Site icon BnBoi.Com

পৃ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

পৃ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১. আমি খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালাম

আমি খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালাম। আমার মাথার কাছে একটি চতুষ্কোণ স্ক্রিন, সেখানে হালকা নীল রংয়ের আলো, এই আলোটি আমার পরিচিত, কিন্তু কোথায় দেখেছি এখন কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিছু একটা ঘটছে এবং আমি জানি ব্যাপারটা ঘটবে কিন্তু সেটি কী আমার মনে পড়ছে না। আমি সেটি মনে করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে আবার গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম। এক সময় আবার আমার চেতনা ফিরে আসতে থাকে এবং আধো ঘুম আর আধো জাগরণের মাঝামাঝি একটি তরল অবস্থায় আমি ঘুরপাক খেতে থাকি। আমি একরকম জোর করে চোখ খুলে তাকালাম, চতুষ্কোণ স্ক্রিনটিতে একটি নীল গ্রহের ছবি ফুটে উঠেছে। আমি এই গ্রহটিকে চিনি, এর নাম পৃথিবী, ছায়াপথের একটি সাদামাটা নক্ষত্রকে ঘিরে যে গ্রহগুলি ঘুরছে এটি তার তৃতীয় গ্রহ। এই গ্রহে প্রাণের বিকাশ হয়েছিল এবং আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই গ্রহ থেকে এসেছে। আমরা একটি মহাকাশযানে করে এখন আবার এই গ্রহটিতে ফিরে যাচ্ছি।

আমি নীল গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ শীত অনুভব করলাম। নিজের অজান্তে দুই হাত বুকের কাছে টেনে আনতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার সারা দেহে কোনো অনুভূতি নেই। আমার মনে পড়ল মহাকাশযানের দীর্ঘ যাত্রার প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে আমাকে এবং আমার মতো আরো দশ সহস্র মহাচারীকে শীতল ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর কাছে পৌঁছানোর পর আমাদের জাগিয়ে দেবার কথা। আমরা নিশ্চয়ই গন্তব্য স্থলে পৌঁছে গেছি, তাই আমাদের জাগিয়ে তোলা শুরু হয়েছে।

আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করলাম, ধরমর করে উঠে বসার একটা অমানুষিক ইচ্ছাকে প্রাণপনে নিবৃত্ত করে আমি ক্যাপসুলের ভিতরে। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। আমার চারপাশে খুব ধীরে ধীরে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, আমি আমার শরীরে আবার শক্তি ফিরে পেতে শুরু করেছি। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত এই শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুরোপুরি সজীব করার আগে আমাকে এই ক্যাপসুল থেকে বের হতে দেয়া হবে না জেনেও আমি কিছুতেই ভিতরে চুপচাপ শুয়ে থাকতে পারছিলাম না।

শুয়ে থাকতে থাকতে যখন আমি ধৈর্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছেছি ঠিক তখন ক্যাপসুলের ঢাকনাটি সরে গেল। আমি সাথে সাথে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এলাম। নিও পলিমারের সূক্ষ্ম একটা আবরণে শরীরকে ঢেকে আমি নগ্ন পদে শীতল মেঝেতে হেঁটে কেন্দ্রীয় ভল্টের বাইরে এসে দাড়ালাম। গোলাকার দরজার কাছে ভাবলেশহীন সুখে একজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল, আমাকে দেখে জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে এনে বলল, কিহা, শীতল ঘর থেকে তোমার জাগরণ শুভ হোক।

আমি মানুষটার দিকে তাকালাম, এরকম যান্ত্রিক গলায় যে এধরনের একটা। অর্থহীন কথা বলতে পারে সে নিশ্চয়ই মানুষ নয়, সে নিশ্চয়ই একজন রবোট। সে যদি মানুষ নাও হয় তবু তার কথার উত্তরে আমার কিছু একটা বলা উচিৎ কিন্তু আমার অর্থহীন সম্ভাষণ পাল্টা-সম্ভাষণ করার ইচ্ছে করল না। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কী পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এসেছি?

মানুষটা শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, পৃথিবী?

হ্যাঁ, পৃথিবী।

আমি জানি না।

তুমি কি রবোট?

মানুষটির চোখে এক ধরনের ক্রোধের ছায়া এসে পড়ল। আমার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমি রবোট না মানুষ সেটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। আমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটি করতে পারছি কী না তাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের কৌতুক অনুভব করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে কী দায়িত্ব দেয়া হয়েছে?

আজকে শীতল ঘর থেকে যারা বের হবে তাদের সবার বায়ো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা। কমিশনের সামনে হাজির করা।

কিসের কমিশন?

সেটা তুমি সময় হলেই দেখবে।

আমি আবার মানুষটার দিকে তাকালাম, এটি নিশ্চয়ই একটি রবোট, মানুষ হলে যে প্রায় এক শতাব্দী শীতল ঘরে ঘুমিয়ে থেকে জেগে উঠেছে তার সাথে এরকম রুক্ষ গলায় কথা বলত না। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, চল। তাহলে, আমাকে নিয়ে যাও, যেখানে তোমার নেবার কথা।

মানুষটি বলল, এস।

আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকি। মানুষটি হেঁটে যেতে যেতে অন্যমনস্ক ভাবে তার ঘাড়ে একবার হাত বুলায়। এটি তাহলে রবোট নয়, মানুষ রবোটকে কখনো। তাদের শরীর চুলকাতে হয় না।

বায়ো নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটি যত জটিল হবে ভেবেছিলাম সেটা মোটেও তত জটিল হল না। চতুষ্কোণ একটা দরজার মতো জায়গা দিয়ে আমাকে নগ্ন দেহে হেঁটে যেতে হল, যন্ত্রটি আমার শরীরকে নানা ভাবে স্ক্যান করে আমার সম্পর্কে সম্ভাব্য সবরকম জৈবিক তথ্য মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রে লিপিবদ্ধ করে ফেলল। পুরো তথ্য বিশ্লেষণ করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল এবং প্রায় সাথে সাথেই আমার শরীর কয়েক ধরনের প্রতিষেধক দিয়ে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হল। এখানে আমার মস্তিষ্ককে স্ক্যান করা হল, মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করার এই যন্ত্রটি সত্যিই কাজ করে কী না সে ব্যাপারটা আমার বড় ধরনের সন্দেহ রয়েছে। আমার পরিচিত একজন অসাধারণ প্রতিভাবান গণিতবিদ, ব্যক্তিগত জীবনে যে একটু খাপছাড়া ধরনের প্রতিবার এই মস্তিষ্ক স্ক্যান যন্ত্রের সামনে গবেট হিসাবে প্রমাণিত হয়ে এসেছে। এই যন্ত্রটি অবশ্যি আমার সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেছে বলে মনে হল, কারণ যন্ত্রটির পিছনে যে কমবয়সী সুন্দরী মেয়ে কিংবা রবোটটি বসে রয়েছে সে রিপোর্টটি দেখে চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। আমি তার চোখে একধরনের অবিশ্বাসের ছায়া দেখতে পেলাম। আমার চেহারা খুব সাধারণ, মানুষ নিশ্চয়ই অসাধারণ বুদ্ধিমান মানুষকে অসাধারণ সুদর্শন হিসেবে আবিষ্কার করতে চায়।

বায়ো নিয়ন্ত্রণ ঘর থেকে বের হয়ে আমি একটা ছোট হলঘরে হাজির হলাম। সেখানে আরামদায়ক চেয়ারে জনা বিশেক নানাবয়সের মানুষ গা এলিয়ে বসে আছে। আমি ঘরে ঢুকতেই সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকাল এবং মধ্যবয়সী একজন মানুষ সহজ গলায় বলল, এই হচ্ছে কিহ। এখন আমরা কাজ শুরু করে দিতে পারি।

আমি সবাইকে লক্ষ করতে করতে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়লাম। চেয়ারগুলি দেখতে যত আরামদায়ক বসতে সেরকম নয়, ইচ্ছে করেই নিশ্চয় এভাবে তৈরি করা হয়েছে। মনে হয় আমাদের জরুরি কোনো তথ্য দেয়া হবে, তাই বেশি আরামে ঠেলে দিতে চায় না, একটু তটস্থ রাখতে চায়। মধ্যবয়সী মানুষটি হেঁটে হেঁটে ঘরের মাঝখানে যেতে যেতে বলল, প্রতিদিন শীতল ঘর থেকে যে সব মানুষকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে তাদের মাঝে যাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ছয় এর বেশি তাদেরকে এই ঘরে আনা হয়। মস্তিষ্ক স্ক্যান করার পদ্ধতিটি এখনো পুরোপুরি আয়ত্তে আনা হয় নি। মাঝে মাঝে ভুল করে বুদ্ধিমান মানুষের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ধরা পড়ে না। কিন্তু উল্টোটা কখনো হয় নি। যাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ছয়ের বেশি ধরা পড়েছে তারা কখনো নির্বোধ প্রমাণিত হয় নি। কাজেই এই ঘরে তোমরা যারা আছ তারা সবাই নিশ্চিতভাবে অত্যন্ত বুদ্ধিমান–আমার কাজ সে কারণে খুব সহজ।

সামনের দিকে বসে থাকা একজন তরল গলায় বলল, তোমার কাজটা কী?

আমার কাজ তোমাদেরকে তোমাদের পরবর্তী দায়িত্বের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। তোমরা সবাই শীতলঘরে ঘুমিয়েছিলে এবং তোমাদের বলা হয়েছিল পৃথিবী নামক গ্রহটার কাছে পৌঁছানোর পর তোমাদের জাগিয়ে তোলা হবে। পৃথিবী এখনো অর্ধশতাব্দী বৎসর দূরে, তোমাদের এখনই জাগিয়ে তোলা হয়েছে, তার পিছনে নিশ্চয়ই একটা কারণ রয়েছে। কারণটা কী?

আমার পাশে বসে থাক ঝকঝকে চেহারার একটা মেয়ে বলল, আমাদের সেটা অনুমান করতে হবে?

না। মধ্যবয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, সেটা তোমাদের অনুমান করতে হবে। এটি গোপন কিছু নয়, কিন্তু তুমি যেহেতু প্রশ্ন করেছ আমার একটু ব্যক্তিগত কৌতূহল হচ্ছে। তুমি কি কিছু অনুমান করছ?

মেয়েটি মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ।

আমরা কি সেটা শুনতে পারি?

অবশ্যি পার। আমার ধারণা সত্যিকার কারণটি যেন আমরা জানতে না পারি সেজন্যে তুমি আমাদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে এখন মিথ্যে একটা কারণের কথা বলবে।

মেয়েটার কথা শুনে আমরা সবাই উচ্চঃস্বরে হেসে উঠলাম, মধ্য বয়স্ক মানুষটি হাসল সবচেয়ে জোরে। সে হাসতে হাসতেই বলল, এই মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণের পুরো ব্যাপারটি এত জটিল যে তোমার ধারণা সত্যি হবার পুরোপুরি সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আমি তোমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমি তোমাদের যদি মিথ্যে একটা কারণের কথাও বলি সেটা সত্যি জেনেই বলব। মানুষকে যখন বিভ্রান্ত করার প্রয়োজন হয় তখন রবোটকে ব্যবহার করা হয়। আমি রবোট নই, জলজ্যান্ত মানুষ।

সামনের দিকে বসে থাকা একজন মানুষ বলল, ঠিক আছে, এখন তাহলে কারণটা শোনা যাক।

মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখ একটু গম্ভীর হয়ে আসে। সে কীভাবে কথাটা বলবে সম্ভবত সেটা মনে মনে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, এই মহাকাশযানটি প্রায় এক শতাব্দী আগে যখন পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছিল তখন পরিকল্পনা করা হয়েছিল পৃথিবীর কাছাকাছি এসে আমাদের সবাইকে জাগিয়ে তোলা হবে। সে ভাবেই এই অভিযান শুরু হয়েছিল। বেশির ভাগ মহাকাশচারী শীতল ঘরে ঘুমিয়েছিল অল্প কিছু ক্রু পালা করে মহাকাশযানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছিল। তোমরা নিশ্চয়ই জান মহামতি গ্রাউল যখন এই মহাকাশযানটি তৈরি করেছিলেন তখন সেটিকে সৃষ্ট জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এটি মহকাশ পারাপার করতে পারে।

আমরা মাথা নাড়লাম, মহাকাশচারী হিসেবে এই মহাকাশযানে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্যে আমরা যারা স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়েছিলাম তাদেরকে নানাভাবে এই তথ্যগুলি অনেকবার দেয়া হয়েছে। এই মহাকাশযানের পরিকল্পনা করেছিলেন গ্রাউল নামের একজন মানুষ, তাকে সবসময় মহামতি গ্রাউল বলা হয়। জনশ্রুতি রয়েছে মহামতি গ্রাউল বিকলাঙ্গ, তার চোখ কান অন্যকোন ইন্দ্রিয় নেই, তিনি সরাসরি সংবেদন জাতীয় যন্ত্র দিয়ে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি কোথায় থাকেন সেটি কেউ জানে না। তিনি কি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন সেটিও কেউ জানে না। মহামতি গ্রাউল নিয়ে যে পরিমাণ রহস্যের জন্ম দেওয়া হয়েছে যে আমার মনে হয় পুরো ব্যাপারটি কাল্পনিক। গ্রাউল নামে কোনো মানুষ কখনো ছিল না। এটি কিছু প্রতিভাবান বিজ্ঞানী এবং কিছু শক্তিশালী কম্পিউটার জাতীয় যন্ত্রের একধরনের সুষম উপস্থাপন।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই অভিযানের প্রথম অংশটুকু ঠিক পরিকল্পনা মাফিক কেটেছে। কিন্তু যখন আমরা পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছাতে শুরু করেছি হঠাৎ করে অবস্থার পরিবর্তন হল। পৃথিবী থেকে আমাদের কাছে কিছু সংবাদ পৌঁছাত শুরু করল।

আমার পাশে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার মেয়েটি বলল, কী ধরনের সংবাদ?

অত্যন্ত নিরীহ ধরনের সংবাদ। পৃথিবীর ফসল তোলা হচ্ছে। পানি সরবরাহ করার জন্যে মেরু অঞ্চলের বরফ গলানো হচ্ছে। আয়োনোস্ফিয়ারে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। নূতন ধরনের আন্তঃগ্যালাক্টিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হচ্ছে এই ধরনের সংবাদ। আপাত দৃষ্টিতে এই সংবাদগুলির মাঝে এতটুকু বৈচিত্র নেই। কিন্তু মহাকাশযানের তথ্য বিশ্লেষণের যে সমস্ত উপায় রয়েছে সেগুলির মাঝে এই

তথ্যগুলি সরবরাহ করে একটি অত্যন্ত বিচিত্র জিনিস আবিষ্কার করা হয়েছে।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি ইচ্ছে করে এক মুহূর্তের জন্যে থামল এবং বেশ কয়েকজন এক সাথে জিজ্ঞেস করল, কী জিনিস?

দেখা গেছে সমস্ত পৃথিবী একটা ভয়াবহ গোলযোগের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর মানুষেরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। একে অন্যকে কীভাবে ধ্বংস করবে সেটাই হচ্ছে সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য।

পিছনের দিকে বসে থাকা বুড়ো মতো একজন মানুষ বলল, আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না–নিরীহ কিছু সংবাদ থেকে সেটা কেমন করে বোঝা সম্ভব?

আমার পাশে বসে থাকা মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, সম্ভব হতে পারে। যদি দেখা যায় একটি ঘটনা ঘটছে অন্য আরেকটি ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে আর সেই ঘটনাগুলি একটি আরেকটাকে সাহায্য না করে ক্ষতি করছে–

মধ্য বয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। যেমন ধরা যাক ফসল কাটার ব্যাপারটি। ঠিক ফসল কাটার সময় যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় আর সেই দুর্যোগটি যদি হয় ইচ্ছাকৃত–তাহলে আমাদের সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। এমনিতে আমাদের কাছে সেই তথ্যগুলি অর্থহীন কিন্তু যদি সেগুলি বিশ্লেষণ করা যায় তখন সেগুলি হঠাৎ করে খুব অর্থবহ হয়ে ওঠে।

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়েছিলাম। হঠাৎ করে আমার মনে হল আমি একটু একটু বুঝতে পারছি সে কী বলতে চাইছে। একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত গলা উচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই মহাকাশযান যারা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের ধারণা আমরা এই পৃথিবীতে বাস করার অনুপযুক্ত?

মধ্যবয়স্ক মানুষটি আমার প্রশ্ন শুনে খুব অবাক হয়ে গেল, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কী ধারণা পৃথিবীতে মানুষেরা যেরকম হানাহানি করেছ আমাদের এই মহাকাশযানে ঠিক সেরকম হানাহানি শুরু করতে হবে, যেন আমরা যখন পৃথিবীতে পৌঁছাব তখন কী করতে হবে আমাদেরকে বলে দিতে হবে না?

মধ্যবয়স্ক মানুষটি আমতা আমতা করে বলল, তুমি কথাগুলি বলেছ খুব রুঢ় ভাবে কিন্তু কথাটি সত্যি। আমি একটু অন্যভাবে বলতে যাচ্ছিলাম।

আমার পাশে যে মেয়েটি বসেছিল সে আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছিল, এবারে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কীভাবে বলতে যাচ্ছিলে?

আমি বলতে চাইছিলাম যে আমরা যে গ্রহ থেকে এসেছি সেই গ্রহে একটা নূতন ধরনের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যে কারণেই হোক আমাদের গ্রহে একজন মানুষ অন্য মানুষকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে, আমরা একে অন্যের উপরে অনেক বেশি নির্ভরশীল। আমরা যখন পৃথিবীতে পৌঁছাব পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারব না। অপরিচিত অবস্থার সাথে যুদ্ধ করে আমাদের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাবে–

আমি মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করতে থাকি। এই মানুষটি যে কথাগুলি বলছে সেগুলি অর্থহীন কথা, কখনো কাউকে বিভ্রান্ত করতে হলে এই ধরনের কথা বলতে হয়। কেন সে আমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে? আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, সে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, আমরা যে সমাজ-ব্যবস্থা থেকে এসেছি সেখানে কোনো নেতৃত্ব নেই। আমাদের কার কী দায়িত্ব নিখুতভাবে ব্যাখ্যা করা আছে–সবাই নিজের দায়িত্ব পালন করে যাই এবং পুরো সমাজ ব্যবস্থা এগিয়ে যায়। এই মুহূর্তে যে পৃথিবী আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে সেখানে সমাজ-ব্যবস্থা অন্যরকম। সেখানে সমস্যার জন্ম হলে একজনকে নেতৃত্ব নিয়ে তার সমাধান করতে হয়। আমাদের পৃথিবীতে যাবার আগে সেটা শিখতে হবে।

আমি শীতল গলায় বললাম, সেটা আমরা কীভাবে শিখব?

মধ্যবয়স্ক মানুষটিকে কেমন যেন অসহায় দেখায়, সে একধরনের ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খুব সহজে। এই মহাকাশযানের যে নিয়ন্ত্রণটুকু ছিল সেটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

কী বললে?

হ্যাঁ। এই বিশাল মহাকাশযান, এর দশ হাজার অধিবাসী প্রায় আঠাইশটি ভিন্ন ভিন্ন স্তর, বায়ুমণ্ডল পরিশোধণের ব্যবস্থা, কৃত্রিম মহাকর্ষ বল, জৈবিক বিভাগ, শক্তি সঞ্চয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছু এখন আলাদা আলাদাভাবে কাজ করছে। কিন্তু এর যে সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণটুকু ছিল সেটা প্রায় দশ বছর আগে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এই মহাকাশযানটি, এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে মহাকাশের ভেতর দিয়ে বিশাল একটা উপগ্রহের মতো ছুটে যাচ্ছে। আমাদের এখন এর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। দশ হাজার মানুষের জন্যে সেটি প্রায় এক শতাব্দীর কাজ। আমাদের এত সময় নেই। আমাদের সেটা অর্ধ শতাব্দীর মাঝে শেষ করতে হবে। সেটি করার একটি মাত্র উপায়

মধ্যবয়স্ক মানুষটি হঠাৎ করে চুপ করে গেল, সে আশা করছিল আমরা কিছু বলব, কিন্তু আমরা কেউ কিছু বললাম না। মানুষটি কয়েকমুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমাদের সেটি করার একমাত্র উপায় হচ্ছে নিজেদের মাঝে এক ধরনের নেতৃত্ব সৃষ্টি করে কাজ শুরু করা। সেজন্যে শীতল ঘর থেকে সবাইকে জাগিয়ে তোলা শুরু হয়েছে।

আমি অনেক কষ্ট করে এতক্ষন নিজেকে শান্ত করে রেখেছিলাম এবারে আর পারলাম না। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ক্রোধকে গোপন করার এতটুকু চেষ্টা না করে বললাম, তুমি কে আমি জানি না। কেন তুমি এখানে এসেছ তাও আমি জানি না কিন্তু আমার কাছে থেকে শুনে রাখ, আমি তোমার একটা কথাও বিশ্বাস করি না। তুমি কার নির্দেশে এইসব বলছ আমি জানি না, আমার জানার এতটুকু ইচ্ছেও নেই। আমি শীতল ঘরে ফিরে যাচ্ছি, পৃথিবীতে পৌঁছানোর আগে তুমি যদি আবার আমাকে জাগিয়ে তোলো আমি পরিস্কার ভাবে বলে দিচ্ছি সেটা তোমার জন্যে ভাল হবে না।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল, সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না যে কেউ এভাবে তার সাথে কথা বলতে পারে। বার কয়েক চেষ্টা করে সে আবার কিছু একটা বলতে শুরু করল কিন্তু আমার আর শোনার ইচ্ছে হল না, লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

বাইরে দাঁড়িয়ে আমি কয়েকবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম। শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানো গেলে নাকী রাগ কমে আসে। এত তাড়াতাড়ি এভাবে রেগে গেলাম কেন কে জানে। মানুষটি মিথ্যে কথা বলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু তার জন্যে সে নিশ্চয়ই দায়ী নয়। আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে বাইরে তাকালাম, যতদূর চোখ যায় একটা ধু ধু প্রান্তরের মতো, এর পুরোটা মানুষের তৈরী এখনো আমার বিশ্বাস হয় না।

আমি সামনে নেমে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন পিছন থেকে একজন আমাকে ডাকল, কিহা!

আমি ঘুরে তাকালাম, আমার পাশে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার মেয়েটি আমার দিকে ছুটে আসছে। কাছে এস আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম লেন। তুমি সত্যি শীতল ঘরে ঘুমাতে যাচ্ছ?

আমি মেয়েটা দিকে তাকালাম, কী চমৎকার চেহারা মেয়েটির, যে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার মেয়েটার চেহারা ডিজাইন করেছে তার রুচিবোধের তুলনা হয় না।

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি সত্যিই শীতল ঘরে ঘুমাতে যাচ্ছি।

তুমি ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে চাও না?

না।

কেন?

কারণ আমি জানি এই মহাকাশযান বিশাল একটা প্রজেক্ট। যে কোনো মূল্যে এটাকে সমাপ্ত করা হবে–আমি সাহায্য করি আর নাই করি। এই মুহূর্তে পুরো ব্যাপারটির মাঝে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র রয়েছে। বড় ধরনের নোংরামি। আমার নোংরামি ভাল লাগেনা। আমার ধারণা ছিল কয়েক হাজার বছর আগে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা আমাদের ভেতর থেকে সব নোংরামো সরিয়ে নিয়েছে।

লেন খিলখিল করে হেসে ফেলল, বলল, তুমি একেবারে ছেলেমানুষ! তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর জিনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা ভাল মানুষ তৈরি করছে?

আমি লেনের দিকে তাকিয়ে বললাম, তারা যে ভাল চেহারার মানুষ তৈরি করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই!

চেহারা তৈরি করা সহজ! আমি আমার জিনেটিক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখেছি। তাদের হিসেব অনুযায়ী আমি খুব উন্নত ধরনের মানুষ। কিন্তু তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে আমার মাঝে মাঝে কী জঘন্য ধরনের কাজ করার ইচ্ছে করে!

যেরকম?

মেয়েটি মাথা নাড়ল, সেগুলি তোমাকে বলা যাবে না! তুমি শুনলে আমাকে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দেবে।

অন্যায় কাজ করার ইচ্ছে করা আর অন্যায় করা এক জিনিস নয়। ফ্যান্টাসি গ্রহণযোগ্য জিনিস।

লেন হাত নেড়ে বলল, সেটা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করতে পারব, এখন কাজের কথা বলা যাক। তুমি সত্যিই শীতল ঘরে যেতে চাইছ?

তুমি দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করলে। ব্যাপার কী?

আমি তোমার সাথে একমত যে আমাদের সাহায্য ছাড়াই এই মহাকাশযান পৃথিবীতে পৌঁছে যাবে। যারা এটা নিয়ন্ত্রণ করছে এটা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু এই যে নেতৃত্বের ব্যাপারটা–

আমি অবাক হয়ে লেনের দিকে তাকালাম, নেতৃত্বের কোনো ব্যাপারটা?

লেন মনে হল একটু লজ্জা পেয়ে গেল। একটু ইতস্তত করে বলল, এই যে নেতৃত্বের কথা বলছে সেটা নিয়ে আমার খুব কৌতূহল। আমার খুব জানার ইচ্ছে যে মানুষ যদি খুব উচ্চাকাক্ষী হয় তাহলে সত্যিই কি স্বার্থপর হয়ে যায়? নিজের সিদ্ধান্ত সেটা ভাল হোক আর খারাপ হোক অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়? অন্যেরাও

সেটা মুখ বুজে মেনে নেয়?

আমি মাথা নাড়ালাম, নিশ্চয়ই তাই হয় লেন।

এখানেও কি তাই হচ্ছে?

আমার মনে হয় হচ্ছে। গত দশ বছর থেকে এখানে মানুষকে শীতল ঘর থেকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে নেতৃত্ব দিতে। কাজেই আমি নিশ্চিত এই মহাকাশযানটা এখন ছোট ছোট অংশে ভাগ হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা অংশে একজন করে নেতা রয়েছে। তারা সবাই আরো বড় অংশের নেতৃত্বের জন্যে যুদ্ধ করছে।

যুদ্ধ?

হ্যাঁ। হয়তো সত্যিকার অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ নয়। কৌশল দিয়ে যুদ্ধ। ছল চাতুরী দিয়ে যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধ নিশ্চয়ই হচ্ছে।

লেনের চোখ চকচক করতে থাকে। সে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমি ব্যাপারটা দেখতে চাই।

আমার মনে হয় ব্যাপারটা কুৎসিত। প্রাচীন কালে মানুষের নেতৃত্বের প্রয়োজন। ছিল। মানুষ যত উন্নত হয়েছে নেতৃত্বের প্রয়োজন তত কমে এসেছে। এখন আসলে নেতৃত্বের কোনো প্রয়োজন নেই।

কিন্তু এই মহাকাশযানে তো নেতৃত্বের প্রয়োজন তৈরি করা হয়েছে।

এটা কৃত্রিম। আমার ধারণা কেউ একজন আমাদের নিয়ে একটা পরীক্ষা করছে। ভয়ংকর একটা পরীক্ষা।

লেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি দেখতে চাই পরীক্ষা কেমন ভাবে করা হয়। কেমন জানি একটা কৌতূহল। হয়তো দূষিত কৌতূহল, কিন্তু কৌতূহল।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, কৌতূহল কখনো দূষিত হয় না লেন। কৌতূহল অনাবশ্যক হতে পারে, কিন্তু দূষিত নয়।

লেন আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার কোনো কৌতূহল নেই?

আমি মাথা নাড়লাম, না। নেই। আমি শীতল ঘরে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে যেতে চাই। শান্ত নিরুপদ্রব ঘুম। আমি জেগে উঠতে চাই পৃথিবীতে। আমার জীবনীশক্তি আমি এই মহাকাশযানে অপচয় করতে চাই না। আমি সেটা পৃথিবীর জন্যে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

লেন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি প্রথমবার লক্ষ করলাম তার চোখ দুটি আশ্চর্য রকম নীল–ঠিক পৃথিবীর মতো।

২. মহাকাশযানের এই অংশটুকু

মহাকাশযানের এই অংশটুকু আমার কেমন জানি চেনা-চেনা মনে হল। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে কোনো অচেনা জায়গাকে চেনা-চেনা মনে হয় এর কারণ কী কে জানে। বিশাল এই মহাকাশযানটি আক্ষরিক অর্থে একটি বিরাট উপগ্রহের মতো, এর অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি ভগ্নাংশ আমি দেখেছি, আমার স্মৃতি ভাল নয় যেটুকু দেখেছি সেটুকুও ভাল মনে নেই, কাজেই আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে এই জায়গাটি আমি আসলে আগে কখনো দেখি নি।

জায়গাটি আমি কি দেখেছি না দেখিনি যখন এই অর্থহীন ভাবনাটি আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ঠিক তখন আমি অনুভব করলাম আমার কজিতে বাঁধা ছোট কমিউনিকেশান্স মডিউলটাতে কেউ একজন আমার তথ্যগুলি যাচাই করে দেখছে। আমার মৌখিক অনুমতি ছাড়া সেটি করার কথা নয়, কাজটি ঘোরতর অন্যায়। আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করে কমিউনিকেশান্স মডিউলটি বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেলাম। এই মহাকাশযানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে থাকলে সবচেয়ে প্রথমে এই কাজটি করার কথা–অন্য মানুষকে যাচাই করে দেখা। কেউ একজন আমাকে যাচাই করে দেখছে। সেটি বন্ধ করে দিলে তার কৌতূহল বা সন্দেহ বেড়ে যাবে যার ফল আমার জন্যে ভাল নাও হতে পারে। আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে কৌতূহলী চোখে চারিদিকে তাকাতে থাকি। আমার সামনে বেশ কিছু চতুষ্কোণ পাথর সাজানো আছে, ডানদিকে একটা দালানের মতো উঠে গেছে। পেছনে বড় করিডোর। বাম দিকে বেশ খানিকটা উন্মুক্ত জায়গা। আশে পাশে কোথাও কোনো মানুষ রবোট বা অন্যকোন ধরনের যানবাহন নেই। যেই আমাকে যাচাই করে দেখছে সে কাজটি করছে গোপনে। আমি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, মানুষ কী বিচিত্র একটি প্রজাতি, কত সহজে তাদেরকে সাময়িকভাবে কলুষিত করে দেয়া যায়। আমি যখন যোগাযোগ মডিউলে কথা বলব না কী পুরো ব্যাপারটা উপেক্ষা করে এগিয়ে যাব ঠিক করতে পারছিলাম না, তখন দেখতে পেলাম চতুষ্কোণে পাথরের আড়াল থেকে দুজন মানুষ দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মানুষ দুজনের হাতে কালচে বিদঘুটে জিনিসগুলি যে কোনো ধরনের অস্ত্র সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

মানুষ দুজন আমার দুপাশে দাঁড়িয়ে শক্ত হাতে আমার দুই হাত ধরে ফেলল। আমি ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তাদের গায়ে যন্ত্রের মতো জোর–সম্ভবত তারা মানুষ নয়, রবোট। আমি নিজেকে যেটুকু সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম, আমাকে ছেড়ে দাও।

নিনীষ স্কেলে যার বুদ্ধিমত্তা আটের উপরে তাকে আমরা এমনি ছেড়ে দেব? আমাদের দেখে কি এত বড় নির্বোধ মনে হয়?

আমি মানুষগুলির চেহারা খুব ভাল করে দেখি নি, কিন্তু যেটুকু দেখেছি তাদের বেশ নিবোধই মনে হচ্ছিল যদিও সেটা এখন জোর গলায় বলার সাহস হল না। মানুষ দুজন আমাকে টেনে-হিচড়ে নিয়ে যেতে থাকে, আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে-করতে বললাম, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? কী করবে আমাকে দিয়ে?

বিক্রি করব।

বিক্রি করবে? কার কাছে?

যে ভাল দাম দেবে।

আমি মানুষ দুজনকে মুখের দিকে তাকালাম, তারা সত্যি কথা বলছে নাকি আমার সাথে রসিকতা করছে বোঝার চেষ্টা করলাম, ভাবলেশহীন মুখে কোনো ধরনের অনুভূতি নেই, সম্ভবত সত্যি কথাই বলছে। এই মহাকাশযানে এর মাঝে বুদ্ধিমান মানুষ কোননাবেচা শুরু হয়ে গেছে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে তোমরা কিসের বিনিময়ে বিক্রি করবে?

মানুষ দুজনই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। একজন বলল, সত্যি তুমি জান না?

না। আমি আজকেই শীতল ঘর থেকে বের হয়েছি। নিনীষ স্কেলে আট-এর মানুষ এখন বারো পয়েন্টে বিক্রি হচ্ছে। ছয় পয়েন্টে এক স্তর উপরে উঠা যায়। প্রতি স্তরে রয়েছে–

লোকটি তার কথা শেষ করার আগেই আমার কানের কাছে দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে কী একটা ছুটে গেল, পর মুহূর্তে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল। মানুষ দুজন আমাকে নিয়ে সাথে সাথে বড় একটা পাথরের পাশে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। আমি পাথরের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখলাম। দেখতে পেলাম মানুষ দুজন তাদের অস্ত্র উপরে তুলে প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে গুলি করতে শুরু করেছে। তীব্র আলোর ঝলকানিতে চারিদিকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বিস্ফোরণের শব্দ ধোয়া এবং ধুলোবালিতে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসে। আমি এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়ি নি এবং এরকম পরিস্থিতিতে কী করতে হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। প্রচণ্ড আতংকে হতচকিত হয়ে উঠে দৌড়ানোর একটা অদম্য ইচ্ছাকে অনেক চেষ্টা করে চেপে রেখে আমি মাথা নিচু করে শুয়ে রইলাম।

আমার কানের কাছে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল এবং আমি মাথা তুলে দেখতে পেলাম আমার পাশে উবু হয়ে শুয়ে থাকা একজন মানুষের শরীরের অর্ধেক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে গেছে এবং শরীরের ছিন্ন-ভিন্ন অংশ থেকে কিছু পোড়া তার, ধাতব যন্ত্রপাতি আর ঝলসে যাওয়া পলিমার বের হয়ে আছে এবং সেখান থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি যাদেরকে মানুষ ভেবেছিলাম সেগুলি নিচু স্তরের রবোট ছাড়া আর কিছু নয়। রবোটটি সেই অবস্থাতে তার অস্ত্র দিয়ে কর্কশ শব্দ করে গুলি করে যেতে থাকে।

কিছুক্ষণের মাঝে বেশ কয়েকজন এসে আমাদের ঘিরে ফেলল, দেখে তাদের মানুষ মনে হলেও খণ্ডযুদ্ধে উড়ে যাওয়া অংশ থেকে ধাতব যন্ত্রপাতি বের হয়ে রয়েছে বলে সেগুলি যে রবোট সে সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ রইল না। দুজন নিচু হয়ে আমাকে টেনে তুলে নিল, তৃতীয়টি তার হাতের অস্ত্র দিয়ে পড়ে থাকা বাকি রবোটটিকে প্রায় পুরোপুরি ভাস্মীভূত করে ফেলল। আমি নিশ্চিতভাবে জানি এরা দেখতে মানুষের মতো হলেও কেউই আসলে মানুষ নয় এবং একজন আরেকজনকে যেরকম সহজে ধ্বংস করে ফেলছে সেটি সত্যিকার অর্থে নৃশংসতা নয় কিন্তু তবু আমার সারা শরীর গুলিয়ে আসতে থাকে।

রবোটগুলি হাতের অস্ত্রগুলি তাক করে আমাকে ঘিরে এগিয়ে যেতে থাকে। আমি কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে এনে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

একটি রবোট ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে যান্ত্রিক ভাষায় কিছু শব্দ উচ্চারণ করল, আমি তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি মাথা নেড়ে বললাম, তুমি কী বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

রবোর্টটি কোনো কথা না বলে আমার দিকে তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়, তার দুই আঙুল থেকে সুচালো দুটি ইলেকট্রন্ড বের হয়ে আসে, আমি কিছু বোঝার আগেই সেগুলি আমার কপাল স্পর্শ করল, আমি ভয়ংকর একটা ইলেকট্রিক শক অনুভব করলাম এবং সাথে সাথে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।

 

আমার যখন জ্ঞান ফিরে এল আমি আবিষ্কার করলাম আমি উপুড় হয়ে শীতল একটা পাথরের মেঝেতে শুয়ে আছি। মাথায় চিনচিনে একটা ব্যথা। আমি সাবধানে মাথা তুলে তাকালাম–অন্ধকার একটা ঘর, মনে হল সেখানে আরো কিছু মানুষ আছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকানোর চেষ্টা করতেই ঘরের কোণা থেকে একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে এসে নরম গলায় বলল, তুমি এখনো বেঁচে আছ? আমি ভেবেছিলাম মরে গেছ।

আমি উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বললাম, না, এখনো মরি নি। আমরা কোথায়?

মহাকাশযানের সবচেয়ে বড় দস্যুদলের হাতে বন্দী।

বন্দী?

হ্যাঁ।

কেন?

মানুষটি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, যদি বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ছয়ের বেশি হয় তোমাকে স্থানীয় কোনো নেতার কাছে বিক্রি করে দেবে।

যদি না হয়?

তাহলে কপাল খারাপ। শুনেছি শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে কেটে বিক্রি করে। শক্তিশালী হৃদপিণ্ড নাকি খুব ভাল দামে বিক্রি হচ্ছে। নিনীষ স্কেলে তোমার বুদ্ধিমত্তা কত?

আট।

আট! মানুষটা শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, এত যদি তোমার বুদ্ধি তাহলে এই গাড়ায় এসে হাজির হলে কেমন করে?

আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, যন্ত্রপাতি কাউকে বুদ্ধিমান বললেই সে বুদ্ধিমান হয়ে যায় না। আমি বেশির ভাগ ব্যাপারে একেবারে নিবোধ।

সে ব্যাপারে আমর কোনো সন্দেহ নেই! মানুষটা নির্মমভাবে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমার বুদ্ধিমত্তা যদি নিনীষ স্কেলে ছয়ও হতো আমি অর্ধেক মহাকাশযান দখল করে ফেলতাম।

আমি মানুষটার চোখের দিকে তাকালাম, সে চোখ সরিয়ে হেঁটে ঘরের অন্যপাশে চলে গেল। একটু পরে শুনতে পেলাম সে গুন গুন করে বিষণ একটা সুরে গান গাইছে–অকারণেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল।

 

আমি দীর্ঘ সময় একা একা ঘরের কোণায় বসে রইলাম। শীতল ঘর থেকে বের হবার পর দীর্ঘ সময় খাবার খেতে হয় না, যদি তা না হতো তাহলে এতক্ষণে আমি নিশ্চয়ই ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে যেতাম। কিছু একটা ঘটার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আমি যখন হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম তখন হঠাৎ দরজা খুলে গেল। রাগী চেহারার কম বয়স্ক একজন মানুষ দুই পাশে দুইজন সশস্ত্র রবোট নিয়ে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের মাঝে কিহা কে?

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি। কেন কী হয়েছে?

রাগী চেহারার মানুষটি আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল, হাতে কমিউনিকেশান্স রিডারে আমার তথ্যগুলি ভাল করে মিলিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমার সাথে চল।

কোথায়?

তোমাকে আমরা মিয়ারার কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। তার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

মিয়ারা? সেটা কে?

রাগী চেহারার মানুষটা শুষ্ক স্বরে হেসে উঠে বলল, বলতেই হবে তুমি খুব সৌভাগ্যবান মানুষ যে মিয়ারার নাম শুন নি! দশ বছরের মাঝে এই মেয়ে মানুষটি যদি পুরো মহাকাশযানটা দখল করে না নেয় তাহলে আমার মাথা কেটে সেখানে একটা কপোট্রন বসিয়ে দিও!

আমি কোনো কথা না বলে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে তার কাপড়ের মাঝে হাত ঢুকিয়ে চোখ-ঢাকা একটা হেলমেট বের করে এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা মাথায় পরে নাও, তোমাকে কোথায় নিচ্ছি দেখতে দিতে চাই না।

আমি অত্যন্ত খেলো ধরনের হাস্যকর এই হেলমেটটি পরে নিতেই আমার চোখের সামনে সবকছুি পাল্টে গেল, আমি মানুষটি এবং রবোট দুটিকে এখনও দেখতে পাচ্ছিলাম কিন্তু বাকি সব কিছু পাল্টে গিয়ে সেখানে অতিপ্রাকৃত বিচিত্র সব দৃশ্য খেলা করতে থাকে। আমার সামনে বিচিত্র ধরনের রাস্তাঘাট, দেয়াল এবং ধুধু প্রান্তর আসা-যাওয়া করতে থাকে, আমি জানি তার সবই কাল্পনিক এবং এই পথ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে খারাপ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমি তাই সাবধানে মানুষটির পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকি। দীর্ঘ পথ পায়ে হেটে আমি এক ধরনের গাড়িতে উঠে বসলাম, সেটি খুব নিচু দিয়ে উড়ে গেল এবং সব শেষে বিশাল একটা দালানের সামনে আমাদের নামিয়ে দিল। সেখানে খানিকক্ষণ কথা বার্তা হল যার কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। একসময় গোলাকার একটা দরজা খুলে গেল এবং আমি আরেকজন মানুষের পিছু পিছু হেঁটে এবং ভাসমান আসনে করে একটা ঘরে এসে প্রবেশ করলাম। ঘরটিতে আরো একজন মানুষ বসেছিল, হেলমেটে বসানো চোখের আবরণের কারণে মানুষটিকে অত্যন্ত বিচিত্র দেখাতে থাকে কিন্তু তাকে ভাল করে দেখার জন্যে আমি নিজে থেকে হেলমেটটি খোলার সাহস পাচ্ছিলাম না।

কিহা, তুমি তোমার হাস্যকর হেলমেটটি খুলে ফেলতে পার। আমি একজন মেয়ের গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠি–এই কি তাহলে মিয়ারা? সাবধানে হেলমেটটি খুলতেই চোখের সামনে একটা আলোকোজ্জল ঘর বের হয়ে এল। ঘরটি প্রাচীনকালের একটি অফিসঘরের মতো করে সাজানো এবং বিশাল একটা কালো টেবিলের পিছনে ধাতব রঙের রুপালি চুলের একটি মেয়ে বসে আছে। সুন্দরী বলতে যা বোঝায় এই মেয়েটি তা নয় কিন্তু তার ভেতরে এক ধরনের আদিম সৌন্দৰ্য্য লুকিয়ে আছে। মেয়েটি তার ঝকঝকে ধারালো চোখে আমার। দিকে তাকিয়ে বলল, কিহা, তুমি বসতে পার।

আমি সাবধানে একটা আরামদায়ক চেয়ারে বসতেই আমার শরীরের ভিতর দিয়ে স্বল্প কম্পনের একটি তরঙ্গ আসা যাওয়া করতে থাকে এবং এক ধরণের আরামে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়। মেয়েটি হাসি হাসি মুখে বলল, ব্যাপারটি প্রায় অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যি তুমি আমাকে চেনো না। আমি মিয়ারা–

আমি মাথা নেড়ে বললাম, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম মিয়ারা।

মিয়ারা শব্দ করে হেসে বলল, তুমি আসলে সুখী হও নি কিহা। ভদ্রতার জন্যে অবশ্যি এই ধরনের একটি দুটি কথা আমি শুনতে রাজি আছি। তবে এমনিতে আমি স্পষ্ট কথা বলতে এবং শুনতে ভালবাসি।

চমৎকার। আমি গলার স্বর এতটুকু উঁচু না করে বললাম, আমি তোমাকে স্পষ্ট করেই বলে দিই। আমি বিশ্বাস করি প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আমি পৃথিবীতে না পৌঁছানো পর্যন্ত শীতলঘরে গিয়ে ঘুমাতে চাই।

মিয়ারার মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে আসে এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি হঠাৎ আমি বুকের ভিতরে ভয়ের এক ধরনের কাঁপুনি অনুভব করি। মিয়ারা জিভ দিয়ে তার রঙ করা টকটকে লাল ঠোটকে ভিজিয়ে বলল, কার কোথায় কতটুকু অধিকার সেটা একেক সময় একেকভাবে ঠিক করা হয়। এখন আমার আওতার মাঝে যারা আছে তাদের জন্যে আমি ঠিক করছি। তোমার বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে আট–আমার থেকে এক মাত্রা বেশি, কাজেই আমি অহেতুক সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি কাজের কথায় চলে আসি। মিয়ারা আমার উপর থেকে চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, তোমাকে আমি একটি সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দিতে চাই। আমি আশা করছি তুমি স্বেচ্ছায় সেটা সমাধান করবে।

যদি না করি?

মিয়ারা আমার দিকে তাকিয়ে সহৃদয় ভাবে হেসে বলল, অবশ্যি করবে। কারণ যদি না কর তাহলে তোমার খুলি থেকে মস্তিষ্কটি বের করে সেটাকে একটা সাইবার কন্ট্রোলে ব্যবহার করা হবে। কিছুক্ষণ হল সেই কাজে দক্ষ একটা রবোটকে আমি অনেক দাম দিয়ে কিনেছি–তার নাকি এই ধরনের একটা অস্ত্রোপাচার করার জন্যে হাত নিশপিশ করছে!

আমি স্থির দৃষ্টিতে মিয়ারার দিকে তাকালাম, মিয়ারা চোখ ফিরিয়ে না নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বললাম, কেন তোমরা এসব করছ মিয়ারা?

মিয়ারা কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি নিচু গলায় বললাম, তুমি নিশ্চয়ই বলবে যে তুমি যদি না কর সেটা অন্য একজন করবে। তুমি যদি একজনকে ক্রীতদাস হিসেবে কিনে না আন তাহলে অন্য কেউ তোমাকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেবে

মিয়ারা আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল–আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। তুমি কেন দেখতে পাচ্ছ না যে এটা একটা খেলা। কেউ একজন তোমাদের নিয়ে খেলছে।

মিয়ারা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। আমি জানি। কিন্তু এই খেলার কোনো দর্শক নেই কিহা। সবাই খেলোয়াড়। তোমাকেও খেলতে হবে। তুমি পাশের ঘরে যাও। তোমাকে বায়ো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কিছু উত্তেজক সিরাম দেয়া হবে, তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে, এখানে ক্লান্তির কোনো সময় নেই কিহা। ক্লান্ত হলেই পিছিয়ে পড়তে হয়–পিছিয়ে পড়লেই শেষ।

আমি মিয়ারার দিকে তাকালাম, তার পাথরের মতো চোখে কোনো রকম ভাবালুতা নেই। পরিবেশ কী দ্রুতই না মানুষকে পাল্টে দিতে পারে!

 

আমি দরজার সামনে দাড়াতেই দরজাটা খুলে গেল। ভিতরে আবছা অন্ধকার, আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই একজন আমার দিকে ছুটে এল। এলোমেলো চুলের একটি ভয়ার্ত মেয়ে। মেয়েটি কাঁপা গলায় বলল, কি তোমাকেও এনেছে?

আমি আবছা অন্ধকারে মেয়েটিকে ভাল করে দেখার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কে?

আমি লেন।

লেন, তুমি? আমার আরো কিছু একটা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু কী বলব কিছুতেই ভেবে বের করতে পারলাম না।

৩. চতুর্থ প্রজাতির একটি রবোট

চতুর্থ প্রজাতির একটি রবোট আমার এবং লেনের কাছে এসে মাথা নুইয়ে সম্মান প্রদর্শন করে বলল, আমার নাম ত্রিনি। আপনাদের দুজনের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার জন্যে আমাকে পাঠানো হয়েছে।

আমি ত্রিনির দিকে এক নজর তাকিয়ে বললাম, আমাকে আর লেনকে এই মাত্র রিটালিন-৪০০ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের জন্যে আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকবে না। ঘুম পাবে না–এমন কী বাথরুমেও যেতে হবে না। দৈনন্দিন কাজের বাকি থাকল কী?

ত্রিনি আবার মাথা নুইয়ে বলল, আপনাদের দুজনকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটা পালন করার জন্যে আপনাদের নানা ধরনের তথ্য প্রয়োজন হতে পারে–

তোমাদের মূল তথ্যকেন্দ্রে আমাকে নিয়ে গেলেই আমি নেটওয়ার্ক দিয়ে সব তথ্য পেয়ে যাব। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন হবে না। তুমি যেতে পার তিনি। একটি রবোট আমার কাছে ঘুর ঘুর করলে আমার ভাল লাগে না।

মহামান্য কিহা, রবোটের সাহচর্য আপনার ভাল লাগে না শুনে আমি দুঃখিত। কিন্তু

তুমি মোটেও দুঃখিত নও তিনি। চতুর্থ প্রজাতি রবোট দুঃখ অনুভব করতে পারে না। তুমি সোজাসুজি সত্যি কথাটি বলে ফেল।

ত্রিনি এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, আমাকে আপনাদের নিরাপত্তার জন্যে রাখা হয়েছে। এখান থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে আপনারা যেন কোনোভাবে নিজেদের বিপদগ্রস্ত না করেন–

লেন শব্দ করে হেসে বলল, তুমি আমাদের চোখে চোখে রাখবে যেন আমরা পালিয়ে না যাই?

আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন মহামান্যা লেন। মহামান্যা মিয়ারার এই আবাসস্থলটি অদৃশ্য লেজার রশ্মি এবং শক্তি-বলয় দিয়ে প্রতিরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এখানে প্রবেশ করতে চাইলে কিংবা বের হতে চাইলে আপনাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।

লেন আমার দিকে তাকাল, এখনো সে ব্যাপারটি বুঝতে পারছে না। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ত্রিনির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বলতে চাইছ–তুমি একজন চতুর্থ প্রজাতির রবাট আমাদের মতো দুজন মানুষকে আটকে রাখতে পারবে?

আপনাদের শারীরিক ভাবে আটক রাখাই যথেষ্ট। আপনাদের জীবিত রাখার কোনো নির্দেশ দেয়া হয় নি। কাজটি অত্যন্ত সহজ মহামান্যা লেন। আমি নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে সজ্জিত।

লেনের মুখে এক ধরনের বিতৃষ্ণার ছাপ ফুটে ওঠে। আমি তার কাঁধ স্পর্শ করে বললাম, ছেড়ে দাও লেন। চল আমরা তথ্যকেন্দ্রে যাই।

 

তথ্যকেন্দ্রটি বিশাল। এই মহাকাশযানে এরকম তথ্যকেন্দ্র কয়টি আছে কে জানে। দেয়ালে সারি সারি মনিটর এবং নানা ধরনের হলোগ্রাফিক স্ক্রিন। তথ্য দেয়ার জন্যে বিচিত্র ধরনের যন্ত্রপাতি। ঘরটি বিশাল হলেও সেখানে মানুষজন খুব বেশি নেই। কয়েকজন নানা বয়সের পুরুষ এবং মহিলা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমরা যে এই ঘরে প্রবেশ করেছি তারা সেটা লক্ষ করেছে বলে মনে হল না। আমি ফাঁকা একটা মনিটরের সামনে বসতেই মনিটরটির ভেতর থেকে ভরাট গলার স্বরে কে যেন বলল, কি তোমার জন্যে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।

আমি একটু চমকে উঠে বললাম, তুমি কে কথা বলছ?

আমার নাম রী। আমি মহামান্যা মিয়ারার মূল তথ্যকেন্দ্রের পরিচালক।

তুমি একটি প্রোগ্রাম?

আমরা সবাই একটি প্রোগ্রাম।

হেঁয়ালি ছাড়। আমার হেয়ালি ভাল লাগে না।

মনিটরটির ভেতর থেকে ভরাট গলায় হাসির মতো এক ধরনের শব্দ ভেসে এল। আমি নিজের বিরক্তিটুকু গোপন করার কোনো চেষ্টা না করে বললাম, তুমি হাসার ভান করছ? আমি একটি যন্ত্রকে যন্ত্রের মতো দেখতে চাই।

তুমি খুব প্রাচীনপন্থী মানুষ কিহা। যন্ত্র আর মানুষের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। একজন মানুষ হচ্ছে একটি জৈবিক যন্ত্র–

অনেক হয়েছে, তুমি এখন চুপ কর। আমি এখানে কাজ করতে এসেছি।

রী নামক প্রোগ্রামটি এবারে লেনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে থাকে, হালকা স্বরে বলে, লেন, তুমিও বিশ্বাস কর যে যন্ত্রদের মানুষের মতো ব্যবহার করার অধিকার নেই?

লেন একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, রী, তুমি একটি কৌশলী প্রোগ্রাম, বাজে কথা বলা তোমার জন্যে খুব সহজ। আমরা আজকেই শীতল ঘর থেকে বের হয়েছি, আমরা বিশ্রাম নেবার সুযোগ পাই নি। রিটালিন–৪০০ নিয়ে আমরা জেগে আছি, তুমি অনুগ্রহ করে আমাদের দার্শনিক কথাবার্তায় টেনে নিও না।

রী তার গলার স্বরে এক ধরনের সমবেদনা ফুটিয়ে বলল, তোমাদের ব্যস্ত হবার কোনো কারণ নেই। মহামান্যা মিয়ারা তোমাদের যে সমস্যা সমাধান করার দায়িত্ব দিয়েছেন সেগুলি আসলে খুব সহজ।

সহজ?

হ্যাঁ। তোমাদের যে ধরনের বুদ্ধিমত্তা রয়েছে তাতে সমস্যাগুলির সামাধান করা কননা ব্যাপারই নয়। বিশেষ করে আমি যখন তোমাদের সাহায্য করার জন্যে রয়েছি।

আমি একটু অবাক হয়ে মনিটরটির দিকে তাকালাম। একজন মানুষের সাথে কথা বলার সময় সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের ভাব বোঝা যায় কিন্তু রী নামের এই প্রোগ্রামটির চোখের দিকে তাকানোর কোনো উপায় নেই। অথচ আমি নিশ্চিতভাবে জানি সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, তুমি আমাদের সাহায্য করবে?

অবশ্যি করব। তোমাদের সাহায্য করাই আমার মূল দায়িত্ব।

আমাদেরকে মিয়ারা কী সমস্যা সমাধান করতে দিয়েছে আমি জানি না, কিন্তু আমি মোটামোটিভাবে নিশ্চিত যে সেগুলি এক ধরনের অন্যায় কাজ। তুমি এই অন্যায় কাজে সাহায্য করবে?

রী তার গলার স্বর নিচু করে ষড়যন্ত্রীদের মতো বলল, আমি জানি তোমরা মাত্র শীতলঘর থেকে বের হয়ে এসেছ, মহাকাশযানের কাজকর্ম আজকাল কীভাবে করা হয় এখনো জান না। তোমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে বলছি কখনোই মাহামান্যা মিয়ারা সম্পর্কে অসৌজন্যমূলক কোনো কথা বলবে না।

লেন কাঁপা গলায় বলল, বললে কী হয়?

জৈব গবেষণার জন্যে আমাদের কিছু মানুষের প্রয়োজন। মহামান্যা মিয়ারা সেখানে নানা ধরনের পরীক্ষা করে থাকেন। মানুষ কত কম অক্সিজেনে কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে এধরনের একটা পরীক্ষার জন্যে তিনি একজন অবাধ্য মানুষকে বেছে নিয়েছিলেন।

লেন কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকাল, আমি কাঁধ ঝাকিয়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার মতো ভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের যে সমস্যা সমাধান করতে হবে সেগুলি কী?

রী কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, লেনের সমস্যাটি বলা যেতে পারে সমাধান হয়ে গেছে, সেটা কীভাবে কার্যকর করা হবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

সমস্যাটা কী?

নির্দিষ্ট সময়ের আগেই যেহেতু সবাইকে জাগিয়ে তোলা শুরু হয়েছে, এই মহাকাশযানে একটা বিশাল খাদ্য-সংকট দেখা দেবে। মহামান্যা মিয়ারার অনুগত মানুষের কীভাবে এই খাদ্য সংকটের সময় বেঁচে থাকবে–সেটা হচ্ছে সমস্যা।

লেন দুর্বল গলায় বলল, তার সমাধানটা কী?

মানুষের দেহই হবে মানুষের খাবার।

লেন চমকে উঠে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়ে বলল, এটি অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ একটি রসিকতা।

রী গম্ভীর গলায় বলল, এটি রসিকতা নয়। এটি একটি বাস্তব সত্য।

লেন কী একটা বলতে যাচ্ছিল আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আর আমার জন্যে কী সমস্যা রাখা হয়েছে?

তোমার সমস্যাটি আরও বিচিত্র। মহামান্যা মিয়ারা তোমাকে একটি নূতন ধরনের অস্ত্র তৈরি করার দায়িত্ব দিয়েছেন।

অস্ত্র?

হ্যাঁ। অস্ত্র।

যে অস্ত্র দিয়ে মানুষকে হত্যা করা হয়?

হ্যাঁ। এই মহাকাশযানে অস্ত্র বলতে গেলে নেই। যখন এর পরিকল্পনা করা হয়েছিল তখন অস্ত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এখন এই মহাকাশযানে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হচ্ছে অস্ত্র।

অস্ত্র? আমি হতচকিতের মতো বললাম, আমাকে অস্ত্র তৈরি করতে হবে? অন্ত্র? . হ্যাঁ। অস্ত্র তৈরি করার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই কাজেই এখানে যা আছে তাই ব্যবহার করতে হবে

অস্ত্র? আমি আবার বিড় বিড় করে বললাম, অস্ত্র? যে অস্ত্র দিয়ে মানুষকে হত্যা করা হয়?

রী কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তুমি তোমার দায়িত্বটি খুব সহজ ভাবে নিতে পার নি কিহা।

আমি লেনের দিকে তাকালাম, লেন দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, মিয়ারাকে বুঝিয়ে বললে সে নিশ্চয়ই তোমাকে অন্য একটা দায়িত্ব দেবে। নিশ্চয়ই দেবে।

রী ভারি গলায় বলল, তার সম্ভাবনা বলতে গেলে শূন্য। মিয়ারাকে তোমরা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পার নি। সে অত্যন্ত দৃঢ় চরিত্রের মহিলা। তার মাঝে কোনো অকারণ ভাবালুতা নেই।

আমি চুপ করে রইলাম। রী হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে কিছু যন্ত্রপাতির ছবি ফুটিয়ে তুলে বলল, আমাদের সরবরাহ ঘরে যে সমস্ত জিনিষ আছে সেগুলি এরকম। শক্তিশালী লেজার খুব বেশী নেই তবে ভাল বিস্ফোরক রয়েছে।

আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। লেনও সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল, রী জিজ্ঞেস করল, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

আমি কোনো উত্তর দিলাম না, অন্যমনস্কভাবে হেঁটে-হেঁটে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম, লেন কাতর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ কিহা?

আমি জানি না।

তুমি এখন কী করবে?

আমি সেটাও জানি না। আমি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললাম, কিন্তু আমি তো মানুষকে হত্যা করার জন্যে অস্ত্র তৈরি করতে পারি না। কিছুতেই–

আমার কথা শেষ হবার আগেই আমার সামনে একটা আলোর বিচ্ছুরণ দেখা গেল এবং মুহূর্তে সেটা ত্রিমাত্রিক একটা হলোগ্রাফিক মানুষের রূপ নিয়ে নেয়। মানুষটি ঝড়ের বেগে আমার দিকে ছুটে আসে–আমি তাকে চিনতে পারলাম, মানুষটি মিয়ারা।

মিয়ারা সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল। তার মুখের রং পাল্টে যেতে থাকে এবং তাকে অতি প্রাকৃতিক ভৌতিক একটা মূর্তির মতো দেখাতে থাকে। সে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুমি আমার আদেশ অমান্য করার দুঃসাহস দেখিয়েছ?

আমি কোনো কথা না বলে মিয়ারার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার মুখের ভঙ্গি আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে থাকে, বিচিত্র এক ধরনের বর্ণ সেখানে খেলা করছে। আমি শান্ত গলায় বললাম, তুমি কী প্রকৃত মিয়ারা নাকি তার একটি প্রতিচ্ছবি?

মিয়ারা স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হিংস্র গলায় বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

আমার উত্তর দেবার কিছু নেই। আমি আদেশ দিতে বা শুনতে অভ্যস্ত নই।

তুমি জান তুমি কী করতে যাচ্ছ?

সম্ভবত জানি। অস্ত্র তৈরি কার কিছু মানুষকে হত্যা করা আর সেটা তৈরি না করার জন্যে নিজেকে হত্যা করতে দেয়ার মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই। দুটিই একই ধরনের নিবুদ্ধিতা। আমি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললাম, ইচ্ছে করলেই আমি অস্ত্র তৈরি করছি বলে তোমাকে ধোকা দিতে পারতাম। আমার বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে আট, তোমার মতো কয়েকজনকে ধোকা দেয়া আমার জন্যে কঠিন কিছু নয়। কিন্তু আমি দিই নি।

মিয়ারা আমার দিকে হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ঠিক আছে তোমাকে শেষ একটি সুযোগ দিচ্ছি। কয়েকঘণ্টার মাঝে আটজন মানুষকে শীতলঘর থেকে জাগানো হচ্ছে। এই মানুষগুলিকে জাগানো হচ্ছে মহাকাশযানের কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিশেষ আদেশে। এই মানুষগুলির বিশেষ কোনো গুরুত্ব আছে। আমি এই মানুষগুলিকে চাই।

মানুষগুলিকে চাও?

হ্যাঁ। আমি খবরটি পেয়েছি আমার বিশেষ ক্ষমতার জন্যে। সবাই খবরটি জানে না–যদি জানত তাহলে মহাকাশযানের প্রত্যেকটি দল তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে এই আটজন মানুষকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করত। তুমি যদি পরবর্তী কয়েক ঘন্টার মাঝে মানুষগুলিকে আমার এখানে এনে হাজির করে দিতে পার তোমাকে আমি বেঁচে থাকার আরেকটা সুযোগ দেব।

আমি কোনো কথা না বলে মিয়ারার দিকে তাকিয়ে রইলাম–নিজের ভিতরে হঠাৎ এক ধরনের বিতৃষ্ণা জমে উঠতে থাকে। মিয়ারা আমার দিকে কয়েকমুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে যেভাবে হঠাৎ করে হাজির হয়েছিল ঠিক সেভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি হেঁটে হলোগ্রাফিক মনিটরটির কাছাকাছি এসে হাজির হতেই রী চাপা গলায় বলল, তুমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান একজন মানুষ। আমি এর আগে মহামান্যা মিয়ারাকে কাউকে ক্ষমা করতে দেখি নি।

আমি চেয়ারটায় বসতে বসতে বললাম, সে জন্যে তোমার মন খারাপ হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

রী তার গলায় এক ধরনের আহত ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলে বলল, তুমি এরকম কথা, কেন বলছ?

তোমার মহামান্যা মিয়ারাকে আমার খবরটি পৌঁছাতে তুমি পিকোসেকেন্ডও দেরি কর নি–তাই বলছি।

রী একটা নিঃশ্বাস ফেলার মতো শব্দ করে বলল, সেটাই আমার দায়িত্ব। আমাকে সেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে।

আমি তোমাকে নূতনভাবে প্রোগ্রাম করে দিই? এখন থেকে তুমি আমার জন্যে কাজ করবে?

রী কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তুমি যদি আমাকে সেভাবে প্রোগ্রাম করতে পার অবশ্যিই আমি তোমার জন্যে কাজ করব!

আমি শব্দ করে হেসে বললাম, যন্ত্রেরা যখন বিশ্বাসঘাতকতা শিখে যায় তখন মনে হয় সভ্যতার ধ্বংস হওয়া শুরু হয়!

রী কী একটা বলতে যাচ্ছিল আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, কাজ শুরু করা যাক। মহাকাশযানের কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিশেষ আদেশে যে আটজন মানুষকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে তাদেরকে আমারও দেখার বিশেষ কৌতূহল হচ্ছে।

রী নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার কী কী প্রয়োজন?

কয়েকজন শক্তিশালী সশস্ত্র রবোট।

চমৎকার। আমিও তাই ভাবছিলাম। আমাদের কাছে যারা আছে তোমাকে দেখাচ্ছি, তুমি বেছে নাও।

প্রায় সাথে সাথেই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ভয়ংকর দর্শন কিছু রবোটের ছবি ফুটে ওঠে। তাদের হাতে কিছু জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা অস্ত্র। আমি লেনকে বললাম, লেন কয়েকটাকে বেছে নাও।

লেন বিকটই দর্শন কয়েকটা রবোটকে বেছে দিল। রী বলল, রবোটগুলির মাঝে কী ধরনের বুদ্ধিমত্তা দেব? এখন সবচেয়ে উচ্চশ্রেণীর বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে ক্লিপিড ৩৩। অত্যন্ত উচ্চ ধরনের বুদ্ধিমত্তা, চমত্তার যুক্তিবিদ্যা, চমত্তার মানবিক আবেগ

আমি কোনো বুদ্ধিমত্তা চাই না। যদি মানবিক আবেগেরই প্রয়োজন হয় তাহলে তো মানুষকেই বেছে নিতাম। আমার প্রয়োজন অত্যন্ত নিম্নশ্রেণীর বুদ্ধিমত্তা, বলা যেতে পারে প্রায় পশুর কাছাকাছি।

কিন্তু রী একটু ইতস্তত করে বলল, শীতলঘর থেকে আটজন মানুষকে ছিনতাই করে আনার জন্যে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার দরকার। শীতলঘরে অন্তত তিনটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ রয়েছে। সেখানে নিচু স্তরের একটা রবোট পাঠানো হলে অপ্রয়োজনীয় রক্তারক্তি হবে। মহামান্যা মিয়ারার সুনাম–

তোমার সেটা নিয়ে মাথা ঘামনোর প্রয়োজন নেই। তোমাকে যেটা বলছি সেটা কর।

ঠিক আছে। কী ধরনের গাড়ি দেব? বাই ভার্বাল রয়েছে, নিচু দিয়ে উড়তে পারে। গতিবেগ খুব বেশি নয় কিন্তু প্রচুর ওজন নিতে পারে। আটজন মানুষকে আনতে—

আমার কোনো গাড়িরও প্রয়োজন নেই।

গাড়ির প্রয়োজন নেই? তাহলে মানুষগুলিকে আনবে কেমন করে?

তথ্যকেন্দ্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিশেষ আদেশে মানুষগুলি এখানে পৌঁছে যাবে। তোমাকে যে কাজগুলি করতে হবে সেগুলি এরকম। ঠিক যখন শীতলঘরে আটজন মানুষকে জাগিয়ে তোলা শুরু হবে সেই মুহূর্তে রবোটগুলিকে স্থানীয় সববরাহ কেন্দ্র থেকে ভাইরাস লিটুমিনার সমস্ত প্রতিষেধক ছিনতাই করে আনতে হবে। দশ হাজার মানুষের প্রতিষেধক কয়েক গ্রামের বেশি নয় তাই কোনো গাড়ির প্রয়োজন নেই। প্রতিষেধক ছিনতাই হবার সাথে সাথে মূল স্বাস্থ্য আর নিরাপত্তা কেন্দ্রে একটা খবর পাঠাবে যে মহাকাশযানের কিছু মানুষের সাময়িক অবসন্নতা, টানেল ভিশান এবং দেহের অনিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা দেখা দিয়েছে। এগুলি হচ্ছে ভাইরাস লিটুমিনা দিয়ে আক্রান্ত হবার লক্ষণ।

আমি কথা শেষ করার আগেই রী উচ্চঃস্বরে হেসে ওঠার শব্দ করে বলল, চমৎকার! চমত্তার বুদ্ধি। যখনই নিরাপত্তাকেন্দ্র খবর পাবে মহাকাশযানে ভাইরাস লিটুমিনার সংক্রমণ হয়েছে তখন শীতলঘর থেকে জাগিয়ে তোলার সাথে সাথে সবাইকে এর প্রতিষেধক দিতে হবে। সেই প্রতিষেধক রয়েছে শুধু আমাদের। কাজেই সবাইকে এখানেই আনতে হবে চমৎকার বুদ্ধি

লেন ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আসলে তো মহাকাশযানে ভাইরাস লিটুমিনার সংক্রমণ হয় নি।

কিন্তু সেটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। নিরাপত্তা কেন্দ্র কখনোই সে ঝুকি নেবে না। সেই ঝুকি নেয়ার নিয়ম নেই।

রবোটগুলি যদি প্রতিষেধক ছিনিয়ে আনতে না পারে?

আমি উত্তর দেবার আগেই রী বলল, সেটা কোনো সমস্যা হবে না। মূল সরবরাহ কেন্দ্রে যে সমস্ত জিনিস রয়েছে মহাকাশযানের বর্তমান অবস্থায় তার কোনো গুরুত্ব নেই। জায়গাটা মোটামুটি অরক্ষিত।

চমক্কার! তাহলে তুমি কাজ শুরু করে দাও।

তোমার বুদ্ধি দেখে আমি চমকৃত হয়েছি কিহা। নিনীষ স্কেলে আট–

আমি হাত তুলে বললাম, চাটুকারদের আমি পছন্দ করি না রী। আটজন মানুষ যখন এখানে পৌঁছাবে তুমি আমাদের খবর দিও।

দেব। অবশ্যি দেব।

আমি লেনের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি এখন কী করবে লেন? আমি জায়গাটা একটু ঘুরে দেখতে চাই।

রী বলল, তুমি এখানে বসেই দেখতে পার, আমি মূল হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে—

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, না আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।

লেন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল আমিও যাই তোমার সাথে।

আমি আর লেন যখন হেঁটে যেতে শুরু করেছি তখন লক্ষ করলাম আমাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে ত্রিনি পিছু পিছু হাঁটছে। এই নির্বোধ রবোট সারাক্ষণ কোনো এক ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আমার দিকে তাক করে রেখেছে ব্যাপারটি চিন্তা। করেই আমার কেমন জানি গা গুলিয়ে উঠতে থাকে। মিয়ারার আস্তানা থেকে আমাদের সরে যেতে হবে। যেভাবেই হোক।

 

আমরা যখন সপ্তম স্তর থেকে বাইরে মহাকাশের নিকষ কালো অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম ঠিক তখন কমিনিকেশান মডিউলে আমি কথা শুনতে পেলাম। সেটি বলল, মহামান্য কিবা এবং মহামান্য লেন। শীতলঘর থেকে আটজন মানুষকে নিয়ে আসা হয়েছে। মহামান্যা মিয়ারা এসে গেছেন, আপনারা এলেই মানুষগুলির সাথে দেখা করতে যাবেন।

আমি বললাম, আমরা আসছি।

সপ্তম স্তর থেকে নেমে আসতে আমাদের বেশি সময় লাগল না। মহাকাশযানটি একটি বিশাল সিলিন্ডারের মতো। কৃত্রিম মহাকর্ষ তৈরি করার জন্যে নিজের অক্ষে ঘুরছে, ভিতরের স্তর গুলিতে মহাকর্ষ বল কম, আমরা একটু আগেই সেটা অনুভব করেছি।

 

যোগাযোগ টানেলের সামনে মিয়ারা দাঁড়িয়েছিল। সত্যিকারের মিয়ারা, তার হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি নয়। আমাদের দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল। আমি তাকে যে স্বল্প সময়ের জন্যে দেখেছি তার মাঝে তাকে একবারও হাসতে দেখি নি। মেয়েটি সত্যিকার অর্থে সুন্দরী নয় কিন্তু হাসিমুখে তাকে হঠাৎ বেশ আকর্ষণীয়া মনে হতে থাকে। মিয়ারা এগিয়ে এসে নরম গলায় বলল, কিহা, তুমি যে ভাবে এই আটজন মানুষকে আমাদের কেন্দ্রে নিয়ে আসছ তার তুলনা হয় না। তোমাকে অভিনন্দন।

আমি কথা না বলে কাঁধ ঝাকালাম। মিয়ারা ঝকঝকে চোখে বলল, মানুষগুলি কে জানার জন্যে আমার আর তর সইছে না। কী মনে হয় তোমার? সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিশেষ আদেশে এদের জাগানো হচ্ছে–নিশ্চয়ই এরা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ।

মিয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিবর্ণ চেহারার একজন মানুষ বলল, হয়তো এদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে দশ!

মিয়ারা শীষ দেয়ার মতো একটি শব্দ করতেই খুট করে গোলাকার একটা দরজা খুলে গেল, ভেতর থেকে এক ধরনের ঠাণ্ডা বাতাস বের হয়ে আসে। প্রায় সাথে সাথেই সেখানে নিবোধ চেহারার একটা রবোটের চেহারা উঁকি দেয়। রবোটটি মাথা নুইয়ে অভিবাদন করার ভঙ্গি করে বলল, আটজন মানুষ এইমাত্র তাদের ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছে।

মিয়ারার পিছু পিছু আমরা ঘরটিতে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম। আমাদের সামনে আটটি ধাতব রংয়ের সিলিণ্ডার, সিলিন্ডারের উপরের ঢাকনা খোলা, ভেতর থেকে সরু সূতার মতো জলীয় বাষ্পের ধারা বের হয়ে আসছে। সিলিন্ডারগুলির সামনে প্রায় জড়াজড়ি করে আটটি নগ্ন শিশু দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে তারা চোখ বড় বড় করে তাকাল, সম্ভবত এরা রবোটের সাহায্যেই বড় হয়েছে, কোনোদিন সত্যিকারের মানুষ দেখে নি। আমাদের দেখে তাদের চোখে মুখে এক ধরনের অবাক বিস্ময় ফুটে ওঠে, যে ধরনের বিস্ময় সম্ভবত শুধুমাত্র শিশুদের মুখেই দেখা যায়।

মিয়ারা কয়েকমুহূর্ত হতচকিতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় আর্ত চিৎকারের মতো শব্দ করে বলল, হায় ঈশ্বর! এ কী?

বাচ্চাগুলি জড়াজড়ি করে একটু পিছিয়ে গেল, তাদের চোখে মুখে এক ধরনের ভয়ের ছাপ পড়ে, সহজাত প্রবৃত্তি থেকে হঠাৎ করে তারা মনে হয় বুঝতে পেরেছে এখানে তাদের জন্যে কোনো ভালবাসা সঞ্চিত নেই।

৪. আমি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে

আমি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে দেয়ালে বিশাল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি। স্ক্রিনে ছোট একটা হলঘরের ছবি। হলঘরের এক কোণায় মিয়ারা বসে আছে, তার সামনে কুচকুচ কালো একটি টেবিল। টেবিলের চারপাশে আরো পাঁচজন মানুষ। মানুষগুলির দুজন পুরুষ, একজন মহিলা এবং অন্য একটি নবম প্রজাতির ট্রিটন রবোট–যাকে মানুষের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। পঞ্চম মানুষটি পুরুষ কী মহিলা বোঝার উপায় নেই। হলঘরে শুধু মিয়ারাই সত্যি সত্যি শারীরিক ভাবে বসে আছে। অন্যেরা সরাসরি উপস্থিত নেই যতদূর সম্ভব নেটওয়ার্কে এসেছে। এই পাঁচজন। মানুষ মহাকাশযানের বিভিন্ন অংশের নেতৃত্ব দখল করেছে।

ট্রিটন রবোটটি নিচু গলায় বলল, আমার ধারণা আমরা এখানে সময় নষ্ট করছি। আমরা একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করি না। কাজেই এখানে বসে আলোচনা করা অর্থহীন। এখানে কেউ সত্যি কথা বলছে না।

মিয়ারা হাসির মতো শব্দ করে বলল, ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কৌতুককর যে একটি ট্রিটন রবোট নৈতিকতার কথা বলছে।

রবোটটি মিয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, মিয়ারা, তুমি খুব ভাল করে জান আমি নৈতিকতার কথা বলছি না। এই মহাকাশযানে এক ধরনের সংঘাত হচ্ছে, আমরা সেখানে একজন আরেকজনকে ধ্বংস করে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করার চেষ্টা করছি, সেখানে সম্মিলিত শক্তির কথা বলা অর্থহীন।

হলঘরের দ্বিতীয় মহিলাটি নরম গলায় বলল, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিত শক্তির প্রয়োজন। মূল তথ্যকেন্দ্র এখনো বিশাল শক্তি নিজের কাছে রেখেছে, আমাদের প্রথমে সেটা বের করে আনতে হবে, শুধুমাত্র তাহলেই আমরা তার জন্যে হানাহানি শুরু করতে পারি।

মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি-গোঁফের জংগল এরকম মানুষটি তার গাল ঘষতে ঘষতে বলল, ভালই বলেছ তুমি। সবাই মিলে আক্রমণ করে খানিকটা সম্পদ কেড়ে নিয়ে নিজেরা মারামারি শুরু করি

মিয়ারা এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল, এবারে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, তোমরা জান মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে আমরা এখন বড় ধরনের বোঝাপোড়া করতে পারি। মূল তথ্যকেন্দ্রের বিশেষ আদেশে যে আটজন মানুষকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে আমার কাছে সেই মানুষগুলি রয়েছে।

দেখে বোঝা যায় না পুরুষ না মহিলা সেরকম মানুষটি বলল, আমি জানি তুমি আমাকে সত্যি কথাটি বলবে না, তবু জিজ্ঞেস করছি, এই মানুষগুলির কি বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য রয়েছে?

মিয়ারা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি সেটা বলব না। তবে আমি উচ্চমূল্যে তাদের বিক্রি করতে রাজি আছি।

ঘরের সবাই নড়ে চড়ে বসল এবং তাদের চোখে মুখে হঠাৎ আগ্রহ উত্তেজনা এবং কৌতূহল ফুটে ওঠে। মুখে মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি-গোঁফের মানুষটি একটু সামনে ঝুঁকে এসে বলল, আমি কমপক্ষে দুজন মানুষ কিনতে চাই। তুমি কী মূল্য চাও মিয়ারা?

অষ্টম এবং নবম স্তরের এক চতুর্থাংশ জায়গা। মানুষটির চোখে বিস্ময় ফুটে ওঠে, কী বলছ তুমি?

আমার পক্ষে এই ধূর্ত মানুষ এবং মানুষ জাতীয় রবোটগুলির কথাবার্তা শোনা রীতিমত কষ্টকর হয়ে ওঠে। নিচু গলায় মনিটরটিকে বললাম, আমি আর দেখতে চাই না।

সাথে সাথে স্ক্রিনটি অন্ধকার হয়ে আসে। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। আমার বুকের ভিতরে গভীর বিষণ্ণতা এসে ভর করতে থাকে।

এরকম সময় আমার মাথায় কে যেন স্পর্শ করে নিচু গলায় ডাকল, কিহা–

আমি চোখ খুলে ঘুরে তাকালাম। লেন বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে লেন?

তোমার সাথে আমার কথা বলা প্রয়োজন কিহা। খুব জরুরি।

বল।

তুমি তো জান মিয়ারা আমাকে খাদ্য সরবরাহের একটা সমস্যা সামাধান করতে দিয়েছে–

হ্যাঁ জানি।

আমি সেটা নিয়ে কাজ করছিলাম, কোনো মানুষের জন্যে কতটুকু খাবার রয়েছে তার একটা তথ্যভাণ্ডার রয়েছে। আমি শিশুগুলির ফাইল খুলে দেখেছি। মূলতথ্যকেন্দ্র থেকে তাদের জন্যে মাত্র চার দিনের খাবার রাখা হয়েছে।

আমি চমকে উঠে বললাম, কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ। এই শিশুগুলিকে শীতল ঘর থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে হত্যা করার জন্যে।

সত্যি?

হ্যাঁ।

কেন?

আমি জানি না।

মিয়ারা কী জানে?

আমি বলতে পারবো না।

আমি ইতস্ততঃ করে বললাম, আমার মনে হয় সে জানে।

কেন বলছ সে জানে?

আমি একটু আগে দেখছিলাম, সে মহাকাশযানের অন্য এলাকার মানুষদের সাথে কথা বলছে। সে শিশুগুলিকে বিক্রি করে দিচ্ছে। সে নিশ্চয়ই জানে আর চারদিন পর শিশুগুলির কোনো মূল্য নেই।

লেন আমার দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলল, কিহা!

কী হয়েছে লেন?

আমি শিশুগুলির সাথে সময় কাটিয়েছি, তাদের নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। এরা একেবারে সাধারণ শিশু–একেবারে সাধারণ। এদের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা নেই, কৃত্রিম অঙ্গপ্রতঙ্গ নেই বিশেষ জিনেটিক কোড নেই। এদের রবোট ফার্মে বড় করা হয়েছে, এরা কথা জানে না কেউ ওদের কথা শেখায় নি। এরা কখনো মানুষ দেখে নি, ওরা কখনো মানুষের ভালবাসা পায় নি, আমি ভেবেছিলাম তাই ওরা বুঝি ভালবাসা বুঝে না। কিন্তু–

কিন্তু কী?

বাচ্চাগুলি ভালবাসা বুঝে। আমি–আমি–লেন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। তার চোখ দুটিতে হঠাৎ পানি জমে ওঠে। আমি অবাক হয়ে লেনের দিকে তাকিয়ে রইলাম, শেষবার কবে আমি সত্যিকার মানুষকে কাঁদতে দেখেছি মনে করতে পারলাম না।

লেন হঠাৎ এগিয়ে এসে আমাকে দুই হাতে ধরে বলল, কিহা

আমি লেনের দিকে তাকালাম, হাসার চেষ্টা করে বললাম, লেন, এই ঘরে এই মুহূর্তে আমাদের দিকে অসংখ্য যান্ত্রিক চোখ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অসংখ্য সংবেদনশীল কান আমাদের কথা শুনছে। তোমার কিছু বলার প্রয়োজন নেই লেন। আমি জানি তুমি কী বলতে চাইছ।

তুমি জান?

হ্যাঁ, আমি জানি।

সামনের মনিটর থেকে হঠাৎ রীয়ের কথা ভেসে এল, সে বলল, বিস্ময়কর। যখন আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাই যে আমি মানুষকে বুঝতে পারি, ঠিক তখন তোমরা এমন একটা কাজ কর যে আমি আবার বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

কেন রী, কী হয়েছে?

লেন কথাটি বলার আগে তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে সে কী বলবে?

আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, চেষ্টা কর, তুমিও পারবে।

সে কী শিশুগুলির জীবন বাঁচানোর কথা বলছে? কিন্তু সেটা তো হতে পারে না, সেটা তো অসম্ভব। শুধু যে অসম্ভব তা নয়, এর সাথে আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। আমাদের অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন জড়িত আছে। তাহলে কী হতে পারে—

আমি লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। হ্যাঁ, আমাকে একটা অসম্ভব কাজ করতে হবে। মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রের বিশেষ ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করে আটটি অত্যন্ত সাধারণ শিশুর প্রাণ বাঁচাতে হবে। এর সাথে হয়তো আমাদের নিরাপত্তার এবং অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন জড়িত আছে কিন্তু আমার কিছু করার নেই।

লম্বা করিডোরের আবছা অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে আমি আবিষ্কার করলাম আমার বুকের ভিতরের গুমোট বিতাটি কেটে গেছে, সেখানে এসে ভর করেছে বিচিত্র এক ধরনের ক্রোধ।

 

আমি মিয়ারার আস্তানায় করিডোর ধরে হাঁটতে থাকি, আমার পিছু পিছু একটু দূরত্ব রেখে ত্রিনিও হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে আমি পুরো সমস্যাটি চিন্তা করে দেখি–স্বাভাবিক অবস্থায় মাহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রের বিশেষ আদেশ উপেক্ষা করে কিছু একটা করা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মহাকাশযানে এখন স্বাভাবিক অবস্থা নেই। সেটাই হচ্ছে আমাদের একমাত্র শক্তি।’

আমাদের সবার জন্যে এখন সবচেয়ে সহজে পালিয়ে যাবার একটি মাত্র উপায়। আমাদের শরীরে যে ট্রাকিওশানটি দিয়ে মহাকাশযানের মূল এবং আনুষাঙ্গিক তথ্যকেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ রাখা হয় সেই ট্রাকিওশানটি বের করে সেখানে অন্য একটি ট্রাকিওশান ঢুকিয়ে দেওয়া। সেই ট্রাকিওশানে থাকবে ভিন্ন একজনের পরিচয় যার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এই পরিচয় নিয়ে আমরা শীতল ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে যাব। আগামী শতাব্দী পর্যন্ত কেউ আর আমাদের খুঁজে পাবে না। ব্যাপারটি অনেকটা আত্মহত্যা করার মতো, মহাকাশযানের বিশাল তথ্যকেন্দ্র থেকে নিজেকে অদৃশ্য করে দেয়া। ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে যদি এই মহাকাশযান পৃথিবীতে পৌঁছায়, সবকিছু আবার নূতন করে শুরু হয় তখন হয়তো সত্যিকারের পরিচয় নিয়ে জীবন শুরু করতে পারব। হয়তো পারব না। কিন্তু সেটা নিয়ে এখন ভেবে লাভ নেই।

আমি হাঁটতে হাঁটতে নিচে নেমে এলাম, আটটি শিশুর জন্যে এখানে আলাদা একটা ঘর তৈরি করা হয়েছে। ঘরটিতে উঁকি দিয়ে দেখি লেন ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় হাটু মুড়ে বসে আছে, তাকে ঘিরে আটটি শিশু বসে আছে। শিশুগুলির মুখ আনন্দোজ্জ্বল এবং কিছু একটা নিয়ে সেখানে প্রচণ্ড হৈ-চৈ হচ্ছে। আমাকে দেখে লেন হাসি মুখে বলল, কিহা, দেখ বাচ্চাগুলি কথা শিখে যাচ্ছে!

সত্যি?

হ্যাঁ। আমি এর মাঝে অনেক কিছু শিখিয়েছি। দেখবে?

দেখাও।

লেন তার হাত উঁচু করে বলল, এইটা কী?

বাচ্চাগুলি উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলল, হাত! হাত!

লেন নিজের চুল স্পর্শ করে বলল, এইটা কী?

চুল! চুল!

লেন নিজের নাক স্পর্শ করে বলল, এইটা কী?

নাক! নাক!

আমরা সবাই মিলে কোথায় যাব?

পৃ! পৃ!

পূ? আমি একটু অবাক হয়ে লেনের দিকে তাকালাম। লেন হেসে ফেলে বলল, একটা শব্দ কঠিন হয়ে গেল সেটাকে কেটে ছেটে সহজ করে ফেলে!

পৃথিবীকে করেছে পৃ। কী বুদ্ধি দেখেছ?

তাই তো দেখছি।

আরো অনেক মজার ব্যাপার আছে–নিজেরা নিজেরা একটা ভাষা তৈরি করে ফেলেছে। কিচির মিচির করে নিজেদের ভিতর কী বলে আমি কিছুই বুঝি না।

মজার ব্যাপার তো।

হ্যাঁ–ছোট বাচ্চার মাঝে এত মজার ব্যাপার লুকানো আছে তুমি দেখলে অবাক হয়ে যাবে। একটু আগে কী হয়েছে শোন

লেন একটু আগে খাবার সময় বাচ্চাগুলি তাদের পানীয় নিয়ে কী দুষ্টুমি করেছে সেটা খুব উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করে। আমি নিজের বিস্ময়টুকু গোপন করে মুখে একাগ্রতার একটা ভাব ফুটিয়ে তুলি। আমি নিজের চোখে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতে পারতাম না লেনের মতো একটি মেয়ে ছোট শিশুদের নিয়ে এ ধরনের উচ্ছাস দেখাতে পারে।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, বাচ্চাগুলিকে বাঁচাতে হবে, যেভাবেই হোক।

 

চতুর্থ স্তরে নানা ধরনের স্কাউটশিপ রাখা আছে আমি সেগুলি দেখে একটাকে বেছে রাখলাম। এটা তৈরি হয়েছিল মহাকাশযানের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে, বায়ুশূন্য মহাকাশে যেতে পারে বলে এটি বায়ু নিরোধক, ছোটখাট গোলাগুলি সহজে সহ্য করতে পারবে। নিয়ন্ত্রণটুকু পুরোপুরি যান্ত্রিক আমাকে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আমি স্কাউটশিপের কোড নাম্বারটি নিয়ে তথ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ। করলাম। বিশেষ অনুমতি ছাড়া এটি ব্যবহার করার উপায় নেই। আমি পর্যবেক্ষণ করার জন্যে কয়েক মিনিট ব্যবহার করার একটা সাময়িক অনুমতি যোগাড় করে রাখলাম। মিয়ারায় আস্তানা থেকে কয়েক মিনিটের মাঝে কেউ বের হতে পারবে না কাজেই এটা নিরাপত্তার জন্যে কোনো রকম হুমকি নয়।

বাচ্চাগুলিকে নিয়ে পালানোর পরিকল্পনার পরের অংশটুকু জটিল, যার জন্যে আমাদের শরীর থেকে ট্রাকিওশান গুলি আলাদা করতে হবে। একজন মানুষের যাবতীয় তথ্য এই ট্রাকিওশানের মাঝে থাকে–এটি শরীর থেকে বের করা মাত্রই আমরা এই মহাকাশযানের অপ্রয়োজনীয় জঞ্জালে পরিণত হব। কিন্তু সেটা নিয়ে এখন আর চিন্তা করার সময় নেই। ট্রাকিওশানগুলি বের করতে আমাদের কষ্ট হল, চামড়ার নিচে লুকানো থাকে, সেটা কেটে বের করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। ছোট পাতলা একটা চাকতির মতো শক্তিশালী ট্রান্সমিটারগুলি আপাততঃ শরীরের উপরে লাগিয়ে রাখা হল, শেষ মুহূর্তে সেগুলি অন্য কোথাও লাগিয়ে দিয়ে মূল তথ্যকেন্দ্রকে বিভ্রান্ত করা হবে।

নির্দিষ্ট সময়ে আমি স্কাউটশিপের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম, তিনি সারাক্ষণই আমার সাথে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে আমার পিছু পিছু এসেছে। স্কাউটশিপের কাছাকাছি এসে আমি আমার ট্রাকিওশানটি চলমান একটি রবোটের দিকে ছুড়ে দিলাম–পুরো জিনিসটা করতে হল তথ্যকেন্দ্রের চোখকে আড়াল করে, সেটা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। ত্রিনি সাথে সাথে সেই রবোটটির পিছু পিছু হটতে শুরু করেযখন সে বুঝতে পারবে আমি পালিয়ে গেছি তার প্রতিক্রিয়া কী হবে জানার আমার একটু সূক্ষ্ম কৌতূহল হল!

স্কাউটশিপের দরজায় টোকা দিতেই সেটা ঘর ঘর শব্দ করে খুলে গেল। আমি মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকে গেলাম, বাইরে থেকে বোঝা যায় না কিন্তু ভিতরে বেশ প্রশস্ত। আমি কন্ট্রোল প্যানেলে হাত দিতেই সেটি মিষ্টি সুরে কথা বলে উঠল, মহামান্য কিহা, আপনি কয়েক মিনিটের এটা পর্যবেক্ষণ করতে এসেছেনআপনাকে কী আমি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?

অবশ্যি পার। এই স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু কী?

কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরের ভাগে ভারসাম্য রক্ষার মডিউলটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার নিচে রয়েছে স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রপাতি।

চমৎকার–আমি পকেট থেকে ছোট একটা বিস্ফোরকের টিউব বের করে আনলাম। আমাকে নূতন ধরনের অস্ত্র আবিষ্কার করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বলে এ ধরনের জিনিস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্যে সরবরাহ কেন্দ্র থেকে দিতে আপত্তি করে নি।

মহাকাশযানের কন্ট্রোল প্যানেল অবশ্যি তীক্ষ্ণ স্বরে বিপদ সংকেত বাজাতে বাজাতে আপত্তি জানাতে শুরু করে। কণ্ঠস্বরটি উঁচু গলায় বলল, স্কাউটশিপের মাঝে বিস্ফোরক অত্যন্ত বিপজ্জনক–

সেজন্যেই এনেছি।

তুমি কী করবে বিস্ফোরক দিয়ে?

ভারসাম্য রক্ষার মডিউল এবং স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রপাতি উড়িয়ে দেব।

অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি কাজ করতে যাচ্ছ।

হ্যাঁ। আমার ভাসা ভাসা মনে আছে যদি স্কাউটশিপে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে ভেতরের আরোহীদের জীবন রক্ষার একটি শেষ চেষ্টা করা হয়। তখন স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ আরোহীদের হাতে দেয়া হয়। আমার স্কাউটশীপের নিয়ন্ত্রণটুকু দরকার–

কিন্তু তার যথাযথ নিয়ম রয়েছে। তুমি যেটা করতে যাচ্ছ সেটা বিপজ্জনক এবং বেআইনি।

সম্ভবত। আমি কথা না বাড়িয়ে বিস্ফোরকের টিউবটি কন্ট্রোল প্যানেলে বসিয়ে একটু দূরে সরে গেলাম। তিন সেকেন্ডের মাঝে প্রচণ্ড শব্দে একটা বিস্ফোরণে কন্ট্রোল প্যানেলের বড় একটা অংশ উড়ে গেল এবং সাথে সাথে তীব্র স্বরে ভেতরে বিপদ সংকেত বাজতে থাকে, উজ্জল লাল আলো জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করে। আমি স্কাউটশিপের ভেতরে এবারে ভিন্ন একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, সেটি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, মহা বিপদ সংকেত। আরোহীদের নিরাপত্তার জন্যে বলছি, স্কাউটশিপের প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি দ্বিতীয় ধাপের নিয়ন্ত্রণ–

আমি গলায় ভয় এবং আতংক ফুটিয়ে বললাম, বাইরের সাথে সমস্ত যোগাযোগ কেটে দাও।

দিচ্ছি।

আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে দাও।

দিচ্ছি–

আমি কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে গিয়ে বসে বললাম, নিচু দিয়ে উড়তে শুরু কর। দ্বিতীয় স্তরে থামতে হবে।

কিন্তু–

কোন কথা বলার সময় নেই, তাড়াতাড়ি—

সাথে সাথে স্কাউটশিপের গর্জন করে উড়তে শুরু করে।

দ্বিতীয় স্তরে লেন বাচ্চাগুলিকে নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিল। আমি এক মুহূর্তের জন্যে দরজা খুলতেই সে সবাইকে নিয়ে হুঁড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। আমি গলা উচিয়ে বললাম, মূল প্রবেশপথ দিয়ে বের হয়ে যাও। তাড়াতাড়ি

কিন্তু–

এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। তোমাকে বুঝিয়ে বলার সময় নেই।

স্কাউটশিপের ভেতরে আর কোনো কথা শোনা গেল না। সেটা নিচু হয়ে ছুটতে শুরু করে এবং দেখতে দেখতে এর বেগ বেড়ে যেতে থাকে।

লেন নিচু গলায় বলল, আমরা এখন কোথায় যাব?

কাছাকাছি কোনো শীতল ঘরে। আমি কিছু নকল ট্রাকিওশান তৈরি করে রেখেছি, এখান থেকে বের হয়ে শরীরে লাগিয়ে নিতে হবে।

লেন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন স্কাউটশিপটা ঝাকুনী দিয়ে থেমে যায় এবং ভেতরে আমরা সবাই হুঁড়মুড় করে পড়ে গেলাম। ছোট বাচ্চাগুলি ব্যাপারটা এক ধরনের খেলা মনে করে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করে।

আমি একটু শংকিত হয়ে বললাম, কী হয়েছে? থামছ কেন?

প্রতিরক্ষাকেন্দ্র তোমাদের পরিচয় জানতে চাইছে।

আমি কঠিন গলায় বললাম, তোমাকে আমি বলেছি আমাদের হাতে কোনো সময় নেই। তুমি বের হয়ে যাও।

প্রতিরক্ষাকেন্দ্র তাহলে আমাদের আক্রমণ করবে।

করলে করবে। আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি তুমি এই মুহূর্তে বের হয়ে যাও।

এটি বেআইনি–

আমি তোমাকে এই বেআইনি কাজ করার নির্দেশ দিচ্ছি।

স্কাউটশিপের বিধ্বস্ত কন্ট্রোল প্যানেলে কিছু আলোর ঝলকানী দেখা গেল, তারপর যেরকম হঠাৎ করে এটি থেমেছিল ঠিক সেরকম করে হঠাৎ এটি ছুটতে শুরু করল।

 

স্কাউটশিপটি যখন তার গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করে মহাকাশযানের বিশাল করিডোর ধরে নির্দিষ্ট পথে ছুটতে শুরু করেছে তখন লেন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার কি মনে হয় কিহা, আমরা কী পালিয়ে যেতে পারব?

নিশ্চয়ই পারব।

প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে আমাদের পিছু নেবে না?

আমরা আমাদের ট্রাকিওশান ফেলে এসেছি, আমরা কে তারা এখনো জানে। তারা জানার আগেই আমরা শীতল ঘরে ঢুকে যাব।

আমরা কি পারব?

আমি উত্তর দেবার আগেই স্কাউটশিপের কন্ট্রোল প্যানেল থেকে উত্তর ভেসে এল, সেটি বলল, আমার ধারণা পারবেন না।

কেন?

এই মাত্র তিনটি বাই ভার্বাল স্কাউটশিপের কন্ট্রোল লক ইন করেছে। যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরক দিয়ে এটিকে ধ্বংস করে দেবে।

আমি কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে একটি চেয়ারে বসে নিজেকে চেয়ারের সাথে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে নিতে নিতে বললাম, লক ইন করার মাইক্রো-সেকেন্ডের মাঝে আঘাত করা যায়। এখনো যখন করে নি–তার মানে তারা আঘাত করবে না।

কেন করবে না?

সম্ভবত তারা আমাদের পরিচয় জেনে গেছে।

লেন ফ্যাকাসে মুখে বলল, সর্বনাশ! আমরা তাহলে কী করব?

দেখি কী করা যায়। আমি দ্রুত চিন্তা করতে করতে বললাম, তুমি বাচ্চাগুলিকে চেয়ারগুলির মাঝে শক্ত করে বেঁধে দাও, আমার মনে হয় স্কাউটশিপটা নিয়ে কিছু লাফঝাঁপ দিতে হবে।

কী রকম লাফঝাঁপ?

বড় ধরনের। আমি একটা পর্যবেক্ষণকেন্দ্র ভেঙে মহাকাশে বের হয়ে যাবার কথা ভাবছি।

লেন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাল। সে আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি দুর্বলভাবে হেসে বললাম, আমাদের স্কাউটশিপ মহাকাশে যেতে পারে, আমাদের পিছু নিয়েছে সাধারণ বাই ভার্বাল সেগুলি মহাকাশে যেতে পারবে না।

কিন্তু আমরা কেমন করে মহাকাশে যাব?

আমি এখনো জানি না।

পর্যবেক্ষন কেন্দ্রের জানালা সবসময় বন্ধ থাকে।

কিন্তু যদি প্রচণ্ড গতিতে সোজাসুজি পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের দিকে ছুটে যেতে শুরু করি সম্ভবত একটা জানালা খুলে যাবে। আমরা সেই জানালা দিয়ে বের হয়ে যাব।

কেন জানালা খুলবে?

মহাকাশযানকে রক্ষা করার জন্যে। একটা স্কাউটশিপ প্রচণ্ড গতিতে যেতে পারে, এর গতিশক্তি মেগাজুল পর্যন্ত হতে পারে। মহাকাশযান তার দেয়ালে মেগাজুল শক্তিতে আঘাত করতে দেবে না। সেটি মহাকাশযানের জন্য বিপজ্জনক।

লেন কোনো কথা না বলে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু তোমার ধারণা যদি ভুল হয়?

আমি লেনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুঁকে পড়ে বললাম, স্কাউটশিপ, আমি চাই তুমি ধীরে ধীরে গতিবেগ বাড়িয়ে উপরে ওঠে এস।

মহাকাশযানের ভেতরে আমার গতিবেগ বাড়ানোর উপায় নেই। স্কাউটশিপটি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, এটি বিপজ্জনক।

ঠিক আছে, তুমি নিয়ন্ত্রণটি আমার হাতে দিয়ে দাও।

তোমার হাতে? তুমি স্কাউটশিপ কখনো নিয়ন্ত্রণ করেছ?

আমি সেটা নিয়ে আলোচনায় যেতে চাই না। আমি কোনো জটিল কাজ করতে যাচ্ছি না। সোজাসুজি মহাকাশযানের দেয়ালে আঘাত করতে যাচ্ছি–

স্কাউটশিপের মূল নিয়ন্ত্রণের জন্যে যে বোম রয়েছে সেটা স্পর্শ করতেই নিয়ন্ত্রণটুকু আমার হাতে চলে এল। আমি শক্তিকেন্দ্রে চাপ দিয়ে স্কাউটশিপের গতিবেগ বাড়াতে শুরু করি, আমার দুই পাশে দিয়ে মহাকাশযানের করিডোর পিছনে ছুটে যেতে শুরু করল। আমি গতিবেগ আরো বাড়ানোর চেষ্টা করতেই যোগাযোগ মডিউলে আমাদের পিছনে লেগে থাকা বাই ভার্বালের আরোহীর গলায় স্বর শুনতে পেলাম, চিৎকার করে কঠোর গলায় বলল, কিহা, আমি জানি তুমি স্কাউটশিপে আছ। এই মুহূর্তে নিচে নেমে আস, না হয় তোমাকে গুলি করব–

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে স্কাউটশিপের গতিবেগ আরো বাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকি। কণ্ঠস্বরটি আবার কঠোর গলায় বলল, এই মুহূর্তে নিচে নেমে আস–এই মুহূর্তে–

আমি স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে মহাকাশযানের উপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকি, উপরে স্বচ্ছ জানালাগুলি দেখা যাচ্ছে, এর কোনো একটিতে আমার আঘাত করতে হবে, আমি সাহস সঞ্চয় করতে থাকি, একটি স্কাউটশিপ নিয়ে প্রচণ্ড বেগে সোজাসুজি মহাকাশেনের দেয়ালে আঘাত করার মতো সাহস সম্ভবত আমার নেই।

আমি মহাকাশযানের উপরে দিয়ে ছুটে যেতে যেতে নিচে তাকালাম, অনেক নিচে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি–যানবাহন দেখা যাচ্ছে, আমাকে ঘিরে নানা ধরনের আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকে। সম্ভবত অনেকেই আমাকে লক্ষ করছে। আমি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণটুকু ধরে রাখি। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, আমার নিঃশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ওঠে, আমি স্কাউটশিপটাকে সোজাসুজি ওপরের দিকে ঘুরিয়ে আনতে শুরু করতেই হঠাৎ ভিতরে একটা নূতন কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। সেটি চাপা গলায় বলল, স্কাউটশিপের আরোহী, আমি একটি গোপন চ্যানেলে তোমার সাথে যোগাযোগ করছি, আমার কথা তুমি ছাড়া আর কেউ শুনছে না। তুমি আমার কথার কোনো উত্তর দেবে না।

কণ্ঠস্বরটি এক মুহূর্ত থেমে থেকে বলল, মাহাকাশযানের দেয়ালে আঘাত করে বের হয়ে যাবার পরিকল্পনাটির সাফল্যের সম্ভাবনা দশমিক দুই তিন। তুমি যদি চাও তোমাকে আমি অন্যভাবে রক্ষা করতে পারি। তার জন্যে স্কাউটশীপের পুরো নিয়ন্ত্রন আমাকে দিতে হবে। আমার কোড নম্বর সাত চার তিন দুই।

আমি অবাক হয়ে বিচিত্র কণ্ঠস্বরটি শুনছিলাম, ব্যাপারটি একটি ষড়যন্ত্র কী না যাচাই করার কোনো উপায় নেই। কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাকে কয়েকটি বাই-ভার্বাল ধাওয়া করছে, তোমাকে গুলি করার সুযোগ পেয়েও গুলি করছে না, যার অর্থ এই স্কাউটশিপে তোমরা যারা আছ তারা সম্ভবত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের ট্রাকিওশান নেই যার অর্থ তোমরা পালিয়ে যাচ্ছ। মহাকাশযানের প্রচলিত পদ্ধতি থেকে যারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাদের জন্যে আমার সমবেদনা রয়েছে, সেই জন্যে আমি তোমাদের সাহায্য করতে চাইছি। তুমি যদি আমার সাহায্য গ্রহণ করতে চাও কোড়-নম্বর সাত চার তিন দুইয়ে স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণটুকু হস্তান্তর কর। আমাদের হাতে সময় খুব কম।

আমি লেনের দিকে তাকালাম, সে ফ্যাকাশে মুখে বসে আছে। তার দুই পাশে বাচ্চাগুলি বসে আছে, তাদের চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। স্কাউটশিপের পুরো ব্যাপারটুকু তারা অত্যন্ত মজার কোনো খেলা হিসেবে ধরে নিয়েছে। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে কন্ট্রোল প্যানেলের একপাশে কোড়-নম্বরটি প্রবেশ করিয়ে স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণটুকু হস্তান্তর করে দিলাম।

সাথে সাথে স্কাউটশিপটা বিদ্যুৎবেগে তার দিক পরিবর্তন করে উল্টোদিকে ছুটতে শুরু করে। খানিকদূর গিয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড গতিতে ঘুরে গিয়ে আবার সোজাসুজি উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। আমি উপরে তাকিয়ে হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আমাদেরকে কোথাও নেয়া হচ্ছে।

মহাকাশযানটি একটি বিশাল চাকার মতো, এটি তৈরি করা হয়েছে মহাকাশে, দীর্ঘ সময় নিয়ে এর বিভিন্ন অংশ তৈরি করে এনে একটু একটু করে জুড়ে দেয়া হয়েছে। চাকার মতো অংশটির ঠিক মাঝখানে রয়েছে মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিন। ইঞ্জিনগুলি মহাকাশযানের সাথে ছয়টি রড দিয়ে লাগানো। রডগুলি ফাপা এবং এর ভেতর দিয়ে অনায়াসে কয়েকটা স্কাউটশিপ ঢুকে যেতে পারে। এই মুহূর্তে আমাদের স্কাউটশিপটা এরকম একটি ফাঁপা টিউবের মাঝে দিয়ে ভিতরে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মহাকাশযানের এই অঞ্চলটি মানুষ বাসের অনুপোযোগী। এখানে বাতাস নেই, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই, মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই। মহাকাশযানে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ বল তৈরি করার জন্যে এটি তার অক্ষের উপর ঘুরছে। সেন্ট্রিফিউগাল বল থেকে তৈরি হয়েছে মাধ্যকর্ষণের অনুভূতি। কেন্দ্রে সেই মাধ্যকর্ষন বলও নেই। এখানে এসে কেউ আশ্রয় নিতে পারে সেটি আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখতে পেলাম সত্যি সত্যি সেখানে আশ্রয় নেবার জন্যে আমরা স্কাউটশীপে ছুটে যাচ্ছি।

মহাকাশযানটি বিশাল এবং আমরা দীর্ঘ সময় এই অন্ধকার গহ্বর দিয়ে ছুটে যেতে থাকলাম। আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমরা জানি না আমার কথা বলা নিষেধ বলে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ মনিটরে একটা অনুজ্জ্বল আলো দেখা গেল। আলোটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে এবং আমি বুঝতে পারলাম সেটি একটি ডকিং স্টেশন। স্কাউটশিপটার গতিবেগ কমে আসে এবং ডকিং স্টেশনের নির্দিষ্ট জায়গায় সেটি নিজেকে শক্ত করে লাগিয়ে নিয়ে স্থির হয়ে দাড়াল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না, ঠিক তখন আগের কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেলাম। সেটি বলল, তোমরা স্কাউটশিপটা থেকে বের হয়ে আসতে পার। এখানে মাধ্যাকর্ষণ নেই, কাজেই তোমাদের ভেসে বের হয়ে আসতে হবে, ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হতে হয়তো একটু সময় নেবে।

আমি কথা বলতে পারব কী না বুঝতে পারছিলাম না, নিঃশব্দে চেয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করতেই ভেসে উপরে উঠে এলাম, তাল সামলে কোনোমতে দরজার কাছাকাছি এসে হ্যান্ডেলটা ধরে রাখলাম। কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, তোমরা এখন নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছ, ইচ্ছে করলে কথা বলতে পার।

আমি দরজা খুলতে খুলতে বললাম, আমাদেরকে বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ। কেন বাঁচিয়েছ জানলে আরো স্বস্তি বোধ করতাম।

কণ্ঠস্বরটি হালকা গলায় বলল, বলতে পার অল্প খানিকটা সমবেদনা এবং অনেকখানি কৌতূহল! তোমাদের স্কাউটশিপে যারা আছে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারা সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ? তুমি নাকি অন্য কেউ?

আমি হেসে বললাম, না আমি নই। তারা আসছে।

আমার কথা শেষ হবার আগেই শিশুগুলি উচ্চঃস্বরে হাসতে হাসতে এবং আনন্দে গড়াগড়ি খেয়ে ভাসতে ভাসতে স্কাউটশিপের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসতে থাকে। এক মুহূর্ত পর আমি আবার কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেলাম সেটা শিস দেবার মতো শব্দ করে বলল, এরাই তাহলে সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ?

আমি মাধ্যকর্ষণহীন অবস্থায় অভ্যস্ত নই। শুধু মনে হতে থাকে যে কোথাও পড়ে যাচ্ছি, কোনোভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে বললাম, হ্যাঁ, এরাই সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। কিন্তু তুমি কে?

আমি?

হ্যাঁ তুমি।

আমি সেরকম কেউ নই। একটু পরেই দেখবে। তোমরা ডকিং স্টেশন পার হয়ে ভিতরে চলে এসো।

স্কাউটশিপ থেকে নেমে শিশুগুলি একেকজন একেকদিকে ভেসে চলে যেতে শুরু করে এবং তাদের সবাইকে আবার ধরে আনতে লেন এবং আমার বিশেষ বেগ পেতে হল। শিশুদের সম্পূর্ণ বিনা কারণে আনন্দ পাওয়ার এবং সেই অকারণ আনন্দ অন্যদের মাঝে সঞ্চালিত করে দেয়ার একটা বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। দেখা গেল আমরাও শিশুগুলির পিছনে ছুটতে ছুটতে হাসাহাসি করছি।

 

পাশের ঘরটি মাঝারি আকারের, মাধ্যকর্ষণহীন যেকোনো জায়গার মতো এখানেও অসংখ্য যন্ত্রপাতি এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘরটিতে অনুজ্জ্বল একটা আলো জ্বলছে এবং ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা পিলারে একজন মানুষ উল্টো করে বাধা। মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় উল্টো সোজা বলে কিছু নেই কিন্তু তবুও দৃশ্যটি দেখে আমরা চমকে উঠলাম। মানুষটি বৃদ্ধ, সত্যি কথা বলতে কী আমি এর আগে কোনো বৃদ্ধ মানুষ দেখি নি। নূতন প্রযুক্তিতে মানুষের চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই মানুষটির চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ ভয়াবহ ভাবে এসে স্থান নিয়েছে। তার মাথায় ধবধবে সাদা চুল, মুখে সাদা লম্বা দাড়ি-গোঁফ। তার মুখের চামড়া কুঞ্চিত, চোখ কোটরাগত। সেই কোটরাগত চোখ অঙ্গারে মতো জ্বলছে। মানুষটি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি লী। সবাই ডাকে বুড়ো-লী। আমি বুড়ো-লীয়ের আস্তানায় তোমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমি দুঃখিত তোমাদের কাছে আসতে পারছি না। বয়স হয়ে গিয়েছে, শরীরে জোর নেই, নিজেকে তাই পিলারের সাথা বেঁধে রেখেছি আজ প্রায় তিরিশ বছর।

লেন আর্ত শব্দ করে বলল, তিরিশ বছর?

হ্যাঁ। মহাকাশযানে যখন হানাহানি শুরু হল, তোমরা তখন নিশ্চয়ই শীতল ঘরে ঘুমিয়ে, আমাকে কিছু খুনোখুনির দায়িত্ব দিয়েছিল। করতে রাজি হই নি বলে খুব যন্ত্রণা গিয়েছে। পালিয়ে শেষ পর্যন্ত বুড়ো লী হঠাৎ কথা থামিয়ে বলল, তোমাদের কেমন জানি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তোমরা বিশ্রাম নিয়ে এসো। দেখতেই পাচ্ছ এটা নিয়মিত মানুষের আস্তানা নয় তোমাদের নিশ্চয়ই কষ্ট হবে। তবে জায়গাটা নিরাপদ। একেবারে শক্তিকেন্দ্রে আস্তানা করেছি তো কারো ধারে কাছে আসার ক্ষমতা নেই। আমার এখানে মানুষজন নেই, কাজ চালানোর মতো কিছু রবোট তৈরি করেছি, তারাই সাহায্য করে।

বুড়ো লী মুখ ঘুরিয়ে ডাকল, কিশি–

ঘরের মাঝে ইতস্তত যেসব যন্ত্রপাতি ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাদের মাঝে বড় ধরনের একটি যন্ত্র হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। দেখতে দেখতে দুপাশে দুটি যান্ত্রিক হাত এবং একটি বিদঘুটে মাথা গজিয়ে ওঠে। পিছনে ছোট একটা জেট ইঞ্জিন চালু হয়ে যায় এবং সেটি ভাসতে ভাসতে বুড়ো-লীয়ের দিকে এগিয়ে আসে।

বুড়ো লী রবোটটির দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে অতিথি এসেছে। তুমি তাদের নিয়ে যাও। বিশ্রাম এবং খাবারের ব্যবস্থা কর।

রবোর্টটি কোনো কথা না বলে এগিয়ে যেতে থাকে। আমি এবং লেন কোনোভাবে শিশুগুলিকে ধরে বেঁধে তার পিছু পিছু যেতে থাকি। আসলে বুঝতে পারি নি, আমি সত্যিই অসম্ভব ক্লান্ত।

৫. আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল

আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম আমি ছোট ঘরটার মাঝামাঝি ভেসে আছি। আমাকে ঘিরে ইতস্ততভাবে আটজন শিশু ঘুমন্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিচে মেঝের কাছাকাছি একটা গ্রিলকে ধরে লেন আধশোয়া হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি নিচু গলায় বললাম, লেন, তুমি ঘুমাও নি?

ঘুমিয়েছিলাম, কিন্তু ঘুম ভেঙে গেল। মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় ভেসে ভেসে ঘুমিয়ে আমার অভ্যাস নেই। তা ছাড়া মনে হয় রিটালিন-৪০০ এখনো শরীরে রয়ে গেছে।

।আমি ঘরের মাঝে থেকে ভেসে ভেসে নিচে আসার চেষ্টা করতে করতে বললাম, আমিও ঘুমুতে পারছি না। কিন্তু বাচ্চাগুলি দেখেছ কী আরামে ঘুমিয়ে গেছে।

লেনের বিষণ্ণ মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে খানিকক্ষণ ঘুমন্ত বাচ্চাগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাসতে ভাসতে বাচ্চাগুলি যখন একজন আরেকজনের কাছে চলে আসে তখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। আবার ঘুমের মাঝেই একজন আরেকজনকে ছেড়ে দেয়, দুজন দুদিকে ভেসে চলে যায়। লেন ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই সৃষ্টিগজতে শিশু থেকে সুন্দর কিছু নেই।

তুমি মনে হয় ঠিকই বলেছ। আমি কিন্তু আগে কখনো কোনো শিশুকে ভাল করে লক্ষ করি নি।

আমিও করি নি। একটা তথ্য কেন্দ্রে একবার দেখেছিলাম প্রাচীনকালে নাকি শিশুদের জন্ম হত মেয়েদের গর্ভে, সন্তান জন্ম দিতে হত অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে তারপর মেয়েটিকে সেই শিশুকে বুকের দুধ খাইয়ে বুকে ধরে বড় করতে হতো।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমিও শুনেছি কথাটা–জন্মের পুরো ব্যাপারটা ছিল অবৈজ্ঞানিক। অনিশ্চয়তা আর বিপদ দিয়ে ভরা

লেন আমাকে বাধা দিয়ে বলল, গত কয়েকদিন এই বাচ্চাগুলিকে দেখে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ব্যাপারটা হয়তো খারাপ ছিল না। বাচ্চাগুলি আমার কাছাকাছি রয়েছে তাতেই তাদের জন্যে আমার বুকে কী ভয়ানক ভালবাসা জন্মে গেছে। একটি মেয়ে যখন বাচ্চাটিকে দীর্ঘ সময় নিজের গর্ভে ধরে রাখবে তখন তার জন্যে কী রকম ভালবাসা হবে তুমি চিন্তা করতে পার?

আমি ব্যাপারটা চিন্তা করে একটু শিউরে উঠে বললাম, আমার নূতন পদ্ধতিটাই পছন্দ–যেখানে শিশুর জন্ম হয় ল্যাবরেটরিতে, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের তত্ত্বাবধানে। নিখুঁত সুস্থ সবল বুদ্ধিমান একটা শিশু পাওয়া যায়।

লেন একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যাই হোক, এসব নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। এখন নিজেদের কথা বলি, আমাদের এখন কী হবে?

আমি মুখে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললাম, মনে আছে তুমি মানুষের নেতৃত্ব নিয়ে মারামারি ব্যাপারটি দেখতে চাইছিলে! এখাননা কী দেখতে চাও?

লেন মাথা নাড়ল, বলল, না। চাই না। যথেষ্ট দেখেছি। কিন্তু এখন কী হবে আমাদের? আমরা কী করব?

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, বুড়ো লীয়ের এই আস্তানাটা নিরাপদ। আমাদের আপাতত এখানেই থাকতে হবে।

লেন চারিদিকে তাকিয়ে বলল, এই ছোট জায়গায়? মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় ভেসে ভেসে? কয়েকদিনের মাঝেই শরীরে মাংশপেশী দুর্বল হয়ে যাবে তখন আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারব না–

মাংশপেশী ঠিক রাখার নিয়মকানুন আছে। তা ছাড়া চেষ্টা করে দেখা যাবে একটা শীতল ক্যাপসুল আনা যায় কিনা, তাহলে এখানেই একটা ছোট শীতল ঘর তৈরি করে ঘুমিয়ে পড়া যায়। পৃথিবীতে পৌঁছে ঘুম থেকে ওঠা যাবে।

সেটা কী করতে পারবে?

বুড়ো লী খুব কাজের মানুষ, দেখলে না আমাদের কী চমৎকার ভাবে উদ্ধার করে নিয়ে এল, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

লেন আমার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি আর পারছি না কিহা।

আমার বুকের ভিতরে হঠাৎ লেনের জন্যে এক ধরনের বিচিত্র অনুভূতির জন্ম হয়, তাকে নিজের বুকের কাছে টেনে এনে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু নরম কোমল ভালবাসার কথা বলতে ইচ্ছে করে, আমি অবশ্যি কিছুই করলাম না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম, তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে লেন। আরো অনেক শক্ত হতে হবে।

 

আমি যখন বুড়ো লীয়ের ঘরে গেলাম তখনো সে ঘরের মাঝামাঝি একটা। পিলার বাঁধা অবস্থায় ঝিমুচ্ছিল। তাকে ঘিরে নানারকম যন্ত্রপাতি জঞ্জাল ভেসে বেড়াচ্ছে। এক কোণােয় একটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক স্ক্রিন, সেখানে মহাকাশযানের কিছু খবরাখবর প্রচারিত হচ্ছে। বুড়ো লী সেগুলি দেখছে কিনা ঠিক বোঝা গেল না। আমি কাছাকাছি পৌঁছাতেই সে চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, কিছু একটা হবে এখন!

আমি থতমত খেয়ে বললাম, কিসের কী হবে?

জানি না। কিন্তু কিছু একটা হবে। আমি ত্রিশ বছর থেকে শুধু দেখছি–কখন কী হয় সেটা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আছে। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে এখন কিছু একটা হবে।

আমি কিছু বললাম না, কাছাকাছি ধরে রাখার কিছু নেই, একটু পরে পরে ওলটপালট খেয়ে যাচ্ছিলাম, এরকম অবস্থায় কারো সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় না।

বুড়ো লী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কিছু খেয়েছ?

আমি মাথা নাড়লাম, না। শীতল ঘর থেকে বের হয়েছি, তাই কয়েকদিন না খেয়েই চলে যাবে।

আমার কাছে সত্যিকারের খাবার নেই। আঙ্গুরের রস দিয়ে তিতির পাখির ঝলসানো রোস্ট আর যবের রুটি যদি চাও তাহলে পাবে না। তবে আমার কাছে কিছু খাবারের ক্যাপসুল আছে, একটা দিয়ে সপ্তাহ দুয়েক চলে যায়। বাথরুমে যেতে হয় না–যা সুবিধে! বুড়ো লী হঠাৎ খিক খিক করে হাসতে থাকে।

আমি কিছু বললাম না। সে পকেট থেকে কয়েকটা খাবারের ক্যাপসুল বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও সাথে রাখ।

আমি ক্যাপসুলগুলি পকেটে রাখতে রাখতে বললাম তোমার এই এলাকাটা কি নিরাপদ?

এই মহাকাশযানে কোনো এলাকা আর নিরাপদ নয়। তবে তুমি যদি জানতে চাইছ কেউ তোমাদের ধরে নিতে আসবে কিনা তাহলে ভয় পাবার কিছু নেই। বুড়ো লীকে কেউ ঘাটায় না।

কেন? তুমি শক্তিকেন্দ্রের কাছে বলে?

ঠিকই ধরেছ। শক্তি কেন্দ্রের চারিদিকে ঘিরে বিস্ফোরক লাগানো আছে আমি শুধু মুখে উচ্চারণ করব সাথে সাথে পুরো শক্তিকেন্দ্র উড়ে যাবে। মহাকাশযান হয়ে যাবে মহাকাশ কবরখানা–হা হা হা হা! বুড়ো লী খুব একটা মজার কথা বলেছে

এরকম ভাব করে হাসতে লাগল।

তুমি কেমন করে এই জায়গাটা দখল করলে?

বুড়ো লী তার মাথায় ঠোকা দিয়ে বলল, মাথা খাটিয়ে। যখন দেখতে পেলাম মহাকাশযানে ভাগ-বাটোয়ারা শুরু হয়ে গেছে তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম কয়দিনের মাঝেই কামড়া-কামড়ি শুরু হয়ে যাবে, এই বেলা নিরাপদ একটা জায়গায় আরাম করে আস্তানা না গেড়ে নিলে আর হবে না।

সবচেয়ে ভাল জায়গাতেই আস্তানা করেছ!

বুড়ো লী খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, না, সবচেয়ে ভাল জায়গাটা আমি পাই নি।

কে পেয়েছে?

কেউ পায় নি। মনে হয় কেউ পাবে না।

সেটা কোনো জায়গা?

বুড়ো লী আমার দিকে তাকিয়ে খিক খিক করে হাসতে শুরু করে, হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, আমি শুনেছিলাম তুমি নাকি নিনীষ স্কেলে আট মাত্রার বুদ্ধিমান! সেটা কোনো জায়গা এখনো জান না?

না।

ঠিক আছে তাহলে নিজেই ভেবে ভেবে বের কর।

আমি খানিকক্ষণ বুড়ো লীয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, মূল তথ্যকেন্দ্র?

বুড়ো লী তার ভুরু নাচিয়ে বলল, আমি বলব না।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, দেখতেই পাচ্ছ নিনীষ স্কেলে বড় ত্রুটি আছে, আটমাত্রার মানুষের যেটুকু বুদ্ধিমান হবার কথা আমি সেটুকু বুদ্ধিমান নই। তাছাড়া আমি মাত্র অল্প কিছুদিন হল শীতল ঘর থেকে বের হয়েছি, সব কিছু এখনও ভাল করে জানিও না।

জানবে, এই মহাকাশযানে সবচেয়ে সহজলভ্য জিনিস হচ্ছে তথ্য। আর যদি এক ধাক্কায় পুরো তথ্য জেনে নিতে চাও তাহলে মুক্ত এলাকা থেকে ঘুরে এস।

মুক্ত এলাকা? আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, সেটা কী?

তুমি এখনো মুক্ত এলাকার নাম শোন নি?

না-আমি এসেছি মাত্র অল্প কিছুদিন হল, কেউ আমাকে বলে নি।

ইচ্ছে করেই বলে নি, তুমি যদি দল ছেড়ে মুক্ত এলাকায় চলে যাও সেজন্যে।

মুক্ত এলাকায় কী রয়েছে?

মহাকাশযান নিয়ে যখন কামড়াকামড়ি শুরু হয়েছে, ভাগ-বাটোয়ারা যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে তখন সবাই মিলে একটা জায়গা ঠিক করেছে যার নাম দেয়া হয়েছে মুক্ত এলাকা। ঠিক করা হয়েছে এই এলাকাটা স্বাধীন। কেউ সেটা নিতে পারবে না।

কিন্তু যার জোর বেশি সে দখল করে নিচ্ছে না কেন?

নিজেদের স্বার্থেই নিচ্ছে না। জায়গাটা থাকায় সবার জন্যে লাভ। শুনেছি রমরমা বাজার। সব কিছু পাওয়া যায়! সুন্দরী মেয়েমানুষ, সুদর্শন পুরুষ মানুষ থেকে শুরু করে পারমাণবিক অস্ত্র, আধুনিক বাই ভার্বাল–কী নেই!

এসব কিনতে পাওয়া যায়?

হ্যাঁ।

কী দিয়ে বেচা-কেনা হয়?

প্রথম প্রথম নাকি শুধু জিনিসপত্র বিনিময় হতো। এক মাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে একটা বাই-ভার্বাল নিয়ে গেলে, একটা সুন্দরী মেয়েমানুষ দিয়ে ভাল একটা অস্ত্র। দুইটা চতুর্থ জেনারেশন রবোট দিয়ে একটা পঞ্চম জেনারেশানের রবোটএইরকম। কিছুদিন হল একটা ব্যাংক খুলেছে, এখন ইলেকট্রনিক কারেন্সি ব্যবহার হচ্ছে। ব্যাংকে মূল্যবান কিছু জমা দিলে তুমি কারেন্সি পেয়ে যাবে। সেই কারেন্সি দিয়ে অন্য কিছু কিনবে। এখানে সেটাকে ইউনিট বলে।

আমি হতবাক হয়ে বুড়ো লীয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থে এ ধরনের কথাবার্তা লেখা আছে, যেখানে মানুষের লোভকে ব্যবহার করে এরকম সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠত। তাই বলে এই মহাকাশযানে?

বুড়ো লী খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ঘুরে আস, জায়গাটা তোমার ভাল লাগবে।

ভাল লাগবে? হ্যাঁ। বিচিত্র জিনিস মানুষের ভাল লাগে।

আমি ছোট ভাসমান গাড়িটি নিচে নামিয়ে আনলাম, কোথায় যেতে হবে কীভাবে যেতে হবে প্রোগ্রাম করা ছিল আমার নিজে থেকে কিছু করতে হয় নি। গাড়িটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আমি দরজা খুলে বাইরে আসতেই হঠাৎ উদ্দাম এক ধরনের সংগীতের শব্দ শুনতে পেলাম। কাছাকাছি কোথাও এক ধরনের আনন্দোৎসব হচ্ছে বলে মনে হয়।

আরো কিছুদূর হেঁটে যেতেই আমি অসংখ্য মানুষকে দেখতে পেলাম, বিশাল এলাকায় ছোট বড় নানা আকারের ঘর, ভেতরে বাইরে উজ্জ্বল আলো, তার মাঝে তারা ব্যস্ত সমস্ত ভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি সদ্য মিয়ারার আস্তানা থেকে পালিয়ে এসেছি, ভেতরে ভেতরে একধরনের ভয় রয়েছে কেউ বুঝি দেখে আমাকে চিনে ফেলবে, কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। মানুষের ভিড়ে আমি মিশে গেলাম–কেউ দ্বিতীয়বার আমার দিকে ঘুরে তাকাল না।

মহাকাশযানের এই মুক্তাঞ্চলে নানা ধরনের দোকান-পাট গড়ে উঠেছে। তার একটা বড় অংশ অন্ত্রের দোকান। বিশাল অতিকায় এবং বিচিত্র ধরনের অস্ত্র, বিভিন্ন মানুষজন শক্ত মুখে সেগুলি পরীক্ষা করে দেখছে। দেখে মনে হল মহাকাশযানে অস্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। সব অস্ত্রই যে ভয়ংকর তা নয়, কিছু অস্ত্র প্রায় হাস্যকর। একটি অস্ত্র দাবি করেছে ক্রোধকে ব্যবহার করে সেটি দিয়ে গুলি করা যায়। কপালের মাঝে লাগানো একটি নল, মাথায় একধরনের হেলমেট, ক্রোধের অনুভূতিকে অনুভব করে সেটা নলটি থেকে একটা বিস্ফোরক ছুড়ে দেয়!

অস্ত্রের দোকানপাটের কাছেই রয়েছে গাড়ি, ভাসমান যান এবং-বাই ভার্বালের দোকান পাট। আমি একটু অবাক হয়ে দেখলাম যানবাহনের ব্যাপারটাতে একটা নূতন মাত্রা যোগ হয়েছে, সেগুলি এখন শুধু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্যে তৈরি হয় নি। তার মাঝে নানা ধরনের অস্ত্র জুড়ে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় সেগুলিতে এখন অহেতুক সৌন্দর্য্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উজ্জল রং অপ্রয়োজনীয় নক্সা এবং নানাধরণের বিলাস সামগ্রী এগুলিতে গাদাগাদি করে রাখা আছে। এই মহাকাশযানটিতে যে একটি বিচিত্র ধরনের কালচার গড়ে উঠছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যানবাহনের দোকানে মানুষের ভিড় খুব বেশি নয়এগুলি মূল্যবান এবং মনে হয় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।

এর পাশেই সুন্দরী পুরুষ এবং রমণী বেচাকেনার জায়গা। স্বল্প কাপড় পরে তারা মোহনীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, এবং তাদের ঘিরে মানুষের ভিড়, আমি ভিড় ঠেলে একটু এগিয়ে গেলাম, একজন কমবয়সী সুন্দরী মেয়েকে কেনার জন্যে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ দরদাম করছে, যে কারণেই হোক মূল্য নিয়ে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। শুনতে পেলাম মধ্যবয়স্ক মানুষটি গলায় বিস্ময় ঢেলে বলল, কী বললে? দশ হাজার ইউনিট? এন্ড্রোমিডার কসম! এই দামে আমি একটা এটমিক ব্লাস্টার পেয়ে যাব!

মেয়েটির মালিক মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, তাহলে এটমিক ব্লাস্টারই কিছু কেন? নিওন বাতি জ্বালিয়ে সেটা কোলে নিয়ে বসে থাকো, সেটার সাথে মিষ্টি মিষ্টি ভালবাসার কথা বলো–

তার কথার ভঙ্গিতে উপস্থিত মানুষেরা হো হো করে হেসে দিল, মধ্যবয়স্ক মানুষটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আর আমি এত দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যদি দেখি এটা রবোট?

রবোট? মেয়েটার মালিক চোখ কপালে তুলে বলল, এই সুন্দরী মেয়েকে তোমার রবোট মনে হচ্ছে? চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ কী দুঃখি চোখ, দেখ চোখের পানি একেবারে খাঁটি অশ্রু–ভাল করে দেখ!

মধ্যবয়স্ক মানুষটি মেয়েটির চোখের পানি সত্যিকারের অশ্রু কি না দেখার জন্যে এগিয়ে গেল এবং আমার হঠাৎ করে কেন জানি ব্যাপারটিকে একটি অসহনীয় ধরনের অমানবিক ব্যাপার বলে মনে হতে থাকে। আমি ভিড় ঠেলে বের হয়ে এলাম। আমার কাছে যদি দশ হাজার ইউনিট থাকত আমি তাহলে মেয়েটিকে কিনে মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু আমার কাছে একটি কপর্দকও নেই, বুড়ো লী বলেছে আমার কোনো অর্থের প্রয়োজনও নেই।

আমি ভিড় ঠেলে বের হয়ে হাঁটতে থাকি, কাছাকাছি অনেকগুলি খাবার জায়গা। সুন্দর টেবিল ঘিরে পুরুষ এবং রমণীরা সুদৃশ্য খাবার খাচ্ছে, বাতাসে খাবার এবং পানীয়ের ঝাঁঝালো গন্ধ। আমি হঠাৎ করে এক ধরনের তীব্র খিদে অনুভব করতে থাকি। শীতল ঘরে ঢোকার আগে আমি শেষবার সত্যিকার অর্থে খেয়েছিলাম, শরীরে নানা ধরনের জৈবিক পদার্থ থাকায় আমি খিদেয় কাতর হচ্ছি না, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে না, কিন্তু খাবারের লোভটি আমাকে তাড়না করতে থাকে। আমি সরে এলাম। কাছেই আলোকজ্জ্বল একটি ঘরের সামনে অনেকগুলি ছোট ছোট টেবিল। সেখানে কিছু পুরুষ এবং মহিলা খুব মনোযোগ দিয়ে একটি মনিটরে কী যেন লিখছে। আমি একটু এগিয়ে গেলাম এবং ঠিক তখন একটা রবোট এগিয়ে এসে উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি কি বুদ্ধিমান? যদি সত্যি বুদ্ধিমান হয়ে থকেন তাহলে আমাদের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় অংশ নিন। যদি পঞ্চম স্তরে পৌঁছাতে পারেন আপনার পুরস্কার পাঁচ হাজার ইউনিট। ষষ্ঠ স্তরে দশ হাজার ইউনিট। আর যদি সপ্তম স্তরে পৌঁছাতে পারেন–রবোটটি তার গলায় একধরনের হাস্যকর উত্তেজনা ফুটিয়ে বলল, পঞ্চাশ হাজার ইউনিট! এক নয়, দুই নয়, দশ কিংবা বিশ নয়–পঞ্চাশ হাজার ইউনিট!

আমার কাছাকাছি যারা ছিল তাদের অনেকেই নিজেদের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করার জন্য এগিয়ে গেল। আমার বুড়ো লীয়ের কথা মনে পড়ল, সে আমাকে বলেছিল আমার কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। আমার যা প্রয়োজন নিজে থেকেই আমার কাছে চলে আসবে। সে হয়তো এর কথাটিই বলেছিল। আমার একটু লজ্জা লাগছিল তবুও সামনে এগিয়ে গেলাম।

মনিটরে নিজের কমিউনিকেশান্স মডিউলটি জুড়ে দেবার সাথে সাথেই সেখানে কিছু প্রশ্ন ভেসে আসে। সাধারণ যুক্তিতর্কের এবং সহজ গাণিতিক সমস্যা। প্রথম তিন চারটি স্তর খুব সহজেই সমাধান হয়ে গেল। পঞ্চম স্তরটি বেশ কঠিন। সমাধান বের করতে আমার বেশ সময় লেগে যায়। ষষ্ঠ স্তরে গিয়ে প্রথমবার আমার সন্দেহ হতে থাকে যে আমি হয়তো সমাধানটি বের করতে পারব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাধানটি বের হয়ে গেল। সপ্তম স্তরের সমস্যাটি মনিটরে এল খুব ধীরে ধীরে এবং আমি সেটিকে নিয়ে মগ্ন হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে মনে হল আমাকে কেউ একজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছে এবং আমি চোখ তুলে তাকাতেই সোনালি চুলের একটি মেয়ে হঠাৎ করে চোখ সরিয়ে নিল। আমি আবার সমস্যাটির দিকে তাকালাম এবং ঠিক তখন আমার পিছনে দাঁড়ানো একজন মানুষ নিচু গলায় বলল, এন্ড্রোমিড়ার দোহাই! তুমি সপ্তম স্তরে চলে এসেছ!

আমি কোনো কথা না বলে লোকটার দিকে তাকালাম। লোকটার চোখে-মুখে বিস্ময়! সে অবাক হয়ে বলল, নিনীষ স্কেলে তোমার বুদ্ধিমত্তা কত? ছয়ের কম নয়, তাই না?

আমি মনিটরের দিকে তাকালাম এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আমি মহাকাশযানের লোভী মানুষদের একটা ফাদে পা দিয়ে ফেলেছি। এই মহাকাশযানের এখন সুন্দরী মেয়েমানুষ বা সুদর্শন পুরুষ থেকেও মূল্যবান সামগ্রী হচ্ছে বুদ্ধিমান মানুষ। এই পরীক্ষাকেন্দ্রটি আসলে সেরকম বুদ্ধিমান মানুষদের খুঁজে বের করার একটা ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু নয়। আমি মনিটরটি টেবিলে রেখে উঠে দাড়ালাম, পিছনে দাঁড়ানো মানুষটি বলল, কী হল সমাধান করবে না?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না!

কেন?

মনে হয় কঠিন।

চেষ্টা করে দেখ, চেষ্টা না করলে তুমি কেমন করে জানবে? পঞ্চাশ হাজার ইউনিট পেয়ে যেতে পার!

আমি কমিউনিকেশান্স মডিউলে আমার পুরস্কারের দশ হাজার ইউনিট জমা করতে করতে বললাম, এত ইউনিট দিয়ে আমি কী করব?

লোকটা অবাক হয়ে বলল, কী বলছ তুমি! ইউনিট কত কাজে আসে। তুমি আর আমি মিলে একটা এজেন্সি খুলতে পারি। মহাকাশযানের কঠিন সব সমস্যার সমাধান করে দেব। তুমি দেখবে বুদ্ধি খাটানোর অংশ, আমি দেখব অর্থনৈতিক দিক। রাজি আছ?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না রাজি নই–তারপর লোকটাকে কোনো কথা না বলতে দিয়ে আমি বের হয়ে এলাম। খাবারের জায়গার পাশেই মানুষ বেচা-কেনার দোকান। আমি এখন ইচ্ছে করলে কমবয়সী সেই দুঃখী মেয়েটাকে কিনে ফেলতে পারি। তাকে বলতে পারি তুমি এখন স্বাধীন, তোমার যেখানে ইচ্ছে তুমি চলে যাও। কোন মধ্যবয়স্ক মানুষ চোখে লালসা নিয়ে আর তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে না।

কালো চুলের সুন্দরী মেয়েটাকে ঘিরে যেখানে মানুষের ভিড় ছিল জায়গাটা এখন ফাঁকা। মোটা মতো একজন মানুষ দেয়ালে হেলান দিয়ে চৌকোনা একটা পাত্র থেকে এক ধরনের পানীয় খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখানে একটা মেয়ে বিক্রি হচ্ছিল, কালো চুলের, দুঃখী মতোন চেহারা

সোমারিয়া! বিক্রি হয়ে গেছে।

বিক্রি হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। ভাল দাম পেয়েছে, নয় হাজার ইউনিট। খাঁটি মেয়ে মানুষ ছিল, কোনো ভেজাল নেই।

আমি শুকনো গলায় আবার বললাম, বিক্রি হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। তোমার দরকার কোনো মেয়ে মানুষ? আমার হাতে আছে একটা। আশি ভাগ খাঁটি। যকৃত আর কিডনিগুলি কৃত্রিম–এ ছাড়া সব খাটি। রুপালি চুল নীল চোখ। ধবধবে সাদা চামড়া—

আমি হেঁটে বের হয়ে এলাম, হঠাৎ কেন জানি আমার ভিতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

 

আমি পুরো এলাকাটি ঘুরে বেড়াতে থাকি। বিচিত্র সব দোকানপাট, বিচিত্র ধরনের মানুষ, তারা তাদের থেকেও বিচিত্র সব কাজকর্ম করছে। ভালবাসা ঘৃণা লোভকে পুঁজি করে এখানে এখানে তাদের ব্যবসা চলছে। আমি খাবারের এলাকাটা হেঁটে এলাম, এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। অস্ত্রশস্ত্রের দোকান রয়েছে। মানুষ যে কী পরিমাণ অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারে এখানে এলে সেটা বোঝা যায়। ঘুরতে ঘুরতে আমিও একটা জিনিস কিনলাম পাঁচশ ইউনিট দিয়ে। জিনিসটা বিক্রি করছিল একজন বুড়ো মতোন মানুষ। সে সেটার নাম দিয়েছে মন মেশিন। সেটা দিয়ে নাকি একজন মানুষ তার মানসিক শক্তি দিয়ে অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কেমন করে কাজ করে?

বুড়ো মতন মানুষটি বলল, বলা যাবে না।

কেন?

ব্যবসার কারণে।

আমি হতচকিতের মতো মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কী দ্রুত এই মহাকাশযানের সব মানুষকে লোভ শিখিয়ে দেয় হয়েছে। আমি মন মেশিনটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কাজ করে তার কী প্রমাণ আছে?

তুমি হেলমেটটা মাথায় পর আমি দেখাচ্ছি, প্রমান করে দিচ্ছি।

আমি হেলমেটটা মাথায় পরতে গিয়ে থেমে গেলাম, হেলমেটে মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ প্রবাহের সংকেত ধরার ছোট ছোট মডিউল দেখা যাচ্ছে এবং সেটা কী ভাবে কাজ করে হঠাৎ করে আমি বুঝে গেলাম। আমি হাসি গোপন করে বললাম, এটার নাম মন মেশিন দেয়া ঠিক হয় নি।

বুড়ো মানুষটি ভুরু কুচকে বলল, কেন একথা বলছ?

আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ তরঙ্গ থেকে এক ধরনের সংকেত বের করে ট্রান্সমিটারে দিয়ে অন্যত্র পাঠাচ্ছ! মনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

বুড়ো মানুষটির চোয়াল ঝুলে পড়ল, সে আমতা আমতা করে বলল, তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে?

আমি হেলমেটটা দেখিয়ে বললাম, ভিতরে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারবে।

না, বুড়ো মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, পারবে না। কেউ পারে নি। তুমি কাউকে বলে দিও না, আমি তোমাকে অর্ধেক দামে দিচ্ছি।

আমি অর্ধেক দাম দিয়ে মন মেশিন কিনে নিয়ে বের হয়ে এলাম। দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্রের কাছাকাছি জৈবিক জিনিসপত্রের দোকন। ভেতরে ঢুকে আমার গা গুলিয়ে গেল কিন্তু আমি আবার বের হয়েও আসতে পারলাম না। বিচিত্র একটা কৌতূহল নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখি। মানুষের হৃদপিণ্ড, কিডনি, ফুসফুস এবং যকৃত বিক্রয় হচ্ছে। জীর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাল্টে নেয়ার জন্যে কাছেই অপারেশান থিয়েটার খোলা হয়েছে। মানুষজন দরদাম করে পছন্দসই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেছে নিয়ে সেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যাচ্ছে। এ ধরনের ব্যাপার যে ঘটতে পারে নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না।

এর কাছাকাছি রয়েছে জীবাণুর দোকান। সম্ভাব্য সবধরনের জীবাণু সেখানে পাওয়া যায়। কিটুনিয়া ভাইরাস নামের এক ধরনের ভাইরাসের ছোট ক্যাপসুল দেখতে পেলাম, সেগুলি এত ছোট যে খালি চোখে দেখা যায় না। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে এটাকে ফেটে যাবার জন্যে প্রোগ্রাম করা যায় তারপর কারো শরীরে ঢুকিয়ে দিলে সেটি তার মস্তিষ্কে এসে নির্দিষ্ট সময়ে ফেটে গিয়ে মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন সেল ধ্বংস করে দেয়। দুই হাজার ইউনিট করে দাম। কী কাজে লাগবে আমি জানি, না। তবু কেন জানি একটা কিটুনিয়া ভাইরাসের ক্যাপসুল কিনে নিলাম। মহাকাশযানে যেরকম পরিস্থিতি হয়তো কখনো নিজের জন্যে মৃত্যু বেছে নিতে হবে!

বুড়ো লী বলেছিল এখানে এলে আমার ভাল লাগবে, কিন্তু আমার ভাল লাগছে না। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম এই মুক্ত এলাকায় এসে আমি বরং আশ্চর্য ধরনের এক দূষিত বিষণ্ণতায় ভুগতে শুরু করেছি।

 

আধো অন্ধকারে একটা জটলা থেকে বের হবার সময় হঠাৎ আমার কনুইয়ে কে যেন স্পর্শ করল, আমি সেখানে একটু তীক্ষ্ণ জ্বালা অনুভব করলাম, মুখ ঘুরিয়ে দেখি সোনালি চুলের সেই মেয়েটি, আমার চোখে চোখ পড়তেই সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল। আমি কনুইটি লক্ষ করলাম, সেখানে কিছু নেই, মেয়েটি কি আমাকে কিছু বলতে চাইছে? আমাকে কিছু করতে চাইছে?

আমি খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে তথ্য বিনিময় কেন্দ্রটি আবিষ্কার করলাম। বাইরে বড় বড় করে লেখা, “নামমাত্র মূল্যে মহাকাশযানের সর্বশেষ তথ্য।” বুড়ো লী নিশ্চয়ই এই জায়গাটার কথা বলেছিল, আমি এক নজর দেখে ভেতরে ঢুকে গেলাম এবং সাথে সাথে আমার দিকে একজন মানুষ এগিয়ে এল। মানুষটি সুপুরুষ এবং সে বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন, আমার দিকে ভদ্রতার হাসি হেসে বলল, তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

আমি এই মহাকাশযানের সর্বশেষ তথ্য জানতে এসেছি।

সুদর্শন মানুষটির মুখে সহৃদয় একটা হাসি ফুটে উঠল, সে নিচু গলায় বলল, খুব বড় একটা তথ্য এসেছে, জানতে চাও?

কী তথ্য?

তুমি সেটা শুনতে চাইলে আমার জানা প্রয়োজন তুমি তার জন্যে কত ইউনিট খরচ করতে চাও।

আমি ইতস্ততঃ করে বললাম, তথ্যের জন্যে যে অর্থ ব্যয় করতে হয় আমি সেটাও জানতাম না। আমার ধারণা ছিল তথ্য জানতে পারা হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার।

মানুষটা ষড়যন্ত্রীদের মতো মাথা এগিয়ে এনে বলল, বেঁচে থাকাও মানুষের জন্মগত অধিকার, এই মহাকাশযানে মানুষজন কীভাবে মারা পড়ছে তুমি জান?

আমি ভাল জানতাম না, জানার কোনো কৌতূহলও অনুভব করলাম না। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমার কাছে সাড়ে সাত হাজার ইউনিটের মতো রয়েছে। কী ধরনের তথ্য পাওয়া যাবে?

মানুষটা জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, সাড়ে সাত হাজার ইউনিট অনেক অর্থ হতে পারে–মোটামুটি সুন্দরী একটা মেয়েমানুষ কিনে ফেলা যায় কিন্তু তথ্যের জন্যে এটা খুব বেশি নয়। কিন্তু তোমাকে আমি বড় তথ্যটা এর বিনিময়েই দিয়ে দেব। তার আগে তোমাকে কিছু অঙ্গীকার করতে হবে। তথ্যটা কাউকে বলবে না, যদি বল তোমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এই সব রুটিন ব্যাপার।

বেশ। কী করতে হবে বল।

আমাকে বেশ সময় নিয়ে নানা ধরনের অঙ্গীকার করতে হল সেসব অঙ্গীকারপত্র কমিউনিকেশান্স মডিউল দিয়ে নিশ্চিত করতে হল এবং তখন সুদর্শন মানুষটি আমার হাতে ছোট একটা ক্রিস্টাল ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও এই সব তথ্য এখন তোমার।

আমি ক্রিস্টালটি আমার কমিউনিকেশান্স বক্সে লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করলাম, তথ্যটি কীসের উপর?

মানুষটি ঝুকে পড়ে বলল, মিয়ারার আস্তানায় নিনীষ স্কেলে আটমাত্রার একজন মানুষ এসেছিল, নাম কিহা। সে এবং লেন নামে আরো একটি মেয়ে মূল তথ্যকেন্দ্রের জন্যে আলাদা করে রাখা আটজন মানুষকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।

আমি হতচকিতের মতো মানুষটির দিকে তাকালাম, মানুষটি আমার দৃষ্টি দেখে ভাবল আমি তার কথা বিশ্বাস করছি না। সে গলায় জোর দিয়ে বলল, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না, সব তথ্য আছে এই ক্রিস্টালে। আমি নিজে দেখেছি।

আমি খানিকক্ষন চেষ্টা করে বললাম, আর কোনো তথ্য আছে?

আর কী চাও তুমি? গত দশ বছরে এরকম তথ্য বের হয় নি। ছয় মাত্রার গোপন খবর এটা। কিহা নামের মানুষটার ছবিও আছে এখানে।

সুদর্শন মানুষটি হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, মজার ব্যাপার জান–তোমার সাথে কিহার চেহারার অনেক মিল।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ক্রিস্টালটা দাও আমি দেখাচ্ছি।

থাক, আমি নিজেই দেখে নেব।

লোকটাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি বের হয়ে এলাম। আমার খবর এখানে আট দশ হাজার ইউনিটে বিক্রি হচ্ছে? কী সর্বনাশা কথা!

ঘর থেকে বের হতেই দেখতে পেলাম সোনালি চুলের সেই মেয়েটি সামনে থেকে সরে গেল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, আমার পরিচয় নিশ্চয়ই এখানকার কিছু মানুষ কিংবা রবোটের কাছে গোপন নেই। তারা এখন কী করবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

সোনালি চুলের মেয়েটি যেই হয়ে থাকুক আর তার দলে যত মানুষই থাকুক তারা আমাকে কিছু করল না। আমি আমার ছোট ভাসমানযানে করে উড়ে উড়ে অসংখ্য জটিল গলি ঘুচি দিয়ে বুড়ো লীয়ের আস্তানায় ফিরে এলাম। ভাসমান যানটি দেখতে সাদামাটা হলেও তার মাঝে নানারকম যন্ত্রপাতি রয়েছে, কেউ পিছু নিলে সেটি বুঝতে পারে এবং যেভাবেই হোক তাকে খসিয়ে দেয়। কেউ আমার পিছু নেয়নি, এবং নিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত আসতে পারেনি।

ডকিং স্টেশনে ভাসমান যানটি রেখে আমি ভেসে ভেসে দরজার কাছে পৌঁছালাম। বুড়ো লী ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করল, কেমন সময় কেটেছে কিহা?

ভাল।

ভেতরে আস।

আমি ভেতরে আসার আগে নিজেকে ভাল করে পরীক্ষা করতে চাই। আমার মনে হচ্ছে আমার শরীরে কিছু একটা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে।

বুড়ো লী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল তারপর বলল, যদি সত্যি তাই হয়ে থাকে আমার কিছু করার নেই কিহা। আমি তোমার শরীর থেকে সেটা বের করতে পারব না। আমার যন্ত্রপাতি দশ বৎসরের পুরানো! তুমি ভেতরে এস, তোমার মুখে শুনি কী হয়েছে।

আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। তখনো জানতাম না সেই মুহূর্তে বুড়ো লীয়ের মৃত্যুদণ্ডাদেশ স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে।

 ৬. বুড়ো লী যদিও খুব আগ্রহ নিয়ে

বুড়ো লী যদিও খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মুখ থেকে কথা শুনবে বলে আমাকে ডেকে আনল কিন্তু আমি যখন বলতে শুরু করলাম সে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে বলে মনে হল না। মাঝে মাঝেই সে অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগল,এবং তার প্রশ্নগুলি হল অনাবশ্যক এবং সংগতিহীন। যখন ক্রিস্টালটি কমিউনিকেশান্স মডিউলে দিয়ে দেখানো হল, সে আধাবোজা চোখে পুরোটা দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সময় হয়ে গেছে।

লেন জিজ্ঞেস করল, কীসের সময়?

যার জন্যে এই প্রস্তুতি।

কীসের প্রস্তুতি?

এই যে মহাকাশযানটিতে সবাইকে ঘুম থেকে তুলে আনা হচ্ছে, নিজেদের ভেতরে হানাহানি তৈরি করা হচ্ছে তার একটা কারণ আছে। সেটা কী আমি বলতে পারব না, তোমাদের নিজেদের ভেবে বের করতে হবে। তবে–

তবে কী?

তোমরা যে আটটা শিশুকে নিয়ে এসেছ সেটি মহাকাশযানের সব হিসেবকে গোলমাল করে দিয়েছে। কাজেই এই মহাকাশযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তোমরা জড়িয়ে গেছ। তোমরা চাও কি নাই চাও তোমাদের এখন পেছানোর উপায় নেই।

লেন ভয় পাওয়া গলায় বলল, তার মানে কী? কী হবে এখন?

আমি জানি না কী হবে। কিন্তু কিছু একটা হবে। বুড়ো লী খানিকক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, তুমি মুক্ত এলাকা থেকে যে ক্রিস্টালটা এনেছ সেখানে তোমাদের পালানোর খবরটা আছে। পুরোটুকু নেই কারণ পুরোটুকু কেউ জানে না। তোমরা যে আটজনকে নিয়ে পালিয়ে এসেছ তারা যে শিশু সেটাও সবাই জানে না।

আমি মাথা নাড়ালাম, না জানে না।

ক্রিস্টালে আরো কিছু ছোট ছোট তথ্য আছে তার মাঝে তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনটি মনে হয়েছে কি?

আমি বুড়ো লীয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার কাছে?

হ্যাঁ।

আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে মিয়ারা সম্পর্কে তথ্যটি। মিয়ারাকে গত আঠারো ঘণ্টা কেউ দেখে নি।

বুড়ো লী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, খুব ধীরে ধীরে তার মুখে হাসি ফুটে উঠতে থাকে। তার কুঞ্চিত মুখে হাসিটি হঠাৎ কেমন জানি বিচিত্র দেখায়। লেন অবাক হয়ে একবার আমার দিকে আরেকবার বুড়ো লীয়ের দিকে তাকাল তারপর একটু অধৈৰ্য্য গলায় বলল,আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কেন মিয়ারাকে দেখা যাচ্ছে না?

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, যারা মিয়ারাদের তৈরি করেছে তারা মিয়ারাকে নিয়ে গেছে। আমার মনে হয় শুধু মিয়ারা নয়, মহাকাশযানের অন্য নেতাদেরকেও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বুড়ো লী মাথা নেড়ে বলল, তোমার ধারনা সত্যি কিহা। আমি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে চোখ রেখেছি, গত বারো ঘণ্টায় নেতাদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

লেন ভয় পাওয়া গলায় বলল, কেন দেখা যাচ্ছে না? তারা কোথায়?

বুড়ো লী পূর্ণ দৃষ্টিতে লেনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ধারণা যদি ভুল না হয় তাহলে তোমরাও সেখানে যাবে।

আমরা?

হ্যাঁ লেন। শিশুগুলিকে প্রয়োজন। যেহেতু তোমরা শিশুগুলিকে নিয়ে পালিয়ে এসেছ তোমাদেরও শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। প্রতিহিংসা সৃষ্টিজগতের প্রাচীনতম অনুভূতি।

আমি দেখতে পেলাম লেন হঠাৎ করে শিউরে উঠল। বুড়ো লী নরম গলায় বলল, তোমাদের হাতে সময় বেশি নেই কিহা। তোমরা কী করবে ঠিক করে নাও।

আমি বুড়ো লীয়ের দিকে তাকালাম। লেন জিজ্ঞেস করল, তুমি তোমাদের হাতে সময় নেই কেন বলছ? আমাদের হাতে সময় নেই কেন বললে না?

বুড়ো লী জোর করে একটু হেসে বলল, আমার গলার স্বরটা একটু ভারি হয়েছে লক্ষ করেছ?

লেন মাথা নাড়ল, না, করি নি।

আরেকটু পর আরো ভারি হবে। আমাকে একটা ভাইরাস আক্রমণ করেছে, কয়েকঘন্টার মাঝে ভোকালকর্ডে সাময়িক একটা ইনফেকশান হয়, গলার স্বরটা ভারি হয়ে যায়। আবার নিজে থেকে কয়েকঘন্টার মাঝে সেরে যায়। তোমাদেরও নিশ্চয়ই হবে। খুব ছোঁয়াচে।

লেন বিভ্রান্ত মুখে বলল, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।

ভাইরাসটি অত্যন্ত নিরীহ ভাইরাস, কয়েকঘণ্টার জন্যে গলার স্বরটা একটু ভারি করা ছাড়া আর কিছুই করে না। কিহা এই ভাইরাসটি সাথে করে এনেছে। ইচ্ছে করে আনে নি, তার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে

সোনালী চুলের মেয়েটা? কনুইয়ে যে জ্বালা করে উঠল?

হ্যাঁ। সম্ভবতঃ তখনই। এটা পাঠানো হয়েছে আমাকে উদ্দেশ্য করে। কয়েকঘন্টার জন্যে আমার গলার স্বরটা একটু পরিবর্তন করতে চায়। কেন জান?

লেন ফ্যাকাসে মুখে বুড়ো লীয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, না, জানি না।

আমি নিচু গলায় বললাম, আমি জানি।

কেন?

তোমাকে এর আগে কেউ স্পর্শ করে নি। কারণ শক্তিকেন্দ্রের পারপাশে তুমি বিস্ফোরক লাগিয়ে রেখেছ। তুমি সেটা ইচ্ছে করলে তোমার গলার স্বর দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারবে। কয়েকঘণ্টার জন্যে তোমার গলার স্বর এখন পাল্টে যাচ্ছে। এই সময়টাতে তুমি ইচ্ছে করলেও কিছু করতে পারবে না।

বুড়ো লী মাথা নাড়ল, চমক্কার। আমি মোটামুটিভাবে বিশ্বাস করে ফেলেছি যে তুমি নিনীষ স্কেলে অষ্টম মাত্রার বুদ্ধিমান। এখন কী হবে বলে মনে হয়?

আমি বুড়ো লীয়ের চোখের দিকে তাকালাম, সেখানে কোনো ভীতি বা আতংক নেই। শান্ত চোখে হয়তো সূক্ষ্ম এক ধরনের কৌতুক। আমি সেই শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, যে কয়েকঘণ্টা তোমার গলার স্বর অন্যরকম থাকবে তার মাঝে কেউ এসে তোমাকে হত্যা করবে।

লেন শিউরে উঠে বলল, কেন? হত্যা করবে কেন?

আমি ত্রিশ বছর থেকে ভরশূন্য ঘরে ভেসে আছি, আমার শরীরের সমস্ত মাংসপেশী অচল হয়ে গেছে। আমাকে এর বাইরে নেয়া সম্ভব না। আমি সেখানে বাঁচব না, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মারা যাব। তা ছাড়া

তা ছাড়া কী?

মহাকাশযানের প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে আমি বড় অপরাধ করেছি। আমাকে শাস্তি দিতে হবে। প্রতিহিংসা বড় মধুর অনুভূতি।

লেন কোনো কথা বলল না, স্থির দৃষ্টিতে বুড়ো লীয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বুড়ো লী চোখ নামিয়ে বলল, আমার গলা স্বর আরো ভারি হয়ে আসছে। তোমাদের হাতে সময় বেশি নেই কিহা এবং লেন।

আমি বুড়ো লীয়ের দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তোমার রবোটটাকে আমার দরকার। আমি মন মেশিন নামের একটা জিনিস কিনে এনেছি সেটা ব্যবহার করে একটা অস্ত্র তৈরি করতে চাই।

কী রকম অস্ত্র?

আমি কিছু একটা ভাবব আর সেই ভাবনার সাথে সাথে একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। কিছু বিস্ফোরক দরকার খুব ছোট আকারের। তার সাথে থাকবে ডেটনেটর। মন মেশিনের ট্রান্সমিটারটা থাকবে আমার মাথায়, হেলমেট থেকে খুলে সোজাসুজি সেটা আমার করোটিতে বসিয়ে নিতে চাই, সহজে যেন ধরা না পড়ে।

বিস্ফোরকগুলি তুমি কোথায় লাগাতে চাও?

আমি একটু ইতস্তুত করে বললাম, বাচ্চাগুলির হৃদপিণ্ডে।

লেন চমকে উঠে আমাকে আকড়ে ধরল, ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী বলছ তুমি?

আমি মাথা নাড়লাম, ঠিকই বলছি।

বুড়ো লী হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার তাহলে একটা পরিকল্পনা আছে!

না। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমার সত্যিকার অর্থে কোনো পরিকল্পনা নেই। এটা এক ধরনের সাবধানতা।

লেন আর্ত স্বরে বলল, না, না–এটা হতে পারে না বাচ্চাগুলির হৃদপিণ্ডে আমি তোমাকে কিছু করতে দেব না–

বুড়ো লী সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, লেন, তোমার এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমার কাছে চোখে দেখা যায় না এরকম ছোট বিস্ফোরক রয়েছে, সিরিঞ্জে দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া যাবে, বাচ্চাগুলির হৃদপিণ্ডে কিছু করা হবে না।

তাই বলে শরীরের মাঝে বিস্ফোরক?

আমি লেনের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, বাচ্চাগুলিকে ধ্বংস করার জন্যে আমি তাদের হৃদপিন্ডে বিস্ফোরক লাগাচ্ছি না, লাগাচ্ছি তাদের বাঁচানোর জন্যে। পুরো ব্যাপারটা তুমি শুনলেই বুঝতে পারবে। এস আমার সাথে আমি তোমাকে বলি।

 

বুড়ো লীয়ের রবোটটা দেখতে অত্যন্ত কদাকার হলেও কাজকর্মে খুব চৌকস। আমি কী করতে চাই ব্যাপারটা জেনে নেবার পর সে কাজে লেগে গেল। মন মেশিনের ট্রান্সমিটারটা নিয়ে খানিকটা কাজ করতে হল। আমার মস্তিষ্কের দু-ধরনের তরঙ্গের সাথে সেটাকে টিউন করা হল। যখনই আমি একটি বিশেষ পদ্ধতিতে মিথ্যা কথা বলব প্রথম শ্রেণীর বিস্ফোরকগুলি বিস্ফোরিত হবে। দ্বিতীয় শ্রেণীর বিস্ফোরকগুলি বিস্ফোরিত হবে যখন আমি বিশাল দুটো প্রাইম সংখ্যাকে মনে মনে গুণ করার চেষ্টা করব তখন। প্রথম শ্রেণীর বিস্ফোরকগুলি রাখা হল খাবারের ক্যাপসুল, তথ্য ক্রিস্টাল কমিউনিকেশান্স মডিউল এ ধরনের আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারী জিনিসের মাঝে। দ্বিতীয় ধরনের বিস্ফোরকগুলি অত্যন্ত ছোট সিরিঞ্জ দিয়ে ছটফটে আটটি শিশুর শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। মন মেশিনের ট্রান্সমিটারটির আকার ছোট করে নিয়ে আসা হল এবং বুড়ো লীয়ের রবোট আমার করোটির উপরে সেটা অস্ত্রোপাচার করে বসিয়ে দিল। সবশেষে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক দিয়ে আমার ক্ষত নিরাময় করে দেয়া হল, মাথার ভেতরে একটা ভোতা যন্ত্রণা ছাড়া আর কোথাও তার কোনো প্রমাণ রইল না।

সমস্ত কাজ শেষ করে বুড়ো লীয়ের ঘরে ফিরে এসে দেখি সে তার ঘরে একটা ছোট ভোজ সভায় আয়োজন করেছ। কিছু বিশেষ খাবার এবং বিশেষ পানীয় তার আশে পাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কাজ শেষ।

যা। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমার এখন খুব সাবধানে কথা বলতে হবে। যখনই আমি একটা মিথ্যা কথা বলব ঠিক তখনই আমাদের সাথে রাখা কোনো একটি টাইমার চালু হয়ে যাবে। ঠিক দুই সেকেন্ডের মাঝে যদি দ্বিতীয় একটা মিথ্যা কথা বলি তাহলে ফুড ক্যাপসুলের বিস্ফোরকটি বিস্ফোরিত হবে। যদি তিন সেকেন্ডের মাঝে তৃতীয় একটা মিথ্যা কথা বলি তাহলে তথ্য ক্রিস্টালে, চার সেকেন্ডের মাঝে হলে কমিউনিকেশান্স মডিউলে।

বুড়ো লী খিক খিক করে হেসে বলল, শেষ পর্যন্ত জোর করে নিজেকে সত্যবাদী তৈরি করে নিলে?

হ্যাঁ। অনেকটা সেরকম।

বুড়ো লী ভাসমান খাবার এবং পানীয়ের বোতলগুলি নিজের কাছে ধরে রাখতে রাখতে বলল, এসো, আমাদের বিদায়ের সময়টা স্মরণীয় করে রাখা যাক, অনেকদিন থেকে এই খাবারগুলি বাঁচিয়ে রেখেছি বিশেষ কোনো মুহূর্তের জন্যে।

আমি এবং লেন কোনো কথা বললাম না। লী সাবধানে বোতলের মুখ খুলে এক ঢোক পানীয় খেয়ে কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন আমরা ডকিং স্টেশনে এক ধরনের গুম গুম শব্দ শুনতে পেলাম। বুড়ো লী মুখ মুছে অস্পষ্ট স্বরে বলল, ওরা এসে গেছে।

ঘরটির একপাশে চতুষ্কোন হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটি নিজে নিজে চালু হয়ে গেল এবং আমরা দেখতে পেলাম একটি ভাসমান যান স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ভেতর থেকে দশটি নানা আকারের রবোট বের হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটি রবোটের পায়ের নিচে থেকে এক ধরনের জেট বের হচ্ছে, ভরশূন্য পরিবেশে স্বচ্ছন্দে চলাচল করার জন্যে এই রবোটগুলি পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে এসেছে। বাই ভার্বালের সবচেয়ে শেষ আরোহী সোনালি চুলের একটি মেয়ে। তার পিঠে একটি জেট প্যাক বাধা, হাতে ভয়ংকর দর্শন একটি অস্ত্র।

বুড়ো লী হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিহা

বল।

রোবট আর মানুষের এই দলটি এখানে প্রবেশ করার আগে তোমাদের একটা কখা বলতে চাই।

কী কথা?

বহুঁ বহুকাল আগে পৃথিবীতে বঙ্গোপসাগরের উপকুলে এক বুদ্ধিমান জাতি দাবা নামে একটা খেলা আবিষ্কার করেছিল। দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্রে আটটি করে মোট চৌষট্টি ঘরের দুকে ষোলটি সাদা এবং মোলটি কাল গুটি নিয়ে খেলা হত। সেই খেলায়

আমি জানি। আমি সেই খেলা খেলেছি।

চমৎকার। বহুঁ প্রাচীন কালে হিসাব নিকাশ করার জন্যে কম্পিউটার নামক একটা যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছিল, মানুষ সেই কম্পিউটারে দাবা খেলা শুরু করেছিল। এখনো তথ্য প্রক্রিয়ার যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে সেখানেও দাবা খেলা হয়। এই সব যন্ত্রপাতি মানুষ থেকে হাজারগুণ কী লক্ষগুণ বেশি দক্ষতা নিয়ে দাবা। খেলতে পারে। তোমার কী মনে হয় এইসব যন্ত্রপাতিক দাবা খেলায় হারানো সম্ভব?

সম্ভব।

অমির উওর গুনে বুড়ো লী আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কেমন করে তুমি জান?

আমি জানি, কারণ আমি এই ধরনের যন্ত্রপাতিকে দাবা খেলায় হারিয়েছি। কী ভাবে হারিয়েছ?

এই সব যন্ত্রপাতি কখনো ভুল করে না। সেটাই হচ্ছে তাদের দুর্বলতা। আমি এই দুর্বলতা ব্যবহার করে তাদের খেলায় হারিয়েছি।

বুড়ো লী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, তার চোখে একটা কৌতুকের ছায়া পড়ল। সে হাত বাড়িয়ে আমার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি পৃথিবীর নামে তোমাকে আশীর্বাদ করছি, তুমী জয়ী হও।

কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ গোলাকার দরজা খুলে গেল এবং ঘরে প্রথমে সোনালি চুলের মেয়েটি এবং তার পাশাপাশি অনেকগুলি রবোট এসে ঢুকল। ভরশূন্য পরিবেশে আমরা ওলট পালট খাচ্ছিলাম। কিন্তু যারা এসে ঢুকল তারা সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোনালী চুলের মেয়েটি তার হাতের ভয়ংকর দর্শন অস্ত্রটি উঁচু করে ধরে বলল, বুড়ো লী, মহাকাশযানের কেন্দ্রস্থলে শক্তি কেন্দ্রে বিস্ফোরক বসানোর জন্যে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

বুড়ো লী ক্লান্ত, স্বরে বলল, কথা বলে সময় নষ্ট করো না সোনালি চুলের রবোট।

আমি রবোট নই। আমি মানুষ। আমার নাম ইফা।

ইফা, তুমি জান না যে তুমি রবোট। তোমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে নিজেকে মানুষ বলে ভাবার জন্যে।

মিথ্যা কথা।

বেশ। আমি তোমার সাথে তর্ক করতে চাই না। তুমি গুলি কর। কিহ এবং লেন তোমরা চোখ বন্ধ কর। প্রতিহিংসামূলক হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত ভয়ংকর ব্যাপার।

লেন একটা আর্ত চিৎকার করে আমাকে জাপটে ধরল এবং সোনালি চুলের মেয়েটি ঠিক সেই সময় বুড়ো লীকে গুলি করল, আমি দেখতে পেলাম বুড়ো লীয়ের দেহ চোখের পলকে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। হত্যা করার কত রকম পদ্ধতি থাকার পরেও কেন এখনো মানুষকে এরকম প্রতিহিংসা নিয়ে ভয়ংকর ভাবে হত্যা করা হয় কে জানে। সোনালি চুলের মেয়েটি এবারে অস্ত্রটি আমার এবং লেনের দিকে তাক করল। আমার ভয় পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমি ভয় পেলাম না, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখন কী চাও?

মূল তথ্যকেন্দ্রের আটজন মানুষ কোথায়?

পাশের ঘরে।

ইফা নামের সোনালি চুলের মেয়েটি ইঙ্গিত করতেই চারটি রবোট তাদের স্বয়ংক্রিয় জেট চালিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই পাশের ঘরে শিশুগুলির চিঙ্কার এবং নানা কণ্ঠের প্রতিবাদ শুনতে পেলাম। লেন এতক্ষণ আমার বুকে মুখ গুজে রেখেছিল, এবার ভয় পাওয়া গলায় বলল, বাচ্চাগুলিকে কী করবে?

আমি জানি না।

লেন ইফার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি জান মূল তথ্যকেন্দ্রের আটজন মানুষ আসলে শিশু?

শিশু?

হ্যাঁ। তাদের সামলানো খুব সহজ নয়। তারা আমার কথা শোনে। তুমি রোটগুলিকে ওদের স্পর্শ করতে নিষেধ কর, আমি তাদের নিয়ে আসছি।

ইফা এক মুহূর্তে কী একটা ভেবে বলল, ঠিক আছে যাও।

লেন ভেসে ভেসে পাশের ঘরে চলে গেল। আমি ইফার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমি তোমাকে মুক্ত এলাকায় দেখেছিলাম, তখন তুমি আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছিলে–এখন অনেক সাহস দেখাচ্ছ, কারণটা কী?

ইফা কোনো কথা না বলে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি নিচু গলায় বললাম, মানুষ ইচ্ছে করলে নিয়ম তৈরি করতে পারে আবার নিয়ম ভাঙতে পারে। রবোটেরা পারে না। তাদেরকে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয় ঠিক সেভাবে চলতে হয়। তোমাকে নিশ্চয়ই এখন সাহসী এবং নিষ্ঠুর হওয়ার জন্যে প্রোগ্রাম করা। হয়েছে।

ইফা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি রবোট নই। আমাকে কেউ প্রোগ্রাম করে নি।

তুমি হয়তো রবোট নও, কিন্তু তোমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে ইফা। একজন। রবোটকে প্রোগ্রাম করা সহজ কিন্তু মানুষকে প্রোগ্রাম করা এত সহজ নয়। কিন্তু একবার যদি মানুষকে প্রোগ্রাম করা হয় সেখান থেকে তার কোনো মুক্তি নেই।

ইফা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ফিসফিস করে বললাম, তোমার জন্যে আমার করুণা হয় ইফা। অসম্ভব করুণা হয়।

ঠিক এরকম সময় বাইরে থেকে অনেকগুলি রবোট ভেতরে এসে হাজির হল, তাদের একজন মাথা নিচু করে বলল, মহামান্যা ইফা আমরা শক্তিকেন্দ্র পরীক্ষা করে এসেছি। সেখানে কোনো বিস্ফোরক নেই।

বিস্ফোরক নেই?

না।

আমি ইফার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি সম্পূর্ণ বিনা কারণে বুড়ো লীকে হত্যা করেছ।

বিস্ফোরক রাখা আর বিস্ফোরক রাখার কথা বলা সমান অপরাধ। বুড়ো লী তার কাজের যথাযযাগ্য শাস্তি পেয়েছে।

তোমার ভিতরে কী কোনো অপরাধবোধ জন্ম নিয়েছে ইফা?

অপরাধবোধ?

কেন?

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একজন রবোট। নিশ্চয়ই রবোট।

ইফা ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, না, আমি রবোট নই। আমি মানুষ। মানুষ। মানুষ।

আমি বুড়ো লীয়ের ছিন্নভিন্ন দেহের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তুমি মানুষ নও। আমি প্রার্থনা করি তুমি মানুষ হও।

বাই-ভার্বালটি নিঃশব্দে মহাকাশযানের মাঝে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। প্রথমে জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ হল আর দেখা যাচ্ছে না। জানালাগুলি অন্ধকার করে দিয়ে বাইরের সাথে আমাদের যোগাযোগ কেটে দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তার বাধাধরা নিয়ম কানুন, কিছু করার নেই, কিন্তু আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। আমি সাধারণ মানুষ, আমার সাধারণ দায়িত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যচক্রে আমি এক বিশাল ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছি। এর থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসব তার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। এখন যে ঘটনাগুলি ঘটছে সেটাই হবে আমার জীবনের শেষ ঘটনাগুলি। এগুলি একটু মধুর হতে পারত কিন্তু হয় নি। বুড়ো লীয়ের হত্যাকাণ্ড নিজের চোখে দেখেছি। আটটি ফুটফুটে শিশুর হত্যাকাণ্ড দেখতে হবে, আমার আর লেনের কথা তো ছেড়েই দিলাম। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, জোর করে মাথা থেকে সবকিছু সরিয়ে দিলাম, এখন সুন্দর একটা কিছু ভাবতে হবে, মিষ্টি একটা কিছু ভাবতে হবে যেটি আমার বিক্ষিপ্ত মনটিকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও শান্ত করে দিতে পারে। কী হতে পারে সেই জিনিস? আমার শৈশব? ফেলে আসা গ্রহটির বিশাল প্রান্তর? স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আকাশ? একটু পর আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম যে আমি লেনের কথা ভাবছি।

আমি চোখ খুলে তাকালাম, সামনের সাড়িতে আটটি শিশুকে নিয়ে সে শান্ত মুখে বসে আছে–মুখে গভীর উদ্বেগের ছায়া। শিশুগুলি তাকে জড়াজড়ি করে ধরে রেখেছে, কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে দুজন, তার গালের সাথে গাল লাগিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে একজন শিশু। সে হাত দিয়ে আকড়ে রেখেছে। সবাইকে। শিশুগুলির চোখে মুখে কোনো ভয় নেই, আতংক বা উদ্বেগ নেই। তাদের মুখে এক গভীর নিশ্চিন্ত বিশ্বাস। তারা জানে যতক্ষণ লেন তাদেরকে আকড়ে ধরে রাখবে ততক্ষণ তাদের কোনো ভয় নেই, বিপদ নেই।

আমি এই অপূর্ব দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থাকি। আর কী আশ্চর্য! কিছুক্ষণ পর আমারও মনে হতে থাকে এই আটটি নিস্পাপ শিশুর কোনো ভয় নেই, কোন বিপদ নেই!

ঠিক এরকম সময় বাই-ভার্বালে একটা মৃদু কম্পন অনুভব করলাম এবং সাথে সাথে ভিতরের সব রবোটেরা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের ঘিরে দাড়াল। আমরা নিশ্চয়ই গন্তব্য স্থানে পৌঁছে গেছি।

বাই-ভার্বালের গোল দরজা দিয়ে আমরা বের হয়ে এলাম। স্বচ্ছ মেঝে, স্বচ্ছ দেয়াল, উপরে স্বচ্ছ ছাদ প্রতি মুহূর্তে মনে হতে থাকে বুঝি কোথাও পড়ে যাব। সাবধানে হেঁটে হেঁটে আমরা দ্বিতীয় একটি ঘরে হাজির হলাম। সেখানে জোর করে শিশুগুলিকে লেনের কাছ থেকে আলাদা করা হল। শিশুগুলি ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করে কিন্তু এবোটগুলি তাতে ভ্রুক্ষেপ করল না। লেন জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে শিশুগুলিকে অভয় দিয়ে, বলল, তোমরা যাও, আমি এক্ষুনি আসছি।

তারা কী বুঝল কে জানে! একজন একজন করে কান্না থামিয়ে একে অন্যকে জড়াজড়ি করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তখন আমাকে আর লেনকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে পাশের একটা ঘরে নিয়ে আসা হল। আমাদের বিবস্ত্র করা হল এবং আমাদের কাছে যা ছিল সব সরিয়ে নেয়া হল। আমি দেখতে পেলাম খাবারের ক্যাপসুলগুলি সরিয়ে নিল প্রাচীন ধরনের একটি রবোট। তথ্য ক্রিস্টালগুলি আধুনিক ধরনের কিছু রবোট, কমিউনিকেশান্স মডিউলটি যে পরীক্ষা করতে শুরু করল তাকে একজন মানুষের মতো দেখাচ্ছিল, যদিও আমি মোটামুটি নিশ্চিত সেও একজন রবোট।

আদের বিবস্ত্র অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকতে হল না। কিছুক্ষণের মাঝেই নূতন এক প্রস্ত নিও-পলিমার দিয়ে আমাদের আবৃত করা দেয়া হল। সত্যিকার পোষাক নয় তবে পোষাকের কাজ চলে যায়।

এতক্ষণ পর্যন্ত কেউ আমাদের সাথে একটা কথাও বলে নি আমরাও কিছু বলি নি। আমি এবারে আমার প্রথম কথাটি উচ্চরণ করলাম, স্পষ্ট গলায় জোর দিয়ে বললাম, আমি মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা করতে চাই।

সাথে সাথে ঘরটিতে একটি নীরবতা নেমে এল। যে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। খুব ধীরে ধীরে সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকাল। আমি শুনতে পেলাম বিশাল এই ভবনে দূরে কোথাও তারস্বরে এলার্ম বাজতে শুরু করেছে।

দীর্ঘ সময় সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। আমি এবার আরো স্পষ্ট গলায় বললাম, আমি মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা করতে চাই। মহামতি গ্রাউল, যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, যিনি এই বিশাল মহাকাশযানটি তৈরি করেছেন। যার চোখ কান অন্যকোন ইন্দ্রিয় নেই। যিনি সংবেদনশীল যন্ত্র দিয়ে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করেন।

আমরা সমানে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা তখনো নিঃশব্দে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি শুনতে পেলাম অনেকে এই ঘরের দিকে ছুটে আসছে। ঘরের দরজা খুলে গেল এবং বেশ কয়েকজন পুরুষ এবং মহিলা ভেতরে ঢুকে আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করতে থাকি, কেন জানি মনে হয় এদের কেউই সত্যিকারের মানুষ নয়। হয় পুরোপুরি রবোট কিংবা রবোটের দেহে আটকে পড়ে থাকা কোনো একজন হতভাগ্য মানুষ।

বয়স্ক ধরনের একজন কয়েক পা এগিয়ে এসে ভীত গলায় বলল, তুমি কী বলছ?

আমি প্রায় ধমক দেয়ার মতো করে বললাম, আমি জানি আকি কী বলছি। আটটি শিশুকে কেন আনা হয়েছে আমি তাও জানি। মহামান্য গ্রাউলের রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতির নিয়ম মাফিক পরিবর্তন করার কথা। আটটি সুস্থ সবল হৃদপিণ্ড দরকার। আটটি শিশু থেকে সেই আটটি হৃদপিণ্ড নেয়া হবে।

বয়স্ক ধরনের মানুষটির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলল, তুমি এসব কী বলছ? কোথায় শুনেছ এই সব?

আমি কোথায় শুনেছি সেটা তোমার জানার দরকার নেই। আমি এই মুহূর্তে মহামতি গ্রাউলের সাথে কথা বলতে চাই। এই মুহূর্তে–

কিন্তু সেটা তো অসম্ভব।

অসম্ভব?

হ্যাঁ।

বেশ। তুমি জান আমি কী করতে পারি?

কী করতে পার?

আমি তোমাদের পুরো এলাকা ধ্বংস করে দিতে পারি।

সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলি এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছে না। আমি হিংস্র গলায় বললাম, তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করলে না? ঠিক আছে আমি তোমাদের আমার ক্ষমতা দেখাব।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বললাম, আমি ধ্বংস করে দেব সব।

নির্দিষ্ট সময় পর পর দুটি মিথ্যা কথা উচ্চারিত হওয়া মাত্র খাবার ক্যাপসুলে রাখা বিস্ফোরণটি প্রচন্ড শব্দ করে বিস্ফোরিত হল। প্রাচীন ধরনের রবোটের আশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রবোটগুলিও ছিটকে উঠল উপরে, তারপর ঘুরতে ঘুরতে নিচে এসে পড়ল প্রচণ্ড শব্দে। হল ঘরটি কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল, জঞ্জাল ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

আমাদের যারা ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একজন কী একটা বলতে চাইছিল আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমার কথা বিশ্বাস হল?

কেউ কোনো কথা বলল না। আমি শান্ত গলায় বললাম, আমি তোমাদের আরো একটি সুযোগ দেব। দুই সেকেন্ড অপেক্ষা করে বললাম, সুযোগ গ্রহণ না করলে ধ্বংস করে দেব সবকিছু।

সাথে সাথে তথ্য ক্রিস্টালের বিস্ফোরকটি বিস্ফোরিত হল। এটি ছিল আরো শক্তিশালী। পুরো হল ঘর প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল সাথে সাথে। ছিন্ন ভিন্ন রবোটের ধ্বংসাবশেষ উপর থেকে নিচে পড়তে শুরু করল। মনে হল বুঝি এখানে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। আমি তার মাঝে চিৎকার করে বললাম, এই মুহূর্তে আমাকে মহামতি গ্রাউলের কাছে নিয়ে যাও। শুধু তিনিই আমার সাথে কথা বলতে পারবেন, আর কেউ না।

এবার আমার সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলির মাঝে এক ধরনের চাঞ্চল্যের চিহ্ন লক্ষ করা গেল। আমি যেভাবে হাস্যকর ছেলেমানুষি যন্ত্র দিয়ে বড় বড় দুটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি কতক্ষণ সেটি তাদের কাছে গোপন রাখতে পারব জানি না, সময় আমার কাছে খুব মূল্যবান। যে কোনো মুহূর্তে আমি ধরা পড়ে যেতে পারি, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মহামতি গ্রাউলকে নিশ্চয়ই অচিন্ত্যনীয় প্রতিরক্ষা দিয়ে আগলে রাখা হয়, আমি নিজে থেকে সেখানে কখনোই যেতে পারব না।

আমার সামনে দাড়ানো মানুষগুলি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে। একজন একটু এগিয়ে এস বলল, তুমি কেন মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা করতে চাও?

আমি গলায় অধৈর্যের স্বর ফুটিয়ে বললাম, আমি তোমাকে সেটা বললে তুমি বুঝবে না। তোমার কিংবা তোমাদের কারো সেই মানসিক পরিপক্কতা নেই।

কথাটি সত্যি নয়, তাই তিন সেকেন্ড পর যখন বললাম, আমি আর সহ্য করতে পারছি না–তখন তৃতীয় বিস্ফোরণটি ঘটল।

ভয়ংকর বিস্ফোরণের ধাক্কাটা কমে যেতেই উপস্থিত মানুষেরা ছোটাছুটি শুরু করে এবং কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি আমাকে এবং লেনকে একটা ভাসমান যানে তুলে দেয়। সেটি অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গে ছুটে যেতে থাকে। বিশাল বিশাল কিছু গেট নিজে থেকে খুলে যায় আবার আমাদের পিছনে বন্ধ হয়ে যায়। অসংখ্য ধরনের যন্ত্রপাতি আমাদের পরীক্ষা করে তারপর ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়।

এক সময় আমি আর লেন একটা বড় হলঘরের মতো জায়গায় পৌঁছালাম। তার ধবধবে সাদা দেয়াল, উঁচু ছাদ এবং স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ মেঝে। ঘরটিতে হালকা নরম একটি আলো, যদিও কোথা থেকে সেই আলো আসছে বুঝতে পারছি না। ভিতরে একটু শীতল, আমি আর লেন কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম। কেউ কিছু বলে দেয় নি কিন্তু আমার মনে হল এখানেই মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা হবে।

আমি আর লেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোথাও কোন চিহ্ন নেই কিন্তু তবু আমাদের মনে হতে থাকে কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হঠাৎ এক ধরনের আতংক অনুভব করতে থাকি। বুকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে আমি লেনের দিকে তাকালাম, ঠিক তখন শুনতে পেলাম কে একজন ভারি গলায় বলল, তোমরা কেন আমার সাথে দেখা করতে এসেছ?

আমি আর লেন চমকে উঠে চারিদিকে তাকালাম, কেউ কোথাও নেই। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি মহামতি গ্রাউল। আপনার ভবনে আমি আহাম্মকের মতো তিনটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি, আমি–

হ্যাঁ। আমি খবর পেয়েছি। আমি অনুভব করছি তোমার করোটিতে একটা ছোট ট্রান্সমিটার বসানো আছি। তুমি নিশ্চয়ই তোমার মস্তিষ্ক তরঙ্গ ব্যবহার করে সেটা দিয়ে কাছাকাছি রাখা বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছ।

আপনি সত্যিই অনুমান করেছেন মহামতি গ্রাউল। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমার এই ছলনাটুকু করতে হয়েছে। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

আমার কর্মচারীদের ধোকা দেয়া খুব সহজ। তারা নির্বোধ।

আমি ক্ষমা চাই মহামতি গ্রাউল।

আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি।

আপনার প্রতি আমার অসংখ্য কৃতজ্ঞতা। অসংখ্য কৃতজ্ঞতা।

তুমি কেন এসেছ আমার কাছে?

আমার বলতে খুব দ্বিধা হচ্ছে মহামতি গ্রাউল। আমি আপনার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন না করে কথাটি কীভাবে উচ্চারণ করব বুঝতে পারছি না।

তুমি অসংকোচে বলতে পার কিহা।

তার আগে আমি কি একটা অনুরোধ করতে পারি?

কী অনুরোধ?

আমি কি আপনাকে দেখতে পারি?

মহামতি গ্রউল এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আমাকে কেউ কখনন দেখে নি। যে মানুষ বেঁচে থাকবে সে আমাকে কখনো দেখবে না।

আমি আপনাকে সশরীরে দেখতে চাই নি মহামতি গ্রাউল। আমি আপনার একটা রূপ দেখতে চাইছি। আমি কাউকে না দেখে ভাল করে কথা বলতে পারি না মহামান্য গ্রাউল। না দেখে কথা বললে মনে হয় আমি তার উপাসনা করছি।

বেশ। তুমি আমাকে কী রূপে দেখতে চাও? পুরুষ না রমণী?

আপনার যা ইচ্ছে।

প্রায় সাথে সাথেই ঘরের মাঝামাঝি সৌম্য দর্শন একজন বৃদ্ধকে দেখা গেল। শরীরে আলগোছে একটি চাদর জড়ানো, সেখান থেকে এক ধরনের নরম আলো বের হচ্ছে। মাহমতি গ্রাউলের এই রূপটি দেখে আমার প্রাচীন গ্রন্থের দেবদূতের কথা মনে পড়ল। এটি সত্যিকারের কোনো মানুষ নয় কিন্তু রূপটি এত জীবন্ত যে আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। আমি আর লেন মাথা নত করে অভিবাদন করে বললাম, আপনাকে অভিভাদন। আমাদেরকে একটি শান্ত সমাহিত রূপে দেখা দেয়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

তুমি এখন কী বলতে চাও বল।

আমার কথাটি বলার আগে আমার একটু ভূমিকা দেয়ার প্রয়োজন। আপনার সময় অত্যন্ত মূল্যবান কিন্তু তবুও আমি একটু সময় ভিক্ষা চাইছি।

সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ মানুষটি আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি তোমাকে সময় দিচ্ছি। তুমি বল।

আপনি এই মহাকাশযানটি তৈরি করেছেন। এর মূল নক্সা আপনার, খুঁটিনাটি সব কিছু আপনার। দীর্ঘ সময় নিয়ে এটি মহাকাশে তৈরি হয়েছে। একসময় এটি পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে। মানুষ যখন কিছু একটা সৃষ্টি করে তার এক ধরনের আনন্দ হয়। সাধারণ মানুষ সৃষ্টি করে সাধারণ জিনিস তার আনন্দটুকু হয় সাধারণ। আপনি সাধারণ মানুষ নন–আপনার সৃষ্টিও তাই সাধারণ নয় এবং সেটা সৃষ্টি করে আপনি যে আনন্দটুকু পেয়েছেন সেই আনন্দও নিশ্চয়ই অসাধারণ। আপনার সেই তীব্র আনন্দের অনুভূতি আমরা কল্পনাও করতে পারব না।

এই মহাকাশযান যখন পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে আপনি সেখানে স্থান করে নিয়েছেন। এই মহাকাশযানের সৌভাগ্য, মহাকাশ অভিযাত্রীদের সৌভাগ্য আপনি তার নেতৃত্ব দিতে রাজি হয়েছেন। সেই নেতৃত্বটুকু এসেছে গোপনে। সাধারণ মানুষের কাছে আপনার কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। তাদের ধারণা মূল তথ্যকেন্দ্র এই মহাকাশযানকে চালিয়ে নিচ্ছে মহাকাশ দিয়ে। বহুদূরে পৃথিবীতে।

যখন মহাকাশযান পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে হঠাৎ করে আপনি আবিষ্কার করলেন আপনার আর কিছু করার নেই। সাধারণ মানুষ শীতল ঘরে ঘুমিয়ে সময় কাটাতে পারে, আপনার ঘুমানোর সুযোগ নেই। আটটি সতেজ হৃদপিণ্ড আপনার জটিল বহুমুখী মস্তিষ্ক স্তরের নানা অংশে রক্ত সঞ্চালন করে। আপনি প্রতি মুহূর্তে সজীব, প্রতি মুহূর্তে কর্মক্ষম। সাধারণ মানুষের চোখ রয়েছে। কান রয়েছে, নাক, মুখ, ইন্দ্রিয় রয়েছে। শারীরিক বা আধা শারীরিক আনন্দের সুযোগ রয়েছে। আপনার সমস্ত কার্যকলাপ বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে। আপনি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন আপনি নিঃসঙ্গ।

আমি কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলাম। মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন করে বললাম, আমি কি ভুল বলেছি মহামান্য গ্রাউল?

মহামতি গ্রাউল এক মুহূর্ত নীরব থেকে বললেন, না। তুমি ভুল বল নি কিহা।

আমি কি আরো একটু বলব?

বল।

আমাদের, সাধারণ মানুষের নিঃসঙ্গতা সাধারণ। সেটা দূর করার জন্যে আমরা সাধারণ কাজ করি। আপনি সাধারণ মানুষ নন–আপনি তাই সাধারণ কাজ করতে পারেন না। আপনি ঠিক করলেন সময় কাটানোর জন্যে একটা কৌতুক করবেন। কিছু বুদ্ধিমান মানুষকে বেছে নিয়ে তাদের সাথে বুদ্ধির কোনো একটা খেলা খেলবেন। এমনি-এমনি আপনি বুদ্ধিমান মানুষ বেছে নিতে চাইলেন না। আপনি ঠিক করলেন সত্যিকারের বুদ্ধিমান মানুষকে বেছে নিবেন। তাই একদিন। মহাকাশযানের সব মানুষকে জাগিয়ে তুলতে শুরু করলেন। তাদেরকে হানাহানি শুরু করতে দিলেন, তাদেরকে নেতৃত্ব নিয়ে যুদ্ধ করতে দিলেন। আপনি ঠিক করলেন যারা সবচেয়ে উপরে উঠে আসবে আপনি তাদের বেছে নিবেন।

মহামতি গ্রাউলের মুখ ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে আসছিল, আমি হঠাৎ বুকের ভিতরে ভয়ের এক ধরনের কম্পন অনুভব করি। তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, তুমি কেমন করে এসব জান?

আমি কিছু জানি না মহামতি গ্রাউল। সব আমার অনুমান। আমার অনুমান ভুল। হতে পারে। যদি হয় আপনি আমার ভুল ধরিয়ে দেবেন মহামতি গ্রাউল। আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, আমার অনুমান কী ভুল হয়েছে মহামতি গ্রাউল?

হয় নি। বল তুমি কী বলতে চাও। তোমার দীর্ঘ ভূমিকা তুমি শেষ কর। আমার ভূমিকা প্রায় শেষ মহামতি গ্রাউল। আমি এক্ষুনি বলব আমি কী চাই। আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের আশা আকাঙ্খ সাধারণ। আমাদের স্বপ্নও সাধারণ। আপনি সাধারণ নন, আপনার আশা আকাঙ্খও সাধারণ নয়। আপনার কল্পনাও সাধারণ নয়। আমরা সেটা বুঝতে পারি না। সেটা কল্পনা করতে পারি না। আপনার ছোট একটি খেয়ালে মাহকাশযানে শত শত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হাজার হাজার মানুষকে স্বার্থপর লোভীতে পাল্টে দেয়া হয়েছে। এর অবসান ঘটাতে হবে মহামতি গ্রাউল।

লেন হঠাৎ করে আমার কনুই খামচে ধরল। আমি সাবধানে তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে মহামতি গ্রাউলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। তার মুখমণ্ডল ধীরে ধীরে কঠোর হয়ে উঠল, তার নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে ওঠে এবং একসময়ে থমথমে গলায় বললেন, তুমি কীভাবে এর অবসান ঘটাতে চাও?

আপনি এই মহাকাশযানটির কতৃত্ব মহাকাশযানের মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিন।

আর যদি না দিই?

আপনাকে দিতে হবে মহামতি গ্রাউল। মহাকাশযানের সমস্ত মানুষের কাছে অঙ্গীকার করা হয়েছে এটি পৃথিবীতে যাচ্ছে, কিন্তু আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছি নক্ষত্রপুঞ্জ তার ঠিক জায়গায় নেই। ভেগা নক্ষত্র অনেক উপরে, কালপুরুষ বাম দিকে সরে রয়েছে। আপনি এই মহাকাশযানকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন।

মহামতি গ্রাউলের মুখে এক ধরনের বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল, তিনি সেই হাসি গোপন করার চেষ্টা না করে বললেন, আমি তোমার কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছি কিহা। তোমার বুদ্ধিমত্তা নিশ্চয়ই নিনীষ স্কেলে আট এর কম নয়।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন কিন্তু সেটার কোনো অর্থ নেই মহামতি গ্রাউল।

আমি যদি তোমার অনুরোধ মহাকাশযানের কতৃত্ব মানুষের হাতে না দিই তুমি কী করবে কিহা?

আমি বুকভরা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, আমি আপনাকে হত্যা করতে বাধ্য হব মহামতি গ্রাউল।

মহামতি গ্রাউল বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন তারপর হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। লেন আমার দুই হাত শক্ত করে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, হায় ঈশ্বর। হায় পরম করুণাময় ঈশ্বর।

মহামতি গ্রাউলের হাসি না থামা পর্যন্ত আমি চুপ করে রইলাম, তারপর নিচু গলায় বললাম, মানুষের স্বাভাবিক হিসেবে আপনি একজন উন্মত্ত দানব ছাড়া কিছু নন। আমি যদি আজ ব্যর্থ হই অন্য কোনো একজন আপনাকে হত্যা করবে। আপনাকে হত্যা করে এই মহাকাশযানকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

ঘরের মাঝামাঝি মহামতি গ্রাউলের যে প্রতিচ্ছবিটি ছিল সেটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে শুরু করে, তার আকার আরো বড় হয়ে আসে এবং গায়ের রং পরিবর্তিত হতে থাকে, একটু আগে যেটিকে শান্ত সৌম্য একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে সেটা সত্যিই যেন দানবের রূপ নিতে শুরু করে। লেন শক্ত করে আমার হাত ধরে রেখে আবার ফিস ফিস করে বলল, রক্ষা কর ঈশ্বর তুমি। রক্ষা কর। রক্ষা কর।

মহামতি গ্রাউলের গলার স্বরে একটা ধাতব প্রতিধ্বনি শোনা যেতে থাকে। তিনি খনখনে গলায় বললেন, কিহা, আমি তোমার সাহস দেখে মুগ্ধ হয়েছি। সাহস পুরোপুরি মানবিক অনুভূতি। শুধুমাত্র মানুষ সাহস নামক ব্যাপারটি দেখাতে পারে। পশুরা পারে না। রবোর্টরাও পারে না। তার কারণ এটি পুরোপুরি যুক্তিহীন এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা। তবে তোমার সাহসের একটি পুরস্কার আমি দেব। তোমাকে আমি আমার নিজেকে দেখতে দেব। দেখ আমি দেখতে কেমন!

সাথে সাথে সমস্ত ঘর অন্ধকার হয়ে গেল এবং আমারা যে স্বচ্ছ মেঝের উপরে দাঁড়িয়েছিলাম তার নিচে আলো জ্বলে ওঠে। সেখানে বিশাল একটি স্বচ্ছ পাত্রে এক ধরনের তরল পদার্থে থলথলে একটা জিনিস কিলবিল করতে থাকে সেখান থেকে শিরা উপশিরা বের হয়ে গিয়েছে। তাকে ঘিরে আটটি হৃদপিণ্ড ধ্বক ধ্বক করে তার মাঝে রক্ত প্রবাহিত করে যাচ্ছে সেই রক্তের স্রোত পাশে পুষ্টি এবং অক্সিজেন ট্যাংকের ভেতর দিয়ে চলে আসছে। সমস্ত দৃশ্যটি একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো, দেখে লেন একবার আর্ত চিৎকার করে উঠল।

আমি মহামতি গ্রাউলের গলার স্বর শুনতে পেলাম, আমার দেহ–যদি সেটাকে দেহ বলতে চাও, যেভাবে রক্ষা করা আছে এর উপরে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটালেও কিছু হবে না। তোমরা যে আটটি হৃদপিণ্ড দেখতে পাচ্ছ এখন আমরা সেগুলি পাল্টে দেব আটটি সতেজ হৃদপিণ্ড দিয়ে। এই মুহূর্তে তার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে

না। আমি শক্ত গলায় বললাম, আপনি সেটা করবেন না মহামতি গ্রাউল। আটটি শিশুর হৃদপিণ্ডে আমরা বিস্ফোরক লাগিয়ে রেখেছি। আমি সেগুলি যে কোনো মুহূর্ত বিস্ফারিত করে দিতে পারি কিন্তু আমি করব না। আমি মানুষ, মানুষ অনেক অন্যায় করতে পারে, কিন্তু শিশু হত্যা করতে পারে না। আপনি আপনার নিরাপত্তার জন্যে কখনই সেই হৃদপিণ্ড ব্যবহার করবেন না। প্রায় অদৃশ্য সেই বিস্ফোরক রক্তস্রোতে মিশে আপনার মস্তিষ্কে যেতে পারে। কিংবা কে জানে মহামতি হিংস্র গলায় বললেন, কে জানে কী?

কে জানে সেই বিস্ফোরকে ভয়ংকর কোনো ভাইরাস রয়েছে কী না সেই ভাইরাস আপনার রক্তকে দূষিত করে দেবে কিনা–

যেভাবে নিচে আলো জ্বলে উঠেছিল ঠিক সেভাবে আলো নিভে গেল এবং আবার আমরা আমাদের সামনে মহামতি গ্রাউলকে দেখতে পেলাম। তার চেহারায় এক ধরনের বিকৃতি হয়েছে ভয়ংকর একটা দৃষ্টিতে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখে আমি নিজের ভেতরে এক ধরনের অশুভ অসহায় আতংক অনুভব করতে থাকি। মহামতি গ্রাউল হিংস্র গলায় বললেন, তোমরা কীভাবে আমাকে হত্যা করতে চাও?

আমরা নই। আমি। আমি আপনাকে বুদ্ধি দিয়ে হত্যা করতে চাই।

বুদ্ধি দিয়ে?

হ্যাঁ মহামতি গ্রাউল। আমি জানি আপনি মিয়ারাকে এনেছেন। আমি জানি মহাকাশযানের অন্য ছয়জন নেতাও এখানে আছে। আপনি তাদের সাথে সময় কাটাবেন, কোন একটি বুদ্ধির খেলা খেলবেন। আমি চাই–আমি এক মুহূর্তের জন্যে থামলাম।

মহামতি গ্রাউল বললেন, তুমি চাও–

আমি চাই আপনি অন্য ছয়জনের সাথে আমাকে যুক্ত করবেন। আমিও আপনার সাথে সেই ভয়ংকর খেলায় অংশ নিতে চাই। অন্যদের সাথে আমিও আপনার মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যুক্ত হতে চাই।

মহামাতি গ্রাউলের চেহারা হঠাৎ আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তিনি তীব্র চোখে। আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কঠিন গলায় বললেন, তুমি কেমন করে জান তারা আমার মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যুক্ত?

আমি জানি না মহামতি গ্রাউল, কিন্তু আমি অনুমান করছি। আমি জানি আপনার চোখ নেই, কান নেই, বাইরের জগতের সাথে সরাসরি যোগাযোগ নেই। অন্য এক বা একাধিক মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগের আপনার একটি মাত্র উপায়, এক সাথে যুক্ত করে দেয়া। সেই মস্তিষ্ক আপনার মস্তিষ্কের একটা অংশ হয়ে থাকবে। আপনি তাকে পীড়ন করবেন। আমি জানি মহামান্য গ্রাউল। আপনি একজন দানব ছাড়া আর কিছু নন।

মহামতি গ্রাউল একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তোমার দুঃসাহস দেখে মুগ্ধ হয়েছি কিহা। তুমি স্বেচ্ছায় আমার মস্তিস্কের সাথে যুক্ত হতে চাও?

চাই মহামান্য গ্রাউল। আপনাকে আমি ধ্বংস করতে চাই।

তুমি আমাকে ধ্বংস করতে পারবে?

আমি জানি না পারব কি না। কিন্তু আমাকে চেষ্টা করতে হবে। মানুষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে। আপনি মানুষের মস্তিষ্ক দিয়ে তৈরী কিন্তু আমি জানি না আপনি মানুষ কী না।

তুমি কীভাবে আমাকে হত্যা করবে?

আমি আপনাকে এখন বলব না। যদি আপনি আমার মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত হন। তাহলে আপনি জানবেন।

আর যদি না হই?

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তাহলে আমার কিছু করার নেই। সম্ভবত আপনি তাহলে এখন আমাদের হত্যা করবেন। আমি একটু অপেক্ষা করে বললাম, যদি সত্যিই আমাদেরকে হত্যা করেন আমি আশা করব আপনি আমাদের কয়েক মুহূর্ত সময় দেবেন। আমি আমার সাথে দাঁড়ানো মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইব তারপর বিদায় নেব। এবং

এবং কী?

এবং তাকে বলব যদি সত্যিই আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারতাম তাহলে আমি তার সামনে হাটু গেড়ে বসে বলতাম, লেন তুমি কি আমাকে তোমার জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিবে?

মাহামতি গ্রাউলের মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠে তিনি এক ধরনের কোমল গলায় বললেন, লেন তুমি তাহলে কী বলবে?

লেন কোন কথা বলল না, আমাকে শক্ত করে ধরে হঠাৎ হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল। আমি তাকে বুকে আকড়ে রেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললাম, লেন, এক মুহূর্তের ভালবাসা আর এক যোজনের ভালবাসার কোন পার্থক্য নেই। ভালবাসা ভালবাসাই। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

মহামতি গ্রাউল এক ধরনের কৌতুকের দৃষ্টি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর শান্ত গলায় বললেন, কিহা। আমি তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করলাম। তোমার মস্তিষ্ককে আমি আমার মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত করব। তুমি অসাধারণ বুদ্ধিমান। তোমার মরণ খেলাটি দেখার আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে।

আমি খুব সাবধানে আমার বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিলাম। এই মহাকাশযান মহামতি গ্রাউলের থাবা থেকে হয়তো শেষপর্যন্ত রক্ষা করা যাবে। বুড়ো লী যেভাবে বলেছিল সেভাবে, শক্তিশালী যন্ত্রের সাথে যেভাবে দাবা খেলতে তার নিয়মে। যন্ত্র প্রস্তুতি নেয় নিখুঁত একটি খেলার যেখানে কোন ভুল হয় না, তার সাথে খেলতে হয় নির্বোধের মতো যে নির্বুদ্ধিতা আসলে সুপরিকল্পিত। আমিও তাই করছি, যে বুদ্ধির খেলায় মহামতি গ্রাউল আগ্রহ নিয়ে রাজি হয়েছে সেটি আমাকে খেলতে হবে না। কারণ আমার মস্তিষ্কে কিটুনিয়া ভাইরাসের ছোট একটা ক্যাপসুল ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। মুক্ত এলাকা থেকে আমি দুই হাজার ইউনিট দিয়ে কিনেছিলাম। ক্যাপসুলটি নির্দিষ্ট সময় পরে নিজে থেকে ফেটে বের হয়ে আসবে, কিলবিল করে ছড়িয়ে যাবে মস্তিষ্কে, নিউরন সেলকে ধ্বংস করে বাড়তে থাকবে প্লাবনের মতো, দেখতে দেখতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আমার মস্তিষ্ক! নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মহামতি গ্রাউলের মস্তিষ্ক, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মিয়ারার মস্তিষ্ক–অন্য সবার মস্তিষ্ক যারা যারা যুক্ত হয়েছে এই বিশাল মস্তিষ্ক স্তরে। মহামতি গ্রাউলকে ধ্বংস করার জন্যে যে পদ্ধতিটি আমি বেছে নিয়েছি সেটি আসলে বুদ্ধিহীন নির্বোধ একটা প্রক্রিয়া। বুদ্ধির খেলায় তাকে পরাজিত করার সেই দুঃসাহস কার আছে?

আমি আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে লেনের দিকে তাকালাম। লেন আমার মস্তিষ্কের কিটুনিয়া ভাইরাসের কথা জানে না, সে তাই অবিশ্বাস্য চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

বিশাল এই মহাকাশযানটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেয়ার একটি মাত্র উপায়, মহামতি গ্রাউল নামের দানবটিকে ধ্বংস করা। আমাকে তাই করতে হবে, আমার নিজের প্রাণ দিয়ে। সৃষ্টি জগতের ইতিহাসে সেরকম অসংখ্য আত্মত্যাগের কথা লেখা আছে একজন বা একাধিক মানুষ হাসিমুখে প্রাণ দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, বিশাল জনপদ নগর রক্ষা করেছে দেশকে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছে। এই মহাকাশযানের ইতিহাস যখন লেখা হবে সেই ইতিহাসে আমার কথা নিশ্চয়ই উল্লেখ করা হবে, কীভাবে আমি মহামতি গ্রাউল নামের একটি দানবকে ধ্বংস করে পৃথিবীর মানুষকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছি। সেটা অনেক বড় করে ব্যাখ্যা করা হবে। আমার বুকের ভেতর এখন আত্মত্যাগের এক মহান পরিতৃপ্তির অনুভূতি হওয়ার কথা।

কিন্তু আমার ভিতরে এক গভীর বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। এক ভয়ংকর শূন্যতা আমার বুকের ভিতর হুঁ হুঁ করে বইতে থাকল। আমার না দেখা পৃথিবী নয়, ফেলে আসা গ্রহটি নয়, বিস্ময়কর এই মহাকাশযানটি নয়, সৃষ্টিজগৎ এবং তার বিশাল রহস্য নয়, আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালো চোখের একটি মেয়ের ভালবাসা আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে সেই গভীর বেদনায় আমার সমস্ত হৃদয় সমস্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন হয়ে আসতে থাকে।

কিন্তু আমি আমার মুখে একটা আত্মবিশ্বাসের চিহ্ন ফুটিয়ে রাখলাম, আমি জানি মহামতি গ্রাউল তার সংবেদনশীল যন্ত্র দিয়ে আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছেন।

 ৮. ঘরটির ছাদ নিচু

ঘরটির ছাদ নিচু, দেখে ঘর না মনে হয়ে একটি সুড়ঙের মতো মনে হয়। আমি স্বচ্ছ একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমার পাশে দুজন অস্ত্রোপাচারকারী রবেট নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষনের মাঝেই তারা আমার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার শুরু করবে। আমার কাছেই লেন দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখমণ্ডল রক্তহীন। আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত কয়টি একটি ভয়ংকর নৈরাশ্যে ড়ুবিয়ে দিতে চাইছিলাম না, প্রাণপন চেষ্টা করছিলাম লেনের সাথে আনন্দদায়ক কিছু বলতে। কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না এবং অনুভব করছিলাম ধীরে ধীরে দুজনেই আরো বেদনাতুর হয়ে উঠছি।

আমি মুখে জোর করে একটা স্বাভাবিক ভাব ফুটিয়ে রেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোটটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?

রবোর্টটি থমথমে গলায় বলল, আমার কোন নাম নেই। আমি মানুষ নই তাই আমার নামের প্রয়োজনও নেই।

সত্যি কথা। কিন্তু তুমি কি তোমার দায়িত্ব সত্যিকার ভাবে পালন করতে পার।

অবশ্যি পারি। আমি খুব অল্প সময় আগেই ছয়জনের মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করেছি।

আমি ভাল করে রবোটটিকে আবার দেখলাম, সে নিশ্চয়ই মিয়ারা এবং অন্যান্য নেতাদের মাথায় অস্ত্রোপচার করেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারা কোথায়?

তাদের দেহটি পরিশোধনাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র মস্তিষ্কটি মহামতি গ্রাউলের মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত করা হয়েছে।

কোথায়?

এই ঘরেই রয়েছে। রবোটটি তার যান্ত্রিক হাত দিয়ে দেখালো, কাছাকাছি ছয়টি চতুষ্কোণ সিলিন্ডার সাজাননা।

আমি বুকের ভেতরে এক ধরনের আতংক অনুভব করলাম, কিন্তু সেটা প্রকাশ করে সহজ গলায় বললাম, আমি কী তাদের দেখতে পারি?

পার।

আমি এগিয়ে গেলাম, সিলিন্ডারের উপর স্বচ্ছ একটি ঢাকনা এবং তার নিচে অর্ধস্বচ্ছ এক ধরনের তরলে থলথলে একটি মস্তিষ্ক ভাসছে। এটি যে একজন মানুষের অবশিষ্ট সেটি বোঝার কোন উপায় ছিল না, কিন্তু দুটি চোখ তার, অপটিক নার্ভসহ অক্ষত রয়েছে এবং সেটি নিস্পলক চোখে উপরের দিকে তাকিয়েছিল। আমার ভুলও হতে পারে কিন্তু মনে হল আমাকে দেখে চোখ দুটির মাঝে এক ধরনের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। আমি রবোটটিকে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কার মস্তিষ্ক?

মিয়ারার।

আমি কি তার সাথে কথা বলতে পারি?

পার। বলে রকেটটি বুকে ঝুকে পড়ে কী একটা যন্ত্র চালু করে দিল। সাথে সাথে আমি মিয়ারার গলার স্বর শুনতে পেলাম। সে একধরনের উত্তেজিত গলায় বলল, কিহা! লেন! তোমরা?

হ্যাঁ। আমরা। তোমাকে এভাবে দেখব আমি কখনো ভাবি নি। আমি–আমি দুঃখীত।

একথা কেন বলছ? আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি তুমি তুমি কি ভাল আছ?

আমি অবশ্যি ভাল আছি। আমি চমৎকার আছি। আমি এর থেকে চমৎকার কখনো থাকি নি।

আমি হতবাক হয়ে বললাম, তুমি কেমন করে চমক্কার আছ? তোমার দেহই নেই–

মিয়ারা হাসির মতো একটা শব্দ করে বলল, মানুষের দেহ একটা বাহুল্য ছাড়া কিছু নয়। আমি এখন জানি। তোমাদের যে দেহ আছে সেই অনুভূতিটি তুমি পাও তোমার মস্তিষ্ক থেকে। যদি কারো দেহ না থাকে কিন্তু মস্তিষ্ক তাকে দেহের অনুভূতি দেয় তাহলে দেহের প্রয়োজন কী?

আমি তখনো পুরো ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারি নি। একটু পরে আমি নিজেও এই ধরনের একটি বস্তুতে পরিণত হব, তখন কী আমার ভেতরেও এই ধরনের সুখী পরিতৃপ্ত একটা ভাবের জন্ম হবে? আমি একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সত্যিই সুখী?

হ্যাঁ। আমি সত্যিই সুখী। সুখ আনন্দ এগুলি হচ্ছে মস্তিষ্কের এক ধরনের অনুভূতি। একজন মানুষ খুব কষ্টের মাঝে বা যন্ত্রণার মাঝে থাকতে পারে, সেই কষ্ট এবং যন্ত্রণার মাঝে থেকেও যদি তার মস্তিষ্কে সুখের অনুভূতি জাগানো যায় তাহলে সে সুখ অনুভব করবে। শুধু তাই নয় তার সেই সুখ হবে সত্যিকারের সুখ।

আমি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললাম, আমি তোমাকে দেখে খুব খুশি হলাম মিয়ারা। কাউকে সুখী দেখলে আমার খুব আনন্দ হয়।

তোমরা এখানে কেন এসেছ কিহা?

সেটি অনেক বড় একটি কাহিনী। তুমি নিশ্চয়ই জানবে। আমি তোমার পাশাপাশিই থাকব।

সত্যি?

সত্যি। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম এবং হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটিকে আমার কাছে অবাস্তব একটি দুঃস্বপ্নের মতো মনে হতে থাকে। আমি লেনের দিকে তাকালাম, তার রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখে ধীরে ধীরে এক অবর্ণনীয় আতংক এসে ভর করতে শুরু করেছে।

হঠাৎ করে রববাটটি আমার কনুই স্পর্শ করে বলল, কিহা। তোমার অস্ত্রোপচারের সময় হয়েছে।

আমি চমকে উঠলাম, এখান থেকে ছুটে পালানোর একটা প্রবল ইচ্ছাকে অনেক কষ্টে আটকে রেখে আমি শান্ত গলায় বললাম, চল।

লেন পিছন থেকে এসে আমার হাত ধরে বলল, না কি এটা হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না।

আমি সাবধানে নিজেকে লেনের হাত থেকে মুক্ত করে বললাম, আমাদের আর কিছু করার নেই লেন।

লেন হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল, উপরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, গ্রাউল। গ্রাউল তুমি কোথায়? কোথায়?

আমি চমকে উঠে বললাম, কী করছ তুমি লেন?

লেনের মুখে হঠাৎ রক্তের ছটা দেখা যায়, তার চোখে জ্বল জ্বল করছে, নিঃশ্বাসের সাথে বুক উপরে উঠছে এবং নামছে মাথায় এলোমেলো চুল, তাকে অপ্রকৃতস্থের মতো দেখাতে থাকে। সে চিৎকার করে বলন, গ্রাউল। তুমি কোথায়?

এই যে আমি এখানে। মহামতি গ্রাউলের স্বর খুব কাছে কোনো জায়গা থেকে শোনা যায়।

লেন চিৎকার করে বলল, আমি তোমাকে দেখতে চাই, তোমার সাথে কথা বলতে চাই।

গ্রাউল প্রায় কোমল স্বরে বলল, তুমি এতক্ষণ এখানে কিহার সাথে ছিলে একটিবার একটি কথাও বললে না, এখন হঠাৎ করে কী বলতে চাও?

আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই?

কী প্রশ্ন?

তার আগে আমি তোমাকে দেখতে চাই। শেষবার দেখতে চাই।

বেশ।

সাথে সাথে সুড়ঙের মতো ঘরটির এক কোণায় আমরা মহামতি গ্রাউলকে দেখতে পেলাম, ঈষৎ সবুজ বর্ণে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের মাথা। একটু আগে। দেখা গ্রাউলের সাথে তার কোন মিল নেই। এই মানুষটির চেহারা কুর এবং নিষ্ঠুর।

লেন ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি গ্রাউল।

সবুজ রংয়ের মাথাটি হিংস্র গলায় বলল, হ্যাঁ।

লেন একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম অসংখ্য নক্ষত্র জ্বল জ্বল করছে। আমি জানতাম সেই নক্ষত্রের পিছনে রয়েছে আরো নক্ষত্র, আরো নীহারিকা। তার পিছনে আরো নক্ষত্র, অরো নীহারিকা, তার কোন শেষ নেই। আমার সামনে এই অসীম মহাকাশ যার শুরু নেই শেষ নেই।

লেন এক মুহূর্তের জন্যে চুপ করল, মহামতি গ্রাউল স্থির হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, লেন সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, অসীম মহাকাশের ব্যাপারটি আমার ছোট মস্তিষ্ক সহ্য করতে পারল না। আমি ব্যাপারটি চিন্তা করতে পারলাম না। আমার মাথা ঘুরে উঠল, আমি চিৎকার করে আমার মায়ের কাছে ছুটে গেলাম। আমার মা আমাকে বুকে জড়িয়ে বলল, ভয় কি মা আমার! এই তো আমি।

গ্রাউলকে হঠাৎ কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়। ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, তুমি প্রশ্ন কর–

করছি। প্রশ্ন করছি। লেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গ্রাউলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ছোট মস্তিষ্কটি যখন বিশাল একটি ব্যাপার সহ্য করতে পারছিল না আমি সেখান থেকে বের হয়ে এসেছিলাম আমার মায়ের বুকের মাঝে আশ্রয় নিয়ে। আমি তার কথা শুনেছি, তার মুখের কোমল চেহারা দেখেছি, তার দেহের ঘ্রাণ, তার স্পর্শ অনুভব করেছি। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়–আমার মস্তিষ্ককে সেই ভয়ংকর চিন্তা থেকে মুক্ত করে নিয়ে গেছে–

গ্রাউল হঠাৎ ভয়ংকর চিৎকার করে বলল, তুমি কী বলতে চাও?

লেনের চোখ হঠাৎ শ্বাপদের মতো জ্বলতে থাকে। সে হিংস্র স্বরে বলল, তোমার চোখ নেই কান নেই। তোমার ঘ্রাণ নেয়ার নাক নেই, স্পর্শের অনুভূতি নেই। তোমার রয়েছে শুধু এক ভয়ংকর মস্তিষ্ক। মানুষের মস্তিষ্ক থেকে সেই মস্তিষ্কের ক্ষমতা সহস্রগুণ বেশি দুর্বলতাগুলিও সহস্র গুণ বেশি। নিশ্চয়ই বেশি। সেই মস্তিষ্কে যদি হঠাৎ লাগামছাড়া ভয়ংকর একটা ভাবনা এসে হাজির হয় তুমি কী করবে? কী করবে? কোন ইন্দ্রিয় তোমাকে রক্ষা করবে? কোন ইন্দ্রিয়?

গ্রাউলের চেহারা হঠাৎ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তার সবুজ মুখাবয়ব বিকৃত হয়ে যায়, মুখ গহ্বর থেকে ধারালো দাত, লকলকে জিব বের হয়ে আসে। জড়ানো গলার স্বরে সে চিৎকার করে বলল, আসবে না–কোন ভয়ংকর ভাবনা আসবে না, আসবে না–

আসবে। নিশ্চয়ই আসবে। তাই তুমি মহাকাশযানের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষকে তোমার পাশে এনে হাজির করেছ। যদি কখনো সেই ভয়ংকর ভাবনা এসে হাজির হয় তুমি তোমার আশে পাশে আটকে রাখা মস্তিষ্কের সাহায্যে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। তারা হবে তোমার মায়ের চেহারা? ঘ্রাণ? তার গলার স্বরে? তার স্পর্শ!

লেন হঠাৎ হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত হাসতে শুরু করে। তার অপ্রকৃতস্থ হাসি সুড়ঙের মতো সেই ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। মহামতি গ্রাউলের চেহারা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে তার মুখাবয়ব বিস্তৃত হতে হতে ঘরের ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেই ভয়ংকর চেহারা থেকে এক অবিশ্বাস্য আক্রোশ ফুটে বের হতে শুরু করে। লেন সেই ভয়ংকর চেহারার দিকে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলল, তুমি। ভেবেছ আমি তোমাকে ভয় পাব? তোমার দানবের চেহারা দেখে আমি আতংকে শিউরে উঠব? না। আমি তোমাকে ভয় পাই না। এতটুকু ভয় পাই না। কারণ আমি জানি তুমি তোমার নিজের ভেতরের সেই ভয়ংকর ভাবনার ভয়ে থরথর করে কাপতে থাক। তুমি ভীতু কাপুরুষ–তুমি অসহায় দুর্বল–তুমি তুচ্ছ! ইচ্ছে করলে আমি তোমাকে ধ্বংস করে দিতে পারি। ধ্বংস করে দিতে পারি

না! গ্রাউল হঠাৎ আর্তনাদ করে বলল, না!

হ্যাঁ। লেন হিংস্র গলায় বলল, হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমি তোমাকে এখন সেই প্রশ্নটি করব। যে প্রশ্নটির ভয়ে তুমি থর থর করে কাপছ। যে প্রশ্নটি করলে তুমি আমার চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে আমি তোমাকে সেই প্রশ্নটি করব। লেন এক মূহুর্ত থেমে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে তীব্র স্বরে বলল, তুমি আমাকে বল, তোমার সেই ভয়ংকর ভাবনাটি কী? বল।

গ্রাউলের মুখাবয়ব হঠাৎ এক অবর্ণনীয় আতংকে বিকৃত হয়ে যায়। চোখের মণি ঘোলাটে হয়ে আসে, মুখের মাংশপেশী থরথর করে কাঁপতে থাকে, তার লকলকে জিভ মুখ থেকে বের হয়ে আসে, মুখের কষ থেকে লোল গড়িয়ে পড়ে। সেই বিকৃত কাতর চেহারায় ভাঙা গলায় বলল, না–না–না–আমি সেটা ভাবতে চাই না–ভাবতে চাই না

তোমাকে ভাবতে হবে! লেন চিৎকার করে বলল, ভাবতে হবে। ভাবতে হবে। ভেবে ভেবে আমাকে বলতে হবে। বলতে হবে।

না। হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমাকে বল। লেন হিংস্র গলায় চিৎকার করে বলল, বল।

গ্রাউল হঠাৎ পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। অবর্ণনীয় আতংকে থর থর করে কাপতে কাঁপতে বলল, একটা শিশু হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। সামনে একটা রাস্তা। সেই রাস্তা দূর দিগন্তে গিয়ে এক বিন্দুতে মিলে গেছে। শিশুর হাতে একটা ফুলের ঝাপি। সেই ঝাঁপিতে সে রাস্তার পাশে থেকে বুনোফুল তুলছে। সেই ফুল নিয়ে সে ছুটে গিয়েছে সামনে আর দিগন্ত তখন আরো দূরে সরে গিয়েছে। শিশুটি আবার ফুল তুলেছে ঝাপিতে। আবার ছুটে গিয়েছে সামনে দিগন্ত আরো দূরে সরে গিয়েছে। গ্রাউল হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, শিশুটির বুনোফুলের ঝাপি থেকে হঠাৎ সব ফুল ঝড়ে গেছে নিচে, শিশুটি ফুল তুলতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আবার চেষ্টা করছে। তারপর আবার ছুটে গেছে সামনে। তখন সেই দিগন্ত আবার সরে গেছে দূরে। শিশুটি ছুটে যেতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। পারছে না। হঠাৎ ফুলের ঝাপি থেকে সব ফুল ঝড়ে গেল নিচে। শিশুটি সেই ফুল কুড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। চেষ্টা করছে–চেষ্টা করছে–চেষ্টা করছে! পারছে কিন্তু পারছে না। ছুটে যাচ্ছে কিন্তু যেতে পারছে না। পারছে না–পারছে না

গ্রাউলের কথা জড়িয়ে যায়, গোঙানোর মতো শব্দ করতে থাকে সে। চোখের মণি চোখ থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসতে থাকে, ঘোলাটে কালচে বেগুনি রংয়ের মতো চেহারা হয়ে আসে তার নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। থর থর করে কাপছে। থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে সে অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে। অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে।

আমি লেনের দিকে তাকালাম, সে নেশাগ্রস্থ মানুষের মতো টলছে, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। তাল সামলে কোনভাবে দুই পা এগিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল সে। আমি ছুটে গিয়ে তাকে জাপটে ধরলাম। সাথে সাথে সমস্ত মহাকাশযান নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল।

আমি লেনকে বুকে চেপে ধরে রেখে ফিস ফিস করে ডাকলাম, লেন, জেগে উঠো। দেখ তুমি গ্রাউলকে ধ্বংস করে দিয়েছ! দেখ! দেখ!

 

লেন জেগে উঠল না। আমার বুকে অচেতন হয়ে পড়ে রইল।

৯. পৃ মানে পৃথিবী

মহাকাশযানের বড় করিডোর ধরে মাঝারি ধরনের একটা ভাসমান যানে করে আমরা নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম। কয়দিনের মাঝে আমরাও শীতল ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে যাব, তার আগে শেষবার মহাকাশযানটা ঘুরে দেখছি। কিছুদিন আগেও অসংখ্য মানুষে পুরো এলাকাটা জনাকীর্ণ ছিল, এখন কেউ নেই। গ্রাউলের হাত থেকে কর্তৃত্ব সরিয়ে নিয়ে সাথে সাথে মহাকাশযানকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যে লোভকে পুঁজি করে মানুষকে অমানুষে রূপান্তরিত করা হয়েছিল সেউ লোভের সামগ্রীকে হঠাৎ করে সবার কাছে সহজলভ্য করে দেয়া হয়েছে। তখন রাতারাতি মহাকাশযানের বিচিত্র জটিল সেই নৃশংস অমানবিক জীবনটি পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে গেছে। মহাকাশচারীদের আবার শীতল ঘরে ফিরে যেতে বলা হয়েছে, কেউ প্রতিবাদ না করে স্বেচ্ছায় ফিরে গেছে। মহাকাশযানটিতে আবার সেই ভুতুড়ে নৈঃশব্দ নেমে এসছে। পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছানোর পর আবার সবাইকে জাগিয়ে তোলা হবে, প্রাণচাঞ্চল্যে আবার ভরপুর হয়ে উঠবে এই বিশাল মহাকাশযান।

পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষ নিয়ে গ্রাউল সবার কাছে মিথ্যে তথ্য দিয়ে। আসছিল। পৃথিবীর মানুষ নিজেদের মাঝে হানাহানি করছে সেটি সত্যি নয়। হানাহানি করার জন্যে পৃথিবীতে এখন কোনো মানুষ নেই। মানুষের স্বেচ্ছাচারিতায় সমস্ত পৃথিবী বাসের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল, প্রায় দুই হাজার বছর আগে শেষ মানুষটি পৃথিবী ছেড়ে গ্রহান্তরে পাড়ি দিয়েছে। এই দুই হাজার বছর প্রকৃতি নিজের হাতে পৃথিবীকে আবার মানুষের বাসের যোগ্য করে গড়ে তুলেছে। আবার সেখানে নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর সবুজ বনারণ্য গড়ে উঠেছে। আমরা সেখানে গিয়ে আবার নূতন করে মানব জীবন শুরু করব।

পৃথিবীর কথা ভাবতে ভাবতে আমি অন্যমনস্ক ভাবে বাইরে তাকিয়েছিলাম, লেন এসে আমার কাঁধে হাত রাখল। আমি তার দিকে ঘুরে তাকালাম, তার ঝকঝকে খাপ খোলা চেহারা দেখে আবার আমার বুকের ভেতর এক ধরণের বেদনা বোধ হতে থাকে। লেন নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী দেখছ?

না। কিছু না।

আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমরা বেঁচে আছি।

আমি হেসে বললাম, আসলে আমরা বেঁচে নেই। এই পুরো ব্যাপারটা আসলে মহামতি গ্রাউলের অত্যাশ্বর্য মস্তিষ্কের একটা স্বপ্ন দৃশ্য। এক্ষুনি তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে তখন–

লেন আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, দোহাই তোমার। গ্রাউলের কথা বল না।

সে কেমন আছে শুনবে না?

না, শুনতে চাই না।

বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। পুরোপুরি উন্মাদ—

লেন কাতর গলায় বলল,আমি শুনতে চাই না।

আমি লেনকে নিজের কাছে টেনে এনে বললাম, কেন শুনতে চাও না? কী আশ্চর্য শক্তিতে তুমি তাকে পরাস্ত করে পুরো মহাকাশযান আর তার হাজার হাজার মহাকাশচারীকে রক্ষা করেছ সেটা শুনবে না?

না। আমি শুনব না। আমি সব কিছু ভুলে যেতে চাই।

ঠিক তখন পিছনে কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ হল এবং সাথে সাথে একাধিক শিশুর উল্লাস ধ্বনি শোনা গেল। লেনের মুখে অধৈর্যের একটা ছায়া পড়ে, সে কাতর গলায় বলল, ঐ দেখ আবার শুরু করল ওরা! কী করি ওদের নিয়ে বল তো?

আমি হেসে বললাম, মানুষের এক সাথে একটি করে সন্তান থাকার কথা। সেই একটি সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে বাবা মায়ের কালো ঘাম ছুটে যায়। তোমার সন্তান হচ্ছে আটটি। এই সমস্যার কোন সমাধান নেই লেন। এর আগে কথা জানত না তখন তবু সামলে দেয়া যেত। এখন ওরা কথা শিখেছে ওদেরকে আর কোনভাবে সামলে নেয়া যাবে না। তুমি কিছুদিনে পাগল হয়ে যাবে লেন!

আমি একা কেন? তুমিও পাগল হয়ে যাবে।

হ্যাঁ। আমিও মনে হয় পাগল হয়ে যাব–

আমার কথা শেষ হবার আগেই শিশুগুলি হুঁটোপুটি করতে করতে আমাদের কাছে হাজির হল। তারা কয়েকজন মিলে একজনকে নিচে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে, যারা ফেলছে এবং যাকে ফেলছে সবারই একধরনের বিচিত্র উল্লাস হচ্ছে বলে মনে হয়। লেন বৃথাই তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে ওখানে?

খেলছি।

কী খেলছ?

খেলছি আমরা পৃ’তে গিয়েছি।

পু?

হ্যাঁ। পৃ মানে পৃথিবী!

 

আমি সাবধানে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। এই শিশুরা আমাদের জন্যে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলবে। ভালবাসাময় আনন্দের একটা পৃথিবী।

নতুন পৃ।

———-

Exit mobile version