Site icon BnBoi.Com

উড়ালকাব্য – আল মাহমুদ

অনড় অবশিষ্ট

স্বপ্নে, কল্পনায় এবং মধ্যাহ্নের ভাতঘুমে যদি
লিফটের শব্দের মত অকস্মাৎ
তোমার ধারণা এসে দুয়ারে দাঁড়ায়
জানালার পর্দা সবি পদ্মা হয়ে ফুলে ওঠে ঘরে।
মাছের চলার শব্দে ভরে যায় গৃহস্থালী। দেখি
এক নৌকা এসে লগি বাঁধে পড়ার টেবিলে।

তুমি মানে এইসব,
নাও নদী ঘটিবাটি এবং প্রকৃতি

কে আর সেখানে ফেরে? এমনকি স্বপ্নেও পৌছবো না কোনদিন—
কে না জানে, তোমার দুয়ারে।
কি করে বা যাওয়া যায়? অর্ধেক শরীর যার হয়ে গেছে
সঘন সিমেন্ট।

কদাকার ভাস্কর্যের মত বেঁচে থাকা।
এখনও আধেক আছে। সেখানেই বাসা বেঁধে স্বপ্নের পাখিরা
তোমার নামের গানে ভরে দেয় অবশিষ্ট
রক্ত চলাচল।

আমার অন্ধকারে আমি

 

আমার জন্য দৃশ্যের মায়া ফুরিয়ে গেছে।
অন্ধকার তো দেখার বিষয় নয়। অনুভব করার বিষয়। আমি
তাই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে
মোটই ভয় পাই না। কারণ অন্ধকারই আমাকে জানিয়ে দেয়, একদা আমারও দুটি
চোখ ছিল। বর্ণ, গন্ধ, প্রেম আর প্রত্যাখ্যান বুঝতে ইশারাই যথেষ্ট নয় চোখেও চেখে
নিতে হয়।
এখন আমার দৃষ্টি এক রকম নেই বললেও চলে কিন্তু বাতাসে প্রাণ ও প্রকৃতির গন্ধ
আমার মনে শ্লোক সৃষ্টির প্রেরণা দেয়
হৃদপিণ্ডের চারদিকে যেন দৈববাণীর বিদ্যুৎ তরঙ্গ বইছে।
তবুও আমাকে কানা বলে বন্ধুরা এ-ওর
গায়ে ঢলে পড়তে তাদের কী আনন্দ।
ব্যাপারটা এমন যে আমার দুটি চোখই কানা হয়ে গেলে কল্পনার মায়াহরিণী যেন তাদের
বন্দুকে বিদ্ধ হবে।
চোখে লেজার নিয়ে ফিরে আসার সময় ডাক্তার হারুনের আফসোসের কথা তোমার
মনে আছে? আমি আর প্রকৃতি নিচয়ের বর্ণ গন্ধের ভোক্তা হবে না বলে
দৃষ্টিবিশারদ সেই বৃদ্ধ চিকিৎসকের কী আফসোস!
তখন কি জানতাম আমরা দুই বৃদ্ধই সমান অন্ধ? তিনি মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়ে
দিতে দিতে
তার পাশে দাঁড়ানো মৃত্যুর ছায়া টের পাননি।
কি কাজে বিলেত গিয়ে কোমায় পড়লেন। আর ফেরেননি।
আমি তো তোমার চেহারা আর বইয়ের অক্ষর দেখতে পাচ্ছি না বলে আঁতকে উঠি।
অথচ ভবিষ্যৎ দেখার জন্য কে যেন আমার ভেতরের চোখ একটু একটু মেলে দিচ্ছেন।
সেই অন্তরের চোখ জোড়া রণসাজে সজ্জিত এক পৃথিবীকে দেখছে। মানব জাতির
শেষ যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের মহাকাব্যের জন্য কবির চোখ লাগে না। লাগে অন্তর্দৃষ্টি যা
অন্ধ হোমার হাতড়ে হাতড়ে ঠিকমত সাজিয়ে তুলেছিলেন।

ঈগল থাকবে ইতিহাস থাকবে না


ভাবো, ইতিহাসের গতি রুদ্ধ। মানুষের আর কোনো ইতিহাস থাকবে না। ফেরাউন থাকবে কিন্তু মুসা থাকবেন না। পুঁজি থাকবে, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববিচরণশীল লুণ্ঠন থাকবে কিন্তু না বলার মত দেশ থাকবে না। আফগানিস্তান বা ফিলিস্তিন কেউ না। কেবল মহাকালব্যাপী ঈগল খচিত বোমারু বিমানগুলো উড়বে কিন্তু মাটি, পাহাড় বা সাগর থাকবে না। পৃথিবী বা মানচিত্র থাকবে না। ধর্ম থাকতে চান থাকুন কিন্তু কোনো মিনার থেকে আজান হবে না। গীর্জাগুলো তো আগেই নিলামে বিক্রি হয়ে গেছে। এখন না ঘন্টাধ্বনি না আজান। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ থাকলে বোমা হামলাও থাকবে। কারণ ইতিহাসের আর প্রয়োজন নেই। ইতিহাস থাকবে না।
রাজরাজড়াদের দিগ্বিজয়ের কেচ্ছা না হয় থাকলো না, কিন্তু প্রেম? প্রেমেরও কি কোনো ইতিহাস কোথাও কেউ গাথাচ্ছলে গেয়ে উঠবে না? যেমন বন্দীরা প্রার্থনা সংগীত গেয়ে ওঠে প্রতিটি শতাব্দীর অন্তিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে। এত বোমাবর্ষণের মধ্যেও কবিরা কেন শুনতে পায় মুক্তির জন্য আদম সন্তানদের আহাজারি। মানুষের ভালোবাসার গান বিধ্বস্ত পৃথিবীর কন্দরে দূর্বাঘাসের মতো ছোপ ছোপ সবুজের মায়া বিছিয়ে পড়ে থাকবে কিন্তু মানুষের কোনো দয়িতা থাকবে না।


বুশের বোমায় তেলজল একাকার
মধ্য এশিয়া মুক্ত উদরে শোয়া;
খুলে গেছে নাভী, ঐশ্বর্যের দ্বার
আকাশে উড়ছে মৃত বিবেকের ধোঁয়া,–
জ্বলছে কাবুল, লুটালো কান্দাহার।

পুঁজির শত্রু কোথা চীন, কোথা রুশ?
সবার পাছায় থাপ্পড় মারে বুশ।
জাতিসংঘও লেজ নাড়ে যথারীতি
তার কাজ শুধু ছড়ানো বিশ্বভীতি,
মধ্যপ্রাচ্যে হামাসের দুরমুশ।

পারস্য জপে পরম প্রভুর নাম
পাখতুন নামে ভারতের জ্বর আসে
মাজারী শরীফে হত্যার পয়গাম
কাশ্মীর কাঁপে রক্তের উচ্ছ্বাসে।

পাকিস্তানে কি দম্‌ ফেলে ইসলাম? ,


জ্ঞানের বিষাদ এসে দাঁড়িয়েছে হত্যার বিজ্ঞানে
কেবল প্রযুক্তি খোজে শাদামাথা হতার নায়ক
সিদ্ধহস্ত খুনীদের নব্যতর বিশ্বের বিধানে
এক ঠ্যাঙে বসে আছে জাতিসংঘ বিবেকের বক।

এক গুঞ্জরিত কবির আত্মা

দুনিয়াতে কেবল আমারই দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে হয়রান হলাম।
কত ঘাট আর বন্দর পেরুলাম। কত আন্তর্জাতিক উড়াল কেন্দ্রে
ঠেলাঠেলি করে শেষে জেটপ্লেনের উদরে সেঁধুলাম। যেন
অতিকায় উড়ন্ত তিমি আমাকে উগরে দিতে একটা পছন্দমত
রানওয়ে না পেয়ে আছড়ে পড়েছে ঢাকার শেওলাধরা জিয়া
আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে।
আমার কোনো লটবহর নেই কয়েকটা রংচটা কবিতার খাতা
ছাড়া। কোথায় যাব এই ভাবনার চেয়ে এই মুহূর্তে দাঁড়াবার মত একটা
জায়গা দরকার
পায়ের তলায় মাটি চাই। খালি পায়ে যারা এই ভূপৃষ্ঠ মাড়িয়ে গেছেন
তাদের মত ক্ষতবিক্ষত দুখানি পা চাই আমার। কি হবে চকচকে
উডল্যান্ড সুতে! আহা গান্ধীজী তার খটখটে খড়ম জোড়া
কোথায় রেখে গেছেন তা যদি জানতাম?
প্রকৃতপক্ষে দাঁড়াবার কথা বললে, কোথায় থামতে হবে তা আমি
জানি। প্রতিটি জেটিতে ধাক্কা খাওয়া জাহাজের মাস্তুলে বসা
সন্ত্রস্ত গাঙচিল আমি। দরিয়া ও নীলিমার মেশামেশি দেখে
মাঝে মাঝে ডানা ঝাড়া দিই। যাতে ভেজা নুনের বিন্দু
আবার অপরিসীম লবণেই মিশে যায়। আমার ডানার এই
শ্বেতাভ ধূসরতায় স্বাদের কোন সঞ্চয় নেই। আমি জমা করিনি
কিছুই তাই পেছন থেকে আমাকে কেউ ডাকে না। তবে না থামার
ছন্দ তা আমাকে অসীম শূন্যতার মধ্যেও ভেসে থাকার কৌশল
শিখিয়েছে। আমি নিজেই তো কবিতা যা ভবিতব্যের কলমে
রচিত। তাহলে
আমাকে কেন কবি বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া!

দিল্লি এয়ারপোর্টে এখন জেটপ্লেনের পেটে অবতরণের
কম্পনে আমার স্বপ্নের শিহরণ স্তম্ভিত। এতক্ষণ আমি
নিজামুদ্দীনের দরগায় লায়লাতুল কদরের জিকিরে
মশগুল ছিলাম।
তিনি তো সেই দরবেশ যিনি সম্রাটদের মুখের
ওপর মৃদু হাসি মিশিয়ে বলে দিয়েছিলেন, দিল্লি দূর অস্ত।
আমি কিন্তু আউলিয়ার মাজারে দাঁড়িয়েই অতিকায় তর্জনীর
মত কতুবুদ্দীন আইবেকের বিশাল ইশারা
হৃদয়ঙ্গম করছি।
হিন্দুস্তানের মুক্তির ইঙ্গিত। মাথা এমনভাবে সোজা করে
দাঁড়ানো যা মেঘবৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম এবং সবরকম
ঝঞাঋতুর দাপটেও অকম্পিত।
সর্বপ্রকার দাসত্বের বিরুদ্ধে এক দাস সম্রাটের বিদ্রোহ কেবল
মাথা উঁচু রাখার ইঙ্গিত মাত্র।
তিনি দাস ছিলেন বলেই উপমহাদেশের দাসত্বের হীনতার
বিরুদ্ধে এই মেঘস্পর্শী মিনার গড়েছিলেন। যা
আজ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বিরুদ্ধে এক
প্রস্তরীভূত অঙ্গুলি সংকেত।
দাঁড়াবার ঠাঁই খুঁজতে গিয়ে এই কীর্তিস্তম্ভের গায়ে একটু
হেলান দিয়ে বসি
কত কবির আত্মা আমাকে জোনাকির মত ঘিরে আলোর
নকশা বুনছে। একটু পরেই আমি শের শাহসুরী
রোড ধরে পুরানা কিল্লার দিওয়ার পেরিয়ে শাহী
মসজিদে আজান দিতে যাবো।
বেপথুমান চিরচঞ্চল কবির আত্মায় এখন গুঞ্জরিত হোক–
দিল্লি নজদিক।

৯-১২-২০০১

একটি চশমা শুধু উড়িতেছে

ডানা আমি গুটিয়েছি। উড়িতেছে চশমা আমার
কানা চোখে থাকে না সে উড়ে যায় আকাশ ভেদিয়া
মানচিত্র ছেড়ে গিয়ে খোজে তার বিচিত্র আহার
পরদেশী জোড়াকাচে কে দিয়েছে অসম্ভব বিয়া?

কানাচোখে থাকবে না উড়ে যাবে অনন্তের কাছে
মেখের উপর বসে ডিম দিবে, ওম দিবে ডিমে
যাতে ফের বৃষ্টি হয় সৃষ্টি হয় পৃথিবীর গাছে
পুষ্পের সমারোহ; ফলভার অনন্ত অসীমে
ফেটে গিয়ে খুলে দিবে তার সব রহস্যের দ্বার
একটি চশমা শুধু ঘুরিতেছে দেখিতেছে সব
কে কোথায় অন্তর্বাস খুলে বলে ওঠে, আমার আমার
এইসব অন্ধকার এইসব আলোর উৎসব।

নয়নবিহীন হে চশমাখানি ফিরে এসো আমার নয়নে
অশ্রুসিক্ত হয়ে তুমি বসে থাকো অন্ধকার কবির শয়নে।

৩০-০১-২০০৩

কানা মামুদের উড়ালকাব্য

উড়াল শিখেছি আমি বহুকাল। শীতার্ত গোলার্ধ ছেড়ে
বরফের কুচি ঝেড়ে এশিয়ার মানচিত্রে গরম
মৌসুমী বায়ুর বেগে ভেসে গেছি, ফুরোয়নি দম
বঙ্গোপসাগরে এসে ঘূর্ণিঝড়, কালবোশেখী মাঝেমধ্যে
আমাকেও নিয়ে গেছে কেড়ে।

পরাজয় মানিনিকো। কানা এই মামুদের আত্মার উড়াল,
পৃথিবীর মেঘবৃষ্টি, রক্তবৃষ্টি, বোমাবর্ষণের আঁচে
ভেবেছি মানুষ তবে মানুষের রক্ত খেয়ে বাঁচে?
ভয় হয়, ভূমধ্যসাগর কবে আদমের রক্তে
হবে লাল?
মানুষের প্রতিবাদ, দীর্ঘশ্বাস অতলান্তিক পার হবে কবে
বুঝিনি, সন্দেহ ছিল। তবু অকস্মাৎ ভেঙে কি পড়েনি বলো
আলিশান পুঁজির প্রতীক?
মানুষের হাহাকার পরাভব মানবে না, এগোবে সে
চূড়ান্ত আহবে।
এগোবে সে আফগানিস্তানে, ফিলিস্তিনে, কাশ্মীরে
ঘড়ির কাঁটার মত ঠিক।

প্রগতির প্রবক্তারা পালিয়েছে। যেমন গীধর
মরণের ইশারায় গ্রাম ছেড়ে শহরে পালায়;
এখনও সাম্যের বুলি, কথাবার্তা নাক বরাবর।
নিজের নাসিকা কেটে খাবি খায় নিজেরই লালায়।
পালায় পালায় লাল শেয়ালেরা গুটিয়ে বিতণ্ডাবাদী
লেজের জলুস
আছে রে হুক্কাহুয়া, না বোঝে সে ক্যায়সে হুয়া?
আছে পথের কোনো হুঁশ।


কানা মামুদ, কানা মামুদ
কোথায় পেলে ওড়ার বারুদ?
আত্মা তোমার হাউই হয়ে
শূন্যে ওড়ে দিগ্বিজয়ে।
যাচ্ছে মেঘের পুচ্ছ ঘেঁষে
অবলীলায় চাঁদের দেশে।
এমন ওড়ার শেষ কি আছে
নিজের গ্রহেই ভোঁদড় নাচে।

গ্রহান্তরে কী পাবে আর
নিজের ঘরেই ইফেল টাওয়ার।

হায়রে কানা মামুদ কানা
নিজকে নিয়েই পদ্য বানা।
তুইতো বোকা, আদম জাতি
আরম্ভ যার আত্মঘাতি।

কানা মামুদের উড়ালকাব্য-২

এখন আমার রাত্রির ভিতর দিয়ে চলা।

অন্ধকারকে একটি সপ্রাণ জগতের মত মনে হয়। আলোর বিন্দু কোথাও নেই, একদা যখন আলোর জগতে ছিলাম তখন তোমার হাসির যে ছটা আমার রক্তকে মথিত করে তুলতো আঁধারের ভেতরে এসে সেই হাসিকে কল্পনায় ফিরিয়ে আনতে চাই।

কিন্তু হাসি যে কারণে হাসি হয়ে ওঠে সেই শব্দকে তো আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না।

 

আমি জানতাম আলোর পরেই অন্ধকার আছে।

কিন্তু সে অন্ধকারে পৌছুতে জীবনকে অন্য কোথাও রেখে আসতে হয়। আমি এসেছি জীবনের সমস্ত অনুভূতি অবিকল রেখে এই অন্ধকারের জগতে। এখানে কারো মুখ দেখা যায় না। না মানুষ, না প্রাণী, তবে আমি আন্দাজ করতে পারি। কারও মুখ না দেখলেও তার অবয়ব দেখে বুঝতে পারি যে এই আয়তনটা আমার চেনা। তবু বলব আমি চেনা জগতের বাইরে চলে এসেছি।

আগে বাতাসকে নিষ্প্রাণ ইথারের তরঙ্গ বলে ভাবতাম।

এখন কেন যেন মনে হয় আমি তাকে সালাম বললে সে উত্তর দেবে। থামতে বললে শিরশির শব্দ তুলে সে থেমে যাবে।

কোনও কিছুই যেন অনাত্মীয় নয়, বোবা বা বধির নয়।

আমি আগে গাছের সাথে কথা বলতাম সেটা ছিল দৃষ্টির জগত। অভ্যেস এখনো ত্যাগ করিনি। গাছের পাতারা সরসর শব্দ তুলে আমার কথার জবাব দিতে থাকে। আমাকে মানুষের মতই কানা বলে ভালোবেসে ঠাট্টা মশকরা করে, আমি গাছের কথায় আসি। পুকুরের মাছের কলকাকলি ও নিঃশ্বাসের শব্দ শুনি।

তবে সবার কাছে তো যেতে পারি না, কেউ হাত ধরে না নিয়ে গেলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার ভয়।

 

আগে যখন সাহিত্য করতাম, সাহিত্যের আড্ডায় বিতর্ক করতাম তখন অন্তদৃষ্টি বলে একটা কথা খুব উচ্চারিত হত। এখন অন্ধ হয়ে গিয়ে অন্তর্দৃষ্টি শব্দটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। অন্তর্দৃষ্টি যেন হারপুন নিয়ে খেলা। যেন একটি দুর্ধর্ষ মাছকে বল্লম দিয়ে গেঁথে ফেলা।

হায় আল্লা। কানা মানুষেরও একটা জগত আছে। এর সবটুকু না দেখিয়ে আমাকে অন্য কোনও পর্দার অন্তরালে ঠেলে দিও না। আমি অন্ধত্বের জগত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাতড়ে হাতড়ে অতিক্রম করব। আমি হোঁচট খেয়ে আসবাবপত্রের ওপর পড়ে যাবো। হয়তোবা শক্ত ও কাঠিন্য পরখ করতে করতে কোনও এক কালে আমি সেই কোমল শিহরণের কাছে পৌছে যাবো যা কবিকেও অশ্রুজলে পরিবর্তিত করে দেয়। কবি হয়ে যান ভর বর্ষার মেঘ।

 

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পানির ভেতর আছি। অবিশ্বাস্য হলেও এই অনুভূতি আমাকে আনন্দ দেয়। প্রশ্ন জাগে হযরত খিজির কি অকূল তরলের ভেতর দিয়ে জগতের ভবিষ্যৎ অবলোকন করেন?

আমি অবলোকন করি আমার ডানদিক দিয়ে অনুকূল এবং বায়ে প্রতিকূল তরঙ্গ বইছে। আমার চোখ দুটি হয়ে যায় মিষ্টিজলের স্বচ্ছ বড় চাঁদামাছ।

স্বচ্ছ তবু দৃষ্টি চলে। ভবিষ্যৎ দেখতে হলে কে বলেছে যে পরিচ্ছন্ন চোখই দরকার। ঘষা কাঁচের মত রহস্যময় চোখ চেয়েছিলাম আমি। আমার প্রভু আমাকে তা দিয়েছেন। কবি জীবনানন্দ দাশ বেতফলের মত ঘোলাটে দৃষ্টি পছন্দ করতেন কিন্তু রহস্যহীন বেদনা কবির কি কাজে লাগে?

আমি যখন স্বচ্ছ চোখের অধিকারী ছিলাম তখন আমার দুটি চোখকে যুক্তিহীন কৌতূহল ঘিরে রেখেছিল। আমি রোদকে দেখেছি গলিত সোনার মত। অন্ধকারের সাথে তুলনা দিয়েছি উল্টে যাওয়া দোয়াতের। এখন আর তা পারি না। কারণ আমি আলোর দিক থেকে রাত্রির দিকে যাত্রা শুরু করেছি। আলোর তো আয়ু শেষ হয় যেমন আমার চোখের আর আলো নেই কিন্তু রাত্রির কি অবসান আছে?

 

তবু আমি প্রার্থনা করি, আমার ধর্ম যে অন্তহীন জগতের কথা বলে, সেই পরকালে চলার শব্দ আমি শুনতে পাই। সেখানে কি সূর্যোদয় আছে, অস্ত ও অন্ধকার আছে, উষার উদয়ের প্রশান্তি আছে? এ সকল প্রশ্নের জবাব আমি আমার প্রার্থনার মধ্যে একটু একটু উচ্চারণ করি। আর মনে মনে ভাবি সব কিছু আছে। আছে, আছে, আছে…।

আছে শব্দটা আমার রক্ত-মাংসকে এতোটাই অভিভূত করে রেখেছে যে জীবনের সীমা পেরুতে আমি ক্রমাগত নির্ভীক ও নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছি। কে আমাকে পর্দা পেরুনোর ভয় দেখায়! আমি তো জানি আমি সেখানে থাকব।

চোখ ছাড়াও তো আমার দেহ-দুর্গে আরও কয়েকটি ইন্দ্রিয় ছিল। তা একে একে ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অস্ত্রের মতো অকেজো হয়ে পড়েছে। এখন চোখও নেই, শুধু সেজদার জায়গাটুকু আন্দাজ করে লুটিয়ে পড়তে চাচ্ছি। যেখানেই আমার ললাট স্থাপিত হোক না কেন আমি জানি তা আমার প্রভুর ক্ষমার মঞ্জিলে গিয়ে উপচে পড়বে। আমাকে অন্ধ বলে তিনি তো আর এড়িয়ে যেতে পারবেন না।

১৮ সেপ্টেম্বর ২০০২

কানা মামুদের উড়ালকাব্য-৩

তোমার মুখতো কখনো মেঘাছন্ন ছিলো না। দৈব মেঘে
আমার দৃষ্টি হারিয়ে গেলে আমি তোমাকে এক ঝলক বৃষ্টির মত
আমার বুকে অনুভব করেছিলাম।

অন্ধের তো অনুভব শক্তি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। শুনেছি
পৃথিবীতে আঠারো হাজার মাখলুকাতের মধ্যে চক্ষুম্মান প্রাণীর সংখ্যা
খুব বেশি নয়। অনেক জীবন আছে যাদের চোখ নেই। জীবন তো
থেমে থাকে না। তারা না দেখেও বাঁচে। হাতড়ে-হাতড়ে বাঁচে।
ধাক্কা খেতে খেতে বাঁচে। উবুড় হয়ে চিৎ হয়ে জীবনকে অতিক্রম
করে যায়। আয়ুকে নদীর ঢেউয়ের মতো বুকের উপর পেতে চায়।
আমি তোমাকে ঐভাবে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চোখের ওপর
মরা প্রজাপতির ডানার গুঁড়ো এসে ঝাপটা মারলো। এখন
আমি কি করবো? আমি কি তোমার কল্পনা ছেড়ে
হাত গুটিয়ে বসে থাকবো?

আমি যখন চক্ষুষ্মন ছিলাম তখন যেমন মানুষের দুঃখ-কষ্ট
ও প্রতিবাদের সাথে এক হয়ে নিশান উড়িয়ে দিয়েছিলাম। ভেবো
এখনও তেমনি আছি। কেবল চোখ না থাকায় তোমার মতো
লালমুখ নিয়ে বিচরণশীল পুঁজির দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে মিছিলে যেতে পারি না
মাঝে মাঝে ভাবি আমার যদি আরো কয়েকটি চোখ থাকতো তা
তোমার গলায় মালা করিয়ে পরিয়ে দিতাম।

আমি ভূমিকম্পের সঠিক খবর তোমাকে দিতে পারি। আমি
কম্পন যন্ত্রের মতো ভূ-গর্ভে গলিত লাভা স্রোত উগড়ে দেওয়ার খবর
তোমাকে জানাবো বলে ওঁৎ পেতে আছি। আমি ধ্বংসে বিশ্বাস
করি না বলে মানুষের উপর এখনও আশা ছাড়িনি। আশাকে
প্রজ্বলিত করতে জ্ঞানীদের দৃষ্টিশক্তির প্রয়োজন হয় না। আমি
কল্পনায় তোমার ক্রুদ্ধ লাল মুখের ওপর আরো একটি নয়ন বসিয়ে
দেব। তুমি হও পৃথিবীর প্রথম ত্রিনয়না নারী। তোমার বাড়তি
চোখ দিয়ে তুমি মানবকুল বিনাশী পুঁজির অধিপতিদের
আসল চেহারা ভালো করে দেখে নাও। দ্যাখো বিশ্বলুণ্ঠনকারীরা
বিশ্বশাসনে পায়তারা করছে। তারা জানে না তাদের কেয়ামত আসন্ন।
তারা কতদিকে হাত বাড়াবে? পিপড়ের সারির মতো মানুষের সন্তানেরা
পৃথিবীর পৃষ্ঠে উঠে আসার জন্য ঘড়ির কাঁটা গুনছে। আমি অন্ধ না হলে
তাদের মুখ নিশ্চয় দেখতে পেতাম। তুমি একটু কাছে এলে আমি তোমার
মুখের ওপর হাত বাড়িয়ে দেব। দেখব তোমার তিনটি চোখই মর্মভেদী
দৃষ্টি নিয়ে মানবজাতির শেষ লড়াইয়ের দিকে অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে।

চতুর্দশপদী

সময়ের স্রোত বয়। কুঁকড়ে যাওয়া কবির শরীর
ব্যাঙের ত্বকের মত অনুভব করে সেই সময়ের গ্লানি;
পানির মতই লাগে কালস্রোত। বল ওগো নিরভিমানিনী
চিড় ধরা এই দেহে কেন বিদ্ধ হয়, এত বিস্মৃতির তীর?

কেবল ঝরার শব্দ। পাতা ঝরে। শিশিরের শেষ ফোঁটাটুক
মুক্তার বিন্দুর মত ঝুলে আছে কাঁঠালিচাঁপার ফুল থেকে,
শহীদের রক্ত যেন লেগে গেছে খুনির বিবেকে
তেমনি কি টলমল করে অই পুষ্পচোয়া পতনে উন্মুখ—

সময়ের প্রাণরস? প্রকৃতির নিগূঢ় ভেষজে
যৌবন ফেরে না আর। চারপাশে ঝরে যাওয়া সমাপ্তির গান
মর্মবেদনার মত; বালি ওড়ে কীর্তিনাশা নদীর বিরান
পেট থেকে। কাদাখোঁচা পাখি এক কাদাখুঁচে আহার্যের খোঁজে।
নদীর মৃত্যুর পর তার সিক্ত তলপেট ঘেটে
যা পেয়েছি এঁটোকাটা সময়ের জিহ্বা নেয় চেটে।

দিগবিজয়ী খঞ্জরাজা

ঊষার প্রার্থনার উচ্চকিত হাতের আঙুলে শিরশিরানির মত
প্রবেশ করল উদয়কালীন আলোর ঝলকানি। কবিত্ব নয়
বীরত্বই সৃজনরীতির নিয়ামক। ওঠো, আক্রমণ করো
নিশ্চিত জয়ের জন্যে সকালের রোদ্রের মত অশ্বারোহী হও।

একটি ময়দানে অসংখ্য নিষ্প্রাণ মানবদেহের মধ্যে আমার ঘোড়া লাফিয়ে উঠে
জানান দিল আমিই সেই খঞ্জবীর আমীর তৈমুর।
হত্যার তৃপ্তিতে আমার দাড়ি ঘর্মাক্ত। আমার বর্মে
শত্রুদের প্রতিহত তীরের শব্দ। বাহুতে
বীরের সদগতির জন্য মায়ের দোয়াঙ্কিত লোহার বলয়।

ঝাঁক বেঁধে মৃতভোজী শকুনেরা নেমে আসছে পরাজিত লাশের ওপর।
নতুন ব্যুহ রচনা করে বহুদূরে স্থিরপদে দাঁড়িয়ে আছে
আমার অনুগত সৈনিকেরা ইঙ্গিতের অপেক্ষায়। আমার ভায়েরা।

আবার হত্যা হবে। পৃথিবীর ভারসাম্যের জন্যে চাই কিছু প্রাণের উচ্ছেদ।
কবিত্বের কাতরানি আর চোখের পানিতে বাষ্পরুদ্ধ মানচিত্রের ওপর
দ্যাখো গ্রীবা বাঁকিয়ে লাফাচ্ছে তৈমুরের ঘোড়া।
দিগবিজয়ী খঞ্জরাজা আমীর তৈমুর।

কে তোলে সন্ধির প্রস্তাব? কারা করে শান্তির উদ্যোগ?
নিশ্চয়ই সেখানে আছে শেয়ালমুখো বণিক আর গাধার মুখোশ পরা ধূর্ত বাজারীরা।
তারা আরও শতেক বছর তাদের পুঁজির বিচরণ চায়। নির্বিবাদে
মানুষের রক্তের স্বাদ চাখতে শেয়ালের বদনে দ্যাখো হরিণের চোখ
কেমন চকচক করছে।

কেটে ফেল এদের সবগুলো মাথা। কাত্‌লে আম।

আমি খোঁড়া রাজা আমীর তৈমুর।

মানুষের নতুন মানবিক উদ্ভাবনার জন্যে, ছন্দ ও নতুন কবিতার জন্যে চাই
যুদ্ধ। চাই মানবরূপী দানবের উচ্ছেদ।

হত্যা হোক।
মানুষের নতুন সৃজনরীতির জন্য শতবর্ষের নৈশব্দের মধ্যে
কেবল আমি। কেবল একটিমাত্র অশ্বখুরের শব্দ।
শুনতে পাও? অক্ষমতার বিরুদ্ধে একমাত্র ঘোড়সোয়ার কে যায়?
আমি তোমাদেরই খঞ্জবীর আমীর তৈমুর।

নির্বিবেক পৃথিবীর ওপর এ কার পতাকা

আমাদের দেহের ওপর শত্রুর প্রতিটি অস্ত্রাঘাতই তোমার চেনা। কারণ
প্রতিটি আঘাতই সামনের দিকে। বর্তমান জগতের সবগুলো যুদ্ধক্ষেত্রেই তো
আমি ছিলাম। ছিলাম নাকি? ভুরুর ওপরের এই কাটা চিহ্নটি তোমার এমন
পছন্দ, জানো কি একটি গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে।
রক্তাক্ত হয়ে যখন লুটিয়ে পড়েছিলাম কারগিলে। মৃত্যুর
অন্ধকারে বেহুঁশ হয়েও অবচেতনার এলোমেলো স্বপ্নে তোমার কাছেই
ফিরে আসার সাঁতার। ভাবো সেই আকুলিবিকুলি।
এখন আগানিস্তান থেকে সঞ্চিত ক্ষতচিহ্নগুলো কি তোমাকে ভয়
ধরিয়ে দিয়েছে? অথচ
আমার পৃষ্ঠদেশে তুমি সারারাত হাতড়েও একটি কাপুরুষতার ক্ষত বের
করতে পারোনি। এবার চুম্বন কর আমার প্রতিটি আঘাতের চিহ্নে, কারণ
পৃথিবীর প্রতিটি রণক্ষেত্রে আমি ভীরুতা, শান্তি ও আত্মসমর্পণের
বিরুদ্ধে লড়ে এসেছি এবং জেহাদের মহিমা প্রচার করেছি। তোমার
উষ্ণ ওষ্ঠের এক সহস্র চুম্বন আমার প্রাপ্য, দাও
ঋণশোধ করে। কে জানে এবার যদি ফিলিস্তিন থেকে আমার আর
ফেরা না হয়? তুমি তো দেখবে না হেবরণের কোনো ধূলিধূসরিত
কান্তারে পড়ে আছে এক শহীদের রক্তে ভেসে যাওয়া
চেহারা, মুখ থুবড়ে। কিন্তু পিঠে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।
কিংবা আল আকসার আঙিনায় হুমড়ি খেয়ে শিশুর মত পড়ে আছে
এক বিজয়ী বীর যার প্রতিটি ক্ষতস্থান থেকে রক্তের বদলে
বেরিয়ে আসছে যুদ্ধের চিকার। আর জেহাদ জেহাদ শব্দে তার
আকুতি ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীতে।

বলো তুমি আর আমি ছাড়া কে আর পৃথিবীতে যুদ্ধ চায়? অধর্মের
বিরুদ্ধে এই হল মানবতার শেষ জেহাদ। আমরা কি আল্লার জমিনে
জানোয়ারের রাজত্ব কায়েমে বাধা দেব না? আমার বাম পাঁজরে
আফগান যুদ্ধের সহস্র বোমার বিধ্বংসী ক্ষতচিহ্ন। তবে কি আমরা
যুদ্ধ ছেড়ে দেব? না, আমাদের নিঃস্তব্ধতা ও মৃত্যুর ভেতর থেকে
জন্ম নিচ্ছে নতুন কবিতা। যুদ্ধের কবিতা। না প্রেম, না শান্তি।

ভাবো, যুদ্ধ ছাড়া ভালো মানুষের আর বাঁচার উপায় রইল না। তোমার
সিজদার জায়গা কোথায়? তোমার কেবলা কোন দিকে?
কবিরা শিল্পীরা কেন এত ভালোবাসার কথা বলে, কেন বলে?
তারা কি মার্কিন বোমার হাত থেকে তাদের আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য রক্ষা করতে সক্ষম?
ভালোবাসা, তোমার ওপর নাপাম বোমা।
প্রেমপ্রীতি মনুষ্যত্ব তোমাদের ওপর কার্পেট বম্বিং
মসজিদ মাদ্রাসা সবকিছুর ওপর বোমা। বোমা, নারী শিশু মাতৃউদর।
শিল্প-সাহিত্য রুচি-সভ্যতা—দ্রুম, দ্রুম, দ্রুম।

এরপর একটাই দৃশ্য দেখতে বাকি, নিপ্রাণ চাঁদের ওপর
যেমন মার্কিন পতাকা, তেমনি নির্বিবেক পৃথিবীর ওপর
পরাজিত পৃথিবীর ওপর একটি বিশাল
মার্কিন পতাকা।

২০-১১-২০০১

পৃথিবীতে চাষ হবে ফের

পৃথিবী অপেক্ষা করে অলৌকিক ঘটনার জন্য।
গাছ, মাছ, মানুষ, পাখি ও প্রকৃতির ভেতর একটা উষ্ণ অনুভূতি।
প্রাণীমাত্রই ম্যাজিক চায়। সবচেয়ে বেশি ম্যাজিকবিলাসী প্রাণীদের
মধ্যে মানুষের কম্পন আমিও নিজের মধ্যে অনুভব করি। একটি
অপার্থিব ঘটনার পুলক আমার হৃৎপিণ্ডকে এমনভাবে ঘটুক ঘটুক
বলে আছড়াতে থাকে যে আমি সকালের আকাশের দিকে
তাকিয়ে হাঁপাতে থাকি। আর ঠিক সেই সময় দোয়েলের
শিসের অজস্র আওয়াজ আজানের আহ্বানের সাথে মিশে গেলে
পূর্ব দিগন্তের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।

মসজিদ শূন্য করে প্রার্থনাকারীরা যার যার আস্তানায় ফিরে
গেলে আমারও হাঁ-মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
ভাবি কিছুই বুঝি ঘটল না।

না, দিগন্তের সীমানা থেকে সূর্যকে লক্ষ লক্ষ তাগড়া মহিষ
বাঁকা শিংয়ে আমাদের পতাকার মতো আকাশে ঠেলে দিয়ে
ঐ তো আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
লক্ষ মোষের হাম্বা ডাকের মধ্যে অর্থবহ হয়ে উঠেছে যেন
এক ভবিষ্যৎ চাষের চাহিদা। পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।
তেজস্ক্রিয় মাটির পরত অসংখ্য লাঙ্গলের ঘায়ে উপড়ে
ফেলে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের। কিন্তু নেই প্রকৃত রাখাল।
কলকারখানার শব্দ থেমে গেছে। সভ্যতার উগড়ে দেওয়া
বর্জ্য ও উচ্ছিষ্টের ভাগাড় চাপা দিতে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।
জ্যোতির্ময় রৌদ্রের নীচে লক্ষ লক্ষ মহিষের ঘামে ভেজা
তেজস্ক্রিয় মাটির ভিতরে মিসরের মমির বাক্সে রেখে যাওয়া
বীজ এনে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।

পুঁজি ও সাম্রাজ্যের সমস্ত খিলানগুলো বিধ্বস্ত সভ্যতার
মতো লুপ্ত হয়ে মিশেছে সাগরে। যেমন আটলান্টিসের
গালগল্প সাগরের ঢেউয়ের উপরে মাঝে মধ্যে বুদবুদের
মতো ভাসে। তবে কি সমুদ্রেও চাষ হবে?

আমি কবি কালের রাখাল। তরঙ্গে রেখেছি এক পা,
অন্যটি ধেয়ে আসা মহিষের পিঠে। পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।

১১-১২-২০০২

পোষা দোয়েলের শিস

পোষা সে দোয়েল এসে বন্ধ চোখে ঠোঁট ঘষে কয়
ওরে ও মামুদ কানা, চোখ মেলে দেখবে না ভোর?
ললাটে পাখির নাচে অকস্মাৎ কেটে গেলে ঘোর
চেয়ে দেখি লেজঝোলা, স্বপ্ন কিংবা দৈববাণী নয়।
পাখি সেই দুঃসাহসী, কালো চঞ্চ, তীক্ষ্ণ তার শিস
ঊষার প্রার্থনা সেরে পিঠ রেখে নিজের শয্যায়
যখন মুদেছি চোখ অকস্মাৎ হাড়ে ও মজ্জায়
ঢুকেছে পাখির শিস, ডাক নয় আল্লার আশিস।
অন্ধের তো শব্দই সম্বল। অকস্মাৎ পাখিটির ডাক
চোখের পাপড়ি দুটি খুলে দিয়ে কৃপণ আলোর
যতটা শুষতে পারে চেখে নিয়ে দেখে এক অফুরন্ত ভোর
অনন্তে অপেক্ষমাণ, চতুর্দিকে আলোর মৌচাক।
পাখিটি ললাট ছেড়ে বসে গিয়ে লাউয়ের মাচায়
মুক্তপ্রাণে গান গায়। আমি আছি নিজের খাঁচায়।

ফিঙে

আমি যখন অতীতের কথা ভাবি
তখন আমার ঘরটা পাখির গন্ধে ভরে যায়
চারদিকে ওড়াউড়ির শব্দ
একটা ফিঙে পাখির তীক্ষ্ণ যুদ্ধংদেহী আওয়াজ
বাতাসের ঢেউয়ের উপর ওঠে গিয়ে
পৃথিবীর সমস্ত চিল ও শকুনকে হতচকিত করে ফেলে।

তারা বাতাসে ঝাঁপ দেয় দিগ্বিদিক দিশেহারার মতো
বায়ুর উপর ভাসতে ভাসতে আবার অশ্বথের ডালে
যার যার নিজের আশ্রয়ে ফিরে আসে আর ঝিমোতে ঝিমোতে ভাবে
ওই ফিঙেটা তার তীক্ষ্ণ চঞ্চুতে তাদের মাথা কামড়ে দিতে আসছে।

অথচ ওই খুদে পাখিটার কালো পালকের ওপর বিদ্যুতের অক্ষরে লেখা ‘দিগ্বিজয়ী’

এই দ্বীপদেশে যখন সব নখঅলা পাখির একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম হওয়ার কথা
তখন একটি মাত্র ক্যাচকাওয়ার কেন এই দুরন্ত গতি? এই দুঃসাহস?
এই মারমুখী ওড়ার কৌশল?

পাখিটির জন্মবৃত্তান্তে না আছে কোনও আভিজাত্য না আছে পালকের বাহার
তার চঞ্চ অতিশয় ক্ষুদ্র এবং আঘাতে কিরিচের তীক্ষ্ণতা
যেন সে গগনভেরী ঈগলের চিরস্থায়ী রাজত্বের বিরুদ্ধে একটি কালো উড়ন্ত প্রতিবাদ।
তার চলনে বলনে ওড়ার কায়দায় তীক্ষ্ণচোখ চিলেরাও বিহ্বল হয়ে পড়ে।
এই পাখিটির উচ্ছেদ নিয়ে পক্ষীমহলে মাঝে মাঝে সাড়া পড়ে যায়।
কিন্তু মানুষেরা বলে ফিঙে হলো অত্যাচারের বিরুদ্ধে——জুলুম, খুনের বিরুদ্ধে
ডিম ও শাবক অপহরণের বিরুদ্ধে একটি সম্বৎসর যুদ্ধের প্রতীকী উড়াল মাত্র।

সে কালো কিন্তু কোকিল নয়, সে কালো কিন্তু কাক নয়
সে বরং কাকের দঙ্গলকে ভিক্ষুকের দল মনে করে।

সে একা উড়ে, একাকী আঁচড়ে কামড়ে পালক ধসিয়ে দেয়
চিলের, শকুনের, বাজের।

বন্ধ দেরাজ খুলে

আজকাল কিভাবে যেন মাঝরাতে ঘুম ছুটে যায়। নিঃশব্দে শূন্য বিছানায়
বসে সিগ্রেট টানি। অবলীলায় তোমার চলে যাওয়ার দৃশ্যগুলো মনে পড়তে
থাকে। ভয় লাগে, মৃত্যুকে তোমার মত আকস্মিকভাবে অতিক্রমের সাহস
কই আমার?
তবে মৃত্যু যে আকস্মিক শূন্যতার ভেতরও গর্ত সৃষ্টি করে তা আমি
প্রতিদিন মর্মে মর্মে, একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি। তোমার যাওয়ার
বছরখানেক পর একটি বন্ধ দেরাজ তালাশ করতে গিয়ে তোমার খোঁপা
সাজাবার আইভরির চিরুনিটি হাতে পেয়ে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকি।
কাঁটাগুলোর ফাঁকে একগুচ্ছ চুল এখনও লেগে আছে দেখে সাবধানে তুলে
মুঠোবন্ধ করে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ি।

প্রথমে বিস্ময় ও নৈশব্দ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি।
বার বার মুঠো খুলি আর বন্ধ করি। অকস্মাৎ মনে হল তোমার ঠাণ্ডা, ছিন্ন
কেশগুচ্ছ স্মৃতির সুতো হয়ে আমার শরীরের ভেতরে আক্ষেপের জাল বুনে
চলেছে। আমি আমার অবসন্ন হাতের তালু বাতাসে উন্মুক্ত করে দিতেই
তোমার পরিত্যক্ত অলকগুচ্ছ ফ্যানের এলোমেলো হাওয়ায় সাঁতার কেটে
চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল। ধুলো ঘূর্ণি যেমন শেষপর্যন্ত পাক খেয়ে ধরণীতেই
মিশে যায় তোমার স্মৃতিও এর বেশি কিছু নয়।

এখন আর তোমার পরিত্যক্ত বাক্সোপেটরা ঘাঁটাঘাঁটি করি না।
কেবল তোমার শূন্য বালিশের ফুলতোলা নকশার ওপর তোয়ালে চাপা
দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় একাকী বসে
সিগ্রেট টানি।
মনে হয় জানালার ফাঁক দিয়ে নামা জ্যোছনা, পোড়া নিকোটিনের সাথে
গোলাপের গন্ধ তালগোল পাকিয়ে একটা অবস্থার সৃষ্টি করেছে
যা কাব্যসৃষ্টি বা ন্দ্রিার সহায়ক নয়।
আমি কবিতা বা প্রেমের ভিখিরি নই। পুনর্বার কারো সাক্ষাপ্রার্থীও নই,
সব ফিরিয়ে দিলেই কি সব নেওয়া যায়? তুমি কি নেবে? তাহলে আমাকে
কেন ঘুমুতে দেবে না।

মাৎস্যন্যায়

এটা হলো বোয়াল মাছের দেশ।
কালি বোয়াল, ধলি বোয়াল, সোনা বোয়াল ও সাদা বোয়ালের অব্যাহত বিচরণভূমি।
খাল-বিল, ডোবা-নালা ও হাওড়ে একচ্ছত্র বোয়ালেরই রাজত্ব।
আমরা বোয়ালরা আমাদের চেয়ে নরম চোয়ালের
মাছেদের আইনসঙ্গতভাবে খেয়ে বাঁচি।
আমাদের চেয়ে একটু গায়ে গতরে ছোট মাছদের
মোটামুটি গিলে ফেলি।

আমরা যাদের গিলি, তারা আবার তাদের চেয়ে নরম চোয়ালের
কৈ, মাগুর, ভেটকি, খৈলশা কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না।
এ হলো নদীগুলোর আদি গিলে খাওয়ার নিয়ম।

পদ্মা, যমুনা, মেঘনার শিরা-উপশিরার পানি
যতই মিষ্টি হোক গিলে খাওয়ার নিয়ম চলছেই।
আমরা ঐ আদি বাঙালীর মহারাজাধিরাজ
গোপালের আগের একশ’ বছরের কাহিনী থেকে এসব পেয়েছি।
গোপাল থেকে মহীপাল পর্যন্ত মানুষের রাজত্ব।
তারপরে আবার বোয়াল।

আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান আছে। আমরা একে বলি বোয়ালসংহিতা।
অপেক্ষাকৃত ছোটদের নির্দ্বিধায় খেয়ে বাঁচো।
আমাদের সংহিতা বলে, শকুন্তলার আংটিচোর
বাইচ্যান্স ধরা পড়ে গেলে তার নির্ঘাত দণ্ড হলো ছয় মাস।
ঘানি টানতে হবে–তার নাম হবে তস্কর।
আর যদি কোন রাঘব বোয়াল এসে পুরো বাংলাদেশটাকেই
আংটির মত গিলে ফেলে তবে তাকে বলতে হবে—
মহারাজাধিরাজ। সেলাম কর তাকে—এরই নাম বোয়ালসংহিতা।

তবে রাঘব বোয়ালরা নানা রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে পড়ে
ভাটির দিকে আসতে পারে না।
তারা গঙ্গা ভাগিরথিতে হা করে ঘুরে বেড়ায়।
তারা আমাদের মিষ্টি জলে সৃষ্টি ছাড়া দৌড় করার জন্য
লালা ঝরিয়ে গঙ্গা ভাগিরথিকে পর্যন্ত বিষাক্ত করে ফেলেছে।

শক্ত চোয়ালওয়ালা রাঘবরা চায়
পদ্মা-যমুনার ভিতর দিয়ে হিমালয় পর্যন্ত একটা নিশ্চিত ট্রানজিট।
কিন্তু আমরা কালা-ধলা, সাদা ও সোনালীদের
হজম না করে তা কি করে সম্ভব?
আমরা যদিও গোপালের আগের একশ’ বছরকে
নিজেদের নদী-নালায়, হাওড়ে-বিলে ফিরিয়ে আনার
চেষ্টায় রাতে ঘুমাই না।
কিন্তু রাঘব বোয়ালদের শক্ত চোয়াল ছিদ্র করার মতো কাঁটাওয়ালা মাছের ঝাঁক
আমরা যে আগেই খেয়ে বসে আছি।

১২-১২-২০০২

শূন্য থেকে সাম্যে

সবাই মাটি, পাথর, বরফ অতিক্রম করে শূন্যতায় গিয়ে পৌঁছে।
কিন্তু আমি শূন্যতা অতিক্রম করে এখানে এসে পৌঁছেছি।
এই তো আমার পায়ের নীচে মাটি। হাত বাড়ালেই তোমার
রক্ত মাংসের ধুকপুকানি, নিঃশ্বাসের গরম বাতাস
অনুভব করি। আমি স্নেহ, মায়া মমতার ওপর আমার
হাত বিছিয়ে দিতে পারি। আমি শূন্যতা থেকে এসেছি
বলে আমার একটা পাওয়ার ইচ্ছা হাতল ধরার
স্বপ্নের মত আমার সামনে দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে
চলে যায়। আমি প্রতিটি পালক পড়ার শব্দের
মধ্যে ডানাওয়ালা হাসের দ্রুতগতি অনুভব করি।
আমি শূন্যতা থেকে এসেছি বলে আমার মধ্যে
এক ধরনের আছে, আছে সংগীত গুঞ্জরিত হয়।
এস্রাজটি কোথায় বাজছে তা অবশ্য আমি
বলতে পারব না। তবে সেই রেওয়াজ শোনার
টিকেট আমি জন্ম থেকেই নিজের পোশাক
হাতড়ে পেয়ে গেছি।

আমি শূন্যতা থেকে এসেছি বলেই সমস্ত
স্পর্শযোগ্য বিষয় আমার কাছে স্বাদ ও গন্ধযুক্ত
খাদ্যের মত মনে হয়। যেন এই মুহূর্তে বেইজিং-এর কোন
রেস্তোরা থেকে হাজার বছর আগে অবলুপ্ত ধোঁয়া ওড়া নীল
‘লবস্টার’ রাঙা করে আমার পাতে তুলে
দিয়েছে মৎস্যকুমারীর মত সুন্দরী এক চীনা বালিকা।
তার মুখে এখনও লেগে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই লং মার্চের
আদব, ‘তা-তাও জিপান জেন’।
জাপানী এনিমিরা নিপাত যাক।

আমি শূন্য থেকে এসেছি বলেই রক পাখির ডিমের মত
ঐশ্বর্যভরা পৃথিবীকে বুকের ভেতর অনুভব করি।
কি উষ্ণ, কি সমুদ্রের তৃপ্তিতে ভরা,
কি হীরকের দ্যুতিতে সমুজ্জ্বল বরফের প্রান্তর।
এই তো পৃথিবী। এই তো আমার আত্মা আমার
আছে, আছে অনিঃশেষ শব্দের দোলনা।

কে এর উপর প্রভুত্ব করবে। সাম্য, মৈত্রী ও ভালবাসা
ছাড়া? ভ্রাতৃত্বের বন্টন ছাড়া?

সহস্রাক্ষ

আমি নিশ্চিতই অপেক্ষমাণ মানুষ। নদী এসে
ছুঁয়ে গেছে। আমার দেহ ঠুকরে অতিক্রম করে
গেল মাছের ঝাঁক। কিন্তু আমি তো কোনো
স্রোতের বা তরঙ্গের জন্য বসে থাকিনি। ঋতুর
পর ঋতু আমার ত্বকে স্পর্শ বুলিয়ে ফিরে গেছে,
দ্যাখো আমি নড়িনি। তবে আমি কার জন্য
বসে থাকি।

একদিন ব্যাকুল হয়ে এক নারী এসে হাত
ধরল। আমি তার আকুলতায় কম্পিত হলেও
চিনতে ভুল হল না তিনি আমার পরিচর্যাকারিণী
স্ত্রী ছিলেন। আমার স্থবিরতা তাকেও বিমুখ
করল। তার শাড়ির আঁচল ধরে অতিক্রম করে
গেল সন্ততিরা আমি অনড়। অটল আমার
প্রতীক্ষা।

পৃথিবীর কত উত্থান-পতন, মানবিক বুদ্ধির
মহাকাশশী সাফল্য, অন্যদিকে পৃথিবীর
দুঃখ-দারিদ্র ঝড়ঝঞা কোনো কিছুই
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কবির অপেক্ষাকে বিচলিত করতে
পারে না। আমি আরও দেখবো, আরো আরো
অফুরান দৃশ্যাবলীর চলচ্চিত্র। কিংবা সমস্ত
প্রত্যক্ষতার বিলয়।

দেখবো বলছি, কিন্তু আমি কি জানতাম চোখ
আর কাজ করে না। আতশকাঁচ ধরেও
প্রজাপতির ডানায় আঁকা অর্থবহ অক্ষর আমি
আর পড়তে পারব না? এখনও কি আমার
দেখার শেষ হবে না? নয়ন নিষ্প্রভ হলে বুকের
ওপর হাত রেখে দেখি হৃদয়ের কাছে হাজার
চোখের পাপড়ি কে যেন মেলে দিয়েছে।
অশ্রুজলে ভেজা।

০৪-০১-২০০২

স্করপিয়ন

বাগদাদের এই মরু বিছেটিকে নিয়ে এখন যত দুশ্চিন্তা।
ঘুম নেই কারো। কত টন বোমায় বিছের বংশ ধ্বংস
হয় তা সমরবিশারদরা হিসেব করে দেখছেন। বিছেটি পাছার
হুল তুলে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে। তার
সর্বাঙ্গের বিষ, মাথায় গোবর এবং কথাবার্তা
মহামতি লেনিনের মৃত্যুর আগে সর্বশেষ ভাষণের মত।
কে জানে কে বেশী বিপ্লবী? বাগদাদের স্করপিয়ন
না ভ্লাদিমির ইলিচ?

পৃথিবী এখন ঘড়িওয়ালা এবং দাড়িওয়ালা মানুষের ভয়ে
আফগান মেয়েদের মত সিঁটিয়ে আছে। সে তার
নিজের কক্ষপথ ছেড়ে অন্য কোন গ্রহের সাথে সংঘর্ষ
বাধিয়ে একটা কেয়ামতের আয়োজন করবে কি না
আল্লাহ্ মালুম।

আমরা পৃথিবীর কবিরা ঘড়িওয়ালা মানুষদের সময়ের
স্রোত গণনার এই বিশেষ নাজুক অবস্থা দেখে
উট পাখির মত বালিতে মুখ গুঁজে এবং কানে
আঙ্গুল দিয়ে অপেক্ষা করছি। আমাদের অপেক্ষা
মূলত আরম্ভটা দেখার জন্য।

সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয়েছে।

সমস্ত দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব এখন উল্টোদিকে বইছে।
ডায়লেকটিক যদি মানুষের ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও যৌনতার
কোন সুরাহা না করতে পারে তাহলে পৃথিবীতে
আরেকটি নতুন দার্শনিক তত্ত্ব ঘোড়ার ডিমের মত
আমাদের সামনে গড়িয়ে আসবে না কি?

আমরা কোনো ঘড়িকেই কালস্রোত গণনার
উপযোগী মনে করতে পারছি না। আমরা
কবিরা টিকটিক শব্দে ঘুমুতে অভ্যস্ত নই।
কারণ যে কোনো টিকটিক শব্দ দেয়ালে টিকটিকির
ঠিকঠিক ডাকের মত সমর্থন ধন্য হয়ে উঠতে পারে।
আমরা ধ্বংসের, মৃত্যুর, নৈঃশব্দের এবং শহরগুলোর
কংকাল নিয়ে কাব্য রচনা করতে চাই না।
কিন্তু কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক বোমার
ভয়ে বোরখা ছেড়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা আফগান
কিশোরীর মত পৃথিবী এখন কবিতার তৃষ্ণায় কাতর।

২৯-১১-০২

স্টিল লাইফ

আমার সংসার ছিল গেরুবাজ কপোতের বাসা
যখন আঁচল টেনে অকস্মাৎ সেঁধুলে হেঁশেলে,
যেন এক চতুর্দশী কৈশোরের স্বপ্ন ঠেলে ফেলে
অনভ্যস্ত শাড়ি পরে, বুকভরা কল্পনার ভাষা

এসেছে কবির ঘরে। ভেঙেচুরে ছন্দের নিয়ম।
কিংবা নিজেই যেন অন্যতর মিলের নিগম
নরম বুকের নিচে উথলায় আশা ও নিরাশা
একদিকে বিজুলীর ছটা।
অন্যদিকে মৃত্যুর রিদম।

৪-১২-২০০১

Exit mobile version