Site icon BnBoi.Com

কিশোর সাহিত্য সমগ্র ১ম খণ্ড – মতি নন্দী

কিশোর সাহিত্য সমগ্র ১ম খণ্ড – মতি নন্দী

স্ট্রাইকার

স্ট্রাইকার – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

।।১।।

কাল রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।

আমাদের গলিটা এঁকেবেঁকে তিনটে মোড় ঘুরে যেখানে বড় রাস্তায় পড়েছে, একটা বিরাট সাদা মোটর গাড়ি সেখানে এসে থামল। অত বড় গাড়ি আমাদের পাড়ার লোকেরা কখনও দ্যাখেনি। তাই তারা ভিড় করে গাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল কুচকুচে কালো এক মধ্যবয়সী বিদেশি। মুখে চুরুট, চোখে কালো চশমা, গাড়ির রঙের মতনই পরনে সাদা কোট ও ট্রাউজারস। চুল কাঁচা—পাকায় মেশা।

ভিড়ের দিকে তাকিয়ে, বিদেশি হাত নেড়ে পোর্তুগিজ ভাষায় কী বলল। আমার পাড়ার লোকেরা বাংলা এবং একটুআধটু ইংরেজি, হিন্দি আর ওড়িয়া ছাড়া কোনও ভাষা বোঝে না। তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকল। বিদেশি আবার কথা বলল। কথার ভঙ্গিতে বোঝা যায়, কিছু একটা জানতে চাইছে বা খোঁজ করছে।

ভিড় থেকে নুটুদা এগিয়ে গেলেন, ”কেয়া মাঙতা, কী চাই?” তারপর মনে মনে কয়েকটা কথা তর্জমা করে বললেন, ”হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?”

এবার বিদেশি পরিষ্কার বাংলায় বলল, ”প্রসূন ভট্টাচার্য নামে একটি ছেলে কি এই রাস্তায় বাস করে?”

বিদেশির মুখে বাংলা শুনে ওরা থতমত হয়ে অবাক হল, ভরসাও পেল। সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলে ভনভন করে বলে উঠল—প্রসূন? প্রসূন! প্রসূন!! কী দরকার? কেন এসেছে লোকটা?

”প্রসূন, মানে অনিল ভটচাজের বড় ছেলে?”

”হ্যাঁ, তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।” বিদেশি আশ্বস্ত হয়ে নুটুদাকে বলল। নুটুদা আমাদেরই পাশের ঘরের আর এক ভাড়াটে। ছাপাখানায় কমপোজিটরের কাজ করেন। বছর দুয়েক আগে ওঁর স্ত্রী মারা গেছেন। সংসারে একমাত্র মেয়ে নীলিমা ছাড়া আর কেউ নেই। মানুষটি অতি সরল, সাদামাটা। দোষের মধ্যে অযাচিত উপদেশ দেন; বারোয়ারি একটা কিছুর, রবীন্দ্রজয়ন্তী বা শীতলা পুজোর সুযোগ পেলেই চাঁদা তুলতে শুরু করেন। ছেলে—বুড়ো সবাই ওঁকে ‘নুটুদা’ বলে ডাকে। নীলিমা প্রায় আমারই বয়সী। ক্লাস টেন—এ পড়ে, সারাদিন পরিশ্রম করে ঘরে—বাইরে। ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব।

নুটুদা সন্দিহান চোখে সেই বিদেশিকে বললেন, ”প্রসূনের সঙ্গে কেন দেখা করবেন?”

বিদেশির চুরুটটা নিভে গেছিল। লাইটার জ্বেলে সেটা ধরাতে ধরাতে বলল, ”আমি ব্রাজিল থেকে আসছি। স্যানটোস ফুটবল ক্লাবের নাম শুনেছেন বোধ হয়। আমি সেই ক্লাবের ম্যানেজার। প্রসূন যদি রাজি হয়, আমরা ওকে নেব।”

নুটুদা বললেন, ”নেবেন মানে?”

বিদেশি ব্যস্ত হয়ে বলল, ”এজন্য নিশ্চয়ই টাকা দেবে আমার ক্লাব। বছরে একবার বাড়ি আসার প্লেন ভাড়াও।”

”কত টাকা দেবেন শুনি?”

বিদেশি সতর্কভাবে বলল, ”সেটা ওর বাবার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করব। প্রসূন তো এখনও নাবালক। আমরা সব খবর সংগ্রহ করেছি। ওর বয়স এখন সতেরো বছর চার মাস।”

নুটুদা বিদেশিকে নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পিছনে পাড়ার লোকের মিছিল। আমাদের বাড়িতে যেতে হলে আড়াই হাত চওড়া একটা মাটির গলিতে ঢুকতে হয়। একতলায় আমরা আর নুটুদারা ভাড়া থাকি দেড়খানা করে ঘর নিয়ে। দোতলায় থাকে বাড়িওয়ালা বিশ্বনাথ দত্ত। তার চার মেয়ে। দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে।

বিশ্বনাথ বা বিশুবাবু বাড়ি থেকে তখন বের হচ্ছিলেন, হঠাৎ একজন বিদেশির পিছনে সারা পাড়ার লোককে গলিতে ঢুকতে দেখে ভড়কে গেলেন। তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে ঢুকে সেজো মেয়ে সোনামুখীকে পাঠিয়ে দিলেন। বিশুবাবুর পুলিশকে ভীষণ ভয়।

বাবা ঘরে চৌকিতে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। মা রান্নাঘরে। আমরা দুই ভাই এক বোন। আমার পর পিন্টু, তার পর পুতুল। নুটুদা বাড়িতে ঢুকেই ”অনিলবাবু! অনিলবাবু!” —বলে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে শুরু করলেন। বাবা গম্ভীর প্রকৃতির, অত্যন্ত কম কথা বলেন। অধিকাংশ দিন আমার সঙ্গে তো একটাও কথা হয় না। আমি ওঁকে এড়িয়ে চলি।

”অনিলবাবু, সন্তাোষ ক্লাবের ম্যানেজার এসেছে!” নুটুদা উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছেন। ”জানেন তো, পেলে ওই ক্লাবের প্লেয়ার!”

”কে পেলে?’ বাবা ভারী গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, ”কোথায় বাড়ি?”

নুটুদা থতমত হয়ে গেলেন। বিদেশি মৃদু হেসে এগিয়ে এসে বলল, ”স্যানটোস ক্লাব ব্রাজিলে। স্যানটোস খুব নামকরা বন্দর, সেখান থেকে কফি চালান যায় সারা পৃথিবীতে। আমাদের ক্লাব পৃথিবীর সেরা ক্লাবগুলোর একটা। পেলে পৃথিবীর সেরা ফুটবলার। অত বড় গুণী প্লেয়ার এখনও দেখা যায়নি।”

বাবা পিছনের ভিড়ের উপর আলতোভাবে চোখ বুলিয়ে বললেন, ”আমি ফুটবলের কোনও খবর রাখি না। আপনার কী প্রয়োজন, বলুন।”

”আপনার ছেলে প্রসূনকে আমাদের ক্লাবে খেলাতে চাই।”

”প্রসূনের সঙ্গে কথা বলুন। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।” বাবা এই বলেই ঘরে ঢুকে গেলেন। বিদেশিও সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল এবং পিছনে নুটুবাবু। বিশুবাবু ইতিমধ্যে পুলিশ নয় জেনে এগিয়ে এসে আমাদের ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন।

বিদেশি বলল, ”প্রসূন নাবালক, ও তো কনট্রাক্ট সই করতে পারবে না, ওর অভিভাবক হিসেবে আপনাকেই তা করতে হবে।”

”না। আমি ফুটবল খেলার কোনও কিছুতে সই করব না। আমি ছেলের সর্বনাশ করে তার অভিশাপ কুড়োতে চাই না।”

নুটুদা ফিসফিস করে বিদেশিকে বললেন, ”অনিলবাবু এক সময়ে ফুটবল খেলতেন। কলকাতার সব থেকে বড় টিম ‘যুগের যাত্রী’—র দুর্ধর্ষ লেফট—ইন ছিলেন। তার পর রোভারস খেলতে গিয়ে বাঁ হাঁটুতে চোট লাগল, খেলা ছেড়ে দিলেন।”

”কে বলেছে খেলা ছেড়ে দিই?” বাবা হঠাৎ তীক্ষ্ন কর্কশ স্বরে বলে উঠলেন, ”খেলা আমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। সেই ইনজুরির কোনও চিকিৎসা হয়নি। আমার নিজের সাধ্য ছিল না, ক্লাবও ট্রিটমেন্ট—এর জন্য একটা পয়সা দেয়নি। ছেঁড়া কারটিলেজ নিয়ে আজও আমি চলছি। ক্লাব আমাকে সেই চোট নিয়েই জোর করে খেলাল। আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে। খেলা ভাঙার তিন মিনিট আগে, তখনও গোললেস। ওপেন নেট গোল আমার সামনে, তাজ মহম্মদ মাটিতে, ব্যোমকেশ বোস ছুটে আসছে, ঘটক গোল ছেড়ে বেরোবে কি না ঠিক করতে পারছে না, সারা মাঠ আকাশ কাঁপিয়ে গোলের জন্য চিৎকার করে উঠেছে, আর মাত্র ছ’ গজ দূর থেকে আমি বাইরে মারলাম।”

উত্তেজিত হয়ে এত কথা বলে বাবা যেন লজ্জা পেলেন। মাথা নিচু করে বাঁ পা মেঝেতে ঘষড়ে ঘষড়ে তক্তপোশে গিয়ে বসলেন। তার পর ফ্যাকাশে হেসে মুখ তুলে বললেন, ‘আমি বলেছিলাম, পারব না, খেলতে পারব না। জোর করে আমায় খেলাল ইনজেকশান দিয়ে। বলেছিল, খেললে একটা চাকরি করে দেবে। আমি কিন্তু অনেক, সত্যিই অনেক চেষ্টা করেছিলাম গোলে মারতে।” বাবা চুপ করে যেতে যেতে অস্ফুটে বললেন, ”আমার সারা মুখে থুথু দিয়ে ওরা বলল, ঘুষ খেয়েছি। বাড়ি ফেরার সময় মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল।” বাবা অন্যমনস্কের মতো কপালের ঠিক মাঝে টিপের মতন কাটা দাগটায় আঙুল বোলালেন।

বিদেশি সহানুভূতির স্বরে বলল, ”পৃথিবীর সব জায়গায়ই ফুটবলারদের এই ভাগ্যই হয়।”

”কেন হবে?” বাবা জ্বলজ্বলে চোখে প্রশ্ন করলেন। ভয়ংকর রাগ আর ঘৃণা তাঁর চোখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে। ”আমি যখন হাঁটু চেপে মাটিতে গড়িয়ে পড়লাম—সবাই বলল, ভান করছি। ওরা একবার ভেবে দেখল না, যে লোকটা ছ’ গজ থেকে শট নিতে পারল না, সে এত দিন ২৫—৩০ গজ থেকে অনায়াসে গোল করেছে, সে দু’ বছর টপ স্কোরার হয়েছে লিগে! ওরা নিষ্ঠুরের মতো অপমান করল। অথচ শিল্ড উইনারের মেডেলের জন্য আমি কত দিন স্বপ্ন দেখেছি। আমার গোলে ক্লাব শিল্ড পাচ্ছে—”

বাবা চুপ করলেন।

”আমরা ভাল টাকা দেব। প্রথম সিজন—এ মাসে যা দেব, ভারতীয় মুদ্রায় তার মূল্য দু’ হাজার টাকা। সেকেন্ড টিমে আমরা এই রকমই দিই। খেলা দেখিয়ে ফার্স্ট টিমে এসে যদি ভাল খেলে—তবে মাইনে, বোনাস, বিজ্ঞাপন থেকে রোজগার সব মিলিয়ে বছরে দু’ লক্ষ টাকা তো পাবেই।”

তখন বিশুবাবু ‘অ্যাঁ’ বলে ঘরে ঢুকে এলেন। নুটুদা ফ্যালফ্যাল করে বিদেশির মুখের দিকে তাকিয়ে, কথা বলতে পারছেন না। দরজার বাইরে ভিড়টা সরব হয়ে উঠল।

”প্রসূনের এত এলেম, অ্যাঁ, ছোঁড়াটাকে দেখে তো কিছু বোঝা যায় না!” বিশুবাবু বললেন।

বাবা অরুণা গ্লাস ফ্যাকট্রিতে টাইম—কিপারের কাজ করেন, তিন মাসের ওপর লক আউট চলছে। পঁয়ত্রিশ টাকা ঘর ভাড়া কিন্তু বাবা এক মাসের জন্যও বাকি ফেলেননি। অসম্ভব আত্মসম্মানবোধ। বাড়িওয়ালা অপমান করবে এটা তাঁর কাছে অসহ্য ব্যাপার। মা’র কাছে শুনেছি একটা ওষুধের দোকানে কাজ করেন। প্রতিদিন দুপুরে বাবা কাজে বেরিয়ে যান। ফেরেন অনেক রাতে, তখন আমি ঘুমিয়ে থাকি।

”আপনি প্রসূনের সঙ্গেই কথা বলুন। গত কুড়ি বছর আমি ফুটবল মাঠে যাইনি। খবরের কাগজে খেলার পাতা পড়ি না। আমি এ ব্যাপারে হাঁ বা না, কোনও কথাই বলব না।”

”অনিলবাবু!” নুটুদা চাপা স্বরে মিনতি করলেন, ”লক্ষ টাকা পর্যন্ত রোজগার করবে প্রসূন। আপনি রাজার হালে থাকবেন।”

”ভাবা যায় না, অ্যাঁ, বলে লাথি মেরেই এত টাকা! লোকটা যা বলছে রাজি হয়ে যান মশাই, রাজি হয়ে যান।” বিশুবাবু বললেন।

”ফুটবলারের আত্মসম্মানবোধ আছে বিশুবাবু। আমি কোনও দিন প্রসূনকে ফুটবল খেলতে বলিনি। সে নিজের আগ্রহে খেলে। আমি কোনও দিন তার খেলা দেখিনি। ফুটবল সম্পর্কে কোনও কথা আমি শুনতে চাই না। আমার যা বলার বলে দিয়েছি।”

বিদেশি অনেক কথা বাবাকে বলল। বাবা শুধু ঘাড় হেঁট করে একগুঁয়ের মতো মাথা নেড়ে গেলেন। নুটুদা, বিশুবাবু বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। অবশেষে বিদেশি একটা কার্ড বাবার হাতে দিয়ে বলল, ”এতে আমার ঠিকানা লেখা আছে। আপনি চিন্তা করুন। তার পর আমাকে চিঠি দেবেন। পেলে রিটায়ার করবে শিগগিরই! আমরা সেই জায়গায় প্রসূনকে খেলাব বলে এখনই ওকে তৈরি করে নিতে চাই।”

বিদেশি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার সঙ্গে সবাই। ফাঁকা ঘরে বাবা একা বসে। হাতে কার্ডটা। তার পর উঠে জানলায় এলেন। কার্ডটা কুচিকুচি করে জানলা দিয়ে ছুড়ে দিলেন উঠোনে। একরাশ শিউলিফুলের মতো কুচিগুলো ছড়িয়ে পড়ল। মা রান্নাঘর থেকে ছুটে গিয়ে কার্ড—এর টুকরোগুলো কুড়োতে শুরু করলেন, তাঁর পিছনে নীলিমা। কুড়োতে কুড়োতে নীলিমা আমার ঘরের জানলার কাছে এসে ফিসফিস করে ডাকল, ‘প্রসূন, এই প্রসূন! ওঠো, ওঠো, পাঁচটা যে বাজে।”

।।২।।

ধড়মড় করে উঠে বসলাম। জানলায় তাকিয়ে দেখি নীলিমা। ও বলল, ”ডেকে দিতে বলেছিলে না?”

আমাদের ঘড়ি নেই। নীলিমাকে কাল রাতে বলে রেখেছিলাম ভোর পাঁচটায় ডেকে দিতে। ওর স্কুল সকালে। খুব ভোরে উঠে জল তুলে, উনুন ধরিয়ে বাবার জন্য ভাত রেঁধে ও স্কুলে যায়। আজ সকালে শোভাবাজার ইউনিয়নের মাঠে আমি, নিমাই আর আনোয়ার ট্রায়াল দিতে যাব। হর্ষদা ইউনিয়নের কোচ বিপিন সিংহকে বলে রেখেছেন।

বিছানায় কিছুক্ষণ বসে স্বপ্নের কথা ভাবলাম। ভাবতে ভাবতে লজ্জা পেলাম। এ রকম অবাস্তব উদ্ভট স্বপ্ন যে কেন দেখতে গেলাম ভেবে অবাক লাগল। তবে স্বপ্নে অবাস্তব অকল্পনীয় ব্যাপারই ঘটে। পোর্তুগিজভাষী ব্রাজিলের লোক কিনা বাংলায় কথা বলছে! এমন না হলে আর স্বপ্ন বলা হয় কেন! কিন্তু শুনেছি অকারণে কেউ স্বপ্ন দেখে না; কোনও না কোনও সময়ে যা ভাবি বা মনে মনে পেতে বা হতে ইচ্ছে করে, সেটাই স্বপ্ন হয়ে ফুটে ওঠে।

তা হলে আমি কি পেলে হতে চাই? উফ কী সাহস আমার! ‘পে—এ—লে।’ নামটা খুব নরম স্বরে ফিসফিসিয়ে বার কয়েক উচ্চচারণ করলাম। ওর গল্প হর্ষদার কাছে বহুবার শুনেছি। হর্ষদা ভীষণ বই পড়েন আর খেলা দেখেন, জীবনে কখনও ফুটবল খেলেননি। আগে আমাদের পাড়ায় থাকতেন। ছোটবেলা থেকে আমায় চেনেন। হর্ষদাই প্রথম আমায় বলেন—’প্রসূন, তোমার মধ্যে ফুটবল খেলা আছে, মন দিয়ে খেলো, বড় হতে পারবে।’ কিন্তু পেলে হবার ইচ্ছেটা কখন যে মনের মধ্যে গজিয়ে উঠেছে, সেটা তো একদমই টের পাইনি। আমার ডান পায়ে প্রচণ্ড শট, কিন্তু বাঁ পা ভাল চলে না, বল নিখুঁতভাবে ট্র্যাপ করতে পারি না, হেড করার সময় চোখ বুজে কুঁকড়ে যাই। সবাই বলে বটে আমি খুব স্পিডি আর ভাল ড্রিবলও করতে পারি, কিন্তু সত্তর মিনিট খেলার দম আমার নেই। কখন ফাঁকা জমিতে গিয়ে বলের জন্য অপেক্ষা করব তাও জানি না।

আরও অনেক ঘাটতি আমার আছে অথচ, আমি কিনা পেলে—র জায়গায় খেলার স্বপ্ন দেখছি। আমি যে আস্ত গাড়োল, তাতে সন্দেহ নেই। নিজের ওপর খানিকটা রাগও হতে লাগল। স্বপ্নের কথা যদি নিমাইটা শোনে, তা হলে আমায় নিয়ে হাসাহাসি তো করবেই। দু’ লক্ষ টাকা বছরে! রীতিমতো মাথা খারাপ হলে তবেই এত টাকার কথা কল্পনা করা যায়।

কালও দুপুরে আমরা ছ’ খানার বেশি রুটি কেউ খাইনি, রাত্রে চারখানা। নাড়িভুঁড়ি জ্বলে যাচ্ছিল, তবু রাত্রে পুতুল আর পিন্টুকে আমার থেকে একখানা ছিঁড়ে দু’ ভাগ করে দিয়েছি। মাকে বলে রেখেছিলাম, আমার জন্য আজ সকালে দু’খানা রুটি যেন রেখে দেয়। আজ ট্রায়ালের দিন। একদম খালি পেটে মাঠে নামতে ভরসা হচ্ছে না, যদি ব্যথা খিমচে ধরে। মাকে অবশ্য ট্রায়ালের কথা বলেছি, আর জানে নীলিমাও।

আমার ঘরটা স্যাঁতসেঁতে আর দুপুরেও মনে হয় যেন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অর্ধেক দেয়ালের বালি খসে গেছে, কড়িকাঠে উই, একমাত্র জানলাটার দুটো কপাটেরই কবজা ভাঙা। বৃষ্টি হলে বেশ অসুবিধা হয়। এই ঘরটাকে পুরো—ঘর কোনওভাবেই বলা যায় না। লম্বায় আট ফুট, চওড়ায় পাঁচ ফুট। আমি একা থাকি। একটা টুলও রাখার জায়গা নেই। দেয়ালে তাক আছে। আমার স্কুলের কয়েকটা বই সেখানে পড়ে আছে। দুটো প্যান্ট আর জামা দড়িতে ঝুলছে।

মা ঘরে ঢুকলেন। আমার মা’র মতন মা পৃথিবীতে আর দুটি আছে কি না জানি না। আমাদের এত কষ্টের সংসার, মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায় ক্ষিধেয়, গরমে অপমানে আর হতাশায়। মা’র কিন্তু সব সময় হাসিমুখ। কম কথা বলেন। মিষ্টি মৃদু স্বর শুনলে মনে হয় দুঃখ বলে কোনও জিনিস পৃথিবীতে নেই। মা ঘরে ঢুকেই বললেন, ”খোকা, উঠে পড়েছিস! এখুনি বেরোবি?”

”হ্যাঁ। বাবা উঠেছে?” আমি ঘর থেকে বেরোবার সময় বললাম।

”না, গা—টা কেমন গরম গরম, জ্বর আসবে বোধ হয়। তোর জন্য রুটি রেখেছি।”

মা আমায় চারখানা রুটি দিলেন। আমার বরাবরই মনে হয়, সকলের থেকে মা আমাকেই বেশি ভালবাসেন। রাত্রে নিশ্চয় না খেয়ে আমার জন্য রুটি রেখে দিয়েছেন। অন্য সময় এই নিয়ে রাগারাগি শুরু করে দিতাম, আজ করলাম না। সাতটার মধ্যে মাঠে পৌঁছতে হবে। নিমাই আর আনোয়ার বটতলা বাস স্টপে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে।

বেরোবার সময় মাকে হঠাৎ প্রণাম করলাম। ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাবে খেলতে যাচ্ছি না, ট্রায়াল দিতে যাচ্ছি মাত্র। যদি বিপিন সিংহের পছন্দ হয়, তা হলে ময়দানের ঘেরা মাঠে খেলার সুযোগ আসবে। ফুটবল আমার কাছে রূপকথার একটা প্রাসাদ। যে আশা মনে মনে বহু দিন ধরে লালন করে আসছি, আজ তার দরজায় পৌঁছোতে যাচ্ছি মাত্র। যদি ঢুকতে পারি, তা হলে এক একটা তলা নীচে ফেলে উপরতলায় উঠবই, উঠতেই হবে। সে জন্য যত পরিশ্রম করা দরকার, করবই। মা আমাকে বুকে চেপে ধরে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। তারপর বললেন, ”খোকা, মন দিয়ে চেষ্টা করবি।”

।।৩।।

কিট ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে যখন বটতলার দিকে যাচ্ছি, তখন মনের মধ্যে মা’র কথাটাই গুনগুন করছিল। মন দিয়ে কেন, প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব, মা সারা জীবন কষ্টে কাটিয়েছেন, ওঁকে সুখী করবই। ফুটবলাররা চাকরি পায়, ক্লাব থেকে টাকাও পায়। আমি জানি শোভাবাজার ইউনিয়ন টাকা দেবে না, দেবার সামর্থ্যও নেই। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল বা যুগের যাত্রীতে আমাকে যেতেই হবে। যাবার প্রথম ধাপ শোভাবাজার। এক কী দু’বছরের মধ্যে চোখে পড়াতেই হবে আমার খেলা। খেলা দেখিয়েই বড় ক্লাবে যেতে চাই, তার পর একদিন ইন্ডিয়ার জারসি—ও পরব। টাকা আর খ্যাতি দুটোই আমার চাই, তবে এখন দরকার শেষেরটা।

নিমাই আর আনোয়ার বটতলায় দাঁড়িয়ে। আমি পৌঁছনো মাত্র আনোয়ার হাতঘড়িতে সময় দেখে বলল, ”সাড়ে ছ’টার মধ্যেই পৌঁছে যাব।”

আমরা তিনজনেই যে উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনার শিকার হয়েছি সেটা বোঝা গেল, কেউ আমরা কথা বলতে চাইলাম না। সব থেকে বেশি কথা বলে নিমাই। লোকের পিছনে লাগতে কিংবা কারুর ভঙ্গি বা গলার স্বর নকল করে হাসাতে নিমাই ওস্তাদ। আমাদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে শান্তিপল্লি নামে এক জবর—দখল কলোনিতে থাকে। বাবা নেই, দাদার কাপড়ের দোকান আছে হাতিবাগানে। নিমাই ক্লাস ফাইভে ফেল করার পর আর স্কুলে যায়নি।

বন্ধুদের মধ্যে অবস্থা ভাল আনোয়ারের। টকটকে রং, ছ’ ফুট লম্বা, ওজন পঁয়ষট্টি কেজি। একটা হোটেল আর দুটো বস্তির মালিক ওর বাবা। ধীর শান্ত প্রকৃতির আনোয়ারের খেলা তার ব্যবহার এবং জামা—প্যান্টের মতন পরিচ্ছন্ন। এখন পার্ট ওয়ান কমার্স—এর ছাত্র। আমার এবং নিমাইয়ের থেকে বছর তিনেকের বড়। আনোয়ার সঙ্গে থাকলে আমাদের পকেট থেকে একটা পয়সাও বার করতে হয় না। বলা বাহুল্য ওকে ছাড়া আমরা সিকি মাইলও চলি না।

বাসে আমরা শ্যামবাজার পর্যন্ত কেউ একটাও কথা বললাম না। আমার একবার শুধু মনে হয়েছিল, বাবাকেও প্রণাম করলে হত। কিন্তু মনের কোথায় যেন একটা চাপা অভিমান বাবার সম্পর্কে রয়ে গেছে। একদিনও আমাকে খেলার বিষয়ে একটা কথাও বলেননি, একবারও খোঁজ নেননি আমি কেমন খেলছি, আমার খেলা দেখতেও যাননি কখনও। ফুটবল সম্পর্কে বাবার তীব্র ঘৃণা আমি ওঁর ঔদাসীন্যের মধ্য দিয়েই বুঝতে পারি। মা মাঝে মাঝে বলতেন, ‘তোর বাবার কাছ থেকে জেনেটেনে নিস না!’ তারপর বলতেন ‘থাকগে।’ একবার শুধু কানে এসেছিল, মা’র কী একটা কথার জবাবে বাবা বললেন, ”ফুটবল আমাকে ফোঁপরা করে দিয়েছে, খোকাকেও দেবে। ওকে বারণ করো।”

শ্যামবাজার থেকে বাস বদল করে এসপ্লানেডে নামলাম ঠিক সওয়া ছটায়। শোভাবাজার টেন্ট—এ পৌঁছে দেখি জনা বারো ছেলে ড্রেস করায় ব্যস্ত। একজনকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, ”বিপিনদা আসবে সাতটায়। আমরা এখন রেড রোড দিয়ে সোজা গিয়ে ট্রাম লাইন পেরিয়ে, প্যারেড গ্রাউন্ডটাকে চক্কোর দেব। ফিরে এসে দেখব বিপিনদা অপেক্ষা করছে।”

ভেবে পেলাম না, এখন আমরা তিনজন কী করব। আনোয়ারই বলল, ”বসে থেকে কী করব, চল ওদের সঙ্গে দৌড়োই। বিপিনদা তাতে ইমপ্রেসড হবে।”

আমরাও ড্রেস করে ওদের সঙ্গে দৌড়ে যোগ দিলাম। মিনিট পাঁচেক দৌড়োবার পর, ওরা প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে না ঘুরে বাঁ দিকে এসপ্লানেড—মুখো হল। তার পর ময়দান হকার্স মারকেট—এ ঢুকে টিউবওয়েল থেকে জল নিয়ে জামায়, মুখে, পায়ে ছিটিয়ে আমাদের দিকে হাসল।

”দাঁড়িয়ে দেখছ কী, গায়ে জল লাগাও। ঘামে জবজব না করলে বিপিনদা খুশি হবে না, আবার ছোটাবে। এবার এখান থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে সোজা টেন্ট—এ।” ওদের মধ্যে সব থেকে বয়স্ক যে, আমাদের লক্ষ্য করে বলল।

”খবরদার বিপিনদাকে এ সব বলবে না। যদি ফাঁস করো, তা হলে”—গাঁট্টাগোট্টা একজন ভয়ংকর চোখে আমাদের তিনজনের দিকে তাকাল।

আমরা কোনও প্রশ্ন না করে ওদের মতন গায়ে মাথায় জল দিয়ে ‘ঘাম—জবজবে’ হয়ে নিলাম। যেহেতু নতুন, তাই একজন অনুগ্রহ করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল, ”রোজ রোজ এতখানি করে একঘেয়ে দৌড় কি ভাল লাগে? দৌড়ের পরই পার্টি করে খেলা, তার পর পাতলা দু’পিস রুটি আর একটা ডিম। এক মাসেই তো টি বি ধরে যাবে! তাই খাটুনি কমাবার জন্যই এসব করি। বিপিনদা জানতে পারলে কিন্তু রক্ষে নেই, মাঠে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে কুড়ি পাক দৌড় করাবে।” এই বলে সে হাসতে শুরু করল।

”আমরা তো আর চ্যামপিয়নশিপ ফাইট করতে যাব না, নেমেও যাব না, এখন তো রেলিগেশন প্রমোশন বন্ধ। তবে এত দৌড়োবার দরকারটা কী? অফিসের খেলা আছে, খেপের খেলা আছে, এত ধকল কি সামলানো যায়?” আর একজন এই বলে আমাদের যাবতীয় কৌতূহল মিটিয়ে দিল।

প্রথম দিনেই এই রকম রূঢ় ধাক্কায় গড়ের মাঠ সম্পর্কে মোহভঙ্গ হবে আশা করিনি। আমাদের টগবগে উৎসাহ এইখানেই খানিকটা থিতিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ‘এইবার চল রে’ বলে ওরা টেন্ট—এর দিকে আবার দৌড় শুরু করল। আমরাও ওদের পিছু নিলাম।

বেঁটে, টাকমাথা এক প্রৌঢ় মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে। পায়ের কাছে গুটি—চারেক বল। হাফপ্যান্টটা হাঁটুর নীচে ঢলঢল করছে। ভুঁড়ি দেখে মনে হয় গেঞ্জির নীচে আর একটি বল রয়েছে। আমরা দৌড়ে এসে ওঁকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়ালাম। একজন পেটে হাত দিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁফাতে লাগল, একজন শুয়ে পড়ল, আর একজন বলল, ”বিপিনদা যা খাটান, উফ আর পারা যায় না! এবার আমরা মরে যাব।”

বিপিনদার মুখ খুশিতে ঝকমক করে উঠল। কিন্তু যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে বললেন, ”কষ্ট না করলে কি কেষ্ট মেলে? বড় প্লেয়ার কি অমনি—অমনি হওয়া যায়? তোদের আর কী খাটাচ্ছি, আমরা খেলার দিন আড়াইশো ডন, পাঁচশো বৈঠক আর মাঠে চল্লিশ পাক দিয়ে গুনে গুনে একশো শট মেরে দু’ সের দুধ আর আধ সের বাদাম খেয়ে বাবুঘাটে চলে যেতুম। গঙ্গামাটি মেখে দু’ ঘণ্টা বসে থাকতুম। দুপুরে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে মাঠে নামতুম।”

আমার পিছনে দাঁড়ানো সেই গাঁট্টাগোট্টা ছেলেটি চাপা স্বরে বলল, ”ফুটবল খেলত না কুস্তি করত?”

বিপিনদা বোধ হয় আঁচ করতে পেরেছেন যে, কেউ একজন মন্তব্য করেছে। তিনি আন্দাজে আমার দিকে তাকালেন। আমি কাঁটা হয়ে গেলাম।

”ইয়েস, কী যেন বললে?”

আমি রীতিমতো নারভাস হয়ে, কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, তখন পিছন থেকে বলে উঠতে শুনলাম, ”আমি বলছিলুম যে বিপিনদাদের সময়ে মিলিটারিদের সঙ্গে খেলতে হত কিনা, তাই ট্রেনিং, খাওয়াদাওয়া ছিল মিলিটারি ধরনের। তাই শুনে এ বলল, ওইভাবে কুস্তি হয়, ফুটবল খেলা যায় না।”

চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি গাঁট্টাগোট্টার তর্জনী আমার দিকে তোলা এবং মুখটি নির্বিকার সারল্যে ভরা। অনেকে মুখ টিপে হাসছে। আনোয়ার হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ”বাজে কথা, প্রসূন আগাগোড়া চুপ করে আছে। কুস্তির কথা তুমিই বলেছ, আমি পরিষ্কার শুনেছি।”

”কে বলেছে আমি বলেছি?” গাঁট্টাগোট্টা তেরিয়া হয়ে এক পা এগিয়ে এসেই কী ভেবে থমকে গেল। আনোয়ার তার হাফপাউন্ড পাঁউরুটির মতো বাইসেপ দুটো একবার শক্ত করেই আলগা করে দিল। বিপিনদা কিন্তু বেশ খুশি হয়েই বললেন, ‘কারেক্ট, কারেক্ট, ফুটবল খেলতে হলে কুস্তির কিছু কিছু প্যাঁচ জানা দরকার, বিশেষ করে লেঙ্গি মারা।” তার পর আমাদের তিনজনের দিকে লক্ষ করে বললেন, ”তোমরা হর্ষর কাছ থেকে এসেছ?”

আমরা ঘাড় নাড়লাম। উনি আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন, ”যাও, ও ধারে গিয়ে শট করো। কত দূর মারতে পারো দেখি।”

।।৪।।

যাক, কিছু একটা দেখাবার মতো কাজ প্রথম দিনে পাওয়া গেল! আমি আর নিমাই এক দিকে আর ৬০/৬৫ গজ দূরে আনোয়ার। আনোয়ারের শটের জোর প্রচণ্ড। আনোয়ারের পেনালটি শট আটকাতে গিয়ে এক গোলকিপারের কবজি ভেঙে যায়। শুনেছি শৈলেন মান্নার শটে খুব জোর ছিল। আমি জোর দেখাবার বদলে কেরামতি দেখাতে লাগলাম। আউট সুইং করালাম, চিপ করলাম, ভলি আর সিজারিয়ান মারলাম, দু’—চারবার বাইসাইকেল কিক করার চেষ্টা করলাম, হল না। পেলের ছবি দেখে এটা নকল করার চেষ্টা করেছিলাম। পরে অবশ্য বুঝি, রীতিমতো জিমন্যাসটিকস না জানলে এই শট মারা যায় না। একজন দেখিয়ে দেবার লোকও চাই।

আনোয়ার বিরাট বিরাট শট করে যাচ্ছে। নিমাই কুড়িয়ে আনছে আর গাঁইগুঁই করছে, ”আমি যেন চাকর। কিছু হবে না … শুধু শট করতেই জানে… আমরা বাদ পড়ে যাব প্রসূন, বুঝলি!… আনোয়ারটার স্কিল বলতে তো ঘণ্টা, বিপিনদাকে বল না এবার একটু ট্র্যাপিং, হেডিং, ড্রিবলিং করে দেখাই।”

বিপিনদা অন্য ছেলেদের দিয়ে একই জিনিস করাচ্ছিলেন, লম্বা লম্বা শট। ওঁর কাছে গিয়ে বললাম, ”বিপিনদা, এবার একটু স্কিল প্র্যাকটিস করব?”

”স্কিল!” মনে হল বিপিনদা শব্দটা প্রথম শুনলেন। ”স্কিল? কী করবে তা দিয়ে?”

মাথা চুলকে বললাম, ”মানে, খেলতে গেলে স্কিল ছাড়া তো খেলা যাবে না।”

”শোভাবাজার ইউনিয়নে স্কিল?” বিপিনদার মুখ এমন হয়ে উঠল যেন দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে কাউকে জুতো পায়ে ঢুকতে দেখছেন। ”আঠাশটা ম্যাচ খেলে আমরা গতবার সাত পয়েন্ট পেয়েছি, তার আগের বছর পেয়েছিলাম পাঁচ পয়েন্ট। লিগের ওঠা—নামা ছিল না তাই রক্ষে। স্কিল লাগে যারা চ্যামপিয়নশিপ ফাইট করে—মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, যুগের যাত্রী এদের। আমরা ফাইট করি রেলিগেশন, নেমে যাওয়া আটকাতে। স্কিল দিয়ে আমাদের কী দরকার?”

”তা হলে এই যে লম্বা লম্বা কিক প্র্যাকটিস করাচ্ছেন!” আমি অতি বিনীতভাবেই তর্ক করার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করলাম।

বিপিনদা একগাল হেসে বললেন, ”এই হচ্ছে পদ্ধতি, আমার পদ্ধতি। প্রেশারের মধ্যে সব ম্যাচ আমাদের খেলতে হবে। অপোনেন্ট—এর ন’জন আগাগোড়া আমাদের পেনালটি বক্স—এ থাকবে, তখন কী করবে?”

”ক্লিয়ার করব।”

”গুড! গুড! তোমার দেখছি ব্রেন আছে। কিন্তু কীভাবে ক্লিয়ার করবে?”

”কিক করে।”

”ভেএএরি গুড! সেই জন্যই এই লং কিকিং প্র্যাকটিস। এই একটা স্কিলই আমাদের বেশি কাজে লাগে। এর পর গোটা দুয়েক ট্যাকলিং শেখাব, যাও মন দিয়ে এখন বল মারো। তোমার সঙ্গে এসেছে ওই যে ছেলেটা, নাম কী?” বিপিনদা আঙুল তুললেন আনোয়ারের দিকে। নামটা শুনে বললেন, ”গুড প্লেয়ার, স্টপারে ভাল মানাবে।”

বুঝলাম আনোয়ারের চান্স হয়ে গেল। তাতে ভালই লাগল। আমার পোজিশন হল স্ট্রাইকার, আনোয়ার আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।

নিমাইয়ের কাছে গিয়ে বিপিনদার সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে বললাম। শুনে নিমাই বলল, ”আমি মোটেই ঘাবড়াচ্ছি না। লেঙ্গি মারার কায়দা দেখিয়ে চান্স করে নেব। তুই বরং নিজের জন্য ভাব।”

আমি মনে মনে বেশ দমে গেছি। ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবলের সঙ্গে এইভাবে পরিচয় হবে ভাবিনি। ফুটবলের সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো জানব, চর্চা করব, তারিফ পাব, অনেক উঁচুতে উঠব, এই সব যা ভাবতাম বিপিনদা তা চুরমার করে দিলেন। আমি গুটিগুটি মাঠের বাইরে এসে বসে পড়লাম। কেউ আমাকে লক্ষ করল না। চারটে বল নিয়ে মাঠে এখন প্র্যাকটিস হচ্ছে হেডিংয়ের। একজন পর পর কর্নার কিক করে যাচ্ছে, গোলের মুখে দশ—বারোজন হেড করে বল বের করে দিচ্ছে। ওরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, হাসাহাসি, গালিগালাজ করছে। একবার হেড করার জন্য সবাই লাফাল, তার পরই একজন নাক চেপে মাঠ থেকে বেরিয়ে এল। কনুই দিয়ে কেউ মেরেছে। আর একবার, গোলকিপার লাফিয়ে উঠে বল—এ হাত দিয়েও ধরল না। কে তার প্যান্টটা এমন জায়গায় টেনে নামিয়ে দিয়েছে যে গোলের থেকে লজ্জা বাঁচানোটাই সে জরুরি কাজ গণ্য করতে বাধ্য হয়েছে।

নাকে ভিজে রুমাল চেপে সেই ছেলেটি আমার কাছে এসে দাঁড়াল। ডিগডিগে রোগা, বয়সে আমার থেকে বছর ছয়—সাতের বড় হবে। চোখাচোখি হতেই বলল, ”কোন পজিশনের?”

বললাম, ”স্ট্রাইকার।”

”কোথা থেকে?”

”পাড়ার ক্লাব। এই প্রথম গড়ের মাঠে।”

আনোয়ার হঠাৎ তলপেটে হাত চেপে কুঁজো হয়ে গেল। কেউ হাঁটু দিয়ে মেরেছে। ও অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে সামলে উঠল। লক্ষ করলাম, গাঁট্টাগোট্টার দিকে আনোয়ার হিংস্র চোখে তাকাচ্ছে। আমি আঙুল তুলে ছেলেটিকে বললাম, ”আচ্ছা, ওই বেঁটেটার নাম কী?”

”পলাশ টিকাদার। ডেনজারাস ছেলে। গত বছর রেফারিকে চড় মেরেছিল, একজনের পা ভেঙে দিয়েছে, টাকা খেয়ে সেমসাইড গোল করে ম্যাচ হারিয়েছে, টেন্ট থেকে একবার চারটে টেরিলিন ফুলপ্যান্ট একসঙ্গে চুরি করেছে। আমরা ওর থেকে দূরে দূরে থাকি।”

‘আপনার নাকে মারল কে? পলাশ?”

”না, রবি। ছেলেটা ভাল। বিপিনদার ইনস্ট্রাকশন, কী আর করবে।”

লক্ষ করলাম, পলাশ আনোয়ারের থেকে দূরে দূরে রয়েছে। আনোয়ার যতবার ওর পাশে আসছে, ও সরে যাচ্ছে। নিমাই ভিড় থেকে তফাতে।

”আপনি শোভাবাজারে ক’বছর?” আমি কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করলাম।

”পাঁচ বছর হবে।”

”ক্লাব বদলাবেন না?”

ওর মুখ ম্লান হয়ে গেল। রক্তমাখা রুমালটা চোখের সামনে অনেকক্ষণ ধরে থেকে বলল, ”বিপিনদা একটা দোকানে কাজ জোগাড় করে দেবে বলেছে।” তার পর রুমালটা মুঠোয় ভরে, ”এইবার নামি” বলে মাঠের দিকে এগিয়ে গেল।

হেডিং প্র্যাকটিস শেষ হয়ে গেছে। এইবার বোধহয় পার্টি করে খেলা হবে। আমি পা থেকে বুট খুলতে শুরু করলাম।

ফেরার সময়ও আসার মতোই কেউ বিশেষ কথা বললাম না। নিমাই একবার বলেছিল, ”মাঠ থেকে উঠে গেলি কেন? এ সব ক্লাবে অত মেজাজ চলে না।” আর একবার বলেছিল, ”পলাশটা মরবে। আনোয়ারকে যা খেপিয়েছে।”

বাড়িতে মা একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ”কী হল?” মন ভাল ছিল না। দায়সারা জবাব দিলাম, ”প্র্যাকটিস হল খানিকটা দম করার জন্য দৌড়োলুম কিছুক্ষণ। প্রথম প্রথম এই সবই চলবে।”

নীলিমা কোনও প্রশ্ন করেনি, তাতে হাঁফ ছেড়েছি। ওর কাছে ফার্স্ট ডিভিশন সম্পর্কে বলে বলে আমি এমন একটা ধারণা করিয়ে দিয়েছি, ময়দানের ঘেরা মাঠ তিনটে যেন দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট আর ঠনঠনের কালীমন্দির; সেই ধারণাটা প্রথম দিনেই ভেঙে দিলে হয়তো ওর চোখে আমি নেমে যাব।

।।৫।।

সন্ধ্যায় হর্ষদার বাড়ি গেলাম। সব শুনে বললেন, ”আরে বিপিন সিংহী যা করতে বলে, করে যাবি। যা গল্প বলবে, শুনে যাবি। ওর কাছে তো খেলা শেখার জন্য তুই যাসনি। গেছিস একটা ফার্স্ট ডিভিশন টিমে ঢুকে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, এরিয়ান কি যুগের যাত্রীর চোখে পড়তে। সে জন্য একটা ক্লাব তো দরকার। শোভাবাজার না হলে তোর মতো অজানা অনামী একটা জুনিয়ারকে চান্স দেবে কে? স্পোর্টিং ইউনিয়ন কি জর্জ টেলিগ্রাফে গেলেও তো পাত্তা পাবি না।”

”চান্স পাবার থেকেও আমি আগে খেলা শিখতে চাই।”

”ম্যাচ খেলাটাও শেখার পক্ষে দরকারি ব্যাপার। এ—বছরটা একটু নাম কর, পরের বছর এরিয়ান কী ভ্রাতৃসঙ্ঘে চেষ্টা করব। বয়স কম রয়েছে, ছোট ক্লাবে দু—তিন বছর থেকে এক্সপিরিয়ান্স তৈরি হলে বরং সুবিধেই হবে বড় ক্লাবে।”

হর্ষদার সঙ্গে তর্ক করা যায় না। একটা না একটা যুক্তি খাড়া করে চুপ করিয়ে দেবেই। ওকে আমার বলতে ইচ্ছে করছিল—দু—তিন বছরই বা নষ্ট করব কেন ছোট ক্লাবে পড়ে থেকে? আমি এখুনি মোহনবাগানে খেলতে চাই। আমার ফেভারিট টিম মোহনবাগান, আমার স্কুলের পুরনো খাতায় খবরের কাগজ থেকে কেটে চুনি গোস্বামীর ছবি পাতার পর পাতায় সেঁটে রেখেছি। মোহনবাগান টেন্টটাকে দূর থেকে তাজমহল ছাড়া আর কিছু ভাবি না।

গোঁড়া ইস্টবেঙ্গলি নিমাই একবার বলেছিল, ওর স্বপ্ন মোহনবাগানের এগেনস্টে হ্যাট্রিক করা। সে দিন থেকে ওর সম্পর্কে এক টুকরো ঘৃণা মনের মধ্যে জমাট বেঁধেছে। বহু সময় সেটাই নিমাইয়ের বিরুদ্ধে আমার রাগে ফেটে পড়ার কারণ হয়। পরে অবশ্য লজ্জা পাই, কেননা আমায় রাগতে দেখলে নিমাই চুপ করে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। তার পর বলে, ”তোর বড্ড মেজাজ। ভীষণ অধৈর্য তুই।”

আমি জানি, ধৈর্য ধরার মতো মন আমার নেই। সেটা আনোয়ারের আছে। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ও খেলে। অত বড় দেহটা বেড়ালের মতো নাড়াচাড়া করায়। ট্যাকল করে বাঘের মতো রোখ নিয়ে অথচ পরিচ্ছন্নভাবে। কেউ ওকে ফাউল করলে, একবার শুধু তার দিকে তাকায়। সাধারণত তার পর আর ফাউল হয় না। সেই তুলনায় নিমাই মিনিটে একটা—দুটো ছোটখাটো ফাউল করে যাবেই। বেশিরভাগই রেফারির চোখের আড়ালে ঘটে। স্টপারটাকে কিছুতেই নড়ানো যাচ্ছে না, মাঝখানটা এঁটে ধরে আছে, অমনি নিমাই তার পিছনে লেগে গেল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দেখা যাবে, বল ছেড়ে সে নিমাইয়ের পিছু নিয়েছে রাগী মুখে। তার পর আমার কাজ ফাঁকা অঞ্চলটাকে ব্যবহার করা এবং সেটা করেও থাকি।

অসম্ভব ভাল থ্রু দিতে পারে নিমাই, আর বল সমেত টিঙটিঙে শরীরটাকে পাঁকাল মাছের মতো হড়কিয়ে নিয়ে যেতে পারে তিন—চারজন ডিফেন্ডারের মধ্য দিয়ে। ও জানে, আমি কোথায় থাকব। বলটা ঠিক আমার পায়েই ছুটে আসে পোষা কুকুরের মতো। তখন একটা কাজই বাকি থাকে—হয় আলতো করে, নয়তো প্রচণ্ড জোরে বলটাকে গোলের মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া। অনেকে বলে, নিমাই না থাকলে আমি গোল করতে পারব না। শুনে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করি, রাগও হয়। কারুর ওপর নির্ভর করে খেলছি, গোল দিচ্ছি, আমার কোনওই কৃতিত্ব নেই—এটা মানতে চাই না। নিমাইকে আমি সত্যিই ঘৃণা করি। কিন্তু ও তা জানে না। ও আমাকে ভালবাসে।

.

শোভাবাজার ইউনিয়নে আমি প্রথম ১৬ জনের মধ্যে রয়ে গেলাম। আনোয়ার আর নিমাই ফার্স্ট টিমে পর পর সাতটা লিগ ম্যাচে খেলল। সাতটাই আমরা হারলাম। ইস্টবেঙ্গল দিল পাঁচ গোল, ইস্টার্ন রেল চার, কালীঘাট দুই, মহামেডান চার, এরিয়ান পাঁচ, স্পোর্টিং ইউনিয়ন দুই, বি—এন—আর তিন। আমরা একটাও গোল দিতে পারিনি।

আনোয়ার সাতটা ম্যাচই পুরো খেলেছে। বিপিনদার অত্যন্ত ফেভারিট হয়ে উঠেছে ও। সাতটা খেলায় শোভাবাজার ২৫ গোল খেয়েছে। আমার ধারণা, স্টপারে আনোয়ার না থাকলে সংখ্যাটা ৫০ হত। প্রমিসিং হিসেবে ওর বেশ নাম হয়ে গেছে এই ক’টা খেলাতেই। নিমাই দুটো ম্যাচ পুরো খেলেছে, বাকিগুলোয় আধা আর সিকি।

নিমাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার। দু’জন তিনজনকে কাটিয়ে গোলের মুখে অভ্যাস মতো বল ঠেলে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দ্যাখে কেউ নেই, ওদের ব্যাক কিংবা গোলকিপার বলটা ধরেছে। নিমাই মাঠের চারধারে তাকায়। ওর খেলার ধরন একমাত্র যে বোঝে সে তখন মাঠের বাইরে বেঞ্চ—এ ড্রেস করে বসে আছে। নিমাই যত গোল ওপেন করেছে, তার শতকরা নব্বুইটা থেকে আমি স্কোর করতে পারতামই। দেখতে দেখতে চোখে জল এসে যায়। নিমাই অসহায়ের মতন আমার দিকে যখন তাকায়, মুখ ঘুরিয়ে ফেলি।

আমি জানি, ওরও আমার মতন অবস্থা। আমাকে খেলানো হচ্ছে না অথচ ও চান্স পাচ্ছে, তাতেও ও মরমে মরে আছে। তার উপর নিজের যাবতীয় চেষ্টা বিফল হতে দেখে শেষের দিকে নিমাই আর গা লাগায় না। রাগে আমার সর্বাঙ্গ রি রি করে, যখন দেখি উইংগার কি আর এক ইনসাইড ভুল জায়গায় পাস দেওয়ার জন্য নিমাইকে দাঁত খিঁচোচ্ছে।

আমি আর আনোয়ার ওকে বলেছিলাম, তুই নিজেই গোল কর। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলায় নিমাই তিনবার শান্ত আর নঈমের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে সামনে থঙ্গরাজকে পেয়েও গোল করতে পারেনি। দু’বার বাইরে মারল, আর একবার হাতে তুলে দিল। ”কীরকম যেন হয়ে গেলুম”—নিমাই পরে আমাকে বলে, ”অত বড় একটা চেহারা দু’হাত মেলে এগিয়ে আসছে! ভয়ের চোটে তাড়াতাড়ি মেরে দিলুম।”

আমিও রেগেই জবাব দিলাম, ”আর মিথ্যা কথা বলে সাফাই দিতে হবে না। যা বল পেয়েছিলি, তাতে গোলে ইয়াসিন থাকলেও গোল হয়। তুই বাঙাল, তাই গোল করিসনি। আমি যদি মোহনবাগানকে এভাবে পেতুম, বলাই দে সুদ্ধু গোলে ঢুকিয়ে দিতুম।”

নিমাই একগাল হেসে বলল, ”তার পর দু’দিন উপোস করে প্রায়শ্চিত্তি করতিস।” কিছুক্ষণ পর ও গলা নামিয়ে বলল, ”খেলার পর যখন টেন্টে ডেকে নিয়ে গেল জল খাওয়াবার জন্য, তখন পি. সিনহা আমার নাম, কত দিন খেলছি, কোথায় থাকি জিজ্ঞাসা করল। কেন বল তো?”

”সামনের বছর পরিমল দে—কে বিদেয় করে তোকে আনবে বলে।”

নিমাই অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেল। তার পর বেশ রেগেই বলল, ”মোহনবাগানকে গুনে গুনে তিন গোল দেব তা হলে।”

রাজস্থানের সঙ্গে খেলার আগের দিন নোটিশ বোর্ড—এ টিমের লিস্ট—এ আমার নাম উঠল। তিন দিন ধরে আকাশ মেঘলা। বৃষ্টিও হয়ে গেছে দু’দিন। লিস্ট—এ এগারোজনের নামের মাথায় লেখা ‘ইফ রেইন’। পাঁচজনের নামের পাশে পাঁচটি নাম, তাঁদের মাথায় লেখা ‘ইফ নট রেইন’। আমার নাম ‘ইফ নট রেইন’—এর তালিকায়। ব্যাপারটা একজন বুঝিয়ে দিল। বৃষ্টি পড়লে কারা খেলবে আর না পড়লে কারা খেলবে। আমার নামের পাশে টিকাদারের নাম। যদি বৃষ্টি পড়ে তা হলে আমি বাদ, টিকাদার খেলবে।

রাতে ঘুমোতে পারলাম না। ঘন ঘন জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম। তারা দেখা যায় না, ঘোলাটে গঙ্গাজলের মতন আকাশ। কাল বিকেলে বৃষ্টি হবে কি হবে না, ঘেরা মাঠে প্রথম খেলার সুযোগ আসবে কি আসবে না, এই চিন্তা করতে করতে একটা ভয় ক্রমশ আমাকে পেয়ে বসল। কাল নির্ঘাত আমি ওপেন নেট মিস করব। এ রকম আগেও হয়েছে।

.

।।৬।।

চাতরায় একবার ফাইনাল খেলাতে নিয়ে গেছিল পাইকপাড়া অগ্রগামী। সারা রাত চিন্তা করেছিলাম অপোনেন্ট ত্রিবেণী যুব সঙ্ঘের স্টপার আর দুটো ব্যাকের কথা। সেমিফাইনালে চারটে গোল দিয়ে মাঠ থেকে বেরোচ্ছি, তখন যে লোকটি আমায় বলেছিল, ”খোকা, তুমি তো বেশ খেলো! কিন্তু তোমার বাঁ পা যে একদম চলে না!”

পরে শুনলাম তার নাম ‘ল্যাটা মন্টে’। ফাইনালে আমাদের অপোনেন্ট স্টপার। বছর কুড়ি আগে কলকাতা মাঠে খুব নামকরা ফরোয়ার্ড ছিলেন এরিয়ানে। এখন মাঝে মাঝে খেলেন স্টপারে। ওঁর ভাল নামটা কেউ বলতে পারল না। ব্যাক দুটি ক’ মাস আগেই জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমের সঙ্গে এশিয়ান ইয়ুথ চ্যামপিয়নশিপ খেলতে গেছিল ব্যাংকক না সিওল—এ। ওদের সেমিফাইনালের খেলা দেখতে দেখতে পাশের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘রাইট ব্যাকটার কী নাম, দাদা?”

”সুধীর কর্মকার। যে রকম খেলছে নাম করবে মনে হচ্ছে।”

ফাইনালের আগের রাতে ঘুমোতে পারিনি, শুধু মাথার মধ্যে অবিরাম গুনগুন করেছে ল্যাটা মন্টের কথাটা, ‘তোমার বাঁ পা যে একদম চলে না’ আর চোখে ভেসেছে সুধীর কর্মকারের ট্যাকলিং। ফাইনালের দিন সকলে ল্যাটা মন্টে আমাদের ঘরে এলেন। ত্রিবেণী টিম পাশের ঘরেই কাল থেকে রয়েছে। আমাদের নীলেদা ওকে দেখেই খাতির করে বসিয়ে বলল, ”মন্টেদা, আজ খেলছেন তো?”

”ভাবছি। শরীরটা বড় ম্যাজম্যাজ করছে, গঙ্গায় সাঁতার কেটে ফিট না হলে খেলব না। সাঁতারের মতো এত ভাল ‘বডি ফিট’ করার আর কিছু তো হয় না।”

আমার বয়স তখন চোদ্দো। কথাগুলো শোনা মাত্র ‘বডি ফিট’ করার জন্য আনচান করে উঠলাম।

”আমার এক্সপিরিয়ান্স থেকে যা বুঝেছি, বুঝলি নীলে, খেলার দিন কোনও রকম প্র্যাকটিস নয়। সকালে শুধু সাঁতার আর দুপুরে রেস্ট—কষে ঘুম। বিকেলে অদ্ভুত ঝরঝরে হয়ে যায় শরীরটা, ব্রেনও খুব ভাল ফাংশন করে। ফরোয়ার্ডদের তো অবশ্যই সাঁতার কাটা দরকার। হ্যাঁ, তার আগে আচ্ছাসে তেল মেখে ডলাই—মলাই, মানে মাসাজ করে মাসলগুলোকে আলগা করে নিতে পারলে তো কথাই নেই। গোষ্ঠ পাল, সামাদ থেকে শুরু করে পিকে, চুনি সবাই ম্যাচের দিন সাঁতার কাটত। ওরা রোম ওলিমপিক—এ হারল কেন জানিস?”

আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। মন্টেদা একটা সিগারেট ধরিয়ে শতরঞ্চিতে বাবু হয়ে বসলেন। আমাদের রাইট আউট ইস্টার্ন রেলে খেলে, খুব বইটই পড়ে। বলল, ”হাঙ্গেরি টিমে অ্যালবারটো ছিল যে!”

”থাকলেই বা!”

”টিচি ছিল।”

”তাতে কী হয়েছে?”

আমরা খুবই দমে গেলাম কারণটা খুঁজে না পেয়ে। মন্টেদা কষে সিগারেটে টান দিয়ে শতরঞ্চি উলটিয়ে মেঝেয় ছাই ঝেড়ে বললেন, ”যেখানে ইন্ডিয়া টিমকে থাকতে দিয়েছিল, সেখানে সাঁতার কাটার মতো একটা চৌবাচ্চচাও ছিল না। বডি ফিট করতে পারেনি ম্যাচের দিন। চুনি—প্রদীপ সারা সকাল অনেক খুঁজেছিল যদি একটা পুকুর কী ডোবাও পাওয়া যায়! পায়নি।”

আমি বললাম, ”ম্যাচের দিন চুনি কি সাঁতার কাটে?”

”নিশ্চয়! ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, ওর অমন ডজ, অমন স্পিড, অমন ব্রেন হয় কী করে? সবই মা গঙ্গার কৃপায়। যে জলে কারেন্ট আছে, সেখানে সাঁতার কাটার উপকারিতা যে কী, তা তো জানো না? অরুণ ঘোষ এমন দারুণ খেলে কী করে? শিবপুরে বাড়ি, পা বাড়ালেই গঙ্গা।”

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মন্টেদা উঠলেন, ”যাই, তেলটেল জোগাড় করিগে।”

নিমাই নেই। আনোয়ার আর আমাকে পাইকপাড়া অগ্রগামী খেলাতে এনেছে। আনোয়ারকে বললাম, ”যাবি গঙ্গায়?” ও আঁতকে উঠল, ”গঙ্গায়! আরে বাপস! চৌবাচ্চচায় পর্যন্ত নামি না—সাঁতার জানি না বলে।”

কিন্তু ইস্টার্ন—এর রাইট আউট আর স্পোর্টিং ইউনিয়নের লেফট হাফব্যাক সরষের তেলের খোঁজে ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। আধ কিলো নিয়ে আমরা চারজন চাতরার গঙ্গার ঘাটে বসে মন্টেদার কথামতো মাসলগুলোকে আধ ঘণ্টা ধরে আলগা করে জলে যখন নামলাম, মন্টেদা তখন ছোট্ট একটা তেলের বাটি হাতে ঘাটে এসে বসলেন। বেশ আরামে সাঁতার কাটা শুরু করলাম।

মন্টেদা চিৎকার করে বললেন, ”ঘাটের কাছে ফুরফুর করে মেয়েদের মতো সাঁতার! তোরা কি ফুটবলার না, লুডো প্লেয়ার?”

প্রবল বিক্রমে আমরা মাঝ গঙ্গার দিকে রওনা হয়ে গেলাম এবং আধ ঘণ্টা পরে যখন ফিরলাম, তখন দম ফেলতে পারছি না। মন্টেদা বাহুতে মালিশ করতে করতে বললেন, ”এই তো, একেই বলে সাঁতার। এখন রেস্ট, জলে ফ্লোট করো এবার।”

অতঃপর আমরা চিত হয়ে জলে ভাসতে শুরু করলাম। মিনিট দশেক পর পাড়ের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। ভাঁটার টানে চাতরা—ঘাট থেকে বহু দূরে চলে এসেছি। টানের বিরুদ্ধে সাঁতরে ফিরে এসে ঘাটের সিঁড়িতেই আমরা এলিয়ে পড়লাম।

মন্টেদা জলে নামতে নামতে গম্ভীর হয়ে বললেন, ”এবার ভাত খেয়েই শুয়ে পড়বে। মনে রেখো, বিকেলে ফাইনাল খেলা।” তার পর কানে আঙুল ঢুকিয়ে কয়েকটা ডুব দিয়েই তিনি উঠে পড়লেন।

গনগনে খিদে পেয়েছিল। গোগ্রাসে ভাত আর মাংস খেয়েই শুয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙিয়ে দিল, সারা টিম তখন ড্রেস করে মাঠে রওনা হবার জন্য তৈরি। সর্বাঙ্গে ব্যথা, মাথা ঝিম ধরে আছে, চোখে ঘুম জড়ানো, পেট ভার। ডাক ছেড়ে আমার কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করল।

থ্রু বাড়িয়ে দিচ্ছে, ছুটতে পারছি না, হেড করার জন্য শরীর তুলতে পারছি না, সামান্য সাইড—পুশেই ছিটকে পড়ছি, ভলি মারতে পা উঠছে না। মাত্র দশ গজ দূরে একবার ফাঁকা গোল পেয়েও শট নেবার আগেই সুধীর কর্মকার পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে গেল। মাঠের চারদিক থেকে টিটকারি আর গালাগাল, বিশেষ করে আমাকেই। কেননা মাঠের মধ্যে সব থেকে বয়স্ক মন্টেদা যে রকম অনায়াসে সব থেকে কনিষ্ঠকে বোকা বানাচ্ছেন, তাতে দর্শকরা মজাই পাচ্ছিল, শুধু পাইকপাড়া অগ্রগামীর অফিসিয়ালরা ছাড়া। হাফ টাইমে আমাকে এবং লেফট হাফ ব্যাককে বসানো হল।

বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত লজ্জায় আমি আর মাথা তুলতে পারিনি। আনোয়ারকে হিংসে করেছিলাম সাঁতার না জানার জন্য। বাঘের মতন ও খেলেছিল। ত্রিবেণী ২—০ গোলে জিতেছিল। প্রথম গোলটা পেনালটি থেকে; মন্টেদা পেনালটি কিক করেন। আনোয়ার পরে বলেছিল, বলটা স্পটে বসিয়ে মন্টেদা একবার গোলকিপারের দিকে তাকান। গোলকিপার দেখল মন্টেদার চোখ ট্যারা। বেচারা ভ্যাবাচাকা খেয়ে কোন দিকে পজিশন নেবে বুঝতেই পারেনি। তার বাঁ দিকে তিন হাত দূর দিয়ে বল গোলে ঢোকে, সে ডান দিকে ডাইভ দিয়েছিল।

রাজস্থানের সঙ্গে খেলার আগের দিন রাত্রে জানলা দিয়ে গঙ্গার মতন ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার চাতরার ফাইনালের কথা মনে পড়ল। আর হাসি পেল। ওপেন নেট মিস করেছিলাম। কাল করব না, হে ভগবান কাল বৃষ্টি দিও না। আমি ‘ইফ নট রেইন’—এর লিস্টে আছি। জীবনের প্রথম ঘেরা মাঠে খেলার সুযোগটা নষ্ট করে দিও না। তার পর শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

।।৭।।

সকালে উঠে দেখি, কখন যেন বেশ ভালই বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশে মাঝে মাঝে নীল রঙের ছোপ। মেঘ অনেকটা কেটে গেছে। শরীরটা ঝরঝরে তাজা লাগল। মাকে বললাম, ”আজ আমার খেলা আছে।”

কথাটাকে মা গুরুত্ব দিলেন না। খেলা আমার প্রায় রোজই থাকে। বললাম, ”আজ প্রথম খেলব ফার্স্ট ডিভিশনে।”

মাকে আজ অন্যমনস্ক লাগল। খুবই সাধারণভাবে বললেন, ”ভাল করে খেলিস।”

আশা করেছিলাম উৎসাহে মা’র চোখমুখ ঝলসে উঠবে, কিন্তু কিছুই হল না। অভিমানে আর ওই প্রসঙ্গ না তুলে বললাম, ”খাবার আছে?” মা’র মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ব্যাপারটা আমি বুঝলাম এবং রেগে উঠলাম। কিন্তু কার উপর রাগ করব ভেবে পেলাম না। অরুণা গ্লাস ফ্যাক্টরি? যেখানে লক আউট চলছে আর তুই বাবা বেকার! বাবা এখন দোকানে সামান্য একটা কাজ করেন, যা পান তাতে দু’বেলা কয়েকটা রুটি ছাড়া আর কিছু আমাদের জোটে না।

পিন্টু বুঝতে শিখেছে আমরা দরিদ্র, ওর হাবভাবে এখনই যেন কেমন বুড়োটে ছাপ পড়ে গেছে। বায়না, আবদার বা অভিমান কী রাগারাগি একদম করে না, গম্ভীর হয়ে শুকনো মুখে বেরিয়ে যায়। শুধু কান্নাকাটি জুড়ে দেয় পুতুলটা। তখন নীলিমা ওকে টেনে নিয়ে যায় নিজেদের ঘরে। কিছুক্ষণ পরে দেখা যায় পুতুল খেলা করছে। নীলিমার মা দু’ বছর আগে মারা গেছেন। সেই থেকে সে সংসারের কর্ত্রী। বাবা টাকা এনে ওর হাতে দেয়, নীলিমা গুছিয়ে হিসেব মতো খরচ করে।

রাগটা শেষ পর্যন্ত নিজের উপরই এসে পড়ে। আমারও তো কিছু করণীয় আছে। আজ পর্যন্ত আমি শুধুই নিয়েছি, কিছুই দিইনি। ক্লাস টেনে ফেল করে পড়া ছেড়ে দিয়েছি। স্কুল ভাল লাগে না, তা ছাড়া আমি বুঝে নিয়েছি লেখাপড়া করার মতন মাথাও আমার নেই। আমি ফুটবল খেলতে ভালবাসি; শুধু ফুটবলই খেলি। তাতে বাবা, মা, ভাই, বোন—কারও কোনও উপকারই হয় না।

সংসারে বিন্দুমাত্র সাহায্যও আমি করতে পারি না! মাঝে মাঝে নিজেকে ফালতু মনে হয়। শুধু আড্ডা আর খেলা! কোন মুখে আমি সংসারে দু’মুঠো ভাত দাবি করব? ফুটবল এখনও আমাকে কিছু দাবি করার মতন জোর দেয়নি। আমার সামনে টাকা রোজগারের একমাত্র পথ খোলা রয়েছে, মাঠে। বড় ফুটবলার না হতে পারলে দেশে আমি আর একটা অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়াব মাত্র।

তীব্র একটা জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে ড্রেস করে ফুটবলটা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ঢালাই লোহার নানা রকম জিনিস তৈরির একটা কারখানা মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই, তার গায়ে ছোট এক খণ্ড জমি আমাদের প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড। এই জমিতেই ফুটবল খেলা শুরু করি। পিন্টু রাস্তায় তার বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল তর্ক করছিল, কানে এল ওর চিৎকার—’য্যা য্যা, জারনেলের মতন স্টপার হতে গেলে নঈমকে আবার নতুন করে খেলা শিখে আসতে হবে।”

আমাকে দেখেই পিন্টু ছুটে এল, ”দাদা, যাব তোর সঙ্গে?”

”আয়।”

বলটা আমার হাত থেকে ও নিয়ে নিল। ক্লাব থেকে বলটা চেয়ে নিয়ে রেখেছি। দুটো তাপ্পি দেওয়া, আকারে অনেকটা পেয়ারার মতন। সকাল বা দুপুরে যখনই পারি রোজ একা একা স্কিল প্র্যাকটিস করি। মাঝে মাঝে পিন্টু আর তার বন্ধুরা আমার সঙ্গী হয়।

আগে বাঁশের কঞ্চি চার হাত অন্তর পুঁতে বল নিয়ে এঁকেবেঁকে ড্রিবল প্র্যাকটিস করতাম। হর্ষদা একদিন বললেন, ”গ্যারিনচাকে এভাবে প্র্যাকটিস করতে বলায়, সে নারাজ হয়ে বলে, ‘অপোনেন্ট তো আর খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না, সে নানাভাবে বাধা দেবেই, কাজেই প্র্যাকটিস করতে হলে সচল মানুষের সঙ্গে ড্রিবল করা দরকার’।”

কথাটা আমার মনে ধরেছিল। সেই থেকে আমি পিন্টু আর তার বন্ধুদের পেলেই প্র্যাকটিসে ডাকি। আজ ওর বন্ধুরা কেউ এল না। কারণ জিজ্ঞাসা করতে ইতস্তত করে পিন্টু বলল, ”দরকার নেই ওদের আসার।”

”কেন, কী হল? ঝগড়া হয়েছে?”

পিন্টু চুপ করে রইল। খানিকক্ষণ পর বলল, ”তুমি নাকি একদিনও খেলায় চান্স পাওনি, বসিয়ে রেখে দিয়েছে। আনোয়ারদা আর নিমাইদা রোজ খেলে?”

আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল, ”হাঁটুতে চোট রয়েছে। প্র্যাকটিসে টিকাদার বলে একজন এমন ট্যাপ করেছে যে ভাল করে এখনও শট নিতে পারি না।”

পিন্টুর মুখ স্বস্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আর আমি মনে মনে কুঁকড়ে গেলাম। ওর কাছে আমি হিরো, আর সেটা বজায় রাখতে মিথ্যে কথাগুলো আপনা থেকেই কেন বেরিয়ে এল, ভেবে পেলাম না। হয়তো ভয়ে। প্রচণ্ড এক স্ট্রাইকার আমার ইজ্জতের ডিফেন্স ভাঙবার জন্য আঘাত হানতে উদ্যত। আমি একটা বিশ্রী ফাউল করে তাকে আটকালাম।

.

কারখানার তিনতলা সমান উঁচু দেয়ালটাকে গোল বানিয়ে টারগেট শুটিং করি। ইট দিয়ে দাগ টেনে মাটি থেকে ৮ গজ × ৮ ফুট একটা ঘর করে সেটাকে ছয় ভাগ করে ১, ২, ৩ লিখে দিয়েছি। পিন্টু বা আর কেউ চেঁচিয়ে নম্বর বলে আর আমি শট করি। দেয়ালে লেগে বল ফিরছে, তখন আবার চেঁচিয়ে নম্বর বলে, আমি ফিরতি বল না থামিয়ে হেড দিয়ে কী শট করে আবার টারগেটে পাঠাই। এভাবে মিনিট দশেকেই হাঁফিয়ে যাই। একটু জিরিয়ে আবার শুরু করি। এভাবে প্র্যাকটিস করতে হর্ষদা আমায় বলে দিয়েছিলেন। কোনও দিন শুধুই পেনালটি শট করি গুনে গুনে একশোটা, কিংবা চিপ করি, কেউ বল ছুড়ে দেয় হেড করি, ভলি মারি আর পিন্টুর পাঁচ—ছ জন বন্ধুর সঙ্গে ড্রিবল করি।

আজ শুধুই পিন্টু। গোলে অর্থাৎ দেওয়ালে শট করছি, পিন্টু পিছন থেকে নম্বর বলছে। বল মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে ছিটকে গেলে আমিই ছুটে কুড়িয়ে আনছি। এক সময় দেখি, নীলিমা দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। বুকের কাছে বইয়ের গোছা, পরনে নীলপাড় সাদা শাড়ি। স্কুল থেকে ফিরছে। শাড়ি পরলে ওকে কিছুটা বড় দেখায়। ওর স্কুলটা মাইলখানেক দূরে। বাসে দশ পয়সা ভাড়া, যাতায়াতের সেই কুড়িটা পয়সা বাঁচাবার জন্য হেঁটে যায় আর আসে।

বলটা রাস্তার দিকে যেতেই নীলিমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। ও হাসল। আমি বললাম, ‘স্কুল থেকে?” ও ঘাড় নাড়ল। মুখটা শুকনো। কপালে কয়েকটা চুল ঘামে সেঁটে রয়েছে। আঁচল দিয়ে গলা ও ঘাড়ের ঘাম মুছল।

”আমার স্কুল বসবে বিকেলে!” বলে আমি হেসে উঠলাম।

”তাই বুঝি পড়া তৈরি করছ?” নীলিমার সাজানো দাঁতগুলো ঝকঝকে করে উঠল।

”আমি খুব খারাপ ছাত্র, প্রমোশন পাব কি না জানি না!” হতাশার ভান করে বললাম।

”খাটলে পাশ করবেই করবে।”

নীলিমার স্বরে, চোখে, এমনকী দাঁড়াবার ভঙ্গিতে আর পরিহাস নই। আমার ভিতরে আলতোভাবে একটা প্রত্যয় পাখির মতন ডানা মেলে ভেসে এল। হাতের বলটাকে হঠাৎ কিক করে সোজা শূন্যে তুলে দিলাম। পিন্টু চিৎকার করে উঠল, ”তিন।”

একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে ফেললাম। চিত হয়ে মাটিতে শুয়ে বলটাকে ব্যাক ভলি করলাম। এভাবে জীবনে কখনও মারিনি। আশ্চর্য, আশ্চর্য, তিন নম্বর টারগেটের মাঝখানে বলটা দুম করে লেগে ফিরে এল। পিন্টু দু’ হাত তুলে চিৎকার করে বলটার পিছু ধাওয়া করল। নীলিমার বড় বড় চোখ দুটো আরও বড় হয়ে গেছে, আর আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমিই প্রসূন ভটচাজ কি না!

”দাদা আর একবার।” পিন্টু আমার কাছে বলটা পাঠিয়ে দিয়ে বলল।

ভালভাবেই জানি, ব্যাপারটা আন্দাজে এবং ভাগ্যের জোরে হয়ে গেছে। আর একবার করতে গেলে, কারখানার চালার উপর দিয়ে বল উড়ে যাবে কি রাস্তার ওপরে পড়বে, তা ভগবানও জানে না।

”হাঁটুতে একটা চোট আছে, এখনও ভাল করে সারেনি।” নীলিমাকে বললাম, ”ফট করে যদি লেগে যায়…”

”না না, আর করতে হবে না!” নীলিমা ব্যস্ত হয়ে বলল।

”আর একবার মারি।”

”না না, আগে পুরোপুরি সারুক।” নীলিমা হাত তুলে বারণ করল। আমি হাঁফ ছাড়লাম। স্ট্রাইকারকে আটকাতে ছোটখাটো ফাউল করাটা খেলার মধ্যেই পড়ে।

”বড্ড খিদে পেয়েছে।” পেটে হাত দিয়ে চোখ মুখ করুণ করে তুললাম। আমি জানি, নীলিমার সঙ্গে ছোট্ট একটা প্লাসটিকের পয়সা রাখার ব্যাগ সব সময় থাকে।

”অমনি খিদে পেয়ে গেল, পড়া শুরু করতে না করতেই!” দু’ আঙুলে ব্লাউজের মধ্যে থেকে ব্যাগটা বার করতে করতে নীলিমা ধমকে উঠল। খুট করে ব্যাগের বোতামটা খুলে ও বলল, ”বেশি নেই, তিরিশটা পয়সা বড়জোর দিতে পারি।”

”মোটে তিরিশ! এমন একটা ব্যাক ভলি দেখালাম!”

”আচ্ছা, পঁয়ত্রিশ।”

”না, না, প্লিজ, আট আনা করো। বদুর দোকানে চারটে কচুরি আর দুটো জিলিপি। ভীষণ খিদে!”

এবার আর ভান নয়। আন্তরিকতার সঙ্গেই বললাম। নীলিমা আমার মুখ দেখেই বুঝল এবং একটি আধুলি দিল।

”ধার রইল।”

”এই নিয়ে কত হল?” গম্ভীর হয়ে নীলিমা বলল।

”হিসেব রেখো, সব একবারে শোধ করে দেব।”

নীলিমা বাড়ি চলে গেল। গত এক বছরে অন্তত পঞ্চাশ—ষাট টাকা এইভাবে ওর কাছ থেকে নিয়েছি। প্রতিবারই বলেছি, লিখে রেখো, সব শোধ দিয়ে দেব। নিশ্চয়ই দেব। আমার এই পরিশ্রম বৃথা যাবে না, যেতে দেব না।

পয়সা হাতে আসতেই খিদেটা চনচনে হয়ে চাড়া দিল। বলটা পিন্টুকে দিয়ে বললাম, ”বাড়ি চলে যা।”

”আর খেলা উচিত নয়। চোটটা আবার চাগিয়ে উঠতে পারে।” বিজ্ঞের মতন পিন্টু আমাকে উপদেশ দিল। হাসি পেলেও হাসলাম না আমি। পিন্টু বল নিয়ে ধাপাতে ধাপাতে চলে গেল।

মিনিট পনেরো পরে বদুর দোকানে গরম কচুরি আর জিলিপি খেয়ে জলের গ্লাসটা হাতে নিয়েই মনে পড়ল, পিন্টুরও খাওয়া হয়নি আজ। পাথর হয়ে গেল আমার সর্বাঙ্গ। শুধু পেটের মধ্যেটা মুচড়ে উঠল।

.

।।৮।।

আমি আর পলাশ টিকাদার পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আবার আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশের উত্তর আর পুব নীলে—ধূসরে মাখা। কিন্তু দক্ষিণ—পশ্চিমে গাঢ় কালো মেঘ। বাতাস বইছে না। ভ্যাপসা গরমে আমরা ঘামছি। বৃষ্টি হবে কি হবে না, বোঝা যাচ্ছে না। আমার প্রথম খেলার ভাগ্য লেখা রয়েছে আকাশে।

ঠাণ্ডা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। মেঘটা ছড়িয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে—তার একটা কোণ মহমেডান মাঠের দিকে। টিকাদারের মুখ খুশিতে ভরে উঠল। বুট পরার জন্য সে টেন্টের ভিতরে চলে গেল। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেঘটা ছড়াচ্ছে পশ্চিম দিকে, হাওয়া বইছে পশ্চিমে। হাঁফ ছাড়লাম।

বুট পরে টেন্ট থেকে বেরিয়ে টিকাদার আকাশে তাকিয়েই বিরক্ত হল। আমার মুখে ক্ষীণ হাসি দেখে সে আবার টেন্টে ঢুকে গেল। এর দশ মিনিট পরেই এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে ভেসে পালাল একটা ছোট্ট মেঘ। আমি বুট হাতে শুকনো মুখে টেন্টের এক কোণে দাঁড়িয়ে। নিমাই বুট পরতে পরতে আমাকে লক্ষ করছিল। কাছে এসে বলল, ”খেলবি আজ?” জবাব না দিয়ে আমি মুখ ঘুরিয়ে টেন্টের বাইরে চলে গেলাম।

মিনিট পাঁচেক পরই বিপিনদা ব্যস্ত হয়ে আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন!

”কাণ্ড দ্যাখো তো, খেলার ঠিক আগেই বমি শুরু হল। প্রসূন কোথায়, প্রসূন … এই যে দ্যাখো তো নিমাইয়ের কাণ্ড! যাও, যাও ড্রেস করো।”

বেঞ্চে নিমাই শুয়ে। হাত দিয়ে চোখ ঢাকা। হঠাৎ নাকি বমি করতে শুরু করেছে। ড্রেস করে বেরোবার সময় আনোয়ারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ”কী হল রে?”

নির্বিকার ভাবে আনোয়ার বলল, ”আধ শিশি আইডিন খেলে বমি তো হবেই।”

শোনামাত্র বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। শুধু বললাম, ”বাঙালটা সব পারে।” নিমাইয়ের কাছে গিয়ে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললাম, ”গুনে গুনে তিনটে গোল দেব।”

চোখ থেকে হাত না সরিয়ে নিমাই বলল, ”মোহনবাগানকে তো?”

”না—” শেষ করার আগেই থেমে গেলাম। হাত নামিয়ে নিমাই জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।

বললাম, ”আজকে।”

.

আমি হ্যাট্রিক করতে পারলাম না প্রথম খেলায়। শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাদের ডিফেনডিং জোনে নেমে এসে আমাকে ট্যাকল করতে হল রাজস্থানের হাফ ব্যাকদের। আনোয়ারের দু’ পাশ দিয়ে দুটো ছেলে, সুকল্যাণ আর সুভাষ বেরোচ্ছে। আমরা দশজন পেনালটি বক্সেপনেরো মিনিটের মধ্যে পাঁচ গোল খেয়ে যাওয়ার কথা। সুকল্যাণের ডান পা থেকে বেরোনো রতিনটে গোলার একটা পোস্টে, একটা আনোয়ারের কাঁধে আর অন্যটা কোন জাদুমন্ত্রে জানি না, বারের উপর দিয়ে তুলে দিল গোলকিপার। বাকি দুটো নষ্ট করল সুভাষ নিজেই। তার পর ১৮ মিনিটে কীভাবে যেন একটা বল ছিটকে সেন্টার লাইনের কাছে চলে এল। আমি বলটা ধরে রাজস্থান গোলের দিকে তাকিয়ে দেখি—গোলকিপার আর আমার মাঝে শুধু ওদের স্টপার ব্যাক ফেন।

মাঝ—মাঠ থেকে আমি বল নিয়ে দৌড়োতে শুরু করলাম, একটু কোনাকুনি, ডান দিকের কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে। ফেন আমার সঙ্গেই দৌড়চ্ছে, তার বাঁ দিক কভার করে। লেফট ব্যাক নেমে আসছে। বয়স্ক ফেনকে মুখোমুখি কাটাতে পারব বলে ভরসা হল না। স্পিডে হারাব স্থির করেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলটা বাঁ দিকে প্রায় পনেরো গজ ঠেলে দিয়ে ফেনকে ডান দিক থেকে প্রচণ্ড দৌড়ে পিছনে ফেলে দিলাম। পেনালটি বক্স—এর মধ্যে যখন ঢুকছি, গোলকিপার অরুণ তীরবেগে এগিয়ে আসছে! সেই সঙ্গে দু’ পাশ থেকে দুই ব্যাক।

আমি শুধু অরুণের শরীরের ভঙ্গিটা লক্ষ করলাম। লাফ দেবার আগে বেড়াল যেমন করে, সেই রকম শরীরটাকে ধনুকের ছিলার মতন টেনেছে। আমি বাঁ দিকে হেলে যাওয়া মাত্রই ও দু’হাত বাড়িয়ে ভেসে এল। আমি মুহূর্তে ডান দিকে বলটাকে টেনে নিলাম এবং ডান পায়ের নিখুঁত নিচু পানচ—এ ডান পোস্ট ঘেঁষে বলটাকে গোলের মধ্যে পাঠালাম আর সেই সঙ্গেই লেফট ব্যাকের প্রচণ্ড চার্জে মাটিতে ছিটকে পড়লাম।

আমার প্রথম গোল! মাটিতে কাত হয়ে এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটার দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আর জালের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বাদামি রঙের ওই গোলাকৃতি বস্তুটা কী নিরীহভাবে বিশ্রাম করছে। আমার সারা পৃথিবী এখন মনে হচ্ছে ওই বলটা। ইচ্ছে করছিল বলটাকে দু’ হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরি।

আমাকে তুলে ধরল দুজনে। রাইট উইং আর রাইট ইনসাইড আনোয়ার। দু’ হাত তুলে ছুটে আসছে। আমার মাথা ঘুরছে তখন। আনোয়ার কী সব বলতে বলতে গালে চুমু খেল। মেম্বার গ্যালারির দিকে তাকালাম। গোটা পঞ্চাশেক লোকও হবে না। মাত্র এই ক’জন সাক্ষী রইল আমার প্রথম গোলের। শোভাবাজারের গোটা টিমটাই আমাকে জড়িয়ে ধরছে, পিঠ চাপড়াচ্ছে। গ্যালারি থেকে কে একজন চিৎকার করে ঠাট্টা করল, ”হয়েছে রে হয়েছে, এবার সেন্টার কর, যেন শিল্ড পাবার গোল দিয়েছিস!” শুনে আমি খুব লজ্জা পেলাম।

দু’ মিনিটের মধ্যেই রাইট উইং—এর ক্রস সেন্টার থেকে সুভাষ হেড করে গোল করল। পরের মিনিটেই আবার একটা একইভাবে হেড করে। হাফ টাইম—এর সময় বিপিনদা এসে উত্তেজিতভাবে আমায় নির্দেশ দিলেন, ”নামবে না তুমি, একদম নামবে না সেন্টার লাইনের এধারে। গোল খাই খাব, তুমি উঠে থাকবে। আর রতন, তুই শুধু বল বাড়াবি।”

রতন হচ্ছে সেই ছেলেটি, প্রথম দিনে যার নাক ফাটতে দেখেছি প্র্যাকটিসের সময়, আর যাকে বিপিনদা একটা চাকরি দেবেন বলেছেন। রতন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তার ক্লান্ত শরীরটা মাটিতে শুইয়ে চোখ বুজল।

একটা অ্যালুমিনিয়ামের গেলাশ আর এক বালতি জল। একজন জল খেয়ে গেলাশটা আর একজনের হাতে দিচ্ছে, সে বালতিতে ডুবিয়ে জল তুলে খাচ্ছে। গেলাশের জন্য অপেক্ষা করছি, তখন টিকাদার বলল, ”খাওয়াচ্ছিস তো আজ!”

”কেন?” বিরক্ত হয়ে বললাম।

”সিজনে শোভাবাজারের প্রথম গোল স্কোর করলি!”

আমি ফিকে হেসে জলের গেলাশের জন্য হাত বাড়ালাম। টিকাদার বলল, ”টিমে আমার জায়গাটা তো খেলি, কমপেনসেট করবি না?”

শুনে আমার ভালই লাগল। বললাম, ”আজ নয়, আর একদিন।”

মাঠে নামবার আগে একবার গ্যালারির দিকে তাকালাম। একেবারে মাথায় এক কোণে কুঁজো হয়ে নিমাই বসে। ওকে আমরা টেন্টের মধ্যে শুইয়ে রেখে বেরিয়েছিলাম। আমায় তাকাতে দেখে চট করে ও হাত তুলল। দেখলাম হাতের আগায় তিনটে আঙুল উঠে রয়েছে।

সুভাষের হ্যাট্রিকের জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে ওরা আরও দুটো গোল নষ্ট করার পর সুকল্যাণ হঠাৎ একটা গোল করে মুষড়ে পড়ল। ও বুঝতেই পারেনি পনেরো গজ দূর থেকে মারা বলটা বিনা বাধায় গোলে ঢুকে যাবে। সুভাষ বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের ঘুষি মেরে রাগে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে ফিরে গেল এবং দু’ মিনিটের মধ্যেই আনোয়ারকে ছিটকে ফেলে দিল শোল্ডার চার্জে।

আমার কিন্তু অবাক লাগল রতনকে। বিপিনদার নির্দেশই শুধু নয়, ও যেন নিজের দলের বাকিদের কথাও ভুলে গেছে। বল পেয়ে ও একাই ছুটছে। আমি চেঁচাচ্ছি বলের জন্য, কিন্তু রতন কানেই নেয় না। জিরজিরে বুকটা হাপরের মতন ওঠানামা করছে, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে, মুখ লাল, ঘাম গড়াচ্ছে রগ বেয়ে থুতনি পর্যন্ত। তবু রতন তাড়া করছে, বল ধরে আবার একাই এগোচ্ছে এবং যথারীতি ওর পা থেকে বল ওরা কেড়ে নিচ্ছে। কিছু যেন ভর করেছে ওকে, সারা মাঠ চষছে, কিন্তু বোকার মতন, অযথা। আমি অধৈর্য, বিরক্ত হয়ে পড়ছিলাম। মাঠের বাইরে থেকে বিপিনদার চিৎকার কানে এল, ”বল ছাড়, রতন! বল ছাড়, প্রসূনকে দে!”

রতন বল ছাড়ার বদলে নিজেই মাঠ ছাড়ল। পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছিল না। দু—তিনজনে ওকে ধরে মাঠের বাইরে রেখে এল আর ওর জায়গায় নামল টিকাদার। তার পরই রাজস্থান পেনালটি পেল। ওদের লেফট আউট আমাদের দুজনকে কাটিয়ে গোল পোস্টের কাছে এসে ব্যাক সেন্টার করতে যাবে, টিকাদার তার পেটে লাথি মারল। পেনালটি থেকে গোলটা করল সুভাষ।

৪—১ গোলে এগিয়ে থেকে ওরা এবার একটু আলগা দিল। আমি দু’বার বল পেয়েও কিছু করতে পারলাম না। রাইট উইং—এর একটা ক্রস পাস ভলি মেরে বারের উপর দিয়ে পাঠালাম। আর একবার দুজনকে কাটিয়ে সামনেই পড়ল ফেন। পাশে কেউ নেই যে ওয়াল করব। তাড়াতাড়ি পেনালটি বক্সের মাথা থেকেই গোলে মারলাম, অরুণ আঙুলের ডগা দিয়ে বলটা তুলে বারের ওপারে পাঠিয়ে দিল।

আমার তখন নিমাইয়ের কথা মনে হল। নিমাই থাকলে, ওকে বলটা ঠেলেই ডান দিকের পোস্ট—এর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ বরাবর আমার জায়গায় চলে যেতাম। নিমাই ঠিক বলটা পাঠিয়ে দিত আমার এক গজ সামনে। তার পর শরীরটাকে বাঁ দিকে একটু হেলিয়ে ডান পা—টাকে পিছনে এক ফুট তুলে বিদ্যুৎ গতিতে একটি ছোবল।

খেলার শেষ বাঁশি বাজার পর মাঠেই আনোয়ার আর টিকাদারের মধ্যে একটা খণ্ডযুদ্ধ প্রায় বেধে যাচ্ছিল। কারণ সেই পেনালটি। আনোয়ারের মতে, টিকাদার অযথা গোল খাইয়েছে লাথিটা মেরে। লেফট আউট ব্যাক—সেন্টার করতই, কিন্তু তা থেকে গোল নাও হতে পারত, চান্স পাওয়া যেত ক্লিয়ার করার। কিন্তু পেনালটি করিয়ে টিকাদার রাজস্থানকেই শিওর চান্স করিয়ে দিয়েছে।

জবাবে টিকাদার কতকগুলো অশ্রাব্য শব্দ উচ্চচারণ করল, তখন আনোয়ার তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। টিকাদার ভয়ংকর চোখে আনোয়ারের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে, দাঁত চেপে ‘আচ্ছা, দেখা যাবে—’ বলে মাঠ থেকে বেরিয়ে এল।

নিমাই গ্যালারি থেকে নেমে এসেছে। বিপিনদা আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘বেশ, বেশ, ভালই খেলেছ।’ রতন আমার দিকে অদ্ভুত চোখে একবার তাকাল। কেমন বিষণ্ণতা আর ভয় ওর চাহনিতে। দুটো টোস্ট আর একটা সিদ্ধ ডিম খেয়ে যখন আমরা তিনজন বাড়ির পথে রওনা হচ্ছি, রতন ইশারায় আমাকে ডাকল।

”তুমি গরিব ঘরের ছেলে, আমিও তাই”, রতন ভারী এবং স্থির স্বরে বলল, ”এখানে টাকা দেয় না, সুতরাং তুমি নিশ্চয়ই পরের বছর অন্য ক্লাবে যাবে। যাবেই, আমি জানি। তোমার খেলা আছে, তুমি এখানে পচে মরবে কেন!”

আমি চুপ করে রইলাম। রতন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ”একটা চাকরি দেবেন বলেছেন বিপিনদা।”

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম, ”জানি।”

”তুমি যদি চাকরি চাও, তা হলে বিপিনদা আগে তোমার জন্যই চেষ্টা করবেন। আমি জানি, আজ তোমার খেলা দেখে বুঝতে পেরেছি।” রতনের স্বর হঠাৎ করুণ দুর্বল হয়ে এল। কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে আমার হাতটাও চেপে ধরল, ”চাকরিটা আমার দরকার! আমার বাড়িতে ভীষণ খারাপ অবস্থা, আমার আগে চাকরিটা দরকার, প্রসূন। কথা দাও, তুমি এখানে কিছু চাইবে না। কথা দাও, তুমি এখানে সামনের বছর থাকবে না।”

আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম, ”আমি এখানে থাকতে আসিনি। আরও বড় হতে চাই। বড় ক্লাবে যেতে চাই।”

রতন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হাতে চাপ দিয়ে বলল, ”কোথায় যেতে চাও, আমার অনেক চেনা আছে। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, এরিয়ান, যুগের যাত্রী?”

”মোহনবাগানে।”

”এখনই? না, আর একটা বছর অন্তত কোথাও কাটাও। তুমি এখনও নেহাতই জুনিয়ার। এখনই অত বড় ক্লাবে যেয়ো না, বসিয়ে রাখবে। এখন একটা বছর নষ্ট হওয়া মানে ভীষণ ক্ষতি। দেখছ না, আমার অবস্থা। লোভে পড়ে বড় ক্লাবে একদিন আমিও গেছলুম। বসিয়ে রেখে দিল। বড় ক্লাবের মোহ ছাড়তে পারলুম না। আশায় আশায় পরের বছরও রইলুম। একটা মাত্র ম্যাচ খেলালে। তাও আধখানা। তার পর উয়াড়ি, তার পর এখানে। আমারও ইচ্ছে ছিল তোমার মতন—আরও বড় হব।”

রতনের স্বর মৃদু হতে হতে গড়ের মাঠের আবছা সন্ধ্যার সঙ্গে মিশে গেল। আমার মনটা ভারী হয়ে উঠল, মাথা নামিয়ে চুপ রইলাম। রতন গাঢ় স্বরে বলল, ”আজ আমি খেলেছি ভয় পেয়ে। তুমি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। টিমে আমার পোজিশন বোধ হয় গেল, এই চিন্তাই শুধু মাথায় ঘুরছিল। কিছু মনে কোরো না!” ও আমার হাতে চাপ দিল। আমি মাথা নাড়লাম।

রতন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ”তুমি গোল দাও, অনেক গোল দাও, বড় ক্লাবে যাও। আর শরীরের যত্ন কোরো। আরও ওজন বাড়াতে হবে, আরও খাটতে হবে তোমায়; এজন্য স্বার্থপর হতে হবে, বাড়ির জন্য ভেবে উপোস দিয়ো না, বরং অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে খাবে। গরিবদের নিষ্ঠুর হতে হবে যদি বড় হতে চায়, নয়তো আমার মতন হবে; এই রকম স্বাস্থ্য নিয়ে কি বড় ফুটবলার হওয়া যায়? প্রসূন, দয়ামায়া মমতা বড় ভয়ংকর শত্রু।”

রতন আচমকাই আমাকে ফেলে রেখে টেন্টের মধ্যে চলে গেল। আনোয়ার আর নিমাই অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। কাছে আসতেই ওরা জানতে চাইল, কী কথা হচ্ছিল। আমার মন ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেছিল। বললাম, ”পরে বলব। এমন কিছু সিরিয়াস কথা নয়।” তার পর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, ”হ্যাট্রিক হল না রে, নিমাই।”

”খেলা দেখতে দেখতে ইচ্ছে করছিল রাজস্থানের দিকে নেমে পড়ি। শিওর তা হলে সুভাষের হ্যাট্রিক করিয়ে দিতাম।” নিমাই খুব গম্ভীর হয়ে বলল, ”কীরকম ডিফেনস ভেঙে ঢোকে দেখেছিস?”

কথাটা আনোয়ারের গায়ে লাগল। তাচ্ছিল্যভরে বলল, ”দেখেছি, সব তো এক—ঠেঙে। শুধু স্পিড আর শট ছাড়া আছেটা কী? হাবিবকে ওয়াচ করিস। কীরকম ওঠানামা করে, অন্যকে খেলায়, স্পেস কভার করে, কী দারুণ রোখ নিয়ে বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে।”

নিমাই আর কথা বলল না। বাসে ওঠার আগে আমি ওদের বললাম, ”কিন্তু সামনের বছর অন্য ক্লাব দেখতে হবে। এখানে আর নয়।”

.

।।৯।।

বিপিনদা কীভাবে যেন জানতে পারলেন, সামনের বছর আমরা তিনজনই শোভাবাজার ইউনিয়ন ছাড়ব ঠিক করেছি। তিনি আমাদের তিনজনকেই একদিন আড়ালে ডেকে বললেন, ”তোদের জুনিয়ার বেঙ্গলে খেলাব, সামনের বছরটা থেকে যা।”

আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কেউ কথা বললাম না। ভিতরে একটা অস্বস্তি শুরু হল, কেননা আমরা জানি বিপিনদা তা পারেন। আই.এফ.এ—তে শোভাবাজারের সেক্রেটারি পরিমল ভটচাজের একটা দল আছে, যারা সব কটা কমিটি দখল করে আছে। তারাই শলা—পরামর্শ করে লিগে ওঠা—নামা বন্ধ করিয়েছে গভর্নিং বডির মিটিং—এ। এতে তাদের বড় লাভ—ফুটবল লিগে প্লেয়ারদের জন্য যে খরচ করতে হত, সেটা আর করতে হল না। কেউ টাকা চাইলেই তারা এখন বলে দিতে পারে—গেট খোলা আছে, বেরিয়ে যাও। আমরা রাস্তা থেকে এগারোটা ছেলে ধরে এনে খেলাব। সব ম্যাচ হারলেও, একটা পয়েন্ট না পেলেও কিছু আসে—যায় না, ওঠা—নামা তো বন্ধ।

সত্যি বলতে কী, অবস্থাটা এই রকম না হলে আমাদের মতন আনকোরা উটকো তিনজন ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার সুযোগ এত তাড়াতাড়ি পেতাম কি না সন্দেহ। প্রতি বছরই শোভাবাজারের অন্তত দু—তিনজন জুনিয়ার বেঙ্গল টিমে থাকে জুনিয়ার ন্যাশনাল চ্যামপিয়নশিপে। জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমেও দুজন ছিল গত বছর।

”বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমার কথা?” বিপিনদা খুব গম্ভীর হয়ে বললেন।

”না—না, তা কেন, তবে—” নিমাই আমাদের মুখপাত্র হয়ে বলল।

”তবে কী? টাকা চাই, চাকরি চাই?”

”না, তা নয়, বড় ক্লাবে খেলার ইচ্ছে তো সকলেরই থাকে।” নিমাই বলল।

”জুনিয়ার বেঙ্গল, জুনিয়ার ইন্ডিয়া, এর থেকেও বড় ক্লাব আর কী আছে! আগে এসব ছাপ নিয়ে নে, তখন দেখবি, বড় ক্লাব তোদের বাড়িতে গিয়ে সাধাসাধি করবে।”

বলতে ইচ্ছে করল, অমন গণ্ডা গণ্ডা ইন্ডিয়া ছাপ মারা প্লেয়ার ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্লেয়ার তো মাত্র দু—তিনজন হতে পেরেছে। কিন্তু এসব কথা এখন বলে কোনও লাভ নেই, তাতে তিক্ততাই শুধু বাড়বে। তাই বললাম, ”বিপিনদা, আমরা ভাল করে খেলা শিখতে চাই, ভাল প্লেয়ারদের পাশে থেকে খেলতে চাই। দেখছেন না, প্রত্যেকটা ম্যাচে নিমাই—আনোয়ারের অবস্থা, আমার অবস্থা। কেউ সামলাতে পারে না, আটকাতে পারে না, একটা পাস দিতে পারে না ঠিকমতো, দম নেই, স্কিল নেই, বুদ্ধি নেই। এখানে আমি উৎসাহ পাই না। একা একা কি ফুটবল খেলা যায়?”

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। গলা চড়ে গেল। নিমাই আর আনোয়ার আমার কথার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে সায় দিচ্ছিল।

বিপিনদার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। ”তোরা ক্লাব ছাড়লে পরিমলদা চটবে। ওকে চটিয়ে পারবি উঁচুতে উঠতে? প্রত্যেকটা ক্লাব ওকে ভয় করে। ইন্ডিয়া টিমে তোদের খেলা বন্ধ করে দিতে পারে, যতই তোরা ভাল খেলিস না কেন। আর, তারই ক্লাবে তোরা খেলবি না, রিকোয়েস্ট সত্ত্বেও?”

আমরা আবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।

আমরা যে দ্বিধায় পড়েছি বিপিনদা বোধ হয় সেটা বুঝতে পারলেন। ”একটা বছর থেকে যা। সামনের বছর সম্ভবত আবার প্রমোশন রেলিগেশন চালু হবে। আমাদের ক্লাবের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছিস, কয়েকটা মাত্র মেম্বার, আই—এফ—এর ডোনেশনে কি সারা বছর এতগুলো খেলা চলে? এর—ওর কাছে ভিক্ষে করেই চালাতে হয়। তবু কথা দিচ্ছি, সামনের বছর প্রথম কিছু কিছু হাত— খরচা দেবার চেষ্টা করব। থেকে যা তোরা। শোভাবাজারই তোদের প্রথম ফার্স্ট ডিভিশনে খেলিয়েছে, এটা ভুলে যাসনি। তোরা বড় হবি, ফেমাস হবি—এটা কি আমরাও চাই না? তখন কি আমরাও গর্ব করব না?”

বিপিনদাকে অত্যন্ত করুণ দেখাচ্ছে। গলার স্বর গাঢ় আর ভিজে। ভিতরে ভিতরে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ছি। পরিমল ভটচাজকে আমরা চোখে দেখেছি মাত্র, আর ওঁর সম্পর্কে শুনেছি অনেক কথা। নিজের স্বার্থ আর ক্ষমতা রক্ষার জন্য উনি যাবতীয় অপকর্ম করতে পারেন ও করেন। যে কোনও ফুটবলারের কেরিয়ার খতম করা ওঁর পক্ষে অতি সামান্য ব্যাপার। বিপিনদা সে সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন একটা হুমকিও দিলেন।

নিমাই হঠাৎ বলল, ”আচ্ছা, আমরা দু দিন ভেবে আপনাকে জানাব।”

বিপিনদা আমাদের তিনজনের মুখের দিকে পর পর তাকিয়ে ঘাড় নাড়লেন।

.

আমি হর্ষদার কাছে গেলাম। ছাদে গোটা কুড়ি টবের মাঝে উবু হয়ে হর্ষদা ফুলগাছের পরিচর্যা করছিলেন। আমার কথা শুনতে শুনতে উনি টবের মাটি খুঁড়ে যাচ্ছিলেন একটা শিক দিয়ে। অনেকক্ষণ কথা বললেন না। একটা গোলাপের শুকনো মরা ডাল গাছ থেকে সাবধানে ভেঙে নিয়ে হর্ষদা মৃদু স্বরে বললেন, ”তোর ইচ্ছেটা কী?”

”আমি এখনও ঠিক করতে পারিনি ক্লাব বদল করব কি করব না। নিমাই—আনোয়ারেরও আমার মতন দোটানা অবস্থা। ওরা একবার বলছে, থেকেই যাই, একটা বছর তো! আবার বলছে, ধ্যুত, একটা বছর স্রেফ অযথা নষ্ট করা।”

”প্রসূন, এখন তোর সামনে চ্যালেঞ্জ, নিবি কি নিবি না, সেটা তুই—ই ঠিক কর।”

আমি শক্ত হয়ে গেলাম, হর্ষদার গলার স্বর অত্যন্ত ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ়। আমি চুপ করে রইলাম মরা গোলাপ ডালটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। হর্ষদা তা লক্ষ করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ”ডালটা মরে গেছে, কিন্তু গাছটা দ্যাখ কেমন জীবন্ত। অন্য ডালে কতগুলো কুঁড়িও ধরেছে। এরকম হয়, সর্বক্ষেত্রেই হয়। মানুষ বেড়ে ওঠে আর ফেলে যায় তার মরা ডালপালা। নতুন ডালে ফুল ফোটায়। এজন্য পরিচর্যা চাই। সার, জল, রোদের তাপ তাকে দিতে হয়। শিকড় থেকে পাতার মধ্যে দিয়ে সে প্রাণশক্তি আহরণ করে। যদি শিকড় নষ্ট হয়, পরিচর্যা না পায়, তা হলে বাড়তে পারে না। মানুষের শিকড় তার চরিত্র। তুই যদি অনুগ্রহ নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে বড় হতে চাস তো তোর শিকড় পচে যাবে। এই গাছটা বেড়েছে ফাইট করে। আমি একে হেলপ করেছি মাত্র। মানুষ হেলপ নাও পেতে পারে, তখন নিজেকে নিজে হেলপ করতে হয়। যার চরিত্র পচে গেছে, সে পারে না। হেরে যায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। চ্যালেঞ্জ নানা রকম চেহারা নিয়ে আসে, আর মানুষকে তার মোকাবিলা করতে হয়।”

শুনতে শুনতে টের পেলাম সারা শরীরে কলকল শব্দে রক্ত ছুটছে, আর দূর থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট একটা স্বরের মতন আমার বুকের মধ্যে ঢেউ উঠছে। সেই ঢেউয়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে কে যেন বলছে, ”স্ট্রাইকার! স্ট্রাইকার! তোমার সামনে দুর্ভেদ্য ডিফেনস। ভাঙতে কি পারবে না?”

আমি মাথা নামিয়ে নিজেকে শুনিয়ে বললাম, ”পারব।”

হর্ষদা অবাক হয়ে একবার তাকালেন, তার পর মরা ডালটা ছুড়ে ফেলে বললেন, ”মনে আছে, তোকে হেমিংওয়ের একটা গল্প একবার বলেছিলাম—ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি! তাতে এক জায়গায় আছে, ম্যান ক্যান বি ডিফিটেড, বাট… তুই লেখাপড়া শিখলি না কেন রে প্রসূন? তা হলে ইংরিজিতেই বইটা নিজে পড়তে পারতিস। মুখে বললে অনেক কিছু যে নষ্ট হয়ে যায়।”

”আমার মনে আছে হর্ষদা, মানুষকে হারানো যেতে পারে, কিন্তু ধ্বংস করা যেতে পারে না, তাই না?” এই বলে আমি আর সেখানে থাকিনি।

।।১০।।

রাস্তায় বেরিয়ে এলোমেলো হাঁটতে শুরু করি। একা প্রায় ঘণ্টাখানেক আমি হাঁটি। অনেক চেনা ছেলের সঙ্গে দেখা হল, কিন্তু আমি তাদের দেখতে পেলাম না। তারা চোখের উপর দিয়ে ভেসে গেল। অনেকে ডাকল, আমি শুনতে পেলাম না। ভূতে পাওয়ার মতন আমি শুধু হাঁটলাম। আর হর্ষদার কথাটা আওড়ালাম মনে মনে, ”এখন তোর সামনে চ্যালেঞ্জ, নিবি কি নিবি না, সেটা তুই ঠিক কর।”

”অ্যাই প্রসূন, দেখতেই পাচ্ছ না যে।” থমকে দাঁড়ালাম। নীলিমা সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকে। কোমরে হাত, চোখে বিস্ময়।

”বাব্বাঃ, খবরের কাগজে নাম বেরোয়, তাতেই এই—ছবি বেরোলে কী হবে?”

লজ্জা পেয়ে আমতা আমতা করে বললাম, ”যাঃ, ও রকম নাম গণ্ডা গণ্ডা লোকের রোজই বেরোয়। শোভাবাজার ইউনিয়নের প্লেয়ারের আবার নাম! সত্যি বলছি, দেখতে পাইনি তোমায়। কোথায় গেছিলে? বাড়ি যাচ্ছ এখন?”

লজ্জাটা কাটিয়ে ওঠার জন্য এলোপাথাড়ি প্রশ্ন করলাম, প্রেশারে পড়ে গ্যালারিতে বল ওড়ানোর মতন।

নীলিমা এবার সত্যিই অবাক হয়ে বলল, ”সে কী, এই সময়ে টিউশনি থেকে রোজ ফিরি, তা ভুলে গেছ? কী ব্যাপার, বলো তো? হাত তুলে দাঁড়াতে বললাম, দাঁড়ালে না। একমনে চলেছ তো চলেছই। কথা বলছ, যেন এই মাত্র পরিচয় হল। উঃ, হয়েছে কী?”

”একটা ব্যাপারে মুশকিলে পড়ে গেছি, সেটা নিয়েই চিন্তা করছিলুম। হর্ষদার বাড়ি থেকে ফিরছি। চলো একটু হাঁটা যাক।”

আমরা দুজনে মন্থরগতিতে হাঁটতে শুরু করলাম। কেউ কথা বলছি না। নীলিমা গম্ভীর হলে গিন্নিবান্নি দেখায়। মা—মরা সংসার দু বছর ধরে চালাতে চালাতে ও রীতিমতো ভারিক্কি হয়ে গেছে। নানান দিক ভেবেচিন্তে বাবার সামান্য আয় আর নিজের টিউশনির টাকায় ওকে সংসার চালাতে হয়। তার উপর নিজের স্কুলের পড়া আছে।

হর্ষদার কথাগুলো মনে পড়ছে আর যেন গায়ে ছ্যাঁকা লাগছে—’যার চরিত্র পচে গেছে, সে পারে না!’ ‘মানুষের শিকড় তার চরিত্র!’ ‘চ্যালেঞ্জ নানা রকম চেহারা নিয়ে আসে!’ ব্যাপার কী! এইসব ভাল ভাল কথা দিয়ে আমি কী করব? ফুটবল, ক্লাব বদল, বেঙ্গল কী ইন্ডিয়া টিমে খেলার সঙ্গে এগুলির কী সম্পর্ক? আমার স্কিল, স্পিড, ড্রিবলিং, স্ট্যামিনা, বুদ্ধি দিয়ে খেলব—এ সবের সঙ্গে চরিত্রের যোগ কোথায়? ভিতরে ভিতরে ছটফট করে উঠলাম এক অসহ্য অসহায়তায়। ধরতে পারছি না আমার অপোনেন্ট যে কে, কী যে তার স্ট্র্যাটেজি, বুঝতে পারছি না।

হালকা হবার জন্যই কথা শুরু করলাম, ”টিউশনি থেকে আসছ বুঝি?”

”না, এক পাবলিশারের কাছে গেছিলাম। প্রুফ দেখার কাজ শিখছি, বাবাই ঠিক করে দিয়েছেন।”

”অনেক টাকা পাওয়া যায়?”

নীলিমা মাথা হেলিয়ে পিছন থেকে বেণীটা সামনে টেনে আনল। বেণীর গোড়ার আলগা চুলগুলো আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল, ”অনেক, এক লক্ষ, দু লক্ষ টাকা।”

”ঠাট্টা করছ!”

”মোটেই না। কষ্ট করে সৎভাবে রোজগার করা একটা টাকা আমার কাছে এক লক্ষ টাকার সমান।”

”আমি এখনও রোজগার করতে পারলাম না। বাড়িতে একটা পয়সাও দিই না।” আমি হাসবার চেষ্টা করলাম। নীলিমাও আমার মতন হাসল।

”ফুটবল খেলে তো হাজার হাজার টাকা বছরে পাওয়া যায় শুনেছি। এটাও তো এক রকমের কাজ। যেমন অফিসে, স্কুলে, কলেজে, কারখানায় লোকে কাজ করে। ফুটবলারকে তো ওদের মতনই শিখতে হয়?” নীলিমা আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

”নিশ্চয়। আমি তো শিখতেই চাই।” এক মুহূর্ত ভেবে আবার বললাম, ”জানো, এখন যে ক্লাবে খেলছি, সেখানে কিছুই শিখতে পারি না। ওরা আর এক বছর থাকতে বলছে। তা হলে কিছু টাকা দেবে, জুনিয়ার বেঙ্গল টিমে খেলিয়ে দেবে, এমনকী ইন্ডিয়া টিমেও। কী যে করি, ভেবে পাচ্ছি না। যদি ওদের কথা না শুনি, তা হলে এসব খেলা বন্ধ করে দেবে। শোভাবাজারের পরিমল ভটচাজের ভীষণ ইনফ্লুয়েন্স অল ইন্ডিয়ায়। ওকে চটিয়ে কোনও ফুটবলার বড় হতে পারে না।”

নীলিমা কিছুক্ষণ কথা বলল না। দেখে মনে হল গভীরভাবে ভাবছে। আমি আবার বললাম, ”হর্ষদা বললেন, এটা একটা চ্যালেঞ্জ।”

”আর কী বললেন?”

ইতস্তত করে বললাম, ”গাছ বেড়ে ওঠে শিকড়ের গুণে। শিকড় হচ্ছে চরিত্র, পচে গেলেই মানুষ মরে যায়।”

নীলিমা রাস্তার উপর থমকে ঘুরে দাঁড়াল। ”প্রসূন, যারা চ্যালেঞ্জ নিয়ে বড় হতে পারে না, তারা বড় হবার যোগ্য নয়। প্রসূন, শিক্ষায় যে ফাঁকি দেয় না, সেই একমাত্র বড় হতে পারে। বড় হতে পারে না কাপুরুষেরা। তুমি কি কাপুরুষ, তুমি কি পরিশ্রমে অনিচ্ছুক?”

”না, তবে সব কিছুতেই ভাগ্য লাগে। পেলে—গ্যারিনচা থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিল তো হেরেছে।”

”জানি না কে পেলে কে গ্যারিনচা, কেমন তারা খেলে, কিন্তু তাদের পালটা টিমেও তো ভাল প্লেয়ার থাকতে পারে! জ্যাঠামশায়ের ভাগ্য খারাপ, তাই পা নষ্ট করে অপমানিত হয়ে ফুটবল থেকে বিদায় নিয়েছেন। তোমার ভাগ্যে তা নাও হতে পারে। তা ছাড়া, তোমার উচিত নয় কি বাবার অপমানের শোধ নেওয়া? যারা একদিন তাঁর মুখে থুথু দিয়েছিল, তাদেরই সেই থুথু চাটতে বাধ্য করা? বড় প্লেয়ার না হলে, বড় কিছু একটা না করলে তা পারবে কী করে? কাউকে খুশি করে ইন্ডিয়া টিমে খেলতে পারো, কিন্তু বড় প্লেয়ার হতে পারো না।”

আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম বড় বড় চোখ দুটোর দিকে। যে পাষাণ ভারটা চেপে বসেছিল বুকে, সেটা সরে যাচ্ছে। হালকা ঝরঝরে লাগছে নিজেকে। বাবা, আমার বাবা গভীর মর্যাদাবান এক অপমানিত ফুটবলার। ফুটবলকে, হাজার হাজার দর্শককে, তাঁর ক্লাব যুগের যাত্রীকে দিয়েছেন অনেক কিছু, বদলে কিছুই পাননি। দিন—রাত এখন সংসারটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন চাবুক খাওয়া বলদের মতন। বাবা, আমার বাবা ক্লান্ত নিঃসঙ্গ অপমানিত এক ফুটবলার। আর আমি তাঁর স্বার্থপর ছেলে।

”নীলিমা, তুমি আমার বাবাকে ভালবাসো! নিমাই আর আনোয়ার বাদে তুমি আর মা—ই আমার সব থেকে বড় বন্ধু।”

নীলিমা শোনামাত্র মুখ লাল করে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ”হয়েছে হয়েছে, ধার দেবার মতন পয়সা এখন আমার হাতে নেই।”

”একটা চানাচুরের দোকান পর্যন্ত যাবার ক্ষমতাও কি তোমার ব্যাগটার নেই?”

.

।।১১।।

মোহনবাগানের সঙ্গে খেলাটার জন্য ছটফটিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আনোয়ার—নিমাইকে আমি জানিয়ে দিয়েছি, সামনের বছর ক্লাব বদল করবই। ওরা আমাকে অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু আমি ঘাড় নেড়ে গেছি গোঁয়ারের মতন। আমি বলেছি, বড় প্লেয়ার হতে চাই, আর কিছু নয়। সেজন্য যত ঝুঁকি নিতে হয়, নেব। ওরা শুনে চুপ করে থেকেছে।

শনিবার মোহনবাগানের সঙ্গে খেলা আমার জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ। প্রথম খেলা। বছরে দু—তিনবার মাত্র আমাদের মতন ছোট ক্লাবের জীবনে এত লোকের সামনে খেলার, চোখে পড়ার, খবরের কাগজে দু—এক লাইন উল্লেখ পাওয়ার সুযোগ আসে। আগের ম্যাচে জর্জ টেলিগ্রাফ দু’ গোলে হেরেছে, দুটোই আমার দেওয়া গোল।

শুক্রবার ক্লাবে এসে নোটিশ বোর্ডে তাকালাম। প্লেয়ারস লিস্ট টাঙানো রয়েছে। সোজা দশ নম্বরে চোখ রাখলাম। এ কী! এস দত্ত কেন? সাধন দত্ত কেন? সাধন, সেই লম্বা সাধন, যে বলে কিক করলেই মাটির চাপড়া ওঠে, কেউ চার্জ করতে এলে বল জমা দিয়ে দেয়। আমার নাম কোথায়? লিস্টের গোড়া থেকে চোখ বুলিয়ে আস্তে আস্তে পাথর হয়ে গেলাম। নিমাই আর আনোয়ারের নাম আছে।

বিপিনদার কাছে গেলাম। গম্ভীর মুখে উনি বললেন, ”ওরা আমার রিকোয়েস্ট রাখবে বলেছে। ওরা নেমকহারাম নয়।”

শোভাবাজার টেন্টটা আমার পায়ের নীচে কাঁপতে শুরু করেছে। আঘাত এসেছে। বুকের মধ্যে কে বলে উঠল, ‘প্রসূন, এইবার তুমি মাঠে নেমেছ। প্রথম গোল খেয়েছ। স্ট্রাইকার, বি রেডি, শোধ দিতে হবে। তার পরেও উইনিং গোল দেওয়া চাই, চাই—ই!’

পরদিন আমরা ৬—০ গোলে হারলাম। গ্যালারিতে বসেছিলাম। খেলা শেষে নিমাই আর আনোয়ার আমায় দেখে ফ্যাকাশে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল।

তারপর শোভাবাজার ইউনিয়ন টেন্টে আর যাইনি।

ভি আই পি রোডে হর্ষদার এক বন্ধুর বিরাট মোটর সারভিসিং ও পেট্রল ফিলিং স্টেশন। সেখানে তিনি আমাকে কাজ ঠিক করে দিলেন। সারভিসিং—এর জন্য নানান যন্ত্রপাতি—এয়ার কমপ্রেশার, ন্যুম্যাটিক গ্রিজ ও মোবিল পামপ, হাইড্রলিক লিফট, ওয়াটার কমপ্রেশার, গ্রিজ ও ওয়াটার গান ইত্যাদি নিয়ে আলাদা বিভাগ। দৈনিক আড়াই টাকা মজুরিতে আমি মেট নিযুক্ত হলাম।

আমার কাজ সকাল আটটায় শুরু। ‘H’ আকৃতির লিফটের উপর মোটরটা প্রথমে ওঠানো হত। তার তলায় দাঁড়িয়ে একটা লোহার খুন্তি দিয়ে মাড—গারড আর শ্যাশি থেকে শুকনো কাদা চেঁছে ফেলে ওয়াটার গান দিয়ে ধুয়ে দেওয়ার কাজ আমাকে দেওয়া হয়। হেড মেকানিক মধু সাহা খুঁটিয়ে আমার কাজ লক্ষ করে তফাতে দাঁড়িয়ে। মাথায় একটা নীল টুপি আর নাকে ন্যাকড়া বেঁধে বেশ ভয়ে ভয়েই কাজ করি। মাঝে মাঝে মধু সাহা আঙুল তুলে হুঙ্কার দেয়, ”ওই যে, ওই যে রয়ে গেছে, ডিফারেনশিয়াল বক্সের তলাতে… দ্যাখ, চোখ দিয়ে টাই—রডটার জয়েন্টটা দ্যাখ।”

এখন সকালের প্র্যাকটিস প্রায় বন্ধই। আমার ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। ভোরে উঠে পাঁচ মাইল দৌড়ে আর আধ ঘণ্টা বল নিয়ে কসরত করে কাজে যাই। কিন্তু এইটুকুতে ভাল প্র্যাকটিস তো হয়ই না, উপরন্তু কাজের সময় ক্লান্তি লাগে। মধু সাহার দাঁতখিঁচুনি শুনতে হয়। পাঁচটায় ছুটির পর বলে তো আর পা দিতে ইচ্ছে করে না। আমি রীতিমতো ভাবনায় পড়ে গেলাম। এখানে চাকরি করলে আমার ফুটবল খেলা উচ্ছন্নে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে গাড়িতে পামপ থেকে ডিজেল বা পেট্রল ভরে দেবার কাজটায় অনেক খাটুনি কম। যদি ওই কাজে বদলি করে দেয়, আর রাতের শিফটে, তা হলে সারা দিন সময় পাব। রাতে শুনেছি ঘুমোনোও যায়। যার তেল দরকার সে হাঁকাহাঁকি করে ডেকে তোলে।

হর্ষদাকে অসুবিধার কথা বললাম। শুনে বললেন, ‘আচ্ছা।” দু’দিন পরে মালিক শিশিরবাবু তাঁর ঘরে ডেকে পাঠালেন।

”তুমি ফুটবল খেলো?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ।” তটস্থ হয়ে বললাম।

”তোমার অসুবিধে হচ্ছে খেলায়?”

”খেলায় নয়, প্র্যাকটিসে। খেলা এখন বন্ধ রেখেছি।”

”কেন বন্ধ?” ভ্রূ তুলে উনি জানতে চাইলেন। আমি ওঁকে সব বললাম। ”আই সি, আই সি!” বলে কলমটা দিয়ে কপালে টোকা দিতে দিতে কী ভাবলেন। তার পর বললেন, ”তুমি রাতেই যখন কাজ করতে চাও, তাই করো কাল থেকে।”

আমি হাঁফ ছাড়লাম।

আই এফ এ শিল্ডের খেলা আরম্ভ হয়ে গেছে। শোভাবাজারের খেলা প্রথম রাউন্ডে বার্নপুর ইউনাইটেডের সঙ্গে। টিকিট কেটে মোহনবাগান মাঠের গ্রিন গ্যালারিতে বসে খেলা দেখলাম। আর একজন মাত্র ছিল পুব দিকের প্রায় বারো হাজার লোক বসার সেই গ্যালারিগুলোয়। খুব অবাক লেগেছিল লোকটিকে দেখে। টিকিট কেটে এই খেলা দেখতেও কেউ আসে! আমার কাছে প্লেয়ারস কার্ড ছিল, কিন্তু আমি চাই না নিমাই বা আনোয়ারের মুখোমুখি হতে। এখনও আমার কাছে ব্যাপারটা ধাঁধার মতন। প্রসূন—নিমাই—আনোয়ার মানেই ‘থ্রি মাসকেটিয়ারস’। বহু টুর্নামেন্টে আমরা ওই নামেই পরিচিত হয়েছিলাম। এক সঙ্গে খেলতাম, বেড়াতাম, আড্ডা দিতাম। গত ছ’—সাত বছরে মনে পড়ে না এমন কোনও দিন যে, আমাদের রোজ না দেখা হয়েছে।

অথচ আমি আলাদা হয়ে গেলাম ওদের থেকে। ছটফট করেছি দেখা করার জন্য, আবার সঙ্গে সঙ্গে ভেবেছি, ওরা আমাকে না জানিয়ে চুপি চুপি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার মানে ওরা আমাকে আর চায় না। আমাদের মধ্যে তফাত ঘটে গেছে। আমার পথে ওরা ফুটবল নিয়ে এগোতে রাজি নয়। এক এক বার মনে হয় ওরাই ঠিক করেছে। উপরে ওঠার মই কেউ এগিয়ে দিলে, তাতে উঠে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি চাই নিজে মই বানাতে। তফাতটা শুধু এই—আমি পরিশ্রম করতে চাই ওদের থেকে বেশি।

নিমাই বা আনোয়ারও আমার সঙ্গে দেখা করেনি। বোধ হয় ওরা নিজেদের অপরাধী ভাবছে। আমাকে শোভাবাজার ইউনিয়ন বসিয়ে দিল, অথচ ওরা তার প্রতিবাদ করল না। ভাবতেই মনে হল, ভালই করেছে ওরা আমার সঙ্গে দেখা না করে। যদি জিজ্ঞাসা করি, কেন তোরা আমার পক্ষ নিলি না, কেন খেললি, তখন কী জবাব দেবে? তবু মনে মনে আমি আজও কষ্ট পাই ওদের অভাবে। কাজটা পেয়ে তবু কিছুটা ভুলে থাকতে পেরেছি। সকালে চার ঘণ্টা টানা মাঠে আর রাস্তায় খাটবার পর দুপুরে খানিকটা ঘুমোই। বিকেলে একটা ক্লাবে যাই একসারসাইজ করতে। রাতে বারোটার পর কদাচিৎ কোনও গাড়ি আসে। ঘুমোবার জন্য অনেক সময় পাওয়া যায়।

।।১২।।

বার্নপুর ৩—১ গোল জিতল। নিমাই চমৎকার খেলছিল। এখন আর ও থ্রু বাড়ায় না। বুঝে গেছে সেগুলো শুধু নষ্টই হবে। নিজেই বল নিয়ে এগোয়, গোলে মারে। দুজন ওকে পাহারায় রেখেছে, তবুও নিমাই মাঝে মাঝে বেরিয়েছে। একটা গোলও দিয়েছে। কিন্তু ঝরঝরে একটা টিমকে একজন—দুজন কি সামাল দিতে পারে? গোল খেয়েই বার্নপুর শোভাবাজারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টুঁটি টিপে ধরল। আনোয়ার পর্যন্ত তিনটে ফাউল করল নিরুপায় হয়ে। হাফ টাইমে বার্নপুর ২—১ গোলে জিতছে।

এর পর বলটা একবার বার্নপুরের লেফট হাফের মিস—কিক থেকে উড়ে এসে গ্যালারিতে পড়ে ড্রপ খেতে খেতে গ্যালারির নীচে ঢুকে গেল। বার করার জন্য অগত্যা আমাকেই গ্যালারির ফাঁক দিয়ে গলে নীচে নামতে হল। বলটা কিক করে মাঠে পাঠাব বলে তুলে ধরেছি, দেখি, নিমাই এগিয়ে আসছে বলটা নিতে। আমি বল হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও আমাকে চিনতে পারা মাত্র দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি বলটা ছুড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, ”ভাল করে খেল।” ওর মুখে একটা যন্ত্রণা ঝিলিক দিয়েই শুকনো হাসিতে রূপান্তরিত হল। এর পর লক্ষ করলাম, নিমাই আর খেলতে পারল না, বা ওর মধ্যে খেলার কোনও ইচ্ছা দেখতে পেলাম না। খেলা শেষ হবার আগেই আমি মাঠ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।

অরুণা গ্লাস ফ্যাক্টরির লক আউট সমানে চলেছে। খুব ভোরে কাজ থেকে বাড়ি ফিরি দৌড়ে মাইল পাঁচেক ঘুরে। রাস্তার লোকেরা আমার হাফ প্যান্ট গেঞ্জি কেডস পরা চেহারাটার সঙ্গে এখন যথেষ্ট পরিচিত, কেউ আর তাকায় না। বাড়িতে ঢুকি প্রায় চোরের মতন। বাবা ঘরে বসে পিন্টু আর পুতুলকে পড়ান এই সময়। আমার খুপরিতে ঢুকে ঢাকা খুলে চটপট রুটি ক’খানা শেষ করেই, বলটা নিয়ে বেরিয়ে যাবার পথে রান্নাঘরে মাকে একটা টাকা দিই। আমার নিজের রোজগারের টাকা। দেবার সময় দারুণ একটা আনন্দ হয়। বাকি দেড়টা টাকায় আমি বেছে বেছে এমন জিনিস কিনে খাই, যাতে বেশি ক্যালরি পাওয়া যায়। আমি সিনেমা দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। টেরিলিনের জামা প্যান্টের বয়স প্রায় দেড় বছর হল, সেলাই করে চালাচ্ছি। একজোড়া বুট না কিনলেই নয়। দু—তিনজন এসেছিল টুর্নামেন্টে খেলবার জন্য ডাকতে, রাজি হলে বুট কেন, জামা প্যান্টের সমস্যাও মিটে যেত। আমি রাজি হইনি। সকালে যখন বল হাতে মাঠের দিকে যাই, তখন বই খাতা হাতে মেয়েরা স্কুলে—কলেজে যায়, বাচ্চচা ছেলেরা প্রাইমারি স্কুলে। তখন নীলিমার কথাটা মনে পড়ে আর নিজের মনেই বলি: আমিও তো স্কুলে যাচ্ছি। আমার স্কুল মাঠে, আমার বই খাতা এই বলটা।

বাবাকে একদিন সকালে দেখলাম মাথা নিচু করে অন্যমনস্কের মতন কোথায় চলেছেন। আমি আর পাড়ারই কয়েকটি ছেলে, কারখানার মাঠে তখন হেডিং প্র্যাকটিস করছিলাম। একটি ছেলে বলল, ”প্রসূনদা, আপনার বাবা যুগের যাত্রীতে খেলতেন?”

”হ্যাঁ, কোথায় শুনলি?”

”মেজকাকা কাল বলছিলেন, দারুণ নাকি খেলতেন। দু পায়ে টেরিফিক শট!”

”বাবার খেলা আমি দেখিনি। আমি জন্মাবার এক বছর পরই খেলা ছেড়ে দেন।”

লক্ষ করলাম আমার কথা শোনামাত্র দু—তিনজন নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুখ টিপে হাসল। প্রথমে বুঝতে পারিনি এর কারণ।

”আপনার বাবা শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলেছিলেন, তাই না?” একজন বলল।

”ওইটেই তো ওঁর জীবনের শেষ খেলা।” আর একজন বলল।

”কাকা বললেন, একবারে ফাঁকা একটা গোল মিস না করলে, ইস্টবেঙ্গল নাকি হেরে যেত। ও রকম গোল নাকি অন্ধেও দিতে পারে।”

”হ্যাঁ, পারে।” আমি বললাম রাগ চাপতে চাপতে ঠাণ্ডা গলায়, ”তোমার কাকা জীবনে কখনও ফুটবল খেলেছেন কি?”

ছেলেটি থতমত হল।

”সম্ভবত খেলেননি।”

”আপনি জানলেন কী করে?” উদ্ধত চোয়াড়ে ভঙ্গিতে ছেলেটি বলল।

”খেললে কখনও বলতে পারতেন না যে, অন্ধেও গোল দিতে পারে।”

”অনেক ক্ষেত্রে পারে, কিন্তু ঘুষ খেলে পারে না।”

”তার মানে?” থরথর করে উত্তেজনায় আমি কাঁপছি। মাথার মধ্যে গলানো বাষ্প উড়ছে। আমি কিছু আর দেখতে পাচ্ছি না।

”তার মানে আবার কী! সবাই জানে ব্যাপারটা।” ছেলেটি ঠোঁট মুচড়ে দিতেই বাকিরা মুখ টিপে হাসল।

এর পর আমি আবিষ্কার করলাম আমি হাঁটছি। ছেলেটি পেট চেপে ধরে মাটিতে পড়ে বোধ হয় এখনও কাতরাচ্ছে। ফাটা ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরতে দেখেছি। লাথি মেরেছি না ঘুঁষি, এখন আর মনে নেই। আমি হনহনিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

ঘণ্টাখানেক পর বাড়ি ফিরছি, দেখি আমাদের সরু গলিটায় ভিড়। একটা লোক—চেহারায় স্বচ্ছলতা, মাথায় টাক, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি—আমাদের দরজায় দাঁড়িয়ে মুঠো তুলে চিৎকার করছে, ”আলবাৎ বলব, ঘুষখোর! ঘুষখোর! ঘুষখোর! আমিও সেদিন মাঠে ছিলাম, আমি নিজে চোখে দেখেছি। সেদিন—” লোকটির গলা ধরে এল, ”সেদিন সেই চান্স!” দেখলাম লোকটি সিল্কের পাঞ্জাবির হাতায় চোখ ঘষল, তার পর ফ্যাঁসফেঁসে স্বরে বলল, ”আজও আমরা শিল্ড পাইনি।”

আমি পায়ে পায়ে পিছু হটে গলি থেকে বেরিয়ে এলাম। আবার রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফেরা মাত্র মা ছুটে এসে উঠোনের উপরই আমার চুল মুঠোয় ধরে ঠাস ঠাস করে চড় কষাতে শুরু করলেন।

”কেন, কেন তুই পরের ছেলেকে মেরেছিস! বাড়ি বয়ে তোর বাবাকে অপমান করে গেল। তুই, তুই, তোর জন্যই—”

মা হাঁফিয়ে পড়লেন। ছোট্ট নরম ঠাণ্ডা স্বল্পবাক হাসিখুশি মা। মা’র হাতে ব্যথা লাগছে। দুচোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়ছে। পিন্টু, পুতুল গম্ভীর মুখে দূরে দাঁড়িয়ে। বাবার ঘরের দরজার পাল্লা ভেজানো। বিশুবাবুর মেয়েরা উপর থেকে দেখছে। পাশের বাড়ির জানলাগুলোয় অনেক মুখ। নীলিমা এসে মা’র হাত চেপে ধরতেই দ্বিগুণ জোরে মা চেঁচিয়ে উঠলেন, ”কুলাঙ্গার! কুলাঙ্গার! বাপের মান যে নষ্ট করে, তেমন ছেলের মুখ দেখাও পাপ।”

নীলিমা মাকে টেনে রেখেছে। আমি ভেজানো পাল্লা দুটো দড়াম করে খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। বাবা চিত হয়ে শুয়ে, চোখের উপর বাঁ হাত আড়াআড়ি রাখা। শব্দ হতেই হাত সরিয়ে একবার মাত্র তাকালেন।

”বাবা, তুমি ঘুষ নিয়েছিলে?” আমি উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করলাম।

বাবা কথা বললেন না, শুধু দেখলাম ওঁর গালের চামড়াটা একবার কেঁপে গেল।

”আমার জানা দরকার।”

”আমি তোমায় জানানোর কোনও প্রয়োজন বোধ করছি না। যদি তোমার লজ্জা হয়, তা হলে পিতৃ—পরিচয় দিয়ো না।”

”ওরা যা বলে আমি তা বিশ্বাস করি না।”

বাবা চুপ করে রইলেন। আমার দিকে একবারও তাকাননি। ওঁর শায়িত দেহটাকে হঠাৎ মনে হল ভাঙা একটা গাছের ডাল। শুকনো, মরা।

”আমার অনুরোধ, তুমি আর আমার জন্য কারও সঙ্গে ঝগড়া করবে না। গায়ে হাত দেবে না। হাজার হাজার লোককে মারধোর করে তো তোমার বিশ্বাসকে তাদের মধ্যে সঞ্চার করতে পারবে না। তার থেকে আমি যেমন আছি, তেমনই থাকতে দাও।”

বাবা চোখ থেকে হাত নামিয়ে আমার দিকে তাকালেন। কপালের মাঝখানে মসৃণ চামড়ার বাদামি টিপটা চকচক করছে। বড় বেশি চকচকে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

পরদিন মা রান্নাঘরে বসে উনুনে বাতাস দিচ্ছিলেন। আমি টাকাটা চৌকাঠে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছি বল হাতে। মা ডাকলেন, কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বাচ্চচা মেয়ের মতো মুখ উঁচু করে বললেন, ”আমার হাতে কাল খুব লেগেছে।”

আমি হেসে ফেললাম। ‘লাগবেই তো। অত জোরে জোরে কখনও মারে?”

”তুই ভাল করে খেলবি? বল, খেলবি?”

আমি একদৃষ্টে মায়ের অপূর্ব মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তার পর আমি মায়ের গলা জড়িয়ে বুকে মুখ চেপে ধরে বললাম, ”খেলব।”

মা আমার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন, ”তোর বাবার মতন বড় হতে পারবি?”

হঠাৎ আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। মাথায় মায়ের স্পর্শ, ঘ্রাণ পাচ্ছি মায়ের দেহের, মনে হচ্ছে মখমলের মতন সবুজ দূর্বা বিছানো মাঠে, হালকা সাদা—কালো ফুটকি দেওয়া বল নিয়ে ড্রিবল করছি। একের পর এক কাটাচ্ছি, দুলে দুলে এগোচ্ছি। ডাইনে ভাঙছি—বাঁয়ে হেলছি, শূন্যে উঠছি—কখনও হরিণ, কখনও চিতা, কখনও চিলের মতন। নিজেকে বললাম—প্রসূন, সুন্দর খেলার আনন্দ বোধ হয় এই রকম। বড় প্লেয়ার হও, তা হলে মাঠেও তুমি মায়ের বুকে থাকবে। তুমি কি তাই চাও?

”হ্যাঁ, আমি তাই চাই।” আচ্ছন্ন গলায় মাকে উত্তর দিলাম।

।।১৩।।

বছর ঘুরে গেল। আমার এক বছর বয়স বাড়ল। মাথায় লম্বা হয়েছি পাঁচ ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি, ওজন তুলনায় কমই, পঁয়ষট্টি কিলোগ্রাম। নীলিমা স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। আমি এখন দিনে সাড়ে তিন টাকা পাচ্ছি, অবশ্য কাজটা রাতেই। অরুণা গ্লাস ফ্যাক্টরি এখনও খোলেনি, চোদ্দো মাস বন্ধ হয়ে রয়েছে। বাবা যথারীতি রোজ দুপুরে বেরোন। আরও শুকিয়ে গেছেন, আরও কম কথা বলেন। আমাদের রাত্রের রুটির বরাদ্দ একই রয়েছে, আমিষ খাদ্য বোধ হয় বছরখানেক রান্না করার সুযোগ মা পাননি। দোতলায় বাড়িওয়ালার রান্নাঘর থেকে যে দিন মাংস কষার গন্ধ আসে, পিন্টু আর পুতুল সে দিন প্রাণপণে পড়ার মধ্যে ডুবে যাবার চেষ্টা করে। হর্ষদা আমায় কয়েকবার বলেছিলেন—প্রসূন, এত যে খাটছ, এতে শরীরে ক্ষয় হচ্ছে—সেই ক্ষয় পূরণ করে খাদ্য। ফুটবলারের ভীষণ দরকার প্রোটিন। মাংস, দুধ, ডিম তোমায় খেতেই হবে, নয়তো বিপদে পড়বে। শুনে আমার ভয় হয়েছিল। শরীর ক্ষয়ে গেলে আমার আর রইল কী! কিন্তু মাংস আমি খাব, পয়সা কোথায়?

কাগজে দেখেছিলাম, বি সি রায় ট্রফি খেলার জন্য জুনিয়ার বেঙ্গল টিমের নাম ঘোষিত হয়েছে। এক দিন ভোররাত্রে হাঁকাহাঁকি করে একটা লোক ঘুম ভাঙাল। পেট্রল চাই দশ লিটার, এখনই ভোরের ফ্লাইট ধরতে হবে। মোটরের ভিতর তাকিয়ে আমার চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেল। পিছনের সিটে নিমাই আর আনোয়ার, সামনে বিপিনদা বসে। ওরা আমায় দেখে অবাক! বিপিনদা বললেন, ”কী রে প্রসূন, খেলা ছেড়ে এখন এই কচ্ছিস? ভাল, ভাল! একটু তাড়াতাড়ি দে বাবা, দিল্লির ফ্লাইটে এদের তুলে দিতে হবে।”

আমি হাসলাম মাত্র। মোটরে পেট্রল ঢালছি মিটারের দিকে তাকিয়ে। বিপিনদা চেঁচিয়ে গাড়ি থেকে মুখ বার করে বললেন, ”আমার কথা তো বিশ্বাস করলি না, এই দ্যাখ নিমাই, আনোয়ার জুনিয়ার ন্যাশনালে খেলতে যাচ্ছে। তুই থাকলে তুইও যেতিস। তোর এত পসিবিলিটি ছিল।”

বিপিনদা জিভটা টাকরায় লাগিয়ে চুকচুক শব্দ করলেন আক্ষেপের। টাকার ভাঙানি ফেরত দেবার সময় আমার মাথাটা মুখের কাছে টেনে এনে চাপা স্বরে উনি বললেন, ”সামনের বছর আয়, দেড় হাজার দেব, এদের থেকেও বেশি। নিজেকে এভাবে নষ্ট করিস না। এবার রেলিগেশন—প্রোমোশন আছে।”

আমি আবার হাসলাম। ওরা দুজন জড়ভরতের মতন বসে। আনোয়ার বাইরে তাকিয়ে, কিন্তু নিমাই একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে। গাড়িটা চলে যাবার পর আমার সত্যিই হিংসা হল। শোভাবাজারে থাকলে আজ আমিও এই মোটরে চেপে দিল্লির প্লেন ধরতে যেতাম। তার পর পরিমল ভটচাজ ঢুকিয়ে দিত জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমে, তার পর ব্যাংকক, সিওল কী টোকিওয়। শুধু একটা বছর যদি থাকি।

নিজের উপর রাগ হল। বোধ হয় বোকামিই করেছি, ক্ষতি করলাম নিজেরই। মুহ্যমান হয়ে খাটিয়ার উপর বসে যখন এইসব ভাবছি, তখন ফিসফিস করে বুকের মধ্যে কে কথা বলে উঠল: ‘কী ক্ষতি করেছ, প্রসূন? পূরণ করে নেবার সময় অনেক পাবে। যাও যাও, প্র্যাকটিসে নামো। খাটো, আরও খাটো। কিচ্ছু বোকামি করোনি। মনে রেখো, কদর পাবে একমাত্র খেলা দিয়েই, বেঙ্গল বা ইন্ডিয়ার ছাপ দিয়ে নয়।’

ভি আই পি রোড ধরে যখন দৌড়োচ্ছি, একটা প্লেন মাথার উপর দিয়ে নিচু হয়ে পশ্চিমে চলে গেল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে ঊর্ধ্বশ্বাসে হঠাৎ পাগলের মতন ছুটতে শুরু করলাম।

।।১৪।।

”তোমার কথা রতন আমাকে বলছিল।” সাদা চুলে ভরা মাথাটা ডাইনে—বাঁয়ে নেড়ে পঁয়ষট্টি বছরের দাসুদা অর্থাৎ দাসু গুহ গম্ভীরভাবে আমার আপাদমস্তক দেখলেন। তার পর চেয়ার থেকে উঠে এসে ধাঁ করে বুকে ঘুষি মারলেন। আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। লেগেছে ভালই, কিন্তু মুখে যন্ত্রণা ফোটালাম না। উনি আমার পিছনে গেলেন। বুঝতে পারছি না, এবার কী করবেন। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেলাম। হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলে নিলাম।

দাসুদার মুখে হাসি ফুটল। ”স্ট্রাইকার?”

আমি মাথা হেলালাম। উনি চেঁচিয়ে ডাকলেন, ”কমল, কমল!”

বেঁটে ফরসা কমল পণ্ডিত ছুটে এল। দাসুদা বললেন, ”ছেলেটাকে পঁচিশ পাক দৌড় করা।”

কমলদা সোনালি সংঘের ট্রেনার। ইন্ডিয়া টিমে ব্যাক খেলেছেন বছর দশেক আগে। অসম্ভব দম আছে শুনেছি।

”প্যান্ট এনেছ?”

”না।”

কমলদা প্যান্ট জোগাড় করে দিলেন। মাঠে হকি খেলা হচ্ছে। কিছু দর্শক ছড়ানো ছেটানো। লক্ষ করলাম, ফুটবল—বুট পায়ে খালি গায়ে তিন—চারটি ছেলে টেন্টের বাইরে গান করছে। মনে হল, ওরা প্র্যাকটিসে নামবে হকি খেলাটা শেষ হলেই। ওরা কৌতূহলে আমার দিকে তাকাল। ওদের মধ্যে গোলকিপার রুনুকে মাত্র চিনলাম। দু—একবার শোভাবাজার টেন্ট—এ দেখেছি রতনের সঙ্গে। তবে আলাপ নেই।

কমলদা আমাকে নিয়ে দৌড়োতে শুরু করলেন মাঠের বাইরে দিয়ে। জোরে হাঁটার থেকে কিছু জোরে। পাঁচ পাকের পর দেখি, কমলদা আমার সামনে এবং গতি ক্রমশই বাড়াচ্ছেন। আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। আঠার মতন সঙ্গে লেগে রইলাম। সতেরো পাকের সময় হকি খেলা শেষ হতে দেখলাম, ফুটবল নিয়ে ওরা মাঠে নেমে পড়েছে। কুড়ি পাকের মাথায় কমলদাকে পিছনে ফেলে এগোতে শুরু করলাম। দাসুদা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওদের দিয়ে পাসিং ও ইনটার—পাসিং করাচ্ছেন, এখন তিনি আমাদের দৌড়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে। দম আমার বুক ভর্তি রয়েছে। কমলদা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছেন। শেষ পাকটা স্প্রিনট করলাম। কমলদাকে পুরো দেড় পাক পিছনে রেখে থামতেই দাসুদা হাত নেড়ে মাঠের মধ্যে ডাকলেন।

”তোর নামটা যেন কী?”

”প্রসূন।”

”বুট আনিসনি কেন?”

শুনেছি দাসুদা যাদের বুট আনতে বলেন, তারাই ফার্স্ট টিমে খেলার যোগ্যতা পেয়েছে ধরে নিতে হয়। খুশিতে আমি মাথা চুলকোতে লাগলাম। কমলদা তখন এসে আমায় জড়িয়ে ধরেছেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ”এই প্রথম আমি হারলাম, দাসুদা।”

”ছোঁড়ার দম আছে।” এই বলে দাসুদা আবার প্র্যাকটিস করানোয় মন দিলেন। মাঠের বাইরে এসে আমি ওদের প্র্যাকটিস দেখতে লাগলাম। ডান দিক থেকে উঁচু ক্রস পেনালটি বক্সে ফেলছে একজন, আর তিনজন ছুটে যাচ্ছে বলটা হেড বা ভলি করতে। ফসকাচ্ছে বা বারের অনেক উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।

আমি গুটিগুটি মাঠের মধ্যে দাসুদার পাশে দাঁড়ালাম।

”আমি একবার চেষ্টা করব?”

দাসুদা মাথা দোলালেন। আমি এগিয়ে গেলাম।

একসঙ্গে দুজন ছুটেছি; বল নিয়ে ডাইনের সাইড লাইন ধরে ছুটে সেন্টার করল একজন। সেন্টারটা ভাল হয়নি, আমাদের দুজনের পিছনে বল পড়ছে। আমি ঘুরে গেলাম গোলের দিকে পিছন ফিরে। বলটা পড়ার আগেই ইনস্টেপ দিয়ে শূন্যে থামিয়ে টুক করে উপরে তুলেই সঙ্গে সঙ্গে পিছনে হেলে মাথার উপর দিয়ে বাইসাইকেল কিক করলাম। মাথা ঘুরিয়ে দেখি, বারের তলায় লেগে বলটা গোলে ঢুকল, আর গোলকিপার হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। নীলিমাকে এই কিকই দেখিয়েছিলাম আন্দাজে মেরে। কিন্তু এখন দশটার আটটাই গোলে পাঠাতে পারি।

দাসুদা আর কমলদা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন, অন্য ছেলেরা আমাকে সপ্রশংস চোখে দেখছে। একজন বলল, ”আর একবার করো তো!”

করতে পারলাম না। বলটা পেলাম বুকের উপর, বুক থেকে ঊরুতে নিলাম, তুললাম ধাক্কা দিয়ে কিন্তু শরীর থেকে বাঁ ধারে বলটা একটু সরে গেল। বাইসাইকেল কিকের চেষ্টা না করে আধ পাক ঘুরে ডান পায়ে ভলি মারলাম। গোলকিপার দুহাত বাড়িয়ে ডান দিকে ঝাঁপাবার আগেই বল গোলে ঢুকে গেছে।

দাসুদা হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে যাওয়া মাত্র জানতে চাইলেন, বাড়িতে কে কে আছেন, বাবা কী করেন, আমি কী করি, কত দূর লেখাপড়া করেছি… ইত্যাদি।

”কাজটা ছেড়ে দে!” দাসুদা বললেন, তার পর আমার বিস্ময় লক্ষ করে যোগ করলেন, ”ও টাকা আমরা দিয়ে দেব তোকে মাসে মাসে, আর কিছু দিতে পারব না।”

আমি রাজি হয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গেই। ছোট টিমগুলোর মধ্যে সোনালি সংঘের নাম আছে ছক বাঁধা আধুনিক পদ্ধতিতে খেলার। এখানকার ছেলেরা সিরিয়াস, মন দিয়ে প্র্যাকটিস করে দাসুদার চোখের সামনে। কমলদা মাঠের মধ্যে ওদের স্কিল রপ্ত করান। সোনালির নিয়ম—শৃঙ্খলা অত্যন্ত কড়া, সেটা শুধু মাঠেই নয়, বাড়িতেও প্রত্যেক প্লেয়ারকে পালন করতে হয়। দাসুদা প্রায়ই এক—এক জনের বাড়িতে হঠাৎ হাজির হয়ে খোঁজ নেন, কী খাচ্ছে, কখন ফিরছে, কখন ঘুমোচ্ছে।

”সামনের হপ্তা থেকে ট্রান্সফার শুরু হবে, কমলের সঙ্গে আই এফ এ অফিসে গিয়ে সই করে আসবি। কাল ভোর থেকেই প্র্যাকটিসে আয়।”

ফেরার সময় শ্যামবাজারের বাসের দম বন্ধ করা ভিড়ের মধ্যে একবার আমার মনে পড়ল, দাসুদা যখন জিজ্ঞাসা করলেন বংশে কেউ কখনও ফুটবল খেলেছে কি না, তখন আমি ‘না’ বলেছিলাম।

।।১৫।।

আই এফ এ অফিসে সই করতে গিয়ে বিপিনদার সঙ্গে দেখা। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যু থেকে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিস পর্যন্ত সুতারকিন স্ট্রিটে হাজারখানেক লোকের জটলা। তার মধ্যে বিপিনদা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখে হাত তুলে থামতে ইশারা করলেন। আমি অস্বস্তি বোধ করলাম।

”সোনালিতে সই কচ্ছিস খবর পেয়েছি।”

”আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কেন?” আমি প্রশ্ন করলাম।

”উইথড্র করাব আজ নিমাই, আনোয়ারকে। ওরা দুটোর সময় আসবে।” বিপিনদা ঘড়ি দেখলেন। ”তুই তা হলে আমার কথাটা ভেবে দেখলি না? এরা কত দেবে?”

”এক পয়সাও নয়।”

বিপিনদা অবাক হয়ে, ‘অ’ বলেই সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঠিক দুটোর সময় আনন্দবাজারের গেটের সামনে কমলদার থাকার কথা। আমি সে দিকে এগিয়ে গেলাম। একদল ছেলে খুব উত্তেজিত হয়ে তর্কাতর্কি করছে। বিষয় নঈম, অরুণ ঘোষ, অসীম মৌলিক, পাপান্না, হাবিব, ধীরেন দে, জ্যোতিষ গুহ, মান্না। হঠাৎ কী যেন হল, ওরা ছুটে গেল আই এফ এ অফিসের দিকে ‘নঈম নঈম’ বলে। একটু পরেই ফিরে এল, ‘যত্তোসব উড়ো গুজব’ বলতে বলতে। আমি ভাবলাম, আমার জন্য এরাও একদিন এখানে এইভাবে অপেক্ষা করবে। আমি দল বদলাতে আসছি শুনে ছুটে যাবে। অথচ এরা জানে না, আমি এখন এদের পাশেই দাঁড়িয়ে। ভাবতেই আমার খুব হাসি পেয়ে গেল।

কমলদার সঙ্গে যখন আই এফ এ অফিসের সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, তখন নিমাই আর আনোয়ার বিপিনদার পিছনে নামছে। আমি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পথ দিলাম। নিমাই চমৎকার ঘিয়ে রঙের একটা প্যান্ট পরেছে। ভীষণ টাইট, কোমরের অনেক নীচে নামানো। জুতোর মুখটা ছুঁচলো। চুল আঁচড়াবার ঢঙটাও বদলেছে, কপালের আধখানা জুড়ে চুল নামানো। আনোয়ার পরেছে একটা নীল নায়লনের স্পোর্টস গেঞ্জি, ফরসা রঙের সঙ্গে সুন্দর মানিয়েছে।

”কেমন আছিস?” আমি বললাম।

ওরা থতমত হল, আশা করেনি আমি কথা বলব।

নিমাই তাড়াতাড়ি বলল, ”তুই রোগা হয়ে গেছিস প্রসূন।”

আমি হাসলাম।

”পরে কথা বলব, এখন চলি।” আনোয়ার মৃদু স্বরে বলল। আমি মাথা কাত করলাম।

পরদিন সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরতেই মা দারুণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ”এ ঘরে আয় শিগগিরই, একটা জিনিস দেখাব।” আমি ছুটে গেলাম। মা’র হাতে পাঁচটি একশো টাকার নোট।

”কোত্থেকে পেলে?” প্রশ্ন করলাম অবাক হয়ে। মা একটা চিঠি হাতে দিলেন। চিঠিতে লেখা: ”প্রসূন, কাল ঠিক দুটোর সময় আমি অপেক্ষা করব আই এফ এ অফিসের কাছে, যেখানে তোর সঙ্গে গতকাল দেখা হয়েছিল। ইতি, বিপিনদা।”

মা’র হাত থেকে নোটগুলো নেবার জন্য হাত বাড়ালাম।

”এ টাকা এখুনি ফেরত দিতে হবে। এটা ঘুষ।”

মা’র হাত থেকে নোটগুলো পড়ে গেল। মনে হল যেন ফেলে দিলেন। ফ্যাকাশে মুখে শুধু বললেন, ”ঘুষের টাকা!”

বিপিনদার বাড়ি পৌঁছোলাম রাত দশটায়। অবাক হয়ে বললেন, ”এত রাতে, ব্যাপার কী রে?’

নোটগুলো ওঁর টেবিলে নামিয়ে রেখে বেরিয়ে আসার সময় বললাম, ‘কয়েক ঘণ্টার জন্য টাকাটা আমার কাছে থেকে গেছিল। সে জন্য সুদ আপনার প্রাপ্য। শোভাবাজারের সঙ্গে যে দিন খেলা থাকবে, সে দিন সেটা শোধ দেব।” বলে দরজা পেরোচ্ছি, পিছনে বলতে শুনলাম, ”বটে!”

।।১৬।।

লিগের তৃতীয় ম্যাচ শোভাবাজারের সঙ্গে। এরিয়ানের সঙ্গে ২—২ করে, উয়াড়িকে ৩—০ হারিয়েছে সোনালি। পাঁচটা গোলই আমার, লিগে প্রথম হ্যাট্রিকও। যুগান্তরে লিখেছে, ”সোনালি সংঘের নবাগত ফরোয়ার্ড পি ভট্টাচার্য সুযোগসন্ধানীরূপে পরিচয় দিয়ে গুনে গুনে তিন তিনটি গোল দিয়ে মরসুমের প্রথম হ্যাট্রিক লাভের গৌরব অর্জন করেন।” পিন্টু কাগজ থেকে কেটে রেখে দিয়েছে। ও প্রায়ই এখন বায়না ধরে আমার খেলা দেখার জন্য। যদি খারাপ খেলি ওর সামনে, এই ভয়ে ওকে কখনও মাঠে আনিনি। ও আমার সব থেকে বড় ভক্ত। কিন্তু আজ ওকে এনেছি, আজ আমি কনফিডেন্ট, ভাল খেলবই।

আনোয়ার দূর থেকে হাত তুলল। আমিও হাত তুললাম। তখন খেলার আগে ওয়ারমিং আপ চলেছে। আনোয়ার জগ করতে করতে আমার কাছে এসে বলল, ”খুব গোল দিচ্ছিস, আজ পারবি না।”

”জুনিয়ার ইন্ডিয়া ক্যাম্পে তোর আর নিমাইয়ের নাম আছে দেখলাম।”

আনোয়ার হেসে চলে গেল। নিমাই আমাদের দিকে এল না। রতন একবার বল কুড়োতে এসে বলে গেল, ”সাবধানে থাকবি আজ।”

”কেন?”

”বললুম।”

রতন চলে যাবার পর আমি ওর কথার মানে বোঝার চেষ্টা করেও কোনও হদিস পেলাম না। অবশেষে বুঝলাম হাফ টাইমের মিনিট তিনেক আগে। শোভাবাজার পেনালটি বক্সের মধ্যে আমাদের রাইট আউট ব্যাক সেন্টার করতেই ছুটে গেলাম। আমার সঙ্গে টিকাদারও। বলটা দু’গজ দূরে ড্রপ পড়ে উঠছে, কী করব? ভলি মারলে বারের দশ হাত উপর দিয়ে যাবে। একমাত্র উপায় ডাইভ দিয়ে হেড। সামনে গোলকিপার বেরিয়ে আসছে, আনোয়ারের বুটের ধপধপ বাঁ দিকে, আমি ঝাঁপ দিলাম।

মাথায় বলের স্পর্শ পাবার সঙ্গে সঙ্গে, ডান পাঁজরে প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা ছুরির ফলার মতো বিঁধল। টিকাদার লাথি কষিয়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে, চোখে অন্ধকার দেখছি। তার মধ্যেই রেফারির লম্বা হুইসল শুনতে পেলাম।

সাইড লাইনের বাইরে আমাকে শোয়ানো হল। জারসি খুলে বুকে বরফ ঘষা হচ্ছে। চোখ খুলতেই পিন্টুর কাঁদো—কাঁদো মুখটা প্রথমে চোখে পড়ল। হাত তুলে ওকে আশ্বাস দিতে গিয়ে খচ করে বুকে যন্ত্রণা উঠল। হাসলাম শুধু। দাসুদা, কমলদা ঝুঁকে রয়েছেন। এখন হাফ টাইম।

”গোলটা হয়েছে?” আস্তে উচ্চচারণ করলাম।

”হ্যাঁ।” কমলদা বললেন।

”কেউ নেমেছে নাকি?”

”সুশান্ত নামছে।”

”বারণ করুন, আমি খেলব, আমি পারব।” ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। ”আমার কিছু হয়নি।”

”তোকে খেলতে হবে না প্রসূন।”

ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। আনোয়ারের টকটকে রাঙা মুখ চোখে পড়ল। ”আবার লাগলে সিজনের মতো বসে যাবি।”

রাগে আমি জ্বলে উঠলাম। ”সেই ব্যবস্থাই তো তোরা করেছিস। কাওয়ার্ড।”

আনোয়ারের চোখ দুটো দপ করে উঠল, কথা না বলে চলে গেল।

”খেলতে পারবি? আমার আপত্তি নেই যদি খেলতে চাস।” দাসুদা বললেন।

”কিন্তু দাসুদা—” কমলদা থেমে গেলেন দাসুদার তোলা হাতটাকে দেখে। পিন্টু ফিসফিস করে বলল, ”আনোয়ারদা একা দু’ হাতে তোমায় মাঠ থেকে তুলে আনল। কী গায়ের জোর!”

মাঠে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বল এখন আমাদের ডিফেনডিং জোনে। নিমাই যথেচ্ছ কাটাচ্ছে, একটার পর একটা বল বাড়াচ্ছে আর শোভাবাজারের ফরোয়ার্ডরা প্রত্যেকটা নষ্ট করছে। শেষে নিমাই শোধ করল গোলটা। আমি জানি, ও করবেই। ওকে রোখার সাধ্য সোনালির ডিফেন্সের নেই। আমাদের আটজন পেনালটি বক্সের মধ্যে। এক ছুটের ওপর তিনজনকে কাটিয়ে শরীরটাকে ডান দিকে বাঁ দিকে করিয়ে ছোট্ট একটা চিপ, বেটাল গোলকিপারের ফ্যালফ্যালে চোখের উপর দিয়ে বলটা গোলে ঢুকে গেল।

আমি দু’—এক বার ছোটার চেষ্টা করে বুঝলাম, পারব না। টিকাদার ছায়ার মতো সঙ্গে রয়েছে। তবু চেষ্টা করলাম। রাইট হাফ উঠে এসেছে। ওর সঙ্গে ওয়াল পাস করে বক্সের মাথায় পৌঁছোলাম। রাইট স্টপার ব্যাক ট্যাকল করতে এল। কাটালাম। লেফট হাফ সামনে। ঠেলে দিলাম বলটা বাঁ দিকের ফাঁকা জায়গায়। আমাদের লেফট আউট উঠে আসছে দেখছি। আনোয়ারের পিছনে চমৎকার জায়গা পড়ে আছে, ওখান থেকে গোল দশ গজ। ছুটে গেলাম সেখানে। লেফট আউট দিল আমাদের লেফট ব্যাককে। বল ধরে ও কাকে দেবে খুঁজছে, আমি হাত নাড়তেই ঠেলে দিল। শোভাবাজারের চারজন আমার দিকে ছুটে এল।

বলটা ঠিকমতো থামাতে পারলাম না। ছিটকে বেরিয়ে গেল পা থেকে। আনোয়ার ছুটে এসে পড়েছে। এবার সোজা গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেবে, তা ছাড়া উপায় নেই। তবু একবার শেষ চেষ্টা করলাম। আনোয়ার বলটা মারবার জন্য পা তুলে থমকে গেল। হুড়মুড়িয়ে আমি আর টিকাদার বলের জন্য এগিয়ে গেলাম।

”ওরে বাপস।”

একটা চাপা আর্তনাদ উঠল। আনোয়ার আর টিকাদার মাটিতে পড়ে। বলটা গড়াচ্ছে। ছুটে গিয়ে ধরলাম বলটা। গোল মাত্র পাঁচ—ছ’ গজ দূরে। একটা টোকা দিয়ে বাকি কাজটা সেরে ফিরে তাকিয়ে দেখি, টিকাদার তলপেট চেপে কাটা পাঁঠার মতো ছটফটাচ্ছে। আমি আনোয়ারের মুখের দিকে তাকালাম।

”কী করলি?”

”বেশ করেছি, তোর কী?”

বিপিনদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন মাঠের মধ্যে চিৎকার করতে করতে : ”সাসপেন্ড করব তোকে। নিজের প্লেয়ারকে মারলি, জানোয়ার কোথাকার! বন্ধুত্বের প্রতিদান হল, সব বুঝি, সব বুঝি।”

আমি লজ্জা পেয়ে সরে গেলাম। রতন আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল, এমন একটা ব্যাপার যে হবে তা সে জানত। টিকাদারকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাবার পর শোভাবাজার আর খেলতে পারল না। আমাদের রাইট আউট পর পর দুটো গোল করল। দাসুদা হাত নেড়ে আমাকে মাঠ থেকে চলে আসতে বললেন।

রাত্রে আমার বুকে ব্যথা শুরু হল। মাকে ডাকলাম। পিন্টু বাড়ি এসে মাকে নিশ্চয় মাঠের কথা বলেছে, নয়তো মা প্রথমেই ক্ষুব্ধ স্বরে বলবেন কেন, ”কী দরকার ছিল অমন করে ডেনজারাসলি গোল দেবার? বুকে লাথি খেতে হয় যেখানে, দরকার কি সে কাজ করার?”

মা’র মুখে ইংরিজি শুনলে হাসি পায় আমার। আসলে পিন্টুর কথাই মা’র মুখ দিয়ে বেরোল। বললাম, ”গোল ডেনজারাসলিই পেতে হয়।” গজগজ করতে করতে মা সরষের তেল গরম করে আনলেন। বুকে মালিশ করতে করতে একবার শুধু বললেন, ”ফুটবলই আমার সর্বনাশ করবে।”

।।১৭।।

সকালে বুক টাটিয়ে উঠল। আমার শুধু একটাই ভয়, এত পরিশ্রম করলাম সারা বছর, বুঝি বিফলে গেল। চোট পেয়েছি জানলে দাসুদা বসিয়ে দেবেন। অথচ বড় ম্যাচ একটাও খেলা হল না এখনও। পরশুই খিদিরপুরের সঙ্গে খেলা। আজ কী কাল ক্লাবে না গেলে নিশ্চয়ই কেউ খোঁজ করতে আসবে, জেনে যাবে চোট পাওয়ার কথা।

ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম দাসুদা কী কমলদাকে জানিয়ে দিই যে, আমি কলকাতায় নেই। মাসির বিয়েতে মামাবাড়ি চলে গেছি। কিন্তু কাকে দিয়ে খবর পাঠাব! পিন্টু ছাড়া আর কেউ নেই। কালীঘাটে দাসুদার বাড়ি কি গড়িয়ায় কমলদার বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার মতো ডাঁটো এখনও সে হয়নি। দাসুদার টেলিফোন আছে, নম্বরটা জানি না। ওঁর ভাল নামটাও জানি না। হর্ষদা জানতে পারেন। পিন্টুকে হর্ষদার কাছে পাঠিয়ে দিলাম, আর সাবধান করে দিলাম, একদম যেন চোট পাওয়া সম্পর্কে একটি কথাও না বলে, তা হলে আর কোনও দিন মাঠে নিয়ে যাব না।

পিন্টু টেলিফোন নম্বর আনল। এবার সমস্যা কাকে দিয়ে টেলিফোন করাব। নীলিমাকে ডাকলাম, ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতেই ও গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল এবং টেলিফোন নম্বর নিয়ে বেরিয়ে গেল। আধ ঘণ্টা পর নীলিমা ফিরল। ওর সাড়া পেয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে হৃৎপিণ্ডটা ধক করে গলায় আটকে গেল। দুই মূর্তি দাঁড়িয়ে, আনোয়ার—নিমাই।

ওদের দেখাচ্ছিল খুবই ব্যস্ত আর সিরিয়াস। আনোয়ার মোটা মোটা আঙুলগুলো আমার বুকে রেখে আলতো চাপ দিল। আমার মুখে যন্ত্রণা ফুটে উঠতে দেখে নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা কাত করল। নিমাইও গম্ভীর হয়ে মাথাটাকে দু’বার উপর—নীচ করল। তার পর দুজনে ফিসফিস কী কথা হল, নিমাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আনোয়ার মাকে বলল, ”মাসিমা, ওকে জামা পরিয়ে দিন, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”

আমি একটাও কথা বলিনি। শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে কোনও পাত্তা না দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। মা আমাকে জামা পরিয়ে দিতে আনোয়ার বলল, ”হাঁটতে পারবি?” আমি মাথা নাড়লাম। নিমাই ট্যাক্সি এনেছে। দু’পাশে দুজনে ধরে আমাকে ট্যাক্সিতে তুলল। আমরা শ্যামবাজারের দিকে রওনা হলাম।

হাড় ভাঙেনি। একস—রে না করলে চিড় খেয়েছে কি না বোঝা যাবে না। ডাক্তার কষে ব্যানডেজ করে দিল বুকটা। শুয়ে থাকতে হবে, নড়াচড়া বারণ। ট্যাক্সিতে ফিরে এলাম। ওরা কেউ আমার সঙ্গে কথা বলল না, আমিও বললাম না। পৌঁছে দিয়ে, মা’র সঙ্গে কথা বলেই ওরা চলে গেল। নীলিমাকে দেখা মাত্র রেগে বললাম, ”কে তোমাকে সর্দারি করে ওদের ডাকতে বলেছে?”

নীলিমা উত্তর দিল, ”টেলিফোন করেছি। বলেছি, দিন পনেরো মামাবাড়ি থাকবে।” এই বলে গম্ভীরভাবে ও আঙুলের ইশারায় আমাকে শুয়ে থাকতে বলে বেরিয়ে গেল।

একস—রে রিপোর্টে কিছুই পাওয়া গেল না।

খিদিরপুর, ইস্টার্ন রেল, মহামেডান, কালীঘাট, রাজস্থান—পাঁচটা ম্যাচ শুয়ে রইলাম বাড়িতে। তিনটে হেরেছি, দুটো ড্র। এর পর আর শুয়ে থাকা গেল না। একদিন সকালে অল্প দৌড়োলাম, সামান্য ব্যায়ামও করলাম, কোনও অসুবিধা হল না। বিকেলে টেন্ট—এ গেলাম। পরদিনই স্পোর্টিং ইউনিয়নের সঙ্গে খেলা। এত দিন মামাবাড়িতে থাকার জন্য দাসুদা মৃদু বকুনি দিলেন এবং জানালেন, টিম হয়ে গেছে। তবে আমি খেলছি। আমার জায়গায় যাকে নামানো হয়েছিল, সে একদম সুবিধা করতে পারছে না।

সাবধানে, ঝুঁকি না নিয়ে প্রায় দাঁড়িয়েই খেললাম। জিতলাম ৩—০। পেনালটি বক্সের মাথায় বল পেয়ে দুটো শট থেকে গোল করলাম। পরের ম্যাচ বি এন আর—এর সঙ্গে। এবার অরুণ ঘোষের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে যাচাই করব, এই ভেবে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কিন্তু মাঠে এসে যখন শুনলাম অরুণ ঘোষ খেলছে না, তখন বেশ ক্ষুণ্ণ হই। মনে হল, অরুণ ঘোষ আমাকে বঞ্চিত করল। নয় মিনিটের মধ্যে দুটো গোল দিয়ে মাঠকে অবাক করে দিলাম। ছোট টিম সোনালি শুরু থেকেই ডিফেনসিভ খেলবে, বোধ হয় এই রকম একটা ধারণা করেছিল বি এন আর। বদলে আমরা সোজা তাদের গোলের দিকে এগিয়ে যাই। পাঁচ মিনিটের পর রাইট আউটের ক্রস করা বল গোলকিপার এগিয়ে এসে পানচ করে সামনে ফেলতেই ছুটে এসে ভলি মেরে নেটে পাঠিয়ে দিলাম। দ্বিতীয় গোল একইভাবে। এর পর বি এন আর গুছিয়ে নিয়ে আমাদের কোণঠাসা করলেও আর গোল দিতে পারেনি। আমাদের গোলকিপার রবি নিশ্চিত চারটে গোল বাঁচিয়েছিল।

পরের ম্যাচে যুগের যাত্রীর সামনে পড়লাম আমরা। লিগে যাত্রী এখন সবার উপরে, একটাও পয়েন্ট নষ্ট করেনি। মোহনবাগান হেরেছে ইস্টার্নের কাছে, ইস্টবেঙ্গল ড্র করেছে রাজস্থানের সঙ্গে। এ বছরে পাঁচটা ম্যাচ খেলেছি মাত্র, কিন্তু তাতেই ময়দানের আনাচে কানাচে, অনেক টেন্টে আমাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সামনের বছর কোন ক্লাব আমাকে তুলে নেবে, কত দর হবে, এ সব কথাও নাকি বলাবলি হচ্ছে। লিগের টপ স্কোরার এখন আমি—পাঁচটি ম্যাচে এগারোটা গোল। অসীম মৌলিক দশটা ম্যাচে দশ গোল, অশোক চ্যাটার্জি এগারোটা ম্যাচে আট গোল।

।।১৮।।

নীলিমা স্কুল ফাইনাল পাশ করেছে সেকেন্ড ডিভিশনে। বাড়িতে হইহই পড়ে গেছে সকালেই। তখনও আমি বিছানা ছেড়ে উঠিনি। বাড়িওয়ালা বিশু দত্ত চেঁচাচ্ছে: ”নুটুবাবু, খাওয়াতে হবে।”

”নিশ্চয় নিশ্চয়, কী খাবেন বলুন!”

”রাবড়ি। বড়বাজারের রাবড়ি।”

ঘরের বাইরে এলাম। দেখি, নীলিমা প্রণাম করছে মাকে। তার পর আমাদের ঘরে ঢুকল। বাবা আছেন ঘরে। মা ফিসফিস করে আমাকে বললেন, ”তোর কাছে টাকা আছে? একটা শাড়ি দিতুম! আহা, কত কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে।”

”বাবার কাছে নেই?’

”এই মাসটা চালাবার মতন আছে।”

”আমার কাছে টাকা বারো আছে। তাই দিয়ে কি শাড়ি হবে?”

মা ভেবে বললেন, ”থাক তা হলে, পরে দেবখন।”

”জ্যেঠিমা, প্রসূন আমার থেকে কত বড়?” নীলিমা ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, ”ছ’ মাসের বেশি কি?”

মা হেসে বললেন, ”ওই রকমই হবে।”

এর পরই একটা ভয়ংকর অপ্রতিভতার মধ্যে নীলিমা আমাকে ফেলে দিল। গোল থেকে এক গজ দূরে বল পেয়ে গোলের বাইরে মারলে মাঠভর্তি লোকের সামনে যা হয়, সেই রকম বোঁ বোঁ করে উঠল মাথাটা। নীলিমা প্রণাম করেছে আমায়। পাশ করলে দেখছি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়! আমি আমতা আমতা করে কী সব বলতে বলতে ঘরে পালিয়ে এলাম। শুনলাম নীলিমা বলছে, ‘প্রসূন যত মন দিয়ে প্র্যাকটিস করে, আমি যদি সেভাবে পড়তাম, তা হলে স্কলারশিপ পেতাম।”

উঁকি মেরে দেখলাম, নীলিমা বালতি হাতে কলঘরে যাচ্ছে। ওকে ডাকলাম।

”এবার তো কলেজ?”

”হ্যাঁ। টাকা জোগাড় করতে হবে, প্রায় একশো।”

মনে মনে সিঁটিয়ে গেলাম। যদি এখন এত দিনের ধারের টাকা চেয়ে বসে। তাড়াতাড়ি বললাম, ”তোমাকে কিছু একটা উপহার দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু হাতে এমন টাকা নেই যে কিনতে পারি।”

নীলিমা কিছু বলতে যাচ্ছে, এমন সময় পিন্টু ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকল।

”দাদা, একটা লোক তোমায় ডাকছে। বলল, খুব দরকার।”

গলিতে বেরিয়ে দেখি, রঙিন বুশ শার্ট গায়ে, ফরসা, কটা—চোখ, বছর চল্লিশের একটি লোক দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই খুব পরিচিতের ভঙ্গিতে বলল, ”প্রসূন, একটা কথা ছিল, চলো একটু বাইরে গিয়ে বলব।”

রাস্তায় এসে বললাম, ”যা বলবার এখানেই বলুন, আমি আর যাব না, কাজ আছে।”

একটা ফিয়াট গাড়ি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে লোকটা বলল, ”চলো না একটু ঘুরে আসি, মোটরে বসেই বলব। কথাটা খুবই প্রাইভেটলি বলতে চাই।”

লোকটার চালচলন আমার বিশ্রি লাগছে, তার উপর ‘প্রাইভেটলি’ কথা বলার প্রস্তাবটা ভাল লাগল না। বললাম, ”আপনার প্রাইভেট কথা এখানে দাঁড়িয়েও বলতে পারেন, কেউ শুনতে পাবে না।”

লোকটা এধার—ওধার তাকিয়ে, গলা খাঁকারি দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ”কালকের ম্যাচটা তুমি খেলো না।”

”যাত্রীর সঙ্গে খেলব না?” আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। ”বলছেন কী আপনি!”

”তুমি কত টাকা আর পাও সোনালি থেকে, মাসে মাসে একশো… খবর রাখি, সব ক্লাবেরই খবর রাখি।” লোকটা হঠাৎ পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে আমার হাতটা টেনে মুঠোয় গুঁজে দিল। ”খেলতে চাও যদি, নিশ্চয়ই খেলবে। কুড়ি—পঁচিশ বছর কলকাতায় কোনও বড় ট্রফি আমরা পাইনি, এবার ভাল চান্স এসেছে লিগ পাবার, কাল তুমি ব্যাগড়া দিয়ো না ভাই।”

আমি তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠিনি। বললাম, ‘আমি ব্যাগড়া দেব?”

”ভয় তোমাকেই প্রসূন। কলকাতার সব ক্লাব এখন তোমাকে ভয় করে; মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান সবাই। কাল তুমি গোল দিয়ো না।”

এতক্ষণে আমি সংবিৎ ফিরে পেয়েছি। একশো টাকার নোটটা লোকটার বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম, ”এখন থাক। আপনি আমাদের বাড়িতে আসুন, আমার বাবার হাতে এটা দেবেন।”

লোকটা ইতস্তত করে বলল, ”তোমার বাবা কী করেন?”

”বেকার। একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। লক আউট হয়ে বন্ধ।”

”তা হলে তো তোমরা বেশ অসুবিধের মধ্যে রয়েছ।” লোকটা বুকপকেটে হাত দিয়ে বেশ খুশি হয়েই বলল, ”তোমার উচিত সংসারকে হেলপ করা।”

আমি কথা বললাম না। লোকটাকে নিয়ে সটান বাবার সামনে হাজির করলাম। নীলিমা তখন বাবার কাছে বসে কলেজে ভর্তি হওয়ার অসুবিধে নিয়ে কথা বলছে। আমি কোনও ভূমিকা না করে বললাম, ”বাবা, কাল যুগের যাত্রীর সঙ্গে আমাদের খেলা। কাল আমি যেন না খেলি বা খেললেও যেন গোল না দিই, এই কথা ইনি বলছেন আর একশো টাকা আমায় দিতে চাইছেন।”

আচমকা এমন ভাবে বললাম যে, শুধু বাবা আর নীলিমাই নয়, কটা—চোখ লোকটাও আড়ষ্ট হয়ে গেল। অবশেষে বাবা মৃদু স্বরে বললেন, ”কোন ক্লাবের সঙ্গে খেলা?”

”যুগের যাত্রী।” আমি বললাম। মনে হল বাবার চোখ ঝলসে উঠল। ওঁর কপালের উপর আমি অবধারিত চোখ রাখলাম।

বাবা মাথা নিচু করে বললেন, ”আমি জানি না। আমি কোনও কথা বলব না। তুমি নিজেই ঠিক করো ঘুষ তুমি নেবে কি না।”

বাবা মাথা তুলে আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমার বুক কাঁপতে শুরু করেছে। নীলিমা কী যেন বলবার চেষ্টা করছে আর আমি কী যেন একটা করতে চাইছি। আমার মনের মধ্যে তখনই কার কণ্ঠস্বর শুনলাম, ”প্রসূন, দ্যাখো দ্যাখো, তোমার বাবার অপমানিত কপাল। ওখানে বিজয়তিলক এঁকে দেবে তুমি, হ্যাঁ তুমিই।”

”কাল যাত্রীকে আমি হারাবই”, দাঁতে দাঁত চেপে বললাম। তার পর লোকটার দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে বললাম, ”গেট আউট!”

লোকটা অবাক হল মাত্র, কিন্তু ঘাবড়াল না। যাবার সময় মুচকি হেসে বলে গেল, ”তুমি গোল দিতে হয়তো পারো, কিন্তু গোল খাওয়া বন্ধ করতে পারবে না। ফুটবল এগারো জনের খেলা মনে রেখো।”

আমার খুপরিতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে আমি বসেছিলাম। ঘরে কে এসে দাঁড়াল। মুখ তুলে দেখি, নীলিমা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে। সাগ্রহে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ”বাবা কিছু বললেন কি তার পর?”

”না, শুধু অনেকক্ষণ পর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল মুছে নিতে দেখেছি।”

”আমি ঠিক করিনি নীলিমা?”

নীলিমা ভারী স্নিগ্ধ নরম স্বরে বলল, ”তুমি আজ সব্বাইকে এত বড় উপহার দিলে প্রসূন। ওহ এত বিরাট! প্রসূন, কাল তুমি দারুণ খেলবে, ঠিক জিতবে।”

।।১৯।।

ফুটবল যে এগারো জনের খেলা, এই সত্য নির্মমভাবে উপলব্ধি করলাম পরদিন। আর একটি শিক্ষা পেলাম—’জিতবই’ এমন কথা কদাচ বলবে না। যাত্রীর কাছে আমরা ২—৩ গোলে হেরে গেলাম। মাঠে যে এত ভিড় হবে কল্পনা করিনি। মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টারই বেশি। ওরা যাত্রীর হার চায়, তাই সোনালিকে মদত দিতে ওরা সবাই সোনালির সাপোর্টার হয়ে গেছে। ওরা আশা করেছিল, আমি একটা কিছু করব।

কিন্তু যাত্রী শোভাবাজার নয়। অত্যন্ত আঁটসাঁট আর চমৎকার গুছোনো ডিফেনস। ওদের লেফট হাফ অমিয় আর রাইট স্টপার ব্যাক দুলাল গত বছর মারডেকা টুরনামেন্ট খেলে এসেছে। গোলকিপার শ্যাম যে দিন খেলে, সে দিন একটি মাছিও গোলে ঢুকতে পারে না। তবে সেই দিনটি যে কোন খেলায় আসবে, তা কেউ বলতে পারবে না, শ্যামও না।

রাইট—ইন বিষ্ণু মিশ্র এ বছর জুনিয়ার ইন্ডিয়া ক্যাম্পে ডাক পেয়েছে, বলের উপর ভাল কনট্রোল আছে, তবে নিমাইয়ের মতো নয়। কিন্তু অনেক বেশি পরিশ্রমী আর যেমন ওঠে তেমনই নেমেও আসতে পারে। বুদ্ধিটা একটু কম। লেফট আউট আব্রাহামের মতো দ্রুত উইঙ্গার কলকাতায় দ্বিতীয় নেই। পেনালটি বক্সের কোণ থেকে ডান পায়ে এমন শট নেয়, যার শতকরা নব্বুইটা গোলে ঢুকবেই। লেফট—ইন শিবরমন ছোটখাটো, অত্যন্ত চতুর, বক্সের মধ্যে ছুঁকছুঁক করে বেড়ায়। কখন যে গোল ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, বোঝা কঠিন। বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু সেটা জানতে দেয় না।

আমরা মরিয়া হয়ে খেলব প্রতিজ্ঞা করে নেমেছিলাম। পনেরো মিনিট পর্যন্ত দু’ পক্ষই সতর্ক হয়ে শুধু মাঝ মাঠে খেলেছি। তার পরই বিষ্ণু হঠাৎ বল নিয়ে এগোয় আমাদের গোলের দিকে। রাইট হাফ ওর পিছু নেয়। বিষ্ণু বাঁ দিকের কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে সরে গেল, আব্রাহাম ভিতরে ঢুকে এল। বিষ্ণু ব্যাক পাস দিল অমিয়কে, সে দিল আব্রাহামকে। কুড়ি গজ থেকে গোলে দুর্বল নিচু শট করল আব্রাহাম। সোনালির গোলকিপার রবি ঝাঁপিয়ে ধরতে পারল না। আমার মনে হল, রবি যেন ইচ্ছে করেই দেরিতে ঝাঁপিয়েছে। হঠাৎ সেই কটা—চোখের কথাটা মনে চমকে উঠল, ”গোল দিতে হয়তো পারো, কিন্তু গোল খাওয়া বন্ধ করতে পারবে না।”

আমি শিউরে উঠলাম। তা হলে একশো টাকার নোটের কাছে নিজেকে বিক্রি করার লোক সোনালিতে ওরা পেয়েছে। কিন্তু ক’জনকে কিনেছে জানি না। প্রত্যেকের উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে এখন। রাইট আউট একটা সহজ বল ট্র্যাপ করতে গিয়ে বাইরে পাঠাল, অমনি সন্দেহ হল। পারলে নিশ্চয় আমাকেই দিতে হত, কেননা চমৎকার জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে। আব্রাহাম রাইট ব্যাককে কাটাতে গিয়ে পারল না। রাইট ব্যাক বলটা পায়ে রেখে লোক খুঁজতে তাকাচ্ছে, আব্রাহাম বল ছিনিয়ে নিল আর আমার সন্দেহ হল। সোনালির গলদ দেখছি আর সন্দেহ হচ্ছে।

হাফ টাইমের দু’ মিনিট আগে যাত্রী দ্বিতীয় গোল দিল। ডান দিক থেকে চমৎকার মুভ করে বাঁ দিক থেকে শেষ করল আব্রাহাম। পোস্ট আর ক্রসবারের কোণ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে বলটা ঢুকল। রবির কিছুই করার ছিল না। হাফ টাইমে দাসুদাকে বললাম আমার সন্দেহের কথা, আর গতকাল যা ঘটেছে। দাসুদা রবির কাছে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন। দূর থেকে দেখলাম রবি খুব অবাক হয়ে গেল, হাত নেড়ে তর্ক শুরু করতেই দাসুদা ইশারায় রিজার্ভ গোলকিপার অজিতকে ওয়ারম—আপ করতে বললেন। রবির মুখ ফ্যাকাশে হতে দেখলাম।

খেলা আবার শুরু হতেই আধ মিনিটের মধ্যে আমি গোল দিলাম। সেন্টার লাইন থেকে বল নিয়ে তিনজনকে কাটিয়ে ষোলো গজ থেকে শট নিলাম। শ্যাম ঠাওর করতে পারেনি, অন্তত তিন গজ বাইরে দিয়ে যাওয়ার কথা যে বলের, সেটা বেঁকে এসে ঢুকতে পারে। বিরাট গর্জন উঠল ইস্টবেঙ্গল মাঠ কাঁপিয়ে। আমি এই প্রথম গোল দেওয়ার পর এত বড় আওয়াজ পেলাম। তিন মিনিট পর রাইট আউট তরতরিয়ে উঠে ক্রস করল। শ্যাম গোল ছেড়ে বেরোতে সেকেন্ড তিনেক মাত্র দেরি করে, বল মাটিতে পড়া মাত্র হাফ ভলিতে নেটে পাঠিয়ে দিলাম।

গ্যালারিতে যেন বাজ ডেকে উঠল আর মাঠ যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। চার—পাঁচ জন আমাকে জাপটে ঘাড়ে পিঠে ওঠার চেষ্টা করছে। দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার মতো অবস্থা। এর পর গ্যালারি থেকে শুধু ”প্রসূনকে বল দে, প্রসূনকে, প্রসূনকে” রব উঠতে লাগল।

যাত্রী দ্বিগুণ উদ্যমে আক্রমণ শুরু করেছে। একে একে আমরা পিছিয়ে নেমে ঠেকাবার চেষ্টা করছি। চাপ ক্রমশই বাড়ছে। নতুন অনভিজ্ঞ অজিত পাগলের মতো খেলছে। লক্ষ করলাম, আমার কাছে যাত্রীর দুজন দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। পঁয়ষট্টি মিনিট পর্যন্ত যাত্রীকে রুখে আর পারা গেল না। অমিয়র চিপ থেকে বিষ্ণু হেড করল, বারে লেগে বল ফিরে আসছে, রাইট স্টপার বলটা উড়িয়ে দিতে গিয়ে মিস—কিক করে বিষ্ণুর পায়েই দিল। সেখানে থেকে বিষ্ণু সহজেই গোল দিল।

হেরে গেলাম। মাঠ থেকে বেরোচ্ছি আর শুনছি ”ওয়েল প্লেড প্রসূন… সাবাস প্রসূন!” কিন্তু আমি মনে মনে কুঁকড়ে আছি। ‘যাত্রীকে হারাব’ বলে বাবার সামনে জাঁক করেছি। হারাতে পারলাম না। হঠাৎ পিঠে একটা মৃদু চাপড়ানি আর চাপা স্বরে ‘তুমি সত্যিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে’ শুনে পিছনে তাকিয়ে সেই কটা—চোখকে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যেতে দেখলাম।

টেন্টে ফিরে রবিকে কয়েকটা কথা বলার ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু বলতে পারলাম না। উন্মনা হয়ে ও এক কোণে বসে রইল, কারও সঙ্গে কথা বলল না। তার পর নিঃশব্দে এক সময় টেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। পিন্টু আমার সঙ্গে রয়েছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি রওনা হলাম। বাসে পিন্টু বলল, ”নিমাইদা আমার সামনে বসেছিল। তোমাকে একটা ছেলে গালাগাল দিতেই নিমাইদা তাকে এক চড় কষিয়ে দিয়েছে।”

”আনোয়ার ছিল?”

”হ্যাঁ। নিমাইদাকে বার বার বলছিল তুই থাকলে প্রসূন আরও দু—তিনটে গোল পেত।”

”কী বলল নিমাই?”

”কিছু বলেনি।”

বাড়ি ফিরে অন্ধকার ঘরে শুয়ে রইলাম। খেলার রেজাল্ট পিন্টুই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। মা একবার ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে গেলেন। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম না খেয়েই।

।।২০।।

যাত্রী লিগ চ্যাম্পিয়ান হল না। শিল্ডও শেষ হল না কোর্টের ইনজাংশনে। এর থেকেও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটল পরের বছরের শুরুতেই। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, যুগের যাত্রী, তিনটি ক্লাবই আমাকে চেয়েছে। আমার ইচ্ছে মোহনবাগানে যাওয়ার। কিন্তু শুনলাম, হাবিব আর সুকল্যাণকে ওরা নিচ্ছে, সুভাষকে ইস্টবেঙ্গল। আমি দোটানায় পড়েছি—যাব কি যাব না, গেলে খেলার সুযোগ পাব কি পাব না, এমন সময় যাত্রী আমায় ছ’হাজার টাকা দর দিল।

যাত্রীর সম্পাদক অনাদি বিশ্বাসের বাড়িতে কথা হচ্ছিল। আর ছিল সেই কটা—চোখ। পরে ওর নামটা জেনেছি, ডাকুদা। যাত্রীর টিম সিলেকশন কমিটির মেম্বার। বছরে হাজার দশেক টাকা খরচ করে। ক্লাবের মধ্যে প্রতিপত্তিতে সম্পাদকেরও উপরে। ডাকুদাই নাকি বিশেষ করে আমাকে চেয়েছে।

”তুমি অনিল ভটচাজের ছেলে। তোমার উপর তো যাত্রীর বিশেষ দাবি আছে।” সম্পাদক এই বলে তাকাল ডাকুদার দিকে। ডাকুদা শুধু মাথা নাড়ল। ”বাপ—ছেলে একই ক্লাবে খেলবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তা ছাড়া—” সম্পাদক থেমে গেল। ডাকুদার দিকে একবার তাকিয়ে কেশে বলল, ”তোমার বাবার উপর সুবিচার করেনি যাত্রী। আমি জানি। কিন্তু তখন আমি তো ক্লাবের একটা অরডিনারি মেম্বার। সেই ফাইনাল খেলা আমি দেখেছি। আহ, কী খেলা তোমার বাবার, এখনও চোখে ভাসছে। অথচ ওর নামেই কিনা কলঙ্ক রটানো হল। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। আমাকেই করতে হবে।” সম্পাদকের যেন আবেগে কণ্ঠরোধ হল। আমার মন দুলে উঠছে বাবার প্রশংসা শুনে। যাক, তা হলে সবাই বিশ্বাস করে না।

”এবার আমরা ইয়ং টিম করব। বয়স হয়ে গেছে বেশির ভাগেরই। তোমাদের দিয়েই রিপ্লেস করাব। বাইরে থেকে আর প্লেয়ার আনব না। কেড়ে নাও, এই সব বুড়োদের হটিয়ে জায়গা কেড়ে নাও। ইন্ডিয়া টিমে যাত্রীর কোটা আছে, আমি তোমায় পুশ করব। স্কুল ফাইনালটা পাশ করো, আমি তোমায় ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকিয়ে দেব। যাত্রীর মেস আছে, সেখানে থাকবে। ভাল খাবে, ভাল করে খেলবে… এত অল্প বয়স, কত সম্ভাবনা তোমার সামনে।” সম্পাদক আন্তরিক স্বরে যেভাবে বলল, তাতে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।

”ছ’ হাজার টাকা এখন তোমায় কেউ দেবে না, কিন্তু আমরা দেব।” ডাকুদা হাতের নখ পরীক্ষা করতে করতে বলল, ”এটা কিন্তু ঘুষ নয়।”

আমি এবার একটু লজ্জা পেলাম। বললাম, ”আমি সৎভাবে টাকা রোজগার করতে চাই।”

”নিশ্চয় নিশ্চয়, তাই তো উচিত।” সম্পাদক টেবিল চাপড়ে বলে উঠল। ডাকুদা ঘড়ি দেখে বলল, ”আচ্ছা প্রসূন, তা হলে এই কথাই রইল। তুমি ভেবে দেখো। এখনও মাসখানেক সময় তো আছে।”

ওখান থেকে আমি সোজা দাসুদার বাড়ি গেলাম। সব কথা শুনে দাসুদা বললেন, ”তুই যাত্রীতেই যা। সোনালিতে থাক, এমন কথা আমি বলব না। নিজের ভবিষ্যৎ তোকে দেখতে হবে তো। ফুটবলই তোর সব কিছু। তুই এবার বড় ক্লাবে যা। তবে সাবধানে থাকিস। ওখানে টাকাপয়সা যেমন বেশি, দলাদলিটাও বেশি। ডাকু লোকটা সুবিধের নয়। অনেক ছেলের ক্ষতি করেছে, কেরিয়ার শেষ করে দিয়েছে।”

”আমার কী ক্ষতি করবে? আমি যদি খেলতে পারি, তা হলে আমায় আটকাবে কে? খেলা দেখিয়েই এতটা এসেছি, আরও যাব।” আস্থাভরেই কথাগুলো বললাম। দাসুদা হেসে বললেন, ”তাই যেন পারিস।”

আমি যাত্রীতেই সই করলাম। ডাকুদা সেই দিনই দু’হাজার টাকা দিল। বাকিটা সারা বছরে চার কিস্তিতে দেবে। আমি সই করার দু’দিন পরেই কাগজে দেখি, আনোয়ার আর নিমাই যাত্রীতে সই করেছে। মনে মনে আমি ভীষণ খুশি হলাম।

দাসুদাকে বলেছিলাম, যদি খেলতে পারি, তা হলে আমায় আটকাবে কে? কিন্তু খেলার সুযোগই যদি না পাই, তা হলে পারি কি পারি না, প্রমাণ করব কেমন করে। যাত্রীর প্রথম পাঁচটা ম্যাচ ড্রেস করে সাইড লাইনের ধারে বেনচে বসে থাকলাম। আমাকে খেলানো হচ্ছে না, আমি নাকি খুবই কাঁচা, অনভিজ্ঞ। বালী প্রতিভা কি কালীঘাটের সঙ্গে খেলার মতন যোগ্যতাও নাকি আমার নেই। এই সব টিমের সঙ্গে খেলাতেও যাত্রীর কমিটি মেম্বারদের মুখ শুকিয়ে আসে, নতুন ছেলেদের নামাতে ভয় পায়। যদি পয়েন্ট যায়, তা হলে দোষ পড়বে কমিটির ঘাড়ে। তার থেকে নামী বুড়ো প্লেয়াররা নিরাপদ, কিছু ঘটলে দায়িত্বটা ওদের।

আনোয়ারকে প্রথম দুটো ম্যাচ খেলানো হয়নি। বালীর সঙ্গে ভাল খেলল, তার পর আর বসেনি। নিমাইও ওই ম্যাচে আধখানা খেলেছে। পরের ম্যাচ খিদিরপুরের সঙ্গেও আধখানা। কালীঘাটের সঙ্গে খেলার দশ মিনিটেই শিবরমনের চোট লাগা হাঁটুতে আবার লাগতে নিমাই নামে। দুটো গোলও দেয়। নিমাইকে এখন আর বসানো যাবে না।

যাত্রীর কোচ প্রিয়দাকে একদিন অধৈর্য হয়ে বললাম, ”আমাকে কি বসিয়ে রাখার জন্য এনেছেন?”

”কী করব ভাই,” নির্বিরোধী প্রিয়দা এধার—ওধার তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন, ”টিম করে সিলেকশন কমিটি, আর কমিটি মানে ডাকুদা। আমাদের কোনও কথাই কানে নেয় না। তুমি বরং ওকেই জিগ্যেস করো।”

ডাকুদাকে সেই দিনই ধরলাম। ওর কয়েকজন পেটোয়া প্লেয়ার আছে, তার মধ্যে দুজন বিষ্ণু আর আব্রাহাম তখন ডাকুদার সঙ্গে ক্লাব টেন্টের বাইরে বাগানে চেয়ারে বসে গল্প করছিল। আমি সটান জিজ্ঞাসা করলাম, ”ডাকুদা, আমাকে নিয়ে এলেন, কিন্তু খেলাচ্ছেন না কেন?”

”দরকার হলেই খেলাব।” ডাকুদা হাতের নখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন।

”কবে দরকার হবে?”

”বলতে পারছি না এখন। হয়তো এই সিজনে দরকার নাও হতে পারে।”

”তা হলে এত টাকা খরচ করছেন কেন আমার জন্য? বসে থেকে যে আমার খেলা নষ্ট হয়ে যাবে।” কাতর স্বরে আমি বললাম।

”যাত্রীর মতন ক্লাব তোমার মতন দু’—চারটে প্লেয়ারকে বসিয়ে টাকা দিলে দেউলে হয়ে যাবে না। টাকার জন্যই তো খেলা, তা যখন পাচ্ছ তখন এত উতলা হওয়া কেন?” ডাকুদা তার কটা—চোখ দুটো বিরক্তিতে সরিয়ে নিলেন আমার মুখের উপর থেকে।

বিষ্ণু ব্যস্ত হয়ে বলল, ”এখন যা তো, আমরা দরকারি কথা বলছি, পরে যা বলার বলিস।”

মুখ কালো করে আমি চলে এলাম। নিমাই হেসে হেসে দুটো ছেলের সঙ্গে টেন্টের মধ্যে কথা বলছে। দেখেই বোঝা যায় পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে। প্রায়ই ওদের দেখি, নিমাইকে নিয়ে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে যেতে। নিমাই আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার গল্প করতে লাগল। আনোয়ার আজ আসেনি। আমি ক্লাব থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ালাম।

একদৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, দু’ হাজার টাকা নিয়ে বাড়িতে পৌঁছোনো মাত্র কেমন উৎসবের মতন হইচই শুরু হয়ে গেছিল। বিশু দত্তও নেমে এল উপর থেকে। পিন্টু, পুতুল, নীলিমা ভিড় করে দাঁড়াল। বাবা বাড়ি ছিলেন না।

”আরে বাব্বাঃ, ফুটবল খেলে অ্যাতো টাকা পাওয়া যায়, তা হলে তো ছোটবেলায় বল পেটালেই লাভ হত দেখছি!” বিশু দত্ত বলল।

”সবার কি আর সব জিনিস হয় দত্ত মশাই, এ সব হল গিয়ে ভগবানদত্ত ব্যাপার। প্রসূনকে তো একটা রিসেপশন দেবার ব্যবস্থা করা উচিত।” নুটুদা চট করে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

”তার আগে একটু খাওয়াদাওয়া হোক। কী প্রসূন, পরোটা আর মাংস হবে নাকি?”

মা তখুনি টাকা দিলেন। বিশু দত্তই বাজারে গেল। সারা বাড়ির নেমন্তন্ন। নীলিমাকে বললাম, ”এবার আমার সব ধার শোধ করব। এখন আমিও কলেজে ভর্তি হয়েছি—ফুটবলের কলেজে।”

বাবা অনেক রাত্রে ফেরেন। আমি জেগে শুয়েছিলাম। মা নিশ্চয়ই বাবাকে বলবেন। উত্তরে বাবা কী বলবেন? দারুণ খুশি হবেন, না যথারীতি মুখ ফিরিয়ে চুপ করে থাকবেন! এক সময় বাবা ফিরলেন। ও ঘরে মা’র কথা বলার শব্দ পেলাম। তার পর আলো নিভে গেল। সকালে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম—বাবাকে বলেছ? মা বললেন, ”উনি খুব অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, আমি সাত বছর খেলেও এত টাকা পাইনি।”

।।২১।।

আনোয়ার আর নিমাইয়ের সঙ্গে যাত্রীতে এসে প্রথম দেখা প্র্যাকটিস শুরুর আগের দিন। ড্রেসিং রুমে আমরা জনা—কুড়ি, কারোর সঙ্গেই তেমন আলাপ নেই। ওদের দুজনের পাশে আমি বসেছিলাম আড়ষ্ট হয়ে। প্রিয়দা আমাদের কাছে ফুটবল সম্পর্কে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দেন। ওঁর পাশে বসেছিল ডাকুদা। যুগের যাত্রীর ঐতিহ্য এবং তা বহন করার দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে ডাকুদাও দু’—চার কথা বলে।

”ফুটবল খুবই সহজ খেলা, যদি না তুমি একে জটিল করে খেলো।” প্রিয়দা প্রথমেই এই কথাটা বলেছিলেন, ”আমরা এত বড়, এত পুরনো টিম, কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনও লিগ বা শিল্ড পাইনি। একবার মাত্র ফাইনালে উঠেছিলাম, কিন্তু—” ডাকুদা থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকলের চোখ আমার উপর এসে পড়েছিল।

আমি প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যেন তারা অদ্ভুত জন্তু দেখছে। কারোর ঠোঁট বাঁকা, কেউ কেউ চোখে চোখে হাসল। আমি মাথা নিচু করে ঘেমে উঠলাম। মনে হল, ডাকুদা ইচ্ছে করেই আমাকে এই অবস্থায় ফেলেছে। যেন কিছু একটার প্রতিশোধ নিচ্ছে। নিমাই তখন হঠাৎ বলেছিল, ”ফাইনালে উঠে কেউ না কেউ তো হারবেই। আমরা আবার যাত্রীকে ফাইনালে তুলব, শিল্ডও নেব।” বলে নিমাই সকলের মুখের দিকে তাকায়। শুধু আনোয়ারই বলে, ”নিশ্চয়ই।”

বেলেঘাটায় যাত্রীর মেসে আর চারজনের সঙ্গে নিমাইও থাকে। আনোয়ার আর আমিও ছিলাম লিগ শুরুর আগে পর্যন্ত। সকালের প্র্যাকটিস বন্ধ হওয়ায় আর একটার পর একটা খেলায় বসে থাকায় বিরক্ত ও হতাশ হয়ে আমি বাড়ি চলে আসি। মেসে কারও সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলতাম না।

নিমাই আর আনোয়ারকে বিশেষ করে এড়িয়ে চললাম। দেখা হলে কথা হত। সাধারণ কথা। আগের মতন গলাগলি আর ফিরে আসেনি। কিন্তু বুঝতে পারি, ওরা চায় আবার আমরা ‘থ্রি মাসকেটিয়ারস’ হই। কিন্তু আমিই সহজ হতে পারি না। সকলের সামনে ডাকুদা শিল্ড ফাইনালের কথা তোলার পর থেকে আমি কুঁকড়ে গেছি।

বাড়িতে কেউ খেলা নিয়ে কথা বলত না। খেলার দিন দুপুরে যখন বাড়ি থেকে বেরোই, তখন শুধু পিন্টুর কথা মনে পড়ত। কিন্তু ও স্কুলে থাকে দুপুরে। বাড়িতে থাকলেও মাঠে যাবার বায়না ধরবে না। ও বোঝে আমার অবস্থাটা। নীলিমা আর মা, ওরাও কিছু বলে না। দিনরাত পড়াশোনা করে ফেল করলে, বাড়ির লোক যেমন ব্যবহার করে, ওরা তাই করছে। শুধু বিশু দত্ত একদিন দোতলা থেকে চেঁচিয়ে বলেছিল, ”কী গো প্রসূন, কাগজে আর নামটাম দেখছি না যে?”

.

কখন যে চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে শুরু করেছে বুঝিনি। বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস জমে উঠেছিল। ধীরে ধীরে সেটা গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়ায় মিশিয়ে দিলাম। কানে কানে কে যেন বলল, ‘হাল ছেড়ো না, হতাশ হোয়ো না প্রসূন! উদ্যত থাকো, সময় এলেই আঘাত করবে।’ আমি আপন মনে মাথা নাড়লাম। পারব না, আর আমি পারব না। ইডেনের ধারে বাসস্ট্যান্ড। আমি শেষ বাসে উঠে বাড়ি এলাম।

.

হাওড়া ইউনিয়নের সঙ্গে ৫—০ গোলে যাত্রী জিতছে, খেলা শেষ হতে প্রায় দশ মিনিট বাকি। ডাকুদা ইশারায় প্রিয়দাকে ডাকল। তার পর প্রিয়দা আমার কাছে এসে বললেন, ”ওয়ারম আপ প্রসূন।”

অবাক হয়ে গেলাম। তা হলে কি কপাল ফিরল! প্রিয়দা রাইট আউট সলিল করকে ডেকে নিলেন। নামার আগে মাঠে আঙুল ঠেকিয়ে যখন কপালে বুকে ছোঁয়ালাম, সারা শরীর কেঁপে গেল। নিমাই ছুটে কাছে এসে বলল, ”বল দেব, গোল কর।”

আধ মিনিটের মধ্যেই নিমাই বল পাঠাল, হাওড়ার হাফ লাইন বরাবর। ছুটে গিয়ে ধরতে পারলাম না। গ্যালারিতে আওয়াজ উঠল। চারদিকে তাকিয়ে কেমন অস্বস্তি হল। নতুন নতুন লাগছে সব। প্লেয়াররা কত দূরে ঠিক আন্দাজ হচ্ছে না। কখন ছুটব, ফাঁকা জমি কোথায়, বল কোথা থেকে আসবে, কিছু বুঝছি না।

দিন—রাত পড়ে জলের মতন যা মুখস্থ ছিল, এখন আর তা মনে পড়ছে না। অনেক দিন বই না খুললে যা হয়। উৎকণ্ঠায় ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। ক’ মিনিট পরেই হুইসল বাজবে। তার মধ্যে একটা কিছু করতেই হবে। ডজ করব কি তিন—চার জনকে? চেঁচালাম, ”নিমাই, দে।”

গ্যালারিতে হাসির রোল উঠল। একজনকে কাটিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। বলকে সেই রকম আগের মতন অনুভব করতে পারছি না। বলটা পায়ে আছে কি নেই, বুঝতে পারিনি। শরীরটাকে কতখানি দোলাব, কোমর থেকে ঝাঁকুনিটা কখন দেব, আন্দাজ করতে পারিনি।

নিমাই বল নিয়ে ডান দিকের কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে এগোচ্ছে। আমি ভিতরে ঢুকে এলাম বক্সের মধ্যে। নিমাই কাটাল লেফট ব্যাককে। বলটা আমায় ঠেলেই স্টপারকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে বলল, ”বল দে আমায়।” আমি বল ঠেললাম সোজা স্টপারের পায়ে। গ্যালারি বিরক্তি জানাল বেশ জোরেই। নিমাই করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ”ঘাবড়ে গেছিস। বি স্টেডি।”

.

পাঁচ গোলে জিতছি, তাই আমার বোকামি আর অপদার্থতা রাগের বদলে মজার জিনিস হয়ে উঠল গ্যালারিতে। খেলার মধ্যে আর কিছু উত্তেজনা নেই, তাই ওরা নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। একটার পর একটা ভুল করছি আর মনে হচ্ছে যেন ডুবে যাচ্ছি। বিষ্ণু কোমরে হাত দিয়ে হাসছে। অমিয় মজা পেয়ে বলছে, ”অ্যাই, অ্যাই, প্রসূনকে বল দে।” গ্যালারি ফেটে পড়ছে হাসিতে। নিমাইয়ের ডিফেনস চিরে দেওয়া থ্রু—টা যখন প্রচণ্ডভাবে পোস্টের চার গজ বাইরে মারলাম, তখন হাওড়ার দু—তিনজনও হাসি চাপতে পারল না। আমি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়লাম। আর তখনই খেলা ভাঙার হুইসল বাজল। কে এসে আমার পিঠে হাত রাখল। মুখ তুললাম। দেখি, নিমাই চলে যাচ্ছে।

আমি যাত্রীর টেন্টের দিকে লিগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর যাইনি। ক্লাব থেকে লোক এসেছিল ডাকতে। শিবরমনের হাঁটুতে জল জমেছে। এই সিজনে আর খেলতে পারবে না। নিমাই আর বিষ্ণুর উপর চাপ পড়ছে খুব। একটা ম্যাচও জিরোতে পারেনি ওরা। মাঝে মাঝে দীপুদাকে খেলানো হয়েছে ওদের একজনকে বসিয়ে। দীপুদা তেরো বছর আগে যাত্রীতে প্রথম খেলা শুরু করেন। এখন আর পারেন না। নতুন ছেলেদের মধ্যে সৌমেন আর বলাইয়ের নাম কাগজে দেখেছি।

যাত্রী লিগে চতুর্থ হয়েছে। বছরের সব থেকে বড় কৃতিত্ব মোহনবাগানের কাছ থেকে একটা পয়েন্ট নেওয়া। নিমাই প্রথমে গোল দিয়েছিল। পেনালটি থেকে প্রণব গাঙ্গুলী শোধ করে। কাগজ পড়ে বুঝতে পারলাম না নিমাই কেমন খেলেছে। রিপোর্টারদের মধ্যে যাত্রীর সাপোর্টার একজনও নেই। মোহনবাগানকে গোল দিতে পেরে নিমাই যে দারুণ খুশি, তাতে আমার সন্দেহ নেই।

বিকেলে আমার ছোট্ট পাঠশালায় পিন্টুর বন্ধুদের নিয়ে প্র্যাকটিস করছিলাম। তখন নিমাই আর আনোয়ার এসে হাজির। আমি অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম শুধু। ওরা রংচঙে বুশ শার্ট পরেছে, চুলগুলো যেমন বড়, জুলফিও তাই। পায়ে দামি চটি। দুজনেরই হাতে বিদেশি ঘড়ি।

”যাস না কেন টেন্টে?” নিমাই বলল।

আমি ফিকে হাসলাম। ”কেন যাই না সেটা তো বুঝতেই পারিস।”

”ফুটবল খেলায় ওরকম অনেক কিছু হয়। মাঠে আয়, প্র্যাকটিস কর, আবার খেলা ফিরে পাবি। এই ছোট মাঠে বল নিয়ে বাচ্চচাদের সঙ্গে ঠুকঠুক করে খেলা আরও খারাপ করছিস কেন?” আনোয়ার বলল।

তর্ক করতে পারতাম, ইচ্ছে হল না। বললাম, ”যাব’খন। প্র্যকটিস হচ্ছে নাকি?”

”হবে না? শিল্ডের খেলা তো এসে গেল। এবার ইন্ডিয়ার বাইরের টিম খেলতে আসছে। তুই আয়, তোকে দরকার। ফরোয়ার্ড আর কেউ তো নেই। বিষ্ণু ইনজুরি নিয়ে খেলেছে লিগের শেষ ক’টা ম্যাচ। আবার লেগে গেলে একদম বসে যাবে।” নিমাই ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল।

”ডাকুদা আমায় খেলাবে ভেবেছিস?”

”আয় না, তার পর দেখা যাবে। গড়ের মাঠ থেকে দূরে থাকিস না, ওতে ক্ষতিই হবে। সকালে আসিস, কেমন?”

মনটা চনমন করে উঠল। গড়ের মাঠ, শিল্ড, ফুটবল এই শব্দগুলোয় শিহরন লাগে। শিল্ডে খেলার লুকোনো ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিল, আবার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীর গ্যালারির বিদ্রূপের হাসিও কানে বেজে উঠল। আমি বলে ফেললাম, ”কেমন যেন ভয় করছে।”

ওরা অবাক হয়ে গেল। আনোয়ার বলল, ”কীসের ভয়? পাবলিককে? গোল দে, দেখবি, ওরাই আবার তোকে মাথায় তুলে নাচবে।”

নিমাই বলল, ”গোল তুই পাবিই, আমি তো আছি।” ঘড়ি দেখে বলল, ”রাজুরা অপেক্ষা করছে রে, আনোয়ার! আর নয়, দেরি হয়ে গেছে। তা হলে কাল, কেমন?”

ওরা চলে যাবার পর মনে হল, আগের দিন হলে এমন করে আমায় ফেলে নিমাই কিংবা আনোয়ার চলে যেত না, এমন পোশাকি ঢঙে কথা তো বলতই না। আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম ওদের কথা। ঠিকই বলেছে, এই ছোট জমিতে ছোটদের সঙ্গে খেলে কিছুই হবে না। গড়ের মাঠের বিরাট জমি, হাজার হাজার লোক, সেই আবহাওয়া আর উত্তেজনার কাছাকাছি থাকতে হবে। দেহে মনে শুষে নিতে হবে। ঠিক করলাম, আবার যাত্রীর মাঠে যাব প্র্যাকটিসে।

।।২২।।

আমার যে কত বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয় আছে, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝলাম যাত্রী শিল্ড ফাইনালে উঠতেই। টিকিট, টিকিট, একখানা টিকিট। ‘প্রসূন, তোকে সেই কত ছোট্টটি দেখেছি, আর কী বড়ই না হয়ে গেছিস… প্রসূন, মনে আছে কী বলেছিলিস… প্রসূনদা আমি কিন্তু ছাড়ব না, আপনার দরজায় হাংগার স্ট্রাইক হবে, মাঠে যেতে দোব না…’ ঝালাপালা হয়ে গেলাম আমি। হেসে মাথা নেড়ে ‘আচ্ছা দেখব, চেষ্টা করব’ এই সব বলে পাশ কাটাচ্ছি। যুগের যাত্রী কুড়ি বছর পর আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে! সেমি ফাইনালে মহামেডানকে এক গোলে হারিয়েছে। গোলটা দিয়েছে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি—প্রসূন ভট্টাচার্য।

দ্বিতীয় রাউন্ডে যাত্রীর প্রথম খেলায় আমি আর বিষ্ণু আধাআধি খেলি কটক কম্বাইন্ডের বিরুদ্ধে। বিষ্ণু খোঁড়াচ্ছিল। ওকে তুলে নিয়ে প্রিয়দা আমাকে নামান। ৩—০ জিতি, তার মধ্যে একটা গোল আমার। অমিয়র লম্বা থ্রো নিমাই হেড করে আমার পায়ে ফেলামাত্র হাফ ভলিতে মারি বারো গজ থেকে। গোলকিপার নড়ার সময় পায়নি। তৃতীয় রাউন্ডে গোয়ার ভাসকো ক্লাবকে ২—০ হারালাম। আমি গোল করতে পারিনি, সলিল আর আব্রাহাম গোল দেয়। ও দিক থেকে রেঙ্গুন ইউনাইটেড উঠেছে কোয়ার্টার ফাইনালে। জলন্ধর লিডারসকে ২—১ গোলে হারিয়ে উঠল সেমি ফাইনালে। এই প্রথম ইডেনে বসে আমি ফুটবল খেলা দেখলাম। রেঙ্গুনের সেন্টার ফরোয়ার্ডের আর রাইট হাফের খেলা আমার ভাল লাগল। আর কারও নাম মনে রাখতে পারিনি, শুধু মংবা আর লি সান ছাড়া। মংবা—র বেশ বয়স হয়েছে, অন্তত পঁয়ত্রিশ তো বটেই। প্রথম গোল খেয়েই রেঙ্গুন চঞ্চল হয়ে ওঠে, খেলায় সাময়িক বিশৃঙ্খলা আসে। মংবা বল ধরে শান্ত ধীরভাবে প্লেয়ারকে কাটিয়ে দেখেশুনে বাড়িয়ে দিচ্ছিল। খেলার গতি ধীরে করে আবার টিমকে গুছিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত মংবা তার চমৎকার বল কন্ট্রোল ক্ষমতাকে যেভাবে কাজে লাগাচ্ছিল, তাতে শ্রদ্ধা হল ওর উপর। লি সান—ও বয়স্ক, নিজেদের পেনালটি বক্স পর্যন্ত নেমে এসে বল নিয়ে আবার উঠছিল। চট করে একজনকে বলটা ঠেলে দিয়েই লি সান আচমকা বুলেটের মতো এগিয়ে আবার পাশটা নেয়। একসঙ্গে দুজন কেটে যায় সেই দৌড়ে। দু’পায়ে তৈরি কিক, হেড দিতে ওঠে সবাইকে ছাড়িয়ে। শুনলাম বর্মা টিম থেকে দুজনেই এবার বাদ পড়েছে।

আমরা এরিয়ান আর শিখ রেজিমেন্টাল সেন্টারকে হারিয়ে উঠলাম সেমি ফাইনালে। আমি গোল করতে পারিনি দুটো খেলাতেই। মহামেডান দু’ দিন ড্র করে ইস্টবেঙ্গলকে এক গোলে হারিয়ে আমাদের সামনে পড়ল, ও দিকে উঠল মোহনবাগান—রেঙ্গুন ইউনাইটেড।

সেমি ফাইনাল খেলার আগের দিন ক্লাব প্রেসিডেন্টের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে আমাদের রাখা হল। তিনতলায় বিরাট একটা হলঘরে আমরা রইলাম। আব্রাহাম, শ্যাম, অমিয়—রা অনেক রাত পর্যন্ত তাস খেলল। সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হল শোভাবাজারের টিকাদারের মতো যেন একজনকে ঢুকতে দেখলাম গেট দিয়ে। একটু পরে প্রিয়দা থমথমে মুখে দুজন সিনিয়ার প্লেয়ারকে ডেকে নিয়ে গেলেন।

দুপুরে খাওয়ার পর শ্যাম আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ”একটা বিশ্রী খবর এসেছে প্রসূন, আনোয়ার নাকি টাকা খেয়েছে।”

থ’ হয়ে গেলাম আমি। অকল্পনীয় এবং ডাহা মিথ্যে। আমি বললাম, ”বিশ্বাস করি না।”

”সত্যি—মিথ্যের কথা নয়! খেলার ঠিক আগে কারও সম্পর্কে এ ধরনের কথা রটলে তাকে বসাতে হয়। মুশকিল হয়েছে ম্যাচটা মহামেডানের সঙ্গে আর আনোয়ারও মুসলমান। চট করে সবাই বিশ্বাস করে নেবে।”

”খবরটা কে দিল?”

”সকালে দু’বার উড়ো টেলিফোন এসেছে, তা ছাড়া টিকাদার এসেও বলে গেল আনোয়ারকে নাকি পরশু রাতে গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরোতে দেখেছে, সঙ্গে ছিল মহামেডানের দুজন অফিসিয়াল।”

”বাজে কথা!” আমি চিৎকার করে উঠলাম। ”আনোয়ার আর আমি পরশু একসঙ্গে টেন্ট থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি গেছি। এ সব টিকাদারের বদমাইসি, ও শোধ নেবার জন্য রটাচ্ছে।”

আমি ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি, ডাকুদা আর প্রিয়দা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। বাকি সবাই বিস্মিত, অপ্রতিভ চোখে কেউ কেউ নির্বাক, কেউ চাপা স্বরে দু’—একটা কথা বলছে। ঘরের এক কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে আনোয়ার বসে।

”আনোয়ারের আজ না খেলাই উচিত।” ডাকুদা বলল, ”মনে অস্বস্তি নিয়ে খেলা যায় না।”

”নিশ্চয়ই খেলবে।”

আমার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, সবাই চমকে উঠল। ”বাজে মিথ্যা গুজবের কাছে মাথা নোয়াব কেন?”

”যদি আজ যাত্রী হারে, যদি আনোয়ারের গলদেই গোল হয়, তা হলে আমাদের আর আনোয়ারের অবস্থাটা কী হবে বুঝতে পারছ?” ডাকুদা বলল। এত উদ্বিগ্ন হতে কখনও ওকে দেখিনি।

আমি তাকালাম নিমাইয়ের দিকে। নিমাই চুপ করে শুনছিল এতক্ষণ। বলল, ”আনোয়ার যদি খেলে, যাত্রী হারবে না।”

গলা খাঁকারি দিয়ে শ্যাম বলল, ”আনোয়ার আজ খেলবে। নয়তো আমার বদলে অন্য কেউ গোলে খেলুক।”

আব্রাহাম বলল, ”আনোয়ারকো খেলানেই হোগা।”

গড়িয়ে পড়ার একটা শব্দ শুনে আমরা তাকিয়ে দেখি, ঠেস দিয়ে বসা আনোয়ার জ্ঞান হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

আনোয়ার বিকেলে খেলেছিল। গোলটা আমি দিয়েছিলাম বটে, কিন্তু একজনে একটা টিমের সঙ্গে কীভাবে লড়তে পারে, সে ধারণাটা সে দিনই প্রথম হল। খেলার পর আমরা আনোয়ারকে কাঁধে করে মাঠ থেকে বেরোই। শ্যাম দু’বার মাত্র বল ধরে সারা ম্যাচে। আনোয়ারকে চারবার আমি মহামেডান পেনালটি বক্সের মধ্যে দেখেছি, গোল করতে উঠে এসেছিল।

পর দিন মোহনবাগান হেরে গেল রেঙ্গুন ইউনাইটেডের কাছে ০—২ গোলে।

।।২৩।।

রাত্রে ঘুম আসছে না। শিল্ড ফাইনালের আর ৪০ ঘণ্টাও বাকি নেই। কাল সকালে আমরা প্রেসিডেন্টের বাড়িতে জমা হব। সেখান থেকে ফাইনাল খেলতে ইডেনে যাব। ছটফট করছি বিছানায়। অস্বস্তি আর উত্তেজনা, ভয় আর আশা সব মিলিয়ে আমার সারা শরীর দপদপ করছে, মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। এমন সময় কে ঘরে ঢুকল। অন্ধকারে তাকিয়ে বুঝলাম, মা।

পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মা বললেন, ”ঘুম আসছে না!”

প্রশ্ন নয়, মা যেন খবরটা জানিয়ে দিলেন। আমি ‘ উ’ বলে মা’র কোলে মাথা তুলে দিলাম।

”জানি। এই রকমই হয়। ফাইনাল খেলা কী জিনিস আ উমার জানা আছে।”

”বাবা কিছু বলেননি! আমি যাত্রীর হয়ে ফাইনাল খেলব, বাবা কিছু বলেননি?”

”ও ঘরে তোর মতোই ছটফট করছে।”

মা আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ধীরে ধীরে ঘুম নেমে আসছে। স্নিগ্ধ হয়ে জুড়িয়ে আসছে শরীর। মা’র শরীর থেকে দূর্বা ঘাস আর ভিজে মাটির গন্ধে ম ম করে উঠছে ঘরটা। মনে হচ্ছে, বল নিয়ে আমি খেলা করছি। ঘুম জড়িয়ে আসছে সর্বাঙ্গে। তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় বললাম, ”কাল টিকিট পাঠিয়ে দেব, তুমি দেখতে যেয়ো!”

তার পর আমি সাদা—কালো ফুটকি দেওয়া বলটা নিয়ে হেলে দুলে এগোতে লাগলাম, লাফালাম, হঠাৎ ছুটলাম। পড়ে গিয়ে আবার উঠলাম। মার বুকের মধ্যে বড় বড় ঢেউয়ের ওঠা—পড়ার শব্দ হচ্ছে। প্রবল বেগে বাঁধ—ভাঙা বন্যার জল যেন ছুটে আসছে।

”পরশু তোর বাবাও খেলবে খোকা। তোর মধ্যে দিয়ে ফিরিয়ে আনবে যা হারিয়েছে। তুই জিতবি, ঠিক জিতবি।”

ক্রমশ মা’র গলার স্বর দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে আর এগিয়ে আসছে প্রচণ্ড গর্জন। আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমি কোথায় যাব, কোথায় আশ্রয় নেব? সাহায্যের জন্য চিৎকার করে উঠলাম—স্ট্রাইকার, স্ট্রাইকার!

গর্জনটা আরও জোরে আমাকে গোল হয়ে ঘিরে ধরল।

.

এত লোক! ষাট—সত্তর হাজারের কম নয়। সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল আমার শট রেঙ্গুনের বার ছুঁয়ে বেরিয়ে যেতেই। পঁয়ত্রিশ গজ থেকে শটটা নিয়েছিলাম, আচমকা।

বাইরে থেকে প্রিয়দা পাগলের মতন হাত নাড়ছেন, আমাকে পিছিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতে দিতে। আজ সকালে বারবার আমাকে বলেছেন, দশ নম্বরের সঙ্গে ছায়ার মতো থাকবে গোপাল। তুই নেমে এসে গোপালের জায়গাটা সামলাবি। লি সান—টাই হচ্ছে ডেনজারাস। ওকে আটকালে ওদের অ্যাটাক খোঁড়া হয়ে যাবে।

গোপালকে নিয়ে লি সান একবার ডাইনে আর একবার বাঁয়ে যাচ্ছে। বড় বড় গ্যাপ পড়ছে আমাদের ডিফেনস—এ। আমি নেমে এসে কোন দিক যে সামলাব ভেবে পাচ্ছি না। ওদের অ্যাটাক খোঁড়া করতে গিয়ে যাত্রীর অ্যাটাকই খোঁড়া হয়ে গেছে, তবু মাঝে মাঝে এগিয়েছি আর প্রিয়দা হাত নেড়ে আমাকে পিছিয়ে যেতে বলেছেন। এক সময় নিমাইকে বললাম, ”এভাবে চললে আমরা গোল খাব। ওদের বক্সে বল নিয়ে গিয়ে খেলতে হবে। আমাদের ডিফেনস থেকে প্রেশার তুলতে হবে, নয়তো এই প্রেশার রাখতে পারব না।

বলতে বলতেই আমরা গোল খেলাম। কর্নার ফ্ল্যাগের কাছ থেকে রেঙ্গুনের লেফট আউট সেন্টার করে। লি সানকে নিয়ে গোপাল ব্যস্ত। লেফট ব্যাক উঠে এসেছিল। চলতি অবস্থাতেই কুড়ি গজ থেকে ধাঁধানো শটে বলটা পোস্টে লেগে গোলে ঢুকল। সারা ইডেন স্তব্ধ। শুধু কয়েকটা হাততালির শব্দ শোনা গেল। খেলার বয়স এখন মাত্র কুড়ি মিনিট।

সেন্টারে বল বসাবার সময় নিমাই বলল, ”উঠে খেল। প্রিয়দার দিকে আর তাকাসনি।”

পরের মিনিটেই নিমাই থেকে আব্রাহাম, আবার নিমাই এবং সে দু’জনকে কাটিয়ে রিভারস পাস দিল আমাকে। গোল হতে পারে! ইডেন দাঁড়িয়ে উঠে খ্যাপার মতো চিৎকার করে উঠল ”গো ও ও ল, গো ও ও ল।” আমার সামনে গোল। স্টপার আর ব্যাকের মাঝখানে একটা ফাঁক দেখতে পাচ্ছি। দ্বিধা করলাম, মারলে যদি গোল না হয়! বরং আর একটু এগিয়ে যাই। ভুল করলাম এইখানেই। বলটা ঠেলে দিয়ে এগিয়ে যাবার মুহূর্তে মংবা—র পরিচ্ছন্ন স্লাইডিং ট্যাকলে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। স্টপার বলটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।

যখন উঠলাম, ইডেনের আর্তনাদ তখন আছড়ে পড়ছে গ্যালারি থেকে। আমি মাথা নামিয়ে ফিরে যাচ্ছি, তখন প্যাভিলিয়নের সামনের গ্যালারি থেকে কে চেঁচিয়ে উঠল, ”কার ব্যাটা দেখতে হবে তো!” আমি মুখ তুলে তাকালাম।

আনোয়ার অনবদ্য খেলছে, অমিয়ও। শ্যামের আজ সেই দিন, যে দিন ও পাগলার মতো খেলে। পর পর তিনটে অবধারিত গোল বাঁচিয়ে যাত্রীর ডিফেনসকে ও চাঙ্গা করে তুলেছে। আঠারো গজ লাইনের কাছে এসে ও উইঙ্গারদের ক্রসগুলো ফরোয়ার্ডের মাথা থেকে তুলে নিয়েছে। বক্সের বাইরে পর্যন্ত বেরিয়ে এসে চার্জ করে বল ক্লিয়ার করেছে। গোলটা খাওয়ার পরই আমাকে উপরে রেখে নিমাই আর সলিল নেমে এসেছে যাত্রীর হাফ এলাকায়।

একা মাঝ—মাঠে দাঁড়িয়ে মনে হল গ্যালারি থেকে লোকেরা যদি এখন হুড়মুড় করে নেমে আসে? কেন যে মনে হল জানি না, আমি ভয়ে পিছিয়ে এলাম। আর ঠিক তখনই আনোয়ার বলটা লব করে রেঙ্গুন হাফ এলাকার ঠিক সেই জায়গায় ফেলল, যেখান থেকে আমি এইমাত্র পিছিয়ে এসেছি। রেঙ্গুনের স্টপার ছাড়া আর কেউ নেই। বলটা ধরবার জন্য সে বাঁদিকে দৌড়োচ্ছে। আনোয়ার চিৎকার করে উঠল, ”প্রসূন, বল ধর।”

ওর গলার স্বরে কী যে ছিল, মনে হল পারব। মরিয়া হয়ে ছুটতে শুরু করলাম। স্টপার যখন বুঝতে পারল, তার আগেই আমি বলের কাছে পৌঁছোব, শেষ চেষ্টা হিসাবে সে ঝাঁপ দিল আমার পায়ের উপর। লাফিয়ে উঠলাম, ওকে ডিঙিয়ে মাটিতে পা রেখেই দেখি, আমার সামনে কেউ নেই। শুধু গোলকিপার ইতস্তত করছে গোল ছেড়ে বেরোবে কি না।

বলটাকে সামনে ঠেলে লম্বা দৌড় শুরু করলাম। পিছনে পায়ের শব্দ পাচ্ছি। ইডেনের গর্জন ধাপে ধাপে উঠছে আর রেঙ্গুনের গোল ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। বক্সে ঢুকে পড়েছি। গোলকিপার এবার বেরিয়েছে। কানে তালা লাগানো চিৎকার আমার চারপাশে। বলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জানি, পিছনে কেউ আসছে বলটা ছিনিয়ে নিতে।

ডান দিকে হেলে বলটাকে মারার জন্য বাঁ পা তুললাম। গোলকিপার বাঁ দিকে ঝুকল। মুহূর্তের ভগ্নাংশে বাঁ দিকে হেলে ডান পায়ে বলটা আলতো করে ওর মাথার ওপর দিয়ে চিপ করে পাঠালাম। বেচারা বাঁ দিকে ঝোঁকা অবস্থায় অসহায়ের মতো ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, বলটা গোলে ঢুকছে।

তার পর যাত্রীর দশজন আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল আর গর্জনে ভেঙে পড়ল ইডেনের আকাশ। যখন সেন্টারে এসে দাঁড়ালাম, তখনও বুঝতে পারছি না কী ঘটেছে। সত্যিই কি গোল করলাম! বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই হাফ টাইমের বাঁশি বাজল।

।।২৪।।

”দারুণ গোল হয়েছে… আমি তো ভেবেছিলুম, এটাও মিস করবি।” প্রিয়দা উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছেন।

”এই গোলই মিস করেছিল একজন।” পিছন থেকে একটা গলা শুনলাম। আমি ফিরে তাকালাম না। জানি, একজোড়া কটা—চোখ এখন আমার পিঠে বিঁধে রয়েছে। ভোলেনি, অনেকেই ভোলেনি। ড্রেসিং রুমে কে ট্রানজিস্টর খুলেছে। পুষ্পেন সরকারের গলা শুনতে পেলাম, ”…শিল্ড ঘরে তুলতে পারবে কি না এখনই বলতে পারছি না, তবে যুগের যাত্রীর তরুণ স্ট্রাইকার প্রসূন ভট্টাচার্য যে অপূর্ব দক্ষতায় গোলটি শোধ দিল তা বহু দিন স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, এই প্রসূনেরই বাবা অনিল ভট্টাচার্য কুড়ি বছর আগে শিল্ড ফাইনাল খেলেছিলেন এই যুগের যাত্রীর হয়ে। পিতা—পুত্রে আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে খেলার নতুন নজির আজ গড়ে উঠল। হয়তো গ্যালারিতে বসে অনিলবাবু এখন দেখছেন…”

বাবা! আসবেন কি খেলা দেখতে! কাল চারটে টিকিট পাঠিয়েছিলাম—বাড়ির জন্য তিনটে, হর্ষদার একটা। কিন্তু বাবা আসবেন বিশ্বাস হয় না। তবু আবার মাঠে নামার সময় গ্যালারিগুলোর দিকে তাকালাম। অজস্র হাত আমার উদ্দেশে নড়ছে। কিন্তু আমি একটা মুখও দেখতে পেলাম না। শুধু আবছা ঘষা কাচের মধ্য দিয়ে যেন হাজার হাজার বিন্দুর নড়াচড়া চলেছে কতকগুলো রেখা তৈরি করে। এর মধ্যে কোথাও কী বাবা বসে আছেন!

রেঙ্গুন ইউনাইটেড ঝড়ের মতো শুরু করল। মিনিট পাঁচেক আমাদের কাঁপিয়ে দিয়ে হঠাৎ ওদের যেন দম ফুরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী উঠে এল ওদের হাফ লাইনে। নিমাই, আব্রাহাম চমৎকার বল রাখছে মাটিতে, পায়ে বল ছিটকে যাচ্ছে স্ফুলিঙ্গের মতো। নিমাই তছনছ করছে হাফ লাইন পর্যন্ত, কিন্তু নিরেট শক্ত ডিফেনসের পাঁচিলটা টপকাতে পারছে না। আমি জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি গোলে শট নেওয়ার। কোথাও যদি আলগা থাকে ভিতরে ঢোকার।

গোল হচ্ছে না। খেলা শেষ মুখে এসে গেছে। অধৈর্য গ্যালারির গর্জন উঠছে নামছে। এমন সময় নিমাইকে ফাউল করল ওদের রাইট ব্যাক, আঠারো গজ লাইনের বাঁ দিকে হাত দুয়েক বাইরে। ফ্রি কিক। বলটা বসিয়ে নিমাই আমার দিকে তাকিয়ে দুটো আঙুল দেখাল। বুঝে গেলাম ও কোথায় বল পাঠাবে। প্র্যাকটিসে এই সঙ্কেতগুলো আমরা ঠিক করে নিয়েছি। ওরা পাঁচজনে পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়েছে। নিমাই আর বিষ্ণু তৈরি হয়েছে শট নিতে। আব্রাহাম হঠাৎ বাঁ দিকে ছুটে গেল, সঙ্গে সঙ্গে ওকে পাহারা দিতে গেল একজন। আমি ডান দিকে সরে গিয়ে তাকালাম ঠিক পেনালটি স্পটে। নিমাই সেটা লক্ষ করল। পাঁচিলের পিছনে ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে, যাতে গোলকিপারের দৃষ্টি ব্যাহত না হয়। রেফারি হুইসল দিতেই নিমাই আর বিষ্ণু এগোল শট নিতে। নিমাই একটু পিছিয়ে। বোঝা মুশকিল কে শট নেবে। তবে, যে কেউই বুঝতে পারবে এটা বহু ব্যবহৃত একটা প্যাঁচ। বিষ্ণু শট নিতে এসে বলের উপর দিয়ে লাফিয়ে যাবে আর নিমাই শট করবে।

বলের উপর দিয়ে বিষ্ণু লাফিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে ছুটে গেল, কিন্তু নিমাই শট না নিয়ে বলটা নিখুঁত মাপে চিপ করল পাঁচিলের মাথা ডিঙিয়ে পেনালটি স্পটের উপর। এবার সব কিছু নির্ভর করছে আমার ছুটে যাওয়ার এবং ঠিক সময়ে পৌঁছোনোর উপর। দিনের পর দিন আমার পাঠশালায় পিন্টুকে নিয়ে যার প্র্যাকটিস করেছি, এবার তার পরীক্ষা। মোটরবাইকের হঠাৎ স্পিড তোলার মতো আমি প্রচণ্ড দমকে, ছিলে—ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে ঢুকলাম।

দেরি হয়ে গেছে। চার পা এগোনো মাত্র বুঝে গেলাম বলটাকে হাফ ভলিতে নিলে বারের উপর দিয়ে চলে যাবে। হঠাৎ বুকের মধ্যে কে বলে উঠল, ”স্ট্রাইকার, এবার ঘা মারো, সর্বশক্তি দিয়ে মারো!” শেষ চেষ্টায় চার গজ দূর থেকে ঝাঁপ দিলাম। বল থেকে চোখ সরাইনি। কপালের ডান দিকে বলটা লাগছে, হাতুড়ির মতো মাথাটা দিয়ে আঘাত করলাম বলে—আর মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়লাম।

চারদিক কেমন শান্ত নিস্তব্ধ! ঘাস আর মাটির মিষ্টি সোঁদা গন্ধে বুক ভরে যাচ্ছে। আমি মুখ তুলে দেখছি অদ্ভুত একটা দৃশ্য, রেঙ্গুন ইউনাইটেডের গোলকিপার গোলের মধ্য থেকে কুড়িয়ে নিল সাদা—কালো ফুটকি আঁকা আমার পৃথিবীটাকে। এর পর ধীরে ধীরে একটা গর্জন আমাকে কাঁপিয়ে দেহের উপর দিয়ে বয়ে যেতে শুরু করল।

.

লক্ষ্মণ মালি এসে বলল, ”আপনাকে একজন মেয়েছেলে ডাকছে।”

যাত্রীর টেন্টের বাইরে তখন উৎসব চলেছে। হাউই, পটকা আর তুবড়ির শব্দে আলোয় আলোয় ঝলমল করছে গড়ের মাঠের এই দিককার আকাশ। বাইরে এলাম খালি গায়ে। নীলিমা আর পিন্টু দাঁড়িয়ে। ভেবেছিলাম মাকে দেখব।

”এ কী তোমরা! খেলা দেখতে তুমি এসেছিলে? এখনও বাড়ি যাওনি, মা কোথায়?” একটানা অনেকগুলো প্রশ্ন করলাম। বাড়ির লোককে দেখে সত্যিই ভাল লাগছে।

”জেঠিমা সকাল থেকে দক্ষিণেশ্বরে। আর জ্যাঠামশাই বললেন, একটু অপেক্ষা করে যাই, এবার হয়তো বাজি পোড়ানো হবে, তাই—”

”বাবা! বাবা কোথায়?” আমার গলা ধরে এল।

”বাইরে। বললেন, তোমরাই দেখা করে এসো।”

ছুটে বাইরে যেতে গিয়ে থমকে গেলাম। তার পর ফুলগাছগুলোর মধ্য দিয়ে রেলিং—এর ধারে গিয়ে বাইরে তাকালাম। একটা তুবড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। ক্রমশ আলোর ঝাড় চালচিত্রের মতো ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে পেলাম, অনেক লোকের মধ্যে একজনের কপালে চিকচিক করছে একটা টিপ। অত্যন্ত উজ্জ্বল, মর্যাদাবান।

তুবড়ির আলোয় আমাকে দেখতে পেয়ে তখন অনেকে ছুটে আসছে ”প্রসূন, প্রসূন!” বলে।

অলৌকিক দিলু

অলৌকিক দিলু – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

”দিলু, এর পরই বাইগাছি। এবার দরজার দিকে এগোতে হবে।” এই বলে বোকামামা উঠে দাঁড়ালেন। ব্যাঙ্ক থেকে নাইলনের ব্যাগটা নামিয়ে বেঞ্চে বসা যাত্রীদের হাঁটু ঠেলতে—ঠেলতে বেরোতে লাগলেন, তার পিছু পিছু দিলীপ। তারও হাতে একটা ব্যাগ, কাঁধে কাপড়ের ঝুলি। ট্রেনের কামরা ভিড়ে ঠাসা। তাদের মতো আরও অনেকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে।

বোকামামা গলা নামিয়ে বললেন, ”এদের পিছু—পিছু এগোবি, দেরি করলেই কিন্তু রান আউট হয়ে যাবি। হুড়মুড়িয়ে লোক এমনভাবে উঠবে যে, তোকে আর নামতে দেবে না, ঠেলতে ঠেলতে আরও পেছনে পাঠিয়ে দেবে। লোকাল ট্রেনে চড়ার অভ্যেস নেই তো।”

শুনে গলা শুকিয়ে গেল দিলুর। এতক্ষণ সে জানলা দিয়ে দেখে এসেছে এক—একটা স্টেশনে ট্রেন থেমেছে আর প্ল্যাটফর্মের লোকেরা টেনে ওঠার জন্য কীরকম ধাক্কাধাক্কি/করছিল। দু—তিনজনকে ছিটকে প্ল্যাটফর্মে গড়াগড়িও দিতে দেখেছে।

বোকামামা বললেন, ”ওঠার থেকে নামাটাই শক্ত। ব্যাগটা মাথার ওপর তুলে ধর, নয়তো হাত থেকে ছিটকে যাবে।”

দিলু হাতের ব্যাগ মাথায় তুলল। ট্রেন বাইগাছি স্টেশনে দাঁড়ানো মাত্র দরজার লোকেরা হুড়হুড় করে নামতে শুরু করল। পেছন থেকে ঠেলা খেয়ে দিলু হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে ওঠার সময় কে তার পা মাড়িয়ে দিল। ”আহ” বলে ওঠার আগেই সে প্ল্যাটফর্মে ছিটকে পড়ে গেল। বোকামামা তার হাত ধরে টেনে সরিয়ে না আনলে দু—তিনজন লোকের পায়ের তলায় সে পড়ে যেত।

দিলুর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা থেঁতলে গেছে। ডান পায়ের চটির চামড়ার ফিতেটা ছিঁড়ে পা থেকে খুলে ট্রেনের কামরাতেই রয়ে যাওয়ায় সে ফ্যালফ্যাল চোখে ছেড়ে দেওয়া ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে রইল।

বোকামামা বললেন, ” তোর আর দোষ কী, কখনও তো বনগাঁ লাইনের ট্রেনে চড়িসনি। তিরিশ বছর যাতায়াত করছি আমি, কতবার যে ধুতি খুলে গেছে! তাই ট্রেনে চড়ার জন্য ধুতি ছেড়ে প্যান্ট ধরেছি। তুই যে আস্ত নামতে পেরেছিস—য়্যা! চটি কোথায়?”

দিলু করুণ স্বরে বলল, ”ট্রেনে।”

বোকামামা বিলীয়মান গার্ডের কামরার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ”তা হলে বাঁ পায়েরটা পরে থেকে আর কী হবে, ফেলে দে। একজোড়া নতুন চটি বরং কিনে দিচ্ছি। তবু ভাল, ব্যাগটা ধরে রাখতে পেরেছিস।”

দিলুর পায়ের দিকে এবার বোকামামা ভাল করে তাকালেন। চোখ কুঁচকে বললেন, ”হল কী তোর আঙুলে?” একটু ঝুঁকে দেখে বললেন, ”বুড়ো আঙুলের নখটা যে আধখানা উঠে গেছে। কী কাণ্ড দ্যাখ তো, মামার বাড়িতে বেড়াতে এসে দু—দুটো অ্যাকসিডেন্ট চটি গেল, নখ ওপড়াল। শিগগিরি চল ডাক্তারখানায়। ইঞ্জেকশন, ওষুধ, ব্যান্ডেজ করাতে হবে। অফিস ছুটির পরের ট্রেনে ওঠাটাই বোকামি হয়েছে।”

প্ল্যাটফর্ম থেকে লোকজন বেরিয়ে যাওয়ার পর ওরা দু’জন স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। ডাক্তারখানা শিবানী মেডিক্যাল হল পঞ্চাশ গজের মধ্যেই। ডাক্তারবাবু তখনও এসে পৌঁছননি। তিনি বিকেল চারটে থেকে হাবড়ায় এক ডাক্তারখানায় বসেন দু’ঘণ্টার জন্য। রোগীর ভিড় থাকলে সেটা আড়াই ঘণ্টাও হয়ে যায়। কম্পাউন্ডার মদনগোপাল বয়স্ক মানুষ। বললেন, ”ডাক্তারবাবুর ফি দেবেন কেন, আমিই যা করার করে দিচ্ছি, দশটা টাকা দেবেন।”

বোকামামা রাজি হয়ে গেলেন। মদনগোপাল অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশন দিয়ে মলম লাগিয়ে তুলো দিয়ে ঢেকে ব্যান্ড—এইড দিয়ে আঙুলটা মুড়ে দিলেন।

”সাবধানে থাকবে খোকা, ধাক্কাটাক্কা যেন না লাগে। জলটল লাগিও না। দিন পনেরো লাগবে ঠিক হয়ে যেতে।”

দিলুর খুব খারাপ লাগছে বোকামামার পঁচিশ টাকা খরচ করিয়ে দেওয়ায়। ‘পদসেবা’ জুতোর দোকানটা কুড়ি গজ দূরে। সবচেয়ে কমদামি হাওয়াই চটি। দিলু ঠিক করল, তাই কিনবে। কিন্তু বোকামামা দোকানে ঢুকেই বললেন, ”এই ছেলেটির পায়ের ভাল চটি আছে?”

সেলসম্যান বলল, ”আছে।” এই বলে সে একটা বাক্স এনে তার থেকে একজোড়া চটি বের করে দিলুর পায়ের সামনে রাখল।

বোকামামা হুকুম করলেন, ”পরে দেখ, বুড়ো আঙুলে লাগে কি না।”

দিলু চটি পরল। বুড়ো আঙুলে যে ফিতেটা রয়েছে সেটা নখে লাগছে হাঁটতে গেলেই।

বোকামামা দিলুর মুখ লক্ষ করে বুঝে গেলেন, লাগছে। বললেন, ”এই চটি চলবে না। পায়ের আঙুলে স্ট্র্যাপ থাকবে না এমন চটি আছে?”

সেলসম্যান দু—তিনটি বাক্স খুলে মাথা নেড়ে বলল, ”সব চটিতেই বুড়ো আঙুলে স্ট্র্যাপ দেওয়া।”

দিলু তখন বলল, ”মামা, হাওয়াই চটিতে বুড়ো আঙুলে লাগবে না।”

বোকামামা ক্ষুণ্ণ স্বরে বললেন, ”হাওয়াই বড় কমদামি, আচ্ছা ঠিক আছে আপাতত কাজ চালানো নিয়ে কথা।”

তিরিশ টাকার হাওয়াই চটি পায়ে দিয়ে দিলু মামার সঙ্গে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। সামনেই যশোহর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, বোকামামা বললেন, ”দিলু এদের ছানার জিলিপি বিশ্ববিখ্যাত, চেখে দেখবি?”

মামার অনেক টাকা সে খরচ করিয়ে দিয়েছে। খরচটা আর যাতে না বাড়ে তাই বলল, ”মিষ্টি আমার ভাল লাগে না।”

”সে কী রে, যশোরের ছানার জিলিপি। একটা অন্তত খেয়ে দেখ।”

বোকামামা দোকানে ঢুকলেন, তার সঙ্গে দিলুও। একটা লম্বা পালিশহীন কাঠের টেবিলে ওরা বসল। বোকামামা শিঙাড়া আর ছানার জিলিপি একটা করে দিতে বললেন।

”সেই কখন ভাত খেয়েছিস, নিশ্চয় খিদে পেয়ে গেছে। এই সময় শিঙাড়া ভাজা শুরু হয়। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় লোকে কিনে নিয়ে যায়। উত্তর চব্বিশ পরগনার বেস্ট শিঙাড়া এখানে হয়।”

কলাপাতায় গরম শিঙাড়া আর নধর চেহারার ছানার জিলিপি দিয়ে গেল। খিদে সত্যিই পেয়েছিল দিলুর। শিঙাড়ায় কামড় দিয়ে তার আর মনে হল না মামার টাকা খরচ করিয়ে দিল। সে ধরে নিল ভাগ্নে হিসেবে এটা তার প্রাপ্য।

ছানার জিলিপির একটা টুকরো ভেঙে মুখে দিতেই সেটা মসৃণভাবে মুখের মধ্যে ভেঙে মিলিয়ে গেল। এমন মিষ্টি সত্যিই সে কখনও খায়নি।

”মামা, তুমি এই ছানার জিলিপিকে বিশ্ববিখ্যাত বললে কেন? বিশ্বে আর কোথাও ছানার জিলিপি হয় কি না তা কি তুমি জানো?”

বোকামামা দুধঘাট উচ্চচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার। স্কুলের প্যাডে ওঁর নাম হরিসাধন ঘোষের পর লেখা আছে এম. এ. বি. টি। তিনটি বিষয়ে ক্লাস নেন—ভূগোল, ইতিহাস ও অঙ্ক। বিশ্ব সম্পর্কে মোটামুটি একটা জ্ঞান তাঁর থাকার কথা এবং তাঁর ধারণা সেটা তাঁর আছে।

”এই পশ্চিমবাংলার বাইরে ছানার জিলিপি কোথাও হয় না, হলেও সেটা জিলিপি নয়, পান্তুয়া। আর এই রাজ্যে শুধু) বাইগাছিতেই এমন জিলিপি হয়। সুতরাং অনায়াসেই একে ওয়ার্ল্ড ফেমাস বলা যায়।”

”আর শিঙাড়াকে উত্তর চব্বিশ পরগনার বেস্ট বললে কী করে?”

বোকামামা ঠোঁট চওড়া করে হাসলেন। ”বত্রিশ বছর আগে বঙ্গবাসী কলেজে যখন পড়তুম তখন থেকে, দমদম টু গোবরডাঙা যত নামী খাবারের দোকান, সবক’টায় খেয়েছি, দমদম টু রানাঘাট মেন লাইনেও সব বড় দোকান দেখা হয়ে গেছে। এরকম ফুলকপির শিঙাড়া কেউ পারে না তৈরি করতে। কেমন লাগছে বল?”

”ভাল।”

”তা হলে আর একটা?”

দিলু মাথা কাত করল।

দোকান থেকে বেরোবার আগে বোকামামা দশটা শিঙাড়া কিনে নিলেন বাড়ির জন্য। ওরা ভ্যান রিকশা স্ট্যান্ডে এসে দুধঘাট যাওয়ার রিকশা পেয়ে গেল। জনা চারেক যাত্রী রিকশায় বসে। ওরা দু’জন চড়তেই রিকশা ছেড়ে দিল। আঙুল বাঁচাতে দিলু পা ঝুলিয়ে বসল। এক মাইল পথ, দশ মিনিটেই পৌঁছে গেল।

বোকামামা অর্থাৎ হরিসাধন ঘোষ দেশভাগের পর পাঁচ বছর বয়সে খুলনা জেলার স্বল্পবাহিরদিয়া গ্রাম থেকে বাবা ও জ্যাঠার এবং লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু পরিবারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন। বোকামামার বাবা পঞ্চাননের এক বন্ধু থাকতেন বারাসাতে। তিনিই ব্যবস্থা করে দুধঘাটে ফলের বাগান সমেত পাঁচবিঘে জমি পুকুরসহ ছোট একটা বাড়ি কিনিয়ে দেন পঞ্চাননকে। সেই বাড়িতে দাদা দাশরথিকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন আটচল্লিশ সাল থেকে।

পঞ্চাননের একটি ছেলে হরিসাধন, দাশরথির একটি মেয়ে মল্লিকা, ডাকনাম মলু। মলু যখন দশ বছরের তখন দাশরথি সাতদিনের জ্বরে মারা যান। তখন ভাল ডাক্তার বা ওষুধপত্র দুধঘাটে পাওয়া যেত না। মলুর মা স্বামীর মৃত্যুর এক বছর পর পাকস্থলীর ক্যান্সারে মারা যান। পিতৃ—মাতৃহারা মলুকে নিজের মেয়ের মতো বড় করে তোলেন পঞ্চানন, তাকে বি—এ পাশ করিয়ে প্রচুর খরচ করে বিয়েও দেন কলকাতার এক উঠতি উকিলের সঙ্গে। হরিসাধনের দুই মেয়ে এবং দু’জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড়টি থাকে দুর্গাপুরে, ছোট মেয়ে কটকে। পঞ্চানন পঁচাশি বছর বয়সে এখনও বাগানের পরিচর্যা করেন, বাজারে যান, ছেলেকে ধমকান।

হরিসাধনের স্কুল—অন্ত—প্রাণ। এই স্কুলেই তিনি পড়েছেন। তখন ছিল তিনটি খড়ের চালের ঘর। শিক্ষকদের বসার ঘরের একধারে কাঠের পার্টিশান দেওয়া খুপরিতে বসতেন হেডমাস্টারমশাই। শিক্ষক ছিলেন আটজন।

দুধঘাটের প্রাক্তন জমিদার ও সরকারি কন্ট্রাক্টর ধনী ও শিক্ষানুরাগী অঘোর চক্রবর্তী নিঃসন্তান ছিলেন। টাকা জমানোয় তাঁর আগ্রহ ছিল না। তাঁরই দেওয়া জমি ও পাঁচ লক্ষ টাকা দুধঘাট স্কুল খোলনলচে বদলে ঝকঝকে আধুনিক চেহারা নেয় তিরিশ বছর আগে। এর চার বছর পর হরিসাধন ‘ফিফথ সার’ রূপে স্কুলে যোগ দেন।

স্কুলের এখন তিনটি পাকা বাড়ি, সায়ান্স ল্যাবরেটরি, খেলার বিরাট মাঠ এবং একুশজন শিক্ষক ও সাতশো ছাত্র নিয়ে এলাহি ব্যাপার। গত বছর হরিসাধনের স্কুল থেকে নব্বুইটি ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। পঁচাত্তরজন পায় ফার্স্ট ডিভিশন, আটজন পায় স্টার।

শুধু এই জেলাতেই নয়, সারা রাজ্যে দুধঘাট স্কুল বিখ্যাত পড়াশুনোয় এবং ফুটবল খেলাতেও। দিল্লিতে তিনবার সুব্রত কাপ ফাইনাল খেলে একবার কাপ জিতেছে। জেলার জুনিয়ার ভলিবল, কবাডি, খোখো দলে দুধঘাট স্কুলের ছেলে নেই এমন ঘটনা গত দশ বছরে ঘটেনি। পড়া এবং খেলায় যা কিছু খ্যাতি সবই হেডমাস্টার হরিসাধন ঘোষের অক্লান্ত আন্তরিক ও সৎ চেষ্টার ফসল। তিনি স্কুলে যেমন রাশভারী, কঠোর শৃঙ্খলনিষ্ঠ, নিয়মানুবর্তী, ঠিক তার উলটোটি হয়ে যান স্কুল থেকে বেরিয়ে এলেই।

হরিসাধন মাঝে—মাঝে কলকাতায় যান। হাতে সময় থাকলে বোন মলুর সঙ্গে দেখা করে আসেন। মৌলালির কাছে মলুর স্বামী তরুণ কর বিরাট একটা পুরনো বাড়ি কিনে সংস্কার করিয়ে বউবাজারে পৈতৃক বাড়ি থেকে ভিন্ন হয়ে এসে বসবাস করছেন। মলুর চার ছেলে, ছোট ছেলে দিলু। কলকাতায় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভায় যোগ দিতে এসে হরিসাধন বোনের বাড়ি এসেছিলেন। মলুর সঙ্গে কথায়—কথায় জানতে পারেন দিলু ষান্মাসিক ক্লাস পরীক্ষায় একশোর মধ্যে ইংরেজিতে চব্বিশ, ইতিহাসে তিরিশ, অঙ্কে কুড়ি নম্বর পাওয়ায় স্কুল থেকে গার্জেনকে হুঁশিয়ার করে চিঠি দেওয়া হয়েছে এই বলে, অ্যানুয়াল পরীক্ষায় যদি একটি বিষয়েও ফেল করে তা হলে ক্লাস নাইনে ওকে প্রোমোশন দেওয়া হবে না। ওর পড়াশুনোর দিকে আপনারা নজর দিন।

”জানো বোকাদা, চিঠিটা পেয়ে এমন রাগ হল যে, দিলুকে আচ্ছা করে পেটালুম, সারাদিন খেতে দিলুম না। ওর বাবা বলল স্কুল ছাড়িয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। কিন্তু লেখাপড়ায় খারাপ ছেলেকে তাও ক্লাস নাইনে কি নতুন স্কুলে ভর্তি করানো সম্ভব? বাড়ির কাছে আদর্শ বিদ্যাভবন নামে একটা স্কুল আছে কিন্তু সেখানে শুনেছি মাস্টাররাই ঠিকমতো ক্লাসে আসে না। তিরিশটা ছেলে মাধ্যমিক দিয়েছিল গত বছর। দু’জন কোনওক্রমে সেকেন্ড ডিভিশন, এগোরোজন ফেল। এমন স্কুলে ওকে দিলে তো আরও খারাপ হয়ে যাবে লেখাপড়ায়।”

হরিসাধন বললেন, ”দিলুর অসুবিধেটা কোথায়, ওকে পড়ায় কে? রোজ দু’বেলা কি পড়তে বসে?”

মল্লিকা বললেন, ”দু’বেলা? সকালে ঘুম থেকেই তো ওঠে আটটায়, পড়বে কখন? স্কুল থেকে ফিরেই ছুটবে খেলার মাঠে, সন্ধেবেলায় মাস্টারমশাই আসেন, পড়তে বসে ঢুলবে। উনি বিরক্ত হয়ে বলেন, যাও ঘুমোও গিয়ে, আর পড়তে হবে না। ঘণ্টাখানেক কানমলা, গাঁট্টা খেয়ে নমো নমো করে পড়া সেরে খেয়েদেয়েই বিছানায়। এই হল রোজকার রুটিন। ওয়ান ডে ক্রিকেট থাকলে স্কুলে যায় না, সারাদিন টিভির সামনে। এত মারধোর করি, এত বোঝাই, তবু শোধরাতে চায় না। কী যে করি, প্রব্লেম চাইল্ড হয়ে উঠেছে।”

হরিসাধন বললেন, ”তোর অন্য ছেলেরা কেমন?”

”সলু তো ল কলেজে বাবার পেশায় ঢুকবে, বিলু আর্ট কলেজে এ—বছর ভর্তি হল, কালু ডিগ্রি কোর্সে সায়ান্স পড়ছে। পড়াশুনোয় সবাই ভাল। কাউকে আমায় তাগিদ দিয়ে পড়ার কথা বলতে হয়নি। শুধু এই ছোট ছেলেটাই জ্বালিয়ে মারছে, কী যে করি।”

”কিছু করতে হবে না তোকে। তোর জ্যাঠার হাতে ওকে ছেড়ে দে। বাবা ঠিক ওকে তৈরি করে দেবে।”

মল্লিকা দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললেন, ”এই বয়সে জেঠু ওকে সামলাবেন কী করে?”

হরিসাধন হেসে ফেললেন, ”বাবাকে তুই অনেকদিন দেখিসনি তাই বললি। হাঁটুর বাতে ইদানীং একটু কাহিল, তবু বহুদিন তেলকই খাননি বলে গতবছর নিজে হাতে জাল ফেললেন পুকুরে, হনুমানে আম নষ্ট করছিল, বন্দুক বের করে ফায়ার করলেন, ভাগ্যি ভাল মরেনি। যদি মরত তা হলে আমরা ও বাড়িতে আর টিকতে পারতুম না। বাবা পঁচাশি হলে কী হবে পাঁচ বছর আগেও কোদাল দিয়ে বাগানে মাটি কোপাতেন। তুই বাবার কাছে এক বছর ওকে রাখ। আমার স্কুলে ওকে ভর্তি করিয়ে নোব। পরীক্ষাটা দিয়েই দুধঘাটে চলে আসুক।”

দিলুর অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হওয়ার দশদিন পর হরিসাধন কলকাতায় আসেন নিজের কাজে। একটা ইতিহাস বই লিখেছেন নবম—দশম শ্রেণীর জন্য, প্রকাশকের কাছে তার পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে দুপুরে বোনের কাছে এলেন ছোট ভাগ্নের খবর নিতে।

”কী ঠিক করলি?” হরিসাধন প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিলেন, ”দুটো প্যান্ট আর শার্ট একটা ব্যাগে ভরে দে। ওকে আজ নিয়েই যাব। দিন সাতেক থেকে দেখুক। যদি মন বসে যায় তা হলে আমাদের কাছেই থাকুক। তোর বা তরুণের তাতে আপত্তি আছে?”

মল্লিকা বললেন, ”আপত্তি কী গো! আমরা তো বেঁচে যাই। আগের দিন তুমি যা বললে দিলুর বাবাকে সে সবই বলেছি। উনি তো শুনে আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। বললেন, অতবড় নামী স্কুলে পড়ার এমন সুযোগ, হেডমাস্টার মামা, দিলুর তো মহাভাগ্যি। এখানে আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে গোল্লায় যাচ্ছে, সলু বলছিল, মা ওকে কোনও হস্টেলে পাঠিয়ে দাও।”

হরিসাধন আঁতকে ওঠার মতো দু’হাত তুলে বললেন, ”না, না, খবরদার নয়। এই ছেলেদের এলোমেলো প্রকৃতিটাকে বাঁধতে হবে, ঠিক পথে অর্থাৎ যে পথে গেলে ওর বিকাশ ঘটবে সেই পথে ওকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। হস্টেলে ওকে বাঁধার লোক কেউ থাকবে না। কিন্তু দিলু কি দুধঘাটে গিয়ে থাকতে রাজি হবে?”

মল্লিকা ভ্রূ কুঁচকে একটু বিরক্তি মাখানো গলায় বললেন, ”ওর রাজি হওয়া—না হওয়ায় কী আসে যায়। ওর ভালর জন্যই আমরা ওকে পাঠাচ্ছি। এটা ওকে মেনে নিতে হবে।”

দিলুকে ডেকে আনলেন মল্লিকা। ভাল স্বাস্থ্যের জন্য বয়সের তুলনায় ওকে বড়ই দেখায়। বাবার মতো কালো গায়ের রং, কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের সঙ্গে চিরুনির সম্পর্ক মাঝেমধ্যে ঘটে। চৌকো মুখের গড়ন চোখদুটি শান্ত কিন্তু চোখের আড়ালে একটা কঠিন জেদি মন ধিকধিক অবিরত জ্বলছে। হরিসাধন সেটা লক্ষ করলেন।

”দিলু যাবি আমার সঙ্গে দুধঘাটে গিয়ে ক’টা দিন থেকে আসবি।”

”যাব। কবে?”

”আজই।” হরিসাধন ঘড়ি দেখলেন, ”পাঁচটা চল্লিশের ট্রেনটা ধরব। রেডি হয়ে নে।”

পাঁচ মিনিট পর দিলু এসে বলল, ”বোকামামা, আমি রেডি!”

হরিসাধন ভ্রূ তুলে তার ছোট ভাগ্নের দিকে তাকালেন। রংচটা জিনসের ট্রাউজার্স, ছাপছোপ দেওয়া হাফহাতা গেঞ্জি, পায়ে চটি, কাঁধে ঝুলি, হাতে নাইলনের ব্যাগ। একে কি রেডি হওয়া বলে!

হরিসাধনের চাহনি থেকে দিলু বুঝে গেল তার বেশবাস মামার মনঃপূত হয়নি। সে বলল, ”এই তো ভাল, হালকা ঝরঝরে। যাব তো মামার বাড়ি, সাজগোজের দরকার কী। জিনস একটা দারুণ সুবিধের জিনিস, ময়লাটয়লা হলেও চলে যায়।”

আর কথা বাড়াননি হরিসাধন।

.

বাগানের মধ্যিখানে ছোট দোতলা বাড়ি। যিনি এটি বানিয়েছিলেন তিনি একজন সিনেমা প্রযোজক, কলকাতায় থাকতেন। বাগানবাড়ি হিসেবেই এটি ব্যবহার করতেন, বছরে তিন—চারবার আসতেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুরা দলে দলে এসে ফাঁকা জমিগুলো দখল করে ঘর তুলে বসতে শুরু করতেই প্রযোজকমশাই বাড়ি, বাগান এবং পুকুরটি বিক্রি করে দেন পঞ্চাননকে।

বাড়িটি চৌকো আকৃতির। পেছন দিকে দোতলায় দুটি ঘরের সামনে টানা একটি টালি ঢাকা বারান্দা। সেটি এত চওড়া যে, তাকে দালানই বলা যায়। দোতলার দু’টি ঘরের নীচে একটি হলঘর ছিল। পঞ্চানন তার মাঝখানে দেওয়াল তুলে দুটি ঘর করে নিয়েছেন। এর একটি ঘর হরিসাধনের পড়া ও লেখার এবং বাইরের লোকেদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। সকাল থেকে লোক আসে, বিশেষ করে স্কুলসংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে। রাত্রে বারোটা পর্যন্ত বই পড়া ও লেখা নিয়ে থাকেন এই ঘরে। দোতলার বারান্দার নীচেও লম্বা একটা সিমেন্টের চওড়া লাল চাতাল। সেখান থেকে কুড়ি মিটার এগোলেই তিরিশ মিটার চওড়া পঞ্চাশ মিটার লম্বা পুকুরে নামার শান বাঁধানো সিঁড়ি। দশটা ধাপ নামলে জল, বর্ষাকালে সাত ধাপ নামলেই।

ভ্যান—রিকশা থেকে নেমে পাশের একটা পথ ধরে কুড়ি মিটার এগিয়ে বাঁ দিকে পাঁচিল ঘেরা দিলুর মামার বাড়ি। ওরা বুকসমান উঁচু লোহার গেট ঠেলে ঢুকল। সন্ধ্যা উতরে গেছে, অন্ধকার গাঢ়। দু’দিকে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা গাছ। তার মাঝখান দিয়ে একটা পথ বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত। দরজার দু’পাশে উঁচু রক। চারধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওরা রকে উঠতেই ”ঘেউ, ঘেউ” করে ছুটে এল একটা কুকুর অন্ধকার বাগান থেকে। দিলু সরে এল মামার গা ঘেঁষে।

হরিসাধন ধমক দিলেন, ”এই ভেলো, চুপ কর, চুপ।”

ভেলো ডাক বন্ধ করে, কাছে এল। হরিসাধন দরজার কড়া নাড়লেন। ভেলো দিলুর হাঁটু, চটি শুঁকেটুকে ল্যাজটা নাড়ল।

”ভেলোর কাজ ভয় দেখানো আসলে কিন্তু খুব ভিতু। বাগান পাহারা দেয়। শেয়াল তাড়া করে। এই অঞ্চলে চুরি ডাকাতি খুব বেশি। একবার আমাদের বাড়িতে ডাকাতির চেষ্টা হয়েছিল, তোর দাদু দোতলার বারান্দা থেকে বন্দুকের আওয়াজ করে ডাকাত তাড়ায়—”।

সদর দরজার মাথার ওপর আলো জ্বলে উঠল। দরজা খুলে দিল এক প্রৌঢ়া। হর্ষমুখী কাজের লোক, পনেরো বছর আছে। নামটা মুখে মুখে হয়ে গেছে ‘হষ্য’, এই বাড়িতে সারাদিন থাকে। প্রাক্তন জমিদার বিশ্বাসদের জমি বর্গায় চাষ করে তার স্বামী, আর আছে এক ছেলে বসুদেব ওরফে বাসু। ওরা তিনজন থাকে পাশের গ্রাম ছোট হুড়ায়। হরিসাধন বাসুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন, এবার তার ক্লাস এইট হবে। পরীক্ষায় বাসু প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকে। পঞ্চানন বাড়িতে সপ্তাহে দু’দিন বাসুকে পড়ান তাই নয়, তার বইপত্তর, খাতা, জামা—জুতো সবই কিনে দেন।

হর্ষমুখী দিলুকে দেখে অবাক হল। চেঁচিয়ে সে ডাকল দিলুর মামি সুলেখাকে, ”ও বউদি এসে দ্যাখো গো দাদার সঙ্গে কে এসেছে।”

সুলেখা ছিলেন দোতলায়। ব্যস্ত হয়ে নেমে এলেন। বাড়িতে একটাও ছেলেমেয়ে নেই। সারাদিন তার ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কেউ এলে সুলেখা খুশি হন নানারকম রান্না করে খাওয়াবার সুযোগ পেয়ে। ব্যাগ থেকে শিঙাড়ার ঠোঙাটা বের করে হরিসাধন হর্ষর হাতে দিয়ে বললেন, ”আমরা খেয়ে এসেছি, এগুলো তোদের জন্য, যশোর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের। বাবা বোধ হয় বাড়ি নেই, গোটা দুয়েক তুলে রাখিস।”

সুলেখা বললেন, ”দিলু কয়েকদিন থাকবে তো?”

দিলু বলল ”হুঁ।”

ছেলেবেলায় মায়ের সঙ্গে দিলু মামার বাড়িতে একবার এসেছিল। এখানকার সবই ভাল শুধু সময় কাটানোটাই হয় সমস্যার। তার সমবয়সী কেউ নেই। মন খুলে কথা বলতে না পারলে সেই জায়গা তার ভাল লাগে না।

হরিসাধন বললেন, ”কয়েকদিন বলছ কী, ভাল লাগলে দিলু এখানেই থেকে যাবে। মলুর সঙ্গে আমার সেরকমই কথা হয়েছে।”

শুনে দিলু মনে মনে হাসল। শুধু মামার বাড়িই নয়, মৌলালিতে নিজেদের বাড়িও তার ভাল লাগে না। নিঃসঙ্গ একঘেয়ে লাগে। দাদারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত, তার সঙ্গে কথা বলার সময়ই হয় না। কথা বললেও বয়সের তফাতটা তারা সবসময় মনে রেখে কথা বলে। মা সারাক্ষণ ব্যস্ত ঝি—চাকর, রান্না—খাওয়া নিয়ে। সারাক্ষণই খিটখিট করে যায় আর আপনমনে প্রায়ই একই কথা বলে—এতবড় সংসার সামলানো কি চাট্টিখানি কথা! দিলু লক্ষ করেছে, মা বি—এ পাশ হলেও বই পড়ে না, এমনকী খবরের কাগজও নয়। সন্ধে থেকে টিভি—র সামনে বসে হাবিজাবি যা দেখানো হয় তাই দেখে। বাবার সঙ্গে দিলুর কদাচিৎ দেখা হয়। সকাল আটটায় ঢোকে একতলার সেরেস্তাঘরে, তারপর সারাদিন কোর্টে, তারপর সন্ধে থেকে আবার সেরেস্তায়, রাত এগারোটা পর্যন্ত। দিলু মার কাছে শুনেছে বাবা জজের সামনে একবার দাঁড়ালেই মক্কেলকে আট হাজার টাকা দিতে হয়।

বাড়িতে থাকলে দিলু হাঁফিয়ে যায়। পাড়ায় একটা পার্ক আছে, অ্যালবার্ট স্কোয়ার। সেখানে সারা বছরই ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা চলে। এত ভিড় হয় যে, খেলার জায়গা পাওয়াই মুশকিল। বিজয়ী সঙ্ঘ, বন্ধু পরিষদ আর সিক্স বুলেটস—এই তিনটি ক্লাব মাঠটাকে ভাগ করে নিয়েছে। বুলেটসরা শুধুই ফুটবল আর বাকি দুটি ক্লাব প্রধানত ক্রিকেট খেলে। দিলু বিজয়ী সঙ্ঘের সদস্য। স্কুল থেকে ফিরেই সে পার্কে ছুটে যায়। খেলা ছাড়াও আছে তার বন্ধুবান্ধব। তাদের সঙ্গে সে শুধু খেলার গল্প করে যেটা বাড়িতে কেউ করে না।

মামিকে বলা বোকামামার কথাটা শুনে দিলু মনে মনে নিশ্চিন্ত হল এখানে থাকা তার হবে না। সমবয়সী কেউ নেই, যার সঙ্গে খেলা যায়, গল্প করা যায়।

”দিলু, হাতমুখ ধুয়ে নাও। হষ্য, ব্যাগ আর থলি মেসোমশাইয়ের ঘরে রেখে আয়। ওখানেই দিলু থাকবে।” সুলেখা তারে ঝোলানো গামছাটা দিলুর হাতে দিলেন।

পঞ্চানন বাড়ি ফিরলেন রাত আটটা নাগাদ। দিলু তখন বারান্দায় একটা চেয়ারে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। বারান্দার ইলেকট্রিক আলো জলে পড়ে চিকচিক করছে, চারধারে অন্ধকার, নারকেল আর সুপুরি গাছ পুকুরের পাড় ঘেঁষে সারি দিয়ে। জোর বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে, শব্দ হচ্ছে সরসর। দূরে দু—তিনটি বাড়িতে জ্বলা আলো ছাড়া দিলু কিছু দেখতে পাচ্ছে না। একটানা ঝিঁঝি—র ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ কানে আসছে না। কলকাতায় এই সময় এমন নিঃসাড় চুপচাপ পরিবেশের কথা সে ভাবতে পারে না। এইরকম শান্ত নির্জনতার মধ্যে বসে থাকাটা তার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা, বেশ ভাল লাগছে।

পঞ্চানন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চেঁচিয়ে বললেন, ”আমার দাদু কোথায়?” বারান্দায় পৌঁছে বললেন, ”শুনলাম তোমার পায়ের নখ নাকি উঠে গেছে।”

দিলু উঠে দাঁড়াল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ”ও কিছু নয়। এরকম আগেও হয়েছে। ফরওয়ার্ড খেলেছি, বলটা ছিল ইয়র্কার, ফসকালুম, বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর বলটা পড়ল, নখটা ফেটে গেল। ওটা পচে গিয়ে পরে নতুন নখ গজাল, এবারও তাই হবে।”

যতক্ষণ কথা বলছিল দিলু, তার মুখের তাচ্ছিল্যের ভাবটা লক্ষ করছিলেন পঞ্চানন। আঘাত অগ্রাহ্য করতে গিয়ে একটা বেপরোয়া ঔদ্ধত্য নাতির কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল। তিনি মনে মনে তারিফ করলেন।

”দাদু, ওই যে বললে ইয়র্কার, সেটা কী জিনিস?”

দিলু চোখ কুঁচকে বলল, ”ফাস্ট বোলাররা দেয়, এটা ওদের একটা বড় অস্ত্র। বলটা সোজা ব্যাটের তলায় এসে পড়ে। এ বল সামলানো বেশ শক্ত। থামাতে গিয়ে ব্যাটের তলা দিয়ে গলে এল বি কি বোল্ড আউট করে দেয়।”

পঞ্চানন চোখ বিস্ফারিত করে বললেন, ”ওরে বাব্বা, এ তো দারুণ বল। তুমি এ বল করতে পারো?”

দিলু বলল, ”আমি ফাস্ট বোলার নই, ব্যাটসম্যান।”

যে লোক ইয়র্কার বল কাকে বলে জানে না, তার সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে দিলু আর আগ্রহ বোধ করল না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে সে বলল, ”দাদু, তোমার শোয়ার ঘরের দেওয়ালে একটা বন্দুক ঝুলছে দেখলাম। বোকামামা বলল তুমি নাকি ডাকাত তাড়িয়েছ গুলি ছুড়ে, সত্যি?”

পঞ্চানন বললেন, ”বলেছে নাকি বোকা? আরে ও কিছু নয়, অনেককাল আগের কথা, তখন এখানে এত ঘরবাড়ি হয়নি। এই বারান্দা থেকে ফাঁকা আওয়াজ করেছিলুম। ওরা তিন—চারটে বোমা ছুড়েই পালাল। ডাকাতিতে সবে হাতেখড়ি হয়েছে। পাকা ডাকাত হলে পালাত না।”

দিলু বলল, ”দাদু, আমাকে বন্দুক চালানো শিখিয়ে দেবে?”

পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”শিখবে? কেন?”

দিলু বলল, ”শিকার করব।”

”বাঘ, সিংহ?”

”হ্যাঁ, তবে এখানে আর সিংহ পাব কোথায়? সেজন্য তো আফ্রিকায় যেতে হবে।”

”তুমি কোথাও মারার জন্য বাঘ—সিংহ পাবে না। সারা পৃথিবীতে আইন করে ওদের মারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওদের মেরে মেরে সংখ্যাটা এত কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, লোপাট হয়ে যাচ্ছে। যে ক’টা বেঁচে আছে তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য আইন করে রক্ষা করা হচ্ছে। আমাদের দেশে আগে চিতাবাঘ ছিল, এখন একটাও নেই। যে চিতাটা শেষ বেঁচে ছিল দিল্লির চিড়িয়াখানায়, সেটা বছর চারেক আগে মারা গেছে। মজা কি জানো, কাগজে প্রায়ই দেখবে লেখা হয়, চিতাবাঘের আক্রমণে গ্রামবাসী নিহত বা গোরু—ছাগল মেরে খেয়েছে। আসলে ওটা লেপার্ড, দুটো আলাদা প্রাণী। লেপার্ডের কোনও বাংলা নেই, তাই চিতা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।”

”বেশ, তা হলে পাখি মারব।” দিলু জেদি গলায় বলল। বন্দুক চালানো তাকে শিখতেই হবে।

পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”কেন! পাখি কি তোমার কোনও ক্ষতি করেছে? শুধু শুধু কেন তাদের খুন করবে?”

দিলু খুন শব্দটিতে অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। আমতা আমতা করে কী একটা বলার চেষ্টা করল। পঞ্চানন ওকে কাছে টেনে নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বললেন, ”শিকার যারা করে তারা জীবন ভালবাসে না, তারা নিষ্ঠুর লোক। বনের প্রাণীকে মানুষের সমাজের খুব দরকার। ওরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। কেঁচো, ব্যাং, ইঁদুর, সাপ, ফড়িং, পোকামাকড় এরাও প্রত্যেকেই কোনও না কোনওভাবে আমাদের উপকার করে।”

এবার তর্ক করার ঢঙে দিলু বলল, ”তা হলে আমরা মাছ ধরে খাই কেন, ওরাও তো প্রাণী।”

”নিশ্চয় প্রাণী। আমরা যদি মাছ না খাই তা হলে কী হবে? এই যে পুকুরটা ওতে মাছ আছে, যদি না ধরি তা হলে মাছগুলোর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা হবে যে, পুকুরে ওদের চলাফেরার জায়গা থাকবে না, তখন ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে মরবে। আমরা মাছ খাই তো প্রয়োজনে, খাবার হিসেবে। শুধু শুধু মজা পাওয়ার জন্য তো ওদের মারি না। আসলে এটাও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা। যাকগে এসব কথা, তোমার ইচ্ছে হয়েছে বন্দুক ছোড়ার, কেমন?”

দিলু মাথা হেলাল। পঞ্চানন ওর কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, ”ছুড়বে। আমি দেখিয়ে দোব।”

হষ্য এসে ডাকল খাওয়ার জন্য। ওরা নীচে নেমে এল। পরপর তিনটি কাঠের পিঁড়ির সামনে কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে রাখা। বাবু হয়ে বসে শেষ কবে খেয়েছে, দিলু মনে করতে পারল না। জন্ম থেকেই বাড়িতে চেয়ার টেবলে খাওয়া। এই মামার বাড়িতেই তাকে মেঝেয় বসে কাঁসার থালা বাটি গেলাসে খেতে হচ্ছে। এটা তার খারাপ লাগে না। পঞ্চানন প্রাচীন মানুষ, জীবন যাপনও প্রাচীন ধারায়। বসবাসের জায়গা বদল করলেও সাবেকি অনেক কিছু বদলায়নি।

দিলু মাঝখানে, দু’পাশে হরিসাধন ও পঞ্চানন। পরিবেশন করছেন সুলেখা। খেতে খেতে হরিসাধন জিজ্ঞেস করলেন, ”বাবা, তা হলে কী ঠিক হল?”

পঞ্চানন বললেন, ”ঠিক হল নাইটগার্ড পার্টি তৈরি করা হবে। পাড়ার ছেলেরা পালা করে সারারাত পাহারা দেবে, বিশেষ করে পূর্ণেন্দুদের বাড়ির এলাকাটা। ওখানেই তো পরশু দুটো লোককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।”

হরিসাধন চিন্তিত স্বরে বললেন, ”ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুলল। পূর্ণেন্দুকে বেশ সাবধানে থাকতে হবে। কিছুদিন যেন বাড়ি থেকে না বেরোয়।”

খাওয়া থামিয়ে পঞ্চানন বললেন, ”তাতে কী লাভ হবে? কতদিন বাড়িতে বসে থাকবে? একদিন না একদিন তো বেরোতেই হবে। কাজ করে কলকাতায়, ট্রেনে তো ওকে উঠতেই হবে। কাগজ খুললেই তো দেখি দিবালোকে ট্রেনের কামরার মধ্যে ডাকাতি, খুন ঘটে চলেছে।”

দিলু এইসব কথাবার্তার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে মামা আর দাদুর মুখের দিকে মাথা ঘুরিয়ে দু’বার তাকাল। শুধু তার মনে হল খুব গোলমেলে কোনও ব্যাপার এই পূর্ণেন্দু নামের লোকটা ঘঁটিয়েছে, তাই তার জীবনের ভয় আছে।

.

রাত্রে দাদুর পাশে বিছানায় শুয়ে দিলু সামনের দেওয়ালে ঝোলানো দোনলা বন্দুকটার দিকে তাকিয়ে ছিল। পঞ্চানন তা লক্ষ করলেন। বললেন, ”দাদু, কাল তোমাকে দেখিয়ে দোব কীভাবে বন্দুক চালাবে।”

”দাদু, নাইটগার্ডের কথা মামাকে তখন বলছিলে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে কি মামাও থাকবে, তুমি থাকবে না?”

”আমি এই বুড়োবয়সে রাতপাহারা কি দিতে পারব? এসব অল্পবয়সীদের জন্য। সত্যি—সত্যি যদি গুণ্ডাবদমাশদের মুখোমুখি হতে হয় তা হলে তো এক থাপ্পড়ে আমায় ফেলে দেবে।”

দিলু বলল, ”কেন, তুমি বন্দুকটা নিয়ে পাহারায় বেরোবে। বন্দুক দেখলে ওরা চোঁ চোঁ দৌড় দেবে।”

পঞ্চানন হেসে ফেলে বললেন, ”দাদু, এখনকার গুণ্ডাদের কাছেও বোমা, পিস্তল, পাইপগান থাকে। এই বুড়ো বয়সে কি আমি পারব? তোমার মামাও পারবে না। বোকা আবার ভিতুও, বয়সও তো ওর পঞ্চাশ পেরিয়েছে। এবার তুমি ঘুমোও।”

দিলু পরদিন যথারীতি দেরিতে ঘুম থেকে উঠল। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখল টেবলে তারই বয়সী একটি ছেলে মাথা নামিয়ে মন দিয়ে খাতায় কী যেন লিখছে। পাশের চেয়ারে বসে দাদু ঝুঁকে খাতার দিকে তাকিয়ে।

”উহুঁহুঁ, হ্যাজবিন নয় হ্যাজবিন নয়, হ্যাডবিন হবে। সেদিন কতবার বলে দিলুম, কাজটা করে যাচ্ছিল তার মানে পাস্ট কন্টিনিউয়াস, অতীতের ঘটনা। যা বলে দিই সেটা বাড়িতে গিয়ে আবার ঝালিয়ে নিলে এই ভুলটা হত না।” পঞ্চানন যখন কথাগুলো বলছিলেন ছেলেটি তখন দিলুর দিকে তাকিয়ে ছিল।

”আরে দাদু, এসো, এসো, ঘুমোচ্ছ দেখে আর ডেকে তুলিনি। গ্রাম—পাড়াগাঁয় লোকের ঘুম সূর্য ওঠার সঙ্গেই ভাঙে, শুতেও যায় তাড়াতাড়ি। এখানে থাকলে তোমারও এই অভ্যেস হয়ে যাবে। এই হল বাসু, ভাল নাম বসুদেব, আমাদের হষ্যর ছেলে। সোমবার থেকে পরীক্ষা, ক্লাস এইট হবে। তোমার তো হবে নাইন। বাসু, এই হল দিলু।”

বাসু হাসল দিলুর দিতে তাকিয়ে। দিলু দেখল ঝকঝকে সাজানো দাঁত, পাতাকাটা চুল, আয়ত চোখে বন্ধুত্বের চাহনি, শীর্ণ লম্বাটে মুখ, রং শ্যামবর্ণ, ছোটখাটো রোগা শরীর।

দিলু অস্বস্তি বোধ করল দাদুর একটা কথায়, ”তোমার তো হবে নাইন। হবে কিনা কে জানে, পরীক্ষা দিয়েই তার মনে হয়েছে পাশ বোধ হয় করতে পারবে না।”

”দাদু নীচে যাও, দাঁত মেজে নাও। ব্রাশ এনেছ তো?”

আধঘণ্টা পর পঞ্চানন আর বাসু যখন একতলায় নামল, দিলু তখন একটা বড় বাটি ভর্তি চিঁড়ে দুধ কলা গুড় মাখা খাচ্ছে।

পঞ্চানন বললেন, ”ডাবের জল খাবে নাকি?”

দিলু মাথা কাত করে বলল, ”হুঁ।” ডাবের জল খেতে তার ভাল লাগে। আগের বার যখন এসেছিল, প্রতিদিন অন্তত দু’তিন গ্লাস ডাবের জল খেয়েছে।

”বাসু, রিদু তো এখনও আসেনি, তুই—ই ডাব পেড়ে দে।”

পঞ্চাননের কথা শেষ হওয়ামাত্র বই খাতা রেখে বাসু হর্ষকে বলল, ”মা, দড়িগাছাটা দাও তো।”

পুকুরের দু’ধারের পাড় ঘেঁষে সার দিয়ে সুপুরি আর নারকেলের গাছ। তার পেছনে সার দিয়ে গোটা কুড়ি বেগুন গাছ। তার লাগোয়া মাচায় করলা আর উচ্ছে ঝুলছে। তার নীচে জমির ওপর লতিয়ে রয়েছে কুমড়ো গাছ। আট নম্বরি ফুটবলের মতো দুটো সোনালি রঙের কুমড়ো জমিতে বিশ্রামরত। পঞ্চানন চোখ কুঁচকে গাছের নারকেলগুলো লক্ষ করে একটি গাছ দেখিয়ে বাসুকে বললেন, ”ওটায় ওঠ, ডাবগুলো কচি রয়েছে।”

বাসু জামা খুলে গাছটার দিকে এগোল। একটা কাঠবেড়ালি ল্যাজ তুলে তুড়ুক তুড়ুক লাফিয়ে গাছটা বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠে বাসুতে দেখতে পেয়ে চটপট নেমে ঝোপের মধ্যে লুকোল। দেখে দিলুর খুব মজা লাগল। দড়ির দুটি প্রান্ত বেঁধে নিয়ে দুই পায়ের গোছে মালার মতো গোল করে আটকে বাসু দু’হাতে গাছটা জড়িয়ে টেনে টেনে নিজেকে তুলে নিচ্ছে ওপরে। প্রায় পাঁচতলা উঁচু গাছ। গাছটা হেলে রয়েছে পুকুরের দিকে। দিলু অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবল ওই রোগা শরীরে কী জোর আর কী সাহস। ফিসফিস করে সে পঞ্চাননকে বলল, ”দাদু, আমাকে নারকেল গাছে চড়া শিখিয়ে দেবে?”

উৎসাহিত গলায় পঞ্চানন বললেন, ”নিশ্চয় দেব। আগে তোমার পায়ের নখটা ঠিক হোক। নারকেল, সুপুরি সব গাছে উঠবে। প্র্যাকটিস করতে করতে দেখবে তুমি হুঁশিয়ার হয়ে গেছ, তোমার সাহসও বেড়ে গেছে, ইয়র্কার বল খেলতে তোমার আর অসুবিধে হবে না।”

বাসু গাছের মাথায় পৌঁছে গেছে। পাতার আড়ালে ওর হাঁটু পর্যন্ত গোটানো প্যান্ট আর পা দুটো দেখা যাচ্ছে। এক হাতে গাছ জড়িয়ে অন্য হাতে এক—একটা ডাব ধরে মুচড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়ে বাসু পুকুরে ছুড়ে ফেলতে লাগল। গোটাছয়েক পুকুরে ফেলে সে যা করল তাতে দিলুর চোখ কপালে উঠল, হাঁ হয়ে গেল মুখ।

পায়ের দড়িটা নীচে ফেলে দিয়ে বাসু দু’ পা দিয়ে গাছে একটা জোর ধাক্কা দিল। পেছন ফিরে পুকুরের জলে প্রায়—বসা অবস্থায় সে ঝপাত করে পড়ল, পাঁচতলা সমান উচ্চচতা থেকে।

গলা শুকিয়ে গেছে দিলুর, ঠোঁট চেটে বলল, ”দাদু একটু ভুল হলে ও তো জলে না পড়ে ডাঙায়ও পড়তে পারত!”

”তা তো পারতই। কতবার ওকে বারণ করেছি এভাবে নামিসনি, কোনদিন মরবি, নয়তো সারাজীবন পঙ্গু হয়ে থাকবি। আসলে কী জানো, তোমাকে দেখে বাহাদুরি দেখাবার লোভ সামলাতে পারেনি।”

বাসু সাঁতার কেটে ডাবগুলো একে একে পাড়ে ছুড়ে দিয়ে ঘাটে এসে জল থেকে উঠল। বাড়ির ভেতরে গিয়ে ভিজে প্যান্টটা ছেড়ে গামছা পরে একটা কাটারি হাতে ফিরে এল। দুই কোপে ডাবের মুণ্ডু উড়িয়ে বাসু সেটা একগাল হেসে এগিয়ে ধরল দিলুর দিকে।

ডাবটা হাতে নিয়ে দিলু বলল, ”অত ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে তোমার ভয় করল না?”

বাসু আবার হেসে মৃদুস্বরে বলল, ”না।”

ছোট ছোট ডাব, দিলু চারটে ডাবের জল খেল, ওরা কেউ খেল না। বাকি ডাবদুটো বাসু ভেতরে নিয়ে গেল। এই সময় দুটি ছেলে পঞ্চাননের সঙ্গে কথা বলতে এল।

তাদের একজন বলল, ”জ্যাঠামশাই, লালুদা জানাল, কাল দুপুরে দুটো অচেনা লোক ওর দোকানে এসে পূর্ণেন্দুর খবর নিয়েছিল। লালুদা তখন দোকানে ছিল না, ওর কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করে পূর্ণেন্দু বাড়ি থেকে বেরোয় কি না, বেরোলে কখন বেরোয় কোনদিকে যায়। আমাদের কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। আজ রাত থেকেই পাহারায় বেরোতে হবে। বড় টর্চ, লাঠি সবার তো নেই, তাই জোগাড় করতে বেরিয়েছি। আপনার কাছে কী আছে?”

পঞ্চানন বললেন, ”লাঠি তো নেই ছড়ি আছে, তাই দিয়ে তো গুণ্ডা সামলানো যাবে না। টর্চ আছে চার ব্যাটারির, সেটা দিচ্ছি। দিলু, দৌড়ে দোতলায় গিয়ে আমার ঘরের টেবলে একটা টর্চ আছে সেটা নিয়ে এসো তো।”

দিলু টর্চ এনে দিতে সেটা নিয়ে ছেলেদুটি চলে গেল।

”দাদু, ব্যাপারটা কী বলো তো?” কৌতূহলী দিলু জিজ্ঞেস করল। ”কাল তুমি আর মামা পূর্ণেন্দু নামের একজনের কথা বলছিলে। মনে হল ওর বিপদ ঘটেছে।”

”বিপদ বলে বিপদ! পূর্ণেন্দু চাকরি করে সল্টলেকে সেচভবনে। সাতদিন আগে বিধাননগর স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেনে উঠেছে। ট্রেন যখন বামনগাছি পৌঁছেছে তখন কামরার মধ্যেই একটা ছেলেকে রিভলভার দিয়ে বুকে গুলি করে তিনজন প্ল্যাটফর্মে নেমে যাচ্ছিল। পূর্ণেন্দু ছিল দরজার কাছে, সে শেষের জনকে জাপটে ধরে। ধস্তাধস্তি হতে হতে ট্রেন ছেড়ে দেয়। এর পর কামরার লোকেরা এমন গণপিটুনি শুরু করে যে, গুণ্ডাটা তাইতে মারা যায়।”

পঞ্চাননকে থামিয়ে দিয়ে দিলু বলল, ”বুঝেছি, গুণ্ডারা এখন বদলা নেওয়ার জন্য পূর্ণেন্দুকে মারার চেষ্টা করছে, কেমন? এরকম ঘটনা আমাদের পাড়াতেও ঘটেছে, তবে রিভলভার নয়, প্রথমে বোমা মারে, রাস্তায় লোকটা পড়ে যায়, তখন ক্ষুর দিয়ে গলা কেটে ওরা মোটরবাইকে উঠে চলে যায়। লোকটা নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় খুন হয় সকালে বাজার করে ফেরার সময়।”

”কী মুশকিলে পূর্ণেন্দু পড়েছে বলো তো।” পঞ্চানন চিন্তায় পড়ে গেলেন, ”খুনি ধরে এখন নিজেই খুন হতে চলেছে। ওরা বাড়িটা ঠিক খুঁজে বের করেছে। আমাদের পাড়ার লোকেরা খুব ভাল, খুব মিলমিশ। কেউ বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়ায়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ওকে বাঁচাবার জন্য ছেলেরা রাতপাহারা দেবে। কিন্তু দিনের বেলাতেও তো ওকে মারার জন্য আসতে পারে। তোমাদের পাড়ায় যে খুনটা হয়েছিল সে তো সকালেই ঘটেছিল। আগে এসব রাতের অন্ধকারে হত, এখন দিনের বেলাতেও হয়। লোকভর্তি ট্রেনের কামরা আর তারই মধ্যে কিনা গুলি করে নেমে চলে যায়! ভাবতে পারো?”

দিলু বলল, ”দাদু, ওরা আচমকা হঠাৎ অ্যাটাক করে, এক মিনিট আগেও তুমি জানতে পারবে না। দুপুরে হয়তো সদর দরজায় কড়া নাড়ল। যেই দরজা খুলবে অমনই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে বোমা মেরে কি গুলি চালিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে মোটরবাইকে চেপে হাওয়া হয়ে যাবে। অ্যাকশনটা করতে লাগবে বড়জোর দু’মিনিট, তখন তোমার রাতপাহারাওলারা কোথায়?”

পঞ্চানন আরও চিন্তায় পড়ে গিয়ে বললেন, ”তাও তো বটে। আমি বরং পূর্ণেন্দুর বাড়ির লোকেদের বলে আসি সদর দরজা সারাক্ষণ বন্ধ রাখবে। আর কেউ কড়া নাড়লে জানলা দিয়ে আগে দেখে নেবে অচেনা লোক কি না।”

পঞ্চাননের সঙ্গে দিলুও বেরোল। গতকাল ভ্যানরিকশা থেকে যেখানে সে নেমেছিল তার থেকে পঞ্চাশ—ষাট মিটার এগিয়ে লালুর মুদির দোকানের উলটো দিকে পূর্ণেন্দুদের বাড়ি। একতলা নিচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। কাঠের ছোট্ট গেট। ইট বিছানো সরু পথ দিয়ে গিয়ে একটা চৌকো বারান্দায় উঠতে হয় দু’ধাপ সিঁড়ি ভেঙে। বারান্দাটার দু’দিকে হাঁটু সমান উঁচু দেওয়াল। তার ওপরে বসানো লোহার গ্রিল। গ্রিল ঘেরা থাকলেও বারান্দাটাকে দু’দিক খোলাই বলা যায় আর বাকি দু’দিকে ঘর। গ্রিলেরই দরজা। বাইরে থেকে এই দরজা দিয়ে বারান্দায় ঢুকে ঘরে যেতে হয়। একটা বেঞ্চ, একটা ছোট নিচু টেবল আর দুটো স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে বাইরের লোকেদের বসার জন্য বারান্দাটাকে ব্যবহার করা হয়। বাড়ির বাইরে দেওয়ালে পলেস্তরা নেই। বোধ হয় টাকায় কুলোয়নি তাই বাড়িটা সম্পূর্ণ করতে পারেনি, পরে টাকা জমিয়ে পলেস্তরা করে নেবে। এইরকম বাড়ি এই অঞ্চলে অনেক, দিলু দেখেছে। পূর্ণেন্দুদের বাড়িটার দু’পাশে কিছু জমি, তাতে একটা পেয়ারা আর কয়েকটা পেঁপেগাছ। জমিতে পড়ে আছে ভাঙা ইট, টালি, কাঠের টুকরো; দিলুর নজর গেল পেয়ারাগাছে, কয়েকটা পেয়ারা বেশ বড় আর ডাঁশা।

কাঠের গেট দিয়ে ঢুকে গ্রিলের দরজার পাশে দেওয়ালে কলিং বেল। পঞ্চানন বোতাম টিপলেন। বেল বাজার শব্দ হল না।

”নির্ঘাত লোডশেডিং। এই এক ঝামেলা। সারা সকাল, দুপুর এই চলবে।” পঞ্চানন বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন, ”পূর্ণেন্দু, পূর্ণেন্দু….নবেন্দু, দিব্যেন্দু—”

ভেতরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন পূর্ণেন্দুর মা বিভা। বিধবা মহিলা।

পঞ্চানন বললেন, ”বাড়িতে কেউ নেই? পূর্ণেন্দু কোথায়, কী করছে? দেখতে এলুম।”

গ্রিলের দরজা ভেতর থেকে তালা দেওয়া। বিভা চাবি দিয়ে তালা খুলে বললেন, ”ছেলেরা এইমাত্র বেরোল। কলেজ, আপিস কামাই করে বাড়িতে বসে পাহারা ক’দিন দেবে। ভগবান আছেন দেখবেন, আর আছেন আপনারা। দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।”

পঞ্চানন চেয়ারে বসলেন। এই সময় বারান্দার পেছনের ঘরের জানলার একটা পাল্লা ফাঁক করে উঁকি দিল একটা মুখ। চোখ দুটিতে ভয় চাপার চেষ্টা। দিলুর মনে হল এই লোকটিই পূর্ণেন্দু।

পঞ্চানন তাকে দেখে বললেন, ”বেরিও না এখন ঘর থেকে। অত ভয় পাওয়ারই বা কী আছে, আমরা তো রয়েইছি। তেমন কিছু মনে হলে আমাকে ডেকো।”

পূর্ণেন্দু বলল, ”দুপুরে আপনাকে ডাকতে হলে তো মাকে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে, তখন যদি ঢুকে পড়ে। দেখছেন তো বাড়িটা একদম খোলা, কোনওরকম প্রোটেকশন নেই।”

দিলু এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। এইবার বলল, ”দাদু, আমরা এসে তো দুপুরে থাকতে পারি। তুমি বন্দুকটা হাতে নিয়ে থাকবে। গুণ্ডারা এলেই গুলি চালাবে।”

”ঠিক বলেছিস।” পঞ্চানন উৎসাহে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। হাঁটুতে বাতের উপদ্রব ঘটল। ”বন্দুক তো সেইজন্যই রাখা, ডাকাত গুণ্ডা তাড়াবার জন্য।”

দিলু বলল, ”তা ছাড়া বন্দুকে যাতে জং না ধরে সেজন্য মাঝে মাঝে ওটা ছোড়াও দরকার।”

বিভা জানতে চাইলেন, ”মেসোমশাই, এই ছেলেটি কেন?”

”নাতি, মলুর ছেলে। বেড়াতে এসেছে। ভাল লাগলে থেকে যাবে, এখানেই পড়াশুনো করবে বোকার স্কুলে।”

দিলু বলল, ”দাদু তা হলে কি আজ দুপুর থেকেই পাহারায় বসবে।”

”আজ নয়। বন্দুকটা ঠিক আছে কি না, কার্ট্রিজগুলো ছ’সাত বছর পড়ে রয়েছে, সেগুলো ফাটবে কিনা আগে পরখ না করে কি পাহারায় বসা যায়?”

বিভা ভেতরে গিয়ে একটা প্লেটে চারটে নারকেল নাড়ু আর এক গ্লাস জল নিয়ে এসে বললেন, ”প্রথম এলে, একটু মিষ্টিমুখ করো।”

দিলু ইতস্তত করছিল, পঞ্চানন চোখের ইশারায় খেয়ে নিতে বললেন।

বাড়ি ফেরার সময় দিলু বলল, ”দাদু, তুমি বলেছিলে বন্দুক চালানো শিখিয়ে দেবে, এবার সেটা শিখিয়ে দাও, তা হলে কার্ট্রিজ আর বন্দুকটা ঠিক আছে কি না তাও সেইসঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।”

”হ্যাঁ, এটা একটা যুক্তি বটে।” পঞ্চানন নাতির পিঠ চাপড়ে বললেন।

.

দোনলা বন্দুকটার ঘাড় মটকে দিয়ে পঞ্চানন এক চোখ বন্ধ করে পরপর নলের ভেতরে তাকালেন, গন্ধ শুঁকলেন, নাক কোঁচকালেন।

”বহুকাল পরিষ্কার করা হয়নি। আগে একটু তেল দিয়ে পরিষ্কার করেনি।”

পঞ্চানন আলমারি থেকে একটা শিশি বের করলেন। খুঁজে—পেতে একটা আড়াই হাত লম্বা কঞ্চি জোগাড় করে তার মাথায় ন্যাকড়া বেঁধে তাতে তেল ঢাললেন। এবার কঞ্চিটা নলের মধ্যে ঢুকিয়ে ঘষাঘষি করে ধুলোময়লা সাফ করলেন। সেফটি ক্যাচ দুটো টেনে পরপর ট্রিগার টিপলেন, খটাস খটাস শব্দ হল। বন্দুকের মটকানো ঘাড় সোজা করে, বাঁটটা বগলের কাছে কাঁধে ঠেকিয়ে বন্দুক তুলে বারান্দার বাইরে নারকেল গাছের দিকে তাক করলেন।

দিলু একমনে দাদুর সবকিছু লক্ষ করে যাচ্ছিল। এ পর্যন্ত যতটুকু দেখল তাতে তার মনে হলে বন্দুক ছোড়ার মধ্যে জটিলতা কিছু নেই। খেলনা পিস্তলে ক্যাপ লাগিয়ে সেফটি ক্যাচটা টেনে আঙুল দিয়ে ট্রিগার টেনে দিলে ‘ফটাস’ শব্দ হয়, সত্যিকারের বন্দুকে হয় ‘গুড়ুম’। তবে বন্দুক ধরা হাতটা স্থির রাখা দরকার আর নিশানাটাকে ঠিকভাবে একদৃষ্টে দেখা। ফাস্ট বোলার যখন ডেলিভারি করছে তখন ব্যাটসম্যান যেমন মাথাটা অনড় রেখে অপেক্ষা করে বলটাকে একদৃষ্টে লক্ষ করার জন্য, দিলুর মনে হল এটাও অনেকটা সেইরকম। তবে শুটার হওয়া তার ইচ্ছে নয়, সে হতে চায় ব্যাটসম্যান। শুধু শখ মেটানোর জন্য সে একবার বন্দুক ছুড়তে চায়।

পঞ্চানন একটা ছোট কাঠের বাক্স আলমারির মাথা থেকে নামালেন। ডালাটা খুলে তিনি দিলুকে বললেন, ”এই হচ্ছে কার্ট্রিজ, যাকে বাংলায় বলে কার্তুজ।”

দিলু দেখল ক্রিকেট বলের রঙের ইঞ্চি চারেক লম্বা মোটা চুরুটের মতো গোলাকার গোটাদশেক কার্ট্রিজ। একদিকটা পেতলে মোড়া, তবে মধ্যিখানে ছোট্ট একটা তামার টিপ। পঞ্চানন বুঝিয়ে দিলেন, ট্রিগার টিপলে এই তামাটায় সেফটি ক্যাচটা ঘা দেয়। আর তখনই ফায়ার হয়।

দিলু বলল, ”দাদু, তুমি আগে একটা গুলি ছুড়ে দেখাও, তারপর আমি ছুড়ব।”

পঞ্চানন দুটো নলে দুটি গুলি ভরলেন। বারান্দায় এসে এ—ধার ও—ধার তাকালেন, গুলি কোনদিকে কোথায় ছুড়বেন সেই লক্ষ্যটা নির্বাচন করতে। কিছুই তাঁর মনে ধরল না। অবশেষে নীচে তাকিয়ে চোখ পড়ল পুকুরে। ঠিক করলেন, জলেই গুলি ছুড়বেন।

”এইবার দেখো, বাঁ পা—টা একটু সামনে বাড়িয়ে বন্দুকের নলের এই জায়গাটা বাঁ হাতের চেটোর ওপর রেখে, বাঁটটা কাঁধের এইখানে চেপে নলের শেষে সর্ষে দানার মতো যে মাছিটা রয়েছে, একচোখ বন্ধ করে, মাছিটাকে তোমার টার্গেটের সমান লাইনে রাখো। ব্যাপারটা বুঝেছ?”

দিলু লক্ষ করছিল দাদুর ভাবভঙ্গি। পুকুরের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরতেই সে সামনে তাকাল। তখন পুকুরের অপর পাড়ে একটা দশ বারো বছরের মেয়ে দড়ি ধরে একটা খয়েরি রঙের গোরুকে নিয়ে যাচ্ছে, পেছনে বাছুর।

পুকুরের মধ্যিখানে তাক করে পঞ্চানন ট্রিগার টিপলেন। নিস্তব্ধ পরিবেশ খানখান করে বন্দুকের শব্দ হতেই কোথা থেকে ভেলো ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠল, গোরুটা থমকে দাঁড়িয়ে হাম্বা রব তুলে বাছুরের দিকে এগিয়ে গেল, গাছগুলো থেকে গোটা তিরিশ পাখি নানান রকম স্বরে ডাকতে ডাকতে ওড়াউড়ি শুরু করল।

পঞ্চানন বন্দুকটা দিলুর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ”দাদু, এবার তুমি ছোড়ো।”

দিলু আগে থেকেই নজর করেছিল বাগানে গাছে ঝুলে থাকা একটা এঁচোড়কে। বন্দুকটা হাতে পেয়ে সময় নষ্ট না করে এবং দাদু বুঝে ওঠার আগেই সে এঁচোড়টা তাক করে ট্রিগার টানল। আবার একটা প্রকৃতির শান্ততা এলোমেলো করা শব্দ। পাখিদের ভীত স্বরে ওড়াউড়ি, ভেলো দিশাহারা ডাক ডাকতে ডাকতে ছুটল বাছুরটারই দিকে, বাছুরটা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে ছুটতে ছুটতে গিয়ে পড়ল পুকুরে।

এঁচোড়টা গাছ থেকে জমিতে পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। দেখে দিলুর রোমাঞ্চ হল। প্রথম গুলি ছোড়াতেই সে শিকার করে ফেলেছে। পঞ্চানন মুগ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, ”শাবাশ দাদু, শাবাশ।”

তখনই মেয়েটির আর্ত চিৎকার তারা শুনল, ”ওগো বাঁচাও, বাছুর ডুবে যাচ্ছে, বাঁচাও।”

দিলু বারান্দা থেকে দেখল বাছুরটা সাঁতরে পাড়ের দিকে এসেছে কিন্তু পাড়টা খাড়াই, ওখানে জল গভীর, দাঁড়াবার মতো তল নেই। বেচারা আঁকুপাকু করছে জমি পাওয়ার জন্য। কিন্তু পাচ্ছে না। ওর মা পাড়ের কিনারে এসে ডাকছে আর চারদিকে তাকাচ্ছে উদভ্রান্ত বিস্ফারিত চোখে।

মেয়েটি ছুটতে ছুটতে বারান্দার নীচে এল। মুখ তুলে চেঁচিয়ে বলল, ”ও দাদু, বাছুরটাকে তুলে দাও না, ও ডুবে মরে যাবে যে।”

দিলুর ইচ্ছে করল, বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ে বাছুরটাকে জল থেকে তুলে আনতে। হায়, সে তো কলকাতার হাজার হাজার ছেলের মতো সাঁতার জানে না। বাছুর না হয়ে যদি মানুষের বাচ্ছা হত তা হলেও সে দূর থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারত না। সে ছয় মারতে পারে, জলে ঝাঁপ দিতে পারে না।

বারান্দা থেকে অসহায় দৃষ্টি ছাড়া আর কিছু না পেয়ে মেয়েটি সময় নষ্ট না করে বাড়ির ভেতরে ছুটে গেল, ”মামি ও মামি, ও হষ্য মাসি—” বলতে বলতে।

এর পরই দিলু দেখল, তার পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী মামি সুলেখা শাড়িটাকে গাছকোমর বাঁধতে বাঁধতে একটা ওলিম্পিক স্প্রিণ্টারের মতো ছুটে যাচ্ছে। বাছুরটা তখন জলে ডুবছে আর উঠছে। মামি পুকুরের পাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু—তিনটি হাত পাড়ি দিয়ে বাছুরটার কাছে পৌঁছে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

পঞ্চানন ও দিলু যখন নীচে নেমে ঘাটে পৌঁছল তখন হর্ষ সেখানে এসে গেছে, আর সুলেখাও বাছুরটাকে বুকে জড়িয়ে সাঁতার কেটে ঘাটের নীচের ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে। হর্ষ জলে নেমে বাছুরটাকে দু’হাতে তুলে ঘাটের ওপরের ধাপে এনে শুইয়ে দিল। জল খাওয়ার জন্য বাছুরটা বমি করছে। ছুটতে ছুটতে ওর মা এসে গেল। জিভ দিয়ে সে চাটতে শুরু করল বাছুরটার মাথা পিঠ বুক।

সুলেখা হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ”হষ্য, উনুনে পোস্ত চাপিয়ে এসেছি, দৌড়ে যা। এতক্ষণে বোধ হয় পুড়ে গেছে।”

পঞ্চানন বললেন, ”যাক পুড়ে। বউমা, তুমি না এসে পড়লে বাছুরটাকে আর বাঁচানো যেত না।”

”বাবা আমি বাঁচাবার কে, ভগবতীর সন্তান, মা—ই বাঁচিয়েছেন।” সুলেখা দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন।

দিলু ফিসফিস করে দাদুকে বলল, ”আমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেবে?”

”দোব। বাসুর পরীক্ষাটা হয়ে যাক, ওকে বলব, ও ভাল সাঁতার জানে।”

”তুমি জানো না?”

”জানি। তবে এই পঁচাশি বছর বয়সে জলে নামার ক্ষমতা আর নেই। দেখলে না বাছুরটা ডুবছে দেখেও দাঁড়িয়ে রইলুম।” বিষণ্ণ হতাশ স্বরে পঞ্চানন বললেন। দাদুর মুখ অপরাধীর মতো দেখাচ্ছে দেখে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো স্বরে দিলু বলল, ”তোমার আর দোষ কী, বয়স তো সব মানুষেরই হয়, ইয়ং ম্যানের মতো ক্ষমতা কি চিরকাল কারুর থাকে? বুড়ো হলে আমারও থাকবে না।”

পঞ্চানন হেসে ফেললেন নাতির বিজ্ঞের মতো কথা শুনে। বললেন, ”ক্ষমতা থাকতে থাকতে একটা দাগ কেটে যাও।”

দিলু অবাক হয়ে বলল, ”দাগ। সে আবার কী!”

”মানুষ হয়ে জন্মেছ যখন এমন কিছু একটা করো যা চিরকাল সবার মনে থাকবে। আমার কথা নয়, স্বামীজির কথা।”

দিলু ভুরু কোঁচকাল। স্বামীজি! দাদু বোধ হয় স্বামী বিবেকানন্দর কথা বলছেন। সে নাম শুনেছে কিন্তু ওঁর কোনও লেখা পড়েনি। বই পড়তে তার ভাল লাগে না।

দুপুরে ঘুম আসে না দিলুর। কলকাতায় হয় তখন স্কুলে এবং ছুটি দিন হলে খেলার মাঠে। খেলা থাকলে স্কুল পালিয়ে খেলতে যায়, বাড়ির কেউ তা জানে না। দুপুরে ঘুমন্ত দাদুর পাশে চিত হয়ে শুয়ে দেওয়ালে ঝোলানো বন্দুকটার দিকে তাকিয়ে সে চলচ্চিচত্রের মতো মনের মধ্যে দেখে যাচ্ছে সকাল থেকে যা যা ঘটেছে।—দাদুর কাছে বাসুর ট্রানস্লেশন করা, নারকেল গাছে বাসুর ওঠা, সেখান থেকে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া, খচাখচ কাটারি দিয়ে ডাব কাটা। এর একটাও সে করতে পারবে না। এর পর পূর্ণেন্দুদের বাড়ি যাওয়া, সেখান থেকে ফিরে বন্দুক থেকে প্রথমবার গুলি ছুড়েই গাছ থেকে এঁচোড় ফেলে দেওয়া…ভাবতেই দিলুর শরীর গরম হয়ে উঠল। এটা তো মিরাকল। কীভাবে যেন ঘটে গেল। এটা দৈব ঘটনা ছাড়া আর কী হতে পারে!

এরকম ঘটনা তো ক্রিকেটেও ঘটেছে। দিলুর মনে পড়ল বিজয়ী সঙ্ঘের সঙ্গে সালকিয়ায় গিয়েছিল ম্যাচ খেলতে, অবশ্য রিজার্ভ প্লেয়ার হিসেবে। হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি নেমে মাঠে জল জমে গেল, খেলা বন্ধ। টিমের স্কোরার বলাইদা জমিয়ে ক্রিকেটের গল্প বলেন। তিনি শুরু করলেন ষাট সালে ব্রিসবেন মাঠে পৃথিবীতে প্রথম টাই হওয়া টেস্ট ম্যাচের গল্প। সেই টেস্ট খেলেছিল বিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফ্রাঙ্ক ওয়ারেলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দু’দলেই বাঘা বাঘা প্লেয়ার। একদিকে সোবার্স, কানহাই, হল, হান্ট, রামাধিন, ভ্যালেন্টাইন, অন্যদিক ববি সিমসন, ডেভিডসন, হার্ভি, ও’নিল, গ্রাউট, ম্যাকডোনাল্ড, ক্লাইনের মতো ক্রিকেটাররা।

বলাইদা যেন মাঠে বসে নিজের চোখে ম্যাচটা দেখেছেন এমনভাবে প্রথমদিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত বর্ণনা দিয়েছিলেন:

”মিরাকল ছাড়া আর কী বলব। জেতার জন্য অস্ট্রেলিয়ার দরকার তিন রান, বাকি রয়েছে তিন বল, হাতে দুটো উইকেট। হলের বলে মেকিফ ব্যাট চালালো। বল স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারির কাছে বড় বড় ঘাসে আটকে থেমে গেল। তীরবেগে ছুটে এসে হান্ট বলটা তুলে নিয়ে প্রায় নব্বই গজ দূর থেকে ছুড়ল। নিখুঁত ছোড়া, সোজা আলেকজান্ডারের গ্লাভসে। তখন দুটো রান নেওয়া হয়ে গেছে, তার মানে ম্যাচ টাই হয়ে গেছে। জিততে হলে আর একটা রান দরকার, ওরা সেই তৃতীয় রানটা নেওয়ার জন্য দৌড়ল। তখনই আলেকজান্ডারের হাতে বলটা পৌঁছল। গ্রাউট ডাইভ দিয়েও রান আউট থেকে রক্ষা পেল না। স্কোর তখন সাতশো সাঁইত্রিশ অল। দু’বল বাকি, জিততে এক রান দরকার। ক্লাইন এল ব্যাট করতে। এর পরই ঘটল সেই মিরাকল। ক্লাইন হলের প্রথম বলটা লেগের দিকে ঠেলে দিয়েই ছুটল। বারো গজ দূর থেকে ছোঁ মেরে সলোমন বলটা তুলেই ছুড়ল। ধীরেসুস্থে টিপ করে ছোড়ার সময় ছিল না। মাত্র একটা স্টাম্প ছাড়া আর কিছু তার নজর করার ছিল না। যদি ফসকাত তা হলে মেকিফ পৌঁছে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া জিতে যেত। বলটা কিন্তু সোজা গিয়ে লাগল স্টাম্পে। এক বল বাকি থাকতে ম্যাচ টাই, একে দৈব ঘটনা ছাড়া আর কী বলব।”

দিলু বিড়বিড় করল, ”মিরাকল, মিরাকল। আমারটাও মিরাকল।”

দাদু ঠিক যেমনটি বলেছিল সেইভাবেই বন্দুকটা ধরে গুলিটা ছুড়েছিল। কাঁধে একটা ধাক্কা লেগেছিল মাত্র। ছররাগুলো লেগেছে এচোড়ের বোঁটার কাছে। তার টিপ যে ভাল এটা সে ক্রিকেট মাঠে ফিল্ড করার সময় জেনে গেছল। ম্যাচে গোটা দুয়েক রান আউট সে করবেই।

বিছানা থেকে উঠে দিলু বারান্দায় এল। সারা বাড়ি নিঝুম। পাশের ঘরটা বোকামামার। মামি এখন বোধ হয় ঘুমোচ্ছে। মামা স্কুলে। হাওয়াই চটিটা পায়ে দিয়ে দিলু নীচে নেমে এল। দালানে মাদুরে শুয়ে পাশ ফিরে হর্ষমুখী ঘুমোচ্ছে। দিলুর চটির শব্দে সে শোয়া অবস্থাতেই বলল, ”কে রে?”

”আমি দিলু।”

”কোথায় চললে?” হর্ষ উঠে বসল।

”ভাল লাগছে না। যাই একটু বাইরে ঘুরে আসি।”

”ভাল না লাগলে কাজ করো, জগৎ সংসার ভুলে থাকতে চাও যদি তা হলে মাছ ধরো। চলো তোমাকে একটা ছিপ দিচ্ছি।”

হর্ষ ভাঁড়ার ঘর থেকে পাঁচ হাত লম্বা বাঁশের কঞ্চি আনল। তার সরু প্রান্তটিতে প্রায় সাত হাত লম্বা শক্ত সুতো বাঁধা, সুতোর মাঝামাঝি বাঁধা শোলার চার ইঞ্চি একটা কাঠি, এটা ফাতনা। সুতোর প্রান্তে জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো সরু তারের বঁড়শি। ছিপটা, কলাপাতায় একমুঠো ভাত আর একটা বড় প্লাস্টিকের মগ হর্ষ দিলুর হাতে দিয়ে বলল, ”যাও ঘাটের নীচের ধাপে বসে পুঁটিমাছ ধরো আর এই মগে মাছ রাখো। দেখবে কেমন মজা লাগবে।”

দিলু লাজুক স্বরে বলল, ”কী করে ধরতে হয় একটু দেখিয়ে দেবে, কখনও তো মাছ ধরিনি।”

সে হর্ষর সঙ্গে পুকুরঘাটে এল। সিঁড়ির ধারের দিকে দাঁড়িয়ে বঁড়শিতে ভাত গেঁথে হর্ষ ছিপটা বাতাসে ছপাৎ করে মারল। বঁড়শিটা দূরে জলে গিয়ে পড়ল। বঁড়শি ডুবে গিয়ে ফাতনাটা ভাসছে।

”এবার ফাতনাটাকে নজর করো।”

দিলু দেখল একটু পরেই জলে স্থির হয়ে ভাসা ফাতনাটা তিরতির করে নড়ে উঠল। হর্ষ ছিপটা শক্ত করে ধরল। তার চোখ তীক্ষ্ন, ঠোঁটের কোণে হাসি।

”মাছ এখন ঠোকরাচ্ছে।”

ফাতনাটা একটা ডুব দিতেই সঙ্গে সঙ্গে হর্ষ ছিপে হ্যাঁচকা টান দিল। আঙুলখানেক লম্বা একটা পুঁটি বঁড়শিতে ছটফটাচ্ছে। মাছটাকে মুঠোয় ধরে হর্ষ বলল, ”এবার দেখো কী করে বঁড়শিটা মাছের মুখ থেকে ছাড়িয়ে নেবে।”

দিলু মন দিয়ে দেখল হর্ষ কীভাবে মাছের মুখের মধ্য থেকে বঁড়শিটা বের করল।

”এইবার তুমি নিজে মাছ ধরো, এ পুকুর পুঁটিমাছ ভরা। মাছ ধরে এই মগে রাখবে। আমি যাচ্ছি।” হর্ষ চলে গেল।

যেমনটি দেখিয়ে দিয়েছিল হর্ষ, সেইভাবে দিলু গভীর মনোযোগে আধঘণ্টায় আটবার ব্যর্থ হয়ে তিনটে পুঁটি বঁড়শিতে গেঁথে তুলল। তাইতে সে এত আনন্দ পেল যে, তার মনে হল ম্যাচে আট ওভার বল করে তিনটে উইকেট যেন পেয়েছে।

”কী দাদু, ক’টা হল?” পঞ্চানন বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন।

”তিনটে, তবে হ্যাটট্রিক নয়।”

”হবে, হবে, এই তো সবে হাতেখড়ি। উইকেটের চরিত্র, ব্যাটসম্যানের মেজাজ ভাল করে বুঝে নাও, তারপর বড় হুইল ছিপ দোব। তখন আর চুনোপুটি নয়, রুই—কাতলা খেলিয়ে তুলবে।”

পঞ্চানন নীচে নেমে এসে ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়ালেন। দিলু তখনই টান মেরে বঁড়শি তুলল। তাতে মাছ নেই, ভাতও নেই।

ঠাট্টা করে পঞ্চানন বললেন, ”রান চুরি করে ব্যাটসম্যান পালাল। রান আউট করতে পারলে না। শুনেছি বড় বড় অনেক ক্রিকেটারের নাকি মাছধরার নেশা আছে, সত্যি?”

দিলু বঁড়শিতে ভাত গাঁথতে গাঁথতে বলল, ”আমিও শুনেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা একমনে ফাতনার দিকে তাকিয়ে কনসেনট্রেট করলে নাকি ব্যাটিংয়ের সময় সেটা কাজে লাগে। জানি না কথাটা সত্যি কি না, তবে মাছের সঙ্গে একটা বুদ্ধির লড়াই যে হয় পুঁটিমাছগুলো আমাকে তা টের পাইয়ে দিয়েছে। দাদু, আমার কিন্তু বেশ মজা লাগছে।”

”তা হলে মামার বাড়িতে থেকে যাও।”

দিলু বঁড়শি ছুড়তে গিয়ে থমকে গেল। কলকাতার বাড়িটা তার ভাল লাগে না ঠিকই, কিন্তু বাড়ির বাইরে অনেক বন্ধু আছে, ক্রিকেট আছে, ম্যাচ খেলা আছে, হার—জিতের উত্তেজনা আছে। কিন্তু এখানে কী আছে? এখানে তো একা—একাই থাকতে হবে, বাড়িতে সমবয়সী কেউ নেই যার সঙ্গে সমানে—সমানে কথা বলা যাবে। এটা ঠিকই সে নারকেল গাছে উঠতে পারে না, সাঁতার জানে না কিন্তু প্রথমবার বন্দুক হাতে নিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে সে কী করতে পারে।

”দাদু, এখানে তো খেলার কোনও সুযোগই নেই।” দিলু বঁড়শি জলে ছুড়ে দিয়ে বলল।

”কে বলল নেই? কোন খেলাটা খেলতে চাও? ফুটবল, কবাডি, ভলি, খো খো, ক্রিকেট—”

”ক্রিকেট আছে!” দিলু একটু অবাক হয়ে বলল।

”অবশ্যই। তুমি কি দুধঘাটকে অজ পাড়াগাঁ ভেবেছ? পলিউশান, মিছিল, ট্রাফিক জ্যাম, উৎকট শব্দ, নোংরা ছাড়া কলকাতায় আর যা যা পাওয়া যায় তার অনেক কিছুই এখানে পাবে, মায় ডাকাত—গুণ্ডা ক্রিকেটও। ফুটবল—ক্রিকেটের কোচিং সেন্টার পর্যন্ত আছে। এখানে অনেক খেলার টুর্নামেন্ট হয়। পরীক্ষার জন্য খেলাধুলো এখন বন্ধ, শেষ হলেই শুরু হয়ে যাবে। আশপাশের সাত—আটটা গ্রামের ছেলেরা আসে খেলতে। তুমি বরং এখানে থাকো, সঙ্গীসাথী অনেক পেয়ে যাবে, টানো টানো—” পঞ্চানন চেঁচিয়ে উঠলেন।

সচকিত হয়ে দিলু বড়শিতে টান দিল। দাদুর কথা শুনতে শুনতে ফাতনা থেকে চোখ সরে গেছল। মাছ উঠল না। পঞ্চানন হাসতে হাসতে বললেন, ”ফাতনা থেকে চোখ একদম সরাবে না।”

দিলুর মনে পড়ল বলাইদার একটা কথা—”ব্র্যাডম্যান যখন ব্যাট করতেন, বল থেকে একদম চোখ সরাতেন না।” কী আশ্চর্য, দাদু হুবহু একই কথা বললেন, তবে ব্যাটিংয়ের নয়, মাছ ধরার সম্পর্কে। সে ছিপ গুটিয়ে বলল, ”আজ এই পর্যন্ত, আবার কাল হবে।”

পঞ্চানন বললেন, ”কাল দুপুরে কিন্তু পূর্ণেন্দুদের বাড়িতে পাহারায় বসতে হবে। তুমি সঙ্গে যাবে তো?”

”সঙ্গে করে বন্দুকটা নেবে কিন্তু।”

রাত্রে খেতে বসে হরিসাধন বললেন, ”শুনেছ বাবা কাল সকালে নেতাজি কলোনিতে কী কাণ্ড হয়েছে, আজ আমাদের রাধুবাবুর কাছে শুনলুম সব।”

পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”কিছু শুনিনি তো, কী হয়েছে?”

”দোকানে বসে চা খাচ্ছিল লালু নামের একটা ছেলে, বছর চব্বিশ বয়স। তখন অটো রিকশায় দুটো লোক এসে দোকানের সামনে দাঁড়ায়, ওদের দেখেই লালু ছুটে দোকানের মধ্যে ঢুকে যায়। অটো থেকে নেমে দুটো লোক ওকে তাড়া করে দোকানে ঢুকে দুটো বোমা ফাটিয়ে অটোয় চেপে পালাতে থাকে। রাস্তার লোক অটোটাকে তাড়া করলে ভিড়ের মধ্যে জোরে চালাতে গিয়ে অটোটা উলটে যায়।”

দিলু বলে উঠল, ”তারপর লোকেরা ওদের ধরে গণপ্রহারে মেরে ফেলল, তাই তো?”

”সেটাই হয়ে থাকে।” হরিসাধন হেসে বললেন, ”এক্ষেত্রে তা হয়নি। লোকেরা ওই দু’জনকে আর অটোর ড্রাইভারকে ধরে রেখে থানায় খবর দেয়, পুলিশ এসে তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। আর লালুকে হাসপাতালে পাঠায়, ইনজুরি খুব বেশি নয়, বোধ হয় বেঁচে যাবে।”

পঞ্চানন জিজ্ঞেস করলেন, ”ছেলেটাকে মারতে এসেছিল কেন?”

”লালুও একটা গুণ্ডা, ল্যাংড়া ভোলার দলের। আর যারা ওকে মারতে এসেছিল তারা বাপির দলের। ট্রেনে যাকে গুলি করে মারল সে বাপির দলের ছেলে, আর তাকে মারল ল্যাংড়া ভোলার লোকেরা। খুনের বদলা নিতে আজ এসেছিল বাপিরা। এই ভোলার লোকেদের একজনকেই সেদিন পূর্ণেন্দু ট্রেনে জাপটে ধরেছিল। আর দু’জন ট্রেন থেকে নেমে পালায়। পুলিশ সন্দেহ করছে সেই পালানোদের একজন হল এই লালু।”

দিলু বলল, ”এই লালুই ট্রেনের খুনিদের একজন কি না সেটা তো সবচেয়ে ভাল বলতে পারবে পূর্ণেন্দুদা, উনি তো খুব কাছের থেকে দেখেছেন।”

হরিসাধন বললেন, ”দেখেছে বলেই তো ওর প্রাণসংশয়। ল্যাংড়া ভোলা তো সেজন্যই পূর্ণেন্দুকে খুঁজছে। ও যদি বলে, হ্যাঁ এই লোকটা সেদিন ট্রেনে খুনির দলে ছিল তা হলে পুলিশ লালুকে অ্যারেস্ট করবে। ভোলা এখন চাইবে পূর্ণেন্দুকে চুপ করিয়ে দিতে। কী গেরোয় যে ছেলেটা পড়ল, কেন যে গুণ্ডাকে জাপটে ধরতে গেল।”

পঞ্চানন রাগ চেপে গম্ভীর স্বরে বললেন, ”তুই কি বলতে চাস পূর্ণেন্দু অন্যায় কাজ করেছে?”

বাবার গলার স্বরে থতমত হরিসাধন বললেন, ”অন্যায় করেছে বলছি না, তবে এখন যা সময় পড়েছে তাতে—।”

”তাতে কী?”

”গুণ্ডা বদমাশদের না ঘাঁটানোই ভাল।”

”চোখের সামনে খুন করতে দেখলেও মুখ ঘুরিয়ে থাকবে, খুনিকে ধরার চেষ্টা করবে না। তুই একজন শিক্ষক হয়ে এই কথা বলছিস!”

বাবার ধমক খেয়ে তখন হরিসাধন মুখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বললেন, ”চেষ্টা করে কী লাভ হল, এখন তো নিজেই বাড়ি থেকে বেরোতে পারছে না। ওরা তো বাড়িতে এসেও মেরে ফেলতে পারে, যা দিনকাল।”

দিলু এইবার কথা বলল, ”ইসস মারা যেন খুব সোজা, আমি আর দাদু কাল থেকে বন্দুক নিয়ে দুপুরে ওদের বাড়িতে বসে পাহারা দোব, আসুক না গুণ্ডারা, দেখা যাবে।”

হরিসাধন অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকালেন। পঞ্চানন বললেন, ”দুপুরে পাড়ার ছেলে—ছোকরারা থাকে না, ঠিক করেছি ওই সময়টায় বন্দুক নিয়ে পাহারা দোব পুর্ণেন্দকে।”

”বাবা, গুণ্ডা বদমাশদের কাছে সকাল দুপুর বিকেল রাত বলে কোনও সময় নেই। যখন ইচ্ছে তখন, যেখানে ইচ্ছে সেখানে ওরা খুন করে গটগটিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কাগজ খুললেই রোজ একটা দুটো এমন ঘটনার খবর তুমি দেখতে পাবে। পাহারা দেবে দাও সেইসঙ্গে একটা চোঙাও হাতে রেখো, মুখে দিয়ে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে হবে তো।”

হরিসাধনের পরিহাসটা গায়ে না মেখে পঞ্চানন নাতির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচালেন। ভাবখানা এমন, দেখেছ কী বুদ্ধি! দিলু চোখ টিপে সায় দিল।

রাতে পঞ্চানন খুঁজেপেতে একটা বড় পেস্ট বোর্ডের টুকরো জোগাড় করলেন, পানের খিলি সাজার মতো গোল করে পাকিয়ে চারটে আলপিন দিয়ে আঁটলেন! চোঙাটার মুখের দিকটা সরু, অনেকটা তালপাতার ভেঁপুর মতো, তবে যথেষ্ট মোটা।

দিলু বলল, ”দাদু, একটা ট্রায়াল দিয়ে দেখব চোঙাটার ক্ষমতা কতটা!”

”কী ট্রায়াল দেবে?”

”এই ধরো চিৎকার করে বলব, ”ডাকাত ডাকাত, বাঁচান বাঁচান, ধরুন ধরুন’।”

আঁতকে উঠে পঞ্চানন বললেন, ”খবরদার, এত রাত্তিরে এই ট্রায়াল দিলে কী হবে জানো? পিলপিল করে পাড়ার লোক বেরিয়ে আসবে আর ভেলোটা সারারাত চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলে রাখবে।”

খাওয়াদাওয়া সেরে দুপুর বারোটা নাগাদ দিলু বন্দুক ঘাড়ে আর পঞ্চানন পেস্টবোর্ডের চোঙা হাতে নিয়ে পূর্ণেন্দুদের বাড়িতে হাজির হল।

বিভা তালা খুলে ওদের ভেতরে নিয়ে এলেন। ”মেসোমশাই আপনারা এসে যে কী ভরসা জোগালেন, পুনু তো আধমরা হয়ে রয়েছে। খালি বলছে, ‘আর কখনও এমন বোকামি করব না, মরে গেলেও করব না,’ আপনি ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো।”

পঞ্চানন ভেতরে গেলেন, সঙ্গে দিলু। জানলাগুলো বন্ধ, ঘর অন্ধকার।

”পূর্ণেন্দু জানলাগুলো খোলো, দমবন্ধ হয়ে এমনিতেই যে মারা যাবে। ওরা যখন আসবে তখন বন্ধ করে দিও। ভয় কী, আমার সঙ্গে দিলু আছে, বন্দুক আছে, লোক ডাকার জন্য চোঙা আছে।”

পূর্ণেন্দু একটা জানলা খুলে দিয়ে ওদের দিকে তাকাল। একজনের বয়স পঁচাশি, অন্যজনের পনেরো, দেখে সে খুব ভরসা পেল বলে মনে হল না। বলল, ”বন্দুকে গুলি ভরা আছে তো?”

দিলু বলল, ”নিশ্চয় আছে, দেখবেন?” সে বন্দুকের ঘাড় মটকে দেখিয়ে দিল দুটো নলেই কার্ট্রিজ ভরা।

দেখে আশ্বস্ত হল পূর্ণেন্দু। এবার সে আর একটা জানলা খুলল। দিলু জানলার বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল পেয়ারাগাছ, ওপরের ডালে ক্রিকেট বল সাইজের চার—পাঁচটা ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা। তার জিভে জল এসে গেল। সে ফিসফিস করে দাদুকে বলল, ”পেয়ারাগুলো দেখেছ দাদু, দারুণ না?”

পূর্ণেন্দু বলল, ”খেতে ইচ্ছে করছে? যাও পেড়ে খাও। নার্সারি থেকে চারা কিনে এনে বাবা লাগিয়েছিলেন, খুব মিষ্টি, বিচি নেই।”

দিলু ঘর থেকে বেরিয়ে গ্রিলের দরজা খুলে বাইরে থেকে হাত গলিয়ে হুড়কোটা লাগিয়ে দিল। বাঁ দিকে বাড়ির আড়ালে গাছটা। কাঠের গেট থেকে সেটা দেখা যায় না। ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জানলা দিয়ে পঞ্চানন বললেন, ”দাদু, পায়ের আঙুলটায় নজর রেখো, ধাক্কাটাক্কা যেন না লাগে।”

পেয়ারাগুলো মগডালের কাছাকাছি। কীভাবে ওখানে পৌঁছনো যায় সেটা ভাল করে দেখে নিয়ে নীচের একটা মোটা ডাল লাফিয়ে ধরে ঝুলে পড়ল দিলু। দুলতে দুলতে জিমন্যাস্টদের বার—এর ওপর শরীর তুলে নেওয়ার মতো সে নিজেকে তুলে নিল। তারপর এ—ডাল সে—ডাল করে পৌঁছে গেল পেয়ারাগুলোর কাছে। হাত বাড়িয়ে একটা ছিঁড়ে নিয়ে প্যান্টের পকেটে রেখে আর একটা ছিঁড়ল।

ঠিক সেই সময়ই রাস্তায় মোটরবাইকের শব্দ শোনা গেল। দিলু পাতার আড়াল থেকে দেখল জিনসের ফুলহাতা জ্যাকেট গায়ে, মাথায় লাল ক্রিকেট ক্যাপ, চোখে কালো কাচের চশমা পরা একটা মোটা লোক মোটরবাইক চালিয়ে কাঠের গেটের সামনে এসে থামল। বাইকের পেছনে বসে রোগাপটকা একটা ছেলে। পরনে বুশ শার্ট, হাতে একটা ছোট থলি। সে গেটের পাল্লা খুলে ভেতরে ঢুকল। দিলু নিঃশব্দে গাছ থেকে নামতে শুরু করল।

”পূর্ণেন্দু….অ্যাই পূর্ণেন্দু, বাড়ি আছিস।” ছেলেটা কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠল। ”কদ্দিন ইঁদুরের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকবি। বেরিয়ে আয় বাইরে, নইলে পেটো মেরে তোর খুপড়ি উড়িয়ে দোব, তোর বাড়িব সবক’টার লাশ ফেলব।”

ছেলেটা যখন এইসব বলছে দিলু তখন গাছ থেকে নেমে ঘরের দেওয়ালের গা ঘেঁষে এগোচ্ছে। ঘরের জানলাটা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। দেওয়ালের কিনারে এসে খুব সন্তর্পণে একটা চোখ বের করে দেখল ছেলেটা ডান হাত তুলে দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা বলের মতো গোল একটা বোমা যাকে পেটো বলে।

দিলুর হাতে পেয়ারা। আপনা থেকেই তার মুঠো শক্ত করে চেপে ধরল সেটা। সেই সময় ঘরের থেকে বেরিয়ে এলেন পঞ্চানন, হাতে বন্দুক।

”কী চাই, কী চাই? ভাগো এখান থেকে, গুণ্ডামি করার আর জায়গা পাওনি। গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দোব।”

দিলু এক চোখ দিয়ে দেখল ছেলেটা দাঁত বের করে হাসছে।

”ওরে বুড়ো ব্যাটা, বন্দুক হাতে খুব রোয়াব দেখছি। ওসব বন্দুক ফন্দুক অনেক দেখা আছে।”

এর পরই প্রচণ্ড একটা শব্দ আর ধোঁয়া। মুহূর্তে দিলুর মাথার মধ্যে লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগল, ঝলসে উঠল বলাইদার কথাগুলো—এর পরই ঘটল সেই মিরাকল, ক্লাইন হলের প্রথম বলটা লেগের দিকে ঠেলে দিয়েই ছুটল। বারো গজ দুর থেকে সলোমন ছোঁ মেরে বলটা তুলে নিয়েই ছুড়ল। ধীরে সুস্থে টিপ করে ছোড়ার সময় ছিল না। মাত্র একটা স্ট্যাম্প ছাড়া আর কিছু—দিলু দেওয়ালের আড়াল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। টিপ করে ধীরেসুস্থে ছোড়ার সময় নেই। সে পেয়ারাটা ক্রিকেট বল ছোড়ার মতো ছুড়ল ছেলেটার মাথা লক্ষ্য করে।

”বাপস”, মাত্র একটা শব্দ করেই ছেলেটা গাছের কাটা ডালের মতো পড়ে গেল। পেয়ারাটা তার বাঁ কানের পাশে রগে লেগেছে।

মোটরবাইকের এঞ্জিন বন্ধ না করে লোকটা সিটে বসে ছিল। ছেলেটাকে পড়ে যেতে দেখে এঞ্জিন বন্ধ করে বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে এল। দিলু এবার পকেট থেকে দ্বিতীয় পেয়ারাটা বের করল। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে মুখের সামনে হাত তোলার আগেই পেয়ারাটা বের করল। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে মুখের সামনে হাত তোলার আগেই পেয়ারাটা দুই চোখের মাঝে নাকে গিয়ে লাগল।

ক্যাপটা মাথা থেকে উড়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল টাক। চশমাটা দু’ টুকরো। নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। লোকটা রীতিমত শক্তসমর্থ, অন্য কেউ হলে মুখ চেপে বসে পড়ত, তা না করে সে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে এসে মোটরবাইকে উঠে স্টার্ট দিল।

দিলুও তাড়া করে গেট দিয়ে বেরিয়ে এল। বেরোবার মুখে ছোঁ মেরে জমি থেকে পেয়ারাটা কুড়িয়ে নিয়েছিল। বাইকটা বারো—চোদ্দো মিটার এগিয়ে গেছে, দিলু তখন মাথা লক্ষ্য করে পেয়ারাটা ছুড়ল। টাকের ধারে লেগে পেয়ারাটা ছিটকে গেল। লোকটা মাথা নিচু করে নিয়ে উধাও হয়ে গেল প্রচণ্ড স্পিড তুলে।

বোমাটা গ্রিলের লোহায় লেগে ফেটেছে। বন্দুক হাতে মেঝেয় উপুড় হয়ে থাকা পঞ্চানন অক্ষত এবং হতভম্ব, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এমন একটা মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং বেঁচে যাবেন সেটা স্বপ্নেও ভাবা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

”বাঁচান বাঁচান, খুন করে ফেলল….ছুটে আসুন, ডাকাত পড়েছে।” পূর্ণেন্দু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে যাচ্ছে। চোঙাটা হাতে ঝুলছে।

”মুখে চোঙাটা লাগিয়ে চেঁচাও।” পঞ্চানন ধমকে উঠলেন।

পূর্ণেন্দুর চিৎকারে নয়, বোমার শব্দেই আশপাশ থেকে কয়েকজন ছুটে এল। তারা এসে দেখল একটা ছেলে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে, পাশে একটি থলি, বন্দুক হাতে পঞ্চানন, চোঙা হাতে পূর্ণেন্দু আর ঝাঁকড়া চুলের কৃষ্ণবর্ণের একটি কিশোর শান্ত চোখে একটা পেয়ারা নিয়ে লোফালুফি করছে।

একজন উত্তেজিত হয়ে বলল, ”গুলি করেছেন জ্যাঠামশাই, গুলি। কোথায় মেরেছেন, পেটে না মাথায়?”

পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”গুলি করব কী, হতভাগাটা কি আমাকে টাইম দিল। ভাগ্যিস গ্রিলে লেগে ফেটে গেল, যদি ফোকর দিয়ে গলে ভেতরে এসে ফাটত, তা হলে,” পঞ্চানন শিউরে উঠে যোগ করলেন, ”বোমাটা ছোড়ার জন্য হাতটা তুলেছে দেখেই আমি তো মেঝেয় শুয়ে পড়েছিলুম মাথায় হাত চেপে।”

” তা হলে ডাকাতটা এভাবে পড়ে আছে কেন। দেখুন তো প্রণববাবু ওর কী হয়েছে।” লুঙ্গির কষি আঁটতে আঁটতে এক প্রৌঢ় বললেন।

”আমি কেন, আপনিই দেখুন না। আমাকে এখুনি কলেজে যেতে হবে।” বলতে বলতে প্রণববাবু পিছু হটে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

”এখন ওঁর পড়াতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল।” লুঙ্গি পরা প্রৌঢ় বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে গুণ্ডাটাকে চিত করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন, ”কই কোথাও তো রক্তটক্ত দেখছি না। তবে কপালের বাঁ দিকটা রক্ত জমে ফুলে রয়েছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা দিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু মারল কে?”

ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, ”এখন এটাকে নিয়ে কী করা হবে। অজ্ঞান অবস্থায় গণপ্রহার করা মনে হয় উচিত হবে না, বরং থানায় ফোন করে খবর দিন আর দেখুন ওর সঙ্গের কেউ আশেপাশে ঘাপটি মেরে আছে কিনা। মনে হচ্ছে ল্যাংড়া ভোলার দলের ছেলে।”

পূর্ণেন্দু বলল, ”একটা মোটরবাইক আসার শব্দ পেয়েছি, সেটা চলে যাওয়ার শব্দও শুনেছি।”

কয়েকজন রাস্তায় এসে এধার ওধার তাকিয়ে ফিরে এসে জানাল, রাস্তায় অচেনা কাউকে দেখা গেল না। আবার গুঞ্জন শুরু হল—তা হলে মারল কে? কী দিয়ে মারা হয়েছে?

একজন থলিটা তুলে ভেতরে দেখে বলল, ”আরে, দুটো বোমা এখনও রয়েছে এর মধ্যে।”

পঞ্চানন আঁতকে উঠে ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”রেখে দাও, রেখে দাও, পূর্ণেন্দুকে যে খুন করার জন্যই এসেছিল ওটা তার প্রমাণ, নাড়ানাড়ি কোরো না।”

দিলু পেয়ারাটা প্যান্টে ঘষে পরিষ্কার করে নিয়ে চিবোতে শুরু করল। যেমন মিষ্টি তেমনই নরম। এখানকার কেউ তাকে চেনে না, তার দিকে কেউ তাকাচ্ছেও না। লোকজনের কথাবার্তা সে শুনছে আর মনে মনে হাসছে।

পূর্ণেন্দুকে আশ্বস্ত করে পঞ্চানন বললেন, ”আর কেউ তোমাকে মারার জন্য এ—তল্লাটের ধারেকাছেও আসবে না। হাতের বন্দুক হাতেই রয়ে গেল অথচ দ্যাখো ধরাশায়ী।” আঙুল দিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা গুন্ডাটাকে দেখালেন। এর পর দিলুর দিকে ফিরে বললেন, ”দাদু, তুমি তো তখন বাইরে ছিলে, কে ওকে মারল দেখেছ কি?”

দিলু তখন পেয়ারাটায় শেষ কামড় দিচ্ছে, অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ”আমি! দেখব কী করে, তখন তো আমি পেয়ারা গাছের ওপরে। বাব্বা, ওই সময় কেউ গাছ থেকে নামে? তবে দাদু তখন মনে হল, জাদুকর ম্যানড্রেকের মতো কালো কোট পরা মাথায় কালো টুপি একজন যেন চোখের পলকে এই পাঁচিলের ওপর দিয়ে হুসস করে লাফিয়ে বেরিয়ে গেল, সত্যি—সত্যি ম্যানড্রেক হলে তো মিরাকল!”

শুনে একজন বলল, ”দুধঘাটে ম্যানড্রেক! জেঠু আপনার নাতির কল্পনাশক্তির তারিফ করতেই হবে!”

দিলুর তখন বলতে ইচ্ছে করল, ‘আমিই মিরাকলটা ঘটিয়েছি।’ কিন্তু বাহাদুরি নেওয়া তার স্বভাবে নেই তাই বলতে পারল না। তা ছাড়া যদি প্রমাণ চায়! প্রমাণ তো সে খেয়ে ফেলেছে। কেউ তাকে পেয়ারা ছুড়তে দেখেনি, এই ব্যাপারে সে স্থিরনিশ্চিত। কিন্তু দিলু জানে মোটরবাইকে চড়া টেকো গুন্ডা, ল্যাংড়া ভোলা, তা দেখেছে।

.

কীভাবে যেন রটে গেল পূর্ণেন্দুকে রক্ষা করতে দৈবীশক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল। ল্যাংড়া ভোলার দলের বোমা ছোড়ার ওস্তাদ ডেয়ারডেভিল ছেলে শান্টু বোমা ছুড়েই অজ্ঞান হয়ে হয়ে। জ্ঞান ফেরে দুধঘাট থানায়। সে জানায়, কী একটা শূন্য থেকে তার রগে প্রচণ্ড ঘা দিল, তারপর আর কিছু তার মনে নেই। পূর্ণেন্দু, পঞ্চানন বা বাড়ির লোকেরা এবং যারা ছুটে এসেছিল তারা কেউই দেখেনি শান্টুর রগে কে, কী দিয়ে মারল। সবারই একই জিজ্ঞাসা, তা হলে কি ভূতে এসে মারল। না কি হেডমাস্টারের কলকাতা থেকে আসা ভাগ্নে যা বলল, জাদুকর ম্যানড্রেকের মতো পোশাক পরা একটা লোককে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাতে দেখল, সেটাই ঠিক?

গবেষণা হল লালুর মুদির দোকানে : ”পূর্ণেন্দুর মা রেগুলার রাধাগোবিন্দর মন্দিরে প্রণাম করতে যান, রেগুলার বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজো দেন। ও বাড়ি ঘিরে আছে দেবতার রক্ষাকবচ, ল্যাংড়া ভোলাফোলার ক্ষমতা কি ওখানে ট্যাঁফোঁ করে? গোবিন্দজি নিজে থাপ্পড় মেরেছেন শান্টুকে, ব্যাটা ভাগ্যবান।”

আলোচনা হল দশরথ হেয়ার কাটিং সেলুনে: ”আমার বউ বলল, উঠোনে যখন কাপড় শুকোতে দিচ্ছে তখন বিশাল একটা চাকতির মতো কী যেন নিঃশব্দে উড়ে গেল পূর্ণেন্দুর বাড়ির দিকে খুব নিচু দিয়ে, আর তাই থেকে লাঠির মতো সবুজ একটা আলো হঠাৎ একবার বেরোল। বউ নিজের চক্ষে দেখল আলোর লাঠিটা আধ সেকেন্ড জ্বলেই নিভে গেল। লোকে বলে এসব গাঁজাখুরি গপ্পো, আরে বাবা, আমার বউ তো গাঁজা খায় না, খবরের কাগজও পড়ে না, তা হলে সে কী করে বলল ফ্লাইং সসার উড়ে যেতে দেখেছে? লেসার বিম দিয়ে শান্টুকে যে হিট করেছে মঙ্গল গ্রহের ইউ ফো তাতে কোনও সন্দেহ নেই।”

শান্টুর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার পেছনে কী রহস্য রয়েছে তাই নিয়ে যখন দুধঘাটে নানারকম গালগল্প চলছে তখন বাইগাছি স্টেশনে এক সকালে বোমা, পাইপগান, লোহার রড আর ভোজালি নিয়ে ঘণ্টাদুয়েক ধরে যুদ্ধ হয়ে গেল ল্যাংড়া ভোলার দলের সঙ্গে বাপির দলের। ভোলার দলের ‘খুনি’ দুটি ছেলে মারা গেল এবং তাকে তল্লাট ছেড়ে পালাতে হল, যদিও তার বাড়ি বাইগাছিতেই। পালাবার আগে সে বলে গেছে, ”শিগগিরি ফিরে আসছি, দেখে নেব বাপিকে।” এখন বাইগাছি স্টেশন রোডের ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের থেকে মাসিক তোলা আদায় করে শুধু বাপির গুন্ডারা, বাপি এখন সাইকেল ও ভ্যানরিকশা ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট।

পূর্ণেন্দু এখন নিশ্চিন্তে অফিস যাচ্ছে। দুধঘাট স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে, বাসু কিন্তু নিয়মিত সকালে আসে বাড়িতে কষা অঙ্ক পঞ্চাননকে দেখাতে এবং নতুন অঙ্ক শিখে নিতে। দিলুর পায়ের নখ ঢাকা ব্যান্ড—এডটা খোলা হয়েছে, নতুন নখ গজাচ্ছে। পঞ্চাননকে সে বলল, ”দাদু এখন তো সাঁতারটা শিখে নেওয়া যায়।”

তার নখ পরীক্ষা করে পঞ্চানন জানালেন, কাল থেকে বাসুর ট্রেনিংয়ে সে সাঁতার শিখবে। পরদিন দিলু জীবনে প্রথম কোনও জলাশয়ে নামল। বাড়িতে বরাবর শাওয়ারে স্নান করেছে। এক পা এক পা করে সিঁড়ির ধাপ মাড়িয়ে কোমর জল পর্যন্ত গিয়ে পিছু ফিরে ঘাটের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা দাদুর দিকে সে তাকাল।

পঞ্চানন চে�চিয়ে বললেন, ”জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার। আরও নামো, বাসু ওকে একটু ঠেলে দে তো।”

বাসু তার পাশেই কোমর জলে। দিলু বাধা দেওয়ার আগেই সে মুচকি হেসে তার পিঠে একটা ছোট্ট ঠেলা দিল। টলমল করতে করতে দিলু জলে পড়ে গেল। দাঁড়াবার চেষ্টা করে পায়ের তলায় ঠাঁই পেল বটে কিন্তু তখন মাথার ওপরে চার আঙুল জল। আঁকুপাকু করে মাথাটা তুলে ”হাফফ হাফফ” শব্দ মুখ দিয়ে বের করে আবার সে জলের নীচে নেমে গেল। এইভাবে পাঁচবার ওঠানামা করার পর পঞ্চানন হাঁক দিলেন, ”বাসু তোল।”

বাসু জলে নেমে দিলুর পেছনে গিয়ে পিঠে ঠেলা দিল। পায়ের নীচে সে সিঁড়ি পেল। হাত বাড়িয়ে দিলুকে টেনে কোমর জলে দাঁড় করাল। থমথমে রাগী মুখে দিলু সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে পঞ্চাননকে বলল, ”এটা কী হল দাদু, আমাকে নাকানি চোবানি করে জল খাওয়ালে।”

উৎসাহ ভরে পঞ্চানন বললেন ”তুমি তো সাঁতারের অর্ধেক শিখে ফেললে। জলের সঙ্গে পরিচয় তো হয়ে গেল, এবার ভাব জমাও। যাও যাও, আবার নামো।”

”না।” মুখগোঁজ করে দিলু বসে পড়ল।

”ক্রিকেট বল কখনও পায়ে হাতে মাথায় লেগেছে?” পঞ্চানন জানতে চাইলেন।

”অনেকবার।”

”সেজন্য তুমি কি ক্রিকেট খেলা বন্ধ করে দিয়েছ?”

দিলু কয়েক সেকেন্ড সময় নিল দাদু কী বলছে চাইছেন সেটা বুঝে নিতে। তারপরই উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। বাসু হাত বাড়িয়ে দিল।

”হাত—পা ছুড়ে যেমন—তেমন করে হোক ঘাটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করো। আমি পাশে পাশে থাকব। ভয়ের কী আছে।” বাসু শান্ত গলায় ভরসা দিল।

ঘাটের শেষধাপ থেকে হাত দশেক দূরে বাসু তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, ”যাও এবার।”

ভয়ে দিলুর বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে রইল তিন—চার সেকেন্ড। ডুবে যাব, ডুবে যাব। বাঁচতে হবে, আমাকে বাঁচতে হবে। দিলুর বুকের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠে বলল, ”চেষ্টা করো দিলু, বাঁচার চেষ্টা করো।’

হাত—পা ছুড়ে সে ঘাটের দিকে নিজেকে টেনে নিয়ে গিয়ে বুকজলে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে সাফল্যের আনন্দে হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেলল।

”শাবাশ দাদু, শাবাশ।” দিলু মুখ তুলে পঞ্চাননকে বুড়ো আঙুল দেখাল।

”আর একবার হবে নাকি?” বাসু জলের মধ্যে দশ হাত দূরেই রয়েছে। সেখান থেকেই দিলুকে ডাক দিল।

”হবে। তুমি ওখানেই থাকো, আমি তোমার কাছে যাব।” চেষ্টা করে দশহাত যেতে পেরেছে, উত্তেজনা আর উৎসাহে এখন সে টগবগ করে ফুটছে। দিলু দু’হাত ছুড়তে ছুড়তে জল ঠেলে এগিয়ে গেল বাসুর দিকে। বাসু তিন—চার হাত পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়সাঁতার কেটে অপেক্ষা করছে। হাঁসফাঁস করতে করতে দিলু বাসুর কাছে পৌঁছেই প্রাণপণে তার গলা জড়িয়ে ধরল।

”আরে ছাড়ো ছাড়ো, এভাবে ধরলে ডুবে যাব যে। পেছন দিকে এসে আমার কাঁধ ধরে একটু জিরিয়ে নাও, তারপর আবার যাবে।” বাসু যথারীতি শান্ত অনুত্তেজিত স্বরে বলল, ”জোরে আঁকড়ে ধরবে না, তা হলে দু’জনেই ডুবব।”

দিলু ঘাটে ফিরল। তবে সাঁতরে নয়, বাসুর পিঠে চড়ে। দু’হাত দিয়ে দু’পাশে জল সরিয়ে সরিয়ে বাসু এগিয়ে চলল। দিলু আলতো করে তার দুটো কাঁধ শুধু ধরে রইল। তাকে ঘাটে পৌঁছে দিয়ে বাসু আপন খুশিতে সাঁতার কেটে পুকুরের অপর প্রান্তে প্রায় পঞ্চাশ মিটার চলে গেল।

”দাদু, আমি কবে ওপারে যেতে পারব?” দিলু উন্মুখ আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

”আজ তো সবে হাতেখড়ি হল। অ আ হস্যই দিঘ্যির ওপর দাগা বুলোও কিছুদিন। অধৈর্য হলে চলে?”

দাগা বুলোতে হলে তো মামার বাড়িতে বেশ কিছুদিন থেকে যেতে হবে। সাঁতার শেখার এমন সুযোগ ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় ফেরা যায় না। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর আগে পুকুরের ওপারে যাবে এমন একটা প্রতিজ্ঞা মনে মনে করে ফেলল। ক্লাস নাইনে পৌঁছনোর থেকেও তার কাছে এখন পুকুরের ওপারটাই একমাত্র লক্ষ্য। তা ছাড়া মাছ ধরাটা, বিশেষ করে হুইল ছিপ দিয়ে বড় বড় রুই—কাতলা খেলিয়ে খেলিয়ে তোলা, দাদু বলেছেন টেস্ট ম্যাচে ছক্কা মারার মতো ব্যাপার। দু—তিনটে ছক্কা না মেরে কি দুধঘাট থেকে যাওয়া যায়!

তা ছাড়া নারকেল গাছে ওঠা, গাছ থেকে পুকুরে ঝাঁপ। এই মজাটা সে কলকাতায় কোথায় পাবে। কলকাতার ছেলেকে ডাউন দেওয়ার জন্য বাসুর বাহাদুরি দেখানোর জবাব দিয়ে যেতে হবে। দিলু মনে মনে বলল, দাঁড়াও। সাঁতার আর গাছে চড়াটা শিখে নি। দাদু তো হাতে করে শেখাবেন না, শেখাবে বাসু। ছেলেটা সত্যিই ভাল, সবসময় হাসে, ওর নাম হওয়া উচিত ছিল হাসু। ওর একটাই দোষ, বড্ড বেশি বই পড়ে, অঙ্ক কষে। দাদু বলেছিল গরিবের ছেলে, মানুষ হয়ে উঠতে হলে তো পড়াশুনো করতেই হবে। কিন্তু বাসু তো মানুষই, তা হলে মানুষ হয়ে ওঠাটা আবার কী জিনিস? দিলু কিছুক্ষণ ভেবে ধাঁধাটার উত্তর বের করতে পারেনি।

বাসু প্রতিদিন সকালে ছোট হুড়া থেকে দু’ মাইল হেঁটে এসে পঞ্চাননের কাছে পড়তে বসে এবং প্রতিদিনই দিলু ঘুম ভেঙে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। বাইরে দালানে বেরোলেই তো দেখতে হবে দাদু বাসুকে হয় ব্যাকরণ ধরছেন নয়তো রচনা লেখা শেখাচ্ছেন। আর তাকে দেখলেই বলবেন, ‘এই যে দাদু ঘুম ভাঙল’—শুনতে এত খারাপ লাগে। তার চেয়ে বরং যদি বলেন, ‘আজ উঠতে দেরি করে ফেলেছ। যাও চট করে মুখ ধুয়ে এসে পড়তে বসে যাও’—এইরকম কিছু বললে বাসুর সামনে লজ্জায় পড়তে হয় না। কিন্তু পড়ার জন্য দাদু আজ পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি। অবশ্য পরীক্ষার পর মামার বাড়ি এসে কেউ লেখাপড়া করতে বসেছে বলে সে শোনেনি। ‘মামার বাড়ি ভারী মজা কিল চড় নাই’ কথাটা তা হলে তৈরি হয়েছে কী জন্য!

একদিন সাঁতার কেটে উঠে বাসু বলল, ”তুমি দাবা খেলতে পারো?”

দিলু বলল, ”না। তাস দাবা পাশা, তিন কর্মনাশা। যেসব খেলা বসে বসে খেলতে হয় তা আমার ভাল লাগে না।”

”বসে ধৈর্য ধরে খেলতে হয় বলে তোমার ভাল লাগে না কিন্তু কর্মনাশা বলছ কেন? পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ লোক দাবা খেলছে, তাদের কি কর্মনাশ হচ্ছে? ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব কষে যুক্তি দিয়ে দাবা খেলায় জিততে হয়। লুডো কি পাশার মতো এতে ভাগ্যের হাত নেই। সেইজন্যই তো দাদু আমাকে দাবা খেলা শিখিয়ে দিয়েছেন, যাতে ব্রেনের কাজ করার ক্ষমতা বাড়ে। দুধঘাটে তো দাবা কম্পিটিশন হয়, দাদু তিনবার জিতেছেন, কাপ পেয়েছেন, তুমি জানো না?” বাসু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

দাদুর এহেন গুণপনার কথা না জানার জন্য দিলু অপ্রতিভ বোধ করল কিন্তু মুখভাবে তা ফোটাল না। বলল, ”কতদিন আগে কাপ জিতেছেন? কই ঘরে তো কোনও কাপটাপ দেখিনি!”

”বছর দশেক আগে শেষ জিতেছেন। লোকজনকে দেখাবার জন্য কাপ মেডেল সাজিয়ে রাখা, সার্টিফিকেট বাঁধিয়ে রাখা দাদু একদম পছন্দ করেন না। বলেন, বিশ্ব কি ভারত চ্যাম্পিয়ান হওয়া তো নয়, দুধঘাট চ্যাম্পিয়ান। এ আর লোককে দেখাব কী! কাপগুলো আলমারির মাথায় পড়ে থেকে থেকে ধুলো জমছিল, মামি সেগুলো ঝেড়েমুছে নিজের ঘরে আলমারিতে সাজিয়ে রেখেছেন, তুমি দেখে এসো।”

দিলু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে নিচু স্বরে বলল, ”ধৈর্য আমার সত্যিই কম। ক্রিজে গিয়েই দুমদাম ব্যাট চালাই, লাগে তুক না লাগে তাক। আমার হায়েস্ট কত জানো—আট বলে পঁয়ত্রিশ তাতে পাঁচটা সিক্সার, একটা ফোর একটা সিঙ্গল। আমাকে নেয় শুধু ফিল্ডিংয়ের জন্য।”

”শুধু ফিল্ডিং দিয়ে কতদিন আর চান্স পাবে, সেইসঙ্গে ব্যাটিং বা বোলিংয়ের একটা তো চাই।”

দিলু মাথা নাড়ল ম্লান হেসে।

”তুমি কখন দাবা খেলো, কার সঙ্গে?”

”রোজ খেলি না, পড়তে পড়তে যখন মাথা ভার হয়ে যায় একঘেয়ে লাগে তখন বিশালাক্ষী মন্দিরে গিয়ে ওখানকার পুরুতমশাই গোবিন্দ ঠাকুরের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক খেলি। উনি খুব ভাল খেলেন, একবারও ওঁকে হারাতে পারিনি।”

”আচ্ছা বাসু, আর কতদিনে পারব ওপারে যেতে। কলকাতায় ফেরার আগেই পুকুর পার হতে চাই।” দিলু উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করল উত্তরের জন্য।

বিব্রত মুখে বাসু বলল, ”তোমার দেখছি তর সইছে না। শ্বাস নেওয়া আর ছাড়াটা এখনও ঠিক হয়নি। মাঝপুকুরে দম ফুরিয়ে গেলে বিপদে পড়বে।”

”তুমি তো আমার পাশে পাশে থাকবে।”

রাত্রে অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে দিলু চাপাস্বরে বলল, ”দাদু দাবা খেলাটা শিখিয়ে দেবে?”

”তোমায় কে বলল আমি দাবা খেলতে জানি!”

”বাসু। ও তোমার কাছে শিখেছে বলল।”

”দাবার বোর্ড আর ঘুঁটি বাসুকে দিয়ে দিয়েছি। কাল বাইগাছি বাজার থেকে কিনে এনে দেবে। ওখানে স্পোর্টস কর্নার নামে দোকানটায় পাওয়া যাবে। হঠাৎ দাবা শেখার ইচ্ছা হল যে?”

”আমার ধৈর্য কম সেটা তো বন্দুক ছোড়া দেখেই বুঝেছ। টিপ করার জন্য সময় না দিয়েই ফায়ার করেছি।”

”আর তাতেই এঁচোড় পড়ে গেল। আমার কী মনে হয় জানো দাদু, তুমি যদি সময় নিয়ে টিপ করে গুলিটা ছুড়তে তা হলে এঁচোড়টা গাছেই থেকে যেত। ধৈর্য কম বলে নয়, এটাকে তোমার গুণই বলো আর দোষই বলো তুমি জন্মগতভাবে পেয়েছ। বাসু খুব ব্রিলিয়ান্ট নয় কিন্তু খুব পরিশ্রমী, ও ভাল রেজাল্ট করে খাটুনির জোরে। যতটুকু ট্যালেন্ট আছে সেটাকে ও ডিসিপ্লিন দিয়ে গুছিয়ে নিয়ে কাজে প্রয়োগ করে এটা ও জন্মগতভাবে পেয়েছে।” পঞ্চানন এই পর্যন্ত বলে চুপ করলেন। কথাগুলো দিলু বুঝতে পারল বলে তার মনে হল না। প্রসঙ্গ বদল করে তিনি বললেন, ”দাবা খেলা শিখতে চাও কি ধৈর্য বাড়াবার জন্য?”

”হ্যাঁ, ব্যাটিংয়ের জন্য।”

”সুনীল গাওস্কর ছশো মিনিট আটশো মিনিট ব্যাট করত কি দাবা খেলে?” পঞ্চানন গম্ভীর স্বরে কথাটা বলে নিঃশব্দে হাসতে শুরু করলেন, অন্ধকারে দিলু তা দেখতে পেল না।

”জানি না দাবা খেলত কি না।”

”যতদূর জানি ক্রিকেট ছাড়া গাওস্কর আর কোনও খেলা খেলত না। যদি ব্যাটিংয়ে উন্নতি করতে চাও তা হলে মনপ্রাণ ঢেলে ব্যাটটাই করে যাও। দাবা খেলাটা শেখো, খেলো, এটা মাথার খেলা, ক্ষতিকর নয়। দাবাতে শুধু বুদ্ধির লড়াই হয় না এতে যুক্তি আর বিচারক্ষমতাও বাড়ে।”

”তা হলে কর্মনাশা বলে কেন?”

”যারা খেলাটা জানে না তারাই বলে। আসলে বহু বছর আগে যেসব লোকের কাজকম্মো ছিল না, কাজ করার দরকার হত না, তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে দাবা খেলে সময় কাটাত। এটা প্রায় একটা নেশার মতো। এই নিয়ে নানান গল্প আছে। একটা লোক দুপুরে বউকে ভাত বাড়তে বলে তেল মেখে গামছা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোল নদীতে গিয়ে চান করবে বলে। যাওয়ার পথে দেখল তার দুই পড়শি বাড়ির দাওয়ায় বসে দাবা খেলছে। দেখে লোকটা ওদের পাশে বসে পড়ল আর বাড়ি ফিরল পরদিন সকালে। এইবার বুঝলে তো দাবার নেশা কী মারাত্মক। ঘরসংসার, খিদে—তেষ্টা সব ভুলিয়ে দেয়।”

”ওরে বাবা, না দাদু, দাবা খেলা আমার দ্বারা হবে না। মাথার খেলা মাথাতেই থাকুক, তুমি অন্য কোনও খেলার কথা বলো যাতে আমার সময় কাটে। বড্ড একঘেয়ে লাগছে। পুঁটিমাছ কতক্ষণ ধরব বলো তো, আর সাঁতার তো সারাদিন ধরে কাটা যায় না।”

”বাসুকে বলব তোমাকে স্কুলের মাঠে নিয়ে যেতে। পরীক্ষা শেষ, এখন ছেলেরা খেলতে নেমে পড়েছে, ফুটবল ক্রিকেট ভলি কবাডি সব পাবে।”

পরদিন বাসুর সঙ্গে দিলু সাঁতার কেটে মাঝপুকুর পর্যন্ত গেছে, তখন বাসু বলল, ”এবার ফেরো, আজ এই পর্যন্ত।” দু’জনে যখন ঘাটের কাছাকাছি তখন হর্ষ হন্তদন্ত হয়ে ঘাটে এসে চেঁচিয়ে বলল, ”অ বাসু তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখ তো বিন্দুপিসির বাড়ির পেছনের বিশ্বাসদের শিমুল গাছটা কারা যেন কেটে ফেলছে। বুড়ি মানুষ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল।”

বাসু ঝটপট হাত চালিয়ে ঘাটে পৌঁছল। হর্ষ তখনও বলে চলেছে, ”গাছটা নাকি ওরা বিক্রি করে দিয়েছে। আহা পঞ্চাশ—ষাট বছরের কতবড় গাছ, টাকার লোভে বিক্রি করে দিল! তুই দৌড়ে গিয়ে বিশ্বাসদের মেজো কত্তাকে গাছকাটা বন্ধ করতে বল।”

বাসু শুকনো প্যান্ট শার্ট পরে নিয়েই ছুটল বাড়ির দিকে। হর্ষ ছলছল চোখে বলল, ”লাল টকটকে ফুল মাটিতে পড়ে থাকত, ফুল কুড়োতুম, তুলো বের করে জমিয়ে জমিয়ে পুতুলের বালিশ—বিছানা করতুম, ও গাছ কি আজকের, জম্মো থেকে দেখছি।”

হর্ষর মুখের দিকে তাকিয়ে দিলুর মনে হল বাল্যসঙ্গী শিমুল গাছটার অপমৃত্যু ঘটছে শুনে খুবই আঘাত পেয়েছে। এখন তার মনে পড়ল খবরের কাগজে মাসছয়েক আগে একটা খবর বেরিয়েছিল, কলকাতায় একটা লোক তার বাড়ির সামনে রাস্তার একটা গাছের ডাল কাটিয়েছিল সেজন্য তার জরিমানা হয়। তাই নিয়ে বাবা আর দাদা বলাবলি করেছিল, অনুমতি ছাড়া গাছকাটা এখন বারণ। পরিবেশরক্ষার জন্য এই আইন করা হয়েছে। যদি কাটতেই হয় তা হলে সেখানে নতুন গাছের চারা লাগিয়ে কাটতে হবে।

দিলুর ইচ্ছে করল ছুটে গিয়ে আইনের কথাটা বিশ্বাসদের মেজো কর্তাকে বলে আসে। বাসুর সঙ্গেই তার ছুটে যাওয়া উচিত ছিল। বাসু কি জানে কাজটা বেআইনি। এতক্ষণে হয়তো গাছটা কেটে ফেলেছে।

আধঘণ্টার মধ্যে বাসু ফিরে এল। মুখ থমথমে। এক চোখে আগুন, অন্য চোখে জল।

”কী হল, গাছকাটা বন্ধ করেছে?” দিলু ব্যগ্রস্বরে জানতে চাইল।

”না, করল না। আমি বারণ করলুম, যে লোকটা গাছ কিনেছে সে আমাকে চড় মেরে বলল, ”তুই কে রে? যা ভাগ, পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গাছ কিনেছি, তোর কথায় কাটব না? দুটো লোক গাছে উঠে মোটা মোটা ডালগুলো দা দিয়ে কাটছিল। একজন নেমে এসে গলার কাছে দা ঠেকিয়ে বলল, ”মাথা নামিয়ে দোব যদি আর একটা কথা বলেছ।’ আমি তখন মেজো কত্তার খোঁজে গেলুম। ওঁর বাড়িতে বলল উনি কলকাতা গেছেন, আমি চলে এলুম।”

”গাছ কতটা কেটেছে?” দিলু উত্তেজিত স্বরে বলল, ”তোমার মাথা কেটে দেবে বলল, স্পর্ধা তো কম নয়!”

”বড় তিনটে ডাল কেটেছে, এখন বোধ হয় মাথাটা কাটছে। গাছের মালিক যদি গাছ বিক্রি করে দেয় আমরা কী করতে পারি।” হতাশ দেখাল বাসুকে।

”পুলিশ খবর দিতে পারি।”

”কোনও লাভ হবে না। পুলিশ ডায়রি নেবে না। নিলেও একটা পুলিশ আসবে চার ঘণ্টা পর, ততক্ষণে গাছ কাটা হয়ে যাবে। পুলিশের ওপর ভরসা নেই বলেই তো লোকেরা ডাকাত গুণ্ডা ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তুমি কি জানো সেই লালু ছেলেটাকে, যাকে পুলিশ অজ্ঞান অবস্থায় পূর্ণেন্দুদার বাড়ি থেকে সেদিন নিয়ে গেল, সে এখন বাইগাছিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন সে ল্যাংড়া ভোলার দল ছেড়ে বাপির দলে। পুলিশকে বলে গাছ রক্ষা করতে পারবে না, করতে হলে নিজেদেরই করতে হবে।”

বাসুর কথা শুনতে শুনতে দিলু অবাক হল, ঘৃণায় রি রি করে উঠল তার মন। অবশেষে বলল, ”চলো তো একবার দেখি কী করা যায়। চড় মারা বের করছি।”

হুঁশিয়ার করে সুলেখা বললেন, ”কোনও গণ্ডগোল পাকিও না যেন। মুখে যা বলার ভালভাবে বলবে। মামা আসুক, যা করার তিনিই করবেন।”

হর্ষ বলল, ”গাছ কেটে ফেলার পর আর কী করার থাকবে বউদি? চল আমিও তোদের সঙ্গে যাব।”

তিনজনে মিলে রওনা হল ছোট হুড়ার দিকে, ছ’—সাত মিনিট হনহনিয়ে হাঁটার পর শুরু হল পাকা বাড়িগুলোর শেষ প্রান্ত। এবার দেখা যেতে লাগল বাঁশের দরমা আর খড়ের চালের বাড়ি। বড় রাস্তা থেকে দূরে বড় বড় গাছ আর তার আড়ালে গ্রামের আভাস। হর্ষ আর বাসু ডান দিকে গোরুর গাড়ি চলার মতো একটা ভাঙাচোরা রাস্তায় নামল। দিলু তাদের পেছনে। সে এধার—ওধার তাকিয়ে হর্ষ আর বাসুর অলক্ষ্যে ইটের দুটো টেনিস বল সাইজের টুকরো চট করে কুড়িয়ে পকেটে রাখল।

”ওই দেখো আমাদের ঘর আর ওই দেখো বিন্দুপিসির ঘর, ওর পেছনেই শিমুল গাছটা,” বাসু আঙুল তুলে দেখাল যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে একটা খালি গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে। কাছেই একটা খেজুর গাছে দুটো বলদ দড়ি দিয়ে বাঁধা। গাড়োয়ানকে দেখা গেল না। রাস্তাতেও লোকজন নেই। রাস্তার ধারের জলায় একটা ছোট মেয়ে কলমি শাক তুলছে।

বাসু বলল, ”গাড়িটা এনেছে কাটা গাছ নিয়ে যাওয়ার জন্য।”

ওরা আর একটু এগোল। এবার গাছটার ওপরের দিক স্পষ্ট দেখা গেল বিন্দুপিসির ঘরের চালের ওপর দিয়ে। খালি গায়ে লুঙ্গি গুটিয়ে নীচের ডালে দাঁড়িয়ে একটা লোক বড় দা দিয়ে ওপরের ডাল কোপাচ্ছে।

”তোমরা এগিয়ে গিয়ে কথা বলো, আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি। বাসু ওই লোকটাই কি তোমার গলায় দা ঠেকিয়েছিল?”

”হ্যাঁ। আর চড় মেরেছিল যে, সে নীচে দাঁড়িয়ে।”

হর্ষ আর বাসু এগিয়ে গেল। দিলুর থেকে গাছের লোকটা মিড অন থেকে স্ট্রাইকারের উইকেটের দূরত্বে। লোকটা মাথা নিচু করে নীচের দিকে তাকাল, বোধ হয় দু’জন নতুন লোককে দেখার জন্য। দিলু হর্ষমাসির তীক্ষ্ন গলার স্বর শুনতে পেল। কথা—কাটাকাটি শুরু হয়েছে। দিলু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিন্দুর ঘরের চালের ওপর দিয়ে লোকটির মাথাটুকু দেখতে পাচ্ছে।

লোকটা দা হাতে নিয়েই মাটিতে পড়ল ”বাবা গো” বলে পাকা বেলের মতো। দিলু আর এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে ছুটে গোরুর গাড়ির কাছে এসে একটা বলদের গলায় হাত বুলোতে শুরু করল। একটা হইচইয়ের শব্দ তার কানে আসছে। বলদটা আরামে চোখ বুজিয়ে ফেলল।

একটু পরেই দুটি লোক একজন অজ্ঞান রক্তাক্ত লোককে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এল। লোকটার মাথায় বাঁধা গামছা, তাদের পেছনে হর্ষ এবং বাসু। বহনকারীদের একজন গাড়োয়ান। সে ব্যস্ত হয়ে বলদ দুটিকে গাড়িতে জুততে শুরু করল।

দিলু অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ”বাসু, হয়েছে কী?”

বাসু বলল, ”লোকটা গাছের ওপর ছিল, হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল।”

প্যান্ট আর বুশশার্ট পরা বেঁটে গোলগাল গড়নের মাঝবয়সী লোকটিকে দেখে দিলুর মনে হল এই বোধ হয় সে—ই, যে গাছটা কিনেছে এবং বাসুকে চড় মেরেছে। লোকটি চোখেমুখে উদ্বেগ, বিরক্তি, ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে বলল, ”কী গেরোর ফেরে পড়লুম এখানে কোথায় ডাক্তার কোথায় ওষুধপত্তর, সেই বাইগাছি যেতে হবে। হাত—পা ভাঙলে তো হাসপাতাল ছাড়া গতি নেই। সেও সাত—আটমাইল, কত খরচ হবে কে জানে! দশ বছর ধরে অন্তত চারশো গাছ কেটেছে, একবারও পড়েনি আর আজই—ওরে যোতনে একটু তাড়াতাড়ি কর বাবা, মরেটরে গেলে বহু টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।”

হর্ষ বলল, ”পড়ে গেছে না অপদেবতায় ঠেলে ফেলে দিয়েছে। ও গাছে তেঁনার বাস আমার জন্মের আগে থেকে। তাঁকে বাসের ঘর থেকে উচ্ছেদ করলে তিনি সহ্য করবেন কেন।” দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে হর্ষ অবদেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানাল।

”অপদেবতা!” লোকটি চমকে উঠল, ”তার মানে ভূত?”

”বেম্মদত্যি! সাদা ধুতি চাদর, এই মোটা পৈতে, পায়ে খড়ম। কতদিন রাতে খটমট আওয়াজ যে শুনেছি।”

”যোতনে তাড়াতাড়ি কর। ব্যাটাকে গাড়িতে তুলে শোয়া।” দু’জনে ধরাধরি করে আহত লোকটিকে তুলল। ”এই যাঃ, গাছ কাটার দা—টা তো ওখানেই পড়ে আছে, যোতনে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আয় না বাবা।”

যতীন একগুঁয়ের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, ”আমি এখন গাছতলায় যেতে পারব না। আপনি গিয়ে নিয়ে আসুন।”

লোকটি কাঁচুমাচু মুখে বাসুকে বলল, ”খোকা তুমি যাবে আমার সঙ্গে?”

বাসু বলল, ”চলুন।”

ওরা দু’জন এগিয়ে যেতেই হর্ষ ফিসফিস করে দিলুকে বলল, ”কেমন ভয়টা দেখালুম বলো তো। ওই গাছটার ধারেকাছে জীবনে আর আসবে না।”

আহত লোকটার জ্ঞান ফিরে আসছে। উঁ উঁ শব্দ বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। যতীন ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, ”কেমন আছিস রে বেচু, খুব যন্তাোন্না হচ্ছে?”

কোনওক্রমে বেচু বলল, ”কী হয়েছে আমার?”

যতীন বলল, ”কী আবার হবে, বেম্মদত্যির গাঁট্টা খেয়ে পড়ে গেছিস।”

.

বাড়ি থেকে দুধঘাট স্কুল এক মাইল। বাসুর সঙ্গে দিলু বিকেলে হাজির হল স্কুলের মাঠে। স্কুলের যে এতবড় ঘাসে ঢাকা মাঠ থাকতে পারে, দিলু তা ভাবতে পারে না। মাঠের মাঝখান থেকে তুলে পঞ্চাশ—ষাট মিটার বল মারলে ওভার বাউন্ডারি হবে। কলকাতায় তার স্কুলের কোনও খেলার জায়গা নেই, আছে একটা ছোট উঠোন। তাতে বড়জোর একটা বাস্কেটবল কোর্ট হতে পারে। তাকে খেলতে হয় পাড়ার পার্কে। সেখানে ঘাসের বালাই নেই, জমি এবড়োখেবড়ো। দুধঘাট স্কুলের মাঠ দেখে তার চোখ জুড়িয়ে গেল।

”বাসু, মাঠটা এত সুন্দর করে রেখেছে কী করে?” দিলু জিজ্ঞেস করল, ”মাঠের মালিক তো স্কুল নিশ্চয় অনেক টাকা খরচ করে।”

বাসু বলল, ”কত খরচ করে তা আমি জানি না, সেটা বলতে পারবেন তোমার মামা, হেডসার।”

মাঠের তিনধারে সার দেওয়া নারকেল আর সুপুরি গাছ, মামার বাড়ির পুকুরের ধারে যেমনটি, তবে এখানে গাছের সংখ্যা অনেক বেশি। চোখ বুলিয়ে দিলুর মনে হল, সব মিলিয়ে অন্তত একশো সুপুরি আর নারকেল গাছ রয়েছে।

”এখানে খেলাধুলোর জন্য যা খরচ হয় তা দেয় এরা।” বাসু আঙুল তুলে গাছগুলোকে দেখাল। ”স্কুলবাড়ির পেছনে আছে দিঘি, বড় বড় মাছ, তারাও দেয় খরচের টাকা। স্কুলের আর আশপাশের গ্রাম থেকে যারা খেলতে আসে তারা একটা পয়সাও দেয় না, শুধু দেয় পরিশ্রম। প্রতি মাসে একটা ছুটির দিনে শ’দুয়েক ছেলে নেমে পড়ি মাঠে। দিঘি থেকে জল পাম্প করে মাঠে ছিটোই, ঘাস লাগাই, চারপাশের আগাছা সাফ করি, মাঠে একটা ইটের টুকরোও পাবে না। হেডসার নিজে একটা চেয়ারে বসে থাকেন, আমরা কাজ করি।”

দিলুর এখন মনে পড়ল তাদের ক্লাসের নীলমণির কথা। বাংলার সেরা জুনিয়ার দাবাডু, জাতীয় জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ানশিপ খেলতে কোজিকোড় গিয়ে তেরো দিন স্কুল কামাই হয়। রানার্স হয়ে ভারতের দু’নম্বর হয়েছে। নীলমণির বাবাকে ডেকে হেডমাস্টার বলেন, ‘হয় দাবা খেলুক নয়তো স্কুল ছাড়ুক। স্কুলে কামাই করে দাবাটাবা খেলা চলবে না।’ নীলমণি স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে দিনরাত দাবা খেলে, দাবার বই পড়ে, দাবার কথা ভাবে। সে গ্র্যান্ড মাস্টার হবেই হবে।

বাসুর গর্বে ঝলমল করা চোখের দিকে তাকিয়ে দিলুর খুব ভাল লাগল। নিজের হাতে যারা মাঠের যত্ন করে, সেবা করে, তারা মাঠকে ভালবাসবে, এ আর নতুন কথা কী। ভাল মাঠ না পেলে ভাল খেলা হয় না, দিলু তা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে। কলকাতায় ভাল মাঠই তো নেই। বিশেষ করে বর্ষাকালে যা অবস্থা হয়। চটি খুলে হাতে নিয়ে দিলু বলল, ”চলো ঘাসের ওপর দিয়ে একটু হাঁটি। কলকাতায় তো এমন ঘাসের ওপর হাঁটা হয় না।”

মখমলের মতো নরম ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার শরীর শিরশির করে উঠল। সুন্দর একটা আমেজ তার শরীর ভরিয়ে দিল। মাঠের ধারে একটা পাকা ঘর, সেটা দেখিয়ে দিলু জানতে চাইল, ”ওটা কী?”

”ওখানে খেলার জিনিসপত্তর থাকে। গোলপোস্টের জাল, ক্রিকেটের নেট, ব্যাট বল প্যাড, উইকেট, ভলিবলের নেট, এইসব। মেডিকেলের কিট ব্যাগও আছে। আমাদের কোনও মালি নেই, হেডসার বলেছেন যেদিন মালির দরকার হবে সেদিনই স্কুলে খেলা বন্ধ করে দেবেন।”

উত্তরদিকের গোলপোস্টের পেছনে কবাডি আর ভলিবল কোর্টে তখন খেলা চলছে। দুটো কোর্টের ধারে জনা চল্লিশ বয়স্ক দর্শক, দুধঘাটেরই লোক। ওরা দু’জন সেদিকে এগিয়ে গেল। ফুটবল ক্রিকেট কেউ খেলছে না দেখে দিলু অবাক হল। তার কৌতূহল মেটাতে বাসু জানাল, ফুটবলাররা আজ মছলন্দপুরে গেছে টুর্নামেন্ট খেলতে, আর মাটি খুঁড়ে নতুন মাটি ফেলা হয়েছে প্র্যাকটিস পিচে গোবর সার দিয়ে ঘাস বোনা হচ্ছে, তারপর রোল করে নেট পড়বে। ওদিকে দক্ষিণদিকের গোলপোস্টের পেছনে, বর্ষা কেটে গেলে পুজোর আগেই হয়তো প্র্যাকটিস শুরু হবে। কথা হচ্ছে কংক্রিটের পিচ করার, তা হলে সারা বছরই প্র্যাকটিস করতে পারবে।

বাসুর কথা শুনতে শুনতে দিলুর হাত নিশপিশ করে উঠল। সে ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করল, ”এখানে রোজ খেলা হয়?”

”রোজ হয়। স্কুল ছুটির পরই শুরু হয়, যারা দূরে থাকে তারা খেলেটেলে বাড়ি ফেরে। ছুটির দিনে তো সকাল থেকে শুরু হয়ে যায়। তখন একটা দেখার মতো দৃশ্য, একসঙ্গে চার—পাঁচ রকমের খেলা মনে হবে খেলার হাট বসে গেছে। তুমি খেলতে না জানলেও তখন তোমার ইচ্ছে করবে ছুটে গিয়ে কোনও একটা খেলায় নেমে পড়ি। দাদু বলেন এজন্যই স্কুলের রেজাল্ট এত ভাল হয়।”

দিলু মনে মনে আক্ষেপ করল, তার যে এমন দাদু আর মামা আছে এটা সে আগে কেন জানত না! জানলে কী করত? তা হলে কি মামার বাড়িতে এসে থাকত? প্রশ্নটা তাকে দোনামনা অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল।

বাড়ি ফেরার পরে দিলু বলল, ”আচ্ছা বাসু, ব্যাট বল নিয়ে খেলা নয় এখন বন্ধ, কিন্তু ফিল্ডিং প্র্যাকটিস তো করতে পারে।”

”পারে মানে!” বাসু থমকে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকাল। ”রোজ করে, প্রত্যেককে ব্যায়াম করতে হয়, দৌড়তে হয়, তারপর ফিল্ডিং, আজ সকালেও করেছে। প্রতাপদা না এলেও রোজ সকালে এসব করতেই হবে।”

দিলু জিজ্ঞেস করল, ”কে প্রতাপদা, কোচ?”

”হ্যাঁ। রঞ্জি ট্রফি শেষ, খেলেছেন আট বছর আগে, স্পিন বোলার ছিলেন। মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্টে পা ভেঙে যাওয়ার পর খেলা ছেড়ে দেন, বারাসাতে থাকেন, চাষের সার আর বীজের ব্যবসা, ওখান থেকেই বাইকে আসেন।”

”আমি ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করব, তুমি প্রতাপদাকে একবার বলবে?”

”কাল সকাল ছ’টায় আমি মাঠে হাজির থাকব, কিন্তু তুমি কি ওই সময় আসতে পারবে? তোমার তো ঘুম ভাঙে—।”

বাসুর কথা শেষ করতে না দিয়ে দিলু তাড়াতাড়ি বলল, ”না, না, খুব ভোরে আমি উঠব, তুমি দেখে নিও।”

দিলু কথা রেখে ভোরে বিছানা ছাড়ল। স্কুলের গেটে পৌঁছে দেখল বাসু দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে হাসল। হাসিটার অর্থ বুঝতে দিলুর অসুবিধে হল না—তা হলে সত্যি—সত্যিই ঘুম ভেঙেছে দেখছি।

মাঠটাকে পাক দিয়ে সাতটি ছেলে জগ করছে। দিলু হাওয়াই চটি খুলে বলল, ”চলো, আমরাও ওদের সঙ্গে জগ করি।”

ছেলেগুলির পেছন পেছন ওরাও জগিং শুরু করল। বাসুকে ওরা চেনে কিন্তু নতুন ছেলেটি কে? কৌতূহলে ওরা বারবার পেছন ফিরে তাকাতে লাগল। ওদের মধ্যে সর্দার ছেলেটি, যার পরনে সাদা হাফপ্যান্ট সাদা টি—শার্ট আর ক্রিকেট বুট, মাথা ন্যাড়া, সে সবার আগে ছুটছে। দিলু চারপাক সবে শেষ করেছে তখন ন্যাড়ামাথা হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে বলল, ”এবার স্ট্রেচিং।”

মাঠের ধারে ওরা ব্যায়াম শুরু করল। দিলু দেখল একটি ছেলে ফিসফিস করে বাসুকে কী জিজ্ঞেস করল বাসুও চাপাস্বরে জবাব দিল। দিলু জানে বাসু কী বলল—হেড সারের ভাগ্নে, কলকাতায় থাকে বেড়াতে এসেছে। ব্যায়ামরত ছেলেদের ফিটনেস দিলুকে অবাক করল। এভাবে সে আগে কখনও ব্যায়াম করেনি। ছেলেদের শরীরের নড়াচড়া দেখে বুঝে গেল সে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে।

ব্যায়ামের পর শুরু হল ক্যাচ লোফা, গ্রাউন্ড ফিল্ডিং, উইকেটকিপারকে বল ছোড়া। মাঠের মাঝে একটা স্টাম্প পোঁতা, সেখানে প্যাড—গ্লাভস পরে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে, তার পাশে ব্যাট হাতে ন্যাড়ামাথা। সে ব্যাট দিয়ে প্রথম বলটা তুলে মারল, বল নারকোল গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো উচ্চচতায় উঠে গেছে। দিলুর ডান দিকে পাঁচ গজ দূরে যেটা ডানহাতি ব্যাটসম্যানের লং অফ, দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে বল নামছে। সে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলটা লক্ষ করতে করতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তিন পা পিছিয়ে গেল। বল এবার জমিতে পড়বে। চিলের শিকার ধরার মতো ঝাঁপিয়ে ছোঁ মেরে ডান হাতের তালুতে বলটা ধরেই একপাক গড়িয়ে ছেড়ে দেওয়া স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠেই ছুড়ল উইকেটকিপারকে। বলটা জমি না ছুঁয়ে সোজা এসে লাগল সেই একমাত্র স্টাম্পটিতে।

সবারই চোখ কপালে উঠল। গত পাঁচ সেকেন্ডে তারা যা দেখল বিশ্বাস করতে পারছে না। একজন তো বলেই উঠল, ‘আনতাউড়ি হয়ে গেছে, ফ্রুক।” ন্যাড়ামাথা চেঁচিয়ে বলল, ”আর একবার করে দেখাতে পারবে?”

”চেষ্টা করে দেখব।” বলার পরই দিলুর চোয়ালের পেশি দপ করে উঠল।

ন্যাড়ামাথা বলটা তুলে ব্যাট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। বল উঠল একস্ট্রা কভারে দিলুর থেকে পনেরো গজ পেছনে। তিরাশির বিশ্বকাপ ফাইনালে ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ ধরার জন্য কপিলদেব যেভাবে বলের দিকে তাকিয়ে ছুটেছিল, দিলু প্রায় সেইভাবেই কভার থেকে ছুটে বাঁ কাঁধের কাছে বলটা লুফেই শরীর ঘুরিয়ে ডান হাতে ছুড়ল। আগের মতোই বল এসে স্টাম্পে লাগল।

চোখগুলো কপালে না উঠে ছানাবড়ার আকার নিল। কারও মুখে কথা নেই, শুধু বাসু ছুটে গিয়ে দিলুকে জড়িয়ে ধরল। ”অদ্ভুত, অদ্ভুত! পরপর দু’বার! তুমি তো অর্জুনের মতো লক্ষ্যভেদ কর দেখছি।”

এমন সময় মোটরবাইকে প্রতাপ লাহিড়ি গেট গিয়ে ঢুকল। ছিপছিপে লম্বা, গোলগলা লাল রঙের গেঞ্জিপরা। বয়স বোঝা যায় না, দেখে মনে হয় পঁয়ত্রিশ, আসলে চল্লিশ। পায়ে স্নিকার। প্রতাপ কলকাতায় উত্তরপল্লী সঙ্ঘের ক্রিকেট সচিব, তারা সি এ বি লিগের প্রথম ডিভিশনে খেলে।

”কীসের লক্ষ্যভেদ রে?” প্রতাপ ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল।

একজন উত্তেজিত গলায় বলল, ”এই যে এই ছেলেটা, আজই প্রথম এসেছে। বাসু বলল হেডসারের ভাগ্নে কলকাতায় থাকে, নাম দিলু, দিলীপ। দুটো দারুণ ক্যাচ নিয়েই নিমেষে বল ছুড়ে স্টাম্পে দু’—দু’বার মারল ওই ওখান থেকে।” ছেলেটি আঙুল দিয়ে দেখাল দিলু যেখান থেকে বল ছুড়েছে।

প্রতাপের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বল ছোড়ার দূরত্বটা চোখ দিয়ে মাপল। ওরা দাঁড়িয়ে ডীপ একস্ট্রা কভারে। প্রতাপ বলটা হাতে নিয়ে লং অফের দিকে তাকিয়ে আচমকা বলটা জোরে গড়িয়ে দিল, যেখানে স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার দাঁড়ায় সেইদিকে। চিৎকার করে উঠল, ”গোওও, রান।”

দিলু ধনুক থেকে বেরোনো তিরের মতো ছুটে গিয়ে শর্ট স্কোয়ার লেগের কাছে জমি থেকে বলটা কুড়িয়েই শরীর মুচড়ে সেই একমাত্র স্টাম্পের দিকে ছুড়ল। প্রতাপ হতভম্ব হয়ে দেখল স্টাম্পটা ছিটকে চারহাত দূরে গিয়ে পড়েছে। সে বিড়বিড় কল, ”অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য, হতে পারে না। তা হলেও ভালভাবে দেখে নেওয়া দরকার।”

এবার ব্যাট হাতে নিল প্রতাপ। স্কোয়ার লেগ থেকে পয়েন্ট, আধখানা মাঠে তুলে তুলে এলোমেলো বল মারল। দিলু প্রত্যেকটা ক্যাচ ধরে স্টাম্পে ছুড়ল, এগোরোবার স্টাম্প ফেলে দিল, শুধু একটি সোজা জমা পড়ল উইকেটকিপারের গ্লাভসে।

প্রতাপের মুখ গম্ভীর থমথমে হয়ে উঠল উত্তেজনা চাপার চেষ্টায়। হাতের আঙুল কাঁপছে। একটা অসাধারণ আবিষ্কার তার চোখের সামনে। মনে মনে বলল, বারোবার পরীক্ষায় এগারোটাতে সফল, এটা কি আবিষ্কার নয়? বাংলা কি ভারত ছেড়েই দিলাম, পৃথিবীতেও কি একটা এমন ফিল্ডার এখন আছে? জন্টি রোডস। দুর, দুর বারোটায় বড়জোর পাঁচটা কি ছ’টা লাগাতে পারবে। ছেলেটাকে হাতছাড়া করা যাবে না। ও বোধ হয় জানে না কী ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা ওর মধ্যে রয়েছে। দিলুর সঙ্গে সে কথা শুরু করল:

”কলকাতায় তুমি থাকো কোথায়??”

”মৌলালিতে।”

”কোনও ক্লাবে কি খেলো?”

”অ্যালবার্ট স্কোয়ারে বিজয়ী সঙ্ঘ ক্লাবে।”

”ওখানে বলাই মিত্তির আছে না?”

”হ্যাঁ। বলাইদা আমাদের স্কোরার।”

”ময়দানে কখনও খেলেছ?”

”না। আমাদের ক্লাবের ময়দান পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা এখনও হয়নি।”

”যদি তোমাকে ময়দানের কোনও ক্লাব ডাকে, যাবে?”

চকচক করে উঠল দিলুর চোখ। ময়দান মানে সি এ বি লিগের ক্লাব। তারপর বেঙ্গল টিমে, তারপর ইন্ডিয়া টিমে। উত্তেজনা দমন করে স্বাভাবিক স্বরে সে বলল, ”আমায় ডাকবে কেন, কী এমন খেলেছি!”

প্রতাপ মনে মনে বলল, ‘যা দেখলুম তার অর্ধেকও যদি দেখাতে পারো তা হলে তোমায় নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে।’ কিন্তু মুখে সে বলল, ”কলকাতায় কবে ফিরছ? কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ো?”

উত্তর দিতে দিলু ইতস্তত করল। পরীক্ষার ফল বেরোতে এখনও সাতদিন বাকি। তার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। সে নব্বুইভাগ নিশ্চিত, পাশ করতে পারবে না। দাদাদের কিংবা বাবার মতো তার মগজ পড়াশুনোর জিনিসপত্রে ভরা নেই, এটা সে মাকে অনেকদিন আগেই জানিয়ে রেখেছে। মা শুধু বলেছিলেন, ‘নীচের ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে বসতে তোর লজ্জা করবে না?’

তার মনে এল বোকামামার কথাটা : ‘ভাল লাগলে দিলু এখানেই থেকে যাবে।’ এ—কথা শুনে সেদিন সে মনে মনে হেসেছিল। মায়ের সঙ্গে ছেলেবেলায় মামার বাড়িতে এসে নিঃসঙ্গ বোধ করত কিন্তু এবার সে করছে না, বরং ভালই লাগছে। এই ক’দিনে এমন কয়েকটা ব্যাপার ঘটে গেছে যাতে সে মজা পেয়েছে, অবাক হয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা, এমন তকতকে একটা মাঠে খেলার সুযোগ আর খেলার জন্য এত ছেলে সে কোথায় পাবে?

”সরস্বতী ইনস্টিটিউশনে। ক্লাস এইটে পরীক্ষা দিয়েছি। কলকাতায় ফিরব কবে ঠিক নেই।” একটু আনমনা দেখাল দিলুকে।

প্রতাপ বলল, ”এখানে থাকলে তুমি সারা বছরই খেলার সঙ্গে যোগ রাখতে পারবে আর কলকাতাও তো বেশিদূর নয়, বরানগর থেকে বাসে ময়দানে পৌঁছতে যে সময় লাগবে এখান থেকেও ততটাই লাগবে। তুমি দুধঘাট স্কুলে ভর্তি হয়ে যেতে পারো, কলকাতার যে—কোনও ভাল স্কুলের থেকে একটুও খারাপ নয়। আচ্ছা, তোমার বয়স কত, তোমার গার্জেন কে, বাবা?”

বয়স বলতে গিয়ে দিলু বরাবরই লজ্জায় পড়ে যায়। তার দেহের আকার দেখে বেশিরভাগ লোকই ধরে নেয় সতেরো—আঠারো।

”পনেরোয় পড়ব দু’ মাস পর।” তারপরই সে তাড়াতাড়ি যোগ করল, ”আমাদের বংশের সবাই খুব লম্বাচওড়া, বাবা সওয়া ছ’ফুট, পঁচানব্বুই কেজি, আমার গার্জেন।”

প্রতাপ কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ”আগে হেডসার হরিসাধনবাবুর সঙ্গে কথা বলি।”

বাসু এতক্ষণ অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল। এবার বলল, ”হেডসারের সঙ্গে নয় প্রতাপদা, আগে কথা বলুন দিলুর দাদুর সঙ্গে, উনি খেলা খুব ভালবাসেন।”

”এখুনি যাচ্ছি।” প্রতাপ তখনি বাইকে উঠে রওনা হল দিলুর মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে, বাড়িটা সে চেনে, আগে দু—তিনবার গেছে। পুকুরধারের বেগুন খেতে পঞ্চানন তখন একটা টুলে বসে রিদুকে দিয়ে গাছগুলোর গোড়ায় মাটি খুঁড়িয়ে সার দেওয়ার কাজ দেখছিলেন, চার বছর আগেও তিনি এই কাজ নিজের হাতে করেছেন। এমন সময় হাজির হল প্রতাপ। পঞ্চানন তাকে দু’বার দেখেছেন এই বাড়িতে, হেডমাস্টারের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। প্রতাপ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে ঠিক করেই রেখেছিল এবং তাই করল। পঞ্চাননের মুখে দেখে মনে হল খুশি হয়েছেন, সে আশ্বস্ত হল।

”আমার নাম প্রতাপ লাহিড়ি, আমি—”

পঞ্চানন হাত তুলে বললেন, ”জানি, তুমি তো এ বাড়িতে আগে এসেছ, ছেলেদের ক্রিকেট শেখাও। বোকা তো এখন বাড়ি নেই।”

”আমি এসেছি আপনার কাছেই, আপনার নাতির খেলার ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে।” এই পর্যন্ত শান্তভাবে বলেই প্রতাপ উচ্ছ্বসিত হয়ে দু’হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ”কী বলব আপনাকে, অদ্ভুত, আউট অব দিস ওয়ার্ল্ড, কখনও দেখিনি—”

পঞ্চানন চোখ পিটপিট করে বললেন, ”ব্যাপার কী, দিলু করেছে কী?”

”অসাধারণ, অবিশ্বাস্য ফিল্ডার। মাঠের যেখান—সেখান থেকে বল ধরেই বিদ্যুৎগতিতে ছুড়ে স্টাম্পে মারছে, একটা স্টাম্পে।”

”তাতে হয়েছে কী?” পঞ্চানন বুঝতে পারছেন না স্টাম্পে বল মারার মধ্যে অসাধারণত্বের কী আছে।

”হয়েছে কী!” প্রতাপ উত্তেজিত হতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ”মাঠে এইরকম একটা ফিল্ডার থাকলে ব্যাটসম্যানের অবস্থাটা কী হবে একবার ভেবে দেখুন। একটা রান নেওয়ার আগে চোদ্দোবার তাকে ভেবে দেখতে হবে, দুটো রান নেওয়ার আগে—নাহ, দ্বিতীয় রানটা নিতেই যাবে না যদি দেখে দিলু বলটা ফিল্ড করতে যাচ্ছে। এরকম একটা ফিল্ডার মাঠে থাকলে অপোনেন্টের রান কত কমে যাবে ভাবতে পারেন। রান আউট হয়ে যাওয়ার ভয়ে ক্রিজ ছেড়ে বেরোবেই না। যেদিকে দিলু থাকবে সেদিকে স্ট্রোক নেবেই না, আর অন্যদিকে মারতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনবে। এবার বুঝতে পারছেন আপনার নাতি কী জিনিস?”

পঞ্চানন শান্তস্বরে বললেন, ”বুঝলাম, তা আমার কাছে কেন, আমি তো আর ব্যাট করব না।”

”ওকে আমার ক্লাব উত্তরপল্লীতে খেলাতে চাই। ক্লাবটা বরানগরে। ফার্স্ট ডিভিশনে গড়ের মাঠে খেলে। বাচ্চচা ছেলে, ওর অভিভাবকদের অনুমতি নেওয়া উচিত বলে মনে হল, তাই আপনার কাছে এসেছি। বেশিরভাগ বাবা—মাই তো পড়াশুনো ফেলে খেলাধুলো পছন্দ করেন না।”

”আমি ওর বাবা নই, মা’ও নই। তুমি তাদের কাছেই যাও।”

”ছেলেটিকে আমি এখানে রাখতে চাই। এখানকার এত ভাল মাঠ, অফুরন্ত প্র্যাকটিসের সুযোগ, আর এত ছেলে, এ—সবই সম্ভব হয়েছে দুধঘাট স্কুল আর তার হেডমাস্টারের জন্য। এই স্কুল তো কলকাতার কোনও স্কুলের চেয়ে লেখাপড়ায় কম নয়। আমি বলি কী, দিলু মামার বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করুক আর ক্রিকেটটা কলকাতায় আমার ক্লাবের হয়ে খেলুক।” প্রতাপ হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল।

পঞ্চাননের ঠোঁটে একচিলতে হাসি খেলে গেল। বললেন, ”দিলু যদি এখানে থাকে তা হলে আমি খুশিই হব, কিন্তু ওর বাবা—মা সেটা চাইবে কিনা তা আমি জানি না। আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে।”

যাওয়ার আগে প্রতাপ বলে গেল, ”আমি কলকাতায় গিয়ে দিলুর বাবার সঙ্গে কথা বলব।”

একটু পরেই দিলু ফিরল। দাদুকে বেগুন খেতে টুলে বসে থাকতে দেখে সে কৌতূহলে এগিয়ে গেল। রিদু উবু হয়ে খুরপি দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সরে যাচ্ছে করলার মাচার দিকে।

”তুমি নাকি অসাধারণ ফিল্ডিং করো, মাঠের যেখান—সেখান থেকে বল মারো স্টাম্পে!” পঞ্চানন বললেন, ”অবিশ্বাস্য কাণ্ড করেছ স্কুলের মাঠে।”

দাদু এরই মধ্যে জেনে গেছে, তার মানে ইতিমধ্যেই প্রতাপদা এসে বলে গেছে। দিলু প্রশংসা শুনলে আড়ষ্ট বোধ করে, লজ্জাও পায়। প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য বলল, ”দাদু, ওই কুমড়ো দুটো তো পেকে গেছে, কাটবে না?”

পঞ্চানন মুখ ফিরিয়ে করলার মাচার নীচে কুমড়োদুটোর ওপর চোখ রাখতেই চোখের মণি স্থির হয়ে গেল। মাচা থেকে একটা সাপ ঝুলছে, ফণা তুলে রয়েছে রিদুর মাথার একহাত ওপরে। রিদু পাশের বেগুনগাছের দিকে সরার জন্য নড়লেই ছোবল মারবে।

দাদু কথা না বলে একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে রইল কেন জানার জন্য দিলুও তাকাল। সাপটার ফণা অল্প অল্প দুলছে। শিরশির করে উঠল তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। সাক্ষাৎ যম রিদুদার মাথার ওপর।

”গোখরো।” পঞ্চানন ফিসফিসিয়ে বললেন, তারপর কুড়ি হাত দূরে উবু হয়ে বসা রিদুকে চাপা গলায় হুঁশিয়ার করলেন, ”রিদু যেমনটি আছিস ঠিক তেমনিই থাক, নড়বি না, তোর মাথার ওপর সাপ ঝুলছে।”

শোনামাত্র নিথর হয়ে গেল রিদু। বছর চল্লিশ বয়স। জীবনে সে অনেক সাপের মুখোমুখি হয়েছে। সে জানে এইরকম মুহূর্তে কী করতে হয়। দিলু জানে সাপের কান নেই, কিন্তু চোখ আছে, শুনতে পায় না কিন্তু দেখতে পায়। সে নীচে তাকিয়ে পায়ের কাছে দেখতে পেল একটা শক্ত মাটির ঢেলা। খুব ধীরে ধীরে হাঁটু ভেঙে ডান হাতটা নামিয়ে কুড়িয়ে নিল ঢেলাটা। স্ট্রোক নেওয়ার আগে ব্যাট পেছনে তোলার মতো সাপটা ফণা একটু পিছিয়ে নিল। পঞ্চানন একদৃষ্টে সাপের দিকে তাকিয়ে, তার কণ্ঠনালী নড়ে উঠল ঢোক গেলার জন্য। দিলু মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে চোখের কোণ দিয়ে তাকাল একবার, আর মুহূর্তের মধ্যে বাঘের লাফের মতো ঝলসে উঠল তার ডান হাত।

দু’হাত লম্বা সাপটা ছিটকে পড়েছে জমিতে, রিদুর সামনে। ছটফটাচ্ছে, পাকিয়ে পাকিয়ে মোচড়াচ্ছে শরীরটা। মাথাটা থেঁতলে রক্তাক্ত। পঞ্চানন তাকিয়ে রইলেন নাতির দিকে, ঢেলাটা যে সাপের মাথায় লাগল সেটা তিনি দেখেছেন এবং কে সেটা ছুড়ল তাও বুঝেছেন, তাঁর মুখে কথা সরল না। দিলুর মুখ নির্বিকার।

”রিদু, তুই যমের বাড়ি থেকে ফিরে এলি।” পঞ্চাননের মুখ দিয়ে বেরোনো এটাই প্রথম কথা। রিদু বাঁশের একটা খেটো দিয়ে সাপটাকে পিটিয়ে মারতে মারতে বলল, ”বড় কত্তা, সাপের এমন দশা হল কী করে বলো তো? খুব বাঁচা বেঁচে গেছি, এ তো গোখরো সাপ গো।” রিদু শিউরে উঠল।

দিলু বলল, ”দাদু, বাসু বাড়ি চলে গেছে, আজ আমি একাই পুকুরের ওপারে যাব।” এই বলে সে ছুটে বাড়ির মধ্যে চলে গেল।

পঞ্চানন রিদুকে বললেন, ”বাড়ি যা, আজ আর কাজ করতে হবে না। পরে বলব সাপটার দশা এমন হল কী করে।”

তেল মাখতে মাখতে দিলুকে পুকুরঘাটের দিকে যেতে দেখার পর বাড়িতে এসে পঞ্চানন সুলেখাকে বললেন, ”বউমা, আজ দুটো রহস্যের সমাধান করেছি, সেই লাল গুণ্ডার অজ্ঞান হওয়ার, আর গাছ কাটতে কাটতে লোকটার পরে যাওয়ার। বাড়ির বাইরের কাউকে যদি না বলো, হষ্যকেও নয়, তা হলে রহস্যটা ফাঁস করতে পারি।”

সুলেখা কথা দিলেন, কাউকে কিছু বলবেন না। পঞ্চানন তখন পুত্রবধূর কানে কানে বললেন, ”এসব দিলুর কাণ্ড।” তারপর তিনি বউমাকে জানালেন প্রতাপের কাছে যা শুনেছেন আর নিজের চোখে সাপটাকে যেভাবে মরতে দেখেছেন তার বিবরণ। অবশেষে বললেন, ”আমার এখন মনে হচ্ছে আগের ঘটনা দুটোও দিলুর কীর্তি। লেখাপড়ায় ওর মন নেই। শুধু ক্রিকেট খেলতে চায়, তাই খেলুক। প্রতাপ চাইছে ওকে এখানে এনে পড়াশুনো করাতে, তাই করাব।”

প্রতাপ একটা দিনও দেরি করতে রাজি নয়, পরের দিনই সে কলকাতায় গিয়ে বলাই মিত্তিরের খোঁজ নিল অ্যালবার্ট স্কোয়ারে। সেখানে একটি ছেলে বলে দিল তার বাড়িটা কোথায়। সে বাড়িতেই বলাইকে পেয়ে গেল। তাদের পরিচয় বহুদিনের। বলাই একসময় কালীঘাট ক্লাবে কয়েক সিজন উইকেট কিপিং করেছে, প্রতাপও তখন কালীঘাটে।

”বলাই তোদের ক্লাবে দিলীপ কর নামে একটা ছেলে খেলে, ওর বাবাকে চিনিস?”

বলাই অবাক হল, এমন একটা প্রশ্ন প্রতাপ প্রথমেই করায়।

”ব্যাপার কী বল তো হঠাৎ দিলুর খোঁজ? ওকে তোদের ক্লাবে নিতে চাস বুঝি?”

”না, না, তেমন কিছু নয়, মানে—” প্রতাপ বলাইয়ের কৌতূহলটায় বিব্রত হয়ে পড়ল। তার এই খোঁজ নেওয়ার আসল কারণটা জানাজানি হয়ে গেলে অনেক ক্লাবই দিলুর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে এটা সে জানে।

”তুই ওকে খেলতে দেখেছিস?” বলাই চোখ সরু করে তাকাল।

”না।”

”তা হলে ওর সম্পর্কে ইন্টারেস্ট নিচ্ছিস কেন?” বলাইয়ের ভ্রূ কুঁচকে উঠল।

”ওর ফিল্ডিং প্র্যাকটিস দেখেছি।” যা বলতে চায়নি অবশেষে প্রতাপ সেটাই বলে ফেলল।

”আহহ তাই বল। প্রতাপ লাহিড়ি কেন দিলুর বাবার খোঁজ নিচ্ছে এবার সেটা বুঝতে পারলুম। ওর বাবা তরুণ কর খুব বড় উকিল, প্রচুর পয়সা, থাকে এগারো নম্বর রিপন রো—এ, পাশের পাড়ায়। দিলু পড়াশুনোয় একদমই ব্রাইট নয়, ওর বাবা তাই খেলাধুলোর ওপর হাড়ে চটা। আমরা তো ওকে টিমে নিই শুধু ওর ফিল্ডিংটার জন্য। অন্তত তিনটে ক্যাচ নেবে কি রান আউট করবেই। যদি একটু ধরে ব্যাটটা করতে পারে তা হলে খুব তাড়াতাড়ি উঠে আসবে।”

প্রতাপ উঠে পড়ল। তার যা জানার জানা হয়ে গেছে, এবার তাকে তরুণ করের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তালতলায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে সময় কাটিয়ে রাত আটটা নাগাদ সে পৌঁছল রিপন রো—এ দিলুদের বাড়ি। সেখানে চারজন মক্কেল তখন অপেক্ষা করছে। তরুণ করের ক্লার্ক জানাল, ঘণ্টাখানেকের আগে দেখা করা সম্ভব হবে না। প্রতাপ একটা চেয়ারে হতাশ হয়ে বসে পড়ল। ঘরের দরজা দিয়ে বাড়ির অন্দর থেকে বেরিয়ে সদর দরজায় যাওয়ার পথটা দেখা যাচ্ছে, প্রতাপ সেইদিকে তাকিয়ে আকাশ—পাতাল ভেবে যাচ্ছে।

একসময় বাড়ির ভেতর থেকে দু’জন মহিলা বেরিয়ে সদর দরজার দিকে গেলেন। প্রতাপ শুনতে পেল—”খুব ভাল লাগল, কতদিন পরে এলে, আবার কিন্তু এসো।” দামি জরিপাড় হলুদ শাড়ি পরা মহিলা অন্দরের দিকে ফিরে যাচ্ছেন, প্রতাপের মনে হল ইনি এ—বাড়ির গিন্নি, দিলুর মা। সে লাফ দিয়ে ঘরের বাইরে এসে বলল, ”আপনি কি দিলুর মা?’

মল্লিকা ঘুরে অবাক হয়ে বললেন, ”হ্যাঁ, আপনি?”

নমস্কার করেই প্রতাপ তাড়াতাড়ি বলল, ”আমি দুধঘাট থেকে আসছি, হরিসাধনবাবু, পঞ্চাননবাবু আমাকে ভালই চেনেন। আমি আপনার কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি দিলুর সম্পর্কে।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলার পরই তার মনে পড়ল নিজের পরিচয়টা দেওয়া হয়নি। ”আমার নাম প্রতাপ লাহিড়ি, আমি দুধঘাট স্কুলের মাঠে ক্রিকেট কোচিং করি।”

মল্লিকাকে কৌতূহলী দেখাল, ”দিলুর সম্পর্কে কী বলবেন?”

”আপনার ছেলে অসাধারণ প্রতিভাবান। ওর মতো ফিল্ডার পৃথিবীতে এখন আছে কিনা আমার জানা নেই।” প্রতাপের স্বর গদগদ পর্যায়ে পৌঁছল। ”ওকে আমাদের ক্লাবে খেলাতে চাই।”

”আপনি ঘরে এসে কথা বলুন।”

তরুণের চেম্বারের পাশের ঘরের দরজা খুলে ধরল মল্লিকা। কার্পেটে—সোফায় সাজানো বসার ঘর। দু’জনে মুখোমুখি বসল।

”আর্জিটা কী?” মল্লিকা সোজাসুজি কথা পাড়লেন।

”দিলুর ক্রিকেট ভবিষ্যতের কথা ভেবে বলছি ওকে এখানে না রেখে মামার বাড়িতে রাখুন। ওখানে খেলার ব্যবস্থা আর সুযোগ কলকাতার চেয়ে অনেক ভাল।”

”আমি আর দিলুর বাবা চাই আমার দাদা, জ্যাঠামশাইয়ের কাছে দিলু থাকুক, তবে শুধুই লেখাপড়ার জন্য, খেলার জন্য নয়। ওখানে গিয়েও যদি এখানকার মতো দিনরাত খেলা—খেলা করে তা হলে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। লেখাপড়ায় দিলু ভাল নয়, আর দুধঘাট স্কুলের সুনামের কথা আমরা জানি। দাদাও চান ওকে লেখাপড়া শেখার জন্য ভর্তি করে নিতে। হয়তো দিলু পৃথিবীর সেরা ফিল্ডার, জানি না কী দেখে পৃথিবীর সেরা বলে দিলেন, তবু মুখ্যু সেরা—ফিল্ডারের বাবা—মা হতে আমরা চাই না, ধরে নিতে পারেন এটা ওর বাবারও কথা। এবার আপনি আসতে পারেন।” মল্লিকা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালেন। ওঁর দৃঢ় স্বর আর কঠিন ভঙ্গি প্রতাপকে আর কথা বাড়াতে সাহস জোগাল না।

কিন্তু প্রতাপ নাছোড়বান্দা। তার ধারণা, সে একটা বিরাট উপহার ভারতকে দিতে পারবে, দিলুর অবিশ্বাস্য ফিল্ডিং প্রতিভাকে তুলে ধরে। বাবা—মায়ের আপত্তিকে যেভাবেই হোক পাশ কাটিয়ে দিলুকে ময়দানে নামাবে এই প্রতিজ্ঞা করে প্রতাপ পরদিনই দেখা করল পঞ্চাননের সঙ্গে।

বিকেলে দোতলার বারান্দায় বসে দু’জনে যখন কথা বলছিল দিলু তখন স্কুলের মাঠে ফিল্ডিং অনুশীলন করায় ব্যস্ত।

”মলু বলল, মুখ্যু সেরা—ফিল্ডারের মা—বাবা তারা হতে চায় না, তা হলে কী হতে চায় সেটা কি বলেছে?” পঞ্চানন শীতল দৃষ্টিতে প্রতাপের দিকে তাকালেন।

”না, সেটা স্পষ্ট করে বলেননি, তবে বলেছেন, শুধুই লেখাপড়া করুক এটাই তিনি চান, আর সেজন্যই ওকে এখানে রাখতে রাজি।”

”লেখাপড়া বলতে আমরা যা বুঝি তা হল একটা ভাল চাকরি পাওয়া, নয়তো কোনও পেশায় যাওয়া। লক্ষ্যটা টাকা রোজগার, এর বাইরেও অবশ্য কেউ কেউ ব্যবসা—বাণিজ্য করে। কিন্তু লেখক হয়ে, গান গেয়ে, সেতার কি তবলা বাজিয়ে, ছবি এঁকে, মূর্তি গড়ে এমনকী খেলাধুলো করেও যে প্রচুর টাকা, নাম যশ খ্যাতি অর্জন করা যায়, এটা আর বাবা—মায়ের মাথায় ঢোকে না। এইসব লোকেদের কিন্তু আমাদের খুব দরকার। দিলুর মতো ছেলেদের তো এগিয়ে দিতে হবে, ওরা যা হয়ে উঠতে চায় তাই হয়ে উঠুক। দেখো বাবা, আমি কিন্তু মলুর চিন্তার সঙ্গে একমত নই। আমি পুরনো ধারার মানুষ কিন্তু মলু তো দেখছি একেবারে মান্ধাতার আমলে পড়ে রয়েছে, কী যে লেখাপড়া শিখল!” পঞ্চানন মাথা নামিয়ে আক্ষেপে নাড়লেন।

”তা হলে?” প্রতাপ ঝুঁকে আশার আলো দেখতে পাওয়ার মতো চোখে তাকিয়ে রইল।

”তা হলে আর কী!” পঞ্চাননের স্বর বদলে গেল, কঠিন ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসলেন, ”দিলু যদি এখানে থাকে তা হলে আমার ইচ্ছানুযায়ী তাকে পড়াব, শেখাব। এটা ওর বাবা—মাকে মানতে হবে।”

”তা হলে দিলুর খেলা বন্ধ হচ্ছে না।” প্রতাপ নিশ্চিত স্বরে বলল।

পঞ্চানন জবাব না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

চারদিন পর রবিবার দুপুরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য হরিসাধন দিলুকে নিয়ে বাইগাছি স্টেশনে সাইকেল ভ্যানরিকশা থেকে নামলেন। নেমেই দিলু বলল, ”বোকামামা, তোমার বিশ্ববিখ্যাত জিনিসটা আর একবার চেখে দেখতে ইচ্ছে করছে।”

দারুণ খুশি হলেন হরিসাধন, ”নিশ্চয় হবে। তার আগে পদসেবা, এই হাওয়াই চটি পরে বাড়িতে গেলে তোর মা বলবে দাদাটা কিপ্টে হয়ে গেছে, একজোড়া ভাল চটিও ভাগ্নেকে কিনে দিলে না। আগে চটি, তারপর ছানার জিলিপি।”

দু’জনে পদসেবায় ঢুকল। সেই সেলসম্যানটি একা দোকানে বসে, ওদের দেখেই চিনতে পেরে হেসে বলল, ”বুড়ো আঙুলের নখটা ঠিক হয়ে গেছে?”

হরিসাধন বললেন, ”এখন একদম নতুন নখ। এবার বের করো তো সেই চটি জোড়া, প্রথম যেটা দেখিয়েছিলে।”

ছেলেটি বাক্স আনল। দিলু চটি পরে হাঁটল। হরিসাধন দেড়শো টাকা গুনে দিয়ে বললেন, ”হাওয়াইটা বাক্সে ভরে নে।”

এর পর তারা এল যশোহর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। যে টেবিলটায় ওরা বসে ছিল সেটাতেই বসল। একটা ছেলে টেবলে এসে দাঁড়াল। হরিসাধন জিজ্ঞেস করলেন, ”ক’টা বলব?” দিলু আঙুল দিয়ে ‘ভি’ দেখাল, ”হরিসাধন ছেলেটিকে বললেন, ”দুটো করে দাও।”

দিলু মোট তিনবার ‘ভি’ দেখায়। বোনের জন্য কুড়িটা ছানার জিলিপি দড়িবাঁধা হাঁড়িতে হাতে ঝুলিয়ে হরিসাধন টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবার দশ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন এসে গেল।

ট্রেনে হরিসাধন একবার জিজ্ঞেস করলেন, ”দিলু, আবার কবে আসবি?”

”শিগগিরই আসব, তবে এবার আসব থাকার জন্য। নীচের ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে বসা আমার দ্বারা হবে না।” এই বলে সে পায়ের পাতা উঁচু করে নতুন চটি ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে দেখতে লাগল।

.

হরিসাধনের সামনে গরম ফুলকো লুচি আর বেগুনভাজার প্লেট টেবলে রেখে মল্লিকা বললেন, ”বোকাদা একটা লোক এসেছিল, নাম বলল প্রতাপ লাহিড়ি, চেনো নাকি?”

”চিনি।” আহার্য বিষয় সামনে থাকলে হরিসাধনের কথাবার্তা সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়।

”কী করে বলো তো? এই ক’দিন আগে হঠাৎ এসে বলল, দিলুকে মামার বাড়িতে রেখে পড়ান। আমি তো অবাক, গায়ে পড়ে পরামর্শ দিতে এসেছে, ব্যাপার কী! বলল, তোমার স্কুলে নাকি খেলার ব্যবস্থা খুব ভাল, দিলুর মতো ফিল্ডার এখন পৃথিবীতে নেই, এইসব হাবিজাবি আমাকে বোঝাতে চাইছিল। আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছি আগে পড়া, তারপর খেলা। দুধঘাটে যদি যায় তো লেখাপড়াই করতে যাবে, খেলতে নয়।”

”প্রতাপ এইসব বলেছে নাকি?”

”বলেছে ওর ক্লাবে দিলুকে খেলাবে। স্কুলে পড়া ছেলে ক্লাস না করে মাঠে গিয়ে খেলবে?”

”দূর দূর, যেতে দেবই না।” বেগুনভাজা লুচি দিয়ে মুড়তে মুড়তে হরিসাধন উত্তর দিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। মলুকে প্রতাপ কী বলেছে তা তিনি জানেন না। কিন্তু এটা বুঝে গেছেন প্রতাপের কথায় মলু বিগড়ে গেছে। ওকে খুশি করা দরকার।

”দারুণ লুচি, তোর করা?”

”নয় তো কে করবে, রাঁধুনি তো আসবে সন্ধেবেলায়।”

”আরও দুটো দে।” হরিসাধন আড়চোখে বোনের মুখটা দেখে নিলেন। কাজ হয়েছে।

মল্লিকা গোটাছয়েক লুচি আর গরম বেগুনভাজা নিয়ে এল। ততক্ষণে হরিসাধন কী বলবেন ভেবে নিয়েছেন। তিনি জানেন মল্লিকা স্কুলের এখনকার অবস্থা দেখেনি।

”মলু আমি ভাবছি স্কুলের মাঠটায় গোলাপ চাষ করব। স্কুলের বেঞ্চিগুলো ভেঙে ঝরঝর করছে। গভর্নমেন্ট টাকা দিতে পারে না। সারাবার খরচ তোলা যাবে গোলাপ ফুল বেচে। আগে খেলা না আগে ক্লাসে বসে পড়া?”

”আগে পড়া তো বটেই। তোমার স্কুলের অত ভাল রেজাল্ট, ভাল করে বসে পড়া না শুনলে রেজাল্ট কি ভাল থাকবে! তুমি খেলার মাঠ তুলে দিয়ে গোলাপ চাষই করো।”

”তুই তা হলে দিলুকে পাঠিয়েই দে।” বেগুন ভাজা ঠাণ্ডা হয়েছে কিনা আঙুল ছুঁইয়ে দেখে হরিসাধন কাজ শুরু করে দিলেন।

”কিন্তু দাদা, প্রতাপ যে বলল—”

”ও কিছু নয় কিছু নয়, ভাগিয়ে দোব। ক্লাবে খেলবে কী এইটুকু ছেলে!”

মল্লিকা প্লেটে চারটে সন্দেশ আনলেন।

”পারব না রে পারব না, ছ’টা ছানার জিলিপি খেয়ে ট্রেনে উঠেছি। হরিসাধন কাতর চোখে তাকালেন। পরেরবার এসে খাব। তরুণ কখন ফিরবে?”

”দশটার আগে তো নয়ই, তাসের আড্ডায় বসলে ওর বাড়ির কথা মনে থাকে না। পরশু দিলুর রেজাল্ট বেরোবে, কী হবে সে তো সবার জানাই আছে। বংশে এই প্রথম একটা মুখ্যু ছেলে হল, মুখ দেখানো দায় হবে।”

খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে হরিসাধন বললেন, ”চলি রে।”

”সামনের রোববারই ওকে দুধঘাটে পৌঁছে দিয়ে আসব।”

সবার যা জানা, দিলু সেটাকে অজানা হতে না দিয়ে পরীক্ষায় ফেল করল। একটা বড় সুটকেস এবং দিলুকে সঙ্গে নিয়ে পরের রবিবার সকালে মল্লিকা মোটরে রওনা হলেন দুধঘাটের উদ্দেশ্যে। তাসের আড্ডা ফেলে তাঁর স্বামী সঙ্গে যেতে রাজি হননি। জাতীয় সড়ক থেকে পিচের সরু ভাঙাচোরা একটা রাস্তা চলে গেছে দুধঘাটের দিকে। সেই রাস্তার ওপরে দুধঘাট স্কুল। মল্লিকার নির্দেশমতো ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে যখন স্কুলবাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে তখন স্কুলের মাঠে খেলার মেলা বসে গেছে। শিউরে উঠে মল্লিকা দেখলেন ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে একটি ছেলে বলটা আকাশের দিকে তুলে মারল। দুটো ছেলে ছুটল ক্যাচ ধরতে। মল্লিকা আড়চোখে পাশেবসা ছেলের দিকে তাকালেন, দিলু তখন অন্য জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে।

”জেঠু দিয়ে গেলুম তোমার ফেল—করা নাতিকে। ” প্রণাম করে মল্লিকার এটাই প্রথম কথা, ”এবার পাশ করিয়ে দাও দেখি।”

পঞ্চানন একগাল হেসে দিলুর দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন, ”এবার থেকে দু’বেলা শুধু পড়া, পড়া আর পড়া।”

”নিশ্চয়। বি—এ—টা পাশ না করলে লোকে বলবে কী! স্কুলের মাঠে দেখলুম খুউব খেলা চলছে, বোকাদা বলল গোলাপের চাষ করে বেঞ্চি সারাবার টাকা তুলবে ওই মাঠ থেকে। তুলুক, তুলুক।”

”আমাকেও বোকা বলেছে। আমি বললুম খুব ভাল কথা, টাকা তো আসবেই। তা ছাড়া সামনে গোলাপ বাগান থাকলে স্কুলটাও কত সুন্দর দেখাবে। বোকার মাথায় বুদ্ধি আছে।” পঞ্চানন মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।

”নীচে যাই, বউদি তো রান্নাঘরে ঢুকল, কী রাঁধছে দেখি গিয়ে। বউদির এই এক বাতিক, কাউকে পেলেই ধরে বেঁধে খাওয়াবে।” মল্লিকা বলতে বলতে সিঁড়ির দিকে এগোলেন।

”পরশু নারকেল পাড়িয়েছি। যাওয়ার সময় চন্দ্রপুলি নিয়ে যাবি কিন্তু।”

মা সিঁড়ি দিয়ে অদৃশ্য হওয়ামাত্র দিলু উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, ”দাদু, স্কুলের মাঠে গোলাপের চাষ, কী ব্যাপার?”

মাছি তাড়াবার মতো নাকের সামনে হাত নেড়ে পঞ্চানন বললেন, ”রাখ তো গোলাপ, ধানচাষ হবে বলেনি এটাই স্কুলের ভাগ্যি।”

কথার অর্থ বুঝতে পেরে দিলুর মুখ নিঃশব্দ হাসিতে ভরে গেল। গেঞ্জিটা খুলে জিনসের প্যান্ট খুলল। জাঙিয়া পরা অবস্থায় সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে তখন পঞ্চানন বললেন, ”যাচ্ছ কোথায়?”

”পুকুরে। মাকে দেখাব সাঁতরে ওপার পর্যন্ত যেতে পারি। আমাদের বাড়িতে কেউ সাঁতার জানে না, খুব অবাক হয়ে যাবে।”

”খবরদার নয়। সাঁতারও খেলার মধ্যে পড়ে। মা দেখলে এখুনি গাড়িতে তুলে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সাঁতার টাতার সব কাল থেকে।”

সন্ত্রস্ত দিলু প্যান্ট পরে নিল চটপট।

”দাদু, বোকামামাও তা হলে মিথ্যে কথা বলে।”

”শুধু বোকামামা? যুধিষ্ঠির পর্যন্ত বলেছিলেন। বোকাকে তো একবার নরক দর্শন করতেই হবে।”

হরিসাধন ক্লাস এইটেই ভর্তি করালেন দিলুকে। ইচ্ছে করলে ক্লাস নাইনেও করাতে পারতেন। কিন্তু তা করালেন না একটা কারণে, আর সেটা শুধু বাবাকেই তিনি বলেছিলেন। ”দিলুর যা বিদ্যের বহর তাতে ওকে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করালে ঠিক হত। ওর আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে বলে সেটা আর করলুম না। কী করে যে এইট পর্যন্ত উঠল, ভেবে পাচ্ছি না। তবে ক্লাস নাইনে উঠতে হলে ওকে আদাজল খেয়ে প্রথম থেকেই লাগতে হবে, বাবা তুমি একটু কড়া হও।”

প্রথম দিন বাসু ক্লাস ঘরের বাইরে দিলুর জন্য অপেক্ষা করে থেকেছিল, ওকে সঙ্গে নিয়ে বাসু ক্লাসে ঢোকে, দু’জনে পাশাপাশি বসে। দিলুকে ইতিমধ্যেই অনেক ছেলে চিনে ফেলেছে তার অবিশ্বাস্য ফিল্ডিং ক্ষমতার গল্প শুনে। সে যে একদিন নামকরা ক্রিকেটার হবে এমন একটা ধারণা স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে চাউর হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। ফলে সবারই নজর তার ওপর। এটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। শিক্ষকরা ক্লাসে তার প্রতি একটু বেশি মনোযোগী, কারণ দিলীপ হরিসাধনবাবুর ভাগ্নে, এটা তাকে বিপদে ফেলে দিয়েছে।

প্রতি সারই পড়াতে পড়াতে তার দিকে তাকিয়ে বলবেন, ”বুঝতে পেরেছ? না পারলে জিজ্ঞেস করো, বারবার করো যতক্ষণ না মাথায় ঢুকছে।” দিলু ঘাড় নেড়ে জানায় সে বুঝেছে। কিন্তু আসলে সে বিন্দুবিসর্গও বোঝেনি। আর সেটা বুঝতে পারে তার পাশে বসা বাসু। সে ফিসফিস করে দিলুকে বলে, ”ঘাড় নাড়লে যে কিছুই তো বোঝনি, সারকে জিজ্ঞেস করো।” জিজ্ঞেস করতে হলে বিষয়টি সম্পর্কে কিছুটা জানা থাকা চাই, তাও সে ভাল করে জানে না। কলকাতার স্কুলে তার এই ঝামেলা ছিল না। সাররা জানতেন তাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। শুধুই সময় নষ্ট, তাই কেউ তার দিকে দৃকপাতও করতেন না।

অন্ধকার ঘরে পঞ্চাননের পাশে রাত্রে চিত হয়ে শুয়ে সে ফিসফিস করে বলল, ”দাদু জেগে আছ?”

”আছি, কিছু বলবে?”

”হ্যাঁ। আমার খুব অসুবিধে হচ্ছে স্কুলে। সারেরা যা পড়ান আমি বুঝতে পারি না।”

”কেন পারো না সেটা কি ভেবে দেখেছ?”

”হ্যাঁ। পড়ায় আমি মন দিতে পারি না। সবসময় শুনি আমার মাথা নেই মাথা নেই, আমার দ্বারা লেখা পড়া হবে না, আমি মুখ্যু হয়ে থাকব। আচ্ছা দাদা, কী করলে পড়াশুনোয় ভাল হওয়া যায়, তুমি জানো?”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পঞ্চানন বললেন, ”জানি।”

”জানো?” দিলু পাশ ফিরে দাদুর মুখোমুখি হল।

”বল ধরে উইকেটে ছোড়ার সময় গোটা মাঠটা চোখের নজরে থাকে না, শুধু তিনটে স্টাম্প নজরে থাকে?”

”শুধু তিনটে স্টাম্প ছাড়া আর কিছু দেখি না। অন্য কিছু তখন দেখতে গেলে বলটা এধার—ওধার হয়ে যাবে।”

”অর্জুন পাখির চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখেননি, গল্পটা তো জানো।”

”জানি।”

”রোজ যেমন ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করো তেমন রোজ দু’বেলা পড়া নিয়ে বসবে আর বোলারের হাত থেকে বেরিয়ে আসা বলটা সারা মনপ্রাণ দিয়ে যেভাবে বুঝতে চেষ্টা করো ঠিক সেইভাবে পড়ায় মনপ্রাণ আটকে দেবে, বুঝতে চেষ্টা করবে পড়াটা, তা হলেই পারবে।”

”বলছ পারব?” বালিশ থেকে দিলুর মাথা উঠে গেল।

”নিশ্চয় পারবে। পড়াশুনো ব্যাপারটা একদমই শক্ত জিনিস নয়। বাসুকে দেখো না, যখন পড়ে কি লেখে তখন ওর কানের পাশে অ্যাটম বোমা ফাটলেও শুনতে পাবে না।”

”বাসু তো খেলে না, আমি কি খেলা বন্ধ করে দোব?”

”একদম নয়। বাসু একধরনের, তুমি আর—এক ধরনের। ওর মনের ডিসিপ্লিনটা তুমি লক্ষ করবে, ওটা তোমার খেলাতেও লাগবে। গল্প শুনেছি গাওস্করের এই ডিসিপ্লিনটা ছিল, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে গিয়ে শুধু বলটাকেই দেখত। এই দেখাটাকে রোজ অভ্যাস করতে হয়, তুমি কখনও তা করোনি।”

দিলু চুপ করে রইল। পঞ্চানন আর কথা বাড়ালেন না, তিনি চাইলেন দিলু ভাবুক। লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকাটা ওর আত্মসম্মান বোধকে আঘাত করেছে, এটাই ভাল লক্ষণ।

পঞ্চানন ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন সূর্য ওঠার, সূর্যকে প্রণাম করে দিনের কাজ শুরু করেন। সেদিনও অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে বারান্দায় এলেন। রেলিং ধরে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাতাস এই সময় স্তব্ধ থাকে। পাখিদের ডাক ছাড়া প্রকৃতিতে কোনও সাড় নেই। নিজের মধ্যে মগ্ন হওয়ার এটাই ঠিক সময়। পঞ্চানন মগ্ন হয়ে গেলেন।

”দাদু।”

পঞ্চানন চমকে তাকালেন প্রায়ান্ধকার বারান্দার অপর প্রান্তে। চেয়ারে দিলু বসে, পঞ্চানন কাছে এলেন, ”দাদু তুমি! এখনও তো ভোর হয়নি।”

”শুধুই পাখির চোখ দেখার জন্য অর্জুন কী করেছিলেন সেটাই খুঁজছি। গাওস্কর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে যায় কী করে সেটা আমায় জানতে হবে।”

”খোঁজে, জানো। এটা তোমাকে নিজে—নিজেই করতে হবে।” পঞ্চানন ঝুঁকে দিলুর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ”দাদু তুমি পারবে, তুমি আমার সেরা নাতি হবে।”

কয়েকদিন পর রবিবার সকালে মোটরবাইকে প্রতাপ এসে হাজির। দিলু তখন দোতলার বারান্দায় টেবলে বাসুর মুখোমুখি বসে ‘আধুনিক যুগ’ বিষয়ে ছোট ছোট দশটি প্রশ্নের উত্তর তৈরি করার জন্য ইতিহাসের বই পড়ে যাচ্ছে। বাসুকে লিখতে হচ্ছে রচনা। ক্লাসে বাংলার সার যেসব পয়েন্ট বলে দিয়েছেন খাতা থেকে সেগুলো দেখে সে ‘সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা’ সম্পর্কে লিখছে। পঞ্চানন একতলায় ছেলের বসার ঘরে তাকে খোঁজাখুজি করছেন বই। মোটরবাইকের শব্দ শুনে বেরিয়ে এলেন।

”মেসোমশাই দিলু আজ প্র্যাকটিসে যায়নি, কী ব্যাপার?”

”স্কুলে টাস্ক দিয়েছে তাই করছে।”

”ওকে একবার কলকাতা যেতে হবে সি এ বি—তে নামটা রেজেস্ট্রি করাতে, আমিই নিয়ে যাব।”

”কবে?”

”কাল কি পরশু।”

”প্রতাপ একটা কথা মনে রেখো, ওর বাবা—মা কিন্তু খেলার ঘোর বিরোধী। যদি জানতে পারে কলকাতার মাঠে খেলছে তা হলে আমাদের মুখ আর দর্শন করবে না মলু। আমি এই নিয়ে খুবই চিন্তার মধ্যে আছি।”

শুনে প্রতাপও চিন্তায় পড়ে গেল। সে বলল, ”তা হলে কি আপনি পিছিয়ে যাচ্ছেন? দিলুকে কি কলকাতায় খেলতে দেবেন না?”

”না, না, তা বলছি না। তবে এমন একটা কিছু ভাবো যাতে ওর বাড়ির লোকেরা যেন জানতে না পারে। পড়া নিয়ে এখন ও খুব খাটছে, মোটামুটি ধরে ফেলেছে। এখন ওর মানসিক উৎসাহটা চাই আর সেটা পাবে ওর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা থেকে।”

”তা হলে তো ওকে মাঠে যেতে হবে।”

পঞ্চানন শঙ্কিত স্বরে বললেন, ”হবে, কিন্তু লুকিয়ে। যদি দিলু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে, আমার ধারণা করবেই, তা হলে তো খবরের কাগজ ঝাঁপিয়ে পড়বে।”

”নিশ্চিত থাকুন মেসোমশাই, ময়দানে আমাদের খেলায় কোনও রিপোর্টার আসে না, সাধারণ পাবলিক তো আসেই না। প্লেয়ারদের আত্মীয় কি বন্ধুবান্ধব দু—চারজন হয়তো খেলা দেখে, আমরা তো মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গল নই। খবরের কাগজ দিলুর কথা জানবেই না।” প্রতাপকে নিশ্চিন্ত দেখাল।

পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”বলছ কী, খবরের কাগজে না বেরোলে দিলুর ট্যালেন্টের কথা দেশের লোক জানবে কী করে? ওটাই তো আসল ব্যাপার। দিলুকে তো বাংলার ক্রিকেট কর্তাদের চোখে পড়তে হবে, নইলে ও উঠবে কী করে?”

”এ তো মহা সমস্যায় পড়া গেল। কাগজে নাম বেরোনো চাই অথচ বাড়ির লোক জানবে না, তা কী করে হয় মেসোমশাই। বাড়ির লোকেরা মুখ্যু তো নয়, খবরের কাগজ পড়বেই, খেলা পছন্দ করে না বলে হয়তো খেলার পাতা পড়বে না কিন্তু পাড়ার লোকজন কি বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শুনে ফেলতে তো পারে।”

”তা তো পারেই, আর তা হলেই সর্বনাশটা হয়ে যাবে। তুমি এ বছরটা বাদ দাও প্রতাপ, পড়াশুনোয় একটু ভাল রেজাল্ট করলে ওর বাপ—মাকে তখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে নরম করতে পারব।”

প্রতাপ হতাশ হয়ে বলল, ”একটা বছর নষ্ট হবে। ভেবেছিলুম পনেরো বছরেই ওকে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলাব।”

”অত কম বয়সে এদেশে কেউ খেলেছে নাকি?” পঞ্চানন কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।

”বলেন কী? পাঞ্জাবের ধ্রুব পাণ্ডভ! কী ট্যালেন্টেড ব্যাটসম্যান যে ছিল। দিল্লি থেকে ট্যাক্সিতে পাটিয়ালায় বাড়ি ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল এই তো ক’বছর আগে বিরানব্বুই সালে। ছেলেটা তো পনেরো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই রঞ্জি ট্রফিতে সেঞ্চুরি করেছিল।”

”আমি তো জানতুম শচীন টেন্ডুলকর সবচেয়ে বাচ্চচা বয়সে রঞ্জি ট্রফিতে সেঞ্চুরি করে।”

”না মেসোমশাই, ধ্রুব পাণ্ডভ মারা না গেলে ওর কথাই মনে রাখতেন, শচীন সেঞ্চুরি করে সাড়ে পনেরো বছর বয়সে। পাণ্ডভের আর একটা রেকর্ড, সবচেয়ে কম বয়সে এক মরশুমে হাজার রান ও—ই করেছে আঠারো বছর তখনও পূর্ণ হয়নি। রেকর্ড ছিল শচীনেরই। লক্ষ করে দেখবেন যারা বড় হয় তারা মাথাচাড়া দেয় পনেরো ষোলো সতেরো বছর বয়সেই। দিলুর কিন্তু এক্সপোজারটা এখনই হওয়া দরকার। পুজোর পরই নেট পড়বে তখন নজর দিতে হবে ওর ব্যাটিংয়ে। অন্তত চল্লিশ—পঞ্চাশটা রান করার মতো না হলে শুধু ফিল্ডিং দিয়ে কতটা আর এগোবে।”

”তুমি কি এই সিজনেই দিলুকে মাঠে নামাতে চাও?”

”পারলে তাই নামাব, কিন্তু যে বাধার কথা বললেন তাতে তো হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। কী যে মুশকিল হল!” প্রতাপের গলা নেতিয়ে পড়ল।

”দেখি একটু ভেবে, তুমি বিকেল পর্যন্ত আছ তো, একবার ঘুরে যেও।”

প্রতাপ চলে যাওয়ার পর পঞ্চানন দোতলায় এলেন। দিলু টেবলে ঘাড় নিচু করে লিখে চলেছে, বাসুও লেখায় ব্যস্ত। ওরা মুখ তুলে তাকাল না। পঞ্চানন রেলিং ধরে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে ভেবে যাচ্ছেন দিলুর খেলার জন্য কী করতে পারেন।

”এভাবে দাঁড়িয়ে কী ভাবছ দাদু?”

দিলুর প্রশ্নে চমকে উঠে পঞ্চানন ফিরে তাকালেন। বই খাতা বন্ধ করে দিলু উঠে দাঁড়াল। বাসুও লেখা বন্ধ করল।

”হয়ে গেছে তোমাদের?”

বাসু ঘাড় নাড়ল। পঞ্চানন বললেন, ”বিকেলে খাতা দেখে দোব, এখন থাক।”

”মনে হচ্ছে আপনি খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন।” ভ্রূ কুঁচকে বাসু বলল।

”তা একটু পড়ে গেছি।” এই বলে পঞ্চানন প্রতাপের সঙ্গে তাঁর যা কথাবার্তা হয়েছে ওদের বললেন। শুনে দিলুর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। বাসু চুপ করে রইল।

একতলা থেকে হর্ষর গলা শোনা গেল ”অ দিলু—বাসু তোরা নাইতে যাবি না?” রবিবার দুপুরে বাসু এই বাড়িতে ভাত খায়। ওরা গামছা নিয়ে তেল মাখতে মাখতে পুকুরঘাটের দিকে যাচ্ছে, হঠাৎ বাসু দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ”দিলু একটা কাজ করলে হয় না, তোমার নামটা যদি বদলে দেওয়া যায়?”

অবাক হয়ে দিলু তাকিয়ে রইল, ”সে কী! নাম বদলাব?”

”হ্যাঁ বদলাবে। তা হলে কাগজে নাম বেরোলেও বাড়ির কেউ ধরতে পারবে না।”

”য্যাহহ, এভাবে কি খেলা যায়! খেলবে একজন আর নাম হবে আর একজনের।”

”নামটা শুধু বদলে নেওয়া, তাতে অসুবিধের কী আছে। কত লোকই তো ছদ্মনাম নেয়। এই তো যে অভিধানটা দাদুর ঘরে রয়েছে, চলন্তিকা, ওটা লিখেছেন রাজশেখর বসু, আবার উনিই গল্প লিখেছেন পরশুরাম নামে। দুটো নাম নেওয়া অনেক লোকই আছে তুমিও নয় থাকবে, তাতে অসুবিধে কী, বরং সুবিধের কথাটা ভাবো।”

বাসুর কথায় দিলু দ্বিধায় পড়ে গেল। মন থেকে বাসুর যুক্তি সে মানতে পারছে না, আবার খেলার সুযোগ তৈরি করার জন্য এই চালাকিটাও তার মন্দ লাগছে না। তাকে দোনামনার মধ্যে থাকতে দেখে বাসু বলল, ”আসল ব্যাপার তো ধরা না পড়ে খেলে যাওয়া, তুমি তো চুরি—ডাকাতি করার জন্য নাম বদলাচ্ছ না, বদলাচ্ছ একটা ভাল উদ্দেশ্যেই। যখন নাম হয়ে যাবে, দেখবে তোমার বাবা—মা কিছু বলবেন না। বরং গর্ব করে বললেন, দিলু আমাদের ছেলে, আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে।”

বাসুর কথা শুনতে শুনতে চকচক করে উঠল দিলুর চোখ। সে মনের চোখে নিজেকে দেখতে পেল ইডেনের মাঠ থেকে ক্লাব হাউসের ড্রেসিংরুমে ফিরছে, হাততালি দিতে দিতে পেছনে আসছে শচীন, সৌরভ, রাহুল। লোকে দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিচ্ছে, দিলু, দিলু নাম ধরে সারা স্টেডিয়াম থেকে চিৎকার ভেসে আসছে, ততদিনে লোকে অবশ্য জেনে গেছে তার আসল নামটা। নকল থেকে আসল নামে ফেরাটা কী আর এমন শক্ত ব্যাপার!

”দিলু, মানুষ বাঁচার জন্য অনেক সময় অন্য নাম নেয়, তোমার খেলাকে বাঁচাবার জন্য একটা কোনও নাম নিলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।” কথাটা বলেই বাসুর কী যেন মনে পড়ে গেল, বলল, ”জানো তো পাণ্ডবরাও অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাটরাজের বাড়িতে এক—একজন ছদ্মনাম নিয়ে থেকেছিলেন। ওরা নিতে পারলে তুমিই বা পারবে না কেন?”

”ঠিক আছে, নোব।” বলেই দিলু দু’হাত বাড়িয়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে হাত পাড়ি দিতে শুরু করল।

বিকেলে প্রতাপ এল। পঞ্চানন বারান্দা থেকে তাকে দোতলায় উঠে আসতে বললেন।

”ভেবে দেখলেন?” প্রতাপ দোতলায় উঠেই বলল।

”দেখেছি। তবে আমি নয়, বাসু।” পঞ্চানন হাসিমুখে বললেন। বাসু খেয়েদেয়ে দুপুরেই ছোট হুড়ায় ফিরে গেছে। ”ছেলেটার সত্যিই মাথা আছে।”

পঞ্চাননের মুখ দেখে প্রতাপ আশান্বিত হল। ”ব্যাপার কী বলুন তো! মনে হচ্ছে রাস্তা বের করে ফেলেছেন।”

”দিলুর নামটা বদলাতে হবে। কাগজে নাম বেরোলেও বাড়ির লোক ধরতে পারবে না। শুধু দেখতে হবে ছবি যেন না বেরোয়।”

প্রতাপ চোখ বুজে রইল কয়েক সেকেন্ড। চোখ খুলল বিশাল একটা হাসি মুখে মাখিয়ে। ”ছবি নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না মেসোমশাই। লোকাল ক্রিকেটের ছবি খবরের কাগজে কখনও বেরোয় না।”

.

উত্তরপল্লী সঙ্ঘ বরানগরের ক্লাব, সেখানে একটা ছোট মাঠে তাদের নেট প্র্যাকটিস হয়। দিলু প্র্যাকটিস করে দুধঘাট স্কুলের মাঠে। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পরই মাঠে নেমে পড়ে ফিল্ডিং ঝালিয়ে নিতে। তারপর নেটে ব্যাটিং।

”ও কী ও কী, ড্রাইভ করলে কিন্তু বলটা উঠে গেল কেন? শর্ট একস্ট্রা কভার তো বুকের কাছে ক্যাচটা পেয়ে যাবে। আগের বলটাতেও দেখলাম এই ব্যাপার হল, লং অফে পল্লব ক্যাচটা নিল। অল অ্যালং দ্য কার্পেট বল যাবে এমনভাবে ড্রাইভ করো। মারার সময় মুখ উঠে যাচ্ছে, বডি থেকে ব্যাট দূরে থাকছে। পিচের কাছে পা পৌঁছচ্ছে না বলে।”

দিলু মুখ নামিয়ে প্রতাপের কথাগুলো শুনল। ব্যাট হাতে ক্রিজে আবার স্টান্স নিয়ে বলল, ”ঠিক আছে।” মনে মনে স্মরণ করল প্রতাপদার কথাগুলো: মাথা নড়বে না, স্থির রাখবে, সামনের পা বলের পিচের কাছে নিয়ে যাবে, মাথা একটু নামাবে। এর পর যদি শট কভারে দিকে মারতে চাও তা হলে বাঁ কাঁধটা সেই মুখো করে শরীরের ভর সামনের পায়ে আনবে। ফলো থ্রুটা হবে সোজা যেদিকে বল মেরেছ।

বোলার বল করল শর্ট পিচ অফ স্টাপের এক হাত বাইরে। দিলু স্কোয়ার কাট করতে গিয়ে ফসকাল।

”কেন ফসকালে? এমন বলেই তো ব্যাটসম্যানের আহ্লাদ হয়। তুমি পা একদম না নড়িয়ে একই জায়গায় রেখে ব্যাটটা চালিয়েছে। এই দ্যাখো।” এই বলে প্রতাপ দিলুর হাত থেকে ব্যাটটা নিয়ে দেখাল সে কীভাবে ব্যাট চালিয়েছিল। তারপর দেখাল শটটা নেওয়ার সময় ডান পা কোথায় নিয়ে যাবে। ”টিভিতে দেখো টেন্ডুলকর কীভাবে মারে।”

দিলু আবার স্টান্স নিয়ে দাঁড়াল, এবারের বলটা মন দিয়ে লক্ষ করে বুঝল হাফভলি আসছে সোজা তার সামনে। ছয় মারবে কি? মুহূর্তে বিচার বদলে ফেলে সে প্রতাপদার কথামতো ড্রাইভ করল। ঘাসের ডগা ঘষড়ে বিদ্যুৎগতিতে বোলারের বাড়ানো ডান হাতের পাশ দিয়ে বল বেরিয়ে গেল। প্রতাপ হাততালি দিয়ে বলল, ”দ্যাটস ইট।”

আরও কয়েকটা ড্রাইভ করল দিলু, বল উঠল না জমি থেকে। প্রতাপ বলল, ”অনেক তো শট নিলে, ক্রিকেটে শট না নেওয়ারও খেলা দরকার পড়লে খেলতে হয়। এবার তুমি দশটা বল ডিফেন্স করো। এগিয়ে বা পিছিয়ে এমনভাবে বল থামাও যেন ব্যাট লেগে বল সেখানেই পড়ে গাছ থেকে খসে পড়া আপেলের মতো।”

প্রতাপ তিনটি ছেলেকে দিলুর দু’পাশে তিন মিটার দূরে দাঁড় করিয়ে দু’জন অফ স্পিনারকে বল করতে দিল। প্রথম বলটা অফ থেকে একটা ঘুরে এল যে, দিলু একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাট সামনে বাড়িয়ে দিল। ব্যাটে লেগে বল শর্ট লেগের হাতে গেল। সে ফ্যালফ্যাল চোখে প্রতাপের দিকে তাকিয়ে রইল।

”ফুটওয়ার্ক কোথায়? যেখানে পিচ পড়ল পা বাড়িয়ে সেখানেই তো বলটা ব্যাট দিয়ে থাবড়ে দিতে পারতে। আবার বলছি ফুটওয়ার্ক ছাড়া ব্যাট করা যায় না। এতকাল শুধু ছয় মেরে গেছ এটা ব্যাটিং নয়, এবার ব্যাট করাটা শেখো।”

দিলু দশটা বল খেলল তাতে দু’বার ব্যাটের কানায় লাগল, দু’ বার লাগল প্যাডে, একটা ফসকাল, বাকিগুলো ঠিকঠাক আটকাল। বাসু নেটের বাইরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল। দিলু যখন পরের ব্যাটসম্যানকে দেওয়ার জন্য প্যাড খুলছে বাসু ডাকল, ”দুলু।” দিলু তখন মুখ নামিয়ে একহাঁটু মুড়ে অন্য প্যাড খোলায় ব্যস্ত, বাসুর দিকে তাকাল না। বাসু এবার একটু জোরে ডাকল, ”অ্যাই দুলাল।” দিলু মুখ তুলে তাকিয়ে কপালে কুঁচকে বলল, ”আমাকে বলছ?” তারপর হো হো করে হেসে উঠল। ”তাই তো ভুলেই গেছলুম আমি দুলাল কর।”

ভবানীপুর মাঠে উত্তরপল্লীর প্রথম লিগ খেলা ইয়াং ফ্রেন্ডসের সঙ্গে। উত্তরপল্লীর ক্যাপ্টেন সনৎ দত্ত যে প্লেয়ার্স লিস্ট আম্পায়ারকে দিলে তাতে এগারো নম্বরে লেখা ডি কর। নতুন ছেলে, বয়স কম, কারও সঙ্গে কথা বলছে না, টেন্টের বাইরে একা চুপচাপ। শুধু প্রতাপ লাহিড়ি ওর সঙ্গে বার দুয়েক কথা বলে সনৎকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ”সনৎ একে একটু দেখিস, ময়দানে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামছে।”

সনৎ স্মিত হেসে দিলুর কাঁধ ধরে ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ”নার্ভাস লাগছে?”

দিলু মাথা নেড়ে বলল, ”না।”

”আগে কোন ক্লাবে খেলেছ?”

”বিজয়ী সঙ্ঘ।”

সনৎ চোখ কুঁচকে প্রতাপের দিকে তাকাল। প্রতাপ তাড়াতাড়ি বলল, ”মৌলালির অ্যালবার্ট স্কোয়্যারের ক্লাব, খুবই ছোট ক্লাব।”

সনতের খেলোয়াড়—জীবনে এটাই প্রথম ঘটনা তার দলের এগারোজনের সবাইকেই সে চেনে না। এগারো নম্বরের ডি কর ব্যাট করে না বল করে তাইই সে জানে না। গতরাতে সেক্রেটারি প্রতাপ লাহিড়ি বাড়িতে ফোন করে বলেছিল, ”সনৎ একটা নতুন ছেলেকে কাল খেলাব। স্কুলে পড়ে। দেখা যাক টিকতে পারে কি না, পারলে মনে হয় অনেকদূর যাবে, একটু গাইড করিস।”

নতুন ছেলে সম্পর্কে সনৎ তখন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। এরকম নতুন ছেলে প্রতিবছরই দু—তিনজন আসে, একটা দুটো ম্যাচ খেলিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়, এই ছেলেটাও হয়তো সেই রকম একটা দুটো ম্যাচের জন্য এসেছে। প্লেয়াস লিস্টে নামগুলো লিখে দিয়েছে প্রতাপ। ডি কর নামটা এগারো নম্বরে। দেখেই সনৎ ধরে নেয় বোলার।

”কী বল করো?” সনৎ জিজ্ঞেস করল। দিলু তাকাল প্রতাপের দিকে।

”দুলাল বোলার নয়।” প্রতাপ স্বর নামিয়ে বলল। সনৎকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে দেখে সে যোগ করল, ”সাত নম্বরে ব্যাট করবে।”

টস হল। জিতেছে ইয়াং ফ্রেন্ডস, তারা প্রথম ব্যাট করবে। মাঠে নামল সনতের সঙ্গে দশজন। ধর্মতলায় মাঠটা শহিদ মিনারের ধারেই বাসস্ট্যান্ডের লাগোয়া, আশেপাশে খাবারের দোকান, লোকজনের ভিড় লেগেই আছে। মাঠের আউটফিল্ডের বহু জায়গায় ঘাস নেই, যেখানে আছে ঘাস সেখানে বড় বড়। জমি অসমান, কাগজ, ফলের খোসা, ভাঁড়ের টুকরো, শালপাতা ইতস্তত ছড়িয়ে। দুধঘাটের মাঠ পলকের জন্য দিলুর চোখে ভেসে উঠল আর তখনই সনৎ তাকে আঙুল দিয়ে লং লেগের দিকটা দেখিয়ে বলল, ”ওখানে।”

যে ওপেন করল সে প্রথম তিনটি বল অফস্টাম্পের অনেকটা বাইরে দেখে ছেড়ে দিল। চতুর্থ বল মিড অফে ঠেলে দিয়ে একটা রান নিল। এবার বল পড়ল শর্ট পিচ, ব্যাটসম্যান সপাটে ঘুরিয়ে বাট চালাল। দিলু দেখল বল তার দিকেই আসছে। ফিল্ড করার সময় বলের জন্য সে অপেক্ষা করে না, তা করলে ব্যাটসম্যান রান নেওয়ার সময় পেয়ে যায়। তাই সে বলের দিকে ছুটে গিয়ে সময় কমিয়ে দেয়। এখনও সে তাই করল। বলটা ডান হাতে কুড়িয়েই ছুড়বে বলে সে নিচু হয়েছে আর তখনই অপ্রত্যাশিত জমির একটা উঁচু জায়গায় ঠোক্কর খেয়ে বলটা লাফিয়ে তার নাক আর কপালের মাঝে লাগল।

রক্ত ঝরছে তার নাক দিয়ে। রুমাল চেপে তাকে টেন্টে আনা হল। নাক ফুলে উঠেছে, সামান্য একটু কেটেছে। ”প্রথম ম্যাচে প্রথমবার বল ধরতে গিয়েই এমন অমুঙ্গুলে কাণ্ড!” প্রতাপকে বিচলিত দেখাল।

ডাক্তার খোঁজা হল, পাওয়া গেল না। ডেটল দিয়ে ধুয়ে প্লাস্টার লাগিয়ে দিলুকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হল। একজন বরফ আনতে ছুটল। এক ঘণ্টা খেলার পর জলপান বিরতি। ইয়ং ফ্রেন্ডসের তখন বিনা উইকেটে চুয়াত্তর রান। ওপেনার দু’জন মারার বল প্রচুর পেয়েছে। এতক্ষণ রুমালে মোড়া বরফের টুকরো দিলু নাকে চেপে ধরে বসে ছিল। এবার প্রতাপের কাছে গিয়ে সে বলল, ”আমি নামব, ঠিক হয়ে গেছি।”

”গুড, ভেরি গুড, এই তো চাই।” প্রতাপকে খুবই উৎসাহী দেখাল। ”যাও, নেমে পড়ো।”

দিলু ছুটতে ছুটতে মাঠে গিয়ে বলল, ”আমি ফিট। সনৎদা এবার আমায় কভারে ফিল্ড করতে দিন।”

সাবস্টিটিউট মাঠ ছেড়ে ফিরে গেল। দিলু আম্পায়ারকে জানাল সে আবার খেলতে নেমেছে। সনৎ তাকে কভারেই রাখল। শুরু হল খেলা। ব্যাটসম্যান প্রথম বলটাই ড্রাইভ করল একস্ট্রা কভারে, কলকাতার মাঠে দুটো রান তো নেওয়া যায়ই। দিলুর ডান দিকে দশ মিটার দূর দিয়ে বল যাবে, সে তাড়া করল। চাঁদোয়ার নীচে স্কোরারের পাশের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল প্রতাপ, অস্ফুটে সে স্কোরারকে বলল, ”এবার একটা রান আউট দেখ।”

বলটা ছোঁ মেরে তুলে একই সঙ্গে সে বোলারের উইকেটে ছুড়ল। ওরা দ্বিতীয় রানটা নিচ্ছিল। বোলারের প্রান্তে যাচ্ছিল যে, পপিং ক্রিজের দু’মিটার আগে সে হতাশ হয়ে দেখল উইকেট ভেঙে গেল, বেলদুটো ছিটকে পড়ল তিন—চার হাত দূরে। ফিল্ডাররা ছুটে গেল দিলুর দিকে। অচেনা নতুন বাচ্চচা ছেলে তাই সবাই পিঠ চাপড়াল, নয়তো ওকে জড়িয়ে ধরত। এক উইকেটে পঁচাত্তর রান। তিন নম্বর ব্যাটসম্যান গার্ড নেওয়ার পর আধমিনিট ফিল্ডারদের অবস্থান দেখে স্টান্স নিল।

প্রথম বলটা সে মিড অফে পুশ করে সাত—আট পা এগিয়ে গেল, দিলুকে বলের দিকে ছুটে যেতে দেখে থেমে গেল। ঘুরে ক্রিজে ফিরতে লাগল অলস ভাবে হেঁটে। তার ভাবখানা, একটা রান তো ছিলই, নন—স্ট্রাইকার কেন যে বেরোল না। এর পরই সে হতভম্ব হয়ে চোখের সামনে দেখল তার অফস্টাম্পকে ডিগবাজি খেতে। তাড়াতাড়ি সে ক্রিজের ওপারে ব্যাট রাখল। উইকেটকিপার আর দু’জন স্লিপ ফিল্ডার চিৎকার করে অ্যাপিল করতেই স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার আঙুল তুললেন। অবিশ্বাস্য রান আউট। ফিল্ডাররা ছুটে গিয়ে দিলুর কাঁধ ধরে ঝাঁকাল। একজন তো গলা জড়িয়ে ধরল। একজন বলল, ”মিরাকুলাস।”

ইয়াং ফ্রেন্ডসের দুই উইকেটে পঁচাত্তর। পরপর দু’বলে দুটো উইকেট পড়ে গেল এবং সে দুটো কোনও বোলার পায়নি।

এক নম্বর ব্যাটসম্যান এখনও ক্রিজে, এল চার নম্বর। সনৎ তাকে ঘিরে দিল তিনজন ফিল্ডার দিয়ে। দিলুকে আনল সিলি পয়েন্টে। ব্যাটসম্যান আড়চোখে তাকে দেখল, চোখে সন্দেহ আর ভয়, উঁচু করে দেওয়া অফস্পিন বল, ব্যাটসম্যান দু’পা বেরিয়ে পিচের কাছে পা বাড়িয়ে ঝুঁকে কপিবুক রক্ষণাত্মক খেলল। ব্যাটের কানায় লেগে বলটা ঘুরে গেল সিলি পয়েন্টে। ঝোঁকানো শরীর তোলার সময় নেই দেখে সে দ্রুত ডান পাটা জমিতে ঘষড়ে ক্রিজের দিকে ঠেলে দিল কিন্তু দাগের ওপারে পৌঁছল না এবং ততক্ষণে অফস্টাম্পে লাগা বল ছিটকে প্রথম স্লিপের পায়ের কাছে। সে—ই প্রথম ছুটে গিয়ে দিলুকে বুকে জড়িয়ে জমি থেকে এক ফুট তুলে ধরল।

”হ্যাটট্রিক হ্যাটট্রিক,” চাঁদোয়ার নীচে দু’হাত তুলে নাচছে প্রতাপ। ”ফিল্ডারের হ্যাটট্রিক শুনেছে কেউ কখনও, তিনটেই ডাইরেক্ট থ্রো থেকে, কারও সাহায্য ছাড়াই।” এর পর স্কোরারকে ধমকে বলল, ”হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে তিনটে রান আউটের পাশে লেখো ডাইরেক্ট থ্রো বাই ডি কর।”

ইয়াং ফ্রেন্ডসের রান তিন উইকেটে পঁচাত্তর। এর পর দু’জন ব্যাটসম্যানের কেউই আর রান নিতে ভরসা পেল না, যেদিকে দিলু রয়েছে। কভারে দিলুকে রেখে সনৎ বোলারদের নির্দেশ দিল অফস্টাম্পের বাইরের দিকে বল করতে। তারা সেইভাবেই বল করে যেতে লাগল। ব্যাটসম্যানরা যা মারে সবই মিড অফে বা কভারে যাচ্ছে। দিলুকে ছুটে যেতে দেখলেই তারা রান নিতে আর দৌড়য় না। শেষে বেপরোয়া হয়ে এক নম্বর ব্যাটসম্যান অফ স্টাম্পের বাইরের একটা ওভারপিচ বল ঘুরিয়ে মিড উইকেটে মারল, ব্যাটে ঠিকমতো বলটা না—লাগায় ক্যাচ উঠে গেল কভারে, দিলু সহজেই ধরে নিল। ইয়াং ফ্রেন্ডস চার উইকেটে আশি।

দশ রান যোগ হওয়ার পর আর একটি উইকেট পড়ল। বোল্ড। পরের ব্যাটসম্যান, দিলু—ভীতি কাটাবার জন্য তুলে ছয়—চার মেরে তিরিশটা রান করল এগারো বলে। শেষ পর্যন্ত সে স্টাম্পড হল। ছয় উইকেটে একশো কুড়ি। আট নম্বর ব্যাটসম্যান এসে দ্বিতীয় বলটা ঠেলল পয়েন্টে দিলুর পাশ দিয়ে, বল কুড়োতে সে ছুটল প্রায় পঁচিশ মিটার, ব্যাটসম্যান সেইদিকে তাকিয়ে, এর পরই সে আবিষ্কার করল নন—স্ট্রাইকার তার পাশে উত্তেজিত স্বরে বলছে, ”ছোট ছোট।” স্ট্রাইকার বলল, ”এখন আর ছুটে কী হবে।” দিলুর ছোড়া বল ধরে বোলার ততক্ষণে বেল ফেলে দিয়েছে। ”বলটা কে চেজ করছে আগে সেটা দেখবি তো।” বলতে বলতে সে মাঠ ছাড়ল।

সাত নম্বর ব্যাটসম্যান এখনও রয়ে গেছে এবং ইনিংসের শেষ পর্যন্ত নট—আউট রয়ে গেল ছত্রিশ বলে ছয় রান করে। শেষ তিন ব্যাটসম্যান একটি লেগবাই বাউন্ডারি সহ তোলে আট রান। এগারো নম্বরের ক্যাচ দিলু নেয় ব্যাকোয়ার্ড পয়েন্টে। ইয়াং ফ্রেন্ডস এক উইকেটে ছিল পঁচাত্তর রানে, সেখান থেকে অল আউট একশো তেত্রিশে, দিলু মাঠে ফিরে আসার পর দশটা উইকেট পড়ে আটান্ন রানে।

ছয় নম্বরে নামার জন্য দিলু প্যাড পরেছিল। উত্তরপল্লী চার উইকেটে একশো পঁয়ত্রিশ করায় তাকে আর মাঠে নামতে হয়নি। প্রতাপের মুখ থমথমে, উত্তেজনা চেপে রাখার চেষ্টায়। গতরাত থেকে সে সিঁটিয়ে ছিল, মনে মনে বলে গেছে ”ডোবাসনি দিলু ডোবাসনি।” সকাল সাতটার মধ্যে সে মোটরবাইকে দুধঘাটে পৌঁছে দেখে দিলু পুকুরে সাঁতার কাটছে। আশ্চর্য, ছেলেটার কোনও টেনশন নেই, এই সময়ে কি কেউ জলে ঝাঁপাঝাঁপি করতে পারে! আটটার সময় দাদুকে মামাকে মামিকে প্রণাম করে সে প্রতাপের পেছনে বাইকে চড়ে বসে। দু’জনের মধ্যে সারা পথে একটাও কথা হয়নি।

প্রতাপকে জনে জনে জিজ্ঞেস করল, ”ছেলেটিকে পেলে কোথায়?”

”গ্রাম থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি।” সে নিস্পৃহ স্বরে জবাব দেয়।

”নাম দেখছি ডি কর, ডি—টা?”

”ডি হল দুলাল।”

”গ্রামের নামটি কী?”

”ছোট হুড়া, ওখানে একটা স্কুলে আমি কোচ করি, দুলু সেই স্কুলে পড়ে।” প্রতাপ হুঁশিয়ার হয়ে বলল। দুধঘাট নামটা যেন চাউর না হয়ে যায়। কোনওভাবে যদি মৌলালির বাড়িতে কথাটা পৌঁছয়, ডি কর নামের একটা ছেলে দুধঘাটে থাকে সে ময়দানে তার প্রথম ম্যাচেই ফিল্ডিং—এ তাক লাগিয়ে দিয়েছে, তা হলে সন্দেহ আর কৌতূহল জাগবেই, ডি কর দিলু নয় তো? প্রতাপ তাই গ্রামের নামটা বদলে দিল।

ভবানীপুর মাঠের লাগোয়াই ক্রীড়া সাংবাদিকদের ক্লাবের তাঁবু। সব কাগজের লোক সেখানে বিকেলে জড়ো হয়। ময়দানে ছড়ানো মাঠগুলোয় যত খেলা হয়েছে তার স্কোরবুক নিয়ে ক্লাবের লোকেরা তাঁবুতে এসে সাংবাদিকদের জানায়। অবশ্য জনপ্রিয় বড় ক্লাবের লোকেরা আসে না, সাংবাদিকরাই তাদের ক্লাবে যায় রেজাল্ট নিতে। উত্তরপল্লীর স্কোরার ছেলেটি খাতা নিয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকদের তাঁবুতে গেল। সে মুখচোরা, বুদ্ধিটাও কম। সে স্কোরবুকটা খুলে কথায় ব্যস্ত এক সাংবাদিকের সামনে এগিয়ে ধরল।

”দেখার সময় নেই, সেঞ্চুরি হয়েছে কি না বলো।”

”না।”

”হ্যাটট্রিক হয়েছে?”

”না।”

”ঠিক আছে, রেজাল্টটা বলো।”

”ইয়াং ফ্রেন্ডস একশো তেত্রিশ, উত্তরপল্লী সঙ্ঘ চার উইকেটে একশো পঁয়ত্রিশ তুলে ছ’ ছইকেটে জিতেছে।”

”আর কিছু হয়েছে?”

”উত্তরপল্লীর একটা ছেলে দারুণ ফিল্ড করেছে। দুটো ক্যাচ চারটে রান আউট—”

”ঠিক আছে। মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গলে খেলুক তখন রান আউট ক্যাচট্যাচ লেখা যাবে।”

স্কোরবুক বগলে নিয়ে ছেলেটি তাঁবু থেকে বেরোচ্ছে তখন একজন তাকে পেছন থেকে ডাকল, ”শুনুন।”

সে ফিরে তাকিয়ে দেখল শীর্ণ, চশমাপরা একটি অল্পবয়সী ছেলে, পায়ে চটি, তার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে চলল, ”তখন কী যেন কানুদাকে বলছিলেন—চারটে রান আউট দুটো ক্যাচ, একজনই কি করেছে?”

”তবে না তো বললুম কেন?”

”দেখি স্কোরবইটা?” এই বলে সে স্কোরবইটা বগল থেকে টেনে নিয়ে পাতা ওলটাল, স্কোর দেখতে দেখতে কপালে ভাঁজ তুলে বলল, ”এটা কী লেখা, কীসের হ্যাটট্রিক?”

”রান আউটের। পরপর তিন বলে তিনজনকে ডাইরেক্ট থ্রোয়ে উইকেট মেরে আউট করেছে, এমন ঘটনার কথা শুনেছেন কখনও?”

সেই নবীন সাংবাদিক এধার—ওধার তাকিয়ে স্কোরারকে তাঁবুর গেটের বাইরে টেনে আনল। স্কোরবই থেকে দরকারি তথ্য নোটবইয়ে টুকে নিয়ে ডি কর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করল।

”আপনার কোন কাগজ?”

”প্রভাতী, নিশ্চয় নাম শোনেননি, যাদবপুর থেকে নতুন বেরিয়েছে। আচ্ছা ছোট হুড়াটা কোথায় বলুন তো?”

”জানি না। বারুইপুর কি শ্রীরামপুরের দিকে হবে।”

”আচ্ছা এই দুলাল আগে কোন ক্লাবে খেলেছে?”

”জানি না।”

ধর্মতলায় মোটরবাইক থেকে নেমে প্রতাপ ওষুধের দোকান থেকে কয়েকটা ক্যাপসুল কিনল। দিলুর হাতে দিয়ে বলল, ”এখনই একটা খেয়ে নাও, রাতে একটা খেও। আর কাল সারাদিনে তিনটে খাবে, ব্যথা কমে যাবে।”

প্রতাপ একটা সফট ড্রিঙ্কসের বোতল কিনে দিলুর হাতে দিয়ে বলল, ”এখানকার জল খুব খারাপ, এই দিয়ে ক্যাপসুলটা গিলে খাও।”

সন্ধ্যা উতরে গেল দুধঘাটে ওদের পৌঁছতে। বাড়ির সবাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সুলেখারই চোখ প্রথম পড়ল দিলুর নাকে।

”কী হল নাকে? বেশ ফুলে রয়েছে দেখছি।”

”কিছু না, একটা বল লেগেছে।” দিলু তাচ্ছিল্যভরে বলল। ”এখন ঠিক হয়ে গেছে। ওষুধ খেয়ে নিয়েছি।”

”প্রতাপ হল কী? খেলল কেমন?” হরিসাধন উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইলেন।

মুখে গাম্ভীর্য আর স্বরে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে প্রতাপ বলল, ”চারটে রান আউট দুটো ক্যাচ, ভাবা যায়। আপনার ভাগ্নে যে কী জিনিস লোকে এইবার জানবে। ফিল্ডিং কাকে বলে আজ তা দেখাল। কত সহজে পটাপট উইকেটে মারল, ক্লাবের ছেলেরা তো থ বনে গেছে। মেসোমশাই আমি বলেছিলুম না আউট অব দিস ওয়ার্ল্ড, ওর ফিল্ডিং পৃথিবীর বাইরের ব্যাপার। ভাল মাঠ পেলে দিলু আজ দেখিয়ে দিত ফিল্ডিং কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়, ছ’জন আউট ওর হাতে। একটা বোলার ছ’টা উইকেট পেলে তাকে নিয়ে নাচানাচি শুরু হয়ে যাবে। দিলু শুধু ফিল্ডিংয়ের জোরেই দেখবেন কত ওপরে ওঠে।”

হরিসাধন ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”ওর সামনে এত প্রশংসা কোরো না প্রতাপ, মাথা ঘুরে যাবে।”

পঞ্চানন বললেন, ”ঠিক কথা। তবে প্রশংসা অনেক সময় উৎসাহ বাড়িয়ে উজ্জীবিত করে তোলে, এটাও মনে রেখো। দাদু তা হলে তুমি আজ খেল দেখিয়েছ, কত লোক দেখল?”

প্রতাপ মিয়োনো স্বরে বলল, ”জনা পঞ্চাশেক হবে। বাইশটা প্লেয়ার, তিন—চারজন রিজার্ভ, দুটো করে স্কোরার আর আম্পায়ার, মালীটালি, ঝালমুড়ি, চা—ওলা আর ক্লাব অফিশিয়াল। তবে সবাই খেলা দেখছিল না।”

”খবরের কাগজের লোক?” পঞ্চানন জানতে চাইলেন।

”একজনও না, এসব ম্যাচে ওঁরা আসেন না সেটা একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে।” প্রতাপ হেসে পঞ্চাননের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। ”মৌলালি অন্ধকারে থাকবে।”

মৌলালি অন্ধকারে থাকলেও বাংলার জুনিয়ার নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান আশিস ঘোষ তার যাদবপুরের বাড়িতে সকালে চা খেতে খেতে টেবল থেকে নতুন বেরোনো কাগজ ‘প্রভাতী’ তুলে নিয়ে প্রথমেই খেলার পাতা খুলে চোখ বোলাতে বোলাতে ঝুঁকে পড়ল একটা মোটা হেডিং দেখে: ”সি এ বি লিগে রান আউটের হ্যাটট্রিক।” তার নীচে পাতলা হেডিং : ”গ্রামের ছেলের অবিশ্বাস্য ফিল্ডিংয়ে ছয়জন আউট।” আশিস দ্রুত খবরটা পড়ে নিয়ে টেলিফোন নম্বরের ছোট নোটবইটা থেকে একটা নম্বর বের করে ডায়াল করল।

”কে প্রতাপ?…আমি আশিস বলছি, আজ কাগজে একটা খবর…কাগজটার নাম প্রভাতী, আমাদের এখান থেকে নতুন বেরিয়েছে…না অন্য কোনও বড় কাগজে তো চোখে পড়ল না দুলাল কর যা করেছে সে তো ফ্যান্টাস্টিক। বয়স কত?…পনেরো? ছেলেটাকে দেখতে হবে তো, তোদের পরের খেলা কবে, কার সঙ্গে? …শনিবার, ক্যালকাটা ইউনাটটেডের সঙ্গে ওদের মাঠে? দেখতে যাব।”

.

ইউনাইটেড মাঠ ভবানীপুর মাঠের তুলনায় অনেক ভাল। ফুটবল মরশুম ছাড়া বছরের বাকি সময় এই মাঠের ওপর দিয়ে লোক চলাচল না—করায় ঘাস সমানভাবে চারিয়ে রয়েছে, মাঠের জমিও সর্বত্র সমতল। তাঁবুর ফেন্সিংয়ের বাইরে লোহার চেয়ারে বসে প্রতাপ, আশিস ঘোষের অপেক্ষায়। ব্যাট করছে ইউনাইটেড। প্রথম তিনটি উইকেট পড়ল আট রানে, তিনজনই রান আউট এবং দিলুর ছোড়া বলে। একস্ট্রা কভার আর ডিপ পয়েন্টের মাঝামাঝি জায়গায় সে ফিল্ড করছে। ডান দিকে ও বাঁ দিকে প্রায় চল্লিশ মিটার জায়গা জুড়ে তার রাজত্ব বিস্তৃত।

তিনজনই দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময় আউট হয় এবং বোলার প্রান্তে, আউট হওয়ার ধরন আগের ম্যাচের মতোই। ইউনাইটেড ব্যাটসম্যানরা একটাই ভুল করেছে, তারা দিলুকে বুঝে নিতে একটু দেরি করে ফেলেছে, যখন বুঝল অফের দিকে একটা বিপজ্জনক ফাঁদ তাদের বধ করার জন্য পাতা রয়েছে ততক্ষণে তিনজন ফাঁদে ধরা পড়ে গেছে।

প্রভাতীর সেই সাংবাদিকটি, যার নাম অলোকেন্দু, স্কোরারদের টেবলের পাশে একটা চেয়ার টেনে এনে বসে গেছে। সে খুবই খুশি, এখন পর্যন্ত অন্য কোনও কাগজের লোক মাঠে হাজির নেই। সম্পাদক উত্তরপল্লীর আগের ম্যাচের লেখাটার প্রশংসা করে তাকে বলেছেন, ”অন্য কোনও কাগজে তো খবরটা নেই, তুমি ছেলেটার সব খেলা কভার করবে। ভেরি পিকিউলার, শুধু ফিল্ডিংয়েই ছ’—ছ’টা উইকেট নিচ্ছে একজন। ম্যাচটা অবশ্য তুচ্ছ, ব্যাটসম্যানরাও নির্বোধ, কিন্তু ওর ডাইরেক্ট থ্রোগুলো তো সত্যি।”

চোখের সামনে তিনটে থ্রো সোজা উইকেটে লাগল। আরও পাঁচটা মেরেছে কিন্তু তাতে কেউ রান আউট হয়নি। অলোকেন্দু প্রতিটি থ্রোয়ের হিসেব রেখেছে—আট থ্রো, তিন আউট। সে তাঁবুর পাশের রাস্তা দিয়ে একটি লোককে হেঁটে যেতে দেখে মনে মনে আঁতকে উঠল, সর্বনাশ সত্যসন্ধি কাগজের শতদলদা, এখানে এসে পড়বে না তো। শতদল মাঠের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অলোকেন্দুকে দেখে এগিয়ে এল।

”অলোকেন্দু এখানে কী করছ, মোহনবাগান মাঠে যাবে না? এখানে কারা খেলছে?”

অলোকেন্দু মনে মনে বলল, হে ভগবান এখন বল যেন দুলালের কাছে না যায়, ছুড়লেই তো উইকেটে মারবে। তাইতে শতদলদার যদি কৌতূহল জেগে ওঠে, আর এখানেই যদি বসে পড়ে।

”খেলছে উত্তরপল্লী আর ক্যালকাটা ইউনাইটেড। একটুখানি দেখেই মোহনবাগান মাঠে যাব, খেলা তো ইস্টার্নের সঙ্গে।”

”হ্যাঁ, এসো। আমি এগোলাম।”

অলোকেন্দু হাঁফ ছাড়ামাত্র দিলু লংঅফে উঁচু করে ওঠা বলে ক্যাচ ধরল প্রায় তিরিশ গজ ছুটে, গোলকিপারের মতো ঝাঁপিয়ে জমি থেকে চার আঙুল ওপরে। অ্যাপিলের চিৎকারে শতদল থমকে একবার মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আবার হাঁটতে লাগল। অলোকেন্দু নোটবইয়ে হিসেব লিখল। হাত কাঁপছে। মনে মনে বলল, ভগবান আজ যেন সাতটা হয়, তা হলে চুটিয়ে লিখব। এক ইনিংসের ম্যাচে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বললে কি ভুল হবে? উইকেটকিপারের অনেক শিকার আছে এক ইনিংসে, কিন্তু ফিল্ডসম্যানের ক’টা আছে? দুলাল কর যদি আজ দশটা শিকার করে ফেলে। কেউ নেই, একজনও রিপোর্টার নেই, স্কুপ হয়ে যাবে।

অলোকেন্দু স্কুপ করল বটে তবে দিলুর শিকার—সংখ্যা ভগবান দশটার বদলে করে দিলেন আট। পাঁচ রান আউট, তিন ক্যাচ। মোট তেরোবার স্ট্যাম্পে বল লাগিয়েছে। ক্যালকাটা ইউনাইটেড পঁয়ষট্টি অল আউট। ফিল্ডাররা মাঠ থেকে ফিরছে। প্রতাপও চেয়ার ছেড়ে তাদের সঙ্গে তাঁবুতে ঢুকতে গিয়ে দেখল আশিস ঘোষ দাঁড়িয়ে। প্রতাপ বলল, ”এ কী এখানে দাঁড়িয়ে, কতক্ষণ এসেছিস? বাইরে বসলি না কেন?”

”ভাল করে দেখতে হলে লোকজন থেকে একটু তফাত হয়ে দেখতে হয়।”

”কেমন দেখলি?”

”প্রতাপ, এ ছেলেটা তো ভগবান রে!” আশিস দু’হাত বাড়িয়ে প্রতাপের হাত ধরল।” একাই তো শেষ করে দিল ইউনাইটেডকে। আমি ওর সবকটা রান আউট আর ক্যাচ এখানে দাঁড়িয়ে দেখেছি। যেখান—সেখান থেকে বল তুলে উইকেটে মারে, একটাও মিস করল না, এটা তো জন্মগত ক্ষমতা। না হলে হাজার প্র্যাকটিস করেও এ—জিনিস আয়ত্ত করা যায় না। ওকে চোখে চোখে রাখিস।”

”আমাকে আর রাখতে হবে না, ও যেখানে থাকে সেখানে চোখে রাখার ঠিক লোক আছে। আশিস, এই ছেলেটাকে অপেক্ষা করিয়ে পচিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। ওকে নিজের চোখে তো দেখলি, এবার ঠেলে তুলে দে।”

”আর একটা ম্যাচ খেলুক, ব্যাটটা কেমন করে দেখি, তারপর আন্ডার সিক্সটিনে ওকে ঢোকাবার জন্য মিটিংয়ে নাম তুলব।”

পঁয়ষট্টি রান টপকাতে উত্তরপল্লীর দুটো উইকেট খরচ হল। দিলু এই ম্যাচেও ব্যাট করার সুযোগ পেল না। খেলা আড়াইটের মধ্যেই শেষ।

অলোকেন্দু তখন ফোটোগ্রাফারের জন্য মাথার চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থায়। দুলালের একটা ছবি তার চাই। কত ফোটোগ্রাফারই তো কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়ায় খবরের কাগজে ছবি বিক্রি করবে বলে। আর আজই কারও পাত্তা নেই। দৌড়ে মোহনবাগান মাঠে গিয়ে খোঁজ করে দেখবে ভেবে সে প্রতাপের কাছে গিয়ে বলল, ”দুলাল এখন দশ—পনেরো মিনিট থাকবে তো, আমি দৌড়ে একজন ফোটোগ্রাফার ধরে আনছি।”

”কীজন্য?” প্রতাপ মনে মনে সিঁটিয়ে প্রশ্ন করল।

অলোকেন্দু অবাক হয়ে বলল, ”কেন ছবি তোলার জন্য। কাল প্রভাতীতে বেরোবে। দুটো ম্যাচে চোদ্দো, ভাবতে পারেন! ওর ছবি বেরোবে না তো কার বেরোবে, প্লিজ দশ মিনিট একে থাকতে বলুন।” বলেই সে ছুটতে শুরু করল মোহনবাগান মাঠের উদ্দেশ্যে।

”দিলু, বিপদ ঘনিয়ে আসছে, কাগজে ছবি বেরোবার ব্যবস্থা হচ্ছে।” দিলুর কানে ফিসফিস করে প্রতাপ বলল, ”এখুনি কেটে পড়তে হবে।”

পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রতাপের মোটরবাইক ছুটল দুধঘাটের দিকে। যখন পৌঁছল তখনও বিকেল। ওরা যখন বাড়ির কাছাকাছি, দেখল রাস্তার ধারে একটা ইটের চাঙড়ের ওপর হর্ষ বসে। মোটবাইক দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ”থামো, থামো, এখন আর বাড়িতে যেও না। উফফ কখন থেকে তোমাদের জন্য বসে আছি। দুপুরে মলুদি এসেছে।”

”মা!” দিলুর মুখ শুকিয়ে গেল।

”দিলুর মা? সর্বনাশ করেছে। কী বলা হয়েছে ওঁকে?” প্রতাপ প্রমাদ গনল।

”বউদি বুদ্ধি করে বলেছে, ছোট হুড়োয় এক বন্ধুর বাড়িতে দিলুদাদা ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে গেছে, সন্ধের আগেই এসে যাবে। তোমাদের আগাম জানিয়ে দেওয়ার জন্য মেসোমশাই আমাকে বললেন হষ্য রাস্তায় নিমতলায় গিয়ে বসে থাক। ওদের আসতে দেখলেই কী বলতে হবে শিখিয়ে দিবি। আর বলবি, খুব ভাল হয় যদি দিলু মাছ হাতে বাড়ি ফেরে।”

”মা—আ—ছ! এখন কি বাজার বসেছে? আচ্ছা আমি বাইগাছি বাজারটা দেখে আসছি নয়তো বারাসাতে চলে যাব, আমার চেনা এক মাছওলা আছে।” প্রতাপ আর কথা বাড়াল না। বাইক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটাল।

”দিলুদাদা তুমি এখন আর বাড়ি যেও না, একেবারে মাছ হাতে বাড়ি ঢুকবে, এখানে বসে থাকো।”

প্রতাপ বাইগাছি গিয়ে দেখল বাজার সুনসান। দেরি না করে মোটরবাইক ঘুরিয়ে ছুটল বারাসাত। সেখানেও মাছের বাজারে লোক নেই, এই সময় থাকার কথাও নয়। কাছেই তিনকড়ির বাড়ি, ছোটবেলার বন্ধু, বাজারে মাছের বড় কারবারি। প্রতাপ হাজির হল তার বাড়িতে।

”তিনু বড় বিপদে পড়ে গেছি, এখুনি একটা মাছ চাই, কিলো দুইয়ের মধ্যে হলেই হবে।”

”মাছ আসবে সন্ধেবেলায় হাওড়ার বাজার থেকে। ঘণ্টাখানেক বোস।” তিনকড়ি নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিয়ে বলল।

”পারব না রে, এক ঘণ্টা বসতে পারব না। সকালের কোনও মাছ পড়েটড়ে নেই।”

”কাটা রুই আছে, সাতশো গ্রামের মতো, চলবে? তা হলে দিতে পারি।”

”চলবে চলবে, মুড়োটা আছে তো?”

”আছে, ল্যাজাটাও আছে। গাদা আর পেটি বিক্রি হয়ে গেছে।”

তিনকড়ি বাড়ি থেকে বাজারে এল। প্রতাপ ছোট একটা থলি কিনে নিল। কঠোর বাক্সে বরফ চাপা দেওয়া পলিথিনে মোড়া মাছ বের করে তিনকড়ি প্রতাপের থলিতে ঢুকিয়ে দিল।

”কত দাম বল।”

”দিতে হবে না। আমার ছেলেটাকে বরং দুধঘাট ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিস। তোর তো চেনা আছে হেডমাস্টারের সঙ্গে।”

”আছে, ভর্তি করিয়ে দোব।”

প্রতাপ প্রায় ছুটে গিয়ে বাইকে চড়ে বসল। আধঘণ্টা কাবার হয়ে গেছে। দিলুর মা যদি এখনও থাকেন তা হলে ভালই নিজের চোখে দেখে যাবেন ছেলে সত্যি মাছ ধরতে গেছল আর ধরেও ছিল একটা কিলো দুয়েকের রুই। অত বড় মাছ খাবার লোক বাড়িতে নেই, তাই সে আধখানা বন্ধুর বাড়িতে দিয়ে এসেছে। প্রতাপ মনে মনে একটা গল্প বানিয়ে ফেলল। তার মনে হল মোটামুটি এটা বিশ্বাসযোগ্যই হবে। তবে একটা মুশকিল, মাছের টুকরোগুলো বরফে ঠান্ডা হয়ে রয়েছে। দিলুর মা কি মাছে হাত দেবেন? প্রতাপের মনে খচখচানি ধরল।

নিমগাছতলায় ওরা দু’জন বসে অপেক্ষা করছে। হর্ষ হাত বাড়িয়ে আগে থলিটা নিয়ে ফাঁক করে দেখল।

”গোটা মাছ পেলুম না। কাটা ছিল তাই নিয়ে এলুম। একটা দু’ কিলোর রুই দিলু ধরেছিল, তার আধখানা বন্ধুর বাড়িতে দিয়ে এসেছে, ওদের ছিপ ওদের পুকুর, দিলু তো দিতেই পারে, পারে না?” প্রতাপ তার গল্পটা অনুমোদন পেতে দেখল হর্ষর মুখভাবে।

”খুব ভাল বলেছেন। আমি তাই বলব।”

ওরা বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। প্রতাপ ব্যস্ত হয়ে ডাকল, ”এই যে এই যে, মাছটা কিন্তু ঠাণ্ডা, বরফে ছিল সকাল থেকে।”

”সে আমি ঠিক করে নোব। দূর থেকে মলুদিকে দেখাব এমনভাবে যে, আর হাতই ছোঁয়াবে না।”

প্রতাপ বাইকে চড়ে ফেরার সময় গেট দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখল একটা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে। সে আশ্বস্ত হল, দিলুর মা এখনও ফিরে যাননি।

বাড়িতে ঢুকেই হর্ষ চেঁচিয়ে বলল, ”ও মলুদি, ও বউদি দেখে যাও দিলুদাদা কতবড় একটা মাছ ধরেছে।”

ওরা দোতলায় ছিল। হর্ষর বাড়ি—মাথায়—করা চিৎকারে তাড়াতাড়ি নেমে এল। ততক্ষণে একটা গামলায় মাছের টুকরোগুলো হর্ষ ঢেলে ফেলেছে।

”দ্যাখো গো মলুদি, তোমার ছেলের কিত্তি। কতবড় মাছ ধরে আবার আধখানা ওদের দিয়েও এসেছে।”

পঞ্চানন বললেন, ”এইরকমই তো হওয়া উচিত। আর হবে নাই বা কেন, মলুর ছেলে তো! দেওয়াথোওয়ার হাত তো দিলু মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে।” আড়চোখে তিনি দেখলেন মলুর চোখ পুলকে জ্বলজ্বল করছে।

হর্ষ ব্যস্ত হয়ে বলল, ”বউদি, আমি চট করে দুটো মাছ মলুদিকে ভেজে দি।” বলেই সে মাছের গামলা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

মলু যথাসাধ্য উদ্বিগ্ন হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ”জেঠু পুকুরের ধারে বসে মাছধরাটা কিন্তু বিপজ্জনক, দিলু সাঁতার জানে না।”

”ঠিক কথা, এটা তো আমার মনে ছিল না। আচ্ছা মলু, ওকে সাঁতারটা শিখিয়ে দিলে কেমন হয়?” পঞ্চানন গম্ভীর মুখে বললেন।

”দাও, তবে যাকে—তাকে দিয়ে শেখাতে যেও না। ডুবে গেলে বাঁচাতে পারবে এমন কাউকে দিয়ে শিখিয়ো।”

মাছভাজা খেয়ে মলু চলে যাওয়ার পর পঞ্চানন জিজ্ঞেস করলেন দিলুকে, ”দাদু আজ ক’টা হল?”

”আটটা।”

”আজ খুব বাঁচান বেঁচে গেছ, তবে বারবার মাছধরার গল্প কিন্তু টিকবে না। পরের ম্যাচ কার সঙ্গে?”

”ব্রাদার্স ইউনিয়নের সঙ্গে, ওদের মাঠেই খেলা।”

”কলকাতা আমার পক্ষে দূরে হয়ে যায়, এই বেতো হাঁটু নিয়ে অত হাঁটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, খুব ইচ্ছে করে একবার তোমার খেলা দেখতে।”

”দাদু, শেষ কবে ময়দানে খেলা দেখেছ?”

”চুয়াত্তরের ডিসেম্বরে। পটৌডি ক্যাপ্টেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইডেনে হারল। ওহ ফোর্থ ডে—র সকালেই চন্দ্রশেখর বোল্ড করল লয়েডকে এখনও চোখে ভাসে, তারপর স্লিপে কালীচরণের ক্যাচ নিল বিশ্বনাথ, চন্দ্ররই বলে। ওখানেই শেষ হয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দু’ চোখ ভরে দেখেছি বিশ্বনাথের ব্যাটিং। প্রায় ছ’ঘণ্টা ব্যাট করে একশো ঊনচল্লিশ রান করেছিল, গিবস আর অ্যান্ডি রবার্টস ছিল বোলার। অমন ব্যাটিং আর দেখা যাবে কি না জানি না। এখন তো যে সেঞ্চুরি করে তাকেই আর্টিস্ট বলা হয়, বিশ্বনাথের ওই খেলা দেখলে আর বলত না।” পঞ্চানন মাথা নাড়তে লাগলেন, দিলু বুঝতে পারল না দাদুর এই আক্ষেপটা বিশ্বনাথের মতো ব্যাটিং আর দেখা যাবে না বলে নাকি সবাই আর্টিস্ট হয়ে যাচ্ছে বলে!

পরের দিন স্কুল ছুটির পর দিলু নেটে ব্যাট করছিল। একটা বল জোরে ড্রাইভ করতেই ব্যাটের কানা ভেঙে একটুকরো কাঠ উড়ে গেল। দিলু অপ্রতিভ হয়ে নেট থেকে বেরিয়ে এল। আর একটা ব্যাট আছে কিন্তু সে আর নেটে ঢুকল না। মাঠের মাঝে কয়েকজনের সঙ্গে ক্যাচিং প্র্যাকটিস শুরু করল। একটু পরেই এল প্রতাপ।

”দিলু, কাল কেউ রান আউট হয়নি তো?”

”হর্ষ মাসি আর দাদুর রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে এত ভাল বোঝাপড়া, যে, মা কোনও চান্সই পায়নি স্ট্যাম্পে হিট করার।”

”আশিস ঘোষ দুপুরে ফোন করেছিল, এই নভেম্বরে আন্ডার সিক্সটিন বিজয় মার্চেন্ট ট্রফির খেলা। বেঙ্গল টিমের জন্য প্রবাবেলদের নিয়ে একটা ট্রায়াল ম্যাচ খেলতে চায়। তোমার নাম করল, ট্রায়ালে তোমাকে আর একটু দেখে নিতে চাইছে। আমি ভাবছি রবিবার দুধঘাটে খেলাটা করার জন্য বললে কেমন হয়; তোমার মামার সঙ্গে আজই কথা বলব, ওর পারমিশন ছাড়া তো খেলা সম্ভব নয়, সন্ধ্যায় উনি বাড়ি থাকেন কি?”

”মামা তো এখনও স্কুলেই রয়েছেন, ওঁর ঘরে গিয়ে দেখা করুন না।” প্রতাপ ব্যস্ত হয়ে রওনা হল হেডমাস্টারের ঘরের দিকে, মিনিট কুড়ি পরে টগবগিয়ে ফিরে এল হাসিমুখে। দিলু ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, ”মামা কী বললেন?”

”এক কথায় রাজি। তাই নয় লাঞ্চ, টি সবই স্কুল দেবে, এমনকী বাইগাছি স্টেশন থেকে এখানে আসার জন্য ভ্যান রিকশার ব্যবস্থাও করবেন বললেন। ওঁর ঘর থেকেই ফোন করলাম আশিসের বাড়িতে, পেলাম না; রাত্রে আর একবার করব, না পেলে কাল সি এ বি—তে যাব।” প্রতাপ অস্থিরভাবে দু’হাত কচলাল।

রাতে সে আশিস ঘোষকে ফোন করে পেয়ে গিয়ে বলল, ”ট্রায়াল ম্যাচটা আমাদের এখানে মানে দুধঘাটের স্কুলের মাঠেই কর না। চমৎকার মাঠ, তবে ইডেনের মতো অত বড় নয়। শেয়ালদা থেকে একঘণ্টা লোকাল ট্রেনে, হাজারদেড়েক লোক তো খেলা দেখবেই। তা ছাড়া লাঞ্চ—টি দিতে স্কুল রাজি।”

”খুব ভাল কথা, আগে দেবু ঘোষালের সঙ্গে কথা বলে নিই; দেবু কোচ, ওর মতামতই এ—ব্যাপারে চূড়ান্ত। ওকে এখুনি ফোন করে তোকে জানাচ্ছি, তুই বাড়ি আছিস তো?” আশিস ফোন রেখে দিল। প্রতাপ ফোনের পাশে বসে রইল। আধঘণ্টা পর ফোন বেজে উঠতেই সে ছোঁ দিয়ে রিসিভার তুলেই বলল, ”আশিস?”

গম্ভীর স্বর এল ”আমি দেবু! কে, প্রতাপদা বলছেন?”

”আশিস তোমায় বলেছে সব?”

”সব মানে, আপনি ট্রায়ালটা দুধঘাটে করাতে চান। ওখানে একটা স্কুল আছে না? শুনেছি খুব নামকরা স্কুল, স্টার লেটার পায় গণ্ডা গণ্ডা। মাঠটা ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত কি!”

”আমি ওখানে কোচ করি। স্কুলের একটা ছেলে এ—বছরই কলকাতায় আমার ক্লাবে দুটো ম্যাচ খেলে ন’টা রান আউট করেছে, পাঁচটা ক্যাচ নিয়েছে। কুড়িটা উইকেটের চোদ্দোটা ও একা ফেলে দিয়েছে। ছেলেটাকে খেলিয়ে দেখতে পারো। ভারতে এখন এমন ফিল্ডার নেই, বয়স পনেরো। মাঠ সম্পর্কে বলতে পারি মোহনবাগান মাঠের মতোই মাঠ।”

”নাম কী ছেলেটার?”

”দুলাল কর।”

”কাগজে নামটা দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।”

”নামকরা ক্লাবে খেললে দেখতে পেতে। তা হলে রবিবারে তোমরা খেলতে রাজি?”

”দেখুন প্রতাপদা, এটা সরকারিভাবে ট্রায়াল ম্যাচ নয়। বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে ম্যাচ হয় তিনদিনের। একদিনের ম্যাচটা খেলতে চাই পনেরোটা ছেলে বেছে নেওয়ার জন্য, আমি ডিস্ট্রিক্টের ছেলে খুঁজছি। রবিবারে ট্রেন কখন?”

”সকাল আটটা পাঁচের ট্রেনে আসাটাই সুবিধের। বাইগাছি স্টেশনে আমরা রিসিভ করব, ওখান থেকে সাইকেল ভ্যানে স্কুলে। প্লেয়ারদের ইকুইপমেন্টস আর বল তোমরা আনছ, আমরা স্ট্যাম্প দোব আর তিরিশজনের লাঞ্চ—টি, আর কিছু?”

”আম্পায়ার দু’জন?”

”একজন আমি আর একজন আশিস বা তুমি। হোয়াইট কোট কিন্তু দিতে পারব না।”

.

হইচই পড়ে গেল দুধঘাটে। স্কুলের ছেলেরা পোস্টার লিখে বাইগাছি বাজারে, স্টেশনে, পোস্ট অফিসের, সিনেমা হলের, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দেওয়ালে পর্যন্ত সেঁটে দিল: ”বাংলার জুনিয়ার ক্রিকেটদলের ওয়ান ডে ম্যাচ/দুধঘাট উচ্চচ মাধ্যমিক স্কুল মাঠে/দলে দলে দেখতে আসুন/রবিবার দোসরা নভেম্বর।” আর—একটা পোস্টারে: ”আসুন দেখুন/বাংলার অলৌকিক ফিল্ডার দুধঘাট স্কুলের ছাত্র/দিলীপ কর/ অষ্টম শ্রেণী/এই ম্যাচে খেলিবে।”

স্কুলের মাঠে প্রতিদিন দিলুর ফিল্ডিং বহু ছাত্রই দেখেছে। কলকাতায় দুটো ম্যাচে তার কৃতিত্বের খবর বাসু মারফত সারা স্কুলে ছড়িয়ে যাওয়ায় দিলু এখন সবার দেখার পাত্র। স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকলেই ছেলেরা ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। সুব্রত কাপ জেতা দুধঘাট স্কুলের ছেলেরাও এত নজর টানেনি, যা দিলু পেতে শুরু করেছে। বিকেলে তার ফিল্ডিং প্র্যাকটিস দেখার জন্য ছাত্ররা তো বটেই, গ্রামের লোকেরাও এখন ভিড় করে থাকে।

সৌরভ গাঙ্গুলি, টিভি, খবরের কাগজের দৌলতে ক্রিকেট এখন জনপ্রিয়তায়, বাইগাছি—দুধঘাটে ফুটবলকে দু’নম্বরে ঠেলে পয়লা জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে। স্কুলের ছেলেদের নিজেদের মধ্যে খেলা ম্যাচ ছাড়া স্থানীয় লোকেদের আর কোনও ক্রিকেট দেখার সুযোগ হয় না। দেখতে হলে যেতে হয় কলকাতায়। এখন কলকাতাই আসছে দুধঘাটে। বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে বাংলার হয়ে যারা খেলবে তারা আসছে, আর তাদের সঙ্গে খেলবে দুধঘাটের ছেলে, এটা কি কম কথা!

উত্তেজনায় ফুটে উঠল দুধঘাট। হরিসাধন ডেকে পাঠালেন, যশোহর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক শঙ্কর নাগকে।

”শঙ্করবাবু, কলকাতা থেকে ছেলেরা খেলতে আসবে, ক্রিকেট। তাদের লাঞ্চে আমি আপনার ছানার জিলিপি খাওয়াব। মনে রাখবেন, আপনার জিলিপিকে আমি বিশ্ববিখ্যাত মনে করি।”

”সে ঠিকই করেন। স্পেশ্যাল কেয়ার নিয়ে বানাব। ক’জন খাবেন?” নাগমশাই নম্রস্বরে জানতে চাইলেন।

”তিরিশজন। ক’টা করে খাবে আমি বলতে পারছি না, তবে ছোটরা মিষ্টি খেতে ভালবাসে। আপনিই বলুন কত লাগবে।”

শঙ্কর নাগ মাথা চুলকোলন, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কী যেন গোনাগুনি করলেন তারপর বললেন, ”কখন খাবে? লাঞ্চ তো খেলার মধ্যিখানে হয়। সেইরকম নিয়ম মেনেই তো খেলা হবে?”

”হ্যাঁ, একদলের ইনিংস শেষ হওয়ার পর লাঞ্চ হবে।” হরিসাধন হেসে উঠে বললেন।

”সার, লাঞ্চটা তো রান্না করতে হবে। সেটা কি স্কুলই করবে?”

”হ্যাঁ। সমরেশবাবুর বাড়ি কাছেই। বুবু কেটারার্সের লোক এসে ওর বাড়িতে তৈরি করবে চিকেন স্টু। সঙ্গে পাউরুটি, স্যালাড, কলা আর ছানার জিলিপি। এ তো বিয়েবাড়ি নয় যে, খাওয়াটাই আসল ব্যাপার, এরা আসছে খেলতে। এবার বলুন কটা লাগবে?”

‘মাথাপিছু পাঁচটা করেই ধরি?” নাগমশাই প্রশ্ন করে আশা নিয়ে তাকালেন।

”পাঁ—আ—চ—টা। বললুম না ওরা খেতে নয়, খেলতে আসবে।” হরিসাধনের মুখে বিরক্তি।

”তা হলে চারটে করে। তিরিশজনই তো আর খেলবে না। তা ছাড়া কারও ভাল লেগে গেলে, লাগবেই, সে আরও দুটো চাইবে। তখন কি আর নেই বলবেন? তাতে ইস্কুলের বদনাম হবে না?”

অকাট্য যুক্তি। স্কুলের বদনাম হরিসাধন হতে দিতে পারেন না। রাজি হয়ে গেলেন। ফিল্ড রেস্ট্রিকশনের তিরিশ গজের সার্কল, বাউন্ডারি লাইনে চুনের দাগ, পিচে জল দেওয়া, রোল—করা প্রতাপ দাঁড়িয়ে থেকে করাল। পঞ্চায়েত থেকে লাল—নীল—হলুদ কাগজের শিকল সুপুরি গাছগুলোয় জড়িয়ে মাঠ ঘেরা হল। লাঞ্চে জলপান বিরতির জন্য কাচের গ্লাস আর জাগ, চা এবং কাপ ডিশ কেটারারই দেবে। একতলায় ক্লাস ফাইভের দুটো ঘর ড্রেসিংরুম হবে। বেঞ্চগুলো, টিচার্স রুম থেকে দশটা চেয়ার আর দুটো টেবল আনা হবে মাঠের ধারে খাটানো ইউনিভার্সাল ডেকরেটরের চাঁদোয়ার নীচে। ফার্স্ট এড বক্স নিয়ে ডাক্তার পোদ্দার সারাক্ষণই থাকবেন কথা দিয়েছেন। দুটো ব্ল্যাকবোর্ড, ডাস্টার, খড়ি স্কোরবোর্ডের জন্য রেডি করে রাখা হয়েছে। নেট প্র্যাকটিসের নেটও চটজলদি খাটিয়ে নেওয়ার মতো অবস্থায় মাঠের বাইরে রাখা হবে। বলা যায় না খেলতে নামার আগে হয়তো ওরা নেট চাইতে পারে। টয়লেটে ব্লিচিং পাউডার দু’দিন ধরে দেওয়া হচ্ছে। মাইক তো থাকবেই।

দুধঘাট স্কুল প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। অবশেষে রবিবার এল। সেদিন সকালেও দিলু পুকুরে সাঁতার কাটল অন্যান্য দিনের মতো। দশটায় ম্যাচ আরম্ভ হবে। এখন আটটা। বর্গমূলের অঙ্ক করার জন্য বই আর খাতা নিয়ে সে টেবলে বসল। পঞ্চানন তখন বললেন, ”দাদু, আজ এসব থাক। এখন বরং তুমি মনে মনে ম্যাচটা খেলো। তুমি তো প্রতিদিন প্র্যাকটিস করে নিজেকে তৈরি করেছ, এখন চোখ বন্ধ করে নিজেকে দ্যাখো ফিল্ড করছ। ব্যাটসম্যান বল মারল, যেদিকে বল যাচ্ছে তুমি ছুটলে, বলের কাছে যত তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায় সেইভাবে ছুটলে, বলে চোখ রেখে তুললে, উইকেটের আন্দাজ নিলে, ছুড়লে। মনে মনে বারবার এটা করো সব ভুলে গিয়ে।” এই বলে পঞ্চানন নীচে নেমে গেলেন দিলুকে একা রেখে।

সওয়া ন’টায় মোটরবাইকে প্রতাপ হাজির হল। হরিসাধন সকাল থেকেই স্কুলে। প্রতাপের পেছনে বসার আগে দিলু বলল, ”দাদু মাঠে যাচ্ছ কখন?”

”এই একটু পরে টুকটুক করে হেঁটে চলে যাব।” পঞ্চানন দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ”দুর্গা দুর্গা।”

প্রতাপ বলল, ”আপনি রেডি হয়ে থাকুন। দিলুকে পৌঁছে দিয়েই আমি আসছি, আপনাকে নিয়ে যাব।”

স্কুল ফটকের সামনে দিলুকে নামিয়ে দিয়ে প্রতাপ বাইক ঘুরিয়ে নিল পঞ্চাননকে নিয়ে আসার জন্য। এক মিনিট পরেই বাইগাছি স্টেশন থেকে সারি দিয়ে ছ’টা সাইকেল ভ্যান রিকশায় পা ঝুলিয়ে বসা পঁচিশ—ছাব্বিশটি ছেলে পৌঁছল। তাদের পিছু পিছু এল আরও চারটি রিকশা। তাতে লম্বা লম্বা ব্যাগে তাদের ব্যক্তিগত খেলার সরঞ্জাম। ছেলেরা যে যার নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে ফটক দিয়ে ঢুকল। হরিসাধন এবং দু’জন শিক্ষক দাঁড়িয়ে।

”সোজা চলে যাও, একতলায় ডান দিকের দুটো ঘর ড্রেসিংরুম।” হরিসাধন স্কুলবাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন। ”দরজাতেই কাগজে টিমের নাম লেখা আছে।” গতকাল প্রতাপ জানিয়ে দেয় দুটো দলের নাম দেওয়া হয়েছে রেড আর ব্লু। ছেলেরা চারধারে চোখ বোলাতে লাগল। দিলু তাদের কাছেই দাঁড়িয়ে। শুনতে পেল তাদের কথা।

”কী বিউটিফুল গ্রাউন্ড আর সারাউন্ডিং। সারি দিয়ে কোকোনাট আর সরু সরু পামগাছ।”

”অংশু ওগুলো পাম গাছ নয় রে সুপুরি গাছ।” একজন সংশোধন করে দিল।

একজন বলল, ”দাদুর কাছে শুনেছি একসময় ইডেন ঘিরে ছিল দেবদারু গাছ। তখন একটা কংক্রিটের খণ্ডও ছিল না ইডেনে। গঙ্গার দিক থেকে হাওয়া আসত, পুরনো বলও সুইং করত।”

আর একজন বলল, ”এখানে ধানখেত থাকলে বলতুম অংশু ওই দেখ, ওই গাছ দিয়ে দারুণ তক্তা হয়।”

অংশু স্বাস্থ্যবান, ফরসা, চোখা নাকমুখ। দামি জিনস পরা। ওদের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, ”বল, বল, বলে যা, সারাক্ষণ ট্রেনে পেছনে লেগেছিস, আবার এখানেও। এবার একটু চুপ কর। এখানকার লোকেরা শুনলে—” সে এধার—ওধার তাকাল। চোখাচোখি হয়ে গেল দিলুর সঙ্গে, দিলু হাসতে লাগল। ”এই দেখ একজন হাসছে।”

ছেলেরা এগিয়ে যাচ্ছে ড্রেসিংরুমের দিকে। দিলু এখনও জানে না সে রেড না ব্লু কোন দলে পড়েছে। কলকাতায় দেবু ঘোষাল টিম করেছে, দিলু তাকে কখনও দেখেনি, সে আশিস ঘোষকেও চেনে না। কোন ঘরে ঢুকবে বুঝতে না পেরে একতলার করিডরে দাঁড়িয়ে রইল। সবাই দরজায় আঁটা কাগজ দেখে দুটো ঘরে আলাদা হয়ে ঢুকল দেখে দিলু বুঝে গেল ওরা জানে কে কোন দলের। ওরা নিশ্চয় বলতে পারবে দুলাল কর বা ডি কর, রেড না ব্লু কোন দলে।

সে কিন্তু কিন্তু করে রেড ঘরে ঢুকল। ছেলেরা প্যান্ট শার্ট বদলে জুতো পরায় ব্যস্ত। সামনেই অংশু বেঞ্চে বসে জুতোর ফিতে বাঁধছে। দিলু নিচু স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করল, ”তোমাদের টিমে কি এখানকার কোনও ছেলে আছে?”

অংশু প্রথমে তার আপাদমস্তক দেখল। তারপর বলল, ”একেবারে ড্রেস করেই এসেছ দেখছি। বোসো। তোমার নামে পোস্টার দেখলুম স্টেশনে, লোকাল হিরো। আমি রেডের ক্যাপ্টেন অংশুমান সিনহা।” অংশু হাত বাড়িয়ে দিল, দিলু হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে ওর পাশে বসল। অংশুকে তার মনে হল পরিষ্কার স্বচ্ছ মনের, সহজেই বন্ধু হয়ে যেতে পারে। উত্তরপল্লীর সনৎদা বয়সে তার দ্বিগুণ। আচরণে কথাবার্তায় সবসময়ই বুঝিয়ে দেন তিনি ক্যাপ্টেন, দিলু আড়ষ্ট বোধ করেছে।

”দেবুদা বলেছেন তুমি দারুণ ফিল্ড করো, যে—কোনও পজিশনে। আমি উইকেটকিপার। তোমার নাম তো দুলাল কর, এই স্কুলে পড়ো, আমি লা মার্টিনিয়ারে।” বলতে বলতে অংশু লম্বা ব্যাগ থেকে ব্যাট প্যাড গ্লাভস এমনকী একটা হেলমেটও বের করল। দেখে দিলু অস্বস্তিতে পড়ল। তার মনে হল, এর প্রত্যেকটাই বেশ দামি। কৌতূহলে সে ব্যাটটা হাতে তুলে নাচাল। দাঁড়িয়ে ব্যাটটা ধরে স্টান্স নিয়ে দু’বার কাল্পনিক বলে ডিফেন্সিভ খেলল এক পা পিছিয়ে এসে। অংশু তাকে লক্ষ করছিল, বলল, ”তোমার প্লেয়িং কিটস কোথায়?”

”স্কুলের ঘরে রয়েছে।” দিলু বলতে পারল না তার নিজস্ব কোনও খেলার সরঞ্জাম নেই, ব্যাটও নেই। দুটো ম্যাচে তার প্যাড, ব্যাট, অ্যাবডোমেন গার্ড সবই ছিল উত্তরপল্লী ক্লাবের। স্কুলের ব্যাটটার কানা সেদিন ভেঙেছে। আর যে ব্যাটটা আছে তা দিয়ে ম্যাচ খেলা যায় না। অংশুর মতো তারও নিজের ব্যাট প্যাড গ্লাভস থাকা দরকার।

”হারি আপ বয়েজ।” দাঁড়িয়ে উঠে অংশু তাড়া দিল।

অংশুর গলার স্বর শুনে দিলু অবাক! কোথায় সেই হাসিখুশি হালকা ভাব, এ তো ক্যাপ্টেনের দাপুটে গলা।

অংশু বলল, ”নেট রয়েছে দেখলাম, ভবানী বলগুলো নিয়ে চল। রবি, নিমু, শান্তু ব্যাট নিয়ে নেটে যা।” দিলুকে বলল, ”তুমিও চলো। থ্রো করবে, আমি ধরব।”

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের ভিড় দেখে দিলু তাজ্জব বনে গেল। স্কুল মাঠের এমন চেহারা সে দেখেনি। সারা মাঠ ঘিরে বসে রয়েছে নানান বয়সী মানুষ, আর কমপক্ষে স্কুলের প্রায় পাঁচশো ছেলে। প্রতাপ তাকে দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকল। দাদু কোথায়? দিলু চেয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে পঞ্চাননকে দেখতে পেল।

”দেবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি। তোমাকেই ও আজ বিশেষ করে দেখবে।”

কাছেই দাঁড়িয়ে দেবু ঘোষাল। কম কথার মানুষ। দিলুর কাঁধে হাত রেখে বলল, ”মনে হচ্ছে না টেনশনে রয়েছ। টিমের সঙ্গে মিশে যাও। তুমি তো অংশুর টিমে, ও খুব ম্যাচিওরড ছেলে।”

আশিস ঘোষ দেবুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দিলুর সঙ্গে কোনও কথা বলল না। মাঠের একধারে অংশু গ্লাভস হাতে পরে একজনের ছোড়া বল ধরে ফেরত পাঠাচ্ছে। গোল হয়ে দাঁড়ানো পাঁচজনকে একটি ছেলে ক্যাচিং প্র্যাকটিস করাচ্ছে। মাঠের আর একদিকে একই ব্যাপার হয়ে চলেছে। ওরা ব্লু দল। স্কুল মাঠে সাদা জামা সাদা ট্রাউজার্স পরা গুটিতিরিশেক ছেলে ব্যাট—বল নিয়ে নেমেছে এমন দৃশ্য আগে কেউ কখনও দেখেনি। দুধঘাটে এটা বিরাট ঘটনা।

আশিস ঘোষ আর প্রতাপ দুই আম্পায়ার। ওদের সঙ্গে মাঠের মাঝে গিয়ে টস করল অংশু আর ব্লু—এর ক্যাপ্টেন আরিফ মহম্মদ। আরিফ টস জিতে ব্যাট নিল। দুটো টিম করেছে দেবু। রেড দলে রেখেছে যারা ভাল ব্যাট করে, ব্লু দলে রয়েছে ভাল বোলাররা। মাইকে ঘোষিত হল টসের ফল এবং দুটো টিমের নাম। ডি কর নামটা উচ্চচারিত হওয়া মাত্র মাঠ ঘিরে হর্ষধ্বনি উঠল।

অংশু ড্রেসিংরুমে ফিরে এসে দিলুর সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিল। ”একে তোমরা আজই প্রথম দেখছ, এর নাম দুলাল কর। এই স্কুলেই পড়ে। ভাল ফিল্ড করে।” ছেলেরা একসঙ্গে বলে উঠল, ”হাই।”

দেবু দরজায় এসে বলল, ”মাঠে নামো, দেরি হয়ে গেছে পনেরো মিনিট। মনে রেখো চল্লিশ ওভারের খেলা। ফিল্ড রেস্ট্রিকশন থাকবে পনেরো নয়, তেরো ওভার।”

ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ক্লাস টেনের দুটি ছাত্র দরজা বন্ধ করে পাহারায় দাঁড়াল। হেডসারের কড়া নির্দেশ, প্লেয়াররা ছাড়া আর কেউ ঘরে ঢুকতে পারবে না। মাঠে এসে অংশু দিলুকে বলল, ‘কোথায় দাঁড়াবে?”

”কভারে।” দিলু পছন্দ করে ওই জায়গায় ফিল্ড করতে।

ছিপছিপে লম্বা অমিতাভ দে মিডিয়াম পেসের বোলার। তার প্রথম বল লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে থেকে আউট সুইং করে অফ স্টাম্পে। ব্যাটসম্যান পিছিয়ে গিয়ে জোরে ড্রাইভ করল। দিলু কুঁজো হয়ে গুটিগুটি এগোচ্ছিল। বলটা তার ডান দিক দিয়ে যাচ্ছে। তার দিকে সে ঝাঁপিয়ে কোনওক্রমে বাঁ হাত বাড়িয়ে বলটা হাতে লাগাল। বলটা ছিটকে তিন মিটার গিয়ে থেমে রইল। নন স্ট্রাইকার কয়েক পা বেরিয়ে জমিতে পড়ে থাকা বলটার দিকে তাকিয়ে দোনামনা করে স্ট্রাইকারের দিকে মুখ ফেরাল। স্ট্রাইকার হাত তুলে তাকে যখন রান নিতে বারণ করছে ততক্ষণে দিলু ছুটে গিয়ে বলটা কুড়িয়ে ছুড়েছে বোলারের উইকেটে। স্টাম্প ছিটকে যাওয়ার পর নন—স্ট্রাইকারের ব্যাট স্পর্শ করল পপিং ক্রিজের পেছনের জমি। দু’হাত তুলে ফিল্ডাররা চিৎকার করে উঠতেই আঙুল তুলল আশিস ঘোষ। প্রথম বলেই ফিরে গেল একজন। অংশু ছুটে গেল দিলুর কাছে, অন্যরাও ছুটে এসে হাই ফাইভ করার জন্য ঠেলাঠেলি শুরু করল।

অংশু বলল ”স্টেশনে পোস্টার দেখে খুব তো হাসাহাসি করেছিলিস, তখন আমি কিন্তু হাসিনি, এইবার হাসব।”

পরের ছেলেটি মাঠে নামছে। ব্যাটসম্যান এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগল দিলুকে দেখিয়ে। নবাগত ঘাড় নেড়ে জানাল সে বুঝেছে। বাকি পাঁচটা বল অফস্টাম্পের বাইরে দিয়ে গেল, অংশু ধরল।

দ্বিতীয় ওভার। বল করবে সুনন্দ। ব্যাটসম্যান বাঁ হাতি। বেঁটে, গাট্টাগোট্টা। তৃতীয় বলে গালিতে ক্যাচ, ফিল্ডারের হাত থেকে পড়ে গেল। পরের বলে কাট করে গালির পাশ দিয়ে দুটো রান নিল। পঞ্চম বলে সোজা ড্রাইভে চার রান, ওভারের শেষ বলে হল নো বল এবং গ্লান্স করে এক রান।

চারটে ওভার বিনা ঘটনায় কেটে গেল, রান এক উইকেটে চোদ্দো। পঞ্চম ওভারে বাঁ—হাতি সোজা ছয় মারল অমিতাভকে। দর্শকদের মধ্যে হইহই পড়ে গেল। ছাত্ররা ”উই ওয়ান্ট সিক্সার” স্লোগান তুলল। বাঁ—হাতি পরের বলে আবার ছয় মারল, বল পড়ল স্কুলের পাঁচিলের বাইরে। তুমুল চিৎকার নারকেল গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেল। নিচু ক্লাসের ছেলেরা মাঠে ঢুকে নাচানাচি শুরু করতেই লাইফ সায়ান্সের সার ছুটে গেলেন, ”কোয়ায়েট, কোয়ায়েট” বলে ছেলেরা দৌড়ে দর্শকদের ভিড়ে মিশে গেল। পর পর দুটো ছয় আর দর্শকদের উচ্ছ্বাস তার মাথায় রক্ত চড়িয়ে দিয়েছে।

অমিতাভ পরের বল দিল গতি একটু কমিয়ে, আগের দুটো ছয় যেভাবে ব্যাট চালিয়ে মেরেছিল বাঁ—হাতি, এবারও সেইভাবে ব্যাট চালাল। বলটা দুটো নারকেল গাছের উচ্চচতায় উঠে একস্ট্রা কভার বাউন্ডারির দিকে যাচ্ছে এবং বলে চোখ রেখে দিলুও সমানে ছুটছে। সম্ভবত ওভার বাউন্ডারি হবে। বলের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলু ঝাঁপাল, দু’পাক গড়িয়ে উঠে দাঁড়াল বল হাতে।

সারা মাঠ চুপ। যখন বুঝল দিলু ক্যাচ ধরেছে, ফিল্ডাররা ছুটে গেল, হাততালি দিয়ে চিৎকার করতে লাগল ‘দি ই লি ই প, দি ই লি ই প”। দিলু ফিরে তাকিয়ে চাঁদোয়ার নীচে চেয়ারে বসা দাদুকে দেখতে পেল ডান হাত মুঠো করে তুলে দাঁড়িয়ে।

ফিরে এসে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে অংশু প্রথম স্লিপকে বলল, ”হ্যাঁ রে, কী বলছে ওরা শোন তো!”

প্রথম স্লিপ শুনে বলল, ”দিলীপ দিলীপ বলছে মনে হচ্ছে।”

অংশু বলল, ”দিলীপ কেন, ওর নাম তো দুলাল। দেবুদা তো তাই বললেন।”

প্রথম স্লিপ কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, ”নাম যাই হোক, ক্যাচটা কীরকম নিল দেখলি। পোস্টারে ঠিকই লিখেছে।”

”বুদ্ধি করে অমিতাভ স্লোয়ার দিল বলেই ক্যাচটা উঠল।” অংশু মনে করিয়ে দিল।

এর পরে যে ছেলেটি ব্যাট হাতে নামল সে এক হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি করল। অফের দিকে মারা কোনও বলেই সে রান নিতে রাজি নয়। সহজ সিঙ্গল থাকলেও সে ”নোও ও” হাঁক দিয়ে উলটোদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চারদিকে হাসাহাসি শুরু হল, তার পার্টনার বিরক্ত হয়ে তার সঙ্গে কথা বলল। কিন্তু সে নিজের বিবেচনা বোধে অনড় রইল। তবে লং লেগে দুটো চার সে মেরেছে আর মিড উইকেট থেকে দুটো সিঙ্গল নিয়েছে।

অতিরিক্ত লেগবাই নিয়ে ব্লু—এর রান দু’ উইকেটে চল্লিশ, এগারো ওভারে। দুই ব্যাটসম্যানই উইকেটের গতি ও বাউন্সের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। বড় একটা পার্টনারশিপ ধীরে ধীরে তৈরি হওয়ার পথে। ওপেনার ছেলেটি অমিতাভর বদলি নতুন বোলার রাজীব জয়সোয়ালকে কাট করে সহজ রান আছে দেখে ”ইয়েস” বলে ছুটল। মাঝপথে গিয়ে দেখল নন স্ট্রাইকার বেরোয়নি। সে চেঁচিয়ে উঠল, ”রান, রান”।

দিলু বাঁ পাশে ঝাঁপিয়ে বলটা ধরে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। ধড়মড়িয়ে উঠে হাঁটু গাড়া অবস্থাতেই ডান হাতে ফাঁকা স্ট্রাইকার প্রান্তে বল ছুড়ে অফস্টাম্প ফেলে দিল। রাগ চাপতে চাপতে ছেলেটি মাঠ ছাড়ল। তেরো ওভার সম্পূর্ণ, চুয়াল্লিশ রান তিন উইকেটে, রানরেট প্রায় সাড়ে তিন।

অংশু এবার আনল তার অফ স্পিনার বুদ্ধদেব চ্যাটার্জিকে। মাঠে ফিল্ডার রাখার বাঁধাবাঁধি এখন আর নেই। অংশু ফিল্ডারদের ছড়িয়ে দিল গণ্ডির বাইরে। দিলুকে নিয়ে এল সিলি মিডঅফে ব্যাট থেকে দশ হাত সামনে। আর একজনকে রাখল ব্যাকওয়ার্ড শটলেগে ব্যাটসম্যানের পিঠের কাছে।

সামনে নাকের কাছে একজন পেছনে পিঠ ঘেঁষে একজন, ব্যাটসম্যানটি অস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে তুলে তুলে দেওয়া চারটি বল পা বাড়িয়ে ঝুঁকে থামিয়ে দিল। একটা বল ব্যাট থেকে সামান্য উঠে গেছল, দিলু সামনে ঝাঁপিয়েও ক্যাচটা পেল না। হতাশ ব্যাটসম্যান ঠিক করল আক্রমণই আত্মরক্ষার সেরা উপায়। পঞ্চম বলটায় প্রচণ্ড জোরে ড্রাইভ করল। জমি থেকে ইঞ্চি দুয়েক ওপর দিয়ে বলটা পা ফাঁক করে ঝুঁকে থাকা দিলুর দিকে জ্বলন্ত গোলার মতো সোজা ধেয়ে গেল।

দু’হাতের তালু চকিতে নামিয়ে দিলু বলটা ধরে নিয়েই মাথার ওপরে ছুড়ে দিয়ে আবার লুফল। দু’জনকে রান আউট, দুটো ক্যাচ কোনওটাই সহজ ছিল না। হাতের ডায়েরি বইটা দেখতে দেখতে দেবু ঘোষাল পাশের লোককে চাপা গলায় বলল, ”এরকম অলরাউন্ড ফিল্ডার জীবনে দেখিনি! চারটে উইকেট তো ওরই।”

চতুর্থবার ছুটে যাওয়ার উৎসাহটা একটু স্তিমিত হয়ে গেল ফিল্ডারদের। রাজর্ষি দিলুর হাতের তালু দুটো পরীক্ষা করে ঠাট্টার সুরে বলল, ”দেখ, বলটারই হয়তো লেগেছে।”

বুদ্ধদেব বাংলার একজন প্রতিশ্রুতিমান স্পিনার, প্রথম ডিভিশান লিগে ফুলবাগান দলে খেলে। লেংথ আর লাইন বজায় রাখায় নিখুঁত, ফ্লাইটের হেরফের ঘটানোতেও ওস্তাদি দেখিয়েছে, স্পিন করানোর ব্যাপারটায় এখনও নিয়ন্ত্রণ আসেনি, টপ স্পিন আয়ত্ত করার জন্য খাটছে। ওর বলে উইকেটের আশেপাশে প্রচুর ক্যাচ ওঠে, সেগুলো ধরার লোক পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রথম চারজন আউট হয়ে গেছে। পাঁচ ও ছয় নম্বর ব্যাটসম্যান শূন্য রানে ব্যাট করছে। ব্লুয়ের উঠেছে চুয়াল্লিশ রান, হাতে রয়েছে ছয় উইকেট আর পঁচিশ ওভার। ব্লু দুশো রানে পৌঁছবার আশা করতে পারেই, যদি এই জুটিটা দাঁড়িয়ে যায়। জয়সোয়ালের বলে একটা চার আর তিনটি সিঙ্গল হল।

এবার বুদ্ধদেবের ওভার। সে দিলুকে আর একটু এগিয়ে ব্যাট থেকে ছ’হাত দূরে দাঁড়াতে বলল। তুলে প্রথম বলটা দিল, লেংথের একটু শর্ট, স্পিন ছিল না। ছেলেটি পিছিয়ে ব্যাট দিয়ে থামাল। এবারের বল আর একটু তুলে একই লেংথে, তবে স্পিন করিয়ে। আবার পিছিয়ে এসে ব্যাট দিয়ে আটকাল।

ব্যাটসম্যানের কপালে ফুটল দুশ্চিন্তার রেখা। সেটা লক্ষ করল দিলু। তার মনে হল, এবার ও ভুল করবে।

তৃতীয় বল আর একটু তুলে এবার গুডলেংথে। ব্যাটসম্যান তাড়াতাড়ি ঝুঁকে ডিফেন্সিভ ব্যাট পাতল। ব্যাট থেকে লোপ্পা হয়ে বল জমা পড়ল দিলুর হাতে। লাফিয়ে উঠে এবার দিলুই ছুটে গেল বোলারের কাছে, জড়িয়ে ধরল বুদ্ধদেবকে।

অংশু বলল, ”দুলাল দৌড়ে গিয়ে অ্যাবডোমেন গার্ড পরে এসো, আর আমার হেলমেটটা। সিনগার্ড নেই, থাকলে ভাল হত।”

দিলু ড্রেসিংরুমের দিকে ছুট লাগাল।

ঠিক সেই সময় বাইগাছি স্টেশনে ট্রেন থেকে নামল মলু। মোটরগাড়ি গ্যারাজে গেছে সেল্ফস্টার্টারের গোলমাল সারাতে। স্টেশনে টিকিট কালেক্টর থাকে না, মলু হাতের টিকিট হাতে নিয়ে বেরোতেই চোখে পড়ল লাল কালিতে লেখা পোস্টার—আসুন, দেখুন/বাংলার অলৌকিক ফিল্ডার দুধঘাট স্কুলের ছাত্র।

এর পরই মলুর চোখ সরু হল ও ভ্রূ জুড়ে গেল দিলীপ কর নামটা দেখে। পোস্টারের দিকে আধ মিনিট তাকিয়ে থেকে সে রিকশা স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখল জায়গাটা ফাঁকা। কী ব্যাপার! একজন নাপিত একটি লোকের দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছে। সে তাকেই জিজ্ঞেস করল, ”স্ট্যান্ডে রিকশা নেই। কী ব্যাপার, ধর্মঘট নাকি?”

খুর চালাতে চালাতেই লোকটি বলল, ”খালি যাচ্ছে আর আসছে, দুধঘাট ইস্কুল মাঠে আজ কিরকেট খেলা আছে না। একটু দাঁড়ান, এখুনি ফিরে আসবে।”

মলুকে মিনিট তিনেক দাঁড়াতে হল। ততক্ষণে পাঁচজন লোক জুটে গেল। তাদের কথা শুনে সে বুঝল, ওরাও স্কুল মাঠে যাবে।

”ছেলেটা নাকি সত্যিই অলৌকিক, যেখান—সেখান থেকে যা ছোড়ে তাই লেগে যায়।”

”আমিও তাই শুনলুম দুধঘাট স্কুলে পড়ে একটা ছেলের কাছে। রোজ ছুটির পর মন দিয়ে বল ছোড়া, ক্যাচ ধরা প্র্যাকটিস করে। দেখি গিয়ে কেমন অলৌকিক।”

”ছেলেটা হেডমাস্টার মশাইয়ের ভাগনা। উনি খুব উৎসাহ দেন খেলাধুলোয়।”

মলু স্তম্ভিত হয়ে শুনে গেল। ভ্যান রিকশা পর পর তিনটি এসে হাজির।

”দুধঘাট স্কুল, দুধঘাট স্কুল।” এর রিকশাওলা জানান দিল চেঁচিয়ে।

ওরা ছ’জনই উঠে বসল রিকশার তিনদিকে পা ঝুলিয়ে। স্কুলের ফটক থেকেই ভিড় শুরু হয়েছে। পাঁচিলের ওপর লোক দাঁড়িয়ে। মলু কোনওক্রমে ঠেলেঠুলে ঢুকে দাঁড়াবার জায়গা করে নিল। মাঠে চোখ বুলিয়ে সে খুঁজে পেল না দিলুকে। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে সে জিজ্ঞেস করল, ”আচ্ছা, দিলীপ কর খেলছে না?”

ছেলেটি খুবই অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ”সে কী, এতক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করছেন দিলীপ খেলছে কিনা?”

অপ্রতিভ মলু বলল, ”আমি এইমাত্র এলাম।”

”খেলছে তো দিলীপই, পাঁচজনকে আউট করেছে। ওই তো হেলমেট পরা উবু হয়ে বসে।” ছেলেটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে দিতেই চেঁচিয়ে উঠল ”কট কট। দিলু আবার ক্যাচ নিয়েছে।”

মলু দেখল, ব্যাটসম্যানের পায়ের কাছে এক হাত বাড়িয়ে দিলু শুয়ে, হাতে লাল রঙের বল। সারামাঠ চিৎকার করছে আর লাফাচ্ছে। চাঁদোয়ার পাশে স্ট্যান্ডে খাড়া করা ব্ল্যাকবোর্ডে একটি ছেলে ৫১—৫ মুছে খড়ি দিয়ে লিখল ৫৯—৬।

”এই নিয়ে ছেলেটা ছ’জনকে একাই ফিরিয়ে দিল, অবিশ্বাস্য প্রতিভা।” মলুর পেছনে কে একজন বলল।

”ছেলেটার সম্পর্কে যা সব শুনতাম মনে হত বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে। এখন দেখছি একটুও বাড়ানো কথা নয়। অবিশ্বাস্য প্রতিভা বলছেন কী, অলৌকিক বলুন। অনেকদূর যাবে, বিরাট নাম করবে।”

মলু ধাঁধায় পড়ে গেল। এসব কথা দিলুর সম্পর্কেই কি বলা হচ্ছে? এত লোক উচ্ছ্বসিত হচ্ছে কি দিলুর জন্য? আশ্চর্য তো। দিলু অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান, কই আমরা কেউ তো জানতুম না। মলু ভিড়ের মধ্যে পথ করে বাউন্ডারির ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

অংশু বোলার বদল করে আবার আনল অমিতাভকে। দিলুকে বলল প্রথম স্লিপে দাঁড়াতে।

”হেলমেটটা রেখে আসি।”

”লাইনের ধারে টুয়েলফথম্যান রয়েছে, ওর হাতে দিয়ে এসো।”

হেলমেট খুলে হাতে নিয়ে দিলু বাউন্ডারি লাইনে দৌড়ে গেল। ছেলেটির হাতে হেলমেটটা দেওয়ার সময় চোখে পড়ল মা দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে।

ছ্যাঁত করে উঠল তার বুকের মধ্যে। ধরা পড়ে গেছি। তারপরই দেখল, মা ডান হাতটা তুললেন, মুখে মা—দুর্গার মতো একটা হাসি।

আশীর্বাদ। দিলু মাথাটা হেলিয়ে হাসল, তারপর ছুটে এসে দাঁড়াল স্লিপে। অমিতাভ প্রথম বলটা ঠুকে দিতে গিয়ে শর্ট পিচে ফেলল। কাঁধের কাছে ওঠা বলটা মারার জন্য ব্যাটসম্যান সপাটে ব্যাট ঘোরাল। বল ব্যাটের কানায় লেগে দিলুর মাথার অনেক ওপর দিয়ে থার্ডম্যান অঞ্চলে উঠে গেল। দিলু ক্যাচ নেওয়ার জন্য দৌড়চ্ছে, থার্ডম্যানে ফিল্ড করছে যে সেও দৌড়ে আসছে। দু’জনে মুখোমুখি হয়ে থমকে দাঁড়াল। বলটা তাদের মাঝখানে পড়ে লাফিয়ে উঠতেই দিলু বল ধরে নিয়েই ঘুরে গিয়ে ছুড়ল। অংশু দিলুর দিকে মুখ করে, উইকেটের পেছনে ছোড়া বলটা ধরার জন্য। ব্যাটসম্যানরা দ্বিতীয় রানটা নিচ্ছে, রান নেওয়া সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই অংশুর গায়ে ছিটকে এসে লাগল স্টাম্পের একটা বেল। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হল ৭১—৭।

মলু এধার—ওধার তাকাতে—তাকাতে দেখতে পেল জেঠুকে। পাশের চেয়ারে বসা এক পাকাচুলকে মাথা নেড়ে কী বোঝাচ্ছেন। মলু ভিড় ঠেলে এগোতে লাগল।

অংশু ঠাট্টা করে দিলুকে বলল, ”সাতটা তো হল, বাকি তিনটে আর পড়ে থাকে কেন, নিয়ে ফেলো।”

দিলু মাথা চুলকে বলল, ”স্পিনার আসুক, তখন দেখা যাবে।”

দেখা অবশ্য হল না। চার ওভার পর আবার বুদ্ধদেব বল করতে এল। তার প্রথম ওভারেই দুটো চার, একটা দুই নিয়ে ব্লু—র ইনিংস একশোয় পৌঁছল একত্রিশ ওভারে। পাঁচ আর আট নম্বর ব্যাটসম্যান এখন ক্রিজে। আট নম্বর বেপরোয়া হয়ে ব্যাট চালাচ্ছে। সুনন্দকে দুটো ছয় মারার পর দুটো ডট বল, তারপরের বলটায় বোল্ড হয়ে গেল। নবাগত প্রথম বলেই পিছিয়ে এসে ডাইভ করেই পিছলে পড়ল। ডানপায়ের গোড়ালি লাগল অফ স্ট্যাম্পে, বেল পড়ে গেল। শেষ ব্যাটসম্যান লাজুক মুখে এল। সে ব্যাট করতে পারে না সবাই জানে এবং সেটা সে জানিয়েও দেয় ঝাড়ু দেওয়ার মতো ব্যাট চালিয়ে। ঝাড়ু মেরে এক রান পেয়ে সে মস্ত বড় করে হেসে নিল। আশাতীত সৌভাগ্যে।

পাঁচ নম্বর তখনও নট আউট চল্লিশ রানে। তার লক্ষ্য একটি অর্ধশত রান পাওয়ার, হাতে রয়েছে চল্লিশ বল। ঝাড়ুদারকে বাঁচিয়ে রেখে আরও দশটি রান তাকে করতে হবে, যেভাবেই হোক বোলিং থেকে ওকে সরিয়ে রাখতে হবে। ওভারের বাকি আরও চার বল। শেষ বলে একটা রান নিয়ে ওধারে যাবে ঠিক করে সে তিনটে বল থামাল। ঝাড়ুদারকে মাথা নেড়ে ইশারায় বলল, এইবার রান নিতে তৈরি হও।

বুদ্ধদেব বল করার আগে অংশু ব্যাটসম্যানের উদ্দেশ্যটা বুঝে ফিল্ডারদের কাছে নিয়ে এল। দুই বা চার রান যদি পায় পাক, এক বা তিন রান যেন না পায়। বুদ্ধদেব বলটা করল আচমকাই মিডিয়াম পেসে, প্রায় ইয়র্কার। পাঁচ নম্বর তাড়াতাড়ি ব্যাট নামাল। ব্যাটে লেগে বল পিচের মাঝখানে এসে থেমে গেল। এদিকে দু’জনেই সেকেন্ড তিনেক ইতস্তত করে রান নিতে ছুটল। বুদ্ধদেব ছুটে এসে বল কুড়িয়েই ছুড়ল। অংশু বলটা ধরেই উইকেট ভেঙে দিল। ঝাড়ুদার রান আউট। ব্লু—র ইনিংস শেষ একশো তেরো রানে।

আম্পায়ার প্রতাপ লাহিড়ি আঙুল তোলামাত্রই স্কুলের প্রায় পঞ্চাশটি ছেলে রে রে করে মাঠে ঢুকে পড়ল। দিলুকে একজন কাঁধে বসাবার চেষ্টা করে পারল না। দু’জন চেষ্টা করল পাঁজাকোলা করতে, পারল না। অবশেষে ছ’জন তাকে ধরে মাথার ওপর লম্বা করে তুলল এবং সেই অবস্থায় বহন করে নিয়ে গেল ড্রেসিংরুমে। দিলু মুখ ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করল মা আর দাদুকে। ভিড়ে তারা আড়াল পড়ে গেছে, সে দেখতে পেল না।

.

ডেসিংরুমে সুনন্দ বলল, ”ভাগ্যিস এখানে খেলতে এসেছি তাই এমন একটা দৃশ্য দেখার সুযোগ হল।”

দেবাংশু ফিসফিস করে তার কানে বলল, ”আর এমন ফিল্ডিং দেখার কথাটাও বল।”

”নিশ্চয় বলব। তবে এখানে নয়, কলকাতায় ফিরে।”

অংশু বলল দিলুকে, ”বাকি তিনটে আর হল না। বিজয় মার্চেন্টে আমাদের প্রথম খেলা কটকে ওড়িশার সঙ্গে, সেখানে আশা করব এক ইনিংসে দশটাই।”

দিলু বিভ্রান্ত স্বরে বলল, ”বেঙ্গল টিমে আমি। কী এমন করলুম?”

অংশু বলল, ”দুশো তেরোটাকে একশো তেরো করে দিয়েছ। ব্লু টিমে যেসব ব্যাটসম্যান রয়েছে তাদের চারজন লাস্ট উইকে ফিফটি করেছে, আজ দশের বেশি করেনি। তুমি টিমে আসছই। কত নম্বরে ব্যাট করবে?”

”যতয় পাঠাবে।”

”দেবুদার সঙ্গে কথা বলে দেখি।”

হরিসাধন এসে তাড়া দিলেন লাঞ্চ খাওয়ার জন্য। দুটো টিম দোতলায় টিচার্স রুমে গেল। চারটে টেবল জোড়া দিয়ে তাতে রাখা হয়েছে চিকেন স্টু, কলা, স্লাইসড পাউরুটি, স্যালাড আর ছানার জিলিপি। প্রত্যেকে প্লেট হাতে ইচ্ছেমতো স্যালাড, পাউরুটি ও চিকেন তুলে নিয়ে দেওয়ালের ধারে রাখা চেয়ারে বসে খেতে শুরু করল।

হরিসাধন বললেন, ”আয়োজন খুবই সামান্য, যতটুকু আমাদের সাধ্য—”

তাকে হাত তুলে থামিয়ে আরিফ বলল, ”ক্লাব ম্যাচে আমাদের এমন খাওয়া জোটে না, চিকেন তো ভাবাই যায় না!”

অংশু বলল, ”এখুনি তো মাঠে নামতে হবে, বেশি খেলে নড়াচড়া করতে পারব না। এইরকম হালকা খাবারই ভাল।”

ছেলেদের খাওয়া দেখে হরিসাধন বিষণ্ণ হলেন। প্রচুর পাউরুটি আর স্টু পড়ে রইল। ওরা শুধু স্যালাড খেল, বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেকে হাতে নিল একটা করে কলা। তিনি এবং গণেশ নাগ সবচেয়ে দুঃখ পেলেন ছানার জিলিপির দুটো প্লেট দেখে। দেওয়া হয়েছিল পঞ্চাশটা, নিঃশেষ হলে আরও পঞ্চাশটা স্টিলের ট্রে—তে চটপট টেবলে আনার জন্য রেডি করে রাখা আছে, তাও ফুরিয়ে গেলে আরও পঞ্চাশটা আসবে। কিন্তু প্রথম পঞ্চাশটাই ফুরোল না। দেখা গেল গোটা বারো প্লেটে পড়ে রয়েছে।

”সার আপনি বলেছিলেন ছোটরা মিষ্টি খেতে ভালবাসে।” গণেশ নাগ মাথা চুলকোলেন।

”শ্রাদ্ধ আর বিয়েবাড়িতে সাপ্লাই দিয়ে দিয়ে খাওয়ার একটা হিসেব আপনার মাথায় বদ্ধমূল হয়ে গেছে—মাথাপিছু পাঁচটা। আপনাকে বলেছিলুম ওরা খেতে নয়, খেলতে আসছে। এখনকার ছেলেরা ভীষণ হেলথ কনশাস মনে রাখবেন।”

”সার, মিষ্টি খাওয়ানোর প্রস্তাবটা তো আপনারই ছিল।” ভয়ে ভয়ে বললেন গণেশ নাগ।

”বলেছি তো কী হয়েছে। যত জিলিপি রয়ে গেছে স্কুলের যে সব ছেলে কাজ করছে তাদের একটা করে দিয়ে দিন।”

ব্যাটিং অর্ডার তৈরি করেছে দেবু ঘোষাল। দিলুকে রেখেছে পাঁচ নম্বরে, তিনজন আউট হলে নামবে। অংশুকে ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে সে বলল, ”তখন স্পিনার এসে যাবে, খেলাও তখন কুড়ি ওভারে পৌঁছবে। মনে রাখিস চল্লিশ ওভারের খেলা, কুড়ি থেকে তিরিশ ওভার—ওই সময়টায় এক—দুই করে রান নিয়ে ওভারে ছ’টা করে রান, দেখি ছেলেটা ওইসময় কেমন ব্যাট করে।”

ঘরে ফিরে এসে অংশু ব্যাটিং অর্ডার পড়ে শোনাল। প্রথম চারজন প্যাড পরতে শুরু করল। দিলু তাকিয়ে রইল ওদের ব্যাট প্যাড গ্লাভসের দিকে। সবই নিজেদের, দেখেই বোঝা যায় বেশ দামি। নিজস্ব সরঞ্জাম বলতে জুতো জোড়া ছাড়া তার কিছুই নেই। সবই স্কুলের। কমদামি প্যাডজোড়া ময়লা, বাঁশের কঞ্চি আর তুলো দিয়ে তৈরি, ওজনে ভারী। প্যাডের একটায় ওপরের বাকল নেই, দুটো বাকলে টাইট করে পায়ে ধরে রাখা যায় না, একটু ছুটলেই প্যাড নেমে আসে। অথচ এদেরগুলো কী হালকা, বাকল দেওয়া নয়। তিনটে পট্টি চেপে লাগিয়ে দিলে আঠার মতো এঁটে থাকে। গ্লাভসেও কবজির কাছে জড়ানো ওই আঠার মতো পট্টি। আর ব্যাট।

দিলু অংশুর ব্যাটটা তুলে ওজনটা অনুভব করতে করতে পাশে বসা সুনন্দকে হালকা চালে জিজ্ঞেস করল, ”ব্যাটটার দাম কত?”

সুনন্দ দশ নম্বরে ব্যাট করবে। দেরি আছে মাঠে নামতে, হয়তো নামতেও হবে না। তার আগেই একশো চোদ্দো রান উঠে যাবে। জুতোর ফিতে খুলছে মুখ নিচু করে। দামটা বলল, কিন্তু দিলু স্পষ্টভাবে শুনতে পেল না।

”কত বললে?”

”সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।” সুনন্দ মুখ তুলে একটু চড়িয়ে বলল।

দিলু বলল, ”দিশি ব্যাটের দামও কি এইরকম?”

সন্দীপ একটু অবাক হয়ে বলল, ” এটা তো দিশি ব্যাটই। আমাদের কাশ্মীরি উইলোয় তৈরি পি ডি এম বা লারসন তো সাহেবরাও কিনছে।”

দিলু ব্যাটটা সযত্নে বেঞ্চের ওপর রেখে দিয়ে স্কুলের কানা ভাঙা ব্যাটটা দুই হাঁটুর মধ্যে চেপে ধরল। দাম জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে আর তার নেই।

ভরত আর কমলেশ দুই ওপেনার ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, দু—তিনজন বলে উঠল, ”বেস্ট অব লাক।” দিলু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লম্বা করিডরে দাঁড়াল। এখান থেকে দুটো উইকেটই দেখা যায়। ওয়ান ডাউন রাজর্ষি তার পাশে এসে দাঁড়াল।

”দুলাল, তুমি কি এখানেই থাকো?”

”হ্যাঁ, কেন বলো তো!” দিলু অবাক হল প্রশ্নটায়।

”অ্যালবার্ট স্কোয়ারে বন্ধু পরিষদে খেলতুম, তখন তোমায় দেখেছি। তোমার বাড়ি তো মৌলালিতে। তা হলে এখানে কেন?”

”এখানে মামার বাড়ি। পরীক্ষায় ফেল করে এখানে এসে স্কুলে ভর্তি হয়েছি।”

দিলুর সরল স্পষ্ট উত্তর রাজর্ষির মনে দাগ কাটল। ‘ফেল করে’ কথাটা কত সহজে বলল। রাজর্ষিও সহজ ভাবে বলল, ”তোমার ব্যাটটা তো দেখলুম কানাভাঙা, একটা ভাল ব্যাট কিনে নাও।”

কত সহজে বলে দিল ‘কিনে নাও।’ নিশ্চয় পয়সাওলা ঘরের ছেলে। দিলুর বলতে ইচ্ছে করল, দামি ব্যাট দিয়ে খেললেই কি দামি ইনিংস খেলা যাবে?

রাজর্ষি মাঠের দিকে তাকিয়ে। ভরত গার্ড নিল প্রতাপ লাহিড়ির কাছ থেকে। বোলিং শুরু করবে আরিফ। প্রথম বল ভরত ব্যাট তুলে ছেড়ে দিল, দ্বিতীয় বলটায় আধা ফরওয়ার্ড খেলল, ব্যাট—প্যাডের মধ্য দিয়ে বলটা গলে এসে অফ স্টাম্প ফেলে দিল।

দিলুর দিকে তাকিয়ে হেসে রাজর্ষি এগোল মাঠে নামার জন্য। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হল ০—১। দিলুর পাশ দিয়ে ভরত ড্রেসিংরুমে ফিরে এল। রাজর্ষি প্রথম বলেই পিছিয়ে খেলে বলটা ফস্কে এল বি ডবলু হল। রেড দল ০—২। দিলু ঘরে এসে প্যাড পরা শুরু করল। দেবাংশু নামল ব্যাট করতে। মাঠ ঘিরে সাড়াশব্দ নেই। প্রথম ওভারেই পড়েছে দুটো উইকেট দু’বলে। দর্শকদের মধ্যে কে একজন বাঁজখাই গলায় চিৎকার করল, ”হ্যাটট্রিক চাই।”

লোকটির দাবি পূরণ করতেই যেন আরিফ কপিলদেবের মতো অসাধারণ আউটসুইং করিয়ে বলটা ফেলল অফ স্টাম্পে। দ্বিতীয় স্লিপ গোড়ালির কাছে ক্যাচটা ধরেই গড়িয়ে পড়ল।

হ্যাটট্রিক প্রথম ওভারেই। রেড ০—৩। দুধঘাটে হ্যাটট্রিক একটা বিরাট ঘটনা। দিলুকে ব্যাট হাতে নামতে দেখে বিশাল অভ্যর্থনা গাছের কাকগুলোকে ভয় পাইয়ে উড়িয়ে দিল।

ওভারের দুটো বল বাকি। দিলু আউট সুইঙ্গারগুলো দেখে নিয়ে ছেড়ে দিল। কানা ভাঙা ব্যাট দিয়ে সুইং করা বল খেলতে যাওয়া মানেই বিপদ ডেকে আনা, এটা সে বুঝে গেছে। দ্বিতীয় ওভার, কমলেশ খেলবে অরুণ মেহটার বলে। পাঁচটা বল খেলল একটা বাই বাউন্ডারি, মিড উইকেট থেকে দুই নিয়ে কমলেশ মিড অফে ক্যাচ তুলে ফিরে গেল। রেড ৬—৪। ছয় রানে চার উইকেট পড়ে গেছে। ক্রিজে এল অংশু।

”দুলাল ডাউন দ্য শাটার, ঝাঁপ ফেলে দাও।” অংশুকে নড়বড়ে দেখাল। প্রথম ওভারেই এতবড় ধাক্কা পেলে কোন অধিনায়ক না নার্ভাস হয়ে পড়বে।

পরের ওভারে বল করতে এল আদিত্য মজুমদার। ইনসুইং করায়, মাঝে মাঝে দেয় লেগকাটার। অংশু মারার বল মারল না, সিঙ্গল রান নিতেও রাজি নয়। মেডেন ওভার।

হ্যাটট্রিক করে আরিফ উৎসাহে ফুটছে। তার দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলটা ওভার পিচ। দিলু স্ট্রেট ড্রাইভ করল। ফলো থ্রুতে আরিফ বলটা থামাতে পারল না। চার হল। অংশু কপাল কুঁচকে শুধু তাকাল। পরের বলে দিলু আবার স্ট্রেট ড্রাইভে বাউন্ডারিতে বল পাঠাল। তৃতীয় বলটা আরিফ বাম্প করাতে চেষ্টা করল, দিলুর কাঁধের কাছে বল উঠতেই সে পুল করল। মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছয় হল। আরিফকে প্রথমে অবাক, তারপর নিজের ওপর বিরক্ত; এখন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। চতুর্থ বল গুড লেংথে, কিন্তু সুইংটা বড় হয়ে গেল। দিলু স্কোয়ার ড্রাইভ করল। পয়েন্ট ও কভারের মাঝ দিয়ে বাউন্ডারিতে যাওয়া বলের দিকে সবাই তাকিয়ে, দিলু তাকিয়ে তার ব্যাটের দিকে। ভাঙা জায়গাটা থেকে ছোট্ট একটা কুচি খসে গেছে।

মাঠ ঘিরে পাগলামির স্রোত বইছে। বল বাউন্ডারিতে পৌঁছলেই বাচ্চচা ছাত্ররা মাঠে ঢুকে নাচানাচি করছে। লাইফ সায়ান্স মাস্টারমশাই হাল ছেড়ে দিলেন। হরিসাধন অতিকষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছেন। সবাই জানে দিলু তাঁর ভাগ্নে, চিৎকার করা বা দু’হাত তুলে অঙ্কের বরদাবাবুর মতো লাফালে পক্ষপাতিত্ব দেখানো হয়ে যাবে। তবে আরিফের হ্যাটট্রিক হতেই তিনি দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিয়েছেন। মলু, যে ক্রিকেটের কিছুই বোঝে না, সেও চারপাশের গনগনে উত্তেজনার আঁচে ঝলসে মুখ লাল করে ফেলেছে। ফিসফিস করে সে পাশে বসা জেঠুকে বলল, ”দিলুটা করছে কী?”

পঞ্চাননও চাপা স্বরে বললেন, ”মাকে বলছে তুমি আমাকে চেনোনি, বোঝোনি। আমি তোমার সেরা ছেলে।”

আরিফের পঞ্চম বলটা সোজা নারকেল গাছের পাতায় গিয়ে লাগল। দিলু চোখের সামনে ব্যাট তুলে দেখল, ভাঙা জায়গাটায় চিড় ধরেছে, আবার একটু কুচি খসে পড়বে। অংশু এগিয়ে এল। দিলুর হাত থেকে ব্যাটটা নিয়ে নিজের ব্যাট তার হাতে দিয়ে হাসল। দিলু ইতস্তত করে বলল, ”দামি ব্যাট। যদি ভেঙে যায়?”

”ভাঙুক। এর চেয়েও দামি টিমের উইন।”

কথাটা শুনেই ঝিনঝিন করে উঠল দিলুর সারা শরীর। দু’বার ব্যাটটা হাতে নাচিয়ে সে স্টান্স নিল। আরিফ এবার জোরে ফুল পিচে বল করল সোজা কাঁধের সমান উচ্চচতায়। আশিস ঘোষ নো বল ডাকল কিন্তু দিলু বলটাকে পুল করে ছয় মেরে দিল লং লেগ বাউন্ডারিতে। এক এবং ছয় রান হল। এক ওভারে একত্রিশ রান নিল দিলু।

অংশু এগিয়ে এল কথা বলতে। দিলু বলল, ”শাটারটা আটকে গেছে, ডাউন করতে পারছি না।”

”আরিফ শ্যাটারড। আর ও বল করবে না মনে হচ্ছে। শাটারটা তুমি আর একটু ওপরে তোলো।”

হাতে দুটো ব্যাট নিয়ে কমলেশ মাঠে ছুটে এল। অংশু একটা বেছে নিয়ে দিলুর ভাঙা ব্যাটটা তার হাতে দিল। আদিত্যর প্রথম বলে পয়েন্ট থেকে অংশু একটা রান নিল। তার রান এবং এই রানটাতেই সে রইল যখন রেড টিমের টোটাল চার উইকেটে সাতান্নয় পৌঁছল। দিলুর পঞ্চাশ, একুশ বল খেলে। একস্ট্রা হয়েছে ছয় রান।

দিলু ব্যাটটা চাঁদোয়ার দিকে লম্বা করে দেখিয়ে দু’বার ঝাঁকাল। পঞ্চানন মলুকে বললেন, ”তোকে দেখাচ্ছে। ওঠ, উঠে হাত নাড়।” মলু সদ্য ঘুমভাঙার মতো ধড়মড়িয়ে উঠে দু’হাত নাড়তে লাগল। পেছন থেকে কে বলে উঠল, ”দিলুর মা।” লোকে তাকে দিলুর পরিচয়ে চিনেছে। মলুর কান গরম হয়ে উঠল।

শতরানে দিলুর পৌঁছতে যখন পনেরো রান বাকি, জয়ের জন্য রেডের তখন দরকার ষোলো রান। আগ্নেয়গিরির মতো মাঠ তখন ফুটছে। হবে কি হবে না। বাজি ধরা শুরু হয়ে গেছে।

”বলছি হবে। সেঞ্চুরি হবেই। বাজি?” এক যুবক বলল, পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে। ”যশোহরের ছানার জিলিপি যত প্যারিস।”

”গেল গেল গেল।” আঁতকে উঠল আর এক যুবক। দিলু ওভারের শেষ বলে এক রান নিচ্ছিল, শর্ট লেগে বল ঠেলে দিয়ে। অংশু দৌড় শুরু করে দেখল, এক ফিল্ডার বল কুড়িয়েছে। অংশু থমকে দাঁড়িয়ে চে�চিয়ে বারণ করল রান না নেওয়ার জন্য। কিন্তু দিলু তখন পিচের মাঝামাঝি এসে গেছে। ফিল্ডার বল ছুড়ল উইকেটকিপারকে আর অংশু অতিক্রম করল দিলুকে। তখনই উইকেটকিপার তিনটি স্টাম্প হাতের ধাক্কায় ফেলে দিল। দিলুর দিকে তাকিয়ে অংশু হাসল মাত্র, তারপর হাঁটা শুরু করল। সারা মাঠ হাততালি দিয়ে তার স্বেচ্ছায় এই রান আউট হওয়াকে তারিফ জানাল।

একটা কিছু ঘটে গেল দিলুর মধ্যে। পরের ওভারে সে পেল এক বাঁ হাতি স্পিনারকে। প্রথম চারটে বলে সে অন আর অফে ড্রাইভ করে তিনটি চার এবং সোজা একটা ছয় মেরে রেড—এর ইনিংস একশো পনেরো রানে পৌঁছে দিল। তার শতরান হল চল্লিশ বলে।

এরপর আবার দেখা গেল সেই দৃশ্য। দিলুকে ঘাড়ে শুইয়ে মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যাওয়া। তবে এবার তাকে বহন করল অংশুর ক্যাপ্টেন্সিতে রেড দলের ছেলেরা।

পাঁচ মিনিট পর ড্রেসিংরুমের বাইরে মলু, পঞ্চানন আর প্রতাপ। ব্যাটটা হাতে নিয়ে দিলু বেরিয়ে এল। মুখে একগাল হাসি, কপালে ঘাম, এলোমেলো চুল আরও এলোমেলো।

মলু হাতব্যাগ খুলে চিরুনি বের করল।

”কাছে আয়।”

দিলু এগিয়ে এসে মাথা নিচু করল। আঁচড়ে দিতে দিতে মলু বলল, ”চুল তো নয় কাকের বাসা, এবার ন্যাড়া করে দোব।” আঁচল দিয়ে দিলুর মুখের ঘাম মুছে দিল। ব্যাটটা দেখে বলল, ”কার ব্যাট?”

”অংশুর। জানো মা, এটার দাম সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা!”

”অ। তরুণ করের ছেলে আর কখনও যেন পরের ব্যাট নিয়ে না খেলে।” মলু গম্ভীর কঠিন গলায় কথাটা বলে প্রতাপের দিকে তাকাল। ”ব্যাটম্যাট কোনটে ভাল কোনটে মন্দ, আমি বুঝি না। আপনি কাল আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে দোকানে নিয়ে যাবেন। ব্যাটের সঙ্গে আর কী কী লাগবে তারও একটা লিস্টি করে আনবেন। ব্যাট লিখবেন দুটো। একটা ভেঙে গেলে অন্যটায় খেলবে। পরের ব্যাট নিয়ে খেলা উচিত নয়।”

প্রতাপ ঘাড় নাড়ল। মলু এবার পঞ্চাননের দিকে তাকাল। ”জেঠু, তুমিই হচ্ছ পালের গোদা। লেখাপড়া করতে তোমার কাছে রাখলুম, আর তুমি—!”

মলু আঁচলে চোখ মুছল।

মিনু চিনুর ট্রফি

কলকাতা থেকে আটাশ মাইল উত্তরে গঙ্গার পশ্চিম তীরে, লঞ্চঘাট থেকে আধমাইল, জি টি রোড থেকে সিকি মাইল আর রেল স্টেশন থেকে এক মাইল দূরের মহাদেবপুর উপনগরীতে প্রায় চার হাজার লোকের বাস। মহাদেবপুর গড়েছে মহাদেব জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল মিলস, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় এম জে টি এম, তারই প্রতিষ্ঠাতা—মালিক মহাদেবদাস মাধোকিয়া। এই উপনগরীতে আছে দুটো বাজার, ছোট একটা হাসপাতাল, স্কুল, মন্দির, অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি, পাওয়ার হাউস, খেলার মাঠ, ছোটদের পার্ক, অফিসারদের ক্লাব—যেখানে আছে এক বিঘৎ ঘাস গজিয়ে যাওয়া একটা টেনিস কোর্ট, আর দুটি ক্যারম খেলার বোর্ড। মহাদেবপুর মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানকার অনেক লোকেরই মোটরগাড়ি আছে, দরকার হলে চট করে কলকাতা ঘুরে আসতে পারে।

মহাদেবপুরের পৌরব্যবস্থা এম জে টি এম—এর নিজস্ব। তাদেরই খরচে এবং তদারকিতে এর দেখভাল করা হয়। এজন্য আলাদা একটা বিভাগ আছে এবং তার সর্বোচ্চচ কর্তা হলেন তন্ময় বসুমল্লিক। ইনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, বলিষ্ঠ, দীর্ঘদেহী, চোখা নাক মুখ। দূরপাল্লার সাঁতারে নাম ছিল এবং অর্থনীতির এম এ। কলকাতা পৌরসভায় বছর চারেক চাকরি করে ভারত স্বাধীন হওয়ার দু’বছর পরই মহাদেবপুরে আসেন।

তন্ময় যেমন হাসিখুশি, সরল, তেমনই গোঁয়ার প্রকৃতিরও। সাবেকি রীতিনীতি মেনে চলতে অভ্যস্ত এমন পরিবারে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা; তিনি উদার মনের মানুষ, বড় চাকরি করলেও মেলামেশায় কোনও বাছবিচার করেন না। তাঁর স্ত্রী তপতী ইলাহাবাদের মেয়ে। বাবা সেখানকার নামী উকিল ছিলেন। বাড়িতে টেনিস কোর্ট ছিল। ভাইদের সঙ্গে বাড়িতে, পরে কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে টেনিস খেলেছেন। চ্যাম্পিয়ানের তিন—চারটে ট্রফিও পেয়েছিলেন। সাইকেল চালিয়ে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার সময় একটা খ্যাপা ষাঁড়ের শিং থেকে বাঁচার জন্য তপতী রাস্তার পাশের নালায় সবেগে নেমে যাওয়ায় তাঁর ডান পায়ের গোড়ালির হাড় কয়েক টুকরোয় পরিণত হয়। দু’বার অপারেশনের পর পা যৎসামান্য ছোট হয়ে যায় বলে একটু জোরে হাঁটলেই ধরা পড়ে তিনি খোঁড়া।

স্বামী যতটা কালো, তপতী ততটাই ফরসা। ক্লাবে অনেকেই রসিকতা করে ওঁদের ‘পূর্ণিমা—অমাবস্যা’ বলে ডাকে। শুনে ওঁরা দু’জন হাসেন। স্বামীর মতো তপতীও জেদি কিন্তু গোঁয়ার নন। কোনও লক্ষ্য একবার স্থির করে ফেললে যতক্ষণ না তা পূরণ হচ্ছে, হাল ছাড়েন না। গোড়ালি ভাঙার পর বগলে ক্রাচ দিয়ে তাঁকে চলাফেরা করতে হত। বাড়ির সবাই ধরে নেয় আজীবন এইভাবেই তাঁকে চলতে হবে। কিন্তু মনের জোর আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এই দুইয়ে মিলে তাঁকে এমনই জেদি করে তোলে যে, দিনের পর দিন ব্যায়াম ও মালিশ করে এক বছরের মধ্যেই ক্রাচের ওপর নির্ভরতা থেকে তপতী নিজেকে মুক্ত করে নেন।

এই বসুমল্লিক দম্পতি নিজেরা খেলার চর্চা এক সময় করেছেন, খেলা ভালবাসেন। এঁদের দুই ছেলে, মৃন্ময় আর চিন্ময়। দু’জনেই পড়ে মহাদেবপুরের এম ডি এম স্কুলে, মৃন্ময়ের ক্লাস থ্রি, চিন্ময়ের ক্লাস ওয়ান। আজ ওদের স্কুলের বাৎসরিক স্পোর্টস।

খাওয়ার টেবলে তন্ময় টোস্টে জেলি মাখাতে মাখাতে হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে হাঁক দিলেন, ”মিনু, চিনু, হারি আপ। ঠিক সাতটায় আমাদের পৌঁছতে হবে। কুইক ব্রেকফাস্ট শেষ করো, আর সময় নেই।”

”বাবা, আমি রেডি।” বলতে বলতে শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল মিনু। নয় বছর বয়স কিন্তু দেখতে দশ—এগারোর মতো। মায়ের মতো অতটা না হলেও, ফরসা, স্বাস্থ্যবান, চটপটে। সাদা হাফপ্যান্টের মধ্যে গোঁজা সাদা গেঞ্জি, সাদা মোজা, সাদা কেডস। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। তন্ময় স্নেহভরে বড় ছেলের দিকে তাকালেন, চোখে ফুটে উঠল তারিফ। এক্কেবারে স্পোর্টসম্যানের মতো দেখাচ্ছে!

”বোস।” তিনি তাঁর পাশের চেয়ারটা দেখালেন। টোস্ট প্লেটে রেখে সেটা মৃন্ময়ের সামনে এগিয়ে দিয়ে তন্ময় বললেন, ”আজ কিন্তু একটার বেশি নয়। এর সঙ্গে এক গ্লাস দুধ আর একটা কলা। পেট হালকা থাকলে জোরে দৌড়নো যায়… চিনু কী করছে? চিনু হারি আপ। … দ্যাখো তো দেরি করছে কেন!”

তন্ময় জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন টেবলের উলটো দিকে। তপতী মন দিয়ে সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছেন। কথা না বলে তিনি উঠে গেলেন ছেলেদের ঘরে।

বিব্রত মুখে চিনু তাকাল মায়ের দিকে। বাঁ হাতের মুঠোয় পেটের কাছে প্যান্টটা ধরা।

”কী হল?” তপতী ভ্রূ কুঁচকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন। ”প্যান্ট অমন করে ধরে আছিস কেন?”

”বোতাম।” ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া স্বর চিনুর।

”বোতাম!”

তপতী প্যান্টধরা চিনুর হাতটা টানতেই সেটা হাঁটুর কাছে নেমে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি সেটা ধরে চিনু টেনে তুলল। আধুলি মাপের একটা সাদা বোতামের ভাঙা অংশ প্যান্টে আটকে রয়েছে।

”হাতে আর সময় নেই, ব্রেকফাস্ট করেই বেরোতে হবে, আর এখন কিনা তোর প্যান্টের বোতাম ভাঙা… ইচ্ছে করছে তোকে একটা…।” ডান হাতটা তুলেও তপতী নামিয়ে নিলেন। অসহায় ফ্যালফ্যাল চোখে চিনু তাকিয়ে রয়েছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রং, রুগণ, দুর্বল শরীর। গেঞ্জি পরা না থাকলে ওর কণ্ঠা আর পাঁজরের হাড় দেখা যেত। পা দুটো সরু, দুটো হাতও তাই। তপতীর চোখের রাগ ধীরে ধীরে মায়ায় ভরে এল। স্কুল থেকে বলে দিয়েছে স্পোর্টসে সাদা প্যান্ট গেঞ্জি পরে যেতে হবে। দ্বিতীয় আর সাদা প্যান্ট নেই। চট করে যে লাগিয়ে দেবেন, ওই মাপের তেমন বোতামও ঘরে নেই। কী করা যায় এখন?

”বউদি, বরং একটা সেফটিপিন লাগিয়ে দাও।” ঘরের দরজা থেকে রাতদিনের কাজের লোক বেলা পরামর্শ দিল। হাতের চুড়ি থেকে সেফটিপিন খুলে তপতীর হাতে দিতে দিতে বলল, ”দাদা তাড়া দিচ্ছে, চেঁচামেচি শুরু করবে।”

তপতী আর কথা না বলে হাঁটু গেড়ে বসে কোমরের কাছে প্যান্টটা টেনে ধরে সেফটিপিন লাগিয়ে দিলেন। চিনুর হাত ধরে যখন তিনি খাবার ঘরে এলেন, তন্ময় তখন উৎসাহভরে মিনুকে স্টার্ট নেওয়ার কৌশল দেখানোয় ব্যস্ত। ছোট ছেলের দিকে তাকাবার ফুরসত নেই।

”যখন বলবে অন ইওর মার্ক… গেট… সেট…” তন্ময় ঘরের মেঝেয় হামা দেওয়ার ভঙ্গিতে, একটা পা সামনে, অন্যটা পিছিয়ে। সামনের পায়ের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে দু’হাতের আঙুলে ভর রেখে সামনে ঝুঁকে। ”কান খাড়া করে রাখবি, এটা খুব দরকারি ব্যাপার,… এই কানটা, বুঝলি? পিস্তল ফায়ারের আওয়াজ শোনামাত্রই…।”

”বাবা, আমাদের আন্টি বলেছেন হুইসল বাজানো হবে।”

”অ। একই ব্যাপার, মোটকথা ওই আওয়াজটা শোনার জন্য তুমি কান খাড়া করে রাখবে। যেই হুইসল বাজল অমনই তুমি…”, তন্ময় মোজাইক করা মেঝেয় পায়ে চাপ দিয়ে স্টার্ট নিতে গিয়ে প্রথম পদক্ষেপটিতেই পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে প্রথমেই তিনি সবার মুখ দেখে নিলেন। কোনও মুখেই হাসির টান পড়েনি। দেখে স্বস্তি বোধ করে বললেন, ”তা হলে মিনু স্টার্টিং ব্যাপারটা বুঝে গেলে, কেমন। এবার ঝালিয়ে নাও একবার।”

মিনু বাবার দেখানো মতোই মেঝেয় হামা দেওয়ার ভঙ্গিতে শরীরটাকে রেখে কানখাড়া করে রইল।

”কারেক্ট, নাউ… অন ইওর মার্ক… গেট… সেট… ফরররর।” তন্ময় মুখেই হুইসল বাজালেন। মিনু স্টার্ট নিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

”এ কী, পড়ে গেলি কেন?” তন্ময় বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন। ”বারে! তুমি তো এইভাবেই স্টার্ট নিলে।” মিনুর ভ্যাবাচাকা মুখ। গলদটা কোথায় হল বুঝতে পারছে না।

খুকখুক হাসির শব্দে তন্ময় মুখ ফেরালেন স্ত্রীর দিকে। জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে বললেন, ”এতে হাসির কী আছে?”

”তোমার বলে দেওয়া উচিত ছিল পিছলে পড়াটা স্টার্টিং টেকনিকের মধ্যে পড়ে না।” গম্ভীর মুখে কথাটা বলে তিনি ছোট ছেলের চেয়ারটা টেবলের নীচে আর একটু ঠেলে দিলেন। প্যান্টে আঁটা সেফটিপিনটা এখনকার মতো স্বামীর নজরে না পড়াই ভাল।

”গাড়ি বার করছি। তাড়াতাড়ি এসো।” তন্ময় দুটো ওয়াটারবটল টেবল থেকে তুলে বেরিয়ে গেলেন মিনুকে সঙ্গে নিয়ে।

”মা, আমি খাব না, খিদে নেই।” চিনু করুণ স্বরে বলল।

”ওসব বললে হবে না, খেয়ে নাও। বাবা মাখন মাখিয়ে দিয়েছে, একটা অন্তত খাও। কখন ফিরব তার ঠিক নেই, খালি পেটে থাকলে… আচ্ছা দুধটুকু খাও।” দুধের গ্লাস ছেলের মুখে তুলে ধরলেন তপতী। পাঁচন গেলার মতো মুখ করে চিনু গ্লাস শেষ করল।

”মা, আমিও কি ওইভাবে স্টার্ট নেব?”

”যেমন খুশি তেমনি ভাবে স্টার্ট নিবি, এটা ওলিম্পিকস নয়। এবার চল… আমার পেছন পেছন আয়, বাবার নজরে যেন সেফটিপিনটা না পড়ে, তা হলে দক্ষযক্ষ বেধে যাবে।”

”মা, দক্ষযজ্ঞ কী?”

”পরে বলব।”

বাইরে থেকে মোটরের হর্ন শোনা গেল। ওরা দু’জন প্রায় ছুটেই বাংলো থেকে বেরোল। একতলা টালির ছাদের বাড়ি। সামনের দিকে ছোট ফুলের বাগান। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় গাছের সারি এবং একই ধরনের বাংলো রাস্তার দু’ধারে। সম—পদমর্যাদার লোকেরা এই রাস্তায় বাস করে। পুরনো ভক্সহল গাড়ির সামনে বসল তন্ময় ও তপতী, পেছনে দুই ছেলে। মোটরগাড়িটা এক সাহেবের কাছ থেকে কেনা।

স্কুলটা মহাদেবপুরের দক্ষিণ প্রান্তে গঙ্গার ধারে। স্কুলের লাগোয়াই, দুটো ফুটবল ম্যাচ একসঙ্গে খেলা যায় এত বড় মাঠ। একধারে শামিয়ানা, চেয়ার, টেবল, ফুলদানি, মাইক্রোফোন, স্তূপ করা প্রাইজসামগ্রী, খাবারের বাক্স ইত্যাদি। শামিয়ানার সামনে অভিভাবকদের জন্য কয়েক সারি চেয়ার। রঙিন কাগজের তৈরি শিকল গোটা বারো বাঁশের খুঁটিতে মালার মতো দুলছে। এক আন্টি অবিরাম ঘোষণা করে চলেছেন মাইকে। অনুষ্ঠান সভাপতি এম জে টি এম—এর জেনারেল ম্যানেজার এবং প্রাইজ হাতে তুলে দেবেন প্রধান অতিথি এক প্রাক্তন ফুটবলার, এঁরা দু’জন আসবেন স্পোর্টস শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে। সারামাঠে উদ্দীপনা, উৎসাহ, কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব।

বসুমল্লিক দম্পতি দুই ছেলে নিয়ে যখন হাজির হলেন তখন স্পোর্টস শুরু হয়ে গেছে। উঁচু ক্লাসের ছেলেদের ইভেন্টগুলো মাঠের অন্যদিকে পুরুষ শিক্ষকদের তদারকিতে চলছে। তাদের আটশো মিটার দৌড় তখন মাঝপথে। মাঠের মাঝে চুনকাম করা খুরি দশ মিটার অন্তর বসানো ট্র্যাক ঘিরে। গাড়ি থেকে নেমেই চিনু ফিসফিস করে মাকে বলল, ”ওইখানে আমাদের দৌড়তে হবে?”

”ওখানে বড় ছেলেদের দৌড় হবে। তুই তো পঞ্চাশ মিটরে দৌড়বি। এদিকে ওই যে লম্বা লম্বা দাগ, ওখানে তোদের দৌড়তে হবে।”

ওঁরা ‘গেস্ট’ লেখা সংরক্ষিত জায়গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন—তখন সুবেশা, স্থূলকায়া এক মহিলা হাতছানি দিয়ে তপতীকে ডাকলেন। ”মিসেস বসুমল্লিক, আগে ওই টেবলে বসা মিস দাসের কাছে গিয়ে জানিয়ে আসুন আপনার ছেলেরা এসেছে। …ক’টা ইভেন্টে ওরা নামবে?”

”অনেক ইভেন্ট। মিনুর তো রানিং ইভেন্টই তিনটে, তা ছাড়া স্যাক রেস, অঙ্ক রেস, জিলিপি রেস, ব্যালান্স রেস… এক মিনিট মিসেস সেন, এসে বলছি।” তপতী কথা অসমাপ্ত রেখে মিস দাসের টেবলের দিকে ছুটলেন। সেখানে বাবা—মায়েদের ভিড়। সবাই হাজিরা জানাবার জন্য ব্যস্ত।

”প্রতীক ঘোষ, ক্লাস ফোর, সেকশন ‘এ’।”

”বিশ্বনাথ জানা, ক্লাস ফোর, সেকশন ‘এ’।”

”কিংশুক চ্যাটার্জি…”

”সুভাষ দত্ত…”

মিনিটপাঁচেক পর তপতী সুযোগ পেলেন। নাম, ক্লাস, সেকশন শুনে মিস দাস খাতা দেখে বললেন, ”মৃন্ময় তো সাতটা ইভেন্টে নাম দিয়েছে আর চিন্ময় চারটেতে। সবক’টাতেই ওরা নামবে তো?”

”নিশ্চয়।”

”পঁচাত্তর মিটার এখনই শুরু হবে। মৃন্ময়কে রেডি রাখুন। নাম অ্যানাউন্স করলেই স্টার্টিং লাইনে পৌঁছে দেবেন। তারপরই আছে চিন্ময়ের পঞ্চাশ মিটার।”

তপতী ফিরে এসে দেখলেন চিনু একা দাঁড়িয়ে।

”বাবা, দাদা কোথায়?”

”ওইদিকে।” আঙুল দিয়ে চিনু দেখাল ভিড়ের শেষে মাঠের একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে তন্ময়ের নির্দেশে মৃন্ময় গা—ছাড়ানোর ব্যায়াম করছে।

”মা, আমিও কি এখন দাদার মতো করব?”

”না। অত করার তোর দরকার নেই।”

”মা, আমার কেমন ঘুমঘুম পাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছে না দৌড়তে।”

”ঘুম পাচ্ছে বললে কি এখন চলে? ওই শোন দাদার নাম অ্যানাউন্স হল। দৌড়ে গিয়ে ওদের ডেকে আন।”

ডাকতে আর হল না। তন্ময় আর মিনুকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল স্টার্টিং লাইনে হাতে কাগজ—কলম আর মাথায় সাদা কাপড়ের ক্যাপ পরা ব্যস্তসমস্ত এক আন্টির দিকে।

মিনু পঁচাত্তর মিটার দৌড়ে শুধু প্রথমই হল না, দ্বিতীয় জনকে প্রায় পনেরো মিটার পেছনে রেখে দিল। দর্শকদের সবার চোখে তারিফ আর মুগ্ধতা। দৌড় শেষ করেই মিনু ছুটে এসে ফিনিশিং লাইনের ধারে দাঁড়ানো মাকে জড়িয়ে ধরল। ছেলের মুখ চুম্বনে ভরিয়ে তপতী তাকালেন স্বামীর দিকে। মিনু কোমর জড়িয়ে ধরেছে বাবার। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তন্ময়ের মুখে গভীর তৃপ্তির সঙ্গে ফুটে উঠল অহঙ্কার।

”যেভাবে স্টার্ট নেওয়াটা শিখিয়েছিলাম তাতে ফার্স্ট না হয়ে কোনও উপায় নেই। টেকনিক… ইটস টেকনিক, বুঝলে!”

”তার মানে, তোমার স্টার্টিং টেকনিকের জন্যই মিনু ফার্স্ট হল, ওর নিজের কোনও কৃতিত্ব এতে নেই?”

থতমত হয়ে তন্ময় বললেন, ”না, না, সে কী কথা! অবশ্যই মিনু নিজের ক্ষমতায় প্রথম হয়েছে।”

”তুমি শুধু মিনুকেই টেকনিক শিখিয়েছ, চিনুকে কিন্তু কিছুই শেখাওনি।”

”ওকে আর কী শেখাব, একদমই বাচ্চচা, তা ছাড়া খুবই দুবলা, ভেরি, ভেরি উইক।”

তপতী চুপ করে রইলেন। কথাটা খুবই সত্যি। তাঁর ছোট ছেলে খুবই দুবলা। ক্লাস ওয়ানের পঞ্চাশ মিটার দৌড়ের জন্য যখন নাম ডাকা হল, তপতী তখন চিনুকে স্টার্টিং লাইনে পৌঁছে দেওয়ার সময় বললেন, ”তুমি যেমন পারো তেমনই দৌড়িও, কেমন? এটা ওলিম্পিকস নয় যে, গোল্ড মেডেল পেতেই হবে। মজা মনে করো এই দৌড়টাকে। তোমাকে ফার্স্ট হতে হবে না।”

চিনু কথাগুলোর কী অর্থ করল কে জানে, তবে ঘাড় নাড়ল। স্টার্টিং লাইনে সব প্রতিযোগীই বাচ্চচা ছেলে, তার মধ্যে চিনুকে তার রুগণতার জন্য আরও বাচ্চচা দেখাচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে সে অসহায়ের মতো বারবার তাকাল মার দিকে। তপতী হাত নাড়লেন।

শুরুর হুইসল বেজে উঠতেই হইহই করে উঠল দর্শকরা, যার অধিকাংশই বাবা—মা। উৎসাহভরে অনেকেই প্রতিযোগীদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে লাগলেন দূরত্ব রেখে। দৌড় শুরু হতেই চিনু দশ মিটার মতো গিয়েই পেটের কাছে প্যান্টটা ধরে দাঁড়িয়ে মার দিকে তাকাল। তপতী হাত নেড়ে ওকে ছুটতে ইশারা করলেন।

”চিনু, দাঁড়িয়ে থেকো না, দৌড়ও।”

প্যান্ট মুঠোয় ধরে চিনু দৌড় শুরু করল আবার এবং সমাপ্ত করল হাঁসফাঁস করতে করতে সবার শেষে পৌঁছে। সফল প্রতিযোগীদের মায়েরা ছুটে গেল ছেলেদের কাছে, তাদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। চিনু দৌড় শেষ করে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তপতী পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে ঝুঁকে কপালে চুমু দিয়ে বললেন, ”তুমি ফিনিশ করেছ, এতে আমি খুব খুশি হয়েছি।”

কাঁধের কাছে জামায় চোখ মুছে চিনু হাসল। ”সেফটিপিনটা খুলে গেল।”

তন্ময় এগিয়ে এসে বললেন, ”তুই ওভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?” তারপরই প্যান্টে আঁটা সেফটিপিনটার দিকে তাঁর নজর পড়ল। ”এ কী, প্যান্টে ওটা কী?”

”দোষটা আমারই। লন্ড্রি থেকে কেচে আসার পর লক্ষ করিনি বোতামটা ভেঙে গেছে। বেরোবার তাড়ায় আর সময় পাইনি নতুন বোতাম লাগাবার, তাই—।” তপতী অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন। তারপরই গলায় উচ্ছ্বাস এল, ”কিন্তু চিনু রেসটা কেমন শেষ করল বলো।”

”ইয়েস, ইয়েস,” চিনুর পিঠে হালকা চাপড় দিলেন তন্ময়। ”শেষ পর্যন্ত দৌড়েছে, রণে ভঙ্গ দেয়নি। এটাই তো চাই। মিনু তোর নেক্সট ইভেন্টের কল দিচ্ছে। এর পর চিনুর কী আছে?”

”বোধ হয় জিলিপি রেস।”

”মিনু চল, এটাতেও কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে।”

ওরা দু’জন চলে যেতেই চিনু মায়ের কোমর জড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, ”আমি আর নামব না… আমার ভাল লাগছে না।”

”সে কী! জিলিপি রেস কী মজার, তা জানিস? দড়িতে জিলিপি ঝুলিয়ে দেবে, দৌড়ে গিয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে।”

”না মা, আমার ভাল লাগছে না। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।” চিনু অনুনয় করল। তপতী ছেলের কপালে হাত রেখে ভ্রূ কোঁচকালেন।

”তোর গা তো বেশ গরম। জ্বর হয়েছে বোধ হয়। থাক তা হলে, আর দৌড়োদৌড়ি করতে হবে না। আয় বসি।”

চিনুকে কোলে নিয়ে তপতী বসলেন একটা চেয়ারে। পেছন থেকে ঝুঁকে মিসেস সেন বললেন, ”আপনার বড় ছেলেটি খুব ভাল দৌড়েছে।”

মুখ ফিরিয়ে তপতী হাসলেন শুধু।

”মনে হয় সব ক’টাতেই ও ফার্স্ট হবে।”

তপতী আবার হাসলেন।

”আপনার ছোট ছেলের তখন হল কী, দাঁড়িয়ে পড়ল কেন?”

”প্যান্ট খুলে পড়ছিল। বোতামটা ভেঙে গেছে।”

”অ অ। আমি ভাবলুম ঘাবড়ে গিয়ে… ওর সঙ্গে যারা দৌড়চ্ছিল তাদের স্বাস্থ্য তো খুবই ভাল।”

তপতীর মাথা গরম হয়ে উঠল কথাটা শুনে। ভাল স্বাস্থ্য দেখে চিনু ভয় পেয়ে গেছল, এমন একটা ধারণা হল কী করে এই মহিলার! চিনু মায়ের বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। তপতী ওর মাথায় গালে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”বাড়ি যাবি?” চিনু মাথা নাড়ল।

ছেলেকে নিয়ে তপতী উঠলেন। তন্ময়কে খুঁজে বার করে বললেন, ”চিনুকে বাড়ি নিয়ে যাব, পৌঁছে দাও। জ্বর জ্বর লাগছে। আমার মনে হয় এখন ওর শুয়ে থাকা দরকার।”

”আমি এখন যাব কী করে, এই শুরু হতে যাচ্ছে মিনুর ফিফটি মিটারটা। বরং তুমিই গাড়ি নিয়ে চলে যাও, আমরা রায়চৌধুরীর গাড়িতে চলে যাব।” তন্ময় গাড়ির চাবি তপতীর হাতে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন।

তপতী গাড়ি চালান, তবে মহাদেবপুরের মধ্যেই। কলকাতা বা অন্য কোথাও যেতে হলে তিনি স্টিয়ারিং ধরেন না। জি টি রোডের ট্রাফিককে তিনি ভয় পান। বাড়ি যাওয়ার পথেই ডাক্তার সিনহার কোয়ার্টার। তপতীর মনে হল চিনুকে একবার ওঁকে দিয়ে দেখিয়ে নেওয়া ভাল।

ডাক্তার কোয়ার্টারে নেই, কলকাতায় গেছেন সপরিবারে। তপতী ফিরে এসে চিনুকে শুইয়ে দিলেন। থার্মোমিটারে তাপ মাপলেন, প্রায় একশো ডিগ্রি। ছেলেকে জড়িয়ে তিনিও শুয়ে পড়লেন।

রীতিমতো হইহই করে তন্ময় ও মৃন্ময় বাড়িতে ঢুকল।

”হিপ হিপ হুররে…থ্রি চিয়ার্স ফর মৃন্ময় বসুমল্লিক… হিপ হিপ… হুররে।” তন্ময় বাড়ি কাঁপিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। তপতী প্রায় ছুটেই বসবার ঘরে এলেন। বাবা আর ছেলের হাত ভর্তি কাপ, মোট সাতটা। তার সঙ্গে একটা বাক্সে রুপোর মেডেল, চ্যাম্পিয়ানের পুরস্কার। এ ছাড়াও একটা তোয়ালে, একটা কিট ব্যাগ, একটা ওয়াটার বটল আর সার্টিফিকেটগুলো।

”ওমমা, মিনু তো বিপদে ফেলে দিল! এত কাপ এখন আমি রাখি কোথায়?”

তপতী ছেলেকে কাছে টেনে নিলেন। মিনুর মুখ লাজুক হয়ে উঠল।

”এই তো সবে শুরু।” কাপগুলো টেবলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে তন্ময় বললেন। ”এবার থেকে বছর বছর গণ্ডায় গণ্ডায় কাপ—মেডেল আসবে। এগুলো এখন এখানেই থাক, লোকে দেখুক।”

দাদা, একটা কাচের আলমারি তৈরি করিয়ে তাতে সাজিয়ে রাখুন।” পরামর্শটা দিল বেলা।

”সেটা আমিও ভেবেছি। আসার সময় রায়চৌধুরীর বউ তো আজ রাতে মিনুকে নেমন্তন্ন করেছে। পায়েস খাওয়াবে। চিনুকেও পাঠিয়ে দিতে বলেছে।”

”চিনু যেতে পারবে না, জ্বর প্রায় একশো।” তপতী জানালেন।

”ডাক্তার দেখাতে হয় তা হলে।” তন্ময় ব্যস্ত পায়ে ছেলেদের ঘরের দিকে চলে গেলেন। ঘুমন্ত চিনুর কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন, ”সিনহাকে কি একবার ডাকব?”

”ওঁরা সব কলকাতায় গেছেন। তুমি বরং কলকাতায় ফোন করে অপূর্ববাবুর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো। চাইল্ড স্পেশালিস্ট দেখানোই ভাল।”

”হ্যাঁ দাদা, কলকাতার ডাক্তারই দেখান। চিনুর প্রায়ই জ্বর হয়, রাতে খুকখুক করে কাশেও।” বেলা এসব জানে, কেননা রাতে সে ছেলেদের ঘরের মেঝেয় শোয়।

রায়চৌধুরীরা, শুভা এবং রাজেন, বছরখানেক রয়েছে মহাদেবপুরে। মাসছয়েক মাত্র ওদের বিয়ে হয়েছে। ধনী পরিবারের সন্তান। রাজেন টেক্সটাইল এঞ্জিনিয়ার। মা আর বাবা মাঝে মাঝে এসে ছেলের কাছে থাকেন। রাজেন সাউথ ক্লাবে টেনিস খেলত, ক্যালকাটা হার্ডকোর্ট চ্যাম্পিয়ানশিপে দু’বার সেমিফাইনালে উঠে প্রেমজিত লাল নামে জুনিয়ার ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ানের কাছে হেরে গেছল। বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ানশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যায় আর এক তরুণ জয়দীপ মুখার্জির কাছে। অতঃপর রাজেন বুঝে যায় টেনিসে বড় খেলোয়াড় হওয়ার মতো প্রতিভা তার নেই, অতএব পড়াশুনোয় মন দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। টেনিস ছেড়ে দিলেও রাজেন ক্লাব ছাড়েনি। ছুটির দিনে মোটরে সে কলকাতায় যায় শুভাকে নিয়ে। এলগিন রোডে তাকে বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় কাছেই সাউথ ক্লাবে। অল্প খেলা, আড্ডা বেশি এবং পরদিন সকাল ছ’টার মধ্যেই মহাদেবপুরে ফিরে কাজে লেগে যাওয়া। এইভাবেই তারা কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে যাচ্ছে।

আজ তারা কলকাতায় যায়নি স্কুলের স্পোর্টস দেখবে বলে। রাজেনের মা পায়েস রেঁধেছেন। বেলার সঙ্গে রাতে মিনু গেল পায়েস খেতে। অবশ্য পায়েসের সঙ্গে লুচি—বেগুনভাজাও ছিল। মিনুকে পৌঁছে দিয়ে বেলা ফিরল একটা বড় বাটি ভর্তি পায়েস নিয়ে।

”শুভাদির শাশুড়ি দিলেন।” খাওয়ার টেবলে বাটিটা রেখে বেলা জানিয়ে দিল।

”কার জন্য দিলেন?” তন্ময় প্রশ্নটা করেই চামচেতে খানিকটা পায়েস তুলে মুখে দিল। ”নলেন গুড় আর গোবিন্দভোগ চাল, ফাস ক্লাস,… কত দিন যে টেস্ট করিনি এই গন্ধটা!”

”কার জন্য আবার, সবার জন্যই দিয়েছেন।” তপতী সতর্ক গলায় বললেন। ‘ফাস ক্লাস’ শব্দ দুটির আড়ালে কী ইচ্ছা উঁকি দিচ্ছে সেটা অনুমান করতে তাঁর অসুবিধে হয়নি।

”এইটুকু জিনিস কী করে সবাইকে দেবে তুমি!” তন্ময় যেন একটু বেশি রকম অবাক হলেন, ”তার থেকে বরং…” কথা শেষ হওয়ার আগেই তপতী হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বেলাকে বললেন, ”দাদা আজ রাতে কষ্ট করে ওইটুকু পায়েস খেয়েই থাকবেন, ওঁর খাবারটা তুলে রাখো। … মিনুকে ওদের বাড়ি থেকে কখন আনতে যাবে?”

”আনতে যেতে হবে না। শুভাদির শ্বশুর বললেন, পৌঁছে দেবেন। মিনু তো ওনার সঙ্গে দাবা খেলতে বসে গেছে।”

”দাবা?” স্বামী—স্ত্রী প্রায় একসঙ্গেই অবাক প্রশ্ন তুললেন।

”মিনু দাবা খেলতে পারে?” তন্ময় স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন।

তপতী বললেন, ”আমি তো জানি না! কোনও দিন তো খেলতে দেখিনি!”

বিস্মিত তন্ময় চেয়ারে বসে পায়েসের বাটিটা টেনে নিয়ে একবার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, ”একটু চেখে দেখবে নাকি?”

”কালই আমি নলেনগুড় আর গোবিন্দভোগ চাল আনিয়ে পায়েস করে একা সব খাব।” তপতী ঘরে চলে গেলেন, ঝাঁঝালো স্বরে কথাগুলো বলে। থার্মোমিটারে চিনুর তাপ দেখলেন। একই রকম রয়েছে।

”মা আমি কি পায়েস খাব?” দুর্বল স্বরে চিনু বলল।

”খাবে, তবে আজ নয়। আগে সেরে ওঠো।”

”যদি ডাক্তারবাবু বারণ করেন?”

”তা হলে খাবে না।” কথাটা বলে তপতী কষ্ট পেলেন। পায়েস খাওয়ার ইচ্ছা কার না হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য, বিশেষ করে সন্তানের মঙ্গলের জন্য তিনি কঠোর হতে দ্বিধা করবেন না।

”যতদিন না ডাক্তারবাবু তোমায় পায়েস খেতে দিচ্ছেন ততদিন আমিও পায়েস খাব না!”

”কেন তুমি খাবে না?”

”খাব না এই জন্যই, আমার ছোট্ট চিনু পায়েস খেতে না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে, আমিও সেই কষ্টের ভাগ নেব। তা হলে চিনুর কষ্টটা অনেক কমে যাবে। তাই না?”

তপতীর মনে হল চিনুর জ্বরক্লিষ্ট মুখে হালকা একটা হাসি ফুটে উঠল। ”যাঃ, তুমি বাজে কথা বলছ। এইভাবে কি কষ্ট কমে? তোমার যখন পা ভেঙেছিল তখন তো তুমি বিছানায় শুয়ে থাকতে, তোমার মাও কি বিছানায় শুয়ে থাকত তোমার কষ্টের ভাগ নিতে?”

”সবার কষ্ট কি একরকমের হয়? তুমি ছোট, তোমার কষ্ট একরকমের, যখন আমার পা ভাঙে তখন তো আমি যথেষ্ট বড়, তাই আলাদা রকমের কষ্ট হত।”

”কী কষ্ট হত তোমার?”

তপতী একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ”খুব ভোরবেলায় উঠে বাগানে গিয়ে দেখতুম ফুলের নতুন কোনও কুঁড়ি ফুটেছে কি না, খালি পায়ে ভিজে ঘাসের ওপর হাঁটতুম, আমায় দেখলে টমি ছুটে এসে আমাকে ঘুরে ঘুরে লাফালাফি করত আর ল্যাজ নাড়ত, আমি তখন ছুটতুম, টমিও ছুটত… বিকেলে টেনিস খেলতুম দাদার সঙ্গে, বাবা তাড়াতাড়ি কোর্ট থেকে ফিরলে আমাদের সঙ্গে খেলতেন। এইসব কিছুই করতে না পারার জন্য কষ্ট হত।”

”মা, আমি টেনিস খেলব তোমার সঙ্গে। তোমার তো একটা র‌্যাকেট আলমারিতে তোলা আছে, আমি দেখেছি। ওটা দেবে আমায়?”

”নিয়ে কী করবি?”

”বাইরে বাগানে গিয়ে দেয়ালে বল মেরে মেরে খেলব। আমাকে একটা টেনিস বল কিনে দেবে?”

”দেব। এখন আর কথা নয় চিনু, এবার ঘুমো।”

”দাদাকে একটা র‌্যাকেট কিনে দিও, তা হলে দু’জনে খেলব।”

”কিনে দোব… এবার ঘুমো।”

”আমাদের এখানে টেনিস খেলার মতো জায়গা নেই, সেই ক্লাবে গিয়ে খেলতে হয়। এখানে একটা কোর্ট থাকলে খুব ভাল হত, তাই না?”

”হ্যাঁ, ভাল হত।”

”কপালে হাত দিয়ে দেখো, এখন আমার জ্বর নেই।” চিনু মায়ের হাতটা তুলে নিয়ে নিজের কপালে রাখল। তপতীর মনে হল, সত্যিই যেন জ্বরটা কম।”

”রাতে তোর কাশি হয়?”

”হ্যাঁ।”

”একদম ঠাণ্ডা লাগাবি না। এবার থেকে সবসময় সোয়েটার পরে থাকবি।”

ঘরের দরজা থেকে বেলা বলল, ”বউদি, দাদার খাবার কি তুলে রাখব, উনি তো পায়েস খাননি।”

তপতী তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে খাওয়ার ঘরে এসে দেখলেন বাটিতে পায়েস যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। তন্ময় বসার ঘরে বড় সোফায় টানটান শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। তপতী বাটিটা থেকে একটা প্লেটে অর্ধেক পায়েস ঢেলে নিয়ে বেলাকে বললেন,”এটা দাদাকে দিয়ে এসো। আর বোলো কাল পায়েস করব সবার জন্য।”

বেলা ফিরে আসতেই তপতী বললেন, ”এই পায়েসটা তুমি খেয়ে নিয়ো।”

”সে কী বউদি, তুমি খাবে না!”

”না। চিনু ভাল হোক, ওর সঙ্গে খাব।”

এই সময়ই ধুপধাপ পায়ের শব্দ করে মিনু ফিরল, তার সঙ্গে রাজেনের বাবা ব্রজেন রায়চৌধুরী। বয়স প্রায় সত্তর। তামাটে রং, লম্বায় ছয়—দুই, ওজন একশো সত্তর পাউন্ড, মাথাভর্তি ধবধবে ব্যাকব্রাশ করা চুল। চোখে পড়ার মতো হল ওর গোঁফ। খুবই পুষ্ট এবং গোরুর শিঙের মতো ডগা দুটো ওপর দিকে তোলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি মেজর ছিলেন সেনাবাহিনীতে, স্বাধীনতার পর মিলিটারি ছেড়ে এক বিলিতি সওদাগরি অফিসে যোগ দেন। বছর তিনেক আগে বিভাগীয় ম্যানেজারের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। হাতের অফুরন্ত সময় কীভাবে কাটাবেন, ধর্মচর্চায় না গ্রামের বাড়িতে পোলট্রি করে, এই ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে অবশেষে দাবায় মন দেন। এখন তাতেই ডুবে আছেন।

পায়েসের নেমন্তন্ন রাখতে গিয়ে মিনুর চোখ পড়ে বসার ঘরের টেবলে রাখা দাবার ছকের ওপর। কৌতূহলী হয়ে সে ঘুঁটিগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। ব্রজেন ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে সিগার খেতে খেতে তিনবার পড়া আগাথা ক্রিস্টির একটা গোয়েন্দা—বই পড়ছিলেন সময় কাটাবার জন্য আর কিছু না পেয়ে। হঠাৎই তাঁর চোখ পড়ল মিনুর ওপর। তাঁর মনে হল এই বাচ্চচা ছেলেটি দাবায় আগ্রহী। একে যদি খেলাটা শিখিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে সারাদিনে গোটা চল্লিশ হাই তোলা থেকে বোধ হয় রেহাই পাওয়া যেতে পারে।

”দাবা খেলবে?”

”হ্যাঁ।”

”খেলেছ কখনও?”

”না, তবে খেলতে দেখেছি।”

মিনুর সপ্রতিভ উত্তর ব্রজেনের ভাল লাগল। তিনি টেবলে উঠে গিয়ে সাদা ঘুঁটিগুলো ছকে সাজিয়ে বললেন, ”এবার তুমি কালো ঘুঁটিগুলো সাজিয়ে দিতে পারবে?”

মিনু সাজানো সাদা ঘুঁটি দেখে দেখে সাজিয়ে দিল কালো ঘুঁটি এবং বেশ দ্রুতই।

”ঘুঁটিগুলোর নাম জানো?”

”হ্যাঁ। এটা গজ, এটা ঘোড়া, এটা নৌকো, এটা রাজা।”

”কোনটের চাল কীরকম তা জানো?”

”জানি।”

”ঘোড়ার চাল দেখাও তো।”

মিনু আড়াই চাল দেখাল। ব্রজেন অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুমি শিখলে কার কাছে? বাড়িতে কেউ খেলে না কি?”

”স্কুলে দু’জন সার টিফিনের সময় টিচার্স রুমে খেলেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি।” মিনুর দাঁত ঝলসে উঠল হাসিতে। ”দেখতে, দেখতে খানিকটা শিখে গেছি।”

”দেখি তো কেমন তুমি শিখেছ!” ব্রজেন উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন। যদি একটা খেলার সঙ্গী জোটে। ”তোমার সাদা ঘুঁটি, আমার কালো। নাও চাল দাও।”

মিনু রাজার সামনের বোড়ে দু’ঘর এগিয়ে দিল। ব্রজেন তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে প্রথম চাল দিলেন। দশ—বারো চাল খেলার পর তাঁর মনে হল, ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে খেললেও এই বাচ্চচা ছেলেটিকে এক মাসের মধ্যে চলনসই প্রতিপক্ষ হওয়ার মতো করে গড়ে তুলতে পারবেন। মিনু তার প্রথম খেলায় হারল পনেরো চালে।

”ঘুঁটি সাজাও, এবার আমার সাদা।” ব্রজেন উত্তেজনা বোধ করছেন। নিভে যাওয়া সিগারটা ধরালেন।

”দাবা এখন থাক।” ব্রজেনের স্ত্রী তাড়া দিলেন। ”খেয়ে নিয়ে বরং আবার বোসো, লুচি ভাজতে শুরু করেছে বউমা।”

খাওয়ার সময় ব্রজেন মিনুর পিঠে হাত রেখে শুভাকে বললেন,”মিনু যে এত তাড়াতাড়ি খেলাটা ধরে ফেলবে, ভাবতেই পারিনি। আমার একটা সমস্যা মিটে গেল বউমা।”

”মিনু আজ কত প্রাইজ পেয়েছে যদি দেখতেন! আপনার ছেলে বলছিল, ও ন্যাচারাল অ্যাথলিট, যে খেলা ধরবে তাতেই ওপরে উঠবে। হবে নাই—বা কেন, বাবা—মা দু’জনেই অল্পবিস্তর স্পোর্টসের মধ্যে ছিল, বাবা সাঁতারে, মা টেনিসে। পরিবারের আবহাওয়াও তো অনেক সাহায্য করে ছেলেমেয়েদের।”

”তোমার এক ভাইকে দেখেছি, কী যেন নাম?” ব্রজেন জানতে চাইলেন মিনুর দিকে তাকিয়ে।

”চিন্ময়, চিনু। … কাকিমা, আমি আর একটা বেগুনভাজা খাব।”

ব্রজেন তারিফ ভরা স্বরে বললেন, ”মিনু তো দেখছি ভাল খাইয়েও। বউমা, একটা নয়, দুটো বেগুনভাজা আর লুচি, চলবে তো?” মিনু সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। ”চিনু আজ ক’টা প্রাইজ পেল?” ব্রজেন প্রশ্ন করলেন মিনুকে।

”একটাও নয়। জ্বর এসে গেল, একটায় নেমে আর নামেনি।”

শুভা বলল, ”বড় রুগণ ছেলেটা, খেলাধুলো ওর দ্বারা হবে না।”

খাওয়ার পর ওরা দু’জন আবার খেলতে বসল। মিনু প্রতিপক্ষের ঘুঁটির দিকে হুঁশ না রেখে চাল দিলেই ব্রজেন প্রত্যেকবারই তার ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন।

”তুমি যে মন্ত্রীটা ওইখানে দিলে কিন্তু লক্ষ করলে না আমার গজ ওই কোণ থেকে এসে একে মেরে দেবে। নাও, চাল ফিরিয়ে নতুন চাল দাও। … আমি কিন্তু আর চাল ফেরত দেব না বলে রাখলাম।”

মিনু একবার ঘোড়া দিয়ে একটা বোড়েকে খেতেই ঘোড়ার খালি করে দেওয়া ঘরে ব্রজেন তাঁর মন্ত্রীকে তুলে মিনুর রাজাকে কিস্তি দিলেন। ”আমি ইচ্ছে করেই বোড়েটাকে তোমার ঘোড়ার মুখে ফেলে দিয়েছিলাম, দেখি তুমি টোপ গেলো কি না। তুমি গিলে ফেললে আর আমারও কিস্তি দেওয়ার রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল। … ভাবো, সময় নিয়ে প্রত্যেকটা চাল দেওয়ার আগে ভাবো। সবদিক বিবেচনা করো। একদম তাড়াহুড়ো করবে না।”

হেরে গিয়ে মিনুর মুখ প্রায় লাল হয়ে উঠল। চোখে হেরে যাওয়ার লজ্জা, সেটা লক্ষ করে ব্রজেন বললেন, ”খেলা শিখেই কেউ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান বটভিনিকের মতো খেলতে পারে না। তুমি এখন বারবার আমার কাছে হারবে, তারপর এমন একটা সময় আসবে যখন তুমিই আমায় বারবার হারাবে। হারা আর হারানো এই দুইয়ের মাঝে শুধু প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস।”

”আর এক হাত খেলব।” মিনু চোখ নামিয়ে বলল।

”আর নয় আর নয়, রাত হয়ে গেছে।” শুভা তাড়া দিল। ”মিনু, বাড়ির সবাই ভাববে, এবার বাড়ি যাও।”

”খেলুক না বউমা।”

”না বাবা, দশটা বাজে। ওইটুকু ছেলের এখন শুয়ে পড়ার কথা।”

”ঠিক আছে, তা হলে কাল আবার আমরা বসব, কেমন? এবার চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

।।২।।

তন্ময়ের বন্ধু অপূর্ব হালদারের চেম্বার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে ধর্মতলা স্ট্রীটে। লন্ডন থেকে ডিগ্রি পাওয়া শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, তন্ময়ের স্কুলের সহপাঠী। চিনুকে দেখাবার জন্য তারিখ ও সময় ঠিক করতে তন্ময় ফোন করেছিল অপূর্বকে। ”তোর ছেলেকে দেখাবার জন্য আবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগবে নাকি! যেদিন খুশি, রবিবার বাদে সন্ধে ছ’টা থেকে আটটার মধ্যে চলে আয় চেম্বারে।” তন্ময় এই উত্তর পেয়েছিল।

”তা হলে আর দেরি করে লাভ নেই, কালই চলো।” উদ্বিগ্ন স্বরে বলেছিল তপতী। ”জ্বরটা রয়েই গেছে। বাড়ছে কমছে, সঙ্গে কাশিটাও, ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না।”

সুতরাং পরদিন যাওয়াই ঠিক হল। বিকেল পাঁচটা নাগাদ তারা মহাদেবপুর থেকে রওনা হয়। মিনুকে নিয়ে সামান্য ঝামেলা হল রওনা হওয়ার আগে। সাড়ে তিনটের সময় স্কুল থেকে ফিরেই সে বাড়ির কাছে একটা ছোট মাঠে ফুটবল খেলতে যেত। এখন আর যায় না। এখন যায় ব্রজেনদাদুর সঙ্গে দাবা খেলতে। দাবা তাকে রীতিমতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বল খেলার বদলে রোজ সে ঘণ্টা তিনেক বসে থাকে দাবার ছকের সামনে, একটা বুড়োমানুষের মতো।

সেদিন যথারীতি সে দাবার ছকের দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিন্তায় মগ্ন। এমন সময় বেলা গিয়ে তাকে ডাকল। ”মিনু শিগগির এসো, ওরা সবাই রেডি হয়ে গেছে, তুমি গেলেই গাড়িতে উঠবে।”

মিনু তখন তার ঘোড়াকে বাঁচাবার জন্য কোথায় সরাবে ভেবে পাচ্ছে না। বেলার কথা শুনে রেগে উঠে সে বলল, ”আমি যাব না যাও। চিনুকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে তো আমি গিয়ে কী করব? এখন ভাগো।”

বেলা ফিরে এসে তন্ময় ও তপতীকে শুনিয়ে দিল মিনুর কথাগুলো। তন্ময় প্রায় লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে তপতী বললেন, ”তোমায় যেতে হবে না, আমি যাচ্ছি।” তপতী দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।

”মিনু, বাবা অপেক্ষা করছেন।” তপতী কথাটা বলে ব্রজেনবাবুর দিকে তাকালেন, ”আমরা কলকাতা যাব, মিনুও সঙ্গে যাবে। আজ আর ও খেলবে না।”

”তোমরা যাও না…” আবদেরে নাকি সুরে মিনু বলতে শুরু করেছিল।

”মিননু।” কঠিন চাপা স্বরে তপতী তাকে থামিয়ে দিলেন, ”উঠে এসো।”

মায়ের চোখে ধকধকে আগুন দেখে মিনু উঠে পড়ল।

”মায়ের কথা শুনতে হয়। খেলা আজকের মতো অ্যাডজোর্নড রইল।” মিনুর পিঠে হাত রেখে স্নেহভরে ব্রজেনবাবু বললেন, ”ছকে ঘুঁটিগুলো যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকবে। কাল আবার শুরু হবে, আমি প্রথমে চাল দেব, কেমন? এখন যাও। বাবা—মার অবাধ্য হতে নেই।”

তারা অপূর্ব হালদারের চেম্বারে পৌঁছল সওয়া ছ’টায়। বসার ঘর ভর্তি রোগী আর সঙ্গের লোক। তন্ময় ছাপা স্লিপে নাম লিখে পাঠাল। ডাক্তারকে দেখিয়ে একজন বেরিয়ে আসতেই তাদের ডাক পড়ল। অপূর্ব ছোটখাটো গোলগাল চেহারার মানুষ, চোখে চশমা, মুখে সবসময় হাসি। অনেকদিন পর দেখা হলে যেরকম কথাবার্তা হয় তাদের মধ্যে, তাই হল। বাইরে রোগীরা অপেক্ষা করছে, তাই ডাক্তার কথা বদল করে চিনুর দিকে নজর দিলেন। চোখ, জিভ, বুক, শ্বাস—প্রশ্বাস, গলার ভেতর, পেট ইত্যাদি শরীরের সাধারণ পরীক্ষাগুলো করতে করতে তিনি তপতীর কাছ থেকে চিনুর নিয়মিত জ্বর হওয়া, কাশি হওয়া সম্পর্কে খবর নিয়ে ভুরু কোঁচকালেন।

”ছেলেটা বড় রোগা। ওকে কি বড় ছেলেটার মতো স্বাস্থ্যবান করা যায় না?” তন্ময় কথাটা বলে মিনুর কাঁধে হাত রাখলেন সস্নেহে।

”কেন মোটা করা যাবে না! শরীরের যত্ন নিলে, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলো, ছোটাছুটি করলে, মন প্রফুল্ল থাকলে স্বাস্থ্য ভাল হবেই। তার আগে এখন দেখতে হবে ওর শরীরে অসুখটা কী।” অপূর্ব চিনুর মুখের দিকে চোখ রাখলেন। ডাক্তারের মুখে হাসি থাকলেও তপতীর বুক ছমছম করে উঠল। বেচারা চিনু। বসে—যাওয়া চোখমুখ এখন যেন আরও বসে গেছে।

ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে তন্ময়ের হাতে দিয়ে বললেন, ”বুকটা এক্স—রে করিয়ে নে আর সেইসঙ্গে মানটু টেস্টও।”

শুনেই তপতী প্রায় আর্তনাদের মতো স্বরে বললেন,”সে কী। এসব তো…।”

ভয়ে আর বাকি কথাগুলো বললেন না।

”এগুলো রুটিন চেক—আপ। টিবি যে হয়েছেই আপনি তা ধরে নিচ্ছেন কেন?” তপতীর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে ডাক্তার তাকালেন। ”কিংবা যদি হয়েই থাকে তাতেই বা ভয় পাওয়ার কী আছে। টিবির অ্যালার্জি আছে কি না সেটা বোঝার জন্যই মানটু টেস্ট। অন্য অনেক রোগের ব্যাপারেও এই টেস্ট করা হয়। তা ছাড়া এমন এমন সব ওষুধ বেরিয়েছে, কমপ্লিটলি সারিয়ে দেবে। এখন প্রোটিন, ভিটামিন, আয়রন এইসব ওর দরকার। ওষুধগুলো লিখে দিলাম, ঠিকমতো খাওয়াবেন।” ডাক্তার খুব সহজ ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে গেলেন। কিন্তু তপতী তাতে আশ্বস্ত বোধ করলেন না। ছোট্ট চিনুর অবোধ সরল মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখ জলে ভরে এল।

”তন্ময়, এক্স—রে—টা ভাল জায়গা থেকে করবি। তোদের ওখানে তো মিলের হাসপাতাল আছে, কেমন সেটা?”

”অফিসারদের জন্য ব্যবস্থা ভালই, তবে লেবারদের জন্য নয়।”

”এক্স—রে প্লেট আর মানটু টেস্টের রিপোর্ট আমাকে দেখিয়ে যাবি, আর ওষুধগুলো এখনই যাওয়ার পথে কিনে নিয়ে যা, আজ থেকেই খাওয়াতে শুরু কর। লিখে দিয়েছি কখন কতবার খাওয়াতে হবে।”

ওরা চেম্বার থেকে যখন বেরিয়ে আসছে ডাক্তার তখন বললেন, ”তন্ময়, তোর বড় ছেলেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন শরীরের ওজন একটু বেশিই। কত ওজন এখন? বয়স কত হল?”

”বলতে পারব না, ওজন কখনও করাইনি। বয়স নয় চলছে। জিজ্ঞেস করলি কেন, খারাপ কিছু?” তন্ময়কে উৎকণ্ঠিত দেখাল।

”বয়সের তুলনায় তো বড়ই দেখাচ্ছে। খারাপ কেন হবে, বেশ ভাল হেলথ। তবে এক্সারসাইজ না করলে মোটা হয়ে যেতে পারে। খেলাধুলো করে?”

”তা করে। স্কুলের স্পোর্টসে সাতটাতে ফার্স্ট হয়েছে।”

”গুড, ভেরি গুড।”

মহাদেবপুরে ফেরার পথে তন্ময় ওষুধগুলো কিনে নিলেন। গাড়ির পেছনের সিটে তপতী দুই ছেলেকে নিয়ে বসেছিলেন। সারা পথ তারা খুব কমই কথা বলল। একসময় মিনু জিজ্ঞেস করল, ”মা, টিবি কি একটা অসুখ?”

হ্যাঁ।

চিনুর কি টিবি হয়েছে? তপতী চমকে উঠে চিনুকে জড়িয়ে ধরলেন। ”না, হয়নি।”

পরদিন তপতী মিলের হাসপাতালে চিনুকে নিয়ে গেলেন। তাকে দেখে অল্পবয়সি ডাক্তার সিনহা অবাক হয়ে বললেন, ”কী ব্যাপার বউদি, আপনি এখানে! কিছু হয়েছে নাকি? দাদা কোথায়?”

”কারও কিছু হয়নি। সবাই ভাল আছে, শুধু আমার এই ছোট ছেলেটা ছাড়া। আপনাকে ভাই দুটো কাজ করে দিতে হবে। আপনার দাদার বন্ধু ডাক্তার হালদার কাল চিনুকে পরীক্ষা করে ওর বুকের এক্স—রে আর মানটু টেস্ট করাতে বললেন।”

তপতী প্রেসক্রিপশনটা বিস্মিত ডাক্তার সিনহার হাতে তুলে দিলেন। সেটা পড়তে পড়তে ডাক্তার বার—দুই চিনুর দিকে তাকালেন। তপতীকে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না।

”আপনি একটু বসুন, ব্যবস্থা করছি।” ঘর থেকে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন, এবং ফিরলেন মিনিট পাঁচেক পর। ”ওকে নিয়ে আসুন। আপনার ভাগ্য ভাল, এক্স—রে মেশিনটা আজ সুস্থ আছে, চারদিন ধরে কাজ করছিল না।”

চিনুর বুকের ছবি নেওয়া হল। ডাক্তার ওর বাঁ হাতের পুরো বাহুতে ছুঁচ ফুটিয়ে ওষুধ ঢুকিয়ে হাতের সেই জায়গাটায় একটা টাকার মাপের বৃত্ত এঁকে দিলেন কালি দিয়ে। বৃত্তের মধ্যে চামড়ার রং বদলায় কি না বা ফুলে ওঠে কি না সেটা তিনদিন লক্ষ করতে হবে। ব্যাপারগুলো চিনু কৌতূহলভরে দেখে গেল।

তিনদিন ধরে তপতী বার বার চিনুর হাতটা নজর করলেন। বৃত্তের মধ্যে চামড়া ক্রমশই গোলাপি হতে শুরু করল, ওখানকার চামড়াটা ফুলেও উঠল। আর সেই সঙ্গে তপতীও মনে মনে ভেঙে পড়লেন। যা ভয় করেছিলেন বোধহয় সেটাই তবে ঘটেছে। এবার আর নিজে নয়, তন্ময়কে তিনি চিনুর সঙ্গে পাঠালেন, হাসপাতালে। গম্ভীর মুখে আধঘণ্টা পর তন্ময় ফিরলেন ডাক্তার সিনহার মানটু টেস্ট রিপোর্ট পকেটে নিয়ে।

”কী লিখেছে রিপোর্টে?” ব্যাকুল তপতী জিজ্ঞেস করলেন।

”যা ভয় করেছিলে তাই, পজিটিভ। কালই ওকে নিয়ে অপূর্বর কাছে যাব। দেরি করব না চিকিৎসা শুরু করতে।” তন্ময় অধৈর্য কণ্ঠে বললেন।

.

এক্স—রে থেকে চিনুর ফুসফুসে সামান্য একটা স্পট পেয়েছিলেন ডাক্তার হালদার। তন্ময়কে তিনি বললেন, ”খাওয়ার ওষুধগুলো লিখে দিচ্ছি, ইঞ্জেকশন ওখানকার ডাক্তারকে দিয়ে দিইয়ে নিবি। তিনমাস পর আবার এক্স—রে করিয়ে আমায় দেখাবি। একদম ভয় পাবি না, ওর যা হয়েছে সেটা প্রায় কিছুই নয়।” এ ছাড়াও তিনি চিনুর খাওয়া, থাকা, পোশাক, ঘোরাফেরা ইত্যাদি বিষয়ে কী কী যত্ন নিতে হবে তাও তন্ময়কে বলে দেন।

এর পরই বসুমল্লিক পরিবারে একটা পরিবর্তন এসে গেল। আলো বাতাস রোদ আসে এমন ঘরে চিনুর থাকা দরকার আর সে রকম দক্ষিণ—পুব খোলা ঘর বাড়িতে একটাই। বসবার ঘর। তপতী বললেন, ”দরকার নেই আমার বাইরের লোকজন আসার, তাদের বসাবার জন্য ঘর। চিনু ওই ঘরেই থাকবে।” তন্ময় তাতে সায় দিয়ে বলেন,”সোফাটোফাগুলো খাওয়ার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি, কেউ এলে ওখানেই বসবে।”

পরিবর্তন এল খাওয়ার ব্যাপারেও। শুধু চিনুর জন্যই নয়, মিনুর জন্যও দুধ, মাখন, ছানা, ডিম, ভেজানো ছোলা—মটর। বেড়ে গেল ডাল ও সবুজ শাকপাতা, ডাঁটা, মাটির নীচে জন্মানো আনাজ। পেয়ারা, কলা বা মরসুমি ফল। মাছের পরিমাণও বাড়ল। সপ্তাহে তিনদিন চিকেন স্টু।

”রোগটা ছোঁয়াচে, আমার মনে হয় আলাদা বাসন থাকা দরকার চিনুর জন্য।” তন্ময়ের এই কথায় সায় দিলেন তপতী। সাবধানের মার নেই, বাড়িতে আরও একটা ছেলে রয়েছে। অতঃপর চিনুর জন্য প্লেট, গ্লাস, বাটি ইত্যাদি কেনা হল।

একদিন রাত্রে সকলের খাওয়াদাওয়ার পর চিনুকে ঘুম পাড়িয়ে তন্ময় ও তপতী খাওয়ার ঘরে বসে কথা বলছিলেন।

”এবার থেকে জল ফুটিয়ে খাওয়াই উচিত। এখানে ট্যাঙ্কের যে জল, তাতে কত যে ব্যাকটিরিয়া।” তপতীর কথাটাকে সমর্থন করলেন তন্ময়। যদিও তিনি মহাদেবপুরের পৌর বিভাগের কর্তা, তবু তিনি জলের পরিশুদ্ধতায় পুরো আস্থা রাখেন না।

”আমাদের এখন মনেপ্রাণে ছেলেদের স্বাস্থ্যের কথাটা ভাবতে হবে। কে ভেবেছিল এমন একটা রোগ, যেটা না খেতে পাওয়া, অস্বাস্থ্যকর জায়গায় থাকা লোকেদেরই হয়, সেই রোগ কিনা আমার ছেলের হল!” তন্ময়ের গলায় ক্ষোভ আর অসহায় ক্রোধ। ”কেন হবে চিনুর, কেন, কেন? এবার থেকে একটা রোগকেও আর বাড়িতে ঢুকতে দেব না। সাধ্যে যতটা কুলোয় আমি চেষ্টা করে যাব।”

”সেজন্য তা হলে খরচ করতে হবে।” তপতী দ্বিধাভরে বললেন। সংসারটা তাঁকেই চালাতে হয় এবং সেজন্য নির্ভর করতে হয় স্বামীর বাঁধা বেতনের ওপর।

”করব খরচ। ছেলেদুটোই তো আমাদের সবকিছু। ওদের সবল, সুস্থ রাখা, লেখাপড়া শিখিয়ে দশজনের একজন করে তোলা, এজন্য আমার শেষ কপর্দকও খরচ করব।” কথাগুলো বলে তন্ময় এমনভাবে তপতীর দিকে তাকালেন, যেন জটিল একটা অঙ্ক কষে ফেলে ফলটা ঠিক হয়েছে কি না জানতে চাইছেন।

”এজন্য আমাদের কষ্ট করতে হবে।” তপতী শান্তস্বরে বললেন।

”হবেই তো। কষ্ট না করলে কি সফল হওয়া যায়?” তন্ময় উত্তেজিত হয়ে তালুতে ঘুসি বসালেন।

”দেখো, আমার মনে হচ্ছে মিনুর এই দাবা খেলাটা বন্ধ করতে হবে। এটা নেশার মতো ওকে পেয়ে বসেছে। আগে বিকেলে মাঠে খেলতে যেত, এখন যায় না। এইটুকু ছেলের পক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকাটা ভাল নয়।”

”তা তো নয়ই, কিন্তু করবটা কী?” তন্ময়কে অসহায় দেখাল। ”কিছু একটা তো করতে হবে।” তপতীর স্বরে দৃঢ়তা ফুটে উঠল।

.

প্রতিদিনের মতো মিনু আর চিনুকে নিয়ে তপতী ভোরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। রোজই তারা হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে যায়। পিচঢালা রাস্তাটা ফেরিঘাটে শেষ হয়েছে। সেখানে একটা কাঠের বেঞ্চে তারা বসে। ভোরের নির্মল বাতাস নদীর ওপর দিয়ে এসে তাদের শরীরকে তাজা করে তোলে। বুকভরে তারা টাটকা বাতাস জমা করে। ফেরার সময় মিনু দৌড়য়। তখন চিনু বলে, ”মা, দাদার সঙ্গে আমিও দৌড়ে বাড়ি যাব।” তপতী ওকে দৌড়তে দেন না। ”আগে ডাক্তারবাবু বলুন, তারপর।”

কিন্তু আজ চিনু বায়না ধরল, সে দৌড়বেই। কী ভেবে তপতী বললেন,”আচ্ছা। কিন্তু জোরে নয়।”

.

মিনু লম্বা কদমে জোরেই ছুটতে শুরু করল, তার পেছনে চিনু। ভোরের নির্জন রাস্তায় তখন গাড়ি চলা শুরু হয় না। ওরা নিশ্চিন্তেই ছুটছিল। বড় রাস্তা থেকে বাঁ দিকে বেঁকে ওরা একটা সরু রাস্তায় ঢুকে গেল। তপতী হাঁটার বেগ বাড়ালেন, ছেলেরা তাঁর দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হতেই।

মিনুর অনেক পেছনে চিনু। রাস্তার দু’ধারে মিলের ব্যারাক। কম মাইনের শ্রমিকরা এখানে থাকে। একতলা টানা লম্বা বাড়িগুলো ছাড়িয়ে কিছুটা ফাঁকা মাঠ, তারপর ডান দিকে ফিরে আবার একটা চওড়া রাস্তা। মিনু ব্যারাকটার শেষপ্রান্তে যখন পৌঁছেছে তখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়েই থেমে পড়ল। চিনু ভয়ে সিঁটিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আর দুটো কুকুর তাকে কামড়াবার জন্য তেড়ে যাচ্ছে পায়ের গোড়ালি তাক করে।

”চিইনউউ।” বলে চিৎকার করে মিনু পাগলের মতো ছুটতে শুরু করল ছোট ভাইয়ের দিকে। দাদাকে ছুটে আসতে দেখে চিনু প্রায় চোখ বুজে মিনুর দিকে ছুট দিল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুর দুটো তার পিছু নিল। মিনু যখন জড়িয়ে ধরল ভাইকে, একটা কুকুর তখন চিনুর কেডসে প্রায় দাঁত ছুঁইয়ে ফেলেছে। চিনুকে পিছনে ঠেলে দিয়ে মিনু দু’হাত মুঠো করে শূন্যে এলোপাথাড়ি ঘুসি চালাতে শুরু করে দিল। কুকুর দুটো আর না এগিয়ে দাঁত বার করে বারবার তেড়ে যেতে লাগল।

সেই সময় ব্যারাক থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে, দুটো তেরিয়া কুকুরের সামনে একটি ছেলেকে ঘুসি চালিয়ে যেতে দেখে কুকুরদুটোকে ধমকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, ”আর কিছু করবে না, এবার তোমরা যাও। তবে ছুটো না।”

মিনু ভাইয়ের কাঁধ একহাতে জড়িয়ে ধরে টানল, ”ভয় কী রে? আমি থাকতে ভয়ের কিছু নেই। চল, এবার হেঁটে হেঁটে যাই। খানিকটা গিয়ে আবার দৌড়ব।”

চিনু থরথর কাঁপছে। ভয়ে ফ্যাকাসে মুখে রক্ত তখনও ফিরে আসেনি। দাদার হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ”কামড়ে আমার মাংস খুবলে নিত, না রে?”

”অত সোজা যেন, খোবলাব বললেই যেন খোবলানো যায়। টেনে এমন একটা লাথি মারতাম যে, দাঁতগুলো ভেঙে যেত।” মিনু লাথি ছুড়ে দেখাল। তাচ্ছিল্যে ঠোঁট বাঁকাল।

”দাদা, তুই মাকে বলে দিবি না তো?”

”বললে কী হয়েছে?”

”মা তা হলে আমায় আর ছুটতে দেবে না।”

”তা হলে ছোট আমার সঙ্গে। না ছুটলে অসুখ সারবে না।”

ঘটনাটার কথা তপতী জানতে পারেননি। তার বদলে জানতে পারলেন আর একটা কথা। যেভাবেই হোক চিনুর অসুখটার কথা গোপন করা সত্ত্বেও অনেকেই জেনে গেছল। একদিন মিনু স্কুল থেকে ফিরে এসে তপতীকে বলল, ”জানো মা, সুব্রত আজ আমার ওয়াটারবটল থেকে জল খেল না।”

”কেন? তুই জল দিতে গেছলি কেন?”

”ও আজ ওয়াটারবটল নিয়ে যেতে ভুলে গেছল। ক্লাসে ওর খুব তেষ্টা পেয়েছিল তাই দিলীপের কাছে জল চাইল। আমি বললুম, ‘আমারটা থেকে খা’, ও বলল, ‘তোর ওয়াটারবটল থেকে জল খাব না। তোদের বাড়িতে ক্ষয়রোগের রুগি আছে। তোর জল খেলে আমারও ক্ষয়রোগ হবে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক্ষয়রোগ কাকে বলে?’ ও বলল,’ক্ষয়ে ক্ষয়ে ভ্যানিশ হয়ে যায় বলে এর নাম ক্ষয়রোগ।’ হ্যাঁ মা, সত্যি? চিনু ভ্যানিশ হয়ে যাবে?”

শুনতে শুনতে তপতীর চোখে জল এসে গেল। কথাগুলো নিশ্চয় সুব্রত বাড়িতে শুনেছে বলেই বলেছে। বাড়ির লোকরা কী নিষ্ঠুরের মতো এইরকম কথাবার্তা বলেছে। সুব্রত মজুমদারের মা প্রতিভা খুবই অমায়িক, মিষ্টভাষী, প্রায়ই স্বামীর সঙ্গে অফিসার্স ক্লাবে যান, সেখানে গল্পের আসর বসান। তপতীকে দেখলেই বলেন, ”এই যে পূর্ণিমা, তোমার অমাবস্যাটি কোথায়?”

গরম লোহার শিকের মতো ‘ভ্যানিশ’ শব্দটা ঢুকে গিয়ে তপতীর মাথাটা গরম করে দিল। একটা জেদ তাঁকে ধীরে ধীরে পেয়ে বসল। তিনি স্থির করলেন আজই ক্লাবে যাবেন এবং চিনুকে সঙ্গে নিয়ে।

সন্ধ্যার পর বসুমল্লিকরা চিনুকে নিয়ে ক্লাবের সামনে ভক্সহল থেকে নামলেন। সঙ্গে ফুটোনো জলে ভরা ওয়াটারবটল। মিনুকে তাঁরা সঙ্গে আনেননি। ক্লাবের লনে ছোট ছোট টেবল ঘিরে চেয়ার। দশ—বারোটি দম্পতি এবং তাঁদের বাচ্চচা ছেলেমেয়েরা চেয়ার ভরিয়ে রেখেছে। একটি টেবল ঘিরে পাঁচজন মহিলা, তাদের মাঝে প্রতিভা মজুমদার হাত নেড়ে নেড়ে, ভ্রূ নাচিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন, বাকি চারজন মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। তপতী আর তন্ময়কে দেখে প্রতিভা আজ আর হাত তুললেন না। ফিসফিস করে অন্যদের কী যেন বললেন। সকলেই মুখ ঘুরিয়ে বসুমল্লিকদের দিকে তাকাল।

লনের মাঝখানে লোহার পোস্টের মাথায় উজ্জ্বল বিদ্যুতের আলো। তার নীচে একটা ফাঁকা টেবলে ওঁরা বসলেন। বেয়ারা এল, কিছু খাবে কি না জানতে।

”কী আছে আজ?” তন্ময় জানতে চাইলেন।

”চিকেন পকৌড়া, শিঙাড়া, চানা—মটর।”

তন্ময় হাত তুলে বেয়ারাকে থামিয়ে দিলেন। ”ওসব খাবার চলবে না।”

”তিন গ্লাস জল দাও আগে, তারপর এক পট চা আর তিনটে কাপ।” তপতী ফরমায়েশ দিলেন। তারপর চিনুকে বললেন, ”যা, দোলনায় চড় গিয়ে।”

একধারে দুটি দোলনা, স্লিপ এবং সি—স্য রয়েছে বাচ্চচাদের খেলার জন্য। কিছু বাচ্চচা খেলছে। দোলনায় দুলছে দুটি মেয়ে। চিনু গিয়ে দোলনার পাশে অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎই প্রতিভাদের টেবল থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ”শিলু, শিগগির চলে এসো এখানে।” কিন্তু শিলু নামের মেয়েটি মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে দুলেই চলল। তার মা উঠে গিয়ে দোলনা থামিয়ে শিলুর গালে চড় কষিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এলেন।

খালি দোলনাটায় চিনু উঠতে পারছিল না, তপতী উঠে গিয়ে তাকে বসিয়ে দিয়ে দোল দিতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেক পর ছেলেকে নিয়ে টেবলে ফিরে এলেন। বেয়ারা চা ও জল দিয়ে গেছে। একটা গ্লাস থেকে জল ফেলে দিয়ে বাড়ি থেকে আনা জল তাতে ভরে চিনুকে বললেন, ”একটু জল খা।”

চিনু যখন জল খাচ্ছে, তপতী আড়চোখে দেখলেন প্রতিভা তাঁদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনটি কাপে তিনি চা ঢাললেন, তবে একটিতে যৎসামান্য। সেটি চিনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ”এক চুমুক, ব্যস।” জীবনে চা খায়নি চিনু, সে অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। ”যা বলছি কর, ঠিক এক চুমুক।”

চিনু তাই করল। তপতী আড়চোখে তাকালেন আবার এবং মনে মনে হাসলেন। সেই সময় ক্লাবে ঢুকল রাজেন এবং শুভা। বসুমল্লিকদের দেখতে পেয়ে তাদের টেবলেই ওরা এসে বসল। বেয়ারা এল। কী খাদ্য আছে, জানতে চাইল রাজেন এবং শুনে নিয়ে সে তন্ময়কে বলল, ”দাদা তা হলে পকৌড়াই আনাই। বউদি, শিঙাড়া চলবে?”

”না।” হেসে তপতী বললেন, ”কোনওটাই না।”

”সে কী! আমি তো আপনাদের খেতে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।”

”যে খাবার আমার ছেলেদের খেতে দিই না, সে খাবার এখন আমরাও খাচ্ছি না।” তন্ময় উত্তর দিলেন। ”আসলে চিনুর এই অসুখটাই আমাদের সচেতন করে দিয়েছে। আমাদের, মানে ছেলেদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা। ওদের ভাল স্বাস্থ্য গড়ে দেওয়ার কাজে আমরা নেমেছি। সেজন্য কিছু বিধিনিষেধ আমরা মানছি। তার মধ্যে রয়েছে এই খাওয়ার ব্যাপারটা। মুখরোচক এইসব খাবার ওদের খেতে দিই না, সেজন্য আমরাও খাই না।” তন্ময় হাসতে শুরু করলেন।

”দারুণ কাজে নেমেছেন তো।” এই বলে রাজেন পাশে দাঁড়ানো বেয়ারাকে বলল,”শুধু চা দাও।”

”কিছু খাবে না তোমরা!” তন্ময় বললেন কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে।

”না দাদা। কিছু বিধিনিষেধ আমিও আজ জারি করলাম। যে খাবার আপনারা খাবেন না, সে খাবার…।”

রাজেন শেষ করার আগেই তন্ময় হেসে উঠলেন। ”নিষেধ মেনে শেষ পর্যন্ত চলতে পারবে তো? বাঙালির নোলা বিশ্বাসঘাতকতায় খুব পটু।”

”আপনাদের একটা কাজের তো পরিচয় পেলাম, এর পর আর কী কাজে নেমেছেন?”

”নামা হয়নি, তবে নামার জন্য চিন্তা করছি।” তপতী বললেন। ”ওদের কোনও একটা খেলা শেখানোর ব্যবস্থা করা। শুধুমাত্র পুষ্টিকর খাওয়া দিয়েই তো স্বাস্থ্য হয় না, শরীর গড়তে পরিশ্রমেরও দরকার হয়।”

”আচ্ছা রাজেন, ওদের কোন খেলা শেখানো যায় বলো তো?”

তন্ময়ের বলার ভঙ্গিতে বোঝা গেল তিনি এটা নিয়ে চিন্তিত।

”এখানে খেলা শেখানো!” ভ্রূ কপালে তুলে রাজেন হতাশভাবে মাথা নাড়ল।

”এখানে মাঠটাঠ আছে, কিন্তু লোকের কোনও উৎসাহ নেই। এই দেখুন না ওই যে টেনিস কোর্টটা, কত বড় বড় ঘাস গজিয়ে গেছে, কেউ খেলে না বলেই তো! সবাই তাস আর ক্যারাম খেলে চা—শিঙাড়া খেয়ে বাড়ি চলে যায়। অথচ খেলার জন্য নেট, কিছু পুরনো বল ক্লাবে পড়ে আছে। ঘাস ছাঁটাইয়ের জন্য একটা লন—মোয়ারও রয়েছে।

”একদিন মিস্টার ভটচাযকে বলেওছিলাম, নতুন সেক্রেটারি হলেন, ক্লাবের হালটা একটু ফেরান। শুধু আড্ডা দেওয়া ছাড়াও মেম্বাররা যাতে একটু ছোটাছুটি করে ঘাম ঝরাতে পারে, তার ব্যবস্থা করুন না! উনি বললেন, ‘কী ব্যবস্থা করব বলুন? টেবল টেনিস বোর্ড কেনার জন্য কমিটি মিটিংয়ে প্রপোজাল দিলাম, সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল। বলল, ‘বোর্ড পাতবেন, জায়গা কোথায়?’ আসলে বোর্ড পাতলে তাস খেলার টেবলগুলো তুলে দিতে হবে তো। বললাম, ‘টেনিস কোর্টটাকে ঠিকঠাক করে দেখুন না আবার চালু করা যায় কি না।’ উনি বললেন, ‘কিসসু হবে না, খেলার লোকই পাওয়া যাবে না। আপনাকে একা একাই খেলতে হবে।’ ভেবে দেখলাম, মিস্টার ভটচায বাজে কথা বলেননি। তবে লোকটা খেলা ভালবাসেন।”

রাজেন নিরুৎসাহিত গলায় কথাগুলো বলে চায়ের কাপ নেওয়ার জন্য শুভার দিকে হাত বাড়াল। তপতী মুখ ঘুরিয়ে অন্ধকার টেনিস কোর্টটার দিকে তাকালেন। কিছু একটা তিনি ভাবছেন। প্রতিভাদের টেবলের মহিলারা উঠলেন। বাড়ি যাওয়ার জন্য ছেলেমেয়েদের ডাকাডাকি শুরু হল।

”আমি একবার মিস্টার ভটচাযের সঙ্গে দেখা করব।” তপতী বললেন।

”কেন?” তন্ময় জানতে চাইলেন।

”যদি কোর্টটাকে আবার জাগিয়ে তোলা যায়। দেখি উনি ক্লাবঘরে আছেন কি না।” তপতী চেয়ার থেকে উঠলেন। কয়েক পা যেতেই পড়লেন প্রতিভার সামনে।

”তোমার ছোট ছেলের নাকি খুব অসুখ হয়েছে শুনলাম,” অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখ প্রতিভার। অসুখটা যেন তাঁর নিজের ছেলেরই হয়েছে।

”হ্যাঁ।”

”আহা রে, একেই তো বরাবরের রুগণ, তার ওপর আবার অসুখ, ছেলেটার যে কী কপাল! অসুখটা কী?”

”টিউবারকুলাসিস, যাকে বলে ক্ষয়রোগ।” তপতী ধীর স্বরে বললেন।

”ও মা! টিইবিই! ভাল ডাক্তার দেখাচ্ছ তো?”

”দেখাচ্ছি।”

”এখন কেমন আছে? মুখ দিয়ে রক্ত টক্ত ওঠে?”

”ওই তো বসে রয়েছে দেখুন না! এখন চিনু ভোরে ওর দাদার সঙ্গে ছোটে।”

”না, না, না, ছোটাছুটি করিও না, ফুসফুস ড্যামেজ হলে ধুঁকতে ধুঁকতে সারা জীবন কাটাবে, চিরকালের মতো অক্ষম হয়ে যাবে।”

”আর নয়তো ক্ষয়ে ক্ষয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাবে।” তপতী হাসতে শুরু করলেন। প্রতিভা সন্দিহান চোখে তপতীর হাসি দেখতে দেখতে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

”যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।” বলে প্রতিভা হনহনিয়ে এগিয়ে গেলেন।

ক্লাবের অফিসে বসে কমল ভটচায দু’জন মেম্বারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। প্লাইউডের পার্টিশন করা খোপের মতো একটা ঘর। দরজায় পাল্লার বদলে একটা পরদা ঝুলছে। তপতীকে দেখে কমল ভটচায অবাক হলেন।

”আপনি! কী ব্যাপার? বসুন, বসুন।”

”একটা বিষয়ে একটু কথা বলতে এসেছি।” একমাত্র খালি চেয়ারটায় বসে তপতী কোনও ভনিতা না করে বললেন, ”ক্লাবের টেনিস কোর্টটাতে খেলার ব্যবস্থা করুন। জানি মেম্বারদের খুব একটা উৎসাহ নেই, কিন্তু তাদের ছেলে মেয়েদের তো থাকতে পারে।”

কমল ভটচায আচমকা এমন একটা অনুরোধের সামনে পড়ে ভেবে পেলেন না কী জবাব দেবেন। কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ”এমন একটা প্রস্তাব অবশ্য রাজেন রায়চৌধুরী একবার আমাকে দিয়েছিলেন। উনি তো একসময় কলকাতায় টেনিস খেলতেন, শুনেছি ভালই খেলতেন, তাই হয়তো টেনিস প্রীতিতেই কথাটা তুলেছিলেন। কিন্তু মিসেস বসুমল্লিক, অসুবিধেটা কী জানেন, মেম্বাররা সারাদিন নানান শিফটে মিল আর অফিস করে রিল্যাক্স করার জন্য এখানে আসেন, তাই কেউ আর টেনিস নিয়ে উৎসাহী হন না। তবে আপনি যেটা বললেন, ছেলেমেয়েদের কথাটা, হ্যাঁ, এটা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু করে কে? কোর্টটায় শুধু বড় বড় ঘাসই নয়, বড় বড় গর্তও আছে। খোয়া, নুড়ি ছড়ানো, জমি অসমান। রীতিমতো মেহনত করতে হবে ওটাকে নিয়ে। এদিকে ক্লাবে একজন বেয়ারা, একজন কুক। মালি ছিল, তাকে এই মাসেই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাসের অর্ধেক দিন তার দেখাই পাওয়া যেত না।”

”আপনার অসুবিধেগুলো আমি বুঝতে পারছি।” তপতী নম্র আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন। ”কিন্তু কেউ যদি দায়িত্বটা নেয় তা হলে কি আপনি সাহায্য করবেন?”

”নিশ্চয় করব। কিন্তু সাহায্য বলতে কী বোঝাচ্ছেন? আপাতত আমার লোকবল নেই। বেয়ারা কি কুক, মাঠের কাজ করবে না বললে তাদের দিয়ে করাতে পারব না। অর্থবলও তেমন নেই যে, লোক ভাড়া করতে পারব। নামেই অফিসার্স ক্লাব, অর্ধেক মেম্বারই তিন—চার মাসের চাঁদা বাকি ফেলেছেন। তাই নিয়েই তো এঁদের সঙ্গে কথা বলছিলাম।” কমল ভটচায হাত দিয়ে দেখালেন এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা দু’জনকে।

”লোকজন বা টাকা কিছুই দিতে হবে না, শুধু কোদাল, ঝুড়ি, বালতি, জল এইসব; আর লন—মোয়ারটা দিলেই হবে।”

”মোয়ারটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে। একটা চাকা আর কী যেন ভেঙেছে।”

”সে আমি সারিয়ে নেব।… তা হলে আপনি অনুমতি দিচ্ছেন।”

”অবশ্যই। যদি দায়িত্ব নিয়ে কোর্টটাকে উদ্ধার করতে পারেন তা হলে সত্যিই একটা কাজের কাজ হবে। কিন্তু মিসেস বসুমল্লিক—” কমল ভটচায থেমে গলা নামিয়ে বললেন, ”খেলার জন্য লোক পাবেন তো?”

”নেটের দু’ধারে দাঁড়াবার জন্য ইতিমধ্যেই দু’জনকে পেয়ে গেছি—আমার বড় ছেলে আর আমি।”

।।৩।।

পরদিন ভোরে ফেরিঘাট থেকে মিনু ও চিনু দৌড় শুরু করার পর তপতী হাঁটতে শুরু করলেন বাড়ির বদলে ক্লাবের দিকে। উদ্দেশ্য, দিনের আলোয় ভাল করে কোর্টের অবস্থাটা দেখে নেওয়া।

মিনিট কুড়ি পর তিনি পৌঁছলেন। রাত্রে ক্লাবঘরে শোয় বেয়ারা কান্তি। তার দেশ নদিয়া জেলার এক গ্রামে। বাড়িতে বউ, ছেলে মেয়ে আছে। বয়স্ক লোক, মানুষ ভাল। সে তপতীকে চেনে। এত সকালে ‘মেমসায়েব’কে ক্লাবে দেখে কান্তি হতভম্ব।

”মালি তার জিনিসপত্র কোথায় রাখে কান্তি, আমি একটু দেখব।”

ক্লাবঘরের পেছনে একটা ঢাকা জায়গায় মোয়ারটা দেয়ালে ঠেস দেওয়া। একটা চাকা খোলা, তবে ভাঙেনি। ছাঁটাই হওয়া ঘাস যে লোহার ডালাটায় পড়ে, সেটা ঝুলে রয়েছে। ঘাস ছাঁটাই করার একটা ব্লেড ভাঙা। কোদাল একটা আছে বটে, তার বাঁশের হাতলটা নেই। একটা শাবলও রয়েছে। কোনও ঝুড়ি নেই। টেনিসের নেটটা খুঁজে পাওয়া গেল না।

”আপনি কী করবেন এসব দিয়ে?” কান্তি তো অবাক!

”মাঠ বানাব। ওই টেনিস কোর্টটাকে খেলার যোগ্য করে তুলতে হবে।”

”আপনি করবেন?”

”লোক দিয়ে করাতে হবে।”

কোর্টের অবস্থা দেখে তপতীর কপালে দু—তিনটে ভাঁজ পড়ল। ঘাস এত লম্বা যে, প্রথমে হেঁসো দিয়ে না কাটলে মোয়ার চালানো যাবে না। জমিতে কয়েকটা জায়গায় মাটি ফেলতে হবে, গর্ত বোজাতে হবে, ঢিপির মতো উঁচু জায়গায় মাটি চাঁছতে হবে আর ভাঙা ইটের টুকরো, কাঁকর বাছতে হবে। এত ‘হবে’ কিন্তু তাঁকে দমাতে পারল না। প্রথমেই মোয়ারটা সারাতে হবে, একটা কি দুটো মাটি ফেলার ও তোলার ঝুড়ি চাই, কোদালের জন্য হাতলও।

”কান্তি, একজন কি দু’জন মজুর জোগাড় করতে পারবে? আর একজন ঘেসুড়ে?”

”তা পারা যাবে।”

”তোমাকে আমি পরশু বলব।”

তপতী যখন বাড়ি ফিরলেন সবাই তখন খাওয়ার টেবলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল।

”কেমন দেখলে?” তন্ময় জানতে চাইলেন।

”যা দেখব ভেবেছিলাম তাই দেখলাম। তবে হয়ে যাবে। তোমার একটু সাহায্য চাই। মোয়ারটা ভাঙাচোরা, ওটাকে সারাতে হবে। তোমার তো অনেক মিস্ত্রি আছে, একজনকে পাঠিয়ে দাও না ওটা ঠিক করে দেবে।”

”পাঠাব। আর কী দেখলে?”

”দেখলাম বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হবে, মিস্ত্রি লাগাতে হবে।”

”টাকা!” তন্ময় নড়েচড়ে বসলেন। চিনুর চিকিৎসা আর সুষম পুষ্টিকর খাদ্য চালু হয়ে সংসার খরচ যথেষ্ট বেড়ে গেছে। মাইনের টাকা হিসেব করে খরচ করতে হচ্ছে এবং খরচটা করে তপতী। সুতরাং টেনিস কোর্ট সংস্কারের জন্য খরচের টাকা যে তাঁদের পক্ষে দেওয়া কষ্টকর হবে, এটা তপতী জানেন।

”টাকা আমাদের খরচ করতে হবে নাকি! ক্লাব দেবে। মেম্বারদের ছেলেমেয়েরাই তো খেলবে।” তন্ময় মৃদু স্বরে আপত্তি জানালেন।

”মনে রেখো মেম্বারদের ছেলে মেয়েদের মধ্যে আমদেরও দুটো ছেলে আছে। ওদের মুখ চেয়ে একাজ আমায় করতেই হবে। আমি মেম্বারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলব।” তপতীর চোখ জ্বলজ্বলে, কণ্ঠস্বরে আবেগ এবং দৃঢ়তা।

”চাঁদা তুলবে! কত করে চাঁদা?”

”দশ টাকা প্রতি ফ্যামিলি। একবারই শুধু দিতে হবে।”

”দঅঅশ টাকা!” তন্ময়ের চোয়াল ঝুলে পড়ল। ”জানো, এই দশ টাকায় বারো সের চাল পাওয়া যায়, আড়াই মাস খবরের কাগজ কেনা যায়…।”

”দুটো হরলিকস কেনা যায়, চার সের সর্ষের তেল কেনা যায়, চার সের পাঁঠার মাংস কেনা যায়… তাতে কী হল?” তপতীর চোখে চ্যালেঞ্জ।

”এত টাকা কী কেউ বাচ্চচার খেলার জন্য দেবে?” তন্ময় স্পষ্টতই সন্দেহ প্রকাশ করলেন। ”প্রাইভেট টিউটর রাখার জন্য টাকা খরচ করতে বললে করবে কিন্তু ছেলে মেয়ের খেলার জন্য…।” তন্ময় কথা অসম্পূর্ণ রেখে মাথা নাড়লেন।

”এসব হতাশার কথা। আগে সবাইকে বলে তো দেখি।”

”ঠিক আছে, বলে দেখো।” তন্ময়ের মুখ দেখে মনে হল না তিনি হতাশা কাটাতে পেরেছেন।

মিনু—চিনু চুপ করে খেয়ে যাচ্ছিল আর বাবা—মার কথা শুনছিল। এবার মিনু বলল,”মা, আমি টেনিস খেলব?”

”হ্যাঁ।”

”আর কে খেলবে?”

”এখানকার সবাই খেলবে।”

চিনু ফিসফিস করে বলল, ”মা আমি?”

”সোমবার তোমার এক্স—রে করার দিন। কলকাতায় ডাক্তারকাকা সেটা দেখবেন। তারপর তিনি যদি খেলতে বলেন তো খেলবে।”

”মা, তুমিও খেলবে? আগে তো খেলতে!” মিনু বলল।

”হ্যাঁ, আমিও খেলব… যদি দরকার পড়ে।”

.

”আরে মিসেস বসুমল্লিক! কী ব্যাপার?” সুধা ঘোষাল অবাক হয়ে অভ্যর্থনা জানালেন তপতীকে। বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ার টেনে বললেন, ”বসুন, বসুন। অনেকদিন পর এলেন।”

”মাসতিনেক প্রায়। ছোট ছেলের অসুখের জন্য কোথাও আর যেতে পারি না।” চেয়ারে বসলেন তপতী। সুধা ঘোষালের স্বামী এখানকার চিফ লেবার অফিসার। ওঁদের এক ছেলে সুধেন্দু ক্লাস সেভেন—এ পড়ে।

”ছেলে এখন কেমন আছে?”

”ভাল। অল্প অল্প ছুটছে, কোনও কষ্ট হচ্ছে না।”

”ভোরে তো দেখি দুই ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে বেরোন, খুব ভাল এটা। আমিও মাঝে মাঝে ভাবি সকালে একটু বেড়াই। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, ডান হাঁটুতে একটু বাতের মতো হয়েছে, তা ছাড়া সুধেন্দুকে নিয়ে পড়াতে বসতে হয়। ক্লাস সেভেন থেকে যদি পড়ায় জোর না দেয় তা হলে স্কুল ফাইনালে ভাল রেজাল্ট করবে কী করে?”

”স্কুল ফাইনালের তো এখনও অনেক দেরি।”

”অনেক দেরি!” সুধা ঘোষাল আর্তনাদ করে উঠলেন। ”মাত্র চারটে বছর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। একে আপনি অনেক দেরি বলছেন?”

তপতীর মনে হল, সুধা ঘোষাল এমনভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে, যেন একটা মানুষকে হঠাৎ বনমানুষে রূপান্তরিত হতে দেখলেন। তিনি অপ্রতিভ বোধ করে সুধা ঘোষালকে তুষ্ট করার জন্য বললেন,”সুধেন্দু তো পড়াশোনায় খুবই ভাল, অমন ছেলে ক’টা আর হয়, এবারও তো ফার্স্ট হয়ে উঠল।”

”সেটা তো স্কুলের ফার্স্ট, কিন্তু গোটা বাংলার তো নয়। ওর বাবা এম এসসি—তে ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড হয়েছিল, আমি বি এ—তে ডিস্টিংশন পেয়েছি। সুধেন্দুকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট তো হতেই হবে। ওর বাবা তো বলে, ‘ছেলে বাপকে ছাড়িয়ে না গেলে সে আর ছেলে কীসের?’ তবে ছেলেও বাপ—মায়ের মন বোঝে, সবসময় পড়ার বই নিয়ে থাকে।”

”কিন্তু মিসেস ঘোষাল, আপনাদের যেমন ইচ্ছে তেমনি ছেলেরও তো কিছু ইচ্ছে থাকতে পারে।”

”ছেলের ইচ্ছে! সুধেন্দুর? ওর একটাই ইচ্ছে, বাপ—মার মুখ উজ্জ্বল করা, আই এ এস, কি আই পি এস হয়ে সমাজের একজন হওয়া। সেইভাবেই আমরা ওকে তৈরি করতে চাই।”

”ওর বয়স এখন কত, তেরো?”

”হ্যাঁ।”

”এই বয়সের ছেলেদের তো খেলতে ইচ্ছে করে, আর সেইজন্যই আপনার কাছে আসা।” সুধা ঘোষালকে কথা বলার কোনও সুযোগ না দিয়ে তপতী বলে চললেন, ”ক্লাবে যে টেনিস কোর্টটা পড়ে আছে সেটাকে সংস্কার করে ছেলে মেয়েদের খেলার ব্যবস্থা করতে চাই, সেজন্য কিছু টাকার দরকার, তাই আপনার কাছে এসেছি যদি দশটা টাকা চাঁদা দেন। সুধেন্দুর বিকেলে একটা কিছু খেলা তো দরকার।” তপতী শেষ বাক্যটির ওপর ভরসা করলেন। ছেলের খেলার একটা ব্যবস্থা হলে কোন মা আর টাকা না দিয়ে থাকতে পারবেন। কিন্তু ফল হল বিপরীত।

”বিকেলে খেলা? …পাঁচটার সময় সুধেন্দুর ইংলিশ টিউটর আসে। এই তো ভেতরের পড়বার ঘরে ও এখন পড়ছে। সকালে আমি পড়াই, বিকেলে টিউটর, অফিস থেকে ফিরে ওর বাবা ওকে নিয়ে বসেন। ওর খেলার সময় কোথায়? আমরা তো ওকে বারবার বলি জীবনে এখনই পড়ার সময়, যা কিছু জ্ঞান এখনই আহরণ করে নাও, খেলার জন্য পরে অনেক সময় পাবে, ঠিক কি না বলুন?”

তপতী ঢোঁক গিললেন। ”বলছিলাম কী, যদি দশটা টাকা চাঁদা—”

”না, না, না, সুধেন্দুকে পড়া ফেলে খেলতে আমরা পাঠাব না। এই দেখুন আপনাকে চা দেওয়া হল না।”

”চা খাব না, আমি এখন উঠি। আরও কয়েকজনের কাছে যেতে হবে।” তপতী চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন।

.

”তপতীদি, আপনি যা করতে চাইছেন সেটা তো খুবই ভাল। ছেলে মেয়েদের সত্যিই এখানে নিয়মিত খেলার কোনও ব্যবস্থা নেই।” চন্দ্রিমা দত্ত তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ে লঘিমাকে কোলের কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বললেন। ”আমি তো সেইজন্যই লঘুকে নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়েছি।”

”খুব ভাল করেছ। তবে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজটাও যদি ওই সঙ্গে করে, তা হলে নাচটা আরও ভাল হবে।”

”তা হয়তো হবে। কিন্তু তপতীদি, টেনিস আর নাচ দুটো চালানো ওর পক্ষে অসম্ভব! বাড়িতে রেগুলার নাচের প্র্যাকটিস, তার সঙ্গে টেনিস, এইটুকু বাচ্চচা, দেখছেনই তো শরীরের হাল, নিতে পারবে না।”

তপতী বুঝে গেলেন, চন্দ্রিমার কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না। নিজের ছেলে মেয়েরা না খেললে তারা চাঁদাও দেবে না। তবু তিনি বললেন, ”বেশ, লঘু নয় খেলতে পারবে না, কিন্তু অন্য অনেকের ছেলে মেয়ে তো খেলবে, তুমি চাঁদার দশটা টাকা দাও। স্রেফ চ্যারিটি।”

”উনি তো এখন নেই, বাড়ি আসুন, ওঁকে বলব।”

তপতী আর কথা বাড়ালেন না। ধরে নিলেন কিছু পাওয়া যাবে না।

.

সুভাষ সেন অমায়িক, মার্জিত এবং এম জে টি এম—এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজার। তপতীর কথা মন দিয়ে শুনে চশমার কাচ রুমালে মুছতে মুছতে বললেন, ”মিসেস বসুমল্লিক আপনার উদ্যোগের সঙ্গে আমি শতকরা একশো ভাগ একমত। কিন্তু মুশকিল একটাই, আর দু’মাস পর শঙ্কু শান্তিনিকেতন চলে যাচ্ছে। ওখানে পাঠভবনে পড়বে।”

”তা হলে তো আর কিছু বলার নেই।” তপতী মুখে হাসি টেনে আনলেন। বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছেন, পেছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সুভাষ সেনের হাতে মানিব্যাগ, তাই থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করেছেন। ”এটা নিয়ে যান।”

তপতী বাড়ি ফিরলেন তিরিশ টাকা সংগ্রহ করে। অনিরুদ্ধ আর গৌতমের বাবা—মা খুব উৎসাহিত হয়েই চাঁদা দিয়েছেন। তন্ময় জানালেন কাল সকালে মেশিন শপের একজন যাবে লন—মোয়ারটা নিয়ে আসার জন্য। একদিনেই সম্ভবত সারানো যাবে।

”কিন্তু তিরিশ টাকায় কী হবে?” তন্ময় প্রশ্ন তুললেন।

”বাকিটা আমাদেরই দিতে হবে।” তপতী শান্ত স্বরে স্বামীর চোখে চোখ রেখে বললেন। ”আমাদের ছেলেদের মুখ চেয়েই খরচ করতে হবে। একদিন বলেছিলে, ওদের সুস্থ সবল রাখা, ভাল স্বাস্থ্য গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব বাবা—মার। এজন্য শেষ কর্পদকটুকুও খরচ করবে।”

”বলেছিলাম।”

”তা হলে অমন চোখ করে তাকিয়ে আছ কেন?

”তাকিয়ে নেই, শুধু ভেবে যাচ্ছি। আমার অফিসের একটা ছেলের বিয়ে, নেমন্তন্ন করেছে। এগারোশো টাকা মাইনে থেকে সংসার খরচ, চিকিৎসা, গাড়ির পেট্রল, মেজ জ্যাঠার বাড়িতেও বিয়ে এই মাসেই। বিয়ের উপহার আর টেনিস কোর্ট—ম্যানেজ করব কী করে?”

”কিছু কিছু খরচ কমিয়ে ম্যানেজ করতে হবে। কমানোর প্রথম ধাপ হোক গাড়ি আর না চড়া। চিনু স্কুলে যায় না, মিনু হেঁটেই যাতায়াত করতে পারবে, আমি সঙ্গে যাব। তুমিও হেঁটে অফিস যাবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, ভুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে তাই হাঁটছি।”

”পরশু এক্স—রে করিয়ে চিনুকে কলকাতা নিয়ে যেতে হবে। কীসে যাব, ট্রেনে?”

”মোটরে। এটা ব্যতিক্রম বলেই ধরতে হবে।”

পরদিন মিনুকে নিয়ে তপতী বেরোলেন স্কুলে পৌঁছে দিতে। দু’জনের মাথায় দুটো ছাতা। মিনু প্রথমে অবাক হয়েছিল হেঁটে স্কুলে যেতে হবে শুনে। তপতী তাকে বুঝিয়ে বললেন, ”আধ মাইল তো রাস্তা, এর জন্য গাড়িতে চড়ার কী দরকার? তুই তো রোজ এক মাইল হেঁটে ফেরিঘাট যাস আর দৌড়ে ফিরিস। পারবি না স্কুলে হেঁটে যেতে? অক্ষম তো নোস। তোর বাবা দু’মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন, দু’মাইল হেঁটে ফিরতেন।”

এই শেষ কথাটাতেই কাজ হয়ে গেল। ”মা আমি দৌড়ে স্কুলে যাব?” মিনু টগবগ করে উঠল।

”না, না, অত বাহাদুরিতে কাজ নেই।”

”জানো মা, আমাদের স্কুলের অনেক বড় ছেলে সাইকেলে আসে। আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে?”

”দোব, যখন তুমি বড় ছেলে হবে।”

মিনুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তপতী ক্লাবে গেলেন। কান্তির কাছে শুনলেন, সায়েবের পাঠানো একটা লোক সাইকেল রিকশায় তুলে মোয়ারটা নিয়ে গেছে।

”কিন্তু কান্তি, ঘাস কাটার ব্যবস্থা তো তাড়াতাড়ি করতে হবে। আর কোদালের হাতলের জন্য একটা বাঁশ কিংবা ডাণ্ডা দরকার।”

”যে লোকটা দুধ আর ডিম দিয়ে যায় তাকে কালই আমি বলে দিয়েছি। ও থাকে এই মাইল দুয়েক দূরে বল্লভপুরে। বলেছিল আজ সকালে পাঠিয়ে দেবে লোক। তা এখনও তো এল না!” কান্তিকে বিব্রত দেখাল।

”ততক্ষণে একটা কাজ করা যাক। নেট—টা কোথায় আছে দেখো তো।”

”দেখেছি। সেক্রেটারির আপিস ঘরে যে কাঠের আলমারিটা তার পেছনে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। বার করব কী! যা ধুলো ঝুল ময়লা, হাত দিতে ঘেন্না করে?”

”দেখি তো।” তপতী একাই দেখতে গেলেন অফিস ঘরে।

তপতী আলমারির পেছনে উঁকি দিয়ে দেখলেন। কান্তি মোটেই বাড়িয়ে বলেনি। তালগোল পাকানো নেটটা যেন ধুলোর ঢিপি। তিনি ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে নেটের খানিকটা আঁকড়ে টেনে বার করলেন। সেই সঙ্গে বেরিয়ে এল তাঁত ছেঁড়া একটা র‌্যাকেট, যার হাতলে মুঠো করে ধরার জায়গার কাঠটা ফাটা। এটাও বোধ হয় ক্লাবেরই সম্পত্তি। নেটটাকে ঘর থেকে টানতে টানতে বাইরের লনে এনে ফেললেন। হাঁ হাঁ করে কান্তি ছুটে এল। ”আপনি কেন, আপনি কেন… আমাকে বললেই তো পারতেন।”

”কান্তি তুমি একদিকের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি আর একদিক ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে এটা খুলব।”

পুরো নেটটা খুলে তপতী হতবাক! অন্তত সাত—আট জায়গায় জালের সুতো ছিঁড়ে গর্ত হয়ে রয়েছে। সুতো কিনে ছেঁড়া গর্ত মেরামত করতে হলে যারা জাল বোনে তাদের কাউকে ডাকতে হবে। তার মানে খরচ! কিন্তু তার আগে নেটটাকে না ধুলে হাতই দেওয়া যাবে না। মহাদেবপুরে পানীয় জল সরবরাহ হয় উঁচু ট্যাঙ্ক থেকে। চব্বিশ ঘণ্টাই জল পাওয়া যায়। নেটটাকে তাঁরা দু’জন জলের কলের নীচে টেনে এনে কল খুলে দিলেন।

”এইভাবে থাকুক ঘণ্টাখানেক। ঝুল কালিটা অন্তত বেরিয়ে যাক।”

ইতিমধ্যে ঘাস কাটার লোক এসে গেছে। বৃদ্ধ এক চাষি। তপতী টেনিস কোর্টটা দেখিয়ে তাকে বললেন, ”এই যে জমিটা, এরই ঘাস মুড়োতে হবে, কত নেবে?”

চোখমুখ কুঁচকে জমিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল, ”পাঁচ টাকা দিতে হবে।”

”পাঁ—আ—আচ!” তপতী যতটা বিস্মিত হওয়া দেখানো সম্ভব দেখালেন। ”পারব না। ঘণ্টা দুয়েকের কাজ, আর বলছ কিনা পাঁচ টাকা!”

”ঘণ্টা দুয়েকের কাজ নয় মা, খাটুনি আছে। সাড়ে চার টাকা হলে করব।”

শেষ পর্যন্ত রফা হল সাড়ে চার টাকায়। তপতী কিছু পয়সা তো বাঁচালেন। ঘাস কেটে দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলার জন্য ঝুড়ি নেই। কান্তি রান্নাঘরের একটা বালতি এনে দিল। রান্না করে তার নিজের খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। কান্তি সেইদিকে মন দিল। এরমধ্যেই ক্লাবের ক্যান্টিনের রাঁধুনিও এসে গেছে। সেও তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। কল থেকে তোড়ে নেটের ওপর জল পড়ছে। তপতী শাড়িটা একটু তুলে নেটের ওপর দাঁড়িয়ে লেফট—রাইট শুরু করলেন। গলগল করে কালো জল বেরোতে লাগল। মিনিট দশেক পর তিনি হাঁফিয়ে উঠে থামলেন। এর পর নেটটাকে টেনে আনলেন ক্লাব লনের ওপর, ছড়িয়ে দিলেন শুকোবার জন্য।

মাথায় গামছা জড়িয়ে, খালি গায়ে বৃদ্ধ উবু হয়ে বসে ঘাস নিড়িয়ে চলেছে। কাটা ঘাস বালতিতে রেখে কিছুক্ষণ পরপর বালতিটা খালি করে আসছে দূরে গিয়ে। ছাতা মাথায় তপতী কোর্টের ধারে একটা চেয়ারে বসে। কান্তি এক কাপ চা নিয়ে এল।

”এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবেন মেমসাব, বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করবেন না?”

”করব, ঘাসকাটাটা শেষ হোক আগে। না দেখলে তো যা—তা করে কাটবে। আর শোনো, নেটটা শুকিয়ে গেলে ভাঁজ করে পাকিয়ে তুলে রেখো। জালের মোটা সুতো কিনে এনে বুনে নেব।”

”আপনি বুনবেন? গঙ্গার ধারে ক’ঘর জেলে থাকে, ওদের বললে তো হয়?”

”লোক দিয়ে করাতে গেলে তো পয়সা লাগবে। কী আর এমন শক্ত কাজ! আর মাঠের ইঁট পাথর কাঁকর বাছার জন্য দুটো লোক চাই, জোগাড় করতে পারবে?”

”সে আর এমন শক্ত কী, আমি এই বুড়োকেই বলে দিচ্ছি।” কান্তি কথাগুলো বলে ঘাসকাটা বৃদ্ধের কাছে গেল। দু—চারটে কথা বলে ফিরে এসে জানাল, ”বুড়ো বলল ও নিজেই করবে, নাতনিকে সঙ্গে আনবে। মাটি চেঁছে দেবে, গত্তে মাটি ফেলবে, দশ টাকা নেবে।”

”দঅশ!” তপতী হতাশ হলেন। ”এইটুকু কাজ, কোনও খাটুনিই নেই আর বলে কিনা দশ টাকা! দরকার নেই আমার।”

দুপুর দুটোর সময় ঘাস কাটা শেষ হল। তপতী কোর্টে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। প্রায় একফুট লম্বা ঘাস চার ইঞ্চিতে নামিয়ে দিয়েছে। এরপর মোয়ার চালিয়ে আরও ছাঁটা হবে।

”এ কী! এখানে ঘাস তো একদমই কাটোনি।” তপতী দাঁড়িয়ে পড়ে আঙুল দেখালেন।

”কাটব কী মা! ওখানটায় তো মাটি উঁচু হয়ে রয়েছে। জমি সমান করতে গেলে তো আপনাকে মাটি তুলতেই হবে, সেইসঙ্গে ঘাসও।”

কথাটা সত্যি। মাটি তোলার মতো মাটি ফেলতেও হবে, তারপর সমান করা। সমান করতে তো জল ঢেলে মাটি নরম করে রোলার চালাতে হবে। কিন্তু রোলার কোথায় পাবেন?

”মা, আমার মজুরিটা দিয়ে দেন,” বৃদ্ধ গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, ”জমিতে ঢেলা বাছাইয়ের কাজ করাবেন তো কাল আসব।”

”দশ টাকা দিতে পারব না।”

”মা, ঘাসকাটার থেকেও এ কাজে খাটুনি বেশি। দেখছেন তো রোদ্দুর কেমন। দু’দিন তো লাগবেই।”

রোদে পোড়া বৃদ্ধের মুখ আর সারা দেহ দেখে তপতীর মায়া হল। তিনি বললেন, ”ঠিক আছে, কাল সকাল সকাল এসো।”

এবার তপতীর হুঁশ হল এখন তাকে বাড়ি যেতে হবে। বৃদ্ধকে টাকা দিয়ে, কান্তিকে নেটটা গুটিয়ে তুলে রাখতে বলে বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলেন। পঞ্চাশ গজ হেঁটেই থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে এলেন।

”কান্তি, ওই যে ভাঙা র‌্যাকেটটা দেখলাম ওটা এনে দাও তো। দেখি সারানো যায় কি না।”

র‌্যাকেটটা নিয়ে ছাতা মাথায় বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে তপতীর মনে হল এইমাত্র যেন টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ডের খেলা জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলেন। এর পর আছে তৃতীয় রাউন্ড, চতুর্থ রাউন্ড…। এতক্ষণে তপতী অনুভব করলেন তাঁর ভীষণ খিদে পেয়েছে।

সন্ধ্যায় তপতী আজকের অভিজ্ঞতা তন্ময়কে জানিয়ে বললেন, ”এখন দরকার জালের জন্য মোটা সুতো আর জমিটাকে সমান করা। এখানকার বাজারে সুতোটা যদি না পাওয়া যায় তা হলে কলকাতা থেকে তোমায় কিন্তু আনিয়ে দিতে হবে, সেইসঙ্গে দুটো টেনিস বলও। আর জমি লেভেল করার জন্য তোমাদের একটা রোলার যদি পাঠিয়ে দাও।”

”দোব। কাল চিনুকে নিয়ে কলকাতা যাব, তোমার যা যা দরকার তার একটা লিস্ট করে ফেলো। যে র‌্যাকেটটা এনেছ তাতে তাঁত বাঁধাতে কোন দোকানে যেতে হবে সেটাই তো জানি না।” তন্ময়ের হঠাৎই এই সময় মনে পড়ে গেল একটা কথা। ”আচ্ছা, তোমার একটা র‌্যাকেট মনে হচ্ছে যেন আলমারিতে তোলা আছে দেখেছি!”

তপতীকে সচকিত দেখাল। তিনি ভুলেই গেছলেন ওটার কথা। বিয়ের দু’বছর পর একবার বাপের বাড়ি থেকে ফেরার সময় তাঁর দাদা র‌্যাকেটটা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ”মিছিমিছি এটা এখানে পড়ে আছে, তুই বরং সঙ্গে নিয়ে যা। যদি খেলার সুযোগ টুযোগ পাস তো দরকারে লাগবে।” র‌্যাকেটটা আলমারির ওপর তাকে জামাকাপড়ের তলায় সেই যে ঢুকেছে গত আট বছরে একবারও আর বেরোয়নি।

তপতী আলমারি খুলে জামাকাপড়ের স্তূপের তলা থেকে র‌্যাকেটটা বার করলেন। আট বছর আগের অবস্থাতেই রয়েছে। র‌্যাকেটের গায়ে সোনালি অক্ষরে ‘ডানলপ’ লেখাটা নতুনের মতোই ঝকঝকে। মুঠোয় ধরতেই অদ্ভুত একটা শিহরণ তিনি বোধ করলেন। তেরো বছর আগে পা ভাঙার পর আর খেলেননি। বাঁ হাতের তালুতে র‌্যাকেটের মাঝখানের তাঁত দিয়ে তিন—চারবার আঘাত করলেন পুরনো অভ্যাসবশে। এভাবে ঘা দিলে টানটান করে বাঁধা তাঁতে ‘পিং’ করে আওয়াজ ওঠে। আওয়াজটা শুনতে তাঁর ভাল লাগত। কিন্তু এখন আওয়াজের বদলে তিন—চারটে তাঁত ছিঁড়ে গেল। তিনি অপ্রতিভ হয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন।

”ছিঁড়ে তো যাবেই। গোরু কি মোষের নাড়িভুঁড়ি দিয়ে তৈরি তাঁত এত বছর পরও কি পচবে না? ভালই হল দুটো র‌্যাকেটই নিয়ে যাব, কিন্তু কোথায় এসব বাঁধায় তা তো জানি না।”

তপতী কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললেন, ”এ ব্যাপারে সেরা লোক রাজেন ঠাকুরপো। টেনিস খেলেছে, এখনও অভ্যাসটা ছাড়েনি। নিশ্চয় ও জানে কোথায় তাঁত বাঁধানো হয়।”

তন্ময় ঘড়ি দেখে বললেন, ”এখনি চলো।”

দু’জনের হাতে দুটো র‌্যাকেট, একটায় তাঁত নেই, রাজেন তো অবাক! ”কী ব্যাপার দাদা, খেলতে যাচ্ছেন কোথাও?”

”এই র‌্যাকেট নিয়ে খেলতে যাওয়া? ঠাট্টা হচ্ছে?” তন্ময় চেয়ারে বসলেন। ”তোমার বউদি তো টেনিস কোর্ট করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। আজ ঘাস ছাঁটিয়েছে। নেটটা বার করে দেখে তাতে বড় বড় ছিদ্র, হাতি না হোক বেড়াল গলে যেতে পারে। সেটা সারাবার জন্য সুতো আনার হুকুম হয়েছে। উনি নিজে বসে বসে ছিদ্র বন্ধ করবেন। তারপর ইঁট পাথর বাছাই। পয়সা বাঁচাতে সেটাও বোধ হয় উনি নিজে করবেন। জমি লেভেলিং করার জন্য রোলার টানানোর অর্ডারও হয়েছে।”

”উরিব্বাস।” রাজেন চেয়ারের ওপর উবু হয়ে বসল। ”করেছেন কী! আপনি তো দেখছি যা ভাবেন তাই করেন।”

”তা করতেই হয়। এখানে এত শিক্ষিত লোক, সবাই ভাল চাকরিও করেন কিন্তু নিজেদের সন্তানদের জন্য ঠিকভাবে চিন্তা করেন না। আমার সন্দেহ হয় ছেলেমেয়েদের যথার্থই ওঁরা ভালবাসেন কি না। কিন্তু আমার সন্তানদের আমি ভালবাসি—অন্যদেরও।” বলে তপতী তাঁর চাঁদা তোলার অভিজ্ঞতার কথা রাজেনকে বললেন।

”কিন্তু শুধু চাঁদা দিলেই তো টেনিস খেলা যায় না, বউদি নিজের র‌্যাকেটও থাকা দরকার। বাচ্চচার বাবারা কি সেটা কিনে দেবে? … তবে দিক বা না দিক আমি দুটো র‌্যাকেট ডোনেট করব। ওদের জন্য দরকার হালকা ছোট মাপের র‌্যাকেট।”

”তা হলে আমাদের এই দুটোরও ব্যবস্থা করে দাও রাজেন।”

রাজেন ক্লাবের র‌্যাকেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, ”এটার যা অবস্থা, উনুনে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।” তারপর দ্বিতীয় র‌্যাকেটটা তুলে ”ওরে বাবা এটা তো দেখছি ডানলপ! পেলেন কোথায়?”

”তোমার বউদির … এক সময় খেলত। ইলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ানও হয়েছিল।”

রাজেনের বিস্ফারিত চোখ দুটি তপতীকে লজ্জায় ফেলে দিল। পা নামিয়ে বসে রাজেন সিরিয়াস গলায় বলল, ”এবার বুঝলাম কেন আপনি টেনিস চালু করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। নিজে খেলাধুলো না করলে কেউ খেলার মর্ম বোঝে না। কথা দিচ্ছি সাধ্যে যতটা কুলোয় আপনাকে আমি সাহায্য করব।”

”তা হলে কোর্টটা যাতে ভালভাবে তৈরি করা যায় সেই ব্যাপারে পরামর্শ দিন।” তপতী সাগ্রহে বললেন।

”বউদি, এখানে খেলবে সেইসব বাচ্চচা, যারা জীবনে কখনও র‌্যাকেট ধরেনি। ওদের জন্য উইম্বলডনের কি সাউথ ক্লাবের মতো সারফেস এখনই দরকার নেই। বলটাকে নেটের এপার ওপার করাটাই আগে শিখুক, র‌্যাকেটের সঙ্গে বলের সম্পর্কটা আগে গড়ে তুলুক, তারপর গ্রাউণ্ড স্ট্রোক শিখবে। নেটে বড় বড় ছ্যাঁদা থাকলেও কিছু আসে—যায় না। আপনি মাঠটাকে সমান করে দিন তারপর আমি মাপজোক করে চুনের দাগ কেটে দেব। সাউথ ক্লাবে পুরনো বল পাওয়া যাবে, এনে দেব। আপনার প্রধান যেটা দরকার সেটা হল খেলার লোক। খেলার জন্য দু’জনের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন আর আপনার বড় ছেলে, মোট তিনজন।”

”চারজন। আমার ছোট ছেলের কথাটা ঠাকুরপো ভুলে যাচ্ছেন। আসলে সবাই চিনুকে ভুলে যায় ওর রুগণ দুর্বল শরীরের জন্য। শরীরটা তৈরি করানোর জন্যও ওকে খেলায় আনব।” তপতীর স্বরে ফুটে উঠল প্রত্যয় আর জেদ। ”একবার যখন ঠিক করে নিয়েছি কী করতে চাই, তখন যত পরিশ্রমই হোক, যত অর্থকষ্টই হোক কাজটা আমরা করবই।”

তপতী কথাটা বলে তন্ময়ের দিকে তাকালেন। সায় জানিয়ে তন্ময় মাথা নাড়লেন।

রাজেন অস্ফুটে বলল, ”অদ্ভুত আপনারা!”

।।৪।।

সকালে তপতী মিনুকে পৌঁছে দিয়ে হেডমিস্ট্রেস জয়ন্তী বসুর সঙ্গে দেখা করলেন।

”চিন্ময় তো ক্লাস করতে পারছে না, পড়াশুনোয় পিছিয়ে পড়ছে। আমি অবশ্য রোজ সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে পড়াতে বসি। তা হলেও যেভাবে লেসনগুলো স্কুলে করানো হচ্ছে সেটা ফলো করা দরকার। বাড়িতে আমার পড়ানো আর স্কুলের পড়ানো একই হওয়া উচিত। তাই বলছিলাম কী, আমি যদি ক্লাসে বসে নোট নিই, তা হলে কি আপনার আপত্তি হবে? আপত্তি না থাকলে যদি অনুমতি দেন।” তপতী আবেদন জানালেন।

”নিশ্চয়, নিশ্চয়, আপত্তি হবে কেন। তবে ক্লাস ওয়ানে এমন কিছু পড়া হয় না যে, আপনাকে নোট নিতে হবে। যাই হোক আপনি চলুন এখন মিসেস বসাক ইংলিশ ক্লাস নিচ্ছেন, আপনাকে ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে আসি।” জয়ন্তী বসু চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, ”চিন্ময় এখন আছে কেমন?”

”ভালই। আজ ডাক্তার ওর এক্স—রে দেখে জানাবেন সেরে উঠেছে কি না।”

”কমপ্লিটলি সেরে উঠলে ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিয়ে ওকে স্কুলে পাঠাবেন। বুঝলেন তো অনেক গার্জিয়ান আবার খুব খুঁতখুঁতে হন। মিসেস বসুমল্লিক আপনার বড় ছেলেটি কিন্তু দারুণ অ্যাথলিট, পড়াশুনাতেও তেমনই ভাল।”

”হুঁ” বলা ছাড়া তপতী কোনও উত্তর দেননি। ‘খুঁতখুঁতে’ শব্দটিকে তিনি প্রসন্ন মনে নিতে পারেননি। সংক্রামক বিপজ্জনক রোগ কি শুধু তাঁর ছেলেরই হল? কত তো ছেলেমেয়ে রোগজীবাণু শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সবাইকে যদি পরীক্ষা করা যেত!

পরপর দুটি ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসে তিনি পড়া বুঝে নিলেন। তাঁর মনে হল বাড়িতে তিনি চিনুকে যা পড়ান তার থেকে স্কুলের পড়া অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখানে একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে পড়ায়, তাই গতিটা প্রথম দিকে মন্থরই হয়, এটা তপতী জানেন। এখন তাঁর মনে হচ্ছে, চিনুকে তিনি একটু বেশিই এগিয়ে দিয়েছেন, এটা ভাল না মন্দ হচ্ছে তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না।

ক্লাবের কাছাকাছি এসে দেখলেন, সেই বুড়ো আর একটা বছর দশেকের মেয়ে কোর্টের এক প্রান্তে উবু হয়ে বসে। তাদের সামনে বালতিটা। কান্তি জানাল, ঘণ্টাখানেক হল ওরা এসে কাজ শুরু করেছে। তপতী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের দেখলেন। দু’জনে ইঁট—পাথর বাছাই করে জড়ো করছে নিজেদের পাশে, পরে মেয়েটি দু’ হাতে সেগুলো তুলে বালতিতে ফেলছে। বালতি ভরে গেলে বুড়ো ফেলে দিয়ে আসছে কোর্টের অন্তত তিরিশ হাত দূরে।

তপতীর মনে হল, চুপচাপ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকার চেয়ে যদি তিনি নিজেও হাত লাগান তা হলে কাজগুলো এগিয়ে থাকবে, সময়ও বাঁচবে। কী কাজ করা যায়? সুতো থাকলে জালটার ফুটোগুলো বোনার কাজ করতে পারতেন। রাজেন ঠাকুরপো অবশ্য বলেছেন, ফুটোগুলো এখন তেমন অসুবিধে করবে না। কোর্টটার মাঝে উঁচু একটা বাধা তুলে দু’ভাগ করা, আপাতত এটাই হবে নেটের কাজ। বাচ্চচারা এখন প্রচণ্ড জোরে বল হিট করবে না। লন—মোয়ারটা যদি মেরামত করে দিয়ে যেত তা হলে সেটা দিয়ে ঘাস ছাঁটার কাজ শুরু করে দিতে পারতেন। কিন্তু মোয়ারটা এখনও ফেরত আসেনি।

কান্তি থলি হাতে কোথায় যেন বেরোচ্ছিল। তপতীকে দেখে বলল ”মেমসাব, কোদালের বাঁশটা খুঁজে পেয়েছি। দোকানে যাচ্ছি। এসে লাগিয়ে দেব।”

তপতীর নজরে পড়ল, কোর্টের অসমান জায়গাগুলো। কোদাল দিয়ে তো সমান করে ফেলার কাজটা করা যায়! যেমন ভাবা তেমনই শুরু করে দেওয়া। ভেতরে গিয়ে কোদালটায় বাঁশের হাতল লাগাবার চেষ্টা শুরু করলেন। বাঁশটা একটু সরু, কোদালে লাগালে ঢলঢল করছে। একটা কাঠের গোঁজ দিলে টাইট হবে। তিনি রান্নার জায়গা থেকে চ্যালাকাঠের একটা টুকরো সংগ্রহ করে এনে সেটা কোদালে গুঁজলেন হাতলের সঙ্গে। একটা আধলা ইট দিয়ে ঘা মেরে মেরে কাঠটাকে বসালেন। হাতল ধরে কোদালটা নাড়িয়ে পরীক্ষা করলেন, টাইট হয়ে বসেছে কি না। মনে হল এবার ব্যবহার করা যাবে। তাঁর মুখে সাফল্যের হাসি ফুটল।

কোর্টের যে জায়গাটা উঁচু বেশি, তপতী সেটাকেই প্রথম লক্ষ্যবস্তু করলেন। ঘাসের নীচে কয়েকটা ইটের মাথা জেগে রয়েছে। মাটির নীচে ইটের অনেকটাই গাঁথা। তপতী একটু ঝুঁকে কোদালটা খানিকটা তুলে জমিতে ঘা দিতেই ‘ঠক’ আওয়াজ হল। শক্ত করে আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে, ঠোঁট চেপে মনে মনে বললেন, ‘দেখাচ্ছি মজা, সবক’টাকে তুলব।’

প্রথমে তিনি কোদাল দিয়ে ঘাস চেঁছে জমির অনেকটা পরিষ্কার করলেন। গোটাপাঁচেক ইট, ভাঙা ভাঁড় মাটিতে গাঁথা। তপতী আড়চোখে দেখলেন, কাজ ফেলে বুড়ো আর নাতনি তাঁর দিকে তাকিয়ে অবাক চোখে। ‘দেখবেই তো, ওদের ধারণা এইসব মেহনতের কাজ শুধু ওরাই পারে … ফুঃ, করে দেখিয়ে দিচ্ছি।’ মনে মনে কথাগুলো বলে কোদালটা মাথার ওপর তুলে বড় একটা ইটের মাথা লক্ষ্য করে সজোরে কোদাল নামালেন। কোদালটার ধারালো দিকটা শক্ত ইটের ওপর পড়ে ছিটকে এসে তপতীর বাঁ পায়ের গোছের কাছে আঘাত করল জোরে। হাত থেকে কোদালটা পড়ে গেল।

তপতী কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় হয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে শাড়ির প্রান্ত খানিকটা তুলে পায়ের দিকে তাকিয়েই তাঁর মাথা ঘুরে গেল। প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হয়ে পায়ের মাংস চেরা আর তার মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে সাদা হাড়। মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোলেন ক্লাবঘরের দিকে। বৃদ্ধ আর নাতনি তাঁর পায়ের দিকে তাকিয়েই ছুটে এল।

”হাসপাতাল যাব। তার আগে এটা ভাল করে বাঁধতে হবে, দেখছ কী রক্ত পড়ছে!”

”হাসপাতাল তো অনেকটা রাস্তা, যাবেন কী করে মা?” বৃদ্ধ বিশাল সমস্যার সামনে পড়ে গেল। ”এটা বাঁধার কাপড়ই বা এখানে পাব কোথায়?”

”দাদু, একটা গামছা শুকোচ্ছে।”

”না, না, না।” তপতী আঁতকে উঠলেন। ”আমার শাড়ির আঁচলটা থেকে বরং ছিঁড়ে বেঁধে নিচ্ছি।”

বৃদ্ধ নাতনিকে বলল, ”খানিকটা ঘাস চিবিয়ে জায়গাটায় চেপে ধর।” নাতনি ছুটে গিয়ে এক মুঠো ঘাস ছিঁড়ে মুখে পুরল।

তপতী বারণ করতে গিয়েও করলেন না। তিনি শুনেছেন, এইসব টোটকা চিকিৎসা খুব কাজ দেয়। মেয়েটি চিবোনো ঘাস তাঁর থেঁতলানো কাটা জায়গায় চেপে বসিয়ে দিল। তপতী শাড়িটা ছিঁড়লেন।

এইসময় দূরে দেখা গেল একটি ছেলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। হ্যান্ডেলে ঝুলছে স্কুলব্যাগ, ”খুকি, দৌড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে ডাক তো ছেলেটাকে।”

বৃদ্ধের নাতনি চিৎকার করতে করতে ছুটল। ”অ্যাই সাইকেল, অ্যাই সাইকেল…।”

ছেলেটি সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। সেই সময় বৃদ্ধ তপতীকে বোঝাচ্ছিল, ”মা, যার কাজ তারে সাজে, অন্য লোকে লাঠি বাজে। … আপনি কেন মিছিমিছি কোদাল ধরতে গেলেন? আমাদের পয়সা দিতে তো আপনাদের কষ্ট লাগে, দর কষাকষি করে পয়সা কমান। … আমাকে বললে তো পারতেন, আমি করে দিতুম, তা হলে এই কাণ্ডটা ঘটত না।”

”তা হলে তো আবার টাকা চাইতে।” কাপড়ের পটি পায়ে জড়াতে জড়াতে তপতী বললেন।

”তা তো চাইতুমই।”

”আমার পুঁজি তিরিশ টাকা আর আমার চাঁদা দশ টাকা মোট চল্লিশ টাকা,…” তপতীর কথার মধ্যেই ছেলেটি এসে পড়ল।

”কী হয়েছে আপনার? মেয়েটা বলল পা নাকি দু—আধখানা হয়ে গেছে!” কিশোর ছেলেটির চোখে মুখে উৎকণ্ঠা।

”হতে পারত বাবা, কপালজোরে বেঁচে গেছি। আমাকে এখনই হাসপাতাল যেতে হবে।” পটিতে একটা গিঁট দিলেন তপতী। ”তুমি কি মহাদেব হাই স্কুলে পড়ো?”

”হ্যাঁ, ক্লাস টেন—এ। আপনি আমার সাইকেলের পেছনে বসবেন? তা হলে আমি সাইকেলটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে যেতুম। … মাসিমা, আপনাকে আমি স্কুলের স্পোর্টসে দেখেছি। আপনার ছেলে তো অনেক প্রাইজ পেল! … সাতটা, তাই না?”

”হ্যাঁ, মৃন্ময়, ক্লাস থ্রিতে পড়ে।” যন্ত্রণা হচ্ছে, তার মধ্যেই তিনি আরাম পেলেন ‘অনেক প্রাইজ পেল’ শুনে। পড়ায় ফার্স্ট হলে মিনু কি এমন বিখ্যাত হত?

তপতীকে সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে উঠে বসতে সাহায্য করল ছেলেটি এবং বৃদ্ধ। দু’জনে সাইকেলের দু’দিকের হ্যান্ডেল ধরে সন্তর্পণে হাঁটতে শুরু করল। মিনিট পাঁচেক পরই থলি হাতে কান্তিকে দেখা গেল বাজার থেকে ফিরতে। চোখ কপালে তুলে ঘটনার কথা শুনে কান্তি বৃদ্ধকে বলল, ”তোমাকে আর হাসপাতাল যেতে হবে না, আমি সাইকেল ধরছি। থলিটা নিয়ে যাও আর গিয়ে কাজে লেগে পড়ো।”

সাইকেল এবার ধরল ছেলেটি আর কান্তি। কয়েক গজ এগোবার পর তপতী ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”থামো, থামো, কান্তি, বুড়োকে জিজ্ঞেস করে এসো তো কোর্টটা সমান করে দিতে কত টাকা নেবে?”

কান্তি ছুটে গিয়ে বৃদ্ধকে ধরল এবং সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল। ”মেমসাব, বলল পাঁচ টাকা, দরাদরি চলবে না।”

”পাঁ—আ—আচ টাকা! বুড়োটা আমাকে মেরে ফেলবে কান্তি, ফতুর করে দেবে। চার টাকায় হয় না?”

”মনে তো হল, এক পয়সাও কমাবে না। বলল, মায়ের পা কেটেছে বলে পাঁচ টাকা, নয়তো ছ’টাকা চাইত।”

”কিন্তু টাকাটা তো আমার নিজের নয়, চাঁদার টাকা, পাঁচজনের টাকা। আমার তো অধিকার নেই নয়ছয় করে খরচ করার।” তপতী করুণ মুখে বললেন।

”মেমসাব, আপনার কী অত মাথাব্যথা খরচ বাঁচাবার! আমি বলে আসছি বুড়োকে,পাঁচ টাকাই পাবে।” কথাটা বলেই কান্তি উত্তরের অপেক্ষা না করে বৃদ্ধকে ধরার জন্য দৌড়ল।

ওরা যখন হাসপাতালে পৌঁছেছে, তন্ময় তখন চিনুকে এক্স—রে করিয়ে বেরোচ্ছেন। দ্রুত এমার্জেন্সিতে ভর্তি হলেন তপতী। তাঁর পায়ে আঠারোটা সেলাই হল এবং পর্যবেক্ষণের জন্য রাখা হল একটি কেবিনে।

”অতি অবশ্যই আজ চিনুকে নিয়ে কলকাতায় যাবে।” তন্ময়কে এই নির্দেশ দিয়ে চোখ বন্ধ করে তপতী ঘোষণা করলেন, ”না গেলে আমি মরে যাব।”

”উতলা হচ্ছ কেন, আমি অপূর্ব্বর কাছে আজই যাব।” উদ্বিগ্ন তন্ময় নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করলেন তপতীকে।

”সুতো আনবে। লন—মোয়ারটা আজ এসে পৌঁছয়নি। কালই যাতে আসে একটু দেখো। মিনুকে যদি পারো স্কুলে পৌঁছে দিয়ো আর বাড়ি এনো, গাড়ি করেই। এটা ব্যতিক্রম বলে ধরতে হবে। … যে বুড়োটা কাজ করছে তাকে টাকা দেওয়া হয়নি। দশটা টাকা এক্ষুনি কান্তির হাতে দিয়ে এসো, বেচারা গরিব মানুষ। আমি দিনকয়েক বোধ হয় হাঁটাচলা করতে পারব না। আজই আমি বাড়ি যাব।”

ডাক্তার রাজি হলেন না। আঘাতটা মোটেই হালকা ধরনের নয়। অন্তত তিনদিন তপতীকে পর্যবেক্ষণে থাকতেই হবে। তন্ময়ও ডাক্তারের সঙ্গে একমত। গম্ভীর স্বরে স্ত্রীকে তিনি শুধু বললেন, ”ডাক্তারবাবুর কথার ওপর আর একটা কথাও নয়।” কথা শেষ করেই তিনি কেবিন থেকে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।

তন্ময় কেবিনে আবার ঢুকলেন রাত আটটা নাগাদ, সঙ্গে দুই ছেলে। চোখ—মুখ উদ্ভাসিত, হাতে এক্স—রে প্লেটের খাম, কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে সোজা হাসপাতালে এসেছেন। ”চিনু কিওরড … চিনু সেরে গেছে!” তন্ময় দু’ হাত তুলে ঝাঁকালেন।

ধড়মড় করে তপতী খাটে উঠে বসলেন এবং ফ্যালফ্যাল করে চিনুর দিকে তাকিয়ে থাকতে—থাকতে তাঁর চোখ জলে ভরে উঠল। লাজুক মুখে চিনু মা’র দিকে এগিয়ে গেল। দু’ হাতে ছেলেকে বুকে চেপে, চুম্বনে—চুম্বনে, মুখ ভুরিয়ে দিয়ে তপতী বললেন, ”আমাদের একটা দুশ্চিন্তা দূর হল, এবার টেনিস খেলাটা শুরু করতে পারলেই হয়।” দু’ হাত কপালে ঠেকিয়ে তিনি ভগবানকে প্রণাম জানালেন।

গলাখাঁকারি দিয়ে তন্ময় বললেন, ”এখনও কিন্তু চিনু কমপ্লিটলি সেরে ওঠেনি। লাংয়ের ওপর স্পটটা প্রায় মিলিয়ে এসেছে, সেরে উঠেছেই বলা যায়, তবে ওষুধপত্তর আরও তিন মাস চালিয়ে যেতে বলল অপূর্ব।”

”তিনটে মাস তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে।” তপতী চিনুর মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন।

কিন্তু তিনটে মাস তপতীর পক্ষে দেখতে দেখতে কাটল না। তাঁর ক্ষতটা তিনদিনের মধ্যেই বিশ্রী দিকে মোড় নিল। পায়ের মাংস, হাড়, স্নায়ু, শিরা, সব মিলিয়ে জখমের জের মারাত্মক হয়ে উঠল। ইঞ্জেকশনে ঝাঁঝরা হলেন, মুঠো মুঠো ওষুধের ট্যাবলেট গিলতে হল এবং বাড়ি ফিরলেন পাঁচ সপ্তাহ পর। তাঁর উঠে দাঁড়াতে সময় লাগল আরও দু’ সপ্তাহ। ততদিন সংসার চালিয়েছে বেলা। আর দুই ছেলেকে দু’ হাতে আগলে রেখেছিলেন তন্ময়।

এই সময় প্রায় প্রতিদিনই রাজেন এসে দেখা করে যেত তপতীর সঙ্গে। কোর্ট তৈরি করার দায়িত্ব রাজেন নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে এতদিনে প্রায় শেষ করে এনেছে, তাকে সহযোগিতা করেছে কান্তি। বুড়ো আর তার নাতনি ইট, পাথর, কাঁকর বেছে, জমি সমান করে দেয় মাটি ফেলে। লন—মোয়ার চালিয়ে কান্তি ঘাস ছেঁটে এক ইঞ্চি করে দিয়েছে। বহু জায়গায় জমিতে টাক দেখা দেয়, সেইসব জায়গায় নতুন করে ঘাস লাগানো হয়েছে। কোর্ট মেপে দড়ি বেঁধে সেই দড়ি বরাবর চুনগোলা দিয়ে লাইনগুলো টানার কাজও শেষ। নেটের ফুটোগুলো কান্তি লোক ধরে এনে সারিয়ে ফেলেছে। নিয়মিত জল দিয়ে জমি ভেজানো হয়। ক্লাবে যারাই আসে তকতকে সবুজ ঘাসে ঢাকা কোর্টটার দিকে প্রশংসাভরা চোখে তাকায়।

”কবে খেলা শুরু হবে রাজেন?” তন্ময় একদিন জানতে চাইলেন।

”বউদি সেরে উঠলে। উনি প্রথম সার্ভিস করে এই কোর্ট ওপেন করবেন। তার আগে এখানে কোনও খেলা হতে পারে না।”

অনিরুদ্ধ আর গৌতম, যাদের বাবা চাঁদা দিয়েছেন, তারা প্রায়ই উঁকি দিয়ে দেখে যায় তাদের তপতী কাকিমাকে। খেলার জন্য তারা অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তপতীর র‌্যাকেটের তাঁত বাঁধিয়ে দিয়ে গেছে রাজেন, সেইসঙ্গে ছোট দুটি নতুন র‌্যাকেট আর কয়েকটা পুরনো বল।

তপতী সবকিছুই শোনেন বিছানা থেকে। এমনকী, বিকেলে খাওয়ার ঘরের দেওয়ালে লাগা টেনিস বলের শব্দ আর সেইসঙ্গে বেলার শাসানি। ”জিনিসপত্তর ভাঙলে কিন্তু দু’জনের ব্যাট—বল উনুনে দিয়ে দেব।”

”বেলামাসি, ব্যাট নয় র‌্যাকেট।” মিনুর গলা।

”ওই হল।”

মিনু দাবা খেলতে আর যায় না। এখন স্কুল থেকে ফিরেই তার নতুন নেশা র‌্যাকেট আর বল। আলমারির কাচ ভাঙা। আর দেওয়ালে বলের ছোপ ধরানোর পর এখন সে বাড়ির বাইরে গিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে খেলে। চিনু স্কুলে যাচ্ছে না এখনও। তার কাজ বসে বসে দাদার খেলা দেখা। সে যথেষ্ট জোর দিয়ে মুঠোয় র‌্যাকেট ধরতে পারে না, কয়েকবার বল মারার জন্য চালালেই হাত ভার হয়ে যায়।

”মা, ফোরহ্যান্ড তো এইভাবে মারে।” মিনু শোওয়ার ঘরে একটা কাল্পনিক বলের দিকে র‌্যাকেট চালাল।

”হ্যাঁ, কে শেখাল?” বালিশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে তপতী খাটের ওপর। মিনুর উৎসাহ তাঁকে তাজা করে তুলল।

”রাজেনকাকা দেখিয়ে দিয়েছে। … সার্ভিস করা দেখবে মা?”

”ঘরের মধ্যে সার্ভিস—ফোরহ্যান্ড কিচ্ছু নয়। সবকিছু বাড়ির বাইরে।”

”তুমি কবে সেরে উঠবে মা?”

তপতীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি তাঁকে সেরে উঠতেই হবে। ডাক্তার বলেছেন, দিন সাতেকের মধ্যেই শোওয়ার ঘর থেকে বসার ঘর পর্যন্ত হাঁটার অনুমতি দেবেন।

অবশেষে তিনি এক বিকেলে হাঁটলেন দুই ছেলের কাঁধে হাত রেখে। এক—পা এক—পা করে বসার ঘরে পৌঁছতেই হাততালি দিয়ে উঠল মিনু আর চিনু। দু’হাত তুলে তপতী মুঠো ঝাঁকালেন। ”পেরেছি।” কথাটা দুই ছেলের মাথার মধ্যে ঢুকে গেল মায়ের দুই হাত তোলা ছবিটাকে সঙ্গে নিয়ে।

কোর্টের উদ্বোধনের জন্য ঠিক হল রবিবারের বিকেল। তন্ময়, রাজেন আর শুভা শনিবার সন্ধ্যায় ক্লাবে গিয়ে টেবল ঘুরে—ঘুরে সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানাল। নোটিশ বোর্ডেও একটা বিজ্ঞপ্তি শুভা সেঁটে দিল। প্রত্যেকেই তাঁরা আসবেন। প্রতিভা মজুমদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন তপতী সম্পর্কে। ”দেখাল বটে তপতী! একা মেয়েমানুষ সাহস করে শুরু করেছিল বলেই তো আজ ছেলেমেয়েদের জন্য একটা খেলার ব্যবস্থা হল। তার ওপর ভাবো কী ঝঞ্ঝাটাই না পোয়াতে হল, প্রথমে ছোট ছেলেটা, তারপর নিজে পড়ল বিছানায়। অবশ্য রাজেন আর তন্ময়বাবু যে পরিশ্রম করে শেষ করলেন, সেটাও বলতে হবে।”

আর—একজন বললেন, ”কত খরচ হল বলুন তো? ক্লাব থেকে একটা পয়সাও তো দেওয়া হয়নি!”

”আচ্ছা, টেনিস তো খেলা হবে, কিন্তু খেলাটা তো শিখতে হবে, নাকি ছেলেমেয়েরা আপনাআপনিই শিখে যাবে?”

”তা বটে! মিসেস ঘোষাল তো মোক্ষম প্রশ্ন করেছেন!” প্রতিভা ঝুঁকে বসলেন। ”খেলা শেখাতে তো মাস্টার লাগবে।”

”মাস্টার নয়, মাস্টার নয়, কোচ লাগবে বলুন।” শুধরে দিলেন চন্দ্রিমা দত্ত।

”ওই হল। তা বাপু কোচ কোত্থেকে আসবে? তাকে তো পয়সা দিতে হবে।”

”কেন, মিসেস বসুমল্লিক নিজেই কোচিং করবেন। শুনেছি তো একসময় খেলতেন—টেলতেন, অনেক কাপ—মেডেলও পেয়েছেন।”

”আরে রাখো তো তোমার কাপ—মেডেল, অমন কাপ—মেডেল অনেকের ঘরেই পাবে।” প্রতিভা চাপা ধমক দিলেন। ”একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে সেটা কি লক্ষ করেছ? বিয়ের আগে একটা পা ভেঙেছিল, এবার আর—একটা পা—ও গেছে। ও শেখাবে খেলা!”

”প্রতিভাদি, কাল আসছেন তো?”

”কাল তো রোববার। কখন লোকজন এসে পড়ে তার কি ঠিক আছে?”

”যা বলেছেন। আমাকেও কাল দিদির বাড়ি যেতে হবে।” মিসেস ঘোষাল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

পরদিন বিকেল পাঁচটায় ভক্সহল থেকে ওঁরা নামলেন ক্লাবের সামনে। তন্ময়ের হাত ধরে তপতী গাড়ির বাইরে পা রেখেই টলে পড়েছিলেন। মিনু তাড়াতাড়ি মায়ের হাত চেপে ধরল।

”আমি ঠিক আছি মিনু … হাত ছেড়ে দে।”

রাজেন এগিয়ে এল, সঙ্গে শুভা। কোর্টের ধারে একটা টেবল। তাতে রাখা হয়েছে দুটো র‌্যাকেট আর দুটো বল। চেয়ারে বসে আছেন ছ’—সাতজন। নেট খাটানো রয়েছে। চুনের দাগ দুপুরে টানা হয়েছে। শুভা হাত ধরে এনে তপতীকে টেবলের পেছনে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলল, ”বউদি আপনার র‌্যাকেট কই?”

”গাড়িতে আছে।”

তপতী আজই প্রথম দেখলেন তাঁর বহু কাঙ্ক্ষিত টেনিস কোর্টটিকে। তাঁর মুখ প্রসন্নতায় ভরে উঠল। গৌতম, অনিরুদ্ধর হাফশার্ট, শর্টস, মোজা, কেডস মিনুর মতোই সাদা। ওদের বাবা ও মায়েরাও এসেছেন। কিন্তু কোর্টের ধারেকাছে কোনও লোক নেই, শুধু কান্তি ছাড়া।

”আজ আমাদের টেনিস কোর্টের উদ্বোধন হবে।” রাজেন এবার টেবলের ধারে দাঁড়িয়ে স্বরটা একটু উঁচু করে বলল, ”বক্তৃতা শোনাতে গেলে যত শ্রোতার দরকার হয়, তত লোক এখানে নেই। সুতরাং বেশি কথা বলব না। ছোটদের নিয়মিত খেলা দরকার, তারা খেলতে চায়। এই সত্যি কথাটা আমরা, বড়রা, বুঝতে চাই না। কিন্তু ছোটরা নিজেরা খেলার ব্যবস্থা করতে পারে না, পারার কথাও নয়। সংগঠন না থাকলে খেলা যায় না, আর এইটুকু—টুকু ছেলেমেয়ের পক্ষে একটা সংগঠন গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। এটা গড়ে দেয় বড়রা।

”এখানে ছোটদের খেলাধুলার কোনও ব্যবস্থা নেই, এই অভাবটা লক্ষ করেই শ্রীমতী তপতী বসুমল্লিক প্রথম উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসেন। কাজ শুরুও করেন, কিন্তু একটা দুর্ঘটনায় তাঁকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে হয়। তিনি যে—কাজ শুরু করেছিলেন, অবশেষে আমরা তাকে সম্পূর্ণ করতে পেরেছি। আমি বিশেষ করে ধন্যবাদ দেব গৌতম আর অনিরুদ্ধর অভিভাবকদের। তাঁরা তাঁদের ছেলেদের খেলার জন্য এখানে পাঠিয়ে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। আর ধন্যবাদ জানাব অফিসার্স ক্লাবের কর্মী কান্তি সাঁতরাকে। সে তদারক না করলে এই কোর্ট তৈরি হয়ে উঠতে পারত না। যাই হোক, বেশি কথা বলব না বলেও বলে ফেললাম। এবার অনুরোধ করব বউদি আপনি কোর্টে এসে প্রথম সার্ভিসটা করুন।”

তপতী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই কান্তি ছুটে এল সাত—আটটা জবাফুলে গড়া একটা স্তবক নিয়ে। ”মেমসাব, আপনার জন্য।”

স্তবকটা হাতে নিয়ে টেবলে রাখলেন। গাড়ি থেকে তন্ময় তপতীর ডানলপ র‌্যাকেটটা নিয়ে এসেছেন, সেটা স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিলেন।

”ঠাকুরপো, সার্ভিস তো করব, রিসিভ করবে কে?”

”কেন, আমি! … র‌্যাকেট তো আমিও এনেছি, শুভা, দাও তো।”

বল হাতে তপতী দাঁড়ালেন বেস লাইনে। তাঁর পায়ে নতুন কেডস। বাঁ পায়ের পাতা লাইনের বাইরে রেখে বাঁ হাতের মুঠোয় বলটা চেপে ধরে সামনে তাকালেন এবং তাকিয়েই ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁর মনে হচ্ছে নেটটা অনেক দূরে। জীবনে তিনি টেনিস কখনও খেলেননি। সার্ভ করে বলটাকে নেটের ওপারে তিনি কখনোই পাঠাতে পারবেন না। সবাই কত আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ওদের মুখগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে, পা কাঁপছে। খুব অন্যায় করতে চলেছেন বলে তাঁর মনে হল। এভাবে লোক হাসাতে কেন তিনি রাজি হলেন?

”মা,” তপতী চমকে পেছনে তাকালেন। গুটিগুটি চিনু কখন যেন তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তার রুগণ দুটি হাতের মুঠি তুলে ঝাঁকাল, ”মা, পেরেছি বলো।”

বাঁ হাত সামনে বাড়িয়ে তিনি বলটা শূন্যে ছুড়লেন। হাতটা আকাশমুখো সোজা হল। বল থেকে চোখ সরালেন না। র‌্যাকেট ধরা ডান হাতটা পেছনে টানলেন। শিরদাঁড়া, পিঠ পেছনে বাঁকল। তারপর সামনের দিকে একটা ধাক্কায় র‌্যাকেটটা আছড়ে পড়ল নেমে আসা বলের ওপর।

সবাইকে অবাক করে বলটা নেটের মাথা ঘেঁষে ওপারে গিয়ে পড়ল। রাজেন বলটা রিটার্ন করার জন্য দু’পা এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল। তপতী মুখ থুবড়ে পড়ে গেছেন,পায়ে জোর না থাকায়।

”মা পেরেছ, দেখো।”

।।৫।।

”হল না, হল না… আবার মারো। দেখালাম তো, কতবার বলেছি র‌্যাকেটটা এইভাবে উঁচু করে, কাঁধ পর্যন্ত তুলে পেছনে টানো, তারপর নীচের দিকে নামাও।”

তপতী একটা কাল্পনিক বল লক্ষ্য করে ধীরগতিতে ফোরহ্যান্ড মারলেন। নেটের ওধারে দুটি ছেলে গভীর মনোযোগে তাঁকে নকল করে র‌্যাকেট চালাল।

”অনিরুদ্ধ, তোমার চোখ বল থেকে কিন্তু সরে গেল আর মিনু ফোরহ্যান্ড মারার সময় বাঁ পায়ে ভর রেখে ফিনিশটা ঠিক হচ্ছে না। …আচ্ছা, আবার আমি বল দিচ্ছি।” তপতী বল মারলেন অনিরুদ্ধর ডান দিকে। বলটা তার পাঁচ গজ আগে পড়ে উঠে এল কাঁধের ওপর। অনিরুদ্ধর ফোরহ্যান্ড বলের নাগাল পেল না।

”মুভ। মুভ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টেনিস খেলা যায় না। … লক্ষ করো কোথায় বলটা পড়ছে, অনুমান করো কতটা লাফাবে, সেইমতো তুমিও এগিয়ে এসো। দু’পা এগোলেই বলটা পেয়ে যেতে… আচ্ছা, আবার …।”

গৌরবর্ণ, এগারো বছরের অনিরুদ্ধর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে তাকে আর মিনুকে ফোরহ্যান্ড গুলে খাওয়াতে চেষ্টা করছেন তপতী। দু’জনকে অন্তত তিরিশবার করে তিনি ফোরহ্যান্ড মারিয়েছেন। মিনু তাঁর কাছে সমস্যা নয়, কিন্তু গোলগাল, ভারী দেহের অনিরুদ্ধ তাঁকে বিব্রত করছে। ছেলেটির চলাফেরা কিঞ্চিৎ গদাইলশকরি, চটপট মাথাটাও কাজ করে না। কোর্টের ধারে চেয়ারে অনিরুদ্ধর ঠাকুমা চোখ কুঁচকে বসে রয়েছেন।

চিনুর হাতে র‌্যাকেট। সে একাই খেলছে নিজের সঙ্গে। বল আকাশের দিকে মেরে ছুটে যাচ্ছে জমিতে পড়ার আগেই বলটাকে আবার আকাশে তুলে দেওয়ার জন্য। গৌতম আজ আসেনি। সে থাকলে চিনু তার সঙ্গে বল দেওয়া—নেওয়া করে, যখন তপতী ব্যস্ত থাকেন মিনু আর অনিরুদ্ধকে নিয়ে।

”এবার মিনু।”

তপতী একটু জোরেই বল পাঠালেন এবং তাঁকে অবাক করে মিনু সপাটে বলটা ফেরত দিল তিন ফুট উঁচু নেট ঘেঁষে, ফোরহ্যান্ডে। মারটাকে তারিফ জানাবার সুযোগ পাওয়ার আগেই তাঁর র‌্যাকেটের দু’গজ বাইরে দিয়ে বলটা বেরিয়ে গিয়ে ক্লাবের সুরকির রাস্তা পেরিয়ে একটা নিমগাছের গুঁড়িতে ধাক্কা দিল। তপতী বলটা পাওয়ার জন্য দু’পা দৌড়বার চেষ্টা করেই থেমে গিয়ে হতাশ চোখে বলটার দিকে তাকালেন। চিনু ছুটে গেল বলটা ফিরিয়ে আনতে।

বলটা হাতে নিয়ে চিনু আলতো করে আকাশের দিকে ছুড়ে নেমে আসার সময় র‌্যাকেট দিয়ে মাথার ওপর থেকে হিট করল। তপতী দেখে অবাক হয়ে গেলেন। প্রায় নিখুঁত সার্ভিস! ওইটুকু ছেলে। কী চমৎকার তাঁকে নকল করে ফেলেছে।

”চিনু, তুই দাদার পাশে গিয়ে দাঁড়া। যেরকম করে ফোরহ্যান্ড দেখিয়ে দিয়েছি, মারতে পারবি?”

অনেকখানি মাথা হেলিয়ে চিনু বলল, ”হ্যাঁ—আআ।”

তপতী পরপর দশটা বল চিনুকে দিলেন আর সদ্য ছ’বছর পার হওয়া বাচ্চচা ছেলেটি হুবহু মাকে নকল করে ফোরহ্যান্ড মারল। গায়ে জোর কম, দুটো বল নেটে আটকে গেল, বাকিগুলো এপারে এল দুর্বল গতিতে।

”অনিরুদ্ধ, দেখলে তো? ওইটুকু ছেলে কী সুন্দরভাবে শট নিল। তাও ওকে কিছুই শেখাইনি। আর তোমাকে কতবার দেখালাম তবু তুমি পারছ না। নাও, আবার করো।”

তপতী অনিরুদ্ধকে নিয়ে আবার শুরু করলেন। কোর্টের একধারে মিনু আর চিনুও ফোরহ্যান্ড আয়ত্ত করার কাজে মন দিল। রীতিমতো গরম পড়ে গেছে। বাতাস নেই,গাছের পাতা নড়ছে না। দরদর ঘামছে সবাই। মহাদেবপুরের একটা কিনারে নির্জন এলাকায় এই ক্লাব। সন্ধ্যার আগে ক্লাব মেম্বাররাও এদিক মাড়ান না। এদিকে লোকচলাচলও কম। তবু পথিকরা, সাইকেল আরোহীরা পথ দিয়ে যাওয়ার সময় টেনিস কোর্টের দিকে একবার তাকাবেই। তাদের দ্রষ্টব্য বিষয় হল তপতী। সাদা তাঁতের শাড়ি গাছকোমর করে বাঁধা, পায়ে কেডস জুতো, অবিরাম চেঁচিয়ে যাওয়া একটা বউ, আর চারটি বা তিনটি বাচ্চচা ছেলে প্রকাশ্যে একটা অপরিচিত খেলা খেলছে, হোক না শিল্পশহর বা কলকাতা থেকে মাত্র আটাশ মাইল দূরে, এখানে সেটা দেখার মতো ব্যাপার।

কিন্তু ক্লাব মেম্বারদের বাড়ির কেউ কৌতূহলবশে বা নিছক উৎসাহ দিতেও বিকেলে আসেন না। রাজেনের কাজের ছুটি যখন হয় তখন তপতী ছেলেদের নিয়ে বাড়ির পথে। তবু ছুটির দিনে কলকাতার আড্ডা ফেলে দু’—তিনবার সে এসেছে।

”বউদি, বাচ্চচাদের আমি ঠিক হ্যান্ডল করতে পারি না, আমার ধৈর্যটা একটু কম। তা ছাড়া ছুটির পর এত টায়ার্ড লাগে!” রাজেন বলেছিল। ”কিন্তু প্রাথমিক যা করা দরকার, অ আ ক খ শেখানো, সেটা তো আপনি ভালভাবেই শেখাচ্ছেন।”

”ইলাহাবাদে যার কাছে প্রথম শিখেছিলাম, তিনি যা—যা করেছিলেন আমি সেটাই করে যাচ্ছি ঠাকুরপো। কিন্তু আমারও তো বিদ্যের একটা সীমা আছে। ওপরের দিকের খেলার কিছুই জানি না। খেলার বই কি ম্যাগাজিন, বিশেষ করে টেনিসের, কিছুই আমাদের দেশে নেই যে, পড়ে—পড়ে শিখব। বিদেশ থেকে হয়তো বইটই আসে, কিন্তু কোথায় পাওয়া যায় তাও জানি না।

”ছোটবেলায় আমরা খবরের কাগজে উইম্বলডনের রেজাল্ট কি দু—একটা ছবি দেখতাম। বিয়ের আগে দাদার কাছে অনেকের নাম শুনতাম। এখনও কয়েকটা নাম মনে আছে—ডোনাল্ড বাজ, ববি রিগস, ক্র্যামার, বরোত্রা, পাঞ্চো গঞ্জালেস; মেয়েদের মধ্যে লুই ব্রাও, মুডি, হার্ট। বিয়ের পর খেলা থেকে এতদূরে চলে গেলাম যে, খবরের কাগজের খেলার পাতাটাও আর দেখতাম না।” তপতীর স্বর ছেলেবেলার স্মৃতি আর বর্তমানের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে যেন বিষণ্ণতায় ভরে রয়েছে।

”বউদি, ছোটদের খেলা শেখানোর সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি কী জানেন? ভাল প্লেয়ারদের খেলা ওদের নিজের চোখে দেখানো। ওরা তা হলে নিজেরাই বুঝে নিতে পারবে কোনটা করতে হবে আর কোনটা করতে হবে না। একটা ছেলে দশটা বই পড়ে যা জানবে,মাত্র একটা ভাল ম্যাচ দেখেই সেটা সে শিখে নিতে পারবে। অবশ্য যদি তার মনে ইচ্ছা আর ঘটে কিছু বুদ্ধি থাকে। আর কিছুদিন পরই তো সাউথ ক্লাবে ইস্ট ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ানশিপ হবে। সুইডেনের হলস্ট্রোম ইন্ডিয়ান সার্কিটে এখন খেলছে,ওকে আনার চেষ্টা চলছে। আমাদের কৃষ্ণন, প্রেমজিত, জয়দীপ তো থাকবেই। ফাইনালের দিন ছেলেদের নিয়ে চলুন।” রাজেন অনুরোধ করেছিল খুব আন্তরিকভাবে। ”আমি আপনাদের সবাইকে নিয়ে যাব। এই বয়সে ওদের খেলা দেখাটা খুব দরকার।”

কিন্তু এখন তিনি অনিরুদ্ধকে বারবার বল দিয়ে দেখিয়ে এবং মুখে বলেও, ফোরহ্যান্ড মারার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ কাঁধ কতটা ঘুরবে আর র‌্যাকেট কতটা উঠবে ফলো—থ্রুতে সেটা ঠিক করাতে পারলেন না।

”মা, অনিরুদ্ধটা একটা ভোঁদা।” মিনু বলে উঠল। চিনুর সঙ্গে খেলতে খেলতে সে লক্ষ করছিল তপতীর নাকাল অবস্থাটা।

”তুমি বরং আমাদের সঙ্গে খেলো।”

তপতীও তাই ভাবছিলেন,শুধুই পণ্ডশ্রম করে যাচ্ছেন। বাড়ির আদুরে এই ছেলেটির টেনিস কেন, কোনও খেলাই হবে না। বরং চিনু—মিনুকে বল দিয়ে গেলে ওরা ঝালাই করার কাজে এগোতে পারবে।

”ঠিক আছে অনিরুদ্ধ, তুমি এখন একটু রেস্ট নাও, আর দেখো ওরা কীভাবে স্ট্রোক করছে।”

তপতীর কথা সবে শেষ হয়েছে তখন একটা গম্ভীর গলা বলে উঠল, ”অনি, চলে আয়। আর তোকে খেলতে হবে না।” গলাটা অনিরুদ্ধর ঠাকুমার। তিনি মিনুর কথা শুনতে পেয়েছেন।

বাধ্য নাতির মতো অনিরুদ্ধ ঠাকুমার কাছে হাজির হল।

”বাড়ি চল।” ঠাকুমা উঠে দাঁড়ালেন। তপতী ছুটে গেলেন ওদের কাছে।

”সে কী মাসিমা, অনিরুদ্ধকে যে আবার প্র্যাকটিস করাব।

”করিয়ে কাজ নেই, ভোঁদা ছেলের পেছনে সময় নষ্ট না করে বরং নিজের ছেলেদেরই দেখো।” ঠাকুমা আর রাগ চাপতে পারলেন না। ”আমার নাতিটাকেই শুধু খাটিয়ে যাচ্ছ, যেন ও একটা কুলিমজুর। কই, নিজের ছেলেদের তো খাটাচ্ছ না। আমি তখন থেকে বসে বসে লক্ষ করে যাচ্ছি তুমি খালি ওর পেছনেই লাগছ।…দরকার নেই বাপু অমন খেলায়…এমন একচোখামি জম্মে কখনও দেখিনি, আয়।” ঠাকুমা অনিরুদ্ধর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলেন।

”আমি তো ওর ভালর জন্যই খাটাচ্ছি মাসিমা।” তপতীর গলায় করুণ মিনতি। যাও—বা দুটো ছেলে পেয়েছেন, তার একটি যদি চলে যায় তা হলে মিনু—চিনু ছাড়া তো কিছুই থাকবে না!

”না, না, আর ভাল করতে হবে না, দেখেছ বাছার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। আয়, খেলে তো চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করবি।”

”ঠাকুমা, বাবা গাড়ি নিয়ে আসবে যে!” অনিরুদ্ধ নিরস্ত করার চেষ্টা করল। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় অনিরুদ্ধর বাবা ওদের তুলে নিয়ে যান। নাতির কথা শুনে ঠাকুমা বসে পড়লেন।

কয়েক সেকেন্ড তপতীর নিজেকেই ভোঁদা মনে হল। তারপর ধীরে—ধীরে তাঁর দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠল। চোয়ালের পেশি দপদপ করে উঠল কয়েকবার। তিনি দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলেন না।

”মিনু, এবার ভলি…দেখছিস তো আমার দুটো পা—ই পঙ্গু, তুই কি আমাকে কষ্ট দিবি? যদি কষ্ট না দিতে চাস, তা হলে এমনভাবে ভলিতে রিটার্ন করবি যেন আমাকে এক পা—ও নড়তে না হয়, সব বল যেন আমার র‌্যাকেটে আসে।…চিনু, যা বললাম শুনলি?”

দুই ভাই মাথা হেলাল। আড়চোখে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল। তপতী সহজ করে বল জোগাতে লাগলেন। একবার মিনুকে, তারপর চিনুকে। মুখের সামনে, বুকের সামনে, কাঁধের পাশে, মাথার ওপর থেকে আসা জমি না ছোঁয়া বলগুলো দুই ভাই নেটের ওধারে মায়ের র‌্যাকেটে পৌঁছে দিতে লাগল। যদি কোনও রিটার্ন তপতীর থেকে একটু আগে বা একটু বেশি দূর হয়ে যায় তা হলে অন্য ভাই উৎকণ্ঠিত চোখে পাশের দিকে তাকায়।

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ওরা বল ফেরাচ্ছে। তপতী এবার বলগুলো ফোরহ্যান্ডের দিকে একটু—একটু করে সরাতে লাগলেন। ডান হাত লম্বা করে পাশে বাড়িয়ে ওদের ভলি করতে হবে। দু’বার চিনু পারল না, ওর থেকে বলিষ্ঠ মিনু পারল। তপতী একটা ব্যাপারে সচেতন হলেন, গায়ের জোর না বাড়ালে তাঁর ছেলেরা খেলোয়াড় হতে পারবে না। এই প্র্যাকটিস বেশিক্ষণ নেওয়ার মতো গায়ের তাগদ চিনুর নেই, মিনুর কিছুটা আছে। কিন্তু যথেষ্ট নয়।

নিমগাছের সামনে অনিরুদ্ধর বাবার গাড়ি এসে থামল। তিনি গাড়ি থেকে নেমে দেখলেন, ছেলে চেয়ারে বসে তার ঠাকুমার সঙ্গে। অন্য দুটি ছেলে তাদের মায়ের সঙ্গে খেলছে। ভ্রূ কুঁচকে গেল তাঁর।

”অনি খেলছ না?” বাবা জানতে চাইলেন।

অনিরুদ্ধ ঠাকুমার দিকে তাকাল। ঠাকুমা ব্যাজার মুখে বললেন,”ওঠ।” নাতি চেয়ার থেকে উঠল র‌্যাকেট হাতে।

”কী ব্যাপার!” বিস্মিত বাবা তাঁর মায়ের দিকে তাকালেন।

”খেলবে না অনি।” ঠাকুমা নাতিকে টানতে টানতে গাড়ির দিকে রওনা হলেন।

”কী ব্যাপার মিসেস বসুমল্লিক, অনি খেলবে না কেন?”

তপতী ঘামে ভেজা মুখ আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন,”আমি ঠিক বলতে পারব না, তবে মাসিমার কথা থেকে মনে হল উনি পছন্দ করছেন না অনিরুদ্ধর ওপর কোনওরকম চাপ দিই। ওর ফোরহ্যান্ডটা ঠিক করার জন্য বারবার ওকে বল দিচ্ছিলাম। মাসিমা সেটাকে কুলিমজুরের মতো খাটানো মনে করলেন।”

অনিরুদ্ধর বাবার মুখ অপ্রতিভ দেখাল। তিনি আড়ষ্ট স্বরে বললেন, ”খেলাধুলো করতে গেলে তো খাটতেই হবে। আর খাটবার জন্যই তো ওকে এখানে পাঠিয়েছি। দিন—দিন কী রকম মোটা হয়ে যাচ্ছে!”

তপতীর মনে হল ভদ্রলোক তাঁর মায়ের উলটোটি। ছেলেকে মাত্রাতিরিক্ত যত্ন—আদর দিয়ে নষ্ট করতে চান না।

”অনিরুদ্ধর শরীর যথেষ্ট ফিট নয় বলেই ওর বডি কোঅর্ডিনেশন খারাপ। ওর হাত, পা, মাথা, কোমর একসঙ্গে কাজ করে না। সেটাই যথাসম্ভব করাবার চেষ্টা করছিলাম।”

”ঠিকই করেছেন। আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে কী জানেন, আমার মার আবার নাতি—অন্ত প্রাণ, আমার স্ত্রীও একমাত্র ছেলেকে নয়নের মণি করে রেখেছেন। মার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলাও যায় না। অনি সম্পর্কে একটু কড়া হলেই সংসারে অশান্তি বেধে যায়, তাই আমি আর কিছু বলি না। যাই, ওকে খেলতে আসার জন্য বলি গিয়ে।” হতাশ এবং তিক্ত মুখ করে তিনি গাড়ির দিকে এগোলেন।

ওরা তিনজন গাড়ির দিকে তাকিয়ে। অনিরুদ্ধর বাবা তাঁর মার সঙ্গে কথা বলছেন। মা হাত নেড়ে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে কিছু বলতে শুরু করলেন। তারপর গাড়ির দরজা খুলে নাতিকে নিয়ে উঠে বসলেন। তপতীদের দিকে একবার তাকিয়ে অনিরুদ্ধর বাবা মাথা নামিয়ে গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং ধরলেন।

”মা, অনি বোধহয় আর আসবে না।” মিনু বলল।

”না।”

”ভালই হল, মা শুধু গৌতম আর আমাদেরই এবার থেকে শেখাবে।” চিনু তারিয়ে মন্তব্য করল।

”গৌতমও আসবে না,” মিনু বলল, ”জানো মা, গৌতম আমাকে বলেছে টেনিস ওর ভাল লাগে না, ওর ভাল লাগে ক্রিকেট। ও বলেছে টেস্ট ম্যাচ খেলবে। হাফ প্যান্ট পরে খেলার থেকে ফুলপ্যান্ট পরে খেললে দেখতে সুন্দর লাগে।”

”মিনু আয়, ভলি এখনও বাকি।” তপতী কোর্টের দিকে এগোলেন।

”মা আমি?” চিনুর চোখে ভীরু আবেদন। তপতী ছোট ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।

”তোর শরীরের সামর্থ্যের থেকে বেশি হয়ে যাচ্ছে না? একদিনেই এতটা করা ভাল নয়।” কথাগুলো বলে কী ভেবে তিনি মত বদলালেন, ”আচ্ছা আয়।”

রোদ পড়ে আসছে। আকাশ ম্লান, দূরের গাছপালা,বাড়ির রং ধূসর—কালো হয়ে উঠেছে। তপতী এইরকম সময়েই খেলা বন্ধ করে ছেলেদের নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন।

”মা, আর পাঁচটা।” মিনু বলল।

তপতী পাঁচবার ভলির জন্য বল দিলেন। ”আর নয়, এবার বাড়ি।”

”মা, আরও পাঁচটা, এই শেষ, আর বলব না।” মিনু মিনতি জানাল।

তপতী দু’বার দিলেন চিনুকে। ব্যাডমিন্টনের শাটলকক ফেরাবার মতো করে মুখের সামনে থেকে ভলি মেরে সে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে রইল। মাকে এক পাও নড়তে হল না দেখে আনন্দে ভরা চোখে সে দাদার দিকে তাকাল।

”মিনু, লাস্ট বল।” তপতী ইচ্ছে করেই বলটা মিনুর ডান দিকে প্রায় পাঁচ গজ দূরে উঁচু করে ফেললেন। দেখা যাক ছেলেটা পারে কি না। মিনু আশা করেনি তার অতদূরে বল আসবে। হুঁশ হওয়া মাত্র সে ডান দিকে দ্রুত দু’পা ছুটে ঝুঁকে র‌্যাকেট বাড়িয়ে দিল। কোর্ট প্রায় ছুঁয়েছে সেই অবস্থা থেকে সে বলটাকে তুলে দিল। আর নিজে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আলতো হয়ে উঁচুতে উঠে নেট পেরিয়ে বলটা অবাক তপতীর মাথার ওপর নেমে এল।

ধড়মড়িয়ে কোর্ট থেকে দাঁড়িয়ে উঠে দু’হাত তুলে মিনু লাফাল। ”পেরেছি…মা, আমি পেরেছি।”

.

ইস্ট ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ানশিপের ফাইনাল। হলস্ট্রোম খেলছে রামনাথন কৃষ্ণনের সঙ্গে।

মিনু আর চিনু বসেছে রাজেনের দু’পাশে। তপতী ও তন্ময় আসেননি। তপতীর বাঁ পায়ে যেখানে কোদালের আঘাতটা লেগেছিল সেই জায়গাটা গত রাতে ফুলে উঠে যন্ত্রণা শুরু হয়। ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন, ওষুধ দিয়ে গেছেন। তাঁর অবস্থা হাঁটাচলার মতো নয়। তন্ময় তাঁর জন্যেই বাড়িতে রয়ে গেছেন।

চতুর্থ সেট, নবম গেম। হলস্ট্রোম ৩—৫ এবং নিজের সার্ভিসে ০—৩০ পিছিয়ে। সে প্রথম সেট জিতেছিল ৬—৪, পরের দুটি সেট হেরেছে ১—৬; ২—৬। খেলা প্রায় দু’ ঘণ্টা গড়িয়েছে, জয়ের জন্য কৃষ্ণনের দরকার আর মাত্র দুটি পয়েন্ট।

হলস্ট্রোম সার্ভ করছে। রাজেন আড়চোখে তার ডানপাশে বসা চিনুর ডান হাতের আঙুলগুলোর দিকে তাকাল। হলস্ট্রোম বলধরা বাঁ হাত সামনে বাড়িয়ে উঁচুতে তুলতে—তুলতে বলটাকে শূন্যে ছুড়ে দিল। রাজেন দেখল, বাচ্চচা ছেলেটার বাঁ হাত গলার কাছে উঠে ফুলের পাপড়ির মতো আঙুলগুলো খুলে গিয়ে কাল্পনিক বলটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিল। ডান হাতের মুঠো কাঁধের কাছে, র‌্যাকেট ধরা কব্জিটা মোচড়ানো, পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকিয়ে চেয়ারে কাঁধ ঠেকে গেছে। তারপরই চিনুর কোমর থেকে ঊর্ধ্বাঙ্গ হলস্ট্রোমের সার্ভিসের সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকল আর ডান কব্জিটা চাবুক মারার মতো সামনে ঝাপটা দিল।

রাজেনের অবাক চোখ হঠাৎ চিনুর নজরে আসতেই সে লজ্জা পেয়ে হাত দুটো কোলের কাছে গুটিয়ে নিল। হলস্ট্রোমের সার্ভিস কৃষ্ণনের ডান দিকে সার্ভিস কোর্টের মাঝামাঝি পড়েছে, সে ডান দিকে সামান্য হেলে সপাটে ফোরহ্যান্ড রিটার্ন মারল ডাউন দ্য লাইন। বেস লাইনের ছ’ ইঞ্চি আগে সাইড লাইনে বল পড়ল। উত্তেজনায় মিনু উঠে দাঁড়িয়েছে।

”লাভ ফার্টি।” মাইকে ঘোষণা করলেন আম্পায়ার।

”মারটা মনে থাকবে তো?” রাজেন ফিসফিস করে বলল। মিনু মাথা হেলাল। ”কৃষ্ণনের ব্যাক হ্যান্ড মনে থাকবে তো?”

”হ্যাঁ। আর একটু হলেই বলটা বাইরে পড়ত।…রাজেনকাকা, কৃষ্ণন খুব প্র্যাকটিস করে?”

”করে, আর সেজন্যই মারগুলো এত মাপা হয়।”

”ফিফটিন ফর্টি।”

হলস্ট্রোমের লব কৃষ্ণনের মাথার ওপর দিয়ে বেস লাইনের কাছে পড়েছিল, কৃষ্ণন পিছু হটতে পারেনি।

”দেখলে মিনু, ফিজিক্যাল ফিটনেসে কৃষ্ণন কত পিছিয়ে। শুধু শট নিতে পারলেই হয় না, খুব চটপটে খুব ফাস্ট মুভ করার জন্য শরীরও তৈরি করতে হবে।”

”দৌড়লে হবে?” চিনুর প্রশ্ন।

”বড় প্লেয়াররা রোজ সাত—আট মাইল দৌড়য়! ব্যায়ামও করে।” রাজেন ফিসফিসিয়ে বলল।

”দাদা, আমরা কতটা দৌড়ই রে?”

”চুপ, চুপ।” রাজেন ঠোঁটে আঙুল দিল। হলস্ট্রোম সার্ভ করছে। ম্যাচে এই নিয়ে প্রায় আশিবার। এত সার্ভিস দেখার পর, রাজেনের মনে হল, বাচ্চচা দুটো নিশ্চয় এর ছবি মনের মধ্যে তুলে রেখে দেবে। প্রচণ্ড জোরালো সার্ভিস করে এই সুইড। কিন্তু শুধু জোরে সার্ভ করতে পারলেই যে ম্যাচ জেতা যায় না, কৃষ্ণন সেটা আজ বুঝিয়ে দিয়েছে।

”থার্টি ফর্টি।” হলস্ট্রোমের সার্ভিস এস হয়েছে।

আবার সার্ভ করল। ফোরহ্যান্ড রিটার্ন কৃষ্ণনের। বলটা উঁচু হয়ে মাঝ কোর্টে। ডান দিকে ভলি মারল হলস্ট্রোম। কৃষ্ণন যেন আগাম জানতই বল কোথায় আসবে। বাঁ দিকে সরে গিয়ে সে অপেক্ষা করছিল। হলস্ট্রোমের কোমরের পাশ দিয়ে আড়াআড়ি মারা একটা ঝলসানো ব্যাকহ্যান্ডে বলটা বেস লাইনের কাছে পড়ে বেরিয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে হলস্ট্রোম একবার তাকিয়ে দেখে নেটের দিকে এগিয়ে গেল হাত বাড়িয়ে। হাজার দুয়েক লোক দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে মিনু—চিনুও। উত্তেজনায় দু’জনের মুখ টসটস করছে।

মহাদেবপুরে ফেরার সময় গাড়ি চালাবার ফাঁকে রাজেন পাশে বসা দুই ভাইকে বলল, ”আজ যা—যা দেখলে সব যেন মনে থাকে।”

”অত জোরে জোরে মারলে যদি মায়ের পাশ দিয়ে বল বেরিয়ে যায়!” চিনুর সামনে এখন এটাই প্রকাণ্ড সমস্যা।

”তুমি কি এখনই অত জোরে জোরে মারতে পারবে?” হালকা সুরে রাজেন বলল।

”না। তবে দাদা জোরে মারতে পারে।”

”ধ্যাত, জোরে মারি নাকি? জোরে মারলে বল এধার—ওধার চলে যায়, মার তাতে অসুবিধে হবে না? জানেন রাজেনকাকা, মা যেখানে দাঁড়ায় ঠিক সেই জায়গাটা লক্ষ্য করে আমরা দু’জনেই বল মারি। আস্তে না মারলে কি ঠিক জায়গায় বল পাঠানো যায়?” বিচক্ষণের মতো মিনু বলল।

”তা বটে, আস্তে আস্তে মেরেই শুরু করতে হয়। কিন্তু মিনু, মার অসুবিধের কথা ভেবে কতদিন তুমি আস্তে মারবে? জোরে জোরে না মারলে বড় প্লেয়ার হবে কী করে? তুমি তো বড়ই হতে চাও, চাও না?”

রাজেনের কথাগুলো এবার মিনুকে সমস্যায় ফেলে দিল। মাকে সে ভালবাসে, আবার বড় প্লেয়ার হওয়ার ইচ্ছাটাও কৃষ্ণনকে দেখার পর তার মধ্যে আলোড়ন তুলছে। তার ছোট্ট মাথা এমন একটা কঠিন অবস্থায় আগে কখনও পড়েনি।

”তুমি তো দাবা খেলেছ। রাজার কিস্তি হতে পারে এমন একটা অবস্থা তো খেলায় একসময় আসবেই। সেজন্য তুমি আগে থেকে নিশ্চয়ই ভেবে রাখো কী কী চাল দেবে, রাখো না কি?” রাজেন সামনের ভিড়—রাস্তায় রাখা সতর্ক দৃষ্টিটা পলকের জন্য ঘুরিয়ে মিনুর মুখটা দেখার চেষ্টা করল। তার মনে হল ছেলেটি উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে।

হঠাৎ চিনু বলে উঠল, ”আচ্ছা রাজেনকাকা, কৃষ্ণন কি মায়ের সঙ্গে খেলত?”

হো হো করে হেসে ওঠার ইচ্ছেটা দমন করতে হল রাজেনকে। জি টি রোডের সালকিয়া, লিলুয়া, বেলুড়ের দিকটায় গাড়ি চালাতে চালাতে সন্ধ্যার মুখে হেসে ওঠা যায় না। সরু রাস্তা, রাস্তায় দোকান, গাঁক গাঁক করা ট্রাক আর বাস এবং ছুটির দিনের বিশৃঙ্খল ভিড় ঠেলে মোটর গাড়িকে এগোতে হয় চোখ কান খুলে।

”চিনু, তুমি কিন্তু নিজের অজান্তেই একটা ভাল বিষয় তুলেছ। কৃষ্ণন ছোট বেলায় মায়ের সঙ্গে নয়, বাবার সঙ্গে খেলত। ভদ্রলোক দিল্লিতে চাকরি করতেন। ঠিক করলেন ছেলেকে বড় টেনিস প্লেয়ার করবেন।” রাজেন ব্রেক কষল। এক স্ত্রীলোক ছুটে রাস্তা পার হচ্ছিল কোমরে একটা শিশুকে নিয়ে। হঠাৎ গায়ের পাশে গাড়ি দেখে দিশাহারা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

মিনুর তর সইছে না। আবার গাড়ি চলা মাত্র সে বলল ”তারপর?”

”তারপর তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সবকিছু বিক্রি করে যা টাকা পয়সা পেলেন তাই নিয়ে দিল্লি থেকে তামিলনাড়ুতে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলেন। সেখানে একটা ক্লে কোর্ট বানালেন, গ্রামে মাটি দিয়ে লেপা উঠোন দেখেছ তো?”

”না দেখিনি।” মিনু বলল।

”মহাদেবপুরের পাশেই তো গ্রাম, একদিন গিয়ে দেখে নিয়ো। গোবর জল আর মাটি দিয়ে লেপা, একেবারে সিমেন্টের মেঝের মতো তকতকে হয়। সেইরকম কোর্টে তিনি ছেলেকে দিনের পর দিন হাতে ধরে টেনিস শেখালেন। ছেলেও রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্র্যাকটিস করল, সেই সঙ্গে লেখাপড়াও। তারপর এল মাদ্রাজ শহরে। তারপর একের পর এক চ্যাম্পিয়নশিপ জিতল। এখন কৃষ্ণন ভারতের সেরা।

”বুঝলে, মিনু, বাবা বিরাট ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন ছেলেকে বড় প্লেয়ার বানাবার জন্য, ছেলেও সেটা বুঝেছিল। আর তাই সে মন প্রাণ দিয়ে খেটে গেছে বাবার স্বপ্নকে সত্যি করে তুলতে।”

”মাও খুব খাটে।” চিনু বলল।

কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। একসময় রাজেন আড়চোখে দেখল মিনু তার ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলছে। তার কানে এল দুটো কথা, ”মারও স্বপ্ন আছে।” চিনু বলল, ”বাবারও আছে।” শুনে রাজেনের মুখে হাসি ফুটে উঠল।

অধীর হয়ে তপতী অপেক্ষা করছিলেন ওদের ফেরার জন্য। ফিরে এসেই দুই ভাই কলকল করে শুরু করল যা দেখে এসেছে তার বর্ণনা দিতে। কৃষ্ণন আর হলস্ট্রোমের ভলি, লব, সার্ভিস, ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড যা কিছু দেখেছে, দুই ভাই র‌্যাকেট হাতে মাকে সেগুলো দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তন্ময় মুখে হাসি নিয়ে তপতীর মতোই চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে দেখে গেলেন।

বেলা এসে তাড়া দিল রাতের খাবার খেয়ে নেবার জন্য। এই ব্যাপারে বাড়ির নিয়ম ভীষণ কড়া। অনিচ্ছুক দুই ভাই খাবার ঘরে চলে যেতেই তপতী বললেন, ”ঠাকুরপো, এদের উৎসাহ তো আপনি চাগিয়ে দিলেন, এবার আমি সামলাই কী করে।”

”উৎসাহের আগুন তো আপনিই জ্বালিয়েছেন, আমি শুধু একটু বাতাস দিলাম। কিন্তু সমস্যাটা সত্যিই এবার এসে পড়েছে। টপ ক্লাস টেনিস কী বস্তু, ওরা আজ তা দেখল; কিছু বুঝেছেও হয়তো। ওরা এবার চাইবে কৃষ্ণন কি হলস্ট্রোমের নকল করে বল মারতে। এবার তো সেই সুযোগগুলো ওদের জন্য করে দিতে হবে, অবশ্য যদি…” রাজেন থেমে গেল।

উৎকণ্ঠিত তন্ময় বললেন, ”যদিটা কী?”

”আগে ঠিক করুন ওদের বড় খেলোয়াড় বানাতে চান, না ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার,ব্যারিস্টার করতে চান? যদি ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার করতে চান তা হলে খেলাটাকে সিরিয়াসলি নেবার দরকার নেই। দুজনে যেভাবে চালাচ্ছে চালাক, একটু আধটু ছুটুক আর মন দিয়ে পড়াশুনো করুক। কিন্তু দাদা, দেশে প্রচুর ডাক্তার, উকিল, জজ—ব্যারিস্টার আছে, কজনের নাম দেশের লোক জানে? কিন্তু কৃষ্ণনের নাম করুন, বহু লোক তাকে চিনবে। মিলখা সিং, শৈলেন মান্না, পঙ্কজ রায়, ভিনু মানকাদ, লক্ষ লক্ষ লোক এঁদের নাম জানে, ঠিক কি না?”

স্বামী—স্ত্রী দুজনেই মাথা নাড়লেন।

”আমি লক্ষ করেছি টেনিস ওরা ভালবাসে, খেলতেও চায়। বড় প্লেয়ার হওয়ার জন্য যে ইচ্ছাটা থাকা দরকার, এই বয়সেই ওদের মধ্যে সেটা ফুটে উঠছে। সেটাকে যদি আরও ফুটিয়ে তোলা যায়, আমার ধারণা ওরা টেনিসে কিছু একটা করে দেখাবে।”

”তুমি বলছ রাজেন?” তন্ময়ের চোখ জ্বলজ্বল করছে ভেতরের উত্তেজনায়।

”হ্যাঁ বলছি। বিরাট ঝুঁকি নেওয়া হবে ঠিকই, কিন্তু কোনও বড় কাজই ঝুঁকি না নিয়ে করা যায় না। আপনি দুটো বছর ওদের সময় দিন। যদি বোঝেন কিছু হবে না, ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছে, তখন নয় বন্ধ করে দেবেন, যদি বোঝেন হবে, তা হলে অল আউট ওদের পিছনে খরচ করবেন।”

”খরচ!” তপতী নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন।

”হ্যাঁ খরচ। ওদের জন্য কোচ রাখতে হবে, তাকে টাকা দিতে হবে।”

”কত টাকা।”

”এখনই বলতে পারব না। খোঁজখবর করে দেখি ভাল কাউকে পাই কি না। এতটুকু ছেলেদের কোচ করতে কলকাতা থেকে আসতে কেউ রাজি হবে কি না সেটাও তো দেখা দরকার। তবে দাদা—বউদি, আপনাদের একটা কথা বলে রাখি, ভেবেচিন্তে নামবেন। শুধু আমার কথা শুনে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেবেন না।…টেনিস খেলে টাকা রোজগার করা যায় না ঠিকই, কিন্তু নাম করতে পারলে ভাল চাকরি, খ্যাতি, সম্মান এগুলো তো পাবে। …প্রতি বছর ভারতে লক্ষ লক্ষ ছেলে কলেজ থেকে বেরোচ্ছে, কিন্তু কৃষ্ণন তো একটাই।”

।।৬।।

রাজেন চলে যাবার পর তন্ময় ও তপতী অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। দুজনের মাথায় ঘুরছে একই চিন্তা আর কয়েকটা কথা—’দুটো বছর ওদের দিন’…’ওরা টেনিসে কিছু একটা করে দেখাবে’…কৃষ্ণন তো একটাই।’

”তা হলে কী করা যায়, কোচ রাখব?” তন্ময় স্ত্রীর কাছে পরামর্শর থেকে যেন সমর্থনই চাইলেন।

”খরচ বাড়বে, তা ছাড়া ঝুঁকিও রয়েছে।” তপতী চিন্তিত স্বরে মনে করিয়ে দিলেন।

”তোমার পায়ের যা অবস্থা তাতে ডাক্তার যা বলে গেলেন সেটাই করা উচিত, কোর্টে নামা একদম বন্ধ। আবার যদি ফুলে ওঠে কি যন্ত্রণা শুরু হয়, তা হলে কী হতে পারে সেটাও তো শুনলে ওঁর কাছে।”

”জন্মের মতো পঙ্গু হয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমি কোর্টে না নামলে কে ওদের…।” তপতী থেমে গেলেন। স্বামীর মুখের দিকে অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকা বললেন, ”আমি ঝুঁকি নেব।”

”পঙ্গু হয়ে যেতে পার শুনেও?” তন্ময় বিরক্তি চাপতে পারলেন না।

”ঝুঁকি নেব দুটো বছর। খরচ যাই হোক, মিনু কি চিনুকে দেশের লোক চিনবে—আমি তাই চাই। তুমিও কি চাও না ওরা টেনিসের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাক?…ঝুঁকির ভয়ে আমি পিছিয়ে যাব না।” ধীর অচঞ্চল স্বরে তপতী বললেন। সঙ্কল্পে তাঁর মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে।

”ভোরে বেরোনো বন্ধ হয়ে রয়েছে, আমিই ওদের নিয়ে বেরোব।” তন্ময় উঠে দাঁড়ালেন। ঝুঁকি নিতে তিনি প্রস্তুত এমন একটা ভাব তাঁরও মুখে।

পরদিন ভোরে মিনু এক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। বাথরুমে পা পিছলে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে তার কপাল কাটল, গালে কালশিটে পড়ল আর ডান হাঁটু ফুলে উঠল। দিন সাতেক লাগল তার সবগুলো আঘাত সেরে উঠতে।

অতঃপর এক ভোরে তন্ময় দুই ছেলের সঙ্গে ছুটতে বেরোলেন। যে পথ ধরে মিনু আর চিনু ফেরিঘাট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসত, তিনজন সেই পথই ধরল। তন্ময়ের অভ্যাস নেই এতটা দৌড়বার। তিনি ফেরিঘাট পৌঁছবার আগেই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

”হ্যাঁ রে তোদের মা এতটা ছুটত কী করে?”

”মা তো ছুটত না, জোরে হাঁটত। আমরা ছুটতাম।” চিনু বলল, ”তুমি হাঁটো আমরা ছুটটে ফেরিঘাট ছুঁয়ে ফিরে আসছি।” মিনু খুবই সহানুভূতির সঙ্গে জানিয়ে দিল ”দশ মিনিটেই ফিরব।”

”তাই যা, আমি একটু জিরোই।” দুই হাঁটুতে হাত রেখে তন্ময় ঝুঁকে পড়লেন।

বাড়িতে ফিরেই তিনি স্ত্রীকে বললেন, ”আমার দ্বারা ছোটা হবে না, রাজেনকে আজই বলব একজন কোচ ঠিক করে দিক।”

”বিকেলে মিনুকে কি স্কুল থেকে ক্লাবে নিয়ে যেতে পারবে?”

”পারব। কিন্তু খেলতে তো পারব না তোমার মতো।”

”তোমায় খেলতে হবে না, ওরাই খেলবে। নিজেদের মতো করে।…অফিস থেকে বাড়ি এসে চিনুকে নিয়ে গাড়িতে করেই যেয়ো।”

তন্ময় যথেষ্ট আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে হেঁটে বাড়িতে এলেন। গাড়ি বার করে চিনুকে নিয়ে স্কুলে গেলেন, সেখান থেকে মিনুকে তুলে নিয়ে ক্লাবে। কোর্টের ধারে একটা চেয়ারে বসলেন।

নেটের দুধারে দুই ভাই, বয়স দশেরও কম। মিনু বলল,”আমি জোরে জোরে মারব তুই বল ধরে সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে ফেরত পাঠাবি। আমি আবার মারব।”

কথা মতোই চিনু কাজ করল। অবশ্য বল ধরতে তাকে কোর্টের নানা দিকে ছুটতে হল, কেননা মিনুর জোরালো মারের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। একসময় চিনু হাঁফিয়ে পড়ল।

”দাদা, আমি আর পারব না। তুই একাই মারবি আর আমি বুঝি মারব না।”

”তা হলে তুই র‌্যাকেট ধর, আমি ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছি।”

ওরা যখন নিজেদের মধ্যে ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড, সার্ভিস ও ভলি মারায় ব্যস্ত সেই সময় নিমগাছের তলায় সাইকেল থেকে একটি বয়স্ক লোক নামলেন। এক হাতে সাইকেলটা ধরে তিনি দুটি ছেলের দিকে তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে রইলেন।

লোকটির পরনে সাদা শর্টস আর নীল স্পোর্টস শার্ট। পায়ে সাদা ময়লা কেডস। লম্বায় ছ’ ফুটের ওপর, গড়ন ছিপছিপে হলেও পেশিগুলো শুকনো দরকচা নয়। বলিষ্ঠ দুটো পা দেখে বোঝা যায় লোকটি পরিশ্রমী, দুই কাঁধের পেশিতেও সেই আভাস। মুখ ঈষৎ লম্বাটে, নাকের পাশে গভীর ভাঁজ, গালেও। মুখখানি বহু অভিজ্ঞতায় পোড়খাওয়া। ছোট করে কাটা চুল কাঁচাপাকায় মেশানো। লোকটিকে ফিরে রয়েছে কঠিন এমন এক আবরণ, যা থেকে মনে হতে পারে তিনি লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না। তাঁর বয়স অনুমান করা শক্ত, তবে পঞ্চাশের নীচে নয়, এইটুকু বলা যেতে পারে।

প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে তিনি দুটি বাচ্চচার নিজেদের মধ্যে খেলা দেখলেন। দেখতে দেখতে তাঁর চোখে কখনও হাসি ফুটে উঠল, কখনও প্রসন্নতা, কখনও কুঁচকে উঠল কপাল। একটা বল তাঁর পায়ের কাছে এসে পড়লে তিনি বলটা হাতে তুলে দাঁড়িয়ে থাকেন। চিনু ছুটে এসেছিল।

”কার কাছে খেলা শিখছ?” লোকটি বললেন। মৃদু গম্ভীর অন্তরঙ্গ স্বর।

”মার কাছে।”

লোকটির ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ”কোথায় মা, তোমরা তো একা একাই খেলছ!”

”মার পায়ে ব্যথা, আসেনি…বলটা দিন।”

”উনি কে, ওই যে চেয়ারে বসে?”

”বাবা।…দিন না।”

”নাম কী তোমার?”

”চিন্ময় বসুমল্লিক।”

চিনুর হাতে বলটা দেওয়ার সময় তিনি বললেন,”জুতোর ফিতেটা খুলে গেছে, বেঁধে নাও।”

পরের দিন সন্ধ্যায় রাজেন এল। তপতী তখন দুই ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন।

”বউদি, একজনকে পেয়ে গেছি। সহদেব মিশ্র। আজ দুপুরে অফিসে এসে বলে গেলেন তিনি রাজি।…খুব অভিজ্ঞ, আমিও ওঁর কাছে কোচিং নিয়েছি কিছুদিন…খুব কড়া কোচ, সাউথ ক্লাবে অনেকদিন আছেন। এই মাইল ছয়েক দূরে হুগলিতে ওঁর বাড়ি, একা মানুষ, বউ মারা গেছে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, বাড়ির একটা ঘরে থাকেন, বাকিটা ভাড়া দিয়েছেন। কোচিং আর ভাল লাগছে না তাই ছেড়ে দেবেন ঠিক করেছেন। বড়লোকদের ছেলেমেয়ে, কেউ বড় প্লেয়ার হওয়ার জন্য তো কোচিং নেয় না, অত খাটুনি ওদের পোষাবে কেন? একশো—দুশো টাকা দিয়ে কোচ রেখেছি, হাতে র‌্যাকেট নিয়ে ঘুরছি, অভিজাত ক্লাবে যাচ্ছি, এইটে দেখাবার জন্যই তো ওদের খেলার ভান করা। সহদেব মিশ্র তাই বিরক্ত হয়ে ঠিক করেছেন আর কোচিং করে সময় নষ্ট করবেন না। তবে মাসকাবারে কিছু টাকা তো ওঁর দরকার, তাই বাড়িতে গিয়ে ওঁকে ধরে বললাম,’সহদেবদা; দুটো বাচ্চচা ছেলে আছে, আপনার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়, নেবেন ওদের?’ রাজি হননি। অনেক বলার পর বললেন,’আগে ওদের দেখব, তারপর হ্যাঁ কি না জানাব।’ আমার কাছ থেকে ক্লাবের হদিসও নিলেন।”

”মা, কাল একটা লোক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখছিল!” চিনু বলল।

”আমিও লোকটাকে দেখেছি। কাঁচাপাকা চুল, সাইকেলে এসেছিল!” তন্ময় বললেন।

”তা হলে এই লোকটাই সহদেবদা। উনি সাইকেলেই কাছেপিঠে ঘোরেন।”

”বললে ছ’ মাইল, সেটা কি খুব কাছেপিঠে হল!” তন্ময় অবাক হলেন।

”ছ’ মাইলটা ওঁর কাছে নস্যি, কোনও ব্যাপারই নয়। বারো—চোদ্দো মাইল রেগুলার সাইকেলে ঘোরেন শরীরটাকে ফিট রাখার জন্য।”

”ঠাকুরপো, মিনু—চিনু সম্পর্কে কী বললেন উনি?” তপতী অধীর হয়ে উঠেছেন তাঁর ছেলেদের দেখে কী ধারণা হয়েছে জানার জন্য।

”সহদেবদা কম কথার মানুষ, শুধু বললেন, ‘গুড’। আর জিজ্ঞেস করলেন বাবা—মা লেগে থাকতে পারবে তো? আমি ওঁকে আপনাদের সম্পর্কে সবই বলেছি।”

”কত নেবেন?” ভয়ে ভয়ে তপতী জানতে চাইলেন।

রাজেন কিন্তু কিন্তু করে বলল,”এক একজনের জন্য একশো টাকা মাসে, একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু উনি এর কমে রাজি নন।”

তপতী চোখ বন্ধ করলেন। কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন,”রাজি।”

”মাসে দুশো টাকা তো, হয়ে যাবে।” তন্ময় যোগ করলেন খুব সহজ গলায়।

তপতী দু’ হাতের তালু দুই ছেলের মাথায় রেখে হাসলেন। ওরা জড়িয়ে ধরল মাকে।

.

অতঃপর এক একটি ঋতু আসে আর চলে যায়, মিনু আর চিনু ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। দেখতে দেখতে কেটে গেল পাঁচটা বছর। সহদেব মিশ্রর কঠিন শিক্ষায় তারা ধাপে ধাপে খেলায় উন্নতি করে চলল। কোর্টের বাইরে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ স্নেহ আর শাসনের সতর্ক প্রহরার দ্বারা মসৃণ করে তোলার জন্য তপতী আর তন্ময় তাঁদের জীবনকে উৎসর্গ করে দিলেন। প্রতিদিন ভোরে কি শীতে কি বর্ষায় দুই ভাইকে ছুটতে দেখায় মহাদেবপুর অভ্যস্ত হয়ে গেছে। খরচ বেড়েছে। নতুন দু’ জোড়া র‌্যাকেট কিনতে হয়েছে। আর কিনতে হয় প্রতি মাসে দু’ ডজন বল। দু’ দিকের বেস লাইনের পেছনে ছ্যাঁচাবাঁশের দরমা দিয়ে দশ ফুট উঁচু বেড়া তোলার জন্য প্রায় পাঁচশো টাকা খরচ করতে হয়েছে তন্ময়কে। এই বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে ছোটখাটো অশান্তিও ঘটে গেল ক্লাবে। কমিটির অনেকেই আপত্তি তুলেছিল এই বলে, টেনিস কোর্টের জমিটা ক্লাবের সম্পত্তি। সেটা প্রাইভেট কোচিংয়ের জন্য ব্যবহার করতে এবং বেড়া তুলতে দেওয়া যায় না।

প্রতিবাদ করেছিল রাজেন। তার বক্তব্য : মেম্বারদের ছেলেমেয়েদের যে কেউই চাঁদা দিয়ে খেলতে পারে, টাকা দিয়ে কোচিং নিতে পারে। কিন্তু দুটি ছেলে ছাড়া যদি আর কেউ না আসে তা হলে ক্লাব কী করতে পারে? ছেলে দুটিকে কি খেলা বন্ধ করে দিতে হবে? তা ছাড়া ক্লাবকে তো এখনও পর্যন্ত একটা পয়সাও খরচ করতে হয়নি? ক্লাব থেকে পাওয়া গেছে শুধু পুরনো ফুটোয় ভরা একটা নেট। কোর্টের ঘাসকাটা, জল দেওয়া, ঘাস লাগানো ইত্যাদি কাজ করে কান্তি। সেজন্য ক্লাবের কাছ থেকে সে বাড়তি পারিশ্রমিক কখনও চায়নি। তা হলে আপত্তি উঠছে কেন? রাজেন আরও বলেছিল, শুধু তাস আর ক্যারাম খেললেই ক্লাব হয় না, আউটডোর খেলারও ব্যবস্থা থাকা চাই। এর পরও রাজেন এম জে টি এম—এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করে সবিস্তার জানায় তপতী ও তন্ময়ের এই টেনিস কোর্টটিকে পুনরুজ্জীবিত করার কথা। এজন্য তাদের কত কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, সে কথাও রাজেন বলে। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং সেক্রেটারি কমল ভট্টাচার্যকে ডাকিয়ে এনে এম ডি নির্দেশ দেন ক্লাব মেম্বারদের ছেলেরা প্রাইভেট কোচিংয়ের জন্য কোর্ট ব্যবহার করতে এবং খেলার সুবিধার জন্য বেড়াও তুলতে পারবে। তিনি মনে করিয়ে দেন মহাদেবপুরের যাবতীয় জমির মালিকই এম জে টি এম।

এই ধরনের ছোটখাটো বাধা ছাড়া মিনু বা চিনুর খেলা তরতরিয়ে এগিয়েছে। তপতী ভোরে আর ছেলেদের সঙ্গে বেরোন না, তবে অতিরিক্ত ধকল এড়াতে দুই ছেলেকে বাড়ি থেকে স্কুলে আর স্কুল থেকে টেনিস কোর্টে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি গাড়ি নিয়ে বেরোন। শুধু দু’বারই সারাদিনে ভক্সহলকে ব্যবহার করা হয়। সাড়ে তিনটেয় স্কুল ছুটি হওয়ামাত্র দু’জনে ছুটতে ছুটতে এসে গাড়িতে ওঠে। যেতে যেতে গাড়ির মধ্যেই তপতীর হাতে গড়া চিজ স্যান্ডুইচ আর কলা খেয়ে নেয়, জুতো, শর্টস, জামা বদলে নেয় যাতে কোর্টে নামতে একমিনিটও দেরি না হয়। ‘সার’ ছ’ মাইল সাইকেল চালিয়ে এসে কোর্টের ধারে চেয়ারে অপেক্ষা করছেন তাদের জন্য। দেরি হলে বলবেন, ”পাঁচ মিনিট পিছিয়ে পড়লে,পঁচিশটা সার্ভিস কমে গেল।”

ভোর ঠিক পাঁচটায় বাংলোর ফটকে ‘ক্রিং ক্রিং’ দুবার সাইকেলের বেল বাজবে। অন্ধকার থাকতেই সহদেব ছ’ মাইল সাইকেল চালিয়ে এসে হাজির হয়ে যান। মিনু—চিনু অপেক্ষা করে থাকে, বেল বাজার সঙ্গেই বেরিয়ে আসে র‌্যাকেট হাতে। ওরা ছুটতে শুরু করে, ওদের পাশে পাশে একটা নির্দিষ্ট গতিতে সাইকেল চালান সহদেব। প্রথমে দৌড়ত তিন মাইল, এখন সেটা উঠেছে পাঁচ মাইল। সারা মহাদেবপুরটাকে তিনবার চক্কর দিয়ে ওরা আসে কোর্টে।

বালতি ভর্তি দু’ ডজন বল নিয়ে শুরু হয় প্র্যাকটিস। কোর্টের একদিক থেকে পরের পর সার্ভ করে যায় মিনু। অন্যদিক থেকে সেগুলো রিটার্ন করে চিনু। সহদেব কোর্টের ধারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে শুধরে দেন কারোর কোনও ভুল হলে। নিজে পাশে গিয়ে দেখিয়েও দেন।

মিনুর একটা সার্ভ রিটার্ন করতে গিয়ে চিনুর র‌্যাকেটের কাঠে লাগল। বলটা অবশ্য মিস হিট সত্ত্বেও ফিরে এল নেটের এধারে।

”এখন তুমি নিজেকে কী বলবে?” সহদেব প্রশ্ন করলেন চিনুকে।

”বলটাকে নজর করো, বলটাকে নজর করো।”

”জোরে জোরে বলো যাতে শোনা যায়। ম্যাচ খেলার সময় তোমার হয়ে এই কথাগুলো আমি তো আর বলতে পারব না। তোমাকেই এটা সবসময় নিজেকে মনে করাতে হবে। জোরে বলো, কেউ শুনতে পেল কি না তাতে বয়েই গেল, নিজেকে শোনানোটাই আসল কথা।”

পরের বলটা যখন চিনুর দিকে আসছে সে চেঁচিয়ে বলল, ”বলটাকে নজর করো।” বলের দিকে চোখ রেখে সে মারল র‌্যাকেটের ঠিক মাঝখান দিয়ে। এর পর আবার একটা বল মিস হিট করতেই সারের শেখানো মতো সে চেঁচিয়ে নিজেকে ধমকাল,”বলটাকে নজর করছিস?”

সহদেব লক্ষ করেছেন মারের পেছনে জোর দেওয়ার জন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রয়োগের মধ্যে যে সামঞ্জস্য দরকার, চিনুর সেটা চমৎকারভাবে রয়েছে। ফলে সে তার শরীরের ওজন প্রতিটি স্ট্রোকে চাপিয়ে দিয়ে যে জোরটা বার করে আনে সেটা তার চেয়ে বেশি বলবান মিনুরই সমান বা তার চেয়েও বেশি। তিনি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যান ছোটভাইটির দৈহিক পরিবর্তন দেখে। পাঁচ বছর আগে দেখা রোগা, ছোটখাটো, দুর্বল গড়নের ছেলেটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তার বদলে সতেজ চারার মতো বাহু ও পায়ের পেশি নিয়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি লম্বা ছেলেটি যেন মহীরুহ হয়ে ওঠার আভাস দিচ্ছে। তিনি জানেন এর জন্য দায়ী হাড়ভাঙা নিয়মিত পরিশ্রম আর ছেলেটির মা।

সকালের কাজ, সহদেব বলেন, ‘ওয়ার্ক আউট’, চলে দেড়ঘণ্টা। কোর্টের দু’ধার থেকে অবিরাম একজন ব্যাকহ্যান্ড অন্যজন রিটার্নে ফোরহ্যান্ড মেরে যায় সহদেবের নির্দেশিত জায়গাগুলোয়। তিনি মনে মনে গোনেন।

হাত ব্যথা করায় কেউ যদি র‌্যাকেট নামিয়ে নেয় অমনই গর্জন ওঠে, ”ডোন্ট স্টপ, কন্টিনিউ, কন্টিনিউ…এখনও তেরোটা বাকি।”

ঘড়ি ধরে ঠিক আটটায় ওরা তিনজন বাড়ির পথ ধরে। মিনু জিজ্ঞেস করে, ”সার,আজ বিকেলে ভলি না সার্ভিস?”

”দুটোই। সার্ভ, রিটার্ন অ্যান্ড ভলি।…তিনবার বল হিট করার জন্য যদি কুড়ি সেকেন্ড ধরি, তা হলে মিনিটে তিনটে সার্ভ হলে দু’ ঘণ্টায় ক’টা হয়?” সহদেব নিরাসক্ত স্বরে সাইকেল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলেন। দুই ভাই আমতা আমতা করছে দেখে বললেন, ”দু’ ঘণ্টায় হয় তিনশো ষাট…এত জানি পারবে না। আমাদের পাঁচ—ছ’ ডজন বল নেই যে মেশিনগানের মতো ফায়ার করে যাবে। তার চেয়েও বড় কথা, এজন্য যে স্ট্যামিনা আর পাওয়ার দরকার, সেটাও এখনও তোমাদের গড়ে ওঠেনি…কিন্তু না উঠলেই বা, খাটতে খাটতেই গড়ে উঠবে। আজ দেখব কতখানি তোমরা পারো।”

দুই ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

”একটা ভাল ম্যাচ পাঁচ সেট গড়ালে কম করে পাঁচ মাইল কোর্টে ছোটাছুটি, বল হিট করতে হয়। এজন্য সবার আগে দরকার দুটো পায়ের জোর, শক্তি। যদি না বলের কাছেই যেতে পারো তা হলে বল মারবে কী করে?…যখন খুব টায়ার্ড হয়ে পড়ো তখন শরীরের কোন জায়গাটায় প্রথম ব্যথা শুরু হয়? তলপেটে। দৌড়লে তলপেটের মাসল মজবুত হয়। তোমরা এখন যতটা দৌড়চ্ছ সেটা আস্তে আস্তে এবার বাড়াতে হবে।”

”সার, স্কুলে যে ন’টার মধ্যে যেতে হবে!” দুই ভাইয়ের মধ্যে চিনু কিঞ্চিৎ অলস। সহদেবের দৌড় বাড়াবার পরিকল্পনাতে রাশ টানার চেষ্টায় সে বলল।

”ওইটেই তো হয়েছে মুশকিল…তোমাদের আর একটু বেশিক্ষণ কোর্টে থাকা দরকার।”

বাড়ি ফিরে স্নান সেরে খাওয়ার টেবলে বসে তিনজন। সহদেব আবার ছ’ মাইল সাইকেল চালিয়ে বাড়ি না গিয়ে, তন্ময় ও তপতীর অনুরোধে ছেলেদের ভাত খাওয়ার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করে নেন। চারখানা হাতে—গড়া রুটি, ডাল, তরকারি আর সামান্য আচার। মাছ—মাংস খান না। খেতে খেতে তিনি নজর রাখেন মিনু—চিনুর পাতের দিকে। ছেলেদুটির খিদে অসম্ভব বেড়ে গেছে, কিন্তু সেজন্য গোগ্রাসে পেট ভরিয়ে খাওয়া সহদেবের চোখের সামনে অন্তত চলবে না। তাঁর কথায়,”খাদ্যগুলোকে হজম হওয়ার জন্য নড়াচড়ার জায়গা দরকার, পেটটা একটু খালি রাখো। বলটা গায়ের কাছে এসে পড়লে স্ট্রোক নেওয়ার জন্য জায়গা করে নিতে হয়। মিনু, কথাটা বুঝলে?”

”বেলামাসি, আর ভাত নেব না।”

”নেবে না কেন? ভাত না খেলে গতর হবে কী করে?” বেলা ভাতের থালা হাতে কটমটিয়ে সহদেবের নির্বিকার মুখের দিকে তাকাল।

”গতর হবে, তবে গণেশ মার্কা নয়।”

”তবে কী মার্কা, মহিষাসুর?”

”হোক না মহিষাসুর! তবে ও নয়, ওর র‌্যাকেটটা।” সহদেব মুচকি হাসলেন, যেটা কদাচিৎ দেখা যায়। টেবল থেকে দুই ভাই উঠে পড়ল।

”দিদি, একটা কথা।” সহদেব তাকালেন এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা তপতীর দিকে। ”ওদের ওয়ার্ক আউটের সময় বাড়াতে হবে। স্কুল থেকে কি একঘণ্টা আগে ওদের ছুটি করানো যায়?”

”বলা মুশকিল। ওদের এখনকার হেডমাস্টার মিস্টার আচার্য চান মাধ্যমিকে ওঁর স্কুল থেকে নাইন্টি পারসেন্ট ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করুক। ছাত্ররা খেলাধুলো করুক, এটার ঘোর বিরোধী তিনি।”

”দুই ভাই স্কুল স্পোর্টসে এত যে ট্রফি জেতে, তার কোনও মূল্য নেই? ওদের জন্য স্পেশ্যাল কনসিডার করা উচিত, শুধু ওদেরই জন্য।”

”আজ বলব, জানি না কনসিডার করবেন কি না। …একটা কথা সহদেববাবু, আমরা দু’ বছরের জন্য মিনু—চিনুর টেনিসের পেছনে টাকা খরচ করব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনার হাতে পড়ে ওদের উৎসাহ আর খেলার মান এমন বাড়তে শুরু করল যে,আমরা আর বন্ধ করতে পারলাম না। এতে আমাদের আর্থিক দিক থেকে খুবই অসুবিধে হচ্ছে। ওদের ভাল জামা জুতো কিনে দিতে পারি না, প্রায়ই কলকাতায় বেড়াতে নিয়ে যেতাম, কিন্তু খরচের কথা ভেবে এখন আর তাও যেতে পারি না। বছরে একবার বাইরে কোথাও—দার্জিলিং, কি পুরী, কি জয়পুর বেড়াতে গেছি, কিন্তু গত পাঁচ বছর এই মহাদেবপুর ছেড়ে কোথাও আমরা যাইনি। খরচের ভয়ে অনেক সামাজিক কাজেও আমরা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে যাইনি। আড়ালে অনেকেই আমাদের কঞ্জুস বলে থাকে। এই সবই আমরা সয়েছি একটা লক্ষ্য সামনে রেখে—আমাদের ছেলে দুটোর দিকে একদিন দেশের লোক তাকিয়ে থাকবে। এখন বলুন আমাদের আশা, আমাদের স্বপ্ন সফল হতে পারবে কি না, মিথ্যা মরীচিকার পেছনে ছুটছি কি না?” তপতী আবেগ চাপতে চাপতে একটানা কথাগুলো বলে উন্মুখ হয়ে সহদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সহদেব মাথা নামিয়ে জবাবটা গুছিয়ে নিতে সময় নিলেন। তিনি আবেগপ্রবণ নন। শুকনো স্বরে বললেন, ”আজ যদি বলেন আর আপনাকে টাকা দিতে পারব না আপনি বিদায় হোন, তা হলেও আধপেটা খেয়ে সাইকেল চালিয়ে এসে ভোরবেলায় আমি বেল বাজাব…।”

কথা অসমাপ্ত রাখলেন সহদেব, মিনু—চিনু পিঠে ব্যাগ আর ওয়াটারবটল হাতে হাজির হয়েছে। তপতী উঠলেন গাড়ি বার করার জন্য। এখান থেকে সহদেব আবার ফিরে যাবেন ক্লাবে। সেখানে দুপুরে দুটো টেবল জোড়া দিয়ে টানটান শুয়ে থাকেন চিত হয়ে। কান্তি তার মাথার বালিশটা দিতে চেয়েছিল, নেননি।

তপতীকে চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল হেডমাস্টার আচার্যের দেখা পেতে। একজন শিক্ষক আসেননি, তাঁর ক্লাসটা নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে তিনি তপতীকে ডেকে পাঠালেন।

তিন মিনিটেই তপতী তাঁর আবেদন শেষ করলেন।

”তা কী করে হয়!”হেডমাস্টার চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিলেন। ”একঘণ্টা আগে ছুটি দিতে হবে খেলার জন্য? এ তো বড় অবাস্তব কথা। আপনার ছেলেরা শুধু খেলে, তার বেশি কিছু নয়। ওরকম তো শত শত ছেলে খেলে। তারা সবাই এসে যদি ছুটি চায় তা হলে স্কুল থেকে লেখাপড়ার পাট তো তুলে দিতে হয়। হ্যাঁ, যদি বুঝতাম ওরা কিছু একটা করেছে, এবার নিজেদের উন্নতির জন্য আরও বেশি ট্রেনিং দরকার, সেজন্য সময় দরকার, তা হলে কনসিডার করে দেখতে পারি। কিন্তু আপনার ছেলেরা যে মস্ত প্লেয়ার হবে সেই প্রতিশ্রুতির প্রমাণ তো চাই। একটা ট্রফি ফ্রফি এনে আগে তো দেখাক। মাপ করবেন মিসেস বসুমল্লিক, আমি ছুটি দিতে পারব না।”

পাংশু মুখে তপতী একটি কথাও না বলে হেডমাস্টারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বিকেলে দুই ছেলেকে নিয়ে গেলেন ক্লাবে। সহদেব একটা বালতিতে চব্বিশটা বল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডানদিকের কোর্টের বেস লাইনের কাছে। নেটের ওধারে সার্ভিস বক্সের বাঁ কোণে একটা নীল রুমাল পাতা।

”মিনু, সার্ভিসগুলো ওই রুমালটায় ফেলতে হবে,…যাও শুরু করো।”

মিনু বালতি থেকে একের পর এক বল তুলে সার্ভ করে যেতে লাগল। শুধু দ্বাদশ সার্ভটা রুমালের কানা ছুঁয়ে গেল, তা ছাড়া পাঁচটা সার্ভ নেটে লাগল, চারটে পড়ল বাইরে। ওধারের বেস লাইন থেকে চিনু এগারোটা বল রিটার্ন পাঠাল। তার মধ্যে মিনু পাঁচটা ভলি করল চিনুর নাগালের বাইরে। সহদেব মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ”কিসসু হয়নি। রুমালে মাত্র একবার পড়ল, অন্তত দশবার ফেলতে হবে।…আবার।”

চিবুক থেকে ঘাম ঝরছে, মিনুর মুখ থমথমে। আড়চোখে চেয়ারে বসা মায়ের দিকে তাকাতেই তপতী মুখটা আকাশের দিকে তুললেন। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে মিনু আবার শুরু করল। এবার রুমালে বল পড়ল তিনবার। তোয়ালে দিয়ে মুখের ঘাম আর র‌্যাকেটের হাতল মুছে, মাটিতে তালু ঘষে মিনু বলল, ”আবার।”

নেটের কাছে এগিয়ে এসে চিনু বলল, ”স্যার, আমি সার্ভ করব না?”

”না। যতক্ষণ না চব্বিশটায় বারোটা বল ফেলছে, মিনু সার্ভ করে যাবে।”

মিনুর ছিয়ানব্বইটা সার্ভ শেষে সহদেব বললেন,”মোট তেরোবার, ফিফটিন পার্সেন্টও নয়। মিনু, তুমি সার্ভ করতে শিখেছ?”

”না সার। আমি আবার করব।” জেদি গলায় দাঁত চেপে মিনু বলল।

”হাত ভেরে গেছে তোমার, এবার চিনু।”

”না সার, আবার সার্ভ করব।”

”এখন থাক। তুমি কনসেনট্রেট করতে পারছ না। রুমালটা ছাড়া আর সব কিছু চোখ থেকে মুছে ফেলতে হবে মিনু। ওইখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকো পাঁচ মিনিট।”

সহদেব রুমালটা তুলে এনে এধারের সার্ভিস বক্সের মাঝামাঝি জায়গায় পাতলেন। ”শুরু করো।” রিটার্ন করার জন্য মিনুর বদলে র‌্যাকেট হাতে তিনি বেস লাইনে দাঁড়ালেন।

চিনু সার্ভ করল চব্বিশটা, তার মধ্যে আটটা পড়ল রুমালে। সহদেবের মুখে পলকের জন্য খুশির ছোঁয়া লেগেই মিলিয়ে গেল।

”মিনু এবার ওধারে যাও, চিনু আমার পাশে এসো।” সহদেব আর চিনু ডানদিকের কোর্টে বেস লাইনের মাঝামাঝি দাঁড়াল, নেটের ওধারে মিনু। দু’ জনে সোজাসুজি বল মারছে তার দিকে। মিনু ব্যাকহ্যান্ড বা ফোরহ্যান্ডে বল ফেরত দিতে লাগল। সহদেব ক্রমশ একটু দূরে বল পাঠিয়ে তাকে বাধ্য করলেন যাতে ছুটে গিয়ে বল মারতে হয়। এর পর তিনি মারের তীব্রতা বাড়ালেন। সারা কোর্ট চষে ফেলে, এগিয়ে—পিছিয়ে দু’ পাশে ছুটে গিয়ে মুহূর্তের জন্যও থামার অবকাশ না পেয়ে মিনুকে বল ফেরাতে হচ্ছে। কখনও ডানদিকে ছুটে লম্বা করে হাত বাড়িয়ে, তার থেকে ভলি করে বা বেস লাইন থেকে কুড়ি গজের ব্যাকহ্যান্ড মেরে। এলোপাতাড়ি ফেরানো নয়, যতটা সম্ভব চিনু আর সহদেবের নাগালের মধ্যে তাকে বল রাখতে হচ্ছে।

পাঁচ মিনিট পরই মিনু দাঁড়িয়ে পড়ল। হাপরের মতো ওঠানামা করছে তার বুক। র‌্যাকেট কোর্টের ওপর ঠেকিয়ে তাতে শরীরের ভার দু’ হাতে রেখে মুখ নামিয়ে। সহদেব দু’ মিনিট মিনুর দিকে তাকিয়ে থেকে কঠিন স্বরে বললেন,”আবার।”

”একটু জিরোই সার।”

”না।” সহদেব চেঁচিয়ে বললেন,”ম্যাচ খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে পড়লে কি পেটে যন্ত্রণা শুরু হলে, তখন কি তুমি খেলা বন্ধ করে জিরিয়ে নেবে?…যন্ত্রণার সঙ্গে সড়গড় হও। যন্ত্রণাকে হেসে উড়িয়ে দাও।”

”সার, আমি তো এখন ম্যাচ খেলছি না।” মিনু কাতর স্বরে বলল।

”না খেললেই বা! মনে মনে নিজেকে দেখো একটা শক্ত ম্যাচ খেলছ। তুমি পাঁচ মাইল দৌড়েছ, হাজারবার বল মেরেছ, শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি যন্ত্রণায় টাটাচ্ছে। এগুলো সহজ করে দিতে পারবে যদি আগেই যন্ত্রণার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়, যদি বুঝে নাও এটা কোনও বড় ব্যাপার নয়, এটা থাকবে না।” সহদেব কথা বলতে বলতে নেটের কাছে এলেন। ওয়ার্ক আউট থামিয়ে দিয়ে মাঝে মাঝে তিনি কথা বলেন দুই ভাইকে কাছে ডেকে নিয়ে। হাতছানি দিয়ে তিনি চিনুকে ডাকলেন।

”তোমরা হয়তো ভাবতে পারো চার মাইল পর্যন্ত দৌড়বার ক্ষমতা তোমাদের আছে, কিন্তু একটা কথা শুনে রাখো,যদি একটা বন্দুক তোমাদের মাথায় ঠেকাই তা হলে আবিষ্কার করবে আরও একটা মাইলও দৌড়তে পারো। এটা টেনিস ম্যাচেও খাটাও। বড় বড় প্লেয়াররা যখন খেলে, তখন একে অপরকে যন্ত্রণায় বিঁধোয়, তখন শুধু একটাই প্রশ্ন, কে আর একটু বেশি যন্ত্রণা দিতে ইচ্ছুক আর কে প্রথম পালাবে। হারতে যতটা সময় লাগে জিততেও ততটা সময় লাগে। ব্যাপারটা যদি তাই হয় তা হলে না জিতে শুধু শুধু যন্ত্রণার শাস্তিটা নেবে কেন? জেতার জন্য নিজেদের তৈরি করো। জিরোবার সবচেয়ে সহজ উপায় কী জানো?” সহদেব ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। ”ওই চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়া। চলো, আমরা বসব এখন।”

”না।” মিনু তীক্ষ্ন স্বরে বলে উঠল,”আপনি গিয়ে বসুন…আয় চিনু।”

সহদেব চোখ কুঁচকে নেটের দু’ দিকে দুই ভাইকে এগিয়ে যেতে দেখলেন। কী ভেবে তিনি কোর্ট থেকে বেরিয়ে এসে তপতীর পাশের খালি চেয়ারে বসলেন।

”আজ গেছলাম হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে।” তপতী প্রথম সুযোগেই কথাটা পাড়লেন। মিনু বা চিনু শুনুক এটা তিনি চান না। ”উনি বললেন, এক ঘণ্টা আগে ছুটি দিতে পারবেন না। ওরা শুধুমাত্র খেলে, তার বেশি কিছু নয়। মস্ত প্লেয়ার হবে এমন প্রতিশ্রুতির প্রমাণ না পেলে উনি ছুটি দিতে পারবেন না।”

”কী প্রমাণ চান উনি?” সহদেব ভ্রূকুটি করলেন।

”বলেছেন আগে একটা ট্রফি এনে দেখাক।…আমার মনে হয় হেডমাস্টার অন্যায্য কিছু বলেননি। সত্যিই তো, যে লোক খেলাধুলো বোঝেন না তিনি ট্রফি দিয়েই প্রমাণ চাইবেন।”

”তা হলে আমাদের এখন দরকার একটা ট্রফি। তার মানে ছেলেদুটোকে এবার বাইরে বেরোতে হবে।” সহদেব মাথা নিচু করে জমির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

”আপনার কি মনে হয় আরও একটা—দুটো বছর—” ইতস্তত করে তপতী থেমে গেলেন।

”না, না, এই বয়সেই কম্পিটিশনের মুখে পড়া দরকার। কাল আমি বি এল টি এ অফিসে যাব কোথায় কী টুর্নামেন্ট হবে খোঁজখবর করতে।”

।।৭।।

দশদিন পর মিনু, চিনু এবং তপতী, বেলা বারোটায় সহদেবের সঙ্গে ট্রেন থেকে নামল হাওড়া স্টেশনে। তারা যাবে নর্থ ক্যালকাটা টেনিস ক্লাবের টুর্নামেন্টে। মিনু আর চিনু এন্ট্রি করেছে। প্রতিযোগিতাটা খুবই ছোট মাপের এবং বড়দের জন্য। সহদেব এন্ট্রি তালিকাটা আগেই দেখে নিয়েছেন। নামী খেলোয়াড় একজনও নেই। কিছু জুনিয়ার আর কিছু সদ্য খেলা ছেড়ে দেওয়া প্রাক্তন নাম দিয়েছে।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে তারা ট্যাক্সি ধরে ক্লাবের ফটকে এসে নামল। বিরাট একটা পার্কের একধারে ক্লাব। ফটক থেকে মোরামের সরু পথ কিছুটা গিয়ে দু’ ভাগ হয়ে দুটো টেনিস কোর্টকে বেড় দিয়ে মিলেছে ক্লাব—তাঁবুর সামনে। তাঁবুর বাইরে কয়েকটা বেঞ্চ আর চেয়ার। দু—তিনজন কথা বলল সহদেবের সঙ্গে। তাঁবুর বাইরে অল্প কিছু লোক। ওদের চেয়ারে বসিয়ে সহদেব তাঁবুর ভেতরে ঢুকে গেলেন। দুই ভাই সাউথ ক্লাব দেখেছে। সেখানকার গ্যালারি, ভিড়, ক্লাববাড়ি আর টানা বারান্দা তাদের মনে যে ছাপ ফেলেছে তার সঙ্গে এখানকার কোনও মিলই তারা পাচ্ছে না। তারা ভেবেছিল স্কুল স্পোর্টসের মতো জমজমাট একটা ব্যাপার দেখবে।

চিনু ফিসফিস করে মিনুকে বলল,”খেলবে কে রে?”

মিনু দু’ধারে তাকিয়ে বলল,”বোধ হয় আমরা আগে এসে পড়েছি।”

তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে সহদেব জানালেন, মিনুর খেলা যার সঙ্গে পড়েছে সে আসতে পারবে না জানিয়েছে, পা মুচকে এখন সে বিছানায়। মিনু সেকেন্ড রাউন্ডে উঠে গেছে। চিনুর সঙ্গে খেলবে অদ্বৈত মল্লিক, এই ম্যাচটা দিয়েই টুর্নামেন্ট শুরু হবে এখনই। সহদেবের কথা শোনা মাত্রই মিনুর মুখ থেকে উদ্দীপনার চকচকে ভাবটা মুছে গেল। আর চিনু খুঁজতে লাগল অদ্বৈত মল্লিককে।

ইতিমধ্যে কোর্টের ধারে কিছু লোক জমা হয়েছে। মালি কয়েকটা টুল রেখে গেল সাইডলাইন আর বেসলাইনের ধারে লাইন্সম্যানদের জন্য। বকের মতো গলা, কোট, প্যান্ট, টাই পরা এক লম্বা লোক, চোখে পুরু কাচ দেওয়া চশমা, স্কোরশিট হাতে নিয়ে আম্পায়ারের উঁচু চেয়ারে বসলেন। তাঁর মুখের কাছে মাইক্রোফোন। লাইন্সম্যানরা টুলে বসল। দু’ দিকের বেসলাইনের এবং নেটের দু’ দিকে বলবয়রা হাজির হল। আম্পায়ার দু’ বার গলাখাঁকরি দিয়ে মাইক পরীক্ষা করে প্লেয়ারদের নাম ডাকলেন।

চিনু ঢোঁক গিলে সহদেবের কানে চুপিচুপি কী একটা বলতেই তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”টেন্টের মধ্যে ঢুকে একেবারে শেষে গিয়ে ডান দিকে। দেখবে দরজায় ‘জেন্টস’ লেখা আছে।”

মিনু ফিসফিস করে তপতীকে বলল,”চিনুটা ঘাবড়ে গেছে।”

”জীবনের প্রথম ম্যাচে সবাই ঘাবড়ায়, তুইও ঘাবড়াবি।”

”দেখা যাবে।”

অদ্বৈত মল্লিক কোর্টে নেমে পড়েছেন। হৃষ্টপুষ্ট, মাথায় সামান্য টাক, বয়স প্রায় চল্লিশ। অ্যাডভোকেট। বছর পনেরো আগে পর্যন্ত নিয়মিত প্রতিদিন খেলতেন, এখন শুধু শনি—রবিবারে। নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্ট দু’ বার জিতেছেন। মল্লিক গেলেন বাঁ দিকের কোর্টে। গোটা ছয়েক নতুন বল একজন গড়িয়ে দিল। মল্লিক একটা বল তুলে নিয়ে সার্ভ করলেন ওধারের ফাঁকা কোর্টে। বলবয় বল ছুড়ে দিল তাঁকে। তিনি আবার একটা সার্ভ করে তাকালেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা পাওয়ার আশায়।

”মা, চিনুর বোতামটা!” মিনু আঙুল দিয়ে দেখাল। তারপর চাপা গলায় বলল,”অ্যাই চিনু, কোমরের বোতাম লাগা।” কোমরে হাত দিয়ে চিনু জিভ কাটল।

কোর্টের ধারে একটা চেয়ারে নিরাসক্ত মুখ করে সহদেব একা বসে । চিনু মাকে প্রণাম করে, কপালে চুমু নিয়ে কোর্টের দিকে এগোতেই তপতী মনে করিয়ে দিলেন,”সারকে।”

সহদেব তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে প্রণামে নত চিনুকে দু’ কাঁধ ধরে তুললেন। বুকে জড়িয়ে মৃদু স্বরে বললেন,”আমার দিকে তাকাবে না, মনে রেখো কোর্টের মধ্যে তুমি একা, নিজেকে নিজেই দেখতে হবে।”

অদ্বৈত মল্লিক হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন চিনুর দিকে অন্তত কুড়ি সেকেন্ড। তিনি ভাবতে পারেননি একটা বালকের সঙ্গে তাঁকে খেলতে হবে। টস করার সময় মল্লিক জিজ্ঞেস করলেন,”খোকা, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?”

চিনু গম্ভীর স্বরে বলল,”ক্লাস সিক্স।”

মল্লিক টস জিতে সার্ভিস নিলেন। ওয়ার্ম—আপের শুরুতে তিনি ফোরহ্যান্ডে প্রথম বলটা পাঠালেন নেটের ওধারে। চিনুর ফোরহ্যান্ড রিটার্ন লাগল নেটে। মল্লিক আবার বল পাঠালেন। চিনু আবার নেটে বল মারল।

মল্লিক নেটের কাছে এসে হাতছানি দিয়ে চিনুকে ডাকলেন। ”র‌্যাকেট কাঁধের আর একটু ওপরে তুলে এইভাবে নামিয়ে ফোরহ্যান্ড মারো।” তিনি র‌্যাকেট চালিয়ে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে মারতে হবে। ”মনে থাকবে?”

চিনু বিনীতভাবে মাথা নাড়ল।

প্রথম সার্ভিস করলেন মল্লিক। চিনুর ফোরহ্যান্ড নেটের এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে সাইডলাইন বরাবর বেসলাইনের কাছে পড়ল। জীবনের প্রথম ম্যাচে প্রথম পয়েন্ট! সে প্রথমে সহদেবের, তারপর মা আর দাদার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাল। সহদেব মাথাটা সামান্য হেলালেন, মিনু দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিল, তপতী দু’ হাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজলেন। মল্লিক দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। পরের সার্ভিসটার সঙ্গে চিনু একই আচরণ করল। মল্লিকের চোখ আর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। তৃতীয় সার্ভিসের ফোরহ্যান্ড রিটার্ন মল্লিকের বুকের কাছে এল, তিনি ভলি করে চিনুর ডান দিকে বল ফেলতেই ফোরহ্যান্ডে সে বাঁ দিকের ফাঁকা কোর্টে বল মারল। চিনু জীবনের প্রথম গেমটা পেল মল্লিক ডাবল—ফল্ট করায়। সময় লাগল দু’ মিনিট। ম্যাচ শেষ হল পঁচিশ মিনিটে : ৬—১, ৬—০। হ্যান্ডশেক করার সময় মল্লিক বললেন,”আমার কথাগুলো মনে রেখেছিলে তা হলে…গুড মেমারি।”

ঘড়ি দেখে সহদেব বললেন,”মাত্র দুটো বাজে। চলুন দিদি, একবার সাউথ ক্লাব ঘুরে আসি। বেঙ্গলের ভাল জুনিয়াররা ওখানে প্র্যাকটিস করছে। ওরা একবার দেখুক।”

বাইরে বেরিয়ে এসে সহদেব বললেন,”বাসে করে চলে যাই, মিছিমিছি কেন ট্যাক্সি ভাড়া দেবেন।”

তপতী বললেন,”দোব। এটা ছেলেদের ব্যাপার।”

কিন্তু ছেলেরা একসঙ্গে বায়না ধরল তারা জীবনে কখনও বাসে—ট্রামে চড়েনি, সুতরাং বাসেই যাবে। চিনু বলল,”সার ট্রামে যাব।” সহদেব বললেন,”এখান থেকে ট্রাম টানা এলগিন রোড পর্যন্ত যায় না, এসপ্ল্যানেডে নেমে আবার ট্রামে উঠতে হবে। তা ছাড়া বাস তাড়াতাড়ি যায় ট্রামের থেকে।”

বাসে উঠে কুড়ি মিনিট পর চৌরঙ্গি—এলগিন রোডের মোড়ে নেমে ওরা হেঁটে সাউথ ক্লাবে পৌঁছল। আটটা কোর্টে তখন খেলা চলছে। চারদিকে শুধু খলব খলব খলব শব্দ। তিনজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একটা কোর্টের ধারে সহদেব ওদের নিয়ে গেলেন, মাঝবয়সি একটি লোক সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান ষোলো—সতেরো বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে খেলছে। সহদেব বললেন,”যে ট্রেনিং করাচ্ছে ওর নাম সৈদুল। আগে বলবয় ছিল, আমার চেনা।”

খুব জোরে মারা একটা ক্রশকোর্ট ফোরহ্যান্ডে সৈদুল র‌্যাকেট ছোঁয়াতে পারল না। বলটাকে কোর্টের বাইরে লুফল মিনু। সৈদুল বলটা চাইল র‌্যাকেট বাড়িয়ে ধরে, আর সেই সময় দেখতে পেল সহদেবকে। হাত তুলে সে চেনা দিল।

”সৈদু শোন,” সহদেব হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

”আরে দেবুদা, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?” একগাল হেসে সৈদুল হাত জড়িয়ে ধরল সহদেবের। ”কী করছ এখন? আছ কোথায়?”

”এই ছেলে দুটোকে নিয়ে আছি মহাদেবপুর বলে একটা জায়গায়, আমার বাড়ির কাছেই।”

সৈদুল হাসিমুখে মিনু—চিনুর দিকে তাকাল। ”এদের শেখাচ্ছ? ভাল।”

”তোর ওই ছেলেটা তো বেশ ভালই খেলে। নাম কী?”

”অরুণ, অরুণ মেটা। এখন জুনিয়ার বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ান। লাস্ট ইয়ারে জুনিয়ার ন্যাশানাল রানার্স হয়েছে, ফাইনালে হেরেছিল ম্যাড্রাসের মুথান্নার কাছে।”

”সৈদু একটা কাজ করবি? তোর ওই ছেলেটার সঙ্গে একে একটা সেট খেলাবি?” সহদেব আঙুল দিয়ে মিনুকে দেখালেন,”ওর নাম মৃন্ময়।”

”বেশ তো, খেলুক। তুমি যখন চাইছ তখন নিশ্চয় ওর স্ট্যান্ডার্ড ভাল।”

”সেইটে দেখার জন্যই খেলাতে চাই। মিনু এখনও পর্যন্ত একটা গেমও বাইরের কারো সঙ্গে খেলেনি।”

সৈদুল নেটের কাছে গিয়ে অরুণের সঙ্গে কথা বলে হাতছানি দিয়ে মিনুকে কোর্টে নামতে বলল। সহদেব মিনুর কাঁধ ধরে সাইডলাইন পর্যন্ত গেলেন,”এটা ম্যাচ খেলা নয় ফ্রেন্ডলি খেলা, রিল্যাক্সড থাকবে। সঙ্কোচে গুটিয়ে যেয়ো না, মনে রেখো অরুণ তোমার মতই জুনিয়ার, ঘাবড়াবার কিছু নেই। খোলাখুলি সহজ মনে হিট করো।”

”দাদা,” চাপা স্বরে চিনু বলল,”তুই ‘জেন্টসে’ যাবি না?”

আগুনে—চোখে ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে মিনু কোর্টে নামল। ওয়ার্ম—আপ করার সময় কামানের গোলার মতো অরুণের প্রথম সার্ভিসটায় র‌্যাকেট ছোঁয়াতেই মিনুর মুঠোর মধ্যে র‌্যাকেটটা সামান্য ঘুরে গেল। সে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরল। মিনিট তিনেক পর সৈদুল নেটের পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,”নাউ স্টার্ট…সার্ভিস অরুণ মেটা, লাভ—অল।”

দশ মিনিটের মধ্যেই মিনুর সার্ভিস দু’বার ভেঙে অরুণ স্কোর নিয়ে গেল ৩—০। প্রচণ্ড জোরালো মারগুলো কোর্টের ঘাসগুলোকে নয়, যেন মিনুর মাথার মধ্যে আঘাত করে করে তাকে অসাড় করে দিয়েছে। তার র‌্যাকেট উঠছে না, দুটো পা চলছে না। শুধু দেখল তার দুপাশ দিয়ে বলগুলো ঘাসে পড়ে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে।

অরুণ কোমরে হাত রেখে সৈদুলের দিকে প্রশ্নভরা চোখে তাকিয়ে। ‘আরও কি খেলতে হবে?’ এমন একটা ভাব তার দাঁড়াবার ভঙ্গিতে। মিনু তাকাল সহদেবের দিকে। ‘দেখি এবার তুমি কী করো’, এমন একটা ভাব সহদেবের মুখে।

চতুর্থ গেমে সার্ভিস করেই মিনু এতক্ষণ যা করেনি, নেটের দিকে ছুটে গেল। রিটার্নটা উঁচু হয়ে তার বাঁ দিকে এল। অরুণের নাগালের বাসরে সেটা ভলি করে মিনু পয়েন্ট পেল। তার পরের সার্ভিস পড়ল বক্সের কোণে। অরুণ দাঁড়িয়ে থেকে ‘এস’টা দেখল। পরের দুটো সার্ভিসও একই জায়গায় পড়ল। পরপর তিনটে সার্ভিস ‘এস’ হতে দেখে বিস্মিত সৈদুল হাততালি দিয়ে হাঁকল,”ওয়ান—থ্রি।”

চিনু ফিসফিস করে তার মায়ের কানে বলল,”সারের রুমালটাকে তিন বলে তিনবার হিট করল।”

মিনুর মাথার মধ্যে যে খিলটা পড়ে ছিল এবার সেটা খুলে গেছে। অরুণের জোরালো মারগুলো আর তাকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছে না। সহজ বাতাস তার সারা শরীরের মধ্যে ভাসছে। সে স্বচ্ছন্দে এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে, পাশে ছুটছে দ্রুতগতিতে। চার মিনিটের মধ্যে অরুণের সার্ভিস ভেঙে সে ৩—৩—এ স্কোর নিয়ে গেল। অরুণ তখন হাঁফাচ্ছে।

অরুণ সৈদুলের কাছে গিয়ে বলল,”আর খেলব না, পিঠের ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে।” র‌্যাকেট—ধরা হাতটা মিনুর দিকে একবার তুলে সে ক্লাবহাউসের দিকে হাঁটতে শুরু করল কোনওদিকে দৃকপাত না করে।

”বড়লোকের ছেলে কখন কী মর্জি হয়!” সৈদুল অপ্রতিভ স্বরে বলল। ”দিনে দেড়ঘণ্টার বেশি ট্রেনিং করে না। বলে বলেও ওকে দৌড় করাতে পারিনি। মৃন্ময়ের স্পিড, স্ট্যামিনা তো খুব ভাল!”

”অরুণের খেলা উচিত ছিল।” সহদেব বললেন। তাঁর মনে হয়েছে, অরুণের পিঠব্যথাটা অজুহাত, আসলে সে পালাল। যারা পালায় তারা কখনওই জেতে না। তবে মনে মনে তিনি খুশি। আজ একটা ব্যাপার তিনি জেনে গেলেন, মিনু বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ান হওয়ার মতো খেলা খেলতে পারে।

.

নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্টে চিনু দ্বিতীয় রাউন্ডে স্ট্রেট সেটে হেরে গেল প্রদীপ ঘোষের কাছে। যে গত বছর সিনিয়ার স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছিল। তিনদিন পর রবিবারে মিনু ২—১ সেটে প্রদীপ ঘোষকে হারাল ফাইনালে। একটা বড় কাপ, একটা মেডেল আর তিনজন আরোহীকে ভক্সহলে বসিয়ে তন্ময় মহাদেবপুর ফিরলেন। সহদেবকে এক পুরনো বন্ধু বাড়িতে ধরে নিয়ে যাওয়ায় তিনি আর এদের সঙ্গে ফেরেননি।

বাড়ির কাছে এসে তন্ময়ের কী মনে হল, তিনি বললেন,”চলো একবার ক্লাবটা ঘুরে আসি। রোববারে অনেকেই থাকবে।”

ক্লাব—লনের প্রায় সবক’টা টেবলই ভরা। একটা বড় কাপ দু’ হাতে ধরে মিনু আর তার পেছনে তন্ময়, চিনু আর তপতীকে ঢুকতে দেখে সকলেই অবাক চোখে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল।

তন্ময় একটু গলা চড়িয়ে বললেন,”আমাদের টেনিস কোর্টের প্রথম ফসল।” কাপটা তিনি মাথার ওপর তুললেন। ”মিনু আজ নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্ট থেকে জিতে আনল।”

হই—হইয়ের সঙ্গে হাততালির শব্দ উঠল। অবশ্য কেউ কেউ হাততালি দিলেন না, গলা থেকে আওয়াজও বার করলেন না। কান্তি চায়ের ট্রে নিয়ে আসছিল। একটা টেবলে ট্রে—টা রেখে ছুটে এসে কাপটা মাথায় তুলে এমনভাবে ঘুরতে শুরু করল, যেন সেটা সে নিজেই জিতেছে! টেনিস কোর্টটা প্রথম দিন থেকে তার হাতেই লালিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। উচ্ছ্বাস ধরে রাখা তার পক্ষে সত্যিই খুব কঠিন। প্রত্যেক টেবলে সে কাপটা দেখাতে দেখাতে অবশেষে প্রতিভা মজুমদারের টেবলে রাখল।

”দেখুন মেমসাব, সেই ছোট্ট মিনু কাপ জিতে এনেছে।”

”দেখেছি, এবার এটা টেবল থেকে সরাও, আর চায়ের একটা পট দিয়ে যাও।”

”দিচ্ছি। রুপোর কাপ তাই না? দাম কত হবে বলুন তো?”

”রুপো না ছাই। পেতলের ওপর রুপোর জল—করা।”

কান্তি অপ্রতিভ হয়ে কাপটা তুলে নিল।

”হোক পেতল, সবাইকে হারিয়ে জিতেছে তো!”

কান্তি চলে যেতেই সুধা ঘোষাল বললেন,”নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্টের নাম তো কখনও শুনিনি।”

”এরকম টুর্নামেন্ট কলকাতায় পাড়ায় পাড়ায় হয়, শুনবে কী করে?” প্রতিভা বললেন।

”প্রতিভাদি, দোকান থেকে কিনে এনে দেখাচ্ছে না তো?” চন্দ্রিমা দত্ত ফোড়ন কাটলেন।

”ওহহো, একটা কথা তো বলা হয়নি।” সুধা ঘোষাল টেবলে ঝুঁকে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটো মাথা। ”মিসেস বসুমল্লিক ছেলেদের খেলার প্র্যাকটিসের জন্য এক ঘণ্টা আগে স্কুল থেকে ছুটি করাতে হেডমাস্টার আচার্যর হাতে পায়ে ধরেছিলেন,জানেন কি?”

”না তো! তারপর কী হল?” প্রতিভার দমবন্ধ হয়ে এল এমন একটা খবরের সন্ধান পেয়ে। ”কে বলল তোমায়?”

”রমু বলল। ওর ক্লাসেই তো পড়ে হেডমাস্টারের ভাগ্নে। কিন্তু হেডমাস্টারকে জানেন তো, খুব কড়া লোক। তিনি ওসব হাতে পায়ে ধরাধরি, কান্নাকাটিতে গলে যাওয়ার পাত্র নন। দিলেন এককথায় তাড়িয়ে। বললেন,’কী এমন করেছে আপনার ছেলে। ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ান হয়েছে কি? একটাও বড় টুর্নামেন্ট জিতেছে কি? কী দেখে আমি ছুটি অ্যালাও করব?’ শুনেই মুখ চুন করে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান।”

”এবার তো উনি এই কাপটা নিয়ে গিয়ে হেডমাস্টারকে দেখিয়ে ছুটি আদায় করবেন।” চন্দ্রিমা বিপন্ন স্বরে বললেন।

”করলেই হল? রমুর বাবা কী বলল জানেন, তা হলে একটা কাপ কিনে হেডমাস্টারকে দেখিয়ে বলব, রমুকে এক ঘণ্টা আগে ছুটি দিতে হবে, ডায়মন্ড হারবারে ওয়াকিং কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছে, হাঁটায় ওর দারুণ প্রতিভা, ওর আরও প্র্যাকটিস দরকার।” বলেই সুধা ঘোষাল হাসতে হাসতে চন্দ্রিমার গায়ে প্রায় গড়িয়ে পড়লেন। অন্য দু’জনও খুকখুক শব্দ করলেন।

”একটা জিনিস লক্ষ করেছ, টেনিস খেলাকে ছুতো করে বসুমল্লিকরা জমিটাকে নিজেদের সম্পত্তি করে ফেলেছে। কাউকে তো খেলতেই দেয় না!”প্রতিভা বললেন গলায় ক্ষোভ নিয়ে।

”যা বলেছেন!” চন্দ্রিমা সূত্রটা ধরে নিয়ে যোগ করলেন,”অনিরুদ্ধ বাগচির কেসটা জানেন তো? ছেলেটা যে কী ভাল, কী বলব! রীতিতমতো চাঁদা দিয়ে টেনিস খেলতে পাঠিয়েছিল ওর বাবা। কোথায় খেলা! শুধু নিজের ছেলে দুটোকে খেলাতেই উনি ব্যস্ত, অনিরুদ্ধ বেচারি চুপচাপ শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। শেষে ওর ঠাকুমা রেগে গিয়ে যাচ্ছেতাই বলে নাতিকে নিয়ে চলে আসেন।”

”যাক গে এসব কথা, কান্তি চা আনছে, চুপ করো।” প্রতিভা হুঁশিয়ার করে দিলেন।

ওদের টেবলের পাশের টেবলেই স্ত্রী বরুণাকে নিয়ে বসে ছিলেন এম জে টি এম—এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজার সুভাষ সেন। ওঁর ছেলে শঙ্কু শান্তিনিকেতনে চলে যাবে, টেনিস খেলবে না, তবুও তিনি তপতীকে চাঁদা দিয়েছিলেন,কারণ বাচ্চচাদের খেলাধুলোর প্রয়োজনটা তিনি বোঝেন। পাশের টেবলের কথাবার্তার অনেকটাই তাঁদের কানে এসেছে।

”শুনলে, কী সব কথা বলল?” সুভাষ সেন স্ত্রীকে বললেন।

”কেউ ভাল কিছু করলে এইসব পুরস্কারই তার জোটে।”

”শঙ্কু যদি এখানে থাকত, তা হলে নিশ্চয় আমি ওকে টেনিস খেলতে পাঠাতাম। লক্ষ করেছ ওঁর দুটি ছেলের কী চমৎকার স্বাস্থ্য তৈরি হয়েছে! হাঁটাচলায় কত স্মার্ট! ছোটটি পাঁচ বছর আগে কী রুগণ দেখতে ছিল, রীতিমতো তো ধুঁকত। আর এখন?” সুভাষ সেনের স্বরে প্রশংসার সঙ্গে শ্রদ্ধাও ফুটে উঠল। ”সবই ওই দু’জনের জন্য।”

”সত্যিই, কষ্ট করেছেন ওদের বাবা মা।” বরুণার গলায় অকৃত্রিম সহানুভূতি। ”মিসেস বসুমল্লিককে ছেঁড়া ব্লাউজ সেলাই করে পরতে দেখেছি। তন্ময়বাবুর জুতোটা দেখেছ? তোমার বেয়ারাও ওর থেকে ভাল জুতো পরে। অথচ ছেলেদের জন্য খরচ করতে কার্পণ্য করেন না। টেনিসের কোচকেই ওঁরা দেন মাসে দুশো টাকা, ভাবতে পারো?”

ভাবতে পারেননি তপতী, মিনুর নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্ট জেতার প্রতিক্রিয়া এমন হবে।

সোমবার তিনি ছেলেদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার সময় কাপটাও সঙ্গে নিয়ে গেছলেন হেডমাস্টারকে দেখাবার জন্য। গিয়ে শুনলেন তিনি আজ স্কুলে আসবেন না, কলকাতায় মধ্যশিক্ষা পর্যদের মিটিংয়ে গেছেন। কাপটা হেডমাস্টারের টেবলের একধারে রেখে তপতী বেয়ারাকে বলে আসেন,”ওঁকে বোলো, ক্লাস এইটের বি সেকশনের মৃন্ময় বসুমল্লিক এটা জিতে এনেছে কলকাতা থেকে। আমি কাল এসে নিয়ে যাব।”

পরদিন গাড়ি থেকে নেমে তপতী দুই ছেলের সঙ্গে স্কুলের বড় ফটক দিয়ে ঢুকে স্কুলবাড়ির কোলাপসিবল ফটকের দিকে এগোচ্ছেন, তখন একটি বড় ছেলে চেঁচিয়ে বলল,”কী রে মৃন্ময়, কাকে হারিয়ে কাপটা পেলি, কৃষ্ণনকে, না জয়দীপ মুখার্জিকে?”

ওরা তিনজন থমকে পাঁচটি ছেলের জটলার দিকে তাকাল। চিনু চাপা গলায় বলল,”দাদা প্রণবেন্দু বলল, চুপ করে থাক, কথা বলিসনি।”

তিনজন কোলাপসিবল ফটকের কাছে পৌঁছেছে তখন তাদের কানে এল,”জিতে আনলি না কিনে আনলি?”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওদের পা অচল হয়ে পড়ল। তপতী তাকালেন মিনুর মুখের দিকে। অপমানে আর বেদনায় মুখটা দিশাহারা। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল, জল ভরে আসছে চোখে। কথাগুলোর ধাক্কা ওর বুকে বেজেছে। ”তাড়াতাড়ি ক্লাসে যা।” তপতী দুই ছেলের পিঠে হাত রেখে ঠেলা দিলেন। ”এসব কথায় জবাব দিলে ওরা আশকারা পেয়ে আরও বলবে, ক্লাসে যা।”

”মা, আমি প্রণবেন্দুকে মারব।” চিনু জ্বলন্ত চোখে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে হাত মুঠো করল।

”মারবে? কেন?”

”দাদাকে অপমান করেছে, আমাদের সবাইকে, তোমাকে, বাবাকে মিথ্যেবাদী, জোচ্চচর বলল।”

”বলতে দে। মিনু ক্লাসে যা। চিনু খবর্দার,যদি মারপিট করিস তা হলে আমি লজ্জায় মরে যাব।”

ছেলেরা দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোল। তপতী ঠোঁট কামড়ে চোখ বুজলেন। শরীরের ভেতরটা থরথর করছে। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন, দেয়ালে হাত রেখে মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে মনে শুধু বলে গেলেন,”হায় ভগবান, এত পরিশ্রম, এত কষ্ট, এত সাধনা করল মিনু আর ওইটুকু ছেলের মাথায় কিনা এমন অপবাদের বোঝা তুলে দিল! ওর জীবন তো শুরুই হয়নি, আর এখনই ঈর্ষা হিংসার আঘাত ওকে পেতে হল! ভেঙে না পড়ে মিনুর নরম কাঁচা মন! ভগবান ওকে শক্তি দাও।”

তপতী হেডমাস্টারের ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন কাপটা টেবল থেকে মেঝেয় নামানো।

”আসুন মিসেস বসুমল্লিক।” হেডমাস্টার আচার্য তিনটি চেয়ারের মধ্যে একমাত্র খালি চেয়ারটার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন,”বসুন।” অন্য দুটি চেয়ারে দু’জন অভিভাবক বসে।

”কাল এসে কাপটা রেখে গেছেন। বেশ বড় কাপ। আজ সকালে তিনটে কাগজে খুঁজলাম—কিন্তু মৃন্ময়ের নাম তো কোথাও দেখতে পেলাম না!” হেডমাস্টারের বিস্মিত চোখে তপতী দেখতে পেলেন প্রশ্ন,’কেন পেলাম না?’

”কেন পেলেন না সেটা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, আমি তো কাগজের সম্পাদক নই।” তপতী শান্ত স্বরে পরিহাস মিশিয়ে বললেন।

”হয়তো ছাপার যোগ্য খবর নয় বলেই ছাপেনি।” হেডমাস্টারের গলা ঈষৎ তির্যক।

”তা হতে পারে।” তপতী উঠে দাঁড়ালেন। ”আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি।”

”হ্যাঁ, নিশ্চয়। ওটা তো দেখা হয়ে গেছে।”

তপতী যত্নভরে কাপটা দু’হাতে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ধীর পায়ে।

বাড়ি ফিরে তিনি বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে রইলেন। বেলা একসময় খেতে ডাকল। ”মাথা ধরেছে”, ”খিদে নেই” বলে কিছু খেলেন না। গাড়ি নিয়ে স্কুলে গেলেন ঠিক সাড়ে তিনটেয়। চিনু—মিনু যখন গাড়ির দিকে আসছে তিনি তীক্ষ্নদৃষ্টিতে ওদের মুখের দিকে তাকালেন। দুই ছেলেরই মুখ গম্ভীর। জামাপ্যান্টে মারামারির কোনও চিহ্ন নেই দেখে তিনি খানিকটা আশ্বস্ত হলেন। তবে মুখের ভাব তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলল। সকালে শোনা কথাগুলো বোধ হয় ওদের মন থেকে মুছে যায়নি।

গাড়িতেই ওরা প্যান্ট শার্ট বদলে খাবার খেয়ে নেয়। কিন্তু আজ খানিকটা খেয়ে রেখে দিল। পোশাক বদলাল না।

”ড্রেস চেঞ্জ করবি না?” গাড়ি চালাতে চালাতে তপতী বললেন।

”না।” চিনু বলল।

”খেলবি না?”

”ভাল লাগছে না।…মা এই স্কুলে আর পড়ব না।” চিনুর স্বরে ক্ষোভ আর বিরাগের সঙ্গে তিক্ততা মাখানো রয়েছে। মিনু চুপ করে আছে।

তপতী উত্তর দিলেন না। তিনি বুঝতে পারছেন দু’জনের মনের অবস্থা। এখন কথা না বলাই ভাল। জমে ওঠা রাগ আর বেদনা ওরা বার করে দিক আগে।

সহদেব অপেক্ষা করছিলেন। তপতী নিজেই বললেন,”আজ আর ওয়ার্ক আউট করাবেন না সহদেববাবু, ওদের মন খুব বিক্ষিপ্ত রয়েছে।”

”সে কী! একটা তো মোটে টুর্নামেন্ট জিতল, এখনও অনেক জিততে হবে মিনুকে। আমি তো ঠিক করে রেখেছি ওকে এ—বছরই কলকাতার সব টুর্নামেন্টে নামাব।”

”তা নামাবেন। কিন্তু আজ থাক, কারণটা আমি পরে বলছি। বরং ওরা নিজেদের মধ্যে খেলুক তা হলে মনটাকে কিছুটা গুছিয়ে নিতে পারবে।”

সহদেব দু’জনকে ডাকলেন। ”ড্রেস করোনি কেন? যাও চেঞ্জ করে এসো…আজ দু’জনে সেকেন্ড সার্ভ প্র্যাকটিস করো। মিনু কাল তিনটে ডাবল—ফল্ট করেছ।”

”আজ আমি কোর্টে নামব না।” মুখ নিচু করে গোঁয়ারের মতো মিনু দাঁড়িয়ে রইল।

”চিনু?”

”আমিও না।”

সহদেব চোখে প্রশ্ন নিয়ে তপতীর দিকে তাকালেন।

”তা হলে আজ থাক।” তপতী বললেন।

”বেশ, তা হলে মন গুছিয়ে নেওয়ার খেলাই ওরা খেলুক।” সহদেব একটা বল তাঁর হাতের র‌্যাকেটের ওপর রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বলটাকে প্রায় পনেরো ফুট শূন্যে ছুড়ে দিলেন। পড়ন্ত বলটা তাঁত ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে র‌্যাকেটটা নীচে নামিয়ে নিতে নিতে বলটাকে তিনি তাঁতের ওপর স্থিরভাবে বসিয়ে নিলেন, যেন জালে ধরা পড়ল বলটা। দু’বার—তিনবার করলেন।

”মিনু র‌্যাকেট নাও। বলেছ যখন কোর্টে তোমায় আজ নামতে হবে না। এখন তুমি ওদিকে কুড়ি পা যাও।”

নির্দেশ মতো কোর্টের বাইরের জমিতে মিনু গুনে গুনে কুড়ি পা দূরত্বে গেল। সহদেব র‌্যাকেটে রাখা বলটা ছুড়ে দিয়েই বললেন,”র‌্যাকেটে ধরো।”

মিনু র‌্যাকেট আলতো করে বলের সঙ্গে নামিয়ে নিতে নিতে তাঁতের ওপর বলটা ধরল।

”ছুড়ে দাও, যেমনভাবে আমি দিলাম।”

এর পর সহদেব বলটাকে মিনুর পেছনে, দু’পাশে কখনও—বা পাঁচ গজ সামনে পাঠাতে লাগলেন। মিনু নিখুঁতভাবে প্রতিটি বল র‌্যাকেটে ধরে পাঠিয়ে দিল।

সহদেব ইশারা করলেন চিনুকে। ”তুমি এবার আমার জায়গা নাও।…এটা করে যাও তা হলে ‘টাচ’ তৈরি হবে, কন্ট্রোল আসবে।” কথাগুলো বলে তিনি তপতীর পাশে এসে বসলেন। ”হ্যাঁ বলুন কী বলবেন।”

তপতী সকালে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বললেন,”ওরা কতটা দাগা পেয়েছে বুঝতেই পারছেন, খেলতে এত ভালবাসে অথচ খেলতে চাইল না।”

শুনতে শুনতে সহদেবের মুখ থমথমে হয়ে গেল রাগে। কিছুক্ষণ কথা না বলে মুখ নামিয়ে রইলেন। একসময় মুখ তুলে বললেন,”দিদি, খেলাটা কোর্টে যতটা না হয় তার থেকেও বেশি হয় মনে। আর মন যদি এইসব কথা শুনে ছত্রাকার হয়ে যায় তা হলে খেলার অবস্থাটাও তাই হবে। ওদের যদি আর একটু বয়স বা অভিজ্ঞতা হত, তা হলে নিজেরাই নিজেদের সামলাতে পারত।…এই কাজটা কিন্তু এখন আপনাকেই করতে হবে। ওদের আড়াল করা, ওদের মনের চার পাশে দেয়াল তুলে শুধু ছাদটা খুলে রাখা, সেখান দিয়ে টেনিস ছাড়া আর কিছু যেন না দেখতে পায়।…পারবেন?”

”পারতে হবে।”

।।৮।।

”মিনু, চিনু তোমরা কী হতে চাও, তোমাদের জীবনের লক্ষ্য কী?”

”বড় টেনিস প্লেয়ার হতে চাই।”

”আমিও।”

খাওয়ার টেবলে ছড়ানো বই, খাতা, স্কুলব্যাগ। তপতীর ডান দিকে চিনু, টেবলের ওধারে মিনু। কোর্ট থেকে ফিরে প্রতি সন্ধ্যার মতো তিনি ছেলেদের নিয়ে পড়াতে বসেছেন। চিনুকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়ে প্রশ্নমালা থেকে দশটা অঙ্ক করতে দিয়েছেন। তারপর মিনুকে করতে দেওয়া ট্রানস্লেশন সংশোধন করতে করতে হঠাৎই তিনি ছেলেদের প্রশ্নটা করলেন। বসার ঘরে সোফায় শুয়ে তন্ময় খবরের কাগজ পড়ছেন, কাগজটা নামিয়ে তিনি দরজা দিয়ে একপলক তাকিয়ে আবার পড়তে শুরু করলেন।

”বড় প্লেয়ার হতে গেলে প্রথমেই কী দরকার?”

উত্তরটা দুই ছেলেরই বহুবার মায়ের কাছ থেকে শোনা আছে।

”কঠোর পরিশ্রম।” মিনু বলল।

”আর?”

”লক্ষ্যপূরণের জন্য মনকে—” চিনু দাদার দিকে তাকাল।

”একমুখীন করতে হবে।” মিনু সম্পূর্ণ করে দিল।

”তোমরা কি তাই করছ?” তপতী ছেলেদের যখন গভীর কোনও কথা বলেন তখন ‘তুই’ হয়ে যায় ‘তুমি’। ”আজ তোমরা কোর্টে নামতে চাইলে না কেন? তোমাদের লক্ষ্য বড় প্লেয়ার হওয়া, কিন্তু আজেবাজে কথা শুনে…।”

”আজেবাজে? প্রণবেন্দু যে কথাটা বলল সেটা আজেবাজে?” রাগে ফুঁসে উঠল মিনু।

”হ্যাঁ আজেবাজে।” শান্ত ধীর স্বরে তপতী কথাটা বলে ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মিনু চোখ নামিয়ে নিল।

”তুমি জানো, পরিশ্রম করে কোনও অন্যায় সুযোগ না নিয়ে, পাঁচজন প্লেয়ারকে পরিচ্ছন্নভাবে হারিয়ে কাপটা জিতেছ।…নিজের কাছে তুমি সৎ। এটাই হল বড় কথা, একমাত্র কথা। জেতার জন্য তোমার মনের মধ্যে একটা সুন্দর অনুভূতি পেয়েছ, তোমার কাজ এই অনুভূতিটাকে বাঁচিয়ে রাখা। তা করতে পারলে দেখবে একটা দুর্লভ ট্রফি তুমি জিতে ফেলেছ।” তপতী কথা শেষ করে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। চিনু—মিনু উৎসুক কৌতূহলভরে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল।

”নিজেকে নিজের ভাল লাগছে—এটাই হল ট্রফি আর এই ট্রফিটা তোমাদের জিততে হবে। সেজন্য যা কিছু সুন্দর জিনিস, সংগ্রহ করে মনে ভরে রাখতে হবে। তা করতে পারলে দেখবে মন একমুখীন হয়েছে। কুৎসা ঈর্ষা রটনা এসব হল আবর্জনা। এগুলো দিয়ে মন ভরিয়ে ফেললেই দেখবে তোমাদের ভেতর দুর্গন্ধ জমে উঠেছে, শ্বাস নিতে পারছ না, ছটফট করছ। তখন মন আর একমুখীন হতে পারবে না…তোমরা বড় প্লেয়ার কেন, কিছুই হতে পারবে না।”

তপতীর নম্র স্বর সারা ঘরে একটা গম্ভীর পরিবেশ তৈরি করেছে। মিনু একদৃষ্টে টেবলের একটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে। চিনু ইরেজারটাকে নখ দিয়ে খুঁটছে। তপতী আড়চোখে দেখলেন বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তন্ময় নিঃশব্দে হাসছেন।

”তাই বলে আমরা হজম করে যাব?” চিনু এখনও মানতে পারছে না সকালে স্কুলের ঘটনাটা।

”হজম করতে না পারলে কোরো না। আমরা কত আশা নিয়ে তোমাদের দিকে তাকিয়ে, তোমরা বড় প্লেয়ার হবে, আমাদের বুক গর্বে ভরে উঠবে। আমাদের দেখে লোকে বলবে ‘ওই যে মৃন্ময় বসুমল্লিকের মা, ওই যে চিন্ময় বসুমল্লিকের বাবা।’ আর আমরা বলব,’ওই দেখো আমাদের মিনু, ওই দেখো আমাদের চিনু, ওদের জন্য আমরা কত কষ্ট করেছি, কত অপমান—কুৎসা সয়েছি। আজ দ্যাখো ওদের কত নাম, কত যশ, ওরা বাবা—মা’র মুখ রেখেছে,ওরা বাবা—মা’কে ভালবাসে।…”’ তপতী থেমে গেলেন মিনুর চোখ ছলছল করছে দেখে। চিনু দু’ হাতে আঁকড়ে মায়ের ডান বাহুতে মুখ চেপে ধরল।

”…কিন্তু মিনু আর চিনু একটা বড় ভুল করে বসল। মায়ের কথা না শুনে ওরা লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে মনকে অশান্তিতে ভরিয়ে তুলল, তাই ওরা বড় হতে পারল না। মা আর বাবাকে দুঃখ দিল। কেউ আর বলবে না ওই যে মৃন্ময় বসুমল্লিকের মা, ওই যে চিন্ময়—।” তপতীকে থেমে যেতে হল।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে মিনু টেবলের বইগুলিকে দু’হাত দিয়ে ছত্রখান করে টেবলে একটা ঘুঁসি বসিয়ে চিৎকার করল,”না,না,না।” তারপরই সে ছুটে নিজেদের ঘরে চলে গেল।

”চিনু!” তপতীর বাহু কামড়ে ধরেছে চিনু।

”আমি হজম করব।”

মিনিটখানেক পর ব্যস্ত হয়ে বেলা হাজির হল। ”কী হয়েছে গো বউদি? মিনু বিছানায় উপুড় হয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেন গো?”

”ও কাঁদছে আর এ কামড়াচ্ছে, কী করি বলো তো?” কৃত্রিম অসহায়তা ফোটালেন তপতী তাঁর গলায়।

দিনকয়েক পর তপতী কোর্টের ধারে বসে। চিনু—মিনুকে দাঁড় করিয়ে সহদেব কথা বলছেন।

”ভলি মারার জন্য, রিফ্লেক্সের স্পিড বাড়াবার জন্য, তোমাদের কব্জির আর হাতের জোর বাড়াবার জন্য নেট গেম প্র্যাকটিসটা আজ অন্যভাবে করতে হবে। বাঁ হাতটা পিঠে ঠেকিয়ে তোমাদের খেলে যেতে হবে। ব্যালেন্সের জন্য একটা হাত না থাকলে দেখবে তোমাদের আরও চটপট মুভ করতে হচ্ছে, উপরন্তু যাবতীয় চাপ পড়বে ডান হাতের ওপর। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ?” দু’জনে মাথা নাড়ল। ”এবার করে দেখা যাক।”

পাঁচ মিনিটের মধ্যে দু’জনেই তিন—চারবার কোর্টে পড়ে গেল ভারসাম্য হারিয়ে।

”আস্তে খেলো আস্তে, প্রথম দিনেই অত ফাস্ট মুভ করতে যেয়ো না…মিনু ব্যাকহ্যান্ডটা বড় দেরিতে হিট করছ তাই বল বাইরে যাচ্ছে, আরও তাড়াতাড়ি র‌্যাকেটটা পেছনে নাও, মাথাটা নামিয়ে দাও স্ট্রোক নেওয়ার সময়…লবটা আরও তুলে দাও চিনু, সূর্যের দিকে তাকাতে মিনুকে বাধ্য করো” সহদেব সমানে চিৎকার করে গেলেন এবং দশ মিনিট পরই ছেলে দুটি দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁফাতে শুরু করল।

”কী হল?” সহদেব ধমকে উঠলেন।

”সার দু’ মিনিট।” মিনু আবেদন জানাল। সহদেব ঘড়ি দেখতে লাগলেন।

”দু’ মিনিট হয়ে গেছে, স্টার্ট।”

বিকেল গড়িয়ে গেছে। চারদিক ধূসর হয়ে উঠছে। গাছে গাছে পাখিদের কিচিরমিচির। চিনু, মিনু ক্লাবের কলে মুখ হাত পা ধুয়ে ফিরে এল।

”চারটে ক্লাব টুর্নামেন্টে তোমাদের এন্ট্রি করিয়েছি, দুটো হবে হার্ডকোর্টে। শ্যামবাজার,কাশীপুর, অর্ডন্যান্স, স্যাটারডে, টানা প্রায় একমাস।

”নানারকমের কোর্টে, নানা কন্ডিশনে, নানা ধরনের প্লেয়ারদের সঙ্গে তোমাদের এখন খেলা দরকার, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তোমাদের ডেভেলপমেন্টের জন্য।”

সহদেব জুতোর ভেতর থেকে কাঁকর ঝেড়ে ফেলে ফিতে বাঁধলেন।

”একমাস তা হলে স্কুল করা হবে না।” মিনু মনে করিয়ে দিল।

”তা হবে না। যদি কলকাতায় থাকতে তা হলে হাফ স্কুল করেও খেলতে যেতে পারতে। কিন্তু এখান থেকে পৌঁছতেই তো দেড়—দু ঘণ্টা লেগে যাবে।…স্কুল কামাই করতেই হবে।” সহদেব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেন।

”একমাস কামাই করলে আমাদের তো নাম কেটে দেবে।”

তপতী গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন,”আমি বরং একবার হেডমাস্টারমশাইকে বলে দেখি যদি মাসখানেকের জন্য ছুটি দেন।”

”যদি না দেয়?” চিনুর চোখে সংশয়।

”না দিলে কী আর করা যাবে, নাম কেটে দিলে দেবে।” তপতী সহজ সুরে কথাগুলো বললেন কিন্তু ঋজু ভঙ্গিতে। ”কেউ যদি অসুখে পড়ে একমাস স্কুলে না যায় তা হলে কি তার নাম কাটা যাবে?”

”আমাদের তো অসুখ নয়।” চিনুর আবার সংশয়।

”তার থেকেও বড় ব্যাপার, সুস্থ থাকার জন্য খেলা! হয়েছে এবার, চলো। সহদেববাবু আপনি টুর্নামেন্টের তারিখগুলো যদি দেন তো কথা বলতে সুবিধে হবে। তবে একটা কথা, ছুটি না দিলেও ওরা কিন্তু খেলতে যাবে।”

এক সপ্তাহ পর তপতী দেখা করলেন হেডমাস্টারের সঙ্গে। তপতীর কথা শুনে পুরো পনেরো সেকেন্ড তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন,”ছেলে দুটো লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক, বড় হোক, এটা কি আপনি চান না?”

”মানুষ হোক এটা তো অবশ্যই চাই। কিন্তু লেখাপড়া শিখলেই মানুষ হবে, এ—ধারণাটাও তো ঠিক নয়। জীবনের আরও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, যেখান থেকে বড় হওয়া যায়। ছবি আঁকা,গানবাজনা, অভিনয় নাচের মধ্য দিয়ে যেমন, তেমনই খেলার মধ্য দিয়েও তো বড় হওয়া যায়, সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়। এই স্কুলের সব ছেলেই কি স্টার পেয়ে পাশ করে? আমার ছেলেরাও নয় স্টার লেটার পাবে না কিন্তু অন্যদিকে তো স্টার পেতে পারে।” তপতীর গলা আবেগে একটু চড়ে গেল, সেটা বুঝতে পেরেই তিনি লজ্জিত হয়ে পড়লেন।

”তা ঠিক। সবাই স্টার লেটার পায় না।” হেডমাস্টার গম্ভীর মুখে সামনে ঝুঁকে বললেন। ”মৃন্ময়, চিন্ময় স্ট্যান্ড করে না বটে, কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্টও খারাপ নয়। কিন্তু এতদিন স্কুল কামাই করে খেলে বেড়ানো, এটা আমি সমর্থন করতে পারছি না।”

”আমরা ঝুঁকি দিয়ে দু’জনকে টেনিস প্লেয়ার তৈরি করছি, আপনিও একটু ঝুঁকি নিন না আমাদের সঙ্গে। এই স্কুলের দুটি ছেলে যদি খেলায় নাম করে তা হলে তো স্কুলেরও সুনাম হবে।” তপতী আশাভরে হেডমাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনে হল,’স্কুলের সুনাম’ কথাটায় বোধ হয় কাজ হয়েছে। হেডমাস্টার ঠোঁট টিপে মাথা নাড়লেন, চোখ দুটো একটু বড় হল।

”এক মাস স্কুলে না এলে পড়াশুনোয় পিছিয়ে পড়বে।”

”আমি বাড়িতে পড়িয়ে সেটা মেকআপ করে দেব…গ্যারান্টি দিচ্ছি।

”বেশ, ওরা খেলুক। মিসেস বসুমল্লিক এই ফেভার কিন্তু এই একবারই; আর কিন্তু দেব না। আশা করি আপনিও আর চাইবেন না।”

”চাইব না।”

.

মিনু চারটে টুর্নামেন্টের তিনটিতে জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ান হল একটা সেটও না হারিয়ে। চিনু তিনটির দুটিতে কোয়ার্টার ও একটিতে সেমিফাইনালে উঠেছিল। সহদেব শুধু অর্ডন্যান্স ক্লাবের টুর্নামেন্টে মিনুকে সিনিয়ার বিভাগে এন্ট্রি করিয়েছিলেন ওর যোগ্যতা ও ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য। সেমিফাইনালে উঠে সে ভারতের ডেভিস কাপার প্রেমজিত লালের সামনে পড়ে। ২—৬,৩—৬—এ হেরে যায় মিনু। ম্যাচটা গড়িয়েছিল পঁয়ষট্টি মিনিট। প্রতিটি পয়েন্টের জন্য মিনু লড়াই করেছে আর সেটাই ভাল লেগেছে দর্শকদের, বিশেষ করে বেঙ্গল লন টেনিসের প্রেসিডেন্ট ভাস্কর মুখার্জির, তিনি অল ইণ্ডিয়া লন টেনিসেরও ট্রেজারার। মিনুকে কাছে ডেকে বলেন,”শুনলাম তুমি সহদেবের হাতে তৈরি, তা হলে তো আর কিছু বলার নেই। তবে এখন তুমি স্টেট আর ন্যাশনাল লেভেলে খেলার কথা ভাবো। প্রেমজিতের কাছে তুমি যে হারবে এটা আমি ধরেই নিয়েছিলাম, কিন্তু কীভাবে হারো সেটাই দেখার ছিল। আমি খুশি তোমার খেলা দেখে। বয়স কত?”

”চোদ্দোয় পড়েছি।”

ভাস্কর মুখার্জির ভুরু উঠে গেল। ”তোমাকে তো ষোলো—সতেরো ভেবেছিলাম। এই বয়সেই প্রেমজিতের কাছ থেকে পাঁচটা গেম নিয়েছ!” মিনুর পিঠ চাপড়ে তিনি অন্য লোকের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত হলেন। ওদের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ইংরেজি কাগজের সাংবাদিক। তিনি ভাস্কর মুখার্জির কথা শুনেছিলেন। সাংবাদিক এক ফাঁকে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন ”বসুমল্লিক সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?” ”ওয়ান অব দ্য মোস্ট প্রমিসিং জুনিয়ারস ইন দ্য কান্ট্রি।” পরদিন সাংবাদিক তাঁর রিপোর্টে দুটি বাক্য লিখলেন মিনু সম্পর্কে: ”বসুমল্লিকের বয়স মাত্র চোদ্দো, কিন্তু লালকে ব্যস্ত রেখে সে পাঁচটা গেম ছিনিয়ে নিয়েছে। টেনিস রসিকদের ধারণা, এই কিশোর ভারতীয় টেনিসে একদিন উজ্জ্বল তারকা হয়ে উঠবে।”

পরদিন তপতী বাক্য দুটি পড়তে পড়তে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। ‘একদিন উজ্জ্বল তারকা হবে উঠবে’ এই স্বপ্নই তো তাঁদের চালিয়ে নিয়ে এসেছে পাঁচটা বছর।

সকালে খাওয়ার টেবলে কাগজটা সকলের হাতে ঘুরল। এর আগে মিনু যে তিনটি টুর্নামেন্টে জুনিয়ার খেতাব জিতেছে তাতে শুধু সিনিয়ারদের ফল কাগজে বেরিয়েছিল। আর এবার নামের সঙ্গে দুটো কথাও। তন্ময় বললেন ”এর কারণ অবশ্য প্রেমজিত লালের সঙ্গে খেলেছে বলে।”

তপতী প্রতিবাদ করলেন,”সে তো অনেকেই খেলেছে, কই এমন ভাবে তো তাদের সম্পর্কে লেখা হয়নি।”

”সহদেববাবু, মিনুর সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সেটা এখনই বলার মতো খেলা কি খেলেছে?” তন্ময় সিরিয়াস স্বরে জানতে চাইলেন।

”ভাস্কর মুখার্জি বহু বছর ধরে বহু প্লেয়ারকে দেখেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, কৃষ্ণন, প্রেমজিত, জয়দীপের পরের একটা ব্যাচ তৈরির জন্য এ আই এল টি এ চারজন জুনিয়ারকে ইউরোপ ট্যুরে পাঠাবে। মিনু যদি জুনিয়ার ন্যাশনালের সেমিফাইনালেও উঠতে পারে তা হলে ট্যুরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।” সহদেব মিনুর দিকে তাকালেন। মুখে পাতলা হাসি। মুখ নামিয়ে মিনু ভাত খেয়ে যাচ্ছে।

”পারবি না মিনু?” তন্ময় আশান্বিত স্বরে জানতে চেয়ে একটা ইতিবাচক উত্তরের আশায় তাকালেন।

মুখ না তুলে মিনু ভাত মুখে একটা শুধু শব্দ করল। যেটা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দুইই হতে পারে।

”সেমিফাইনালে যেতে পারবি?” তন্ময় আবার বললেন।

”তন্ময়বাবু এসব কথা থাক এখন।” সহদেব প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি যোগ করলেন, ”আগে জুনিয়ার বেঙ্গলটা উতরোক। ধাপে ধাপে জিনিসগুলো হওয়া ভাল।”

খাওয়া শেষ করে মিনু হাত ধোওয়ার জন্য উঠে যেতেই সহদেব বললেন,”জুনিয়ার ন্যাশনাল নিয়ে একটা কথাও ওকে বলবেন না। অযথা মনের ওপর একটা প্রেশার তৈরি হবে। আপনাদের আশা যত বাড়বে, প্রেশারটাও তত বাড়বে, বাচ্চচা ছেলে সেটা নিতে পারবে না।”

”আপনি ঠিকই বলেছেন।” কথাটা বলে তপতী চাহনি দিয়ে স্বামীর ভর্ৎসনা জানালেন। ”চিনু, এসব নিয়ে কারও সঙ্গে গল্প করবে না।”

খাওয়া চিনুরও শেষ হয়েছে। চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে সে বলল,”খবরের কাগজটা আমি স্কুলে নিয়ে যাব, সবাইকে দেখাব। নর্থ ক্যালকাটার কাপ জেতার থেকেও স্টাফ রিপোর্টারের এই কথাগুলো দাদার মান বাড়িয়েছে।”

”একদম নয় চিনু।” তপতী ছিলেছেঁড়া ধনুকের মতো দাঁড়িয়ে উঠলেন। ”কাউকে কিছু দেখাতে হবে না।…এখানকার কারোর কোনও প্রশংসা আমার দরকার নেই, আমার ছেলেদেরও দরকার নেই।” তপতী উত্তেজনায় কাঁপছেন।

”চিনু যদি তুমি এই কাগজ নিয়ে কাউকে দেখাও বা কাউকে এর উল্লেখ পর্যন্ত করো তা হলে র‌্যাকেট দিয়ে তোমার পিঠ ভাঙব।”

তুই নয় তুমি! মার মুখের দিকে তাকিয়ে চিনু বুঝে গেল র‌্যাকেট তার পিঠের সঙ্গে মাথাও ভেঙে দিতে পারে। সে একটি কথাও আর না বলে বেরিয়ে গেল। তপতীর হঠাৎ এমন আচরণে তন্ময় ও সহদেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এভাবে ওঁকে রেগে উঠতে তাঁরা কখনও দেখেননি।

”এখানকার কয়েকটা লোক এমন সব কথা রটিয়েছে, যা শুনলে মনে হবে পৃথিবীটা খুব খারাপ জায়গা…আমি চাই ছেলেরা জানুক পৃথিবীটা খুব ভাল জায়গা।…এরপর হয়তো শুনব কাগজের রিপোর্টারকে টাকা খাইয়ে লিখিয়ে নিয়েছি। এরা সব কিছুই বলতে পারে।”

তপতী বেরিয়ে গেলেন গাড়ি বের করতে। সহদেব নিচু গলায় বললেন,”দিদিকে কিন্তু আর রাগতে দেবেন না, তা হলে ছেলেদের ক্ষতি হবে।”

”আমি কি রাগিয়েছি না কি! রাগ বহুদিন জমে ছিল, আজ সেটা ফেটে বেরোল। তবে এটুকু বলতে পারি, আর কখনও রাগবে না।” তন্ময় নিশ্চিত স্বরে জানালেন।

বাইরে হর্ন বাজল। মিনু চিনু স্কুলব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল।

”তা হলে এবার?” তন্ময় বললেন।

”এবার জুনিয়ার বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ানশিপ।” সহদেব আড়মোড়া ভাঙলেন।

ছেলেদের পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় তপতী একটা শক্ত মলাটের সাদা এক্সারসাইজ খাতা কিনে আনলেন। বাড়ি এসে দেখলেন তন্ময় স্নান করতে কলঘরে গেছেন। খবরের কাগজ থেকে টেনিস ম্যাচের রিপোর্টের অংশটি কাঁচি দিয়ে কেটে গঁদ লাগিয়ে তিনি কাটিংটা খাতার প্রথম পাতায় সেঁটে দিলেন।

অফিসে যাওয়ার সময় খবরের কাগজটা খাওয়ার টেবলে ভাঁজ করা পড়ে আছে দেখে তন্ময় থমকে গেলেন। তপতী রান্নাঘরে। সেদিকে দু’বার তাকিয়ে চট করে কাগজটা তুলে হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। অফিসে প্রথমেই তিনি গেলেন ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঘরে। তিনি ব্যস্ত টেলিফোনে কথা বলায়। তন্ময় খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে মুখ হাসি হাসি করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

”কী ব্যাপার বসুমল্লিক?” এম ডি ফোন রেখে বললেন।

”সার, আজকের কাগজে আমার বড়ছেলের সম্পর্কে দুটো সেন্টেন্স আছে। দেখুন।” তন্ময় গর্বিতভাবে স্পোর্টসের পাতাটা খুলে কাগজটা হাতে দিয়ে মুখ ফ্যাকাসে করে ফেললেন।

”কী হল!”

”সার একটা গোলমাল হয়ে গেছে। রিপোর্টটা কেউ কেটে নিয়েছে, বোধ হয় আমার স্ত্রী। আই অ্যাম ভেরি সরি।” তন্ময় কাঁচুমাচু।

এম ডি হাসি চেপে হাত বাড়িয়ে র‌্যাকে রাখা তিন—চারটে খবরের কাগজের থেকে একটা তুলে নিলেন। পাতা উলটে বললেন,”এই খবরটা?”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ।” তন্ময়ের ধড়ে যেন প্রাণ এল।

এম ডি দু’বার পড়লেন। ভ্রূ কয়েকবার উঠল, নামল। তন্ময়ের মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন,”পাঁচটা গেম নিয়েছে, আ বিগ অ্যাচিভমেন্ট।”

.

”বেঙ্গল লন টেনিসের প্রেসিডেন্ট বলেছেন যদি ন্যাশনালের সেমিফাইনালেও উঠতে পারে তা হলে ইউরোপ ট্যুরের জন্য মিনু সিলেক্ট হতে পারে।”

এম ডি চোখ কুঁচকে বললেন,”ইউরোপ ট্যুরে? বলেন কী! এই মহাদেবপুর থেকে ইউরোপে খেলতে যাবে? মাই গড! এটা তো আমাদের পক্ষে খুব গর্বের ব্যাপার হবে।”

বুকপকেট থেকে পার্কার ফাউন্টেন পেনটা তুলে নিয়ে তন্ময়ের হাতে দিয়ে বললেন,”মৃন্ময়কে আমার উপহার।”

.

বেঙ্গল লন টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে রাজ্য জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ানশিপ শুরুর দু’দিন আগে খেলার ফিক্সচার দেখে সহদেবের চোখ কুঁচকে উঠল। বত্রিশ জনকে নিয়ে চ্যাম্পিয়ানশিপ হচ্ছে। ফিক্সচারের ওপরের দিকে ষোলো জনের মধ্যে রয়েছে অরুণ মেটা। তলার দিকের ষোলো জনে রয়েছে মিনু, সেইসঙ্গে চিনুও। দু’জনেই যদি তাদের প্রথম দুটো ম্যাচ জেতে তা হলে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হবে দুই ভাই।

সহদেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াবে? সন্দেহ নেই মিনুই জিতবে। চিনু হরিণের গতিতে তার খেলায় উন্নতি করেছে কিন্তু মিনু করেছে চিতাবাঘের গতিতে। দু’জনের মধ্যেকার ব্যবধানটা এতই যে, মিনু তার অর্ধেক খেলা খেলেই চিনুকে স্ট্রেট সেটে হারাবে। কিন্তু এর ফলে কোনও খারাপ প্রতিক্রিয়া ঘটবে না তো? দুই ভাইয়ের মধ্যে এত মনের মিল, একের জন্য অপরের এত ভালবাসা, হরিহর আত্মার মতো দু’জনের সম্পর্ক তাতে চিড় ধরবে না তো?

সহদেব বুঝে উঠতে পারছেন না মিনুর মনে ভাইকে হারিয়ে দেওয়ার দুঃখটা কতখানি বাজবে, কতদিন ধরে তাকে মানসিক অবসাদের মধ্যে রাখবে। চিনুর মনেও অভিমানের মেঘ কতটা জমবে সেটাও তাঁর অনুমানের বাইরে। অবশেষে তিনি ঠিক করলেন ব্যাপারটা ওদের বাবা—মায়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল। বিষয়টি নিয়ে তিনি ছেলে দুটির সামনে আলোচনা করতে চান না, তাই ওরা মায়ের সঙ্গে স্কুলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তন্ময় যখন খেতে বসেছেন তখন সহদেব তাঁকে সমস্যার কথা জানালেন।

তন্ময় শুনেই বললেন,”ফিক্সচারটা বদলানো যায় না?”

”অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন বদলানো যায় না।” সহদেব মাথা নাড়লেন।

”কিন্তু ভাইয়ের হাতে ভাই হারবে এটা তো মেনে নেওয়া যায় না।…যাই হোক, তপতী আসুক, ওঁর সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি করুন।”

তন্ময় বেরিয়ে যাওয়ার পর সহদেব অপেক্ষা করলেন তপতীর ফিরে আসার জন্য। মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনি ফিরলেন।

”দিদি, আপনার জন্যই বসে আছি।” তপতী কিছু বলার আগেই সহদেব কথা শুরু করে দিলেন। তাঁর অপেক্ষা করার কারণটা তপতী শুনলেন। ”এটা নিয়ে এত ভাবার কী আছে? দু’জনকে যদি মুখোমুখি হতে হয়, হবে। সহদেববাবু আপনি অযথাই একটু বেশি বেশি ধরে নিচ্ছেন। খেলাটা ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের তো হবে না, হবে দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে। আপনিই তো বহুদিন ওদের বলেছেন, ‘নেটের ওধারের লোকটা তোমায় খতম করতে চায় তাই তোমার একমাত্র কাজ আগেই ওকে খতম করে দেওয়া। সব সময় ভাববে ও লোকটা তোমার শত্রু, ও তোমায় দয়া করবে না। তুমিও কখনও দয়া দেখাবে না।’ সহদেববাবু এখন কি ওদের অন্যরকম কিছু বলবেন?”

সহদেব চুপ করে রইলেন।

।।৯।।

প্রথম রাউন্ডের ষোলোটি ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই বোঝা গেল অন্তত পঁচিশজন খেলোয়াড়ের এই চ্যাম্পিয়ানশিপে খেলার কোনও যোগ্যতা নেই। মিনু তার প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাল ৬—০, ৬—০। ষোলোটা ‘এস’ সমেত সে ম্যাচটা শেষ করল পঁয়ত্রিশ মিনিটে। চিনু জিতল ৬—১, ৬—২। দ্বিতীয় রাউন্ডে মিনু জিতল ৬—১, ৬—০, চিনু হারাল তার থেকে পাঁচ বছরের বড় একজনকে ৬—৩, ৬—১।

কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার আগের রাতে যখন ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া বিশ্বচরাচর নিঝুম, তখন মিনু হাত বাড়াল পাশের খাটের দিকে। চিনুর কাঁধে তার আঙুল ঠেকল।

”ঘুম আসছে না?”

”না।”

”কী ভাবছিস?”

”অনেকদিন আগে আমায় কুকুরে তাড়া করেছিল। তুই আমাকে আড়াল করে ঘুঁসি চালাচ্ছিলি। একটা লোক এসে কুকুরদুটোকে তাড়িয়ে দিল। তুই আমাকে পরে বললি ‘ভয় কী রে, আমি থাকতে ভয়ের কিছু নেই।’ এখন আবার বলবি কথাটা।”

”কেন?”

”আমার খুব ভয় করছে। কাল তুই বোধ হয় ইচ্ছে করে হেরে যাবি।”

মিনু হাত টেনে নিল। অনেকক্ষণ পরে সে বলল,”কাল আমি জিতব।…এবার ঘুমো।”

তপতী আর তন্ময় ইচ্ছে করেই দুই ছেলের খেলা দেখতে কলকাতায় গেলেন না। সন্ধ্যায় সহদেবের সঙ্গে তারা ফিরতেই বাবা—মা প্রথমেই দুই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে খেলার ফল বোঝার চেষ্টা করলেন। দু’জনের মুখেই তৃপ্তির ছোঁয়া লেগে। তাঁরা সহদেবের দিকে তাকালেন। সেখানেও সুখের আভাস।

”সিক্স—থ্রি, সেভেন—ফাইভ। চিনু যে এমন খেলা খেলবে ভাবতে পারিনি। আপনারা যদি যেতেন তা হলে খেলার মতো খেলা একটা দেখতে পেতেন। কোর্টের ধারে অন্তত জনা ষাটেক লোক জমে গেছল। এত লোক এখনও কোনও ম্যাচে হয়নি। সেকেন্ড সেটটা নরেশকুমার দেখে বলল, ছোটভাইয়ের টাচ খুব ভাল, কৃষ্ণনকে মনে পড়িয়ে দেয় কিন্তু পাওয়ার আর স্পিড এই দুটোতেই ও বড় ভাইয়ের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। এমন হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ দেখে কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে এরা দুই ভাই! রীতিমতো লড়ে মিনুকে জিততে হয়েছে।”

”যাক, আমার দুশ্চিন্তা দূর হল, বোধ হয় আপনারও।” তপতী বললেন সহদেবকে।

”কোথায় দূর হল, এখন তো চিনুর স্পিড আর পাওয়ার নিয়ে আমায় ভাবতে হবে। এখানে দু’জনের মধ্যে খেলায় তো এমন প্রচণ্ডভাবে ভেতরের জিনিস বেরিয়ে আসে না, যা আজকে দেখা গেল।”

.

আম্পায়ারের উঁচু চেয়ারের দু’পাশে দুটি চেয়ার। তার একটি মৃন্ময় বসুমল্লিকের জন্য,অপরটি অরুণ মেটার।

মিনু তার র‌্যাকেট কভারের চেন টেনে খুলল। সারের উপদেশ মনে পড়ল,’যতক্ষণ না রেডি হচ্ছ ততক্ষণ কোর্টে নামবে না।’ বাঁ কব্জিতে সোয়েটলেটটা আর একবার ঘুরিয়ে একটু তুলল। এখন তার দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এসেছে। র‌্যাকেটটা চোখের সামনে ধরে হাতের তালুতে আঘাত করে তাঁতের বাঁধন টানটান আছে কি না অনুভব করল। বাতাসে কয়েকবার সে র‌্যাকেট চালিয়ে ব্যাকহ্যান্ড ও ফোরহ্যান্ড মারল।

”দেয়ার উইল বি আ থ্রি—মিনিট নক আপ।” আম্পায়ার জানিয়ে দিলেন দু’জনকে।

মিনু প্রথম বল মারার আগে হাতের খিল ছাড়াবার জন্য র‌্যাকেটটা ঘোরাতে লাগল। অরুণ বেস লাইনে এগিয়ে গেছে। এরপর দু’জনে র‌্যালি শুরু করতেই মিনুর হাতের আড়ষ্টতা কেটে যেতে লাগল। চারপাশের দর্শক, বাবা—মা, সার আর চিনুকে চোখের বাইরে রেখে ধীরে ধীরে সে তার দৃষ্টিকে গুটিয়ে আনল সাদা লাইন কাটা ঘাসের জমির মধ্যে, যে জমিতে শুধু টেনিস বল আর অরুণ মেটাকে নিয়ে এবার সে থাকবে।

”ওয়ান মোর মিনিট।”

অরুণ পরপর দুটো ভলি নেটে মারল। মিনুর মনে হল ও ভাল করে হাতটা তুলতে পারছে না, বল নজর করতেও যেন ওর অসুবিধে হচ্ছে।

প্রথম সার্ভ করল অরুণ। মিনু একটা পয়েন্টও নিতে না দিয়ে ওর সার্ভিস ভেঙে নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ২—০ গেমে এগিয়ে গেল।

পরের দুটো গেম, মিনুর সার্ভিস ভেঙে অরুণ দখল করল। ২—২—এর পর পঞ্চম গেমে শুরু হল যেন তলোয়ারের খেলা। ভোঁতা ডগার তলোয়ার নিয়ে ওলিম্পিকসে যে প্রতিযোগিতা হয়—এই বাড়িয়ে দিচ্ছে,পাঁয়তারা করছে, ঝনঝন ঠোকাঠুকি হচ্ছে, একে অপরকে বুঝে নিচ্ছে—সেইভাবে যেন তারা খেলতে শুরু করল। ৩—৩, ৪—৪, ৫—৫। এর পরই খোঁচাখুঁচি আর আত্মরক্ষার ভঙ্গিটা বদলে এসে গেল আক্রমণ। এবার ভোঁতা ডগার তলোয়ারের বদলে ওদের হাতে উঠে এল তীক্ষ্ন ডগার ধারালো ফলার বাঁকা তলোয়ার। বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে এবার তারা নিধনের জন্য মেতে উঠল।

মিনুর কপাল থেকে গাল আর নাকের দু’ধার দিয়ে ঘাম ঝরছে। আঙুল দিয়ে কপাল থেকে ঘাম মুছল। সে জানে অরুণের থেকে তার শরীর মজবুত, ফুসফুসের ক্ষমতাও বেশি। এখন তাকে শুধু একটা কাজই করতে হবে—কোর্টে টিকে থাকা আর অরুণকে ছুটিয়ে খাটিয়ে ধীরে ধীরে যন্ত্রণার মধ্যে নিয়ে ফেলা।

প্রথম সেট মিনু জিতল ৭—৫। দ্বিতীয় সেট অরুণ পেল ৮—৬। তৃতীয় সেটে আবার শুরু হল জাঁতাকলে পেষাই। ঘাসের কোর্টে খেলার ধরন হয় সার্ভ আর ভলি, পয়েন্ট জেতা হয় খুব অল্প সময়ে। কিন্তু মিনু খেলার ধরনটা এমনই মন্থর করে দিয়েছে যেন খেলা ক্লে কোর্টে। বুদ্ধিটা, বলাবাহুল্য, সহদেবের। অরুণকে তার স্বাভাবিক খেলা খেলতে না দেওয়ার জন্যই এই কৌশল। কিছুদিন আগেই সৈদুলের কাছ থেকে সহদেব শুনে নিয়েছেন অরুণ সহনশীলতা বাড়াবার জন্য দৌড়য় না। ওকে অবসন্ন করে শেষ করে দেওয়ার নির্দেশ মিনুকে তিনি দিয়েছেন।

এখন দু’জনেই পরীক্ষায় নেমেছে শরীর আর মন কতক্ষণ কষ্ট সইতে পারবে তাই নির্ধারণের জন্য, কতক্ষণ অরুণ মনে রাখতে পারবে খেলায় সে জিততে চায়। যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মিনুর আগে আগুনের ওপর থেকে সে কখন হাত সরিয়ে নিয়ে জেতার বাসনা জুড়িয়ে ফেলবে, তারই খেলা চলেছে।

অরুণ বুঝতে পেরেছে মিনুর কৌশল। মরিয়া হয়ে এবার সে চেষ্টা শুরু করল দ্রুত পয়েন্ট জেতার জন্য। র‌্যালি কমিয়ে একটা মার থেকেই পয়েন্ট জেতার জন্য সে শট নিতে থাকল। কোর্টের এধার—ওধার থেকে প্রায় অসম্ভব শট ছোটাছুটি করে নিল। মিনুর র‌্যাকেট ধরা মুঠোয় আঙুলের ছাল উঠে গেছে। জড়ানো টেপের ফাঁক দিয়ে ঘাম ঢুকে আঙুল জ্বলছে। সে মুঠো শক্ত করল।

দর্শকরা শ্রান্ত হয়ে পড়ছেন টেনশনের জন্য। নিশ্বাস ধরে রেখে বেশিক্ষণ খেলা দেখা যায় না। অনেকে চেয়ার থেকে উঠে কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন, তখন কোর্টে খেলোয়াড় দু’জনও তাদের কাঁধে, তাদের মুঠোয়, পায়ের তলায় এবং হাজার হাজারবার সার্ভিস করায়, পাঁচ—ছ’ মাইল দৌড়োনোয় সাহায্য করা পেশিগুলোয় সেই শ্রান্তি বোধ করছে। বোধ করেও তারা কোর্টে দাঁড়িয়ে। পরস্পরের দিকে ওত পেতে। একে অন্যকে ডাইনে বাঁয়ে ছোটাচ্ছে,পেছনে হটাচ্ছে, নেট থেকে ঠেলে দিচ্ছে, শরীরকে শাস্তি দিচ্ছে, ক্রমশ চুপসিয়ে আসছে এবং এইরকমই চলবে যতক্ষণ না কোনও একজনের পেশির ওপর থেকে তার মস্তিষ্ক কর্তৃত্ব হারায়।

অরুণের মস্তিষ্ক তার দুই পা, দুই হাত এবং দুই চোখের কাছে কাজ করার দাবি জানাতে লাগল। কিন্তু পা দুটো মন্থর হতে শুরু করেছে, হাত দুটো দুর্বল হয়ে পড়ছে আর চোখ দুটো সেকেন্ডের ভগ্নাংশের দেরিতে বল দেখছে।

মিনু এবার সংহার শুরু করে দিল। ফেরত দেওয়া অসম্ভব, এমন কিছু সার্ভ আর ভলি পরপর মেরে সে অরুণকে ব্যতিব্যস্ত করল; আর অরুণের সার্ভগুলো গুঁড়িয়ে ভলিগুলোকে ঘুসিয়ে, আঘাতের পর আঘাত হেনে গেল যতক্ষণ না ১১—৯—এ অরুণ পরাজয় মানতে বাধ্য হল।

কোর্ট থেকে বেরিয়ে এষস মিনু চেয়ারে বসল। কথা বলার, জল খাওয়ার, এমনকী হাসার মতো ক্ষমতাও তার নেই। মুখটা ফ্যাকাসে, চোখ বসা। বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। সহদেব জলের বোতল হাতে দিয়ে বললেন,”এখন চুপ করে বসে থাকো।”

সৈদুলের কাঁধে হাত রেখে ছাপান্ন গেম খেলা শ্রান্ত দেহটাকে টানতে টানতে প্রাক্তন রাজ্য জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ান হেঁটে চলে গেল ড্রেসিং রুমে।

তপতী আঁচল দিয়ে মিনুর মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,”কষ্ট হচ্ছে?”

মিনু মাথা নাড়ল। মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,”মা,আমি জিতেছি।” তার মুখে পাতলা একটা হাসি ভেসে উঠল। ”মা, তুমি খুশি?”

তপতী বুকে টেনে নিলেন ছেলের মুখ। চুম্বন করলেন ছেলের মাথা আর আশীর্বাদ জানালেন চোখের জল দিয়ে।

বিজয়ীর ট্রফি মিনু নিল ভাস্কর মুখার্জির হাত থেকে। ট্রফি দেওয়ার পর তিনি মৃদুস্বরে বললেন,”সামনের মাসে জুনিয়ার ন্যাশনাল বাঙ্গালোরে, জিতে আসতে পারবে তো?”

”চেষ্টা করব।”

খবরের কাগজের ফোটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশ বালব মুহুর্মুহু ঝলসাল। বহু অপরিচিত লোক মিনুর পিঠ চাপড়ে বলে গেলেন:”দারুণ খেলেছ।”

দাদার ট্রফিটা বুকে জড়িয়ে ধরে চিনু তার মাকে বলল,”এবার কি স্কুলে নিয়ে গিয়ে দেখাতে পারি?”

”না, কারও দেখার ইচ্ছে হলে আমাদের বাড়িতে এসে দেখে যাবে।”

তন্ময় একবার বললেন,”রাজেন এই সময়ই দেশের বাইরে। থাকলে খুব খুশি হত।” চার মাসের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে রাজেনকে স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে পাঠিয়েছে এম জে টি এম। শুভ্রা, ব্রজেনবাবু ও তাঁর স্ত্রী এখন রয়েছেন বাংলোয়। ”কাল বাংলা, ইংরেজি সবক’টা কাগজ কিনতে হবে, রাজেন এলে দেখাব।” আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে যোগ করলেন ”দুটো করে কিনতে হবে।”

”সরি সৈদুল।” সহদেব হাত ধরে বললেন।

”কনগ্রাচুলেশনস দেবুদা। আমি কিন্তু খুশি হয়েছি মৃন্ময় জেতায়। ছেলেটা অনেক উঠবে।”

”খেটেছে তাই উঠেছে, আরও খাটলে নিশ্চয় উঠবে।”

”আমিও কোচিং করি দেবুদা,ওর খাটনির পেছনে আর একজনকেও যে খাটতে হয়েছে সেটা বুঝতে পারি। তুমি ভাগ্যবান তাই এমন ছেলে পেয়েছ, আমি কুড়ি বছরেও পেলাম না।”

পরদিন বহু লোক এলেন অভিনন্দন জানাতে। কাপটা রাখা হয়েছে বাসর ঘরের টেবলে। সকালেই এসেছিলেন সুভাষ আর বরুণা সেন। তাঁরা ছোট্ট একট পোর্সেলিন টব হাতে করে আনলেন, তাতে একটা পাতাবাহার গাছ। গাছটায় কচুপাতার মতো পাতা, তাতে অজস্র সিঁদুরে টিপ। মিনুর হাতে দিয়ে সুভাষ বললেন,”তোমার জন্য আমাদের ভালবাসা এই গাছটার সঙ্গে বাড়বে।” মিনু প্রণাম করল।

এলেন রাজেনের বাবা ব্রজেনবাবু। বগলে দাবার বোর্ড আর ঘুঁটির বাক্স। তপতীকে বললেন,”বউমা, তুমি আমার পার্টনারকে কেড়ে নিয়ে গেছলে, তারপর থেকে আমি আর দাবা খেলি না, এগুলো মিনুকে দিয়ে যাচ্ছি। কবে সরে যাই তার ঠিক নেই। টেনিস থেকে রিটায়ার করার পর এই বোর্ড পেতে মিনু খেলবে আর আমাকে মনে করবে।” মিনুকে বুকে জড়িয়ে বিশালদেহী বৃদ্ধ মানুষটি বললেন,”সেই ছোট্ট মিনু আজ কত বড়টি হয়ে গেছে!”

চিনু ফিসফিস করে মাকে বলল,”আজ কি আমরা স্কুলে যাব?”

”যাওয়ার সময় তো পার হয়ে গেছে, ক’টা বাজে দেখেছিস?”

”সার বলেছেন দু’দিন ওয়ার্ক আউট বন্ধ থাকবে, উনি বুধবার থেকে আসবেন। আমরাও কি তা হলে বুধবার থেকে স্কুলে যাব?”

”না। কালই যাবে। এই ক’দিন কেউ বই নিয়ে বসোনি।” তপতী মনে রেখেছেন হেডমাস্টারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি।

কান্তি এল শালপাতার ঠোঙা ভর্তি গুজিয়া নিয়ে। সেটা মিনুর হাতে দিয়ে বলল,”খেও। একদিন দুটো মিষ্টি খেলে মা কিছু বলবে না।” কান্তি তপতীর দিকে তাকিয়ে সম্মতি দিতে মিনতি করল চাহনি দিয়ে।

তপতী হেসে বললেন,”খাও।”

”অত! ওইটুকু ছেলে খাবে?” তন্ময় ঠোঙাটা মিনুর হাত থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিলেন।

”তুমি অফিস যাবে না? চান করে খেতে বোসো, ক’টা বাজে দেখছ?” তপতীর স্বরে কিছু একটা ছিল যেজন্য তন্ময় ঠোঙাটা মিনুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,”তাই তো, এখন তো ভাত খেতে হবে।”

বারোটা নাগাদ হইহই করে জনা দশেক ছেষল হাজির হল। মিনুর ক্লাসের বন্ধু। কী ব্যাপার?

”মৃন্ময়, আজ স্কুলে যাসনি কেন?”

”আজ থার্ড পিরিয়ডের পর স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, তোর জন্য।”

আনন্দ আর লজ্জায় আপ্লুত মিনু শুধু বলল,”য্যাহহ!”

”নোটিসে কী লিখেছে জানিস?…গর্বের সঙ্গে আমরা জানাচ্ছি আমাদের স্কুলের ছাত্র—”

”থাক, থাক, আর বলতে হবে না।” মিনু থামিয়ে দিল।

”কেন বলতে হবে না?” চিনু প্রতিবাদ করল। ”কী সব কথা শুনতে হয়েছে ভুলে গেছিস?”

বন্ধুদের প্রত্যেকে ট্রফিটা হাতে নিল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। ট্রফির গায়ে লেখা কথাগুলো পড়ল। সারা বাড়ি ভরে গেল খুশির কলকল উচ্ছ্বাসে। কান্তির গুজিয়াগুলোর সদ্ব্যবহার করলেন তপতী প্রত্যেকের হাতে একটা করে তুলে দিয়ে।

রাত্রে শোবার আগে ছেলেরা দুধ খায়। তপতী দুটো গ্লাস হাতে নিয়ে ছেলেদের ঘরে ঢুকতে গিয়ে ভেতর থেকে আসা চাপা স্বরের কথা শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন।

”না না, অনেক টাকা… এখন বলতে হবে না।”

”মোটরে স্কুলে যেতে ভাল লাগে? লজ্জা করে না? দুটো সাইকেলের কত আর দাম হবে?”

”যতই হোক…বাবার কষ্ট হবে, মারও।”

গলাখাঁকারি দিয়ে তপতী ঘরে ঢুকলেন। ”অনেকেই তো উপহার দিল, আমি কিছু দেব না।”

ওরা অবাক হল। মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

”আমি তো ভাবছি, মিনু তো বড় হয়েছে, এবার দেখেশুনে সাইকেল চালাতে পারবে।”

”মা, আমিও বড় হয়েছি।” চিনু তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল।”

”হয়েছিস নাকি!” তপতী গম্ভীর হলেন। ”মিনু, ওর পাশে দাঁড়া তো।”

মিনু দাঁড়াল চিনুর পাশে। পলকের জন্য তপতী চোখ নীচে নামালেন। ”চিনু গোড়ালি নামা।”

ধীরে ধীরে চিনুর উচ্চচতা হ্রাস পেল।

পরদিন সকালে তন্ময় গাড়ি বার করলেন, তপতীও উঠলেন।

বাবাকে স্টিয়ারিংয়ে বসতে দেখে ওরা অবাক! গম্ভীর মুখে তন্ময় বললেন,”একটা জরুরি দরকার, আমাদের কলকাতায় যেতে হবে।” দুই ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ওঁরা চলে গেলেন কলকাতায়। স্কুল ছুটির পর ছেলেদের গাড়ি করে আনলেন তপতী। তিনি গাড়ি গ্যারাজ করতে করতে শুনলেন দুই ভাইয়ের উল্লসিত চিৎকার। বাড়িতে ঢুকছেন যখন, ছুটে বেরিয়ে এল দুই ভাই। মিনু দু’হাতে মায়ের হাঁটু জড়িয়ে মেঝে থেকে দু’ ফুট ওপরে তাঁকে তুলে বনবন পাক দিতে লাগল। ঘুরে ঘুরে দু’ হাত তুলে নাচছে চিনু।

”ওরে ছাড় ছাড়, আমার পায়ে ব্যথা।…মাথা ঘুরছে।”

”আমাদের ট্রফি,…মা আমাদের ট্রফি…।” চিনু সুর করে গেয়ে চলেছে। ”হিপ হিপ হুররে…মা আমাদের ট্রফি, আমরা বড় হয়েছি…মাকে ট্রফি পেয়েছি…।”

”মা কখনও ট্রফি হয় নাকি!” তপতী দুহাতে মাথা টিপে ধরে বড় বড় চোখে বললেন।

”হয়, আমাদের মা হয়।” মিনু বলল।

”আমাদের কাছে তুমি আমাদের ট্রফি।” চিনু যোগ করল। ”এর থেকে সেরা ট্রফি আর কিছু নেই।”

”তোরা ট্রফি পেলি, আর আমার ট্রফি তা হলে কোথায়?”

দুই ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তপতী হাসতে হাসতে বললেন,”একটা নয়, আমার দুটো ট্রফি।”

দু’হাতে তিনি দুই ছেলেকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন,”মিনু এরপর ভারতের জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন হবে তারপর হবে সিনিয়র চ্যাম্পিয়ন…..তারপর উইম্বলডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া…..লোকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আমাকে বলবে ওই যে মৃন্ময়ের মা।”

”চিন্ময়ের মা বলবে না?” চিনু ভারী গলায় অভিমানী স্বরে বলল।

”বলবে, দাদার পরেপরেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠে আসবে ভাই। আমরা তো এত বছর সেই স্বপ্নই দেখেছি রে।” তপতীর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ল।

ভেতর থেকে তখন বেলার গজগজানি শোনা গেল। ”খাবার ঘরে এ দুটো রাখা চলবে না,তা হলে কিন্তু চারটে চাকাই ফুটো করে দোব।”

ধানকুড়ির কিংকং

ধান্যকুড়িয়া প্রাথমিক আদর্শ শিশুশিক্ষা নিকেতনের প্রধানা শিক্ষয়িত্রী দেবিকা ঘোষাল মাথা নামিয়ে নিবিষ্ট মনে ক্লাস ফোরের অঙ্কের ফাইনাল পরীক্ষার খাতায় দেওয়া নম্বরগুলো স্ক্রুটিনি করছিলেন। চল্লিশটার মধ্যে তেরোটা দেখা হয়েছে এবং নম্বর যোগ দেওয়ায় তিনটি ভুল আবিষ্কার করেছেন। ঠিক এমন সময়ই তিনি শুনলেন, ”বড়দিদিমণি আসব?”

দেবিকা মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, ”আসুন।” আবার খাতা দেখতে শুরু করলেন।

যিনি বললেন ”বড়দিদিমণি আসব” তিনি বছর ষাটের সাদা থান কাপড় পরা বেঁটেখাটো স্থূলকায় ধীর শান্ত নম্র স্বরের সুলতা মণ্ডল। ধানকুড়ির (ধান্যকুড়িয়ার এটাই ডাকনাম) অন্তত সত্তরভাগ মানুষ তাঁকে চেনেন এবং বড়দিদিমণিও তাঁর নাম শুনেছেন এবং এই চেনা ও শোনার কারণটা পরে বলা যাবে।

মুখ নামিয়েই দেবিকা বললেন, ”বলুন মাসিমা।”

ইতস্তত করে সুলতা বললেন, ”আমার নাতিটাকে ভর্তি করাতে এনেছি।”

”কোথায় নাতি?”

”এই তো।” সুলতা মুখ ফিরিয়ে দেখালেন।

দেবিকা মুখ তুলে দেখলেন লম্বা একট কিশোর। ঘোর কালো গায়ের রং। নাকটি ভোঁতা, ঝাঁকড়া রুক্ষ চুল। সারল্য ও বোকামি মুখে মাখানো। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন গ্রামাঞ্চলে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া একটু বেশি বয়সেই শুরু করে। কিন্তু এত বড় ছেলে তো শিশুশিক্ষা নিকেতনের অর্থাৎ প্রাইমারি স্কুলের পক্ষে অত্যন্ত অনুপযুক্ত।

দেবিকা হেসে বললেন, ”মাসিমা, দশটার পর এসে বড়বাড়ির হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করুন।”

প্রাথমিক স্কুলের টালির চালের তিনখানি ঘরকে বলা হয় ছোট বাড়ি আর তার পঞ্চাশ গজ দূরের দোতলা মাধ্যমিক স্কুলটিকে বলা হয় বড়বাড়ি।

”না, না, আমি কালীকে বড় স্কুলে নয়, এখানে ভর্তি করাব বলেই এনেছি।” সুলতা ব্যস্ত হয়ে বললেন।

দেবিকা কপাল কুঁচকে জানতে চাইলেন, ”বয়স কত?”

উত্তরে যা শুনলেন তাতে চেয়ার থেকে ওঁর পড়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু পড়লেন না কেন না উনি খুব শক্ত ধাতের মহিলা, তবে টেবলের কোনা চেপে ধরে বিস্ফারিত চোখে শুধু বললেন, ”আপনার নাতির বয়স ছয়।”

সুলতাও অবাক স্বরে বললেন, ”হ্যাঁ। ছয়। আমি ওর বাথ সাট্টিফিকেট সঙ্গে করে এনেছি। কালী তো জন্মেছে এখানেই, এই তো আমাদের মিনিসিপ্যাল হাসপাতালে মেয়ের পেট কেটে ওকে বার করতে হয়েছিল। যমে মানুষে সে কী টানাটানি! ডাক্তারবাবুও খুব শক্তপোক্ত ছিল, যম একদম সুবিধে করতে পারেনি। একমাস পর জামাই এসে মা—ছেলেকে সুন্দরবনের মৌসুনীতে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়।” বলতে বলতে সুলতা ধান্যকুড়িয়া মিউনিসিপ্যালিটির দেওয়া বার্থ সার্টিফিকেট কাগজটা খাম থেকে বার করে এগিয়ে দিলেন।

দেবিকা তিনবার জন্মতারিখটা দেখে মনে মনে দ্রুত একটা অঙ্ক কষে ফলটা বার করে নিলেন, কালীর বয়স আজ ছ’বছর দুশো দশ দিন। আড়চোখে ঘরের বাইরে দাওয়ায় মাদুরে—বসা পাঁচ ছয় বছরের ছেলেমেয়েদের একবার দেখে নিলেন তিনি।

বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে শক্তধাতের বড়দিদিমণি এবার কৌতূহলী হয়ে পড়লেন।

”নাতি কতটা পড়েছে, মানে অ আ ক খ, এক দুই তিন চার কাকে বলে জানে?”

”জানবে কী করে? আমার মেয়ে তো তিন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে, আমার মতো তো পেরাইমারি পাশ করেনি আর জামাই…. ” সুলতা এধার—ওধার সন্তর্পণে তাকিয়ে এগিয়ে এসে টেবলে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, ”কাউকে বলবেন না কথা দিন।”

”দিলুম।”

সুলতা এবার গলা আরও নামিয়ে বললেন, ”ডাকাত।”

দেবিকাও ফিসফিস করে বললেন, ”কে ডাকাত?”

”আমার জামাই। মাধ্যমিক পাশ, লেখাপড়া জানা।”

খবরটা শুনে বড়দিদিমণি যতটা শিহরিত হলেন ততটা আতঙ্কিতও। কিন্তু তিনি শক্ত ধাতের মানুষ, ঘাবড়ালেন না।

”আপনি ডাকাতকে জামাই করলেন?”

সুলতা এবার বিরক্ত হয়েই বললেন, ”আমি কেন জামাই করতে যাব? ও তো নিজে থেকেই জামাই হল, শিবু এখানে এসেছিল একটা খোঁজখবর করতে, নস্করবাড়িতে ডাকাতি করবে বলে। তখনই ওর চোখে পড়ে যায় আন্না, আমার মেয়ে এই কালীর মা, দারুণ কবাডি খেলত। নস্করবাড়ির সেজো মেয়ের বন্ধু, ডাকাতির সময় সন্ধেবেলা ওদের বাড়িতে আন্না তখন লুডো খেলছিল। মেয়েদের গা থেকে গয়না খুলতে খুলতে শিবু আন্নার সামনে এসে বলল, ”খোল নাকছাবি, নয়তো নাক কেটে নোব।”

”তারপর?” উদগ্রীব দেবিকা।

”তারপর আর কী, ”নির্বিকার মুখে সুলতা বললেন, ”আন্না টেনে এমন একটা চড় কষাল, শিবু ছিটকে পড়ল।”

”তারপর?” দেবিকা উত্তেজিত। ”ডাকাত চড় খেয়ে ছিটকে পড়ল? ওরে বাব্বা।”

”পড়বে না? আন্নার থাবাটা তো আপনি দেখেননি, এই অ্যাত্তো বড়।” সুলতা দু’হাতের পাঞ্জা পাশাপাশি রেখে দেখালেন।

”তারপর?”

”তিনদিন পর রাতে আমার বাড়িতে ডাকাত পড়ল, কালো কাপড় দিয়ে সবগুলোর মুখ ঢাকা। আমাকে শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় শেকল তুলে দিল। জানালা দিয়ে চিৎকার করে লোকজন ডাকতে লাগলুম। আমার বাড়ি তো গ্রামের একটেরেয় একেবারে কিনারে, মাঠ বনজঙ্গল পেরিয়ে লোক আসতে আসতে ততক্ষণে ডাকাতরা চলে গেছে।”

”জিনিসপত্র গয়নাগাটি টাকাকড়ি সব সাফ করে নিয়ে গেল তো?”

”একটা জিনিসও নেয়নি, যেখানে যা ছিল সব ঠিকঠাক রয়েছে, শুধু আন্না নেই।”

”সে কী।” দেবিকা আঁতকে উঠলেন। ”মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল? কেন, চড় মারার বদলা নিতে? মানে খুন করার জন্য?”

”চড় খেয়ে শিবুর টনক নড়ে, তখনই বুঝে যায় এই মেয়েই ডাকাতের বউ হবার উপযুক্ত। তা ছাড়া খুন করে দিলে কি কালী জন্মাত?” সুলতাকে একটু বিরক্ত দেখাল।

”খুন করতে চাইলে তুলে নিয়ে যাবে কেন, বাড়িতেই তো দায়ের এক কোপে আন্নার মুণ্ডুটা নামিয়ে দিতে পারত।”

অপ্রতিভ দেবিকা বললেন, ”তা বটে। আচ্ছা আপনার জামাই ক’টা মুণ্ডু আজ পর্যন্ত নামিয়েছে?”

”তা আমি কী করে বলব, চোখে তো দেখিনি। আর এখনকার ডাকাতরা দা কাটারি সড়কি নিয়ে তো ডাকাতি করে না, এখন তো বোমা বন্দুক মোটরবাইক পিস্তলের যুগ।”

”আপনার মেয়ে আপনার কাছে এখন আসে।”

”খুব কম। কলকাতার বউবাজারে ফেলাট কিনেছে শিবু। আন্না সেখানেই থাকে, বাচ্চচা একটা মেয়েকে নিয়ে। শিবু এখন কলকাতাতেই দল করে কারবার চালাচ্ছে। আন্না ছেলেকে আমার কাছে দিয়ে বলে গেছে, ‘মা তুমি ওকে মানুষ করো, আমার কাছে থাকলে কালীকে ডাকাত বানাবে ওর বাপ। একদিন ওর হাতে একটা পাইপগান দিয়েছিল তোমার জামাই, খেলা করার জন্য।’ শুনে কী বলব বড়দিমণি, বুকটা ধড়াস করে উঠল। আন্নাকে বললুম ভাল করেছিস, কালী আমার কাছেই থাকুক। ওকে পাঠশালায় পড়াব তারপর বড় ইস্কুলে তারপর কলেজে। ভদ্দর সমাজে মেশার উপযুক্ত করে তুলব।”

সুলতা দু’পা এগিয়ে ঝুঁকে বড়দিদিমণির দুটো হাঁটু চেপে ধরে বললেন, ”আপনি কালীকে রক্ষে করুন, নইলে শিবু ওকে নিয়ে গিয়ে ডাকাত বানাবে। দয়া করুন বড়দিমণি।”

শান্ত মানুষ দেবিকা সিঁটিয়ে গেছেন। উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি বললেন, ”আপনি একদম চিন্তা করবেন না। কাল ওকে নিয়ে আসুন। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে নেব।”

”না বড়দিমণি ওয়ান বড্ড নিচু কেলাস, কালীকে ফোর নয়তো থিরিতে ভর্তি করে নিন।”

”সে কী! অ আ ক খ, এক দুই তিন, চার যে শেখেনি তাকে একেবারে থ্রি, ফোরে ভর্তি করে নিলে আমার তো চাকরি থাকবে না।”

”থাকবে সে ব্যবস্থা শিবুকে দিয়ে আমি করব। কালী কী পরিশ্রমী আর বাধ্য আপনি জানেন না। একবার যদি মনে করে অ—আ থেকে বিসগ্য চন্দবিন্দু মুখস্ত করব তা হলে না খেয়েদেয়ে দিনরাত পড়ে তিনদিনেই গড়গড়িয়ে মুখস্ত বলে দেবে। তিনদিনে পাঁচঘরের পর্যন্ত নামতা পড়ে দেবে।”

চমৎকৃত দেবিকা বললেন, ”আপনি কাল আসুন তো তারপর দেখা যাবে।” বলেই তিনি আড়চোখে কালীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন। হাফ প্যান্ট হাওয়াই শার্ট পরা ছেলেটি তখন থেকে পাথরের মূর্তির মতো একভাবে দাঁড়িয়ে। মিষ্টি হেসে বললেন, ”তোমার নাম কী খোকা?”

সর্দি হওয়ায় কালীর কণ্ঠস্বর ঘড়ঘড়ে হয়ে রয়েছে। সে নাম বলল। বাল্যকালে পুকুরে স্নান করার সময় দেবিকার কানে জল ঢুকে তাঁর শ্রবণ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। তাই তিনি কালীর কথা ভাল করে বুঝতে পারলেন না। বললেন, ”কী নাম তোমার? কালী, তারপর কী যেন বললে?”

কালী আবার ঘড়ঘড়ে স্বরে বাকিটা বলল।

দেবিকা একটু অবাক হয়ে বললেন, ”কালী কিং কং? অদ্ভুত পদবি তো।” সুলতা দ্রুত ভুল শুধরে দিলেন, ”না গো বড়দিমণি, কিং কং নয়, কিং কং নয় কিঙ্কর, কালীকিঙ্কর ঢালি। বাবার নাম শিবশঙ্কর ঢালি।”

”ওর হাইট কত, মানে লম্বা কতটা?”

”এই তো দেখতেই পাচ্ছেন।”

”তা তো পাচ্ছিস, তবে কত ফুট কত ইঞ্চি?”

”অতশত জানি না।” সুলতা কিঞ্চিৎ বিড়ম্বিত স্বরে বললেন, ”আজ তক্তপোশে শুইয়ে মাপব ক’হাত লম্বা। কাল আপনাকে জানাব।”

পরের দিন কালীকে সঙ্গে নিয়ে সুলতা শিশুশিক্ষা নিকেতনে হাজির হলেন। দেবিকা তখন ক্লাস নিচ্ছিলেন। ওদের অপেক্ষা করতে হল। দাওয়ায় মাদুরে বসে ক্লাস ওয়ানের প্রায় ত্রিশটি বাচ্চচা শ্লেটে দাগা বুলোচ্ছে স্বরবর্ণের অক্ষরে। রোগা লম্বা ব্যাজার মুখের এক শিক্ষিকা চেয়ারে বসে । টেবল নেই। তার হাতে বাঁশের একটা ছ’ফুট লম্বা কঞ্চি। দাওয়ার পাশে দাঁড়িয়ে কালী ও সুলতা। দেবিকা ক্লাস ফোরের ঘরে নারকেল দড়িতে দেওয়ালে ঝোলানো কালো বোর্ডে সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক পনেরোটি ছাত্রকে কষে বোঝাচ্ছিলেন। এ ঘরে অবশ্য ছাত্রদের জন্য বেঞ্চ আছে।

ক্লাস ওয়ানের শিক্ষিকা কঞ্চি দিয়ে তৃতীয় সারিতে বসা এক বাচ্চচার মাথায় ঠক করে মেরে ধমকে উঠলেন, ”অ্যাই, তখন থেকে আ—টাকে ঘষে ঘষে মোটা করছিস, যেমন করে দাগ বুলোতে বলেছি সেইভাবে বুলিয়ে বুলিয়ে মোটা কর। ” এরপর তিনি অপেক্ষমাণ দু’জনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকালেন। ভারিক্কি স্বরে বলে উঠলেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কাউকে দরকার?”

সুলতা ঢোঁক গিলে বললেন, ”হ্যাঁ, ভর্তি করাব বলে এসেছি।”

”তাকে নিয়ে আসুন।”

”কাকে?”

”কাকে আবার, যাকে ভর্তি করাবেন তাকে।”

”এই তো সঙ্গে রয়েছে।” সুলতা মাথা হেলিয়ে দেখিয়ে দিলেন। ওয়ানের শিক্ষিকার চোখ—মুখের অবস্থা ঠিক সেইরকমই হল যা গতকাল বড়দিদিমণির হয়েছিল। কয়েক সেকেন্ড কালীর দিকে তাকিয়ে থেকে ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ”কোন ক্লাসে ভর্তি হবে, ফোরে?”

”আমি তো তাই—ই চেয়েছি, কিন্তু বড়দিমণি বললেন, আগে ওয়ানে তো ভর্তি হোক।”

শিক্ষিকার হাতের কঞ্চিটা ধীরে ধীরে নেমে এসে দাওয়ায় ঠেকল। ফ্যালফ্যাল চোখে কালীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক বোঝানো হয়ে গেছে। দেবিকা দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে সুলতাকে দেখতে পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ”এসে গেছেন। রাধা, দ্যাখো তো এই ছেলেটিকে তোমার ক্লাসে ভর্তি করা যায় কিনা?”

রাধা অর্থাৎ ক্লাস ওয়ানের শিক্ষিকার মুখ ইতিমধ্যেই শুকিয়ে গেছে। ক্ষীণস্বরে বললেন, ”দেবীদি, ক্লাস ওয়ানে এ পড়বে?”

”তুমি একটু পরীক্ষা করে দেখো না, হয়তো ক্লাস ফোরেও অ্যাডমিট করা যেতে পারে।”

একটু ভেবে রাধারানি গায়েন জিজ্ঞাসা করলেন কালীকে, ”পদ্য পড়েছ?”

”হুঁ।” কালী মাথা হেলিয়ে দিল।

”জানেন বড়দিমণি, কাল এখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে মর্জিনার বাড়িতে গেছলুম, ওর সেজছেলে রহিম বড় স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। মর্জিকে বললুম রমুকে আমার বাড়িতে একবার পাঠিয়ে দিস তো স্কুল থেকে ফিরলেই যেন কালীকে একটু পড়া করিয়ে দিয়ে যায়। বিকেলে রমু এসে বাদাম আর বাতাসা দিয়ে চালভাজা খেতে খেতে কালীকে আধঘণ্টা পড়িয়েছে। তারপর মাঝরাত্তির পর্যন্ত কালী শুধু বিড়বিড় করে মুখস্থ করে গেছে রমু যা যা ওর কানে ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। বল না কালী সেই পদ্যটা যেটা আমাকে রাত্তিরে শোনালি।”

সুলতা থামামাত্র কালী ঝড়ের বেগে শুরু করল, ”পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল, কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল, রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে, শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে, ফুটিল মালতী ফুল সৌরভ ছুটিল, পরিমল লোভে অলি আসিয়া জুটিল।” এক নিশ্বাসে বলে কালী থমকে গেল। পরের লাইনটা মনে পড়ছে না। মনে করার জন্য চেষ্টা করতে করতে কালো মুখ বেগুনি হয়ে উঠল, কপালে বিনবিনে ঘাম ফুটল, ঠোঁট চাটল, আড়চোখে তাকিয়ে দিদিমার উৎকণ্ঠিত মুখ দেখে আরও ঘাবড়ে গেল।

উৎকণ্ঠিত চোখ রাধারানি গায়েনেরও। ছেলেটা যদি ফেল করে তা হলে দেবীদি তো বলবেন, থ্রি ফোর নয়, ক্লাস ওয়ানেই ভর্তি হোক। আর এতবড় একটা ছেলেকে ম্যানেজ করা কি সোজা ব্যাপার হবে। ”বলো বলো ভয় কী, মনে করো পরের লাইনটা।” রাধারানি অভয় দিলেন স্নেহ বাৎসল্য গলায় ঢেলে।

এবার মনে পড়েছে কালীর। দুটো লাইন বাদ দিয়ে সে তড়বড়িয়ে শেষ দুটো লাইন বলল, ”ওঠো শিশু মুখ ধোও পর নিজ বেশ, আপন পাঠেতে মনে করহ নিবেশ।” বলেই সে যুদ্ধ জয়ের হাসি হাসল।

উদ্ভাসিত মুখে রাধারানি বললেন, ”শুনলেন দেবীদি, শুনলেন, হুবহু সবটা মুখস্থ বলে গেল। সেই কবে বিদ্যাসাগর মশায়ের ”ভোরের কাজ” পদ্যটা ক্লাস ফোরে পড়েছিলুম আমার আজও মনে আছে।”

দেবিকা চোখে হাসি নিয়ে বললেন, ”অঙ্ক জানো? যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ?”

কালী চুপ! সুলতা বললেন ”আধঘণ্টায় আর কতটা পড়া হয়, তবু যতটা পেরেছে অঙ্ক শিখেছে।”

”দেখা যাক। বলো তো পাঁচ আর পাঁচে কত হয়।”

কালী আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে যোগ দিয়ে বলল, ”দশ।”

রাধারানি প্রায় হাততালি দিয়ে বলল, ”দারুণ মাথা। এ তো ক্লাস ফোরের অঙ্ক।”

”এবার বিয়োগ, পাঁচ থেকে পাঁচ বাদ দিলে কত থাকে হাতে?”

কালী একমুহূর্তও না ভেবে বলল, ”শূন্য।”

দেবিকার মুখের হাসি মুছে গেল। সিরিয়াস হয়ে গেল চাহনি। ”পাঁচকে পাঁচ দিয়ে গুণ করলে কত হয়।”

”পঁচিশ।”

দেবিকার এবার যেন জেদ চেপে গেল। বললেন, ”এবার ভাগ। পাঁচকে পাঁচ দিয়ে ভাগ করলে কত হবে ভাগফল।”

এইবার কালী চুপ। দিদিমার দিকে ফ্যাকাসে মুখে তাকিয়ে রইল। বড়দিদিমণি মুচকি হাসলেন, রাধারানি প্রমাদ গুনছেন।

”ভাগফলের অঙ্ক পর্যন্ত পৌছবার আগেই তো রমুর বাটির চালভাজা শেষ। তড়াক করে লাফিয়ে ফুটবল মাঠের দিকে দৌড় দিল, কালী তা হলে শিখবে কী করে? বড়দিমণি আপনি ওকে ফোরেই ভর্তি করান আমি বাড়িতে মাস্টার রেখে ওকে পড়াব। দেখবেন চার বছরের পড়া ও এক বছরে শেষ করে দেবে।”

রাধারানি মাথা নেড়ে সুলতাকে সমর্থন জানিয়ে বললেন, ”অসম্ভব নয়। যে অ আ ক খ, এক দুই তিন চার কী জিনিস গতকালও জানত না, সে গড়গড়িয়ে পদ্য মুখস্থ বলল, যোগ বিয়োগ গুণ পর্যন্ত শেলেট পেন্সিল ছাড়াই করে দিল মাত্র আধঘণ্টার কোচিং নিয়ে। দেবীদি, এ ছেলে চার কেন, পাঁচ বছরের পড়া এক বছরে হজম করে দেবে। এতদিন পড়াচ্ছি অন্তত দুশো ছেলেমেয়ে তো দেখলুম, অভিজ্ঞতাও কম হয়নি কিন্তু এরকম ব্রেন জীবনে দেখিনি।”

দেবিকা চুপ করে কীসব ভাবলেন। মাথা চুলকে বললেন, ”ঠিক আছে ক্লাস ফোরেই পড়ুক, তবে টেম্পোরারি ছাত্র হবে একমাসের জন্য। যদি দেখি প্রোগ্রেস করেছে তবে পার্মানেন্ট স্টুডেন্ট করব। না পারলে ক্লাস ওয়ানে নামিয়ে দোব, রাজি?”

”রাজি।” সুলতা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন।

কালী পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভর্তি হয়ে গেল। বড়দিদিমণি বললেন ”সামনের সোমবার থেকে ক্লাস করুক।” সুলতা যখন ধান্যকুড়িয়া প্রাথমিক আদর্শ শিশুশিক্ষা নিকেতন থেকে বেরিয়ে আসছেন বড়দিদিমণি তখন পিছু ডাকলেন।

”মাসিমা, কালীকে মেপেছেন?”

”ওই দ্যাখো বলতে ভুলেই গেছি। তক্তপোশে শুইয়ে কালকেই মেপেছি, সাড়ে তিনহাত থেকে এই দু’ আঙুল কম। তা হলে কতটা হল?”

”আপনার হাতের মাপ তো পুরুষদের মতো আঠারো ইঞ্চি নয়, একটু কমই হবে। তা হলেও…”বড়দিদিমণি মনে মনে একটা অঙ্ক কষে নিয়ে বললেন, ”পাঁচফুট দু’ইঞ্চির মতো।” তারপরই শিউরে উঠে প্রায় আর্তনাদের মতো বললেন ”সাড়ে /ছ’বছর/বয়সেই এই, তা হলে বারো বছর বয়সে কী দাঁড়াবে!”

কথাগুলো সুলতা বা কালী শুনতে পেল না, তারা ততক্ষণে হাঁটা দিয়েছে বাড়ির দিকে। রাধারানি তখন হঠাৎ ধড়মড়িয়ে প্রায় ছুটে গেলেন সুলতাকে ধরার জন্য।

”মাসিমা, মাসিমা, দাঁড়ান, একটা কথা ছিল।”

অবাক সুলতা দাঁড়িয়ে পড়লেন।

”আপনি তখন বললেন কালীর জন্য মাস্টার রাখবেন।”

”রাখবই তো। আপনার হাতে মাস্টার আছে?”

”আছে। খুব ভাল ছেলে বড়বাড়িতে ক্লাস টেনে পড়ে। খুব গরিব। থাকে আমার পাশের পাড়ায়। কয়েকটা টাকা পেলে ওর খুব উপকার হবে। আমি বলছি খুব যত্ন করে কালীকে পড়াবে।”

”বলছেন ভাল করে পড়াবে? বেশ পাঠিয়ে দেবেন আজ বিকেলে। চেনে আমার বাড়ি?”

”চিনে নেবে, এখানকারই ছেলে তো।”

রাধারানি স্কুলে ফিরে আসামাত্র দেবিকা তাকে ডাকলেন। স্কুলে মোট তিনজন পড়ান। তৃতীয়জন অধীরবাবু ম্যালেরিয়ায় শয্যাশায়ী থাকায় অনুপস্থিত।

”রাধা, ক্লাস ওয়ানকে ছুটি নিয়ে দিচ্ছি। ক্লাস টুকে মাছ আঁকতে বসিয়ে দাও। অঙ্ক দিচ্ছি ক্লাস থ্রিকে, ফোরকে পদ্য মুখস্থ করাও। আর শোনো, যা ভাল করে জানো না সেই বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যেয়ো না। পাখি সব করে রব বিদ্যাসাগর মশায়ের লেখা তোমায় কে বলল? ওটা তো মাইকেলের লেখা, পড়েছ কিছু ওঁর লেখা?”

”বাহ পড়ব না? উচ্চচ মাধ্যমিকে তো পলাশীর যুদ্ধ আমাদের পড়তে হয়েছে।”

.

বিকেলে একটি ছেলে হাজির হল সুলতার বাড়ি। পরনে হাফপ্যান্ট হাফশার্ট। কালী যতটা কালো, ছেলেটি ততটাই ফরসা, কালীর থেকে অন্তত ইঞ্চি চারেকের খাটো, ওজনেও প্রায় দশ কেজি কম।

সুলতা আপাদমস্তক দেখে বললেন, ”আগে তো কখনও দেখিনি, থাকিস কোথায়?”

”শেতলাতলায়।” ছেলেটির কণ্ঠস্বর কোমল ও মিষ্টি, প্রায় মেয়েলি।

”ওটা তো বামুনপাড়া, নাম কী?”

”সুধন্য হালদার। ডাক নাম ধানু।”

”টেন ক্লাসে পড়িস? অঙ্কে কত নম্বর পেয়েছিলিস ক্লাসে ওঠার পরীক্ষায়?”

”একশো।”

”কতোর মধ্যে একশো?” সুলতা হঠাৎ গম্ভীর করে ফেললেন স্বর।

ধাতু ভ্যাবাচ্যাকা। এমন প্রশ্নের মুখে কখনও আগে পড়েনি। উত্তর হাতড়াতে শুরু করল। একটা কথা সে বুঝে গেছে, তার সামনে এখন যে মহিলা লেখাপড়া সম্পর্কে তার কোনও ধারণা নেই কিন্তু কাজটা তার চাই এবং ইনি যাতে বিরূপ না হন এমনভাবে উত্তরটা দিতে হবে।

”একশো পাঁচের মধ্যে একশো।”

”হুমম পাঁচ নম্বর কম।” সুলতার ভুরু কুঁচকে উঠল। ”পুরো নম্বর পাসনি কেন?”

”ওটা নিয়ম। অঙ্ক থেকে পাঁচ নম্বর তুলে রাখা হয়। অন্য কোনও বিষয়ে নম্বর কম পড়লে তখন ওই তোলা নম্বরটা থেকে দেওয়া হয়। আমার নম্বর কম পড়েছিল জীবন বিজ্ঞানে, পাঁচ নম্বর ওখান থেকে দিয়েছিল।”

উত্তর পেয়ে কী বুঝলেন সুলতা, সেটা বুঝতে পারল না ধানু। তবে নম্বরের পথে প্রৌঢ়া আর এগোলেন না। ”তোকে কী করতে হবে ছোটদিদিমণি বলে দিয়েছেন?”

”দিয়েছেন। চার বছরের পড়া এক বছরে করিয়ে দিতে হবে।”

”পারবি?”

”চেষ্টা করব।”

”কী করে চেষ্টা করবি। মারধোর করতে পারবি না কিন্তু। কালী বাচ্চচা ছেলে, সাড়ে ছ’বছর মাত্র বয়স।”

”বাচ্চচাদের আমার খুব ভাল লাগে।”

”কালীকে দেখেছিস?”

”না। তবে রাধামাসির কাছে শুনেছি চেহারাটা একটু বড়সড়।”

”ওকে আগে দ্যাখ, কথা বল, তারপর ঠিক কর ওকে পড়াতে পারবি কি না। ওর মাথাটা খুব ভাল আর ঠাণ্ডা ছেলে, কম কথা বলে। মুশকিল কী জানিস বাবা, এমন একটা গতর ও পেয়েছে, যেজন্য লোকজনের নজর পড়ে ওর ওপর। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। কেউ বিশ্বাস করে না ওর বয়স এত কম। আর সেজন্যই কালী লোকজন এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। মনটা বাচ্চচাছেলের, লোকে তো তা জানে না, তারা বড়ছেলে ভেবে সেইরকম ব্যবহার করে ওর সঙ্গে। তাইতে ও অবাক হয়ে যায়। ওর বয়সিরা ওর সঙ্গে মিশতে চায় না, খেলতে চায় না। মনে মনে সেজন্য ও কষ্ট পায়।”

সুলতার কথা শুনে ধানুর মন কালীর জন্য সহানুভূতিতে ভরে গেল। সে বলল, ”দিদিমা, আপনি ওর জন্য ভাববেন না, আমি যতটা পারি ওকে দেখব। এখন ও কোথায় দেখতে পাচ্ছি না তো!”

”বোধহয় খালধারের মাঠে গেছে বল খেলা দেখতে, গিয়ে দ্যাখ তো।”

ধানু চলে যাচ্ছে সুলতা ডাকলেন। ”আসল কথাটাই তো হল না, মাইনে নিবি কত?”

ইতস্তত করছে ধানু। কখনও টিউশনির কাজ সে করেনি, কত টাকা চাইবে বুঝে উঠতে পারছে না। সুলতা বুঝতে পারলেন ধানুর জলে পড়ে যাওয়া হাঁসফাসে অবস্থাটা। ছেলেটিকে তার ভাল লেগেছে।

”বাড়িতে আছে কে কে?”

”মা আর দুটো ছোট বোন।”

”বাবা?”

”গত বছর যক্ষ্মায় মারা গেছে।”

”সংসার চলে কী করে?”

ধানু পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল মুখ নামিয়ে। সুলতা বুঝলেন বলতে চায় না।

”কাল সকাল থেকে পড়াতে আয়।”

”না দিদিমা সকালে পড়াতে পারব না, কাজ থাকে।”

সুলতা গলাটা একটু চড়িয়ে বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ”পড়াশুনো তো ভোর ভোর সকালে করলে ভাল করে মাথায় ঢোকে। এই তো আমি বাড়িতে বসেই শুনতে পাই সক্কালবেলা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে এবাড়ি ওবাড়ির ছেলেমেয়েরা পড়া মুখস্ত করছে। কালীকেও তো চার বছরের বই এক বছরই শেষ করে ফেলতে হবে নইলে নীচের ক্লাসে নামিয়ে দেবে। তুই তো সকালে এসে ওকে মুখস্ত করাবি।”

”তাকিয়ে রইলেন সুলতা তাঁর কথাগুলো ভুল না ঠিক ধানুর চোখ থেকে তা যাচাই করে নেওয়ার জন্য। ধাতুর চোখে বিব্রত ভাব।

”না দিদিমা, আমি পারব না।” ধানুর গলা যথেষ্ট কঠিন ও জেদি।

সুলতা আশা করেননি এইটুকু একটা ছেলে যে অভাবের সংসার থেকে এসেছে,স্পষ্ট ভাষায় বলবে ‘পারব না।’ তার মানে কাজটা সে নেবে না। কিন্তু কেন?

”ভোরবেলায় সূর্য ওঠার আগেই আমি বাবার ভ্যানরিকশাটা নিয়ে বেরোই। ওই পূব দিকে বাগডাঙা কুসুমতলা লাউগেছে যেতে হয়। চাষিরা আমার রিকশায় তাদের খেতের আনাজপাতি বেগুন, নটে, লাউ, কলমি শাক, কচু, ডাব, কাঁচকলা এইসব তুলে দেয়। সেগুলো সন্তাোষপুরের বাজারে পৌঁছে দিতে হয়। তারপর বাড়ি ফিরে স্কুলের পড়া নিয়ে বসি, তিন ঘণ্টা পড়ি তারপর স্কুলে যাই। না দিদিমা, আমার কাজ আর পড়া ফেলে সকালে আসতে পারব না।” যে কথাটা উহ্য রয়ে গেল— তাতে যদি পড়ানোর চাকরিটা হাতছাড়া হয় তো হবে।

সুলতা বাস্তব বোঝেন, বুদ্ধিমতী এবং নমনীয় চরিত্রের। ধানু তাঁর স্নেহ ও সমীহ ইতিমধ্যেই অর্জন করে ফেলেছে। বুঝে গেছেন মেয়েলি গলার এই কিশোর শান্ত ধাতের, একবগগা, সৎ। কালীর জন্য এমন একজনকেই তিনি চাইছেন।

”দিনে কত টাকা রোজগার করিস?”

”কুড়ি টাকা। মা সকালে ন’টার মধ্যে দুটো বাড়িতে রান্নার কাজ করে, আটশো টাকা পায়। এই দিয়ে আমাদের সংসার চলে।”

”তা হলে কালই বিকেল—সন্ধে নাগাদ আয়। দু’দিন তো পড়া তারপর মাইনেপত্তর ঠিক হবে।”

সুলতার বাড়ি থেকে মিনিটতিনেক হেঁটে ধানু এল খালধারের ফুটবল মাঠে। খাল বলতে একটা বারো মিটার চওড়া নালা। জল খুবই কম, হেঁটে পার হওয়া যায়। পঞ্চাশ বছর আগে এটা ছিল জলভরা খাল এবং তাই দিয়ে নৌকা চলত। খালের ধারে মিউনিসিপ্যালিটির বড় মাঠ। পরিচর্যা করা হয় না, এখানে ওখানে সামান্য ঘাস ছাড়া বাকিটা ন্যাড়া এবড়ো—খেবড়ো উঁচু নিচু মাটিতে ঢাকা। দু’দিকে কাঠের গোলপোস্ট ও ক্রসবার। মাঠ ঘিরে বট, তাল, নিম অশ্বত্থগাছ আর ঝোপঝাড়। ধান্যকুড়িয়া স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন ও ধান্যকুড়িয়া আদর্শ উচ্চচ মাধ্যমিক শিক্ষা নিকেতনকে মাঠে খেলা করার অনুমতি দিয়েছে মিউনিসিপ্যালিটি।

মাঠে তখন লিগ খেলা চলছে। স্থানীয় বালক সঙ্ঘের সঙ্গে উদয়পুরের অরুণোদয় ক্লাবের। মাঠ ঘিরে পাঁচ—ছ’শো লোক। বেশিরভাগই পাশের গ্রাম উদয়পুরের। এই ম্যাচটা লিগ জেতার জন্য উদয়পুরের কাছে খুবই দরকারি। আজ তারা একটা পয়েন্ট খোয়ালে ধান্যকুড়ির পূর্বাচল ক্লাবের চ্যাম্পিয়ান হওয়ার রাস্তাটা খুলে যাবে। মাঠ ঘিরে টানটান পরিস্থিতি। পূর্বাচলের সাপোর্টাররা চিৎকার করে বালক সঙ্ঘকে চাগিয়ে যাচ্ছে।

ধানু যখন মাঠে এল তখন ম্যাচ শেষ হতে বাকি তিন মিনিট এবং ফল ০—০। বালক সঙ্ঘের গোলের পিছনে তিনটে তালগাছের ধারে সে এসে দাঁড়াল। সেখানে রয়েছে উদয়পুরের সাপোর্টাররা। হঠাৎ গোল খেয়ে গেল বালক সঙ্ঘ। লব করে দেওয়া বলটা ব্যাকের মাথার উপর দিয়ে বালক সঙ্ঘের পেনাল্টি স্পটের উপর পড়ছিল অরুণোদয়ের স্ট্রাইকার ছিটকে ঢুকে গিয়ে বলটা গোলে ঠেলে দেয়। রেফারি গোলের বাঁশি বাজাতেই উদয়পুরবাসীরা উল্লাসে মাঠে নেমে ডিগবাজি খেতে শুরু করে, গোলদাতাকে জড়িয়ে সাত—আটজন মাঠে গড়াগড়ি দিতে থাকে। লাইন্সম্যান যে অফসাইডের জন্য ফ্ল্যাগ তুলে রয়েছে সেটা আর তারা লক্ষ করেনি। রেফারি বলটা জমিতে বসিয়ে বালক সঙ্ঘকে যখন ফ্রি কিক দিল তখনই শুরু হয়ে গেল মাঠের মধ্যে দাঙ্গা। গাছের ভাঙা ডাল, বাঁশের খেটো নিয়ে মাঠে ঢুকে পড়ল কিছু লোক। তাদের মুখে একটাই কথা, ”জোচ্চচুরি, জোচ্চচুরি। আমাদের চ্যাম্পিয়ান হতে না দেবার জন্য চক্রান্ত। ল্যাইন্সম্যানকে ম্যানেজ করা হয়েছে।”

বালক সঙ্ঘ আর পূর্বাচলের লোকেরা ধানকুড়ির। সংখ্যায় তারা তো বেশি হবেই। বাইরের লোকেরা তাদের পিটোবে এটা তারা সইবে কেন। সুতরাং ধানকুড়ির লোকেরাও হাতের কাছে যা পেল তাই নিয়ে নেমে পড়ল। ফটাফট ফটাফট আওয়াজ মাঠ জুড়ে। মাঝে মধ্যে মানুষের গলায় ”বাবা রে, মরে গেলুম।” ”মার মার, মাথা ভেঙে দে।” সুখের বিষয় ছোরা, বোমা বা পাইপগান যা এইরকম মারপিটে ব্যবহার করা হয়, কোনও পক্ষের কাছে এইসব অস্ত্র ছিল না। কিন্তু কাঠ, বাঁশ, মাটির ঢেলা, ইট তাই—বা কম কী।

ধানু দাঙ্গা থামাতে মঠে ঢুকে গেছল। (পরে অবশ্য স্বীকার করে বোকামি করে ফেলেছিল।) এবং একটা বাঁশ মাথায় পড়তেই দু’হাতে মাথা চেপে বসে পড়ে। আর এক ঘা পিঠে পড়বে ধরে নিয়ে সে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু বাঁশ আর পড়ল না। ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে দেখে হাফপ্যান্ট পরা একটা লোক বাঁশ মুঠোয় ধরে টানাটানি করে চলেছে। অবশেষে হ্যাঁচকা টানে বাঁশটা ছাড়িয়ে দিল।

”পালান এখান থেকে।”

লোকটির কথামতো ধানু দৌড়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মাথা থেকে অল্প রক্ত পড়েছিল। জখমটা গুরুতর হয়নি। ডাক্তারবাবু মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দেন। পরদিন ভোরে সে প্রতিদিনের মতো সবজি বইতে ভ্যানরিকশা নিয়ে বেরোয়, স্কুলেও যায়।

বিকেলে সে সুলতার বাড়িতে হাজির হল। সদর দরজার পাশে টানা রোয়াক। তাইতে পা ঝুলিয়ে বসে সেই লোকটা, গতকাল যে বাঁশ ধরে ফেলে তাকে বাঁচিয়ে দিল। হাতে চালভাজার বাটি, পা দোলাতে দোলাতে চালভাজা খাচ্ছে। ধানুকে দেখে রোয়াক থেকে লাফিয়ে নামল।

”আপনি কি ধানুদা?”

”হ্যাঁ, আপনি?”

”আমি কালী।” বলেই একগাল হাসি। ”দিদা বলেছে এখন থেকে আমি তোমার ছাত্তর।”

ধাতু বলল, ”ছাত্তর নয় বলবে ছাত্র।”

কালীকে শিক্ষাদানের প্রাথমিক কাজ এইভাবেই ধানু শুরু করল।

.

প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের এই বিনামূল্যে পড়ুয়াদের দেওয়া হয়। কিন্তু ধানকুড়ির এই প্রাথমিক স্কুলে সেইসব বই এখনও এসে পৌঁছয়নি। তা হলে কালী কী বই পড়বে?

ওর সঙ্গে প্রথম কথা বলার পরের দিন ধানু তার পড়শি নীলামাসির মেয়ের অঙ্ক আর বাংলা বই কয়েক ঘণ্টার জন্য ধার করে নিয়ে এল। ক্লাস টু—এ পড়ে মেয়েটি। বিনামূল্যে স্কুল থেকে পাওয়া ওইসব বই পুরনো। বছর শেষ হলে বই ফিরিয়ে দিতে হয় স্কুলে, কেন না নিচু ক্লাস থেকে যারা উঠেছে তারা এবার পড়বে এই বই।

ধানুর কথামতো সুলতা লাইনটানা ফুলস্ক্যাপ কাগজ, শ্লেট ইত্যাদি কিনে রেখেছিলেন। কালী পাঁচ আর পাঁচে দশ হয় জানে, পাঁচ থেকে পাঁচ বাদ দিলে শূন্য হয় জানে, পাঁচকে পাঁচ দিয়ে গুণ করলে পঁচিশ হয় এটাও জানে, শুধু ভাগটাই জানে না।

নব গণিত মুকুল বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে ধানু বুঝে গেল এই বই কালীর আর পড়ার দরকার নেই। এখন যেটা ওর দরকার অক্ষর আর রাশি চিনে পড়তে শেখা এবং লিখতে পারা। কিশলয় বইটি সে কালীর সামনে খুলে ধরে বলল, ”তোমাকে এইসব অক্ষর চিনে পড়তে হবে আর লিখতে হবে। পারবে তো?”

সুলতা দু’জনের পাশে বসে ধানুর কথা শুনছিলেন, গজগজিয়ে বললেন, ”তো মানে? হবে, পারতে হবে। ওসব তো—টো চলবে না। সামনের বছরই বড় বাড়িতে ভর্তি হতে হবে। মনে থাকে যেন। এরপর কোমল স্বরে বললেন, ”হ্যাঁরে ধানু, গুড় দিয়ে দুটো রুটি খাবি? এখুনি বানিয়ে দিচ্ছি।”

উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে সুলতা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। কালী সহজপাঠ বই খুলে ছবি দেখছে। একটা পাতার উপরের কোণে আঁকাবাঁকা অক্ষরে নাম লেখা। কালীর কৌতূহল হল নামটা জানতে।

”ধানুদা এটা কী লেখা?”

ধানু দেখল লেখা রয়েছে ‘পিংকী শিকারী’। বলল, ‘পিঙ্কি শিকারি। একটা মেয়ের নাম এটা। বইটা তার।”

”নিজের হাতে লিখেছে।” কালীর চোখে সমীহ ফুটে উঠল।

অক্ষরগুলোর চেহারা দেখে ধানু বলল, ”হ্যাঁ, নিজের হাতে লিখেছে।”

আবদেরে স্বরে কালী বলল ”ধানুদা, নিজের হাতে আমিও নাম লিখব, শিখিয়ে দেবে?”

ধানুর ভাল লাগল কালীর এই ইচ্ছাটা নিজে থেকে জেগেছে দেখে, সেই সঙ্গে খেয়াল হল ওর বয়স মাত্র সাড়ে ছয় বছর। মনে পড়ল সুলতার কথাগুলো , ”মনটা বাচ্চচাছেলের লোকে তো তা জানে না, তারা বড় ছেলে ভেবে সেইরকম…’

তারপর সে ক—এর পাশে আ—কার এবং ল—এর পাশে দীর্ঘ ঈ চিহ্ন এঁকে উচ্চচারণ করে বুঝিয়ে দিল চিহ্নগুলো দিয়ে কী রকমভাবে কালী শব্দটি তৈরি করা হল। কিঙ্কর লিখতে গিয়ে তার মনে হল ‘ঙ্ক’—টা বেশ খটমট। পিংকী বানানটার মতো লেখা কালীর পক্ষে সহজ হবে যদি কিংকর লেখে। ধানু তাই লিখল। ঢালি শব্দটায় জটিলতা নেই। পুরো নামটা লিখে সে বলল, ”এভাবে কিন্তু অক্ষর পরিচয় হয় না। তোমাকে অ, আ, ক খ থেকে শিখতে হবে।”

এই বলে কাগজে সে স্বরবর্ণ অ থেকে ঔ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ক থেকে চন্দ্রবিন্দুপর্যন্ত মুক্তোর মতো অক্ষরে লিখে বলল, ”বইগুলো তো আজকেই পিঙ্কিকে ফেরত দিতে হবে নইলে বই দেখেই করতে পারতে। তুমি আমার এই লেখা দেখেই শুরু করো বরং। অ—র নীচে দশটা অ, আ—র নীচে দশটা আ লিখবে ঠিক যেভাবে আমি লিখেছি, একেবারে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত। পারবে তো আজ রাতের মধ্যে।”

কালী একদৃষ্টে ধানুর লেখা অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে। প্রশ্নের জবাবে শুধু মাথা নাড়ল। গরম রুটি আর গুড় দু’জনের জন্য দু’টি স্টিলের থালায় নিয়ে এলেন সুলতা।

”আগে খেয়ে নে তারপর পড়া। পেটে খিদে নিয়ে পড়াশুনো হয় না।”

ধানু হেসে থালা টেনে নিতে গিয়ে দেখল সুলতার হাতে একটা শুকনো বাঁশের কঞ্চি। অবাক হয়ে তাকাতেই সুলতা বললেন, ”রান্নাঘরে পেলুম, তোর কাজে লাগবে। চার বছরের পড়া এক বছরে তুলে দেওয়া কি সোজা ব্যাপার।” বলেই তিনি কঞ্চিটা সপাং করে মেঝেয় কষালেন। ”পাঠশালায় আমাদের সময় গুরুমশায়দের হাতে বেত থাকত। বেতটা হাতে নড়ে উঠলেই ভুলে যাওয়া নামতা মনে পড়ে যেত।”

”না না দিদিমা, বেত কঞ্চি কিছুরই আমার দরকার হবে না। কালী তো শুনেছি একবার শুনলেই সব মনে রাখতে পারে।”

”পারেই তো। তুই আজ পড়া দিয়ে যা, কালকে এসে পড়া ধরলে দেখবি সব বলে দেবে। রমু তো আধঘণ্টা মোটে পড়িয়েছিল তাইতেই কালী দিদিমণিদের তাক লাগিয়ে দেয়। কিন্তু মুশকিল কী হয়েছে জানিস বাবা, ওর এই গতরটা।”

ধানু বলল, ”মুশকিল এখন ততটা হবে না কিন্তু পরে হবে, যদি সাড়ে সাত বছরে কালী ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়।” কথাটা বলে সে আড়চোখে কালীর দিকে তাকাল। মাথা নামিয়ে কালী তখনও অ আ, ক খ লেখা কাগজের দিকে তাকিয়ে, ঠোঁট নড়ছে।

”কালী, তুমি এখন খেয়ে নাও, পরে পড়বে।” ধানু বলল।

”খাচ্ছি।” কালী মুখ তুলে হাত বাড়াল রুটির দিকে। ”ধানুদা, তুমি আর একবার অক্ষরগুলো চিনিয়ে দেবে? আচ্ছা, এটা তো হস্বই আর এটা ওঔ, তাই না?”

ধানু শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, ”হ্যাঁ।”

”আরে এটা গ, এটা ইঁও, এটা থ, এটা….?” কালী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল ধানুর দিকে।

”দন্তান্ন। তারপর প ফ…।”

কালী হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল, ”জানি।”

সুলতা ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে বললেন, ”কী বলেছিলুম।” তারপর কালীকে বললেন, ”লক্ষ্মী বাবা, রুটিগুলো খেয়ে নে, জুড়িয়ে যাচ্ছে।”

”না দিদিমা আগে পড়া শেষ করি তারপর খাব।” কাগজগুলো নিয়ে কালী ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে দালানে গিয়ে বসল।

এখন ধানুর মনে হচ্ছে একবছর পর কালী ক্লাস ফাইভে পড়তে বড় বাড়িতে যাবে। সে বলল ”দিদিমা সামনের বছর কালী যদি ফাইভে পড়ে তবে পাঁচ বছর পরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় কত বছর বয়সে বসবে?”

”এখন সাড়ে ছয়, সামনের বছর সাড়ে সাত, তার সঙ্গে পাঁচ যোগ কর, কত হয়?”

”সাড়ে বারো। অত কম বয়সে তো পরীক্ষা দেওয়া যায় না। আপনি অন্তত আর চার বছর বয়স বাড়ান।”

সুলতার মাথায় এবার বাজ ভেঙে পড়ল। ”লোকে তো ছেলেমেয়ে ইস্কুলে ভর্তি করার সময় বয়স কমায়! কালীর বয়স বাড়াতে বলছিস? এ কী সব্বোনেশে কথা। এখন কী করে বাড়াব? মিনিসিপালের বাথ সাট্টিফিকেট কি ফেলে দোব?”

”না, না, দিদিমা ফেলবেন না।” ধানু আঁতকে উঠল। ”ব্যবস্থা করে জন্মসালটা চার বছর শুধু পিছিয়ে দিতে হবে। শ’দুয়েক টাকা খরচ করলেই কালীর বয়স বাড়ানো যাবে। বড় বাড়ির যতীন মাস্টারমশাই এইসব ব্যবস্থা করেন। কত ছেলের বয়স কমিয়ে সার্টিফিকেট বার করে এনেছেন আর এ তো বাড়ানো।”

”তা হলে তাই করে দিস বাবা। লেখাপড়া করতে গেলে যে অ্যাতো হ্যাপায় পড়তে হবে কে জানত। আর কী কী করতে হবে বলে দিস।”

”কালীর হাফপ্যান্ট পরাটা বন্ধ করতে হবে। বড্ড বেখাপ্পা দেখায়। লোকজন বারবার তাকাবে তাতে ও অস্বস্তিতে পড়বে। গড়িয়ায় রেডিমেড ফুলপ্যান্টের অনেক দোকান আছে একজোড়া কিনে দিন।”

”এই তো বাপু আবার খরচের ধাক্কায় ফেললি। ধুতি পরলে হয় না? ওর দাদামশায়ের তিন—চারটে ধুতি তোলা আছে, ছেঁড়াখোড়া নয়, আস্ত।”

ধানু মাথা নেড়ে বলল, ”প্যান্টে অনেক সুবিধে দিদিমা, দেখেন না এখন বেশির ভাগ লোক প্যান্ট পরে। কালীর তো বয়স কম। ও লাফাবে ছুটবে ঝাঁপাবে তখন তো ধুতি খুলে যেতে পারে।”

সুলতার মনে হল ছেলেটা বিচক্ষণও বটে। ”বেশ কালকেই কালীকে বিকেলে নিয়ে গিয়ে তুই কিনে নিস। কত পড়বে একজোড়ার দাম?”

কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে ধানু বলল, ”চারশো টাকায় দুটো প্যান্ট হয়ে যাবে। যদি আরও ভাল চান তো বারো—তেরোশো টাকা।”

”ওরে বাবা বলিস কী।” অত টাকা কিন্তু আমার নেই। রোববার আন্না আসবে ছেলেকে দেখতে, বলব দুটো প্যান্ট কিনে দিয়ে যা নয়তো শিবুর পুরনো দুটো পাঠিয়ে দে।”

রবিবার ধানুর স্কুলে যাওয়া নেই, ভোরে বাজারে সবজি আনাজ পৌঁছে দিয়ে, ঘণ্টাতিনেক নিজের পড়া করে আর বোনেদের পড়িয়ে কালীর অ আ ক খ কতদূর এগোল জানার জন্য রওনা দিল সুলতার বাড়ি। আন্নাকালী তার ছোট্ট মেয়ে কৃষ্ণকলিকে সঙ্গে নিয়ে সন্দেশের বাক্স হাতে তখনই হাজির হয়েছে। বোনকে দেখেই কালী ছুটে গিয়ে দু’হাতে তাকে তুলে বনবন করে ঘোরাতে শুরু করল। সাত আট পাক ঘুরিয়ে নামিয়ে দিয়ে তারপর জড়িয়ে ধরল মাকে। প্রায় একমাস পর সে মাকে কাছে পেয়েছে।

”জানো মা, আমি ইস্কুলে ভর্তি হয়েছি।” গর্বে আর আনন্দে কালী উচ্ছ্বসিত।

সুলতা বললেন, ”দিলুম শিক্ষা নিকেতনে ভর্তি করে। কাল থেকে পড়তে যাবে। বড়দিমণিকে অনেক করে বলে ফোর কেলাসে নিইয়েছি তবে বলে দিয়েছেন, ওয়ান কেলাসে নামিয়ে দেবেন যদি পড়া না পারে। একটা ছেলেকে রেখেছি পড়াবার জন্য, কাল পড়া দিয়ে গেছে। আন্না তোর কাছে হাজারখানেক টাকা হবে?”

অবাক হয়ে আন্না বলল, ”অত টাকা! কেন কী দরকার?”

”কালীর দুটো ফুলপ্যান্ট কিনতে হবে আর সাট্টিফিকেটে ওর বয়স বাড়াতে দুশো টাকা খরচা লাগবে। চটিটারও তো এখন তখন অবস্থা। জামাইয়ের তো অনেক প্যান্ট আছে দুটো প্যান্ট আর জামা গেঞ্জি পাঠিয়ে দিস না, কালীর গায়ে লেগে যাবে।”

আন্না ভ্রুকুটি করে বলল, ”আমার ছেলে পুরনো জামাকাপড় পরবে কেন, ও ভিখিরি, না হাঘরে।” হাতের ব্যাগ খুলে সে পঞ্চাশ ও একশো টাকার নোট মুঠোয় বার করে মা’র হাতে দিয়ে বলল, ”তোমার কাছে রেখেছি ডাকাত না হয়ে যাতে মানুষ হয় আর সেজন্য যত টাকা লাগে আমি দোব। ভগবান আশীব্বাদ করে ওকে আশ্চর্য রকমের একটা শরীর দিয়েছেন পিথিবীতে আর কোনও ছেলের এমন বডি আছে? আগের জন্মে কত যে পুণ্যি করেছিলুম তাই এ জম্মে আমি ওর মা হয়েছি।” বলতে বলতে আন্নার দু’চোখ ছলছল করে উঠল।

‘শুধু কি গতর রে আন্না! ওর মাথাটার মধ্যে ভগবান কী জিনিস যে ভরে দিয়েছেন তা বোঝা দুষ্কর। যা একবার শুনবে ঠিক মনে করে রেখে দেবে। দেখবি?”

সুলতা ডাকলেন কালীকে। সে তখন বোনকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরের উঠোনে কামিনী গাছ থেকে ফুল পাড়ছে। একটা হলুদ ছোট্ট পাখি ফুড়ুত করে উড়ে এসে বসল নিম গাছে। ফুল থেকে চোখ সরে গেল কৃষ্ণকলির। কালী বলল, ”ওটা বেনেবউ। কী সুন্দর, না?”

”আমাদের বাড়িতে ময়না আছে। সেটাও খুব সুন্দর, মা রোজ ভাত খেতে দেয়।”

”ওই দ্যাখ পাখিটা কেমন উড়ে উড়ে খেলা করছে। তোদের ময়নাটা করে?”

”কী করে করবে, থাকে তো খাঁচার মধ্যে। খাঁচার মধ্যে কি ওড়া যায়?”

কালী চুপ করে রইল। আবছা কষ্ট ছাপ ফেলল তার মুখে। অস্ফুটে বোনকে বলল, ”উড়তে না পারার জন্য ওর দুঃখু হয়।”

”তুমি জানলে কী করে দুঃখু হয়?”

”আমি জানি…হয়।”

তখনই দিদিমার ডাক শুনতে পেয়ে সে বোনকে নিয়ে বাড়ির মধ্যে এল।

”ধানু তোকে কাল যে পড়া আর লেখাগুলো করতে বলে গেছল করেছিস? বলব কী আন্না এই অ্যাত্ত মুখস্ত আর লেখা।” সুলতা দুটো হাত বিস্তার করে দেখালেন। ”কাল রাতে না খেয়ে না দেয়ে পড়েছে আর লিখেছে। দ্যাখা না কালী, মাকে দ্যাখা না।” সুলতা ছেলেমানুষের মতো ছুটে গিয়ে কাগজগুলো নিয়ে এলেন।

আন্নাকালীর বিদ্যাবুদ্ধি তার মায়েরই মতন। অবশ্য অ আ ক খ সে বোঝে, নিজের নামটাও লিখতে পারে। কাগজ ভর্তি আ ই দীর্ঘ ঈ—র চিহ্নগুলো সে চিনতে পারল। একটা কাগজে পরপর লেখা কালী কিংকর ঢালি, লেখা দেখে আন্না বানান করে করে পড়ে ছেলেকে জড়িয়ে গালে চুমু খেয়ে বলল, ”করেছিস কী, একরাতেই নামটাও লিখতে শিখে গেছিস।”

সেই সময় বাড়িতে ঢুকল ধানু। সুলতা মেয়েকে বললেন, ”আন্না, এই হল কালীর মাস্টার ধানু। এখানকার ছেলে, এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। পড়াশুনোয় খুব ভাল। অঙ্কে একশো পাঁচের মধ্যে একশো পেয়েছে।”

আন্না অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, ”অ্যাতটুকু ছেলে, পারবে কালীকে পড়াতে?”

সুলতা এবার ধানুকে বললেন, ”হ্যাঁ রে ধানু, কালীর মা বলছে পারবি পড়াতে?”

ধানু ঠোঁট কামড়ে বলল, ”কালীকে পড়াতে হয় না দিদিমা, শুধু দেখিয়ে দিতে হয়, আর বলে দিতে হয়। পড়াটা ও নিজেই করে নেয়।”

কালীর লেখা কাগজগুলো হাতে নিয়ে ধানু দেখতে লাগল। তারপর সে কালীকে স্বরবর্ণ অ থেকে ঔ মুখস্থ বলতে বলল। নির্ভুলভাবে কালী বলে গেল। তারপর ব্যঞ্জন বর্ণ। ক থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত বলতে গিয়ে মাত্র দু’বার তার আটকাল।

আন্না মায়ের কানে ফিসফিস করে বলল, ”মাস্টার তো খুব ভাল। মাইনে কত?”

”টাকা তো তুই দিবি, এখনই কথা বলে নে।”

গম্ভীর হয়ে গেল আন্না। হিসেবি গলায় বলল, ”একদিনের পড়া থেকে অবশ্য কিছু বোঝা যায় না তুমি কেমন মাস্টার, তবে আন্দাজ একটা পাওয়া যায়।” হাতের সোনার বালাটা ঘোরাতে ঘোরাতে সে বলল, ”উঁচু ক্লাসের ছাত্তর নয় কালী, তোমাকে বেশি খাটতে হবে না। বলো কত মাইনে নেবে?”

ধানু যেন তৈরিই ছিল প্রশ্নটার জন্য। বলল, ”আপনার মেয়ে কী স্কুলে পড়ে?”

”ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে কে জি—টুতে।”

”ওর প্রাইভেট টিউটর আছে?”

এবার সুলতা আগ বাড়িয়ে জবাব দিলেন। ”মাস্টার থাকবে না? ইংরিজি তা হলে পড়াবে কে? হ্যা রে, আন্না, কত যেন মাইনে নেয় আন্টি?”

”এম এ পাশ। কমই নেন, পাঁচশো টাকা।”

সুলতার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ”শুনলি তো ধানু, এম এ পাশ। তুই তা হলে একশো নে।”

ধানুর মুখ কঠিন দেখাল। ”আমি এখনও মাধ্যমিক পাশও করিনি। ঠিক কথা। কিন্তু চার বছরের পড়া এক বছরের মধ্যে করিয়ে দেওয়াটা সহজ ব্যাপার নয়। কালীর মতো পড়ুয়া ছেলে এমন অসাধারণ ওর মেমারি দেখেই রাজি হয়েছি। ফাঁকি আমি দোব না, দিতে পারবও না। আন্টিকে যে টাকা দেন আমাকেও তা দিতে হবে।” শেষের বাক্যটি বলার সময় ধানুর স্বর শক্ত হয়ে উঠল।

আন্না ভ্রু কুঁচকে চোখ সরু করে তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে ধানুকে দেখছিল। মনে মনে জরিপ করে নিচ্ছিল এই কিশোরের মানসিক ক্ষমতাটা। কীসের জোরে এতটুকু ছেলে বলল, আন্টিকে যে টাকা দেন আমাকেও তা দিতে হবে। অনেক ধরনের মানুষ ওই ডাকাতের বউকে দেখতে হয়েছে, অনেক রকমের বিপদ—আপদ থেকে বুদ্ধি করে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। সুলতাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে সে গলা নামিয়ে বলল, ”মনে হচ্ছে ছেলেটা সলিড। মা রাজি হয়ে যাও। টাকাটা বড় কথা নয়। কালীকে শিক্ষিত করে তুলতে হলে এই ছেলেটাকে দরকার।”

মেয়ের জ্ঞানগম্যির উপর সুলতার অগাধ আস্থা। গত সাত আট বছর ডাকাত স্বামীকে চরাচ্ছে, ডাকাতি আর তোলাবাজি ছাড়িয়ে বাড়ির প্রমোটারি ব্যবসায় নামিয়ে শিবুকে ভদ্রসমাজে মেলামেশার উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টায় আন্না অনেকটা সফল, মেয়েকে ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। এসবই সুলতার গর্বের কারণ।

”দ্যাখ ধানু,” সুলতা গভীর চিন্তার মধ্যে ডুবে গেছেন এমন একটা ভাব নিয়ে বলতে শুরু করলেন। ”টাকাটা তো কোনও ব্যাপার নয়, এম এ পাশ করাটাও নয়। আসল কথা হল যত্ন নিয়ে ফাঁকি না দিয়ে পড়ানো। কিন্তু পড়াবে কী করে তোর তো ছোট্টখাট্ট দুবলা টিঙটিঙে শরীর। তোকে মোটা হতে হবে। আর সেজন্য দু’বেলা আমার এখানে ভাত খেতে হবে। সকালে ইস্কুলে যাওয়ার আগে আর রাতে কালীকে পড়িয়েটড়িয়ে বাড়ি ফেরার আগে। রাজি কি না বল?”

সুলতার এহেন প্রস্তাবে ধানু তাজ্জব হয়ে গেল। শুধু বলল, ”মাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু বলতে পারব না।”

ধানু চলে যাওয়ার পর সুলতা আন্নাকে বললেন, ”কেন খেতে বললুম বল তো? রাতে খেতে দিতে দেরি করলে ওই সময়টা বেশি পড়িয়ে নেওয়া যাবে।”

মায়ের বুদ্ধির বহরে আন্না তো চমৎকৃত।

.

কালী প্রথম দিন স্কুলে যাওয়ামাত্র বড়দিদিমণি দেবিকা তাকে স্বাগত জানালেন, ”আরে কিং কং, এসো, এসো। ফুলপ্যান্ট পরে ভালই করেছ। যাও, ক্লাসে বোসো।” ক্লাস ফোরের ঘরটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তিনি কথা বলে যেতে লাগলেন এক ছাত্রীর মায়ের সঙ্গে।

একটু পরে দেবিকা ক্লাস ঘরে ঢুকে দেখলেন কালী জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে।

একটি ছেলে বলে উঠল, ”দেখুন না বড়দি, এই লোকটা এসে বেঞ্চিতে বসেছিল। আমরা সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছিলুম না।”

”আরে ও লোক নয়, লোক নয়, তোমাদের থেকেও বয়সে দু’ তিন বছরের ছোট। ওর নাম কালী কিং কং ঢালি। চেহারাটাই যা বড়, এখন থেকে ও তোমাদের সঙ্গে পড়বে। কালী তুমি পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বোসো।”

সারা ক্লাস অবাক চোখে কৌতূহল ভরে মুখ ফিরিয়ে ফিরিয়ে কালীকে দেখতে থাকে, তাইতে অস্বস্তিতে সে থেমে উঠল। দেবিকা পড়ালেন ভূগোল। ভারতের সীমানা আর জলবায়ু ছিল পাঠের বিষয়। কালী চুপচাপ বসে শুনে গেল। সকলেই বই এনেছে শুধু তারই বই নেই। সঙ্গে শুধু খাতা আর কলম। ছুটির পর দেবিকা তাকে বললেন, ”স্কুল থেকে কবে বই পাবে তার ঠিক নেই, দোকান থেকে বই কিনে নিয়ো, আজই।”

সেই দিন বিকেলেই সুলতা ধানকুড়ির একমাত্র বইয়ের দোকান পপুলার বুক স্টোর থেকে ক্লাস ফ্লোরের যাবতীয় বই কিনে আনেন। সন্ধ্যায় ধানু পড়াতে এসে দেখে কালী ভূগোল বই খুলে বানান করে করে পড়ার চেষ্টা করছে। তাই দেখে ধানু সুলতাকে বলল, ”দিদিমা আমি দু’বেলা কালীকে পড়াব। সকালে আমার বই নিয়ে এখানে চলে আসব নিজে পড়ব আর কালীকে পড়াব, এখান থেকেই চান করে ভাত খেয়ে স্কুলে চলে যাব।”

পুলক চেপে সুলতা বললেন, ”তোমার বোনেদের সকালে পড়াও, তার কী হবে?”

”সে হয়ে যাবে। ওরা লিখতে পড়তে জানে, ফাইভ সিক্সের যা পড়া তা নিজেরাই পড়ে নিতে পারে। আটকে গেলে তখন বুঝিয়ে দিয়ে হেলপ করব, সেটা বিকেলেও করা যাবে।”

সুলতা এবার আন্তরিকভাবে বললেন, ”আর তোর নিজের পড়া? অঙ্কে তো তুই কাঁচা, তার কী হবে? একশো পাঁচের মধ্যে একশো পাঁচ কিন্তু বড় পরীক্ষার তোকে পেতেই হবে। ধানু, এবার তুই মাস্টারের কাছে পড়। তোর নিজের মাস্টারি করার টাকাটা এবার খরচ কর।”

ধানু মন দিয়ে এই প্রৌঢ়ার কথাগুলো শুনল, মনে গেঁথে নিল এবং মা—কে রাত্রে জানাল।

”তোকে টিউশনির টাকা সংসারে দিতে হবে না।” মা বলেছিলেন, ”তোকে দাঁড়াতে হবে। পরীক্ষায় ভাল ফল না করলে দাঁড়াবি কী করে। তোর বাবা কী কষ্টটা করেছেন সে তো দেখেছিস, তাঁর কী মনের আশা ছিল তাও জানিস। এতগুলো টাকা পাচ্ছিস তাকে ভালমতো ব্যবহার কর। সংসার যেমন করে চলছে তেমনই চলবে।”

ধানু জানত মা এইরকম কথাই বলবে। স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক মধুসূদন ভটচাজ বাড়িতে কয়েকজন ছাত্র পড়ান। পরদিনই ধানু মধুবাবুর কোচিং—এ ভর্তি হয়ে যায়। সপ্তাহে দু’দিন চারশো টাকা।

বিকেলে ধানু খালপাড়ের খেলার মাঠে যায়। তার স্বাস্থ্য ফুটবলের মতো ধাক্কাধাক্কির খেলার উপযুক্ত নয়। মাঠের একধারে কবাডি খেলা হয়। সেখানেই সে দেখতে পায় কালীকে। কবাডি মাঠের ধারে সে তুমুলভাবে দুটো দলের কোনও একটিকে সমর্থন করে যাচ্ছে, ধানু তাকে বলেছিল, ”তুমিও খেলো না কেন? গায়ে তোমার এত জোর! খুব সরল খেলা দু’বার দেখেই তো শিখে ফেলা যায়। খেলতে চাও তো শক্তি সঙ্ঘকে বলি ওখানে আমার চেনা আছে।”

”ধানুদা আমার বয়স জানলে ওরা আমাকে খেলতে নেবে না।”

”বয়স জানাব না। বলব তোমার বয়স—কত বলব?” জিজ্ঞাসা করল ধানু কালীকেই।

ফাঁপরে পড়ল সাড়ে ছয় বছরের পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির ছেলেটি। হতভম্ব চোখে সে ধানুর দিকে তাকিয়ে রইল। হেসে ধানু বলল, ”আঠারো।”

শক্তি সঙ্ঘ লুফে নিল কালীকে। ওদের একজন বলিষ্ঠ রেইডার দরকার ছিল যে একটা হানাতেই দু’জনকে অন্তত মোড় করে আসতে পারবে। কালী তাদের আশা পূরণ করল। কালীর উচ্চচতা গড়পড়তা বাঙালি পুরুষের মতো তাই লোকের চোখে পড়ে না, তবে কথা বললেই বোঝা যায় সে বালক কিন্তু সে লোকের সঙ্গে কথা বলে না। তাই পাঁচজনের একজন হয়েই সে ভিড়ে মিশে রইল।

একদিন ভোররাতে প্রবল ঝড়বৃষ্টি ধানকুড়ির উপর নেমে এল। আধঘণ্টা প্রলয় চালিয়ে ঝড় উধাও হল বৃষ্টিকে সঙ্গে নিয়ে। সুলতা বললেন, ”কালী ইস্কুলে যাবি? যা দুর্যোগ গেল, মনে হয় না তোর ইস্কুলবাড়ি আস্ত আছে, যা একবার ঘুরে আয়।”

বই খাতা ভরা থলি কাঁধে ঝুলিয়ে কালী স্কুলে যাবার জন্য বেরোল। তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, ধানুদা কি ভ্যানরিকশা নিয়ে বেরোতে পেরেছে? ছোট গাছগুলো উপড়ে পড়ে আছে। অশ্বত্থ গাছের বড় মোটা একটা ডাল ভেঙে পড়ে আছে রাস্তায়, সেটা এড়িয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার মনে হল একটা ‘ব্যা আ আ’ শব্দ যেন সে শুনতে পেল। কৌতূহলী হয়ে সে ভাঙা ডালটার দিকে এগিয়ে গেল।

ডালের পাতাগুলো সরিয়ে সে দেখতে পেল, একটা ছাগল ডাল চাপা পড়ে মরে রয়েছে আর একটা ছোট্ট ছাগলছানা কীভাবে যেন বেঁচে গিয়ে মরা ছাগলটার কোলের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। কালী পাতা সরাতেই মুখ তুলে ‘ব্যা আ আ’ করে ডেকে উঠল। কালী বুঝল মরা ছাগলটা এই ছানার মা। সে সন্তর্পণে দুহাত দিয়ে তুলে দাঁড় করিয়ে দিতেই ছানাটা হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল।

ছাগলছানাটাকে কোলে নিয়ে কালী স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে সুলতাকে ডেকে বলল, ”দ্যাখো দিদিমা, কাকে এনেছি। গাছচাপা পড়েছিল শিবতলার কাছে। মা’টা মরে গেছে। আমার মনে হচ্ছে এর পা ভেঙেছে, একটু দ্যাখো তো।”

”আহা রে!” বলে সুলতা কালীর হাত থেকে ছানাটাকে নিয়ে নিলেন।

কালী আশ্বস্ত হয়ে আবার স্কুলের দিকে রওনা হল। সেখানে পৌঁছে দেখল, স্কুলের ঘরের টালির চালা ভেঙে ক্লাস ঘরের বেঞ্চের উপর পড়ে রয়েছে। কিছু টালি উড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বড় বাড়ির উঠোনে। বড়দিদিমণি দেবিকা আর অধীরবাবু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। ছোটদিদিমণি রাধারানি টালি সরিয়ে একপাশে জড়ো করে রাখছেন। প্রায় তিরিশটি ছেলেমেয়ে একটু দূরে জটলা করে ভয় ভয় চোখে স্কুলের দশার দিকে তাকিয়ে।

দেবিকা বললেন, দেখতেই তো পাচ্ছ কী অবস্থা? আজ বাড়ি যাও তোমরা, বড় বাড়ির মাঠে ক্লাস করা যায় কি না তাই নিয়ে হেডমাস্টার মশায়ের সঙ্গে আজ কথা বলব। তোমরা কাল এসো।”

কালী বাড়ি ফিরে আসছে এবার অন্য একটা সরু পায়ে চলা পথ দিয়ে। একই রাস্তা দিয়ে বারবার হাঁটতে তার ভাল লাগে না। দু’ধারে ঝোপ আর তার মধ্যে বড় বড় গাছ। এই পথটা হেকিমপুকুর নামে আগাছাভরা বড় জলাশয়ের ধার দিয়ে একটা বড় বাঁশবনের পাশ কাটিয়ে ফণীমনসা ঝোপের ধার ঘেঁষে তার বাড়ির দিকে গেছে। যেতে যেতে কালী দেখল একটা বিশাল রাধাচুড়া গাছের তলায় গোটা পঁচিশ কাক ওড়াওড়ি করছে আর ‘কা কা’ শব্দে ডেকে চলেছে। কিছু একটা জিনিসকে ওরা ঠোকরাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বড় বড় ঘাসের জন্য কালী জিনিসটা দূর থেকে দেখতে পেল না।

কালী পায়ে পায়ে সতর্ক ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। ব্যাপারটা কী তাকে দেখতে হবে। তাকে দেখে কাকগুলো অল্প হটে গেল। আর একটু এগিয়ে সে পাখির মাথা দেখতে পেল, মাথাটা কাক শালিখ ছাতারে এমনকী চিলের মাথার থেকেও বড়। মাথাটা সাদা। কালী কৌতূহলী হয়ে আরও এগোল। পাখিটা তাকে দেখতে পেয়েছে কিন্তু উড়ে যাওয়ার কোনও চেষ্টা করল না। উবু হয়ে যেমন বসেছিল তেমনই বসে রইল।

পাখিটার ভাবভঙ্গি দেখে কালীর মনে হল, ওর ওড়ার ক্ষমতা নেই। বোধহয় ঝড়ের দাপটে আকাশ থেকে ছিটকে এসে পড়েছে। ঠোঁট দুটি তীক্ষ্ন এবং বাঁকানো। হিংস্র ও শিকারি পাখি কিন্তু এখন অসহায়। কালী তার সাড়ে ছয় বছরের বুদ্ধিতেই বুঝে গেছে একবার যদি ঠোকরায় তা হলে মাংস খুবলে নেবে। সে কাকগুলোকে তাড়াবার জন্য একটা মরা সরু ডাল কুড়িয়ে নিয়ে ”হেই হুশশ” করে ঘোরাতে শুরু করল। কাকেরা পিছিয়ে গেল, অনেকে গাছে চড়ে বসল কিন্তু পালাল না বরং দ্বিগুণ রবে ‘কা—কা—কা’ শুরু করে দিল।

এইবার কালী পাখিটার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। তার মনে হল পাখিটার চাহনিতে স্বস্তি ফুটে উঠেছে, মোলায়েম হয়েছে চোখের মণি, গলা থেকে বুক পর্যন্ত পালকের রং সাদা। ঘাড়ের কাছে ইটের রং, ডানা আর পিঠ আরশোলা রঙের। পাখিটা মুখ তুলে হাঁ করল, মুখের মধ্যেটা গোলাপি। গোটা শরীর আকারে চিলের থেকে সামান্য বড়।

কালী আলতো করে ওর মাথায় আঙুল ছোঁয়াল, পাখিটা চোখ বন্ধ করে ফেলল। আঙুলটা আস্তে দু’তিনবার বোলাল, মাথাটা নামিয়ে পাখিটা এবার যেন জানিয়ে দিল ‘আমার ভাল লাগছে।’ দু’পায়ে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। সারা পা সাদা লোমে মোড়া। কালীর মনে হল যেন সাদা ফুল মোজা পরে রয়েছে, দেখে তার মজাই লাগল । সে পাখিটার দু’পাশ ধরে তুলে নিল। চুপটি করে থেকে সে মাথা বাঁকিয়ে শুধু কালীর মুখের দিকে তাকাল। কাকগুলো অর্ধেক পথ কালীর চারপাশে ঘিরে উড়ে অবশেষে ফিরে গেল। বাড়িতে ঢুকেই কালী হাঁক পাড়ল। ”দিদিমা, দেখে যাও। আর একজনকে এনেছি।”

সুলতা তখন ছাগল ছানার সামনের ডান পায়ে কাপড়ের পাড় জড়িয়ে ব্যান্ডেজ করছিলেন।

”আবার কাকে আনলি।” বলে পিছনে মুখ ফিরিয়ে দেখলেন উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে বড় মোরগের আকৃতির একটা পাখি। দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন সুলতা। ”ওমমা, এ তো ভারী সুন্দর দেখতে রে, কোথায় পেলি?”

‘হেকিমপুকুরের ধারে গাছের নীচে কাকে ঠোকরাচ্ছিল, উড়তে পারে না।”

”কেন পারে না?”

”সেটা দেখতে হবে। ইস্কুল ছুটি দিয়ে দিল ঘরের চালা ভেঙে পড়েছে। যদি বড়বাড়ির হেডমাস্টার মশাই বলেন তো ওঁদের মাঠে ক্লাস হবে। দিদিমা ছানাটার পায়ে কী হয়েছে?”

”বোধহয় ভেঙেছে, মনে হচ্ছে খিদে পেয়েছে রে কালী। কার ছাগল বাচ্চচা কে জানে, খোঁজ নিয়ে ফেরত দিতে হবে। মায়ের দুধ তো দিতে পারব না, গরুর দুধই খাওয়াই।” দুধের সন্ধানে সুলতা গোয়ালঘরে ঢুকলেন বাটি হাতে।

কেন উড়তে পারছে না জানার জন্য কালী পাখিটাকে তুলে ধরে ছুড়ে দিল আকাশের দিকে। ডানা বিস্তার করে দু—তিনবার ঝাপটাল এবং উঠোনে পড়ে গেল। অবাক হয়ে কালী দেখল পাখিটার ডানার পালক কেটে নেওয়া হয়েছে এমনভাবে, যাতে উড়তে না পারে। কাজটা মানুষেরই করা। কে করেছে কেন করল তাই নিয়ে কালী মাথা ঘামাল না। দুধের বাটি হাতে গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে আসা দিদিমাকে সে বলল, ”এই পাখিটারও কিন্তু খিদে পেয়েছে। দুধ একেও দাও দিদিমা।”

”দুর বোকা এসব পাখি নিরিমিষ্যি খায় না, ইঁদুর টিকটিকি ছোটখাটো সাপ পায়রা শালিক এইসব খায়। পুকুরে গিয়ে দেখি গেঁড়ি কি গুগলি পাই কি না।”

”দিদিমা পাখিটাকে আমি পুষব।”

”বেশ তো। এমন চেহারার পাখি তো আমি জন্মে দেখিনি। পোষ মানবে কি না জানি না।”

বিকেলে ধানু আসতেই কালী প্রবল উৎসাহে পাখিটাকে দেখাল। ধানু তো দেখে চমৎকৃত।

”কী পাখি আমি বলতে পারব না তবে মধুবাবু হয়তো বলতে পারবেন। ওঁর বাড়িতে এইসব বিষয়ে অনেক বই আছে।”

দু’দিন পর ধানু জানাল, ”মধুবাবু আমার কাছ থেকে সব শুনে বইটই খুলে বললেন, ভারত থেকে উত্তর—পূর্ব অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত চিলের মিলভিনে প্রজাতির একটা শাখা হয়তো হতে পারে। খুব বিরল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সমুদ্রের ধারে আর বাদা অঞ্চলে দু’চারটে দেখা যায়। ওরা মাছ খায়, গেঁড়ি গুগলিও খায়। বাংলায় এই পাখিকে সিন্ধু—গরুড়ও বলে।”

মন দিয়ে শুনে কালী বলল, ”ধানুদা, এর একটা নাম ঠিক করে দাও।”

”নাম তো সিন্ধু—গরুড় রয়েছেই, তুই একে গরুড় বলবি।”

ঠিক সেই সময় ঘরের বাইরের দাওয়া থেকে ”ব্যা—আ—আ’ শব্দ ভেসে এল। ছাগল ছানাটাকে সুলতা একটা চটের থলির উপর শুইয়ে রেখেছেন।

”ধানুদা, ওই শোনো আর একজনও নাম চাইল। তবে দিদিমা বলছিল কুড়িয়ে পাওয়া তাই কুড়োন নাম রাখতে। তুমি কি বলো।”

”খুব ভাল নাম, একজন কুড়োন আর অন্যজন…।” ধানু ভাবতে লাগল।

”উড়োন।’ কালী লাফিয়ে উঠে বলল। ”ও তো একদিন না একদিন উড়বেই, ডানার পালক কি চিরকাল ছোটই থাকবে।”

কালীর কথাই ঠিক। উড়োনের পাখার পালক যেমন ধীরে ধীরে বাড়ল তেমনি কালীও একটু একটু করে আরও লম্বা হল, কুড়োন তিন পায়ে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে বেড়াতে শুরু করল। ধানুও মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসল।

কালী ক্লাস ফাইভে ভর্তি হল বড়বাড়িতে। হেডমাস্টার প্রণব মাইতি শুনেছিলেন, ছোটবাড়ির একটি ছেলে অস্বাভাবিক লম্বা, প্রবল স্মৃতিধর এবং অবিশ্বাস্য পরিশ্রমী। মাত্র এক বছরেই সে অ আ ক খ এবং এক দুই তিন চার শিখে ক্লাস ফোর—এর পড়া শেষ করেছে। দেবিকা ঘোষাল তাঁকে একথাও বলে গেছেন যে, ”দেখবেন ও ছ’বছরের পড়া তিন বছরে শেষ করে স্টার নিয়ে মাধ্যমিক পাস করবে।”

প্রণব মাইতি অবশ্য ছোটবাড়ির বড়দিদিমণির কথা বিশ্বাস করেননি। তার মনে হয়েছে ছেলেটা আর সবার মতোই বাড়িতে পাঁচ ছয় বছর বয়স থেকে পড়া শুরু করে ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়েছিল। বার্থ সার্টিফিকেটে তিনি দেখেছেন কালীকিঙ্কর ঢালির এখন বয়স বারো। অস্বাভাবিক কিছু নয়, শুধু ওর উচ্চচতাটাই স্বাভাবিক নয়। হেডমাস্টার শুনেছেন কালীকিঙ্কর যখন ক্লাস ফোর—এ ভর্তি হয় তখন ছিল পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চি। এক বছর পর এখন তার মনে হচ্ছে উচ্চচতাটা ভুল রয়েছে, ছেলেটা আরও লম্বা।

তার মনে হওয়ার কারণ একদিন তিনি লাইব্রেরিতে ভারতের নদীর ম্যাপ নিতে যান ক্লাসে যাওয়ার আগে। কালী তখন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল একটা বই নেওয়ার জন্য। প্রণব মাইতি কালীর গা ঘেঁষে এসে আড়চোখে দেখেন তাঁর কাঁধ ও কালীর কাঁধ সমান্তরাল রেখায় এবং তিনি পাঁচ ফুট ছ’ইঞ্চি। ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম হতেই তিনি অস্বস্তিতে পড়ে যান—ক্লাস ফাইভেই কলেজের উচ্চচতর ছাত্র! ক্লাস টেন—এ তা হলে কী দাঁড়াবে!

.

স্কুলে হইহই পড়ে গেল। সুধন্য হালদার, গরিব ভ্যানরিকশাচালকের ছেলে স্টার পেয়ে মাধ্যমিক পাস করেছে। তার নম্বর চারটি লেটার সহ ছ’শো তিপ্পান্ন। এক বাক্স সন্দেশ হাতে নিয়ে ধানু সুলতাকে প্রণাম করতেই তিনি কাঁটা হয়ে গেলেন, ”বামুনের ছেলে পায়ে হাত দিলি, আমার নরক বাস যে সাত জম্মো ধরে হবে রে, এ কী করলি ধানু!” সুলতা হায় হায় করে উঠলেন।

ধানু হেসে বলল, ”হয় যদি হবে। দু’বেলা আপনার অন্ন ধ্বংস করেছি আপনার পুণ্যিও নয় খানিকটা ধ্বংস করলুম।”

”অঙ্কে পুরো নম্বর পেয়েছিস তো?”

”না দিদিমা, আট নম্বর কেটে রেখে দিয়েছে।”

হতাশ সুলতা বললে, ”একশো পাঁচ তোর কপালে আর নেই।”

টেলিফোনে কালীর কাছ থেকে খবর পেয়ে শিবুর মোটরবাইকের পিছনে বসে একঘণ্টার মধ্যে আন্নাকালী পৌঁছে গেল। ধানকুড়ির সীমানার বাইরে ই এম বাইপাসে আন্নাকে নামিয়ে দিয়ে শিবু সোনারপুর চলে গেছে, একঘণ্টা পর এখান থেকেই সে বউকে আবার তুলে নেবে। শীতলাতলায় বামুনপাড়াটা আন্না চেনে। সোজা সেখানে চলে গেল পলিথিনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে। ধানু এখন বিখ্যাত ছেলে তার বাড়ি খুঁজে নিতে তিরিশ সেকেন্ডও খরচ হল না। তখন বাড়িতে মা আর বোনেরা ছিল।

টিনভর্তি রসগোল্লা, ফুলপ্যান্ট ও বুশশার্ট মায়ের হাতে দিয়ে আন্না জানতে চাইল ধানু এবার কোথায় পড়বে?

মা বললেন, ”টালিগঞ্জে, নয়তো কাছেই গড়িয়ায় উচ্চচ মাধ্যমিক পড়তে চায়, কলকাতায় ভাল ইস্কুলে তো এই নম্বরে ভর্তি নেবে না।”

”যাতায়াতে তো অনেক সময় যাবে।”

”তা তো যাবেই।”

”তা হলে কালীকে পড়াবে কখন? কালীর বাবার একটা স্কুটার পড়ে পড়ে পচছে। ধানু ওটা নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করুক, সময় বাঁচবে। পেট্রল খরচ আমার। স্কুটার চালানোটা ওকে শিখে নিতে হবে।”

কালীর পড়াশুনোয় এতটুকু ব্যাঘাত আন্না হতে দেবে না।

ধানুদের বাড়ি থেকে আন্না এল বাপের বাড়ি। কালী তখন স্কুলে। সুলতা বাইরের উঠোনে ধানঝাড়াই তদারক করছিলেন। একটা প্রায় তিনতলা সমান বাঁশ কালী উঠোনে পুঁতে দিয়েছে, উড়োন সেই বাঁশের ডগায় বসে ধানঝাড়া দেখছে। এখনও সে দূরে উড়ে যেতে পারে না। তার ডানার পালক পুরোপুরি গজায়নি। একদিন আকাশে কিছুটা উঠেছিল। তখন একটা চিল কোথা থেকে উড়ে এসে তাকে তাড়া করে। ডানার পূর্ণতা না থাকায় সে আকাশে মহড়া দিতে পারেনি। ঠোকরানি খেয়ে উঠোনে নেমে পড়ে। কালী ওর মাথায় মলম লাগিয়ে দিয়েছিল।

কুড়োন এখন ভালই হাঁটে, তবে খুঁড়িয়ে। সুলতার যত্নে এখন সে হৃষ্টপুষ্ট, উজ্জ্বল হয়েছে কালো চামড়া। বড়ির মতো দুটো শিংও দেখা যাচ্ছে। সুলতা বাড়ির পিছনের পাঁচ কাঠা জমিতে আনাজের ছোট বাগান করেছেন। সেখানে বেগুন, কুমড়ো, ঢ্যাঁড়স, লঙ্কা, মানকচু ওল আর মাচা করে ঝিঙে, চিচিঙ্গে, করলা, উচ্ছে লাগিয়েছেন। প্রতিদিন পরিচর্যা করেন গাছপালার, সঙ্গে থাকে কালী। বালতি বালতি জল এনে ঢালা, খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে গোবরসার, খইলসার দেওয়ার কাজ কালীই করে। খিড়কির দরজা দিয়ে যেতে হয় আনাজের বাগানে। কুড়োন হাঁটাচলা শুরু করার পর থেকেই খিড়কি দরজা বন্ধ করে রাখেন সুলতা।

একদিন সকালে বাগানে কাজ করে এসে কালী বলল, ”দিদিমা কুমড়ো ফুলগুলো বেশ বড় বড় হয়েছে ভাজা খাওয়াও না, অনেকদিন খাইনি।”

নাতির আবদার শুনে সুলতা চাল গুঁড়োলেন। বাগান থেকে কমলা রঙের গোটা কয়েক কুমড়ো ফুল তুলে আনলেন। লঙ্কা দিয়ে চালগুড়োয় মাখিয়ে ভেজে কালীকে খাওয়ালেন। রাত্রে বাড়ির দরজাগুলো তিনি নিজের হাতে বন্ধ করেন। এটা তার বহু বছরের অভ্যাস। প্রথমেই দেখে নেন খিড়কির দরজা বন্ধ আছে কি না। দেখতে গিয়ে আঁতকে ”সব্বোনাশ করেছে,” বলে উঠলেন। দরজা হাট করে খোলা!

রাতটা প্রায় জেগেই কাটিয়ে পরদিন সকাল হতেই বাগানে গিয়ে সুলতা দেখলেন, পালং চারা আর কুমড়ো ডগা সাফ। রান্নাঘর থেকে কঞ্চিটা নিয়ে অপরাধীর সন্ধানে বেরিয়েই চোখে পড়ল কালী দু’হাতে উড়োনকে ধরে কুড়োনের পিঠের উপর বসাবার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা কুড়োনের মনঃপূত নয় কেন না উড়োনের তীক্ষ্ন নখগুলো তার পিঠের চামড়া আঁকড়ে ধরায় সে যন্ত্রণায় গা ঝাড়া দিয়ে ছুট লাগাল।

সুলতা কঞ্চি হাতে কুড়োনের পিছু নিলেন। ছুটে পারলেন না। কঞ্চিটা মাটিতে আছড়ে বললেন, ”হতভাগা পাঁঠা। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।” তারপর কালীর বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”একটা পালং গাছ আস্ত রাখেনি সব মুড়িয়ে খেয়েছে, কুমড়োর ডগা বলে আর কিছু নেই। বিদেয় কর, আজই, এখুনি।”

সুলতা যাকে বিদায় করতে বললেন তার ল্যাজের ডগাটি ত্রিসীমানায় সারা সকাল আর দেখা গেল না। আন্না তার কথামতো স্কুটার পাঠিয়ে দিয়েছে। একটি ছেলে কলকাতা থেকে চালিয়ে এনে ধানুকে বুঝিয়ে দেখিয়ে এবং তাকে সিটে বসিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাটি দিয়ে যায়। ছেলেটি যখন বুঝিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল কালী তখন সেখানে দাঁড়িয়েছিল। ধানু প্রায় পঞ্চাশ গজ ছেলেটির সামনে কয়েকবার টলমল করে চালায়। সাইকেল চালাতে সে ভালই জানে সুতরাং ব্যালান্স নিয়ে তাকে ঝঞ্ঝাটে পড়তে হয়নি। শুধু অ্যাক্সিলেটর, গিয়ার, ব্রেক ইত্যাদির প্রয়োগ বুঝতে সময় ব্যয় করতে হয়েছে।

প্রতিদিন ধানু বিকেলে এসে স্কুটারটি দাওয়া থেকে বার করে ধানকুড়ির ভিতরের রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ চালায়। ভিড় রাস্তা দিয়ে স্কুল ‘পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার মতো হাত এখনও যথেষ্ট পাকেনি। তবে যন্ত্রের নিয়মগুলোয় সড়গড় হয়ে গেছে। কালীর ইচ্ছা করে স্কুটার চালাতে। রোজ সকালে ধানু তাকে পড়িয়ে ভাত খেয়ে গড়িয়ায় তার স্কুলে রওনা হওয়ার পর কালী নিঃসাড়ে স্কুটারটি বার করে কিছুদূর হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে স্টার্ট দেয়। শব্দ শুনেই বাঁশের ডগা থেকে উড়োন উড়তে শুরু করে। ধীর গতিতে চালিয়ে সে খালপাড়ের ফুটবল মাঠে আসে। তার মাথার উপর পাক দেয় উড়োন আর স্কুটারের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর করে মাঠটা সে চক্কর দিতে থাকে। দিতে দিতে কালী খুশিতে আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে—

”হেই উড়োন আমিও আকাশে উড়ব।…..সাঁ সাঁ করে সাঁ সাঁ করে আকাশে স্কুটার চালাব। আমাকে তুই ধরতে পারবি না….কেউ ধরতে পারবে না আমাকে।” বলতে বলতে সে অদ্ভুত সুরে শিস দিয়ে ওঠে। ”লম্বা, আমি আরও লম্বা হব, পুঁচকে বেঁটেরা হাঁ করে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে….হা হা হা, তাকাবে তাকাবে! শুধু তুই তুই সিন্ধু—গরুড় আকাশ থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে আমাকে দেখবি।”

ফাঁকা মাঠে কালি স্কুটার চালায় আর চেঁচিয়ে যায়। মিনিট দশেক পর সে বাড়ি ফিরে আসে। উড়োন তখন হেকিমপুকুরের পাড়ে উড়ে যায় শামুক আর মাছের খোঁজে। ফেরে দুপুরে। একতলা বাড়ির ছাদের দক্ষিণ দিকের কার্নিসে বসে থাকে যতক্ষণ না কালী স্কুল থেকে ফেরে। কালীকে দেখামাত্র ‘খক খক’ করে ডেকে দুটো ডানা ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে।

সেদিন কুড়োনকে দুপুরেও দেখতে না পেয়ে সুলতার মুখ শুকিয়ে গেল। তার শুধু মনে হতে লাগল, ওকে কেউ চুরি করল না তো? এখানে বাচ্চচা বেওয়ারিশ পাঁঠা প্রায়ই চুরি হয়। চুরি যাওয়া পাঁঠা চালান হয়ে যায় কসবা কিংবা যাদবপুরের মাংসের দোকানে। সুলতা মুখে ভাত তুলতে পারলেন না। সারা দুপুর সদর দরজার পাশের রোয়াকে বসে কাটালেন।

কালী স্কুল থেকে ফিরতেই সুলতা বললেন, ”দ্যাখ তো কালী কুড়োন রাগ করে সকাল থেকে কোথায় যে চলে গেল এখনও ফেরেনি।”

কালী মুখের দু’পাশে হাতের তালু রেখে ছাগলের ডাকের নকল করে কয়েকবার ‘ব্যা ব্যা’ আওয়াজ করল। দু’মিনিট অপেক্ষা করে আবার করল। কুড়োনের সাড়াশব্দ এবারও মিলল না। কালী হুমম শব্দ করে উড়োনকে কার্নিস থেকে উড়িয়ে দিল। উড়োন হেকিমপুকুরের দিকে উড়ে গেল।

মিনিট পাঁচেক পর দেখা গেল কুড়োন ছুটতে ছুটতে আসছে আর উড়োন ওর পিঠে বসার চেষ্টায় দুটো ডানা ছড়িয়ে ব্যালান্স করার জন্য বাঁকানো লোহার হুকের মতো নখগুলো দিয়ে পিঠটা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছে। ছুটন্ত কুড়োনের পিঠে দু’তিন সেকেন্ড বসেই উড়োন আবার শূন্যে উঠল আবার বসল। যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে কুড়োন এবার সুলতার কোলে একছুটে পৌঁছে গেল। এরপর কুড়োনের পিঠে কয়েকটা চড় পড়ল এবং দুপুরে না খাওয়া সুলতার ভাত তাকে খেতে হল।

কালী ফাইভ থেকে সিক্সে উঠল প্রথম হয়ে এবং তার দেহের উচ্চচতাও নজর কাড়ার মতো ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে। হেডমাস্টারমশাই শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রথম দিনই কালীকে ক্লাস থেকে ডাকিয়ে তার ঘরে নিয়ে এলেন।

”তোমার হাইট এখন কত?”

হেডস্যারের গম্ভীর স্বরে কালী মনে মনে কুঁকড়ে গেল। যখন বেয়ারা ক্লাসে গিয়ে বলল কালীকিঙ্কর ঢালিকে হেডস্যার ডাকছেন, তখন সে ভেবেছিল পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার জন্য পিঠ চাপড়ে বলবেন, ‘খুব ভাল। এবার আরও ভাল ফল করতে হবে। ইংরিজিটা নতুন বিষয়, তবে শক্ত নয়। তুমি ঠিক ধরে ফেলতে পারবে।’ ধানুদা এই ভাবেই তাকে বলেছে, হেডস্যারও নিশ্চয় এইরকমই কিছু বলবেন, কিন্তু একী অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন?

”আমি জানি না স্যার, মেপে দেখিনি।”

প্রণব মাইতি বিশাল একটা ‘হমমম’ শব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। টেবল থেকে কাগজ কাটার ছুরিটা তুলে নিয়ে দেওয়ালের কাছে গিয়ে বললেন, ”এদিকে এসো, দেওয়াল ঘেঁষে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াও!”

কালী তাই করল। হেডস্যার ছুরিটা কালীর ব্রহ্মতালুর উপর চেপে দেওয়ালে ঠেকিয়ে বললেন, ”এবার সরে দাও।”

কালী সরে গেল। ছুরি যেখানে ছিল সেইখানে দেওয়ালে দাগ কাটলেন। তারপর পেনসিল দিয়ে কালো আঁচড় টেনে বললেন, ”মনে হচ্ছে এক বছরে ইঞ্চি চারেক বেড়েছ। ছ’ ফিটের কাছাকাছি হবে। এখন যাও, টিফিনে দেখা কোরো।”

টিফিনের সময় কালী হেডমাস্টারের ঘরে গেল। দেখল একটা দৈর্ঘ্য মাপার ফিতে টেবলের উপর আর হেডস্যারের কপালের উপর দুটো রেখা।

”যা আন্দাজ করেছিলুম, পাঁচ ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি। কালীকিঙ্কর তুমি যদি এইভাবে বাড়তে থাকো তা হলে ক্লাস টেনে কী হবে? একটা উৎকট বীভৎস লম্বা দৈত্য হবে।”

কালী চুপ করে রইল। শুধু দৈত্য শব্দটা কানে একঘেয়ে স্কুটার হর্নের মতো বেজে যেতে লাগল।

”কমাও, হাইট কমাও। মানুষের মতো, আমাদের মতো হাইট করো, নয়তো এই স্কুলে তোমায় রাখা যাবে না।”

ঢোঁক গিলে কালী বলল, ”কী করে হাইট কমাব স্যার?”

হেডমাস্টার নিশ্চিত স্বরে বললে, ”এটা একটা অসুখ, ডাক্তার দেখাও, নয়তো যাগযজ্ঞ করো। সব থেকে ভাল হয় বাড়িতে বসে থাকো আর পড়ো। পরীক্ষার ক’টা দিন এসে পরীক্ষা দিয়ে যেও। সুধন্য তোমার প্রাইভেট টিউটর তো, ওকে বলো আমার সঙ্গে দেখা করুক।”

আকাশ কারুর মাথায় ভেঙে পড়ে না, কিন্তু কালীর মাথায় পড়ল। সে বাড়িতে এসেই দিদিমাকে বলল হেডস্যারের কথাগুলো।

সুলতা অবাক হয়ে বললেন, ”বলছিস কী, লম্বা হওয়াটা অপরাধ? মানুষ তো লম্বা—চওড়াই হতে চায়, এটা তো ভগবানের আশীব্বাদ!” তারপরই ক্ষিপ্তস্বরে বললেন, ”দেখি তোর হেডস্যারের কেমন মুরোদ ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে। আমি রাস্তা আটকাব, বাইপাস বন্ধ করব, ধন্না দিয়ে ইস্কুলে বসে থাকব।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে সুলতা হাঁফাতে লাগলেন।

সন্ধ্যায় সব শুনে ধানু বলল, ”কালকেই আমি হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করব।”

স্কুল কামাই করে ধানু দেখা করতে গেল প্রণব মাইতির সঙ্গে। হেডমাস্টারের দরজা বন্ধ, কামরার বাইরে তখন বয়স্ক নারীপুরুষের ভিড় আর চেঁচামেচি চলেছে। ওরা এসেছে কয়েক নম্বরের জন্য ফেল করা ছেলেমেয়েদের পাশ করিয়ে দেওয়ার আর্জি নিয়ে। হেডমাস্টার মশাই ‘অসম্ভব’ বলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। আরজিটা এর পরই বদলে গিয়ে হয়েছে দাবি এবং দাবির যা পরিণতি হয় এখন সেটাই চলছে, বিক্ষোভ এবং স্লোগান।

এক মহিলা কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, ”দেখুন তো কী জুলুম, মোটে সতেরো নম্বর কম পেয়েছে ভূতের বিজ্ঞানে আর কিনা ফেল করিয়ে দিল?”

তাই শুনে এক মাঝবয়সী পুরুষ হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ”হেডমাস্টারের অন্যায় জুলুম মানছি না মানব না।”

ধানু একধারে দাঁড়িয়ে দেখছিল। পাশে দাঁড়ানো একজনকে নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, ”আপনি এখানে কেন, কেসটা কী?”

”ইতিহাস, বাংলা আর অঙ্ক। ইতিহাসে চব্বিশ, বাংলায় তেরো, অঙ্কে নয় পেয়েছে। ভাল ছেলে তবু কেন যে এমন নম্বর পেল! খাতাই ঠিকমতো দেখা হয়নি। দেখবে কখন, টিউশনি করে সময় পেলে তো দেখবে।” ব্যাজার মুখে কথাগুলো বলে ভদ্রলোক মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ”চলবে না, চলবে না।”

ধানু আবার জিজ্ঞাসা করল, ”আপনি রোজ পড়াতে বসাতেন?”

বিরক্ত মুখে ভদ্রলোক বললেন, ”অতো সময় কোথায় আমার।”

থানায় খবর চলে গেছে। দুজন লাঠিধারী কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে খাঁকি উর্দিপরা দারোগা হবিবুল মোল্লা (ধানকুড়িতে তিনি হাবু দারোগা নামে প্রসিদ্ধ) জিপ থেকে নামলেন। ধানুর সঙ্গে পরিচয় আছে হাবু দারোগার। ওর ছেলে বসির মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ধানুর সঙ্গে, ভাল বন্ধুত্বও রয়েছে।

”তুই কেন এখানে? পড়তে যাসনি?” ধানুকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ধমকে বলেন হাবু দারোগা। ভিড় ঠেলে হেডমাস্টারের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, ”যে স্কুটারটা চালাস ওটা এক ডাকাতের, তবে বেনামে, আর তোর ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।”

দারোগার সঙ্গে ধানুও হেডসারের ঘরে ঢুকে গেল। প্রণব মাইতিকে সেলাম করে দারোগাবাবু বললেন, ”স্কুল থেকে থানায় টেলিফোন গেছল আপনি বিপন্ন, প্রাণ সংশয়ও রয়েছে। স্যার যদি বলেন লাঠি চালিয়ে স্কুল থেকে এদের বার করে দিতে পারি।”

”তারপর এই স্কুল থেকে চিরকালের জন্য আমাকেও বেরিয়ে যেতে হবে।” শুকনো মুখে হেডস্যার জানিয়ে দিলেন। ”লাঠিফাটি একদম নয়। সব ক’টাকে পাশ করিয়ে দিচ্ছি। ভবিষ্যৎ তো ঝরঝরে হয়ে গেছে, বাপ মা যদি আরও ঝরঝরে করতে চায় তো হোক। তিনবার খাতা দেখে টেনেটুনে বাড়িয়েও যদি পাশমার্ক না পায় তা হলে ফেল না করিয়ে উপায় কী?”

হাবু দারোগা ঘর থেকে বেরিয়ে উৎকণ্ঠিত ভিড়কে জানিয়ে দিলেন, ”হেডমাস্টারমশাই বলেছেন সবাই পাশ, খুশি তো? এবার আপনারা বাড়ি যান।”

একজন বলে উঠল, ”হেডমাস্টার প্রণব মাইতি জিন্দাবাদ।”

”জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।” সমস্বরে জয়ধ্বনি দিতে দিতে ভিড় উধাও হল।

ঘর ফাঁকা হতে প্রণব মাইতি বললেন, ”সুধন্য, কালী ছেলেটি পড়াশুনোয় ভাল, খুবই ভাল, বিনয়ী নম্র শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করে কিন্তু মুশকিল কী জানো, ওর চেহারাটা বড্ড বড়, হাইট প্রায় ছ’ফুট, যখন প্রথম আসে ছিল সাড়ে পাঁচ ফুট, আমার সমান। স্কুলের রেকর্ডে বয়স এখন বারো। অবশ্য ছোটবাড়ির হেডমিস্ট্রেস দেবিকা ঘোষাল বলেছেন বয়সটা বছর চারেক বাড়ানো হয়েছে। সারা স্কুল এখন আড়ালে ওকে কিংকং বলতে শুরু করেছে। নামটা যে কী করে তৈরি হল কে জানে।”

ধানু বলল, ”আমি জানি স্যার। ছোট দিদিমণি আমার প্রতিবেশী তিনি আমাকে বলেছেন, কালী যখন ভর্তি হয়ে যায় তখন নাম জিজ্ঞাসা করেন বড়দিদিমণি। উনি কানে একটু কম শোনেন আর কালীর তখন সর্দি হয়ে গলা ঘড়ঘড়ে। কিঙ্করকে তিনি শোনেন কিংকং। কালীকে উনি খুব স্নেহ করতেন, খুশি হলে কিংকং বলে ডাকতেন।”

”কিন্তু নামটা যে ফিল্মের পরদা থেকে ধানকুড়িতে নেমে আসছে। একটা বিরাট চেহারা ক্লাস সিক্সে বসে, ছেলেদের তো বটেই মাস্টারমশাইদেরও পড়াতে অস্বস্তি হয়। মদনবাবু, ননীগোপালবাবু, সেলিমসাব আমাকে বলেছেন ছোট ছোট ছেলেদের মধ্যে ওকে দেখলে একদম বেমানান লাগে, পড়াতে অস্বস্তি হয়। আমার ধারণা কালীরও হয়। বছর যতই গড়াবে আমার মনে হচ্ছে কালীর শরীরও ততই বাড়বে। তখন তো ধান্যকুড়িয়া আদর্শ মাধ্যমিক শিক্ষা নিকেতন একটা দ্রষ্টব্য স্থান হয়ে উঠবে চিড়িয়াখানার মতো।”

”চিড়িয়াখানা’ শব্দটা গরম করে দিল ধানুর মাথা। কালীকে পশু বা পাখি ভাবতে তার কষ্ট হচ্ছে। আবার হেডস্যারের কথাগুলোও ফেলে দেওয়ার মতো নয়, তারও মনে হচ্ছে কালীর শরীরের বৃদ্ধি ঘটবে, সমস্যায় পড়বে।

”তা হলে কী করতে বলেন?”

”আমার মনে হয় না চিকিৎসা করে ওর বাড়বৃদ্ধি বন্ধ করা যাবে বা তাগা মাদুলি পুজো দিয়েও কিছু করা যাবে। তুমি তো ওকে বাড়িতে পড়াও, তাই করো। স্কুলে আসার কোনও দরকার নেই। এই স্কুল থেকেই কালী সোজা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে সে ব্যবস্থা আমি করব।”

”স্যার, এখন ওর যা হাইট সেটা এমন কিছু চোখে পড়ার মতো নয়। ছয় কি সাড়ে ছয় ফুট লম্বা লোক তো প্রচুর দেখা যায়।” ধানু যথাসাধ্য সওয়াল করার চেষ্টা চালাল কালীর স্কুলে পড়ার পক্ষে। ”আরও দু’—তিনটে বছর দেখুন না, তেমন মনে হলে আমিই ওকে স্কুলে আসতে দেব না।”

হেডমাস্টারমশাই রাজি হলেন ধানুর কথায়।

ধানু সুলতাকে জানিয়ে দিল কালী যেমন স্কুলে যাচ্ছে তেমনই যাবে।

স্বস্তি পেলেন সুলতা, তাকে পথ অবরোধে বা ধর্নায় আর বসতে হবে না।

খেলার ও ভূগোলের যুগ্মশিক্ষক নুরমহম্মদস্যারের হঠাৎই মনে হল তার স্কুলেই লুকিয়ে রয়েছে ব্রেট লী। কালীকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে ঘণ্টায় একশো মাইল বেগে ওকে দিয়ে বল করানোটা কোনও ব্যাপারই হবে না। কালীকে তিনি ডেকে পাঠালেন।

”কালী তুমি কখনও কোনও খেলা খেলেছ?”

”কবাডি খেলি স্যার।”

”ফুটবল ক্রিকেট হকি?”

”না স্যার।”

”ফাস্টবোলার চাই আমাদের স্কুল টিমের, তুমি হবে?”

”হব স্যার।”

”কখনও বল করেছ?”

”না স্যার।”

”খালপাড়ের মাঠে আজ বিকেলে এসো।”

এইভাবে কথাবার্তা হল টিচার্স রুমে দু’জনের মধ্যে। বিকেলে কালী হাজির হল খালপাড়ে। দুটি পুরনো ক্রিকেট বল, দু’জোড়া ব্যাটিং গ্লাভস, দু’ সেট স্টাম্প, দু’জোড়া প্যাড, দুটি ক্রিকেট ব্যাট এবং উইকেটে কিপিং গ্লাভস এই হল স্কুলের ক্রিকেট—সম্পদ। মাঠের একবারে ঘাস চেঁছে মাটিতে জল ঢেলে দুরমুশ করে যথাসাথ্য সমান করার চেষ্টায় পিচ ঢেউ খেলানো। জনাআষ্টেক ছেলে নেট প্র্যাকটিসে হাজির এবং নুরমহম্মদস্যারও।

কালীকে দেখেই নুরুসার (ছাত্ররা ওই নামেই তাঁকে ডাকে), বললেন, ”কালী, বল করার আগে মাঠটা দু’পাক দৌড়ে নাও।”

কালী দুটো পাক দিয়ে আসতেই নুরুস্যার বললেন, ”কোন হাতে বল করবে, ডান হাতে তো?”

”হ্যাঁ।”

”আমি বল করছি তুমি দেখো, মন দিয়ে লক্ষ করো।” নুরুস্যার ছিপছিপে, বয়স বছর চল্লিশ। কলকাতার ময়দানে দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাব কসবা ফ্রেন্ডস ইউনিয়নে অফস্পিন বোলার ছিলেন। খেলেছেন এক বছর, চারটি ম্যাচে। ট্রাউজার্স হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে বল হাতে একুশ পা হেঁটে একটা ইট দিয়ে মাটিতে দাগ কাটলেন। বলটা ট্রাউজার্সে ঘষতে ঘষতে কালীকে চেঁচিয়ে বললেন, ”ওয়াচ মি কালী। এইভাবে ধরলে ইনসুইং করবে বল।”

এর পর নুরুস্যার প্রবল গতিতে ছুটে বোলারের উইকেটের কাছে পৌঁছেই তড়াক করে একটা লাফ দিয়ে হাত ঘুরিয়ে বল ছাড়লেন। ব্যাট হাতে ক্লাস টেন—এর শম্ভু, স্কুলটিমের সেরা ব্যাট। বলটা তার মাথার সমান উঁচুতে আসছে দেখে সে ভয়ে বসে পড়ল। গ্লাভস হাতে একটি ছেলে উইকেটের পিছনে ছিল সে বলটা ধরার কোনও চেষ্টাই করল না। বলটা কুড়িয়ে আনতে দৌড়ল আর একজন।

”ঠিক যেভাবে ডেলিভারি দিলুম সেইভাবে বল করে দেখাও!” নুরুস্যার কালীর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন। একটা দারুণ এক্সপেরিমেন্ট সফল হবে কি হবে না, সেই উত্তেজনায় তাঁর বুকের মধ্যে কাঁপন দিচ্ছে।

যেভাবে নুরুস্যার দৌড়ে এসেছিলেন ঠিক সেইভাবে কালী বল হাতে দৌড়ে এল একুশ কদম। লাফাল এবং হাত ঘুরিয়ে বল করল। নুরুস্যারের থেকে দশ গুণ গতিতে বলটা শম্ভুর মাথা লক্ষ্য করে ধেয়ে গেল। সে সরে যাওয়ার কি মাথা নামাবার সময়টুকুও পেল না তবে আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিবশে ব্যাটটা মুখের কাছে তুলে ধরে। ‘খটাস’ একটা শব্দ হল। শম্ভু ব্যাট ছুড়ে ফেলে দিয়ে গ্লাভস খুলে ডান হাতের তর্জনী চোখের সামনে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

কান্না দেখে নুরুস্যার ঘাবড়ে গেলেন। কালীকে ধমকে বললেন, ”এটা কী বল হল?”

কাঁচুমাচু হয়ে কালী বলল, ”আমি তো স্যার ঠিক যেভাবে আপনি বল করবেন সেই ভাবেই করেছি, ভুল হয়েছে কী?”

নুরুস্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, ”বল কোথায় পিচ করতে হয় জানো না। গবেট কোথাকার।” তারপর শম্ভুকে বললেন, ”অ্যাই শম্ভু বাচ্চচাছেলের মতো কাঁদিস না। ক্রিকেট পুরুষমানুষের খেলা। ওরকম একটু—আধটু সবারই লাগে। যা ব্যাট কর।”

”না স্যার।” গোঁয়ারের মতো গলায় শম্ভু মাথা নেড়ে প্যাড খুলতে খুলতে বলল, ”ওই কিংকংটা বল করলে আমি ব্যাট ধরব না।”

ঘটনাটা এবং নুরুস্যারকে দেওয়া শম্ভুর উত্তরটা পরদিনই স্কুলে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। কালীকে এখন সবাই কিংকং বলে। প্রথমে সে অবাক হয়ে যেত। বড়দিদিমণিকে একবার সে জিজ্ঞাসা করেছিল নামটার মানে কী? তিনি বলেছিলেন, ”আফ্রিকার কঙ্গো রাজ্যের জঙ্গলে একটা গেরিলা ছিল, পাহাড়ের মতো তার চেহারা। কয়েকটা দুষ্টুলোক ওর চেহারা ভাঙিয়ে ব্যবসা করবে বলে ওকে অজ্ঞান করে লোহার খাঁচায় পুরে জঙ্গল থেকে ধরে নিয়ে আসে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। তারা ওর নাম দেয় কিংকং অর্থাৎ রাজা কং। শ’য়ে শ’য়ে লোক টিকিট কেটে কং—কে দেখতে আসে। তখন সে খেপে উঠে লোহার শিকল ছিঁড়ে খাঁচার লোহার গরাদ দুমড়েমুচড়ে বেরিয়ে এসে লণ্ডভণ্ড শুরু করে দেয়। দু’হাতে বেয়ে বেয়ে কং প্রায় আটশো হাত উঁচু এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ে ওঠে। শেষকালে অবশ্য তাকে পুলিশ এরোপ্লেন থেকে গুলি করে মেরে ফেলে। আমার বাবা ছোটবেলায় কিংকং সিনেমাটা দেখেছিলেন। গল্পটা আমার ছোটবেলায় বাবা বলেছিলেন। কং—এর মনটা খুব ভাল ছিল, মায়ামমতায় ভরা ছিল।”

বড়দিদিমণির কাছে যতটুকু শুনেছিল তাতে কিংকং—কে ভালই লেগেছিল কালীর। সে তো খারাপ কাজ কিছু করেনি। তাকে জঙ্গল থেকে ধরে আনল যে লোকগুলো তারাই তো বদমায়েশি করেছিল। কং—এর উপর অত্যাচার হয়েছিল বলেই সে খেপে উঠেছিল, নয়তো সে ভালমানুষই ছিল। কালী মনে মনে কং—এর পক্ষ নিয়ে যুক্তি সাজিয়ে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে। ছেলেরা কিংকং বলে ডাকলে তার ভালই লাগে। রাতে খোলা জানলা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের শরীরটাকে কল্পনায় কং—এর মতো বিরাট করে সে শিকল ছিঁড়ে গরাদ ভেঙে বেরিয়ে আসে, তারপর উড়োন হয়ে উড়ে যায়। আকাশের পর আকাশ পার হয়, মেঘ নিয়ে লোফালুফি করে, দু’হাতে তারাদের কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করে, একটা একটা করে সেগুলো নীচে ফেলে দিয়ে দেখে, দিদিমা উঠোনে ঝাঁট দিয়ে তারা কুড়োচ্ছে। তারাগুলো আঁচলে তুলে দিদিমা রান্নাঘরে চলে গেল বোধহয় চালভাজার মতো করে ভাজবে । কালী তারপর শোঁ শোঁ করে নেমে আসে। তারাভাজা খেতে কেমন লাগে সেটা পরখ করবে বলে। রান্নাঘরের দরজায় বসে থাকতে থাকতে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

কিন্তু উড়ে বেড়াবার বদলে সে প্রথম ধাক্কা গেল ক্লাস সেভেনে উঠে।

.

হেডমাস্টারমশাই বলেছিলেন, ‘বছর যতই গড়াবে আমার মনে হচ্ছে কালীর শরীরও ততই বাড়বে।’ দেখা গেল তাঁর অনুমানটাই ঠিক। ক্লাস সেভেনে কালী উঠল সাড়ে ছয় ফুট লম্বা হয়ে।

উঁচু ক্লাসেরই কোনও ছাত্রের মাথা থেকে বেরিয়েছিল পাঞ্জা লড়াইয়ের ব্যাপারটা। প্রত্যেক সেকশন থেকে তিন জনের একটা করে টিম হবে। তিনটি ছেলে অন্য সেকশানের তিনটি ছেলের সঙ্গে লড়বে। জিতলে পাবে এক পয়েন্ট। ফাইভ থেকে টেন মোট পনেরোটি সেকশনের মধ্যে, ‘ধান্যকুড়িয়া মাধ্যমিক আদর্শ শিক্ষা নিকেতন আর্ম রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপে’ নাম দিল আটটি সেকশন। সাতটি সেকশন নাম দিল না একটি কারণে, যথেষ্ট বলশালী ছেলে সংগ্রহ করে উঠতে না পারায়।

পাঞ্জা লড়াইকে ঘিরে স্কুলে উৎসাহের জোয়ার বইল। চ্যাম্পিয়নদের জন্য কাপ, রানার্সদের জন্য মেডেল দেওয়া হবে। সে কথা পোস্টারে লিখে দেওয়ালে সাঁটা হয়ে গেল। উদ্যোক্তা ছাত্ররা পুরস্কার কেনার জন্য চাঁদা তুলল। প্রতিযোগিতার সূচি তৈরি করতে বসে সংগঠকরা ক্লাস সেভেন ‘বি’ সেকশনের টিমে কালীকিঙ্কর ঢালি নামটা দেখে আঁতকে উঠল।

”সর্বনাশ! কিংকং! ওর থাবায় কে হাত দেবে? ধরবে আর গুঁড়িয়ে দেবে। আমি বাবা পাঞ্জা লড়ায় নেই, তুলে নিচ্ছি আমার নাম।” কথাটা বলল হৃষ্টপুষ্ট দেহের দশম ক্লাসের ছাত্র বিজন ঘোষ।

সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করল।

”ভেবে দেখার মতো কথা।” আর একজন বলল, ”কালীকে ছেঁটে ফেলে দিতে হবে নইলে ও একাই কাপ জিতে নিয়ে যাবে।”

সংগঠক ছেলেরা দেখা করল নুরুস্যারের সঙ্গে। তিনি বললেন ”এ আর এমন কী শক্ত ব্যাপার। তোমরা শরীরের ওজনের ভিত্তিতে গ্রুপ করো। কালীর এখন ওজন কত?”

ছেলেরা মাথা চুলকোতে লাগল। একজন বলল, ”আশি—পঁচাশি কেজি হবে।” আর একজন বলল, ”একশোর কাছাকাছি হতে পারে।”

নুরুস্যার বললেন, ”কুস্তি, ওয়েটলিফটিং, বক্সিংয়ে যেমন ওয়েটের ক্যাটাগরি থাকে তোমরা সেইভাবে তিনটে ভাগ করো। পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ কেজি একটা, আর একটা পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন আর তৃতীয়টা পঞ্চান্ন থেকে—তিনি ভ্রূ কুঁচকে চোখ সরু করলেন। ”কত পর্যন্ত রাখতে চাও?”

একটি ছেলে তাড়াতাড়ি বলল, ”বিজনের ওয়েট যতটা আমাদের মধ্যে ওরই ওজন সব থেকে বেশি।”

”কত ওয়েট বিজনের?”

”তা তো জানি না, ডাক্তারবাবুর চেম্বারে গিয়ে ওজন করিয়ে আনতে হবে।”

নুরুস্যার বললেন, ”এখনও জানো না? তা হলে আজই করিয়ে নাও আর বিজনের ওজনটাই হবে তৃতীয় ক্যাটাগরির লিমিট।”

সেদিন সন্ধ্যাতেই ডাক্তারমল্লিকের চেম্বারে গিয়ে বিজন ওজন নিল—সাড়ে তেষট্টি কেজি। এরপর ঠিক হল তৃতীয় ক্যাটাগরি হবে পঞ্চান্ন থেকে পঁয়ষট্টি কেজি। ওরা নিশ্চিত, কালী এই ওজনের থেকে বেশিই হবে।

পরদিনই প্রতিযোগিতার নতুন নিয়ম ক্লাসে ক্লাসে জানিয়ে দেওয়া হল। ওজন না করিয়েই এর ফলে বাদ পড়ে গেল কালী। এই ক’দিন ক্লাস সেভেন হৈ হৈ করে বলে বেড়াচ্ছিল, তারা চ্যাম্পিয়ন হচ্ছেই কেন না তাদের টিমে আছে ‘কিংকং’ কালী। সে নিজেও ধরে নিয়েছিল তার ক্লাসকে জেতাচ্ছে, সবাই তার কাছে এসে হাতটা ধরছে। ক্লাসের সব থেকে লম্বা ছেলেটি তার থেকে এক ফুট ছোট, বাকিরা সব একহাত নীচে। দূরে দূরে থাকে ওরা। পাঞ্জা লড়ায় ক্লাসকে স্কুলের সেরা করলে আনন্দে ওরা তার কাছে এগিয়ে আসবে। এই ভেবে কালী মনে মনে খুশিতে ফুরফুরে হয়েছিল। হঠাৎ নতুন নিয়মের বজ্রাঘাতে তার মনের খুশি জ্বলে খাক হয়ে গেল।

তার মনমরা মুখ দেখে নুরুস্যার বুঝলেন আঘাত পেয়েছে, অপরাধ বোধে পীড়িত হলেন। আসলে তাঁর দেওয়া বুদ্ধিতেই তো কালীকে বাদ দেওয়া গেছে। তিনি স্থির করলেন, ছেলেটিকে অন্য কোনও খেলার মধ্যে নিয়ে সকলের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দেবেন। স্কুলে ক্রিকেট ছাড়া খেলা বলতে আর আছে ফুটবল। ফুটবল দলেই কালী তা হলে আসুক।

তিনি স্কুলের গেটের কাছে কালীকে ধরলেন।

”কালী ফুটবল খেলেছ কখনও?”

”না স্যার, তবে খালপাড়ের মাঠে দেখেছি।”

”গোলকিপার কীভাবে খেলে দেখেছ তো? পারবে গোলকিপার খেলতে?”

কালী মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল, ”দু’—চারদিন প্র্যাকটিস করলেই পারব।”

খুব আনন্দ হল কালীর। অনেকের সঙ্গে মিশে গিয়ে খেলতে তার ইচ্ছে করে। সে অনেক অনেক ছেলের মধ্যে থাকতে চায়।

”তা হলে কাল সকালে সাতটার মধ্যে মাঠে চলে এসো। গোলকিপিং কীভাবে করতে হয় সেটা শিখিয়ে দেব। আমি অবশ্য ফুটবলের নই ক্রিকেটের লোক, তা হলেও ফুটবল নিয়ে অল্পসল্প পড়েছি। ফান্ডামেন্টাল জ্ঞানটা আমার আছে। যাই হোক তোমার এই হাইটটা কাজে লাগাতে চাই। আমাদের দেশে লম্বা গোলকিপার খুব কমই পাওয়া গেছে। দেখি তোমাকে দিয়ে অভাবটা পূরণ করা যায় কি না। কাল এসো কিন্তু।” এই বলে তিনি কালীর পিঠে দুটো চাপড় দিলেন।

পরদিন কালী সকালে খালপাড়ের মাঠে ঠিক সময়ে পৌঁছল। স্কুলের উঁচু ক্লাসের জনা বারো ছেলে দল করে খেলছে। তাকে দেখে নুরুস্যার মাঠটা দুটো চক্কর দিয়ে দৌড়তে বললেন। সে দৌড়ল। দৌড়তে দৌড়তে সে দেখল উড়োন উড়ে এসে অশ্বত্থ গাছটায় বসল। গাছটার পাশ দিয়ে সে দৌড়ে যাওয়ার সময় উড়োন ডানা ঝাপটে উড়ল এবং ছুটন্ত কালীর মাথার উপর তাকে অনুসরণ করে উড়তে থাকল। নুরুস্যার ব্যাপারটা লক্ষ করলেন।

দু’ চক্কর ছুটে এসে কালী দাঁড়াতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ”পাখিটা কি তোমার?”

উড়োন আবার অশ্বত্থ গাছে গিয়ে বসেছে। সেদিকে তাকিয়ে কালী হাসল। ”হ্যাঁ স্যার।”

”পেলে কী করে?”

”এই হেকিমপুকুরের ধারে গাছতলায়। রাতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল, সকালে ও ঘাসের ওপর পড়ে ছিল, কাকে ঠোকরাচ্ছিল, ডানার পালকগুলো কাটা ছিল, উড়তে পারছিল না। বোধহয় ওর ওড়া বন্ধ করার জন্য কোনও লোক ডানা ছেঁটে দিয়েছিল। ওর নাম রেখেছি উড়োন, নামটা ভাল নয় স্যার?” কালী উদ্দীপনাভরা চোখে তাকাল।

”ওকে একটু ভাল করে দেখতে হবে। তোমাদের বাড়িতে গেলে দেখা যাবে?”

”দেখবেন? এখুনি দেখাচ্ছি।” কালী মুখে আঙুল ঢুকিয়ে তীক্ষ্ন শিস দিল। তারপর সুর করে গলা ছেড়ে ডাকল, ”উ উ উ উ ড় অ অ ন।”

শিস শুনেই উড়োন চকিত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। ডাক শুনে উড়ে এল। দুটো ডানা ছড়িয়ে কালীর মাথার উপর গোল হয়ে ঘুরতে লাগল। নুরুস্যার মুখ তুলে চোখ বিস্ফারিত করে উড়োনকে দেখতে লাগলেন।

”রেয়ার বার্ড, বিরল প্রজাতির, আমি এই প্রথম এমন একটা পাখি দেখলুম। কালী ওকে গাছে গিয়ে বসতে বলো তো।”

কালী অশ্বত্থ গাছের দিকে হাত ছুড়ে ছুড়ে ”যাহ যাহ” বলল। উড়োন শোনামাত্র গাছের দিকে উড়ে গেল কিন্তু কোনও ডালে বসল না, না বসে গাছটা পেরিয়ে উড়ে গেল দক্ষিণে।

কালী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ”খাবারের খোঁজে গেল।”

ছেলেরা খেলা শেষ করে মাঠের ধারে এসে দাঁড়াল। নুরুস্যার ওদের বললেন, ”কালীকে যদি গোলকিপার করা যায় তা হলে কেমন হবে বল তো ভোলা?”

ভোলা বলল, ”দারুণ হবে স্যার, ওপর দিয়ে কেউ গোল দিতে পারবে না।”

”তা হলে ওকেই আমাদের গোলকিপার করা যাক। কিন্তু মুশকিল কী জানিস, কালী কোনওদিন ফুটবল খেলেনি, শুধু কবাডিই খেলেছে।” নুরুস্যার চিন্তিত মুখে বললেন। ”ওকে গোলকিপিংটা শেখাতে হবে। ঠিক আছে, শিখিয়ে দেওয়া যাবে। কালী গোলে গিয়ে দাঁড়াও।” নুরুস্যার আঙুল তুলে একদিকের গোল দেখালেন।

প্রথমে পনেরো মিটার দূর থেকে অমিয় শট নিল। মাঝারি গতির শট কালীর মুখের কাছে। মাছি ধরার মতো খপ করে সে বলটা দু’হাতে ধরে নিল। পরের শটটা নিল শামিম, বেশ জোরে কালীর ডান দিকে। লম্বা হাত দিয়ে মশা তাড়াবার মতো সে বলটা সরিয়ে দিল। নুরুস্যার উত্তেজিত হয়ে দু’হাত মুঠো করে ঝাঁকালেন।

”এই তো পেয়ে গেছি, দেখলি পাঁচকড়ি কীভাবে দুটো শিওর গোল বাঁচাল কালী। এবার নীচে দিয়ে শট নিয়ে দ্যাখ তো, পারে কি না।”

পাঁচকড়ি পঁচিশ হাত দূর থেকে জমি ঘেঁষে কড়া শট নিল। কালী ডান পা বাড়িয়ে বলটা গোললাইনের বাইরে ঠেলে দিল। নুরুস্যার চেঁচিয়ে উঠলেন, ”ওয়ার্ল্ড ক্লাস শেভ। পাঁচকড়ি, জার্মান গোলকিপারকে দেখেছিলি ঠিক ওইভাবে পা দিয়ে ১০ গজ থেকে ফিগোর মারা বলটা শেভ করেছিল। নে আরও গোটা দশেক মার।”

দশ নয় পরপর কুড়িটা শট মারল সাতজন। এগারোটা গোলে এল এবং প্রত্যেকটাই কালী হাত নয়তো পা দিয়ে আটকে দিল। একটা ব্যাপার সবারই নজরে পড়ল, কালী বিশেষ নড়াচড়া করে না হয়তো করার দরকার হয়নি বলে। নুরুস্যার একটা সারকথা বুঝে গেছেন, কালী যেভাবে খেলছে খেলুক, কিছু শেখাতে গেলেই স্বাভাবিক খেলাটা ও হারিয়ে ফেলবে। দরকার নেই শিখিয়ে।

এক সপ্তাহ পর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপের ‘ডি’ গ্রুপের প্রথম ম্যাচ চড়কহাটিতে। ধানকুড়ির সঙ্গে গ্রুপে আছে আরও তিনটি স্কুল। কালী স্কুল টিমের গোলকিপার। একটা ম্যাটাডোর ভাড়া করা হয়েছে। জনাপনেরো ছেলে দুটো বল আর বগলে ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়ল, নুরুস্যার ড্রাইভারের পাশে। ম্যাটাডোর ভাঙাচোরা গর্তভরা রাস্তা দিয়ে প্রায় অর্ধেক পথ গেছে তখন পিছনের একটা চাকার টিউবে রাইফেল থেকে গুলি ছোঁড়ার শব্দ হল এবং বাহনটি একদিকে হেলে পড়ল।

ম্যাটাডোরে বাড়তি একটি টায়ার ছিল এবং ড্রাইভারও খুব চটপটে। চাকা খুলে আবার পরাতে গেলে গাড়িটাকে উঁচু করে তুলে রাখতে হয় সেজন্য দরকার জ্যাক—এর। সেই জ্যাকটিই গাড়িতে আনা হয়নি। চটপটে ড্রাইভার পাঁচ মিনিটেই চাকা বদলে ফেলল এবং সেই পাঁচ মিনিট গাড়িটি জমি থেকে চার ইঞ্চি উপরে তুলে ধরে রেখেছিল কালী। অবশ্য একা নয় আরও দুটি ছেলে তিন মিনিট তাকে সাহায্য করে।

চড়কহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে খেলাটি ০—০ থাকে, প্রায় এক হাজার মানুষ খেলা দেখেছিল।

খেলার পর তারা একবাক্যে বলে, ধানকুড়ি এক ডজন গোলে হারত এই ঢ্যাঙা গোলকিপারটা না থাকলে। পরের ম্যাচ শাঁখাপোতা দেবেন্দ্রনাথ উচ্চচ বিদ্যালয়ের সঙ্গে। পাঁচ মাইল বাসে যেতে হয়। কালীর ব্রহ্মতালু সাড়ে ছয় ফুট উঁচুতে, সেটা বাসের ছাদে প্রায় ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। শাঁখাপোতার রেফারি তিনটে পেনাল্টি দেয় ধানকুড়ির বিরুদ্ধে, এর দুটিকে নিশ্চিতভাবে অন্যায্য বলা যায়। নুরুস্যার তক্ষুনি মাঠেই লিখিত প্রতিবাদ দেওয়ার জন্য স্কুলের প্যাড বার করেও ‘প্রোটেস্ট লেটার’ লেখেননি। একটিই কারণে, ধানকুড়ির গোলকিপার তিনটি পেনাল্টি শটই গোলের মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে কর্নার করে দিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা তারা জিতেছিল ১—০। জেতা যখন হয়েই গেছে তখন আর প্রোটেস্ট করার দরকার কী।

গ্রুপের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচ খেলা হবে ধান্যকুড়িয়া স্কুলের মাঠে অর্থাৎ খালপাড়ের মাঠে। দুটো ম্যাচ খেলে তাদের তিন পয়েন্ট। হাতাখালি পল্লী সেবক বিদ্যালয়ের এখন চার পয়েন্ট। ধান্যকুড়িয়ার এই ম্যাচে হারলে তো চলবেই না, ড্র করলেও চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে ছিটকে যাবে। নক আউট পর্যায়ে উঠতে হলে জেতা ছাড়া আর কোনও পথ নেই এবং সবাই জানে জয়ের প্রধান ও একমাত্র ভরসা ক্লাস সেভেনের কালীকঙ্কর ঢালি।

পাঞ্জা লড়াই প্রতিযোগিতায় ‘নায়ক’ হয়ে ওঠার সুযোগ থেকে কালী বঞ্চিত হলেও আরও জনপ্রিয় ফুটবল ‘নায়ক’ হওয়া থেকে তাকে ঠেকানো যায়নি। প্রথম দুটো ম্যাচে তার আজব গোলরক্ষার গল্প মুখে মুখে শুধু স্কুলেই নয়, সারা ধান্যকুড়িয়ার ছড়িয়ে গেছে। এখন সুলতা মণ্ডলের নাতিকে সবাই চেনে।

এই চেনার জন্যই হাবু দারোগা হাতাখালির সঙ্গে ম্যাচের দু’দিন আগে হাজির হলেন সুলতার বাড়িতে। সঙ্গে কনস্টেবল প্রহ্লাদ পোদ্দার।

.

পুলিশ দেখেই ছ্যাঁত করে উঠল সুলতার বুকের মধ্যে। প্রথমেই মনে হল জামাই শিবু কিছু করেছেটরেছে নাকি? এখন তো সে ভদ্দরলোক হয়ে গেছে, তা হলে?

হবিবুল মোল্লা ঝানু দারোগা। সুলতার মুখ দেখেই বুঝলেন, ভয় পেয়েছে। এটাই স্বাভাবিক, বাড়িতে পুলিশ আসা আর অমঙ্গল আসা সমান কথা। তবে হাবুদারোগা মোটেই অত্যাচারী নন সেকেলে দারোগাদের মতো। এক পয়সাও ঘুষ খান না এবং এইজন্যই তাঁকে নিয়ে মুশকিলে পড়ে বদমায়েশ লোকেরা, কিছুতেই কবজা করতে পারে না মোটা বেঁটে এই মোল্লাকে। হাবুদারোগা আতঙ্কের কারণ, তিনি আইনের দাস হিসাবে প্রভু—সরকারকে মেনে চলেন। পান থেকে চুন হয়তো বা খসতে পারে কিন্তু আইন থেকে এক সেন্টিমিটারও তিনি নড়েন না। একদিনে তিনি আটটি ভ্যানরিকশা বাজেয়াপ্ত করেছিলেন লাইসেন্স না থাকার অপরাধে। পরদিন স্ট্যান্ডে একটিও রিকশা ছিল না। দূরের গ্রামের যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়ে। হাবুদারোগা তাতে ভ্রূক্ষেপও করেননি। তিনটি রাজনৈতিক দল, ম্যাজিস্ট্রেট, পুর চেয়ারম্যান এবং এস পি—কে দরখাস্ত দিল, হুমকি দিল তাঁকে বদলি করিয়ে দেবে। তাতেও হাবুদারোগা নির্বিকার, অটল। শেষ পর্যন্ত তিনিই উদ্যোগী হয়ে দু’দিনের মধ্যে লাইসেন্স করিয়ে তবেই স্বস্তি পান। তাঁর শুধু একটাই কথা—সরকারি আইন মেনে কাজ করেছি।

এ হেন হাবুদারোগাকে বাড়িতে হাজির হতে দেখে সুলতার বুক কেঁপে ওঠা স্বাভাবিক। সৎ মানুষকে কে না ভয় পায়। কিন্তু তিনি এটাও জানেন, একমাত্র শিবু যদি কিচ্ছু গণ্ডগোল করে না থাকে তা হলে হাবুদারোগাকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। চরিত্রের পরিচ্ছন্নতায় তিনি এই দারোগার সঙ্গে সমানে টক্কর দিতে পারেন।

”কী ভাগ্যি আমার, দারোগাবাবু আমার বাড়িতে! বসুন বসুন। ওরে লক্ষ্মী একটা টুল দিয়ে যা।”

”না, না বসতে আসিনি, যাচ্ছিলুম এদিক দিয়ে জল তেষ্টা পেল তাই এলুম একগ্লাস জল খেতে।”

বাড়ির বাইরের খোলা জায়গায় তাঁরা কথা বলছেন। কাজের বউ লক্ষ্মী একটা টুল রেখে গেল।

”পরশু ডাব পাড়িয়েছি, টিউবকলের জল থাকেন কেন ডাব খান।”

”কীরে পেল্লাদ ডাব খাবি নাকি?” হাবুদারোগা জিজ্ঞাসা করলেন টুলে বসে। পেল্লাদ তখন চারপাশের গাছপালায় তীক্ষ্ন নজরে কী যেন খোঁজাখুজি চালাচ্ছিল।

”হ্যাঁ স্যার খাব। শুনেছি মাসিমার ডাবের জল খুব মিষ্টি।”

”দিন মিসেস মণ্ডল, খেয়েই যাই।”

অতিথিসেবার সুযোগ পেয়ে সুলতা যত খুশি তার থেকেও বেশি আনন্দ পেলেন দারোগার মুখে ‘মিসেস’ শব্দটি শুনে। তিনি জানেন যাকে—তাকে এভাবে সম্বোধন করা হয় না। তিনি বাড়ির ভিতরে চলে যেতেই হাবুদারোগা চাপা স্বরে বললেন, ”দেখতে পেলি? মনে হচ্ছে এখন থাকে না।”

প্রহ্লাদ বলল, ”আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার। সন্ধে—সন্ধেয় এলে দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু ধরবেন কী করে স্যার? এ তো পায়রা কি ঘুঘু নয় যে উঠোনে কি বাড়ির ছাদে দু’মুঠো ধান ছড়িয়ে জাল দিয়ে ধরবেন।”

হাবুদারোগা গম্ভীর হয়ে গেলেন, চিন্তিত স্বরে বললেন, ”জালটাল দিয়ে যে ধরা যাবে না সেটা আমি জানি। পাখিটা তো পোষ মানা। কালীকেই বলব ওটাকে ধরে আমার হাতে দাও।”

প্রহ্লাদ বলল, ”দাও বললেই অমনি আপনার হাতে তুলে দেবে?”

হাবুদারোগা বললেন, ”যাতে দেয় সেইভাবে বলতে হবে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের কথা বলতে হবে, শিডিউল টু—এ কী বলা আছে বলতে হবে। ভয় পাওয়াতে একটু বাড়িয়ে, একটু বানিয়ে বলতে হবে। আমি তো আর পাখিটা পুষব না বিক্রিও করব না। সরকারের ঘরে জমা করে দেব। দুষ্প্রাপ্য প্রাণীদের বুঝলি রক্ষা করা দরকার। নুরমহম্মদ পাখিটাকে দেখেছে, বউকে বলেছে রেয়ার বার্ড। সমুদ্রে ধারে পাওয়া যায়।”

প্রহ্লাদ মন দিয়ে শুনছিল, ”স্যার, সমুদ্দুর তো এখান থেকে অনেক দূরে। ডায়মন্ড হারবার এখান থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল তারপর কাকদ্বীপ নামখানা তারপর সমুদ্দুর। সেখান থেকে এখানে উড়ে এল।”

দু’হাতে কাচের আর স্টিলের দুটো গ্লাসে ডাবের জল নিয়ে এলেন সুলতা। দু’জনের পান করার পর ঢেকুর তোলার শব্দে তিনি তৃপ্ত হয়ে বললেন, ”আর এক গ্লাস দোব?”

হাবুদারোগা বললেন, ”না না এই যথেষ্ট।”

প্রহ্লাদ ডাকল, ”আমি তো বলেইছিলুম মাসিমার ডাব খুব মিষ্টি। বউকে গিয়ে গল্প করব।”

সুলতা চেঁচিয়ে বললেন, ”ওরে লক্ষ্মী দুটো ডাব নিয়ে আয় তো।”

হাবুদারোগা সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, ”দুটো নয়, একটা।”

প্রহ্লাদ তাড়াতাড়ি বলল, ”স্যার, এভাবে কিছু নেনটেন না। দুটো ডাব আমিই নিয়ে যাব, বউকে বলব তোর জন্য মাসিমা দিয়েছে।”

”মিসেস মণ্ডল আপনার এখানে তো দেখছি বেশ গাছপালা। কিন্তু পাখিটাখি তো তেমন দেখছি না।” হাবু দারোগা চারপাশে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললেন।

”পাখি তো অনেক আছে। ঘুঘু, শালিক, বুলবুলি অনেক টিয়াও আসে।”

”বড় পাখি আসে না।” প্রহ্লাদ অধৈর্য গলায় জানতে চাইল।

”নাহ, বড় পাখি এখানে কী কত্তে আসবে। বছর দশেক আগে চিল একবার বাসা করেছিল ওই বটগাছটায়। তারপর আর বড় পাখি কোথায় একমাত্র উড়োন ছাড়া।”

হাবুদারোগা চকিত হলেন। ”উড়োন? সে আবার কে?”

”একটা সুন্দর দেখতে পাখি। ওই বড়সড়ো একটা মোরগের মতো। বুক আর পা দুটো সাদা। কালী কুড়িয়ে পায় হেকিমপুকুরের ধার থেকে। ডানা ছাঁটা ছিল তাই উড়তে পারছিল না। কালী ওকে তিন বছর ধরে পালছে। কী যে ভাব দু’জনের মধ্যে কী বলব। রাত্তিরে ও তো কালীর সঙ্গে এক ঘরেই ঘুমোয়। কালী ওকে যা বলবে উড়োন তাই করবে।”

হাবুদারোগা বললেন, ”এমন পাখি আপনি আগে কখনও দেখেছেন। বা এইরকম পাখি দুনিয়ায় থাকতে পারে বলে কখনও ভাবতে পেরেছিলেন।”

”না দারোগাবাবু, আগে কখনও দেখিনি, ভাবতেও পারিনি। এমন জীব থাকতে পারে। দেখে মনে হয় বিষ্ণুর বাহন গরুড় নিজে যেন ধানকুড়িতে নেমে এসেছেন আকাশ থেকে।”

”তার মানে বিরল দুষ্প্রাপ্য। মিসেস মণ্ডল, আমাদের দেশে একটা আইন আছে” হাবুদারোগার স্বর হালকা থেকে গম্ভীর হয়ে গেল।

”দুষ্প্রাপ্য জীবজন্তু রক্ষা করা ভীষণভাবে দরকার হয় এদের চিড়িয়াখানায় রেখে, নয়তো তাদের নিজস্ব প্রকৃতির মধ্যে বিচরণ ক্ষেত্রে, বনজঙ্গল খালবিল নদীতে বসবাস করতে দেওয়া উচিত, যেখানে তারা বংশবৃদ্ধি করতে পারে। নয়তো এদের প্রজাতি লোপ পেয়ে যাবে, সেটা কি উচিত?”

হাবুদারোগা তাঁর বিবৃতির প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্য থামলেন। দেখলেন প্রতিক্রিয়াটা সুবিধাজনক নয়। সুলতা অশিক্ষিত বটে, কিন্তু দারোগার মতোই বা তার থেকেও বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিমতী। যা শুনলেন তার মমার্থ ঠিকই বুঝে ফেলেছেন।

”উচিত কি অনুচিত অতশত জানি না। তবে উড়োন যদি, ওই যেন কী বললেন?”

”দুষ্প্রাপ্য বিরল প্রজাতির।” হাবুদারোগা ধরিয়ে দিলেন।

”হ্যাঁ। উড়োন দুষ্পাপ্য যদি হয় তবে হোক। ওকে বনজঙ্গলে গিয়ে বংশ রক্ষা করতে হবে না, চাইলে আমার এখানেই করতে পারে।”

হাবুদারোগা ঢোক গিললেন।

”আমার যা কর্তব্য আমি করলুম। এবার সল্ট লেকে ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজার্ভেশনের অফিসে জানিয়ে দোব। তারা যদি কিছু করে তো করবে। তবে এই উড়োনকে ধরে রাখাটা কিন্তু বেআইনি।”

”ধরে রাখা?” সুলতা চোখ কপালে তুললেন। ”কে কাকে ধরে রাখে সেটা সারাদিন থেকে একদিন রেখে যাবেন।”

”পেল্লাদ চল।” হাবু দারোগা উঠে হাঁটা দিলেন।

সুলতা পিছু ডাকলেন, ”ও হে পেল্লাদ, ডাবদুটো ফেলে যাচ্ছ কেন, বউমা জল খেয়ে কী বলে আমাকে বলে যেয়ো।”

.

স্কুল থেকে ফেরামাত্র কালী দিদিমার কাছে দারোগার আসার ‘সব্বোনেশে’ উদ্দেশ্যেটা শুনল। তার আসার সঙ্গে সঙ্গে উড়োনও এসে বসেছে বটগাছে। এখন কালী যাবে খালপাড়ের মাঠে প্র্যাকটিসে, মাথার উপর দিয়ে উড়ে উড়ে চক্কর দিচ্ছে উড়োন।

মাঠে পুরো স্কুলটিম আর নুরুস্যার হাজির। তা ছাড়াও প্র্যাকটিস দেখতে জমা হয়েছে ষাট—সত্তরজন ছেলে আর বয়স্ক লোক। সবার আসার একটাই উদ্দেশ্য, কালী ‘কিংকং’—কে দেখা। কালীকে অনেকেই আগে দেখেছে, একটা সাড়ে ছ’ফুট লম্বা লোক এইভাবেই তারা জেনেছে কিন্তু তার আসল বয়স সে সাড়ে আট বছর (স্কুলের খাতায় অবশ্য বয়স ১৩) এটা কেউ জানত না। এবার সেটা জানাজানি হতেই বিস্ময় আর কৌতূহল আকাশছোঁয়া উচ্চচতা পেয়েছে।

উড়োন যথারীতি উড়ে গিয়ে বসল অশ্বত্থ গাছে। কালী মুখভার করে নুরুস্যারকে বলল, ”আমি কাল খেলব না স্যার।”

”কেন?” অবাক এবং আতঙ্কিত হয়ে তিনি বললেন, ”হল কী? জ্বর হয়েছে।” কালীর কপালে আঙুল ছুঁইয়ে আশ্বস্ত হলেন। ”নাহ ঠিকই আছে তা হলে খেলবে না কেন?”

”দারোগাবাবু দিদিমাকে বলেছেন উড়োনকে তিনি নিয়ে যাবেন, সল্ট লেকে জমা করে দেবেন। উড়োন নাকি বিরল রেয়ার বার্ড, ওকে বাড়িতে রেখে পোষা যাবে না। আইনে নাকি সেটা বারণ।”

‘রেয়ার বার্ড’ কথাটা নুরুস্যারের মুখ দিয়েই কিছুদিন আগে বেরিয়েছিল এই মাঠেই উড়োনকে প্রথম দেখে। সেইদিনই কথায় কথায় কী লায়লাকে বলেন, ”আজ একটা অদ্ভুত সুন্দর পাখি দেখলুম, আমার ছাত্র কালী তাকে পুষছে, এই অ্যাত্তোবড় ডানা, লম্বা লম্বা পা, সাদা পালকে ঢাকা, রংটাও সাদা, রেয়ার বার্ড। এসব পাখি বিরল প্রজাতির।” তারপর লায়লা হয়তো হাবুদারোগার বিবির কাছে বাজারে কি দরগায় দেখা হতে গল্প করেছে। দারোগার কানে সেটা পৌঁছে যেতে তারপর আর বেশি সময় লাগেনি।

নুরুস্যার একবার তো কালীকে পাঞ্জা প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়ার কৌশল বাতলে বিবেকের কামড় খেয়েছিলেন, এখন আবার দংশন অনুভব করলেন। মনে মনে নিজের গালে চড় মেরে বললেন, ‘রেয়ার বার্ড কথাটা কেন যে মরতে বউকে বলতে গেলুম! দারোগা পাখিটাকে ধরে নিয়ে গেলে কালী বিরাট আঘাত পাবে। কুড়িয়ে এনে তিন বছর ধরে সে পালন করছে, দু’জনের মধ্যে যে ভীষণ ভাব সেটা তো তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন। আলাদা হয়ে গেলে কষ্ট পাবে দু’জনেই। নুরুস্যার খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন।

”কালী তুমি ভেব না, তোমার উড়োনকে হাবুদারোগা ধরতে পারবে না যদি এই ম্যাচটা জিতিয়ে দিতে পারো। যাও যাও মাঠে নামো।”

”জিতলে উড়োন আমার কাছে থাকবে? ঠিক বলছেন স্যার?”

হ্যাঁ থাকবে। কথা দিচ্ছি।”

কালী ছুটে মাঠে নামল। সে গোলে গিয়ে দাঁড়াতেই ভিড়টা সেদিকে সরে গেল।

সন্ধ্যাবেলায় ধানু পড়াতে এল। এখন সে আশুতোষ কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে বি এসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। এখনও সে ভোরে ভ্যান রিকশা নিয়ে বেরিয়ে তিনটে গ্রাম থেকে আনাজ—তরকারি সংগ্রহ করে। সকালে নিজে পড়ে কালীকে পড়িয়ে ভাত খেয়ে স্কুটারে বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় এসে কালীকে নিয়ে বসে। আজ সে সুলতার মুখে শুনল হাবু দারোগার আগমন বৃত্তান্ত। কালী তাকে জানাল নুরুস্যার আশ্বাস দিয়েছেন উড়োনকে দারোগা ধরতে পারবে না। শর্তটাও সেইসঙ্গে ধানুকে জানিয়ে দিল—যদি ম্যাচটা জিতিয়ে দিতে পারে।

এইসব শুনে ধানু তখনি বেরিয়ে পড়ল স্কুটারে, সে গেল থানায়। হাবুদারোগা এই সময় থানায় থাকেন। ধান্যকুড়িয়া থানাটি বেশ বড়। মেজোবাবু, সেজোবাবুসহ আঠারোজন কর্মী। ধানু যখন পৌঁছল হাবুদারোগা তখন মেজোবাবুকে বকছিলেন।

”দুটোকে ধরে এনে আবার ঝামেলা বাড়ালে কেন, আচ্ছাসে পিটিয়ে ছেড়ে দিতে পারতে তো। এখন তো ওদের নেতারা এসে হম্বিতম্বি করে মাথা খারাপ করে দেবে।”

”স্যার, যা পেটাবার পিটিয়েছি। মানবাধিকার এক ইঞ্চিও লঙ্ঘন করিনি। একটা ভোজালি আর পাইপগান ছাড়া আর কিছু পাইনি। এই দেখুন স্যার।”

ধানু দেখল টেবলে রাখা অস্ত্র দু’টি। যে দু’টি ছেলে দাঁড়িয়ে বড়বাবুর টেবলের পাশে গোঁজমুখ করে তারা ধানুকে চেনে, পাড়ারই ছেলে এবং ভ্যানরিকশা চালায় সকাল—সন্ধ্যায়, একজনের নাম অসিত, অন্যজনের নাম ছোট গ্যাঁড়া। স্ট্যান্ডে আগে—পরে রিকশা রাখা নিয়ে অনেকদিনের ঝগড়া, এজন্য মারপিট প্রায়ই হয়, আজও হয়েছিল। হাবুদারোগা কড়া চোখে প্রথমে দু’জনকে দেখে নিয়ে তারপর ধানুকে দেখলেন।

”তুই কী কত্তে এখন এসেছিস? কেমিস্ট্রি খুব কঠিন সাবজেক্ট, দিন—রাত বই মুখে নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। বসিরকে তো দেখি এখন থেকেই মোটা মোটা বই কিনেছে। ডাক্তারি পড়ানোর খরচ যে কত এইবার মালুম হচ্ছে। বল কী বলবি?”

জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স পাশ করে বসির বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে, সেখানেই থাকে। ধানু বলল, ”চাচা, পাখিটা বিরল প্রজাতির ঠিকই, এর নাম সিন্ধু—গরুড়, আপনি দেখেননি, আমি তিন বছর ধরে দেখেছি।”

হঠাৎ ছোট গ্যাঁড়া বলে উঠল, ”বড়বাবু আমিও দেখেছি। বিউটিফুল দেখতে, গোদা চিলের থেকেও বড়, হাত—পা—বুক ধবধবে সাদা—”

”চুপ কর।” হাবুদারোগার মুখ থেকে বজ্র বেরিয়ে এল। ”তোকে কে দালালি করে কথা বলতে বলেছে?” রক্তচক্ষু এবার সরিয়ে তিনি ধানুর উপর নিক্ষেপ করলেন, ”তিন বছর ধরে দেখছিস তো কী হয়েছে?”

”উড়োন তো বিপন্ন নয় তা হলে ওকে ধরতে চাইছেন কেন, ওকে তো কাকে ঠুকরে মেরে ফেলছিল, কালীই উদ্ধার করে ওকে বাঁচায়। উড়োন একটা আশ্রয় পেয়েছে, ভালবাসা পেয়েছে, ধানকুড়ি জায়গাটা ওর পছন্দ হয়েছে, এখান থেকে অন্য কোথাও ওকে পাঠিয়ে দিলেই বরং উড়োন বিপন্ন হবে।”

”ঠিক বলেছে ধানু। পোষ মেনে যাওয়া পাখি লড়তে পারে না। আমার একটা পোষা চন্দনা ছিল স্যার—!”

”আবার।” হাবুদারোগা বজ্রপাত ঘটিয়ে টেবলের উপর থেকে পাইপগানটা তুলে নিয়ে বললেন, ”আর একটা যদি কথা বলেছিস তা হলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দোব।”

অপারাধীর মতো কুণ্ঠিত স্বরে ছোট গ্যাঁড়া বলল, ”স্যার গুলিটা ফায়ার করে দিয়েছি, ওতে এখন ফাঁকা খোলটাই শুধু রয়েছে।”

হাবুদারোগা সপ্রতিভ গলায় বললেন, ”তাতে কী হয়েছে। এর বাঁটটা দিয়ে তোর খুলি ভেঙে দিতে পারি, তা জানিস?”

”স্যার, মানবাধিকার!” মেজোবাবু ঝুঁকে বড়বাবুর কানে ফিসফিস করে বললেন। হাবুদারোগা পাইপগানটা টেবলে রেখে দিলেন ধীরে ধীরে।

”চাচা পরশুদিন জেলা স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ, ধান্যকুড়িয়া স্কুলের কাছে এটা মরণ—বাঁচনের খেলা, জেতা—হারা অনেকটা নির্ভর করছে গোলকিপারের উপর আর সেখানেই খেলবে কালী। ও বলছে উড়োনকে যদি পুলিশে ধরে তা হলে খেলবে না। স্কুলের ছেলেরা তো বটেই তাদের গার্জেনরা পর্যন্ত এই ম্যাচটার জেতা দেখতে চাইছে। জিতলে ধানকুড়ির স্কুল চ্যাম্পিযনশিপের গ্রুপ থেকে মূলপর্বে উঠবে। সেটা হবে বিরাট কৃতিত্ব।”

অসিত এতক্ষণ কথা বলেনি। এইবার বলল, ”হ্যাঁ বড়বাবু, আমার প্যাসেঞ্জাররা দু’দিন ধরে বলাবলি করে যাচ্ছে, তারা কালীর খেলা দেখতে শনিবার মাঠে আসবে।”

ছোট গ্যাঁড়া বলল, ”আমিও যাব দেখতে।”

হাবুদারোগা তাকালেন মেজোবাবুর দিকে। মেজোবাবু পাইপগানটা চট করে তুলে নিলেন টেবল থেকে।

”এই ‘বিরাট কৃতিত্ব’ পাওয়ার জন্য আইনকানুন শিকেয় তুলে বিরল পাখিটাকে বাড়িতে রেখে দিতে হবে?” হাবুদারোগা একটুও নরম না হয়ে বললেন। ”মামদোবাজি পেয়েছ? পরশুই আমি পাখিসমেত কালীকে অ্যারেস্ট করব তাতে স্কুলের বিরাট কৃতিত্ব পাওয়া হোক আর নাই হোক।” তারপর তিনি মেজোবাবুর দিকে চোখ তুলে বললেন, ”এই দুটো বাঁদরকে কী করা যায়? পাইপগান নিয়ে শান্তিভঙ্গ করা তো এদের কাছে খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী করা যায় বলো তো?”

মেজোবাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ”স্যার, এরা বাঁদর ঠিকই কিন্তু বিরল প্রজাতির নয়। এদের মতো বাঁদর চারদিকে গিস গিস করছে। বলি কী, দুটোকে ছেড়েই দিন, কেউ তো ইনজিওর্ড হয়নি।”

”বিনা শাস্তিতে। তাই হয় নাকি! হাতে না হলে ভাতে মারা দরকার, রিকশা দুটো কোথায়?”

”স্যার, থানার দরজায়।”

হাবুদারোগা টেবল থেকে ভোজালিটা তুলে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ধানুও ঘর থেকে বেরোল হাবুদারোগা ভোজালি দিয়ে কী করেন দেখার জন্য। যা দেখল তাতে অবাক হয়ে গেল এবং দুঃখবোধ করল।

ভোজালি দিয়ে দুটো রিকশার সামনের চাকার টায়ার হাবুদারোগা চিরে দিলেন। টায়ারের রবার প্রায় পাঁচ ইঞ্চি ফাঁক হয়ে গেল। যাওয়ার মতোই গটগটিয়ে তিনি ফিরে এলেন।

”যা এবার রিকশা নিয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়াগে যা।”

অসিত আর ছোট গ্যাঁড়া বেরিয়ে এসে রিকশার চাকার দিকে মিনিটখানেক তাকিয়ে রইল। তারপর অসিত মাথায় হাত দিয়ে ধীরে ধীরে বসে পড়ল। ছোট গ্যাঁড়া রিকশার হ্যান্ডেল ধরে সামনে কিছুটা টেনে নিয়ে গিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ”বড়বাবু শেষে কিনা এ ভাবে ভাতে মারল।”

হাবুদারোগা ধানুকে বললেন, ”কালীকে গিয়ে বল, পাখিটাকে থানায় দিয়ে যেতে।”

”থানায় রাখবেন কোথায় চাচা?”

হাজত এখন খালি রয়েছে ওখানেই রাখব।”

আর কথা না বলে ধানু বেরিয়ে এল থানা থেকে। স্কুটারে কিছুটা যেতেই দেখল ভ্যানরিকশা দুটো হাতে করে টানতে টানতে চলেছে অসিত আর ছোট গ্যাঁড়া। ধানুকে হাত তুলে থামিয়ে বলল, ”বড়বাবুকে একটা শিক্ষে দিতে হবে। কী ক্ষতিটা আমাদের করে দিল দেখেছিস।” ধানু দেখল অসিতের চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে।

”দেখব পাখিটাকে কী করে অ্যারেস্ট করে। মামদোবাজি করে, আমি দেখাব কে মামদো, আমি না হাবুদারোগা।” ছোট গ্যাঁড়ার কথাগুলো হাবুদারোগার দেহের খণ্ড খণ্ড মাংসের মতো তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। হিংস্রমুখে সে রিকশার সিটে ঘুঁষি বসাল।

ধানু বলল, ”আমি তো অবাক হয়ে গেলুম। ওইভাবে যে সাইকেলের টায়ার ফাঁসিয়ে দেবে কল্পনাও করতে পারি না। অথচ লোকটা সৎ, আইন মেনে কাজ করে, ডিসিপ্লিনড। ওর মনের মধ্যে যে এমন একটা কসাই লুকিয়ে আছে জানতুম না।”

”তুই জেনে রাখ ধানু, যা বললুম, তাই করব। চল অসিত, সবাইকে গিয়ে চাকাদুটো দেখাই।”

ধানু এবার নুরুস্যারের বাড়ির দিকে রওনা দিল, উনি কথা দিয়েছেন উড়োন কালীর কাছেই থাকবে, হাবুদারোগা ধরতে পারবে না। কী করবেন নুরুস্যার যে জন্য উড়োনকে ধরা যাবে না? সেটা এখন তাকে জানতে হবে।

.

খেলা শনিবার, তার আগের দিন নুরমহম্মদ ওরফে নুরুস্যার বিজন, ভোলা, অমিয়, শামিম, পাঁচকড়ি এবং আরও দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাসে ক্লাসে ঘুরে তিন মিনিটের একটি বক্তৃতা দিলেন, তার শুরুটা ছিল এই রকম।

”তোমরা নিশ্চয় চাও তোমাদের স্কুলের গৌরব বাড়ুক, ঠিক কি না? এই যে কালকের ফুটবল ম্যাচ এটা যদি জিতি তা হলে জেলা চ্যাম্পিয়ন হবার পথে আমরা প্রথম ধাপটা পেরোব, এটা গৌরব অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে আমাদের। আর এই জয়ের জন্য আমরা নির্ভর করছি আমাদের গোলকিপার কালীকিঙ্করের উপর।” এইবার ক্লাসের ছেলেরা ”কিংকং, কিংকং” বলে ফিসফিস শুরু করে দেয়।

”শোনো মন দিয়ে, কালী বলছে তার পোষা পাখি উড়োনকে অ্যারেস্ট করবে দারোগা হবিবুল মোল্লা, কেন না উড়োন বিরল বিপন্ন প্রজাতির, কিন্তু আমরা মনে করি সে বিরল বটে, কিন্তু বিপন্ন নয়, উড়োনকে যদি দারোগা ধরে, কালী বলেছে তা হলে সে খেলবে না। সুতরাং তাকে অ্যারেস্ট করা চলবে না। এবার আমাদের কী করতে হবে সেটা এরা তোমাদের বলে দেবে।” নুরুস্যার আঙুল দিয়ে পাঁচকড়ি , অমিয়দের দেখিয়ে তাঁর বক্তৃতা শেষ করে অন্য ক্লাসে চলে যান। সেখানেও আবার একই বক্তৃতা তিনি দেন।

হাবুদারোগার ভয়ে কালী হাফ ছুটি হওয়ামাত্র বাড়ি ফিরে বাইরের উঠোনের বাঁশের খুঁটির উপর উড়োনকে বসে থাকতে দেখল। সুলতা খুঁটির পাশে বসে কুড়োনকে তখন কাঁঠালপাতা খাওয়াচ্ছিলেন। কালীকে দেখে বললেন, ”উড়োনকে বসিয়ে রেখে আমিও বসে আছি। দারোগাকে দেখলে ওকে উড়ে যেতে বলব। দেখি কী করে ওকে ধরে।”

”দিদিমা, উড়োনের বদলে তখন তো আমায় ধরবে।”

”ধরুক না। উড়োনের কথা এখন ধানকুড়ির সবাই জেনেছে। চণ্ডীউকিলের বউ এসেছিল ওকে দেখতে। বললাম দারোগার কথা। তো বউমা বলল, ওরেন্ট ছাড়া কাউকে অমনি অমনি হাজতে ভরা যায় না, ভরলে দারোগাকে কোর্টে টেনে নিয়ে গিয়ে হাকিমের ধমকানি খাওয়ানো যাবে। ওর স্বামীকে উকিল দিলে সে ব্যবস্থাও হবে।”

কালী কিছু বলল না। উড়োনকে দু’হাতে তুলে ঘরে নিয়ে গিয়ে তক্তপোশের ধারে উপুড় করা ঝুড়িটার উপর বসিয়ে দিয়ে বলল, ”চুপ করে বসে থাক। হাবুদারোগা যেন দেখতে না পায়। দেখলেই ধরে নিয়ে যাবে।”

আজ কালী খালপাড়ের মাঠে প্র্যাকটিসে গেল না। বাইরের উঠোনে বসে দিদিমার সঙ্গে এটা—ওটা নিয়ে কথা বলতে লাগল। তখনই হাজির হল প্রহ্লাদ।

”কী ব্যাপার পেল্লাদ, ডাব খেয়ে বউ কী বলল?” সুলতা একটু বাঁকাসুরে বললেন।

”ডাব খেয়ে তো বাপের বাড়ির জন্য বউয়ের মন কেমন করতে লেগেছে। এমন মিঠে জলের ডাব ওর বাপের বাড়ির একটা মাত্তির গাছেই হয়। সেই গাছটার কথা খালি মনে পড়ছে আর চোখ দিয়ে জল ঝরছে।”

”জল ঝরছে আর বলছে আরও দুটো খাব, কেমন? ঠিক বলেছি?” সুলতা হাসি চেপে চোখ পিট পিট করে বললেন।

”আপনি জানলেন কী করে মাসিমা, বউ আরও দুটো খেতে চাইছে?”

”জানি, জানতে হয়। দুটো কেন চারটে ডাব দোব, এবার বলো তো, তোমার বড়বাবু কী মতলব ভেঁজেছে? উড়োন আর কালীকে কাল কখন ধরতে আসবে?”

প্রহ্লাদ ডান হাতের পাঞ্জা দেখিয়ে বলল, ”চারটে নয় পাঁচটা ডাব।”

”ঠিক আছে, পাঁচটা।”

এধার ওধার তাকিয়ে গলা নামিয়ে প্রহ্লাদ বলল, ”ঝড়খালিতে পাখি ধরার লোক আছে তাকে আনতে কনস্টেবল পাঠিয়েছে বড়বাবু। কাল চারটের সময় খেলা, বড়বাবু তিনটের সময় বারো জনকে নিয়ে আসবে, তাদের তিন জনের সঙ্গে আর্মস থাকবে, মাছ ধরার খ্যাপলা জাল আজ থানায় আনা হয়েছে। সবাইকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে পাখির গায়ে আঁচড়টি যেন না পড়ে। বিরল প্রজাতির বিপন্ন পাখি বলে কথা।”

শুনতে শুনতে সুলতার বুক শুকিয়ে এল। এ তো বাড়িতে ডাকাত পড়ার থেকেও ভয়ংকর ব্যাপার।

”মাসিমা এবার আমি যাব, পাখিটা আছে কি না দেখতে পাঠিয়েছিল, গিয়ে বলব এখনও ফেরেনি সন্ধের সময় ফিরবে।”

সুলতা ডাব আনতে নিজেই ভিতরে চলে গেলেন। প্রহ্লাদ তখন কথা শুরু করল কালীর সঙ্গে।

”শুনলুম তুমি নাকি দারুণ গোলকিপারিং করো? কাল দেখব কেমন তুমি খেলো।”

”খেলব কী করে, উড়োনকে তো হাবুদারোগা অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।”

”যাক না নিয়ে, তাতে খেলতে অসুবিধের কী?”

প্রহ্লাদের কথা শুনে রাগে থমথমে হয়ে গেল কালীর মুখ। সে উঠে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”যদি আমি সত্যিকারের কিংকং হতুম তা হলে থানাটাকে গুঁড়িয়ে দিতুম।”

কথাটা বলেই সে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। সুলতা ডাব হাতে ঝুলিয়ে এলেন। প্রহ্লাদ দেখেই বলল, ”মাসিমা আপনি তো পাঁচটা দিতে রাজি হলেন।”

”আর একটা কাল এসে নিয়ে যেয়ো, এই চারটেই ঘরে ছিল।”

রাতে কালীর ঘুম আর আসছে না। মাথার মধ্যে শুধু পুলিশের বারো জোড়া বুটের শব্দ খট খট করে এগিয়ে আসছে। মাথার উপর দু’পাক ঘুরিয়ে কে যেন খ্যাপলা জাল ছুড়ল উড়োনকে লক্ষ্য করে। চমকে উঠল কালী। ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দেখল ঝুড়ির উপর গুটিসুটি হয়ে বসে রয়েছে উড়োন, মাথাটা সামনে ঝোঁকানো। ঘুমোচ্ছে। কালী আশ্বস্ত হয়ে আবার শুয়ে পড়ল আলো নিভিয়ে। আর একবার তার মনে হল, খোলা জানলায় কেউ দাঁড়িয়ে, মুখটা যেন হাবুদারোগার। ভয়ে তার বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে গেল। কোনওক্রমে সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ”কে?”

”আমি হাবুদারোগা।”

”কী দরকার আপনার?”

”উড়োনকে ধরতে এসেছি।” বলেই হাবুদারোগা জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে টর্চের আলো ফেলল। কালী মুখ ফিরিয়ে উড়োনকে দেখার জন্য তাকাল। আশ্চর্য, উড়োন ঝুড়ির উপর নেই।

কোথায় গেল পাখিটা, একটু আগেও তো ঝুড়ির উপর ছিল, কোথায় গেল? হাবুদারোগা জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কালীর চুল মুঠোয় ধরে ঝাঁকাতে লাগল।

”বলো, বলো, কোথায় গেল উড়োন?”

”লাগছে, ছাড়ুন চুল, লাগছে। উড়োন এখন খালপারের মাঠে অশথ গাছটায় বসে আছে। আমি মাঠে গেলে ও আমার মাথার ওপর চক্কোর দিয়ে উড়বে। আপনি কি ওকে অ্যারেস্ট করবেন?” টর্চের আলো মুখের উপর পড়ায় কালীর চোখ আধবোজা। সে মুখটা পাশে ঘুরিয়ে বলল, ”উড়োনকে আপনি ধরতে পারবেন না। ও বিরল পাখি, ও এখানকার নয়, উড়োন সিন্ধু—গরুড়, আমার বন্ধু। আমি কিংকং, আমিও এখানকার নই। আমরা দু’জনে আকাশে উড়ে যাব কেউ আমাদের ধরতে পারবে না, আপনিও নয়।”

”বটে! দেখা যাক ধরতে পারি কি না।” হাবুদারোগা চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে বলল, ”কাল দেখা হবে।”

কালী বিছানায় উঠে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। ফাঁকা মাঠ, ঝাঁকড়া বটগাছ, একাদশীর চাঁদের আলো, নিঝুম চরাচর। সবই তার পরিচিত কিন্তু হাবুদারোগা এর মধ্যে মিলিয়ে গেল কী করে। সে আলতো করে মাথার চুল টানল। ঝুড়িতে সড়সড় শব্দ হল। কালী ফিসফিস করে ডাকল, ”উড়োন।” খড়খড় শব্দ জোরে হল। ”কাল উড়ে যাব তোর সঙ্গে।”

প্রহ্লাদ বলেছে, বড়বাবু তিনটের সময় বারো জনকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। কালী প্রতিদিনের মতো উড়োনকে ছেড়ে দিতেই সে প্রথমে বাঁশের খুঁটির উপর কিছুক্ষণ বসল। তারপর উড়ে গেল দক্ষিণ আকাশে। দেখে কালী ও সুলতা হাঁফ ছাড়লেন। ধানু এসে উপস্থিত।

”কালী আজ আর লেখাপড়া নয়। জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ। হাতাখালি টিমে তিন—চারটে বয়স্ক ছেলে আছে, কলকাতার ময়দানে সেকেন্ড ডিভিশনে খেলে। এসব নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না, যেভাবে খেলিস সেইভাবেই খেলবি। রাতে ভাল ঘুম হয়েছে।”

”হয়েছে।”

”সাড়ে তিনটের সময় টিম মাঠে যাবে। ড্রেস করে রেডি থাকিস। দিদিমা, আমি একটু ঘুরে আসছি।”

ধানু স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে গেল।

হবিবুল মোল্লা ঠিক তিনটেয় থানা থেকে জিপে উঠলেন। পিছনে রাইফেল হাতে দু’জন পুলিশের সঙ্গে খ্যাপলা জাল নিয়ে একজন বসে, তার পেশা মাছ ধরা। মেজোবাবুর আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। থানা দেখার জন্য সেজোবাবু রয়ে গেছেন। দশ জন লাঠিধারী পুলিশ জিপের পাঁচ মিনিট পর হাঁটতে হাঁটতে রওনা দিল।

জিপ বড় সড়ক থেকে মাঝারি একটা রাস্তা ধরবে, তারপর স্কুলবাড়ির পাশ দিয়ে বাজার ঘেঁষে শীতলা মন্দিরের পাশ কাটিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির অফিস আর পূর্বাচল ক্লাবের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা দক্ষিণে গেছে সেটা দিয়ে হাবুদারোগার জিপকে সুলতা মণ্ডলের বাড়িতে পৌঁছনোর জন্য যেতে হবে। মোটরে তিন মিনিট, হেঁটে দশ মিনিটের পথ।

জিপ যখন স্কুল বাড়ির কাছাকাছি তখনই ”পিঁইইপ পিপ পিপ” আওয়াজ হল হুইসলের। ঠিক এইভাবেই হুইসলের আওয়াজ করে নুরুস্যার মাঠে ফুটবল প্র্যাকটিস করান। স্কুলের উঠোনে জমা হওয়া শ’তিনেক ছেলে হুইসলের আওয়াজ শোনামাত্র সার দিয়ে, স্কুল গেট দিয়ে দুই সারিতে বেরিয়ে আসতে শুরু করল।

ব্রেক কষে জিপ দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে রাস্তা জুড়ে দুই সারিতে চলেছে ছেলেরা, তাদের হাতে কাঠিতে লাগানো হাতে লেখা পোস্টার। নানানা রকম স্লোগান তাতে লেখা, যেমন—”পুলিশের অন্নায় জুলুম চলবে না।” ”উড়োন বিপন্ন পাখি নয়/ওকে স্বাধীনতা দেওয়া হোক।” ”কালীকিঙ্কর জিন্দাবাদ/আজ কালী খেলবেই খেলবে।” ”হাবুদারোগার কালো হাত/ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও।”

হাবুদারোগা মুখ বার করে দেখে বিড় বিড় করলেন, ”বড়দের দেখে শিখেছে। এই জিপ রাখ। হেঁটেই যাব।”

তিনি জিপ থেকে নামতেই ড্রাইভার বাদে বাকিরাও নামল। তারা দুই সারি ছেলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এগোতে লাগল। ড্রাইভার জিপটা ঘোরাবার জন্য পিছনে হটতে গিয়ে দেখল সার দিয়ে খালি ভ্যানরিকশা দাঁড়িয়ে, প্রথম দুটো রিকশায় ছোট গ্যাঁড়া আর অসিত।

”এই রিকশা হটা।” ড্রাইভার খেঁকিয়ে উঠল।

”হটাব কোথায়, পেছনে তাকিয়ে দেখো না!” অসিত বলল।

ড্রাইভার মুখ উঁচু করে তাকিয়ে দেখল অন্তত কুড়িটা রিকশা পর পর দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বলল, ”মতলবটা কী বল তো?”

”তোমার বড়বাবু রিকশার দুটো চাকা নিয়েছে, আমরা তোমার গাড়ির চারটে চাকা নোব।” ছোট গ্যাঁড়া হাতে তুলে ধরল এক হাত লম্বা লোহার তীক্ষ্ন মুখ একটা গজাল। অসিত তুলে দেখাল একটা করাত।

ড্রাইভার আর কথা না বাড়িয়ে বড়বাবুকে খবর দিতে ছুটল। হনহনিয়ে হেঁটে হাবুদারোগা তখন পূর্বাচল ক্লাব পর্যন্ত পৌঁছেছেন, ছাত্রদের মিছিলকে পিছনে ফেলে।

”স্যার স্যার”। বলে চিৎকার করতে করতে ড্রাইভার ছুটে এল। ”বিপদ স্যার। অসিত আর ছোটগ্যাঁড়া কালকের বদলা নিতে জিপের চাকা ফাঁসাচ্ছে, কাটছে।”

”জিপ ব্যাক করে থানায় চলে যাও।”

”যাবার উপায় নেই স্যার, রাস্তা জ্যাম করে রেখেছে গোটা কুড়ি—তিরিশ ভ্যানরিকশা।”

হাবু ঠোঁট কামড়ালেন। ”প্ল্যান করে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করছে।” রাইফেলধারী দু’জনকে বললেন, ”এখুনি গিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করে দাও।”

”স্যার, যদি ক্লিয়ার না হতে চায়।”

”ফায়ার করবে।”

”ফায়ারিং—এর অর্ডার কে দেবে স্যার। আপনি তো এখানে।”

”নিজেরা দেবে।”

”না, স্যার, আপনি অর্ডার না দিলে ফায়ার করতে পারব না। শেষে চাকরি নিয়ে টানাটানি হোক আর কী!”

তিক্ত মুখে হাবুদারোগা বললেন, ”সিপাইরা পিছনে আসছে। তাদের বলো বড়বাবু অর্ডার দিয়েছেন লাঠি চার্জ করতে। রাস্তা ক্লিয়ার হলে জিপটা থানায় নয় এখানে নিয়ে আসবে। ছেলেদের মিছিল তো মাঠে চলে যাবে। আমি কালী মণ্ডলকে আগে অ্যারেস্ট করে জিপে তুলব তারপর পাখিটাকে—যাও যাও, কুইক।”

রাস্তা থেকে বাঁ দিকে বেঁকে নিমগাছটাকে ডাইনে রেখে অন্তত তিরিশ গজ মাটির রাস্তা ধরে গেলে সুলতা মণ্ডলের বাড়ির বাইরের উঠোন। ছাত্রদের সারি সোজা মাঠের দিক না গিয়ে নিমগাছের পাশ দিয়ে সুলতা মণ্ডলের বাড়ির দিকে বেঁকে গেল। বাইরের উঠোনে বাঁশের খুঁটির উপর বসে রয়েছে উড়োন, খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে সুলতা, ধানু আর খেলার ড্রেস করে কালী। উড়োন ব্যস্ত উদ্বিগ্ন চোখে এতগুলো ছেলেকে দেখে উড়ে পালাবার উদ্যোগ নিচ্ছে।

”এই উড়োন বসে থাক।” কালী থমকে উঠল।

ছাত্ররা নিঃশব্দে গোল হয়ে খুঁটিটাকে ঘিরে দাঁড়াল। কম করে দশ সারি ছেলে। হাবুদারোগা এসে হতভম্ব। পাখিটা দেখতে পাচ্ছেন, কালীকেও। জাল হাতে জেলে তাঁর পাশে। তিনি বললেন, ”এখানে থেকে জাল জুড়ে পারবে ওটাকে ধরতে?”

”না দারোগাবাবু, আর একটু কাছে যেতে হবে।”

”ঠিক আছে, আমার পেছনে এসো।” হাবুদারেগা রাস্তা বার করার জন্য ছেলেদের ধাক্কা দিয়ে এগোতে যাওয়া মাত্র ”পিপ পিপ পিইইপ” হুইসল বেজে উঠল। ছেলেরা মুহূর্তে হাবুদারোগাকে ঘিরে শুয়ে পড়ল।

”এখন তো আমিই বিপন্ন প্রজাতির হয়ে গেলুম।” বড়বাবু কাকে শুনিয়ে বললেন কে জানে।

ধানু বলল, ”কালী, এখন মাঠে যেতে হবে। উড়োনকে কোলে করে নে।”

কালী ”আয়, আয়” বলে মাটিতে চাপড় দিল। খুঁটির উপর থেকে উড়োন ঝপ করে মাটিতে নেমে এল। কালী দু’হাতে তাকে তুলে বুকের কাছে ধরে রইল।

ঘেরাও করে শুয়ে থাকা ছেলেদের মাঝে দাঁড়িয়ে হাবুদারোগা দেখলেন, কালীর কোলে চড়ে বিরল বিপন্ন সিন্ধু—গরুর ফুটবল খেলা দেখতে রওনা হল।

”ও ধানুদা, কতক্ষণ শুয়ে থাকব, আমরা খেলা দেখব না?”

”হুইসল বাজলে ছেড়ে দিবি।”

পাঁচ মিনিট পর কালী যখন উড়োনকে কোলে নিয়ে মাঠে পৌঁছেছে তখন নিমগাছের তলা থেকে ‘পিইইইইপ’ শোনা গেল, স্কুল ছুটির ঘণ্টা শুনে ছেলেরা যেমন কলরব করে ওঠে, সেইভাবে ঘেরাওকারীরা হইহই করে লাফিয়ে উঠে ছুট লাগাল মাঠের দিকে।

হাবুদারোগা নিমগাছের তলায় হুইসল মুখে লোকটির দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ”নুরমহম্মদ, চক্রান্তটা তা হলে তোমার।”

কালী উড়োনকে ছেড়ে দিতেই সে অশ্বত্থ গাছে নীচের ডালটিতে গিয়ে বসল। মাঠে দুটো টিমই নেমে ওয়ার্ম—আপ করছে। মাঠ ঘিরে হাজার পাঁচেক লোক। ভিড়টা দু’দিকের গোলের পিছনে ও দু’পাশে, খুব কাছের থেকে ওরা কালীকে দেখতে চায়।

হাতাখালির বেশিরভাগ ছেলেই আকারে বড়। বয়সও বেশি। ওদের দু’তিনজন কলকাতার ময়দানে খেলে। হাতাখালি স্কুলই আজ ফেভারিট। নুরুস্যার গত তিন দিন ধরে সকালে প্র্যাকটিসে বলেছেন, ”মনে আছে ভারত বিশ্বকাপ জিতেছিল। লয়েডের টিমে তো বাঘা—বাঘা ব্যাটসম্যান আর ফাস্ট বোলার ছিল, ওরাই তো ফেভারিট। কিন্তু কী হল বল তো। শেষ পর্যন্ত তো কপিলরাই জিতল। কেন জিতল? এগারো জনই জান লড়িয়ে দিয়েছিল। ভারত রান কম করেছিল তাতে কী, একটা ক্যাচও কেউ ফসকায়নি। বাউন্ডারি লাইন পর্যন্ত তাড়া করে বল ধরেছে। ওদের মতো তোরাও বিশ্বাস কর আমরা জিতছি, জিতব। হাতাখালি তো রিয়েল মাদ্রিদ নয়। পজিটিভ চিন্তা কর।”

ধান্যকুড়িয়া যে চিন্তাই করে থাকুক খেলার প্রথম দশ মিনিট পায়ে বল ঠেকাতে পারেনি। তার মধ্যে চারটে শট, দুটো হেড কালী দু’হাতে চাপড়ে, ঘুঁষি মেরে, হাঁটু দিয়ে থামিয়ে নিশ্চিত গোল খাওয়া থেকে ধানকুড়িকে রক্ষা করে। অবশ্য হাফ টাইমের আগে তারা হাতাখালির কাছ থেকে খেলার দখল কিছুটা নিয়ে নেয়। সেখানে বল সেখানেই ধানকুড়ির কেউ না কেউ বল ছিনিয়ে নেবার জন্য হাজির। এই পদ্ধতি নিয়ে তারা ব্যতিব্যস্ত করে দেয় হাতাখালিকে। প্রচুর ফাউল হতে থাকে। একবার গোলের মুখে উঁচু বল কালী ধরার জন্য লাফিয়ে উঠতেই কে একজন তার পেটে ঘুঁষি মারল। সে জমিতে পড়ে গিয়ে ফসকানো বলটা আঁকুপাকু করে ধরতে হাত বাড়াল। হাতটা মাড়িয়ে দিল একজন। কালী হাতটা দু’বার ঝেড়ে নিল মাত্র।

খেলা যখন চলছে উড়োন গাছের ডালে বসেছিল। হাফ টাইমে সে উড়ে মাঠের উপর চক্কর দিতে লাগল। সারা মাঠ মুখ তুলে হাঁ করে পাখি দেখতে লাগল।

কে একজন বলল, ”পাখিটা পয়মন্ত। দেখবি ধানকুড়ি জিতবে।”

আর একজন বলল, ”কালীর পোষা পাখি। দেখতে অদ্ভুত সুন্দর তাই না?”

”ওটা কী পাখি বলুন তো? অনেকটা চিল আর ঈগলের মাঝামাঝি দেখতে।”

উড়োনের জাত কী, তাই নিয়ে আলোচনা হতে হতেই দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হয়ে গেল। কালীর ডান কবজিতে একটা ব্যান্ডেজ। উড়োন গাছের ডালে। নুরুস্যার ছাপা স্কুলের প্যাড বার করেছেন। জঘন্য রেফারিং সম্পর্কে প্রতিবাদ জানাবেন বলে। কালীর হাত বেঁটে ছেলেটা যে মাড়িয়ে দিয়েছিল তার দিকে নজর রেখেছিল পাঁচকড়ি। পেনাল্টি বক্সের মধ্যে বল নিয়ে ঢুকে সেই বেঁটে শট নিতে যাবে পাঁচকড়ি পাশ থেকে তার পায়ের গোছ লক্ষ্য করে পা চালাল। ছেলেটি পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগল। কোনও দ্বিধা না করে রেফারি পেনাল্টি দিলেন। খেলা তখন ০—০। আর মিনিট চারেক বাকি খেলা শেষ হতে।

পেনাল্টি স্পটে বল বসিয়ে ছেলেটি দশ পা পিছিয়ে এসে কালীর মুখের দিকে তাকাল। পা ফাঁক করে দুটো হাত ডানার মতো ছড়িয়ে কালী ডাইনে—বাঁয়ে দুলছে। ছেলেটি ছুটে এসে প্রচণ্ড শট নিল নিচু এবং সোজা। মাঠের সবাই চোখ বন্ধ করে ফেলল। কালী একচুলও নড়েনি। সোজা বলটাকে সোজা শট মেরে ফাঁকা মাঝ মাঠে পাঠিয়ে দিল। শামিম তড়াক করে বল ধরে হাতাখালির জনবিরল রক্ষণ এলাকার দিকে এগোচ্ছে, গোলকিপারও ছুটে পেনাল্টি এলাকার বাইরে এসে গেছে। শামিম তাড়াহুড়ো করে বলটা মারল। গোলকিপার ডান দিকে ঝাঁপিয়ে হাত দিয়ে কোনও ক্রমে আটকাল।

আইন ভেঙে তার এলাকার বাইরে এসে গোলকিপার বলে হাত লাগিয়েছে। ফ্রি কিক দিলেন রেফারি। নুরুস্যার প্যাডের পাতা মুড়ে পাশে রেখে দিলেন। ভাল ফ্রিকিক মারে অমিয়। মারলও এক ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে বল কর্নার হয় গেল। রেফারির সঙ্গে দর্শকদের অনেকেই হাত তুলে ঘড়ি দেখলেন। আর বোধহয় এক মিনিট বাকি।

হঠাৎ উড়োন গাছ থেকে ডানা ঝাপটে উড়ল। কর্নার কিক নিতে গেল রতন। বল মারতে যাবে সেই সময় কালী ছুটতে শুরু করল হাতাখালির গোলের দিকে। খেলোয়াড়রা এবং দর্শকরাও অবাক। গোল ছেড়ে গোলকিপারের এ কী পাগলামি! রতন বল মারল। উড়োন উড়ছে কালীর মাথার উপর। লাফিয়ে সে বলে মাথা ছোঁয়াল। গোলার মতো বলটা গোলে ঢুকে গেল। রেফারি বাঁশি বাজিয়ে দু’হাত দিয়ে সেন্টার দেখালেন। তারপরই খেলা সমাপ্তির লম্বা বাঁশি বাজালেন।

মাঠে লোক নেমে এসেছে। কালীকে কাঁধে তোলার জন্য একটা চেষ্টা শুরু হল। নুরুস্যার মন্তব্য করলেন, ”গুড রেফারি।” গোলটা হওয়ার পরই উড়োন উধাও। কোথায় গেল? কালী এই নিয়ে চিন্তিত নয়। সে জানে উড়োন এখন বাঁশের খুঁটিতে বসে। ধান্যকুড়িয়া স্কুল মূলপর্বে উঠল।

শোভাযাত্রা করে কালীকে বাড়ি পৌঁছে দিল স্কুলের ছেলেরা। তাদের মুখে ছিল একটাই স্লোগান ”কিং কিং, কিং কিং, কিং কং।”

কালী যা ভেবেছিল তাই, বাঁশের খুঁটিতে বসে উড়োন আর খুঁটির পাশে টুলে বসে হাবু দারোগা। সুলতা বললেন, ”আর এক গ্লাস দি?” হাবু দারোগা বললেন, ”দিন আপনার ডাবের জল সত্যিই মিষ্টি।”

তখনই হইহই করে ছেলেরা নিয়ে এল ধানকুড়ির কিং কং—কে।

সারথির সারথি

সারথির সারথি – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

।।এক।।

”অ্যাঁ, একি!” জ্যোতি আধশোয়া থেকে সিধে হয়ে বসল বিছানায়, খবরের কাগজটা ইঞ্চি চারেক এগিয়ে আনল চোখের কাছে। যেন কাছে আনলেই খবরের সত্যতা আরো ভাল করে যাচাই করা যাবে। মাথামুণ্ডু কিছুই সে বুঝতে পারছে না। অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে ক্রমশ এগিয়ে এসে আবার হটে যাচ্ছে সর্ষেদানার মত ছোট হয়। তিন চার বার এমনটি হল।

জ্যোতি অন্যমনস্কর মত ডানহাতটা পাশে বাড়াল। হাতের ধাক্কায় নীচু ত্রিপদে রাখা চায়ের কাপটা ছিটকে মেঝেয় পড়তেই সে চমকে তাকাল। কাপটা ভাঙেনি। কোনদিন এমনটা হয় না। আঙুলগুলো অব্যর্থভাবেই কান ধরে কাপটাকে তুলে মুখের কাছে এনে দেয়।

”কি হল জ্যোতি, কি ভাঙল রে?”

ঘরের বাইরে থেকে আশালতা চেঁচিয়ে উঠলেন।

”কিছু না।” অধৈর্য, রুক্ষ স্বরে সে জবাব দিল।

”আজ বাজার যাবি নাকি? কাল যে বললি, এক বেঘৎ লম্বা কই মাছ নিজে গিয়ে কিনবি?”

জ্যোতি কথাগুলোকে গ্রাহ্যে না এনে খবরের হেডিংটা আবার পড়ল—পতিতাগৃহ থেকে ধৃতদের মধ্যে ফুটবল কোচ।

তার নিজের ষাট বছর বয়সী বাবা বলাৎকার করে ধরা পড়েছে, এমন একটা খবর যেন সে শুনল, জ্যোতি সেই রকমই বিমূঢ় বোধ করেছে। অবিশ্বাস্য, তার কাছে একদমই অবিশ্বাস্য যে অরবিন্দদা, যিনি তার বাবার থেকে দশ বছরের ছোট, রিপন স্ট্রীটে এক বেশ্যাবাড়িতে যেতে পারেন।

আদালতের সংবাদদাতার খবরটায় বিশেষ বিস্তারিত নেই। অরবিন্দদা কোন ক্লাবের কোচ তারও উল্লেখ নেই। শুধু বলা হয়েছে—রিপন স্ট্রীটে জনৈকা মিসেস সিকুয়েরার বাড়িতে বুধবার রাত্রে পুলিশ হানা দেয়। সেখানে বদ্ধ ঘর থেকে অশালীন অবস্থায় পাওয়া চারজোড়া নারী ও পুরুষকে পাকড়াও করে তারা থানায় নিয়ে যায়। ধৃতদের মধ্যে আছে এক ফুটবল কোচ অরবিন্দ মজুমদার। পুলিশ গৃহকর্ত্রীকেও গ্রেপ্তার করেছে। ধৃতদের বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করা হয়। ব্যক্তিগত জামিনে তারা ছাড়া পেয়েছেন।

আজ শুক্রবার। অরবিন্দদা এখন নিশ্চয়ই বাড়িতে। বাড়ি মানে সল্ট লেকে দু’ ঘরের ফ্ল্যাট। অরবিন্দদা আর প্রভাতী বৌদি। সন্তান নেই। গত চোদ্দ বছর ধরে বৌদি পক্ষাঘাতে বিছানায়। জ্যোতি বিছানা থেকে উঠে পড়ল। সে ঠিক করে উঠতে পারছে না, এখন কি করবে। ফুটবল খেলোয়াড় হিসাবে এখন তার যত নামডাক, প্রতিষ্ঠা, তার কিছুই হত না যদি সে সাত বছর আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে অরবিন্দদার ফ্ল্যাটে গিয়ে একদিন না দাঁড়াত।

ঠিক এই সময়ে কি অরবিন্দদার মুখোমুখি হওয়া উচিত? সামনে দাঁড়ান কি সম্ভব? দাঁড়াল ওঁর কি হবে জানি না কিন্তু নিজেরই লজ্জা করবে। বস্তুত সল্ট লেক থেকে টিটাগড়, অন্তত ষোল—সতেরো কিলোমিটার দূরে নিজের ঘরে একা, তবু সে অদ্ভুত একটা লজ্জার মধ্যে নিজেকে নিয়ে বিপন্ন বোধ করছে। বুকের ভিতরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে। অরবিন্দদা কিনা শেষকালে…।

কিন্তু খবরের কাগজে অনেক তো ভুল খবরও বেরোয়।

”ছোটু, ছোটু।” জ্যোতি চেঁচিয়ে তার ছোটভাইকে ডাকল। বছর আঠারোর ছোটু আসতেই সে একটা পাঁচটাকার নোট তার হাতে দিয়ে বলল, ”দৌড়ে যা, যে কটা কাগজ পাবি, সব একটা করে কিনে নিয়ে আয়, জলদি, চটপট।”

”কিন্তু আমি যে এখন—।”

”যা বলছি।” এত জোরে চীৎকার এ—বাড়িতে জ্যোতি আগে কখনো করেনি। ছোটুর হাতটা কেঁপে গেল।

”কটা কাগজ আনব?”

”পাঁচটা, ছ’টা, যে কটা হয়।”

ছোটু আর কথা বাড়াল না। আশালতা ঘরে এলেন।

”কি হল, চেঁচিয়ে উঠলি কেন? ওমা, চায়ের কাপটা যে—” কাপটা তুলে নিয়ে তিনি ন্যাতা আনতে বেরিয়ে গেলেন। জ্যোতি জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। জানালার পাশেই ছোট্ট একটা পুকুর। তার ডানদিকে একতলা পাকা বাড়ি। সাত বছর আগে বাড়িটা কিনে, মেরামত করে বসবাস করছে একটি পরিবার। জ্যোতি ওদের কাউকে চেনে না, নাম পর্যন্ত জানে না।

গত সাত বছর নিজের বাড়ি, বাবা—মা, ভাইদের সঙ্গে জ্যোতির সম্পর্ক প্রায় ছিলই না। ভাইয়ের হাত দিয়ে সে মাসে মাসে টাকা পাঠিয়েছে। আশালতা দু’বছর আগে চিঠিতে একটা ফিরিস্তি দিয়েছিলেন, বাড়িটার জন্য কি কি করতে হবে। জ্যোতি তার পরের ভাই লাটুকে মুখেই বলে দিয়েছিল, এই বাড়িতে থাকার কোন ইচ্ছেই তার নেই। সুতরাং মুখে রক্ত তুলে ফুটবল খেলে যে টাকা আয় করছে, সেই টাকা এই বাড়ির পিছনে সে ঢালবে না। তাছাড়া বাড়িটাও তার নিজের নয়, বাবার। অন্য ছেলেদেরও অংশ আছে। সে একা টাকা খরচ করে দোতলা তুলবে আর অন্য ভাইয়েরা ভোগ করবে, তা হতে পারে না। একটা কথা শুধু সে বলেনি, মিনিস্টারকে ধরে পাতিপুকুরে সে পাঁচ কাঠার সরকারী প্লট কিনেছে। সেখানেই নিজের বাড়ি করবে।

একটা লীগ ম্যাচের পর ক্লাব তাঁবুর বাইরে চেয়ারে বসে দুই ভাই কথা বলছিল। লাটু চুপ করে মেজদার কথাগুলো শুনে যায়, ঘাসের দিকে চোখ রেখে। জ্যোতিকে তার ভাইয়েরা মেজদা বলে। বড় ভাই কৈশোরে গঙ্গায় ডুবে মারা গেছে। ”আমার যা কর্তব্য আমি তা করেছি, করেও যাচ্ছি। তোকে একটা চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছি, মাসে ছশো টাকা এই বাজারে এমন কিছু খারাপ নয় ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়া একটা ছেলের পক্ষে। ছোটুর পড়ার খরচ আমার। যতদিন পড়াশুনো চালাবে ততদিন চালাব। বাবা—মা যদ্দিন বাঁচবে আমি দেখব। মাসে মাসে হাজার টাকা দিচ্ছি…এরপর আর আমি কি করতে পারি? বাড়িটা দোতলা করে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ছোটখাটো মেরামতি, নতুন পায়খানা, জলের কল, ইলেকট্রিক সবই তো করে দিয়েছি। তুই আর ছোটুই বাড়িটা ভোগ করবি, আমি ওখানে থাকব না। যা করার তোরা দুজনই করবি।”

সারথি সংঘে এসে জ্যোতি প্রথম বছরটা কাটিয়েছে ক্লাবের তালতলার মেসে, সাতটি খাট পাতা লম্বা ঘরটায়। দ্বিতীয় বছরেই দোতলায় উত্তরপ্রান্তের ঘরটা একা থাকার জন্য তাকে দেওয়া হয়, যখন শৈবাল মণ্ডল মোহনবাগানে সই করে সারথি ছেড়ে চলে যায়। জ্যোতির মত নবাগতকে একবছর খেলিয়েই পঁচাত্তর হাজার টাকা দেওয়া হবে শুনে স্টপার ব্যাক শৈবাল নব্বই হাজার চেয়েছিল। জেনারেল সেক্রেটারি সরোজ সেন রাজী হননি। বরং বলেছিলেন, ”শৈবাল, এ বছর যা পেয়েছে, সেই পঁচাত্তরই দেব সামনের সিজনে, তাতে যদি থাকতে রাজী থাকে তো থাকবে, নইলে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল কি যুগের যাত্রী যেখানে যেতে চায় যেতে পারে।” শৈবালকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে শুনে বিক্ষোভ, ঘেরাও, হাতাহাতি হয়েছিল। সারথির প্রেসিডেণ্ট সন্তাোষ ভট্টাচার্য আর ট্রেজারার কিরণ ঘোষের জোটের লোকদের সঙ্গে সরোজ সেন আর ফুটবল সেক্রেটারি চঞ্চল মৈত্র জোটের লোকেদের। যারা হাতাহাতি, খেস্তাখেস্তি করেছিল তাদের অবশ্য ‘লোক’ বললে ঠিক পরিচয়টা বোঝান যায় না। কলকাতার প্রত্যেক ফুটবল ক্লাবের কর্তা—ব্যক্তিরা ক্ষমতা হাতে রাখার ও নানান ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণের জন্য নিজস্ব দল পোষে।

ট্রান্সফারের সময় ফুটবলার গায়েব করা থেকে শুরু করে, গ্যালারিতে মারপিট, ক্লাবের বিপক্ষ গোষ্ঠীর পেটোয়া খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে সমর্থকদের উস্কে দিয়ে চড়—ঘুঁষির শিকার বানিয়ে নার্ভাস করে দেওয়া, সাংবাদিকদের অকথ্য নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করে যথার্থ রিপোর্ট লেখা বন্ধ করার চেষ্টা—এইসব কাজ করার জন্য অল্পবয়সী, বেকার, অশিক্ষিত, কিছু ছেলে পোষা হয়। এরা ক্লাবের সাফল্যের জন্য যে কোন কাজ করতে পারে, এমনকি প্রাণও দিতে পারে। ক্লাবের খেলা দেখার জন্য অবাধে মেম্বার গেট দিয়ে মাঠে ঢোকার পুরস্কারটুকু ছাড়া এরা আর কিছু পায় না। শৈবালকে নিয়ে ক্লাব যখন তপ্ত তখন সরোজ সেন শুধু একটা কথাই অরবিন্দ মজুমদারকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ”আপনার এই জ্যোতির্ময় বিশ্বাস ছেলেটা সম্পর্কে যা বলেছেন, তা ঠিক তো? শেষকালে ডোবাবে না তো?” অরবিন্দ মজুমদার জবাব দিয়েছিলেন, ”পঁয়ত্রিশ বছর মাঠে আসছি, খেলেছি সব কটা বড় ক্লাবে, কোচ করছি এগারো বছর, ভারতের হেন ট্রফি নেই যা আমি জিতিনি। কিছুটা ফুটবলার চেনার ক্ষমতা আমার হয়েছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, জ্যোতি আপনাকে ডোবাবে না, ভাসাবে।” সেই মরশুমে মোহনবাগান লীগ চ্যাম্পিয়ন হল কিন্তু একটি মাত্র ম্যাচই তারা লীগে হেরেছিল, সারথির কাছে দু গোলে। দুটো গোলই জ্যোতির। খেলার পর টেণ্টে নিজের কামরায় জ্যোতিকে ডাকিয়ে এনে সরোজ সেন বলেন, ”তোমার নাকি মোটর সাইকেল চড়ার খুব শখ?” অরবিন্দ মজুমদার তখন সেখানে বসে। মিটমিট হাসছিলেন। জ্যোতি তার এই শখের কথা একবারই শুধু অরবিন্দদাকে বলেছিল সিজনের প্রথম দিকে। সরোজদার কানে কথাটা তোলা তাহলে ওরই কাজ। ”আমি কালই বুক করব, রয়্যাল এনফিল্ড, বুলেট। দু গোলের জন্য দু চাকার, যেদিন চার গোল দেবে মোহনবাগান কি ইস্টবেঙ্গলকে কি যাত্রীকে সেদিন চার চাকার গাড়ি…।”

সরোজ সেনের কাছ থেকে মোটর গাড়ি আর পাওয়া হয়নি। শেয়ার বাজারে হঠকারিতা করে তিনি এমনই ফাটকা খেলেছিলেন যে শুধু বিষয় সম্পত্তিই নয়, বিরাট অফসেট প্রেসও বিক্রি করতে হয়। এরপর তিনি সারথি সংঘের গেটে আর পা রাখেননি। হাওড়ায় বস্তির মত একটা অঞ্চলে দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে এখন সপরিবারে আছেন।

জ্যোতি জানালার বাইরে থেকে চোখ সরাল। বুলেটটা উঠোনে হেলান দিয়ে রয়েছে স্টেপনিতে। গত পাঁচ বছর অবসর পেলেই এই প্রিয় বাহনটিতে চড়ে সে পশ্চিমবাংলা চষে বেড়িয়েছে।

একগোছা কাগজ হাতে ছোটু বাড়িতে ঢুকছে। দেখেই জ্যোতি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই কাগজগুলোতেও কি, ধৃতদের মধ্যে অরবিন্দ মজুমদার রয়েছেন, লেখা আছে? ভুলও তো হতে পারে। ভগবান, তাই যেন হয়। অরবিন্দ সমাদ্দার কিংবা অরবিন্দ মুখার্জি নামে কেউ, কিন্তু অরবিন্দ মজুমদার যেন না হয়। ছাপার ভুল কিংবা আদালত সংবাদদাতার লেখার ভুল এইরকম একটা কিছু যেন হয়।

কাগজগুলো বিছানার উপর রেখে সে একটার পর একটা খুঁটিয়ে পড়ল। দুটো কাগজে আইন—আদালত কলামে খবরটা বেরিয়েছে, দুই প্যারাগ্রাফ। বাকিগুলোতে খেলার পাতায় বেরিয়েছে রীতিমত ফলাও করে। ইদানীং চাঞ্চল্যকর খবর বার করায় নাম করেছে ‘প্রভাত সংবাদ’ পত্রিকা। এদের রিপোর্টার রঞ্জন অধিকারীকে টেণ্ট থেকে বার করে দিয়েছিলেন অরবিন্দদা, তার বক্তব্য বিকৃত করে রিপোর্ট করার জন্য। তার ফলে ক্লাবে প্রেসিডেন্ট সন্তাোষ ভট্টাচার্যকে কিছু সমর্থক ঘেরাও করে গালাগালি দিয়েছিল। বিশ্রী একটা নোংরা আবহাওয়া ক্লাবে তৈরি করে দিয়েছিল রঞ্জনের রিপোর্ট। সরোজ সেনের সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে গেছিল প্রেসিডেণ্টের। দিন সাতেক পর রঞ্জন টেণ্টে এলে, অরবিন্দদা ওর জামার কলার ধরে ক্লাবের গেট পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে শুধু বলেছিলেন, ”আগে ভদ্রলোক হও তারপর সাংবাদিক হয়ো।”

রঞ্জনের কাগজ প্রতিশোধ নেবার সুযোগটা ছাড়েনি। বড় অক্ষরে তিন কলাম হেডিং করেছে—ফুটবল কোচ অরবিন্দ মজুমদার গণিকা গৃহে ধরা পড়েছেন। তারপর প্রায় দু’কলাম ধরে, সবিস্তার বর্ণনা পুলিশ হানার, অরবিন্দ মজুমদারের ফুটবল কেরিয়ারের, ওর কোচিংয়ে সারথি সংঘের নানান ট্রফি জয়ের, ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রীর অসুস্থতার এমনকি জ্যোতির্ময় বিশ্বাসকে আবিষ্কার করার কথাও লেখা হয়েছে।

”আশ্চর্য, এত কথা যোগাড় করে এইটুকু সময়ের মধ্যে লিখে ফেলল!” জ্যোতি একদৃষ্টে ছড়ান কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঠিক করে ফেলল, দাশুদার সঙ্গে আগে একবার কথা বলে নেবে।

দাশু বা দাশরথি সেনশর্মা, সারথি সংঘের একজন সক্রিয় সদস্য ছাড়া, ক্লাবে তার আর কিছু পরিচয় নেই। কখনো কোন কমিটিতে থাকেনি, বিয়ে করেনি, ইনটিরিয়ার ডেকরেটিংয়ের ব্যবসা করে, প্রতিদিন ক্লাবে হাজিরা দেয়, প্রেসিডেণ্ট থেকে মালি সবাই তাকে চেনে, ক্লাবের প্রয়োজনে পনের কুড়ি হাজার টাকা বিনা প্রশ্নে ধার দেয়, ফুটবলারদের বিপদে আপদে তাদের বাড়িতে ছুটে যায়, অন্য ক্লাব থেকে কাউকে ফুসলে আনতে সে মাসের পর মাস পিছনে লেগে থাকতে পারে, আই এফ এ, রাইটার্স বিল্ডিংস, ফোর্ট উইলিয়াম আর লালবাজার, প্রত্যেক জায়গাতেই, যাদের দিয়ে কার্যোদ্ধার হয়, তাদের সঙ্গে দাশুর চেনাপরিচয় আছে। সারথির উপকার হবে, এমন কাজ থেকে তাকে দমান অসম্ভব। ওর আনুগত্য ক্লাবের কোন ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়, সারথির মঙ্গল বা হিতই প্রধান বিবেচ্য। হাসিখুশি দিলখোলা বছর পঞ্চাশের এই লোকটির বাইরেটা যত নরম, ভিতরটা কিন্তু ততটা নয়। বিশেষত সারথির স্বার্থ যেখানে জড়িত।

ক্লাবে প্রথম বছরেই জ্যোতিকে পছন্দ করে ফেলে দাশু। বড় ভাইয়ের স্নেহে, নানা উপদেশ ও শাসনের মধ্য দিয়ে সে জ্যোতিকে আড়াল করে প্রথম দুটো বছর রেখেছিল। দরকারও ছিল। তিন চারটি ক্লাব জ্যোতিকে পাবার জন্য হাত বাড়াচ্ছিল। সারথির দামী সম্পত্তিটিকে ধরে রাখার সুখ ছাড়া তার আর কোন স্বার্থ নেই। জ্যোতি বহুবার নানান ধরনের উপকার নিয়েছে। সর্বশেষটি জমি কেনার ব্যাপারে। রাইটার্সে যথাস্থানে কলকাঠি নেড়ে দাশু সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

দাশুদার বাড়িতে আর কারখানায় ফোন আছে। কিন্তু এখানে ধারেকাছে ফোন নেই। এটাই জ্যোতির মুশকিল। যদি সে অনেকের মতই, মেসে না থেকে বাড়ি থেকেই যাতায়াত করত, তাহলে টেলিফোন এনে দিত। এসব তার কাছে সমস্যা নয়। কিন্তু বাড়িটা তার কাছে বসবাসের স্থান হিসেবে একদমই পছন্দ নয়। একটা মানসিক প্রতিবন্ধকতা সাত বছর আগে তৈরি হয়ে গেছল যেটাকে আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রথম তিন বছর সে একদিনের জন্যও টিটাগড় মুখো হয়নি। তারপর মাঝেমধ্যে আসতে শুরু করে কয়েক ঘণ্টার বা একবেলার জন্য। গত বছর থেকে তিন চারদিন টানা থাকছে। নয়তো সিজন শেষ হয়ে গেল, মেস যখন ফাঁকা, ঘরগুলো বন্ধ, তখন সে দাশুদার গড়চার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকে।

এটা দাশুদার লুকোন আস্তানা। বন্ধু এবং বান্ধবীদের সঙ্গে হুল্লোড়—ফুর্তি করে সন্ধ্যেটা কাটাবার জন্য পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ির দোতলায় পিছনদিকে তিনঘরের ফ্ল্যাটটা বছর দশেক আসে সে ভাড়া নেয়। ফুর্তি গভীর রাত পর্যন্তই গড়ায় এবং বান্ধবীদের কেউ কেউ আর বাড়ি ফেরে না। জ্যোতি প্রথমদিকে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঠ হয়ে শুয়ে থাকত। কিন্তু দাশুদাকে সে কখনো অপ্রতিভ বা লজ্জিত হতে দেখেনি। ”এসব একটু আধটু দরকার। এখন ঠিক বুঝবি না। আর একটু লায়েক হয়ে নে তারপর আমিই ডাকব, আয় জয়েন কর। এখন একমনে খেলাটা তৈরি কর, কেরিয়ার গড়ে নে।”

অরবিন্দদার ব্যাপারটা সম্পর্কে কি করা যায় তাই নিয়ে এখুনি একবার দাশুদার সঙ্গে কথা বলা দরকার। অরবিন্দদাকে প্রেসিডেণ্টের দলবল একদমই পছন্দ করে না। ওকে সরাবার জন্য গত সাত বছরে দশবার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সরোজ সেন সেগুলো কাটিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে সাহায্য করেছে জ্যোতি এবং দাশুদাও। তাছাড়া অরবিন্দদা এমন একটা সময়ে সারথিতে আসেন যখন ক্লাব মুখ থুবড়ে পড়েছে। লীগে মাঝামাঝি জায়গায় থাকার জন্য হাঁকপাঁক করছে, দু বছর ভারতের বড় টুর্ণামেন্টগুলোয় থার্ড রাউণ্ডের উপর যেতে পারছিল না, ছোট টুর্ণামেণ্ট একটাও জিততে পারেনি। ক্লাবের ভিতরে দলাদলি মাথা চাড়া দিয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ট্রান্সফারের সময় ক্লাবেরই কোন কোন কর্তা ”নিজের” খেলোয়াড়দের অন্যান্য ক্লাবের হাতে তুলে দিয়ে ভাঙন ধরিয়ে দেয়। এমন একটা অবস্থা থেকে অরবিন্দদা দু বছরের মধ্যে ক্লাবকে টেনে তুলে লীগে রানার্স করান, পরের বছরই লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং রোভার্স কাপ নিয়ে আসেন। সারথি আবার চাঙা হয়ে দাপিয়ে চলতে শুরু করে। অরবিন্দ মজুমদার একটা কথা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, জ্যোতিকে না পেলে তিনি সফল হতেন না। সাহস এবং আস্থা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় নামতে পারতেন না।

এবার থেকে সারথি মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছিল অরবিন্দদার। দলটা তার মুঠোয় এবং সেই মুঠো তিনি কখনো আলগা করতে রাজী নন। কারুর কোন অনুরোধ, যদি না যুক্তিপূর্ণ হত, তিনি রক্ষা করেননি। শৃঙ্খলা ভাঙলে বা নির্দেশ অমান্য করলে কাউকে রেয়াৎ করেননি। অনেক গণ্যমান্য কর্তা তার কাছ থেকে মান হারিয়ে ফিরে এসেছেন। স্বভাবতই, তার বিরুদ্ধে একটা জোরালো গোষ্ঠী ক্লাবের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে যদিও বাইরে হাজার হাজার ক্লাব সমর্থকদের কাছে তিনি পরিত্রাতা গণ্য হয়েছেন। মূলত এই বাইরের সাধারণ সমর্থকদের ভয়েই কেউ এতকাল অরবিন্দদার গায়ে আঁচড় কাটতে পারেনি। তাছাড়া ট্রফি জয়ের সাফল্যগুলো তো ছিলই।

কিন্তু এখন? কাগজের হেডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে জ্যোতি মাথা নাড়ল। আর বোধহয় বাঁচান যাবে না। ওর রক্ত নেবার জন্য তো অনেকেই তৈরি, এখন তারা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেই। এবার লীগে ফোর্থ, বরদলুইয়ে সেমি ফাইনাল থেকে আর ডুরাণ্ডে কোয়ার্টার ফাইনালের আগেই বিদায় নিয়েছে সারথি। অরবিন্দদার আগের ঔজ্জল্য আর নেই, দাপটও স্তিমিত। এবার এই ঘটনাই ওঁকে শেষ করে দেবে।

বুকের মধ্যে শুধুই বাতাস ছাড়া জ্যোতি আর কিছু বোধ করছে না। শূন্যতা। এই লোকটিই তার খেলা গড়ে দিয়েছে, আজ সে যতটুকু হতে পেরেছে তা ওঁরই জন্য। ক্লাব থেকে ওঁকে সরিয়ে দিলে সে নিজেও খুব ভাল অবস্থায় থাকবে না। সবাই তাকে জানে অরবিন্দ মজুমদারের ‘ছেলে’। নতুন কেউ ওঁর জায়গায় কোচ হয়ে আসবে। যেই আসুক, তার সঙ্গে বনিবনা হবে কিনা কে জানে! তবে জ্যোতি বিশ্বাসকে তাড়াবার চিন্তা নিশ্চয়ই কারুর মাথায় আসবে না। এক লাখ টাকা চাইলে, যুগের যাত্রী তাকে সামনের বছরই কাঁধে তুলে নিয়ে যাবে। দু বছর আগে দেড়লাখ পর্যন্ত ওরা উঠেছিল তাকে পাওয়ার জন্য।

‘ছোটু, ছোটু।”

লুঙ্গি ছেড়ে ট্রাউজার্স পরতে—পরতে জ্যোতি হাঁক দিল।

”ছোটু বেরিয়ে গেছে, কি দরকার কি?” আশালতা দরজায় এসে দাঁড়ালেন।

”এই তিরিশটা টাকা নাও, ছোটুকে বাজারে গিয়ে মাছ আনতে বল, আমি একটু কলকাতায় যাচ্ছি, খুব দরকার।”

”ফিরবি কখন, খাবি তো?”

”তুলে রেখে দিও, যখন ফিরব তখন খাব। কালই আমি মেসে চলে যাব।”

সোমবার থেকে রোভার্সের জন্য প্র্যাকটিস শুরু হবার কথা। জ্যোতি কালো চশমাটা চোখে লাগিয়ে ঘর থেকে বেরোল। চশমাটা চার বছর আগের, কুয়ালালামপুরে কিনেছিল, মারডেকা টুর্ণামেণ্টে খেলতে গিয়ে। চশমাটা ছাড়া সে মোটরবাইকে চড়ে না।

বুলেটটাকে ঠেলে বাড়ির বাইরে এনে স্টার্ট দেবার আগে হঠাৎ মনে পড়ায় সে মাকে ডেকে বলল, ”কাগজগুলো বিছানায় ছড়ান রয়েছে, আমার দরকারে লাগবে, গুছিয়ে তুলে রেখে দিও। আর বিপিন স্যার যদি খোঁজ নেন তো বোলো খুব দরকারে কলকাতায় গেছি, ফিরে এসেই ওঁর বাড়িতে যাব।”

বিপিন গোস্বামী, অঘোরচন্দ্র উচ্চচ মাধ্যমিক বিদ্যাসদনের শিক্ষক। জ্যোতিকে কেউ যদি আবিষ্কার করে থাকেন তো তিনি এই বিপিন স্যার। জ্যোতি যখন বাড়ির কাছে প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র তখন একটা ছোট মাঠে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলতে দেখে বিপিন স্যার দাঁড়িয়ে পড়েন। জ্যোতিকে ডেকে তার বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে দু’দিন পরই প্রিয়রঞ্জনের কাছে হাজির হন।

ছেলে ভাল ফুটবল খেলে বা তাকে উৎসাহিত করলে বড় খেলোয়াড় হতে পারবে, একথা শুনে প্রিয়রঞ্জন মোটেই উদ্দীপ্ত হননি। বেঁটে, টাকমাথা বিপিন স্যারকে ঘাবড়ে দেবার মত দৃষ্টি হেনে বলেছিলেন, ”ফুটবল কি আমার গুষ্টি উদ্ধার করবে? খালি খেলা আর খেলা, লেখাপড়া না করলে এই দিনকালে করেকম্মে খাবে কি? আর আপনি, একটা জ্ঞানীগুণী শিক্ষক হয়ে কিনা বলছেন, ওকে ফুটবল খেলতে দিন!”

”হ্যাঁ বলছি।” ছোট্টখাট্ট মানুষটার গলা থেকে যে এমন কঠিন স্বর বেরোতে পারে, প্রিয়রঞ্জন তা আশা করেননি। থতমত হলেন। কিঞ্চিৎ ঘাবড়ালেনও।

”যাঁর যেটা হবে তাকে সেই পথে যেতে দেওয়াই ভাল। জ্যোতিকে আমাদের স্কুলে নেব। ফ্রিশিপ পাবে, পড়ার বইপত্তর আমিই দেব, আপত্তি আছে আপনার?”

প্রিয়রঞ্জন অসচ্ছল কম্পাউণ্ডার। জুট মিলের ডিস্পেন্সারিতে কাজ করেন। চুরির সুযোগ আছে এবং সে সুযোগ নিতে তিনি দুর্বলতা দেখান না। তবু সংসারের টানাটানি ঘোচে না, যেহেতু চুরির পয়সাগুলো খেয়ে নেয় দিশি মদ। নিজে লেখাপড়া না শিখলেও প্রিয়রঞ্জনের মাথায় এটুকু ঢুকে আছে, কলেজের ডিগ্রি চাইই আর সেটা রোজ দু বেলা বই খুলে চিৎকার করে না পড়লে, পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে, দু বেলাই জ্যোতিকে বেদম প্রহার থেকে তিনি বঞ্চিত করেননি। বাবাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করা, ছোটবেলা থেকেই জ্যোতির মধ্যে শুরু হয়ে গেছিল।

অঘোরচন্দ্র স্কুলে পড়াতে খরচ লাগবে না, শুনেই তার বাবা রাজী হয়ে যান। এরপর জ্যোতি ধাপে ধাপে ক্লাস টেন পর্যন্ত ওঠে, কিন্তু ফুটবলে সে আরো দ্রুত ডিঙিয়ে গেছে ধাপগুলো। কলকাতার ময়দানে সে সতেরো বছর বয়সেই পৌঁছে যায়।

মোটর বাইকটা পুকুরের ধার দিয়ে, চার হাত চওড়া ইঁট বাঁধানো রাস্তার দিকে নিয়ে যাবার সময় একতলা বাড়িটার সামনে আসতেই জ্যোতির ভিতরটা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য কাঠ হয়ে উঠল। তাকাবে না ঠিক করেও একবার চট করে আড়চোখে তাকাল।

বাইকের শব্দে একটি কিশোরী কৌতূহলবশতই জানালার কাছে এসে রাস্তায় তাকিয়েছে। ছ্যাঁৎ করে উঠল জ্যোতির বুক। তারপরই স্বস্তিতে শিথিল হয়ে গেল অ্যাক্সিলেটরের মুঠো। এ বাড়ির লোকজনেরা নতুন। এদের কাউকে সে চেনে না, কখনো চোখেও দেখেনি। বাড়িটা সাত বছর আগে বিক্রি করে বিনয় ভটচায আর তার মেয়ে উষা কোথায় যে চলে গেছে, কেউ তা জানে না। মেয়েটি যে জানলাটি থেকে তাকিয়েছে, ঠিক ওই জানলা থেকেই উষা তাকাত!

ইঁট বাঁধানো রাস্তাটা সর্পিলভাবে আধ মাইল গিয়ে বি টি রোডে মিশেছে। মেশার আগে বাঁদিকে একটা ছোট্ট জমির ধার দিয়ে রাস্তাটা বেঁকে গেছে। জনা পনেরো বালক ও কিশোর ফুটবল খেলছে সেই মাঠে।

জগা মালির মাঠ বলা হয় এটাকে। কেন যে এই নাম কেউ তা জানে না। আপনা থেকেই মন্থর হয়ে গেল বাইকটা।

তখন এইরকম দোকানগুলো ছিল না, মাঠের ধারের বাড়িগুলোও নয়। একটি দোতলা বাড়ি আড়াল করে দিয়েছে বিপিন স্যারের কাঠ আর ছিটেবাঁশের দেওয়াল দেওয়া টালির চালের ঘরটাকে। ঘরের জানালা দিয়ে তিনি মাঠে ছেলেদের খেলা দেখতে পেতেন।

জ্যোতি বাইকটা থামাল চায়ের দোকানের সামনে। বেঞ্চে বসে যারা চা খেতে খেতে কথা বলছিল তারা তটস্থ হয়ে গেল। জ্যোতিকে তারা নামে মাত্র চেনে। এই অঞ্চলে সে সবথেকে খ্যাতিমান।

”একটা চা দিন তো ভাই।” বাইকে বসেই সে আন্তরিক স্বরে বলল। চোখ মাঠের দিকে।

”বেঞ্চে এসে বসুন না।” ময়লা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা মাঝবয়সী চা—ওলা বিগলিত স্বরে বলল।

”এই ঠিক আছি, খেলছে কারা?”

”পাড়ারই ছেলেপুলে সব। আপনিও তো জগামালির মাঠে খেলেছেন ছোটবেলায়।”

”হ্যাঁ। তখন মাঠটা একটু বড় ছিল। এইসব বাড়িটাড়ি তখনো হয়নি।”

”আরো ছোট হয়ে যাবে। ধারের দিকের জমি বিক্রি হয়ে গেছে। খেলাটেলা ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাবে।”

জ্যোতি কথা না বলে চায়ের কাপটা নিল। ছোট ছোট চুমুকে দু মিনিটেই চা শেষ করে, পয়সা দিয়ে বাইকে স্টার্ট দিল। আড়চোখে দেখল ছেলেরা খেলা থামিয়ে তাকে দেখছে।

.

।।দুই।।

এগার বছর বয়সে অঘোরচন্দ্র স্কুলে আসার পর জ্যোতির্ময় বিশ্বাস শুনতে থাকে, বিশেষ এক ধরনের ফুটবল—প্রতিভা নাকি তার মধ্যে রয়েছে। পরবর্তী কালে অবশ্য ফুটবল সাংবাদিকরা তার সম্পর্কে সঠিক বিশেষণ খুঁজে না পেয়ে অবশেষে ‘দ্বিতীয় চুনী’/ ‘নতুন বলরাম’ ইত্যাদি বাক্যাবলী তার নামের সঙ্গে জুড়েছে।

কি করে ফুটবল খেলতে হয়, সেটা একজনও তাকে শেখায়নি। স্বাভাবিকভাবেই, খেলাটা তার কাছে এসেছে। খেলতে খেলতেই সে ‘অফ সাইড’ ‘থ্রো’, ‘ফ্রি কিক’ ইত্যাদি শব্দ শুনেছে আর খেলার নিয়ম জেনেছে। এখন তবু বাঁশের গোলপোস্ট, তার ছোটবেলায় জগামালির মাঠে ইঁট কিংবা শার্ট খুলে গোলের চিহ্ন রাখা হত।

পার্টি করে খেলা হত। দু পক্ষের জন্য ক্যাপ্টেন ঠিক হবার পর ছেলেরা দুজন—দুজন করে দূরে সরে গিয়ে কানে কানে নিজেদের একটা নাম ঠিক করে নিত। তারা দুজন ছাড়া নামদুটো আর কেউ জানবে না।

”ডাক ডাক ডাক কিসকো ডাক?” কাঁধ ধরাধরি করে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেরা এসে ক্যাপ্টেনদের সামনে দাঁড়িয়ে ওই বলে জিজ্ঞাসা করত। দুই ক্যাপ্টেনের একজন তখন বলত, ”হাম কো মেরি তোমকো ডাক।” দুজন ছেলের একজন তখন বলত, ”কে নেবে চাপাটি কে নেবে পরোটা, কিংবা হয়তো বলত, ”কে নেবে টগর ফুল, কে নেবে পদ্ম ফুল।” কিংবা এই ধরনেরই কিছু।

যে ক্যাপ্টেনের ডাক দেবার কথা সে তীক্ষ্ন চোখে বোঝার চেষ্টা করত, দুজনের মধ্যে যে ছেলেটি ভাল খেলে তার নাম কোনটা হতে পারে? চাপাটি না পরোটা? দুজনের কেউ অবশ্য ইশারা করে বা ভাবভঙ্গিতে বুঝিয়েও দিতে পারে সে—ই চাপাটি বা সে—ই পরোটা। অবশ্য এসব ব্যাপার করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে তুমুল ঝগড়া এবং হাতাহাতিও শুরু হয়ে যেতে পারে। ক্যাপ্টেন স্রেফ আন্দাজেই বলে দেয়, ”আমি নেব পরোটা।’ তখন দুজনের মধ্যে যার নাম পরোটা, সে এগিয়ে এসে ডাকদেওয়া ক্যাপ্টেনের বাঁদিকে দাঁড়াবে। এরপর অন্য ক্যাপ্টেনের ডাক দেবার পালা। আর একজোড়া ছেলে এগিয়ে এসে তাকে বলবে, ‘ডাক ডাক ডাক কিসকো ডাক।’

এইভাবে প্রায় লটারি করেই সাত—আটজনের দুটো দল হত। মুশকিল হত জ্যোতিকে নিয়ে। দুই ক্যাপ্টেনই তাকে চাইত। অনেক দিন জ্যোতিকে দুই দলের হয়েই আধাআধি করে খেলতে হয়েছে।

লাথি মারা, ঘুঁষি মারা, থুথু দেওয়া, গালাগালি, খিমচে রক্ত বের করা, এগুলো হতই। এজন্য প্রায়ই খেলা বন্ধ হয়ে যেত এবং আবার কিছুক্ষণ পর শুরু হত। বেশির ভাগ ছেলেই ছিল জ্যোতি থেকে পাঁচ—ছয় বছরের বড়। জ্যোতিকে আটকাতে তাদের কাজ ছিল, বল ধরলেই তাকে পিঠে ধাক্কা দিয়ে বা পিছন থেকে গোড়ালিতে লাথি কষিয়ে বা সররা কেটে ফেলে দিয়ে তাকে বল থেকে সরিয়ে দেওয়া।

প্রথম প্রথম সে ক্ষেপে উঠত। চিৎকার করত, মাঠ থেকে বেরিয়ে যেত কিন্তু এসব করে সে মার খাওয়া থামাতে পারেনি। অবশেষে নিজেকে বাঁচাবার জন্য উপায় খুঁজতে খুঁজতে সে জানতে পারল, হঠাৎ যদি নিজের দৌড়ের গতিটা বাড়িয়ে দেয় বা বল ধরার সময়টা নিখুঁত ভাবে বুঝে নিয়ে এগোয় তাহলে ওদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারবে। কখন তাকে মারতে আসবে, ওটাও সে ধীরে ধীরে শিখতে শুরু করে।

জ্যোতির মনে তখন ঘূণাক্ষরেও এই চিন্তাটা আসেনি যে, বড় হয়ে ফুটবল খেলেই সে অর্থ রোজগার করবে, পঁচিশ বছর বয়সের আগেই দেড় লাখ টাকার বাড়ি তৈরির জন্য আর্কিটেক্টের সঙ্গে দেখা করবে।

মাঝে মাঝে যখন সে ছোটবেলার দিকে তাকিয়েছে, জগামালির মাঠের কাছে সে কৃতজ্ঞ থেকেছে। এখানেই সে কষওয়ালা ফুটবলার হবার প্রাথমিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে দিয়ে জীবন শুরু করেছিল। এই মাঠেই সে শিখেছিল কিভাবে মার নিতে হয় এবং তার থেকেও বড় কথা, কিভাবে মার এড়াতে হয়। আজ পর্যন্ত জ্যোতি বড় ধরনের আঘাত পায়নি।

একবার একটা ইংরাজী ম্যাগাজিনে, তার সাফল্যের কারণ সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘বছরের পর বছর ধরে অসাধারণ ধৈর্যে প্র্যাকটিস আর নিবিড় ট্রেনিংয়ের ফলেই সে এমন নিখুঁত হয়ে উঠেছে।’ পড়ে সে খুব হেসেছিল। জ্যোতির মনে হয়েছিল জগামালির মাঠে যা করেছে তার থেকে বেশি কিছু সে এখন করে না। তফাৎটা শুধু, এখন যা করে থাকে সেটা বড় মাঠে, ভিন্ন পরিবেশে আর বেশি লোকের সামনে।

সারথিতে আসার তিন বছরের মধ্যেই খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনগুলো তাকে ফুটবলের সুপারম্যান বানিয়ে এমন একটা জায়গায় তুলে দেয় যে, অপরিণত মস্তিষ্ক, নাবালক, সারথি ভক্তরা তাকে ‘সারথির সারথি’ বলা শুরু করে দেয়। এই ধরনের স্তুতি সে কখনো গায়ে মাখেনি , স্তাবকতা তার পায়াভারি করেনি। বরং এগুলোকে সে নানান ধরনের সুবিধা আদায়ের সুযোগ রূপেই ব্যবহার করেছে।

একটা ফুটবলারের, বিশেষত স্ট্রাইকারের জীবন, ক’বছর টপ ফর্মে থাকতে পারে? চুনী গোস্বামী থেকে হাবিব পর্যন্ত হিসেব করে সে এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, খুব গুছিয়ে, শৃঙ্খলা মেনে জীবন যাপন এবং খেলার গুরুত্ব বুঝে শক্তি ক্ষয় করে সে সাত বড় জোর আট বছর চুটিয়ে খেলতে পারবে।

দাশুদা তাকে আর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিরাট সাহায্য করেছিল। একদিন তার ফ্ল্যাটে দুজন অচেনা লোক আর দুজন বান্ধবীর সঙ্গে দাশুদা খানা—পিনার সন্ধ্যেটা কাটাবার পর রাত্রে দাশুদা তাকে ঘর থেকে ডাকিয়ে মুখোমুখি বসে।

”জ্যোতি তোকে একটা কথা বলি, এই যে ব্যাঙ্কে চাকরি করছিস, এটা ছেড়ে দে। ক্লাব থেকে অনেক টাকাই তো পাচ্ছিস, বিয়ে—থা করিসনি, বাড়িতেও এমন কিছু খরচের চাহিদা নেই, তোর নিজেরও খরচ বলতে প্রায় কিছুই নেই, কেমন ঠিক বলছি?”

জ্যোতি মাথা হেলান।

”তোর কাজ মাঠে গোল দেওয়া। সেটা যত বছর ধরে দিবি, তত বছর তোর টাকা। কেমন? তুই যদি বছরগুলো বাড়াতে পারিস তাহলে টাকাও বাড়বে। এই যে হাবিজাবি এধার ওধার ম্যাচ খেলা আর অফিসের খেলা, এগুলো ফুটবলারের শক্তি শুষে নিয়ে শরীরের জোর যেমন কমায় তার থেকেও বেশি ক্ষতি করে মনের দিক থেকে বোদা করে দিয়ে। ফুটবলে অরুচি ধরায়, মাঠে নামতে বিতৃষ্ণা আসে, অনেকেই আমাকে বলেছে সামনে খোলা গোল পেয়েও শট নিতে গাছাড়া ভাবের জন্য বাইরে মেরেছে। এইভাবেই ভেতর থেকে ফুটবল সম্পর্কে আগ্রহ চলে যায় ফলে বছরগুলোও কমে আসে। নিজেকে তাজা রাখার চেষ্টা কর, অফিস ছেড়ে দে।”

”মাসে মাসে এতগুলো টাকা যখন পাচ্ছিই…” জ্যোতি কথাটা শেষ করার আগেই দাশুদা হাতের গ্লাসটা টেবলে ঠুকে আওয়াজ করল চুপ করার জন্য আদেশ জানাবার ঢঙে।

”এতগুলো টাকা! কত টাকা! তোর খেলা, সুনাম, যশ, খ্যাতি এসবের থেকেও কি বেশি? কয়েক সেকেণ্ড জ্যোতির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দাশুদা মেঝে থেকে হুইস্কির বোতল তুলে নিয়ে গ্লাসে অল্প ঢালল। আর একটা বোতল থেকে জল ঢেলে গ্লাসটা ভর্তি করে নিল।

”আজ সওয়া লাখ টাকার অর্ডার পাকা করে নিলুম। যে দুটো লোক এসেছিল দেখেছিস তো…ওদের ব্যাণ্ডেল অফিসের চেয়ার টেবল থেকে পর্দা পর্যন্ত সব আমার কোম্পানি করে দেবে। এজন্য আমাকে কি করতে হল? দুটো মেয়েমানুষ, ওদের তো এখানে অনেকবার দেখেছিস, দেড় বোতল ভ্যাট সিক্সটিনাইন আর ব্লু ফিল্ম। ঘরে প্রোজেক্টার আছে এটা বোধহয় তুই এখনো জানিস না।”

জ্যোতি জানত না তাই অবাকই হল। ব্লু ফিল্মে কি থাকে সেটা অনেকের কাছে শুনেছে কিন্তু কখনো দেখেনি। দেখার জন্য কৌতূহল যথেষ্ট আছে।

”তোকে দেখাব। তোকে একটা পুরুষমানুষ তৈরি করে দোব। হ্যাঁ, কি যেন বলছিলুম, সওয়া লাখ টাকার অর্ডার…লোক দুটো খুব শিক্ষিত, একজন আবার ম্যাগাজিনে পদ্যও লেখে, দুজনেই সোনাগাছি যায় বলে খবর পেয়েছি, ব্যাস, এটুকু জানাই যথেষ্ট। হ্যাঁ, তুই কি যেন বললি তখন…টাকা, মাসে মাসে অতগুলো, কতগুলো? এই অর্ডারের জন্য যে টাকা খরচ করলুম, এটা করতে হতো না যদি তুই একবার গিয়ে দাঁড়াতিস।”

”মানে!”

”মানে আবার কি, তুই কি জানিস কতটা তোর পপুলারিটি, তোর ফ্যান, তোর ভক্ত কত আছে? যে কোন অফিসে তুই গিয়ে দাঁড়ালে কত লোক তোকে শুধু দেখতে আসবে, সই নেবে, তা কি তুই জানিস?”

জ্যোতি একদৃষ্টে শুধু তাকিয়ে রইল দাশুদার মুখের দিকে। খুব আন্তরিক ভাবে বলছে। এত ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে আগে তার কাছে কখনো মন খোলেনি।

”তুই গিয়ে যদি একটু হেসে বলিস, এই কাজটা আমার জন্য একটু যদি করে দেন, তাহলে উপকার হয়, তাহলে মিনিস্টার থেকে বেয়ারা—কোন ব্যাটা না করে দেবে? করবি?”

”কি করব?”

”আমার হয়ে একটু বলা—কওয়া, এখান—ওখানে যাওয়া, বাড়িতে গিয়ে বৌদের কি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্পগুজব, রিকোয়েস্ট করলে ফাংশানে প্রধান অতিথি—টতিথি হওয়া, মোট কথা, ওদের ধন্য করে দিবি, আর তুইও কৃতার্থ হচ্ছিস এমনভাবে করবি…করবি?”

”তোমার অর্ডার সিকিওর করার জন্য?”

”টেন পার্সেণ্ট দোব, চাকরি করার থেকে অনেক ভাল। তাছাড়া ইচ্ছে আছে, তোর টাকাগুলো যাতে কাজে লাগিয়ে বাড়াতে পারিস তেমন একটা ব্যবস্থা করার। শৈবাল রেস্টুরেণ্ট করেছে শ্যামবাজারে, অজিত স্টিলের বাসনকোসনের দোকান দিয়েছে গড়িয়াহাটে, বাচ্চচু মিত্তির কাপড়ের এজেন্সি নিয়েছে এক গুজরাটির সঙ্গে শেয়ারে, শোরুম খুলেছে বেলেঘাটায়। ভাবছি প্লাইউডের বিল্ডিং মেটিরিয়াল সাপ্লাইয়ের কাজে নামব। আমার এক বন্ধুর কাছে শুনছিলাম, দুর্গাপুরে তাদের নতুন দুটো অফিস বাড়ি হচ্ছে আর স্টাফ কোয়ার্টার। শুধু দরজার জন্যই ওরা আট লাখ টাকার অর্ডার দিয়েছে। শুনে মনে হয়েছিল, আমিও তো অনেকটা এই ধরনের জিনিসই করি। কারখানাটা বাড়িয়ে আলাদা একটা বিজনেস শুরু করা যায়। যদি চাস তো তোকে পার্টনার করব। এখনই নামছি না, আগে বাজার বুঝেনি, হুট করে এসব ব্যবসায়ে তো আর নামা যায় না। তোকে শুধু আমার মনের ইচ্ছেটা জানিয়ে রাখলাম। পরে ভেবে দেখিস।”

জ্যোতি বলতে যাচ্ছিল, ব্যবসার সে কিছুই বোঝে না, যদি টাকা মার যায় তাহলে তো পথে বসতে হবে। দাশুদা তার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই মনের ভিতরটা পড়ে নিয়ে বলল, ”লোকসান যাবে তোর, এমন কাজ আমার দ্বারা হবে না জেনে রাখিস।”

তারপর হঠাৎই ছলছল করে ওঠে দাশুদার চোখ। গলা নামিয়ে কোমল স্বরে বলে, ”জ্যোতি, তোকে আমি ভালবাসি। তোর খেলা আমাকে নেশা ধরিয়ে দেয়, বুঁদ হয়ে যাই, কেমন যেন উদাস লাগে। মদ, মেয়েমানুষ, টাকা, সব কিছু তুচ্ছ মনে হয়। বিয়ে করিনি, কিন্তু তুই যদি আমার ছেলে হতিস! ছেলের জন্য যা যা করতাম সেইসব করতে ইচ্ছে করে তোর জন্য।”

”একটু আগে তুমি ব্লু ফিল্ম দেখাবে বলেছ।”

গ্লাসটা মুখের কাছে তুলেছিল, ধীরে ধীরে নামিয়ে নিয়ে দাশুদা আচমকা অট্টহাসে উছলে উঠল।

”ব্যাটা ধরেছিস তো বেশ। ছেলেকে ব্লু ফিল্ম দেখাবে কিনা বাবা? হ্যা হ্যা হ্যা, না রে জ্যোতি, তুই আমার ছেলে হোসনি। আমার দ্বারা বাপ হওয়া সম্ভব নয়।”

আবার অট্টহাসি। কিছুক্ষণ পর চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে তুলে দাশুদা গম্ভীর গলায়, কেজো গলায় বলল, ”আসলে ব্যাপারটা কি জানিস, ফুটবল বা এইরকম সব খেলায় যাতে গতর খাটাতে হয়, রীতিমত ঘাম রক্ত ঝরাতে হয়, টেনশনে থাকতে হয়, এতে শরীরটা ছিলেটানা ধনুকের মত হয়ে যায়। বেশিক্ষণ এই ভাবে টেনে রাখলে ধনুকটা মটাৎ করে ভেঙে যেতে পারে। তাই ছিলেটা আলগা করে দিতে হয়। যে কোন স্পোর্টসম্যানের শরীরও এই ধনুকের মত।”

থেমে গিয়ে দাশুদা মিটমিট চোখে জ্যোতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অস্বস্তি বোধ করল সে। কি বলতে চায় দাশুদা বুঝতে পারছে না।

”মাথায় ঢুকল না? কলকাতার ফুটবলাররা বড় মাথামোটা হয়, তোর শরীর গরম লাগে না? ভেতরে টান ধরে না ধনুকের ছিলের মত?”

জ্যোতি নড়ে বসল। দাশুদার কথার ইঙ্গিতটা সে বুঝতে পারছে।

”আলগা করা দরকার, নয়তো মটাৎ হয়ে যাবে। এটা খারাপ কিছু নয়। আমি নিজে খেলি না কিন্তু বুঝতে পারি। কত বড় বড় ফুটবলারকে তো দেখেছি, টান আর সহ্য করতে পারে না, মেয়েমানুষের কাছে ছুটে যেতেই হয়। ভগবানের এই আশ্চর্য এক যন্তর হল মেয়েমানুষ। সবার দরকার হয়। কি খুনী, কি পুলিশ? কি ঘুষ দেনেওলা, কি ঘুষ লেনেওলা, কি ফুটবলার, কি রেফারী, যারাই টেনশনের মধ্য দিয়ে চলে তাদের আলগা হওয়ার কাজটা মেয়েমানুষ ছাড়া আর কিছুতে হয় না। জ্যোতি, যদি তুই তাড়াতাড়ি খাক হয়ে জ্বলে যেতে না চাস তাহলে মেয়েমানুষ ধর। লোকে বলবে তোকে নষ্ট হবার বুদ্ধি দিচ্ছি, কিন্তু আমি বলি তুই মাঝে মাঝে ফুর্তি কর। ডিসিপ্লিনড থাকবি, বাড়াবাড়ি করবি না, শুধু ঠাণ্ডা করার জন্য নিজেকে ভিজিয়ে নিবি। তোর ভাবসাব আছে কি কোন মেয়ের সঙ্গে?”

সন্ত্রস্তের মতো কুঁকড়ে গিয়ে জ্যোতি ব্যগ্র স্বরে বলল, ”না না, কারুর সঙ্গে ভাব নেই।”

”গৌরীকে দেখেছিস? আজকেই তো ছিল এখানে, লম্বা ছিপছিপে ফর্সাটারে। পছন্দ হয়?”

”কি যে আবোলতাবোল বকছ তখন থেকে।” জ্যোতি উঠে দাঁড়াল। ”ঘুম পাচ্ছে আমার।”

”বোস। বোস বলছি।”

ধমকে উঠল দাশুদা। গ্লাসটায় শেষ চুমুক দিয়ে ঝুঁকে বোতলটা তুলল। চোখের সামনে ধরে কতটা রয়েছে দেখে নিয়ে বলল, ”এটা শেষ করে আমিও ঘুমোব। ততক্ষণ বোস।”

ছোকরা চাকর—তথা—ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার নাণ্টু এসে টেবল থেকে খালি বোতলটা তুলে নিল।

”দুটো কাটলেট আছে, গরম করে দেব?”

”নাহ, বরং জ্যোতিকে দে।”

”এত রাতে কাটলেট, পাগল হয়েছ!”

”নাণ্টু, তাহলে তুইই খেয়ে নে।”

নাণ্টু ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর দাশুদা একটু আনমনা হল। একদৃষ্টে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে কি একটা ভাবতে—ভাবতে বলল, ”নাণ্টুকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছি যখন ওর বারো বছর বয়স। ফুটপাথেই জন্মেছে, বাপ জিনিসটা যে কি তা জানে না। ওর পাঁচটা ভাইবোন, কে কোথায় ছিটকেছাটকে গেছে জানে না। খুব ফেইথফুল। ও জানে এখানে কি কাজকম্মো হয়, কিন্তু ওর পেট থেকে একটা কথাও কেউ বার করতে পারবে না।”

দাশুদা হাসল। স্বচ্ছ নির্মল হাসি।

”নাণ্টুর মত বারো বছর বয়েসে আমার বাবা মারা যায়। দাদা তখন কলেজে পড়ে। খুব কষ্টে আমরা বড় হয়েছি। তুই কি কখনো কষ্ট পেয়েছিস?”

জ্যোতি ইতঃস্তত করল। অভাবের সংসারে সে জন্মেছে, বড় হয়েছে। তবু একটা পর্যায় রেখে তাদের সংসারটা বাবার চাকরির টাকায় চলেছে। গায়ে জামা, পায়ে চটি বা থালার ভাত বরাবরই পেয়েছে। কিন্তু সবই ছিল দারিদ্র্যের কিনার ঘেঁষে।

”পেয়েছি, কিন্তু বলার মত নয়।”

দাশুদা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। তারপর হাতের গ্লাসটা ঝাঁকিয়ে যেন নিজের অতীতকে খারিজ করে দিয়ে বলল, ”গৌরী মেয়েটা আমার অনেক কাজ উদ্ধার করে দিয়েছে। ওকে মাসে মাসে টাকা দিই, আটশো করে, কাজ না থাকলেও। কাজ করে দিলে আলাদা দু’হাজারও দিয়েছি। দু’ তিনটে ক্লায়েণ্টও জুটিয়ে দিয়েছি। এই ধরনের কাজই। চেহারায়, কথায়, চালচলনে সফিস্টিকেটেড। প্রত্যেকেই হ্যাপি ওর সম্পর্কে। মাস চারেক আগে এক সুগার ফ্যাক্টরির গুজরাটি মালিকের সঙ্গে মহারাষ্ট্রের কতকগুলো জায়গা ঘুরে এল। ভাল টাকাই পেয়েছে। ভাল ঘরেই ওর বিয়ে হয়েছিল। স্বামীটা কোকেনের নেশা করত।…যা এবার ঘুমো গে।”

”তুমি একে পেলে কি করে?”

”পেতে কি হয়, নিজেরাই আসে। যেমন, তুই একদিন নিজেই এসেছিলি অরবিন্দ মজুমদারের কাছে, মনে আছে?”

.

।।তিন।।

জ্যোতির অবশ্যই মনে আছে সেকথা। সারা জীবন সে মনে করে রাখবে। কেন সে মার খাওয়া ভীত কুকুরের মতো শুধুমাত্র লুকিয়ে থাকার একটা জায়গা পাবার আশায় সল্ট লেকে অরবিন্দ মজুমদারের ফ্ল্যাটের কলিংবেল টিপেছিল এবং তারপর জীবনের মোড় দ্রুত ঘুরে গিয়ে কিভাবে একটা সফল জীবনের দিকে তাকে ঠেলে দিয়েছিল, সে কথা কোনদিন সে কাউকে বলেনি কারণ সেগুলো বলার মতো কথা নয়।

শ্যামবাজার মোড় থেকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড ধরে জ্যোতির বুলেট দক্ষিণে এগিয়ে অরবিন্দ সরণিতে বাঁক নিল। পূব দিকে মিনিট তিন—চার গিয়েই উল্টাডাঙ্গা রেলস্টেশন। আরো এগিয়ে তিনটি রাস্তার মোড়। সেখান থেকে বুলেট সল্ট লেক শহরের রাস্তা নিল।

দু’ঘরের ফ্ল্যাট নিয়ে সরকারী আবাসন। দোতলায় অরবিন্দ মজুমদারের ফ্ল্যাট। জ্যোতি প্রথম যখন আসে তখন সবেমাত্র আবাসনটি তৈরি হয়েছে। চারিদিকে ধূ—ধূ মাঠ। প্রাইভেট বাসের টার্মিনাস দশ মিনিট হেঁটে এবং কমপক্ষে আধঘণ্টা অপেক্ষা করে বাস পাওয়া যেত। ফ্ল্যাট কিনেও বহু মালিকই থাকত না। দোকান—বাজার এত দূরে, তাছাড়া নির্জনতা এবং মশার জন্যও থাকা সম্ভব নয়। অনেকেই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে দেয়। তখন অরবিন্দ মজুমদার ভাড়া নিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য সারথি—সংঘের কোচের জন্য দাশুদাই ফ্ল্যাটটি সংগ্রহ করে দেয়।

কিন্তু তিন—চার বছরের মধ্যেই শ’য়ে শ’য়ে বাড়ি তৈরি শুরু হয়ে যায়। অধিকাংশ দোতলা এবং অনেকগুলিরই বাইরের চেহারা আধুনিক গৃহস্থাপত্যের নিদর্শনরূপে তাকিয়ে থাকার মতো। সরকারী অফিসের সংখ্যা বেড়েছে, লোকজনের বাস বেড়েছে, পরিবহণ বেড়েছে। জ্যোতির প্রথম দেখা সল্ট লেক বা বিধাননগর এখন আর নেই।

কলিংবেলের আওয়াজটা আর আগের মতো নেই। তিনটি মিষ্টি শব্দের বদলে এখন সুরেলা ধ্বনি। প্রভাতীবৌদি এই সময় বারান্দায় হেলান চেয়ারে বসে থাকেন। বিধবা এক প্রৌঢ়া তাকে রাতদিন দেখাশোনা এবং রান্নার কাজ করে। ঠিকে ঝি বাকি কাজ করে চলে যায়।

একতলায় সিঁড়ির পাশে সরু জায়গায় স্কুটারটা দেখে জ্যোতি আশ্বস্ত হয়েছিল। তাহলে আছে। কিন্তু বেল টেপার পরই সে কাঠ হয়ে রইল। ভিতর থেকে কেউ যেন ”কে” বলল। হঠাৎই তার মনে হল, চলে যাই। এখন আসাটা বোকামি হয়েছে। দাশুদার কাছে প্রথমে যাবে ঠিক করেছিল। নানান কথা ভাবতে ভাবতে শ্যামবাজার থেকে অন্যমনস্কের মতো বাইক চালিয়ে সল্ট লেকে ঢোকার আগেও তার মনে ছিল না, ঠিক কি জন্য সে অরবিন্দদার কাছে যাচ্ছে।

মনে যখন পড়ল, কলিংবেল সুইচ ততক্ষণে টেপা হয়ে গেছে। দরজাটা সামান্য ফাঁক হল। একটি চোখ আর সাদা থান কাপড়। চেনা লোক দেখে পাল্লাটা আরো ফাঁক হল।

”অরবিন্দদা…”

”দাদা আর বৌদি তো ভোরবেলাতেই চলে গেছে।”

”চলে গেছে? কোথায়?”

”দেশের বাড়িতে।”

অরবিন্দদার দেশ তারকেশ্বরের দিকে রাজপুর নামে এক গ্রামে, কিন্তু ভোরবেলায় পক্ষাঘাতে পঙ্গু বৌদিকে নিয়ে গেল কি করে?

”সঙ্গে আর কেউ ছিল?”

”এক বাবু এসেছিলেন গাড়ি নিয়ে।”

”কি রকম দেখতে?”

”রোগা, লম্বা, খুব ফর্সা, চোখে সোনার চশমা…”

”ধুতি—পাঞ্জাবি পরা, সামনে চুল ওঠা?”

”হ্যাঁ হ্যাঁ।”

”খয়েরি রঙের মোটর?”

”হ্যাঁ।”

”কিছু বলে গেছে, কখন আসবে?”

”কিছু তো বলেনি। দাদা শুধু বলল, দেশে হঠাৎই খুব জরুরী কাজ পড়ে গেছে, বৌদিকে নিয়ে যেতেই হবে। পরে একসময় এসে কাপড় চোপড় নিয়ে যাবে আর আমাকেও যেতে হবে।”

দরজার ফাঁক দিয়ে জ্যোতি ভিতরে তাকিয়ে দালানে খাবার টেবলের উপর একটা খবরের কাগজ দেখতে পেল। এখনো খোলা হয়নি।

”কাগজটা কখন এল?”

”এই তো একটু আগে দাদারা চলে যাবার পর। বড্ড বেলায় এখানে কাগজ দেয়।”

”যে লোকটা এসেছিল সে কি কাগজ হাতে এসেছিল?”

”হ্যাঁ। দাদা তার কাছ থেকেই কাগজ নিয়ে পড়ল!”

”তারপর বলল দেশে চলে যাবে?”

”হ্যাঁ।”

”বৌদি কি বলল?”

”কি আর বলবে, যে মানুষ শুয়েই থাকে সারাদিন তার আবার বলাবলি কি? আমাকে বৌদি শুধু বলল, দাদার খুব বিপদ হবে কলকাতায় থাকলে, খারাপ লোকেরা দাদার পেছনে লেগেছে, প্রাণে মারারও চেষ্টা করছে তাই কেউ জানার আগেই চলে যাচ্ছে।”

”কবে আসবে কিছু তো বলেনি, তোমাকে বাজার—টাজার করার টাকা দিয়ে গেছে?”

”একশো টাকা দিয়েছে।”

জ্যোতি নীচে নেমে এল। সেই সময় একতলার ফ্ল্যাট থেকে এক মহিলা বাচ্চচার হাত ধরে বেরোলেন। স্কুলে পৌঁছে দিতে যাচ্ছেন মনে হল। চাহনি থেকে জ্যোতির আরো মনে হল, খবরটা ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছেন। ইনি একবার তার সই নিয়েছিলেন ভাইয়ের জন্য। দেখা হলে বিগলিত হাসি হাসেন।

”ওরা তো ভোরবেলায়ই চলে গেছেন।”

গম্ভীর মুখে জ্যোতি শুধু মাথা নাড়ল।

”ভালোই করেছেন,” গলাটা আরো নামিয়ে, ”এরপর এখানে না থাকাই উচিত।”

জ্যোতি তার বুলেটকে দু হাতে ধরে স্টার্ট দিতে যাচ্ছে, মহিলা তখন পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ”ওর স্ত্রী কী ভীষণ মানসিক আঘাত পেলেন বলুন তো? এই শক কাটিয়ে ওঠা—”

জ্যোতি এঞ্জিনটাকে তখন এত জোরে তিন—চারবার রেস করাল যে সেই গর্জনে মহিলার স্বর ডুবে গেল। বুলেট ছিটকে বেরিয়ে গেল মহিলাটির গা ঘেঁষে। জ্যোতি একবারও আর পিছনে তাকায়নি।

তাহলে দাশুদা সকালে এসেছিল। এখন রাজপুরে তার যাওয়ার কোন মানে হয় না। জ্যোতি ধরেই নিল, দাশুদা ওদের সঙ্গে যাবে না। যাতায়াতে প্রায় আশি—নব্বুই মাইল। কাজের লোক, সময় অপচয় করতে চাইবে না। তাছাড়া সঙ্গে থেকেই বা কি করবে! গাড়িটা দিয়েছে ওদের পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য। সারথির কোচকে অসম্ভ্রমের হাত থেকে বাঁচাতে, কিংবা সারথিরই মান বাঁচাতে দাশুদা ছুটে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এরপর? অরবিন্দদা কি আর মাঠে আসবেন?

জ্যোতি প্রথমে ভাবল বাড়ি ফিরে যাবে। উল্টাডাঙ্গার মোড়ে পৌঁছে সে মন বদলাল। এখন একবার দাশুদার ফ্ল্যাটে গিয়ে বরং দেখা যাক। হয়তো রাজপুরে নিয়ে গেছেন রটিয়ে দিয়ে আসলে ওখানে নিয়ে গিয়ে ওদের তুলেছে। দাশুদার সরল হাবভাবের আড়ালে চমৎকার একটি কুটিল মন যে লুকিয়ে রাখে, এটা সে এতদিনে জেনে গেছে।

বাড়ির নীচে, সিমেণ্ট বাঁধানো গাড়ি রাখার চত্বর। জ্যোতি তার বুলেট সেখানে রেখে, দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে জানল দাশুদাকে সে কাল রাতে গাড়িতে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। ফিরলে গাড়িটা তো এখানেই থাকত।

ফ্ল্যাটের কলিংবেল সুইচে আঙুল দিতে গিয়ে তার চোখে পড়ল, দরজাটা অল্প ফাঁক হয়ে রয়েছে। কেউ ঢুকেছে অথবা বেরিয়েছে। বেরোলে নাণ্টুই।

পা টিপে সে ভিতরে ঢুকল। বসার ও খাওয়ার জন্য লম্বা দালানটা ফাঁকা, তার দুদিকে তিনটি ঘর। জ্যোতি এসে যে ঘরটায় থাকে সেটার দরজা আধ ভেজান। বাকি দুটি দাশুদার খাস ঘর। বন্ধ রয়েছে। রাতে বেরিয়ে দাশুদা আর তাহলে ফেরেনি।

সন্তর্পণে দরজার পাল্লাটা ঠেলে ঘরের ভিতরে তাকিয়েই জ্যোতি চমকে উঠল। তার পক্ষে এটা কল্পনাতেও অসম্ভব। খাটে উপুড় হয়ে একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে এবং চুল, পিঠ, নিতম্ব নির্ভুলভাবে গৌরীকে চিনিয়ে দিচ্ছে। এই দেহটিকে সে চেনে।

এই সকালে! তার ঘরে! ব্যাপার কি!

জ্যোতি নিথর দাঁড়িয়ে রইল মিনিট দুয়েক, চাহনির মারফৎ তার বিস্ময় এবং হঠাৎ জেগে ওঠা কামনা বুলিয়ে দিল গৌরীকে মাথা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত। তারপর নিঃসাড়ে এগিয়ে খাটে বসে ঝুঁকে মুখটা নিয়ে গেল ঘাড়ের কাছে। চুলের কিনার ঘাড়ের শেষ হয়েছে, সেখান থেকে নীচু—গলা ব্লাউজের ফাঁকের মাঝে মসৃণ সাটিনের মত গাত্রত্বক। জ্যোতি জিভ দিয়ে চাটল।

”কে, কে!”

গৌরী ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। চোখ থেকে ঘুমের রেশ কাটিয়ে ওঠার জন্য বার কয়েক পিটপিট করে ক্ষীণ হাসল।

বুকের কাপড় খসে পড়েছে। জ্যোতি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে সে কাপড়টা কাঁধে তুলে দিল, জ্যোতি কাঁধ থেকে সেটা ফেলে দিয়ে বলল, ”এখন তাহলে ব্রা পরতে হচ্ছে!”

গৌরী আবার শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে ঘুমজড়ানো স্বরে বলল, ”বয়স তো হচ্ছে।”

”কত হল?”

”তোমার বয়সের সঙ্গে চার—পাঁচ যোগ কর।”

”আমার বয়স কত জানো?”

”কত জায়গায় তোমার জীবনী বেরিয়েছে।”

”তুমি সে সব পড়েছ? ফুটবলে তোমার ইণ্টারেস্ট আছে বলে তো জানা ছিল না।”

”আজও নেই। খেলা—টেলার কোনও খবরই রাখি না।”

”তাহলে পড়লে কেন?”

”দাশুদা একবার একটা ম্যাগাজিন পড়তে দিয়েছিল।”

”কবে, কতদিন আগে?”

”অনেক দিন আগে, তখনো আলাপসালাপ হয়নি। দাশুদা বলল, এই খোকাটাকে পুরুষমানুষ বানিয়ে দে তো।”

”বানাতে পেরেছ?”

চোখ বোজা গৌরীর ঠোঁটদুটোয় স্মিত হাসি ছাড়িয়ে পড়ল।

”মনে তো হচ্ছে পারিনি।”

জ্যোতি মুখটা নামিয়ে গৌরীর দুই স্তনের মাঝে চেপে ধরল। আলতো করে ডান হাতটা গৌরী ওর মাথায় রাখল। চুলের মধ্যে আঙুলগুলো চিরুনির মতো চালাতে চালাতে বলল, ”বড্ড টায়ার্ড লাগছে।”

”রাতে কোথাও ছিলে?”

”হ্যাঁ, গ্র্যাণ্ডে। দিল্লী থেকে একজন বড় অফিসার এসেছে। তার সুইটেই ওরা পার্টি দিয়েছিল।”

”তাহলে ঘুমোও এখন।”

জ্যোতি মুখ তুলতে যাচ্ছিল। গৌরী চেপে ধরে রইল।

”থাকো। ভাল লাগছে।”

জ্যোতি আর একটু সরে এসে মুখটা পাশ ফিরিয়ে দু হাতে গৌরীকে জড়িয়ে ধরল। গৌরী ওর চুলে বিলি কেটে যেতে লাগল।

”কাল ভেলোর যাব।”

”ভেলোর! কেন? ওখানে তো লোকে অপারেশন করাতে যায়।”

”তোতনের হার্টের অবস্থা বিপজ্জনক।”

”তার মানে?”

জ্যোতি মুখ তুলল। গৌরী সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। চোখে ভেসে রয়েছে চাপা যন্ত্রণা।

”জন্ম থেকেই ওর হার্টে ত্রুটি রয়েছে। একটা ভালভ কাজ করে না। আমায় প্রায়ই বলত, খেলতে গেলে হাঁপিয়ে পড়ে। তখন গ্রাহ্য করতাম না। এবার ও যখন এসেছিল স্পেশ্যালিস্ট দেখাই আর তখনই জানা গেল, ডাক্তার মোদকই বললেন ভেলোরে গিয়ে ঠিক করিয়ে নিতে। তিনিই চিঠিপত্র লিখে যা করার করেছেন। আমি কাল তোতনকে নিয়ে যাব।”

”এত ব্যাপার হয়ে গেছে, কই কিছু তো বলনি?”

গৌরী হাসল, জ্যোতি উঠে বসল।

”আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার এসব। সবাইকে বলে বেড়াব কেন?”

জ্যোতি কখনো কৌতূহল দেখায়নি গৌরীর নিজস্ব ব্যাপারে। দাশুদাই বারণ করে দিয়েছিল, ‘প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব কিছু গোপনীয়তা থাকে। সেগুলো লোকে জানুক এটা সবাই চায় না। গৌরী খুব চাপা মেয়ে।”

দাশুদার কাছ থেকে সে শুধু জেনেছিল, গৌরী তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে যায়, তার পর ডিভোর্স করে। ছেলেকে কালিংপঙে একটা স্কুলে পড়াচ্ছে। এখন বয়েস বছর দশেক। তোতনকে জ্যোতি কখনো দেখেনি। একবার গৌরী তার অটোগ্রাফ করা ছবি চেয়ে নিয়ে ছেলেকে পাঠিয়েছিল। ‘তোতনকে লিখেছিলাম, জ্যোতি বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ও তো বিশ্বাসই করতে চায় না। লিখেছে, ওর সই করা ছবি পাঠাও। ও যে তোমার ফ্যান আমি জানতামই না। একটা ছবি সই করে দিও তো।’

জ্যোতি দিয়েছিল এবং ব্যাপারটা ভুলে গেছল।

”কি রকম খরচ পড়বে?”

”তা ভালই পড়বে। যা জমাতে পেরেছি সবই যাবে। আরও হাজার দশেক যোগাড় করতে হবে।”

”তোমার সঙ্গে অনেক টাকাওলা লোকের চেনা আছে।”

”তা আছে। কিন্তু দশ হাজার কেউ দেবে না।”

”দাশুদা?”

”সে জন্যই তো এসেছি। নাণ্টুর কাছে শুনলাম কাল রাতে এসেই আবার চলে গেছে।”

জ্যোতির মনে পড়ে গেল তার নিজের এখানে আসার উদ্দেশ্যটা।

”তুমি আজকের কাগজ পড়েছ?”

নাহ, পড়ার সময় পেলাম কই। কেন কি হয়েছে?”

জ্যোতি কাগজের খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল নাণ্টু সোফায় বসে একটা বাংলা কমিকস মন দিয়ে দেখছে। তাকে দেখে সে মুখ তুলে তাকাল।

”কোথায় ছিলিস এতক্ষণ? দরজা খুলে রেখে বেরিয়েছিলি!”

”ওপরের ফ্ল্যাটে গেছলুম, বইটা আনতে।”

”রান্না করেছিস?”

”গৌরীদি বলল খাবে না শরীর খারাপ। শুধু আমার জন্য রেঁধেছি।”

”আজকের কাগজটা কোথায়?” এই বলে জ্যোতি নিজেই টেবলের নীচের র‌্যাক থেকে দু—তিনটি কাগজের মধ্যে প্রভাত সংবাদটা তুলে নিল। ”আমার জন্য আড়াইশো দই নিয়ে আয়, ভাত দিয়ে খাব।”

পাঁচ টাকার নোট নাণ্টুকে দিয়ে সে ঘরে এল। গৌরী মুখ ফিরিয়ে শুয়ে।

”এই খবরটা আগে পড়।”

গৌরীর মুখের দিকে জ্যোতি তাকিয়ে রইল। যতক্ষণ ধরে সে খবরটা পড়ল। বিশেষ কোন ভাবান্তর হতে দেখল না। তার মনে হল, সারথি বা তার ফুটবল কোচ সম্পর্কে কোন পরিচয় বা আগ্রহ না থাকায় গৌরীর কাছে এই ধরনের খবরের কোন তাৎপর্য নেই।

”অরবিন্দ মজুমদারের বাড়ি থেকে এখানে আসছি। ওখানে শুনলাম অরবিন্দদা আর তার পঙ্গু বৌকে কেউ একজন ভোরে এসে গাড়িতে করে নিয়ে গেছেন দেশের বাড়িতে। ওই একজনটি দাশুদা।”

”কেন?”

”বৌদি এখনো বোধহয় জানে না। জানার আগেই সরিয়ে নিয়ে গেল।”

”তোমার অরবিন্দদাকেও এবার ক্লাব থেকে সরিয়ে ফেলা সহজ হয়ে যাবে।”

”এরকম বললে কেন?” জ্যোতি চমকে উঠে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

”এমনিই মনে হল তাই বললাম। তুমি এসব জায়গায় যাওটাও না তো?”

”কোনদিনই না।”

”সাবধান। তাহলে কিন্তু হঠাৎ পুলিশ রেড করে ধরে নিয়ে গেলে কাগজে এইরকম বড় বড় করে হেডিং বেরোবে, আর কেরিয়ার খতম হয়ে যাবে।”

”কিন্তু তুমি একথা বললে কেন, অরবিন্দদাকে এবার ক্লাব থেকে সরিয়ে ফেলা সহজ হয়ে যাবে? এ সম্পর্কে জান কিছু?”

”একবার, মাস চারেক আগে, দাশুদা গল্প করতে করতে ওর এক ক্লায়েণ্টকে বলেছিল, আমিতো ক্লাবটলাব অত বুঝি না তাই কানও দিইনি, তবে কথাটা কানে গেছল, ‘অরবিন্দ মজুমদার ফিনিশ হয়ে গেছে, সারথি আর কিছু ওর কাছ থেকে পাবে না, একটা ট্রফিও এবছর আনতে পারল না’ তারপর হঠাৎ এই খবরটা পড়ে কি রকম যেন মনে হল তাই বলে ফেললাম।”

”অদ্ভুত তো!”

”কিসের অদ্ভুত? আমার এমন মনে হওয়াটা?”

গৌরী নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জানলার দিকে। জ্যোতি তাকিয়ে আছে গৌরীর মুখে। বয়স হঠাৎ যেন আঁচড়িয়ে দিল মুখটায়। হালকা সুর্মার নীচে কালি পড়েছে, গালের মাংস ঝুলে গেছে, ভাঁজ পড়েছে ঠোঁটের দুধারে।

”মাঠের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, কিন্তু জীবনে কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। অনেক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছি, যা তুমি হয়তো যাওনি।”

”তুমি কতটা জান আমার সম্পর্কে?”

”কিছুই না।”

”তাহলে একথা বললে কী করে?”

”মনে হল। একটা অবিবাহিত ছেলে বছরে লাখটাকা কামাচ্ছে, দায়দায়িত্ব বলে কিছু নেই, মানছি তারও যন্ত্রণা থাকতে পারে, কিন্তু সেটা আমার সমান নয়, হতে পারে না। আমাকে এই জীবনে আসতে হল কেন? সেটা বোঝার ক্ষমতা তোমার আছে কি? তুমি যদি মেয়ে হতে আর কোন পুরুষ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করত…”

”থাক থাক, আর বলতে হবে না।” জ্যোতি রুক্ষস্বরে বলে উঠল গৌরীকে থামিয়ে দিয়ে। ভ্রূ—কুঁচকে গৌরীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে মুখটা ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের গলার স্বর নিজের কানেই তার খারাপ লেগেছে।

”চান করতে হবে।” অপ্রতিভ বোধটা কাটিয়ে ওঠার জন্য খাপছাড়া ভাবে কথাটা বলে সে ঘরের লাগোয়া স্নানের ঘরের দরজা খুলে ভিতরে তাকিয়ে, দরজা বন্ধ করল।

”আশ্চর্য, তোয়ালেটাও রাখেনি।”

জামাটা খুলে খাটের উপর ছুঁড়ে দিয়ে জ্যোতি স্নানের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। গৌরীর কথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে তার মাথায়।

‘তুমি যদি মেয়ে হতে আর কোন পুরুষ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করত…কোন পুরুষ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করত…বিশ্বাসঘাতকতা…করত…’

অনেক দিন আগে, অনেক দিন আগে, উষা…এই নামে একটা মেয়ে, ছোটবেলা থেকে জ্যোতি তাকে চেনে। পুকুরপাড়ের সরু পথটা দিয়ে রাস্তায় পড়লেই উষাদের একতলা বাড়ি। ওর বাবা সুবিনয় ভট্টাচার্য রেশনের দোকানে চাকরি করতেন আর বাকি সময় ব্যস্ত থাকতেন পুরোহিতের কাজে। ওর চার বছর বয়সে মা নিরুদ্দেশ হয়। দূর সম্পর্কের এক বৃদ্ধা পিসিকে ওর বাবা এনে রাখেন। বছর দশেক পর পিসি মারা যান। তারপর থেকে বাড়িতে শুধু বাবা আর মেয়ে।

উষা তার থেকে এক বছরের ছোট। সকালের স্কুলে পড়ত। সে যখন স্কুল থেকে ফিরত জ্যোতি তখন স্কুলের দিকে যাচ্ছে। পথে দেখা হত, দু—চারটে কথা হত আর চিঠি বিনিময়।

তারপর জ্যোতি কলকাতায় প্রথম ডিভিশনে ফুটবল খেলতে গেল। প্রথম বছরেই তার গোলে মহমেডান স্পোর্টিং হারল, ইস্টবেঙ্গল আর সারথি সংঘের সঙ্গে ড্র হল। সেই বছরই অরবিন্দ মজুমদার সারথির কোচ হয়ে এসেছেন। খেলার পর তাঁবুতে নিজের ঘরে জ্যোতিকে ডেকে আনিয়ে কোন ভণিতা না করেই বলেছিলেন, ”সামনের বছর সারথিতে এস। তোমার গোলটা নিশ্চয় দারুণ হয়েছে কিন্তু অনেক ত্রুটি আছে তোমার খেলায়, মাজাঘষা দরকার। ভাল প্লেয়ার পাশে না পেলে তুমি ডেভেলাপ করতে পারবে না। ছোট টিমে খেলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আসবে আমার ক্লাবে?”

”মাত্র এই বছরই গড়ের মাঠে খেলছি।” জ্যোতি বলেছিল, ”এখনো কিছুই জানি না, বুঝি না। বড় ক্লাবে গিয়ে অনেককেই তো সাইড লাইনের ধারে সারা সিজন বসে থাকতে দেখেছি। আমি বসে থেকে পচে যেতে চাই না।”

”আমি যখন তোমাকে যেচে ডেকে আনছি তখন এটা নিশ্চয় বুঝতে পারছ বসিয়ে রাখার জন্য ডাকছি না। আমার কলেজেরই সহপাঠী তোমরা স্কুলের টিচার বিপিন গোস্বামী আমাকে মাসখানেক আগে চিঠি দিয়ে তোমার কথা বলেছিল। তোমার চারটে ম্যাচ আমি তারপর দেখেছি। এর মধ্যে যদি মোহনবাগান বা ইষ্টবেঙ্গল তোমার সঙ্গে কনট্যাক্ট করে না থাকে, নিশ্চয়ই করেনি, তাহলে আমি তোমাকে অফার দিচ্ছি।”

জ্যোতি হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। শুধু বলেছিল, ভেবে দেখব। বিপিন স্যার যে চিঠি দিয়েছেন একথা উনি ঘুণাক্ষরেও তাকে বলেননি। তবে অরবিন্দ মজুমদার যে তার সঙ্গে কলেজে পড়তেন কয়েকবার সেটা বলেছিলেন। মনে মনে সে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল প্রকৃতপক্ষে তার প্রথম আবিষ্কর্তাকে। বিপিনস্যার তার ফুটবল কোচ, তার প্রথম প্রকৃত বন্ধু। তাকে পরামর্শ দিয়ে চালনা করেছেন যখন সে বাস্তব জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অসহায় বোধ করেছে। বিপদের সময়ও পাশে দাঁড়িয়ে অভয় দিয়েছেন। আর সেই বিপদও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে একদিন এসেছিল যেদিন উষা জানলা থেকে ডেকে তাকে দাঁড় করিয়ে আতঙ্কিত মুখে তাকে কথাটা জানাল। তারপর কাতরস্বরে বলেছিল, ”জ্যোতি আমাকে বিট্রে করো না।”

স্নানঘরের দরজায় খটখট শব্দটা অনেকবার হয়েছে। শাওয়ারের নীচে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে জ্যোতি সাত বছর পিছিয়ে স্মৃতির মধ্যে ডুবে থাকায় শুনতে পায়নি, অবশেষে খুব জোরে ধাক্কা পড়তে তার হুঁশ ফেরে।

”কে?”

”আমি। তাড়াতাড়ি কর, আমাকেও চান করতে হবে।”

তোয়ালে নেই ভেজা গায়েই প্যাণ্ট পরে সে বেরিয়ে এল। মাথার চুল থেকে জল ঝরছে।

”দেখি, মাথাটা নিচু কর।”

বাধ্য ছেলের মতো জ্যোতি মাথা নামাল। গৌরী আঁচল দিয়ে মাথাটা মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, ”হঠাৎ মেজাজটা বদলে গেল যে? তোমার অরবিন্দদার জন্য?”

জ্যোতি ভাল সেণ্টের ফিকে গন্ধ পেল গৌরীর শরীর থেকে। স্নান করবে বলে ব্লাউজটা খুলেছে। পাতলা শাড়ির আড়ালে স্তনের নড়াচড়ার আভাস পাচ্ছে। জ্যোতি তার ঠোঁট চেপে ধরল স্তনাগ্রে এবং হাঁ করে কিছু কিছুটা মুখে পুরে হালকাভাবে দাঁত বসাল।

”কি হচ্ছে কি?” মাথা মোছা থামিয়ে গৌরী কৃত্রিম ধমক দিল।

”তোমারও মেজাজ খারাপ হয়েছে। তোতনের জন্য?”

”স্বাভাবিকই।”

গৌরী স্নানঘরে ঢুকল। জ্যোতি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

”একমাত্র ছেলের প্রাণ যখন বিপন্ন হয় তখন কোন মা মেজাজ ঠিক রাখতে পারে?”

জ্যোতির উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে গৌরী শাড়ি খুলে আলনায় রাখল। সায়া খোলার সময় মুখ তুলে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ”লজ্জা পাচ্ছ?”

”না না লজ্জা পাব কেন, টেণ্টে ড্রেসিংরুমে তো উদোম হয়ে থাকিই।”

”সেখানে মেয়েরা তো থাকে না।”

গৌরী শাওয়ার খুলে, চুল বাঁচাতে মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে দাঁড়াল। জ্যোতির চাহনিতে তারিফ ফুটে উঠল। বছর পাঁচেক আগেও যে শরীর দেখেছে আজও তা অটুট রয়েছে। খাওয়ার এবং ব্যায়ামের ব্যাপারে গৌরী কঠোর নিয়ম মেনে চলে। ”বল আমার ফিগারটা কেমন?” প্রথমবার যখন গৌরী নগ্ন হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করেছিল জ্যোতি তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছিল। সে ভাবতেও পারেনি এত স্বচ্ছন্দে কোন মেয়ে একের পর এক বস্ত্র শরীর থেকে খুলে ফেলতে পারে প্রায় অপরিচিত কোন পুরুষের সামনে, তাও ঘরে আলো জ্বলছে!

”মুখে কথা নেই কেন? শুনেছি তুমি ফুটবলকে দিয়ে নাকি কথা বলাও!”

”দাশুদা বলেছে?”

”তাছাড়া আর কে?”

”দাশুদা তোমায় ফিট করেছে আমাকে পুরুষ মানুষ করে তুলতে?”

”তুমি তো পুরুষই, করে আবার তুলব কি?”

গৌরী এগিয়ে এসে তার বুকে হাত রেখে বলে, ”দাশুদা বললেই সব কাজ আমি করব, এমন কোন কথা আছে কি? আমারও তো ইচ্ছা অনিচ্ছার, ভাল লাগার ব্যাপার আছে।”

”এজন্য দাশুদা তোমাকে টাকা দেবে?”

”কতটা বীয়ার খেয়েছ?”

”আড়াই বোতল—বললে না তো দাশুদা টাকা দেবে কি না?”

দু হাতে গলা জড়িয়ে, মুখের কাছে মুখ এনে বলেছিল, ”না। দিলেও নেব না। একেবারে ভলাণ্টারি সার্ভিস।” তারপর ধাক্কা দিয়ে বলেছিল, ”তুমি তো বললে না আমার ফিগার কেমন লাগল?”

গলা শুকিয়ে আসছিল। ঢোঁক গিলে জ্যোতি শুধু বলেছিল ‘ভাল।’

”শুধুই ভাল, হাত দাও গায়ে, যেখানে খুশি।”

জ্যোতি হাত রেখেছিল কাঁধে। আঙুলগুলো তখন কাঁপছিল। চোখে চোখ রাখতে গিয়েও পারছিল না। গৌরীর মুখ টিপে হাসিটার অর্থ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না: বাচ্চচা, নাবালক, অপদার্থ।

কোমরের বেল্ট ধরে গৌরী বলেছিল, ”এগুলো এবারে হঠাও।”

”না।” আর্তনাদ করে উঠেছিল জ্যোতি। ”আলো জ্বলছে!”

হাসতে হাসতে গৌরী কুঁজো হয়ে যায়। ”এই যে বললে ড্রেসিংরুমে—”

জ্যোতি ছুটে গিয়ে সুইচ টিপে ঘর অন্ধকার করে দিয়েছিল। তারপর অত্যন্ত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটে যায়। একটা নব্বুই মিনিটের হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচের পর মাথা যেরকম ঘোরের মধ্যে থাকে, বুকের মধ্যে কলজেটা দপদপায়, চোখে ঝাপসা লাগে, অনুভব ক্ষমতা কমে যায় প্রায় সেই রকমই তার মনে হয়েছিল। স্বপ্নের মত অনেক দূরের ব্যাপার যেন, যত চেষ্টা করে কাছে যেতে ততই সুদূরের মনে হয়েছিল। মহাশূন্যে যেন ভেসে যাচ্ছিল গৌরীর দেহটাকে আঁকড়ে ধরে। অস্পষ্ট গোঙানি, মর্মর ধ্বনির মত হালকা কথা, ভারী নিঃশ্বাস পাচ্ছিল গৌরীর কাছ থেকে। অবশেষে একটা তরঙ্গ তার সারা শরীর বেয়ে নেমে তাকে নির্জীব অসহায় অবস্থায় পৌঁছে দেয়।

যখন গভীর নিঃশ্বাস নিতে সে অকাতরে ঘুমের জন্য প্রার্থনা করছিল সেই সময় গৌরী বলেছিল, ”আমিই কি প্রথম?” সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরের সব কটা পেশী শক্ত হয়ে উঠেছিল। একথা বলল কেন? ও কি টের পেয়ে গেছে? গৌরীর এ ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে। হয়তো তার শরীর থেকে কিছু বুঝে নিয়েছে। তখন চোখে ভেসে উঠেছিল উষার মুখ। গৌরীকে সে বলতে যাচ্ছিল, না তুমি দ্বিতীয়। বলতে পারেনি, আজ পর্যন্ত কাউকেই বলতে পারেনি শুধু বিপিন স্যারকে ছাড়া।

শাওয়ার বন্ধ করে ভিজে শরীরেই গৌরী সায়াটা পরতে যাচ্ছিল। জ্যোতি বলল, ”দাঁড়াও, বেড কভারটা দিয়ে গা মুছিয়ে দি।”

ছুটে গিয়ে বেডকভারটা এনে সে গৌরীকে প্রায় মুড়ে জল শুষে নেবার জন্য পা থেকে গলা পর্যন্ত চেপে দিল।

”তুমি এখন কোথায় যাবে?” জ্যোতি বলল।

”পার্ক সার্কাসে যাব, ঘর দেখতে।” গৌরী চিরুনি দিয়ে চুল ঠিক করছিল। আয়না সামনে।

”ঘর? কার জন্য?”

”আমার জন্য। ফ্ল্যাটের এত ভাড়া আর আমি টানতে পারব না। এখন আমাকে ধার শোধের কথা ভাবতে হবে। তোতনের জন্য বছর বছর খরচের টাকাটা একরকম ভাবে এত কাল ম্যানেজ করেছি কিন্তু এই অসুখটার ধাক্কা—”

কাতর, অসহায় চোখে গৌরী তাকিয়ে আছে। ওর কঠিন, স্বচ্ছন্দ, বাস্তববোধ গলে গলে ধুয়ে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে দিশেহারা একটি কোমল অন্তঃকরণ।

”খুবই কি ভয় পাওয়ার মত অসুখ?”

”ডাক্তার তো বলছেন, এ সব অপারেশন এখন আকছারই হচ্ছে। তবে খরচ খুব।”

”টাকার জন্য কারুর কাছে তুমি চেও না, আমি দেব।”

গৌরীর অবাক এবং বিভ্রান্ত চোখ জ্যোতিকে খুশি করল। তারপরই অনুযোগের স্বরে সে বলল, ”তোমার তো আমাকেই প্রথম বলা উচিত ছিল। হঠাৎ আজ দেখা হল তাই, নইলে আমি তো জানতেই পারতাম না!”

”কাউকে আমি জানাতে চাই না। তোতন আমার নিজস্ব, আমার সব কিছুই ওর জন্যই, শুধু ওর জন্যই। আমি আবার বিয়ে করতে পারতাম, দুটি লোক চেয়েছিল, কিন্তু করিনি। মনে হয়েছিল খুব নির্ভরযোগ্য নয়, তাছাড়া তোতনও সেটা মেনে নিতে পারবে না।”

”কিন্তু এখন যা করছ সেটা তো একদিন জানতে পারবে!”

”আমি সরে যাবার চেষ্টা করছি। চাকরি বাকরি পাওয়া আমার পক্ষে শক্ত, চেহারাটা ছাড়া কোন যোগ্যতাই নেই। সিনেমায় চেষ্টা করেছিলাম, হয়নি। স্টেজে চেষ্টা করে যাচ্ছি, যাত্রায়ও। মডেলিং লাইনে আছে এমন কয়েকজনকে চিনি, এবার দেখি ওখানে কিছু হয় কি না।”

”কবে তোমার টাকার দরকার?”

”ভেলোর ঘুরে আসি তারপর বলব। কিন্তু অত টাকা দিতে তোমার অসুবিধা হবে না তো?”

”দশ বিশ হাজার যখন তখন দেবার ক্ষমতা আমার আছে।” কথাটা বলেই জ্যোতির হাসিমুখটা হঠাৎ পাংশু হয়ে গেল। জগামালীর মাঠের ধারে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বিপিন স্যার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ”জ্যোতি, ডাক্তার পাঁচশো টাকা চাইছেন, যোগাড় করতে পারিস?” শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। ”স্যার, এত টাকা এখন কোথায় পাব!” যেখানে থেকে পারিস যোগাড় কর, নয়তো উষার সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার কাছেও তো অত টাকা নেই যে দেব।”

”একটু সময় লাগবে শোধ দিতে।” গৌরীর সারা শরীরে অনুনয়ের সঙ্গে কাতর আবেদন। জ্যোতি বিষণ্ণ বোধ করল। সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্য হালাকা ফাজিল স্বরে বলল, ”আরে সেজন্য ভাবতে হবে না।” গলার স্বর নামিয়ে বদমাইসী চাহনি নিয়ে তারপর বলল, ”তুমিই তো আমায় পুরুষ মানুষ করে দিয়েছ।”

”বটে! পুরুষ মানুষ হয়েই তুমি আমার কাছে এসেছিলে।”

জ্যোতি ম্লান হয়ে গেল। গৌরীর কথার মধ্যে কি যে এক ইঙ্গিত রয়েছে, বারবার কেন জানি উষাকেই মনে পড়ছে। সে কোথায় এখন? বাড়িটা বিক্রি করে মেয়েকে নিয়ে সুবিনয় ভট্টাচার্য কোথায় যে মিলিয়ে গেলেন! আর সে নিজেও কেন যে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল অরবিন্দ মজুমদারের কাছে! অবশ্য তখন সে জানত না এতদিন লোকে ‘সারথির সারথি’ বলে বিস্ময়ে, সম্ভ্রমে, আদরে তাকে উল্লেখ করবে।

”নাণ্টু দই এনেছে, একটু খেয়ে যাও।”

”এক চামচও নয়, একদম উপোস। আমি এখন যাই।” ঘড়ি দেখল গৌরী। ”আমার পৌঁছবার টাইম হয়ে গেছে। বাড়িঅলা অপেক্ষায় থাকবে। অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট ফেল করলে প্রথমেই একটা ব্যাড ইম্প্রেশন হবে। চলি।”

জ্যোতি পিছু ডেকে বলল, ”তোমাকে পাব কোথায় তাহলে?”

”আমাকে পেতে হবে না, বিখ্যাত লোক তো, আমিই তোমাকে খুঁজে নেব! গরজ তো এখন আমার। তুমি নিশ্চয় এখন একটা ঘুম দেবে, তারপর সিনেমা।”

”এক্স্যাকটলি। এর মধ্যে দাশুদা এসে পড়লে তো ভালই।”

।।চার।।

বিপিন স্যার ডাকছেন। জ্যোতি অবাক হয়ে গেছল বেয়ারা কাশিদা যখন টিফিনে খবরটা দেয়।

টিচার্স রুমের জানলার কাছে বসেছিলেন বিপিন স্যার।

”জ্যোতি, হাবড়ায় পরশু স্কুলের খেলা মাধবপুরের সঙ্গে, খেলতে পারবি?”

”স্যার!…” জ্যোতির মুখ থেকে আর কোন শব্দ বেরোয়নি।

”তোর বয়সটা খুবই কম, অভিজ্ঞতাও নেই। আপত্তি উঠবেই। তাহলেও আমি তোকে টিমে রাখব। অন্য ছেলেরা কম করেও তোর থেকে তিন—চার বছরের বড়। ঘাবড়ে যাবি না তো?”

”না স্যার।” জ্যোতি ঢোঁক গিলতে গিলতে বলে।

”তরুণ কাল জ্বরে পড়েছে। একটু আগে ওর কাকা খবর দিয়ে গেল একশো তিন জ্বর উঠেছে। ওর জায়গায় ফরোয়ার্ডে তোকে খেলতে হবে। রিজার্ভে অবশ্য পলাশ আর বঙ্কু আছে, কিন্তু…যদি না পারবি তো বলে দে, তাহলে পলাশকে নামাব।”

”না না স্যার পারব।”

বোঁ বোঁ ঘোরা মাথা নিয়ে জ্যোতি ক্লাসে ফিরেছিল। স্কুল টিমে চান্স পাওয়ার কথা সে এখনো ভাবতে পারে না। দিল্লিতে সুব্রত কাপ খেলার জন্য অঘোরচন্দ্র বিদ্যাসদন গত পাঁচ বছর চেষ্টা করে ব্যর্থ। বাংলার আঞ্চলিক প্রতিযোগিতাতেই উঠতে পারেনি। বিপিন স্যার গোঁ ধরে রয়েছেন স্কুলকে দিল্লিতে নিয়ে যাবেনই। ঘুরে ঘুরে ফুটবল খেলা দেখে বেড়ান। ভাল প্লেয়ার বুঝলে ধরে—বেঁধে স্কুলে এনে ভর্তি করান। তাদের অধিকাংশই স্কুলে ক্লাসে আসে না। কোথায় যে তাদের বাড়ি তাও জ্যোতি জানে না। অনেককেই প্রতিদিন দাড়ি গোঁফ কামাতে হয়। অথচ সতেরো বছরের বেশি বয়সীদের খেলার নিয়ম নেই।

”রাখ তোর এজ—লিমিট। কটা স্কুল মানছে এসব নিয়ম? দ্যাখ গিয়ে দু ছেলের বাপও সুব্রত কাপের ফাইনালে খেলছে।” কথাটা বলেছিল তরুণই। ওর বয়স কমপক্ষে একুশ।

তরুণ মাঝে মাঝে ক্লাস করে। এজন্য কোন শিক্ষক কিছু বলেন না। প্রতি বছর ক্লাস পরীক্ষায় পাস হয়ে গেছে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিন বছর ফেল করেছে। জ্যোতি ওকে সকালে মেয়ে স্কুলের সামনে সঙ্গীদের আড্ডা দিতে দেখেছে। ঊষা বলেছিল, গায়ে পড়ে তার সঙ্গে তরুণ কথা বলার চেষ্টা করে। অবশ্য সে পাত্তা দেয়নি।

একদিন তরুণ তাকে বলেছিল, ‘এই জ্যোতি, তোর সঙ্গে ঊষার অত ভাব কেন রে? রোজই কথা বলিস, লাইন করেছিস?” ”আমার পাড়ার মেয়ে” জ্যোতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে সরে যায়।

হাবড়ায় তিনটি লীগ ম্যাচ। সেখান থেকে উঠতে পারলে আন্তঃ অঞ্চল প্রতিযোগিতায় খেলতে হবে। কোথায় যে সেটা হবে জ্যোতি জানে না। গত বছর শিলিগুড়িতে হয়েছিল। কিন্তু আন্তঃ অঞ্চল নয়, জ্যোতির মাথায় এখন পরশুর খেলা ঘুরপাক খাচ্ছে। রাত্রে সে অন্ধকারে জগামালির মাঠে টানা আধ ঘণ্টা চক্কর দিয়ে দৌড়ল, না জিরিয়ে। নিজের ফুটবল নেই। বিপিন স্যারের বাড়িতে স্কুলের জার্সি, ফুটবল ইত্যাদি থাকে। সকালে সে বল চাইতে গেল। বিপিন স্যার দিলেন না। ”নিজেকে টায়ার্ড করিসনি। বিশ্রাম নে। আজ আর স্কুলে যেতে হবে না।”

রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। মাধবপুর হাইস্কুল গোবড়ডাঙ্গা এলাকায়। এই মাঠ তাদের অপরিচিত নয়। মাঠ অসমান, অল্প জায়গাতেই ঘাস রয়েছে। পেনাল্টি এলাকায় বিশেষ করে গোলের সামনে কাদা। মাঝে মাঝে জোরালো হাওয়া বইছে। মাঠ এবং মেঘলা আবহাওয়া জ্যোতির পছন্দের নয়। তার সূক্ষ্ম ছোঁয়ার জন্য দরকার খটখটে ঝকঝকে মাঠ আর মৃদু বাতাস।

কাদাই তাকে মুশকিলে ফেলে দেয়। এড়াতে হলে পেনালটি এলাকার বাইরে তাকে খেলতে হবে অর্থাৎ শট নিতে হবে দূরপাল্লার। প্রথমার্ধে বাতাসের সাহায্য পেলেও, বলের জন্য তাকে ছ’—সাত মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। মাধবপুর গোঁয়ারের মত খেলছে। কোনক্রমে বাতাসের বিরুদ্ধে প্রথমার্ধ কাটিয়ে, দ্বিতীয়ার্ধে সুবিধা নেবার পরিকল্পনা নিয়ে ওরা খেলছিল। বল ধরে রেখে সময় কাটাচ্ছিল মাধবপুর।

হতাশ হয়ে পড়ছিল জ্যোতি। ডিফেন্সকে সাহায্য করার জন্য নেমে গিয়ে খেলছে তার রাইট আউট নবারুণ। ডানদিকটা একদম ফাঁকা পড়ে আছে। একবার যদি একটা বল সে পায় তাহলে চড়চড় করে সে গোলের দিকে এগোতে পারবে। দু’—তিনবার হাত তুলে সে বল চাইল। কিন্তু কেউ নজরই করল না। ভাবল চেঁচিয়ে বল চাইবে। কিন্তু টিমে এই প্রথম সে বড় ছেলেদের সঙ্গে খেলছে, যদি ওরা বিরক্ত হয়! যদি বল নিয়ে কিছু একটা করতে না পারে তাহলে ওরা বিপিন স্যারকেই দুষবে, এমন একটা অপদার্থকে নামাবার জন্য।

অবশেষে সে বল পেল। নিজেদের কারুর দেওয়া পাস থেকে নয়। মাধবপুরের স্টপার একটা জোরালো শট নিতে যায়। বলটা তার বুকে কেটে গিয়ে সোজা আসে জ্যোতির কাছে। তার ধারেকাছে কেউ নেই। বলটা পেয়েই সে তরতরিয়ে গোলের দিকে ছোটে মাঠের শুকনো জায়গা ধরে। মাধবপুরের চারজন ছুটছে তাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু তারা পৌঁছবার আগেই পেনালটি এলাকার কিনার থেকে ডান পায়ে জমিঘেঁষা শট নিয়ে দ্বিতীয় পোস্ট ঘেঁষে বল গোলে পাঠায়, এগিয়ে আসা গোলকিপারের ডানদিক দিয়ে।

ওরা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে, কেউ কেউ চুমুও খায়। ”দারুণ শটটা নিয়েছিস,” ”আর একটা গোল দে” ”তুই এত ভাল শট নিস!” জ্যোতি মাঠের বাইরে একজনকে ছাতা নাড়তে দেখেছিল। বিপিন স্যার।

এরপর তার কাছে বল আসতে শুরু করে। সে যে কিছু করতে পারে এটা দেখিয়েছে, ওরা চায় আবার করে দেখাক। জ্যোতি হতাশ করেনি। পনেরো গজ দূর থেকে একটা শট গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে ডীপ করে গোলে ঢোকে। দ্বিতীয়ার্ধে কর্ণার থেকে হেড করে সে তৃতীয় গোলটি করে। হ্যাটট্রিক!

বাড়ি ফেরার সময় বাস থেকে নেমে নাইলন জালের থলিতে রাখা চারটি বলের একটা বার করে বিপিন স্যার তার হাতে দিয়ে বলেন, ”এই নে।”

জ্যোতিকে অবাক হতে দেখে বলেন, ”এটা তোকে দিলাম।”

”দিলাম!…একেবারে?”

”হ্যাঁ।”

জীবনে এই প্রথম তার নিজস্ব ফুটবল। অবাক হয়ে সে বলটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে তার মনে হচ্ছিল একটা বেড়াল যেন পাকিয়ে গোল হয়ে বলে রূপান্তরিত হয়েছে। দু হাতে সে বলটাকে আদর করে।

দ্বিতীয় ম্যাচ দক্ষিণেশ্বরের রাজা প্রাণকৃষ্ণ স্কুলের সঙ্গে। খেলা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে দু’দলই বলের পিছনে তাড়া করে অদ্ভুত তালগোল পাকান অবস্থা তৈরি করে ফেলল। দু’দলের স্টপাররা ছাড়া আর সবাই গোঁতাগুতিতে মেতে গেছে। জ্যোতি ভীড় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখল। প্রথমার্ধ শেষ হল গোলশূন্য থেকে।

গ্লুকোজ জল খাবার সময় বিপিন স্যার একটা কথাই শুধু তাকে বলেন, ”একটু স্কিল দরকার। মাঠের মাঝখানে জড়াজড়ি হচ্ছে। ডানদিকটা ফাঁকা পড়ে। ফাঁকা জায়গা কাজে লাগা।”

দ্বিতীয়ার্ধে জ্যোতি তাই করল। বলটা এর পায়ে তার পায়ে হয়ে ঘুরছে লাফাচ্ছে। সে হঠাৎ ভিতরে এসে বল ধরেই ইনস্টেপে প্রাণকৃষ্ণ স্কুলের তিনজনের মাথার উপর দিয়ে ফ্লিক করে, নিজেই ছুটে গিয়ে বলটা ডানদিকে ধরল। সামনে তাকিয়ে দেখল লেফট ব্যাক এগিয়ে আসছে বুনো মোষের মত। তার পিছনে, একই লাইনে গোলকীপার ছাড়া আর কোন ডিফেণ্ডার নেই।

জ্যোতি বলটাকে ডান পায়ে বাঁ পায়ে করল বিদ্যুৎ ঝলকের গতিতে। লেফট ব্যাক থমকে যেতেই তার পাশ দিয়ে বল নিয়ে বেরিয়ে ছুটল পেনাল্টি এলাকার দিকে। এখন শুধু গোলকিপারকে হার মানানো, গোলের মুখ ছোট হয়ে এসেছে। গোলকিপার যদি বেরিয়ে আসে তাহলে মাথার উপর দিয়ে বলটা লব করে দেবে অথবা বল নিয়ে সরে যাবে বাঁদিকে। কিন্তু গোলকিপার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে শটের অপেক্ষায়।

শট নিলে সহজেই পাঞ্চ করে বল সরিয়ে দেবে, এটা বুঝতে পেরেই জ্যোতি গোলকিপারের ছ’ গজের মধ্যে পৌঁছেই গমনপথটা বদলে গোলের মাঝের দিকে এত দ্রুত সরে গেল যে, গোলকিপার বিপদ যখন বুঝতে পারল তখন দেরী হয়ে গেছে। ডান পায়ে বলটা ঠেলে বাঁ পায়ে জ্যোতি সুইং করিয়ে গোলে মারল। ঝাঁপান গোলকিপারের আঙুল ছুঁয়ে উপরের জালে বল আটকাল।

ফুটবল শিল্পের সঙ্গে সম্পর্করহিত এই ম্যাচে একবারই সে মায়াবী একটা মুহূর্ত তৈরি করে দিয়েছিল। এ গোলে জ্যোতির স্কুল জেতে। গোল দেবার পরই মাঠের বাইরে একটা ছাতাকে পতাকার মত নাড়তে দেখার আশা নিয়ে সে তাকায়। নিরাশ হয়নি।

দুটি ম্যাচ চারটি গোল। অঘোরচন্দ্র আন্তঃ আঞ্চলিক খেলছেই জ্যোতির জন্য। স্কুলের প্রায় বারশো ছেলের চোখ তার উপর পড়ল। এখন সে স্কুল হিরো।

তরুণ পরদিনই স্কুলে এল। তার জ্বর সেরে গেছে। তৃতীয় ম্যাচে সে খেলতে চায়।

”কার জায়গায় খেলবে? জ্যোতিকে তো বসাবার প্রশ্নই ওঠে না, আর অন্য কাউকে বসিয়ে যে তোমায় খেলাব তেমন খারাপ কেউই খেলেনি। যদি কারুর ইনজুরি হয়, অক্ষম হয়ে পড়ে তখন বরং তোমাকে নেয়া যাবে।”

বিপিন স্যারের কথা শুনে কিছুক্ষণ গোঁজ হয়ে থেকে তরুণ চলে যায়।

পরদিন ভোরে, যখন সূর্যের আভাটুকু মাত্র আকাশে লেগেছে, কাকপক্ষিরা বাসার আড়মোড়া ভাঙছে গাছের ডালে বসে, দূরের মানুষকে আবছা দেখাচ্ছে, এমন সময়ে জ্যোতি জগামালির মাঠে এল প্র্যাকটিসের জন্য। হাতে উপহার পাওয়া বলটা।

মাঠের মাঝমাঝি বলটা রেখে দিয়ে সে চক্রাকারে মাঠের কিনারা দিয়ে ছুটতে শুরু করল। এটা তার প্রতিদিনের কাজ। ঝড়—জল—বৃষ্টিতেও সে কামাই দেয় না। তার শরীরটা শীর্ণ বটে কিন্তু ফুসফুসের ক্ষমতা তার চেহারা থেকে বোঝা যায় না।

জ্যোতি চিবুক তুলে সামনে তাকিয়ে ছুটে যাচ্ছিল তাই লক্ষ্য করেনি চারটি ছেলে কখন মাঠের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা মন্থরগতিতে মাঠের মধ্যে এসে বলটা নিয়ে পায়ে পায়ে নাড়াচাড়া করছে, তখন জ্যোতি দেখতে পেয়ে ছুটে এল।

”কি হচ্ছে?”

”কি আবার হবে, খেলছি।” রুক্ষস্বরে একজন বলল, এদের তিনজনকে জ্যোতি চেনে। তরুণের সঙ্গে সকালে মেয়ে স্কুলের সামনে বসে থাকে।

”থাক, খেলতে হবে না।”

”খেলব না কি রে ব্যাটা, তোর বাবার বল? এটা স্কুলের বল।”

”তোমরা স্কুলে পড় নাকি?”

”পড়ি কি না পড়ি সেটা কি তোকে বলতে হবে?”

”দিয়ে দাও।”

জ্যোতি ঝুঁকে বলটা কুড়িয়ে তুলতেই একজন তার বল—ধরা তালুতে লাথি কষাল। বলটা ছিটকে গেল। সে ছুটে যাচ্ছিল বলটা ধরার জন্যে। সেই সময় একজন পা বাড়িয়ে তার পায়ে আলতো লাথি মারতেই সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। দ্রুত উঠে দাঁড়ান মাত্র তার পাছায় এবং উরুতে দুজন লাথি মারল। সে আবার পড়ে গেল। ওদের প্রত্যেকের পায়ে শক্ত চামড়ার জুতো।

এরপর মিনিট খানেক ওই চারজন মাঠে ছিল, জ্যোতির চিৎকার শুনে পথ দিয়ে যাওয়া দুজন লোক এগিয়ে না আসা পর্যন্ত। তারই মধ্যে একজন ওর কাঁধে, আর একজন কোমরে লাথি মেরে চলে। আর একজন পায়ের গোছের উপর দাঁড়িয়ে শরীরের সবটুকু ভার চাপিয়ে লাফাতে থাকে।

চারজন ধীরে সুস্থেই রাস্তায় নেমে অদৃশ্য হয়ে যায়। লোক দু’জন জ্যোতিকে হাত ধরে টেনে তোলে। কয়েক পা এগিয়েই সে কাৎরে উঠে পায়ের যন্ত্রণায় বসে পড়ে।

তার প্রথম চিন্তা হয় বলটার জন্য। হামা দিয়ে সে কুড়ি মিটার গিয়ে বলটা দু হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এরপর ভয় হয় বাড়ির কথা ভেবে। পড়ার বদলে ফুটবল খেলার জন্য বাবার আপত্তির কিছু কিছু চিহ্ন তার কপালে, বাহুতে, পায়ে জ্বলজ্বলে হয়ে রয়েছে। এখন এই অবস্থায় বাড়ি ফিরলে এই যন্ত্রণার উপর আরো কিছু যন্ত্রণা নিতে হবে।

ওরা মারল কেন, তা বুঝতে জ্যোতির মাথা খাটাতে হল না। পরের ম্যাচে তার খেলা বন্ধ করতে চায়। তার ইনজুরি হলে তরুণ নামতে পারবে। একমাত্র পায়ের গোছের আর কাঁধের আঘাত ছাড়া খুব বেশি তার লাগেনি। দুটো দিন সে হাতে পাচ্ছে, এর মধ্যে কি ঠিক করে ফেলতে পারবে না? যেভাবেই হোক পারতেই হবে। ওদের দেখিয়ে দিতে হবে, এভাবে মেরে তাকে দাবান যায় না, যাবে না।

একটা রাগ দপদপ করে উঠল তার শরীরের মধ্যে। শিরাগুলোর মধ্যে দিয়ে গরম স্রোত ছড়িয়ে পড়ল, কোষে কোষে। জ্যোতির পা থেকে কিছুক্ষণের জন্য যেন বেদনা মিলিয়ে গেল। সে কখন যে হাঁটতে হাঁটতে ঊষাদের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছে খেয়াল করেনি।

”কি ব্যাপার, এত সকালে?”

ঊষা স্কুলে যাবার জন্য তৈরি। খয়েরি স্কার্ট, সাদা ব্লাউজ, টেনে চুল বাঁধা, খয়েরি টিপ, কানে ছোট্ট সোনার রিং।

”কি হয়েছে তোমার? খোঁড়াচ্ছ কেন?”

”একটু চূণ—হলুদ যদি করে দিতে। প্র্যাকটিস করতে গিয়ে গর্তে পা’টা মুচকে গেল।” মার খাওয়ার ব্যাপারটা সে চেপে গেল।

ঊষা আর স্কুলে যায়নি সেদিন। ধারে কাছে বরফ না পাওয়ায় তার বাবা সুবিনয় বাসে ব্যারাকপুরে গিয়ে বরফ আনেন। সারা সকাল বরফে আর গরম জলে পাল্টাপাল্টি করে ডান পায়ের শুশ্রূষা করে যায়।

”ঊষা, বাড়িতে যেন না জানতে পারে। তাহলে বাবা মেরে ফেলবে।”

”না, বলব না। তুমি বরং এখানেই দুপুরে শুয়ে থাক। আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়ে খবর দিয়ে আসছি।”

”না, না, একদম নয়। এখানে আছি বলো না। বরং বলে এসো স্কুলে আজ ফাংশন আছে, স্টেজ তৈরি করছে বলে আটকে পড়েছে। অবশ্য দুপুরে বাড়ি না ফিরলে মা কিছু মনে করবে না, ভাতটা বেঁচে গেল তো!”

ব্যথাটা কমে গেল বিকেলের মধ্যেই। ঊষার কাঁধ ধরে জ্যোতি ঘরের মধ্যে চলাফেরা করল। ডান পায়ে শরীরের ভর রেখে দেখল ব্যথা কম লাগছে।

”তোমার জন্যই সম্ভব হল।’ কৃতজ্ঞ স্বরে সে ঊষাকে বলেছিল। ”খুব ইম্পর্ট্যান্ট এই ম্যাচটা, আমার কাছে।”

খুশিতে ঝকঝকে হয়ে ওঠা ঊষার মুখটা তখন তার কাছে পৃথিবীর একমাত্র সৌন্দর্য বলে মনে হল। সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।

”যদি খেলতে পারি, তাহলে তোমার জন্যই পারব। চ্যালেঞ্জ দিয়ে এই ম্যাচটা খেলব।”

এরপরই সে অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসে। ঊষাকে দু হাতে জড়িয়ে বুকের কাছে এনে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে। কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ছাড়া ওই চুম্বনে আর কিছু ছিল না। ঊষা চোখ বুঁজে ছিল, বাধা দেয়নি।

তারপর দুজনে দুজনের দিকে চোখ রেখে আর তাকাতে পারেনি। ঊষা ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায়। জ্যোতি আচ্ছন্নের মত বসে থাকে।

জ্যোতি অবশ্যই তার ‘ইম্পর্ট্যান্ট ম্যাচটা’ খেলেছিল। বিপিন স্যারকে কারা জানিয়েছিল জ্যোতির পায়ে সিরিয়াস ইনজুরি হয়েছে। তিনি জ্যোতিকে ডেকে সব ঘটনা শোনেন। বলেছিলেন, ”পারবি খেলতে?” জ্যোতি মাথা হেলিয়ে ছিল। ”মুখে বল।” ”হ্যাঁ পারব।” গম্ভীর স্বরে তারপর তিনি বলেন, ”তুই খেলবি। এবার আমার পরীক্ষা। মানুষ চিনতে পারি কিনা এবার জানতে পারব।”

পায়ের ব্যথা পুরো সারেনি কিন্তু গাঢ় গভীর ইচ্ছা দিয়ে সে নিজের শরীরকে যন্ত্রণার উপরে তুলে নিয়ে গেছল।

দুজন তার গায়ে আঠার মত লেগে ছিল সারাক্ষণ। তার হাঁটু, গোছ আর পাঁজর ছিল ওদের লক্ষ্যবস্তু। জ্যোতি সারা ম্যাচে দুবার শুধু তার প্রহরীদের শ্লথতার সুযোগ নিতে পেরেছিল। বল পায়ে তিরিশ গজ ছুটে সে নীচু স্কোয়্যার পাস দেয়। পেনাল্টি স্পটের কাছ থেকে গোপাল শট নিয়ে প্রথম গোল করে। সাত মিনিটের মধ্যেই গোল শোধ হয়ে যায়। খেলা শেষের চার মিনিট আগে জ্যোতি মাঝ মাঠে বল ধরে গোপালের সঙ্গে ওয়ান—টু—ওয়ান করে বাঁদিকে উঁচু ক্রস পাঠায়। সেখান থেকে ফেরত আসা বল বুকে ধরে জমিতে পড়ার আগেই বাঁ পায়ের ভলিতে জালে পাঠায়।

”স্যার, আপনি কি পাস করেছেন পরীক্ষায়?”

মাঠ থেকে বেরিয়ে এসেই জ্যোতির প্রথম কথা ছিল এইটাই। বিপিন স্যার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। উত্তর দেননি। দু চোখ চেয়ে টপটপ জল ঝরছিল।

রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় ঊষাদের বাড়ির সামনে সে দাঁড়ায়। ঘরে আলো জ্বলছে। সে দরজায় টোকা দেয়। জানলায় ঊষার মুখ উঁকি দিয়েই তাকে দেখে সরে গেল। দরজা খুলল।

”কি হল?” উদ্বিগ্ন মুখ, ঊষা প্রতীক্ষা করছিল।

”জিতেছি। উইনিং গোল আমার।”

রাস্তার উপরেই ঘর, খোলা দরজা, ঘরে আলো জ্বলছে। ঊষা হাত ধরে তাকে টেনে ভিতরে এনে দরজা বন্ধ করেই গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। এটা ঠিক কৃতজ্ঞতা জানাবার মত চুম্বন নয়। তবে তার থেকেও যে বেশি কিছু সেটা জ্যোতি এর মধ্যে অনুভব করে। কিন্তু সেটা যে কি, কোন দিনও সে বুঝে উঠতে পারেনি।

.

।।পাঁচ।।

জ্যোতি মোটরবাইক রাস্তায় রেখে, বিপিন স্যারের বাড়ির দিকে এগোল। রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়িতে দেখল ন’টা—কুড়ি। স্যারের এই সময় বই পড়ার অভ্যাস ছিল, হয়তো এখনো আছে। একতলা কয়েকটা বাড়ির পিছন দিয়ে সরু একফালি পথ। রেডিও এবং টিভি চলছে। তাছাড়া সাড়াশব্দ নেই এবং অন্ধকার। ইঁটে ঠোক্কর লাগল। জ্যোতি অশ্রাব্য একটা গালাগালি দিয়ে উঠল। আগে যখন বাড়িগুলো ছিল না তখন কত সহজ সে স্যারের বাড়িতে আসত।

বিপিন স্যার ডেকেছেন কেন?

দূর থেকে জানলা এবং জানলার মধ্য দিয়ে সে স্যারকে দেখতে পেল। গেঞ্জির উপর হাতকাটা সোয়েটার, মাথাটা নীচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে। টেবল ল্যাম্পটা বইয়ের উপর হুমড়ি খেয়ে রয়েছে। ঘরটা আবছা অন্ধকার। দেয়ালে কাঠের পাটাতনে কিছু বই। এই ঘরে দিনের অধিকাংশ সময় তাঁর কাটে। বাইরের লোক আর ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলা বা খাতা দেখা, বই পড়া এই ছোট্ট ঘরেই।

”স্যার আমি জ্যোতি, ডেকেছেন?”

জানলার কাছে দাঁড়িয়ে সে বলল। বিপিন স্যার ঘুরে তাকিয়ে অন্ধকারের সঙ্গে চোখ সড়গড় করে নিয়ে বললেন, ”দরজা খোলা আছে, আয়।”

ঘরের দ্বিতীয় চেয়ারটায় বসার পর জ্যোতি কৈফিয়ৎ দেবার স্বরে বলল, ”কলকাতায় গেছলাম। অরবিন্দদার সঙ্গে…”

”কাগজে দেখলাম।” কিছুক্ষণ টেবিলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, ”দেখা হল?”

”না। বৌদিকে নিয়ে ভোরেই কোথায় চলে গেছেন। মনে হয় দেশের বাড়িতে। ভাবছি সেখানে একবার যাব।”

”কেন?”

জ্যোতি চট করে জবাব দিতে পারল না। কেন সে যেতে চায় সেটা তার কাছে পরিষ্কার নয়। কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করতে যেতে হয়। শোক পেলে সান্ত্বনা দিতে যেতে হয়। কিন্তু অরবিন্দদার ব্যাপারটা বিপদ বা শোকের পর্যায়ে পড়ছে না। এখন তাকে সাহায্য করারও কিছু নেই। যা হবার হয়েই গেছে।

সন্ধ্যায় সিনেমা দেখতে গেছল। ইংরাজী মারপিটের ছবি। সিনেমা হলে ঢোকার মুখে দেখা হয় অসিত আর বিষ্ণুর সঙ্গে। অসিত এগারো বছর ফাস্ট ডিভিশনে খেলছে। সারথি তার পঞ্চম ক্লাব। একবার মারডেকা টুর্নামেন্ট খেলে এসেছে। লেফট ব্যাক ছিল কিন্তু অরবিন্দদা ওকে লিঙ্কম্যান করেছেন। অসিত এজন্য অসন্তুষ্ট। বিষ্ণু এই বছরই সারথিতে এসেছে টালিগঞ্জ অগ্রগামী থেকে। ময়দানে অন্যতম উদীয়মান লেফট আউট। মোট ছ’টা পুরো ম্যাচ খেলেছে। সুবিধে করতে পারছে না।

ওদের দেখে জ্যোতি এগিয়ে গেল।

”দাশুদাকে দেখেছিস আজ?”

”দাশুদা? না।” অসিত অধৈর্য। শো আরম্ভ হতে এখনো দশ মিনিট বাকি। ”তুইও কি বইটা দেখতে এসেছিস।”

”হ্যাঁ। ক্লাবে গেছলি?”

”গেছলুম। টাকা দেবে বলেছিল কিরণদা, দু হাজার। দিল না। এই নিয়ে তিনবার ঘোরাল। আমিও বলে দিয়েছি, রোভার্সে যাব না, প্র্যাকটিসেও আর আসব না। আরে বাঞ্চোৎটা বলে কিনা—ক্লাবের সব্বোনাশ হয়ে গেছে, মানসম্মান ধুলোয় লুটিয়ে গেছে আর তুই কিনা টাকা চাইছিস? শোন কথা, ক্লাবের মান আমি নষ্ট করেছি নাকি যে টাকা দেবে না? অরবিন্দ মজুমদার করেছে, সেজন্য তার পেমেণ্ট আটকাও!”

”ক্লাব কি করবে বলে তোর মনে হল…অরবিন্দদা সম্পর্কে?”

”ক্লাবে গিয়ে তো মনে হল শ্মশানে মড়া নিয়ে সবাই বসে রয়েছে।” বিষ্ণু মুখ খুলল। ”একি হল, একি হল! ক্লাবের চরিত্র নষ্ট হল, এইসব কথাই সবার মুখে। চঞ্চলদা বলল, একটা ফোনও যদি থানা থেকে করত, তাহলে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করা যেত। ব্যাপারটা কোর্ট পর্যন্ত যেতই না।”

”ফোন করেছিল কি করেনি, তাই বা কে জানে?” অসিত বলল।

জ্যোতিরও তাই মনে হয়েছিল খবরটা পড়েই। এই ধরনের ঘটনায় নামী অনেক ফুটবলার, ক্রিকেটাররা ধরা পড়েছিল বলে সে শুনেছে। কিন্তু কেস লেখার আগেই তাদের থানা থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে। অরবিন্দ মজুমদারের নাম আছে, সারথিও নামী ক্লাব, থানা থেকেই কেউ ফোন করে ক্লাবের চেনাশোনা কাউকে প্রথমে জানিয়ে দেবে। পুলিসের বড়কর্তাদের মধ্যেও সারথির সাপোর্টার আছে। তাদের একটা ফোনেই কাজ হয়ে যাবে। অরবিন্দদা তাদের কাউকে তো থানা থেকে ফোন করতে পারতেন।

”অরবিন্দদা নিজে ছাড়া আর কারুর পক্ষে তো এ বিষয়ে বলা সম্ভব নয়। তবে থানায় খোঁজ নিলেই ব্যাপারটা জানা যাবে, ফোন কাউকে করেছিল কিনা।” অসিত এই বলে, ঘড়ি দেখল।

”আমার এক বন্ধুর দাদা সার্জেণ্ট, এখন বোধহয় পার্ক স্ট্রীট থানায়। ওকে একবার বলে দেখব, খোঁজ নিয়ে বলতে পারে কিনা।” বিষ্ণু বলল।

”অসিত তোর কি মনে হয়েছে অরবিন্দদা কাউকে ফোন করেছিল সাহায্য চেয়ে?”

”আমার ভাই কিছুই মনে হয় না। এই সব ক্লাব হল খচ্চচরদের জায়গা। গরু যখন দুধ দেয় তখন তার চাঁট হাসিমুখে সইবে, দুধ আর দেবে না বুঝলেই কসাইখানায় বেচে দেবে। আগে আগে টাকা চাইলেই পেতুম, এখন শালারা আজ নয় কাল করছে। তোকে তো এসব ঝামেলা পোয়াতে হয়নি কখনো। চল ঢুকি এবার।” বিষ্ণুকে একটা ঠেলা দিয়ে বিরক্ত মুখে অসিত এগিয়ে গেল হলের দরজার দিকে।

জ্যোতি চেঁচিয়ে বলল, ”প্র্যাকটিসে আসছিস তো?”

”না।”

অরবিন্দদার জীবনে এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ এদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। টাকার চিন্তাই অসিতের মন জুড়ে। সিনেমায় জ্যোতির মন বসল না। হাফ টাইমেই সে হল থেকে বেরিয়ে আসে।

ফেরার পথে তার মনে হল, অসিত বা তার মত প্লেয়ারদের খুব দোষ দেওয়া যায় না। অরবিন্দদার সঙ্গে তার যা সম্পর্ক তেমনটি আর কারুর সঙ্গে হয়নি। অসিত চার বছর হল সারথিতে এসেছে অনেক ঘাটের জল খেয়ে। মুখে আঁটঘাট নেই। একদিন টেণ্টে সে চেঁচিয়েই বলেছিল, ”আমি গরীব ঘরের ছেলে, দারিদ্র্য কি জিনিস তা আমি জানি, লেখাপড়াও শিখিনি, শুধু ফুটবলটাই একটু খেলতে পারি। তাই ভাঙ্গিয়েই ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছি আর দুটো পয়সার মুখ দেখছি। খেলা চিরকাল তো আর থাকবে না কাজেই যা পারি কুড়িয়ে বাড়িয়ে নেব। কোচ যেমন খেলতে বলবে তেমনি খেলব, ক্লাব যত ম্যাচ খেলতে বলবে তত ম্যাচই খেলব, শরীরে কুলোক আর নাই কুলোক কিন্তু টাকা আমি গুণে নেব, যা কথা হয়েছে তার থেকে একটা পয়সাও ছাড়ব না। গড়ের মাঠ জোচ্চচরদের জায়গা, ভালমানুষী করেছ কি মরেছ। সব ক্লাবে শালা পকেটমার হারামীরা বসে আছে।”

বাইক চালাতে চালাতেই জ্যোতি আপনমনে হেসে ফেলেছিল। অসিতের কথাগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশ শিক্ষিত বেকারে ভর্তি অথচ লেখাপড়া জানে না। চাকরি কোনভাবেই অসিত পেত না যদি না ফুটবলটা খেলতে পারত। খেলা পড়ে আসছে এটা অসিত যতই বুঝতে পারছে ততই টাকার অর্থাৎ দর রাখার চিন্তা ওকে খেপিয়ে তুলছে। অরবিন্দদার জন্য ওর মনে বিশেষ কোন স্থান নেই। গড়ের মাঠে কেউই ওর আপন নয়। অরবিন্দদাও ওকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন না, তার আপত্তি সত্ত্বেও অসিতকে আনা হয়েছিল। এটা অসিত জানে।

”কই, বললি না তো, কেন অরবিন্দর সঙ্গে দেখা করতে যাবি?”

জ্যোতির চটকা ভাঙল। বিপিন স্যার তীক্ষ্নদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

”ওকে লজ্জা দেবার জন্য?”

”না, না, তা কি করে হয়।”

”তাহলে লজ্জা ভেঙে দেবার জন্য?”

জ্যোতি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ঠিক। এই জন্যই সে যেতে চায়। একটা পাতলা হাসি তার মুখে সবে মাত্র ছড়াতে শুরু করেছে, বিপিন স্যার তখন ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, ”ঊষার একটা চিঠি পেয়েছি, ওর বাবা ক্যান্সারে মারা গেছেন।”

হাসিটা ছড়িয়ে পড়ার মাঝপথে থেমে গিয়ে আবার ফিরে গেল ভেঙে পড়তে পড়তে। জ্যোতির কাঁধ দুটো সামান্য ঝুলে পড়ল। অস্ফুটে শুধু বলল, ”ঊষা!”

”মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ওরা কয়েকদিন রেখে ছেড়ে দেন…বাড়ি গিয়ে মরার জন্য। মেয়ের কাছেই মারা গেছেন।”

”কোথায়? এখন ঊষা কোথায়?”

”আছে কোথাও…ভালই আছে মনে হয়। বিয়ে করেনি, করা উচিতও নয়। চাকরি করছে একটা গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, নার্সের চাকরি। লিখেছে, বদলি হতে চায় অন্য কোথাও। হেলথ ডিপার্টমেণ্টে আমার এক ছাত্র আছে এটা ও জানে। তাকে ধরেই ওর চাকরিটা হয়েছিল। লিখেছে, যদি তাকে দিয়ে বদলি করাতে পারি। ও আর বাণীপুরে থাকতে চায় না।”

”বাণীপুরটা কোথায়?”

”পশ্চিমবঙ্গেই।” বিপিন স্যার কঠিন স্বরে বললেন, প্রায় বিদ্রূপের মত সেটা শোনাল।

”আমার ঠিকানাটা দেবেন?”

”কেন, কি দরকার? সেখানে গিয়ে ওর লজ্জা ভেঙে দেবে বলে?”

জ্যোতি গুম হয়ে গেল। মাথার মধ্যে অপ্রকৃতিস্থ একটা ব্যাপার শুরু হয়েছে। বস্তুত সকাল থেকেই শুরু হয়ে এখন সেটা চূড়ান্ত পর্যায়ে তাকে ঠেলে তুলেছে।

লুকিয়ে থাকা একটা রাগ এবার তার মধ্যে ফেঁপে উঠতে লাগল। অসহায় করে দেওয়া এই সব ঘটনা অল্প সময়ের মধ্যে তার স্নায়ুমণ্ডলকে প্রহার করে করে এমন একটা অবস্থায় এনে ফেলেছে যে রেহাই পাবার জন্য অন্ধের মত ঘোরাঘুরি করে একটা কানাগলির মধ্যে এবার সে ঢুকে পড়েছে। রাগ তাকে দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে ধাক্কা দিল। তার বোধ বিবেচনা অনুভব থেঁতলে গেল।

”আপনি আমার যা উপকার করেছেন, কোনদিনই তা অস্বীকার করব না—কিন্তু তাই বলে ব্যঙ্গ করছেন কেন? ভুল মানুষ মাত্রই করে।”

”কিন্তু মানুষ সে ভুল শোধরায় যদি সে মানুষ হয়।”

”আমার উপায় ছিল না।”

”ছিল। তুই ঊষাকে বিয়ে করতে পারতিস।”

”না। তাহলে আমার খেলার সর্বনাশ হয়ে যেত।”

”ঊষার থেকেও তোর খেলা বড়!”

”হ্যাঁ।”

বলেই জ্যোতি অবাক হয়ে গেল। শব্দটা তার মুখ থেকে বেরোল কি করে! বলার জন্য মোটেই তার অনুতাপ হচ্ছে না বরং এত সাহস যে তার মধ্যে রয়েছে এটাই তার জানা ছিল না!

”কি বললি! আবার বল, আবার বল।”

বিপিন স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন। দু পাশে তাকালেন। জ্যোতির মনে হল, উনি যেন বেত খুঁজছেন দুর্বিনীত ছাত্রকে সায়েস্তা করার জন্য।

”আমার খেলাই আমার সব কিছু, গোটা অস্তিত্ব। আমি মন—প্রাণ দিয়ে খেলায় যেতে চেয়েছি, খেলাকে শ্রদ্ধা করেছি। এদেশে বিরাট ঝুঁকি কিন্তু তবু চাকরি করিনি আজও। স্বার্থপর না হলে কোন কিছুতেই ঠেলে ওঠা যায় না। নিজেকে নিজেই তৈরি করে নিয়েছি, সেজন্য স্বার্থপরও হয়েছি অনেক ব্যাপারে। সবাই বলবে অন্যায় করেছি, বলুক তারা। মানুষকে আনন্দ দেওয়া আমার কাজ, এর একটা গুরুত্ব সমাজে আছে। সারথির হাজার হাজার সাপোর্টারকে আমি আনন্দ দিয়েছি, এর কি কোন মূল্য নেই?

”তখন বিয়ে করলে আমি আর উঠতে পারতাম না। বিশ্বাস করুন স্যার, তখন সে কি যন্ত্রণার মধ্যে আমি দিন কাটিয়েছি, রাত কাটিয়েছি। তখন আমার বয়স মাত্র উনিশ। কিছু বুঝি না, জানি না। পাপ পুণ্যের কথা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি। সেই প্রথম তখন আমি জিনিসটার মুখোমুখি হলাম। বয়স তখন উনিশ। কাউকে বলতে পারিনি, কেউ ছিল না আমার যাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে পারি—এবার আমি কি করব? একদিকে ঊষা আমার সত্যিকারের বন্ধু, আমার ভালবাসা আর একদিকে খেলা, বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, ভবিষ্যৎ।

”স্যার, আমার অবস্থাটা তখন কি ছিল? আমি নিজেকে সংযত করতে পারিনি, ঠিক কথা। আমি পালিয়ে গিয়ে সারথির মেসে আশ্রয় নিয়েছিলাম, কয়েক বছর এই অঞ্চলেই পা মাড়াইনি। হয়তো সেজন্যই, কৃতকর্মের দাম চোকাতে আমি দ্বিগুণ ভাবে খেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।

”পাপবোধ কিনা জানি না, তবে অন্যায় করেছি, এটা সবসময় আমার মাথায় থেকে গেছে। কিন্তু সাহসে কুলোয়নি ঊষার খোঁজ নিতে। সে বেঁচে আছে কিনা, বিয়ে করেছে কিনা, কিছুই আমি জানি না। ইচ্ছে করেই জানার চেষ্টা করিনি। হ্যাঁ, খেলা আমার কাছে ঊষার থেকেও বড় হয়ে উঠেছিল।

”স্যার, ঘর সংসার, ছেলে বৌ ফেলে রেখে কেউ যখন সন্ন্যাসী হবার জন্য নিরুদ্দেশ হয় তখন কি বলেন লোকটা নিষ্ঠুর, দায়িত্ববোধহীন, স্বার্থপর? বলেন না, কেননা সে বড় কাজ করার জন্য বৌ—ছেলেকে ফেলে বেরিয়ে গেছে, ভগবান পাবার জন্য তপস্যায় বসতে গেছে, জ্ঞানী হয়ে এসে মানুষকে উদ্ধার করবে বলে সংসার ছেড়েছে। আমি ভগবান—টগবান বুঝি না, বুঝি ওই হাওয়াভরা গোল জিনিসটাকে, ওটাই আমার ভগবান। আমার ভগবানের জন্য আমিও বেরিয়ে গেছি। আমাদের মধ্যে তাহলে তফাৎটা কোথায়? আমার সাধনার ফল দিয়ে আমি মানুষকে আনন্দ দিয়েছি, পার্থক্যটা কোথায়? আমি পাপী আর সে পুণ্যবান হবে কেন? গতর ভাঙ্গিয়ে আমার ভগবানের সেবা করি বলেই কি আমি নিকৃষ্ট আত্মার লোক, অপাংক্তেয়?”

জমে ওঠা অনেক কথা, যা বহুকাল বুকের মধ্যে দমবন্ধ করা অবস্থা তৈরি করে জ্যোতিকে বিস্ফোরণের পর্যায়ে নিয়ে গেছল, তারই সেফটি ভালভ খুলে সে যেন কিছুটা বার করে দিল। চোখ দুটি বিষ্ফারিত করে সে বিপিন স্যারের দিকে তাকিয়ে শক্ত করা মুঠো, শিরা ফুলে উঠেছে পুরো বাহুতে, ঠোঁটের কোণে ফেনা।

অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে রইল। দেখে মনে হয় দুজনেই গভীর কিছু ভাবছে, আসলে একদমই ভাবছে না। এত শূন্য হয়ে পড়েছে মানসিক ভাণ্ডার যে কথা বলার কোন উপাদানই ওদের কাছে এখন নেই।

জ্যোতি উঠে দাঁড়াল। কথা না বলে দরজায় পৌঁছে একবার ঘুরে তাকিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে, বিপিন স্যার ডাকলেন। জ্যোতি দাঁড়িয়ে পড়ল।

”এই নে ঊষার ঠিকানাটা।”

কাগজের টুকরোটা হাতে নিল জ্যোতি। সেটার দিকে একবার তাকিয়েও দেখল না।

”জ্যোতি, মানুষ নিজের মত করে ভগবান গড়ে নেয়। কারুর ভগবানই ছোট নয়। কিন্তু কথাটা হল, সন্ন্যাসীরা বা সাধকরা যে সাধনায় জ্ঞান অর্জন করেন তার উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে উন্নত জীবনের পথ দেখাবার জন্য, সমাজের মঙ্গল সাধনের জন্য, স্থায়ী আনন্দ লাভ যাতে হয়, প্রেম প্রশান্তি যাতে পায়, তার জন্যই তারা কষ্ট করেন। উদ্দেশ্য শুভ তাই তারা শ্রদ্ধেয়, মাননীয়। তোমার সাধনার দ্বারা তুমি কি মানুষকে ভালবাসার পথে, মঙ্গলের পথে নিয়ে যেতে পেরেছ? হিংসা, হানাহানি, রক্তপাত বন্ধ করার নির্দেশ কি তোমার খেলা দিতে পেরেছে?

”আমি বলছি না তোমার ভগবান নিকৃষ্ট বা অপাংক্তেয়, কিন্তু যা শুধুই সাময়িক আনন্দের বস্তু তা কখনো গুরুত্ব পায় না মানুষের কাছে। এর শেষে আছে ক্লান্তি, অবসাদ, অতৃপ্তি।”

জ্যোতি অধৈর্য স্বরে বলে উঠল, ”মাইক্রোফোনের সামনে এক লক্ষ বার শান্তির কথা বলার থেকে অনেক বেশি কাজ দেয় হাজার হাজার লোকের চোখের সামনে, মাঠের মাঝে যদি একটা স্পোর্টসম্যানশিপ দেখান যায়। এই সবই তো ভাল কাজের প্রেরণা দেয়, সৎ হতে এগিয়ে দেয়, চরিত্র সবল করে। হেরে যাওয়ার পরও হাসিমুখে অপোনেণ্টকে জড়িয়ে ধরা, রেফারীর ভুল ডিসিশনে ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নেওয়া, এসবের প্রভাব খোল—কত্তাল বাজিয়ে কীর্তন করার থেকে কি কম কিছু?”

বিপিন স্যারের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য সে তাকিয়ে রইল। তিনি চুপ করেই রইলেন। জ্যোতির উত্তেজনা তাতে কমল না।

”আপনি যদি মাঠে যান তাহলে দেখতে পাবেন।”

মোটরবাইকে স্টার্ট দেবার আগে সে তার হাতে—ধরা কাগজের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিল।

.

।।ছয়।।

.

রোভার্স থেকে সারথি ফিরে আসে মফৎলালের কাছে তিন—শূন্য গোলে হেরে। অরবিন্দ মজুমদারকে বাদ দিয়েই সারথি বোম্বাই গিয়েছিল। তিনি আর ক্লাবে একবারের জন্যও আসেন নি। একটা তিন লাইনের চিঠি ফুটবল সচিব চঞ্চল মৈত্রর কাছে তিনি পাঠিয়েছিলেন, তাতে শুধু লেখেন, ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে ক্লাবের ফুটবল কোচের কাজ চালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। তাই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিচ্ছি।

রোভার্সে যাওয়ার আগে ট্রেনিং করতে, কয়েকজন খেলোয়াড় মাত্র মাঠে এসেছিল। জ্যোতিও ছিল তাদের মধ্যে। অরবিন্দ মজুমদারের সরকারী রথীন চন্দ, চার বছর আগেও সে জ্যোতির সঙ্গে ফাস্ট ডিভিশনে খেলেছে। তাদের নিয়ে সে দৌড়, শুটিং ও পাসিং প্র্যাকটিস করায়। বয়স্ক প্লেয়াররা রথীনকে পাত্তা দেয় না, কর্তৃত্বব্যঞ্জক ব্যক্তিত্বও তার নেই। জুনিয়র ছেলেরা অবশ্য তাকে মান্য করে। ট্রেনিংয়ে প্রত্যেকেরই ছিল গাছাড়া ভাব। মাঠে এসেও দুজন প্র্যাকটিসে নামেনি, ইনজুরির অজুহাতে। জবেদ আর সত্যমূর্তি দেশে চলে গেছেন, ওরা বাড়ির থেকে বোম্বাইয়ে আসে শ্লথ, আনফিট অবস্থায়। বিষ্ণু কিছুটা সিরিয়াস হয়ে ট্রেনিং করেছিল। অসিত যা বলেছিল তাই করেছে, ট্রেনিংয়ে আসেনি। তবে বাড়িতে ওকে দু হাজার টাকা পৌঁছে দিয়ে আসায় প্লেনে বোম্বাই যায় এবং সবার থেকে ভাল খেলে।

জ্যোতি বুঝেই গিয়েছিল রোভার্স খেলতে বৃথাই যাওয়া। দলে আর বাঁধন নেই। পারস্পরিক ঈর্ষা থেকে যে আকচা আকচি তৈরি হয়েছে সেটাকে কাজে লাগাচ্ছে ক্লাবের কিছু মাতব্বর। খবরের কাগজে প্লেয়াররা, অফিসিয়ালরা নিয়মিত বিকৃতি, প্রতিবাদ আর অস্বীকৃতি জানানোর খেয়োখেয়ি শুরু করেছে। প্লেয়াররা তিন চারটে গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গেছে। টাকার পেমেণ্ট প্রতিশ্রুতিমত না পাওয়ায়, ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে ক্রমশ সন্দেহ এবং হতাশায় পৌঁছেছে। চোট থাকায় এবং ফর্মে না থাকায় কয়েকজন সিনিয়র প্লেয়ার দায়সারা ভাবে খেলে সারথিকে অসহায় অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।

যে কোন সফল ফুটবল ক্লাবে একটা সময় আসেই যখন চূড়া থেকে গড়িয়ে পড়তে হয়। কোন কিছুই সঠিক ভাবে চলে না। নতুন করে সব কিছু আবার গড়ে তুলতে হয়। এমন ব্যাপার, গড়ের মাঠে বারবার দেখা গেছে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডান বা যুগের যাত্রীর জীবনে। সারথি সংঘও ওঠা—পড়ার চক্রে এখন পড়তি ক্লাব।

অরবিন্দ মজুমদার ওটা বুঝতে পেরেছিলেন। গত সিজনের শুরুতেই তিনি কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন ফুটবল কমিটির কাছে। টুর্নামেণ্ট খেলা, ট্রেনিং, রিত্রূ«ট করা ও প্লেয়ার ছেড়ে দেওয়া সম্পর্কে তার একটি কথাও কমিটি মেনে নেয়নি। তারপর একদিন তিনি আলগোছেই জ্যোতিকে বলেছিলেন, ‘আর আমার এখানে থাকার দরকার নেই।’

”সেকি! কেন?”

”আমি আর পারছি না, আর ভাল লাগছে না।”

বুঝতে না পেরে জ্যোতি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

”জ্যোতি তোরও কি আর আগের মত আনন্দ হয় মাঠে নেমে? নেহাত টাকা নিয়েছিস তাই ম্যাচের পর ম্যাচ খেলতে নামছিস, এরকম কি এখন মনে হয় না? অন্তরের ভেতর থেকে কি আর তাগিদ পাস?”

জ্যোতি চুপ করে ছিল। কিছুকাল ধরেই এক ধরনের ক্লান্তি মাঝে মাঝে তাকে হাঁফিয়ে তুলছে। ফুটবল ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে উঠছে। যাদের সঙ্গে বা যাদের বিরুদ্ধে তাকে খেলতে হয়, তাদের স্কিল বা বৈচিত্র আর তার কাছে প্রতিবন্ধক বা চ্যালেঞ্জ হয়ে তাকে উত্তেজিত করায় না, তার উদ্ভাবনী ক্ষমতার কাছে দাবী তোলে না। রুটিন মাফিক সে খেলে চলেছে। নিজেকে উন্নত করার দরকারটা তার কাছে এখন আর জরুরী ব্যাপার নয়।

”বদল ঘটা দরকার।”

”এই ফুটবল কাঠামোটার?” জ্যোতি কৌতূহল দেখাল।

অরবিন্দ মজুমদার হাসলেন, মাথা নাড়লেন। ”আমাদের জীবন যাপন প্রণালীটার, যে ছকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি সেটা একঘেয়ে হয়ে গেছে। ফুটবল ছেড়ে অন্য কোন জীবনে যাওয়া দরকার। আসল কথা হল বেঁচে থাকা। কি ভাবে প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছি, সেটা যথার্থই আমাকে জীবন্ত করে রাখছে কিনা—”

অরবিন্দ মজুমদার আর কথা বাড়াননি। এখন জ্যোতির মনে হচ্ছে, যে তীব্রতা, উদ্যম আর পরীক্ষা—নিরীক্ষা চালিয়ে গড়ার যে ইচ্ছা এক সময় সে অরবিন্দদার মধ্যে দেখেছিল সেটা যেন ইদানীং ঝিমিয়ে পড়েছিল। ক্লাবে তাঁর বিরোধীরা ধীরে ধীরে ক্ষমতা দখল করে নানান ভাবে তাঁর কাজে বাধা তৈরি করছিল। টিম সিলেকশনে এক সময় তাঁর ইচ্ছাই ছিল চূড়ান্ত কিন্তু তাঁর কব্জা থেকে এই অধিকারটা ধীরে ধীরে কেড়ে নেওয়া হয়। ফুটবল সেক্রেটারির নির্দেশে এমন সব খেলোয়াড়দের দলে রাখতে শুরু করেন যাদের তিনি সারথির জার্সি গায়ে দেওয়ার যোগ্য বলে মনে করতেন না।

বোম্বাই থেকে ফেরার সময় ট্রেনে সে বিষ্ণুর কাছে শুনেছিল, মফৎলালের কোচ সাধন নাথকে সারথিতে আনা হবে অরবিন্দদার জায়গায়।

শুধু জ্যোতিই নয়, সারথির মালি থেকে র‌্যামপার্টের সাপোর্টার সবাই জানত অরবিন্দ মজুমদারকে আর রাখা হবে না। তার জায়গায় কাকে আনা হবে তাই নিয়ে কানাঘুষো শুরু হয়ে গেছিল। পি. কে, অরুণ ঘোষ, অমল দত্ত—এইসব নামগুলি বক্সারদের ঘুঁষির মত ছোঁড়াছুড়ি হচ্ছিল।

জ্যোতিও কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। অরবিন্দ মজুমদারকে বাদ দিয়ে সারথিতে সে কিভাবে নিজেকে মানিয়ে রাখবে, তার ফুটবল জীবনে এর প্রতিক্রিয়া কতখানি ঘটবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছিল না। প্রতিটি ব্যাপারে অরবিন্দ তাকে সাহস, প্রেরণা এবং সুযোগ, অনেকের মতে ‘লাই’ দিয়ে গেছেন। দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা প্রায় বাপ—ছেলের মত হয়ে উঠেছিল। জ্যোতির নিজের সম্পর্কে প্রত্যয়টা বেড়ে উঠেছিল অরবিন্দরই প্রভাবে।

সারথিতে প্রথম ম্যাচ খেলার কথা সে জীবনে ভুলবে না। আটটা লীগ খেলায় তাকে ড্রেস করিয়ে সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছিলেন অরবিন্দ মজুমদার। জ্যোতি বিরক্ত, হতাশ হয়ে উঠছিল। গত বছর অবনমন থেকে কোনক্রমে রক্ষা পাওয়া অরুণোদয়ের সঙ্গে গোলশূন্য খেলার পর সারথি প্রবলভাবে পাঁচ গোলে বান্ধব সমিতিকে হারায়।

দুদিন পর জ্যোতি টেণ্টে অরবিন্দর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল কেউ নেই।

”একটা কথা বলব?”

”কি ব্যাপার, কি বলবে?”

সরাসরি জ্যোতি প্রসঙ্গে এল। ”এবার আমি মাঠে নামতে চাই।”

ঝাঁকুনি দিয়ে অরবিন্দ সিধে হয়ে বসলেন অবাক চোখে। ছেলেটির সাহসে নয়, স্পর্ধায় তিনি বিস্মিত। হেসে উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জ্যোতির চোখমুখের ভাব দেখে নিজেকে সংযত করলেন।

”খেলতে চাও? ভাল, এরকম অ্যাম্বিশনই দরকার।”

”পরের ম্যাচেই নামতে চাই, যদি টিমে জায়গা থাকে।”

”বসো।” গম্ভীর গলায় অরবিন্দ বললেন। ”সোজাসুজিই কথা বলা ভাল। তুমি মনে করছ যে ফার্স্ট ইলেভেনে খেলার উপযুক্ত?”

”হ্যাঁ।”

”বয়স কত?”

”উনিশ ছাড়াব এই জুলাইয়ে।”

”সারথিতে সবে এসেছ, এখনো পুরো সিজনও কাটেনি। এর মধ্যেই ফার্স্ট টিমে আসতে চাও?” অরবিন্দ সামান্য ধমকের ভঙ্গি স্বরে আনলেও, ছেলেটির নার্ভের তারিফ করলেন মনে মনে।

”রিজার্ভে তুমি একা নও, আরো চারজন আছে যারা গত বছর থেকে রয়েছে।”

”থাকতে পারে। যোগ্যতা না থাকলে অনন্তকাল রিজার্ভে থাকবে কিংবা অন্য ক্লাবে চলে যাবে। কিন্তু আমি ওদের স্ট্যাণ্ডার্ডের নই, এটা আমি জানি।”

জ্যোতির মনে হল, বোধহয় অহঙ্কার দেখাল। কিন্তু নিজেকে হামবড়াই করে তুলে ধরার জন্য সে কোচের কাছে আসেনি। তাকে বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাতেই তার আসা।

”একটা কথা জেনে রাখ, বলা কওয়া করে বা কাউকে দিয়ে পুশ করিয়ে আমার টিমে আসা যায় না। যখন নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে তখন সিলেক্টেড হবে। বুঝেছ?”

”হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম যদি একটা সুযোগ…”

”সুযোগ তখনই পাবে যখন আমি মনে করব তুমি তৈরি হয়েছ। ইতিমধ্যে যা ট্রেনিং করে যাচ্ছ করে যাও। এখনো তোমার সামনে বারো—চোদ্দ বছর পড়ে আছে। এত ব্যস্ত হবার কি? কতদিন বাড়ি যাওনি?”

”মেসে আসার পর আর যাইনি।”

”বিপিন গোস্বামী আমাকে চিঠি দিয়েছে, তুমি কেমন করছ—টরছ তাই জানতে। লিখেছি ভালই করছে।”

অরবিন্দ টেবলের কয়েকটা চিঠি তুলে নিয়ে তাতে মনযোগ দিলেন। কথাবার্তা শেষ হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত।

”বেশ।” জ্যোতি হাসিমুখে বলল।

”মনে রেখ, মেনি আর কল্ড, ফিউ আর চোসন।”

জ্যোতি চলে যাবার পর অরবিন্দর মুখ হাসিতে ভরে ওঠে। ফুটবলারদের জীবন গড়ে তোলায় ভাগ্যের হাত থাকেই। পর পর কয়েকটা চোট আর রেড কার্ড, চারজনকে প্রথম টিম থেকে সরিয়ে দিতেই জ্যোতির সুযোগ এল।

”মনে কোর না তুমি পাকাপাকি টিমে এলে। সেরে উঠে ওরা ফিরে এলেই আবার সাইড বেঞ্চে বসতে হবে।” অরবিন্দ জল ঢেলে দিয়েছিলেন জ্যোতির টগবগে উৎসাহে। কিন্তু যেটা তিনি বলেননি কিন্তু বলার ইচ্ছা ছিল—এমনভাবে নিজেকে প্রমাণ কর যেন দল থেকে তোমাকে বাদ দেওয়া না যায়, এমনকি পুরো দল ফিট থাকলেও।

অরবিন্দ মজুমদার পঁয়ত্রিশ বছর গড়ের মাঠে ঘোরাফেরা করছেন। প্রতিভা চিনে নিতে তাঁর বেশি সময় লাগে না। তিনি বোঝেন জ্যোতিকে খুব সাবধানে গড়ে তোলা দরকার, বেশি চাপের মধ্যে ঠেলে দিলে পঙ্গু হয়ে যাবে। ওর পিছনে ডায়নামো লাগিয়ে উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি করাতেও তাঁর সায় নেই। স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দ্রুতবেগে বৃদ্ধি ঘটাতে গেলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। এরকম তিনি অনেক দেখেছেন, প্রতিশ্রুতিবান ছেলেরা কুড়ি পার হতে না হতেই জ্বলে শেষ হয়ে গেছে, ক্ষমতার অতিরিক্ত নিজেদের ঠেলে তুলতে গিয়ে।

”নিজের যা খেলা তাই খেলবি। হাঁকপাক করে খেলবি না।” কথাগুলো মাঠে নামার সময় অরবিন্দ তাকে বলেছিলেন। ”দমদম একতাকে হারান কঠিন কাজ। টাফ ডিফেন্সের এগেনস্টে তোকে খেলতে হবে। বল থেকে যতটা পারবি দূরে ফাঁকায় থাকবি, বাচ্চচু, তোকে ফীড করাবে। আবার বলছি হাঁকপাক নয়, নিজের খেলাটা খেলে যাবি…আর কিছু আমার বলার নেই।”

অরবিন্দর কথাগুলো কতটা তার মাথায় ঢুকেছিল সে জানে না তবে একটা ব্যাপার আজও মনে আছে—অরবিন্দদা সেদিন ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’—তে নেমেছিলেন। এটাই সেদিন তাকে একটা গভীর সুখে ভরিয়ে মাঠে নামিয়েছিল।

তখন প্রধান স্ট্রাইকার ছিল শৈবাল। আগের বছর সে গোড়ালিতে চোট পেয়ে বসে গেছল। ধীরে ধীরে ফর্মে ফিরে এসেছে। ওর খেলাটা দ্রুত এবং কঠিন, ডিফেন্স চেরা থ্রু, পাশ দেয় পরিচ্ছন্নভাবে, আর চমৎকার হেড করে। সারথি থেকে মোহনবাগান হয়ে শৈবাল এখন খেলছে যুগের যাত্রীতে। তার পাশে সেদিন জ্যোতির নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। কিক অফ থেকে শৈবাল বলটা প্রথম পরশের জন্য জ্যোতিকে দিল। সে হাফ ব্যাককে ব্যাকহিল করেই সামনে ছুটে গেল।

একতার সমর্থকদের উল্লসিত চিৎকারে সে পিছনে তাকিয়ে দেখল একতার খেলোয়াড়রা তাদের একজনকে জড়িয়ে চুমু খাচ্ছে আর গোল থেকে বল বার করে আনছে গৌতম।

শুরুতেই গোল খেয়ে জ্যোতি দমে গেল। শৈবাল অশ্রাব্য কয়েকটা গালি দিল নিজেদের গোলকিপারকে। কিক অফ থেকে আবার সে বল দিল জ্যোতিকে। এবার সে ব্যাকহিল করার ভাণ করে বলটা ডান পায়ে থামিয়ে পায়ের পাতা দিয়ে ইনসাইড লেফটকে দিল। সে বল ধরতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ায়, দখলে রাখতে পারল না কিন্তু পা চালিয়ে বলটাকে বাঁদিকে জবেদের কাছে পাঠিয়ে দিল। জবেদ দোনামনা করল। টাচলাইন ধরে সোজা দৌড়বে না তুলে গোলমুখে ফেলবে সেটা ঠিক করে উঠতে পারছিল না। অবশেষে গোলের সামনে ফেলল। বলটার জন্য কয়েকটা পা এলোপাতাড়ি চলল। শেষে একজনের বুকের ডগা থেকে এল জ্যোতির কাছে।

বলটা আবার গোলমুখে পাঠিয়ে কিছু একটা প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে পারে অথবা ডানদিকে সরে গিয়ে গোল শট নিতে পারে—কোনটা করবে? কোণাচে ভাবে ডানদিকে সরে গেল জ্যোতি। সারথির জার্সিগুলো প্রত্যাশিত ক্রসের জন্য জায়গা নিয়ে দাঁড়াল আর একতার জার্সিগুলো তাদের সামনে ও পিছনে এসে গেল। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য দুই দলের জটলা আর একতা গোলকিপার একই লাইনে জ্যোতির সামনে। সে উঁচু করে আলতো শটে বলটাকে মাথাগুলোর উপর দিয়ে ফেলল এবং ক্রসবার ঘেঁষে সেটা গোলে ঢুকল। একতার গোলকিপার শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে বলটার দিকে তাকিয়ে রইল।

জ্যোতিও অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে থেকেছিল। গোল? হতে পারে না! মুখ ফিরিয়ে রেফারির দিকে তাকাল। নিশ্চয় কারুর অফসাইড কিংবা কারুর ফাউল হয়েছে আর ফ্রি কিক নেবার জন্য রেফারি আঙুল দেখাচ্ছে জায়গাটার দিকে। এই ভেবেই সে তাকিয়েছিল এবং দেখল রেফারি সেণ্টারের দিকে হাত দেখাচ্ছে। তা হলে গোল! গ্যালারিতে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে।

সারথির প্রথম টিমে খেলতে নেমে তিন মিনিটেই জ্যোতি গোল করে। এরপর খেলাটা আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ, অল্পের জন্য সুযোগ নষ্ট, গোলমুখে জটলা, অফসাইড এবং দীর্ঘ সময় ধরে মাঝ মাঠে আটকে থেকে অবশেষে এক—এক অমীমাংসিত থাকে।

পরদিন প্রত্যেকটি কাগজে তার ছবি বেরোয়। ম্যাচের প্রত্যেক রিপোর্টেই রেখে—ঢেকে, সতর্কভাবে, মোটামুটি একটি ধারণা, বিভিন্ন ভাষায় ও ভঙ্গিতে বলা হয়েছে—নতুন একটি তারকার উদয় হতে চলেছে।

পরের ম্যাচ হাওড়া ফ্রেণ্ডসের সঙ্গে। প্রথমার্ধেই সারথি দু গোলে পিছিয়ে গেল। অরবিন্দ মজুমদার বিরতির সময় কোনরকম উত্তেজনা প্রকাশ বা কাকে কি করতে হবে বলা পছন্দ করেন না। নাটুকে বক্তৃতা করে আবেগের তোড়ে ভাসিয়ে দেওয়া কি চিৎকার করে গালিগালাজ, তার রণকৌশলের অন্তর্গত নয়। খেলোয়াড়রা শান্তিতে জিরোক, এটাই তিনি চান।

”এবার চার—তিন—তিন ফর্মেশন নিয়ে আর আমরা খেলব না। এবার অল আউট অ্যাটাক। হারলে লড়ে হারব। মনে হচ্ছে, ওরা ধরেই নিয়েছে আমাদের হাঁটুতে জং ধরে গেছে, ঘুরে দাঁড়াবার ক্ষমতা আর নেই। কিন্তু এবার আমরা ওদের হাঁটু খুলে নেব, কয়েকটা গোল ওদের গেলাব। টু—থ্রি—ফাইভ—পুরনো আমলের ছকে এবার আবার আমরা খেলব। কিছু জিজ্ঞাসা করার আছে?”

কেউ কোন জিজ্ঞাসা তোলেনি। পঞ্চান্ন আর আটান্ন মিনিটে শৈবাল দুটো গোল দেয়, আটষট্টি মিনিটে জ্যোতির গোলে সারথি ম্যাচ জেতে। দু ঘণ্টা পর, স্নান সেরে যখন সে তাঁবু থেকে বেরোচ্ছিল তখন অরবিন্দদা তাকে ডেকে পাঠান।

”জ্যোতি তোর গায়ের মাপটা দিস তো। তোর বৌদি ভাল সোয়েটার বোনে।”

”এই গ্রীষ্মে সোয়েটার কি করব!”

”আহা, বোনা শেষ হতে হতে শীত এসে যাবে। নড়াচড়া তো নেই, বসে বসেই যতটা কাজ—টাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে আর কি…তুই বরং নিজে গিয়ে মাপ দিয়ে আসিস।”

এই অরবিন্দ মজুমদারের জায়গায় আসবে সাধন নাথ। লোকটি সম্পর্কে জ্যোতি বিশেষ কিছু জানে না। কলকাতায় ছোট কয়েকটা ক্লাবের কোচ করেছিল এন আই এস থেকে ফিরে। ক্লাবগুলোর কোন উন্নতি হয়নি বরং একটি নেমে যায় দ্বিতীয় ডিভিসনে । তারপর এক বছর হাতে কোন ক্লাব পায়নি। একদিন হঠাৎ চাকরি নিয়ে সাধন নাথ ভিলাই স্টিলের ফুটবল কোচ হয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। তারপর কলকাতার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিল না, শুধু টিম নিয়ে আই এফ এ শীল্ডে খেলতে আসা ছাড়া।

সাধন ভিলাই ছেড়ে কবে বোম্বাইয়ে গেছে কেউ সে খবর রাখেনি। টাটা স্পোর্টস থেকে মফৎলালে গিয়ে দু বছর তাদের হারউড লিগ চ্যাম্পিয়ন করার পর সাধন ভারতীয় ফুটবল দলের কাজাকিস্তান সফরে কোচ হয়েছিল। জ্যোতি ও শৈবাল নির্বাচিত হয়েছিল কিন্তু জ্যোতি যেতে পারেনি। ম্যালেরিয়া তাকে ভারত দলে প্রথমবার খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছিল।

সফর থেকে ফিরে আসার পর শৈবালের মুখে সে সাধন নাথের প্রশংসা শুনেছে। ”খুব স্ট্রিক্ট, ডিসিপ্লিনের দিকে কড়া নজর। আর দারুণ জ্ঞান ট্যাকটিকস সম্পর্কে।”

মাঠে সে সাধন নাথকে দেখেছে, অন্তত সাত—আটবার, কিন্তু কখনো মুখে হাসি দেখেনি। বোধহয় হাসলে লোকে উৎসাহিত হবে অন্তরঙ্গতার, তাই তাদের দূরে রাখার জন্য গোমড়ামুখো। একবার জ্যোতিকে মফৎলালের এক বাঙালী খেলোয়াড় বলেছিল, ”সাধন নাথের সঙ্গে কোনদিন কারুর ঘনিষ্ঠতা দেখিনি। প্রেম করে নাকি বিয়ে করেছে, কি করে যে বৌকে প্রোপোজ করল…আরো অবাক কাণ্ড দুটো মেয়েও হয়েছে, একেই বলে দৈবের হাত!”

ট্রেনেই জ্যোতি জিজ্ঞাসা করেছিল বিষ্ণুকে, ”সাধন নাথকে সারথিতে আসার জন্য কে কথাবার্তা বলল?”

”চঞ্চলদাই বোধহয়। হোটেলে একদিন ওর ঘরে সাধন নাথকে দেখেছি।”

জ্যোতি আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। কলকাতার কাছাকাছি ট্রেন এলে সে চঞ্চল মৈত্রকে একা পেয়ে জানতে চায় কথাটা সত্যি কিনা এবং নির্বাচনটা কে করেছে? বরাবর অরবিন্দ মজুমদারের আওতায় সে থেকেছে। অঙ্কুর থেকে মহীরুহ হয়ে উঠতে যে অবাধ রোদ বাতাস জল দরকার, অরবিন্দ তাকে তা যুগিয়েছে। মাঠে তার খেলার স্বাধীনতায় কখনো রাশ পরাননি। এখন নতুন কোচ তাকে কি ভাবে ব্যবহার করবে, তাকে তার মত খেলতে দেবে কিনা, এই নিয়ে সে উদ্বেগ বোধ করতে শুরু করেছে।

”সাধনকে আনার কথা তো অনেক দিন ধরেই ভাবা হচ্ছিল।”

”অনেক দিন! কত দিন?”

”সিজনের গোড়া থেকেই।…অরবিন্দকে দিয়ে আর চলে না, মানছি লোকটা সারথির জন্য অনেক করেছে, টিমটা দাঁড় করিয়েছে, অনেক ট্রফি এনে দিয়েছে। কিন্তু গত দু বছর ধরে আর পারছিল না। চিরকাল মানুষ সফল হতে পারে না। একটা সময় আসে যখন সাফল্যগুলোই বোঝার মত কাঁধে চেপে বসে। বিপর্যয় ঘটার সময় তখনই আসে। তখনই সেট—ব্যাক হতে শুরু করে, যা সারথির এখন হয়েছে।

”ওর যা দেবার দিয়েছে। কলকাতার কটা কোচ পেরেছে যা অরবিন্দ পেরেছে? কিন্তু তাই বলে এত বড় একটা ক্লাব তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। ও সব পুরনো বনেদী বড়লোকের বাড়িতে চলে। কবে ঘি খেয়েছি আজও হাতে তার গন্ধ শুঁকিয়ে বেড়ান, দেখছিস না মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অবস্থা!”

”ওকে আনাটা কে ঠিক করল?”

”অনেকেই চাইছে। সন্তাোষদা, কিরণ ওরা তো গত বছরই বলেছিল, প্লেয়াররা সব মাথায় চড়ে বসছে অরবিন্দর আস্কারায়, পেমেণ্ট নিয়ে ঝগড়া করছে, খেলব না বলে মোচড় দিয়ে টাকা আদায় করছে, ছোটলোকের মত ব্যবহার করছে ক্লাবের সঙ্গে।”

”কিন্তু চঞ্চলদা, প্লেয়ারদের সঙ্গে যা কথা হয়েছিল, যে ভাবে কিস্তিতে টাকা দেবার কথা, তা যদি না দেওয়া হয়, আজ নয় কাল বলে যদি ঘোরানো হয়, তা হলে তো ওরা খেপে যাবেই। গত বছর পুলক যাত্রীতে চলে গেল। ও নাকি সারথির কাছ থেকে এখনো আট হাজার টাকা পায়।”

”মিথ্যে কথা। তুই আসিস, তোকে খাতা দেখাব, ওর সই দেখাব। কড়ায় গণ্ডায় সব টাকা নিয়ে গেছে। এমন কি মায়ের গলব্লাডার অপারেশন হবে বলে পাঁচ হাজার টাকা অ্যাডভান্স চেয়ে পায়ে ধারধরি করেছিল, দিয়েছি। সেই টাকা কেটে রেখে ওর সব প্রাপ্য চুকিয়ে দিয়েছি। আর এখন বলে বেড়াচ্ছে সারথি টাকা মেরেছে, নেমকহারাম…সব নেমকহারাম। থাকত তো হাওড়ার অজ গাঁয়ে একটা ভাঙা কুঁড়েঘরে, দেখেছি তো। সেখান থেকে তুলে এনেছিলাম। আর আজ কিনা…”আচ্ছা জ্যোতি এত বছর তো তুই আছিস, কোনদিন কি তোর একটা পয়সা বাকি ফেলেছি? বল, বল?”

জ্যোতি মাথা নাড়ল। সে জানে তার পাওনা টাকা বাকি থাকলে অরবিন্দদার জিভের চাবুকে প্রেসিডেণ্ট বা সেক্রেটারি জর্জরিত হবে। ‘ভক্ত’রা যদি জানতে পারে তা হলে কমিটি সদস্যদের মোটর গাড়িগুলোর কাচ আস্ত থাকবে না। সব থেকে বড় কথা, জ্যোতি বিশ্বাসকে অখুশি রাখাটা বিপদ ডেকে আনবে। প্রতি বছরই ট্রান্সফারের আগে জল্পনা হয় জ্যোতিকে নিয়ে, ক্লাব কত টাকার অফার নিয়ে ঝুলোঝুলি করছে তাই নিয়ে ময়দানে কানাঘুষো শুরু হয় এবং সে উইথড্র না করা পর্যন্ত সারথির সাপোর্টাররা যন্ত্রণায় দিন কাটায়।

”চঞ্চলদা, তা হলে আপনারা ঠিক করেই ফেলেছিলেন অরবিন্দদাকে সরাবেন?”

”আহ হা, সরাব বললেই কি ওকে সরান যায়? ওর কত সাপোর্টার ক্লাবে আর ক্লাবের বাইরে আছে তা জানিস? সরোজদা ওকে এনেছিলেন, আমিই তো গিয়ে কথাবার্তা বলেছিলাম। ক্লাবে সরোজদার প্রভাব প্রতিপত্তি তখন তুঙ্গে। যা বলে তাই হয়। খরচও করত দু হাতে, মেজাজও ছিল নবাবের মতো। তোর মোটর—বাইকটার কথাই মনে কর না, পেলি কি করে?…তারপর কি যে শনির দৃষ্টি ওর ওপর পড়ল, শেয়ার বাজারে একেবারে ভিখিরি হয়ে গেল। কিন্তু দ্যাখ, সেজন্য সারথি সঙ্ঘ কি ধুলোয় লুটোল না ক্লাব উঠে গেল? একটু তখন অসুবিধে হল বটে কিন্তু আবার নতুন লোক এসে সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। একটা—দুটো লোক কি প্লেয়ারের ভরসায় বড় বড় ক্লাব তো চলে না, চলে নিজের জোরে। নামের ভারেই কেটে যায়।”

”প্রথম প্রথম একটু খিচখিচ করে, তখন একটু ঝাড়পোছ, এখানে ওখানে গ্রীজ আর মোবিল, নাট বল্টুগুলো একটু টাইট, তারপর চাকা যেমন ঘুরছিল তেমনিই ঘুরছে। বড় বড় কোম্পানিতে, কত ম্যানেজার, কন্ট্রোলার, ডিরেক্টর ছেড়ে যাচ্ছে, সরে যাচ্ছে, তাই বলে কি কোম্পানি উঠে যাচ্ছে?”

”অরবিন্দদাকে আগেই সরালেন না কেন? তা যদি করতেন তা হলে এই যে ঘটনা ওকে নিয়ে ঘটল, তার ফলে সারথির গায়ে কালি লাগত না।”

”কে বলেছে লেগেছে! এত বড় ক্লাবের গায়ে কালি কি অত সহজে লাগে? খোঁজ নিয়ে দ্যাখ লোকে সব ভুলে গেছে। এইটেই তো বড় ভরসা, সাপোর্টারদের স্মৃতি। সারথিতে সরোজদার কম অবদান! কিন্তু দ্যাখ, একজনও আর ওকে মনে রাখেনি। দু হপ্তা, তিন হপ্তা, বড়জোর এক মাস…ব্যাস। তারপর একটা ট্রফি জিতলেই সব স্মৃতি ধুয়ে মুছে সাফ।”

”আমাকে তো সবাই ‘অরবিন্দর ছেলে’ বলে জানে।” জ্যোতি মুচকি হেসে বলল, ”অরবিন্দদা না থাকলে আমার তো কোন প্রোটেকশন ক্লাবে থাকবে না।”

”তোর প্রোটেকশন!” চঞ্চল মৈত্র এমন ভয়ঙ্কর রকমের অবাক কথা যেন এই প্রথম শুনল। ”বলিস কি? ক্লাব তো তোরই প্রোটেকশনে রয়েছে!”

”কোন ট্রফি এ বছর জেতা হয়নি, লিগে ফোর্থ। সাপোর্টারদের বিখ্যাত বা কুখ্যাত স্মৃতি থেকে ধুয়ে মুছে যাবার সময় তো ঘনিয়ে এল।”

”ঠাট্টা করছিস। আমি যতদিন ক্লাবে আছি তোকে কোন চিন্তা করতে হবে না। ক’বছর আর খেললি যে এইসব চিন্তা শুরু করেছিস? দ্যাখ পি কে, চুনী, অরুণ কত বছর ফর্ম নিয়ে খেলে গেছে, হাবিব, শ্যাম এখনো খেলে যাচ্ছে আর তোর তো দশটা বছরও এখনো হল না। এখনো তুই সারথির সারথি!”

”কিন্তু একটা কথার উত্তর পেলাম না, অরবিন্দদাকে আগেই কেন ছাঁটাই করা হয়নি?” জ্যোতি স্বরটাকে তীক্ষ্ন, কঠিন করায় চঞ্চলের খোসমেজাজী খোলসটা খসে পড়ল।

”অসুবিধে ছিল। তা হলে কাকে কোচ করা যেত? কেউ নেই। কলকাতার কাউকে রাখা হবে না সেটা ঠিক করাই হয়েছিল। তা ছাড়া অরবিন্দকে সরাবার মত কোন কারণ বা যুক্তিও তেমন জোরাল ছিল না। মেম্বারদের ফেস করতে হবে, কি বলা যেত?”

”যদি অরবিন্দদার এই ব্যাপারটা না ঘটতো তা হলে কি করতেন?”

”কি আর করা যেত, কিছুই না। ওকে ক্লাব ছাড়ার জন্য তো বলা হয়েছিল।”

”সে কি! কই আমি তো শুনিনি এটা?” জ্যোতি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল।

”দাশুই ওকে বলেছিল। খুব ধুমধাম করে সংবর্ধনা দিয়ে ফেয়ারওয়েল আর চাঁদা তুলে হাজার তিরিশ—চল্লিশ টাকার একটা চেক দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এসব কথা দাশু বা অরবিন্দ কেউই কি তোকে বলেনি?”

”না।”

চঞ্চলকে অপ্রতিভ দেখাল। কথাগুলো বলে ফেলাটা ঠিক হল কিনা বুঝতে পারছে না। তবে নতুন কোচ যখন এসে যাচ্ছেই তখন এসব কথা প্রকাশ হলে কিই বা আসে যায়।

”অরবিন্দদা কি বলেছিল?”

”তা তো আমি জানি না। তোর তো দাশুর সঙ্গে খুব ভাব, ওকেই জিজ্ঞেস করে নিস।”

জ্যোতির ক্ষোভ যতটা হচ্ছে ততটাই অভিমান। এই দু’জন লোকের এত কাছের মানুষ যে অথচ কেউই তাকে কিছু বলেনি। গুম হয়ে সে উঠে গিয়ে নিজের জায়গায় বসল। ট্রেন খড়্গপুর স্টেশনে তখন ঢুকছে।

.

।।সাত।।

মেসে নিজের ঘরে বিছানায় গা এলিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা খাম নিয়ে এল সূর্য। ডাকে এসেছে।

”আর আসেনি?”

”না, একটাই। চা দেব?”

”না।”

মাত্র একটা চিঠি! তিন—চারমাস ধরে চিঠির সংখ্যা কমে আসছে। জ্যোতির খারাপ লাগে ভক্তদের চিঠি না পেলে। অধিকাংশই বালক বা কিশোরদের লেখা। উচ্ছ্বাস, স্তুতি আর ট্রফি জেতার জন্য মিনতি, কখনো বা দাবী। এগুলো প্রথম দিকে পড়তে জ্যোতির ভালই লাগত। কিছু কিছু জমিয়ে রেখেছিল। পরে আর সে চিঠিগুলো পড়ত না, চোখ বুলিয়ে ফেলে দিত।

সই করা ফোটো চেয়ে চিঠি আসত। এক ফোটোগ্রাফার জ্যোতিকে তার দুটো ছবির নেগেটিভ দিয়েছিল। গোল দিয়ে দুহাত তুলে রয়েছে আর বিছানায় পাজামা পরা বালিশে হেলান দেওয়া—এই দুটির কয়েকশো প্রিণ্ট করিয়ে রেখেছিল। দুমাসেই সেগুলো শেষ হয়ে যায়। তারপর আবার প্রিণ্ট করায় এবং চিঠির বয়ান আর গুরুত্ব বুঝে এরপর সে ছবি উপহার দিত।

কিছু চিঠি আসত বয়স্কদের কাছ থেকে। প্রশংসা অথবা সমালোচনা এবং উপদেশে ভরা সেই সব চিঠি। সে খুঁটিয়েই পড়ত। কিভাবে শরীরের যত্ন নিতে হবে, ত্রিফলার জল খায় কিনা, ঘানির সর্ষের তেল মাখে কিনা থেকে শুরু করে টাকা কি ভাবে জমাতে হয়, জাতীয় সার্টিফিকেট কিনতে হলে কোন পোস্ট অফিসে কার সঙ্গে দেখা করতে হবে তাও বলা থাকত। সে সাঁই বাবার ভক্ত কিনা, স্বামী বিবেকানন্দর লেখা পড়েছে কিনা ইত্যাদি ছাড়াও একজন তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবার প্রস্তাবও পাঠিয়েছিল, মেয়ের ছবিসহ। তাই নিয়ে মেসে হাসাহাসি পড়ে গিয়েছিল। ”চল মেয়ে দেখে আসি, এক প্লেট খাবার তো পাওয়া যাবে,” গৌতম এই বলে জনাচারেককে রাজি করিয়েও ফেলেছিল।

চিঠি আসত মেয়েদের কাছ থেকেও। সাধারণ অভিনন্দন থেকে শুরু করে গদগদ আবেগভরা উচ্ছ্বাস, যাকে অনায়াসেই প্রেম নিবেদন বলা যায়। জ্যোতির লোভ হত এদের সঙ্গে আলাপ করতে, ঘনিষ্ঠ হতে। কোন কোন মেয়ে পরিষ্কারই লিখেছিল তারা জ্যোতির সঙ্গে শুতে চায়। নিজেকে দমন করতে না পেরে একজনকে সে উত্তরও দিয়েছিল।

কালো কাচের চশমা পরে জ্যোতি অপেক্ষা করেছিল পার্ক স্ট্রিটে মুলাঁ রুজ—এ। জীনস পরা, ঢোলা ব্লাউজ ছেলেদের মত ছাঁটা চুল, লম্বা, রুগণ একটি মেয়ে, চিঠির নির্দেশ মত যথাসময়ে তার টেবলে এসে দাঁড়ায়। তাকে দেখেই জ্যোতি ঢোঁক গিলেছিল। মেয়েটি ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে পড়ে, ঝরঝরে ইংরাজী বলে, বাবা রেলওয়েজে বড় অফিসার। কিছুক্ষণ গল্প করে, বীয়ার ও তন্দুরি চিকেন খেয়ে, দরকারী কাজ আছে আবার পরে দেখা হবে বলে জ্যোতি উঠে পড়ে। ট্যাক্সি ডেকে অনিচ্ছুক মেয়েটিকে তাতে তুলে দিয়ে এবং ভাড়ার জন্য কুড়ি টাকার একটি নোট জোর করে হাতে ধরিয়ে দেয়।

”খবরদার জ্যোতি, এরকম অনেক চিঠি পাবি, অনেকে কাছে আসবেও, একদমই পাত্তা দিবি না, কোনও ভাবে ইনভলভড হবি না, তাহলে ফেঁসে যাবি। অনেক দেখেছি এরকম।” দাশুদা সাবধান করে দিয়েছিল। তারপরই গৌরীর সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দেয়।

সারথির সাফল্য কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিঠিও কমে গেছে। তার নিজের খেলার টানে যে চিঠিগুলো আসত, তারও সংখ্যা কমতে কমতে সপ্তাহে একটি—দুটিতে ঠেকেছে।

এসব কিসের লক্ষণ? তার খেলা কি পড়ে আসছে? জ্যোতির বুক থেকে শীতল একটা ঝাপটা শিরা উপশিরা দিয়ে চুল এবং নখ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। জনপ্রিয়তা কমে আসছে? সারথি আর জিতছে না, আর সে জেতাতে পারছে না।

ফুটবল একার খেলা নয়, বাকি দশজনকে নিয়ে মালার মত যদি গাঁথা না হয় তাহলে দল কখনো গতি পায় না, ছন্দে ওঠানামা করে না। মালা গাঁথার কাজ ছিল অরবিন্দদার। সে কাজ তিনি আর করতেন না। জ্যোতিই খেলে জিতিয়ে দেবে। আর সবার মত শেষ দিকে তিনিও এই ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ফুটবল তো একার খেলা নয়।

ডানবাহু দিয়ে চোখ ঢেকে সে চিৎ হয়ে শুয়ে রইল। তার কিছুই আর এখন ভাল লাগছে না। আর খেলতে পারছে না, এমন ভয়ঙ্কর দিনের কথা আজ পর্যন্ত কখনো তার মনে উঁকি দেয়নি। সে জানে, সব ফুটবলারই জানে, একদিন মাঠ থেকে রিটায়ার করতেই হবে। কিন্তু এখনই কেন, মনের মধ্যে এসব অমঙ্গলে ভাবনা ঢুকছে! এখনো সে ইচ্ছে করলে ভারতের যে কোন ডিফেন্সকে তছনছ করে দিতে পারে।

সত্যি কি পারে? জ্যোতির চোখে ভীত চাহনি ফুটে উঠল। কই রোভার্সে তো পারল না। যুগের যাত্রী, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের সঙ্গে লীগের খেলায়, আই এফ এ শীল্ডে এরিয়ানের সঙ্গে, বরদলুইয়ে, ডুরাণ্ডে কোথাও তো সে সারথিকে জেতাতে পারেনি! তছনছ করার ক্ষমতা একসময় ছিল…তাহলে কি অতীতের সাফল্যের মধ্যে সে বাস করছে? এটা তো পড়ে যাওয়ার লক্ষণ!

ঘরের খোলা দরজায় গলা খাঁকারি শুনে জ্যোতি তাকাল। ‘প্রভাত সংবাদে’র রঞ্জন অধিকারী দাঁড়িয়ে।

জ্যোতিরই সমবয়সী বা দু—তিন বছরের বড়। তাদের আলাপ বছর পাঁচেকের। বড় বড় ক্লাবের বা আই এফ এ—র ভিতরের খবর, সাধারণত ড্রেসিংরুমের ঝগড়াঝাটি কুৎসা ইত্যাদির দিকেই ওর ঝোঁক। খবর তৈরির জন্য তথ্যকে দুমড়ে দিতে বা পুরো মিথ্যা কথা লিখতে ওর কলম কাঁপে না। কারুর বিরুদ্ধে নোংরা কিছু রটনা করতে হলে ময়দানে প্রথমে রঞ্জনেরই খোঁজ পড়ে।

”কি রে জ্যোতি, বোম্বাই থেকে এসেই শুয়ে পড়েছিস?”

জ্যোতি উঠে বসল। ছোট টেবলটায় চায়ের কাপ পিরিচ ঢাকা দেওয়া। ঢাকা তুলে দেখল ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সূর্য নিঃশব্দে কাজ করে।

”খাবি না তো, আমায় দে।”

বলার সঙ্গে সঙ্গেই কাপটা তুলে একচুমুকে রঞ্জন চা শেষ করল।

”কি মনে করে?”

”মনে আবার করে তোর কাছে আসি নাকি? রোভার্স খেলে এলি, ভাবলুম যাই দেখা করে আসি, কেমন দেখলি, বুঝলি, সেটাও জেনে নেব। সাধন নাথ তো তোদের কোচ হয়ে আসছে, কেমন বুঝছিস, পারবে?”

”কি পারবে?”

”সারথিকে টানতে! অরবিন্দ মজুমদার যেখানে পৌঁছে দিয়ে গেছে সেখান থেকে টানা ধরে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অবশ্য শক্ত কাজ হবে না।”

”অরবিন্দদা যে পীকে পৌঁছে দিয়েছিল সেটা দু বছর আগের কথা, তারপর থেকে সারথি নীচের দিকে গড়াচ্ছে। সাধন নাথকে এই গড়িয়ে যাওয়াটা থামাতে হবে।”

”গত দু বছর অরবিন্দ মজুমদার তাহলে কিছুই করেনি? এত যে সব স্টার রয়েছে তবু তিনি ফেইলিওর!”

”স্টার প্লেয়ার থাকলেই বুঝি টিম জেতে? একজন স্টারের কাঁধে চোট, একজন স্টারের দু মাস হাঁটু সারছে না, একজন স্টার স্টপার থেকে মিডফিল্ডার পজিসনে গিয়ে নাকি এবিলিটি লস করেছে, একজন স্টার ইনসাইড তার লিঙ্কম্যান আর আউটসাইডের সঙ্গে এখনো অ্যাডজাস্ট করে উঠতে পারছে না, একজন স্টারকে তার অরিজিন্যাল পজিশনে খেলান হচ্ছে না বলে সিটার মিস করছে—বুঝলে রঞ্জনদা এই হচ্ছে তারকাখচিত টিমের হাল!”

”এসব তো অরবিন্দ মজুমদারের আমলেরই তৈরি।”

রঞ্জন বালিশ নিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। জ্যোতি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, ”নিশ্চয়। শেষদিকে অরবিন্দদার গাছাড়া ভাব ছিল তো বটেই। ক্লাব অফিসিয়ালরাও কি কম দায়ী? এই যে অসিত টাকা না পাওয়ার জন্য ট্রেনিংয়ে এল না, মেণ্টালি ডিস্টার্বড, আনহ্যাপি, তার কাছ থেকে কি খেলা আশা করব? তবু ও রোভার্সে অন্যদের থেকে ভাল খেলেছে, কিন্তু অন্যরা?”

”জবেদের আর অজিতের মাঝখানে স্পিডে মেরে দিয়ে অরুণাচলম বল নিয়ে ঢুকে গেল, গৌতমও গোল লাইনে দাঁড়িয়ে রইল, অরুণাচলম ডান থেকে বাঁ পায়ে বল নিয়ে তাইয়ে তাইয়ে শট নিয়ে উপরের জালে বল রাখল। তারপর জবেদ আর অজিত মাঠেই ঝগড়া শুরু করল, এসব ব্যাপার তো আগে ঘটত না!”

রঞ্জন চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে মন্তব্যের জন্য জ্যোতির মুখের দিকে ত্যারছা চোখে তাকিয়ে থেকে শুধু আর একটা কথা জুড়ল, ”অনেকে বলছে জ্যোতি সিরিয়াসলি খেলেনি যেহেতু অরবিন্দ মজুমদার আর নেই।”

”কে বলেছে একথা?” জ্যোতি ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মত সোজা হয়ে গেল। ”আমার নামে কে বলেছে?”

”শুনলাম কারুর কারুর কাছে, নাম বলব না।”

”রথীন? চঞ্চলদা? অজিত, বাচ্চচু, বিষ্ণু?”

”বললাম তো, নাম বলব না।”

”যতসব অযোগ্যদের ভীড় হয়েছে এখন সারথিতে। চিড়ে চ্যাপ্টা করে দিয়েছে মিডফিল্ড, কি গ্রাউণ্ডে কি এয়ারে বীট করে যাচ্ছে অ্যাট ইজ, কে যে কোথায় দাঁড়াবে, কাকে রাখবে তাই ঠিক করতে পারছে না। ডিফেন্স হাসফাঁস করছে দেখে বাধ্য হয়েই নেমে এসে খেলতে হয়েছে, আর রথীন বলল কেন নেমে খেলেছি। গোল নাকি সেজন্যই আমরা দিতে পারিনি। অদ্ভুত যুক্তি! আমি ছাড়া কি গোল দেবার আর লোক ছিল না? তারা কি করছিল? তিনটে ওপেন করেছি, তিনবারই বিষ্ণু সাত—আট গজ থেকে বাইরে মারল। মূর্তি একটা হেড করে বারের ওপর তুলে দিল গোলকীপার তখন মাটিতে পড়ে! আর অরবিন্দ মজুমদারের থাকা বা না থাকার সঙ্গে আমার খেলার সম্পর্ক কি? আমি আমার খেলা খেলব। এসব বাজে রটনার উদ্দেশ্য কি?”

”উদ্দেশ্য আবার কি, তোকে পছন্দ করে না নানা কারণে তাই বলে। সাধন নাথ এলে তোর কি কোন অসুবিধে হবে?”

”অসুবিধে?” জ্যোতির উত্তেজনার প্রবাহের সামনে যেন পাথরের চাঙড় পড়ল। ধাক্কা খেয়ে ছিটকে উঠল তার কথার তোড়। ”মফৎলাল টিমটা অঙ্কের মত ফুটবল খেলল। প্রত্যেকটা প্লেয়ারকে কাজ দেওয়া আছে, প্রত্যেকে জানে কখন কোথায় তাকে থাকতে হবে। ছট কাটা খেলা। এভাবে আমি কখনো খেলিনি, আমার এই মেথডিক্যাল খেলা একদম পোষায় না। অরবিন্দদা এটা জানতেন, বুঝতেন, তাই আমাকে মাঠে ছেড়ে রেখে দিতেন। যদি আমাকে ছকের মধ্যে কেউ বাঁধতে চায় তাহলে আমার পক্ষে—”

”তাহলে তোর পক্ষে কি?—বনিবনা করে চলা সম্ভব হবে না?”

”তাই।” কথা খুঁজে না পেয়ে জ্যোতি সায় দিল।

”সাধন নাথ অনেক পাওয়ার নিয়ে আসছে। ওর কাজে বা সিদ্ধান্তে কাউকে নাক গলাতে দেবে না। যদি মনে করে কাউকে বসাবে বা তাড়াবে তাহলে কিন্তু তাই করবে।”

”তুমি বলতে চাও আমাকেও বসাবে বা তাড়াবে?—একবার চেষ্টা করে তাহলে দেখুক, কত ধানে কত চাল বোঝা যাবে।”

”কি করবি তাহলে?”

”কেন সারথি ছাড়া আর কি ক্লাব নেই?”

”তাহলে কি যাত্রীতে যাবি?”

জ্যোতি এবার বিরক্ত স্বরে বলল, ”কোথায় যাব সে পরে দেখা যাবে। এখন আমি একটু ঘুমোব।”

রঞ্জন উঠে দাঁড়াল। চোখে পড়ল একটা খাম মেঝেয় পড়ে রয়েছে। সেটা তুলে নাম ঠিকানা পড়ে বলল, ”মেয়ের হাতের লেখা। কার?”

”কার তা আমি কি করে জানব!”

জ্যোতি হাত বাড়িয়ে খামটা টেনে নিল। রঞ্জন অপেক্ষা করছে, খাম ছিঁড়ে চিঠি বার করার। জ্যোতি খামটা বালিশের নীচে রেখে দিল।

”খাওয়াবি কিছু?”

”এখন ঘুমোব, তুমি বরং মোড়ের মিষ্টির দোকান থেকে কিনে খেয়ে নাও।”

জ্যোতি দশ টাকার একটা নোট দিল রঞ্জনকে। সেটা পকেটে পুরেই সে বেরিয়ে গেল। জ্যোতি অস্ফুটে বলল, ”শালা।”

বালিশের তলা থেকে খামটা বার করে সে ছোট চিঠিটা পড়ল।

”জ্যোতি,

তোতনের অপারেশনের জন্য যে টাকার কথা বলেছিলাম, তার আর দরকার হবে না। টাকার যোগাড় হয়ে গেছে। ভাগ্যটা এখন ভাল যাচ্ছে মনে হয়। অনুপমা যাত্রা সমাজের সঙ্গে আমার কন্ট্র্যাক্ট হয়েছে; অ্যাডভান্স যা পেয়েছি তাতেই মনে হয় কুলিয়ে যাবে। তুমি আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য টাকা দেবে বলেছিলে, তোমার এই উদারতা চিরকাল আমার মনে থাকবে। তোতনকে নিয়ে দোসরা রওনা হচ্ছি। আবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি তোমাকে। ইতি,

গৌরী।

চিঠিটা দ্বিতীয়বার পড়ে সে দলা পাকিয়ে ঘরের কোণে ছুঁড়ে দিল। তার কাছ থেকে গৌরীর টাকার বা উপকার নেবার আর দরকার হল না। এটা মনে হতেই জ্যোতির মনে জ্বালাধরা একটা হতাশা কিছুক্ষণ জমে রইল।

দুদিন পর প্রভাত সংবাদের খেলার পাতায় বড় অক্ষরে হেডিংটা দেখে জ্যোতির হৃদপিণ্ডের দু’তিনটে স্পন্দন ফসকে গেল। হাতের কাগজ কেঁপে উঠল।

”সাধন নাথ কোচ হলে সারথিতে আমি থাকব না: জ্যোতি।”

একি লিখেছে রঞ্জন! জ্যোতির চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করল, শুধুই একটা চিৎকার।

স্টাফ রিপোর্টার লিখেছে: না, সাধন নাথের মেথডিক্যাল ফুটবলের সঙ্গে বনিবনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার ছক কাটা আঁকা কষা ধরনের সঙ্গে আমার খেলার ধরনের একদমই মিল নেই। আমাকে ছকের বাঁধনে কেউ বাঁধতে চাইলে আমার পক্ষে তার সঙ্গে মানিয়ে চলা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে—’। ”সারথির সারথি,” ভারতীয় ফুটবলের উজ্জ্বল নক্ষত্র জ্যোতি বিশ্বাস কথাগুলো বললেন রোভার্স থেকে ফিরে। বলার সময় তার কণ্ঠে ছিল তীব্র ঝাঁঝ আর চোখে আগুন। সারথি সঙ্ঘের মেসে নিজের ঘরে, লাল জয়পুরী প্রিণ্টের বেডকভারে ঢাকা বিছানায় শুয়ে শুয়ে জ্যোতি বললেন, ‘সারথি এখন ভরে গেছে অযোগ্যদের ভীড়ে। বাংলার সম্মান এরা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে এল বোম্বাইয়ে। কেউই কণ্ডিশনে ছিল না, ইনজুরি আছে অনেকের কিন্তু তারা সেকথা চেপে গেছল। আনফিট অবস্থায় খেলে তারা টিমকে ডুবিয়েছে। আমি নাকি সিন্সিয়ার ছিলাম না বলে কেউ একজন বা কয়েকজন অভিযোগ তুলেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সারথির জন্য আমি বুকের শেষ বিন্দু নিঃশ্বাস কুপারেজ মাঠে ঝরিয়ে দিয়ে আসতে পারি। যারা বলে আমি সিন্সিয়ার নই, তারা নিজেদের কি প্রমাণ করতে পারবে তারা খুব সিন্সিয়ার?’

রাগে ফুঁসছিলেন জ্যোতি। ‘বললেন, ম্যাচ হারলেই সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপাবার একটা চক্রান্ত সারথিতে বিষাক্ত আবহাওয়া এখন তৈরি করেছে।’ এরপর তিনি প্রাক্তন কোচ এবং গণিকা গৃহে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া অরবিন্দ মজুমদার সম্পর্কে বলেন, ‘এই সব ব্যাপার অরবিন্দদার আমলেই তৈরি। তার গাছাড়া ভাবের জন্যই শেষদিকে প্লেয়াররা আস্কারা পেয়েছে।’ অবশ্য অরবিন্দ মজুমদারের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও তিনি ভোলেননি। বলেন, ‘সারথিকে তিনি যে পীকে তুলে দিয়ে গেছেন, সাধন নাথের পক্ষে তার রাশ ধরে থাকা শক্ত কাজ হবে না। তবে এতগুলো স্টার প্লেয়ার সামলানোর মত ব্যক্তিত্ব তার আছে বলে মনে হয় না।’

প্রশ্ন করি, সাধন নাথের সঙ্গে যদি মতের মিল না হয় তাহলে, আপনি কি অন্য দলে যাবেন? উত্তরে কলকাতার সবথেকে দামী এই ফুটবলারটি বিষাদভরা দৃষ্টি মেলে, সজল কণ্ঠে বললেন, ‘আমাকে যদি তিনি তাড়াতে চান তাহলে নিশ্চয় অন্য ক্লাবের কথা ভাবব। ফুটবলই তো আমার প্রাণ, আমার সাধনা। তবে মনে হয় না সাধন নাথ আমার খেলা নষ্ট করার মত কিছু করবেন।’ চলে আসার আগে জ্যোতি বিশ্বাস আমার দিকে কেউটের ছোবলের মত একটা কথা ছুঁড়ে দিলেন, ‘কারা যেন বলে বেড়াচ্ছে আমি নাকি যুগের যাত্রীতে চলে যাব? লিখে দিতে পারেন, সারথিতেই আমি জন্মেছি সারথিতেই আমি মরব।’

পড়ার পর জ্যোতি শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল দেয়ালের দিকে। তার মুখ দিয়ে বেরোন কথা বলে বলে যা সব লেখা হয়েছে নিশ্চয় সারথির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই তা পড়বে। একটা ব্যাপার সে পরিষ্কার জেনে গেল, এখন সে যতই প্রতিবাদ করুক তার বন্ধু বা হিতৈষী রূপে সারথির কাউকে সে আর পাশে পাবে না। সে একা হয়ে গেল। প্রত্যেকটি সহ খেলোয়াড় তার উপর চটবে, সাধন নাথ তো রীতিমত অপমানিত বোধ করবে আর অরবিন্দদা ভাববেন, বেইমান।

এত ক্ষতি মানুষের প্রতি কোন মানুষ যে অকারণে করতে পারে, জ্যোতি তা বুঝে উঠতে পারছে না।

আগাগোড়া বিকৃত এই রিপোর্ট অত্যন্ত চতুরভাবে সারথি থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিল।

পাথরের মত বসে থাকা জ্যোতির চোখ বেয়ে টপটপ জল পড়ল লাল জয়পুরী বেডকভারে।

.

।।আট।।

নাণ্টুকে দিয়ে দাশুদা খবর পাঠিয়েছে, এখুনি দেখা কর।

জ্যোতি দেখা করতে গেল। দাশুদা ফ্ল্যাটে একাই ছিল।

”এই যে। রোভার্স থেকে ফিরে এসেই খবরের কাগজে স্টেটমেণ্ট ছেড়েছিস দেখলুম। এসব রোগ তো তোর আগে ছিল না!”

”আমি কোন স্টেটমেণ্ট দিইনি। রঞ্জন আগাগোড়া বানিয়ে লিখেছে। ও গল্প করার জন্য এসেছিল, আমিও সেই ভাবে কথা বলেছি। এইসব কথা যে লিখে দেবে, তাও হয়কে নয় করে তা তো জানতাম না! আর আমাকে ঘুণাক্ষরেও বলেনি যা বলেছি তা ছাপা হবে। তাহলে কনসাশ হয়ে কথা বলতাম। রিপোর্টাররা যে এত জঘন্য, নীচ, মিথ্যাবাদী হয় তা আমার ধারণায় ছিল না।”

”আগাগোড়াই মিথ্যে লিখে দিল? তুই কিছুই ওকে বলিসনি?”

দাশুদার বলার ভঙ্গিতে সন্দেহ এবং কৈফিয়ৎ চাওয়া দুটোই রয়েছে।

”ওর সঙ্গে আমার সামান্যমাত্র কথা হয়েছিল আর তাছাড়া এভাবে এসব কথা আমি বলিইনি। অথচ…”

”তুই কি প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিস?”

”আজই পাঠিয়ে দিয়েছি একটা ছেলের হাত দিয়ে।”

”দ্যাখ ছাপে কি না আর ছাপলেও কেটেকুটে কতটা রাখে!”

”আমি আর কি করতে পারি বল?”

জ্যোতি অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। দাশুদা নাণ্টুকে ইশারা করল বীয়ার দেবার জন্য।

”খুব ক্ষতি হলো তোর আর সারথিরও। এইসব খবরের কাগজের লোকগুলোকে আর ক্লাবে ঢুকতে দেওয়াই উচিত নয়। সন্তাোষদাকে বলব নোটিস দেবার জন্য, প্লেয়াররাও যেন ওদের কাছে মুখ না খোলে।”

”কোন কাজ হবে না তাতে। প্লেয়াররা নিজেরাই যেচে গিয়ে খবর দেয়, তাদেরও তো স্বার্থ আছে!”

”তোর সঙ্গে সাধন নাথের একটা হিচ তৈরি করে দিল। এতে ক্লাবের ক্ষতিই হবে। যদি রেজাল্ট খারাপ হয় এবার, তাহলে কিন্তু মেম্বার—সাপোর্টাররা তোকেই দায়ী করবে। বলবে, জ্যোতি বিশ্বাস কো—অপারেট করেনি কোচের সঙ্গে। অরবিন্দ মজুমদারের লোক তো, তাই সাধন নাথকে কাজ করতে দিচ্ছে না। সাপোর্টাররা তোর পেছনেই তখন লাগবে।”

জ্যোতি বিব্রত বোধ করল। ব্যাপারটা যে এই রকম একটা চেহারা নিতে পারে, তার নিজেরও মনে হয়েছে। সাপোর্টাররা তাকে মাথায় তুলে যতই নাচানাচি করুক, মাথা থেকে মুহূর্তেই ফেলেও দিতে পারে। অরবিন্দদা আসার আগে তাঁবুতে ইঁট ছোড়া, কয়েকজন মেম্বারের গাড়ির কাচ ভাঙা, এমনকি দুজন প্লেয়ারের স্কুটারও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, প্রেসিডেণ্ট আর সেক্রেটারি দু সপ্তাহ ক্লাবের ছায়া মাড়ায়নি। ওদের বাড়িতেও পুলিশ পোস্ট করতে হয়েছিল।

”এবার কাকে কাকে আনবেন ঠিক করেছেন?”

”ওসব ব্যাপারে আমি নেই, থাকিও না। যা করার চঞ্চল, সন্তাোষদা আর লালচাঁদই করবে। সাধন নাথ আসছে, ওর সঙ্গেও কথা বলে ঠিক করা হবে, কাকে কাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে শৈবালকে ফিরিয়ে আনা যে হবে এটা ধরে নিতে পারিস।”

”সাধন নাথ ওকে পছন্দ করে। ক্লাবেও অনেকে ওকে চাইছে। অমিত তো থাকবে না জানা কথাই, জবেদও বোধহয় ওর সঙ্গেই যাত্রীতে চলে যাবে। যাই হোক খুব একটা ক্ষতি আমাদের হবে না। কিন্তু তোর এই কাগজের স্টেটমেণ্টটা…”

”আমার স্টেটমেণ্ট নয় দাশুদা।”

”ওই হল।”

দুজনে বীয়ারের গ্লাস নাণ্টুর হাত থেকে নিল।

”তোর জন্য নেপাল থেকে ভেলভেট কর্ডের একটা প্যান্ট পীস এনেছি। জলিলকে মাপটা দিয়ে আসিস।”

এই ধরনের উপহার দাশুদার কাছ থেকে পাওয়াটা জ্যোতির কাছে খুবই সাধারণ ব্যাপার। সে উৎসাহ প্রকাশ করল না, শুধু বলল, ”আছে তো অনেক।”

”থাকুক আর একটা।”

”ব্যবসার কাজে গেছলে?”

”হ্যাঁ। তোকে তো ব্যবসায় আর নামাতে পারলুম না। টাকাগুলো কি করবি, বাড়ি?”

”হ্যাঁ। নিজের একটা বাড়ি আমার অনেক দিনের ইচ্ছে।”

”তারপর বিয়ে। ঠিক করেছিস?”

”না।”

”দেখব মেয়ে?”

”ওরে বাবা, না না, এসব ব্যাপারে তুমি মাথা দিও না।”

”কেন, আমি কি খুব খারাপ মেয়ে তোকে দিয়েছি?

জ্যোতি গ্লাসে চুমুক দিল অনেকটা সময় নিয়ে। না, দাশুদা ভাল মেয়েই দিয়েছিল। একটু বেশি ভাল।

”গৌরীর ছেলের হার্ট অপারেশন হবে, ভেলোরে। তুমি কি তা জান?”

”সে কি! কই আমায় তো বলেনি কিছু? ও কি কলকাতায় আছে?”

”ছেলেকে নিয়ে ভেলোরে গেছে। দোসরা রওনা হয়েছে।”

”তুই জানলি কি করে?”

চিঠি দিয়ে গেছে।

”অদ্ভুত এই মেয়ে জাতটা। তিন চারদিনের মধ্যে ওকে দরকার, আর কিনা না বলে চলে গেল!”

”ছেলের হার্ট অপারেশন।”

”তাতে কি হল। দুচারটে দিন দেরী হয়ে গেলে কি ছেলে মরে যেত? এতদিন তো বিনা অপারেশনেই বেঁচে রয়েছে।”

জ্যোতি অবাক বোধ করল দাশুদার হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠায়। তার মনে হল, এই সময় এইভাবে কথাগুলো বলা একমাত্র নিষ্ঠুরের পক্ষেই সম্ভব। মায়ের কাছে ছেলের জীবনের মূল্য এবং প্রয়োজন যে কতটা তা বোঝার মত বোধশক্তি এই লোকটির নেই। নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।

”এখন আমি কাকে আবার যোগাড় করি।”

গোঁজ হয়ে রইল দাশুদা। জ্যোতি গ্লাস শেষ করে নাণ্টুর হাতে দিল ভরে দেবার জন্য। প্লেট থেকে চিকেন পকৌড়া তুলে মুখে দিল। কিছুক্ষণ পর দাশুদার চিন্তাবিকৃত মুখটা স্বাভাবিক হয়ে এল। চোখে—মুখে হালকা স্বাচ্ছন্দ্য ফুটে উঠল।

জ্যোতির বলতে ইচ্ছে করেছিল, গৌরী আর এই জীবনে ফিরে আসবে না, ওকে দিয়ে আর কোন কাজ তুমি করাতে পারবে না। সে নিজের একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কিন্তু পরিবেশটা অস্বস্তিকর করে তুলতে সে চাইল না।

”জ্যোতি চাকরি—বাকরিতে এবার ঢুকে পড়। খেলা তো চিরকাল থাকবে না, এই দরও তোর থাকবে না। বাকি জীবনটা টানবি কি করে? দেখছিস তো দিনকাল কেমন বদলে যাচ্ছে। কাগজে তোর পেছনে মিথ্যেমিথ্যি যে রকম লেগেছে…এসব জিনিস দশ বছর আগেও ছিল না, ভাবাই যেত না।”

”তখন প্লেয়ারদের এত টাকা দেয়া হত না বলেই নোংরামিটা ছিল না।

”হবে।” দাশুদা চিকেন পকৌড়া তুলল। ”আচ্ছা জ্যোতি তুই যে বলেছিস, সারথিতে তোর বিরুদ্ধে একটা চক্রান্ত অরবিন্দ মজুমদারের আমলেই তৈরি, তার গাছাড়া ভাবের জন্য…”

জ্যোতিকে হাত তুলতে দেখে দাশুদা থামল।

”আবার বলছি আমি বলিনি। বলেছিলাম, স্টার স্টাডেড টিমের এই হাল অরবিন্দদার শেষদিকে গাছাড়া ভাবের জন্য আর অফিসিয়ালদের জন্য হয়েছে। খুব কি ভুল বলেছি?”

”তোর কি মনে হয়েছে কখনো অরবিন্দদা আর পারছে না, সারথিকে ডোবাচ্ছে, এবার সরে যাওয়া উচিত? মনে হয়নি কি, টিমের একটা নতুন অ্যাপ্রোচ এবার দরকার, নতুন আইডিয়া নিয়ে সারথি খেলুক।”

”হ্যাঁ, মাঝে মাঝে মনে হতো।”

”কিন্তু অরবিন্দ মজুমদার থাকলে তা সম্ভব নয়। কিন্তু ওকে সরানও সম্ভব নয়।”

”তুমি ওকে সরে যেতে বলেছিলে?”

দাশুদা পিটপিট করে তাকিয়ে, মুখে ক্ষীণ হাসি।

”আমার কাছে এটা চেপে গেছলে।” জ্যোতি ঈষৎ অভিমান দেখাল।

”সব কথা কি বলা যায়? সারথির ভাল—মন্দ আমার কাছে প্রথম প্রায়রিটির ব্যাপার। সারথির জন্য এমন কোন কাজ নেই, তা যত খারাপই হোক, করতে না পারি!”

”সেজন্য তুমি আমাকে ছুরি মারতে পার?”

”যদি মনে হয় তোর জন্য সারথির ক্ষতি হচ্ছে…তা হলে…যদি মনে হয় তোকে সরিয়ে দিলে সারথির ভাল হবে…তা হলে…।”

দাশুদা গ্লাসটা মুখে তুলল। জ্যোতির মনে হল, কণ্ঠস্বর যতই লঘু হোক না, ‘তা হলে’ শব্দটায় ইস্পাত—ফলার তীক্ষ্নতা ছিল। সিরসির করে উঠেছে কলিজা। তার অদ্ভুত ধরনের অস্বস্তি লাগছে। সোফায় গা এলিয়ে দেওয়া, শান্ত মুখ, পাজামা—পাঞ্জাবি—পরা লোকটি, পরিশ্রমী, বহু টাকা রোজগেরে ব্যবসায়ী কিন্তু নিজের কোন অস্তিত্বই নেই! ফুটবল ক্লাবই ওর ধ্যান—জ্ঞান! অথচ ক্লাব থেকে একটা পয়সাও নেয় না।

”দাশুদা একটা কথা বলব?”

”বল।”

”ভোরবেলা অরবিন্দদার বাড়িতে গাড়ি নিয়ে গিয়ে তাকে আর বৌদিকে তুলে দেশের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলে ওদের লোকলজ্জার হাত থেকে কি না বাঁচাতে। কিন্তু ব্যাপারটা তো এতদূর না—ও গড়াতে পারত, মানে কোর্ট পর্যন্ত যেতই না যদি সেই রাত্তিরেই থানা থেকে অরবিন্দদাকে বার করে আনা হত।”

”নিশ্চয়, কোর্টে কেস উঠতই না যদি একবার কেউ তখন আমায় জানাত। কিন্তু আমি তো জানলুম খবরের কাগজের রিপোর্ট পড়ে।”

”অত ভোরেই তুমি রিপোর্ট পড়ে গাড়ি নিয়ে ছুটে গেলে। তুমি তো অনেক দেরিতে ঘুম থেকে ওঠ জানি।”

”সেদিন অনেক রাতে জামশেদপুর থেকে ফিরেছিলুম, আর ঘুমোইনি। ভোরে কাগজ খুলে খবরটা পড়েই তো স্তম্ভিত। প্রথমেই মাথায় হিট করল, এ খবর পড়ে ওর বৌ, যে পঙ্গু দুর্বল, সে তো হার্টফেল করবে! তাই গাড়ি নিয়ে ছুটলাম।”

জ্যোতি লক্ষ্য করে যাচ্ছিল দাশুদার মুখ। প্রথমেই একটা চকিত ইতস্তত ভাব ফুটে উঠেছিল। তারপর স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যে কথাগুলো বললেও তার মনে হচ্ছিল দাশুদা বানিয়ে বলছে।

হঠাৎই তার মনে পড়ল, সেদিন সল্ট লেকে অরবিন্দদার ফ্ল্যাট থেকে এখানে এসে নীচে বাইকটা রাখার সময় দরোয়ানকে সে দাশুদার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। দরোয়ান জানিয়েছিল, দাশুদা গত রাত্তিরে এসে আবার বেরিয়ে গেছে গাড়িতে। এক রাত্তিরেই কি জামশেদপুর গিয়ে আবার সেই রাতের মধ্যে ফিরে আসা যায়? হয়তো যায়! কিন্তু দাশুদা যে মিথ্যা কথা বলেছে, সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন?

”আমিও খবরের কাগজ থেকে প্রথম জানলাম। আগে যদি জানতাম তা হলে থানা থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতাম।”

”নিশ্চয়, যে কেউ করত। জ্যোতি, আমি শুধু ভাবছি অরবিন্দ মজুমদার সেই রাতে থানা থেকে কাউকে, চঞ্চল বা কিরণ বা সন্তাোষদা কিংবা আমাকেও যদি একবার ফোন করত তা হলে ব্যাপারটা হাস—আপ করে দেওয়া যেত। পার্ক স্ট্রিট, হেস্টিংস, বৌবাজার কোন থানায় না আমার চেনা ও সি আছে? অত বড় নামী কোচ, তা ছাড়া অনেক পুলিসও তো ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করে, ওকে যদি চিনত তা হলে ছেড়েই দিত। পরে শুনলাম সেদিন থানায় উনি নিজের নাম না বলে অন্য নাম বলেছিলেন। আর থানায় তখন ছিল ছোটবাবু, সে ফুটবল কেন কোন খেলা নিয়ে একদমই মাথা ঘামায় না তাই চেহারাও চিনতে পারেনি। ব্যাপারটা বড় স্যাড, বড় দুঃখের হয়ে রইল।”

”তুমি আর দেখা করেছ অরবিন্দদার সঙ্গে?”

”না। একদম অজ পাড়াগাঁ, সেই রূপনারায়ণ নদীর ধারে রাজপুর, যাওয়ার সময় আর পেলাম কোথায়।”

”আমি একবার যাব ভাবছি।”

”এখন যাসনি, আর একটু থিতোতে দে, স্বাভাবিক হতে দে লোকটাকে। ভীষণ আপসেট হয়ে গেছল, একবার তো বলেও ফেলেছিল সুইসাইড করবে। তবু ভাল ধারে—কাছে ভদ্দরলোকের বাস নেই যে খবরের কাগজ পড়ে ওকে উত্ত্যক্ত করবে। ধূ ধূ ক্ষেত, খাল, পুকুর, গাছ আর চাষাভুসো মানুষ, মনে হয় বাকি জীবন এদের নিয়ে ভালই কাটাতে পারবে। আমরা গিয়ে ওকে ডিস্টার্ব না করাই ভাল।”

বীয়ারের ছ’টা খালি বোতল দেয়ালের ধারে সাজিয়ে রাখা। নাণ্টু আর দুটো বোতল বার করে আনল ফ্রিজ থেকে।

”জ্যোতি, এ বছরটা সারথির পক্ষে খুবই ভাইটাল। নতুন কোচ আসছে, টিমও নতুন ভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। তোকে কিন্তু এ বছর খেলতে হবে…জান—মান লড়িয়ে খেলতে হবে।”

দাশুদা এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে তাকিয়ে রইল। চকচক করছে চোখ। মুখটা ঈষৎ ফুলো, গলার স্বর একটু চড়া। ভিতর থেকে একটা উত্তেজনা বেরিয়ে আসার জন্য দাপাচ্ছে ওর চাহনিতে।

”কাগজে যা বেরিয়েছে, যতই প্রতিবাদ কর কেউ তোর কথা বিশ্বাস করবে না। সবাই বলবে, নিশ্চয় কিছু অন্তত বলেছে, নইলে অমনি কি লিখে দিল? টিমে যত ঝগড়াঝাটি, খেয়োখেয়ি সব তোকে কেন্দ্র করে। তোর জন্য টিম স্পিরিট নষ্ট হয়েছে।”

”বলছেন কি দাশুদা?” জ্যোতি গ্লাস নামিয়ে রাখল।

”ঠিকই বলছি। কিন্তু এসবের জন্য ক্লাব সাফার করেনি। তুই একাই খেলা দিয়ে সেটা পুষিয়ে দিতিস। কিন্তু এখন আর তা পারছিস না। ভাল প্লেয়ার আর আসছে না, তোকে খেলাবার মত যোগ্যতা এখন আর কারুর নেই। এইসব সাধারণ স্ট্যাণ্ডার্ডের প্লেয়ার দিয়েই এবার কাজ চালাতে হবে। তুই এদের মধ্যে মিস ফিট। তুই ফালতুর মত এখন মাঠে দাঁড়িয়ে থাকিস মাত্র। তোর খেলা এরা বোঝে না, একটা বল দিতে পারে না, তোর কাছ থেকে নিতেও পারে না। তোর দিন ঘনিয়ে এসেছে জ্যোতি। এখন ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়াদের আমল আসছে, এর মধ্যে রেসের ঘোড়া বেমানান, তাই নয় ক্ষতির কারণও।”

জ্যোতি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে দাশুদা আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ল। খালি গ্লাসটায় বোতল উপুড় করে ভরে নিতে নিতে চিৎকার করল, ”নাণ্টু…পকৌড়া দে।” গ্লাস বেয়ে বীয়ারের ফেনা মেঝেয় পড়ছে। দাশুদা গ্লাসে চুমুক দিতেই ঠোঁটের উপর ফেনা আটকে গেল।

”যে টিমে ট্যালেণ্ট নেই সেই টিমকে অন্যভাবে কোচ করে খেলাতে হয়। স্কিলের ঘাটতি এনডিওরেন্স আর স্ট্যামিনা দিয়ে পোষাতে হয়। হ্যাঁ, ছক কেটে অঙ্কের মত করেই সারথি খেলবে, তাই সাধন নাথকে আনা। ওর কথা মত তোকে চলতে হবে, খেলতে হবে এবার থেকে। ইনডিভিজুয়াল প্লেয়ার, ব্রিলিয়ান্স এসব এখন ভুলে যা, টিমের স্বার্থে তোকে এবার অন্যভাবে, সবার সঙ্গে মানিয়ে খেলতে হবে। যদি খেলতে না পারিস তা হলে…।”

ঝনঝন করে গ্লাসটা ভেঙে গেল দেয়ালে লেগে। দাশুদা উঠে দাঁড়াল, ”মেসে ফিরে যেতে হবে না, এখানেই শুয়ে পড়। আমার ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।”

দাশুদা বেরিয়ে গেল। একটু পরে নীচ থেকে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ এল। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত জ্যোতি বসে রইল। ‘তোর দিন ঘনিয়ে এসেছে জ্যোতি’ কথাগুলো তার মাথার মধ্যে ঘুরে ঘুরে বড় হয়ে উঠছে কর্কশ থেকে আরো বীভৎস কর্কশ হয়ে।

তার ভয় করছে। হয়তো অরবিন্দদার মতই বদনামের বোঝা মাথায় নিয়ে তাকে বিদায় নিতে হবে। তখন সে যাবে কোথায়? সারথির বাইরে কিছুই সে চেনে না, জানে না। ফুটবলের বাইরে জীবনটা কেমন তা সে কখনো খোঁজেনি। সোফায় হেলান দিয়ে মুখটা সিলিংয়ের দিকে তুলে জ্যোতি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

.

কিছুদিন পর প্রভাত সংবাদে সাধন নাথের ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছাপা হল। সারথির আঙিনায় বেঞ্চে বসা, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, হাসি—খুশি মুখ, হাতের মুঠো ঘুঁসির মত পাকিয়ে তুলে ধরা। সতর্ক, মাপা কথাবার্তা। তার মূল বক্তব্য মোটামুটি এই রকম—সারথি সঙ্ঘের বিরাট ঐতিহ্য সম্পর্কে আমি সচেতন। আমি যথাসাধ্য করব, ক্ষমতায় যতটা কুলোয় আমি নিজেকে নিংড়ে দেব ক্লাবের সম্মান রক্ষার জন্য, ক্লাবকে আরো বড় সম্মান এনে দেবার জন্য। কিন্তু এ কাজ একার দ্বারা সম্ভব নয়। কোন কোচই তা পারে না। আমি নির্ভর করব প্লেয়ারদের টিম স্পিরিটের ওপর, কর্মকর্তাদের সহযোগিতার ওপর। মেম্বার—সাপোর্টারদের শুভেচ্ছাই হবে আমার প্রেরণা, সব কিছুর উপর আমি চাইব কঠিন পরিশ্রম। প্রপার ওয়ার্ক রেট ছাড়া কোন দলই সফল হতে পারে না, বিশেষত আজকের এই কম্পিটিশনের যুগে। যদি আমরা কঠিন পরিশ্রম করি, সবাই যদি নিজেকে উজাড় করে দিই, তা হলে আমাদের সাফল্য কেউ আটকাতে পারবে না।”

প্রশ্ন ছিল, টিমে কোন অদলবদল করবেন কি না। তাইতে সাধন নাথ, একটু হেসে বলেন, ”এই তো সবে এলাম। আগে আমায় ছেলেদের দেখতে বুঝতে দিন।”

”জ্যোতি বিশ্বাসকে কিভাবে খেলাবেন, কিছু ভেবেছেন কি?”

”কিভাবে খেলাব, মানে?”

”আপনি যে ধরনের মেথডিক্যাল ফুটবল চান, জ্যোতি তো সেরকম ভাবে খেলায় অভ্যস্ত নয়।”

”ক্লাবের স্বার্থে, টিমের স্বার্থে তা হলে তাকে খেলা বদলাতে হবে।” অতঃপর সাধন নাথ এই বিষয়ে আর আলোচনায় রাজি হলেন না।

.

।।নয়।।

সিজনের প্রথম দিন প্র্যাকটিসের সকালে ড্রেসিং রুমে জ্যোতি বুট পরছে তখন রথীন বলল, ”সাধনদা তোকে আগে একবার দেখা করতে বলেছেন।”

”কি জন্য?”

”বলতে পারব না।” রথীন গাম্ভীর্য রক্ষায় ব্যস্ত রইল। সাধন নাথ এসে তার চাকরিটা খায়নি, এ জন্য সে তার প্রতি কৃতজ্ঞ।

এই প্রথম সে সাধন নাথের সঙ্গে একা মুখোমুখি হল। এর আগে ড্রেসিং রুমে অন্য সবার সঙ্গে আরো বেশি ওয়ার্ক রেটের প্রয়োজন সম্পর্কে কথাবার্তা ছাড়া আর তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।

সাধন নাথের ঘরে, যেটা আগে অরবিন্দ মজুমদারের ঘর ছিল, পা দেওয়ামাত্রই, ”কেমন লাগছে তোমার, এখানে?” এমন প্রশ্নের সামনে জ্যোতি পড়ল।

”লাগছে কেমন?” সাধন নাথ আবার বলল।

”আমার তো এখানে সাত বছর হয়ে গেল!”

”আমি যা জিজ্ঞাসা করলাম তার উত্তর দাও।”

”বুঝলাম না।”

”সহজ সরল প্রশ্ন। সাত বছর বলতে কি বোঝাচ্ছ?”

”সোজা স্পোর্টিং ইউনিয়ন থেকে।”

”তুমি অতীতের কথা বলছ আর আমি বর্তমান নিয়ে। কতদিন সারথিতে আছ বা অতীতে কি করেছ তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এখানে আমি যেদিন শুরু করব, সেদিন অন্যদেরও শুরু বলে আমি ধরে নেব। সবাইকেই আমি খুঁটিয়ে দেখলাম, কে কি রকম তাও আমি জানি। একটা কথা প্রথমেই বলে রাখছি, টিমে কারুরই জায়গা বাঁধা নয়। অনেক ঢিলেঢালা জিনিস নজরে পড়েছে, অবশ্য যেভাবে টিম চালান হচ্ছিল তাই থেকেই এসব এসেছে। বৃহস্পতিবার টিম মিটিং, কিন্তু তার আগে তোমার সঙ্গে দু—চারটে কথা বলে নিতে চাই।”

জ্যোতি দাঁড়িয়ে আছে ডেস্কের সামনে। সাধন নাথ তাকে বসতে বলেনি, কথা বলার সময় মুখের দিকেও তাকায়নি। তার উপস্থিতির কোন গুরুত্বই সাধন দিতে চায়নি।

”আমি মিড ফিল্ডে তোমাকে খেলাব। অ্যাটাক আর মিড ফিল্ডের মধ্যে বড় একটা ফাঁক রয়ে গেছে। ওখানেই দেখেছি সারথির মুভগুলো ভেঙে যায়। ওপরে আরো পেনিট্রেশন চাই, কিন্তু সেটা হয় না যেহেতু মিড ফিল্ডে আরো বেশি স্কিমিং দরকার। এখানেই তোমাকে আমি চাই। অসিত চলে গেছে, বাচ্চচুকে আমি অ্যাটাকে আনব, তুমি তার পিছনে থেকে খেলবে, অ্যাটাক তৈরি করাবে, দরকার হলে নিজেও উঠবে।”

”তার মানে আমাকে আপনি হাফ—ব্যাক লাইনে খেলাতে চান?”

”মিড ফিল্ডে, উপর দিকে। এতে তুমি আরো স্কোপ পাবে।”

”আমি মিড ফিল্ডের প্লেয়ার নই।”

সাধন নাথ চোখ তুলে জ্যোতির মুখটা দেখে নিল। চশমাটা খুলে ডেস্কের উপর রেখে চেয়ারে অলস ভঙ্গিতে এলিয়ে পড়ল।

”তুমি সারথির প্লেয়ার, আর যেখানে তুমি সব থেকে কার্যকরী হবে বলে আমি মনে করব, সেখানেই তুমি খেলবে।”

”কিন্তু আমি তো স্ট্রাইকার।”

”তুমি টিমের একজন, আর আমি ঠিক করব টিম সাজানোর ব্যাপারটা।”

”স্ট্রাইকারের পিছনে থেকে কোনদিন খেলিনি, আমি আনকমফর্টেবল ফিল করব অনভ্যস্ত জায়গায়।”

”তা হলে তোমায় আনকমফর্টেবলই থাকতে হবে। এখন থেকে তোমার কাজটা কি হবে সেটাই তোমায় বলে দিলাম।”

”এভাবে আমি কখনো খেলিনি।”

”ওসব অতীতের কথা। কে কবে কী করেছে তাই নিয়ে আমি মাথাব্যথা করতে চাই না। সারথিতে যদি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে চাও, তা হলে যা বলেছি তাই করো। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?”

জ্যোতি বুঝল কথা বাড়িয়ে কোন লাভ হবে না। সাধন নাথ নানান আইডিয়া নিয়ে এসেছে, কিন্তু জ্যোতি জানে তার একটাও খাটবে না। এই ধরনের অদল—বদল আগেও করা হয়েছিল অরবিন্দদার আমলে, আবার বাতিলও করতে হয়েছে। সাধন নাথকেও কাঠ—খড় পুড়িয়ে শেষকালে তা জানতে হবে।

”বেশ, চেষ্টা করে দেখব।”

”চেষ্টা নয়, করতেই হবে।”

”আপনি যখন কোচ, তখন তো করতেই হবে।”

”সেটা মনে থাকে যেন।”

টিম মিটিংয়ে জনাম কুড়ি প্লেয়ার হাজির হয়। তার মধ্যে ছিল শৈবাল, বিপ্লব, পরিতোষ, যাদের আবার সারথিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। গৌতম গত দু বছর অধিনায়ক ছিল। সাধন নাথের পরামর্শে নতুন অধিনায়ক হয়েছে শৈবাল। গৌতম এতে খুশি নয়।

”সিজনের শুরুতে সিংহের মত গর্জন তুলে সিজনের শেষে ভেড়ার মত ব্যা ব্যা করা আমার স্বভাব নয়।” টিম মিটিংয়ে এই ভাবে শুরু করল সাধন নাথ। ”কোন সিদ্ধান্তে আসার আগে সব কিছু ওজন করে, মেপে নেওয়াই আমার রীতি। এতদিন প্র্যকটিসে যা দেখেছি তাতে এইটুকু বুঝলাম সব বিভাগেই শান পড়া দরকার, পালিস দরকার। ডিফেন্সে গলদ দেখা যাচ্ছে, অ্যাটাকেও কিছু পারছি না। এর সিক্রেটটা রয়েছে মিড ফিল্ডে। মিড ফিল্ডে দখল নাও তা হলে ম্যাচও দখলে পাবে। তোমাদের এক—দু’জনকে ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছি কি আমি চাই। একজন মধ্যমণি কিংবা বলা যায় পিভট যাকে কেন্দ্র করে টিমটা ঘুরবে। এটা শৈবালের কাজ, তাই ওকে ক্যাপ্টেন করা হয়েছে। এর আগে গৌতম ক্যাপ্টেন ছিল। কিন্তু মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চিৎকার করে গলা ব্যথা করা ছাড়া গোলকীপার ক্যাপ্টেনের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। রেফারির হুইসল মত খেলবে আর খেলবে শৈবাল যেভাবে খেলাবে।”

জ্যোতি আড়চোখে দেখল গৌতম মুখ নীচু করে জুতোর ডগা দিয়ে মেঝেয় আঁচড় কাটছে আর শৈবাল ক্লাসের ফার্স্টবয়ের মত মনোযোগে সাধন নাথের কথাগুলো শুনছে।

”আর একটা কথা। লক্ষ্য করছি ক্রসফিল্ড পাস আমরা ভালমত কাজে লাগাচ্ছি না। আর একটা জিনিস, ডিফেন্সকে সাহায্য করতে ফরোয়ার্ডরা খুব কমই ফানেল করে নামছে। আমাদের একটা ছক তৈরি করতে হবে জোনাল ডিফেন্সের। আমার মতে, ডিফেন্স আর অ্যাটাক পরস্পরের পরিপূরক, এটা মিলে যায় একটা জায়গায়—মিড ফিল্ডে…”

এইভাবে আরো মিনিট পনের সাধন নাথ কথা বলে গেল। জ্যোতি একটি প্রশ্নও তোলেনি। শুধু মনে মনে বলল, ডেসিং রুমে কথা বলেই যদি ম্যাচ জেতা যায় তা হলে সারথি এবার অবধারিত লিগ চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে।

.

।।দশ।।

প্রথম আটটি ম্যাচে সারথি পাঁচ পয়েণ্ট নষ্ট করল তিনটি ড্র ও ইস্টবেঙ্গলের কাছে এক গোলে হেরে। তাঁবু রক্ষার জন্য এখন পুলিস পাহারা থাকছে খেলার পর। তবে এখনো ইঁটপাটকেল ছোঁড়া শুরু হয়নি। শুধু খেলার পর বাপ—মা—তোলা অশ্রাব্য গালাগালির মধ্য দিয়ে সারথির খেলোয়াড়দের মাঠ থেকে তাঁবুতে ফিরতে হয়। গত ম্যাচে তাঁবুতে ফেরার সময় জ্যোতির মুখে থুথু দিয়েছিল একজন গ্যালারি থেকে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটির পাঁজরে ঘুঁষি মারে। তখন কয়েকজন জ্যোতিকে মারার চেষ্টা করেছিল। ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াত যদি না গৌতম ও শৈবাল তাকে টেনে তাঁবুতে আনত।

পরের ম্যাচ বান্ধব সমিতির সঙ্গে। কিক অফের সময় জ্যোতি দাঁড়াল বাচ্চচুর পিছনে। সমিতির সেন্টার ফরোয়ার্ড কিক অফ করে বল দিল তার ইনসাইড লেফটকে, সে পিছনে ঠেলে দিতেই অভ্যাসমত জ্যোতি পাসটা ধরার জন্য বাচ্চচুর সামনে এগিয়ে ছুটল। তারপরই মনে পড়ল, তার পিছিয়ে থাকার কথা। সঙ্গে সঙ্গে সে পিছিয়ে এল।

পাঁচ মিনিট পর সে প্রথম বল স্পর্শ করল। সারথির হাফলাইনের মাঝখান থেকে বলটা যখন এল সে তখন চোখের কোণ থেকে দেখে নিয়েছে শৈবাল, বাচ্চচু, এবং সত্যমূর্তির সঙ্গে সমিতির ডিফেণ্ডাররা সেঁটে রয়েছে। সমিতির এক ডিফেণ্ডার বল কাড়ার জন্য তার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে জ্যোতি ট্যাকল এড়িয়ে বল নিয়ে ছুট দিল।

পেনাল্টি এলাকার কিনারে তিনজন ডিফেণ্ডার তার অপেক্ষায় পথ আটকে রয়েছে। জটলা এড়াতে, প্রকৃষ্ট উপায় লেফট উইংকে হাই লব করে বল দেওয়া।

”ব্যাকপাস।” জ্যোতি তার পিছনে শৈবালের চিৎকার শুনেই ব্যাক হিল করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পিছন থেকে প্রচণ্ড জোরে নেওয়া শটটা তার ডান কাঁধে লাগল এবং সে মুখ থুবড়ে পড়ল।

”নীচু হবি তো?” তাকে হাত ধরে টেনে তুলে শৈবাল বলল।

”ওখান থেকে কি শট নেয়?” রেগে জ্যোতি বলল।

”সোজা বলটা গোলে যেত যদি তুই মাথাটা ঝোঁকাতিস। গোলি বল দেখারই সময় পেত না।”

হাফ টাইমে সাধন নাথ তাকে বলল, ”বলটা যদি প্রথমেই শৈবালকে দিয়ে দিতে তা হলে এখন এক গোলে এগিয়ে থাকতাম। তুমি অত উঠে খেলছ আবার?”

”ওকে মার্ক করে ছিল, তাই ডিফেন্সকে সরাবার চেষ্টা করেছিলাম।”

”শৈবালকে পিছনে রেখে দিয়েছিলে বলেই গাধার মত ব্যাকপাসটা করতে হল।”

”ও বল চাইল।”

”চাইবে না তো কি করবে? যা খেলছ, সেটা কি ফুটবল ম্যাচ না দাড়িয়া—বান্ধা? এবার একটু বুদ্ধি খরচ করে খেল।”

”আমিই কি শুধু বুদ্ধি খরচ করব?”

”ম্যাচ উইনার তুমিই।”

দ্বিতীয়ার্ধে জ্যোতি যতই পিছিয়ে খেলার চেষ্টা করুক না কেন চুম্বকের আকর্ষণের মত সে এগিয়ে যাচ্ছিল গোলের দিকে। রথীন সাইডলাইনে হাত তুলে লাফাচ্ছে তাকে পিছিয়ে যাবার জন্য। অবশেষে খেলা থামিয়ে রেফারি তার কাছে গিয়ে জানিয়ে এল, আর একবার এমন করতে দেখলে ফেন্সিংয়ের ওধারে তাকে পাঠিয়ে দেবেন।

মিড ফিল্ডে তার কাছ থেকে বল ছাড়া খেলার এবং আক্রমণে তার কোন ভূমিকা নেই এমন আক্রমণ গড়ে তোলার প্রত্যাশা জ্যোতির কাছে করাটাই অবাস্তব ব্যাপার। এটা তার স্টাইল নয়। নেমে গিয়ে এবার খেলা উচিত, এই রকম চিন্তা যখন সে নিজে করে তখনই সে পিছিয়ে এসে খেলতে পারে, নয়তো অন্যের নির্দেশে বাধ্য হয়ে খেলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ভেবে—চিন্তে কাজ ঠিক করে নিয়ে সেটা করা তার দ্বারা হয়ে ওঠে না। অনুভূতির উপর দ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠতে না পারলেই সে গোলমালে পড়ে যায়। পথভ্রষ্টের মত তখন সে নির্দেশের মুখাপেক্ষী হয়।

ডিফেণ্ডার ও অ্যাটাকারের মধ্যবর্তী স্থানই মিড ফিল্ড খেলোয়াড়ের, তার মধ্যে উভয়েরই সম্মেলন, কোনটিতেই পুরোপুরি এককভাবে নয়। জ্যোতি বরাবরই অ্যাটাকার, তার পক্ষে ডিফেণ্ডার হওয়া অসম্ভব, আবার একই সঙ্গে উভয় ভূমিকা পালনেও সে অপরাগ।

সাধন নাথ তাকে এমন জোরে উল্টো দিকে টেনে দিয়েছে যার ফলে তার খেলাটাই ছিঁড়ে গেছে।

”আমি ওপরে উঠছি” শৈবালকে সে বলল, ”বাচ্চচুকে নামিয়ে নাও।”

”সাধনদা যা বলেছে তাই কর।” শৈবাল খিঁচিয়ে উঠল।

”আমি খেলতেই পারছি না, এখন গোল দরকার।”

”ভাল করে বল বাড়া।”

”তুমি কি করছ, দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া?”

”সেটা তোর দেখার কথা নয়।”

সাধন নাথ কি ভাববে, তার পরোয়া না করেই মিড ফিল্ডারের কাজ ফেলে দিয়ে জ্যোতি উপরে উঠে গেল।

একতার লেফট ব্যাকের ঘাড়ে অনেক বোঝা, খেলার শেষ দিকে বোঝাটা আরো বাড়ুক এটা তার অভিপ্রেত নয়। জ্যোতি মিড ফিল্ডে থাকায় সে স্বস্তিতে ছিল। এখন তাকে উঠে আসতে দেখে তার মনে হল সারথি এবার আক্রমণ জোরদার করার মতলব নিয়েছে। খেলায় এখনো একটাও গোল হয়নি। জ্যোতিকে অকেজো করার জন্য কিছু একটা না করলে একতা গোল খেয়ে যেতে পারে।

সুযোগ এল। রেফারি তখন অন্য দিকে তাকিয়ে। জ্যোতি একটা ছুটকো বলের দিকে দৌড় শুরু করেছে। লেফট ব্যাক কুড়ুলের মত জ্যোতির পায়ে লাথি কষাল। পড়ে গিয়েও যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে জ্যোতি লাফিয়ে উঠল, ছুটে গিয়ে বলটা ধরল। তার এই কাণ্ডে বিভ্রান্ত লেফট ব্যাক হুড়মুড়িয়ে জ্যোতির ঘাড়ে পড়ল। এবং তার ডান পা বুট দিয়ে ইচ্ছে করেই মাড়াল।

যন্ত্রণায় অধীর হয়ে জ্যোতি বাঁ পা চালাল লেফট ব্যাকের পায়ের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি পেতে। লাথিটা লাগল তার ডান হাঁটুতে। ”বাবা রে” বলে লেফট ব্যাক হাঁটু ধরে ঘুরে পড়ল।

কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটল। রেফারি প্রায় পনেরো গজ দূরে। পকেট থেকে লাল কার্ড বার করতে করতে তিনি ছুটে এলেন। কার্ডটা সদর্পে মাথার উপর তুললেন জ্যোতির সামনে দাঁড়িয়ে। সারথির খেলোয়াড়রা ছুটে এসে তাকে ঘিরে ধরল। আবেদন, নিবেদন, চোরা খিস্তি, সামান্য ধাক্কা, সব কিছুই রেফারি অগ্রাহ্য করলেন।

”জ্যোতিকেই কিন্তু আগে ফাউল করা হয়েছিল, সেটা তো আপনি…” বাচ্চচু প্রতিবাদ করে। তাকে থামিয়ে রেফারি তর্জন করে ওঠেন, ”তুমিও কি বাইরে যেতে চাও? এইসব বন্ধ করে এক্ষুনি যদি শুরু না কর তা হলে ম্যাচ অ্যাবানডণ্ড করে দেব।”

মাঠভরা লোকের চোখের সামনে, জ্যোতি মন্থর পায়ে বেরিয়ে আসছে। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন শূন্যে টানা দড়ির ওপর দিয়ে চলা। দর্শকরা শুধু তাকেই এখন দেখছে। জীবনে এই প্রথম তাকে মাঠ থেকে বার করে দেওয়া হল।

ফেন্সিং দরজা পেরিয়ে আসতেই তার চোখ ও কানের ক্ষমতা আবার চালু হয়ে উঠল। সে দেখল গ্যালারির মাঝ দিয়ে তাঁবুতে যাবার সরু পথে ক্রুদ্ধ জটলা। অশ্রাব্য গালিগালাজ উড়ে আসছে।

”এটাকে আর নামায় কেন সাধন নাথ! শেষ হয়ে গেছে তো!”

”নামে কাটছে শালা, একসময় খেলেছে, তাই বলে কি চিরকাল চলবে?”

”ব্যাটা পলিটিক্স করছে। ইচ্ছে করে ডোবাচ্ছে। অরবিন্দ মজুমদারের দলের লোক তো, তাই সাধন নাথকে অপদস্থ করে তাড়াবার জন্য প্ল্যান করে এইসব হচ্ছে।”

”খানকির বাচ্চচাটাকে ওই অরবিন্দর সঙ্গেই বিদায় করা উচিত ছিল…ভাবতে পারেন আটটা ম্যাচে এগারো পয়েণ্ট!”

”এ বছরও আর চ্যাম্পিয়ন হবার আশা রইল না।”

জ্যোতি জটলায় বাধা পেল।

”এই যে শুওরের বাচ্চচা, দুটো ম্যাচ বিশ্রাম নেবার ব্যবস্থা করে এলে!”

জ্যোতির মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। কতবার ভক্তদের কাঁধে চড়ে সে এই পথ দিয়েই তাঁবুতে ফিরেছে।

কতবার এই পথেই জড়িয়ে ধরার জন্য ভক্তরা কাড়াকাড়ি করত তার পা নিয়ে।

‘সারথির সারথি…সারথির সারথি…’

দূর থেকে মেঘ গর্জনের মত গড়িয়ে আসত শব্দগুলো। গ্যালারির দিকে তাকিয়ে সে দু হাত মাথার উপর তুলে নাড়ত।

কবেকার কথা?

”বাঞ্চোৎ পলিটিক্স এবার বন্ধ কর, নইলে জ্যান্ত চামড়া তুলে নেব।”

থরথর করে উঠল তার সারা শরীর। জটলা ভেদ করে শ্রান্ত নিজেকে ঠেলে নিয়ে যাবার সময় জ্যোতি পিঠে, পাঁজরে তীক্ষ্ন যন্ত্রণা পেল। মাথায় থাপ্পড়ের আঘাতটা গরম শিকের মত তার স্নায়ুকেন্দ্রে ঢুকে তাকে এলোমেলো বিপর্যস্ত করে দিল।

জ্যোতি টলতে টলতে নির্জন ড্রেসিং রুমে এসে বেঞ্চে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। অক্ষম নির্দয় ক্রোধ তাকে অবশ করে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সে গোঙানির মত একটা শব্দ করে বেঞ্চে মাথা ঠুকতে শুরু করল।

জ্যোতির খুবই পরিচিত একটা আওয়াজ একসময় ড্রেসিং রুমে আছড়ে পড়ল। গোল হল। আওয়াজের বহর থেকে সে বুঝল সারথি গোল করেছে। কিন্তু বিন্দুমাত্র উল্লাস তার মনে জাগল না।

ওরা ফিরে এল। ড্রেসিং রুম মুখর হয়ে উঠল। গোল দিয়েছে শৈবাল। বেঞ্চের একধারে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে জ্যোতি বসে ছিল। শৈবালের হাতটা ধরে সে ঝাঁকুনি দিল। কথা বলল না।

খবরের কাগজের তিন—চারজন লোক ঘরে ঢুকে পড়েছে। তাদের মধ্যে রঞ্জনও আছে।

”জ্যোতি, এই কি প্রথম রেড কার্ড দেখলি?” রঞ্জন জানতে চাইল।

”হ্যাঁ।”

”আরে এইটাই তো কালকের খবর।”

”কি রকম লাগল আপনার যখন কার্ডটা দেখাল।” অল্পবয়সী একজন প্রশ্ন করল।

”তোমাকে দেখালে কি রকম লাগত?”

”রেফারি কি বলল তোমাকে জ্যোতি?”

”বলল গায়ে বড় গন্ধ যাও চান করে এস।”

”অ্যাঁ!”

”বলল চান করে এস।”

”তুমি কি বললে?”

”বললাম, আসুন গায়ে সাবান ঘষে দেবেন।”

রিপোর্টাররা হেসে উঠল।

”রেফারিং সম্পর্কে তোর কোন বক্তব্য আছে?” রঞ্জন প্রশ্ন করল।

”আছে, কিন্তু তা ছাপা যাবে না।”

”বলেই দ্যাখ, ছাপা হয় কি না হয়।”

”মানহানির মামলায় পড়তে চাই না।”

”কি ব্যাপার, এখানে এত ভিড় কিসের। যান, যান, এখন সব যান।”

সাধন নাথ ঢুকল। চোখে—মুখে বিরক্তি।

”আপনারা এখানে কেন? জ্যোতি, একটা কথাও রিপোর্টারদের বলবে না।”

প্রায় ঠেলেই ওদের বার করে দিয়ে সাধন নাথ দরজা বন্ধ করে দিল।

”আমি কিছুই বলিনি।”

”ভাল, কিছু বলে আর কাজ নেই, এমনিতেই তো যথেষ্ট ক্ষতি করেছ।”

”আমি কি ক্ষতি করলাম? কি করেছি আমি?”

সাধন নাথ অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে বলল, ”তুমি কি জান, কি বলছ? কি করেছি আমি? মাঠ থেকে বার করে এনেছ নিজেকে, এটাই তুমি করেছ। নিজেরই মর্যাদা লুটোওনি, ক্লাবেরও মাথা হেঁট করেছ। ভাল কথা, তবে এটাও জেনে রাখ ব্যাপারটা খুব খারাপ হল।”

”আপনি তো দেখেছেন, কিভাবে বল ছেড়ে পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে রইল।”

”হ্যাঁ দেখেছি, কিন্তু তুমি কি লাথি চালাওনি?”

”আমি নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছি। আমাকে পঙ্গু করে ফেলতে চেষ্টা করেছিল।”

”রেফারি তা হলে ওকে কার্ড দেখাল না কেন?”

”আমি তার কি জানি হয়তো টাকা খেয়েছে।”

”হয়তো তুমি রিট্যালিয়েশন আইনটা জান না।”

”অমন ঝাড় খেলে আপনি তখন কি করতেন?”

ঘরের সবাই চুপচাপ। দুজনের কথা কাটাকাটিতে ওদের মাথা গলাবার কোন ইচ্ছাই কারুর নেই। কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে দু—চারটে কথা নিজেদের মধ্যে বলল। কারুর মুখে বিস্ময়, কারুর চোখে মজা।

”রেফারি কিছু অন্যায় করেনি তোমাকে বার করে দিয়ে।”

”আপনি কার পক্ষ নিচ্ছেন?”

”ঠিক এই প্রশ্নটা আমিও তোমায় করছি। তোমাকে নীচে থেকে খেলতে বলেছি তুমি কেন উপরে উঠে গেলে?”

”খেলা আমাকে যেখানে নিয়ে গেছে সেখানেই গেছি।”

”শৈবাল তোমাকে মিড ফিল্ডে থাকতে বলেছিল। তুমি তা অগ্রাহ্য করেছ। আমি দেখেছি ও তোমাকে বলছিল। একলাইনে দুই ইনসাইড চলেছে, একে অপরের সঙ্গে জড়ামড়ি করছে। এ সবই হয়েছে তোমার জন্য।”

”আমি তো বলেই ছিলাম চেষ্টা করব।”

”কিন্তু তা কি করেছ? কি মহৎ ইচ্ছা—চেষ্টা করব। কতক্ষণের জন্য? বড়জোর দশ মিনিট।”

”এভাবে খেলা সম্ভব নয়।”

”এভাবে নয়, বল তোমার দ্বারা সম্ভব নয়। তুমি পারছ না, পার না। তুমি চাও না। তুমি এমন ভাবে খেলাটা তৈরি করতে চাও যাতে ওপরে উঠে খেলতে পার। কিন্তু জেনে রাখ, সেভাবে আমি খেলাতে রাজি নই। কয়েকটা ম্যাচ তো দেখলাম, তা থেকেই বুঝতে পারছি তোমার মনের মধ্যে কি জিনিস কাজ করছে। হয় তোমার ইচ্ছামত খেলা হোক, নয়তো খেলবেই না।”

”আমার ইচ্ছা যা ছিল তা মরে গেছে।”

”তুমি একটা কোচকে হয়তো ম্যানেজ করেছ কিন্তু আমাকে ম্যানেজ করতে পারবে না। আগে কি ভাবে পার পেয়েছ জানি না, কিন্তু আমার কাছে কোন জারিজুরি চলবে না। আমার মত করে খেলতে হবে নয়তো একদমই নয়।”

”আপনি কি থ্রেট করছেন?”

”যদি তাই মনে কর, তা হলে তাই।”

”কিসের থ্রেট, বসিয়ে দেবেন?”

সাধন নাথ কটমটিয়ে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। জ্যোতি তাকিয়ে দেখল হলঘরে রঞ্জন ও কয়েকজন রিপোর্টার দাঁড়িয়ে।

তার অরবিন্দ মজুমদারকে মনে পড়ল। যদি তিনি এখন থাকতেন! যে—কোন অসুবিধায় বা বিপদে তার কাছে অনায়াসে যাওয়া যেত, কথা বলা যেত মন খুলে। উনি প্লেয়ারদেরই লোক ছিলেন। কখনো বেদীর উপর থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন না। সমানে সমানে ছিল ব্যবহার। মন দিয়ে যেভাবে সমস্যার কথা শুনতেন তাতেই ভরসা পাওয়া যেত, স্বস্তি আসত।

অরবিন্দ মজুমদারই সারথিকে ছুটিয়ে টেনে নিয়ে গেছলেন। একজন কোচের পক্ষে যতটা একটা ক্লাবকে তোলা যায়, তা তিনি তুলেছিলেন। এখনো মেম্বাররা অরবিন্দর সফল দিনগুলোর কথা বলে। জ্যোতি আসার কয়েক বছর আগের দিনগুলোকে আজও বলে ‘সারথির সোনালী দিন।’ ওরা চায় সেই আমলের পুনরাবৃত্তি অবিরত হোক। কিন্তু তাই কি কখনো হয়।

অরবিন্দ মজুমদার চলে গেলেও সারথির ভাবমূর্তি এখনো অবিকৃত রয়েছে। এটা ওঁরই তৈরি করা। লিগে প্রথম চারটি দলের মধ্যে সারথিকে দশ বছর ধরে রেখে গেছেন। ‘দৃষ্টিটা সব সময় উপর দিকে নিবদ্ধ রাখবে’ এটাই ছিল তাঁর কথা। প্লেয়ারদের ওপর আস্থা রাখতেন, যথোপযুক্ত শ্রদ্ধাও দিতেন। তাঁর ব্যক্তিগত পরশ থাকত সব কিছুতেই। খবরের কাগজের লোকেদের সঙ্গে কেউ কথা বললে আপত্তি করতেন না। বিশ্বাস করতেন তাঁর খেলোয়াড়রা এমন কিছু বলবে না বা করবে না যাতে ক্লাবের সম্মান নষ্ট হয়।

জ্যোতি ভেবে অবাক হল সাধন নাথ অরবিন্দ মজুমদারের মধ্যে পার্থক্য আকাশ থেকে পাতালের অথচ ফুটবল জগতে দুজনের জায়গা একই স্তরে হল কি করে?

যদি বুঝতাম এই রকম দশায় পড়তে হবে তা হলে ট্রান্সফার নিতাম। জ্যোতি টেণ্ট থেকে বেরোবার সময়ও চিন্তা করে যাচ্ছিল। পিছনের দরজায় সিঁড়ির পাশে তার মোটরবাইকটা থাকে। বাইরে থেকে দেখা যায় না। এখন ঘুষি মারছে, থুথু ছিটোচ্ছে, খিস্তি করছে, কোনদিন হয়তো বাইকটাকে ওরা জ্বালিয়ে দেবে।

কিন্তু সাধন নাথ ড্রেসিং রুমে সবার সামনে এভাবে তার সঙ্গে ঝগড়া করল কেন? কথাগুলো তো আলাদা ডেকে নিয়ে বলা যেত। নাকি বাইরে দাঁড়ান রিপোর্টারদের কাছে যাতে ঝগড়ার কথাটা পৌঁছে যায় সেইজন্য ইচ্ছে করেই সে ঝগড়াটা ঘটাল! এসব খবর পৌঁছে দেবার লোক তো প্লেয়ারদের মধ্যেই আছে। এরপর সাধন নাথ কাগজের লোকেদের কাছে বলতে শুরু করবে, জ্যোতি তার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ নিয়ে কাজ করছে, জনসাধারণের কাছে ক্লাবকে হেয় করছে। জ্যোতির মনে হচ্ছে, তাকে খুঁচিয়ে উত্ত্যক্ত করে, তার মুখ দিয়ে কথা বার করিয়ে আসলে মেম্বার—সাপোর্টারদের তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়াই বোধহয় সাধন নাথের উদ্দেশ্য।

যার তাঁবুর বাইরে, রেলিংয়ের ওপার থেকে চিৎকার করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল তারা চলে গেছে। রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। ময়দানে বেড়াতে—আসা নর—নারীর ভিড় জমছে। বিকেলের ক্ষিপ্ত, উত্তপ্ত ময়দানের মন্থর প্রশান্তি এবার নেমে আসছে। বাইক ঘুরিয়ে নিয়ে জ্যোতি গঙ্গার দিকে রওনা হল। ভিড় ট্র্যাফিকের মধ্য দিয়ে এখনি মেসে ফেরার ইচ্ছে তার নেই। মাথাটা জুড়িয়ে নেওয়া দরকার। এখন যদি অরবিন্দদা থাকতেন।

সে এলোমেলো কিছুক্ষণ ঘুরল। বাইক থামিয়ে খুব ঝাল দেওয়া আলুচাট খেল। একটু পরে চারটে এগরোল ও দু কাপ আইসক্রীম। ঘণ্টা দুই পর মেসে ফিরে সূর্যর কাছে শুনল খবরের কাগজের লোক তার জন্য ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেছিল। জবেদ আর অজিতের সঙ্গে গল্প করে দুটো ডবল ডিমের মামলেট খেয়ে গেছে।

”আজ নাকি অনেক কাণ্ড হয়েছে মাঠ, তোমার সঙ্গে নাকি কোচের ফাটাফাটি হয়ে গেছে!” সূর্য বলল।

জ্যোতি সচকিত হল। আজকের ব্যাপারগুলো নিয়ে নানান ধরনের রটনা যে হবে, তা সে অনুমান করছে। মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার অপমান ও হেনস্থায় প্লেয়ারদের মধ্যে অনেকেই যে খুশি হয়েছে, সেটা বুঝে নিতে জ্যোতিষী জানার দরকার হয় না।

”কে বলল তোমায়?”

”কে আবার আমায় বলবে, শুনছিলুম বলাবলি হচ্ছিল।”

”ওহ।” তারপর জ্যোতি বলল, ”আমি কিছু খাব না। আর কাল বাড়ি যাব? ক’দিন মেসে থাকব না।”

দুটো ম্যাচ বসে যাওয়া মানে এক সপ্তাহ। কি হবে এখানে বাস করে! বাড়িতে অতদিন থাকাটাও বিরক্তির, একঘেয়ে। বরং গোবরডাঙ্গায় বিকাশের বাড়িতে গিয়ে ক’টা দিন কাটিয়ে এলে হয়! ওদের বাগানের ল্যাংড়া আমের স্বাদ সহজে ভোলা যায় না। কিন্তু মুশকিল একটাই, বিকাশের লেখার বাতিকটা। সে নানান ম্যাগাজিনে এক সময় তাকে নিয়ে লিখেছিল ‘নতুন তাজা আদর্শ ও রোমাঞ্চের খোঁজে ব্যস্ত আধুনিক যুবমানসের প্রতিভূ জ্যোতি বিশ্বাস।’ যে নাকি ‘তার প্রজন্মের স্বপ্নকে রূপায়িত করছে তার খেলার মধ্য দিয়ে।’

অন্ধকার ঘরে বিছানায় এপাশ—ওপাশ করতে করতে জ্যোতির চোখের সামনে ভেসে উঠছে গ্যালারিতে এবং সরু পথটায় দেখা মুখগুলো। কি তীব্র ঘৃণা! এমন ঘৃণার সামনে সে জীবনে কখনো পড়েনি। এ সবই তৈরি হয়েছে তার ক্রমান্বয় ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করেই। বছর বছর প্রতিটি ম্যাচেই তাকে ভাল খেলতে হবে, গোল করতে হবে, এই ওদের ইচ্ছা বা দাবী। গাধা! নির্বোধদের খুশিতে ডগমগ করে রাখার জন্যই কি সে ফুটবল খেলছে?

কিন্তু একটা সময় গেছে যখন সে ক্লাব অনুগামীদের খুশি করেছে প্রতি ম্যাচে। তখন সে ভাবেওনি, যেদিন তা পারবে না সেদিন কি করবে?

বিকাশ একবার রেডিওর ‘যুববাণী’ প্রোগ্রামে তার ইণ্টারভিউ নিয়েছিল। প্রশ্ন করেছিল, ‘যদি আপনি ফুটবল খেলোয়াড় না হতেন তা হলে কি করতেন?’ সঙ্গে সঙ্গে সে জবাব দিয়েছিল, ‘কিছু না’। ‘কিছু না’? ‘যদি ফুটবল না খেলতাম তা হলে অন্য কিছু করবার ইচ্ছাই আমার হত না।’

এখন তার মনে হচ্ছে একমাত্র টাকা পাওয়া ছাড়া ফুটবল থেকে সে কিছুই পায়নি। নিজেকে তার পরিপূর্ণ ভরাট মনে হচ্ছে না। গভীর আনন্দ জীবনের পাত্রটি থেকে উপচে পড়ছে বা হৃদয়ের অন্তস্থলে আশ্রয় নেবার মত প্রশান্তির কোন ছায়া, কিছুই তার চোখে পড়ছে না। রাস্তার একটা মাস্তানের যে মর্যাদা, তার বেশি আর কিছু নিজেকে সে দিতে পারছে না।

বিপিন স্যারের যে কথাগুলো স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা অহরহ সে করে, ঘুরে ঘুরে সেগুলো তাকে মাকড়সার জালের মত ঘিরে নেয়।

‘তোমার সাধনার দ্বারা তুমি কি মানুষকে ভালবাসার পথে, মঙ্গলের পথে নিয়ে যেতে পেরেছ?’

যে মুখগুলো আজ বিকেলে ঘৃণায় দুমড়ে মুচড়ে গেছল সেগুলো কার সৃষ্টি? স্যারকে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে সেদিন বলেছিল, ‘যদি মাঠে যান তা হলে দেখতে পাবেন।’ কি দেখতে পাবেন? তাঁর ছাত্র, মানুষদের কতখানি শান্তি, সম্প্রীতি, স্পোর্টসম্যানশিপের স্তরে তুলে দিয়েছে?

.

পরদিন সকালে প্রভাত সংবাদের খেলার পাতায় প্রথমেই দু লাইন, তিন কলাম হেডিংটায় জ্যোতির চোখ আটকে গেল। ‘মাঠের ভিতরে লাল কার্ড, মাঠের বাইরে রক্তচক্ষু দেখলেন জ্যোতি।’

এরপর স্টাফ রিপোর্টার শুরু করেছে—”সারথির একদা নামী ও দামী স্ট্রাইকার বর্তমানে মিড ফিল্ডার জ্যোতি বিশ্বাস মঙ্গলবার দমদম একতার লেফট ব্যাক সুব্রত বসুকে বিশ্রিভাবে লাথি মারায় তাতে লাল কার্ড দেখান। মরশুমের শুরু থেকেই ব্যর্থ জ্যোতি যখন মাঠ থেকে বেরিয়ে আসছেন তখন কিছু সদ্যস্যের হাতে তিনি লাঞ্ছিত হন। খেলার পর ড্রেসিং রুমে কোচ সাধন নাথের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় একসময় প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছেছিল। কিন্তু সাধন নাথ তা অস্বীকার করে বলেন, ‘জ্যোতি এখনো সারথির অ্যাসেট, সব খেলোয়াড়ের জীবনেই ফর্ম হারানোর একটা পালা আসে। মনে হয় ও নিয়মিত প্র্যাকটিস করে ফর্মে ফিরে আসবে।’ কিন্তু ক্লাবের এক কর্মকর্তা (নামপ্রকাশে বারণ করেছেন) বললেন, জ্যোতি প্রথম থেকেই সাধন নাথের সঙ্গে অসহযোগিতা করে আসছে। প্র্যাকটিসে সিরিয়াস নয়। তাকে মিড ফিল্ডে খেলানোর জন্য সে কোচের বিরোধিতা করে যাচ্ছে এবং কোচকে ভুল প্রমাণের জন্য নিজের খেলা খেলছে না। ক্লাব কমিটি জ্যোতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার কথা ভাবছে।’

”বেশি রাতে সারথির মেসে জ্যোতির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। সে মাঠ থেকে তখনো ফেরেনি। তবে কয়েকজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, টিমের কেউই তার খেলা সম্পর্কে আর ভরসা রাখেন না। একজন তো বললেনই, ‘টাকা দিয়ে সাদা হাতি পোষা হচ্ছে। জ্যোতি বিশ্বাস আগের খেলা ভুলে গেছে। এখন হাত পা ছুঁড়ে মাঠে ভয় দেখায়। সারথির পয়েণ্টগুলো তো অপোনেণ্ট নেয়নি, নিয়েছে জ্যোতি।’ আর একজন বললেন, ‘এতকাল ওকে যারা মাথায় তুলে নেচে এসেছে এখন তাদের ভুল ভাঙছে। ফুটবল একজনের খেলা নয়।’ গোটা সারথি শিবিরই এখন জ্যোতি সম্পর্কে হতাশ এবং সমর্থকরাও।”

এরপর রয়েছে ড্রেসিং রুমে তার সঙ্গে সাধন নাথের কথাবার্তার প্রায় নিখুঁত বিবরণ। এমনভাবে সাজিয়ে লেখা হয়েছে যাতে জ্যোতিকে উদ্ধত ও অবাধ্য বলে মনে হয়। সাফল্যের জন্য সাধন নাথের চেষ্টা যে কত আন্তরিক এবং তা বানচাল করার জন্য জ্যোতির তরফে যে আগ্রহ রয়েছে সেটাও চাপাভাবে বিবরণ থেকে ফুটে উঠেছে।

ঘুলিয়ে উঠল জ্যোতির শরীর। আস্তাকুঁড়ের এঁটোকাটা যেন এতক্ষণ সে চিবোচ্ছিল। কাগজটা হাত থেকে পড়ে গেল মেঝেয়। তোলার চেষ্টা করল না। ‘কয়েকজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলে’! রঞ্জন কাদের সঙ্গে কথা বলেছে সেটা খোঁজ করে বার করে ফেলা যায়। কিন্তু জেনে কি লাভ হবে? এ ধরনের বলাবলি ইদানীং অনেকেই করে, তার কানেও আসে। অগ্রাহ্য করেছে। এই রিপোর্টও অগ্রাহ্য করবে কিন্তু সারথির হাজার হাজার পাগল সাপোর্টাররা কি এসব অগ্রাহ্য করবে? ছাপার অক্ষরে মিথ্যা কথা বেরোতে পারে না, এটাই তো ওরা বিশ্বাস করে!

অবসন্ন লাগছে নিজেকে। চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিজের সম্পর্কে তার ভয় হচ্ছে হয়তো তার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। জ্যোতির মনের মধ্যে অস্পষ্ট ক্ষীণ একটা কাতর কণ্ঠের স্বর অতীত থেকে ভেসে আসছে—”আমার কি হবে?’ সেদিনও তার এইরকম অবস্থা হয়েছিল। মনে হয়েছিল পাগল হয়ে যাবে। সেদিন সে বাড়ি ছেড়ে, টিটাগড় ছেড়ে পালিয়ে গেছল। এবারও কি তাকে পালাতে হবে? কিন্তু কোথায় যাবে সে?

।।এগারো।।

জ্যোতি দু সপ্তাহ মেসে আসেনি। সারথির লোক টিটাগড়ে গিয়ে তাকে পায়নি। দশ দিন আগে সে বাইক রেখেই বেরিয়েছে। বলে গেছে মালদা, কৃষ্ণনগর, গোবরডাঙ্গা হয়ে ফিরবে। বাইকে চলাফেরা আর নিরাপদ নয় ভেবেই সেটা রেখে গেছে। বাংলার গ্রামের দিকে সারথির সাপোর্টাররা একটু বেশিমাত্রায় খবরের কাগজকে বিশ্বাস করে। বাইক আটকে তাকে উত্তপ্ত করে মেজাজ নষ্ট করতে পারে।

বাড়িতে ফিরে খবর পেয়ে জ্যোতি মেসে ফিরল। তার জায়গায় মিড ফিল্ডে অজিতকে আর নতুন একটি ছেলেকে খেলান হয়েছে। চারটি খেলায় আরো এক পয়েণ্ট গেছে। তেরো খেলায় মোট ছয় পয়েণ্ট হারিয়ে সাধন নাথ এখন চিন্তার মধ্যে। যত ঢাক—ঢোল পিটিয়ে এবং আশা জাগিয়ে শুরু হয়েছিল তার সিকি ভাগও পূরণ হয়নি। সারথি যে’কটা ম্যাচ জিতেছে তাতে খেলা দেখে গ্যালারির দর্শকরা খুশি হয়নি, স্বস্তি পায়নি।

লিগ চ্যাম্পিয়ান কেন, চতুর্থ স্থানে আসার সম্ভাবনাও আর নেই। এখন সমর্থকদের মনে শুধু একটাই বাসনা তীব্র হয়ে উঠেছে। যুগের যাত্রীকে হারাতেই হবে।

ডেসিং রুমে জ্যোতির সঙ্গে কথা বলায়, গৌতম ছাড়া আর কেউ উৎসাহ দেখাল না। সে লক্ষ্য করল, সবার মধ্যেই কেমন গা—ছাড়া ভাব। দু’দিন পরেই যাত্রীর সঙ্গে খেলা কিন্তু কেউই তাই নিয়ে ভাবছে না। গত বছর যাত্রী তাদের এক গোলে হারিয়েছিল?

”বাচ্চচুদার বিয়ে কি সেই মেয়েটার সঙ্গেই ঠিক হল?” গৌতম জানতে চাইল।

”তবে আবার কার সঙ্গে ঠিক হবে!” বিপ্লব বিস্ময় প্রকাশ করল। ”সাত বছর ধরে বাচ্চচু লেগে আছে। কম ঝামেলা করেছে মেয়ের বাপ? ফুটবল প্লেয়ারের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে কিছুতেই দেবে না ঠিক করেছিল। সাধনদা, চঞ্চলদা কথা বলে রাজি করিয়েছে।”

”বাচ্চচু তো এখনই প্রতিজ্ঞা করেছে, ছেলে হলে কবাডি প্লেয়ার বানাবে তবু ফুটবলার কিছুতেই নয়।”

”ওরে বাবা এখনই ছেলের কথা ভাবছে! আরে আগে বিয়েটা হোক, বৌকে নিয়ে…” বিপ্লব চোখ মারল সারা ঘরের উদ্দেশ্যে।

অরবিন্দ মজুমদারের আমলে ড্রেসিং রুমে এই ধরনের রসিকতা হত না। জ্যোতি মুখ ফিরিয়ে রথীনের দিকে তাকাল। অপ্রতিভ রথীন চেঁচিয়ে উঠল, ”আর দেরী নয়, সাধনদা মাঠে চলে গেছে। হারি আপ।”

এই সকালেই মাঠের ফেন্সিংয়ের ধারে, গ্যালারিতে জনা পঞ্চাশ ছেলে প্র্যাকটিস দেখতে এসেছে। তাদের মধ্যে খবরের কাগজেরও একজন রয়েছে। শৈবালের সঙ্গে সে কথা বলছিল পরশুর ম্যাচ সম্পর্কে। পাশ দিয়ে যাবার সময় জ্যোতি শুনতে পেল—”নতুন কি আর বলার আছে। ভাল তো খেলতেই হবে। নিজেদের খেলা খেলতে পারলে ম্যাচ আমরা বার করে দেব।”

জ্যোতির মনে হল শৈবালের কথার মধ্যে আত্মবিশ্বাসটাই যেন ঝিমিয়ে রয়েছে। নেহাত বলতে হয় তাই বলা। জবেদের মাসল পুল, পরিতোষের জ্বর। ওরা খেলতে পারবে না।

”ওয়ার্ক রেট অনেক কমে গেছে, উন্নতি ঘটাতে হবে।” সাধন নাথ সবাইকে দাঁড় করিয়ে প্রথম কথা বলল। শুক্রবারের ম্যাচ আমাদের জিততেই হবে। না জিততে পারলে জেনে রেখ, গড়ের মাঠে আমাদের আর পা দিতে হবে না, হাড়গোড়ও আস্ত থাকবে না। আর সব খেলার হারি বা জিতি তাতে এমন কিছু যায় আসে না, কিন্তু এই ম্যাচটা আমাদের চাই—ই, হাজার হাজার সাপোর্টার তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে…”

সাধন নাথ একটানা বলে যাচ্ছে। জ্যোতি তখন পায়ের বলটা নাড়াচাড়া করছিল। সেটা লক্ষ্য করে সাধন হঠাৎ কথা বন্ধ করে বলল, ”এবার দৌড় শুরু করা যাক। প্রথমে মাঠে কুড়ি পাক তারপর বেরিয়ে রেড রোড ধরে যেমন দৌড়ও।”

জ্যোতি বুঝে গেছে, সাধন নাথের বিশ্বাস ফিটনেসই হল আসল জিনিস। সে ধরেই রেখেছে, বল নিয়ে যা কিছু করার জন্য যে স্কিল দরকার খেলোয়াড়দের মধ্যে সেটা তো থাকবেই। বল কণ্ট্রোলের জন্য প্র্যাকটিসকে সে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু মনে করে না। কেউ যদি বলকে আপনা থেকেই কণ্ট্রোল করতে না পারে তা হলে তার ফুটবল খেলাই উচিত নয়। আর সব কিছুর মূলে রয়েছে এনডিওরেন্স। গতি না কমিয়ে টানা নব্বই বা সত্তর মিনিট যদি খেলোয়াড়রা দৌড়তে পারে তা হলে ম্যাচ জেতা হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া যায় শুরুর আগেই। ম্যাচ জিততে না পারলে সাধন নাথ প্রথমেই বলে, ‘ট্রেনিংয়ে ঢিলেমি দেওয়ার ফলটা পেলে তো।’ তারপর তার প্রিয় বাক্যটি বলবে, ‘ওয়ার্ক রেট আরো বাড়াতে হবে।’ কিন্তু কোন খেলোয়াড়ই নিশ্চিত ভাবে জানে না ওয়ার্ক রেট বলতে কি বোঝাতে চায়। তবে এই ধারণাটুকু তাদের হয়েছে যে না—থেমে দৌড়নর সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।

একবার দৌড়তে দৌড়তে গৌতম বলেছিল, ‘যে রেটে ছোটাচ্ছে তাতে তো ওলিম্পিক ম্যারাথনে কোয়ালিফাইট করে যাব!’ ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ম্যাচের আগে দু মাইল দৌড়ের পর দু মিনিটের জন্য বিশ্রামের সময় সে বলেছিল, ‘শুধুই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব না হয়ে মোহনবাগানের মত অ্যাথলেটিক ক্লাব যদি হতো, তা হলে ফুটবল ম্যাচের বদলে অ্যাথলেটিক কম্পিটিশন করলে আমরা নির্ঘাৎ জিতে যেতাম।’

দৌড়ের পর, পার্টি করে খেলা, তারপর কিছু শুটিং প্র্যাকটিস সেরে ওরা যখন তাঁবুতে ফিরল তখন দাশুদা অপেক্ষা করছে জ্যোতির জন্য।

”যাত্রীর ম্যাচটায় তুই খেলছিস।”

জ্যোতিরও মনে হয়েছিল, তাকে নামতে হবে। সাধন নাথ যতই অনিচ্ছুক থাকুক, তাকে না নামিয়ে আর উপায় নেই। টিম এখন ছন্নছাড়া অবস্থায়, ইনজুরি আর অসুখে আরো কাহিল হয়ে পড়েছে। রিজার্ভে এখন কেউ নেই যাকে এই ম্যাচে নামান যায়।

”মিড ফিল্ডে খেলতে হবে?”

”হবে! যা বলছে তাই কর।”

”দাশুদা অনেকবার বলেছি, আমাকে আমার জায়গায় খেলতে দিন। ব্যাণ্টাম ওয়েটকে যদি বলেন, এখন থেকে তুমি হেভিওয়েট তা হলেই কি সে হেভিওয়েট হয়ে যাবে?”

”তোর যা ট্যালেণ্ট তাতে তুই সব জায়গায় খেলতে পারিস।”

”হ্যাঁ এই ট্যালেণ্টটাই এখন সাধন নাথের দরকার।”

”যাক ওসব কথা, আজ সন্ধেবেলায় আসছিস।”

অর্থাৎ ওর ফ্ল্যাটে। বীয়ার খাওয়ার বা ব্লু ফিল্ম দেখার জন্য?

”না, সময় নেই।”

জ্যোতি দ্রুত স্নানের ঘরের দিকে চলে গেল।

.

এত লোক খেলা দেখতে আসবে জ্যোতি তা ভাবেনি। সবুজ গ্যালারিতে তিল ধারণের জায়গা নেই। যাত্রীর আর সারথির পতাকা আন্দোলিত হচ্ছে গ্যালারিতে অন্যান্য বছরের থেকে এবারের টেনশন অনেক বেশি। দুটি দলেরই সমান খেলায় সমান পয়েণ্ট। তৃতীয় স্থানের জন্য লড়াই এবং আজকের খেলাতেই সেটা স্থির হয়ে যাবে।

সারথির ড্রেসিং রুমেও টেনশন। কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলছে না। সাধন নাথ থমথমে মুখ দিয়ে নিজের ঘরে। মাঠের গুঞ্জন ঘরে আসছে। শৈবাল জানলা বন্ধ করে দিল। জবেদ উঠে গিয়ে জানলা খুলে দিল।

”খুললি কেন?”

”গরম লাগছে।”

”লাগুক।” শৈবাল শব্দ করে পাল্লা বন্ধ করল।

”না, খোলা থাকবে।” জবেদকে হঠাৎ হিংস্র দেখাল।

জ্যোতি চুপ করে হোজ পরতে পরতে দেখছে দু’জনের ব্যাপারটা। টেনশনের প্রকাশ এভাবেই ঘটে। সে নিজেও শান্ত নেই। একটা ঝাঁঝালো অবস্থা তার মধ্যেও তৈরি হচ্ছে।

পাশ থেকে অজিত বিড়বিড় করল, ”আমাকে রাখতে হবে ওদের লেফট উইংটাকে। নতুন ছেলে, খুব ফাস্ট।…সাধনদা বলেছে না পারলে মাঠের বাইরে চালান করতে।”

”মারবি?”

”তা ছাড়া আর কি করব।” অজিত মাথা নীচু করে বুটে ফিতে পরাতে লাগল।

হঠাৎ একটা গোলমালের শব্দ ভেসে এল। একটু পরেই ঘরে ঢুকল চঞ্চল মৈত্র।

”সবুজ গ্যালারিতে মারপিট শুরু হয়ে গেছে। বোতল, ইঁট চলছে, সারথি সাপোর্টার কয়েকজনের মাথা ফেটেছে। ওর বদলা চাই।” চঞ্চল দু হাত ঝাঁকিয়ে প্রায় উন্মাদের মত চিৎকার করে উঠল। ”এর শোধ তোরা নিবি। আমাদের লোক মার খাচ্ছে, তোরা যদি মানুষের বাচ্চচা হোস, যদি মায়ের দুধ খেয়ে থাকিস তা হলে আজ জিতে ফিরে আসবি।”

সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। জ্যোতির গলা শুকিয়ে আসছে। থরথর করে হাতের আঙুল কেঁপে উঠল। ম্যাচ শুরুর আগেই মারামারি, রক্তারক্তি। এটা ভাল লক্ষণ নয়। সারা মাঠ যে কি টেনশনে রয়েছে, তারই প্রমাণ এইসব।

ম্যাচে জিততেই হবে। নরখাদক বাঘ গুড়ি মেরে অপেক্ষায় রয়েছে সারা মাঠ ঘিরে। তীক্ষ্ন নজরে তার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করে যাবে।

আগের ম্যাচের কথা মনে পড়ল তার। জ্যোতি বিশ্বাস ইচ্ছে করে ক্লাবকে ডোবাচ্ছে,…পলিটিক্স করছে…ক্লাব সাদা হাতি পুষছে…যারা মাথায় তুলে নেচেছে এখন ভুল ভাঙছে তাদের…নিজের খেলা খেলছে না,…জ্যান্ত চামড়া তুলে নেব।

তার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে সে দু—তিন মিনিটের বেশি আর দৌড়তে পারবে না। পা দুটো ভারী লাগছে। শট নেবার জন্য পা বোধহয় তুলতে পারবে না।

কে একজন এসে কপালে সিঁদুর লাগিয়ে দিল। কিন্তু কালিঘাটের কালী কি এখন তার ঝাপসা চোখ পরিষ্কার করে দিতে পারবেন? সে কিছুই তো দেখতে পারছে না।

”সবাই রেডি।” সাধন নাথ দরজায় এসে দাঁড়াল। ”যা বলার তাতো বলেই দিয়েছি। মাঠে আজ দারুণ টেনশন। তোমরা রিল্যাকসড থেকে খেলে যাও।”

তাঁবু থেকে সবার সঙ্গে বেরিয়ে জ্যোতি মাঠের দিকে এগোল। সারথিকে দেখামাত্র ক্র্যাকার ফাটিয়ে অর্ধেক মাঠ গর্জন করে উঠতেই তার চটকাটা ভাঙল। হঠাৎই বুকটা তার কেঁপে উঠল। এই গর্জনটায় সে অভ্যস্ত, তাকে মধুর উত্তেজনায় ভরিয়ে দেয় এই বিশাল ধ্বনিপুঞ্জ। সে জানে এই গর্জন তার জন্যই, বিরাট প্রত্যাশা লুকিয়ে থাকে এর আড়ালে যেটা ঝলসে ওঠে তার কাছ থেকে গোল পাবার পর।

কিন্তু এখন সে ভয় পেল। এই গর্জন তাকে স্বাগত জানাতে হয়নি। আহত ক্রুদ্ধ একটা নরখাদক শিকারের উপর লাফিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে যে গর্জন করে, এটা তাই।

”ভগবান, আজ যেন খেলতে পারি।”

মনে মনে জ্যোতি বলল এবং জীবনে এই প্রথমবার। ভগবানে বিশ্বাস তার কখনো ছিল না। অরবিন্দদার একটা কথা মনে পড়ছে তার। ‘যেভাবে খেললে তুই স্বচ্ছন্দ বোধ করবি, সেই ভাবেই খেলবি। আর কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাবি না।’

কিন্তু চারপাশে এখন কি হচ্ছে? কিভাবে স্বচ্ছন্দ বোধ করব? আমাকে সাধন নাথ চেপে, কুঁকড়ে, পিষে দিয়েছে। কোথায় আমার স্বাধীনতা? কোথায় আমার গতি? এসপার—ওসপার মনোভাব? হঠাৎ ঝলসানি দেওয়ার ইচ্ছা? মনের সঙ্গে তাল রেখে শরীর কেন আর চলে না?

রাগে ক্ষেপে উঠছে? জ্যোতির এবার চোয়াল শক্ত হল। রগের কাছটায় টিপটিপে ব্যথা জমছে। সাধন নাথের মুখের দিকে সে তাকাল মাঠকে প্রমাণ করে নামার আগে। এই লোকটা কিংবা এই গর্জন কিংবা এই বেইমান সাপোর্টাররা সবাইকে সে শিক্ষা দেবে। বুঝিয়ে দেবে জ্যোতি বিশ্বাস মরে যায়নি।

খেলা দু মিনিট না গড়াতেই জ্যোতি বুঝে গেল আজ সে পাহারায় রয়েছে। যাত্রীর অসিত আজ তাকে খেলতে দেবে না। নিশ্চয় কোচের নির্দেশেই সে জ্যোতির দু গজের বাইরে নিজেকে রাখছে না। অসিত ঝগড়া করে সারথি ছেড়ে গেছে। প্রতিশোধ নেওয়ার জেদ তাকে ক্ষেপিয়ে রেখেছে। জ্যোতিকে অকেজো করার দায় তার উপরই পড়েছে এবং অসিত তাতে অখুশি নয়।

আজ ফরোয়ার্ডদের খেলানোর দায়িত্ব, আক্রমণ তৈরি করে দেওয়ার কাজ জ্যোতির। প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল অসিত তাকে বল ছুঁতে দেয়নি। ছায়ার মত সঙ্গে লেগে রয়েছে।

গ্যালারিতে যাত্রীর গর্জন আর সারথির হতাশা খেলার মাঠ ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছে। শৈবাল খিঁচিয়ে হাত নেড়ে জ্যোতিকে গালাগাল দিল। জ্যোতি না শোনার ভাণ করল।

অবশেষে পিছন থেকে পাওয়া একটা বল সেণ্টার লাইনের কাছে ধরে সে অসিতকে টলিয়ে দু পা এগোতেই অসিত তাকে ট্রিপ করে ফেলে দিল। নিজেই ফ্রি কিক নিয়ে ডান দিকে বিষ্ণুকে দিয়ে, বলটা ফেরত পাবার আশায় সে সামনে দৌড়ল, পাশাপাশি অসিতও। বিষ্ণু উঁচু ক্রস পাঠাল, বলটা মাথায় নেবার জন্য জ্যোতি লাফাতেই অসিত কনুই দিয়ে পাঁজরে মারল। বুক চেপে সে বসে পড়ামাত্র যাত্রীর স্টপার বলটা পেয়ে মাঝ মাঠে পাঠাল।

”আমাকে টাইট মার্কিংয়ে রেখেছে…কি করব…মূর্তিকে আমার পাশে খেলতে বল।” জ্যোতি ছুটে গিয়ে শৈবালকে বলল।

”সাধনদা যা বলে দিয়েছে…তুই যেভাবে পারিস চালিয়ে যা। আর একটু নেমে খেল।”

জ্যোতি আরো তিনবার বল ধরে এগোন মাত্র অসিত তাকে ফেলে দিল। রেফারি দুবার তাকে হুঁশিয়ার করে অবশেষে অসিতকে হলুদ কার্ড দেখালেন।

গ্যালারিতে চিৎকার, বিদ্রূপ এবং গালিগালাজ শুরু হল। বল সাইডলাইনের বাইরে যাওয়ায় থ্রো ইনের জন্য বলটা কুড়োতে গিয়ে জ্যোতির চোখ দর্শকদের উপর পড়ল। খালি গায়ে, দু হাত ঝাঁকিয়ে উন্মাদের মত চাহনি নিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে। ঠোঁটের কষে গ্যাঁজলা। এক কিশোর টলতে টলতে ছুটে গ্যালারির ভিড় ঠেলে নেমে এসে কাঠের বেড়ায় কপাল ঠুকতে লাগল। বলটা কুড়িয়ে সে একবার পিছনে তাকাল। কপাল থেকে রক্ত ঝরছে।

হাফ টাইমে খেলা গোলশূন্য।

”হয় আমাকে বসিয়ে দিন নয়তো অন্য কোথাও খেলান।”

সাধন নাথ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন জ্যোতির দিকে।

”অসিতকে তুমি ছাড়াতে পারছ না, এটা আমায় বিশ্বাস করতে হবে? তোমার নখের যুগ্যি ও নয়।”

”আপনি বলতে চান অসিত কোন প্লেয়ারই নয়, ও খেলতেই জানে না?”

”অসিত তোমার খেলা নষ্ট করছে, কেন তুমি কি ওর খেলাটা নষ্ট করতে পার না? আসলে তুমি চেষ্টাই করছ না। শুনেছ, গ্যালারিতে কি বলছে তোমার সম্পর্কে?”

জ্যোতির স্নায়ু এবং হৃৎপিণ্ড একই সঙ্গে ঝাঁকুনি খেল। পেশিগুলো টানটান হয়ে উঠল। মাথা নীচু করে বসে রইল মাঠে নামা পর্যন্ত।

অসিত প্রথমার্ধের মত একইভাবে তাকে পাহারা দিতে লাগল। সে নিজে খেলছে না, জ্যোতিকেও খেলতে দিচ্ছে না এবং সারথির সমন্বয় বা সংগঠন এর ফলে ক্রমশ বাঁধন ছেঁড়া এলোমেলো হতে শুরু করল। ম্যাচটা যাত্রীর মুঠোয় ধীরে ধীরে এসে গেছে। পেনাল্টি এলাকায় অবিরাম চাপ তৈরি হচ্ছে। যে—কোন সময় সারথি গোল খেয়ে যেতে পারে।

যাত্রীর সমর্থকদের উল্লাস এবং রণহুঙ্কার একটানা বয়ে চলেছে। সারথির ডিফেন্স তছনছ। আটজনে উঠে এসে ওরা ঘিরে ধরেছে, নয়জনে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় জবেদের একটা ক্লিয়ারেন্স ছিটকে সোজা এল বাঁদিকে জ্যোতির পায়ে। অসিত একটু দূরে। যাত্রীর গোল প্রায় ষাট গজ দূরে। সামনে বাধা শুধু একজন স্টপার।

বল নিয়ে জ্যোতি দৌড়ল। কয়েক মুহূর্তের জন্য গ্যালারি নিস্তব্ধ রইল অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটায়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে জ্যোতি মোক্ষম মারণাস্ত্রের মত নিখুঁত। কি হতে যাচ্ছে বুঝে উঠতেই সারথির সমর্থকরা কলজে ফাটানো চীৎকার করে উঠল।

অসিত তাকে তাড়া করেছে। স্টপার বুঝতে পারছে না চ্যালেঞ্জ দিয়ে এগোবে, না আর একটু পিছিয়ে ট্যাকলে যাবে। সে হাফ লাইনের কাছে জ্যোতির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তৈরি হয়ে রইল।

কাছাকাছি হয়ে জ্যোতি ডজ করার ঝুঁকি আর নিল না। বলটা স্টপারের পাশ দিয়ে ঠেলে দিয়েই তাকে পাশ কাটিয়ে সে বোরোতে দেখল সামনে শুধু গোলকিপার। অবধারিত গোল হচ্ছে জেনে গ্যালারিতে ক্র্যাকার ফাটল।

জ্যোতি বলটাকে আবার দখলে আনতে পায়ে সবেমাত্র ছুঁয়েছে সেই সময় অসিত পিছন থেকে শেষ চেষ্টা করল তার পায়ের গোছে লাথি মেরে। হুমড়ি খেয়ে জ্যোতি মুখ থুবড়ে পড়ল এবং অদ্ভুত এক ব্যাপার করে বসল। লাফ দিয়ে উঠে বলটা আবার আয়ত্তে আনার বদলে সে ছুটে গিয়ে জমিতে পড়ে—থাকা অসিতের বুকে লাথি কষাল।

সারা মাঠ স্তম্ভিত। ছুটে এল দু দলের কয়েকজন ঘুঁষি তুলে। তাদের বাধা দিতে ছুটে এল কয়েকজন। জটলা এবং ধস্তাধস্তির মধ্যে রেফারি লাল কার্ড তুলে দু’জনকে দেখালেন।

এই সময়ই দেখা গেল গ্যালারির একদিকে কি যেন ঘটছে। পরপর তিনটে ক্র্যাকার ফাটল। একদল লোক দিশেহারা হয়ে হুড়মুড় করে নীচে নেমে আসছে। খালি গায়ে ঝাকড়া চুল একজন একটা ছুরি হাতে এলোপাথাড়ি ডাইনে বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে। গ্যালারির ওইদিকের অংশটা দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। মাটিতে গাদাগাদি, ভয়ার্ত চিৎকার। সবাই দরজার দিকে যাবার চেষ্টা করছে।

মাঠে খেলা শুরু হয়ে গেছে। শেষ হতে ছয় মিনিট তখনো বাকি। দেখা গেল, গ্যালারি ও মাঠের মাঝখানে কাঠের বেড়ার উপরের কাঁটাতার টেনে নামিয়ে ফেলছে কয়েকজন লোক। কয়েকটা দেহ বেড়ার ওধার থেকে ধরাধরি করে নামিয়ে দেওয়া হল মাঠের ধারে। পুলিশ ঢাল আর ব্যাটন নিয়ে গ্যালারিতে উঠে এলোমেলো পিটোতে শুরু করেছে।

শেষ হুইশল বাজার আগেই জ্যোতি তাঁবুতে চলে এসেছিল। আজ সে ফেরার সময় কোন জনতার সামনে পড়ল না। ড্রেসিং রুমে সে একাই বসেছিল। দেয়ালে ঠেশ দিয়ে চোখ বন্ধ করে সে ঘটনাটা মনে মনে আবার তৈরি করার চেষ্টা করছিল।

বাইরে ক্লাবলনে কিছু একটা হচ্ছে মনে হওয়ায় সে জানলা খুলে তাকাল এবং বিমূঢ় হয়ে গেল। রেলিংয়ের ধারে শত শত মানুষ নির্বাক দাঁড়িয়ে। সাত—আটটি দেহ লনের উপর শোয়ান। আরো দেহ কাঁধে, ঘাড়ে, পাঁজাকোলা করে আনা হচ্ছে। দেহগুলির দিকে আর একবার তাকিয়ে জ্যোতির বুঝতে অসুবিধা হল না সেগুলিতে প্রাণ নেই।

ধীরে ধীরে জ্যোতির চেতনা থেকে আলো সরে গিয়ে অন্ধকার নেমে এল। অজ্ঞান হয়ে মেঝেয় পড়ে যাবার আগে সে শুধু বলেছিল, ”ভগবান, আমার জন্যই…”

।।বারো।।

এগারো জন মারা গেছে।

কেউ পায়ের চাপে, কেউ বেড়ায় বা বন্ধ দরজায় ভিড়ের চাপে পিষে, দম—বন্ধ হয়ে। মৃতরা পালাতে চেয়ে দিগভ্রান্তের মত সরু পথ দিয়ে দরজার দিকে ছুটেছিল বেরোবার জন্য। কাঠের দরজার খিল খোলার আগেই তারা ভিড়ের চাপে পড়ে যায়। ওরা ভয় পেয়ে হঠাৎই একসঙ্গে ছুটেছিল।

ভয় জ্যোতিও পেয়েছিল। দিনের পর দিন সে নিজের খেলা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তার ভয় হচ্ছিল নিজের ফুটবল জীবনকে সে হারিয়ে ফেলছে। চারিদিক থেকে পরিস্থিতিগুলো তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তাকে ঘিরে দম—বন্ধ—করা একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সে বাঁচার জন্য খেলার মধ্যে আসতে চেয়েছিল। ফুটবলের বাইরে তার জীবনের কোন অর্থ নেই। ছোটবেলা থেকে এটাই সে জেনে এসেছে।

অ্যাম্বুলেন্স আসার আগে অনেকেই তাদের গাড়িতে অসাড় দেহগুলোকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সরকারীভাবে মৃত ঘোষণার জন্য। তাঁবুর মধ্যে শ্মশানের মুহ্যমানতা। যাত্রীর খেলোয়াড়রাও নিজেদের তাঁবুতে ফিরে যায়নি। বড় হল ঘরে তারা সারথির খেলোয়াড়দের সঙ্গে বসে। তাঁবুর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা।

এখন কি কথা যে বলবে ওরা ভেবে পাচ্ছে না। পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে ওরা চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। সান্ত্বনা দেবার জন্য কাউকে ওরা পাচ্ছে না, সান্ত্বনা নেবার ইচ্ছাও যেন ওদের নেই। প্রত্যেকেই নিজেকে অপরাধী ভাবছে।

হঠাৎ কে একজন অস্ফুটে বলল, ”পড়ে গিয়ে উঠল, তখনো চেষ্টা করলে বলটা কন্ট্রোলে নিতে পারত।”

কেউ কথা বলল না। শুধু জ্যোতির মাথাটা নীচু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে তার মুখে জলের ঝাপটা দেওয়া হয়েছে। ভিজে চুল থেকে টপটপ জল পড়ল কোলে।

হয়তো ঠিকই বলেছে। বলটা আবার সে দখলে এনে গোলের দিকে এগিয়ে যেতে পারত। শুধু গোলকিপার ছাড়া তো সামনে আর কেউ ছিল না। কিন্তু তা না করে সে অসিতের দিকে ছুটে গেল। কেন? সারা জীবন তাকে এর উত্তর খুঁজতে হবে এবং উত্তর পাবে না।

জীবনে অনেক ব্যাপারেরই উত্তর পাওয়া যায় না। তবু খোঁজাখুঁজি চলে। এগারোটা প্রাণ চলে গেল। জ্যোতি বুঝে উঠতে পারছে না, কেন গেল? তার ওই লাথিটাই কি দায়ী? লাথি মারা দেখেই কি গ্যালারিতে তাণ্ডব শুরু হল? সবাই তাই বলবে।

কিন্তু এই খেলাটার মধ্যেই কি হিংস্রতার বীজ নেই? সেটাকেই চমৎকারভাবে বার করে আনার, বাড়িয়ে তোলার জন্য কি লিগ আর টুর্নামেণ্টের ব্যবস্থা রাখা হয়নি? ম্যাচ জেতাটাই বড় কথা আর সেজন্যই চাই গোল। খেলোয়াড়রাই নয়, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ চায় জিততে। যে—কোন পন্থায়।

আমিই কি শুধু দায়ী? যারা মারা গেল তারাও এসেছিল জয় দেখতে। তারা কোন দলের সমর্থক জ্যোতি তা জানে না, কিন্তু ভয় না পেলে ওরা হয়তো এখন জীবন্ত থাকত।

এটাকে ভয় বলা যায় কি, না শোভনতা, রুচি, শান্তি রক্ষার জন্য চেষ্টারই একটা প্রকাশ। ভয়ের বদলে ওরাও তো আত্মরক্ষার জন্য হিংস্র হয়ে উঠতে পারত! জীবনের ভাল দিকটা ওরা দেখাতে চেয়েছিল কি? আর আমিই সেটা ধ্বংস করলাম। কাকে যেন বলেছিলাম, হাজার হাজার মানুষকে আমি খেলার মধ্য দিয়ে আনন্দ দিই? দুঃখকষ্টের জীবন থেকে মুক্তি দিই?

”জ্যোতি আর এখানে নয়, আমার সঙ্গে চল।”

চোখ তুলে সে দাশুদার ঝুঁকে পড়া মুখটার দিকে তাকাল। নির্বাক অর্থহীন চাহনি তার। যাত্রীর লোকেরা নিঃশব্দে কখন নিজেদের তাঁবুতে চলে গেছে।

”কাগজের লোকেরা তোকে ধরার জন্য দাঁড়িয়ে। তোর স্টেটমেণ্ট চায়। বলেছি নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে, শুয়ে আছে ট্রাঙ্কুইলাইজার খেয়ে। টুক করে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আমার গাড়িতে গিয়ে বোস।”

”আমি কথা বলব।”

”না।’ দাঁতে দাঁতে চেপে দাশুদা গজরে উঠল। ”একটি কথাও নয়। এই মুহূর্তে তোর একটা বেফাঁস কথায় সারথির সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।”

”আমি নিজের কথা বলব, সারথিকে কোন কিছুতেই টানব না। দাশুদা প্লিজ…”

”চুপ কর শুয়োরের বাচ্চচা। তুই এখনো সারথির প্লেয়ার, এখনো তোর গায়ে সারথির জার্সি। যা বলবি সেটা ক্লাবেরই কথা হয়ে যাবে। আর নিজের কথা তোর কি—ই বা বলার আছে, কি সাফাই গাইবি? রাস্তায় বেরোতে পারবি? লোকে খুনী বলবে তোকে।”

”ওরা ভুল, মিথ্যে কথা লিখবে।”

”লিখুক, যা খুশি লিখুক। দু—চারদিন লোকে মনে রাখবে, তারপর ভুলে যাবে। তুই বেরিয়ে গিয়ে বোস গাড়িতে। বুট, হোজ এগুলো খুলে ফেল, এই লুঙ্গিটা পর আর গামছাটা গায়ে মাথায় জড়িয়ে নে।”

”আমার মোটরবাইকটা…”

”থাকুক এখানে। চাবিটা দে, কাউকে দিয়ে আনিয়ে নেব। এখন তোর বাইক চাপা উচিত নয়।”

”কোথায় যাব?”

”আমার ওখানে আপাতত। তোকে খুঁজতে মেসে যাবেই, হয়তো টিটাগড়ও যাবে।”

জ্যোতি নির্বিঘ্নেই রাস্তায় বেরিয়ে এল। অন্য দিনের মতই রাস্তা। স্বাভাবিক, ব্যস্ত, আমুদে। ফুটবল মাঠের দর্শকরা বিস্ময় আর বিষাদ নিয়ে ফিরে গেছে। গঙ্গার দিকের আকাশে সূর্যাস্তের রূপ ধরছে। তাই দেখে জ্যোতির মনে গভীরতা স্পর্শ করল।

দাশুদার ফ্ল্যাটে অন্ধকার ঘরে সে শুয়ে। ছবির মত চোখের উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, সকাল থেকে সারা দিনটা। একসময় নীচে মোটর বাইকের শব্দ হল। তার বুলেট ফিরে এল। দরজায় বেল বাজাল। দুজনের কথা হচ্ছে। একটু পরে নাণ্টু ঘরে ঢুকল।

”জ্যোতিদা, তোমার জামা—প্যাণ্ট আর চাবিটা রইল।”

সে জবাব দিল না। নাণ্টু বেরিয়ে গেল। রাতে সে আধ—ঘুম, আধ—জাগরণের মধ্যে এপাশ—ওপাশ করে একসময় উঠে পড়ল। ঘড়িতে দেখল চারটে বাজে। নাণ্টু সোফায় ঘুমোচ্ছে, মেঝেয় একটা গল্পের বই পড়ে, আলো জ্বলছে।

আধঘণ্টা পর সে নিঃসাড়ে বেরোল ফ্ল্যাটের দরজা খুলে। অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে গেটে। নাইট গার্ড জেগেই ছিল। তাকে সে চেনে।

”বাহাদুর, গেটটা খুলে দাও।”

”এখনো তো আঁধার রয়েছে!”

”হ্যাঁ, এই সময়টায় বেড়াতে খুব ভাল লাগে।”

খোলা গেট দিয়ে বুলেটটা বেরিয়ে এসে ছুটল হাওড়া ব্রিজের দিকে। গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়া ময়দান থেকে বাঁদিকে ঘুরল। শিবপুর হয়ে একসময় বোম্বে রোড ধরে জ্যোতির বাইক ছুটল পশ্চিমে রূপনারায়ণ নদীর দিকে।

.

।।তেরো।।

গর্ত আর ঢিবিতে বাইক নিয়ন্ত্রণে রাখা ক্রমশই বিরক্তকর হয়ে পড়ছে। খালি গা, ইজের পরা ছেলেটি বলে দিল এই কাঁচা রাস্তাটা ধরে আরো দশ মিনিট যেতে হবে। দূরে বড় বড় গাছের আড়ালেই রয়েছে রাজপুর। ছেলেটি অরবিন্দ মজুমদারের নাম শোনেনি। পানিত্রাসের কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করতে করতে অবশেষে এই পর্যন্ত পৌঁছেছে। বছর চারেক আগে শরৎচন্দ্রের বাড়ি দেখতে এসেছিল। সেই পর্যন্ত পথ তার চেনাই ছিল।

পথের অবস্থার জন্য বাধ্য হয়েছে বটে কিন্তু তা না হলেও জ্যোতি বাইকের গতি মন্থর করত। সকালের গ্রাম, দু’পাশের সবুজ ধানক্ষেত, রোদের মৃদু তাত, আকাশে চিল, মাটি, জল, কাদা, লতাগুল্ম, গাছ, শস্য এবং বাতাস দ্বারা তৈরি অলৌকিক সোঁদা গন্ধ আর নির্জনতা এবং নৈঃশব্দ্য, এসব চেখে নিতে হলে ব্যস্ততা বর্জন দরকার।

কোনদিকে যে তাকাবে সে ঠিক করে উঠতে পারছে না। সূর্য ডান দিকে দূরের গাছ ছাড়িয়ে উঠেছে। বাঁ দিকে ডোবায় জাল ফেলছে গেরস্থ। ছুটে আসছে এক বালক মোটরবাইকটাকে কাছ থেকে দেখবে বলে। দুধ দোওয়া বন্ধ রেখে বৌটি মুখ ঘুরিয়ে, দেখছে, গরুটি চেটে যাচ্ছে তার বাছুরকে। দুটো বুলবুলি ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করছে নিমগাছটায়।

হঠাৎ জ্যোতির মনে হল কে যেন তাকে ডাকছে। বাইক থামিয়ে সে মুখ ফেরাল। দুশো গজ দূরে একটা ডোবার পাশে, জড়াজড়ি করা কয়েকটা খেজুর গাছের ধারে দুটি লোক। তাদেরই একজন হাত তুলে নাড়ছে আর চেঁচাচ্ছে।

”জ্যোওওতিইই…অ্যাই জ্যোওওতি…”

অরবিন্দদা! জ্যোতি দু’হাত তুলল, গোল দিয়ে সে রকম ভাবে তুলত। আশ্চর্য, যত দূরেই হোক অরবিন্দদাকে সে চিনতেই পারেনি অথচ খেজুর গাছগুলোর ওপর থেকে তার চোখ ঘুরে এসেছে।

আসমান জমি আর আলের উপর দিয়ে অরবিন্দ মজুমদার ছুটে আসছেন। গেঞ্জি আর হাঁটু পর্যন্ত গোটান ধুতি। ফুটবলারের মত অভ্যস্ত সুঠাম দৌড়।

”দূর থেকে আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। তারপর দেখি কিন্তু তুই!”

”আমি কিন্তু চিনতেই পারিনি। এখানে কি করছেন?”

”আগে বল তুই যে এখানে?”

”পালিয়ে এলাম।”

”কি করেছিস?”

”কাগজ আসুক জানতে পারবেন।”

”খবরের কাগজ এখানে আসে না,” অরবিন্দ মজুমদার হাসলেন। ”এলেও আমি পড়ব না।”

জ্যোতি অপ্রতিভ হল। কাগজের কথা তোলাটা উচিত হয়নি।

”এখানে একটা জমিতে ধান দিয়েছি। পোকা লেগেছে, কাল ওষুধ দিয়ে গেছলাম, দেখতে এসেছি। তোর ব্যাপার কি? কিছু হয়েছে নাকি? এখনো তো লিগ চলছে আর তুই,…ক্লাবের সঙ্গে কিছু?”

”আমি অনেক কিছুই জানি না অরবিন্দদা। আমি হেরে যাচ্ছি।” বাইকের দু’পাশে পা, দুটো হাত হ্যাণ্ডেলে, কাতর স্বরে জ্যোতি রাজপুরের রাস্তায় কথাগুলো বলল।

অরবিন্দ মজুমদার বুঝে উঠতে পারলেন না। তাকিয়ে রইলেন।

”আমি ঠিক বোঝাতে পারব না আপনাকে। যা হতে চেয়েছিলাম তা হতে পারলাম না। ফুটবলকে সাধনার জিনিস করতে পারলাম না। মানুষকে মঙ্গলের পথে নিয়ে যাবার ক্ষমতা আমার নেই, এটা কাল আমি জেনেছি। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি পালিয়ে এসেছি।”

ধীরে ধীরে অরবিন্দ মজুমদারের মুখে হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল। মাথা নাড়লেন আক্ষেপে। ”এই রকমই হয়। বড় বেশি আঁকড়ে ধরেছিলিস কিনা। ক’দিন এখানে থেকে যা। চল বাড়িতে যাই, আজ তোর বাইকে উঠব।”

”বৌদি কেমন আছেন?”

”খুব ভাল।” বলতে বলতে তিনি বাইকের পিছনে বসে দু’হাতে জ্যোতির কাঁধ ধরলেন। বাইক চলতে শুরু করার পর বললেন, ”জ্যোতি, ফুটবলটা জীবনের একটা সামান্য অংশমাত্র। এত ভেঙে পড়ছিস কেন? নিজের মত করে কি জীবনটাকে খেলাতে পারসি না?”

”না, পারি না। জীবনটা যে কত বিশাল সে ধারণাই আমার নেই।”

”আমারও নেই, কিন্তু তাতে কি এসে যায়! যেমন যেমন জানছি তেমন তেমন করে চলি। তোর মত হতাশা আমারও এসেছিল। তাই আমি ভেতরে ভেতরে আলগা হয়ে গেছলুম, কোচিং করা আর আমার ভাল লাগত না। টিম হেরে গেলে আগে প্লেয়ারদের পাশে দাঁড়াতুম, সান্ত্বনা দিতুম, সহানুভূতি জানাতুম, ভুল ত্রুটি দেখিয়ে দিতুম। তুই নিজেও তো দেখেছিস আমায়। কিন্তু পরে বিরক্ত হয়ে মুখ দিয়ে যা—তা কথা বেরোত। এইসব গাধাদের পিটিয়ে ঘোড়া করা যায় না, এমন কথাও বলেছি। তাই তো আমার বিরুদ্ধে অনেকেই চটে যায়। তাদের অনেকের মন্তব্য কাগজেও বেরোয়।”

”হ্যাঁ জানি সেসব, পড়েছিও।”

”টানা সাফল্য ফুটবলে কখনো চিরকাল থাকে না। জীবনেও তেমন হয় না। তুই লক্ষ্য কর পৃথিবীর বড় বড় ক্লাবগুলোকে, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, কি রিয়্যাল মাদ্রিদ, ইণ্টার মিলান, টটেনহাম হস্পার কিংবা বেয়ার্ণ মিউনিখ। এরা এক এক সময় উঠেছে, পড়েছে, আবার উঠেছে। এই ওঠা—পড়ার পিছনে কতকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করেছে। কোচ, প্লেয়ার, ম্যানেজমেণ্ট, সাপোর্টার সব মিলিয়ে ক্লিক করে গেলেই ওঠা। সারথিও এই কারণে উঠেছিল। সাফল্যই আবার পতনের কারণগুলো তৈরি করল। এটা অবধারিত ছিল। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলুম কবে, এটা আসবে। তারপর গত বছর থেকেই দেখলুম পতন শুরু হচ্ছে।”

”আমায় তো কখনো বলেননি!”

”ইচ্ছে করেই বলিনি। আমি চেয়েছিলুম তুই ঠেকে শেখ। ফুটবলার হিসেবে তোর যা দেবার তা তুই দিয়ে ফেলেছিস। এখন তুই দেখছিস কিছুই ফিরে পাসনি।”

জ্যোতি মাথা নাড়ল। ”না অরবিন্দদা, কিছুই পেলাম না।”

”কেন, টাকা পয়সা, নাম যশ? এগুলো কি কিছুই নয়?”

”অনেক কিছুই। কিন্তু—।” জ্যোতি থেমে গেল। অরবিন্দ মজুমদার তার কাঁধের উপর মুখ ঝুঁকিয়ে দিলেন।

”কিন্তুটা কি?”

”টাকা বা খ্যাতিটাই সব কিছু নয়।”

অরবিন্দর মুখে সকালের রোদের মত ছড়িয়ে পড়ল হাসি। জ্যোতির পিঠে চাপড় মেরে বললেন, ”তাহলে বললি কেন হেরে যাচ্ছি? টাকা আর খ্যাতির বাইরেও মস্ত একটা জীবন আছে, এটা তো এবার বুঝতে পারছিস। সেই জীবনে গিয়ে এবার খেল, জেতার চেষ্টা কর। জীবনে অনেক ট্রফি ছড়িয়ে রয়েছে, গুনে শেষ করতে পারবি না।”

”জানেন অরবিন্দদা, সেদিন বিপিনস্যারকে বড় মুখ করে বলেছিলাম, আমার খেলাই আমার সব কিছু, গোটা অস্তিত্ব। মানুষকে আনন্দ দেওয়াই আমার কাজ, তারও একটা গুরুত্ব সমাজে আছে। হাওয়াভরা ওই গোল জিনিসটাই আমার ভগবান। তখন জানতাম না কয়েক মাসের মধ্যেই আমার ভগবান চুপসে যাবেন। বড় বড় কথা আর চিন্তার সঙ্গে বাস্তবের যে কত পার্থক্য!”

”জ্যোতি, বাঁদিকে একতলা গোলাপি বাড়িটা হেলথ সেণ্টার, ওর উল্টোদিকেই ডানদিকের সরু রাস্তাটায় নামবি। ওই যে আমগাছগুলো, ওর পেছনেই আমার বাড়ি।”

কথামত জ্যোতি বাইকটা ডান দিকে ঘুরিয়ে রাস্তা থেকে নেমে কাঁচা পথ ধরল, আমবাগানের পাশ দিয়ে একতলা একটা বাড়ির সামনে এল। বাড়িটা খুবই পুরনো। দেয়ালে সম্প্রতি কিছু কিছু জায়গায় পলেস্তারা করা হয়েছে। ছাদে পাঁচিল নেই। বাইরের দিকে দুটো দরজা, তার সামনে টানা খোলা সিমেণ্টের দালান। তারপর নিচু পাঁচিল ঘেরা মাটির উঠোন যাতে একটা ভলিবল কোর্ট হতে পারে। উঠোনের ধারে ধানের গোলা, কাগজি লেবু, লঙ্কা, গাঁদা, জবা, স্থলপদ্ম ইত্যাদির গাছ। এক প্রৌঢ়া কাজের লোক উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। রান্নার কাঠের জন্য একটি লোক কুড়ুল দিয়ে একটা গুঁড়ি ফাড়ছে। ছ’সাত বছরের একটি ছেলে কুড়ুল চালনা দেখছে একমনে।

দালানে ইজিচেয়ারে বসে প্রভাতী। মোটরবাইকের শব্দ শুনে কৌতূহলে মুখ তুলে রয়েছে। পাঁচিলের ফটকের সামনে জ্যোতি বাইক থামিয়ে ভিতরে তাকিয়ে বলল, ”বৌদি কেমন আছেন, অরবিন্দদা?”

”একই রকম।” অরবিন্দ বাইক থেকে নেমে কাঠের ফটকটা খুলতে খুলতে হেসে বললেন, ”তোর বৌদিকে সব বলেছি।”

”কি বলেছেন?”

”রিপন স্ট্রীটে ধরাপড়ায় কথা।”

”সে কি! কেন বলতে গেলেন?” জ্যোতি ক্ষুব্ধ চোখে তাকাল। তার মনে হল, অরবিন্দদা এই সততা দেখিয়ে স্ত্রীর মনের উপর অত্যাচার করেছেন। ব্যাপারটা চেপে গেলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হত না। ”এটা আপনার বাড়াবাড়িই বলব।”

”প্রভাতী চোদ্দ বছর পঙ্গু হয়ে রয়েছে। ও নিজেই আমাকে যেতে বলত। আমি কয়েক বছর ধরেই যাচ্ছিলাম। প্রভাতী তা জানে। পুলিস রেইড আগেও হয়েছে। ধরা পড়েছি, চিনতে পেরে ছেড়েও দিয়েছে। দরকার পড়লে দাশুকে ফোন করে ছাড়া পেয়েছি।”

দালান থেকে প্রভাতী চেঁচিয়ে বলল, ”জ্যোতি না?”

”হ্যাঁ বৌদি, আমি।” জ্যোতিও চেঁচিয়ে উত্তর দিল। তারপর অরবিন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, ”তাহলে সেদিন দাশুদাকে ফোন করলেন না কেন?”

”করেছিলাম।” ফটকের খোলা পাল্লাটা এক হাতে ধরে রেখে তিনি বললেন, ”ভেতরে আয়। পুলিশ রেইডটা দাশুই করিয়েছিল। খবরের কাগজে যাতে ভাল করে ছাপা হয় সে ব্যবস্থাটাও করেছিল।”

”জানলেন কি করে?”

জ্যোতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অরবিন্দর মুখের দিকে। কুড়ুল চালানো থামিয়ে লোকটি অবাক হয়ে মোটরবাইক দেখছে। বাচ্চচা ছেলেটি গুটিগুটি এগিয়ে এসে ফটকের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। ফিসফিস করে সে অরবিন্দকে বলল, ”দাদু, এটা কি?”

”এটাকে বলে মোটরবাইক।” ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে কথাটা বলে অরবিন্দ তাকাল জ্যোতির দিকে। ”আমাদের এখানে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাবার জন্য গাড়িতে উঠে দাশুই আমাকে বলেছিল। সারথি থেকে আমি যাতে বিদায় নিতে বাধ্য হই সেজন্যই ও এই কাজটা করেছে। ও জানত আমি আর কিছু সারথিকে দিতে পারব না। পরিবেশ, মানসিকতা সব কিছুই বদলে গেছে, আমি এখন মিসফিট। এখন এইসব ছেলেদের নিয়ে সাকসেস পেতে হলে অন্যভাবে খেলাতে হবে, অন্য ধরনের কোচ চাই। কিন্তু ক্লাবের বড় একটা গোষ্ঠী আমাকেই রাখতে চায়। এই কাণ্ডটা করিয়ে দাশু তাদের—” অরবিন্দ অর্থপূর্ণ হাসি হাসল।

”জ্যোতি ভেতরে এসো, অনেক দিন দেখি না তোমায়।” প্রভাতী আবার চেঁচিয়ে বললেন।

”যাই বৌদি।”

বাইক নিয়ে জ্যোতি ভিতরে ঢুকল। ধানের গোলার কাছে বাইকটা রেখে সে প্রভাতীর কাছে এগিয়ে এল। প্রণাম করে দালানের কিনারে বসল পা ঝুলিয়ে।

”পথ চিনে আসতে অসুবিধে হয়নি?” প্রভাতী হাসিমুখে জানতে চাইলেন।

”অরবিন্দদার কোচিংয়ে গোলের পথ যে চিনেছে তার পক্ষে রাজপুরের পথ চেনাটা কোন ব্যাপারই নয়।”

”নিশ্চয় ভোরে বেরিয়েছ, পেটে কিছুই এখনো পড়েনি।”

”সত্যিই খিদে পেয়েছে বৌদি।”

”আমি দেখছি।” অরবিন্দ ব্যস্ত হয়ে বললেন। ”জ্যোতি, মুড়ি খাবি নারকোল দিয়ে?”

”তার সঙ্গে খেজুরগুড় যদি থাকে!”

”গুড় নেই, বাতাসা আছে। মাছ ধরিয়ে তারপর ভাজা খাওয়াব। এখানে এর বেশি আর কিছু দিতে পারব না।”

”আমি এর বেশি আর চাইও না।”

ফটকের কাছে চার—পাঁচটি বাচ্চচা ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলভরে বাইকটার দিকে তাকিয়ে। যে ছেলেটি অরবিন্দর কাছে জানতে চেয়েছিল ‘দাদু এটা কি?’, সে বাইকটার গায়ে হাত দিয়ে ভয়ে ভয়ে জ্যোতির দিকে তাকাল। প্রভাতী চেঁচিয়ে বললেন, ”হাত দিও না বুড়ুম, পড়ে যাবে।”

”দিক হাত, পড়বে না। অরবিন্দদাকে দাদু বলল, নাতি নাকি?”

প্রভাতী হাসলেন। ”এই পাশেই থাকে। হেলথ সেণ্টারে ওর মা কাজ করে। যখন ডিউটিতে যায় তখন এখানে ছেলেকে রেখে যায়।”

জ্যোতির মাথার মধ্যে হেলথ সেণ্টার শব্দ দুটো পুকুরে ঢিল ফেলার মত কাজ করল। স্মৃতির কিছু তরঙ্গ তাতে কেঁপে উঠল। জ্যোতি ছেলেটির দিকে আর একবার কেন যে মুখ ফিরিয়ে তাকাল তা সে নিজেই জানে না।

”জ্যোতি, তোমার খবর কি, খেলছ কেমন? আমরা তো এখানে খবরের কাগজ রাখি না তাই কিছু জানি না। রেডিও আছে, তাতেই যতটুকু খবর পাই।”

”আপনাদের অসুবিধা হয় না?”

”প্রথম প্রথম হত, এখন হয় না। এখানকার সবকিছুর সঙ্গে এখন আমরা মিলেমিশে গেছি। বড় শান্ত এই জায়গাটা। পাখির ডাক শুনতে পাই, বাতাসের শব্দও শোনা যায়। এমন কি গাছের পাতায় রোদ পড়ে রঙ বদলে গেলেও চোখে পড়ে। খুব শান্তিতে আমরা আছি।”

”এই শান্তি থেকে আমাকে একটু ভাগ দেবেন বৌদি?”

জ্যোতির গলার স্বরে কি যেন একটা শূন্যতা রয়েছে যেটা প্রভাতীর কানে ধরা পড়ল। বললেন, ”তোমার কি কিছু হয়েছে?”

”হয়েছে, সেটা ফুটবল আর ক্লাব সংক্রান্ত। এই পরিবেশ দূষিত হয়ে যাবে সেসব কথা বললে, তাই আর বলব না। শুধু এইটুকুই এখন বলব, আমি পালাতে চাই, বৌদি, এখন আমি মাঠ থেকে পালাতে চাই।”

”দিদা!” বুড়ুম কাছে এসে প্রভাতীকে বলল, ”আমি ওই গাড়িটার ওপর একবার উঠব?”

”ওটা আমার গাড়ি নয়, এনার। উঠতে হলে এনার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।”

বুড়ুম জ্যোতির দিকে তাকাল। পরস্পরের দিকে নীরবে চোখে চোখ রেখে দুজনে তাকিয়ে রইল। তখন জ্যোতির স্মৃতিতে আবার কয়েকটা ঢেউ কেঁপে উঠল। বুড়ুমের চোখের চাউনিতে খুব চেনা একটা ছায়া যেন ভেসে রয়েছে।

”তুমি বাইকে চড়বে?”

”হ্যাঁ।”

”চলো তোমায় বসিয়ে দি।”

জ্যোতি উঠে দাঁড়িয়ে বুড়ুমের হাত ধরে বাইকের কাছে গেল। দু হাতে ওকে তুলে সীটের উপর বসিয়ে দিয়ে হঠাৎই সে জিজ্ঞাসা করল, ”বাড়িতে তোমার কে আছেন?”

”মা।”

”আর?”

”গোপালের মা…আমি এই দুটো ধরব, তুমি যেভাবে ধরেছিলে।”

বুড়ুমের দুটো হাত হ্যাণ্ডেলের উপর বসিয়ে দিয়ে জ্যোতি আবার জিজ্ঞাসা করল, ”আর কে আছেন?”

বুড়ুম বিভ্রান্ত চোখে তাকাল জ্যোতির দিকে।

”আর কেউ তো নেই। দাদু তো মরে গেছে!”

”বাবা?”

”ওরে জ্যোতি, আয়।” অরবিন্দ ডাক দিলেন। দালানে দাঁড়িয়ে, হাতে একটা কাঁসার থালা। ”বুড়ুম, মুড়ি খাবি তো আয়।”

”না, খাব না।” বুড়ুম উত্তেজিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল।

জ্যোতি ফিরে এসে মুড়ির থালাটা নিয়ে দালানে বসে বলল, ”ছেলেটার বাবা নেই বুঝি?”

অরবিন্দ আর প্রভাতী মুখ—চাওয়াচাওয়ি করলেন। জ্যোতি সেটা লক্ষ্য করেই খাওয়ায় মন দিল।

”বাবা নিরুদ্দেশ। মা আর ছেলে, শুধু এই দুজনই।” প্রভাতী বললেন।

”তুই ক’দিন থাকবি তো?” অরবিন্দ জিজ্ঞাসা করেই জুড়ে দিলেন, ”একটু অসুবিধে হয়তো হবে, তবে ভালও লাগবে।”

জ্যোতি মুখ নীচু করে মুড়ি খেয়ে যাচ্ছে, জবাব দিল না। নিরুদ্দেশ শব্দটা তার মাথার মধ্যে গুনগুন করে যাচ্ছে।

”জানো, জ্যোতি বলল আমাদের শান্তি থেকে ওর একটু ভাগ চাই। কিন্তু ভাগ নিতে হলে তো ওকে এখানে এসে থাকতে হবে!”

”বাহ, আমরা এত কষ্ট করে, আমোদ—আহ্লাদ ছেড়ে, ভাল খাওয়া ভাল পরা সব ত্যাগ করে যা অর্জন করলুম, তাই থেকে ওকে ভাগ দেব কেন? জ্যোতি নিজের জন্য নিজেই যোগাড় করে নিক। কি রে, তাই তো হওয়া উচিত।” অরবিন্দ মিটমিট হাসছেন।

”আচ্ছা, ওর মার নাম কি?” আচমকা জ্যোতি বলল।

”কেন? মার নাম দিয়ে তোর কি দরকার?” অরবিন্দর চোখ সরু হয়ে গেল।

”আচ্ছা অরবিন্দদা, আপনার কাছে আমি প্রথম হাজির হয়েছিলাম যেদিন আপনার কি সেদিনের কথা মনে আছে?”

”সারথির টেণ্টে তো? তোকে ডেকে পাঠিয়ে এনে বলেছিলুম সামনের বছরই সারথিতে চলে এস। হ্যাঁ, মনে আছে। তুই বললি ভেবে দেখব।”

”না না, ওই দিনের কথা নয়। যেদিন সল্ট লেকে আপনার ফ্ল্যাটে প্রথম গিয়ে হাজির হই।”

”মনে আছে। তোকে কেমন যেন উদভ্রান্তের মত দেখাচ্ছিল। প্রথমেই বললি, সারথিতে আমি খেলব। আর আমি বাড়ি ফিরব না, আমায় কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিন। শুনে আমার অবাকই লেগেছিল।”

”আজও আবার সেই আপনার কাছে এসেছি। পালিয়ে এসেছি। সেদিনও আপনার কাছে গেছলাম একজনের কাছ থেকে পালিয়ে। কেন জানি এই মুহূর্তে তার কথাই মনে পড়ছে। আমার এই পালানো ব্যাপারটা শেষ করা দরকার।”

বুড়ুম বাইক থেকে নামার চেষ্টা করছে। দেখতে পেয়ে জ্যোতি থালা রেখে উঠে দাঁড়াল। ”দাঁড়াও দাঁড়াও, বাইক আর তুমি দুজনেই পড়বে।”

জ্যোতি এগিয়ে গিয়ে বুড়ুমকে নামাবার সময় মৃদুস্বরে বলল, ”তুমি এটায় চড়ে ঘুরবে?”

ফ্যালফ্যাল করে বাচ্চচা ছেলেটির তাকিয়ে থাকা দেখতে দেখতে জ্যোতির বুকের মধ্যে কাঁপন ছুঁয়ে গেল। বুড়ুম যেন বিশ্বাস করতে পারছে না এমন সৌভাগ্য তার হবে! সে মাথাটা শুধু হেলাল।

”কোথায় যাবে বলো? মার কাছে?”

”হ্যাঁ।”

”মা কোথায় এখন?”

”কাজে গেছে। হেলথ সেণ্টারে।”

”মার নাম কি?”

”উষা।”

অরবিন্দ এবং প্রভাতী তাকিয়ে ছিলেন দুজনের দিকে। বাইকের পিছনে বুড়ুমকে বসিয়ে জ্যোতিকেও উঠে বসতে দেখে অরবিন্দ চেঁচিয়ে উঠলেন, ”অ্যাই অ্যাই, এখন আবার বুড়ুমকে নিয়ে কোথায় ঘুরতে বেরোচ্ছিস, পরে যাস।”

”ঘুরে আসছি অরবিন্দদা। বৌদি, নিজের জন্য শান্তি নিজেই যোগাড় করতে পারি কিনা সেটাই এবার দেখতে যাচ্ছি।”

বাইক স্টার্টের প্রচণ্ড গর্জনে বুড়ুম ভয় পেয়ে জ্যোতিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল।

.

।।চোদ্দ।।

দরজার পাশে ‘বহির্বিভাগ’ লেখা একটা টিনের পাতে। ময়লা নীল হ্যাণ্ডলুম পর্দাটা একটা ঠেঁটো লুঙ্গির মত দরজার সামনে দড়িতে ঝুলছে। ঘরের মধ্যে অনেক লোক। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জ্যোতি। তার বাঁদিকে লম্বা একটা করিডোর, একধারে পর পর তিনটে দরজা। ভিতরে কয়েকটি খাটে রোগীদের সে দেখতে পাচ্ছে। বুড়ুম তার ডানদিকের পর্দা ঝোলানো ঘরটাতেই এখন ঢুকেছে।

”তুই! এখন? এখানে?…কি করে এলি?”

জ্যোতির মনে হল এই ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর তার চেনা। সে অস্বস্তি বোধ করল।

”কাজের সময়…কার সঙ্গে এসেছিস?”

বুড়ুমের জবাবটা জ্যোতি শুনতে পেল না। বোধ হয় ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। তার মনে হল, ভিতরে গিয়ে এখন বোধ হয় ওর মাকে বললে ভাল হয়—আমিই ওকে নিয়ে এসেছি, আবার সঙ্গে করে বাড়িতে পৌঁছে দেব।

”বাইকে চড়ে? কার বাইক, কে তিনি?…স্যার, আমি একটু দেখে আসছি। কি ঝঞ্ঝাট যে এই ছেলেকে নিয়ে হয়!”

পর্দা সরিয়ে উষা বেরিয়ে আসতেই জ্যোতির বুকে একটা ধাক্কা লাগল। ঊষা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে। বুড়ুম মুখ তুলে দুজনের মুখভাব লক্ষ করছে।

”কি ব্যাপার!” উষা দ্রুত ধাতস্থ হয়ে গম্ভীর গলায় জানতে চাইল।

”অরবিন্দ মজুমদারের বাড়িতে এসেছি। উনি আমার গুরু, পিতৃতুল্য। সেখানেই বুড়ুমের সঙ্গে আলাপ। ওকে বাইকে চড়িয়ে একটু ঘোরাবার জন্য বেরিয়ে, এখানে এসে পড়লাম।” জ্যোতি কৈফিয়ৎ দেবার মত কথাগুলো বলেই হাত বাড়িয়ে বুড়ুমকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ”মাকে দেখা হল তো, চলো এবার।”

জ্যোতি হাসার চেষ্টা করল। সাত বছর বয়স বেড়েছে উষার। কত বয়স এখন? চব্বিশ, পঁচিশ বড়জোর। মুখটি ভরাট হয়েছে। কাঁধ, গলা, হাত আগের থেকেও সুডৌল। কোমরে বেল্টের বাঁধন থেকে জানা যাচ্ছে ক্ষীণকটি। কিন্তু ওর চোখ দুটিতে প্রচুর বয়স জমা হয়েছে। দুই ঠোঁট কঠিন মনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বুড়ুমকে নিয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়েই জ্যোতি ঘুরে দাঁড়াল। উষার কাছে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ”বুড়ুম আমার ছেলে?” তারপরই সে এগিয়ে গিয়ে ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।

ভিতর থেকে জ্যোতি শুনতে পেল একটা ক্রুদ্ধ স্বর, ”যার—তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়া…চুপ করে এখানে বসে থাক।”

জ্যোতি ছুটে এসে তার বুলেটে চড়ে স্টার্ট দিল। অরবিন্দদার কাছে আবার তাকে সেইভাবে হাজির হতে হবে, সাত বছর আগে যেভাবে সে সল্টলেকের ফ্ল্যাটে হাজির হয়েছিল।

.

দুজনেই অবাক হয়ে শুনে গেলেন।

”এত ব্যাপার! কই, কখনো তো আমায় কিছু বলিস নি?” অরবিন্দ অনুযোগ নয়, তাঁর বিস্ময়কেই প্রকাশ করলেন।

”বলার মত ব্যাপার কি?”

”বলছ কি জ্যোতি, বুড়ুম তোমারই ছেলে? কি অদ্ভুত যে ব্যাপার, কি আশ্চর্য যোগাযোগ!” প্রভাতী অবাক হওয়ার শেষ প্রান্তে এসে গেছেন।

”অরবিন্দদা, আমি বিয়ে করব। এখানে, এখনি। আপনি ব্যবস্থা করে দিন। অনেক কিছুই তো আমার জন্য করেছেন, এটাও আপনাকে করতে হবে।”

”তুই তো চাস, কিন্তু উষা কি চায়? তোর কথা শুনে মনে হল ও তোকে মন থেকে মুছে ফেলেছে। সাত—সাতটা বছর যথেষ্ট সময় একটা লোককে ভুলতে, সাত মিনিটেও তো ভুলে যাওয়া যায়। এই সাত বছরে তোর জন্য ওর মনে কত যে ঘৃণা জমেছে!”

”জ্যোতিকে ভুলে গেছে বলছ কেন?” প্রভাতী স্বামীর দিকে তাকিয়ে তাঁর কোমল স্বরে দৃঢ়ভাবে বললেন, ”যতবার উষা বুড়ুমের দিকে তাকিয়েছে ততবারই জ্যোতিকে মনে পড়েছে। ভোলা কি এত সহজই?”

”বৌদি, কাল অনেকগুলো লোক আমার জন্য মরেছে। আমি সারারাত দগ্ধে মরেছি। আমি পালিয়ে এসেছি এখানে। আমি আর মাঠে ফিরতে পারব কিনা জানি না।” জ্যোতির গলায় গোঙানির মত আওয়াজ। ভয়ার্ত চোখে সে প্রভাতীর দিকে তাকিয়ে।

”ফিরতে পারবি না বলছিস কেন? নিশ্চয় পারবি। জীবনে কি মাঠ শুধু একটাই? সাতটা বছর একটা সহায়সম্বলহীন মেয়ে লড়ে গেছে, এখনো যাচ্ছে। তোর ফুটবল মাঠের লড়াইয়ের থেকে এটা কম কিসে? দাঁড়া, তোর কোচকে এবার ধরে আনি।”

অরবিন্দ মোড়া থেকে উঠে বাড়ির ভিতরে গেলেন। জ্যোতি উবু হয়ে বসেছিল দালানে। এখন দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ চেপে রইল। প্রভাতী তার কাজের স্ত্রীলোকটিকে ডেকে রান্নার নির্দেশ দিতে লাগলেন।

পরিষ্কার ধুতি—পাঞ্জাবি পরে অরবিন্দ ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। প্রভাতী মুখ তুলে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললেন, ”কোথায় চললে এখন?”

”হেলথ সেণ্টারে।” বলতে বলতে অরবিন্দ দালানের সিঁড়ি দিয়ে উঠোনে নেমেছেন তখন প্রভাতী ডাকল।

”কি বলবে ওকে?”

”বলব আর কি, এখন তো বোঝাব। মানুষ ভুল করে, ভুলের খেসারতও দেয়। জ্যোতিকে তুমি মাপ করে দাও, সে অনুতপ্ত, সে—।”

”না।” প্রভাতীর গলায় যে পাথরের মত এমন কাঠিন্য আছে অরবিন্দও তা জানতেন না। তিনি হতভম্বের মত ফিরে তাকিয়ে রইলেন।

”আমাদের নাতিকে নিয়ে বৌমা যেন এখনি তার শাশুড়ীর কাছে চলে আসে, এখুনি। আমাদের ছেলেকে কষ্ট দেবার অধিকার তার আছে কিনা সেটা আমি দেখতে চাই। আমি পঙ্গু বটে কিন্তু মরে যাইনি। বলে দিও আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি। সে সাত বছর লড়েছে, আমি কত বছর?”

জিজ্ঞাসু চোখে প্রভাতী নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে। অরবিন্দর মুখের উপর দিয়ে ভেসে গেল মমতা, ভালবাসা, বন্ধুত্ব আর শ্রদ্ধার ছায়া। কি একটা কথা বলতে গিয়েও বললেন না। শুধু জ্যোতির দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে প্রভাতীকে দেখালেন আর বললেন, ”জীবনটা কি বিশাল দেখেছিস!”

অরবিন্দ বেরিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় জ্যোতি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ার মত প্রভাতীর কোলে মুখ গুঁজে, দু’হাতে পা জড়িয়ে ধরল। তারপর বহুদিনের জমানো কান্না বার করে দিতে শুরু করল। প্রভাতীর হাত এসে পড়ল জ্যোতির মাথায়। অস্ফুটে তিনি বললেন, ”পুরুষমানুষদের কিছু কিছু ভুল করতে দিতে হয়।”

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর। ইজিচেয়ারে পিছনদিকে মাথা হেলিয়ে প্রভাতী আকাশের দিকে তাকিয়ে। তাঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে জ্যোতি। গভীর শ্বাস—প্রশ্বাসে ফুলে উঠছে তার পিঠ।

হাল্কা শব্দ হল ফটক খোলার। প্রভাতী মাথা নামিয়ে তাকালেন। ফটকে দাঁড়িয়ে উষা। তিনি স্মিত চোখে হাসলেন। কুণ্ঠিত পায়ে উষা এগিয়ে আসতে আসতে আঁচলটা মাথায় তুলে দিল।

”শ্বশুর আর ছেলে কোথায়?” জ্যোতির ঘুম যাতে না ভাঙ্গে সেজন্য প্রভাতীর স্বর নিচু।

”এখানকার পুরুতমশায়ের বাড়িতে গেলেন বুড়ুমকে সঙ্গে নিয়ে।” প্রণাম করার জন্য উষা নীচু হয়ে হাত বাড়াতে গিয়ে দেখল প্রভাতীর পায়ের পাতা আঁকড়ে রয়েছে জ্যোতির হাত। হাতের উপর উষা হাত রাখল।

স্টপার

স্টপার – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

।।এক।।

”এসে গেছেন! আচ্ছা এক মিনিট, আপনি বরং এখানেই বসুন।”

অনুরোধ নয়, যেন নির্দেশ। তরুণ সাংবাদিক ঢোঁক গিলে ঘাড় নাড়ল এবং নড়বড়ে লোহার চেয়ারটায় বসে সপ্রতিভ হবার জন্য রুমাল দিয়ে ঘাড় গলা মুছে, পায়ের উপর পা তুলে প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করল, তারপর কী ভেবে সিগারেটটা আবার প্যাকেটে ভরে রাখল।

তার দশ গজ দূরেই ছড়িয়ে রয়েছে হাফপ্যান্ট পরা, কতকগুলো আদুড় দেহ। তারা ঘাসের উপর চিত হয়ে, উপুড় হয়ে বা পা ছড়িয়ে বসে। ঘাম শুকিয়ে এখন ওদের চামড়ার রং ঝামা ইটের মতো বিবর্ণ, খসখসে। সন্তর্পণে তারা শ্রান্ত হাত পা বা মাথা নাড়ছে। চোখের চাহনি ভাবলেশহীন এবং স্থির।

ওদের একজন গভীর মনোযোগে পায়ের গোছে বরফ ঘষছে; ধুতি পাঞ্জাবি পরা স্থূলকায় এক মাঝবয়সী লোক তার সামনে উবু হয়ে দু’বার কী বলল, মাথা নিচু করে ছেলেটি বরফ ঘষেই যাচ্ছে, জবাব দিল না।

উপুড় হয়ে দুই বাহুর মধ্যে মাথা গুঁজে এতক্ষণ শুয়েছিল যে ছেলেটি, সে হঠাৎ উঠে বসে কর্কশস্বরে চিৎকার করল, ”কেষ্ট, কতক্ষণ বলেছি জল দিয়ে যেতে।”

তাঁবুর পিছন দিক থেকে একটা চাপা গজগজানি এর জবাবে ভেসে এল।

তরুণ সাংবাদিক তাঁবুর ভিতরে তাকাল। তাঁবুর মাঝখানে সিমেন্টের একফালি চত্বর। পাতলা কাঠের পাল্লা দেওয়া স্প্রিং—এর দরজা দু’ধারে। দরজাগুলো ঝাপট দিচ্ছে ব্যস্ত মানুষের আনাগোনায়, চত্বরটার পিছনটা খোলা। সেখান দিয়ে পাশের তাঁবু এবং একটা টিউবওয়েল দেখা যাচ্ছে। একটা গোল স্টিলের টেবিল চত্বরের মাঝখানে, সেটা ঘিরে সাত—আটজন লোক বসে এবং গলা চড়িয়ে তারা তর্ক করছে। কয়েকটা চায়ের কাপ টেবিলে। একজন চোখ বুজে টোস্ট চিবোচ্ছে। পাখা ঘুরছে। বাইরে থেকে বোঝা যায় তাঁবুর ভিতরটায় ভ্যাপসা গুমোট।

”আপনার চা।”

সাংবাদিক চমকে তাকাল। গেঞ্জি পরা একটা ছেলে, হাতে ময়লা কাপ। দুটি বিস্কুট কোনওক্রমে কাপের কিনারে পিরিচে জায়গা করে রয়েছে।

”আমার! আমি তো—”

”কমলবাবু পাঠিয়ে দিলেন।”

সাংবাদিক হাত বাড়িয়ে পিরিচটা ধরল, আর চা খেতে খেতে মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে লাগল গত দু’দিন ধরে তৈরি করে রাখা প্রশ্নগুলো।

”তোকে পইপই বললাম, ডানদিকটা চেপে থাক, তবু ভেতরে চলে আসছিলিস।”

”আমি কী করব, শম্ভুটা বার বার বলছে—রাখতে পাচ্ছি না, রাখতে পাচ্ছি না, বলাই একটু এধারে এসে আগলা। সাইড আর মিডল দুটো ম্যানেজ করব কী করে?”

”সলিলটা যদি চোট না পেত! ভালই খেলছিল। সুকল্যাণের ওই শট গোললাইনে বুক দিয়ে আটকানো, বাপস। আমি তো ভাবলাম বুকটা ফেটে গেল বুঝি।”

”সলিলের লেগেছে কেমন?”

”কে জানে, কমলদা তো ভেতরে নিয়ে গিয়ে কী সব ওষুধ টষুধ দিচ্ছে।”

”পুষ্যিপুত্তুর কিনা, তাই ওর বেলা ওষুধ আর আমাদের বেলা বরফ ঘষো।”

”ট্যালেন্ট। ওর মধ্যে ট্যালেন্ট আছে আর আমাদের মধ্যে গোবর। যাকগে, ছোটমুখে বড় কথা বলে লাভ নেই; বলাই, মনে থাকে যেন কাল ঠিক সাড়ে পাঁচটায় বসুশ্রীর গেটে।”

”এখনও তোর কাছে চার আনা পাই।”

”কীসের চার আনা?”

”ভুলে মেরে দিচ্ছ বাবা, ‘দিলকো—দেখো’—র টিকিট কাটার সময় ধার নিয়েছিলি না?”

”উঃ, কবেকার কথা ঠিক মনে রেখে দিয়েছিস তো। চার আনা আবার পয়সা নাকি!”

সাংবাদিক কান খাড়া করে ওদের কথা শুনছে। ডিগডিগে লম্বা যে ছেলেটি এতক্ষণ চিত হয়ে দু’হাতে চোখ ঢেকে শুয়েছিল, অস্ফুট একটা শব্দ করে হাত নামিয়ে তাকাতেই সাংবাদিকের সঙ্গে চোখাচোখি হল।

”রেজাল্ট?” সাংবাদিক চাপা গলায় জানতে চাইল।

”পাঁচ।”

সাংবাদিক সমবেদনা জানাতে চোখ মুখে যথাসম্ভব দুঃখের ভাব ফুটিয়ে তুলল। ছেলেটি শুকনো হেসে বলল, ”ডজন দিতে পারত, দেয়নি।”

”সিজনের প্রথম খেলা এটা?”

ছেলেটি ঘাড় নেড়ে উঠে বসল। ঢোঁক গিলল, শুকনো ঠোঁট চাটল, জিরজিরে বুক। কাঁধে উঁচু হয়ে রয়েছে হাড়। কোমর থেকে পাতা পর্যন্ত পা দুটো সমান। পেশির ওঠানামা কোথাও ঘটেনি। সাংবাদিকের মনে হল ছেলেটিকে গোল পোস্টের মাঝখানে ছাড়া মাঠের আর কোথাও ভাবা যায় না।

”সরি, অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। চা দিয়ে গেছে তো?”

একটা চেয়ার টানতে টানতে কমল গুহ সাংবাদিকের পাশে এনে রাখল।

”আর এক কাপ হোক।”

”না, না, আমি বেশি চা খাই না।”

”ভাল। বেশি চা খেলে স্বাস্থ্য থাকে না। গত পঁচিশ বছরে আমি ক’কাপ চা খেয়েছি বলে দিতে পারি। ফুটবলারের সব থেকে আগে দেখা উচিত নিজের শরীরটাকে। নয়তো বেশিদিন খেলা সম্ভব নয়। ফার্স্ট ডিভিশনেই কুড়ি বছর, হ্যাঁ, প্রায় কুড়ি বছরই খেলছি।”

সাংবাদিক ইতিমধ্যে তার নোটবই খুলে বল পেনের আঁচড়ে দু’চার কথা লিখে ফেলেছে।

”আপনার বয়স কত এখন?”

”আপনিই বলুন।”

”কুড়ি বছর যদি ফার্স্ট ডিভিশনে হয় তা হলে অন্তত চল্লিশ।”

কমলের চোখে আশাভঙ্গের ছাপ ফুটে উঠল। ”আপনি আমার কেরিয়ার থেকে হিসেব করে বললেন। কিন্তু আমায় দেখে বলুন তো বয়স কত?”

ভ্রূ কুঁচকে সাংবাদিক বোর্ডে দুরূহ কোনও অঙ্কের দিকে তাকানো মেধাবী ছাত্রের মতো ওর দিকে তাকাল। চুলগুলো কোঁকড়া, মোটা, ছোট করে ছাঁটা। দু’কানের উপরে অনেক চুল পাকা। কপালে রেখা পড়েছে তিন—চারটি। সাংবাদিকের মনে পড়ল একটা বইয়ে পাতাজোড়া স্ট্যানলি ম্যাথুজের মুখের ছবি সে দেখেছিল। তলায় লেখা—’দি ফেস অফ থারটিফাইভ ইয়ারস অফ টেনশন ইন ফুটবল।’ ম্যাথুজের কপালে পাঁচটি রেখা; ঠোঁটের কোলে একটি, তার পরেই আর একটু বড় আকারের টানাপোড়েনে থরথর দুটি ঢেউ যেন আছড়ে পড়েছে। এরপর চোখের কোণ পর্যন্ত সারা গাল বেলাভূমির মতো কুঞ্চিত। কিন্তু কমল গুহর চোখ ম্যাথুজের মতন বিশ্রামপ্রত্যাশী অবসন্ন নয়। পাথরের মতো ঝকঝকে, কোটরের মধ্যে বসানো। অসন্তুষ্ট, বিক্ষুব্ধ এবং চ্যালেঞ্জ জানায়।

সাংবাদিক নোটবইটা কাত করে, কমল গুহর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায়ই পাতার কোনায় চট করে লিখল—রাগী ভোঁতা, সেন্টিমেন্টাল।

বেশি দুধ দেওয়া চায়ের মতন গায়ের রং কিংবা মেদহীন মধ্যমাকৃতি এই বাঙালি ফুটবলারের চেহারার মধ্যে সাংবাদিক কোনও বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেল না। গলার স্বর ঈষৎ ভারী ও কর্কশ। শুধু চোখে পড়ে হাঁটার সময় দেহটি বাহিত হয় শহিদ মিনারের মতো খাড়া মেরুদণ্ড দ্বারা। হাঁটার মধ্যে ব্যস্ততা নেই।

”আটাশ, বড়জোর তিরিশ।” সাংবাদিক ইতস্তত করে বলল।

আচমকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল কমল গুহ। সাংবাদিকের অস্বস্তি দেখে হাসিটা আরও বেড়ে গেল। তাঁবুর সামনে দিয়ে দুটো ঘোড়সওয়ার পুলিশ ডিউটি সেরে ফিরছিল। তারা বাধ্য হল ঘোড়ার রাশ টেনে ফিরে তাকাতে।

”বড্ড কমালেন কিন্তু। আমার অফিসের বয়স কমানো আছে বটে, কিন্তু এতটা কমাতে সাহস হয়নি। কিছু মনে করবেন না, আপনার বয়স কত?”

সাংবাদিক গলা খাঁকারি দিয়ে খুব গম্ভীর হতে হতে বলল, ”পঁচিশ।”

কমল গুহ ভুরু নাচিয়ে বলল, ”আসুন মাঠটা দশ পাক দৌড়ে আসি।”

”তা কী করে সম্ভব!” সাংবাদিক প্রতিবাদ করল। ”একজন ফুটবলারের সঙ্গে আমি পারব কেন। আপনাকে যদি বলি এক পাতা লিখতে, পারবেন কি আমার মতন?”

কমল গুহ’র মুখ থেকে মজার ভাবটা আস্তে আস্তে উবে গেল।

”ঠিক। বলেছেন ঠিকই। আমি পারব না এক পাতা লিখতে। কিন্তু আপনি আমার বয়স জানতে চাইলেন কেন? আমার শরীরের ক্ষমতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাবার জন্যই তো? যদি বলি পঁচিশ তা হলে ভেবে নেবেন, অন্তত এগারো সেকেন্ডে আমি একশো মিটার দৌড়োতে পারি। যদি বলি চল্লিশ তা হলে সেটা পনেরো সেকেন্ড হয়ে যাবে। কিন্তু যদি আমরা দুজনে দৌড়োই এবং আপনাকে হারিয়ে দিই, তা হলে কি আমার বয়স পঁচিশ বছর বলে আপনি মেনে নেবেন না? সন তারিখ দিয়ে কি বয়স ঠিক করা যায়, শরীরের ক্ষমতাই হচ্ছে বয়স। বুঝলেন এখন আমার বয়স সাতাশ।”

সাংবাদিক টুক করে তার নোটবইয়ে ‘হামবাগ’ কথাটা লিখে প্রশ্ন করল, ”আপনার লাস্ট ম্যাচ কোনটা যেটা খেলে রিটায়ার করেন?”

”রিটায়ার, আমি? লাস্ট ইয়ারেও দুটো ম্যাচ খেলেছি হাফ টাইমের পর। দরকার হলে এ বছরও খেলব। সলিলটা আজ হাঁটুতে চোট পেয়েছে, সারতে মাসখানেক লাগবে। হয়তো আমাকে নামতে হতে পারে। স্টপারে খেলা, ছোট একটা জায়গা নিয়ে, খুব একটা অসুবিধে হয় না।”

”স্ট্যানলি ম্যাথুজ তো প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল খেলে গেছেন। ইংল্যান্ডের হয়েই তো খেলেছেন তেইশ বছর।”

”মহাপুরুষ ওঁরা। তাও উইং ফরোয়ার্ডে। অত বয়সে ওই পজিশনে খেলা ভাবতে পারি না। আমি প্রথম যখন ফার্স্ট ডিভিশনে শুরু করি, রাইট ইনে খেলতাম।”

”কোন ক্লাবে?”

”এখানে শোভাবাজার স্পোর্টিংয়েই প্রথম দু’বছর, তারপর ভবানীপুর, দু’বছর পর এরিয়ানে, যেখানে এক বছর কাটিয়ে যুগের যাত্রীতে চার বছর, মোহনবাগানে এক বছর,আবার যুগের যাত্রীতে দু’বছর, তারপর আবার শোভাবাজারে। টু ব্যাক সিস্টেমে খেলা শুরু করে, থ্রি ব্যাক পার করে, ফোর ব্যাকে পৌঁছে গেছি। রাইট ইন থেকে পল্টুদা আমাকে স্টপারে আনেন।”

”কে পল্টুদা?” সাংবাদিক বল—পেন উঁচিয়ে প্রশ্ন করল।

”চিনবেন না আপনি। পল্টু মুখার্জি, আমার গুরু। থার্টি ফাইভে উনি খেলা ছেড়েছেন। দুখিরাম বাবুর হাতে তৈরি, খেলতেনও এরিয়ানে। ওঁর আড্ডা ছিল এই শোভাবাজার টেন্টে তাস খেলার। জুয়া, রেস, নেশাভাঙ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কিন্তু তৈরি করেছেন অনেক ফুটবলার। ফুটবলের যতটুকু শিখেছি বা যতটুকু খ্যাতি পেয়েছি সবই ওঁর জন্য। গুরুর ঋণ আমি কোনওদিনই শুধতে পারব না। বলতে গেলে, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আমাকে মানুষ করেছেন। কতদিন ওর বাড়িতেই খেয়েছি, থেকেছি। উনিই আমাকে ম্যাট্রিক পাশ করিয়েছেন।”

কমল গুহ হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে জামা খুলতে শুরু করল। সাংবাদিক অবাক হয়ে থাকার মধ্যেই চট করে নোটবইয়ে লিখে ফেলল, ‘গুরুবাদী’।

জামাটা গলা পর্যন্ত তুলে কমল গুহ পিছন ফিরে বলল,”দেখছেন ঘাড়ের নীচে শিরদাঁড়ার কাছে?”

একটা বহু পুরনো, প্রায় দু’ইঞ্চি দাগ দেখতে পেল সাংবাদিক। ”হ্যাঁ, বুটের দাগ।”

”বুটের নয়, কাঁসার বগিথালা দিয়ে পিটিয়েছিলেন।”

”থালা দিয়ে!”

কথাটা কে বলল দেখার জন্য সাংবাদিক পিছন ফিরে তাকাতেই তার শরীর সিরসিরিয়ে উঠল। একটা বনমানুষ যেন জামা প্যান্ট করে দাঁড়িয়ে। নিকষ কালো রং, ভুরুর এক ইঞ্চি উপর থেকে শুরু মাথার চুল, চোখ দুটো কুতকুতে গর্তে ঢোকানো। নীচের ঠোঁট এত পুরু যে ঝুলে পড়েছে।

কমল গুহ সামনে ফিরে, দু’হাতে মাথার চুলগুলোকে দুধারে টেনে বলল, ”এখানে আছে একটা খড়ম পরতেন তারই প্রমাণ রেখে দিয়েছেন।”

”এইভাবে মার খেয়েছেন, কই, কখনও তো বলেননি!” ছেলেটির মুখ দেখে বোঝা যায় না তার মনে ভয় বা শ্রদ্ধার উদয় হয়েছে! কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত মুখের জমি প্রায় সমান। যেন ভূমিষ্ঠ হবার সময়ই মুখে প্রচণ্ড থাবড়া খেয়েছে। কণ্ঠস্বর ওর মনের ভাব প্রকাশ করে।

”খেলা শেখার মাশুল; দস্তুর মতো মার খেয়ে শিখেছি। থালাটা পিঠে পড়েছিল আমাকে সিনেমা হল থেকে বেরোতে দেখে, খড়মটা মাথায় পড়ে টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে।” বলতে বলতে কমল গুহর গলার স্বর ভারী হয়ে এল। চিকচিক করে উঠল চোখের সাদা অংশ। ”গুরু হতে গেলে যা হয়, তাই ছিলেন। এখন এভাবে খেলা শেখার কথা ভাবাই যায় না। শট মারতেও শিখল না, বলে কত টাকা দেবেন? যদি বলো ট্রেনিংয়ে আসনি কেন, অমনি চোখ রাঙিয়ে বলবে, আমি কি ক্লাবের চাকর? ওই জন্য কিছু আর বলি না। পচা পচা, সব পচা। যে হতে চায় তাকে তাগিদ দিতে হয় না।”

কমল গুহ কথাগুলো বলল ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে। মুখ নামিয়ে ছেলেটি দাঁড়িয়ে।

”আজই ডাক্তারের কাছে যাবি। হাঁটু খুব বিশ্রী ব্যাপার, কোনওরকম গাফিলতি করবি না। বহু ভাল ফুটবলারকে শেষ করে দিয়েছে এই হাঁটু। ট্যাক্সিতে যা, টাকা আছে তো?”

ছেলেটি ঘাড় নাড়ল।

কমল গুহ সন্দিহান হয়ে বলল। কই টাকা দেখি?”

”ঠিক চলে যাবখন।” ছেলেটি ব্যস্ত হয়ে বলল। কমল গুহ পকেট থেকে একটা পাঁচটাকার নোট বার করে এগিয়ে ধরল।

”না, না বাসেই চলে যেতে পারব।”

”যা বলছি তাই কর।”

ছেলেটিই শুধু নয়, সাংবাদিকও সেই গম্ভীর আদেশ শুনে কুঁকড়ে গেল। নোটটা নিয়ে ছেলেটি কমল গুহকে প্রণাম করল। কমল গুহ আলতো হাত রাখল পিঠে, তারপর ও চলে গেল বাঁ পা টেনে টেনে।

”ছেলেটা সিরিয়াস। গুড মেটিরিয়াল। পড়াশুনা হয়নি, বুদ্ধি কম, কিন্তু খাঁটি সোলজার। যা হুকুম হবে তাই পালন করবে। প্রাণ দিতে বললে দেবে। এমন প্লেয়ারও দরকার হয়। দেখি কতখানি তৈরি করা যায়।” কমল গুহর স্বর এই প্রথম কোমল শোনা গেল।

”আপনি কি ওর কোচ?” সাংবাদিক বলপেন বাগিয়ে ধরল।

”কোচ? ওহ না ক্লাবে এন আই এস থেকে পাশ করা কোচ একজন আছে। তবে সলিলকে আমি নিজের হাতে গড়ছি। বস্তিতে থাকে, ন’টা ভাই বোন, যতটুকু পারি সাহায্য করি। বেঁচে থাকার লোভ তো সকলের মধ্যেই আছে, কিন্তু একটা সময় আসে যখন মানুষকে মরতেই হয়। তখন সে বেঁচে থাকে বংশধরের মধ্য দিয়ে। ফুটবলারকেও একসময় মাঠ ছাড়তে হয়। কিন্তু সে বাঁচতে পারে ফুটবলার তৈরি করে। সলিলই আমার বংশধর।”

”আপনার ছেলেমেয়ে ক’টি?”

কমল গুহর মুখের উপর দিয়ে ক্ষণেকের জন্য বেদনা ও হতাশার মেঘ ভেসে চলে গেল। ”একটি মাত্র ছেলে। বয়স সতেরো, প্রি—ইউ পড়ে। আমার বিয়ে হয়েছিল খুবই অল্প বয়সে।”

”কোথায় খেলে এখন?”

”কোথাও না। জীবনে কোনওদিন ফুটবলে পা দেয়নি। হি হেটস ফুটবল। এমনকী খেলা পর্যন্ত দেখে না। আমার খেলাও দেখেনি কখনও। ভাবতে খুব অবাকই লাগে, তাই নয়?”

”আপনার স্ত্রীর ইন্টারেস্ট নেই আপনার খেলা সম্পর্কে?”

কমল গুহ মাথা নাড়ল ক্লান্ত ভঙ্গিতে। ”নেই নয়, ছিল না। দশ বছর আগে মারা গেছে, আমার খেলার জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেনি একদিনও। অমিতাভ তার মা’র কাছ থেকেই ফুটবলকে ঘৃণা করতে শিখেছে। পলিটিক্সের কথা বলে, তাই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করে, গান গায়, কবিতা লেখার চেষ্টা করে, কিন্তু ফুটবল সম্পর্কে একদিনও একটি কথা বলেনি।”

”স্ট্রেঞ্জ।” সাংবাদিক তারপর নোটবইয়ে লিখল, ‘স্যাড লাইফ’।

কমল গুহ আনমনা হয়ে স্থির চোখে বহুদূরে এসপ্ল্যানেডের একটা নিওন বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাংবাদিক অপেক্ষা করতে লাগল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। যেসব ফুটবলার খালি গায়ে শুয়ে—বসে ছিল, তারা স্নান সেরে ফিটফাট হয়ে এখন পাঁউরুটি আর মাংসের স্টু খাওয়ায় ব্যস্ত। তাঁবুর মধ্য থেকে ভেসে আসা টুকরো টুকরো কথা শোনা যাচ্ছে।

”কালীঘাটের খেলার রেজাল্ট কী হল রে…”

”চলে না দাদা, চলে না, ওসব প্লেয়ার কলকাতা মাঠে সাতদিন খেলবে। বৃষ্টি নামুক, দেখবেন তখন কীরকম মাল ছড়াবে…”

”একশো টাকা হারব যদি কখনও নিমু হেড করে গোল দেয়…”

”আমাদের নেক্সট ম্যাচ কার সঙ্গে রে…”

”তুই বলটা শ্রীধরকে না দিয়ে গোপালকে চিপ করলি কেন, এয়ারে নায়িমের সঙ্গে কি ও পারে?”

”আপনার আর কি প্রশ্ন আছে?”

সাংবাদিক ইতস্তত করে বলল, ”বহু প্রশ্ন ছিল।”

”যেমন?” কমল গুহ নিরুৎসুক স্বরে জানতে চাইল।

”আপনি ফিফটি সিক্স ওলিম্পিকে যাবেন বলেই সবাই ধরে নিয়েছিল কিন্তু যেতে পারেননি। কী তার কারণ? আপনি চারবার সন্তাোষ ট্রফিতে খেলেছেন, রাশিয়ান টিমের সঙ্গে দুটো ম্যাচ খেলেছেন, ইন্ডিয়ার সেরা স্টপার হিসেবে আপনার নাম ছিল। অথচ কত আজেবাজে প্লেয়ার এশিয়ান গেমসে বা মারডেকায় খেলতে গেল আর আপনি একবারও ইন্ডিয়ার বাইরে যেতে পারেননি, কেন?”

”আর কী প্রশ্ন?”

কমল গুহর নিরুৎসুক স্বর একটুও বদলায়নি। সাংবাদিক তাইতে গম্ভীর হয়ে ওঠা উচিত মনে করল। ”কলকাতার মাঠে আপনাদের মতো ফুটবলার আর পাওয়া যাচ্ছে না, তার কারণ কী? নব্বুই মিনিটের ফুটবল আমাদের পক্ষে খেলা সম্ভব কি না? ফুটবল সিজন শীতকালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে খেলা আরও ভাল হবে কি না…।”

সাংবাদিক থেমে গেল। তাঁবুর মধ্যে ফোন বাজছিল। একজন চিৎকার করে ডাকল, ”কমলদা, আপনার ফোন।”

কমল গুহ চেঁচিয়ে তাকে বলল, ”আসছি, এক মিনিট ধরতে বল।”

তারপর দ্রুত সাংবাদিককে বলল, ”আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে অনেকক্ষণ সময় লাগবে, আপনি বরং আর একদিন আসুন।”

”যদি আপনার বাড়িতে যাই?”

তাঁবুর দিকে যেতে যেতে কমল গুহ বলল, ”তাও পারেন। ছুটির দিনে আসবেন। সকালে।”

সাংবাদিক তার নোটবইটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কিছু একটা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করল এবং গভীর বিরক্তিতে ভ্রু কুঞ্চিত অবস্থায় শোভাবাজার স্পোর্টিয়ের বেড়ার দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে একবার পিছু ফিরে তাকাল। তাঁবুর একটা জানলার মধ্যে দিয়ে কমল গুহকে দেখা যাচ্ছে, ঘাড় নিচু করে ফোনে কথা বলছে।

”অরু! অরুণা? কী ব্যাপার, হঠাৎ যে…অ্যাঁ! পল্টুদা পড়ে গেছেন? ব্লাডপ্রেশার আবার…ডাক্তার কী বলেন!… দেখানো হয়নি! হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি, এখুনি রওনা হচ্ছি। টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তুমি ডাক্তার আনো।” ফোন রেখে কমল ঘরের একমাত্র লোক শোভাবাজারের সহ সম্পাদক অবনী মণ্ডলকে বলল, ”কিছু টাকা এখুনি চাই, শ’খানেক অন্তত।”

”অ্যাক—শো! এখন কোথায় পাব?”

”যেখান থেকে হোক, যেভাবে হোক এখনি।”

”চাই বললেই এখন কোথায় পাই, শোভাবাজারের ক্যাশে কত টাকা তা তো আপনাকে বলার দরকার নেই।”

কমল একটা অসহায় রাগে আচ্ছন্ন হয়ে কথা বলতে পারল না কিছুক্ষণ। অবনী যা বলল তা সত্যি। কিন্তু এখনি টাকাও চাই। এই তাঁবুতে যারা গল্প করছে বা তাস খেলছে তারা কেউ একশো টাকা পকেটে নিয়ে ঘোরে না।

”পল্টুদার স্ট্রোক হয়েছে, এই নিয়ে তিনবার। ওর বড় মেয়েই ফোন করেছে। কিন্তু কী করে এই মুহূর্তে টাকা পাওয়া যায় বলুন তো? বাড়িতে আছে কিন্তু এখন বাগবাজারে গিয়ে আবার নাকতলায় যেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।”

”তাই তো, গড়ের মাঠে এই সময় একশো টাকা—” অবনী মণ্ডলের চিন্তিত গলা থেমে গেল। কমল ফোনটা তুলে দ্রুত ডায়াল করছে।

”রথীন মজুমদার আছে? আমি কমল, কমল গুহ শোভাবাজার টেস্ট থেকে বলছি। খুব দরকার…হ্যাঁ ধরছি।”

মিনিট দুয়েক অধৈর্য প্রতীক্ষার পর ওদিকে থেকে সাড়া পেয়ে কমল বলল, ”কমল বলছি। সংক্ষেপে একশো টাকা চাওয়ার কারণটা জানিয়ে বলল, ”যদি পারিস তো দে, চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব তোর কাছে। অনেক তো করেছিস আমার জন্যে, এটাও কর। গুরুদক্ষিণা তো জীবনে দেওয়া হল না, চিকিৎসাটুকুও যদি করতে পারি। কালই অফিসে নিশ্চয়ই টাকাটা দিয়ে দেব।”

ওধার থেকে জবাব শোনার জন্য অপেক্ষা করে কমল বলল, ”যুগের যাত্রী টেন্টে? এখনি? হ্যাঁ, হ্যাঁ দশ মিনিটেই পৌঁছোচ্ছি।”

কমল রিসিভারটা ছুড়েই ক্রেডলের উপর ফেলল। তাঁবু থেকে দ্রুত বেরিয়ে বেড়ার দরজা পার হয়ে ময়দানের অন্ধকারে ঢোকার পর সে প্রায় ছুটতে শুরু করল যুগের যাত্রীর তাঁবুর দিকে।

.

।।দুই।।

গত পনেরো বছরে কমল দু’বার চাকরি, ছয় বার বাসা এবং ছয় বার ক্লাব বদল করেছে। শোভাবাজার স্পোর্টিং, ভবানীপুর, এরিয়ান, যুগের যাত্রী, মোহনবাগান এবং আবার যুগের যাত্রী হয়ে এখন শোভাবাজারে আছে। এই সময়ে সে দর্জিপাড়া, আহিরিটোলা, শ্যামপুকুর, কুমারটুলি, আবার শ্যামপুকুর হয়ে এখন বাগবাজারে বাসা নিয়েছে। ক্লাবের জন্ম শোভাবাজারে এবং নাম শোভাবাজার স্পোর্টিং হলেও তার কোনও অস্তিত্ব জন্মস্থানে এখন আর নেই, যেমন কমলের জন্ম ফরিদপুরে হলেও, তিন বছর বয়স সেখান থেকে চলে আসার পর আর সে দেশের মুখ দেখেনি। শোভাবাজার স্পোর্টিং এখন ময়দানের তাঁবুতে আর বেলেঘাটায় কেষ্টদার অর্থাৎ কৃষ্ণপ্রসাদ মাইতির বাড়িতেই বিদ্যমান।

কমল যুগের যাত্রীর তাঁবুতে শেষ বার পা দিয়েছিল সাত বছর আগে। মোহনবাগান থেকে যাত্রীতে আসার জন্য ট্রান্সফার ফর্মে সে সই করে এক হাজার টাকা আগাম নিয়ে। কথা ছিল পাঁচ হাজার টাকা যাত্রী তাকে দেবে।

বছর শেষে সে মোট পায় চার হাজার টাকা। দিল্লিতে ডুরান্ডে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে আসার পরই সে গুলোদার কাছে বাকি টাকাটা চায়। যুগের যাত্রীর সব থেকে ক্ষমতাশালী গুলোদা অর্থাৎ ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রতাপ ভাদুড়ি। সকালে প্র্যাকটিসের পর প্লেয়াররা কী খাবে, কোন ম্যাচে কোন প্লেয়ার খেলবে, কোন প্লেয়ারকে যাত্রীতে নেওয়া হবে, এবং কত টাকায়, এসব স্থির করা ছাড়াও গুলোদা এবং তার উপদলের নির্দেশেই নির্বাচিত হয় ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, ফুটবল সম্পাদক, এমনকী প্রেসিডেন্টও। ফুটবল চ্যারিটি ম্যাচের বা ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচের টিকিট গুলোদার হাতেই প্রথমে আসে, তারপর মেম্বারদের বিক্রি করা হয়। আই এফ এ এবং সি এ বি—র তিন—চারটি সাব কমিটিতে গুলোদা আছে। একটি ছোট্ট প্রেসের মালিক গুলোদা গত বছরে দুটি বাড়ি করেছে ভবানীপুরে ও কসবায়।

গুলোদা নম্রস্বরে বিনীতে ভঙ্গিতে কথা বলে।

”সে কী, তুই টাকা পাসনি এখনও!” গুলোদার বিস্ময়ে কমল অভিভূত হয়ে যায়।

”ছি ছি, অন্যায়, খুব অন্যায়। আমি এখুনি তপেনকে বলছি।”

গুলোদা অ্যাকাউন্ট্যান্ট তপেন রায়কে ডেকে পাঠাল। সে আসতেই ঈষৎ রুষ্টস্বরে বলল, ”একী, কমলের টাকা পাওনা আছে যে? না না, যত শিগগিরি পারো দিয়ে দাও, কমল আমাদের ডিফেন্সের মুল খুঁটি, ওকে কমজোরি করলে যাত্রী শক্ত হয়ে দাঁড়াবে কী করে!”

কমল সতর্ক হয়ে বলে, ”গুলোদা, টাকাটা রোভার্সে যাবার আগেই পাচ্ছি তো?”

”তুই ভাই তপেনের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নে।” বলতে বলতে গুলোদা ফোন তুলে ডায়াল করতে শুরু করে দেয়।

তপেন তিন দিন ঘুরিয়ে টাকা দেয়নি। কমলও রোভার্সে যায়নি। ফুটবল সেক্রেটারির কাছে খবর পাঠায়, হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে। তাই শুনে গুলোদা শুধু বলেছিল, ”বটে।”

পরের মরশুমের জন্য ফুটবল ট্রান্সফার শুরু হবার আগে গুলোদা ডেকে পাঠায় কমলকে। ও আসা মাত্র ড্রয়ার থেকে একশো টাকার দশটি নোট বার করে একগাল হেসে গুলোদা বলে,”গুনে নে। তোরা যদি রাগ করিস, তা হলে যাত্রী চলবে কী করে বলতে পারিস? না না কমল, ছেলেমানুষি করা তোর পক্ষে শোভা পায় না। দশ বছরের ওপর তুই ফার্স্ট ডিভিশনে খেলছিস। ইন্ডিয়া কালার, বেঙ্গল কালার পরেছিস। চ্যাংড়া ফুটবলারদের মতো তুইও যদি টাকা নিয়ে…না না, তোকে দেখেই তো ওরা শিখবে, ক্লাবকে ভালবাসবে। ইউ মাস্ট বি ডিগনিফায়েড। এবার ভাল করে গুছিয়ে টিম কর। কাকে কাকে নিতে হবে সে সম্পর্কে ভেবেছিস?”

গুলোদা সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে ইশারা করল। কমল হাতের নোটগুলো প্যান্টের পকেটে রেখে চেয়ারে বসতেই গুলোদা আবার শুরু করে, ”প্লেয়ার কোথায়? একটু আগে দেবু টাকা চাইতে এসেছিল। বললুম, টাকা তো দেব, কাগজ পেনসিল নিয়ে বসে একবার হিসেব কর, ক’মিনিট খেলেছিস, কত গজ দৌড়েছিস, ক’টা ভুল পাশ দিয়েছিস, ক’টা বল রিসিভ করতে পারিসনি, ক’টা ওপেন নেট পেয়ে বাইরে মেরেছিস। … মেম্বাররা লিগ চায়, শিল্ড চায়, আরে বাবা, যে ক’টা প্লেয়ার, সবই তো মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল নিয়ে বসে আছে। প্লেয়ার না হলে ট্রফি আনবে কে! একা কমল গুহ যা খেলে তার সিকিও যদি দুটো ব্যাক খেলতে পারত, তা হলে ইন্ডিয়ার সব ট্রফি আমরা পেতাম। ক্লাস—ক্লাস, ক্লাসের তফাত। তোর ক্লাসের প্লেয়ার কলকাতা মাঠে এখন ক’টা আছে আঙুলে গুনে বলা যায়। তুই কিন্তু ট্রান্সফারের প্রথম দিনেই উইথড্র করবি।”

কমল বলতে শুরু করে, ”কিন্তু টাকার কথাটা তো…”

”আহ, ওসব নিয়ে তোর সঙ্গে কি দর কষাকষি করতে হবে। গত বছর যা পেয়েছিস এবারও তাই পাবি।”

কমল ট্রান্সফারের প্রথম দিনেই ওল্ড ফ্রেন্ডসে সই করেই উইথড্র করে। লিগে সাতটি ম্যাচে তাকে ড্রেস করিয়ে সাইড লাইনের ধারে বসিয়ে রাখা হয়। অষ্টম ম্যাচ স্পোর্টিং ইউনিয়নের সঙ্গে পাঁচ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় খেলা শেষের দশ মিনিট আগে কোচ বিভাস সেন এসে বলে, ”কমল নামতে হবে, ওয়ারম আপ করো।”

শোনা মাত্রই ঝাঁঝিয়ে ওঠে কমলের মাথা। দিনের পর দিন হাজার হাজার লোকের সামনে আনকোরা প্লেয়ারের মতো সেজেগুজে লাইনের ধারে বসে থাকার লজ্জা আর অপমানের ক্ষতে যেন নুনের ছিটে এই দশ মিনিটের জন্য খেলতে নামানো।

”এতদিনে হঠাৎ মনে পড়ল যে?” কমল অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা স্বরে বলে।

”রাগ করিসনি ভাই, বুঝিসই তো, আমার কোনও হাত নেই। সবই একজনের ইচ্ছেতেই তো হয় এখানে।” বিভাস চোরের মতো এধার—ওধার তাকিয়ে বলে, ‘খেলার আগেই গুলোদা বলে দেয় কমলকে দশ মিনিট আগে নামিও।”

কমল বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে গ্যালারির দিতে তাকায়। একেবারে উপরে গুলোদা তার নির্দিষ্ট জায়গাটিতে বসে। কমল সটান উঠে এসে গুলোদার সামনে দাঁড়াল। জার্সিটা গা থেকে খুলে হাতে ধরে বলল, ”বয়স হয়েছে, খেলাও পড়ে এসেছে। কিন্তু কমল গুহ যতদিন বল নিয়ে ময়দানে নামবে, ততদিন এই জার্সিকে সে ভয়ে কাঁপাবে।”

জার্সিটা হতবাক গুলোদার কোলে ছুড়ে দিয়ে,খালি গায়ে কমল শত শত লোকের কৌতূহলী দৃষ্টির ভিড় কাটিয়ে গ্যালারি থেকে নেমে আসে। তাঁবুতে এসে জামা প্যান্ট পরে, নিজের বুট এবং অন্যান্য জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে যখন সে বেরোচ্ছে, তখন খেলা শেষের বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে হাউইয়ের মতো একটা উল্লাস আকাশে উঠে প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ল। কমল থমকে পিছন ফিরে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুটে বলল, ”এই শব্দকে কাতরানিতে বদলে দেব।”

যুগের যাত্রী তাঁবুর চৌহদ্দিতে কমল আর পা দেয়নি। পরের বছর ট্রান্সফারের প্রথম দিনেই সে সই করে আসে শোভাবাজার স্পোর্টিংয়ে খেলার জন্য। লিগ তালিকায় শেষের পাঁচ—ছ’টি দল প্রথম ডিভিশনে টিকে থাকার জন্য জোট পাকায় আর পয়েন্ট ছাড়াছাড়ি করে, শোভাবাজার তাদেরই একজন। তিনটি খেলায় এগারো গোল খেয়ে সে বছর ওদের খেলা পড়ে যায় যাত্রীর সঙ্গে। কমল খেলতে নেমেছিল এবং শুধু তারই জন্য যাত্রীর ফরোয়ার্ডরা পেনাল্টি বক্সের মাথা থেকেই বার বার ফিরে যায়। খেলা ০—০ শেষ হয়। শেষ বাঁশির সঙ্গে মাঠে থমথমে গাম্ভীর্য নেমে আসে। কমল শোভাবাজারের দু’জন প্লেয়ারে কাঁধে ভর দিয়ে টলতে টলতে মাঠ থেকে বেরোবার সময় বলে ”শরীরে আর একবিন্দুও শক্তি নেই রে, নইলে এখন আমি একটা দারুণ চিৎকার করতুম।”

ফিরতি লিগে শোভাবাজারের যখন পঁচিশটা খেলায় চোদ্দো পয়েন্ট, তখন পড়ল যাত্রীর সামনে। লিগ তালিকায় যাত্রী তখন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান আর এরিয়ান্সের পরে, বি এন আরের ঠিক উপরে। চ্যাম্পিয়ান হওয়ার কোনও আশা তো নেই—এটা শুধু ছিল মানরক্ষার খেলা।

হাফ টাইমে যাত্রীর মেম্বাররা কুৎসিত গালিগালাজ করতে করতে গুলোদার দিকে জুতো, ইট, কাঠের টুকরো ছুড়তে শুরু করে। তাদের চিৎকারের মধ্যে একটা গলা শোনা গেল, ”কমলকে কেন ছেড়ে দেওয়া হল?” খেলার ফল তখন ০—০।

এরপর গুলোদার এক পার্শ্বচর দ্রুত গ্যালারি থেকে নেমে গিয়ে শোভাবাজারের সম্পাদক কৃষ্ণ মাইতির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে এল।

হাফ টাইমের পর মাঠে নামতে গিয়ে কমল অবাক হয়ে দেখল, যে সিধু এতক্ষণ দারুণ খেলে অন্তত তিনটি অবধারিত গোল বাঁচাল, তাকে বসিয়ে নতুন ছেলে ভরতকে গোলে নামানো হচ্ছে। খেলা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই যাত্রীর লেফট হাফ প্রায় তিরিশ গজ থেকে একটি অতি সাধারণ শট গোলে নিল। কমল শিউরে উঠে দেখল, বলটা ধরতে ভরত সামনে এগিয়ে এসে হঠাৎ থমকে গেল, তার সামনেই ড্রপ পড়ে মাথা ডিঙ্গিয়ে বল গোলে ঢুকল। …মিনিট দশেক পর কমলের পায়ে আবার বল। যাত্রীর দুটো ফরোয়ার্ড দু’পাশ থেকে এসে পড়েছে। ওদের আড়াল করে কমল ফাঁকায় দাঁড়ানো রাইট ব্যাককে বলটা দিতেই ছেলেটি কিছু না দেখে এবং না ভেবে আবার কমলকেই বলটা ফিরিয়ে দিল। যাত্রীর লেফট ইন ছুটে এল বল ধরার জন্য। পরিস্থিতিটা এমনই দাঁড়াল যে, কর্নার করা অথবা গোলকিপারকে বলটা ঠেলে দেওয়া ছাড়া কমলের আর কোনও পথ নেই। সে গোলের দিকে বলটা ঠেলে দিয়ে দেখল, ভরত অযথা একটা লোকদেখানো ডাইভ দিল এবং বল তার আঙুলে লেগে গোলে ঢুকল। ০—২ গোলে শোভাবাজার হেরে গেল। গ্যালারির মধ্যেকার সরু পথটা দিয়ে যখন মাথা নিচু করে বেরাচ্ছে, উপর থেকে চিৎকার করে একজন বলল, ”কী রে কমল, যুগের যাত্রীকে কাপাবি না?”

তিনদিন পর ভরতকে আড়ালে ডেকে কমল জিজ্ঞাসা করেছিল, ”একরকম করলি কেন?”

ভরতের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তর্ক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে অবশেষে স্বীকার করে, ”কেষ্টদা বলল, রেগুলার খেলতে চাস যদি তা হলে দুটো গোল আজ ছাড়তে হবে। রাজি থাকিস তো নামাব। আমি লোভ সামলাতে পারলুম না কমলদা। দু’বছর রিজার্ভেই কাটালুম, মাত্র চারটে পুরো ম্যাচ খেলেছি।” তারপরেই সে ঝুঁকে কমলের পা দু’হাতে চেপে ধরল। ”আমাকে মাপ করুন কমলদা, এমন কাজ আর করব না।” কমল তখন আপন মনে নিজেকে উদ্দেশ করেই বলে, ‘স্টপার, কোন দিকের আক্রমণ তুমি সামলাবে!”

পরের বছর যাত্রীর সঙ্গে লিগের প্রথম খেলায়, শুরু সাত মিনিটেই কমল পেনাল্টি বক্সের একগজ বাইরে নিরুপায় হয়ে একজনকে ল্যাং দিয়ে ফেলে দেয়। বাঁশি বাজাতে বাজাতে রেফারি রাধাকান্ত ঘোষ ছুটে এল পেনাল্টি স্পটের দিকে আঙুল দেখিয়ে।

তাজ্জব হয়ে কমল জিজ্ঞাসা করল, ”পেনাল্টি কীসের জন্য?”

”নো নো, ইটস পেনাল্টি।’ রাধাকান্ত বলটা হাতে নিয়ে দাগের উপর বসাল।

”বক্সের অনেক বাইরে ফাউল হয়েছে।” কমল নাছোড়বান্দার মতো তর্ক করতে গেল।

”নো আরগুমেন্ট। আই অ্যাম কোয়ায়েট সিওর অফ ইট।”

”বুঝেছি।” কমল তির্যককণ্ঠে বলল। রাধাকান্ত না শোনার ভান করে বাঁশি বাজাল। কমল চোখ বন্ধ করে দু’কানের পাশে তালু চেপে ধরল। এখনি সেই মর্মান্তিক চিৎকারটা উঠবে।

একটা প্রবল দীর্ঘশ্বাস মাঠের উপর গড়িয়ে পড়ল। কমল অবাক হয়ে চোখ খুলে দেখল, ভরত বলটা দু’হাতে বুকের কাছে আঁকড়ে উপুড় হয়ে। এরপর শোভাবাজার দ্বিগুণ বিক্রমে যাত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাফটাইমের আগের মিনিটে রাইট উইং বল নিয়ে টাচ লাইন ধরে তরতরিয়ে ছুটে চমৎকার সেন্টার করে। বলটা পেনাল্টি বক্সের মাথায় দাঁড়ানো রাইট ইন বুক দিয়ে ধরেই সামনে বাড়িয়ে দেয়। লেফট উইং যাত্রীর দুই ব্যাকের মধ্যে দিয়ে ছিটকে ঢুকে এসে বলটা গোলে প্লেস করা মাত্র রাধাকান্ত বাঁশি বাজিয়ে ছুটে আসে। অফসাইড। তখন কমল মনে মনে বলে, ”আক্রমণ, স্টপার কী করে এই আক্রমণ রুখবে!”

যুগের যাত্রী খেলাটা ১—০ জিতেছিল। প্রায় শেষ মিনিটে ফ্রি কিক থেকে শোভাবাজার গোলের মুখে বল পড়েছিল। ভরত এগিয়ে পাঞ্চ করতেই যাত্রীর রাইট উইংয়ের মাথায় বল আসে। সে হেড করে গোলের দিকে পাঠাতেই ভরত পিছু হটে বলটা ধরতে গিয়ে আটকে যায়। যাত্রীর লেফট ইন তার প্যান্ট ধরে আছে। বিনা বাধায় বল গোলে ঢোকে।

খেলা শেষে মাঠের মধ্যে শোভাবাজার প্লেয়াররা ভিড় কমার জন্য অপেক্ষা করছিল। এমন সময় রথীনকে দেখতে পেয়ে কমল হেসে এগিয়ে এসে বলল, ”আজ আমরা এক গোলে জিতেছি!”

রথীন শুকনো হেসে বলল, ”এ বছর আমি যাত্রীর ফুটবল সেক্রেটারি।”

”ওহ, তাই তো। মনেই ছিল না। সরি, আমার বরং বলা উচিত, রেফারি আজ জিতেছে। এভাবে না জিতে ভাল করে টিম কর। খেলার মতো খেলে জেত।”

কথাটা গায়ে না মেখে রথীন বলল, ”এভাবে কদ্দিন তুই আমাদের জ্বালাবি বল তো?”

”আমি জ্বালাচ্ছি! তুই তা হলে ফুটবলের ‘ফ’—ও বুঝিস না। তোদের গুলোদাকে জিজ্ঞেস কর, তিনি বোঝেন বলেই আমাকে দু’বছর আগেই ড্রেস করিয়ে সাইড লাইনের বাইরে বসিয়ে রাখতেন।”

”তোকে দেখলে হিংসে হয়। এখনও দিব্যি খেলাটা রেখেছিস, আর আমরা কেমন বুড়িয়ে গেলুম।”

”তার বদলে তুই আখেরটা গুছিয়ে নিতে পেরেছিস। শুনেছি প্রগ্রেসিভ ব্যাঙ্কে এখন বেশ বড় পোস্টে আছিস। একটা চাকরিবাকরি দে না।” হাসতে হাসতে কমল বলল, ”তা হলে আর যাত্রীকে জ্বালাব না। খেলে কি আর তোদের মতো বড় ক্লাবের সঙ্গে পারা যায়!”

”আর ইউ সিরিয়াস, চাকরি সম্পর্কে? তা হলে টেন্টে আয়, কথা বলা যাবে।”

”সরি রথীন।” কঠিন হয়ে উঠল কমলের মুখ। ”চাকরি আমার দরকার, দু’মাস ধরে বেকার। কিন্তু যাত্রীর টেন্টে যাব না।”

আর কথা না বলে কমল সরে আসে রথীনের কাছ থেকে। এসব পাঁচ বছর আগের ঘটনা।

.

।।তিন।।

যুগের যাত্রীর টেন্টের সামনে রাস্তায় একটা সবুজ পুরনো ফিয়াট মোটর দাঁড়িয়ে। কমল দেখা মাত্র চিনল, এটি রথীনের। মাস ছয়েক আগে রথীনের পদোন্নতি হয়ে ডিপার্টমেন্টাল ইনচার্জ হয়েছে। এখন মাইনে সতেরো শো। ব্যাঙ্কে রীতিমতো ক্ষমতাবান। চলাফেরা কথাবাতায় সেটা সে সর্বদা বুঝিয়েও দিতে চায়। তা ছাড়া রথীন সুদর্শন, যদিও এখন ভুঁড়ি হয়ে আগের মতো আর ততটা কমবয়সী দেখায় না।

পাঁচ বছর আগে সেদিন রথীনকে নিছকই ঠাট্টা করে কমল চাকরির কথা বলেছিল। পরের দিনই রথীন শোভাবাজার টেন্টে ফোন করে তাকে দেখা করতে বলে। কমল খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল। গোঁয়ারের মতো এক কথায় বেঙ্গল জুট মিলের চারশো টাকার চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে দু’মাস ধরে অবস্থাটা শোচনীয় হয়ে আসছিল। কমল ব্যাঙ্কে গিয়ে রথীনের সঙ্গে দেখা করে। রথীন বলে, ”আমাদের অফিস টিমে তোকে খেলতে হবে। অফিস স্পোর্টস ক্লাবের সেক্রেটারির সঙ্গে কথা হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি পারিস দরখাস্ত দিয়ে যা। ডেসপ্যাচ সেকশনে লোক নেওয়া হবে।”

”মাইনে কত?” কমল প্রশ্ন করে।

রথীন ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, ”যদি বলি একশো টাকা! দু’মাস বেকার আছিস, মাইনে যদি পঞ্চাশ টাকাও হয়, সেটাও তো তোর লাভ।”

কমল আর কথা বাড়ায়নি। পরদিনই দরখাস্ত নিয়ে হাজির হয় এবং যে চাকরিটি পায় তার বেতন এই পাঁচ বছরে ৪৬১ টাকায় পৌঁছেছে। কমল জানে, তার যা শিক্ষাগত যোগ্যতা তাতে এই চাকরি কোনও ভাবেই তার পক্ষে পাওয়া সম্ভব হত না, যদি না রথীন পাইয়ে দিত। পঞ্চান্ন থেকে ষাট নাগাদ কমল গুহর যে নাম ছিল, এখন তার অর্ধেকও নেই। ফুটবল ভাঙিয়ে চাকরি পাওয়ার দিন তার উতরে গেছে। তবু পেয়েছে একমাত্র রথীনের জন্যই।

সাত বছর পর যাত্রীর টেন্টে আবার ঢুকতে গিয়ে কমলের মনে হল, তাকে দেখে সবাই নিশ্চয়ই অবাক হবে। কিন্তু কেউ যদি অপমান করার চেষ্টা করে? অবশ্য নিজের জন্য টাকা চাইতে নয় এবং ফুটবল সেক্রেটারি আসতে বলেছে বলেই এসেছি, সুতরাং কমল মনে মনে বলল—আমার মনে গ্লানি থাকার কোনও কারণ নেই।

টেন্টের বাইরে ইতস্তত ছড়ানো বেঞ্চে যাত্রীর প্রবীণ মেম্বাররা গল্পে ব্যস্ত। তারা কেউ কমলকে লক্ষ করল না। টেন্টের মধ্যে ঢুকে কমলের সঙ্গে প্রথম চোখাচোখি হল যুগের যাত্রীর অ্যাকাউন্ট্যান্ট তপেন রায়ের। টেবিলে আরও দু’জন লোক বসে। একজনকে কমল চেনে। গুলোদার ‘চামচা’ হিসাবে খ্যাতি আছে তার।

”আরে, কমল যে, কী ব্যাপার!”

”রথীন কোথায়? এইমাত্র ফোনে আমায় এখানে আসতে বলল।”

”হ্যাঁ, আমার কাছে একশো টাকা চেয়েছিল তোমাকে দেবার জন্য।”

বলতে বলতে তপেন বুকপকেট থেকে একটি নোট বার করে এগিয়ে ধরল। কমলের মনে হল টাকা নিয়ে তপেন যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছে।

গুলোদার চামচাটি ব্যস্ত হয়ে বলল, ”ভাউচারে সই করাতে হবে না?”

তপেন তাচ্ছিল্যভরে বলল, ”না, এটা ক্লাবের টাকা নয়। কমল তো যাত্রীর টাকা ছোঁবে না, আমার পকেট থেকেই দিচ্ছি।”

কমল গম্ভীর গলায় বলল, ”টাকাটা কালই রথীনের হাতে দিয়ে দেব। ও এখন কোথায়?”

”ঘরে কথা বলছে প্লেয়ারদের সঙ্গে। কাল কুমারটুলির সঙ্গে খেলা।”

কমল ইতস্তত করল। রথীনকে একবার বলে যাওয়া উচিত। কিন্তু প্লেয়ারদের সঙ্গে হয়তো কালকের খেলা সম্পর্কে আলোচনা করছে, তা হলে যাওয়াটা উচিত হবে না বাইরের লোকের।

”কমল এ বছর খেলছ তো?” তপেন রায় হাই চাপার জন্য মুখের সামনে হাত তুলে রেখে বলল। তারপর স্বগতোক্তির মতো মন্তব্য করল, ”আর কত দিন চালাবে!”

কমল হাসল মাত্র।

”তপেনদা, কমলের বডিটা দেখেছেন!” চামচা বলল। ”এখনকার একটা ছেলেরও এমন ফিট বডি নেই।”

তপেন কথাগুলো না শোনার ভান করে তার আগের কথার জের ধরে বলল, ”চার ব্যাক হয়ে বয়স্ক ডিফেন্সের প্লেয়ারদের সুবিধেই হয়েছে। কেরিয়ারটার সঙ্গে সঙ্গে রোজাগারটাও বাড়াতে পেরেছে। শোভাবাজার থেকে এখন পাচ্ছ কত?”

”একটা আধলাও নয়।”

তপেনের ভ্রূ কুঞ্চিত হল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।

”ফ্রি সার্ভিস এই বাজারে!” চামচা অবাক হল। ”অবশ্য কমল লিগে দুটো ছাড়া তো ম্যাচই খেলে না।”

”শুধু দুটো ম্যাচ! কেন, আর খেলে না?” তপেন প্রশ্ন করল চামচাকে।

”লাস্ট টু ইয়ার্স তো কমল শুধু আমাদের এগেনস্টেই খেলেছে।” চামচা চোখ পিটপিট করল। ”যাত্রীকে কিন্তু কাঁপাতে পারেনি কমল। আমরা ফুল পয়েন্ট তুলেছি। যাত্রীর জার্সি সকলের সামনে খুলে ছুড়ে ফেলেছিল বটে, কিন্তু দম্ভ রাখতে পারেনি। ফুটবল কি একজনের খেলা!”

কমলের বলতে ইচ্ছে হল, ”প্লেয়ার, অফিসিয়াল, রেফারি, সবকিছু ম্যানেজ করেই তো ফুল পয়েন্ট তুলেছ।” কিন্তু বলতে পারল না। রথীন স্প্রিংয়ের পাল্লা ঠেলে এই সময় ঘর থেকে বেরোল। সঙ্গে চারটি ছেলে। কমলকে দেখে সে বলল, ”অঃ, কখন এলি? তপেনদা দিয়ে দিয়েছেন?”

তপেন ঘাড় নাড়তেই রথীন বলল, ”আমি টালিগঞ্জের দিকেই এখন যাব। কমল, তুই তো নাকতলায় যাবি, যদি মিনিট কয়েক অপেক্ষা করিস, তা হলে আমার সঙ্গে যেতে পারিস।”

কমল বলল, ”আমি তোর গাড়িতে গিয়ে বসছি। তুই তাড়াতাড়ি কর।”

তপেন মৃদুস্বরে বলল, ”টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হতে হবে না, কমল।”

”কেন?”

”যখন দরকার হবে আমি চেয়ে নেব। তোমার প্রয়োজনের সময় দিতে পেরেছি, শুধু এইটুকু মনে রাখলেই আমি খুশি হব। তুমি বিপদে পড়ে যাত্রীর কাছেই এসেছ এটা ভাবতে আমার ভালই লাগছে।”

শুনতে শুনতে কমলের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এল। সে বলল, ”আমি টাকা চেয়েছি রথীনের কাছে, যাত্রীর কাছে নয়। চেয়েছি অন্যের জন্য, নিজের জন্য নয়।”

কমল বলতে যাচ্ছিল, এ টাকা যদি যাত্রীর হয় তা হলে এখনি ফিরিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু পল্টুদার মুখটা ভেসে উঠতেই আর বলতে পারল না। তার মনে হচ্ছে, অদ্ভুত একটা খাঁচার মধ্যে সে ঢুকে পড়েছে, যার চারদিকটাই খোলা অথচ বেরোনো যাচ্ছে না।

তপেন তার স্মিত হাসিটা কমলের মুখের উপর অনেকক্ষণ ধরে রেখে বলল, ”যদি আরও টাকার দরকার হয় আমাকে বাড়িতে ফোন কোরো। পল্টু মুখার্জির চিকিৎসায় আমাদেরও সাহায্য করা কর্তব্য। এ টাকা ধার নয় কমল, পল্টুদাকে আমার…যুগের যাত্রীর প্রণামী।”

কমল শুনতে শুনতে হঠাৎ নিজেকে অসহায় বোধ করল। তার মনে হচ্ছে, পেনাল্টি বক্সের মধ্যে বল নিয়ে দুটো ফরোয়ার্ড এগিয়ে আসছে। সে একা তাদের মুখোমুখি। ব্যাকেরা কোথায় দেখার জন্য চোখ সরাবার সময়ও নেই।

.

গাড়িতে দু’জনের কেউই অনেকক্ষণ কথা বলল না। রেড রোড ধরে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের পশ্চিম দিয়ে যখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের কাছে পৌঁছেছে তখন রথীন মুখ ফিরিয়ে বলল, ”অফিসের দুটো খেলায় তুই খেলিসনি!”

”এসব খেলা অর্থহীন, আমার ভাল লাগে না খেলতে। তা ছাড়া শোভাবাজারের প্র্যাকটিস ম্যাচ ছিল। কতকগুলো নতুন ছেলে কেমন খেলে দেখার জন্যই গেছলুম।”

”কিন্তু ব্যাঙ্ক চাকরি দিয়েছে তার হয়ে খেলার জন্য।’

কমল চুপ করে রইল।

”এই নিয়ে কথা উঠেছে। তা ছাড়া রোজই তুই কাজ ফেলে সাড়ে তিনটে—চারটেয় বেরিয়ে যাস।”

”কে বলল, নিশ্চয় রণেন দাস?”

”যেই বলুক, সেটা কোনও কথা নয়। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তারা মিথ্যে বলেনি।”

পুলিশ হাত তুলেছে। রথীন ব্রেক কষল। ডানদিকে মোড় ফিরে হরিশ মুখার্জি রোডে এবার গাড়ি ঢুকবে। কমল পুলিশটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। রথীন মোড় ঘুরে গিয়ার বদল করে শান্ত মৃদু স্বরে বলল, ”বুঝিস না কেন, তোর আর আগের মতো নাম নেই, খেলা নেই। এখনকার উঠতি নামী প্লেয়াররা যে অ্যাডভান্টেজ অফিসে পায় বা নেয়, তোর পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তোকে এখন চাকরিটাকেই বড় করে দেখতে হবে। তার জন্য যে সব নিয়ম মানতে হয় মেনে চলতে হবে। অন্য পাঁচজনের থেকে তুই এখন আর আলাদা নোস।”

”আমি আর পাঁচজনের মতো—কোনও তফতাই নেই?” কমল প্রায় ফিসফিস করে বলল।

রথীনের মুখে অস্বস্তিকর বেদনার ছাপ মুহূর্তের জন্য পড়ে মিলিয়ে গিয়েই কঠিন হয়ে উঠল।

”বিপুল ঘোষ, রণেন দাস কি সতু সাহার মতো কেরানিদের সঙ্গে আমার তফাত নেই, রথীন এ তুই কী বলছিস! আমি ইন্ডিয়া টিমে খেলেছি, দেশের জন্য আমার কন্ট্রিবিউশন আছে। জীবনের সেরা সময়ে দিনের পর দিন পরিশ্রম করেছি, কষ্ট করেছি, লেখাপড়া করার সময় পাইনি, জীবনের নিরাপত্তার কথা ভাবিনি, সংসারের দিকে তাকাইনি। কী স্যাক্রিফাইস ওরা করেছে, বল? ওরা আর আমি সমান হয়ে যাব কোন যুক্তিতে?”

রথীন চুপ করে থাকল। গাড়ি চালানোয় ওর মনোযোগটাও বেড়ে গেল হঠাৎ।

”আমি এখনও ফুটবলের জন্য কিছু করতে চাই। প্লেয়ার তৈরি করতে চাই। তাই অফিস থেকে আগে বেরোই। আর অফিস লিগে খেলাটা তো এলেবেলে।”

”কমল, আমাদের দেশে খেলোয়াড়কে ততদিনই মনে রাখে যতদিন সে মাঠে নামে। তারপর স্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। নতুন ‘হিরো’ আসে, তাকে নিয়ে নাচানাচি করে। দ্যাখ না, যাত্রীতে এখন প্রসূন ভটচাজকে নিয়ে কী কাণ্ড চলছে,অথচ ওর বাবাকেই একদিন সাপোর্টাররা মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল ঘুষ খেয়েছে বলে। তোকে মনে রাখবে এমন একটা কিছু কর।”

”রথীন, আমার বয়স হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার মতো সামর্থ্য নেই। ফুটবলারের সামর্থ্য তো শরীর।”

”তা হলে মন দিয়ে চাকরিটা কর। তোকে চাকরি দেওয়ায় ইউনিয়ন থেকে পর্যন্ত অপোজিশন এসেছিল। সবাই বলেছিল উঠতি নামী অল্প বয়সীকে চাকরি দিতে। তুই তো জানিস, সেকেন্ড ডিভিশনে খেলে অপূর্ব ছেলেটাকে চাকরি দেওয়া হবে বলে গত বছর আটটা ম্যাচ খেলানো হয়। ভালই খেলে কিন্তু এখনও চাকরি পায়নি। কমিটি মেম্বাররা বড় বড় নাম চায়। ইস্টবেঙ্গল—মোহনবাগানের চার জনের নাম উঠেছিল। আমি তর্ক করে বলি, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, অফিসের খেলায় এইসব বড় ক্লাবের নামী প্লেয়াররা একদমই খেটে খেলে না। ওরা থেকেও টিম হারে। এতে অফিসের কোনও লাভ হয় না। বরং পড়তি প্লেয়াররা ভাল সার্ভিস দেয়। তোর জন্য এ জি এম পর্যন্ত ধরাধরি করেছি। এখন তুই যদি অফিসের হয়ে না খেলিস তা হলে আমার মুখ থাকে কোথায়? অফিসে নানা দিকে নানা দিকে নানা কথা উঠেছে, এরকম ফাঁকি দিলে তো আমাকে তোর এগেনস্টে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নিতে হবে।”

”কিন্তু আমার পক্ষে শোভাবাজারের ম্যাচের দিন পাঁচটা পর্যন্ত অফিসে থাকা কিংবা অফিসের হয়ে খেলা সম্ভব নয়।”

কমল গোঁয়ারের মতো গোঁজ হয়ে বসল। রথীনের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল।

”অনেকগুলো চাকরি তো ছেড়েছিস। এই বয়সে এই চাকরিটা যদি হারাস, তা হলে কী হবে ভেবে দেখিস। আমার তো মনে হয় না, আর কোথাও পাবি। দেশের লেখাপড়া জানা বেকার ছেলেদের সংখ্যাটা কত জানিস?”

”না, জানি না, জানার ইচ্ছেও নেই। এখানে থামা।”

কমল অধৈর্য ভঙ্গিতে প্রায় চিৎকার করে উঠল। রথীন একটু অবাক হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ব্রেক কষে গাড়ি থামল।

”আরও এগিয়ে তোকে নামিয়ে দিতে পারি।”

”না, এখানেই নামব আর টাকাটা কাল তোকে অফিসেই দিয়ে দেব।”

কমল গাড়ি থেকে নেমে অনাবশ্যক জোরে দরজাটা বন্ধ করে হনহনিয়ে পিছন দিকে হাঁটতে শুরু করল বাস স্টপের দিকে।

.

।।চার।।

বাসে উঠে দমবন্ধ করা ভিড়ে কমল মাথার উপরের রড ধরে মনে করতে চেষ্টা করল পুরনো কথা। তেরো বছর আগে প্রথমবার যুগের যাত্রীতে খেলার সময় রথীন ছিল রাইট ব্যাক, কমল স্টপার। রথীন সে বছর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ক্যাপ্টেন হয়ে লখনৌ থেকে স্যার আশুতোষ ট্রফি এনেছে। মোটামুটি কাজ চালাবার মতো খেলত। তখন ডাকত ‘কমলদা’। রথীন ছিল গুলোদার খুবই প্রিয়পাত্র। মালয়েশিয়ায় নতুন টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে মারডেকা নামে। ইন্ডিয়া টিম খেলতে যাবে। বোম্বাইয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে বাংলা থেকে বারো জন গিয়েছিল। যাত্রী থেকে তিনজন—রথীন, আমিরুল্লা আর সুনীত। বলা হয়েছিল, কমলের হাঁটুতে চোট আছে তাই ট্রায়ালে পাঠানো হয়নি, তা ছাড়া চোখেও নাকি কম দেখছে। দুটোই ডাহা মিথ্যে কথা।

কমল সামান্য একটু চোট পেয়েছিল ইস্টার্ন রেলের সঙ্গে খেলায়। পরের ম্যাচে কমল বসে, রথীন স্টপারে খেলে কালীঘাটের বিরুদ্ধে।

ভালই খেলেছিল। তার পরের ম্যাচে এরিয়ান্সের কাছে এক গোলে যাত্রী হারে। কমল একটা হাই ক্রসের ফ্লাইট বুঝতে না পেরে হেড করতে গিয়ে ফসকায়। সেন্টার ফরোয়ার্ড পিছনে ছিল, বলটা ধরেই গোল করে। খেলার পর ক্লাবে কানাঘুষো শোনা যায়, কমল চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছে না।

কমল ছুটে গেছল পল্টু মুখার্জির কাছে।

”পল্টুদা, এরা আমায় বসিয়ে দিল একেবারে।”

”সে কী রে, একেবারে বসে গেছিস!” পল্টুদা সদর দরজার বাইরে একচিলতে সিমেন্টের দাওয়ায় ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে কাগজ পড়ছিলেন। খুব একচোট প্রথমে হো হো করে হাসলেন।

”বসে গেছিস? কই দেখছি না তো, দিব্বি তো দাঁড়িয়ে আছিস।”

”না পল্টুদা, ঠাট্টা নয়। আর ভাল লাগছে না কিছু। আমি খেলা ছেড়ে দেব।”

”ভাল লাগছে না বুঝি! আচ্ছা, ভাল লাগার ব্যবস্থা করছি। এখান থেকে একদৌড়ে যাদবপুর স্টেশন যাবি আর একদৌড়ে আসবি। এখুনি।”

কমল কথাটাকে আমল না দিয়ে বলল, ”আমি সত্যিই খেলা ছেড়ে দেব। এমন জঘন্য অন্যায়, নখের যুগ্যি নয় রথীন, সে—” বলতে বলতে কমল থেমে গেল।

পল্টুদা ইজিচেয়ারে খাড়া হয়ে বসেছেন। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। দু’চোখে ঘনিয়ে উঠেছে রাগ।

”অরু!” পল্টুদা ঘরের দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর গলায় ডাকলেন, ”অরু, শুনে যা।”

পল্টুদার বড় মেয়ে অরুণা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই পল্টুদা বললেন, ”আমার লাঠিটা নিয়ে আয়।”

কমল শোনা মাত্র অজান্তে এক পা পিছিয়ে গেল। অরুণা অবাক হয়ে বলল, ”এখন আবার কোথায় বেরোবে?”

”লাঠিটা নিয়ে আয় বলছি।” পল্টুদা হুঙ্কার দিলেন।

বাচ্চচা ছেলের মতো কমলের সন্ত্রস্ত মুখটা দেখে অরুণা আঁচ করতে পারল যে, লাঠি আনার কাজটা উচিত হবে না। এরকম দৃশ্য সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। শুধু মজা করার জন্য বলল, ”মোটা লাঠিটা আনব বাবা?”

পল্টুদা উত্তর দিলেন না। অরুণা ঘরের দিকে পা বাড়ানো মাত্র কমল আর একটিও কথা না বলে ঘুরেই দ্রুত ছুটতে শুরু করল। যতক্ষণ দেখা যায় অপসৃয়মাণ ছুটন্ত কমলকে দেখতে দেখতে পল্টুদা এগিয়ে গেলেন। রাস্তার ধারে এসে থুতনি তুলে চেষ্টা করলেন কমলকে দেখার।

অবাক হয়ে রাস্তার লোকেরা তাকিয়ে। বহু লোক কমলকে চেনে। এত বড় এক নামকরা ফুটবলারকে জুতো, জামা আর ফুলপ্যান্ট পরা অবস্থায় সকাল আটটার সময় গিজগিজে ভিড়ের রাস্তা দিয়ে ছুটতে দেখবে, এমন দৃশ্য কল্পনাও করতে পারে না।

পল্টুদা অবসন্নের মতো ফিরে এসে ইজিচেয়ারে বসলেন। বাঁ হাতটা চোখের উপর রাখলেন। অরুণা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাবার কপালে সে হাত রাখতেই পল্টুদা চোখ থেকে বাঁ হাতটা নামালেন। জলের শীর্ণ ধারা দুটি গাল বেয়ে নেমে আসছে।

”মনে বড় দাগা পেয়েছে ছেলেটা। দুঃখ তো জীবনে আছেই, কিন্তু এমন অন্যায় পথ ধরে দুঃখগুলো কেন যে আসে!” পল্টুদা আবার চোখের উপর হাত রাখলেন।

অনেকক্ষণ পর পল্টুদার রান্নাঘরের জানলায় উঁকি দিল দরদর ঘাম ঝরা আর পরিশ্রমে লাল হয়ে ওঠা কমলের মুখ।

”অরু!”

অরুণা মুখ তুলল বাটনা বাটা বন্ধ করে।

”কমলদা? এখনও তো—।”

”অ্যাঁ, এখনও?”

”হ্যাঁ, লাঠিটা তো হাতেই রেখেছে দেখলাম। তুমি যাদবপুর স্টেশন পর্যন্ত ঠিক গেছ তো?”

‘ফুটবলের দিব্যি।”

”দাঁড়াও দেখে আসি।”

আধ মিনিট পরেই অরুণা ফিরে এসে বলল, ”সদর দরজা দিয়ে এসো। না, হাতে লাঠি নেই আর।”

পল্টুদা তখন ছুঁচ—সুতো নিয়ে জামার বোতাম লাগাতে ব্যস্ত। কমলকে একনজর দেখে বললেন, ”খেয়ে এসেছিস?”

”হ্যাঁ।”

”ছেলে কেমন আছে? বয়স কত হল?”

”ভাল, পাঁচ বছর পূর্ণ হবে এই সেপ্টেম্বরে।”

”প্র্যাকটিসটা আরও ভাল করে কর। হতাশা আসবে, তাকে জয় করতেও হবে। ইন্ডিয়া টিমে খেললেই কি বড় প্লেয়ার হয়? বড় তখনই হয়, যখন সে নিজে অনুভব করে মনের মধ্যে আলাদা এক ধরনের সুখ, প্রশান্তি। সেখানে হতাশা পৌঁছোয় না। তুই খেলা ছেড়ে দিবি বলছিস, তার মানে তুই বড় খেলোয়াড় হতে পারিসনি।”

কমল মাথা নিচু করে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। একটা অদ্ভুত ক্ষোভ আর কান্না মিলেমিশে তখন তার বুকের মধ্যে দুলে উঠেছিল।

.

আর এখন, তেরো বছর আগের ওই সব কথা মনে করতে করতে যখন সে বাস থেকে নেমে মিনিট চারেক হেঁটে পল্টুদার বাড়িতে ঢুকল, তখন একটা অদ্ভুত মমতা আর বেদনা কমলের বুকের মধ্যে ফেঁপে উঠছিল। থাক দেওয়া তিনটে বালিশের উপর হেলান দিয়ে পল্টুদা আধশোয়া। ওকে দেখে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।

”ভালই আছি।” মৃদুস্বরে পল্টুদা বললেন।

”কথা বলা একদম বারণ।” অরুণা কথাটা বলল কমলকে লক্ষ্য করে।

কমল তাকাল অরুণার দিকে। সাদা থান পরনে। পাঁচ বছর আগে বিধবা হয়ে একটি ছেলে নিয়ে বাপের বাড়িতেই রয়েছে। এখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। পল্টুদা আরও তিনটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। স্ত্রী দু’বছর আগে মারা গেছেন। সংসারে ছোট মেয়ে করুণা ছাড়াও আছে এক বিধবা বোন। শুকনো মুখে তারা খাটের ধারে দাঁড়িয়ে। অরুণার ছেলে পিন্টু দাদুর খাটের একধারে বসে।

”কেমন আছেন?” কমল ফিসফিস করে অরুণাকে জিজ্ঞেস করল। ”ডাক্তার দেখানো হয়েছে?”

”হ্যাঁ, বললেন কিছু করার নেই।”

”ওষুধ?”

”দিয়েছেন লিখে। আনা হয়নি। বাবাই বারণ করলেন।”

”প্রেসক্রিপশনটা দাও।” কমল হাত বাড়াল।

পল্টুদা ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। ক্লান্ত এবং গম্ভীর স্বরে বললেন, ”আমার জন্য আর টাকা নষ্ট করার দরকার নেই।”

বাড়ানো হাতটা কমল সন্তর্পণে নামিয়ে নিল।

”আর কেউ আসেনি?” কমলের প্রশ্নে অরুণা মাথা নাড়াল। পল্টুদার হাতে গড়া চারজন প্লেয়ার ইন্ডিয়া টিমে খেলেছে, পনেরো জন বেঙ্গল টিমে।

”ব্যালান্স, কমল, ব্যালান্স কখনও হারাসনি। আমি ব্যালান্স রাখতে পারিনি তাই কিছুই রেখে যেতে পারছি না, একমাত্র তোকে ছাড়া।” পল্টুদা ডান হাতটা পিণ্টুর মাথায় রেখে চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, ”এই পৃথিবীটা ঘুরছে ব্যালান্সের ওপর। মানুষ হাঁটে ব্যালান্সে, দৌড়োয়, ড্রিবল করে, এমনকী মানুষের মনও রয়েছে ব্যালান্সের ওপর। চালচলনে, ব্যবহারে ও চিন্তাধারায় কখনও ব্যালান্স হারাসনি। কে আমায় দেখতে এল কি এল না, তাই নিয়ে আমার আর কিছু যায়—আসে না। তুই এসেছিস, জানতুম তুই আসবি।” এক মুহূর্ত থেমে বললেন, ”এদের তুই একটু দেখিস। আজ তোর কাছে এইটেই আমার শেষ চাওয়া।”

”পল্টুদা, আমি থাকলে আপনি কথা বলেই যাবেন, তার থেকে আমি বরং চলে যাই।”

”পারবি যেতে?” মুচকি হাসলেন পল্টুদা, ”যদি বলি আমার সামনে তুই শুধু দাঁড়িয়ে থাক। আমি তোকে দেখব আর সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠবে তোর বল কন্ট্রোল, মুখ তুলে বলটাকে পায়ে স্ট্রোক দিতে দিতে এগিয়ে যাওয়া, এধার—ওধার তাকানো। আমার তখন কেন জানি না অভিমন্যুর কথা মনে পড়ত। শুটিংয়ের পর ফলো থ্রু—র ভঙ্গিটা, আর সেই ডজটা। ডান দিকে হেলে, বাঁ দিকে ঝুঁকেই আবার ডান দিকে—একটুও স্পিড না কমিয়ে। পারিস এখনও?”

”না। আমার বয়স হয়ে গেছে পল্টুদা।”

”না, হয়নি। চেষ্টা করলেই পারবি। করবি?”

কমল বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল পল্টুদার মুখের দিকে। শীর্ণ মুখে দুটি চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। কিন্তু কী অদ্ভুত জ্বলজ্বল করছে। প্রায় কুড়ি বছর আগে অমন করে তাকাতেন।

”তুই আমার কাছ থেকে যা শিক্ষা পেয়েছিস সেটা দেখাবি?” পল্টুদার সেই হুকমের গলা নয়, মিনতি।

কমলের হাত অদৃশ্য সুতোর টানে পুতুলের মতো মাথায় উঠে গেল। চুলগুলো ফাঁক করে মাথা হেঁট করল পল্টুদাকে দেখাবার জন্য। তারপর আস্তে আস্তে মাথাটা হেলিয়ে অস্ফুটে বলল, ”হ্যাঁ করব।”

তার চোখে পড়ল খাটের নীচে একটা রবারের বল, সম্ভবত পিণ্টুর। কমল বলটা পা দিয়ে টেনে আনল। চেটোর তলা দিয়ে বলটাকে ডাইনে বাঁয়ে খেলাল। তাই দেখে পিণ্টু খাট থেকে নেমে গুটি গুটি কমলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ কচি পা—টা বাড়িয়ে দিল। বলটা ছিটকে দেয়ালে গিয়ে লাগল। ঘরে একমাত্র পিণ্টু ছাড়া আর কেউ হেসে উঠল না।

ছিলে টানা ধনুকের মতো কমল কুঁজো হয়ে গেল নিজের অজান্তেই। সামনে যেন একজন প্রতিদ্বন্দ্বী বল কেড়ে নিতে অপেক্ষা করছে। কমল একদৃষ্টে পিণ্টুর দিকে তাকিয়ে বলটাকে চেটো দিয়ে ডাইনে—বাঁয়ে, সামনে—পিছনে গড়িয়ে গড়িয়ে সারা ঘরটা ঘুরতে লাগল, পিণ্টু এলোপাথাড়ি লাথি ছুঁড়ছে, বলে পা লাগাতে পারছে না। কমল হঠাৎ একটা পাক দিয়ে পিণ্টুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোমর থেকে শরীরের উপরটা ডাইনে ঝাঁকিয়ে বাঁয়ে হেলেই সিধে হয়ে গেল। পিণ্টু ব্যালান্স হারিয়ে মেঝেয় পড়ে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে সকলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর লাফ দিয়ে উঠে অরুণাকে জড়িয়ে ধরল লজ্জা লুকোবার জন্য।

কমলের কোনও খেয়াল নেই। আস্তে আস্তে সে ভুলে গেল ঘরটাকে, ঘরের মানুষদের, মৃত্যুপথযাত্রী পল্টুদাকেও। তার মনে হচেছ সে মাঠেই নেমে খেলছে। গ্যালারি ভরা দর্শক তাকে তুমুল উচ্ছ্বাসে তারিফ জানাচ্ছে। প্রমত্ত নটরাজের মতো কমল বুঁদ হয়ে আপন মনে বলটাকে নিয়ে দুলে দুলে সারা ঘর ঘুরছে। কাল্পনিক প্রতিপক্ষকে একের পর এক কাটাচ্ছে। বলটাকে পায়ের পাতার উপর তুলে নাচাতে নাচাতে ঊরুর উপর, সেখান থেকে কপালে আবার ঊরু, আবার পাতা—কমলের সর্বাঙ্গে বল খেলা করছে।

পল্টুদা নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখ হাসিতে ভরে রয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে চোখ বুজলেন।

কিছুক্ষণ পর মৃদুস্বরে অরুণা বলল, ”কমলদা, বাবা বোধ হয় মারা গেলেন!”

.

।।পাঁচ।।

সকাল ন’টায় অফিসে বেরিয়ে পরদিন রাত ন’টায়, ছত্রিশ ঘণ্টা পর কমল বাড়ি ফিরল। চোখ দুটি লাল, চুল এলোমেলো, ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েছে সটান শরীরটা।

একতলায় দুটি ঘর নিয়ে কমল থাকে। একটিতে সে, অপরটিতে অমিতাভ। দুটি লোকের এই সংসারের যাবতীয় কাজ ও রান্না করে দিয়ে কালোর মা রাতে চলে যায়। দশ বছর অগে শিখা মারা যাবার পরই সাত বছরের অমিতাভকে তার দিদিমা গৌহাটিতে নিয়ে চলে যান। দু’বছর আগে সে বাবার কাছে ফিরেছে। প্রথমে দু’জনের সম্পর্কটা ছিল স্কুলে ভর্তি হওয়া নতুন দুটি ছেলের মতো।

দু’বছরেও কিন্তু ওদের মধ্যে ভাব হয়নি। ওরা কথা কমই বলে, দু’জনে দু’জনকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। কেউ কারোর ঘরে পর্যন্ত ঢোকে না। তবে একবার রেজেস্ট্রি চিঠি সই করে নেবার জন্য অমিতাভর ঘরে কমল ঢুকেছিল কলমের খোঁজে। একটা খাতার মধ্যে কলম পায়। তখন দেখেছিল, খাতাটা কবিতায় অর্ধেক ভরা আর টেবিলের উপর থাক দিয়ে রাখা বইয়ের ফাঁকে অমিতাভর মায়ের ফোটো। ছবিটা কমলের ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ছিল। কমল দুঃখ পেয়েছিল। অমিতাভ তার মা’র ছবিটা চুরি না করে যদি চেয়ে নিত তা হলে সে খুশিই হত। মেধাবী গম্ভীর মৃদুভাষী ছেলেকে কমল ভালবাসে। শুধু অস্বস্তি বোধ করে তার দুর্বল পাতলা শরীর ও পুরু লেন্সের চশমাটার দিকে তাকালেই। অমিতাভ তার বাবাকে ‘আপনি’ বলে। কমলের ইচ্ছে ও ‘তুমি’ বলুক।

অমিতাভর ঘরে আরও দুটি ছেলে বসে কথা বলছে। কমল একবার সেদিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। ইজিচেয়ারটা পাতাই ছিল, তাতে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। একে একে তার মনে ভেসে উঠতে লাগল গত চব্বিশ ঘণ্টার ব্যাপারগুলো। কান্না,ছোটাছুটি টেলিফোন করা, শ্মশান যাওয়া, আবার পল্টুদার নাকতলার বাড়ি। পল্টুদার জামাইরা এসেছিল, তাদের আর্থিক সঙ্গতিও ভাল নয়। একশোটা টাকা খুবই কাজে লেগেছে।

পায়ের শব্দে কমল চোখ খুলল। অমিতাভ, তার পিছনে ছেলে দুটি।

”এরা আমার কলেজের বন্ধু, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে।” অমিতাভর বিব্রত স্বর কমলের কানে বিশ্রী লাগল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে সে বলল, ”আজ থাক, অন্য আর একদিন এসো। আজ আমার শরীর মন দুটোই খারাপ।”

কথা না বলে ওরা চলে গেল। কমল আবার চোখ বন্ধ করল এবং মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।

প্রতিদিনের মতো ঠিক পাঁচটায় ওর ঘুম ভাঙল। ঘরের আলোটা পর্যন্ত নেভানো হয়নি, জামা প্যান্টও বদলানো হয়নি। কমল তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই সে হিটারে চায়ের জল বসিয়ে, প্রতিদিনের মতো অমিতাভর ঘরের দরজায় কয়েকটা টোকা দিয়ে, খাওয়ার টেবিলে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। অমিতাভ এসে যখন চেয়ার টেনে বসল তখন চা তৈরি হয়ে গেছে।

”পরশু আমার গুরু মারা গেলেন, তাই বাড়ি ফেরা হয়নি।”

অমিতাভ ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলল, ”কে?”

”পল্টু মুখার্জি।” কমল আর কিছু না বলে অমিতাভর একমনে রুটিতে জেলি মাখানো দেখতে লাগল।

”তুমি অবশ্য ওঁর নাম নিশ্চয় শোনোনি।”

”না। খেলার আমি কিছুই জানি না।”

”পল্টুদা হচ্ছেন,” কমল উৎসাহ দেখিয়ে বলে উঠল, ”সাহিত্যে যেমন ধরো…”

অমিতাভর পুরু লেন্সের ওধারে চোখ দুটোকে কৌতূহলভরে তাকিয়ে থাকতে দেখে কমল ঘাবড়ে গেল।

”যেমন রবীন্দ্রনাথ?”

”না না, অত বড় নয়!” কমল অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। এবং অবস্থাটি কাটিয়ে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে বলল, ”কিন্তু আমার জীবনে উনি রবীন্দ্রনাথের মতোই।”

”তা হলে আপনি খুবই আঘাত পেয়েছেন।”

কমল চুপ করে রইল।

”মা মারা যেতে আঘাত পেয়েছিলেন কি?”

কমল তীব্র দৃষ্টিতে অমিতাভর দিকে তাকাল। সে মাথা নামিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল।

”তোমার মামানিয়ে নিতে পারেনি আমার জীবনকে, আকাঙ্ক্ষাকে। একজন ফুটবলারের স্ত্রী হতে গেলে তাকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়, সহ্য করতে হয়। তা করার মতো মনের জোর তার ছিল না। ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে থেকেছি, টুর্নামেন্ট খেলতে বাইরে গেছি—এসব সে পছন্দ করত না। তাই নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হত। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যাত্রীর সঙ্গে রোভার্সে খেলতে যাই। তখনই ঘটনাটা ঘটে।”

”মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর আপনাকে টেলিগ্রাম করা হয়েছিল। কিন্তু আপনি আসেননি।” অমিতাভ কঠিন ঠাণ্ডা গলায় অভিযুক্ত করল কমলকে। ‘আসেননি’—র পর নিঃশব্দে একটি ‘কেন’ আপনা থেকেই ধ্বনিত হল কমলের কানে। সঙ্গে সঙ্গে রাগে পুড়ে গেল তার মুখের কোমল বিষাদটুকু।

”আগেও বলেছি তোমায়, সেই ট্রেলিগ্রাম আমাদের ম্যানেজার গুলোদার হাতে পড়ে। সেটাকে তিনি চেপে রাখেন, কেননা পরদিনই ছিল হায়দ্রাবাদ পুলিশের সঙ্গে সেমি ফাইনাল খেলা। আমাকে বাদ দিয়ে যাত্রীর পক্ষে খেলতে নামা সম্ভব ছিল না।” কথাগুলো বলতে বলতে কমল তীক্ষ্ন চোখে তাকাল অমিতাভর দিকে।

বাঁকানো ঠোঁটের কোলে মোটা দাগে আগের মতোই অবিশ্বাস ফুটে রয়েছে। আজও ওকে বোঝানো গেল না, টেলিগ্রামটা পেলে সে অবশ্যই খেলা ফেলে মুম্বই থেকে ছুটে আসত।

কমল খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে পড়ল। ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়িতে হাত বোলাল। বেশ বড় হয়েছে। কিন্তু অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না। দাড়ি না কামালেও চলে। গালে কয়েকটা পাকা চুল। কমল কাঁচি দিয়ে সেগুলো সাবধানে কাটতে বসল।

সদর দরজা খোলার শব্দ হল। কালোর মা বোধ হয়, কিংবা খবরের কাগজওলা। কমল কাঁচি রেখে প্যান্টের পকেট থেকে টাকা বার করতে লাগল। বাজার করে কালোর মা। টাকা পেতে দেরি করলে গজগজ শুরু করে।

”কমলদা!”

সলিল ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে।

”কী রে, এত সকালে?”

”মাঠ থেকে আসছি। প্র্যাকটিস করতে গেছলুম।”

”তোর না পায়ে চোট!”

”ডাক্তারবাবু বললেন কিছু নয়, রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।” সলিল খাটের উপর বসল। কমলের মনে হল ও যেন অন্য কিছু বলতে এসেছে।

”পল্টুদা মারা গেলেন!”

”হুঁ। তিয়াত্তর বছর বয়স হয়েছিল।” কমল দাড়ি কাটতে কাটতে আয়নার মধ্যে দিয়ে সলিলকে লক্ষ করতে লাগল।

”কিছু বলবি আমায়?”

সলিল মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুলটা মেঝেয় কিছুক্ষণ ঘষাঘষি করে ধরা গলায় বলল, ”কমলদা, দু’দিন আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি। আমাদের সংসারে আটটা লোক।”

কমল ভেবে পেল না এখন সে কী বলবে! এ রকম কথা প্রায়ই সে শোনে ময়দানে। প্রথম প্রথম একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে কেঁপে উঠত, এখন শুধু তার চোয়ালটা শক্ত হয়ে যায়।

”একটা কার্ডবোর্ড কারখানায় কাজ পেয়েছি, হপ্তায় আঠারো টাকা। আজ থেকেই কাজে লাগতে হবে।”

”ফুটবল?”

সলিল আবার মাথা নামিয়ে চুপ করে রইল। কমল দেখল, টসটস করে ওর চোখ বেয়ে জল পড়ছে। তারপর নিঃসাড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওকে ডাকবে ভেবেও কমল ডাকল না।

জীবনে প্রথম বড় সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে ছেলেটা। এখন ওর মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছে ফুটবলের সঙ্গে সংসারের। আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মায়া—মমতা—ভালবাসার। যদি ফুটবলকে ভালবাসে, বড় খেলোয়াড় হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা হলে ওকে নিষ্ঠুর হতে হবে। সংসারের সুখ—দুঃখ থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। বাঙালিরা বড় কোমল। বেশির ভাগ ছেলেরাই তা পারে না। সংসারের সর্বগ্রাসী হাঁ—এর মধ্যে ঢুকে যায়। ও নিজেই নিক। দু—চারটে টাকা দিয়ে করুণা করে ওকে ফুটবলার হয়ে ওঠায় সাহায্য করা যায় না।

কমলের নিজের কথা মনে পড়ে গেল। মা মারা যাওয়ার পর সংসার দেখাশুনোর জন্য জোর করে বাবা তার বিয়ে দেয়। তখন বয়স মাত্র কুড়ি। তারপর অদ্ভুত একটা লড়াই তাকে করে যেতে হয় অমিতাভর মায়ের সঙ্গে। কিন্তু ছেলে সেসব কথা বুঝবে না। ওর বন্ধুরা আগ্রহ নিয়ে আলাপ করতে আসে অথচ অমিতাভ তার বাবার খেলা সম্পর্কে উদাসীন। একদিনও বলেনি, টিকিট দেবেন—খেলা দেখতে যাব! কমলের বহুদিনের সাধ ছেলে তার খেলা দেখতে আসুক।

”বাবা, দর্জির দোকান থেকে আজ প্যান্টটা আনার তারিখ।”

”আজকেই,” কমল ব্যস্ত হয়ে চাবি নিয়ে দেরাজের দিকে এগোল। ”কত টাকা?”

”কুড়ি।”

টাকাটা অভিতাভর হাতে দেবার সময় কমলের মুহূর্তের জন্য মনে পড়ল, সলিল হপ্তায় মাত্র আঠারো টাকা মাইনের একটা চাকরি নিচ্ছে। অমিতাভ আর সলিল প্রায় এক বয়সী হবে।

।।ছয়।।

বিকেলে কমল শোভাবাজার টেন্টে এল। পল্টু মুখার্জি মারা যাবার খবর সবাই জেনে গেছে। কমলকে অনেকের কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দিতে হল। শোভাবাজারের কোচ সরোজ বলল, ”কমলদা, কাল রাজস্থানের সঙ্গে খেলা! একবার তো বসতে হয় টিমটা করার জন্য।”

”বসার আর কী আছে! আগের ম্যাচে যারা খেলেছে, তাদেরই খেলাও। শুরুতেই বেশি নাড়াচাড়া করার দরকার কী?”

”সলিল বলছে, খেলবে। কিন্তু আমি মনে করি না ও ফিট। সকালে প্র্যাকটিসে দেখলাম, দুটো ফিফটি মিটার স্প্রিন্ট করার পর লিম্প করছে। লাফ দেওয়ালাম, পারছে না।”

”অন্তত দু সপ্তাহ রেস্ট দাও।”

”কিন্তু রাইট স্টপারে খেলবে কে? প্লেয়ার কোথায়? সত্য বা শম্ভু জানেনই তো কেমন খেলে। স্বপনকে হাফ থেকে নামিয়ে আনতে পারি, কিন্তু ফরোয়ার্ড লাইনকে ফিড করাবে কে? রুদ্রকে দিয়ে আর যাই হোক, বল ডিসট্রিবিউশনের কাজ চলে না।”

”তা হলে?” কমল চিন্তিত হয়ে সরোজের মুখের দিকে তাকাল এবং ম্লান হেসে বলল, ‘অগত্যা আমি?”

সরোজ মাথা হেলাল।

”কিন্তু এ সিজনে দু—তিনদিন মাত্র বলে পা দিয়েছি। ভাল মতো ট্রেনিং করিনি।”

”তাতে কিছু এসে যায় না।” সরোজ উৎসাহভরে বলল। ”এক্সপিরিয়েন্সের কাছে বাধা ভেসে যাবে। আমার ডিফেন্সে সব থেকে বড় অভাব অভিজ্ঞতার। মোহনবাগানের দিন দেখেছেন তো, চারটে ব্যাক এক লাইনে দাঁড়িয়ে, এক—একটা থ্রু পাশে চারজনই কেটে যাচ্ছে। ওরা প্রচণ্ড পেসে খেলা শুরু করল আর এরাও তার সঙ্গে তাল দিয়ে মাঠময় ছোটাছুটি করে আধ ঘণ্টাতেই বে—দম হয়ে গেল। গেমটাকে যে স্লো ডাউন করবে, বল হোল্ড করে করে খেলবে—কেউ তা জানে না।”

”জানবে, খেলতে খেলতেই জানবে। আচ্ছা, আমি কাল খেলব। কাল সকালে ছেলেদের আসতে বলে দিয়ো মাঠে। একটু প্র্যাকটিস করাব।”

”খেলার দিনে?”

”সামান্য। দু—চারটে মুভ প্র্যাকটিস করাব। ভয় নেই, তোমার প্লেয়ারদের এক ঘণ্টার বেশি মাঠে রাখব না।”

সরোজের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। কমল বুঝল, ব্যাপারটা ও পছন্দ করছে না। কোচের আত্মমর্যাদায় লেগেছে। কমল সুর বদল করে মৃদু স্বরে এবং বন্ধুর মতো বলল, ”আমাদের মতো ছোট ক্লাব, সঙ্গতি কিছুই নেই। প্লেয়াররা অত্যন্ত কাঁচা, অমার্জিত, সিজনের শেষ দিকে ম্যাচ গট—আপ করে ফার্স্ট ডিভিশনে টিকে থাকতে হয়—এদের নিয়ে আর্টিস্টিক ফুটবল খেলতে গেলে পরিণাম কী হবে তা কি ভেবেছ? এই বছর প্রথম গড়ের মাঠে কোচিং করছ, তুমি কি চাও এটাই তোমার শেষ বছর হোক?”

সরোজের মুখ ক্ষণিকের জন্য পাণ্ডুর হয়েই কঠিন হয়ে উঠল। ”আমি ফুটবল খেলাতে চাই, কমলদা। ফুটবল খেলে শোভাবাজার নেমে যাক আমার দুঃখ নেই, আমিও যদি সেই সঙ্গে ডুবে যাই, আফসোস করব না। কিন্তু শুরুতেই আত্মসমর্পণ করব না।”

”তোমার এই মনোভাব শোভাবাজারের অফিসিয়ালরা জানে? কেষ্টদা জানে?”

”জানলে এই মুহূর্তে ক্লাবে ঢোকা বন্ধ করে দেবে।” সরোজ হাসিটা লুকোল না।

”সরোজ, তোমায় বলাই বাহুল্য, তবু দু—চারটে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তোমার থেকে বোধ হয় আমি বেশি খেলেছি, বড় বড় ম্যাচের অভিজ্ঞতাও বেশি। সেই সূত্রে, বরং বলা ভাল, আলোচনা করতে চাই।”

”কমলদা, এ সব বলছেন কেন, আপনার সঙ্গে আমার তুলনাই হয় না। আপনার কাছে আমার অনেক কিছু শেখার আছে।” সরোজ বিনীতভাবে বলল।

”তুমি যেভাবে খেলাতে চাও, সেইভাবে খেলার মতো প্লেয়ার আমাদের আছে কি?”

”নেই।” সরোজ চটপট জবাব দিল।

”তা হলে আমরা একটার পর একটা ম্যাচ হারব। শেষে পয়েন্ট ম্যানেজ করার নোংরা ব্যাপারে ক্লাব জড়াবেই, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। লাভ নেই সরোজ আর্টিস্টিক ফুটবলে। যতদিন না উপযুক্ত ছেলেদের পাচ্ছ ততদিন তোমার চিন্তা শিকেয় তুলে রাখো। আগে ক্লাবকে বাঁচাও, তারপর খেলা। আগে ছেলে জোগাড় করো, তাদের তৈরি করো। আগে ডিফেন্স করো, তারপর কাউন্টার অ্যাটাক। সর্বক্ষেত্রে এটাই সেরা পদ্ধতি, জীবনের ক্ষেত্রেও।”

”তার মানে যেমন চলছে চলুক!”

”হ্যাঁ, তবু এর মধ্যেই ডিফেন্সটাকে আরও শক্ত করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। তোমার যা কিছু ট্যাকটিকস, সত্তর মিনিটের পুরো খেলাটায়, সব কিছুর মূলেই জমি দখলের, স্পেস কভার করার চেষ্টা। ফাঁকা জমিতে বল পেলে বল কন্ট্রোল করার সময় পাওয়া যায়। স্পেসই হচ্ছে সময়। অপোনেন্টকে জমির সুবিধা না দেওয়া মানে সময় না দেওয়া। তাই এখন ম্যান টু ম্যান টাইট মার্কিং খেলা হয়। আমি তিন ব্যাকে খেলেছি, অনেক গলদ তখন ডিফেন্সে ছিল। চার ব্যাকে সেটা বন্ধ হয়েছে। আগে উইঙ্গাররা পঁচিশ গজ পর্যন্ত ছাড়া জমি পেত, চার ব্যাকে সেটা পাঁচ গজ পর্যন্ত কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু চার ব্যাকেও লক্ষ করেছ, শোভাবাজার সামলাতে পারে না।”

”আপনি কি পাঁচ ব্যাকে খেলাতে চান।”

”প্রায় তাই। চার ব্যাকের পিছনে একজন ফ্রি ব্যাক রেখে খেলে দেখলে কেমন হয়। ফরোয়ার্ড থেকে একজনকে হাফে আনা যায়, দু’জনকেও আনা যায়। ফরমেশানটা ১—৪—৩—২ হবে।”

”আপনি কাতানাচ্চিচও ডিফেন্স চাইছেন অর্থাৎ ফুটবলকে খুন করতে চাইছেন?”

সরোজ হঠাৎ গোঁয়ারের মতো রেগে উঠল। কমল এই রকম একটা কিছু হবে আশা করেছিল। সে বলল, ”মোহনবাগানের কাছে আমরা পাঁচ গোল খেয়ে দুটো পয়েন্ট হারাতুম না এই ফরমেশনে খেললে। একটা পয়েন্ট পেতুমই। সেটা কি মন্দ ব্যাপার হত? তুমি মিড ফিল্ড খেলার ওপর বড় বেশি জোর দাও, কিন্তু এখন ওটার আর কোনও গুরুত্বই নেই। এখন লড়াই পেনাল্টি এরিয়ার মাথায়—অ্যাটাকিং অ্যাঙ্গেলকে সরু করে গোলে শট নেওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে। তুমি এটা বুঝছ না কেন, গোল করাই হচ্ছে খেলার একমাত্র উদ্দেশ্য, খেলা জেতা যায় গোল করেই। শোভাবাজারের ক্ষমতা নেই গোল দেওয়ার কিন্তু গোল খাওয়া তো বন্ধ করতে পারে।”

”কমলদা, আপনার আর আমার চিন্তাধারা এক খাতে বোধ হয় বইছে না। শোভাবাজার টিম যতদিন আমার হাতে থাকবে, আমি আমার চিন্তা অনুসারেই খেলাতে চাই।”

সরোজ কঠিন এবং দৃঢ়স্বরে যেভাবে কথাগুলি বলল তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না, আর তর্ক করতে সে রাজি নয়। কমল মুখটা ঘুরিয়ে আলতো স্বরে বলল, ”বেশ।”

”কাল তা হলে খেলছেন?”

কমল মাথা হেলিয়ে হাসল।

।।সাত।।

দু’দিন কামাই করে কমল অফিসে এল। রণেন দাসকে চেয়ারে দেখতে পেল না। খাটো চেহারার ঘোষদা অর্থাৎ বিপুল ঘোষকে অবশ্য প্রতিদিনের মতো কাঁটায় কাঁটায় দশটায় চেয়ারে বসে কাগজে লাল কালিতে ”শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়’ লিখতে দেখা যাচ্ছে। প্রায় সাড়ে চারশো লোকের বিরাট পাঁচতলা অফিস বাড়িটা হট্টগোলে মুখর। সাড়ে দশটার আগে কেউ কলম ধরে না। কলমদের ডেসপ্যাচ বিভাগে তারা মাত্র তিনজন।

বিপুল তার নিত্যকর্ম সেরে কমলকে বলল, ”দু’দিন আসেননি, অসুখবিসুখ করেছিল?”

”এক আত্মীয় মারা গেলেন তাতেই ব্যস্ত ছিলাম। ঘোষদা, আপনার কাছে লিভ অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম আছে?”

বিপুল ড্রয়ার থেকে ছুটির দরখাস্তের ফর্ম বার করে দিল। কমল তাতে যা লেখার লিখে সেটা নিয়ে নিজেই গেল চারতলায় লিভ সেকশনে জমা দিতে। সেখানে অনুপম ঘোষালকে ঘিরে অল্পবয়সীরা জটলা করছে। অনুপম যুগের যাত্রীর উঠতি রাইট উইঙ্গার। রথীনই চাকরি করে দিয়েছে। কাল অনুপম হ্যাটট্রিক করেছে কুমারটুলির বিরুদ্ধে।

”আর একটা গোল কি অনুপমের হত না! সেকেন্ড হাফের শুরুতেই প্রসূন তিনজনকে কাটিয়ে যখন সেলফিসের মতো একাই গোলটা করতে গেল, তখন অনুপম তো ফাঁকায় গোল থেকে পাঁচ হাত দূরে। প্রসূন ওকে বলটা যদি দিত, তা হলে কি অনুপমের আর একটা গোল হত না? কী অনুপম, হত কি না?”

মৃদু হেসে অনুপম বলল, ”ফুটবল খেলায় কিছুই বলা যায় না।”

”প্রসূনকে তুই দোষ দিচ্ছিস কেন? অনুপমকে বল দেবে কি, ও তো তখন ক্লিয়ার অফ সাইডে!”

”বাজে কথা। অনুপম, তুই তখন অফ সাইডে ছিলিস কি?”

অনুপম গম্ভীর হয়ে মুখটা পাশে ফিরিয়ে বলল, ”লেফট ব্যাক আর আমি এক লাইনেই ছিলুম!”

”তবে, তবে! আমি কতদিন বলেছি প্রসূনটা নাম্বার ওয়ান সেলফিস। বল পেলে আর ছাড়ে না, একাই গোল দেবে। ওর জন্য যাত্রীর অনেক গোল কমেছে। বালী প্রতিভার দিন পাঁচটা গোল হল বটে, কিন্তু প্রসূন ঠিক ঠিক যদি বল দিতে অনুপমকে, অন্তত আরও পাঁচটা গোল হত। অনুপম হার্ডলি চারটে বলও প্রসূনের কাছ থেকে পেয়েছে কি না সন্দেহ। কী অনুপম, ঠিক বলেছি কি না?”

অনুপম উদাসীনের মতো হেসে বলল, ”যাকগে ওসব কথা।”

”হ্যাঁ হ্যাঁ, বাদ দে তো ফালতু কথা। প্রসূন বল দিল কি না দিল তাতে অনুপমের কিছু আসে যায় না। এর পরের ম্যাচ ইস্টার্ন রেল। অনুপম, আগেই কিন্তু বলে রাখছি, আমার ভাগ্নেটা ধরেছে খেলা দেখার জন্য।”

”সত্যদা, আজকাল ঢোকানো বড্ড শক্ত হয়ে পড়েছে। ডে—স্লিপ দেওয়ার ব্যাপারেও গোনাগুনতি।”

”ওসব কোনও কথা শুনব না। তোমায় ব্যবস্থা করে দিতেই হবে।”

অনুপম, সেকশনাল ইন—চার্জ নির্মল দত্তর টেবিলের দিকে এগোবার উদ্যোগ করে বলল, ”আচ্ছা দেখি।”

দত্তর কাছে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে অনুপম রোজই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে।

”অনুপম, ইস্টবেঙ্গলের দিন কিন্তু এই রকম খেলা চাই।”

অনুপম এগিয়ে যেতে যেতে হাসল মাত্র।

এবার ওদের চোখ পড়ল কমলের ওপর। দরখাস্তটা হাতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করছে।

”কী ব্যাপার কমলবাবু, ক্যাজুয়াল? এই টেবিলে রেখে যান।”

কমল রেখে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, একজন ডেকে বলল, ”আচ্ছা, আপনার কী মনে হয় অনুপমের খেলা সম্পর্কে? দারুণ খেলে, তাই নয়?”

”হ্যাঁ, দারুণ খেলে।”

”আপনি ওর এ বছরের সব ক’টা খেলাই দেখেছেন?”

”একটাও না।”

”তা হলে যে বললেন দারুণ খেলে!”

”আপনারা বলছেন তাই আমিও বললাম।”

”না না, ঠাট্টা নয়, সত্যি বলুন, ছেলেটার মধ্যে পার্টস আছে কি না। আপনার চোখ আর আমাদের চোখ তো এক নয়।”

কমল কয়েক মুহূর্ত ভাবল। তারপর কঠিন স্বরে বলল, ”শুধু খেলা দেখেই প্লেয়ার বিচার করবেন না। খেলা সম্পর্কে তার অ্যাটিচিউড, চিন্তা, সাধনা কেমন সেটাও দেখবেন। হয়তো ভাল খেলে। কিন্তু গোল থেকে পাঁচ হাত দূরে ফাঁকায় যে দাঁড়িয়ে, সে যদি বলে যে, গোল করতে পারতুম কি না কিছুই বলা যায় না, তা হলে আমি তাকে প্লেয়ার বলে মনে করব না।”

”পৃথিবীর বহু বড় প্লেয়ার এক হাত দূর থেকেও তো গোল মিস করেছে।”

”করেছে কি না জানি না, কিন্তু তারা কখনওই বলবে না—পাঁচ হাত দূরের থেকে গোল করতে পারব কি না! এই ‘কি না’ অর্থাৎ অনিশ্চয়তা, নিজের উপর অনাস্থা, কখনওই তাদের মুখ থেকে বেরোবে না। দুইকে দুই দিয়ে গুণ দিতে বললে, আপনার কি সন্দেহ থাকতে পারে, উত্তরটা চারের বদলে আর কিছু হবে?”

ঝোঁকের মাথায় কথাগুলো বলে কমল লক্ষ করল, শ্রোতাদের মুখে অসুখী ছায়া পড়েছে।

”আপনার কথাগুলো একদিক দিয়ে ঠিক, তবে কী জানেন, যোগ—বিয়োগটা শিশুকাল থেকে করে করে শ্বাস—প্রশ্বাসের মতো হয়ে যায়, আজীবন দুই দুগুণে চারই বলব। কিন্তু ফুটবল খেলাটা তো তা নয়, একটা বয়সে রপ্ত করে আর একটা বয়সে ছেড়ে দিতেই হয়। যত বড় প্লেয়ারই হোক, একই ভাবে সে খেলতে পারে না চিরকাল। আপনি যেভাবে একদিন চুনী কি প্রদীপ কি বলরামকে রুখতেন, পারবেন কি আজ সেই ভাবে অনুপমকে আটকাতে?”

বক্তার বলার ভঙ্গিতে তেরছা বিদ্রূপ ছিল। কমলের রগ দুটো দপদপ করে উঠল। পিছন দিক থেকে কে মন্তব্য করল, ”নখদন্তহীন বৃদ্ধ সিংহ!”

কমলের ইচ্ছে হল ঘুরে একবার দেখে, কথাটা কে বলল! কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে বলল, ”শিক্ষায় যদি ফাঁকি না থাকে, তা হলে যে স্কিল মানুষ পরিশ্রম করে অর্জন করে তা কখনও সে হারায় না, বয়স বাড়লেও।”

”তার মানে, আপনি আগের মতোই এখনও খেলতে পারেন?”

”না। কিন্তু অনুপমদের আটকাবার মতো খেলা বোধহয় এখনও খেলতে পারি।”

প্রত্যেকের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠে তারপর সেটি অবিশ্বাস্যতা থেকে মজা পাওয়ায় রূপান্তরিত হল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। কমলের মনে হল সে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।

”বুড়োবয়সে ল্যাজেগোবরে করে ছেড়ে দেবে।”

দাঁতে দাঁত চেপে কমল বলল, ”যাত্রীর সঙ্গে লিগে শোভাবাজারের তো দেখা হবেই, তখন দেখা যাবে’খন।”

কমল যখন চারতলার হলঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে, শুনতে পেল কে চেঁচিয়ে বলছে, ”ওরে চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেল। অনুপমকে জানিয়ে দিতে হবে।”

কমল নিজের সেকশনে আসামাত্রই রণেন দাস তাকে ডাকল, ”এই যে, ছিলেন কোথায় এই দু’দিন? ডুব মারবেন তো আগেভাগে বলে যেতে পারেন না? লোক তো তিনজন অথচ কাজ থাকে বারোজনের। তার মধ্যে একজন কামাই করলে কী অবস্থাটা হয়? এর উপর তিনটে বাজতে না বাজতেই তো প্লেয়ার হয়ে যাবেন।”

যে বিশ্রি মেজাজ নিয়ে কমল চারতলা থেকে নেমে এসেছে সেটা এখনও অটুট। তিক্ত স্বরে সে বলল, ”দরকার হয়েছিল বলেই ছুটি নিয়েছি। ছুটি নেবার অধিকারও আমার আছে।”

”অ। অধিকার আছে? রোজ তিনটের সময় বেরিয়ে যাওয়াটাও বুঝি অধিকারের মধ্যে!”

কমল জবাব দিল না। রণেন দাসকে সে একদমই পছন্দ করে না। লোকটা অর্ধেক সময় সিটে থাকে না। ক্যান্টিন অথবা ইউনিয়ন অফিসঘরে কিংবা চারতলা বা পাঁচতলায় গিয়ে পরচর্চায় সময় কাটায়, চুকলি কাটে আর ওভারটাইম রোজগারের তালে থাকে। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে, তিরিশ বছর প্রায় চাকরি করছে, এগারোশো টাকা মাইনে পায়, কিন্তু সিগারেটটা পর্যন্ত চেয়ে খায়। রণেন দাস ডেসপ্যাচের কর্তা।

দুপুর দুটো নাগাদ গেমস সেক্রেটারি নতু সাহা খাতা হাতে কমলের কাছে হাজির হল।

”কাল আপনাকে খুঁজে গেছি, আপনি আসেননি। আজ খেলা আছে বেঙ্গল টিউবের সঙ্গে ভবানীপুর মাঠে।” বলতে বলতে নতু সাহা খাতাটা খুলে এগিয়ে দিল। খাতায় টিমের খেলোয়াড়দের নাম লেখা। কমলের নামটি দু’জনের পরেই। সকলেরই সই আছে নামের পাশে।

প্রথমেই কমলের মনে পড়ল, আজ শোভাবাজারের খেলা আছে, তাকে খেলতেই হবে। কিন্তু সেকথা বললে নতু সাহা রেহাই দেবে না। রথীনের কথাগুলো মনে পড়ল—অফিসের দুটো খেলায় তুই খেলিসনি—এই নিয়ে কথা উঠেছে…তোকে চাকরি দেওয়ায় ইউনিয়ন থেকে পর্যন্ত অপোজিশন এসেছিল….তোর জন্য এ জি এম পর্যন্ত ধরাধরি করেছি।

কমল খাতায় নিজের নামটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে ভাবল, কী করে এখন! শোভাবাজারে আজ তাকে দরকার। সেখানকার টিমেও তার নাম আছে। ওই খেলারই গুরুত্বটা বেশি, কিন্তু এই খেলাটা চাকরির জন্য। অবশ্য খেলব না বলে দেওয়া যায় নতু সাহাকে। তা হলে তিনটে—চারটের সময় অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুবিধেটা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে।

”কী হল, সইটা করে দিন। একটু পরেই তো বেরোতে হবে।” অধৈর্য হয়ে নতু সাহা বলল।

”আমাকে আজ বাদ দেওয়া যায় না কি?”

”না না, আমাদের ডিফেন্সে আজ কেউ নেই। ফরোয়ার্ডে শুধু অনুপম। গোবিন্দ তো এক হপ্তার ছুটিতে গেছে, জহরের পায়ে চোট, আজ তো টিমই হচ্ছিল না।”

কমল আর কথা না বলে নিজের নামের পাশে সই করে দিল। সেই মুহূর্তে একবার সরোজের মুখটা সে দেখতে পেল—অসহায় এবং রাগে থমথমে।

.

।।আট।।

প্রগ্রেসিভ ব্যাঙ্কের ভ্যান ওদের চারটের সময় মাঠে পৌঁছে দিল। কমল লক্ষ করে, ভ্যানের এককোণে অনুপম বসে মাঝে মাঝে তার দিকে তাকাচ্ছিল, তাইতে ওর মনে হয়, নিশ্চয় কথাটা কানে গেছে। কমল অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। ড্রেস করে মাঠে নামতে গিয়ে সে দেখল, অনুপম ড্রেস করেনি। নতু সাহাকে কমল জিজ্ঞাসা করল, ”অনুপম নামবে না?”

”বলছে, দরকার হলে নামব। বড় প্লেয়ার, বুঝলেন না!” তির্যক স্বরে নতু সাহা বিরক্তি চাপতে চাপতে বলল, ”কিছু বলাও যাবে না, সারা অফিস জুড়ে অমনি ভক্তরা হইহই করে উঠবে।”

কমল হাসল। তার মনে পড়ল, এমন মেজাজ একদিন সে—ও দেখিয়েছে।

হাফটাইমে প্রগ্রেসিভ ব্যাঙ্ক তিন গোলে হারছে। বেঙ্গল টিউব চারবার মাত্র বল এনেছিল, আর তাতেই তিনটি গোল! একমাত্র রাইট আউট আর সেন্টার ফরোয়ার্ডটিই যা কিছু খেলছে এবং তাদের গোলের দিকে এগোনোর পথ কমল অনায়াসেই বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তা সে করল না ইচ্ছে করেই। দু’বার সে ট্যাকল করতে গিয়ে কাঁচা খেলোয়াড়ের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ল, আর একবার হেড করতে উঠল দু’সেকেন্ড দেরি করে। তাতেই গোল তিনটি হয়ে যায়।

হাফটাইমে মাঠ থেকে বেরিয়ে এসেই কমলের চোখে পড়ল, অনুপম ড্রেস করে তার জনাচারেক ভক্তর সঙ্গে কথা বলছে। কমল মনে মনে হাসল। নতু সাহা বিরক্ত ও উত্তেজিত হয়ে ছুটে এসে কমলকে বলল, ”এভাবে গোল খাওয়ার মানে হয়? অ্যালেন লিগের প্লেয়ারও অমন করে চার্জ করে না, আপনি যা করলেন।”

কমল কথা না বলে ঘাসের উপর বসে পড়ে লিমনেডের একটা বোতল তুলে নিল।

”লোকে যে কেন আপনাকে বড় প্লেয়ার বলত বুঝি না!”

মুখ থেকে বোতলটা নামিয়ে কমল হেসে নিচু গলায় বলল, ”আর গোল হবে না। আপনারা যাকে বড় প্লেয়ার বলেন, তাকে এবার গোল শোধ করতে বলুন।”

”সেজন্য ভাবছি না। অনুপম খানপাঁচেক অনায়াসেই চাপিয়ে দেবে। কিন্তু দোহাই আর গোল খাওয়াবেন না।”

কমল খালি বোতলটা রেখে উঠে দাঁড়াল। একটু দূরে বেঙ্গল টিউবের খেলোয়াড়রা বসে জিরোচ্ছে। কমল লক্ষ করেছে, ওদের লেফট হাফ বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা ছেলেটি এলোপাথাড়ি পা চালায়, পাস দিতে গিয়ে কেমন গোলমাল করে ফেলে, বিন্দুমাত্র কন্ট্রোল নেই বলের উপর কিন্তু দম আর বেপরোয়া গোঁয়ার্তুমিটা আছে। যার ফলে যেখানে বল সেইখানেই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো গুঁতোতে ছুটছে। বল ধরতে গিয়েও ওকে দেখে অনেকেই বল ছেড়ে সরে যাচ্ছে।

কমল ওর কাছে গিয়ে বলল, ”দারুণ খেলছো তো। প্রগ্রেসিভকে তো দেখছি তুমি একাই রুখে দিয়েছ।”

আনন্দে এবং লজ্জায় ছেলেটি মাথা চুলকোতে লাগল। কমল গুহর কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া সাধারণ ব্যাপার নয়।

”তবে এবার তোমার কপালে দুঃখ্যু আছে।”

সচকিত হয়ে ছেলেটি বলল, ”কেন, কেন?”

”এবার অনুপম নামছে। ও বলেছে—পাঁচখানা চাপাব, বেঙ্গল টিউব আবার টিম নাকি?”

কমল লক্ষ করল, ছেলেটির মুখ রাগে থমথমে হয়ে উঠল।

”দেখি তুমি কত ভাল প্লেয়ার, এইবার বুঝব।” এই বলে কমল সরে এল।

খেলা আবার শুরু হয়ে বল মাঝ—মাঠেই রইল মিনিট পাঁচেক। অনুপম কোমরে হাত দিয়ে ডান টাচ লাইনের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বিরক্ত হয়ে ভিতরে ঢুকে এল বলের আশায়।

বল পেল অনুপম। কাটাল একজনকে, পরের লোকটাকেও। কমল দেখল টিউবের লেফট হাফ প্রায় চল্লিশ গজ থেকে ছুটে আসছে। সামনে তিন ডিফেন্ডার। অনুপম বল থামিয়ে দেখছে কাকে দেওয়া যায়। চোখে পড়ল বুলডোজারের মতো আসছে লেফট হাফ। অনুপম তাড়াতাড়ি বলটা নিজেদের সেন্টার ফরোয়ার্ডকে ঠেলে দিয়ে সরে দাঁড়াল। লেফট হাফ ব্রেক করতে পনেরো গজ এগিয়ে গেল এবং তারপরই ঘুরে আবার বলের দিকে তাড়া করল।

অনুপমের দেওয়া বল সেন্টার ফরোয়ার্ড রাখতে পারেনি। বল এল কমলের পায়ে। অবহেলায় সে ছোট্ট জায়গার মধ্যে পাঁচ—ছয়বার কাটিয়ে নিতে নিতে দেখে নিল অনুপম ও তার প্রহরী লেফট হাফটি কোথায়। তারপর অনবদ্য ভাবে ঠিক দু’জনের মাঝ বরাবর বলটা ঠেলে দিল, যাতে ছুটে গিয়ে অনুপমকে পাসটা ধরতে হয়।

অনুপম ছুটে গিয়ে বলে পা দিতে যাবে, তখন আর একটি পা সেখানে পৌঁছে গেছে। টায়ার ফাটার মতো চার্জের শব্দ হল। বলটা ছিটকে এল প্রগ্রেসিভের হাফ লাইনে। পর পর তিনবার কমল থ্রু দিল অনুপমকে, অবশ্যই লেফট হাফের দিকে ঘেঁষে। সবাই দেখল, অনুপম বল ধরতে পারল না বা ছুটেও থমকে পড়ল। রাইট উইং থেকে সে লেফট উইংয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে লেফট হাফও ডানদিকে চলে এল। মাঠের বাইরে মুখ টিপে অনেকে হাসল। কমল দেখল, অনুপমের মুখে রাগ, বিরক্তি ও হতাশা।

আবার অনুপমকে বল বাড়াল কমল। টিউব যেন জেনে গেছে সব বল অনুপমকেই দেওয়া হবে। তিনজন ওর উপর নজর রেখে ওর কাছাকাছি ঘুরছে। অনুপম বলটা ধরার জন্য এক হাতও এগোল না। বরং দু’হাত নেড়ে চিৎকার করতে করতে সে কমলের কাছে এসে বলল, ”আমাকে কেন, আমাকে কেন। বল দেবার জন্য আর কি মাঠে লোক নেই?”

অবাক হয়ে কমল বলল, ”সে কী, অফিসে শুনলুম, কাল প্রসূন বল দেয়নি বলে তুমি তিনটের বেশি গোল পাওনি!”

অনুপম আর কথা বলেনি। মাঠের মধ্যে সে ছোটাছুটি শুরু করল, লেফট হাফের পাহারা থেকে মুক্তি পাবার জন্য। তার তখন একমাত্র চিন্তা—চোট যেন না লাগে। এর পরই কমল বল নিয়ে উঠল। এগোতে এগোতে টিউবের পেনাল্টি এরিয়ার কাছে পৌঁছে অনুপমকে বল দেবার জন্য তার দিকে ফিরে হঠাৎ ঘুরে গিয়ে একজনকে কাটিয়েই প্রায় ষোলো গজ থেকে গোলে শট নিল। টিউবের কেউ ভাবতে পারেনি, অনুপমকে বল না দিয়ে কমল নিজেই আচমকা গোলে মারবে। বল যখন ডান পোস্টের গা ঘেঁষে গোলে ঢুকছে, গোলকিপার তখনও অনুপমের দিকে তাকিয়ে বাঁ পোস্টের কাছে দাঁড়ানো।

তিন মিনিট পরে ঠিক একই ভাবে কমল আবার গোল দিল। টিউব এবার অনুপমকে ছেড়ে কমল সম্পর্কে সজাগ হয়ে পড়ল। খেলা শেষ হতে চার মিনিট বাকি, রেজাল্ট তখন ৩—২। প্রগ্রেসিভ হারছে। কমল বল নিয়ে আবার উঠতে শুরু করল, তিন জনকে কাটিয়ে সে বল দিল রাইট ইনকে। সে আবার ফিরিয়ে দিল কমলকে। অনুপমের প্রহরী তেড়ে আসছে। কমল বলটা রেখে অপেক্ষা করল এবং শেষ মুহূর্তে নিমেষে বল নিয়ে সরে দাঁড়াল। লেফট হাফ ফিরে দাঁড়িয়ে আবার তেড়ে এল। কমল আবার একই ভাবে এগিয়ে এল। কমল ডান পায়ে বল মারার ভঙ্গি করে চেঁচিয়ে উঠল, ”অনুপম!”

অনুপম বাঁ দিক দিয়ে এগিয়ে গেল বলের আশায়। তার সঙ্গে গেল টিউবের তিনজন। কমল বাঁ পায়ে বলটা ঠেলে দিল দুজন ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে পেনাল্টি বক্সের মাঝখানে। আর রাইট ইন, যে বল সে একশোটার মধ্যে আটানব্বুইটা গোলের বাইরে মারবে, সে—ই বল গোলে পাঠিয়ে দিল।

খেলা শেষে নতু সাহা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল কমলের দিকে। কমল থমকে দাঁড়িয়ে অনুপমকে বলল, ”পাস কখন দেবে, কেন দেবে এবং দেবে না, সেটা প্রসূন জানে। বল পেয়ে খেলা যেমন, না পেয়েও তেমন একটা খেলা আছে। সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

অনুপমের কাঁধে একটা চাপড় দিয়ে নতু সাহার হাতটা সরিয়ে কমল টেন্টের দিকে এগিয়ে গেল।

বাড়ি ফেরার পথে সে ট্রামে শুনল, শোভাবাজার তিন গোলে রাজস্থানের কাছে হেরেছে।

.

।।নয়।।

পরদিন অফিসে পৌঁছোনো মাত্র কমল শুনল, রথীন তাকে দেখা করতে বলেছে। ওর চেম্বারে ঢুকতেই রথীন টেলিফোনে কথা বলতে বলতে ইশারায় কমলকে বসতে বলল।

”তারপর,” রথীন টেলিফোন রেখে বলল, ”কাল নাকি দারুণ খেলেছিস!”

”কে বলল!” কমল ভাবতে শুরু করল, রথীনকে এর মধ্যেই কে খবর দিতে পারে!”

”যেই বলুক না। তিন গোল খাইয়ে অনুপমকে মাঠে নামিয়েছিস, এমন থ্রু বাড়িয়েছিস যাতে না ও ধরতে পারে, তারপর গোল দিয়ে মান বাঁচিয়েছিস। সাবাস, অসাধারণ! এক ঢিলে তিন পাখি—একেই বলে।”

কমল কথা না বলে ফিকে হাসল। রথীনের মুখ থমথম করছে।

”একজন সিনিয়ার প্লেয়ার জুনিয়ারকে মাঠের মাঝে অপদস্থ করবে ভাবা যায় না। আনস্পোর্টিং।”

কমল শক খেয়ে সিধে হয়ে বসল। রাগটা কয়েকবার দপদপ করে উঠল চোখের চাউনিতে।

”ব্যাপারটা কী? অনুপম তোর ক্লাবের প্লেয়ার বলেই কি আমি আনস্পোর্টিং?”

”আমার ক্লাব বলে কোনও কথা নয়। একটা উঠতি প্রমিসিং ছেলে, তাকে হাস্যকর করে তুললে সাইকোলজিক্যালি তার একটা সেটব্যাক হয়। এবছর যাত্রীর ফরোয়ার্ড লাইনে অনুপম অত্যন্ত ইম্পর্টান্ট রোল প্লে করছে। যাত্রী শিল্ড পেয়েছে কিন্তু লিগ পায়নি কখনও। আমার আমলে যাত্রীকে আমি লিগ এনে দেব। এ বছর নিখুঁত যন্ত্রের মতো যাত্রী খেলছে। আমি চাই না এর সামান্য একটা পার্টসও বিগড়ে যাক। আমি তা হতে দেব না।” রথীনের মুঠো করা হাতটার দিকে কমল তাকাল। হিংস্র আঘাতের জন্য মুঠোটা তৈরি। কমল নির্লিপ্ত স্বরে বলল, ”আমি কি এবার উঠতে পারি?”

কঠিন চোখে রথীন তাকাল। কমলও।

”আমার কথাটা আশা করে বুঝিয়ে দিতে পেরেছি।”

কমল ঘাড় নাড়ল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ”একশো টাকাটা এখনও শোধ দিতে পারিনি, হাতে একদমই টাকা নেই। সামনের মাসে মাইনে পেলেই দিয়ে দেব।”

”না দিলেও চলবে। একশো টাকার জন্য যাত্রী মরে যাবে না।”

”কত টাকার জন্য তা হলে মরতে পারে?”

”মানে!”

”পাঁচ হাজার?”

রথীনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কমল সেটা লক্ষ করে বলল, ”আমার মনে হয় না যুগের যাত্রী খুব একটা স্পোর্টিং ক্লাব।”

”এখন তুমি যেতে পারো।’ রথীন দরজার দিকে আঙুল তুলল।

কমল নিজের চেয়ারে এসে বসা মাত্র বিপুল ঘোষ ফিসফিস করে বলল, ”কাল কী রকম খেলেছেন মশাই, অফিসের ছোকরারা খাপ্পা হয়ে গেছে। আপনি নাকি খুব বড় একজন প্লেয়ারকে খেলতে না দিয়ে একাই খেলেছেন?”

”হ্যাঁ।”

”কত বড় প্লেয়ার সে!”

”মস্ত বড়। আট হাজার টাকা নাকি পায়।”

”আ—ট! বলেন কী মশাই, সাত ঘণ্টা চোদ্দো বছর ধরে কলম পিষে আজ পাচ্ছি বছরে আট হাজার। আর এরা একটা বলকে লাথি মেরে পাচ্ছে আট হাজার টাকা! তার সঙ্গে চাকরির টাকাটাও ধরুন।”

”পাক না টাকা। ভালই তো। কলম পেষার থেকে ফুটবল খেলা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।”

কমল আলোচনা বন্ধের জন্য চিঠির গোছা সাজাতে শুরু করল। এগুলোর কুষ্ঠি—ঠিকুজি এখন খাতায় এন্ট্রি করতে হবে। তারপর খামে ভরে দপ্তরির কাছে পাঠানো স্ট্যাম্প দিয়ে ডাকে পাঠাবার জন্য। ভুল হয়ে গেলে একের চিঠি অন্যের কাছে চলে যাবে। চাকরি নিয়ে তখন টানাটানি পড়বে।

রণেন সাহা এতক্ষণ একমনে কাজ করছিল। মাথা না তুলে এবার বলল, ”আজও তিনটের সময় চলে যাবেন নাকি?”

”কেন!” কমল বলল।

”কাল যে দুটো গোল করেছেন।”

কমল হেসে উঠল।

ছুটির কিছু আগে ফোন এল কমলের। অরুণার গলা: ”কমলদা, একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। বেলেঘাটায় একটা স্কুলে টিচার নেওয়া হচ্ছে। তোমাদের ক্লাবের সেক্রেটারির সঙ্গে একবার আলাপ করিয়ে দেবে? উনি ওই স্কুলের কমিটিতে আছেন। যদি চাকরিটা পাই, তা হলে এখন যেটা করি সেটা বরুণাকে দিয়ে দেব।”

কমল ওকে জানাল, ক্লাবে গিয়ে কেষ্টদার সঙ্গে সে আজকেই কথা বলবে।

অফিস থেকে বেরিয়ে কমল হেঁটেই ময়দানে যায়। আজ যাবার পথে সারাক্ষণ রথীনের কথাগুলো, তার আচরণের পরিবর্তন এবং সব থেকে বেশি ‘আনস্পোর্টিং’ শব্দটি কমলের মাথার মধ্যে ঠকঠক করে আঘাত করতে লাগল।

”এই যে। আপনার কাছেই যাব ভাবছিলুম। দেখা হয়ে ভালই হল।”

চমকে উঠে কমল দেখল, সাংবাদিক সামনে দাঁড়িয়ে। হেসে বলল, ”কেন?”

”একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি, আপনি কি রিটায়ার করেছেন?”

”সে কী! কোথায় শুনলেন?”

”কাল যুগের যাত্রীর টেন্টে গেছলুম। সেখানে প্রতাপ ভাদুড়ি বলল আপনি নাকি রিটায়ার করেছেন।”

চলতে চলতে কমল বলল, ”আচ্ছা, তাই নাকি! আর কী শুনলেন?”

”যাত্রীর কে যেন কাল অফিস লিগে আপনার খেলা দেখতে গিয়েছিল। তার সঙ্গেই আলোচনা করছিল প্রতাপ ভাদুড়ি। আপনি অনুপমকে নাজেহাল করেছেন শুনে বলল, কমল তো শুনছি রিটায়ার করে গেছে। ওকে কিছু টাকা বেনিফিট হিসাবে দেব ভাবছি, অনেক বছর যাত্রীতে খেলে গেছে তো।”

”কত টাকা দেবে কিছু বলেছে?”

”না।”

”শোভাবাজারের পরের ম্যাচেই আমি খেলছি।”

”তা হলে রিটায়ার করেননি!”

কমল জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল বিস্মিত সাংবাদিককে ভিড়ের মধ্যে ফেলে রেখে।

শোভাবাজার টেন্টে ঢোকার মুখেই কমলের সঙ্গে দেখা হল সত্য আর বলাইয়ের।

”কাল আপনি এলেন না কমলদা? খেলা আরম্ভ হবার পাঁচ মিনিট আগে পর্যন্ত সরোজদা আপনার জন্য অপেক্ষা করেছে।”

”অফিস আটকে দিল।” কমল অপ্রতিভ হয়ে বলল। ”খেললি কেমন তোরা?”

বলাই হেসে বলল, ”আর খেলা! আপনার জায়গায় স্বপনকে নামানো হয়েছিল। তিনটে গোল ওই খাওয়াল।”

”লাস্ট গোলটা, বুঝলেন কমলদা, যদি দেখতেন তো হাসতে হাসতে মরে যেতেন। ওদের শ্যামল বোস দুটো গোল করেছে। রাইট আউট বল নিয়ে এগোচ্ছে। স্বপন ট্যাকল করতে কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে এগিয়ে হঠাৎ ঘুরে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে শ্যামল বোসের কাছে দৌড়ে এসে দাঁড়াল। ওদিকে রাইট আউট ফাঁকায় এগিয়ে এসে গোল করে দিল। আমরা তো অবাক। বললুম—স্বপন, তুই ওভাবে ছেড়ে দিয়ে এদিকে দৌড়ে এলি কেন? কী বলল জানেন! যদি শ্যামল বোসকে বল দিত আর যদি শ্যামল বোস গোল করত তা হলে ওর হ্যাটট্রিক হয়ে যেত না?”

বলতে বলতে সত্য হো হো করে হেসে উঠল। বলাইও। ”বুঝলেন কমলদা, উফফ, স্বপন হ্যাটট্রিক করতে দেয়নি। ওহঃ, গোল খাও, পরোয়া নেই, হ্যাটট্রিক হোনে নেহি দেগা।”

কমলও হাসল। তারপর চোখে পড়ল, ভরত টেন্টের মধ্যে চেয়ারে বসে তাদের দিকেই তাকিয়ে। কমল এগিয়ে এসে বলল, ”সরি ভরত।”

”আপনি থাকলে কাল গোল খেতুম না।”

”কী করব, অফিসের খেলা ফেলে আসতে পারলাম না।”

”কমলদা, শোভাবাজারে ন’বছর আছি। ফার্স্ট গোলি সাত বছর ধরে। এমন জঘন্য টিম কোনও বার দেখিনি। থার্ড ডিভিশনেও এরা খেলার যোগ্য নয়। না আছে স্কিল না আছে ফুটবল সেন্স। পারে শুধু গালাগালি আর লাথি চালাতে। বলাই, সত্য, শ্রীধর তিনজনকেই রেফারি ওয়ার্ন করেছে। স্বপন যতই বোকামি করুক, প্রাণ দিয়ে খেলেছে ওর সাধ্য মতো।”

”নেকস্ট ম্যাচ কার সঙ্গে? বাটা?”

”হ্যাঁ।”

সেক্রেটারির ঘর থেকে এই সময় সরোজ বেরোল। কমলকে দেখেই গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।

”আসতে পারলাম না সরোজ।”

”জানি, অফিসের হয়ে খেলেছেন।”

”পরের ম্যাচে অবশ্যই খেলব। তাতে চাকরি যায় যাবে।”

”সরি কমলদা, টিম হয়ে গেছ। স্বপনই খেলবে।”

”সরোজ, আমি রিটায়ার করেছি বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ওটা মিথ্যা রটনা প্রমাণ করতে আমাকে নামতেই হবে মাঠে।”

”টিম আর বদলানো যাবে না।” সরোজ স্বরে কাঠিন্যের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ”অন্য ম্যাচে খেলবেন।”

শোভাবাজারের মতো নগণ্য টিমের অতি নবীন কোচ যে এভাবে তার সঙ্গে কথা বলবে, কমলের তা কল্পনার বাইরে। কথা না বাড়িয়ে সে সেক্রেটারির ঘরে ঢুকল।

কৃষ্ণ মাইতি বাড়িতে তিন—চার টাকার বেশি বাজার করেন না। বাইরে লুকিয়ে রসনা—তৃপ্তিকর খাদ্য উদরস্থ করাই তাঁর জীবনের একমাত্র শখ। আস্ত চিকেন রোস্ট নিয়ে ধস্তাধস্তি করছিলেন। যখন কমল সামনে এসে বসল, কথা না বলে একবার তাকালেন শুধু তিনি।

”সামনের ম্যাচ বাটার সঙ্গে। কেষ্টদা, আমি খেলতে চাই।”

”বেশ তো, নিশ্চয় খেলবি।”

”সরোজ টিমে আমার নাম রাখেনি।”

”সে কী!” কৃষ্ণ মাইতি চিৎকার করে উঠলেন, ”সরোজ, সরোজ!”

সরোজ ঘরে ঢোকা মাত্র বললেন, ”কমল বাটা ম্যাচ খেলবে।”

”কিন্তু—” সরোজ কড়া চোখে কমলের দিকে তাকাল।

”কিন্তুটিন্তু নয়। কমল কলকাতা মাঠের সব থেকে সিনিয়ার প্লেয়ার। বড় বড় টিম এখনও মাঠে ওকে দেখলে ভয়ে কাঁপে। ও খেলতে চেয়েছে, খেলবে।”

”কিন্তু কেষ্টদা, আমি টিমটা অনেক ভেবেই করেছি একটা বিশেষ প্যাটার্নে খেলাব বলে। তা ছাড়া কমলদা তো একদিনও প্র্যাকটিস করলেন না ছেলেদের সঙ্গে।”

”প্র্যাকটিস!” কেষ্টদা দারুণ বিষম খেলেন। কয়েকবার ব্রহ্মতালু থাবড়ে নিয়ে ধাতস্থ হয়ে বললেন, ”প্যাটার্ন, প্র্যাকটিস সব হবে, সব হবে। যা বললুম তাই করো। কমল খেলবে।”

”আচ্ছা।”

সরোজ বেরিয়ে যাবার সময় কঠিন দৃষ্টি হেনে গেল কমলের দিকে।

”বুঝলে কমল, বাবুরা কোচিং করে ক্লাবকে উদ্ধার করবে। শেষ দিকে পয়েন্ট ম্যানেজ করে তো রেলিগেশন থেকে বাঁচতে হবে। ওঠা—নামা যদ্দিন বন্ধ ছিল, বুঝলে, শান্তিতে ছিলুম।”

”কেষ্টদা, আপনি যে মেয়েদের স্কুলের কমিটি মেম্বার, সেখানে টিচার নেওয়া হচ্ছে। আমার একজন পরিচিত অ্যাপ্লাই করেছে। আপনি একটু দেখবেন?”

”কে হয় তোর?”

”পল্টু মুখার্জির বড় মেয়ে।”

ভ্রূ কুঁচকে কৃষ্ণ মাইতি আঙুলে লেগে থাকা ঝোল চাটতে চাটতে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ”আচ্ছা দেখব’খন। কিন্তু তোর সঙ্গে একটা কথা আছে। যুগের যাত্রীর সঙ্গে লিগের প্রথম খেলা সতেরোই। পয়েন্ট নিতে হবে। যদি নিতে পারিস, তা হলে চাকরিটা হবে।”

কমল অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। চাকরি দেবার এরকম অদ্ভুত শর্তের কারণ সে বুঝতে পারছে না।

”কেষ্টদা, তা কী করে হয়!”

”হতেই হবে। পয়েন্ট দে, আমিও তা হলে চেষ্টা করব। গুলোকে আমি একবার দেখে নেব। গত বছর কথা ছিল, ম্যাচ ছেড়ে দিলে আর গভর্নিং বডির মিটিংয়ে কালীঘাটের সঙ্গে গণ্ডগোল বন্ধ হয়ে যাওয়া খেলাটা রি—প্লে হওয়ার পক্ষে ভোট দিলে সাতশো টাকা দেবে টেন্ট সারাতে। ম্যাচ ছাড়ার আর দরকার হয়নি, এমনিতেই যাত্রী চার গোল দিয়েছে। ভোট দিয়েছিলুম কিন্তু যাত্রী জিততে পারেনি। ব্যস, ব্যাটা আর টাকা ঠেকাল না। যদি পারিস ফার্স্ট ম্যাচে পয়েন্ট নিতে তা হলে ভয় খাবে, রিটার্ন লিগ ম্যাচে সুদে—আসলে তখন কান মলে আদায় করে নেব। পল্টু মুখুজ্যের মেয়ের চাকরি, কমল এখন তোর হাতে।”

কমল কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না, শুধু তাকিয়ে রইল চশমার পিছনে পিটপিটে দুটো চোখের দিকে। যাত্রীকে পয়েন্ট থেকে বঞ্চিত করার ইচ্ছাটা তারও প্রবল। কিন্তু কৃষ্ণ মাইতির ইচ্ছাটার সঙ্গে তারটির কিন্তু ভীষণ অমিল। সব থেকে অস্বস্তিকর ও ভয়ের ব্যাপার এই শর্তটা। যাত্রীর কাছ থেকে পয়েন্ট নেওয়া একার সাধ্যে সম্ভব নয়। বয়স হয়েছে, দমে কুলোয় না। এজিলিটি কমে গেছে, স্পিডও। শুধু অভিজ্ঞতা সম্বল করে একটা তাজা দলের সঙ্গে একা লড়াই করা যায় না। তার থেকেও বড় কথা, অরুণার চাকরি পাওয়া যদি যাত্রীর সঙ্গে খেলার ফলের উপর নির্ভর করে, তবে সেটা একটা বাড়তি চাপ হবে মনের উপর।

কমলের মনের মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল এক বৃদ্ধের ছবি। কী যেন বলছেন, কমল মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করল, তারপর বিড়বিড় করে বলল, ”ব্যালান্স! হ্যাঁ পল্টুদা, ব্যালান্স রাখতে হবে।”

”ব্যালান্স কী রে, পয়েন্ট চাই।”

কমল উঠে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল, ”আমি চেষ্টা করব।”

.

।।দশ।।

কিক অফের বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে কমলের শরীরে হালকা একটা কাঁপন লাগল। গত বছর আই এফ এ শিল্ডের প্রথম রাউন্ডে এই মহমেডান মাঠেই শেষবার খেলেছে। তারপর ঘেরা মাঠে আজ প্রথম। প্রত্যেকবার, গত কুড়ি বছরই, কিক অফের বাঁশি শুনলেই তার শরীর মুহূর্তের জন্য কেঁপে ওঠে। স্নায়ুগুলো নাড়াচাড়া খেয়ে আবার ঠিক হয়ে যায়। তারপর প্রত্যেকটা কোষ ফেটে পড়ার জন্য তৈরি হয়ে উঠতে শুরু করে।

কমল অনুভব করল আজকেও সে তৈরি। বাটা আলস্যভরে খেলা শুরু করেছে। বল নিয়ে ওরা মাঝখান দিয়ে ঢুকছিল, রাইট হাফ সত্য চার্জ করে বলটা লম্বা শটে ডান কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে পাঠিয়ে দিল। কমল বিরক্ত হল। অযথা বোকার মতো বলটা নষ্ট করল। উইং রুদ্র তখন সেন্টার ফ্ল্যাগের কাছে, তার পক্ষে ওই বল ধরা সম্ভব নয়। তবু রুদ্র দৌড়িয়ে খানিকটা দম খরচ করল।

পেনাল্টি এরিয়ার ১৮ × ৪৪ গজ জায়গা নিয়ে কমল খেলতে থাকে। দু’বার তাকে বল নিয়ে আগুয়ান ফরোয়ার্ডকে চ্যালেঞ্জ করতে হয়েছে এবং দু’বারই বল দখল করেছে। নির্ভুল বল দিয়েছে ফরোয়ার্ডদের, কাঁচা ছেলে স্বপন নিজের জায়গা ছেড়ে বলের পিছনে যত্রতত্র ছুটছে, তাকে কোথায় পজিশন নিতে হবে বার বার চেঁচিয়ে বলছে, বল নিয়ে ওঠার মতো ফাঁকা জমি পেয়েও সে প্রলোভন সামলেছে। খেলা পনেরো মিনিটে গড়াবার আগেই কমল নিজের সম্পর্কে আস্থাবান হয়ে উঠল।

সবুজ গ্যালারিতে দুটি মাত্র লোক। হাওড়া ইউনিয়নের মেম্বার—গ্যালারিতে জনা পনেরো লোক। ওরা রোজই আসে, খেলার পরও সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকে। মহমেডান মেম্বার—গ্যালারিতেও কিছু লোক। খেলা চলছে উদ্দেশ্যবিহীন, মাঝ মাঠে। কিন্তু এরই মধ্যে কমল লক্ষ করল, শোভাবাজারের তিন—চারজনের যেন খেলার ইচ্ছাটা একদমই নেই। বিপক্ষের পায়ে বল থাকলে চ্যালেঞ্জ করতে এগোয় না, ট্যাকল করতে পা বাড়ায় না, বল নিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলে তাড়া করে না। কমল ক্রমশ অনুভব করতে লাগল যে, তার ওপর চাপ পড়ছে। মাঝমাঠে যে বাঁধটা রয়েছে তাতে একটার পর একটা ছিদ্র দেখা দিচ্ছে আর অবিরাম বল নিয়ে বাটা এগিয়ে আসছে।

কিন্তু অবাক হল কমল, রাইট ব্যাকে স্বপনের খেলা দেখে। যেখানেই বল সেখানেই স্বপন। এলোপাথাড়ি পা চালিয়ে, ঝাঁপিয়ে, লাফিয়ে সে নিজেকে হাস্যকর করে তুললেও, কমল বুঝতে পারছে, ওর এই ভাবে খেলাটা ফল দিচ্ছে। নিজের জায়গা ছেড়ে ছোটাছুটি করলেও কমল ওকে আর নিষেধ করল না। তবে ডান দিকের বিরাট ফাঁকা জায়গাটা বিপজ্জনক হয়ে রইল।

হাফটাইমের পর প্রথম মিনিটেই শোভাবাজার গোলকিক পেয়েছে। ভরত বলটা গোল এরিয়ার মাথায় বসাবার সময় কমলকে বলল, ”সত্য, শম্ভু, বলাই মনে হচ্ছে বেগোড়বাই শুরু করেছে। কমলদা, আপনি রুদ্রকে নেমে এসে ডানদিকটা দেখতে বলুন।”

কমল কিক করার আগে শুধু বলল, ”আর একটু দেখি।”

কিন্তু এক মিনিটের মধ্যেই বাটা পেনাল্টি কিক পেল। লেফট ব্যাক বলাই অযথা দু’হাতে বলটা ধরল, যেটা না ধরলে ভরত অনায়াসেই ধরে নিত। ভরত তাজ্জব হয়ে বলল, ”এটা তুই কী করলি?”

বলাই মাথায় হাত দিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ”একদম বুঝতে পারিনি। ভাবলুম তুই বোধ হয় পজিশনে নেই, বলটা গোলে ঢুকে যাবে।”

ভরত বিড়বিড় করে কয়েকটা শব্দ উচ্চচারণ করে গোলে দাঁড়াল এবং পেনাল্টি কিক হবার পর গোলের মধ্য থেকে বলটা বার করে প্রবল বিরক্তিতে মাটিতে আছাড় মারল।

”বলাই!” গম্ভীর স্বরে কমল বলল, ”তুমি রাইট উইংয়ে যাও। আর রুদ্র, তুমি নেমে এসে খেলো।”

বলাই উদ্ধতভাবে প্রশ্ন করল, ”কেন? আমি পজিশান ছেড়ে খেলব কেন?”

”আমি বলছি খেলবে।”

”আপনি অর্ডার দেবার কে? ক্যাপ্টেন দেবীদাস কিংবা কোচ সরোজদা ছাড়া হুকুম দেবার অধিকার কারোর নেই।”

কমল চুপ করে সরে গেল। সত্য চেঁচিয়ে বলাইকে জিজ্ঞাসা করল, ”কী বলছে রে?”

রাগে অপমানে ঝাঁপিয়ে উঠল কমলের মাথা। শুধুমাত্র স্বপন আর প্রাণবন্ধুকে দু’পাশে নিয়ে সে লড়াই শুরু করল। রুদ্র নেমে এসে খেলছে। এখন বাটাকে গোল দেবার কোনও কথাই ওঠে না। শোভাবাজার গোল না খাওয়ার জন্য লড়ছে সাত—আটজনকে সম্বল করে।

পঞ্চাশ মিনিটের পর থেকেই শোভাবাজার ডিফেন্স ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে শুরু করল। সত্য, শম্ভু, বলাই অযথা ফাউল করছে। তিনটে ফ্রি কিকের দুটি ভরত দুর্দান্তভাবে আটকেছে, অন্যটি ফিস্ট করে কর্নার করেছে। কমল দাঁতে—দাঁত চেপে পেনাল্টি এরিয়ার ফোকরগুলো ভরাট করে চলেছে আর চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছে স্বপন আর প্রাণবন্ধুকে। বাটার ছয়জন, কখনও আটজন আক্রমণে উঠে আসছে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আরও তিনটি গোল তারা দিল।

”কমলদা, আর আমি পারছি না।” হাঁফাতে হাঁফাতে স্বপন বলল। ছেলেটার জন্য কষ্ট হচ্ছে কমলের। কিন্তু সেটা প্রকাশ করার বা ওকে ঢিলে দিতে বলার সময় এখন নয়। চার গোল খেয়েছে শোভাবাজার। বাটার দুজনের জন্য তাদের একজন। সংখ্যার অসমত্ব নিয়ে লড়াই অসম্ভব। খেলাটা এখন এলোপাথাড়ি পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাটা গোল না দিয়ে শোভাবাজারকে নিয়ে এখন ছেলেখেলা করছে।

”তোর থেকে আমার ডবল বয়েস। আমি পারছি, তুই পারবি না কেন?”

স্বপন ঘোলাটে চোখে কমলের দিকে তাকিয়ে মাথাটা দু’বার ঝাঁকিয়ে আবার বলের দিকে ছুটে গেল। কমলের মনে হল, যদি এখন সলিলটাও পাশে থাকত। প্রাণবন্ধু, স্বপন এবং রুদ্রও এখন পেনাল্টি এরিয়ায় নেমে এসে খেলছে। ফরোয়ার্ডরা—দেবীদাস, গোপাল, শ্রীধর হাফ লাইনে নেমে এসেছে। বাটার গোলকিপার পোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। কমল কখনও যা করতে চায় না, যা করতে সে ঘৃণা বোধ করে, তাই শুরু করল। সময় নষ্ট করে কাটাবার জন্য, বল পাওয়া মাত্র গ্যালারিতে পাঠাতে লাগল। গ্যালারিতে লোক নেই, বল কুড়িয়ে আনতে সময় লাগে।

চার গোলেই শোভাবাজার হারল। খেলার শেষে মাঠের বাইরে এসেই স্বপন আছড়ে পড়ল। কমল এক গ্লাস জল মাথায় ঢেলে শুধু একবার সরোজের দিকে তাকাল। সরোজ মুখ ঘুরিয়ে নিল। বলাই হাসতে হাসতে সরোজকে বলল, ”শুধু চিকেন চৌমিনে হবে না বলে রাখছি, এক প্লেট করে চিলি চিকেনও।”

কমল ঝুঁকে স্বপনের হাতটা তুলে নিয়ে নাড়ি দেখল। গতি অসম্ভব দ্রুত। মনে হল মিনিটে দেড়শোর উপর। ওর পাশে উবু হয়ে বসা রুদ্র আর প্রাণবন্ধুর দিকে তাকিয়ে কমল ম্লান হেসে বলল, ”রেস্ট নিক আর একটু। পরশু থেকে তোদের নিয়ে প্র্যাকটিসে নামব।”

টেন্টে এসে স্নান করে কমল যখন ড্রেসিং রুমে পোশাক পরছে, তখন শুনতে পেল বাইরে ক্লাবের দুই একজিকিউটিভ মেম্বার বলাবলি করছে:

”সরোজ তো তখনই বলেছিল, চলে না, বুড়ো ঘোড়া দিয়ে আর চলে না। মডার্ন ফুটবল খেলতে হলে খাটুনি কত!”

”কেষ্টদার যে কী দুর্বলতা ওর উপরে, বুঝি না। ইয়াং ছেলেরা চান্স না পেলে টিম তৈরি হবে কী করে, কোচ রাখারই বা মানে কী? পাওয়ার ফুটবল এখন পৃথিবীর সব জায়গায় আর আমরা—”

”সরোজ বলছে, এভাবে তার উপর হস্তক্ষেপ করলে সে আর দায়িত্ব নিতে পারবে না।”

”কেষ্টদার উপর তো আর এখানে কথা চলে না, ডুবল, ক্লাবটা ডুবল।”

কমল ঘর থেকে বেরোতেই ওরা চুপ করে ভ্যাবাচাকার মতো তাকিয়ে রইল। তারপর একজন তাড়াতাড়ি বলল, ”অ্যাঁ, তা হলে চার গোল হল!”

”হ্যাঁ, চার গোল।” কমল গম্ভীরভাবে জবাব দিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। টেন্টের বাইরে এসে দেখল, ক্যান্টিনের কাউন্টারে সরোজ চা খাচ্ছে। ওকে ডাকতে গিয়ে কমল ইতস্তত করল, কয়েকটা কথা এখন তার সরোজকে বলতে ইচ্ছে করছে। তারপর ভাবল, থাক, তর্কাতর্কি করে ভিড় জমিয়ে লাভ নেই। কমল বেরিয়ে এল ক্লাব থেকে।

বাসে দমবন্ধ ভিড়ে কমল মাথার উপরে হাতল ধরে দাঁড়িয়েছিল। সামনেই মাঝবয়সী একটি লোক বার বার তার দিকে তাকাতে তাকাতে অবশেষে বলল, ”আজ খেলা ছিল বুঝি?”

”হ্যাঁ।”

”কী রেজাল্ট হল?”

বুকের মধ্যে ডজনখানেক ছুঁচ ফোটার ব্যথা কমল অনুভব করল। ভাবল, না শোনার ভান করে মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু লোকটির প্রত্যাশাভরা মুখটি অগ্রাহ্য করতে পারল না। আস্তে বলল, ”ফোর নীল।” তারপর বলল, ”হেরে গেছি।”

লক্ষ করল, সঙ্গে সঙ্গে লোকটির মুখ বেদনায় কালো হয়ে গেল। ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। কমলের দিকে আর মুখ ফেরাল না। মুঠোর মধ্যে হাতলটা দুমড়েমুচড়ে ভেঙে ফেলতে চাইল কমল। হয়তো এই লোকটি তার দশ কি বারো বছর আগের খেলা দেখেছে। তারপর নানান কাজে জড়িয়ে পড়ে আর মাঠে যায় না। কিন্তু মনে করে রেখেছে কমল গুহর খেলা। হয়তো একদিন এই লোকটিও তাকে কাঁধে তুলে মাঠ থেকে টেন্টে বয়ে নিয়ে গেছে খেলার পর।

ভাবতে ভাবতে কমল নিজের উপরই রাগে ক্ষোভে আর অদ্ভুত এক অপমানের জ্বালায় ছটফট করে বাস থেকে নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরল।

পরদিন অফিসে নিজের চেয়ারে বসতেই চোখে পড়ল, খড়ি দিয়ে তার টেবলে বড় বড় অক্ষরে লেখা: ”৪-০। এবং যুগের যাত্রীর সঙ্গেও এই রেজাল্ট হবে।”

কমল কিছুক্ষণ টেবলের দিকে তাকিয়ে রইল। লেখাটা মুছল না।

”চ্যাংড়াদের কাজ। মুছে ফেলুন কমলবাবু।” বিপুল তার টেবল থেকে ঝুঁকে বলল!

”না থাক।” কমল ম্লান হাসল।

”আপনি বরং যুগের যাত্রীর দিন খেলবেন না।”

কমল শোনা মাত্র আড়ষ্ট হয়ে গেল। বিপুল তার শুভার্থী। বিপুল চায় না সে আর অপমানিত হোক। বিপুল ধরেই নিয়েছে, সে পারবে না যুগের যাত্রীকে আটকাতে, তাই বন্ধুর মতোই পরামর্শ দিয়েছে। কমল মুখ নামিয়ে বলল, ”আমার ওপর কনফিডেন্স নেই আপনার?”

”না না, সে কী কথা। আমি তো খেলাটেলা দেখি না, বুঝিও না। তবে আজকালকার ছেলেপুলেরা, বোঝেনই তো, মানীদের মান রাখতে জানে না।”

”কিন্তু আমি যাত্রীর সঙ্গে খেলব।” কমল দৃঢ়স্বরে বলল। ”আমাকে অন্য কারণেও খেলতে হবে।”

এক ঘণ্টা পরেই বেয়ারা একটা খাম রেখে গেল কমলের টেবলে। খুলে দেখল, মেমোরান্ডাম। গতকাল অফিস ছুটির নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কমল বিভাগীয় ইনচার্জের বিনা অনুমতিতে অফিস ত্যাগ করা জন্য এই চিঠিতে তাকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। এ রকম আবার ঘটলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কমল দেখল, চিঠির নীচে রথীনের সই। চিঠিটা ভাঁজ করে খামে রাখার সময় লক্ষ করল, রণেন দাস মুচকি মুচকি হাসছে। কমল মনে মনে বলল, ”ব্যালান্স, এখন আমার ব্যালান্স রাখতে হবে যে।”

.

।।এগারো।।

অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই কমল শুয়ে পড়ে। শরীর গরম, জ্বরজ্বর ভাব। ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। অমিতাভর ডাকে চোখ মেলল।

”খাবেন না, রাত হয়েছে!”

কমল উঠে বসার সময় অনুভব করল, তার সারা গায়ে ব্যথা। অমিতাভ দেখল, কমলের চোখ দুটি লাল।

”তোমার খাওয়া হয়েছে?”

ইতস্তত করে অমিতাভ বলল, ”না, একসঙ্গেই খাব।”

”আমার বোধ হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে, আমি কিছুই খাব না।”

অমিতাভ চলে যাচ্ছে, কমল তাকে ডাকল।

”তোমার অ্যালার্ম ঘড়িটা আমায় একটু দেবে? কাল খুব ভোরে উঠতে হবে। প্র্যাকটিসে যাব।”

”প্র্যাকটিসে!” অমিতাভর চোখ বড় হয়ে গেল। ”আপনার তো জ্বর হয়েছে!”

এই বলে অমিতাভ এগিয়ে এসে কমলের কপালে হাত রাখল। ”প্রায় একশো।”

কমল চোখ দুটি বন্ধ করে অভিতাভর শীর্ণ আঙুলের স্পর্শ অনুভব করতে করতে বলল, ”আমাকে খেলতে হবে।”

”এই শরীরে?”

”হ্যাঁ? প্র্যাকটিস না করলে খেলা যায় না। আমি আর সময় নষ্ট করতে পারি না।”

”কিন্তু—” অমিতাভ চুপ করে গিয়ে একরাশ প্রশ্ন তুলে ধরল।

কমল একটু হাসল। ”সারা জীবন পারফেকশন খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। যে যার নিজের ক্ষেত্রে পারফেক্ট হতে চায়; আমার ক্ষেত্রটা ফুটবল। আমি মানুষ হতে পারব না জেনে ফুটবলার হতে চেয়েছি। কিন্তু দুঃখের কথা কী জানো, ফুটবলারের সময়টা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তার শরীর, তার যৌবনই তার সময়, কিন্তু বড্ড ছোট্ট সময়টা। আমার মতো তৃতীয় শ্রেণীর ফুটবলার অল্প সময়ের মধ্যে কী করতে পারে যদি না খাটে, যদি না পরিশ্রম করে?”

”কিন্তু আপনি অসুস্থ।”

”হোক। চ্যালেঞ্জ এসেছে, আমি তা নেবই। বহু অপমান সহ্য করেছি, তার জবাব না দিতে পারলে বাকি জীবন আমি কী করে কাটাব?”

কমল উঠে দাঁড়াল। কুঁজো হয়ে খাটের তলা থেকে ধুলোয় ভরা নীল রঙের কেডস জুতোজোড়া বার করে বুরুশ দিয়ে ঘষতে শুরু করল। হঠাৎ অমিতাভ বলল, ”আপনি ফুটবলকে এত ভালবাসেন!”

মাথা হেলিয়ে কমল কয়েক সেকেন্ড থেমে বলল, ”হ্যাঁ, এজন্য আমার দাম দিতে হয়েছে। অনেক কিছুই হারিয়েছি, তার বদলে এমন কিছুই পেলাম না যা দিয়ে আমার লোকসান পূরণ করতে পারি। ব্যঙ্গ—বিদ্রূপ খেলার জীবনে অনেক শুনেছি, কিন্তু মূর্খ, বোকা, বদমাস, অহঙ্কারীদের অপমানের জবাব না দিয়ে আমি রিটায়ার করব না। আমি খেলব, যেমন করেই হোক, যদি মরতে হয় তবুও।”

”যদি না পারেন? সময় তো ফুরিয়ে এসেছে বললেন।”

”আমি ভয় পাই এ কথা ভাবতে। আমাকে পারতেই হবে, একাই আমায় চেষ্টা করতে হবে। আমি জানি, ঠিক সময়ে বল এগিয়ে দেব কিন্তু তখন বল ধরার লোক থাকবে না। নিখুঁত পাস দেব কিন্তু কন্ট্রোলে আনতে পারবে না, বল পাব কিন্তু এত বিশ্রী ভাবে আসবে যে কাজে লাগাবার উপায় তখন থাকবে না। নানান অসুবিধা নিয়ে আমার চারপাশের প্লেয়ারদের সঙ্গে মানিয়ে খেলতে হবে। কেউ কারোর খেলা বোঝে না, ওরা এক একজন এক এক রকমের। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এজন্য প্র্যাকটিস চাই একসঙ্গে।”

”তা হলেই আপনি সফল হবেন?”

কমল তীব্র কৌতূহল দেখতে পেল অমিতাভর চোখে। এতক্ষণ ধরে এত কথা তারা আগে কখনও বলেনি। কমলের মনে হল, তার কথা শুনতে অমিতাভর যেন ভাল লাগছে। যে ভয়ঙ্কর ঔদাসীন্য এবং চাপা ঘৃণা নিয়ে সে বাবার সঙ্গে কথা বলত, সেটা সরে গিয়ে একটা কৌতূহলী ছেলেমানুষ বেরিয়ে এসেছে। আর একটা ব্যাপার কমল বুঝতে পারল, তার জ্বরজ্বর ভাব এবং গায়ের ব্যথা এখন আর নেই।

স্কিপিং—এর দড়িটা টেনে পরীক্ষা করতে কমল বলল, ”সফল? তোমার কী মনে হয়?”

অমিতাভ গম্ভীর হয়ে গেল।

কমল উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে রইল।

”আমি ফুটবলের কিছু বুঝি না।”

”কিন্তু এটা ফুটবল হিসাবে দেখছ কেন, জীবনের যে কোনও ব্যাপারেই তো এরকম পরিস্থিতি আসে। যে মানুষ একা, যার কেউ নেই, সে তখন সফল হবার জন্য কী করতে পারে?”

অমিতাভ চুপ করে রইল।

কমল উত্তেজিত হয়ে বলল, ”সে তখন পারে শুধু লড়তে। তুমি কি নিজেকে একা বোধ করো অমিতাভ?”

অমিতাভ জবাব দিল না।

কমলের উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমে এল। আস্তে আস্তে সে বলল, ”যোগাযোগ করো। মাঠে আমি খেলার সময় তাই করি। কিন্তু বাড়িতে ফিরে আর তা পারি না। বড় একা লাগে।”

খাটের উপর বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে কমল বলল, ”অনেক কথা বললাম, হয়তো এর মানে আমরা কেউই জানি না। তুমি আমাকে ভালবাস না, আমাকে ঘৃণা করো, এটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আমি তোমায় ভালবাসি।”

কমলের চোখ জলে চিকচিক করছে। স্বর ভারী। অমিতাভ পাথরের মূর্তির মতো একইভাবে দাঁড়িয়ে। কমল মুখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকাল।

”ফুটবল খেলা একদিন আমায় শেষ করতেই হবে, তারপর আমি কী নিয়ে, কাকে নিয়ে থাকব?”

এ কথা শুনে অমিতাভর মুখে কোন ভাব ফুটে ওঠে দেখার জন্য মুখ তুলে কমল দেখল, ঘরে অমিতাভ নেই। নিঃসাড়ে সে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে।

.

ভোর সাড়ে পাঁচটায় কমল কিটব্যাগ হাতে বাড়ি থেকে বেরোল। বাগবাজার থেকে ময়দান সে ধীর গতিতে জগ করে পৌঁছল যখন, শোভাবাজারের টেন্টে তখন তিনটি ছেলে সদ্য এসে পৌঁছেছে। ওরা—স্বপন, রুদ্র আর শিবশম্ভু চটপট তৈরি হয়ে নিল।

”এখান থেকে চৌরঙ্গি রোড ধরে ভিক্টোরিয়া, তারপর পশ্চিমে বেঁকে রেস কোর্সের দক্ষিণ দিয়ে ট্রামলাইন পেরিয়ে প্রিনসেপ ঘাট। সেখান থেকে গঙ্গা ধরে উত্তরে, তারপর বেঁকে মোহনবাগান মাঠের পাশ দিয়ে নেতাজি স্ট্যাচু ঘুরে আবার এখানে।” কমল দৌড়ের পথ ছকে দিল রওনা হবার আগে। ওরা ঘাড় নাড়ল।

চৌরঙ্গি দিয়ে দৌড়বার সময় একটা বাস থেকে লাফিয়ে নামল ভরত। ওরা থমকে দাঁড়াল।

”কমলদা, আপনারা বেরিয়ে পড়েছেন, আমিও তো প্র্যাকটিস করব বলে এলুম।”

”ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই আসছি। তুই রেডি হয়ে থাক।”

ওরা চারজন আবার ছুটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ ছোটার পর কমল পাশে তাকিয়ে স্বপনকে বলল, ”সাত—বারো কত হয় রে?”

বিস্ময় ফুটে উঠল স্বপনের মুখে। ছুটতে ছুটতে এ কী বেয়াড়া প্রশ্ন! ক্লাস এইটে ফেল করার পর স্বপন আর স্কুল—মুখো হয়নি এবং মাথা খাটানোর মতো কোনও ঝঞ্ঝাটে ব্যাপারে ব্যস্ত হয়নি। কমলের প্রশ্নের জবাব দিতে সে বিড়বিড় করে সাতের ঘরের নামতা শুরু করল।

কিছুক্ষণ পর স্বপন বলল, ”চুরোআশি।”

”দেশ কোথায় ছিল, যশোরে?”

স্বপন একগাল হাসল।

ওরা ছুটতে ছুটতে রবীন্দ্রসদন পার হয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পিছন দিয়ে পশ্চিমে চলেছে। কমল এবার রুদ্রকে বলল, ”পাখি সব করে রব—পদ্যটা মুখস্থ আছে?”

”না, পড়িনি।”

”পঞ্চনদীর তীরে বেণী পাকাইয়া শিরে?”

”মুখস্থ নেই।”

”এগারোর উপপাদ্য কিংবা ভারতের জলবায়ু মনে আছে? তুই তো গত বছর বি কম পরীক্ষা দিয়েছিস, বল তো।”

ছুটতে ছুটতে রুদ্রর ভুরু কুঁচকে গেল। প্রাণপণে সে মনে করার চেষ্টা শুরু করল। কমল তখন শিবশম্ভুকে কর্মধারয় ও দ্বিগু সমাসের ধাঁধায় ফেলে স্বপনকে একটি সহজ মানসাঙ্কের জট ছাড়াতে দিল। কমল ট্রেনিংয়ের অঙ্গ হিসাবে মাথার কাজ শরীরের খাটুনি একসঙ্গে করার এই পদ্ধতিটা শিখেছে পল্টুদার কাছে। তাকে দিয়ে তিনি এই ভাবে কাজ করাতেন। কমল নিষ্ঠার সঙ্গে বরাবর তা পালন করে এসেছে। পল্টুদা বলতেন, শরীর যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন মাথাও আর কাজ করতে পারে না। ফুটবলে মাথা খাটাতে হয় ক্লান্তির মধ্যেও। সেইজন্যে ব্রেনটাকে তৈরি করতে হয়, তারও ট্রেনিং লাগে। যখন দৌড়বি তখন মাথাকে অলস রাখবি না কখনও।

গঙ্গার ধার দিয়ে ছোটার সময় মালভর্তি লরি যেতে দেখে কমল বলল, ”তাড়া কর লরিটাকে, দেখি কে ধরতে পারে।”

চারজনে একসঙ্গে স্প্রিন্ট শুরু করল। প্রায় সত্তর মিটার দৌড়ে লরিটাকে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করে ওরা দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল। একটা বাস ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল। কমল হঠাৎ বলল, ”স্বপন, এটাকে ধর।”

হকচকিয়ে স্বপন বলল, ”আবার?”

”কুইক।”

স্বপন প্রাণপণে ছুটে পঁচিশ মিটার যেতেই কমল চেঁচিয়ে তাকে দাঁড়াতে বলল। এই ভাবে রুদ্র ও শিবশম্ভুকেও আচমকা সে ছুটতে বলল বাস বা লরির পিছনে পালা করে। এরপর ওরা আবার ছুটতে শুরু করল। কমল তিনজনের আগে দৌড়চ্ছে। ইডেনের কাছে এসে কমল বলল, ”চল, গাছে চড়ি।”

একটা জামরুল গাছ বেছে নিয়ে কমল বলল, ”কে আগে চড়ে ওই ছড়ানো ডালটা ধরে ঝুলে নীচে লাফিয়ে পড়তে পারে!”

চারজন একসঙ্গে গাছটাকে আক্রমণ করল। স্বপন ধাক্কা দিয়ে কমলকে ফেলে দিয়ে সবার আগে উঠল, তারপর রুদ্র। শিবশম্ভুর পর কমল যখন গাছে উঠে ডালের প্রান্তে পৌঁছে প্রায় বারো ফুট উঁচু থেকে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন স্বপন কাঁচুমাচু মুখে কমলকে কিছু বলার জন্য এগোতেই সে হেসে বলল, ”ঠিক আছে, খেলার সময়ও ওই রকম শ্যোলডার চার্জ করবি।”

শোভাবাজারের মাঠে ওরা যখন পৌঁছল, ভরত তখন শূন্যে উঁচু করে বল মেরে দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে মাথার উপর থেকে ধরা প্র্যাকটিস করছিল একা একাই। ওদের দেখে সে চেঁচিয়ে বলল, ”আমাকে কেউ একটু প্র্যাকটিস দিয়ে যাও।”

”হবে, হবে, আগে একটু জিরোতে দে।” কমল এই বলে ঘাসের উপরে শুয়ে পড়ল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই পর্যন্ত সে প্রায় দশ—বারো মাইল ছুটেছে। ফুটবল মরশুমের মাঝামাঝি এমন পরিশ্রমী ট্রেনিং কেউ করে না।

ঘণ্টা দেড়েক বল দেওয়া, বল ধরা, দুজনের বিরুদ্ধে একজনের ট্যাকলিং হেডিং এবং শুটিং—এর পর কমলের খেয়াল হল, অফিস যেতে হবে। অফিস থেকে শুধু বেরিয়ে যাওয়ারই নয়, এখন থেকে অফিসে হাজিরা দেওয়ার সময় সম্পর্কেও তাকে সাবধান হতে হবে। তা ছাড়া ছেলেগুলো পরশু খেলবে মহমেডানের সঙ্গে। এখন আর খাটানো ঠিক হবে না। কমল টেন্টেই স্নান করে, ক্যান্টিনে ভাত খেয়ে হেঁটেই অফিস রওনা হয়ে গেল।

দুপুরে নতু সাহা তাকে জানাল, কাল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে খেলা আছে। কমল বলল, ”শরীর খারাপ, খেলব না।”

গম্ভীর হয়ে নতু সাহা চলে গেল।

।।বারো।।

যুগের যাত্রীর পনেরোটা ম্যাচ খেলে আঠারো পয়েন্ট। মোহনবাগানের চৌদ্দটি খেলায় চব্বিশ, ইস্টবেঙ্গলের চৌদ্দটি খেলায় ছাব্বিশ, মহমেডানের পনেরোটি খেলায় পঁচিশ পয়েন্ট। আর শোভাবাজারের ষোলোটি খেলায় ছয় পয়েন্টে। লিগের প্রথমার্ধ শেষ হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে ময়দানে গুলতানি শুরু হয়ে গেছে—দ্বিতীয় ডিভিশনে শোভাবাজার অবধারিত নামছে। বালী প্রতিভা, স্পোর্টিং ইউনিয়ন, জর্জ টেলিগ্রাফ, কালীঘাট দু—তিন পয়েন্টে শোভাবাজারের উপরে।

যুগের যাত্রীর সঙ্গে লিগের প্রথম খেলার আগের দিন, অফিসের লিফটে ওঠার জন্য কমল যখন দাঁড়িয়ে, পিছন থেকে একজন বলল, ”কমলবাবু, কাল খেলছেন তো?”

গলার স্বরে চাপা বিদ্রুপ বিচ্ছুরিত হল। কমল জবাব দিল না। প্রশ্নকারী তাতে উত্তেজিত হয়ে উঠল। এবার রেগে বলল, ”আরে মশাই, যেটুকু নাম এখনও লোকে করে সেটা ডুবিয়ে কোনও লাভ আছে? অনেক তো খেললেন সারা জীবনে।”

লিফটের দরজা খুলে গেল। লাইন দেওয়া লোকেরা ঢুকল, তাদের সঙ্গে কমলও। দরজা বন্ধ হবার সময় সে শুনতে পেল, লাইনে দাঁড়ানো প্রশ্নকারী সকলকে শুনিয়ে বলছে, ”বুঝলেন, এরাই ফুটবলের ইজ্জৎ নষ্ট করে।”

টিফিনের সময় কমল নিজের চেয়ার থেকে উঠল না। আবার কে তাকে শুনিয়ে বিদ্রূপাত্মক কথা বলবে কে জানে। একমনে মাথা নিচু করে সে কাজ করে চলেছে। চমকে উঠল যখন তার সামনে একটা লোক হাজির হয়ে বলল, ”কমল, আছ কেমন?”

মুখ তুলে কমল দেখল, যুগের যাত্রীর তপেন রায়। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল, একশো টাকা ধার নেওয়ার কথাটা—মুখটা পাংশু হয়ে গেল।

”খেলাটেলা কেমন চলছে, শুনলুম দারুণ প্র্যাকটিস করছ?” চেয়ার টেনে বসতে বসতে তপেন রায় বলল।

”তপেনদা, আপনার টাকাটা এখনও দিতে পারিনি, এবার মাইনে পেলেই দিয়ে দেব।”

”টাকা! কীসের টাকা?” তপেন রায় আকাশ থেকে পড়ল।

কমল আরও কুণ্ঠিত স্বরে বলল, ”মনে আমার ঠিকই আছে, তবে একবারে একশোটা টাকা দেওয়ার সামর্থ তো নেই।”

তপেন রায় কিছুক্ষণ কমলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে যেন অতি কষ্টে মনে করতে পারল। তারপর বলল, ”ও হো, সেই টাকাটা! আমি তো ভুলেই গেছলুম। আরে দূর, ওটা তোমার ফেরত দিতে হবে না।” তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ”যাত্রীর কাছে কত টাকা তুমি পাও, সেটা তো আমি ভাল করেই জানি। তোমায় ঠকিয়েছে কী ভাবে তার সাক্ষী আমি ছাড়া আর কে! এ টাকা তো আর মামলা করে যাত্রী আদায় করতে পারবে না। যা পেয়েছ তাই নিয়ে নাও।”

মুহূর্তে কমল সাবধান হয়ে গেল। এতদিন ফুটবল খেলে সে মাঠের লোকদের চিনেছে। হঠাৎ তপেন রায়ের আবির্ভাব এবং খুবই বন্ধুর মতো কথাবার্তা তার ভাল লাগল না। সে সতর্ক স্বরে বলল, ”তারপর, কী মনে করে হঠাৎ…।”

”বলছি।” তপেন রায় সিগারেট বার করল, ধরাল এবং প্রথম ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ”যুগের যাত্রীকে কমল গুহ যে সার্ভিস দিয়েছে তা ভোলার নয়। কিন্তু যাত্রী তার বিনিময়ে তাকে কী দিয়েছে? কিছুই নয়। এই নিয়ে ক্লাবে অনেকে অনেক কথা বলেছে। কমিটি মিটিং ডাকা হয়েছিল। ঠিক হয়েছে, তোমাকে এবারের লিগের শেষ খেলার দিন মাঠেই পাঁচ হাজার টাকার চেক দেওয়া হবে।”

”যাত্রীর সঙ্গে লিগের শেষ খেলা কিন্তু শোভাবাজারের।”

”তাই না কি! তা হলে তো ভালই। কিন্তু সবার আগে তোমার অনুমতি চাই, তুমি গ্রহণ করবে কি না। অবশ্য বলে রাখছি, পরশু দিনই কমিটির একটা মিটিং আছে, ব্যাপারটা তখনই পাকাপাকি ঠিক করা হবে।”

কমল একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল তপেন রায়ের চোখ দুটি। অতি সরল। ভিতর থেকে আন্তরিকতা ঠিকরে বেরোচ্ছে। কমল মনে মনে হেসে বলল, ”কাল যাত্রীর সঙ্গে খেলার পর আপনাকে জানাব।”

”কাল তুমি খেলছ না কি?”

”হ্যাঁ।”

তপেন রায় ঘন ঘন সিগারেটে টান দিয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে বলল, ”এই বাজারে পাঁচ হাজার টাকার দাম কম নয়। বলতে গেলে এক রকম পড়েই পাওয়া। মাথা গরম করে হারিয়ো না এটা। যাত্রী তো নাও দিতে পারে, তবু দেবে বলে মনস্থ করেছে। এতে তোমাকে যেমন সম্মান দেওয়া হবে, তেমনি যাত্রীর উপরও প্লেয়ারদের কনফিডেন্স আসবে, তাই নয় কি?”

কমল ঘাড় নাড়ল।

”এখনকার ক্লাবগুলো যা হয়েছে, বুঝলে কমল, একেবারে নেমকহারাম। প্লেয়ারাও সেই রকম। পয়সা ছাড়া মুখে কোনও কথা নেই। কিন্তু যাত্রী তো সেরকম ক্লাব নয়। প্লেয়ারদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্কে না থাকলে ক্লাব চলে না।” তপেন রায় আবেগ চাপতে গিয়ে চুপ করল। কমল কথা বলল না।

”তা হলে তুমি এখন বলবে না টাকা নিতে রাজি কি না?”

”না। কাল খেলার পর এ নিয়ে ভাবব।”

তপেন রায় চলে যাবার পর বিপুল ঘোষ গলা বাড়িয়ে বলল, ”পাঁচ হাজার টাকা! ব্যাপার কী?”

”পরীক্ষা দিলাম। স্টপার খেলি, নানান দিক থেকে আক্রমণ আসে। এটাও একটা।”

”তার মানে?”

”আমরা সবাই তো স্টপার ঘোষদা, কেউ মাঠের মধ্যে, কেউ মাঠের বাইরে। ঠেকাচ্ছি আর ঠেকাচ্ছি। এটাও ঠেকালাম—লোভকে। ঘুষ দেবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল লোকটা। কাল ওদের টিমের সঙ্গে খেলা। আমাদের মজুমদার সাহেবের টিম। এবছর লিগ চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য খেলছে, ভালই খেলছে। হয়তো হয়েও যাবে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হবার পথে যাতে একটিও কাঁটা না থাকে সেই ব্যবস্থা করতে এসেছিল। আমাকে ওরা একটা কাঁটা ভাবে।”

”ঘুষ দিয়ে? না না মশাই, কাল আপনি ভাল করে খেলুন। দারুণ খেলুন। আচ্ছা করে জব্দ করে দিন।”

কমল দেখল, বিপুল ঘোষের সারা মুখ আন্তরিকতায় কোমল ও উজ্জ্বল।

”কাল অফিসে আসছেন তো?” দূর থেকে রণেন দাস প্রশ্ন করল।

”কেন?” কমল সচকিত হয়ে বলল।

”সেটা আপনি ভালই জানেন। তবে বলে রাখছি পাঁচটার আগে আপনাকে আমি ছাড়তে পারব না।”

”জানি আমি। তবে কাল আমি ক্যাজুয়াল নিচ্ছি।”

.

অফিস ছুটির পর শোভাবাজার টেন্টে আসা মাত্র কৃষ্ণ মাইতি হাত ধরে বলল, ”গুলোকে শিক্ষা দিতে হবে কমল। ব্যাটা টাকা মেরেছে কাজ হাসিল করে নিয়ে। পয়েন্ট চাই—ই চাই। তুই কিন্তু প্রধান ভরসা। ক্লাবের সবাই তোকে খেলানোর এগেনস্টে, আমি জোর করে বলেছি, কমলকে খেলাতেই হবে।”

নার্ভাস বোধ করল কমল। বিব্রত স্বরে বলল, ”কিন্তু কেষ্টদা, একা আমার ওপর এতটা ভরসা করবেন না, করা উচিত নয়। ফুটবল একজনের খেলা নয়।”

”তুই একাই এগারোজন হয়ে খেলতে পারিস, যদি মনে করিস খেলব। তা ছাড়া—মনে আছে সেই চাকরির কথাটা, পল্টু মুখুজ্যের মেয়ের চাকরি। যদি কাল একটা পয়েন্ট আনতে পারিস, গ্যারান্টি দিচ্ছি চাকরিটা হবে।”

কমল তর্ক করে কথা বাড়াল না। হঠাৎ সে ক্লান্ত বোধ করতে শুরু করল। অনেক কিছু নির্ভর করছে কালকের খেলার উপর। এখন যার সঙ্গেই দেখা হবে, সে মনের উপর একটা দায়িত্বের পাথর চাপিয়ে দেবে। কমল চেয়ার নিয়ে টেন্টের বাইরে বেড়ার ধার ঘেঁষে বসল।

ভরত এসে বলল, ”কমলদা, একটা কথা বলার ছিল। খুবই জরুরি, কিন্তু এখানে বলব না। আপনি বাইরে আসুন, মিনিট পাঁচেক পর আমি টাউন ক্লাব টেন্টের সামনে থাকব।”

এই বলেই ভরত হনহন করে বেরিয়ে গেল। অবাক হয়ে কমল চারপাশে তাকাল। ক্যান্টিনের কাছে সত্য আর দেবীদাস হাসাহাসি করছে। স্বপন একটু আলাদা দাঁড়িয়ে ঘুগনি খাচ্ছে। টেন্টের মধ্যে যথারীতি টেবিল ঘিরে গুলতানি। ভরতের কী এমন কথা থাকতে পারে যা একান্তে বলা দরকার!

কমল টাউন টেন্টের কাছে পৌঁছতেই অপেক্ষমান ভরত বলল, ”কমলদা, আমাদের দুজন কাল গট আপ হয়েছে।”

শোনামাত্র কমল জমে গেল। ”গট আপ! কারা?”

”আজ সকালে যাত্রীর লোক এসেছিল আমার বাড়িতে। সঙ্গে ছিল শম্ভু। টেরিলিন স্যুট করে দেবে যাত্রী। শম্ভু আর সত্য গোলাম আলিতে মাপ দিয়ে এসেছে।”

”তুই গেলি না?”

ভরত শুধু হাসল। কমলও হাসল। তারপর ভরতের পিঠ চাপড়ে বলল, ”এখন কাউকে বলিসনি এসব কথা। আগে খেলাটা হোক।”

”সলিলের কিছু খবর জানেন, আসে না কেন? ও থাকলে খানিকটা সামলানো যেত।”

”সলিল একটা কাজ পেয়েছে, খেলার জন্য আর সময় পায় না। হয়তো আর কোনও দিনই পাবে না। কিন্তু ভরত, বাটার সঙ্গে খেলার মতো অবস্থা কাল যেন হবে মনে হচ্ছে।”

”কী জানি!” অনিশ্চিত স্বরে ভরত বলল, ”আমাদের আর একটা ছেলেও নেই যাকে নামানো যায়। নইলে কেষ্টদাকে বলে সত্য আর শম্ভুকে বসিয়ে দেওয়া যেত।”

ম্লান হেসে কমল বলল, ”তা হলে কাল ভাগ্যের উপরই ভরসা করতে হবে।”

”হ্যাঁ, ভাগ্যের উপরেই।”

.

।।তেরো।।

যুগের যাত্রী ৫-০ গোলে শোভাবাজারকে হারাল।

অন্ধকার ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে কমল শুয়ে। অ্যালার্ম ঘড়ির টিকটিক শব্দ একটানা তার মাথার মধ্যে হাতুড়ির ঘা মেরে চলেছে। কমল হাত দিয়ে দু’কান চেপে অস্ফুটে কাতরাল। এখনও কানে বাজছে ভয়ঙ্কর চিৎকারগুলো। ঘড়িটা আছড়ে ভেঙে ফেলা যায়, কিন্তু পাঁচটা গোলের চিৎকার।

গ্যালারির মাঝখানের সরু পথ দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় উপর থেকে তার মাথায় থুথু পড়ে, ইটের টুকরো লাগে পিঠে। একটা চিৎকারও শুনেছিল, ”কী রে কমল, অনুপমকে আটকাতে পারিস বলেছিলি না!”

আজ অনুপম তিনটি গোল দিয়েছে। তবে হ্যাটট্রিক হয়নি। কমল বিছানায় বার কয়েক কপাল ঠুকল। অজান্তে একটা গোঙানি মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

”কী গো কমল, যাত্রীর জার্সিকে ভয়ে কাঁপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা এবার ছাড়ো।”

গুলোদার হাসিখুশি মুখ আর চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথাগুলো যেন বিছানার মধ্যে থেকে উঠে আসছে। বিছানাটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে একশা করা যায়, কিন্তু কথাগুলোকে।

”আমি কী করব, যিনি টিম করেছেন তাঁকে গিয়ে বলুন। বুড়ো প্লেয়ার দিয়ে যদি ফুটবল খেলাতে চান তা হলে খেলান। বলিহারি শখ! নিজেরও তো একটা আক্কেল—বিবেচনা থাকে।” সরোজ খেলা শেষে মাঠের উপর দাঁড়িয়ে একজনকে যখন কথাগুলো বলছিল, কমল মুহূর্তের জন্য দেখেছিল চাপা তৃপ্তির আমেজ তার চোখে মুখে ছড়িয়ে রয়েছে।

খেলার শেষ বাঁশি বাজতেই ভরত ছুটে গিয়ে মাঠের মধ্যেই শম্ভুকে চড় কষায়। শম্ভু লাথি মারে ভরতকে। দু’জনকে যখন সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন চিৎকার করে শম্ভু বলে, ”গোল কি আমার দোষে হয়েছে? ওই লোকটা, ওই লোকটার জন্য।”

শম্ভুর আঙুল একটা ছোরার মতো উঠে কমলকে শিকার করে। কোনও দিকে না তাকিয়ে কমল মাঠ থেকে বেরিয়ে আসে।

”এত ভরসা করেছিলুম তোর ওপর। আমায় একেবারে ডুবিয়ে দিলি।” কেষ্টদার হতাশ এবং বিরক্ত কণ্ঠস্বরে কমলের চকিতে মনে পড়েছিল, অরুণার চাকরিটা বোধ হয় হল না!

মুখ দেখাবার উপায় কোথাও আর রইল না। বাটার সঙ্গে খেলাটাই আবার অনুষ্ঠিত হল। তবে যাত্রী আরও দক্ষ, আরও কঠিন এবং উদ্দেশ্যপরায়ণ। কমল চোখ বুজে এখনও দেখতে পাচ্ছে, অনুপম আর প্রসূন তার দু’পাশ দিয়ে ঢুকছে আর ফাঁকা মাঝ মাঠ দিয়ে বল নিয়ে উঠে আসছে যাত্রীর রাইট ব্যাক। স্বপন আর রুদ্র কোন দিকে কাকে আটকাবে ভেবে পাচ্ছে না। কমল স্থির করেছিল আজ সে অনুপমকে রুখবে। কিন্তু অনুপমের পাশাপাশি প্রসূন সব সময় ছিল তাকে ধাঁধায় ফেলার জন্য। যেখানেই বল প্রসূন সেখানে তার দলের খেলোয়াড়ের পাশে গিয়ে হাজির হয়েছে। শোভাবাজারের একজনের সামনে যাত্রীর দু’জন ফরোয়ার্ড সব সময়ই। লোক পাহারা দেবে না জমি আগলাবে কমল এই সমস্যা সমাধান করতে পারেনি লোকের অভাবে। এবং কেন এই অভাব ঘটল এক মাত্র সে আর ভরত তা জানে।

কিন্তু সেকথা এখন বললে লোকে বলবে সাফাই গাইছে। উপায়ও নেই, মুখ দেখাবার কোনও উপায় আর রইল না। বিদ্রূপ আর ইতর মন্তব্য শুনতে হবে বহুদিন। কমল বিছানায় মুখটা চেপে ধরে থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করল।

হঠাৎ ঘরের আলোটা কে জ্বালল। কমল ছিটকে উঠে বসল।

”কমলদা, আমি এসেছি।” ঘরের মধ্যে সলিল দাঁড়িয়ে। মুখে লাজুক বিব্রত হাসি।

”কেন?”

”শুনলুম আজ পাঁচ গোলে শোভাবাজার হেরেছে।”

কথা না বলে কমল একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

”আমি খেলব কমলদা। আমি আর বাড়িতে ফিরব না। কাজ আমি করতে চাই না, আমি খেলতে চাই। আমাকে শুধু দু’মুঠো খেতে দেবেন আর একটু ঘুমোবার জায়গা।”

উঠে দাঁড়াল কমল।

”আমি বাড়ির জন্য আর ভাবব না। ওদের বাঁচানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি—”

এরপরই সলিল পেটটা চেপে ধরে ছিটকে দেয়ালে আছড়ে পড়ল কমলের লাথি খেয়ে।

”কী জন্য এসেছিস এখানে! রাসকেল, করুণা দেখাতে এসেছিস? পাঁচ গোল খেয়েছি বলে সাহায্য করতে এসেছিস? ফুটবল খেলে আমায় উদ্ধার করতে এসেছিস?” বলতে বলতে কমল আবার লাথি কষাল। সলিল কাত হয়ে মেঝেয় পড়ে গেল। তার পিঠে কোমরে মাথায় কমল পাগলের মতো এলোপাথাড়ি লাথি মারতে শুরু করল। চুল ধরে টেনে তুলে মুখে ঘুষি মারল।

”আমায় মারবেন না কমলদা, আমি চলে যাচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি।” সলিল উঠে বসতেই কমল ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল।

”কেন এসেছিস, বল কেন এসেছিস?”

সলিল হাঁ করে মুখটা তুলে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে, নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে আর চোখ বেয়ে জল। ও বলার আগেই দরজার কাছে অমিতাভ বলে উঠল, ”ছাড়ুন, ওকে ছাড়ুন।”

দ্রুত ঘরে ঢুকে সে সলিলের চুল—ধরা কমলের হাতে ধাক্কা দিল।

”তোমার কী দরকার এখানে?”

”আপনি এভাবে মারছেন কেন ওকে?”

”আমি যা করছি তাতে তোমার নাক গলাতে হবে না।”

”একজনকে এভাবে মারবেন আর তাই দেখে বাধা দেব না? দেখুন তো কী অবস্থা হয়েছে ওর! জানোয়ারকেও এভাবে মারে না।”

”না না, কমলদা আমায় মারেননি।” সলিল দু’হাত তুলে অমিতাভর কাছে আবদেন জানাল ঘড়ঘড়ে স্বরে। ”কমলদা আমায় কখনও মারেন না, শুধু আমায় শাস্তি দেন।”

”চুপ করো তুমি।” অমিতাভ ধমক দিল সলিলকে। তারপর ঝুঁকে তার শীর্ণ হাতটা বাড়িয়ে সলিলের কাঁধে আঙুল ছোঁয়াল। ”এসো আমার ঘরে, মুখ ধুইয়ে মলম লাগাতে হবে।”

অমিতাভ বেরিয়ে যাবার সময় থমকে একবার কমলের দিকে তাকাল। অদ্ভুত একটা ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে কমলের মুখে ফুটে উঠেছে দীনতার ছাপ। বয়সটা যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। কমল কুঁজো হয়ে ধীর গতিতে এসে খাটের উপর বসল। শূন্য দৃষ্টিতে সলিলের দিকে তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্কের মতো চুলে আঙুল চালাতে লাগল।

সলিল ওঠবার চেষ্টা করে যন্ত্রণায় কাতরে উঠে পেট চেপে বসে পড়ল। আবার চেষ্টা করল ওঠবার। আবার বসে পড়ল। অসহায়ভাবে কমলের দিকে তাকাল। একদৃষ্টে কমল তার দিকে তাকিয়ে, চোখে কোনও অভিব্যক্তি নেই।

”আপনার মাথায় দাগটা এখান থেকেও আমি দেখতে পাচ্ছি কমলদা।”

কমল নিরুত্তর রইল। সলিল হাসবার চেষ্টা করল, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কমল চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে যেতে লাগল। অনেকক্ষণ পর অমিতাভ ঘরে ঢুকে মৃদু স্বরে বলল, ”আপনি শুয়ে পড়ুন।”

কমল মুখ তুলে কিছুক্ষণ ধরে অমিতাভর মুখের উপর চোখ রাখল। ক্রমশ সংবিৎ ফিরে এল তার চাহনিতে। মুখ দুমড়ে গেল বেদনায়। ফিসফিস করে সে বলল, ”আমি শেষ হয়ে গেলাম!”

অমিতাভ আলো নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

।।চৌদ্দ।।

পরদিন থেকে কমল যেন বদলে গেল। চোহারায় এবং মনেও। অফিসে সারাক্ষণ নিজের চেয়ারে থাকে। কথা বলে না প্রয়োজন না হলে। ছুটির পর সোজা বাড়ি চলে আসে। গড়ের মাঠের পথ আর মাড়ায় না। অফিসে অরুণা ফোন করেছিল। কমল কথা বলেনি। বিপুল ঘোষকে সে বলতে বলে, ‘অফিসে আসেনি, জানিয়ে দিন।’

কমল যতটা ভেবেছিল তেমন কোনও বিদ্রূপ অফিসে বা অন্য কোথাও তাকে শুনতে হয়নি। সবাই যেন ধরেই নিয়েছে এমনটিই হবে। ওর মনে হয়, এই রকম ঔদাসীন্যের থেকে বরং বিদ্রূপই ভাল ছিল। মাসের মাইনে পেয়েই সে রথীনের ঘরে গিয়ে একশো টাকার নোট টেবিলে রেখে বলে, ”ধার নিয়েছিলাম, সেই টাকাটা।”

”ধার! আমি তো দিইনি। যে দিয়েছে তাকে দিয়ে এসো।” রথীন কমলের দিকে আর না তাকিয়ে কাজে মন দেয়।

কমল দ্বিধায় পড়ে। অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভেবে সে স্থির করে, তপেন রায়ের হাতেই টাকাটা দিয়ে আসবে। ছুটির পর সে যাত্রীর টেন্টের দিকে রওনা হয়। যখন পৌছল, যাত্রীর প্লেয়াররাও ঠিক তখনই এরিয়ান মাঠ থেকে ফিরল বি এন আর—কে ২—০ গোলে হারিয়ে। প্রায় শ’খানেক লোক হইচই করছে টেন্টের মধ্যে ও বাইরে। কমল একধারে দাঁড়িয়ে খুঁজতে লাগল তপেন রায়কে।

”আরে কমলবাবু, ইখানে দাঁড়িয়ে!” ক্লাবের বুড়ো মালী দয়ানিধি কমলকে দেখে নমস্কার করে এগিয়ে এল।

”তপেনবাবুকে খুঁজছি, কোথায় বলতে পারো?”

”ভিতরে আছে বোধ হয়, যান না।”

ইতস্তত করে কমল ভিতরে গেল।

তপেন রায় কয়েকটি ছেলের পথ আটকে প্লেয়ারদের ড্রেসিংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে, ”না না, এখন নয়। ওরা এখন টায়ার্ড। এখন কোনও কথাবার্তা নয়।”

কমল এগিয়ে গেল। তাকে দেখে তপেন রায় অবাক হয়েও স্বাভাবিক স্বরে বলল, ”কী খবর কমল?”

”একটু দরকার ছিল।”

”দেখেছ তো কী অবস্থা, এখান থেকে নড়ার উপায় নেই, যা বলার বরং এখানেই বলো।”

কমল নোটটা পকেট থেকে বার করে এগিয়ে ধরে বলল, ”টাকাটা দিতে এসেছি।”

তপেন রায় কী ভেবে নিয়ে তাচ্ছিল্যভরে বলল, ”ও টাকা তুমিই রাখো। এত বছর যাত্রীতে খেলে গেলে—ট্রফিফ্রফি তো কিছুই ক্লাবকে দিতে পারোনি, টাকা ফেরত দিয়ে ক্লাবের কী আর এমন উপকার করবে? এবছর যাত্রী লিগ পাচ্ছেই, শুধু বড় টিম দুটোর সঙ্গেই আসল যা খেলা বাকি; তারপর শুধু বাজিই পুড়বে দশ হাজার টাকা। একশো টাকার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আমার নেই।”

শুনতে শুনতে কমলের পা দুটো কেঁপে উঠল। মাথার মধ্যে লক্ষ গোলের চিৎকার। তবু ঠাণ্ডা গলায় বলল, ”বাজি পোড়ানো দেখতে আমি আসব। কিন্তু টাকা আপনাকে ফেরত নিতে হবে। যাত্রীর কাছে আমি ঋণী থাকব না, থাকতে চাই না।”

ওদের ঘিরে বহু লোকের ভিড় জমে গেছে। গুলোদা এই সময় টেন্টে ঢুকল। ভিড় দেখেই কৌতূহলভরে এগিয়ে এল।

”ব্যাপার কী? আরে কমল যে!”

”এক সময় দরকারে টাকা নিয়েছিলুম। ফেরত দিতে এসেছি, কিন্তু তপেনদা নিচ্ছেন না।”

”সেই টাকাটা গুলোদা, আপনিই তো বলেছিলেন দরকার নেই ফেরত নেবার।” তপেন রায় মনে করিয়ে দিল ব্যস্ত ভঙ্গিতে।

”অ। দিতে চায় যখন নিয়ে নাও তবে,” গুলোদা অতি মিহি স্বরে বলল, ”যাত্রীর শেষ খেলা শোভাবাজারের সঙ্গে, যদি কমল কথা দেয় সেদিন খেলবে না, তা হলেই ফেরত নেব।”

ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, ”খেললেই বা কমল গুহ, যাত্রী এবার দশ গোল ভরে দেবে শোভাবাজারকে।”

স্মিত মুখে গুলোদা বলল, ”সেইজন্যই তো বলছি, কমলের মতো এতবড় প্লেয়ারের টিম দশ গোল খাচ্ছে, এ দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারব না। এটা যাত্রীর পক্ষেও বেদনাদায়ক হবে। হাজার হোক এক সময় কমল তো যাত্রীর—ই ছিল।”

”ঠিক ঠিক, গুলোদা ঠিক বলেছেন।” ভিড়ের মধ্যে একজন মাথা নেড়ে বলল, ”কমলদা, আপনি কিন্তু সেদিন খেলতে পারবেন না। আপনার ইজ্জতের সঙ্গে যাত্রীর ইজ্জতও জড়িয়ে আছে।”

পাংশু কালো মুখ নিয়ে কমল হাসল। এরা আজ অপমান করার জন্য পন্থা নিয়েছে করুণা দেখাবার। ওর ইচ্ছে করল নোটটা টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠতে—আমি এখনও শেষ হয়ে যাইনি, যাইনি। ঠিক তখনই কমলের বুকের মধ্যে এক বৃদ্ধের কণ্ঠ ফিসফিস করে উঠল—ব্যালান্স, কমল, ব্যালান্স কখনও হারাসনি।

ম্লান চোখে কমল সকলের মুখের উপর দিয়ে চাহনি বুলিয়ে ধীর স্বরে বলল, ”টাকাটা ফেরত নিন। আমার আর খেলার ইচ্ছে নেই।”

নোটটা তপেন রায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে কমল বেরিয়ে এল যাত্রীর টেন্ট থেকে। মাথার মধ্যেটা অসাড় হয়ে গেছে। হাঁটু দুটো মনে হচ্ছে মাখনে তৈরি, এখনি গলে গিয়ে তাকে ফেলে দেবে। বুকের মধ্যে দপদপ করে জ্বলে উঠতে চাইছে শোধ নেবার একটা প্রচণ্ড ইচ্ছা। যে বিমর্ষতা, হতাশা তাকে এই ক’দিন দমিয়ে রেখেছে, সেটা কেটে গিয়ে এখন সে অপমানের জ্বালায় ছটফট করে উঠল। উদ্দেশ্যহীনের মতো ময়দানের মধ্য দিয়ে এলোপাথাড়ি হাঁটতে হাঁটতে কমল কখন যে শোভাবাজার টেন্টে পৌঁছে গেছে খেয়াল করেনি। ডাক শুনে তাকিয়ে দেখল, ভরত আর সলিল ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে। ভরত এগিয়ে এল, সলিল এল না।

”আপনার কি অসুখ করেছে কমলদা? কেমন যেন শুকনো দেখাচ্ছে। অনেক দিন আসেন না, ভেবেছিলুম আপনার বাড়িতে যাব।”

প্রশ্নটা এড়িয়ে কমল বলল, ”ক্লাবের খবর কী, বল।”

”খবর আর কী, যা হয়ে থাকে প্রতি বছর তাই হচ্ছে। তিনটে ড্র করে তিন পয়েন্ট ম্যানেজ হয়েছে, তবু এখনও ভয় কাটেনি।” ভরত বিপন্ন হয়ে বলল, ”ভাল লাগে না কমলদা। এইভাবে ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার কোনও মানে হয় না।”

”সলিল কি খেলছে?”

”কেন, আপনি জানেন না! ও তো লাস্ট চারটে ম্যাচে খেলেছে, বেশ ভাল খেলছে। ইস্টবেঙ্গলের দিন হাবিবকে নড়াচড়া করতে দেয়নি। সব কাগজে ওর কথা লিখেছে।”

”তাই নাকি, আমি কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছি। আর কী খবর আছে?”

”আর যা আছে সেটা খুব মজার। সত্য আর শম্ভু তো গোলাম আলিতে স্যুটের মাপ দিয়ে এসেছিল। সাত দিন পর ট্রায়াল দিতে গিয়ে শোনে, গুলোদা টেলিফোন করে আগেই জানিয়ে রেখেছিল, তার অর্ডার না পাওয়া পর্যন্ত কাঁচি ধরবে না, শুধু মাপটা নিয়ে রেখে দেবে। গুলোদা আর ফোন করেনি। শুনে সত্য আর শম্ভু তো ফুঁসছে, এভাবে বোকা বনে যাবে ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। কথাটা কাউকে বলতেও পারছে না, কিল খেয়ে কিল চুরি করা ছাড়া ওদের আর উপায় নেই। এখন বলছে, রিটার্ন ম্যাচটায় যাত্রীকে দেখে নেব।”

কমল ফিকে হাসল মাত্র কথাগুলো শুনে। বলল, ”সরোজ কোথায়, প্র্যাকটিস কেমন চলছে?”

”কোথায় প্র্যাকটিস! সরোজদা তো প্রায় দশ দিন হল টেন্টই মাড়ায় না। শুনছি জামশেদপুর না দুর্গাপুরে চাকরি পেয়েছে। সলিল, স্বপন, রুদ্র, এরাই যা বল নিয়ে সকালে নাড়াচাড়া করে। সকালে এখন এক কাপ চা আর দুটো টোস্ট ছাড়া আর সব বন্ধ করে দিয়েছে কেষ্টদা।”

”সলিল চাকরিটা করছে কি এখনও?”

”একদিন ওর বাবা এসেছিল খুঁজতে। সলিল কাজ ছেড়ে দিয়েছে, বাড়িতেও থাকে না। কোথায় থাকে কেউ জানে না। ওকে জিজ্ঞেস করেছি, ঠিকানা দেয়নি।”

”সলিলকে বলিস আমার সঙ্গে দেখা করতে।”

কমল বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হতেই ভরত মাথা চুলকে বলল, ”সেদিনের পর থেকে আর আপনি মাঠে আসেন না।”

”হ্যাঁ, আর ভাল লাগে না। মাঠ থেকে এবার চলে যাওয়াই উচিত। আমার কোনও ফোন এসেছিল কি?”

”জানি না তো।”

.

।।পনেরো।।

বাড়ি ফিরেই কমল শুনল যে, কালোর মা গজগজ করে চলেছে, ”বাইরের লোকের প্যান্ট আমি কেন কাচব? বাইরের লোকের খাওয়া এঁটো বাসন মাজতে হবে, এমন কথা তো বাপু ছিল না। মাইনে না বাড়ালে আমি আর বাড়তি কাজ করতে পারব না।” ইত্যাদি ইত্যাদি?

বাইরের লোকটা আবার কে?” কমল কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করে।

”কেন, দাদাবাবুর যে বন্ধুটি থাকে!”

”থাকে! দাদাবাবুর বন্ধু?”

”কেন, আপনি জানেন না?” কালোর মা বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলার উপক্রম করতে কমল আর কথা বাড়াল না।

রাত্রে কমলের মনে হল, অমিতাভর ঘরে চাপা স্বরে কারা কথা বলছে। সকালে অমিতাভর ঘরের সামনে দিয়ে যাতায়াত করবার সময় খুঁটিয়ে ঘরের মধ্যে লক্ষ করে সে কিছুই বুঝতে পারল না। ভাবল, অমিতাভকে জিজ্ঞাসা করবে।

অফিসে বেরোবার সময় অমিতাভ তার কাছে কুড়িটা টাকা চাইল। এক সপ্তাহে চল্লিশ টাকা দিয়েছে, তাই কমল অস্বস্তিভরে বলল, ”হঠাৎ এত ঘন ঘন টাকার দরকার হচ্ছে যে? আমি যা মাইনে পাই তাতে এভাবে চললে কুলিয়ে ওঠা তো সম্ভব হবে না।”

”এক বন্ধুর অসুখ, তাকে ওষুধ কিনে দেবার জন্য—” অমিতাভ ঢোঁক গিলে বলল।

”কালোর মা বলছিল তোমার এক বন্ধু নাকি এখানে খায়?”

”তিন—চার দিন খেয়েছে। আর খাবে না।”

টাকা দেবার সময় কমল বলল, ”খাওয়ার জন্য আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।”

এরপর কমল লক্ষ করল, অমিতাভ যেন ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। গম্ভীর ভারিক্কি ভাবটা আর নেই, চলাফেরায় চঞ্চলতা দেখা যাচ্ছে, চেঁচিয়ে হঠাৎ গানও গেয়ে ওঠে, এমনকী একদিন সকালে উঠে চা তৈরি করে সে কমলকে ডেকে তুলেছে। কমল লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলে, ”খেলা ছেড়ে দিয়ে দেখছি অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সকালের একসারসাইজটা আমার শুরু করতে হবে কাল থেকে।”

”আপনি খেলা ছেড়ে দিয়েছেন?” অবাক হয়ে অমিতাভ জিজ্ঞাসা করে।

”হ্যাঁ।”

”কেন?”

কমল জবাব না দিয়ে বাজার রওনা হয়। সেইদিন শোভাবাজার টেন্টে গিয়ে সে শোনে, মহামেডানের সঙ্গে খেলায় বলাই ও অ্যামব্রোজ মারপিট করায় রেফারি দু’জনকেই মাঠ থেকে বার করে দিয়েছে, আর শ্রীধরের হাঁটুর পুরনো চোটটায় আবার লেগেছে, যার ফলে তাঁর দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। টেন্টে সকলেরই মুখ শুকনো, দুশ্চিন্তায় কপালে কুঞ্চন। খেলার মতো এগারো জন প্লেয়ার এখন শোভাবাজারের নেই। সহসম্পাদক অবনী মণ্ডল ওকে দেখে ছুটে এসে বলে, ”কমলবাবু, আপনার কাছেই যাব ভাবছিলুম! আপনাকে বাকি ম্যাচ তিনটে খেলতে হবে।”

”না।” কমল গম্ভীর স্বরে বলে, ”আমি আর খেলব না।” তারপর সে টেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে হতভম্ব অবনী মণ্ডলকে ফেলে রেখে।

অস্বস্তিপূর্ণ মন নিয়ে কমল বাড়ি ফিরল। শোভাবাজার এখন সত্যিই দুরবস্থায়। অথচ সে বলে এল খেলবে না। এই ক্লাব থেকেই সে গড়ের মাঠে খেলা শুরু করেছিল। ব্যাপারটা নেমকহারামির মতো লাগছে। ইচ্ছে করলে তিনটে ম্যাচ এখন সে অনায়াসে খেলে দিতে পারে। শেষ ম্যাচটা যাত্রীর সঙ্গে। গুলোদার বিদ্রুপভরা কথাগুলো কমলের কানে বেজে উঠল। তপেন রায়ের হাতে একশো টাকার নোটটা দেবার আগে সে বলেছিল, আর খেলবে না। তখন দাউদাউ আগুন জ্বলছিল মাথার মধ্যে। আর এখন শুধু ছাই হয়ে পড়ে আছে তার প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছাটা।

অভিতাভর ঘর অন্ধকার। কমল নিজের ঘরে ঢুকে জামাপ্যান্ট বদলে ইজিচেয়ারে গা ঢেলে দিল আলো নিভিয়ে। কুড়ি বছরের খেলার জীবনের অজস্র কথা আর দৃশ্য মনের মধ্যে ভিড় করে ঠেলাঠেলি করছে। তার মধ্যে বার বার দেখতে পাচ্ছে পল্টুদাকে, শুনতে পাচ্ছে তাঁর গলার স্বর—”প্র্যাকটিসটা আরও ভাল কর। হতাশা আসবে, তাকে জয় করতেও হবে… তুই খেলা ছেড়ে দিবি বলছিস, তার মানে তুই বড় খেলোয়াড় হতে পারিসনি।”

না,পারিনি। কমল বার বার নিজেকে শোনাতে থাকে, পারিনি, পারিনি, আমি হতে পারিনি। আমার মধ্যে প্রশান্তি আসেনি। অনেক কিছুই অপূর্ণ রয়ে গেছে।

অমিতাভর ঘরের দরজা খোলার এবং আলো জ্বালানোর শব্দ হল। কমলের মনে পড়ল আজ সকালে সে স্কিপিং দড়িটা খুঁজে পায়নি। অমিতাভ কি কোনও কাজে নিয়ে গেছে তার ঘরে! জিজ্ঞাসা করার জন্য সে উঠল। আলো জ্বালল। চটি করে ‘অমিত’ বলে ডেকে ঘর থেকে বেরোবার সময় তার মনে হল, পাশের ঘরে দ্রুত একটা ঘষড়ানির শব্দ হল। দ্রুত অমিতাভর ঘরের দরজায় পৌঁছে সে দেখল, খাটের নীচে কেউ ঢুকে যাচ্ছে, পলকের জন্য দুটি পা শুধু দেখতে পেল।

চোর! কমল থমকে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও চেঁচাল না। পা দুটো তার চেনা মনে হল। প্যান্টের যতটুকু দেখতে পেয়েছে, সেটাও খুব পরিচিত। সলিল।

দু’হাতে পাঁউরুটি নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে অমিতাভ থমকে তারপর আড়ষ্ট হয়ে গেল কমলকে খাটে বসে একটা বইয়ের পাতা ওলটাতে দেখে।

”পাঁউরুটি! কেন, ভাত রান্না হয়নি?”

”আজ শরীরটা ভাল নয়, তাই—”

”এতগুলো? এ তো প্রায় দু’জনের মতো দেখছি!”

”কালকের জন্যও এনে রাখলুম।”

কমল গম্ভীর মুখে আবার কয়েকটা পাতা উলটিয়ে গেল। অমিতাভ সন্তর্পণে ঘরের চারধারে চোখ বুলিয়ে নিল।

”ফুটবল যারা খেলে তাদের তুমি ঘৃণা করো। যেমন আমায় করো।” কমল অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে, কিন্তু প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট ভাবে ধীরে ধীরে উচ্চচারণ করল, ”তোমার মা’র মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী ভেবে তুমি কখনও আমায় সহজভাবে নিতে পারোনি, বাপ—ছেলের স্বাভাবিক সম্পর্ক আমাদের যেন হয়নি। হ্যাঁ, স্বীকার করি, তাকে অবহেলা করে আমি ফুটবলকেই বড় করে দেখেছি। আমি শুধু জানতে চাই, আমার প্রতি ঘৃণাটা তোমার আছে কি এখনও?”

অমিতাভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ”আমি বুঝতে পারছি না, হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেন?”

”কৌতূহলে। তোমার কি কখনও কৌতূহল হয় না, খেলার জন্য তোমার মাকে অগ্রাহ্য করেছে যে লোক, তার খেলা একবারও দেখার?”

”হয়, কিন্তু ওই কারণে নয়। ফুটবলকে এত ভালবেসে শেষে অপমান ও তাচ্ছিল্য নিয়ে খেলা থেকে সরে যাচ্ছে যে লোকটি, তার খেলা একবার দেখতে ইচ্ছে করে।”

কমল তীব্র চোখে তাকাল ছেলের দিকে। অমিতাভ অচঞ্চল।

”শুধু এই জন্য ইচ্ছে করে?”

”না। খেলাকে ভালবাসলে মানুষ কী পরিমাণ পাগল হয়, সেটা দেখতে দেখতেই আমার কৌতূহল জেগেছে।”

”কাকে দেখে, সলিলকে?”

অমিতাভ চমকে উঠে কমলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বিস্ময় তার সারা মুখে।

”তুমি ওকে আশ্রয় দিয়েছ কেন?” কমল কঠিন স্বরে প্রশ্ন করল।

”ও আমাকে অবাক করেছে। সেদিন অমানুষিক মার খাবার পর বলেছিল, কমলদার মতো আমার মাথায় দাগ তৈরি হবে না, আমার মাথা ফাটেনি। এই বলে ও কেঁদেছিল। ও আশ্রয় চেয়েছিল, আমি আশ্রয় দিয়েছি। এই ঘরে। ভোরে বেরিয়ে যায়, দুপুরে আসে, বিকেলে বেরিয়ে রাত্রে আসে। ও নিজের বাপ—মা ভাই—বোনদের ত্যাগ করেছে। ওর মধ্যে আমি অনেক কিছু না বোঝা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি।”

”কী বুঝেছ, কী বুঝেছ?” কমল উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠল। ”আমার কোনও দোষ ছিল না। খেলা শুধু শারীরিকই নয়, একটা মানসিক ব্যাপারও—সেটা বুঝেছ কি?”

”আপনার খেলা দেখার পর সেটা বুঝব।”

”তুমি আমার খেলা দেখবে!” কমল হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে হাতটা নামিয়ে নিল। অমিতাভ মাথাটা কাত করল।

কমল পরদিন অফিস থেকে শোভাবাজার টেন্টে ফোন করল, ”আমি খেলব, যাত্রীর সঙ্গে খেলাটায়।”

.

।।ষোলো।।

কাঁসর, শাঁখ, পটকা নিয়ে যাত্রীর সমর্থকরা ইস্টবেঙ্গল মাঠের সবুজ গ্যালারি ছেয়ে রয়েছে। দশ গজ পর পর হাতে উড়ছে যাত্রীর পতাকা। যুগের যাত্রী আজ লিগ চ্যামপিয়ন হবে। যাত্রীর ইতিহাসে প্রথম। আর দু’টি পয়েন্ট তাদের দরকার। যাত্রীর সমান খেলে ইস্টবেঙ্গল এক পয়েন্টে পিছিয়ে, মোহনবাগান তিন পয়েন্ট, মহমেডান ছয় পয়েন্ট। প্রত্যেকেরই একটি করে খেলা বাকি। যাত্রীকে আর ধরা যাবে না। যদি আজ যাত্রী ড্র করে এক পয়েন্ট খোয়ায়, তা হলে ইস্টবেঙ্গল সমান সমান হবার সুযোগ পাবে, কেননা তাদের শেষ ম্যাচ জর্জ টেলিগ্রাফের সঙ্গে। প্রথম খেলায় টেলিগ্রাফকে চার গোলে হারিয়েছে ইস্টবেঙ্গল।

গ্যালারিতে একজন দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল,”যাত্রী আজ যদি হেরে যায়! খেলার কথা তো কিছুই বলা যায় না।”

অবশ্য লোকটি কয়েক মুহূর্ত পরেই বুদ্ধিমান হয়ে গেল এবং সবাইকে শুনিয়ে বলল, ”পি সি সরকার কিংবা পেলে ছাড়া যাত্রীকে আজ হারাবার ক্ষমতা কার আছে! আগের ম্যাচে কীভাবে শোভাবাজার পাঁচ গোল খেয়েছিল মনে পড়ে?”

”শোভাবাজারের সেই টিমই খেলবে।” খুব বোদ্ধার মতো আর একজন বলল, ”সিজন যত শেষ হয়ে আসে, বর্ষা নামে, ছোট টিম ততই টায়ার্ড হয়, খারাপ খেলে। আমার তো মনে হয়, রেকর্ড গোল দিয়ে যাত্রীর লিগ চ্যামপিয়ন হওয়ার আজই সুযোগ।”

”দাদা, আগের ম্যাচে তো কমল গুহ খেলেছিল, আজও খেলবে কি?”

”কে জানে? অনেকদিন তো কাগজে নামটাম চোখে পড়েনি? আর খেললেই বা কী আসে যায়?”

”জানেন তো যাত্রী ছেড়ে যাবার সময় কমল গুহ কী বলেছিল?”

”আরে রাখুন ওসব বলাবলি। অনুপম আর প্রসূন আজ ওর পিণ্ডি চটকে ছাড়বে। দম্ভ নিয়ে মশাই ক’জন তা রাখতে পেরেছে? রাবণ পারেনি, দুর্যোধন পারেনি, হিটলার পারেনি, আর কমল গুহ পারবে?”

আজ শোভাবাজারের সমর্থক শুধু ইস্টবেঙ্গল মেম্বার—গ্যালারিতে। তাদের মনে একটা ক্ষীণ আশা—যদি যাত্রী হারে। হারলে, ইস্টবেঙ্গলের চ্যামপিয়ন হওয়া ওই পেলে বা পি সি সরকারও বন্ধ করতে পারবে না।

”অসম্ভব, হতি পারে না। যাত্রীর হার হতি পারে না। শোভাবাজারের আছেডা কে? লিগটা লইয়াই গেল শ্যাস পর্যন্ত।” কপালে করাঘাত হল।

”চ্যাঁচাইয়া যদি জেতান যায় তো আজ কলজে ফাটাইয়া দিমু। কী কস?”

”তাই দে।”

”নিচ্চচয়, আজ যেমন কইরা হোক জেতাইতে হইবই। ক্যান, স্পোর্টিং ইউনিয়নের দিন জেতাই নাই ইস্টবেঙ্গলেরে।”

”আরে মশাই, চেঁচিয়ে জেতাবেন শ’বাজার সে টিম নয়। পহাকড়ি দিয়ে দু—চারটে প্লেয়ারকে যাত্রী ঠিক ম্যানেজ করে রেখেছে। ষোল বচ্চচর তো খেলা দেখচি।”

”ছারপোকা! আমাগো গ্যালারিতে?”

”ছাইড়া দে। অগো আর আমাগো আজ কমন ইন্টারেস্ট। ইংরাজি বোঝোস তো?”

”চার বছছর আই এছছি পড়ছি। ইন্টারেস্ট মানে সুদ তা আর জানি না?”

পাশেই এরিয়ানের গ্যালারির অংশে রয়েছে যুগের যাত্রীর মেম্বাররা। সেখানে হইহই পড়ে গেছে বিপুল কলেবর ‘ফিল্ডমার্শাল’ কে দেখে। বিরাট গোঁফওলা লোকটি, চারটি সিগারেট মুঠো করে রাখা পাঁচ আঙুলের ফাঁকে। এক একটি টান দিচ্ছে আর মুখ থেকে পাটকলের চিমনির মতো ধোঁয়া বার করছে। যাত্রী ম্যাচ জেতার পর ফিল্ডমার্শাল এইভাবে সিগারেট খায়। আজ খেলা শুরুর আগেই খাচ্ছে।

‘ফিল্ডমার্শালে’র পিছন পিছন দু’টি চাকর বিরাট এক হাণ্ডা নিয়ে গ্যালারিতে এসেছে। ওতে আছে পনেরো কিলো রান্না করা মাংস। খেলা শেষে ভাঁড়ে বিতরণ করা হবে। হুটোপুটি পড়ে গেল হাণ্ডার কাছাকাছি থাকার জন্য।

”বড় খিদে পেয়েছে দাদা, ব্যাপারটা অ্যাডভান্সই চুকিয়ে ফেলুন না। রেজাল্ট তো জানাই আছে, তবে আর আমাদের কষ্ট দেওয়া কেন?”

”নৌ নৌ। এখন নয়।” ফিল্ডমার্শাল দু’হাত তুলল। ”অফিসিয়াল ভিকট্রির পর।”

মাঠের এক কোনায় গ্যালারিতে রয়েছে শোভাবাজার স্পোর্টিয়ের ডে—স্লিপ নিয়ে যারা এসেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই অবশ্য মনে মনে যাত্রীর সমর্থক। বিপুল ঘোষ আজ প্রথম মাঠে এসেছে কমলের কাছ থেকে স্লিপ নিয়ে। তার পাশেই বসেছে অমিতাভ। চুপচাপ একা। সলিল তাকে স্লিপ দিয়েছে। ফুটবল মাঠে আজই প্রথম আসা। ওদের পিছনে বসে অরুণা আর পিণ্টু। গতকাল কমল গেছল ওদের বাড়িতে; পল্টু মুখার্জির ছবির সামনে চোখ বুজে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, ছবিতে মাথা ঠেকিয়ে সে বিড়বিড় করে কিছু বলে। পিণ্টুও তার দেখাদেখি প্রণাম জানায়। পিণ্টুই বায়না ধরে, কমলমামার খেলা সে দেখবে।

গ্যালারিতে পিণ্টু অধৈর্য হয়ে ছটফট করে, কখন টিম নামবে। অরুণা ছোটবেলায়, পিণ্টুরই বয়সে বাবার সঙ্গে মাঠে এসে দেখেছে কমলের খেলা, শুধু মনে আছে, সারা মাঠ উচ্ছ্বসিত হয়েছিল কমলকে নিয়ে। আজ তারও প্রচণ্ড কৌতূহল। বিপুল ঘোষ ঘড়ি দেখে পাশের অমিতাভকে বলল, ”খেলা ক’টায় আরম্ভ বলতে পারেন?”

অমিতাভ মাথা নাড়ল। শোভাবাজারকে কতকটা বিদ্রূপ জানাতেই প্রচণ্ড শব্দে মাঠের মধ্যে পটকা পড়ল, তারপর পিণ্টু প্রবল উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ”ওই যে কমলমামা।”

.

কয়েকদিন ধরে কমল বারোটি ছেলেকে নিয়ে রীতিমতো ক্লাস করেছে তার শোবার ঘরে। মেঝেয় খড়ি দিয়ে মাঠ এঁকে, তার মধ্যে ঢিল সাজিয়ে (ঢিলগুলি প্লেয়ার) সে যাত্রীকে এক একটা মুভ দেখিয়ে কীভাবে সেগুলো প্রতিহত করতে হবে বুঝিয়েছে। ওরা গোল হয়ে ঘিরে বসে গভীর মনোযোগে শুনেছে। যাত্রীর অ্যাটাক প্রধানত কাকে ঘিরে, কোথা থেকে বল আসে, কী কী ফন্দি এঁটে ওরা স্যুটিং স্পেস তৈরি করে, পাহারা দেওয়া ডিফেন্ডারকে সরবার জন্য কীভাবে ওরা বল—ছাড়া দৌড়োদৌড়ি করে, ওভারল্যাপ করে ওদের ব্যাক কী ভাবে ওঠে, কমল ওদের দেখিয়েছে ঢিলগুলি নাড়াচাড়া করে। তারপর বুঝিয়েছে কার কী কর্তব্য। যাত্রীর প্রতিটি প্লেয়ারের গুণ এবং ত্রুটি এবং শোভাবাজারের কোন প্লেয়ারকে কী কাজ করতে হবে বার বার বলেছে। খেলার দিন সকালেও সে সকলকে ডেকে এনে শেষবারের মতো বলে, ”চারজন ব্যাকের পিছনে থাকব আমি। যখনই দরকার তখনই প্রত্যেক ডিফেন্ডারকে কভার দেব। ডিফেন্ডাররা নিজের নিজের লোককে ধরে রাখবে। মুহূর্ত দেরি না করে ট্যাকল করবে। বল ওরা কন্ট্রোলে আনার আগেই চ্যালেঞ্জ করবে। বিশেষ করে প্রসূনকে। যেখানে ও যাবে সলিল ছায়ার মতো সঙ্গে থাকবে। অনুপমকে দেখবে স্বপন। চারজন ব্যাকের সামনে থাকবে শম্ভু। প্রত্যেকটা পাস মাঝপথে ধরার চেষ্টা করবে, যেন যাত্রীর কোনও ফরোয়ার্ডের কাছে বল পৌঁছতে না পারে। অ্যাটাক কোথায় থেকে শুরু হচ্ছে দেখা মাত্র গিয়ে চ্যালেঞ্জ করবে। শম্ভুর সামনে তিনজন হাফ ব্যাক থাকবে। যাত্রীর অ্যাটাক শুরু হবার মুখেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আবার দরকার হলে নেমে এসে হেলপ করবে, আবার কাউন্টার—অ্যাটাকে বল নিয়ে এগিয়ে যাবে। আর যাত্রীর পেনাল্টি বক্সের কাছে থাকবে গোপাল। মোট কথা, আমাদের ছকটা হবে ১—৪—১—৩—১।”

”কমলদা, আমি কিন্তু ওদের দু—একটাকে বার করবই।” শম্ভু গোঁয়ারের মতো বলেছিল।

কমল কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ”ওদের একজনকে বার করার সঙ্গে সঙ্গে তোমাকেও বেরিয়ে যেতে হবে। তাতে ক্ষতি হবে শোভাবাজারেরই। শম্ভু, আজ সব থেকে দায়িত্বের কাজ তোমার উপর। তুমি কি দায়িত্বের ভয়ে পালিয়ে যেতে চাও?”

”কে বলল?” শম্ভু লাফিয়ে উঠল। চোখ দিয়ে রাগ ঠিকরে পড়ল। দেয়ালে ঘুষি মেরে সে বলল, ”আমি পালাব, আমি পালিয়ে যেতে চাই? আমার বাপ দেশ ভাগ হতে পালিয়ে এসেছিল। শেয়ালদার প্ল্যাটফর্মে আমি জন্মেছি কমলদা, আমার মা মরেছে উপোস দিয়ে, বড় ভাই মরেছে খাদ্য আন্দোলনে গুলি খেয়ে। আমি চুরিচামারি অনেক করেছি। আজ ছিঁড়ে খাব সবাইকে।”

কমল পর পর সকলের মুখের দিকে তাকায়, তারপর ফিসফিসে গলায় বলে, ”আজ শোভাবাজার লড়বে।”

ওরা চুপ করে শুধু কমলের দিকে তাকিয়ে থেকেছিল।

.

।।সতেরো।।

তারপর শোভাবাজার লড়াই শুরু করল।

কিক অফের সঙ্গে সঙ্গে অনুপম ছুটতে শুরু করল আর প্রসূন ডান টাচ লাইনে লম্বা শটে বল পাঠাল, ছোটবার মাথায় অনুপম বলে পা দেওয়া মাত্র স্বপন বুলডোজারের মতো এগিয়ে এসে ধাক্কা মারল। ফাউল। গ্যালারিতে বিশ্রী কথাবার্তা আর চিৎকার শুরু হয়ে গেল। যাত্রীর রাইট ব্যাক ফ্রি কিক করে পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে বল ফেলা মাত্র প্রাণবন্ধু হেড দিয়ে ক্লিয়ার করার জন্য উঠল, আর প্রায় পনেরো গজ ছুটে এসে ভরত তার মাথার উপর থেকে বলটা তুলে নিয়ে একগাল হাসল।

”ভরত, হচ্ছে কী, গোলে দাঁড়া।” কমল ধমক দিল।

কিক করে বলটা মাঝমাঠে পাঠিয়ে ভরত বলল, ”কমলদা, পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে কাউকে আজ মাথায় বল লাগাতে দেব না।”

যাত্রী শুরুতেই ধাক্কা দিয়ে তারপর ক্রমশ এগিয়ে এসে শোভাবাজারের পেনাল্টি এরিয়াকে ছয়জনে ঘিরে ধরল এবং দুই উইং ব্যাকও উঠে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। শোভাবাজারের গোপাল ছাড়া আর সবাই গোলের মুখে নেমে এসেছে। কমল বিপদের গন্ধ পেল। আঠারো জন লোক একটা ছোট জায়গার মধ্যে গুঁতোগুঁতি করতে করতে হঠাৎ কখন কে ফাঁক পেয়ে গোলে বল মেরে দেবে এবং এইরকম অবস্থায় সাধারণত ভিড়ের জন্য গোলকিপারের দৃষ্টিপথ আড়াল থাকে। তা ছাড়া ট্যাকল করার আগে কোনও রকম বিচারবোধ ব্যবহার না করায় এবং যথেষ্ট স্কিল না থাকায় শোভাবাজারের ডিফেন্ডাররাও বেসামাল হতে শুরু করেছে।

এতটা ডিফেন্সিভ হওয়া উচিত হয়নি। কমল দ্রুত চিন্তা করে যেতে লাগল। শুধু গোঁয়ার্তুমি সাহস বা দমের জোরে একটা স্কিল্ড অ্যাটাককে ঠেকানো যায় না। কাউন্টার—অ্যাটাক চাই। বল নিয়ে উঠতে হবে। গোপাল উঠে আছে কিন্তু ওকে বল দিয়ে কাজ হবে না। একা বল নিয়ে দুটো স্টপারকে কাটিয়ে বেরোবার ক্ষমতা ওর নেই। বল আবার ফিরে আসবে।

প্রাণবন্ধুর একটা মিসকিক কমল ধরে ফেলল। সামনেই যাত্রীর আব্রাহাম। কোমর থেকে একটা ঝাঁকুনির দোলা কমলের শরীরের উপর দিয়ে উঠে যেতেই আব্রাহাম টলে পড়ল। বল নিয়ে কমল পেনাল্টি এরিয়া পার হল।

”ওঠ সলিল।”

কমলের পিছনে প্রসূন, অনুসরণ করছে সলিল। কমলের ডাকে সে এগিয়ে এল। যাত্রীর হাফ ব্যাক অমিয় এগিয়ে আসতেই কমল বলটা ঠেলে দিল সলিলকে। দ্রুত শোভাবাজারের চারজন উঠছে। বল ডান থেকে বাঁ দিকে, আবার ঘুরে ডান দিকে এল। শেষপর্যন্ত যাত্রীর কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে রুদ্রর কাছ থেকে বল কেড়ে নিল আনোয়ার।

কমল এগিয়ে এসেছে। প্রায় দশ মিনিট যাত্রীর চাপ তারা ধরে রেখেছিল। খেলাটাকে মাঝমাঠে আটকে রেখে যাত্রীর গতি মন্থর করাতে হবে। কমল বল ধরে পায়ে রাখতে শুরু করল। রুদ্র, সত্য আর দেবীদাস মাঠের মাঝখানে, শম্ভু ঠিক ওদের পিছনে। তার কাছে বল পাঠিয়ে কমল চার ব্যাকের পিছনে পেনাল্টি এরিয়া লাইনের উপর দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে লাগল যাত্রীর কে কোথায় কীভাবে নড়াচড়া করছে।

আঠার মতো লেগে আছে শোভাবাজারের চারটি ব্যাক যাত্রীর চার ফরোয়ার্ডের সঙ্গে। অনুপমের কাছে চার বার বল এসেছে এবং প্রতিবার সে বলে পা লাগাবার আগেই স্বপন ছিনিয়ে নিয়েছে। বল যখন যাত্রীর বাম কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে, অনুপম তখন শোভাবাজারের রাইট হাফের কাছাকাছি ডান টাচ লাইন ঘেঁষে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর পাঁচ হাত দূরে স্বপন। অনুপম হাঁটতে লাগল সেন্টার লাইনের দিকে, ওর পাশাপাশি চলল স্বপনও। অনুপম হঠাৎ ঘুরে আসার আগের জায়গায় ফিরে এল, স্বপনও ওর সঙ্গে ফিরে এল। গ্যালারিতে যাত্রীর সমর্থকরা পর্যন্ত ব্যাপারটা দেখে হেসে উঠল। অনুপম ডানদিক থেকে বাঁদিকে নিমাইয়ের জায়গায় ছুটে গেল, স্বপনও। যতবার বল তার দিকে আসে, স্বপন হয় টাচ লাইনের বাইরে ঠেলে দেয়, নয়তো মাঠের যেখানে খুশি কিক করে পাঠায়। অনুপম দু’বার স্বপনকে কাটিয়েই দেখে, কমল স্বপনকে কভার করে এগিয়ে এসে তার পথ জুড়ে আছে। কী করবে ভেবে ঠিক করার আগে স্বপনই ঘুরে এসে ছোঁ মেরে বলটা নিয়ে গেল।

শম্ভু পাগলের মতো মাঝমাঠটাকে ফালা ফালা করে দিচ্ছে যাত্রীর ফরোয়ার্ডদের উদ্দেশ্যে পিছন থেকে পাঠানো বল ধরার জন্য, ডাইনে—বামে যেখান থেকেই আক্রমণ তৈরি হয়ে ওঠার গন্ধ পেয়েছে, ছুটে যাচ্ছে বুলডগের মতো। সব সময়েই যে সফল হচ্ছে তা নয়, কিন্তু ওর জন্য বল নিয়ে যাত্রীর কেউ সহজে উঠে আসতে পারছে না। যদিও বা ওয়াল—পাস করে উঠে আসে, প্রাণবন্ধু নয় তো সলিল এগিয়ে আসে চ্যালেঞ্জ করতে।

প্রসূন পিছিয়ে নেমে এসেছে। সলিলও তার সঙ্গে যাচিছল, কমল বারণ করল।

”মাঝমাঠে যত ইচ্ছে প্রসূন খেলুক, তুই এখানে থাক! যখনই উঠে আসবে আবার লেগে থাকবি।”

তারপরই যাত্রীর দুই উইং ব্যাক দু’দিক থেকে উঠতে শুরু করল। কমল বিপদ দেখতে পেল। নিমাই, আব্রাহাম আর অনুপম ছোটাছুটি করে ছড়িয়ে যাচ্ছে বলাই, প্রাণবন্ধু আর স্বপনকে নিয়ে। প্রসূন বল নিয়ে উঠছে, দু’পাশ থেকে উইং ব্যাক দু’জন। কমল দু’দিকে নজর রাখতে লাগল কোন দিকে প্রসূন বল বাড়িয়ে দেয়।

চার ব্যাকের পিছনে মাঝামাঝি জায়গায় কমল দাঁড়াল। প্রসূন দেবীদাসকে কাটাল, শম্ভুর স্লাইডিং ট্যাকল ব্যর্থ হল। সলিল এগোচ্ছে। প্রসূনের বাঁ কাঁধ সামান্য ঘুরেছে গোলের দিকে, এবার ডানদিকে বল বাড়াবে। কমল তার বাঁ দিক চেপে সরে গিয়ে উঠে আসা রাইট ব্যাকের দিকে নজর দিল আর প্রসূন অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় শরীর মুচড়ে তার বাঁ দিকে বল পাঠাল, যেখানে লেফট ব্যাক বাঁদিক থেকে ফাঁকায় উঠে এসেছে।

প্রায় পঁচিশ হাজার কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল—গো—ও—ল গো—ও—ল। সেই প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে জ্বালা ধরানো কোনও খবর ছিল না যা কমলের স্নায়ুকেন্দ্রে মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটাল। বাঁ দিকে ঝোঁকা দেহভারকে সে চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় ডান দিকে ঘুরিয়ে ছুটে এল লেফট ব্যাকের সামনে। প্রায় ১২ গজ দূরত্ব গোল থেকে। শট নিলে নিশ্চিত গোল। হঠাৎ সামনে কমলকে দেখে সে শট নিতে গিয়েও নিতে পারল না। পলকের মধ্যে কমল বলটা কেড়ে নিয়ে যখন রুদ্রর কাছে পাঠাল তখন গ্যালারির চিৎকার চাপা হতাশায় কাতরে উঠেছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট খেলা হয়ে গেল, এখনও গোল হল না। শোভাবাজার একবারও যাত্রীর গোলের দিকে যায়নি।

কিন্তু হাফ টাইমের কয়েক সেকেন্ড আগে শম্ভুর পা থেকে ছিটকে যাওয়া বল পেয়ে গোপাল অভাবিত যাত্রীর গোলের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায় আনোয়ার ও অমিয়কে পিছনে ফেলে। গোলকিপার শ্যাম এগিয়ে এসেছে। গোপাল প্রায় চোখ বুজেই শট নেয়। শ্যামের ঝাঁপানো হাতের নাগাল পেরিয়ে বল ক্রসবারে লেগে মাঠে ফিরে এল।

সারা মাঠ বিস্ময়ে হতবাক। অকল্পনীয় ব্যাপার, শোভাবাজার গোল দিয়ে দিয়েছিল প্রায়। বিস্ময়ের ঘোর কাটল রেফারির হাফ টাইমের বাঁশিতে। মাঠের সীমানার বাইরে এসে শোভাবাজারের ছেলেরা একে একে বসে পড়ল। কৃষ্ণ মাইতি জলের গ্লাস আর তোয়ালে নিয়ে ব্যস্ত। প্লেয়াররা কেউ কথা বলছে না। পরিশ্রান্ত দেহগুলো ধুঁকছে। অবসন্নতায় পিঠগুলো বেঁকে গেছে।

কৃষ্ণ মাইতি হাত নেড়ে বক্তৃতা দেওয়ার ঢঙে বলল, ”এবার লং পাসে খেলে যা, শর্ট পাস বন্ধ কর! সত্য, তুই অত নেমে খেলছিস কেন, উঠে খেল। সলিল, আরও রোবাস্টলি খেলতে হবে, বার কয়েক পা চালা, আব্রাহামটা দারুণ ভিতু।”

কমল হাত তুলে কৃষ্ণ মাইতিকে চুপ করতে ইশারা করল, ”এখন ওদের কিছু বলবেন না।”

সলিল বলল, ”কমলদা, ওটা আমারই দোষ ছিল। প্রসূন পাসটা অত আগেই দেবে বুঝতে পারিনি, নয়তো আগেই ট্যাকল করতুম। আপনি না থাকলে গোল হয়ে যেত।”

কমল কথাগুলো না শোনার ভান করে গ্যালারির শেষ প্রান্তে তাকাল। চেষ্টা করল একটা মুখ খুঁজে বার করতে। ব্যর্থ হয়ে বলল, ”অমিতাভ এসেছে কি?”

সলিল বলল, ”হ্যাঁ, ওই তো। ওই যে একজন মেয়েছেলে বসে আছে—ঠিক তার সামনে। বল আনতে গিয়ে আমি দেখেছি।”

কমল আবার তাকাল।

যাত্রীর মেম্বারদের মধ্যে থমথমে ভাব। কেউ কেউ উত্তেজিত। ‘অনুপমের এ কী খেলা!’ ডিফেন্স যখন ক্রাউডেড করেছে তা হলে ওদের টেনে বার করে ফাঁকা করুক।’ ‘প্রসূন নিজে গোলে না মেরে পাস দিতে গেল কেন?’

‘শম্ভুর ট্যাকলিং প্রত্যেকটা ফাউল, রেফারি দেখেও দেখছে না। আব্রাহামকে যে অফসাইডটা দিল দেখেছেন তো?’ ”একবার বল এনেছে তাতেই গোল হয়ে যাচ্ছিল; চলে না, আনোয়ার ফানোয়ার আর চলে না।”

কমল উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল। কানে এল কচি গলায় পিণ্টু ডাকছে, ”কমলমামা, কমলমামা, এই যে আমরা এখানে।”

.

।।আঠারো।।

রেফারি বাঁশি বাজাল।

”মনে আছে তো, শোভাবাজার আজ লড়বে।” মাঠে নামার সময় কমল মনে করিয়ে দিল। ওরা কথা বলল না।

কমল আশা করেছিল যাত্রী ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু সাবধানে ওরা মাঝমাঠে বল রেখে খেলছে। মিনিট পাঁচেক কেটে যাবার পর অনুপম বল পেয়ে কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে ছুটে থমকে স্বপনকে কাটিয়ে নিয়ে ঢুকতে গিয়ে কমলের কাছে বাধা পেল। সেন্টার করল সে। ভরত সহজেই আব্রাহামের মাথা থেকে বল তুলে নিল।

”স্বপন, কী ব্যাপার! অনুপম বিট করে গেল?” কমল কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে গেল। আবার অনুপম এগোচ্ছে বল নিয়ে।

স্বপন এবারও পিছনে পড়ে ঘুরে এসে আর চ্যালেঞ্জ করল না। কমল বুঝে গেল স্বপন আর পারছে না। এবং লক্ষ করল, বলাই এবং প্রাণবন্ধুও মন্থর হয়ে এসেছে। সলিলের মধ্যে ক্লান্তির ছাপ এখনও দেখা দেয়নি। শম্ভু মাঝমাঠে দোর্দণ্ড হয়ে রয়েছে। যেখানে বল সেখানেই ছুটে যাচ্ছে। দেবীদাস আর সত্য বল দেওয়া—নেওয়া করে যাত্রীর হাফ লাইন পর্যন্ত বার কয়েক পৌঁছতে পেরেছে।

ফাউল করেছে শম্ভু। যাত্রীর রাইট ব্যাকের বুকে পা তুলে দিয়েছে। সে কলার ধরেছে শম্ভুর। গ্যালারি থেকে কাঠের টুকরো আর ইট পড়ছে মাঠে শম্ভুকে লক্ষ্য করে। এর এক মিনিট পরেই শম্ভুকে মাঠের বাইরে যেতে হল। আব্রাহাম, অমিয় আর শম্ভু এক সঙ্গে বলের উদ্দেশ্যে ছুটে গিয়ে এক সঙ্গেই মাটিতে পড়ে গেল। দু’জন উঠে দাঁড়াল, শম্ভুকে ধরাধরি করে বাইরে আনা হল। এবং মিনিট তিনেক পর যখন সে মাঠে এল তখন খোঁড়াচ্ছে।

মাঝমাঠে এখন যাত্রীর রাজত্ব। শম্ভু ছুটতে যায় আর যন্ত্রণায় কাতরে ওঠে।

”কমলদা, আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমাকে শেষ করে দিয়েছে। ওদের একটাকে নিয়ে বরং আমি বেরিয়ে যাই।”

”না। তুই বোস। রতনকে নামতে বল।”

”আমি বরং প্রসূনকে নিয়ে—ও ভাল খেলছে।”

”খেলুক। খেলতে হবে ওকে।” কমলের রগের শিরা দপদপ করে উঠল। ”না খেললে কমল গুহকে টপকানো যাবে না।”

শম্ভু বসল এবং তৃতীয় ডিভিশন থেকে এই বছরেই আসা নতুন ছেলে রতন নামল। তখন গ্যালারিতে পটকা ফাটল। যাত্রীর আক্রমণে আট জন উঠে এল এবং ক্লান্ত শোভাবাজার সময় গুনতে লাগল কখন গোল হয়। এবং—

একটা প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের মতো কমল গুহ তখন শোভাবাজারের পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে শাখা বিস্তার করে দিল। কখনও সে বন্য মহিষ কখনও বনবিড়াল, কখনও গোখরো সাপ। শোভাবাজার পেনাল্টি এলাকাটা ভয়ঙ্কর করে তুলল কমল তার ক্রুদ্ধ চতুর হিংস্র বিচরণে। একটার পর একটা আক্রমণ আসছে, প্রধানত সলিলকে নিয়ে কমল সেগুলো রুখে যাচ্ছে। আর গ্যালারিতে অশ্রান্ত গর্জন ক্রুদ্ধ—হতাশায় আর্তনাদে পরিণত হচ্ছে।

এইবার, এইবার যাত্রী, আমি শোধ নেব। কমল নিজের সঙ্গে কথা বলে চলে। আমার মাথা নোয়াতে পারোনি, আজও উঁচু করে বেরোব মাঠ থেকে। গুলোদা, রথীন, এদের সব ব্যঙ্গ সব বিদ্রূপ আজ ফিরিয়ে দেব। বল আনছে প্রসূন, এগোক, এগোক, সলিল আছে। ওর পিছনে আমি। আহ লেফট উইং নিমাইকে দিল, বলাই চেজ করছে, ওর পিছনে আমি আছি।

কমলের সামনে বল নিয়ে নিমাই থমকে দাঁড়াল। ডাইনে ঝুঁকল, বাঁয়ে হেলল। কমল নিস্পন্দের মতো, চোখ দুটি বলের দিকে স্থির। নিমাই কাকে বলটা দেওয়া যায় দেখার জন্য মুহূর্তের জন্য চোখ সরাতেই ছোবল দেবার মতো কমলের ডান পা নিমাইয়ের হেফাজত থেকে বলটা সরিয়ে নিল।

কমল বল নিয়ে উঠছে। আয়, আয় কে আসবি, গুলোদা, সরোজ, রথীন, রণেন দাস—কোথায় অনুপমের ভক্তরা—আয় কমল গুহর পায়ে বল, আয় দেখি কেড়ে নে।

রাইট হাফকে কাটিয়ে কমল দাঁড়িয়ে পড়ল। সাইড লাইনের ধারের বেঞ্চে রথীন। ওর সুশ্রী মুখটা যন্ত্রণায় মুচড়ে রয়েছে। কমল একবার মুখ ফিরিয়ে রথীনের দিকে তাকিয়ে হাসল। আজও জ্বালাচ্ছি তোদের। বছরের পর বছর আমি জ্বলেছি রে। আমাকে বঞ্চিত করে যাত্রী তোকে ইন্ডিয়ার জার্সি পরিয়েছে, আমাকে প্রাপ্য টাকা থেকে বঞ্চিত করেছে যাত্রী, আমাকে সাধারণ প্লেয়ারের মতো বসিয়ে রেখে অপমান করেছিল…কমল মাঠের মধ্যে সরে আসতেই, দু’জন এগিয়ে এল চ্যালেঞ্জ করতে। হঠাৎ গতি বাড়িয়ে কমল দু’জনের মধ্যে দিয়ে পিছলে এগিয়ে গেল, বলটা আঠার মতো পায়ে লেগে রয়েছে— অমিতাভর মায়ের মৃত্যুর খবরটা যাত্রী আমাকে দেয়নি রে রথীন। ট্রফি জিততে কমল গুহকে দরকার, তাই খবরটা চেপে গেছল। …আর একজন সামনে এগিয়ে এল কমলের। ডান দিকে সরে যেতে লাগল কমল। বল নিয়ে দাঁড়াল। গোল প্রায় তিরিশ গজ। বলটা আর একটু নিয়ে কমল শট নিল। নিখুঁত মাপা শট। বার ও পোস্টের জোড় লক্ষ্য করে বলটা জমি থেকে উঠে যাচ্ছে। গ্যালারিতে হাজার হাজার হৃদস্পন্দনের শব্দ মুহূর্তের জন্য তখন বন্ধ হয়ে গেল। শ্যাম লাফিয়ে উঠে চমৎকারভাবে আঙুলের ডগা দিয়ে বলটা বারের উপর তুলে দিতেই মাঠের চারধারে আবার নিশ্বাস পড়ল।

কর্নার। শোভাবাজারের আজ প্রথম। যাত্রী পেয়েছে আটটা। তার মধ্যে সাতটাই ভরত লুফে নিয়েছে। বল বসাচ্ছিল দেবীদাস। সত্য ছুটে এসে তাকে সরিয়ে দিল। যাত্রীর ছ’জন গোলের মুখে। শোভাবাজারের পাঁচজনকে তারা আগলে রেখে দাঁড়াল।

সত্য কিক নিল। মসৃণ গতিতে বলটা রামধনুর মতো বক্রতায় গোলমুখে পড়ছিল। গোপাল লাফাল। তার মাথার উপর থেকে পাঞ্চ করল শ্যাম। প্রায় পনেরো গজ দূরে গিয়ে বল পড়ছে। সেখানে দেবীদাস। দু’জন তার দিকে ছিটকে এগোল।

”দেবী!”

বাঁ পাশ থেকে ডাকটা শুনেই দেবীদাস বলটা বাঁ দিকে ঠেলে সরে গেল। পিছন থেকে ঝলসে বেরিয়ে এল একটা চেহারা। তার বাঁ পা—টা উঠল এবং বলে আঘাত করল। বাম পোস্ট ঘেঁষে বলটা যাত্রীর গোলের মধ্যে ঢুকল। এমন অতর্কিত ব্যাপারটা ঘটে গেল যে খেলোয়াড়রা শুধু অবিশ্বাসভরে আঘাতকারীর দিকে তাকিয়ে থাকা কয়েক সেকেন্ড চোখ সরাতে পারল না।

যাত্রীর মেম্বারদের মধ্যে কথা নেই। শুধু একটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল মাত্র, ”অত মাংস খাবে কে এবার।”

বিপুল ঘোষ হতভম্ব হয়ে অমিতাভকে বলল, ”য়্যাঁ, যুগের যাত্রী গোল খেয়ে গেল; কে গোলটা দিল?”

অমিতাভ গলার কাছে জমে ওঠা বাষ্প ভেদ করে অস্ফুটে শব্দগুলো বার করে আনল, ”কমল গুহ।” তারপর লাজুক স্বরে যোগ করল, ”আমার বাবা।”

ঝাঁপিয়ে পড়ল যাত্রী শোভাবাজারের গোলে। চার মিনিট বাকি। পরপর তিনটি কর্নার, দু’টি ফ্রি কিক যাত্রী পেল। আব্রাহামের চোরা ঘুষিতে বলাইয়ের ঠোঁট ফাটল। কিন্তু সেই বৃহৎ প্রাচীন অশ্বত্থ গাছটি সব ঝড়ঝাপটা থেকে আড়াল করে রাখল তার পিছনের গোলটিকে।

শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে মাঠের মধ্যে দৌড়ে এল শম্ভু। ”আমি সেরে গেছি, আমি সেরে গেছি কমলদা। আমার আর ব্যথা নেই।”

প্রথম কমলের দুই হাঁটু জড়িয়ে তাকে উপরে তুলল সত্য। তারপর কীভাবে যেন চারটে কাঁধ চেয়ার হয়ে কমলকে বসিয়ে নিল। ইস্টবেঙ্গল মেম্বার গ্যালারি উত্তেজনায় বিস্ময়ে টগবগ করছে।

কাঁধের উপর কমলকে তুলে ওরা মাঠের বাইরে এল। কৃষ্ণ মাইতির গলা ধরে গেছে চিৎকার করে। ”কমল, বল বল, আমি প্লেয়ার চিনি কি না বল। নিজের রিসকে সব অপোজিশন অগ্রাহ্য করে তোকে খেলিয়েছিলুম আগের ম্যাচে, বল ঠিক বলছি কি না।”

কমলের মস্তিষ্ক ঘিরে এখন যেন একটা কালো পরদা টাঙানো। কী ঘটছে, কে কী বলছে তার মাথার মধ্যে ঢুকছে না, কোনও আবেগ বেরোতেও পারছে না। ক্লান্তিতে দু’চোখ ঝাপসা। তার শুধু মনে হচ্ছে, কিছু অর্থহীন শব্দ আর কিছু মানুষ তার চারপাশে কিলবিল করছে। কমল ভারবাহী একটা ক্রেনের মতো নিজের শরীরটা নামিয়ে দিল ভূমিতে। দু’হাতে মুখ ঢেকে সে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর টপটপ করে তার চোখ থেকে জল ঝরে পড়ল ঘাসের উপর। কেন পড়ছে তা সে জানে না।

অতি যত্নে তার পা থেকে বুট খুলে দিচ্ছে কে! কমল মাথা ফিরিয়ে দেখল, সলিল। গ্যালারির দিকে কমল তাকাল। একটা পটকাও ফাটেনি। পতাকা ওড়েনি। উৎসব করতে আসা মানুষগুলো নিঃশব্দে বিবর্ণ অপমানিত মুখগুলোয় শ্মশানের বিষণ্ণতা নিয়ে মাঠ থেকে চলে যাচ্ছে। গ্যালারি ক্রমশ শূন্য হয়ে এল। বেদনায় মুচড়ে উঠল কমলের বুক। আর কখনও সে মাঠের মধ্যে থেকে ভরা—গ্যালারি দেখতে পাবে না। কমল গুহ আজ জীবনের শেষ খেলা খেলেছে।

কমল উঠে দাঁড়াল। কোনও দিকে না তাকিয়ে মুখ নিচু করে সে মাঠের মাঝে সেন্টার সার্কেলের মধ্যে এসে দাঁড়াল। আকাশের দিকে মুখ তুলল। অস্ফুটে বলল, ”আমি যেন কখনও ব্যালান্স না হারাই। আমার ফুটবল যেন সারা জীবন আমাকে নিয়ে খেলা করে।”

কমল নিচু হয়ে মাটি তুলল। কপালে সেই মাটি লাগিয়ে মন্ত্রোচ্চচারণের মতো বলল, ”অনেক দিয়েছ, অনেক নিয়েছও। আজ আমি বরাবরের জন্য তোমার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। জ্ঞানত তোমার অসম্মান করিনি। নতুন নতুন ছেলেরা আসবে তোমাকে গৌরব দিতে। দয়া করে আমাকে একটু মনে রেখো।”

”কমলদা, চলুন এবার।” মাঠের বাইরে থেকে ভরত চেঁচিয়ে ডাকল। ওরা অপেক্ষা করছে তার জন্য।

মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখল, সেই সাংবাদিকটিকে খুব উত্তেজিত স্বরে কৃষ্ণ মাইতি বলছে, ”আমিই তো কমলকে, বলতে গেলে, আবিষ্কার করি; ফুটবলের অ আ ক খ প্রথম শেখে আমার কাছেই।”

শুনে কমল হাসল। তারপরই চোখে পড়ল অমিতাভ দূরে দাঁড়িয়ে। কমল অবাক হল, বুকটা উৎকণ্ঠা আর প্রত্যাশায় দুলে উঠল।

এগিয়ে এসে প্রায় চুপিচুপিই বলল, ”আজ জীবনের শেষ খেলা খেললাম, কেমন লাগল তোমার?”

অমিতাভ উত্তেজনায় থরথর স্বরে বলল, ”তোমার জন্য আমার গর্ব হচ্ছিল বাবা।”

”সত্যি!” কমলের বিস্ময় হাউয়ের মতো ফেটে পড়ল চোখেমুখে। তার মনে হল গ্যালারিগুলো আবার ভরে গেল।

”সত্যিই।”

”যদি আমার দশ বছর আগের খেলা তুই দেখতিস!” কমল হাসতে শুরু করল।

Exit mobile version