Site icon BnBoi.Com

নিউটনের ভুল সূত্ৰ – হুমায়ূন আহমেদ

নিউটনের ভুল সূত্ৰ - হুমায়ূন আহমেদ

মতিনউদ্দিন সাহেবকে কেউ পছন্দ করে না

মতিনউদ্দিন সাহেবকে কেন জানি কেউ পছন্দ করে না। অফিসের লোকজন করে না, বাড়ির লোকজনও না। এর কী কারণ মতিন সাহেব জানেন না। প্রায়ই তাঁর ইচ্ছা করে পরিচিত কাউকে জিজ্ঞেস করেন— আচ্ছা আপনি আমাকে পছন্দ করেন না কেন? জিজ্ঞেস করা হয় না। তাঁর লজ্জা লাগে। মনে মনে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলেন—থাক, কী হবে জিজ্ঞেস করে?

তাঁর স্ত্রীকে অবশ্যি একদিন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন। নাশতা খেতে খেতে অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা কথা, তুমি আমাকে পছন্দ করো না কেন?

মতিন সাহেবের স্ত্রী রাহেলা বেগম তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, তুমি কী বললে?

না—কিছু বলিনি।

পছন্দের কথা কী যেন বললে?

মানে জানতে চাচ্ছিলাম তুমি আমাকে পছন্দ কর কি না।

তোমার কি ভীমরতি হয়ে গেল না কি, আজেবাজে কথা জিজ্ঞেস করছ।

আর করব না।

তাঁর স্ত্রী যে তাকে দুচোখে দেখতে পারেন না তা মতিন সাহেব জানেন। তিনি থাকেন একা একটা ঘরে। সেই ঘরটাও বাড়ির সবচে খারাপ ঘর। আলো-বাতাস ঢােকে না বললেই হয়। দিনের বেলায় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। হঠাৎ দেশের বাড়ি থেকে কোন মেহমান চলে এলে এই ঘরও তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়। তখন কোথায় শোবেন তাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বড় ছেলের ঘরটা সুন্দর। খাটটাও বড়। অনায়াসে দুজন শোয়া যায়। কিন্তু শোয়া সম্ভব না বড় ছেলে বিরক্ত হয়। ছোট দুই মেয়ে এক ঘরে শোয়, সেখানে জায়গা নেই। তিনি খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে শেষ পর্যন্ত বসার ঘরের সোফায় ঘুমুতে যান। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে।

গত পূজার ছুটিতে বাসার সবাই ঠিক করল দল বেঁধে কক্সবাজার যাবে। তাঁকে অবশ্যি কেউ বলল না। তিনি খাবার টেবিলে আলোচনা শুনলেন। সব খরচ দিচ্ছে তার বড় ছেলে। ব্যবসায় তার ভাল লাভ হয়েছে। কিছু টাকা খরচ করতে চায়। সে হাসি মুখে বলল, এখান থেকে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে, মাইক্রবাসে যাব। নিজেদের কনট্রোলে একটা গাড়ি থাকার খুব সুবিধা। ধরো, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে ইচ্ছা করল, হুট করে চলে গেলাম।

মেজো মেয়ে নীতু বলল, কিন্তু ভাইয়া ট্রেন জার্নির আলাদা মজা। একটা পুরা কামরা রিজার্ভ করে যদি যাই…গাড়ি তুমি কক্সবাজরে ভাড়া করো। ওখানে ভাড়া পাওয়া যায় না?

ছোট মেয়ে বলল, আমার প্লেনে যেতে ইচ্ছা করছে ভাইয়া। ঢাকা থেকে চিটাগাং পর্যন্ত ট্রেনে, সেখান থেকে প্লেনে কক্সবাজার।

এই সব আলোচনা শুনতে তাঁর খুব আনন্দ হচ্ছিল। অবশ্যি তিনি আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন না। কারণ তিনি জানেন কিছু বলতে গেলেই রাহেলা বলবেন, চুপ করে তো, তুমি জানো কী?

মতিন সাহেব কিছু বললেন না ঠিকই কিন্তু জোগাড়-যন্ত্র করে রাখলেন। কাপড়-চোপড় ধুয়ে ইস্ত্ৰি করিয়ে রাখলেন। অফিসে বড় সাহেবকে বললেন, আমার কয়েকদিন ছুটি লাগবে স্যার। পরিবারের সবাই কক্সবাজার যাচ্ছি।

বড় সাহেব বললেন, হঠাৎ কক্সবাজার। ব্যাপার কী?

বাচ্চারা ধরল—বেড়াতে যাবে। আমি বললাম, ঠিক আছে চলো। ওদের আনন্দের জন্য যাওয়া। অবশ্যি আমি নিজেও কোনদিন সমুদ্র দেখিনি। ভাবলাম দেখেই আসি…

বলতে বলতে আনন্দে তার চোখে পানি এসে গেল। বড় সাহেব সাতদিনের ছুটি মঞ্জুর করলেন।

কক্সবাজার রওনা হবার আগের দিন রাহেলা এসে বললেন, আমরা সবাই কক্সবাজার যাচ্ছি জানো তো? তোমার তো আবার কোন উঁশ থাকে না। ঘরে কী আলোচনা হয় তাও জানো না। কাল রওনা হচ্ছি। মাইক্রোবাসে যাচ্ছি। বাস চলে আসবে তোর ছটায়।

মতিন সাহেব হাসি মুখে বললেন, জানি। আমি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি। অফিস থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়েছি। আর্নড লিভ।

রাহেলা অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে ছুটি নিতে কে বলল? আগ বাড়িয়ে যে এক একটা কাজ করো রাগে গা জ্বলে যায়। আমি কি বাসা খালি রেখে যাব না কি? রোজ চুরি হচ্ছে। তুমি থাকবে এখানে।

আচ্ছা।

ফ্রিজে এক সপ্তাহের মত গোশত রান্না করে রাখা হয়েছে। চারটা চাল ফুটিয়ে খেয়ে নেবে। পারবে না?

পারব।

শোবার আগে সব ঘর বন্ধ হয়েছে কি না ভাল করে দেখবে। তোমার উপর কোন দায়িত্ব দিয়েও তো নিশ্চিন্ত হতে পারি না।

এ জাতীয় ব্যাপার যে শুধু বাড়িতে ঘটে তাই না। অফিসেও নিয়মিত ঘটে। তাদের অফিসের এক সহকর্মী কোন-এক সিনেমায় ডাক্তারের ভূমিকায় অভিনয় করেছে। নায়িকার খুব জ্বর। ডাক্তার জ্বর দেখে বললেন-হু, জ্বর একশ তিন। পেসেন্টকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিতে হবে। নায়িকা তখন কাতর গলায় বলে, আমি বাঁচতে চাই না ডাক্তার। মৃত্যুই আমার জন্যে ভাল। পৃথিবীর এ আলো হাওয়া, এ আনন্দ আমি সহ্য করতে পারছি না। ডাক্তার তখন বলেন, ছিঃ এমন কথা বলবেন না।

এইটুকুই পার্ট। তবু তো সিনেমার পার্ট। পরিচিত একজন সিনেমায় পার্ট করছে এটা দেখায়ও আনন্দ। যে পার্ট করছে সে বলল, বৃহস্পতিবার সে সবার জন্য পাস নিয়ে আসবে। অফিসের শেষে সবাই তার বাসায় চা-টা খেয়ে সন্ধ্যাবেলা এক সঙ্গে ছবি দেখতে যাবে।

মতিন সাহেব খুব আগ্রহ নিয়ে বৃহস্পতিবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ছবিঘরে অনেকদিন ছবি দেখা হয় না। ছবি দেখা হবে। তাছাড়া দলবল নিয়ে ছবি দেখার আনন্দও আছে। উত্তেজনায় বৃহস্পতিবারে তিনি অফিসের কাজও ঠিকমত করতে পারলেন না। ছুটির পর সবাই এক সঙ্গে বেরুচ্ছেন, সিনেমার ডাক্তার অভিনেতা মতিন সাহেবকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, একটা ভুল হয়ে গেছে। তেরটা পাস এনেছি, এখন দেখি মানুষ চৌদ্দজন। কী করা যায় বলুন তো?

মতিন সাহেব কিছু বললেন না। তাঁর খুব যেতে ইচ্ছা করছে। নিজ থেকে বলতে ইচ্ছা করছে না, আপনারা যান। আমি থাকি।

শুনুন মতিন সাহেব, আপনি বরং থাকুন। আপনাকে পরে পাস এনে দেব। আর ছবিও খুব আজেবাজে। পুরা ছবি দেখলে হলের মধ্যে বমি করে দেবেন। না দেখাই ভাল।

মতিন সাহেব বললেন, আচ্ছা।

মনে কিছু করলেন না তো আবার?

জ্বি না।

বাসা পর্যন্ত চলুন। এক সঙ্গে চা খাই। অসুবিধা নেই তো?

জ্বি না।

শেষ পর্যন্ত বাসায় যাওয়া হল না। একটা জিপ জোগাড় হয়েছিল, সেই জিপে সবার জায়গা হল মতিন সাহেবের হল না।

মতিন সাহেব, আপনি রবং একটা রিকশা নিয়ে চলে আসুন। ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। মালিবাগ চৌধুরী পাড়া। অসুবিধা হবে না তো?

জ্বি না।

ঠিকানা নিয়ে তিনি রিকশা করে মালিবাগে নামলেন। বাসা খুঁজে পেলেন না কারণ ঠিকানায় সবই দেয়া আছে বাসার নাম্বার দেয়া নেই। মতিন সাহেবের একবার ক্ষীণ সন্দেহ হল-ইচ্ছা করেই বাসার নাম্বার দেয়নি। পর মুহূর্তেই সেই সন্দেহ তিনি ঝেড়ে ফেলে দিলেন। তা কী করে হয়। সন্ধ্যা না মেলানো পর্যন্ত তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করলেন বাড়ি খুঁজে বের করবার। পারলেন না।

সায়েন্স টিচার অমর বাবু

রূপেশ্বর নিউ মডেল হাইস্কুলের সায়েন্স টিচার হচ্ছেন অমর বাবু। (অমর নাথ পাল, বি. এসসি. (অনার্স, গোল্ড মেডেল)।

খুব সিরিয়াস ধরনের শিক্ষক। স্কুলের স্যারদের আসল নামের বাইরে একটা নকল নাম থাকে। ছাত্র মহলে সেই নামেই তারা পরিচিত হন। অমর বাবু স্কুলে ঘড়ি স্যার নামে পরিচিত। তাঁর বুক পকেটে একটা গোল ঘড়ি আছে। ক্লাসে ঢােকার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নেন। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ামাত্র আবার ঘড়ি বের করে সময় দেখেন। তখন যদি তার ভুরু কুঁচকে যায় তাহলে বুঝতে হবে ঘণ্টা ঠিকমতো পড়েনি। দুএক মিনিট এদিক-ওদিক হয়েছে।

তার ক্লাসে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে। আসা যাবে না, পেনসিল দিয়ে পাশের ছেলের পিঠে খোচা দেয়া চলবে না। খাতায় কাটাকুটি খেলা চলবে না। মনের ভুলেও যদি কেউ হেসে ফেলে তিনি হতভম্ব চোখে তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলবেন, সায়েন্স ছেলেখেলা নয়। হাসাহাসির কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেই। সায়েন্স পড়াবার সময় তুমি হেসেছ, তার মানে বিজ্ঞানকে তুমি উপহাস করেছ। মহা অন্যায় করেছ। তার জন্যে শাস্তি হবে। আজ ক্লাস শেষ হবার পর বাড়ি যাবে না। পাটিগণিতের সাত প্ৰশ্নমালার ১৭, ১৮, ১৯ এই তিনটি অঙ্ক করে বাড়ি যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?

অপরাধী শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। তার লাঞ্ছনা দেখে অন্য কেউ হয়তো ফিক করে হেসে ফেলল। অমর স্যার থমথমে গলায় বলবেন, ওকি, তুমি হাসছ কেন? হাস্যকর কিছু কি বলেছি? তুমি উঠে দাড়াও। অকারণে হাসার জন্য শাস্তি হিসেবে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবে।

অমর বাবু পকেট থেকে ঘড়ি বের করবেন। পাঁচ মিনিট তিনি এক দৃষ্টিতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইবেন। ছাত্ররা মূর্তির মতো বসে থাকবে।

 

অমর বাবুর বয়স পঞ্চাশ। স্ত্রী, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে—এই নিয়ে তাঁর সংসার। দুটি ছেলেই বড় হয়েছে রূপেশ্বর বাজারে একজনের কাপড়ের ব্যবসা, অন্যজনের ফার্মেসি আছে। ভালো টাকা রোজগার করে। একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্য মেয়েটির বিয়ের কথা হচ্ছে। এদের কারোর সঙ্গেই তাঁর বনে না। স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের তিনি সহ্য করতে পারেন না। অনেক দিন হল বাড়িতেও থাকেন না। স্কুলের দোতলায় একটা খালি ঘরে বাস করেন। সেখানে বিছানা বালিশ আছে। একটা স্টোভ আছে। গভীর রাতে স্টোভে চা বানিয়ে খান।

রূপেশ্বর স্কুলের হেড স্যার তাকে বলেছিলেন, আপনার ঘর-সংসার থাকতে আপনি স্কুলে থাকেন, এটা কেমন কথা?

অমর বাবু গম্ভীর গলায় বললেন, রাত জেগে পড়াশোনা করি, একা থাকতেই ভালো লাগে। তাছাড়া ওদের সঙ্গে আমার বনে না। তবে স্কুলে রাত্রি যাপন করে যদি আপনাদের অসুবিধার কারণ ঘটিয়ে থাকি তাহলে আমাকে সরাসরি বলুন, আমি ভিন্ন ব্যবস্থা দেখি।

হেড স্যার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আরে না এই কথা হচ্ছে না। আপনার যেখানে ভালো লাগবে আপনি সেখানে থাকবেন।

তিনি অমর বাবুকে ঘাটালেন না। কারণ অমর বাবু অসম্ভব ভালো শিক্ষক। অঙ্কের ডুবোজাহাজ। ডুবোজাহাজ বলার অর্থ তাঁকে দেখে মনে হয় না তিনি অঙ্ক জানেন। ভাবুক ভাবুক ভাব আছে। ক্লাসে কোনো অঙ্ক তাকে করতে দিলে এমন ভাব করেন যেন অঙ্কটা মাথাতেই ঢুকছে না। তারপর পকেট থেকে গোল ঘড়ি বের করে ঘড়ির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, চোখ বন্ধ করে মুখে মুখে অঙ্কটা করে দেন। স্কুলের অনেক ছাত্রের ধারণা এই ঘড়িতে রহস্য আছে। ঘড়ি অঙ্ক করে দেয়। ব্যাপার তা নয়। তাঁর ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটায় গণ্ডগোল আছে। কখনো দ্রুত যায় কখনো আস্তে তবে গড়ে সমান থাকে। এইটাই তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা করেন।

অমর বাবুকে ভালো মানুষ বলা যেতে পারে তবে তিনি অমিশুক, কথাবার্তা প্রায় বলেন না বললেই নয়। কারোর সাতে-পাঁচেও থাকেন না। টিচার্স কমন রুমে জানালার পাশের চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকেন। ঘন্টা পড়লে ক্লাসে রওনা হন। স্কুলের আরবি শিক্ষক মৌলানা ইদরিস আলী তাঁকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ঠাট্টা-তামাশা করার চেষ্টা করেন। বিশেষ লাভ হয় না। তিনি ঠাট্টাতামাশা পছন্দ করেন না। কেউ ঠাট্টা করলে কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকেন।

আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল। আগামীকাল ছুটি। ছাত্র-শিক্ষক সবার মধ্যেই একটা ছুটি-ছুটি ভাব চলে এসেছে। থার্ড পিরিয়ডে অমর বাবুর ক্লাস নেই। তিনি জানালার কাছের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ইরিস সাহেব তাঁর সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, তারপর অমর বাবু, আপনার সায়েন্সের কি খবর?

অমর বাবু কিছু বললেন না তবে চোখ তুলে তাকালেন। মনে মনে রসিকতার জন্য প্রস্তুত হলেন। বিজ্ঞান নিয়ে এই লোকটি কঠিন রসিকতা করে যা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।

ইরিস সাহেব পানের কৌটা থেকে পান বের করতে করতে বললেন, অনেকদিন থেকে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে। রোজই ভাবি আপনাকে জিজ্ঞেস করব।

জিজ্ঞেস করলেই পারেন।

ভরসা হয় না। আপনি তো আবার প্রশ্ন করলে রেগে যান।

বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা করলে রাগি। এমনিতে রাগি না—আপনার প্রশ্নটা কি?

ইদরিস সাহেব পান চিবুতে চিবুতে বললেন, পৃথিবী যে ঘুরছে এই নিয়ে প্রশ্ন। পৃথিবী তো ঘুরছে, তাই না?

জি। পৃথিবীর দুরকম গতি-নিজের অক্ষের উপর ঘুরছে, আবার সূর্যের চারদিকে ঘুরছে।

বাঁই বাঁই করে ঘুরছে?

জ্বি?

তাই যদি হয় তাহলে আমাদের মাথা কেন ঘুরে না? মাথা ঘোরা উচিত ছিল না? এমনিতে তো মাঠে দুটো চক্কর দিলে মাথা ঘুরতে থাকে। ওকি, এরকম করে তাকাচ্ছেন কেন? রাগ করছেন না-কি?

বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা আমি পছন্দ করি না।

রসিকতা কি করলাম?

অমর বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ঘন্টা পড়বার আগেই ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এই তার নিয়ম। পৃথিবী কোনো কারণে হঠাৎ উল্টে গেলেও নিয়মের ব্যতিক্রম হবে না।

আজ পড়ার বিষয়বস্তু হল আলো। আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ। বড় চমকার বিষয়। আলো হচ্ছে একই সঙ্গে তরঙ্গ ও বস্তু। কী অসাধারণ ব্যাপার। ক্লাস টেনের ছেলেগুলি অবশ্যি এসব বুঝবে না। তবে বড় হয়ে যখন পড়বে তখন চমৎকৃত হবে।

অমর বাবু ক্লাসে ঢুকেই বললেন, আলোর গতিবেগ কতকে বলতে পার? সাতজন ছেলে হাত তুলল। তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল সবাই হাত তুলবে। ছেলেগুলি কি সায়েন্সে মজা পাচ্ছে না? তা কি করে হয়?

পৃথিবীতে মজার বিষয় তো একটাই। সায়েন্স।

তুমি বল, আলোর গতিবেগ কত?

প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল।

ভেরি গুড। এখন তুমি বল, আলোর গতি কি এর চেয়ে বেশি হতে পারে?

জ্বিনা স্যার।

কেন পারে না।

এটাই স্যার নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম।

ভেরি গুড। ভেরি ভেরি গুড। প্রকৃতির কিছু নিয়ম আছে যে নিয়মের কখনো ব্যতিক্রম হবে না। হতে পারে না। যেমন মাধ্যাকর্ষণ। একটা আম যদি গাছ থেকে। পড়ে তাহলে তা মাটিতেই পড়বে, আকাশে উড়ে যাবে না। ইজ ইট ক্লিয়ার?

জি-স্যার।

মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জনক কে?

নিউটন।

নামটা তুমি এইভাবে বললে যেন নিউটন হলেন একজন রাম-শ্যাম, যদুমধু, রহিম-করিম। নাম উচ্চারণে কোনো শ্ৰদ্ধা নাই—বল মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।

ছাত্রটা কাঁচুমাচু মুখে বলল, মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।

একজন অত্যন্ত শ্ৰদ্ধেয় বিজ্ঞানীর নাম অশ্রদ্ধার সঙ্গে বলার জন্যে তোমার শাস্তি হবে। ক্লাস শেষ হলে বাড়ি যাবে না, পাটিগণিতের বার নম্বর প্রশ্নমালার একুশ আর বাইশ এই দুটি অঙ্ক করে তারপর যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?

ছেলেটির মুখ আরো শুকিয়ে গেল।

অমর বাবুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ছেলেগুলি তাঁর মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞান অবহেলা করছে। অশ্রদ্ধার সঙ্গে পড়ছে। খুবই দুঃখের কথা।

সন্ধ্যার পর তিনি স্কুল লাইব্রেরিতে খানিকক্ষণ পড়াশোনা করলেন। বিজ্ঞানী নিউটনের জীবনকথা। মনের অশান্ত ভাব একটু কমল। তিনি স্কুলের দোতলায় নিজের ঘরে ফিরে এলেন। তাঁর ছোট ছেলে রতন টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছে। মুখ কাচুমাচু করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বাবাকে স্কুলের ছাত্রদের চেয়েও বেশি ভয় করে।

রতন কিছু বলবি?

মা বলছিলেন, অনেকদিন আপনি বাড়িতে যান না।

তাতে অসুবিধা তো কিছু হচ্ছে না।

মার শরীরটা ভালো না। জ্বর।

ডাক্তার ডেকে নিয়ে যা। আমাকে বলছিস কেন? আমি কি ডাক্তার।

রতন মাথা নিচু করে চলে গেল। অমর বাবুর মনে হল আরেকটু ভালো ব্যবহার করলেই হত। এতটা কঠিন হবার প্রয়োজন ছিল না। কঠিন না হয়েই বা কি করবেন—গাধা ছেলে-মেট্রিকটা তিনবারেও পাস করতে পারেনি। জগতের আনন্দময় বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলি কিছুই জানল না—আলো কি সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আলো কি জিজ্ঞেস করলে নিৰ্ঘাৎ বলবে—এক ধরনের তরকারি, ভর্তা করেও খাওয়া যায়। ছিঃ ছিঃ।

ঘড়ি ধরে ঠিক নটায় তিনি রাতের খাবার শেষ করলেন। খাওয়া শেষ করতেই কেঁপে বৃষ্টি নামল। খোলা জানালা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া আসতে লাগল। মেঘ ডাকতে লাগল। অমর বাবু দরজা-জানালা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলেন। তাঁর ঘুমুতে যাবার সময় বাধা আছে রাত দশটা কুড়ি। এখনো অনেক বাকি আছে। এই সময়টা তিনি চুপচাপ বসে নানা বিষয় ভাবেন। ভাবতে ভালো লাগে। আগে পড়াশোনা করতেন। এখন চোখের কারণে হারিকেনের আলোয় বেশিক্ষণ পড়তে পারেন না। মাথায় যন্ত্রণা হয়। ঢাকায় গিয়ে ভালো ডাক্তার দিয়ে চোখ দেখানো দরকার।

তিনি বিছানায় পা তুলে উঠে বসলেন। শীত-শীত লাগছিল, গায়ে একটা চাদর জড়াবেন কি-না যখন ভাবছেন তখন হঠাৎ শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল। তিনি খানিকটা নড়ে উঠলেন। আর তখন অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার হল—তিনি লক্ষ করলেন বিছানা ছেড়ে তিনি উপরে উঠে যাচ্ছেন। প্রায় হাত তিনেক উঠে গেলেন এবং সেখানেই স্থির হয়ে গেলেন। চোখের ভুল? অবশ্যই চোখের ভুল। মহাবিজ্ঞানী নিউটনের সূত্র অনুযায়ী এটা হতে পারে না। হতে পারে না। হতে পারে না। নিতান্তই অসম্ভব। সূর্য পশ্চিম দিকে উঠা যেমন অসম্ভব, এটাও তেমনি অসম্ভব। এ হতেই পারে না।

কিন্তু হয়েছে। তিনি খাট থেকে তিন হাত উপরে স্থির হয়ে আছেন। ঘরের সবকিছু আগের মতো আছে, শুধু তিনি শূন্যে ভাসছেন। অমর বাবু চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললেন, হে ঈশ্বর, দয়া কর। দয়া কর। শরীরে কেমন যেন অনুভূতি হল। হয়তো এবার নিচে নেমেছেন। তিনি চোখ খুললেন, না আগের জায়গাতেই আছেন। এটা কি করে হয়?

প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল আর তার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ধপ করে নিচে পড়লেন। খানিকটা ব্যথাও পেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে দিলেন। কি ঘটেছে তা নিয়ে তিনি আর ভাবতে চান না। ঘুমুতে চান। ঘুম ভেঙে যাবার পর হয়তো সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

রাতে তাঁর ভালো ঘুম হল। শেষ রাতের দিকে তিনি একবার জেগে উঠে বাথরুমে যান। আজ তাও গেলেন না, এক ঘুমে রাত পার করে দিলেন। যখন ঘুম ভাঙল—তখন চারদিকে দিনের কড়া আলো, রোদ উঠে গেছে। তাঁর দীর্ঘ জীবনে এই প্রথম সূর্য উঠার পর ঘুম ভাঙল। রাতে কি ঘটেছিল তা মনে করে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দুঃস্বপ্ন। বদহজম হয়েছিল। বদহজমের কারণে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এরকম হয়। মানুষ খুব ক্লান্ত থাকলে বসে বসে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখেছেন। দীর্ঘ স্বপ্নের স্থায়িত্বকাল হয় খুব কম। হয়তো এক সেকেন্ডের একটা স্বপ্ন দেখেছেন। এই হবে-এছাড়া আর কি? স্বপ্ন, অবশ্যই স্বপ্ন। অমর বাবুর মন একটু হালকা হল।

পরের দিনের কথা। প্রথম পিরিয়ডে অমর বাবুর ক্লাস নেই। টিচার্স কমন রুমে চুপচাপ বসে আছেন। ইরিস সাহেব যথারীতি তার পাশে এসে বসলেন। পানের কৌটা বের করতে করতে বললেন, অমর বাবুর শরীর খারাপ না-কি?

জ্বি-না।

দেখে কেমন কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে অসুস্থ। গায়ে কি জ্বর আছে?

জ্বি-না।

রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল?

হুঁ, তবে দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

কী দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?

অমর বাবু ইতস্তত করে বললেন, দেখলাম শূন্যে ভাসছি।

আরে ভাই এটা কি দুঃস্বপ্ন? শূন্যে ভাসা, আকাশে উড়ে যাওয়া—এইসব স্বপ্ন তো আমি রোজই দেখি। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি অনেক উঁচু থেকে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেছি…খুব টেনশানের স্বপ্ন।

অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, ঠিক স্বপ্ন না, মনে হয় জাগ্রত অবস্থায় দেখেছি।

কী বললেন? জাগ্রত অবস্থায়? জেগে জেগে দেখলেন আপনি শূন্যে ভাসছেন?

জ্বি।

জাগ্রত অবস্থায় দেখলেন শূন্যে ভাসছেন?

অমর বাবু জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। ইদরিস সাহেব বললেন, রাত-দিন সায়েন্স সায়েন্স করে আপনার মাথা ইয়ে হয়ে গেছে। বিশ্রাম দরকার। আপনি এক কাজ করুন ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান। আজ ক্লাস নেয়ার দরকার নেই। আমি হেড স্যারকে বলে আসি?

না না, আমার শরীর ঠিকই আছে।

অমর বাবু যথারীতি ক্লাসে গেলেন। তাঁর পড়াবার কথা আলোর ধর্ম। তিনি শুরু করলেন মাধ্যাকর্ষণ।

দুটি বস্তু আছে। একটির ভর m1 অন্যটির ভর m2, তাদের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে r তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বলের পরিমাণ হবে–

mlm2 / r²

এটি একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। স্যার আইজাক নিউটনের বিখ্যাত সূত্র। এর কোনো নড়াচড় হবে না। হতে পারে না। বাবারা বুঝতে পারছ?

ছেলেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। আজ পড়াবার কথা আলোর ধর্ম, প্রতিফলন, প্রতিসরণ; স্যার মাধ্যাকর্ষণ পড়াচ্ছেন কেন?

বাবারা কি বলছি বুঝতে পারছ?

ছাত্ররা জবাব দিল না।

যদি কেউ বুঝতে না পার হাত তোল।

কেউ হাত তুলল না। এক সময় ঘণ্টা পড়ে গেল। কোনোদিনও যা হয় না। তাই হল। অমর বাবু ঘণ্টা পড়ার পরেও চুপচাপ বসে রইলেন। পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন না বা উঠে গেলেন না। চোখ বন্ধ করে মূর্তির মতো বসে রইলেন। ছাত্রদের বিস্ময়ের কোনো সীমা রইল না।

দীর্ঘ ত্রিশ বছর চাকরির পর

দীর্ঘ ত্রিশ বছর চাকরির পর তিনি রিটায়ার কররেন। জুনিয়র অফিসার হিসেবে ঢুকেছিলেন, রিটায়ার করলেন সিনিয়র অফিসার হিসাবে। ত্রিশ বছরে একটিমাত্র প্রমোশন। বর্তমান অফিসের জেনারেল ম্যানেজার তাঁর সঙ্গেই চাকরিতে ঢুকেছিলেন। এখন তাঁকে স্যার ডাকতে হয়। মতিন সাহেবের লজ্জা লজ্জা করে। উপায় কী?

রিটায়ার করা উপলক্ষে অফিসে বিদায় সভার আয়োজন করা হয়েছে। অফিস শেষে বেলা সাড়ে পাঁচটায় সভা হবে। মতিন সাহেব কী বলবেন সব ভেবে রেখেছেন। ভেবে রাখা কথা সব বলতে পারবেন কি না তা জানেন না। হয়ত চোখে পানি এসে যাবে, গলা ধরে যাবে। বিকাল পাঁচটা বাজতেই তিনি হল-ঘরে বসে রইলেন। আশ্চর্য তিনি একা একটি লোকও নেই। ছটা পর্যন্ত তিনি একা একাই বসে রইলেন। লক্ষ করলেন অফিসের লোকজন একে একে চলে যাচ্ছে। এদিকে কেউ উঁকিও দিচ্ছে না।

সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় জি.এম. অফিস থেকে বেরুবার সময় বিস্মিত হয়ে বললেন, আরে মতিন সাহেব আপনি? বসে আছেন কেন?

মতিন সাহেব ইতস্তত করে বললেন, বিদায় সভা হবে এই জন্যে…

আজ তো হবে না। আজ আমি ব্যস্ত, এই জন্যে ক্যাসেল করে দিয়েছি। আপনি নোটিশ পাননি?

জ্বি না।

আরে বলেন কী? আচ্ছা বাড়ি চলে যান। পরে এক সময় ফেয়ার ওয়েল হবে। আপনাকে খবর দেয়া হবে।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

চাকরি জীবন শেষ হয়ে অবসর জীবন শুরু এই ভেবে মতিন সাহেব এক কেজি সন্দেশ কিনে ফেললেন। হেঁটে বাড়ি ফিরলেন। সন্ধ্যার দিকে হাঁটতে তাঁর ভাল লাগে। বাড়ি ফিরে তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। বাড়ি খালি। জনপ্ৰাণী নেই-আসবাবপত্র নেই। সব ধুধু করছে। রোগা একটা ছেলে বালতি ভর্তি পানি দিয়ে মেঝে ধুচ্ছে। মতিন সাহেব বললেন, ওরা কোথায়?

ছেলেটি বলল, কারা?

এই বাড়িতে যারা থাকত?

বাড়ি ছাইড়া নতুন বাড়িতে গেছে।

কোথায় গেছে?

আমি ক্যামনে কই?

বাড়িওয়ালার কাছে খোঁজ নিয়ে জানলেন—তারা পল্লবীতে বাড়ি নিয়েছে। বড় বাড়ি। সে বাড়ির ঠিকানা তিনি জানেন না।

অনেক যন্ত্ৰণা করে রাত দশটায় পল্লবীর বাড়িতে তিনি উপস্থিত। রাহেলা খড়খড়ে গলায় বললেন, এতক্ষণে তোমার সময় হল? আজ বাড়ি বদল হচ্ছে, কোথায় সকাল সকাল ফিরবে। সাহায্য করবে। আর তুমি কি না উদয় হয়েছ। মাঝরাতে।

বাড়ি বদল করছ জানতাম না। তুমি আমাকে কিছু বলেনি।

সব কিছু তোমাকে জানিয়ে তোমার অনুমতি নিয়ে করতে হবে?

না তা না। মানে আমি জানতাম না যে বাড়ি বদল করছ।

রোজ এই নিয়ে কথা হচ্ছে। জিনিসপত্র বাঁধাছাদা হচ্ছে—আর তুমি বলছ তুমি জানতে না।

কিছু তো বলেনি… আর কীভাবে বলব? মাইক ভাড়া করে বলতে হবে?

নতুন বাড়ির ঠিকানাও জানতাম না-খুব যন্ত্রণা করে ঠিকানা বের করেছি।

যন্ত্রণা করে ঠিকানা বের করতে হয়েছে? কী এমন যন্ত্রণা করেছ শুনি। হাতে ওটা কী?

সন্দেশ।

সন্দেশ কিনলে কেন?

এম্নি কিনলাম।

জানো এই বাড়িতে মিষ্টি কেউ খায় না-তারপরেও সন্দেশ কিনে আনলে কী মনে করে?

ভুল হয়ে গেছে।

নতুন বাসায় মতিন সাহেবের ঘর হল ছাদের চিলেকোঠায়। এই ঘরটা আগের চেয়েও ছোট তবে প্রচুর আলো-বাতাস। সবচে বড় সুবিধা হচ্ছে যে কোন সময় ছাদে আসা যায়। রাতে কোন কারণে তাঁর ঘুম ভাঙলেই তিনি ছাদে এসে বসে থাকেন। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, কেন সবাই তাকে এত অপছন্দ করে। তিনি কি মানুষটা খারাপ?

তা তো না। কখনো কোন অন্যায় করেছেন বলে তো মনে পড়ে না। সম্ভাবে থেকেছেন। সৎ জীবন যাপন করেছেন।

তাহলে কি তার চেহারা খারাপ? কিংবা চেহারাটা এমন যে দেখলেই সবার রাগ লাগে?

তাও বোধ হয় না। আয়নায় তিনি দীর্ঘ সময় নিজেকে দেখেছেন। একবার না, অনেকবার দেখেছেন। খারাপ বলে তো মনে হয় না। তাছাড়া চেহারা কি খুব বড় ব্যাপার? কত কুৎসিত দর্শন মানুষ পৃথিবীতে আছে। তাদের প্রতি কত ভালবাসা সবাই দেখায়। তাঁদের অফিসেই তো একজন আছেন, পরিমল বাবু। আগুনে পুড়ে মুখের একটা দিক ঝলসে গেছে, বা চোখটা নষ্ট। তাকালে শিউরে উঠতে হয়। অথচ সবার মুখে পরিমলদা, পরিমলদা। অফিসের পিকনিক হবে, ব্যবস্থা করবে পরিমলদা। নাটক দেখতে যাবে, ডাকো পরিমলদাকে।

তাহলে ব্যাপারটা কী? তিনি খানিকটা বোকা বলেই কি সবাই তাকে এড়িয়ে চলে? বোকাদের কেউ পছন্দ করে না—কিন্তু তিনি কি সত্যি বোকা? কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। কাকে জিজ্ঞেস করবেন? জিজ্ঞেস করবার মত কোন বন্ধু তার নেই। কাজেই তিনি গভীর রাতে ছাদে বসে আকাশের তারা গোনেন।

দিনের বেলাটা তার অবশ্যি খুব ভাল কাটে। সকালে নাশতা শেষ করেই বের হয়ে পড়েন। এগারোটা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করেন। বাচ্চাদের স্কুলগুলির সামনে দাঁড়ান। এক একদিন এক এক স্কুল। ছোট ছোট বাচ্চারা হৈচৈ করে স্কুলে ঢুকে। তার দেখতে বড় ভাল লাগে। এগারোটার দিকে রোদ কড়া হয়ে গেলে ঘুরতে আর ভাল লাগে না। কোন একটা পার্কে চলে যান। দুপুরটা কাটে পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে শুয়ে। দুপুরের খাবার তিনি পার্কেই খান। এক ছটাক বাদাম, এক গ্লাস পানি আর এক কাপ চা। কোন কোন দিন দুটা সিঙ্গারা, একটা কলা। সবই পার্কে পাওয়া যায়। দুপুরে তিনি যে বাড়িতে খেতে যান না এ নিয়ে কেউ তাকে কখনো কিছু বলে না।

রোদ একটু কমে গেলে বেলা চারটার দিকে তিনি আবার ঘুরতে বের হন। বাসায় ফিরে যান সন্ধ্যার দিকে—এই হচ্ছে মতিন সাহেবের রুটিন। বাসায় ফিরে জিজ্ঞেস করেন অফিস থেকে কোন চিঠি এসেছে কি না। বিদায় সভার খবরের জন্য তিনি এখনো মনে মনে অপেক্ষা করেন।

এক রোববারের কথা। চৈত্র মাস। ঝাঁঝালো রোদ উঠেছে। মতিন সাহেব যথারীতি রমনা পার্কে উপস্থিত হয়েছেন। পছন্দসই একটা বেঞ্চ বের করে লম্বা হয়ে শুয়েছেন। আকাশ ঘন নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন হঠাৎ কেমন যেন হল। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ ঝাঁকুনি অনুভব করলেন। পেটের নাড়িভুঁড়ি মনে হল হঠাৎ একটা পাক দিয়েছে। মুখ ভর্তি হয়ে গেল লালায়। চোখের সামনে তীব্ব নীল আলো ঝলসে উঠল।

তিনি চোখ বন্ধ করে তিনবার বললেন, ইয়া মাবুদ, ইয়া মাবুদ, ইয়া মাবুদ।

চোখ খুললেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। যা দেখলেন তার জন্যে তাঁর কোন রকম মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। তিনি দেখলেন—তার চারপাশে ছসাতটি শিশু। বয়স সাত থেকে বারোর মধ্যে। প্রতিটি শিশুর মুখ এত সুন্দর যে মনে হয় যেন তুলি দিয়ে আঁকা। গায়ের রঙ গোলাপি, পাতলা ঠোট, গা লাল রঙের। চোখের পল্লব দীর্ঘ। চোখগুলি বড় বড়। সেই চোখে মুগ্ধ বিস্ময়।

মতিন সাহেব চোখ মেলতেই সবগুলি বাচ্চা এক সঙ্গে কলকল করে উঠল। তারা কথা বলছে। অতি বিচিত্র কোন ভাষায় কথা বলছে। সেই বিচিত্র ভাষার এক বৰ্ণও তিনি বুঝতে পারছেন না। তারা কথা বলছে অতি মিষ্টি সুরে। খানিকটা টেনে টেনে। এক-একটা বাক্য বলার পর তারা বা হাত চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে—এটাই বোধ হয় এদের কথা বলার ভঙ্গি।

এরা যে মানবশিশু এতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু কোথাকার মানবশিশু? এদের পোশকও অতি বিচিত্র। সবারই গলা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পোশাক। যার রঙ কোন স্থায়ী রঙ না ক্ষণে ক্ষণে তা বদলাচ্ছে।

মতিন সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বাচ্চাদের কলকল শব্দ সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল। চারদিক পুরোপুরি নিঃশব্দ। এধরনের নীরবতা সহ্য করাও মুশকিল। মতিন সাহেব চোখ মেললেন, সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চারা আবার কলকল শুরু করল। এরা সবাই উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে। ব্যাপার কী ঘটছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মতিন সাহেব ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। যদিও এই অবস্থায় মাথা ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল।

তিনি শুয়ে ছিলেন সিমেন্টের বেঞ্চে। এখন তিনি শুয়ে আছেন ঘাসের উপর। ঘাসগুলি অবশ্যি অন্য রকম। সবুজ নয়, হালকা নীল। ঘাসের পাতা সুতার মত সূক্ষ্ম। সিমেন্টের বেঞ্চে যখন শুয়েছিলেন তখন সূর্য ছিল মাথার উপর। এখন কোন সূর্য নেই। তিনি সূর্যের খোঁজে এদিক-ওদিক তাকালেন। বাচ্চারাও তার মত এদিক-ওদিক দেখছে। তিনি হাতের ইশারায় বললেন–সূর্যটা কোথায়? বাচ্চারা কিছু বুঝতে পারল বলে মনে হল না—তারাও অবিকল তাঁর মত হাতের ইশারা করল। এরা যেন একদল পুতুল। তিনি যা করবেন। এরাও তাই করবে। মতিন সাহেব বললেন, তোমরা কারা?

এরা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর সবাই একসঙ্গে মিষ্টি করে বলল, তোমরা কারা?

এর মানে কী? কী হচ্ছে এসব? তিনি কোথায়? আগে রমনা পার্কে শুয়ে ছিলেন—এখন যেখানে আছেন এটাও মনে হয় কোন পার্ক তবে একটা গাছও চিনতে পারছেন না। অচেনা সব গাছ তবে বড় গাছ না সবই লতানো গাছ। পাতাগুলির বেশির ভাগই গোলাকার। প্রতিটি গাছ ফুলে ভর্তি। ফুলের রঙ নীল এবং বেগুনিতে মেশানো। চৈত্র মাসের ঝাঁঝালো রোদ নেই তবু চারদিক আলো হয়ে আছে। যে বাচ্চা কটি তাকে ঘিরে আছে তাদের কারো পায়ে জুতো নেই। এত সুন্দর পোশাক কিন্তু এরা দাঁড়িয়ে আছে খালি পায়ে। মতিন সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

সব কটি বাচ্চা আগের মত এক সঙ্গে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

মতিন সাহেব বুঝতে পারছেন-পুরো জায়গাটাই বিরাট একটা বাগান। এত বড় বাগানে এই কটি মাত্র শিশু। আর কেউ নেই। এরা গোল হয়ে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ হাসি-হাসি। চোখে মুগ্ধ বিস্ময়। এরা তাঁকে দেখে কী ভাবছে? কোন জন্তু যে দেখতে মানুষের মতো? এরকম হলে ছুটে গিয়ে বড় কাউকে নিয়ে আসা উচিত। তা তারা করছে না। কিংবা কে জানে। হয়ত করেছে। তাদের ভেতর থেকে কেউ গেছে বড়দের খবর দিতে। এরা অপেক্ষা করছে। তবে এরা খুব যে ভয় পাচ্ছে তা না। ভয় পেলে এত কাছে। দাঁড়িয়ে থাকত না। দূর থেকে দেখত। চোখে চোখ পড়ামাত্র চোখ নামিয়ে নিত। মতিন সাহেব অপেক্ষা করতে লাগলেন। আসুক, বড় কেউ আসুক।

তাঁর খিধে পেয়ে গেল। আজ ভোরে তিনি নাশতা না খেয়ে বের হয়েছেন। দুপুরেও কিছু খাননি। দুছটাক বাদাম কিনেছিলেন। সেই বাদামের ঠোঙা হাতে আছে। তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে একটা বাদাম ভেঙে মুখে দিলেন। সবাই কৌতূহলী চোখে তাকে দেখছে। পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। মতিনউদ্দিন ঠোঙাটি ওদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, খাও, বাদাম। ঝাল মরিচ দিয়ে খেতে খুব ভাল। এবার আর তাঁর কথা শুনে সবাই এক সঙ্গে কথা বলে উঠল না। কেউ বাদামও নিল না। শুধু একজন একটু এগিয়ে এসে ঠোঙা থেকে বাদাম নিল। খোসা ছাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে মুখে দিল। সে এত ভয় পাচ্ছিল যে তার হাত-পা রীতিমত কাঁপছে। অন্য বাচ্চাগুলি শংকিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মতিন সাহেব ভেবে পেলেন না এরা এত ভয় পাচ্ছে কেন। বাদাম কি তারা আগে কখনো দেখেনি?

যে সাহস করে বাদাম খেয়েছে তার দিকে তাকিয়ে মতিন সাহেব বললেন, আমার নাম মতিনউদ্দিন। এই জায়গাটা কোথায় আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

বাচ্চাগুলি এবারো ঠিক আগের মত করল। তিনি যা বললেন তারাও তাই বলল। তবে এবার একটু ব্যতিক্রম হল। কথা শেষ হওয়ামাত্র তারা সরে গেল। অনেকটা দূরে সরে গেল। যে ছেলেটি বাদাম খেয়েছে শুধু সে দাড়িয়ে রইল। মতিন সাহেব তিনজন বয়স্ক মানুষকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন। এদের ভেতর দুজন পুরুষ, একজন মহিলা। তাদের প্রত্যেকের হাতেই অদ্ভুতদর্শন কিছু যন্ত্রপাতি। যন্ত্রগুলি থেকে মৌমাছির পাখা নাড়ার শব্দের মতো শব্দ আসছে। বয়স্ক মানুষ তিনটির চোখে-মুখে গভীর বিস্ময়।

মতিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বিনীত গলায় বললেন, স্যার আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এই জায়গাটা কি তাও জানি না। এখানে কী করে আসলাম তাও জানি না। যদি অপরাধ করে থাকি, আপনাদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি।

মতিন সাহেব দুহাত জোড় করলেন। বয়স্ক মানুষ তিনজনের মুখে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল। তারা কি তার কথা বুঝতে পেরে হাসছে না মতিন সাহেবকে হাত জোড় করতে দেখে হাসছে?

স্যার আমার বাসা পল্লবীতে। এখন রিটায়ার করেছি তো। কিছু করার নেই তাই ঘুরে বেড়াই। ঘুরতে ঘুরতে রমনা পার্কে এসে বেঞ্চিতে বসেছি তারপরেই এই কাণ্ড। স্যার, এখন আমার অসম্ভব পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। জানি আমার কথা আপনারা কিছুই বুঝতে পারছেন না, তবু পানির তৃষ্ণার কথা না বলে পারলাম না।

মতিন সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ করলেন তিনি তাদের কোন কথা বুঝতে না পারলেও তারা তাঁর কথা বুঝতে পারছে। কারণ পানির কথা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বড় মেয়েটি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাঁর কাঁধে ঝুলানো বস্তু, যাকে মতিন সাহেব যন্ত্রপাতি বলে ভাবছেন, তার এক ফাঁক দিয়ে দুটি খুব ছোট ছোট কফির কাপের মত বাটি বের করল। বাটি ভর্তি তরল পদার্থ যা পানি নয়। পানির চেয়ে অনেক হালকা। রঙ, হালকা সবুজ। খেতে চমৎকার। মুখে নেয়ামাত্র সমস্ত মুখ ঠাণ্ডা ভাব হল। তৃষ্ণা দূর হয়ে গেল। মতিন সাহেব দুটি কাপই শেষ করলেন। অন্য কাপটির তরল বস্তুর স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঝাঁঝালো-টক টক।

মতিন সাহেব বললেন, স্যার আপনাদের ধন্যবাদ।

পুরুষদের একজন এগিয়ে এসে মতিন সাহেবকে হাতের ইশারায় বলল, তিনি যেন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন।

প্রথমবারেই মতিন সাহেব তা বুঝলেন। তবু সে বারবার এটা বুঝাতে লাগল। মতিন সাহেব বললেন, আপনার কথা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি। আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। শুধু যদি একটু বুঝিয়ে দেন আমি এখানে কীভাবে আসলাম—আপনারা কারা—তাহলে মনটা শান্ত হবে। আমার মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে।

তারা এই কথায় একসঙ্গে হাসল। মতিন সাহেব ভেবে পেলেন না তিনি এমন কী বলেছেন যাতে এদের হাসি আসবে। বোঝাই যাচ্ছে তিনি কোন ভয়ংকর ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন। এতে হাসির তো কিছু নেই।

আরো তিনজন লোক এসে উপস্থিত হয়েছে। এরা আগের তিনজনের মত হেঁটে আসেনি—গাড়িতে করে এসেছে। গাড়িগুলিকে কি গাড়ি বলা যায়? হাওয়া গাড়ি? কারণ গাড়িগুলি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এসেছে। গাড়ি ভর্তি নানান ধরনের যন্ত্রপাতি। নতুন তিনজন মানুষ গাড়ি থেকে নেমেই মতিন সাহেবের চারদিকে যন্ত্রপাতি বসাতে লাগল। এমন সব বিকট আকৃতির যন্ত্র যে তাকালেই বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগে।

মতিন সাহেবের চোখের ঠিক সোজাসুজি দশ ফুটের মত দূরে টিভি পর্দার মত পাতলা একটি পর্দা বসানো হয়েছে। মনে হচ্ছে এইটিই সবচে জটিল যন্ত্র, কারণ ছয়জন মানুষের মধ্যে চারজনই এটি নিয়ে ব্যস্ত।

মতিন সাহেব বাচ্চাগুলিকে কোথাও দেখতে পেলেন না। এরা নিঃশব্দে সরে গেছে। শুধু যে বাচ্চাটি বাদাম খেয়েছে সে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত তাকেও নড়াচড়া করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ তার চারপাশে গোল করে সাদা রঙের দাগ দেয়া হয়েছে। ছেলেটি এই দাগের বাইরে যাচ্ছে না। বাচ্চাটাকে এখন ক্লান্ত মনে হচ্ছে।

মতিন সাহেব বললেন, স্যার আমি বসতে পারি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঝি ধরে গেছে।

এরা তার কথা বুঝতে পারল। সম্ভবত যন্ত্রপাতিগুলি ভাষা অনুবাদ করে দিচ্ছে কিংবা কে জানে হয়ত তারা মনের কথা বুঝতে পারে।

সবচে বয়স্ক মানুষটি তাঁকে বসতে ইশারা করল। মতিন সাহেব বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাদা পর্দাটা নিচে নেমে এল। চোখের সোজাসুজি স্থির হয়ে গেল। তিনি ডান দিকে ফিরলেন। পর্দাও ডান দিকে সরে গেল। মজার ব্যাপার হতো।

বয়স্ক লোকটি ইশারায় বলল, পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকতে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে পর্দায় কিছু দেখা যাবে। অথচ তিনি কিছুই দেখছেন না। লোকগুলি মনে হয় এতে খুব হতাশ হচ্ছে। মতিন সাহেবের আবার পানির পিপাসা পেয়ে গেল। একটু আগে পানি চেয়েছেন। আবার চাইতে লজ্জা লাগছে। তাছাড়া এরা সবাই পর্দাটা নিয়ে খুব ব্যস্ত। হাওয়া গাড়িতে আরো তিনজন মানুষ এল। এখানকার ছজন থেকে তিনজন ফিরে গেল। এই তিনজন সম্ভবত পর্দার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। এখন নতুন তিনজনই কাজ করছে। আগের তিনজন একটু দূরে হতাশ মুখে দাঁড়ানো। মনে হচ্ছে পর্দাটা ঠিকঠাক করা তাদের কাছে খুব জরুরি।

মতিন সাহেব মাথায় আচমকা একটা তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় ছবি দেখতে পেলেন। নিজের ছবি। দু হাত মেলে দশটি আঙুল বের করে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। এর মানে কী!

মতিন সাহেব বললেন, স্যার আমি ছবি দেখতে পাচ্ছি। নিজের ছবি।

সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবি মুছে গেল। পর্দায় দেখা গেল তার পাশে বসে থাকা। বাচ্চাটির ছবি। সেও আঙুল মেলে দাঁড়িয়ে আছে। একটা আশ্চর্যের ব্যাপার। এই ছেলেটির প্রতি হাতে চারটি করে মোট আটটি আঙুল। তিনি পর্দা থেকে চোখ ফিরিয়ে পাশে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকালেন। আসলেও তাই। এর হাতে চারটি করে আঙুল। পায়েও তাই।

তিনি চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলির দিকে তাকালেন। এদের সবার হাতে চারটি করে আঙুল। পর্দার ছবির অর্থ এখন পরিষ্কার হচ্ছে—এরা বলতে চাচ্ছে—আমরা দেখতে অবিকল তোমাদের মত হলেও কিছু পার্থক্য আছে। এই হচ্ছে সেই পার্থক্য।

এখন আরো সব পার্থক্য দেখানো হচ্ছে—এগুলি মতিন সাহেব কিছুই বুঝছেন না। তারা চলে গেছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডি এন এ, আর এন এ তে। পুরো জিনিসটি যদিও দেখানো হচ্ছে ছবিতে তবু মতিন সাহেব কিছু বুঝলেন না। লাজুক গলায় বললেন,

স্যার আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি আর্টস-এর ছাত্র। বি. এতে আমার ছিল লজিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইসলামের ইতিহাস।

পর্দার ছবি মুছে গেল—এখন অন্য ছবি আসছে। এই ছবিতে বাদাম খাওয়া বাচ্চাটিকে বাগানে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। এটাই সেই বাগান। বাচ্চাটি হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে সে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে—সে উল্টো দিকে দৌড়াচ্ছে। আরো কয়েকটি শিশুর সঙ্গে তার দেখা হল। এবার সে কিছুটা সাহস ফিরে পেয়েছে। অন্য শিশুরাও আসছে তার সঙ্গে সঙ্গে। তারা যে জিনিসটি দেখে ভয় পেয়েছে এবার সেটিকে দেখা যাচ্ছে জিনিসটি হচ্ছে মতিন সাহেব।

পর্দায় দেখানো হচ্ছে মতিন সাহেবের এই জায়গায় আসার ছবি। মনে হচ্ছে দূরে ক্যামেরা বসিয়ে পুরো জিনিসটারই ছবি তোলা হয়েছে। এখন সে ছবি দেখানো হচ্ছে।

মতিন সাহেব দ্বিতীয় দফায় মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি এদের কথা বুঝতে পারলেন। পরিষ্কার শুনলেন মাথার ভেতরে কে যেন বলছে–

আপনি কি আমাদের কথা বুঝতে পারছেন? আমরা নানান ভাবে চেষ্টা করছি যাতে আপনি আমাদের কথা বোঝেন। আমরা আপনার চিন্তা-ভাবনা বুঝতে পারছি না। শেষ চেষ্টা হিসাবে ইরিওক্রোম পর্দা ব্যবহার করছি। এই পর্দায় তীব্র শক্তির রেডিয়েশন ব্যবহৃত হয় যা আপনার মস্তিষ্কের নিওরোনের জন্য ক্ষতিকর। কাজেই এই পদ-আমরা বেশি সময় ব্যবহার করতে পারব না। আপনি কি আমাদের কথা বুঝতে পারছেন?

পারছি।

অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। আপনি আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন।

আপনারা কারা?

আপনি এবং আমরা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দুই প্রান্তের অধিবাসী। আপনার বাসস্থান যাকে আপনি পৃথিবী বলেন তার দূরত্ব আমাদের এখান থেকে প্রায় এক কোটি আলোকবর্ষ।

আমি এখনে কী করে এলাম?

এই প্রশ্নের জবাব আমাদের জানা নেই। বিজ্ঞানীরা একটি থিওরি দিয়েছে—সেই থিওরি আপনি চাইলে আপনাকে বলতে পারি।

আমি থিওরি বুঝব না—আমি বলতে গেলে একজন মূৰ্খ মানুষ। বি.এ পাস করেছি থার্ড ডিভিশনে। তাও প্রথমবারে পাস করতে পারিনি, ইংরেজিতে রেফার্ড ছিল।

এই থিওরি যে কেউ বুঝতে পারবে। আপনি পারবেন। বিজ্ঞানীরা মাঝে মাঝে নিজেদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য কিছু থিওরি তৈরি করেন। এটিও সে জাতের থিওরি। বিজ্ঞানীরা বলছেন প্রকৃতির অতি সুশৃঙ্খল নিয়মেও মাঝে মধ্যে ভুল হয়ে যায়। ভুল করে প্রকৃতি। আপনার ক্ষেত্রেও এরকম ভুল হয়েছে। যার জন্যে অকল্পনীয় দূরত্ব থেকে আপনি উপস্থিত হয়েছেন এখানে। তবে প্ৰকতি অতি দ্রুত তার ভুল ঠিক করে। আপনার ক্ষেত্রেও তাই করবে বলে আমাদের ধারণা। আপনি যেখান থেকে এসেছেন আবার সেখানে ফিরে যাবেন। প্রকৃতি এই ব্যবস্থা করবে। আমাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞান অতি উন্নত হওয়া সত্ত্বেও আমরা আপনাকে ফেরত পাঠাতে পারছি না।

যদি প্রকৃতি তার ভুল ঠিক করতে না পারে তাহলে কী হবে?

আপনাকে এখানেই থেকে যেতে হবে।

স্যার, আমার কোন অসুবিধা নেই। দেশ-বিদেশ দেখার আমার খুব শখ।

আপনার এই শখ আমরা মেটানোর চেষ্টা করছি। পর্দায় আপনি আমাদের এই গ্রহ দেখতে পাবেন। তার প্রতিটি সুন্দর জায়গা আপনাকে দেখানো হবে। তবে যে কোন মুহুর্তে আপনি হয়ত আপনার জায়গায় ফিরে যাবেন। দয়া করে আমাদের কথা মনে রাখবেন। আপনার দেশের বিজ্ঞানীদের বলবেন আমাদের কথা।

আমি বললে লাভ হবে না, স্যার। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া আমি কোন বিজ্ঞানীকে চিনি না। একজনকে শুধু চিনি–আব্দুস সোবহান খিলগাঁও হাইস্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক। বোটানিতে এম.এসসি. ফার্স্ট ক্লাস।

শুনুন মতিন সাহেব, আপনার এই গ্রহে আগমন একটি বিরাট ঘটনা। এই উপলক্ষে সমগ্র গ্রহে একদিনের ছুটি দেয়া হয়েছে। এই গ্রহের প্রতিটি প্রাণী বসে আছে ত্রিমাত্রিক টিভি সেটের সামনে। এই মুহূর্তে সবাই দেখছে আপনাকে। এই গ্রহে আপনার আগমন চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য এই গ্রহের সবচে বড় সড়কটির নাম রাখা হচ্ছে আপনার নামে—সড়কের দুমাথায় থাকবে আপনার দুটি ইরিডিয়ামের মূর্তি।

আমাকে লজ্জা দেবেন না, স্যার।

লজ্জা দেয়ার কোন ব্যাপার নেই। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার এই গ্রহে আগমন যে কত বড় ঘটনা তা বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছায়াপথে একই ধরনের দুটি প্রাণের উদ্ভব হয়েছে এটা যে কত বড় ঘটনা আপনি তা অনুমান করতে পারবেন না।

একই ধরনের প্রাণী না স্যার আঙুলে বেশকম আছে।

এই তফাৎ সামান্য অতি সামান্য।

একটা ছোট কথা জিজ্ঞেস করি, স্যার?

করুন।

আপনি বলেছেন প্রকৃতি ভুল করে। প্রকৃতির কি ভুল করা উচিত?

না উচিত নয়। হয়ত প্রকৃতি কোন ভুল করেনি। সে ইচ্ছা করেই আপনাকে এখানে এনেছে। অন্য কোথাও আপনাকে নিতে পারত। তা নেয়নি। এমন এক গ্রহে এনেছে যার তাপমাত্রা আপনার পৃথিবীর মত। যার অক্সিজেনের পরিমাণও আপনার গ্রহের অক্সিজেনের কাছাকাছি।

মতিন সাহেব পর্দা থেকে দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্যে ফিরিয়ে নিলেনতাকালেন চারদিকে। আশ্চর্য! কেউ নেই। শুধু বাদাম খাওয়া বাচ্চাটি বসে আছে। যে লোকগুলি যন্ত্র ঠিক করছিল তারাও নেই। চারদিকে সুনসান নীরবতা। মতিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, স্যার, ওরা কোথায়?

সবাইকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

কেন?

কারণ আমাদের বিজ্ঞানীদের ধারণা আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আপনার চারপাশের চৌম্বকক্ষেত্র পরিবর্তিত হচ্ছে। বায়ুতে আয়নের পরিমাণ বাড়ছে।

ছোট বাচ্চাটিকে এখানে বসিয়ে রেখেছেন কেন?

আপনাকে যখন এখানে পাঠানো হয় তখন ছোট বাচ্চাটি আপনার পাশে ছিল। অবিকল আগের অবস্থা বজায় রাখার জন্য বাচ্চাটিকে আপনার পাশে রাখা হয়েছে।

এর কোন ক্ষতি হবে না তো?

সম্ভবত না। আপনাকে আমাদের উচ্চতর বিজ্ঞানের কিছু কথা শিখিয়ে দিতে পারলে ভাল হত। আপনি আপনার পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের তা শেখাতে পারতেন। ক্যানসারের চিকিৎসা কি শিখিয়ে দেব?

দরকার নেই, স্যার। ওরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না।

তারচেয়েও বড় কথা আপনি কিছু মনে রাখতে পারবেন না।

সত্যি কথা বলেছেন। আমার স্মৃতিশক্তি দুর্বল।

চৌম্বকক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন হয়েছে। আপনি সম্ভবত চলে যাচ্ছেন। পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকুন। দেখুন, আমাদের গ্ৰহ দেখুন—শেষবারের মত দেখুন।

মতিন সাহেব পর্দার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুগ্ধ বিস্ময়ে এই বিচিত্র গ্রহ দেখলেনদেখলেন তার ভূগর্ভস্থ বিশাল নগরী, দেখলেন তুষারঢাকা পর্বতমালা, দেখলেন বনভূমি, দেখলেন এই গ্রহের প্রাণদায়িনী সূর্য যার আলো কিঞ্চিৎ নীলাভ।

তাকে শুনানো হল তাদের শ্ৰেষ্ঠতম সঙ্গীত। দেখানো হল মহান সব শিল্পকর্ম। আত্ কী অপূর্ব অভিজ্ঞতা! মতিন সাহেব ইরিডিয়ামের তৈরি তাঁর দুটি মূৰ্তিও দেখলেন। কী বিশাল মূর্তি। আগামী লক্ষ বছর এই মূর্তির কিছু হবে না। এই গ্রহের অদ্ভুত সুন্দর মানুষগুলি তার মূর্তির দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকাবে।

হে ভিন গ্রহের মানুষ, আমাদের ধারণা আপনার বিদায়ের মুহূর্ত সমাগত। চৌম্বকক্ষেত্র সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। বিদায়, বিদায়। এই গ্রহের সব কটি মানুষ এক সঙ্গে বলল-বিদায়, বিদায়!

মতিন সাহেব হঠাৎ এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করলেন। শরীরের প্রতিটি রক্ত কণিকা এক সঙ্গে কেঁপে উঠল। তারপর সব আগের মত হয়ে গেল। তিনি দেখলেন রমনা পার্কের বেঞ্চিতে তিনি চুপচাপ বসে আছেন। হাতে বাদামের ঠোঙা। বাদামওয়ালা টাকার ভাংতি নিয়ে এসেছে। তিনি বাদামওয়ালাকে চারটা টাকা দিলেন। তাঁর রুটিনের ব্যতিক্রম হল না। দুপুরে বেঞ্চিতে ঘুমালেন। বিকেলে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে বাসায় ফিরলেন।

নামাযের সময় হয়েছে তিনি বারান্দায় বসে বদনার পানিতে অযু করছেন। তাঁর স্ত্রী চিল্কার করে উঠলেন—ওকী! কী!

মতিন সাহেব বললেন, কী হল।

তোমার হাতে চারটা আঙুল কেন? মতিন সাহেব হাতের দিকে তাকালেন। আসলেই তাই। দুটি হাতেই চারটি করে আঙুল। শুধু হাতে নয়। পায়েও তাই।

কী হয়েছে তোমার। এসব কী?

মতিন সাহেব উদাস গলায় বললেন, জানি না।

কী বলছ তুমি! কী সর্বনাশের কথা!

মতিন সাহেব বললেন, সর্বনাশের কী আছে? চারটা আঙুলে অসুবিধা তো হচ্ছে না।

তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে অযু করে যাচ্ছেন। আঙুল চারটা হয়ে যাওয়ায় তাঁর মধ্যে কোন ভাবান্তর হচ্ছে না। তিনি জানেন প্রকৃতি ভুল করে না। ঐ গ্রহ থেকে এখানে ফিরিয়ে আনার সময় প্রকৃতি এই সামান্য পরিবর্তন করেছে। নিশ্চয়ই তার প্রয়োজন ছিল। অন্তত তিনি নিজে তো বুঝছেন তার জীবনে যা ঘটেছে তা স্বপ্ন নয়—বাস্তবেই ঘটেছে। প্রকৃতি তার প্রমাণ রেখে গেল।

তাছাড়া চার আঙুলে হাতটাকে দেখাচ্ছেও সুন্দর।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অমর বাবু স্কুল লাইব্রেরিতে বসে আছেন। হাতে একটা বই। নাম—মৌমাছিদের বিচিত্র জীবন। পড়তে বড় ভালো লাগছে। কত ক্ষুদ্র প্রাণী অথচ কী অসম্ভব বুদ্ধি, কী অসম্ভব জ্ঞান। মৌচাকের ভেতরের তাপমাত্রা তারা একটা নির্দিষ্ট স্থানে স্থির করে রাখে। বাড়তেও দেয় না, কমতেও দেয় না। এই কাজটা তারা করে অতি দ্রুত পাখা কাঁপিয়ে। তাপমাত্রা এক হাজার ভাগের এক ভাগও বেশ-কম হয় না। মানুষের পক্ষেও যা বেশ কঠিন।

তিনি রাত আটটার সময় নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। শরীরটা ভালো লাগছে না। একটু জ্বর জ্বর লাগছে। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দিয়ে গেছে। তিনি কিছু খাবেন না বলে ঠিক করলেন। না খাওয়াই ভালো হবে। অনেক সময় পেটের গণ্ডগোল থেকে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়। তাতে আজেবাজে স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা ঘটতে পারে। না খেলে তা হবে না। লেবুর সরবত বানিয়ে এক গ্লাস, সরবত খেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়লেন।

কাল শীতশীত লাগছিল, আজ আবার গরম লাগছে। জানালা খোলা, সামান্য বাতাস আসছে। সেই বাতাস মশারির ভেতর ঢুকছে না। তিনি মশারি খুলে ফেললেন। মশা কামড়াবে। কামড়াক। গরমের চেয়ে মশার কামড় খাওয়া ভালো।

মশারি খুলে ফেলে বিছানায় শোয়ামাত্র আবার গত রাতের মতো হল। তিনি ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে যেতে লাগলেন। দেখতে দেখতে তাঁর মাথা ঘরের ছাদ স্পর্শ করল।

তিনি হাত দিয়ে সেই ছাদে ধাক্কা দেয়া মাত্র খানিকটা নিচে নেমে আবার উপরে উঠতে লাগলেন। একি অদ্ভুত কাণ্ড? আবারো কি স্বপ্ন? না, স্বপ্ন না। আজকেরটা স্বপ্ন না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার উপর কাজ করছে না। পৃথিবীর ভর যদি হয় m1, তিনি যদি হন m2 এরং তাঁর ভর m2 যদি হয় শূন্য তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বল হবে শূন্য। তাঁর ভর কি এখন শূন্য? তিনি পাশ ফিরলেন, শরীরটা চমৎকারভাবে ঘুরে গেল। সাঁতার কাটার মতো করলেন। তেমন লাভ হল না। যেখানে ছিলেন সেখানেই রইলেন। এটাই স্বাভাবিক, বাতাস অতি হালকা। হালকা বাতাসে সাঁতার কাটা যাবে না।

ব্যাখ্যা কি? এর ব্যাখ্যা কি? একটা মানুষের ভর হঠাৎ শূন্য হয়ে যেতে পারে না। নিচে নামার উপায় কি? মনে মনে আমি যদি চিন্তা করি নিচে নামব তাহলে কি নিচে নামতে পারব? তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন—নেমে যাচ্ছি, দ্রুত নেমে যাচ্ছি। লাভ হল না। যেখানে ছিলেন সেখানেই রইলেন।

আচ্ছা তিনি যদি থুথু ফেলেন তাহলে থুথুটার কি হবে? মাটিতে পড়ে যাবে না শূন্যে ঝুলতে থাকবে? তিনি থুথু ফেললেন। খুব স্বাভাবিকভাবে থুথু মাটিতে পড়ল। গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে ছেড়ে দিলে সেটিও কি শূন্যে ভাসতে থাকবে? নাকি নিচে পড়ে যাবে? অতি সহজেই এই পরীক্ষা করা যায়। তিনি গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেললেন। ছেড়ে দিতেই দ্রুত তা নিচে নেমে গেল। তার মানে এই অদ্ভুত ব্যাপারটির সঙ্গে শুধু তিনিই জড়িত। তাঁর গায়ের পোশাকের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। তিনি চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছেন মাধ্যাকর্ষণ বল যদি হয় F তাহলে–

F= mlm2 / r²

m1 পৃথিবীর ভর। m2 তাঁর নিজের ভর। r হচ্ছে তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব। m2 যদি 0 হয়, F হবে শূন্য। কিংবা r যদি হয় অসীম হলেও F হবে 0, কোনো বিচিত্র কারণে কি তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব অসীম হয়ে যাচ্ছে? ভাবতে ভাবতে অমর বাবুর ঘুম পেয়ে গেল। এক সময় মাটি থেকে ছফুট উঁচুতে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর ঘুম। তার নাকও ডাকতে লাগল। ঘুমের মধ্যেই তিনি পাশ ফিরে খুলেন। কোনো রকম অসুবিধা হল না।

ঘুম ভাঙল ভোরবেলা।

অনেক বেলা হয়েছে। ঘরে রোদ ঢুকেছে। তিনি পড়ে আছেন মেঝেতে। কখন মাটিতে নেমে এসেছেন তিনি জানেন না। গায়ে কোনো ব্যথা বোধ নেই, কাজেই ধপ করে পড়েন নি—আস্তে আস্তে নেমে এসেছেন।

অমর বাবু স্বাভাবিক মানুষের মতো হাত-মুখ ধুলেন। মুড়ি গুড় দিয়ে সকালের নাশতা সারলেন। পুকুর থেকে গোসল শেষ করে যথাসময়ে স্কুলে গেলেন। আজ প্রথম পিরিয়ডেই তার ক্লাস। তিনি ক্লাস না নিয়ে নিজের চেয়ারে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। মনে হল ঘুমুচ্ছেন। আসলে ঘুমুচ্ছিলেন না, ভাবার চেষ্টা করছিলেন তার জীবনে এসব কি ঘটছে?

ব্যাপারটা শুধু রাতেই ঘটছে। দিনে ঘটছে না। আচ্ছা তিনি যদি তাঁর নিজের ঘরে না ঘুমিয়ে অন্য কোথাও থাকেন তাহলেও কি এই ব্যাপার ঘটবে? রাতে খোলা মাঠে যদি ঘুমিয়ে থাকেন তাহলে কি ভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে চলে যাবেন? মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি বা সূর্যের কাছাকাছি? কিংবা আরো দূরে এড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ…সুদূর কোনো ছায়াপথে…?

স্যার!

অমর বাবু চমকে তাকালেন। দপ্তরি কালিপদ দাঁড়িয়ে আছে।

হেড স্যার, আপনাকে বুলায়।

হেড স্যার তাঁকে কেন ডেকে পাঠালেন তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। ইদরিস সাহেব কি হেড স্যারকে কিছু বলেছেন? বলতেও পারেন। পেট পাতলা মানুষ বলাটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা ব্যাপারটা কি তিনি নিজে গুছিয়ে হেড স্যারকে বলবেন? বলা যেতে পারে। মানুষটা ভালো। শুরুতেই অবিশ্বাসের হাসি হাসবেন না।

হেড স্যার বললেন, কেমন আছেন অমর বাবু?

জ্বি ভালো।

দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে না। চা খাবেন?

চা তো স্যার আমি খাই না।

এক-আধবার খেলে কিছু হয় না। খান কালিপদকে চা দিতে বলেছি।

কালিপদ চা দিয়ে থার্ড পিরিয়ডের ঘণ্টা দিতে গেল। হেড স্যার বললেন, শুনলাম গতকাল ক্লাস নেননি। আজও ফাস্ট পিরিয়ড মিস গেছে।

ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে স্যার।

ও আচ্ছা। আপনার তো সব ঘড়ি-ধরা। ঘুম ভাঙতে দেরি হল কেন?

অমর বাবু চুপ করে রইলেন।

পারিবারিক কোনো সমস্যা যাচ্ছে না-কি?

জ্বি-না।

আপনার মেয়ে গতকাল আমার কাছে এসেছিল। খুব কান্নাকাটি করল। আপনি বাড়িতে থাকেন না। এই নিয়ে বেচারির মনে খুব দুঃখ। দুঃখ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

আমি একা থাকতেই পছন্দ করি।

নিজের পছন্দকে সব সময় খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নেই। অন্যদের কথাও ভাবতে হয়। আমরা সামাজিক জীব…

স্যার উঠি?

বসুন খানিকক্ষণ। গল্প করি।-অমর বাবু আমি বলি কি যদি অসুবিধা না থাকে তা হলে, আপনার সমস্যাটা আমাকে বলুন। ইরিস সাহেব স্বপ্নের কথা কি সব বলছিলেন–

অমর বাবু ইতস্তত করে বললেন, বিজ্ঞানের সূত্র মিলছে না স্যার। হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন সূত্র মিলছে না?

স্যার আইজাক নিউটনের সূত্রমাধ্যাকর্ষণ সূত্র।

আপনার ধারণা সূত্রটা ভুল?

অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। এক সময় বললেন, আচ্ছা আপনি বরং বাড়িতে চলে যান। আপনাকে দশ দিনের ছুটি দিয়ে দিলাম। বিশ্রাম করুন। বিশ্রাম দরকার। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মাঝে মাঝে মানুষের কথা এলোমেলো হয়ে যায়।

স্যার, আমার মাথা ঠিকই আছে।

অবশ্যই ঠিক আছে। কথার কথা বললাম। যান, বাসায় চলে যান…বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে আছে।

অমর বাবু বাড়ি গেলেন না। কমন রুমে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। হাতে একটা ফুল স্ক্যাপ কাগজ। সেই কাগজে নিউটনের সূত্র নতুনভাবে লিখলেন

F=k.( mlm2 / r²)

এখানে k-এর মান ১ তবে মাঝে মাঝে k এর মান হচ্ছে শূন্য। যেমন তাঁর ক্ষেত্রে হচ্ছে। এক সময় কলম দিয়ে নির্মমভাবে সব কেটেও ফেললেন। নিউটন যে সূত্র দিয়ে গেছেন—তাঁর মতো সামান্য মানুষ সেই সূত্র পাল্টাতে পারেন না।

অমর বাবু টিফিন পিরিয়ডে অনেক সময় নিয়ে ইংরেজিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠির বাংলা অনুবাদ অনেকটা এই রকম–

জনাব,

আমি রূপেশ্বর হাইস্কুলের বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক। নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া আপনাকে পত্র দিতেছি। সম্প্রতি আমার জীবনে এমন এক ঘটনা ঘটিতেছে যাহার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি খুঁজিয়া না পাইয়া আপনার দ্বারস্থ হইলাম। আমি শূন্যে ভাসিতে পারি। আপনার নিকট খুব অদ্ভুত মনে হইলেও ইহা সত্য। আমি ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়া বলিতেছি আপনাকে যাহা বলিলা সবই সত্য। কোনো রকম চেষ্টা ছাড়াই আমি শূন্যে উঠিতে পারি এবং ভাসমান অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাইতে পারি। জনাব, বিষয়টি কি বুঝিবার ব্যাপারে আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন তাহা হইলে এই অধম আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিবে। আপনি বললেই ঢাকায় আসিয়া আমি আপনাকে শূন্যে ভাসার ব্যাপারটি চাক্ষুষ দেখাইব। জনাব, আপনি আমার প্রতি দয়া করুন বিষয়টি বুঝিতে আমাকে সাহায্য করুন।

বিনীত
অমর দাস পাল
B. Sc. (Hons)

দশ দিনের পুরোটাই তিনি নিজের ঘরে কাটালেন-বাড়িতে গেলেন না। তাঁকে নিতে তাঁর ছোট মেয়ে অতসী এসেছিল। তাকে ধমকে বিয়ে করলেন। এই মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো ছিল—তাকে এত করে বললেন সায়েন্স পড়তে, সে ভর্তি হল আর্টস-এ। কোনো মানে হয়? তাকে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র কি জিজ্ঞেস করলে সে হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। কী দুঃখের কথা।

অতসীকে ধমকে ঘর থেকে বের করে দিলেও সে গেল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। তিনি বাইরে এসে বিরক্ত গলায় বললেন, কদছিস কেন?

সে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল, তোমার শরীর খারাপ বাবা। তুমি বাড়িতে চল।

শরীর খারাপ তোকে কে বলল?

সবাই বলাবলি করছে। তুমি না-কি কি সব স্বপ্ন-টপ্ন দেখ।

কোনো স্বপ্ন দেখি না। আমি ভালো আছি। নির্জনে একটা পরীক্ষা করছি। পরীক্ষা শেষ হোক তোদর সঙ্গে এসে কয়েকদিন থাকব।

কীসের পরীক্ষা?

কীসের পরীক্ষা বললে তো তুই বুঝবি না। হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকবি। এত করে বললাম সায়েন্স পড়তে।

অঙ্ক পারি না যে।

অঙ্ক না পারার কি আছে? যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ-অঙ্ক তো এর বাইরে না। কাঁদিস না। বাসায় যা। আমি ভালো আছি।

তিনি যে ভালো আছেন তা কিন্তু না।

রোজ রাতে একই ব্যাপার ঘটছে। খেয়ে-দেয়ে ঘুমুতে যানমাঝ রাতে ঘুম ভেঙে দেশেন শূন্যে ভাসছেন। তখন আতঙ্কে অস্থির হওয়া ছাড়া পথ থাকে না। তিনি ইচ্ছে করলেই নিচে নামতে পারেন না।

নিচে কীভাবে নামেন তাও জানেন না। রাতটা তার অঘুমেই কাটে। তিনি ঘুমুতে যান দিনে। এমন যদি হত তিনি দিনরাত সারাক্ষণই শূন্যে ভাসছেন তাহলেও একটা কথা ছিল। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন যে, কোনো-এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় তাঁর ভর শূন্য হয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে রকম না। এমন কেউ এখানে নেই যে তিনি সাহায্যের জন্যে তাঁর কাছে যাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যান সাহেবও কিছু লিখছেন না। হয়তো ভেবেছেন পাগলের চিঠি। কে আর কষ্ট করে পাগলের চিঠির জবাব দেয়?

নদিনের মাথায় অমর বাবু চিঠির জবাব পেলেন। অতি ভদ্র চিঠি। চেয়ারম্যান সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাডে লিখেছেন–

জনাব,

আপনার চিঠি কৌতূহল নিয়ে পড়লাম। আপনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। কাজেই বুঝতে পারছেন আপনি যে বিষয়ের অবতারণা করেছেন তা বিজ্ঞান স্বীকার করে না। আপনি যদি আমার অফিসে এসে শূন্যে ভাসতে থাকেন তাহলেও আমি বিশ্বাস করব না। ভাবব এর পেছনে ম্যাজিকের কোনো কৌশল কাজ করছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন জাদুকররা শূন্যে ভাসার খেলা সব সময়ই দেখায়।

যাই হোক, আপনার চিঠি পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে আপনার সমস্যাটি মানসিক। আপনি মনে মনে ভাবছেন-শূন্যে ভাসছেন। আসলে ভাসছেন না। সবচে ভালো হয় যদি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। একমাত্র তিনিই আপনাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি আপনাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে শেষ করছি।

বিনীত
এস. আলি
M. Sc., Ph. D. F.R.S.

অমর বাবু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবার ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দিলেন না। কারণ তিনি জানেন বিষয়টা সত্যি। তিনি দুএকটা ছোটখাটো পরীক্ষা করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। যেমন স্কুল থেকে লাল রঙের চক নিয়ে এসেছিলেন। শূন্যে উঠে যাবার পর সেই লাল রঙের চক দিয়ে ছাদে বড় বড় করে লিখলেন,

হে পরম পিতা ঈশ্বর, তুমি আমাকে দয়া কর।

তোমার অপার রহস্যের খানিকটা আমাকে দেখতে দাও।

আমি অন্ধ, তুমি আমাকে পথ দেখাও। জ্ঞানের আলো আমার হৃদয়ে প্ৰজ্বলিত কর। পথ দেখাও পরম পিতা।

আরো অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল, চক ফুরিয়ে যাওয়ায় লেখা হল না। এই লেখাটা ছাদে আছে। তিনি তাকালেই দেখতে পান। এমন যদি হত লেখাটা তিনি একা দেখতে পাচ্ছেন তাহলেও বোঝা যেত সমস্যাটা মনে। কিন্তু তা তো না। অন্যরাও লেখা পড়তে পারছে। গতকাল বিকেলে হেড মাস্টার সাহেব তাঁকে দেখতে এসে হঠাৎ করেই বিস্মিত গলায় বললেন, ছাদে এই সব কি লেখা?

অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, প্রার্থনা সংগীত।

প্রার্থনা সংগীত ছাদে লিখলেন কেন?

শুয়ে শুয়ে যাতে পড়তে পারি এই জন্যে।

লিখলেন কীভাবে? মই দিয়ে উঠেছিলেন না-কি?

অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেড মাস্টার সাহেব জবাবের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, আপনার ছুটি তো শেষ হয়ে গেল, আপনি কি ছুটি আরো বাড়াতে চান?

জ্বি-না।

আপনি বরং আরো কিছুদিন ছুটি নিন। শরীরটা এখনো সেরেছে বলে মনে হয় না। আপনাকে খুব দুর্বল লাগছে।

আমার শরীর যা আছে তাই থাকবে স্যার। আর ভালো হবে না।

এইসব কি ধরনের কথা? কোনো ডাক্তারকে কি দেখিয়েছেন?

জ্বি-না।

ডাক্তার দেখাতে হবে। ডাক্তার না দেখালে কিভাবে হবে? বিধু বাবুকে দেখান। বিধু বাবু এল.এম. এফ. হলেও ভালো ডাক্তার। যে কোনো বড় ডাক্তারের কান টেনে নিতে পারে। বিধু বাবুকে দেখানোর কথা মনে থাকবে?

জ্বি স্যার, থাকবে।

না আপনার মনে থাকবে না। আমি বরং নিয়ে আসব। আমার ছোট মেয়েটার জ্বর। বিধু বাবুকে বাসায় আসতে বলেছি। এলে, আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।

জ্বি আচ্ছা।

এখন তাহলে উঠি অমর বাবু?

একটু বসুন স্যার।

হেড মাস্টার সাহেব উঠতে গিয়েও বসে পড়লেন। তিনি খানিকটা বিস্মিত, কারণ অমর বাবু এক দৃষ্টিতে ছাদের লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি স্যার—যদি কিছু মনে না করেন।

বলুন কি বলবেন। মনে করাকরির কি আছে?

অমর বাবু প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আমি শূন্যে ভাসতে পারি।

বুঝতে পারলাম না কি বলছেন। আমি আপনা-আপনি শূন্যে উঠে যেতে পারি।

ও আচ্ছা।

হেড মাস্টার সাহেব ও আচ্ছা এমন ভঙ্গিতে বললেন, যেন শূন্যে ভেসে থাকবার ব্যাপারটা রোজই ঘটছে। তবে তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব চিন্তিত বোধ করছেন।

ছাদের লেখাগুলি শূন্যে ভাসতে ভাসতে লেখা।

ও আচ্ছা।

আপনার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?

হেড মাস্টার সাহেব জবাব দিলেন না। অমর বাবু বললেন, আমি স্যার এই জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলিনি। ছেলেবেলায় হয়তো বলেছি, জ্ঞান হবার পর থেকে বলিনি।

আমি বিধু বাবুকে পাঠিয়ে দেব।

জি আচ্ছা।

হেড মাস্টার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, উনাকে শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা বলার দরকার নেই। জানাজানি হবে-ইয়ে মানে—লোকজন হাসাহাসি করতে পারে।

আমি আপনাকেই খোলাখুলি বলেছি। আর কাউকে বলিনি।

ভালো করেছেন। খুব ভালো করেছেন।

বিধু বাবু এসে খানিকক্ষণ গল্পটল্প করে যাবার সময় ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেলেন। বললেন, দুঃস্বপ্ন না দেখার একটাই পথ। গভীর নিদ্রা। দ্রিা পাতলা হলেই মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে। আমি ফোনোবারবিটন ট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। শোবার আগে দুটা করে খাবেন।

অমর বাবু দুটো ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। তবে ঘুমুতে যাবার আগে এক কাণ্ড করলেন-কালিপদকে বললেন, লম্বা একাছি দড়ি নিয়ে তাঁকে খুব ভালো করে চৌকির সঙ্গে বেঁধে রাখতে।

কালিপদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।

অমর বাবু বিরক্ত মুখে বললেন, আমার মাথা খারাপ হয়নি। মাথা ঠিক আছে। তোমাকে যা করতে বলেছি কর। ব্যাপারটা কি পরে বুঝিয়ে বলব। লম্বা দেখে একগাছি দড়ি আন। শক্ত করে আমাকে চৌকির সঙ্গে বাঁধ।

কালিপদ তাই করল। তবে করল খুব অনিচ্ছার সঙ্গে।

অমর বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ট্যাবলেটের কারণে তাঁর গাঢ় দ্রিা হল। ঘুম ভাঙল বেলা উঠার পর। তিনি দেখলেন—এখনো চৌকির সঙ্গে বাঁধা আছেন তবে চৌকি আগের জায়গায় নেই, ঘরের মাঝামাঝি চলে এসেছে। তার একটিই মানে—চৌকি নিয়েই তিনি শূন্যে ভেসেছেন। নামার সময় চৌকি আগের জায়গায় নামেনি। স্থান পরিবর্তন হয়েছে।

তিনি সেদিনই বিছানাপত্র নিয়ে বাড়িতে চলে এলেন। অতসী তাঁকে দেখে কেঁদে ফেলল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, নাকে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে?

অতসী কাঁদতে কাঁদতেই বলল, তোমার শরীর এত খারাপ হয়েছে কেন বাবা? কী ভয়ংকর রোগা হয়ে গেছে।

ভালো ঘুম হচ্ছে না, এই জন্যে শরীর খারাপ হয়েছে, এতে নাকে কাদার কি হল?

সবাই বলাবলি করছে তোমার না-কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কালিপদ নাকি রোজ রাতে দড়ি দিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখে।

কী যন্ত্রণা! একবারই বাঁধতে বলেছিলাম—এর মধ্যে এই গল্প ছড়িয়ে গেছে?

তোমার কী হয়েছে বাবা বল?

কিছু হয়নি।

অমর বাবু ছদিন বাড়িতে থাকলেন। এই ছদিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করলেন। শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা তিনি একা একা থাকার সময়ই ঘটে। অন্য কেউ তাঁর সঙ্গে ঘুমুলে ঘটে না। যে কত তাঁর স্ত্রী তাঁর সঙ্গে ঘুমিয়েছেন সে করাত তিনি শূন্যে ভাসেননি। দুরাত ছিলেন একা একা, দুরাতেই শূন্যে উঠে গেছেন।

পূজার ছুটির পর স্কুল নিয়মিত শুরু হল। তিনি স্কুলে গেলেন না। লম্বা ছুটির দরখাস্ত করলেন। আবার বাড়ি ছেড়ে বাস করতে শুরু করলেন স্কুলের ঘরে। দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকতে তার ভালো লাগে না।

শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা রোজ ঘটতে লাগল। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘটতে লাগল। এখন বিছানায় শোয়ামাত্র শূন্যে উঠে যান। সারারাত সেখানেই কাটে। শেষ রাতের দিকে নিচে নেমে আসেন। ব্যাপারটা ঘটে শুধু রাতে, দিনে ঘটে না। কখনো না। এবং অন্য কোনো ব্যক্তির সামনেও ঘটে না।

হেড স্যার এবং ইদরিস স্যার পর পর দুরাত অমর বাবুর ঘরে জেগে বসে ছিলেন। দেখার জন্যে ব্যাপারটা কি। তাঁরা মুহুর্তের জন্যেও চোখের পাতা এক করেননি। লাভ হয়নি, কিছুই দেখেননি। হেড স্যার বললেন, ব্যাপারটা পুরোপুরি মানসিক।

অমর বাবু দুঃখিত গলায় বললেন, আপনার কি ধারণা আমি পাগল হয়ে গেছি?

না, তা না। পাগল হবেন কেন? তবু আমার ধারণা ব্যাপারটা আপনার মনে ঘটছে। একবার ঢাকায় চলুন না, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলি।

না।

ক্ষতি তো কিছু নেই। চলুন না।

আমি যেতে চাচ্ছি না স্যার, কারণ আমি জানি ব্যাপারটা সত্যি। সত্যি না হলে ছাদে এই লেখাগুলি আমি কীভাবে লিখলাম? দেখছেন তো ঘরে কোনো মই নেই।

হেড স্যার চুপ করে রইলেন। অমর বাবু বললেন, আপনারা ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, আমি আবার শূন্যে উঠে ছাদে একটা লেখা লিখব।

হেড স্যার বললেন, তার দরকার নেই; কিন্তু কথা হচ্ছে আপনি আমাদের সামনে ব্যাপারটা পারছেন না কেন?

আমি জানি না। জানলে বলতাম। জানার চেষ্টা করছি, দিন-রাত এটা নিয়েই ভাবছি।

এত ভাবাভাবির দরকার নেই, আপনি আমার সঙ্গে ঢাকা চলুন। দুদিনের ব্যাপার। যাব, ডাক্তার দেখাব, চলে আসব। আমার একটা অনুরোধ রাখুন। প্লিজ। আপনার হয়তো লাভ হবে না কিন্তু ক্ষতি তো কিছু হবে না।

অমর বাবু ঢাকায় গেলেন

অমর বাবু ঢাকায় গেলেন।

একজন অতি বিখ্যাত মনোররাগ বিশেষজ্ঞ দীর্ঘ সময় ধরে তাঁকে নানান প্রশ্ন করলেন। পরপর কয়েকদিন তার কাছে যেতে হল। শেষ দিনে বিশেষজ্ঞ

ভদ্ৰলোক বললেন,

আপনার যা হয়েছে তা একটা রোগ। এর উৎপত্তি হচ্ছে অবসেসনে। বিজ্ঞানের প্রতি আপনার তীব্র অনুরাগ। সেই অনুরাগ রূপান্তরিত হয়েছে অবসেসনে। কেউ যখন বিজ্ঞানকে অবহেলা করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা বলে তখন আপনি তীব্র আঘাত পান। এই আঘাত আপনি পেয়েছেন আপনার অতি নিকটজনের কাছ থেকে। যেমন ধরুন আপনার কন্যা। সে বিজ্ঞান পড়েনি। আর্টস পড়ছে। এই তীব্র আঘাত আপনার মন গ্রহণ করতে পারেনি। আপনার অবচেতন মন ভাবতে শুরু করেছে—বিজ্ঞানের সূত্র অভ্রান্ত নয়। ভুল সূত্বও আছে। মাধ্যাকর্ষণ সূত্রও ভুল। এক সময় অবচেতন মনের ধারণা সঞ্চারিত হয়েছে চেতন মনে। বুঝতে পারছেন?

জ্বি না, বুঝতে পারছি না।

মোদ্দা কথা হল, আপনার রোগটা মনে।

না—আমি নিজে বিজ্ঞানের শিক্ষক। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচার-বিবেচনা করেছি। আমি যে শূন্যে উঠতে পারি এটা ভুল না। পরীক্ষিত সত্য।

মোটেও পরীক্ষিত সত্য নয়। আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি দেখেনি যে আপনি শূন্যে ভাসছেন। দেখলেও কথা ছিল, কেউ কি দেখেছে?

জ্বিনা।

আমি ট্ৰাংকুলাইজার জাতীয় কিছু ওষুধ দিচ্ছি। নিয়মিত খাবেন, ব্যায়াম করবেন। মন প্ৰফুল্ল রাখবেন। বিজ্ঞান নিয়ে কোনো পড়াশোনা করবেন না।

অমর বাবু দুঃখিত গলায় বললেন, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি; কিন্তু আমি যা বলছি সত্য বলছি।

ব্যাপারটা হয়তো আপনার কাছে সত্যি। কিন্তু সবার কাছে নয়। আপনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করলেও এই সিদ্ধান্তে আসবেন।

অমর বাবু ভগ্নহৃদয়ে রূপেশ্বরে ফিরে এলেন। স্কুলে যোগ দিলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই মাথা খারাপের সব লক্ষণ তার মধ্যে একে একে দেখা দিতে লাগল। বিড়বিড় করে কথা বলেন, একা একা হাঁটেন। হাঁটার সময় দৃষ্টি থাকে আকাশের দিকে। নিতান্ত অপরিচিত কাউকে দেখলে থমকে দাঁড়িয়ে যান, শান্ত গলায় বলেন, কিছু মনে করবেন না। আপনি কি নিউটনের গতিসূত্র জানেন?

পাগলের অনেক রকম চিকিৎসা করানো হল। কোনো লাভ হল না। বরং লক্ষণগুলি আরো প্রকট হওয়া শুরু করল। গভীর রাতে ছাত্রদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে উঁচু গলায় ডাকেন—জব্বার, ও জব্বার, ওঠে আয় তো বাবা। খুব দরকার।

জব্বার উঠে এলে তিনি করুণ গলায় বলেন, নিউটনের সূত্র মনে আছে? ভালো করে পড়। এস.এস, সি তে আসবে। সাথে অঙ্ক থাকবে ভূমি থেকে দশ ফুট উচ্চতায় ১ গ্রাম ভর বিশিষ্ট একটি আপেল ছাড়িয়া দিলে তার গতিবেগ পাঁচ ফুট উচ্চতায় কত হইবে? অঙ্কটা চট করে কর। মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ কত মনে আছে তো?

আমাদের সমাজ পাগলদের প্রতি খুব নিষ্ঠুর আচরণ করে। অমর বাবুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। বছর খানিক না ঘুরতেই দেখা গেল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে বলছে—নিউটনের সূত্রটা কি যেন? অমর বাবু দাঁতমুখ খিচিয়ে এদের তাড়া করছেন। তারা মজা পেয়ে খুব হাসছে। কারণ তারা জানে পাগলরা শিশুদের তাড়া করে ঠিকই কখনো আক্রমণ করে না।

 

পৌষের শুরু। জঁকিয়ে শীত পড়েছে। এই শীতেও খালি গায়ে শুধু একটা ধুতি কোমরে পেঁচিয়ে অমর বাবু রাস্তায় রাস্তায় হাঁটেন। নিউটনের সূত্র মনে আছে কিনা এই প্রশ্ন তিনি এখন আর কোনো মানুষকে করেন না। পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গদের করেন। তারা প্রশ্নের উত্তর সঙ্গত কারণেই দেয় না। তিনি তখন ক্ষেপে যান।

 

রাত দশটার মতো বাজে। কনকনে শীত।

অমর বাবু দাঁড়িয়ে আছেন একটা কাঁঠাল গাছের নিচে। কাঁঠাল গাছের ডালে কয়েকটা বাদুড় ঝুলছে। তিনি বাদুড়গুলিকে নিউটনের সূত্র সম্পর্কে বলছেন। তখনই দেখা গেলহারিকেন হাতে হেড স্যার আসছেন। কাঁঠাল গাছের কাছে এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। অমর বাবুর দিকে তাকিয়ে দুঃখিত গলায় বললেন, কে অমর?

জ্বি স্যার।

কী করছেন?

বাদুড়গুলির সঙ্গে কথা বলছিলাম স্যার।

ও আচ্ছা।

এদের সঙ্গে কথা বললে মনটা হালকা হয়। ওদের নিউটনের সূত্রগুলি বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম।

এই শীতে বাইরে ঘুরছেন। বাসায় গিয়ে ঘুমান।

ঘুম আসে না স্যার।

হেড মাস্টার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ইয়ে অমর বাবু, এখনো কি আপনি শূন্যে ভাসেন?

জ্বি-না। ঢাকা থেকে আসার পর আর ভাসিনি। যদি আবার কখনো ভাসতে পারি–আপনাকে বলব। আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না। ভাসতে ভাসতে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে।

দূরে কোথায়?

মহাশূন্যে—অসীম দূরত্বে। চন্দ্ৰ সূৰ্য গ্ৰহ নক্ষত্র সব ছাড়িয়ে…

ও আচ্ছা।

যাবার আগে আমি আপনাকে খবর দিয়ে যাব।

আচ্ছা।

শীত কেটে গিয়ে বর্ষা

শীত কেটে গিয়ে বর্ষা এসে গেল। অমর বাবু লোকালয় প্রায় ত্যাগ করলেন। বেশির ভাগ সময় বনে-জঙ্গলে থাকেন। রূপেশ্বরের পাশের গ্রাম হলদিয়ায় ঘন বন আছে। এখন ঐ বনেই তাঁর আস্তানা। তাঁর মেয়ে অতসী প্রায়ই তাঁকে খুঁজতে আসে। পায় না। মেয়েটা বনে বনে ঘুরে এবং কাঁদে। তিনি চার-পাঁচদিন পর পর একবার বের হয়ে আসেন। তাঁকে দেখে আগের অমর বাবু বলে চেনার কোনো উপায় নেই। যেন মানুষ না-প্ৰেত বিশেষ। মাথাভর্তি বিরাট চুল, বড় বড় দাড়ি। হাতের নখগুলি বড় হতে হতে পাখির ঠোটের মতো বেঁকে গেছে। স্বভাব-চরিত্র হয়েছে ভয়ংকর। মানুষ দেখলে কামড়াতে আসেন। ইট-পাথর ছুড়েন। একবার স্থানীয় পোস্ট মাস্টারকে গলা টিপে প্রায় মেরে ফেলতে বসেছিলেন। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। অতসীর বিয়ে হয়ে গেছে, সেও এখন আর বাবার খোঁজে আসে না।

 

দেখতে দেখতে এক বছর পার হয়ে গেল। কার্তিক মাস। অল্প অল্প শীত পড়ছে। এগারোটার মতো বাজে। হেড স্যার খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছেন, হঠাৎ শুনলেন উঠান থেকে অমর বাবু ডাকছেন—স্যার, স্যার-স্যার জেগে আছেন?

কে?

স্যার আমি অমর। একটু বাইরে আসবেন?

হেড স্যার অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, খবরদার, তুমি বেরুতে পারবে না। পাগল মানুষকি না কি করে বসে। ঘুমাও।

অমর বাবু আবার কাতর গলায় বললেন, একটু বাইরে আসুন স্যার খুব দরকার। খুব বেশি দরকার।

হেড স্যার ভয়ে ভয়ে বাইরে এলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন তাঁর বাড়ির সামনের আমগাছের সমান উচ্চতায় অমর বাবু ভাসছেন। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় দৃশ্য। একটা মানুষ অবলীলায় শূন্যে ভাসছে। তার জন্যে পাখিদের মতো তাঁকে ডানা ঝাল্টাতে হচ্ছে না।

স্যার দেখুন আমি ভাসছি।

হেড স্যার জবাব দিতে পারছেন না। প্রথম কয়েক মুহূর্ত মনে হচ্ছিল চোখের ভুল। এখন তা মনে হচ্ছে না। ফকফকা চাঁদের আলো। দিনের আলোর মতো সব দেখা যাচ্ছে। তিনি পরিষ্কার দেখছেন—অমর বাবু শূন্যে ভাসছেন। এই তো ভাসতে ভাসতে খানিকটা এগিয়ে এলেন। সাঁতার কাটার মতো অবস্থায় মানুষটা শুয়ে আছে। কী আশ্চর্য।

স্যার দেখতে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

আজ হঠাৎ করে শূন্যে উঠে গেলাম। বন থেকে বের হয়ে রূপেশ্বরের দিকে। আসছি হঠাৎ শরীরটা হালকা হয়ে গেল। দেখতে দেখতে দশ-বারো ফুট উঠে গেলাম। প্রথমেই ভাবলাম আপনাকে দেখিয়ে আসি। ভাসতে ভাসতে আসলাম।

আর কেউ দেখেনি?

না। কয়েকটা কুকুর দেখেছে। ওরা ভয় পেয়ে খুব চিৎকার করছিল। এরকম দেখে তো অভ্যাস নেই। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে স্যার?

হ্যাঁ, হচ্ছে। আমি ঠিক করেছিভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাব।

ও আচ্ছা।

আমার মাথাটা বোধ হয় খারাপ হয়ে গিয়েছিল সারাক্ষণ ব্যথা করত। এখন ব্যথাও নেই। আগে কাউকে চিনতে পারতাম না। এখন পারছি।

শুনে ভালো লাগছে অমর বাবু।

অন্য একটা কারণেও মনে খুব শান্তি পাচ্ছি। কারণটা বলি—মহাশূন্যে ভাসার রহস্যটাও ধরতে পেরেছি।

হেড মাস্টার সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, রহস্যটা কী?

রহস্যটা খুব সাধারণ। এতদিন কেন ধরতে পারিনি কে জানে। তবে স্যার আপনাকে রহস্যটা বলব না। বললে আপনি শিখে যাবেন। তখন দেখা যাবে সবাই শূন্যে ভাসছে। এটা ঠিক না। প্রকৃতি তা চায় না। স্যার যাই?

অমর বাবু উপরে উঠতে লাগলেন। অনেক অনেক উঁচুতে। এক সময় তাঁকে কালো বিন্দুর মতো দেখাতে লাগল।

হেড স্যারের স্ত্রী হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে ভীত গলায় বললেন, কি ব্যাপার? পাগলটা কোথায়?

চলে গেছে।

তুমি বাইরে কেন? ভেতরে এসে ঘুমাও।

তিনি ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন।

অমর বাবুকে এর পর আর কেউ এই অঞ্চলে দেখখনি। হেড স্যার সেই রাত্রির কথা কাউকেই বলেননি। কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। সবাই পাগল ভাববে। আর একবার পাগল ভাবতে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত পাগল হতেই হয়—এটা তো তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন।

Exit mobile version