Site icon BnBoi.Com

ফিনিক্স – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ফিনিক্স – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১. প্রভু ক্লড

ফিনিক্স – সায়েন্স ফিকশান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

পূর্বকথা

ভাইরাসটির নাম ছিল ইকুয়িনা, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহার করে বললে বলতে হয় ইকুয়িনা। বি. কিউ. ২৩–৪৯। যে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার দীর্ঘদিন গবেষণা করে এই ভাইরাসটি দাঁড়া করিয়েছিলেন ভাইরাসটিকে তার নামে নামকরণ করা হয়েছিল। বিজ্ঞানী ইকুয়িনা কখনো কল্পনাও করেন নি এই ভাইরাসটি ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের বাইরে যেতে পারবে তা হলে তিনি নিশ্চয়ই কিছুতেই নিজের নামটি ব্যবহার করতে দিতেন না। কিন্তু এই ভাইরাসটি ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের বাইরে গিয়েছিল, কারো কোনো ভুলের জন্য নয়, কোনো দুর্ঘটনাতেও নয়–এটি বাইরে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর নির্দেশে। সময়টি ছিল পৃথিবীর জন্যে খুব অস্থির একটা সময়, পৃথিবীর দরিদ্র দেশ আর উন্নত দেশগুলোর মাঝে তখন এক ভালবাসাহীন নিষ্ঠুর সম্পর্ক। পারমাণবিক বোমা আর মারণাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয় না, এটি সবার কাছেই আছে, যেকোনো মুহূর্তে যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে–নতুন ধরনের একটা অস্ত্রের খুব প্রয়োজন, ঠিক তখন ইকুয়িনা ভাইরাসটি যুদ্ধবাজ জেনারেলদের চোখে পড়ে। যদিও তখনো এটি পৃথিবীর একটি মানুষেরও মৃত্যুর কারণ হয় নি কিন্তু সবাই জানত মানুষকে হত্য করার জন্যে এর চাইতে নিশ্চিত কোনো ভাইরাস পৃথিবীর বুকে কখনো সৃষ্টি হয় নি। কোনো জীবিত মানুষের ওপর এটি পরীক্ষা করে দেখা হয় নি তবুও বিজ্ঞানীরা এর ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার কথা জানতেন। সংক্রমণের প্রথম সপ্তাহে কিছু বোঝা যাবে না, দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথমে খুশখুশে কাশি এবং অল্প মাথাব্যথা দিয়ে শুরু হয়ে কয়েকদিনের ভেতরে তীব্র মাথাব্যথা এবং জ্বর শুরু হবে। ধীরে ধীরে সেটা মস্তিষ্কের প্রদাহে রূপ নেবে, সপ্তাহ শেষ হবার আগে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে এমনভাবে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যাবে যে দেখে মনে হবে মানুষটির পুরো দেহটি বুঝি একটি গলিত মাংসপিণ্ড। যে দেহ একটি মাত্র ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, প্রতি বিন্দু রক্ত তখন কোটি কোটি ইকুয়িনা ভাইরাসে কিলবিল করতে থাকবে। এই ভাইরাস বাতাসে ভর করে চোখের পলকে কয়েক শ কিলোমিটার ছড়িয়ে পড়তে পারে। কোনো ভাবে একটি ভাইরাসও যদি মানুষের শরীরে স্থান নিতে পারে সেই মানুষটির বেঁচে যাবার কোনো উপায় নেই। এর কোনো প্রতিষেধক নেই, এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই। আক্রান্ত মানুষটির মৃত্যু হবে যন্ত্রণাদায়ক এবং নিশ্চিত একেবারে এক শ ভাগ নিশ্চিত, এবং সেইটি ছিল সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়।

সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় শ্রেণীর বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা করার চেষ্টা করলেন। তাঁরা ভাইরাসটির মাঝে সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলেন যেন ভাইরাসটি সব মানুষের ওপরে কার্যকরী না হয়ে শুধুমাত্র বিশেষ একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে সংক্রমিত হয়–তা হলে যুদ্ধবাজ জেনারেলরা সেটাকে বিশেষ দেশের বিশেষ মানুষের ওপর ব্যবহার করতে পারবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবছিল, পরিবর্তিত ইকুয়িনা ভাইরাসটি ছিল তাদের সেই ভয়ংকর পৈশাচিক স্বপ্নের উত্তর। সেই পৈশাচিক গবেষণাটি সফল হয় নি সেটা কিন্তু সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় শ্রেণীর বিজ্ঞানীরা জানতেন না। গোপন একটা ফিল্ড টেস্ট করতে গিয়ে ইকুয়িনা ভাইরাসটি পৃথিবীতে মুক্ত হয়ে যায়। আফ্রিকায় একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলের পুরো দ্বীপবাসী দুই সপ্তাহের মাঝে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার খবরটি পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল এবং সেই গোপনীয়তাটুকু ছিল পুরোপুরি অর্থহীন কারণ ততক্ষণে সারা পৃথিবীর সকল মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মৌসুমি বাতাসে ইকুয়িনা ভাইরাস ইউরোপ–এশিয়া হয়ে উত্তর আমেরিকায় এবং অস্ট্রেলিয়া হয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে যায়। পরবর্তী দুই সপ্তাহের মাঝে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পৃথিবীর বুকে যে ভয়াবহ আতঙ্কের জন্ম নিল তার কোনো তুলনা নেই, এই ভাইরাসের ভয়াবহ থাবা থেকে কোনো মুক্তি নেই সেটি সাধারণ মানুষ তখনো জানত না, বেঁচে থাকার জন্যে তাদের উন্মত্ত আকুলতা সেই ভয়াবহ দিনগুলোকে আরো। ভয়াবহ করে তুলল।

দুই মাসের মাঝে পৃথিবীর ছয় বিলিয়ন মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, বেঁচে রইল একেবারে হাতেগোনা কিছু শিশু এবং কিশোর। প্রকৃতির কোন রহস্যের কারণে এই হাতেগোনা অল্প কয়জন শিশু–কিশোর ইকুয়িনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে সেটি কেউ জানে না, সেই রহস্য খুঁজে বের করার মতো কোনো মানুষ তখন পৃথিবীতে একজনও বেঁচে নেই।

তারপর পৃথিবীতে আরো দুই শতাব্দী কেটে গিয়েছে। ইকুয়িনা ভাইরাসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সেই শিশু এবং কিশোরের বংশধরেরা পৃথিবীতে একটা নূতন সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। পুরোনো পৃথিবী, তার জ্ঞান বিজ্ঞান–ইতিহাসের কোনো স্মৃতি কারো মাঝে নেই। পৃথিবীর নানা অংশে যাযাবরের মতো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা মানুষেরা পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার মাঝে ঘুরে বেড়ায়। নানা ধরনের কুসংস্কার, কিছু সহজাত প্রবৃত্তি এবং বেঁচে থাকার একেবারে আদিম তাড়নার ওপর ভর করে মানুষগুলো বিচিত্র একটি পৃথিবীতে টিকে থাকার চেষ্টা করে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে তারা নিজের পরিবার নিজের গোষ্ঠীকে রক্ষা করে আবার প্রয়োজনে হিংস্র পশুর মতো অন্য গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। বড় বড় ট্রাকে করে তারা পৃথিবীর লোহিত মৃত্তিকায় ধূলি উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়, পৃথিবীর মানুষের হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার মাঝে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে বেড়ায়।

বেঁচে থাকার এক কঠিন প্রক্রিয়ায় তাদের সাহায্য করে তাদের নিজস্ব ঈশ্বর। কিংবা ঈশ্বরী।

১. প্রভু ক্লড

রিহান আধো ঘুমের মাঝে অনুভব করল কেউ একজন তার কাঁধে আলতোভাবে স্পর্শ করেছে। মুহূর্তের মাঝে রিহানের ঘুম ভেঙে যায়, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে ধরে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, কে?

মানুষটি নিচু গলায় বলল, আমি।

রিহান অস্ত্রটি নিচে নামিয়ে রেখে বলল, ও! তুমি? মানুষটি তাদেরই একজন, প্রতি রাতে সে পাহারার ডিউটি ভাগাভাগি করে দেয়। মাঝরাতে একবার ঘুরে ঘুরে দেখে সবাই ঠিকমতো তাদের ডিউটি করছে কি না। রিহান অপরাধীর মতো বলল, বসে থাকতে থাকতে চোখে ঘুম চলে এসেছিল।

মানুষটি উত্তর না দিয়ে নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করল।

রিহান বলল, আর হবে না, দেখে নিও।

মানুষটি আবার নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে বলল, চল।

রিহান ভয় পাওয়া গলায় বলল, কোথায়?

গ্রাউসের কাছে।

গ্রাউস! রিহান চমকে উঠে বলল, গ্রাউসের কাছে কেন? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আর কখনো এরকম হবে না। আমি বসবই না–

আহ! মানুষটি হাত তুলে রিহানকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সেজন্য নয়। তুমি ডিউটিতে জেগে আছ না ঘুমিয়ে আছ সেটা নিয়ে গ্রাউস মাথা ঘামায়?

তা হলে কী জন্যে ডাকছে?

আমি কেমন করে বলব? মানুষটি হাত নেড়ে বলল, গ্রাউস আমাকে কখনো বলবে?

রিহান অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল, মানুষটি ঠিকই বলেছে। গ্রাউস তাদের দলপতি, এতজন মানুষের দায়িত্ব তার ওপর। তাদের মতো ছোটখাটো মানুষের জন্য গ্রাউসের দেখা পাওয়াই একটি কঠিন ব্যাপার। তারপরও সে চেষ্টা করল, জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই জান না কেন ডেকেছে? আন্দাজও করতে পারবে না?

না। এখন এটা নিয়ে সময় নষ্ট কোরো না। তাড়াতাড়ি চল। গ্রাউস অপেক্ষা করছে।

রিহান ইতস্তত করে বলল, এখানে ডিউটি করবে কে?

মানুষটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, সে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমার কাছে অস্ত্রটা দিয়ে তুমি যাও, তাড়াতাড়ি।

রিহান অস্ত্রটি মানুষটির হাতে দিল, মানুষটি সেটা হাতে নিয়ে তার কপালে স্পর্শ করে তারপর ম্যাগাজিনে ঠোঁট স্পর্শ করে সম্মান প্রদর্শন করে। এটি দ্বিতীয় মাত্রার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই সম্মান প্রদর্শন করা যায়। লেজার গাইডেড স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো হাতে নিলে হাঁটু গেড়ে সম্মান দেখাতে হয়।

রিহান দুশ্চিন্তিত মুখে আবছা অন্ধকারে তাদের আস্তানার দিকে হাঁটতে থাকে। তাদের আস্তানায় সব মিলিয়ে সাতচল্লিশটি নানা আকারের ট্রাক আর লরি রয়েছে। কাটাতার দিয়ে ঘিরে তার ভেতরে ট্রাকগুলো গোল করে ঘিরে রাখা হয়েছে, হঠাৎ করে কোনো দল আক্রমণ করলে চট করে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। রিহান হেঁটে হেঁটে গ্রাউসের লরিটা খুঁজে বের করল, এটি তুলনামূলকভাবে বড়, ইঞ্জিনটি শক্তিশালী। রিহান পেছনের দরজায় শব্দ করতেই সেটা খুট করে খুলে গেল। ভেতরে হলুদ রঙের একটা অনুজ্জ্বল আলো জ্বলছে, গ্রাউস দরজা থেকে সরে গিয়ে বলল, এস রিহান। ভিতরে এস।

রিহান তীক্ষ্ণ চোখে গ্রাউসের মুখের ভাবভঙ্গি লক্ষ করার চেষ্টা করল, মানুষটির মুখে বড় বড় দাড়ি–গোফ, চোখ দুটো স্থির এবং ভাবলেশহীন, দেখে মনের ভাব বোঝা যায় না।

রিহান কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে ডেকেছ গ্রাউস?

হ্যাঁ। গ্রাউস আরো কিছু বলবে ভেবে রিহান অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু গ্রাউস কিছু বলল না, একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল।

রিহান একটু ইতস্তত করে বলল, আমাকে কেন ডেকেছ?

তোমাকে দেখার জন্যে।

রিহান অবাক হয়ে বলল, আমাকে দেখার জন্যে?

হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম তুমি আরো বড়। কিন্তু তুমি তো দেখছি একেবারে বাচ্চা ছেলে।

রিহান জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, না মহামান্য গ্রাউস, আমি মোটেও বাচ্চা ছেলে নই। গত শীতে আমার বয়স সতের হয়েছে। আমি এখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালাতে অনুমতি পেয়েছি। রিকি বলেছে আমাকে একটা মোটরবাইক দেবে। আট সিলিন্ডারের।

গ্রাউস কোনো কথা না বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তার কথাগুলো শুনেছে কি না রিহান ঠিক বুঝতে পারল না। কী কারণ জানা নেই, রিহান হঠাৎ এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করতে থাকে, চাপা এক ধরনের ভয় হঠাৎ তার ভেতরে দানা। বাধতে শুরু করে। গ্রাউস আবার একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, রিহান।

বলো, গ্রাউস।

তুমি কী করেছ?

আমি? রিহান চমকে উঠে বলল, আমি কী করব?

কিছু কর নি?

রিহান দ্রুত চিন্তা করতে থাকে, সে কি অস্বাভাবিক বা অন্যায় কিছু করেছে? তেরো নম্বর লরিটির হাসিখুশি কিশোরী মেয়েটির সাথে একটু ঠাট্টা-মশকরা করেছে, লরির দেয়ালে চেপে ধরে একটু চুমু খাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এই বয়সের ছেলেমেয়েরা তো সেটা করেই। থাকে, সেটা তো এমন কিছু বড় অন্যায় নয়। মেয়েটা রাগ হবার ভান করেছে কিন্তু আসলে তো রাগ হয় নি, একটু পরেই তো লরির উপর থেকে তার মাথায় আধ বোতল গ্যাসোলিন। ঢেলে হি হি করে হেসেছে।

মনে করতে পারছ না?

গ্রাউসের কথায় চমকে উঠে রিহান বলল, না গ্রাউস। আমি তো কিছুই মনে করতে পারছি না। বিশ্বাস কর

গ্রাউস হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে তীব্র গলায় বলল, তা হলে কেন প্রভু ক্লড তোমার সাথে দেখা করতে চাইছেন?

রিহান আতঙ্কে শিউরে উঠে গ্রাউসের দিকে তাকাল, কথাটি শুনেও যেন বুঝতে পারছে, কিংবা বুঝতে পারলেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, প্রভু ক্লড আ–আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন?

হ্যাঁ।

আ–আমার সাথে?

হ্যাঁ। তোমার সাথে। গ্রাউস শীতল গলায় বলল, এখন বলো, কেন?

রিহানের হঠাৎ মনে হতে থাকে তার হাঁটুতে কোনো জোর নেই। এর আগে যারা প্রভু ক্লডের সাথে দেখা করতে গিয়েছে এবং কখনো ফিরে আসে নি হঠাৎ করে তাদের কথা মনে পড়ে যায়। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে কোনোমতে দুই পা পিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ করে তার মনে হতে থাকে কেউ বুঝি তার সারা শরীরের শক্তি শুষে নিয়েছে। সে কাঁপা গলায় বলল, বিশ্বাস কর গ্রাউস, আমি কিছু করি নি

গ্রাউস কিছুক্ষণ রিহানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, তাই যেন সত্যি হয় রিহান।

রিহান এক ধরনের কাতর গলায় বলল, আমি এখন কী করব গ্রাউস?

গ্রাউস জোর করে একবার হাসার চেষ্টা করে বলল, প্রভু ক্লড তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন আর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ কী করবে? তুমি এক্ষুনি দেখা করতে যাও। প্রভু ক্লড তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

কেমন করে যাব গ্রাউস?

আর্মাড কারের লাল দরজার সাসনে গিয়ে দাঁড়াও, ভেতর থেকে এসে তোমাকে ডেকে নেবে।

রিহান তবুও দেয়াল স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে রইল। গ্রাউস কঠিন গলায় বলল, যাও রিহান। দেরি কোরো না।

রিহান অনেক কষ্ট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর ঘুরে লরির দরজা খুলে বের হয়ে এল। পাটাতন থেকে নিচে নেমে এসে সে তাদের আস্তানার মাঝখানে তাকায়, ছয়টি আর্মাড কার বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভেতরে প্রভু ক্লডের নিজস্ব আর, ভি,, বাইরে থেকে কখনো সেটা দেখা যায় না। রিহান অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে তাকায়, এই এলাকাটি মরুভূমির মতো, রাত্রিবেলা আকাশটি একেবারে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো ঝকঝক করতে থাকে। আকাশের অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে, প্রতিদিন দেখার পরও নক্ষত্রগুলোকে কেমন যেন অচেনা মনে হয়। মরুভূমির শুকনো হাওয়া বইছে, বাতাসের শব্দটি কেমন যেন হাহাকারের মতো শোনায়, কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে রিহানের বুকের ভেতর বিচিত্র এক ধরনের শূন্যতা এসে ভর করে। রিহান কয়েক মুহূর্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, মরুভূমির শীতল বাতাসের জন্যেই কিনা কে জানে হঠাৎ তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।

বুকের ভেতরে আটকে থাকা চাপা একটা নিশ্বাসকে বের করে দিয়ে রিহান সামনে এগিয়ে যায়। বড় আর্মাড কারের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে তার নিজেকে বড় অসহায় মনে হতে থাকে। সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, রাতের অন্ধকারে বড় বড় লরি এবং ট্রাকগুলোকে অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো মনে হয়। চারদিকে জমাট–বাধা অন্ধকার এবং নিঃশব্দ, শুধুমাত্র পাওয়ার স্টেশন থেকে চাপা গুঞ্জনের মতো একটা শব্দ আসছে। রিহানের মনে হতে থাকে বড় বড় লরির জানালা দিয়ে অন্ধকারকে আড়াল করে সবাই তার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে, সবার চোখে আতঙ্ক। হঠাৎ তার ইচ্ছে হতে থাকে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে, কিন্তু তার সাহস হয় না। সে স্থাণুর মতো আর্মাড কারের লাল দরজার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।

রিহান কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানে না, হঠাৎ খুট করে দরজাটা খুলে গেল, ভেতরে আবছা অন্ধকার তার মাঝে রিহান শুনতে পেল নারী কন্ঠে কেউ তাকে চাপা গলায় ডাকল, ভেতরে এস।

রিহান সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসতেই কাচক্যাচ শব্দ করে পিছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। রিহান ভিতরে তাকাল, আসবাবপত্রহীন একটি ধাতব কন্টেইনার। কন্টেইনারের ঠিক মাঝখানে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটির পোশাক খুব সংক্ষিপ্ত এবং সেই পোশাকের ভেতর দিয়ে তার সুগঠিত শরীর দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির ধাতব রঙের চুলগুলো বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। মেয়েটির চোখের পাতায় নীল রঙ, ঠোঁট দুটো টকটকে লাল। যে কোনো হিসেবে মেয়েটি সুন্দরী কিন্তু চেহারায় কোনো এক ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে সেটি কী রিহান ঠিক ধরতে পারল না। মেয়েটির বুকের উপরে বুলেটের একটি বেল্ট, ডান হাতে তৃতীয় মাত্রার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আলগোছে ধরে রাখা। মেয়েটি শুকনো এক ধরনের খসখসে গলায় বলল, রিহান, তুমি দুই হাত পাশে ছড়িয়ে রেখে এক পা এগিয়ে এস।

গলার স্বর শুরে রিহান হঠাৎ করে মেয়েটিকে চিনতে পারল, মেয়েটি দৃনা, ছয় নম্বর লরিতে থাকত, আজ থেকে চার বছর আগে হঠাৎ করে একদিন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কী আশ্চর্য! দৃনা এখানে? প্রভু ক্লডের কাছে? রিহান চাপা গলায় বলল, দৃনা! তুমি এখানে? আমরা ভেবেছিলাম

দৃনা রিহানকে বাধা দিয়ে যান্ত্রিক গলায় বলল, দুই হাত পাশে ছড়িয়ে এগিয়ে এস।

রিহান থতমত খেয়ে থেমে গিয়ে হতচকিত ভাবে দৃনার দিকে তাকাল, ভাবলেশহীন এক ধরনের মুখ, সেখানে অনুভূতির কোনো চিহ্ন নেই। রিহান একটা নিশ্বাস ফেলে দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে দিয়ে এক পা এগিয়ে আসে। দৃনা দক্ষ মানুষের মতো রিহানের শরীর সার্চ করে, নির্বিকারভাবে তার জম্মদেশ, বুকে, পিঠে হাত দিয়ে দেখে সামনে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে বলল, আমার সাথে এস।

রিহান হাঁটতে থাকে। সামনে আর্মাড কারের দরজা খুলে রিহান বের হয়ে আসতেই প্রভু ক্লডের বিশাল আর. ভি. টি দেখতে পেল। জানালায় হালকা নীল আলো জ্বলছে, উপরে কয়েকটি বিচিত্র ধরনের এন্টেনা, দেখে মনে হয় কোনো ধরনের স্থাপত্যকর্ম। দৃনা নিচু গলায় বলল, যাও।

রিহান কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

সামনে গেলেই দরজা দেখতে পাবে। দরজা খুলে ঢুকে যাও। দৃনা একমুহূর্ত থেমে বলল, আর শোন, কখনোই সরাসরি প্রভু ক্লডের চোখের দিকে তাকাবে না।

রিহান মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে, তাকাব না।

প্রভু তোমাকে অনুমতি দিলেই শুধু কথা বলবে, নিজে থেকে একটি কথাও বলবে না।

বলব না।

মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন করবে।

ঠিক আছে দৃনা।

বের হবার সময় কখনো প্রভুর দিকে পিছন দেবে না।

দেব না।

মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে না।

রিহান মাথা নেড়ে বলল, দাঁড়াব না।

হে প্রভু ক্লড, হে ঈশ্বর-পুত্র বলে তাকে সম্বোধন করবে।

ঠিক আছে দৃনা।

যাও। এবার ভেতরে যাও।

রিহান একমুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, তুমি কি জান প্রভু ক্লড আমাকে কেন ডেকেছেন?

দৃনা বলল, না, জানি না।

রিহান কাতর গলায় বলল, না, আমার খুব ভয় করছে। তুমি কি আমার জন্যে বাইরে অপেক্ষা করবে?

দৃনা তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, যাও। ভেতরে যাও।

রিহান একটা নিশ্বাস ফেলল, তারপর সাহস সঞ্চয় করে বিশাল আর. ডি. টির দিকে এগিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে একটু উপরে একটি দরজা। দরজাটি বন্ধ, হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই দরজাটি খুলে গেল। ভেতরে হালকা নীল রঙের একটা আলো জ্বলছে। রিহান নিশ্বাস নিতেই ক্ষীণ বাসি ফুলের মতো এক ধরনের গন্ধ পেল। রিহানের বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করছে, তার ভেতর কোনোভাবে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দৃনা তাকে মাথা তুলে তাকাতে নিষেধ করেছে, সে মাথা তুলে তাকাল না। লাল নরম কার্পেটের উপর দাঁড়িয়ে সে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আর, ভি.য়ের অন্যপাশে হঠাৎ কাপড়ের এক ধরনের খসখসে শব্দ শুনতে পায়–রিহান মাথা উঁচু করে সেদিকে তাকাতে সাহস পেল না, মাথা নিচু করে অভিবাদন করল।

রিহান শুনল প্রভু ক্লড বললেন, আমার দিকে তাকাও, ছেলে তোমার চেহারাটা দেখি।

ভারী ভরাট গলা, ঘরে তার কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল। দৃনা সোজাসুজি প্রভু ক্লডের দিকে তাকাতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু রিহান প্রভু ক্লডের আদেশ অমান্য করতে সাহস পেল না। রিহান মাথা তুলে ক্লডের দিকে তাকাল, দুজন প্রথমবারের মতো দুজনকে দেখতে পেল।

প্রভু ক্লডের মাথায় ধবধবে সাদা চুল এবং দাড়ি, পরনে লম্বা সাদা আলখাল্লা। মুখে বয়সের বলিরেখা, চোখ দুটো আশ্চর্য রকম নীল। তার চোখের দৃষ্টি এত তীব্র যে রিহান বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না, সে চোখ নামিয়ে নিল।

প্রভু ক্লড জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে, তোমাকে আমি কেন ডেকেছি জান?

রিহান মাথা নাড়ল, বলল, না, প্রভু ক্লড, আমি জানি না।

তুমি অনুমান করতে পার?

পারি না প্রভু ক্লড। আমি অনুমান করতে পারি না।

প্রভু ক্লড কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ শীতল গলায় বললেন, গত পরশু দিন তুমি পাওয়ার স্টেশনে কী করেছিলে?

রিহানের হঠাৎ বুক কেঁপে উঠল, সে আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠে বলল, প্রভু ক্লড, ঈশ্বরপুত্র, আমার ভুল হয়েছিল। আমার খুব বড় ভুল হয়েছিল।

প্রভু কুড হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ভুল না শুদ্ধ আমি তোমার কাছে সেটি জানতে চাইছি না ছেলে–আমি জানতে চেয়েছি সেখানে কী হয়েছিল।

আপনি সব জানেন প্রভু।

তবু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।

রিহান তবু চুপ করে রইল, তখন প্রভু ক্লড কঠিন গলায় বললেন, বলো।

রিহান কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, পাওয়ার স্টেশনের সামনে আমার ডিউটি পড়েছিল প্রভু ক্লড, হঠাৎ সেটা অদ্ভুত এক রকম শব্দ করতে লাগল। কয়েকটা যন্ত্র থেমে কেমন যেন সংকেতের মতো শব্দ বের হতে লাগল। তখন– রিহান কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায়।

বলো ছেলে। তখন কী হল?

আমি তখন পাওয়ার স্টেশনের কাছে গেলাম।

একটি নবম মাত্রার যন্ত্রের কাছে তুমি অনুমতি না নিয়ে গেলে? অপবিত্রভাবে গেলে? সম্মান প্রদর্শন না করে গেলে?

রিহান কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রভু ক্লড শীতল গলায় বললেন, তারপর কী হল?

আমি আমি পাওয়ার স্টেশনটি পরীক্ষা করে দেখলাম। দেখলাম একটা পানির টিউব ফেটে গেছে, পানি যাচ্ছে না। স্টেশনটি গরম হয়ে যাচ্ছে। আমি তখন– রিহান আবার চুপ করে যায়।

তখন? তখন কী?

রিহান মাথা তুলে কাতর গলায় বলল, আমাকে ক্ষমা করুন। প্রভু ক্লড–ক্ষমা করুন।

প্রভু ক্লড কঠিন গলায় বললেন, তখন কী?

রিহান ভাঙা গলায় বলল, তখন আমি পানির পাইপটা পাল্টে দিয়েছি।

কী দিয়ে পাল্টে দিয়েছ?

পুরোনো ট্রাকে সেরকম একটা পাইপ ছিল, সেটা খুলে।

তুমি কী দিয়ে খুলেছ?

আমার কাছে একটা প্লায়ার্স ছিল।

তুমি কোথায় পেয়েছ প্লায়ার্স?

রিহান পুরোপুরি ভেঙে গিয়ে বলল, যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে চুরি করেছি প্রভু ক্লড।

কেন চুরি করেছ?

আমার–আমার

তোমার কী?

আমার যন্ত্রপাতি দিয়ে খেলতে ভালো লাগে প্রভু ক্লড। যন্ত্র কেমন করে কাজ করে আমার জানতে ইচ্ছে করে, বুঝতে ইচ্ছে করে– কথা বলতে বলতে রিহানের গলা ভেঙে গেল। সে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে যায়, দুই হাত জোড় করে অনুনয় করে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু ক্লড। হে ঈশ্বরপুত্র হে করুণাময়

প্রভু ক্লড নরম গলায় বললেন, রিহান–

গলার স্বর শুনে রিহান চমকে উঠে আশান্বিত চোখে প্রভু ক্লডের দিকে তাকাল, বলুন প্রভু।

তুমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালাতে পার?

পারি। রিহান গলার স্বরে খানিকটা উৎসাহ ঢেলে বলল, আমার বয়স সতের হবার পর আমাকে শেখানো হয়েছে। আমি রাত্রিবেলা ডিউটি করি মহামান্য প্রভু ক্লড।

তোমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির কী হয়েছিল?

রিহানের মুখ হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে যায়, তার সারা শরীর আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। সে মাথা নিচু করে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু ক্লড।

কী হয়েছিল তোমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের?

সেটি জ্যাম হয়ে গিয়েছিল।

অস্ত্র জ্যাম হয়ে গেলে কী করতে হয়?

তাকে সম্মানের সাথে অস্ত্রাগারে ফেরত দিয়ে নূতন অস্ত্র নিতে হয়।

আর, তুমি কী করেছিলে?

রিহান একমুহূর্তের জন্যে মাথা উঁচু করে আবার মাথা নিচু করে বলল, আমি অস্ত্রটি ঠিক করেছিলাম প্রভু ক্লড।

কীভাবে ঠিক করেছিলে?

আমি সেটা খুলেছিলাম। খুলে পরিষ্কার করেছিলাম। যেখানে যেখানে জং ধরেছিল সেখানে গ্রিজ লাগিয়েছিলাম।

তখন সেটি ঠিক হয়েছিল?

হয়েছিল প্রভু ক্লড।

প্রভু ক্লড কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে, তোমার অস্ত্রটি জ্যাম হয়েছিল কেন?

রিহান কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রইল। প্রভু ক্লড শান্ত গলায় বললেন, আমার কথার উত্তর দাও ছেলে।

আমি অস্ত্রটিতে পানি ঢেলেছিলাম।

কেন পানি ঢেলেছিলে?

কী হয় দেখার জন্যে। অস্ত্রে কীভাবে জং ধরে বোঝার জন্যে।

বুঝে কী হবে?

ভবিষ্যতে অস্ত্রগুলো রক্ষা করা যাবে।

তুমি কী বুঝেছ?

রিহান কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রইল। প্রভু ক্লড জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আর কী কী করেছ রিহান?

আপনি সব জানেন। আপনি প্রভু ক্লড। আপনি ঈশ্বরপুত্র ঈশ্বর। আপনি সর্বজ্ঞ। আপনি মহাশক্তিমান।

তবুও আমি তোমার মুখেই শুনতে চাই ছেলে। বলো।

রিহান কাঁপা গলায় বলল, আমি বুলেট ভেঙে দেখেছি তার ভিতরে কী আছে।

কী আছে?

কালো রঙের এক ধরনের পাউডার।

কী হয় সেই পাউডার দিয়ে?

আগুন জ্বালালে বিস্ফোরণ হয়।

সেই পরীক্ষা করতে গিয়ে তোমার কী হয়েছিল?

রিহান নিচু গলায় বলল, আপনি সর্বজ্ঞ। আপনি জানেন। আমার হাত পুড়ে গিয়েছিল।

তুমি চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলে?

না মহামান্য প্রভু।

কেন যাও নি?

আমি ভয় পেয়েছিলাম।

রিহান হাঁটু ভেঙে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, প্রভু ক্লড হেঁটে তার খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ সময় কেউ কোনো কথা বলল না। একসময় প্রভু ক্লড একটি নিশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বললেন, ছেলে, তুমি কি জান এই পৃথিবীতে কী হয়েছিল?

রিহান মাথা নাড়াল, বলল, না প্রভু। আমি জানি না।

এই পৃথিবীতে একসময় ছয় বিলিয়ন মানুষ ছিল।

রিহান মাথা তুলে বিস্তারিত চোখে প্রভু ক্লডের দিকে তাকাল, বলল, ছয় বিলিয়ন?

হ্যাঁ। একদিন তারা সব মরে গিয়েছিল। কেন জান?

জানি না প্রভু ক্লড।

প্রভু ক্লড তীব্র স্বরে বললেন, তোমার মতো মানুষের জন্যে। তাদের কৌতূহলের জন্যে। প্রভু ক্লড কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মানুষের সেই সভ্যতা শেষ হয়ে গেছে ছেলে। এখন পৃথিবীতে নূতন সভ্যতার জন্ম হয়েছে। এই সভ্যতায় কৌতূহলের কোনো স্থান নেই।

আমার ভুল হয়েছে প্রভু।

এই সভ্যতায় মানুষকে রক্ষা করার জন্যে আমরা আমাদের জীবনকে উৎসর্গ করেছি।

আমরা জানি প্রভু। আমরা সে জন্যে কৃতজ্ঞ।

আমরা তোমাদের প্রভু হয়েছি। তোমাদের ঈশ্বর হয়েছি। তোমাদের সাহায্য করার জন্যে আমরা সর্বজ্ঞ হয়েছি।

আপনাদের দয়া। আপনাদের মহানুভবতা।

আমি প্রভু ক্লড হয়ে তোমাদের প্রায় অর্ধশতাব্দী থেকে রক্ষা করে আসছি। এই সুদীর্ঘ সময়ে কেউ আমার আশাভঙ্গ করে নি। ঠিক যেভাবে চেয়েছি সেভাবে চলে এসেছে। তুমি–

রিহানের সারা শরীর হঠাৎ আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠল। প্রভু কুডের গলায় হঠাৎ এক আশ্চর্য কাঠিন্য এসে ভর করে, তুমি প্রথমবার আমাকে নিরাশ করেছ। তুমি নিউক্লিয়ার রি–একটরের কুলিং নিয়ে খেলা করেছ। তুমি জান নিউক্লিয়ার রি–একটর কী? তুমি জান রেডিয়েশান কী? তুমি জান কোর মেন্টডাউন কী? জান না–কিন্তু তার পরও তুমি সেখানে হাত দিয়েছ! নির্বোধ ছেলে প্রচণ্ড রেডিয়েশানে আমরা সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারতাম!

রিহান কোনো কথা বলল না, মাথা নিচু করে হাঁটু ভেঙে বসে রইল। প্রভু ক্লড আবার বললেন, তুমি বারুদের মাঝে আগুন দিয়েছ। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নষ্ট করেছ? সেটা খুলে ফেলেছ! তুমি জান এর অর্থ কী?

রিহান মাথা নাড়ল, বলল, জানি না প্রভু। আমি মূর্খ। আমি নির্বোধ। আমি তুচ্ছ–

এর অর্থ তুমি অনেক কষ্ট করে তৈরি করা আমাদের এই পদ্ধতিটি অস্বীকার করেছ।

রিহান মাথা নেড়ে বলল, না প্রভু না। আমি অস্বীকার করতে চাই নি। আমার ভুল হয়েছে। আমার অনেক বড় ভুল হয়েছে।

প্রভু ক্লড একটা নিশ্বাস ফেলে হঠাৎ কোমল গলায় বললেন, তুমি কেন এটা করেছ ছেলে? তুমি কেন এই নিয়ম ভেঙেছ?

রিহান প্রভু ক্লডের গলায় কোমল স্নেহের আভাস পেয়ে প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, আমার মনে হয়েছিল

কী মনে হয়েছিল?

এই যন্ত্র তো মানুষ তৈরি করেছে। মানুষের তৈরি যন্ত্রকে কেন আমাদের উপাসনা করতে হবে? আমরা কেন যন্ত্রকে বুঝতে চেষ্টা করব না?

তোমার তাই মনে হয়েছিল?

জি মহামান্য ঈশ্বরপুত্র। আমার কাছে মনে হয়েছিল এই নিয়মটি একটি বাহুল্য। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি যন্ত্রের উপাসনা করা না হলেও সেগুলি কাজ করে।

তুমি সেটি পরীক্ষা করেছ?

জি মহামান্য প্রভু ক্লড।

প্রভু ক্লড বললেন, তুমি জান তুমি একটি খুব বড় অপরাধ করেছ। যে প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে আমাদের পুরো সভ্যতাটি গড়ে উঠেছে তুমি সেই প্রক্রিয়াটিকে অবিশ্বাস করেছ। অসম্মান করেছ।

রিহান কাতর গলায় বলল, আমি বুঝতে পারিনি, মহামান্য প্রভু।

যে যন্ত্রের ওপর নির্ভর করে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, তুমি সেই যন্ত্রকে অসম্মান করেছ।

আমার ভুল হয়েছে। রিহান মাথা নিচু করে বলল, আপনি আমাকে শাস্তি দিন।

প্রভু ক্লড কয়েক মুহূর্ত রিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী শাস্তি চাও?

আপনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন আমি সেই শাস্তি মাথা পেতে নেব।

প্রভু ক্লড একটি নিশ্বাস ফেলে কঠোর গলায় বললেন, আমি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম।

রিহান ভয়ংকর আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে ওঠে। দুই হাত জোড় করে কাতর গলায় বলল, না, প্রভু না। আমাকে অন্য কোনো শাস্তি দিন। আমাকে বেঁচে থাকতে দিন। একটিবার মাত্র একটিবার সুযোগ দিন

প্রভু ক্লড স্থির দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রিহান মাথা নিচু করে ভাঙা গলায় বলল, আমায় ক্ষমা করুন প্রভু। ক্ষমা করুন। আমি ভুল করেছি, আর আমি ভুল করব না। আমাকে মাত্র একটিবার সুযোগ দিন

রিহান মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল ঘরে কেউ নেই। প্রভু ক্লড ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছেন। রিহান পাগলের মতো উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় হাহাকার করে বলল, প্রভু ক্লড! প্রভু—প্রভু–

হঠাৎ করে রিহান অনুভব করে তার দুইপাশ থেকে দুজন তাকে শক্ত করে ধরেছে। রিহান মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, মুখে রঙ মাখা দুজন মেয়ে। ধাতব রঙের চুলগুলো মাথার উপরে চুড়োর মতো করে বাঁধা। মেয়ে দুটো আলগোছে একটা করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখেছে।

রিহান উন্মাদের মতো ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল, কিন্তু পারল না। ঠিক তখন কে জানি তার মাথায় পিছন থেকে আঘাত করে।

চোখের সামনে তার সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। গভীর বিষাদে তার হৃদয় হাহাকার করে ওঠে। এই কি তা হলে মৃত্যু?

মরুভূমি

মোটরবাইকের এক ধরনের কর্কশ শব্দ শুনতে শুনতে রিহান জ্ঞান ফিরে পেল। তার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি এবং মুখের উপর বাতাসের ঝাঁপটা–তাকে নিশ্চয়ই মোটরবাইকের পিছনে বসিয়ে একটা স্ট্যান্ডের সাথে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রিহান চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, নিশ্চয়ই কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। মরুভূমির শীতল বাতাসে তার শরীর অবশ হয়ে আসতে চায়, তার ভেতরে যন্ত্রণায় শরীরের ভেতরে কেঁপে কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছে মাথাটা ছিঁড়ে পড়ে যাবে। হাত দুটো পেছনে শক্ত করে বাঁধা, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হাত দুটোতে কোনো অনুভূতি নেই বলে মনে হচ্ছে। রিহান কান পেতে শুনল–আশপাশে একাধিক মোটরবাইকের শব্দ। একসাথে বেশ কয়েকজন তাকে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় কে জানে। রিহান হাত দুটো নাড়িয়ে বাধনটা একটু ঢিলে করার চেষ্টা করল, কোনো লাভ হলো না কিন্তু হঠাৎ করে রক্ত সঞ্চালনের একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল।

রিহানের সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে আছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আবার সে চেতনা হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু তার ভিতরেও অনেক কষ্টে সে নিজেকে জাগিয়ে রাখল। তাকে কারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে জানে না, কিন্তু অনুমান করতে পারে–নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবে হাতের বাধন খুলতে পারলে তবুও সে বাচার একটা শেষ চেষ্টা করতে পারে। রিহান আবার চেষ্টা করে দেখল, বাঁধনটা খুলতে পারল না কিন্তু মনে হয় একটু ঢিলে হল। রিহান নিশ্বাস বন্ধ করে চেষ্টা করতে থাকে, বাঁধনটা না খুলেও সে যদি কোনোভাবে একটা হাত বের করে আনতে পারে তা হলেও সে একবার বাঁচার চেষ্টা করে দেখতে পারে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করে সে বাম হাতটাকে টেনে বের করে আনার চেষ্টা করে, হাত কেটে রক্তাক্ত হয়ে যায় তবু সে হাল ছাড়ে না, একসময় মনে হতে থাকে সে বুঝি কখনোই পারবে না তবুও সে দাঁতে দাঁত চেপে লেগে রইল। যখন মনে হল আর কিছুতেই পারবে না তখন হঠাৎ করে বাম হাতটা খুলে এল। সাথে সাথে হাতের তীব্র যন্ত্রণাটা ম্যাজিকের মতো কমে যায়, অন্ধকারে হাত ঘষে ঘষে রিহান হাতের মাঝে রক্ত সঞ্চালন করতে থাকে।

রিহান শুনতে পেল যারা মোটরবাইক চালাচ্ছে তারা নিজেদের মাঝে কথা বলছে মোটরবাইকের প্রচণ্ড শব্দে কথা স্পষ্ট বোঝা গেল না, রিহানের মনে হল তারা কোথাও থামার কথা বলছে। দেখা গেল সত্যিই তাই, তার মোটরবাইকটা খানিকটা ঘুরে বেশ হঠাৎ করেই থেমে গেল। রিহান বাঁধা অবস্থায় অচেতন হয়ে থাকার ভান করে, বুঝতে পারে তার দুই পাশে আরো দুটি মোটরবাইক থেমেছে এবং সেখান থেকে মানুষগুলো নেমে এসেছে। একজন বলল, জ্ঞান হয়েছে নাকি?

রিহান গলার স্বরটি চিনতে পারল না, সে দুই হাত একসাথে করে অচেতন হওয়ার ভান করে রইল। ভালো করে লক্ষ না করলে কেউ সহজে বুঝতে পারবে না তার হাতগুলো খোলা। রিহান অনুভব করল একজন মানুষ সাবধানে তাকে স্পর্শ করে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, না, এখনো অজ্ঞান হয়ে আছে।

জ্ঞান আর ফিরবে না। জানতেই পারবে না কী হয়েছে– কথাটা খুব ভালো একটা রসিকতা এরকম ভঙ্গি করে মানুষটা উচ্চ স্বরে হেসে উঠল, কিন্তু অন্য কেউ তার হাসিতে যোগ দিল না।

ছেলেটাকে খুলে এই খাদের কাছে নিয়ে এস–গুলি করে নিচে ফেলে দেব।

ঠিক আছে।

রিহান অনুভব করল দুজনে মিলে তার শরীরের বাধন খুলে ফেলছে, উত্তেজনায় তার বুক ধকধক করতে থাকে, যদি দেখে ফেলে সে হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছে তা হলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে, কিন্তু মানুষগুলো সেটা বুঝতে পারল না। কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা তাই সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না, হয়তো এখানে অন্ধকার। রিহান টের পেল তাকে ধরাধরি করে মানুষগুলো খাদের কাছে নিয়ে এসেছে, সে তার শরীর শক্ত করে রাখে, ঠিক বুঝতে পারছে না কী করবে। হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠে ছুটে পালানোর চেষ্টা করবে? নাকি কাউকে জাপটে ধরে তার অস্ত্রটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করবে?

রিহান শুনল একজন বলল, কে গুলি করবে?

ভারী গলায় একজন বলল, আমি করবো না। আমার খুনোখুনি ভালো লাগে না।

অন্য একজন বলল, খুনোখুনি করতে কি আমাদের ভালো লাগে নাকি? করতে হয় বলে করি। মনে আছে সেবার কী হল তানিয়াকে নিয়ে?

রিহানের বুক ধকধক করতে থাকে, তানিয়া নামের একটি মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল বছর দুয়েক আগে। তাকেও মেরে ফেলেছিল এরা? ঈশ্বর ক্লডের আদেশে? কী করেছিল তানিয়া?

আমি বলি কী—

কী?

লটারি করে বের করি কে গুলি করবে।

এই কাজের জন্যে লটারি করতে হবে। এই দ্যাখো আমি গুলি করি–

রিহান লাফিয়ে উঠে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে শুনতে পেল, আহা–এত তাড়া কীসের? করা যাক লটারি, মজা হবে খানিকটা। শেষ রাতে একটু মজা হোক না।

কীভাবে লটারি করবে?

এই যে পাথরটা কোন হাতে আছে বলতে হবে। যে হারবে সে গুলি করবে। কী বলো?

ঠিক আছে।

রিহান শুনতে পায় মানুষগুলো কথা বলতে বলতে একটু দূরে সরে গিয়ে লটারি করতে থাকে। এটাই তার সুযোগ—-শেষ সুযোগ। রিহান নিঃশব্দে হাত দিয়ে চোখের বাধা কাপড়টা খুলে তাকাল। এতক্ষণ চোখ বাঁধা ছিল বলেই কিনা কে জানে আবছা অন্ধকারে সে বেশ স্পষ্ট দেখতে পেল তিনটা মোটরবাইক পাশাপাশি দাঁড় করানো। দুটোর ইঞ্জিন বন্ধ করানো, তৃতীয়টি ধুকধুক করে চলছে। তার হেডলাইট জ্বালিয়ে খানিকটা আলোর ব্যবস্থা করা আছে। রিহান মনে মনে হিসেব করে সে যদি হঠাৎ করে মোটরবাইকটার ওপরে উঠে বসতে পারে তা হলে পালানোর একটা সুযোগ আছে। মানুষগুলো ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতে একটু সময় লাগবে তার মাঝে সে অনেকদূর সরে যেতে পারবে। তখন সবাই মিলে তাকে গুলি করার চেষ্টা করবে, পিছু পিছু ধাওয়া করবে কিন্তু মনে হয় তার মাঝেও তার পালিয়ে যাবার একটা ভালো সম্ভাবনা আছে।

রিহান বুক ভরে একটা নিশ্বাস নেয়, হঠাৎ করে সে তার সারা শরীরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। চোখের কোনা দিয়ে সে মানুষ তিনজনকে দেখে তারপর সাবধানে উঠে গুঁড়ি মেরে মোটরবাইকটার দিকে এগুতে থাকে। আবছা অন্ধকার থাকায় মানুষগুলো প্রথম দুএক সেকেন্ড তাকে দেখতে পায় নি, হঠাৎ করে একজন তাকে দেখে চিৎকার করে উঠল। রিহান তখন লাফিয়ে উঠে ছুটে মোটরবাইকটার উপর বসে এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে সোজা মানুষগুলোর দিকে ছুটে যায়। মানুষগুলো নিজেদের বাঁচানোর জন্যে লাফিয়ে সরে গেল এবং রিহান পোড়া টায়ারের গন্ধ ছুটিয়ে তাদের ভেতর দিয়ে গুলির মতো বের হয়ে গেল। মরুভূমির বিস্তৃত পাথুরে সমতলের উপর দিয়ে সে ছুটে যেতে থাকে, মরুভূমির শীতল বাতাসে তার চুল উড়তে থাকে, বাতাস চোখে–মুখে কেটে কেটে বসতে শুরু করে।

কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই সে গুলির শব্দ শুনতে পেল। তার কানের কাছ দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে বুলেট ছুটে যেতেই সে তার মোটরবাইকের হেডলাইট বন্ধ করে দিল। অন্ধকার অপরিচিত মরুপ্রান্তর, যে কোনো মুহূর্তে একটা বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে সে ছিটকে পড়তে পারে কিন্তু রিহান এই মুহূর্তে সেটি তার মাথা থেকে জোর করে সরিয়ে রাখল। রিহান মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল অন্য দুটি মোটরবাইক তাকে ধরার জন্যে ছুটে আসছে, ধরে না ফেললেও গুলির আওতায় পেয়ে যাবে কিছুক্ষণের মাঝে, তখন কী

মোটরবাইকটিকে এলোমেলোভাবে ছুটিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ করে রিহান হতবুদ্ধি হয়ে যায়, বিশাল একটা খাদের দিকে সে ছুটে যাচ্ছে। কী করছে চিন্তা না করেই সে চলন্ত মোটরবাইক থেকে লাফিয়ে পড়ল, প্রায় সাথে সাথে মোটরবাইকটা প্রায় উড়ে গিয়ে খাদের মাঝে পড়ে এবং কয়েক সেকেন্ড পরে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, সাথে সাথে আগুনের হলকা উপরে উঠে আসে।

রিহান প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দাতে দাঁত চেপে কোনোভাবে নিজেকে অচেতন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করল। কোনোভাবেই এখন তাকে অজ্ঞান হয়ে গেলে চলবে না। মানুষগুলো কয়েক মিনিটের মাঝে এখানে চলে আসবে, তার মাঝে তাকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। যেভাবে হোক।

রিহান মাটিতে ঘষে ঘষে প্রায় সরীসৃপের মতো নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকে। বড় বড় কিছু পাথর আছে কয়েক মিটার দূরে, তার পিছনে চলে যেতে পারলে সে নিজেকে লুকিয়ে নিতে পারবে। শরীরের কোনো হাড় ভেঙেছে কি না সে জানে না, কপালের এক পাশ থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে বাম চোখটা বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের সামনে একটা কালো পরদা নেমে আসতে চাইছে বারবার, অনেক কষ্টে রিহান নিজেকে জাগিয়ে রেখে নিজেকে টেনে নিতে থাকে। অমানুষিক একটা পরিশ্রম করে শেষ পর্যন্ত নিজেকে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে সে বড় বড় নিশ্বাস নিতে লাগল।

কিছুক্ষণের মাঝেই খুব কাছাকাছি দুটো মোটরবাইক এসে থামল। মানুষগুলো অস্ত্র হাতে নেমে আসে। খাদের পাশে দাঁড়িয়ে তারা বিধ্বস্ত জ্বলন্ত মোটরবাইকটা দেখার চেষ্টা করতে থাকে। একজন মাথা উচিয়ে জিজ্ঞেস করল, দেখা যাচ্ছে?

অন্যজন উত্তর করল, কী দেখতে চাও?

ছেলেটাকে।

কত গভীর খাদ দেখেছ? এখান থেকে দেখবে কেমন করে?

প্রথম মানুষটা চিন্তিত মুখে বলল, তা হলে ঈশ্বর ক্লডকে কী বলব?

যেটা সত্যি সেটাই বলব।।

সেটা কী? ছেলেটা বেঁচে আছে না মরে গেছে?

এখান থেকে পড়লে কেউ বেঁচে থাকতে পারে?

কিন্তু—

কিন্তু কী?

আমরা তো কখনোই নিশ্চিত হতে পারব না।

আমরা না পারলেও ঈশ্বর ক্লড নিশ্চিত হবেন। ঈশ্বর ক্লড সব জানেন।

তা ঠিক।

মোটা গলার মানুষটা হেঁটে খাদের খুব কাছাকাছি গিয়ে বলল, যদি ছেলেটা বেঁচেও থাকে, এই মরুভূমিতে একা একা চব্বিশ ঘণ্টার বেশি বেঁচে থাকতে পারবে না।

তা ঠিক।

তোমার লটারির বুদ্ধি না শুনে তখনই যদি কানের নিচে একটা গুলি করে দিতাম তা হলে একটা মোটরবাইক নষ্ট হত না।

ছেলেটার কত বড় সাহস দেখেছ? প্রভু ক্লড মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন তার পরেও বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। লাভ হল কিছু?

একটা মোটরবাইক নষ্ট হল।

চল যাই।

খাদে নেমে কি দেখতে চাও?

দেখতে চাইলে দিনের বেলায় আসতে হবে। এখন অন্ধকারে নামা যাবে না।

তা ঠিক।

মানুষগুলো নিচু গলায় কথা বলতে বলতে ফিরে যেতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই রিহান মোটরবাইক দুটোর ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে পেল। ফাঁকা মরুভূমিতে দীর্ঘ সময় সে সেই শব্দ শুনতে পায়, বহুদূর থেকে সেই শব্দ তার কাছে ভেসে আসছে।

মানুষগুলো চলে যাবার পর রিহান নিজেকে পরীক্ষা করে দেখল, শরীরের কোনো হাড় ভাঙে নি, কিছু জায়গা থেতলে গেছে, চটচটে রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। খানিকক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে রিহান বড় বড় নিশ্বাস নিল, তারপর উঠে বসল। এই এলাকা থেকে তাকে সরে যেতে হবে–যতদূর সম্ভব।

নক্ষত্রের আলোতে রিহান উত্তর দিকে হেঁটে যেতে শুরু করে, একটু পরপর তার মাথায় একটা অশুভ চিন্তা এসে ভর করতে থাকে, এই নির্জন নির্বান্ধব মরুভূমিতে সে কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবে? রিহান জোর করে চিন্তাটা তার মাথা থেকে সরিয়ে রাখে।

সূর্যের আলো প্রখর না হওয়া পর্যন্ত সে হেঁটে গেল। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় তার ভেতরটুকু পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে, একটু পরপর ক্লান্তিতে তার সমস্ত শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে কিন্তু তবুও সে থামল না। যখন আর হাঁটতে পারছিল না তখন থেমে সে একটা বড় পাথরের উপরে উঠে চারদিকে দেখার চেষ্টা করে। দূরে কোথাও কোনো পরিত্যক্ত আবাসভূমি, গুদামঘর, ধসে যাওয়া ফ্যাক্টরি, বা অন্য কিছু আছে কি না খুঁজে দেখে। সূর্যের প্রখর আলোতে চারদিক ধিকিধিকি করে জ্বলছে। বহুদূরে পশ্চিমে কিছু ধসে যাওয়া বাড়িঘর আছে বলে মনে হল। সেগুলো পাথরের স্তূপও হতে পারে। এত দূর থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। রিহান চারদিকে তাকিয়ে গাছপালা খোজার চেষ্টা করে কিন্তু কোথাও সবুজের কোনো চিহ্ন নেই। রিহান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে পাথর থেকে নেমে আসে, কোনো একটা বড় পাথরের ছায়ায় সে এখন বিশ্রাম নেবে, সূর্য ঢলে গিয়ে অন্ধকার হওয়ার পর সে পশ্চিম দিকে হেঁটে যাবে।

প্রচণ্ড তৃষ্ণা এবং ক্ষুধায় কাতর হয়ে সে পাথরের ছায়ায় ঘুমানোর চেষ্টা করল। তার চোখে ঘুম এল না কিন্তু ভয়ংকর ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়েছিল বলে ছাড়া ছাড়া ভাবে মাঝে মাঝে ঘুমের মতো এক ধরনের অচেতনার অন্ধকারে ঢলে পড়ছিল, আবার ঘুম ভেঙে চমকে চমকে সে জেগে উঠছিল। ধীরে ধীরে সূর্যের আলো তীব্র হয়ে ওঠে, তার মাঝে রিহান একটা বড় পাথরের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে। শরীরের নানা অংশ প্রচণ্ড ব্যথায় অসাড় হয়ে আছে, রিহান তার মাঝে সূর্য ঢলে পড়ার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। সূর্য ঢলে পড়ে তাপমাত্রাটা মোটামুটি সহনীয় হয়ে যাবার পর রিহান উঠে বসে তারপর নিজেকে টেনে টেনে এগিয়ে নিতে থাকে।

রিহান ভালো করে চিন্তা করতে পারে না, তার মনে হতে থাকে হয়তো তার প্রভু ক্লডের কাছে গিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া উচিত তা হলে হয়তো মৃত্যুর আগে এক আঁজলা পানি খেতে পারবে। টলটলে ঠাণ্ডা পানি। চুমুক দিয়ে খাবার আগে সে হয়তো খানিকটা পানি নিজের মুখে ছিটিয়ে দিয়ে শীতল করে নেবে নিজের শরীরকে।

রিহান নিশ্বাস ফেলে চিন্তাটাকে মন থেকে দূর করে দেয়, তারপর ক্লান্ত দেহকে টেনে টেনে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণ পরপর তাকে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে, সে আর নিজেকে টেনে নিতে পারছে না। শরীরের সমস্ত চামড়া শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে, ক্ষতে মুখের ভেতরে এক ধরনের নোনা স্বাদ ছিল এখন সেখানে কোনো অনুভূতি নেই, জিবটা মনে হয় একটা শুকনো কাঠ। বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে তার মাঝে ধুকে ধুকে সে নিজেকে টেনে নিতে থাকে। পশ্চিমে যে এলাকাটাকে সে ধসে যাওয়া প্রাচীন বাড়িঘর মনে করছে সেটা কতদূর সে জানে না, সেটা সত্যিই প্রাচীন বাড়িঘর কি না কিংবা সত্যি সত্যি সেখানে সে পৌঁছতে পারবে কি না সেটাও সে জানে না, তারপরেও সে এগুতে থাকে। নিজেকে টেনে নিতে নিতে মাঝে মাঝে সে দাঁড়িয়ে যায়, রাতের নানা বিচিত্র শব্দ শোনা যায় তখন, নিশ্বাস বন্ধ করে সে পরিচিত শব্দ শোনার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু শুনতে পায় না। গতীর রাতে বহুদূর থেকে সে একটা ইঞ্জিনের চাপা গর্জন শুনতে পেল। কিসের ইঞ্জিন? কোনো লোকালয়ের? কোথায় আছে তারা।

ভোর রাতের দিকে রিহান থামল। সে পশ্চিম দিকে হেঁটে যাবার চেষ্টা করছে কিন্তু অন্ধকারে কোন দিকে হেঁটেছে সে জানে না, একটা গোলকধাঁধার মতো কি সারাক্ষণ ঘুরপাক। খেয়েছে? কী হবে এখন? হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল জীবনের সাথে যুদ্ধে সে হেরে গেছে। এই ভয়ংকর নির্জন মরুভূমিতে সে বেঁচে থাকতে পারবে না, প্রভু ক্লডের মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে আসলে তার মুক্তি নেই। রুক্ষ বিবর্ণ পাথরে তার মৃতদেহ পড়ে থাকবে, শুকনো বালুতে সেটি বিবর্ণ ধূসর হয়ে একসময় মাটিতে মিশে যাবে। রিহান ভালো করে চিন্তা করতে পারছিল না, মাথার ভেতরে দপদপ করছে, সে কেমন যেন একটা ঘোরের মাঝে রয়েছে। চারপাশে কী হচ্ছে সেটাও সে দেখতে পারছে না, হঠাৎ করে মনে হচ্ছে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।

ভোরের আলো ফোঁটার আগেই রিহান একটা বড় পাথরের পাশে অচেতন হয়ে পড়ল। ভোরের প্রথম আলোতে একটা সরীসৃপ সাবধানে তাকে পরীক্ষা করে সরে যায়। একটা বিষাক্ত বিছে তার খুব কাছে দিয়ে ছুটে গেল। কিছু গুবরে পোকা গর্তের ভেতর থেকে বের হয়ে ইতস্তত ছোটাছুটি করতে থাকে। একটা ছোট মাকড়সা একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে চারদিক পরীক্ষা করতে শুরু করে।

রিহান ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল সে একটা সবুজ বাগানে ঝরনার কাছে বসে আছে। চারপাশে কচি সবুজ পাতা নড়ছে, পাখি ডাকছে কিচিরমিচির করে। রিহান ঝরনার কাছে এগিয়ে যায়, ঝরনার পানিতে পা ডুবিয়ে সে এক আঁজলা পানি নিয়ে মুখে দেওয়ার চেষ্টা করতেই ঝরঝর করে পানিটুকু তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। আবার চেষ্টা করল সে, আবার পানিটুকু পড়ে গেল। পাগলের মতো আবার চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হল না, কিছুতেই সে মুখে পানি দিতে পারছে না। কে যেন হা–হা করে হেসে উঠেছে, মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে সামনে প্রভু ক্লড দাঁড়িয়ে আছেন। কঠোর মুখে বললেন, না, রিহান তুমি পানি খেতে পারবে না। আমি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। তোমার কোনো মুক্তি নেই।

রিহান কাতর গলায় বলল, আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু। ক্ষমা করুন।

প্রভু ক্লড হা–হা করে হেসে উঠে বললেন, ক্ষমা করব? তোমাকে? কক্ষনো না। তারপর হাত তুলে বললেন, নিয়ে যাও ওকে আমার সামনে থেকে।

দুজন মানুষ তখন তাকে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। তাকে নেবার জন্যে অনেকগুলো মানুষ মোটরবাইকে করে আসতে থাকে। আস্তে আস্তে মোটরবাইকের গর্জন বাড়তে থাকে, ভোঁতা কর্কশ গর্জন। একসময় প্রচণ্ড গর্জনে তার কানে তালা লেগে যায়–চোখ খুলে তাকাল রিহান। সে এখনো বেঁচে আছে? একটা ভোঁতা কর্কশ গর্জন শুনতে পেল সে। মোটরবাইকের গর্জন? প্রভু ক্লডের অনুচরেরা তাকে ধরতে আসছে? এটি কি স্বপ্ন না। সত্যি?

রিহান চিন্তা করতে পারে না, কোনো কিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায় না। সে আবার চোখ বন্ধ করল, চোখ বন্ধ করেও সে মোটরবাইকের গর্জন শুনতে পেল–মাটিতে সে কম্পন অনুভব করল। হঠাৎ করে গর্জন থেমে যায়, তখন মানুষের পায়ের শব্দ আর কণ্ঠস্বর শুনতে পায় রিহান। মনে হয় অনেক দূর থেকে কারো গলার স্বর ভেসে আসছে। কেউ একজন বলছে, দেখো। একটা মানুষ মরে পড়ে আছে।

রিহানের মনে হল অনেক মানুষ তাকে ঘিরে ভিড় করছে। কে একজন তাকে স্পর্শ করল, তারপর বলল, না, না এখনো মরে নি।

কী আশ্চর্য! বেঁচে আছে? বেঁচে আছে এখনো?

রিহান অনেক কষ্ট করে চোখ খুলে তাকাল, ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু অশরীরী প্রাণী তাকে ঘিরে রেখেছে। রিহান কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু বলতে পারল না, শুকনো অসাড় জিবটাকে সে নাড়াতে পারল না, শুধু ঠোঁট দুটো নড়ল একবার। অচেতনার অন্ধকারে ডুবে যাবার আগে সে আরো একবার বলার চেষ্টা করল, পানি। কিন্তু সে বলতে পারল না।

শুনতে পেল ভারী গলায় একজন বলল, পানির বোতলটা দাও দেখি। এর মুখে একটু পানি দিতে হবে।

কথাটি সত্যি না স্বপ্ন রিহান বুঝতে পারল না। কিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায়।

কিছু আসে যায় না।

 ৩. গ্রুস্তান পরিবার

রিহান বাটি থেকে চুমুক দিয়ে স্যুপটা শেষ করে খালি বাটিটা ত্রানাকে ফেরত দিল। ত্রানার বয়স দশ যদিও তাকে দেখে আরো কম মনে হয়। সে খালি বাটিটা হাতে নিয়ে সাথে সাথে চলে গেল না, রিহানের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইল। রিহান চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল, কী হল ত্রানা, তুমি কিছু বলবে?

ত্রানা মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চাও, লজ্জা করো না, জিজ্ঞেস করে ফেলো।

ত্রানা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, তোমার পা যে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে তোমার ব্যথা করে না?

রিহান শিকল দিয়ে বাঁধা ডান পাটি নাড়িয়ে বলল, নাহ। অভ্যাস হয়ে গেছে।

ত্রানা এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, তোমাকে বেঁধে রেখেছে কেন? তুমি কি খুব ভয়ংকর?

রিহান মুখে হাসি টেনে আনার চেষ্টা করে বলল, তোমার কী মনে হয়?

আমি জানি না। ত্রানা তার মুখে বয়সের তুলনায় বেশি গাম্ভীর্য ফুটানোর চেষ্টা করে বলল, বাবা বলেছে তুমি খুব ভয়ংকর সেজন্যে তোমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে।

রিহান কী বলবে বুঝতে না পেরে বিস্ময়াভিভূত বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্রানা গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো বলল, বাবা বলেছে তুমি নিশ্চয়ই তোমার কমিউনে কাউকে খুন করে পালিয়ে এসেছ। তোমার কমিউনের লোকেরা তোমাকে নিশ্চয়ই খুঁজছে।

রিহান হেসে বলল, আমি যদি আসলেই ভয়ংকর হতাম তা হলে কি তোমার বাবা তোমার মতো এরকম একটা ছোট মেয়েকে দিয়ে স্যুপ পাঠাত?

ত্রানা ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে মাথা নেড়ে বলল, সেটা তুমি ঠিকই বলেছ।

আসলে আমাকে তো কেউ চেনে না তাই সবাই ভয় পায়। অচেনা মানুষকে সবাই ভয় পায়।

ত্রানা কিছুক্ষণ রিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বাবা যখন তোমাকে এনেছিল আমরা সবাই ভেবেছিলাম তুমি মরে যাবে?

আমিও তাই ভেবেছিলাম।

তুমি কি তোমার কমিউন থেকে পালিয়ে এসেছ?

সেটা অনেক বড় গল্প।

ত্রানার চোখ চকচক করে ওঠে, তার খুব গল্প শোনার শখ। রিহানের আরেকটু কাছে এসে বলল, আমাকে গল্পটা বলবে?

রিহান ত্রানার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, নিশ্চয়ই বলব। কিন্তু তুমি কাউকে বলে দেবে না তো?

জানা দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, কাউকে বলব না। ঈশ্বরী প্রিমার কসম!

ঈশ্বরী প্রিমা! রিহানের বুকের ভেতর হঠাৎ ধক করে ওঠে, প্রভু ক্লডের হাত থেকে সে কোনোভাবে বেঁচে এসেছে, এখানে আছেন ঈশ্বরী প্রিমা। আবার কি নূতন করে কোনো বিপদে পড়বে? ঈশ্বরী প্রিমা যখন তার সম্পর্কে জানবে তখন কী হবে তার?

জানা একটু অধৈর্য গলায় বলল, কী হল? বলবে না?

হ্যাঁ বলব। আরো কয়দিন যাক তারপর বলব।

ত্রানার খানিকটা আশাভঙ্গ হল, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন কন্টেইনারের দরজায় ছোট ছোট কয়েকটা ছেলেমেয়ে ভিড় করে এসে ডাকাডাকি রু করে দেয়। তাদের খেলার সময় হয়েছে এবং ত্রানাকে ছাড়া খেলা কিছুতেই জমে ওঠে না!

ত্রানা চলে যাবার পর রিহান উঠে দাঁড়ায়, তাকে কয়েক মিটার লম্বা একটা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, কন্টেইনারের ভেতরে সে একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারে, খোলা দরজার কাছাকাছি বসে বাইরে তাকাতে পারে কিন্তু এর কেশ কিছু করতে পারে না। রিহান কন্টেইনারের ভেতর পায়চারি করতে থাকে, ত্রানাকে বলেছে পায়ের মাঝে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকতে তার অভ্যাস হয়ে গেছে কিন্তু আসলে অভ্যাস হয় নি। একজন মানুষ সম্ভবত অন্য। অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হতে পারে কিন্তু শেকল বাঁধা অবস্থায় বেঁচে থাকতে কখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠে না।

.

তালা খোলার শব্দে রিহান ঘুম থেকে জেগে ওঠে। গ্রুস্তান কন্টেইনারের তালা খুলে ভিতরে এসে ঢুকেছে। এখন খুব সকাল, ভালো করে দিনটি শুরু হয় নি। গ্রুস্তান রিহানের পায়ে বাধা শিকলটির অন্য মাথায় তালাটি খুলে বলল, চল।

রিহান আগেও লক্ষ করেছে গ্রুস্তান খুব কম কথার মানুষ। এর আগেও রিহান তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু সুবিধে করতে পারে নি। তার প্রাণ রক্ষা করার জন্যে সে অনেকবার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে, গ্রুস্তানের কোনো ভাবান্তর হয় নি। শেকল দিয়ে তাকে বেঁধে রাখার ব্যাপারটি নিয়ে রিহান অনেকবার কৌতূহল কিংবা আপত্তি প্রকাশ করেছে গ্রুস্তান সেখানেও কখনো কোনো কথা বলে নি, তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়েছে একজন মানুষকে পশুর মতো শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা সম্ভবত খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।

রিহান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কোথায়?

গ্রুস্তান উত্তর না দিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে।

রিহান নিজের শেকলের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, আমাকে আগে খুলে দাও।

না।

কেন নয়?

আমাদের আক্রমণ করতে আসছে, তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে।

রিহান ভয়ংকরভাবে চমকে উঠল, মাথা ঘুরিয়ে গ্রুস্তানের দিকে ভালো করে তাকাল, চুপচাপ ঠাণ্ডা ধরনের মানুষটির চেহারার মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা। রিহান কান পেতে শুনতে পেল বাইরে মানুষজন ছোটাছুটি করছে, নীরব এক ধরনের ব্যস্ততা, কোনো একটা কমিউনে যখন বাইরের কোনো দল আক্রমণ করে তখন এরকম অস্থির একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

রিহান জিজ্ঞেস করল, আমাকেও যুদ্ধ করতে হবে?

হ্যাঁ।

শেকল দিয়ে বেঁধে রাখলে কেমন করে যুদ্ধ করব?

তুমি যেহেতু পালাতে পারবে না তাই জানপ্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করবে। তা ছাড়া—

তা ছাড়া কী?

তোমাকে আমরা চিনি না। তোমার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, এমনও হতে পারে যারা আসছে তারা তোমাদেরই মানুষ।

রিহান হতবুদ্ধি হয়ে গ্রুস্তানের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু গ্রুস্তান সুযোগ দিল না, শেকলে টান দিয়ে বলল, চল। তাড়াতাড়ি।

রিহান কন্টেইনারের বাইরে পা দিয়ে চারদিকে তাকায়। ট্রাকগুলো গোল করে সাজানো হয়েছে। মানুষেরা অস্ত্র হাতে ছোটাছুটি করছে। একটা ট্রাকের ছাদে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ বাইনোকুলার দিয়ে দূরে দেখার চেষ্টা করছে। রিহান কান পেতে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা মোটরবাইকের ইঞ্জিনের মৃদু গর্জন শুনতে পায়, মনে হয় বেশ বড় একটা বহর এদিকে আসছে।

গ্রুস্তান একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের হাতে রিহানের শিকলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, একে তোমাদের সাথে নিয়ে যাও। ফ্রন্ট লাইনে কোনোকিছুর সাথে বেঁধে রেখো।

ঠিক আছে।

এর কাছাকাছি থেকে তোমরা।

থাকব।

মধ্যবয়স্ক মানুষটিকে একটু নার্ভাস দেখায়, সে কাঁপা গলায় বলল, ঈশ্বরী প্রিমা কী বলেছেন?

এখনো কিছু বলেন নি। তোমরা ফ্রন্ট লাইনে চলে যাও ঈশ্বরীর নির্দেশ আসা মাত্রই জানিয়ে দেব।

ঠিক আছে।

মধ্যবয়স্ক মানুষ দুজন কঠোর চেহারার মেয়েকে নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। রিহানের পায়ে বাধা শিকলটা গুটিয়ে নিয়ে একজন মেয়ে তার হাতে একটা মাঝারি শক্তির স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে বলল, এটা হাতে রাখ। ফ্রন্ট লাইনে গিয়ে কেমন করে চালাতে হয় শিখিয়ে দেব।

রিহান অস্ত্রটা একনজর দেখল, আমাকে শিখাতে হবে না। আমি এটা চালাতে জানি।

মেয়েটা একটু অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল, রিহান বলল, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। চল।

পাথুরে রাস্তা দিয়ে রিহান এবং অন্য তিনজন এগিয়ে যায়। প্রায় কয়েক শ মিটার দূরে বড় বড় কিছু পাথরের কাছে এসে সবাই দাঁড়াল। মধ্যবয়স্ক মানুষটি এদিক–সেদিক তাকিয়ে একটা পুড়ে যাওয়া লরির এক্সেলের সাথে রিহানের শেকলটা বেঁধে দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেল। রিহান বলল, আমাদের আরো সামনে যাওয়া দরকার।

মানুষটি অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল। তুরু কুঁচকে বলল, কী বললে?

বলেছি, আমাদের আরো সামনে যাওয়া দরকার।

কেন?

মোটরবাইকগুলোকে তা হলে আমরা সামনাসামনি পাব। একেবারে খোলা টার্গেট। এখানে থাকলে সেগুলো হঠাৎ করে চলে আসবে আমরা প্রস্তুত হবারও সময় পাব না।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি খানিকক্ষণ বিস্ফারিত চোখে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, আমাদের কী করতে হবে সেটা তোমার কাছ থেকে শোনার কোনো প্রয়োজন নেই। সেজন্যে ঈশ্বরী প্রিমা আছেন।

রিহান অপমানটা গায়ে মাখল না, একটু পরেই এখানে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হবে, এখন মান–অপমান নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। রিহান তার বুকের ভেতর ভয় এবং অস্থিরতার এক ধরনের কাপন অনুভব করে। বহু দূরে ধুলো উড়িয়ে মোটরবাইকগুলো আসছে, মোটরবাইকের গুঞ্জন এবারে বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। রিহান কান পেতে কিছুক্ষণ শুনে একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, বেভাস্টিসি ৪৩!

মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, কী হয়েছে?

বেভাষ্টিসি ৪৩ মোটরবাইক। দুই হাজার সিসির ইঞ্জিন!

তুমি কেমন করে জান?

শব্দ শুনে বোঝা যায়। আমি চালিয়েছিলাম একবার, খুব শক্তিশালী মেশিন!

মধ্যবয়স্ক মানুষ এবং মেয়ে দুটি রিহানের উচ্ছাসে কোনো অংশ না নিয়ে দুই পাশে সরে যেতে থাকে। রিহান তবু দমে গেল না, বলল, বেভাস্টিসি ৪৩-এর খুব বড় গোলমাল আছে

মধ্যবয়স্ক মানুষটি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, কোনো যন্ত্রপাতি নিয়ে তুমি কোনো অশোভন উক্তি করবে না। খবরদার।

রিহান থতমত খেয়ে বলল, আমি কোনো অশোভন উক্তি করছি না। যেটা সত্যি সেটা বলছি। গ্যাসোলিন ট্যাংকটা অরক্ষিত। হালকা এলুমিনিয়ামের মান্ড। বারো গ্রামের এক্সপ্রেসিভ বুলেট দিয়ে গুলি করলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি তার অন্য দুইজন সঙ্গীর দিকে তাকাল এবং সবাই মিলে রিহানকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আশপাশে অস্ত্র বসানোর ভালো জায়গা খুঁজতে শুরু করে। বড় একটা। পাথরের উপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি দাঁড় করিয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটি মাথা নিচু করে সেটার প্রতি সম্মান দেখাল, বিড়বিড় করে কিছু একটা উচ্চারণ করে অস্ত্রটির ব্যারেলে হাত দিয়ে স্পর্শ করে কপালে ছোঁয়াল।

ঠিক এরকম সময়ে গ্রুস্তানকে দৌড়ে আসতে দেখা যায়। পাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সে কিছু একটা বলতে বলতে ছুটে আসছে। কাছাকাছি এসে গ্রুস্তান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ঈশ্বরী প্রিয়ার নির্দেশ এসে গেছে।

মধ্যবয়স্ক মানুষটা খুশি হয়ে গেল, জয় হোক ঈশ্বরী প্রিমার। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে দুইজনের একজন বলল, কী বলেছেন ঈশ্বরী প্রিমা?

বলেছেন এগুলো বেভাষ্টিসি ৪৩ মোটরবাইক। এর গ্যাসোলিন ট্যাংক হালকা এলুমিনিয়ামের মোন্ড। বারো গ্রামের এক্সপ্রেসিভ বুলেট দিয়ে গুলি করতে বলেছেন।

মধ্যবয়স্ক মানুষ এবং তার সাথের মেয়ে দুজন কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তাদের মুখ দেখে মনে হল তারা গ্রুস্তানের কথা বুঝতে পারছে না। গ্রুস্তান একটু অবাক হয়ে বলল, কী হল তোমাদের?

না–না–কিছু না। বলে মধ্যবয়স্ক মানুষটি রিহানের দিকে তাকাল। হঠাৎ করে তার চোখে এক ধরনের ভীতি ফুটে উঠেছে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না ঈশ্বরী প্রিমার কথাটুকু রিহান আগেই বলে দিয়েছে।

গ্রুস্তান অবিশ্যি সেটা বুঝতে পারল না, সে বলল, ঈশ্বরী বলেছেন তোমরা আরো সামনে যাও। তা হলে মোটরবাইকগুলোকে সামনাসামনি আক্রমণ করতে পারবে। একেবারে খোলা টার্গেট হিসেবে পেয়ে যাবে, যাও দেরি করো না।

গ্রুস্তান যেভাবে ছুটে এসেছিল ঠিক সেভাবে পাথরের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে কমিউনের দিকে ফিরে গেল। রিহান তার হাতের অস্ত্রটি হাত বদল করে বলল, এখন আমার কথা বিশ্বাস হল?

মধ্যবয়স্ক মানুষটি কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, তুমি কেমন করে জেনেছ?

রিহান কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সেটা নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। এখন তাড়াতাড়ি চল। দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

মানুষটি পোড়া লরির দিকে এগিয়ে গিয়ে শেকলের তালা খুলে আনে। সেটা শক্ত করে ধরে রেখে কঠোর দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে বলল, সামনে এগিয়ে যাও। একটু যদি বাড়াবাড়ি কর তা হলে আমি কিন্তু তোমাকে খুন করে ফেলব। ঈশ্বরী প্রিমার কসম।

শক্ত চেহারার মেয়েটি রিহানকে পিছনে ধাক্কা দিয়ে সামনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, যুদ্ধ শেষ হলে ঈশ্বরী প্রিমার কাছে তোমাকে রিপোর্ট করতে হবে।

অন্য মেয়েটি বলল, রিপোর্ট করতে হবে না। ঈশ্বরী প্রিমা নিজেই জেনে যাবেন।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, জয় হোক ঈশ্বরী প্রিমার।

অন্য দুজন যন্ত্রের মতো বলল, জয় হোক।

.

দুই শ মিটার দূরে খানিকটা উঁচু চালে রিহান এবং অন্য তিনজন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো তাক করে নিয়ে মোটরবাইকগুলোর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। মুখ খুললে পরে বিপদ হতে পারে নিশ্চিত জেনেও রিহান বলল, রেঞ্জের ভিতরে না আসা পর্যন্ত গুলি করবে না। লেজার লক গ্যারান্টি হবার পর ট্রিগারে হাত দেবে। তার আগে নয়।

এটি ঈশ্বরী প্রিমার নির্দেশ নয়, তারপরেও মধ্যবয়স্ক মানুষ এবং সাথের মেয়ে দুজন সেটি গোমড়া মুখে মেনে নিল। তারা বুঝে গিয়েছে রিহানের ভেতরে কিছু একটা আছে যেটা তাদের নেই। সেটা কী তারা ধরতে পারছে না সেজন্যে তারা খুব অস্বস্তিতে আছে। রিহানের কথামতো তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে এবং মোটরবাইকের বহরটি যখন খুব কাছাকাছি হাজির হয়েছে তখন টার্গেট লক ইন করে তারা ট্রিগার টেনে ধরল, সাথে সাথে পুরো পরিবেশটি ভয়ংকর হয়ে উঠল। চোখের পলকে তিনটি মোটরবাইক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গেল। মানুষের চিৎকার, গোলাগুলি এবং বারুদের গন্ধে পরিবেশটি নারকীয় হয়ে ওঠে। আক্রমণকারী দলটি বেপরোয়া, দলের অর্ধেক যোদ্ধাই মহিলা, তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে বারবার তাদের ব্যুহ ভেদ করে চলে আসতে চেষ্টা করছিল। গ্রুস্তান আরো কিছু মানুষ নিয়ে তাদের সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে। আসে। ভয়ংকর গোলাগুলিতে পুরো এলাকাটা প্রকম্পিত হতে থাকে।

যুদ্ধটা যেরকম প্রায় হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল সেরকম হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল। আক্রমণকারী দলটি হঠাৎ করে পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মোটরবাইকে তাদের আহত পুরুষ এবং মেয়েদের তুলে নিয়ে গুলি করতে করতে ধুলো উড়িয়ে তারা দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। বড় ধরনের কোনো ক্ষতি ছাড়াই শত্রুকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে সবার ভেতরে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে। মোটামুটিভাবে পুরো এলাকাটা একটা উৎসবের মতো আনন্দে মেতে উঠল। সবাই কমিউনে ফিরে যাবার পর রিহান আবিষ্কার করল সে একা এখানে রয়ে গেছে। শেকল দিয়ে তাকে একটা ট্রাকের এক্সেলের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল, তাকে খুলে নিয়ে যাবার কথা কারো মনে নেই।

রিহান অবিশ্যি তাতে খুশিই হল। কন্টেইনারের ছোট ঘুপচি ঘরে সে দীর্ঘদিন থেকে আটকা পড়ে আছে। বাইরে খোলা প্রান্তরে বসে থাকতে তার খারাপ লাগছে না। রিহান একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে দূরে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক জানা নেই কেন তার মনটা বিষণ্ণ হয়ে আসছে। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল জানা নেই, হঠাৎ শুনল রিহান।

বাচ্চা মেয়ের গলার স্বর। রিহান মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, ত্রানা ছোট একটা পানীয়ের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিহান নরম গলায় বলল, কী খবর ত্রানা!

তুমি এখানে একা একা কেন বসে আছ?

আমাকে এখানে বেঁধে রেখেছে।

ও! ত্রানা কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে তার দিকে পানীয়ের বোতলটি এগিয়ে দেয়, এইটা তোমার জন্যে এনেছি।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ত্রানা। রিহান পানীয়ের বোতলটা খুলে ঢকঢক করে গলায় খানিকটা উত্তেজক পানীয় ঢেলে বলল, আমার কথা সবাই ভুলে গেছে মনে হয়।

উঁহু। ত্রানা মাথা নাড়ল, ভোলে নি।

রিহান একটু অবাক হয়ে তাকাল, তুমি কেমন করে জান?

আমি বাবাকে অন্যদের সাথে কথা বলতে শুনেছি।

কী কথা বলছে?

ত্রানা মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। তোমাকে মনে হয় ঈশ্বরী প্রিমার কাছে নিয়ে যাবে।

রিহান চমকে উঠে বলল, কী বললে?

ত্রানা ভুরু কুঁচকে রিহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি খুব ভয়ংকর, তাই না?

রিহান কোনো কথা বলল না, সে মোটেই ভয়ংকর নয়। সে অন্যরকম। অন্যরকম মানে ভয়ংকর নয়। কিন্তু এই কথাটি সে কেমন করে অন্যদের বোঝাবে?

৪. ঈশ্বরী প্রিমা

রিহান হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার হাত দুটি পেছনে বাঁধা, দুপাশে দুজন কঠিন চেহারার মানুষ। একজন তার কাঁধের কাছে পোশাকটা খামচে ধরে রেখেছে, সে ছুটে যেন না যায় সেজন্যে নয়–সম্ভবত তাকে বোঝানোর জন্যে সে এখানে ঈশ্বরী প্রিমার কাছে নেহায়েত নগণ্য এবং তুচ্ছ একজন মানুষ।

বিহানের ভেতরে কোনো বোধ নেই। এই মুহূর্তে তার নিজেকে পুরোপুরি অনুভূতিহীন একটি যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে। তার ভেতরে হতাশা এবং ক্ষোভ থাকার কথা, কিন্তু সেরকম কিছু নেই। তার ভেতরে বিস্ময় এবং আতঙ্কও থাকার কথা সেরকমও কিছু নেই। বরং সে। নিজের ভেতরে সূক্ষ্ম এক ধরনের কৌতূহল অনুভব করছে। ঈশ্বরী প্রিমা তাকে কী শাস্তি। দেবে সেটি নিয়ে কৌতূহল নয়, ঈশ্বরী প্রিমা দেখতে কেমন সেটি নিয়ে কৌতূহল। রিহান চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কখন আসবে ঈশ্বরী প্রিমা?

তাকে খামচে ধরে রাখা মানুষটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চাপা গলায় বলল, কোনো কথা নয়। চুপ, একেবারে চুপ।

রিহান চুপ করে গেল এবং প্রায় সাথে সাথেই সে ঘরের ভেতরে কাপড়ের খসখস একটা শব্দ শুনতে পায়। নিশ্চয়ই ঈশ্বরী প্রিমা এসেছেন, কারণ রিহানের দু পাশের দুজন মানুষ তখন তার মতোই মাথা নিচু করে উবু হয়ে বসে গেল। ঘরের ভেতরে কিছুক্ষণের জন্যে এক ধরনের অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। হঠাৎ ঈশ্বরী প্রিমার গলা শোনা গেল, এটিই তা হলে সেই মানুষ!

কেউ কোনো কথা বলল না, এটি ঠিক প্রশ্ন ছিল না, এটি ছিল এক ধরনের স্বগতোক্তি। তা ছাড়া কখনোই ঈশ্বরী প্রিয়ার সাথে সরাসরি কথা বলার অনুমতি নেই। রিহান আবার কাপড়ের মৃদু খসখস শব্দ শুনতে পেল, সম্ভবত ঈশ্বরী প্রিমা তাকে ভালো করে দেখার জন্যে আরো একটু কাছে এসেছেন। রিহান একটা নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল, অনেকটা দীর্ঘশ্বাসের মতো। তারপর ঈশ্বরী প্রিমা আবার বললেন, মানুষটা এখানে থাকুক। তোমরা দুজন যাও।

সাথে সাথে রিহানের দু পাশের দুজন মানুষ মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এখন এই ছোট ঘরটিতে রিহান এবং ঈশ্বরী প্রিমা ছাড়া আর কেউ নেই। রিহানের খুব ইচ্ছে। করছিল মাথা তুলে ঈশ্বরী প্রিমাকে দেখে, কিন্তু প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে যদি কোনো মানুষ ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরীর সত্যিকার চেহারা দেখে তা হলে সে বেঁচে থাকতে পারে না। যাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় শুধু তাদেরকেই ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরী তাদের নিজের চেহারা দেখতে দেন। রিহান এটি বিশ্বাস করে না, কিন্তু তবুও সে মাথা তুলে দেখার সাহস করল না।

রিহান হঠাৎ করে ঈশ্বরী প্রিমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, তুমি জান, তুমি খুব বড় অপরাধ করেছ?

রিহানের ঠিক কী হল কে জানে, সে মাথা নেড়ে বলল, না, আমার জানা নেই ঈশ্বরী প্রিমা।

ঈশ্বরী প্রিমা রিহানের কথায় খুব অবাক হলেন, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, পৃথিবীর সব কমিউনে ঈশ্বর এবং মানুষের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তুমি সেটি অস্বীকার করেছ?

রিহান কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। মাত্র কয়েকদিন আগে হুবহু একই রকম কথা বলে প্রভু ক্লড তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এখানে সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে কী হবে? একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে?

ঈশ্বরী প্রিমা বললেন, যে কাজটি আমার করার কথা, তুমি কেন সেই কাজটি করছ?

রিহান কিছু বলল না।

ঈশ্বরী প্রিমা কঠিন গলায় বললেন, আমার কথার উত্তর দাও।

রিহান হঠাৎ মাথা তুলে তাকাল, সাথে সাথে ঈশ্বরী প্রিমা তার হাতে ধরে রাখা কারুকার্যখচিত একটি মুখোশে নিজের মুখ ঢেকে ফেললেন বলে রিহান ঈশ্বরী প্রিমার চেহারাটা দেখতে পেল না। ঈশ্বরী প্রিমার মাথায় কুচকুচে কালো চুল বেণি করে বেঁধে দু পাশ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। শরীরে ধবধবে সাদা একটি পাতলা পোশাক, যার ভেতর দিয়ে আবছাভাবে দেহের অবয়ব দেখা যায়। রিহান শান্ত গলায় বলল, ঈশ্বরী প্রিমা, কোন কাজটি ঈশ্বরের এবং কোন কাজটি মানুষের সেই পার্থক্যটি খুব অস্পষ্ট। আমাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে যে কাজটি করার কথা ছিল সেটিই করেছি। অন্যকে করতে বলেছি।

তুমি ঈশ্বর এবং ঈশ্বরীর ক্ষমতায় বিশ্বাস কর না? তুমি নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়েছ? সিদ্ধান্ত নিয়েছ?

রিহান কোনো কথা না বলে ঈশ্বরী প্রিমার দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশ্বরী প্রিমা বললেন, আমার কথার উত্তর দাও।

রিহান নিচু গলায় বলল, অনুগ্রহ করে আমাকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করবেন না। মহামান্য প্রিমা।

কেন নয়?

কারণ–কারণ– রিহান বুঝতে পারল তার কিছুতেই এই কথাটি বলা ঠিক হবে না কিন্তু তার পরেও সে বলে ফেলল, আমি ঈশ্বর এবং ঈশ্বরীর কোনো অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করি না।

ঈশ্বরী প্রিমা চমকে উঠে কারুকার্যখচিত মুখোশের ভিতর দিয়ে রিহানের দিকে তাকালেন। অস্পষ্ট এবং শোনা যায় না এরকম গলায় বললেন, তুমি কেন এ কথা বলছ?

কারণ–কারণ– এই কথাটিও নিশ্চয়ই কিছুতেই বলা উচিত নয়, তার পরেও রিহান বলে ফেলল, আমাকে একজন ঈশ্বর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল কিন্তু আমি মরি নি!

রিহান দেখল ঈশ্বরী প্রিমা থরথর করে কেঁপে উঠলেন। মুখোশের আড়ালে তার মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছে না কিন্তু সেটি নিশ্চয়ই ভয়ংকর ক্রোধে কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করে রিহান ভয় পেয়ে গেল, সে মাঞ্জনিচু করে বলল, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করুন ঈশ্বরী প্রিমা।

ঈশ্বরী প্রিমা কোনো কথা না বলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। রিহান আবার বলল, আমাকে আবার মৃত্যুদণ্ড দেবেন না ঈশ্বরী প্রিমা। আমি কারো কোনো ক্ষতি করতে চাই না–আমি শুধু বেঁচে থাকতে চাই। যেটুকু কৌতূহল নিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা উচিত আমি শুধুমাত্র সেটুকু কৌতূহল নিয়ে–

ঈশ্বরী প্রিমা রিহানকে বাধা দিয়ে বললেন, তুমি একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী সম্পর্কে কতটুকু জান?

রিহান থতমত খেয়ে বলল, আমি বেশি জানি না।

একজন সাধারণ মানুষ কেমন করে একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী হয়?

রিহান কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

আমার কথার উত্তর দাও।

আমাকে ক্ষমা করুন মহামান্য ঈশ্বরী প্রিমা। আমি বলতে পারব না।

তোমার বলতে হবে, আমি জানতে চাই। বলো, সাধারণ মানুষ কেমন করে একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী হয়?

হয় না ঈশ্বরী প্রিমা। সাধারণ মানুষ কখনো ঈশ্বর বা ঈশ্বরী হয় না।

তা হলে? তা হলে তারা কেমন করে সবাইকে রক্ষা করে।

তাদের কাছে নিশ্চয়ই কিছু তথ্য আছে যেটা অন্যদের কাছে নেই। সেই তথ্যটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কাউকে কাউকে ঈশ্বর করা হয়। আমার মনে হয়–

কী মনে হয়?

আমার মনে হয় একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী খুব নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। খুব দুঃখী একজন মানুষ।

ঈশ্বরী প্রিমা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে রিহানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। রিহান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আপনি কি আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন?

ঈশ্বরী প্রিমা ফিসফিস করে বললেন, হ্যাঁ, তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবার কথা। কিন্তু

কিন্তু কী?

আমি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেব না। ঈশ্বরী প্রিমা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি যাও, তুমি এখান থেকে যাও। চলে যাও।

রিহান উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন করে সে পিছিয়ে যেতে থাকে। দরজা ঠেলে ঘর থেকে বের হবার সময় আরো একবার মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল ঈশ্বরী প্রিমা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কারুকার্যখচিত মুখোশের আড়ালে ঈশ্বরী প্রিমার মুখমণ্ডলটি একবার দেখার জন্যে হঠাৎ করে রিহান এক ধরনের কৌতূহল অনুভব করে। অদম্য কৌতূহল। কিন্তু রিহান তার মুখমণ্ডল দেখতে পেল না।

ভোরবেলা খুট করে কন্টেইনারের দরজা খুলতেই রিহানের ঘুম ভেঙে গেল। সাধারণত বেশ বেলা হবার পর তার জন্যে ত্রানা একটা বাটিতে একটু খাবার নিয়ে আসে, এত সকালে কে এসেছে কে জানে। শিকল বাঁধা পাটা কাছে টেনে এনে শরীরে কম্বলটা জড়িয়ে রিহান বিছানায় উঠে বসল।

দরজা খুলে গ্রুস্তান এবং তার সাথে একজন মহিলা এসে ঢুকল। মহিলাটি মধ্যবয়স্কা, শক্ত সমর্থ চেহারা। রোদে পোড়া, নীল চোখ এবং কাঁচা-পাকা চুল। মহিলাটি কাছে এসে বলল, আমার নাম নীলন। আমি এই কমিউনের দায়িত্বে আছি। গ্রুস্তানের কাছে আমি তোমার কথা শুনেছি, কিন্তু তোমার সাথে আমার পরিচয় হয় নি।

রিহান বলল, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে আমি খুশি হলাম নীলন।

নীলন তার পা থেকে বাধা দীর্ঘ শিকলটি দেখিয়ে বলল, তোমাকে দীর্ঘ সময় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ নিরাপত্তার কারণে আমরা কোনো ঝুঁকি নেই নি।

গলার স্বরে সূক্ষ্ম অপরাধবোধের ছোঁয়া আবিষ্কার করে রিহান একটু অবাক হয়ে নীলনের দিকে তাকাল। তবে কি এখন তার শেকল খুলে ফেলা হবে?

গ্রুস্তান বলল, তোমাকে আমরা যখন পেয়েছিলাম একবারও ভাবি নি তোমাকে বাঁচাতে পারব।

রিহান বলল, আমার জীবন বাঁচানোর জন্যে আমি সারা জীবন তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।

কিন্তু আমরা কেউ জানতাম না, তুমি কে, তুমি কোথা থেকে এসেছ কিংবা তোমাকে বিশ্বাস করা যায় কি না।

নীলন বলল, কিন্তু আমরা এখন জানি তোমাকে বিশ্বাস করা যায়।

রিহান অবাক হয়ে বলল, কেমন করে জান?

ঈশ্বরী প্রিমা আমাদের জানিয়েছেন। আমরা আজ তোমাকে মুক্ত করে দেব। এতদিন তোমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার জন্যে তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব। আমরা তোমাকে

নীলন আরো কিছু বলতে চাইছিল, রিহান বাধা দিয়ে বলল, ঈশ্বরী প্রিমা কী জানিয়েছেন?

তিনি জানিয়েছেন আমরা যেন তোমাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে আমাদের কমিউনে গ্রহণ করি। তোমাকে যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিই।

স্বাধীনভাবে?

হ্যাঁ। এটি খুব বিস্ময়কর নির্দেশ। তুমি নিশ্চয়ই জান কমিউনে ঠিকভাবে কাজ করার জন্যে আমাদের সবাইকে খুব কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হয়। ঈশ্বরী প্রিমা তোমাকে সেই নিয়ম থেকে মুক্তি দিয়েছেন।

গ্রুস্তান তার পকেট থেকে ছোট একটা চাবি বের করে রিহানের পা থেকে শিকল খুলতে খুলতে বলল, তোমাকে গত রাতে আমরা একজন অপরাধী হিসেবে বিচারের জন্যে ঈশ্বরী প্রিয়ার কাছে পাঠিয়েছিলাম।

নীলন হেসে বলল, ব্যাপারটা চিন্তা করে আমার এখন খুব লজ্জা লাগছে।

গ্রুস্তান শিকলটা সরিয়ে বলল, আমার মেয়ে জানা অবিশ্যি তোমাকে খুব পছন্দ করে। এখন বোঝা যাচ্ছে ছোট শিশুরা মানুষকে ঠিকভাবে বুঝতে পারে।

রিহান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল, পায়ে শিকল নেই, অনেক দিন পর স্বাধীনভাবে দুই পা হেঁটে রিহান গ্রুস্তানের কাছে গিয়ে তার কাধ স্পর্শ করে বলল, ধন্যবাদ গ্রুস্তান।

নীলন বলল, তোমাকে আমাদের কমিউনিএকটা থাকার জায়গা করে দিতে হবে। ট্রিশির লরিটি তুমি ব্যবহার করতে পার। তোমার আর কী কী লাগবে তার একটা তালিকা করে দিও।

রিহান বলল, আমার এখন আর কিছু লাগবে না। আমার দায়িত্বটি বুঝিয়ে দিও, যেন তোমাদের বোঝা না হয়ে যাই।

নীলন একটু হেসে বলল, তোমার কোনো দায়িত্ব নেই। ঈশ্বরী প্রিমা স্পষ্ট করে বলেছেন তোমাকে যেন স্বাধীনভাবে থাকতে দিই।

কিন্তু কিছু না করে আমি কেমন করে থাকব?

সেটি তোমার ইচ্ছে। তুমি কী করতে চাও সেটি তুমি ঠিক করবে।

রিহান একটু অবাক হয়ে নীলনের দিকে তাকাল, কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, ঠিক আছে। ঠিক আছে নীলন।

নীলন রিহানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, রিহান, আমি এই কমিউনের দলপতি হিসেবে তোমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কমিউনে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

এখন এস, আমাদের লরিতে, তুমি আমাদের সাথে সকালের নাস্তা খাবে।

.

নীলনের লরি থেকে নাস্তা করে বের হয়ে রিহান এই ছোট কমিউনটি ঘুরে দেখতে বের হল। সে এখানে অনেক দিন থেকে আছে কিন্তু কমিউনটি সে দেখে নি। মানুষজন ঘুম থেকে উঠে দিন শুরু করতে যাচ্ছে। রিহানকে হেঁটে বেড়াতে দেখে সবাই একটু অবাক হয়ে তার। দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণেই নিশ্চয়ই খবরটি ছড়িয়ে গেছে কারণ তাকে দেখে সবাই হাসিমুখে সম্ভাষণ করতে শুরু করল। তাকে এভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হল ত্রানা, সে ছুটে এসে তার হাত ধরে বলল, রিহান! তুমি নাকি আমাদের নতুন দলপতি!

রিহান চোখ কপালে তুলে বলল, সে কী! তুমি কোথা থেকে এই খবর পেয়েছ?

সবাই বলছে! ঈশ্বরী প্রিমা বলেছেন তুমি এখানে যা খুশি করতে পার।

সবাই আর কী কী বলেছে?

বলছে তুমি নাকি সাহসী আর বুদ্ধিমান। তেজস্বী আর সুদর্শন।

রিহান হা–হা করে হেসে বলল, বিয়ে করার জন্যে আমার একটি বউ খুঁজে পেতে তা হলে কোনো সমস্যা হবে না।

ত্রানা মাথা নেড়ে বলল, উঁহু। বরং তোমার উল্টো সমস্যা হবে। আমাদের কমিউনে যত মেয়ে আছে সবাই তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে। কাকে ছেড়ে কাকে বেছে নেবে সেটা হবে তোমার সমস্যা।

এত বড় জটিল সমস্যা সমাধান করব কেমন করে? রিহান মাথা নেড়ে বলল, তখন তোমার কাছে পরামর্শের জন্যে আসতে হবে। কী বলো?

ত্রানা খুশিতে দাঁত বের করে হেসে বলল, আমি এখনই তোমাকে বলে দিতে পারি। ত্রানা এদিক–সেদিক তাকিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো গলা নামিয়ে বলল, লুকদের যে মেয়েটি আছে খবরদার তাকে বিয়ে করো না। সে দেখতে সবচেয়ে সুন্দরী কিন্তু সে সবচেয়ে বেশি হিংসুটে। গত ভোজের সময় কী করেছে জান?

কী করেছে?

জানা গলা নামিয়ে লুকদের পরিবারের সুন্দর মেয়েটি কী হিংসুটেপনা করেছে তার বর্ণনা শুরু করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আশপাশের ট্রাক, লরি, কন্টেইনার থেকে ছোট ছোট বাচ্চারা এসে রিহানের আশপাশে ভিড় জমালো–কাজেই ত্রানাকে আপাতত তার গল্পটিকে স্থগিত করতে হল।

ছোট ছোট বাচ্চাদের বহরটি রিহানকে কমিউনের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতে থাকে। তাদের রান্নাঘর, পয়ঃশোধনাগার, পানি সরবরাহ কেন্দ্র, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, নিউক্লিয়ার রি–এক্টর, সৌরচুল্লি, অস্ত্রাগার শেষ করে তারা যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে এসে হাজির হল। বড় একটা এলাকা জুড়ে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। ভাঙা এবং পুরোনো মোটরবাইক, ট্রাক এবং লরির ইঞ্জিন, নানা ধরনের অকেজো অস্ত্রপাতি ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রিহান তার স্বাভাবিক কৌতূহলে যন্ত্রপাতিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, ঘোট ছোট বাচ্চাগুলো খানিকটা দূরত্ব নিয়ে বেশ সম্ভ্রমের সাথে রিহান এবং যন্ত্রপাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

রিহানকে দেখে যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মীরা এগিয়ে আসে–বেশিরভাগই অল্পবয়স্ক মেয়ে, ঈশ্বরী প্রিমার কাছ থেকে আসা তালিকা দেখে যন্ত্রপাতিগুলোর অকেজো অংশগুলোর সঠিক অংশগুলো পরিবর্তন করছে। রিহান একটা কাজুরা মোটরবাইক দেখে এগিয়ে গিয়ে বলল, বাহ! কী চমৎকার, এর ডুয়েল টার্বো ইঞ্জিন।

নিহানা নামে রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের একটি মেয়ে কর্মী মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, এর ডুয়েল টার্বো ইঞ্জিন।

এটি অকেজো হয়েছে কেমন করে?

ডায়াগনষ্টিক মেশিনে ফিট করে রিপোর্ট পাঠিয়েছি ঈশ্বরী প্রিমার কাছে। ঈশ্বরী প্রিমা এখনো বলেন নি, কী করতে হবে।

আমি একটু দেখি

নিহানা কিছু বলার আগেই রিহান বিশাল মোটরবাইকটা টেনে এনে তার স্টার্টারে ঝাঁকুনি দেয়। মোটরবাইকটা গর্জন করে স্টার্ট হয়ে প্রায় সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল। রিহান কান পেতে ইঞ্জিনের শব্দ শুনে আবার স্টার্টারে ঝাঁকুনি দিতেই আবার ইঞ্জিনটা ঘরঘর শব্দ করে স্টার্ট নেয়, কয়েক সেকেন্ড চালু থেকে আবার সেটা বন্ধ হয়ে গেল। রিহান ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ল তারপর নিচু হয়ে ইঞ্জিনটার উপর ঝুঁকে পড়ল। ঘোট ছোট বাচ্চারা এবারে কৌতূহলী হয়ে ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসে, তারা সবিস্ময়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিহান ফুয়েল পাইপটা খুঁজে বের করে সেটা ধরে মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মেয়ে কর্মীটিকে বলল, আমাকে সাইজ ফোর একটা প্লয়ার্স দেবে?

কিন্তু রিহান—

কী?

যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রটিতে সপ্তম মাত্রার নিয়মকানুন। সার্টিফাইড কর্মী ছাড়া অন্য কেউ এখানে কোনো কিছু স্পর্শ করতে পারবে না।

রিহান হা–হা করে হেসে বলল, আমার জন্যে কোনো নিয়ম নেই। ঈশ্বরী প্রিমা আমাকে যা খুশি তাই করার অধিকার দিয়েছেন।

মেয়ে কর্মীর একজন আরেকজনের দিকে তাকাল এবং একজন মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। এটা সত্যি কথা। নীলনের অর্ডারের কপি আছে আমার কাছে।

রিহান বলল, দেখেছ? এবারে একটা প্লায়ার্স দাও।

একজন মেয়ে কর্মী ওয়ার্কশপের ভেতরে ঢুকে একটা সাইজ ফোর প্লয়ার্স নিয়ে এল। রিহান প্লয়ার্স দিয়ে ঘুরিয়ে টিউবের একটা ছোট অংশ খুলে ভেতরে উঁকি দিতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল, বলল, যা ভেবেছিলাম তাই!

নিহানা নামের মেয়ে কর্মীটি বলল, কী হয়েছে?

টিউবটি বালু দিয়ে বন্ধ হয়ে আছে। কাজুরা মোটরবাইকের এটা হচ্ছে সমস্যা। ফিল্টারটা ভালো না, ফুয়েল পাইপ বন্ধ হয়ে যায়। এটা পরিষ্কার করলেই ঠিক হয়ে যাবে। একটা চিকন তার আছে?

নিহানা একটু বিভ্রান্ত হয়ে বলল, চিকন তার?

হ্যাঁ। আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখি টিউব পরিষ্কার করার মতো কিছু পাওয়া যায় নাকি। রিহান টিউবটা ত্রানার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ত্রানা এটা ধর আমি একটা তার নিয়ে আসি।

ত্রানা এবং তার সাথে সাথে অন্য সবগুলো বাচ্চা সভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। ত্রানা মাথা নেড়ে বলল, না রিহান, আমাদের বাচ্চাদের যন্ত্রপাতি ধরার নিয়ম নেই। আমরা এখনো প্রার্থনা শিখি নি।

রিহান থতমত খেয়ে থেমে গেল, সে ভুলেই গিয়েছিল যে যন্ত্রপাতিকে এক ধরনের পবিত্র জিনিস বলে বিবেচনা করা হয়। কারা এটি স্পর্শ করবে, কারা এটি নিয়ন্ত্রণ করবে সেই বিষয় নিয়ে কঠোর নিয়মকানুন আছে। সে নিজে এই নিয়ম ভেঙে যন্ত্রপাতি নিয়ে খেলাধুলা করেছে, পরীক্ষা করেছে কিন্তু এই ছোট বাচ্চারা তো সেটি জানে না। রিহান একমুহূর্ত চিন্তা করল, তারপর বলল, ত্রানা তুমি এটি ধর, কিছু হবে না। তুমি দেখবে প্রার্থনা না করলেও যন্ত্রপাতি কাজ করে।

মেয়ে কর্মীরা এবং সবগুলো বাচ্চা একসাথে বিস্ময় এবং আতঙ্কের একটা শব্দ করল। রিহান আবার বলল, নাও। ধর।

ত্রানা সাবধানে কাঁপা হাত দিয়ে ফুয়েল টিউবটা ধরল এবং অন্য সবগুলো বাচ্চা এক ধরনের আতংক নিয়ে ত্রানার দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান ওয়ার্কশপে খুঁজে খুঁচিয়ে পরিষ্কার করা যায় এরকম একটা চিকন তার এনে ত্রানার হাত থেকে টিউবটা নিয়ে সেটা পরিষ্কার করতে শুরু করে। টিউবটা আবার মোটরবাইকে লাগিয়ে সে বাচ্চাদের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কী মনে হয়? মোটরবাইকটা কি এখন স্টার্ট নেবে?

বাচ্চারা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল, এক ভাগ মাথা নেড়ে বলল স্টার্ট নেবে। অন্যভাগ বলল। নেবে না। রিহান চোখ মটকে স্টার্টারে ঝাঁকুনি দিতেই বিশাল কাজুরা মোটরবাইকটি গর্জন। করে স্টার্ট নিয়ে নিল। এবং দুএক সেকেন্ড পরে বন্ধ হয়ে গেল না। ত্রানা এবং অন্য সব বাচ্চা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে এবং সেই আনন্দ ধ্বনির মাঝে রিহান মোটরবাইকটির উপর চেপে বসে। রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের ফাঁকা জায়গাতে ধূলি উড়িয়ে সে মোটরবাইকটি ঘুরিয়ে আনল তারপর ইঞ্জিন বন্ধ করে মোটরবাইকটি দাঁড়া করিয়ে বলল, এই মোটরবাইকটি ঠিক করার জন্য এখন আর ঈশ্বরী প্রিমাকে বিরক্ত করতে হবে না।

নিহানা ইতস্তত করে বলল, কিন্তু—

কিন্তু কী?

কে কোন কাজ করবে সেটি তো নিয়ম করা আছে।

রিহান হেসে বলল, আমার জন্যে কোনো নিয়ম নেই।

কিন্তু এই বাচ্চারা? তাদের জন্যে

এরা যদি আমার সাথে থাকে তাহলে তাদের জন্যেও কোনো নিয়ম নেই।

নিহানা নামের মেয়ে কর্মীটি এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে।

.

রাতে রিহান তার নিজের লরিতে শোয়ার আয়োজন করছিল, তখন হঠাৎ করে দরজায় শব্দ হল। রিহান দরজা খুলে দেখে সেখানে নীলন এবং গ্রুস্তান দাঁড়িয়ে আছে। রিহান সপ্রশ্ন। দৃষ্টিতে তাকাতেই নীলন বলল, আমরা তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি রিহান?

অবশ্যই। ভেতরে এস।

নীলন এবং গ্রুস্তান ভেতরে এসে হাত দুটো ঘষে গরম করতে করতে বলল, রিহান তুমি আজকে যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে একটি খুব অস্বাভাবিক কাজ করেছ।

রিহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমি জানি।

এই কমিউনের সব বাচ্চা এখন বলছে যন্ত্রপাতিকে সম্মান করতে হয় না। প্রার্থনা শেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সব নিয়মকানুন ভুল

সব নিয়মকানুন ভুল নয়। কিছু কিছু ভুল–

কিন্তু একটা কমিউনে যদি নিয়মকানুন খুব কঠোরভাবে মানা না হয় তার শৃঙ্খলা থাকে না। শৃখলা না থাকলে কমিউন টিকে থাকতে পারে না।

রিহান বলল, নীলন, আমার বয়স তোমার থেকে অনেক কম কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা তোমার থেকে অনেক বেশি! আমি কিছু জিনিস জানি যেটা অন্য মানুষ জানে না।

নীলন একটু অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল। রিহান বলল, আমি সেটা তোমাদের বলতে চাই না, কিন্তু একদিন বলতে হবে। একদিন সবাইকে জানতে হবে। তার জন্যে প্রস্তুতি নিতে হবে। সেজন্যে নিয়মকানুনগুলো নূতন করে লিখতে হবে।

গ্রুস্তান নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি আজকে যেটা করেছ সেটা ঈশ্বরী প্রিমাকে জানানো হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম তিনি অনুমোদন করবেন না কিন্তু ঈশ্বরী প্রিমা সেটা অনুমোদন করেছেন।

রিহান উজ্জ্বল মুখে বলল, আমি জানতাম তিনি করবেন।

নীলন নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমাদের ভয় করে। নিয়ম ভাঙতে আমাদের খুব ভয় করে।

রিহান নীলনের হাত স্পর্শ করে বলল, ভয়ের কিছু নেই নীলন। আমরা নিয়ম ভাঙছি, আমরা নূতন নিয়ম তৈরি করছি!

 ৫. শস্যক্ষেত্র

রিহানের ধারণা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি সে এখন কাটাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে একটু নাস্তা করেই সে যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে চলে আসে। স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা অকেজো যন্ত্রপাতি নিয়ে পুরো দিন কাটিয়ে দেয়। অচল মোটরবাইকের বেশিরভাগ সে সারিয়ে ফেলেছে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলোও সে খুলে আবার জুড়ে দিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। ট্রাক এবং লরির। ইঞ্জিনগুলো নিয়ে একটা সমস্যা হলেও সে মোটামুটি ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছে। কয়েকটা এক ধরনের অচল যন্ত্রপাতি দিয়ে সেএকটা যন্ত্রকে দাঁড়া করিয়ে ফেলতে পারে। শুধু যে। যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে অচল এবং অকেজো যন্ত্রপাতি সারিয়ে তুলেছে তা নয়– কমিউনের ট্রাক, লরি আর কন্টেইনার ঘিরে গড়ে ওঠা মানুষজনের দৈনন্দিন সংসার নিয়েও সে কাজ করতে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ প্রবাহকে ঠিক রাখার জন্যে সে তারগুলো ঠিক করে টানিয়ে দিয়েছে, কীভাবে কোনটা ব্যবহার করতে হবে তার নিয়ম তৈরি করে দিয়েছে। আজকাল দুর্ঘটনা হচ্ছে অনেক কম।

শুধু যে সে একা কাজ শুরু করেছে তা নয়–তার সাথে বাচ্চাকাচ্চারাও এই ব্যাপারটিতে উৎসাহ পেতে শুরু করেছে। তাদের অনেকেই ছোটখাটো কাজ করতে শিখে গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি উপকার হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মী মেয়েগুলোর। আগে অকেজো যন্ত্র সারানোর জন্যে ঈশ্বরী প্রিমাকে একটা দীর্ঘ রিপোর্ট পাঠাতে হত। ডায়াগনষ্টিক মেশিনের সেই রিপোর্টটি ঠিক করে তৈরি করা খুব কঠিন। সেই রিপোর্ট দেখে ঈশ্বরী প্রিমা সেটা সারানোর জন্যে যন্ত্রপাতির ইউনিট নম্বর লিখে দিতেন। তাদের সরবরাহ কেন্দ্রে সেই ইউনিট নম্বরের যন্ত্রপাতি থাকলে সেটি ঠিক জায়গায় লাগিয়ে সেটি ঠিক করতে হত। সঠিক ইউনিট নম্বরের যন্ত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন, যখনই রসদ সগ্রহের জন্যে তাদের বিশেষ বাহিনী বের হত। তাদেরকে প্রয়োজনীয় ইউনিট নম্বরসহ একটা তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হত। সেই তালিকার যন্ত্রপাতি কখনোই পুরোপুরি পাওয়া যেত না। তাই কখনোই যন্ত্রপাতি পুরোপুরি ঠিক হত না।

এই কমিউনে রিহান প্রথম যখন যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে শুরু করল তখন কমিউনের সবাই যে সেটাকে সহজভাবে নিয়েছিল তা নয়। অনেকেই তীব্র প্রতিবাদ করেছিল–যন্ত্রকে আর সম্মান প্রদর্শন করতে হবে না, এই ব্যাপারটিতে তাদের আপত্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। বড়দের পাশ কাটিয়ে ব্যাপারটি একেবারে শিশুদের ভেতর দিয়ে শুরু হয়েছিল বলে কেউ কিছু করতে পারে নি। এখন মোটামুটিভাবে সবাই ব্যাপারটিকে মেনে নিয়েছে এবং তার চাইতে বড় কথা কমিউনের আরো নিয়মকানুন নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।

কমিউনে শুধু যে যন্ত্রপাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হয়েছে তা নয়–হঠাৎ করে নূতন যন্ত্রপাতি তৈরি হতে শুরু করেছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় যন্ত্রগুলো অবশ্যই খেলনা–ঘোট ঘোট বাচ্চাদের খেলার জন্যে স্টিয়ারিং হইল লাগানো গাড়ি! সেই গাড়ি থেকে উল্টে পড়ে দুই চারজন বাচ্চার যে হাত পায়ের ছাল–চামড়া ওঠে নি তা নয়, কিন্তু তার পরেও বাচ্চাগুলোর মাঝে এগুলো অসম্ভব জনপ্রিয়। গান শোনার জন্যে যে ক্রিস্টাল ডিস্ক রিডার ছিল সেগুলো ব্যবহার করার সৌর ব্যাটারির খুব অভাব ছিল। বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র থেকে নূতন করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার পর এখন প্রতি লরিতেই গান শোনার ব্যবস্থা হয়েছে। সন্ধেবেলাতেই যেভাবে গান বাজতে থাকে যে নীলনকে নূতন করে আদেশ দিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনতে হয়েছে!

রাত্রিবেলা ঠাণ্ডার কষ্ট থেকে বাচার জন্য আগুন জ্বালানোর একটা ব্যবস্থা করা হত– আজকাল আর সেটা করা হয় না। নিউক্লিয়ার রি–একটরের পাশে একটা গরম পানির ধারা থাকে, সেটাকে টিউব দিয়ে পুরো কমিউনে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাত্রিবেলা সব ট্রাক লরি এবং কন্টেইনারগুলোর ভেতরে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।

তবে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক আবিষ্কারটি হয়েছে অন্য জায়গায়। সেটি শুরু হয়েছে এভাবে : ঈশ্বরী প্রিমার কাছ থেকে বিশেষ নির্দেশ এসেছে বলে নীলন একদিন কমিউনের সবাইকে নিয়ে একটা সভা ডেকেছে। বেশি ছোট বাচ্চাগুলোকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মায়েরা বসেছে, একটু বড় বাচ্চাগুলো হুটোপুটি করে খেলছে এবং যারা মোটামুটিভাবে বুঝতে শিখেছে তারা গম্ভীর হয়ে বাবা–মায়ের কাছে বসে আছে–কখন এই সভা শেষ হবে সেজন্যে অপেক্ষা করছে। অন্যেরা ট্রাকের চাকায় বা যন্ত্রপাতিতে হেলান দিয়ে বসে নীলনের ঘোষণার জন্যে অপেক্ষা করছে। শুধু যাদের সেন্ট্রি ডিউটি দেওয়া হয়েছে তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে বাইরে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

নীলন সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে সভার কাজ শুরু করল, বলল, তোমরা সবাই জান আর কিছুদিনের ভেতরেই ঠাণ্ডা পড়ে যাবে এবং তার আগেই আমরা দক্ষিণে যাত্রা শুরু করব। এবং তোমরা এটাও জান যে যাত্রা শুরু করার আগে আমাদের শীতকালের শস্যভাণ্ডার পুরো করতে হবে।

এরকম সময়ে কমবয়সী তরুণ–তরুণীরা যন্ত্রণার একটি শব্দ করল! নীলন সেটা না শোনার ভান করে বলল, আমরা আমাদের স্কাউট বাহিনীকে আশপাশে এবং শস্যভূমিতে পাঠিয়েছি, তারা তাদের রিপোর্ট দিয়েছে। ঈশ্বরী প্রিয়া আমাদের শস্যক্ষেত্রে যাবার দিন ঠিক করে দিয়েছেন।

ঈশ্বরী প্রিমা নামটির জন্যে তরুণ–তরুণীরা এবারে যন্ত্রণার শব্দ করার সাহস পেল না। তবে শস্য কাটতে যাওয়ার এই দিনটি নিয়ে কারো মনে আনন্দের কোনো স্মৃতি নেই।

ঈশ্বরী প্রিমা বলেছেন এবার শস্যক্ষেত্রে শস্য একটু আগেই প্রস্তুত হয়েছে এবং আমাদের আগেই যেতে হবে। এলাকার অন্যান্য কমিউনের সদস্যরাও সেখানে শস্য সংগ্রহ করতে যাবে কাজেই আমাদের শস্য কাটতে হবে দ্রুত, সেজন্যে এবারে আরো অনেককে শস্য কাটতে যেতে হবে। সবাইকে সেজন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।

যন্ত্রণার মতো শব্দ করা হলে ঈশ্বরী প্রিমার প্রতি অসম্মান করা হয় বলে কমবয়সী তরুণ–তরুণীরা বেশ কষ্ট করে চুপ করে রইল। তখন পিছনে বসে থাকা যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মী বাহিনীর একটি মেয়ে, নিহানা, দাঁড়িয়ে বলল, মহামান্য নীলন, আমি কি একটা প্রস্তাব করতে পারি?

কী প্রস্তাব?

শস্য কাটার জন্যে আমরা যে চাকু ব্যবহার করি সেটি খুব ভালো কাজ করে। আমাদের অনেক সময় নষ্ট হয় এবং প্রত্যেকবারই আমাদের ছোটখাটো দুর্ঘটনা হয়। কিন্তু আমার মনে হয় মেয়েটি কথা বন্ধ করে একটু সময়ের জন্যে অপেক্ষা করে।

কী মনে হয়?

আমার মনে হয় আমরা শস্য কাটার জন্যে একটা যন্ত্র তৈরি করতে পারি যেটা দিয়ে অনেক তাড়াতাড়ি শস্য কাটতে পারব।

যারা উপস্থিত ছিল তাদের মাঝে অনেকেই অবিশ্বাসের শব্দ করল। একজন বলল, অসম্ভব। এরকম যন্ত্র তৈরি করা যদি সম্ভব হত ঈশ্বরী প্রিমা আমাদের জন্যে সেটি খুঁজে বের করতেন।

মেয়েটি বলল, এটি অসম্ভব নয়। সত্যি কথা বলতে কী আমি যন্ত্রটা তৈরি করেছি, তবে এখনো পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পাই নি।

এবারে সবাই বিস্ময়ের একটা শব্দ করল। মেয়েটা লাজুক মুখে বলল, একটা মোটরবাইকের পিছনে এটা লাগাতে হবে। মোটরবাইকটা যখন সামনে যাবে তখন আমার যন্ত্রটা ঘুরে ঘুরে শস্য কাটতে থাকবে।।

রিহান উঠে দাঁড়িয়ে আনন্দের একটা ধ্বনি বের করে বলল, অভিনন্দন! তোমাকে একশ অভিনন্দন! এক হাজার অভিনন্দন!

অন্য অনেকে এবার হাত তালি দিতে থাকে। কাউকেই আর ভোঁতা চাকু দিয়ে শস্য কাটতে হবে না–একটা যন্ত্র সবার শস্য কেটে দেবে, দৃশ্যটি চিন্তা করেই সবাই খুশি হয়ে যায়। নীলন হাত তুলে সবার আনন্দোচ্ছাসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি নিজেই খুব অবাক হয়ে দেখছি কিছুদিন আগেও যে ব্যাপারটি আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না এখন কত সহজে আমরা সেটি করতে পারি। ঈশ্বরী প্রিমার প্রতি আমাদের শত সহস্র কৃতজ্ঞতা যে তিনি আমাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে এই পরীক্ষা–নিরীক্ষা এবং গবেষণা করার সুযোগ করে দিয়েছেন।

একজন চিৎকার করে বলল, জয় হোক ঈশ্বরী প্রিমার।

সবাই সমস্বরে বলল, জয় হোক।

নীলন আগের কথার সূত্র ধরে বলল, আমাদের নিহানা শস্য কাটার একটা যন্ত্র তৈরি করেছে সেজন্যে তাকে সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। তবে সবাইকে একটা জিনিস লক্ষ রাখতে হবে–বছরের একটা সময় আমাদের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই শস্যক্ষেত্রগুলোতে প্রতি বছর নিজে শস্য জন্মায় এবং আমরা শস্য কেটে আনি। আমাদের শরীর ঠিক রাখার জন্যে কী কী খেতে হবে ঈশ্বরী প্রিমা সেটি ঠিক করে দেন–তার কাছ থেকে আমরা জেনেছি এই শস্য মজুত করে রাখতে হয়। কাজেই নিহানার যন্ত্রটি আমরা ব্যবহার করব কি না সেটি খুব ভেবেচিন্তে ঠিক করতে হবে। যদি কোনো কারণে যন্ত্রটি ঠিকভাবে কাজ না করে এবং আমরা ঠিক সময়ে শস্য কেটে আনতে না পারি আমাদের পুরো কমিউনের ওপর ভয়ংকর দুর্যোগ নেমে আসবে।

নিহানা বলল, তুমি ঠিকই বলেছ নীলন। সেজন্যে আমি আগে আমার যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই।

কমবয়সী একজন দাঁড়িয়ে বলল, পাহাড়ের নিচে ঘাসের বন আছে। আমরা সেই ঘাসের বনে শস্য কাটার যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখতে পারি।

নীলন বলল, আমি যন্ত্রটা ব্যবহার করার পক্ষে কিন্তু যদি যন্ত্রটা কোনো কারণে কাজ করে তার জন্যেও প্রস্তুতি রাখতে চাই। তা ছাড়া নীলন একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, এই এলাকার মানুষের যেসব কমিউন আছে তারা অনেকেই এখানে শস্য কাটতে আসে। কিছু কিছু কমিউন অত্যন্ত দুর্ধর্ষ এবং নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তাদের সাথে যুদ্ধ হতে পারে সেজন্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে।

কমিউনের বয়স্ক সদস্যরা তখন ঘুঁটিনাটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেয়। অনেক আলোচনা করে মোটামুটি একটা পরিকল্পনা করে সেদিনকার সতা শেষ করা হল।

নিহানার যন্ত্রটা যেরকম কাজ করবে ভাবা হয়েছিল, দেখা গেল সেটি তার থেকে অনেক ভালো কাজ করছে। পাহাড়ের নিচে কাশবনের জঙ্গলটি সেটি কয়েক মিনিটে কেটে শেষ করে ফেলল, সেটি দেখে সবাই এত উৎসাহ পেল যে তখন তখনই তারা শস্য মাড়াই করার একটা যন্ত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা করা শুরু করল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে আগে যে কাজ করতে তাদের পুরো এক সপ্তাহ লেগে যাবার কথা ছিল সেটি চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে শেষ হয়ে যাবে বলে সবাই আশা করতে থাকে।

নির্দিষ্ট দিনে বড় কন্টেইনারসহ একটা ট্রাক এবং দশটা মোটরবাইকে করে বিশজন মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে শস্য কাটতে রওনা হৃল। কন্টেইনারের ভিতরে নিহানার শস্য কাটার এবাং শস্য মাড়াই করার যন্ত্র। শস্যক্ষেত্রটি অনেক দূর, ভোরবেলা রওনা দিয়ে পাথুরে রাস্তায় সারা দিন চালিয়ে ওরা গভীর রাতে সেখানে পৌঁছাল। সবাই ক্লান্ত, তার পরেও তারা শস্য কাটার যন্ত্রটি মোটরবাইকের সাথে লাগানোর কাজটুকু সেরে রাখল যেন খুব ভোর বেলাতেই কাজ শুরু করে দিতে পারে।

রাতের খাবার খেয়ে সবাই শুতে গিয়েছে। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলে ভোরবেলা কাজ করা সহজ হবে। নিহানার যন্ত্রটা ঠিকভাবে কাজ করলে তাদের খুব বেশি পরিশ্রম হবার কথা নয়। জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা, কন্টেইনারের ভেতর স্লিপিং ব্যাগে অন্য সবার সাথে গুটিসুটি মেরে রিহান শুয়ে পড়ল। যন্ত্রপাতি ঠিক করার জন্যে কাছাকাছি কেউ নেই বলে তাকে আনা হয়েছে, যদি কোনো সমস্যা হয় তাকে ঠিক করে দিতে হবে।

রাত্রে হঠাৎ রিহানের ঘুম ভেঙে গেল। কেন ঘুম ভেঙেছে রিহান বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ ঘাপটি মেরে শুয়ে থেকে তার মনে হতে থাকে কিছু একটা অস্বাভাবিক জিনিস ঘটেছে কিন্তু সেটা কী সে বুঝতে পারছে না। রিহান মাথা উঁচু করে বোঝার চেষ্টা করে। তখন সে বহু দূরে কয়েকটা মোটরবাইকের শব্দ শুনতে পেল। এই শস্যক্ষেত্রের আশপাশে কোনো কমিউন নেই, বহু দূর থেকে মানুষেরা শস্য কাটার জন্যে এখানে আসে। তাদের মতো আরো কোনো দল হয়তো শস্য কাটতে আসছে।

রিহান উঠে বসল, যারা আসছে তারা কী ধরনের মানুষ কে জানে। এসে একটা গোলাগুলি শুরু করে দিলে কী হবে? সবাইকে ডেকে তুলবে কি না রিহান বুঝতে পারল না। সবাই ক্লান্ত হয়ে এমন গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছে যে রিহানের তাদের ডেকে তুলতে মায়া হল। মোটরবাইকগুলো এখনো অনেক দূরে, আরো একটু কাছে এলে ডেকে তোলা। যাবে। রিহান কন্টেইনারের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে মোটরবাইকের শব্দগুলো শুনতে থাকে। যদি কমিউনের লোকেরা শস্য কাটতে আসে তা হলে মোটরবাইকের সাথে বড় বড় ট্রাক এবং লরির শক্তিশালী ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাবে কিন্তু সেরকম কিছু নেই। দুই থেকে তিনটি মোটরবাইকের শব্দ শোনা যাচ্ছে–কখনো আস্তে, কখনো জোরে, কখনো সেটা পাহাড়ের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে।

রিহান চুপচাপ বসে থাকে, ধীরে ধীরে মোটরবাইকের শব্দ বাড়ছে, যারা আসছে তারা কাছাকাছি এসে পৌঁছে গেছে। সম্ভবত অন্য কোনো কমিউনের স্কাউট দল, শস্যক্ষেত্রটি দেখতে এসেছে, ভোরের আলোতে দেখে আবার ফিরে চলে যাবে।

রিহান তবু ঝুঁকি নিল না, কন্টেইনারে ঘুমিয়ে থাকা গ্রুস্তানকে ডেকে তুলে সাবধানে বের হয়ে আসে। বাইরে আরো দুজন সেন্ট্রি পাহারা দিচ্ছিল, মোটরবাইকের শব্দ তারাও শুনেছে, হাতে অস্ত্র নিয়ে তারাও অপেক্ষা করছে।

গ্রুস্তান বলল, ভয়ের কিছু নেই। মনে হয় স্কাউট দল। আমরা একটু সতর্ক থাকি।

রিহান বলল, ঠিক আছে।

মোটরবাইকগুলো কাছে এসে হঠাৎ করে হেডলাইট নিভিয়ে ফেলে, ইঞ্জিনগুলো চাপা গর্জন করে আরো কাছাকাছি এসে থেমে যায়। গ্রুস্তান নিচু গলায় বলল, আমাদের দেখেছে।

কিন্তু হেডলাইট নিভিয়েছে কেন?

বুঝতে পারছি না।

গ্রুস্তান চাপা গলায় সেন্ট্রি দুজনকে বলল, তোমরা দুই পাশে চলে যাও। সন্দেহজনক কিছু দেখলে গুলি করতে হতে পারে।

সেন্ট্রি দুজন মাথা নেড়ে দুই পাশে সরে গেল। গ্রুস্তান আর রিহান অন্ধকারে কন্টেইনারের পিছনে লুকিয়ে থাকে। তারা কিছুক্ষণের মাঝেই কয়েকটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল–ছায়ামূর্তিগুলো পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে। ট্রাকের সামনে এসে সেটা পরীক্ষা করল, খুব চাপা গলায় ফিসফিস করে কথা বলল। চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখা মোটরবাইকগুলো দেখল, নিজেরা নিজেরা কিছু একটা কথা বলল, তারপর তারা ফিরে যেতে শুরু করল।

গ্রুস্তান ফিসফিস করে বলল, লোকগুলো ফিরে যাচ্ছে।

হ্যাঁ।

কোনো কমিউনের স্কাউট দল মনে হচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই।

রিহান মাথা নেড়ে সম্মতি দিতে গিয়ে থেমে গেল, লোকগুলো আবার ফিরে আসছে। তাদের হাতে বড় একটা পাত্র। রিহান ফিসফিস করে বলল, কিন্তু লোকগুলো ফিরে আসছে। কেন?

পরের দৃশ্য দেখে রিহান আর গ্রুস্তান আঁতকে উঠল, সর্বনাশ! কী একটা জানি ছিটাচ্ছে! আগুন ধরিয়ে দেবে।

কী ধরনের মানুষ অপরিচিত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করতে পারে? কিন্তু সেই কারণ খুঁজে বের করার অনেক সময় পাওয়া যাবে, এই মুহূর্তে তাদের থামাতে হবে।

রিহান হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র উঁচু করে চিৎকার করে বলল, হাত তুলে দাঁড়াও–না হলে গুলি করব!

মানুষগুলো থমকে দাঁড়াল, মনে হল ছুটে পালানোর চেষ্টা করবে কিন্তু তার আগেই সেন্ট্রি দুজনের ক্রিপটন ফ্লাশ লাইটের তীব্র আলো তাদের ওপর এসে পড়ল। তিনজন মানুষ, মধ্যবয়স্ক পুরুষ, শরীরে কালো বায়ু নিরোধক পোশাক, মাথায় হেলমেট এবং চোখে নাইট গগলস।

গ্রুস্তান অস্ত্র উদ্যত করে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, তোমরা এক পা নড়লে গুলি করে শেষ করে দেব। আমরা চারজন মানুষ তোমাদের টার্গেট করেছি। খবরদার ভুলেও হাতে অস্ত্র নেবার চেষ্টা করবে না।

মানুষগুলো চেষ্টা করল না। ক্রিপটন ল্যাম্পের তীব্র আলোতে হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গ্রুস্তান এবং রিহান আরো একটু এগিয়ে যায়। সেন্ট্রি দুজনও কাছাকাছি এগিয়ে আসে।

গ্রুস্তান জিজ্ঞেস করল, তোমাদের হাতে ওটা কী?

মানুষগুলো কোনো কথা বলল না।

গ্রুস্তান ধমক দিয়ে বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমাদের হাতে কী?

বিস্ফোরক। প্লাস্টিক বিস্ফোরক।

তোমরা কেন ওটা এখানে ছড়াচ্ছ?

মানুষগুলো প্রশ্নের উত্তর দিল না।

গ্রুস্তান আবার ধমক দিল, কেন?

আমরা তোমাদের কন্টেইনারটা উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম।

রিহান হঠাৎ করে চমকে উঠল, সে আগে এই কণ্ঠস্বরটি কোথাও শুনেছে। দুই পা এগিয়ে সে তীক্ষ্ণ চোখে মানুষগুলোর দিকে তাকাল। তাদের কণ্ঠস্বর পরিচিত কিন্তু চেহারা পরিচিত নয়।

গ্রুস্তান আবার জিজ্ঞেস করল, কেন তোমরা আমাদের কন্টেইনারটি উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলে? তোমরা জান এই কন্টেইনারের ভেতর আমাদের মানুষেরা ঘুমাচ্ছে?

জানি।

তা হলে?

পৃথিবীতে শস্যের অভাব। আমরা আমাদের কমিউনের জন্যে শস্য নিতে চাই।

রিহান এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে, সে নিশ্চিত এই কণ্ঠস্বরটি আগে শুনেছে। মানুষগুলো অপরিচিত কিন্তু কণ্ঠস্বর পরিচিত সেটি কেমন করে হতে পারে? হঠাৎ রিহান বিদ্যৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, হ্যাঁ, তার মনে পড়েছে। এই মানুষ তিনজন প্রভু ক্লডের আদেশে তাকে হত্যা করার জন্যে নিয়েছিল। অন্ধকারে তাদের চেহারা দেখতে পায় নি শুধু গলার স্বর শুনেছে। রিহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কী আশ্চর্য কিছুদিন আগে যারা তাকে হত্যা করার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল এখন তারাই তার উদ্যত অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে?

রিহান এক পা এগিয়ে এসে বলল, তোমরা তোমাদের কমিউনের জন্যে শস্য নিতে চাও?

হ্যাঁ।

প্রয়োজন হলে অন্যদের ধ্বংস করে?

একজন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ প্রয়োজন হলে অন্যদের ধ্বংস করে। পৃথিবীতে যারা যোগ্য তারা বেঁচে থাকবে।

তোমাদের সেটা কে শিখিয়েছে? তোমাদের ঈশ্বর? তোমাদের প্রভু?

হ্যাঁ। আমাদের প্রভু।

রিহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের প্রভু ভুল জিনিস শিখিয়েছে।

মোটা গলার একজন মানুষ বলল, আমাদের প্রভু কখনো ভুল জিনিস শেখান না। আমাদের প্রভূ কখনো ভুল করেন না।

করেন, তোমার প্রভু হচ্ছে প্রভু ক্লড। এবং প্রভু ক্লড অনেক বড় ভুল করেছেন! আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তা হলে আমার দিকে তাকাও

মানুষগুলো অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল। ক্রিপটন ল্যাম্পের তীব্র আলোর কারণে প্রথমে তারা তাকে দেখতে পাচ্ছিল না। রিহান সেন্ট্রির দিকে ইঙ্গিত করতেই সে আলোটা খানিকটা তার দিকে ঘুরিয়ে আনে। মানুষগুলো রিহানকে দেখে হতবাক হয়ে যায়, বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না।

রিহান উদ্যত অস্ত্র হাতে মানুষগুলোর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, তোমার প্রভু আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল! সে যদি সত্যিকারের ঈশ্বর হত তার মৃত্যুদণ্ড থেকে আমি বেঁচে আসতে পারতাম না। তোমরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে, হত্যা করতে পার নি। আমি বেঁচে এসেছি। শুধু যে বেঁচে এসেছি তা নয়–এখন আমি তোমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছি। ট্রিগারে একটু টান দিলেই তোমাদের রক্তাক্ত শরীর এখানে পড়ে থাকবে।

গ্রুস্তান আর সেন্ট্রি দুজন অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান হিংস্র গলায় বলল, তোমরা বেঁচে থাকবে না মরে যাবে সেটা এখন নির্ভর করছে আমার ইচ্ছের ওপর। তোমার প্রভু ক্লড তোমার প্রাণ বাঁচাতে পারবে না–তোমার প্রাণ বাঁচাতে পারব আমি!

মানুষগুলো কোনো কথা না বলে হতচকিত হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান গ্রুস্তানের দিকে তাকিয়ে বলল, গ্রুস্তান, এদের কী করবে?

গ্রুস্তান হাত নেড়ে বলল, এরা হচ্ছে চতুর্থ শ্রেণীর ঘাতক। এদের বেঁচে থাকা মরে যাওয়ায় কিছু আসে যায় না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এদেরকে মেরে ফেললে পৃথিবীর উপকার হয়। কিন্তু আমরা মানুষ মেরে অভ্যস্ত নই।

মানুষগুলো হঠাৎ হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বলল, আমরা ক্ষমা চাই–আমাদের হত্যা করবেন না। ঈশ্বরের দোহাই।

রিহান জিজ্ঞেস করল, কোন ঈশ্বর? তোমাদের না আমাদের?

মানুষগুলো একমুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে তারপর বলে, আপনাদের ঈশ্বর।

রিহান হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, তোমাদের মেরে ফেললে পৃথিবীর উপকার হয়। কিন্তু তোমাদের আমরা মারব না তোমাদের ছেড়ে দেব। কেন ছেড়ে দেব জান?

মানুষগুলো মাথা নাড়ল, তারা জানে না।

তোমাদের ছেড়ে দেব যেন তোমরা তোমাদের প্রভু ক্লডের কাছে গিয়ে বলতে পার যে আপনি সত্যিকারের ঈশ্বর নন। আপনি মিথ্যা। আপনি যখন কোনো মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেন সেই মানুষের মৃত্যু হয় না। শুধু যে মৃত্যু হয় না তাই না, সেই মানুষ ফিরে এসে আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দেয়।

মানুষগুলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রিহান বলল, কী বলেছি তোমাদের মনে থাকবে?

মানুষগুলো মাথা নেড়ে জানাল যে তাদের মনে থাকবে। রিহান বলল, বেশ, এবারে দেখা যাক তোমাদের সাথে কী আছে। তোমাদের যন্ত্রপাতি, বিস্ফোরকগুলো রেখে দিই যেন ফিরে যাবার সময় অন্য কোনো মানুষের কোনো ক্ষতি করতে না পার।

রিহান কাছে গিয়ে বলল, দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও, দেখি তোমাদের শরীরে কী আছে।

.

মানুষগুলোর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, গুলির বেল্ট, বিস্ফোরক সরিয়ে রেখে তাদেরকে যখন যেতে দিল তখন পূর্বের আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। সূর্য ওঠার আগেই তারা বুঝতে পারল এই মানুষগুলোকে যেতে দিয়ে তারা বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। মানুষগুলো যাবার আগে শস্যক্ষেত্রে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে। সেই আগুন ধীরে ধীরে শস্যক্ষেত্রকে গ্রাস করতে আসছে। প্রভু ক্লডের অনুসারীরা কোনো মানুষকে এই শস্যের অংশ দেবে না প্রয়োজনে নিজের সর্বনাশ করে হলেও।

সবাই এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে শস্যক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিশাল এই শস্যক্ষেত্রটিতে প্রতি বছর শস্যের জন্ম হয়। তারা ভাসা ভাসা ভাবে জানে একসময় পৃথিবীতে অনেক মানুষ ছিল তখন নিশ্চয়ই এখানে তারা এগুলোকে শস্যভূমি তৈরি করেছিল। এখনো তার কিছু অবশেষ রয়ে গেছে মানুষের কোনো সাহায্য ছাড়াই এই বিশাল প্রান্তরে প্রতি বছর শস্য বেড়ে ওঠে। পৃথিবীতে এখন নানা কমিউনে যে মানুষেরা বেঁচে আছে তাদের অনেকে এখান থেকে শস্য কেটে নিয়ে যায়–যে পরিমাণ শস্য জন্মায় পৃথিবীর এই অঞ্চলে বেঁচে থাকা মানুষের জন্যে সেগুলো যথেষ্ট। কিন্তু আজ সেই শস্যক্ষেত্রে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, দেখতে দেখতে পুরো শস্যক্ষেত্র আগুনে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

রিহান কাঁপা গলায় বলল, গ্রুস্তান, এই আগুনটা আসতে কতক্ষণ লাগবে বলে মনে হয়?

বাতাস নেই তাই দুই–তিন ঘণ্টা লেগে যেতে পারে। বাতাস শুরু হলে দেখতে দেখতে চলে আসবে।

আমরা শুধু শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে আগুনটা না দেখে কিছু একটা কাজ করতে পারি না?

কী করতে চাও? এখানে তো ঈশ্বর প্রিমা নেই যে তাকে জিজ্ঞেস করব।

একজন বলল, ইশ! যদি কোনোভাবে ঈশ্বর প্রিমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম!

রিহান বলল, শুধু শুধু দাঁড়িয়ে না থেকে আমরা কি শস্য কাটা শুরু করতে পারি না?

গ্রুস্তান মাথা নেড়ে বলল, দুই–তিন ঘণ্টায় তুমি কতটুকু শস্য কাটবে?

রিহান খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, আগুনটা জ্বলছে শস্য গাছে। আমরা আগুনের পথে শস্যগুলো কেটে রাখতে পারি না যেন আগুন জ্বলার জন্যে কিছু না থাকে?

গ্রুস্তান বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল। রিহান বলল, নিহানার শস্য কাটার যন্ত্রটা শস্য গাছকে চমৎকারভাবে কাটতে পারে–আমরা সেটা ব্যবহার করে লম্বালম্বিভাবে শস্যক্ষেত্রে খানিকটা জায়গায় গাছগুলো একেবারে গোড়া পর্যন্ত কেটে সরিয়ে নেব। আগুনটা তখন এই পর্যন্ত এসে থেমে যাবে–আর এগুতে পারবে না কারণ আগুন জ্বলার জন্যে কিছু থাকবে না!

গ্রুস্তান খানিকক্ষণ অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আমার কী মনে হয় জান?

কী?

আমরা যদি ঈশ্বরী প্রিমাকে এখন জিজ্ঞেস করতাম, তা হলে তিনিও এটাই বলতেন!

তা হলে দেরি করে লাভ কী? চল কাজ শুরু করে দিই।

চল।

নিহানার তৈরি শস্য কাটার যন্ত্রটা শস্যক্ষেত্রে নামিয়ে আনা হল। সেটা শস্য কেটে যেতে থাকল এবং দলের বিশজনের সবাই কাটা শস্যের গাছগুলো সরিয়ে নিতে লাগল। ঘণ্টাখানেকের মাঝেই প্রায় দুই মিটার চওড়া আগুনের জন্যে একটা বাধা তৈরি করা হল। ততক্ষণে আগুনটা আরো এগিয়ে এসেছে, বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ, মাঝে মাঝে আগুনের ফুলকি ছুটে আসছে। সবাইকে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল আগুনের ফুলকি থেকে যেন নূতন কোনো আগুন শুরু হয়ে না যায় তার দিকে লক্ষ রাখতে।

আগুনের জ্বলন্ত শিখা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ফাঁকা জায়গাটাতে দুর্বল হয়ে পড়ে সেখানে জ্বলার মতো কিছু নেই। কিছুক্ষণ ধিকিধিকি করে জ্বলে আগুনটা নিভে যায়। সবাই বিস্মিত হয়ে দেখে শস্যক্ষেত্রের এক অংশ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে, অন্য পাশে সোনালি শস্যক্ষেত্র বাতাসে নড়ছে!

গ্রুস্তান রিহানকে জড়িয়ে ধরে বলল, রিহান তুমি আজ এখানে না থাকলে আমরা কিছুতেই শস্যক্ষেত্রটা বাঁচাতে পারতাম না। তোমার বুদ্ধিটা অসাধারণ।

রিহান মাথা নেড়ে বলল, উঁহু, নিহানা যদি তার শস্য কাটার যন্ত্রটা আবিষ্কার না করত আমরা কিছুই করতে পারতাম না! যত বুদ্ধিই থাকুক কোনো কাজই হত না।

নিহানা হেসে বলল, আমার যন্ত্রটা শস্য গাছগুলো কেটেছে–কিন্তু সবাই যদি কাটা গাছগুলো সরিয়ে না নিত কোনো লাভই হত না। কাজেই কৃতজ্ঞতা জানাতে হলে সেটা জানানো উচিত তাদেরকে।

গ্ৰস্তান হেসে বলল, ঠিক আছে! বোঝা যাচ্ছে কারো একার বুদ্ধিতে এই অসাধ্য সাধন হয় নি! সবাই মিলে করা হয়েছে।

কালিঝুলি মাখা কমবয়সী একজন তরুণ বলল, ঈশ্বরী প্রিমার সাহায্য ছাড়াই আমরা কত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি দেখেছ?

সবাই মাথা নেড়ে কথাটা মেনে নিল, শুধু রিহান চমকে উঠে ভাবল, এই কথাটার কি অন্য কোনো অর্থ রয়েছে? যদি সবাই একসঙ্গে থাকে তা হলে কি ঈশ্বর ছাড়াও কমিউন বেঁচে থাকতে পারবে?

পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা ফসল কাটা, মাড়াই করা, বাক্স বোঝাই করে ট্রাকে তোলার অমানুষিক পরিশ্রমের মাঝে ঘুরেফিরে রিহানের শুধু এই কথাটা মনে হতে থাকল।

৬. কারুকার্যখচিত মুখোশ

ঈশ্বরী প্রিমা বললেন, রিহান, তুমি বস।

রিহান চমকে উঠে ঈশ্বরী প্রিমার দিকে তাকাল। একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী কখনোই সাধারণ একজন মানুষকে তার নাম দিয়ে সম্বোধন করেন না, কখনোই তাদেরকে তার সামনে বসতে অনুরোধ করবেন না। রিহান তার বিস্ময়টুকু গোপন করে ঈশ্বরী প্রিমার নির্দেশ মতো তার সামনের চেয়ারটিতে বসল। এখন তাদের দুজনের ভিতরে দূরত্ব একটি পাথরের টেবিল। ঈশ্বরী প্রিমা তার সেই কারুকার্যময় মুখোশটি দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন। হালকা নীল রঙের পোশাকটির ভেতরে কিশোরীর মতো হালকা ছিপছিপে দেহের অবয়বটি দেখা যাচ্ছে। ঈশ্বরী প্রিমার সামনে বসে রিহান এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে, তিনি কেন তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন সে জানে না। নিশ্চয়ই সে বড় কোনো অপরাধ করে নি, তা হলে তাকে নাম ধরে ডাকতেন না, তাকে বসতে বলতেন না।

ঈশ্বরী প্রিমা দীর্ঘ সময় মুখোশের ভেতর দিয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী সম্পর্কে তুমি কতটুকু জান রিহান?

রিহান এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করে, নিচু গলায় বলে, আমি বেশি কিছু জানি না ঈশ্বরী প্রিমা।

তুমি কেন সাধারণ একজন মানুষ রিহান আর আমি কেন ঈশ্বরী প্রিয়া তুমি বলতে পারবে?

রিহান মাথা নাড়ল, বলল, পারব না ঈশ্বরী প্রিমা। শুনেছি অসংখ্য মানুষের মাঝে একজন দুইজন ঈশ্বরের ক্ষমতা নিয়ে জন্মান। তাদেরকে খুঁজে বের করে ঈশ্বরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তাদেরকে কেমন করে খুঁজে বের করা হয়?

আমি জানি না ঈশ্বরী প্রিমা। রিহান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যখন। আপনার চলে যাবার সময় হবে তখন আপনি নূতন একজন ঈশ্বরকে দায়িত্ব দেবেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন কে ঈশ্বর হয়ে জন্ম নিয়েছে।

ঈশ্বরী প্রিমা মুখোশের আড়ালে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠলেন, মুখোশটি হাসছে না, শুধু মানুষটি হাসছে বিষয়টি রিহানকে এক ধরনের বিভ্রান্তির মাঝে ফেলে দিল। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি কেন হাসছেন ঈশ্বরী প্রিমা?

ঈশ্বরী প্রিমা হাসি থামিয়ে বললেন, কেন? শুধু তোমরা মানুষেরা হাসবে আনন্দ করবে আমরা ঈশ্বর এবং ঈশ্বরীরা চার দেয়ালের মাঝে কঠিন মুখ করে বসে থাকব সেটি কেমন নিয়ম?

আমি সেটা বলি নি ঈশ্বরী প্রিমা।

আমি জানি তুমি সেটা বলে নি।

আমি বলেছিলাম–।

তুমি বলেছিলে তুমি ঈশ্বরের কোনো অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস কর না।

রিহান মাথা নিচু করে বলল, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন ঈশ্বরী প্রিমা।

তুমি বলেছিলে তুমি একজন ঈশ্বরীকে করুণা কর, তার জন্যে দুঃখ অনুভব কর

রিহান ব্যস্ত হয়ে বলল, আমি সেভাবে বলি নি

তুমি বলেছ একজন ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরী খুব নিঃসঙ্গ।

রিহান মাথা নিচু করে বলল, হ্যাঁ। আমি সেটা বলেছিলাম। আমার সব সময় মনে হয়েছে

ঈশ্বরী প্রিমা রিহানকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এটি কোন বিচার যে তুমি রিহান হয়ে জীবনকে উপভোগ করবে আর আমি ঈশ্বরী হয়ে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে থাকব?

রিহান কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে ঈশ্বরী প্রিমার দিকে তাকাল। তার কারুকার্যময় মুখোশের আড়ালে এই মুহূর্তে কী অনুভূতি খেলা করছে সেটি দেখতে পাচ্ছে না। সেখানে কি ভয়ংকর ক্রোধ? তীব্র অভিমান? নাকি গভীর বিষাদ?

ঈশ্বরী অরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, তুমি জান ঈশ্বরী হবার জন্যে আমার কী ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে?

না। জানি না।

আমার বাবা–মা ছিল। ছোট দুজন ভাই ছিল। সবাইকে ছেড়ে এখানে আসতে হয়েছে।

আমি দুঃখিত ঈশ্বরী প্রিমা।

দুঃখ বলতে কী বোঝায় সেটা তোমরা জান না রিহান। আমি ঈশ্বরী হয়ে এখানে আসার পর যে আমার বাবা–মা ছোট ছোট দুজন ভাই দুর্ঘটনায় মারা গেছে সেটি কি শুধু দুর্ঘটনা? নাকি হত্যাকাণ্ড?

রিহান কোনো কথা না বলে বিস্ফারিত চোখে ঈশ্বরী প্রিমার দিকে তাকিয়ে রইল।

ঈশ্বরী প্রিমা ভাঙা গলায় বললেন, আমি তো ঈশ্বরী হতে চাই নি। আমি তো সাধারণ মানুষ হয়ে বড় হতে চেয়েছিলাম। আমি ছোট একটা সংসার চেয়েছিলাম, ভালোমানুষ একজন স্বামী চেয়েছিলাম। ছোট একটি সন্তান চেয়েছিলাম। তাকে গভীর ভালবাসায় বুকে চেপে ধরতে চেয়েছিলাম। তা হলে কেন আমাকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে তোমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে?

রিহান কোনো কথা না বলে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ঈশ্বরী প্রিমার দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশ্বরী প্রিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি আমার নিজের জীবনকে গ্রহণ করে ফেলেছিলাম। পুরো জীবন ঈশ্বরী হয়ে থেকে তোমাদের সুখ শান্তি আর নিরাপত্তার জন্যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলাম। নিজের ভিতরে মানুষের সব অনুভূতি মুছে সেখানে ঈশ্বরের কাঠিন্য নিয়ে এসেছিলাম। তখন, ঠিক তখন–

তখন কী ঈশ্বরী প্রিমা?

তখন তুমি এসে বললে তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর না! ঈশ্বর তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে নি। ঈশ্বরের কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই–শুধু তাই না, তুমি বললে তুমি জান যে ঈশ্বরী আসলে নিঃসঙ্গ।

রিহান কোনো কথা না বলে ঈশ্বরী প্রিমার কারুকার্যখচিত মুখোশটির দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশ্বরী প্রিমা একটি নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি না জেনে আমার জীবনকে ওলটপালট করে দিয়েছ। আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি। আমাদের কমিউনে তুমি যেটা করতে চেয়েছ আমি তোমাকে সেটা করতে দিয়েছি।

আমি সেজন্যে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ ঈশ্বরী প্রিমা।

আমার ধারণা, সেটি আমাদের কমিউনের জন্যে খুব চমৎকার একটি ব্যাপার হয়েছে। ঈশ্বরীর সাহায্য না নিয়ে তোমরা বড় বড় সমস্যার সমাধান করেছ!

রিহান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। করেছি।

একজন ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরীর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে কমিউনের সব মানুষকে সর ব্যাপারে তার ওপর নির্ভরশীল রাখা, নিশ্চিত করা মানুষ যেন কখনোই নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে। কিন্তু আমি তাদেরকে পায়ে দাঁড়াতে দিয়েছি, আমি সবাইকে একজন ঈশ্বর ছাড়া, বেঁচে থাকা শেখাতে চাই।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

কিন্তু রিহান আজকে আমি তোমাকে ডেকেছি একটি সত্য কথা বলার জন্য।

রিহানের বুক কেঁপে উঠল, জিজ্ঞেস করল, কী কথা?

আমি এই কমিউনের মানুষকে কেন নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে দিয়েছি তুমি জান? কেন ঈশ্বরের সাহায্য ছাড়া তাদের বেঁচে থাকতে শিখাচ্ছি?

তাদের ভালোর জন্যে, তাদের ভবিষ্যতের জন্যে

না–না–না। ঈশ্বরী প্রিমা তীব্র কণ্ঠে কথা বলতে বলতে মাথা নাড়লেন, আমি এটা করেছি আমার নিজের জন্যে।

নিজের জন্যে?

স্যা। আমার নিজের জন্যে! আমি আর ঈশ্বরী প্রিমা থাকতে চাই না। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই। তুচ্ছ একজন মানুষ, অকিঞ্চিতকর একজন মানুষ! আমার ছোট একটা ঘরে ছোট একটা শিশু থাকবে, সাদাসিধে একজন স্বামী থাকবে, আমরা সারা দিন খেটেখুটে একমুঠো খাবার খাব–মাথার উপর একটা আচ্ছাদন থাকবে

ঈশ্বরী প্রিমা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। মুখ তুলে রিহানের দিকে তাকালেন, বললেন, রিহান, তুমি একজন ঈশ্বরীকে মানুষ হবার স্বপ্ন দেখিয়েছ! দোহাই তোমার, তোমাকে এই স্বপ্ন পূরণ করে দিতে হবে।

রিহান হতচকিত হয়ে বলল, আমাকে?

হ্যাঁ। তুমি বলেছ একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরীর কাছে কিছু তথ্য থাকে যেটা অন্য কারো কাছে থাকে না।

আমি সেটা অনুমান করেছিলাম।

তোমার অনুমান সত্যি। আমি তোমার মতো একজন সাধারণ মানুষ–শুধু একটা পার্থক্য আমার কাছে এমন তথ্য আছে যেটা কোনো মানুষের কাছে নেই!

রিহান অবাক হয়ে বলল, কোথায় আছে সেই তথ্য? কেমন করে আছে?

আমি সব তোমাকে বলব। কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাও আমাকে আবার মানুষের মতো বাচতে দেবে।

ঈশ্বরী প্রিমা, আপনি যেটা বলছেন সেটা অনেক বড় একটা দায়িত্ব। আমি কি সেটা পারব?

আমি একা যদি এতদিন সেটা পেরে থাকি তুমি সবাইকে নিয়ে সেটা পারবে না?

আমি এখনো সেটা জানি না ঈশ্বরী প্রিমা। কিন্তু আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি আমি চেষ্টা করব। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করব।

ঈশ্বরী প্রিমা কাঁপা হাতে তার কারুকার্যময় মুখোশটি খুলে নিলেন, রিহান বিষয়ে হতবাক হয়ে গেল, মুখোশের আড়ালে একটি তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়ের মুখ। বড় বড় নিষ্পাপ চোখ, সেই চোখে ব্যাকুল একটা দৃষ্টি, পাতলা গোলাপি ঠোঁট, সেখানে বিষণ্ণতার একটা ছাপ। রিহান কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তু–তু–তুমি ঈশ্বরী প্রিমা?

ঈশ্বরী প্রিমা মাথা নাড়ল।

তুমি তো ছোট একটি মেয়ে!

হ্যাঁ। আমি ছোট একটি মেয়ে। আমি খুব ভীতু আর দুর্বল ছোট একটি মেয়ে। কিশোরী মেয়েটি কার গলায় বলল, বলল, তুমি আমাকে রক্ষা করবে। বলো–কথা দাও।

রিহান নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়াল, তারপর কিশোরী মেয়েটির কাছে গিয়ে তার হাত স্পর্শ করল, বলল, ঈশ্বরী প্রিমা

না। মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, ঈশ্বরী নয়, বলো প্রিমা। শুধু প্রিমা।

প্রিমা–আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি রক্ষা করব।

কিশোরী মেয়েটি যে কিছুক্ষণ আগেও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরী প্রিমা ছিল, রিহানের দুই হাত ধরে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল। রিহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর খুব সাবধানে মেয়েটির মুখটাকে দুই হাতে ধরে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই প্রিমা! কোনো ভয় নেই।

.

রাত্রিবেলা রিহানের চোখে ঘুম আসছিল না। ঈশ্বরী প্রিমাকে আজ সে যেভাবে দেখে এসেছে সেটি কিছুতেই ভুলতে পারছে না। কিশোরী মেয়েটি যখন আকুল হয়ে কাঁদছিল গভীর একটি দুঃখে তার বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল। এখনো তার বুকের ভিতরে সেই কষ্টটি রয়ে গেছে, কিছুতেই সেটা দূর করতে পারছে না।

রিহান বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে একসময় নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে গেল।

কে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে–রিহান চোখ খুলে তাকাল। গ্রুস্তান উদ্বিগ্ন মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিহান হঠাৎ ধড়মড় করে জেগে উঠল, কী হয়েছে গ্রুস্তান?

ঘুম থেকে ওঠ তাড়াতাড়ি।

কেন?

ঈশ্বরী প্রিমা জরুরি খবর পাঠিয়েছেন।

রিহান চমকে উঠে বলল, কী জরুরি খবর পাঠিয়েছেন?

এই মুহূর্তে তোমাকে যেন সরিয়ে নেওয়া হয়।

আমাকে? রিহান অবাক হয়ে বলল, কেন?

জানি না। কিন্তু ঈশ্বরী প্রিমার আদেশ এটা।

কেন এরকম আদেশ দিয়েছেন?

গ্রুস্তান গম্ভীর মুখে বলল, নিশ্চয়ই তাঁর কাছে কোনো জরুরি খবর আছে।

কীসের জরুরি খবর?

বাইরে এসে দেখ।

রিহান বাইরে এসে স্তম্ভিত হয়ে গেল। চারদিকে বিন্দু বিন্দু আলো কাঁপছে, তার সাথে চাপা গুঞ্জন। তাদের কমিউনের দিকে শত শত মোটরবাইক ছুটে আসছে। বিন্দু বিন্দু আলোগুলো মোটরবাইকের হেডলাইটের আলো, গুঞ্জনটি বহুদূর থেকে ভেসে আসা শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জন। রিহান কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তারপর ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করে, কী হচ্ছে এখানে?

আমাদের আক্রমণ করতে আসছে।

কারা?

সবাই।

রিহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, সবাই?

হ্যাঁ সবাই। এই এলাকায় যতো কমিউন আছে তাদের সবাই।

সে কী? কেন?

জানি না। কিন্তু আমার ধারণা তোমার জন্যে।

আমার জন্যে?

গ্রুস্তান গম্ভীর হয়ে বলল, একজন ঈশ্বর তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল–তুমি সেই মৃত্যুদণ্ড থেকে পালিয়ে এসেছ। তোমাকে সেই মৃত্যুদণ্ড পেতে হবে। যদি না পাও তা হলে সেই ঈশ্বর অর্থহীন হয়ে যায়। অসত্য হয়ে যায়। সেটি কেউ মেনে নিতে পারছে না।

রিহান কাঁপা গলায় বলল, মেনে নিতে পারছে না?

ঈশ্বরী প্রিমা ছাড়া। ঈশ্বরী প্রিমা তোমাকে বাঁচাতে চান। তাই তোমাকে সরে যেতে বলছেন।

রিহান হঠাৎ কঠিন মুখে বলল, আমি সরে যাব না।

তুমি কী করবে?

আমি এখানে থাকব।

কেন?

ওদের সাথে যুদ্ধ করব।

গ্রুস্তান কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠে বলল, তুমি এই কয়েক হাজার মানুষের সাথে যুদ্ধ করবে?

তা হলে আমরা কী করব?

সেটা ঈশ্বরী প্রিমাকে সিদ্ধান্ত নিতে দাও।

ঈশ্বরী প্রিমা কী সিদ্ধান্ত নেবেন?

গ্রুস্তান কঠিন মুখে বলল, দেখ রিহান, ঈশ্বর এবং ঈশ্বরীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমি এর আগেও অনেক বড় বিপদ ডেকে এনেছ–এবারে সেটি না হয় নাই করলে।

রিহান গ্রুস্তানের মুখের দিকে তাকাল, হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে সে কেমন যেন অসহায় অনুভব করে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, গ্রুস্তান। এরা সবাই যদি আমাকে ধরার জন্যে আসে তা হলে পালিয়ে না গিয়ে আমার এখানে থাকা উচিত। আমাকে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে তারা চলে যাবে। এখানে আর কারো কোনো ক্ষতি করবে না।

গ্রুস্তান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমারও তাই ধারণা।

কাজেই আমি পালিয়ে যেতে চাই না। আমি এখানে থাকতে চাই।

কিন্তু ঈশ্বরী প্রিমা চান তুমি চলে যাও। কাজেই তোমাকে চলে যেতে হবে।

আমি যাব না।

ঈশ্বরীর নির্দেশ তুমি অমান্য করতে পারবে না। তুমি যেতে না চাইলে তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবার নির্দেশ আছে।

জোর করে?

হ্যাঁ। গ্রুস্তান বলল, তোমার ঠিক কোথায় আঘাত করলে তুমি দীর্ঘ সময়ের জন্যে অজ্ঞান হয়ে যাবে, ঈশ্বরী প্রিমা সেটাও বলে দিয়েছেন।

রিহান কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই কিছু একটা তীব্র শক্তিতে তার ঘাড়ে আঘাত করে। কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে।

.

রিহান যখন চোখ খুলে তাকাল তখন অন্ধকার কেটে পূর্ব আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। উঠে বসতে গিয়ে হঠাৎ সে মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে। দুই হাতে খানিকক্ষণ তার মাথা ধরে রেখে সে সাবধানে উঠে বসে, ভোরের শীতল বাতাসে সারা শরীর হঠাৎ একটু কেঁপে উঠল। সে কোথায় আছে কেমন আছে মনে করার চেষ্টা করল, এবং হঠাৎ করে তার পুরো ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। শত শত মোটরবাইক হিংস্র পশুর মতো তাদের কমিউনের দিকে ছুটে আসছিল এবং তার মাঝে তাকে অচেতন করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাকে কোথায় সরিয়ে নিয়েছে?

রিহান উঠে বসে চারদিকে তাকায়, পাহাড়ি একটা এলাকা–আগে কখনো এখানে এসেছে বলে মনে পড়ে না। রিহান সাবধানে উঠে দাঁড়ায়, বড় বড় কিছু পাথরের আড়ালে তাকে রেখে গেছে। পাথরগুলো ধরে সে বের হয়ে আসে, সামনে একটা বড় উপত্যকা তার অন্যপাশে বহুদূরে আবছাভাবে তাদের কমিউনটি দেখা যাচ্ছে। রিহান ভোরের আবছা আলোতে কমিউনটি ভালো করে দেখার চেষ্টা করল, তার আশঙ্কা হচ্ছিল হয়তো দেখবে পুরো কমিউনটি জ্বালিয়ে অঙ্গার করে দিয়েছে, মৃত মানুষের দেহ আর কালো ধোঁয়ায় সেটি বীভৎস হয়ে আছে। কিন্তু সেরকম কিছু দেখল না। মনে হল কমিউনটির কোনো ক্ষতি হয় নি–ঠিক সেভাবেই আছে। রিহান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, তার জন্যে পুরো কমিউনটি ধ্বংস করে দেওয়া হলে সে কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না।

রিহান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে তার কমিউনের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।

কমিউনের কাছাকাছি পৌঁছেই রিহান বুঝতে পারল কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। তাকে প্রথমে দেখতে পেল ত্রান, কিন্তু তাকে দেখে ত্রানা অন্যবারের মতো তার কাছে ছুটে এল না, বরং দূরে সরে গেল। রিহান আরেকটু কাছে যেতেই লরি ট্রাক থেকে মানুষজন বের। হয়ে আসতে থাকে কিন্তু কেউ তার সাথে কোনো কথা বলে না, কেমন যেন আতঙ্ক ক্রোধ এবং ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রিহান কেমন যেন ভয় পেয়ে যায়, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না। ঠিক এরকম সময় সে গ্রুস্তানকে দেখতে পেল, একটা ট্রাকের পাটাতনে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। রিহাত দ্রুত পায়ে তার কাছে হেঁটে যায়, গ্রুস্তান তার দিকে তাকাল কিন্তু তার মুখে কোনো অভিব্যক্তির ছাপ পড়ল না।

রিহান ভয় পাওয়া গলায় ডাকল, গ্রুস্তান।

গ্ৰস্তান কোন কথা না বলে শীতল চোখে তার দিকে তাকাল। রিহান জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে গ্রুস্তান?

তুমি এখনো জান না?

না।

গ্রুস্তান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ঈশ্বরী প্রিমাকে ধরে নিয়ে গেছে।

রিহান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না, বিস্ফারিত চোখে গ্রুস্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েকবার চেষ্টা করে বলে, ঈশ্বরী প্রিমাকে? ধরে নিয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

রিহান মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেল, কমিউনের সবাই ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবার দৃষ্টি শীতল। সবার মুখে এক ধরনের ঘৃণা। রিহান শুষ্ক গলায় জিজ্ঞেস করল, কেন তারা ঈশ্বরী প্রিমাকে ধরে নিয়ে গেছে?

তোমাকে না পেয়ে।

আমাকে না পেয়ে?

হ্যাঁ। তোমাকে যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, সেটি তোমাকে পেতে হবে তাই। তোমাকে না পেলে ঈশ্বরী প্রিমাকে।

রিহান কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, এখন কী হবে?

আমাদের সবাইকে ভাগাভাগি করে অন্য সব কমিউনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

কেন?

আমাদের কোনো ঈশ্বর নেই। কোনো ঈশ্বরী নেই। আমরা কেমন করে থাকব?

হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল, সব তোমার জন্যে রিহান। তুমি এসে আমাদের কমিউনে সব নষ্ট করে দিয়েছ। সব ধ্বংস করে দিয়েছ।

রিহান চমকে উঠে তাকাল, অন্য সবাই মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ তোমার জন্যে। তোমার জন্যে নির্বোধ কোথাকার!

রিহান এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাকায়, সবাই কেমন যেন ক্ষিপ্ত পশুর মতো মারমুখী হয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে তাকে ধরে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ঠিক তখন কোথা থেকে জানি নীলন এসে হাজির হল, ভিড় ঠেলে ভিতরে এসে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, শান্ত হও। সবাই শান্ত হাও। ঈশ্বরী প্রিমা তার শেষ কথায় তোমাদের বলে গেছেন তোমরা যেন রিহানকে ভুল না বোঝ। ঈশ্বরী বলেছেন তাকে ক্ষমা করে দিতে

না, আমরা ক্ষমা করব না। কিছুতেই ক্ষমা করব না। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা রাগে উন্মত্ত মানুষেরা চিৎকার করে বলল, আমরা খুন করে ফেলব। টুটি ছিঁড়ে ফেলব।

নীলন রিহানকে আড়াল করে রেখে বলল, তোমরা শান্ত হও। শান্ত হও–কোনো পাগলামো করো না। আমরা সভ্য মানুষ, সভ্য মানুষের মতো ব্যবহার করতে হবে।

মধ্যবয়সী একজন মানুষ চিৎকার করে বলল, আমি তখনই বলেছিলাম এই মানুষটাকে এখানে ঢুকতে দিও না

একজন মহিলা বলল, যখন আমাদের ঈশ্বরী প্রিমাকে ধরে নিয়ে শেষ করে দেবে তখন রিহান এখানে বেঁচে থাকবে, ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াবে সেটি কেমন করে হয়?

বেশ কয়েকজন চিৎকার করে বলল, খুন করে ফেলো। খুন করে ফেলল এই হতভাগাকে

রিহান হতচকিত হয়ে এই ক্রুদ্ধ মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের ক্রোধ অর্থহীন নয়, সত্যি সত্যিই তার জন্যে আজ ঈশ্বরী প্রিমাকে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু শুধু কি তার জন্যে? রিহান বুকের ভিতরে এক ধরনের গভীর হতাশা অনুভব করে। গভীর দুঃখে তার বুক ভেঙে যেতে চায়। সে নীলনকে পাশ কাটিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল, সবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দাও।

কে জানি চিৎকার করে বলল, না। দেব না। খুন করে ফেলব তোমাকে।

রিহান বলল, তোমরা যদি আমাকে খুন করতে চাও আমি সেটার জন্যেও প্রস্তুত। কিন্তু আগে আমাকে দুটি কথা বলতে দাও।

কী কথা?

তোমরা সবাই বলছ পুরো ব্যাপারটার জন্যে দায়ী আমি। সত্যি কথা বলতে কী আমি এমন কিছু ব্যাপার জানি যেটা অন্য কেউ জানে না! জানলে পুরো ব্যাপারটা তোমরা। অন্যভাবে দেখতে। কিন্তু আমি সেখানে যাচ্ছি না। আমি সমস্ত দোষ স্বীকার করে নিচ্ছি। আমি আমার কাজকর্ম দিয়ে যেসব দুঃখকষ্ট তৈরি করেছি তার জন্যে ক্ষমা চাইছি। তোমরা যদি আমাকে অনুমতি দাও তা হলে আমি এই মুহূর্তে প্রভু ক্লডের কাছে ধরা দেব। তার দেওয়া মৃত্যুদণ্ড মেনে নিয়ে ঈশ্বরী প্রিমাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্যে অনুরোধ করব।

রিহানকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা কেউ কোনো কথা বলল না। রিহান নীলনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমাকে একটা মোটরবাইক দেবে? সাথে কিছু গ্যাসোলিন।

গ্রুস্তান বলল, সেটি সমস্যা নয়।

তা হলে সমস্যা কী?

তুমি কোথায় গিয়ে ধরা দেবে? এই বিশাল এলাকা তুমি চেন, কোন কমিউনটি কোথায় তুমি জান?

রিহান মাথা নেড়ে বলল, না। জানি না।

তা হলে?

নীলন বলল, আমার কাছে একটি ম্যাপ আছে।

সেই ম্যাপে কমিউনগুলো দেখানো আছে?

নেই। কিন্তু ঈশ্বরী প্রিমার কাছে একটা তালিকা আছে। তার ঘরের দেয়ালে টাঙানো থাকে। সেখানে কমিউনগুলোর অবস্থান বলা আছে।

গ্রুস্তান ভুরু কুঁচকে নীলনের দিকে তাকাল, তুমি কেমন করে জান?

নীলন বলল, আমি জানি। আমি তার ঘরে গিয়েছি। তার ঘরের সবকিছু ভেঙেচুরে দিয়ে গেছে। কিন্তু কাগজপত্রগুলো আছে।

রিহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তা হলে আমাকে ম্যাপটি আর এই কমিউনের তালিকাটি দাও। আমি ঈশ্বরী প্রিমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য ধরা দেব। এই মুহূর্তে।

কেউ কোনো কথা বলল না। রিহান সবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা আমার জন্যে শুভ কামনা কর যেন আমি ঈশ্বরী প্রিমাকে ফিরিয়ে আনতে পারি।

কেউ এবারেও কোনো কথা বলল না।

রিহান আবার বলল, তোমরা কি আমার জন্যে শুভ কামনা করবে না?

নীলন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যে মানুষটি মারা যাবার জন্যে যাচ্ছে তার জন্যে শুভ কামনা করা যায় না। শুভ মৃত্যুদণ্ড বলে কিছু নেই রিহান।

কমবয়সী একটি মেয়ে হঠাৎ অপ্রকৃতস্থের মতো হেসে উঠে বলল, শুভ মৃত্যুদণ্ড হি–হি–হি।

রিহান বিস্ফারিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

৭. বৃত্ত

রিহান মোটরবাইকটি নিয়ে পাথুরে প্রান্তরের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। মরুভূমির উত্তপ্ত বাতাসের হলকা চোখে–মুখে এসে লাগছে, ম্যাপ অনুযায়ী সামনে একটা উঁচু পাহাড় আসবে সেটা ঘুরে ডান দিকে যেতে হবে। কমিউনগুলো কোথায় সেটা সে কনট্যুর মেপে বসিয়ে নিয়েছে, একটার পর আরেকটা কমিউন খুঁজে খুঁজে যেতে হবে।

মোটরবাইকে ছুটে যেতে যেতে রিহান বুঝতে পারে কিছু একটা ব্যাপার তাকে খানিকটা বিচলিত করে রেখেছে কিন্তু সেটি কী সে ঠিক ধরতে পারছে না। যাকে সবাই ঈশ্বরী প্রিমা হিসেবে জানে সে যে খুব দুঃখী অসহায় বাচ্চা একটি মেয়ে সেটি রিহান ছাড়া আর কেউ জানে না। এই মুহূর্তে সে মাথা থেকে সেটি সরিয়ে রেখেছে। সে যখন প্রভু ক্লডের

কমিউনে হাজির হবে তখন তাকে যে হত্যা করা হবে কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে সেটাও তাকে সেরকম বিচলিত করছে না। একটু আগে সবাই মিলে তাকে যেভাবে অপমান এবং লাঞ্ছনা করেছে সেই গ্লানিটুকুও এই মুহূর্তে তার মাথার মাঝে নেই। সবকিছু ছাপিয়ে অন্য একটি বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটেছে বলে তার মনে হচ্ছে কিন্তু সেটা কী রিহান ঠিক ধরতে পারছে না। তার পকেটে রাখা ম্যাপের মাঝেই বিস্ময়টুকু লুকানো আছে বলে তার কাছে মনে হচ্ছে কিন্তু সেটি কোথায় ঠিক বুঝতে পারছে না। রিহান অন্যমনস্কভাবে মোটরবাইকটি ছুটিয়ে নিতে নিতে পাহাড়ের ঢালে একটা ছায়া ঢাকা জায়গা দেখে থেমে গেল। কোমরে ঝোলানো পানির বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে সে পকেট থেকে ম্যাপটা বের করে আবার সেই ম্যাপের দিকে তাকাল। বেশ বড় একটি নিখুঁত কনট্র্যর ম্যাপ, এই পুরো এলাকাটি খুব চমৎকারভাবে দেখানো রয়েছে। রওনা দেবার আগে সে বেশ কয়েকটি কমিউনের অবস্থান ম্যাপের মাঝে বসিয়ে নিয়েছে, মোটামুটি আধবৃত্তাকারভাবে ছড়িয়ে আছে। রিহান কিছুক্ষণ ম্যাপটির দিকে তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে অন্য কমিউনের অবস্থানগুলো বের করে ম্যাপের মাঝে বসাতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই রিহান তার। বিস্ময়ের কারণটুকু বুঝতে পারে। সবগুলো কমিউনের অবস্থান একটা নিখুঁত বৃত্তের উপর। কী আশ্চর্য!

রিহান হতচকিত হয়ে ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থাকে, এটি কেমন করে সম্ভব? একটি কমিউন কিছুক্ষণ এক জায়গায় থেকে স্থান বদল করে অন্য জায়গায় যায়। সব সময়েই সবাই ভেবে এসেছে এই স্থান বদলগুলোতে কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু সেটা সত্যি নয় তারা নিখুঁত একটা বৃত্তের উপর থাকে। রিহান তার হাতের তালিকাটি দেখল, বিভিন্ন কমিউন আগে কোথায় ছিল সেগুলোও এখানে দেওয়া আছে। রিহান ধৈর্য ধরে সেগুলোও ম্যাপে বসাতে থাকে এবং বিস্মিত হয়ে দেখে সেগুলোও এই বৃত্তের মাঝে! কখনোই বৃত্তের বাইরে নয়। যার অর্থ গত অর্ধশতাব্দী থেকে সবগুলো কমিউন বৃত্তাকারে ঘুরছে। কী আশ্চর্য!

রিহান ম্যাপটির দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে বুঝতে পারে এটি বিক্ষিপ্ত কোনো ঘটনা নয়, এবং হঠাৎ করে এটি ঘটে নি এর পেছনে একটা কারণ আছে। রিহানকে কেউ বলে দেয় নি কিন্তু সে জানে কারণটি নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। রিহান আকাশের দিকে তাকাল, সূর্যটা ঢলে পড়তে শুরু করেছে। বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছাতে হলে তার এখনই আবার রওনা দেওয়া উচিত, কিন্তু এই বিচিত্র রহস্যটির একটা কিনারা না করে সে কেমন করে যাবে? সে তো এ জীবনে আর কখনো এই রহস্যটি সমাধান করতে পারবে না।

রিহান আবার ম্যাপের দিকে তাকাল, এই এলাকায় অসংখ্য কমিউনের মানুষেরা জানে না তারা একটি বিশাল বৃত্তের পরিধি বরাবর ঘুরছে। সেই বৃত্তটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো তার মনে হল এই বৃত্তটির একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র রয়েছে, আর সেই কেন্দ্রটিতেই নিশ্চয়ই রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে। কমিউনের সব মানুষ যে কেন্দ্রটিকে নিয়ে ঘুরছে সেই কেন্দ্রটি নিশ্চয়ই সাধারণ জায়গা নয়–নিশ্চয়ই সেটি একটি অসাধারণ জায়গা, নিশ্চয়ই এই জায়গাটির একটা অস্বাভাবিক গুরুত্ব আছে।

রিহান ম্যাপটির ওপর ঝুঁকে পড়ল, বৃত্তের পরিধিকে সমান দুভাগে ভঁজ করে বৃত্তের একটা ব্যাস বের করে নেয়। দ্বিতীয়বার অন্য একটি অংশে ভাঁজ করে দ্বিতীয় একটা ব্যাস বের করে নেওয়ার সাথে সাথে দুটি ব্যাসের সংযোগস্থলে বৃত্তের কেন্দ্রটি বের করে ফেলল। কেন্দ্রটি পড়েছে সামনে যে পাহাড়ের সারি আছে তার ভেতরে কোনো একটি ছোট পাহাড়ের উপর। আলাদা করে সেটিকে বোঝার কোনো উপায় নেই, এর কোনো বিশেষত্ব আছে সেটাও বোঝার উপায় নেই, শুধুমাত্র এই ম্যাপটির দিকে তাকালে এই জায়গাটার গুরুত্বটা ভয়ানকভাবে চোখে পড়ে।

রিহান ম্যাপটা ভাঁজ করে পকেটে রাখে, তাকে এই জায়গাটি আগে খুঁজে বের করতে হবে, এই রহস্যের সমাধান না করে সে মারা যেতে পারবে না।

ঘণ্টাখানেক মোটরবাইকে গিয়ে রিহান পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছাল, এখান থেকে বাকিটা তার হেঁটে যেতে হবে। এবড়োখেবড়ো পাথরে পা দিয়ে সে পাহাড়ে উঠতে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে গরমে ঘেমে ওঠে। পানির বোতলে পানি কমে আসছে। সে সাবধানে দুই এক চুমুক খেয়ে বাকি পানিটুকু বাচিয়ে রাখতে চেষ্টা করল, তাকে কতদূর যেতে হবে কে জানে। ঘণ্টাখানেক উপরে উঠে সে তার ম্যাপটি খুলে তাকাল, পথ ভুলে সে অন্য কোনোদিকে চলে যাচ্ছে না এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করার জন্যে। কনট্র ম্যাপে দেখানো আছে সামনে একটা ছোট পাহাড় ডান দিকে খাড়া নেমে যাবার কথা, রিহান তাকিয়ে সামনের ছোট পাহাড় এবং ডান দিকে খাড়া ঢালুটি দেখতে পেয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল। সামনের ছোট পাহাড়টি পার হবার পর একটা ঢালু জায়গা থাকার কথা, তারপর হঠাৎ খাড়া উপরে উঠে গেছে, সেই খাড়া বেয়ে উঠে গেলেই নির্দিষ্ট জায়গাটা পেয়ে যাবে। রিহান সূর্যের দিকে তাকাল, যদি কোনো ঝামেলা না হয় সূর্য ডুবে যাবার আগেই সে সেই রহস্যময় জায়গায় পৌঁছে যাবে।

রিহানের হঠাৎ একটা বিচিত্র কথা মনে হল, এমন যদি হয় যে সে গিয়ে দেখে যে জায়গাটি এই বিচিত্র বৃত্তের কেন্দ্র সেটি আসলে পুরোপুরি বিশেষত্বহীন একটা জায়গা তা হলে কী হবে? রিহান জোর করে চিন্তাটি মাথা থেকে সরিয়ে দেয়–এটি হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না।

শেষ পর্যন্ত রিহান যখন নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছেছে তখন সে কুলকুল করে ঘামছে। পাহাড়ের উপরে বেশ খানিকটা জায়গা তুলনামূলকভাবে সমতল, রিহান সেখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে ঘুরে তাকাল। অনেকটুকু উপরে উঠে এসেছে, সূর্যের শেষ রশ্মি পড়ে দূরে মরুভূমির এই এলাকাটিতে এক ধরনের লালচে আভা, হঠাৎ দেখে মনে হয় এটি বুঝি পৃথিবীর কোনো অংশ নয়–মনে হয় এটি কোনো পরাবাস্তব জগতের অংশ। রিহান পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখতে শুরু করে। তার ভেতরে এক ধরনের আশা ছিল যে এখানে সে কোনো একটা ঘর বা দালান দেখবে, কিন্তু এখানে সেরকম কিছু নেই। সে প্রায় আশা হারিয়ে ফেলছিল কিন্তু হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল জায়গাটি আসলে বৈশিষ্ট্যহীন নয়, এর একটা বৈশিষ্ট্য আছে–জায়গাটি তুলনামূলকভাবে সমতল এবং হঠাৎ করে প্রকৃতিতে এত বড় সমতল আর মসৃণ জায়গা পাওয়া যায় না। শুধু যে সমতল তাই নয়, জায়গাটি বৃত্তাকার, মনে হয় বেশ যত্ন করে এই অংশটুকু এভাবে তৈরি করা হয়েছে।

রিহান বৃত্তাকার জায়গাটির ঠিক মাঝামাঝি জায়গাটুকু খুঁজে বের করে নিচে তাকাল এবং হঠাৎ করে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল সেখানে একটা গোলাকার ধাতব ঢাকনা। রিহান উত্তেজিত হয়ে ওঠে, কোনোভাবে ধাতব অংশটুকু টেনে তোলা যায় কি না চেষ্টা করে দেখল, কিন্তু মসৃণ ধাতব অংশটুকু পাথরের সাথে মিশে আছে, এটাকে টেনে তোলার কোনো উপায় নেই। রিহান তখন ধাতব অংশটিতে হাত দিয়ে থাবা দিল সাথে সাথে ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো একটা শব্দ ভেসে এল। রিহান নিশ্বাস বন্ধ করে আবার একবার থাবা দিতেই আবার প্রতিধ্বনির মতো শব্দটি শোনা গেল। রিহান এবারে দ্রুত দুবার থাবা দেয় সাথে সাথে ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো শব্দ শোনা যায় এবারে শব্দটি আসে চারবার। রিহান নিঃসন্দেহ হয়ে গেল যে সে সত্যি সত্যিই রহস্যময় জায়গাটি খুঁজে পেয়েছে। সে এবারে তিনবার থাবা দিল সাথে সাথে ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো শব্দ আসতে থাকে পরপর নয়বার শব্দ হয়ে থেমে গেল। সে যতবার শব্দ করছে তার বর্গ সংখ্যক শব্দ ফিরে আসছে। ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে সে চারবার শব্দ করল, ভেতর থেকে এবার যোলবার প্রতিধ্বনি ফিরে আসার কথা। সত্যি সত্যি মোলবার প্রতিধ্বনি ফিরে এল। রিহান নিজের ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে, এই রহস্যময় জায়গাটির সাথে যোগাযোগ করার একটি পথ হয়তো সে খুঁজে পাবে। কী করবে যখন ঠিক করতে পারছে তখন হঠাৎ করে ভেতর থেকে একবার শব্দ ভেসে এলএবার তাকে কেউ পরীক্ষা করছে। রিহান পাল্টা একবার শব্দ করল। ভেতর থেকে এবার দুবার শব্দ হল, রিহান দুয়ের। বর্গ চারবার শব্দ করল। ভেতরে কী আছে সে জানে না, কিন্তু সেটি এবারে তিনটি শব্দ করল। রিহান গুনে গুনে নয়বার শব্দ করল। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা, এবারে ভেতর থেকে চারটি শব্দ হল, রিহান গুনে গুনে পাল্টা ষোলটি শব্দ করল।

সাথে সাথে একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে থাকে, পুরো এলাকাটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। রিহান চমকে উঠে দাঁড়ায় তারপর লাফ দিয়ে পিছনে সরে যায়। সে বিস্ফারিত চোখে দেখে পাথরের মাঝখান একটা চতুষ্কোণ জায়গা যেন ফেটে বের হয়ে উঠে আসতে শুরু করেছে। ভোঁতা একটা শব্দ করে এক মানুষ উঁচু একটা চতুষ্কোণ ধাতব অংশ বের হয়ে হঠাৎ করে থেমে যায়। রিহান নিঃশব্দে কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখানে ঢোকার কোনো জায়গা আছে কি? রিহান চারপাশে একবার ঘুরে দেখল, কোনো দরজা নেই, কিন্তু এক পাশে একটা সবুজ বোতাম। খানিকক্ষণ চিন্তা করে সে বোতামটা স্পর্শ করে। কিছু হল। না দেখে বোতামটা চাপ দিল সাথে সাথে একটা যান্ত্রিক শব্দ করে তার সামনে একটা দরজা খুলে গেল, ভেতরে একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।

রিহান একটা নিশ্বাস ফেলল, ঠিক কেন জানা নেই হঠাৎ কৌতূহল ছাপিয়ে তার ভেতরে একটা চাপা ভয় উঁকি দেয়। কী আছে ভিতরে? সে যদি ভেতরে আটকা পড়ে যায়, যদি আর কোনোদিন বের হতে না পারে? সে যে সবাইকে কথা দিয়ে এসেছে প্রভু ক্লডের কাছে ধরা দিয়ে ঈশ্বরী প্রিমাকে মুক্ত করে আনবে?

মাথা থেকে সব চিন্তা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে রিহান ধীরে ধীরে সিঁড়িতে পা দিলে সাথে সাথে পেছনের দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। সে কি আর কখনো বের হতে পারবে? রিহান একমুহূর্ত অপেক্ষা করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। প্রায় চল্লিশটি ধাপ নিচে একটা চতুষ্কোণ জায়গা। একপাশে অধস্বচ্ছ কাচের দরজা। ভেতর থেকে হালকা নীলাভ আলো বের হয়ে আসছে। রিহান কান পেতে শুনল খুব হালকা এক ধরনের যান্ত্রিক গুঞ্জন, এ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। সে সাহস সঞ্চয় করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে উঠল। বড় একটি ঘরের এক কোনায় একটি চেয়ার, চেয়ারে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বসে আছে। রিহানকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে মানুষটি মাথা তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস কল, কে?

ভয়ংকর আতঙ্কে রিহান ছুটে বের হয়ে যাচ্ছিল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

মানুষটি তাকে দেখার চেষ্টা করতে করতে উঠে দাঁড়াল, তারপর দুই পা এগিয়ে এসে সহৃদয়ভাবে বলল, এস, ভেতরে এস।

রিহান অনেক কষ্ট করে সাহস সঞ্চয় করে ভেতরে ঢুকল। মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম কী ছেলে?

রিহান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, রিহান।

রিহান?

হ্যাঁ।

চমৎকার। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হয়েছি রিহান। আমি তোমার জন্যে দুই শ তিরিশ বছর থেকে এই চেয়ারে বসে আছি।

রিহান একটা আর্ত শব্দ করে বলল, দুই শ তিরিশ বছর?

হ্যাঁ। আমার জন্যে সেটি কোনো সমস্যা নয়। কারণ আমি সত্য মানুষ নই। আমি একটা হলোগ্রাফিক ছবি। মানুষটি হাত তুলে দুই পাশে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখো দুই পাশ থেকে লেজারের আলো এসে সুষম উপস্থাপন করে আমাকে তৈরি করেছে।

রিহান বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল, যে মানুষ নিজে দাবি করছে সে সত্যি নয় তার সাথে কথা বলা যায় কি না সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়।

হলোগ্রাফিক মানুষটি বলল, তুমি খুব অবাক হচ্ছ? আমার হিসাব অনুযায়ী তোমার অবাক হবার কথা। আমার মনে হয় তোমার সাথে আমার খোলাখুলি কথা বলা দরকার।

রিহান তবু কোনো কথা বলল না। হলোগ্রাফিক মানুষটি একটু হেসে বলল, তোমার ভয় পাবার কিছু নেই রিহান। তুমি এখানে খুব নিরাপদ। আমি সবকিছু জানি, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব।

আমাকে সাহায্য করতে পারবে?

হ্যাঁ। রিহান তুমি এই চেয়ারটায় বসো। হলোগ্রাফিক মানুষটা ঘরের অন্যপাশে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, তুমি ইচ্ছে করলে আমার শরীরের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলে যেতে পার।

রিহান তবু দাঁড়িয়ে রইল। হলোগ্রাফিক মানুষটি বলল, এস রিহান। তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার।

রিহান সাবধানে হেঁটে হলোগ্রাফিক মানুষটার কাছে গিয়ে তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করল, দেখল সত্যিই সেখানে কিছু নেই, তার হাতে শুধু রঙিন আলো এসে পড়ছে।

মানুষটি হেসে বলল, দেখেছ? ভয়ের কিছু নেই। যাও, তুমি গিয়ে বস।

রিহান জিজ্ঞেস করল, কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?

আমি তোমাকে বলব। এর মাঝে অলৌকিক কিছু নেই–এটি বিজ্ঞানের ব্যাপার। সহজ বিজ্ঞান। এস।

রিহান সত্যি সত্যি মানুষটার ভেতর দিয়ে হেঁটে ঘরের অন্যপাশে একটা চেয়ারে বসল। এখনো পুরো ব্যাপারটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। মানুষটি তার সামনে একটা চেয়ারে বসে কথা বলতে শুরু করে।

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল দুই শ তিরিশ বছর আগে। পৃথিবীতে তখন ছয় বিলিয়ন মানুষ, ইকুয়িনা নামে ভয়ংকর একটা ভাইরাসের কারণে পৃথিবীর সব মানুষ কয়েক সপ্তাহের মাঝে মরে শেষ হয়ে গেল। ভাইরাসের সংক্রমণ হবার পর মারা যেতে দুই সপ্তাহের মতো সময় নেয়। পৃথিবীর কিছু বিজ্ঞানী তাদের জীবনের শেষ দুই সপ্তাহের সময়ে ভবিষ্যতের মানুষের জন্যে এটা তৈরি করে গিয়েছিলেন।

এই প্রজেক্টটি তৈরি করা হয়েছিল আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশ ভ্রমণের জন্যে। মানুষ যখন আন্তঃনক্ষত্র পরিভ্রমণে যাবে সেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যেতে পারে। এই দীর্ঘ সময়ে কী হবে কেউ জানে না, বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতা থাকলে ভালো কিন্তু কোনো কারণে সেই মহাকাশচারীরা যদি নিজেরা যুদ্ধবিগ্রহ করে মারা যায়, যদি শুধু কিছু ছোট শিশু বেঁচে থাকে তখন কী হবে? তারা বড় হয়ে পৃথিবীর এই বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের কিছুই পাবে, নিঃসঙ্গ একটি মহাকাশযানে বিচিত্র একটি পরিবেশে বড় হবে। পৃথিবীর পুরো জ্ঞানভাণ্ডার কি আবার গোড়া থেকে আবিষ্কার করতে হবে? সেটি তো হতে পারে না। এ ধরনের। পরিবেশে সেই শিশুদের সাহায্য করার জন্যে আমাদের তৈরি করা হয়েছে।

হলোগ্রাফিক মানুষটি তার চারপাশে দেখিয়ে বলল, এখানে যে যন্ত্রটি আছে প্রাথমিকভাবে এটাকে বলা হত কম্পিউটার। বিংশ শতাব্দী থেকে এটা তৈরি শুরু হয়, প্রতি বছর এর ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে যেতে রু করল। একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রথম মানুষের সমান ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার তৈরি করা হল। তারপর আরো এক শতাব্দী কেটে গেল, পৃথিবীর বুকে এমন কম্পিউটার তৈরি হল যা মানুষের পুরো সভ্যতাকে নিজের ভেতরে ধরে রাখতে পারে। নিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও সেই কম্পিউটার ধ্বংস করা যাবে না, সাইক্লোন টাইফুন ভূমিকম্প তাকে ধ্বংস করতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা তার জন্যে এমন ইন্টারফেস তৈরি করা হল যেটি যে কোনো মানুষের যে কোনো ধরনের বুদ্ধিমত্তায় কাজ করতে পারে। কেন জান?

কেন?

হলোগ্রাফিক মানুষটা নিজেকে দেখিয়ে বলল, কারণ ইন্টারফেসটা এরকম। একজন সহৃদয় মানুষ কথা বলছে। যে কোনো ভাষায় যে কোনো পরিবেশে। যে কোনো মানুষের। সাথে! যে কোনো বিষয়ে।

যাই হোক, তোমাকে যেটা বলছিলাম–দুই শ তিরিশ বছর আগে যখন পৃথিবীর সব মানুষ ইকুয়িনা ভাইরাসে মারা যেতে শুরু করেছিল, তখন কিছু বিজ্ঞানী তাদের জীবনের শেষ দুই সপ্তাহে পৃথিবীর পুরো সভ্যতা, পুরো জ্ঞানবিজ্ঞান ঢুকিয়ে এই পাহাড়ের মাঝে রেখে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলে তো হবে না, যদি কিছু মানুষ বেঁচে যায় তাদেরকে এর কাছে। আনতে হবে, এটি দিয়ে পৃথিবীর লক্ষকোটি বছরের জ্ঞানবিজ্ঞান সভ্যতা শিক্ষা দিতে হবে। সেটা করবেন কী দিয়ে? কেউ কি বেঁচে থাকবে শেষ পর্যন্ত?

বিজ্ঞানীরা কিছু জানতেন না। তাই সারা পৃথিবীতে অসংখ্য যোগাযোগ মডিউল ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন। উপগ্রহ ব্যবহার করে সেগুলো সারা পৃথিবী থেকে সরাসরি এখানে যোগাযোগ করতে পারত। ছোট চৌকোনা বাক্সে একটা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে কিছু ছবি! প্রথম কয়েক মাস কোনো সাড়া পাওয়া গেল না, তারপর হঠাৎ করে এই ইন্টারফেসে যোগাযোগ। হতে শুরু করল–আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যারা যোগাযোগ করছে তারা ছোট ঘোট শিশু!

আমরা সেই যোগাযোগ মডিউল ব্যবহার করে তাদের সাথে কথা বলতাম, তাদের সান্তনা দিতাম, সাহস দিতাম। বিপদে সাহায্য করতাম। ধীরে ধীরে শিশুগুলো বড় হতে লাগল, তাদের নিজেদের ব্যক্তিত্ব জন্ম হতে শুরু করল, দেখতে পেলাম তারা নিজেদের মাঝে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি করছে। তুচ্ছ কারণে খুনোখুনি শুরু করছে। তাদেরকে যে আবার সারা পৃথিবীর দায়িত্ব নিতে হবে সেটা তারা জানে না, সেটা তারা বুঝতে পারছে না।

তখন ধীরে ধীরে সেখানে নেতৃত্ব গড়ে উঠতে শুরু করল, পুরো দলের ভেতর সবচেয়ে যে কর্মক্ষম মানুষ সে পুরো দলটির দায়িত্ব নিতে শুরু করল, দলের মাঝে শৃঙ্খলা ফিলে এল! দলগুলো তখন গুছিয়ে নিয়েছে, বেঁচে থাকার নিয়মগুলো ধরে ফেলেছে। সারা পৃথিবীতে ছয় বিলিয়ন মানুষের সম্পদ ব্যবহার করছে কয়েক হাজার মানুষ তাদের প্রাচুর্যের কোনো অভাব নেই।

দেখতে দেখতে এই নেতৃত্ব তখন একটি ভিন্ন ধরনে পাল্টে যেতে রু করল। একটি দলে বা একটি কমিউনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে যোগাযোগ মডিউলের এই হলোগ্রাফিক ইন্টারফেস। দলের নেতারা সেই ইন্টারফেসটা নিজেদের মাঝে কুক্ষিগত করে ফেলল। বেঁচে থাকার জন্যে সবচেয়ে জরুরি জিনিস হচ্ছে তথ্য, সেই তথ্যটি পেতে পারে শুধুমাত্র দলের নেতা। কাজেই যারা নেতা তাদের ক্ষমতা আকাশচুম্বী হতে রু করল। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের ঈশ্বর বলে ভাবতে শুরু করে দিল।

আগে নেতৃত্ব দিত যারা সত্যিকারের নেতা তারা। একবার নিজেদের ঈশ্বর বলে ভাবতে শুরু করার পর সেই ব্যাপারটি আর তা থাকল না–একজন ঈশ্বরের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে কে হবে পরের ঈশ্বর। নেতৃত্ব আসতে শুরু করল অযোগ্য মানুষের ওপর। মানুষের সমাজে কমিউনগুলোতে তখন সমস্যা দেখা দিতে শুরু করল। তারা কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে প্রু করল, স্বার্থপর হয়ে যেতে লাগল।

আমরা ইচ্ছে করলে সে জায়গায় হস্তক্ষেপ করতে পারতাম কিন্তু করি নি। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে দিয়েছি। তবে একটা ব্যাপার করেছি। পৃথিবীর যত মানুষের যত দল আছে, যত কমিউন আছে তাদেরকে ধীরে ধীরে এই এলাকায় নিয়ে আসতে শুরু করেছি। ধীরে ধীরে তারা এখানে এসে জড়ো হয়েছে।

রিহান জিজ্ঞেস করল, তাদেরকে কীভাবে এখানে এনেছ?

হলোগ্রাফিক মানুষটি হেসে বলল, যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল করে দিতাম, ভালো সিগন্যালের জন্যে ছোটাছুটি করত– যেখানে আনতে চাই সেখানে আসার পর পুরো সিগন্যাল পাঠাতাম।

ঈশ্বরেরা কিছু বুঝতে পারত না?

না। তারা জানে পুরো ব্যাপারটা ঐশ্বরিক। পুরো ব্যাপারটা অলৌকিক।

রিহান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি তা হলে ঠিকই অনুমান করেছিলাম।

হ্যাঁ। তুমি ঠিকই অনুমান করেছিলে। আমরা তোমার মতো একজন মানুষের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। যে নূতন করে নেতৃত্ব নেবে। সার্বিকভাবে নেতৃত্ব নেবে।

নেতৃত্ব? রিহান অবাক হয়ে হলোগ্রাফিক মানুষটির দিকে তাকাল।

হ্যাঁ। নেতৃত্ব।

আমি নেতৃত্ব দেব?

হ্যাঁ। তুমি নেতৃত্ব দেবে। যে মানুষ আমাদের খুঁজে বের করতে পারবে সে হচ্ছে সঠিক মানুষ।

না।

হলোগ্রাফিক মানুষ অবাক হয়ে বলল, না!

আমি তো নেতৃত্ব দিতে আসি নি।

তুমি কেন এসেছ?

আমি একটা মেয়েকে উদ্ধার করতে এসেছি। মেয়েটির নাম প্রিমা। বাচ্চা একটি মেয়ে, অসহায় দুঃখী একটা মেয়ে। তাকে সবাই মিলে ধরে নিয়ে গেছে।

হলোগ্রাফিক মানুষ অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিহান মানুষটির দৃষ্টি এড়িয়ে বলল, আমার এখন নিজেকে ধরা দিতে হবে। নিজেকে ধরা দিয়ে প্রিমাকে মুক্ত করতে হবে।

হলোগ্রাফিক মানুষটি তখনো এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিহান কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবল, তারপর সোজা হয়ে বসে মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?

মানুষটি শব্দ করে হেসে বলল, তুমি কী রকম সাহায্য চাও রিহান? এখানে সবকিছু আছে, বিজ্ঞানের সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কার মানুষের জন্যে এখানে রাখা আছে। বলো তুমি কী চাও? বলো–

রিহানকে কেমন জানি অপ্রস্তুত দেখাল, সে নিচু গলায় বলল, আমাকে কিছু খেতে দিতে পারবে? খুব খিদে লেগেছে–সারা দিন কিছু খাই নি আমি।

 ৮. মুখোমুখি

রিহান মোটরবাইকটা দাঁড় করিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বড় একটা ট্রাকে হেলান দিয়ে একজন প্রহরী ঝিমুচ্ছিল, সে চমকে উঠে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তাক করে বলল, কে? কে যায়?

রিহান হাঁটার গতি এতটুকু না কমিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, আমার নাম রিহান।

দাঁড়াও। দাঁড়াও না হলে গুলি করে দেব।

রিহান মুখে হাসি টেনে বলল, কেন খামোখা গুলি করে একটা বুলেট নষ্ট করবে। আমি এমন কিছু ভয়ংকর মানুষ নই।

মানুষটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে, কী বলবে বুঝতে পারে। রিহান মুখের হাসিটা ধরে রেখে বলল, এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলে? আমি তো এখানেই ছিলাম। মনে নেই?

মানুষটি কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, রি–হান? তুমি?

হ্যাঁ। তোমরা সবাই আমাকে ধরার জন্যে গিয়েছিলে খবর পেয়েছি। খুব দুঃখিত আমি ছিলাম না। খবর পেয়েই চলে এসেছি।

তুমি কেন এসেছ?

তোমাদের কাছে ধরা দিতে। রিহান দুই হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও বেঁধে ফেলো।

মানুষটি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বলল, তুমি একটু দাঁড়াও, এক সেকেন্ড দাঁড়াও

মানুষটি তার অস্ত্র নিয়ে ভিতরে ছুটে যেতে থাকে। রিহান মুখে কৌতুকের এক ধরনের ভাব ধরে রেখে ইতস্তত পায়চারি করতে থাকে। একসময় সে এখানেই ছিল, এলাকাটা বেশ ভালো করে জানে, কোন ট্রাকে কে থাকে, কোন লরিটি কোন পরিবারের এখনো মনে আছে, ইচ্ছা করলেই কোথাও গিয়ে সে দরজায় শব্দ করে বলতে পারে, এই যে, আমি রিহান, তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।

কিন্তু সে কিছুই করল না, পকেটে হাত ঢুকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

কিছুক্ষণের ভিতর গ্রাউস এবং তার সাথে আরো তিন–চার জন সশস্ত্র মানুষকে দেখা গেল, মানুষগুলো দ্রুত রিহানকে ঘিরে ফেলল। গ্রাউস রিহানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, রিহান!

হ্যাঁ গ্রাউস। ভালো আছ?

গ্রাউস প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, তুমি কেন এসেছ?

প্রভু ক্লডের সাথে দেখা করতে।

গ্রাউস চমকে উঠে বলল, কী বললে?

বলেছি প্রভু ক্লডের সাথে দেখা করতে।

গ্রাউস কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তোমার সাহস খুব বেশি হয়েছে রিহান?

মনে হয় আগের থেকে একটু বেশি হয়েছে। মনে আছে তুমি আগেরবার যখন প্রভু ক্লডের কাছে পাঠাচ্ছিলে তখন আমি কী ভয় পেয়েছিলাম? এখন আমি নিজেই দেখা করতে চাইছি! খুব একটা মজার কথা বলেছে সেরকম ভঙ্গি করে রিহান হা–হা করে হাসতে লাগল।

তুমি কেমন করে জান প্রভু ক্লড তোমার সাথে দেখা করবেন?

আমি জানি। সবাই আমাকে দেখতে চায়। তোমরা কয়েক হাজার মানুষ কি আমার খোঁজে যাও নি?

গ্রাউস কোনো কথা না বলে ক্রোধের এক ধরনের শব্দ করল। রিহান সেটা না শোনার ভান করে বলল, যদি প্রভু ক্লড দেখা করতে না চান তাকে বলো তার জন্যে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এনেছি।

কী তথ্য?

যেমন মনে কর আলোর ব্যাপারটি। আলো হচ্ছে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। তার গতিবেগ সেকেন্ডে তিন শ হাজার কিলোমিটার।

গ্রাউস কিছু বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান সহৃদয় ভঙ্গি করে হেসে বলল, কিংবা মনে কর নিউক্লিয়ার রি–এক্টরের ব্যাপারটি। এর ভেতরে কী হয় তুমি জান? ফুয়েল রডে কী থাকে তুমি জান? নিশ্চয়ই জান না। আমি কিন্তু জানি! প্রভু ক্লডকে আমি এই তথ্যগুলো দিতে চাই। গ্রাউস, এসব ব্যাপারে তোমার কোনো কৌতূহল না থাকতে পারে, প্রভু ক্লডের অনেক কৌতূহল। কেন জান?

গ্রাউস রিহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। রিহান হাসি হাসি মুখ করে বলল, প্রভু ক্লডের অনেক কৌতূহল, কারণ তিনি ঈশ্বর। ঈশ্বর ছাড়া অন্য কারো এইসব কথা জানার কথা না। কিন্তু তুচ্ছ মানুষ হয়ে আমি এসব জেনে গেছি!

ঠিক এরকম সময়ে দেখা গেল একজন মানুষ ছুটতে ছুটতে আসছে, কাছাকাছি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মহামান্য গ্রাউস। প্রভু ক্লড এই মুহূর্তে রিহানকে তার কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন।

রিহান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, দেখেছ গ্রাউস, আমি তোমাকে বলেছিলাম না! প্রভু ক্লড আমাকে না দেখে থাকতেই পারবেন না।

আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে তাকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করল। রিহান তখন এগিয়ে যেতে রু করে, কোথায় যেতে হবে কীভাবে যেতে হবে সে জানে। রিহান হেঁটে যেতে যেতে বুঝতে পারে আশপাশের সব ট্রাক লরি থেকে মানুষজন বের হয়ে এক ধরনের অবিশ্বাস্য বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যে মানুষটি ঈশ্বরের মৃত্যুদণ্ডকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকে এবং নিশ্চিত মৃত্যুর ভয় না করে সেই মৃত্যুদণ্ড নিতে নিজে থেকে ফিরে আসে তাকে নিয়ে সবার যে এক ধরনের কৌতূহল হতে পারে তাতে অবাক হবার কী আছে?

.

রিহান সোজা হয়ে প্রভু ক্লডের দিকে তাকিয়ে রইল। এই অল্প কয়েকদিনে মনে হয় প্রভু ক্লডের মুখে বয়সের একটি ছাপ পড়েছে। প্রভু ক্লড তীব্র দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে হিংস্র গলায় বললেন, তুমি আমার সাথে দেখা করতে চাইছ!

হ্যাঁ।

কেন?

আমি ঈশ্বরী প্রিমার খোঁজ নিতে এসেছি। তিনি কেমন আছেন জানতে এসেছি।

তুমি একজন মানুষ হয়ে ঈশ্বরীর খোঁজ নিতে এসেছ, তোমার এত বড় দুঃসাহস?

রিহান তরল গলায় বলল, আমার দুঃসাহসের জন্য ক্ষমা চাই প্রভু ক্লড। তবে আমার কারণে ঈশ্বরী প্রিমা শাস্তি পাচ্ছেন সেজন্যে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।

প্রভু ক্লড কোনো কথা না বলে তীক্ষ্ণ চোখে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রিহান বলল, আমি এখন আমার শাস্তির জন্যে এসেছি। ঈশ্বরী প্রিমাকে কি তার কমিউনে ফিরে যেতে দেবেন?

সেই সিদ্ধান্ত নেব আমি।

অবশ্যই। অবশ্যই প্রভু ক্লড। রিহান কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, ঈশ্বরী প্রিমা এখন কোথায় আছেন?

তোমার সেটি জানার কোনো প্রয়োজন নেই।

আমি কি তা হলে অন্য একটি জিনিস জানতে পারি?

কী জানতে চাও?

আমি কেন সাধারণ মানুষ আর আপনি কেন ঈশ্বর?

প্রভু ক্লডের মুখ হঠাৎ ভয়ংকর হিংস্র হয়ে ওঠে, তিনি চিৎকার করে বললেন, বেশি দুঃসাহস দেখিও না ছেলে।

আপনি যে তথ্যটুকু পান, হঠাৎ করে সেই তথ্য যদি বন্ধ হয়ে যায় তা হলে আপনি কি সাধারণ মানুষ হয়ে যাবেন?

তুমি কী বলতে চাইছ?

আপনি যে তথ্যটুকু পান, আমরা সবাই যদি সেই তথ্য পেতে শুরু করি তা হলে কি আমরা সবাই ঈশ্বর আর ঈশ্বরী হয়ে যাব?

ভয়ংকর ক্রোধে প্রভু ক্লডের মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে, তিনি চিৎকার করে বললেন, কে আছ? নিয়ে যাও একে এই মুহূর্তে নিয়ে যাও।

প্রায় সাথে সাথে দুইজন মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ছুটে আসে। দুই পাশ থেকে তাকে দুজনে ধরে ফেলে, রিহান ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু ছাড়াতে পারল না। প্রভু ক্লড চিৎকার করে বললেন, বাইরে নিয়ে যাও একে। গুলি করে হত্যা কর সবার সামনে। এই মুহূর্তে।

মানুষ দুইজন মাথা নিচু করে বলল, আপনার যেরকম ইচ্ছে প্রভু ক্লড।

.

সবার সামনে কাউকে গুলি করে হত্যা করার জন্যে খানিকটা প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। কমিউনে বহুদিন কাউকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় নি–ঠিক কীভাবে সেটা করা হয় সেটাও ভালো জানা নেই। রিহানের সামনেই যখন ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ঠিক তখন এক কোনা থেকে নিউক্লিয়ার রি–এক্টর থেকে এলার্মের শব্দ শোনা গেল। বিপদের মাত্রা অনুযায়ী এলার্মের শব্দের তারতম্য হয়, এই এলার্মটি সর্বোচ্চ বিপদের। মুহূর্তের মাঝে পুরো কমিউনে একটি আতঙ্কের শিহরন বয়ে গেল। ঘরের দরজা খুলে চিৎকার গ্রতে প্রতে লোকজন বের হয়ে ছোটাছুটি ক্ষ করে দেয়। গ্রাউস দুই হাত তুলে তাদের থামানোর চেষ্টা করে, বলতে থাকে, শান্ত হও। সবাই শান্ত হও। ভয় পাবার কিছু নেই। প্রভু কড এক্ষুনি সব নিয়ন্ত্রণ করে দেবেন–

সবাই তার কথা শুনতে পেল না, যারা শুনতে পেল তারাও খুব শান্ত হল বলে মনে হল। এই কমিউনে বেঁচে থাকার অংশ হিসেবে তাদেরকে এই এলার্মের শব্দগুলোর সাথে পরিচয় করানো হয়েছে।

গ্রাউস একজনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, যাও। প্রভু ক্লডের নির্দেশ নিয়ে এস। এক্ষুনি যাও।

মানুষটি প্রভু ক্লডের আর. ভি. এর দিকে ছুটে যেতে থাকে। রিহান মুখে এক ধরনের কৌতুকের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, গ্রাউসকে ডেকে বলল, গ্রাউস! আমার একটি কথা শুনবে?

কী কথা?

যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, পালাও।

তুমি কী বলতে চাইছ?

এই এলার্মটি হচ্ছে কোর মেন্টডাউনের এলার্ম। কিছুক্ষণের মাঝে মেল্টডাউন হবে, রেডিয়েশনে কেউ বেঁচে থাকবে না।

গ্রাউস ক্রুদ্ধ গলায় বলল, সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। প্রভু ক্লড তার সমাধান দেবেন।

দেবেন না।

কী বলতে চাইছ তুমি?

তোমাদের প্রভু ক্লড যে তথ্যের সরবরাহ পেয়ে ঈশ্বর হয়েছিলেন তার সেই সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রভু ক্লড এখন আর ঈশ্বর নেই। তিনি এখন আমাদের মতো মানুষ!

গ্রাউস অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান?

রিহান হা–হা করে হেসে বলল, আমি এমন অনেক জিনিস জানি যেটা তোমরা কেউ জান না! আমার কথা বিশ্বাস না হলে প্রভু ক্লডের কাছে যাও। নিজের কানে শুনে এস। নিজের চোখে দেখে এস।

গ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল।

মানুষজন হইচই করে ছোটাছুটি করছে তার মাঝে ভয়ংকর শব্দ করে এলার্ম বাজতে থাকে, কে কী করবে বুঝতে পারছে না। ছোট বাচ্চারা চিৎকার করে কাঁদছে, অনেকে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করতে শুরু করেছে। গ্রাউস যে মানুষটিকে প্রভু ক্লডের কাছে পাঠিয়েছিল হঠাৎ করে দেখল সে বিবর্ণ ফ্যাকাসে মুখে ছুটতে ছুটতে আসছে। গাউসের কাছে এসে বলল, গ্রাউস!

কী হয়েছে?

প্রভু ক্লড কিছু বলছেন না—

কিছু বলছেন না মানে?

মানে কিছু বলছেন না। তার কাছে কোনো সমাধান নাই।

গ্রাউস আর্তচিৎকার করে বলল, কী বলছ তুমি পাগলের মতো?

আমি ঠিকই বলছি। বিশ্বাস না হলে তুমি যাও। তুমি শুনে এস।

গ্রাউস ভয়ার্ত মুখে একবার চারদিকে তাকাল, তাকে কেমন জানি অসহায় দেখায়। রিহান গলা উঁচু করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হল গ্রাউস?

গাউসের চোখ–মুখ হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠে, সে রিহানের কাছে ছুটে এসে বলল, তুমি কিছু একটা করেছ! তুমি?।

রিহান হা–হা করে হেসে বলল, আমি? আমি তুচ্ছ মানুষ ঈশ্বরের কাজে বাধা দেব? কী বলছ তুমি গ্রাউস?

মানুষ ছুটোছুটি করে গ্রাউসের কাছে ছুটে আসতে থাকে, দেখতে দেখতে সবাই তাকে ঘিরে ফেলে, ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, আমরা কী করব গ্রাউস? এখন আমরা কী করব?

গ্রাউস আমতা–আমতা করে বলল, আমি জানি না

কী বলছ তুমি জান না? প্রভু ক্লড কী বলেছেন?

প্রভু ক্লডও জানেন না।

গ্রাউসকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তারা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ছোট একটা বাচ্চাকে শক্ত করে বুকে ধরে রাখা মা ভয় পাওয়া গলায় বলল, তা হলে কে জানে?

রিহান গলা উঁচু করে বলল, আমি জানি।

একসাথে সবাই তার দিকে ঘুরে তাকাল। রিহান বলল, হ্যাঁ, আমি জানি। এই এলার্ম সর্বোচ্চ বিপদের এলার্ম। এর অর্থ নিউক্লিয়ার রি-একটরের কোর গলতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই অচিন্তনীয় পরিমাণ রেডিয়েশন বের হবে। তোমরা অর্ধেক মানুষ সাথে সাথে মারা যাবে, বাকি অর্ধেক মারা যাবে আগামী তিন মাসের মাঝে। তারপরেও যারা বেঁচে থাকবে, তারা ক্যান্সারে ভুগে ভুগে মারা যাবে।

কয়েকজন চিৎকার করে বলল, কিন্তু আমরা কী করব?

তোমরা পালাও।

পালাব?

হ্যাঁ, এই মুহূর্তে ট্রাকে উঠে পালাও। বাতাসের বিপরীত দিকে পালাও, কারণ কোর মেন্টডাউন হলে বাতাসে রেডিয়েশন ভেসে আসতে পারে!

একজন ভয়ার্ত মুখে বলল, কিন্তু প্রভু ক্লডের আদেশ ছাড়া আমরা পালাব?

রিহান হা–হা করে হেসে বলল, তোমাদের প্রভু ক্লডও তোমাদের সাথে পালাবেন। তিনি আর ঈশ্বর নন, তিনি এখন সাধারণ মানুষ! সত্যি কথা বলতে কী সাধারণ মানুষ তবু কোনো না কোনো কাজে লাগে, একজন ঈশ্বর যখন সাধারণ মানুষ হয়ে যায় সে কোনো কাজে আসে না

উপস্থিত মানুষজন এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে রিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন কাঁপা গলায় বলল, তুমি কেমন করে জান?

আমি জানি। তোমাদের প্রভু ক্লড যে তথ্য দিয়ে ঈশ্বর হয়েছিল, সেই তথ্য তার কাছে আর আসছে না। তার কাছে আর কখনো আসবে না।

কিন্তু–কিন্তু তুমি কেমন করে জান?

বেঁচে থাকলে আমরা সেটা নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাব, এখন পালাও। দেরি কোরো না!

জরুরি এলার্মটা তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হতে শুরু করেছে। শব্দের সাথে সাথে লাল আলো জ্বলতে শুরু করেছে, দেখতে দেখতে পুরো পরিবেশটা ভয়ংকর হয়ে উঠল। রিহান দেখতে পেল তার কথা শুনে ট্রাকে করে মানুষজন পালাতে শুরু করেছে। একটি ট্রাককে চলে যেতে দেখে সবাই ছুটোছুটি করে অন্য ট্রাকে উঠতে রু করেছে। দেখতে দেখতে পুরো এলাকাটি ফাঁকা হয়ে যেতে শুরু করে, শুধু ভয়ংকর এলার্মটি তীক্ষ্ণ কর্কশ শব্দ করে বাজতে থাকে।

যে দুজন মানুষ রিহানকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করার জন্যে এনেছিল তাদেরকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়, তারা কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। রিহান তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা পালাবে না?

তোমাকে কী করব?

প্রভু ক্লড গুলি করে মারতে বলেছে, গুলি করে মার।

মানুষ দুজন একটু অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল, এর আগে তারা কখনো কাউকে এত সহজে নিজেকে গুলি করার কথা বলতে শোনে নি। রিহান চোখ মটকে বলল, যেটা করতে চাও, তাড়াতাড়ি কর।

কেন?

রিহান হা–হা করে হেসে বলল তোমরা যে প্রভু ক্লডের ওপর ভরসা করে আছ ঐ যে তাকিয়ে দেখ সেও তোমাদের ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে!

মানুষগুলো অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি আতঙ্কিত প্রভু ক্লড তার আর. ভি. থেকে বের হয়ে এসেছেন, কী করবেন বুঝতে না পেরে খোলা প্রান্তরের উপর দিয়ে ছুটতে শুরু করেছেন।

রিহান বলল, আমাকে মারার অনেক সুযোগ পাবে। যাও, আগে এই বুড়ো মানুষটাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য কর। ধরে কোনো একটা ট্রাকে তুলে দাও।

স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাত বদল করে বলল, কিন্তু তুমি

আমি যদি তুমি হতাম তা হলে আমাকে ঘাটাতাম না! কারণ কী জান?

কী?

তোমার প্রভু ক্লড আর কোনোদিন তোমাদের সাহায্য করতে পারবে না। যে তথ্য দিয়ে সে তোমাদের সাহায্য করত সেই তথ্য বন্ধ হয়ে গেছে! কিন্তু আমি এখনো তোমাদের সাহায্য করতে পারব। শুধু আমি জানি কেমন করে এই নিউক্লিয়ার রি-এক্টর রক্ষা করা যায়।

মানুষগুলো এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান নিচু গলায় বলল, আর দেরি কোরো না, যা করার তাড়াতাড়ি কর। কিছুক্ষণের মাঝে রেড এলার্ট শুরু হয়ে যাবে, তখন আর কিছু করা যাবে না।

স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে মানুষ দুটো নিজেদের ভেতর নিচু গলায় কথা বলল, তারপর এগিয়ে এসে রিহানকে খুলে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমরা তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি।

চমৎকার। তোমাদের ধন্যবাদ।

তুমি চেষ্টা করে দেখো রি-একটর মেন্টডাউন বন্ধ করতে পার কি না!

দেখব। তোমরা এখন পালাও।

রিহান কিছুক্ষণের মাঝেই দুটো শক্তিশালী মোটরবাইকের শব্দ শুনতে পায়। মানুষ দুটো এই কমিউন ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুভয় খুব বড় ভয়।

.

রিহান একটা নিশ্বাস ফেলে প্রভু ক্লডের বাসভবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পুরো কমিউনের সবাই সরে গেছে এখানে এখন আছে শুধু রিহান এবং প্রিমা। প্রিমাকে খুঁজে বের করতে হবে, সে নিশ্চয়ই আতঙ্কে অধীর হয়ে আছে।

রিহান যখন প্রিমার হাত এবং পায়ের শেকল খুলছে তখন নিউক্লিয়ার রি–এক্টরের কোর মেন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে, রেড এলার্ট হিসেবে ভয়ংকর সাইরেন বাজছে, ভয়ংকর। রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়তে রু করেছে। প্রিমা ভয়ার্ত গলায় রিহানের হাত আঁকড়ে ধরে বলল, আমাদের কী হবে রিহান?

রিহান হেসে বলল, কিছু হবে না।

কোর মেল্টডাউন হচ্ছে, রেডিয়েশনে মারা যাব আমরা।

না, আমরা মারা যাব না।

প্রিমা অবাক হয়ে বলল, কেন মারা যাব না

কারণ এখানে কিছু হচ্ছে না, শুধু প্রচণ্ড শব্দে একটা এলার্ম বাজছে।

শুধু এলার্ম বাজছে? সেটি কীভাবে সম্ভব?

খুব সম্ভব। এটা একটা হাস্যকর খেলনা যন্ত্র–ভয়ংকর এলার্ম বাজিয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করে দেয়। আসলে কিছু না।

কিন্তু কিন্তু

কিন্তু কী?

কেউ সেটা বুঝতে পারছে না কেন?

কারণ প্রভু ক্লডের তথ্য পাওয়ার জন্যে যোগাযোগ মডিউলে যে হলোগ্রাফিক ইন্টারফেস ছিল সেটা আর কাজ করছে না। তার বোঝার কোনো উপায় নেই। এখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত প্রত্ ক্লড। প্রভু ক্লড যখন অচল হয়ে যায় সবকিছু অচল হয়ে যায়।

প্রিমা চোখ বড় বড় করে বলল, কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ। আমি ঠিকই বলছি। যে যন্ত্রের ওপর ভরসা করে সবাই ঈশ্বর হত সেই যন্ত্র আর কোনোদিন কাজ করবে না। পৃথিবীতে আর কেউ ভবিষ্যতে ঈশ্বর হতে পারবে না।

কেন?

সেটি অনেক বড় কাহিনী।

আমি সেটি শুনতে চাই।

রিহান হেসে বলল, তার চাইতে ভালো একটা কাজ করা যায়।

কী করা যায়?

তোমাকে সেটা দেখানো যায়।

কী দেখানো যায়?

আমি সেটা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না প্রিমা। সেটা বিশ্বাস করতে হলে তোমাকে নিজের চোখে দেখতে হবে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমি নিজের চোখে দেখেও সেটা বিশ্বাস করবে না।

প্রিমা অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ ছটফট করে বলল, আমাকে দেখাও। এক্ষুনি দেখাও।

হ্যাঁ দেখাব, কিন্তু তার আগে চল এই এলার্মটা বন্ধ করে দিই। কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।

.

কিছুক্ষণের ভেতরেই দেখা গেল রিহান শক্তিশালী মোটরবাইকে করে মরুভূমির পাথুরে প্রান্তরের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। পিছনের সিটে বসে প্রিমা রিহানকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। নিরাপত্তার জন্যে যতটুকু শক্ত করে ধরা দরকার প্রিমা তার চাইতে অনেক শক্ত করে ধরেছে। তাকে দেখলে মনে হয় সে ভাবছে এই মানুষটিকে ছেড়ে দিলেই বুঝি সে হারিয়ে যাবে। সে কিছুতেই এই মানুষটিকে হারাতে চায় না। কিছুতেই না।

 ৯. শেষ কথা

চার বছর পরের কথা।

রিহান ককপিটে বসে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করতেই প্রপেলার ধরে রাখা মানুষটি সেটা ঘোরানোর চেষ্টা করল। রিহান ফুয়েল পাম্পে চাপ দিয়ে ইগনিশান কী-টা ঘোরানোর সাথেই। ভট ভট শব্দ করে ইঞ্জিনটা চালু হবার চেষ্টা করে কয়েকবার শব্দ করে থেমে গেল। রিহান। ফুয়েল পাম্প কয়েকবার চাপ দিয়ে হাত দিয়ে আবার ইঙ্গিত করতেই প্রপেলারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা দ্বিতীয়বার গায়ের জোর দিয়ে প্রপেলারটা ঘোরানোর চেষ্টা করল, এবারে বার কতক আঁকুনি দিয়ে হঠাৎ ইঞ্জিনটা বিকট শব্দ করে চালু হয়ে যায়। দেখতে দেখতে ইঞ্জিনটা পুরো শক্তিতে ঘুরতে শুরু করে, প্রবল বাতাসে ধুলোবালি এবং বড়কুটো। উড়ে যেতে শুরু করে। রিহান গগলসটা চোখে লাগিয়ে কন্ট্রোলটা হাতে নিয়ে প্লেনটা একটু সামনে নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক তখন দেখতে পেল কে একজন হাত নাড়তে নাড়তে ছুটে আসছে মানুষটি ছুটতে ছুটতে প্রাণপণে রিহানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। রিহান একটু অবাক হয়ে দেখল, মানুষটি গ্রুস্তান, তার ডান হাতে একটা কাগজ এবং কাগজটা নাড়তে নাড়তে সে ছুটে আসছে।

রিহান সুইচ টিপে ইঞ্জিনটা বন্ধ করে একটা যন্ত্রণাসূচক শব্দ করে চোখের গগলসটা খুলে গ্রুস্তানের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। এই চার বছরে গ্রুস্তানের দেহটি আরো বিস্তৃত হয়েছে এবং ছুটে আসার কারণে সে রীতিমতো হাঁপাতে থাকে। রিহান জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে গ্রুস্তান?

গ্রুস্তান প্রত্যেকটি শব্দের পর একটা করে নিশ্বাস নিয়ে বলল, ঠিক সময়ে তোমাকে ধরেছি।

মোটেও ঠিক সময়ে আমাকে ধর নি। খুব ভুল সময়ে ধরেছ। রিহান গলা উঁচু করে বলল, আমি এক্ষুনি প্লেনটা ফিল্ড টেস্ট করতে নিয়ে যাচ্ছিলাম।

সেজন্যেই বলেছি ঠিক সময়ে ধরেছি। গ্রুস্তান হঠাৎ করে তার মুখটা প্রয়োজন থেকে অতিরিক্ত গম্ভীর করে বলল, তোমার এই প্লেনের কার্যক্রমের ওপর আইনগত বাধা এসেছে।

রিহানের কথাটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল, সে মুখ হাঁ করে বলল, কী বাধা?

আইনগত বাধা।

আইনগত বাধা? রিহানের মুখ দেখে মনে হল সে কথাটার অর্থ বুঝতে পারছে না। বারকয়েক চেষ্টা করে আবার বলল, আইনগত বাধা?

হ্যাঁ। গ্রুস্তান খুব চেষ্টা করে মুখে একটা কঠোর ভাব এনে বলল, একজন নাগরিক তোমার প্লেনের কার্যক্রমের ওপর মামলা করেছে। সে বলেছে মানুষের আকাশে ওড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যদি প্রকৃতি চাইত মানুষ আকাশে উড়ুক তা হলে তাদের পাখির মতো ডানা থাকত। যেহেতু মানুষের ডানা নেই কাজেই তাদের আকাশে ওড়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

রিহান খুব চেষ্টা করে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, কোর্ট এই যুক্তি গ্রহণ করেছে?

করে নাই। গ্রুস্তান গম্ভীর গলায় বলল, কোর্ট বলেছে বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে কোনো সীমা বেঁধে দেওয়া যাবে না। যার যেটা ইচ্ছে সে সেটা নিয়ে গবেষণা করতে পারবে।

তা হলে আইনগত বাধাটা এল কোথা থেকে?

কারণ মামলার আবেদনে আরো একটি কথা ছিল।

সেটি কী কথা?

গ্রুস্তান হাতের কাগজটি দেখে বলল, সেখানে বলা হয়েছে তোমার প্লেনের কার্যক্রম এখনো পরীক্ষামূলক অবস্থায় আছে। এখনই এটার ফিড টেস্ট করা হলে জানমালের ক্ষতি হতে পারে।

রিহান এবার রেগে উঠতে শুরু করল, অনেক কষ্ট করে রাগটা প্রকাশ করতে না দিয়ে বলল, জানমালের ক্ষতি হতে পারে? কোর্ট এই যুক্তি গ্রহণ করেছে?

আমাদের বিচারকরা মামলাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছেন। তারা অনেকক্ষণ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই মুহূর্তে এই প্লেন চালানো বেআইনি এবং জনস্বাস্থ্যের প্রতি ক্ষতিকর।

রিহানের মুখ রাগে থমথমে হয়ে ওঠে, সে দাতে দাঁত ঘষে বলল, জনস্বাস্থ্যের প্রতি ক্ষতিকর?

হ্যাঁ।

কীভাবে সেটা ক্ষতিকর?।

গ্রুস্তান হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, ঐ সব ঘুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে পরে শুনানি হবে। তুমি তখন বিচারকদের সামনে তোমার কথাগুলো বলার সুযোগ পাবে। তোমাকে সেটা বলার জন্যে ডাকা হবে।

রিহান এবার রাগে ফেটে পড়ল, ককপিটের দরজা খুলে সে লাফিয়ে নিচে নেমে পা দাপিয়ে বলল, তোমরা ফাজলেমি পেয়েছ? এরকম একটা ব্যাপার নিয়ে তোমরা ঠাট্টা গ্রু করেছ?

এটা মোটেও ঠাট্টা নয়। গ্রুস্তান কষ্ট করে মুখে একটা গাম্ভীর্য ধরে রেখে বলল, কোর্টের সিদ্ধান্তকে ঠাট্টা বললে তোমার ওপর কোর্ট অবমাননার অভিযোগ আনা যায়।

কোর্ট অবমাননা?

কোর্ট অবমাননার শাস্তি হচ্ছে কারাদণ্ড। তোমাকে তা হলে আমাদের জেলখানায় এক সপ্তাহ আটকে রাখতে হবে। গ্রুস্তান সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, এক দিক দিয়ে তা হলে ভালোই হয়–আমাদের জেলখানাটা একটু ব্যবহার হয়! এতদিন হল জেলখানা তৈরি করেছি এখনো একজনকে ঢোকাতে পারলাম না! তোমাকে দিয়ে শুরু করলে মন্দ হয় না–

রিহান হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তোমরা মনে হয় ব্যাপারটা ধরতে পারছ না। আইন তৈরি করা হয় মানুষকে সাহায্য করার জন্যে, কারো ক্ষতি করার জন্যে নয়!

আমরা কারো ক্ষতি করার চেষ্টা করছি না।

ক্ষতি করার চেষ্টা করছ না? এত দিন চেষ্টা করে আমরা একটা প্লেন দাঁড় করিয়েছি, সবকিছু প্রস্তুত, আমরা যাচ্ছি ফিড টেস্ট করতে ঠিক সেই মুহূর্তে এসে তোমরা এটাকে আটকে দিলে! কার বিরুদ্ধে সেটা করলে? আমার বিরুদ্ধে! আমি–রিহান, যে নাকি একা তোমাদের সবার বিরুদ্ধে থেকে সবার জন্যে তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করেছি। যে তথ্য পেয়ে আগে একজন মানুষ ঈশ্বর হয়ে যেত এখন কমিউনের যে কোনো মানুষ তার থেকে একশ গুণ বেশি তথ্য পেতে পারে। কে তার ব্যবস্থা করেছে? আমি! সেই আমার বিরুদ্ধে তোমরা ষড়যন্ত্র শুরু করেছ?

গ্রুস্তান গম্ভীর গলায় বলল, আইনের চোখে সবাই সমান। তুমি পৃথিবীর সব মানুষের জন্যে তথ্য সরবরাহ করে ঈশ্বর–ঈশ্বরীর ব্যাপারটা শেষ করে দিয়েছ সেজন্যে আমরা সবাই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা স্কুলের জন্যে যে ইতিহাস বই লিখছি সেখানে তোমার ওপরে একটা চ্যাপ্টার আছে কিন্তু মনে করো না সেজন্যে তোমাকে আইনের চোখে আলাদাভাবে দেখা হবে। একজন নাগরিক মামলা করেছে আমাদের সেই মামলাটা বিবেচনা করতে হয়েছে। একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

এই নাগরিকটা কে জানতে পারি?

তুমি নিয়মমাফিক আবেদন করলে কোর্ট তোমাকে এই সুনাগরিকের নাম জানাতে পারে।

রিহান চোখ পাকিয়ে বলল, দেখো গ্রুস্তান, ভালো হবে না বলছি। কে এই সুনাগরিক?

প্রিমা। গ্রুস্তানের মুখ হঠাৎ কৌতুকের হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে! তোমার বিবাহিত স্ত্রী, কিন্তু আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি সিদ্ধান্ত নেবার সময়ে তাকে আমরা একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করেছি। একবারও তোমার স্ত্রী হিসেবে দেখি নি–

রিহান কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না, তারপর হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, প্রিমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

গ্রুস্তান সহৃদয়ভাবে রিহানের হাত ধরে বলল, মাথা খারাপ হবে কেন? তোমাকে একশবার বলেছে তুমি শোন নি, একটা প্লেন তো আর ছেলেখেলা নয়। অ্যাকসিডেন্ট তো হতেই পারে–

তাই বলে কোর্টে!

আহা–হা। এত কষ্ট করে আমরা একটা আইন বিভাগ দাঁড় করিয়েছি কেউ যদি ব্যবহার না করে তা হলে কেমন করে হবে? বিচারকদের কথা চিন্তা কর–বেচারারা রীতিমতো ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছে কিন্তু এখন কোনো কাজ নেই। প্রিমার মামলার কারণে তবু শেষ পর্যন্ত একটা কাজ পেয়েছিল। সবার কী উৎসাহ তুমি যদি দেখতে?

রিহান মাথা থেকে হেলমেট খুলে ককপিটের ভেতরে রেখে হতাশভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, প্রিমা কোথায়?

মনে হয় স্কুলে।

চলো যাই। দেখি অনুরোধ করে মামলাটা তুলিয়ে নেওয়া যায় কি না।

.

স্কুলটা তৈরি করা হয়েছে খুব সুন্দর করে। সাদা দেয়ালের ওপর লাল টাইলের ছাদ। চারপাশে গাছের ছায়া। পাহাড়ের উপর থেকে একটা ঝরনা নেমে এসেছে, পাথরের উপর দিয়ে স্বচ্ছ পানিটুকু ঝিরঝির করে গড়িয়ে যাচ্ছে, শব্দটুকু ভারি সুন্দর। রিহানের কোনো কাজ না থাকলে সে পানিতে পা ডুবিয়ে বড় একটা পাথরে বসে থাকে। কিছুদিন হল কিছু পাখি এসে এখানে ভিড় জমিয়েছে, তাদের কিচিরমিচির শুনতে বেশ লাগে!

রিহান স্কুলের ভেতর ঢুকে ক্লাসরুমগুলোতে উঁকি দিল, বারো তেরো বছরের কিছু ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে প্রিমা কী একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড়া করছিল, রিহানকে দেখে বলল, কী ব্যাপার রিহান? কাজ শেষ?

রিহান রাগের ভান করে বলল, তোমার কী মনে হয়?

প্রিমা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে বলল, কেমন জব্দ হলে আজ? আমাদের বিচার বিভাগের ক্ষমতা দেখলে?

সেটা নিয়েই তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি।

একটু দাঁড়াও। আমি এদের প্লাঙ্ক কনস্টেন্টটা বের করে দিয়ে আসছি।

ঠিক আছে।

রিহান সময় কাটানোর জন্যে ক্লাসরুমের করিডর ধরে হাঁটতে থাকে। একপাশে একটা ল্যাবরেটরিতে একটা মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে একটা মেয়ে কিছু একটা দেখছে, মাথা তুলতেই দেখল মেয়েটি ত্রানা। রিহান হাসিমুখে বলল, কী খবর এনা? কেমন চলছে তোমার গবেষণা?

জানা গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, এক জায়গায় আটকে গেছি! কিছুতেই একটা জিনিস ধরতে পারছি না।

কী জিনিস?

তুমি বুঝবে না। জিনেটিক কোডিঙের একটা ব্যাপার।

তথ্যকেন্দ্র থেকে জেনে নাও।

উঁহু। আমি নিজে নিজে বের করতে চাই। জিজ্ঞেস করে জেনে নিলে লাভ কী?

ত্রানা আবার মাইক্রোস্কোপে চোখ রাখতে গিয়ে থেমে গিয়ে উচ্চ স্বরে ডাকল, ক্লড।

পাশের ঘর থেকে ক্লড বলল, কী হল?

আমার পেটরি ডিশগুলো কোথায়?

এই যে নিয়ে আসছি। বলে একটা ট্রেতে বেশ কিছু পেটরি ডিশ নিয়ে ক্লড ল্যাবরেটরির ঘরে ঢুকল। তার মাথার চুলগুলো আরো সাদা হয়েছে, মুখে বয়সের বলিরেখা। ত্রানা একটা পেটরি ডিশ হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে বলল, এটা কি পরিষ্কার করা হল? তোমাকে এত করে বলেছি ভালো করে পরিষ্কার করতে কিন্তু তুমি আমার কথা শোনোই না।

ক্লড অপরাধীর মতো মুখ করে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ইয়ে, মানে চেষ্টা করেছিলাম!

তুমি একটা পেটরি ডিশ ঠিক করে পরিষ্কার করতে পার না কিন্তু একসময় তুমি নাকি একজন ঈশ্বর ছিলে! মানুষ তোমাকে ডাকত প্রভু ক্লড আর তুমি কথায় কথায় মানুষকে ফাঁসি দিয়ে দিতে। তোমাকে দেখলে কেউ সেটা বিশ্বাস করবে?

ক্লড কিছু একটা কথা বলতে যাচ্ছিল না তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এস আমার সাথে। আমি তোমাকে দেখিয়ে দিই কেমন করে পরিষ্কার করতে হয়। আর যেন ভুল না হয়।

.

প্রিমা রিহানের হাত ধরে যাচ্ছে বড় একটা পাথরের উপর থেকে পানির ধারা বাঁচিয়ে অন্য একটা পাথরে পা দিয়ে বলল, তুমি কি রাগ করেছ রিহান?

করেছিলাম, কিন্তু এখন কমে গেছে।

কমে গেলেই ভালো।

রিহান প্রিয়াকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, কিন্তু আমাকে একটা কথা বলল, কোর্টে মামলা করার বুদ্ধিটা তোমাকে কে দিয়েছে?

কে আবার? গ্রুস্তান!

আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।

প্রিমা রিহানের হাত টেনে বলল, তুমি যেন আবার গ্রুস্তানের সাথে রাগারাগি না কর।

না, করব না।

প্রিমা সুর পাল্টে বলল, তুমি এরকম একটা পাগলামি করবে, আর আমার ভয় করবে না?

পাগলামি?

হ্যাঁ, যদি কিছু একটা হয়? সব বিপদের কাজগুলো তোমাকেই কেন করতে হয়? তুমি অন্যদের সুযোগ দিতে চাও না কেন?

রিহান বলল, কে বলেছে দিতে চাই না?

আমি জানি বিপদের কাজগুলো তুমি নিজে করতে চাও। মনে রেখো এখন কিন্তু তুমি মানে শুধু তুমি না। তুমি মানে তুমি আর আমি আর আমাদের বাচ্চা কিশি।

রিহান কোন কথা বলল না, ধীরে ধীরে একবার মাথা নাড়ল। প্রিমা হাত টেনে বলল, মনে থাকবে তো?

থাকবে।

.

রিহান তার টেবিলে একটা প্লেনের নকশার উপর ঝুঁকে পড়ে কত গতিবেগে কত লিফট হতে পারে সেটা হিসাব করে বের করছে। প্রিমা গিয়েছে কিশিকে ঘুম পাড়াতে। হিসাব করতে করতে রিহান শুনতে পেল কিশি বলছে, মা আমাকে সেই পাখির গল্পটা বলো না।

কোন পাখির গল্প?

ফিনিক্স পাখির গল্প।

এক গল্প কতবার শুনবে বোকা ছেলে।

শুনব মা শুনব! বলো না–

.

রিহান শুনতে পেল প্রিমা তাদের সন্তানকে ফিনিক্স পাখির গল্প বলছে। কেমন করে ফিনিক্স পাখি আকাশের বুকে পাখা উড়িয়ে উড়ত–কেমন করে একদিন সেই ফিনিক্স পাখি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সেই ছাইয়ের ভেতর থেকে কেমন করে আবার নতুন ফিনিক্স পাখির জন্ম হল, বিশাল পাখা উড়িয়ে কীভাবে সেই পাখি আবার আকাশের বুকে ডানা মেলে দিল–

টেবিলের নকশার উপর ঝুঁকে কাজ করার ভান করতে করতে রিহান প্রিমার মুখ থেকে ফিনিক্স পাখির গল্প শুনতে থাকে।

তার ছেলের মতোই সমান আগ্রহে।

Exit mobile version