Site icon BnBoi.Com

ত্রিনিত্রি রাশিমালা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ত্রিনিত্রি রাশিমালা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 ০১. খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে

আমি দীর্ঘ সময় খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরে আবছা অন্ধকার, আকাশে সম্ভবত মেঘ করেছে, দক্ষিণের একটা নিম্নচাপ এই এলাকার উপর দিয়ে যাবার কথা। মেঘ আমার বড় ভালো লাগে, কিন্তু আজ আমি মেঘের জন্যে অপেক্ষা করছি না। দিনের আলো নিভে যখন অন্ধকার নেমে আসে, নিচের আদিগন্ত বিস্তৃত শহরে যখন একটি একটি করে নক্ষত্রের মতো আলো ফুটতে থাকে তখন সেটি দেখতেও আমার খুব ভালো লাগে, কিন্তু আজ আমি সেটাও দেখছি না। আমার মন আজ বড় বিক্ষিপ্ত, আমার ভালবাসার মেয়েটি আজ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

আমার হঠাৎ ত্রিশার কথা মনে পড়ল, সাথে সাথে বুকের ভিতর কোথায় জানি যন্ত্রণা করে ওঠে। কিছুক্ষণ আগেও ত্রিশা এই ঘরে ছিল। আমি আর ত্রিশা মুখোমুখি বসেছিলাম। ত্রিশা বসেছিল আমার খুব কাছে, এত কাছে যে আমি তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছিল সেই বাতাসে তার মাথার চুল উড়ে উড়ে যাচ্ছিল, আমার খুব ইচ্ছে করছিল হাত দিয়ে আমি তার চুল স্পর্শ করি। কিন্তু আমি চুপ করে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, আমি বুঝতে পেরেছিলমি সে আজ আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।

ত্রিশা অনেকক্ষণ বিষণ্ণ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আমার কপাল থেকে কয়েকটা চুল সরিয়ে নরম গলায় ডেকে বলেছিল, রিকি—

আমি কোনো কথা না বলে তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলাম। তখন সে কেমন যেন চেষ্টা করে নিজেকে একটু শক্ত করে বলেছিল, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই রিকি।

আমি খুব সাবধানে একটা নিশ্বাস গোপন করে বলেছিলাম, তুমি কী বলবে আমি জানি ত্রিশা।

ত্রিশা তখন খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি জান?

হ্যা আমি জানি। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নরম গলায় বলেছিলাম, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, ত্রিশা।

আমার কথা শুনে ত্রিশা চমকে উঠেছিল, তার মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে সে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কেমন করে এটা জানলে?

আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, আমি জানি না।

তখন ত্রিশা আমার দিকে অনেকক্ষণ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। তার দুই চোখে পানি জমে উঠেছিল, হাত দিয়ে পানি মুছে সে গলার স্বর খুব স্বাভাবিক করে বলেছিল, আমি খুব দুঃখিত রিকি। তুমি খুব চমৎকার একটি মানুষ, আমি কখনো তোমার কথা ভুলব না। কিন্তু আমরা দুজন একজন আরেকজনের জন্যে নই। আমরা যদি কাছাকাছি থাকি একজন থেকে আরেকজন শুধু কষ্টই পাব–

ত্রিশা নরম গলায় আরো অনেক কথা বলেছিল, আমি সেগুলো ভালো করে শুনি নি। সেসব কথায় কিছু আসে যায় না। আমার খুব ইচ্ছে করছিল তার দুই হাত জাপটে ধরে অনুনয় করে বলি, ত্রিশা তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমি জানি তুমি কী চাও, আমি তোমার সব স্বপ্ন সত্য করে দেব। বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছা করলে পারি।

কিন্তু আমি ত্রিশাকে কিছু বলি নি। আমি তাকে উঠে যেতে দেখেছি, টেবিল থেকে তার ছোট ব্যাগটা তুলে নিতে দেখেছি, তারপর আমাকে গভীর ভালবাসায় একবার আলিঙ্গন করে দরজা খুলে চলে যেতে দেখেছি। আমি তাকে ডেকে ফেরাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফেরাই নি। কেন ফেরাই নি কে জানে? আমি অন্য মানুষের মনের কথা বুঝে ফেলি অনায়াসে কিন্তু কখনো নিজেকে বুঝতে পারি নি। কেন ঈশ্বর আমাকে সাধারণ একজন মানুষ করে জন্ম দিল না? কেন?

আমি জানালা খুলে নিচে তাকালাম এবং ঠিক তখন আমার খুব একটা বিচিত্র জিনিস মনে হল। আমি যদি এখন তিন শ এগার তালার উপর থেকে নিচের চকচকে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ি তাহলে কেমন হয়? তিন শ এগার তালা অনেক উঁচু, নিচে পড়তে কম করে হলেও চৌদ্দ সেকেন্ড সময় লাগবে। এই চৌদ্দ সেকেন্ড সময় যখন নিজেকে ভরশূন্য মনে হতে থাকবে এবং যখন নিশ্চিত মৃত্যুকে দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখব তখন কি জীবনকে একটি সম্পূর্ণ নূতন দৃষ্টি থেকে দেখা যাবে? যে দৃষ্টিতে আমি জীবনকে কখনো দেখি নি? আমি এক ধরনের লোভাতুর দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং ঠিক তখন আমার কানের কাছে কিটি ফিসফিস করে বলল, লাফ দিতে চাও?

আমি ঘুরে কিটির দিকে তাকালাম, কিটি আমার ঘরের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার রবোট। সে দীর্ঘদিন থেকে আমার সাথে আছে। বুদ্ধিমত্তা নিনিষ স্কেলে চার মাত্রা থেকে বেশি হওয়ার কথা নয়। শুধুমাত্র দীর্ঘদিনের সাহচর্যের কারণে তার সাথে আমার এক ধরনের বিচিত্র বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। ইদানীং সে আমাকে খানিকটা বুঝতে শিখেছে বলে মনে হয়। আমি একটু অবাক হয়ে কিটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী বললে?

জানালা দিয়ে লাফ দিতে চাও?

লাফ দেব? কেন?

কোনো মানুষকে যখন তাদের ভালবাসার মেয়েরা ছেড়ে চলে যায় তখন তারা এ রকম করে। কেউ মাথায় গুলি করে, কেউ জানালা দিয়ে লাফ দেয়। আমি খবরের কাগজে পড়েছি। এটাকে মানসিক ভারসাম্যহীনতা বলে।

তোমার তাই মনে হচ্ছে? আমি মানসিক ভারসাম্যহীন?

হ্যাঁ। কিটি তার সবুজ চোখে এক ধরনের একাগ্রতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকে, মাথা নেড়ে বলে, তুমি আজ অবশ্যি মানসিক ভারসাম্যহীন। কফিতে দুই চামচ চিনি না দিয়ে এক চামচ চিনি দিয়েছ।

এক চামচ?

হ্যাঁ।

সেই জন্যে আমি মানসিক ভারসাম্যহীন?

হ্যাঁ। তুমি কম্পিউটারে তোমার জার্নাল পড় নি। চিঠি খুলে দেখ নি। এখন এত বেলা হয়েছে তুমি তবু আমাকে রাতের খাবার গরম করতে বল নি। তুমি মানসিক ভারসাম্যহীন। তুমি দুঃখী। তুমি মনে হয় এখন জানালা দিয়ে লাফ দেবে।

আমি খানিকক্ষণ কিটির দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে বললাম, কিটি তুমি একেবারে সত্য কথা বলেছ! আমার সত্যি ইচ্ছে করছে জানালা থেকে লাফ দিয়ে জীবন শেষ করে দিই।

আমি আগেও লক্ষ করেছি, আমার মনের গভীরের কথা যেগুলো কখনোই অন্য কোনো মানুষকে জানতে দিই না আমি অবলীলায় এই নির্বোধ রবোটটিকে বলে ফেলি। রবোটটি কখনোই আমার অনুভূতির গভীরতা ধরতে পারে না, আজকেও পারল না। তার চোখের ঔজ্জ্বল্য কয়েক মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমারও তাই ইচ্ছে করছে।

তোমার কী ইচ্ছে করছে?

তোমার সাথে লাফ দিই।

কেন?

তুমি যখন মরে যাবে তখন আমাকে এমনিতেই ধ্বংস করে ফেলবে। চার মাত্রার রবোটে তেতাল্লিশ দশমিক তিন পয়েন্ট কপোট্রন এখন কোথাও নেই। তাই আমার মনে হয় তোমার সাথে লাফ দেয়াই ভালো। তোমার যদি কোনোকিছুর প্রয়োজন হয় আমি কাছাকাছি থাকব।

প্রয়োজন?

হ্যাঁ। তুমি যখন নিচে পড়তে থাকবে তখন যদি কিছু প্রয়োজন হয়।

আমি এক ধরনের স্নেহের চোখে এই পরিপূর্ণ নির্বোধ রবোটটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে খানিকক্ষণ আমাকে লক্ষ্য করে হঠাৎ ঘরের ভিতরে গিয়ে প্রায় সাথে সাথে একটা ইলেকট্রনিক নোট প্যাড নিয়ে ফিরে এল। নোট প্যাডটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি কি কিছু লিখে যেতে চাও?

কী লিখব?

মানুষেরা যখন নিজেরা নিজেদের সার্কিট নষ্ট করে ফেলে তখন সাধারণত তার আগে কিছু লিখে যায়।

কী লেখে?

আমার সার্কিট নষ্ট করার জন্যে কেউ দায়ী নয়।

সার্কিট নষ্ট?

হ্যাঁ। তোমরা মৃত্যু বল সেটাকে। সেটাও লিখতে পার, আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়।

আমি কিটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খুকখুক করে হেসে ফেললাম, কিটি সাথে সাথে ঘুরে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ হেঁটে ঘরের ভিতরে চলে গেল। আমি পিছন থেকে ডেকে বললাম, কী হল? তুমি কোথায় যাও?

খাবার গরম করি। তুমি খাবে।

হঠাৎ করে?

তুমি হেসেছ, তার মানে তোমার মানসিক ভারসাম্যতা ফিরে এসেছে। তুমি এখন জানালা দিয়ে লাফ দিবে না।

আমি এক ধরনের ঈর্ষার দৃষ্টিতে কিটির দিকে তাকিয়ে থাকি। কী ভয়ঙ্কর রকমের সহজ সরল তার হিসেব–জীবন যদি সত্যিই এ রকম সহজ হত কী চমৎকারই না হত সবকিছু।

আমার আবার ত্রিশার কথা মনে পড়ল, আমি এখন যেরকম কষ্টে ছটফট করছি ত্রিশাও নিশ্চয়ই কোথাও ঠিক আমার মতো কষ্টে ছটফট করছে। আমি মানুষকে ভালবাসতে জানতাম না, ত্রিশা আমাকে শিখিয়েছে। আমি যখন ভালবাসতে শিখেছি তখন সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি তাকে পেতে পারতাম, সেও আমাকে পেতে পারত, কিন্তু তবু আমরা একজন আরেকজনকে পেলাম না। পেলাম না কারণ ত্রিশা সত্যিকার জীবনের কথা ভেবেছে। যে জীবনে ঘুম থেকে উঠে সুড়ঙ্গ দিয়ে অতল গহ্বরে কাজ করতে যেতে হয়, দিনশেষে ক্লান্ত দেহে লম্বা লাইন দিয়ে খাবারের প্যাকেট তুলে আনতে হয়, মাসের শেষে টার্মিনালে নিজের একাউন্টে শেষ রসদটি যত্ন করে খরচ করতে হয়, শীতের রাতে বুভুক্ষের মতো আলোকোজ্জ্বল উষ্ণ দালানের দিকে হিংসাতুর চোখে তাকিয়ে থাকতে হয়। ত্রিশা সে জীবন চায় নি, নিজের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সে ভয় পেয়েছে। সে যে জীবন চেয়েছে। আমি তাকে সেই জীবন দিতে পারব না। চাইলে হয়তো পারতাম কিন্তু আমি কখনো চাই নি। তাই আমি শহরতলিতে তিন শ এগার তালায় মেঘের কাছাকাছি একটা ঘরে নির্বোধ একটা রবোটকে নিয়ে দিন কাটিয়ে দিই। হ্রদের কাছে পাইন গাছের আড়ালে আমার মেটে রঙের কাঠের বাসা নেই, আমার ঘরে মেগা কম্পিউটার নেই, হ্রদে নিউক্লিয়ার নৌকা নেই, বাগানে বাই ভার্বাল নেই, বাসার পিছনে নরম রোদে বসে থাকা আমার স্ত্রী নেই, ঘাসে লুটোপুটি খাওয়া আমার সন্তান নেই। আমি জানি আমার থাকবে না, ত্রিশা তাই আমার কাছে এসেও এল না।

রাতে কিটি গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাকে স্যুপ খেতে দেখল। খাওয়া শেষ করার পর বলল, ঠিকমতো গরম হয়েছিল?

হ্যাঁ, কিটি।

তুমি জান গতকাল স্যুপের মাঝে মাংস তুলনামূলকভাবে একটু বেশি ছিল।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আপেক্ষিক তাপও ছিল বেশি। তাই স্যুপের তাপমাত্রা ঠিক উনাশি ডিগ্রিতে পৌঁছায় নি।

উনাশি ডিগ্রি?

হ্যাঁ। তোমার বান্ধবী ত্রিশা উনাশি ডিগ্রির স্যুপ খেতে পছন্দ করে। কালকে সে স্যুপটি পছন্দ করে নি। মনে হয় সে জন্যেই তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

আমি আবার একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, না কিটি। স্যুপের তাপমাত্রা উনাশি ডিগ্রি হয় নি বলে কখনো কোনো মেয়ে কাউকে ছেড়ে যায় নি।

গিয়েছে। কিটি গম্ভীর ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, আমি খবরের কাগজে পড়েছি একটা মানুষ সবুজ রঙের ট্রাউজারের সাথে লাল রঙের প্যান্ট পরেছিল বলে একটি মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সবুজ আর লাল মানুষের চোখে পরিপূরক রং জান তো? ছেলে এবং মেয়ের ভালবাসা হলে ছোট ছোট জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।

ভালবাসা মানে তুমি বোঝ কিটি?

একটু একটু বুঝি। দুজন মানুষের টিউনিং ফ্রিকোয়েন্সি এক হওয়ার মানে ভালবাসা। রেজোনেন্স হওয়া মানে ভালবাসা।

কিটি গম্ভীর ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে থাকে। ঘাড়ের কাছে কোথাও নিশ্চয়ই একটা স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে। কয়দিন থেকেই দেখছি অল্পতেই তার মাথা বেসামালভাবে নড়তে থাকে।

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুরেফিরে আমার শুধু ত্রিশার কথা মনে হল। আমি জীবনে সত্যিকার অর্থে এর আগে কখনো দুঃখ পাই নি। শৈশবে আমার মা আর বাবা আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের জন্যে আমার ভিতরে ভালবাসা বা আক্রোশ কোনোটাই নেই। অনাথ আশ্রম সম্পর্কে যেরকম ভয়ঙ্কর সব গল্প শোনা যায় তার সব সত্যি নয়। পুরোপুরি রবোটের তত্ত্বাবধানে অনাথ শিশুরা মানুষ হয় সত্যি কিন্তু মাঝে মাঝে সত্যিকারের মানুষও দেখা করতে আসে। আমাদের অনাথ আশ্রমে যে মানুষটি আসতেন তিনি ছিলেন একজন মায়াবতী মহিলা। সেই মহিলাটি সপ্তাহে একবার করে এসে আমাদের সবার সাথে আলাদা করে কথা বলতেন। সত্যিকারের মানুষ খুব বেশি দেখতে পেতাম না। বলে আমরা অনাথ শিশুরা একে অন্যকে খুব ভালবাসতাম। আমার এখনো অনেকের সাথে যোগাযোগ আছে। তাদের কেউ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি, শৈশবে মানুষের সাহচর্য ছাড়া বড় হলে মনে হয় মানুষের জীবনে কোথায় কী জানি ওলটপালট হয়ে যায়।

বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে এক সময় সত্যি আমার চোখে ঘুম নেমে এল। ঠিক যখন ঘুমে ঢলে পড়ছি তখন কিটির গলার স্বর শুনতে পেলাম, সে আমাকে ডেকে বলল, রিকি, তুমি আজকে তোমার চিঠিগুলো দেখ নি।

আমি ঘুম জড়ানো গলায় বললাম, আজ থাক, কাল ভোরে দেখব।

একটা খুব জরুরি চিঠি আছে মনে হয়। লাল রঙের বর্ডার।

থাকুক।

ইয়োরন রিসির চিঠি।

আধো ঘুমে আমি কিটির গলার স্বর ভালো করে শুনতে পেলাম না, নামটি পরিচিত মনে হল কিন্তু ধরতে পারলাম না। ঠিক ঘুমিয়ে পড়ার পূর্বমুহূর্তে মানুষের মস্তিষ্ক সম্ভবত স্মৃতি হাতড়ে কোনো তথ্য খুঁজে বের করতে চায় না। তা না হলে আমি ইয়োরন রিসি নাম শুনেও ঘুমিয়ে যেতে পারতাম না। সে

ইয়োরন রিসি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক–ঈশ্বরের পর পৃথিবীতে তাকে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী বলে ধরা হয়।

০২. ঘুম ভাঙল খুব ভোরে

আমার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। ঘুমাতে ঘুমাতে সবসময় আমার দেরি হয়ে যায়, কখনোই আমি ভোরে উঠতে পারি না। আজ কিটি আমাকে ডেকে তুলল, পা ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, রিকি, ওঠ। জরুরি দরকার।

কিটি ঠাট্টা, তামাশা, রসিকতা বা রহস্য বোঝে না। কাজেই সে যদি বলে জরুরি দরকার তার অর্থ সত্যিই জরুরি দরকার। আমি ধড়মড় করে চোখ খুলে উঠে বসলাম, কী হয়েছে?

তোমার কাছে দুজন লোক এসেছে।

কোথায়?

বসার ঘরে বসে আছে।

বসার ঘরে?

হ্যাঁ।

আমি বিছানা থেকে নামলাম, কারা এরা?

বিজ্ঞান পরিষদের লোক। মনে আছে কাল রাতে তোমার কাছে ইয়োরন রিসির চিঠি এসেছিল?

কার? আমি প্রায় আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করলাম, কার?

ইয়োরন রিসির। বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক।

আমি চিৎকার করে বললাম, কোথায় সেই চিঠি? এতক্ষণে বলছ মানে? তোমার কপোট্রনে কি ফুটো হয়ে গেছে?

কিটি শান্ত গলায় বলল, তোমাকে আমি কাল রাতেই বলেছি। তুমি কোনো গুরুত্ব দাও নি। মনে নেই কাল তুমি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলে? এই যে চিঠি।

আমি তার হাত থেকে চিঠিটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে খুলে ফেললাম, চিঠিটা দেখে আমার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক ইয়োরন রিসি নিজের হাতে বিজ্ঞান পরিষদের প্যাডে লিখেছেন,

প্রিয় রিকি :
তুমি কি কাল সময় করে আমাদের কয়েকজনের সাথে একটু দেখা করতে পারবে?
–ইয়োরন রিসি।

আমার হাত কাঁপতে থাকে, চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থেকেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ নিজের হাতে একটা চিঠি লিখে আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন! আমার সাথে? নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ভুল হয়েছে। আমি কিটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, নিশ্চয় কিছু ভুল হয়েছে।

কিটি বলল, বাজে কথা বোলোনা। বিজ্ঞান পরিষদ কখনো কোনো ভুল করে না। মহামান্য রিসি কখনো কোনো ভুল করেন না।

কিন্তু কিন্তু আমার সাথে মহামান্য রিসির কী দরকার থাকতে পারে? আমি তখনো একটা ঘোরের মাঝে রয়ে গেছি, শুকনো গলায় বললাম, কী দরকার?

এত ব্যস্ত হওয়ার কী আছে? একটু পরেই তো জানতে পারবে। কিটি ঘুরঘুর করে পাশের ঘরে চলে গেল, সম্ভবত আমার জন্যে পরিষ্কার কাপড় জামা বের করবে। তার ভাবভঙ্গি খুব সহজ, দেখে মনে হয় বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালকের আমার সাথে দেখা করা একটা দৈনন্দিন ব্যাপার। নিচু স্তরের রবোটদের অবাক হবার ক্ষমতা নেই ব্যাপারটা আমি আগেও লক্ষ করেছি।

আমি ঘুমের কাপড়েই বসার ঘরে উঁকি দিলাম, ফুটফুটে একটা মেয়ে এবং মাঝবয়সী একজন মানুষ চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। তাদের ভাবভঙ্গি খুব সপ্রতিভ। আমাকে দেখে মানুষটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম আমরা?

কী ব্যাপার! আমি শুকনো গলায় বললাম, মহামান্য রিসি কেন দেখা করতে চান আমার সাথে?

লোকটা হো হো করে হেসে বলল, আপনি সত্যিই মনে করেন মহামান্য রিসি নিজে আপনার সাথে দেখা করতে চাইবেন আর আমাদের মতো মানুষ তার কারণটা জানবে?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু আমার সাথে?

হ্যাঁ।

যদি আমি কাল বাসায় না থাকতাম? চিঠি যদি না পেতাম?

লোকটা হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, আপনি মনে করছেন মহামান্য রিসি যদি আপনার সাথে দেখা করতে চান তখন সেটা আমরা কখনো ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিই? কখনোই দিই না!

আমি–আমি কখনো এত বড় মানুষের সাথে দেখা করি নি। কী করতে হয়, কী বলতে হয় কিছুই জানি না। ভালো কাপড়ও মনে হয় নেই আমার

সাথের মেয়েটি এই প্রথমবার কথা বলল, আপনি যেন সেসব নিয়ে মাথা না ঘামান সে জন্যেই আমরা এখানে এসেছি। মহামান্য রিসি আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন সেটা হচ্ছে বড় কথা! আপনি যেভাবে সহজ বোধ করেন ঠিক সেভাবে থাকবেন। কোনোকিছু নিয়ে এক বিন্দু মাথা ঘামাবেন না।

আর কে কে সেখানে থাকবে?

আমরা তো জানি না। আমাদের জানার কথাও না!

কোনোরকম কি কিছু আভাস দিতে পারেন?

মধ্যবয়স্ক লোকটি এবারে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, রিকি–আপনি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষদের একজন। ব্যাপারটি কী আমরা জানি না, কিন্তু এটুকু নিশ্চিত জানি আর যাই হোক এটা অশুভ হতে পারে না। আপনি যান, হাতমুখ ধুয়ে আসুন! একসাথে নাশতা করা যাক।

আমি ভিতরে যাচ্ছিলাম, মেয়েটা বলল, একটা মাত্রার রবোট দেখলাম, আপনার রবোট এটা?

হ্যাঁ। কিটি।

কী আশ্চর্য! আমি কখনো সচল চতুর্থ মাত্রার রবোট দেখি নি। আমার ধারণা ছিল সব সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

আমি হেসে বললাম, খোঁজ পেলে কিটিকেও সরিয়ে নেবে। আমি খোঁজ দিই নি। অনেকদিন থেকে আছে তাই মায়া পড়ে গেছে।

ও! মেয়েটা মনে হল একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কোনো তাড়াহুড়া করবেন না। আমরাই আপনাকে বিজ্ঞান পরিষদে নিয়ে যাব।

.

আমরা যখন বিজ্ঞান পরিষদে পৌঁছেছি তখনো বেশ সকাল। দরজায় নানা রকম কড়াকড়ি রয়েছে, সবার রেটিনা স্ক্যান করে ভেতরে ঢুকতে হচ্ছে কিন্তু আমার কিছুই করতে হল না। সাথের দুজন আমাকে ভিতরে নিয়ে এসে অন্য দুজন মানুষের কাছে পৌঁছে দিল, তারা আবার অন্য দুজনের কাছে এবং এই দুজন আমাকে বিশাল একটি হলঘরে নিয়ে হাজির হল। ঘরটির দেয়াল অর্ধস্বচ্ছ এক ধরনের পাথরের তৈরী।

ছাদটি অনেক উঁচুতে, সেখান থেকে হালকা এক ধরনের আলো বের হচ্ছে, সমস্ত ঘরে কোমল এক ধরনের আলো। ঘরে কোনো জানালা নেই, শুধু মাঝখানে বিশাল একটা কালো টেবিল। টেবিলটি ঘিরে রয়েছে খুব সুন্দর অনেকগুলো চেয়ার, সুন্দর চেয়ার সাধারণত আরামদায়ক নয় কিন্তু আমি বসে বুঝতে পারলাম চেয়ারগুলো তৈরি হয়েছে অসম্ভব যত্ন করে, বসতে ভারি আরাম।

ঘরটিতে আমি ছাড়াও আর চার জন মানুষ, দুজন মেয়ে এবং দুজন পুরুষ। সবাই মোটামুটি আমার বয়সী, দেখে মনে হয় আমার সাথে তাদের সবার এক ধরনের মিল রয়েছে, কিন্তু মিলটুকু কোথায় আমি ঠিক ধরতে পারলাম না। দুজন পুরুষ মানুষের মাঝে একজন খুব ছিমছাম পরিষ্কার, মাথার চুল পরিপাটি, কাপড় জামা সুন্দর এবং মোটামুটি রুচিসম্মত। সে আরামদায়ক চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে খুব শান্তভাবে বসে আছে। এমনিতে। দেখে বোঝা যায় না কিন্তু তার চোখের দিকে তাকাতেই বোঝা যায় মানুষটি ভিতরে ভিতরে খুব উদ্বিগ্ন।

ঘরের দ্বিতীয় মানুষটির মাথায় লম্বা চুল, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। গায়ের জামাকাপড় যাচ্ছেতাই এবং চেহারাতে এক ধরনের বেপরোয়া ভাব। তাকে দেখে মনে হয় কোনো কিছুতেই তার কিছু আসে যায় না। মেয়ে দুজনের একজন কোমল চেহারার, রাস্তায় ছোট শিশুর হাত ধরে যেরকম কমবয়সী মায়েদের হেঁটে যেতে দেখা যায় তার চেহারা অনেকটা সেরকম। মেয়েটা ইচ্ছে করলেই একটু সেজেগুঁজে নিজেকে অনেকখানি আকর্ষণীয়া করে ফেলতে পারত, কিন্তু মনে হয় তার সেদিকে কোনো আগ্রহ নেই। মেয়েটি টেবিলে দুই হাত রেখে শান্ত কিন্তু উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। দ্বিতীয় মেয়েটির চেহারা খাপখোলা তলোয়ারের মতো ঝকঝকে। সে অস্থির এবং উদ্বিগ্ন এবং সেটা ঢেকে রাখার একটুও চেষ্টা করছে না। মেয়েটি চেয়ারে না বসে একটু পরে পরেই টেবিলটা ঘুরে আসছে, মসৃণ মার্বেল পাথরের মেঝেতে তার জুতোর শব্দ হচ্ছে ঘরটির একমাত্র শব্দ।

আমি আমার চেয়ারে বসে সবার দিকে একনজর তাকিয়েই বুঝতে পারি আমাকে মহামান্য রিসি যেভাবে ডেকে এনেছেন, এদের চারজনকেও ঠিক সেভাবে ডেকে আনা হয়েছে। আমার মতোই এরা কেউ জানে না তারা কেন এখানে অপেক্ষা করছে।

ধারালো চেহারার মেয়েটি টেবিলটা আরো একবার ঘুরে এসে হঠাৎ আমার কাছে থেমে জিজ্ঞেস করল, আমাদের এখানে বসিয়ে রেখেছে কেন জান?

মনে হয় আমরা যেন নিজেরা একটু কথা বলি সেজন্যে।

তাহলে কথা বলছি না কেন?

মনে হয় আমরা সবাই খুব ঘাবড়ে আছি!

আমার কথা শুনে সবাই একটু হেসে ফেলল। হাসি একটি চমৎকার ব্যাপার, মানুষকে চোখের পলকে সহজ করে দেয়। হঠাৎ সবাই সহজ হয়ে গেল। ছিমছাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষটি বলল, আমাদের এখানে কেন এনেছে তোমরা কেউ আন্দাজ করতে পার?

আমি ভেবেছিলাম সবাই মাথা নেড়ে বলবে, না, পারি না। কিন্তু কেউ সেটি বলল না, একে অন্যের দিকে তাকাল এবং সবার চোখে সূক্ষ্ম বিস্ময়ের একটু ছায়া পড়ল। সবাই কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে, ঠিক আমার মতোই! বারবার যে জিনিসটি আমার মাথায় উঁকি দিয়ে উঠছে এবং বারবার আমি যেটা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিচ্ছি সেটা হয়তো সত্যি। সেটা সম্ভব হতে পারে শুধুমাত্র একভাবে, আমি আবার সবার দিকে ঘুরে তাকালাম এবং লক্ষ করলাম, সবাই ঠিক আমার মতোই অন্য সবার দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে, সবিস্ময়ে!

ঠিক এই সময় নিঃশব্দে একটা দরজা খুলে গেল এবং বুড়োমতো একজন ছোটখাটো মানুষ হাতে ছোট একটা প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকল। মানুষটি ছোট ছোট পায়ে হেঁটে আমাদের কাছে এগিয়ে এল এবং আমরা হঠাৎ করে তাকে চিনতে পারলাম, ইয়োরন রিসি! কতবার হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে এই মানুষটির ছবি দেখেছি কিন্তু কখনোই ভাবি নি তিনি এ রকম ছোটখাটো মানুষ। কেন জানি না ধারণা ছিল তিনি হবেন বিশাল, তার চেহারা হবে কান্তিময়, গায়ের রং হবে উজ্জ্বল, তার পোশাক হবে বর্ণময়–কিন্তু তিনি একেবারে সাধারণ চেহারার মানুষ। কিন্তু তাকে দেখে আমার আশাভঙ্গ হল না বরং বুকের ভিতরে আমি এক ধরনের গভীর ভালবাসা অনুভব করতে থাকি। আমার এক ধরনের অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চ হতে থাকে।

ইয়োরন রিসি টেবিলের কাছে এসে থেমে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, সে কী! তোমরা সবাই এত দূরে দূরে বসেছ কেন? এস কাছাকাছি এস। এখানে এত বড় একটা টেবিল রাখাই ভুল হয়েছে।

আমি তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে হাঁটুতে একটা চোট পেলাম। সে অবস্থাতেই তার যতটুকু কাছে গিয়ে বসা সম্ভব সেখানে বসে গেলাম। এই মানুষটির পাশে বসা দূরে থাকুক কোনোদিন নিজের চোখে দেখব ভাবি নি।

ইয়োরন রিসি আমাদের দিকে তাকালেন। তার মুখে এক ধরনের হাসি, দুষ্ট ছেলের দুষ্টুমি ধরে ফেলে সহৃদয় বাবারা যেভাবে হাসে অনেকটা সেরকম। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ আমি ইয়োরন রিসি। তোমরা কারা পরিচয় দিতে হবে না, আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালো করে চিনি।

আমরা পাঁচ জন অবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। আমাদের বিস্ময়টুকু মনে হয় তিনি খুব উপভোগ করলেন, হা হা করে হেসে বললেন, বিশ্বাস হচ্ছে না তোমাদের? এই দেখ আমি ঠিক বলি কি না—

ইয়োরন রিসি দাড়িগোঁফে ঢাকা জঙ্গুলে চেহারার মানুষটিকে দেখিয়ে বললেন, তুমি হিশান। তুমি একটা ব্যাংকে চাকরি কর। ছোট্ট চাকরি, তোমার কাজে মন নেই। উপরওয়ালা দুদিন পরে পরে তোমাকে হুমকি দিয়ে বলে তোমাকে ছাঁটাই করে দেবে। শীতের শুরুতে তুমি দাড়িগোঁফ রাখা শুরু কর, বসন্তের শেষে যখন একটু গরম পড়তে শুরু করে তখন তুমি দাড়িগোঁফ চুল কামিয়ে পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে যাও। ঠিক কি না, হিশান?।

হিশান নামের মানুষটি হেসে ফেলল। দাড়িগোঁফে আড়াল হয়ে থাকা মুখ থেকে সহৃদয় হাসিটি বের হতেই আমরা হঠাৎ করে টের পেলাম মানুষটিকে দেখে তিরিক্ষে বদমেজাজি মনে হলেও সে নেহাতই ভালো মানুষ।

ইয়োরন রিসি এবারে ছিমছাম পরিষ্কার মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ইগা। তোমার একটা গোপন ল্যাবরেটরি আছে সেখানে তুমি বিসুবিচারিয়াস বানাও। খোলাবাজারে মোটামুটি ভালো দামে বিক্রি হয়, এত মজার নেশা আর কি আছে?

ইগার মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ইয়োরন্ রিসি হা হা করে হেসে তার প্যাকেটটা তুলে বললেন, তুমি ভাবছ কেউ জানে না? এই দেখ আমার কাছে তোমার কত বড় ফাইল!

ইগা নামের মানুষটি কী একটা কথা বলতে গেল, ইয়োরন রিসি তার কাধ স্পর্শ করে থামিয়ে দিয়ে চোখ মটকে বললেন, তোমার কোনো ভয় নেই ইগা। পুলিশ কোনোদিন তোমাকে ধরবে না। আমি আছি তোমার পিছনে।

ইগা ভয়ে ভয়ে ইয়োরন রিসির দিকে তাকাল, এখনো সে ঠিক বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। বেশ দ্রুত তার মুখ থেকে ভয়ের চিহ্ন কেটে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। ইয়োরন রিসি এবারে ঘুরে কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি নুবা। তুমি দক্ষিণের পাহাড়ি অঞ্চলে একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়াও। তোমার প্রিয় বিষয় হচ্ছে ইতিহাস। ছুটির দিনে তুমি হেঁটে হেঁটে একটা ছোট পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাক। তুমি যে গ্রামে থাক সেখানকার সবাই তোমাকে খুব পছন্দ করে, যদিও তাদের অনেকের ধারণা ভালো ওষুধপত্র খেলে তোমার চুপচাপ একা একা বসে থাকার রোগ ভালো হয়ে যাবে।

ইয়োরন রিসির সাথে সাথে আমরাও হেসে উঠলাম। তিনি হাসি থামিয়ে এবার খাপখোলা তলোয়ারের মতো ঝকমকে চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি য়োমি। একটা খবরের কাগজের অফিসে কাজ কর। অত্যন্ত বিরক্তিকর কাজ, ভিডিও সেন্টারে বসে থাকা, লোকজনের যার যত সমস্যা আছে, অভিযোগ আছে তোমার কাছে বলে। মাঝে মাঝেই কিছু খ্যাপা গোছের মানুষ বের হয়ে যায়–তোমাকে খামখাই যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করে। তুমি গত দুই বছর থেকে ভাবছ এই কাজ ছেড়ে দেবে কিন্তু তবু ছাড়ছ না।

ইয়োরন রিসি এবারে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি রিকি। তোমার বন্ধুবান্ধব খুব বেশি নেই। তোমার অনেকদিনের ভালবাসার মেয়েটিও গতকাল তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার ধারণা তোমার জীবন নিয়ে খুব উচ্চাশা নেই। সত্যি কথা বলতে কী তোমার পরিচিতদের সবারই তাই ধারণা। এখানে অন্য চার জন কিছু–না–কিছু কাজ করে, তুমি কিছুই কর না। তোমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হচ্ছে চার মাত্রার একটা রবোট!

ইয়োরন রিসি আবার হা হা করে হাসলেন এবং অন্য সবাই সেই হাসিতে যোগ দিল। চার মাত্রার একটি রবোটের সাথে একজন মানুষের বন্ধুত্ব হতে পারে সেটা বিশ্বাসযোগ্য কথা নয় ঠাট্টা করে বলা হয়েছে। ইয়োরন রিসি সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, আমি কি কারো সম্পর্কে ভুল কিছু বলেছি?

আমরা মাথা নাড়লাম, না।

তোমাদের এই পাঁচ জনকে আমি এখানে কেন এনেছি জান?

আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। ইয়োরন রিসি নরম গলায় বললেন, তোমাদের জানার কথা নয়, কিন্তু আমি নিশ্চিত তবু তোমরা জান। কারণ তোমরা কেউ সাধারণ মানুষ নও। তোমরা প্রত্যেকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান, সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষদের একজন। ঈশ্বর সম্ভবত নিজের হাতে তোমাদের মস্তিষ্কের নিউরোন সেলগুলো একটি একটি করে সাজিয়েছেন। তোমাদের মস্তিষ্কের যে ক্ষমতা–একজন মানুষের মস্তিষ্ক কেমন করে সেরকম ক্ষমতাশালী হতে পারে সেটা একটা রহস্য।

ইয়োরন রিসি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমরা নিজেরা জান যে তোমরা সাধারণ মানুষ নও। তোমাদের প্রত্যেকে অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছ কিন্তু তোমরা সেটা প্রাণপণে সবার কাছে গোপন করে রাখ। শুধু যে অন্যদের কাছে গোপন রাখ। তাই নয়, অনেক সময় তোমরা তোমাদের নিজেদের কাছে পর্যন্ত গোপন করে রাখ। কেন সেটা কর আমাদের কাছে, বিজ্ঞান পরিষদের কাছে তা একটা মস্ত বড় রহস্য। ইচ্ছে করলেই তোমরা পৃথিবীর যত সম্পদ, যত সম্মান, ভালবাসা, খ্যাতি, প্রতিপত্তি সবকিছু পেতে। পার। কিন্তু তোমরা সেটা চাও না। হিশান একটা ব্যাংকে কষ্ট করে কাজ কর, ইগা জেলে যাবার ঝুঁকি নিয়ে নেশার ওষুধ তৈরি কর, নুবা একটা স্কুলে পড়াও, য়োমি খবরের কাগজের অফিসে খ্যাপা মানুষদের অভিযোগ শুনে সময় কাটাও, রিকি ভালবাসার মেয়েটিকে ছেড়ে চলে যেতে দাও। কেন এটা কর আমরা কেউ জানি না। মনে হয় কোনোদিন জানবও না। মানুষের মন খুব বিচিত্র একে কেউ বোঝে না। আমরা তাই তোমাদের কখনো বিরক্ত করি নি। তোমাদের একটু চোখে চোখে রেখেছি, একটু আগলে রেখেছি কিন্তু কখনোই তোমাদের স্বাধীন জীবনে হাত দিই নি। কখনো না।

ইয়োরন রিসি একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ভেবেছিলাম কখনো দেব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলাম না। তোমাদের মতো মানুষদের একটা ছোট লিস্ট আছে আমার কাছে। সেখান থেকে বেছে বেছে আমি তোমাদের পাঁচ জনকে আজ এখানে ডেকে এনেছি। কেন ডেনে এনেছি জান?

হিশান তার লম্বা চুলে হাত ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমাদের একটা সমস্যা সমাধান করতে হবে?

ইয়োরন রিসি মাথা নাড়লেন– হ্যাঁ। কী সমস্যা বলতে পারবে?

ইগা বলল, কঠিন কোনো সমস্যা? যার সাথে

যার সাথে?

যার সাথে পৃথিবীর অস্তিত্ব জড়িত?

হ্যাঁ। হঠাৎ করে ইয়োরন রিসির মুখ কেমন জানি বিষণ্ন হয়ে যায়। আস্তে আস্তে বললেন, পৃথিবীর খুব বিপদ। খুব বড় বিপদ।

তিনি হঠাৎ ঘুরে নুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, নুবা তুমি বলতে পারবে কী বিপদ?

আমি?

হ্যাঁ।

আমাকে যখন জিজ্ঞেস করছেন তার মানে এর সাথে ঐতিহাসিক কোনো ঘটনার যোগাযোগ আছে।

ইয়োরন রিসি কোনো কথা বললেন না, আমি দেখতে পেলাম হঠাৎ করে নুবার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে কাঁপা গলায় বলল, শ্যালন গ্রুন ফিরে এসেছে?

ইয়োরন রিসি অত্যন্ত বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাসলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ নুবা। আমাদের খুব দুর্ভাগ্য শ্যালক্স গ্রুন গত সপ্তাহে পৃথিবীতে অবতরণ করেছে।

আমি হঠাৎ আতঙ্কের একটা শীতল স্রোতকে মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যেতে অনুভব করলাম।

০৩. শৈশবে যখন অনাথ আশ্রমে

শৈশবে আমি যখন অনাথ আশ্রমে ছিলাম তখন রাত্রিবেলা আমরা ঘুমাতে দেরি করলে আমাদের শ্যালক্স গ্রুনের ভয় দেখানো হত। শ্যালক্স গ্রুন মানুষটা কে, কেন তার নাম শুনে আমাদের ভয় পেতে হবে আমরা তার কিছুই জানতাম না। কিন্তু সত্যি সত্যি ভয়ে আমাদের হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। একটু বড় হয়ে শ্যালক্স গ্রুনের সত্যিকার পরিচয় জেনেছি। অসাধারণ প্রতিভাবান এবং সম্পূর্ণ ভালবাসাহীন একজন মানুষ। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে পৃথিবীর যা–কিছু সুন্দর তার সবকিছুতে মানুষটির এক ভয়ঙ্কর একরোখা আক্রোশ। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে সে এক ধরনের ভাইরাস বের করেছে যার বিরুদ্ধে মানুষের কোনো ধরনের প্রতিরক্ষা নেই। ভাইরাসটির নাম লিটুমিনা–৭২, বাতাসে ভেসে সেটি ছড়িয়ে পড়তে পারে, বিজ্ঞানীদের ধারণা ছোট একটা কাঁচের এল ভরা মানুষের রক্তে যে পরিমাণ লিটুমিনা–৭২ নেয়া সম্ভব সেটা দিয়ে পৃথিবীর সব মানুষকে একাধিকবার মেরে ফেলা যায়। বাতাস কোনদিকে বইছে তার ওপর নির্ভর করবে কতটুকু সময়ে পুরো পৃথিবী প্রাণহীন হয়ে যাবে। শ্যালক্স গ্রুনের এই ভাইরাসটির প্রতি গভীর মমতা ছিল। একদিন সে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গোপন ভল্ট থেকে এই ভাইরাসের নমুনার বোতলটি নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। যাবার আগে সে বলে গিয়েছিল পৃথিবীর ওপরে সে পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে–তাকে নিজের হাতে ধ্বংস করা থেকে বেশি আনন্দ আর কিছুতে সে পাবে না। সে ইচ্ছে করলেই এই আনন্দ পেতে পারে, তার কাছে যথেষ্ট লিটুমিনা–৭২ রয়েছে, কিন্তু এই পৃথিবী এত নিচু স্তরে রয়ে গেছে যে সেটিকে ধ্বংস করায় কোনো আনন্দ নেই। তাই সে ভবিষ্যতে পাড়ি দিচ্ছে, হয়তো পৃথিবী খানিকটা উন্নত হবে, তখন সেটাকে ধ্বংস করা মোটামুটি একটা আনন্দের ব্যাপার হতে পারে।

পৃথিবীর মানুষ তারপর আর কখনো শ্যালক্স গ্রুনকে দেখে নি। সত্যি সত্যি সে ভবিষ্যতে পাড়ি দিয়েছে সেটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার নয়। গবেষণাগারে ছোটখাটো জিনিসকে সময় পরিভ্রমণ করে কিছু দূরত্ব নেয়া যায়, কিন্তু তাই বলে সত্যিকারের একজন মানুষ কোনো এক ধরনের সময়–পরিভ্রমণ–যানে সুদূর ভবিষ্যতে চলে যাবে সেটি সে–সময়ের বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিতে কিছুতেই সম্ভব হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু শ্যালক্স গ্রুন সেই অসম্ভব ব্যাপারটিকে সম্ভব করেছিল, ঠিক কীভাবে করেছিল সেটাও একটি রহস্য।

শ্যালক্স গ্রুন অদৃশ্য হওয়ার পর প্রায় এক শ বছর পার হয়ে গেছে। এই এক শ বছরে পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, বিজ্ঞানের বড় কোনো আবিষ্কার হয় নি সত্যি কিন্তু প্রযুক্তির জগতে অনেক যুগান্তকারী উন্নতি হয়েছে। বিজ্ঞানের একটা বড় অংশ তার সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করেছে শ্যালক্স গ্রুনের আক্রোশ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে। পৃথিবী কতটুকু প্রস্তুত কেউ জানে না, ইয়োরন রিসির কথা শুনে মনে হল হয়তো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। যদি প্রস্তুত থাকত তাহলে কি আমাদের এভাবে ডেকে একত্র করাতেন?

আমি কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন একটা বড় দরজা খুলে গেল এবং মিলিটারি পোশাক পরা কয়েকজন মানুষ ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে ঢুকল। তারা ইয়োরন রিসির সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল। এত ব্যস্ত হয়ে ছুটে এসেছে, আমি ভেবেছিলাম নিশ্চয়ই কিছু একটা বলবে কিন্তু তারা কিছু বলল না। সামরিক বাহিনীতে নানা ধরনের হাস্যকর নিয়মকানুন থাকে, সম্ভবত ইয়োরন রিসি অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত তাদের নিজেদের মুখ ফুটে কিছু বলার কথা নয়।

ইয়োরন রিসি মাথা ঘুরিয়ে মিলিটারি পোশাক পরা মানুষগুলোকে এক নজর দেখে। বললেন, কী হয়েছে জেনারেল ইকোয়া? তোমাকে খুব উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে।

আপনাকে একটা খবর দিতে হবে মহামান্য রিসি।

কী খবর?

প্রজেক্ট গ্রুন নিয়ে খুব জরুরি একটা খবর। আপনি কিছুক্ষণের জন্যে কি কন্ট্রোলরুমে আসতে পারবেন মহামান্য রিসি?

ইয়োরন রিসি খানিকক্ষণ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ তুলে বললেন, এখানেই বল।

জেনারেলটি একবার চোখের কোনা দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বলল, এটি গোপনীয়তার মাত্রায় সাত নম্বর। আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বলার কথা নয়।

ইয়োরন রিসি একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, আমি প্রজেক্ট গ্রুনের দায়িত্ব এই পাঁচ জনের হাতে তুলে দিচ্ছি জেনারেল ইকোয়া। তুমি নির্দ্বিধায় এদের সামনে বলতে পার।

ইলেকট্রনিক শক খেলে মানুষ যেভাবে চমকে ওঠে, জেনারেল ইকোয়া অনেকটা সেভাবে চমকে উঠল। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে সামলে নিয়ে সে খানিকক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা ঘুরিয়ে ইয়োরন রিসির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন মহামান্য রিসি। কিন্তু আপনি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত? এর ওপরে পৃথিবীর অস্তিত্ব নির্ভর করছে।

আমি জানি জেনারেল ইকোয়া। আমি নিশ্চিত। তুমি বল।

জেনারেল ইকোয়া একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল জিক্লো শ্যালক্স গ্রুনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। শ্যালক্স গ্রুন তাকে মেরে ফেলেছে মহামান্য রিসি।

ইয়োরন রিসির মুখ হঠাৎ কেমন যেন দুঃখী মানুষের মতো হয়ে যায়। বিষণ্ণ মুখে অনেকটা আপন মনে বললেন, মেরেই ফেলল? আহা রে!

তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বললেন, কেন মেরেছে জান?

জানি।

কেন?

শ্যালক্স গ্রুনের ধারণা জেনারেল জিক্লো–জেনারেল ইকোয়া হঠাৎ থেমে যায়, তার মুখে এক ধরনের অপমান এবং ক্রোধের চিহ্ন ফুটে ওঠে।

জেনারেল জিক্লো?

তার ধারণা জেনারেল জিক্লোর বুদ্ধিমত্তা খুব নিচু স্তরের। সে বলেছে, তার সাথে কথা বলার জন্যে এ রকম নির্বোধ একটা প্রাণী পাঠানোতে সে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেছে। ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি সে নাকি সহ্য করবে না।

তাই বলেছে?

হ্যাঁ। বলেছে জেনারেল জিক্লোকে হত্যা করে পৃথিবীর একটা নির্বোধ মানুষ কমিয়ে দিয়ে পৃথিবীর ছোট একটা উপকার করেছে।

ইয়োরন রিসি আবার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, জেনারেল জিক্লোর মৃতদেহ সমাহিত করার ব্যবস্থা কর।

করা হয়েছে মহামান্য রিসি।

আমি তার স্ত্রীর সাথে একটু দেখা করতে চাই। তাকে আমি কী বলে সান্ত্বনা দেব বুঝতে পারছি না।

জেনারেল ইকোয়া কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইল। ইয়োরন রিসি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আর কিছু বলবে?

আমরা কি এই হত্যাকাণ্ডের খবরটি গোপন রাখব? নাকি প্রচারিত হতে দেব?

আমি সেই সিদ্ধান্তটি নেব না জেনারেল ইকোয়া।

তাহলে কে নেবে মহামান্য রিসি?

এই পাঁচ জন। পৃথিবীর স্বার্থে আমার ওপর যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেই ক্ষমতার অধিকারে আমি এই পাঁচ জনকে প্রজেক্ট গ্রুনের পুরো দায়িত্ব দিতে চাই। ইয়োরন রিসি হঠাৎ ঘুরে পূর্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন, তোমরা কি সেই দায়িত্ব নেবে?

আমার মনে হল বুকের ভিতর আমার হৃৎপিণ্ডটি বুঝি এক মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল, আমি অন্যদের দিকে তাকালাম, তাদের মুখও রক্তশূন্য হয়ে আছে। আমরা চেষ্টা করে নিজেদের স্বাভাবিক করে সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। ইয়োরন রিসি মাথা নেড়ে বললেন, আনুষ্ঠানিকতার কারণে তোমাদের কথাটি মুখে উচ্চারণ করতে হবে। তোমরা এক জন এক জন করে বল।

ইয়োরন রিসির চোখ সবার ওপর দিয়ে ঘুরে এসে আমার ওপর স্থির হল। তিনি বললেন, রিকি?

আমি নিচু গলায় বললাম, মহামান্য রিসি আপনি যদি সত্যি বিশ্বাস করেন আমি এই দায়িত্ব নিতে পারব তাহলে আমি এই দায়িত্ব নেব।

আমি বিশ্বাস করি। তুমি নেবে?

নেব মহামান্য ইয়োরন রিসি।

তুমি এই পৃথিবীকে রক্ষা করবে রিকি?

আমি–আমি চেষ্টা করব।

ইয়োরন রিসি একদৃষ্টে আমার দিকে তাকালেন, কী আশ্চর্য স্বচ্ছ তার চোখ, কী ভয়ঙ্কর তীব্র তার দৃষ্টি! আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এই পৃথিবীকে রক্ষা করবে রিকি?

আমি পৃথিবীকে রক্ষা করব মহামান্য রিসি–কথাটি বলতে গিয়ে হঠাৎ আমার বুক কেঁপে গেল। এত বড় একটি কথা বলার শক্তি আমি কোথায় পেলাম?

ইয়োরন রিসি গভীর ভালবাসা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর ঘুরে তাকালেন আমার পাশে বসে থাকা য়োমির দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, য়োমি তুমি কি এই দায়িত্ব নেবে? তুমি কি পৃথিবীকে রক্ষা করবে?

য়োমি কাঁপা গলায় বলল, আমি এই দায়িত্ব নেব মহামান্য বিসি। আমি–আমি এই পৃথিবীকে রক্ষা করব।

ইয়োরন রিসি তারপর ঘুরে তাকালেন নুবা ইগা আর হিশানের দিকে, তাদের ঠিক একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, তারা ঠিক একই উত্তর দিল কাঁপা গলায়। তখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন তার চেয়ার থেকে, হাতের ব্যাগটি খুলে সেখান থেকে লাল রঙের চতুষ্কোণ কয়েকটা কার্ড বের করে টেবিলের উপর রাখলে রেখে বললেন, এখানে পাঁচটা লাল কার্ড রয়েছে। তোমাদের পাঁচ জনের জন্যে। পৃথিবীতে সব মিলিয়ে এক শ বার জনের এই লাল কার্ড রয়েছে, তোমাদের নিয়ে হল এক সতের।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জেনারেল ইকোয়া একটা আর্ত শব্দ করল, মনে হল তার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে সামলে নিয়ে আমাদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়, তার সাথে অন্য সবাই। আমাদের বুঝতে একটু সময় লাগল যে এটি এক ধরনের বাধ্যতামূলক সম্মান প্রদর্শন। সামরিক বিভাগে এ ধরনের অসংখ্য অর্থহীন নিয়মকানুন রয়েছে যেগুলো সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই।

আমরা একে অন্যের দিকে তাকালাম এবং নুবা সবার আগে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আপনারা সবাই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন।

জেনারেল ইকোয়া এবং অন্য সবাই সোজা হয়ে দাঁড়াল। হিশান নিজের দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, ভবিষ্যতে আপনাদের কারো এ রকম হাস্যকর ভঙ্গিতে সম্মান দেখানোর প্রয়োজন নেই। আমরা এতে অভ্যস্ত নই।

আমরা মাথা নাড়লাম এবং আমাদের সাথে সাথে জেনারেল ইকোয়া এবং তার সঙ্গীরা কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়ল। তাদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে বলে মনে হয় না।

ইয়োরন রিসি হঠাৎ নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাকে এখনই যেতে হবে। বিজ্ঞান পরিষদের একটা খুব জরুরি মিটিং আছে।

তিনি তখন এগিয়ে এসে এক জন এক জন করে আমাদের সাথে হাত মেলালেন, তাকে দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু তার হাত লোহার মতো শক্ত। তারপর আমাদের একবার অভিবাদন করে হেঁটে হেঁটে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন, তার পিছু পিছু হতচকিত জেনারেল ইকোয়া এবং তার সঙ্গীরা।

সবাই চলে যাবার পর আমরা বিশাল ঘরে একটি কালো টেবিলকে ঘিরে চুপচাপ বসে রইলাম। আমাদের সামনে টেবিলে পাঁচটি লাল কার্ড, দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই কিন্তু আমরা জানি এই কার্ডগুলো স্পর্শ করা মাত্র আমাদের জীবন হঠাৎ করে পুরোপুরি পাল্টে যাবে। আমরা কেউই সেটা চাই নি কিন্তু আমাদের কারো কিছু করার নেই।

আমাদের মাঝে সবচেয়ে প্রথম কথা বলল নুবা। নরম গলায় বলল, আমাদের হাতে মনে হয় কোনো সময় নেই। কাজ শুরু করে দেয়া দরকার।

হ্যাঁ। হিশান তার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, কাজ শুরু করে দেয়া দরকার। যখন কী করতে হবে কিছুই জানি না তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে দেয়া দরকার।

য়োমি একটু এগিয়ে এসে বলল, কিন্তু ঠিক কীভাবে শুরু করব।

আমি একটা লাল কার্ড নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললাম, লাল কার্ড দিয়ে শুরু করা যাক।

কার্ডটিকে স্পর্শ করা মাত্র একটা বিচিত্র শব্দ করে তার মাঝে থেকে একটা নীল রঙের আলো বের হয়ে এল। নিশ্চয়ই কার্ডটি আমার ব্যবহারের উপযোগী করার জন্যে প্রাথমিক কাজ শুরু করে দিয়েছে। লাল কার্ডের মাঝে একটা মেগা কম্পিউটার রয়েছে, পৃথিবীর ভিতরে এবং বাইরে সবগুলো ডাটাবেসে যোগাযোগ করার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ আলাদা করে রাখা আছে। মহাকাশের সবগুলো মূল উপগ্রহের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। পৃথিবীর কেন্দ্রীয় কম্পিউটারে প্রবেশ করে তার যে–কোনো তথ্য দেখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই ছোট লাল কার্ডটিকে প্রয়োজন হলে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, অন্যান্য জিনিসের মাঝে এই কার্ডটির মাঝে দুটি ক্ষুদ্র ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।

আমি অভিভূত হয়ে কার্ডটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাম পাশে ছোট একটা চৌকোনো অংশে দ্রুত নানা ধরনের ছবি ভেসে আসতে শুরু করেছে, বেশিরভাগই হলোগ্রাফিক ত্রিমাত্রিক ছবি। কার্ডের ডান পাশের কিছু বিন্দু থেকে উজ্জ্বল কিছু আলোর ঝলকানি দেখা গেল। ছোট একটা স্পিকার থেকে তীক্ষ্ণ একটানা কিছু শব্দ ভেসে আসছিল, শব্দের কম্পন কমে এসে হঠাৎ সেটি নীরব হয়ে যায়, চতুষ্কোণ অংশটিতে হঠাৎ আমার নিজের একটা ছবি ভেসে ওঠে। আমি কার্ডটি ধরে অন্যদের দেখিয়ে বললাম, আমার কার্ডটি মনে হয় প্রস্তুত হয়ে গেছে।

অন্যরাও তখন হাত বাড়িয়ে একটা করে কার্ড তুলে নেয় এবং মুহূর্তে নীল আলোর ঝলকানি দিয়ে কার্ডগুলো কাজ শুরু করে দেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই এই ঘরটির মাঝে একটা ইতিহাস সৃষ্টি হবে। পাঁচ জন লাল কার্ডের অধিকারী মানুষ একটি ঘরে একত্র হবে।

আমার হঠাৎ ত্রিশার কথা মনে পড়ল। আমি লাল কার্ডের অধিকারী হব জানলে ত্রিশা কি আমাকে ছেড়ে চলে যেত? আমার ঠিক ইচ্ছে ছিল না কিন্তু হঠাৎ আমার বুক থেকে একটা। দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।

সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না।

আমি দীর্ঘশ্বাসটি কেন ফেলেছি তারা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছে কিন্তু কেউ সেটা প্রকাশ করল না। য়োমি লাল কার্ডটির দিকে তাকিয়ে বলল, সবার আগে আমাদের তথ্য সগ্রহ করতে হবে। যতটুকু সম্ভব। শ্যালক্স গ্রুন সম্পর্কে আমাদের সবকিছু জানতে হবে।

হিশান ভুরু কুঁচকে বলল, কিন্তু সেটা কি সম্ভব? একজন মানুষ সম্পর্কে কি কখনো সবকিছু জানা যায়?

নূবা মাথা নেড়ে বলল, তা যায় না, কিন্তু চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। মানুষটাকে খানিকটা বুঝতে হবে। কী ধরনের মানুষ, বুদ্ধিমত্তা কতটুকু, কী রকম চরিত্র, দুর্বলতাটুকু কোথায়–

ইগা মাথা নেড়ে বলল, উহু, মানুষকে কখনো বোঝা যায় না। যারা আমাকে চেনে তাদের সবার ধারণা আমি অত্যন্ত সৎ নীতিবান মানুষ। কিন্তু আমি মোটেই সৎ এবং নীতিবান নই। তোমরা তো নিজেরাই শুনলে আমার মাদকদ্রব্যের গোপন কারখানা আছে।

য়োমি সরু চোখে বলল, কিন্তু সেটা তো গোপন নেই। মহামান্য রিসি নিজে বলেছেন সেটা অনেকেই জানে।

তা ঠিক, ইগা মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আমার চরিত্রে আরো অনেক কিছু আছে যেটা কেউ জানে না। যেটা আমি চাই না কেউ জানুক।

হিশান মাথাটা একটু এগিয়ে এনে বলল, কিন্তু আমাদের তো কোনো একটা জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। শ্যালক্স গ্রুন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আমরা কাজ শুরু করতে পারি। আমার মনে হয় আমরা অন্য যেকোনো মানুষ থেকে তথ্যগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে পারব।

য়োমি কোনো কথা না বলে সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। নুবা বলল, তথ্য সংগ্রহ করা বিশ্লেষণ করায় তো কোনো ক্ষতি নেই।

ইগা ভুরু কুঁচকে বলল, ক্ষতি আছে।

কী ক্ষতি?

এক টুকরা ভুল তথ্য তোমাদের সবাইকে বিভ্রান্ত করে দিতে পারে। বিশেষ করে শ্যালক্স গ্রুনের মতো ধূর্ত মানুষ–

য়োমি সরু চোখে বলল, তাহলে তুমি আমাদের কী করতে বল?

ইগা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমি জানি না।

নুবা হেসে বলল, জানি না বললে তো হবে না। কিছু একটা বলতে হবে।

ইগা আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, শুধু আমাকে বলছ কেন? রিকি এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলে নি—

সবাই তখন আমার দিকে তাকাল। নুবা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সত্যিই তুমি কিছু বল নি। কিছু একটা বল।

আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, আসলে এ ধরনের ব্যাপারে আমি কখনো কোনোভাবে অংশ নিই নি। কীভাবে শুরু করতে হয় আমার কোনো ধারণা নেই। আমি মোটামুটি ঘরে বসে বসে দিন কাটিয়েছি।

আমার কথা শুনে হঠাৎ সবাই তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকাল। নুবার চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে ওঠে। আমার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, সত্যি তুমি কখনো কোনো প্রজেক্টে অংশ নাও নি?

না।

নুবা ঘুরে অন্যদের দিকে তাকায় এবং হঠাৎ করে সবাই কমবেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ইগা টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বলল, চমৎকার!

আমি বললাম, কী চমৎকার?

তোমার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই সেটা।

ইগা কী বলতে চাইছে আমি সেটা হঠাৎ আঁচ করতে পারি। ইয়োরন রিসি আমাকে যে এই দলটিতে এনেছেন সেটাই কি তার কারণ?

হিশান তার বাড়ির মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে বলল, হ্যাঁ, তাহলে তোমার মুখেই শুনি। তোমার যেহেতু কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই তুমি এই সমস্যাটিকে একেবারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখবে। তুমি বল আমরা কীভাবে শুরু করব।

আমি?

হ্যাঁ, তুমি।

আমার মনে হয় আমাদের শ্যালক্স গ্রুনের সাথে দেখা করা উচিত।

হঠাৎ করে সবাই স্থির হয়ে গেল, মনে হল ঘরে যদি একটা সুচও পড়ে সেটা শোনা যাবে। আমি সবার দিকে একবার তাকিয়ে বললাম, আমাকে যদি সত্যি জিজ্ঞেস কর তাহলে আমি সেটাই বলব। তার সম্পর্কে কোনোরকম খোঁজখবর না নিয়ে, কোনোরকম তথ্য বিশ্লেষণ না করে তার সাথে দেখা করা। সম্পূর্ণ একজন অপরিচিত মানুষের সাথে যেভাবে দেখা করা হয়–সেভাবে।

ইগা খুব ধীরে ধীরে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়তে থাকে, অন্য কেউ কোনো কথা বলে। য়োমি হঠাৎ টেবিলে হাত রেখে বলল, কেন?

তার সম্পর্কে জানার জন্যে।

তুমি কেন মনে কর তার সাথে দেখা করলে তুমি তার সম্পর্কে জানতে পারবে?

কারণ সে একজন মানুষ। অসম্ভব ধূর্ত মানুষ। ডাটাবেসে তার সম্পর্কে যেসব তথ্য থাকবে সেটা কখনোই সম্পূর্ণ তথ্য হবে না। একজন মানুষ অত্যন্ত জটিল ব্যাপার, কখনো তথ্য দিয়ে তাকে বোঝানো যায় না। তাকে বুঝতে হলে সম্ভবত অন্য আরেকজন মানুষ দরকার।

নুবা স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল, আমি কথা শেষ করতেই বলল, আমার মনে হয় রিকি ঠিকই বলেছে।

ইগাও মাথা নাড়ল, যা আমাদের একজন যদি তার সাথে দেখা করে কথা বলে ফিরে আসতে পারি, সম্ভবত মানুষটা সম্পর্কে খুব ভালো একটা ধারণা হবে। রিকি ঠিকই বলেছে। য়োমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইগার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নিশ্চিত?

ইগা কিছু বলার আগেই আমি বললাম, আমি নিশ্চিত।

য়োমি মাথা নেড়ে বলল, আমি বিশ্বাস করি না।

কী বিশ্বাস কর না?

যে একজন মানুষের সাথে কথা বলে তার সম্পর্কে কিছু জানা যায়।

একজন সাধারণ মানুষ যদি কথা বলে সে হয়তো কিছু জানবে না। কিন্তু ব্যাপারটা অস্বীকার করে তো লাভ নেই–আমরা কেউই সাধারণ মানুষ নই।

য়োমির চোখ দুটি হঠাৎ কেমন জানি জ্বলজ্বল করে ওঠে, খানিকক্ষণ আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি আমাকে আগে কখনো দেখ নি কাজেই আমার সম্পর্কে কিছু জান না। এখন কিছুক্ষণ হল তুমি আমার সাথে কথা বলেছ–তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছ? তুমি সেটা বল, দেখি সত্যি বলতে পার কি না।

নুবা, ইগা এবং হিশান একটু অবাক হয়ে এবং বেশ খানিকটা কৌতূহল নিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি হঠাৎ বিব্রত অনুভব করতে থাকি, কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আমার মনে হয় না সেটা ঠিক হবে য়োমি।

কেন?

কারণ তুমি হয়তো পছন্দ করবে না।

কেন পছন্দ করব না?

একজন মানুষের চরিত্রের অনেক দিক থাকে। যেটা সহজেই প্রকাশ হয়ে যায় সেটা প্রায় সময়েই হয় দুর্বল দিক। সেটা তার মূল চরিত্র নাও হতে পারে।

তবু তুমি বল, আমি জানতে চাই। আমরা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি, এখানে ভুল করার কোনো জায়গা নেই। তুমি সত্যিই আমার চরিত্রের কথা বলতে পার কি না তার ওপর নির্ভর করছে আমরা কী করব। এখানে আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের কোনো গুরুত্ব নেই। তুমি বল।

বেশ। আমি একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, তোমার ভিতরে প্রতিযোগিতার একটা ভাব আছে য়োমি, তোমার প্রখর বুদ্ধিমত্তা তুমি কেন আড়াল করে রেখেছ সেটা একটা রহস্য। তোমার অনুভূতি খুব চড়া সুরে বাঁধা–

এসব কথা অর্থহীন। য়োমি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমার সম্পর্কে কোনো তথ্য বল।

আমি য়োমির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম, এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললাম, তুমি একজন প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ। তুমি অপরাধ করতে সক্ষম। তোমার লাল কার্ড ব্যবহার করে তুমি কোনো একজনকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দেয়ার কথা ভাবছ। সম্ভবত মানুষটি তোমার শৈশবের কোনো ভালবাসার মানুষ। আমার ধারণা তুমি অতীতে কোনো বড় অপরাধ করেছ।

য়োমির মুখ মুহূর্তে রক্তশূন্য হয়ে গেল, আমি মৃদু স্বরে বললাম, তোমাকে আমাদের সাথে কাজ করতে দেয়া কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। আমার মনে হয় অনেক ভেবেচিন্তে দেয়া হয়েছে। শ্যালক্স গ্রুনের মস্তিষ্ক কেমন করে কাজ করবে সেটা সবচেয়ে ভালো বুঝবে তুমি। আমার ধারণা–

য়োমি প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ঠিক আছে রিকি তোমাকে আর বলতে হবে না। যথেষ্ট হয়েছে।

আমি, আমি কি ভুল বলেছি?

য়োমি নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, না। তুমি কেমন করে বলেছ আমি জানি না। এটি–এটি প্রায় অসম্ভব।

অসম্ভব নয় য়োমি। তুমি যেভাবে লাল কার্ডটি হাতে নিয়ে সেটার দিকে তাকিয়েছিলে দেখে যে কেউ বলতে পারবে তুমি এটা দিয়ে কাউকে শাস্তি দেবে। তোমার চোখে যে ঈর্ষার ছায়া ফুটে উঠেছিল সেটা দেখে বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না, কোনো একজন ভালবাসার মানুষ তোমাকে ছেড়ে গেছে, তুমি যেভাবে আমার দিকে তাকিয়েছ সেই দৃষ্টি থেকে—

নূবা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রিকি, আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করেছি। তুমি সম্ভবত একজন মানুষকে খুব ভালো বুঝতে পার, যেটা আমরা পারি না।

হিশান আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার ধারেকাছে থাকতে চাই না!

সবাই জোর করে একটু হেসে ব্যাপারটা একটু হালকা করে দেয়ার চেষ্টা করে তবুও পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে হয়ে থাকে। খানিকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না, ইগা খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের নখকে লক্ষ করতে করতে হঠাৎ মুখ তুলে বলল, তাহলে কি রিকি যাবে শ্যালক্স গ্রুনের সাথে দেখা করতে?

যদি রিকির আপত্তি না থাকে।

না, আমার আপত্তি নেই। আমি মাথা নেড়ে বললাম, সত্যি কথা বলতে কী লোকটিকে দেখার আমার অসম্ভব কৌতূহল হচ্ছে!

কিন্তু তুমি জান ব্যাপারটি ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক।

নুবা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার ভয় করছে না রিকি?

হা করছে। কিন্তু কী করা যাবে?

হিশান বলল, জেনারেল জিক্লোকে মেরে ফেলেছে কারণ মানুষটি নাকি নির্বোধ ছিল। অন্ততপক্ষে রিকিকে সে দোষ দিতে পারবে না।

ইগা য়োমির দিকে তাকিয়ে বলল, য়োমি, তোমার কী মনে হয়?

য়োমির চোখ হঠাৎ করে জ্বলজ্বল করে ওঠে, মনে হল রেগে কিছু একটা করবে। কিন্তু করল না, কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সত্যি আমার কী মনে হয় জান?

কী?

আমার মনে হয় রিকির জীবন্ত ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম। শ্যালক্স গ্রুন প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ–আমার মতোই। রিকি যদি তার সাথে কথা বলে কিছু একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জেনে যায় সাথে সাথে তাকে মেরে ফেলবে।

তুমি সত্যিই তাই মনে কর?

হ্যাঁ। আমি শ্যালক্স গ্রুন হলে তাই করতাম

আমি মৃদু স্বরে বললাম, আমার মনে হয় য়োমি ঠিকই বলেছে। আমি কিন্তু তবু যেতে চাই।

সত্যি?

হ্যাঁ। আমি চেষ্টা করব বেঁচে একতে। তবু যদি না পারি তোমরা একটা জিনিস জানবে।

কী জিনিস?

জানবে মানুষটার মাঝে কিছু একটা দুর্বলতা আছে। জানবে তার পুরো পরিকল্পনার কোথাও কিছু একটা কারচুপি আছে। পুরো সমস্যাটি তখন তোমাদের কাছে অনেক সহজ হয়ে যাবে।

নুবা আমার দিকে এক ধরনের বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মনে হচ্ছে আমি যদি এখানে না থাকতাম ভালো হত। খুব সহজে খুব বড় সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে আমার– আমি পারি না এসব।

আমরা কেউই পারি না নুবা। ইগা একটা হাত বাড়িয়ে নুবার হাত স্পর্শ করে বলল, কিন্তু আমাদের কোনো উপায় নেই।

আমরা পাঁচ জন চুপচাপ বসে থাকি খানিকক্ষণ। কেউ কিছু বলছি না কিন্তু তবু মনে হচ্ছে একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছি–মনে হচ্ছে একজন আরেকজনকে চিনি বহুকাল থেকে। এক সময় আমি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমার মনে হয় এখনই যাওয়া দরকার, কী বল?

সবাই দ্বিধান্বিতভাবে মাথা নাড়ল। হিশান বলল, যেতেই যদি হয় তাহলে যত তাড়াতাড়ি যেতে পার ততই ভালো।

নুবা ঘুরে আমার কাছাকাছি এসে আমাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, আমরা তোমার মঙ্গল কামনা করছি রিকি।

আমি নরম গলায় বললাম, আমি জানি।

আমার কখনো কোনো পরিবার ছিল না, কোনো আপনজন ছিল না। আমি সবসময় নিঃসঙ্গ একাকী বড় হয়েছি। হঠাৎ করে এই বিশাল ঘরে চার জন মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনে হল আমি বুঝি আর নিঃসঙ্গ নই। আমারও আপনজন আছে–আমারও পরিবার আছে। কথাটি আমি বলতে গিয়ে থেমে গেলাম, মুখ ফুটে বলতে পারলাম না।

হয়তো বলার প্রয়োজনও নেই, এরা নিশ্চয়ই জানে আমি কী বলতে চেয়েছি। এরা সবাই অসাধারণ মানুষ!

» ০৪. শ্যালক্স গ্রুন

শ্যালক্স গ্রুন যে জিনিসটি করে পৃথিবীতে নেমে এসেছে সেটি দেখতে একটি কদাকার দালানের মতো। কোনো দরজা জানালা নেই, বিবর্ণ দেয়াল স্থানে স্থানে পুড়ে ঝলসে আছে। পুরো জিনিসটি একটু কাত হয়ে বড় কিছু পাথরের উপর বসে রয়েছে। চারপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, উচ্চচাপের বিদ্যুৎপ্রবাহ হচ্ছে আমি কান পেতে এক ধরনের চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। আরো দূরে উঁচু কংক্রিটের দেয়াল, দেখে বোঝা যায় তাড়াহুড়া করে তৈরি হয়েছে। শক্তিশালী লেজার দিয়ে খুব সহজেই বিস্তীর্ণ এলাকা ঘিরে রাখা যায় কিন্তু এখানে কোনো ঝুঁকি নেয়া হয় নি, শক্ত কংক্রিটের দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। প্রথম দুটি গেটে মানুষের প্রহরা ছিল তারপরের দুটিতে রবোট। শেষ গেটটিতে কোনো প্রহরা ছিল না। কিন্তু আমি নিশ্চিত সেখানে অদৃশ্য কোনো লেজাররশ্মি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। আমার কাছে লাল কার্ডটি ছিল বলে ঢুকতে পেরেছি না হয় ঢোকা নিঃসন্দেহে খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার।

আমি কদাকার ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম, পুরো এলাকাটিতে এক ধরনের অশুভ চিহ্ন, কেন জানি অকারণে মন খারাপ হয়ে যায়। আমার হঠাৎ ত্রিশার কথা মনে পড়ল। কোথায় আছে ত্রিশা? কেমন আছে? আমি ইচ্ছে করলেই লাল কার্ডটি স্পর্শ করে ত্রিশার কথা জানতে পারি, পৃথিবীর যেখানেই সে থাকুক না কেন আমার সামনে তার ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে আসবে। আমার হঠাৎ তাকে খুব দেখার ইচ্ছে করল, অনেক কষ্ট করে আমি ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখলাম। বলা যেতে পারে পৃথিবীর সব মানুষের জীবন এখন বিপন্ন, এই মুহূর্তে একজন মানুষের জন্যে ব্যাকুল হওয়া হয়তো স্বার্থপরের কাজ। আমি কদাকার ঘরটির দিকে এগিয়ে গেলাম, হঠাৎ নিচে থেকে ক্যাচক্যাচ শব্দ করে গোলাকার একটা ছোট দরজা খুলে গেল। আমি একটু চমকে উঠি–আমার জন্যেই ভোলা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শ্যালক্স গ্রুন কি কোনো গোপন জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে?

আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, আমাকে এখন ভেতরে ঢুকতে হবে। জীবন্ত কি ফিরে আসতে পারব আমি? গোল অন্ধকার দরজায় পা দেবার আগে হঠাৎ আমার লাল কার্ডটার। কথা মনে পড়ল, ইচ্ছে করলে সেটাকে একটা ভয়ঙ্কর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। শ্যালক্স গ্রুনের সাথে একটা অস্ত্র নিয়ে দেখা করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? আমি এক মুহূর্ত ভেবে লাল কার্ডটা পকেট থেকে বের করে বাইরে ছুঁড়ে দিলাম, ছোট একটা ঝোঁপের নিচে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

সামনের দরজাটি হোট। ভিতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার–আমি একটু দ্বিধা করে মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকতেই ঘরঘর শব্দ করে পিছনের দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। ভিতরে ঝাঁজালো গন্ধ, ভাপসা গরম এবং ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আমি সাবধানে দেয়াল ধরে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম, সাথে সাথে শুনতে পেলাম কে যেন ভারি গলায় বলল, তুমি কেন এসেছ?

আমি চমকে উঠে বললাম, আমি–আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।

কেন?

আমি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই জান কেন।

কণ্ঠস্বরটি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ জানি।

আমি ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রাণপণ চেষ্টা করে মানুষটিকে দেখার চেষ্টা করতে থাকি, কিন্তু চারদিকে দুর্ভেদ্য অন্ধকারের দেয়াল, আমি কাউকে দেখতে পেলাম না।

কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, তুমি জান এর আগে যে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল সে অত্যন্ত নির্বোধ ব্যক্তি ছিল।

বুদ্ধিমত্তা খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। তাছাড়াও এটি বহুমাত্রিক।

তুমি কি নির্বোধ?

কোনো কোনো বিষয়ে সবাই নির্বোধ। তুমি অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ বলে শুনেছি কিন্তু অন্তত একটি ব্যাপারে তুমিও নির্বোধ।

কণ্ঠস্বরটি দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। প্রতি মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল অন্ধকার থেকে একটি বুলেট ছুটে এসে আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিবে। আমি ত্রিশার কথা ভাবতে চাইলাম, যখনই আমি অসহায় অনুভব করি আমি ত্রিশার কথা ভাবি।

তুমি ভয় পেয়েছ।

হ্যাঁ।

কিন্তু তুমি তীত নও। যে আমাকে নির্বোধ বলতে পারে সে ভীতু হতে পারে না। মানুষের প্রাণের জন্যে আমার কোনো মমতা নেই।

জানি

তুমি কেন আমাকে নির্বোধ মনে কর?

কারণ তুমি পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলবে বলে ভয় দেখিয়েছ।

আমি ভয় দেখাই নি। আমি সত্যি সত্যি সেটা করতে চাই।

আমার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে, মানুষটি সত্যি কথা বলছে। সত্যিই সে পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলতে চায়। আমি জিভ দিয়ে আমার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম, তুমি কেন পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলতে চাও?

আমি সেটা বহুবার বলেছি। পৃথিবীর সব ডাটাবেসে সে তথ্য আছে।

আমি তোমার নিজের মুখ থেকে শুনতে চাই।

কেন?

কারণ আমি পৃথিবীকে তোমার হাত থেকে রক্ষা করব। তোমার সম্পর্কে আমার জানা প্রয়োজন।

তুমি একা পৃথিবীকে রক্ষা করবে?

না, আমার সাথে আরো চার জন অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষ রয়েছে।

তোমরা পাঁচ জন মিলে পৃথিবীকে রক্ষা করবে?

না। আমাদের সহযোগিতা করবে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান—

চুপ কর কণ্ঠস্বরটি হঠাৎ তীব্র স্বরে আমাকে ধমকে ওঠে, হঠাৎ করে আমি সত্যিকারের এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করি। আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা স্রোত বয়ে যেতে থাকে। ভয়ঙ্কর অন্ধকারে আমি দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি, আমি প্রথমবার অনুভব করতে পারলাম অন্ধকারে যে প্রাণীটির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেটি মানুষ নয়, সেটি একটি দানব। আমি কুলকুল করে ঘামতে থাকি। আবার আমি ত্রিশার কথা ভাবতে শুরু করি। আমার চোখের সামনে তার চেহারা ভেসে ওঠে, আমার দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে, লাল ঠোঁট ঝকঝকে স্ফটিকের মতো দাঁত। বাতাসে তার রেশমের মতো কালো চুল উড়ছে।

তুমি কার কথা ভাবছ?

মানুষটি এই ঘুটঘুটে অন্ধকারেও আমাকে স্পষ্ট দেখছে, আমি দেয়াল স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে আমার শরীরের আরো অনেক তথ্য পেয়ে যাচ্ছে।

কথা বল।

আমি বলতে চাই না।

কেন?

এটি আমার খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাছাড়া

তাছাড়া কী?

তুমি হয়তো সেটা বুঝবে না। মানুষ সম্পর্কে তোমার ধারণাটি অত্যন্ত বিচিত্র। তোমার ধারণা পৃথিবীতে মানুষের জন্ম পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবীর মানুষকে ধ্বংস করে তুমি তাদের যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে দেবে।

তোমার কথা খানিকটা সত্যি।

কিন্তু সেটি সত্যি নয়। পৃথিবীতে মানুষের জন্ম ব্যর্থ হয় নি। যতদিন পৃথিবীতে একজন মানুষের জন্যে অন্য মানুষের ভালবাসা থাকবে ততদিন মানবজন্ম বৃথা হবে না।

চুপ কর তুমি। চুপ কর—

না, আমি চুপ করব না। আমাকে মেরে ফেলতে চাইলে তুমি মেরে ফেলতে পার, কিন্তু আমি যেটা বলতে চাই সেটা বলবই। জ্ঞান বিজ্ঞান সত্যতা শিল্প সাহিত্য মানুষের জীবনের মাপকাঠি না– মানুষের জীবনের মাপকাঠি হচ্ছে একের জন্যে অন্যের ভালবাসা। তুমি সেটা জান না। তুমি সেটা কোনোদিন জানবে না।

আমি মানুষটি দেখতে পারছি না, মানুষটি এখন সম্ভবত আমাকে মেরে ফেলবে, আমার হয়তো চুপ করে থাকাই উচিত ছিল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি, নিজেকে হঠাৎ খুব অসহায় মনে হয়। দীর্ঘ সময় কোথাও কোনো শব্দ নেই, মনে হয় আমি বুঝি কফিনের মাঝে একটি মৃতদেহকে নিয়ে বসে আছি। আমি চাপা গলায় ডাকলাম, শ্যালক্স গ্রুন।

বল।

তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে?

এখনো জানি না।

আমি কি তোমার সাথে কথা বলতে পারি?

কী কথা বলতে চাও?

তুমি কি নিজের মুখে আমাকে একবার বলবে কেন তুমি পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলতে চাও?

তুমি বলতে পারবে?

আমি?

হ্যাঁ, তুমি।

আমি একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, চেষ্টা করতে পারি।

কর।

তোমার মানুষের জন্যে কোনো মমতা নেই। সম্ভবত শৈশবে খুব হৃদয়হীন কিছু মানুষ তোমার ওপর খুব অবিচার করেছিল। তুমি তার প্রতিশোধ নিতে চাও।

আমি একটু থামতেই শ্যালক্স গ্রুন বলল, বলতে থাক।

তুমি ভয়ঙ্কর স্বার্থপর। তোমার মৃত্যুর পর পৃথিবী বেঁচে থাকুক আর ধ্বংস হোক তাতে তোমার কিছু আসে যায় না। তাই তুমি এই খেলাটি বেছে নিয়েছ, তুমি বনাম পৃথিবী।

আমি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বললাম, আমি কি ভুল বলেছি?

না।

অনেক ধন্যবাদ শ্যালক্স গ্রুন

শ্যালক্স গ্রুন কোনো কথা বলল না। আবার দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। আমি অন্ধকারে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভয়ঙ্কর অন্ধকার স্নায়ুর ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করে, আমি কেমন জানি এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে থাকি। যখন মনে হল শ্যালক্স গ্রুন আর কোনো কথা বলবে না, আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন সে বলল, তোমরা পৃথিবীকে রক্ষা করবে ঠিক করেছ?

হ্যাঁ।

কীভাবে?

আমি মোটামুটি নিঃসন্দেহ তুমি সত্যি সত্যি সব মানুষকে মেরে ফেলতে চাও। কিন্তু সেটি যখন করা হবে তুমি নিজেও মারা যাবে। কিন্তু তুমি মৃত্যুর জন্যে এখনো প্রস্তুত নও। পৃথিবীর মানুষের সাথে তুমি যে খেলাটি খেলছ সেটা তুমি আরো একটু খেলতে চাও। আমার ধারণা তুমি আমার কাছে কোনো প্রস্তাব দেবে।

প্রস্তাব?

হ্যাঁ। কিছু একটা তুমি দাবি করবে। অসম্ভব একটা দাবি। সে দাবি পূরণ করতে না পারলে তুমি পৃথিবীর সব মানুষকে ধ্বংস করে দেবে।

আর সেই দাবি যদি পূরণ করা হয়?

তাহলে তুমি আরো ভবিষ্যতে পাড়ি দেবে। আরো এক শ বছর সামনে।

কিন্তু সেটি পৃথিবীকে রক্ষা করা হল না। মাত্র এক শ বছর সময় নেয়া হল।

হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যখন পৃথিবীতে নেমে আসবে পৃথিবীর বিজ্ঞান তখন আরো এক শ বছর এগিয়ে যাবে। আমরা তাদের অমূল্য কিছু তথ্য দেব যেটা ব্যবহার করে তোমাকে ধ্বংস করা হবে।

সেই অমূল্য তথ্য তুমি পেয়ে গেছ?

এখনো পাই নি। কিন্তু আমি জানি সেই তথ্য আছে।

কেমন করে জান?

কারণ তুমি এই ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার করে রেখেছ। আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। তুমি কিন্তু আমাকে স্পষ্ট দেখছ। এটা এক ধরনের সতর্কতা। এই সতর্কতার প্রয়োজন হয় যখন কোনো দুর্বলতা থাকে। তোমার কোনো একটা দুর্বলতা আছে। সেটি কী আমি জানি না।

শ্যালক্স গ্রুন কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। আমি বললাম, দ্বিতীয় আরেকটি ব্যাপার হতে পারে।

কী?

তোমার কোনো ধরনের শারীরিক বিকৃতি রয়েছে। লিটুমিনা–৭২ এর ছোট এম্পুলটি কোনোভাবে তোমার শরীরে বসানো আছে। তোমার রক্ত খেয়ে সেই ভাইরাস বেঁচে আছে। সেটা তোমার শরীরে বসাতে গিয়ে তোমার ভয়াবহ শারীরিক বিকৃতি হয়েছে। তুমি কুদর্শন এবং বিসদৃশ। তাই তুমি কাউকে তোমার চেহারা দেখাতে চাও না।

আর কিছু বলবে?

হ্যাঁ। তৃতীয় আরেকটি সম্ভাবনা আছে। খুব ক্ষুদ্র সম্ভাবনা। মানুষের ওপর তুমি পুরোপুরি বিশ্বাস হারিয়েছ। অন্য আরেকজন মানুষ তোমার কাছে একটি জঞ্জালের মতো। তাকে তুমি মানুষের সম্মান দিতে রাজি নও। তাকে তুমি দীর্ঘ সময় অন্ধকারে অসহায়ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখ। সম্পূর্ণ অকারণে। তুমি হয়তো লক্ষও কর নি যে আমি একজন মানুষ সম্পূর্ণ অন্ধকারে একটা দেয়াল ধরে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে আছি।

এই তিনটি সম্ভাবনার মাঝে কোনটি সত্যি?

আমি এখনো জানি না।

টুক করে একটা শব্দ হল এবং হঠাৎ করে খুব ঋরে ধীরে ঘরে একটা আলো জ্বলে উঠতে শুরু করে। ছোট একটা ঘর, দেয়ালে প্রাচীন যন্ত্রপাতি, কুদর্শন ডায়াল। ছাদ থেকে বিচিত্র কিছু টিউব ঝুলে আছে। সামনে একটা চেয়ার, সেই চেয়ারে গা ডুবিয়ে বসে আছে একটি মানুষ। অত্যন্ত সুদর্শন একজন মানুষ। মাথা ভরা এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মানুষটির চোখ দুটি আশ্চর্য নীলসেই নীল চোখে সে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে এক ধরনের শীতলতা যেটি আমি আগে কখনো কোনো মানুষের চোখে দেখি নি। আমার সমস্ত শরীর কেমন যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রাচীন লোকগাথায় যেসব ভয়াবহ প্রেত অশরীরী দানবের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হয়তো কাল্পনিক নয়, সেগুলো হয়তো এই রকম মানুষের কথা।

আমি জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটি ভিজিয়ে বললাম, তুমি কুদর্শন নও। তুমি অসম্ভব রূপবান।

শ্যালক্স গ্রুন কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি কেন জানি সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না, আমাকে চোখ সরিয়ে নিতে হল। আমি আবার ঘরটির দিকে তাকালাম, এই প্রাচীন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মানুষটি ভবিষ্যতে চলে এসেছে? এই মানুষটি লিটুমিনা–৭২ ভাইরাস তৈরি করেছে–পৃথিবীর সব বিজ্ঞানী এক শ বছর চেষ্টা করেও যার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিষেধক বের করতে পারে নি? এই সেই মানুষ যার ভিতরে এতটুকু মমতা নেই? ভালবাসা নেই? আমি আবার শ্যালক্স গ্রুনের দিকে তাকালাম, কী ভয়ঙ্কর তার চোখের দৃষ্টি। সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি এখন আমাকে মেরে ফেলবে?

শ্যালক্স গ্রুন আমার দিকে বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, খুব ধীরে ধীরে তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কি মেরে ফেলবে?

তোমার কী মনে হয়?

আমি ঠিক জানি না।

সত্যি জান না?

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, জানি। এটা একটা খেলা। যে–কোনো খেলাতে একটা প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতে হয়। তা না হলে সেই খেলায় কোনো আনন্দ নেই।

খেলায় ঘুঁটিও থাকতে হয়। অর্থহীন প্রয়োজনহীন ঘুঁটি–

না। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি খেলার ঘুঁটি না। আমি যদি অর্থহীন প্রয়োজনহীন ঘুঁটি হতাম মহামান্য ইয়োরন রিসি সারা পৃথিবী খুঁজে তোমার মুখোমুখি হবার জন্যে আমাকে বেছে নিতেন না!

তাহলে ঘুঁটি কে?

পৃথিবীর পাঁচ বিলিয়ন মানুষ।

শ্যালক্স গ্রুন কোনো কথা বলল না, তার মুখে বিদ্রুপের খুব সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে ওঠে। আমি তার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বললাম, আমি কি যেতে পারি?

যাও।

আমি ভেবেছিলাম তুমি কিছু একটা দাবি করবে।

তুমি ঠিকই ভেবেছ। আমি একটা জিনিস চাই।

আমি ঘুরে তাকালাম, কী?

দেখি তুমি বলতে পার কি না।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, ত্রিনিত্রি রাশিমালা?

হ্যাঁ। এক সপ্তাহের মাঝে আমি ত্রিনিত্রি রাশিমালা চাই। তুমি এখন যাও।

যাবার আগে আমি একটা কথা বলতে পারি?

কী কথা?

তুমি এক শ বছর আগের টেকনোলজি ব্যবহার করে একটা অসাধ্য সাধন করেছ। কেমন করে করেছ আমি জানি না, আমি বিজ্ঞান ভালো বুঝি না। কিন্তু আমি জানি ব্যাপারটা কঠিন, ভবিষ্যতে চলে আসতে প্রচণ্ড শক্তি ক্ষয় হয়–এমন কি হতে পারে না যে সেই ভয়ঙ্কর অভিযানে প্রকৃত শ্যালক্স গ্রুন মারা গেছে। তুমি সত্যি নও, তুমি আসলে তোমার ওমেগা কম্পিউটারের তৈরী একটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক ছবি।

হতে পারে।

আমি কি তোমাকে স্পর্শ করে দেখতে পারি তুমি সত্যি কি না?

শ্যালক্স গ্রুন তার হাতটি আমার দিকে এগিয়ে দেয়, আমি দুই পা এগিয়ে গিয়ে তার হাত স্পর্শ করলাম। সাথে সাথে কেন জানি না আমার সমস্ত শরীর হঠাৎ শিউরে ওঠে।

০৫. দেয়ালে হেলান দিয়ে

আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছি। আমার হাতে একটা সাদা তোয়ালে, আমি সেটা দিয়ে আমার হাতটা মোছার চেষ্টা করছি। আমাকে ঘিরে অন্য চার জন বসে আছে। নুবা বলল, রিকি, তোমার সত্যি আর হাতটা মোছার প্রয়োজন নেই।

হ্যাঁ। হিশান বলল, হাতে শ্যালক্স গ্রুনের যেটুকু চিহ্ন ছিল মুছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

আমি জানি। আমি এর মাঝে কম করে হলেও দশবার হাত ধুয়ে এসেছি তবুও কেমন জানি গা ঘিনঘিন করছে, মনে হচ্ছে কিছু অশুভ একটা কিছু ঘটে গেছে। ব্যাপারটা আমি ঠিক বোঝাতে পারব না, আমার কখনো এ রকম হয় নি।

নুবা নরম গলায় বলল, রিকি। আমার মনে হয় তুমি বাইরে থেকে ঘুরে আস।

হ্যাঁ।

হিশান আর ইগা একসাথে মাথা নাড়ে। তোমার কাজ তুমি করেছ, তুমি এখন এক দিনের জন্যে ছুটি নাও।

কিন্তু আমাদের সময় নেই–

আমি জানি। কিন্তু তুমি সত্যি এখন কোনো কাজে আসছ না। একজন মানুষ হাত থেকে অদৃশ্য কিছু মুছে ফেলার চেষ্টা করছে–ব্যাপারটা দেখা খুব মজার ব্যাপার না।

আমি সবার মুখের দিকে তাকালাম, সত্যি তোমরা মনে কর আমি এখন যেতে পারি?

হ্যাঁ, সত্যি আমরা মনে করি।

আমি সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম, আমার সত্যিই খানিকক্ষণের জন্যে এই জীবনটির কথা ভুলে যাওয়া দরকার।

.

বিজ্ঞান পরিষদের বিশাল ভবন থেকে বের হয়ে আমি খানিকক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকি। পাশে বড় রাস্তা, তার বিভিন্ন স্তরে নানা আকারের বাই ভার্বাল যাচ্ছে আসছে। দুপাশে বড় বড় আলোকোজ্জ্বল ভবন। রাস্তায় নানা ধরনের মানুষ। এটি শহরের ভালো এলাকাটি, মানুষগুলোর চেহারায়, পোশাকে তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। অপরিচিত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করতে আমার খুব ভালো লাগে। আমি আগেও দেখেছি শহরের দরিদ্র এবং অবস্থাপন্ন অঞ্চলের মানুষের অনুভূতির মাঝে খুব বেশি তারতম্য নেই।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষজনকে লক্ষ করতে করতে হঠাৎ দুজন তরুণ–তরুণীকে হাত ধরে হেঁটে যেতে দেখলাম। তরুণীটির চেহারার সাথে কোথায় জানি ত্রিশার চেহারার মিল রয়েছে, আমার হঠাৎ করে কেমন জানি বিষণ্ণ লাগতে থাকে। আমি বুকের ভিতরে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করি, ঘনিষ্ঠ একজনের সাথে কথা বলার জন্যে হঠাৎ বুকটি হা হা করতে থাকে। কিন্তু আমার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই।

আমি ক্লান্ত পায়ে রাস্তা ধরে কয়েক পা হেঁটেছি আর ঠিক তখন আমার পাশে অত্যন্ত সুদৃশ্য একটি বাই ভার্বাল এসে দাঁড়াল।

দরজা খুলে কমবয়সী একটি মেয়ে লাফিয়ে নেমে এসে বলল, মহামান্য রিকি!

আমাকে বলছ?

অবশ্যি! কোথায় যাবেন আপনি?

আমাকে নিয়ে যাবে তুমি?

অবশ্যি!

ঠিক তখন আমার মনে পড়ল আজ সকালে আমার জীবন পাল্টে গেছে, আমি পৃথিবীর এক শ সতের জন লাল কার্ডের অধিকারীদের এক জন। আমি একবার ভাবলাম মেয়েটিকে চলে যেতে বলি, কিন্তু কী মনে করে আমি বাই ভার্বালে উঠে বসলাম।

কোথায় যাবেন মহামান্য রিকি?

তোমার আমাকে মহামান্য রিকি ডাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে শুধু রিকি ডাকতে পার।

মেয়েটি খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।

বাই ভার্বালটি নিঃশব্দে উপরে উঠে একটা নির্দিষ্ট গতিপথে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। আমি প্রায় মুগ্ধ হয়ে এই যন্ত্রটিকে দেখছিলাম, তখন মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাবেন?

আমি জানি না।

মেয়েটি হেসে ফেলল, যেন খুব মজার কথা একটা শুনেছে। হাসতে হাসতে বলল, জাতীয় শিক্ষকেন্দ্রে খুব সুন্দর একটি নৃত্যানুষ্ঠান হচ্ছে।

না, আমি মাথা নাড়লাম, আমার মানুষের ভিড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।

তাহলে কি জাতীয় মিউজিয়ামে–

না। আমার মস্তিষ্কটিকে একটু বিশ্রাম দিতে হবে। খুব কষ্ট হয়েছে আজ। মিউজিয়ামে গেলে বিশ্রাম হবে না।

আপনাকে কি তাহলে বাসায় নিয়ে যাব?

না। বাসাতেও যেতে ইচ্ছে করছে না।

আপনার কোনো বন্ধুর বাসায়?

আমার বন্ধু বলতে গেলে নেই। আমি যে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি সেখানে যারা ছিল তাদের সাথে খানিকটা যোগাযোগ আছে।

যাবেন তাদের বাসায়?

মন্দ হয় না। এই বাই ভার্বাল নিয়ে যাওয়া যাবে না। শহরের সবচেয়ে দুস্থ এলাকায় থাকে তারা!

সেটি নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।

সত্যি সত্যি সেটা নিয়ে আমার কোনো চিন্তা করতে হল না। মেয়েটি কীভাবে কীভাবে জানি দুস্থ এলাকার সরু একটা রাস্তার পাশে বিল বাই ভার্বালটি নামিয়ে ফেলল।

আমি দরজা খুলে বের হতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, আমি কি আপনার জন্যে অপেক্ষা করব?

মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? বাড়ি যাও এখন। মেয়েটি আমাকে অভিবাদন করে বাই ভার্বালের মাঝে ঢুকে যায়, আমার কেন যেন সন্দেহ হতে থাকে মেয়েটি আসলে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকবে।

আমার অনাথ আশ্রমের যে বন্ধুটির সাথে আমি দেখা করতে এসেছি তার নাম রিহাস। সে শক্তসমর্থ বিশাল একটি মানুষ, কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা অপরিণতবয়স্ক কিশোরের মতো। তার ভিতরে এক ধরনের সারল্য আছে যেটা আমাকে বরাবর মুগ্ধ করে এসেছে।

আমি তার দরজায় শব্দ করতেই সে দরজা খুলে দিল। আমাকে দেখে সে একই সাথে বিস্মিত এবং আনন্দিত হয়ে ওঠে। সে দুই হাতে শক্ত করে আমার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, কী আশ্চর্য! রিকি তুমি এসেছ আমার বাসায়! কী আশ্চর্য!

আমি তার ঝাঁকুনি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে করতে বললাম, এর মাঝে আশ্চর্য হবার কী আছে? আমি কি তোমার বাসায় আগে কখনো আসি নি?

কিন্তু আজকেই আমি তোমার বাসায় খোঁজ করেছিলাম!

সত্যি?

হ্যাঁ। ভারি মজার ব্যাপার হয়েছে আজ। ভারি মজা!

কী?

তোমার বাসায় খোঁজ করেছি, যোগাযোগ মডিউলটি ধরেছে তোমার রবোট!

কিটি?

হ্যাঁ। কিটি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রিকি কোথায়? সে কী বলল জান?

কী?

হাঃ হাঃ হাঃ। তুমি শুনলে বিশ্বাস করবে না, সে বলল রিকিকে বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক মহামান্য ইয়োরন রিসি ডেকে পাঠিয়েছেন! রিহাস আবার বিকট স্বরে হাসতে শুরু করল!

তাই বলল?

হ্যাঁ। রিহাস অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে তার চোখ মুছে বলল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন ডেকেছে রিকিকে? সে কী বলল জান?

কী?

বলল, মনে হয় পৃথিবীর কোনো সমস্যা হয়েছে। রিকি তার সমাধান করবে! রিহাস আবার হাসতে শুরু করে। তার দিকে তাকিয়ে আমিও হাসতে শুরু করি। মুহূর্তে আমার মনের সমস্ত গ্লানি কেটে যায়, বুকের ভিতর এক ধরনের সজীব আনন্দ এসে ভর করে।

রিহাস আমার হাত ধরে আমাকে টেনে ঘরের ভিতরে নিয়ে আসে। আমি তার প্রবল আপ্যায়ন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে করতে বললাম, তুমি আমাকে খোঁজ করছিলে কেন?

অনেকদিন থেকে দেখা নেই তাই ভাবলাম একটু খোঁজ নিই। তাছাড়া

তাছাড়া কী?

রিহাস লাজুক মুখে বলল, লানার কথা মনে আছে?

লানা? তোমার বান্ধবী?

হ্যাঁ। আমি আর লানা ঠিক করেছি বিয়ে করব। এই বসন্তেই।

সত্যি? আমি কনুই দিয়ে রিহাসের পেটে চা দিয়ে বললাম, সত্যি?

রিহাস দাঁত বের করে হেসে বলল, সত্যি! লানাকে আজ আমি খেতে আসতে বলেছি, তাই ভাবছিলাম তোমাকেও ডাকি! কী আশ্চর্য সত্যি সত্যি তুমি এসে হাজির! এটাকে যদি ভাগ্য না বল তাহলে ভাগ্যটা কী?

আমি মাথা নেড়ে রিহাসের কথায় সায় দিলাম। রিহাস আমার হাত ধরে বার কয়েক ঝাঁকুনি দিয়ে ঘরের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ভিতরে খানিকক্ষণ নানা ধরনের শব্দ হয়, সম্ভবত কিছু একটা রান্না হচ্ছে। একটু পরেই সে ফিরে এসে বলল, তোমার খিদে পেয়েছে তো? মাংসের স্টু রান্না হচ্ছে। কৃত্রিম মাংস নয়, একেবারে পাহাড়ি ভেড়ার রান! অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি।

রিহাসের ঘরে আসবাবপত্র বিশেষ নেই, কিন্তু যেটুকু আছে সেটুকু খুব সাজানো গোছানো। ঘরের একপাশে ছোট টিউব। আমি সেদিকে তাকাতেই রিহাস মাথা নেড়ে বলল, টিউবটা এক সপ্তাহ থেকে নষ্ট হয়ে আছে। বিশ্বাস কর, কম করে হলেও তিনবার খবর পাঠিয়েছি, কারো কোনো গরজ নেই।

আমি অন্যমনস্কতাবে টিউবটার সুইচ স্পর্শ করতেই সেটা চালু হয়ে ঘরে হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে আসে। রিহাস অবাক হয়ে বলল, আরে! ঠিক হয়ে গেছে দেখি! কেমন করে ঠিক হল?

আমি জানি না।

কী আশ্চর্য! আমি একটু আগে চেষ্টা করলাম কিছুতেই চালু হল না।

টিউবে জেনারেল জিক্লোকে সমাহিত হবার খবরটি দেখানো হচ্ছিল। কীভাবে মারা গেছেন সেটি ব্যাখ্যা করা হয় নি, একটি দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। একটু আগে আমরা এই শব্দটি ঠিক করে দিয়েছিলাম–শ্যালক্স গ্রুনের কথা এই মুহূর্তে কাউকে বলা সম্ভবত সুবিবেচনার কাজ নয়।

রিহাস ঘরের একপাশে হিটারের কাছে দাঁড়িয়ে বাতাসের উত্তাপ পরীক্ষা করতে করতে বলল, আশ্চর্যের পর আশ্চর্য!

কী হয়েছে?

গরম বাতাসের হিটারটি নষ্ট হয়েছিল সেটাও ঠিক হয়ে গেছে! দেখ কী চমৎকার উষ্ণ বাতাস!

আমি রিহাসের কাছে দাঁড়িয়ে বাতাসের প্রবাহে হাত রেখে উষ্ণতাটা অনুভব করতে করতে বললাম, ভারি চমৎকার।

কিন্তু কেমন করে হল এটা?

আমি জানি না। মাথা নেড়ে বললাম, জানি না।

আমি রিহাসের মুখের দিকে তাকালাম, তার চেহারায় একটি অল্পবয়স্ক বালকের ছাপ। রয়েছে। আমরা যখন অনাথ আশ্রমে ছিলাম সে সবসময় আমাকে অন্য দুরন্ত শিশুদের হাত থেকে রক্ষা করত। আমি সবসময় রিহাসের জন্যে এক ধরনের মমতা অনুভব করে এসেছি। আজকেও তার কিশোরসুলভ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি এক ধরনের গভীর ভালবাসা অনুভব করি। আমি তার হাত স্পর্শ করে বললাম, রিহাস

কী হল?

তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

কী কথা?

তোমার কি মনে হয় মানুষের জীবন অর্থহীন?

রিহাস ভেবাচেকা খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমার প্রশ্নটি সে ধরতে পেরেছে মনে হয় না। প্রাণপণ চেষ্টা করে বোঝার চেষ্টা করতে থাকে আমি তার সাথে কোনো ধরনের রসিকতা করার চেষ্টা করছি কি না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কী বললে?

বলেছি, তোমার কি মনে হয় বেঁচে থাকার কোনো অর্থ আছে?

অর্থ থাকবে না কেন?

এই যে, কী কষ্টের একটা জীবন! তুমি আর আমি অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছি–বাবা মা নেই, আদর করে কথা বলার একটি মানুষ নেই। বেঁচে থাকার জন্যে কী কষ্ট, সূর্য ওঠার আগে তুমি ঘুম থেকে উঠে সুড়ঙ্গে করে কাজ করতে যাও, ফিরে আস সন্ধেবেলা, খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে

কী হল তোমার? রিহাস আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কি গোপন রাজনীতির দলে নাম লিখেছ?

না।

তাহলে?

তাহলে কী?

তাহলে এ রকম মন খারাপ করা কথা বলছ কেন? অনেক কষ্ট করতে হয় সত্যি– কিন্তু সবাই কষ্ট করে। তুমি শুধু কষ্টটা দেখছ কেন? ভালো জিনিসটা দেখছ না কেন?

ভালো কোন জিনিসটা?

কত কী আছে। লানার কথা ধর–লানার সাথে আমি যখন থাকি তখন আমার মনে হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।

আমি রিহাসের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললাম, রিহাস, যদি মনে কর কেউ এসে বলে তোমার জীবন তুচ্ছ, তুমি তুচ্ছ, তোমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই, তুমি কী বলবে?

আমি?

হ্যাঁ, তুমি।

আমি এক ঘুসিতে তার মুখের ছয়টা দাঁত খুলে নিয়ে বলব, জাহান্নামে যাও!

আমি রিহাসের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। রিহাস খানিকক্ষণ আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার আজকে কী হয়েছে? রাজনীতির লোকদের মতো কথা বলছ কেন?

আর বলব না!

সেটাই ভালো–সে আরো কী একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। নিশ্চয়ই লানা এসেছে।

রিহাস যেরকম বিশাল, লানা ঠিক সেরকম ছোটখাটো। তার লাল চুল শক্ত করে পিছনে টেনে বাধা। ঠিক সুন্দরী বলতে যা বোঝায় লানা তা নয়, কিন্তু তার চেহারায় এক ধরনের স্নিগ্ধ কমনীয়তা রয়েছে। লানা তার ভারী কোট খুলে দু হাত ঘষে উষ্ণ হতে হতে বলল, খুব একটা অবাক ব্যাপার হয়েছে বাইরে।

কী হয়েছে?

বিশাল একটা বাই ভার্বাল দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। শুধুমাত্র ছবিতে এ রকম বাই ভার্বাল দেখা যায়–চিত্রতারকারা এ রকম বাই ভার্বালে করে যায়।

আমি একটু এগিয়ে এলাম, কী হয়েছে সেই বাই ভার্বালে?

ভিতরে একটা মেয়ে, কী সুন্দর দেখতে গায়ের রং কী উজ্জ্বল!

কী হয়েছে সেই মেয়ের?

আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি লানা?

রিহাস অবাক হয়ে বলল, সত্যি?

হ্যাঁ। আমি বললাম হ্যাঁ, আমি লানা। তখন আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আর রিহাস এই বসন্তকালে বিয়ে করবে? আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি কে? তুমি কেমন করে জান? মেয়েটি হেসে বলল, আমি সব জানি। এই নাও তোমাদের বিয়ের উপহার। আমার হাতে একটা ছোট খাম ধরিয়ে দিল। আমি নিতে চাচ্ছিলাম না, যাকে আমি চিনি না, কেন তার থেকে উপহার নেব? মেয়েটা তখন কী বলল জান?

কী?

বলল, তুমি আর রিহাস পৃথিবীর খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষকে খুব খুশি করেছ। আমরা তার পক্ষ থেকে উপহার দিচ্ছি। তোমাকে নিতে হবে।

তাই বলল?

হ্যাঁ।

রিহাস এগিয়ে গিয়ে খামটা হাতে নিয়ে বলল, দেখি কী আছে খামে। খামটা খুলে সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে।

অনেকক্ষণ পর সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল হয়েছে কোথাও।

কেন? কী আছে খামে?

আমাদের দুজনের জন্যে দক্ষিণের সমুদ্রোপকূলে দু সপ্তাহের জন্যে একটি কটেজ। যাতায়াতের খরচ। সরকারি ছুটি, হাতখরচের জন্যে ভাউচার।

লানা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। সত্যি?

হ্যাঁ, এই দেখ। নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল হয়েছে।

লানা মাথা নাড়ল, বলল, না ভুল হয় নি। মেয়েটি আমাকে স্পষ্ট বলেছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ দিয়েছে। এত গুরুত্বপূর্ণ যে তার লাল কার্ড রয়েছে।

লাল কার্ড?

হা। রিহাস জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকাল, রিকি, শুনেছ, লাল কার্ডের একজন মানুষ আমাকে আর লানাকে বিয়ের উপহার দিয়েছে। শুনেছ?

আমি জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে আনি, শুনেছি।

মানুষটা কে? কখন আমি তাকে খুশি করেছি? কীভাবে করেছি?

আমি রিহাসের হাত স্পর্শ করে বললাম, রিহাস, একজন মানুষ যখন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় তখন তাকে আর বোঝা যায় না। তোমরাও কোনোদিন এই মানুষটিকে বুঝবে না। কোনোদিন তাকে খুঁজেও পাবে না!

তুমি কেমন করে জান?

আমি জানি না। আন্দাজ করছি।

রিহাস আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রিকি, তুমি আমার জন্যে আজকে সৌভাগ্য নিয়ে এসেছ। প্রথমে টিউব ঠিক হয়ে গেল, তারপর গরম বাসের হিটার, এখন এই সাংঘাতিক উপহার! তাই না লানা?

লানা মিষ্টি করে হেসে বলল, হ্যাঁ। কিছু কিছু মানুষ হয় এ রকম। তারা সবার জন্যে সৌভাগ্য নিয়ে আসে। আমি আগেও দেখেছি রিকি সবসময় সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে।

আমি মনে মনে বললাম, তোমার কথা সত্যি হোক লানা। শ্যালক্স গ্রুনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হচ্ছে সৌভাগ্য। অনেক অনেক সৌভাগ্য।

.

গভীর রাত্রিতে আমার হঠাৎ ত্রিশার কথা মনে হল। কোথায় আছে এখন? কী করছে? তাকে একটিবার দেখার জন্যে আমার বুক হাহাকার করতে থাকে। আমি বিছানায় দুই হাঁটুর মাঝে মুখ রেখে চুপ করে বসে থাকি। টেবিলের উপর আমার লাল কার্ডটি পড়ে রয়েছে। আমি সেটা স্পর্শ করে ত্রিশার খোঁজ নিতে পারি, তাকে দেখতে পারি, আমার কাছে নিয়ে আসতে পারি।

কিন্তু আমি কিছুই করলাম না। চুপ করে বসে রইলাম।

০৬. আমরা পাঁচ জন

আমরা পাঁচ জন যে ঘরটিতে বসে আছি সেটি বেশ ছোট। ঘরটির দেয়াল কাঠের, দুপাশে বড় বড় জানালা, সেই জানালা দিয়ে বিস্তৃত প্রান্তর দেখা যায়। বাইরে ঝড়ো বাতাস, সেই বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। ঘরের ভিতরে বসে আমরা বাতাসের শো শো শব্দ শুনতে পাই, কেন জানি না এই শব্দে বুকের মাঝে কেমন জানি এক ধরনের শূন্যতার জন্ম দেয়।

বড় জানালার একটিতে নুবা পা তুলে বসে আছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে সে তরল গলায় বলল, কী সুন্দর এই জায়গাটা!

হিশান হা হা করে হেসে বলল, তুমি সুন্দর বলছ এই জায়গাটাকে? জেনারেল ইকোয়া শুনলে হার্টফেল করে মারা যাবেন!

য়োমি বলল, বেচারাকে দোষ দিয়ে লাভ কী? আমাদের পাহারা দেবার জন্যে বাইরে এই ঝড়ো বাতাসে কতজন বসে আছে তুমি জান?

নুবা হাত নেড়ে বলল, দরকার কী পাহারা দেবার? আমরা কি ছোট শিশু।

ইগা মাথা নেড়ে বলল, বেচারাদের কোনো উপায় নেই। সংবিধানে লেখা আছে যার কাছে লাল কার্ড রয়েছে তাকে যে–কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।

নুবা তার পকেট থেকে লাল কার্ডটি বের করে সেটাকে এক নজর দেখে বলল, এটা নিয়ে তো দেখি মহা যন্ত্রণা হল।

তা বলতে পার। আমি হেসে বললাম, কাল তোমরা যখন আমাকে ছুটি দিলে আমি হাঁটতে বের হয়েছিলাম, সাথে সাথে একটা বিশাল বাই ভার্বাল হাজির! যার বাসায় গিয়েছি চোখের পলকে তার বাসার সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল! সেই বাসার মানুষটি বিয়ে করবে সে জন্যে উপহার

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি।

কীভাবে হয়েছে শুনি?

আমি খুলে বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। বললাম, একটা জিনিস লক্ষ করছ? আমরা ইচ্ছে করে অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কথা বছি আমাদের যে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলা দরকার সেটা এড়িয়ে যাচ্ছি?

নুবা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি। তুমি ঠিকই বলেছ রিকি। ব্যাপারটা এমন মন খারাপ করা যে সেটা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না।

কিন্তু বলতে হবে।

হ্যাঁ। বলতে হবে।

ইগা য়োমির দিকে তাকিয়ে বলল, য়োমি তুমি আমাদের সবাইকে পুরো ব্যাপারটার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।

আমি? য়োমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইগার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কেন?

দুটি কারণে। প্রথমত, আমি দেখেছি একটি মেয়ে সাধারণত খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। দ্বিতীয়ত, তুমি শ্যালক্স গ্রুনকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে পারবে।

য়োমি তীব্র স্বরে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, নুবা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে আমি বলছি। যদি কিছু ভুল বলি তোমরা শুধরে দিও।

আমি নুবার দিকে খানিকটা হিংসার দৃষ্টিতে তাকালাম। কী সাদাসিধে দেখতে অথচ কী চমৎকার সহজ একটা নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা! ইয়েরিন রিসি নিশ্চয়ই অনেক ভেবেচিন্তে এই দলটিকে দাঁড় করিয়েছেন।

নুবা জানালা থেকে নেমে এসে একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। কয়েক মুহূর্ত নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা তুলে বলল, প্রথমে সবার পক্ষ থেকে রিকিকে ধন্যবাদ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্যালক্স গ্রুনের সাথে দেখা করার জন্যে। রিকি আমাদের খুব মূল্যবান দুটি তথ্য এনে দিয়েছে। দুটি তথ্যই খুব মন খারাপ করা তথ্য, কিন্তু মূল্যবান তাতে সন্দেহ নেই। সত্যি কথা বলতে কী, এই দুটি তথ্য জানার পর আমাদের আর খুঁটিনাটি কিছু জানার নেই।

প্রথম তথ্যটি হচ্ছে শ্যালক্স গ্রুন ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছে না। সে সত্যিই পুরো পৃথিবী ধ্বংস করতে চায়। কখন করবে সেই সময়টি সে এখনো ঠিক করে নি, কিন্তু সে তার চেষ্টা করবে। রিকির ধারণা ভয়ঙ্কর ভাইরাসের এম্পূলটি সে তার নিজের শরীরের ভিতরে রেখেছে। যতক্ষণ সে বেঁচে থাকবে এম্পূলটি অক্ষত থাকবে। কোনোভাবে তার মৃত্যু হলে সাথে সাথে এম্পুলটি ফেটে লিটুমিনা–৭২ ভাইরাস বের হয়ে পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দেবে।

রিকির ধারণা সত্যি। শ্যালক্স গ্রুনকে স্পর্শ করে তার ত্বকের যে নমুনা সে নিয়ে এসেছে সেটি পরীক্ষা করে বায়োবিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন। সত্যিই তার শরীরে একটি সিলাকিত কার্বনের এম্পুল রয়েছে। রিপোর্টটি ঘরে কোথাও আছে কৌতূহল হলে দেখতে পার।

হিশান আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এটি একটি অসম্ভব দুঃসাহসিক কাজ করেছ।

ইগা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমাদের প্রযুক্তি খুব উন্নত নয়। যদি আরো কয়েক শ বছর পরে হত, শ্যালক্স গ্রুনের ত্বকের কোষ ব্যবহার করে আরেকটি শ্যালক্স গ্রুন তৈরি করে তাকে ব্যবহার করা যেত–

নুবা হেসে ফেলে বলল, রক্ষা কর! একটি শ্যালক্স গ্রুন নিয়েই আমরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি, দুটি হলে কী হবে চিন্তা করতে পার?

তা ঠিক।

যাই হোক, যা বলছিলাম, রিকির নিয়ে আসা দ্বিতীয় তথ্যটি বলা যেতে পারে খানিকটা আশাপ্রদ। শ্যালক্স গ্রুন পৃথিবীর কাছে ত্রিনিত্রি রাশিমালা দাবি করেছে। যার অর্থ সে এই মুহূর্তে পৃথিবীকে ধ্বংস করবে না। ত্রিনিত্রি রাশিমালা ব্যবহার করে সে আরো এক শ বছর ভবিষ্যতে পাড়ি দেবে। আমরা যদি তাকে ত্রিনিত্রি রাশিমালা দিই পৃথিবী আরো এক শ বছর সময় পাবে।

হিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু সেই এক শ বছর হবে অর্থহীন। শ্যালক্স গ্রুনের কাছে যদি ত্রিনিত্রি রাশিমালা থাকে সে আজ থেকে এক শ বছর পরে এসে পৃথিবীর পুরো প্রযুক্তি নিজের হাতে নিয়ে নেবে। পুরোটা ব্যবহার করবে নিজের স্বার্থে।

হ্যাঁ। নুবা একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়।

আমরাও চুপ করে বসে রইলাম। আমি জানি আমরা সবাই একটি কথা ভাবছি কিন্তু কেউই মুখ ফুটে কথাটি বলতে পারছি না। য়োমি শেষ পর্যন্ত আর চুপ করে থাকতে পারল না, অধৈর্য হয়ে বলে ফেলল, সবাই চুপ করে আছ কেন? বলে ফেল কেউ একজন।

ঠিক আছে আমি বলছি। আমি উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, বাতাসের বেগ মনে হয় আরো একটু বেড়েছে। বাইরে গাছের ডালগুলো এখন দাপাদাপি করছে।

ঘরের ভিতরে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে আমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমরা। শ্যালক্স গ্রুনকে ত্রিনিত্রি রাশিমালা দেব। সেটি হবে আসলটির কাছাকাছি কিন্তু আসলটি নয়।

আমি দেখলাম সবাই কেমন যেন শিউরে উঠল। নুবা চাপা গলায় বলল, হায় ঈশ্বর! তুমি পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা কর।

ইগা মাথা ঘুরিয়ে নুবার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান ঈশ্বর বলে কিছু নেই।

নুবা মাথা নেড়ে বলল, না আমি জানি না। কিন্তু আমার ভাবতে ভালো লাগে ঈশ্বর বলে একজন খুব ভালবাসা নিয়ে পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করে যাবেন।

ব্যাপারটি তোমার ঈশ্বরের জন্যে আরো সহজ হত যদি তিনি শ্যালক্স গ্রুনের জন্ম না দিতেন!

হিশান হঠাৎ হা হা করে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠে! মুবা এক ধরনের আহত দৃষ্টি নিয়ে ইগা এবং হিশানের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বললাম, তোমরা এখন একজন আরেকজনের পিছনে লেগে সময় নষ্ট কোরো না। আমাদের অনেক কাজ বাকি

ইগা মাথা নাড়ল, আসলে কাজ খুব বেশি বাকি নেই। সবচেয়ে বড় কাজটি ছিল সিদ্ধান্তটি নেয়া, সেটি যখন নেয়া হয়ে গেছে অন্য কাজগুলো সহজ।

কিন্তু সিদ্ধান্তটি কি নেয়া হয়েছে?

সবাই নুবার দিকে ঘুরে তাকাল। নুবা একটু অবাক হয়ে বলল, সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন?

ইগা বলল, দুটি কারণে। প্রথম কারণ, তোমার ভিতরে একটি সহজাত নেতৃত্বের ক্ষমতা রয়েছে, আমরা সবাই সেই নেতৃত্ব মেনে নিয়েছি। দ্বিতীয় কারণ, তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর। এই ধরনের গুরুতর সিদ্ধান্ত নিতে হলে মনে হয় ঈশ্বরের বিশ্বাস করা খারাপ নয়। খানিকটা দায়–দায়িত্ব তাকে দেয়া যায়–

বাজে কথা বোলো না।

ইগা হেসে বলল, আমি কথাটি হালকাভাবে বলেছি, কিন্তু কথাটি সত্যি।

নুবা ঘুরে আমাদের দিকে তাকাল এবং আমরা সবাই মাথা নাড়লাম। ধীরে ধীরে নুবার মুখে এক ধরনের কাঠিন্য এসে যায়। সে দীর্ঘ সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি শ্যালক্স গ্রুনকে সত্যিকারের ত্রিনিত্রি রাশিমালা দেয়া হবে না।

চমৎকার। হিশান উঠে গিয়ে নুবার কাঁধ স্পর্শ করে বলল, এখন আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দাও।

বেশ। নুবা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, শ্যালক্স গ্রুন ত্রিনিত্রি রাশিমালা হাতে পাওয়ার পর সেটি সত্যি কি না পরীক্ষা করে দেখবে। সে কীভাবে সেটি পরীক্ষা করবে সেটা আমাদের আগে থেকে জানতে হবে। সেটা বের করার দায়িত্ব দিচ্ছি রিকি এবং য়োমিকে। তোমাদের আপত্তি আছে?

আমি এবং য়োমি একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম তারপর মাথা নাড়লাম, না আপত্তি নেই।

চমৎকার। যেহেতু আমরা সত্যিকারের ত্রিনিত্রি রাশিমালা দেব না, এবং শ্যালক্স গ্রুন সেটা জানে না–আমরা তার যন্ত্রপাতির মাঝে তার কম্পিউটারের তথ্য ডাটাবেসের মাঝে বড় পরিবর্তন করে দিতে পারব। সেটি কীভাবে করা হবে তার একটা ধারণা করার দায়িত্ব দিচ্ছি ইগা এবং হিশানকে।

ইগা এবং হিশান খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। হিশান মাথা চুলকে বলল, আমি আসলে বিজ্ঞান ভালো জানি না।

জানার প্রয়োজনও নেই। সে ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য করবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা।

বেশ। হিশান মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করবে?

শ্যালক্স গ্রুন যখন ত্রিনিত্রি রাশিমালা পরীক্ষা করে দেখবে সারা পৃথিবীতে তখন একটা প্রলয় কাণ্ড ঘটবে। আমি চেষ্টা করব সেটি যেন সত্যিকারের প্রলয় কাণ্ড না হয়। সেটি যেন দেখায় প্রলয় কাণ্ডের মতো–কিন্তু আসলে যেন প্রলয় কাণ্ড না হয়। ব্যাপারটিতে আমার তোমাদের সাহায্যের দরকার হবে কিন্তু সেটি নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা নয়।

আমরা মাথা নাড়লাম, না কোনো সমস্যা নয়। চমৎকার, এবার তাহলে জেনারেল ইকোয়াকে ডাকা যাক।

নুবা তার লাল কার্ডটি স্পর্শ করতে যাচ্ছিল ঠিক তখন য়োমি বলল, তোমরা সবাই নিশ্চয়ই জান জেনারেল ইকোয়া একজন রবোট?

আমরা মাথা নাড়লাম, জানি।

য়োমি হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকাল, রিকি তুমি ঠিক কখন সেটা বুঝতে পেরেছ?

প্রথমদিন যখন দেখা হল, আমাদের লাল কার্ড দেয়া হয়েছে শুনে যখন খুব অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল। তার চোখের দিকে তাকাতেই মনে হল কী যেন নেই

তুমি যদি চোখের দিকে না তাকাতে তাহলে কি বলতে পারতে?

না, মনে হয় না। আজকাল এত চমৎকার মানুষের মতো রবোট তৈরি করে যে সেটা বলা খুব কঠিন।

আমি হঠাৎ ঘুরে য়োমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন এটা আমাকে জিজ্ঞেস করলে?

য়োমি চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, না, এমনি জানতে চেয়েছি।

য়োমির গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, আমি হঠাও বুঝতে পারলাম সে আমার কাছে থেকে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। কী হতে পারে সেটি? কেন সে আমাকে জানতে দিতে চায় না?

০৭. একটা ছোট ঘরে

একটা ছোট ঘরে আমি আর য়োমি মুখোমুখি বসে আছি। আমাদের সামনে একটা টেবিল, টেবিলে একটি ইলেকট্রনিক নোট প্যাড–সেটি এখনো পুরোপুরি ফাঁকা, তাতে কিছু লেখা হয় নি। য়োমি টেবিলে ঝুঁকে পড়ে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, রিকি, তুমি আবার গোড়া থেকে বল ঠিক কী হয়েছিল শ্যালক্স গ্রুনের সাথে।

য়োমি, আমি এই নিয়ে তিনবার বলেছি।

হা। কিন্তু প্রত্যেকবার একটু নূতন জিনিস বলেছ! আমার সবকিছু জানতে হবে। মানুষটা কীভাবে চিন্তা করে আমার বুঝতে হবে।

আমি তোমাকে বলেছি মানুষটি কীভাবে চিন্তা করে।

কিন্তু সেটা তোমার মতো করে বলেছ–সেটা যথেষ্ট নয়। মনে রেখো মানুষটা অসম্ভব প্রতিহিংসাপরায়ণ–তুমি সেটা জান না!

তুমি জান?

তোমার থেকে বেশি জানি। বল আবার।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করি, য়োমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাকে দেখে মনে হয় একটি হিংস্র শ্বাপদ, শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে সমস্ত স্নায়ু টান টান করে দাঁড়িয়ে আছে।

আবার পুরোটুকু বলে শেষ করতে অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল, আমি নিজেও জানতাম আমার এত রকম ঘুঁটিনাটি মনে ছিল। মানুষের মস্তিষ্ক নিঃসন্দেহে একটি অবিশ্বাস্য জিনিস। আমার কথা শেষ হবার পর য়োমি অনেকক্ষণ আমার দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, কী হয়েছে তোমার?

কিছু হয় নি। ভাবছি।

কী ভাবছ?

তুমি জান আমি কী ভাবছি। শ্যালক্স গ্রুন একজন সাধারণ মানুষ নয়। ত্রিনিত্রি রাশিমালা হাতে নিয়ে সে পরীক্ষা করে দেখবে এটা সত্যি কি না। মানুষটির বিষাক্ত জিনিসের দিকে একটা আসক্তি আছে প্রথমেই নিশ্চয়ই কিছু বিষাক্ত কেমিক্যাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেবে। একটি দুটি মহাকাশযান ধ্বংস করবে, কিছু উপগ্রহ উড়িয়ে দেবে ইতস্তত পারমাণবিক বোমা ফেলবে–কিন্তু সেগুলো সহজ! পৃথিবীর মূল কম্পিউটারে এই সবকিছুই তৈরি করা সম্ভব। পৃথিবীর তথ্যকেন্দ্র থেকে এইসব খবর প্রচার করা সম্ভব, বাতাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ কেমিক্যাল, তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব, বিস্ফোরণ শকওয়েভ সবকিছু তৈরি করা। সম্ভব। কিন্তু শ্যালক্স গ্রুন খুব ধূর্ত মানুষ–সে আরো একটা কিছু করবে–অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটা পরীক্ষা, আমি সেটা বোঝার চেষ্টা করছি।

বুঝতে পেরেছ?

না। এখনো বুঝতে পারি নি। সেটা যতক্ষণ বুঝতে না পারছি আমি শান্তি পাচ্ছি না।

য়োমি টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছোট ঘরটিতে হাঁটতে থাকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খাঁচায় আটকে রাখা একটি বন্য পশুর মতো। মেয়েটির চেহারায় একটি আশ্চর্য সতেজ ভাব যেটি সাধারণত চোখে পড়ে না। য়োমি হঠাৎ ঝড়িয়ে গিয়ে বলল, রিকি।

কী হল?

চল বাইরে থেকে ঘুরে আসি।

কোথায় যাবে?

জানি না। বদ্ধ ঘরে আটকে থাকলে আমার মাথা কাজ করে না।

আমি উঠে দাঁড়ালাম, ঠিক আছে তাহলে, চল যাই।

বাইরের ঘরে হিশান এবং ইগার সাথে একজন বুড়োমতো মানুষ বসেছিল। মানুষটিকে খানিকটা উত্তেজিত দেখাচ্ছে, শুনতে পেলাম মানুষটি ক্রুদ্ধ স্বরে বলছে, তোমাদের ধারণা শ্যালক্স গ্রুন সাংঘাতিক প্রতিভাবান মানুষ

ইগা একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলল, আমরা তো তাই জানতাম! এক শ বছর আগের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেউ যদি ভবিষ্যতে চলে আসতে পারে–

তুমি ভবিষ্যতে যেতে চাও? আমি তোমাকে ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দেব। কীভাবে?

তোমাকে শীতলঘরে ঘুম পাড়িয়ে দেব। তোমার শরীর তরল নাইট্রোজেন তাপমাত্রায় রেখে দেব এক শ বছর। জেগে উঠে দেখবে ভবিষ্যতে চলে এসেছ

কিন্তু শ্যালক্স গ্রুন তো সেভাবে আসে নি। চতুর্মাত্রিক সময়ক্ষেত্র ছেদ করে

বুড়োমতো মানুষটি হাত ঝাঁকিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দিয়ে বলল, চার শ বছর আগে আইনস্টাইন বলে গিয়েছিলেন, গতিবেগ বাড়াতে থাক সময় ধীর হয়ে যাবে। শ্যালক্স গ্রুন তাই করেছে, অসম্ভব শক্তিশালী কয়েকটা কুরু ইঞ্জিন চুরি করে একটা বাক্সের সাথে জুড়ে দিয়েছে। আর কিছু না–

হিশান মাথা নাড়তে থাকে, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, যদি গতিবেগ বাড়িয়ে সে সময়কে আটকে রাখার চেষ্টা করেছে তাহলে তার এই গ্রহ নক্ষত্র পার হয়ে বহুদূরে চলে যাবার কথা ছিল! সে তো পৃথিবীতেই আছে–

বুড়োমতো মানুষটা মুখ কুঁচকে বললেন, হ্যাঁ, সেই জন্যে তাকে খানিকটা বাহবা দেয়া যায়। গতি দু রকমের হতে পারে। তুমি সময়ের সাথে অবস্থানের পরিবর্তন করছ কিংবা তোমার চারপাশে যে ক্ষেত্রটি আছে সেটাকে পরিবর্তন করছ। প্রচণ্ড শক্তি ক্ষয় করে সেটা করা যায়–কাজটি বিপজ্জনক কিন্তু শ্যালক্স গ্রুন বিপজ্জনক কাজকে ভয় পায় না।

ইগা হঠাৎ চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, তার মানে আপনি বলছেন, প্রচণ্ড গতিবেগ এবং শ্যালক্স গ্রুন যেটা করছে সেটা খুব কাছাকাছি একটা ব্যাপার?

হা। মনে কর প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্যে একটা জায়গায় ক্ষেত্রটি সঙ্কুচিত হয়ে আছে–

ইগা বাধা দিয়ে বলল, যদি আপনাকে বলা হয় আপনি কুরু ইঞ্জিনটির মাঝে কিছু একটা পরিবর্তন করে দেন, যেন সে ভবিষ্যতে না গিয়ে প্রচণ্ড গতিবেগ নিয়ে এই সৌরজগতের বাইরে চলে যাবে আপনি সেটা করতে পারবেন?

আমি নিজে সেটা পারব না, কিন্তু গোটা চারেক যান্ত্রিক রবোট, মূল কম্পিউটারে খানিকটা সময়, কিছু ভালো প্রোগ্রামার, কিছু যন্ত্রপাতি দেয়া হলে এমন কিছু কঠিন নয়! কিন্তু আমাকে এটা জিজ্ঞেস করছ কেন? সত্যি এটা করতে চাও নাকি?

য়োমি আমার হাত ধরে বাইরে টেনে নিতে নিতে বলল, বিজ্ঞানের কথা শুনতে ভালো লাগছে না–চল বাইরে যাই।

কিন্তু ইগা বুদ্ধিটা মন্দ বের করে নি। ভবিষ্যতে না পাঠিয়ে শ্যালক্স গ্রুনকে পাঠিয়ে দেবে বিশ্বজগতের বাইরে!

.

আমরা যখন বাইরে এসেছি তখন অন্ধকার হয়ে এসেছিল। এলাকাটি নির্জন, মানুষজন নেই তাই আমাদের পিছনে দূরত্ব রেখে যে চারটি ছায়ামূর্তি হাঁটছে তারা যে নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষ এবং রবোট বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না। কেউ সবসময় আমাকে চোখে। চোখে রাখছে ব্যাপারটা চিন্তা করতে ভালো লাগে না, কিন্তু এখন আমাদের কিছু করার নেই।

আমি আর য়োমি পাশাপাশি হাঁটছি–ঠিক কী কারণে জানি না আমার হঠাৎ ত্রিশার কথা মনে হল। আমি ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, সাথে সাথে য়োমি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার ত্রিশার কথা মনে পড়েছে?

হ্যাঁ। সবসময় মনে পড়ে।

তুমি কি তার সাথে দেখা করতে চাও?

আমি সবসময় তার সাথে দেখা করতে চাই।

তাহলে দেখা করছ না কেন?

এখন তার ঠিক সময় নয়, য়োমি।

কেন এ কথা বলছ? আমাদের একটা দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমরা সেটা করছি। আমার মনে হয় এটা চমৎকার সময়। চল ত্রিশার সাথে দেখা করি।

আমি একটু অবাক হয়ে য়োমির দিকে তাকালাম, কী বলছ তুমি? তুমি ত্রিশার সাথে দেখা করবে?

য়োমি একটু হেসে বলল, হ্যাঁ, এক ধরনের কৌতূহল বলতে পার। চল যাই।

সত্যি সত্যি আমি আর য়োমি কিছুক্ষণের মাঝে শহরের একটা দরিদ্র এলাকায় মাটির নিচে গভীর সুড়ঙ্গের মাঝে একটি প্রোগ্রামিং ফার্মে এসে হাজির হলাম। এক সময় মানুষের ধারণা ছিল বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উন্নতি হবার পর মানুষ বুঝি অর্থহীন গাধা কাজ থেকে মুক্তি পাবে। সেই কাজ করা হবে যন্ত্র দিয়ে কিন্তু সেটি সত্যি বলে প্রমাণিত হয় নি। এখনো মানুষকে অর্থহীন কাজ করে যেতে হয়। কে জানে এখন যে কাজকে অর্থহীন কাজ বলে বিবেচনা করা হয় এক সময় হয়তো সেই কাজটিকেই খুব বুদ্ধিমত্তার কাজ বলে বিবেচনা করা হত।

আমি আর য়োমি যখন পৌঁছেছি তখন একটি দলের কাজ শেষ হয়েছে, তারা ক্লান্ত পায়ে ছোট ঘোট গেট দিয়ে বের হয়ে আসছে। য়োমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ত্রিশাকে কি দেখছ?

এখনো দেখি নি।

আমি আর য়োমি দাঁড়িয়ে থেকে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম তখন ত্রিশা বের হয়ে এল। মাথায় একটা লাল স্কার্ফ শক্ত করে বেঁধে রেখেছে, শরীরের কাপড় ধুলায় ধূসর। চোখের কোনায় ক্লান্তি। হাতে একটি ছোট ব্যাগ নিয়ে সে ক্লান্ত পায়ে বের হয়ে এসে উপরের। দিকে তাকাল। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম, মুখে কী গভীর বিষাদের ছাপ।

য়োমি আমার হাত স্পর্শ করে বলল, যাও রিকি। কথা বল।

না, আমি যেতে চাই না।

কেন নয়? যাও।

ঠিক তখন ত্রিশা ঘুরে আমার দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়।

আমি ত্রিশার দিকে এগিয়ে গেলাম। ত্রিশা মাথার স্কার্ফটি খুলে সেটা দিয়ে মিছেই তার মুখের ধুলা ঝাড়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, তুমি?

হ্যাঁ।

কেন এসেছ তুমি?

আমি জানি না ত্রিশা।

ত্রিশা কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, আমিও দাঁড়িয়ে থাকি। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়, আমি কী বলব বুঝতে পারি না। ত্রিশা হঠাৎ মুখ তুলে বলল, তুমি আর এসো না।

ঠিক আছে। আর আসব না।

এখন যাও।

হ্যাঁ যাব। তুমি ভালো আছ ত্রিশা?

হ্যাঁ ভালো আছি

আমরা আরো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। ত্রিশা হাতের স্কার্ফটি তার ব্যাগের মাঝে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, কিটি ভালো আছে?

কিটি? যা নিশ্চয়ই ভালো আছে। তার সাথে আমার অনেকদিন দেখা হয় নি।

দেখা হয় নি কেন?

আমি–আমি–আমি আসলে কয়দিন বাসায় যাই নি।

ত্রিশা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। আমরা আবার খানিকক্ষণ

দাঁড়িয়ে রইলাম। ত্রিশা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি এখন যাই। খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে একটু পরে।

ত্রিশা–

কী?

আমি তোমার সাথে আসি?

ত্রিশা হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকাল তারপর মাথা নেড়ে বলল, না। প্লিজ না।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, ঠিক আছে ত্রিশা।

.

আমি আর য়োমি কোনো কথা না বলে পাশাপাশি হেঁটে যেতে থাকি। য়োমির মুখ কেমন যেন বিষণ্ণ। কিছু একটা চিন্তা করছে খুব গভীরভাবে। আমি চেষ্টা করলে বুঝতে পারি মানুষ কী ভাবছে, কিন্তু এখন চেষ্টা করতে ইচ্ছে করছে না।

যে বাই ভার্বালটি করে আমরা এখানে এসেছি সেটা বড় রাস্তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে আর য়োমিকে ফিরে আসতে দেখে দুজন মানুষ দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল।

আমি য়োমিকে বললাম, তুমি যাও। আমি খানিকক্ষণ একা হেঁটে আসি।

কোথায় যাবে?

আমার আগের বাসায়।

কেন?

আমার রবোটটির সাথে অনেকদিন দেখা হয় নি। একটু কথা বলে আসি।

.

কিটি আমাকে দেখে উল্লসিত বা বিস্মিত হল না–তার সে ক্ষমতাও নেই। ঘুরঘুর করে আমার চারপাশে ঘুরে বলল, তোমার চিঠিপত্র, টেলি জার্নাল নিয়ে আসব?

দরকার নেই কিটি।

তোমার খাবার কি গরম করব?

তারও কোনো প্রয়োজন নেই।

তোমার কাপড় জামা পরিষ্কার করে দেব?

কোনো প্রয়োজন নেই।

তুমি কি মানসিক ভারসাম্যহীন?

না, আমার মানসিক ভারসাম্যতা ঠিকই আছে। তুমি ব্যস্ত হয়ো না।

কিটি ঘুরঘুর করে পাশের ঘরে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল, তোমাকে কয়েকজন মানুষ খোঁজ করেছিল। আমি তাদেরকে বলেছি ইয়োরন রিসি তোমাকে কোনো সমস্যা সমাধান করতে ডেকে পাঠিয়েছেন।

তারা তোমার কথা বিশ্বাস করেছে?

নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেছে। আমি কখনো ভুল তথ্য দিই না।

ও।

ইয়োরন রিসি তোমাকে কী সমস্যা সমাধান করতে দিয়েছেন?

খুব একটা জটিল সমস্যা। একজন অত্যন্ত খারাপ মানুষ

মানুষ কেমন করে খারাপ হয়?

আমি একটু থতমত খেয়ে থেমে গেলাম, প্রশ্নটির উত্তর আমার জানা নেই।

গভীর রাতে আমি আমাদের ছোট কাঠের বাসায় ফিরে এসে দেখি নুবা জানালায় চুপচাপ পা তুলে বসে আছে। আমাকে দেখে একটু হেসে বলল, তোমার রবোট কেমন আছে?

ভালো। য়োমি কি ফিরে এসেছে?

হ্যাঁ। নুবা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, ফিরে এসেছে।

য়োমির ধারণা শ্যালক্স গ্রুন খুব একটা নিষ্ঠুর পরীক্ষা করবে–এখনো জানে না ঠিক কী হতে পারে

হ্যাঁ, আমাকে বলেছে।

আমি নুবার দিকে তাকালাম, সে আমার কাছে কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা করছে। কী হতে পারে সেটা?

.

ভোররাতে ইগা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। আমি চোখ খুলে অবাক হয়ে বললাম, কী হয়েছে ইগা?

মহামান্য ইয়োরন রিসি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছেন।

আমার সাথে? আমি ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে বসলাম।

 ০৮. আমি যখন ঘরে ঢুকেছি

আমি যখন ঘরে ঢুকেছি তখন ইয়োরন রিসি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়েছিলেন। ঘরে নুবা আর হিশানও আছে, য়োমিকে কোথাও দেখা গেল না। আমাদের পায়ের শব্দ শুনে ইয়োরন রিসি ঘুরে তাকালেন, সাথে সাথে তার মুখে সহৃদয় একটা হাসি ফুটে উঠল। বললেন, রিকি তোমাকে ঘুম থেকে তুলে ফেললাম!

আমি অভিবাদন করে বললাম, সেটি আমার জন্যে একটি অকল্পনীয় সম্মান।

শুনে খুশি হলাম। আমাকে কেউ যদি মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে ফেলে আমার খুব মেজাজ গরম হয়ে যায়। যাই হোক, রিকি আমি তোমাকে নিতে এসেছি।

আমাকে?

হ্যাঁ। আমি অন্যদের সাথে কথা বলেছি, তারা বলেছে আমি তোমাকে নিতে পারি। তুমি আর য়োমি একসাথে কাজ করছিলে?

জি, মহামান্য ইয়োরন রিসি।

য়োমি সম্ভবত একাই করতে পারবে, তোমার সাথে তো কথা হয়েছে?

জি, মহামান্য ইয়োরন রিসি।

সে তো ছোটাছুটি করছে দেখছি। তুমি চল আমার সাথে। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

মহামান্য ইয়োরন রিসি আমার সাথে যে কথাটি বলতে চেয়েছেন সেটি নিঃসন্দেহে খুব জরুরি কথা কিন্তু সারা রাস্তা তিনি আমার সাথে হালকা কথা বলে কাটিয়ে দিলেন। আমি কী খেতে পছন্দ করি, ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত পছন্দ করি কি না, বিমূর্ত শিল্প তুলে দিলে কেমন হয়– আমাদের কথাবার্তা এই ধরনের বিষয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। মানুষটির মাঝে এক ধরনের বিস্ময়কর সারল্য রয়েছে যেটি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না।

তার ঘরে পৌঁছানোর পর একটা বড় টেবিলের দুপাশে আমরা মুখোমুখি বসলাম। তিনি দীর্ঘ সময় আমার দিকে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার কী মনে হয় রিকি, পরিকল্পনাটি কি ঠিক করে কাজ করবে?

নিশ্চয়ই করবে। মহামান্য রিসি। নিশ্চয়ই করবে।

তুমি জান যে পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু নির্ভর করছে তোমার ওপর।

আমার ওপরে?

হ্যাঁ। তোমার ওপরে। কারণ ত্রিনিত্রি রাশিমালাটি নিয়ে যাবে তুমি।

আমি নিজের অজান্তেই একটু শিউরে উঠি। ইয়োরন রিসি আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার কি ভয় করছে?

আমি মাথা নাড়লাম, করছে মহামান্য ইয়োরন রিসি।

ইয়োরন রিসি একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, কিন্তু তবু তোমাকেই যেতে হবে।

আমি জানি।

তুমি সম্ভবত একমাত্র মানুষ যে শ্যালক্স গ্রুনের সাথে পাল্লা দিতে পারবে। তার অসম্ভব ধূর্ত চোখকে ধোঁকা দিতে পারবে। শুধু তুমিই তাকে একটি অসম্পূর্ণ ত্রিনিত্রি রাশিমালা ধরিয়ে দিতে পারবে।

আমি আগে কখনো কাউকে মিথ্যা কথা বলি নি।

আমি জানি।

ইয়োরন রিসি আমার দিকে নরম চোখে তাকালেন, বললেন, তুমি পৃথিবীর মানুষের মুখ চেয়ে একবার একটি মিথ্যে কথা বলবে। সেটিকে মিথ্যা জেনে নয়–সেটাকে সত্যি জেনে বলবে!

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, আমি বলব মহামান্য রিসি। আমি আমার শেষ শক্তি দিয়ে এই মিথ্যাটুকু বলব।

আমাকে তুমি কথা দাও।

আমি কথা দিচ্ছি।

ইয়োরন রিসি এগিয়ে এসে আমার হাত স্পর্শ করলেন।

.

পরের কয়েক ঘণ্টা আমাকে ত্রিনিত্রি রাশিমালা সম্পর্কে শেখানো হল। আমি ব্যাপারটি ভাসা ভাসাভাবে জানতাম, এবার প্রথমবার সেটির ঘুঁটিনাটি জানতে পারলাম। পৃথিবীর সভ্যতা যেন পরস্পরবিরোধী হয়ে গড়ে না ওঠে তার নিশ্চয়তা বিধান করার জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ ত্রিনিত্রি এই রাশিমালাটি দিয়েছিলেন। সময়ের সাথে এই রাশিমালাটির পরিবর্তন হয়, ব্যবহারের সাথেও এর পরিবর্তন হয়। পুরোপুরি এই রাশিমালাটি কখনো কেউ জানতে পারে না। কেউ যদি জানার চেষ্টা করে সে একটি অংশ জানতে পারে কিন্তু অন্য অংশ তার কাছে অস্পষ্ট হয়ে আসে। পদার্থবিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার সূত্রের মতো এই রাশিমালাতেও এক ধরনের অনিশ্চয়তা লুকানো রয়েছে, শ্যালক্স গ্রুনের বিরুদ্ধে সেটাই হচ্ছে। আমাদের একমাত্র অস্ত্র। সে যখন রাশিমালাটি পরীক্ষা করে দেখবে। যতই তার গভীরে যাবার চেষ্টা করবে ততই একটা অংশ তার কাছে অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকবে। তার নিজের নিরাপত্তার জন্যেই সে কোনো একটি বিষয়ের খুব গভীরে যেতে চাইবে না।

ত্রিনিত্রি রাশিমালা সম্পর্কে আমার একটা ধারণা হয়ে যাবার পর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একদল বিজ্ঞানী আর গণিতবিদ আমাকে নিয়ে বিভিন্ন কলকারখানা, সামরিক প্রতিষ্ঠান, মহাজাগতিক ল্যাবরেটরি, যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ঘুরে বেড়ালেন। ত্রিনিত্রি রাশিমালা

কেমন করে ব্যবহার করা যায় সেটা শেখালেন, আমি সেটা ব্যবহার করে একটা মহাকাশযানকে তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করে দিলাম, একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে খানিকক্ষণের জন্যে একটি শহরকে অন্ধকার করে রাখলাম। আমি এখন ইচ্ছে করলে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারি। যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে পারি। উপগ্রহদের ধ্বংস করে দিতে পারি। ক্রিস্টাল ডিস্কে সাজিয়ে রাখা কিছু সংখ্যার যে এত বড় ক্ষমতা হতে পারে সেটি বিশ্বাস করা কঠিন।

ত্রিনিত্রি রাশিমালায় অভ্যস্ত হতে প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা কেটে গেল। এক সময় বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদেরা তাদের যান্ত্রিক কাজে পারদর্শী রবোটদের নিয়ে বিদায় নিলেন। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল একটি ঘরে, সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন মহামান্য ইয়োরন রিসি। আমাকে দেখে মৃদু হেসে বললেন, খুব খাটুনি গিয়েছে, তাই না।

আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ। কিন্তু পরিশ্রমটির প্রয়োজন ছিল। ত্রিনিত্রি রাশিমালা কী এখন আমি জানি।

হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যে রাশিমালাটি নিয়ে যাবে সেটি সত্যিকারের নয়। সেটি প্রায় তৈরি হয়ে গেছে, এই মুহূর্তে তোমাদের অন্য চার জন সেটি পরীক্ষা করে দেখছে।

কখন সেটি সম্পূর্ণ হবে?

আমার মনে হয় আর কিছুক্ষণের মাঝেই।

আমি কখন সেটি নিয়ে যাব?

তোমার যখন ইচ্ছা। আমার মনে হয় এখন তোমার খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়া দরকার। তুমি কোথায় বিশ্রাম নিতে চাও?

আমি কি আমার নিজের বাসায় নিতে পারি?

ইয়োরন রিসি মৃদু হেসে বললেন, কিটির কাছে?

হ্যাঁ, মহামান্য ইয়োরন রিসি। আমার স্নায়ু খুব উত্তেজিত হয়ে আছে। কিটির সাথে কথা বললে আমার স্নায়ু সবসময়ই শীতল হয়ে আসে।

তুমি তাহলে যাও। যখন সময় হবে আমরা তোমাকে নিয়ে আসব।

আমি উঠে দাঁড়ালাম, ইয়োরন রিসি এগিয়ে এসে আমাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করলেন।

.

আমাকে দেখে কিটি কোনো ধরনের উত্তেজনা প্রকাশ করল না। কয়েকবার আমার চারপাশে ঘুরে বলল, তোমার কাপড় জামা পান্টানোর সময় হয়েছে। আমি কি নূতন কাপড় নিয়ে আসব?

তার কোনো প্রয়োজন নেই।

তোমার খাবার কি গরম করব?

আমি খেয়ে এসেছি কিটি।

তোমার টেলি জার্নাল চিঠিপত্র—

এখন দেখতে ইচ্ছে করছে না।

কিটি এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, তুমি কি মানসিক ভারসাম্যহীন?

আমি হেসে বললাম, বলতে পার আমি এখন এক ধরনের মানসিক ভারসাম্যহীন! আমার ওপর খুব বড় একটা দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সেই বড় দায়িত্বটি এত বড় যে তার তুলনায় অন্য সবকিছু এখন গুরুত্বহীন মনে হয়। সবকিছু হাস্যকর ছেলেমানুষি এবং অর্থহীন মনে হয়।

কিটি কী বুঝল আমি জানি না কিন্তু এক ধরনের গাম্ভীর্য নিয়ে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, আমি তোমার জন্যে দুঃখিত রিকি। আমি কি কোনোভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি?

তুমি কীভাবে আমাকে সাহায্য করতে চাও?

প্রয়োজন হলে আমি তোমার জন্যে সেই বড় দায়িত্বটি করতে পারি।

আমি হেসে ফেললাম, না, কিটি তুমি সেটা করতে পারবে না।

কেন নয়?

কারণ আমাকে একজন মানুষের সামনে একটি খুব বড় মিথ্যা কথা বলতে হবে। সে যদি বুঝতে পারে আমি মিথ্যা কথা বলছি তাহলে খুব ভয়ঙ্কর একটি ব্যাপার হবে।

মিথ্যা মানে কী?

আমি হেসে বললাম, তুমি সেটা জানতে চেয়ো না কিটি! আমি যদি বলি তবুও তুমি বুঝবে না। কোনো পশুপাখি মিথ্যাচার করে না, কোনো যন্ত্রও মিথ্যাচার করে না। মিথ্যাচার করে শুধু মানুষ–কখনো ইচ্ছে করে, আর কখনো করে যখন তার আর কোনো উপায় থাকে না। আমার আর কোনো উপায় নেই কিটি।

আমি তোমার জন্যে দুঃখিত রিকি। আমি স্পষ্ট অনুভব করছি আমার কপোট্রনের চতুর্থ অংশের তৃতীয় পিনটিতে ভোল্টেজের পরিবর্তন ঘটছে। এটি নিশ্চিত দুঃখের অনুভূতি।

আমি এক ধরনের স্নেহের চোখে এই পরিপূর্ণ নির্বোধ রবোটটির দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি বুঝতে পারছি আমার স্নায়ু শীতল হয়ে আসছেকিছুক্ষণের মাঝেই আমি গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যেতে পারব।

০৯. শ্যালক্স গ্রুনের কদাকার সময়

আমরা পাঁচ জন শ্যালক্স গ্রুনের কদাকার সময়–পরিভ্রমণ যানটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, এই পুরো এলাকাটিতে কৃত্রিম আলোর কোনো ব্যবস্থা নেই, আবছা অন্ধকারে সময়–পরিভ্রমণ যানটিকে দেখাচ্ছে একটা অশুভ প্রেতপুরীর মতো।

য়োমি নিচু গলায় বলল, কী বীভৎস একটা জিনিস। রিকি আমি চিন্তাও করতে পারি না তুমি কেমন করে এর ভিতরে যাবে।

আমি য়োমির দিকে তাকিয়ে বললাম, আমিও পারি না।

থাক, এখন সেসব কথা তুলে লাভ নেই। নুবা আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, তোমার কাছে ত্রিনিত্রি রাশিমালার ক্রিস্টাল ডিস্কটা আছে?

আমি পকেটে হাত দিয়ে বললাম, হ্যাঁ, আছে।

তাহলে তুমি যাও শ্যালক্স গ্রুনের কাছে।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে যেতে গিয়ে থেমে গেলাম। ঘুরে তাকিয়ে বললাম, যদি আমাদের পরিকল্পনা কাজ না করে তাহলে কী হবে?

নুবা নিচু স্বরে বলল, এখন সেটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই।

কিন্তু যদি কিছু একটা ভুল হয়ে যায়?

হিশান এগিয়ে এসে আমার কাধ স্পর্শ করে বলল, ওই যে উপরে তাকিয়ে দেখ।

আমি উপরে তাকালাম, আকাশে রুপালি একটা গোলক স্থির হয়ে আছে। আমি একটু অবাক হয়ে হিশানের দিকে তাকালাম, কী ওটা?

থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা। যেটুকু আছে সেটা দিয়ে অর্ধেক পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার কথা।

এটা কেন এখানে?

যে তাপমাত্রায় লিটুমিনা–৭২ ভাইরাসকে ধ্বংস করা যায় সেই তাপমাত্রা সৃষ্টি করার এটা হচ্ছে একমাত্র উপায়। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগে সেগুলোকে ধ্বংস করা যাবে কি না সেটা কেউ এখনো জানে না, কিন্তু চেষ্টা করে দেখা হবে।

যদি না যায়?

পৃথিবীর গোপন ভন্টে অসংখ্য শিশুকে শীতলঘরে রাখা আছে। মহাকাশে অসংখ্য মানুষকে, বিজ্ঞানীকে ইঞ্জিনিয়ার শিল্পী সাহিত্যিককে পাঠানো হয়েছে। যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় তারা বেঁচে থাকবে। আবার নূতন করে সভ্যতার সৃষ্টি হবে।

আমি স্থির চোখে হিশানের দিকে তাকিয়ে বললাম, হিশান, সত্যি কি আবার নূতন করে সভ্যতার সৃষ্টি করতে হবে?

না রিকি। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখো। তুমি যাও।

ইগা ফিসফিস করে বলল, তোমার যাত্রা শুভ হোক রিকি।

আমি পায়ে পায়ে কদাকার যানটির দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। কাছাকাছি আসতেই একটি গোল দরজা খুলে গেল, শ্যালক্স গ্রুন আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।

ভিতরে গাঢ় অন্ধকার। আমি দেয়াল ধরে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলাম তবু অন্ধকারে আমার চোখ সয়ে গেল না। এক সময় কাঁপা গলায় ডাকলাম, শ্যালক্স গ্রুন

ভিতরের গাঢ় অন্ধকার থেকে শ্যালক্স গ্রুনের গলার স্বর ভেসে এল, তুমি এসেছ?

হ্যাঁ।

ত্রিনিত্রি রাশিমালা এনেছ আমার জন্যে?

ছোট একটা ক্রিস্টাল ডিস্ক দিয়েছে আমাকে। তার মাঝে ত্রিনিত্রি রাশিমালা থাকার কথা।

তুমি সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে এ রকম হেঁয়ালি করে কেন কথা বলছ?

কারণ আমরা চেষ্টা করছি তোমাকে ধ্বংস করতে।

এক মুহূর্তের জন্যে শ্যালক্স গ্রুন কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ সে হা হা করে হেসে উঠল। অত্যন্ত ক্রুর সেই হাসি, আমার শরীর কেমন জানি কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাসতে হাসতেই সে বলল, তোমার সাহস দেখে আমি এক ধরনের আনন্দ পাই! ব্যাপারটি ভালো কি না সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ নই কিন্তু ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কৌতুককর। তোমরা কি আমাকে ধ্বংস করতে পারবে?

সেটি ঠিক করা হবে এই কিছুক্ষণের মাঝে।

হঠাৎ করে ঘরের আলো জ্বলে ওঠে, আমি আবার শ্যালক্স গ্রুনকে সামনাসামনি দেখতে পেলাম, একটা দীর্ঘ টেবিলের অন্যপাশে বসে আছে। মাথায় এলোমেলো কালো চুল, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, মনে হয় সেই দৃষ্টি আমার শরীর ভেদ করে যাচ্ছে। একটু মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, কিছুক্ষণের মাঝে তুমি জানতে পারবে?

হ্যাঁ।

কেমন করে?

তোমাকে যে ক্রিস্টাল ডিস্কটি দিয়েছি তার মাঝে যে রাশিমালাটি রয়েছে সেটি একটি অর্থহীন সংখ্যা না সত্যিকারের ত্রিনিত্রি রাশিমালা তুমি সেটা জান না। তোমাকে সেটা আমি নিজে থেকে বলব না, আমি বললেও তুমি বিশ্বাস করবে না। তোমার নিজেকে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তুমি নিশ্চয়ই জান ত্রিনিত্রি রাশিমালার মাঝে একটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। যখন তুমি একটি অংশ পরীক্ষা করে দেখবে তখন অন্য একটি অংশ অস্পষ্ট হয়ে যাবে।

শ্যালক্স গ্রুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বললাম, ত্রিনিত্রি রাশিমালার যে অংশ তোমার কাছে অস্পষ্ট সেই অংশটি আমাদের অস্ত্র। আজ থেকে এক শ বছর পর তুমি যখন আবার পৃথিবীতে নেমে আসবে পৃথিবী তখন তোমার জন্যে প্রস্তুত থাকবে।

তুমি মিথ্যা কথা বলছ।

হঠাৎ আমার বুক কেঁপে ওঠে, এই মানুষটি অসম্ভব ধূর্ত। আমি কি সত্যিই তাকে ধোঁকা দিতে পারব? শ্যালক্স গ্রুন আবার চাপা স্বরে বলল, তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলছ, মানুষ মিথ্যা কথা বললে আমি বুঝতে পারি।

আমি চুপ করে রইলাম। শ্যালক্স গ্রুন আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, কিছু একটা পরিকল্পনা তোমাদের আছে সেটা কী আমি এখনো জানি না। তুমি জান আমি যদি চাই আমি সেটা যখন ইচ্ছে জানতে পারব। আমি মানুষকে অসম্ভব যন্ত্রণা দিতে পারি। মনোবিজ্ঞানে আমার মতো চরিত্রের একটি গালভরা নাম রয়েছে।

হঠাৎ আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে ওঠে।

আমি জিভ দিয়ে আমার শুকনো ঠোঁটকে ভিজিয়ে বললাম, তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ?

না, আমি আলাদা করে কাউকে ভয় দেখাতে চাই না। তার প্রয়োজন হয় না। সাধারণ মানুষ এমনিতেই আমাকে ভয় পায়।

আমি শ্যালক্স গ্রুনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কী ভয়ঙ্কর নিষ্করুণ দৃষ্টি। আমার বুকের ভিতর শিরশির করতে থাকে অনেক কষ্টে নিজেকে শক্ত করে আমি বললাম, তুমি কি আমার মুখে আমাদের পরিকল্পনাটি জানতে চাও?

হ্যাঁ, চাই।

কিন্তু আমি নিজে থেকে বলব না। তোমার সেটা জোর করে বের করতে হবে।

শ্যালক্স গ্রুন দীর্ঘ সময় আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল তারপর হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে বলল, তুমি ত্রিনিত্রি রাশিমালাটি আমার মূল কম্পিউটারে প্রবেশ করাও।

আমি গত দুই দিন এই ব্যাপারটি কেমন করে করতে হয় খুব ভালো করে শিখে এসেছি। শ্যালক্স গ্রুন আদেশ দেয়া মাত্র কাজে লেগে গেলাম। দীর্ঘ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ কাজ। এক সময় সেটি শেষ হল, আমি যোগাযোগ মডিউলটি শ্যালক্স গ্রুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে দেয়ালের পাশে সরে দাঁড়ালাম।

আমি ইচ্ছে করলে এখন সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারি? যেখানে ইচ্ছে পারমাণবিক বোমা ফেলতে পারি? বাঁধ ভেঙে পানিতে শহর ডুবিয়ে দিতে পারি?

পার।

ইচ্ছে করলে আমি চোখের পলকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলতে পারি?

হ্যা পার। কিন্তু ত্রিনিত্রি রাশিমালার উদ্দেশ্য কিন্তু সেটা নয়। তার উদ্দেশ্য সভ্যতার নিয়ন্ত্রণ। আমি আশা করব তুমি সেটা ব্যবহার করবে বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের মতো।

আমি কীভাবে সেটা ব্যবহার করব সেটা আমাকেই ঠিক করতে দাও।

শ্যালক্স গ্রুন যোগাযোগ মডিউলটি নিজের কাছে টেনে নিয়ে অত্যন্ত সহজ গলায় খুব কাছাকাছি একটা পারমাণবিক বিস্ফোরণের আদেশ দিল। মানুষের জনবসতির উপর এত সহজে কেউ একটি এ রকম ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটানোর আদেশ দিতে পারে নিজের চোখে না দেখলে আমার বিশ্বাস হত না। মুহর্তের মাঝেই প্রথমে তীব্র আলোর ঝলকানি আমাদের চোখ ধাধিয়ে দিল। এক মুহূর্ত পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ, সাথে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন পায়ের নিচে দুলে উঠল। কয়েক মুহূর্ত আশ্চর্য এক ধরনের নীরবতা তারপর হঠাৎ যেন প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে সমস্ত এলাকা উড়ে যেতে শুরু করল।

আমি দেয়াল খামচে ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শ্যালক্স গ্রুনের সময়–পরিভ্রমণ যানের ভিতর অসংখ্য মনিটর তীব্র স্বরে শব্দ করতে শুরু করে, একটি বড় লালবাতি বারবার জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করে। কোথাও কিছু একটা ভেঙে গেছে বলে সন্দেহ হতে থাকে।

শ্যালক্স গ্রুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একটা প্যানেলের দিকে তাকিয়ে থাকে, ছোট একটা নোট প্যাডে কিছু একটা হিসেব করে মাথার কাছে ছোট একটা গোল জানালা খুলে বাইরে তাকায় তারপর আবার ঘুরে আমার দিকে তাকাল, তার মুখে এক ধরনের সন্তুষ্টির ছাপ। সে একটু হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি আগে কখনো পারমাণবিক বোমা ফেলি নি–চমৎকার একটি জিনিস। মুহূর্তের মাঝে তেজস্ক্রিয়তা কতগুণ বেড়ে যায়!

আমি কোনো কথা না বলে ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। শ্যালক্স গ্রুন আমার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, বিস্ফোরণটি খুব কাছাকাছি করা হল, মনে হচ্ছে এত কাছে না করলেও হত। আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম তোমরা আমাকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছ কি না।

আমি দাতে দাঁত ঘষে বললাম, তুমি সেটা নিয়ে কখনো নিশ্চিত হতে পারবে না।

আমার প্রয়োজনও নেই। এই মুহূর্তে আমি শুধু একটা জিনিস নিয়ে নিশ্চিত হতে চাই।

কী?

আমি যেন নিরাপদে আরো এক শ বছর ভবিষ্যতে যেতে পারি।

আমি কোনো কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

শ্যালক্স গ্রুন নিচু গলায় বলল, তুমি আমাকে সাহায্য করবে। আমার দুটি কুরু ইঞ্জিন পাল্টে নূতন দুটি ইঞ্জিন লাগিয়ে দেবে, আমি জানি তুমি সেটা করে দেবে। কেন জান?

কেন?

শ্যালক্স গ্রুন দীর্ঘ সময় কোনো কথা বলল না। তার বড় চেয়ারটি ঘুরিয়ে সে সোজাসুজি আমার দিকে তাকাল। তার মুখটি হঠাৎ কেমন জানি বিষণ্ণ দেখাতে থাকে, সে এক ধরনের ক্লান্ত গলায় বলল, আমি বড় নিঃসঙ্গ।

হঠাৎ আমার বুক কেঁপে ওঠে। য়োমির কথা মনে পড়ল আমার–অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটা পরীক্ষা করবে শ্যালক্স রুন। এটাই কি সেই পরীক্ষা?

শ্যালক্স গ্রুন তার হাত তুলে খুব মনোযোগ দিয়ে আঙুলগুলো পরীক্ষা করতে করতে বলল, আমার একজন সঙ্গী প্রয়োজন। আমি বড় একা। তাছাড়া দীর্ঘদিন আমি কোনো রমণীর দেহ স্পর্শ করি নি।

আমি চমকে উঠলাম, চাপা গলায় চিৎকার করে বললাম, কী বলতে চাইছ তুমি?

আমি তোমার ভালবাসার মেয়েটিকে আমার সাথে নিয়ে যাব। কী নাম মেয়েটির?

মনে হল হঠাৎ আমার মাথার মাঝে একটা ছোট বিস্ফোরণ হল। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না–হাঁটু ভেঙে বসে পড়লাম, মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, না–না–না–

কী নাম মেয়েটির?

না-না-

শ্যালক্স গ্রুন হঠাৎ তীব্র স্বরে চিৎকার করে ওঠে, কী নাম মেয়েটির?

ত্রিশা।

ত্রিশা! কী সুন্দর নাম!

আমি দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকি। হঠাৎ সবকিছু আমার কাছে অর্থহীন হয়ে আসে, বিশাল শূন্যতায় আমার বুকের মাঝে হা হা করে ওঠে! হায় ঈশ্বর! তুমি এ কী করলে?

শ্যালক্স গ্রুন নরম গলায় বলল, উঠে দাঁড়াও তুমি। আমার খুব বেশি সময় নেই। কাজ শুরু করে দাও।

শ্যালক্স গ্রুন আমার দিকে যোগাযোগ মডিউলটি এগিয়ে দেয়। আমি তবু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

এক শ বছর পর আমি ত্রিশাকে ফিরিয়ে দেব। তুমি ইচ্ছে করলে শীতলঘরে এক শ বছর অপেক্ষা করতে পার। আমার কাছে এসো, আমি তখন তোমার হাতে ত্রিশাকে তুলে দেব। কথা দিচ্ছি।

আমি হিংস্র চোখে শ্যালক্স গ্রুনের দিকে তাকিয়ে থাকি। ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কণ্ঠনালী চেপে ধরে মানুষটিকে শেষ করে দেয়ার একটি অদম্য ইচ্ছে আমার মাথার মাঝে পাক খেতে থাকে।

কিন্তু আমি জানি আমি সেটা করতে পারব না। পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জীবন সে তার বুকের মাঝে একটি সিলাকিত কার্বনের ক্যাপসুলের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে। একটি ছোট ভুলে সেই জীবন হারিয়ে যেতে পারে। আমি অসহায় আক্রোশে একটি দানবের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

 ১০. সময়-পরিভ্রমণ যান

শ্যালক্স গ্রুনের সময়-পরিভ্রমণ যানটির একপাশে নিচু হয়ে নেমে গেছে শেষ মাথায় একটি গোল দরজা। আমি এই দরজা দিয়ে ঢুকেছি, ত্রিশাও এই দরজা দিয়ে ঢুকবে। আমি দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছি, এখনো পুরো ব্যাপারটি আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

ক্যাচক্যাচ শব্দ করে হঠাৎ গোল দরজাটা খুলে গেল। ত্রিশাকে কি ধরে এনেছে এখন? সে কি চিৎকার করে কাঁদছে? আমার বুকের ভিতর যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে উঠতে থাকে। আমি কেমন করে ত্রিশার মুখের দিকে তাকাব?

গোল দরজায় একজন মানুষের ছায়া পড়ল, আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম। ত্রিশা পায়ে পায়ে ভিতরে এসে দাঁড়াল। একটি লাল রুমাল দিয়ে মাথার চুলগুলো শক্ত করে বাধা, হালকা নীল রঙের একটা পোশাক। পায়ে বিবর্ণ একজোড়া জুতো।

দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ত্রিশা মাথা ঘুরে তাকায়। তার মুখে এক ধরনের অসহনীয় আতঙ্ক। সে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁপা গলায় বলল, রিকি, তুমি কোথায়?

এই যে আমি এখানে।

ত্রিশা মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, কিন্তু আমার কাছে ছুটে এল না। সেখানে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে ওরা এখানে এনেছে কেন?

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ত্রিশা আবার জিজ্ঞেস করল, রিকি, তুমি কথা বলছ না কেন? এটি কোন জায়গা, এখানে এ রকম আবছা অন্ধকার কেন?

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, ত্রিশা, তুমি আমাকে ক্ষমা কর, ত্রিশা।

তুমি এ কথা কেন বলছ?

তোমার ওপরে খুব বড় একটা অবিচার করা হবে ত্রিশা।

ত্রিশার গলার স্বর হঠাৎ কেঁপে যায়, কী অবিচার?

আমি ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, ত্রিশার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না।

ত্রিশা হঠাৎ আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, তুমি কথা বলছ না কেন? কী হয়েছে রিকি?

আমি তবু কোনো কথা বলতে পারি না

ত্রিশা দুই পা এগিয়ে এসে হঠাৎ শ্যালক্স গ্রুনকে দেখতে পেল। সাথে সাথে সে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, কে ওটা?

শ্যালক্স গ্রুন প্রায় হাসি–হাসি মুখে বলল, আমার নাম শ্যালক্স গ্রুন, তুমি সম্ভবত আমার নাম শুনে থাকবে।

ত্রিশা একটা চিৎকার করে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে পিছনে ছুটে যেতে থাকে। সে দরজার কাছে। পৌঁছানোর আগেই ক্যাচক্যাচ করে গোল দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সে দুই হাতে দরজায় আঘাত করতে করতে হঠাৎ আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল।

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেললাম। হায় ঈশ্বর, তুমি কেন পৃথিবীতে এত অবিচার জন্ম দাও? কেন?

আমি আবার মাথা তুলে তাকালাম, শ্যালক্স গ্রুন শান্তমুখে তাকিয়ে আছে, মুখে এক ধরনের কোমল স্মিত হাসি। শুধুমাত্র সে-ই মনে হয় এ রকম হৃদয়হীন একটি পরিবেশেও এক ধরনের শান্তি খুঁজে পেতে পারে। শ্যালক্স গ্রুন হয়ে জন্ম নিতে হলে একজন মানুষকে কতটুকু নিষ্ঠুর হতে হয়?

আমি উঠে দাঁড়ালাম, তারপর পায়ে পায়ে হেঁটে ত্রিশার দিকে এগিয়ে গেলাম। ত্রিশা বিকারগ্রস্তের মতো কাঁদছে, আমি পিছন থেকে তাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করালাম, সে। ঘুরে দুই হাতে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলল। আমার বুকে মাথা গুঁজে সে হঠাৎ আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, রিকি তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না রিকি। আমাকে তুমি ছেড়ে যেয়ো না।

আমি দুই হাতে তার মুখ স্পর্শ করে নিজের দিকে টেনে আনি, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে আমি তার দিকে তাকালাম।

কান্নাভেজা চোখে সে আকুল হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এই মেয়েটি ত্রিশা নয়। এই মেয়েটি অবিকল ত্রিশার মতো দেখতে একটি রবোট। শ্যালক্স গ্রুনের নিষ্ঠুর পরীক্ষাটি কী হবে য়োমি সেটি বুঝতে পেরেছিল, ঠিক ত্রিশার মতো দেখতে একটি রবোট তৈরি করে রেখেছিল আগে থেকে। আমাকে জানায় নি ইচ্ছে করেই। হঠাৎ করে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে।

ত্রিশার মতো দেখতে রবোটটি আমার বুকের কাপড় ধরে আবার আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে। তার দুঃখে ভেজা ব্যথাতুর আতঙ্কিত মুখটি দেখে কেন জানি না হঠাৎ আমার চোখে পানি এসে যায়। এই মেয়েটি হয়তো সত্যিকারের মানুষ নয়, কিন্তু তার কষ্টটি সত্যি, তার দুঃখ হতাশা আর আতঙ্কটুকু সত্যি। আমার জন্যে তার ভালবাসাটুকুও সত্যি। মানুষ হয়ে জন্ম হয় নি বলে তার দুঃখ কষ্ট হতাশা আর ভালবাসাকে পায়ে দলে একজন দানবের হাতে তুলে দেয়া হবে।

আমি রবোট মেয়েটির মুখটি ধরে নিজের কাছে টেনে এনে তাকে গভীর ভালবাসায় চুম্বন করলাম। তাকে ফিসফিস করে বললাম, ত্রিশা, সোনামণি আমার, আমি আছি, আমি তোমার কাছে আছি। আমি সবসময় তোমার কাছে আছি–সবসময়–

আমার বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল যে আমি সত্যিই বুঝি থাকব ত্রিশার কাছে। হোক না সে রবোট তবুও তো সে ত্রিশা! আমার ভালবাসার ত্রিশা। কিন্তু আমি ত্রিশার কাছে থাকতে পারলাম না। শ্যালক্স গ্রুন পায়ে পায়ে আমাদের কাছে হেঁটে এল, ত্রিশাকে শক্ত করে ধরে রেখে সে গোল দরজাটি খুলে দিল। আমাকে বলল, যাও, শীতলঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। এক শ বছর পর এসো, আমি তোমাকে তোমার ত্রিশাকে ফিরিয়ে দেব।

ত্রিশা চিৎকার করে কাঁদছে। আমি তার দিকে পিছন ফিরে এগিয়ে গেলাম। আমার শরীর কাঁপছে, আমার চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসছে, ইচ্ছে করছে পিছনে ছুটে গিয়ে ত্রিশাকে আঁকড়ে ধরে বলি, এস ত্রিশা তুমি আমার সাথে এস।

কিন্তু আমি সোজা সামনে হেঁটে গেলাম, ফিসফিস করে নিজেকে বললাম, না, ওই মেয়েটি ত্রিশা নয়। ওই মেয়েটি একটি রবোট। রবোট। তুচ্ছ রবোট। আমি শুনতে পেলাম কাঁচক্যাচ শব্দ করে পিছনের দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল।

আমি সামনে তাকালাম, আবছা অন্ধকারে চার জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, দূর থেকে ভালো বোঝা যায় না, কিন্তু আমি জানি তারা কে। ইগা হিশান, য়োমি আর নুবা। আমাকে দেখে তারা আমার কাছে ছুটে এল। য়োমি আমার হাত ধরে বলল, কী হয়েছে রিকি? তোমার চোখে পানি কেন?

আমি চোখ মুছে বললাম, জানি না কেন। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার ত্রিশার জন্যে। সে মানুষ নয় তবু আমার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।

য়োমি আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখল

আমরা পাঁচ জন একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে শ্যালক্স গ্রুনের কদাকার সময়–পরিভ্রমণ যানটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কুরু ইঞ্জিন দুটি এখনো চালু করা হয় নি, আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে আছি। যেই মুহূর্তে কুরু ইঞ্জিন দুটি চালু করা হবে সাথে সাথে সুপ্ত গোপন প্রোগ্রামটি জীবন্ত হয়ে উঠে খুব ধীরে ধীরে সময়–পরিভ্রমণ যানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করবে।

প্রথমে একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম, তারপর কুরু ইঞ্জিন দুটিতে মৃদু কম্পন শুরু হল। আমি বুকের মাঝে আটকে রাখা একটা নিশ্বাস খুব সাবধানে বের করে দিই, শ্যালক্স গ্রুন ইঞ্জিন দুটিকে চালু করেছে। প্রতি মুহূর্তে এখন একটু একটু করে সময়–পরিভ্রমণ যানের নিয়ন্ত্রণ তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে কুরু ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর গর্জন শোনা যেতে থাকে। থরথর করে মাটি কাঁপতে থাকে, আয়োনিত গ্যাস প্রচণ্ড বেগ বের হতে শুরু করেছে পিছন দিয়ে। আগুনের লেলিহান শিখায় চারদিক ঢেকে যেতে শুরু করেছে, কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে খেয়ে উপরে উঠছে।

সময়–পরিভ্রমণ যানটি আস্তে আস্তে মাটি থেকে উপরে উঠে আসছে, মনে হতে থাকে বিশাল একটি কীট বুঝি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যায়, তার মাঝে সময়–পরিভ্রমণ যানটি আস্তে আস্তে উপরে উঠে যাচ্ছে, গতিবেগ বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি। আর কয়েক মুহূর্ত পর সময় পরিভ্রমণ যানটি পৃথিবীর আকর্ষণ ছিন্ন করে মহাকাশে ছুটে যাবে। শ্যালক্স গ্রুন এখনো জানে না সে সময়–পরিভ্রমণ করবে না–তার পরিভ্রমণ হবে দূরত্বে। সে পৃথিবী, সৌরজগৎ পার হয়ে চলে যাবে দূর কোনো এক নক্ষত্রের দিকে। তার বুকের ভিতর সিলাকিত ক্যাপসুলে থাকবে এক ভয়াবহ ভাইরাস। তার কাছাকাছি থাকবে তিশা। রবোটের অবয়বে তৈরী আমার ভালবাসার ত্রিশা। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, সময়–পরিভ্রমণ যানের কুরু ইঞ্জিন থেকে আয়োনিত গ্যাস বের করে সেটা উপরে উঠে যাচ্ছে, খুব ধীরে ধীরে দিক পরিবর্তন করতে শুরু করেছে, পৃথিবীর আবর্তনের সাথে সাথে গতিবেগের সামঞ্জস্য আনার জন্যে। আকস্মিক কোনো বিস্ফোরণে ধ্বংস না হয়ে গেলে আর কেউ এখন শ্যালক্স গ্রুনকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কোনোদিন ফিরিয়ে আনতে পারবে না। পৃথিবীর একটা অশুভ স্বপ্ন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে মহাকাশে।

আমরা সবাই খুব সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিলাম। সত্যিই কি পৃথিবীকে রক্ষা করা হয়েছে? নুবা দেয়াল স্পর্শ করে খুব সাবধানে ঘাসের উপর বসে পড়ল। মাথা ঘুরিয়ে আমাদের সবার দিকে তাকাল, তারপর কাঁপা গলায় বলল, আমরা কি বেঁচে গেছি?

ইগা তার ঘড়ির দিকে তাকাল, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, হা নুবা আমরা বেঁচে গেছি।

আমরা তাহলে পৃথিবীকে রক্ষা করেছি?

হ্যাঁ। আমরা পৃথিবীকে রক্ষা করেছি।

তাহলে আমরা আনন্দ করছি না কেন?

কেউ কোনো কথা বলল না। য়োমি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, নুবা, আমি জানি না কেন আমরা আনন্দ করছি না।

ইগা একটু হেসে বলল, চল কন্টোলঘরে যাই। নিজের চোখে যদি শ্যালক্স গ্রুনকে দেখতে পাই হয়তো তখন সত্যি সত্যি বিশ্বাস হবে। তখন হয়তো আমরা আনন্দ করতে পারব।

কাছাকাছি একটা ছোট সেলে তাড়াহুড়া করে কন্ট্রোলঘরটি তৈরি হয়েছে। স্বচ্ছ দেয়াল সরিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকে গেলাম। দেয়ালে একটি বড় স্ক্রিন ছাড়া কিছু নেই। হঠাৎ করে দেখে এটাকে কন্ট্রোলঘর মনে হয় না। ইগা ছোট একটা সুইচ স্পর্শ করতেই স্ক্রিনটা আলোকিত হয়ে আসে, মাঝামাঝি একটা লাল বিন্দু জ্বলছে এবং নিভছে। নুবা জিজ্ঞেস করল, এটা কী?

শ্যালক্স গ্রুনের সময়–পরিভ্রমণ যান।

ভিতরে কি দেখা যাবে?

পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর দেখা যাবে।

যোগাযোগের জন্যে কী ব্যবহার করা হবে?

য়োমি এগিয়ে এসে বলল, ত্রিশার মতো দেখতে যে রবোটটি পাঠিয়েছি তার সাথে রয়েছে মাইক্রো কমিউনিকেশন মডিউল। যেসব ছবি পাঠানো হবে তার রিজলিউশন খুব ভালো হবে না আগেই বলে রাখছি।

আমরা স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ সেখানে কিছু তরঙ্গ খেলা করতে থাকে। য়োমি চাপা গলায় বলল, এখন ভিতরে দেখা যাবে। কমিউনিকেশন মডিউল কাজ করতে শুরু করেছে।

নুবা বলল, রিকি তুমি সামনে যাও। কথা বল।

আমি?

হ্যাঁ। শুধু তুমিই শ্যালক্স গ্রুনের সাথে কথা বলেছ। যাও।

আমি স্ক্রিনের সামনে এগিয়ে গেলাম, খুব ধীরে ধীরে সেখানে একটা ছবি ভেসে উঠেছে। আমি বড় একটা করিডোর দেখতে পেলাম, সামনে কিছু ছোট ছোট স্ক্রিনের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে শ্যালক্স গ্রুন। তার ভুরু কুঞ্চিত, মুখে গভীর একটা উদ্বেগের ছাপ। সে কিছু একটা স্পর্শ করে কয়েকটা বোতাম টিপতে থাকে, ছোট মাইক্রোফোনে কিছু একটা কথা বলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, আমি দেখতে পেলাম তার মুখ রক্তশূন্য, সেখানে এক ধরনের অমানুষিক আতঙ্ক। আমি ডাকলাম, শ্যালক্স গ্রুন।

পৃথিবী থেকে বহুদূরে চলে গেছে, আমার কথা পৌঁছুতে একটু সময় লাগল কিন্তু যখন আমার কথা শুনতে পেল সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে চিৎকার করে বলল, কে?

আমি।

আমি কে?

রিকি।

রিকি? রিকি!

হ্যা শ্যালক্স গ্রুন, তুমি হেরে গেছ। আমাদের কাছে তুমি হেরে গেছ। তোমাকে ত্রিনিত্রি রাশিমালা দেয়া হয় নি। অর্থহীন কিছু সংখ্যা নিয়ে তুমি এখন মহাকাশে উড়ে যাচ্ছ। বৃহস্পতি গ্রহের কাছে দিয়ে তুমি উড়ে যাবে সৌরজগতের বাইরে।

না। শ্যালক্স গ্রুন ছুটে গিয়ে তার কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুঁকে পড়ে। হাত দিয়ে আঘাত করতে করতে চিৎকার করতে থাকে। আমরা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম, ভয়ঙ্কর মুখ করে সে ঘুরে তাকায়। তারপর হিসহিস করে বলল, ত্রিশা, ত্রিশাকে অষ্টম তোমার সামনে খুন করব। খুন করব।

আমরা প্রথমবার ত্রিশাকে দেখতে পেলাম। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে আর ভয় নেই। তার কপোট্রনে পুরোনো স্মৃতি মুছে ফেলে এখন নতুন স্মৃতি লেখা হচ্ছে। ভালবাসাহীন এক স্মৃতি। আতঙ্কহীন এক স্মৃতি। নিষ্ঠুর প্রতিশোধের এক স্মৃতি। আমি ফিসফিস করে বললাম, শ্যালক্স গ্রুন! তুমি ত্রিশাকে স্পর্শ করবে না। তুমি স্পর্শ করতে পারবে না।

শ্যালক্স গ্রুন ঘুরে ত্রিশার দিকে তাকায় এবং হঠাৎ করে তার মুখ আতঙ্কে কদর্য হয়ে যায়। সে নিজের বুক স্পর্শ করে এক পা পিছিয়ে যায়। একটু আগে যে ত্রিশা ছিল সে আর ত্রিশা নয়, তার চোখ জ্বলছে, হাত থেকে বের হয়ে এসেছে ধারালো ধাতব ছোরা। ছায়ামূর্তিটি শ্যালক্স গ্রুনের দিকে এগিয়ে যায়–

না না না_শ্যালক্স গ্রুন আতঙ্কে চিৎকার করে পিছনে সরে যেতে থাকে। মানুষটি নিষ্ঠুর অমানবিক, তার ভিতরে ভালবাসার কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু মানুষের প্রাচীনতম অনুভূতি ভীতি তার বুকের ভিতর লুকিয়েছিল সে জানত না।

আমি স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, আমি আর দেখতে পারছি না, তোমরা কেউ স্ক্রিনটি বন্ধ করে দেবে?

ইগা হাত বাড়িয়ে কী একটা স্পর্শ করতেই স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল। য়োমি চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ স্ক্রিনটা বন্ধ করে দাও। রবোটের ওপর নির্দেশ দেয়া আছে শ্যালক্স গ্রুনের শরীর থেকে ভাইরাসের এম্পুলটা বের করার দৃশ্যটি মনে হয় না আমি সহ্য করতে পারব।

নুবা একটা নিশ্বাস নিয়ে পিছনে সরে গিয়ে বলল, মানুষটিকে হত্যা না করে কি এম্পুলটা বের করা যেত না?

হয়তো যেত। য়োমি নুবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তার চেষ্টা করি নি। আমি খুব প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ। মানুষের জগতে এই দানবটির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।

আমরা ছোট কন্ট্রোলঘর থেকে বের হয়ে এলাম। দূরে একটা বাই ভার্বাল নেমেছে। তার ভিতর থেকে বেশ কয়েকজন মানুষ হেঁটে হেঁটে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, সবার সামনে ইয়োরন রিসি। আমরা তার দিকে হেঁটে যেতে থাকি।

মহামান্য ইয়োরন রিসি এক জন এক জন করে আমাদের প্রত্যেককে আলিঙ্গন করে বললেন, পৃথিবীর পক্ষ থেকে তোমাদের অভিনন্দন। এই পৃথিবী যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তোমাদের কাছে ঋণী হয়ে থাকবে।

নুবা নরম গলায় বলল, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন মহামান্য ইয়োরন রিসি, কিন্তু আপনি একটু অতিরঞ্জন করেছেন। আপনার আদেশে আমরা কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার বেশি কিছু নয়! সব কাজ করেছে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ। অসংখ্য বিজ্ঞানী, অসংখ্য ইঞ্জিনিয়ার, অসংখ্য প্রতিভাবান শ্রমিক।

য়োমি মাথা নেড়ে বলল, নুবা একটুও বাড়িয়ে বলে নি। আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝে আমাকে একটা রবোট তৈরি করে দিয়েছে। নিখুঁত রবোট, রিকির মতো মানুষ সেই রবোট দেখে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল!

ইগা মাথা নেড়ে বলল, আর কুরু ইঞ্জিনের সেই ব্যাপারটা। আমরা নিজেরা কি সেটা কখনো করতে পারতাম? সময়–পরিভ্রমণকে পাল্টে দূরত্ব–পরিভ্রমণ করে ফেলা? আমি নিজে তো বিজ্ঞান শিখেছি গত দু দিনে!

নুবা বলল, তার ওপর একটি নকল ত্রিনিত্রি রাশিমালা তৈরি করে দেয়া–যেটি সত্যিকারের রাশিমালার কাছাকাছি কিন্তু সত্যিকারের নয়।

হিশান হেসে বলল, সবচেয়ে চমৎকার হয়েছে কৃত্রিম পারমাণবিক বিস্ফোরণ, একেবারে তেজস্ক্রিয়তা থেকে শুরু করে শক ওয়েভ, বাতাসের ঝাঁপটা, শ্যালক্স গ্রুন এতটুকু সন্দেহ করে নি!

ইয়োররন রিসি মাথা নাড়লেন, তোমাদের কথা সত্যি। পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ তোমাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সত্যিকারের কাজটি করেছ তোমরা। আমি সেটা জানি, তোমরাও সেটা জান!

কিন্তু–

আমি পৃথিবীর বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক, আমার আদেশ তোমরা আমার সাথে এই ব্যাপারটি নিয়ে তর্ক করবে না!

আমরা তার কথায় হেসে ফেললাম, মানুষটির মাঝে এক ধরনের বিস্ময়কর সারল্য রয়েছে যেটা অন্য কোনো মানুষের মাঝে দেখি নি।

ইয়োরন রিসি নরম গলায় বললেন, পুরো ব্যাপারটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তোমাদের স্নায়ুর উপর নিশ্চয়ই অসম্ভব চাপ পড়েছে। এখন তোমাদের প্রয়োজন বিশ্রাম। আমি কি তোমাদের কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?

আমি ইয়োরন রিসির দিকে তাকালাম। বললাম, পারেন মহামান্য ইয়োরন রিসি।

তুমি বল রিকি, তুমি কী চাও।

আমি আমার পকেটে হাত দিয়ে লাল কার্ডটি বের করে ইয়োরন রিসির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমার এই কার্ডটি আপনি ফিরিয়ে নেবেন।

ইয়োরন রিসি কোমল চোখে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে রিকি, সেটাই যদি তোমার ইচ্ছে।

ইয়োরন রিসি কার্ডটি নেবার জন্যে হাত বাড়ালেন। সাথে সাথে ইগা, হিশান, য়োমি আর নুবা তাদের নিজেদের লাল কার্ডগুলো বের করে তার দিকে এগিয়ে দেয়। ইয়োরন রিসি খানিকক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসতে হাসতে বললেন, পৃথিবীর একেক জন মানুষ এই লাল কার্ডের জন্যে নিজেদের প্রাণ দিয়ে দেবে আর তোমরা অবহেলায় সেটা ফিরিয়ে দিচ্ছ?

ইগা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা হয়তো এই পৃথিবীর উপযুক্ত মানুষ নই মহামান্য রিসি। হয়তো কিছু গোলমাল আছে আমাদের!

ইয়োরন রিসি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল আছে।

১১.

দীর্ঘ লিফটে করে আমি মাটির নিচে সুড়ঙ্গে নেমে এসেছি। শেষবার যখন এসেছিলাম আমার কাছে লাল কার্ড ছিল, আমি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারতাম। এখন আমার কাছে সেই লাল কার্ড নেই, মানুষের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে আমাকে নিচে নামতে হয়েছে। আমি প্রোগ্রামিং ফার্মের বাইরে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভিতরে এক শিফটের কাজ শেষ হয়েছে, শ্রমিকেরা একে একে বের হয়ে আসছে। তাদের চোখেমুখে ক্লান্তি, তাদের পোশাক ধুলায় ধূসর। আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে ত্রিশাকে খুঁজতে থাকি। দাঁড়িয়ে থেকে–থেকে আমি যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম ঠিক তখন ত্রিশা বের হয়ে এল, তার পরনে হালকা নীল পোশাক, তার মাথায় একটা লাল রুমাল শক্ত করে বাঁধা।

আমি ভিড় ঠেলে সামনে ছুটে গেলাম, চিৎকার করে ডাকলাম, ত্রিশা ত্রিশা—

ত্রিশা চমকে ঘুরে তাকাল, আমাকে দেখে এক মুহূর্ত দ্বিধা করে সে হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, রিকি। তুমি?

হ্যাঁ, ত্রিশা আমি। তুমি ভালো আছ?

ত্রিশা মাথা নাড়ল, ভালো। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ করে বলল, আমি কয়দিন থেকে তোমার কথা ভাবছিলাম।

সত্যি?

হ্যাঁ। খুব একটা অবাক ব্যাপার হয়েছিল দুদিন আগে।

কী অবাক ব্যাপার?

চার জন মানুষ এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। দুজন পুরুষ দুজন মহিলা। বয়স খুব বেশি নয়, সবাই প্রায় আমাদের বয়সী। কিন্তু তারা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।

সত্যি?

হ্যাঁ। তুমি বিশ্বাস করবে না তাদের কী আশ্চর্য ক্ষমতা! যেটা করতে চায় সেটাই তারা করতে পারে। যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে।

আমি আমার মুখে অবাক হবার একটা চিহ্ন ফোঁটাতে চেষ্টা করতে থাকি। ত্রিশা চোখ বড় বড় করে বলল, তারা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল একটা রবোটের ফার্মে।

সত্যি?

হ্যাঁ। সারারাত কথা বলল আমার সাথে। তোমার কথা জিজ্ঞেস করল অনেকবার। যখন আমি চলে আসছিলাম তখন ফার্মের লোকজন এসে আমার অনেকগুলো ছবি তুলল, আমার শরীরের মাপ নিল। সবশেষে আমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করল।

আমি আমার মুখে বিস্ময় ফোঁটানোর চেষ্টা করতে থাকি। ত্রিশা মাথা নেড়ে বলল, একটা ব্যাপার জান?

কী?

ওই চার জন মানুষের সাথে আর তোমার সাথে কী একটা মিল রয়েছে।

মিল?

হ্যাঁ, আমি ঠিক ধরতে পারছি না মিলটুকু কোথায় কিন্তু কিছু একটা মিল আছে। সেই থেকে আমার কেন জানি শুধু তোমার কথা মনে হচ্ছে!

ত্রিশা হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকাল, খানিকক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ওই চার জন মানুষকে চেন রিকি?

আমি খানিকক্ষণ ত্রিশার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, হ্যাঁ ত্রিশা। আমি তাদের চিনি।

তুমি–তুমি ঠিক ওদের মতো একজন?

হ্যাঁ ত্রিশা, আমি ঠিক তাদের মতো একজন।

ত্রিশা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি আমাকে কখনো তোমার নিজের কথা বল নি, তাই না?

আমি বলি নি কারণ আমি জানতাম না ত্রিশা। আর জানলেও বিশ্বাস করতাম না।

ত্রিশা আমার হাত ধরে বলল, তুমি বলবে তোমার কথা?

তুমি শুনবে?

শুনব।

আমি ত্রিশাকে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে বললাম, ঠিক আছে আমি বলব। তুমি বিশ্বাস করবে না তবু আমি বলব।

আমি সবসময় তোমার কথা বিশ্বাস করব রিকি।

ত্রিশা আমার দিকে তাকিয়ে খুব সাবধানে তার চোখের পানি মুছে নেয়।

.

দক্ষিণের পাহাড়ি অঞ্চলের একটি ছোট স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে আমি আর ত্রিশা শহর ছেড়ে চলে এসেছি। ছোট কাঠের একটা বাসা আছে আমাদের। শীতের বিকেলে যখন তুষার পড়তে থাকে জানালার পাশে, আগুনের উষ্ণতায় বসে আমরা জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকি। আমাদের ছোট ছেলেটি ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে থাকে– অসম্ভব দুরন্ত একটি শিশু হয়ে বড় হচ্ছে সে।

নুবা, য়োমি, ইগা আর হিশানের সাথে আমার ভালো যোগাযোগ নেই। শুধু বছরে একবার আমরা কোথাও এসে একত্র হই, নুবা তার ভালোমানুষ হাসিখুশি স্বামীটিকে নিয়ে আসে। হিশানের সাথে আসে তার কমবয়সী বান্ধবী। য়োমি এখনো একা, আমার কেন জানি মনে হয় সারাজীবন সে একাই থাকবে। ইগার সাথে একেকবারে একেকজন আসে, কমবয়সী অপূর্ব সুন্দরী কোনো মেয়ে! আমি ত্রিশাকে নিয়ে যাই।

ত্রিশাকে তারা সবাই খুব ভালো করে চেনে, মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি আমার থেকেও ভালো করে।

Exit mobile version