এই ধরনের সবুজ রংয়ের চুলের একটি মানুষ বলল, জানি না।

জান না? ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে বলল, কেমন ছিলে জান না? কী বলছ উলন?

উলন স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ম্যাঙ্গেল কাসের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর শীতল গলায় বলল, কেমন করে জানব। ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণ হলো, তারপর আর কিছু মনে নাই।

মনে নাই?

না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস অন্যদের দিকে তাকাল, অন্যেরাও তখন মাথা নাড়ল, বলল, নাই, মনে নাই।

কিছু মনে নাই?

মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল তারপর বলল, না, মনে নাই।

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না হঠাৎ করে ম্যাঙ্গেল ক্বাস রেগে উঠল কেন, গলার স্বর উঁচু করে বলল, আসলে মনে আছে, তোমরা মিথ্যা কথা বলছ।

মাঝামাঝি বসে থাকা একজন মানুষ তখন ধীরে ধীরে উঠে এল, তার শরীরের একটা বড় অংশ বিকটভাবে পুড়ে গেছে, একটা হাত ভেঙে অসহায়ভাবে ঝুলছে, মানুষটির চেহারায় জগৎসংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা— ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাছাকাছি এসে বলল, আমরা মিথ্যা কথা বলছি?

হ্যাঁ। আমার ধারণা তোমরা মিথ্যা কথা বলছ।

কেন?

কারণ, তোমরা আমাকে বলবে না গ্লকোনাইটগুলো কোথায় আছে।

মানুষগুলো চুপ করে বসে এবং দাঁড়িয়ে রইল, তাদের দেখে মনে হলো তারা ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা বুঝতে পারছে না।

বল, কেথায় রেখেছ গ্লকোনাইটগুলো।

খিলা নামের মহিলাটি প্রথমে হেসে উঠল, প্রাণহীন আনন্দহীন ভয়ংকর একধরনের হাসি। তার হাসি শুনে অন্য আরো কয়েকজন হেসে উঠল এবং ম্যাঙ্গেল ক্বাস আরো রেগে উঠে, চিৎকার করে বলল, তোমরা বলবে না কোথায় আছে গ্লুকোনাইটগুলো?

মুখে নোংরা দাড়িগোঁফ একজন মানুষ উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা বেঁচে আছি না মারা গেছি সেটাই মনে নাই— আর গ্লকোনাইট!

উলন জিজ্ঞেস করল, থ্রকোনাইট কী?

ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবারে তার হাতে অস্ত্রটা তুলে নিয়ে সেটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তোমরা এখন বলতে চাও গ্লকোনাইট চেনো না?

ইরি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, হতে পারে চিনি কিংবা চিনি না। মনে নাই। আসলে কিছু মনে নাই।

আমাকে মনে আছে?

ইরি উত্তর না দিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে তাকিয়ে রইল। ম্যাঙ্গেল ক্বাস হাতের অস্ত্র উদ্যত করে দুই পা এগিয়ে গিয়ে বলল, তোমরা কি ভেবেছ আমি শুধু তোমাদের উদ্ধার করা জন্যে এসেছি?

পুরষ, মহিলা এবং না-পুরষ না-মহিলা কেউই কোনো কথা বলল না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস পা দাপিয়ে বলল, না, আমি শুধু তোমাদের উদ্ধার করার জন্যে এখানে আসি নাই। একটা মহাকাশযান দখল করে এই উদ্ভট উপগ্রহে কেউ শুধু মানুষকে উদ্ধার করার জন্যে আসে না। আমিও আসি নাই। আমি গ্লকোনাইটের জন্যেও এসেছি। বল কোথায় আছে। গ্লকোনাইট।

ইরি চিন্তিত মুখে বলল, দাঁড়াও জিজ্ঞেস করে দেখি।

কাকে জিজ্ঞেস করবে?

ইরি কিছু একটা বলার চেষ্টা করে থেমে গেল। মনে হলো কিছু একটা নিয়ে সে হঠাৎ যন্ত্রণাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল কাকে জিজ্ঞেস করবে?

এ তো–ঐ যে, যারা–মানে– এই যে—  ইরিকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখায়।

ম্যাঙ্গেল জ্বাস ভুর কুঁচকে তাকিয়ে রইল, তারপর হিংস্র গলায় বলল, বুঝেছি। তোমরা সহজ কথায় নড়বে না। আবার আমাকে একটা উদাহরণ তৈরি করতে হবে, যেন তোমাদের সব কথা মনে পড়ে।

আমি একধরনের আতংক নিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্লাসের দিকে তাকালাম, সে এখন কী করতে যাচ্ছে?

ম্যাঙ্গেল ক্বাস দাঁতে দাত ঘঁষে বলল, আমি ঠিক দশ সেকেন্ড সময় দিলাম, তার মাঝে তোমরা যদি না বলো গ্লুকোমাইটগুলো কোথায় আছে তাহলে আমি তোমাদের একজনকে গুলি করে মারব।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার অস্ত্র উঁচু করে ধরল এবং আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, সে সত্যিই দশ সেকেন্ড পর গুলি করবে। আমি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে এগিয়ে গেলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস— ।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস ধমক দিয়ে বলল, তুমি চুপ করো এখন। আমি এখানে ধর্ম প্রচারে আসি নি। এদের একজন দুই জনকে গুলি করে মেরে না ফেলা পর্যন্ত—

আমি বাধা দিয়ে বললাম, তুমি কাকে মারতে চাইছ?

কেন? এদেরকে।

যারা মরে গেছে, তাদেরকে মারা যায় না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, কী বললে?

আমি চাপা গলায় বললাম, এরা সবাই মরে গেছে।

মরে গেছে?

হ্যাঁ। এই গ্রহে অক্সিজেন নেই, শুধু বিষাক্ত বাতাস। এই মানুষগুলো কেউ কোনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। দেখেছ?

নিঃশ্বাস নিচ্ছে না?

না।

তাহলে এরা কথা বলছে কেমন করে?

জানি না। আমার ধারণা–

তোমার ধারণা–

আমার ধারণা, এই মৃতদেহগুলোকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর মাথা ঝাকিয়ে বলল, বাজে কথা বল না।

আমি বুঝতে পারলাম সে আমার কথা বিশ্বাস করল না, আমি বুঝতে পারলাম সে এখন এদের একজন-দুজনকে গুলি করবে। আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম খিলা নামের মেয়েটা খুব ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একমাত্র এই দরজা দিয়ে বের হওয়া যায়, দরজাটি বন্ধ করে দিলে আর কেউ বের হতে পারবে না। সমস্ত শরীরের বেশিরভাগ পুড়ে যাওয়া মানুষটাও আমাদের অন্যপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। উলন এবং ইরিও উঠে দাঁড়িয়েছে— সবাই খুব ধীরে ধীরে আমাদেরকে ঘিরে ফেলছে। আমি মানুষগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম, সেগুলো কাচের চোখের মতো প্রাণহীন, নিষ্প্রভ। মানুষগুলোর চোখেমুখে জীবনের কোনো চিহ্ন নেই।

আমি সাবধানে এক পা পিছিয়ে এসে মিত্তিকার কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললাম, মিত্তিকা।

কী?

তুমি আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াও।

কেন?

এখন বলতে পারব না প্রস্তুত হয়ে থাকো।

কীসের জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকব?

জানি না।

আমি সাবধানে অস্ত্রটা হাতে নিয়ে চোখের কোনা দিয়ে চারপাশে তাকালাম, মানুষগুলো খুব নিঃশব্দ আমাদের ঘিরে ফেলে চারপাশ থেকে এগিয়ে আসছে এবং হঠাৎ আমার মনে হলো, এই প্রথম ম্যঙ্গেল ক্বাস একটু ভয় পেয়েছে। ভয়টা লুকানোর জন্যে সে চিল্কার করে বলল, দাঁড়াও সাবাই যে যেখানে আছ দাঁড়াও।

কেউ দাঁড়াল না, বরং আরো এক পা এগিয়ে এল, ম্যাঙ্গেল ক্বাস হিংস্র স্বরে চিৎকার করে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ট্রিগার টেনে ধরল। প্রচণ্ড শব্দে একঝাঁক গুলি বের হয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে ঝাঝরা করে ফেলল, কিন্তু একজন মানুষও থমকে দাঁড়াল না, কারো মুখে যন্ত্রণার একটু চিহ্নও ফুটে উঠল না। ইরি হঠাৎ করে অপ্রকৃতস্থের মতো হেসে উঠল।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস এই প্রথম আতঙ্কিত হয়ে উঠল, সে ফ্যাকাসে মুখে একবার আমার দিকে তাকাল তারপর আবার ঘুরে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার হিংস্রভাবে গুলি করতে লাগল।

আমি দেখতে পেলাম মানুষগুলোর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেখান থেকে কোনো রক্ত বের হচ্ছে না। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সবিস্ময়ে দেখতে পেলাম শরীরের ভেতর থেকে কিলবিলে কালচে রংয়ের কোনো একটা জীবন্ত প্রাণী বের হয়ে আসছে। বিভিন্ন ক্ষতস্থান থেকে অক্টোপাসের পায়ের মতো আঠালো কিলবিলে কিছু একটা বের হয়ে আসছে, আবার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। ঘরের ভেতরে জান্তব চাপা একধরনের হিসহিস শব্দ শোনা যেতে থাকে।

মিত্তিকা আতংকে চিৎকার করে আমাকে আঁকড়ে ধরল, আমি একহাত দিয়ে তাকে শক্ত করে ধরে রেখে বললাম, আমাকে ধরে রেখ।

আমি অন্য হাত দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা উপরের দিকে তাক করলাম, এটিকে এটমিক ব্লাস্টার হিসেবে ব্যবহার করলে মহাকাশযানের ছাদটুকু উড়িয়ে দিয়ে যাবার কথা। আমি নিঃশ্বাস আটকে রেখে ট্রিগার টেনে ধরতেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ এবং আগুনের হলকায় ঘরটি কেঁপে উঠল, মহাকাশযানের ছাদের একটা বড় অংশ উড়ে ফাঁকা হয়ে গেছে সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে বিচিত্র উপগ্রহের কুৎসিত আকাশ দেখা যাচ্ছে।

আমি একহাতে অস্ত্রটাকে ধরে রেখে অন্য হাতে জেট প্যাকটার সুইচ স্পর্শ করলাম সাথে সাথে জেট প্যাকের ক্ষুদ্র ইঞ্জিন দুটো গর্জন করে উঠল। জেট প্যাক একজন মানুষকে নিয়ে উড়ে যেতে পারে, দুজনকে নিয়ে উড়তে পারবে। কি না আমি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ নই কিন্তু এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করায় সময় নেই। মিত্তিকা নিজে থেকে তার জেট প্যাক চালাতে পারবে না— সে আগে কখনো ব্যবহার করে নি, আমি জেট প্যাকের ইঞ্জিনের উপর পুরোপুরি নির্ভর না করে সেটাকে একটা শক্তিশালী ধাক্কা দেবার জন্যে প্রাণপণে লাফিয়ে উঠলাম। ঠিক সময়ে জেট প্যাকের ইঞ্জিন কান ফাটানো শব্দে গর্জন করে উঠল এবং আমরা দুজন মুহুর্তের মাঝে বিধ্বস্ত মহাকাশযানের বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া ছাদ। দিয়ে বের হয়ে এলাম। আমার মনে হলো শেষ মুহূর্তে নিচের মানুষগুলো ছুটে এসে আমাদের ধরার চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমরা ততক্ষণে তাদের নাগালের বাইরে চলে এসেছি। আমি নিচে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম, একধরনের হুটোপুটি হচ্ছে বলে মনে হলো। কিন্তু ততক্ষণে আমরা অনেক দূর চলে এসেছি।

আমি মিত্তিকাকে এক হাতে কোনোভাবে ধরে রেখে বললাম, আমাকে শক্ত করে ধরে রেখো মিত্তিকা।

মিত্তিকা আমাকে ধরে রেখে কাপা গলায় বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছি।

এখনই এত নিশ্চিত হয়ো না মিত্তিকা–

কেন নয়?

এই প্রাণীগুলি এত সহজে আমাদের ছেড়ে দেবে না।

মিত্তিকা ভয়-পাওয়া-গলায় বলল, কেন? একথা বলছ কেন?

প্রাণীগুলি এতদিন শুধু মৃত মানুষদের দেখেছে এই প্রথমবার তারা জীবিত মানুষ দেখছে। বুদ্ধিমান প্রাণী হলে কৌতূহল হবার কথা।

সর্বনাশ!

হ্যাঁ, প্রস্তুত থেকো। অস্ত্রটা হাতে রেখো–

কিন্তু আমি বলেছি আমি গুলি করতে পারি না। কীভাবে করতে হয় আমি জানি না—

তোমার জানতে হবে না। যখন সময় হবে তুমি জানবে।

কেমন করে জানব?

বেঁচে থাকার আদিম প্রবৃত্তি থেকে।

আমি আর মিত্তিকা মাটি থেকে শ-খানেক মিটার উপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগলাম, চারপাশে সবুজাভ একধরনের কুয়াশা এবং ধুলো, আমি টের পেলাম আমার শরীরে বৈদ্যুতিক চার্জ জমা হতে শুরু করেছে। আমরা তার মাঝে উড়ে যেতে লাগলাম। মিত্তিকা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, আমি টের পাচ্ছি সে এখনো থরথর করে কাঁপছে।

কিছুক্ষণের মাঝে আমি স্কাউটশিপটা দেখতে পেলাম— অস্থিতিশীল গ্রহটির আবছা আলোতে সেটিকে একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো লাগছিল। আমি স্কাউটশিপের সাথে যোগাযোগ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমরা কাছাকাছি এসে গেছি মিত্তিকা। নামার জন্যে প্রস্তুত হও।

আমি প্রস্তুত আছি।

আমি জেট প্যাকের সুইচ স্পর্শ করে ইঞ্জিন দুটো নিয়ন্ত্রণ করে সাবধানে নিচে নেমে এলাম। হাতে অস্ত্রটি ধরে রেখে আমি দ্রত চারপাশে একবার তাকিয়ে নিই, কোথাও কিছু নেই। মিত্তিকা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে আমি শুনতে পেলাম তার স্পেস স্যুটের ভিতরে সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

আমরা স্কাউটশিপের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। আমি মিত্তিকাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বললাম, যাও ভেতরে ঢোকো।

প্রথমে মিত্তিকা এবং তার পিছু পিছু আমি ভিতরে ঢুকলাম এবং প্রায় সাথে সাথে ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। মিত্তিকা স্কাউটশিপের দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, আমরা বেঁচে গেছি? বেঁচে গেছি ইবান?

সেটা এখনো জানি না, তবে মনে হচ্ছে বিপদের ঝুঁকি অনেকটা কমেছে। আমি নরম গলায় বললাম, নিরাপদে মহাকাশযান ফোবিয়ানে ফিরে যাবার সম্ভাবনা এখন শতকরা নব্বই ভাগ।

আমরা স্কাউটশিপের কোয়ারেন্টাইন কক্ষে দাঁড়িয়ে রইলাম, স্কাউটশিপের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি আমাদের স্পেসস্যুট থেকে সকল রকম জৈব-অজৈব পদার্থ পরিষ্কার করতে শুরু করেছে। আমাদের ঘিরে নানারকম রাসায়নিক তরল ঘুরতে থাকে, শক্তিশালী আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি এসে আঘাত করে সকল বাতাস শুষে নেয়া হয়। মিত্তিকা অধৈর্য হয়ে বলল, এটা কখন শেষ হবে? কখন আমরা স্কাউটশিপ চালু করব?

এই তো এক্ষুনি।

এত দেরি হচ্ছে কেন?

কিছু করার নেই মিত্তিকা, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পুরোপুরি পরিস্কার করা না হচ্ছে আমাদের এখান থেকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হবে না। অজানা কোনো জীবনের চিহ্ন, কোনো ভাইরাস কোনো জীবাণু নিয়ে আমরা ফোবিয়ানে। ফিরে যেতে পারব না।

কেন?

আমাদের নিরাপত্তার জন্যেই।

মিত্তিকা অধৈর্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছটফট করতে লাগল। আমিও ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে গেছি কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না, মহাকাশযানের অধিনায়কদের নিজেদের অনুভূতি এত সহজে প্রকাশ করার কথা নয়।

একসময় কোয়ারেন্টাইন ঘরে নিরাপত্তার সবুজ আলো জ্বলে উঠল। আমি আর মিত্তিকা বায়ু নিরোধক দরজা দিয়ে স্কাউটশিপের ভিতরে ঢুকলাম। আমরা দ্রত আমাদের স্পেস স্যুট খুলে নিতে শুরু করি, যদিও নতুন এই পোশাকগুলি পুরোপুরি বায়ু নিরোধক হয়েও আশ্চর্য রকম পেলব কিন্তু তারপরেও দীর্ঘ সময় একটি বায়ু নিরোধক পরিবেশের ভেতরে থেকে যন্ত্রপাতি দিয়ে কথা বলার ব্যাপারটি স্নায়ুর উপরে একধরনের চাপের সৃষ্টি করে। স্পেস স্যুট ভল্টের মাঝে ঢুকিয়ে, অস্ত্রগুলো খুলে নিরাপদ জায়গায় রেখে আমরা স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের কাছে এসে দাঁড়ালাম। মিত্তিকা আমার কাছে এসে আমার হাত স্পর্শ করে বলল, ইবান–

কী হলো?

আমার প্রাণ রক্ষা করার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

তোমার প্রাণ তো আলাদাভাবে রক্ষা করি নি। আমি আমাদের প্রাণ রক্ষা করেছি।

কিন্তু তুমি তো আমাকে নিয়ে বের হয়ে এসেছ, তুমি তো ইচ্ছে করলে জেট প্যাক ব্যবহার করে একা বের হয়ে আসতে পারতে।

আমি অবাক হয়ে মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, বললাম, আমি একা কেন বের হয়ে আসব?

মিত্তিকা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, সেটাই নিয়ম। সবাই নিজের জন্যে বেঁচে থাকে। আমি সেটাই শিখেছি। সেটাই শেখানো হয়েছে।

সেটা নিয়ম না, মিত্তিকা। আমি সেটা শিখি নি।

মিত্তিকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি অন্যরকম। তোমার জিনেটিক প্রোফাইল অন্যরকম। আমি লক্ষ করছি।

আমি কিছু না বলে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে স্কাউটশিপের ইঞ্জিনের অবস্থা লক্ষ করে সেটা চালু করার প্রাথমিক ব্যবস্থাগুলো শেষ করতে থাকি। মিত্তিকা আমার পাশে দাঁড়িয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এর মাঝে সবচেয়ে ভালো

কী হয়েছে জানো?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, জানি। ম্যাঙ্গেল ক্বাস দূর হয়েছে।

হ্যাঁ। আমি জানি না তাকে আর কোনোভাবে দূর করা যেত কি না–

মনে হয় এত সহজে যেত না। একজন খুব খারাপ মানুষকে শুধুমাত্র অন্য একজন খুব খারাপ মানুষ শায়েস্তা করতে পারে।

মিত্তিকা খুব সুন্দর করে হেসে বলল, তুমি খারাপ মানুষ নও। তুমি খুব চমৎকার একজন মানুষ। কাজেই তুমি ওর কিছু করতে পারতে না।

আমি হেসে বললাম, তুমি আমার সম্পর্কে কিছু জানো না, তুমি আমাকে দেখেছ মাত্র অল্প কয়েকদিন।

সেটাই যথেষ্ট। আমি অনেক মানুষকে দেখেছি, তুমি অন্যরকম। তোমার ভিতরে কিছু একটা আছে যেটা অন্যের ভেতরে নেই।

আমি সুইচ স্পর্শ করে মূল ইঞ্জিনে জ্বালানির প্রবাহ সৃষ্টি করে তাকিয়ে রইলাম, আর কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা এই অশুভ গ্রহটাকে ছেড়ে চলে যেতে পারব। মিত্তিকা আরো একটু এগিয়ে এসে বলল, ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে ওরা কী করছে বলে তোমার মনে হয়?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বলা কঠিন। তবে আমাদের চাইতে সে অনেক বেশি বিচিত্র। ভয়ঙ্কর মানুষ ছিল। ম্যাঙ্গেল ক্বাস। মস্তিষ্কে আরো একটা কপোট্রন বসিয়ে রেখেছে হাইব্রিড মানুষ। যখন তার মানুষের অংশটাকে কাবু। করে ফেলা হয়— তার যন্ত্রের অংশটা দায়িত্ব নিয়ে নেয়।

কী ভয়ানক!

আর চিন্তা নেই। যন্ত্রণা দূর হয়েছে। আমি কন্ট্রোল প্যানেল দেখে মিত্তিকাকে বললাম, ইঞ্জিন চালু করার সময় হয়েছে। মিত্তিকা তুমি নিরাপত্তা বেল্ট লাগিয়ে গিয়ে বসো।

মিত্তিকা তার বসার আসনের দিকে রওনা দিয়ে হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার করে উঠল। আমি চমকে উঠে ঘুরে। তাকালাম এবং হঠাৎ করে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। স্কাউটশিপের জানালায় ম্যাঙ্গেল ক্বাস দাঁড়িয়ে আছে সে ফিরে এসেছে!

মিত্তিকা চিৎকার করে বলল, ইবান! ইঞ্জিন চালু কর— এক্ষুনি।

আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের উপর ঝুঁকে পড়লাম— ম্যাঙ্গেল ক্বাস স্কাউটশিপের ভিতরে ঢুকতে পারবে না তার হাতের অস্ত্র দিয়েও সহজে আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি সুইচ স্পর্শ করতে গিয়ে থেমে গেলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে কুৎসিত সাপের মতো কিছু একটা জড়িয়ে ধরেছে, সে প্রাণপণে সেই কিলবিলে জিনিসটি থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। তার মুখে আতঙ্ক, সে চিৎকার করছে।

মিত্তিকা হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো আবার চিল্কার করতে থাকে, তাড়াতাড়ি ইবান, তাড়াতাড়ি—

ইঞ্জিন চালু করতে গিয়ে আমি আবার থেমে গেলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের চোখে মুখে অনুনয়, তার জীবন ভিক্ষা চাইছে অস্ত্র দিয়ে গুলি করেও প্রাণীটির আলিঙ্গন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। একজন মানুষ একটি মহাজাগতিক প্রাণী থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে আমি মানুষ হয়ে সেখানে কি আরেকজন মানুষকে ধ্বংস হতে দিতে পারি?

আমি সুইচ থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মিত্তিকা চিকার করে বলল, কী হলো?

ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে সাহায্য করতে হবে।

কী বললে? মিত্তিকা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, তুমি কী বললে?

বলেছি ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে এই মহাজাগতিক প্রাণীর হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

কেন? মিত্তিকা চিকার করে বলল, কেন?

কারণ, ম্যাঙ্গেলা জ্বাস একজন মানুষ। একজন মানুষ সবসময় অন্য মানুষকে রক্ষা করে।

করে না। কক্ষনো করে না— ম্যাঙ্গেল ক্বাস মানুষ নয়। দানব। আমাদের শেষ করে দেবে।

সম্ভবত। আমি শান্ত গলায় বললাম, কিন্তু আমি একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে এভাবে ফেলে চলে যেতে পারব না।

কী বলছ তুমি? কী বলছ? মিত্তিকা চিৎকার করে উঠল, তুমি কীরকম মানুষ?

আমি মাথা নেড়ে স্কাউটশিপের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম, নিচু গলায় বললাম, আমি দুঃখিত মিত্তিকা। তুমি একটু আগেই বলেছ আমি অন্যরকম মানুষ আমি একটু থেমে যোগ করলাম, মনে হয় আসলেই অন্যরকম। অন্যরকম নির্বোধ।

আমি হঠাৎ করে আমার মায়ের উপর একধরনের অভিমান অনুভব করলাম। বিচিত্র একধরনের অভিমান কেন আমার মা আমাকে এরকম একজন অর্থহীন ভালোমানুষ হিসেবে জন্ম দিয়েছিল?

৬. স্কাউটশিপের প্লাজমা ইঞ্জিন

স্কাউটশিপের প্লাজমা ইঞ্জিন দুটো গুমগুম শব্দ করছে, আমরা উপগ্রহটা ঘুরে এসে এইমাত্র সেখান থেকে ফোবিয়ানের দিকে রওনা দিয়েছি। স্কাউটশিপের যোগাযোগ মডিউল ঠিকভাবে ফোবিয়ানের সাথে যোগাযোগ করে স্বয়ংক্রিয় ফিডব্যাক চালু করেছে নিশ্চিত হওয়ার পর আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছি। ঠিক এরকম সময়ে আমি অনুভব করলাম আমার গলায় শীতল একটা ধাতব জিনিস স্পর্শ করেছে, জিনিসটা কী বুঝতে আমার অসুবিধে হলো না। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি। আমার কাছে ব্যাপারটি খুব অস্বাভাবিক মনে হলো না, আমি এরকম কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস শীতল গলায় বলল, আহাম্মক কোথাকার।

আমি কোনো কথা বললাম না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, আমাকে যে দরজা খুলে স্কাউটশিপে ঢুকতে দিয়েছ সেটা প্রমাণ করে তুমি কত বড় আহাম্মক। কত বড় নির্বোধ।

আমি এবারও কোনো কথা বললাম না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবারে যেন একটু ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, তার অস্ত্রটি দিয়ে আমার গলায় একটা খোঁচা দিয়ে বলল, আমি এই মুহূর্তে তোমার মাথায় গুলি করে ঘিলু বের করে দিতাম। কেন সেটা করছি না জানো?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না, জানি না।

কারণ তা হলে কন্ট্রোল প্যানেলটা তোমার মস্তিষ্কের টিস্যু আর রক্তে মাখামাখি হয়ে যাবে। বুঝেছ?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বুঝেছি।

আমি নির্বোধ মানুষ সহ্য করতে পারি না।

আমি এবারে হাত দিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের উদ্যত অস্ত্রটা অবহেলার সাথে সরিয়ে বললাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস— তুমি খুব ভালো করে জান কেন তুমি আমাকে সহ্য করতে পার না। আমি নির্বোধ সে-কারণে নয়।

তাহলে কেন?

কারণ আমি তোমার প্রাণ রক্ষা করেছি। সেজন্যে। আমি এবারে ঘুরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি বুঝতে পারছ না কেন আমি তোমার প্রাণ রক্ষা করেছি। সেটা বুঝতে না পেরে তুমি ছটফট করছ।

আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি আহাম্মক।

না, তোমার বোঝার ক্ষমতা নেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস। তবে তোমার মানসিক শান্তির জন্যে আমি সেটা তোমাকে বলব।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস সর চেখে আমার চোখের দিকে তাকাল। আমি বললাম, এই উপগ্রহের প্রাণীরা বুদ্ধিমান। যদি এরা বুদ্ধিমান না হতো তাহলে ছয়জন মৃত মানুষের মস্তিষ্ক থেকে সকল তথ্য বের করে নিয়ে এসে তাদেরকে জীবন্ত মানুষের মতো ব্যবহার করতে পারত না। আমি নিশ্চিত এই প্রাণীদের সাথে আবার আমাদের দেখা হবে, যোগাযোগ। হবে এমনকি বন্ধুত্ব হবে। আমি তাদের একটা ভুল ধারণা দিতে চাই নি।

কী ভুল ধারণা?

যে বিপদের সময় একজন মানুষ অন্য মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস কোনো কথা না বলে আমার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইল তারপর হিসহিস করে বলল, আমি তোমাকে শেষ করব। ইবান  প্রত্যেকটা শব্দে আলাদা করে জোর দিয়ে বলল, সারাজীবনের জন্যে শেষ করব।

আমি মাথা ঘুরিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের দিকে তাকিয়ে বললাম, তাতে কিছু আসে যায় না ম্যাঙ্গেল জ্বাস। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, তাতে কিছু আসে যায় না।

স্কাউটশিপটা ফোবিয়ানের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে মনিটরে ফোবিয়ান ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমি অনেকটা অন্যমনস্কভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম এরকম সময় হঠাৎ করে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। স্কাউটশিপে কেউ একজন কাঁদছে। পিছনে ঘুরে না তাকিয়েও আমি বুঝতে পারলাম সেটি মিত্তিকা। মিত্তিকা কেন কাঁদছে?

 

রিতুন ক্লিস আমার ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি একটি হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি তাই তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন প্রয়োজন হলে বসেও থাকতে পারেন। ভরশূন্য পরিবেশে একজন সত্যিকারের মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না বা বসে থাকতে পারে না। তাকে ভেসে থাকতে হয়। আমি ঘরের দেওয়াল স্পর্শ করে তার সামনে স্থির হয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। আমি বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনার কী মনে হয়? আমি কি ভুল করেছি?

রিতুন ক্লিস মাথা নাড়লেন, বললেন, না ইবান। তুমি ভুল করো নি।

আপনি কি সত্যিই বলছেন, নাকি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলছেন।

মহামান্য রিতুন হেসে মাথা নাড়লেন, আমি যখন একজন সত্যিকার মানুষ ছিলাম তখনো মিছিমিছি কাউকে সান্ত্বনা দিই নি এখন তো কোনো প্রশ্নই আসে না!

শুনে খুব শান্তি পেলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার পর থেকে খুব অশান্তিতে ছিলাম, শুধু মনে হচ্ছিল কাজটা কি ঠিক করলাম? বিশেষ করে যখন মিত্তিকার কান্নার কথা মনে হচ্ছিল তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল।

সেটা খুবই স্বাভাবিক। মহামান্য রিতুন নরম গলায় বললেন, পুরোপুরি একশ ভাগ বিবেকহীন অপরাধী যখন হাইব্রিড মানুষ হয়ে একটা মহাকাশযান দখল করে ফেলে তখন সেটা খুব ভয়ের ব্যাপার হতে পারে। তুমি যে নিজেকে অপরাধী ভাবছ সেটা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু কিন্তু মিত্তিকা এত ভেঙে পড়ল কেন?

সম্ভবত সে কিছু একটা জানে যেটা তুমি জানো না। সে কিছু একটা অনুভব করতে পারছে যেটা তুমি অনুভব করতে পারছ না।

আমি চমকে উঠে বললাম, আপনি কী বলছেন মহামান্য রিতুন?

রিতুন ক্লিস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি কিছুই বলছি না ইবান, আমি অনুমান করার চেষ্টা করছি।

আপনি কী অনুমান করেছেন?

মিত্তিকা অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিঃসঙ্গ একজন পুরুষ মানুষের আদিম প্রবৃত্তি অনুমান করা তো কঠিন কিছু নয়।

আমি কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারলাম না, হতবাক হয়ে রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শুকনো ঠোট জিব দিয়ে ভিজিয়ে বললাম, আপনি বলেছিলেন জীবনকে সহজভাবে নিতে। আমি নিজের জীবনকে সহজভাবে নিতে পারি কিন্তু মিত্তিকার জীবন?

রিতুন ক্লিস কিছু বললেন না। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। আমি কাতর গলায় বললাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে যদি ঐ ভয়ঙ্কর উপগ্রহটাকে ছেড়ে আসতাম তাহলে আমরা বেঁচে যেতাম! আমি নিজের হাতে এই দানবটাকে নিয়ে এসেছি

রিতুন ক্লিস মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ। এই দানবটাকে এখন তোমার নিজের হাতে খুন করতে হবে।

এটি কি একটি স্ববিরোধী কাজ হলো না? একজন মানুষকে বাঁচিয়ে এনেছি তাকে খুন করার জন্যে?

কোনো হিসেবে নিশ্চয়ই স্ববিরোধী। তুমি সেই হিসেবে যেও না ইবান।

আমি অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বললাম কিন্তু ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে খুন করা যায় না মহামান্য রিতুন। তার শরীর থেকে গুলি ফিরে আসে।

আমি দুঃখিত ইবান, মানুষকে কীভাবে খুন করতে হয় সে-সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

কিন্তু তাহলে কেমন করে হবে? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, আপনার আমাকে সাহায্য করতে হবে মহামান্য রিতুন। দোহাই আপনাকে–

আমি একটি হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি ইবান। আমার অস্তিত্ব একটি নিউরাল নেটওয়ার্কে।

কিন্তু আপনি নিজেই বলেছেন আপনি সত্যিকার রিতুন ক্লিস। আপনি সর্বকালের সবচেয়ে প্রতিভাবান মানুষ—

সেটি অতিরঞ্জন। সেটি ভালোবাসার কথা। আমি আসলে সাধারণ মানুষ।

কিন্তু আপনি যেটা জানেন সেটা নিশ্চিতভাবে জানেন, সেটা বিশ্বাস করেন। আপনি বলুন আমি কী করব?

রিতুন ক্লিস দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সে হাইব্রিড মানুষ। সেই শক্তিকে তার দুর্বলতায় পরিণত করে দাও।

কীভাবে করব সেটা।

আমি জানি না। সেটা আমি জানি না ইবান। সেটা তোমাকে ভেবে বের করতে হবে।

রিতুন ক্লিস চলে যাবার পরও আমি স্থির হয়ে একজায়গায় ভেসে রইলাম। আমি এখন কী করব? ম্যাঙ্গেল ক্বাসের। শক্তিকে কীভাবে আমি দুর্বলতায় পরিণত করব? আমি ঠাণ্ডামাথায় পুরো ব্যাপারটি ভাবতে চাইলাম এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম আমার হাঁটার ইচ্ছে করছে, আমি যখন কোনো কিছু নিয়ে ভাবি তখন আমি একা-একা হাঁটি। এই ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে থাকা যায় কিন্তু হাঁটা যায় না— আমি তাই ভেসে ভেসে মহাকাশে শরীর ঠিক রাখার জন্যে ছোট ব্যায়ামের ঘরটিতে গিয়ে হাজির হলাম। গোলাকার এই ঘরটিকে তার অক্ষের উপর ঘুরিয়ে এর ভেতরে কম বা বেশি মাধ্যাকর্ষণ তৈরি করা যায়। দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানে যেতে হলে সবাইকে সময় করে নিয়মমাফিক এখানে প্রবেশ করতে হয়। আমি দেয়ালে সুইচটি স্পর্শ করতেই গোলাকার ঘরটি ঘুরতে শুরু করল এবং আমি কিছুক্ষণের মাঝেই ঘরের দেয়ালে পা দিয়ে দাঁড়ালাম। দুই হাত ছড়িয়ে শরীরে রক্ত চলাচল করিয়ে আমি এবারে হাঁটতে শুরু করি, হাঁটতে হাঁটতে পুরো ব্যাপারটি একেবারে গোড়া থেকে ভাবা দরকার।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস একজন হাইব্রিড মানুষ যার অর্থ সে একই সাথে মানুষ এবং যন্ত্র। তার শরীরে কী ধরনের যান্ত্রিক ব্যাপার আছে আমি জানি না। কিন্তু তার মস্তিষ্কে একটা কপোট্রন বসানো আছে সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাই যখন। তার দেহের তাপমাত্রা শীতল করে তাকে ক্যাপসুলে ভরে রাখা হয়েছিল সে তার ভেতর থেকে বের হতে পেরেছিল। একজন সাধারণ মানুষ অচেতন হয়ে যায় ম্যাঙ্গেল জ্বাস কখনো অচেতন হয় না— তার কপোট্রন তখন তার শরীরের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। সেই কপোট্রনটি কতটুকু বুদ্ধিমান? যেহেতু তার মাথার মাঝে বসানো আছে সেটি বাড়াবাড়ি কিছু হতে পারে না, নিশ্চয়ই কাজ চালানোর মতো একটি কপোট্রন। যদি কোনোভাবে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে অচেতন করে তার। কপোট্রনকে বের করে আনা যেত তাহলে কী বুদ্ধিমত্তার একটা প্রতিযোগিতা করা যেত না?

আমি গোলাকার ঘরের মাঝে আরো দ্রত হাঁটতে থাকি এবং আমার হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে ঘরটি আরো দ্রত ঘুরতে থাকে এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও বেড়ে যায় আমার মনে হতে থাকে আমার শরীর ভারী হয়ে আসছে। ম্যাঙ্গেল কাসকে অচেতন করতে হলে তাকে বিষাক্ত কোনো গ্যাস দিয়ে অচেতন করতে হবে কিংবা খাবারের মাঝে কোনো বিষাক্ত জিনিষ মিশিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এগুলো তৃতীয় শ্রেণীর অপরাধীর কাজ আমি কেমন করে সেটা করব?

আমি আরো দ্রত হাঁটতে থাকি এবং অনুভব করতে থাকি আমার শরীরের ওজন আরো বেড়ে যাচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিশ্চয়ই অনেকগুণ বেড়ে গেছে। আমার হঠাৎ একধরনের ছেলেমানুষি ঝোক চাপল, আমি আমার শারীরিক ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যে আরো দ্রত হাঁটতে থাকি এবং দেখতে দেখতে আমার শরীর সিসার মতো ভারী হয়ে আসে, আমার মাথা হালকা লাগতে থাকে এবং আমার মনে হয় আমি বুঝি অচেতন হয়ে পড়ব। আমি তবুও দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে টেনে নিতে থাকি আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে আমার সারা শরীর ঘামতে থাকে। আমি পাথরের মতো ভারী দুটি পাকে আরো দ্রত টেনে নিতে থাকি, ধাতব দেয়ালে পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতে থাকে আমার মনে হতে থাকে লাল একটা পর্দা বুঝি চোখের সামনে নেমে আসতে চাইছে, তবু আমি থামলাম না, আমি ছুটেই চললাম।

হঠাৎ করে কোথায় জানি কর্কশ স্বরে একটা এলার্ম ভেজে ওঠে এবং একটা লাল বাতি জ্বলতে-নিভতে শুরু করে। আমি সাথে সাথে ফোবিয়ানের কথা শুনতে পেলাম, মহামান্য ইবান, আপনি থামুন না হয় অচেতন হয়ে যাবেন।

আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে বললাম, কী বললে তুমি ফোবি? কী বললে?

বলেছি আপনি এক্ষুনি যদি না থামেন তাহলে অচেতন হয়ে যাবেন, আপনার মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমে আসছে।

অচেতন? তুমি বলছ অচেতন হয়ে যাব?

হ্যাঁ।

ফোবি আমি দেখতে চাই আমি অচেতন না হয়ে কতদূর যেতে পারি—

কেন মহামান্য ইবান?

কারণ আছে, একটা কারণ আছে।

কী কারণ?

সময় হলেই তোমাকে বলব। এখন আমাকে আরো বেশি মাধ্যাকর্ষণে নিয়ে চলো–আরো বেশি–

ব্যাপারটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আপনি যে ভয়ঙ্কর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন, বেশিরভাগ মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তার অনেক আগেই অচেতন হয়ে পড়বে।

আমি হিংস্রভাবে একটু হেসে বললাম, আমি সেটাই চাই ফোবি, সব মানুষ যে মাধ্যাকর্ষণ বলে অচেতন হয়ে পড়বে আমি সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই।

আমি বুঝতে পারছি না মহামান্য ইবান।

তোমার বোঝার দরকার নেই। তুমি মূল তথ্যকেন্দ্র থেকে সব তথ্য নিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করো ভয়ঙ্কর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাঝে আমাকে স্থির থাকার শক্তি এনে দাও। মানুষের শরীরের যেটুকু শক্তি থাকতে পারে, যেটুকু সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে পারে তার পুরোটুকু আমার মাঝে এনে দাও। আমাকে পাথরের মতো শক্ত করে দাও।

সেজন্যে সময়ের প্রয়োজন মহামান্য ইবান। রাতারাতি মানুষকে অতি-মানবে রূপান্তর করা যায় না।

আমার কতটুকু সময় আছে আমি জানি না, কিন্তু আমি জানি নষ্ট করার জন্যে এক মাইক্রোসেকেন্ডও নেই।

ফোবি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেশ।

আমি মুখ হা করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে গোলাকার ঘরটিতে নিজেকে টেনে নিতে থাকি আমাকে যেভাবেই হোক জ্ঞান না হারিয়ে থাকতে হবে। মানুষের পক্ষে যেটা অসম্ভব আমাকে সেই অসম্ভব শক্তি অর্জন করতে হবে। মিত্তিকাকে বাঁচানোর এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

 

ঘুম থেকে উঠে আমি মিত্তিকাকে খুঁজে বের করলাম। মহাকাশযানের এক নির্জন কোনায় গোল জানালার পাশে শুয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাইরে অসংখ্য নক্ষত্র কালো মহাকাশের মাঝে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মহাকাশযানটি নিউট্রন স্টারের কাছাকাছি চলে আসছে, আমরা বুঝতে পারছি না কিন্তু মহাকাশযানটির গতিবেগ দ্রত বেড়ে যাচ্ছে। নিউট্রন স্টারটি এত ছোট যে এটিকে দেখা যাচ্ছে না। দূরে একটি নেবুলা তার সমস্ত বিচিত্র রূপ নিয়ে ফুটে আছে। আমি মিত্তিকার পাশে গিয়ে নরম গলায় ডাকলাম, মিত্তিকা।

সে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, কিছু বলল না।

আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, তুমি আমার উপর খুব রেগে আছ তাই না?

মিত্তিকা এবারেও কোনো কথা বলল না। আমি অপরাধীর মতো বললাম, তোমার সাথে আমি একটু কথা বলতে চাইছিলাম মিত্তিকা।

মিত্তিকা বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে একটু হেসে বলল, তোমার মতো একজন মহাপুরষ আমার মতো তুচ্ছ একজন মানুষের সাথে কথা বলবে?

আমি একটু হতচকিত হয়ে বললাম, তুমি কী বলছ মিত্তিকা?

আমি ঠিকই বলছি। তুমি অন্য ধরনের মানুষ— তুমি দশজন সাধারণ মানুষের মতো নও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বড় বড় জিনিস নিয়ে তোমাকে ভাবতে হয়। মহাজাগতিক প্রাণীরা যেন মানুষকে ভুল না ভাবে সেজন্যে আমার মতো তুচ্ছ একজন মানুষকে তুমি আবর্জনার মতো জঞ্জালের মতো ফেলে দাও।

 

কী বলছ তুমি মিত্তিকা?

মিত্তিকা গলার স্বরে শ্লেষ ফুটিয়ে এনে বলল, আমি ভুল বলেছি? নিশ্চয়ই ভুল বলেছি। আমি তুচ্ছ সাধারণ অশিক্ষিত মূখ একজন মেয়ে, আমি কি এই মহাজগতের বড় বড় জিনিস বুঝতে পারি? পারি না–

মিত্তিকা–

মিত্তিকা মুখ ফিরিয়ে বলল, আমাকে একা থাকতে দাও ইবান। দোহাই তোমার—

কিন্তু মিত্তিকা তোমার সাথে আমার কথা বলতেই হবে।

না ইবান। মিত্তিকা মাথা নেড়ে বলল, আমার সাথে তোমার কথা বলার কিছু নেই ইবান। আমাকে একা থাকতে দাও। দোহাই তোমার।

মিত্তিকা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তার চোখ মুছে নিল – আমার সামনে সে কাঁদতেও রাজি নয়।

আমি ভেসে ভেসে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ফিরে এলাম, হঠাৎ করে আমার নিজেকে একজন সত্যিকারের অপরাধী বলে মনে হতে থাকে।

নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ম্যাঙ্গেল ক্বাস চিন্তিত মুখে বসেছিল, আমাকে দেখে সে সর চোখে বলল, ইবান, তোমার সাথে আমার কথা রয়েছে।

আমি দেখতে পেলাম সে কোমরে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝুলিয়ে রেখেছে। আমি কাছাকাছি গিয়ে বললাম, কী কথা?

তুমি জানো আমি উপগ্রহে আটকা পড়ে থাকা আমার দলের লোকজনকে উদ্ধার করে আনতে চেয়েছিলাম।

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, জানি।

কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ আমি আমার লোকজনকে উদ্ধার করতে পারি নি। ম্যাঙ্গেল ক্বাস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তার মানে বুঝতে পারছ?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বুঝতে পারছি। তোমাকে আবার নতুন করে তোমার দল দাঁড়া করাতে হবে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস একটু চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল, সে আমার কাছে এই উত্তর আশা করে নি। কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছ, আমাকে আবার নতুন করে আমার দল তৈরি করতে হবে। দল তৈরি করার জন্যে দরকার মানুষ। কাজেই আমার কিছু মানুষ দরকার।

আমি মুখে বিদ্রুপের একটা হাসি ফুটিয়ে বললাম, তোমার কিছু মানুষ দরকার নেই, তোমার দরকার কিছু দানবের।

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে উঠল, সে কঠোর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার সাহস দেখে মাঝে মাঝে বেশ অবাক হয়ে যাই। বেশি সাহস কারা দেখায় জানো।

জানি।

কারা?

দুই ধরনের মানুষ যারা সাহসী এবং যারা নির্বোধ। আমি জানি আমি সাহসী নই। কাজেই আমি নিশ্চয়ই নির্বোধ। কথা শেষ করে আমি দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গি করলাম।

না, তুমি নির্বোধ নও। আমি প্রায় মন স্থির করে ফেলেছি যে তোমাকে আমি আমার দলে নেব।

আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম, একজন পুরোদস্তুর দস্যু আমাকে তার দলে নেবে সে-ধরনের কথা আমি শুনতে পাব কখনো কল্পনা করি নি। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম— মানুষটি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছে? আমি কয়েকবার চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত বললাম, তুমি কী বলছ?

তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি। এখন তুমি ভাবছ ব্যাপারটা অসম্ভব। তোমার মতো একজন নীতিবান সৎ ভালোমানুষ কেমন করে দস্যুদলে যোগ দেবে? কিন্তু ব্যাপারটা আসলে অন্যরকম।

অন্যরকম?

হ্যাঁ। সেই বিংশ শতাব্দীতে মানুষ আবিষ্কার করেছিল মস্তিষ্কের সামনের দিকে একটা অংশ রয়েছে যেটি মানুষের নৈতিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবে ট্রান্সক্ৰানিয়াল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেটর৩৬ দিয়ে সেই অংশটি নিখুঁত ভাবে খুঁজে বের করা হয়েছে। আমি সেই অংশটির অবস্থান জানি– মস্তিষ্কের এই অংশটি নষ্ট করে দেয়া হলো মানুষকে মুক্তি দেয়া হয়।

মুক্তি?

হ্যাঁ। তোমাদের তথাকথিত নৈতিকতার বন্ধন থেকে মুক্তি। একবার যখন মুক্তি পাবে তখন তোমাদের আর ভালো কাজ করতে হবে না, মহত্ত্ব দেখাতে হবে না, নৈতিকতা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় তখন তুমি মানুষ খুন করতে পারবে।

আমি কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে তাকিয়ে রইলাম, মানুষটির কথাবার্তায় রহস্য বা বিদ্রুপের এতটুকু চিহ্ন নেই। সে যে কথাটি বিশ্বাস করে ঠিক সেই কথাটিই বলছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, আমি ছোট একটা যন্ত্র তৈরি করিয়েছি, কপালের উপর বসিয়ে দিতে হয়, মাথার তিনদিক দিয়ে স্ক্যান করে মস্তিষ্কের মাঝে নির্দিষ্ট অংশটি খুঁজে বের করে। তারপর কপালে ড্রিল করে মস্তিষ্কে ঢুকে যায়, সেখানে নির্দিষ্ট অংশটিতে উচ্চ চাপের বিদ্যুৎ দিয়ে নিউরনগুলোতে ঝলসে দেয়া হয়। চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে তুমি পুরোপুরি অন্য মানুষ হয়ে সেরে উঠবে। ম্যাঙ্গেল কাস কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে মধুরভাবে হাসার চেষ্টা করল।

আমি হঠাৎ অনুভব করলাম ভয়ের একটা শীতল স্রোত আমার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার আতংকটি বুঝতে পারল, মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে মাথা নেড়ে বলল, আসলে ব্যাপারটি তোমার কাছে যত ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছে সেটা মোটেও তত ভয়ঙ্কর নয়। পুরো ব্যাপারটি দুই ঘণ্টার মাঝে শেষ হয়ে যায়, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশটা খুঁজে বের করতে একঘণ্টা, মাথায় ড্রিল করে ফুটো করতে একঘণ্টা। নিউরনগুলো চোখের পলকে ঝলসে দেয়া যায়। সেরে উঠতে চব্বিশ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। পুরো ব্যাপারে সেটাই সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ। তোমার কাছে এখন মনে হচ্ছে অন্যায় কাজ করা খুব কঠিন, কিন্তু তুমি দেখবে কত সহজ।

আমি কোনো কথা না বলে বিস্ফারিত চোখে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ম্যাঙ্গেল কাস জিব বের করে ঠোট দুটো ভিজিয়ে নিয়ে প্রত্যেকটি শব্দ আলাদাভাবে উচ্চারণ করে বলল, ভূমিকা শেষ হয়েছে, এবারে আসল কাজের কথায় আসা যাক। সে একটা নিঃশ্বাস নিল তারপর নিজের নখের দিকে তাকাল তারপর ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ইবান, আমি বড় নিঃসঙ্গ।

আমি ভেতরে শিউরে উঠলেও বাইরে শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার মহাকাশযান ফোবিয়ানের মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। নামটিও খুব সুন্দর, মিত্তিকা।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি ঠিক করেছি মিত্তিকাকে আমার সঙ্গী করে নেব। কী বল?

তোমার মতো একজন দানবের চরিত্রের সাথে মানানসই একটা সিদ্ধান্ত।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস কোমরে বেঁধে রাখা অস্ত্রটি খুলে এবারে হাতে নিয়ে বলল, তোমার নিজের মঙ্গলের জন্যে বলছি ইবান, সীমা অতিক্রম করো না। ব্যাপারটি নিয়ে দুঃখিত হবারও সুযোগ পাবে না।

তুমি আমার মতামত জানতে চেয়েছিলে–

আসলে মতামত জানতে চাই নি, তোমাকে জানিয়ে রাখছিলাম। তোমার আসল সমস্যাটি কোথায় জানো?

ঠিক কোন সমস্যার কথা বলছ জানালে হয়ত বলতে পারতাম।

না, পারতে না। কারণ তুমি জানো না। ন্যায়-অন্যায় অপরাধ-মহত্ত্ব এসবের সংজ্ঞার পরিবর্তন হয়েছে। মস্তিষ্কের একটি ছোট অংশ আছে কি নেই সেটা হচ্ছে অপরাধী এবং নিরপরাধীর মাঝে পার্থক্য। যার সেই ছোট অংশ নেই তাকে কি আর অপরাধী হিসেবে ঘৃণা করা যায়, নাকি শাস্তি দেয়া যায়?

আমি কোনো কথা বললাম না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, প্রাচীনকালে অপরাধী ছিল, নীতিবান মানুষও ছিল, এখন ওসব কিছু নেই। যেমন মনে করো মিত্তিকার কথা। মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমি কি তাকে জোর করে আমার সঙ্গী করব? ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কখনোই না। আমি তার মস্তিষ্কে ছোট একটা অস্ত্রোপচার করব, মিত্তিকা তখন তার চারপাশের জগৎকে নতুন চোখে দেখবে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস হাত দিয়ে নিজের বুক স্পর্শ করে বলল, মিত্তিকার তখন মনে হবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে সুদর্শন সবচেয়ে আকর্ষণীয় মানুষ হচ্ছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। পতঙ্গ যেভাবে আগুনের দিকে ছুটে যায়, গ্রহাণু যেভাবে ব্ল্যাকহোলের দিকে ছুটে যায় ঠিক সেভাবে সে আমার কাছে ছুটে আসবে। বুঝেছ?

আমি মাথা নেড়ে জানালাম যে আমি বুঝেছি।

ঠিক এরকম সময়ে মহাকাশযানটি একটু কেঁপে উঠল, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের ভুর একটু কুঞ্চিত হয়ে উঠল, সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

আমরা নিউট্রন স্টারের মাধ্যাকর্ষণের কাছাকাছি চলে আসছি। ফোবিয়ানের গতিবেগ বেড়ে যাচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর গতিবেগের জন্যে এটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। আমরা নিউট্রন স্টারের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ব্যবহার করে গ্যালাক্সির এই অংশ পাড়ি দেব।

স্লিং শট প্রক্রিয়া?

হ্যাঁ।

অত্যন্ত অস্থিতিশীল সময়?

খানিকটা। তোমার হিসেবে ভুল হলে নিউট্রন স্টারে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে।

আমি শান্ত গলায় বললাম, হিসেবে ভুল হবে না। ফোবিয়ান পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযান, এর নিউরাল নেটওয়ার্ক হিসেবে ভুল করে না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস উঠে দাঁড়াতে গিয়ে খানিকদূর ভেসে গেল, ঘুরেফিরে এসে বলল, ইবান, এই ভরশূন্য পরিবেশ আমার আর ভালো লাগছে না। তুমি মহাকাশযানটিকে অক্ষের উপর ঘুরিয়ে মাধ্যাকর্ষণ ফিরিয়ে এনো।

আমি বললাম, আনব। নিশ্চয়ই আনব।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস চলে যাবার পর আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে বসে দীর্ঘ সময় নিয়ে ফোবিয়ানের যাত্রাপথ পর্যবেক্ষণ করলাম। ফোবিয়ানের জ্বালানি সীমিত কাজেই যাত্রাপথে প্রতিটি বড় গ্রহ, নিরাপদ নক্ষত্র বা নিউট্রন স্টারকে ব্যবহার করা হয়, কোনো বিপদ না ঘটিয়ে যতটুকু সম্ভব কাছাকাছি যাওয়া হয়, প্রবল মহাকর্ষণে ফোবিয়ানের গতিবেগ বাড়িয়ে নেয়া হয়। গতিপথটি খুব যত্ন করে ছক করে নিতে হয় যেন নির্দিষ্ট দিকে নির্দিষ্ট বেগে যাওয়া যায়। ফোবিয়ানের নিউরাল নেটওয়ার্ক হিসেবে কোনো ভুল করবে না সে-ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, তবুও পুরোটা নিজের চোখে দেখতে চাইলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলকে উদ্ধার করার জন্যে খানিকটা ঘুরে আসতে হয়েছে। জ্বালানি। নষ্ট না করে সেই ক্ষতিটুকু পূরণ করার জন্যে এই নিউট্রন স্টারের বেশ কাছাকাছি যেতে হচ্ছে, যে ব্যাপারটি আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। এখান থেকে যে পরিমাণ বিকীরণ হচ্ছে সেটা ফোবিয়ান কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে কে জানে। আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে নিউট্রন স্টারের অবস্থানটুকু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, এর আকর্ষণে মহাকাশযানটির গতিবেগ প্রতিমুহূর্তে বেড়ে যাচ্ছে। মহাকাশযানে একধরনের কম্পন অনুভব করা যাচ্ছে, যতই সময় যাচ্ছে সেটা ততই বেড়ে যাচ্ছে। এরকম সময়ে যদি কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে যায়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হবে।

আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেল থেকে সরে এসে ব্যায়াম করার ঘরটিতে ঢুকে সেটা ঘুরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলাম। দেখতে দেখতে ঘূর্ণি বেড়ে গেল আমি সাথে সাথে দেয়ালে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণের মাঝেই আমার দেহের ওজন বেড়ে যেতে শুরু করে, আমি আবার আমার শরীরের সহ্য করার ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করে দেই।

কিছুক্ষণের মাঝেই আমার শরীর সিসার মতো ভারী হয়ে আসে, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, আমার চোখের সামনে লাল পর্দা কাঁপতে থাকে, আমি কোনোমতে পা টেনে টেনে দৌড়াতে থাকি, আমি টের পাই আমার সমস্ত শরীর ঘামতে শুরু করেছে। যখন মনে হলো আমি লুটিয়ে মাটিতে পড়ে যাব ঠিক তখন আমার কানের কাছে ফোবির কথা শুনতে পেলাম, মহামান্য ইবান।

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোভাবে বললাম, বল ফোবি।

আপনি আবার নিরাপত্তার সীমা অতিক্রম করছেন।

ইচ্ছে করেই করছি ফোবি।

আমি এখনো বুঝতে পারছি না কেন।

সময় হলেই বুঝবে। এখন আমার একটা কথা শোন।

বলুন মহামান্য ইবান।

আমার কথা কি পুরোপুরি গোপনীয়? আর কেউ কী শুনতে পাবে?

না মাহামান্য ইবান, আর কেউ শুনতে পাবে না।

বেশ, তাহলে শোন আমি তোমাকে সপ্তম মাত্রার একটি জরুরি নির্দেশ দিচ্ছি।

ফোবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সপ্তম মাত্রার নির্দেশ? আপনি কি সত্যিই বলছেন?

আমি সত্যিই বলছি।

সপ্তম মাত্রার নির্দেশে মহাকাশযানকে ধ্বংস করার পর্যায়ে নেয়া হয়।

হ্যাঁ। আমি জানি। অধিনায়ক হিসেবে আমার সেই ক্ষমতা আছে।

আপনি কেন সপ্তম মাত্রার আদেশ দিচ্ছেন মহামান্য ইবান?

তুমি নিশ্চয়ই জানো ম্যাঙ্গেল ক্বাস মিত্তিকার মস্তিষ্কে একটা অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জানি। অত্যন্ত দুঃখজনক একটি সিদ্ধান্ত।

সে যদি সত্যিই অস্ত্রোপচার শুরু করে তোমাকে এই আদেশ কার্যকরী করতে হবে। যদি না করে তাহলে প্রয়োজন নেই।

আমি কীভাবে আদেশ কার্যকরী করব?

ফোবিয়ানের গতিবেগ কমিয়ে আনতে শুরু করবে।

তার জন্যে ইঞ্জিন চালু করার প্রয়োজন রয়েছে।

আমি তোমাকে ইঞ্জিন চালু করার অনুমতি দিচ্ছি।

ফোবিয়ান দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, ফোবিয়ানের গতিবেগ কমিয়ে আনার অর্থ আমরা নিউট্রন স্টারে গিয়ে আঘাত করব।

হ্যাঁ, আমার ধারণা আত্মহত্যার জন্যে সেটি চমৎকার একটি উপায়।

আপনি আত্মহত্যা করতে চাইছেন মহামান্য ইবান?

না, চাইছি না। তবে অনেক সময় কিছু একটা না চাইলেও সেটা করতে হয়।

ফোবি আবার দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনি সত্যিই এটা করতে চাইছেন?

হ্যাঁ। ফোবি আমি চাইছি।

বেশ তবে আমার কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রয়োজন। কী হারে গতিবেগ কমাব।

আমি বলছি, তুমি মন দিয়ে শোনো।

আমি আমার পাথরের মতো ভারী দেহকে টেনে নিতে নিতে ফোবিকে নির্দেশ দিতে শুরু করলাম।

৭. মাত্র কিছুক্ষণ হলো

মাত্র কিছুক্ষণ হলো আমি ফোবিয়ানে খানিকটা মাধ্যাকর্ষণ বল ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে পুরো মহাকাশযানটিকে তার অক্ষের উপর ঘােরানো শুরু করেছি। এত বড় মহাকাশযানটিকে ঘুরাতে প্রচুর শক্তির প্রয়োজন, খুব ধীরে ধীরে সেটা ঘুরতে শুরু কছে। প্রায় সাথে সাথেই আমরা সবাই মহাকাশযানের দেয়ালে দাঁড়াতে শুরু করেছি। যতক্ষণ ভেসেছিলাম বুঝতে পারি নি এখন বুঝতে পারছি যে ফোবিয়ান আসলে ভয়ানকভাবে কাঁপছে, নিউট্রন স্টারের প্রবল মহাকর্ষ বলটি এই মহাকাশযানের উপর বেশ ভয়ঙ্কর চাপ সৃষ্টি করেছে। আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে ফোবিয়ানের যাত্রাপথটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম তখন পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকিয়ে আমি ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম। ম্যাঙ্গেল কাস সৈনিকদের মতো পা ফেলে হেঁটে আসছে, তার পিছনে দুজন অপরিচিত মানুষ, তারা মিত্তিকাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসছে।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, কী হচ্ছে, কী হচ্ছে এখানে?

ম্যাঙ্গেল ক্বাস শীতল গলায় বলল, বিশেষ কিছু নয়। এই মহাকাশযানের নতুন দুজন সদস্যকে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই অধিনায়ক ইবান।

মিত্তিকাকে ধরে রাখা দুজন মানুষ অদ্ভুত একটা ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করল, তাদের চোখের দৃষ্টি দেখে তাদেরকে স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হলো না। এদেরকে আমি আগে কখনো দেখি নি, নিশ্চয়ই শীতল কক্ষ থেকে তাদের জাগিয়ে আনা হয়েছে। আরেকটু কাছে এলে আমি দেখতে পেতাম দুজনের কপালের ঠিক একই জায়গায় একটা ক্ষত, ম্যঙ্গেল ক্বাস নিশ্চয়ই তার অস্ত্রোপচার করে এই দুজন মানুষকে ঘাঘু অপরাধীতে পাল্টে নিয়েছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, এরা হচ্ছে ক্লদ এবং মুশ। একসময়ে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য ছিল এখন আমার একান্ত অনুগত সদস্য। তাই না?

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথার উত্তরে দুজনেই অনুগত গৃহপালিত রবোটের মতো মাথা নাড়ল। ম্যাঙ্গেল ক্বাস মুখে হাসি। ফুটিয়ে বলল, আমি তাদেরকে তাদের প্রথম দায়িত্ব দিয়েছি, দেখো তারা কী উৎসাহ নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে।

আমি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, দায়িত্বটি কী?

মিত্তিকাকে চিকিৎসা কক্ষে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে শুইয়ে দেয়া। আমার তৃতীয় অস্ত্রোপচারের জন্যে প্রস্তুত করা।

মিত্তিকা আতঙ্কে চিৎকার করে ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, ক্লদ এবং মুশ শক্ত করে তাকে ধরে রেখেছে। তাদের মুখে একটা উল্লাসের ছায়া পড়ল, মনে হতে লাগল পুরো ব্যাপারটিতে তাদের। খুব আনন্দ হচ্ছে। আমি কঠোর গলায় বললাম, মিত্তিকাকে ছেড়ে দাও।

ক্লদ এবং মুশ এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমি একটা অত্যন্ত মজার কথা বলেছি, তারা একে অপরের দিকে তাকাল এবং উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করল। আমি গলার স্বর উঁচু করে বললাম, তোমরা বুঝতে পারছ না। তোমাদের মাথায় এই মানুষটি অস্ত্রোপচার করেছে? এখন তোমাদের ভেতরে কোনো ন্যায়-অন্যায় বোধ নেই। তোমাদের দিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাস ভয়ঙ্কর অন্যায় করিয়ে নিচ্ছে।

ক্লদ হাত দিয়ে তার ক্ষতস্থান স্পর্শ করে মুখে জোর করে একধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, অস্ত্রোপচার যদি করে থাকে সেটি আমাদের ভালোর জন্যেই করেছে।

মুশ মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, ভালোর জন্যেই করেছে।

দুজনে মিলে মিত্তিকাকে টেনে নিতে নিতে বলল, এখন আমরা এই মেয়েটার মাথায় অস্ত্রোপচার করব, তখন। সেও আমাদের একজন হয়ে যাবে।

মিত্তিকা আবার নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ইবান আমাকে বাঁচাও।

মিত্তিকার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার বুক ভেঙে গেল, আমি সাহস দিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ম্যাঙ্গেল জ্বাস আমাকে সে সুযোগ দিল না, মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল, যে বেঁচে আছে তাকে নতুন করে বাঁচানো যায় না মেয়ে।

মিত্তিকা কিছু একটা বলতে চাইছিল ক্লদ এবং মুশ তাকে সে সুযোগ দিল না, একটি ঝটকা মেরে তাকে টেনে নিয়ে গেল। আমি শুনতে পেলাম সে হিস্টিরিয়া- গ্রস্তের মতো চিৎকার করে কাঁদছে, মহাকাশযানে তার কান্নার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নেড়ে বলল, বোকা মেয়ে অবুঝ মেয়ে।

আমি ম্যাঙ্গেল কাসের দিকে হিংস্র চোখে তাকিয়ে রইলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, আশা করছি তুমি কোনোরকম নির্বুদ্ধিতা করবে না। তুমি জান আমার শরীরের ভেতরেও বিস্ফোরক রয়েছে, আমি আমার আঙুল দিয়ে একটা এলাকা ধ্বংস করে দিতে পারি।

আমি জানি।

আমার শরীরের উপর বায়োমারের আস্তরণ রয়েছে, কোনো বিস্ফোরক দিয়ে সেটা তুমি ছিন্ন করতে পারবে না।

আমি জানি।

আমি হাইব্রিড মানুষ। আমার মস্তিষ্কে কপোট্রন রয়েছে, আমাকে কখনো থামিয়ে রাখা যায় না, আমার জৈবিক শারীরকে অচেতন করলেও কপোট্রন শরীরের দায়িত্ব নিয়ে নেয়।

আমি জানি।

বর্তমান প্রযুক্তি আমাকে থামাতে পারবে না। কাজেই আমার বিরদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা কোরো না।

আমি কোনো কথা বললাম না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিচু গলায় বলল, তোমার আমাকে সাহায্যও করতে হবে না ইবান, কিন্তু আমার বিরোধিতা কোরো না।

আমি এবারেও কোনো কথা বললাম না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ইবান একসময় তুমি আমার একজন ঘনিষ্ঠ মানুষ হবে। তুমি আমি আর মিত্তিকা খুব পাশাপাশি থাকব।

আমি এবারও কোনো কথা বললাম না, ম্যাঙ্গেল ক্বাস চোখে বিদ্রুপ ফুটিয়ে বলল, কিছু একটা বল ইবান।

তুমি গোল্লায় যাও ম্যাঙ্গেল ক্বাস।

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের চোখ হঠাৎ হিংস্র শ্বাপদের মতো জ্বলে উঠল, আমার মুহূর্তের জন্যে মনে হলো সে আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল, তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তবে তাই হোক ইবান।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস ঘুরে চিকিৎসা কক্ষের দিকে রওনা দিতেই হঠাৎ পুরো ফোবিয়ান থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিলাম, সম্ভবত মিত্তিকাকে অপারেশন থিয়েটারে জোর করে শোয়ানো হয়েছে এবং ফোবি আমার সপ্তম মাত্রার নির্দেশমতো ফোবিয়ানের গতি কমিয়ে আনছে। আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের দিকে তাকালাম, সেখানে একটি লাল আলো জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। আমি মূল ইঞ্জিন দুটোর গুঞ্জন শুনতে পেলাম। ম্যাঙ্গেল কাস আমার দিকে ভুর কুঁচকে তাকাল, কী হচ্ছে এখন?

আমরা নিউট্রন স্টারের কাখাকাছি চলে আসছি। ফোবিয়ানের গতিবেগ নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখার জন্যে যাত্রাপথকে একটু পরিবর্তন করতে হচ্ছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, আমি বললাম, তুমি স্বীকার করো আর না-ই করো। আমি এখনো এই মহাকাশযানের অধিনায়ক। তোমাকে আমার উপর নির্ভর করতে হবে ম্যাঙ্গেল ক্বাস।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার ঘুরে চিকিৎসা কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল।

আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খুব ধীরে ধীরে ফোবিয়ানের গতিবেগ কমে আসছে, এভাবে আর কিছুক্ষণ চলতে থাকলে ফোবিয়ান নিউট্রন স্টারের প্রবল মহাকর্ষণ থেকে কোনোদিনই বের হয়ে আসতে পারবে না। আমি শান্ত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম, মিত্তিকাকে বাঁচানোর জন্যে আর কোনো উপায় ছিল কি না আমার জানা নেই। থাকলেও এখন আর কিছু করার নেই, মহাকাশযান ফোবিয়ান এবং এর যাত্রীদের নিয়ে আমি যে ভয়ঙ্কর খেলায় নেমেছি তার থেকে আর ফিরে আসার কোনো উপায় নেই। আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে বসে দেখতে থাকি ফোবিয়ান ধীরে ধীরে তার নিরাপদ দূরত্ব থেকে সরে আসছে, নিউট্রন স্টারের প্রবল আকর্ষণে ফোবিয়ান একটু পরে পরে কেঁপে উঠছে, প্রতিবার কেঁপে ওঠার সময় বিচিত্র একধরনের শব্দ শোনা যায়, অশুভ একধরনের শব্দ আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার পরও এই শব্দ শুনে আমার বুক কেঁপে ওঠে।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম, শেষপর্যন্ত কী হবে আমি জানি না, যদি এই ভয়ঙ্কর খেলা থেকে ফিরে আসতে না পারি তাহলে আর কারো সাথে দেখা হবে না। আমার মনে হয় মিত্তিকার কাছে একবার ক্ষমা চেয়ে আসা উচিত।

আমি ফোবিয়ানের দেওয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে চিকিৎসা কক্ষে হাজির হলাম, ঘরের দরজায় লাল আলো জ্বলছে, এখন ভেতরে কারো ঢোকার কথা নয়। আমি অধিনায়কের কোড প্রবেশ করিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকাল। মিত্তিকাকে অপারেশন থিয়েটারে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে, তার কপালের উপর একটি রিং। সেখান থেকে দুর্বোধ্য কিছু সংকেত বের হয়ে আসছে। ক্লদ বা মুশ দুজনের একজনের হাতে গ্যাস মাস্ক, মিত্তিকাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবার জন্যে গ্যাস নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমাকে দেখে যেন খুশি হয়ে উঠল, মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, চমৎকার! আমি তোমাকেই চাইছিলাম।

কেন?

মিত্তিকার মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। সেই জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে হলে সেখানে একধরনের আলোড়ন তৈরি করতে হবে যেন আমার সিনান্স মডিউল সেটা খুঁজে পায়।

আমি শীতল গলায় বললাম, আমি তোমাকে সেই জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে সাহায্য করব তোমার সেরকম ধারণা কেমন করে হলো?

তোমার সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে না ইবান। তোমার জন্যে মিত্তিকার ভেতরে খুব একটা স্নেহার্দ্র জায়গা আছে, তোমাকে দেখলেই তার মস্তিষ্কের এক জায়গায় আলোড়ন হবে—

এবং তুমি সেই জায়গাগুলো ধ্বংস করবে?

ম্যাঙ্গেল ক্বাস একগাল হেসে বলল, ঠিক অনুমান করেছ।

ক্লদ কিংবা মুশ দুজনের একজন, আমি এখনো তাদের আলাদা করে ধরতে পারছি না— উত্তেজিত গলায় বলল, ক্যাপ্টেন, সিনান্স মডিউলে সঙ্কেত আসছে।

চমৎকার! ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আরো একটু কাছে এসে দাঁড়াও।

আমি আরো একটু কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে মিত্তিকার শক্ত করে বেঁধে রাখা হাত স্পর্শ করে বললাম, মিত্তিকা, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি।

মিত্তিকার সেই ভয়ঙ্কর ভীতিটুকু আর নেই। তার চোখেমুখে হঠাৎ করে পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেয়া মানুষের একধরনের প্রশান্তি চলে এসেছে, সে নরম গলায় বলল, বল ইবান।

আমি খুব দুঃখিত মিত্তিকা–

তোমার দুঃখ পাবার কিছু নেই ইবান। আমি সারাক্ষণ বুঝতে চেষ্টা করছিলাম তুমি কেমন করে এই মানুষটিকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলে। আমি বুঝতে পারি নি। এইখানে এই অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছি।

মিত্তিকা—

আমি বুঝতে পেরেছি যে এই সৃষ্টিজগতে অন্যায় ভয়ঙ্কর অন্যায় যেরকম থাকবে তাকে থামানোর জন্যে সেরকম সত্য আর ন্যায় থাকতে হবে। অন্যায়কে অন্যায় দিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। ন্যায় দিয়ে অন্যায়ের সাথে যুদ্ধ করতে হয়।

মিত্তিকা শোনো—

আমি তোমার উপর অভিমান করেছিলাম ইবান। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে এই ভয়ঙ্কর মানুষের হাতে তুলে দিয়েছ। এই নিঃসঙ্গ অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে শুয়ে আমি হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছি যে আসলে কেউ আমাকে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের হাতে তুলে দিতে পারবে না! কেউ পারবে না।

মিত্তিকা খুব সুন্দর করে হাসল, হেসে বলল, আমার ভেতরকার যত সুন্দর অনুভূতি, যত ভালোবাসা সবকিছু এই মানুষটি ধ্বংস করে দেবে। তারপর যেটা বেঁচে থাকবে সেটা তো মিত্তিকা নয়। সেটা অন্য কেউ। সেই ভয়ঙ্কর অমানুষ চরিত্রটির শরীর হয়ত আমার কিন্তু সেটি আমি নই। জগতের সব ভালোবাসা, সব সুন্দর, সব সত্য, সব ন্যায় সরিয়ে নিলে সেটা আমি থাকব না। আমার ভেতরকার ভালোটুকু আমি, খারাপটুকু আমি নই।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস উফুল্ল গলায় বলল, চমৎকার মিত্তিকা, এর চাইতে ভালোভাবে এটা করা সম্ভব ছিল না। তোমার মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার জন্যে নিহিলা গ্যাস মাস্কটি মিত্তিকার মুখের কাছে এগিয়ে নিয়ে ক্লদ বলল, এখন ঘুম পাড়িয়ে দেব, ক্যাপ্টেন?

হ্যাঁ। ঘুম পাড়িয়ে দাও। আর একঘণ্টার মাঝে মিত্তিকা নতুন মানুষ হয়ে উঠবে।

ক্লদ মিত্তিকার মুখের উপর গ্যাস মাস্কটি নামিয়ে আনল। মিত্তিকা খুব সুন্দর করে হাসল, হেসে বলল, ইবান, বিদায়। আমার চোখে ঘুম নেমে আসছে। এই ঘুম থেকে যে মানুষটি জেগে উঠবে সেটি আর মিত্তিকা থাকবে না। সেই ভয়ঙ্কর মানুষটিকে তুমি ক্ষমা করে দিও ইবান।

আমি মিত্তিকার হাতে চাপ দিয়ে বললাম, মিত্তিকা, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। তোমার ভেতরকার ভালোবাসা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

মিত্তিকা তার শক্ত করে বেঁধে রাখা হাত দিয়ে আমার হাতকে স্পর্শ করার চেষ্টা করল, পারল না, আমি অনুভব করলাম তার হাত দুর্বল হয়ে আসছে, আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। সেখানে গভীর ঘুম নেমে আসছে। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল, আমি ভেবেছিলাম তুমি কাউকে মিথ্যা সান্ত্বনা দাও না।

না। আমি দেই না।

তাহলে তাকে কেন বলেছ কেউ তার ভেতরকার ভালোবাসা কেড়ে নিতে পারবে না?

কারণ তার আগেই সে মারা যাবে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস চমকে উঠে বলল, কী বললে?

শুধু মিত্তিকা নয়। তুমি, আমি তোমার এই প্রভুভক্ত অনুচর সবাই মারা যাবে।

কেন?

আমি ফোবিয়ানকে ধ্বংস করে ফেলছি ম্যাঙ্গেল ক্বাস। তুমি টের পাচ্ছ না ফোবিয়ান তার গতিবেগ পাল্টে নিউট্রন স্টারের দিকে ছুটে যাচ্ছে?

আমি এই প্রথমবার ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখে আতঙ্কের চিহ্ন দেখলাম। সে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, কী বললে? তুমি ফোবিয়ানকে ধ্বংস করে ফেলছ?

হ্যাঁ। কেন?

আমি মিত্তিকাকে দেখিয়ে বললাম, এই মেয়েটার মাঝে একটা আশ্চর্য সরলতা রয়েছে। তাকে একজন কুৎসিত অপরাধীতে পাল্টে দেবে সেটা আমার জন্যে গ্রহণযোগ্য নয়।

এই একটা তুচ্ছ মেয়ের জন্যে তুমি—

একজন মানুষ কখনো তুচ্ছ নয়। আমি তোমার মতো দানবকেও উদ্ধার করে এনেছিলাম। তার তুলনায় মিত্তিকা একজন দেবী, মিত্তিকা খুব ভালো একটি মেয়ে, আমি তার ভালোটুকু বাচিয়ে রাখার জন্যে এক-দুইটি মহাকাশযান ধ্বংস করে ফেলতে পারি।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস হঠাৎ আমার কাছে এসে বুকের কাছাকাছি পোশাকটি শক্ত করে ধরল, চিল্কার করে বলল, তুমি মিথ্যা কথা বলছ।

আমি ম্যাঙ্গেল কাসের হাতটি সরিয়ে বললাম, আমি সাধারণত মিথ্যা কথা বলি না।

ক্লদ এবং মুশ ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাছে ছুটে এসে বলল, এখন কী হবে?

ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা ঝাকিয়ে বলল, এ মিথ্যা কথা বলছে। এত সহজে কেউ পঞ্চম মাত্রার একটা মহাকাশযান ধ্বংস করে দেয় না।

কোনটি সহজ কোনটি কঠিন সে-ব্যাপারে তোমার এবং আমার মাঝে বিশাল পার্থক্য।

আমার কথা শেষ হবার আগেই মহাকাশযান ফোবিয়ান হঠাৎ করে ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল, মনে হলো পুরো মহাকাশযানটি বুঝি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, অশুভ একধরনের কর্কশ শব্দ পুরো মহাকাশযানের ভেতরে। প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল।

ক্লদ আতঙ্কিত হয়ে বলল, ক্যাপ্টেন! আসলেই মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে!

ম্যাঙ্গেল ক্বাস চাপা গলায় বলল, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে চল, দেখি কী হচ্ছে।

কথা শেষ করার আগেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবং তার পিছু পিছু ক্লদ এবং মুশ ছুটে বের হয়ে গেল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে মিত্তিকার কাছে এগিয়ে গেলাম, তার ঘুমন্ত মুখটি স্পর্শ করে নরম গলায় বললাম, ঘুমাও মিত্তিকা। আমি দেখি তোমাকে বাঁচাতে পারি কি না।

আমি মিত্তিকার মাথার কাছে রাখা নিহিলা গ্যাস সিলিন্ডারটি তুলে নিলাম। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে ছোট অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকে, একটু খুঁজে সেটাও বের করে নিলাম। পোশাকের ভেতরে সেগুলো লুকিয়ে নিয়ে এবারে আমিও ছুটে চললাম নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখানে এখন আসল নাটকটি অভিনীত হবে। আমি তার মূল অভিনেতা। আমাকে থাকতেই হবে।

নিয়ন্ত্রণ কক্ষে আমাকে দেখে ম্যাঙ্গেল ক্বাস দাঁতের ফাঁক দিয়ে কুৎসিত একটা গালি উচ্চারণ করে বলল, নির্বোধ আহাম্মক কোথাকার।

আমি অত্যন্ত সহজ একটা ভঙ্গি করে বললাম, এখন আমার কথা বিশ্বাস হলো? দেখেছ, মহাকাশযানটা ধ্বংস হতে যাচ্ছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস চিৎকার করে বলল, না। ধ্বংস হচ্ছে না। আমি সেটাকে ফিরিয়ে আনব।

তুমি পারবে না।

দেখি পারি কি না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস অভিজ্ঞ মহাকাশ-দস্যু মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে নিতে হয় সেটি খুব ভালো করে জানে। সে দ্রত কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ বুলিয়ে নেয়, তারপর প্যানেল স্পর্শ করে মূল ইঞ্জিন দুটো পরিপূর্ণভাবে চার্জ করে নেয়। এখন ইঞ্জিন দুটো চালু করতেই প্রচণ্ড শক্তিশালী দুটো ইঞ্জিন মহাকাশযানটিকে সঠিক যাত্রাপথে নেয়ার চেষ্টা করবে। সেই ভয়ঙ্কর শক্তি মহাকাশযানটিকে প্রচণ্ড ত্বরণের মুখোমুখি এনে ফেলবে, মহাকাশযানের ভেতরে সেটি এক অচিন্ত্যনীয় মাধ্যাকর্ষণের জন্ম দেবে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস, ক্লদ আর মুশ সেই অচিন্ত্যনীয় মহাকর্ষণে অচেতন হয়ে পড়বে, কিন্তু আমাকে চেতনা হারালে চলবে না, যেভাবেই হোক আমাকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমি জানি না পারব কি না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেল স্পর্শ করার জন্যে তার হাত বাড়িয়ে দিল, আমি নিজেকে রক্ষা করার জন্যে নিচে লাফিয়ে পড়লাম, দুই হাত শক্ত করে দুইপাশে দুটি ধাতব রিং আঁকড়ে ধরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস সুইচ স্পর্শ করল এবং সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে পুরো মহাকাশযানটি কেঁপে উঠল। আমার প্রথমে মনে হলো মহাকাশযানটি বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাচ্ছে, কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে না মহাকাশযানটি এখনো টুকরো টুকরো হয়ে যায় নি প্রচণ্ড ঝাকুনিতে মহাকাশযানের সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে উড়ে গেছে মাত্র। আমি চিৎ হয়ে শুয়েছিলাম বলে ম্যাঙ্গেল ক্বাস, ক্লদ বা মুশকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু কাতর চিৎকার শুনে বুঝতে পারছি তাদের কেউ-না-কেউ ছিটকে পড়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।

মহাকাশযানটি থরথর করে কাঁপতে শুরু করছে। পদার্থ-প্রতিপদার্থের শক্তিশালী ইঞ্জিন ভয়ঙ্কর গর্জন করে শব্দ করছে, আয়োনিত গ্যাস অচিন্ত্যনীয় গবিবেগে ছুটে বের হয়ে মহাকাশযানটিকে নিউট্রন স্টারের মহাকর্ষ থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারছি মাধ্যাকর্ষণের টানে আমার ওজন বেড়ে যাচ্ছ, মনে হচ্ছে সমস্ত শক্তি দিয়ে অদৃশ্য কোনো দানব আমাকে মহাকাশযানের মেঝেতে চেপে ধরছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমার চোখের উপর একটা লাল পর্দা কাঁপতে শুরু করছে, মনে হচ্ছে আমি বুঝি এক্ষুনি অচেতন হয়ে পড়ব।

কিন্তু আমি জোর করে নিজের চেতনাকে শানিত করে রাখলাম, আমার কিছুতেই জ্ঞান হারানো চলবে না, আমাকে যেভাবেই হোক নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে জেগে থাকতে হবে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে জেগে রইলাম।

 

আমি অনুভব করতে পারছি মহাকাশযানের প্রচণ্ড ত্বরণে আমার চেহারা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, অদৃশ্য শক্তি মুখের চামড়া দুইপাশে টেনে ধরেছে, হাত নাড়ানোর চেষ্টা করে নাড়াতে পারছি না, মনে হচ্ছে কেউ যেন পেরেক দিয়ে আমার সমস্ত শরীরকে মেঝের সাথে গেঁথে ফেলেছে, শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেউ যেন পিষে ফেলছে। নিজের শরীরের প্রচণ্ড চাপে আমার নিজের অস্তিত্ব যেন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর কষ্টে আমার মুখ শুকিয়ে যায়, প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বুক হা হা করতে থাকে। মনে হয় কেউ যেন মহাকাশযান থেকে সমস্ত বাতাস শুষে নিয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও আমি একফোটা বাতাস বুকের ভেতরে আনতে পারি না। মাথার ভিতরে কিছু একটা দপদপ করতে থাকে, মনে হয় বুঝি এক্ষুনি একটা ধমনী ছিড়ে যাবে, নাক মুখ চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসবে।

আমি আর পারছি না, অনেক চেষ্টা করেও আর নিজের চেতনাকে ধরে রাখতে পারছি না। হঠাৎ করে মনে হতে থাকে চোখের সামনে একটা কালো পর্দা নেমে আসছে, চারপাশে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি যখন হাল ছেড়ে দিয়ে অচেতনতার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন কে যেন আমাকে ডাকল, ইবান।

কে? কে কথা বলে? আমি চোখ খোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। আমি আবার গলার স্বর শুনতে পেলাম, ইবান। তুমি কিছুতেই জ্ঞান হারাতে পারবে না। তোমাকে যেভাবে হোক চেতনাকে ধরে রাখতে হবে। যেভাবেই হোক।

কে কথা বলছে? মানুষের গলার স্বরটি আমি আগে কোথাও শুনেছি কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। গলার স্বরটি আবার কথা বলল, ইবান। তুমি চোখ খুলে তাকাও।

আমি পারছিলাম না, কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিলাম না, কিন্তু গলার স্বরটি আবার জোর করল, চোখ খুলে তাকাও, ইবান।

আমি অনেক কষ্টে চোখ খুলে তাকালাম, আমার মুখের কাছে ঝুঁকে রিতুন ক্লিস দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে বললেন, আমি হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি না হয়ে সত্যিকার মানুষ হলে তোমাকে বুকে করে তুলে নিতাম ইবান। কিন্তু আমি সেটা পারব না। তোমাকে জেগে উঠতে হবে ইবান। যেভাবেই হোক জেগে উঠতে হবে। যদি মিত্তিকাকে বাঁচাতে চাও এই মহাকাশযানটিকে বাঁচাতে চাও তোমাকে জেগে উঠতেই হবে।

আমি দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললাম, আমি পারছি না, কিছুতেই পারছি না।

তোমাকে পারতেই হবে। যেভাবেই হোক তোমাকে পারতেই হবে। ওঠ। ম্যাঙ্গেল ক্বাস আর তার দুইজন অনুচর অচেতন হয়ে আছে, ওঠ তুমি।

আমি কী করব?

নিহিলা গ্যাসের সিলিন্ডারটি এনেছ না?

হ্যাঁ, এনেছিলাম।

এই সিলিন্ডারটি এনে তাদের কাছাকাছি খুলে দিতে হবে— এদেরকে দীর্ঘ সময় অচেতন রাখতে হবে। ওঠ তুমি।

আমি ওঠার চেষ্টা করে পারলাম না, মনে হলো একটি পাহাড় ধরে চেপে রেখেছে। মনে হলো সমস্ত শরীর কেউ শিকল দিয়ে মেঝের সাথে বেঁধে রেখেছে। কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, পারছি না আমি মহামান্য রিতুন ক্লিস।

না পারলে হবে না ইবান। তোমাকে পারতেই হবে। এই যে দেখ তোমার পাশে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্যে অক্সিজেন সিলিন্ডারটি আছে, তুমি এনেছিলে চিকিৎসা কক্ষ থেকে। সেটা নিজের কাছে টেনে নাও, টিউবটা তোমার নাকে লাগাও, তুমি শরীরে জোর পাবে ইবান।

আমি অমানুষিক পরিশ্রম করে পাশে পড়ে থাকা সিলিন্ডারটি নিজের কাছে টেনে আনলাম, জরুরি অবস্থায় শ্বাস নেবার জন্যে ছোট অক্সিজেন সিলিন্ডারটির সাথে লাগানো টিউবটি নিজের নাকে লাগানোর সাথে সাথে মনে হলো বুকের ভেতরে বাতাস এসে আমাকে বাঁচিয়ে তুলছে। বুক ভরে দুবার নিঃশ্বাস নিতেই মাথার ভেতর দপদপ করতে থাকা ভাবটা একটু কমে এল, আমি আবার চোখ খুলে তাকালাম।

রিতুন ক্লিস মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, চমৎকার ইবান! চমৎকার। এবারে নিহিলা গ্যাসের সিলিন্ডারটি নিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাছে যাও। সে এখনো অচেতন হয়ে আছে, তার নাকের কাছে নিহিলা গ্যাসটি ছেড়ে দিতে হবে, সে যেন আর জ্ঞান ফিরে না পায়।

কিন্তু সে অচেতন হয়ে থাকলেও তার মাথার ভিতরে কপোট্রন রয়েছে।

থাকুক। সেটা পরে দেখা যাবে। তুমি এগিয়ে যাও। নিহিলা গ্যাসের সিলিন্ডারটা নিয়ে এগিয়ে যাও। দেরি করো না।

আমি সমস্ত শক্তি ব্যয় করে কোনোভাবে উপুড় হয়ে নিলাম। তারপর নিহিলা গ্যাসের সিলিন্ডারটি হাতে নিয়ে সরীসৃপের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। মেঝের সাথে ঘর্ষণে আমার মুখের চামড়া উঠে গিয়ে সমস্ত মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়, আমার পোশাক ছিড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু আমি তার মাঝেই নিজেকে টেনে টেনে নিতে থাকি। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যেতে আমার মনে হলো একযুগ লেগে গেল। প্রথমে ক্লদ এবং তারপর। মুশের অচেতন দেহ পার হয়ে আমি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাছে এগিয়ে গেলাম। ক্লদ আর মুশ দুজনেই খারাপভাবে আঘাত পেয়েছে, মহাকাশযানের ভয়ঙ্কর ত্বরণের সাথে অপরিচিত অনভিজ্ঞ দুজন মানুষ প্রথম ধাক্কাতেই ছিটকে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। মাথার কোথাও আঘাত লেগেছে সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আমি তাদের মুখের উপর নিহিলা গ্যাসের মাস্কটি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে লাগিয়ে এসেছি, খুব সহজে এখন তাদের জ্ঞান ফিরে আসবে না।

আমি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাছে পৌছে খুব কষ্ট করে মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম, সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে খুব ধীরে ধীরে তার বুক ওঠানামা করছে। আমি খুব সাবধানে ধীরে ধীরে নিহিলা গ্যাসের মাস্কটি হাতে নিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখে লাগানোর জন্যে এগিয়ে গেলাম, হঠাৎ করে ম্যাঙ্গেল কাসের চোখ খুলে গেল এবং তার ডান হাতটি খপ করে আমার হাত ধরে ফেলল। আমি হাতটি ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে পারলাম না, সেটি শক্ত লোহার মতো আমার হাতকে ধরে রেখেছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবারে খুব ধীরে ধীরে আমার দিকে তাকাল, তার। চোখে একটি অতিপ্রাকৃত দৃষ্টি, সে বিচিত্র একটি যান্ত্রিক গলায় বলল, তুমি কে? তুমি কী করছ?

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মাথায় বসানো কপোট্রনটি কথা বলছে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম সেটি আমাকে চেনে না— সম্ভবত ম্যাঙ্গেল ক্বাস যখন পুরোপুরি অচেতন হয়ে যায় শুধুমাত্র তখনই সেটি তার শরীরের দায়িত্ব নেয়। সম্ভবত এটি আমার জন্যে একটি সুযোগ। আমি গলার স্বর অত্যন্ত স্বাভাবিক রেখে বললাম, আমি ইবান। আমি মহাকাশযান ফোবিয়ানের অধিনায়ক।

তুমি নিহিলা গ্যাস মাস্ক নিয়ে কী করছ?

আমি ফোবিয়ানের সকল যাত্রীকে অচেতন করে রাখছি।

কেন?

ফোবিয়ানকে রক্ষা করার জন্যে তার গতিবেগকে অত্যন্ত দ্রুত বাড়াতে হবে, তার জন্যে প্রয়োজনীয় ত্বরণ মানুষের শরীর সহ্য করতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত গতিবেগ নিয়ন্ত্রিত না হচ্ছে ফোবিয়ানের সকল যাত্রীকে অচেতন করে রাখতে হবে।

কেন?

এই প্রচণ্ড ত্বরণের মাঝে মানুষ যেন নিজে থেকে কিছু করার চেষ্টা করে নিজের শরীরের ক্ষতি না করে ফেলে। সেজন্যে।

কিন্তু তুমি তো অচেতন নও।

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, না, আমি এখনো অচেতন নই।

কেন নও?

আমিও নিজেকে অচেতন করে ফেলব।

তাহলে কেন নিজেকে অচেতন করছ না?

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মস্তিষ্কে বসানো কপোট্রনটিকে এরকম সম্পূর্ণ একটি সপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে এরকম গুর তর আলোচনা শুরু করতে দেখে আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম। আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু তবুও জোর করে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের গলা থেকে আবার বিচিত্র একটা শব্দ বের হলো, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও,

তুমি কেন নিজেকে অচেতন করছ না?

তুমি কেন এটা জানতে চাইছ?

আমি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মস্তিষ্কের কপোট্রন। যখন প্রভু ম্যাঙ্গেল ক্বাস অচেতন থাকেন তখন আমি তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেই। আমাকে জানতে হবে তুমি কী করছ।

কেন?

যদি আমার মনে হয় তুমি প্রভুর বিরদ্ধে কিছু করছ তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করব।

আমি আতঙ্কে শিউরে উঠে দেখলাম ম্যাঙ্গেল ক্বাসের একটি হাত খুব ধীরে ধীরে আমার মস্তিষ্কের দিকে তাক করে স্থির হলো। আমি জানি তার হাতের আঙুলে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক লুকানো রয়েছে, মুহূর্তে সেটি ছুটে এসে আমার মস্তিষ্ককে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম তার আঙুলের ভেতর চামড়ার নিচে দিয়ে কিছু একটা নড়ে গেল, সম্ভবত বিস্ফোরকটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির হয়েছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের গলা দিয়ে আবার যান্ত্রিক বিচিত্র একটি শব্দ বের হলো, কাটা-কাটা গলায় বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও ইবান। তুমি কেন নিজেকে অচেতন করছ না?

আমি হতচকিত হয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের উদ্যত হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম, ইতস্তত করে বললাম, যারা নিজেদেরকে অচেতন করতে পারছে না আমি শুধু তাদের অচেতন করছি।

আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার জন্যে আরো কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলাম, মনে হলো হঠাৎ করে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের ভিতরে কিছু একটা ঘটে গেছে, সে অত্যন্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে স্থির হয়ে রইল। সে কিছু বলল না বা কিছু করল না। তার উদ্যত হাতটি এতটুকু নড়ল না এবং যে হাত দিয়ে আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল, সেই হাতটিও হঠাৎ করে শিথিল হয়ে গেল। কী হয়েছে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না কিন্তু আমি বোঝার চেষ্টাও করলাম না। নিহিলা গ্যাসের মাস্কটি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখে চেপে ধরলাম, আমি দেখতে পেলাম ম্যাঙ্গেল কাসের বুক ওঠানামা করছে, এই গ্যাসটি তার ফুসফুসে রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের কপোট্রনের উপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই কিন্তু মানুষ ম্যাঙ্গেল কাস। সহজে ঘুম থেকে জেগে উঠবে না।

আমি প্রবল ক্লান্তিতে মেঝেতে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলাম। ঠিক তখন কে যেন আমার খুব কাছে হেসে উঠল। আমি কষ্ট করে চোখ খুলে তাকালাম, আমার খুব কাছে রিতুন ক্লিস দাঁড়িয়ে আছেন। হাসতে হাসতে তিনি আমার পাশে বসে পড়লেন, বললেন, চমৎকার! ইবান— চমৎকার।

কী হয়েছে?

তুমি দেখছ না কী হয়েছে?

না দেখছি না। আমি বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?

ম্যাঙ্গেল কাসকে তুমি নিহিলা গ্যাস দিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্যে অচেতন করে দিয়েছ। তার কপোট্রনকেও অচল করে দিয়েছ।

আমি কপোট্রনকে অচল করে দিয়েছি? কখন? কীভাবে?

তোমার সাথে কথোপকথনের সময় তুমি তাকে কী বলেছ মনে আছে?

না। আমার মনে নেই। অচেতন করা নিয়ে কিছু একটা বলছিল তখন আমিও জানি ভয় পেয়ে কিছু একটা উত্তর দিয়েছি।

রিতুন ক্লিস আবার হেসে উঠে বললেন, তোমার মনে নেই কিন্তু আমার খুব ভালো করে মনে আছে। কারণ তোমাদের এই কথোপকথন হচ্ছে ঐতিহাসিক একটি ব্যাপার। এরকম কথোপকথন আগে কখনো হয়েছে বলে আমার জানা নেই, ভবিষ্যতেও কখনো হবে কি না জানি না। কিন্তু যুক্তি তর্ক বা গণিতের একেবারে প্রাথমিক আলোচনাতেও এই কথোপকথনের যুক্তিগুলি থাকে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। রিতুন ক্লিস আমার আরো কাছে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কপোট্রন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছে তুমি কেন নিজেকে অচেতন করছ না?

আমি কষ্ট করে মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ মনে পড়েছে।

তুমি বলেছ, যারা নিজেদেরকে অচেতন করতে পারছে না তুমি শুধু তাদের অচেতন করছ। তাহলে কি তুমি নিজেকে অচেতন করবে? এই প্রশ্নের শুধুমাত্র দুটি উত্তর হতে পারে, এক : নিজেকে অচেতন করবে কিংবা দুই : নিজেকে অচেতন করবে না। ধরা যাক প্রথমটি সত্যি, অর্থাৎ তুমি নিজেকে অচেতন করবে, কিন্তু তুমি বলেছ যারা নিজেকে অচেতন করছে না তুমি শুধু তাদের অচেতন করছ কাজেই এটা হতে পারে না। তাহলে নিশ্চয়ই দ্বিতীয় উত্তরটি সত্যি, অর্থাৎ তুমি নিজেকে অচেতন করছ না। কিন্তু তুমি বলেছ যারা নিজেদেরকে অচেতন করছে না তুমি শুধু তাদের অচেতন করছ কাজেই এটাও সত্যি হতে পারে না। এটি একটি অত্যন্ত পুরানো গাণিতিক বিভ্রান্তি, তুমি খুব চমৎকারভাবে এখানে ব্যবহার করেছ। এই কপাট্রনের ক্ষমতা খুব সীমিত, এই বিভ্রান্তি থেকে সেটি কিছুতেই বের হতে পারছে না।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি এটা বুঝে ব্যবহার করি নি, হঠাৎ করে ঘটে গেছে।

আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না, এটা নিশ্চয়ই হঠাৎ করে ঘটে নি। কিন্তু সেটা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে, এখন আরো একটা খুব জরুরি কাজ বাকি রয়েছে।

কী কাজ?

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কপোট্রন কতক্ষণ এভাবে থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই; তুমি এটাকে পুরোপুরি বিকল করে দাও।

কীভাবে বিকল করব?

এই দেখো ওর মাথার পিছনে দুটি ইলেকট্রড আছে, এদিক দিয়ে যদি এক মিলিওন ভোল্টের একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ দেয়া যায় কপোট্রনটা পাকাপাকিভাবে অচল হয়ে যাবে।

এক মিলিওন ভোল্ট?

হ্যাঁ, ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেই। কন্ট্রোল প্যানেলেই তুমি পাবে। কমিউনিকেশন্স মডিউলের বাইপাসে এরকম ভোল্টেজ থাকে। তুমি দুটো তার বের করে নাও, নিউরাল নেটওয়ার্ক তোমাকে ভোল্টেজ প্রস্তুত করে দেবে।

আমি নিজেকে টেনে নিতে গিয়ে আবার মেঝেতে শুয়ে পড়ে কাতর গলায় বললাম, আমি পারছি না মহামান্য রিতুন।

রিতুন ক্লিস ফিসফিস করে বললেন, তোমাকে পারতেই হবে ইবান। তুমি যদি না পার তাহলে যে-কোনো মুহূর্তে ম্যাঙ্গেল কাসের কপোট্রন এই বিভ্রান্তি থেকে বের হয়ে আসবে, তখন তুমি তার সাথে পারবে না। তোমার জীবন শুধু নয় মিত্তিকার জীবনও শেষ হয়ে যাবে। তুমি চেষ্টা কর ইবান।

আমি অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে বুক ভরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে আবার গুড়ি মেরে সরীসৃপের মতো এগুতে থাকি। কন্ট্রোল প্যানেলের নিচে শুয়ে কমিউনিকেশান্স মডিউলের দুটি তার টেনে খুলে এনে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাছে এগিয়ে গেলাম আর মাথার পিছনে দুটি ইলেকট্রড থাকার কথা, চুলের পিছনে লুকিয়ে আছে। আমি খুঁজে বের করে তার দুটো লাগিয়ে একটু সরে এসে নিচু গলায় ফোবিকে ডাকলাম, ফোবি।

বলুন মহামান্য ইবান।

তুমি এই তার দুটোতে এক মিলিওন ভোল্টের একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ দাও।

দিচ্ছি, আপনি আরো একটু সরে যান।

আমি পারছি না ফোবি, তুমি দিয়ে দাও।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস হঠাৎ একটু নড়ে উঠল, আমি চিল্কার করে উঠলাম, ফোবি, এক্ষুনি দাও।

সাথে সাথে ভয়ঙ্কর বিদ্যুঝলকে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের পুরো শরীর কেঁপে উঠল, তার হাত দুটো হঠাৎ করে প্রায় ছিটকে সোজা হয়ে উঠল এবং আঙুলের ডগা দিয়ে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক বের হয়ে আসে, আমি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম, ফোবিয়ান থরথর করে কেঁপে উঠল, কালো ধোঁয়ায় পুরো নিয়ন্ত্রণ কক্ষটি অন্ধকার হয়ে আসে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের শরীরটা বিচিত্রভাবে নড়তে শুরু করে, একটা চোখ হঠাৎ করে খুলে ছিটকে বের হয়ে আসে, চোখের কালো গর্তের ভেতর দিয়ে সবুজ রংয়ের ধোয়া এবং কিছু ফাইবার বের হতে শুরু করে। মুখটি হা করে খুলে জিবের নিচে থেকে কিছু জটিল যন্ত্রপাতি বের হয়ে আসে। যন্ত্রগুলি অনিয়ন্ত্রিতভাবে নড়তে থাকে, একধরনের কালো। তেলতেলে জিনিস মুখ বেয়ে বের হতে থাকে। কান থেকে শাদা আঠালো একধরনের জিনিস বের হতে শুরু করে।

আমি আতঙ্কে চিল্কার করে পিছনে সরে আসার চেষ্টা করলাম। রিতুন ক্লিস আমার পাশে বসে শান্ত গলায় বললেন, ভয় নেই ইবান, কোনো ভয় নেই।

কী হয়েছে? ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কী হয়েছে?

ও হাইব্রিড মানুষ। ওর যন্ত্রের অংশটি নষ্ট হয়ে গেছে ইবান। মানুষের অংশটি আছে, ঘুমুচ্ছে।

ঘুমুচ্ছে?

হ্যাঁ সহজে ঘুম ভাঙবে না।

আমি কি একটু ঘুমুতে পারি রিতুন ক্লিস?

রিতুন ক্লিস কী বললেন আমি শুনতে পেলাম না কারণ তার আগেই আমি অচেতন হয়ে গেলাম। মানুষের শরীর অত্যন্ত বিচিত্র, যে সময়টুকু জেগে না থাকলেই নয় তখন জেগে ছিল এখন যেহেতু প্রয়োজন মিটেছে আমার শরীর আর একমুহূর্ত জেগে থাকতে রাজি নয়।

 ৮. মিত্তিকার হাত এবং পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে

আমি মিত্তিকার হাত এবং পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে তার মাথার কাছে রাখা বায়ো জ্যাকেটটি চালু করে দিলাম। প্রায় সাথে সাথেই বায়ো জ্যাকেটের ছোট পাম্পটি গুঞ্জন করে ওঠে। আমি মনিটরে দেখতে পেলাম তার রক্তের মাঝে দ্রবীভূত হয়ে থাকা নিহিলা গ্যাসটুকু পরিশোধন করতে শুরু করে দিয়েছে। আমি মিত্তিকার মাথার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, মেয়েটি সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী, চেহারার মাঝে একধরনের সারল্য রয়েছে যেটি সচরাচর দেখা যায় না। আমার এখনো বিশ্বাস হয় না যে মিত্তিকাকে আরেকটু হলে ম্যাঙ্গেল ক্বাস একজন ঘাঘু অপরাধীতে পাল্টে দিতে চাইছিল।

আমি মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, খুব ধীরে ধীরে তার দেহে প্রাণের চিহ্ন ফিরে আসছে, মিত্তিকার মুখে গোলাপি আভা ফিরে এল, সে হাত-পা নাড়ল এবং একসময় ছটফট করে মাথা নাড়তে শুত্র করল। আমি তার হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে ডাকলাম, মিত্তিকা, চোখ খুলে তাকাও মিত্তিকা।

মিত্তিকা মাথা নেড়ে অস্পষ্ট স্বরে কাতর গলায় কিছু একটা বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। মিত্তিকার হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে আমি আবার ডাকলাম, মিত্তিকা। মিত্তিকা—

মিত্তিকা হঠাৎ চোখ খুলে তাকাল, তার দৃষ্টি অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো বিভ্রান্ত। আমাকে দেখে সে চিনতে পারল বলে মনে হলো না। মিত্তিকা অসহায়ের মতো চারদিকে একবার তাকিয়ে হঠাৎ করে আমার দুই হাত জাপটে ধরে বলল, আমি কোথায়? আমার কী হয়েছে?

তোমার কিছু হয় নি মিত্তিকা। আমি মিত্তিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, তোমার যেখানে থাকার কথা ছিল তুমি সেখানেই আছ।

মিত্তিকার হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেল, আর্তচিৎকার করে ভয়ার্ত গলায় বলল, ম্যাঙ্গেল ক্বাস?

আমি হেসে বললাম, তোমার কোনো ভয় নাই মিত্তিকা। ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে নিয়ে আর কোনো ভয় নাই।

মিত্তিকা আতঙ্কিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় আছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস?

এসো আমার সাথে, দেখবে।

না। মিত্তিকা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, দেখব না, আমি দেখব না।

দেখতে না চাইলে দেখো না, কিন্তু আমার মনে হয় এখন যদি তাকে দেখো তোমার খুব খারাপ লাগবে না।

কেন?

কারণ সে আর হাইব্রিড মানুষ নেই। তার ভেতরের যেটুকু অংশ যন্ত্র ছিল সেটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। যেটা একসময় তার শক্তি ছিল এখন সেটা তার দুর্বলতা।

মিত্তিকা একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হলো সে আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি কী বলছ, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কে তাকে ধ্বংস করল? কীভাবে করল? কখন করল?

সে অনেক বড় ইতিহাস। আমি একটু হেসে বললাম,তুমি আমার সাথে চলো নিজের চোখেই দেখতে পাবে।

মিত্তিকা অপারেশন থিয়েটার থেকে নেমে এল। আমি তার হাত ধরে তাকে নিয়ে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকলাম।

ক্লদ এবং মুশ আলাদা আলাদা দুটি চেয়ারে বসেছিল, তাদের হাত পিছনে শক্ত করে বাঁধা। আমাকে দেখে ক্লদ বলল, মহামান্য অধিনায়ক, আমার হাত দুটো খুলে দেবেন?

কেন?

অনেকক্ষণ থেকে আমার নাকের উপরের অংশ চুলকাচ্ছে।

আমি রক্তে মাখামাখি হয়ে থাকা এই মানুষ দুজনের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের সমবেদনা অনুভব করলাম, একসময়ে নিশ্চয়ই তারা চমৎকার মানুষ ছিল, ম্যাঙ্গেল কাস তাদেরকে আধা-মানুষ আধা-জন্তুতে পরিণত করে দিয়েছে। আমি জানি না তাদের মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গা আবার ঠিক করে দিয়ে আবার তাদের স্বাভাবিক মানুষে তৈরি করে দেয়া যাবে কি না।

ক্লদ আবার অনুনয় করে বলল, মহামান্য অধিনায়ক ইবন, আপনি কি আমার হাত দুটি খুলে দেবেন?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না ক্লদ। সেটি সম্ভব নয়। আমি ঠিক জানি না তোমরা ব্যাপারটির গুর ত্বটুকু ধরতে পেরেছ কি না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস তোমাদের মস্তিষ্কে একধরনের অস্ত্রোপচার করে তোমাদের স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতা অনেকটুকু নষ্ট করে দিয়েছে। আমার পক্ষে এখন কোনো ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।

ক্লদ কাতর মুখে বলল, আপনি বিশ্বাস কর ন মহামান্য ইবান আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না।

মুশও গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, আমিও ক্ষতি করব না।

আমিও মাথা নাড়লাম, আমি দুঃখিত ক্লদ এবং মুশ, তোমাদের আরো একটু কষ্ট করতে হবে। আমি কিছুক্ষণের মাঝে তোমাদের কিছু একটা ব্যবস্থা করব।

ক্লদ এবং মুশ নেহায়েৎ অপ্রসন্ন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি মিত্তিকাকে নিয়ে আরো একটু এগিয়ে গেলাম, নিয়ন্ত্রণ কক্ষের একেবারে কোনার দিকে আমি ম্যাঙ্গেল কাসকে বেঁধে রেখেছি। তাপ পরিবহনের টিউবগুলো যেখানে ঘরের মেঝেতে নেমে এসেছে সেখানে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দুটি হাত ছড়িয়ে আলাদা করে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে, আমি সেখানেও কোনো ঝুঁকি নিই নি, দুটি পা শক্ত করে বেঁধে রেখেছি। ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে দেখে মিত্তিকা আতঙ্ক চিৎকার করে আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আমি ফিসফিস করে বললাম, মিত্তিকা, ভয় পাবার কিছু নেই। যখন তাকে ভয় পাবার কথা ছিল তখন যেহেতু তাকে ভয় পাও নি এখন ভয় পেয়ো না।

মিত্তিকা ভাঙা গলায় বলল, কিন্তু, দেখো কী বীভৎস! কী ভয়ানক!

আমি তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই বীভৎস, সত্যিই ভয়ানক। একটি চোখ খুলে ঝুলছে, চোখের গর্ত থেকে কিছু ফাইবার বের হয়ে আছে, মুখের ভেতর থেকে কিছু যন্ত্রপাতি বের হয়ে আসছে, কিছু গালের চামড়া ফুটো করে ফেলেছে। হাত এবং পায়ের নানা অংশ থেকে ধাতব অংশ শরীরের চামড়া ফুটো করে বের হয়ে এসেছে, সেসব জায়গা থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস যখন হাইব্রিড় মানুষ ছিল তখন তার যন্ত্র এবং মানব-অংশের মাঝে চমৎকার একটি সমন্বয় ছিল, এখন নেই। এখন দেখে ভিতরে একটি আতঙ্ক হতে থাকে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার ভালো চোখটি দিয়ে আমাদের দিকে তাকাল, একটি যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে বলল, ইবান, আমি তোমাকে বলছি আমাকে কীভাবে হত্যা করতে হবে। সে কথাগুলো বলল খুব কষ্ট করে তার উচ্চারণ হলো অস্পষ্ট এবং জড়িত।

আমি বললাম, আমি সেটা জানতে চাই না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস অনুনয় করে বলল, একটা চতুর্থ মাত্রার অস্ত্র নিয়ে আমার চোখের ফুটো দিয়ে উপরের দিকে লক্ষ্য করে গুলি করলে মস্তিষ্কটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা শুনে মিত্তিকা শিউরে উঠল, আমি তাকে শক্ত করে ধরে রেখে বললাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস, আমি তোমাকে হত্যা করব না। তোমাকে হত্যা করাই যদি আমার উদ্দেশ্য হতো আমি তাহলে তোমাকে ঐ উপগ্রহটিকে তোমার মৃত বন্ধুদের সাথে রেখে আসতে পারতাম।

তুমি তাহলে আমাকে কী করতে চাও?

তোমাকে কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে চাই।

আমি ভেবেছিলাম তুমি ভালো মানুষ। তুমি কাউকে কষ্ট দিতে চাও না।

আমি আসলেই কাউকে কষ্ট দিতে চাই না।

তাহলে কেন তুমি আমাকে হত্যা করছ না?

কারণ আমি দীর্ঘদিন চিকিৎসাবিজ্ঞানের খোঁজ রাখি নি হয়ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে, হয়ত তারা তোমার মস্তিষ্ক সারিয়ে তুলতে পারবে, তুমি হয়ত আবার একজন সাধারণ মানুষ হয়ে যাবে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার বিচিত্র যান্ত্রিক মুখ দিয়ে অবিশ্বাসের মতো একটা ভঙ্গি করে বলল, তুমি সত্যিই সেটা বিশ্বাস কর?

হ্যাঁ করি।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু তাহলে সেই মানুষটি তো ম্যাঙ্গেল ক্বাস থাকবে না, সেটি হবে অন্য একজন মানুষ। আমি কি অন্য মানুষ হতে চাই?

আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তার এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।

 

ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবং তার দুই অনুচর ক্লদ এবং মুশকে তাদের ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে, দেহগুলোকে শীতল করে দীর্ঘসময়ের জন্যে সংরক্ষণ করতে আমার এবং মিত্তিকার দীর্ঘ সময় লেগে গেল। সত্যি কথা বলতে কি মিত্তিকা না থাকলে আমার একার পক্ষে এ কাজগুলো করা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। ক্লদ এবং মুশ খুব সহজেই তাদের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিল কিন্তু ম্যাঙ্গেল কাসের জন্যে সেটি ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। ক্যাপসুলের কালো ঢাকনাটি যখন ধীরে ধীরে নেমে আসছিল তখনো সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় তাকে হত্যা করার জন্যে অনুরোধ করে যাচ্ছিল। কোনো একটি বিচিত্র কারণে ম্যাঙ্গেল ক্বাস বুঝতে পারছিল না যে আসলে তার মৃত্যু ঘটে গেছে। একজন মানুষ যখন এভাবে মৃত্যু কামনা করে তখন তার বেঁচে থাকা না-থাকায় আর কিছু আসে যায় না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আর তার দুজন অনুচরকে নিরাপদে সংরক্ষণ করার পর আমি প্রথমবার ফোবিয়ানের দিকে নজর দিলাম, নিউট্রন স্টারের প্রবল আকর্ষণ থেকে বের হয়ে আসার জন্যে যে প্রচণ্ড শক্তিক্ষয় হয়েছে তার চিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নিয়ন্ত্রণের মূল অংশটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় জরুরি অংশটি কোনোভাবে কাজ করছে। তাপ। সঞ্চালনের অনেকগুলো টিউব দুমড়ে মুচড়ে ফেটে গেছে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একটি বড় অংশ অচল হয়ে আছে। ফোবিয়ানের দেওয়ালের কোথাও কোথাও সূক্ষ্ম ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে, ভেতর থেকে বাতাস বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকায় ফোবিয়ানের অনেকগুলো অংশের জরুরি চাপ নিরোধক দরজা পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে আছে। যোগাযোগ মডিউলের কিছু অংশও অকেজো হয়ে আছে, গন্তব্য স্থানে নিয়মিত যে সিগন্যাল পাঠানো হচ্ছিল সেটি বন্ধ হয়ে গেছে, সেটি আবার চালু করে না দিলে মহাজাগতিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ধারণা করতে পারে ফোবিয়ান নিউট্রন স্টারের আকর্ষণে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এখন প্রচুর কাজ। কিছু কিছু এই মুহূর্তে শুরু করতে হবে।

কিন্তু সব কাজ শুরু করার আগে আমার মিত্তিকাকে তার শীতল ক্যাপসুলে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। এই মহাকাশযানটিতে শুধুমাত্র তার অধিনায়কের থাকার কথা— এটি সেভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছে। কোনো একটি বিচিত্র কারণে আমার মিত্তিকাকে শীতল ক্যাপসুলে ঘুম পাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল না— ইচ্ছে করছিল তাকে আমার পাশাপাশি রেখে দেই, কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। সে মহাকাশযানের একজন যাত্রী তাকে নিরাপদে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হবে। একজন যাত্রীকে সারাক্ষণ তার শীতল ক্যাপসুলে ঘুমিয়ে থাকার কথা, আর এখন এই মহাকাশযানের মোটামুটি বিপজ্জনক পরিবেশে তাকে বাইরে রাখা বেআইনি এবং বিপজ্জনক; একজন মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে আমি কোনো অবস্থাতেই সেটি করতে পারি না। মিত্তিকা নিজেও সেটা জানে কাজেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবং তার দুজন অনুচরকে ঘুম পড়িয়ে দেয়ার পর সে আমাকে বলল, এবার আমার পালা।

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, হ্যাঁ।

মহাকাশযানের যে অবস্থা আমার মনে হচ্ছে তোমাকে সাহায্য করতে পারলে হতো কিন্তু তুমি তো জান আমি মহাকাশযানের কিছুই জানি না।

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, আমি জানি। তোমার জানার কথা নয়। আমাকে দীর্ঘদিনে এসব শিখতে হয়েছে।

মিত্তিকা চোখে একটু দুশ্চিন্তা ফুটিয়ে বলল, তুমি কি একা এইসব কাজ শেষ করতে পারবে?

আমার ইচ্ছে হলো বলি, না, পারব না। তুমি আমার পাশে থাকো কিন্তু আমি সেটা মুখ ফুটে বলতে পারলাম। বললাম, পারব মিত্তিকা। আমাকে সাহায্য করার জন্যে সাহায্যকারী রবোটগুলি চালু করে দেব। নিউরাল নেটওয়ার্কে সব তথ্য রাখা আছে। কোনো সমস্যা হবে না।

মিত্তিকা কিছু বলল না একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আমি বললাম, এই মহাকাশযানের যাত্রী হওয়ার কারণে তোমার অনেক দুর্ভোগ হলো মিত্তিকা। ফোবিয়ানের অধিনায়ক হিসেবে আমি আন্তরিকভাবে তোমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। তুমি যদি চাও আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পারি।

মিত্তিকা শব্দ করে হেসে বলল, এর প্রয়োজন নেই ইবান, অধিনায়ক হিসেবে তুমি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পার— কিন্তু আমি কী করব? আমার তো কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা নেই, আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে আমি কীভাবে ধন্যবাদ জানাব?

ধন্যবাদ জানানোর কিছু নেই মিত্তিকা। আসলে আমরা খুব সৌভাগ্যবান তাই এত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেছি। আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের উপর রাখা কোয়ার্টজের গোলকের ভিতরে সৌভাগ্য-বৃক্ষটিকে দেখিয়ে বললাম, এই সৌভাগ্য-বৃক্ষে এতক্ষণ ফুল ফুটে যাওয়া উচিৎ ছিল।

ঠিকই বলেছ। আমরা যে সৌভাগ্যবান সেটা জানার জন্যে আমাদের যেটুকু সময় বেঁচে থাকার দরকার ছিল তুমি থাকলে সেটা সম্ভব হতো না।

আমি কোনো কিছু না বলে একটু হাসলাম। মিত্তিকা একটু এগিয়ে এসে আমার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি তোমার কাছে আরো একটি ব্যাপারে কৃতজ্ঞ ইবান।

কী ব্যাপার?

আমি তোমার কাছে প্রথম দেখতে পেয়েছি যে অন্য মানুষের জন্যে ভালোবাসা থাকতে হয়। নিজের ক্ষতি করে। হলেও অন্যের ভালো দেখতে হয়!

আমি শব্দ করে হেসে বললাম, আমার মা আমার এই সর্বনাশটি করে গেছেন! বিশ্বজগতের সব মানুষ যখন বুদ্ধি প্রতিভা সৌন্দর্য, শক্তি সৃজনশীলতা নিয়ে জন্ম হচ্ছে তখন আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন ভালোবাসা দিয়ে!

সত্যি?

হ্যাঁ, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে শুধুমাত্র এই একটি জিনিসই আমাকে দেয়া হয়েছে। আমার জন্ম হয়েছে। একজন দুর্বল মানুষ হয়ে, আমি বড় হয়েছি দুর্বল মানুষ হিসেবে!

মিত্তিকা সুন্দর করে হেসে বলল, ভালোবাসা দুর্বলতা নয় ইবান। তোমার মা চমৎকার একজন মানুষ নিজের সন্তানকে এর চাইতে ভালো কী দেয়া যায়?

আমি মাথা নাড়লাম, যখন বড় হওয়ার জন্যে আমি কষ্ট করেছি তখন এই গুণটি আমার খুব প্রয়োজনীয় মনে হয় নি।

তোমার মা এখন কোথায় আছেন?

তুমি যেখানে যাচ্ছ সেখানে রিশি নক্ষত্রের কলোনির কাছাকাছি কোথাও আছেন। আমি আসলে সেজন্যেই যাচ্ছি, মায়ের সাথে দেখা করব! এই সৌভাগ্য- বৃক্ষটা আমি মায়ের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।

ইশ! কী মজা।

হ্যাঁ, আমি খুব অপেক্ষা করে আছি। ফোবিয়ানের যোগাযোগ মডিউলটা হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে গেল— এটা ঠিক করে আমি চারপাশে ট্রেসার পাঠানো শুরু করব। খুঁজে বের করতে হবে আমার মা কোথায় আছেন।

মিত্তিকা সুন্দর করে হেসে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, তুমি খুব সৌভাগ্যবান ইবান, তোমার একজন প্রিয় মানুষ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার কেউ নেই।

আমার হঠাৎ করে বলার ইচ্ছে করল, মিত্তিকা আমি আছি, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব। কিন্তু আমি সেটা বলতে পারলাম না, মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একজন প্রিয়জন পাবে মিত্তিকা। নিশ্চয়ই পাবে।

মিত্তিকা কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বিচিত্র একটা ভঙ্গিতে হাসল। তার সেই হাসি দেখে হঠাৎ কেন জানি আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল।

 

মিত্তিকা তার নিও পলিমারের পোশাক পরে কালো ক্যাপসুলে শুয়ে আছে। আমি খুব ধীরে ধীরে ক্যাপসুলের ঢাকনাটি নিচে নামিয়ে আনলাম, মিত্তিকা শেষ মুহূর্তে ফিসফিস করে বলল, ভালো থেকো ইবান।

আমিও নরম গলায় বললাম, তুমিও ভালো থেকো মিত্তিকা।

মিত্তিকা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, বিদায়।

বিদায় মিত্তিকা।

আমি ক্যাপসুলের ঢাকনাটি নামিয়ে সুইচটা স্পর্শ করতেই স্বয়ংক্রিয় জীবন রক্ষাকারী প্লাজমা জ্যাকেটের হালকা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। ক্যাপসুলের স্বচ্ছ ঢাকনা দিয়ে আমি মিত্তিকাকে দেখতে পেলাম খুব ধীরে ধীরে তার চোখ বন্ধ। হয়ে আসছে। ক্যাপসুলের মাঝে শীতল একটি প্রবাহ বইতে শুরু করেছে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে গভীর ঘুমে অচেতন। হয়ে পড়বে। আমি একদৃষ্টে মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, মনে হলো এই সাদামাটা সরল মেয়েটি আমার জীবনের বড় একটা অংশকে ওলট-পালট করে দিয়ে গেল।

শীতল কক্ষ থেকে বের হয়ে আমি ফোবিকে ডাকলাম। ফোবি সাথে সাথে উত্তর দিল, বলল, বলুন মহামান্য ইবান।

ফোবিয়ান তো প্রায় ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বলা যায় একটি বিপজ্জনক অবস্থা।

আপনি ঠিকই বলেছেন।

সবচেয়ে জরুরি কাজ কোনটি? কোন কাজটা দিয়ে শুরু করব?

সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে যোগাযোগ মডিউলটি ঠিক করা। ত্বরণের প্রথম ধাক্কাটা লাগার সাথে সাথে প্রচণ্ড ঝাকুনিতে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। গত ছত্রিশ ঘণ্টা এখান থেকে কোনো সংকেত যায় নি। মহাজাগতিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের লোকজন ভাবতে পারে আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি!

বেশ। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তাহলে এটা দিয়েই শুরু করা যাক।

আপনি এটা দিয়ে শুরু করতে পারবেন না মহামান্য ইবান। মূল নিয়ন্ত্রণটি না সারিয়ে আপনি কিছুতেই যোগাযোগ মডিউল সারাতে পারবেন না। আবার মূল নিয়ন্ত্রণ সারিয়ে তোলার আগে দেওয়ালের সূক্ষ্ম ফাটলগুলো বন্ধ করতে হবে।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ার রবোট ছেড়ে দাও, কাজে লেগে যাই।

আমি প্রায় একডজন ইঞ্জিনিয়ার রবোট নিয়ে কাজে লেগে গেলাম। মহাকাশযানের বাইরে থেকে মাইক্রো স্ক্যানার দিয়ে সূক্ষ্ম ফাটলগুলো খুঁজে বের করে ইঞ্জিনিয়ার রবোটদের নিয়ে সেগুলো ওয়েল্ড করে সারিয়ে তুলতে লাগলাম। প্রায় একটানা কাজ করে যখন দেখতে পেলাম শরীর আর চলছে না তখন আমি মহাকাশযানের ভিতরে ফিরে এলাম, এসে দেখি মহামান্য রিতুন ক্লিস আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমি বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনি?

হ্যাঁ! তোমার কাছে বিদায় নিতে এসেছি।

বিদায়?

হ্যাঁ। মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটি তুমি চমৎকারভাবে গুছিয়ে নিয়েছ। আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনার প্রয়োজন কখনোই ফুরাবে না মহামান্য রিতুন। আপনি সাহায্য না করলে আমি কখনোই এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতাম না।

রিতুন ক্লিস হেসে বললেন, সেটি সত্যি নয়। যেটি করার সেটি তুমি নিজেই করেছ।

কিন্তু কী করতে হবে আমি জানতাম না। তুমি জানতে ইবান।

তুমি এখনো জানো। নিজের উপরে বিশ্বাস রেখো।

রাখব।

রিতুন ক্লিস কাছাকাছি এসে বললেন, আমি সত্যিকারের মানুষ হলে তোমাকে স্পর্শ করতাম। সত্যিকারের মানুষ নই বলে স্পর্শ করতে পারছি না।

আমি বললাম, আমার কাছে আপনি তবুও সত্যিকারের মানুষ।

শুনে খুশি হলাম। রিতুন ক্লিস আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাবার আগে একটা শেষ কথা বলে যাই?

বলুন।

আমি সত্যিকারের মানুষ নই। যারা সত্যিকারের মানুষ তাদের নিয়ে কখনো নিজের সাথে প্রতারণা কোরো না।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, আপনি কী বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মহামান্য রিতুন।

বুঝতে না পারলে কথাটি তোমার জন্যে নয় ইবান। কিন্তু কখনো যদি বুঝতে পারো কথাটি মনে রেখো। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, আমাকে বিদায় দাও ইবান।

বিদায়। বিদায় মহামান্য রিতুন।

বিদায়– আমার একটু ভয়-ভয় করছে ইবান। ভয় এবং দুঃখ। তার সাথে একটু আনন্দ– তোমার মতো। একজন চমৎকার মানুষের সাথে পরিচয় হলো সেই আনন্দ।

আমারও খুব সৌভাগ্য মহামান্য রিতুন যে আপনার সাথে আমার পরিচয় হলো। আমার মা এখানে থাকলে খুব খুশি হতেন।

রিতুন ক্লিস কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তারপর নিচু এবং বিষণ গলায় বললেন, যদি তার সাথে দেখা হয় তাকে আমার ভালোবাসা জানিও। তাকে বলবে তিনি ঠিক কাজ করেছিলেন, সন্তানের বুকের মাঝে সবার আগে ভালোবাসা দিয়েছিলেন।

বলব।

রিতুন ক্লিস একটি হাত উপরে তুলে হঠাৎ করে মিলিয়ে গেলেন, আমার মনে হলো আমি মৃদু একটা আর্তচিৎকার শুনলাম তবে সেটি আমার মনের ভুলও হতে পারে। ঘরের ফাঁকা জায়গাটিতে তাকিয়ে আমি বুকের ভিতরে একধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। আমার মা সত্যি কথাই বলেছিলেন, রিতুন ক্লিস সত্যিই চমৎকার একজন মানুষ। ফোবিয়ানে আমার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সময় রিতুন ক্লিস না থাকলে কী সর্বনাশই-না হতো। পুরো গল্পটা যখন আমার মাকে শোনাবো আমার হাসিখুশি ছেলেমানুষি মা নিশ্চয়ই কী আগ্রহ নিয়েই-না শুনবেন। ব্যাপারটি চিন্তা করেই একধরনের আনন্দে আমার চোখ ভিজে ওঠে।

যোগাযোগ মডিউলটি ঠিক হওয়ার সাথে সাথে আমি মহাজাগতিক মূল কেন্দ্রে যোগাযোগ করার জন্যে তথ্য পাঠাতে শুরু করলাম। এপর্যন্ত যা ঘটেছে তার পুরো বর্ণনা দিয়ে আমি আমার মায়ের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম। তার আন্তঃগ্যালাক্টিক পরিচয়-সংখ্যা দিয়ে তিনি কোথায় আছেন সেটি খুঁজে বের করার জন্যে একটি অনুরোধ পাঠালাম। আনুষ্ঠানিকভাবে এটি অনুরোধ হলেও পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে এটি একটি নির্দেশ হিসেবেই বিবেচনা করার কথা। মহাজাগতিক মূল কেন্দ্র থেকে খবর ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে, আমি তার মাঝে ফোবিয়ানের অন্যান্য সমস্যাগুলো সারতে শুরু করে দিলাম।

বিদ্যুৎ সঞ্চালনের অংশটুকু সেরে তুলতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল। কাজটি সহজ হলেও বেশ সময়সাপেক্ষ, অভিজ্ঞ রবোটগুলি পুরো সময়টুকু একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছোটাছুটি করছিল। মহাকাশযানের ভেতরে সারাক্ষণই এক। ধরনের ছোটাছুটি এবং বিদ্যুতের ঝলকানি এবং তার সাথে হালকা ওজোনের গন্ধ। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের কাজটুকু শেষ হওয়ার পর আমি তাপ পরিবহনের অংশটুকুতে হাত দিলাম, তাপ সুপরিবাহী বিশেষ সংকর ধাতুর উজ্জ্বল টিউবগুলো অনেক জায়গাতেই দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে, ভেতরে তাপ পরিবাহী ত্বরণগুলো নানা জায়গাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলো পরিষ্কার করে টিউবগুলো পাল্টে দেয়ার কাজ শুরু করতে হলো। ফোবিয়ানের মূল পাম্পের বিভিন্ন অংশ থেকে টিউবগুলোর ভেতর দিয়ে তরলগুলো মহাকাশযানের নানা অংশে পাঠিয়ে পুরো পদ্ধতিটি বারবার পরীক্ষা করে দেখতে হলো।

ফোবিয়ানকে পুরোপুরি দাঁড় করানো বিশাল কাজ করতে করতে আমার সময়ের জ্ঞান ছিল না, ফোবিয়ানের অনুরোধে মাঝে মাঝে খেয়েছি মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়েছি। গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর আগে আমি মহাকাশযানটিকে তার আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে চাই।

এরকম সময়ে ফোবি আমাকে জানাল মূল মহাজাগতিক কেন্দ্রের সাথে আমাদের যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, চমৎকার! তাদের প্রতিক্রিয়া কীরকম?

ফোবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি নিজেই দেখুন মহামান্য ইবান।

আমি হাতের যন্ত্রপাতি নামিয়ে রেখে মনিটরের দিকে তাকালাম, মহাজাগতিক কেন্দ্রের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী হাত-পা নেড়ে ফোবিয়ানে যা ঘটেছে সেটা নিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে হড়বড় করে কথা বলছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মতো বড় একজন অপরাধীকে সার্বিকভাবে পরীক্ষা না করে ফোবিয়ানে তুলে দেয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। উপগ্রহটিতে সেই বিচিত্র প্রাণীদের নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছে এবং তাদের নিয়ে গবেষণা করার বিস্তারিত পরিকল্পনার বর্ণনা দিতে শুরু করেছে। ফোবিয়ানকে নিউট্রন স্টারের প্রবল মহাকর্ষ বল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার জন্যে আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে— আমি একধরনের কৌতুকমিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে তার কথা শুনতে লাগলাম। উচ্চপদস্থ কর্মচারীর দীর্ঘ বক্তব্য একসময় শেষ হলো এবং আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিতে গিয়ে হঠাৎ করে থেমে বলল, অধিনায়ক ইবান, তুমি একজন মহিলার খোঁজ নেয়ার জন্যে যে ট্রেসার পাঠিয়েছিলে সেটি ফিরে এসেছে। আমি সেসংক্রান্ত তথ্য তোমাকে পাঠালাম।

আমি চমকে উঠে সোজা হয়ে বসলাম, আমার মা সম্পর্কে তথ্য এসেছে যার অর্থ তাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। আমার বুক আনন্দে ছলাৎ করে ওঠে। মনিটরে কিছু অর্থহীন সংখ্যা এবং বিচিত্র প্রতিচ্ছবি খেলা করতে লাগল এবং হঠাৎ করে মনিটরে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে দেখতে পেলাম। মানুষটির বিষণ্ণ একধরনের চেহারা। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অধিনায়ক ইবান, আমি ঠিক কীভাবে খবরটি দেব বুঝতে পারছি না।

আমি চমকে উঠলাম, মানুষটি কী বলতে চাইছে?

তোমার মা খবর পেয়েছিলেন তুমি ফোবিয়ানে করে আসছ। তুমি কবে পৌঁছাবে সেটি জানার জন্যে তিনি মহাজাগতিক কেন্দ্রের সাথে প্রায় প্রতিদিন যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং সেটিই হয়েছে কাল।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যখন ফোবিয়ান নিউট্রন স্টারের মহাকর্ষ বলে আটকা পড়ে সেখানে বিধ্বস্ত হওয়ার উপক্রম হলো এবং হঠাৎ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তখন আমরা সবাই ভেবেছিলাম ফোবিয়ান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আধিনায়ক ইবান, তোমার মা যখন আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন আমরা তখন তাকে জানিয়েছিলাম যে নিউট্রন স্টারের মহাকর্ষ বলে আটকা পড়ে ফোবিয়ান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে– আমাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই।

আমি খুব দুঃখিত অধিনায়ক ইবান, এই খবরটিতে তোমার মায়ের বুক ভেঙে গেল। তোমাকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসতেন, তিনি কিছুতেই সেই ভয়ংকর আশাভঙ্গের দুঃখ থেকে উঠে আসতে পারলেন না। একদিন রাতে যখন জোড়া উপগ্রহ থেকে উথালপাথাল জোৎস্নার আলো, কালো সমুদ্রে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ছুটে এসেছে, তোমার মা তখন হেঁটে হেঁটে সেই সমুদ্রের ফুসে ওঠা পানির মাঝে হেঁটে গেলেন। সমুদ্রের পানি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমি খুব দুঃখিত অধিনায়ক ইবান পরদিন তার দেহ যখন বালুবেলায় ফিরে এসেছে সেটি ছিল প্রাণহীন।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বিষণ্ণ চোখে তাকাল, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার মা মৃত্যুর আগে একটা ছোট ভিডিও ক্লিপ রেখে গিয়েছেন। আমরা তোমার কাছে সেটা পাঠালাম।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি বিষণ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনিটর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার হঠাৎ করে মনে হলো বুকের ভিতরটি ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, ফোবিয়ানের বিশাল কক্ষ জটিল যন্ত্রপাতি উজ্জ্বল আলো, গোল জানালা দিয়ে বাইরের কালো মহাকাশ এবং উজ্জল নেবুলা এবং মনিটরের উপর সাজিয়ে রাখা আমার মায়ের জন্যে সৌভাগ্য-বৃক্ষ সবকিছু কেমন জানি অর্থহীন মনে হতে থাকে। আমার চোখের সামনে সবকিছু কেমন জানি অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে, নিশ্চয়ই চোখ ভিজে আসছে। আমি হাতের উল্টো পৃষ্ঠা দিয়ে চোখ মুছে মনিটরে তাকালাম সেখানে আমার মায়ের ভিত্তি ও ক্লিপটি দেখা যাচ্ছে আমি হাত বাড়িয়ে সেটি স্পর্শ করতেই হঠাৎ করে ঘরের মাঝখানে আমার মা জীবন্ত হয়ে উঠলেন, তার কালো চুল বাতাসে উড়ছে, আকাশের মতো দুটি নীল চোখে গভীর বেদনা। আমার মা ঘুরে অনিশ্চিতের মতো তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, আমি আর পারছি না, খুব আশা করেছিলাম যে ছেলেটাকে দেখব, বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাব। হলো না। এক নিঃসঙ্গ একটি মহাকাশযানে আমার সোনার টুকরো ছেলেটি নিউট্রন স্টারের প্রবল আকর্ষণে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেল। প্রাচীনকালে মানুষ বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর একজন মানুষ আকাশের নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকে। আমারও সেটা খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে আমার সোনামনি ইবান আকাশের একটি নক্ষত্র হয়ে বেঁচে আছে।

আমার মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার সোনামনি ইবানের কাছে আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। আমিও সেই নক্ষত্রের পাশাপাশি অন্য একটি নক্ষত্র হয়ে থাকব। উথালপাথাল জোছনায় একটু পরে যখন কালো সমুদ্রের পানি ফুসে উঠবে আমি তখন তার মাঝে হেঁটে হেঁটে যাব। আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

আমার মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন, সমুদ্রের বাতাসে তার চুল উড়তে লাগল, তার উজ্জ্বল চোখ দুটো গভীর বেদনায় নীল হয়ে রইল। আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখ পানিতে ভরে উঠল, আমার মা অস্পষ্ট হয়ে এলেন। ঠিক তখন শুনতে পেলাম কেউ একজন আমাকে ডাকল, ইবান।

আমি ঘুরে তাকালাম। ফোবিয়ানের দরজা ধরে মিত্তিকা দাঁড়িয়ে আছে। সে শান্ত পায়ে হেঁটে এসে আমাকে আঁকড়ে ধরে বলল, বুড়োমতো একজন মানুষ আমাকে জাগিয়ে তুলে বলেছে তুমি ইবানের কাছে যাও। আজ তার জন্যে খুব দুঃখের দিন। কী হয়েছে ইবান? আজ কেন তোমার জন্যে দুঃখের দিন?

আমার মা মারা গেছেন মিত্তিকা।

মারা গেছেন? তোমার মা?

হ্যাঁ।

কেমন করে মারা গেলেন?

আমার মা ভেবেছিলেন ফোবিয়ান নিউট্রন স্টার ধ্বংস হয়ে গেছে, আমিও ধ্বংস হয়ে গেছি। সেটা ভেবে আমার মা এত কষ্ট পেলেন যে–

যে?

আর বেঁচে থাকতে চাইলেন না। আমার মা সমুদ্রের পানিতে হেঁটে হেঁটে চিরদিনের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

মিত্তিকা একধরনের বেদনার্ত মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, আমি খুব দুঃখিত ইবান। আমি খুব দুঃখিত।

আমি মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তার নীল দুটি চোখে এক আশ্চর্য গভীর বেদনা— ঠিক আমার মায়ের মতন। আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুকের ভিতরে এক বিচিত্র আলোড়ন অনুভব করলাম, এক বিচিত্র নিঃসঙ্গতা হঠাৎ করে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমার রিতুন ক্লিসের কথা মনে পড়ল, তিনি বলেছিলেন আমি যেন নিজেকে প্রতারণা না করি। আমি করলাম না, মিত্তিকার হাত ধরে ফিসফিস করে বললাম, মিত্তিকা

কী হয়েছে, ইবান?

আমি— আমি বড় একা।

মিত্তিকা গভীর মমতায় আমার হাত ধরল। আমি কাতর গলায় বললাম, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, মিত্তিকা।

মিত্তিকা গভীর ভালোবাসায় আমার মুখমণ্ডল স্পর্শ করে বলল, যাব না। আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না ইবান।

হঠাৎ করে ঘরের মাঝামাঝি একটা ছায়া পড়ল, আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে রিতুন ক্লিস দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি ভেবেছিলাম আপনি চলে গিয়েছেন রিতুন ক্লিস।

হ্যাঁ আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমাকে একা ফেলে যেতে পারছিলাম না ইবান।

ধন্যবাদ রিতুন ক্লিস। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তোমাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল আমি তাই মিত্তিকাকে জাগিয়ে দিলাম। মনে হলো মিত্তিকা হয়ত তোমার পাশে থাকতে পারবে। মানুষের অবলম্বন লাগে— মানুষ যত শক্তই হোক তার একজন অবলম্বন দরকার, তার পাশে একজনকে থাকতে হয়।

আমার জন্যে আপনার ভালোবাসা আমি কখনো ফিরিয়ে দিতে পারব না।

তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ ইবান। আমি তাই এখন যেতে পারব। তোমাকে ছেড়ে আমি যেতে পারব। রিতুন ক্লিস তার বিষণ্ণ মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন, বিদায় ইবান। বিদায় মিত্তিকা!

আমি আর মিত্তিকা হাত নাড়লাম, বললাম, বিদায়।

রিতুন ক্লিসের ছায়ামূর্তি খুব ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। চিরদিনের মতোই।

» ৯. ফোবিয়ানের দুই নিঃসঙ্গ যাত্রী

মহাকাশ নিকষ কালো অন্ধকার, তার মাঝে অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। কোথাও নেবুলার রক্তিম ঘূর্ণন, কোথাও ধোয়াটে গ্যালাক্সি। কোথাও কোয়াজারের উজ্জ্বল নীলাভ আলো, কোথাও অদৃশ্য ব্ল্যাকহোলের আকর্ষণে আটকে পড়া নক্ষত্রে তীব্র আলোকছটা। সেই আদি নেই অন্ত নেই অন্ধকার হিমশীতল মহাকাশ দিয়ে নিঃশব্দে ছুটে চলছে ফোবিয়ান। নিঃসঙ্গ এই মহাকাশযানে দুজন যাত্রী। আমি এবং মিত্তিকা।

ফোবিয়ানের দুই নিঃসঙ্গ যাত্রী।

———-

নির্ঘণ্ট

১. নিও পলিমার : পোশাক হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে নতুন ধরনের পলিমার (কাল্পনিক)।

২. বায়োডোম : জীবন রক্ষাকারী বিশাল গোলক (কাল্পনিক)।

৩. ভিডি টিউব : যোগাযোগের জন্যে বিশেষ ভিডিও সংযোগ (কাল্পনিক)।

৪. হলোগ্রাফিক : আলোর ব্যতিচার ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক ছবি দেখানোর বিশেষ পদ্ধতি।

৫. জিন : মানুষের ক্রমোজমে যে অংশটুকু জৈবিক বৈশিষ্ট বহন করে।

৬. জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং : জিনের পরিবর্তন করে জৈবিক বৈশিষ্ট পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।

৭. গ্রিশিন গ্রহ : উল্কাপাতে বায়োডোম ধ্বংস হয়ে বসবাসকারী মানুষের মৃত্যু হয়েছিল যে গ্রহে (কাল্পনিক)।

৮, ব্ল্যাকহোল : প্রবল মহাকর্ষ বলে সৃষ্ট Singularity, যেখান থেকে আলো পর্যন্ত বের হতে পারে না।

৯. কারগো বে : মহাকাশযানের যেখানে পরিবহন করার জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয় (কাল্পনিক)।

১০. নিউরণ : মস্তিষ্কের কোষ।

১১. সিনান্স : নিউরণদের মাঝে যোগাযোগ হওয়ার সংযোগস্থান।

১২. নিউরাল নেটওয়ার্ক : মানুষের মস্তিষ্কের অনুকরণে সৃষ্ট নেটওয়ার্ক।

১৩, মস্তিষ্ক ম্যাপিং : একজন মানুষের মস্তিষ্ককে সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়া (কাল্পনিক)।

১৪. জিনম ল্যাবরেটরি : মানুষকে জন্ম দেওয়ার কৃত্রিম পদ্ধতি যে ল্যাবরেটরিতে ব্যবহার করা হয় (কাল্পনিক)।

১৫. প্ল্যাসেন্টা : মাতৃগর্ভে সন্তান যে অংশ দিয়ে মায়ের দেহ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে।

১৬. মেটা ফাইল : যে ফাইলে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণ করা যায় (কাল্পনিক)।

১৭. স্কাউটশিপ : মূল মহাকাশযান থেকে আশেপাশে যাওয়ার জন্যে ছোট মহাকাশযান (কাল্পনিক)।

১৮. প্রতিপদার্থ : পদার্থের সংস্পর্শে এসে যেটি শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

১৯, প্লাজমা : পদার্থের চতুর্থ অবস্থা আয়োনিত গ্যাস।

২০. এক্সরে লেজার : কয়েক এংস্ট্রম তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দিয়ে তৈরি লেজার।

২১. নিহিলিন ১৮ : যে ড্রাগ খেয়ে দীর্ঘ সময় না ঘুমিয়ে থাকা যায় (কাল্পনিক)।

২২. তরল হিলিয়াম তাপমাত্রা : শূন্যের নিচে প্রায় দুইশত সত্ত্বর ডিগ্রি সেলসিয়াস।

২৩. নিউট্রন স্টার; যে নক্ষত্রে পরমাণু ভেঙে নিউক্লিয়াস সম্মিলিত হয়ে যায়।

২৪. হাইব্রিড : যে মানুষের ভিতরে তার জৈবিক সত্তার পাশাপাশি একটি যান্ত্রিক সত্তা বিরাজ করে (কাল্পনিক)।

২৫. বায়োমার : মানুষের শরীরের ওপর ব্যবহার করার জন্যে একটি বিশেষ পলিমার (কাল্পনিক)।

২৬. হোয়াইট ডোয়ারফ : নক্ষত্রের বিবর্তনে একটি বিশেষ পর্যায়।

২৭. আয়ন : পরমাণুতে প্রয়োজন থেকে বেশি কিংবা কম ইলেকট্রনের উপস্থিতি

২৮. গ্যালাক্টিক অবস্থান নির্ধারণ মডিউল : যে যন্ত্র দিয়ে গ্যালাক্সিতে যে-কোনো জায়গার অবস্থান নিখুঁতভাবে জানা যায় (কাল্পনিক)।

২৯. গ্লকোনাইট : অচিন্ত্যনীয় বিস্ফোরণের ক্ষমতাসম্পন্ন দুষ্প্রাপ্য খনিজ (কাল্পনিক)।

৩০. এটমিক ব্লাস্টার : শক্তিশালী পরমাণু দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের অস্ত্র (কাল্পনিক)।

৩১. জেট প্যাক : শরীরের সাথে লাগানো ক্ষুদ্রকায় জেট ইঞ্জিন যেটি একজন মানুষকে উড়িয়ে নিতে পারে (কাল্পনিক)।

৩২. কোয়ারেন্টাইন কক্ষ : যে কক্ষে কোনো কিছুকে জীবাণু মুক্ত করা হয়।

৩৩. আন্ট্রাভায়োলেট রশ্মি : যে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থেকে ছোট।

৩৪. জিনেটিক প্রোফাইল : একজন মানুষের জিনের বিন্যাস।

৩৫. কপোট্রন : কৃত্রিম মস্তিষ্ক (কাল্পনিক)।

৩৬. ট্রান্সক্র্যানিয়াল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেটর : উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এবং উচ্চ কম্পনের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দিয়ে মস্তিষ্কের বাইরে থেকে মস্তিষ্কের ভিতরে সংবেদন সৃষ্টি করার বিশেষ যন্ত্র।

৩৭. স্লিংশট : মহাকর্ষ বল ব্যবহার করে মহাকাশযানের গতিপথে শক্তি প্রয়োগের পদ্ধতি।

৩৮. সিনান্স মডিউল : মস্তিষ্কের ভিতরে কোথায় আলোড়ন সৃষ্টি হয় সেটি খুঁজে বের করার বিশেষ যন্ত্র (কাল্পনিক)।

৩৯. নিহিলা : মানুষকে দীর্ঘ সময় অচেতন রাখার বিশেষ ধরনের গ্যাস (কাল্পনিক)।

Exit mobile version