পৃথিবী থেকে একসময় মহাকাশে যে উপগ্রহ পাঠানো হতো সেটাকে আবার ফিরিয়ে আনা হতো না। মহাকাশযানে করে যখন মানুষ মহাকাশে যেতে শুরু করেছে তখন মহাকাশযানগুলোকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা শুরু হয়েছে । মহাকাশযানকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের সাথে ঘর্ষণ। মহাকাশযানগুলো ঘণ্টায় কয়েক হাজার মাইল বেগে বায়ুমণ্ডলে ঢুকে, সেই প্রচণ্ড গতিতে ঢোকার সময় যে ভয়ঙ্কর উত্তাপ তৈরি হয় তাতে মহাকাশযানটি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা! আকাশে যখন উল্কাপাত হয় তখন ঠিক সেই ব্যাপারটাই ঘটে! স্পেস শাটলের মতো মহাকাশযানগুলো যখন বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসে তখন বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণের ভেতর দিয়ে তার গতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। সেজন্যে স্পেস শাটলের যে অংশটির সাথে বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণ হয় সেটা তৈরি করতে হয় সত্যিকারের তাপ নিরোধক বস্তু দিয়ে। সেজন্যে যে বস্তুকে বেছে নেয়া হয়েছে সেটি আসলে এক ধরনের কাঁচ। এটা তৈরি করার সময় অসংখ্য বাতাসের বুদ্বুদ ভেতরে আটকে রাখা হয়–বলা যেতে পারে এই ধরনের কাচের ভেতরে 90 শতাংশ থেকে বেশি হচ্ছে বাতাসের বুদ্বুদ। পৃথিবীতে সবচেয়ে চমকপ্রদ তাপ অপরিবাহী বস্তু হচ্ছে বাতাস (সেজন্যে লেপের তুলোয় বাতাস আটকে রাখা হয়, শীতের দিনে শরীরের তাপ যেন বেরিয়ে যেতে না পারে!)। কাজেই স্পেস শাটলকে প্রচণ্ড তাপের হাত থেকে রক্ষা করে বাতাস ঠেসে রাখে এই চমকপ্রদ কাঁচ!
দেখা গেছে কিছু কিছু ক্যান্সারের কোষকে একটু উচ্চ তাপে (45 ডিগ্রি সেলসিয়াস) ধ্বংস করে ফেলা যায় যদিও এই তাপমাত্রায় সুস্থ কোষ টিকে থাকতে পারে। কাজেই শরীরের তাপমাত্রা দীর্ঘ সময় 45 ডিগ্রিতে রেখে দেওয়া ক্যান্সারের একটা চিকিৎসা হতে পারত, সমস্যা হচ্ছে মানুষের শরীর উচ্চ তাপমাত্রায় থাকতে চায় না–আমরা লক্ষ করেছি গরমের সময় আমরা দরদর করে ঘামতে থাকি–সেটা হচ্ছে শরীরকে ঠাণ্ডা রাখার শরীরের নিজস্ব প্রক্রিয়া। কাজেই বিজ্ঞানীরা পুরো শরীরকে উচ্চ তাপমাত্রায় না রেখে শুধুমাত্র যে অংশে ক্যান্সার সেল রয়েছে সেই অংশকে উচ্চ তাপমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা একটা বিশেষ ধরনের কাচ তৈরি করেছেন যার ভেতরে রয়েছে ম্যাগনেটিক ক্রিস্টাল। সেগুলো ডাক্তারেরা ক্যান্সার টিউমারে ইনজেকশান করে ঢুকিয়ে দেন, তারপর বাইরে থেকে একটা পরিবর্তনশীল চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করলে ম্যাগনেটিক ক্রিস্টালগুলো কাঁপতে থাকে, সেখান থেকে তাপ সৃষ্টি হয়। সেই তাপ তখন ক্যান্সারের কোষগুলো ধ্বংস করতে থাকে। এই বিশেষ কাচ লোহা এবং ফসফেটের যে মিশ্রণ দিয়ে তৈরি হয় সেটা শরীরের কোনো ক্ষতি করে না, তাই সেটা শরীরের ভেতর থাকা নিয়ে কাউকে মাথাও ঘামাতে হয় না।
সাম্প্রতিককালে কাচের সবচেয়ে আলোচিত ব্যবহার মনে হয় ফাইবার অপটিক ক্যাবল। আমরা আমাদের দেশের সাবমেরিন সংযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলাম, এখন আমরা আন্তর্জাতিক ব্যাকবোনের সাথে সংযুক্ত হয়েছি। দেশের মানুষ এখন এই ক্যাবলের ভেতর দিয়ে সারা পৃথিবীতে তথ্য পাঠাতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে একটি অপটিকেল ফাইবার দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক হাজার বইয়ের সকল তথ্য পাঠানো সম্ভব! এই অপটিকেল ফাইবার আসলে খুবই সরু কাচের তন্তু। চুল থেকেও সরু সেই তন্তুর ভেতর দিয়ে তথ্যকে আলো হিসেবে পাঠানো হয় আর সেই তথ্য প্রায় আলোর গতিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারে। (কাচের প্রতিসরাঙ্ক 1.5-এর কাছাকাছি, কাজেই কাচের ভেতরে আলোর গতি 1.5 গুণ কমে যায়) বিজ্ঞানীরা প্রথমবার যখন প্রথম ঠিক করলেন কাচের ভেতর দিয়ে আলো পাঠিয়ে তথ্য পাঠাবেন তখন সেখানে আলো শোষিত হয়ে যেত। শোষণের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে মাত্র 3 মিটার যেতে না যেতেই অর্ধেক আলো শোষিত হয়ে যেত। বিজ্ঞানীরা কাঁচকে পরিশোধন করতে করতে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে এসেছেন যে এখন আলোর অর্ধেক পরিমাণ শোষিত হতে 12 কিলোমিটার যেতে হয়! বিজ্ঞানীরা যখন কোনো কিছুর উন্নতি করেন সেটা হয় 10 বা 20 শতাংশ উন্নতি, 100 শতাংশ বা দুই গুণ উন্নতি করা রীতিমতো কঠিন। ফাইবার অপটিক ক্যাবলের আলো শোষণের উন্নতিটুকু সে হিসেবে একেবারেই লাগামছাড়া, যে উন্নতিটুকু করা হয়েছে সেটা এক, দুই বা দশ গুণ নয়, চার হাজার গুণ। পৃথিবীর ইতিহাসে সেরকম উদাহরণ খুব বেশি নেই।
আমাদের চোখের চশমার লেন্স হিসেবে যে রকম কাচ ব্যবহার করা হয় ঠিক সেরকম বড় বড় টেলিস্কোপের লেন্স তৈরি করার জন্যেও কাচ ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর যে কয়টি বড় টেলিস্কোপ রয়েছে তার মাঝে খুব বিখ্যাত টেলিস্কোপটি রয়েছে মাউন্ট পালামোরে। তার লেন্সের ব্যাস ছিল দুইশ ইঞ্চি, বিশাল সেই টেলিস্কোপটি রীতিমত একটি দর্শনীয় বস্তু! (আমার সেই টেলিস্কোপটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, তার ডিজাইন এত চমৎকার যে এক আঙুল দিয়ে এটাকে ঠেলে ঘোরানো সম্ভব!) এই টেলিস্কোপের লেন্সটি তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কর্নিং নামে একটি কোম্পানিকে। কাচ লাগিয়ে লেন্সটি ঢালাই করার পর সেটাকে ধীরে ধীরে শীতল হওয়ার জন্যে প্রায় দুই বছর সময় দেয়ার কথা। এক বছর পর একজন ইঞ্জিনিয়ার অধৈর্য হয়ে সেটা খুলে দেখার সময় লেন্সটা ফেটে যায়। কর্নিং ফ্যাক্টরিকে তখন দ্বিতীয়বার পুরো কাজটি করতে হয়েছিল। কর্নিং গ্লাসের মিউজিয়ামে সেই ফাটা লেন্সটি রাখা হয়েছে–তবে অধৈর্য সেই ইঞ্জিনিয়ারকে কী করা হয়েছে সেটি কোথাও লেখা নেই।