Site icon BnBoi.Com

গীতিগুচ্ছ – সুকান্ত ভট্টাচার্য

গীতিগুচ্ছ - সুকান্ত ভট্টাচার্য

এই নিবিড় বাদল দিনে

এই নিবিড় বাদল দিনে
কে নেবে আমায় চিনে,
জানিনে তা।
এই নব ঘন ঘোরে,
কে ডেকে নেবে মোরে
কে নেবে হৃদয় কিনে,
উদাসচেতা।
পবন যে গহন ঘুম আনে,
তার বাণী দেবে কি কানে,
যে আমার চিরদিন
অভিপ্ৰেতা!
শ্যামল রঙ বনে বনে,
উদাস সুর মনে মনে,
অদেখা বাঁধন বিনে
ফিরে কি আসবে হেথা?

 ও কে যায় চলে কথা না বলে দিও না যেতে

ও কে যায় চলে কথা না বলে দিও না যেতে
তাহারই তরে আসন ঘরে রেখেছি পেতে।
কেন সে সুধার পাত্র ফেলে
চলে যেতে চায় আজ অবহেলে
রামধনু রথে বিদায়ের পথে উঠিছে মেতে।

রঙে রঙে আজ গোধূলি গগন
নহেকো রঙিন, বিলাপে মগন।
আমি কেঁদে কই যেয়ে না কোথাও,
সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও,
বাড়ায়ে বাহু বিরহ-রাহু চাহিছে পেতে।

ওগো কবি তুমি আপন ভোলা

ওগো কবি তুমি আপন ভোলা,
আনিলে তুমি নিথর জলে ঢেউয়ের দোলা!
মালাখানি নিয়ে মোর একী বাঁধিলে অলখ ডোর!
নিবেদিত প্ৰাণে গোপনে তোমার কী সুর
তোলা।
জেনেছ তো তুমি অজানা প্ৰাণের
নীরব কথা।
তোমার বাণীতে আমার মনের
এ ব্যাকুলতা—
পেয়েছ কী তুমি সাঁঝের বেলাতে
যখন ছিলাম কাজের খেলাতে
তখন কি তুমি এসেছিলে
ছিল দুয়ার খোলা।

কঙ্কণ-কিঙ্কিণী মঞ্জুল মঞ্জীর ধ্বনি

কঙ্কণ-কিঙ্কিণী মঞ্জুল মঞ্জীর ধ্বনি,
মম অন্তর-প্ৰাঙ্গণে আসন্ন হল আগমনী।
ঘুমভাঙা উদ্বেল রাতে,
আধ-ফোটা ভীরু জ্যোৎস্নাতে
কার চরণের ছোঁয়া হৃদয়ে উঠিল রণরণি
মেঘ-অঞ্জন-ঘন কার এই আঁখি পাতে লিখা,
বন্দন-নন্দিত উৎসবে জ্বালা দীপশিখা।
মুকুলিত আপনার ভারে
টলিয়া পড়িছে বারে বারে
সংগীত হিল্লোলে কে সে স্বপনের অগ্ৰণী।।

কিছু দিয়ে যাও এই ধূলিমাখা পান্থশালায়

কিছু দিয়ে যাও এই ধূলিমাখা পান্থশালায়,
কিছু মধু দাও আমার বুকের ফুলের মালায়।
কত জন গেল এ পথ দিয়ে
আমার বুকের সুবাস নিয়ে
কিছু ধন তারা দিয়ে গেল মোর সোনার থালায়।
পথ চেয়ে আমি বসে আছি হেথা তোমার আশে
তুমি এলে যদি কাছে বসে প্রিয় আমার পাশে।
কিছু কথা বল আমার সনে,
ঢেউ তুলে যাও নীরব মনে,
এইটুকু শুধু দাও তুমি ওগো আমার ডালায়।

কোন অভিশাপ নিয়ে এল এই

কোন অভিশাপ নিয়ে এল এই
বিরহ বিধুর-আষাঢ়।
এখানে বুঝি বা শেষ হয়ে গেছে
উচ্ছল ভালবাসার।
বিরহী যক্ষ রামগিরি হতে
পাঠাল বারতা জলদের স্রোতে
প্রিয়ার কাছেতে জানাতে চাহিল
সব শেষ সব আশার।।

আমার হৃদয়ে এল বুঝি সেই মেঘ,
সেই বিহবল পৰ্বত-উদ্বেগ।
তাই এই ভরা বাদল আঁধারে
মন উন্মন হল বারে বারে
হৃদয় তাইতে সমুখীন হল
বিপুল সর্বনাশার।।

ক্লান্ত আমি ক্লান্ত আমি কর ক্ষমা

ক্লান্ত আমি, ক্লান্ত আমি কর ক্ষমা,
মুক্তি দাও। হে এ-মরু তরুরে, প্ৰিয়তমা।
ছিন্ন কর এ গ্রন্থিডোর
রিক্ত হয়েছে চিত্ত মোর
নেমেছে আমার হৃদয়ে শ্রান্তি ঘন-অমা।

যে আসব ছিল তোমার পাত্রে,
শোষণ করেছি দিনে ও রাত্রে।
রসের সিন্ধু মন্থন শেষে,
গরল উঠেছে তব উদ্দেশে,
তুমি আর নিহ আমার অতীত, হে মনোরম।

গানের সাগর পারি দিলাম

গানের সাগর পারি দিলাম
সুরের তরঙ্গে,
প্ৰাণ ছুটেছে নিরুদ্দেশে
ভাবের তুরঙ্গে।
আমার আকাশ মীড়ের মূর্ছনাতে
উধাও দিনে রাতে;
তান তুলেছে। অন্তবিহীন
রসের মৃদঙ্গে।
আমি কবি সপ্তসুরের ডোরে,
মগ্ন হলাম অতল ঘুম-ঘোরে;
জয় করেছি জীবনে শঙ্কারে,
মোর বীণা ঝংকারে :
গানের পথের পথিক আমি
সুরেরই সঙ্গে।

গুঞ্জরিয়া এল অলি

গুঞ্জরিয়া এল অলি;
যেথা নিবেদন অঞ্জলি।
পুষ্পিত কুসুমের দলে
গুন্‌গুন্‌ গুঞ্জিয়া চলে
দলে দলে যেথা ফোটা-কলি।

আমার পরাণে ফুল ফুটিল যবে,
তখন মেতেছি আমি কী উৎসবে।
আজ মোর ঝরিবার পালা,
সব মধু হয়ে গেছে ঢালা;
আজ মোরে চলে যেও দলি।

দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে

দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে
যেয়ে না চলে,
অরুণ-আলো কে যে দেবে
যাও গো বলে।
ফেরো তুমি যাবার বেলা,
সাঁঝ আকাশে রঙের মেলা
দেখেছি কী কেমন ক’রে
আগুন হয়ে উঠল জ্বলে।
পুব গগনের পানে বারেক তাকাও
বিরহেরই ছবি কেন আঁকাও?
আঁধার যেন প্লাবন সম আসছে বেগে
শেষ হয়ে যাক তারা তোমার
ছোঁয়াচ লেগে।
থামো ওগো, যেয়ে না হয়।
সময় হলে।।

ফোটে ফুল আসে যৌবন

ফোটে ফুল আসে যৌবন
সুরভি বিলায় দোঁহে
বসন্তে জাগে ফুলবন
অকারণে যায বহে।।

কোনো এককাল মিলনে,
বিশ্বেরে অনুশীলনে
কাটে জানি জানি অনুক্ষণ
অতি অপরূপ মোহে।।

ফুল ঝরে আর যৌবন চলে যায়,
বার বার তারা ‘ভালবাসো’ বলে যায়
তারপর কাটে বিরহে,
শূন্য শাখায় কী রহে
সে কথা শুধায় কোন মন?
‘তুমি বৃথা’ যায় কহে।।

 ভুল হল বুঝি এই ধরণীতলে

ভুল হল বুঝি এই ধরণীতলে,
তাই প্ৰাণে চিরকাল আগুন জ্বলে
তাই আগুন জ্বলে।
দিনের শেষে
এক প্লাবন এসে
জানি ঘিরিবে আমার মন কৌতূহলে,
নব কৌতূহলে।
আমার জীবনে ভুল ছিল না বুঝি,
তাই বারে বারে সে আমারে গিয়াছে খুঁজি।
দিনের শেষে
আজ বাউল বেশে
ঘূচাব মনের ভুল নয়ন জলে,
মোর নয়ন জলে।।

মুখ তুলে চায় সুবিপুল হিমালয়

মুখ তুলে চায় সুবিপুল হিমালয়,
আকাশের সাথে প্ৰণয়ের কথা কয়,
আকাশ কহিছে ডেকে,
কথা কও কোথা থেকে?
তুমি যে ক্ষুদ্র মোর কাছে মনে হয়।।
হিমালয় তাই মুর্ছিত অভিমানে,
সে কথা কেহ না জানে।
ব্যর্থ প্রেমের ভারে
দীর্ঘ নিশাস ছাড়ে—
হিমালয় হতে তুষারের ঝড় বয়।।

মেঘ-বিনিন্দিত স্বরে

মেঘ-বিনিন্দিত স্বরে–
কে তুমি আমারে ডাকিলে শ্রাবণ বাতাসে?
তোমার আহবান ধ্বনি
পরশিয়া মোরে গরজিল দূর আকাশে।
বেদনা বিভোল আমি
ক্ষণেক দুয়ারে থামি
বাহিরে ধূসর দিনে—
ছুটে চলি পথে মন্দির-বিবশ নিশাসে।

মেঘে মেঘে ছাওয়া মলিন গগনে,
কোন আয়োজন ছিল আনমনে।
বাহিরে কী ঘনঘটা,
ভিতরে বিজলী-ছটা
মত্ত ভিতরে বাহিরে–
আজ কি কাটিবে বিরহ বিধুর হতাশে।।

শীতের হাওয়া ছুয়ে গেল ফুলের বনে

শীতের হাওয়া ছুয়ে গেল ফুলের বনে,
শিউলি-বকুল উদাস হল ক্ষণে ক্ষণে,
ধূলি-ওড়া পথের প’রে
বনের পাতা শীতের ঝড়ে
যায় ভেসে ক্ষীণ মলিন হেসে আপন মনে
রাতের বেলা বইল বাতাস নিরুদ্দেশে,
কাঁপনটুকু রইল শুধু বনের শেষে।
কাশের পাশে হিমের হাওয়া,
কেবল তারি আসা-যাওয়া—
সব-ঝরাবার মন্ত্রণা সে দিল শুধু সংগোপনে।

শয়ন শিয়রে ভোরের পাখির রবে

শয়ন শিয়রে ভোরের পাখির রবে
তন্দ্ৰা টুটিল যবে।
দেখিলাম আমি খোলা বাতায়নে
তুমি আনমনা কুসুম চয়নে
অন্তর মোর ভরে গেল সৌরভে।
সন্ধ্যায় যবে ক্লান্ত পাখিরা ধীরে,
ফিরিছে আপন নীড়ে,
দেখিলাম তুমি এলে নদীকূলে
চাহিলে আমায় ভীরু আঁখি তুলে
হৃদয় তখনি উড়িল অজানা নভে।।

সাঁঝের আঁধার ঘিরল যখন

সাঁঝের আঁধার ঘিরল যখন
শাল-পিয়ালের বন,
তারই আভাস দিল আমায়
হঠাৎ সমীরণ।
কুটির ছেড়ে বাইরে এসে দেখি
আকাশকোণে তারার লেখালেখি
শুরু হয়ে গেছে বহুক্ষণ।
আজকে আমার মনের কোণে
কে দিল যে গান,
ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠি
রোমাঞ্চিত প্ৰাণ।
আকাশতলে বিমুক্ত প্ৰান্তরে,
উধাও হয়ে গেলাম ক্ষণ তরে!
কার ইশারায় হলাম অন্যমন।।

হে পাষান আমি নির্ঝরিণী

হে পাষান, আমি নির্ঝরিণী
তব হৃদয়ে দাও ঠাঁই।
আমার কল্লোলে
নিঠুর যায় গ’লে
ঢেউয়েতে প্ৰাণ দোলে,
—তবু নীরব সদাই!
আমার মৰ্মেতে কী গান ওঠে মেতে
জানো না তুমি তা,
তোমার কঠিন পায় চির দিবসই হায়
রহিনু অবনতা।
যতই কাছে আসি
আমারে মৃদু হাসি
করিছ পরবাসী,
তোমাতে প্ৰেম নাই।।

 হে মোর মরণ

হে মোর মরণ, হে মোর মরণ!
বিদায় বেলা আজ একেলা
দাও গো শরণ।
তুমি আমার বেদনাতে
দাও আলো আজ এই ছায়াতে
ফোটার গন্ধে অলস ছন্দে
ফেলিও চরণ।।
তোমার বুকে অজানা স্বাদ,
ক্লান্তি আনো, দাও অবসাদ;
তোমায় আমি দিবসযামী
করিনু বরণ।
তোমার পায়ে কী আছে যে,
জীবনবীণা উঠেছে বেজে?
আমায় তুমি নীরব চুমি
করিও হরণ।।

Exit mobile version