Site icon BnBoi.Com

রাজা যায় রাজা আসে – আবুল হাসান

রাজা যায় রাজা আসে

রাজা যায় রাজা আসে (কাব্যগ্রন্থ) – আবুল হাসান

উৎসর্গ
আমার মা
আমার মাতৃভূমির মতোই অসহায়

প্রথম প্রকাশ – ডিসেম্বর ১৯৭২
*

আবুল হাসান

সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,
মায়াবী করুণ
এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?
এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ?
মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর
কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর?

আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে,
যারা খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে, যারা এঘরে ওঘরে যায়
সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী
তারা কেউ কেউ বলেছে আমাকে—
এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ন রূপান্তর,
একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা,
তুই যার অনিচ্ছুক দাস!

হয়তো যুদ্ধের নাম, জ্যোৎস্নায় দুরন্ত চাঁদে ছুঁয়ে যাওয়া,
নীল দীর্ঘশ্বাস কোনো মানুষের!
সত্যিই কি মানুষের?

তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কোনোদিন
ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙ্গুল?
ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল?
*

বনভূমির ছায়া

কথা ছিল তিনদিন বাদেই আমরা পিকনিকে যাবো,
বনভূমির ভিতরে আরো গভীর নির্জন বনে আগুন ধরাবো,
আমাদের সব শীত ঢেকে দেবে সূর্যাস্তের বড় শাল গজারী পাতায়।

আমাদের দলের ভিতরে যে দুইজন কবি
তারা ফিরে এসে অরণ্য স্তুতি লিখবে পত্রিকায়
কথা ছিল গল্পলেখক অরণ্য যুবতী নিয়ে গল্প লিখবে নতুন আঙ্গিকে!

আর যিনি সিনেমা বানাবেন, কথা ছিল।
তার প্রথম থীমটি হবে আমাদের পিকনিকপ্রসূত।

তাই সবাই আগে থেকেই ঠিকঠাক, সবাই প্রস্তুত,
যাবার দিনে কারো ঘাড়ে ঝুললো ফ্লাস্কের বোতল
ডেটল ও শাদা তুলো, কারো ঘাড়ে টারপুলিনের টেন্ট, খাদ্যদ্রব্য,
একজনের সখ জাগলো পাখির সঙ্গীত তিনি টেপরেকর্ডারে তুলে আনবেন

বনে বনে ঘুরে ঠিক সন্ধ্যেবেলাটিতে
তিনি তুলবেন পাতার মর্মর জোড়া পাখির সঙ্গীত!
তাই টেপরেকর্ডার নিলেন তিনি।

একজন মহিলাও চললেন আমাদের সঙ্গে
তিনি নিলেন তাঁর সাথে তাঁর টাটকা চিবুক, তার চোখের সুষমা আর
উষ্ণ শরীর!
আমাদের বাস চলতে লাগলো ক্রমাগত
হঠাৎ এক জায়গায় এসে কী ভেবে যেনো
আমি ড্রাইভারকে বোললুম : রোক্কো–

শহরের কাছের শহর
নতুন নির্মিত একটি সাঁকোর সামনে দেখলুম তীরতীর কোরছে জল,
আমাদের সবার মুখ সেখানে প্রতিফলিত হলো,
হঠাৎ জলের নীচে পরস্পর আমরা দেখলুম
আমাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষ।

আমরা হঠাৎ কী রকম অসহায় আর একা হয়ে গেলাম!
আমাদের আর পিকনিকে যাওয়া হলো না,
লোকালয়ের কয়েকটি মানুষ আমরা
কেউই আর আমাদের এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব, অসহায়বোধ
আর মৃত্যুবোধ নিয়ে বনভূমির কাছে যেতে সাহস পেলাম না!
*

স্বীকৃতি চাই

আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই
স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে,
মৃত্যুমাখা মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছি একলা মানুষ,
বেঁচে থাকার স্বীকৃতি চাই,
স্বীকৃত দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে!

ঐ যে কাদের শ্যামলা মেয়ে মৌন হাতের মর্মব্যথায়
দাঁড়িয়ে আছে দোরের গোড়ায়
অই মেয়েটির স্বীকৃতি চাই,
স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে।

সস্তা স্মৃতির বিষণ্ণতার
নাভিমূলের অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি চাই
স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে

আমি আমার আলো হবার স্বীকৃতি চাই
স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে

অন্ধকারের স্বীকৃতি চাই
স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বকৃতি দে।
*

পাখি হয়ে যায় প্রাণ

অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!

জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন।

ফাতিমা ফুফুর প্রভাতকালীন কোরানের
মর্মায়িত গানের স্মরণে তাইকেন যেনো আমি

চলে যাই আজো সেই বর্নির বাওড়ের বৈকালিক ভ্রমণের পথে,
যেখানে নদীর ভরা কান্না শোনা যেত মাঝে মাঝে
জনপদবালাদের স্ফুরিত সিনানের অন্তর্লীন শব্দে মেদুর!

মনে পড়ে সরজু দিদির কপালের লক্ষী চাঁদ তারা
নরম যুঁইয়ের গন্ধ মেলার মতো চোখের মাথুর ভাষা আর
হরিকীর্তনের নদীভূত বোল!
বড় ভাই আসতেন মাঝরাতে মহাকুমা শহরের যাত্রা গান শুনে,
সাইকেল বেজে উঠতো ফেলে আসা শব্দে যখোন,
নিদ্রার নেশায় উবু হয়ে শুনতাম, যেনো শব্দে কান পেতে রেখে;
কেউ বলে যাচ্ছে যেনো,
বাবলু তোমার নীল চোখের ভিতর এক সামুদ্রিক ঝড় কেন?
পিঠে অই সারসের মতো কী বেঁধে রেখেছো?

আসতেন পাখি শিকারের সূক্ষ্ম চোখ নিয়ে দুলাভাই!
ছোটবোন ঘরে বসে কেন যেনো তখন কেমন
পানের পাতার মতো নমনীয় হতো ক্রমে ক্রমে!

আর অন্ধ লোকটাও সন্ধ্যায়, পাখিহীন দৃশ্য চোখে ভরে!
দীঘিতে ভাসতো ঘনমেঘ, জল নিতে এসে
মেঘ হয়ে যেতো লীলা বৌদি সেই গোধূলি বেলায়,
পাতা ঝরবার মতো শব্দ হতো জলে ভাবতুম
এমন দিনে কি ওরে বলা যায়-?

স্মরণপ্রদেশ থেকে এক একটি নিবাস উঠে গেছে
সরজু দিদিরা ঐ বাংলায়, বড়ভাই নিরুদ্দিষ্ট,
সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি সাথে কোরে নিয়ে গেছে গাঁয়ের হালট!

একে একে নদীর ধারার মতো তারা বহুদূরে গত!
বদলপ্রয়াসী এই জীবনের জোয়ারে কেবল অন্তঃশীল একটি দ্বীপের মতো

সবার গোচরহীন আছি অজো সুদূর সন্ধানী!
দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেরই অচেনা নিজে
কেবল দিব্যতাদুষ্ট শোণিতের ভারা ভারা স্বপ্ন বোঝাই মাঠে দেখি,
সেখানেও বসে আছে বৃক্ষের মতোন একা একজন লোক,
যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত গাইছে কেবলি
শতজীবনের শত কুহেলী ও কুয়াশার গান!

পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলী মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত।
*

চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ

আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে সরকারী লোক, পুলিশ বিভাগে চাকরী কোরেও
পুলিশী মেজাজ কেন ছিলনা ওনার বলুন চলায় ও বলায়?
চেয়ার থেকে ঘরোয়া ধুলো, হারিকেনের চিমনীগুলো মুছে ফেলার মতোন তিনি
আস্তে কেন চাকর বাকর এই আমাদের প্রভু নফর সম্পর্কটা সরিয়ে দিতেন?
থানার যত পেশাধারী, পুলিশ সেপাই অধীনস্থ কনেস্টবল
সবার তিনি একবয়সী এমনভাবে তাস দাবাতেন সারা বিকেল।

মায়ের সঙ্গে ব্যবহারটা ছিল যেমন ব্যর্থ প্রেমিক
কৃপ ভিক্ষা নিতে এসেছে নারীর কাছে!

আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে দেশে যখন তাঁর ভাইয়েরা জমিজমার হিশেব কষছে লাভ অলাভের
ব্যক্তিগত স্বার্থ সবার আদায় কোরে নিচ্ছে সবাই
বাবা তখন উপার্জিত সবুজ ছিপের সুতো পেঁচিয়ে মাকে বোলছেন এ্যাই দ্যাখোতো
জলের রং-এর সাথে এবার এই সুতোটা খাপ খাবে না?

কোথায় কাদের ঐতিহাসিক পুকুর বাড়ি, পুরনো সিঁড়ি
অনেক মাইল হেঁটে যেতেন মাছ ধরতে!

আমি যখন মায়ের মুখে লজ্জাব্রীড়া, ঘুমের ক্রীড়া
ইত্যাদিতে মিশেছিলুম, বাবা তখন কাব্যি কোরতে কম করেননি মাকে নিয়ে
শুনেছি শাদা চামেলী নাকি চাপা এনে পরিয়ে দিতেন রাত্রিবেলা মায়ের খোঁপায়!

মা বোলতেন বাবাকে তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখোনা?
ঘুস খাচ্ছে, জমি কিনছে, শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,
কত রকম ফন্দি আটছে কত রকম সুখে থাকছে,
তুমি এসব লোক দ্যাখোনা?

বাবা তখোন হাতের বোনা চাদর গায়ে বেরিয়ে কোথায়
কবি গানের আসরে যেতেন মাঝরাত্তিরে
লোকের ভীড়ে সামান্য লোক, শিশিরগুলি চোখে মাখাতেন!

এখন তিনি পরাজিত, কেউ দ্যাখেনা একলা মানুষ
চিলেকোঠার মতোন তিনি আকাশ দ্যাখেন, বাতাস দ্যাখেন
জীর্ণ ব্যর্থ চিবুক বিষণ্ণ লাল রক্তে ভাবুক রোদন আসে,
হঠাৎ বাবা কিসের ত্রাসে দুচোখ ভাসান তিনিই জানেন!

একটি ছেলে ঘুরে বেড়ায় কবির মতো কুখ্যাত সব পাড়ায় পাড়ায়
আর ছেলেরা সবাই যে যার স্বার্থ নিয়ে সরে দাঁড়ায়
বাবা একলা শিরঃদাঁড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন, কী যে ভাবেন,
প্রায়ই তিনি রাত্রি জাগেন, বসে থাকেন চেয়ার নিয়ে

চামেলী হাতে ব্যর্থ মানুষ, নিম্নমানের মানুষ!
*

ঐ লোকটা কে

ফটোগ্রাফের বদৌলতে আজ পুরনো একটি
দৈনিক পত্রিকায় তোমাকে দেখলাম,

বুড়ো সুড়ো গাছের নীচে
বসে বসে ভিটাকোলা খাচ্ছো,

দু’একটি বিদেশী পত্রিকা
পড়ে আছে তোমার টেবিলে
পড়ে আছে সিগ্রেটের বাকস,
একটি নীল বল পয়েন্টের কলম

কিন্তু ঐ লোকটা কে?

বদমাশ নাকের উপর চশমা
হো হো হাসছে,
প্রেমিকের মতো ব্যবহার কোরছে?
ফটোগ্রাফের বদৌলতে
বহুদিন পর তোমাকে দেখলাম এ্যালবামে,

কিন্তু ঐ লোকটা কে?

হো হো হাসছে
বদমাশ নাকের উপর চশমা?
প্রেমিকের মতো ব্যবহার কোরছে

স্টুপিড ঐ লোকটা কে? ঐ লোকটা কে?
*

শিল্পসহবাস

এই কবিতা তোমার মতো সহজ থাকুক সুশিক্ষিতা,
এর গায়ে থাক রাত্রি জাগার একটু না হয় ক্লান্তি হলুদ,

জিভ দিয়ে জিভ ছোঁয়া চুমোর গন্ধ থাকুক এই কবিতায়।

সাদাসিদে যেনো বা কোনো গিন্নি মেয়ে
করম সকম তালবাহানার ধার ধারেনা এই কবিতা!
কেবল ঘরের রঙ্গীন ধূলি মাখায় কালি সারাটি গায়ে
উল্টোপাল্টা শব্দ ও-রং যার কোনোই মানে হয়না,
তবুও তাকে ভালো লাগে, তবুও তাকে মিষ্টি দেখায়!

এই কবিতা তোমার মতো সমালোচকের ভুলশোষকের
শাসনত্ৰাশন ভেঙে ফেলে, মুখের উপর থুথুড়ি দেয়;

ইচ্ছে হলেই শিল্প দেখায় রক্ত মাখায় এই কবিতা!
*

সবিতাব্রত

হৃদয় একটাই, কিন্তু সবদিকে ওর গতায়াত,
বড় গতিপ্রিয় হয় এই বস্তু, বড় স্পর্শকাতর!
ওকে আর আগুনে নিওনা, জ্বলে যাবে, দুঃসময় দেখিওনা
ভিক্ষুকের মতো দ্বারে ভিখ মেগে খাবে।
ও বড় পক্ষপাতী, জীবনের দিকে ওর পক্ষপাত চিরদিন
মানুষের মনীষার, মঞ্জুষার, মুগ্ধতার মহিমার
মৌনতাবাহক, ওতো সকলেরই সহ অবস্থান দিতে
সমূহ ইচ্ছুক, ওতে চায় শান্তি শুধু শান্তি, শান্তি।
সমাজের শিরা উপশিরাময় ওতো ঘুরে ঘুরে খুঁজেছে তোমাকে!

ওকে আর আগুনে নিওনা জ্বলে যাবে, দুঃসময় দেখিওনা
দেখাও মানুষ, ওকে নিয়ে যাও মানুষের কাছে
ওকে নিয়ে যাও সুসময়ে সবিতাকে আলোয় ফেরাও!
*

প্রতিনির্জনের আলাপ

সূর্যাস্তের মতো যেদিকে থেকে এসে আমি ডুবছি তুমি সেদিকে কখনো এসোনা
রয়েছে ভয় আগেই ডুববার;
পথের চিহ্নরা সামনে এসে ডাকেনা কখনো তাই তুমি পথের কালোয় ঘেসোনা
থাকেনা কেউ কুশল শুধাবার!
অনেক হাত থাকে যারা অন্ধকার থেকেই পরম আলো কুড়ায়, আলোও কেমন
যায় মিশে বুকের পাশে সহজে,
আবার কারো বা হাতের ভাঁজে অন্ধকার ছিন্ন পাখার মতো বাজে ঠিক যেমন
স্রোতের তোড়ে জলে ফেনা গরজে!
তুমি অই আলোয় ভরা হাতের খেয়ার মতো হলে হও পরম ঊষার অভিসার
ভরাও শূন্যঘাট নৌকায়;
না হলে না হয় সে নিষ্প্রদীপ দুঃখের কালোয় হয়ে একা নক্ষত্রের পরিবার
ভাসাও তরী আঁধার সন্ধ্যায়!
জলের নিগূঢ় গান বাতাসে ভাসছে ভাবি কাছেই কোথাও এখনই এক হরিণী
দেখছে মুখ সারঙ্গের ভীড়ে
ও পবিত্র জলের অনুরোধে আমাকে যদি পারো হে অবলীলা হে শুভ হরিণী

মিলাও অরুণোদয়ের নিবিড়ে!

*

জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন

মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা,

আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন
কী লাভ যুদ্ধ কোরে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন?
আধিপত্যে এত লোভ? পত্রিকা তো কেবলি আপনাদের
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর…

মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলোনা!

পৃথিবীতে তবু আমার মতোন কেউ রাত জেগে
নুলো ভিখিরীর গান, দারিদ্রের এত অভিমান দেখলোনা!

আমাদের জীবনের অর্ধেক সময় তো আমরা
সঙ্গমে আর সন্তান উৎপাদনে শেষ কোরে দিলাম,
সুধীবৃন্দ, তবু জীবনে কয়বার বলুন তো
আমরা আমাদের কাছে বোলতে পেরেছি,

ভালো আছি, খুব ভালো আছি?
*

ব্লেড

লিমিটেড কোম্পানীর কোকিল স্বভাবা মেয়ে,
তাকে যদি ডাকি, ওহে ইস্পাতিনী ঘরে আছো
মোড়কের মায়াবী অন্দর থেকে মুখ তুলে তাকায় সে,
বলে, আরে, এযে সেই ইতর নাগর।

কতদিন যেনো তোর জোটেনি চুম্বন আহা
ওষ্ঠের উপরিভাগে অভিভূত আগাছা ছেড়েছে তাই,
মুখে চারপাশে কালো কচুরীপানারা!

চেহারায় চেরীর ঝোপের আর
মুখে তোর মোজেক ফ্লোরের মতো মাধুরী না এলে এই
শহরে কি, বণিক এমন শহরে কি
সম্ভবে হে সুখ, স্বপ্ন গোলচাঁদ, গোলাপ গোলাপ?

বলি তাই এসেছি তোমার কাছে ইস্পতিনী
শুশ্রূষার সবুজ চুম্বনে আজ স্নিগ্ধ কোরে দাও তুমি এ হেন মলিন মুখ,
সামাজিক ওষ্ঠ আর অন্তরাল,
গভীর গভীরতর অন্তরাল
সেবিকা, সেবিকা!
*

মাতৃভাষা

আমি জানিনা দুঃখের কী মাতৃভাষা
ভালোবাসার কী মাতৃভাষা
বেদনার কী মাতৃভাষা
যুদ্ধের কী মাতৃভাষা।

আমি জানিনা নদীর কী মাতৃভাষা
নগ্নতার কী মাতৃভাষা
একটা নিবিড় বৃক্ষ কোন ভাষায় কথা বলে এখনো জানিনা।

শুধু আমি কোথাও ঘরের দরোজায় দাঁড়ালেই আজো
সভ্যতার শেষ মানুষের পদশব্দ শুনি আর
কোথাও করুণ জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে,
আর সেই জলপতনের শব্দে সিক্ত হতে থাকে
সর্বাঙ্গে সবুজ হতে থাকে আমার শরীর।

সর্বাঙ্গে সবুজ আমি কোথাও ঘরের দরোজায় দাঁড়ালেই আজো
পোষা পাখিদের কিচিরমিচির শুনি
শিশুদের কলরব শুনি
সুবর্ণ কঙ্কন পরা কামনার হাস্যধ্বনি শুনি!

ঐযে নষ্ট গলি, নিশ্চুপ দরোজা
ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, গণিকারা-
মধ্যরাতে উলঙ্গ শয্যায় ওরা কীসের ভাষায় কথা বলে?
ঐযে কমলা রং কিশোরীরা যাচ্ছে ইশকুলে
আজো ঐ কিশোরীর প্রথম কম্পনে দুটি হাত রাখলে
রক্তে স্রোত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে, শব্দ হয়, শুনি

কিন্তু আমি রক্তের কী মাতৃভাষা এখনও জানিনা!

বেনার কী মাতৃভাষা এখনো জানিনা!

শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ,
আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা!
*

বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা

মনে আছে একবার বৃষ্টি নেমেছিল?

একবার ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে থেমেছিল
আমাদের ইস্টিশনে সারাদিন জল ডাকাতের মতো
উৎপাত শুরু কোরে দিয়েছিল তারা;
ছোট-খাটো রাজনীতিকের মতো পাড়ায়-পাড়ায়
জুড়ে দিয়েছিল অথই শ্লোগান।

তবু কেউ আমাদের কাদা ভেঙে যাইনি মিটিং-এ
থিয়েটার পণ্ড হলো, এ বৃষ্টিতে সভা আর
তাসের আড্ডার লোক ফিরে এলো ঘরে;
ব্যবসার হলো ক্ষতি দারুণ দুর্দশা,

সারাদিন অমুক নিপাত যাক, অমুক জিন্দাবাদ
অমুকের ধ্বংস চাই বলে আর হাবিজাবি হলোনা পাড়াটা।

ভদ্রশান্ত কেবল কয়েকটি গাছ বেফাঁস নারীর মতো
চুল ঝাড়লো আঙ্গিনায় হঠাৎ বাতাসে আর
পাশের বাড়ীতে কোনো হারমোনিয়ামে শুধু উঠতি এক আগ্রহী গায়িকা
স্বরচিত মেঘমালা গাইলো তিনবার।

আর ক’টি চা’খোর মানুষ এলো
রেনকোট গায়ে চেপে চায়ের দোকানে;
তাদের স্বভাবসিদ্ধ গলা থেকে শোনা গেলঃ
কী করি বলুন দেখি, দাঁত পড়ে যাচ্ছে তবু মাইনেটা বাড়ছেনা,
ডাক্তারের কাছে যাই তবু শুধু বাড়ছেই ক্রমাগত বাড়ছেই
হৃদয়োগ, চোখের অসুখ!

একজন বেরসিক তার মধ্যে বলে উঠলো :
বৃষ্টি মানে বুঝলেন তো অযথাই যানবাহন, পয়সা খরচ!

একজন বাতের রোগী গলা কাশলো :
ওহে ছোকরা, নুন চায়ে এক টুকরো বেশী লেবু দিও।

তাদের বিভিন্ন সব জীবনের খুঁটিনাটি দুঃখবোধ সমস্যায় তবু
সেদিন বৃষ্টিতে কিছু আসে যায়নি আমাদের
কেননা সেদিন সারাদিন বৃষ্টি পড়েছিল,
সারাদিন আকাশের অন্ধকার বর্ষণের সানুনয় অনুরোধে
আমাদের পাশাপাশি শুয়ে থাকতে হয়েছিল সারাদিন

আমাদের হৃদয়ে অক্ষরভরা উপন্যাস পড়তে হয়েছিল!
*

উচ্চারণগুলি শোকের

লক্ষ্মী বউটিকে
আমি আজ আর কোথাও দেখিনা,
হাঁটি হাঁটি শিশুটিকে
কোথাও দেখিনা;
কতগুলি রাজহাঁস দেখি,
নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি,
কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখিনা
শিশুটিকে কোথাও দেখিনা!

তবে কি বউটিকে রাজহাঁস?
তবে কি শিশুটি আজ
সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?

অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো,
অনেক রক্ত গেলো,
শিমুল তুলোর মতো
সোনারূপো ছড়ালো বাতাস।

ছোটো ভাইটিকে আমি
কোথাও দেখিনা,
নরোম নোলক পরা বোনটিকে
আজ আর কোথাও দেখিনা!

কেবল পতাকা দেখি,
কেবল উৎসব দেখি,
স্বাধীনতা দেখি,

তবে কি আমার ভাই আজ
ঐ স্বাধীন পতাকা?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?
*

শান্তিকল্যাণ

কেবল শান্তির শর্তে লোকগুলো যার যার
বদলে বদলে নেবে,
সময়ের রাস্তাঘাট
ব্যবহৃত দালান দোকান-পাট
বদলে বদলে নেবে,

কেবল শান্তির শর্তে লোকগুলো যার যার
বদলে বদলে নেবে,
রাজা রাণী, রাজমহিষীর ঘোড়া
বদলে বদলে নেবে,

কেবল শান্তির শর্তে নদী থেকে নদী
শিমুলের তুলো থেকে তুলো
মানুষের মুখ থেকে মুখ আর
মোমের আগুন, হাত, ভালোবাসা হবে;
কেবল শান্তির শর্তে প্রেমিকারা, মহিলারা
কিশোরীরা খোপ খুলে দেবে,
ভাসবে কোমল ঘ্রাণে, আসবে ময়ূর!
*

নিঃসন্দেহ গন্তব্য

ছোট ডিঙ্গিটা ভোলা ঝিনুকের মতোনই
ভাসছে ভাটায় সাঁকোটার নিয়ে
কালভার্টটার কালিতেও আছে লেপটে
মাছের জালের মতোন বাবলা ছায়ারা।

মনে পড়ে যায় খালি ঘড়াটার পার্শ্বে
চোখে ডুব দিয়ে মা আছেন দাঁড়িয়েই
অনাহার মার কাঁধে বুলাচ্ছে সেই কোন্
প্রপিতামহীর হৃষ্টপুষ্ট করতল!

অইতো খেজুর বৃক্ষের সারি-মোযটা
শিং-এর শীর্ষে খুঁড়ে ফেলে সূর্যাস্ত!

জলের জিহ্বা ছুঁয়ে আছে নলখাগড়া
নলখাগড়াটা পেরুলে তো আর নয় দূর
দেখা যাবে সেই কাঠের বস্তি লোকালয়।

শিরীষের কোলে ঢালছে আগুন নীলিমা
হলুদ পাখিটা বুঝি সোনার পিণ্ড
লুকিয়ে রয়েছে আবছায়া শাখা-শেলফ-এ
যেনো মেটে কুপি ধরে আছে সাঁঝরাত্রে
কোনো কালো মেয়ে কোনো পুকুরের পার্শ্বে!

মঠটা রয়েছে মাথাটা ডুবিয়ে বাতাসে
গাছের শাখাটা নয়তো পেয়েছে স্বাস্থ্য
অই মঠটার নিচের কারোর হাড়েই;

আমাদের হাড় সেও তো চূর্ণ মন্দির
মাংসের তলে ডুবে দেখে সূর্যাস্ত!

সন্ধ্যা বসবে রাত্রির ভোজে একবার
রোদের সুরুয়া শেষবার শুষে গাছটা
তাই যেনো তার খেদমদগারে বসছে;

মা-ওকি এখন খালি ঘড়াটার পার্শ্বে
নাকি দু’চোখের অশ্রুরই বার্ধক্যে
শীতল কাথায় শুয়ে শুয়ে শুধু স্বপ্ন
রিফু কোরছেন শিমুল তুলোর বালিশে?

লেবেল ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রেনটা
শুনছি কেমন সুগভীর থৈ শব্দ,
ঊষাকাল যেতে সন্ধ্যা-ঘণ্টা বাজছে

ঊষাকাল থেকে কতদূর শেষ যাত্রা?
বয়স কেবলি চায় ভ্রমণের সঙ্গ
কালো শাদা হয়ে বিভিন্ন শিলাখণ্ডে
লিখে রেখে যায় সামনেরও গন্তব্য!

কিন্তু চাইনা আমি তো দীর্ঘ যাত্রা,
ভালোবাসি তাই, যা কিনা সূক্ষ্ম সংক্ষেপে
ঝাউয়ের কোটর খোলাইতো কাঠঠোকরা,

আমরাও বক্ষে একটি গর্ত প্রয়োজন!

যার ফোকরের মধ্যে চালিয়ে চক্ষু
খোলা দরজার মতোন মা মণি আমারই
সেই দূর থেকে দেখবেন, আমি দিনরাত
রেঁদা তুরপুন চালাচ্ছি কত তক্তায়-

(আর) সেলাই কলের সুতোর মতোন কত হাত
রক্ত নামিয়ে দিচ্ছি ভাগ্য বুননে!
*

ঘৃণা

যতই জপি আঁধার ঘরে বসে বসে হরি ওঁ
সাতমহরার অলীক বাড়ি, হাওয়ার বাগান, ন্দ্রিা ওঁ

ফুরফুরে এই জীবন পালের ফুলে ওঠা বক্ষটায়
তবুও সাধের আলবাট্রাস রক্তস্বেদে মুখ লুকায়!

খিল আঁটা এই দুয়ার খুলে কেমনে ঘুরি তিনভূবন
বাদ সেধেছে ঘরের দুখী, শূন্য ভাঁড়ার, রুগ্ন বোন,

বাদ সেধেছে তাঁহার উরু চকচকে দুই চক্ষু আর
ভিতর বাড়ির জংধরা সেই মায়ের দেহের পাতাবাহার!

হেই বাবা ও বাউল গোসাই এক তারার এই নিত্য ভোল
অতিন্দ্রিয়ে তবুও এমন লাগায় কেন গণ্ডগোল?

দেহের ক্ষুধা, রাতের ক্ষুধা, গহনসুবাস তার ক্ষুধায়
জরায় কেন ঘৃণা ভীষণ ভালোবাসা অহিংসায়?

পর্দা ওঠা ভুল নাটকের ঈষৎ হাসির হরি ওঁ
সাতমহলার অলীক বাড়ি, হাওয়ার বাগান, নিন্দ্রা ওঁ

শুধুই অধম ছলাকলায় অবহেলায় স্বপ্ন যার
বিস্বাদে তার ভালোবাসা? উরুর কুয়োয় ডুব সাঁতার?
*

স্বাতীর সঙ্গে এক সকাল

বারান্দায় স্বাতী কমলা খেলো, তার
শাড়ীর উপরে সমন্বয়ে সকালে বসলো রোদ,
রোদের পারদ লেগে স্বাতীর সমস্তটা মুখ যেনো আয়না, গভীর আয়না!
সদ্য বেড়ে ওঠা, প্রতিকৃতি আমার নিজের তাতে দেখলুম,
বোকা বোকা একটি লোক,
কমলালেবু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছে বারান্দায় স্বাতীর সম্মুখে।

আশ্রমের শান্তির মতোন সুখে চেয়ে আছে তার
তৃষ্ণার আনত করতলে বাহাদুর কমলালেবুটি!

যেনো বোলছে, এরকম ঐতিহাসিক দিন,
খুঁটিনাটি ইচ্ছার সম্ভোগ দিয়ে শুরু হোক
স্বাতীকে দেখার কাজ, নীল দেখা রক্তের ভিতরে গিয়ে
হৃৎপিণ্ডে আজ কেউ জরিপ করুক সব বেঁচে থাকা
সম্ভোগের, শিল্পের এলাকা!
শিল্প হলো স্বাতীর হাতের ঐ কমলালেবু,
লজ্জায় আনত মুখ, রোদের ফড়িং
শিল্প হলো স্বাতীর কানের রিং,
চুল থেকে টেনে আনা সুগন্ধের সমস্ত বাতাস,
শিল্প হলো আঙ্গিনায়, উঠোনে স্বাতীর জলে
জীবনের সিক্ত তাজা ঘাস!

শিল্প তো নিরাশ্রয় করেনা, কাউকে দুঃখ দেয়না
কোনো হীন সিদ্ধান্তের মতো
যৌবনের মাংসে তারা রাখেনা কখনোই কোনো
অভাবের কালো ব্যধি, দূরারোগ্য ক্ষত!

শিল্প তো স্বাতীর বুকে মানবিক হৃৎপিণ্ড, তাই
আমি তার হৃৎপিণ্ডে বয়ে যাই চিরকাল রক্তে আমি
শান্তি আর শিল্পের মানুষ!
*

ব্যক্তিগত পোশাক পরলে

দৃশ্য মধ্যে অহরহ পরস্পরকে খুঁজে আবার কোথায় হই প্রতিধ্বনিত
আমার নিজ কণ্ঠস্বরে অন্য কাউকে ডেকে ফিরছি, ছেঁড়া চক্ষু ভাঙা গলা
দেখে যাচ্ছি, শুনে যাচ্ছি, একই বৃত্তে পরস্পরকে একই সঙ্গে এক আসরে

অথচ দ্যাখো আমরা কেউ চিনিনা কাউকে ব্যক্তিগত পোশাক পরলে!

বয় বেয়ারা, অফিস গাড়ী, গীর্জা মতোন শান্ত বাড়ি
দেখে যাচ্ছি, শুনে যাচ্ছি,
এসেন্স পোরা সখ্যতায় ও জাফরীকাটা হাস্যলাপে একই বৃত্তে পরস্পরকে,

অথচ দ্যাখো আমরা কেউ চিনিনা কাউকে ব্যক্তিগত পোশাক পরলে!
রোদে পোড়া স্রোতস্বিনী, রুমাল থেকে রৌদ্র সেঁচে
আঙ্গুল ধারায় চক্ষু মোছে, গ্রীবা মোছে, ফাইলপত্তর হিসাব-নিকাশ?

কমলালেবুর মধুরবিকাশ স্মৃতি পাল্টে বোলতে চাচ্ছে
দেখে নাওতো কিশোর বেলায় কোন পাগলটা ছিঁড়েছিল প্রথম ফলটা!
ভাঙা বয়স, ভাঙা আয়না, গ্রীবা রেখায় ধুলো জমছে একই বৃত্তে একই সঙ্গে
দেখে যাচ্ছি সত্য বলি সবাই কেমন আত্মগ্রস্থঃ শবাযাত্রীও বোলতে পারো,
এখন আমরা কেউই কাউকে চিনতে চাই না; স্বজন বন্ধু অন্নদাত্রী,

আমরা কেউই চিনিনা কাউকে ব্যক্তিগত পোশাক পরলে!
*

মেঘেরও রয়েছে কাজ

মেঘেরও রয়েছে কাজ
ওকে ছুটি দাও
ওকে দিয়ে দাও ওর কালো আমব্রেলাটি,
ফিরে যাক ও তার তল্লাটে!

প্রকৃতির সব চেয়ে নিম্ন, বেতনভোগী কর্মচারী
ঐ মেঘ,
ওরও তো রয়েছে বহু শিল্পকর্ম,
এবং বাসনা!

ওকে ছুটি দাও,
ওকে দিয়ে দাও ওর কালো আমব্রেলাটি,
ফিরে যাক ও তার তল্লাটে!
*

একলা বাতাস

নোখের ভিতর নষ্ট ময়লা,
চোখের ভিতর প্রেম,
চুলের কাছে ফেরার বাতাস
দেখেই শুধালেম,
এখন তুমি কোথায় যাবে?
কোন আঘাটার জল ঘোলাবে?
কোন আগুনের স্পর্শ নেবে
রক্তে কি প্রব্লেম?
হঠাৎ তাহার ছায়ায় আমি যেদিকে তাকালেম
তাহার শরীর মাড়িয়ে দিয়ে
দিগন্তে দুইচক্ষু নিয়ে
আমার দিকে তাকিয়ে আমি আমাকে শুধালেম

এখন তুমি কোথায় যাবে?
কোন আঘাটার জল ঘোলাবে?
কোন আগুনের স্পর্শ নেবে
রক্তে কি প্রব্লেম?
*

গাছগুলো
(শহীদ কাদরীকে)

সজীব গাউন পরা অই গাছগুলো কী রগড় করে যে
হাওয়ার সাথে প্রতিদিন!

সবুজ পাতার মুদ্রা তুলে তুলে নাচে, বক্ষোবাস খুলে খুলে নাচে
নিপুণ নটীর সহোদরা।

সকালে কাঠের খোপ থেকে বের হয়ে মুরগীগুলো
যখোন শস্যকণা খোঁজে,
কাক ও চড়াই চঞ্চু দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলে আনে
টাটকা সুগন্ধী ভোর;
তখনো কোচড় থেকে সোমত্ত সুন্দর গাছগুলো
ঢেলে দেয় মিহি অকসিজেন!

সারারাত শয়নিতা পাখিনীর শয়ন গড়িয়ে রাখে ওরা
প্রাতঃরাশ সাজিয়ে সকালে
সূর্য ওঠার আগে দাঁড়িয়েই থাকে ঠায় পাখির ঘরের কাছে
প্রাকৃতিক চাকর, খানসামা!
সচ্ছল সিন্দুক থেকে বের কোরে দেয় রোজ
ভেষজ ওষুধ ফল,
প্রাণপ্রতিশোধক নির্যাস!

আমরা যখোন শার্টের তলায়
নিজস্ব গোপন ছুরি নিয়ে চলা ফেরা করি
প্রতিমূহুর্তের আয়নায় আত্মহত্যা করি আর
প্রতিমুহূর্তের অবিশ্বাসে।
এর ওর সাথে কথা বলি,
সে মুহূর্তে ওরা বিলায় ওদের নিজস্ব সম্পদ
নির্বিশেষে চুপিচাপি,

বড় মায়া হয় যখোন ওদের দেখি।
কুঠারের ক্রুশে বিদ্ধ মেরীর সন্তান!
*

শীতে ভালোবাসা পদ্ধতি

কনক তুমি শীতে এবার কার্ডিগানটা পরো কেমন?

আমাকে তুমি শিখিয়ে দিও লালঝুটো সেই পাখির নামটি?
কনক আমরা এবার শীতে নদীর তীরে হো হো হাসবো,
সন্ধেবেলা তোমার চুলে শিশির ভরে রাখবো লক্ষ্মী
তোমার অনামিকায় কামড় দিয়ে আমি হঠাৎ আবার
‘যাহ-কী-দুষ্টু’ ওষ্ঠে তোমার ওষ্ঠ ছোবো সকাল বেলায়
সূর্যোদয়ের কাছে কেবল শান্তি চাইবো, বুঝলে কনক

তোমার মাথাধরাও আমি এক চুমোতে সারিয়ে দেবো!
*

স্মৃতিকথা
(হেলাল, কাঞ্চন, ওয়ালী, বাচ্চু ও রাব্বীকে)

যে বন্ধুরা কৈশোরে নারকেল বনের পাশে বসে
আত্মহত্যার মতো বিষণ্ণ উপায়ে উষ্ণ মেয়েদের গল্প কোরতো
শীতকালে চাঁদের মতোন গোল বোতামের কোট পরে
ঘুরতো পাড়ায়,
যে বন্ধুরা থিয়েটারে পার্ট কোরতো,
কেউ সাজতো মীরজাফর, কেউবা সিরাজ
তারা আজ, এখন, কোথায়?

রোমেনা যে পড়াতো ইশকুলে ছোট মনিদের বিদ্যালয়ে
রোমেনা যে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস পড়ে তার।
নায়িকার মতো জ্বরে ভুগতো,
আর মিহি শরীরের সাথে মিল রেখে
কপালে পরতো টিপ,
শাদা কোমরের কাছে দীর্ঘচুল ঝুলিয়ে রাখতে
ব্লু কালারের ব্যাগ,

দুবৎসর আগে শুনেছি বিবাহ হ’য়ে গেছে তার,
এখন কোথায়?

রুনী তার মাতাল স্বামীর কাছে না গিয়ে নিজেই একরাতে
একে একে শূন্যতায় সলজ্জ কাপড়গুলি খুলে ফেলে কুয়াশায়
উন্মাদিনী কোথায় পালালো!
নিজস্ব ভ্রুণের হত্যা গেঁথে দিয়েছিল তাকে মানসিক হাসপাতালের এক কোণে!
কোথায় সে? এখন কোথায়?

অনেকেই চলে গেছে, অনেক নারকেল গাছ হয়ে গেছে বুড়ো
অনেক প্রাঙ্গণ থেকে উঠে গেছে
গোলাপ চারার মতো সুন্দর বয়সমাখা প্রসিদ্ধা তরুণী,

মধ্যরাতে নারকেল বনের কাছে ভেঙে যায় আমারও গল্পগুলি
স্মৃতিকথা সেখানে নিশ্চুপ!
*

প্রতাবর্তনের সময়

আমি আবার ফিরে এলাম, আমাকে নাও,
ভাঁড়ার ঘরের নুন মরিচ আবার মশলাপাতা গেরুয়া ছাই
আমায় তুমি গ্রহণ করো।

আমি আবার ফিরে এলাম,
স্নিগ্ধ কাক, আলাপচারী তালচড়াই
আমাকে আজ গ্রহণ করো।

বহুদিনের নির্বাসনের কাতরতার চিহ্ন আমার সর্ব অঙ্গে
বহুদিনের দৃশ্য দেখার উৎসাহ তাই
এক জোড়া চোখ নিয়ে এলাম নিজের সঙ্গে

আমি আবার ফিরে এলাম আমাকে নাও,
আমাকে নাও, ডুবতে ডুবতে বেঁচে গিয়েছি
নকশী কাঁথা, নদীর বালিশ অনেক রকম গ্রাম্য শালিস
মনে কি পড়ে, মনে কি পড়ে?

পারদমাখা শয্যা আমায় শান্তি দেয়নি, নারী আমায় নিদ্রা দেয়নি
গ্রন্থ এখন কেবলি শুধু ছাপার হরফ, সভ্যতা যে অধঃপতন,

অমল কোনো পাইনি মানুষ যাকে ধারণ কোরলে আমি আলো পেতাম!

শুধু শুধুই দুপুর গেছে মানুষ গেছে ব্যর্থ মানুষ,
শিল্প এখন সুবিধাবাদ!

তাইতো আমি ফিরে এলাম, আমাকে নাও
আমাকে আজ গ্রহণ করো,
মাছের আঁশটে, হলুদ রৌদ্রে ভাঁড়ার ঘরের নুন মরিচ আর
মশলা পাতা গেরুয়া ছাই, শালিধানের গন্ধ তুমি,
ভেজা মাটির বৃষ্টি তুমি গ্রহণ করো আমাকে নাও, আমাকে নাও!
*

রূপসনাতন
(সিকদার আমিনুল হককে)

এসেছিস তো কী হয়েছে? কিছুই হয়নি, দ্যাখ
ঐতো আচ্ছন্ন ঘাস; ধানী জমি, ঐতো কোমল নৌকো, ধরিত্রী আকাশ!

এসেছিস তো কী হয়েছে? কিছুই হয়নি দ্যাখ,
ঐতো ডাকছে পাখি, জ্বলছে যৌবন, চাঁদ, ঐতো জোনাকী

যাবি তো কাঁদিস কেন? কিছুই কান্নার নেই শোন
শরীরে নকশী কাঁথা, মাটির কলস রইলো ফুলদানি কয়েকটি কলম!

যাবি তো থামিস কেন? কোথাও থামার নেই, আর
ঐতো নৌকো যায়, মাটির কলস যায়, ফুলদানি যায়!
*

অন্তর্গত মানুষ
(মুহম্মদ নূরুল হুদাকে)

আমি যদি বোলতে পারতাম
আমি এর কিছু নই!

এই পাথরের চোখ,
পরচুলা
নকল পোশাক,
এসব আমার নয়
এসব আমার নয়, প্রভু

আমি যদি বোলতে পারতাম!
*

বদলে যাও, কিছুটা বদলাও
(শফিকুর রহমানকে)

কিছুটা বদলাতে হবে বাঁশী
কিছুটা বদলাতে হবে সুর
সাতটি ছিদ্রের সূর্য, সময়ের গাঢ় অন্তঃপুর
কিছুটা বদলাতে হবে
মাটির কনুই, ভাঁজ
রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে…

বদলে দাও, তুমি বদলাও
নইলে এক্ষুণি
ঢুকে পড়বে পাঁচজন বদমাশ খুনী,

যখোন যেখানে পাবে
মেরে রেখে যাবে,
তোমার সংসার, বাঁশী, আঘাটার নাও।

বদলে যাও, বদলে যাও, কিছুটা বদলাও!
*

একমাত্র কুসংস্কার

একে একে সব গেছে, কিছু নেই, কিচ্ছুটি নেই।
শুধু ওরা আছে থাক,
ভেজা বাড়ি, ঘরদোর, আনাচ, কানাচ, ইঁদুর খসানো মাটি
ওরা আছে, ওরা থাক!

আমার বোনটি যেই বারান্দায় দাঁড় কাক ডাকলেই
বলে ওঠে, ভাই-
গুনে গুনে সাতটি চাল ফেলে দে তো কাকটার মুখে?
চালের গন্ধ পেয়ে দেখিস কাকটি উড়ে যাবে,
আমাদের বিপদ আসবেনা;
আমি সেই অশুভ কাকের মুখে গুনে গুনে
সাতটি চাল ফেলে দেই,
আমি ফের সকল বিপদ থেকে মুক্তি লাভ করি!

একবার মাকে মাথার উপরে,
হুশ শব্দটিকে দিয়ে টিয়ে ডাক ডাকতে শুনেছি,
মা তুমি আবার সেই টিয়ে ডাক ডাকো দেখি,
আমরা তো ভুলতে ভুলতে সব পাখিদেরও আজ
ডাক নাম ভুলতে বসেছি!

একে একে সব গেছে, কিছু নেই, কিচ্ছুটি নেই,
তবু কিছু কষ্টেসৃষ্টে ধরে আছে এখনো মানুষ!

এখনো পেঁচার ডাকে কেউ কেউ লক্ষ্মীর আগমন টের পায়!
বিড়ালের হাই তোলা হাত দেখে
গৃহিনীরা আজো অনেকেই অতিথির ভাত তুলে রাখে!

কে সেই অতিথি? কে সেই বিড়াল হাত আঁচায়, অন্ধকারে
কে সেই সুন্দর পেঁচা যার ডাকে লক্ষ্মী চলে আসে?
এসব প্রশ্ন থাক, তার চেয়ে এই যেনো হয়?
ছোট বোন বারান্দায় বারবার
কাক ডেকে উঠলেই বলে ওঠে, ভাই,
গুনে গুনে সাতটি চাল ফেলে দে তো কাকটার মুখে!

মা যেনো আবার বলে দেয়
কোনদিকে, কোথায় এখনো আছে
ভালোবাসা, পাখি, প্রেম, অন্ধকার আলো ও মানুষ!
*

বয়ঃসন্ধি

চিকন কঞ্চির মতো ছিপছিপে রোদের ভিতরে আসি
কে আমাকে নুইয়ে দেয় মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!

পানা পুকুরের পাড়ে জলের আয়না আছে, মুখ ধুই
আমি কাকে নুইয়ে দিই মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!

নাসারন্ধ্রে নিমের ফুলের ঘ্রাণ, খয়েরী দুপুরে আমি
আলোর আঁধারে কেন ভেসে যাই মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!

আমার সুন্দর হতে ভালোই লাগে না; আমি ভয় পাই!

আমার শরীরে এই অসহবিসহ আলো, বিচ্ছুরণ তেলেসমাতির খেল
আমার শরীরে এই সোনালি ত্বকের ছটা বুক জোড়া উঁচু শিহরণ!

কোথায় লুকাবো মা? ভয় লাগে, আমার ভীষণ ভয় লাগে!
*

মৌলিক পার্থক্য
(নজরুল ইসলাম শাহকে)

আমার একবার খুব ভেদবমি হয়েছিল,
ভেদবমি কাহাকে বলে?
তখোন বয়স নয়, দশ কি এগারো
ভেদবমির কী বুঝতাম!
তখোন পেচ্ছাব খুব সাদা হতো, কান্নায় তেমন কোনো কষ্ট ছিলনা,
বাবার পকেট থেকে অনায়াসে চুরি কোরে খেতাম সন্দেশ!

আমার একবার দুঃখদুঃখ ভাব জেগেছিল,
দুঃখ কাহাকে বলে?
তখোন বয়স তেরো, চৌদ্দ কি পনেরো-
দুঃখের কী কাঁচকলা তখোন বুঝতাম?
তখোন কেবল এক তরুণের বুকে আমি
অত্যন্ত সীমিত সাদা আগুন দেখেছি!
দুঃখ কি অমন কোনো সীমাবদ্ধ সীমিত আগুন?

আমার একবার খুব সৌন্দর্যের বোধ জন্মেছিল,
সৌন্দর্য কাহাকে বলে?
তখোন বয়স খুব বেশি হলে ষোল কি সতেরো;
সৌন্দর্যের তখোন আমি কিইবা বুঝতাম?
তখোন যুবতী দেখলে ক্ষিধে পেতো এইটুকু জানি,
গোলাপ ফুলের চেয়ে মূল্যবান মনে হতো সকালে সিদ্ধ ডিম!
আমার বয়স আজ দীর্ঘ পঁচিশ! প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়,
এখনো অভ্যাসবশে আমার যুবতী দেখলে ক্ষিধে পায়!

এখনো অভ্যাসবশে গোলাপ ফুলের চাইতে
সিদ্ধ ডিমই প্রিয় মনে হয়!
*

সেই সুখ
(সুফিয়া চৌধুরীকে)

সেই সুখ মাছের ভিতরে ছিল,
সেই সুখ মাংসের ভিতরে ছিল,
রাতের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যেতো ছেলেবেলা
সেই সুখ চাঁদের ভিতরে ছিল,
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল!

নারী কোন রমণীকে বলে?
যার চোখ মুখ স্তন ফুটেছে সেই রমণী কি নারী?
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল,
যখোন আমরা খুব গলাগলি শুয়ে
অনু অপলাদের স্তন শরীর মুখ ঊরু থেকে
অকস্মাৎ ঝিনুকের মতো যোনি,
অর্থাৎ নারীকে আমরা যখোন খুঁজেছি
হরিণের মতো হুররে দাঁত দিয়ে ছিঁড়েছি তাদের নখ, অন্ধকার
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল।

যখোন আমরা শীতে গলাবন্ধে পশমী চাদর জড়িয়েছি
কিশোরীর কামরাঙা কেড়ে নিয়ে দাঁত বসিয়েছি।
সেই সুখ পশমী চাদরে ছিল, কামরাঙা কিশোরীতে ছিল!

রঙীন বুদ্বুদ মাছ, তাজা মাংস, সুপেয় মশলার ঘ্রাণ
চিংড়ি মাছের ঝোল যখোন খেতাম শীতল পাটিতে বসে
সেই সুখ শীতল পাটিতে ছিল।

প্রথম যে কার ঠোঁটে চুমু খাই মনে নেই
প্রথম কোনদিন আমি স্নান করি মনে নেই।
কবে কাঁচা আম নুন লঙ্কা দিয়ে খেতে খেতে
দাঁত টক হয়েছিল মনে নেই
মনে নেই কবে যৌবনের প্রথম মিথুন আমি ঘটিয়েছিলাম
মনে নেই…
যা কিছু আমার মনে নেই তাই হলো সুখ!
আহ! সে সুখ…
*

অসভ্য দর্শন
(নির্মলেন্দু গুণকে)

দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,
দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরোম কুঠার তাও রাজনীতি,
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!
মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি!

বোন তার বেণী খুলছে যৌবনের অসহায় রোদে মুখ নত কোরে
বুকের ভ্রমর হাতে রাখছে লুকিয়ে- তাও রাজনীতি

তরুণেরা অধঃপাতে যাচ্ছে তাও রাজনীতি পুনরায়
মারামারি যুদ্ধ আর অত্যাচার, হত্যার আগ্রসী খুন মানুষের

ছাড়ানো বীর্যের ব্যথা, বিষণ্ণ মিথুন
মহিলার রক্তের ভিতরে ভ্রুণ, সমস্যার ছদ্মবেশে আবার আগুন
উর্বর হচ্ছে, রাজনীতি, তাও রাজনীতি!

আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি
জীবনের অস্তিত্বে ক্ষুধায় মরছি রাজনীতি, তাও রাজনীতি আর

বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে খাঁ, খাঁ, খল,
তীব্র এক বেদেনীর সাপ খেলা দেখছি আমি; রাজনীতির তাও কি
রাজনীতি?
*

একটা কিছু মারাত্মক
(মামুনুর রশীদকে)

একটা কিছু মারাত্মক ঘটছে কোথাও
নইলে ডাইনীর মতোন কেন কোমর বাঁকানো
একটি চাঁদ উঠব্র জ্যোৎস্নায়
উলুকঝুলুক গাছ,
মানুষের খোলা, আকাশের নীচে রেস্তোরাঁয়
এখানে সেখানে,
সবদিকে
কেন এত রক্তপাত হবে? গুপ্তহত্যা হবে?
কেন জীবনের দ্রব্যমূল্য বাড়বে এত শনৈঃ শনৈঃ
কেন ফুরাবে এমন আমাদের পকেটে সিগ্রেট,
খাদ্য, রূপালী আত্মার ঘ্রাণ রমণী ও টাকা?
একটা কিছু মারাত্মক ঘটছে কোথাও
নইলে কেন পাওয়া যায় না প্রেমিকা?
কেন মোমের আলোর শিখা আজকাল
ধীরে জ্বলে,
ধীরে জ্বলে, মাঝরাতে
মহিলার শাড়ি কেন সভ্যতার শোভার মতন
খুলে যায়।
নেমে যায়, আজকাল
কেন এত সহজেই ভেঙে পড়ে কালো চোখ, কোমল যৌবন?

একটা কিছু মারাত্মক ঘটছে কোথাও
নইলে কিশোর চেনেনা কেন ঘাস ফুল? ঘাস কেন সবুজের বদলে হলুদ?

একটা কিছু মারাত্মক ঘটছে কোথাও
নইলে নয়টি অমল হাঁস
থেঁতলে যায় ট্রাকের চাকায়?
ভালোবাসা, কেবলি…কেবল একটি
বাজেয়াপ্ত শব্দের তালিকা হয়?

একটা কিছু মারাত্মক ঘটছে কোথাও
নইলে মানুষের দরোজায় টোকা দিলে কেন আজ দরোজা খোলে না?

‘বৃষ্টি হলে গা জুড়োবে’ কেউ কেন বলেনা এখন?
*

দূরযাত্রা
(আবিদ, শেহাব, সুকান্ত, মনোয়ার ও মাশুককে)

আমি কার কাছে যাবো? কোনদিকে যাবো?

অধঃপতনের ধুম সবদিকে, সভ্যতার সেয়ানা গুণ্ডার মতো
মতবাদ; রাজনীতি, শিল্পকলা শ্বাস ফেলছে এদিকে ওদিকে,
শহরের সবদিকে সাজানো রয়েছে শুধু শাণিত দুর্দিন, বন্যা অবরোধ
আহত বাতাস!
আমি কার কাছে যাবো? কোনদিকে যাবো?
কোন শহরের দিকে যাবো আমি? যৌবনের জ্বলন্ত শিরায় আজ
এই যে জ্বলছে চাঁদ জ্যোৎস্না, চাঁদ জ্যোৎস্না আর জ্যোৎস্নাফুল,
হৃদয়ের ভিতরে ব্যাকুল,
জলছে এই যে স্বপ্ন, স্মৃতি, শব্দ, অলঙ্কার
অভাবের মরীচিকা, এ শহর কার?

এ শহরে জন্মদিবস হয় না? সোনালি যুবতী নেই? চন্দ্রহার
বাহুর বৃত্তের বহ্নি, পিপাসার রক্তসাগরমাখা সমস্যার
সাম্রজ্যে এখানে বুঝি বাজে.না সানাইয়ের সুর?
বসে না উদার তাবু? লাল নীল কার্ণিভাল, আসে না ময়ূর?
এখানে কেবলি ক্ষুধা, মহামারী, মৃত্যুভয়
অবচেতনায়ও যদি আলো-কে নেভায় বলো আমার কি আসে যায় তাতে?

আমি নই ক্রীতদাস, হৃদয়ের আমি তো সম্রাট, আমি
এক লক্ষ রাজহাঁস ছেড়েছি শহরে, আমি জয়ী, আমি জয়ী!

আমি সভ্যতার পরোয়া করি না; সমস্যায় শূন্যতায় এ শহর যদি ফেরে
শত্রু কবলিত হয়,- হলে হোক- মহামারী বাড় ক পাঁজরে আর
মাংসের ভিতরে তার অন্ধকার আগ্রাসী আভায়
ঝরে যায় যদি সব, পুড়ে যায় যদি প্রেম, থোকা থোকা
আমাদের সে উদ্ধত অভিজ্ঞান, ধন্য সব আশা কুহকিনী,
আমি তবু পরোয়া করিনা আমি যে শহরে যাবো,

সে তো শিল্প, সে তো ‘সারাদিন’- পুনর্বার বাংলাভাষার।
সে তো ভোর, রঙ্গীন জলের আয়না, মধ্যরাত, সোনালি সুদিন!
*

মিসট্রেস : ফ্রি স্কুল স্ট্রীট

প্লাস্টিক ক্লিপের মতো সহস্র কোকিল যেই বনভূমি গেঁথে নেয়
সবুজ খোঁপায় ভোরবেলা- ময়ূরের পেখমের মতো খোলা রোদে বসে
ব্লাউসের বোতাম লাগিয়ে মিসট্রেস আসে ইশকুলে আর
কয় ঝাঁক বালকের নির্দোষ নিখিল ভরা ক্লাসরুমে এসেও সে শোনে

বনখোঁপা বাঁধা কোকিলের কাজল কূজন তার চুলে, চমৎকার
চিরোল গ্রীবায়, শেষে গৌর লাজুক শিয়রে শিহরিত শুধু
পেতে গিয়ে এক হারানো প্রেমের ঘ্রাণ, বয়ে নেয় সে তখন
কী যে এক আর্দ্র পরাজয় তার আত্মব্যস্ত অতীতের অথই সীমায়!

দেরি কোরে এসে ইশকুলে ক্লান্ত কর্ণেও ভরে নিতে হয় তাকে মাঝে মাঝে
হেড মিসট্রেসের শ্লীলতাবিহীন সাধুভাষা- আর তাই দেখে করুণাতে
আর্দ্র হও কখনো কি তুমি হে স্ট্রীট? বুঝে নিতে পারো তার বি
খ্যাত বেদনা? নারী, নারীই কেবল যদি বোঝে কোনো নারীর হৃদয়- তবে
তুমি ভূখণ্ডের মানে এই ঢাকা শহরের এক সবুজ তনয়া, নারী
তুমি কি বোঝোনা তার তিরিশ বছর কাল কুমারী থাকার অভিশাপ?
বোঝো না কি
তিরিশ বছর কত কাঁদায় যৌবন ঐ কোকিলের পাষণ্ড রোদন!
মিসট্রেস, কালো মিসট্রেস, করুণকোমল ঐ রোদনরূপসী মিসট্রেস!
যেনো কোনো রেফ্রিজারেটারে তার তুমুল হৃদয় রেখে আসে ইশকুলে,
ক্লান্ত! এখন অধীরা, যেনো কতদিন সে তার নিজের মুখ মোছেনা
আনন্দ অভিধায়!
অভিমানী, সর্বস্ব খোয়োনো ঐ মেয়ে
মানসিক শ্রমে জব্দ জীবনধারিণী!
ওকে দয়া করো,
হে ভোর,
হে স্ট্রীট,
শিশুক্লাস,
আর্ট খাতা,
বনের বিজন
সাঁঝবেলা!
বিষণ্ণ ও কুমারীকে দয়া করো!
দয়া করো!
দয়া করো!
*

শিকড়ে টান পড়তেই
(আব্দুল মান্নান সৈয়দকে)

এত রাতে কে যায় ধুলোর রাস্তা? কে যায় বিবর্ণ ঘাস?
কে যায় আগুন? বলো এত রাতে কে যায় পাহারাঅলা?
বলো, বলো, বলো তুমি হে রাত, হে তুমুল দুর্দিন
কাকে তুমি যেতে দাও?
হে ধুলো, বিবর্ণ ঘাস, কাকে রাখো? কাকে ফেলে দাও
উচ্ছিষ্ট ভাতের মতো? কুকুরের মতো?

মড়া পোড়া কাঠের মতোন তুমি হে পাবক কাহাকে পোড়াও?
হে আগুন নিশিথের নিমগ্ন তাপস তুমি ধ্রুবশিখা?

বলো, বলো, আমাকে জানিয়ে দাও, আমি কান পেতে আছি
ত্রিশূলের মতো সোজা টান টান আমার শরীর আমি
আলো করে রেখেছি লোহায়, বলো,
বলো অগ্নি, বলো ধ্রুবশিখা,
আমি সোমরস দেবো, কমণ্ডুলু থেকে আমি ঢেলে দেবো
আলোর প্লাবন;
পৃথিবীর পুরাতন পদ্মটির মতো হবো বিশুদ্ধ বিনয়ী,
বলো, প্রেম, বলো ভালোবাসা,
কাকে তুমি তমসায় তীব্র করো, তুচ্ছ করো, কাকে রাখো, কাকে ফেলে দাও,
উচ্ছিষ্ট ভাতের মতো। কুকুরের মতো।

আমি অন্ধ হৃদয়ের ক্রন্দন জ্বালিয়ে রাখবো অনিষ্কাম,
আমি তোমাকে খাওয়াবো দীর্ণ আমার শরীর থেকে পাপরস
ঘাম, রক্ত, শ্রমের গ্লানির হেতু;
আমি সর্বত্র স্থির থেকে টান মেরে ছিঁড়ে নেবো আমার সকল জ্ঞান,

বলো অগ্নি, বলো হে পাবক, বলো হোমযজ্ঞাগ্নির উষ্ণ জ্যোতি শিখা
মৃত্যু, হিমস্তব্ধতা নগরের এই সব উচ্চাসীন স্কাইস্ক্রেপার
এই জাতিসংঘ, শ্রমিক লীগের নায়কেরা, সভাপতি, সভাসদ
এই সামাজিক জীব,
এই অধিনায়কেরা কী চায়? কেবলি ক্লান্তি! কেবলি কনিষ্ঠ তরবারী?
কেবলি করুণ প্রেম?
কেবলি নারীর নষ্ট শরীরের ঘ্রাণ?

কিন্তু আমি তরবারীর সঠিক স্বভাব আজো বুঝতে পারিনি,
আমি সমাজের সঠিক শব্দার্থ আজো খুঁজে পাইনি কোনো শ্লোকে;
মানবিক ভালোবাসা, নারীর নির্জন হাত কাকে বলে এখনো জানিনা!
আমি সমুদ্রের কাছে গিয়ে পুনর্বার সমাজের কাছে ফিরে এসেছি!
রমণীর কাছে গিয়ে পুনর্বার প্রশ্নাতীত আঁধারের কাছে ফিরে এসেছি তমসা,

আমি আলোর ভিতরে শুধু ধ্বংস, হাড় হৃৎপিণ্ড, রোদনের স্রোত দেখে
এসেছি তোমার কাছে ফিরে ফিরে হে পাবক, অগ্নিশিখা হে তীব্র তামস!
*

অগ্নি দহন বুনো দহন
(রফিক আজাদকে)

বুনো আগুনের ছেঁড়া দহনেই করেছি মাতম শুধু,
পাপের মোড়কে দু’হাত ঢুকিয়ে পাখিদের আর তরু
বীথিদের সাথে চারিয়ে দিয়েছি নৃশংস ডম্বুরু
মাটিতে মর্মে হায়রে এ কোন দহনের হলো শুরু।

নীরব প্রাণের কণার জন্যে কীইবা রাখবো আর,
বোধিমূল থেকে সরে গেছে জল, রক্তের ব্যবহার
খোলেনা এখন প্রভাত কুসুম সম্মেলনের দ্বার
প্রাণসম্মুখে, বোধিমূল হায় পুড়ে হলো ছারখার!

এ কার নিপট হাতের ইশারা? দেবতায়-দ্রাক্ষায়
সমটান দিয়ে আমাকে নিচ্ছে টেনে কালো প্রেক্ষায়।
যার সাথে হাসি, সেই ফের দ্যাখো হাহাকার কান্নায়
বিষাদ জমিয়ে শোণিত শস্যে আগুন ছড়িয়ে যায়!

তাইতো পারি না নেভাতে আগুন চারিদিক থেকে যারা
নেভাতে আসবে, তাদের চোখেও হতাশার খরধারা
ফাঁদ পেতে আছে মাকড়ের মতো জালে বাঁধা পড়ে তারা
পোকার মতোন অসহায় নিয়ে চোখে হতাশার ধারা

অন্তিমে তবে মাতমই মুক্তি? যন্ত্রের বিবসনা
বধূর কাছেই উদোম স্নায়ুকে দিনরাত একটানা
প্রকাশিত কোরে- প্রকাশিত কোরে নীরব প্রাণের কণা
তুলে দেবো তাকে? দিনরাত শুধু দিনরাত একটানা?
বৃথাই তা’হলে প্রাণকে বলেছি পাখি তরুদের সখী,
বাষ্পের মতো নম্র যে সুর বাজায় করুণ পাখি
বাজায় আমার রক্তে শুধুই বাজায় সে ডাকাডাকি
ছেড়া দহনের মাতামে মিলবে? পাখিদের ডাকাডাকি?
*

প্রতিক্ষার শোকগাথা

তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে
আর আমার হাত ঘড়ি
নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে!

টুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে
সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী

এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে
শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো এ্যাসট্রেতে!

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আজ স্বাতী?

তোমার কথার মতো নরম সবুজ
কেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচে

তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ!

তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়

আর একটি অস্থির নীল প্রজাপতি পর্দার বুনট থেকে উড়ে এসে
ঢুকে গেছে আমার মাথায়!

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসছোনা আজ স্বাতী?

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আর স্বাতী?
*

কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন

কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন
এখানে প্রাসাদ আছে, এখানে নন্দন
চতুর্দিকে খোলা জানলা, হাওয়া আসে হাওয়া
কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন

আঙ্গুলে সেলাই করবি আমার আঙ্গুল
বুক থেকে নামবি না পারদ বা পরিতৃপ্ত ঘৃণা
শরীরে ধনুক বেঁধে সুন্দরের ছিলা রাখবি টান
কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন

আমাকে শাসাবি খুব, কষ্ট দিবি, ক্লান্তি দিবি, আর
রাত হলে স্বপ্ন দিবি শুতে দিবি বুকের খোঁপায়
শরীরে সেলাই করবি সেই সাপ, সেই আদি পাপ

হাতের পাতায় তোর বেলফুল, বক্ষময় লতা

কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন?
*

ফেরার আগে
(গোলাম সাবদার সিদ্দিকীকে)

এ কথা তো ঠিকই
ফেরার সময় হলে যে যার মন্তব্যে ফিরে যাবো।
কিন্তু তার আগে এই অন্ধকার
আলোর ভিতরে আলো
সমাজের ভালো মানুষের সমস্ত জমকালো খেলা
নারীর নিকটে গিয়ে এক আধরাত্রিবেলা
ভালোবাসা, জীবনযাপন!
জনতায় হাত ফেলে উত্তোলন,
যৌবনের কাছে কারো ফেলে আসা আর এক যৌবন,
আকাশের সুবিস্তৃত শূন্যতায় সহিষ্ণু ভুবন যদি পাই
তার আগে ভাইকে যদি ভাই বলে ডাকি

যদি দেখি, না,-
নারী তার অলঙ্কার
মাঠ তার তৃণের সবুজ
শিশু তার ত্রিভুজ-শুভ্রতা পেয়ে গেছে;

যদি দেখি, না,
পৃথিবীর কোথাও এখন আর যুদ্ধ নেই, ঘৃণা নেই, ক্ষয়ক্ষতি নেই।

তাহলেই হাসতে হাসতে যে যার আপন ঘরে
আমরাও ফিরে যেতে পারি!

হাসতে হাসতে যে যার গন্তব্যে আমরা ফিরে যেতে পারি!
*

সাইকেল

সাইকেল ছিল প্রতিবেশীর কলেরা রোগে দ্বিপ্রহরে কাফন মতো রৌদ্র খুলে
শ্যাম ডাক্তারকে ডেকে আনা;
সাইকেল ছিল মেঘমাখানো বিকেলে খালার পাহাড়ভূমির সে স্থলপদ্ম!
রাত্রিবেলা নারীশরীরের শৌখিন ঘর! আঙ্গিনাতে কাঠবাদাম!

সাইকেল ছিল মরণদাসীর বৈষ্ণবআখড়া, শীতকল্যাণে
খুলনা গিয়ে ছবিঘরে সচল দৃশ্য!

লম্বালম্বি গাছের মতো মর্মরিত সেই লোকটা,
সন্তপুরুষ বাল্মীকিকে দেখিনি, কিন্তু তাকে দেখে মনে হতো,
বাল্মীকি কি অমন ছিলেন?

সাইকেল ছিল বাঁশবেড়িয়ার বাঁশের সাঁকো,
কুমারী মেয়ের আত্মহত্যা,

যুক্তফ্রন্টের ইলেকশনে কিশোর ক’জন
স্কুলবোর্ডিং-এ শরণার্থী সারাটা রাত কাটিয়ে দিলুম হরিণ নিয়ে!
সেই হরিণটা আর দেখিনা, বুকেও নয় বনেও নয়!

সে জ্যোৎস্নাও আর আসে না!
সাইকেল ছিল পরস্পরের কুশলবার্তা, নম্রতায়িত
লঞ্চে কোরে হরিদাশপুর, একহপ্তাকার কবিগানের গৃহীত শ্রোতা,

সাইকেল ছিল যেদিন ওরা মানুষ মারলো মানুষ মারলো অপকৃষ্ট
সেদিন স্বর্গ ধর্ম ভাঙা লাথি মেরে ঈশ্বরমূলে।
*

ক্লান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়

দুপুর ঘুরে কিশোর তুমি বিকেলবেলায়
বাড়ি ফিরলে ক্লান্ত দেখায় ক্লান্ত দেখায়।
ক্লান্ত মুখটি ক্লান্ত দেখায়, ক্লান্ত চোখটি ক্লান্ত দেখায়।

দুপুর ঘুরে কিশোর তুমি বিকেলবেলায়
বাড়ি ফিরলে ক্লান্ত দেখায়! ক্লান্ত দেখায়!

কোথায় ঘোরে সারাদুপুর, ক্লান্ত কিশোর কোথায় ঘোরে?
বুকের মধ্যে কিসের একটা কঠিন দুঃখ রুক্ষ দুপুর শাসন করে,
কিশোর তুমি তার ভিতর বসেই থাকো বাড়ি ফেরোনি… বাড়ি ফেরোনা!

একহারা শরীর দোহারা জামা, দু’হাত যেনো দগ্ধ তামা,
অভিমানে বাড়ি ফেরোনা, রক্ত চক্ষু শক্ত চোয়াল
সূর্য ঘেরা সকল দেয়াল ভেঙে তুমি কোথায় যে যাও…
অভিমানে বাড়ি ফেরোনা বাড়ি ফেরোনা!

উত্তোলিত হাতের মুষ্ঠি, কী তুমি চাও?
সর্বনাশ? না সুহৃদ আকাশ? ফিরে তাকাওনা, রাস্তা চলো?

কিসের একটা কঠিন দুঃখ যেনো তোমাকে পাথর ছোড়ে
যেনো তোমাকে আউছি করে?
অভিমানে বাড়ি ফেরোনা, সারাদুপুর বাড়ি ফেরোনা বাড়ি ফেরোনা
কোথায় যে যাও…

বিকেলবেলায় যখোন ফেরাও পা দুটিকে, ক্লান্ত দেখায়
ক্লান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়,
ক্লান্ত দেখায়! তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়!
*

স্রোতে রাজহাঁস আসছে

পুনর্বার স্রোতে ভাসছে হাঁস, ভাসতে দাও
কোমল জলের ঘ্রাণ মাখুক হাঁসেরা;
বহুদিন পর ওরা জলে নামছে, বহুদিন পর ওরা কাটছে সাঁতার
স্রোতে রাজহাঁস আসছে, আসতে দাও,

বহুদিন পর যেনো রোদ আসছে, আসতে দাও
নত হতে দাও আকাশকে,
আর একটু নত হোক আলো
আর একটু নির্জন হোক অন্ধকার!

আজ তুমি, পরে নাও তোমার গহনা, দুল
তোমার আঙ্গুল হোক হেমন্তের ফুল,
আমি শুঁকি, শুঁকতে দাও!

বহুদিন পর যেনো শুঁকছি বকুল!
বহুদিন তোমার ভিতরে যাইনা, বহুদিন বকুল ফুলের ঘ্রাণ।
পাইনা এ মনে!

মনে করতে দাও তবু কোনখানে বকুলবাগান ছিল
গেরস্থের হাজার দুয়ারী ঘরবাড়ি
উঁচু আসন, সিংহাসন
মনে করো, মনে কোরে নাও
আমাদেরও সিংহাসন আছে আজও
আমাদের হাজার দুয়ারী বাড়ি আছে

মাটির ময়ূর, ঠোঁটে ঠোঁটে, ফুলে ফুল
লুকোনো ডাকবাকস আছে সবুজের কাছে
মনে করো আমাদেরও ভালোবাসা আছে
খাগের কলমে লেখা তাদের অক্ষরগুলি
ধানের শীষের মতো টলমলায় সেখানে শরীরে

তুমি মনে করো, মনে করে নাও
তোমার শরীরে শাড়ি,
গেরস্থের হাজার দুয়ারী ঘরবাড়ি
আলো আর অন্ধকার মনে করো, মনে করে নাও

আমরা নৌকার জলে ভাসতে ভাসতে যেনো প্রতীকের হাঁস
ঐ রাজহাঁস
জল থেকে আরো জলে,
ঢেউ থেকে আরো ঢেউয়ে ছড়াতে ছড়াতে
পৌঁছে যাবো আগে।
*

মানুষ
(মুশাররফ রসুলকে)

আমি যেনো আবহমান থাকবো বসে
ঠুকরে খাবো সূর্যলতা গাছের শিকড়
অন্ধকারের জল!
আমি যেনো অনাদিকাল থাকবো বসে
বিশ্রুতিময় জীবনে কল্লোল।

আমি যেনো আবহমান থাকবো বসে
আবহমান আমিই কল্লোল
সময় থেকে সভ্যতাকে রাখবো ঢেকে
যুদ্ধ মড়ক নগ্ন ফলাফল।

Exit mobile version