Site icon BnBoi.Com

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যগ্রন্থ

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যগ্রন্থ

অর্কেষ্ট্রা (১৯৩৫)

 অপচয়

প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্‌ময় রজনী,
ফেনিল মদিরা-মত্ত জনতার উল্বণ উল্লাস,
বাঁশির বর্বর কান্না,মৃদঙ্গের আদিম উচ্ছ্বাস,
অন্তরের অন্ধকারে অনঙ্গের লঘু পদধ্বনি ?

আছে কি স্মরনে,সখী, উৎসবের উগ্র উন্মাদনা,
করদ্বয়ে পরিপ্লুতি, চারি চক্ষে প্রগল্‌ভ বিস্ময়,
শুন্য পথে দুটি যাত্রী, সহসা লজ্জার পরাজয়,
প্রতিজ্ঞার বহুলতা,আশ্লেষের যুগ্ম প্রবর্তনা ?

সে-শুদ্ধ চৈতন্য, হায়, বৃথা তর্কে আজি দিশাহারা,
বন্ধ্য স্পর্শে পরিণত স্বপ্নপ্রসূ সে-গাঢ় চুম্বন ;
ভ্রাম্যমাণ আলেয়ারে ভেবেছিল বুঝি ধ্রুবতারা,
অকূল পাথারে তাই মগ্নতরী আমার যৌবন।।

মরে না দুরাশা তবু ; মনে হয় এ-নিঃস্ব জগতে
এতখানি অপচয় ঘটাবে না বিধি কোনও মতে ।।

নাম

চাই চাই আজো চাই তোমারে কেবলি |
আজো বলি,
জনশূণ্যতার কানে রুদ্ধ কণ্ঠে বলি আজো বলি—
অভাবে তোমার
অসহ্য অধুনা মোর, ভবিষ্যত বন্ধ অন্ধকার,
কাম্য শুধু স্থবির মরণ |
নিরাশ অসীমে আজো নিরেপক্ষ তব আকর্ষণ
লক্ষ্যহীন কক্ষে মোরে বন্দী ক’রে রেখেছে, প্রেয়সী,
গতি-অবসন্ন চোখে উঠিছে বিকশি’
অতীতের প্রতিভাস জ্যোতিষ্কের নিঃসার নির্মোকে |
আমার জাগর স্বপ্নলোকে
একমাত্র সত্তা তুমি, সত্য শুধু তোমারি স্মরণ ||

তবু মোর মন
চাহে নাই মোহের আশ্রয় |
জানি তুমি মরীচিকা ; তোমা সনে প্রাণ বিনিময়
কোনোদিন হবে না আমার |
আমার পাতালমুখী বসুধার ভার,
জানি, কেহ পারিবে না ভাগ ক’রে নিতে ;
আমারে নিঃশেষে পিষে, মিশে যাবে নিশ্চিহ্ন নাস্তিতে
এক দিন স্বরচিত এ পৃথিবী মম ||

জানি ব্যর্থ., ব্যর্থ সেই সন্ধ্যা নিরুপম
যবে মোর আননে নেহারি
অগাধ নয়নে তব ফলদা স্বাতীর পূণ্য বারি
উঠেছিল সহসা উচ্ছলি |
জানি সেই বনপথে, চিরাভ্যস্ত প্রেম নিবেদনে
আপনারে ছলি,
পশিনি তোমার মর্মে, নিজের গহনে
জমিয়েছিলাম শুধু মিথ্যার জঞ্জাল |
জানি, কত তরুণীর গাল
অমনি অধৈর্যভরে শতবার দিয়েছি রাঙায়ে ;
অনুপূর্ব পথিকার পারে
বজ্রাহত অশোকেরে অলজ্জায় করেছি বিনত
ক্ষণিক পুষ্পের লোভে | ক্রমাগত
তাদের পদাঙ্ক মুছে গেছে রৌদ্রে, ধারাপাতে, ঝড়ে ;
যুগান্তরে
তোমার স্মৃতিও জানি, সেই মতো হারাবে ধুলায় ||

তবু চায়, প্রাণ মোর তোমারেই চায় |
তবু আজ প্রেতপূর্ণ ঘরে
অদম্য উদ্বেগ মোর অব্যক্তেরে অমর্যাদা করে ;
অনন্ত ক্ষতির সংজ্ঞা জপে তব পরাক্রান্ত নাম—
নাম—শুধু নাম—শুধু নাম ||

শাশ্বতী

শ্রান্ত বরষা অবেলার অবসরে
প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া ;
স্বর্ণ সুযোগে লুকাচুরি-খেলা করে
গগনে-গগনে পলাতক আলোছায়া |
আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে ;
হানে মৃদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি :
মূক প্রতীক্ষা সমাপ্ত অবশেষে
মাঠে, ঘাটে, বাটে আরব্ধ আগমনী |
কুহেলিকলুষ দীর্ঘ দিনের সীমা
এখনই হারাবে কৌমুদীজাগরে যে ;
বিরহবিজন ধৈর্যের ধূসরিমা
রঞ্জিত হবে দলিত শেফালি শেজে |
মিলনোত্সবে সেও তো পড়েনি বাকি,
নবান্নে তার আসন রয়েছে পাতা :
পশ্চাতে চায় আমরই উদাস আঁখি ;
একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা ||

একদা এমনই বাদলশেষের রাতে—
মনে হয় যেন শত জনমের আগে—
সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে ;
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে ;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে |
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী ;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি ;
একটি পণের অমিত প্রগল্ ভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ দিল অবারিত ক’রে ||

সন্ধিলগ্ন ফিরেছে সগৌরবে ;
অধরা আবার ডাকে সুধাসংকেতে,
মদমুকুলিত তারই দেহসৌরভে
অনামা কুসুম অজানায় ওঠে মেতে |
ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি,
অবাধ সাগরে উধাও অগাধ থেকে ;
অমল আকাশে মুকুলিত তার হৃদি
দিব্য শিশিরে তারই স্বেদ অভিষেকে |
স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখিসম ;
সে-রোমরাজি কোমলতা ঘাসে-ঘাসে ;
পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম ;
আজ সে কেবল আর কারে ভালবাসে |
স্মৃতিপিপিলিকা তাই পুঞ্জিত করে
অমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা ;
সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিবো না |

হৈমন্তী

বৈদেহী বিচিত্র আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়
প্রচারিল আচম্বিতে অধরার অহেতু আকূতি :
অস্তগামী সবিতার মেঘমুক্ত মাঙ্গলিক দ্যুতি
অনিত্যের দায়ভাগ রেখে গেল রজনীগন্ধায়।।

ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্তলোহিত,
তরুণতরুণীশূন্য বনবীথি চ্যুত পত্রে ঢাকা,
শৈবালিত স্তব্ধ হ্রদ,নিশাক্রান্ত বিষন্ন বলাকা
ম্লান চেতনারে মোর অকস্মাৎ করেছে মোহিত ।।

নীরব, নশ্বর যারা, অবজ্ঞেয়, অকিঞ্চন যত,
রুচির মায়ায় যেন বিকশিত তাদের মহিমা ;
আমার সঙ্কীর্ণ আত্মা, লঙ্ঘি আজ দর্শনের সীমা,
ছুটেছে দক্ষিনাপথে যাযাবর বিহঙ্গের মতো ।।

সহসা বিস্ময়মৌন উচ্চকন্ঠ বিতর্ক, বিচার,
প্রাণের প্রত্যেক ছিদ্রে পরিপূর্ণ বাঁশরীর সুর :
জানি মুগ্ধ মুহূর্তের অবশেষ নৈরাশে নিষ্ঠুর ;
তবু জীবনের জয় ভাষা মাগে অধরে আমার ।।

যারা ছিল একদিন ; কথা দিয়ে, চ’লে গেছে যারা ;
যাদের আগমবার্তা মিছে ব’লে বুঝেছি নিশ্চয় ;
স্বয়ম্ভূ সংগীতে আজ তাদের চপল পরিচয়
আকস্মিক দুরাশায় থেকে থেকে করিবে ইশারা ।।

ফুটিবে গীতায় মোর দুঃস্থ হাসি, সুখের ক্রন্দন,
দৈনিক দীনতা-দুষ্ট বাঁচিবার উল্লাস কেবল,
নিমেষের আত্মবোধ, নিমেষের অধৈর্য অবল,
অখণ্ড নির্বাণ-ভরা রমণীর তড়িৎ চুম্বন ।।

মোদের ক্ষণিক প্রেম স্থান পাবে ক্ষণিকের গানে,
স্থান পাবে, হে ক্ষণিকা, শ্লথনীবি যৌবন তোমার :
বক্ষের যুগল স্বর্গে ক্ষণতরে দিলে অধিকার ;
আজি আর ফিরিব না শাশ্বতের নিষ্ফল সন্ধানে ।।

উত্তর ফাল্গুনী (১৯৪০)

নিরুক্তি

আমারে তুমি ভালবাসো না ব’লে,
দুঃখ আমি অবশ্যই পাই ;
কিন্তু তাতে বিষাদই শুধু আছে,
তাছাড়া কোন যাতনা, জ্বালা নাই।।

জনমাবধি প্রণয়বিনিময়ে
অনেক বেলা হয়েছে অবসান ;
বেজেছে ফলে কেবলই বৃথা ব্যথা,
পারিনি কভু করিতে বরদান।।

এ-ভুজমাঝে হাজার রূপবতী
আচম্বিতে প্রসাদ হারায়েছে ;
অমরা হতে দেবীরা সুধা এনে,
গরল নিয়ে নরকে চ’লে গেছে।।

অযুত নারী, তাদের প্রতিশোধে,
জাগায়ে লোভ হেনেছে অবহেলা ;
সাহারা,গোবি ছেয়েছে ভাঙা পণে,
মরমহিমা হয়েছে ছেলেখেলা।।

অসূয়া বুকে করেছে মাতামাতি
ঝড়ের রাতে বিজুলিঝলাসম;
চিনেছি তাতে আপন নীচতারে,
টুটেছে মান, উঠেছে বেড়ে তম।।

মিলনে ক্ষুধা মিটেনি কোনও কালে ;
কামনা শেষে মিশেছে এসে কামে ।
অন্ধ আশা রুদ্র বিরহেরে
ভাববিলাসী করেছে পরিণামে।।

হয়ত তাই তোমার অনাদরে
আজিকে আমি হই না বিচলিত ;
শিখেছি ঠেকে ব্যর্থ ভালোবাসা,
কালের কাছে অতনু পরাজিত ।।

হৃদয় তবু বিষাদে ভ’রে ওঠে
নিরুদ্দেশ শুন্যে যবে চাই ;
পাই না ভেবে শান্তিতে কি হবে,
সাধনাতে যে সিদ্ধি হেথা নাই।।

নন্দনের বদ্ধ দ্বার, জানি,
যাবে না খুলে তোমার করাঘাতে;
অমৃতযোগে প্রেতের কানাকানি ;
ঘুচাবে ভেদ তৃপ্তি-শোচনাতে।।

তথাপি মিছে আত্মসমাহিতি ;
নিরাসক্তি আসক্তিরই ভেক ;
নাস্তি যার পৃষ্ঠে, পুরোভাগে,
সমান তার বিবেক, অবিবেক।।

আত্মা সদা স্বগত,একা বটে,
তাই কি হেয় দেহের পরিচিতি?
থাক না তাতে তৃষিত অচিরতা,
বাকি যা-কিছু, সবই যে অনুমিতি।।

প্রতিদান

ওগো গরবিনী,সত্রে তোমার
যত উপবাসী নিত্য জুটে,
আমি তো তাদের একজন নই,
চাব না ভিক্ষা চরনে লুটে।
তা ব’লে ভেব না ক্ষুধা নেই মম,
জানি না অভাব নিষ্ঠুরতম,
আশা-নিরাশার দোদুল দোলায়
নামিনি পাতালে, উঠিনি কূটে ।
প্রতিদানহীন ডান নিতে তবু
আসিনি লোভীর সঙ্গে জুটে ।।

বহুবার বিধি বহু দিক হতে
বহু বঞ্চনা করেছে মোরে
খনে খনে তবু অলোকের স্নেহে
জীবন আমার গিয়েছে ভ’রে ।
কপট পাশায় পৃথিবীপতিরে
বনে পাঠায়েছে অবনত শিরে ;
দ্বৈরথরণে তারই মাহাত্ম্য
দিয়েছে আবার দ্বিগুন ক’রে।
শাপ ও আশিস্‌, সুধা আর বিষ
একত্রে বিধি বিতরে মোরে ।।

যদিও আজিকে সম্পদহীন
পথে পথে ঘুরি মৌন দুখে,
তবু অরূপের অক্ষয় স্মৃতি
সঞ্চিত আছে আমারই বুকে ।
আমি জানি কোথা কোন পল্বলে
সোনার সবিতা তিলে তিলে গলে,
বকুলবনের কোন্‌ কোণে শশী
দেখে মুখছবি মুকুরে ঝুঁকে ।
তারার মেলায় যে গণে প্রহর,
অতন্দ্রিত সে আমারই দুখে ।।

যদিও আজিকে বীত নিঃশ্বাস,
দীর্ণ আমার মোহন বেণু,
তবু হয়েছিল সে-সুরে সিদ্ধি,
যা শুনে ভ্রষ্ট কল্পধেনু
ফিরে আসে গোঠে গোধূলিবেলায়,
চপলতা জাগে রাধিকার পায়,
মধুমালতীর বন্ধ্যা শাখায়
উড়ে এসে লাগে সৃজনরেণু ।
দেবতারা রাতে দীপ্র নয়নে
শুনে গেছে মোর দিব্য বেণু ।।
যেই বিভিষিকা ছায়ার সমান
ফেরে অহরহ রূপের পাছে,
বহুবার তার আকার,প্রকার
ব্যক্ত হয়েছে আমার কাছে।
আমার মনের আদিম আঁধারে
বাস করে প্রেত কাতারে কাতারে ।
প্রাক্‌পুরাণিক বিকট পশুর
দায়ভাগ মোর শোণিতে নাচে ।
সমুখে মরুর মরীচিকা ডাকে,
প্রলয়পয়োধি গরজে পাছে ।।

খিন্ন হলেও আমার নয়ন
দিব্যদৃষ্টি তাতেই রাজে।
আমি জানি কেন নিগূঢ় বেদনা
নবপ্রণয়ীর মরমে বাজে।
নির্মিত আমি পরশ পাথরে;
মৃন্ময়ী হয়য় সোনা মোর করে ।
জানি উর্বশী চিরযৌবনা
কারে পরখিতে জরতী সাজে ।
বুঝি আমি কোন্‌ নিগম অর্থ
ইতরের অপভাষায় রাজে ।।

তোমার প্রাণের পরতে পরতে
যে-অনাম তৃষা গুমরি কাঁদে,
অনুকম্পায়ী জীববীণা মোর
ঝংকৃত আজ সে অনুনাদে।
অচিন পথের দূতরূপে তাই
প্রতিদিন এসে দুয়ারে দাঁড়াই ;
অভাবনীয়ের আহ্বান নিয়ে
অবক নয়ন তোমায় সাধে ।
নিত্য জ্বালায় কলুষকালিমা
জানি ; তাই হিয়া দরদে কাঁদে ।।

নিয়ে যাবো আমি তোমারে যে –পথে,
সে-পথে একাকী যায় না যাওয়া ;
পদে পদে তার কাঁটার আঘাত,
পাকে পাকে হাঁকে পাগল হাওয়া ;
হিতবুদ্ধির তড়িৎ ভ্রুকুটি
দূরদিগন্তে উঠে ফুটিফুটি;
ভ্রমে আশেপাশে হিংসালু শিবি ;
পশ্চাতে আর যায় না চাওয়া ।
সর্বহারার দুর্গম পথে
নিয়ামক বিনা যায় না যাওয়া।।

তবু পরিহরি বিত্তের মোহ
রিক্ত অয়নে দাঁড়াও নেমে।
তোমার ত্যাগের দাম ধ’রে দেব
অনির্বচন অমর প্রেমে ;
নিয়ে যাব যেথা নেই দেশ-কাল,
নেই ব্যাধি-জরা, ক্ষয়-জঞ্জাল,
সত্য যেখানে স্বপ্নসুষমা,
ভেদ নেই যেথা সীসায় হেমে।
স্বার্থপরের অর্ঘ্যের লোভ
ত্যাগ ক’রে এসো নিভৃতে নেমে ।।

মোদের সমুখে নন্দনবন
আগলমুক্ত আবার হবে ;
রবে পদতলে অলকানন্দা,
ইন্দ্রধনুর তোরণ নভে ।
রচি ফুলশেজ চ্যুত পারিজাতে
পীযূষপেয়ালা তুলে দেব হাতে ।
উধাও মলয় দ্যুলোকে-ভূলোকে
মোদের প্রেমের কাহিনী কবে।
মোর অসাধ্যসাধনে, মানবী,
নিশ্চয় তুমি সিদ্ধ হবে।

ক্রন্দসী (১৯৩৭)

অকৃতজ্ঞ

আমার মৃত্যুর দিনে কৌতূহলী প্রশ্ন করে যদি-
সাধিলাম কি সুকৃতি, হব যার প্রসাদে অমর ?
মেনে নিও মুক্ত কণ্ঠে, নেই মোর পাপের অবধি ;
সারা ইতিহাস খুঁজে মিলিবে না হেন স্বার্থপর ।।

অজস্র ঐশ্বর্য মোরে অর্পিয়াছে সমুদার বিধি ;
ভুঞ্জেছি নিষ্কুন্ঠ মনে সে-সকলই প্রাপ্য ভেবে আমি ।
পেয়েছি অমিত সুধা আমন্থিয়া কালের বারিধি ;
করেছি তা আত্মসাৎ, শুধু বিষ কন্ঠে গেছে থামি ।।

দেখেছি এ-মরচক্ষে নটরাজ মহাশূন্যে নাচে;
শুনেছি পার্থিব কানে সে-নক্ষত্রনুপূরের ধ্বনি।
তথাপি আমার বীণা বাজায়েছে বেসুর পিশাচে ;
অধরার অনুনাদে সাড়া কভু দেয়নি ধমনী।।

ফাল্গুন অঙ্গনে মোর ছড়ায়েছে অশোক পলাশ।
দক্ষিণের বাতায়নে কৃষ্ণচূড়া হেনেছে বৈশাখ ।
জাগায়ে মেদুর মেঘে চপলার চকিত বিলাস
বিকচ কদম্বকুঞ্জে আষাঢ় দিয়েছে মোরে ডাক ।।

শেফালিরঞ্জিত হস্তে নবান্নের নৈবেদ্য এনেছে
অতিক্রমি কাশবন সিতাম্বর শ্যামল আশ্বিন ।
কাননে ছড়ায়ে সোনা উদাসী অঘ্রান চ’লে গেছে
পৌষের পাথেয় দিতে সর্বহারা হয়েছে বিপিন ।।

তথাপি অভাব মোর মিটে নাই মুহূর্তের তরে ;
অপব্যয়ী প্রকৃতির অরক্ষিত দানসত্র থেকে
অপহরি মহাবিত্ত আনিয়াছি বৎসরে বৎসরে
অন্তর্ভৌম কোষাগারে মরুলুপ্ত সুড়ঙ্গের পথে ।।

সে-উদার দৃষ্টান্তেও হয় নাই কার্পণ্য লজ্জিত,
সন্দেহের অবকাশ পায় নাই গৃধ্নুতা আমার।
ফিরেছি ধনীর দ্বারে অপলাপী চীবরে সজ্জিত,
বলেছি নাটকী স্বরে, বিশ্বে শুধু সত্য অবিচার ।।

অন্তরঙ্গ সখাসম ফুলধনু আমার ইঙ্গিতে
ফুটায়েছে পারিজাত হিমরুক্ষ তুঙ্গ তপোবনে ;
স্বয়ংবরা শৈলসুতা এসেছে কৌমার্য নিবেদিতে ;
টুটেছে দুঃস্বপ্ন মোর ব্রহ্মান্ডের মঙ্গলাচরণে ।।

তবু মোর নীল কন্ঠে উঠে নাই কামোদ ঝংকারি;
অনভ্যস্ত রসনায় উৎসরিত হয়নি দীপক ।
মোর প্রিয়সম্ভাষণে বিরহের আশঙ্কা সঞ্চারি,
অন্তরের দ্বার জুড়ে হেসেছে অশ্লীল বিদূষক ।।

গোপন বৈভব আমি ব্যক্ত কভু করিনি প্রিয়ারে ;
বুঝি নাই বিনিময়, বিনা বরে কুড়িয়েছি পূজা;
অভিব্যাপ্ত ক্ষুধা মম অবরোধে ঘিরেছে তাহারে ;
পরিতৃপ্তি বিতরিতে পারেনি স্বয়ং দশভূজা।।

নিমেষ না যেতে তাই ফুরায়েছে প্রথম আবেশ;
উন্মীলিত বিলোচন জ্বলিয়াছে বিপ্রবলব্ধ লোভে,
অচিরাৎ সে-আগুন কামেরে করেছে ভস্মশেষ ;
অপর্না সেজেছে চন্ডী আত্মহিতে মোর উপদ্রবে ।।

কেবলই চেয়েছি আমি, ক্ষতি কভু ছোঁয়নি আমারে ;
কোনওদিন বজ্রাঘাতে সর্বস্বান্ত করেনি উর্বশী ;
মোর তারাদীপাবলী মূলাধার অমার ফুৎকারে
কখনও যায়নি নিবে, ধংসমূক হয়নি ক্রন্দসী ।।

শিখিনি কদাচ আমি কাম্য যার নিশ্চিন্ত অমরা,
অনির্বাণ কুম্ভীপাকে হতে হয় তাহারে নিখাদ ।
শুধুই জঞ্জালে তাই ভরিয়াছি প্রাণের পসরা ;
গায়ত্রী জপেছি, কিন্তু শোনা গেছে নিরর্থ নিনাদ ।।

আমার মৃত্যুর দিনে, তাই যদি অলস জিজ্ঞাসু
মাগে শবপরিচিতি, বিনা ভাষ্যে বোলো তারে,সখা,-
জগতের কোনও কাজে লাগেনি এ-অখ্যাত গতাসু,
যায়নি অনাথ ক’রে কোনও মৌন হৃদয়-অলকা।।

উটপাখি

আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি ?
কেন মুখ গুঁজে আছো তবে মিছে ছলে ?
কোথায় লুকোবে ? ধু-ধু করে মরুভূমি ;
ক্ষ’য়ে-ক্ষ’য়ে ছায়া ম’রে গেছে পদতলে |
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই ;
নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ |
নিষাদের মন মায়ামৃগে ম’জে নেই ;
তুমি বিনা তার সমুহ সর্বনাশ |
কোথায় পালাবে ? ছুটবে বা আর কত ?
উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা |
প্রাকপুরাণিক বাল্যবন্ধু যত
বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা ||

ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে ?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া |
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে ?
কেবল শূণ্যে চলবে না আগাগোড়া |
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও ;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনো বিপদপ্রাজ্ঞ নও |
নব সংসার পাতি গে আবার, চলো
যে-কোনো নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে |
মিলবে সেখানে অনন্ত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্শনে ||

ল্পলতার বেড়ার আড়ালে সেথা
গ’ড়ে তুলবো না লোহার চিড়িয়াখানা ;
ডেকে আনবো না হাজার হাজার ক্রেতা
ছাঁটতে তোমার অনাবশ্যক ডানা |
ভূমিতে ছড়ালে অকারি পালকগুলি
শ্রমণশোভন বীজন বানাবো তাতে ;
উধাও তাহার উড্ডীন পদধূলি
পুঙ্খে পুঙ্খে খুঁজবো না অমারাতে |
তোমার নিবিদে বাজাবো না ঝুমঝুমি,
নির্বোধ লোভে যাবে না ভাবনা মিশে ;
সে-পাড়াজুড়ানো বুলবুলি নও তুমি
বর্গীর ধান খায় সে উনতিরিশে ||

আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দুজনে সমান অংশিদার
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার |
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি |
অন্ধ হ’লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে ?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি |
ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে |
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক’রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি :
তুমি নিয়ে চল আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে বন্ধু আমি লোকায়তে বাঁধি ||

জাতিস্মর

নাথু সংকটে হাঁকে তিব্বতী হাওয়া ।
প্রাকৃত তিমিরে মগ্ন চুমলহরি ।
ছঙ্গু-সায়রে কার বহিত্র যাওয়া
অপর্ণ বনে দিয়েছে রহস ভরি ।।

সুহৃদ আগুন নিবে গেছে গৃহকোণে ;
শ্রান্তসাথীরা স্বপনে আপনহারা ;
আমি শুধু বসে তুষারিত বাতায়নে
প্রহরে প্রহরে গুণি খসে কত তারা ।।

অঙ্গ তুহিন, তপ্ত আমার মাথা,
ক্লান্ত, তথাপি নিদ্রা আসে না ডাকে ;
বাণীহীন কোন্‌ অনাদি বিষাদগাথা
গুঞ্জরে বিস্মরণের ফাঁকে ফাঁকে ।।

হিমানীবিজন এই দুর্গম দেশে,
মনে হয় যেন, কে আমার অনুগামী ;
হয়তো বা আমি ভুলে গেছি আজ কে সে,
কিন্তু ভোলেনি তারে অন্তর্যামী ।।

বিগত জনমে, এই পর্বতশিরে,
এমনই নীরব প্রাগিতিহাসিক রাতে
শিকার সমাপি এসেছিনু ঘরে ফিরে
মৃগের বদলে তাহারে কি ল’য়ে সাথে ?

মিনতি আমার প্রথমে ধরেনি কানে ;
কুতিল ভ্রুকুটি মোছেনি ললাটে ত্বরা ;
তার পরে কেন – তা কেবল সেই জানে-
অযাচিতে হল সহসা স্বয়ংবরা ।।

চ্যুত বল্কলে নিবে গেল দীপখানি ;
বাহিরের হিম মুকুরিল দ্রব চোখে ;
হঠাৎ তাহার লঘু ভাস্বর পাণি
খুঁজিল আমারে প্রাক্তন নিরালোকে ।।

আবার কি তার আদিম নিমন্ত্রণী
আহ্বানে মরে অমৃতের অভিসারে ?
কাঁদে সেদিনের প্রণব প্রতিধ্বনি
প্রতন গিরির গহ্বরকারাগারে?

পুরাণপুরুষ ছাড়া পাবে নিমেষে কি?
মাটির মানুষ মিলিবে মাটির সনে?
বিদগ্ধ প্রাণী, এ কি মরীচিকা দেখি ?
ফিরিব প্রভাতে পরিচিত পরিজনে ।।

মৌল আকূতি মরমেই যাবে ম’রে।
জনশুন্যতা সদা মোরে ঘিরে রবে।
সামান্যাদের সোহাগ খরিদ ক’রে
চিরন্তনীর অভাব মিটাতে হবে ।।

বর্বর বায়ু চিরায়ু অচলচূড়ে
মুছে দিবে মোর অশুচি পায়ের রেখা ।
মার্জিতরুচি জনপদে ,বহু দূরে,
ভিড়ে মিশে আমি ভেসে যাব একা একা ।।

 পরাবর্ত

ছুটেছে গৈরিক পথ নির্বিকার সন্ন্যাসীর মতো
নির্গুণ নির্বাণভরা, নিরাকার শূন্যের অন্বেষে ;
নিরাশ্রয় আঁখিপাখী নিশাক্রান্ত,অশক্ত,আহত,
ঘুরে মরে দিশে দিশে মরুময় অজানা বিদেশে ;
যে-বিরল পান্থদল ওই দূরে দিগন্তের পটে
চিত্রার্পিত করেছিল মানুষের বিরাট সাধন,
তাদের মৃন্ময় মূর্তি ধুয়ে গেছে বৃষ্টির ঝাপটে ;
পলাতক চক্রবালে উল্লসে ধূলার আবর্তন ;
সমুদ্যত ভবিতব্য জগদ্দল নৈঃশব্দ্যের ভারে
দলিছে দুর্বার দর্পে অতীতের চারণসংগীত ;
রুদ্রের নয়নদগ্ধ মদনের প্রেত বারেবারে
করে যেন বজ্রাগ্নিতে অনুতপ্ত ভ্রমের ইঙ্গিত ;
বিক্ষিপ্ত নৈরাশকণা পুঞ্জীভূত হয়ে ঘন মেঘে
হানিছে জীবনাকাশে বিরঞ্জন আঁধার সমতা ;
আত্মধিক্কারের ঘূর্ণি রিক্ত বক্ষে ধেয়ে আসে বেগে ;
ঝ’রে পড়ে লক্ষ ধারে ভারাতুর,নির্লজ্জ মমতা ।।

ঊষার মাহেন্দ্রক্ষণে, পৌত্তলিক প্রথম ফাল্গুনে,
ভাবিলি মনোজ্ঞা ব’লে যে-অচেনা অবগুণ্ঠিতারে
দূর থেকে দেখে শুধু, কেবল নিরর্থ নাম শুনে
ফিরিলি ছায়ার মতো এতদিন যার অনুসারে,
আজি সেই মোহিনীর জরাজীর্ণ, প্রচ্ছন্ন স্বরূপ
ব্যক্ত হয়ে থাকে যদি বিদ্যুতের নির্দয় আলোকে ;
বৈহাসিক অবিশ্বাসী ঢালে যদি বিষাক্ত বিদ্রূপ
স্বর্গচ্যুত কৈশোরের অভিব্যাপ্ত অরুন্তুদ ক্ষতে ;
তবুও কেমনে, কবি , অস্বীকার করিবি সুন্দরে ;
বলিবি অলীক পদ্ম,সত্য শুধু পঙ্কমূল তার ?
গরিমারে মিথ্যা জেনে নি:সংশয়ে কহিবি কি ক’রে
লঘিমাই সনাতন, বস্তুবিশ্ব শুধু ধ্বংসসার ?
সংগীতের রসায়নে চেয়েছিলি করিতে নির্মাণ
সমুচ্চ সুবর্ণলঙ্কা ;আসুরিক সে-মহাপ্রয়াস
ধূমাঙ্কিত ব্যর্থতায় হয়ে থাকে যদি অবসান,
তবে ভস্মমসিপাতে স্বাক্ষরিত কর্‌ সর্বনাশ ।।

তুই মূঢ়, বরেছিলি অনিশ্চিত –বক্রতা-বিহীন,
প্রাসাদনিবৃত্ত, ঋজু, স্থিরলক্ষ্য প্রশস্ত সরণী,
আদিম বন্যতা যার পূর্বগামী করিল মসৃণ,
যার হিংসা, প্রতিহিংসা বক্ষ পেতে রোধিল অগ্রণী ।
কনককণিকা-খচা,চেয়েছিলি, সান্দ্র অবচ্ছায়া,
নিয়ন্ত্রিত শাল্মলীর মর্মরিত প্রবীণ বীথিকা,
মলয়বীজনস্নিগ্ধ, নিরাপদ প্রগতির মায়া,
পুষ্পের আশীষ-বৃষ্টি, বিহঙ্গের বন্দনাগীতিকা ।
তুই চেয়েছিলি,লোভী,পথপার্শ্বে বিস্মিত নয়ন,
উৎসবের পীতাম্বর,করতালি কঙ্কনমুখর,
সম্মুখে মঙ্গলঘট, রক্তধ্বজ বিজয়তোরণ,
পশ্চাতে ধ্বংসের ধূলি, নির্জিতের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ।।

আজি সে-সুখের নিদ্রা অকস্মাৎ তুতিল কি, কবি?
গোলাপী নেশায় ভরা রুদ্ধ আঁখি ফুটিল সহসা?
বিবর্ণ দিনের দীপ্তি মুছে দিল সে-চলন্ত ছবি,
ভাতিল দৈনিক দৈন্য , ঘুচিল সে-দয়ালু তমসা ?
বুঝিলি কি আচম্বিতে সাঙ্গ তোর স্বপণপ্রয়াণ,
সে নহে তো শোভাযাত্রা, যৌবনের শবযাত্রা সে যে;
তাই নাই পুষ্পবৃষ্টি, বন্দীদের উচ্চ জয়গান ;
নিরিক্ত প্রস্তরপথ দগ্ধ তাই স্পন্দমান তেজে ?
সরল বিস্ময় টুটে অন্তর্দৃষ্টি ফুটিল কি চোখে ;
বুঝিলি এ-বাটে যারা লঘু পায়ে গেছে তোর আগে,
তারা নয় অতিনর; আত্মহারা গড্ডলিকা তোকে
অভিযুক্ত করে গেছে উদ্‌ভ্রান্তির মৌল দায়ভাগে ;
তাই তোর বৈজয়ন্তী দর্শকের বিদ্রূপ জাগায়,
বিপ্রলব্ধ অনুযাত্র শঙ্খনাদে রহে নিরুত্তর ;
প্রতীকীর অশ্বমেধ শুধু শুন্যে অধিকার পায়,
নিশ্চিন্ত স্বর্গের হাস্যে অপ্রতিষ্ঠ ত্রিশঙ্কু অমর ?

কোন জন্মান্ধের কাছে শিখেছিস, ওরে অন্ধ কবি,
ব্রহ্মান্ডনেমীর কেন্দ্র্র বৃত্তিবদ্ধ, বিকল মানুষ ;
প্রাণের প্রথম প্রৈতি তার মনোবাসনার ছবি ;
জন্মমৃত্যুপরম্পরা শুধু তার করুনা, পৌরুষ ;
উদ্দাম অভীপ্সা তার মূর্ত লক্ষ তারার কম্পনে ;
তার দীর্ণ দীর্ঘশ্বাস বাতাহত বেণুতে ফুকারে ;
তার আকস্মিক খুশি শ্রাবণের নৈশ বরিষণে ;
মুমুক্ষু বিদ্রোহ তার চৈত্রে স্তব্ধ জলদে হুংকারে ;
বেতস বিরহমূক সদা তার মুখস্পর্শ মাগে ;
লুতায় মানিনী যূথী, কণ্ঠাশ্লেষ না পেয়ে, ধূলায় ;
অনঙ্গের লক্ষ্যভেদে মধুমাসে সে যদি না জাগে,
বিধাতা প্রমাদ গণে, চরাচর ম’রে,ঝ’রে যায় ;
অব্যক্তির গর্ভ হতে রহস্যের নিত্য নিরুদ্দেশে
উধাও সে ধূমকেতু দীপ্র সেতুসংরচন করে :
এই মুগ্ধ মায়াবাদ কিনিতে কি নি:স্ব হলি শেষে,
বোঝাই সোনার তরী রেখে এলি বিদেহনগরে ?

কুশের ফুৎকারজাত বুদ্বুদের স্ফটিকমণ্ডলে
বিচ্ছুরিত বর্নচ্ছটা অন্তর্হিত হলে মহাকাশে
সনির্বন্ধ শিশু যথা ডুবে যায় অশ্রুর অতলে,
বিশ্বের বৈচিত্র্য খোঁজে আপনার ভাবালু বিলাসে ;
তুই ও তেমনই কবি ভেবেছিলি চির চিরন্তন
কালাবর্ত পরিস্ফীত, পরজীবী রঙের স্বপ্নেরে।
ফুরাল তাহার বেলা ; ঝেড়ে ফেলে সংহত ক্রন্দন,
ফিরে যা সংসারে পুন ক্রন্দসীর ঊষরতা ছেড়ে ।
অজ্ঞাত সিন্ধুর মর্মে, জাদুকরী অধরা যেখানে
উৎকর্ণ অর্ণবপোত ধ্বংস করে অপ্সর সংগীতে,
সেথা বাঁধি নিজ দেহ,মুদি চক্ষু, অবরুদ্ধ কানে
পারায়ে যা পরিচিতা সুন্দরীরে বরমাল্য দিতে ।।

যদিও আত্মার ঐক্য অসম্ভব সে- জড়জগতে,
সুলভ সমানধর্মী তবু সেথা নিরবধি কালে;
আকর্ষণ,বিকর্ষণ তুল্যমূল্য সে-স্বতন্ত্র পথে,
সান্নিধ্য,দূরত্ব মিথ্যা,ভেদ নাই আকাশে পাতালে;
ব্যতিক্রম,অপচার নিষিদ্ধ সে-নৈরাজ্যে নিশ্চয়,
পরিণতি স্বত:সিদ্ধ, অনিবার্য স্বায়ত্তশাসন ;
সেখানে সম্পূর্ণ বৃত্ত, শুধু ভগ্ন কুটিলতা নয়,
অতীত অসার স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ অসত্য ভাষণ;
সেখানে অনন্ত বাহ্য; সে-অসীমে অণুও শ্রদ্ধেয়,
সংক্রান্তি সংক্ষিপ্ততম, অগ্রগতি অপচয়হীন,
ভ্রান্তি শুধু আপেক্ষিক, নির্বিকার প্রকৃতি প্রমেয়,
প্রলয় অভাবনীয়, সর্বনাশে নির্মিত নবীন।
শূন্য যেথা শুন্য নয়, ভারাতুর সংসক্ত তড়িতে,
প্রসার সহস্রমুখী, হরিহর মুক্তি আর কারা,
হয়ত একদা সেথা মণিময় অমারজনীতে
পাবি,কবি, অকস্মাৎ অজানিত দয়িতের সাড়া ।
সেথা কি অগুরুর গর্ভে সুকুমারী কোনও নীহারিকা
নিজের অজ্ঞাতসারে আগন্তুক দৈবেরে বহে না,
বেদে কিংবা ইতিহাসে নেই যার কোষ্ঠীপত্র লিখা,
শুধিবে যে- ক্ষেমংকর প্রবঞ্চিত মানুষের দেনা ?
কিন্তু তোর ভাগ্যগুনে সে-আশাও যদ্যপি না মেটে,
অহৈতিক অনিশ্চয়ে অবশেষে হারায় প্রমিতি ;
বিস্ফোটক বস্তুবিশ্ব যায় যদি বিপ্রকর্ষে ফেটে,
বিশৃঙ্খল বিসংবাদে ভ’রে ওঠে আবার অমিতি,
পরিব্যাপ্ত পরমাণু নিপাতন প্রচারে নিখিলে,
হিরণ্ময়ের ক্ষয়ে সীসকের পরমায়ু বাড়ে,
কেবল আদিম জাড্য প্রাথমিক মাৎস্যন্যায় মিলে
সমষ্টির অভিসন্ধি নিঃসহায় ব্যষ্টিরে সংহারে ;
তবেই বুঝিবি ওই নিরপেক্ষ নক্ষত্রনিচয়,
নিপট কপট ওরা,শুধু নাম, জনশ্রুত নাম ;
মাটিই একান্ত সত্য,আর সব বৃথা বাক্যব্যয়,
সহস্র ইন্দের শবে রত্নপ্রসূ এই মর্ত্যধাম ।
হয়ত সে-শুভদিনে মরণের তুঙ্গ চূড়া হতে
সিদ্ধির ষোড়শ কলা কেড়ে নেবে বামন মানুষ ;
সুন্দরের পদরেখা ধরা দেবে ধূলাঢাকা পথে ;
আবার সপ্তম স্বর্গে স্থান পাবে ধর্মিষ্ঠ নহুষ ।।

সমাপ্তি

বরষাবিষন্ন বেলা কাটালাম উন্মন আবেশে |
জনশূণ্য হৃদয়ের কবাট উদ্ঘাটি’,
স্মরণে চলাচল করিলাম সহজ, সরল |
দৃষ্টিহারা নেত্রপাতে দেখিলাম সন্নত আকাশে
এইমতো আর-এক দিবসের ছবি |
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির বিলাপে
শুনিলাম সে কণ্ঠের স্নেহসম্ভাষণ |
অর্গলিত বাতায়নে ঝটিকার নিরর্থ আক্রোশে
বিচ্ছেদবিধ্বস্ত হিয়া বাখানিলো ক্ষুব্ ধ অক্ষমতা
নির্বিকার, নিরুত্তর, রুক্ষ বিধাতারে ||

এলো সন্ধ্যা রক্তবরিষণ ;
দিনান্তের মুমূর্ষু বর্তিকা
প্রাকনির্বাপণ দীপ্তি প্রজ্বলিত করিল সহসা
প্রাণের অন্তিম শক্তিব্যয়ে ;
তার পর অন্তরে বাহিরে
অন্ধকার বিস্তারিল শবপ্রাবরণী ||

মনে হ’লো আশা নাই
মনে হ’লো ভাষা নাই পিঞ্জরিত ব্যর্থতা বলার |
মনে হ’লো
সংকুচিত হ’য়ে আসে মরণের চক্রব্যূহ যেন |
মনে হ’লো রন্ধ্রচারী মুষিকের মতো
শটিত জঞ্জালকণা কুড়ায়েছি এতকাল ধ’রে
কৃপণের ভাণ্ডারে ভাণ্ডারে ;
এইবার ফুরায়েছে পালা,
ঘাতক যন্ত্রের কারা অবরুদ্ধ হ’লো অবশেষে ;
এইবার উত্তোলিত সম্মার্জনীমূলে
পিষ্ট হবে অচিরাৎ অকিঞ্চন উঞ্ছবৃত্তি মম ||

সৃষ্টিরহস্য

আয়ুর সোপানমার্গ বহু কষ্টে অতিক্রম করি
উন্মুক্ত মৃত্যুর প্রান্তে ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়ায়েছি এসে ;
সিন্ধুর ভাস্বর আঁখি খোঁজে মোরে নিম্নে নিরুদ্দেশে ;
আমার আরতিদীপ মহাশুন্যে সাজায় শর্বরী ।।

সম্মুখে নিখিল নাস্তি, পৃষ্ঠদেশে মৌল নীরবতা ;
প্রশান্তি দক্ষিণে, বামে ; জনহীন, অন্তর,বাহির।
তবু কার আবির্ভাবে কণ্টকিত আমার শরীর ;
অবচেতনার তলে গুমরে কী জাতিস্মর কথা?

তবে কি বিরাট শূন্য শূন্য নয়, সাগরের প্রেত ;
উদ্বেল বিক্ষোভ তার পরিণত বিদেহ ঈথারে?
তবে কি দুর্মর মর্ত্য ক্রন্দসীতে ক্রন্দন বিথারে;
শস্যের মিসরী শবে উপ্ত সম্ভাবনার সংকেত ?

নির্লিপ্ত আলোর দ্বীপ নয় ওই দিব্য নীহারিকা,
কালের প্রপাতে মগ্ন বাসনার ভাসমান ফেনা ?
অবচ্ছিন্ন তারারাশি, ওরা চিরদিনকার চেনা
পশুদের স্থুল সত্তা, লালসার মূর্ত বিভীষিকা ?

নাই নাই মৌন নাই, সর্বব্যাপী বাঙ্‌ময় জগৎ ;
নির্বাণ বুদ্ধির স্বপ্ন, মৃত্যুঞ্জয় জ্বলন্ত হৃদয় ;
হয়ত মানুষ মরে, কিন্তু তার বৃত্তি বেঁচে রয় ;
জন্ম হতে জন্মান্তরে সংক্রমিত প্রত্ন মনোরথ ।।

কপোল কল্পনা ত্যাগ ; নিরাসক্তি অসাধ্যসাধন;
অনন্তপ্রস্থান মিথ্যা ; সত্য শুধু আত্মপরিক্রমা ;
বিদ্রোহে স্বাতন্ত্র্য নাই ; মুক্তি মানে নিরুপায় ক্ষমা ;
সৃষ্টির রহস্য মাত্র আলিঙ্গন, পুনরালিঙ্গন।।

তন্বী (১৯৩০)

শ্রাবণবন্যা

সংকীর্ণ দিগন্ত-চক্র ; অবলুপ্ত নিকট গগনে ;
পরিব্যাপ্ত পাংশুল সমতা ;
অবিশ্রান্ত অবিরল বক্রধারা ঝরিছে সঘনে ;
হাঁকে বজ্র বিস্মৃত মমতা ;
প্লাবিত পথের পাশে আনত বঙ্কিম তরুবীথি
শিহরিছে প্রমত্ত ঝঞ্ঝায় ; নিমজ্জিত প্রহরের বৃতি ;
ভেদ নাই উষায় সন্ধ্যায় ||

পথস্থ কুটিরদ্বারে ভয়ে পান্থ নিয়েছে আশ্রয় ;
সিক্ত গাভী ছুটে চলে গোঠে ;
কপোত কুলায় কাঁপে ; দাদুরী নীরব হয়ে রয় ;
পুষ্পবুকে অশ্রু ভ’রে ওঠে ;
নিষিক্ত স্তব্ধতা ভেদি, প্রলয়ের হুংকার-রণনে,
পরিপ্লুত নদীর কল্লোলে,
উন্মাদ শ্রাবণবন্যা ছুটে আসে ভৈরব নিঃস্বনে,
অবরুদ্ধ পরান-পল্বলে ||

দশমী (১৯৫৬)

প্রতীক্ষা

পাতী অরণ্যে কার পদপাত শুনি
জানি কোনও দিন ফিরবে না ফাল্গুনী;
তবে অঞ্জলি উদ্যত কেন পলাশে?
বনের বাহিরে ক্ষওয়া মাটি ধূ ধূ করে;
নেই ফসলের দুরাশাও অম্বরে;
যা ছিল বলার, কবে হয়ে গেছে বলা সে।।

মহাশূন্যের মৌনে পরিস্ফীত,
বিবিক্তি আজ বেষ্টনীবিরহিত;
অধুনায় নিশ্চিহ্ন অতীত, আগামী;
নাস্তিতে নেতি স্বতঃসিদ্ধ প্রমা,
সোহংবাদীর আর্তি আত্মোপমা,
অগতির গতি মনোরথ বৃথা লাগামই।।

আরও এক বার, হাজার বছর আগে,
বিপ্রলব্ধ আস্থা অন্তরাগে
খুঁজে পেয়েছিল উজ্জীবনের প্রেরণা;
এবং আবার সহস্র বৎসর
পূবে আসে বটে, তবু মন্বন্তর
মানবেতিহাসে সর্বনাশেরই দেশনা।।

অন্তত এতে সন্দেহ নেই আর
অলাতচক্রে ঘুরে ঘুরে, সংসার
অনাদি অমাকে আনে আমাদের গোচরে;
পুঞ্জ পুঞ্জ ব্যক্তির বুদ্ধুদ,
সময়ের স্রোতে অচির, অরুন্তুদ,
মমতার জোট পাকায় এ-চরে, ও-চরে।।

অভাব হয়তো স্বভাবেরই অগ্রজ :
নিরবধি তাই প্রভাসে ফুরায় ব্রজ–
প্রতিজ্ঞা রাখে মরণ ত্রাতার বদলে;
বিশৃঙ্খলার পরাকাষ্ঠায় স্থাণু,
পৃথিবী অনাথ; যথেচ্ছ পরমাণু;
প্রগতিক শুধু কালভৈরব সদলে।।

অতএব কারও পথ চেয়ে লাভ নেই :
অমোঘ নিধন শ্রেয় তো স্বধর্মেই;
বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী।
অনুমানে শুরু, সমাধা অনুশ্চয়ে,
জীবন পীড়িত প্রত্যয়ে প্রত্যয়ে :
তথাচ পাব না আমি আপনার দেখা কি?

কলকাতা
২৭ জুলাই ১৯৫৪

প্রতিধ্বনি (১৯৫৪)

অধঃপাত

অনাচারে ডোবে নিসর্গসুন্দরী-
মানবধর্মে নিয়েছে কি সেও দীক্ষা ?
পশু,পাখী,কীট,ফল,ফুল,মঞ্জরী,
প্রাপ্ত সকলে অপলাপে লোকশিক্ষা ।।

বিশ্বাস করি কী ক’রে কুমুদ সতী ?
হাটে হাঁড়ি ভেঙে ,রসরঙ্গে সে লিপ্ত ;
নটবর নবকার্তিক প্রজাপতি,
অবাক সাধ্বী চাটু চুম্বনে দীপ্ত ।।

ভীরু মাধবীও মনে মনে রঙ্গিলা ;
রতিপরিমলে নেই তার অনায়ত্তি ;
আপাতত যেন কুমারী লজ্জাশীলা,
আসলে সে সাধে মোহিনীর প্রতিপত্তি ।।

বুলবুল গলা কাঁপায় যে পালাগানে,
নেই তাতে উপলব্ধির নাম-গন্ধ ;
সন্দেহ হয় বাঁধা গীতে মিড় টানে
অতিরঞ্জিত কাকুতির নির্বন্ধ ।।

ক্রমে ম’রে আসে সত্য সর্ব ঘটে,
নিষ্ঠা বা তার দেখা পাওয়া আজ শক্ত।
কুকুরের ল্যাজ যথারীতি নড়ে বটে,
কিন্তু জগতে নেই আর প্রভুভক্ত ।।

-হাইন্‌রিখ্‌ হাইনে

আত্মপরিচয়

মুক্তির সংগ্রামে আমি কাটিয়েছি তিরিশ বৎসর ;
করিনি চেষ্টার ত্রুটি দূরবর্তী দুর্গের রক্ষায় ;
ছিল না জয়ের আশা, তবু যুদ্ধে থেকেছি তৎপর;
ভাবিনি অক্ষত দেহে ঘরে ফিরে যাব পুনরায়।।

অহোরাত্র পাহারায় এক বারও ফেলিনি পলক ;
অসাধ্য লেগেছে নিদ্রা শিবিরের সামান্য শয়নে ;
অনিচ্ছায় ঢুল এলে, তৎক্ষণাৎ ভেঙেছে চমক
সৎসাহসী সঙ্গীদের সমস্বর নাসিকাগর্জনে ।।

মাঝে মাঝে মহানিশা ভ’রে গেছে সান্দ্র অবসাদে,
হৃদয়ে জেগেছে আর্তি- নির্বোধেরই ভয়-ডর নেই-
অশ্লীল গানের কলি সে-সময়ে ভেঁজেছি অবাধে ;
পুরেছে বিবিক্ত মৌন কখনও বা উদ্ধত শিসেই ।।

উন্নিদ্র সন্দেহ চোখে, শব্দভেদী অবধান কানে,
সজাগ বন্দুকে উষ্মা, কৌতূহলী অজ্ঞের প্রগতি
থামিয়েছি অর্ধপথে ; দেখিয়েছি অব্যর্থ সন্ধানে
সূচ্যগ্রপ্রমাণ যত লম্বোদর দাম্ভিকের গতি।।

কিন্তু সে-ক্লীবের দলে হেন শত্রু মিলেছে দৈবাৎ
সাংঘাতিক লক্ষ্যবেধে যে সব্যসাচীর প্রতিযোগী;
না মেনে উপায় নেই-সাক্ষী আছে বহু রক্তপাত,
অসংখ্য উন্মুদ্র ক্ষতে প্রতিপন্ন আমি ভুক্তভোগী ।।

অনাথ দূরান্ত দুর্গ; রক্তগঙ্গা আহত প্রহরী;
বন্ধুরা নিহত,কিংবা অগ্রগামী, নচেৎ বিমুখ;
মরণেও অপরাস্ত, অবশেষে খাতে ট’লে পড়ি;
ভাঙেনি আমার অস্ত্র,শুধু জানি ফেটে গেছে বুক ।।

–হাইন্‌রিখ্‌ হাইনে

উত্তর

“চাঁদ কী রকম?” শুধালে কেউ, বোলো,
“এমনইটি ঠিক”, দাঁড়িয়ে ছাদের ‘পরে।
দেখিও মুখের দীপ্র সমারোহ,
“সূর্য কেমন?” –প্রশ্ন যদি করে।
জানতে যে চায় কিসের গুণে যীশু
প্রাণ পুনরায় জাগিয়েছিল শবে,
তার কপাল ও আমার অধর ছুঁয়ো
চুম্বনে-সব সহজ সরল হবে ।।

– জালালুদ্দীন রুমি (ইংরেজি অনুবাদ- সি ফীল্‌ড্‌)

গোধূলি

মাঝি-মাল্লার বৈকালী সভা :
আকাশ,বাতাস গোধূলি মাখে :
তার পাশে ব’সে, বাহিরে তাকাই,
যেখানে সিন্ধু অসীমে ডাকে ।।

জ্বলে একে একে দিশারী প্রদীপ,
আলোকমঞ্চ অভয়ে ভাসে ;
দূর দিগন্তে বিবাগী জাহাজ
এখনও দৃষ্টি গোচরে আসে ।।

আলোচনা হয় নাবিক জীবন :
তুফানে কী ক’রে নৌকা ডোবে ;
শুন্যে ও জলে ঘেরা কান্ডারী,
দ্বিধাটলমল খুশিতে, ক্ষোভে ।।

অভাবনীয়ের লীলানিকেতন
অবাচী,উদীচী,প্রতীচী,প্রাচী :
আচারে,বিচারে বিপরীত মতি,
মানবসমাজ সব্যসাচী ।।

স্রোতে প্রতিভাত লক্ষ মানিক,
মত্ত মলয় বকুলবনে,
গঙ্গার তীরে সৌম্য পুরুষ
সমাধিমগ্ন পদ্মাসনে ।।

ল্যাপ্‌দেশীয়েরা বামনের জাতি,
নোংরা, হাঁ বড়,চ্যাপ্টা মাথা,
আগুন পোহায়, মাছ সেঁকে খায়,
কথা কয় না তো , ঘোরায় জাঁতা ।।

যে যা বলে, সে তা কান পেতে শোনে,
তার পরে মুখ খোলে না আর ;
দেখা যায় না সে-বিবাগী জাহাজ,
বাহিরে গভীর অন্ধকার ।।

-হাইন্‌রিখ্‌ হাইনে

পরিবাদ

সাঁচ্চা কিছুই নেই জগতে; দুষ্ট সবাই দোষে।
গোলাপ আপন বোঁটায় বোঁটায় তীক্ষ্ণ কাঁটা পোষে।
সন্দেহ হয় ঊর্ধ্বলোকে দেবতা থাকেন যত,
হয়ত তাঁরাও খাদে ভরা মর্ত্যবাসীর মত।
কিংশুকে, কই, সৌরভই নেই। বৃন্দাবনে তাপ।
গেরুয়া দিয়ে ঢাকেন সাধু মহাবিদ্যার ছাপ।
সীতা যদি গোসা ক’রে মার কাছে না যেত,
পঞ্চসতীর পুণ্য শ্লোকে তবেই সে ঠাঁই পেত।
শিখীর পেখম জবর হলেও,বীভৎস পা তার।
শকুন্তলা, কালিদাসের কাব্যকলার সার,
তার ভণিতাও সকল সময় সহ্য হবার নয়।
কাদম্বরীর বিপুল বহর স্বতই জাগায় ভয়।
ষণ্ড স্বয়ং শিবের বাহন, জানে না দেবভাষা।
বাচস্পতি শেখেননি তো বয়েৎ খাসা খাসা।
কোণারকের সুন্দরীদের পাছা বেজায় ভারী।
বাঙালীদের নাকের আবার নেই কো বাড়াবাড়ি।
ছন্দ যতই হোক না মধুর, খুঁত থেকে যায় মিলে।
মৌচাকে,হায়, বিষাক্ত হুল। গ্রাম্য বধুর পিলে।
ব্যাধের হাতে মারা গেলেন কৃষ্ণ ভগবান।
তানসেনও, সে কলমা প’ড়ে হল মুসলমান।
স্বর্গচারী, দীপ্ত তারা, সর্দি তাকেও ধরে;
তারও কবর ধূলার ধরায়; ঠান্ডাতে সেও মরে।
দুগ্ধে মিলে ঘাসের গন্ধ। সূর্যদেবের গায়
দাগ দেখা যায় শাদা চোখেও, সেই বোঝে, যে চায়।
তোমায়, দেবী, ভক্তি করি ; কিন্তু তোমার ত্রুটি
কত যে, তার হিসাব রাখি, কোথায় এমন ছুটি?
ডাগর চোখে, শুধাও কি দোষ? আছে কি তার শেষ?
ওই সমতল বুকের তলায় নেই হৃদয়ের লেশ!

–হাইন্‌রিখ্‌ হাইনে

 প্রত্যাবর্তন

মধুমালতীর কুঞ্জ – চৈত্র সন্ধ্যা- আমরা দু জনে
আবার আগের মতো ব’সে আছি খোলা জানালায়-
চাঁদ ওঠে ধীরে ধীরে , স্নাত মর্ত্য স্নিগ্ধ সঞ্জীবনে-
কেবল আমরা যেন প্রেতচ্ছায়া, গলগ্রহ দায় ।।

দ্বাদশ বৎসর পূর্বে শেষ বসেছিলুম উভয়ে
এখানে যুগলাসনে, এ-রকম কবোষ্ণ প্রদোষে ;
নবানুরাগের জ্বালা ইতিমধ্যে নিবেছে হৃদয়ে,
সম্প্রতি মন্দাগ্নি কাম অনুচিত পারণে, উপোসে ।।

নিতান্ত নিঃসাড় আমি, তথাচ সে কথার জাহাজ ;
মুখের বিরাম নেই, সঙ্গে সঙ্গে নাড়ে নিরন্তর
প্রণয়ের চিতাভস্ম; বোঝে না সে কোন মতে আজ
নির্বাপিত বিস্ফুলিঙ্গ পুনরায় হবে না ভাস্বর।।

অফুরন্ত ইতিহাস : কুচিন্তার বিরুদ্ধে সে নাকি
এত দিন যুদ্ধ ক’রে উপনীত আর্তির চরমে
অপ্রতিষ্ঠ একনিষ্ঠা, পাপস্পর্শে নষ্ট তার রাখী।
তাকাই বোবার মতো সে যখন সায় চায় সমে ।।

অগত্যা পালিয়ে বাঁচি; কিন্তু মৃত লাগে চন্দ্রালোক;
ভূতের কাতার দেখি দু পাশের অতিক্রান্ত গাছে;
নিরালায় কথা কয় পৃথিবীর পুঞ্জিভূত শোক;
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলি, তবু সঙ্গ ছাড়ে না পিশাচে।।

-হাইন্‌রিখ্‌ হাইনে

প্রদীপ

বনবীথি জনশূন্য নিশীথে;
শঙ্কিত শিখা বক্ষোদীপে ;
সুদূরের বাঁশি ডাকে অভিসারে ;
পিছনে কে চলে পা টিপে টিপে ;
পথের দু পাশে ভূতের জটলা
স্মৃতি-বিস্মৃতি উজাড় করে ;
চিত্রার্পিত পুরাণ কাহিনী
নক্ষত্রের ঘুণাক্ষরে ;
চক্রী পবনে গুঢ় কানাকানি,
প্রতিবাদে জাগে প্রতিধ্বনি ;
বনস্পতির নিবিদ রটায়
অবোধ হৃদয়ে কি আগমনী ;
অনাদি কালের চির রহস্য
ত্রস্নু শরীরে বেপথু হানে ;
সৃজননেমীর ঘূর্নাবর্ত
ভ্রাম্যমাণেরে কেন্দ্রে টানে;
বিশ্বপিতার হাতে হাত রেখে,
শিশু ধরিত্রী আচম্বিতে
দোলা ছেড়ে ওঠে, টলমল পদে
ক্রান্তিবলয়ে টহল দিতে;
স্তম্ভিত কভু হয় না সে তবু,
যদিও পলক পড়ে না চোখে ;
শুধু আনন্দ বেদনার সাড়া
পায় মাঝে মাঝে মানসলোকে ।।
নিশীথে বিজন বনবীথি যবে,
শঙ্কিত শিখা বক্ষোদীপে,
নিরুদ্দেশের যাত্রী তখন
আপনার ছবি নিরখে নীপে ;
প্রথম প্রাণের পরম প্রণবে
সার্থক তার মর্মবাণী;
অভিসারিকার নূপুরে সে-সুর,
সে-তালে দোদুল অরণ্যানি ;
অগ্নিগর্ভ গুল্মে আবার
পুরাণপুরুষ আবির্ভূত ;
কান্ডে কান্ডে ধরা পড়ে যূপ
আত্মবলির মন্ত্র-পূত,
যুগান্তরের সঞ্চিত খেদ
নিবেদন করে মৌন তারে ;
মৃত্যুদণ্ডে নতশির যীশু
তারই অগ্রিম কপটাচারে ;
দর্শক আর দৃশ্যের দ্বিধা
ঘুচে যায় তার সংগোপনে ;
থাকেনা প্রভেদ শ্রুতিতে শ্রোতাতে ;
প্রবর্তকে ও প্রবর্তনে ;
প্রেমেও যেহেতু নিষ্কাম, তাই
নির্বিকার সে দুঃখে,সুখে ;
আত্মীয়-পর সরূপ যমজ,
পক্ষপাতের আপদ চুকে ;
নৈশ পাখীর স্বগত কূজনে
পূরে আরব্ধ কাব্যকলি ;
জানে সে কোথায় মাধুরী জমায়
অন্ধকারের অতলে অলি ;
চটকের চ্যুতি দেখে সে যেমন,
তেমনই মুগ্ধ উল্কাপাতে ;
ভাস্বর বনবীথিকা যখন
দীপ্রহৃদয়, নিভৃত রাতে ।।

দূর থেকে দূরে যায় সে একাকী,
নিঃস্ব, অথচ পৃথিবীপতি ;
অদ্বিতীয় সে অনুকম্পায়,
ত্রিভুবনে তার অবাধ গতি ;
মন্দাকিনীর অমৃত শীকর
থেকে থেকে তার মাথায় ঝরে ;
অধরার বরমাল্য গলায়,
সৃষ্টির চাবি মুক্ত করে,
সে আসে যেখানে বন্দী অরূপ
যক্ষজাগর পাতালে কাঁদে,
পারায়ে বনের নৈশ নিরালা
বক্ষোদীপের আশীর্বাদে ।।

-হিউ মেনাই

প্রদোষ

প্রদোষ : বিলীয়মান দূর বনরাজী;
কানে আসে কাকের কলহ ;
শৈলমূলে কুয়াশা ও একাধিক দীপ;
সর্বোপরি একমাত্র গ্রহ ;
চাষীরা ফসল মাড়ে ওই যে-খামারে,
থেমে গেছে ওখানে গুঞ্জন ।
প্রদোষ সখার সঙ্গে পরিচিত পথে
পুনরায় করি বিচরণ ।।

যারা মৃত, এক কালে প্রিয় ছিল যারা,
ভাবি সেই বন্ধুদের কথা :
মৃত আজ সে-সুন্দর বন্ধুরা,যদিও
ক্ষণস্থায়ী মৃত্যুর ক্ষমতা;
তাদের সুন্দর দৃষ্টি অশুচি ধূলায়,
একে একে, নিবে গেছে কবে ;
সুন্দরহৃদয় তারা প্রচুর প্রসাদ
এনেছিল আমার শৈশবে ।।

-জন্‌ মেস্‌ফীল্‌ড

ফাল্গুনী

বসন্তদিনের সনে করিব কি তোমার তুলনা?
তুমি আরও কমনীয়,আরও স্নিগ্ধ,নম্র,সুকুমার :
কালবৈশাখীতে টুটে মাধবের বিকচ কল্পনা,
ঋতুরাজ ক্ষীণপ্রাণ,অপ্রতিষ্ঠ যৌবরাজ্য তার ;
আলোকের বিলোচন কখনও বা জ্বলে রুদ্র তাপে,
কখনও সন্নত বাষ্পে হিরণ্ময় অতিশয় ম্লান ;
প্রাকৃত বিকারে, কিংবা নিয়তির গূঢ় অভিশাপে,
অসংবৃত অধঃপাতে সুন্দরের অমোঘ প্রস্থান ।
তোমার মাধুরী কিন্তু কোনও কালে হবে না নিঃশেষ :
অজর ফাল্গুনী তুমি, অনবদ্য রূপের আশ্রয় ;
মানে না প্রগতি তব মরনের প্রগল্‌ভ নির্দেশ,
অমৃতের অধিকারী যেহেতু এ-পঙ্‌ক্তিকতিপয় ।
মানুষ নিঃশ্বাস নেবে, চোখ মেলে তাকাবে যাবৎ,
আমার কাব্যের সঙ্গে তুমি রবে জীবিত তাবৎ ।।

-উইলিয়ম্‌ শেক্‌স্‌পীয়র

মাধুরী

শুন্য মাঠে সূর্যোদয়,গিরিশৃঙ্গে সূর্যাস্ত দেখেছি,
গম্ভীর সৌন্দর্যে শান্ত সনাতন গায়ত্রীর মতো ;
মাধবের সমাগমে অতসীর পরাগ মেখেছি ;
প্রত্যক্ষ করেছি তৃণ নব জলধারায় উদ্‌গত ।।

ফুলের খেয়াল আর সমুদ্রের ধ্রুপদ শুনেছি;
পাল-তোলা তরী থেকে তাকিয়েছি কত দূর দেশে ;
কিন্তু সে সমস্তে নয়, বিধাতার প্রসাদ গুনেছি
তার বাঁকা বিম্বাধরে, কন্ঠস্বরে, দৃষ্টিপাতে,কেশে ।।

–জন্‌ মেস্‌ফীল্‌ড

মায়ার খেলা

বিদ্যুতের পক্ষপাতী যেহেতু আমি, তাই
ভাবো কি নই কুলিশে কৃতবিদ্য ?
ভ্রান্ত ব’লে বোঝো না লীলা দেখাই, না দেখাই,
স্বভাবতই আমি অশনিসিদ্ধ ।।

শুনতে পাবে পরীক্ষার ভয়ঙ্কর দিনে
আমার রূঢ় কণ্ঠ মেঘমন্দ্রে,
ত্রাহিস্বর বাত্যাহত বৃক্ষে তথা তৃণে,
প্রতিধ্বনি রন্ধ্র থেকে রন্ধ্রে ।।

সে-দুর্যোগে বজ্র মেতে উঠবে তান্ডবে,
লাগবে যত প্রাসাদে ভূমিকম্প,
দৈবতের গর্ব হবে খর্ব খাণ্ডবে,
অবাধ শত শিখার উল্লম্ফ ।।

-হাইন্‌রিখ্‌ হাইনে

স্বপ্নপ্রয়াণ

চেয়ে দেখেছিলে আমাকে নিবিড় সুখে,
বিচ্ছেদে আজ খেদ, ক্ষতি নেই তাই;
যেখানেই থাকো,সেখানে, দীপ্র মুখে,
স্বপ্নকে দিও আঁধার শয়নে ঠাঁই ।।
ঘুমে বুজে আসে তোমার তরল আঁখি,
বিবশ রসনা মানে না তথাপি মানা ;
মিলনে যে-কটি কথা রয়ে গেল বাকী,
অবাধ হয়েছে বিরহে তাদের হানা ।।

ঘুমাও,ঘুমাও, আরামে ঘুমাও তবে,
আমার আশিষে তোমার শিয়র পূত;
সংবৃত তুমি অধুনা যে-গৌরবে,
আমি সে-রহসে নিয়ত আবির্ভূত ।।

কৃপণ গানের অমৃত সঞ্চয়নে
ব্যক্ত তোমার অনুপম পরিচিতি ;
বাসা বেঁধেছিলে আজ যে-আলিঙ্গনে,
তাতে বার বার ফেরাবে তোমাকে স্মৃতি ।।

-সীগ্‌ফ্রিড্‌ সসুন্‌

সংবর্ত (১৯৫৩)

১৯৪৫

তুমি বলেছিলে জয় হবে, জয় হবে :
নাট্‌সী পিশাচও অবিনশ্বর নয় ।
জার্মানি আজ ম্রিয়মাণ পরাভবে ;
পশ্চিমে নাকি আগত অরুণোদয় ।
অন্তত রুষ বাহিনী বন্যাবেগে
কবলিত করে শোষিত দেশের মাটি ;
বিভীষণদের উচ্ছেদে ওঠে জেগে
স্বাধীন প্যারিস্‌, যথারীতি পরিপাটী ;
এ-বারে সমরে,শান্তিতে সহযোগী
মার্কিন্‌ ঢালে সমানে শোণিত, টাকা ;
ধনিক যুগের প্রধান ভুক্তভোগী
ইংলণ্ডেই সমাজতন্ত্র পাকা।।

অবশ্য চীনে নেতারা স্বার্থপর,
সর্বথা জনশক্তির বাধ সাধে ;
স্থগিত ভারতে আপ্ত কালান্তর,
জিন্না যেহেতু বিমুখ গান্ধিবাদে ।
তাছাড়া আবার রক্ষকে ভক্ষকে
ভেদ ভোলে স্বচ্ছন্দ বেল্‌জিয়ামে ;
ইটালীর প্রতিবিপ্লবী পক্ষকে
সম্মুখ রেখে, ত্রাতারা তারণে নামে।
তথাচ গ্রীসের ট্রটস্কীয় বামাচারী
বিনষ্ট চার্চিলের বাক্যবাণে;
ধরে তুরস্ক বিশ্রুত তরবারি ;
আর্জেন্টিনা প্রগতির রথ টানে ।।

সত্য কি তবে সে-দিন তোমার মুখে
ভর করেছিল দুরূহ দৈববাণী ?
ভূয়োদর্শনে ঢাকি অতিবস্তুকে,
তাই আমাদের অনুভবে শুধু হানি?
হয়তো অমৃত ব্যর্থ মৃত্য বিনা,
পাপ পুণ্যের মুকুরিত প্রতিরূপ,
ক্লীবের মারণ ভীষ্মের দক্ষিণা,
মুক্তির উৎপত্তি অন্ধকূপ,
ভূতের অগাধে নিহিত ভবিষ্যৎ,
অন্যায় আনে আস্থা ন্যায়ের প্রতি,
শত্রুনিপাত মহামৈত্রীর পথ,
পরিশ্রমীর স্বধর্মে সদ্‌গতি ।।

কিন্তু জীবন এতই বিকল কি যে
কেবল মরণে প্রমার সম্ভাবনা ?
প্রাণধারনের যে- দৃষ্টান্ত নিজে
রেখে গেছ, তা কি অন্ধ প্রবঞ্চনা ?
ক্ষমা, অহিংসা,মনীষা,বিবেকী দ্বিধা,
অত্যাচারের সঙ্গে অসহযোগ,
অসম্পৃক্ত ইষ্টের সদভিধা,
বিচারে বিশ্বমানবের বিনিয়োগ-
এ-সকলে আজ তুমি কি নিরুৎসাহ,
বুঝেছ সাধুর শাঠ্যেই মজে শঠ ?
রাইনে জুড়ায় বার্সেলোনার দাহ,
স্পেনে নিষিদ্ধ যদিও ধর্মঘট !

অতএব হোক আহ্লাদে আটখানা
বুদাপেস্তের ধ্বংসে হিসাবী চেক্‌ :
কার্যকারণে ধার্য বিমানহানা,
ভার্শাও দ্রেস্‌দেনের পূর্বলেখ ।
সমিতি বসুক লণ্ডনে, লুব্লিনে,
যে যাবে, সে যাক সান্‌ফ্রান্সিস্কোতে,
মিথ্যা মানুক আর্তেরা দুর্দিনে :
কর্মের ফল ফলবেই জোতে জোতে।
আজও নিমিত্তমাত্র সব্যসাচী ;
মমতা অচল সাধারণ শুদ্ধিতে :
কৃপা খুঁজে মরে মোহজালে কানামাছি ;
ব্যাহত বিধাতা ব্যক্তির বুদ্ধিতে ।।

তবু জানি যবে জয় হবে বলেছিলে,
চাওনি তখন তুমিও এ-পরিণাম :
শুন্যে ঠেকেছে লাভে লোকসানে মিলে,
ক্লান্তির মতো, শান্তিও অনিকাম।
এরই আয়োজনে অর্ধশতক ধ’রে,
দু-দুটো যুদ্ধে,একাধিক বিপ্লবে ;
কোটি কোটি শব পচে অগভীর গোরে,
মেদিনী মুখর একনায়কের স্তবে !

নির্বাণ নভে গৃধ্নু রাহুর গ্রাস
তুমি অনিকেত নির্বাক নাস্তিতে :
কে জবাব দেবে, নিখিল সর্বনাশ
কোন্‌ অবরোহী পাতকের শাস্তিতে?

Exit mobile version