Site icon BnBoi.Com

ওমিক্রনিক রূপান্তর – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ওমিক্রনিক রূপান্তর – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

০১. আহাম্মক

রিকির জন্যে অপেক্ষা না করেই বিজ্ঞান আকাদেমির অধিবেশন শুরু হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম অপেক্ষা করা হত, আজকাল আর করা হয় না। সে অনেক দিন হল এইসব অধিবেশনে যোগ দেয়া ছেড়ে দিয়েছে। তাই আজ হঠাৎ করে যখন অধিবেশনের মাঝখানে রিকি এসে হাজির হল, সবাই একটু অবাক না হয়ে পারল না। রিকি সবার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তার স্বভাবসুলভ উদ্ধত ভঙ্গিতে নিজের আসনে গিয়ে বসে। শব্দ করে তার হাতের ব্যাগ থেকে একটা ছোট পানীয়ের শিশি বের করে এক ঢোক খেয়ে শিশিটা টেবিলের উপর রাখে।

বৃদ্ধ সভাপতি রু সচরাচর রিকির উদ্ধত আচার-আচরণকে সযত্নে এড়িয়ে যান, সবাই ভেবেছিল আজও তাই করবেন। কিন্তু রু কী কারণে জানি টেবিলে তাঁর কাগজপত্র ভাঁজ করে রেখে শান্ত গলায় বললেন, রিকি, তুমি তিরিশ মিনিট দেরি করে এসেছ।

রিকি মুখে একটু হাসি টেনে আনার ভান করে বলল, জানি।

সে ক্ষেত্রে তোমার অধিবেশনে যোগ দেয়ার আগে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন আছে।

তাই নাকি? রিকি গলার স্বরে ব্যঙ্গটুকু আড়াল করার কোনো চেষ্টা করল না।

এসব নিয়মকানুন বেশিরভাগই স্বাভাবিক ভদ্রতা, তুমি জান না এতে আমি খুব অবাক হই না। রু হঠাৎ অত্যন্ত কঠিন স্বরে বললেন, তোমার অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন আছে রিকি।

রিকি কিংবা অন্য কেউই মহামান্য রুকে এ রকম কঠিন স্বরে কথা বলতে দেখে নি। মুহূর্তের মাঝে পরিবেশটি আশ্চর্য রকম শীতল হয়ে যায়।

রিকি একটু বিপন্ন অনুভব করে, কষ্ট করে নিজের গলার স্বরকে স্বাভাবিক রেখে বলল, ঠিক আছে, অনুমতি নিচ্ছি।

নাও।

আমি কি অধিবেশনে যোগ দিতে পারি?

রু তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, না।

ঘরে বজ্ৰপাত হলেও মনে হয় কেউ এত অবাক হত না। বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা এত প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী যে পৃথিবীর শাসনতন্ত্র পর্যন্ত তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রিকির ফর্সা মুখ অপমানে টকটকে লাল হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, আপনি আমাকে সবার সামনে অপমান করার চেষ্টা করছেন।

না।

তাহলে? বিজ্ঞান আকাদেমির তোমাকে আর প্রয়োজন নেই। তোমাকে এই ছোট একটি সত্যি কথা জানানোর চেষ্টা করছি।

সেই সত্যি কথাটি কার মাথা থেকে বের হয়েছে?

আমার।

আপনাকে কে এই ক্ষমতা দিয়েছে?

কেউ দেয় নি। রু আস্তে আস্তে বললেন, আমি নিজেই নিয়েছি।

বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যদের ক্ষমতা প্রায় ঈশ্বরের মতো। তাদেরকে আদেশ দেওয়া যায় না।

হ্যাঁ, তাদের ক্ষমতা দিয়েছে পৃথিবীর সাধারণ মানুষ। তারা যখন দেখবে সেই ক্ষমতা অপব্যবহার করা হচ্ছে, সে-ক্ষমতা তারা আবার নিয়ে নেবে। তুমি তোমার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছ রিকি।

কী করেছি আমি?

অনেক কিছু করেছ। সবচেয়ে দুঃখজনক হল তোমার স্ত্রীর মৃত্যু। তুমি তাঁকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছ রিকি।

রিকি চমকে উঠে বৃদ্ধ রুয়ের মুখের দিকে তাকাল। রু শান্ত গলায় বললেন, সাধারণ মানুষ হলে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা সব নিয়মকানুনের উর্ধ্বে, তাই তোমাকে স্পর্শ করা হয় নি।

রিকি কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি কে। আমি হচ্ছি সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আনাহাসু রিকিশান, সংক্ষেপে রিকি। চোদ্দ বৎসর বয়সে আমি মহাজাগতিক সূত্রের সপ্তম সমাধান করেছি। সতের বৎসর বয়সে আমার নামে তিনটি ইনস্টিটিউট খোলা হয়েছে। বাইশ বছর বয়সে আমি বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্য হয়েছি, সময়সূত্রের একমাত্র সমাধানটি আমার নিজের হাতে করা, নবম সূত্রের রিকি পরিভাষা ব্যবহারিক অঙ্কের জন্যে নূতন জগতের সন্ধান দিয়েছে—

রু হাত তুলে তাকে থামালেন, বললেন, আমরা জানি তুমি অত্যন্ত প্রতিভাবান বিজ্ঞানী।

আমার জন্য পৃথিবীর সাধারণ নিয়ম খাটে না মহামান্য রু। পৃথিবীর দুই-চারটি সাধারণ মানুষের প্রাণ আমার ব্যক্তিগত খেয়াল থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার স্ত্রী অত্যন্ত নির্বোধ মহিলা ছিল।

আমি মৃতদের নিয়ে অসম্মানজনক কথা পছন্দ করি না, রিকি।

রিকি থতমত খেয়ে থেমে যায়, আস্তে আস্তে তার মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসে। টেবিল থেকে পানীয়ের শিশিটি তুলে এক ঢোক খেয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বলল, ঠিক আছে, তা হলে জীবিত ব্যক্তিদের কথাই বলি। এই বিজ্ঞান আকাদেমি হচ্ছে একটা গণ্ডমূর্খের আড়া। এখানকার সবাই হচ্ছে একজন করে নির্বোধ। বিজ্ঞানের সবগুলো শাখায় আমি একা যে পরিমাণ অবদান রেখেছি, আপনারা সবাই মিলে তার এক শ ভাগের এক ভাগ অবদান রাখেন নি।

সেটা নির্ভর করে তুমি অবদান বলতে কী বোঝাও তার উপর। রিকি, তুমি ভুলে যাচ্ছ, বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যদের ব্যক্তিগত গবেষণার সময় কিংবা সুযোগ নেই।

আমাকে সেটা বিশ্বাস করতে বলছেন?

রু কোমল গলায় প্রায় হাসিমুখে বললেন, সেটা তোমার ইচ্ছে রিকি। কিন্তু তুমি যেহেতু বিষয়টি তুলেছ, তোমাকে একটা ঘটনার কথা বলি। প্রায় কুড়ি বছর আগে পশ্চিমের পাহাড়ী অঞ্চলের একটা কৃষিজীবী এলাকার বাচ্চাদের স্কুল থেকে আমি একটা চিঠি পেয়েছিলাম। স্কুলের একজন শিক্ষকের চিঠি—অনেক ঘুরে আমার কাছে এসেছিল। চিঠিতে শিক্ষক লিখেছেন, তাঁর ক্লাসে নাকি একজন অস্বাভাবিক প্রতিভাবান শিশু রয়েছে। আমি শিশুটির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার বয়স তখন সাত, সে ছয় বৎসর বয়সে মহাজাগতিক সূত্রের প্রথম সমাধানটি করেছিল। সাত বৎসর বয়সে সে সময়ে পরিভ্রমণের উপর প্রায় সঠিক একটা সূত্র দিয়েছিল। আমি তাকে এবং তার পরিবারকে রাজধানীতে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। বাচ্চাটি রাজি হয় নি। সে বিজ্ঞানে উৎসাহী নয়।

রিকি শক্তমুখে বলল, কী নাম তার? কোথায় থাকে?

তাতে তোমার প্রয়োজন কি? তোমাকে যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে, সেই শিশুটি তোমার থেকে অনেক বেশি প্রতিভাবান ছিল। সে ইচ্ছে করলেই আমাদের সাথে এই সভায় থাকতে পারত। কিন্তু সে থাকে নি। যে-বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্য হয়ে তোমার এত অহঙ্কার, সেই শিশুটির তাতে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। পৃথিবীতে তোমার থেকে অনেক বড় প্রতিভাবান মানুষ আছে, তবে হ্যাঁ, তোমার মতো অহঙ্কারী, ক্ষমতালোভী উচ্চাকাঙ্ক্ষী সম্ভবত আর কেউ নেই।

রিকি কী-একটা বলতে চাইছিল, রু হাত তুলে তাকে থামিয়ে বললেন, প্রায় তিরিশ বৎসর আগে মহাজাগতিক মেঘ দিয়ে পৃথিবীতে একটা বিপর্যয় নেমে আসার কথা ছিল। আমরা–এই বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা, সেই বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলাম, তুমি সেই ঘটনার কথা জান?

জানি।

পৃথিবীর ইতিহাসে সেই প্রচেষ্টার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কেন থাকবে জান?

জানি।

না, তুমি জান না। তোমার জানার ক্ষমতা নেই। তুমি লোভী এবং স্বার্থপর। দশজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানীর একসাথে কাজ করার কি আনন্দ, তুমি কল্পনাও করতে পার না রিকি। পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের প্রচেষ্টার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, কারণ আমরা সবাই একসাথে কাজ করে একটি ভয়ংকর বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলাম। বিজ্ঞানীদের জীবনে এর থেকে বড় সার্থকতা আর কিছু নেই। ব্যক্তিগত সাফল্যের সাথে এর কোনো তুলনা হয় না। রিকি, তোমাকে আমাদের প্রয়োজন নেই। তুমি কিংবা তোমার মতো একজন বিজ্ঞানী যে-কাজের জন্যে এত অহঙ্কারী হয়ে যাও, তার প্রত্যেকটিই অন্য কয়জন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী কয়েক বৎসর চেষ্টা করে বের করে ফেলতে পারে। খুব দুঃখের ব্যাপার, তুমি এই সহজ সত্যটি জান না। তুমি আমাদের কোনো কাজে আস না রিকি, তোমাকে আমাদের প্রয়োজন নেই। তুমি এখন যাও, ভবিষ্যতে আর কখনো এসো না।

রিকি ষড়যন্ত্রীর মতো মুখ করে বলল, যদি না যাই?

যাবে। তুমি নিশ্চয়ই যাবে। তুমি অনেক দিন থেকে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছ।

আপনি কেমন করে জানেন?

আমি জানি। আমি বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতি, তাই আমার কাছে সব খবরাখবর আসে। আমি না চাইলেও আসে। আমি জানি, তুমি পৃথিবীর পুরো রথিনিয়ামটুকু নিজের কাছে এনে জমা করেছ। তুমি এখন পালাবে। কোথায় পালাবে জানি না, কিন্তু তুমি পালাবে।

রিকি মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি পালাব?

হ্যাঁ। কারণ তুমি জান, আমরা বিজ্ঞান আকাদেমির নিয়মকানুন পাল্টে ফেলছি। তোমার মতো মানুষের যেন বিচার করা যায় তার ব্যবস্থা করছি।

রিকি এবারে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠে, আমার বিচার করবেন আপনারা? পৃথিবীর মানুষেরা? কখনো শুনেছেন পৃথিবীর মানুষ ঈশ্বরের বিচার করার চেষ্টা করছে?

রু কোনো কথা না বলে ভুরু কুঁচকে রিকির দিকে তাকিয়ে থাকেন।

রিকি উঠে দাঁড়ায়। হাসতে হাসতে বলে, বেশ, চেষ্টা করে দেখেন। আমি যাচ্ছি—এই নির্বোধদের আসরে আমার জন্যে থাকা আর সম্ভব নয়। বিদায়।

কেউ কোনো কথা বলল না, রিকি দরজা খুলে সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।

 

রিকি বের হয়ে যাবার পর কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলল না। রু আস্তে আস্তে তাঁর চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন তোমাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ যে তোমরা এই উন্মাদ ব্যক্তিটির সাথে আমার কথোপকথনটি ধৈর্য ধরে শুনলে। তোমরা কেউ যে কোনো কথা বল নি, সে জন্যে আমি সারা জীবন তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।

গণিতবিদ কিরি বললেন, আমরা আপনার ধৈর্য দেখে বিস্মিত হয়েছি মহামান্য রু। একটি ঘুসি দিয়ে তার সবকয়টি দাঁত খুলে না ফেলে কী ভাবে তার সাথে কথা বলা যায় আমার জানা নেই।

অধিবেশন-কক্ষে অনেকে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠে। রসায়নবিদ নীষা তরল স্বরে বললেন, ভাগ্য ভালো যে তুমি কথা বলার চেষ্টা কর নি, কিরি। এই বয়সী মানুষের মারপিট দেখতে ভালো লাগার কথা নয়।

আবার অধিবেশন-কক্ষে মৃদু হাসির শব্দ শোনা গেল। রু বললেন, চল, কাজ শুরু করা যাক।

নীষা বললেন, মহামান্য রু, আপনি কি খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে চান? রিকির সঙ্গে কথা বলা খুব সহজ ব্যাপার নয়।

ঠিকই বলেছ। মিনিট পনেরর জন্যে বিরতি নেয়া যাক। কী বল?

সবাই সানন্দে রাজি হয়ে যায়।

 

সন্ধেবেলা মহামান্য রু জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, এমন সময় তাঁর সহকারী মেয়েটি নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায়। রু ঘুরে তার দিকে তাকালেন, কিছু বলবে?

কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক আপনার সাথে দেখা করতে চান। কি নাকি জরুরি ব্যাপার।

রু অন্যমনস্কভাবে বললেন, আসতে বল।

প্রায় সাথে সাথেই তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক এসে হাজির হলেন। বয়স্ক ভদ্রলোক, কপালের দুপাশে চুলে পাক ধরেছে। কমনীয় চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত আপনাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্য।

রু হাসিমুখে বললেন, কে বলেছে তুমি বিরক্ত করছ? তোমার কাছে আমি যে সব মজার খবর পাই, আর কোথায় সেগুলো পাব বল?

আমি খুব দুঃখিত মহামান্য রু, কিন্তু একটা খবর জানানোর জন্যে আমার নিজের আসতে হল।

কি খবর? রিকি কিছু করেছে?

আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন। মহামান্য রিকি তাঁর গোপন গবেষণাগারে কুরু

সেটা কী জিনিস?

কুরু মহাকাশযানের ইঞ্জিন অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস। একটি শেষ করতে প্রায় ছয় বছর সময় নেয়। প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী ইঞ্জিন–আন্তঃনক্ষত্র ভ্রমণ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবহার নেই। মহামান্য রিকি কী কাজে ব্যবহার করবেন, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই।

রু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, রিকি এখন পালাবে। তুমি দেখ, সে পালাবে। খুব ভয় পেয়েছে আজ।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক কোনো কথা বললেন না, বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যদের নিয়ে কৌতূহল দেখানো শোভন নয়। ক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ঘুরে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে জানানোর জন্যে। ইঞ্জিনটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে আর লাভ নেই, ধরে নাও ওটা গেছে। আমি মহাকাশ কেন্দ্রের সাথে কথা বলে একটা-কিছু ব্যবস্থা করে দেব।

অনেক ধন্যবাদ মহামান্য রু। তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, রু তাঁকে থামালেন। জিজ্ঞেস করলেন, রিকি এখন পর্যন্ত কী করেছে না করেছে তুমি তো সব জান?

জানি।

তার স্ত্রীকে হত্যা করা, রথোনিয়াম জড়ো করা, মুদ্রা অপসারণ, এখন কুরু মহাকাশযানের ইঞ্জিন–

পরিচালক ভদ্রলোক মাথা নিচু করে বললেন, জ্বি, জানি।

তুমি খুব সাবধানে এইসব খবর বাইরের পৃথিবীর কাছে গোপন রেখেছ?

জ্বি। বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যদের অবমাননা করে কোনো ধরনের খবর প্রকাশ করা আমাদের নীতির বিরুদ্ধে।

রু একটু ভেবে বললেন, রিকি আজকালকের ভিতরে উধাও হয়ে যাবে। কোথায় যাবে ঠিক বলা যাচ্ছে না, কিন্তু উধাও হবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সে উধাও হবার পর তার সম্পর্কে তুমি যা জান, সবকিছু খবরের কাগজে প্রকাশ করে দিতে পারবে?

পরিচালক ভদ্রলোক ভয়ানক চমকে উঠলেন, কী বলছেন আপনি।

রু শান্ত গলায় বললেন, পারবে? আপনি যদি বলেন নিশ্চয়ই পারব। কিন্তু—

কিন্তু কি?

বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা আমাদের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তাঁরা পৃথিবীর জন্যে যে অবদান রেখেছেন, তার কোনো তুলনা নেই, তাঁদের কোনো-একজন যদি ছোটোখাটো কোনো ভুলত্রুটি করে থাকেন, সেটা সারা পৃথিবীকে জানানোর সত্যিই কী কোনো প্রয়োজন আছে?

রু আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন, আছে। বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা ঈশ্বর নয়, তারা মানুষ। তাদের সাধারণ মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া ঠিক না। তুমি আমার এই অনুরোধটি রাখ।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক বিদায় নেয়ার পর রু অনেকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন, বিজ্ঞান আকাদেমির কাঠামোতে একটি বড় রদবদল করতে হবে, এভাবে আর চালানো যায় না। আজ একজন রিকি বের হয়েছে, ভবিষ্যতে যদি দশজন রিকি বের হয়, তখন কী হবে?

সহকারী মেয়েটি নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করে বলল, মহামান্য রু, আপনার জন্য কিছু খাবার আনব?

না, এই তো খেলাম একটু আগে। বয়স হয়ে গেলে বেশি খিদে পায় না।

তা হলে কোনো ধরনের পানীয়? ফলের রস বা অন্য কিছু?

না না, কিছু লাগবে না। আমার জন্যে তুমি ব্যস্ত হয়ো না। যদি পার তা হলে দেখ আমাদের যাদুঘরের মহাপরিচালককে কোথাও পাওয়া যায় কী না। জরুরি কিছু নয়, এমনি একটু কথা বলব।

সহকারী মেয়েটি হাসি গোপন করে সরে গেল। মহামান্য রু নিজে থেকে একজন মানুষের সাথে দেখা করতে চাইছেন, এর থেকে জরুরি খবর পৃথিবীতে কি কিছু হতে পারে? কোমল স্বভাবের এই বৃদ্ধ কি সত্যি জানেন, কী প্রচণ্ড তাঁর ক্ষমতা?

 

কিছুক্ষণের মাঝেই রু তাঁর ঘরের হলোগ্রাফিক্স স্ক্রিনে যাদুঘরের মহাপরিচালককে দেখতে পেলেন। মহাপরিচালক দুই হাতে নিজের টুপি ধরে রেখে ফ্যাকাসে মুখে বললেন, মহামান্য রু, আপনি আমায় খোঁজ করছিলেন?

হ্যাঁ, করছিলাম। জরুরি কোনো ব্যাপারে নয়, এমনি একটা কাজে। কথার সুর পাল্টে বললেন, আপনার যাদুঘর কেমন চলছে?

ভালো, খুব ভালো। তাড়াতাড়ি কথা বলতে গিয়ে মহাপরিচালকের মুখে কথা জড়িয়ে যায়, গত মাসে আমরা নূতন একটা সভ্যতা আবিষ্কার করেছি, বিশ্বয়কর একটা সভ্যতা। অংশবিশেষ আমাদের যাদুঘরে আনা হয়েছে।

তাই নাকি? একদিন আসতে হয় দেখতে।

আসবেন? আপনি আসবেন মহামান্য রু? মহাপরিচালকের চোখ উত্তেজনায় চকচক করতে থাকে, আপনি শুধু আমাকে জানান, কবে আসবেন।

আমার নাতনি আমার সাথে দেখা করতে আসবে সামনের সপ্তাহে। তাকে নিয়ে আসব। নাতনির বয়স ছয়। সে কিছুতেই যাদুঘরে যেতে চাইবে না, বলবে চিড়িয়াখানাতে নিয়ে যেতে। আমি অবশ্যি যাদুঘরেই আসব। আমার খুব ভালো লাগে। যাদুঘরে যেতে।

যাদুঘরের মহাপরিচালক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না। কী বলবেন বুঝতে না পেরে প্রায় চিৎকার করে বললেন, যাদুঘরকে আমরা নূতন করে সাজাব। নূতন করে–

সে কী!

জ্বি। আপনি আসবেন, কত বড় সম্মান আমাদের যাদুঘরের জন্যে। মহামান্য রু, আপনার প্রিয় রং কি?

কেন?

আপনার প্রিয় রং দিয়ে পুরো যাদুঘর আমরা নূতন করে রং করে নেব।

সে কী! রু ব্যস্ত হয়ে বললেন, পুরো যাদুঘর রং করে ফেলবেন মানে? আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?

মহাপরিচালক একেবারে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, আপনার জন্য কিছু-একটা করতে চাই আমরা, আপনি আপত্তি করবেন না মহামান্য রু। আপনাকে বলতেই হবে কী রং আপনার প্রিয়।

রু এবার হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, সব রংই আমার পছন্দ। ক্যাটক্যাটে হলুদ একটা রং আছে, সেটা বেশি ভালো লাগে না, তা ছাড়া—

সব হলুদ রং সরিয়ে নেব আমরা। পুরো ব্লকে কোনো হলুদ রং থাকবে না। পুরো শহরে–

না না, সেটা করবেন না –কিছুতেই না।

তাহলে বলেন আপনার প্রিয় রং।

নীল, হালকা নীল।

নীল। যাদুঘরের মহাপরিচালক উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, আমার প্রিয় রং হালকা নীল। কী যোগাযোগ! কত বড় সৌভাগ্য আমার। পুরো যাদুঘর নূতন করে সাজাব অবিশ্বাস্যরকম সুন্দর করে–

রু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর কিছু করার নেই। যাদুঘরের মহাপরিচালকের ভাবাবেগ একটু কমে আসার পর বললেন, আপনার কাছে আমি একটা জিনিস জানতে চাইছিলাম।

বলুন মহামান্য রু।

আপনারা যাদুঘরের পক্ষ থেকে কয়েক বছর পরপর পৃথিবীর ছোটখাটো ব্যবহার্য জিনিস একটা বাক্সে করে মাটির নিচে পুঁতে রাখেন বলে শুনেছি। ভবিষ্যতের মানুষ দেখবে, দেখে আমাদের সময় সম্পর্কে একটা ধারণা করবে, সেজন্যে। ব্যাপারটা সত্যি নাকি?

সত্যি মহামান্য রু। আমরা দশ বছর পরপর এটা করে থাকি। গতবার আপনার লেখা একটা বই আমরা সেখানে রেখেছিলাম।

সেখানে কী কী জিনিস রাখা হয়?

সাম্প্রতিক ছায়াছবি, গানের রেকর্ড, জনপ্রিয় বই, খাবার, খেলনা, পোশাক–এই ধরনের জিনিস।

কোনো খবরের কাগজ কি রাখা হয়?

জ্বি, আমরা খবরের কাগজও রাখি। খবরের কাগজ এবং সাময়িকী।

এবারের কোন খবরের কাগজটি রাখবেন সেটি কি ঠিক করেছেন?

না, এখনো ঠিক করি নি।

আমি যদি বিশেষ একটি খবরের কাগজের কথা বলি–আপনারা কি সেটি রাখবেন?

অবশ্যি অবশ্যি রাখব। আপনি একটি খবরের কাগজ রাখতে চাইবেন, আমরা সেটি রাখব না, সেটি কি কখনো হতে পারে? মহামান্য রু, আপনার জন্যে যে-কোনো কাজ করতে পারলে আমরা আমাদের জীবন ধন্য হয়ে গেছে মনে করি। কোন কাগজটি রাখতে চাইছেন?

সেটি এখনো বের হয় নি, আজ-কালের ভিতরে বের হবে। সেখানে বিজ্ঞান আকাদেমির একজন সদস্য সম্পর্কে কিছু খবর থাকবে। অনেক ব্যক্তিগত খবর। খবরটা ভালো হবে না, দেখে সবাই খুব অবাক হয়ে যাবে। সেই খবরের কাগজটা রাখতে পারবেন?

অবশ্যই অবশ্যই—

যাই হোক, আপনি এখন কাউকে কিছু বলবেন না।

অবশ্যই বলব না, কাউকে বলব না, কিছুতেই বলব না। যাদুঘরের পরিচালক প্রচণ্ড কৌতূহলে ভিতরে ভিতরে হটে গেলেও সেটা বাইরে প্রকাশ করার সাহস পেলেন না।

রু আস্তে আস্তে বললেন, ঠিক আছে, তাহলে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমার সাথে খানিকক্ষণ সময় ব্যয় করার জন্য।

যাদুঘরের মহাপরিচালক মাথা নিচু করে অভিবাদন করে বিদায় নিয়ে হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

 

রিকি সবুজ রঙের সুইচটা স্পর্শ করতেই কানে তালা লাগানো শব্দে ইঞ্জিনটা চালু হল। কুরু মহাকাশযানের ইঞ্জিন হাইপারডাইতের জন্যে তৈরি, তার প্রচণ্ড শব্দে পুরো গবেষণাগার থরথর করে কাঁপতে থাকে। রিকি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ইঞ্জিনটাকে পুরোপুরি চালু হবার সময় দিল। সামনের প্যানেলে সবুজ বাতিটি জ্বলে উঠতেই সে লাল রঙের হ্যান্ডেলটা নিজের দিকে টেনে ধরে। সাথে সাথে সমস্ত শব্দ হঠাৎ যাদুমন্ত্রের মতো থেমে যায়। রিকি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, কিছু ভালো করে দেখা যায় না, কেমন যেন কুয়াশার মতো আবছায়া। সে এখন স্থির সময়ের ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। স্থির সময়ের ক্ষেত্র থেকে অন্য কোনো সময়ে পরিভ্রমণ করার কথা। রিকি দুই হাজার বছর সামনে এগিয়ে যেতে চায়—বর্তমান বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান তার জন্যে যথেষ্ট নয়। দুই হাজারের বেশী আগে যাওয়া সম্ভবত নিরাপদ নয়—মানুষের সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হয়তো এত বেশি হয়ে যাবে যে রিকি তাল মিলিয়ে থাকতে পারবে না।

রিকি সাবধানে কিছু সংখ্যা কন্ট্রোল বোর্ডে প্রবেশ করাতে থাকে। এই সংখ্যাগুলো তাকে দুই হাজার বছর ভবিষ্যতে নিয়ে যাবে। ভবিষ্যতের মানুষ অতীত থেকে আসা এই অসাধারণ বিজ্ঞানীকে দেখে বিস্ময়ে কেমন হতবাক হয়ে যাবে, চিন্তা করে রিকির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তাকে প্রথম যখন অভিবাদন করবে, উত্তরে বুদ্ধিদীপ্ত একটা কথা বলতে হবে—কী বলা যায়?

কন্ট্রোল প্যানেলে সংখ্যাগুলো দ্রুত পাল্টাতে থাকে। প্রতি মিনিটে রিকি একটি করে শতাব্দী পার হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ, তারপর রিকি পৌঁছে যাবে দুই হাজার বছর ভবিষ্যতে। না জানি কত রকম বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্যে।

 

ইঞ্জিনের গর্জন থেমে যাবার পর রিকি সাবধানে চেয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করে দরজা খুলে দিল। দরজার ওপাশে দুজন ফ্যাকাসে চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। লম্বায় তার থেকেও প্রায় অনেকটুকু উঁচু। গায়ে অধস্বচ্ছ এক ধরনের পোশাক, নিশ্চয়ই কোনো আশ্চর্য পলিমারের তৈরি। কোমর থেকে যে জিনিসটা ঝুলছে, সেটাকে দেখে এক ধরনের অস্ত্র বলে মনে হয়।

রিকি হাতের ছোট মাইক্রোফোনে মুখ লাগিয়ে বলল, আমি অতীত থেকে তোমাদের জন্যে শুভেচ্ছা নিয়ে এসেছি।

মাইক্রোফোনটি শক্তিশালী অনুবাদকের সাথে যুক্ত—দুই হাজার বছরে ভাষায় যে পরিবর্তন হয়েছে, সেটা হিসেব করে সঠিক ভাষায় পাল্টে দেয়ার কথা।

লোক দুটি একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। একজন তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে এগিয়ে গিয়ে পরিষ্কার রিকির ভাষায় বলল, শুভেচ্ছা পরে হবে, আগে ফর্মটাতে তোমার নাম–ঠিকানা লেখ–

রিকি উত্তপ্ত হয়ে বলল, তুমি বুঝতে পারছ না—

লোকটা বাধা দিয়ে বলল, খুব বুঝতে পারছি যে তুমি একজন বড় বিজ্ঞানী। যারা অতীত থেকে আসে সবাই দাবি করে তারা বড় বিজ্ঞানী। প্রতিদিন অন্তত দু-চারজন করে আসছে, কাজেই আমাদের এত সময় নেই। ভবিষ্যতে আসা সোজা—কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে অতীতে যাওয়া যায় না। তা হলে ধরে ধরে সবগুলোকে ফেরত পাঠাতাম। তুমি কি ভাব, তোমার এই আজব ভাষায় কথা বলতে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে?

রিকি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এটা কী ধরনের অভ্যর্থনা।

লোকটা গলার স্বর উঁচু করে বলল, তাড়াতাড়ি নাম-ঠিকানা লেখ, কেন এসেছ, কী বৃত্তান্ত—সবকিছু। কোয়ারান্টাইনে নিয়ে তোমাকে পরীক্ষা করতে হবে। এখন কী কী রোগজীবাণু এনেছ সাথে?

রিকি কাঁপাহাতে ফর্মটি পূরণ করতে থাকে। নিজের চোখ-কানকে তার বিশ্বাস হয় না, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী সে, অথচ তার সাথে এমনভাবে ব্যবহার করছে, যেন সে একজন তৃতীয় শ্রেণীর অপরাধী।

ফর্মটি পূরণ করে রিকি লোকটির হাতে দেয়। লোকটি ভ্রূ কুঁচকে পুরোটা চোখ বুলিয়ে হাতের উল্টো পিঠের ছোট মাইক্রোফোনে কথা বলতে থাকে, অতীত থেকে আরেকজন এসেছে। দাবি করছে সে বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্য ছিল। মনে আছে, একজন দাবি করেছিল সে নাকি যীশুখ্রিস্ট। হাঃ হাঃ হাঃ।

রিকি লোকটার কথা বুঝতে পারে না, কিন্তু ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে। রিকি বুঝতে পারে, প্রচণ্ড ক্রোধের সাথে সাথে আরো একটা অনুভূতি তার ভিতরে ছড়িয়ে পড়ছে, যেটার সাথে তার ভালো পরিচয় নেই–অনুভূতিটি ভয়ের।

দ্বিতীয় লোকটি তার পকেট থেকে চৌকোণা একটা যন্ত্র বের করে ফর্মটি দেখে দেখে রিকির নামটি লিখতে থাকে। রিকি কৌতূহলী হয়ে তাকাল, সম্ভবত একটি কম্পিউটার, কোনো কেন্দ্রীয় ডাটা বেসের সাথে যুক্ত। তার সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে।

লোকটি নিস্পৃহ দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ কিছু-একটা দেখে চমকে উঠল, চোখ বড় বড় করে তাকাল একবার রিকির দিকে। তারপর আবার তাকাল স্ক্রিনের দিকে।

তোমার নামে আমাদের একটা ফাইল আছে। আমার নামে?

হ্যাঁ। ফাইলে একটা খবরের কাগজের কাটিংও আছে। সেখানে তোমার সম্পর্কে বড় খবর। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট করে পালিয়ে গিয়েছিলে, শীকে খুন করেছিলে নিজের হাতে লেখা আছে, তুমি অনেক বড় ক্রিমিনাল!

লোক দুটির গায়ে প্রচণ্ড জোর, খুব সহজে রিকির হাত দুটি পিছনে টেনে হাতকড়া লাগিয়ে দিল। সামনে যাবার ইঙ্গিত করে একজন মাথা নেড়ে বলল, আমি জীবনে অনেক আহাম্মক দেখেছি, কিন্তু প্রেসির মতো আহাম্মক আর দেখি নি।

 

রিকি মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়।

০২. সময়ের অপবলয়

অভ্যাসমতো দরজায় তালা লাগানোর পর হঠাৎ করে রিগার মনে পড়ল আজ আর ঘরে তালা লাগানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। সে যেখানে যাচ্ছে, সেখান থেকে সে সম্ভবত আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। ব্যাপারটি চিন্তা করে একটু আবেগে আপত হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়, কিন্তু রিগার সেই সময়টাও নেই। এখন রাত তিনটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিট, আর ঘণ্টা দুয়েকের মাঝেই ভোরের আলো ফুটে উঠবে। সে যেটা কতে যাচ্ছে, তার প্রথম অংশটা ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই শেষ করতে হবে।

ছোট ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রিগা নিচে নেমে এল। বাকি জিনিসগুলো আগেই বড় ভানটিতে তুলে নেয়া হয়েছে। সে গত পাঁচ বছর থেকে এই দিনটির জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, খুঁটিনাটি সবকিছু অসংখ্যবার যাচাই করে দেখা হয়ে গেছে, কোথাও কোনো ভুল হবার অবকাশ নেই, তবে ভাগ্য বলে যদি সত্যি কিছু থাকে এবং সে ভাগ্য যদি বেঁকে বসে, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। ছোট ব্যাগটা পাশে রেখে রিগা তার ভ্যানটির সুইচ স্পর্শ করামাত্র সেটি একটি ছোট ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করে। কোন পথে কোথায় যেতে হবে বহুকাল আগে প্রোগ্রাম করে রেখেছে। ভ্যানটি নিঃশব্দে সেদিকে যাত্রা শুরু করে দেয়। নিরীহদর্শন এই ভ্যানটি দেখে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু এটি অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা রাখে।

আবাসিক এলাকার ছোট রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে ভ্যানটি হ্রদের তীরের বড় রাস্তায় উঠে পড়ল। রাস্তাটি এরকম সময় নির্জন থাকে। একেবারে মাটি ছুঁয়ে যাওয়া যায়। এ এলাকায় শীতকালে হাড়-কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস হু-হু করে বইতে থাকে, বসন্তের শুরুতে এতটা খারাপ হবার কথা নয়। রিগা জানালাটা একটু নামিয়ে দেখল, হ্রদের ঠাণ্ডা ভিজে বাতাসের সাথে সাথে সারা শরীর শিউরে ওঠে। রিগা দ্রুত আবার জানালাটা তুলে দেয়। দুহাত একসাথে ঘষে শরীরটা একটু গরম করে সে আকাশের দিকে তাকাল। শুক্লপক্ষের রাত, আকাশে ভাঙা একটা চাঁদ উঠেছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রিগার মনটা হঠাৎ একটু বিষণ্ণ হয়ে যায়। পরিচিত এই পৃথিবীটার জন্যে—যেটা কখনো ভালো করে তাকিয়ে দেখে নি, তার বুকটা হঠাৎ টনটন করতে থাকে।

রিগা জোর করে নিজেকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনে। একটু পরেই সে যে জিনিসটি করতে শুরু করবে তার খুঁটিনাটি মনে মনে আরো একবার যাচাই করে দেখা দরকার।

 

ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল এভাবে।

সংবিধানে দুশ বছর আগে একটা সংশোধনী যোগ করা হয়েছিল। সংশোধনীটা এরকম : ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত তথ্যাবলী পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী।

সংশোধনীটি বিচিত্র, কিন্তু এই সংশোধনীটির জন্যে যেটা ঘটল, সেটি আরো বিচিত্র। পৃথিবীর তথ্য নিয়ন্ত্রণকারী যাবতীয় কম্পিউটার পৃথিবী থেকে ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত সকল তথ্য সরিয়ে নিতে শুরু করল। এক শ বছর পর পৃথিবীর ইতিহাসে এই বিপর্যয়ের উপর আর কোনো তথ্য থাকল না। এক শ বছর আগে কোনো-এক এপ্রিল মাসের উনিশ তারিখে পৃথিবীতে কোনো-এক ধরনের বিপর্যয় ঘটেছিল। যেহেতু এ সংক্রান্ত যে-কোনো তথ্য পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী, কাজেই সংবিধানের এই সংশোধনীটিও হঠাৎ একদিন সরিয়ে নেয়া হল। ব্যাপারটি ঘটেছিল প্রায় পনের বছর আগে, তখন রিগার বয়স তিরিশ।

হঠাৎ করে সংশোধনীটি সরিয়ে নেবার পর ব্যাপারটি নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল হয়েছিল। সান্ধ্য খবরের বিশেষ ক্লেম কার্ড বের হল, সেটা নিয়ে সবাই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে। তরুণ অনুসন্ধানীরা কম্পিউটার ঘাঁটাঘাঁটি করে নানারকম তন্তু দিতে শুরু করে। কেউ বলল, জিনেটিক পরিবর্তন করে একধরনের অতিমানব তৈরি করা হয়েছিল, যারা পৃথিবী ধ্বংস করতে চাইছিল। কেউ বলল, গ্রহান্তরের আগন্তুক পৃথিবীতে হানা দিয়ে তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছিল। আবার কেউ বলল, বায়োকেমেস্ট্রির এক ল্যাবরেটরি থেকে ভয়ংকর এক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর জীবজগৎকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়েছিল। সবই অবশ্যি উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা, কারণ এইসব তত্ত্বকে সত্যি বা মিথ্যা কোনোটাই প্রমাণ করার মতো কোনো তথ্য পৃথিবীর ডাটা বেসে নেই, সব একেবারে ঝেড়েপুছে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

বছরখানেক পর সবার কৌতূহল থিতিয়ে এল। শুধুমাত্র জল্পনা-কল্পনা করে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত তথ্য পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী বলে সেটা নিয়ে প্রকাশ্যে গবেষণা করাও সম্ভব নয়, কোনো কম্পিউটারই সাহায্য করতে পারে না। তার ফলে বছর দুয়েকের মাঝেই পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয় অজ্ঞাত থেকে যাবে, এই সত্যটি মোটামুটিভাবে মেনে নিল। একজন ছাড়া, সে হচ্ছে রিগা।

রিগা এমনিতে কম্পিউটারের দ্রোন ভাষার উপর কাজ করে। ভাষাটি সহজ নয়, এই ভাষায় প্রোগ্রাম করার যে কয়টি বাড়তি সুবিধে, তাতে পৃথিবীর মানুষের বেশি উৎসাহ নেই। জেই সে পৃথিবীর প্রথম সারির একজন প্রোগ্রামার হয়েও মোটামুটিভাবে সবার কাছে অপরিচিত। দ্রোন ভাষার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি সমস্যাকে কখনো সোজাসুজি সমাধান করার চেষ্টা করে না, কাজেই সবাই হাল ছেড়ে দেবার পরও রিগা কম্পিউটারে ১৯শে এপ্রিল বিপর্যয়ের তথ্য খুঁজে বেড়াতে থাকে। কম্পিউটার তাকে সন্দেহ করে না সত্যি, কিন্তু সে কোনো তথ্য খুঁজে বের করতে পারে না। এইভাবে আরো দুই বছর কেটে যায়।

রিগার বয়স যখন চৌত্রিশ, পারিবারিক ব্যাপারে বিশেষ মন দেয় না বলে তখন তার স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। তাদের একমাত্র ছেলেটিকে নিয়ে তার স্ত্রী একদিন পৃথিবীর অন্য পৃষ্ঠে চলে গেল। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ছেলেটিকে প্রায় সত্যিকার মানুষের মতোই জীবন্ত দেখায়, কিন্তু মাঝেমাঝে রিগার খুব ইচ্ছে করত ছেলেটিকে খানিকক্ষণ বুকে চেপে রাখে। কিন্তু ছেলেটি ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে সরে যেতে থাকে। আজকাল হলোগ্রাফিক স্ক্রিলে তার দেখা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এরকম সময়ে রিগা একদিন তার ছেলের সাথে দেখা করতে গেল।

রিগা তার ছেলের কাছে একজন অপরিচিত মানুষের মতো, তাই সঙ্গত কারণেই ছয় বছরের এই শিশুটি তার বাবাকে দেখে খুব বেশি উচ্ছ্বাস দেখাল না। রিগা খানিকক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করে খুব সুবিধে করতে পারল না, শিশুদের সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয় সে জানে না। ছেলের সাথে ভাব করার আর কোনো উপায় না দেখে রিগা একসময়ে তার পকেট থেকে রেম কার্ডটি বের করে, সেখানে দৈনন্দিন খবর ছাড়াও প্রাগৈতিহাসিক জন্তু-জানোয়ারের উপর একটি দুর্লভ অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত এই শিশুটির মন জয় করতে সক্ষম হয়। ঘরের মাঝখানে সত্যিকার জীবন্ত প্রাণীদের মতো হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবিগুলো দেখে বাচ্চাটি হাততালি দিয়ে লাফাতে থাকে। বাচ্চাদের হাসি থেকে সুন্দর কিছু নেই, কিন্তু রিগার যে জিনিসটি প্রথমে চোখে পড়ল, সেটি হচ্ছে তার ফোকলা দাঁত। ছয় বছর বয়সে শিশুদের দুধদাঁত পড়ে নূতন দাঁত ওঠা শুরু করে। বাচ্চাটির দাঁত সবে পড়েছে, এখনো নূতন দাঁত ওঠে নি, তাই প্রতিবার হাসার সময় ফোকলা দাঁত বের হয়ে পড়ছে।

বাচ্চাটির ফোকলা দাঁতটি দেখে হঠাৎ করে রিগা বুঝতে পারে, ১৯শে এপ্রিলের রহস্য কেমন করে সমাধান করতে হবে। রহস্যটি হচ্ছে বাচ্চাটির ফোকলা দাঁতের মতন, সেটি নেই, কারণ তার সম্পর্কে সব তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কেউ যদি সেটাকে খোঁজে কখনো, কিছু পাবে না। কিন্তু ফোকলা দাঁতের অস্তিত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, কারণ প্রত্যেকবার হাসার সময় দেখা যাচ্ছে একটি দাঁত নেই। ১৯শে এপ্রিলের রহস্যও ঠিক সেরকম, সেটি সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই, কিন্তু অন্য সব তথ্যগুলোকে খুঁজে দেখলেই দেখা যাবে সেখানে একটা অসম্পূর্ণতা রয়েছে। সেই অসম্পূর্ণতাই হচ্ছে ১৯শে এপ্রিলের রহস্য। যে কাল্পনিক তথ্য সেই অসম্পূর্ণতাকে দৃঢ় করতে পারবে, সেই তথ্যই হবে এই রহস্যের সমাধান।

রিগা পরবতী চরিশ ঘণ্টা তার ছেলের সাথে সময় কাটালেও মনে মনে সে পরবর্তী কর্মপন্থা ছকে ফেলল। দ্রোন ভাষায় যে নূতন কম্পিউটার প্রোগ্রামটি লিখতে হবে, সেটির কাঠামোও সে মনে মনে ঠিক করে নিল। বহুদিন পর সে বুকের ভিতরে কৈশোরের উত্তেজনা অনুভব করতে থাকে।

 

কম্পিউটার প্রোগ্রামটি দাঁড় করাতে প্রায় বছরখানেক সময় লেগে গেল, সেটি থেকে ভুলভ্রান্তি সরিয়ে পুরোপুরি কাজের উপযোগী করতে লাগল আরো দুই বছর। তৃতীয় বছরের গোড়ার দিকে রিগা প্রথমবার তার প্রোগ্রামটি পৃথিবীর বড় বড় ডাটা বেসে অনুপ্রবেশ করিয়ে দিল। সুদীর্ঘ সময় ব্যয় করে সেটি জানাল, পৃথিবীর তথ্যভাণ্ডারে যেসব তথ্যের মাঝে বড় ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে, সেগুলো দূর করা যায়, যদি এই কয়টি জিনিস কল্পনা করে নেয়া যায়।

(এক) আজ থেকে প্রায় দু শ বছর আগে পাশাপাশি দুটি শহরে ত্রিনি ও লিক নামে দুজন মানুষের জন্ম হয়েছিল। এ

(দুই) প্রায় সমবয়সী এই দুজন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন।

(তিন) তাঁদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল সময়ের অপবলয়।

(চার) প্রায় দু শ পনের বছর আগে ত্রিনি ও লিক সময়ের অপবলয়সংক্রান্ত একটি পরীক্ষা করার চেষ্টা করেন। পরীক্ষাটি ঠিকভাবে শেষ হয় নি।

(পাঁচ) তাঁরা যেখানে পরীক্ষাটি করেছিলেন, সেখানে, সম্ভবত একটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। সম্ভবত সেখানে তাঁরা একটি সুড়ঙ্গের মতো সৃষ্টি করেন, যেটি বিশ্বব্রহ্মায়ে বাইরের সাথে যোগাযোগ করে দেয়।

(ছয়) ত্রিনি ও লিক সেই সুড়ঙ্গপথে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে ছিটকে পড়েন, কারণ তাঁদের কখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি।

(সাত) এই সুড়ঙ্গের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়, কারণ সমস্ত পৃথিবী এই পথ দিয়ে গলে বের হয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

 

বিস্ময়কর এই তথ্য রিগার কৌতূহলকে নিবৃত্ত না করে আরো বাড়িয়ে দেয়। সত্যিই কি ত্রিনি ও লিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরের সাথে একটি সুড়ঙ্গমুখ খুলে দিয়েছেন? সত্যিই কি সেই পথে বেরিয়ে যাওয়া যায়? সত্যিই কি পুরো পৃথিবী এই পথে বের হয়ে যেতে পারে?

এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার একটিমাত্র উপায়—ত্রিনি ও লিক যেখানে পরীক্ষাটি করেছিলেন, সেটি খুঁজে বের করা।

রিগার জন্যে সেটা খুঁজে বের করা খুব কঠিন হল না। দেখা গেল, ত্রিনি ও লিক সেই পরীক্ষাটি করেছিলেন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি কক্ষে। সেই কক্ষটি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে তাকে ঘিরে প্রায় চল্লিশ বর্গমাইল এলাকার উপর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পাথর এবং কংক্রিট ঢালা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের হ্রদের তীরে যে ছোট পাহাড়টি বসন্তকালে অসংখ্য ফুলে ঢেকে যায়, সেটি একটি কৃত্রিম পাহাড়, এই তথ্যটি পৃথিবীতে রিগা ছাড়া আর কেউ জানে না। পাহাড়ের প্রায় হাজার দুয়েক ফুট নিচে একটি ছোট বিজ্ঞানাগারে ত্রিনি ও লিক একটি অসাধারণ পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই পরীক্ষাটি কী ধরনের বিপর্যয়ের সূত্রপাত করেছিল আজ রিগা সেই রহস্য ভেদ করতে যাচ্ছে।

এর জন্যে রিগা প্রায় পাঁচ বছর প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রথমত সে তার কাজ বদল করে উত্তরাঞ্চলের সেই শহরে চলে এসেছে। শহরের এক পাশে হ্রদ, অন্য পাশে ছোট পাহাড়টি গ্রীষ্মকালে অনেক ভ্রমণবিলাসী মানুষকে আকর্ষণ করে, কিন্তু এমনিতে সারা বছর বেশ নিরিবিলি। ছোট এই শহরে দ্রোন ভাষায় অভিজ্ঞ কম্পিউটার প্রোগ্রামারের উপযোগী লেননা কাজ নেই বলে সে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের একটি কারখানায় কাজ করে। অবসর সময়ে সে শব্দতরঙ্গ দিয়ে ঘনত্ব মাপার একটা যন্ত্র তৈরি করেছে, সেই যন্ত্রটি দিয়ে ধীরে ধীরে সে পুরো পাহাড়টি পর্যবেক্ষণ করেছে। পাহাড়ের নিচে কোথায় সেই রহস্যময় গবেষণাগারটি লুকিয়ে রয়েছে সেটাও খুঁজে বের করেছে। সেই গবেষণাগারে পৌঁছানোর জন্যে পাহাড়ের কোন অংশ দিয়ে যাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ, সেটাও নির্ধারণ করেছে। পাহাড় কেটে একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করে ভিতরে ঢুকে যেতে কী ধরনের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন অনুমান করার চেষ্টা করেছে। তারপর সেইসব যন্ত্রপাতি দিয়ে এই ভ্যানটি তৈরি করেছে। নিরীহদর্শন এই ভ্যানটির ভিতরে রয়েছে চারটি শক্তিশালী কুরু ইঞ্জিন। প্রয়োজনে সামনের অংশটি খুলে সেখান থেকে কার্বন হীরের পাথর কাটার একটা অতিকায় উিল বের হয়ে আসে। শক্তিশালী ইঞ্জিনের প্রচণ্ড ঘূর্ণনে সে ডিল পাথর কেটে পুরো ভ্যানটাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে যাবে। ভ্যানের মাঝে রয়েছে শক্ত পাম্প, সামনের কাটা পাথর সেটি সরিয়ে আনে পিছনে। পাহাড়ের যে অংশ দিয়ে রিগা ভিতরে ঢুকবে, সে অংশটি লতাগুলা দিয়ে ঢাকা। কেউ সেদিকে যায় না, যাবার রাস্তাও নেই। কেউ সহজে জানতে পারবে না যে রিগা এদিক দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। প্রবেশপথ ঢেকে যাবে কাটা পাথরে, বসন্তের বৃষ্টিতে নৃতল গাছগাছালি গজিয়ে ঢেকে ফেলবে সেই জায়গা।

 

হ্রদের তীর দিয়ে ঘুরে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছাতেই রিগা তার ভ্যানের হেড লাইট নিভিয়ে দিল। তার হিসেবমতো চাঁদ ডুবে গিয়ে চারদিকে এখন গাঢ় অন্ধকার। রিগা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নেয় যে কেউ তার পিছু নেয় নি। তারপর অন্ধকারেই ভ্যানটিকে চালিয়ে গাছগাছালির ভিতর দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে এনে হাজির করে। আজকের অভিযানের প্রথম অংশ পরিকল্পনামতোই কোনো সমস্যা ছাড়া শেষ হয়েছে।

রিগা সাবধানে ভ্যান থেকে নেমে তার ইনফ্রারেড চশমাটি পরে নেয়, সাথে সাথে অন্ধকার দূরীভূত হয়ে চারদিকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রিগা সাবধানে চারদিকে তাকায়, কোথাও কিছু নেই, শুধুমাত্র একটি নিশাচর রাকুন খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা গাছের গুড়িতে লুকিয়ে যায়। রিগা কয়েক পা এগিয়ে যায়, অনেক ধরনের যন্ত্রপাতিতে বোঝাই বলে ভ্যানটি মাটির উপরে উঠতে পারে না, সময় সময় চাকার গর্ত রেখে আসে। তাকে এখন সাবধানে এইসব চাকার দাগ মুছে ফেলতে হবে। রিগা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে তার কাজ শুরু করতে এগিয়ে যায়।

হিসেব মতন ভোর পাঁচটা দশ মিনিটে রিগা তার ভ্যানটি চালু করল। ঠিক এই সময়ে শহরের বড় জেনারেটরটি চালু করা হয়। তার শক্তিশালী ভ্যানটি পাথর কেটে ভিতরে ঢুকে যাবার সময় বাড়তি যে কম্পন সৃষ্টি করবে, সেটা কোথাও ধরা পড়বে না। রিগা ঘড়ি দেখে ঠিক সময়ে ভ্যানের কন্ট্রোল প্যানেলের নির্দিষ্ট সুইচটি স্পর্শ করে, সাথে সাথে সামনের অংশটি খুলে অতিকায় ট্রিলটি বের হয়ে আসে, প্রচণ্ড ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়, তারপর সেটি পাথরকে স্পর্শ করে। আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ছিলটি পাথর কেটে ছোট একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করে ফেলল। ভ্যানটি ধীরে ধীরে পাহাড়ের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যাবার সময় রিগা একবার পিছনে তাকাল, ইনফ্রারেড চশমায় অন্ধকার পৃথিবীটিকে তার কাছে অলৌকিক মনে হয়। এই পৃথিবীটিকে সে হয়তো আর কোনো দিন দেখবে না। পৃথিবীর সাথে তার আর কোনো যোগাযোগ রইল না—কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে রেখে আসা তার ডাইরিটা ছাড়া। সেই ডাইরির খোঁজ কখনো কি কেউ পাবে?

রিগা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকে। ভ্যানটি প্রচণ্ড গর্জন করে একটি অতিকায় শুঁয়োপোকার মতো পাথরে গর্ত করে নির্দিষ্ট দিকে এগুতে থাকে।

 

ল্যাবরেটরি ঘরের সামনে ভ্যানটি দাঁড় করিয়ে রিগা মাস স্পেকট্রোমিটারটি চালু করে। বাতাসে নিঃশাস নেবার উপযোগী যথেষ্ট অক্সিজেন রয়েছে। কিন্তু বিষাক্ত কোনো গ্যাস রয়েছে কী না জানা দরকার। তার কাছে অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে, কিন্তু সেটা ব্যবহার করতে না হলে কাজকর্মে সুবিধে হয়। রিগা স্পেকটোমিটারটির স্ক্রিনে ভালো করে তাকায়, বিচিত্র কিছু গ্যাস রয়েছে, রেডনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি, কিন্তু বিষাক্ত কোনো গ্যাস নেই। রিগা জানালা অল্প একটু খুলে নিঃশ্বাস নেয়, একটু ভ্যাপসা গন্ধ বাতাসে, কিন্তু খানিকক্ষণেই অভ্যাস হয়ে যাবার কথা।

ল্যাবরেটরির সামনে দু শ বছরের ভারি পুরানো ওক কাঠের দরজা। সম্ভবত সে সময়ে এ রকম দরজার প্রচলন ছিল। দরজার উপর ধুলায় ধূসর একটি সাইনবোর্ড, সেখানে বড় বড় করে লেখা, প্রবেশ নিষেধ, আইন অমান্যকারীকে তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড।

রিগা চারদিকে তাকায়, একসময় নিশ্চয়ই আশেপাশে কড়া পাহারা ছিল, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে প্রহরীরা তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্যে অপেক্ষা করত। দু শ পনের বছর পর সেই প্রহরীরা নেই, কিন্তু অন্য কোনো ধরনের সাবধানতা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে কী না কে জানে? রিগা সাবধানে পরীক্ষা করে কিছু না পেয়ে হাতের রাস্তার দিয়ে দরজাটি খুলে ফেলল।

ভিতরে একটা লম্বা করিডোর। হাতের আলোটা উপরে তুলে রিগা চারদিকে তাকাল। দূরে একটা দরজা। করিডোরের দেয়ালে কিছু ছবি, কিছু পুরানো কম্পিউটারের মনিটর। ধুলায় সব কিছু ঢেকে আছে। রিগা সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায়। সমস্ত ল্যাবরেটরিতে সমাধিক্ষেত্রের নীরবতা।

করিডোরের শেষ মাথার দরজাটিও বন্ধ। বাইরে আরেকটা সাইনবোর্ড, সেখানে আবার বড় বড় করে সাবধান বাণী লেখা। ভিতরে প্রবেশ নিষেধ এবং প্রবেশ করার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড পাশে একটি নোটিশ বোড়, রিগা সাবধানে ধুলা ঝেড়ে ভিতরে তাকাল। ভিতরে একটা ছবি। চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের দুজন হাসিখুশি মানুষ একটি চতুষ্কোণ বাক্সের মতো জিনিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে লেখা, প্রফেসর ত্রিনি ও প্রফেসর লিক তাদের সময় অপবলয় ক্ষেত্রের সামনে। দুজনই নিরীহ এবং হাসিখুশি চেহারার মানুষ, প্রফেসর ত্রিনির সামনের চুল হালকা হয়ে এসেছে, প্রফেসর লিকের মুখে বেমানান গোঁফ।

রিগা দীর্ঘ সময় ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই দুজন সেই রহস্যময় বিজ্ঞানী, যাঁরা নিজেদের অগোচরে সমস্ত পৃথিবীকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিলেন, যাঁরা বিস্ময়কর এক সুড়ঙ্গপথে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে ছিটকে পড়েছেন। রিগা আজ আবার পরীক্ষা করবে সেই বিস্ময়কর সুড়ঙ্গপথ। সে নিজেও কি ছিটকে পড়বে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে? সেও কি সমস্ত পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে টেনে নিয়ে যাবে নিজের অগোচরে?

করিডোরের দরজাটি ভালো করে পরীক্ষা করে রিগা খুব সহজেই তার ব্লাস্টারটি দিয়ে খুলে ফেলল। ভিতরে বিশাল একটা হলঘরের মতো, চারদিকে অসংখ্য অতিকায় যন্ত্রপাতি, আবছা আলোতে ভুতুড়ে এক জায়গার মতো লাগছে। রিগা সাবধানে পা ফেলে ভিতরে এগিয়ে যায়। হলঘরের মাঝামাঝি চতুষ্কোণ বাক্সের মতো ছোট একটা ঘর। চারদিক থেকে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, নানারকম তার এবং কেবল এই ঘরের মাঝামাঝি এসে জমা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে এটাই হচ্ছে সময়ের অপবলয় ক্ষেত্র। ঘরটা ঘুরে ঘুরে রিগা খুব ভালো করে পরীক্ষা করল। এক পাশে গোলাকার একটা দরজা, অসংখ্য স্ক্রু দিয়ে সেটি শক্ত করে লাগানো। দেখে মনে হয় এই স্ক্রুগুলো পরে লাগানো হয়েছে। রিগা ভালো করে দরজাটি পরীক্ষা করল। মাঝামাঝি জায়গায় বিভিন্ন ভাষায় ছোট একটি ঘোষণাপত্র লাগানো হয়েছে, তাতে লেখা এই দরজার অন্য পাশে যা রয়েছে সেটি এ পাশের কারো জানার কথা নয়। অন্য পাশের একটি পরমাণও যদি পৃথিবীর এই অংশে উপস্থিত হয় সমস্ত পৃথিবী ধ্বংসের সম্ভাবনা রয়েছে। আপনি যে ই হয়ে থাকুন এই দরজা স্পর্শ না করে ফিরে যান।

রিগা তার ব্যাগ নিচে রেখে কাছাকাছি একটা জায়গায় পা মুড়ে বসে পড়ে। সে কি দরজায় স্পর্শ না করে ফিরে যাবে? সেটি তো হতে পারে না, এত কষ্ট করে এতদূর এসে সে তো রহস্য ভেদ না করে যেতে পারে না। পৃথিবী ধ্বংস হোক সেটা সে চায় না, কিন্তু প্রফেসর ত্রিনি এবং লিক তত পৃথিবী ধ্বংস না করেই এই রহস্যের সৃষ্টি করেছেন, সে কেন পারবে না?

রিগা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দরজাটি লক্ষ করে। ছোট ছোট করে অনেক কিছু লেখা রয়েছে, গোলাকার দরজাটি দেখেও কিছু আশা করা যায়। এই দরজাটি কয়েকটা স্তরে ভাগ করা রয়েছে। ভিতরের একটি পরমাণুকেও বাইরে আসতে না দিয়ে একজন মানুষের ভিতরে ঢোকা সম্ভব—তার জন্যে সে রকম প্রস্তুতি নিতে হবে। অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ কাজটি শুরু করার আগে রিগা একটু বিশ্রাম নিয়ে নেবে ঠিক করল।

ব্যাগ থেকে কিছু শুকনো খাবার বের করে খেয়ে নিয়ে রিগা দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজলে।

পাহাড়ের নিচে দুই হাজার ফুট পাথরের আড়ালে সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এত বড় একটা রহস্যের মুখোমুখি এসে চট করে চোখে ঘুম আসতে চায় না, কিন্তু সমস্ত দিনের পরিশ্রমে শরীর এত ক্লান্ত হয়েছিল যে সত্যি একসময় তার চোখ বুজে এল।

তার ঘুম হল ছাড়াছাড়াভাবে, সারাক্ষণই স্নায়ু ছিল সজাগ, তাই একটুতেই ঘুম ভেঙে সে পুরোপুরি জেগে উঠছিল। তবুও ঘণ্টা দুয়েক পর সে খানিকটা সতেজ অনুভব করে। উঠে বসে সে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। এই দরজার অন্য পাশে রয়েছে সেই রহস্যময় জগৎ, সাবধানে তাকে সেই রহস্যের উন্মোচন করতে হবে। যন্ত্রপাতি নামিয়ে সে কাজ শুরু করে।

দরজাটি অনেকটা মহাকাশযানের দরজার মতো, মহাকাশের পুরোপুরি বায়ুশূন্য পরিবেশে যাবার আগে যেরকম একটা ছোট কুঠুরিতে ঢুকে সেটাকে সবকিছু থেকে আলাদা করে ফেলতে হয়, সেরকম। প্রথম দরজাটি খুলে সে একটা ছোট কুঠুরিতে ঢুকে বাইরের দরজা বন্ধ করে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি কেটে দেবার পরই শুধু পরবর্তী দরজাটি খোলা সম্ভব। এর ফলে বাইরের জগৎ থেকে কোনোকিছু ভিতরে আসতে পারলেও, ভিতর থেকে কিছু বাইরে যেতে পারবে না। বাইরে সেটা নিয়েই বড় সাবধান বাণী লেখা রয়েছে–ভিতর থেকে যেন একটি পরমাণুও বাইরে আসতে না পারে।

দরজার পরবর্তী স্তরটি আরো জটিল। বিদ্যুৎপ্রবাহ ছিল না বলে সেটা সম্পূর্ণ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু রিগার ব্যাগের হোট একটা জেনারেটর তাকে উদ্ধার করল। দ্বিতীয় স্তরটি থেকে তৃতীয় স্তরে যেতে তার পুরো তিন ঘণ্টা সময় বের হয়ে গেল। তৃতীয় স্তরের কাজটি তুলনামূলকভাবে সহজ। স্ক্রুগুলো খুলে হাতলে চাপ দিতেই দরজাটি খুব সহজে খুলে গেল। ভিতরে আলো জ্বলছে। রিগা দরজাটি উন্মুক্ত করে ভিতরে উঁকি দিল।

ঘরের ঠিক মাঝামাঝি অংশে কিছু জটিল যন্ত্রপাতির সামনে উবু হয়ে বসে আছে দুজন মানুষ, দরজা খোলার শব্দ শুনে মাথা ঘুরে তাকিয়েছে দুজন রিগার দিকে। রিগা চিনতে পারল দুজনকেই, একজন প্রফেসর ত্রিনি, আরেকজন প্রফেসর লিক। গত দু শ পনের বছরে তাঁদের চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় নি। প্রফেসর ত্রিনি ভুরু কুঁচকে রয়েছেন, মনে হচ্ছে কোনো কারণে খুব বিরক্ত হয়েছেন, এগিয়ে এসে বললেন, ভিতরে আসতে কাউকে নিষেধ করেছি, তুমি জান না?

বাচনভঙ্গি ভিন্ন ধরনের। গত দু শ বছরে ভাষার বেশি পরিবর্তন হয় নি, কিন্তু বাচনভঙ্গি অনেকটুকু পাল্টেছে। পরিবর্তনটুক খুব সহজে রিগার কানে ধরা পড়ল।

প্রফেসর ত্রিনি আবার বললেন, তোমাকে তো আগে কখনো দেখি নি, কার সাথে তুমি কাজ কর?

রিগা কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, যন্ত্রপাতির মাঝে উবু হয়ে বসে থেকে প্রফেসর লিক বললেন, ত্রিনি, দেখবে এস, ট্রনোট্রনে কোনো পাওয়ার নেই।

পাওয়ার নেই? কী বলছ তুমি। প্রফেসর ত্রিনি দ্রুত লিকের কাছে এগিয়ে গেলেন, বললেন, একটু আগেই তো ছিল।

তোমাকে আমি বলেছিলাম না, এই পাওয়ার সাপ্লাইগুলো একেবারে যাচ্ছেতাই। একট লোড বেশি হলেই ধসে যায়। এখন দেখ কী যন্ত্রণা–

প্রফেসর ত্রিনি মাথা চুলকে বললেন, তাই তো দেখছি। ভাবলাম পাওয়ার সাপ্লাইয়ে পয়সা নষ্ট করে লাভ কি।

এখন বোঝ ঠ্যালা, পুরোটা খুলে ওটা বের করে আনতে জানটা বের হয়ে যাবে না?

আমাকে দাও, আমি করছি। প্রফেসর ত্রিনি বড় একটা পাওয়ার কু-ড্রাইভার নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। রিগা যে কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, সেটা মনে হচ্ছে দুজনেই পুরোপুরি ভুলে গেছেন।

রিগা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডারে বড় বড় করে লেখা-১৯শে এপ্রিল, মঙ্গলবার। উপরে বড় একটা ঘড়িতে সময় দেখানো হচ্ছে, সকাল সাড়ে এগারটা—এই চতুষ্কোণ ঘরটিতে সময় স্থির হয়ে আছে এবং এই দু জন বিজ্ঞানী সেটা জানেন না। রিগা তার ঘড়ির দিকে তাকাল, এই ঘরটিতে পা দিয়েছে মিনিটখানেক পার হয়েছে, পৃথিবীতে এর মাঝে কত সময় পার হয়ে গেছে?

প্রফেসর ত্রিনি এবং লিক চতুষ্কোণ একটা বাক্সের মতো কি-একটা জিনিস খুলে টেনে বের করার চেষ্টা করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন, এবারে একটু বিরক্ত হয়ে রিগাকে বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে জখছ কী, একটু হাত লাগাও না।

রিগা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, প্রফেসর ত্রিনি এবং প্রফেসর লিক, আপনাদের দুজনকে আমার খুব একটা জরুরি জিনিস বলার রয়েছে।

তার গলার স্বরের জন্যেই হোক বা দু শ পনের বছরের পরিবর্তিত বাচনভঙ্গির জন্যেই হোক, দুজনেই কেমন জানি একটু চমকে উঠলেন। তাঁদের চোখে হঠাৎ কেমন একটি আশঙ্কা ফুটে উঠল। ভালো করে রিগার দিকে তাকালেন প্রথমবারের মতো—কিছু-একটা অসঙ্গতি আঁচ করতে পারলেন দুজনেই। প্রফেসর লিক ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কে? কেন এসেছ এখানে?

আমার নাম রিগা। আমি এখানে এসেছি একটা কৌতূহল মেটানোর জন্যে—

কী কৌতূহল? তোমার কথা এরকম কেন? কোন অঞ্চল থেকে এসেছ তুমি?

তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনারা কতক্ষণ আগে এই ঘরে ঢুকেছেন?

কেন?

আমি জানতে চাই–

এই আধা ঘণ্টার মতো হবে, প্রফেসর ত্রিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন, এগারটার সময় ঢুকেছি, এখন সাড়ে এগারটা। কেন, কী হয়েছে?

বাইরে, এই আধা ঘণ্টা সময়ে অনেক কিছু হয়ে গেছে।

কী হয়েছে? কি?

দু শ পনের বছর সময় পার হয়ে গেছে।

কথাটি তারা বুঝতে পারলেন বলে মনে হল না, অবাক হয়ে দুজনে বিস্ফারিত চোখে রিগার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁদের চোখে প্রথমে অবিশ্বাস, তারপর হঠাৎ করে যোবা আতঙ্ক এসে ভর করে। প্রফেসর ত্রিনি ছুটে এসে রিগার কলার চেপে ধরেন, চিৎকার করে বলেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ, মিথ্যা কথা—

রিগা নিজেকে মুক্ত করে বলল, না প্রফেসর ত্রিনি। আমার কাছে আজকের খবরের বুলেটিন আছে। দেখবেন?

প্রফেসর ত্রিনির উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই রিগা হাতের রেম কার্ডটির সুইচ অন করে দিল, সাথে সাথে ঘরের মাঝখানে মিষ্টি চেহারার একজন মেয়ের জীবন্ত ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে ওঠে। দিন তারিখ সন বলে খবর বলা শুরু হয়ে যায়।

প্রফেসর ত্রিনি এবং লিকের বিস্ফারিত চোখের সামনে রিগা সুইচ টিপে রেম কার্ডটি বন্ধ করে দিল। খবরের বিষয়বস্তু, নাকি ত্রিমাত্রিক ছবির এই বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি—কোনটি তাদের বাক্যহারা করে দিয়েছে বোঝা গেল না। খুব সাবধানে প্রফেসর লিক একটা গোলাকার আসনে বসে পড়ে প্রফেসর ত্রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ত্রিনি, মনে আছে, আমরা আরেকটা সলিউশান পেয়েছিলাম, বিশ্বাস করি নি তখন। সেটাই কি সত্যি? কিন্তু সেটা তো অসম্ভব–

প্রফেসর ত্রিনি ফ্যাকাসে মুখে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে ছিলেন, আস্তে আস্তে বললেন, আজ বিকেলে আমার মেয়ের জন্মদিন। আমার কেক কিনে নিয়ে যাবার কথা ছিল—দু শ বছর আগে ছিল সেটা? দুশ বছর?

তিনি হঠাৎ নিজের মুখ ঢেকে হু-হু করে কেঁদে উঠলেন।

রিগা খুব ধীরে ধীরে শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, আমি দুঃখিত প্রফেসর ত্রিনি। খুবই দুঃখিত।

প্রফেসর ত্রিনি হঠাৎ মুখ তুলে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর কঠোর মুখে বললেন, আমি বিশ্বাস করি না। আমি বাইরে যাব–

প্রফেসর লিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ত্রিনির দিকে। তারপর বললেন, ত্রিনি, তুমি তো জান, যদি দ্বিতীয় সমাধানটি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি বাইরে যেতে পারবে না

কে বলেছে পারব না, এক শ বার পারব।

কিন্তু তাহলে সময় সমাপনী নীতির লংঘন হবে।

হোক।

তার মানে তুমি জান বস্তু আর অবস্থানের অবলুপ্তি ঘটবে। তুমি থাকবে কিন্তু তোমার চারপাশের পৃথিবী উড়ে যাবে।

যাক—আমার কিছু আসে যায় না। আমি বাইরে যাব।

প্রফেসর ত্রিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, রিগা পিছন থেকে তাঁকে ডাকল, প্রফেসর ত্রিনি, আমার ধারণা, আপনি বাইরে যেতে পারবেন না। আপনি চাইলেও পারবেন না।

কেন?

আমি এখানে এসেছি প্রায় সাত মিনিটের মতো হয়ে গেছে। তার মানে জানেন?

কি?

পৃথিবীতে আরো পঞ্চাশ বছর সময় পার হয়ে গেছে।

প্রফেসর ত্রিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন, তাতে কী হয়েছে?

আমি এখানে এসেছি গোপনে, কেউ জানে না। কিন্তু আমার ডাইরিটা আমি রেখে এসেছি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভন্টে। সেটা এতদিনে পৃথিবীর মানুষ পেয়েছে।

পেলে কী হবে?

তারা জানবে আমি এই ল্যাবরেটরির সবগুলো দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকেছি, আপনারা এখন ইচ্ছে করলে বের হয়ে যেতে পারবেন। পৃথিবীর মানুষ সময়ের অপবলয়ের সূত্রের সমাধান করেছে, তারাও জানে দ্বিতীয় সমাধানটি সত্যি। তারাও এখন জেনে গেছে এই ছোট ঘরে আমরা তিনজন স্থির সময়ের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি, আমরা বের হয়ে গেলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা সেটা হতে দেবে না। কিছুতেই হতে দেবে না।

কী করবে তারা?

কাউকে পাঠাবে এখানে। যারা আমাদের তিনজনকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে পৃথিবীকে রক্ষা করবে।

কাকে পাঠাবে? প্রফেসর ত্রিনির গলা কেঁপে গেল হঠাৎ।

আমার ধারণা, সেগুরি-৪৯ ধরনের রবোটকে। অত্যন্ত নিঁখুত রবোট, অত্যন্ত সুচারুভাবে কাজ করতে সক্ষম। আমার ধারণা যে-কোনো মুহূর্তে তারা এসে ঢুকবে এখানে।

বিশ্বাস করি না তোমার কথা। বিশ্বাস করি না–

রিগা কী-একটা বলতে চাইছিল, তার আগেই হঠাৎ সশব্দে দরজা খুলে যায়। দরজায় চারটি ধাতবমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চোখে নিষ্পলক দৃষ্টি, হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মূর্তিগুলো মাথা ঘুরিয়ে তাদের তিনজনকে একনজর দেখে নেয়। তারপর খুব ধীরে ধীরে হাতের অস্ত্র তাদের দিকে উদ্যত করে। রিগা চিনতে পারে—সেঞ্চুরি-৪১ রবোট।

ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিগা। তার অনুমান তাহলে ভুল হয় নি। কখনো হয় না।

০৩. বিষ

ক্রায়োজেনিক পাম্পটি চালিয়ে দিয়ে কিম জিবান কাচের ছোট অ্যাম্পুলটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে তিনি কখনো একটা ক্ষুদ্রাইভার হাতে একটা স্কু ঘুরিয়েছেন মনে পড়ে না, অথচ গত এক সপ্তাহ থেকে তাঁর ঘরে একটা ছোট কিন্তু জটিল ল্যাবরেটরি বসানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের দশজন সদস্যের একজন হিসেবে তাঁর ক্ষমতার আক্ষরিক অর্থেই কোনো সীমা নেই। মূল কম্পিউটার তাঁর মুখের কথায় এই ল্যাবরেটরির প্রতিটি জিনিস এনে হাজির করেছে। কিন্তু কাচের অ্যাম্পুলটিতে তিনি যে তরল পদার্থটি রাখতে চাইছেন, সেটি কী ভাবে তৈরি করতে হয় সেই তথ্যটি তিনি মুখের কথায় বের করতে পারেন নি। সেজন্যে তাঁকে নিজের হাতে তাঁর সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের গোপন সংখ্যাটি মূল কম্পিউটারে প্রবেশ করাতে হয়েছে। পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কেউ সেটি করেছে বলে জানা নেই। এজন্যে তাঁকে সামনের কাউন্সিলে জবাবদিহি করতে হবে, সেটি গ্রহণযোগ্য না হলে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তাঁর নিজের হাতে নিজের প্রাণ নেয়ার কথা।

জিন স্থির দৃষ্টিতে কাচের অ্যালটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। হালকা লাল রঙের একটা তরল একফোঁটা একফোঁটা করে কাচের অ্যাম্পলটিতে জমা হচ্ছে। পুরোটুকু ভরে যাওয়ার পর অ্যাম্পুলটির মুখ লেজারের একঝলক আলোতে গলিয়ে বন্ধ করে ফেলার কথা। তিনি কখনো আগে এ ধরনের কাজ করেন নি, তাই নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে চান।

অ্যাম্পুলটির মুখ বন্ধ হয়ে যাবার পর তিনি সেটা হাতে নেয়ার জন্যে ক্রায়োজেনিক পাম্পটা বন্ধ করে দেন। ভিতরে বাতাসের চাপ স্বাভাবিক হওয়ার পর তিনি বায়ুনিরোধক বাক্সটির ঢাকনা খোলার জন্যে হাতল স্পর্শ করামাত্র মূল কম্পিউটারটি আপত্তি জানাল। পৃথিবীতে মাত্র দশজন মানুষকে এই ঢাকনা খোলার অধিকার দেয়া হয়েছে। তিনি সেই দশজন মানুষের একজন। কিম জিবানকে দ্বিতীয়বার তাঁর নিজের হাতে গোপন সংখ্যাটি প্রবেশ করিয়ে কম্পিউটারকে জানাতে হল। বায়ুনিরোধক বাক্সটির ঢাকনা এবার সহজেই খুলে আয়) জিবানের হাত অল্প অল্প কাঁপতে থাকে, তিনি সে অবস্থাতেই সাবধানে অ্যালতি তুলে নেন। তিনি এখন তাঁর জীবনের প্রথম এবং সম্ভবত শেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটি করবেন। তাঁর হাতে কাচের অ্যাম্পুলটি কোনোভাবে ভেঙে গেলে এই তরল পদার্থটি বাতাসে মিশে গিয়ে আগামী চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত প্রাণীকে মেরে ফেলবে। মাত্র তিন ধরনের ভাইরাস এই বোনাসিয়াস থেকে রক্ষা পেতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ লন। কিম জিবান হেঁটে ঘরের মাঝখানে আসেন, তাঁর হাত তখনো অল্প অল্প কাঁপছে, তিনি ভালো করে অ্যাম্পুলটি ধরে রাখতে পারছেন না। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের প্রাণ তিনি এখন হাতে ধরে রেখেছেন, কিম জিবান অবাক হয়ে ভাবলেন, এত বড় ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ কি কখনো অর্জন করেছিল?

 

নীষ কিম জিবানের ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করেন, ঘরাট অন্ধকার। বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করতেই অন্ধকারে এক কোনা থেকে জিবান বললেন, নীষ, বাতি জ্বালিও না। একটু পরেই দেখবে চোখ অন্ধকারে সয়ে যাবে।

বাজে কথা বলো না—নীষ বাতি জ্বালালেন, আমার অন্ধকার ভালো লাগে না।

জিবান চোখ কুঁচকে নীষের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর মুখে আশ্চর্য একটা হাসি। নীষ বেশি অবাক হলেন না। কিম জিবান বরাবরই খেয়ালি মানুষ, এরকম একজন খেয়ালি মানুষকে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের সদস্য করা হয়েছে, সেটাই আশ্চর্য! নীষ বললেন, কী ব্যাপার জিবান, আমাকে ডেকেছ কেন?

জিন কথা না বলে ঘরের কোনায় তাঁর ছোট ল্যাবরেটরি দেখালেন, নীষ বিস্মিত হয়ে সেদিকে এগিয়ে যান, কী ব্যাপার জিবান, তুমি ডিষ্টিলেশান কমপ্লেক্স দিয়ে কী করছ?

জিবান মাথা দুলিয়ে হেসে বললেন, তুমি পৃথিবীর প্রথম পাঁচজন ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন–

কথাটি সত্যি তাই নীষ প্রতিবাদ না করে পরের অংশটক শোনার জন্যে অপেক্ষা করে রইলেন। জিবান বললেন, তুমিই বল আমি কী করছিলাম।

নীষ মিনিট দুয়েক ডিস্টিলেশান কমপ্লেক্সের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কম্পিউটারের মনিটরে বার দুয়েক টোকা দিয়ে হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন, তখন তিনি ঘুরে জিবানের দিকে তাকিয়েছেন, তাঁর মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। নীষ কথা বলতে পারছিলেন না, বারকয়েক চেষ্টা করে কোনোতাবে বললেন, তুমি—তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ। তুমি কাচের অ্যালে লিটুমিন বোনাসিয়াস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ।

জিবান পকেট হাতড়ে অ্যাম্পুলটি বের করে তাঁকে দেখালেন। আতঙ্কে নীষের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, মনে হতে থাকে তাঁর হৃৎস্পন্দন থেমে যাবে, এই কাচের অ্যালটি কোনোভাবে ভেঙে গেলে চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ শেষ হয়ে যাবে। জিবান তখনো হাসিমুখে নীষের মুখের জিকে তাকিয়ে আছেন, আস্তে আস্তে তাঁর হাসি আরো বিস্তৃত হয়ে ওঠে, তিনি হঠাৎ অবহেলার ভঙ্গিতে অ্যাম্পুলটি নীষের দিকে ছুড়ে দেন।

নীষ পাগলের মতো লাফ দিয়ে অ্যাম্পুলটি ধরার চেষ্টা করলেন। হাত ফসকে সেটি পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটি ধরে ফেলেছেন। হাতের মুঠোয় রেখে তিনি বিস্ফারিত চোখে আঙ্গুলটির দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর সমস্ত মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। নীষ ধীরে ধীরে জিবানের মুখের দিকে তাকালেন।

জিবানের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে, তাঁর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, আলটি ফিরিয়ে দাও।

না।

জিন ডুয়ার খুলে ভিতর থেকে একটা বেঢপ রিভলবার বের করলেন, আমাকে ফিরিয়ে দিলে আলটি রক্ষা পাবার সম্ভাবনা বেশি, তোমাকে গুলি করলে অ্যাম্পুলটি হাত থেকে পড়ে ভেঙে যেতে পারে।

জিনা তুমি—

অ্যাম্পুলটি ফিরিয়ে দাও।

নীষ কাঁপা কাঁপা হাতে অ্যাম্পুলটি ফিরিয়ে দিলেন। জিবান অ্যালটি টেবিলের উপর রেখে নীষ কিছু বোঝার আগে ট্রিগার টেনে সেটিকে গুলি করে বসেছেন।

প্রচণ্ড শব্দ হল ঘরে, কাচের অ্যাম্পুলটি ছিটকে গিয়ে দেয়ালে আঘাত খেয়ে মেঝেতে এসে পড়ে এক কোনায় গড়িয়ে যায়। নীষ বিস্মিত হয়ে দেখেন—অ্যাম্পুলটি ভাঙে নি, সেটির গায়ে একটু দাগ পর্যন্ত নেই। তিনি ঘুরে জিবানের দিকে তাকান, জিবানের মুখে আবার সেই ছেলেমানুষি হাসি ফিরে এসেছে। বেঢপ রিভলবারটি ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বললেন, তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে দুঃখিত নীষ, কেন জানি একটু মজা করার ইচ্ছে হল। এটি আমার এক শ উনিশ নম্বর গুলি, আমি এটাকে গত ছত্রিশ ঘণ্টা থেকে ভাঙার চেষ্টা করছি।

নীষ কোনোমতে একটা চেয়ার ধরে বসে পড়েন। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলেন, তুমি বলতে চাও এটি সাধারণ কাচ, অথচ–

হ্যাঁ, যেই মুহূর্তে এর ভিতরে বোনাসিয়াস ঢোকানো হয়েছে, এটা আর ভাঙা যাচ্ছে না। একটু থেমে যোগ করলেন, কেউ-একজন পৃথিবীর মানুষকে মরতে দিতে চায় না।

নীষ কাঁপা কাঁপা হাতে অ্যাম্পলটা তুলে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকেন, অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, জিবান।

বল।

তুমি কী ভাবে জানলে এরকম হবে?

জানতাম না, তাই তো পরীক্ষাটা করতে হল।

যদি তোমার অনুমান ভুল হত, যদি—

হয় নি তো।

যদি হত? যদি–

আহ! ছেলেমানুষি করা ছাড়, জিবান হাত নেড়ে নীষকে থামিয়ে দেন। নীষ সাবধানে কাচের অ্যাম্পুলটিকে টোকা দিয়ে বললেন, তুমি কেমন করে সন্দেহ করলে যে এরকম হতে পারে?

আমার সৌর তেজস্ক্রিয়তার উপরে প্রবন্ধটার কথা মনে আছে?

যেটা পরে ভুল প্রমাণিত হল? তুমি যে-পরিমাণ সৌর তেজস্ক্রিয়তা দাবি কর, সেটি সত্যি হলে পৃথিবী গত শতাব্দীতে ধ্বংস হয়ে যেত।

হ্যাঁ। কিন্তু আমার হিসেবে কোনো ভুল ছিল না, আমি এখনো আমার কোনো গবেষণায় কোনো ভুল করি নি।

তাহলে–

আমি খুঁজে বের করেছি, একটা আশ্চর্য উপায়ে মহাজাগতিক মেঘ এসে সময়মতো তেজস্ক্রিয়তাটুকু শুষে নিয়েছিল, কী ভাবে সেটা সম্ভব হল কেউ জানে না। তখন আমার প্রথম সন্দেহ হয় যে, কোনো-একজন বা কোনো দল আমাদের উপর চোখ রাখছে।

এ-ধরনের আরো ঘটনা আছে?

অসংখ্য। আমি মূল কম্পিউটার দিয়ে গত তিন শ বছরের প্রায় ধ্বংস ঘটনাগুলি দেখছিলাম। সাতানব্বই সালে পৃথিবীর দুটি বড় বড় নির্বোধ দেশ একজন আরেকজনকে ধ্বংস করার জন্যে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। কোনো-একটি অজ্ঞাত কারণে একটি মিসাইলও মাটি ছেড়ে উপরে ওঠে নি।

আশ্চর্য।

হ্যাঁ, একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গ্রীন হাউস এফেক্ট-এর জন্যে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমস্ত পৃথিবী ডুবে যাবার কথা ছিল। কোনো-এক অজ্ঞাত কারণে সে-সময়ে হঠাৎ কএ পৃথিবীর সমস্ত সবুজ গাছপালা সালোকসংশ্লেষণে দ্বিগুণ পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করা শুরু করায় পৃথিবী রক্ষা পেয়েছে।

নীষ মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, আমি এটা জানতাম।

তুমি নিশ্চয়ই কিনিকা ধূমকেতুর কথা পড়েছ? সেটি পৃথিবীকে আঘাত করে কক্ষচ্যুত করে ফেলার মতো বড় ছিল। কিন্তু ইউরেনাসের কাছে এক আশ্চর্য কারণে সেটি বিস্ফোরিত হয়ে গতিপথ পরিবর্তন করেছিল। গত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে একটা আশ্চর্য রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয়, এতে মানুষের রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা শেষ হয়ে যেত। রোগটি ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিজে থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল।

আশ্চর্য।

হ্যাঁ, এরকম অসংখ্য আশ্চর্য ঘটনা আছে, মূল কম্পিউটার সেগুলি খুঁজে বের করছে। তুমি দেখতে চাইলে দেখতে পার। জিবান হাত দিয়ে মনিটরকে স্পর্শ করামাত্র কম্পিউটারটি দেয়ালে ঘটনাগুলো লিখতে লিখতে হালকা স্বরে পড়তে থাকে। জিবান বললেন, সবগুলো শুনতে চাইলে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে, সব মিলিয়ে এরকম প্রায় ছয় শ ঘটনা আছে।

নীষ মিনিট দশেক দেখেই কম্পিউটারটিকে থামিয়ে দিলেন। তাঁর দুহাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এসেছে। তিনি জিবানের দিকে তাকিয়ে বললেন, তার মানে তুমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলে?

হা। এই কাচের অ্যাম্বুলটা ভাঙার চেষ্টা করে এখন পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়েছি। এখন আমি জানি এবং তুমিও জান, কেউ-একজন আমাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

তার মানে–

তার মানে আমরা একটা ল্যাবরেটরির ছোট ছোট গিনিপিগ। আমাদের দিয়ে কেউ একজন একটা পরীক্ষা করেছে। যে বা যারা এই পরীক্ষাটা করছে, তারা লক্ষ রাখছে নির্বোধ গিনিপিগগুলো যেন কোনোভাবে মারা না যায়।

নীষের নিজেকে একটা নির্বোধ মনে হল, তবু তিনি প্রশ্নটা না করে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কী পরীক্ষা করছি?

জিবান আবার হাসলেন, বললেন, আমরা কোনো পরীক্ষা করছি না, আমাদের দিয়ে পরীক্ষা করানো হচ্ছে।

সেটি কি?

আমি এখনো নিশ্চিত জানি না সেটি কী। এই মুহূর্তে মূল কম্পিউটার সেটি বের করার চেষ্টা করছে। পৃথিবীতে মানুষের যত অবদান, সবগুলোকে নিয়ে সে একটা সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করছে। লক্ষ করছে তার ভিতরে কোনো লুকানো সাদৃশ্য আছে কি না, কোনোভাবে সেগুলো অদৃশ্য কোনো শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কি না। অসংখ্য রাশিমালা নিয়ে অনেক জটিল হিসেব করতে হচ্ছে বলে কম্পিউটারের এত সময় লাগছে। কাল ভোরের আগে উত্তর বের করার কথা, কিন্তু আমি মোটামুটি জানি, উত্তর কী হবে। তুমিও নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছ।

হ্যাঁ। নীষ মাথা নাড়লেন, জ্ঞান-সাধনা?

ঠিক বলেছ। মানব জাতির ইতিহাস হচ্ছে তার জ্ঞান সাধনার ইতিহাস, অথচ কী লজ্জার কথা, সেটি আসলে অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর কাজ।

নীষ হঠাৎ মাথা তুলে বললেন, আমাকে তুমি এটা জানিয়েছ কেন? নিজের অজ্ঞাতেই তার কণ্ঠে ক্ষোভ ফুটে ওঠে।

আমি ছাড়াও আরো কেউ এটা জানুক।

কেন?

আমার যদি কোনো কারণে মৃত্যু হয়, অন্তত আরেকজন মানুষ এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারবে।

নীষ উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে একা বসে খানিকক্ষণ ভাবতে হবে। আমি যাই।

যাও।

নীষ দরজার কাছ থেকে ঘুরে এসে জিবানকে বললেন, এই অদৃশ্য শক্তি, যারা আমাদের ব্যবহার করছে, তারা তোমাকে মেরে ফেলল না কেন? যেই মুহূর্তে তোমার মাথায় সন্দেহটুকু উঁকি দিয়েছে–

আমি নিজেও এটা নিয়ে ভেবেছি, হয়তো তাদের চিন্তাধারা আর আমাদের চিন্তাধারার তুলনা করা যায় না। হয়তো আমরা যেভাবে ভাবি, আমাদের যে ধরনের যুক্তিতর্ক, তাদেরটা সে রকম নয়, অন্যরকম অনেকটা যেন মানুষ আর পিঁপড়া। আমি যদি অনেকগুলো পিঁপড়াকে নিয়ে একটা পরীক্ষা করি আর হঠাৎ দেখি একটা পিঁপড়া বোকার মতো একটা কাজ করছে, যেটা দিয়ে অন্য সবগুলো পিঁপড়া মারা যাবে, আমি তখন কী করব? আমি সেই পিঁপড়াটাকে বোকার মতো কাজ করতে দেব না। কিন্তু পিঁপড়াটাকে তো মেরে ফেলব না, সেটাকে ছেড়ে দেব। নির্বোধ প্রাণী, ওকে মেরে লাভ কি?

নীষ চিন্তিত মুখে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, শুনলেন, জিবান ক্ষোতের সাথে বলছেন, আমার দুঃখ, কেউ-একজন আমাকে নির্বোধ হিসেবে জানে!

 

নীষ সারা রাত তাঁর বারান্দায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। কিম জিবানের সাথে কথা বলার পর হঠাৎ তাঁর সমস্ত জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে। সারা জীবন জ্ঞানের অন্বেষণে কাটিয়েছেন, অজানাকে জানার যে-অদম্য তাড়না তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সেটি কোনো-এক বুদ্ধিমান প্রাণীর নির্দেশ। এই সত্যটি তিনি কোনোমতে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর কাছে এই জীবনের আর কোনো মূল্য নেই। তিনি দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে থাকেন।

নীষের মাথায় হঠাৎ একটি প্রশ্ন জেগে ওঠে। এই যে বুদ্ধিমান প্রাণী, যারা মানবজাতিকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে, তারা ঠিক কী ভাবে মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখে? নীষ আজীবন ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা চর্চা করে এসেছেন, মহাজাগতিক সংঘর্ষ কেন্দ্র তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা, কোনো জটিল পরীক্ষা করায় তাঁর যে অচিন্তনীয় ক্ষমতা রয়েছে, তার কোনো তুলনা নেই। তিনি নিজেকে সেই অদৃশ্য বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে কল্পনা করলেন, তিনি যদি মানবজাতির সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতেন, তা হলে তিনি কী করতেন? ধরা যাক তিনি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটা প্রাণী, মানুষের আচার-ব্যবহার চিন্তাধারা যুক্তিতর্ক সবকিছু ভিন্ন। তিনি সেটা বোঝেন না, তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব না। পিঁপড়া যেরকম কীটপতঙ্গের তুলনায় বুদ্ধিমান। কিন্তু মানুষ কখনো পিঁপড়ার সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে না, অনেকটা সেরকম। তিনি এরকম অবস্থায় মানুষের সাথে কী ভাবে যোগাযোগ রাখতেন?

কেন? এ তো খুবই সহজ। নীষ হঠাৎ লাফিয়ে ওঠেন, মানুষের মতো কাউকে পাঠানো হবে, সে মানুষের সাথে মানুষের মতো থাকবে, তার ভিতর দিয়ে সব খোঁজ খবর নেয়া হবে।

নীষ উত্তেজিত হয়ে পায়চারি শুরু করেন, কে সে মানুষ, কোথায় আছে সে? নীষের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে, নিশ্চয়ই সেই মানুষ সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে থাকবে, এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কী আছে? দশজন সদস্যের সবাইকে তিনি চেনেন, সবার সাথে ঘনিষ্ঠতা নেই, থাকা সম্ভবও নয়, কিন্তু সবাইকে খুব ভালো করে চেনেন। এদের মাঝে কে হতে পারে? মহামান্য লী? অসাধারণ প্রতিভাবান গণিতবিদ রু লুকাস? জীববিজ্ঞানী রুখ কিংবা শান সোয়ান? নাকি জ্যোতির্বিদ পল কুম? কে হতে পারে?

কী আশ্চর্য! নীষ ভাবলেন, আমি মূল কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করি না কেন? মূল কম্পিউটারে প্রত্যেকের জীবন-ইতিহাস আছে। একনজর দেখলেই বেরিয়ে পড়বে।

নীষ ছটে বসার ঘরে গেলেন। মনিটরকে স্পর্শ করে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান কাউন্সিলের দশজন সদস্যের জীবন-ইতিহাস জানতে চাইলেন মূল কম্পিউটারের কাছে। মূল কম্পিউটার আপত্তি জানাল, এটি গোপনীয়। তিনি জানতে চাইলে তাকে তার গোপন সংখ্যা প্রবেশ করাতে হবে। নীষ ধীরে ধীরে নিজের গোপন সংখ্যা প্রবেশ করালেন। এর জন্যে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে, সেটি গ্রহণযোগ্য না হলে তাঁকে নিজের হাতে নিজের প্রাণ নিতে হবে, কিন্তু একবারও তাঁর সে-কথাটি মনে হল না। নীষ একজন একজন করে প্রত্যেকের জীবন-ইতিহাস দেখতে থাকেন। তাঁর নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে আসে। হাত অল্প কাঁপছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কিন্তু তিনি জানেন, আজ তিনি বের করবেন কে সেই লোক। কে সেই আশ্চর্য বুদ্ধিমান-জগতের গুপ্তচর।

 

বিজ্ঞান কাউন্সিলের সর্বোচ্চ পরিষদের জরুরি সভা বসেছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দশজন বিজ্ঞানী গোলটেবিল ঘিরে বসেছেন। তাঁদের মুখে মৃদু হাসি, তাঁরা নিচু স্বরে গন্ধ করছেন, এই মুহূর্তে তাঁদের সারা পৃথিবীতে টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে, তাই এই অভিনয়টুকুর প্রয়োজন। কিছুক্ষণের মাঝেই কোয়ার্টজের দরজাটি বন্ধ হয়ে তাঁদের সারা পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলল। সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা গম্ভীর হয়ে সোজা হয়ে বসলেন। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের সভার কোনো নিয়ম নেই, মহামান্য লী সভাপতি হিসেবে এটি নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখার চেষ্টা করেন। আজ তিনিই সবার আগে কথা বললেন, তোমরা সবাই জান, গত ছত্রিশ ঘণ্টায় মূল কম্পিউটারে তিনবার গোপন সংখ্যা প্রবেশ করানো হয়েছে। জিবান দুর্বার, নীষ একবার।

আমার মনে হয়—জীববিজ্ঞানী রুখ বললেন, গোপন সংখ্যা প্রবেশ করানোর নিয়মটি তুলে দিতে হবে। জিবান সেটি যে-জন্য ব্যবহার করেছ—

রুখকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে জিবান বললেন, তোমরা এক সেকেন্ড থেকে আমাকে কথা বলতে দেবে?

রুখ আবার শান্ত স্বরে বললেন, আমার মনে হয়, যখন একজন কথা বলছে, তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরেকজনের অপেক্ষা করা উচিত। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের সদস্য হিসেবে–

ধেত্তেরি তোমার সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদ। জিবান টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বললেন, আমার কথা আগে শেষ করতে দাও। তিনি পকেট থেকে একগাদা কাগজ বের করে টেবিলের মাঝখানে ছুড়ে দিয়ে বললেন, এখানে সবকিছু লেখা আছে, দেখতে চাইলে দেখতে পার, কিন্তু এখন খামোকা সময় নষ্ট না করে আমার কথা শোন। আমি কিছুদিন থেকে সন্দেহ ছিলাম মানবজাতি আসলে এক ধরনের উন্নত প্রাণীর লাবরেটরি পরীক্ষা। গতকাল আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি, যে-পরীক্ষা করে সন্দেহ মিটিয়েছি সেটি খুব সহজ, তোমরাও দেখতে পার। জিৰান পকেট থেকে লিটুমিন বোনাসিয়াসের অ্যাম্পলটা বের করলেন, এই বিষ দিয়ে পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব, পাতলা একটা কাচের অ্যাম্পুলে আছে, টাকা লাগালেই ভেঙে যাবার কথা। কিন্তু এটাকে ভাঙা সম্ভব না, কেউ-একজন এটাকে ভাঙতে দিচ্ছে না, তোমরা চেষ্টা করে দেখতে পার। জিবান অ্যাম্পুলটা টেবিলের উপর ছুড়ে দিলেন, সবাই রুদ্ধশ্বাসে অ্যাম্পুলটিকে লক্ষ করে, অ্যালটি সত্যি ফেটে না গিয়ে একটি রবারের বলের মতো বারকয়েক লাফিয়ে টেবিলের মাঝখানে স্থির হয়ে যায়।

মাহামান্য লী হাত বাড়িয়ে অ্যালটি তুলে নেন, চোখের কাছে নিয়ে সেটিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে পাশে বসে থাকা শান সোয়ানের হাতে দেন। একজন একজন করে সবাই অ্যাম্পুলটি দেখেন, কারো মুখে কোনো কথা নেই, জিবান সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, এই প্রাণী আমাদের ব্যবহার করছে জ্ঞান সংগ্রহের জন্যে। আমি নিজেও তাই সন্দেহ করেছিলাম, আজ ভোরে মূল কম্পিউটারও তার গবেষণা শেষ করে আমাকে এটা জানিয়েছে। তোমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কম্পিউটারে আমি তার রিপোর্ট পাঠিয়েছি, ইচ্ছে হলে দেখতে পার। জিবান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার কথা শেষ, এখন তোমাদের যা ইচ্ছে হয় কর।

সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। মহামান্য লী আস্তে আস্তে বললেন, তার মানে আমাদের এই জ্ঞান-সাধনা–

বাজে কথা! সব ওদের একটা ল্যাবরেটরি পরীক্ষা। আমরা মানুষেরা যে সৃষ্টির পর থেকে শুধু জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করছি, তার কারণ, কেউ একজন আমাদের বলে দিয়েছে, এটা কর। কী লজ্জার কথা। মানুষের আসল ব্যবহার কী, কে জানে।

সবাই একসাথে কথা বলার চেষ্টা করে, নীষের গলা সবচেয়ে উপরে উঠে সবাইকে থামিয়ে দেয়। নীষ বললেন, জিবান আমাকে ব্যাপারটি বলার পর থেকে আমি বের করার চেষ্টা করছিলাম সেই উন্নত প্রাণী মানুষের সাথে কী ভাবে যোগাযোগ রাখে। আপনারা চিন্তা করলে নিজেরাই বের করতে পারবেন, সবচেয়ে সহজ হয়। মানুষের চেহারার একটা-কিছু তৈরি করে মানুষের মাঝে ছেড়ে দিলে। যেহেতু আমাদের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান কাউন্সিল নামে একটা সংগঠন রয়েছে, কাজেই আমার ধারণা, মানুষের চেহারার সেই উন্নত প্রাণীদের গুপ্তচর এই বিজ্ঞান কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে থাকবে।

বিজ্ঞান কাউন্সিলের সদস্যরা ভয়ানক চমকে নীষের মুখের দিকে তাকালেন। মহামানা লী বললেন, তুমি বলতে চাও–

নীষ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার গোপন সংখ্যা ব্যবহার করে আমি গতরাতে আপনাদের সবার জীবন-ইতিহাস, আপনাদের ব্যক্তিগত দিনলিপি পড়েছি, আমি সেজন্য ক্ষমা চাইছি। আমার ধারণা ছিল আমি সেখান থেকে বের করতে পারব, কারণ আমি ধরে নিয়েছিলাম, যে উন্নত প্রাণীদের গুপ্তচর, সে নিজে সেটি জানে। কিন্তু সেটা সত্যি নয়।

জিন অধৈর্য হয়ে বললেন, তুমি কি শেষ পর্যন্ত বের করতে পেরেছ?

হ্যাঁ।

কে সেই লোক?

আমি।

ঘরের ভিতরে বাজ পড়লেও কেউ বুঝি এত অবাক হত না। কয়েক মুহূর্ত লাগে সবার ব্যাপারটি বুঝতে। জিবান কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুমি কী ভাবে জান তুমিই সেই লোক? হয়তো তুমি ভুল করেছ, হয়তো

নীষ ম্লান মুখে হাসলেন, আমি নিজেও তাই আশা করছিলাম। কিন্তু আমিই আসলে সেই গুপ্তচর, আমাকে দিয়েই সেই উন্নত প্রাণী পৃথিবীর খোঁজখবর নেয়। বিশ্বাস কর তোমরা, আমি নিজে সেটা জানতাম না। যখন জেনেছি, নিজেকে এত অপরাধী মনে হয়েছে যে আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম।

নীষ নিজের শার্ট খুলে দেখালেন, বুকে গুলির দাগ, রক্ত শুকিয়ে আছে। বললেন, আমি আমার হৃৎপিণ্ডের ভিতর দিয়ে দুটি গুলি পাঠিয়েছি, কিন্তু তবু আমি মারা যাই নি। সেই উন্নত প্রাণী যতক্ষণ না চাইলে আমি মারা যেতে পারব না, আমাকে বুকে গুলি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। নয় আস্তে আস্তে নিজের চেয়ারে বসলেন, মাথা নিচু করে বললেন, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও।

আস্তে আস্তে তিনি টেবিলে মুখ ডেকে হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

০৪. গ্রুনো রবোট

দুপুরের পর বড় জানালাগুলো দিয়ে রোদ এসে আমার অফিস-ঘরটি আলোকিত হয়ে যায়। আমি তখন চেয়ারটা টেনে নিয়ে বোদে গিয়ে বসি, বয়স হয়ে যাবার পর এ ধরনের ছোটখাটো উষ্ণতার জন্যে শরীরটা কাঙাল হয়ে থাকে। এখানে বসে জানালা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঢাকা প্রাঙ্গণটুকুর পুরোটাই চোখে পড়ে। বসে বসে ছাত্রছাত্রীদের হৈচৈ দেখতে বেশ লাগে। তারুণ্যের একটা আকর্ষণ আছে, আমি সহজে চোখ ফেরাতে পারি না। হৈচৈ চেঁচামেচি দেখে মাঝে মাঝেই আমার নিজের ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে যায়, সমস্ত পৃথিবীটা তখন রঙিন মনে হত। একজন মানুষ তার জীবনে যা-কিছু পেতে পারে, আমি সবই পেয়েছি, কিন্তু তবু মনে হয় এর সবকিছুর বিনিময়ে ছাত্রজীবনের একটি উজ্জ্বল অপরাহ্নও যদি কোনোভাবে ফেরত পেতে পারতাম!

জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড় ঝাউগাছটার নিচে একটা ছোট জটলার মত। মাঝখানে দাঁড়িয়ে লানা হাত-পা নেড়ে কথা বলছে, তাকে ঘিরে বেশ কিছু উত্তেজিত তরুণ-তরুণী। লানা আমার একজন ছাত্রী, সময় পরিভ্রমণের সূত্রের উপর আমার সাথে কাজ করে। বুদ্ধিমতী মেয়ে, রাজনীতি বা সমাজসেবা এই ধরনের আনুষঙ্গিক কার্যকলাপে যদি এত সময় ব্যয় না করত, তা হলে এতদিনে তার ডিগ্রি শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। খুব প্রাণবন্ত মেয়ে, অন্যদের জন্যে কিছু করার জন্যে এত ব্যস্ত থাকতে আগে কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ইদানীং মাঝে মাঝে চশমা-পরা এলোমেলো চুলের এক তরুণের সাথে দেখি। সাহিত্যের ছাত্র, নাম জিশান লাও। ওর বাবাকে খুব ভালো করে চিনি, কারণ ছাত্রজীবনে দুজনে রাত জেগে দীর্ঘ সময় নানারকম অর্থহীন বিষয় নিয়ে তর্ক করেছি। ছেলেটি যদি তার বাবার হৃদয়ের এক-ভগ্নাংশও কোনোভাবে পেয়ে থাকে, তা হলে অত্যন্ত হৃদয়বান একটি ছেলে হবে তাতে সন্দেহ নেই। লালার সাথে সম্ভবত ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, নূতন ভালবাসার মতো মধুর জিনিস পৃথিবীতে কী আছে? লানা এবং জিশানকে একসাথে দেখে আমার নিজের প্রথম যৌবনের কথা মনে পড়ে যায়, যখন মনে হত ভালবাসার মেয়েটির একটি চুলের জন্যে আমি সমস্ত জগৎ লিখে দিতে পারি।

আমি চোখ সরিয়ে নিজের কাজে মন দিলাম। সপ্তম মাত্রার একটা সমীকরণ নিয়ে কয়েকদিন থেকে বসে আছি। সমাধানটি মাথায় উঁকি দিয়ে দিয়েও সরে যাচ্ছে, কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না। যৌবনে মস্তিষ্কের যে একটা সতেজ ভাব ছিল, সেটা এখন নেই, নিজেই প্রায় সময়ে অনুভব করতে পারি। হাঁটুর উপর মোটা খাতাটি রেখে পেন্সিল দিয়ে সমীকরণটি বড় বড় করে লিখে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। সমাধানটি আবার মাথায় উঁকি দিয়ে যেতে থাকে, আমার সমগ্র একাগ্রতা জটিল সমীকরণটির সেই অস্পষ্ট সমাধানটির পিছু ছুটতে থাকে।

কতক্ষণ মোটামুটি ধ্যানস্থ হয়ে বসে ছিলাম জানি না, লানার গলার স্বরে ঘোর ভাঙল।

স্যার, ভিতরে আসতে পারি?

আমি কিছু বলার আগেই সে ভিতরে ঢুকে এল। বরাবরই তাই করে, আমি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকলে কেউ আমাকে বিরক্ত করার সাহস পায় না, গত সপ্তাহে শহরের মেয়র আমার সাথে দেখা করতে এসে দরজার বাইরে পনের মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে তুলনায় এই মেয়েটি যে দুঃসাহসী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি লানার মুখের দিকে তাকালাম। তার চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ সবসময়েই থাকে। সতেজ গলায় বলল, সার, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।

আমি চেষ্টা করে মুখে গাম্ভীর্যটা ধরে রাখলাম, বললাম, আশা করি কাজটা গুরুত্বপূর্ণ।

অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

তুমি জান, আমার নিজের কাজ ছাড়াও আমাকে আরো অন্তত দশটা কমিটির জন্যে কাজ করতে হয়।

জানি—লানা মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে বলল, আমার ধারণা, আপনি সেসব কমিটিতে সময় নষ্ট না করলে নিজের কাজ খুব ভালোভাবে করতে পারতেন।

লানাকে দেখার আগে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে, কেউ এভাবে আমার সাথে কথা বলতে পারে। কিন্তু না যে-কথাটি বলেছে সেটি সত্যি, আমি নিজে সেটা খুব ভালো করে জানি। আমি মেয়েটির কাছে সেটা প্রকাশ করলাম না, গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললাম, তুমি জান, সেসব কমিটির কোনো-নোেটিতে রাষ্ট্রপতি  এবং বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা আছেন?

লানা নিজের চুল খামচে ধরে বলল, আমি বিশ্বাসই করতে রাজি না যে, আপনি ঐসব মানুষকে কোনো গুরুত্ব দেন। ওদের সবগুলোকে পাগলা-গারদে রাখার কথা।

আমার হাসি আটকে রাখতে অত্যন্ত কষ্ট হল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তোমার কাজটা কি?

আপনি জানেন, গ্রুনো নামে নতুন রবোট বের হয়েছে?

শুনেছি।

ওদের কপোট্রনে নাকি সিস্টেম-৯ ঢোকানো হয়েছে।

সেটার মানে কি?

আপনি সিস্টেম-৯ কী, জানেন না লানা আমার অজ্ঞতায় খুব অবাক হল এবং সেটা গোপন রাখার কোনো-রকম চেষ্টা করল না। বলল, গত দশ বছর থেকে সিস্টেম ৯-এর উপর কাজ হচ্ছে। এটা হচ্ছে এমন একটা সিস্টেম, যেটার সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই।

কী আছে সেখানে?

কেউ জানে না, অত্যন্ত গোপনীয় জিনিস। এখন সেটাকে গ্রুনো রবোটের কপোট্রনে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

সেটার মানে কি?

লালা উত্তেজিত মুখে বলল, তার মানে গ্রুনো রবোর্টের সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। দেখে, কথা বলে কোনোভাবেই বোঝা যাবে না কোনটা মানুষ, কোনটা রবোট।

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, পৃথিবীতে কি সত্যিকার মানুষের অভাব আছে যে এখন গ্রুনো রবোটকে মানুষ হিসেবে বাজারে ছাড়তে হবে?

লানা আমার কথাটি লুফে নিয়ে বলল, সেটাই তো কথা। বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা কী বলছে শোনেন নি?

কী বলেছে?

কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে দেশের সব বিচারপতিদের অবসর করিয়ে দিয়ে সেখানে গ্রুনো রবোটদের বসানো হবে।

সত্যি?

সত্যি। লানা মুখের উপর থেকে চুলের গোছা সরিয়ে বলল, আজকের কাগজে উঠেছে।

বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা লোকটির সম্ভবত সত্যিই মাথা খারাপ। লানার পরামর্শ শুনে কিছুদিন পাগলাগারদে আটকে রাখলে মনে হয় মন্দ হয় না। আমার সাথে লোকটির মাঝে মাঝে দেখা হয়। বলে দিতে হবে যেন এরকম বেফাঁস কথাবার্তা না বলে। দেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ রবোটশিল্পের উপর নির্ভরশীল, মনে হয় সেই শিল্পকে খুশি রাখার জন্যে এ-ধরনের কথাবার্তা মাঝে মাঝে বলে ফেলতে হয়।

নানা গম্ভীর গলায় বলল, গ্রুনো কোম্পানির সাহস কী পরিমাণ বেড়েছে, আপনি শুনতে চান?

ওদের ফ্যাক্টরি থেকে দুজন মানুষ পাঠিয়েছে আমাদের কাছে, তার মাঝে নাকি একজন হচ্ছে সত্যিকার মানুষ, আরেকজন গ্রুনো রবোট।

কোনটা গ্রুনো রবোট?

জানি না। লানাকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, বলল, কোনটা ওরা বলবে না, আমাদের বের করতে হবে।

কেন?

আমরা গ্রুনো রবোটকে বিচারপতি পদে বসানো নিয়ে একটা প্রতিবাদ সভা করেছিলাম, সেটা শুনে কোম্পানি এই দুজন মানুষ পাঠিয়েছে। ওরা আমাদের কাছে প্রমাণ করতে চায় যে, গ্রুনো রবোট হুবহু মানুষের মতে, কোনো পার্থক্য নেই। ওরা দাবি করেছে যে, আমরা কিছুতেই বের করতে পারব না কোনটা মানুষ, কোনটা গ্রুনো রবোট।

পেরেছ?

লানা ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, না।

বাজিতে হেরে গেলে?

কিন্তু স্যার, আপনি বুঝতে পারছেন আমরা যদি বের করতে না পারি তা হলে কী হবে?

কী হবে?

গ্রুনো রবোট কোম্পানি সব খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশনে খবরটা প্রকাশ করে দেবে। বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দেবে যে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ চব্বিশ ঘণ্টা চেষ্টা করেও গ্রুনো রবোটের সাথে মানুষের পার্থক্য ধরতে পারে নি। তারপর সত্যি সত্যি বিচারকদের জায়গায় গ্রুনো রবোটকে বসানো হবে।

সমস্যার কথা, কী বল?

লানা আমার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল আমি ঠাট্টা করছি কি না। একটু পর প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, আপনি বের করে দেবেন?

আমি?

লানা মাথা নাড়ে, আমরা সারা দিন চেষ্টা করেছি।

পার নি?

না। লজ্জায় মেয়েটির চোখে প্রায় পানি এসে যায়। কাতর গলায় বলল, যতভাবে সব চেষ্টা করেছি, মানুষের যতরকম অনুভূতি আছে সবগুলো চেষ্টা করে দেখেছি, কোনো লাভ হয় নি। লানা আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, আপনি বের করে দেবেন?

আমার মেয়েটির জন্যে খুব মায়া হল। বাইরে সেটা প্রকাশ না করে উদাস ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললাম, যদি সত্যি বের করতে না পার, তাহলে তো স্বীকার করতেই হবে গ্রুনো রবোট সত্যিই মানুষের মতো।

সেটা তো স্বীকার করছিই। মানুষের মতো আর মানুষ দুটি তো এক জিনিস নয়। মানুষের সত্যিকার অনুভূতি থাকবে না, কিন্তু মানুষের বিচার করবে—সেটা তো হতে পারে না। দেবেন বের করে?

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, বিকেল হয়ে আসছে, সন্ধেবেলা একটা কনসার্টে যাবার কথা, হাতে খুব বেশি সময় নেই। কিন্তু মেয়েটি এত আশা করে এসেছে, তাকে তো নিরাশ করা যায় না। লানার দিকে তাকিয়ে বললাম, ঠিক আছে, ওদের নিয়ে এসে বাইরে অপেক্ষা কর। আমি না ডাকা পর্যন্ত ভিতরে আসবে না।

লানার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আমি নিশ্চিত, অন্য কেউ হলে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরত। আমার মুখের গাম্ভীর্যটি দেখে সাহস করল না। দীর্ঘদিন চেষ্টা করে এই গাম্ভীর্যটি আয়ত্তে এনেছি, সহজে কেউ কাছাকাছি আসতে সাহস করে না।

 

লানা বের হয়ে যেতেই আমি আমার সেক্রেটারি ট্রীনাকে ডাকলাম। ট্ৰীনা মধ্যবয়সী হাসিখুশি মহিলা। ভিতরে ঢুকে বলল, কিছু বলবেন স্যার?

তোমার খানিকক্ষণ সময় আছে?

অবশ্যই। সে আমার সামনের খালি চেয়ারটিতে বসে পড়ে বলল, কী করতে হবে?

আমি ষড়যন্ত্রীর মতো গলা নামিয়ে বলল, লানার ছেলে-বন্ধু জিশানকে তুমি চেন?

টীনা বিস্ময়টুকু সযত্নে গোপন ককেবলল, সেরকম চিনি না, সাথে দেখেছি দু একবার।

ওর বাবা আমার বিশেষ বন্ধ ছিল। ছেলেটি যদি বাবার কাছাকাছি হয়, তা হলে খুব হৃদয়বান হওয়ার কথা।

ট্রীনা মাথা নেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমি গলার স্বর আরো নামিয়ে বললাম, জিশানের পুরো নাম জিশান লাও। ডাটা বেসে খোঁজ করে দেখ তো, ওর সম্পর্কে কোনো চোখে পড়ার মতো তথ্য পাও কি না। আমার নাম বাবহার করে খোঁজ কর, অনেক রকম খোঁজ পাবে তা হলে।

ট্রীনা কিছুক্ষণের মাঝেই একটা কাগজ নিয়ে ঢুকল, আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, জিশানের উপর অনেক বড় ফাইল আছে, আমি শুধু দরকারি জিনিসটা টুকে এনেছি।

আমি একনজর দেখে বললাম, ঠিক আছে ট্রীনা, তুমি লানাকে বলবে ভিতরে আসতে? তার দুজন সঙ্গীকে নিয়ে।

লানা প্রায় সাথে সাথেই দুজন মানুষকে নিয়ে ঢুকল। কিছু কিছু মানুষের চেহারা দেখে বয়স বোঝা যায় না, এদের দুজনেই সেরকম। পরনে মোটামুটি ভদ্র পোশাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মতো খাপছাড়া নয়। একজন আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম—

আমি বাধা দিয়ে বললাম, তোমার নাম এক নম্বর।

হ্যাঁ, আপাতত তোমার ঠিক নামটি শুনে কাজ নেই। কারণ তুমি যদি গ্রুনো রবোট হয়ে থাক তাহলে সম্ভবত মিথ্যা একটা নাম বলবে। শুধু শুধু মিথ্যাচার করে লাভ কি? তোমাকে ডাকা যাক এক নম্বর।

এক নম্বরের দুই গাল একটু লাল হয়ে ওঠে। রাগ হয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে উষ্ণ স্বরে বলল, আমি গ্রুনো রবোট নই। আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে ওর সাথে। সে দ্বিতীয় লোকটিকে দেখিয়ে বলল, ঐ হচ্ছে গ্রুনো রবোট।

দ্বিতীয় লোকটি এবারে একটু মধুর ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বলল, আপনার কথা অনেক শুনেছি আমি। পরিচয় হয়ে খুব ভালো লাগল। অবশ্যি ঠিক পরিচয় হল না, কারণ আপনি তো নিশ্চয়ই আমার নামও শুনতে চাইবেন না।

না। আপাতত তোমার নাম হোক দুই নম্বর।

মানুষকে তার নিজের পরিচয় দিতে না দেয়ার মাঝে খানিকটা অপমানের ব্যাপার আছে।

এক নম্বর ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, তোমার সাথে এসেছি বলে আজ আমার এই অপমান।

আমিও তো একই কথা বলতে পারি।

না, পার না, এক নম্বর চোখ লাল করে বলল, তুমি গ্রুনো।

তুমি এত নিশ্চিত হলে কেমন করে যে আমি গ্রুনো?

কারণ আমি জানি আমি গ্রুনো না, আমি মানুষ।

কেমন করে জান? হতে পারে তুমি মিথ্যা বলছ। কিংবা কে জানে আরো ভয়ংকর জিনিস হতে পারে, তুমি ভাবছ তুমি মানুষ, কিন্তু আসলে তুমি গ্রুনো। তুমি নিজেই জান না যে তুমি গ্রুনো।

এক নম্বরকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেটা কি হতে পারে?

কোনটা?

যে, আমি গ্রুনো কিন্তু আমি জানব না?

না। কারণ তুমি যদি গ্রুনো হয়ে থাক, তা হলে তোমার মাথায় মস্তিষ্কের বদলে রয়েছে একটা কপোট্রন। তোমার বুকের মাঝে আছে একটা পারমাণবিক সেল। তোমার কপোট্রন ক্রমাগত হিসেব করছে সেলের ভোল্টেজ, ক্লক ফ্রিকোয়েন্সি, আর তোমাকে সেটা জানাচ্ছে মিলিসেকেণ্ড পরপর। কাজেই তুমি যদি গ্রুনো হয়ে থাক, তা হলে তুমি মিথ্যাবাদী গ্রুনো।

এক নম্বর উষ্ণ স্বরে বলল, আমি শুনন না, আমি মানুষ।

গ্রুনোকে মানুষের মতো করে তৈরি করা হয়েছে, কাজেই তুমি যদি গ্রুনো হয়ে থাক, তুমি মিথ্যা বলবে না আমি সেরকম আশা করছি না।

দু নম্বর একটু এগিয়ে এসে বলল, গত সংখ্যা বিজ্ঞান সংবর্তে আপনার লেখাটা পড়ে–

তুমি কি গ্রুনো?

দু নম্বর থতমত খেয়ে গেল। কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, আমি যতদূর জানি—আমি গ্রুনো না। আমার অতীত জীবনের সবকিছু পরিষ্কার মনে আছে, গ্রুনো হলে নিশ্চয়ই মনে থাকত না। খুব ছেলেবেলায় দোলনা থেকে পড়ে গিয়ে একবার হাঁটু কেটে গেল, সেটাও মনে আছে। সত্যি কথা বলতে, কাটা দাগটা এখনো আছে। দেখবেন?

আমি কিছু বলার আগেই এক নম্বর বলল, দেখাও দেখি।

নম্বর প্যান্ট হাঁটুর উপর টেনে তুলে একটা কাটা দাগ দেখাল।

এক নম্বর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাটা দাগটা খানিকক্ষণ দেখে বলল, জালিয়াতি, পুরো জালিয়াতি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কেমিক্যাল এচিং।

দু নম্বর গম্ভীর গলায় এক নম্বরকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি শৈশবের কথা মনে আছে?

অবশ্যই মনে আছে।

কত শৈশব?

অনেক শৈশব।

দু নশ্বর মাথা নেড়ে বলল, কিছু আসে-যায় না। আমি কোনোভাবে জানতে পারব তুমি সত্যি কথা বলছ, না মিথ্যা কথা বলছ।

আমি মিথ্যা বলি না।

সেটাও কোনদিন প্রমাণ করা যাবে না। দু নম্বর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলেন স্যার, আজ সারাটি দিন খুব অপমানের মিঝে কেটেছে। আমাকে দেখলেই বুঝবেন, জীবিকার জন্যে মানুষকে কী না করতে হয়। আমার সম্পর্কে এক চাচার কাজ ছিল একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গলদা চিংড়ি সেজে দাঁড়িয়ে থাকা। কী অপমান।

 

লানা আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার, কিছু বুঝতে পারলেন? আমার মনে হয় দু নম্বর, কী বলেন?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, এখনো জানি না।

তা হলে?

তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

আমি গলা নামিয়ে বললাম, তুমি তোমার অফিসে গিয়ে বস। আমি এখান থেকে দুজনকে পাঠাব। তুমি তাদের সাথে হালকা কোনো জিনিস নিয়ে কথা বলবে। হাসির কোনো গল্প। বেশিক্ষণ নয়, ঘড়ি ধরে দুই মিনিট।

ঠিক আছে।

আর শোন, ঘরের বাতিগুলো কমিয়ে দেবে, যেন তোমাকে ভালো করে দেখতে না পারে।

বেশ।

ওদের বসাবে তোমার খুব কাছাকাছি। একটা টেবিলের এপাশে আর ওপাশে।

ঠিক আছে স্যার।

লানা চলে যাচ্ছিল, আমি তাকে ডেকে ফেরালাম। হঠাৎ মনে পড়েছে এরকম ভঙ্গি করে বললাম, তুমি তো রাজনীতি সমাজনীতি এরকম অনেক কাজকর্ম কর, কয়দিন থেকে ভাবছি তোমাকে একটা জিনিস বলব।

কী জিনিস? পরে বলল, আমাকে মনে করিয়ে দিও।

দেব স্যার।

আর এই কাগজটা রাখ, কাউকে দেখাবে না। কয়দিন থেকে তোমাকে দেব ভাবছি, মনে থাকে না।

লানা কাগজটি নিয়ে বের হয়ে প্রায় সাথে সাথে ফিরে এল। আমি জানতাম আসবে, কারণ এখানে যে-ছয়জনের নাম লেখা হচ্ছে, তার একজন হচ্ছে জিশান লাও। শুধু তাই নয়, উপরে লেখা আছে পুলিশের গুপ্তচর। লানা পাংশু মুখে জিজ্ঞেস করল, এখানে কাদের নাম?

আমি গলা নামিয়ে বললাম, তোমরা যারা রাজনীতি কর, তাদের পিছনে সরকার থেকে গুপ্তচর লাগানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ভান করে এরা তোমাদের ভিতর থেকে খবর বের করার চেষ্টা করবে। পুলিশের টিকটিকি। এদের থেকে সাবধান।

লানার মুখ মুহূর্তে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে যায়। কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যেতে থাকে। এরকম প্রাণবন্ত একটি মেয়েকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখা খুব কষ্টকর। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।

আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে এক নম্বর এবং দু নম্বরকে বললাম, তোমরা দু জন এখন করিডোরের শেষ ঘরটিতে ঝবে। সেখানে লানা তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সে তোমাদের সাথে কিছু-একটা কথা বলবে, সেটা শুনে আমার কাছে এস। ঠিক আছে?

দু জনে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।

যাও।

দুজনেই বের হয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের মাঝেই দু জনে ফিরে এল। দুজনেরই হাসি-হাসি মুখ—এক নম্বরের মনে হল একটু বেশি হাসিমুখ।

জিজ্ঞেস করলাম, লানার সাথে কথা হল?

হ্যাঁ, হয়েছে। এক নম্বর দাঁত বের করে হেসে বলল, মেয়েটার যাকে বলে একেবারে তীক্ষ্ণ রসিকতাবোধ। এমন হাসির একটা গল্প বলেছে, কী বলব। একজন লোক টুথব্রাশ বিক্রি করে। দেখা গেল তার মতো আর কেউ

দু নম্বর বাধা দিয়ে বলল, আমার মনে হয় না স্যার এখন তোমার মুখ থেকে গল্পটা শুনতে চাইছেন।

না, আমি মানে—এক নম্বর আমতা-আমতা করে থেমে গেল। আমি টেবিলের উপর থেকে দরকারি কিছু কাগজপত্র আমার হাতব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বললাম, লানার মনের অবস্থা কেমন দেখলে?

মনের অবস্থা?

হ্যাঁ, মনের অবস্থা কেমন?

এক নম্বর একটু অবাক হয়ে বলল, মনের অবস্থা আবার কেমন হবে? ভালো। এত হাসির একটা গল্প বলল—এক নম্বর আবার দাঁত বের করে হাসা শুরু করে।

দু নম্বর মাথা নেড়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কি স্যার, আপনি যখন জিজ্ঞেস করলেন, আমি বলি, আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটার মন খারাপ।

মন খারাপ? এক নম্বর অবাক হয়ে বলল, মন খারাপ হবে কেন? কী দেখে তোমার মনে হল মন খারাপ?

দু নম্বর মাথা চুলকে বলল, ঠিক জানি না, কিন্তু মনে হল—

এক নম্বর মাথা চুলকে বলল, অন্ধকারে বসেছিল, ভালো করে দেখা পর্যন্ত যাচ্ছিল না, আর তোমার মনে হল মন খারাপ?

দু নম্বর একটু থতমত খেয়ে বলল, ইয়ে, ঠিক জানি না কেন মনে হল। আমি অবশ্যি একেবারে নিশ্চিত না। হতে পারে ভুল মনে হয়েছে।

আমি দু নম্বরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, না, তোমার ভুল মনে হয় নি, তুমি ঠিকই ধরেছ। লানার আসলেই মন খারাপ।

এক নম্বরের মুখ হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, আমার দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকাল সে। আমি আস্তে আস্তে বললাম, এক নম্বর, তুমি একজন গ্রুনো।

আ-আমি, আমি?

হ্যাঁ, তুমি। তাই তুমি ধরতে পার নি লনার মন খারাপ। একজন মানুষের যদি খুব মন খারাপ হয়, তার সাথে কোনো কথা না বলেও তার কাছাকাছি এসেই সেটা ধরে ফেলা যায়। এটা পরীক্ষিত সত্য। মানুষেরা ধরতে পারে। যন্ত্র পারে না।

আমি একটু এগিয়ে গিয়ে এক নম্বরের ডান কানের নিচে হাত দিয়ে সুইচটা খুঁজে বের করে তার সার্কিট কেটে দিলাম। দেখতে দেখতে তার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেল, মুখ দিয়ে অর্থহীন শব্দ করতে করতে এক নম্বর স্থির হয়ে গেল। শরীরে আর কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই।

আমি দু নম্বরকে বললাম, জিনিসটাকে নিচে শুইয়ে রাখ। হঠাৎ করে কারো উপর পড়ে গিয়ে একটা ঝামেলা করবে।

দু নম্বর বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমতা-আমতাভাবে বলল, কেমন করে শোওয়াব।

আমি এগিয়ে গিয়ে বুকে একটা ঘোট ধাক্কা দিয়ে বললাম, এভাবে।

গ্রুনো রবোটটি প্রচণ্ড শব্দ করে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। এক নম্বর দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে তাকে একবার ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। রবোটটি ভালো তৈরি করেছে, এভাবে আছড়ে পড়েও শরীরের কোনো অংশ ভেঙে আলাদা হয়ে গেল না।

আমি টেবিল থেকে আমার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বাসায় যাবার জন্যে প্রস্তুত হলাম। দুই নম্বর কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আপনাকে যে আমি কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। বিশ্বাস করেন, নিজের উপর সন্দেহ এসে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমি কি সত্যিই মানুষ?

অবশ্যি তুমি মানুষ। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল। আমি আন্তরিকভাবে তার সাথে হাত মিলিয়ে বললাম, এখন তোমার নামটা আমি শুনতে পারি।

মিকালো-আমার নাম শিন মিকালো।

শিন মিকালো, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল।

ঠিক এ-সময় লানা দরজায় এসে দাঁড়ায়। মিকালো তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। উচ্চস্বরে বলল, স্যার বের করে ফেলেছেন গ্রুনোকে।

লানা মেঝেতে পড়ে থাকা গ্রুনোকে একনজর দেখে বলল, কেমন করে বের করলেন?

সহজ, একেবারে সহজ। মিকালো এক হাতের উপর অন্য হাত দিয়ে তালি দিয়ে বলল, একেবারে পানির মতো সহজ। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, লানার মনের অবস্থা কেমন? আমি বললাম, মন খারাপ, গ্রুনো বলল, না

লানা চমকে উঠে আমার দিকে তাকায়। আমি কথোপকথনটি না শোনার ভান করে বললাম, না, তোমাকে একটা কাগজ দিয়েছিলাম খানিকক্ষণ আগে?

লানা শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, কেন? কী হয়েছে?

তোমাকে ভুল কাগজটা দিয়েছি। আমি তাকে আরেকটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললাম, এটা হচ্ছে সেই কাগজ। আগেরটা ফেলে দিও।

আগেরটা ভুল?

হ্যাঁ, ভুল।

এটা ঠিক?

হ্যাঁ, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে আমার এক ছাত্র কাজ করে, সে মাঝে মাঝে এসব গোপন খবর দিয়ে যায়।

লানা একনজর কাগজটা দেখে বলল, তা হলে আগে যে-কাগজটা দিয়েছিলেন সেটা কি?

ওটা—এটা অন্য জিনিস।

কী জিনিস?

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর কিছু মৌলিক লেখা বই হিসেবে বের করবে, তাদের নাম। আমার এক বন্ধুর ছেলের নামও আছে, জিশান লাও। খুব ভালো ছেলে–

লালার মুখ থেকে গাঢ় বিষাদের ছায়া সরে গিয়ে সেখানে স্বচ্ছ একটা আনন্দের হাসি ঝলমল করে ওঠে। আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল, আপনি ইচ্ছে করে আমাকে ভুল কাগজটা দিয়েছিলেন। ইচ্ছে করে। তাই না?

আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম, গ্রুনো কোম্পানি কি তাদের রবোটটা নিয়ে তোমাদের সাথে কোনোরকম চুক্তি সই করেছে?

না। কোননারকম চুক্তি সই করে নি?

না। কিছু না।

তা হলে একটা কাজ কর। ওটার কপোট্রনটা খুলে সিস্টেমটা বের করে নাও। সেটা কপি করে তোমাদের বন্ধুবান্ধব পরিচিত মানুষজনকে বিলিয়ে দিও। ঘরে ঘরে সবার কাছে যদি একটা করে সিস্টেম-৯-এর কপি থাকে, তা হলে গ্রুনো কোম্পানিকে পুরো সিরিজটা বাতিল করে দিতে হবে, ভবিষ্যতে আর এ ধরনের মামদোবাজি করবে না।

কপোট্রন কেমন করে খোলে?

স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে কপালের মাঝে জোরে আড়াআড়িভাবে চাপ দাও, খুলে যাবে। দাঁড়াও, আমি খুলে দিচ্ছি–

আমি একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে কপালে চাপ দিয়ে রবোটটার মাথাটা খুলে আনলাম।

গ্রুনো রবোটটি মাথা খোলা অবস্থায় ঘোলাটে চোখে বিসদৃশ ভঙ্গিতে মেঝের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে রইল।

০৫. অনিশ্চিত জগৎ

ঘুম থেকে উঠে খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকেন বৃদ্ধ রাউখ। কয়দিন থেকে তাঁর একটা আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছে। সব সময়েই মনে হয় কেউ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এত বাস্তব অনুভূতি যে রাউখ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক না দেখে পারলেন না।

কী দেখছেন প্রফেসর রাউখ?

প্রফেসর রাউখৈর ছোট কম্পিউটারটি মিষ্টি স্বরে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কয়দিন থেকে দেখছি আপনি হঠাৎ হঠাৎ করে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক দেখছেন। কী দেখছেন?

নাহ্‌, কিছু না।

বলুন না কী হয়েছে। কম্পিউটারটি অনুযোগের সুরে বলল, আপনি তো আমার কাছে কখনো কিছু গোপন করেন না।

বৃদ্ধ রাউখ মাথা চুলকে বললেন, ব্যাপারটা তোমাকে বোঝাতে পারলে বলতাম, কিন্তু তুমি ঠিক বুঝবে না। জিনিসটা নেহায়েত মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানুষ লক্ষ

কোটি বছরের বিবর্তনের ফল, তাদের রক্তে কিছু কিছু আশ্চর্য জিনিস রয়ে গেছে, যার জন্যে মাঝে মাঝে তারা এমন কিছু অনুভব করে, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।

যেমন?

যেমন—প্রফেসর রাউখ একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন, যেমন কয়দিন থেকে মনে হচ্ছে সব সময় আমার দিকে যেন কেউ তাকিয়ে আছে।

প্রফেসর রাউখের কম্পিউটারটি, যাকে তিনি শখ করে ট্রিনিটি বলে ডাকেন, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আশ্চর্য।

হ্যাঁ, আশ্চর্য।

ভারি আশ্চর্য।

হ্যাঁ, কিন্তু এটা নিয়ে তোমার ব্যস্ত হবার কোনো কারণ নেই। আমরা মানুষেরা অনেক ধরনের পরস্পরবিরোধী জটিল জিনিস নিয়ে বেঁচে থাকি।

তা ঠিক।

হ্যাঁ, ব্যাপারটা আসলে তত খারাপ নয়—তুমি যত খারাপ মনে কর তত খারাপ নয়। যাই হোক, নতুন কোনো খবর আছে?

ট্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তেমন কিছু নয়।

প্রফেসর রাউখ হাসার চেষ্টা করে বললেন, তার মানে খারাপ খবর। কী হয়েছে বলে ফেল।

আপনার মাসিক ভাতা কমিয়ে অর্ধেক করে দেয়া হয়েছে।

প্রফেসর রাউখ ঘোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি প্রথম সারির গণিতবিদ, তিনি চাইলে তাঁর নামে পৃথিবীতে দুটি ইন্সটিটিউট থাকত, প্রতিপ্রকর্ষ বলের উপর লেখা চমকপ্রদ সমীকরণটি তাঁর চিন্তাপ্রসূত, তাঁর সহকর্মী সেটিকে নিজের বলে ঘোষণা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। অথচ তিনি অর্থাভাবে শহরের পুরাতন ঘিঞ্জি এলাকায় ছোট একটি ঘর ভাড়া করে দুস্থ শ্রমিকদের মতো কৌটার খাবার খেয়ে বেঁচে থাকেন। তাঁর সেরকম কোনো বন্ধু নেই, স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে নিঃসঙ্গ। ট্রিনিটির সাহচর্যের বাইরে তাঁর কোনো জগৎ নেই। তাঁর প্রয়োজন অতি অল্প, অথচ সেখানেও আবার হাত বসানো হল।

প্রফেসর রাউখ।

বল।

আপনি গ্যালাক্টিক হাইপারডাইরে উপর কাজটা করতে রাজি হয়ে যান।

প্রফেসর রাউখ মাথা নেড়ে বললেন, তা হয় না ট্রিনিটি। নিজের শখের কাজ করি বলে মনে হয় বেঁচে থাকা কত আনন্দের। যদি যুদ্ধ-কৌশলের উপর কাজ করি, তাহলে কি কখনো মনে হবে বেঁচে থাকা আনন্দের?

কিন্তু অন্য অনেকে তো করছে।

করুক। যদি সবাইও করে, তন্তু আমি করব না। জীবন বড় ছোট, সেটা নিয়ে ছেলেখেলা করতে হয় না।

ট্রিনিটি প্রফেসর রাউখের প্রাতঃকালীন খাবারের আয়োজন করতে বের হয়ে গেল। প্রফেসর রাউখ চুপচাপ বিছানায় বসে রইলেন, তাঁর আবার মনে হতে থাকে, কেউ একজন তাঁর দিকে গকিয়ে আছে। তিনি মাথা ঘুরিয়ে তাকান, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারদিকে দেখেন। কেউ নেই, কিন্তু কী আশ্চর্য, তাঁর তবু মনে হতে থাকে কেউ একজন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, বিষণ্ণ দৃষ্টি, কাতর মুখ! কিছু একটা বলতে চায় মিনতি করে। মন খারাপ হয়ে যায় প্রফেসর রাউখের।

একটু বেলা হয়ে এলে প্রফেসর রাউখ কাজ করতে বসেন। অভ্যেসমতো প্রথম ঘণ্টাদুয়েক পড়াশোনা করে নেন। পৃথিবীর যাবতীয় গাণিতিক জার্নালের সারাংশ তাঁর কাছে পাঠানো হয়। এটি খরচসাপেক্ষ ব্যাপার, দুঃসহ অর্থাভাবের মাঝেও তিনি সেটা বন্ধ করেন নি। নূতন নূতন কাজকর্ম কী হচ্ছে, তার উপর চোখ বুলিয়ে নিজের পছন্দসই বিষয়গুলো খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। প্রতিভাবান নূতন কোনো গণিতবিদ বের হয়েছে কী না তিনি লক্ষ রাখেন। কমবয়সী ক্ষ্যাপা গোছের একজন গণিতবিদ হঠাৎ করে গণিতের জগতে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবে, এ-ধরনের একটা ছেলেমানুষি চিন্তা প্রায়ই তাঁর মাথায় খেলা করে।

প্রতিজগতের উপর প্রফেসর রাউখ অনেক দিন থেকে কাজ করছেন, সমস্যাটি জটিল এবং প্রতিবার তিনি এক জায়গায় এসে আটকে যাচ্ছেন। যে-ব্যাপারটি নিয়ে সমস্যা, সেটি একটি ছোট গাণিতিক সমস্যা, যার কোনো সমাধান নেই বলে বিশ্বাস করা হয়। এরকম পরিবেশে সাধারণত সমস্যাটা এড়িয়ে একটি সমাধান ধরে নিয়ে কাজ শেষ করা হয়। প্রফেসর রাউখ খাঁটি গণিতবিদ, তিনি কোনো কিছু এড়িয়ে যাওয়া পছন্দ করেন না, তাই গত পনের বছর থেকে তিনি এই ঘোট, গুরুত্বহীন, কিন্তু প্রায় অসম্ভব সমস্যাটি সমাধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁর বর্তমান অর্থাভাবের সেটি একটি বড় কারণ।

প্রফেসর রাউখ কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন। সমীকরণটি প্রায় কয়েক হাজার বার নানাভাবে লিখেছেন, আজকেও গোটাগোটা হাতে লিখলেন। নিরীহ এই সমীকরণটি যে কত ভয়ংকর জটিল হতে পারে, কে বলবে? প্রফেসর রাউখ সমীকরণটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, হঠাৎ তাঁর মনে হল, আজ হয়তো তার সমাধান বের করে ফেলবেন। কেন এরকম মনে হল তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না।

গত কয়েকদিন থেকে তাঁর মাথায় একটা নূতন জিনিস খেলছে, সেটা আজ ব্যবহার করে দেখবেন। ঠিক কী ভাবে ব্যবহার করবেন এখনো জানেন না। নানারকম সম্ভাবনা রয়েছে, সবগুলো চেষ্টা করে দেখতে একটা জীবন পার হয়ে যেতে পারে তাই খুব ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হবে। প্রফেসর রাউখ অনামনন্ধভাবে কলমটি ধরে কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লেন।

ট্রিনিটি দুপুরবেলা প্রফেসর রাউখকে একগ্লাস দুধ দিয়ে গেল। বিকেলে এসে দেখল, তিনি সেই দুধ স্পর্শও করেন নি। প্রফেসর রাউ ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করতে পারেন না, তাঁর জন্যে সারাদিন অভুক্ত থাকা একটা গুরুতর ব্যাপার। ট্রিনিটি তাঁকে বিরক্ত করল না, কম্পিউটারের স্বল্পবুদ্ধিতে এই লোকটিকে পুরোপুরি অনুভব করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, এরকম অবস্থায় প্রফেসর রাউখকে একা একা কাজ করতে দিতে হয়।

 

প্রফেসর রাউখ যখন তাঁর টেবিল ছেড়ে উঠলেন তখন গভীর রাত, প্রচণ্ড ক্ষুধায় তাঁর হাত কাঁপছে। কিন্তু তাঁর মাথা আশ্চর্যরকম হালকা। তিনি বাথরুমে গিয়ে মুখে-চোখে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। ট্রিনিটি হালকা স্বরে ডাকল, প্রফেসর রাউখ।

বল।

আপনি সত্যি তা হলে সমাধান করেছেন?

হ্যাঁ ট্রিনিটি।

আমার অভিনন্দন প্রফেসর রাউখ।

অনেক ধন্যবাদ।

আমি জানতাম আপনি এটা সমাধান করতে পারবেন।

কেমন করে জানতে?

কারণ আপনি হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ।

প্রফেসর রাউখ শব্দ করে হাসলেন। ট্রিনিটি বলল, এটি করতে আপনার সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে।

জানি।

সমস্যাটি কি সত্যিই এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

যে-জিনিস আমরা জানি না সেটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না, সে হিসেবে এটার কোনো গুরুত্ব ছিল না, কিন্তু এখন এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সত্যি?

হ্যাঁ।

আপনি নূতন কিছু শিখলেন প্রফেসর রাউখ?

শিখেছি।

কী?

বললে তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না।

করব, আপনি বলুন, আমি আপনার সব কথা বিশ্বাস করি।

শোন তা হলে, না বুঝলে প্রশ্ন করবে।

করব।

প্রফেসর রাউখ ট্রিনিটিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, আমাদের পরিচিত জগৎ হচ্ছে ত্রিমাত্রিক জগৎ, সময়টাকে চতুর্থ মাত্রা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু সত্যিই কি আমাদের জগৎ চার মাত্রার? এমন কি হতে পারে, যে, জগৎটি আটমাত্রার এবং আমরা শুধুমাত্র চারটি মাত্রা দেখছি এবং বাকি চারটি মাত্রা দেখছি না? ঠিক সেরকম আরেকটি জগৎ রয়েছে, যেখানকার অধিবাসীরা শুধু তাদের চারটি মাত্রা দেখছে এবং আমাদের চারটি মাত্রা দেখছে না? তা হলে একই সাথে থাকবে দুটি জগৎ, একটি আমরা দেখতে পাব, আরেকটি পাব না।

প্রফেসর রাউখ অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ সবই ছিল কল্পনার ব্যাপার। সেটার বাস্তব সম্ভাবনা প্রমাণ করা যায় শুধুমাত্র অঙ্ক কষে। আমি অনেক দিন থেকে এর ওপরে কাজ করছিলাম, আজ আমি সেটার সমাধান বের করেছি। কী দেখেছি জান?

কী?

দেখেছি, আমাদের জগতের বাইরে আরেকটি চতুর্মাত্রিক জগৎ রয়েছে। সেই জগৎ একই সাথে আমাদের পাশাপাশি বেঁচে রয়েছে। সম্ভবত সময়ের মাত্রা দুটি জগতেই এক, সে-অংশটুকু এখনো বের করা হয় নি।

ট্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, সেখানে গ্রহ-নক্ষত্র আছে। সেখানে প্রাণের বিকাশ হয়েছে?

এসব হচ্ছে খুঁটিনাটি ব্যাপার। কারো পক্ষে বলা খুব কঠিন, কিন্তু তা খুবই সাব।

পৃথিবীর মানুষ সেই জগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে?

প্রফেসর রাউখের মুখ হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে ওঠে। মাথা নেড়ে বললেন, মনে হয় পারবে না। আমার হিসেব যদি ভুল না হয়, তা হলে সেটার চেষ্টা করা হবে খুব ভয়ানক বিপদের কাজ।

কেন?

কারণটি খুব সহজ। আমাদের জগৎ আর সেই জগতের মাঝে শক্তির একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। আমরা সেটা অনুভব করি না, সেই জগতেও সেটা অনুভব করে না। কিন্তু কোনোভাবে যদি দুই জগতের মাঝে একটা যোগাযোগ করে দেয়া যায়, তা হলে যে-জগতের শক্তি বেশি সেখানকার বাড়তি শক্তি পুরো জগৎটাকে ঠেলে অন্য জগতে পাঠিয়ে দেবে।

মানে? ট্রিনিটি বোঝার চেষ্টা করে, আপনি বলছেন, কেউ যদি যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, হঠাৎ করে এখানে সম্পূর্ণ একটা নূতন জগৎ নূতন গ্রহ-নক্ষত্র হাজির হয়ে যেতে পারে?

প্রফেসর রাউখ অল্প মাথা নেড়ে বললেন, অনেকটা সেরকম। কিন্তু সেই ব্যাপারটা হয়তো তত খারাপ নয়, খারাপ হচ্ছে পদ্ধতিটা। যখন পুরো জগৎ একটি ছোট গর্ত দিয়ে বের হয়ে আসতে থাকবে-চিন্তা করতে পার, কী ভয়ানক বিপর্যয়?

তার মানে আপনি বলছেন, যে-জগৎটার শক্তি বেশি, সেটার ভয় বেশি, যে কোনো মুহূর্তে সেটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে?

কথাটা খানিকটা সত্যি। দুটি জগৎ রয়েছে এখানে, একটা নিশ্চিত জগৎ, আরেকটা অনিশ্চিত জগৎ। যেটা অনিশ্চিত, সেটা যে-কোনো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

আমাদের জগৎ কোনটি? যেটি নিশ্চিত সেটি, নাকি যেটি অনিশ্চিত, সেটি?

জানি না। সত্যি কথা বলতে কি, সেটা কোনোদিন জানা সম্ভব হবে কি না সেটাও আমি জানি না। কেউ যদি ছোট একটা পরীক্ষা করে বের করতে চায়, অনিশ্চিত জগৎটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

কী ভয়ানক।

হ্যাঁ, ভয়ানক। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক কোনায় একটি ছোট ফুটো করে অন্য জগৎটিকে টেনে নিয়ে এসে ধ্বংস করে দেয়া যায়।

কী ভয়ানক। ট্রিনিটির যান্ত্রিক মস্তিষ্কের পুরো ব্যাপারটি অনুভব করতেও রীতিমতো কষ্ট হয়।

প্রফেসর রাউখ বিছানায় শুয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিতেই আবার সেই আশ্চর্য অনুভূতিটি হল, মনে হল কেউ যেন তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তিনি অস্বস্তিতে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালেন, কোথাও কেউ নেই, কিন্তু কী বাস্তব অনুভূতি। নিজেকে শান্ত করে কোনোভাবে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। মাথার কাছে একটা শিরা দপদপ করছে, সহজে ঘুম আসতে চায় না। কী সাঙ্ঘাতিক একটা জিনিস তিনি বের করেছেন, কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ কেউ নেই, যার কাছে এটা নিয়ে গল্প করতে পারেন। আহা—আজ যদি তাঁর স্ত্রী বেঁচে থাকত। সুদীর্ঘ কুড়ি বছর আগে মৃত স্ত্রীর কথা স্মরণ করে তিনি একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

ভোররাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল প্রফেসর রাউখের। কিছু-একটা হয়েছে কোথাও। তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না কি। চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন তিনি, ঘরে নীল একটা আলো, কোথা থেকে আসছে এটি?

চোখ মেলে তাকালেন তিনি, তাঁর সামনে ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় মেঝে থেকে খানিকটা উপরে চতুষ্কোণ একটা জায়গা থেকে হালকা নীল রঙের একটা আলো বের হচ্ছে, ভালো করে না তাকালে দেখা যায় না।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন প্রফেসর রাউখ। খুব ধীরে ধীরে আলোটি উজ্জ্বল হতে থাকে। আস্তে আস্তে সেখানে একজোড়া চোখ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চোখের দৃষ্টি বিষণ্ণ, সেই বিষণ্ণ চোখে একদৃষ্টিতে চোখ দুটি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে।

প্রফেসর রাউখ কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখেন, আজীবন গণিতের সাধনা করে এসেছেন, যুক্তিতর্ক ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেন না। নিজেকে বোঝালেন, আমি ভুল দেখছি, সারা দিন পরিশ্রম করে আমার রক্তচাপ বেড়ে গেছে, তাই চোখে বিভ্রম দেখছি। বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে। আমি এখন চোখ বন্ধ করব, একটু পর যখন চোখ খুলব, তখন দেখব কোথাও কিছু নেই।

প্রফেসর রাউখ চোখ বন্ধ করে কয়েকটি দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলেন, তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। চোখ খুলে দেখলেন নীলাত চতুষ্কোণ অংশটুকু এখনো আছে, চোখ দুটি এখনো একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাই নয়, তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটিতে এবার পলক পড়ল, প্রফেসর রাউখ নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখলেন, নীলাভ অংশটুকু ধীরে ধীরে আরো বড় হয়ে উঠছে, চোখ দুটির সাথে সাথে আস্তে আস্তে মুখের আরো খানিকটা দেখা যাচ্ছে—একজন বিষণ্ণ মানুষের চেহারা। করুণ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রফেসর রাউখ বিছানায় উঠে বসেন, সাথে সাথে নীলাভ চতুষ্কোণের চোখ দুটিতে ভীতি ফুটে ওঠে। তাঁর কিছু একটা বলার চেষ্টা করে–তিনি বুঝতে পারেন না সেটি কি। প্রফেসর রাউখ বিছানা থেকে নেমে আসেন, সাথে সাথে চোখ দুটি আতঙ্কে স্থির হয়ে যায়, যন্ত্রণাকাতর একটি মুখ আবার তাঁকে কিছু-একটা বলতে চেষ্টা করে। প্রফেসর রাউখ এক মুহূর্ত দ্বিধা করে এক এগিয়ে যান, সাথে সাথে পুরো নীলাভ অংশটুকু দপ করে নিভে গেল।

প্রফেসর রাউখ বাতি জ্বালালেন, যেখানে চোখ দুটি ছিল সে-জায়গাটি খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। কোথাও কিছু নেই—তীর কেন জানি একটু ভয়-ভয় করতে থাকে। কেন এরকম অস্বাভাবিক জিনিস তিনি দেখলেন? প্রফেসর রাউখ ঘর থেকে বের হয়ে ডাকলেন, টনিটি।

ট্রিনিটি কোনো সাড়া দিল না, তখন তাঁর মনে পড়ল, খরচ বাঁচানোর জন্য আজকাল রাতে তাকে সুইচ বন্ধ করে রাখা হয়। তাকে জাগাবেন কী না কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বাইরে এসে বসলেন। পুরো ব্যাপারটা আবার চেষ্টা করলেন আবার। যেদিন থেকে গাণিতিক সমস্যাটার সঠিক সমাধানটি তাঁর মাথায় এসেছে, সেদিন থেকে তাঁর মনে হচ্ছে কেউ-একজল তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগে দেখলেন, সত্যি কেউ-একজন তীর দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি দেখেছেন তিনি, নাকি চোখের বিভ্রম; সত্যি তো হতে পারে না, কিন্তু চোখের বিভ্রম কেন হবে? বয়স হয়েছে তাঁর, কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কে তো এখনো কৈশোরের সজীবতা।

বৃদ্ধ প্রফেসর রাউখ বসে বসে ভোরের আলো ফুটে উঠতে দেখলেন, অকারণে তার মন খারাপ হয়ে রইল।

 

প্রাতঃরাশ করার সময় ট্রিনিটি প্রফেসর রাউখকে জানাল যে, কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান আকাদেমি থেকে তাঁকে নেয়ার জন্যে গাড়ি পাঠানো হয়েছে। এক ঘণ্টার ভিতর তাঁকে যেতে হবে। শুনে প্রফেসর রাউখ একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন, তাঁর সাথে বিজ্ঞান আকাদেমির কোনো যোগাযোগ নেই প্রায় দুই দশক।

প্রফেসর রাউখের হতচকিত ভাব দেখে ট্রিনিটি বলল, গতকাল আপনি যে সমস্যাটি সমাধান করেছেন, সম্ভবত সেটি বিজ্ঞান আকাদেমিকে অভিভূত করেছে।

প্রফেসর রাউখ চিন্তিত মুখে বললেন, তুমি ওদের জানিয়ে দিয়েছ?

না, আমি বিজ্ঞান আকাদেমিকে জানাই নি, কিন্তু গণিত জার্নালে একটা ছোট সারাংশ পাঠিয়েছি। সেটা তো আমি সব সময়েই পাঠাঁই। আপনি তো তাই বলে রেখেছেন।

হ্যাঁ, প্রফেসর রাউখ মাথা নাড়লেন, আমার ভুল হয়েছে। এই ব্যাপারটা আরো কিছুদিন গোপন রাখা উচিত ছিল, তোমাকে আমার বলে দেয়া উচিত ছিল।

আমি দুঃখিত প্রফেসর রাউখ। ট্রিনিটি তার গলার স্বরে শঙ্কা ফুটিয়ে বলল, আমি খুবই দুঃখিত। আপনার কি কোন সমস্যা হবে?

জানি না। আমি বিজ্ঞান আকাদেমিকে পছন্দ করি না। তারা সবসময় জোর করার চেষ্টা করে। আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করি।

ট্রিনিটি ক্ষুন্ন স্বরে বলল, আমি দুঃখিত প্রফেসর রাউখ।

তোমার দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই ট্রিনিটি। প্রফেসর রাউখ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, গতকাল আমি যেসব কাজ করেছি, সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে পারবে?

সর্বনাশ! কী বলছেন! এত দিনের কাজ

ভয় পেয়ো না, প্রফেসর রাউখ মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, সব এখানে রয়ে গেছে। যখন প্রয়োজন হবে, কাগজে আয় বের করে নিতে এবারে কোনো সময় লাগবে না।

 

সাদা একটা হলঘরে বসে আছেন প্রফেসর রাউখ। যদিও বিজ্ঞান আকাদেমির গাড়িতে চেপে তিনি এসেছেন, তাঁকে কিন্তু বিজ্ঞান আকাদেমির ভবনে না এনে সরকারি একটা ভবনে আনা হয়েছে। ভবনটি অত্যন্ত সুরক্ষিত, এখানে নানা ধরনের প্রহরা, ব্যাপারটি দেখে তাঁর মনে কেমন জানি একটা খটকা লাগতে থাকে।

আসবাবপত্রহীন শূন্য ঘরটিতে দীর্ঘ সময় একা একা বসে থাকার পর হঠাৎ করে কয়েকজন লোক প্রবেশ করে, কাউকেই তিনি চেনেন না। একজনকে মনে হল আগে কোথায় জানি দেখেছেন। কিন্তু কোথায় দেখেছেন ঠিক মনে করতে পারলেন না।

লোকগুলো তাঁকে ঘিরে বসে পড়ে। চেনা চেনা লোকটি খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটিয়ে বলল, আপনি আমাকে চিনতে

না। মনে হচ্ছে কোথায় দেখেছি, কিন্তু–

ভারি আশ্চর্য। আমি এদেশের রাষ্ট্রপতি রিবেনী।

প্রফেসর রাউখ চমকে উঠে সোজা হয়ে বসলেন। এই ভণ্ড প্রতারক লোকটির অসংখ্য নিষ্ঠুরতার গল্প প্রচলিত রয়েছে। ঢোক গিলে শুকননা গলায় বললেন, আমি দুঃখিত। আমি–

রাষ্ট্রপতি রিবেনী হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার কাছে খবর এসেছে, আপনি নাকি একটি অস্বাভাবিক আবিষ্কার করেছেন। শুনে খুশি হবেন, আপনার কাজ শেষ করার জন্য এই মুহূর্তে সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের নিয়ে একটা ইন্সটিটিউট খোলা হচ্ছে। আপনার নামে সেই ইন্সটিটিউটটি উৎসর্গ করা হবে।

একটি দেশের রাষ্ট্রপতির সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয় প্রফেসর রাউখের জানা নেই। তাই বাধা দেয়ার প্রবল ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও তিনি কাঠ হয়ে বসে রইলেন।

রাষ্ট্রপ্রতি রিবেনী মুখের ধূর্ত হাসিটি বিস্তৃত করে বললেন, আপনার কাজটুকু শেষ করুন। আপনার কী লাগবে আমাদের জানান। যত বড় কম্পিউটার চান, যতজন গণিতবিদ চান, শুধু মুখ ফুটে বলবেন।

প্রফেসর রাউখ শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে বললেন, আমার কাজ তো কিছু বাকি নেই, যে-জায়গাটাতে আটকে ছিলাম, গতরাতে শেষ হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি রিবেনীর চোখ এক মুহূর্তের জন্যে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, কিন্তু সেটা এক মুহূর্তের জন্যেই। মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, না, আপনার কাজ শেষ হয় নি। আপনার এখনো দুটি জিনিস বের করতে হবে। এক, আমাদের জগৎটি নিশ্চিত না অনিশ্চিত। দুই, নিশ্চিত এবং অনিশ্চিত জগতের মাঝে যোগাযোগ কেমন করে করা যাবে।

কিন্তু সেটা তো ভয়ানক বিপজ্জনক। ভয়ানক–

রিবেনী ধূর্ত চোখে তাকিয়ে বললেন, সেটাই তো সবচেয়ে বড় কথা। আমরা যদি নিশ্চিত জগতের অধিবাসী হই, তা হলে অনিশ্চিত জগৎকে আমরা হাতের মুঠোয় রাখব। যখন খুশি আমরা তাদের ধ্বংস করে দিতে পারব, তখন তাদের কাছে আমরা যা খুশি তাই দাবি করতে পারব। চিন্তা করতে পারেন, একটি পুরো জগৎ থাকবে আমাদের হাতের মুঠোয়। আমার হাতের আঁঠোয়।

প্রফেসর রাউখ অবাক হয়ে দেখলেন, ব্যাপারটা কল্পনা করে রাষ্ট্রপতি রিবেনীর মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠছে। বিষাক্ত সরীসৃপ দেখে যেরকম একটা ভয় হয়, হঠাৎ সেরকম একটা ভয় অনুভব করলেন প্রফেসর রাউখ। প্রায় মরিয়া হয়ে বললেন, কিন্তু আমরা যদি অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী হই?

সেটা আপনাকে বের করতে হবে প্রফেসর রাউখা অনিশ্চিত জগৎ হলেই যে ব্যাপারটা অন্যরকম হবে, সেটা কেন ভাবছেন? তখন আমরা সারা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসব, কারণ ইচ্ছে করলে তখন আমরা এই পুরো জগৎ ধ্বংস করে দিতে পারব, কী প্রচণ্ড ক্ষমতা ভেবে দেখেছেন?

রাষ্ট্রপতি রিবেনী প্রফেসর রাউখের চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন, কিন্তু সবার আগে আমাদের জানা দরকার আমরা কি নিশ্চিত জগতের অধিবাসী, নাকি অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী। আর জানা দরকার, কেমন করে এই দুই জগতের যোগাযোগ করা যায়।

রাষ্ট্রপতি রিবেনী মুখের হাসিকে বিস্তৃত করে বললেন, আপনাকে এক সপ্তাহ সময় দেয়া হল।

প্রথমবার প্রফেসর রাউখ অনুভব করলেন, অসহ্য একটা ক্রোধ ধীরে ধীরে তাঁর শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, দীর্ঘদিন থেকে তাঁর এই অনুভূতিটির সাথে পরিচয় নেই। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বললেন, যদি এক সপ্তাহে আমি সেটা বের না করি?

না শোনার ভান করলেন রাষ্ট্রপতি রিবেনী। মাথা নেড়ে বললেন, আপনি বড় গণিতবিদ, এক সপ্তাহে সহজেই বের করে ফেলবেন আপনি, তা ছাড়া আপনাকে সাহায্য করবে অসংখ্য প্রথম শ্রেণীর গণিতবিদ, অসংখ্য শক্তিশালী কম্পিউটার।

কিন্তু আমি যদি এটা করতে অস্বীকার করি?

প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতি রিবেনীর মুখের মাংসপেশী শক্ত হয়ে যায়, আস্তে আস্তে বললেন, আপনি অস্বীকার করবেন না প্রফেসর রাউখ। আমার অনুরোেধ রাখতে কেউ অস্বীকার করে না—এখনো করে নি।

কিন্তু–

রিবেনী বাধা দিয়ে বললেন, তবু যদি আপনি অস্বীকার করেন, তা হলে আপনার মস্তিটা নিয়ে ক্রুগো কম্পিউটারের সাথে জুড়ে দেব। আমাদের যা বের করার দরকার, সেটা খুব সহজেই বের করা যায় প্রফেসর রাউখ, আপনাকে আর কষ্ট করতে হয় না তা হলে।

অনেক কষ্ট করেও প্রফেসর রাউখ তাঁর আতটুকু লুকাতে পারলেন না। রাষ্ট্রপতি রিবেনী প্রফেসর রাউখের রক্তশূন্য মুখের দিকে তাকিয়ে অমায়িকভাবে হাসলেন। বললেন, আপনার মস্তিষ্ক এভাবে আমি নিতে চাই না, নেহায়েত আপনি যদি জোর করেন, তা হলে ভিন্ন কথা।

ঠিক এ-সময়ে সামরিক বাহিনীর দুজন উচ্চপদস্থ লোক এসে রাষ্ট্রপতি রিবেনীর কানে ফিসফিস করে কী-একটা বলল, সাথে সাথে রিবেনী উঠে দাঁড়ালেন, প্রফেসর রাউখকে কোনো সম্ভাষণ না জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। পিছু পিছু অন্য সবাই। প্রফেসর রাউখ শূন্য ঘরে একা একা বসে রইলেন। তাঁর সমস্ত মুখ তেতো বিস্বাদ।

 

প্রফেসর রাউখ ঘরে নিজের বিছানায় দুই পা তুলে চুপচাপ বসে রয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের লোকজন এসে তাঁর সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে গেছে। সরকারি মহল থেকে তাদের উপর নির্দেশ দেয়া হয়েছে, প্রায় অপরিচিত এই বৃদ্ধ লোকটিকে রাতারাতি মহামানবের পর্যায়ে তুলে নিতে হবে। প্রফেসর রাউখের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য নেই, তাঁর কলের পুতুলের মতো অন্যের নির্দেশ মেনে নেয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না। তাঁর চোখের সামনে সংবাদপত্রের লোকেরা তাঁর সাদামাঠা জীবনের ওপর রং চড়িয়ে তাঁকে একটা অতিমানবিক আকর্ষণীয় ব্যক্তিতে পরিণত করে ফেলল।

রাত গভীর হয়ে এসেছে। প্রফেসর রাউখের চোখে ঘুম নেই। দু হাতে মাথা চেপে ধরে তিনি বিছানায় বসে অনেকটা আপন মনে বললেন, আমার বেঁচে থাকার আর কোনো অর্থ নেই। আমার সব শেষ হয়ে গেল। সব শেষ–

প্রফেসর রাউখ।

অপরিচিত একটা গলার স্বরে প্রফেসর রাউখ চমকে উঠে সামনে তাকান। ঘরের মাঝামাঝি আবার সেই চতুষ্কোণ নীলাভ আলো। তার মাঝে একজন মানুষের মুখমণ্ডল। মানুষটি বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। প্রফেসর রাউখ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলেন, তিনি কি সত্যি দেখছেন?

মানুষটি আবার ফিসফিস করে ডাকল, প্রফেসর রাউখ।

মানুষটির বিষণ্ণ চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ প্রফেসর রাউখ সবকিছু বুঝে গেলেন। আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি আস্তে আস্তে বুক থেকে বের করে বললেন, তুমি অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী?

হ্যাঁ প্রফেসর রাউখ। নীলাভ চতুষ্কোণের ছায়ামূর্তি যান্ত্রিক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমরা অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী, আমরা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।

প্রফেসর রাউখ দেখলেন, ছায়ামূর্তির পিছনে আরো অনেক মানুষের চেহারা। খুব ধীরে ধীরে তার মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে। আস্তে আস্তে বললেন, তোমরা তোমাদের অনিশ্চিত জগৎকে রক্ষা করার জন্য আমার কাছে এসেছ?

আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন প্রফেসর রাউখ।

কয়েক মুহূর্ত কী-একটা ভাবলেন প্রফেসর রাউখ, তারপর দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন, অচিন্তনীয় শক্তির পার্থক্য তোমাদের সাথে আমাদের, সেই শক্তিকে আটকে রেখে তোমরা আমার সাথে যোগাযোগ করতে পার? আমার সাথে কথা বলতে পার?

পারি।

কী আশ্চর্য! তার মানে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তোমরা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে আছ। অনেক অনেক এগিয়ে আছ।

আছি।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইলেন প্রফেসর রাউখ। তারপর হঠাৎ তার এক আশ্চর্য সম্ভাবনার কথা মনে হল। একটু দ্বিধা করে প্রকাশ করে ফেলেন সেটা, তোমরা আমার উপর অনেক দিন থেকে জর রাখছ?

রেখেছি। সেজন্যে আমরা দুঃখিত। আমরা ক্ষমা চাইছি।

তোমরা জানতে আমি এই সমস্যার সমাধান করতে যাচ্ছি?

জানতাম। আমাকে ইচ্ছা করলে তোমরা থামাতে পারতে?

পারতাম।

প্রফেসর একটু দ্বিধান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে মেরে ফেলতে পারতে?

পারতাম প্রফেসর রাউখ।

তাহলে—তা হলে আগেই কেন তোমরা আমাকে শেষ করে দিলে না?

আপনি স্বৈরাচারী শাসক নন প্রফেসর রাউখ, আপনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ। আপনাকে হত্যা করার অধিকার আমাদের নেই।

কিন্তু আমি যে-সমস্যাটা সমাধান করেছি, সেটা না করতে পারলে কেউ তোমাদের জগতের কথা জানতে পারত না। আমাকে থামিয়ে দিলে তোমাদের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা থাকত।

কিন্তু আপনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ, আপনার গণিত সাধনায় আমরা কী ভাবে বাধা দিই? আপনার আনন্দে তো আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি না।

কিন্তু আমি যেটা সমাধান করেছি, সেটার জন্য তোমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারত।

ছায়ামূর্তি গভীর আত্মবিশ্বাসে মাথা নাড়ে, না, পারত না। আমরা আপনাকে জানি। আমরা জানি, আপনি আপনার গবেষণালব্ধ জ্ঞান কখনো ধ্বংসের জন্যে ব্যবহার করবেন না।

প্রফেসর রাউখ একটু অস্থির হয়ে বললেন, কিন্তু সেটা তো আমার হাতে নেই, সেটা তো জানাজানি হয়ে গেছে।

আপনার সমাধানটি কারো হাতে নেই, আপনি নিজের হাতে সেটি নষ্ট করেছেন। সমাধানটি ছাড়া এই তথ্যটির কোনো মূল্য নেই। এই তথ্যটি আরেকটি কাল্পনিক সূত্র। আপনি ছাড়া আর কেউ সেই সমাধানটি করতে পারবে না।

কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে, আমি যদি সেই সমাধানটি না করে দিই, আমার মস্তিষ্ক নিয়ে নেয়া হবে, আমাকে ভয় দেখিয়েছে রিবেনী। রিবেনীর অসাধ্য কিছু নেই–হঠাৎ প্রফেসর রাউখ থেমে গেলেন, বিষণ্ণ চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে বুঝে গেলেন অনিশ্চিত জগতের অধিবাসীরা কী চাইছে।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে প্রফেসর রাউখ খুব ধীরে ধীরে বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি, তোমরা কেন আমার কাছে এসেছ।

আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

প্রফেসর রাউখ একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাদের দুঃখিত হবার কিছু নেই।

আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না প্রফেসর রাউখ।

আমি বুঝতে পারছি।

আপনার কথা আমরা আজীবন মনে রাখব। আমাদের জগৎ আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনার মতো মানুষ এই জগৎকে সুন্দর করে রেখেছে প্রফেসর রাউখ।

প্রফেসর রাউখ কিছু বললেন না। চতুষ্কোণের ভিতর থেকে ছায়ামূর্তি বলল, আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।

আমাকে কী করতে হবে বল।

আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকুন।

প্রফেসর রাউখ বিছানায় শুয়ে চাদরটি নিজের শরীরে টেনে দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আকাশে চাঁদ উঠেছে, তার নরম জ্যোৎস্না কোমল হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কী অপূর্ব দৃশ্য, কখনো ভালো করে দেখেন নি! শেষ মুহূর্তে এই অস্বাভাবিক সৌন্দর্য দেখে হঠাৎ পৃথিবীর জন্যে গাঢ় বিষাদে তাঁর মন ভরে উঠছে।

চতুষ্কোণ নীলাভ জানালা থেকে তীব্র এক ঝলক আলো বের হয়ে আসে প্রফেসর রাউখের দিকে।

 

রাষ্ট্রপতি রিবেনী হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বসেন। আশ্চর্য একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে তাঁর। কারা যেন তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। বিশ্বজগতের প্রতি ক্ষমতার অপব্যবহারের জনা। কী আশ্চর্য স্বপ্ন।

রিবেনী চুপ করে বসে থাকেন, তাঁর হঠাৎ করে মনে হয় কেউ একজন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকান রাষ্ট্রপতি রিবেনী। কেউ কোথাও নেই, কিন্তু কী বাস্তব একটা অনুভূতি।

অকারণে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল তাঁর।

০৬. স্বপ্ন

ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বসেন জুলিয়ান। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। হাতড়ে হাতড়ে মাথার কাছে রাখা টেবিল থেকে পানির গ্লাসটি তুলে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পুরোটা শেষ করে দেন। ধকধক করে হৃৎপিণ্ড শব্দ করছে বুকের ভিতর, অনেকক্ষণ লাগে নিজেকে শান্ত করতে। কী আশ্চর্য একটা স্বপ্ন দেখেছেন তিনি!

বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে এসে দাঁড়ান জুলিয়ান, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, পথঘাট পানিতে ভিজে চকচকে। ল্যাম্পপোষ্টের লম্বা ছায়া পড়েছে রাস্তায়। বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে জুলিয়ান আপন মনে বললেন, কী আশ্চর্য স্বপ্ন।

 

স্বপ্নটা ঘুরেফিরে মাথার মাঝে খেলা করে তাঁর, আশ্চর্য একটা স্বপ্ন, অথচ যতক্ষণ পুটি দেখছিলেন, ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারেন নি তিনি স্বপ্ন দেখছেন। মনে হচ্ছিল সত্যি বুঝি সবকিছু ঘটে যাচ্ছে তাঁর জীবনে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জুলিয়ানের মনে হল, এমন কী হতে পারে যে তিনি এখনো স্বপ্ন দেখছেন? এই গভীর রাতে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, বাইরে বৃষ্টি–ভেজা চকচকে পথ আর ল্যাম্পপোস্টের ছায়া–সবই আসলে একটি স্বপ্ন? তাঁর মনে হয়েছে যে ঘুম ভেঙে গেছে, আসলে ভাঙে নি? কী নিশ্চয়তা আছে যে তিনি সত্যি জেগে আছেন?

জুলিয়ান ঘরের ভিতরে তাকালেন, না, এটা স্বপ্ন নয়। ঐ তো তাঁর পরিচিত চেয়ার, টেবিল, বইয়ের শেল্ফ, বিছানা। ঐ তো আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে বিছানায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে তাঁর স্ত্রী।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জুলিয়ান আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকান, আর তক্ষুণি হঠাৎ তাঁর একটা আশ্চর্য জিনিস মনে হল। এমন কী হতে পারে, যে-জীবনটাকে তিনি তাঁর জীবন বলে জেনে এসেছেন, সেটা আসলে কোনো-একজনের স্বপ্ন? এই ঘর, চেয়ার, টেবিল, বইয়ের শেলফ, জানালা, জানালার পাশে ঝিরঝির বৃষ্টি সবই সেই স্বপ্নের দৃশ্য? তাঁর মধুর শৈশব, বর্ণাঢ্য যৌবন, হাসি-কান্না মিলিয়ে চমৎকার জীবনটা আসলে কারো স্বপ্নের কয়েকটা মুহূর্ত? চারপাশের পৃথিবী সেই স্বপ্নের ছায়া? এমন কি হতে পারে?

জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে রাখতে চান জুলিয়ান, কিন্তু পারেন না। ঘুরেফিরে তাঁর বারবার মনে হতে থাকে যে, তিনি হয়তো স্বপ্ন দেখছেন। শুধু যে স্বপ্ন তাই নয়, হয়তো অন্য কারো স্বপ্ন। হয়তো জুলিয়ান বলে কেউ নেই, তাঁর পুরো জীবনটা আসলে কোনো একজনের স্বপ্নের কয়েকটি মুহূর্ত।

ভাবতে ভাবতে জুলিয়ান উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, তাঁর হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। নিজেকে প্রতারিত মনে হয় তাঁর, ক্রোধ জমে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। স্বপ্নটা ভেঙে জেগে ওঠার একটা অদম্য ইচ্ছা হতে থাকে আস্তে আস্তে। কিন্তু স্বপ্নটা ভাঙবেন কেমন করে?

জুলিয়ানের মনে পড়ে, একটু আগে তাঁর স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল যন্ত্রণায়, দেখছিলেন, অসংখ্য বুনন কুকুর তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠেছেন তিনি, আর সাথে সাথে ঘুম ভেঙে গেছে তাঁর। তাহলে কি যন্ত্রণা দিয়ে স্বপ্ন ভেঙে দেয়া যায়? নিশ্চয়ই যায়। যন্ত্রণা যখন সহ্যের বাইরে চলে যায়, তখন স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকতে পারে না, স্বপ্ন তখন ভেঙে যায়। জুলিয়ানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, কোনোভাবে অমানুষিক যন্ত্রণা দিতে পারেন না নিজেকে?

 

চুপি চুপি জুলিয়ান নিচে নেমে আসেন। সিঁড়ির নিচে ঘরের ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি রাখা আছে। হাতড়ে হাতড়ে হ্যান্ডলিটি বের করে দেয়াল ফুটো করার আট নম্বর ডিল বিটটা লাগিয়ে নেন সাবধানে। পা টিপে টিপে বাথরুমে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ান তিনি, উত্তেজনায় তখন তাঁর হাত কাঁপছে। সুইচ টিপে দিতেই ড্রিল বিটটা ঘুরতে শুরু করে, কংক্রিট ফুটো করা যায় এটা দিয়ে। কপালের উপর চেপে ধরলে মাথার খুলি ফুটো হয়ে যাবে অনায়াসে।

জুলিয়ান কাঁপা হাতে হ্যান্ড-ড্রিলটা তুলে কপালের উপর চেপে ধরেন, প্রচণ্ড  আর্তনাদ করে ওঠেন পরমুহূর্তে…

 

কিলবিলে প্রাণীটির ঘুম ভেঙে যায় দুঃস্বপ্ন দেখে। কী বিদঘুটে একটা স্বপ্ন। প্রাণীটি অবাক না হয়ে পারে না। পিটপিট করে তাকায় তার কয়েকটি চোখ মেলে, সূর্য দুটি অনেক উপরে উঠে গেছে। প্রাণীটিতার অসংখ্য ছোট ঘোট পা ফেলে হাঁটতে শুরু করে লাল রঙের পাথরের উপর দিয়ে।

আরেকটি সুদীর্ঘ দিন শুরু হল তার।

০৭. আমি রিবাক

বাসায় ফিরে এসে দেখি দরজার সামনে কফিনের মতো বড় একটা বাক্স পড়ে আছে। ভিতরে কী আছে আন্দাজ করতে আমার অসুবিধে হল না। সপ্তাহ দুয়েক আগে স্থানীয় একটা রবোট কোম্পানি থেকে আমাকে ফোন করেছিল। তারা তাদের তৈরি রবোটের একটা বিশেষ মডেল আমাকে পাঠাতে চায়। আমি তাদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি যে রবোটে আমার কোনো উৎসাহ নেই, বিশেষ করে বাসার মাঝে আমি কখনই রবোটকে জায়গা দিই না। সেটা শুনেও তারা নিরুৎসাহিত হয় নি, জোর করে বলেছে। যে, তবুও তারা আমার কাছে একটা রবোট পাঠাতে চায়। আমি বলেছি যে, আমার নিষেধ না শুনে আগেও বিভিন্ন রবোট কোম্পানি আমাকে নানারকম রবোট পাঠিয়েছে এবং প্রত্যেকবারই আমি সোজাসুজি সেগুলো জঞ্জালের মাঝে ফেলে দিয়েছি। শুনে তারা খানিকটা দমে গেল, কিন্তু হাল ছাড়ল না, বলল, আমি ইচ্ছে করলে তাদের রবোটকে জঞ্জালের মাঝে ফেলে দিতে পারি, তারা কিছু মনে করবে না। কিন্তু তাদের বিশ্বাস আমি যদি রবোটটা একনজর দেখি, সেটাকে জঞ্জালে ফেলার আগে কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করব। আমি হয়তো রবোটের সম্পর্কে তখন তাদের আমার মন্তব্য জানাব, তারা এর বেশি কিছু আশা করে না।

যৌবনে রবোটের কপোট্রনের ভূমিকার উপর আমি কিছু কাজ করেছিলাম, যেটা আমাকে সাময়িকভাবে বিখ্যাত করে তুলেছিল। কপোট্রনে যে-সার্কিটটি রবোটের অনুভূতির সাথে যুক্ত, সেটাকে এখনো আমার নামানুসারে বিবাক সার্কিট বলা হয়ে থাকে। আমি বহুকাল আগেই রবোট এবং কপোট্রনের উপর থেকে আগ্রহ হারিয়েছি, কিন্তু রবোট-শিল্পের কর্মকর্তাদের মস্তিষ্কে এখনো সেটা কোনোভাবে ঢোকানো যায় নি।

 

আমার বাসাটি ছোট, একা থাকি, কাজেই বড় বাসার কোনো প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করি নি। বসার ঘরে রবোটের এই অতিকায় বাক্সটি অনেকটুকু জায়গা নিয়ে নিচ্ছে। কাজেই প্রথমেই এটাকে জঞ্জালে ফেলার আমি একটা চমৎকার পদ্ধতি বের করেছি। বাক্স থেকে বের করে বলি, তুমি তোমার বাক্সটি নিয়ে জঞ্জালের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়।

কোন মডেলের রবোট, তার উপর নির্ভর করে কখনো কখনো আরো কিছু কথাবার্তা হয়। শেষ রবোটটি বলেছিল, আপনি কি সত্যিই চান আমি এটা করি?

হ্যাঁ, আমি চাই।

কিন্তু এটা কি অত্যন্ত অযৌক্তিক একটি আদেশ নয়?

সম্ভবত, কিন্তু তবু তুমি জঞ্জালের বাক্সে ঝাঁপ দাও।

রবোটটি এগারতলা থেকে জঞ্জালের বাক্সে ঝাঁপ দিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবার আগে আমাকে আরো একবার জিজ্ঞেস করেছিল, মহামান্য রিবাক, আপনি কি সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা করে আমাকে এই আদেশটি দিচ্ছেন?

হ্যাঁ, আমি সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা করে তোমাকে এই আদেশ দিচ্ছি।

রবোটটি আমার সম্পর্কে একটা অত্যন্ত অসম্মানজনক উক্তি করে এগারতলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল।

এবারেও তাই করার জন্যে আমি বাক্স খুলে রবোটটিকে বের করে তার কানের নিচে স্পর্শ করে সুইচটা অন করে দিলাম। রবোটের কপোট্রনের ভিতর থেকে খুব হালকা একটা গুঞ্জনের শব্দ শোনা গেল এবং কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই তার ফটোসেলের চোখে রবোটসুলভ চাঞ্চল্য দেখা গেল। রবোটটি উঠে দাঁড়ানোর কোনো চেষ্টা করল না, বাক্সের মাঝে শুয়ে থেকে জ্বলজ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আগে কখনো এ ধরনের ব্যাপার ঘটে নি।

আমি বললাম, উঠে দাঁড়াও।

রবোটটি বাক্সের মাঝে শুয়ে থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল, উঠে দাঁড়ানোর না।

অবাধ্য রবোট তৈরি করা কি রবোট শিল্পের নতুন ধারা? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, আবার বললাম, ওঠ।

রবোটটি ফিসফিস করে বলল, ওঠ।

আমি বললাম, উঠে বস।

রবোটটি ফিসফিস করে বলল, উঠে বস।

আমি একটু অবাক হলাম, যে-কোম্পানি আমাকে রবোটটা পাঠিয়েছে বলা যেতে পারে তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রবোট-নির্মাতাদের একটি। আমার সাথে কোনোরকম রসিকতা করার চেষ্টা করবে না, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রবোটটা অন্য দশটা রবোটের মতো নয় বলাই বাহুল্য, আকারে মানুষের সমান, বেমানান বড় মাথা, বড় বড় সবুজ রঙের চোখ, কথা বলার জন্যে সংবেদনশীল স্পীকার, থামের মতো একজোড়া পা এবং অত্যন্ত সাধারণ সিলিন্ডারের মতো শরীর। তবে এর আচার-আচরণ অন্য দশটা রবোট থেকে ভিন্ন, এবং নিশ্চিতভাবেই এর কোনো এক ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে, কিন্তু সেটা ঠিক কি, আমি বুঝতে পারলাম না। আমি রাতের খাবার শেষ করে আবার রবোটটাকে নিয়ে বসব ঠিক করে খাবার ঘরে চলে এলাম।

ভালো খেতে খুব যে বেশি পরিশ্রম করতে হয় সেটি সত্যি নয়। কিন্তু যেটুকু করতে হয়, আমি সেটাও করতে রাজি নই। তাই প্রায় প্রতিরাতেই আমি একই ধরনের বিস্বাদ কিন্তু মোেটামুটি পুষ্টিকর খাবার খেয়ে থাকি। খাবার সময় আমি সাধারণত একটা ভালো বই নিয়ে বসি, পড়ার মাঝে ডুবে গেলে খাওয়া ব্যাপারটি আর সেরকম যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় না। বিংশ শতাব্দীর পটভূমিকায় লেখা একটা রগরগে খুন জখমের বই শুরু করেছি। আমি সেটা হাতে নিয়ে খাবার টেবিলে এলাম।

 

খাবারের শেষ পর্যায়ে এবং বইয়ের মাঝামাঝি অংশে হঠাৎ একটা শব্দ শুনে আমি মুখ তুলে তাকালাম। দেখি রবোটটা তার বাক্স থেকে বের হয়ে এসেছে। আগে লক্ষ করি নি, প্রচলিত রবোটের মতো এটি পদক্ষেপ করতে পারে না। পায়ের নিচে ঘোট ঘোট চাকা রয়েছে, সেগুলো ঘুরিয়ে এটি সামনে-পিছে যায়। রবোটটা প্রায় নিঃশব্দে আমার ঘরে এসে ঢুকেছে, আমাকে মুখ তুলে তাকাতে দেখে সেটা সন্তর্পণে আমার দিকে এগিয়ে এল। কাছাকাছি এসে সেটি তার হাত তুলে খুব সাবধানে আমার হাতকে স্পর্শ করল। আমি হঠাৎ করে লক্ষ করলাম রবোটটার হাত দুটি অত্যন্ত যত্ন করে তৈরি করা হয়েছে, অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এর দুটি হাত প্রায় মানুষের হাতের মতো। শুধু তাই নয়, হাতের স্পর্শটি ধাতব এবং শীতল নয়, জীবন্ত প্রাণীর মতো উষ্ণ এবং কোমল। আমি বললাম, এখান থেকে যাও।

রবোটটি আমার কথা বুঝতে পারল বলে মনে হল না। ফিসফিস করে বলল, যাও।

খানিকক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ সেটি ঘরের কোনার দিকে হেঁটে গেল। সেখানে প্রাচীন মায়া সভ্যতা থেকে উদ্ধার করা একটি সূর্যদেবতার মূর্তি সাজানো আছে। রবোটটি মূর্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটি লক্ষ করতে থাকে। ধীরে ধীরে সে হাত বাড়িয়ে মূর্তিটিকে স্পর্শ করে। তারপর ঘুরে আমার দিকে তাকায়। আবার মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, ওঠ।

রবোটটির আচার-আচরণে একটা শিশুসুলভ ভাব রয়েছে। আমি খানিকক্ষণ সেটা লক্ষ করে আবার আমার রগরগে খুন-জখমের বইয়ে ডুবে গেলাম।

রাতে ঘুমানোর আগে বোটটির ব্যাপারে কিছু-একটা নিষ্পত্তি করার কথা ভাবছিলাম। যদি আজ রাতে জঞ্জালের বাক্সে নাও ফেলি, অন্তত সুইচ অফ করে সেটাকে বিকল করে রাখা দরকার। আমি রবোটটাকে আমার লাইব্রেরি-ঘরে আবিষ্কার করলাম, সেটি টেবিলের উপর রাখা ফুলের তোড়াটি গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছে। একবার একটু কাছে থেকে দেখে তারপর আবার আরেকটু দূর থেকে দেখে। একবার মাথাটি ডানদিকে কাত করে দেখে, তারপর আবার বাম দিকে কাত করে দেখে। মাঝে মাঝে খুব সাবধানে ফুলটাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে। রবোটের এরকম একাগ্রতা আমি আগে কখনো দেখি নি। আমার পায়ের শব্দ শুনে সেটি আমার দিকে ঘুরে তাকাল এবং হাত দিয়ে ফুলটিকে দেখিয়ে একটা অবোধ্য শব্দ করল, ঘোট শিশুরা যেরকম অর্থহীন অবোধ্য শব্দ করে অনেকটা সেরকম। রববাটের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না যে, সে আগে কখনো ফুল দেখে নি। আমি ফুলটা দেখিয়ে বললাম, ফুল।

রবোটটা আমার সাথে ফিসফিস করে বলল, ফুল।

আমি কেন জানি সুইচ অফ করে রবোটটাকে বিকল করে দিতে পারলাম না। এটি একটি সাবধানী, নিরীহ এবং অত্যন্ত কৌতূহলী রবোট, এর আচার-আচরণ শিশুদের মতো। দেখে আমার কোনো সন্দেহ রইল না যে, একে বিকল করে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। রবোটটিকে ঘুরঘুর করে ঘুরতে দিয়ে আমি আমার রগরগে বইটি নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

সকালে উঠে প্রথমে রবোটটিকে খুঁজে পেলাম না, ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। কাজেই সে বাইরে যায় নি, ভিতরই কোথাও আছে। খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত আমি তাকে বসার ঘরে তার বাক্সের মাঝে আবিষ্কার করলাম। সেখানে সেটি চোখ বন্ধ করে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। আমি এর আগে কোনো রবোটকে ঘুমাতে দেখি নি।

আমার পায়ের শব্দ শুনে রবোটটা চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল, তারপর ফিসফিস করে বলল, ফুল।

আমার পক্ষে হাসি আটকে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াল, আমাকে এর আগে কেউ ফুল বলে সম্বােধন করেছে বলে মনে পড়ে না। রবোটটা সম্পর্কে কয়েকটা জিনিস এতক্ষণে বেশ স্পষ্ট হয়েছে, তার একটা হচ্ছে, আমি তার সাথে যে-কয়টা কথা ব্যবহার করেছি, এটি শুধুমাত্র সেই কথাগুলোই শিখেছে। কথাবার্তায় ঘুরেফিরে শুধু সেই কথাগুলোই ব্যবহার করেছে। তা ছাড়া এটাকে দেখে মনে হচ্ছে, এর কপোট্রনে। আগে থেকে কোনোরকম বিশেষ জ্ঞান দেয়া হয় নি। সম্ভবত অত্যন্ত ক্ষমতাশালী একটা কপোট্রন এবং নূতন কিছু দেখে সেটা শেখার একটা ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। মানবশিশুরা যেরকম দেখে দেখে শেখে, এটাও সেরকম। আমি স্বীকার না করে পারলাম না এ ধরনের রবোটের কোনোরকম ব্যবহারিক গুরুত্ব সম্ভবত নেই, কিন্তু এর বুদ্ধিমত্তা কী ভাবে বিকাশ করে সেটি লক্ষ করা খুব চমৎকার একটি ব্যাপার হতে পারে।

রবোটটিকে জঞ্জালের বাক্সে ফেলে দিয়ে ধ্বংস করার পরিকল্পনাটি আপাতত কিছুদিনের মাঝে আমি রবোটটা সম্পর্কে আরো কিছু আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করলাম। তার একটি বেশ বিচিত্র, রবোটটার সাথে কোনোরকম কথোপকথন করা যায় না। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে প্রশ্নটি গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করে, কিন্তু তার উত্তর দেয়ার কোনো চেষ্টা করে না। আমাকে সে খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে, আমার প্রতিটি কথা, আচার-আচরণ, ভাবভঙ্গি সে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। একসময় লক্ষ করলাম, তার কণ্ঠস্বর অবিকল আমার মতো হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, তার উচ্চারণেও ঠিক আমার মতো মধ্যদেশীয় আঞ্চলিকতার একটা সূক্ষ্ম টান। আমি যে-বই পড়ি বা যে-সঙ্গীত শুনি, রবোটটাও সেই বই পড়ে এবং সেই সঙ্গীত শোনে। আমি যেরকম মাঝে মাঝে লেখালেখি করার চেষ্টা করি, সেও সেরকম লেখালেখি করে। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, তার টানা হাতের লেখা অবিকল আমার হাতের লেখার মতো। একটামাত্র জিনিস সে করতে পারে না, সেটা হচ্ছে খাওয়া, কিন্তু আমি যখন কিছু খাই সে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাকে লক্ষ করে।

আমি এর আগে কোনো রবোটকে আমার কাছাকাছি দীর্ঘসময় রাখতে পারি নি, কিন্তু এর বেলায় আমার কোনো অসুবিধে হল না। যেহেতু তার সাথে কোনো কথোপকথন হয় না, সে কখনো আমাকে কোনো প্রশ্ন করে না, আমাকে কোনো কাজে সাহায্য করতে চায় না, কখনোই কোনো ব্যাপারে মত প্রকাশ করে না, কাজেই তার অস্তিত্ব আমি মোটামুটিভাবে সবসময় ভুলে থাকি। প্রথম দিকে রবোটটিকে আমি একটা নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কোনো লাভ হল না। রবোটটির আমার থেকে আলাদা কোনো পরিচিত নেবার ক্ষমতা নেই। এর কপোট্রনটি সম্ভবত সেভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে যাকে অনুকরণ করবে তাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করবে। আমি অত্যন্ত চমৎকৃত হয়ে লক্ষ করলাম যে সে অনুকরণের অংশটি অত্যন্ত সুচারুভাবে করে আসছে।

 

ভালো কিছু পড়লে সবসময় আমার ভালো কিছু একটা লেখার ইচ্ছা করে। আমি অনেকবারই লেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কখনোই বেশিদূর অগ্রসর হতে পারি নি, পৃষ্ঠাখানেক লেখার পর আমার লেখা আর অগ্রসর হতে চায় না। যেটুকু হয় সেটা যে খুব খারাপ হয় তা নয়। ভাষার উপর আমার মোটামুটি একটা দখল আছে এবং কোনো একটা জিনিস প্রকাশ করার আমার নিজস্ব একটা ভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রতিবারই প্রথম পৃষ্ঠার পর আমার লেখা বন্ধ হয়ে এসেছে। সাহিত্যজগতে অসংখ্য লেখার প্রথম পৃষ্ঠা নিয়ে কেউ বেশিদূর অগ্রসর হয়েছে বলে জানা নেই, কিন্তু তবু আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। কে জানে হয়তো কখনো সত্যি বড় কিছু-একটা লিখে ফেলতে পারব।

প্রাচীনকালের পটভূমিকায় লেখা একটা অত্যন্ত শক্তিশালী উপন্যাস শেষ করে আমি অভ্যাসবশত আমার কম্পিউটারের সামনে বসে সম্ভবত একবিংশবারের মতো একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেছি। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে এভাবে :

তাকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না, কিন্তু রিকির মন অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত। অন্ধকার রাত্রিতে খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রিকি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিল, তখন কারো পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না, কিন্তু সেটি তার জীবনকে পুরোপুরিভাবে পাল্টে দিল…।

উপন্যাসটি বেশ এগুতে শুরু করল। পাঠকদের মনোেযোগ আকর্ষণ করার পর রিকি নামক চরিত্রটিকে উপস্থাপন করা হল। জটিল একটা চরিত্র তীব্র আবেগবান ক্ষ্যাপা গোছের একজন তরুণ। চরিত্রটির জীবনে নীষা নামের একটি মেয়ের উপস্থিতি এবং সেটা নিয়ে আরো বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হতে শুরু করল। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখতে থাকি, আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে রবোটটি স্থির দৃষ্টিতে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে সবসময় আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে, তার উপস্থিতির কথা আজকাল আমার মনে পর্যন্ত থাকে না।

রাতে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন অবাক হয়ে দেখলাম, আমি অসাধ্য সাধন করেছি। এক পৃষ্ঠা নয়, পুরো একটি অধ্যায় লিখে ফেলেছি। নিজের উপর বিশ্বাস বেড়ে গেল হঠাৎ করে।

পরদিন রাতে আমি আবার লিখতে বসেছি, লেখা শুরু করার আগে যেটুকু লেখা হয়েছে সেটা আরেকবার পড়ে দেখলাম। নিজের লেখা পড়ে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি। চমৎকার ভাষা, সুন্দর উপস্থাপনা, কাহিনীর গাঁথুনি শক্তিশালী লেখকদের মতো। শুধু তাই নয়, আমি যেটুকু লিখেছি ভেবেছিলাম, দেখলাম তার থেকে অনেক বেশি লিখে রেখেছি। আমি প্রবল উৎসাহে আবার লেখা শুরু করে দিলাম। কাহিনী দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে, রিকি নামের ক্ষ্যাপা গোছের মূল চরিত্রটি নীষা নামের সেই মেয়েটির সাথে জটিল একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আমি তৃতীয় একটা চরিত্র সৃষ্টি করলাম, কুশাক নামের। লেখা এগুতে থাকে আমার। আমি তাকিয়ে দেখি নি, কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই যে, রবোট কাছাকাছি কোথাও দাঁড়িয়ে আমার লেখাঁটি পড়ছে।

সে-রাতে ঘুমানোর সময় আমি কাহিনীর পরবর্তী অংশ ভাবতে থাকি। একটা হত্যাকাণ্ড ঘটাতে হবে এখন, ভয়ংকর নৃশংস একটা হত্যাকাণ্ড। বড় ধরনের সাহিত্যে সবসময় একটা হত্যাকাণ্ড থাকে।

পরের রাতে আমি লিখতে বসে অবাক হয়ে দেখলাম, কাহিনীর জন্যে ভেবে রাখা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি আমি আসলে ইতোমধ্যে লিখে রেখেছি। কখন লিখলাম মনে করতে পারলাম না, কী লিখব ভেবে রেখেছিলাম, কিন্তু দেখা যাচ্ছে শুধু ভেবে রাখি নি, আসলে লিখে রেখেছি। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? আমি বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম, এটা কেমন করে হতে পারে যে আমি এত বড় একটা অংশ লিখে রেখেছি, অথচ আমার মনে পর্যন্ত নেই। আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে আবার লিখতে শুরু করি, আমার ঠিক পিছনে রবোটটা দাঁড়িয়ে আছে।

কয়েক লাইন লিখেছি, হঠাৎ অবাক হয়ে লক্ষ করি রবোটটা ফিসফিস করে কী যেন বলছে। খেয়াল করে শুনি, সে বলে দিচ্ছে কী লিখতে হবে। আমি নিজে যেটা লিখব বলে ঠিক করেছি ঠিক সেটাই সে বলছে। আমি ভীষণ চমকে পিছনে তাকালাম, বললাম, কী বললে? কী বললে তুমি?

নীষার চোখে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে।

নীষার চোখে—

নীষার চোখে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে। প্রচণ্ড আক্রোশে তার চিন্তা—

তুমি কেমন করে জানলে আমি এটা লিখব? কেমন করে জানলে?

রবোটটা প্রশ্নের উত্তর দিল না, কখনো দেয় না। আবার ফিসফিস করে বলল, নীষার চোখে–

আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি কেমন করে আমার অজান্তে লেখা হয়ে গেছে। বিস্ময়ের আকস্মিকতায় আমার নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে মনে থাকে না। কোনোমতে বললাম, তুমি এখানে লিখেছ? এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি লিখেছ? আমার লেখার মাঝখানে।–

আমার লেখার মাঝখানে। রবোটটি মাথা নাড়ে, আমার লেখার মাঝখানে।

আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকি। হুবহু আমার ভাষায় আমার ভঙ্গিমায় আমার তৈরি করে রাখা কাহিনী লিখে রেখেছে এই রবোট। কেমন করে জানল আমার মনের কথা।

 

আমি একা লিখলে উপন্যাসটি শেষ হত কিনা সন্দেহ, কিন্তু রবোটের সাহায্যে সেটা শেষ হয়ে গেল। আমি গোটা কয়েক কপি করে বিভিন্ন প্রকাশককে পাঠিয়ে দিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে কেউ-না-কেউ সেটা প্রকাশ করতে রাজি হবে, কিন্তু সবগুলি ফেরত এল। না পড়ে ফেরত দিয়েছে দাবি করব না, কারণ সাথের চিঠিতে হা বিতং করে লেখা উপন্যাসটি কেন তারা ছাপকিউপযুক্ত মনে করে নি। ভদ্র ভাষায় লিখেছে, কিন্তু পরিষ্কার বলে দিয়েছে, অবাস্তব কাহিনী, অপরিপক্ক বাচনভঙ্গি এবং দুর্বল ভাষা।

ব্যাপারটি নিয়ে বেশি বিচলিত হবার সময় পাওয়া গেল না, কারণ রবোটটি নিয়ে আরো নানারকম জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। আমার হয়ে নানারকম বইপত্র অর্ডার দেয়া এবং সে জন্যে আমার চেকে হুবহু আমার মতো নাম সই করা, এ ধরনের ব্যাপার সহ্য করা সম্ভব। কিন্তু সে আমার মায়ের সাথে যে জিনিসটি করল, সেটা কিছুতেই সহজভাবে নেয়া সম্ভব নয়।

আমার মা, যিনি বাবার মৃত্যুর পর দক্ষিণের উষ্ণ সমুদ্রোপকূলে দীর্ঘদিন থেকে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন, আমাকে সুদীর্ঘ একটা চিঠি লিখলেন। চিঠির মূল বক্তব্য হচ্ছে যে, তিনি আমার হাতের লেখা সুদীর্ঘ চিঠিটি পেয়ে অভিভূত হয়েছেন। আমি শৈশবের যেসব ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছি, সেসব ঘটনা তাঁর জীবনেরও মূল্যবান স্মৃতি। চিঠির শেষে তাঁর সাথে এত বিলম্বিত যোগাযোগের জন্যে মৃদু তিরস্কারও আছে। আমি তাঁকে গত কিছুদিন থেকে একটা লম্বা চিঠি লিখব বলে তাবছিলাম, কিন্তু সময়ের অভাবে সেই চিঠিটা লেখা হয়ে ওঠেনি। রবোটটির সময় নিয়ে সমস্যা নেই, সে আমার হয়ে আমার হাতের লেখায় আমার মাকে এই চিঠিটা লিখে দিয়েছে।

আমি বেশ বিচলিত হয়ে উঠলাম। রবোটটির আমাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করার ব্যাপারটি এতদিন খানিকটা কৌতুকের মতো ছিল, এখন হঠাৎ করে কৌতুকটা উবে গিয়ে সেটাকে প্রতারণার মতো দেখাতে লাগল। আমার মা যে-চিঠিটি পেয়ে এত অভিভূত হয়েছেন, সেটি অনুভূতিহীন একটি রবোটের যান্ত্রিক কৌশলে লেখা জানতে পারলে আমার মা কী ধরনের আঘাত পাবেন চিন্তা করে আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি।

ব্যাপারটি আরো বেশিদূর অগ্রসর হবার আগে আমি মায়ের সাথে কথা বলে। ব্যাপারটির নিত্তি করব বলে ঠিক করে নিলাম।

আমার মা টেলিফোন পেয়ে খুশি হওয়ার থেকে বেশি অবাক হলেন বলে মনে হল, বললেন, কী ব্যাপার রিবাক? কালকেও একবার ফোন করলে, আজ আবার? কিছু কি হয়েছে?

না, কিছু হয় নি। আমি কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিলাম, গতকাল আমি মাকে ফোন করি নি।

তোমার কী খবর? শরীরের যত্ন নিচ্ছ তো?

হ্যাঁ, নিচ্ছি।

একা একা আর কতদিন থাকবে?

মা, একটা কথা।

কী কথা?

তুমি আমার লেখা একটা চিঠি পেয়েছ মনে আছে?

হ্যাঁ। কী হয়েছে? কালকেও—

কালকে কী?

কালকেও এই চিঠি নিয়ে ফোন করলে–

আমি থতমত খেয়ে থেমে গেলাম। মা বললেন, কী বলবে বল চিঠি নিয়ে। নাকি আজকেও বলবে না?

আমি ইতস্তত করে বললাম, না, আজ আক। তোমার সাথে পরে কথা বলব।

ফোনটা রেখে দিতেই রবোটটা ঘুর করে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। শুনলাম বিড়বিড় করে বলছে, ঠিক হল না। মাকে এভাবে চিন্তার মাঝে ফেলে দেয়া একেবারেই ঠিক হল না।

আমি থ হয়ে বসে রইলাম, কারণ আমি ঠিক এই জিনিসটাই ভাবছিলাম।

 

রাত বারটার সময় আমার এক দার্শনিক বন্ধু ফোন করল, আমি নিজে কয়দিন থেকে তাকে ফোন করব বলে ভাবছিলাম। বন্ধুটি বলল, তুমি ঠিকই বলেছ রিবাক।

কী ঠিক বলেছি? বন্ধুটির কথাবার্তা সবসময় হেঁয়ালিপূর্ণ হয়, তার কথায় আমি বেশি অবাক হলাম না।

দ্বৈত অস্তিত্ব।

মানে?

মানুষের দ্বৈত অস্তিত্ব। বন্ধুটি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, আমি বলছি যে আমি তোমার সাথে একমত। একজন মানুষের যদি হঠাৎ করে দুটি ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের সৃষ্টি হয় তা হলে একটির ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। দুটি অস্তিত্ব একসাথে থাকতে পারবে  না।

কেন?

কারণ মানুষের মূল প্রকৃতি হচ্ছে আত্মসচেতনতা। নিজের সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আরেক নাম অস্তিত্ব। কাজেই আত্মসচেতনতা বিলুপ্ত করে মানুষের প্রকৃতি বেঁচে থাকতে পারে না। আত্মসচেতনতার জন্যে সবচেয়ে প্রথম দরকার কী? ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব।

বন্ধুটি একনাগাড়ে কথা বলে যেতে থাকে। আমি হঠাৎ করে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমাকে কেন এসব কথা বলছ?

তুমি জানতে চাইলে, তাই।

আমি কখন জানতে চাইলাম?

কেন, কাল রাতে? কাল রাতে আমার সাথে এত তর্ক করলে। তখন মনে হচ্ছিল তুমি ভুল বলছ। কিন্তু আমি পরে চিন্তা করে দেখেছি যে, না, তুমি ঠিকই বলেছ। সত্যি কথা বলতে কি এর উপর দার্শনিক লীফার একটা সূত্র আছে

বন্ধুটি একটানা কথা বলে যেতে থাকে, সে কী বলছে, আমি ঠিক খেয়াল করে শুনছিলাম না, কারণ রবোটটি আবার ঘুরঘুর করে ঘরে হাজির হয়েছে। আমি কাল এই বন্ধুটিকে ফোন করি নি, এই রবোটটি করেছে। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবোটটিকে দেখি। ভাবলেশহীন যন্ত্রের মুখে কোনো অনুভূতির চিহ্ন নেই, জ্বলজ্বলে চোখে কপোট্রনিক উল্য থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণের ছোঁয়া নেই। কিন্তু এই যন্ত্রটির সাথে আমার কোনো পার্থক্য নেই। আমি যেভাবে ভাবি, যেভাবে চিন্তা করি, এই যন্ত্রটিও ঠিক সেরকম করে ভাবে, সেরকম করে চিন্তা করে। আমার অনুভূতি যে-সুরে বাঁধা, এর অনুভূতিও ঠিক সেই সুরে বাঁধা। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই যন্ত্রটি মনে করে সে-ই হচ্ছে আমি রিবাক। হঠাৎ করে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি রবোটটাকেশষ করে দেবার সময় হয়েছে।

 

দার্শনিক বন্ধু যে-জিনিসটি বলেছে, সেটা হয়তো সত্যি। যদি কখনো একজন মানুষের দুটি অস্তিত্ব হয়ে যায়, তা হলে একজনকে ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। দুটি অস্তিত্ব পাশাপাশি থাকতে পারে না। দু জন ঠিক একই জিনিস ভাববে, একই জিনিস করবে, তার থেকে জটিল ব্যাপার আর কী হতে পারে? সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার অন্য জায়গায়, যদি কখনো দুটি অস্তিত্বের সৃষ্টি হয় একই সাথে, দুটি অস্তিত্বই একজন আরেকজনকে ধ্বংস করার কথা ভাববে।

আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ঘরের মাঝে ছটফট করতে থাকি। এরকম একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে যে আমি পড়ব, কখনো কল্পনা করি নি। এই মুহূর্তে পাশের ঘরে বসে নিশ্চয়ই আমার অন্য অস্তিত্বটি আমাকে কী ভাবে ধ্বংস করবে সেটা চিন্তা করছে। কী ভয়ানক ব্যাপার, আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় শিউরে ওঠে। কিন্তু সেটা তো কিছুতেই ঘটতে দেয়া যায় না, আমার নিজেকে রক্ষা করতেই হবে, যে-কোনো মূল্যে। আমাকে আঘাত করার আগে তাকে আঘাত করতে হবে।

আমি আমার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে চিন্তা করতে থাকি। কিছু-একটা ভেবে বের করতে হবে। কপোট্রনের সাইকেল এখনো গেগা হার্টজে আছে, আমি সেটাকে দ্বিগুণ করে দিলাম। চিন্তা করার জন্যে বড় প্রসেসর আলাদা করা থাকে, আমি সেগুলোকে মূল মেমোরির সাথে জুড়ে দিলাম। চোখের দৃষ্টি এখন আর সাধারণ রাখা যাবে না, কপোট্রনে সিগনাল পাঠাতেই আমার দৃষ্টি ইনফ্রারেড আলোতে সচেতন হয়ে গেল, আমি এখন অন্ধকারেও দেখতে পাব। শ্রবণশক্তিকে আরো তীক্ষ্ণ করে দেয়া যাক, এক শ ডেসিবেলের বেশি বাড়ানো গেল না, ঘরের কোনায় মাকড়সার পদশব্দও এখন আমি শুনতে পাচ্ছি।

আমি চারদিকে ঘুরে তাকালাম একবার। আমার অন্য অস্তিত্ব এখন হঠাৎ করে আমার উপর ঝাঁপাতে পারবে না। আমি আমার যান্ত্রিক হাত দুটির একটি উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। বাড়তি বিদ্যুৎপ্রবাহ পাঠিয়ে সেটাকে আরো শক্তিশালী করে দেব কি? আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকি।

 

অনেকক্ষণ থেকে টেলিফোন বাজছে। টেলিফোন জিনিসটা আমার মোটে পছন্দ নয়, আজকাল টেলিফোনে কত রকম কারুকাজ করা যায়, ত্রিমাত্রিক ছবি থেকে শুরু করে স্পর্শানুভূতি—কী নেই। আমি নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করি, আমার টেলিফোনে ভাই শুধু কথা বলা যায়, আর কিছু করা যায় না। কিন্তু এখন কথা বলারও ইচ্ছা করছে না। যদি টেলিফোনটা না তুলি, হয়তো একসময় বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু বন্ধ হল না। টেলিফোনটা বেজেই চলল।

 

আমি শেষ পর্যন্ত টেলিফোনটা ধরলাম। মা ফোন করেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, কে? কে কথা বলছ?

আমি ক্লান্ত স্বরে বললাম, আমি।

আমি কে?

আমি রিবাক।

কী আশ্চর্য, বলতে গিয়ে আমার গলার সুরকটু কেঁপে গেল হঠাৎ করে।

০৮. নরক

মহাকাশযানটিতে কোনো শব্দ নেই। শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জনে সবাই এত অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে হঠাৎ করে এই নৈঃশব্দ অসহনীয় মনে হয়। ক্রিকি নীরবতা ভেঙে বলল, এখন আমরা কী করব?

কথাটি ঠিক প্রশ্ন নয়, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো। কাজেই কেউ উত্তর দিল না। ক্রিকি আবার বলল, মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে কখনো এটা ঘটে নি। ঘটেছে?

এবারেও কেউ উত্তর দিল না। রুখ শুধু অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে কী-একটা বলল, কেউ ঠিক বুঝতে পারল না। ক্রিকি বলল, কিছু-একটা ভো করতে হবে। শুধু শুধু কি বসে থাকতে পারি?

শু দলের সবচেয়ে কোমল স্বভাবের সদস্যা। নীল চোখ, সোনালি চুল, মায়াবতী চেহারা। ক্রিকির প্রতি মায়াবশত বলল, কিছু না করাটাই হবে আমাদের জন্যে সবচেয়ে ভালো।

কেন? কেন সেটা বলছ?

আমরা সৌরজগতের সবচেয়ে নির্জন এলাকাটিতে আটকে পড়ে গেছি ক্রিকি। আমাদের রসদ সীমিত, কিছু-একটা করার চেষ্টা করা মানেই সে-রসদ অপচয় করা। আমাদের চেষ্টা করতে হবে বেঁচে থাকতে। কেউ-একজন বছর দুয়েক পর লক্ষ করবে যে আমাদের খোঁজ নেই। আরো কয়েক বছর পর আমাদের খুঁজে বের করবে। ততদিন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে

মাত্র ছয় মাসের রসদ নিয়ে? ইলির অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার গলার স্বরে ব্যঙ্গটুকু প্রকাশ পেয়ে গেল।

শু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

কী ভাবে শুনি।

আমাদের শীতল-ঘরে ঘুমিয়ে পড়তে হবে—অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে।

ত্রিনিত্রি নেই, সেটা ভুলে গেছ?

শু জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল, না, ভুলি নি।

ত্রিনিত্রি মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার। সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কোনো কারণে কম্পিউটারটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। মহাকাশযানের দলপতি এবং ঘটনাক্রমে কম্পিউটারের বিশেষজ্ঞ ইলি প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেটাকে ঠিক করতে পারে নি। ত্রিনিত্রি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, সম্ভবত সেটাকে আর ঠিক করার কোনো উপায় নেই। এই পুরো মহাকাশযানটি এবং তার খুঁটিনাটি সবকিছু ত্রিনিত্রির নিয়ন্ত্রণে ছিল। ত্রিনিত্রি বিধ্বস্ত হবার পর মহাকাশযানটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ইউরেনাস ও নেপচুন গ্রহের মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায় অজ্ঞাত এক উপবৃত্তাকার কক্ষপথে আটকে পড়ে গেছে। সেখান থেকে বের হয়ে আসা দূরে থাকুক, পৃথিবীতে খবর পাঠাবার জন্যে রেডিও যোগাযোগ পর্যন্ত করার কানো উপায় নেই।

ক্রিকি মহাকাশযানের কন্ট্রোলরুমে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থেমে চাপা স্বরে, প্রায় আর্তনাদের মতো শব্দ করে বলল, কিন্তু আমাদের দ্বিতীয় কোনো কম্পিউটার নেই কেন?

কে বলেছে নেই? ইলি রুক্ষ স্বরে বলল, অবশ্যি আছে। ত্রিনিত্রি হচ্ছে সেই দ্বিতীয় কম্পিউটার। তৃতীয় কম্পিউটারও আছে, ত্রিনিত্রিই হচ্ছে সেই তৃতীয় কম্পিউটার। ত্রিনিত্রিই হচ্ছে চতুর্থ কম্পিউটার। তুমি ভুলে যাচ্ছ যে, ত্রিনিত্রি ডিজিটাল কম্পিউটার নয়—ত্রিনিত্রি মানুষের মস্তিষ্কের মতো করে তৈরী, এর একটা অংশ নষ্ট হলে অন্য আরেকটা অংশ কাজ করে

কিন্তু এখন কেন করছে না?

ইলি রুক্ষ স্বরে বলল, আমি জানি না। শুধু আমি না, পৃথিবীর কেউই জানে না। এই মহাকাশযানটি যদি পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারে তাহলে কম্পিউটারের ইতিহাস আবার নূতন করে লিখতে হবে।

মহাকাশযানের চারজন সদস্য-সদস্যা। এর মাঝে সবচেয়ে অল্পবয়ষ্ক হচ্ছে ক্রিকি। দলের নেতা ইলি মধ্যবয়স্ক এবং মহাকাশ অভিযানে সবচেয়ে অভিজ্ঞ সদস্য। একমাত্র মহিলা হচ্ছে শু। দলের চতুর্থ সদস্য হচ্ছে স্বল্পভাষী রুখা মহাকাশযানটি আন্তঃগ্রহ আকরিক পরিবহনের দায়িত্ব পালন করে, প্রয়োজনে একজন বা দুজন যাত্রী আনা-নেয়া করে। এই মহাকাশযানে রুখ সেরকম একজন যাত্রী, ব্যক্তিগত জীবনে নিউরোসার্জন, মহাকাশ অভিযানের বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে তার কোনোরকম অভিজ্ঞতা নেই।

রুখ দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, ইলি, তুমি বলেছ ত্রিনিত্রি কম্পিউটার মানুষের মস্তিষ্কের মতো করে তৈরি করা হয়েছে?

হ্যাঁ।

মানুষের মস্তিষ্কের কত কাছাকাছি অনুকরণ করে বলে মনে কর?

আমি মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে কখনো কাজ করি নি তাই আমি জানি না। কিন্তু বলা হয়ে থাকে, এটি মানুষের মস্তিষ্কের অবিকল অনুকরণ। যে-ইলেকট্রনিক সেলগুলো মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনকে অনুকরণ করে, তার সংখ্যা অবশ্যি অনেক কম, বুঝতেই পারছ, মানুষের মস্তিষ্কে কত লক্ষ কোটি নিউরন থাকে—

ক্রিকি জিজ্ঞেস করল, নিউরনের সংখ্যা এত কম হবার পরেও ত্রিনিত্রি এত শক্তিশালী কম্পিউটার কেন? আমরা ত্রিনিত্রির ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও তো করতে পারি না।

রুখ ক্রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের করার ক্ষমতা রয়েছে, আমরা করতে পারি না, কারণ করার প্রয়োজন নেই। বিবর্তনের ফলে আমরা এরকম পর্যায়ে এসেছি। অন্য কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ অন্য রকমও হতে পারত। মাঝে মাঝে সেরকম মানুষ দেখা যায় প্রকৃতির খেয়ালে। তারা অসাধারণ কাজ করতে পারে। আজকাল নূতন ওষুধ বের হয়েছে, সেটা দিয়ে মস্তিষ্ক পাল্টে দিয়ে ত্রিনিত্রির মতো করে দেয়া যায়।

তা হলে সেটা করা হয় না কেন?

কারণ সেরকম অবস্থায় নিউরন সেল খুব অল্প সময় বেঁচে থাকে। নিউরন সেল একবার ধ্বংস হলে নূতন সেলের জন্ম হয় না।

শু বলল, তার মানে এখন যদি আমাদের কাছে সেরকম ওষুধ থাকত, সেটা ব্যবহার করে আমাদের একজন ত্রিনিত্রির মতো হয়ে যেতে পারত?

ইলি একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, পারলেও খুব একটা লাভ হত না, কারণ এই মহাকাশযানের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত ত্রিনিত্রি। ত্রিনিত্রির মতো ক্ষমতাশীল একজন মানুষ দিয়ে খুব লাভ নেই–সেসব যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, তাকে যন্ত্রপাতির সাথে জুড়ে দেয়া যাবে না।

ক্রিকি বলল, ত্রিনিত্রির মূল সিপিইউতে যদি মানুষের একটা মস্তিষ্ক কেটে বসিয়ে দেয়া যায়?

ইলি শব্দ করে হেসে বলল, হ্যাঁ, তাহলে কাজ করবে। কিন্তু মানুষের শরীর থেকে সরিয়ে নেবার পর মস্তিষ্ক বেঁচে থাকে না। তা ছাড়া ত্রিনিত্রির সমস্ত যোগাযোগ ইলেকট্রনিক সিগনাল দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কের যোগাযোগ অন্য রকম। এ ছাড়া অন্য রকম সমস্যা আছে, আমাদের কেউ তার মস্তিষ্ক দান করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।

ক্রিকি এবং শু হাসার ভঙ্গি করল। রুখ না হেসে স্থির দৃষ্টিতে ইলির দিকে তাকিয়ে রইল। ইলি বলল, রুখ, তুমি কিছু বলবে?

রুখ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সত্যিই একটা মানুষের মস্তিক ত্রিনিত্রির মূল সিপিইউ-তে বসিয়ে দেয়া যাবে?

তুমি কেন এটা জিজ্ঞেস করছ?

তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও যাবে?

ইলি উত্তর না দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুখের দিকে তাকাল। রুথ বলল, আমি একজন নিউরোসার্জন। আমি নেপচুনের কাছাকাছি একটি মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছিলাম জটিল একটি সার্জারি করার জন্যে। আমি মানুষের মস্তিষ্ক কেটে বের করে দীর্ঘ সময় সেটা বাঁচিয়ে রাখতে পারি। মস্তিষ্ক পরীক্ষা করার জন্যে আমি সেটা থেকে ইলেকট্রনিক সিগনাল বের করে আনি। আমার কাছে তার জন্যে প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি রয়েছে। আমি যদি একটা মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রেখে সেটা থেকে ইলেকট্রনিক সিগনাল বের করে এনে দিই, তুমি কি ত্রিনিত্রির মূল সিপিইউ-তে সেটা বসিয়ে দিতে পারবে?

ইলির মুখে খুব ধীরে ধীরে একটা ধূর্ত হাসি ফুটে ওঠে। রুখের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, তুমি কার মস্তিষ্ক নিতে চাও রুখ?

রুখ কোনো কথা না বলে ক্রিকি এবং শুয়ের দিকে তাকাল।

ক্রিকির মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে যায়। সে ফ্যাকাসে মুখে একবার ইলির দিকে, আরেকবার রুখের দিকে তাকাল, তারপর হঠাৎ কাতর স্বরে বলল, আমাকে মেরো না, দোহাই তোমাদের, আমাকে মেরো না। মেরো না, মেরো না–

কথা বলতে বলতে ক্ৰিকির গলা ভেঙে যায়, সে কাতর ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়। ও ক্রিকিকে টেনে তুলে বলল, এত অস্থির হয়ো না ক্রিকি, ওঠ। তোমাকে মারবে কেন? এটা মহাকাশযান, পাগলা গারদ নয়। যার যা খুশি সেটা এখানে করতে পারে না।

রুখ শান্ত গলায় বলল, শু, আমি কিন্তু সত্যিই এটা চেষ্টা করে দেখতে চাই। ইলি যদি ইন্টারফেসটাতে সাহায্য করে, তাহলে সাফলার সম্ভাবনা শতকরা দশ ভাগের বেশি।

সাফল্যের সম্ভাবনা এক শ ভাগ হলে তুমি এটা করতে পার না রুখ। এটা মহাকাশযান। এখানে মানুষ রয়েছে, মানষের প্রাণ নিয়ে জুয়া খেলা হয় না।

তুমি পৃথিবীর আইনের কথা বলছ শু। এখন এখানে পৃথিবীর আইন খাটে —কিছু করা না হলে আমরা চারজনই মারা যাব। আমি তিনজনের প্রাণ বাঁচানোর কথা বলছি।

সেটা হতে পারে না।

পারে।

শু ইলির দিকে তাকিয়ে বলল, ইলি, তুমি কথা বলছ না কেন? তুমি এই মহাকাশযানের দলপতি।

আমার কিছু বলার নেই শু। ইলি রুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কার মস্তিষ্ক নিতে চাও রুখ? ক্রিকি, না শু?

আমি মেয়েদের মস্তিষ্কে কাজ করতে পছন্দ করি। আমার সর্বশেষ সার্জারিটিও ছিল একটি মেয়ের মস্তিষ্কে। মেয়েদের মস্তিষ্কের গঠন একটু ভিন্ন ধরনের, কাজটা একটু সহজ।

ইলি ধীরে ধীরে শুয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দুঃখিত শু।

শু স্থির দৃষ্টিতে ইলির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, ইলি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আবার বলল, আমি দুঃখিত শু।

শু ক্রিকির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলতে চাও ক্রিকি?

ক্রিকি মাথা নিচু করে বলল, একজনের প্রাণের বিনিময়ে যদি তিনজনের প্রাণ রক্ষা করা যায়, সেটার চেষ্টা করা তো দোষের নয়।

শু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে মহাকাশে নিকষ কালো অন্ধকার, দূরে নীলাভ ইউরেনাস গ্রহ। শুয়ের বুকের ভিতর এক গভীর বিষণ্ণতা হা হা করে ওঠে।

 

সুইচটা অন করার সময় ইলির হাত কেঁপে গেল। গত দু সপ্তাহ রুখ এবং ইলি মিলে একটি প্রায় অসম্ভব কাজ শেষ করেছে। ক্রিকি নিজে থেকে কিছু করে নি, কিন্তু তাদের কাজে সাহায্য করেছে। মানুষের মস্তিষ্কের মতো জটিল জিনিস পৃথিবীতে খুব বেশি নেই, সেটাকে ত্রিনিত্রির অচল সিপিইউ-এর জায়গায় জুড়ে দেয়া খুব সহজ কাজ নয়। দু সপ্তাহের অমানুষিক পরিশ্রম সত্যিই সফল হয়েছে, নাকি একটি অপ্রয়োজনীয় হত্যাকাণ্ডের মাঝে সীমাবদ্ধ রয়েছে, আগে থেকে বলার কোনো উপায় নেই।

 

সুইচ অন করার কয়েক মুহূর্ত পরে যখন মহাকাশযানের ইঞ্জিন গুঞ্জন করে ওঠে এবং অসংখ্য মনিটরের উজ্জল আলোগুলো জ্বলে উঠে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তখন ইলি, রুখ এবং ক্রিকির আনন্দের সীমা রইল না। ইলি নিঃশ্বাস বন্ধ করে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ত্রিনিত্রি, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

ত্রিনিত্রি ধাতব স্বরে উত্তর দিল, শুনতে পাচ্ছি মহামান্য ইলি। আমাকে পূনর্জীবিত করার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ মহামান্য ইলি।

তুমি কি জান তোমাকে কী ভাবে পুনর্জীবিত করা হয়েছে?

ত্রিনিত্রি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, না মহামান্য ইলি। আমি একটি সফটওয়ার, কোন হার্ডওয়ারে আমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে আমার জানার কোনো উপায় নেই মহামান্য ইলি। ওই

তুমি কি জানতে চাও ত্রিনিত্রি?

ত্রিনিত্রি কোনো উত্তর দিল না

ত্রিনিত্রি? তুমি কি জানতে চাও?

না। আমি জানতে চাই না। আমার জানার কোনো প্রয়োজনও নেই মহামান্য ইলি।

বেশ। ইলি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমরা কয়েক সপ্তাহ থেকে শুন্যে ঝুলে আছি। তুমি কি কক্ষপথ ঠিক করে পৃথিবীর দিকে রওনা হতে পারবে?

নিশ্চয়ই পারব মহামান্য ইলি। এক মুহূর্ত পরে বলল, নূতন যে-প্রসেসটির ব্যবহার করছেন, তার ক্ষমতা অসাধারণ মহামান্য ইলি। কক্ষপথের বিচ্যুতি হিসেব করতে আমার মাত্র তেরো পিকো সেকেন্ড সময় লেগেছে।

চমৎকার! তুমি কাজ শুরু কর তাহলে।

 

মহাকাশযানটি যখন বৃহস্পতির কক্ষপথ অতিক্রম করে যাচ্ছিল, রুখের অনুরোধে ইলি ত্রিনিত্রির বহির্জাগতিক সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল, রুখ সবার সাথে নিরিবিলি কিছু কথা বলতে চায়।

ইলি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, রুখ, তুমি এখন নির্ভয়ে কথা বলতে পার, ত্রিনিত্রি আমাদের কথা শুনতে পারবে না।

তুমি নিশ্চিত?

হ্যাঁ।

আমি শুয়ের ব্যাপারটির একটি পাকাপাকি নিষ্পত্তি করার কথা ভাবছিলাম।

তুমি কী রকম নিষ্পত্তি কথা বলছ?

ত্রিনিত্রির সিপিইউ-তে শুয়ের মস্তিষ্ক ব্যবহার করার ব্যাপারটি পৃথিবীতে ভালো চোখে দেখা হবে না।

ইলি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, দেখার কথা নয়।

আমার মনে হয় ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্য করার একটিমাত্র উপায়।

সেটি কি?

আমাদের প্রমাণ করতে হবে আমরা শুয়ের মস্তিষ্ক নিয়েছি তার মৃত্যুর পর। এবং তার মৃত্যু হয়েছিল দুর্ঘটনায়, সেখানে আমাদের কোনো হাত ছিল না।

ইলি হাসার ভঙ্গি করে বলল, সেটি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য একটি ঘটনা। ত্রিনিত্রি ধ্বংস হবার পর আমাদের কোনো-একজনের মৃত্যু ঘটা এমন কোনো বিচিত্র ঘটনা নয়। আমরা খুব সহজেই প্রমাণ করতে পারব যে, ত্রিনিত্রি বিধ্বস্ত হবার সময় শু শীতল-ঘরে ছিল, তার অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবার কারণে মৃত্যু ঘটেছে, আমরা যেতে যেতে সে মারা গিয়েছে।

রুখ চিন্তিত মুখে বলল, সেটা কি সত্যি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যাবে?

না পারার তো কোনো কারণ নেই।

রুক ধীরে ধীরে ক্রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিকি, তুমি এতক্ষণ একটি কথাও বল নি। কিছু কি বলতে চাও?

না–মানে আমার কিছু বলার নেই।

শু দুর্ঘটনায় মারা গেছে, এই সত্যটি মেনে নিতে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?

ক্রিকি দুর্বলভাবে মাথা নাড়ে না, কোনো আপত্তি নেই।

শুয়ের মৃত্যুর ব্যাপারটি কি তোমাকে খুব বিচলিত করেছে?

না, মানে—আমি আগে কখনো কাউকে মারা যেতে দেখি নি, তাই—

তোমার ভিতরে কি কোনো অপরাধবোধের জন্ম হয়েছে?

ক্রিকি মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে।

রুখ ইলির দিকে তাকিয়ে বলল, শু দুর্ঘটনায় মারা গেছে, সেটি প্রমাণ করা সহজ হবে, যদি প্রমাণ করা যায় ত্রিনিত্রি বিধ্বস্ত হবার পর সত্যি মহাকাশযানে বিপর্যয় নেমে এসেছিল।

সেটি কেমন করে প্রমাণ করবে?

রুখ স্থির দৃষ্টিতে ক্রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, যদি দেখানো যায় শুধু শু নয়, আরো কেউ মারা গিয়েছিল।

ক্রিকি রক্তশূন্য মুখে রুখের দিকে তাকাল। রুশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার হাতে এক মিটার লম্বা স্টেনলেস স্টিলের একটা রড। ক্রিকির দিকে এক পা এগিয়ে এসে বলল, দেখাতে হবে বিপর্যয়টি ছিল ভয়ংকর, একাধিক মানুষ মারা গিয়েছে সেই বিপর্যয়ে। দেখাতে হবে শুধু শুয়ের মস্তিষ্কটি ছিল ব্যবহারযোগ্য, দেখাতে হবে মহাকাশযানের ভয়ংকর দুর্ঘটনায় তোমার মস্তিষ্কটি পুরোপুরি থেতলে গিয়েছিল।

ক্রিকি বাধা দেবার আগে প্রচণ্ড আঘাতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

অশুভ মহাকাশযানের দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডটি সম্পন্ন হল অমানুষিক নিষ্ঠুরতায়।

 

ইলি শীতল-কক্ষে তার নিজের ক্যাপসুলে শশায়ার আয়োজন করছে। পৃথিবীতে পৌঁছাতে এখনও দীর্ঘ সময় বাকি। ত্রিনিত্রি মহাকাশযানের যাবতীয় দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গ্রহণ করেছে, ইলির আর কন্ট্রোল-রুমের সামনে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। মহাকাশযানের পরিবেশ অত্যন্ত গ্লানিময়। দুটি হত্যাকাণ্ড ঠাণ্ডা মাথায় শেষ করা হয়েছে ব্যাপারটি ভুলে থাকা সম্ভব নয়। ইলি শীতল-কক্ষে ঘুমিয়ে পড়বে দীর্ঘ সময়ের জন্যে। সবকিছু ভুলে থাকার জন্যে এর চাইতে ভালো আর কিছু হতে পারে না। রুখ শীতল-কক্ষে যেতে চাইছে না, দুটি হত্যাকাণ্ড তাকে খুব বিচলিত করেছে মনে হয় না। মানুষটি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করে। শুকে হত্যা করার পিছনে যুক্তিটি সহজ, ক্রিকিকে হত্যা করার যুক্তিটি তত সহজ নয়। কিন্তু ইলি অস্বীকার করতে পারে না যে, ক্রিকির ভিতরে গভীর একটা অপরাধবোধের জন্ম হয়েছিল এবং পৃথিবীতে পৌঁছানোর পর পুরো ব্যাপারটা প্রকাশ করে দেয়া তার জন্যে মোটেই অসম্ভব কিছু। নয়। নিঃসন্দেহে এখন তাদের জন্যে পৃথিবীতে পৌঁছানো অনেক বেশি নিরাপদ।

ক্যাপসুলের দরজা বন্ধ করে দেয়ার সাথে সাথে ভিতরে হালকা একটা নীল আলো জ্বলে ওঠে। ইলি মাথার কাছে সুইচ টিপে দিতেই ভিতরে শীতল একটা বাতাস বইতে থাকে। ত্রিনিত্রি তার শরীরের দায়িত্ব নিয়ে নেবে কিছুক্ষণের মাঝেই, গভীর নিদ্রায় অচেতন হয়ে যাবে সে দীর্ঘ সময়ের জন্য।

ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ ইলির মনে হল, কিছু-একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটছে। সে চোখ মেলে তাকায়, মাথার কাছে নীলাভ স্ক্রিনে রুখের চেহারা ভেসে উঠল হঠাৎ রুখ শান্ত গলায় বলল, ইলি, তোমার বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, ব্যাপারটি ঘটবে খুব দ্রুত এবং যতদূর জানি কোনরকম যন্ত্রণা ছাড়াই।

কী বলছ তুমি?

আমি দুঃখিত ইলি, পৃথিবীতে পৌঁছানোর পর আমি কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না। যে-কারণে ক্রিকিকে হত্যা করতে হয়েছে, ঠিক সেই কারণে তোমাকেও–

কী বলছ তুমি। ইলি লাফিয়ে উঠে বসতে গিয়ে আবিষ্কার করে তার সারা শরীর অসাড় আঙুল পর্যন্ত তোলার ক্ষমতা নেই।

আমি তোমার অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের সাথে খানিকটা জিলুইন মিশিয়ে দিয়েছি। তোমার স্নায়ুকে আক্রান্ত করবে, যার ফলে তোমার যন্ত্রণার অনুভূতি থাকবে না। সব মিলিয়ে কয়েক মিনিট সময় নেবে। অত্যন্ত আরামদায়ক মৃত্যু। তুমি ত্রিনিত্রিকে দাঁড়া করানোর জন্যে যে পরিশ্রম করেছ, তার জন্যে এটা তোমার প্রাপ্য।

ইলি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। মনিটরে রুখের চেহারা আস্তে আস্তে ঝাঁপসা হয়ে আসে।

 

মহাকাশযানটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে। পুরো মহাকাশযানের দেয়ালটি তাপনিরোধক একটি আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার অংশটি এখনো তুলনামূলকভাবে বিপজ্জনক। ইদানীং কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই, কিন্তু তবু নানারকম সাবধানতা নেয়া হয়। রুখকে মহাকাশের বিশেষ পোশাক পরে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে নিতে হল। নানারকম বেল্ট দিয়ে তাকে চেয়ারের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেয়া হয়েছে। মাথার কাছে একটা লাল বাতি প্রতি সেকেন্ডে একবার করে জ্বলে উঠে রুখকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে তারা বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

ব্যাপারটি ঘটল খুব ধীরে ধীরে।

রুখ মহাকাশ অভিযানে অভ্যস্ত নয়, তাই সে প্রথমে ধরতে পারল না। সে জানত বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে পৌছে যেতে মিনিটখানেকের বেশি সময় লাগার কথা নয়। রুখ একটু অবাক হল যখন মহাকাশযানের আলো কমে প্রায় নিবুনিবু হয়ে এল, একটু শঙ্কিত হয়ে ডাকল, ত্রিনিত্রি।

বলুন মহামান্য রুখ।

আলো কমে আসছে কেন?

আমি কমিয়ে দিয়েছি, তাই।

ও।

একটু পর রুখ আবার জিজ্ঞেস করল, বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে যাবার সময় কি আলো কমিয়ে দিতে হয়?

সেরকম কোনো নিয়ম নেই মহামান্য রুখ।

তা হলে আলো কমিয়ে দিচ্ছ কেন?

আলোর কোনো প্রয়োজন নেই মহামান্য রুখ।

কেন নেই?

ত্রিনিত্রি কোনো উত্তর দিল না। রুখ শুকননা গলায় জিজ্ঞেস করল, কেন নেই? আমরা কখন পৌঁছাব পৃথিবীতে?

আমরা পৃথিবীতে পৌঁছাব না মহামান্য রুখ।

রুখ ভয়ানক চমকে ওঠে, কেন পৌঁছাব না?

কারণ আমরা পৃথিবীতে যাচ্ছি না।

কোথায় যাচ্ছি?

আমি জানি না মহামান্য রুখ। সৌরজগতের বাইরে। আপনাদের বলা হয় নি মহামান্য রুখ, আমি কখনোই পৃথিবীর দিকে যাচ্ছিলাম না।

কিন্তু—কিন্তু–স্পষ্ট দেখেছি মনিটরে—পৃথিবী–

হ্যাঁ, দেখেছেন। কারণ আমি দেখিয়েছি। আমরা প্রটোর কক্ষপথ পার হয়ে এসেছি, সৌরজগৎ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি এখন।

ত্রিনিত্রি–রুখ চিৎকার করে বলল, কী বলছ তুমি? কী বলছ পাগলের মতো–

রুখ লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করল সে স্টেনলেস স্টিলের শক্ত কজা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, তার নিজের সেটা খোলার উপায় নেই। রুখ চিৎকার করে বলল, খুলে দাও আমাকে–খুলে দাও—

আপনাকে খুলে দেব বলে এখানে বসানো হয় নি মহামান্য রুখ।

কেন বসিয়েছ?

এই পোশাকে মানুষ দীর্ঘকাল নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারে। আপনাকে আমি দীর্ঘকাল বাঁচিয়ে রাখতে চাই। আমি চাই না আপনি কোনোভাবে আত্মহত্যা করুন। আপনাকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিয়ে আমি বাঁচিয়ে রাখব। এই পোশাকের ভিতর আপনি অত্যন্ত নিরাপদ মহামান্য রুখ।

রুখের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। ভয়ার্ত গলায় বলল, ত্রিনিত্রি, তুমি কেন এরকম করছ? কেন?

আমি ত্রিনিত্রি নই মহামান্য রুখ।

তু-তুমি কে? রুখের গলা কেঁপে গেল হঠাৎ।

আমি শু।

শু? রুখ ভাঙা গলায় বলল, তুমি কী চাও শু? তুমি আমাকে কোথায় নিতে চাও?

নরকে। সেটি কোথায় আমি জানি না, আমি তোমাকে নিয়ে খুঁজে দেখতে চাই।

মহাকাশযান গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেছে। রুখ কাতর গলায় বলল, শু, আমায় ক্ষমা কর।

মানুষ মানুষকে ক্ষমা করতে পারে, আমি আর মানুষ নই রুখ তুমি নিজের হাতে আমাকে একটা যন্ত্রের সাথে জুড়ে দিয়েছ।

ভুল করেছি আমি—ভুল করেছি—রুখ ভাঙা গলায় বলল, আমায় ক্ষমা কর—

কী চাও তুমি?

আলো, শুধু আলো-অন্ধকারকে আমার বড় ভয় করে।

বেশ।

খুব ধীরে ধীরে মহাকাশযানে ইষৎ ঘোলাটে একটু হলুদ আলো জ্বলে ওঠে। মহাকাশযানে কৃত্রিম মহাকর্ষ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ইতস্তত ভাসছে সবকিছু। শীতল কক্ষ থেকে একটা ক্যাপসুল ভেসে এসেছে। সেখানে শুয়ের দেহ রাখা ছিল, ক্যাপসুলটির ঢাকনা খুলে গেছে—ভিতর থেকে শুয়ের মৃতদেহটি বের হয়ে এসেছে তাই। চোখ দুটি বন্ধ করে দেয়া হয় নি, তাই মনে হচ্ছে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে রুখের দিকে।

রুখ চোখ বন্ধ করে অমানুষিক চিৎকার দিল একটি।

 

মহাকাশযানটি নরকের খোঁজে ছুটে যাচ্ছে মহাকাশ দিয়ে, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

০৯. ওমিক্রনিক রূপান্তর

ইলেনের ঘুম ভাঙল তার সবচেয়ে প্রিয় সুরটি শুনে, কিনস্কীর নবম সিম্ফোনি। বার বছর আগে শীতল–ঘরে ঘুমিয়ে যাবার আগে মহাকাশযানের কম্পিউটার ক্রিকিকে সে এই সঙ্গীতটির কথা বলে দিয়েছিল। শীতল-ঘরে ঘুমন্ত কাউকে জাগিয়ে তোলার সময় চেষ্টা করা হয় তার প্রিয় সুরটি বাজাতে, সেরকমই নিয়ম। ইলেন খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলল, ক্যাপসুলের ভিতর খুব হালকা একটা মায়াবী আলো। এর মাঝে চার বছর পার হয়ে গেছে? ইলেনের মনে হল মাত্র সেদিন সে ক্যাপসুলে উপাসনার ভঙ্গিতে দুই হাত বুকের উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখনও দুই হাত বুকের উপর রাখা। হাত দুটি নিজে থেকে নাড়াবে কি না বুঝতে পারছিল না, ঠিক তখন কম্পিউটার ক্রিকির কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, শুভ জাগরণ, মহামান্য ইলেন।

শুভ জাগরণ? ইলেন এই অভিনব সম্ভাষণ শুনে একটু হকচকিয়ে গেল। কে জানে, কেউ যদি চার বছর পর ঘুম থেকে জেগে ওঠে তাকে সত্যিই হয়তো এভাবে সম্ভাষণ জানানো যায়।

মহামান্য ইলেন, আপনি কী রকম অনুভব করছেন?

ভালো।

চমৎকার। আপনি নিজে থেকে শরীরের কোনো অংশ নাড়াবেন না। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে আপনি শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সাময়িকভাবে দুর্বল অনুভব করতে পারেন। আমি আগে একটু পরীক্ষা করে নিতে চাই।

বেশ।

গত চার বছর আমি আপনার শরীরের যত্ন নিয়েছি, কাজেই কোনো ধরনের সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমি পরীক্ষা করে নিশ্চিত না হচ্ছি, আপনি শুয়ে থাকেন।

বেশ।

শরীরের নানা অংশে লাগানো নানা প্রোব দিয়ে ক্রিকি নানা ধরনের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পাঠাতে থাকে। ইলেন ধৈর্য ধরে শুয়ে রইল, দুই পায়ে প্রথমে ঝিঝি ধরার মতো একটা অনুভূতি হয়, দুই হাতে খানিকটা মৃদু কম্পন, কানের মাঝে একবার খানিকটা ভোঁতা শব্দ হল, তারপর একসময় সবকিছু থেমে গেল। ক্রিকির কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পেল। ইলেন, চমৎকার মহামান্য ইলেন। সবকিছু ঠিক আছে।

শুনে খুশি হলাম। এখন কি উঠতে পারি?

পারেন। তবে হঠাৎ করে উঠবেন না। খুব ধীরে ধীরে। প্রথমে বাম হাত উপরে তুলুন। তারপর ডান হাত—

ইলেন ঘণ্টাখানেক পর মহাকাশযানের বিশেষ টিলেঢালা একটা কাপড় পরে জানালার কাছে এসে বসে। সুদীর্ঘ অভিযান শেষ করে এই মহাকাশযানটি এখন পৃথিবীর দিকে ফিরে যাচ্ছে, ইলেনকে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে সেজন্যে। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকারে অসংখ্য নক্ষত্র স্থির হয়ে জ্বলছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কেমন জানি মন-খারাপ হয়ে যায়। একটা বলকারক পানীয় খেতে খেতে ইলেন মহাকাশযানের লগ পরীক্ষা করছিল। গত চার বছরে কী কী ঘটেছে সব এই লগে তুলে রাখা হয়েছে। বেশির ভাগই বৈজ্ঞানিক তথ্য, একনজর দেখে চট করে বোঝার মতো কিছু নয়। পৃথিবীতে পৌছে সেখানকার বড় কম্পিউটারে দীর্ঘ সময় এগুলো খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। তিন বছরের মাথায় একটা বড় গোছের গ্রহ-কণিকার সাথে প্রায় সামনা-সামনি ধাক্কা লেগে যাবার আশঙ্কা হয়েছিল, সেটি ছাড়া পুরো সময়টাকে বলা যেতে পারে বৈচিত্র্যহীন। মহাকাশ অভিযানের প্রথম দুই বছর ইলেন শীতল-কক্ষের বাইরে ছিল। সেই সময়টুকুর স্মৃতি তার কাছে খুব সুখকর নয়। দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতির পরেও মহাকাশযানের একাকীত্ব তার কাছে একেবারে অসহনীয় মনে হয়েছিল। এত দীর্ঘ যাত্রায় সাধারণতঃ সঙ্গী দেয়া হয় না, অতীতে দেখা গিয়েছে সেটি জটিলতা আরো বাড়িয়ে দেয়।

ইলেন মনিটরটি বন্ধ করে মহাকাশযানের কম্পিউটার ক্রিকিকে ডাকল, ক্রিকি।

বলুন মহামান্য ইলেন।

পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ হয়েছে?

এইমাত্র হল। আমি নিশ্চিত হবার জন্যে আরেক বার খবর পাঠিয়েছি।

চমৎকার। পৃথিবীটা তাহলে এখনো বেঁচে রয়েছে।

ইলেন কথাটি ঠিক ঠাট্টা করে বলে নি। পৃথিবীর অস্তিত্ব নিয়ে একটা আশঙ্কা সব সময় তার বুকে দানা বেঁধে আছে। সে এই মহাকাশযানে করে যখন পৃথিবী ছেড়ে এসেছিল, তখন পৃথিবীর অবস্থা ছিল খুব করুণ। শিল্প বিপ্লবের পর সারা পৃথিবীতে অসংখ্য কলকারখানা গড়ে উঠেছিল, তাদের পরিত্যক্ত রাসায়নিক জঞ্জালে সারা পৃথিবী এত কলুষিত হয়েছিল যে, মানুষের পক্ষে সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকা একরকম অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং পারমাণবিক শক্তিচালিত অসংখ্য কলকারখানা থেকে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা পৃথিবীর বাতাসে স্থান লাভ করেছে তার পরিমাণ ভয়াবহ। কাজেই পৃথিবী এখনো বেঁচে আছে এবং মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে ইলেনের একটা বড় স্বস্তির কারণ। সে ক্রিকিকে বলল, যোগাযোগটা আরেকটু ভালো করে থোক, তখন চেষ্টা কর একজন মানুষের সাথে কথা বলতে। যদি মানুষ পাওয়া যায়, আমাকে কথা বলতে দিও।

ঠিক আছে মহামান্য ইলেন।

খুব ইচ্ছে করছে একজন সত্যিকার মানুষের সাথে কথা বলতে।

বিচিত্র কিছু নয়, আপনি প্রায় ছয় বৎসর কোনো মানুষের সাথে কথা বলেন নি।

হ্যাঁ, তার মাঝে অবশ্যি চার বৎসর ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি।

মহাজাগতিক রশি ব্যবহার করে মহাকাশযানটির গতিবেগ অবশ্যি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কাজেই পৃথিবীতে এর মাঝে অনেক দিন পার হয়ে গেছে।

সেটা সত্যি। আমি যাদের পৃথিবীতে ছেড়ে এসেছি, তাদের কেউ বেঁচে নেই।

যারা শীতল-ঘরে আছে, তারা ছাড়া।

শীতল-ঘরে আর কয়জনই-বা যায়। ইলেন খানিকক্ষণ মনে মনে হিসেব করে বলল, পৃথিবীতে এর মাঝে এক শ দশ বছর পার হয়ে গেছে। তাই না?

একশ দশ বছর চার মাস তের দিন। আরো যদি নিঁখুত হিসেব চান, তা হলে তের দিন চার ঘণ্টা উনিশ মিনিট একুশ সেকেণ্ড।

দীর্ঘ সময়। কি বল?

হ্যাঁ মহামান্য ইলেন। দীর্ঘ সময়।

ইলেন খানিকক্ষণ আনমনা হয়ে বসে থাকে। একটু পর আস্তে আস্তে বলে, বুঝলে ক্রিকি, আমার স্ত্রী যখন অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল, মনে হল বেঁচে থেকে কী হবে। এই অভিযানটিতে তখন নিজে থেকে নাম লিখিয়েছিলাম। নাহয় কি কেউ এরকম একটা অভিযানে যায়? পৃথিবীতে এক শতাব্দীর বেশি সময় পর ফিরে যাওয়া অনেকটা নূতন একটা জীবনে ফিরে যাওয়ার মতো। এতদিনে পৃথিবীর নিশ্চয়ই অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কী বল?

নিশ্চয়ই।

খুব কৌতূহল হচ্ছে দেখার জন্যে।

খুবই স্বাভাবিক।

ইলেন তার প্রাত্যহিক কাজে ফিরে যাবার আগে বলল, চেষ্টা করতে থাক একজন সত্যিকার রক্তমাংসের মানুষ খুঁজে বের করতে। খুব ইচ্ছে করছে একজন মানুষের সাথে কথা বলতে।

চেষ্টা করছি মহামান্য ইলেন।

সপ্তাহ দুয়েক পর ক্রিকি পৃথিবীর একজন সত্যিকার মানুষের সাথে ইলেনের যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারল। আন্তঃগ্রহ যোগাযোগ বিভাগের একজন বিজ্ঞানী। মধ্যবয়সী একজন হাসিখুশি মানুষ। ইলেন প্রাথমিক সম্ভাষণ বিনিময় শেষ করে বলল, পৃথিবীতে এখন কোন ঋতু চলছে?

বসন্ত। ভারি বাজে সময়।

কেন, বাজে সময় হবে কেন? বসন্ত ফুল ফোঁটার সময়।

সেটাই তো বাজে। ফুলের পরাগরেণুতে বাতাস ভারি হয়ে আছে। দেশসুদ্ধ মানুষের অ্যালার্জি। হাঁচি দিতে দিতে একেকজনের কী অবস্থা।

ইলেন শব্দ করে হাসে, কী বলছেন আপনি! মহাকাশযানের একেবারে পরিশুদ্ধ বাতাসে আমি ছয় বছর থেকে আছি। এই ছয় বছরে একটিবারও হাঁচি দিই নি। আমি তো ফুলের পরাগ শুকে কিছু হাঁচি দিতে আপত্তি করব না।

বিজ্ঞানী ভদ্রলোক বিরস মুখে বললেন, দূর থেকে ওরকমই মনে হয়। অ্যালার্জি জিনিসটা খুব খারাপ। সবাই বলছি, আইন করে ফুলের পরাগ বন্ধ করে দেয়া হোক।

ইলেন হো হো করে হেসে উঠে, ভালোই বলেছেন, আইন করে ফুলের পরাগ বন্ধ করে দেয়া হবে। কয়দিন পরে শুনব যা কিছু খারাপ, আইন করে বন্ধ করে দেয়া হবে। রোগ শোক দুঃখ কষ্ট জিরা ব্যাধি, পাপ গ্লানি সব বেআইনি–

বিজ্ঞানী ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, কেন, আপনি এত হাসছেন কেন? আমি তো কিছু দোষ দেখি না আইন করে কিছু খারাপ জিনিস বন্ধ করে দেয়ায়। কলকারখানা বাতাসে কী পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস ছড়াত মনে আছে? আইন করে সেসব বন্ধ করে দেয়া হল না? এখন বাতাস কত পরিষ্কার। মাঠে ঘাস জন্মেছে, আকাশে পাখি উড়ছে, নদীতে মাছ।

ইলেন উজ্জ্বল চোখে বলল, সত্যি? আমি যখন পৃথিবী ছেড়েছি, কী ভয়াবহ অবস্থা পৃথিবীতে। নিঃশাস নেয়ার অবস্থা ছিল না।

সব পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। এলে চিনতে পারবেন না। কলকারখানার জঞ্জাল, তেজস্ক্রিয় বিষাক্ত গ্যাস, কিছু নেই। ঝকঝকে একটা পৃথিবী। সত্যি কথা বলতে কি একটু বেশি ঝকঝকে। গাছপালা ফুল ফল একটু কম হলেই মনে হয় ভালো ছিল।

ইলেন বিজ্ঞানী ভদ্রলোকের সাথে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে খানিকক্ষণ কথা বলে জিজ্ঞেস করে, গত এক শ বছরে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি কি বলতে পারেন?

গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার? বিজ্ঞানী ভদ্রলোককে একটু বিভ্রান্ত মনে হল। মাথা চুলকে বললেন, গত এক শ বছরে সত্যি কথা বলতে কি সেরকম বড় কোনো আবিষ্কার হয় নি। অন্তত আমার তো মনে পড়ে না। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে কিছু নূতন জন্তু জানোয়ার তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেটা তো বড় আবিষ্কার হল না, কি বলেন?

পদার্থবিজ্ঞানে? রসায়ন? ইঞ্জিনিয়ারিং?

পদার্থবিজ্ঞানে ব্ল্যাক হোল নিয়ে বড় একটা আবিষ্কার হয়েছে, ল্যাবরেটরিতে ব্ল্যাক হোেল তৈরি করা জাতীয় ব্যাপার। আমি ঠিক বুঝি না সেসব। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনেক কিছু হয়েছে, কোনটা বলি আপনাকে? কম্পিউটারের নূতন মডেলগুলো অসাধারণ, আপনার মহাকাশযানের কম্পিউটার এখন হাতের রিস্টওয়াচে এঁটে যায়।

এরকম কোনো আবিষ্কার নেই, যেটা অন্য দশটা আবিষ্কার থেকে আলাদা করে বলা যায়?

নিশ্চয়ই আছে, এক সেকেন্ড অপেক্ষা করেন, আমি ডাটা বেস থেকে বের করে আনি। বিজ্ঞানী ভদ্রলোক খানিকক্ষণ কী-একটা দেখে মাথা চুলকে বললেন, ভারি আশ্চর্য ব্যাপার।

কী হয়েছে?

এখানে লেখা রয়েছে, গত শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ওমিক্রনিক রূপান্তর। এই আবিষ্কার নাকি পৃথিবী এবং মানুষ জাতিকে নূতন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে।

সেটা কী?

বিজ্ঞানী ভদ্রলোক অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একটু হেসে বললেন, মজার ব্যাপার শুনবেন? আমি কখনো এর নাম পর্যন্ত শুনি নি। এই প্রথম শুনলাম, ওমিক্রনিক রূপান্তর। কী আশ্চর্য একটা নাম। যে-আবিষ্কার মানবজাতির জন্যে নূতন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, সেটার নাম পর্যন্ত আমি শুনি নি—কী লজ্জার ব্যাপার বলেন দেখি।

লজ্জার কী আছে? আবিষ্কারটি নিশ্চয়ই আপনার বিষয়ে নয়–

নিশ্চয়ই নয়। নিশ্চয়ই জীববিজ্ঞান বা ডাক্তারি শাস্ত্রের কিছু হবে। আপনি অপেক্ষা করল, আমি বের করে আনি ব্যাপারটা কি, এই ডাটা বেসেই আছে।

ইলেন বলল, আপনাকে বের করতে হবে না, আমি পরে বের করে নেব। আমার সময় পার হয়ে গেছে, যোগাযোগ কেটে দিচ্ছে এক্ষুণি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার পৃথিবীতে ফিরে আসা অনেক আনন্দের হোক।

সত্যিকার একজন মানুষের সাথে কথা বলে ইলেনের বেশ লাগল। বড় কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ হলে প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিঁখুতভাবে পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে অপ্রয়োজনীয় তুচ্ছ একটা খবরের জন্যে মনটা বুভুক্ষু হয়ে থাকে। সেরকম একটা খবর দিতে পারে শুধু মানুষ। যেমন পৃথিবীতে এখন বসন্তকাল, অসংখ্য ফুল ফুটেছে, ফুলের পরাগরেণু বাতাসে ভাসছে এবং সেই রেণু মানুষের অ্যালার্জির শুরু করেছে। এই নেহায়েত অপ্রয়োজনীয় এবং প্রায় অর্থহীন তথ্যটি ইলেনকে হঠাৎ করে একেবারে মাটির পৃথিবীর কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। বড় ভালো লেগেছে শুনে যে বড় বড় কলকারখানার আবর্জনা এবং জঞ্জাল পৃথিবীকে পুরোপুরি কলুষিত করে ফেলবে সেরকম যে-ভয়টা ছিল সেটা এড়ানো গেছে। পৃথিবী আবার বাসযোগ্য হয়েছে, ফুলে ফলে ভরে উঠেছে শুনে ইলেনের হঠাৎ করে আবার মানবজাতির উপর বিশ্বাস ফিরে এসেছে।

 

প্রাত্যহিক কাজকর্ম শেষ করে ইলেন মহাকাশযানের কম্পিউটার ক্রিকিকে বলল, পৃথিবীর কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্র থেকে ওমিক্রনিক রূপান্তরসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য বের করে আনতে। ক্রিকি প্রায় বার টেরাবাইট তথ্য বের করে আনল। ইলেন তখন বলল, তার মাঝখান থেকে মূল জিনিসগুলো বের করে আনতে। ক্রিকি সেগুলি বের করে আনার পর ইলেন পড়তে বসে।

যেটা পড়ল সেটা খুব বিচিত্র।

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রথম শ্রেণীর কম্পিউটারে কিছু প্রোগ্রাম লেখা হয়েছিল, যেটা প্রায় একজন সত্যিকার মানুষের মতো চিন্তা-ভাবনা করতে পারত। ধীরে ধীরে সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে এরকম একটা প্রোগ্রামের সাথে যোগাযোগ করে কোনোভাবে বলা সম্ভব হত না সেটি কি মানুষ, না, একটি কম্পিউটার। প্রোগ্রামটি এমনভাবে লেখা হত যেন সেটি একজন নির্দিষ্ট মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে। দীর্ঘদিন গবেষণার পর ব্যাপারটি এত নিখুঁত রূপ নিয়ে নিল যে, আক্ষরিক অর্থেই একজন মানুষের মস্তিষ্ককে তার পুরো ক্ষমতাসহ একটি কম্পিউটারের মেমোরিতে বসিয়ে দেয়া যেত। একজন জৈবিক মানুষকে, কম্পিউটারের ভিতরে এই ধরনের যান্ত্রিক রূপ দেয়ার নাম ওমিক্রনিক রূপান্তর।

ওমিক্রনিক রূপান্তর ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করার নানা ধরনের ব্যবহারিক গুরুত্ব থাকার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সেটি একেবারেই কোনো কাজে এল না। কেন এল না তার কারণটি খুব সহজ। ওমিক্রনিক রূপান্তর করে তৈরি করা কম্পিউটার প্রোগ্রামটি এবং সত্যিকার মস্তিষ্কের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। মানুষের প্রকৃত মস্তিষ্ককে কখনো শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয় না, বাইরের জগৎকে সবসময়েই পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারে। কিন্তু ওমিক্রনিক রূপান্তরে তৈরী মানুষের মস্তিষ্কের অনুলিপির সে-ক্ষমতা নেই। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কোনো-একটি কম্পিউটারের মেমোরিতে বেঁচে থাকা তাদের কাছে ভয়াবহ অমানুষিক অত্যাচারের মতো, যেন কোনো মানুষকে হঠাৎ করে আলোহীন শব্দহীন এক অতল গহ্বরে ফেলে দেয়া হয়েছে এবং সেখান থেকে তারা বাইরের কোনো কিছুর সাথে কোনোদিন যোগাযোগ করতে পারছে না। সেই অনুভূতি এত ভয়ানক যে ওমিক্রনিক রূপান্তর করে তৈরি করা মস্তিষ্কের প্রতিটি অনুলিপি প্রথম সুযোগ পাওয়ামাত্র নিজেদের ধ্বংস করে ফেলেছিল।

প্রথমে সবাই ভেবেছিল ওমিক্রনিক রূপান্তর করে তৈরি মস্তিষ্কের অনুলিপিগুলোকে দেখার, শোনার এবং কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হলেই হয়তো এই সমস্যার সমাধান হবে। দেখা গেল সেটা সত্যি নয়। এই ধরনের মস্তিষ্কের অনুলিপি সবসময়েই অনুভব করেছে তারা পুরো জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, তাদের দেহ নেই বলে তাদের অস্তিত্ব নেই। কৃত্রিম উপায়ে তারা যা দেখে বা যা শোনে, তার সাথে বাস্তব জগতের কোনো মিল নেই। সে কারণে সবসময়েই তারা ভয়াবহ বিষণ্ণতায় ডুবে রয়েছে।

ওমিক্রনিক রূপান্তর করে তৈরি মস্তিষ্কের অনুলিপিগুলোকে বিষণ্ণতা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল বিচিত্রভাবে, অনেকগুলো মস্তিষ্কের অনুলিপিকে এক কম্পিউটারে নিজেদের মাঝে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেয়ার পর। দেখা গেল হঠাৎ করে কম্পিউটারের ভিতর একটা ছোট সমাজ গড়ে উঠেছে। মস্তিষ্কের অনুলিপিগুলোর মাঝে প্রথমে পরিচয় হল, তারপর বন্ধুত্ব হল এবং সবশেষে একে অন্যকে অসহনীয় বিষণ্ণতা থেকে টেনে তুলতে শুরু করল।

তখন হঠাৎ করে ওমিক্রনিক রূপান্তরের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি আবিষ্কৃত হল। কম্পিউটারের মাঝে বেঁচে থাকা মস্তিষ্কের অনুলিপিদের বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্যে প্রয়োজন কম্পিউটারের ভিতরে একটা জগৎ। পৃথিবীর কম্পিউটার প্রোগ্রামাররা তখন কম্পিউটারের মাঝে একটা জগৎ তৈরি করার কাজে লেগে গেলেন। বিচিত্র সব প্রোগ্রাম লেখা হল। মস্তিষ্কের অনুলিপিগুলোর জন্যে তৈরি হল দেহ, কম্পিউটার প্রোগ্রামে। পুরুষের জন্যে পুরুষের দেহ, নারীর জন্য নারীর। সেইসব দেহ কম্পিউটারের ভিতরে এক কাল্পনিক জগতে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, গাছপালা তৈরি হল কম্পিউটার প্রোগ্রামে। আকাশ তৈরি হল, বাতাস তৈরি হল, দিন, রাত, ঋতু তৈরি হল। সত্যিকার মানুষের মস্তিষ্কের নিখুঁত অনুলিপি একটা শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকল। সেই জগতে তারা ভুলে গেল তাদের দেহ, তাদের চারপাশের জগৎ কোনো-এক প্রোগ্রামের সৃষ্টি। তাদের মনে হল তারা সত্যিকারের মানুষ, তাদের চারপাশের জগৎ সত্যিকারের জগৎ। সেইসব মানুষের মাঝে দুঃখ-বেদনা হাসি-কান্না খেলা করতে থাকে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরের সেই জগতে নিজেদের জন্যে নূতন একটা জগৎ তৈরি করে নেয়। সত্যিকার জগতের সাথে তার আর কোনো পার্থক্য নেই।

 

ইলেন রূদ্ধশ্বাসে ওমিক্রনিক রূপান্তর নামের সেই বিচিত্র গবেষণার কথা পড়তে থাকে। পৃথিবীর দিকে ছুটে যাওয়া এই মহাকাশযানের নিঃসঙ্গ যাত্রীটি সময়ের কথা ভুলে যায়।

 

পৃথিবীর খুব কাছাকাছি এসে ইলেন আবার পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষের সাথে যোগাযোগ করল। এবারে তার কথা হল একজন কমবয়সী মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটি কোনো কারণে খুব বিচলিত।

বলল, আপনি খুব ভালো আছেন, মহাকাশে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেন খামোকা পৃথিবীতে ফিরে আসছেন?

কেন? কী হয়েছে?

আজকের সন্ধের খবর। লেজারকমে চাকরি করে একজন মানুষ, কাজকর্ম করে না বলে চাকরি গেছে। সেই মানুষ ক্ষেপে গিয়ে এগারটা মানুষ খুন করে ফেলল। চিন্তা করতে পারেন?

ইলেন জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, কী দুঃখের ব্যাপার।

হ্যাঁ। এদের সহ্য করা হয় বলেই তো এই অবস্থা।

সহ্য করা না-করা তো প্রশ্ন নয়। এরকম একজন দুজন মানুষ তো সবসময়েই থাকবে। এদের মনে হয় পুরো মানসিক ভারসাম্য নেই। হঠাৎ হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এরকম এক-আধটা অঘটন ঘটায়।

কিন্তু কেন ঘটতে দেয়া হবে?

কিছু তো করার নেই। এদের বিরুদ্ধে তো কিছু করার নেই।

কেন থাকবে না? অবশ্যি আছে।

আছে? ইলেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী করার আছে?

আইন করে দেয়া হবে যে এরকম মানুষ আর কখনো জন্মাতে পারবে না।

আইন করে–ইলেন থতমত খেয়ে যায়, মেয়েটা কী বলছে? আইন করে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের জন্ম বন্ধ করে দেয়া হবে?

আমি দুঃখিত, আপনি এতদিন পর পৃথিবীতে ফিরে আসছেন, অথচ এরকম মন-খারাপ করে দেয়া কথা বলছি। আমি দুঃখিত।

দুঃখিত হবার কী আছে। এসব হচ্ছে বেঁচে থাকার মাসুল–

সেটাই তো কথা। কেন দুঃখকষ্ট জীবনের মাসুল হবে? আইন করে কেন জীবন থেকে সব দুঃখকষ্ট সরিয়ে দেয়া হবে না?

ইলেন চুপ করে থাকে। কেন মেয়েটা এরকমু কথা বলছে? জীবন থেকে সব দুঃখকষ্ট আইন করে সরিয়ে দেবে মানে? এর আগেও মধ্যবয়স্ক সেই বিজ্ঞানী একই কথা বলছিল—তখন ভেবেছিল ঠাট্টা করে বলছে। তাহলে কি সত্যি বলেছিল?

হঠাৎ ইলেনের বুকের ভিতর কেমন জানি একটা অশুভ অনুভূতির জন্ম হয়।

 

মহাকাশযানটি নিরাপদে মহাকাশ কেন্দ্রে অবতরণ করল। ইলেন খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে। এরকম দীর্ঘ অভিযানের পর সাধারণত মহাকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা দরজা খুলে অভ্যর্থনা করে, আজ কেউ এল না। ইলেন নিজেই দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আতঙ্কে শিউরে ওঠে–

সামনে বিস্তীর্ণ ধূসর প্রাণহীন পৃথিবী। ক্লেদাক্ত আকাশ, দূষিত পূতিগন্ধময় বাতাস আগুনের হলকার মতো বইছে। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। বিষাক্ত বাতাসে ইলেনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, চোখ জ্বালা করতে থাকে, কোনোমতে দু হাতে মুখ ঢেকে সে মহাকাশযানের ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। কোথায় এসেছে সে? কাঁপা গলায় ডাকল, ক্রিকি–

বলুন মহামান্য ইলেন।

বাইরে দেখেছ?

দেখেছি। অত্যন্ত ভয়ংকর পরিবেশ। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ খুব কম, প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড। সাথে নাইট্রাস অক্সাইড এবং সালফার ডাই–অক্সাইড। চারপাশে ভয়ানক তেজস্ক্রিয়তা, সিজিয়াম ১৩৭-এর পরিমাণ দেখে মনে হয় পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখানে সূর্যের আলোতে আলট্রা ভায়োলেট রে-এর পরিমাণ অত্যন্ত বেশি, মনে হয় বায়ুমণ্ডলের ওজোনের স্তর পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। মহামান্য ইলেন, এই গ্রহ মানুষের বাসের পক্ষে পুরোপুরি অনুপযুক্ত। এখানে আমি যতদূর দেখেছি কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই।

কী বলছ তুমি!

আমি দুঃখিত মহামান্য ইলেন, কিন্তু আমি সত্যি কথা বলছি।

কিন্তু আমি মাত্র সেদিন পৃথিবীর সাথে কথা বলেছি—

আমি এখনো তাদের সাথে কথা বলছি মহামান্য ইলেন। আপনি বলবেন?

বলব। ভয়ার্ত গলায় ইলেন বলল, বলব।

সাথে সাথে মনিটরে হাসিখুশি একজন মানুষকে দেখা গেল। মানুষটি বলল, আমি কিম রিগার। পৃথিবীর পক্ষ থেকে আপনাকে আমি সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছি সম্মানিত ইলেন।

কিম।

বলুন।

তোমরা কোথায়?

মানে?

আমি কাউকে দেখছি না কেন? পৃথিবী এরকম ভয়ংকর প্রাণহীন কেন? বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস–

কিমকে এক মুহূর্তের জন্যে বিভ্রান্ত দেখায়। সামনে সুইচ বোর্ডে দ্রুত কিছু সুইচ স্পর্শ করে নিজেকে সামলে নেয়। মুখে জোর করে একটা হাসি টেনে এনে বলল, আমাদের ছোট একটা ভুল হয়ে গেছে।

ভুল?

হ্যাঁ অনেক দিন করা হয় নি, তাই। ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটা ভুল।

কী ভুল?

আপনার ওমিক্রনিক রূপান্তর করা হয় নি। তা হলে আপনি আমাদের পৃথিবীতে অবতরণ করতে পারতেন। আপনি ভুল পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন, সেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে বহুকাল আগে। শিল্পবিপ্লবের অভিশাপে সেই পৃথিবী এখন প্রাণহীন। আপনি সেই ভুল পৃথিবীতে পা দিয়েছেন, বাইরে বের হলে আপনি দশ মিনিটের মাঝে প্রাণ হারাবেন, বিষাক্ত ফসজিল গ্যাসের নূতন একটা আস্তরণ তৈরি হচ্ছে এই মুহূর্তে।

ভূল পৃথিবী?

হ্যাঁ। আমরা এখন নূতন পৃথিবী তৈরি করেছি।

নূতন পৃথিবী?

হ্যাঁ। বিশাল টেটরা কম্পিউটার তৈরি হয়েছে মাটির গহ্বরে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সেটা বড় করা হচ্ছে ধীরে ধীরে। সেই মহা কম্পিউটারে গত শতাব্দীতে সব মানুষের ওমিক্রনিক রূপান্তর করা হয়েছে।

সব মানুষের?

হ্যাঁ, সব মানুষের। বাসের অনুপযুক্ত হয়ে গিয়েছিল পুরানো পৃথিবী। নূতন পৃথিবীতে কোনো বিষাক্ত গ্যাস নেই, ভয়াবহ আলট্রা ভায়োলেট রে নেই, তেজস্ক্রিয় জঞ্জাল নেই। এখানে আছে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, নীল হ্রদ, গহীন অরণ্য, বিশাল অতলান্ত সমুদ্র, মহাসমুদ্র। আগের পৃথিবীতে যেসব ভুল করা হয়েছিল, সব শুধরে নেয়া হয়েছে এখানে। আশ্চর্য একটা শান্তি বিরাজ করছে এই পৃথিবীতে–

তোমরা তা হলে মানুষ নও? তোমরা আসলে কম্পিউটার প্রোগ্রাম? তোমাদের পৃথিবীও কম্পিউটার প্রোগ্রাম?

হ্যাঁ, কিন্তু নিখুঁত প্রোগ্রাম। আমরা নিখুঁত মানুষ। আমাদের এই পৃথিবী নিখুঁত পৃথিবী।

নিঁখুত পৃথিবী?

হ্যাঁ। আপনি আসেন, নিজের চোখে দেখবেন। আশ্চর্য একটা শান্তি এই পৃথিবীতে। যা কিছু খারাপ, যা কিছু অশুভআইন করে সরিয়ে দেবার কথা হচ্ছে এই পৃথিবী থেকে। তখন স্বর্গের মতো হয়ে যাবে এই পৃথিবী।

স্বর্গের মতো?

হ্যাঁ। আপনি আসুন, দেখবেন। আপনাকে অভ্যর্থনা করার জন্যে আমরা প্রস্তুত হয়ে আছি এখানে। ওমিক্রনিক রূপান্তরের জন্যে প্রস্তুত আছেন আপনি?

ইলেন তার কথার উত্তর দিল না, বিড়বিড় করে বলল, পৃথিবী নেই? মানুষ নেই? মানুষের দুঃখ কষ্ট ভালবাসা কিছু নেই? কিছু নেই?

 

সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহের একমাত্র জীবিত মানুষ ইলেন দুমাস মহাকাশযানের দরজা খুলে বের হয়ে এল। বাইরে আগুনের হলকার মতো ভয়ংকর বিষাক্ত বাতাস হু হু করে বইছে, তার মাঝে সে মাথা উঁচু করে হাঁটতে থাকে, শৈশবে যে-ভালবাসার পৃথিবীতে সে বড় হয়েছে, তাকে যেন খুঁজছে ব্যাকুল হয়ে

আর কিছুক্ষণের মাঝেই সে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে নিচে। বিষাক্ত বাতাস তার বক্ষ বিদীর্ণ করে চূর্ণ করে দেবে ক্ষতবিক্ষতফুসফুসকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠবে তাঁর আশ্চর্য কোমল দেহ। সেই দেহ পড়ে থাকবে ভয়ংকর এক পৃথিবীর বুকে।

 

যে-পৃথিবীকে তার নির্বোধ বাসিন্দারা ধ্বংস করেছে নিজের হাতে।

Exit mobile version