গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা
গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা।
আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা ॥
হয়তো সে তুমি শোন নাই, সহজে বিদায় দিলে তাই–
আকাশ মুখর ছিল যে তখন, ঝরোঝরো বারিধারা ॥
চেয়েছিনু যবে মুখে তোলো নাই আঁখি,
আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি।
আর কি কখনো কবে এমন সন্ধ্যা হবে–
জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা ॥
গোপন কথাটি রবে না গোপনে
গোপন কথাটি রবে না গোপনে,
উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে।
না না না, রবে না গোপনে॥
বিভল হাসিতে
বাজিল বাঁশিতে,
স্ফুরিল অধরে নিভৃত স্বপনে–
না না না, রবে না গোপনে॥
মধুপ গুঞ্জরিল,
মধুর বেদনায় আলোক-পিয়াসি
অশোক মুঞ্জরিল।
হৃদয়শতদল
করিছে টলমল
অরুণ প্রভাতে করুণ তপনে।
না না না, রবে না গোপনে॥
ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্গুনিয়ে
ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্গুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥
আলোতে কোন্ গগনে মাধবী জাগল বনে,
এল সেই ফুল-জাগানোর খবর নিয়ে।
সারাদিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে।
কেমনে রহি ঘরে, মন যে কেমন করে,
কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে।
কী মায়া দেয় বুলায়ে, দিল সব কাজ ভুলায়ে,
বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥
ঘুমের ঘন গহন হতে যেমন আসে স্বপ্ন
ঘুমের ঘন গহন হতে যেমন আসে স্বপ্ন,
তেমনি উঠে এসো এসো।
শমীশাখার বক্ষ হতে যেমন জ্বলে অগ্নি,
তেমনি তুমি, এসো এসো॥
ঈশানকোণে কালো মেঘের নিষেধ বিদারি
যেমন আসে সহসা বিদ্যুৎ,
তেমনি তুমি চমক হানি এসো হৃদয়তলে–
এসো তুমি, এসো তুমি এসো এসো॥
আঁধার যবে পাঠায় ডাক মৌন ইশারায়,
যেমন আসে কালপুরুষ সন্ধ্যাকাশে
তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো।
সুদূর হিমগিরির শিখরে
মন্ত্র যবে প্রেরণ করে তাপস বৈশাখ,
প্রখর তাপে কঠিন ঘন তুষার গলায়ে
বন্যাধারা যেমন নেমে আসে–
তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো॥
চপল তব নবীন আঁখি দুটি
চপল তব নবীন আঁখি দুটি
সহসা যত বাঁধন হতে আমারে দিল ছুটি॥
হৃদয় মম আকাশে গেল খুলি,
সুদূরবনগন্ধ আসি করিল কোলাকুলি।
ঘাসের ছোঁওয়া নিভৃত তরুছায়ে
চুপিচুপি কী করুণ কথা কহিল সারা গায়ে।
আমের বোল, ঝাউয়ের দোল, ঢেউয়ের লুটোপুটি–
বুকের কাছে সবাই এল জুটি॥
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো ॥
পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে–
ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো ॥
নীল গগনের ললাটখানি চন্দনে আজ মাখা,
বাণীবনের হংসমিথুন মেলেছে আজ পাখা।
পারিজাতের কেশর নিয়ে ধরায়, শশী, ছড়াও কী এ।
ইন্দ্রপুরীর কোন্ রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো ॥
চিত্ত পিপাসিত রে
চিত্ত পিপাসিত রে
গীতাসুধার তরে ॥
তাপিত শুষ্কলতা বর্ষণ যাচে যথা
কাতর অন্তর মোর লুণ্ঠিত ধূলি ‘পরে
গীতসুধার তরে ॥
আজি বসন্তনিশা, আজি অনন্ত তৃষা,
আজি এ জাগ্রত প্রাণ তৃষিত চকোর-সমান
গীতসুধার তরে।
চন্দ্র অতন্দ্র নভে জাগিছে সুপ্ত ভবে
অন্তর বাহির আজি কাঁদে উদাস স্বরে
গীতসুধার তরে ॥
চিনিলে না আমারে কি
চিনিলে না আমারে কি।
দীপহারা কোণে আমি ছিনু অন্যমনে, ফিরে গেলে কারেও না দেখি॥
দ্বারে এসে গেলে ভুলে পরশনে দ্বার যেত খুলে–
মোর ভাগ্যতরী এটুকু বাধায় গেল ঠেকি॥
ঝড়ের রাতে ছিনু প্রহর গণি।
হায়, শুনি নাই, শুনি নাই রথের ধ্বনি তব রথের ধ্বনি।
গুরুগুরু গরজনে কাঁপি বক্ষ ধরিয়াছিনু চাপি,
আকাশে বিদ্যুতবহ্নি অভিশাপ গেল লেখি॥
চৈত্রপবনে মন চিত্তবনে বাণীমঞ্জরী সঞ্চলিতা
চৈত্রপবনে মন চিত্তবনে বাণীমঞ্জরী সঞ্চলিতা
ওগো ললিতা
যদি বিজনে দিন বহে যায় খর তপনে ঝরে পড়ে হায়
অনাদরে হবে ধূলিদলিতা
ওগো ললিতা ॥
তোমার লাগিয়া আছি পথ চাহি– বুঝি বেলা আর নাহি নাহি।
বনছায়াতে তারে দেখা দাও, করুণ হাতে তুলে নিয়ে যাও–
কণ্ঠাহারে করো সঙ্কলিতা
ওগো ললিতা ॥
ছি ছি মরি লাজে মরি লাজে
ছি ছি, মরি লাজে, মরি লাজে–
কে সাজালো মোরে মিছে সাজে। হায়॥
বিধাতার নিষ্ঠুর বিদ্রূপে নিয়ে এল চুপে চুপে
মোরে তোমাদের দুজনের মাঝে॥
আমি নাই, আমি নাই– আদরিণী লহো তব ঠাঁই
যেথা তব আসন বিরাজে। হায়॥
ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে ওরে পাখি
ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে ওরে পাখি,
যা উড়ে যা উড়ে যা রে একাকী॥
বাজবে তোর পায়ে সেই বন্ধ, পাখাতে পাবি আনন্দ,
দিশাহারা মেঘ যে গেল ডাকি॥
নির্মল দুঃখ যে সেই তো মুক্তি নির্মল শূন্যের প্রেমে–
আত্মবিড়ম্বনা দারুণ লজ্জা, নিঃশেষে যাক সে থেমে।
দুরাশায় যে মরাবাঁচায় এত দিন ছিলি তোর খাঁচায়,
ধুলিতলে তারে যাবি রাখি॥
ছুটির বাঁশি বাজল যে ওই নীল গগনে
ছুটির বাঁশি বাজল যে ওই নীল গগনে,
আমি কেন একলা বসে এই বিজনে॥
বাঁধন টুটে উঠবে ফুটে শিউলিগুলি,
তাই তো কুঁড়ি কানন জুড়ি উঠছে দুলি,
শিশির-ধোওয়া হাওয়ার ছোঁওয়া লাগল বনে–
সুর খুঁজে তাই শূন্যে তাকাই আপন-মনে॥
বনের পথে কী মায়াজাল হয় যে বোনা,
সেইখানেতে আলোছায়ার চেনাশোনা।
ঝরে-পড়া মালতী তার গন্ধশ্বাসে
কান্না-আভাস দেয় মেলে ওই ঘাসে ঘাসে,
আকাশ হাসে শুভ্র কাশের আন্দোলনে–
সুর খুঁজে তাই শূন্যে তাকাই আপন-মনে॥