Site icon BnBoi.Com

কাব্য আমপারা – কাজী নজরুল ইসলাম

কাব্য আমপারা - কাজী নজরুল ইসলাম

সুরা আ-দিয়াত

শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,
কৃপা করুণার যিনি অপার পাথার।

বিদ্যুৎ-গতি দীর্ঘশ্বসা
(বীরবাহী উটের শপথ),
যাহার চরণ-আঘাত উগারে
তপ্ত বহ্নি ফিনকিবৎ।
প্রত্যুষে করে ধূলি উৎক্ষেপি
(শত্রু-শিবির) আক্রমণ,
অনন্তর সে (অরি) দলে পশে
(এই হেন করে বিলুন্ঠন)।
শপথ তাদের – নিঃসংশয়
অকৃতজ্ঞ মানবকুল
তাদের পালনকর্তা প্রভুর
পরে, নিশ্চয়, (নহে সে ভুল!)
আর সে নিজেই সাক্ষী ইহার
কঠিন বিষয়াসক্তি তার,
সে কি তা জানে না, কবর হইতে
উঠানো হইবে সবে আবার?
হৃদয় তাদের লুকানো যা-কিছু
প্রকাশ করাব সব সেদিন,
জানিবে তাদের (সকল গোপন)
কথা – ‘রাব্বুল আলামিন’ ।
————-
সুরা আ-দিয়াত
এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হইয়াছে। ইহাতে ১১টি আয়াত, ৪০টি শব্দ ও ১৭০টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – হজরত তাঁহার সহচর মোনজের-বেনে-আমরকে একদল অশ্বারোহীসহ ‘বণি-কানানা’ সম্প্রদায়কে আক্রমণ করিতে পাঠান এবং ফিরিয়া আসিবার দিন নির্দিষ্ট করিয়া দেন। পাথের এক স্থান জলপ্লাবিত থাকায় তাঁহাদের ফিরিয়া আসিতে বিলম্ব হয়। তখন কাফেরগণ উক্ত সৈন্য দল বিনষ্ট হইয়াছে বলিয়া মিথ্যা সংবাদ প্রচার করায় মুসলমানগণ দুঃখিত হয়। তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা প্রদানের নিমিত্ত এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা আ-লা

শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,
করুণা-নিধান যিনি দয়ার পাথার।

মহত্তম যা নাম প্রভুর,
বর্ণনা করো পবিত্রতা তার,
সৃজন করিয়া যিনি পূর্ণতা
দানিয়াছেন তায় আবার।
উচিত ধর্মে নিয়ন্ত্রণ
করিয়া তিনিই দেখান পথ,
সৃজিয়া তৃণাদি তারে আবার
করেন কৃষ্ণ ভস্মবৎ।
আমি তোমা পড়াইব কোরান,
বিস্মৃত তাই হবে না আর,
তবে আল্লাহ্ জানেন সব
প্রকাশ গোপন সব ব্যাপার।
তোমার তরে সে কল্যাণের
পথেরে সহজ দিব করে,
অতএব উপদেশ বিলাও
যদি সে সুফল হয়, ওরে!
উপদেশ তব লবে ত্বরায়
সেই জন আছে যাহার ভয়,
অতিশয় হতভাগ্য যে
তাহা হতে দূরে সরিয়া রয়,
দোজখের মহা অনল মাঝ
করিবে প্রবেশ সেই সে জন
বাঁচিবেও না সে (শান্তিতে)
হবে না সেথায় তার মরণ।
সেই জন হয় সফলকাম
অন্তঃকরণ পবিত্র যার,
নামাজ পড়ে যে, করি স্মরণ
নাম সে দয়াল প্রভুর তার।
পছন্দ সে করিল হায়
পার্থিব এই জীবনকেই
উত্তম আর অবিনাশী
জীবন যা পাবে পরকালেই।
নিশ্চয় পূর্বের সকল
কেতাবেই আছে তা বিদ্যমান,
বিশেষ করিয়া ইব্রাহিম,
মুসার কেতাব তার প্রমাণ।

———–
সুরা আ-লা
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ১৯টি আয়াত, ৭২টি শব্দ ও ২৯৯টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – যখন হজরতের প্রতি সুদীর্ঘ সুরাসমূহ নাজেল হইতে থাকে এবং তিনি অসংখ্য তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিতে থাকেন, তখন তাঁহার মনে এই চিন্তা উপস্থিত হয় যে, আমি কোনো শিক্ষকের নিকট লেখাপড়া শিখি নাই, এমতাবস্থায় এত অধিক সংখ্যক শব্দ ও সূক্ষ্ম মর্ম আয়ত্ত করা ও স্মরণ রাখা সম্ভব হইবে না, হয়তো ইহার অধিকাংশ বিলুপ্ত হইয়া যাইতে পারে। তাঁহাকে সান্ত্বনা প্রদানার্থ এই সুরা অবতীর্ণ হয় – ‘খোদাই আপনার শিক্ষাদাতা, আপনি উহা ভুলিবার কল্পনাও করিবেন

সুরা আবাসা

শুরু করি লয়ে নাম আল্লার,
দয়া করুণার যার নাই নাই পার।

(মোহাম্মদ) ভ্রু-ভঙ্গি করি ফিরাইল মুখ
যেহেতু আসিল এক অন্ধ আগন্তুক
তাঁহার নিকট। তুমি জান (মোহাম্মদ)?
হয়তো বা লভিবে সে শুদ্ধির সম্পদ;
কিংবা তব উপদেশ মতো সে চলিবে,
তাহাতে তাহার তরে সুফল ফলিবে।
মানে না যে তব কথা বেপরোয়া হয়ে,
বুঝাইতে কত যত্ন তব, তারে লয়ে!
অথচ সে শুদ্ধাচারী না হইলে পর
তোমার দায়িত্ব নাই প্রভুর গোচর।
কিন্তু তব পাশে ছুটে আসে যেইজন
আল্লার সে ভয়ও রাখে, তার থেকে মন
সরাইয়া লও তুমি! উচিত এ নয়,
আল্লার এ উপদেশ জানিয়ো নিশ্চয়;
কাজেই যাহার ইচ্ছা, করুক উহার
আলোচনা। ( সেই উপদেশ-সম্ভার)
মহিম-মহান পত্রাবলিতে (লিখিত),
উন্নত পূত লেখক হস্তে (সুরক্ষিত)।
(আর সে লেখকগণ) সৎ ও মহান।
সর্বনাশ মানুষের! সে কৃতঘ্ন-প্রাণ
অতি ঘোর! (হায়), তারে কোন বস্তু হতে
সৃজন করিয়াছেন তিনি? শুক্র হতে!
– তারে সৃষ্টি করে
যথাযথভাবে তারে সাজান, তা পরে
সহজ করেন তার জন্য পথ তার,
পরে মৃত্যু ঘটাইয়া সমাধি মাঝার
লন তারে। পুনরায় ইচ্ছা সে যখন,
বাঁচাইয়া তুলিবেন তাহারে তখন।
না, না তিনি করেছেন যে আদেশ তারে
সমাধা সে করিল না তাহা (একেবারে)।
করুক মানুষ এবার দৃষ্টিপাত
তাহার খাদ্যের পানে, কত বৃষ্টিপাত
করিয়াছি (তার তরে); মাটিরে তা-পরে
বিদীর্ণ করিয়াছি কত ভালো করে।
অনন্তর জন্মায়েছি ফসল প্রচুর,
আঙ্গুর শাকসব্জি, জায়তুন, খেজুর,
গহন কাননরাজি, তৃণাদি ও ফল;
তোমাদের, তোমাদের পশুর মঙ্গল
সাধিতে। আসিবে যবে সে বিপদ-দিন,
(ভীষণ নিনাদে) লোক পালাবে সেদিন
নিজ ভ্রাতা, নিজ পিতা-মাতা হতে,
সঙ্গিনী ও পুত্রগণে (ফেলে রেখে পথে)।
সেদিন এমনই হবে অবস্থা লোকের,
ভাবিতে সে পারিবে না কথা অন্যের।
সেদিন উজ্জ্বল হবে কত সে আনন,
হাসিরাশি-ভরা আর পূর্ণ-হরষন;
আবার কত সে মুখ ধূসর ধুলায়
(হইবে হায় রে) আচ্ছাদিত কালিমায়!
– ইহারা তাহারা,
অমান্যকারী আর ভ্রষ্টাচারী যারা।

————
সুরা আবাসা
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৩২টি আয়াত, ১৩৩ টি শব্দ ও ৫৫৩টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – একদা হজরত কোরেশ সম্প্রদায়ের ওৎবা, আবুজাহেল, আব্বাস প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিগণকে ইসলামের দিকে এই আশায় আহ্বান করিতেছিলেন যে, তাহারা ইসলাম গ্রহণ করিলে বহু লোক ইসলাম ধর্মগ্রহণ করিতে পারে। সেই সময় আবদুল্লাহ-এবনে-ওম্মে মকতুম নামক জনৈক অন্ধ লোক তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে কোরান শিক্ষা দিবার জন্য হজরতকে তাঁহার দিকে অগ্রসর হইতে বলে। সে হজরতের কথোপকথনে বাধা প্রদান করিতে আসিয়াছে ভাবিয়া হজরত মুখ বিমর্ষ করিয়াছিলেন। তখন এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা আলক

শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,
করুণা-সাগর যিনি দয়ার পাথার।

পাঠ করো প্রভুর নামে, স্রষ্টা যে জন,
করিছেন যিনি ঘন সে শোণিতে মানবে সৃজন।
পাঠ করো, তব বিধাতা মহিমা-মহান সেই,
দিয়াছেন সবে লেখনীর দ্বারা শিক্ষা যেই।
–সে জানিত না যাহা,
মানুষেরে তিনি দেছেন শিক্ষা তাহা।
না, না, মানুষ সীমা লঙ্ঘন করিয়া যায়,
ধন-গৌরবে মত্ত যে ভাবে সে আপনায়
নিশ্চয় তব প্রভুর পানে যে ফিরিতে হবে।
দেখেছ কি তারে–আমার দাসেরে সে জন যবে
নিবারণ করে দাস মোর যবে নামাজ পড়ে?
দেখেছ, সে জন থাকিত যদি রে সুপথ ধরে!
সে যদি অন্যে সংযমী হতে করিত আদেশ!
সত্যেরে যদি মিথ্যা বলে সে (শাস্তি অশেষ)।
(সত্য হইতে) মুখ সে ফিরায়! সে জন তবে
জানে না কি, খোদা দেখিতেছেন যে তার সে সবে?
না, না, যদি নিবৃত্ত সে না হয়, শেষ
টানিয়া আনিব ধরিয়া তাহার ললাট-কেশ।
মিথ্যাবাদী সে মহা পাতকীর ললাট (ধরি)
(টানিব)। ডাকুক সভা সে তাহার পারিষদেরই।
আমিও আমার বীর সেবকেরে দিই খবর,
না, না, না কখনও মানিয়ো না তাদের পর।
সেজদা করো
হও ক্রমে মোর নিকট হইতে নিকটতর।

———-
সুরা আলক
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ২৯টি আয়াত, ৭২টি শব্দ ও ২৯০টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – মক্কার অদূরে হেরা গিরি-গহ্বরে হজরত এবাদতে মশগুল হইতেন। জেব্রাইল হজরতের নিকট সর্বপ্রথম তথায় উপস্থিত হইয়া বলিলেন – ‘আপনি পাঠ করুন।’ হজরত বলিলেন – ‘আমি নিরক্ষর এবং পাঠ করিতে সমর্থ নহি।’ এইরূপ তিন প্রশ্নোত্তরের পর জেব্রাইল বলিলেন – ‘আপনি সেই মহান খোদার নামে পাঠ করুন’ ইত্যাদি। (কবির, কাশ্‌শাফ, বায়জাবী)
প্রথম পাঁচ আয়াত তখন নাজেল হয়। প্রথম ৫ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর সুরা ফাতেহা ও তৎপর সুরা মোদ্দাস্‌সের অবতীর্ণ হয়। হজরত সেজদা করিতেছেন দেখিলে আবু জহল তাঁহার গ্রীবায় পদাঘাত ও তাঁহার মুখমণ্ডল মৃত্তিকায় প্রোথিত করিবে বলিয়া প্রতিবার শপথ করিয়াছিল। হজরতের নামাজ পড়িবার সময় কাছে উপস্থিত হইয়াও প্রতিজ্ঞা অনুরূপ কাজ করিতে সক্ষম হয় না। তখন ৬-১৪ আয়াত নাজেল হয়।

সুরা আস্‌র

শুরু করি শুভ নামে সেই আল্লার,
করুণা-আধার যিনি কৃপা-পারাবার।

অনন্ত কালের শপথ, সংশয় নাই,
ক্ষতির মাঝারে রাজে মানব সবাই।
(তারা ছাড়া) ধর্মে যারা বিশ্বাস সে রাখে,
আর যারা সৎকাজ করে থাকে,
আর যারা উপদেশ দেয় সত্য তরে,
ধৈর্যে সে উদ্‌বুদ্ধ যারা করে পরস্পরে।

————-
সুরা আস্‌র
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ৩টি আয়াত, ১৪টি শব্দ ও ৭৪টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – একদা হজরত আবুবকর (রাঃ) তাঁহার পূর্ববন্ধু কালদার সঙ্গে বসিয়া আহার করিতেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে কালদা বলিল – আপনি দক্ষতা সহকারে বাণিজ্য করিয়া লাভবান হইয়া আসিতেছেন – বর্তমানে পৈতৃক ধর্ম (প্রতিমা-পূজা) পরিত্যাগে মহা ক্ষতিগ্রস্ত হইলেন। তদুত্তরে আবুবকর (রাঃ) বলিলেন – যে সত্য ধর্ম অবলম্বন ও সৎকার্য সম্পাদন করে, সে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে পারে না। সেই সময় এই সুরা অবতীর্ণ হয়।
এবনে আব্বাসের মতে, ইহা অলিদ, আ-স কিংবা আসওয়াদের সম্বন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল।
মোকাতেলের মতে, আবু লাহাব সম্বন্ধে ইহা অবতীর্ণ হইয়াছিল।

সুরা ইখলাস

শুরু করিলাম পূত নামেতে আল্লার
শেষ নাই সীমা নাই যাঁর করুণার।

বলো, আল্লাহ্ এক! প্রভু ইচ্ছাময়,
নিষ্কাম নিরপেক্ষ, অন্য কেহ নয়।
করেন না কাহারেও তিনি যে জনন,
কাহারও ঔরসজাত তিনি নন।
সমতুল তাঁর
নাই কেহ আর।

————–
সুরা ইকলাস
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ৪টি আয়াত, ১৭টি শব্দ, ৪৯টি অক্ষর ও ১টি রুকু আছে।

শানে-নজুল– মক্কার অধিবাসী কতিপয় কাফের হজরতকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আল্লাহ্ কী উপাদানে গঠিত? তিনি কী আহার করেন? তাঁহার জনক কে? ইত্যাদি; তদুত্তরে এই সুরা নাজেল হয়। এমাম কাতাবা বলেন-‘সামাম’ অর্থ-যিনি পান-আহার করেন না। এই শব্দের– অভাব রহিত, শ্রেষ্ঠতম, অনাদি, নিষ্কাম, অনন্ত ইত্যাদি বহু অর্থ আছে। আল্লাহ্ কাহারও মুখাপেক্ষী বা সাহায্যপ্রার্থী নন, সকলেই তাঁহার সাহায্যপ্রার্থী; তিনি বে-নেয়াজ। এই সুরায় অংশীবাদী ও পৌত্তলিকদের মতবাদকে খণ্ডন করা হইয়াছে। –(করির, কাশ্‌শাফ, বায়জাবী।)

সুরা ইনফিতার

শুরু করি লয়ে শুভ নাম আল্লার,
করুণা-পাথার যিনি দয়া পারাবার।

আশমান সবে বিদীর্ণ হবে
          খসিয়া পড়িবে তারকা সব,
সমাধিপুঞ্জ হবে উন্মুক্ত
          উচ্ছ্বসিত হবে অর্ণব,
তখন জানিবে প্রত্যেক লোকে
          জীবনে করেছে কী সঞ্চয়,
রাখিয়া এসেছে পশ্চাতে কীবা!
          হে মানব! তবে সে কৃপাময়
প্রভু হতে রাখে বঞ্চিত করে
          তোমার কীসে? যে প্রভু তোমার
সৃজিয়া তা পর সাজাল কেমন
          কৌশলে যেথা যাহা মানায়।
যুক্ত তোমায় করেছেন তিনি
          যে আকারে তাঁর ইচ্ছা হয়,
মিথ্যা বল যে কর্মফলেরে
          নহে নহে তাহা কখনও নয়।
নিয়োজিত আছে রক্ষীবৃন্দ
          নিশ্চয় তোমাদিগের পর,
যাহা কিছু মর, মহান হিসাব –
          লেখকদের তা হয় গোচর।
রবে নিশ্চয় পরমাহ্লাদে
          পুণ্যবান সৎকর্মীরা,
নিশ্চয় যাবে দোজখে সে যত
          দুঃশীল কু-ব্যক্তিরা।
করিবে প্রবেশ রোজ কিয়ামতে
          সে দোজখে তারা। পশি সেথা
লুকাতে পলাতে পারিবে না আর,
          তাহা কী জানাল তোমাকে – তা?
জিজ্ঞাসা করি আবার তোমারে
          কিয়ামত কী তা জান কি সে?
ইহা সেই শেষ-বিচার দিবস,
          যেদিন মানব-মানবী সে
কেহই কারুর উপকারে কোনো
          আসিবে না, হবে নিঃসহায়,
একমাত্র সে আল্লাতালার
          হুকুম সেদিন রবে সেথায়।

————
সুরা ইনফিতার
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ১৯টি আয়াত, ৮০ টি শব্দ ও ৩৩৪টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল –কেয়ামতের ভীষণ অবস্থার বর্ণনা ও মানুষকে যে তাহার কর্মফল নিশ্চয়ই ভোগ করিতে হইবে তাহা এই সুরার প্রতিপাদ্য বিষয়।
পরজীবনে সুফল পাইবার জন্য মানুষ যেন সৎকর্ম করে আর কুকর্মের ফল পরজীবনে যন্ত্রণাদায়ক হইবে ভাবিয়া যেন (এ জীবনে) কুকর্ম হইতে বিরত থাকে – এই উদ্দেশ্যেই এই সুরা নাজেল হইয়াছে।

সুরা ইনশিকাক

শুরু করিলাম শুভ নামেতে আল্লার,
করুণা কৃপার যাঁর নাই নাই পার।

(রোজ কিয়ামতে) যবে ফাটিবে আকাশ
হবে সে প্রভুর নিজ আজ্ঞাবহ দাস, –
এই উপযোগী করে গড়েছি তাহায়;
লাগিবে সে আকর্ষণ যখন ধরায়;
যাহা কিছু আছে তার মধ্যে ‘ফেলি’ তায়
হইয়া যাইবে শূন্য-গর্ভ সে, হায়!
মানিবে পৃথিবী আজ্ঞা তাহার খোদার,
এরই উপযোগী করে সৃজন যে তার।
তোমার খোদার পানে চলিতে, মানব!
তোমারে করিতে হবে চেষ্টা অসম্ভব।
তবে সে করিবে লাভ মিলন তাঁহার! –
মিলিবে ‘আমলনামা’ ডান হাতে যার,
সহজে দিবে সে তার হিসাব-নিকাশ,
হরষে ফিরিবে নিজ পরিজন পাশ।
যে পাবে আমলনামা পশ্চাৎ পানে,
‘সর্বনাশ’ বলিয়া সে কাঁদিবে সেখানে।
পশিবে সে অগ্নিকুণ্ডে। – আত্মীয়-স্বজনে
বেষ্টিত ছিল সে যবে হরষিত মনে,
ধরিয়া লইয়াছিল মনে সে তাহার
ফিরিতে কখনও তারে হইবে না আর।
– তারে সর্বদা
দেখিতেছিলেন, নিশ্চয়, তার যে খোদা
সান্ধ্য-গগনে ওই গোধূলি-রাগের
শপথ করি আর যে তিমির রাতের,
যামিনী সংগ্রহ করে যত কিছু তার,
আর শপথ করি আমি পূর্ণ-চন্দ্রমার;
– নিশ্চয় তোমরা পৌঁছিবে পরে পরে
এক স্তর হতে পুনরায় অন্য স্তরে।
(অতএব) তাহাদের কী হয়েছে?
তারা বিশ্বাস করে না এ বিশ্বাসহারা!
কোরান তাদের কাছে যবে পাঠ হয়,
(কেন) তাহারা সেজদা নাহি করে সেসময়!
অমান্য করে যারা তারাই আবার
সত্যে সে আরোপ করে তারাই মিথ্যার।
তাহারা পোষণ করে মনে যাহা যত,
আল্লাহ্ বিশেষরূপে তাহা অবগত।
– কঠোর দণ্ডের
অতএব দিয়ে রাখো সংবাদ তাদের।
(তবে) যাহারা ইমান আনে,
নেক কাজ করে,
অন্তহীন পুরস্কার তাহাদের তরে।

———-
সুরা ইনশিকাক
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ২৫টি আয়াত, ১০৮টি শব্দ ও ৪৪৮টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – কেয়ামতের সময় মানুষের যে ভীষণ অবস্থা হইবে তাহার বর্ণনা ও পুনর্জীবন লাভের কথা এই সুরায় প্রকটিত হইয়াছে। কেয়ামত ও পুনর্জীবন লাভের কথা ভাবিয়া মানুষ যাহাতে সৎকর্ম সম্পাদন করে এই উদ্দেশ্যেই এই সুরা অবতীর্ণ হইয়াছে।

সুরা ইনশেরাহ্

শুরু করি লয়ে পাক নাম আল্লার,
করুণা কৃপার যিনি অসীম পাথার।

তোমার কারণ
করিনি কি আমি তব বক্ষ বিদারণ?
নামায়ে সে ভার (মুক্তি) দিইনি তোমারে?
ন্যুব্জ-পৃষ্ঠ ছিলে তুমি যে বোঝার ভারে?
নাম কী তোমার
করিনি কি মহীয়ান মহিমা-বিথার?
সংকটের সাথে আছে শুভ নিশ্চয়,
অতএব অবসর পাবে যে সময় –
উপাসনায় রত হবে সংকল্প লয়ে,
প্রভুর করিবে ধ্যান একমন হয়ে।

———-
সুরা ইনশেরাহ্
এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হয়। ইহাতে ৮টি আয়াত, ২৭টি শব্দ ও ১০৩টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – খদিজা বিবির মৃত্যুর পর হজরত সাতিশয় মর্মাহত ও চিন্তাভারাক্রান্ত হইয়া পড়েন। তাঁহাকে উক্ত শোকে সান্ত্বনা দিবার জন্য এই সুরা নাজেল হয়। এবাদত-বন্দেগী ও কোরআনে তোমাকে উল্লেখ করিয়া এবং তোমার গুরুতর দায়িত্ব পরিপূর্ণ করিয়া দিয়া তোমাকে মহিমান্বিত করি নাই কি? ইত্যাদি শানে-নজুলের মর্ম। – (তফসীরে কবির।)

সুরা কদর

শুরু করি লয়ে শুভ নাম আল্লার,
আদি অন্তহীন যিনি দয়া করুণার।

করিয়াছি অবতীর্ণ কোরান পুণ্য ‘শবে কদরে’ ;
জানবে কীসে শবে কদর কয় কারে? ধরা পরে
হাজার মাসের চেয়েও বেশি কদর এই যে নিশীথের,
এই সে রাতে ফেরেশতা আর জিবরাইল আলমের
করতে সরঞ্জাম সকলই নেমে আসে ধরণি,
উষার উদয় তক থাকে এই শান্ত পূত রজনি।

—————
সুরা কদর
এই সুরায় ৫টি আয়াত, ৩০টি শব্দ ও ১১৫টি অক্ষর আছে। ইহা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে।
কাশ্‌শাফ বায়জাবী, জালালাইন ও হোসেনীর মতে, এই সুরা মদিনা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে।

শানে-নজুল – কোনো কথাপ্রসঙ্গে একদা হজরত উল্লেখ করেন যে, ইসরায়েল বংশীয় হজরত সমউন সহস্র মাস কাল দিবস রোজা রাখিতেন ও জেহাদ (ধর্মযুদ্ধ) করিতেন আর রাত্রি জাগিয়া নামাজ পড়িতেন। ইহা শুনিয়া তাঁহার আসহাবগণ বলিল – সাধারণত আমরা ৬০/৭০ বৎসর বাঁচিয়া থাকি; তন্মধ্যে কতকাংশ শৈশবাবস্থায়, কতকাংশ নিদ্রিতাবস্থায়, কতকাংশ পীড়িত ও শৈথিল্যাবস্থায় এবং কতকাংশ জীবিকা সংগ্রহ করিতে অতিবাহিত হয়; অবশিষ্টাংশে আমরা কতটুকু সৎকার্য করিতে সক্ষম হইব? উহাতে হজরত দুঃখিত হন। তখন এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা কাওসার

শুরু করিলাম পূত নামেতে খোদার,
কৃপা করুণার যিনি অসীম পাথার।

অনন্ত কল্যাণ তোমা দিয়াছি নিশ্চয়
অতএব তব প্রতিপালক যে হয়
নামাজ পড়ো ও দাও কোরবানি তাঁরেই,
বিদ্বেষে তোমারে যে, অপুত্রক সে-ই।

—————
সুরা কাওসার
এই সুরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়; ইহাতে ৩টি আয়াত, ১০টি শব্দ ও ৩৭টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – এই সুরাটি আবু জহল, আবু লহব, আ-স ও আকাবার সম্বন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল। কথিত আছে, হজরতের পুত্র তাহের দেহত্যাগ করার পর আ-স নামীয় জনৈক ধর্মদ্রোহী হজরতের সহিত আলাপ করার পর নিজের দলের লোকদের প্রশ্নের উত্তরে বলিয়াছিল, আমি আব্‌তর নিঃসন্তান বা আঁটকুড়ের সহিত আলাপ করিয়াছি। উহা শ্রবণ করিয়া হজরত দুঃখিত হইয়া বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার এন্তেকালের পর হয়তো তাঁহার নাম লোপ পাইবে। তাঁহার সান্ত্বনার জন্য এই সুরা অবতীর্ণ হয়।

সুরা কাফেরুন

আরম্ভ করি লয়ে নাম আল্লার,
আকর যে সব দয়া কৃপা করুণার।

বলো, হে বিধর্মিগণ, তোমরা যাহার
পূজা কর, – আমি পূজা করি না তাহার।
তোমরা পূজ না তাঁরে আমি পূজি যাঁরে,
তোমরা যাহারে পূজ – আমিও তাহারে
পূজিতে সম্মত নই। তোমরাও নহ
প্রস্তুত পূজিতে, যাঁরে পূজি অহরহ।
তোমাদের ধর্ম যাহা তোমাদের তরে,
আমার যে ধর্ম রবে আমারই উপরে।

————-
সুরা কাফেরুন
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ; ইহাতে ৬টি আয়াত, ২৭টি শব্দ ও ৯৯টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – ওমাইয়া, হারেছ, আ-স, অলিদ প্রভৃতি কোরেশগণ হজরত তাহাদের ধর্মমতের অনুসরণ করিলে তাহারাও হজরতের ধর্মমতের অনুসরণ করিবেন বলায় তিনি বলিলেন, আমি আল্লার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি, আমি কখনও তাঁহার অংশীস্থাপন করিতে পারিব না। তাহারা বশ্যতা স্বীকার করে না অথচ হজরতের সহিত মিলিত হইতে চায়; তখন এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা কোরায়শ

শুরু করিলাম শুভ নামে আল্লার
রহিম ও রহমান যিনি দয়ার পাথার।

কী অদ্ভুত আচরণ কোরায়শগণের,
ব্যক্ত যাহা পর্যটনে শীত গ্রীষ্মের।
এখন উচিত, তারা সেই অনুরাগে
এই গৃহাধিপতির অর্চনায় লাগে।
যিনি অন্ন দিয়াছেন তাদের ক্ষুধায়,
ভয়ে দিয়াছেন শান্তি – পূজুক তাহায়।

———–
সুরা কোরায়শ
ইহা মক্কায় নাজেল হইয়াছে। এই সুরাতে ৪টি আয়াত, ১৭টি শব্দ ও ৭৯টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – করশ শব্দ হইতে কোরায়শ শব্দ উৎপন্ন হইয়াছে। ইহার আভিধানিক অর্থ – অর্থ সংগ্রহ করা বা উপজীবিকা সংগ্রহ করা। কোরায়েশগণ ব্যবসায় দ্বারা অর্থ বা উপজীবিকা সংগ্রহ করিতেন – তজ্জন্য তাঁহারা এই নামে অভিহিত হইতেন। এবনে আব্বাসের মতে, কোরায়েশ নামক এক প্রকার জলজন্তু সমুদ্রে বাস করে। উহারা সামুদ্রিক জন্তুদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। উহারা যে সামুদ্রিক জন্তুর নিকট উপস্থিত হয় তাহাকেই গ্রাস করে; কিন্তু অন্য কোনো জন্তু উহাদিগকে গ্রাস করিতে পারে না। আরব দেশের সর্বাপেক্ষা পরাক্রমশালী সম্প্রদায় কেলাবের পুত্র কোছাইয়ের বংশধরেরা এই নামে অভিহিত। তাহারা বাণিজ্যার্থে শীতকালে ইমন প্রদেশের দিকে ও গ্রীষ্মকালে শাম (সিরিয়া) দেশের দিকে যাইত। কাবাগৃহের রক্ষক ও অধিপতি বলিয়া উভয় দেশের নরপতিগণ তাহাদিগকে প্রচুর সম্মান করিত; আর তাহারাও বস্ত্র, খাদ্য ইত্যাদি আবশ্যকীয় বস্তুগুলি স্বদেশে আনয়ন করিত ও বাণিজ্যে বেশ লাভবান হইত।

কানানার পুত্র নাজারকে কোরায়েশ নামে অভিহিত করা হইত। তৎপর তাহার বংশধরেরা উক্ত নামে অভিহিত হইতে থাকে। হজরত ও তাঁহার ৪ জন খলিফা এই বংশসম্ভূত।

সুরা ক্বারেয়াত

শুরু করি লয়ে শুভ নাম আল্লার,
করুণা-আকর যিনি দয়ার পাথার।

প্রলয়ান্তক সেই বিপদ
          কোন সে বিপদ ধ্বংস ভয়?
কীসে সে তোমারে জানাল, সেই
          বিপদ ভীষণ প্রলয়ময়?
বিক্ষিপ্ত পতঙ্গপ্রায়
          সেদিন উড়িবে লোক সবায়,
বিধূনিত লোমবৎ সেদিন
          পর্বতরাজি উড়িবে বায়।
সেদিন সে পাবে সুখী জীবন
          পাল্লা যাহার হবে ভারী,
পাল্লা হবে হালকা যার
          (হবে) ‘হাভিয়া’ দোজখ মাতা তারই।
          হাভিয়া কী, তুমি জান কি সে?
          প্রজ্বলিত বহ্নি সে।

—————-
সুরা ক্বারেয়াত
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ১১টি আয়াত, ৩৫টি শব্দ ও ১৬০টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – কেয়ামতের ভীতি প্রদর্শন ও ইসলামের বিজয়ের ইঙ্গিত করার জন্য এই সুরা নাজেল হয়। এমাম কাতাদা বলেন – একদা ইহুদিগণ বলিয়াছিল যে, আমরা বিপক্ষ দল অপেক্ষা সংখ্যায় অধিক; সেই সময়ে এই সুরা নাজেল হয়।
এমাম এবনে কসিরের মতে, মদিনাবাসী বণি-হরেস ও বণি-হারেসা এই দুই দল ধনসম্পদের অহংকার করিয়াছিল, তজ্জন্য এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা গ্‌বাশিয়া

শুরু করি শুভ নাম লয়ে আল্লার,
করুণা-নিধান যিনি কৃপা-পারাবার।

– আসিয়াছে নিকটে তোমার
বৃত্তান্ত কি আচ্ছন্নকারী ঘটনার?
বহু সে আনন হবে নত জ্যোতিঃহীন;
শ্রান্ত কর্ম-পরিক্লান্ত তাহারা সেদিন
প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করিয়া
ফুটন্ত উৎসের জল যাইবে পিইয়া।
বিষ কণ্টক শুধু পাইবে আহার,
করিবে না পুষ্ট দেহ, নিবৃত্তি ক্ষুধার।
খুশিতে হইবে বহু মুখ উজ্জ্বল,
হরষে লইবে তারা নিজ পুণ্যফল।
মহিমা-সুন্দর পাবে তাহারা বাগান,
শোনে না কেহই সেথা মিথ্যার ব্যাখ্যান।
সেথা চির বহমান উৎস সমুদয়,
সমুন্নত সিংহাসন সেইখানে রয়।
রাখা আছে পানপাত্র, শত উপাধান,
বিছানো মখমল শয্যা (আরাম-শয়ান)।
দেখে নাকি উট সব চেয়ে তারা সবে?
কীরূপে তাদের সৃষ্টি হইল, না ভাবে?
দেখে না বিনা স্তম্ভে আকাশ কেমনে
উচ্চে হয়েছে রাখা? পর্বতগণে
দেখে না কেমনে হল তাদের স্থাপন?
বিস্তারিত হল এ-ধরা সে কেমন?
তুমি উপদেষ্টা শুধু, উপদেশ দাও,
তুমি তো প্রহরী নহ, (পথ সে দেখাও)।
মানিবে না আদেশ যে, ফিরাইবে মুখ,
দিবেন আল্লাহ্ তারে কঠোর সে দুখ।
নিশ্চয় ফিরিতে হবে তারে মোর পাশে,
হিসাব-নিকাশ হবে আমারই সকাশে।

———–
সুরা গ্বাশিয়া
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৬টি আয়াত, ৯৩টি শব্দ ও ৩৮৪টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – মানুষ পরজীবনের কর্মফল ভোগ করিবে, আরবেরা ইহা বিশ্বাস করিত না। তাহারা বলিত, মানুষ একবার মরিয়া মাটি হইয়া গেলে পুনর্জীবন লাভ করিবে কী করিয়া? এই সুরায় মেঘমালার দৃষ্টান্ত দ্বারা বুঝানো হইয়াছে যে, আল্লার কুদ্‌রতে সব কিছু সম্ভব, অনন্ত শক্তিময় আল্লার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। তিনি মানুষকে পুনর্জীবন দান করিয়া এই জীবনের কর্মফল ভোগ করাইবেন। মানুষ এই জীবনে দুষ্কর্ম করিলে পরজীবনে তাহার সাজা পাইবে, আর এই জীবনে সৎকর্ম করিলে পরজীবনে তাহার পুরস্কার পাইবে। মানুষের কোনো কর্মই বৃথা হইবে না, ইহা বুঝাইবার জন্যই এই সুরা নাজেল হইয়াছে।

সুরা জিলজাল

শুরু করি লয়ে ‘পাক’ নাম আল্লার,
করুণানিধান যিনি কৃপার পাথার।

ঘোর কম্পনে ভূমণ্ডল প্রকম্পিত সে হবে যেদিন
ধরা তার ভার বাহির করিয়া দিবে (সেদিন)।
       ‘কী হইল এর’ কহিবে লোকেরা,
              সেদিন ব্যক্ত করিবে সে
       নিজের যা কিছু খবর, তোমার
              প্রভুর সে খোদার নির্দেশে।
       প্রত্যাগত সে হইবে সেদিন
              দলে দলে যত লোক সকল,
       দেখানো হইবে কর্ম সকল
              তাদের (পাপ ও পুণ্য-ফল)।
       এক রেণুবৎ যে পুণ্য
              করিবে, তাহাও দেখিবে সে,
       পাপ যে করেছে এক রেণুবৎ
              দেখা দিবে তারে তাও এসে।

————–
সুরা জিলজাল
এই সুরায় ৮টি আয়াত, ৩৭টি শব্দ ও ১৫৮টি অক্ষর আছে। হাক্কানী, হোসেনী, শাহ্ অলিউল্লাহ্, শাহ্ রফিউদ্দিন, শাহ্ আবদুল আজিজ প্রভৃতির মতে, এই সুরা মদিনা শরিফে নাজেল হইয়াছে। কবির বলেন – এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে (এবনে আব্বাস, কাতাদা)। কাশ্‌শাপ, বায়জাবী ও জালালাইন বলেন – এই সুরার অবতরণ-স্থান সম্বন্ধে মতভেদ দৃষ্ট হয়। – (বোখারী শরিফ, Part1, Vol.1.)

শানে-নজুল – একদা হজরতের সঙ্গে আবুবকর (রাঃ) যখন কিছু খাদ্য গ্রহণ করিতেছিলেন, সেই সময় ৭/৮ আয়াত নাজেল হয়। তখন আবুবকর (রাঃ) আহার গ্রহণ ত্যাগ করিয়া হজরতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি কি এক বিন্দু কুকর্মের প্রতিফল প্রাপ্ত হইব? তদুত্তরে হজরত বলিয়াছিলেন, সংসারে তুমি যে কোনও সময়ে বিপদাপন্ন হও, উহা তোমার বিন্দু বিন্দু অসৎ কর্মের প্রতিফল; আর তোমার বিন্দু বিন্দু পুণ্যকে আল্লা তোমার জন্য সম্বলস্বরূপ রক্ষা করেন, পরকালে, ওই সকলের প্রতিদান আল্লা তোমাকে দিবেন। সামান্য সামান্য সৎকার্য আর সামান্য সামান্য পাপকার্য একত্রিত হইয়া পর্বততুল্য হইয়া যায়; অকিঞ্চিৎকর কার্যও বৃথা যায় না – এই শিক্ষা প্রচারার্থে উক্ত আয়াতদ্বয় নাজেল হয়।

সুরা তকভীর

শুরু করিলাম শুভ নামেতে খোদার,
করুণা-আকর যিনি দয়ার আধার।

সংকুচিত হয়ে যবে সূর্য যাবে জড়ায়ে,
তারকা সব পড়বে যখন ইতস্তত ছড়ায়ে,
পর্বত সব সঞ্চারিয়া ফিরবে যখন (ধূলির প্রায়),
পূর্ণগর্ভা উটগুলিরে দেখবে না কেউ উপেক্ষায়,
বেরিয়ে আসবে বুনো যত জানোয়ারেরা বেঁধে দল,
হবে প্লাবন-উদ্‌বেলিত যখন সকল সাগর-জল।
আত্মা হবে যুক্ত দেহে। জ্যান্ত পোঁতা কন্যাদের
পুছব যখন কোন দোষে বধ করছে পিতা তোদের?
যখন খোলা হবে সবার আমলনামা; সেই সেদিন
জ্বলবে দোজখ ধুধু, হবে আকাশ আবরণ-বিহীন,
জানবে সেদিন প্রতি মানব, সাথে সে কী অনল তার!
শপথ করি ওই চলমান আর স্থিতিশীল তারকার,
রাত্রি যখন পোহায় এবং উষা যখন ছায় সেদিক,
শপথ তাদের, মহিমময় রসুলের এ বাণী ঠিক।
আরশ-অধিপতির কাছে প্রতিষ্ঠা তাঁর, সেই রসুল
বিশ্বস্ত, সম্মানার্হ, শক্তিধর, ধরায় অতুল।
পাগল নহে তোমাদের এই সহচরী, সাক্ষ্য দিই,
মুক্ত দিগন্তরে জিব্রাইল দেখেছেন সে তিনিই।
অদেখা যা দেখেন ইনি ব্যক্ত করেন তখন তাই,
বিতাড়িত শয়তানের এ উক্তি নহে (কহেন খোদাই)।
তোমরা যবে অতঃপর কোন সেদিকে? বাণীতে
– যাহা কই,
বিশ্ব-নিখিল-শুভ তরে নয় তো এ উপদেশ বই!
এই উপদেশ তাহার তরে, তোমাদিগের মাঝ হতে
চলিতে যে চাহে আমার সুদৃঢ় সরল পথে।
নিখিল-বিশ্ব-অধিরাজের ইচ্ছা না হয় যতক্ষণ,
তোমরা ইচ্ছা করতে নাহি পারবে জানি ততক্ষণ।

————–
সুরা তকভীর
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ২৯টি আয়াত, ১০৪ টি শব্দ ও ৪৩৬টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল –কেয়ামত, পরকাল ও কর্মফল ভোগের কথা যখন হজরত মোহাম্মদ (দঃ) বলিতেন তখন মক্কাবাসীরা তাঁহাকে পাগল বলিত। কেয়ামতের ভীষণ ধ্বংসলীলা ও আল্লার শক্তির বর্ণনা দ্বারা তাঁহার প্রতি নির্ভরশীল হইয়া সৎকর্ম করিবার জন্য তাকিদ দিবার নিমিত্ত এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা তাকাসুর

শুরু করি লয়ে শুভ নাম আল্লার,
নাহি আদি নাহি অন্ত যাঁর করুণার।
  
অধিক লোভের বাসনা রেখেছে তোমাদেরে
                 মোহ-ঘোরে,
যাবৎ না দেখ তোমরা গোরস্থানের
                 আঁধার গোরে।
না, না, না, তোমরা শীঘ্র জানিবে পুনরায়
                 (কহি) ত্বরা
জ্ঞাত হবে; না, না, হতে যদি জ্ঞানী ধ্রুব সে
                 জ্ঞানেতে ভরা।
দোজখ -অগ্নি করিবে তোমরা নিশ্চয় দর্শন
দেখিবে তাহারে তার পর লয়ে বিশ্বাসীর নয়ন।
                 – নিশ্চয় তার পরে
হইবে জিজ্ঞাসিত আল্লার চিরসম্পদ তরে।

———–
সুরা তাকাসুর
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ৮টি আয়াত, ২৮টি শব্দ ও ১২৩টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – কোরেশ কুলের এক শাখার নাম বণি-আব্দ-বেনে মান্নাফ, অপর শাখার নাম বণি-সাহম। প্রত্যেক শ্রেণি অহংকারে মত্ত হইয়া বলিতে লাগিল – আমরা অর্থে, ঐশ্বর্যে, সম্ভ্রমে ও লোকসংখ্যায় শ্রেষ্ঠতর। এমনকী, প্রত্যেক দল স্বীয় গৌরব বর্ধনের নিমিত্ত আপন দলভুক্ত লোকদিগকে গণনা করিতে আরম্ভ করিল। এই গণনায় আব্দ-মান্নাফ বংশের লোক সংখ্যায় অধিক হইল। পরে জীবিত ও মৃত উভয় শ্রেণির লোক গণনা করায় বণি-সাহম দলের লোকসংখ্যা অধিক হইল। লোকসংখ্যা নিরূপণের নিমিত্ত তাহারা গোরস্থানে গিয়াছিল। সেই সময় এই সুরা নাজেল হয়।

[মতান্তরে :- ইহুদিগণের নামে সংখ্যাধিক্য লইয়া কলহের সূত্রপাত হওয়ায় মদিনাবাসী বণি-হারেস ও বণি-হারেসা এই দুই দল পরস্পর ধনৈশ্বর্যের অহংকার করায় এই সুরা নাজেল হয়। – (এক্‌সির)]

সুরা তারেক

শুরু করি লয়ে শুভ নাম আল্লার,
করুণা-সাগর যিনি দয়ার পাথার।

শপথ ‘তারেক’ ও আকাশের সে ‘তারেক’ কী তা জান কীসে? নক্ষত্র সে জ্যোতিষ্মান (নিশীথে আগত অতিথি সে) এমন কোনো সে নাহি মানব রক্ষক নাই উপর যার, অতএব দেখা উচিত তার কোন বস্তুতে সৃষ্টি তার। বেগে বাহিরায় উছল জল- বিন্দু তাতেই সৃজন তার পিঠ ও বুকের মধ্য দেশ সেই যে জল স্থান যাহার। সক্ষম তিনি নিশ্চয়ই করিতে পুনর্জীবন দান, অভিব্যক্ত হবে সবার গুপ্ত বিষয় হবে প্রমাণ, রবে না শক্তি সহায় আর সেদিন তাহার কোনো কিছুই, শপথ নীরদ-ঘন নভের শপথ বিদায়শীল এ-ভুঁই। ইহাই চরম বাক্য ঠিক, নিরর্থক এ নহে সে দেখ, মতলব করে তাহারা এক মতলব করি আমিও এক অবসর তুমি দাও হে তাই বিধর্মীদের ক্ষণতরে দাও অবকাশ তাহাদেরে।

————-
সুরা তারেক
এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হয়। ইহাতে ১৭টি আয়াত, ৬১টি শব্দ ও ২৫৪টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – একদা রাত্রিতে হজরতের গৃহে তাঁহার পিতৃব্য আবু তালেব উপস্থিত হইলে পর, তাঁহার সামনে আহারের নিমিত্ত রুটি ও দুগ্ধ হাজির করা হয়। তাঁহারা উভয়ে যখন খাদ্য গ্রহণে রত তখন একটি উল্কাপিণ্ডের জ্যোতিতে ওই গৃহ উদ্ভাসিত হইলে ওই জ্যোতিতে আবু তালেবের চোখের জ্যোতি ক্ষীণ হইয়া গেল। ব্যস্ততা-সহকারে ভোজন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন – ইহা কী? হজরত বলিলেন – শয়তানেরা যখন আশমানের গুপ্ত তত্ত্ব অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত উড্ডীয়মান হয়, তখন ফেরেশতারা উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করিয়া উহাদিগকে বিতাড়িত করে। আবু তালেব বিস্ময়ান্বিত হইয়া নিস্তব্ধ হইলেন। তখন এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা তাৎফিফ

শুরু করি লয়ে পূত নাম বিধাতার
করুণা ও দয়া যার অনাদি অপার।

সর্বনাশ তাহাদের, হ্রাসকারী যারা,
যখন লোকের কাছে মেপে লয় তারা,
তখন পূর্ণ করে চায় মেপে নিতে,
তাদেরে ওজন করে হয় যবে দিতে,
তখন কম সে করে মাপে ও ওজনে।
উঠিতে হইবে পুন, করে না তা মনে।
উঠিবে মানব পুন মহান সেদিন,
বিশ্বপালকের কাছে দাঁড়াবে যেদিন।
পাপিষ্ঠ লোকের সে কার্য সমুদয়
নিশ্চয় ‘সিজ্জিনে’ থাকে, কভু মিথ্যা নয়।
জান কি, সে ‘সিজ্জিন’ কী? লিখিত কেতাব
(লেখা রবে যাতে তার পাপের হিসাব)।
– সর্বনাশ হবে
তাদের – সত্যেরে বলে মিথ্যা যারা সবে।
কর্মফল প্রাপ্তির এদিন হাশরের –
বলে মিথ্যা – সর্বনাশ হবে তাহাদের।
আদেশ-লঙ্ঘনকারী পাতকী ব্যতীত
আর কেহ বলে না – এ সত্যের অতীত।
তার কাছে পাঠ হলে আমার এ বাণী,
সে বলে এ ‘পূর্বতন লোকের কাহিনি!’
– কখনই নহে, তাহা নহে
অভ্যস্ত তাদের নিজ কাজগুলি রহে,
জমেছে মরিচারূপে তাহাদের মনে।
সেদিন তাহারা নিজ খোদার সদনে,
পারিবে না যেতে নিশ্চয়! তারপর
প্রবেশ করিবে তারা দোজখ ভিতর।
সেই কর্মের ফল জেনো ইহা সেই,
তোমরা মিথ্যা সদা বলিতে এরেই।
কখনই মিথ্যা নহে, রহিবে নিশ্চয়,
লেখা ‘ইল্লিয়নে’ সব কার্য সমুদয়
যত সৎলোকের সে। জান ‘ইল্লিয়ন’
কারে কয়? লিখিত সে কেতাব রতন।
প্রত্যক্ষ কেবল তারা করিবে দর্শন
আল্লার নিকটে যাবে যে মানবগণ।
সুপ্রচুর সুখে রবে পুণ্য-আত্মাগণ,
সুউচ্চ তখ্‌তে রহি করিবে দর্শন।
– সে সুখ-পুলকে
দেখিতে পাইবে তারা নিজ মুখে চোখে
–শিলমোহর করা
তাহারা করিবে পান সুপবিত্র সুরা।
কস্তুরীর সে মোহর। কামনা কারুর
থাকে যদি – করুক কামনা এ দারুর।
‘তস্‌নীম’ সুধা মেশা হয় সে সুরায়,
‘তস্‌নীম’ সে প্রস্রবণ-উৎস যাহায়
আল্লার নিকট যারা, করে তারা পান।
অবিশ্বাসী সবার প্রতি বিদ্রুপ-বাণ
হানিত যে অপরাধিগণ নিশ্চয়,
আঁখি-ঠারে ইঙ্গিত তারা যে সময়
করিত পরস্পরে বিশ্বাসীরে দেখে
তাহাদের পাশ দিয়া যাইলে তাহাকে।
স্বজনের কাছে সব ফিরে গিয়ে পুন
করিত বিদ্রুপ ব্যঙ্গ ইহারা তখনও।
দেখায়ে (বিশ্বাসিগণ) বলিত, ‘ইহারা
নিশ্চয়, নিশ্চয়ই, সবে পথহারা!’
বিশ্বাসীদের পরে অথচ বেশক
প্রেরিত হয়নি এরা হইয়া রক্ষক।
ইমান এনেছে যারা, তারা আজিকে
উপহাস করিবে বিধর্মী দেখে।
উঁচু সে তখ্‌তে বসি করিবে দর্শন,
কর্মফল পেল আজ বিধর্মিগণ॥

————
সুরা তাৎফিফ
এই সুরা মক্কায় কি মদিনায় নাজেল হয় এ-সম্বন্ধে মতভেদ দৃষ্ট হয়। ইহাতে ৩৬টি আয়াত, ১৭২টি শব্দ ও ৭৫৮টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – হজরত মদিনায় পদার্পণ করিয়া দেখিলেন যে, উক্ত স্থানের অধিবাসীগণ পরিমাণ ও ওজনে কম-বেশি করিয়া থাকে, তখন এই সুরা নাজেল হয়।
মক্কায় এই সুরা প্রথম নাজেল হইয়াছিল। হজরত মদিনায় যাওয়ার পর সেখানে ইহা পাঠ করিয়া শুনাইয়াদিলেন।

সুরা তীন

শুরু করি লয়ে শুভ নাম আল্লার,
করুণা ও কৃপা যাঁর অনন্ত অপার।

শপথ ‘তীন’ ‘জায়তুন’ ‘সিনাই’ পাহাড়
শপথ সে শান্তিপূর্ণ নগর মক্কার –
নিশ্চয় মানুষে আমি করেছি সৃজন
দিয়া যত কিছু শ্রেষ্ঠ মুরতি গঠন।
(যে জন সুবিধা এর লইল না তারে)
করিয়াছি নীচাদপি নীচ সে জনারে।
কিন্তু যে ইমান আনে, সৎকাজ করে,
অনন্ত সে পুরস্কার আছে তার তরে।
‘সুবিচার পাবে সবে’ বলিলে তোমায়
মিথ্যার আরোপ করে কে সে তবে, হায়?
আল্লাহ্ কি নন
সব বিচারক চেয়ে শ্রেষ্ঠতম জন?

————
সুরা তীন
এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হইয়াছে। ইহাতে ৮টি আয়াত, ৩৪টি শব্দ ও ১৬৫টি অক্ষর আছে।

শানে নজুল –
১। তীন-আঞ্জির, জায়তুন-তৈল বৃক্ষ বিশেষ। উভয় নামে পরিচিত পর্বতে হজরত ইশার জন্ম ও নবুয়ত-প্রাপ্তি হয়।
২। সিনিনা – সিনাই পাহাড়; এ স্থানে হজরত মুসা ‘তওরত’ গ্রন্থ প্রাপ্ত হন।
৩। বালাদুন আমিন – ‘শান্তিময় নগর’ – এই বাক্যাংশ দ্বরা হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার (দঃ) জন্মভূমি মক্কা নগরকে বুঝায়।
উক্ত তিনটি পাক স্থানের নামি উপরোক্ত নবিগণের স্মরণার্থ আল্লাহ্‌তালা শপথ করিয়া মানবগণকে এই সাবধান-বাণী জানাইতেছেন যে, তিনি আদেশ-প্রদাতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ (আদেশ-প্রদাতা)।

 সুরা দ্বোহা

শুরু করি লয়ে পাক নাম আল্লার,
অনন্ত সাগর যিনি দয়া করুণার।

শপথ প্রথম দিবস-বেলার
শপথ রাতের তিমির-ঘন,
করেননি প্রভু বর্জন তোমা,
করেননি দুশমনি কখনও।
পরকাল সে যে উত্তমতর
ইহকাল আর দুনিয়া হতে,
অচিরাৎ তব প্রভু দানিবেন
(সম্পদ) খুশি হইবে যাতে।
পিতৃহীন সে তোমারে তিনি কি
করেননি পরে শরণ দান?
ভ্রান্ত-পথে তোমারে পাইয়া
তিনিই না তোমা পথ দেখান?
তিনি কি পাননি অভাবী তোমারে
অভাব সব করেন মোচন?
করিয়ো না তাই পিতৃহীনের
উপরে কখনও উৎপীড়ন।
যে জন প্রার্থী তাহারে দেখিয়ো
কোরো না তিরস্কার কভু,
ব্যক্ত করহ নিয়ামত যাহা
দিলেন তোমারে তব প্রভু।
————-
সুরা দ্বোহা
এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হয়। ইহাতে ১১টি আয়াত, ৪০টি শব্দ ও ১৬৬টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – হজরতের নিকট কোনো কারণে কয়েকদিন (কাহারও মতে ১০, কাহারও মতে ১৫, কাহারও মতে ৪০ দিন) অহি নাজেল না হওয়ায় কাফেরেরা বিদ্রুপ করিয়া বলিতেছিল – মোহাম্মদকে (দঃ) তাঁর আল্লা পরিত্যাগ করিয়াছেন। ইহা শ্রবণ করিয়া হজরত দুঃখে মর্মাহত হন, তখন এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা নসর্

শুরু করিলাম শুভ নামে আল্লার,
নাই আদি অন্ত যাঁর করুণা কৃপার।

আসিছে আল্লার শুভ সাহায্য বিজয়!
দেখিবে – আল্লার ধর্মে এ জগৎময়
যত লোক দলে দলে করিছে প্রবেশ,
এবে নিজ পালক সে প্রভুর অশেষ
প্রচারো হে প্রশংসা কৃতজ্ঞ অন্তরে,
করো ক্ষমা-প্রার্থনা তাঁহার গোচরে।
করেন গ্রহণ তিনি সবার অধিক
ক্ষমা আর অনুতাপ-যাচ্‌ঞা সঠিক।

—————
সুরা নসর্‌
র্এই সুরা মদিনা শরিফে অবতীর্ণ হয়; ইহাতে ৩টি আয়াত, ১৯টি শব্দ ও ৮১টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – হিজরি ষষ্ঠ সালে হজরত ছাহাবাগণসহ ‘ওমরা’ সম্পন্ন করার জন্য হোদায়বিয়া নামক স্থানে উপস্থিত হইলে কোরেশগণ তাঁহাদিগকে মক্কা শরিফে প্রবেশ করিতে বাধা প্রদান করে। সেই সময় কোরেশগণের সহিত হজরতের এই মর্মে এক সন্ধি হয় যে, একদল অপর দলের প্রতি কোনো প্রকার অত্যাচার করিতে পারিবে না। বনুবকর সম্প্রদায় কোরেশদের ও খোজা সম্প্রদায় হজরতের পক্ষভুক্ত হইল। কিছুকাল পর বনুবকরেরা কোরেশদের সহায়তায় উক্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করতঃ খোজাদলকে আক্রমণ করে। খোজারা হেরেম শরিফে আশ্রয় গ্রহণ করা সত্ত্বেও বনুবকরেরা তাহাদিগকে প্রহার করে। জনৈক খোজা-নেতা ও তাহাদের দলের কয়েকজন লোক মদিনা শরিফে হজরতের নিকট উপস্থিত হইয়া সাহায্য প্রার্থনা করেন। হজরত ছাহাবাগণকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইতে আদেশ প্রদান করেন। পূর্বের অঙ্গীকার দৃঢ় ও শর্তের সময় বৃদ্ধি করার মানসে কোরেশগণ আবুসুফিয়ানকে মদিনা শরিফে প্রেরণ করেন। হজরত আলি, জোবায়ের প্রভৃতি ছাহাবার প্রেরিত পত্রবাহকের নিকট হইতে পত্র কাড়িয়া লন। দশম হিজরিতে দশ হাজার ছাহাবা-সহ মক্কা অভিমুখে হজরত যাত্রা করেন। আবুসুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণ, হজরত আব্বাসের প্রার্থনায় তাহার মুক্তি, বহু সৈন্যের ভীতি, মক্কা বিজয়, অধিবাসীগণকে ক্ষমা, ১৫ দিবস তথায় অবস্থান ইত্যাদির আভাস ইহাতে প্রদান করা হইয়াছে।

সুরা নাজেয়াত

শুরু করি লয়ে পূত নাম সে খোদার
যিনি চির-দয়াময় করুণা-আধার।

তাদের শপথ পূর্ণ-বেগে টানে যারা(ধনুর্গুণ)
তাদের শপথ ছুটে (যে শর) তীব্র সে গতি-নিপুণ।
তাদের শপথ পূর্ণবেগে যারা সন্তরণকারী,
দ্রুতবেগে অগ্রগামী (অশ্ব যে) প্রমাণ তারই।
করে যারা সব বিষয়ের ব্যবস্থা তাদের প্রমাণ।
কম্পনের সে পরে যেদিন ধরা হবে কম্পমান,
কত সে অন্তরাত্মা সেদিন হবে ঘন-স্পন্দিত,
দৃষ্টিগুলি তাদের সেদিন হবে অবনমিত।
বলছে তারা (ব্যঙ্গসুরে) ‘আমরা কি গো পুনর্বার
জীর্ণ অস্থি হবার পরেও পূর্বজীবন পথে আর
(বিতাড়িত হব)। ওহো, তবে বড়োই ক্ষতিকর
হবে তো সে জীবন পাওয়া।’ একটি মাত্র তাড়নায়
প্রান্তর-ভূমিতে তারা অমনি হাজির হবে, হায়
তোমার কাছে পৌঁছেনি কি মুসার সেই সে বিবরণ?
তাহার প্রভু যখন তারে করিলেন সেই সম্বোধন
পূত ‘তোওয়া’ প্রান্তরে ‘ফেরাউনের’ বরাবর,
উচ্ছৃঙ্খল হয়েছে সে। বলবে তারে অতঃপর, –
‘তুমি পাক হতে কি চাও? দেখাইয়া দিই তোমায়
তোমার প্রভুর দিকের পন্থা, চলবে হে ভয় করে তায়।’
(পরে) মুসা দেখাল তায় শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন,
সে সত্যরে মিথ্যা বলে লইল না তা (ফেরাউন)।
প্রবৃত্ত সে হইল কুচেষ্টায় যে অতঃপর,
ঘোষণা সে করিল ফলে জুটিয়ে (বহু লস্কর),
বলিল তখন, ‘আমিও তো পরম প্রভু তোদের রে!’
ইহকাল আর পরকালের শাস্তি দিতে চাই তারে
ধৃত করিলেন আল্লাহ্। ভয় রাখে যে তাঁর তরে
বিশেষ করে জানার উপদেশ আছে (কোরান ভরে)।
তোমাদের কি সৃষ্টি অধিক কঠিন? না ওই আকাশের?
সৃজিয়া তায় ঊর্ধ্বকে তার করিলেন সুউচ্চ ফের।
ঠিক-ঠাক তায় দিলেন করে। রজনিকে তিমিরময়
করলেন (দূর করে তাহার আলোকরাশি সমুদয়)।
প্রসারিত করলেন এই ধরায় তিনি অতঃপর
তাহার থেকে করলেন বাহির পানি এবং চারণ-চর।
(তোমাদের ও তোমাদের পশুর উপকার তরে)
প্রতিষ্ঠিত করলেন ওই শৈলমালা উপরে।
সে মহাবিপদ আসবে যেদিন অতঃপর,
অর্জন সে করিছে কী বুঝতে পারবে সেদিন নর।
দর্শকে দেখানোর তরে দোজখ হবে সুপ্রকাশ,
লঙ্ঘন যে করে বিধি পার্থিব জীবনের আশ –
মুখ্যভাবে যে জন করে তার স্থিতিস্থান দোজখ পরে।
কিন্তু প্রভুর সম্মুখে তার দাঁড়াবার যে ভয় রাখে,
নীচ যত প্রবৃত্তি হতে মুক্ত রাখে আত্মাকে,
ফলে – (হবে) নিশ্চয় ওই বেহেশ্‌ত তাহার স্থিতিস্থান!
জিজ্ঞাসিছে ওরা ‘হবে কখন তাহার অধিষ্ঠান,
সেই মুহূর্ত আসবে কবে? তুমি আলোচনায় সেই
(ব্যস্ত) আছ? তার নিরুপণ তোমার প্রভুর নিকটেই।
– যেসব লোকে ভয় রাখে সেই মুহূর্তের
তুমি কেবল করতে পার সাবধান সে তাহাদের
(করবে মনে সেদিন তারা) দেখবে যখন সে খন,
রয়নি তারা এক সাঁঝ বা এক প্রভাতের অধিকক্ষণ।

———
সুরা নাজেয়াত
এই সুরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৪৬টি আয়াত, ১৮১টি শব্দ ও ৮৯১টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – অনন্ত শক্তিময় আল্লার শক্তির কথা আর পরকাল ও পুনর্জীবন প্রভৃতি বর্ণনা দ্বারা মানুষকে সাবধান করিয়া দেওয়া হইয়াছে, – মানুষ যেন নিজের মনকে নীচ প্রবৃত্তি হইতে নিবৃত্ত রাখে এবং ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের সুখ-লালসার নিমিত্ত যেন পরকালের অনন্ত জীবনের অনন্ত সুখের পথ বিনষ্ট না করে। পরকালের প্রতি লক্ষ রাখার ইঙ্গিত দিবার জন্যই এই সুরা অবতীর্ণ হইয়াছে।

সুরা নাবা

শুরু করি লয়ে নাম খোদার,
করুণাময় ও কৃপা-আধার।

পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তারা কোন বিষয়?
সেই সে মহান খবর লয়ে যাতে সে ভিন্নমত হয়?
না, না, তারা জানবে ত্বরায়, জানবে, কই আবার
করিনি কি শয্যারূপে নির্মাণ আমি এই ধরার?
কীলক স্বরূপ করিনি কি স্থাপিত ওই সব পাহাড়?
জোড়ায় জোড়ায় তোমাদের সৃষ্টি করেছি আবার।
বিরাম লাগি দিয়াছি ঘুম, রাত তোমাদের আবরণ,
করিয়াছি জীবিকার তরে দিবসের সৃজন।
নির্মিয়াছি দৃঢ় সপ্ত (আকাশ) ঊর্ধ্বে তোমাদের,
করিয়াছি প্রস্তুত এক প্রদীপ্ত সে প্রদীপ ফের,
বর্ষণ করেছি সলিল মেঘ হতে মুষলধারায়,
কারণ আমি জন্মাব যে উদ্ভিদ ও শস্য তায়,
এবং গহন কাননরাজি। আছে আছে সুনিশ্চয়,
মীমাংসা সে অবধারিত যেদিন সে ভেরি প্রলয়
উঠবে বেজে; শুনে তাহা তোমরা সবে দলে দল
সমাগত হবে; এবং খোলা হবে গগনতল,
তাহার ফলে হয়ে, যাহে সেদিন তাহা বহুদ্বার,
সঞ্চালিত করা হবে পাহাড় সবে; ফলে তার
মরীচিবৎ হবে তারা। দোজখ আছে অপেক্ষায়,
সুনিশ্চয়; অবাধ্য যারা তাদের বাসস্থান তাহায়।
সেই খানেতে করবে তারা বহু, ‘হোকবা’ অবস্থান!
পাবে নাকো সেখানে তারা স্নিগ্ধ স্বাদ এবং পান
করতে নাহি পাবে কিছু, যেমন কর্ম তেমনি ফল,
পাবে সলিল উষ্ণ ভীষণ কিংবা দারুণ সুশীতল।
হিসাব-নিকাশ আশা তারা করত নাকো সুনিশ্চয়,
মিথ্যার আরোপ করেছিল নিদর্শন সে সমুদয়।
দেখতে আমার ওরা সবে হঠকারিতা করেই
অথচ রেখেছি গুনে গুনে প্রতি বস্তুকেই।
সুতরাং এবার মজা দেখো! এখন কেবল যাতনাই
বাড়িয়ে দিতে থাকব আমি, তোমাদিগের
– (রেহাই নাই)!
সংযমী লোক সবার তরেই সফলতা সুনিশ্চয়,
প্রাচীর ঘেরা কাননরাজি এবং আঙুর (সেথায় রয়)।
সমান বয়েস তরুণীদল, পানপাত্র পরের পর
আসবে সেথা পূর্ণ এবং পবিত্র (অমৃত ভর)।
শুনতে নাহি পাবে তারা মিথ্যা প্রলাপ সেই সে স্থান
বিনিময়ে তোমার প্রভুর থেকে তাই যথেষ্ট দান।
ভূলোক ও দ্যুলোকের যিনি সকল কিছুর অধীশ্বর,
করুণাময় যিনি তাহার কেহই সে দিন তাঁহার পর
হবে নাকো অধিকারী সম্বোধন করিতে তার।
জিবরাইল আর ফেরেশ্‌তারা দাঁড়াবে সব দিয়ে সার
সেদিন তারা কইতে নারবে কোনো কথা; কিন্তু যার
মিলবে আদেশ কৃপা-নিধান খোদার কাছে বলবে সে
সঙ্গত সেকথা। উহাই নিশ্চিত দিন সত্য যে সে।
সুতরাং যার ইচ্ছা হয়
আপন প্রভুর কাছে এসে গ্রহণ করুক সে আশ্রয়।
অনাগত শাস্তি সে কি, তার বিষয়
সাবধান করেছি আমি তোমাদের সুনিশ্চয়।
দেখতে পাবে সেদিন মানুষ পাঠাল দুই হস্ত তার
কোন সম্বল আগের থেকে! বলতে থাকবে কাফের
– আর (ভাগ্যহত আমি হায়)
হতাম যদি মাটি – (ছিল শান্তি তায়)!

তাম্মাত

————-
সুরা নাবা
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৪০টি আয়াত, ১৭৪টি শব্দ ও ৮০১টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – হজরত প্রথম যে সময়ে লোকদিগকে ইসলামের দিকে আহ্বান করিয়া কোরান শুনাইতেন ও কেয়ামতের ভীতিপ্রদ সংবাদ বর্ণনা করিতেন সেই সময়ে বিধর্মীরা তাঁহার প্রেরিত তত্ত্ব, কোরান ও কেয়ামত সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক করিত, আর একে অপরের নিকট ওই সকল বিষয় সম্বন্ধে নানারূপ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিত। তখন এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা নাস

শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।

বল, আমি তাঁরই কাছে মাগি গো শরণ
সকল মানবে যিনি করেন পালন।
কেবল তাঁহারই কাছে – ত্রিভুবন মাঝ
সবার উপাস্য যিনি রাজ- অধিরাজ।
কুমন্ত্রণাদানকারী ‘খান্নাস’ শয়তান
মানব দানব হতে চাহি পরিত্রাণ।

————-
সুরা নাস
মদিনা শরিফে অবতীর্ণ; ইহাতে ৬টি আয়াত, ২০টি শব্দ, ৮১টি অক্ষর ও ১টি রুকু আছে। ‘নাস’ অর্থ মানুষ। (কোর-আন শরিফের মোট ১১৪টি সুরার মধ্যে এইটিই শেষ সুরা)।

শানে-নজুল– মদিনা শরিফের অধিবাসী লবিদ নামক একজন ইহুদির কয়েকটি কন্যা ছিল। তাহারা হজরত নবি করিমের মাথার কয়েকটি চুল ও চিরুনির কয়েকটি দাঁতের উপর জাদুমন্ত্র পাঠ করিয়া এগারোটি গ্রন্থি দিয়াছিল এবং তাহা এক একটি খোর্মা মুকুলের মধ্যে রাখিয়া ‘যোরআন’ নামক কূপের তলদেশস্থ প্রস্তরের নীচে স্থাপন করিয়াছিল। এই জাদুর দরুন হজরতের শরীর এরূপ অসুস্থ হইয়াছিল যে, তিনি যে কাজ করেন নাই তাহাও করিয়াছেন বলিয়া কখনও কখনও তাঁহার ধাটণা হইত। হজরত ছয় মাস কাল যাবৎ এরূপ ব্যাধিগ্রস্ত ছিলেন। এক রাত্রে তিনি স্বপ্নে জানিতে পারিলেন তাঁহার ওই পীড়ার কারণ কী। প্রাতে হজরত আলি, আম্মার ও জোবায়েরকে ‘যোরআন’ কূপের দিকে প্রেরণ করেন। তাঁহারা উক্ত কূপের তলদেশ হইতে ওইসব দ্রব্য তুলিয়া হজরতের নিকট নিয়া হাজির করেন। তখন জিব্রাইল ‘ফলক’ ও ‘নাস’ এই দুই সুরা সহ অবতরণ করেন। এই দুই সুরায় এগারোটি আয়াত আছে। তিনি এক এক করিয়া ক্রমান্বয়ে এগারোটি আয়াত পাঠ করিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এক এক করিয়া উহার এগারোটি গ্রন্থি খুলিয়া গেল। অতঃপর হজরত সম্পূর্ণরূপে রোগ হইতে মুক্তি লাভ করিলেন।
(–এমাম এবনে কছির, জালালায়ন, কবির।)
এস্থলে ইহাও উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, জাদুমন্ত্র দ্বারা মানুষের শারীরিক ক্ষতি হওয়া অসমীচীন নয়; কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ জাদুমন্ত্র-প্রভাবে স্বর্গীয় আদেশ প্রচারের কালে বিকারগ্রস্ত হইয়াছিলেন এরূপ ধারণা করা বাতুলতা মাত্র।
(কবির, হাক্কানী)

সুরা ফজর

শুরু করি লয়ে পাক নাম আল্লার,
করুণা-নিধান যিনি কৃপা-পারাবার।

উষার শপথ। দশ সে রাতের শপথ করি,
জোড়-বিজোড় সে দিনের শপথ! সে বিভাবরী,
যবে অবসান হতে থাকে করি তার শপথ
জ্ঞানীদের তরে যথেষ্ট শপথ – এই তো।
ভীমবাহু ওই ইরামীয়, ‘আদ’দের পরে,
করেছেন কীবা প্রভু তব, দেখনি কি ওরে?
হয়নি সৃজিত নগরসমূহে তাদের প্রায়
আর সে ‘সামুদ’ জাতি সে পাথর কাটিয়া
        সে উপত্যকায় –
বসাইয়াছিল নগর বসতি, আর বহু কীলকধারী;
ফেরাউন সাথে বিনাশ সাধিলাম কেন
        আমি তাহারই?
  
নগরে নগরে করেছিল ঔদ্ধত্য – আর
বহু অনাচার এনেছিল তথায় আবার।
শাস্তি দণ্ড তোমাদের প্রভু
        তাদের উপরে দিলেন তাই,
নিশ্চয় তব প্রভু দেখে সব,
        থাকেন সময় প্রতীক্ষায়।
মানবে যখন দিয়ে সম্পদ
        সম্মান, করে পরীক্ষা প্রভু,
‘আমার প্রভুই দিলেন এ সব
        সম্মান’ – বলে অবোধ তবু।
আবার তাহারে পরীক্ষা যবে
        করেন জীবিকা হ্রাস করে,
সে বলে, ‘আমার প্রভুই এ হেন
        অপমানিত গো করিল মোরে!’
নহে, নহে, তাহা কখনই নহে,
        এ সবের তরে তোমরা দায়ী,
এতিমে তোমরা গ্রাহ্য কর না
        কাঙালে খাদ্য দিতে উৎসাহ নাহি।
অন্নমুষ্টি তারে নাহি দাও,
        অত বেশি কর অর্থের মায়া,
পিতৃ-সম্পদ বিনা বিচারে সে
        যাও যে তোমরা ভোগ করিয়া।
জান না কি, যবে ভীষণ রবে
        এ-ধরিত্রী বিচূর্ণিত হবে,
দলে দলে ফেরেশ্‌তাগণ
        তখন হাজির হবে সবে।
আর আসিবেন সেদিন
        তব মহান প্রভু সেথায়,
দোজখ সেদিন হইবে আনীত,
        সেদিন মানুষ স্মরিবে হায়!
কিন্তু সেদিন স্মরণে কি হবে?
        ‘হায় হায়’ করি কাঁদিবে সব,
‘পূর্বে যদি এ জীবনের তরে
        প্রেরিতাম পুণ্যের বিভব!’
অন্য কেহ সে পারিবে না দিতে
        তেমন শাস্তি সেদিন,
অন্য কেহই তখন বাধা দিতে
        পারিবে না সেই যে দিন।
শাস্তি-প্রাপ্ত মানব-আত্মা!
        ফিরে এসো নিজ প্রভু পানে।
   তুমি তার প্রতি প্রীত যেমন
   তিনি তব প্রতি প্রীত তেমন।
অনুগত মোর দাস যারা
        এসো সেই দলে,
বেহেশ্‌তে মোর করিবে প্রবেশ
        অবহেলে।

————–
সুরা ফজর
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৩০টি আয়াত, ১৩৭টি শব্দ ও ৫৮৫টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – এক সময় কাফেররা বলিতে লাগিল যে, মানুষের ভালোমন্দ কার্যের প্রতিফল প্রদান করা আল্লার অভিপ্রেত নহে। যদি তিনি পাপীর প্রতি অসন্তুষ্ট ও পুণ্যবানের প্রতি সন্তুষ্ট হইতেন তবে কেয়ামতের প্রতীক্ষা না করিয়া ইহজগতেই কেন সৎ লোকদিগকে সম্পদশালী ও অসৎ লোকদিগকে বিপদগ্রস্ত করেন না? পরলোক মিথ্যা ইত্যাদি। তখন এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা ফলক

শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।

বল, আমি শরণ যাচি ঊষাপতির,
হাত হতে তার – সৃষ্টিতে যা আছে ক্ষতির।
আঁধার-ঘন নিশীথ রাতের ভয় অপকার-
এ সব হতে অভয় শরণ যাচি তাঁহার।
জাদুর ফুঁয়ে শিথিল করে (কঠিন সাধন)
সংকল্পের বাঁধন, যাচি তার নিবারণ।
ঈর্ষাতুরের বিদ্বেষ যে ক্ষতি করে
শরণ যাচি, পানাহ্ মাগি তাহার তরে।

————-
সুরা ফলক
মদিনা শরিফে অবতীর্ণ; ইহাতে ৫টি আয়াত, ২৩টি শব্দ, ৭৩টি অক্ষর ও ১টি রুকু। ‘ফলক’ – উষা, প্রাতঃকাল। ইহা কোর-আনের ধারাবাহিক ১১৩ নং সুরা।

শানে-নজুল– মদিনা শরিফের অধিবাসী লবিদ নামক একজন ইহুদির কয়েকটি কন্যা ছিল। তাহারা হজরত নবি করিমের মাথার কয়েকটি চুল ও চিরুনির কয়েকটি দাঁতের উপর জাদুমন্ত্র পাঠ করিয়া এগারোটি গ্রন্থি দিয়াছিল এবং তাহা এক একটি খোর্মা মুকুলের মধ্যে রাখিয়া ‘যোরআন’ নামক কূপের তলদেশস্থ প্রস্তরের নীচে স্থাপন করিয়াছিল। এই জাদুর দরুন হজরতের শরীর এরূপ অসুস্থ হইয়াছিল যে, তিনি যে কাজ করেন নাই তাহাও করিয়াছেন বলিয়া কখনও কখনও তাঁহার ধাটণা হইত। হজরত ছয় মাস কাল যাবৎ এরূপ ব্যাধিগ্রস্ত ছিলেন। এক রাত্রে তিনি স্বপ্নে জানিতে পারিলেন তাঁহার ওই পীড়ার কারণ কী। প্রাতে হজরত আলি, আম্মার ও জোবায়েরকে ‘যোরআন’ কূপের দিকে প্রেরণ করেন। তাঁহারা উক্ত কূপের তলদেশ হইতে ওইসব দ্রব্য তুলিয়া হজরতের নিকট নিয়া হাজির করেন। তখন জিব্রাইল ‘ফলক’ ও ‘নাস’ এই দুই সুরা সহ অবতরণ করেন। এই দুই সুরায় এগারোটি আয়াত আছে। তিনি এক এক করিয়া ক্রমান্বয়ে এগারোটি আয়াত পাঠ করিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এক এক করিয়া উহার এগারোটি গ্রন্থি খুলিয়া গেল। অতঃপর হজরত সম্পূর্ণরূপে রোগ হইতে মুক্তি লাভ করিলেন।
(–এমাম এবনে কছির, জালালায়ন, কবির।)
এস্থলে ইহাও উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, জাদুমন্ত্র দ্বারা মানুষের শারীরিক ক্ষতি হওয়া অসমীচীন নয়; কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ জাদুমন্ত্র-প্রভাবে স্বর্গীয় আদেশ প্রচারের কালে বিকারগ্রস্ত হইয়াছিলেন এরূপ ধারণা করা বাতুলতা মাত্র।
(কবির, হাক্কানী)

সুরা ফাতেহা

শুরু করিলাম) লয়ে নাম আল্লার
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।

সকলই বিশ্বের স্বামী আল্লার মহিমা,
করুণা কৃপার যাঁর নাই নাই সীমা।
বিচার-দিনের বিভু! কেবল তোমারই
আরাধনা করি আর শক্তি ভিক্ষা করি।
সহজ সরল পথে মোদেরে চালাও,
যাদেরে বিলাও দয়া সে পথ দেখাও।
অভিশপ্ত আর পথভ্রষ্ট যারা, প্রভু,
তাহাদের পথে যেন চালায়ো না কভু।

অর্থ – সংকেত

সুরা ফাতেহা
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ৭টি আয়াত, ২৫টি শব্দ, ১২৩টি অক্ষর ও ১টি রুকু। ইহার অপর নাম ‘সাবাউল মাসানী’। ‘সাবা’ অর্থ সাত; ‘মাসানী’ অর্থ পুনঃপুন।

ফাতেহা – উদ্‌ঘাটিকা। এই ‘সুরা’ দিয়াই পবিত্র কোর-আন শরিফের আরম্ভ। এইজন্য এই সুরার নাম ‘ফাতেহা’। ইহা কোর-আনের শেষ খণ্ড আমপারায় নাই, ইহা কোর-আন শরিফের প্রথম খণ্ডের প্রথম ‘সুরা’। নামাজ, বন্দেগী, প্রার্থনা প্রভৃতি সকল পবিত্র কাজেই সুরা ফাতেহার প্রয়োজন হয় বলিয়া আমপারার সঙ্গে ইহার অনুবাদ দেওয়া হইল।

শানে-নজুল– (অবতীর্ণ হইবার কারণ) – একদা হজরত মোহাম্মদ (দঃ) মক্কার প্রান্তর অতিক্রম করিবার সময় দৈববাণী শুনিতে পাইলেন, মোহাম্মদ! আমি স্বর্গীয় দূত জেব্রাইল, আপনি পয়গম্বর, আমি শপথ করিতেছি – আল্লাহ্ ভিন্ন আর কোন উপাস্য নাই, মোহাম্মদ (দঃ) আল্লাহ্‌র রসুল (তত্ত্ববাহক)। আপনি বলুন, আলহামদোলিল্লাহ্- সকল প্রশংসাই বিশ্বপতি আল্লার, ইত্যাদি।
(–তফসীরে আজিজী ও তফসীরে মাজহারী)

সুরা ফীল

শুরু করিলাম শুভ নামে সে আল্লার,
করুণানিধান যিনি কৃপা-পারাবার।

দেখ নাই, তব প্রভু কেমন (দুর্গতি)
করিলেন সেই গজ-বাহিনীর প্রতি?
(দেখ নাই, তব প্রভু) করেননি কি রে
বিফল তাদের সেই দুরভিসন্ধিরে?
পাঠালেন দলে দলে সেথা পক্ষী আর
করিতে লাগিল তারা প্রস্তর প্রহার
গজপতিদেরে। তিনি তাদেরে তখন
করিলেন ভক্ষিত সে তৃণের মতন।

————-
সুরা ফীল
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। আবরাহার দলের উপর জয়ী হওয়ায় আবিসিনিয়াবাসীদের সম্বন্ধে এই সুরা অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৫টি আয়াত, ২৪টি শব্দ ও ৯৪টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – ইমন প্রদেশের শাসনকর্তা আবরহা ঈর্ষার বশবর্তী হইয়া ইমনের ‘ছানয়া’ নামক স্থানে রত্নরাজি খচিত ‘কলিসা’ নামে একটি গির্জা প্রস্তুত করিয়া তথায় উপাসনার নিমিত্ত লোকদিগকে আহ্বান করেন। ধার্মিক লোকেরা তাঁহার আদেশ মানিতে রাজি না হওয়ায় তিনি কাবাগৃহ ধ্বংসের নিমিত্ত বহু সৈন্যসামন্ত ও ১৩টি হাতি (‘মামুদ’ সহ) প্রেরণ করেন। হজরতের পিতামহ আবদুল মোতালেব ‘মোগাম্মছ’ নামক স্থানে হান্নাতা নামক ব্যক্তির সহিত যাইয়া আবরাহার নিকট হাজির হন ও যথেষ্ট সম্মান পান এবং তাঁহার লুণ্ঠিত দুই শত উষ্ট্র ফেরত পাইবার দাবি জানান। আবরাহা কাবা ধ্বংসের বাসনা জ্ঞাপন করায় তিনি বলেন – আমি উটের মালিক, উট ফেরত চাই – কাবা গৃহের মালিক স্বয়ং আল্লাহ্, কাজেই তিনি উহা রক্ষা করিবেন। আরবের অপর যে-সকল নেতা তাঁহার সঙ্গে গিয়াছিলেন তাঁহারা মক্কার ধনসম্পদ বা চতুষ্পদ জন্তুসমূহের দুই-তৃতীয়াংশ আবরাহাকে দিতে চাওয়া সত্ত্বেও আবরহা কাবা ধ্বংসের সংকল্প ত্যাগ করিলেন না, আবদুল মোতালেবের উটগুলি ফেরত দিতে আদেশ দিলেন।
আবরাহা যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। তখন কাবার মর্যাদা রক্ষার নিমিত্ত আল্লাহ্‌তালা দলে দলে পাখি প্রেরণ করিলেন। উহারা উপর হইতে কঙ্কর নিক্ষেপ করতঃ আবরাহার সমস্ত হস্তী ও সৈন্য বিনাশ করিয়া দিল।
এই ঘটনার কিছুকাল পর হজরতের জন্ম হয়। কোরেশগণের উপর যে আল্লাহ্ মহা অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহাই এই সুরায় বর্ণিত হইয়াছে। উক্ত অনুগ্রহ স্মরণ করিয়া আল্লার এবাদত করা কোরায়েশগণের কর্তব্য, এই উদ্দেশ্যে এই সুরা অবতীর্ণ হইয়াছে।

সুরা বাইয়েনাহ্

শুরু করিলাম নামে পবিত্র আল্লার,
সীমা নাই যাঁর দয়া কৃপা করুণার।

‘আহ্‌লে কেতাব’ আর অংশীবাদিগণ
নিবৃত্ত হয়নি যারা বিশ্বাসে আপন।
ভিন্ন-মত হয় নাই তাহারা তাবৎ,
না এল তাদের কাছে প্রমাণ যাবৎ।
আল্লার রসুল যিনি, পবিত্র কোরান
উদ্‌গাতা যাহাতে দৃঢ় সত্য অধিষ্ঠান
(ভিন্ন-মত হইল তাহারা তাঁর পরে);
‘আহ‌্‌লে কেতাব’ দল এইরূপ করে,
যতদিন আসে নাই পরম প্রমাণ,
করে নাই দলাদলি, করেছে সম্মান।
তাদেরে কেবল মাত্র আজিকার মতো
এই সে আদেশ দেওয়া আছিল সতত –
কর্মেতে ‘হানিফ’ হয়ে কেবল আল্লার
করুক তাহারা পূজা, উপাসনা আর।
নামাজ পড়ুক, দিক্ জাকাত সে সাথে,
চির-দৃঢ় সত্য ধর্ম, ইহাই ধরাতে।
‘আহ্‌লে কেতাব’ আর ‘মুশরিক’ যারা
প্রত্যাখ্যান করিয়াছে সত্যধর্ম তারা
দোখজ-আগুনে হবে হবে চিরস্থায়ী,
সৃষ্টির অধম তারা, সংশয় নাই।
সৃষ্টির বরেণ্য তারা নিশ্চয়ই যারা
ইমান আনিয়া করে সৎকাজ তারা।
তাহাদের পুরস্কার দরগায় আল্লার
বেহেশ্‌ত-কানন আছে, তলদেশে যার।
নহর-লহর বহে; তারা সেই লোকে
অনন্ত কালের তরে রবে নিরাশোকে।
প্রসন্ন তাদের প্রতি সদা বিশ্বপতি,
তাহারাও প্রীত তাই আল্লাহের প্রতি।
জীবন-প্রভুরে হেন ভয় যার মনে
এই পুরস্কার আছে তাদেরই কারণে।

—————
সুরা বাইয়েনাহ্
এই সুরায় ৮টি আয়াত, ৯৫টি শব্দ ও ৪১৩টি অক্ষর আছে। কবির, হাক্কানী, শাহ অলিউল্লাহ, ও শাহ্ রফিউদ্দিন বলেন – এই সুরা মদিনা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। কাশ্‌শাফ, বায়জাবী, জালালাইন ও হোসেনী বলেন, এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে।

শানে-নজুল – মদিনার ইহুদিগণ ও মক্কার অংশীবাদীগণ তৌরাতের প্রতিশ্রুত শেষ পয়গম্বরের প্রতীক্ষায় ছিল। শেষ পয়গম্বর আবির্ভাব হওয়া সত্ত্বেও তাহারা পাপকার্য হইতে বিরত হয় নাই – তজ্জন্য এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা বালাদ্

শুরু করি লয়ে শুভ নাম আল্লার,
যিনি দয়াশীল আর কৃপার আধার।

শপথ করি এই নগরের
যেহেতু বিরাজ করিছ হেথায়
শপথ পিতার আর তাহাদের সন্তানের
অধিবাসী এই নগর মক্কায়।
মানুষে করেছি সৃষ্টি যে আমি
নিশ্চয় দুঃখ-ক্লেশের মাঝ,
সে কী ভাবে, তার পরে প্রভুত্ব
করিতে কেহই নাহি সে আজ?
‘উড়ায়ে দিয়াছি রাশি রাশি টাকা
আমি’ – সে বলে বিনাশিতে তোমারে,
সে কি (এই শুধু) মনে করে
কেহ দেখিতেছে না তাহারে?
আমি কি তাহার মঙ্গল লাগি
দিইনি তাহারে যুগল নয়ন?
জিহ্বা ওষ্ঠ দিইনি? দেখায়ে
দিইনি উভয় পথ সে কারণ?
কিন্তু প্রবেশ করিল না তো সে
দুর্গম পথে উপত্যকার,
উপত্যকার দুর্গম সেই
পথ – জান তুমি সন্ধান তার?
সে পথ – দাসেরে মুক্তিদান
ও অন্নদান সে ক্ষুধার্তেরে
আশ্রয় দান ধূলি-লুণ্ঠিত
কাঙালে, ‘এতিম’ আত্মীয়েরে।
এমনি করে সে হয় একজন
তাদের মতোই, ইমান যারা
আনে আর দেয় উপদেশ
সব বিপদে (মহৎ তারা)।
উপদেশ দেয় পরস্পরে সে
দয়াশীল হতে, তারাই হবে
দক্ষিণকর অধিকারী। আর
এ আয়াতে অবিশ্বাস করে গো যারা – হবে
বাম হস্তের অধিকারী তারা, তাদের তরে
আছে নিবদ্ধ হুতাশনের বরাদ্দ রে।
————-
সুরা বালাদ্
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ২০টি আয়াত, ৮২টি শব্দ ও ৩৪৭টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – কালদা নামক বলিষ্ঠ কাফেরকে হজরত মোহাম্মদ (দঃ) ইসলাম গ্রহণ করিতে বলায় সে অবজ্ঞাভরে বলিয়াছিল যে, দোজখের ১৯জন ফেরেশতাকে সে একা বাম হস্তে অবরোধ করিতে পারিবে; বেহেশ্‌তের বাগিচা, নহর ও মণিকাঞ্চনের মূল্য তাহার বিবাহাদি উৎসবে ব্যয়িত অর্থের তুল্য হইতে পারে না। তখন এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা বুরুজ

শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,
করুণা কৃপার যিনি অসীম পাথার।

গ্রহ-উপগ্রহ ভরা শপথ আকাশের,
আর শপথ প্রতিশ্রুত রোজহাশরের
শপথ উপস্থিত, উপস্থাপিত সবার,
ধ্বংস হল সে অধিকারিগণ পরিখার।
কাষ্ঠপূর্ণ অগ্নিকুণ্ড-অধিকারিগণ
বসেছিল তদুপরি তাহারা যখন।
আল্লায়-বিশ্বাসিগণে ধরিয়া তথায়
ফেলিয়া দেখিতেছিল নিজেরাই, হায়!
সাজা দিতেছিল শুধু অপরাধে এই
বিশ্বাসিগণের প্রতি; বিশ্বাসীরা যেই
ইমান আনিয়াছিল আল্লাহ্‌র প্রতি,
অনন্ত-প্রতাপ যিনি মহীয়ান অতি।
স্বর্গ মর্ত্য রাজত্বের অধিপতি যিনি,
জ্ঞাত এ-সবের তত্ত্ব একমাত্র তিনি।
ইমানদার সে নর-নারীরে যাহারা
দেয় যন্ত্রণা, তৌবা নাহি করে তাহারা
ইহারই জন্য যাবে দোজখে নিশ্চয়,
অনল দাহন জ্বালা যেথা শুধু রয়।
অবশ্য যাহারা সৎ ‘নেক’ কাজ করে,
আনে সে ইমান; আছে তাহাদের তরে,
এমন বাগান, যার নিম্নদেশ দিয়া
পুণ্য-তোয়া নদী সব চলিছে বহিয়া।
শ্রেষ্ঠ সফলতা এই নিশ্চয় তোমার
প্রভু প্রতাপান্বিত বিপুল বিথার।
প্রথমে সৃজিয়া যিনি গড়েন আবার
তিনি মহা-প্রেমময় ক্ষমাবান, আর
জগৎ-সাম্রাজ্য-সিংহাসনের পতি,
ইচ্ছাময় প্রভু তিনি গরীয়ান অতি।
ফেরাউন সামুদের সেনা – সস্বার
তাদের বৃত্তান্ত শোনা আছে কি তোমার?
জান কি কেমনে হল তারা ছারখার?
যে জন অমান্য করে আদেশ আমার
সত্যেরে অসত্য বলা কাজ যে তাহার।
অথচ আল্লাহ্‌তালা ঘিরিয়া তাহায়
পরিব্যাপ্ত রয়েছেন চারিদিকে, হায়!
মহিমান্বিত মহা কোর-আন এই
লিখিত সুরক্ষিত পাক ‘লওহে’ ই।

———–
সুরা বুরুজ
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ২২টি আয়াত, ১০৯টি শব্দ ও ৪৭৫ টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – মক্কার পৌত্তলিকেরা মুসলমানগণকে ইসলাম গ্রহণ করার দরুন নানা প্রকার উৎপীড়ন করিত। হজরতের নিকট মুসলমানগণ অভিযোগ করায় তিনি উত্তরে বলিয়াছিলেন যে, এক সময় তাহাদের দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ গ্রহণ করিতে খোদা তোমাদিগকে সক্ষম করিবেন। এ কথা শ্রবণ করিয়া কাফেররা বলিতে লাগিল – এরূপ দুর্বল, অপমানিত ও অর্থহীন লোকেরা কীরূপে প্রতিশোধ লইতে সক্ষম হইবে? খোদার ইচ্ছাতেই আমরা সম্মানিত আর তাহারা হেয় ও লাঞ্ছিত। কাফেরদের উক্ত কথার প্রত্যুত্তরস্বরূপ ওই সময় এই সুরা অবতীর্ণ হয়। অগ্নিকুণ্ড স্থাপয়িতাদের পরিণাম বর্ণনা করিয়া ইসলাম ধর্মাবলম্বীদিগকে ইহাতে সান্ত্বনা প্রদান করা হইয়াছে। – (আজিজী)।

সুরা মাঊন

শুরু করি নামে সেই পবিত্র আল্লার
করুণা দয়ার যাঁর নাই শেষ পার।

তুমি কী দেখেছ, বলে ধর্ম মিথ্যা যেই?
পিতৃহীনে তাড়াইয়া দেয়, ব্যক্তি এই।
দরিদ্র কাঙালগণে অন্নদান তরে
এই লোক উৎসাহ দান নাহি করে।
যাবে ভণ্ড তপস্বীরা বিনাশ হইয়া
ভ্রান্ত যারা নিজেদের নামাজ লইয়া;
সৎকাজ করে যারা দেখাইতে লোক,
বাধা দেয় দান ধ্যানে, ধ্বংস তারা হোক!

————–
সুরা মাঊন
মক্কা শরিফে এই সুরা অবতীর্ণ হয়; ইহাতে ৭টি আয়াত, ২৫টি শব্দ ও ১১৫টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – আবু জহল কোনো মুমূর্ষু ব্যক্তির সন্তানের তত্ত্বাবধানের ভার লইয়া উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর নিজেই বালকের পিতার ত্যাজ্য সম্পত্তি ভোগ করিতে থাকে, এবং বালকটিকে বিতাড়িত করিয়া দেয়। উক্ত বালক ক্ষুধার্ত ও বিবস্ত্র অবস্থায় হজরতের নিকট উপস্থিত হইয়া আবু জহলের অসদ্‌ব্যবহার ও অত্যাচার-কাহিনি প্রকাশ করে। হজরত আবু জহলের নিকট যাইয়া উহার প্রতিকারার্থে তাহাকে কেয়ামতের ভীতি প্রদর্শন করেন। আবু জহল কেয়ামতের প্রতি অসত্যারোপ করিতে থাকায় হজরত দুঃখিত মনে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।
আবু সুফিয়ান সম্মান লাভের ইচ্ছায় প্রতি সপ্তাহে দুইটি করিয়া উষ্ট্র জবেহ করিয়া সম্ভ্রান্ত কোরেশদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইত। একদা জনৈক পিতৃহীন বালক আবু সুফিয়ানের বাড়িতে নিমন্ত্রণের দিন উপস্থিত হইয়া কিছু মাংস ভিক্ষা চাহিয়াছিল। উহাতে সে যষ্টির আঘাত করিয়া উক্ত বালককে বিতাড়িত করে; সেইজন্য এই সুরা নাজেল হয়।
(এমাম রাজী।)

কেহ কেহ বলেন– কেয়ামত অমান্যকারী পাপী আ-স কিংবা ধনশালী, অবাধ্য ও অহংকারী অলীদের সম্বন্ধে ইহা অবতীর্ণ হইয়াছিল।
শেষার্ধ আবদুল্লা-বেনে-ওবাইয়া নামক জনৈক কপটাচারীর সম্বন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল বলিয়া ‘খাজেনে’ উল্লিখিত আছে।
পরন্তু ধার্মিক বলিয়া পরিচিত যে সকল ব্যক্তির ব্যবহারে অধর্ম প্রকাশ পায় তাহাদের লোক-দেখানো কপটতার উদ্দেশ্যেই এই সুরা নাজেল হইয়াছে।

সুরা লহব্

শুরু করিলাম নামে সেই আল্লার,
করুণানিধান যিনি কৃপার পাথার।

ধ্বংস হোক আবুলাহাবের বাহুদ্বয়,
হইবে বিধ্বস্ত তাহা হইবে নিশ্চয়।
করেছে অর্জন ধন-সম্পদ সে যাহা
কিছু নয়, কাজে তার লাগিবে না তাহা।
শিখাময় অনলে সে পশিবে ত্বরায়
সাথে তার সে অনল-কুণ্ডে যাবে হায়
জায়া তার – অপবাদ – ইন্ধনবাহিনী,
তাহার গলায় দড়ি বহিবে আপনি।

————-
সুরা লহব্‌
মক্কায় অবতীর্ণ; ইহাতে ৫টি আয়াত, ২৪টি শব্দ, ৮১টি অক্ষর।

শানে-নজুল – বোখারী ও মোছলেম প্রভৃতি টীকাকারদের মতে খোদাতালা হজরতের আত্মীয়-স্বজনদের সম্বন্ধে শাস্তির ভীতি প্রদর্শনসংক্রান্ত আয়ত অবতীর্ণ করিলে তিনি সাফা পর্বতের উপর আরোহণ করিয়া আরবের তদানীন্তন নিয়মানুসারে উচ্চৈঃস্বরে ‘সাবধান’ ‘সাবধান’ বলিয়া চিৎকার করিতে থাকেন। তাহাতে কোরায়েশ বংশের অনেক লোক তথায় উপস্থিত হইয়া হজরতকে জিজ্ঞাসা করে, কী হইয়াছে? হজরত তাহাদের সম্বোধন করিয়া বলিলেন যে, যদি আমি বলি যে, একদল শত্রু তোমাদিগকে আক্রমণ করিবার জন্য পর্বতের অপর পার্শ্বে উপস্থিত হইয়াছে, তবে তোমরা আমার এই কাজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিবে কি? তদুত্তরে তাহারা বলিল, নিশ্চয় বিশ্বাস স্থাপন করিব। আমরা বেশ পরীক্ষা করিয়াছি, আপনি কখনও মিথ্যা কথা বলেন না। তৎপরে হজরত বলিলেন, – হে কোরেশগণ! তোমাদের সম্মুখে জ্বলন্ত দোজখের মহাশাস্তি রহিয়াছে; যদি তোমরা আমার ও খোদার বাণীর উপর আস্থা স্থাপন না কর, তবে তোমাদিগকে ওই শাস্তি ভোগ করিতে হইবে। তোমরা স্ব স্ব আত্মাকে উক্ত শাস্তি হইতে রক্ষা করো। ইহা শুনিয়া আবু লহব (হজরতের পিতার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা, তাহার স্ত্রী আবু সুফিয়ানের ভগ্নী উম্মে জামিলা) রাগান্বিত হইয়া বলিল, ‘তাব্বান লাকা’ – তোর ধ্বংস হউক। এই ঘটনার পর এই সুরা অবতীর্ণ হয়।
(বোখারী)

সুরা লায়ল্

শুরু করি শুভ নাম লয়ে আল্লার,
দয়া করুণার যিনি মহা-পারাবার।

শপথ রাতের আবৃত যখন করে সে অন্ধকারে
দিনের শপথ প্রোজ্জ্বল যাহা করে দেয় জ্যোতিঃধারে,
নর ও নারীর শপথ – যাদের তিনি সে স্রষ্টা প্রভু,
তোমাদের যত কর্মফল একমত নহে কভু।
যারা দাতা সংযমী, সত্যধর্মে সত্য বলিয়া লয়,
সহজ করিয়া দিব কল্যাণে তাহাদেরে নিশ্চয়।
কিন্তু যাহারা কৃপণ, নিজেরে ভাবে অতি বড়ো যারা,
বলে সত্যধর্মে মিথ্যা, শীঘ্র দেখিতে পাইবে তারা,
সহজ করিয়া দিয়াছি তাদের দোজখের পথ, আর
রক্ষা করিতে পারিবে না তারে তার ধন-সম্ভার।
তখন ধ্বংস হইবে সে, জেনো সুপথ প্রদর্শন
কর্তব্য সে আমার, একাল পরকাল সবখন
কেবল আমারই এক্তিয়ারে সে। করি তাই সাবধান,
প্রজ্বলিত সে অনল হইতে জ্বলজ্বল লেলিহান।
হত ভাগা সেই জন সত্য হতে যে মুখ ফিরায়,
সে ছাড়া সেই যে অগ্নিকুণ্ডে পশিবে না কেহ হায়।
সে অনল হতে রক্ষা পাইবে সেই সংযমী জন
শুদ্ধ হবার মানসে যে জন করে ধন বিতরণ।
কাহারও দয়ার প্রতিদানরূপে করে না সে ধন দান,
তাহার মহিমময় সে প্রভুরে তুষিতে যত্নবান।

———-
সুরা লায়্‌ল্
এই সুরা মক্কাতে নাজেল হয়। ইহাতে ২১টি আয়াত, ৭১টি শব্দ ও ৩১৪টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – আবুবকর (রাঃ) ও ২য় খালাফের পুত্র ওমাইয়া মক্কায় ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত সমাজ-নেতা ছিলেন। ওমাইয়া ১২টি কিঙ্কর দ্বারা নানা উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করিয়াছিলেন। পরকালের জন্য কেন তিনি দান করেন না? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলিতেন – প্রয়াসী বিপুল অর্থ সম্পদ থাকিতে কল্পিত বেহেশ্‌তের সম্পদ লাভের আশায় আমি নাই। ইনিই হজরত বেলালের মনিব ছিলেন। ওমাইয়ার গৃহে রাত্রে ক্রন্দনের শব্দ শ্রবণ করিয়া হজরত আবুবকর স্বীয় ক্রীতদাস নাস্তাশ ও ৪০টি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বেলালকে ক্রয় করিয়া হজরতের সামনে নিয়া তাঁহাকে মুক্তি দান করেন।
অতএব, আবুবকর ও ওমাইয়া সম্বন্ধে এই সুরা নাজেল হয়।

সুরা শাম্‌স্

শুরু করি লয়ে নাম মহান আল্লার,
যিনি সব দয়া-কৃপা-করুণা-আধার।

শপথ রবি ও রবি-কিরণের

যখন চন্দ্র চলে সে পিছনে তার,

দিবস যখন করে সপ্রকাশ

রবিরে, রজনি অন্ধকার,

যখন ছাইয়া ফেলে সে রবিরে;

নভঃ-নির্মাণকারী তাহার;

এই সে পৃথিবী সবিস্তার;

আত্মা, সুচারু গঠন তার।

সেই আত্মার সৎ ও অসতের

দিয়াছি দিব্য জ্ঞান,

এই সকলের শপথ ইহারা

সকলে করিছে সাক্ষ্য দান –

আত্মাশুদ্ধি হইল যার,

নিশ্চয় সার্থক জীবন,

আত্মায় কলুষিত করিল যে

চির-বঞ্চিত হল সে জন।

সত্যেরে বলিল মিথ্যা

‘সামুদ’ জাতি সে গর্বভরে

অগ্রসর হল হতভাগ্যেরা

(রসুলেরে নাহি গ্রহণ করে)।

কহিলেন রসুল খোদার প্রেরিত

–সলিল করিতে পান

ওই আল্লার উটেরে

দিয়ো নাকো বাধা বধো না প্রাণ।

বলিল নবিরে মিথ্যাবাদী

তথাপি তাহারা বধিল উটেরে,

তাহাদের তাই পাপের ফলে

বিধ্বস্ত করিল আল্লা তাদেরে।

ধূলিসাৎ করে ফেলিলেন খোদা

তাদেরে; এই সে ধ্বংস-লীলার

পরিণাম ফলে বে-পরোয়া তিনি

কোনো ভয় কভু নাই তাঁর।
————

সুরা শাম্‌স্

এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ১৫টি আয়াত, ৫৬টি শব্দ ও ২৫৪টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল – কোরআন শরিফে সাধারণত আধিভৌতিক, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনের যুক্তির সাহায্যে কোনো একটা সত্য প্রতিষ্ঠা ও সপ্রমাণ করার বিষয় দেখিতে পাওয়া যায়।

এই সুরায় সূর্য, চন্দ্র ও দিবারাত্রি প্রভৃতির উল্লেখ দ্বারা উহাদের তারতম্য বুঝানো হইয়াছে; আর কোন কার্য দ্বারা মানুষ আত্মাকে পবিত্র রাখিয়া জীবন সার্থক করিতে পারে এবং কোন কার্য করিলে মানুষের আত্মা কলুষিত ও জীবন ব্যর্থ হয় তাহার দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে। ‘সমুদ’ জাতির এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া – ‘খোদাতায়ালা যাহাকে ইচ্ছা হেদায়েত করেন, যাহাকে ইচ্ছা গোমরাহ্ করেন’ – এই উক্তি উপরোক্ত সুরা দ্বারা খণ্ডন করা হইয়াছে।

সুরা হুমাজাত

শুরু করিলাম শুভ নামেতে আল্লার,
দয়া করুণার যিনি অসীম আধার।

নিন্দা ও ইঙ্গিতে নিন্দা করে যে – তাহার,
গণে গণে রাখে ধন, জমায় যে আর,
চিরজীবী হবে ধনে মনে যেই করে,
সর্বনাশ ( ইহাদের সকলের তরে),
নিশ্চয় নিক্ষিপ্ত হবে সে যে ‘হোতামায়’,
‘হোতামা’ কাহারে বলে, জান কি তাহায়?
(ইহা) আল্লার সেই লেলিহান শিখা,
হৃৎপিণ্ড স্পর্শ করে যে (জ্বালা দাহিকা)।
রুদ্ধদ্বার সে অনল আবদ্ধ আবার
দীর্ঘ স্তম্ভে (আশা নাই মুক্তির তাহার)।

————
সুরা হুমাজাত
এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্না হইয়াছে। ইহাতে ৯টি আয়াত, ৩৩টি শব্দ ও ২৩৫টি অক্ষর আছে।

শানে-নজুল –ধর্মদ্রোহী আখনাস, অলিদ, ওবাই, ওমাইয়া, জমি ও আ-স এর সাক্ষাতে হজরতকে ও তাহার সহচরগণকে বিদ্রুপ করিত, এবং অসাক্ষাতে তাঁহাদের অপবাদ প্রচার করিত। এই জন্য এই সুরা অবতীর্ণ হইয়াছে।

Exit mobile version