”এসব এমন কিছু কথা নয়; আমাদেরও জানা আছে। শুনতে ভালই লাগে।” হরিচরণ ভারিক্কি চালে বলল এবং প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল। ”আসল যে জিনিস ফুড সেটা কই? খাটবে যে খাদ্য কই? তা যখন পাওয়া যাবে না তখন খাটিয়ে খাটিয়ে টিবি রোগ ধরিয়ে দিয়ে লাভ কিছু হবে?”
”ঠিক কথা। ফুড কই?”
যজ্ঞেশ্বর টেবল চাপড়ে বলে উঠল।
প্রেসিডেন্ট এবং ধীরেন ঘোষ মাথা নাড়ল। বদু কৌটো থেকে বড় এক টিপ নস্যি বার করল।
”বাজে কথা।”
ক্ষিতীশ চাপা এবং দৃঢ়স্বরে বলল।
”আজ পর্যন্ত কেউ টি বি রুগী হয়েছে সাঁতার কেটে, এমন কথা শুনিনি। আসলে এটা অলস ফাঁকিবাজদের, যাদের উচ্চকাঙ্ক্ষা নেই তাদের অজুহাত। যতটুকু খাদ্য আমরা জোটাতে পারি, সেই অনুপাতে আমরা ট্রেনিং করি না। শ্যামল, গোবিন্দ বিদ্যেবুদ্ধির জন্য নয়, সাঁতারের জন্যই চাকরি পেয়েছে। কিন্তু সাঁতারকে তারা এর বিনিময়ে কি দিচ্ছে? এরা অকৃতজ্ঞ। এরা গুছিয়ে রোজ পাঁচ টাকাও যদি খাওয়ার জন্য খরচ করে, ডিসিপ্লিনড লাইফ লীড করে, নিয়মিত কঠিন ট্রেনিং করে, তাহলে দু’বছরেই এরা এক মিনিটে একশো মিটার ফ্রি স্টাইল কাটবে, এক পাঁচে ব্যাক স্ট্রোক কাটবে।”
”তাহলে এদের ট্রেনিং করাতে পারেননি কেন?” ধীরেন বলল।
”ছেলে ফেল করলে দোষটা মাস্টার মশায়েরও।” কার্তিক কনুই দিয়ে বদুকে খোঁচা দিল।
”নিশ্চয়, শুধু ওদের অকিতজ্ঞ বলে নিজের দোষ খালন করলে কি চলে!”
”না, আমি দোষ স্খালন করতে চাই না। বরং আমি বলতে চাই, এদের দিয়ে আর কিছু হবে না। এদের বয়স হয়ে গেছে, এদের মনে পচ ধরেছে। এদের পিছনে পরিশ্রম করে লাভ নেই।”
”আমি বিশ্বাস করি না।” হরিচরণের তীব্র স্বরে ক্ষিতীশও বিস্মিত হল।
”কি বিশ্বাস করিস না?”
”এদের দিয়ে এখনো টাইম কমানো যায়। আমি করাতে পারি। আমি পারি এদের খাটাতে। পচ—টচ ধরেছে এসব বাজে কথা।”
ক্ষিতীশ কিছুক্ষণ হরিচরণের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
”তাহলে তুই দায়িত্ব নে। আমি আজ থেকে চিফ ট্রেনারের পদ ছেড়ে দিলাম। রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দেব। আমি কাল থেকে আর আসব না।”
”না না, আসবে না এটা কি কথা!” বদু ব্যস্ত হয়ে উঠল। ”এতদিনকার মেম্বার!”
ক্ষিতীশ হাসল ম্লানভাবে, তারপরই চোখ দুটো পিট পিট করে উঠল। প্রেসিডেন্টকে লক্ষ করে বলল, ”ট্রেনার হতে গেলে নাম করা সাঁতারু হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। পৃথিবীর নাম করা কোচেরা—ট্যালবট, কারলাইল, গ্যালাঘার, হেইন্স, কাউন্সিলম্যান এরা কেউ ওলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন নয়। জলে নেমে এদের কোচ করতে হয় না। এরা সুইমারদের কোচ, নভিসদের নয়। জলের উপর থেকেই অনেক ভাল লক্ষ করা যায়, তাই ডাঙ্গাতেই আমি থাকি।”
”ক্ষিদ্দা, তুমি দেখছি ওইসব কোচেদের সঙ্গে নিজেকে এক পংক্তিতে ফেললে।” যজ্ঞেশ্বর কৃত্রিম বিস্ময় চোখে ফোটাল।
”ওরা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন তৈরী করছে, তুমি তো একটা বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নও তৈরী করতে পারনি!” কার্তিক সাহার গলায় বিদ্রূপ মোচড় দিল।
”পারবে পারবে, নিশ্চয় পারবে। ওয়ার্ল্ড রেকর্ড আমরা শিগ্গিরিই পাব, তাই না ক্ষিতীশ?” ধীরেন ঘোষ মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
”চ্যাম্পিয়ন সুইমার তৈরী করা এদেশে সম্ভব নয়।” প্রেসিডেন্ট বিনোদ ভড় এতক্ষণে কথা বলল।
ক্ষিতীশ উঠে দাঁড়াল।
”কোন দেশেই সম্ভব নয়। চ্যাম্পিয়নরা জন্মায়, ওদের তৈরী করা যায় না। ওদের খোঁজে থাকতে হয়, লক্ষণ মিলিয়ে চিনে নিতে হয়।” ক্লান্তস্বরে কথাগুলো বলে ক্ষিতীশ দরজার দিকে এগোল।
”সেই ভাল, এবার থেকে তপস্যা শুরু করো ক্ষিদ্দা।”
”ক্ষিতীশ, চা—টা খেয়ে যাও।”
”ক্ষিতীশবাবু ক্লাবে আপনার কিন্তু রেগুলার আসা চাই।”
ঘর থেকে বেরিয়েই ক্ষিতীশ দেখল শ্যামল, গোবিন্দ এবং আরো চার পাঁচটি ছেলে দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাল সে। ওরা হঠাৎ কাঠের মতো হয়ে গেল।
”তোদের অনেক বকেছি—ঝকেছি, কটু কথাও বলেছি। আর এসব শুনতে হবে না। আজ থেকে আমি আর এ ক্লাবের ট্রেনার নই। সাঁতারটা মন দিয়ে করিস।”
ক্ষিতীশ মাথা নামিয়ে ধীর পায়ে ক্লাবের বাইরে এসে দাঁড়াল।
কমলদিঘির কালো জলের উপর পার্কের আলোগুলো খড়ির মত দাগ টেনেছে। জুপিটার ক্লাববাড়ির চুড়োর ঘড়িতে আটটা বাজতে পাঁচ। দিঘিটা আকারে গোল। তাকে ঘিরে ইঁট বাঁধানো রাস্তা। নারী পুরুষ শিশুর ভীড়ে রাস্তাটা গিজগিজ করছে। আলোগুলোর নীচে তাস খেলা চলছে, অকসন ব্রিজ বা টোয়েন্টিনাইন। মাঝে মাঝে দমকা চীৎকার উঠছে তাসের আড্ডা থেকে। বেঞ্চগুলোয় বসার স্থান নেই। ফুলগাছের ঝোপগুলো লোহার বেড়ায় ঘেরা। বেড়ায় ঠেস দিয়ে যুবকরা গল্প করছে। ঘুগনি, আলুকাবলি, বাদাম, ঝালমুড়ি বা কুলফি মালাইওয়ালারা ব্যবসায়ে ব্যস্ত।
দুটি হাত রেলিংয়ে রেখে ক্ষিতীশ দিঘির অন্ধকার জলের দিকে তাকিয়ে। জুপিটারের ঠিক উল্টোদিকেই অ্যাপোলোর ক্লাববাড়ি। ডাইভিং বোর্ডের কংক্রিট কাঠামোর থামগুলো অন্ধকারে ব্রহ্মদত্যির পায়ের মতো জল থেকে উঠেছে।
”ক্ষিদ্দা!”
চমকে পেছনে তাকাল ক্ষিতীশ।
”ভেলো!”
”কি হল ক্ষিদ্দা?”
”কি আবার হবে, ছেড়ে দিলুম।”
”ভালই করেছ। ঝগড়াঝাটি, গোলমাল হয়নি তো?”
”না।”
ক্ষিতীশ মুখটা আবার জলের দিকে ঘোরাল। হাওয়া বয়ে আসছে জলের উপর দিয়ে। বাতাসে জলের কণা, আর শ্যাওলা আর ঝাঁঝির আঁশটে গন্ধ। পঁয়ত্রিশ বছর এই শুঁকে আসছে ক্ষিতীশ। তার কাছে এর থেকে সুবাস পৃথিবীতে নেই।