খোঁড়াসিঙ্গি তর্জনগর্জন করে বললেন, তাহলে তোকেই ভিটেছাড়া করব বলে দিচ্ছি। বেশ বুঝেছি, তুই-ই যত নষ্টের গোড়া। তোরই আস্কারা পেয়ে হারামজাদাগুলোর এত বাড় বেড়েছে। দাঁড়া! কালই পঞ্চগেরামি করে তোর বিচারের ব্যবস্থা করছি।
সে আমলে পঞ্চগেরামি অর্থাৎ পঞ্চগ্রামী মানে পাঁচ গাঁয়ের মাতব্বর লোকদের ডেকে বিচারসভার আয়োজন। সেই বিচারসভা বসল চণ্ডীমন্ডপে। মোনাকে ডেকে আনা হল। মোনা-ওঝা কিন্তু একটুও দমে যায়নি। সে মুচকি হেসে বলল, বাবুমশাইরা! ওপরে দেবতা, নিচে মা বসুমতী। ন্যায্য বিচার করে বলুন দিকি দোষটা কার? সিঙ্গিমশাইয়ের ঠ্যাং কি ভূতগুলো ভেঙেছে, নাকি নিজেই গর্তে আছাড় খেয়ে নিজেই ভেঙেছেন? জিগ্যেস করুন তো সিঙ্গিমশাইকে।
সবাই একমত হলেন যে, ভূতগুলো সিঙ্গিমশাইয়ের ঠ্যাং-এ আঘাত করেনি, এটা সত্যি। কিন্তু পাশের গাঁয়ের চক্কোত্তিমশাই বললেন,-মানছি,–ওরা সিঙ্গি মশাইয়ের ঠ্যাং ভাঙেনি। তবে এ-ও তো ঠিক যে ভূতগুলো ওঁকে ভয় না দেখালে উনি দৌড়ে পালাতেন না এবং গর্তেও পড়তেন না। ঠ্যাং-ও ভাঙত না।
মোনা-ওঝা হাত নেড়ে বলল,–ভুল! একেবারে ভুল। ভূতগুলো ওঁকে কক্ষনও ভয় দেখায়নি। মা চণ্ডীর দিব্যি করে বলুন উনি।
মাতব্বররা সিঙ্গিমশাইকে জিগ্যেস করলেন কথাটা। সিঙ্গিমশাই গাঁইগুই করে বললেন,–মানে, ঠিক ভয় দেখায়নি। তবে আমার হাতে রসমালাইয়ের ভঁড় ছিল। সেটা কেড়ে নিতে এসেছিল।
মোনা-ওঝা বলল, আবার ভুল হল বাবুমশাইরা! কেড়ে নিতে এসেছিল, নাকি চেয়েছিল? মা-চণ্ডীর দিব্যি, সত্যি কথাটা বলুন।
আমাদের গাঁয়ের মা-চণ্ডী জাগ্রত দেবী। তার ভয়ে খোঁড়াসিঙ্গিকে স্বীকার করতে হল, রসমালাইগুলো কেড়ে নেবে বলে মনে হচ্ছিল বটে, তবে ওরা র্দে-দে করে চেঁচাচ্ছিল সেটা মিথ্যা নয়।
তাহলে? –মোনা-ওঝা একগাল হেসে বলল,-এবার বলুন দোষটা কার? হাতে রসমালাই দেখলে কেউ চাইতেই পারে। আপনি ইচ্ছে হলে দেবেন, নয়তো দেবেন না, আপনি বলতেন পারতেন, দেব না। তা না করে আপনি দৌড়ে পালালেন। গর্তে পড়ে ঠ্যাংটি ভাঙলেন। আর দোষটা দিচ্ছেন অনাকে?
মামলা ভেস্তে যাচ্ছে দেখে খোঁড়াসিঙ্গি বললেন, কিন্তু আমার নালিশ তো এই মোনর বিরুদ্ধে। মোনার আস্কারাতেই এ গাঁয়ের ভূতগুলোর বড় বাড় বেড়েছে।
মোনা-ওঝা বলল,–প্রমাণ?
মাতব্বররাও বলে উঠলেন,–হ্যাঁ। প্রমাণ চাই। সাক্ষী চাই, সিঙ্গিমশাই, কই আপনার সাক্ষীদের ডাকুন।
সাক্ষী পাওয়া গেল না। আমাদের গাঁয়ের লোকেরা বলল, ভূতগুলো বাড়াবাড়ি করলে বরং মোনা-ওঝাই এসে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয়। কাজেই মোনা তাদের আস্কারা দেয় বলা চলে না। তা ছাড়া আজ অব্দি মোনা-ওঝা কারুর পেছনে ভূতকে লেলিয়ে দিয়েছে বলেও জানা নেই।
পঞ্চগেরামি বিচারসভায় মোনা-ওঝা বিলকুল খালাস পেয়ে গেল।
কিন্তু খোঁড়াসিঙ্গির রাগ পড়েনি। কিছুদিন পরে উনি কোত্থেকে এক সাধুবাবাকে নিয়ে এলেন। সাধুবাবা ঠাকরুনতলায় ত্রিশূল পুঁতে মড়ার খুলির সামনে ধুনি জ্বেলে ধ্যানে বসলেন। গা-সুষ্টু ছোট-বড় সবাই ভিড় জমাল সেখানে। আমরা, ছোটরাও ব্যাপারটা দেখতে গেলাম।
সাধুবাবা একসময় ধ্যান ভেঙে লালচোখে চারদিকে দেখে নিয়ে মড়ার খুলিটা তুলে নিলেন। মন্তর আওড়ে গর্জন করলেন, আয়-আয়! যে যেখানে আছিস, চলে আয়। এই খুলির মধ্যে ঢুকে পড় সবাই। বেম্মদত্যি, কন্ধকাটা, শাঁকচুন্নি, মামদো, পেঁচো, গোদানো, হাঁদা, নুলো, ভুলো, কেলো, ক্যাংলা-খ্যাংলা দুই ভাই, জট-জটি, পিশাচ, গলায় দড়ে, যখবুড়ো সব্বাই আয়! সব্বাই এসে ঢুকে পড় এই খুলির ভেতর।
এই বলে সাধুবাবা মড়ার খুলিটা দুহাতে চেপে ধরে ঝুলিতে ঢোকালেন। ত্রিশূল তুলে হুঙ্কার দিতে দিতে এগিয়ে গেলেন ঝিলের দিকে। ঝিলের জলে মড়ার খুলিটা বের করে ছুঁড়ে ফেলে বললেন, থাক তোরা জলের তলায়। আর বলে দিচ্ছি, যে এই খুলি তুলবে, তার মুখে রক্ত উঠে মারা পড়বে।…
এরপর বেশ কিছুদিন আমাদের গায়ে আর ভূতের সাড়াশব্দ ছিল না। মোনা ওঝা নাকি মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াত। লোকেরা রাত-বিরেতে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করত। মাঝে-মাঝে দেখতাম, রামুখোপার গাধাটা ঝিলের ধরে ঘাস খেতে-খেতে হঠাৎ মুখ তুলে তাকাত! ওর দৃষ্টিটা খুব করুণ মনে হতো। তার খেলার সঙ্গীরা জলের তলায় খুলির ভেতর বন্দি। বেচারার দুঃখ হতেই পারে।
হঠাৎ একদিন হইচই পড়ে গেল।
রামুধোপ গিয়েছিল ঝিলের জলে কাপড় কাঁচতে। সে দেখেছে সেই মড়ার খুলিটা ঝিলের ধারে পড়ে আছে। জল থেকে নিশ্চয় কেউ ভূতবোঝাই খুলিটা তুলেছে।
সারা গাঁ ভেঙে পড়ল ব্যাপারটা দেখতে। খোঁড়াসিঙ্গিও ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে সেখানে হাজির হলেন। আমারও দেখার ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বড়রা কিছুতেই ছোটদের যেতে দিলেন না। জলের তলার খুলি থেকে খালাস পাওয়া ভূতগুলো খাপ্পা হয়েই আছে। কাজেই অবোধ আর দুর্বল ছোটদের ওপর তাদের নজর পড়ার সম্ভাবনা আছে।
পরে শুনলাম, দায়টা চেপেছে মোনা-ওঝারই কাঁধে। মোনাও তন্ত্রমন্ত্র জানে। কাজেই সাধুবাবার ফেলে দেওয়া খুলি সে ছাড়া জল থেকে তুলবে সাধ্য কার? তা ছাড়া মোনা নিশ্চয় কোনও বড় ওঝার কাছে নতুন বিদ্যে রপ্ত করে এসেছে। তবে শেষপর্যন্ত এতে মোনা-ওঝারাই জয়-জয়কার পড়ে গেল। মুখে রক্ত উঠে সে মারা পড়েনি। তার মানে, আমাদের গাঁয়ের এই ওঝা সেই সাধুবাবার চেয়ে এখন আরও ক্ষমতাশালী। সিঙ্গিমশাই কেঁচো হয়ে ঘরে ঢুকলেন। কদাচিং বাইরে বেরুতেন তিনি। বেরুলেই দিনদুপুর ছাড়া নয়। মোনা-ওঝার এতে দাপট বেড়ে গেল।