Site icon BnBoi.Com

হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে – শামসুর রাহমান

হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে - শামসুর রাহমান

অতিথি

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই দেখি, একজন লোক
আমার চেয়ারে দিব্যি বেপরোয়া বসে আছে। চোখ দুটো তার
আমাকে পরখ করে নিচ্ছে যেন, ঠোঁটে মৃদু হাসি। আমি তাকে
প্রশ্ন করি, কে আপনি এই সাত সকালে আমার
ঘরে বসে আছেন এত্তেলা না দিয়েই? এরকম আচরণ
ভদ্রোচিত নয় মোটে। আগন্তুক বিন্দুমাত্র বিব্রত না হয়ে
চেয়ারে থাকেন বসে খানিক আয়েশে, টেবিলের
বুক থেকে সহজে কুড়িয়ে নেন জীবনানন্দের ‘মাল্যবান।‘

আমাকে নিশ্চুপ দেখে বইটির পাতা
ওল্টাতে ওল্টাতে সেই অনাহুত অতিথি বলেন, ‘কী ব্যাপার,
বোবা হয়ে গেলে না কি? মুখ থেকে কথাই গায়েব? শোনো তবে,
আমি কেউকেটা নই কেউটেও নই, আমি হই
ভবঘুরে একজন, লোকে বলে আমি এই সমাজের বাতিল আপদ,
আমি হই সামান্য মানুষ, আমি হই
লালনের আখড়ার গানে-পাওয়া নিরীহ বাউল,
আমি হই তোমার মনের মানুষ হে ধূলিরঙ নাগরিক।
৭.১১.২০০০

অবচেতনের জমি

গোছা গোছা ফুল কি ফুটেছে লোকটির মেঘময়
অবচেতনের জমি জুড়ে? সে জমিনে গোধূলি
কখন যে নেমে আসে, জটিলতা সৃষ্টি হয়, লোকটি বোঝে না
কিছুতেই, অন্ধকারে অনেকটা অন্ধের মতোই
আবছা বেড়ায় ডানে বামে। আশঙ্কার বাইসন
তেড়ে আসে ডান দিক থেকে, বোঝে না সে।

আকাশে জমলে কালো মেঘ, রাজপথে
কেউ দিনদুপুরে হঠাৎ খুন হলে কিংবা কোথাও হাঙ্গামা
বাঁধলে লোকটা নিজেকেই অপরাধী ভেবে বসে আর মনের অসুখ
তাকে কুরে কুরে খায়।
বিশেষত রাতগুলো খুব ভয়াবহ চেহারায়
সম্মুখে হাজির হয়। ঘরের দেয়াল চারদিক
থেকে তীক্ষ্ণ দাঁত-নখ খিঁচিয়ে এগিয়ে আসে সেই
লোকটাকে লক্ষ্য করে। ঘোর অনিদ্রার প্রহরের চাপে
দম বন্ধ হয়ে আসে তার, তখন সে মৃত্যুকেই
পরম সুহৃদ ভেবে নেয়। কখনও কখনও অবচেতনের
ছায়াচ্ছন্নতায় এক মোহন উদ্যান দেখা দেয়, তার দিকে
কারও মায়াময় হাত অপরূপ মুদ্রায় এগোয়।

রোদের কামড় লোকটাকে যন্ত্রণাকাতর করে বড়, লহমায়
জ্যোৎস্নার মলমে ঠিক নিভে যায় জ্বালা। যখন সে
ঘাসে শুয়ে নক্ষত্রের উদ্দীপিত সভা দ্যাখে,
অনেক পুরনো কথা বুদ্বুদের মতো জেগে উঠে
মিশে যায় স্মৃতিমগ্ন ধূসর গুদামে। ধুলো ওড়ে
কিছুক্ষণ, অনেক মুখের ভিড়ে একটি মুখের রূপরেখা
ক্রমাগত গাঢ় হতে হতে লোকটার
নিজেরই হৃদয় হয়ে যায়। পরমুহূর্তেই তার
বুকের ভেতর এক বেয়াড়া নেউল বড় বেশি দাপাদাপি
গুরু করে; লোকটা ভীষণ ভয় পেয়ে মুখ ঢাকে। মাঝে মাঝে
আঙুলের ফাঁক দিয়ে দ্যাখে, আশঙ্কায় কাঁপে-
হয়তো অনেক কিছু এক্ষুণি হাজির হবে, অকস্মাৎ চোখে
পড়ে তার-একটি করুণ লাশ ভাসে ফিকে চাঁদের আলোয়।
ভাবে, কার এই লাশ? এটা কি অভাগা
কোনও পুরুষের, যার নাম জানবে না কেউ আর? নাকি তার?
১৭.১২.২০০০

আকাশপ্রদীপ রূপে

নক্ষত্র, সবুজ ঘাস, টলটলে শিশির এবং গোধূলির
রঙে গড়া একজন বড় একা নিশ্চুপ যাচ্ছেন হেঁটে, চোখ
তাঁর ভাসমান মেঘে, কালো যমজ পাম্পসু জোড়া
ধুলোয় সফেদপ্রায়। হাঁটছেন, তিনি হাঁটছেন
ফুটপাতে, বলা যেতে পারে, হাজার বছর ধরে। নালন্দার
গভীর জ্ঞানের আভা বিচ্ছুরিত তাঁর মুখমণ্ডলে সর্বদা।

অক্লান্ত পথিক তিনি প্রান্তরে, উদ্যানে, কখনও বা
সরাইখানার ধার ঘেঁষে, প্রজাপতিময় কোনও সর্ষেক্ষেত
বামে রেখে হেঁটে যান; দিঘির কাজল
ঠাণ্ডা জল সুস্থির আঁজলা ভরে করেন সাগ্রহে পান আর
কখনও গাছের শান্ত ছায়ায় বসেন, নানা পাখি
কাছে আসে নিকট আত্মীয় ভেবে তাঁকে।

দূর অজন্তার গুহাচিত্রের যুগল নরনারী উদাসীন
সেই পথিকের পদতলে রাখে অগণিত ঘিয়ের প্রদীপ
অন্ধকারে, কলকাতার কলরোল মেশে
ধানসিঁড়ি নদীর কল্লোলে, ট্রামলাইন বিমুগ্ধ যাত্রী করে
আকাশে বিলীন হয়, ভাবমগ্ন যাত্রীর ধূসর পাণ্ডুলিপি
অধিক উজ্জ্বলতায় আকাশ প্রদীপ রূপে প্রতিভাত হয়।
১৮.১.২০০১

আমার পড়ার ঘর থেকে

আমার পড়ার ঘর থেকে কিয়দ্দূরে
দু’জন দাঁড়িয়ে আচেহ বহুদিন থেকে। একজন দীর্ঘকায়,
হৃষ্টপুষ্ট; অন্যজন স্বাস্থ্যে ঝলসিত,
অথচ ঈষৎ খাটো, শীর্ণকায়। উভয়ে সবুজ পাতা আর
ডালপালা নিয়ে মৃত্তিকায় এবং আকাশে চোখ
রেখে চেয়ে থাকে, পরস্পর আলিঙ্গনে,
চুম্বনে অত্যন্ত অভিলাষী। বস্তুত বিচ্ছিন্ন থাকে
সর্বদাই, কালেভদ্রে দু’জন কিঞ্চিৎ হয়ে ওঠে স্পর্শময়।

কখনও কখনও মনে হয় ওরা, সেই বৃক্ষযুগল, আমার
জানালা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়তে ইচ্ছুক খুবই,
যেন কিছু গূঢ় কথা অথবা কাহিনী
বলার তাগিদে সেই কবে থেকে আছে প্রতীক্ষায়
দিনরাত। কিছুকাল পর এক গোধূলিবেলায়,
যেদিন কলম নিয়ে বসেছি কবিতা
লেখার অপ্রতিরোধ্য তাড়নায়, দীর্ঘকায় গাছটি ওপার
থেকে ডেকে বলে গাঢ় সকরুণ স্বরে, ‘শোনো কবি,
আমরা বিপন্ন অতিশয়, আমাদের সর্বনাশ
ঘনিয়ে আসছে দ্রুত, আমাদের দেবে বলি বড়
বেশি লোভী কিছু লোক; রক্ষা করো তুমি আমাদের। আমি
অসহায় চেয়ে থাকি, কলম দুর্বল অতি কুঠারের কাছে।
২২.১২.২০০০

আমার ভেতরে অন্য কেউ

আচমকা মনে হলো, কারা যেন ঘরের ভেতর
এসেছে অত্যন্ত সন্তর্পণে। অথচ কাউকে আমি
কোথাও দেখতে পাচ্ছি, এমন তো নয়। তাহলে কি
কল্পনা আমাকে কিছু অদৃশ্য সত্তার
মুখোমুখি দাঁড় করাবার
কৌশল নিয়েছে অগোচরে? বসে থাকি
একলা নিশ্চুপ থমথমে ঘরে। সারা
শরীর আমার যেন অন্য কারও শরীরের ভেতরে প্রবেশ
করানো হয়েছে চাতুরীর ছায়াবৃত প্রক্রিয়ায়
নিজেকে বড়ই ফাঁকা ফাঁপা মনে হয়।

আমি কি ডাকবো চড়া গলায় কাউকে? কিন্তু হায়,
কারা ছলনায় কণ্ঠ রোধ করে রেখেছে আমার। হা কপাল,
শত চেষ্টা সত্ত্বেও এখন গলা থেকে
গোঙানি ব্যতীত, হাহাকার ছাড়া কিছু
বেরুবে না কোনওমতে। গলার ভেতরে
হাজার হাজার কাঁটা ছড়ানো রয়েছে, রক্ত ঝরে অবিরাম।
আমার বিরুদ্ধে এ কেমন
ষড়যন্ত্রের মেতেছে রহস্যময় কোন সে এলাকাবাসী? তুমি,
যে আমার পথপ্রদর্শক, সম্ভবত বন্দি আজ মায়াজালে।

আমি তো শুনতে পাচ্ছি ঘণ্টাধ্বনি, মনে হয়, শুভবাদীদের।
তবে কি পুরনো কঙ্কালের হুটোপুটি
হবে শেষ অচিরেই? পূর্ণিমার আলোর জোয়ারে
ভেসে যাবে কণ্ঠকিত অমাবস্যা, আর
শ্যাওলা-জড়ানো কিছু উড়ন্ত করোটি গুঁড়ো হয়ে
ঝরে যাবে ধূধূ তেপান্তরে। কিষাণীরা ভালো ফলনের গীতে
ছন্দিত ঝংকৃত আর রাখালের বাঁশি
দিগন্তের দিকে সুদিনের সুর হয়ে মঞ্জরিত।
এখন আমার ঘরে সহজ সুন্দর অধিষ্ঠিত,
নীরবে ছড়ান তিনি কিছু ফুল চৌদিকে এবং আমি খুব
শ্রদ্ধাভরে কুড়াই সে-ফুল আর আমার ভেতরে
অন্য কেউ জেগে উঠে পূর্ণিমা সৃজনে মগ্ন হয়।
১৬.৭.২০০০

 আমি তো ডুবুরি নই

আমি তো ডুবুরি নই, তবুও সমুদ্রে ডুব দিই ঘন ঘন।
ঢেউয়ের প্রহারে ক্লান্ত হই, মাঝে মাঝে ভয় হয়
হয়তো হাঙর এসে কেটে নেবে আলগোছে পা দুটো আমার,
তবু সমুদ্রের তলদেশ বারবার ছুঁতে খুব ইচ্ছে হয়।

আমার অজানা নয় এই ডুবে ফের ভেসে ওঠার কারণ-
অন্তরে রেখেছি পুরে বাসনার একটি ভ্রমর,
অপরূপ গুঞ্জরণ যার দেয় না সুস্থির হতে
কখনও আমাকে। আমি চাই সমুদ্রের তলদেশে
আন্দোলিত লতাগুল্মেলগ্ন কিছু মুক্তো তুলে নিতে-
আজীবন এই তো আমার সাধ এবং সাধনা।
১০.১২.২০০০

আমি থাকি আমারই ধরনে

আমি থাকি আমারই ধরনে; কারও ভাবনার ছাঁচে
কখনও পড়ি না ধরা, অনুমান করি। একটি সংসারে আছি
বহুদিন, অথচ সংসারী নই। নিয়ত বাজাই
আত্মলোপী একতারা, তবু বাউলের আলখাল্লা অদ্যাবধি
করিনি ধারণ অঙ্গে। আকাশের চাঁদ হাতে আসে
মধ্যরাতে, তারার নূপুর বাজে ঘরে নিস্তব্ধ প্রহরে মাঝে মাঝে।

আমার সংকেতে, কিন্তু যাদুকর
আমাকে যাবে না বলা কোনও মতে, এমনই তরিকা অধমের
আমার বাড়ির কাছে অদূরে দাঁড়ানো গাছে সবুজ পাতার
সমারোহ দেখি, ঝরা পাতার নীরব কান্না শুনি
কখনও চলার পথে, কষ্ট পাই। পথের কিনারে অসহায় একজন
যখন দাঁড়িয়ে থাকে, বেদনার্ত হয় মন। মনে হয়, সমস্ত শহর
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে এতিমের মতো। ঘরে ফিরে
কবিতার খাতা খুলে বসি, পঙ্‌ক্তিমালা টেনে আনি
মেঘ, রোদ, পাখি আর মানুষের মুখ থেকে, ওরা
কবি বলে আমাকেই, অথচ বলে না কেউ কেউ।
১২.১২.২০০০

আরোগ্যনিকেতনে একা

ভাসমান মেঘে মেঘে উড়াল আমার,
সকল সময় নয়, প্রায়শই। সবুজ পাতার ঘ্রাণে বুঁদ
হয়ে থাকি কখনও কখনও; মাঝেমাঝে
নদীর গভীর অন্য গভীরতা খুঁজে বিয়াবান
চর ছুঁয়ে ফেলি, মৃত সারসের পুরনো পালক
ধরায় কেমন নেশা! অসুস্থতা ভর করে হঠাৎ কখন,
বোঝা দায়, অন্তর্গত ঝাঁঝ নিভে যেতে চায়,
হাড়-হিম-করা হুহু হাওয়ায় কী যেন ভেসে আসে অতিদূর
থেকে, অস্তিত্বের নড়বড়ে কাঠামো বেদিশা বড়, কেউ নেই
ধারেকাছে, শুশ্রূষায় প্রকৃত হাতের স্পর্শ নেই এতটুকু,
ধূ ধূ শূন্যতায় ঝুলে থাকি। অসীমের ফিসফিস চতুর্দিকে।

কেমন আবছা পদধ্বনি, না-দেখা মানব-মানবীর কিছু
একান্ত ঝাপসা কণ্ঠস্বর, অতি-ব্যবহৃত
রোগীর শয্যায়, রাত তিনটায় ওয়ার্ড নিঝুম অতিশয়,
আমি একা পড়ে আছি বেগানা শবের মতো শীতল, নির্ঘুম,
কপালে কাঙ্ক্ষিত কোনও কোমল হাতের স্পর্শ নেই,
বোবা অন্ধকারের মশারি
আমাকে রয়েছে ঘিরে, জানি না কেমন ভোর ছোবে
আমাকে আবার, না কি পাবো না কখনও আর রৌদ্রের চুম্বন।

অন্ধকারে বিষকাঁটা ক্রমশ গজাতে থাকে শরীরে আমার,
ইচ্ছে হয় ভীষণ চিৎকারে স্তব্ধতাকে
গুঁড়ো করি কাচের মতোই, রোগীদের
কথা ভেবে চুপচাপ বেডে পড়ে থাকি।

কী আমার ব্যাধি? কোন্‌ জীবাণু আমার রক্তে ক্রিয়াপরায়ণ
তোমরা কি বলে দেবে আমাকে এখন
এমন নিঃসঙ্গ প্রহরের ঠাণ্ডা, অন্ধ স্তব্ধতায়?
কেবলি বাড়ছে যন্ত্রণা, এ কেমন আরোগ্যনিকেতন?
২০.৫.২০০০
নোআজিএল (প্যারিস)

ঈগল

অগোছালো টেবিলে ছড়ানো
কয়েকটি বই, খাতা আর
একটি কলম, শূন্য ধুধু
চেয়ার, দড়িতে ঝোলে শার্ট,
দেয়াল পোস্টারে সুসজ্জিত;
সূর্যাস্তের মুমূর্ষ আলোয়
ঘরের বাসিন্দা ফিরে আসে,
গুলিবিদ্ধ নিষ্প্রাণ ঈগল।
৫.২.২০০১

 ঊনত্রিশ বছর পরেও

ঊনত্রিশ বছর পরেও এ কেমন বিবমিষা মৃত্তিকার?
ভীষণ বমনে তার নিমেষে বেরিয়ে আসে বিষণ্ন কঙ্কাল-
গুনে দেখা গেল ঠিক আটটি কঙ্কাল ওরা; দূরে
নীল আকাশের দিকে মুখ করে পড়ে আছে পথের কিনারে।

ক’জন উৎসুক পথচারী কাছে এসে ঝুঁকে শনাক্ত করার
অভিলাষে মেতে ওঠে; কারও কারও মনে
প্রশ্ন জাগে, এই আটজন হিন্দু ছিল? কেউ কেউ
মাথা চুল্‌কে ভাবে,
ওরা কি প্রকৃত মুসলিম নাকি কাদিয়ানী সব? কঙ্কালেরা
নিরুত্তর। অদূরে একটি পাখি গেয়ে ওঠে, ‘মানুষ, মানুষ।
১০.১২.২০০০

 এ কেমন অনুভূতি

এ কেমন অনুভূতি বুদ্ধুদের মতো এখন উঠছে জেগে
বারবার অন্তরে আমার এই স্থানে বসে? এখানে আগেও
এসেছি, বসেছি বৃক্ষতলে
শ্বাসনালী শুদ্ধ করে নিতে
নিজেরই অজ্ঞাতে। তাকিয়েছি চারদিকে প্রফুল্ল দৃষ্টিতে; কত
পাখি স্বাভাবিক নৃত্যকলায় বিভোর
ডালে ডালে, সতেজ সবুজ ঘাসে। দর্শকের প্রতি বেখেয়াল
ছিল সেইসব আনন্দিত ক্ষুদ্রকায় প্রাণী সহজ বিশ্বাসে।

ওদের বিশ্বাস আমি কাচগুড়ো করিনি কখনও,
বরং সুস্নিগ্ধ উপভোগে
প্রফুল্ল হয়েছে মন। এখানে তো ছিল কতিপয়
স্মিত, স্বপ্নাতুল গাছ। হায়, আজ নেই, ক্ষীণ গুঁড়ি
রয়ে গেছে বেদনার্ত কঙ্কালের নিঝুম ভঙ্গিতে
অবিকল। হু হু হাওয়া স্মৃতি বয়ে আনে
মর্মাহত আস্তানার; কখনও এখানে ছিল গান, যুগলের
বসে-থাকা, মোটা মিহি কণ্ঠস্বর, ঘনিষ্ঠ আলাপ।

এ কোন্‌ বেগানা স্থানে আগন্তুক আমি আজ? নিজেকেই খুব
অচেনা লাগছে, যেন আমি নই আমি আর, এই দেহমন
অন্য কারও; ভয় হামাগুড়ি দিতে থাকে
আমার ভেতর; মাথা ঘোরে। মনে হয়,
রুক্ষ ধুলোবালির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছি কোনওমতে,
এখন শীতল জলে মুখ ধুলে বেশ ভালো লাগবে আমার।
১৪.১২.২০০০

একজন নিশাচরের ডায়েরি থেকে

সকাল জড়াতে চায় দুপুরকে, দুপুর বিকেলে কী সহজে
মিশে যায় এবং বিকেল গোধূলির ইশারায়
আলিঙ্গনে লিপ্ত হয় সন্ধ্যার সহিত, সন্ধ্যা নিশীথের সাথে
বাসর-শয্যার করে আয়োজন। কতিপয় নক্ষত্র সহজে মেতে ওঠে
মিটিমিটি নিরীহ কৌতুকে। একজন ভবঘুরে মাঠে শুয়ে
ভাবনায় বুঁদ হয়ে আছে। স্তব্ধ গাছে দুটি পাখির প্রণয়।

তিনজন ফতুর জুয়াড়ি হাঁটে ফুটপাতে, রাত
খোঁয়াড়িতে টলে আর অদূরে জানালা খুলে গেলে
একটি উৎসুক মুখ নীরবে কী যেন খোঁজে, ঘুম? না কি
উধাও স্বপ্নের পদধূলি? হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে
নিশীথের বুক, কয়েকটি পাখির ডানার ঝাপটানি
যুগধ্বনি হয়ে ফের নিস্তব্ধতা হয়ে নামে চারপাশে।

একজন অসুস্থ ভিখিরি একা পুরনো পার্কের বেঞ্চে শুয়ে
নির্ঘুম গোঙায়, ভাবে হয়তো টহলদার পুলিশ তাড়িয়ে
দেবে তাকে, যেন সে কুকুর কোনও। একদা সংসার ছিল তারও,
বানে সব কিছু গেছে ভেসে। তিনজন ফতুর জুয়াড়ি এসে
ভিখিরির পুটুলির বিশদ তল্লাশি নিয়ে ফের রেখে দেয়
চরম ঘেন্নায়, আসমানে নক্ষত্রেরা শুধু মিটিমিটি হাসে।
২৬.১.২০০১

একজন প্রৌঢ়, তিনটি পুস্তক

কেমন ধূসর কাল নিশ্চিন্তে করছে গ্রাস সময়কে আর
ঘন অন্ধ কুয়াশায় চকিতে হারায়
যৌথ আর্তনাদ; ইদানীং
ভীতিচিহ্নগুলো ক্রমে প্রকট ভঙ্গিতে ছোট বাসগৃহটির
দরজা জানালা জুড়ে দাঁড়ায়, ওদের চাউনিতে তুষারের
শীতলতা জমে থাকে। দোর থেক ফিরে যায় উদাস বাউল।

ছোট বাসগৃহটিতে বসে আছেন যে প্রৌঢ়, তাঁর
মনে হলো, শহর ধূসর এক চাদর জড়িয়ে বসে আছে
শহরের অন্য কোনওখানে ভ্রমণে যাওয়ার বড়
সাধ সেই কবে থেকে, অথচ চলৎশক্তি নেই এতটুকু,
সেহেতু নিশ্চল, জবুথবু বসে আছে; রোজ নানা
পীড়ন সইছে মুখ বুজে আর অসহায় দেখছে কত না
দারুণ ইঁদুর-দৌড় চৌরাস্তায়, অলিতে গলিতে,

তিনটি পুস্তক, সম্ভবত কবিতার, মরালপ্রতিম উড়ে
আসছে পৌঢ়ের দিকে। ওদের অস্তিত্ব থেকে ঝরে
এক্তাপ্লুত বেদনার সুর, বুঝি কোনও তীরন্দাজ
তিনটি পাখির বুক ভেবে ছুঁড়েছিল তীক্ষ্ম শর। এখন তো
আহত পুস্তকগুলো ইতস্তত ধুলোয় থাকবে পড়ে, পৌঢ়
লিখবেন এলিজি; কাঁদবে ঘাস, প্রজাপতি এবং আকাশ।
২২.১১.২০০০

একটি ধূসর বক

কে হে তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো? আমাকে দেখাচ্ছো ভয় এই
থমথমে সন্ধ্যেবেলা? আমি তো শহুরে
একজন; দিনরাত হট্রগোল, আবর্জনা আর
বিষাক্ত ধোঁয়ার নিপীড়নে
ধুঁকছি বেজায়। ফুসফুস কাবু খুব, বহুরূপী সন্ত্রাসের
অবাধ দাপটে, হায়, ঘরে কি বাইরে
টেকা দায়, জেনেছি বোবার শক্র নেই,
সহজে খুলি না মুখ তাই, ফুঁসি মনের গহনে।

কী খেয়াল হলো, অকস্মাৎ বহুদিন পর ছুটে
গেলাম আপন গ্রামে শান্তির সন্ধানে। বিকেলের
শান্ত রোদে নৌকায় ভ্রমণ করি ছোট নদীবুকে। চোখে পড়ে,
একটি ধূসর বক দাঁড়ানো শান্তিতে ডোবা চরে
ধ্যানীর ধরনে একা, যদিও রয়েছে মনে মাছ
শিকারের আশা ক্ষুধা নিবৃত্তির খাঁখাঁ প্রয়োজনে।

হঠাৎ কোত্থেকে এক জাঁহাবাজ গুলি ছুটে এসে
নিঝুম ধূসর বকটিকে কী ভীষণ রাঙা করে দেয়।
টাটকা, সুস্বাদু মাছ শিকারের প্রয়োজনে উড়ে-আসা পাখি
নিজেই শিকার হলো শেষ বিকেলের রোদে। তাজা
গুলির কর্কশ শব্দ, ধোঁয়া, ছোট্র প্রাণীর বুকের রক্তধারা
স্বরণ করিয়ে দেয় পাড়াগাঁর গোধূলিতে শহুরে সন্ত্রাস।
৬.৮.২০০০

একটি বিস্মৃত নাম

বুড়োসুড়ো লোক, প্রতি রাতই প্রায়
নির্ঘুম কাটে শয্যায়। দিনে মাঝে মাঝে ঈষৎ
ঝিমুনি ধরে আর নানা হিজিবিজি ভাবনা
হাতকড়া পরিয়ে, শেকলে বেঁধে বৃদ্ধকে
দিব্যি মজা লোটে। কিছুকাল আগেও তিনি কবিতার
নানা রঙের চমৎকার সব ঘুড়ি
উড়িয়ে দিতেন নীলাকাশে। অনেকে বাহবাও দিতো,
এরকম গল্প চালু আছে প্রবীণদের মহলে।

আজ বুড়োসুড়ো লোকটা স্থবির, সকল
উচ্ছল চাঞ্চল্যের বাইরে বসে কখনও ঝিমোয়,
কখনও বা অতিশয় ঝাপসা দৃষ্টিতে আশেপাশে কী যেন
খোঁজে। কখনও কখনও ওর মানস-হ্রদে
ভেসে ওঠে একটি কি দু’টি স্মৃতিসিক্ত মুখ, কোনও
জ্বলজ্বলে নেশা-ধরানো শরীর। তাদের নাম
ঘন নীরবতা ও মধুর সুরে আবৃত্তি করে বৃদ্ধকে আচানক
চম্‌কে দিয়ে। একটি কটমটে, রাগান্বিত মুখের চক্ষুদ্বয় বিষ ছড়ায়।

বুড়োসুড়ো লোকটা সেই কটমটে মুখের নাম মাথা কুটেও
স্মরণের চৌহদ্দিতে আনতে অপারগ। দারুণ
অস্বস্তিতে কাটে তার অনেক প্রহর। সেই রোষদগ্ধ চেহারার
অধিকারী বহুকাল আগেই পৃথিবীর রৌদ্রজ্যোৎস্না থেকে
সরে গেছেন চিরতরে। বুড়োসুড়ো লোকটা যৌবনে সেই অপ্রসন্ন,
প্রায় ক্ষ্যাপাটে ভদ্রলোকের জীবনসঙ্গিনীর দেহ-সরোবরে
ডুবসাঁতার কেটেছে, এই অমূলক ধারণা নিয়েই
দুনিয়া থেকে মুছে গেছেন। আসল সাঁতারু কে ছিল তা কি
তিনি জানতে পেরেছিলেন কোনওদিন? কানাঘুষোর
সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচয় ছিল নিরপরাধ যুবকের, অর্থাৎ আজকের বৃদ্ধের।

বুড়োসুড়ো লোকটা রুষ্ট ভদ্রলোকের কুমারী গৃহিণীর
হৃদয়পদ্মের সুরভিতে সত্যি মজেছিল জ্বলজ্বলে যৌবনে,
কিন্তু তাকে সর্বক্ষণ ভুল শনাক্ত করেছে
ঈর্ষাকাতর স্বামী, অপরের দস্যুতা তার সত্তায় আরোপ করে
নিজে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে বারবার। আজো তার
জ্বলন্ত দৃষ্টিময় চেহারা মনে পড়ে বৃদ্ধের, যদিও বিস্মৃত নাম।
১৫.৬.২০০০

একটি হাট-করা দরজা

দরজাটা হাট-করা। ওর চারপাশে গিজগিজে ভিড়,
ভেতরে যাওয়ার জন্যে সবার কী হুটোপুটি। এ ওকে কনুই দিয়ে
ধাক্কা দিচ্ছে, কেউবা পাশের লোকটিকে আচমকা মারছে ল্যাঙ।
কেউ কেউ ক্রোধে চুল্লীর আগুন, কারও কারও ইতর বুলি শুনে কানে
দু’হাত চেপে ধরতে ইচ্ছে করে আমার। গুঁতোগুঁতির ভয়ানক এক প্রতিযোগিতায়
ক্লান্ত সবাই, কিন্তু প্রত্যেকেই দরজা পেরুতে
নাকাম। এই হট্ররোলের মধ্যে লক্ষ করি, একটি অজগর কারুকাজময়
দরজা আগলে দাঁড়ানো। দরজার সামনে গিয়ে প্রচণ্ড
আঁৎকে ওঠে লোকগুলো, পড়িমরি করে পিছিয়ে আসে।

আস্তে-সুস্থে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ভিড় এড়িয়ে। খানিক
এগুতেই চোখে পড়ে দরজার পাশে দুলছে অনুপম রমণীয়
দুটি হাত, যেন আমাকে বরণ করে নেয়ার চাওয়া দশটি
সরু আঙ্গুলে আঙ্কিত। অজগরটিকে দেখতে পাচ্ছি না,
কোথাও যেন কোনও যদুবলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে নিমেষে।
প্রতিবন্ধকহীন প্রবেশ করি ভেতরের দরজা পেরিয়ে; ভেতরকার
দৃশ্য বর্ণনা করার ভাষা আমার অজ্ঞাত। মুগ্ধতা আমাকে
মূক করে ফেলে এক লহমায়। অপরূপ সৌন্দর্যের এমন
প্রকাশ ইতিপূর্বে বাস্তবে কি স্বপ্নে চোখ মেলে আমার দেখা
হয়নি। কী করে এক হর্ম্য, এক উদ্যান পেরিয়ে এলাম তা জড়ানো
থাক রহস্যময়তায়, এই শব্দগুচ্ছ কে যেন আমার কানে
আতরের তুলোর মতো গুঁজে দেয়। সেই শব্দরাজির নির্দেশ
অমান্য করা আমার সাধ্যাতীত।

কী করে সেই বন, সেই কাঁটা-বিছানো পথ, হাট-করা সেই
দরজা, হর্ম্য, উদ্যান থেকে ফিরে এলাম আপন ঘরে, বলতে
পারবো না। তবে ঘরে ফিরে আসতেই আমার হাতের
তিন আঙুলে বিদ্যুচ্চমক, পাহাড়ি ঝর্ণার গান। বহু দিন ধরে
বন্ধ্যা পড়ে-থাকা আমার খাতা গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে অজস্র
রঙধনুরূপী শব্দের মিছিলে।
১৫.৫.২০০০
নোআজিএল (প্যারিস)

একান্নবর্তী

একজন বুড়ো শুধু
কাশতে থাকেন,
একজন নারী ভোরে,
বাসন মাজেন,
একজন আধবুড়ো
দূরের দপ্তরে যান,
গোসলখানায় কাঁদে
ফুটন্ত তরুণী।
একজন যুবা জেবে
পুরে নেয় রোদ,
মাছে গোধূলির রঙ
চেটে নেয় জিভে,
এবং দু’চোখে তার
বার বার দোলে
অগণিত পিটিশন,
গোলাকার দড়ি
৫.২.২০০১

এবং উঠোনে মুমূর্ষু কবুতর

(মোহাম্মদ আবুল কাশেমের উদ্দেশে)

দিনরাত বছরের পর বছর এভাবে বিছানায়
সেঁটে থাকা, সামান্যই নড়াচড়া, মানে
অন্যের সাহায্যে শুধু এপাশ ওপাশ করা, ওঠা
কিংবা বসা নেই এতটুকু। এভাবেই ওষুধের,
ডেটলের এবং নিজের অস্তিত্বের দুঃসহ গন্ধের মধ্যে যাচ্ছে বয়ে
দিনগুলো, রাতগুলো। জীবনসঙ্গিনী যিনি, তার
শুশ্রূষা, সংসার চালাবার
নাছোড় সংগ্রাম এই অক্ষম আমার বড় শুষ্ক হৃদয়ের
জমিনে শিশিরবিন্দু ঝরায় নিয়ত। তার দিকে
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, বলি না কিছুই।

না, এভাবে আর শয্যাবন্দি থাকবো না, এবার আমার
গাঝাড়া দেয়ার পালা। এইতো বিছানা থেকে নেমে
দাঁড়িয়েছি সটান মেঝেতে, দিব্যি হেঁটে যাচ্ছি একা
বাড়িটার কৃপণ বাগানে, জনাকীর্ণ ফুটপাতে। কতকাল
দেখিনি এসব দৃশ্য, এসব দোকানপাট, শুনিনি ভিড়ের
কোলাহল, স্রেফ ভুলে ছিলাম মোটরকার, বাসের গর্জন।

কী আশ্চর্য, এই তো উড়ছি আমি নীল আসমানে, ভাসমান
মেঘ চুমো খাচ্ছে বারবার আমাকে এবং নিজে
হচ্ছি রেশমের মতো মেঘ হচ্ছি বাতাসের মিহি ঢেউ; লাল,
নীল, সাদা, সবুজ, হলুদ পাখি হচ্ছি, অবিরত
ফুটছি গোলাপ, পদ্ম হয়ে, ঝরাছি বকুল হয়ে
চকিতে কোথাও। আমি আর আমি নই, অন্য কেউ একজন।

তোশক-বিছানো খাটে ভয়ানক সাঁটা নই, নই স্থাণু, নানা
ওষুধের গন্ধ আর করে না পীড়ন দিনরাত, ভালো করে
তাকাও আমার দিকে, আমার শরীরে
নক্ষত্রপুঞ্জের দ্যুতি, আমি অবিকল ডানাঅলা
দেবদূত। যখন যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি অনায়াসে, কেউ
পারে না রুখতে গতি। হঠাৎ আমার এ কী হলো!
কোথায় অমল ডানা? সেঁটে আছি পুরনো চাদরে, অপরাগ
শয্যাত্যাগে, নানাবিধ ওষুধের ঝাঁঝাঁ গন্ধে স্বপ্নের পরাগ
ঝরে যায়, সুদূরের মেঘ শুষে নেয়
হায়, দেবদূতের মহিমা আর উঠোনে মুমূর্ষু কবুতর।
১১.৭.২০০০

 ওরা দু’জন

একটি নাজুক ছোট বাড়িতে বুড়োবুড়ি
করতেন বসবাস। সন্তানসন্ততি
ছিল না তাদের কেউ। দু’জনের সীমিত সংসার
আনন্দের মধুর রোদ্দুর চাঁদিনীতে
ছিল উদ্ভাসিত, জানতাম পড়শিরা। কীযে ভালো
লাগতো তাদের দেখে দূর থেকে। কখনও সখনও
যেতাম তাদের কাছে, গল্পসল্প হতো,
পুরনো দিনের কথা রূপায়িত হতো চায়ের বাটিতে বেশ।

দু’জনের সংসার চলতো জানি প্রবীণের শেষ পেনসনে।
শুনিনি তাদের মুখে সামান্য নালিশ, নিন্দা কারও।
ভাসতেন দু’জন তৃপ্তির সরোবরে। কালো রাতে
বিছানায় দু’টি প্রাণী থাকতেন পরস্পর জড়াজড়ি করে
আর অতীতের কিছু স্মৃতি সুকান্ত পাখির মতো
উড়ে উড়ে ঘুরতো, গাইতো গান মনের প্রসন্ন গোধূলিতে।
কখনও বা পূর্ণিমা চাঁদের রোশনিতে
পড়তো ওদের মনে নিজস্ব যৌবন।

একদিন সে প্রবীণ নিলেন বিদায় জীবনের সুমধুর
সব কলরব থেকে, আর নিঃসঙ্গ সে বৃদ্ধা নিষ্প্রদীপ
ছোট ঘরটিতে রাতে বিছানায় জলভেজা চোখে
কী বিপুল শূন্যতাকে আক্রোশে করেন আলিঙ্গন।
১৫.১০.২০০০

কখনও ঝরাবে অশ্রু, কখনও আগুন

এই তো হৃৎপদ্ম আমাদের বারবার
দুলে ওঠে সুর হয়ে, দুলে ওঠে লালন সাঁইয়ের অনুপম
গান হয়ে। নিশ্চিত জেনেছি ছেউড়িয়া
নয় শুধু রুক্ষ জমি কোনও, নয় একটি ভরাট নদী ধুধু,
বৃক্ষহারা করুণ বিবর্ণ মরু নয়।
ছেউড়িয়া লালনের আপন হৃদয়,
ছেউড়িয়া অগণিত বাউলের পূণ্য ধ্যানভূমি। ছেউড়িয়া
আমাদের সবার অন্তরে ফোটা অনন্য গোলাপ।

ভয়ঙ্কর তরিকার মুখ দেখি প্রশান্তির নির্মল আসরে,
বাউল-তাড়ানো সন্ত্রাসের জন্ম হয়
ভাড়াটে লেঠেল আর অস্ত্রবাজদের অতিশয় ন্যাংটো, ক্রূর
হামলায়; লালনের গান আর একতারা করে আর্তনাদ।

আমাদের গোলাপের বুক থেকে রক্ত ঝরে কোদালের ঘায়ে,
প্রবীণ বৃক্ষেরা ভূলুণ্ঠিত। লালনের স্মৃতিসৌধ অচিরেই
ভিন্ন উঁচু দালানের গ্রীবা জিরাফের মতো শেষে
ফেলবে কদর্য ছায়া। লালন সাঁইয়ের একতারা
এতকাল পরে ফের প্রকৃত বাজবে নিদারুণ
অপমানে, ক্ষোভে, শোকে; বেদনার সুর
প্রকৃতিকে বড় বেশি করবে করুণ। এক, দুই, তিন, চার,
হাজার হাজার প্রতিবাদী একতারা
এবং দোতারা ভোরবেলা, বিষণ্ন দুপুরে, রাতে
কখনও ঝরাবে আশ্রু কখনও আগুন।
৯.১১.২০০০০

কত অগ্নিবলয় পেরিয়ে

একদা আমারও ছিল জ্বলজ্বলে যৌবনের কাল। যৌবনের
প্রত্যুষে ভেবেছি, হেসে খেলে,
খাতার সফেদ পাতা জুড়ে মাঝে মাঝে
সযত্নে সাজিয়ে কিছু শব্দের মিছিল
রঙিন সিল্কের মতো কেটে যাবে মসৃণ আমোদে
জীবন আমার বসন্তের পুষ্পঘ্রাণে, প্রেমঘোরে।

তখন ভাবিনি মোটে জনকের প্রশ্রয়, আশ্রয়
কত ক্ষণস্থায়ী, কত খটখটে, নিষ্পৃহ, নির্দয়
পরিবেশ; প্রতি মোড়ে ছদ্মবেশী আততায়ী ওঁৎ পেতে থাকে
কুটিল সংঘের নির্দেশনা প্রশ্নহীন, শর্তহীন মেনে নিয়ে
প্রতিবার। ঢের ঝড়জল
বয়ে গেছে মাথার ওপর আর বহুরূপী ভর্ৎসনা, যন্ত্রণা
সইতে হয়েছে নানা মহলের। অথচ নিজস্ব বিশ্বাসের
মাটি থেকে আজ অব্দি এক চুলও দাঁড়াইনি সরে।

বারবার কত অগ্নিবলয় পেরিয়ে
এসেছি ঝল্‌সে-যাওয়া দেহমন নিয়ে। যন্ত্রণায়
হয়েছি কাতর সত্য, অথচ কখনও নিরাশার পাখসাটে
যাইনি তলিয়ে পাতালের
অতল তিমিরে। শুভ আলো, যত ক্ষীণ হোক, পথ
দেখিয়ে এনেছে প্রতিবার; দেহ মনের জখম সেরে গেছে
ফুল, পাখি, শুকতারা এবং নারীর শুশ্রূষায়। কণ্টকিত
পথে হাঁটা এখনও হয়নি শেষ, রয়ে গেছে ঢের
ধূর্ত ফাঁদ আর অগ্নিবলয় এখনও। পারবো কি
অভীষ্ট সে বৃক্ষের অনন্য
ছায়ায় দাঁড়াতে, বোধি যার নাম? অন্ধদের ভিড়ে
পারবো কি নির্ভয়ে করতে উচ্চারণ আলোকিত কথামালা?

এখনও হাঁটছি দ্যাখো, হেঁটে যেতে হবে, যতই নামুক চোখে
ক্লান্তির কুয়াশা আর ছায়ারা দেখাক ভয়। এই তো অদূরে
প্রতিভাত ঝলমলে সরোবর গোধূলিতে, অপরূপ এক
নীলপদ্ম বুক খুলে দুলছে সেখানে
ছড়িয়ে প্রশান্ত আভা। পারব কি তুলে নিতে ওকে
সরোবর থেকে? হায়, আমি তো ভুলেও
শিখিনি সাঁতার কোনওকালে। বাস্তবিক
নিয়মিত তীরে এসে তরী ডোবা আমার নিয়তি।
১০.৮.২০০০

কল্যাণের বাঁশি

মাইল মাইল পথ পেরিয়ে এসেছি ক্লান্তি নিয়ে
ঘর্মাক্ত শরীরে এই বৃক্ষতলে। জনশূন্যতায়
জায়াগাটা থমথমে খুব, দাঁড়াবো কি
আবার এগিয়ে যাবো সামনের দিকে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো
বেজায় কঠিন হলো। শঙ্কা বৃশ্চিকের মতো করছে দংশন
ক্রমাগত আমাকে, ধোঁয়াটে মনে হয় সবকিছু।

আমাকে ডাকছে ধুধু পথ, কাছে টানছে সবুজ ঘাস আর
পাখি বলে, ‘যেও না পথিক কোনওখানে,
এখানেই বিশ্রামের স্থান বেছে নাও, পরে রাঙা সূর্যোদয়
তোমাকে দেখাবে পথ। পাখির গানের মতো কথা
আশার কুসুম স্নিগ্ধ সুরভি ছড়ায় মনে। বসি বৃক্ষতলে।

এখানেই এই বিয়াবানে অন্ধকারাচ্ছন্ন নিশীথের কাছে
কী পাবো প্রার্থনা করে? নিদ্রা লুট হয়ে যাবে বিচিত্র আওয়াজে,
অমূলক নয় দুর্ভাবনা, দূর নদীতীর থেকে
কোনও গূঢ় বার্তা আসবে না জানি, তবু
অমাবস্যা-রাতে চেয়ে থাকি, যদি শোনা যায় কিছু, যদি
কারও পদধ্বনি বেজে ওঠে রুক্ষ পথে।

অকস্মাৎ আমার হৃদয়ে জাগে অন্ধকার হননের গান
আর এই বিরানায় নিমেষেই চন্দ্রোদয় হয়
রাজসিক ভঙ্গিমায়। অশুভের ডঙ্কা যত জোরেই বাজুক,
কল্যাণের বাঁশি আমি বাজাবো নিশ্চিত সুন্দরের তালে তালে।
১৩.১২.২০০০

কিছু বাতিল কাগজ

প্রায়শই খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে বসাই নিজেকে
বিভিন্ন আসনে আর স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে। নানা কোণ
থেকে দেখি নিজেকে, আবার জুড়ে দিয়ে
আমার আমাকে খুব কাছ থেকে সম্পূর্ণ সত্তার
আসল আদলটুকু নিবিড় পরখ
করে নিই অভিজ্ঞ দর্জির ভঙ্গিমায়।

এই যে লোকটা আমি হামেশাই বসে থাকি সামান্য চেয়ারে,
বই পড়ি, খবরের কাগজে বুলাই চোখ আর
অনেক সফেদ পাতা পঙ্‌ক্তিতে সাজিয়ে তুলি গভীর নিষ্ঠায়,
যখন আমার দিকে দৃষ্টি দেয় কেউ কেউ, তারা বিস্ময়ের ঢেউয়ে
ঢেউয়ে নড়ে ওঠে, কেউ কেউ ঠোঁট নিপুণ বেঁকিয়ে
উপেক্ষার হাসি হেসে দূরে সরে গিয়ে বড় স্মার্ট ভঙ্গিমায়
হাঁটে, এই আমার ভেতরকার লোক
মাথার গভীর হ্রদে কিছু রঙিন মাছের খেলা মাঝে মাঝে
অনুভব করে লালনের তরিকায়-সেইসব মাছ কোন্‌ জাদুবলে
কবিতার পঙ্‌ক্তিরূপে খুব সন্তরণপ্রিয় হয়ে ওঠে।

অন্ধকার কাঁকড়ার মতো মতো হাঁটে চতুর্দিকে, তবু আলো খুঁজি,
যেমন নদের চাঁদ ঘুরে বেড়ায় একলা শূন্য নদীতীরে
আর বনবাঁদাড়ে ব্যাকুল মহুয়ার খোঁজে চোখে চোখ
রাখার সুতীব্র পিপাসায়। কণ্ঠ বিশুষ্ক ভীষণ।

মাঝে মাঝে কী বৈশাখে কিংবা মাঘে সামাজিকতায়
বড় বেশি মেতে উঠি। এ আমার স্বভাববিরুদ্ধ, তবু কেন
এভাবে কাটাই ঢের সময়, বুঝি না। কখন যে
নিজের ভেতর ঘটে বিস্ফোরণ, কেঁপে উঠি ভয়াবহভাবে।

পরমুহূর্তেই ঠিক অদৃশ্য রবারে মুছে ফেলি খুঁটিনাটি
অতি দ্রুত। নীরবে টেবিলে ঝুঁকে কবিতার খাতা
খুলে বসি, মনের ভেতরে
কখনও ভ্রমর করে গুনগুন, কখনও বা জোনাকিরা জ্বলে
আর নেভে। ভিন্ন লোক হয়ে কলমের প্রভুরূপে স্বর্গে
মর্ত্যে করি বিচরণ, কীভাবে? নিজেরই জানা নেই।

মাঝে মধ্যে কাটাকুটিময় কিছু শব্দ-উঁকি-দেয়া
কাগজ বাইরে ফেলে দিই দূরে দারুণ হেলায়। মনে হয়, মনে হলে
তৃপ্তি পাই, সেসব কুড়িয়ে নেন অনন্তযৌবনা একজন অগোচরে-
সে রূপসী, সদাসঙ্গী যার অপরূপ বীণা আর সাদা হাঁস,
বাতিল কাগজগুলো ফুল-কুড়ানোর মতো করেন সঞ্চয়
আগামীকালের কোনও কবির ব্যাকুল অঞ্জলিতে তুলে দিতে।

কোকিলের কঙ্কাল কুড়াই

উড়ে উড়ে বহুদূরে পাখির ডানার সুরে সুরে চলে যাই
কোথায় মেঘের খুব নিরিবিলি অন্দরমহলে-
‘ও ভাই, কে আছো’ বলে ডাকি। মেঘেদের
গহীন ভেতরে ডাক পৌছে যায়, অনুমান করি; তবু কেন
পাই না তিলেক সাড়া কারও। এখানে তো পাখিদের
ঝাঁক নেই, সুরের আনন্দধারা বইবার নেই অবকাশ।

উড়ে উড়ে নিত্য মেঘে থাকা, বাসা বাঁধা অসম্ভব
মনে হয়; বস্তুত অপ্রতিরোধ্য মাটির অহ্বান চিরদিন-
কাজ সেরে বাড়ি ফিরে বাজানো কলিংবেল, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা,
শিশুর অম্লান আলিঙ্গন, জানালার শিক ধরে
গোধূলির রঙ দেখা ভালো লাগে। অকস্মাৎ গলির সুন্দর
কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিধন-পর্বের জন্যে, পড়শিনী মহিলার সদ্য
সন্তান-হারানো আর্তনাদ আমাকে বিমর্ষ করে।
তবু ধোঁয়া-ওড়ানো চায়ের পেয়ালায় চুমু দিই, কবিতার
বই খুলে বসি, উড়ে উড়ে বহুদূরে গোধূলি-মেঘের দিকে
চলে যাই, মেঘবালাদের সঙ্গে কেলিপরায়ণ হয়ে উঠি।

ওলো মেঘ, ওরে মেঘ, বল তো এমন
কী পাই তোদের কাছে? তবে কেন এই শেষবেলা
উড়ে উড়ে চলে যাই বারবার তোদের সান্নিধ্যে? বল কেন
এমন কাঙাল আমি মাঝে মাঝে মনে হয়, এই তো শুনছি
তোদের মোহিনী ডাক, ভাবি, এই বুঝি ঢুকে গেলি
আমার ভেতর আর এমন ধারণা হয়, মেঘের রেশম,
গোধূলি-বিচ্ছুরণে অকৃপণ ফ্ল্যাট তৈরি হয়ে যাবে শূন্যলোকে।

এই বয়সেও খুব ঝুঁকে কত কিছু গড়ি, ভাঙার খেলাও
কিছু কম খেলি না বিবাগী ঝোঁকে-ভগ্নাংশের কথা
ভেবে খেদ জাগে না কখনও। মাঝে মাঝে নিরুদ্বেগ,
নিঃস্পৃহ ওড়াই ছাই, কোকিলের কঙ্কাল কুড়াই।
২০.৯.২০০০

ক্ষ্যাপা হয়ে

যখন কবিতা আসে আমার নিকট ভালোবেসে
রূপসী মাছের মতো হৃদয়ের জলে,
আমি তো থাকি না আর স্বাভাবিক; কেমন উতলা
হয়ে যাই, বুঝি বা গানের সুরে মাতাল বাউল-রূপ ধরি।
আমি আর একতারা একাত্ম যেন বা,
বেজে উঠি; গাছের সবুজ পাতা, আসমানী নক্ষত্রেরা বাজে।

যখন কবিতা পদযুগ রাখে না আমার আখড়ায় কোনও
অভিমানে, আউলা বাউলা
হই না তখন আর, আতশবাজির মতো আর
ফুটি না, উঠি না জ্বলে। বেনামি আন্ধারে
ডুবে থাকি অষ্টপ্রহর; আমি তো
আগের মতোই ক্ষ্যাপা হয়ে নেচে গেয়ে আসমান ছুঁতে চাই।
২০.১২.২০০০

গোধূলিতে প্রত্যাশা

অনেকটা পথ তো হেঁটেছি এ যাবত। রৌদ্রছায়া
দেখা হলো বেশ কিছু, পাথরের সন্ত্রাসে জখমি হয়ে খুব
কখনও ক্লান্তিতে চোখ বুজে এসেছে বিজন পথে,
যেখানে ঘাতক পশু কিংবা মানুষ নামের স্রেফ
নকল তক্‌মা-আঁটা জানোয়ার ওঁৎ পেতে থাকে। কখনও বা
মধ্যপথে অকস্মাৎ ফুলের সুঘ্রাণে প্রাণ সঞ্জীবিত হয়।

কত যে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে খুঁজতে হবে শুভ
ঠিকানা কোথাও। কিন্তু সত্যি কি ঠিকানা বলে কিছু
কোথাও বিরাজ করে? কায়ক্লেশে যেখানেই যাই
নিজেকে বেগানা লাগে খুব, সবাই আমার দিকে
তাকায় এমন ঢঙে, যেন আমি এক সঙ, এসেছি সুদূর
অচেনা অজানা কোনও গ্রহ থেকে। কেউ
করে না আলাপ, শুধু দৃষ্টি হেনে যে যার গন্তব্যে
পৌঁছে যায় হয়তো বা। আমি একা পড়ে থাকি পথের কিনারে,
ভীষণ সিঁটিয়ে থাকি নিজের ভেতর। কয়েকটি রুক্ষ গাছ
আজ সাক্ষী আমার নিঃসঙ্গতার; রক্তখেকো পাখি ডেকে ওঠে
নানা দিক থেকে, দিশেহারা আমি চোখ মেলে রাখি
সেদিকেই, যখন যেদিক থেকে সন্ত্রাসী পাখির ধমকের শব্দ আসে।

আমার পথের শেষ কোথায়, জানি না। যেখানেই
হোক না, সেখানে যেন থাকে সুশীতল
ঝরনাধারা, লতাগুল্ম, গাঢ় ছায়া-ছড়ানো ক’জন
প্রবীণ দয়ালু গাছ, যারা ক্লান্তি মুছিয়ে দেবেন
পথিকের। আর যেন থাকেন নিকটে
জ্যোতির্ময়ী কেউ, যিনি আমার ব্যাকুল আঁজলায়
দেবেন ঝরিয়ে গোধূলিতে
ঝরনার শীতল জল প্রণয়ের গহন আঙ্গিকে।
৮.৭.২০০০

জীবন হোক হাসি-ঝলসিত শারদ আকাশ

এ কী হলো! ভাবিনি কখনও আগে এরকম হুট
করে, হায়, গোধূলি আসবে নেমে জীবনে আমার
কাঁপিয়ে সত্তার মূল কাঠামো, ছিলাম
মগ্ন কাজে, সাদা
কাগজে আঁচড়ে কেটে কেটে, কত রাত হয়ে গেছে
শিশুর হাসির মতো ফুটফুটে ভোর। কখনও বা
তুইতোকারিতে, হাসি-হুল্লোড়ে করেছি নরক
গুলজার ইয়ারবক্সির সঙ্গে। প্রণয় পেখম
মেলে কত বিমুগ্ধ প্রহরে
করেছে আমাকে ঋণী, কেটেছি সাঁতার ঝলমলে সরোবরে।

আজ এই গাঢ় গোধূলিতে ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতা
শিরায় শৈত্যপ্রবাহ আনে, এমনকি
ভিড়ে আরও বেশি একা লাগে, মনে হয় ডুবে যাবো
অতল আন্ধারে। কত ছায়া-সহচর আসে যায়,
কেউ চুপচাপ বসে থাকে, কেউ বা ভ্যাংচায় মুখ, কেউ কেউ
অঙ্গুলি নির্দেশ করে মাটির স্তূপের দিকে, নিভৃত কবর
যার ডাক নাম। যেন খুব কাছের কাউকে ডেকে
ইচ্ছে হয় বলি এই গোধূলিতে মগজ ভীষণ
যাচ্ছে ছিঁড়ে নখরের সুতীক্ষ্ণ আঘাতে। কে আমাকে
বাঁচারে এমন সন্ত্রাসের নগ্ন নিপীড়ন থেকে?

কেউ কেউ ভীষণ ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে ধমকায়-
‘বুড়ো তোকে মৃত্যু এই মুহূর্তে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাক। আজ আমি
এমনই বেহুদা আর ঘূণিত উদ্বৃত্ত কেউ, খুব
অপ্রয়োজনীয় আর নিশ্চিত বাতিল। আকাশের
দিকে চোখ চলে যায় অভ্যাসবশত, চোখ ভিজে
ওঠে প্রায়, তবু শুক্‌নো রয়ে যায়, বড় জ্বালা করে।

তবে কি আমার উপস্থিতি এই গোধূলিতে এতই অসহ্য,
আমাকে এখনই চলে যেতে হবে সব ছেড়েছুড়ে? এখনই কি
ওরা সব আমার দু’চোখে
সূর্যাস্ত আনতে চায়? আমি যা দিয়েছি এতকাল
নিজেকে পীড়ন করে, নিংড়ে, তার নেই কি কোনওই মূল্য, হায়?
সবই কানাকড়ি আর এক মুঠো ধুলো?

কারও বাড়া ভাতে ছাই দিইনি কস্মিনকালে, কারও
বাগান করিনি লণ্ডভণ্ড বুনো মোষ ছেড়ে দিয়ে। আমি শুধু
চেয়েছি থাকতে নিরিবিলি আপনজনের মাঝে,
চেয়েছি ঝরুক জীবনের সুধা আমার উৎসুক ঠোঁটে,
বর্ষায় উঠুক বেজে মাঝে মাঝে বৃষ্টির নূপুর,
শিশুর মধুর কণ্ঠস্বরে গান হোক সারা ঘর,
গ্রীষ্মে কিংবা শীতে হৃদয়ের ভিটে মুখরিত হোক
উৎসবে, জীবন হোক হাসি-ঝলসিত শান্ত শারদ আকাশ।
১৬.৮.২০০০

 টাইটান

প্যারিসের সহনশীল দূরবর্তী নিঝুম জায়গা নোয়াজিএলে
এক গা ঘুম থেকে ঝকঝকে সকালে জেগে উঠে কী এক ঘোরে
দেখতে পাই, প্রিয় স্বদেশে আমি সুদূর সময়ের একটি অগ্নিরথে
সওয়ার। রথ বিপুল আগুনের গোলা ছুঁড়ছে চারদিকে। এই
গোলাগুলো শান্ত, ভালো মানুষদের গায়ে লাগছে না।
আমার হাতে মারাত্মক সব অস্ত্র, যেগুলো থেকে নিঃশ্বাস বেরুচ্ছে নিশ্চিত
মৃত্যুর; কিন্তু এই অবধারিত নিঃশ্বাস এতটুকু ছোঁবে না অবোধ শিশু
অথবা সৎ, নিরপরাধ, শান্তিপ্রিয় নারী-পুরুষদের।

এই অগ্নিরথের সারথি সত্য, সুন্দর এবং কল্যাণ। ইতিমধ্যে আমি
রূপান্তরিত এক টাইটানে। অতিকায় মানুষটি সংরক্ষিত এক
অভেদ্য বর্মে, আমার অগ্নিময় ফুৎকার এক ঝটকায় পুড়িয়ে
ফেলবে বিচিত্র জঞ্জাল, মানবতার জাতশক্র হিংস্র ধর্মান্ধ, নানা
ধর্মের মৌলবাদী, নিষ্ঠুর উৎপীড়নকারীর সকল প্রকাশ্য ও গুপ্ত আস্তানা।
শত বাধাবিপত্তি উজিয়ে এতকাল যে ইলিম হাসিল করেছি, কসম তার,
আমার ভেতর একরত্তিও সংহার-প্রবৃত্তি নেই।
১৪.৫.২০০
নোআজিএল (প্যারিস)

ডাক

ছেলেবেলা হেসে খেলে কেটে গেছে, কৈশোরে হেঁটেছি
নিষ্কণ্টক, পাথরবিহীন পথে এবং যৌবনে
পথ চলাতেই ছিল রাঙা পলাশের
জয়োল্লাস, পূর্ণিমার শান্ত মাদকতা আর অনিন্দ্য সঙ্গীত
হৃদয়ের। অথচ যৌবনোত্তর কালে
আকাশ আচ্ছন্ন হলো কালো মেঘে, ঝড়ক্ষুব্ধ কত
দিনরাত কাটলো উদ্বেগে, বারবার
জানা ও অজানা না শঙ্কায় উঠেছি কেঁপে নিজেরই ভিটায়।

বিস্তর বয়স হলো, শরীরের কাঠামো বড়ই
নড়বড়ে, রকমারি অসুখের চোরাগোপ্তা মারে প্রায়শই
হচ্ছি কাবু। কী-যে হলো, আজকাল রজ্জু দেখলেই
বিষধর সর্প বলে ভ্রম হয়, আঁতকে উঠে ক’হাত পেছনে
হটে যাই, ঘিরে ধরে দুঃস্বপ্নের জাল অষ্পষ্ট নিদ্রার কালে।
কত প্রতারণা আর কত যে জোচ্চুরি, খুব ঠাণ্ডা
মাথায় দিনদুপুরে সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ বস্তুত মনুষ্যরূপী
পশুদের বর্ধমান। অসহায় মানবের আর্তনাদে মেঘ,
নক্ষত্রের বুক দীর্ণ হয় হামেশাই। কত মুখ
অবলীলাক্রমে হলো বিকট মুখোশ কারও গোপন সংকেতে।

কোজাগরী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাধারা পারে না ঘোচাতে
ঘাতকের রক্তপায়ী ছোরার খুনের ছাপ, ব্যর্থ অপরাধী
রিভলবারের কালি মোছাতে সর্বদা। ইদানীং
শুভ আত্মাহুতি দেয় অশুভের পঙ্কিল ডোবায়।

কুচক্রী ছায়ার নিচে দিন কাটে, রাত
অনিদ্রার কাঁটায় নিয়ত বিদ্ধ কম্পিত হৃদয়ে শুনি
একটি আবছা ডাক। আজকাল সেই ডাক আমার শরীর
ছুঁয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে, একদা যা ছিল
অস্তিত্ববিহীন প্রায়। এখন তো নিজ গৃহকোণে
লেখার টেবিলে ঝুঁকে বই পড়া কিংবা কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা
রচনার ধ্যানকালে অথবা যখন প্রিয় বন্ধুমণ্ডলীর
গুলজার আড্ডায় বেজায় মশগুল কিংবা চেনা শ্যামলীর
ওভারব্রিজের ভিড়ে হেঁটে যাই, কবি-সম্মেলনে এক কোণে
চুপাচুপ বসে থাকি, সে-ডাক আমাকে আচমকা
ভীষণ চমকে দেয়। এ-ও জানি, একদিন এই ডাক এমন অমোঘ,
দুর্নিবার হবে, গাঢ় অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হবো আত্মসমর্পণে!

তবুও ভোরবেলা

চিনি তাকে, পুরোপুরি নয়, আংশিকভাবেই,
বলা যায়। কথা হয় মাঝে মাঝে কখনও পথের
এক কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, কখনও বা নদীতীরে গোধূলিতে
জনহীনতায়, সেইসব কথা কিছু কিছু বুঝি, সিংহভাগ
বোধের আড়ালে থেকে যায়। কোথায় নিবাস তার, জীবিকার
কী ধরন, জানতে পারিনি কোনওদিন। তিনি কি সংসারত্যাগী?

একদিন নিবিড় গোধূলিলগ্নে পথে যেতে যেতে গাঢ় স্বরে
আমাকে বলেন তিনি, ‘একটি অদ্ভুত জীব দ্রুত চেটে চেটে
খাচ্ছে ঘরবাড়ি, পথঘাট এবং দোকানপাট। জীবটির
সমস্ত শরীরে ফুটে উঠছে আক্রোশ, জিভ থেকে
ঝরছে উত্তপ্ত লাভা। বিভীষিকাময়
ধ্বংসের বিষাক্ত কাঁটা বিদ্ধ হচ্ছে ডানে বামে। একটু পরেই
তুমিও শুনতে, পাবে সম্মিলিত সত্তাদীর্ণ ক্রন্দনের রোল
এখানে, সর্বত্র, বলে তিনি অন্তর্হিত অতিদূর গোধূলিতে।

তবুও কিশোরী ছোটে ভোরবেলা প্রজাপতির পেছনে, সরু
গলিতে যুবক গান গায়, ফেরিঅলা ডেকে যায়, বারান্দায়
তরুণ-তরুণী প্রেমালাপ করে, প্রবীণেরা হাওয়া খেতে যান
পার্কে, আমি বই খুলে বসি, দেখি ভাসমান মেঘ।
১৪.১২.২০০০

তসলিমার জন্যে পঙ্‌ক্তিমালা

তসলিমা, প্যারিসের কিয়দ্দূরে একটি মনোরম
সবুজ-ওড়না জড়ানো শান্ত এলাকায়
এক রাত্তিরে তুমি ছুটে এলে এই অসুস্থ, ভাঙাচোরা
আমার কাছে। আমি জানি, তুমিও ভালো করেই জানো,
তসলিমা, যে যাই ভাবুক, তোমার আমার সম্পর্ক
চাওয়া-পাওয়ার কোনও বুনিয়াদে স্থাপিত নয়।

তসলিমা, তুমি যে বিষাক্ত শরাহত কাতর
হরিণীর মতো তা বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। হ্যাঁ, তুমি
নাছোড় আকুলতায় হাজির হয়েছিলে, ঘন ঘন সিগারেট ফোঁকা
তোমার মনের আবহাওয়াকে নগ্ন করে
তুলছিল; বেদনা দরবারী রাগ হয়ে
ছড়িয়ে পড়ছিল তোমার সত্তাকে ঘিরে। তোমার দুটি চোখ
বিস্তারিত বর্ণনাকে টপকে এক সীমাহীন যন্ত্রণার
ইতিহাসকে প্রকাশ করছিল আশ্চর্য ভঙ্গিতে।
খ্যাতির জৌলুশ এখানে বলডান্স মগ্ন তোমার সঙ্গে,
চারপাশে থেকে তোমার দিকে এগিয়ে আসছে শ্যাম্পেনের
বোতল, পানপত্র, ভোগবাদী দর্শনের টানাহ্যাঁচড়ায়
তসলিমা, তুমি ক্লান্ত, ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছ,
দেখতে পেয়ে আমার মনে বিষণ্নতার লতাগুল্ম ঝুলে রইল।
ভীষণ ব্যস্ত তুমি, যেন কোনও অতিশয় মূল্যবান রঙিন মাছ
আটকা পড়েছ জটিল জালে। তোমার ছটফটানি
আমি প্রত্যক্ষ করি তরুণ বন্ধুর পাশাপাশি বসে তার ড্রইংরুমে।

না তসলিমা, তোমার আর কোনওদিনই খাওয়া হবে না
মায়ের হাতে রাঁধা ভাপ-ওঠা লাল চালের ভাত,
টাট্‌কি মাছের ভর্তা, শিং মাছের ঝোল; তোমার না আর
কোনওদিন উত্তর আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে
তোমার অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটাবেন না, তোমার
কল্যাণের জন্যে খোদার আরশে মাথা লুটিয়ে
পড়ে থাকবেন না। না তসলিমা, মার সঙ্গে
তোমার কস্মিনকালেও আর দেখা হবে না। এ কথা অনেক আগেই
জেনে গেছ তুমি। তোমার সুতীক্ষ্ম বোধ তোমাকে
অনেক কিছুকেই খোলা রাস্তায় ন্যাংটো করতে শিখিয়েছে।

তসলিমা, তোমার কি মনে পড়ে সেইসব আগুনে ঝলসানো
দিনগুলোর কথা, যখন তুমি, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আমি
কতিপয় তরুণ তরুণী ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি
তোমার ফ্ল্যাটে আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরে
তোমার সম্ভাব্য বিপদের কথা আঁচ করে। প্রতিটি
মুহূর্ত আমাদের কেটেছিল আশঙ্কায়, আতঙ্কে এবং
শাসন-না-মানা এক ধরনের আনন্দে। সেই অতিবাহিত সময়
আজও মনে যুগপৎ বেদনা ও আনন্দের প্রহর ডেকে আনে
রাখালিয়া সুরের মতো। তসলিমা, তুমি সেই সুরে
ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হও মৈয়মনসিং-এর কোনও পুকুরঘাটে,
ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, আড়িয়ালা খাঁর তীরে, ফেব্রুয়ারির বইমেলায়
কলকাতার কফিহাউসে কলেজ স্ট্রিটে।

তসলিমা, তুমি সেই রাতে শুধু আমাকে দেখার জন্যেই
ছুটে আসোনি প্যারিসের কিয়দ্দূরে এক শান্ত এলাকায়। লুকিও না,
সত্যি কথাটি বলেই ফেলো তুমি তো স্পষ্টভাষিণী। আসলে
তুমি আমার কাছে এসেছিলে ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা নদী, রাস্তার
ধুলোর ঘ্রাণ শুঁকে নিতে, কান পেতে শুনতে
বাংলাদেশের হৃৎস্পন্দন, তুমি বিদেশে স্বদেশকে আলিঙ্গন
করতেই এসেছিলে ছুটে গোল্লাছুট খেলতে আসা বালিকার ধরনে।
অথচ এই দেশ থেকেই তোমাকে কতিপয় অন্ধ, নির্বিবেক, নিষ্ঠুর লোক
হিঁচড়ে টেনে বের করে দিলো দু’দেশের সীমানা-চিহ্নিত
কাঁটাতারের ওপারে, যেখানেও আখেরে ঠাঁই হলো না তোমার।

১৩.৫.২০০০.

তার খেদোক্তি

ভীষণ অসুস্থ কবি; শয্যাগত তিন মাস ধরে। মুখে তার
রুচি নেই, বমি হয় ঘন ঘন, রাত্তিরে গায়ের ঘুম,
কিছু ছায়া ভাসে চোখে। যে-নারী কবির প্রিয়তমা
সেভাবে বিষণ্নতায় ডুবে, ‘প্রজাপতি,
লেজঝোলা পাখি, পিঁপড়ে, দেয়ালবিহারী টিকটিকি, এমনকি
অদূরে দাঁড়ানো নিম গাছের সবুজ পাতা, রোদ, জ্যোৎস্না আর
বৃষ্টিধারা দ্যাখে তাকে বারবার বাঁধহীন। কাব্যলক্ষ্মী রোজ
গভীর রাত্তিরে যান তার শয্যাপাশে, জপেন কত না পঙ্‌ক্তি
কানে কানে; শুক্‌নো ঠোঁটে মদির আবেগে দেন এঁকে
অগণন তপ্ত চুমো, অথচ পারি না আমি যেতে
আমার কবির কাছে যখন তখন। হা সমাজ,
হায় লোকলাজ, যাক গুঁড়িয়ে সকল কিছু আজ।

গুঁড়িয়ে যায় না কিছু, সমাজপতিরা আজও বড়ই কঠোর,
বিদ্রোহের শিখা ফুঁয়ে ফুঁয়ে নেভাবার
আয়োজনে বেজায় তৎপর অনেকেই। কত হৃৎপদ্ম শুকায়
নিষ্ঠুর খরায় অন্তরালে, জাঁহাবাজ নখর এবং ওষ্ঠ
ঠুক্‌রে ঠুক্‌রে খায়্য প্রণয়ের চোখ, মানবতা শুধু
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর চিতাগ্নিতে পোড়ে বিবেকের শব।
৭.১১.২০০০

দুটো চোখ

এই তো সেদিন গোধূলিতে আধলেখা একটি কবিতা শেষ
করবার ইচ্ছায় টেবিলে ঝুঁকে ছিলাম লেখায়
মগ্ন কিছুক্ষণ, কয়েকটি শব্দ আমার মাথায়
বাগানে সুস্নিগ্ধ প্রজাপতির ধরনে উড়ে উড়ে
দিব্যি ঘুরে বেড়ায়, কখনও ফুলে বসে নিরিবিলি
পাখনা নাচায়, পঙ্‌ক্তি হয়ে দেখা দেয়
খাতার পাতায়। হৈ হুল্লোড় নেই, অকস্মাৎ দেখি,
টেবিলের মধ্যস্থলে একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে
বিহ্বল আমার দিকে। কার চোখ? মনে হয় চিনি,
অথচ অচেনা লাগে পরমুহূর্তেই।

সেই দুটি চোখ এখন হ্যাঙারে
ঝোলানো মলিন ট্রাউজারে, তখন উজ্জ্বল বিছানায় আর
আমার নিঝুম ঘুমে ঘুরে বেড়ায় কেবলি। চক্ষুদ্বয়
কিছু কি বলতে চায়? বলতে কি চায় কোনও ইতিহাস
অথবা খুলতে চায় দূর কোনও ট্রাজেডির জট? হায়, আমি
মরণের পূর্বমুহূর্তেও জেনে যাবো না সে দুটি
চোখের না-বলা কথা। শুধু মাঝে মাঝে দেখা দেবে
আমার এ বাসগৃহে, সভাস্থলে, কখনও বা পৌরপথে। ভাবি,
ওরা একালেরই কারও স্মিত মুখে সুশোভিত কিংবা
সুদূর কালের কোনও রূপসীর প্রগাঢ় নয়ন।
১৩.১২.২০০০

দূরত্ব থেকেই যায়, কাছে থাকলেও; এই যে এখানে আমি
শত শত মাইলের ব্যবধানে একা।
ভিনদেশে রেস্ট হাউজের শূন্য ঘরে নিঃসঙ্গতা
নিয়ে বসে আছি বহুক্ষণ, মনে হয় বহুকাল,
ভাবছো কেমন করে এই ভয়ঙ্কর শীতল হিংস্রতা নাম্নী
রমণীর সঙ্গে ঘর করছি এখন? এমনই তো হয়ে থাকে
বহুদিন ভিন্ন ভিন্ন রূপে। এমনকি যখন তোমার পাশে
বসে থাকি বাক্যহারা কিংবা তোমার কথার কলি
প্রস্ফুটিত হয়, চেয়ে থাকি
গভীর তোমার দিকে, ডুবে যাই গহন পাতালে বড় একা।
২০.১২.২০০০

ধিক্কারের ঝড়

লালনের আখড়ার
চোখ থেকে আজকাল
অবিরল জল ঝরে,
এখন তো লালনের
আখড়ার বুক ফেটে
চৌচির গাছের শোকে,
অশুভ ছায়ায় ম্লান
সব বাউলের মুখ,
উঁচু দালানের ভিত
নড়ে ধিক্কারের ঝড়ে;
মেঘলোকে ফোটে, ভাসে
মরমী কুসুমগুলি।
আখড়ার হৃৎপদ্মে
একতারা কেঁদে মরে,
একী ঝকমারি আজ,
লালনের নেই ঠাঁই
তাঁরই নিজ আখড়ায়,
তাড়া খাওয়া সাঁইজির
একতারা বেজে চলে
মাঠে, হাট বাজারেই।
১৪.১.২০০১

নিদ্রার কুয়াশায়

ইদানীং এই স্বপ্ন অনাহূত অতিথির মতো
হুট করে চলে আসে আমার নিদ্রার কুয়াশায়,
দাঁড়ায় কোমরে হাত রেখে খাস খোলা
দরজায় নির্দ্বিধায়। ঠোঁটে তার কৌতুক মেশানো
হাসি খেলা করে, যেন সেই মৃদু হাসি
একটি কাহিনী ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখেছে,
যা বলার তাগিদে এখানে এসে পড়ে
বারবার বিনা আমন্ত্রণে। আছে তার অলিখিত অধিকার।

এ স্বপ্নের জিভ গল্পময় আরব্য হাজার এক রজনীর
শাহেরজাদীর মতো। অনর্গল বলে সে আমার
কবিতার কথা, বলে-অম্লান জীবনানন্দ, পল এলুয়ার,
ইয়েটস্‌ ফেলেছেন নিরিবিলি ছায়া
আস্তেসুস্থে বিমুগ্ধ প্রহরে
আমার অজ্ঞাতে অধমের কোনও কোনও কবিতায়।

নেমকহারাম নই, করবো না অস্বীকার। এ-ও তো বলেন
গুণীজন-কোনও কোনও কবিতা হতেই পারে অন্য কবিতার
জন্মভূমি, লালিত হতেই পারে কিছু
নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসহ। এ নিয়ে চায়ের পেয়ালায় নিরর্থক ঝড় তোলা।

কয়েক মুহূর্ত পরে সতেজ শরীর থেকে সব ঝরাপাতা ঝেড়ে ফেলে
জেগে ওঠে স্বপ্নের আলাদা অংশ নতুন আলোয়-
এ স্বপ্ন আমারই সত্তা, লাফিয়ে উঠেছে কণ্ঠে তার
মায়াবী সুরের এক দীপ্তিময় পাখি যার দু’টি
চোখে ক্ষণে ক্ষণে খেলে যায় সত্যের বিদ্যুৎ, কণ্ঠে
ঝলসিত কী উদাত্ত উচ্চারণ, ‘আমি কারও প্রতিধ্বনি নই।
আমাকে সমীহ করো আর না-ই করো,
যতই সামান্য হই, তবুও অনন্য সর্বদাই।
২৯.৬.২০০০

পাউরুটিগণ

রাত্তির ডাগর হ’লে দোকানিরা বেবাক দোকানপাট বন্ধ
করে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর এক
তালাবদ্ধ জমকালো কনফেকশনারি দোকানে
পাঁউরুটিগণ সভা থেকে গোপনে সিদ্ধান্ত নিয়ে
উড়ে উড়ে দোকানের বাইরে ছড়িয়ে
পড়ে আসমানে মেঘলোকে, নানাদিকে, যেন পাখি।
পাউরুটিগণ উড়ে উড়ে যাচ্ছে ডাগর রাত্তিরে
নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে মহল্লায়, সুনীল সমুদ্রতীরে, সোমত্থ
নদীর
বুক ছুঁয়ে, আহত বনের গাছ এবং পাখির নীড়ে কিছু
আদর বুলিয়ে; উড্ডয়নে ক্লান্তি নেই দ্রোহীদের।

আখেরে উড়ন্ত পাউরুটিগণ নামে ভালোবেসে
ধূসর মাটিতে
যেখানে নিঘুর্ম ছটফট
করছে ক্ষুধায় ক’টি মানবসন্তান। দ্রোহী পাউরুটিগণ
ওদের নিকট এলে অন্ধকারও আলোর অধিক
হয়ে যায়, হীরের অধিক হয় বেশ কিছু চোখ।
ভীষণ ক্ষুধার্ত নরনারী লহমায় খেয়ে ফেলে সব রুটি,
আর দ্রোহী পাউরুটিগণ
অকাতরে এই আত্মবিসর্জনে ধন্য মানে
নিজেদের ক্ষণিক জীবন।
২৯ ১২ ২০০০

পাড়াতলী গাঁয়ে যাই

পাড়াতলী একটি গাঁয়ের নাম, এই সহজ কথাটি আজ
অনেকেই জানে বলে অনুমান করি। পাড়াতলী
আমাদের আদি বাসস্থান
বহু যুগ ধরে কল্লোলিত মেঘনা নদীর তীরে। এখানেই
ছিলেন আমার পিতা, পিতামহ, মাতামহ আর
প্রবীণ প্রপিতামহ আর বহু গুরুজন। আরও অনেকের
নাম সময়ের কালি ঢেকে
ফেলেছে সে কবে, আমি জানতে পারিনি।

পাড়াতলী গাঁয়ে কখনও সখনও যাই গূঢ় আকর্ষণে
নিজের উৎসের আর পিতার নির্মিত
দালানে প্রবেশ করি কিছু স্মৃতির সুঘ্রাণ নিতে। দালানের
পাশেই পুরনো মসজিদ, মসজিদটির পাশে
কী নিঝুম গোরস্তান, যেখানে আমার পিতা, পিতামহ আর
মাতামহ গভীর, গভীরতম ঘুমে অচেতন এবং আমার প্রিয়
সন্তানও সেখানে আছে মাটির নিচে ঘুমপাড়ানিয়া
গানে মগ্ন দুনিয়ার মাঠের খেলার মায়া ভুলে।

পাড়াতলী গাঁয়ে আজও বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। এই গ্রাম
এখনও প্রকৃত গ্রাম রয়ে গেছে, নগরের নষ্টামি, ভ্রষ্টামি
এখনও করেনি স্পর্শ। মেঘনা নদীর ডাকে, আমার উৎসের
গভীর গভীর টানে মাঝে মাঝে আমি পাড়াতলী গাঁয়ে যাই।
১৭.১২.২০০০

প্রকৃতির দীপ্র স্নিগ্ধ উৎসব

কে তুমি? কে তুমি আমাকে ব্যাকুল ডাকছ এই দারুণ
অবেলায়? তুমি কোনও বিজ্ঞানী নও নিশ্চয়ই,
তোমাকে তোমার দুরূহ গবেষণার কোনও কাজে
এতটুকু সাহায্য করার যোগ্যতা আমার নেই।

কে তুমি এই ঘুটঘুটে আন্ধারে উচ্চস্বরে ডাকছ আমাকে? তুমি কি
দার্শনিক? গূঢ় কোনও তত্ত্বের আলোচনার
প্রাথমিক ধাপে উঠে আসতে পারি, নিজেকে এরকম
ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করতে অপারগ আমি।

অনেক অনেক হৈ-হুল্লোড় থেকে কে ডাকছে আমাকে? কোনও
রাজনৈতিক নেই নেতা গলা ফুলিয়ে আমাকে ডাকবে, হতেই পারে না।
ক্ষমতার জৌলুশে মাতোয়ারা সে ডুবে আছে
মোসাহেবদের বন্দনায়। আমাকে দিয়ে ওর কোনও কাজ হাসিল হওয়ার নয়!

একজন কবি কি আমাকে ডাকছে কালবেলায়?
কেন ডাকবে সে এই বিপন্ন, অসহায় আমাকে? সে-তো এখন
ঝুঁকে রয়েছে তার লেখার টেবিলে। তার খাতার পাতায়্য জ্যোৎস্না,
নদীর ঢেউ খেলা করছে, ফুটছে ফুল, দুলছে আনন্দ-বেদনার
রৌদ্রছায়া। কবির নিজস্ব জগতে সবচেয়ে বিশ্বস্ত,
একনিষ্ঠ সঙ্গী নিঃসঙ্গতা। আমি ওর জন্যে অপরিহার্য কেউ নই।

কণ্ঠে সুরেলা ঢেউ তুলে কে ডাকছে? ডাকছে কি আমাকে?
সেই ডাক দুলে দুলে চলে আসছে আমারই দিকে, আমার সত্তায়
বুলিয়ে দিচ্ছে আদরের রেশম। সত্যের মতো নগ্ন,
গাছের কচি পাতার মতো সজীব, আনন্দময়
একজন শিশু অপ্রতিরোধ্য তুলতুলে ভাষায় ডেকে ডেকে
হাঁটি পাঁটি পা-পা আসছে
আমারই দিকে দু’হাত বাড়িয়ে। ওকে জড়িয়ে ধরার জন্যে
আমি আমার সকল অনীহা আর প্রত্যাখ্যান
সরিয়ে এগিয়ে যাই, ওকে টেনে নিই ব্যাকুল শূন্য বুকে
এবং আমাদের ঘিরে তখন প্রকৃতির দীপ্র স্নিগ্ধ উৎসব।

 ফিরে এসো বন্ধু

বন্ধু, এ কেমন অভিমান তোমার? কত না সূর্যোদয়, কত
সূর্যাস্ত বিলীন হলো অনন্তে, অথচ
ভীষণ নির্বাক তুমি, তোমার ঠোঁটে একটিবারও
ঝলসে উঠছে না আমাদের চিরচেনা
সেই মধুর হাসি। প্রিয় সেন্টু, প্রিয় কবিবন্ধু
আবু জাফর ওরায়দুল্লাহ, তোমার নীরবতা এমন
কনকনে শীত আর সইতে পারছি না আমরা, তোমার
কণ্ঠস্বরের জন্যে বড় তৃষ্ণার্ত ঘরের চার দেয়াল,
লেখার টেবিল, বইপত্তর, সবচেয়ে বেশি তোমার প্রিয়তমা
জীবনসঙ্গিনী, তোমার আত্মজা কাকাতুয়া, তোমার
আড্ডাবাজ বন্ধুমণ্ডলী। আর কত হিমযুগ তুমি ঢেলে দেবে
ওদের দিকে? কোন উষ্মায়? কোন একরোখা অভিমানে?

ভাবতেই পারি না এতদিন তুমি এভাবে থাকবে
এমন নীরবতা ভালোবেসে। মনে হয় কত শতাব্দী কেটে গেছে,
তুমি কিংবদন্তির কথা বলো না, তোমার মমতাময়ী মায়ের
কবরের ঝরা ফুলের কথা বলো না। চর্যাপদের
হরিণ আর ইয়েটস-এর রাজহাঁস
তোমার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে, ওদের কি অভ্যর্থনা
জানাবে না তুমি? সস্নেহে বাড়িয়ে কি দেবে না হাত?
ওগো বন্ধু, জাগো কবি, সময় বয়ে যায়।

ফিরে এসো বন্ধু নিস্তব্ধ কুয়াশাচ্ছন্ন প্রান্তর থেকে
ফিরে এসো প্রিয়তমা মনির উষ্ণ আলিঙ্গনে। চেয়ে দেখো,
কী ব্যাকুল দৃষ্টিতে সে অষ্টপ্রহর তাকিয়ে রয়েছে তোমার দিকে,
তাকিয়ে দেখো, যে কোমল হাত সারাক্ষণ তোমার
শুশ্রুষায় নিবেদিত, সেই হাতে নিয়ে আবার
ক্রীড়াপরায়ণ হও তুমি। ভালো করে দেখো তোমার ঘরে কাব্যলক্ষ্মী
অপরূপ চাঞ্চল্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর বারবার
তোমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন কবিতার খাতা। বেলা যে যায়,
এবার চটজলদি কুয়াশার জাল ছিঁড়ে
উঠে পড়ো, আনন্দের ঝর্ণাধারা বইয়ে দাও নিরানন্দ ফ্ল্যাটে।
১.১১.২০০০

ফেরার উপায় নেই

আহারে ছিল না রুচি, উপরন্তু অনিদ্রা আমাকে ঘষটাতে
ঘষটাতে বৃক্ষতলে ফেলে দেয়। এমন অচেনা পরিবেশে
এলেই চৌদিক থেকে কিছু ধ্বনি প্রতিধ্বনি নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে
আমাকে ঝাঁকুনি দেয়। বার বার অস্তিত্বের ভিড় কেঁপে ওঠে।

পরিবেশ পাল্টে যায়, আমার কম্পিত অস্তিত্বের অন্তর্গত
অন্য একজন আচমকা ঝোড়ো ভঙ্গিমায় এসে
ছোট ঘরটায় বসে আমার সম্মুখে। অবয়ব তার খুব
অস্পষ্ট; কখনও চেনা, কখনও বা কেমন অচেনা মনে হয়।
বাস্তবিক! তাকে কোন্‌ নামের ব্র্যাকেটে সম্বোধন
করবো, স্বাগত জানাবার ভঙ্গিমায়
আন্তরিক গড়বো হাতের মুদ্রা, ভেবেই পাইনি। সে চকিতে
চেয়ারে নিবিড় বসে টেনে নেয় খাতা, যার কতিপয় পাতা
সযত্নে সাজানো কবিতায়। আধোচেনা লোকটার
হাতের কলম লহমায় বেজায় চঞ্চল হয়, সাদা পাতা
ক্রমান্বয়ে প্রফুল্ল ধারণ করে পঙ্‌ক্তিমালা। এমনই ধরন
লোকটার, যেন আমি নেই এই ঘরের কোথাও।

পরিচিতি হস্তাক্ষরময় পাতা টেবিলের এক কোণে রেখে
চেয়ার ছেড়ে সে চুপচাপ ঠাঁই নেয় পুনরায়
অন্তরে আমার। অকস্মাৎ দু’চোখে আপনকার ছোট ঘর
অনন্য নক্ষত্র পল্লীরূপে প্রতিভাত হয়। অচেনা রূপসী
একজন, সমস্ত শরীর যার জলবিনুময়,
চোখে জ্বলজ্বলে অমরতা, বলেন আমাকে অতি নৈর্ব্যক্তিক
কণ্ঠস্বরে, ‘ব্যর্থতার ধুধু মাঠ কখনও কাউকে
হতাশার ধুলো ছাড়া দেয় না কিছুই। অগণিত কঙ্কালেরা
অট্রহাসি ছুঁড়ে করুণ কান্নার রোল শোনায়, শিরায়
রক্তধারা হিম হয়ে আসে। ফিরে যাও, ফিরে যাও।

আমাকে বিপন্ন করে রূপসীর কণ্ঠস্বর অজানা কোথাও
ডুবে যায়। সরোবরে? সমুদ্দুরে? অথচ আমার
ফেরার উপায় নেই; আশা কিংবা নিরাশায় সেই একই পক্ষে
যেতে হবে চেতনা সজাগ রেখে কায়ক্লেশ সয়ে দিনরাত।
৯.১.২০০১

বনসাই নই

আমি তো প্রকৃত বট, সমুন্নত, বিস্তৃত সবুজ
মাথা; শান্তি আমি সর্বক্ষণ, পরিশ্রান্ত পথিকের
জন্যে নিত্য সস্নেহে বিছিয়ে রাখি ছায়া। নানা পাখি,
এমনকি কীটপতঙ্গের জন্যেও বরাদ্দ আছে নিভৃত আশ্রয়।

এখনও ভালোই আছি, ঝড়ঝাপটা আসে মাঝে মাঝে,
মুষড়ে পড়ি না, মাথা উঁচু রাখি, ছায়া
গুটিয়ে নিই না। আজও বহু লোক এই পথে হেঁটে
যেতে যেতে ক্লান্তির কুয়াশা-মেঘে ঢাকা পড়ে গেলে
পরম নিশ্চিন্তে বসে আমার সবুজ ছায়াতলে, ফিরে পায়
উদ্দীপনা পুনরায়, হেঁটে চলে যায়
যে যার দৃষ্টিতে গন্তব্যের দিকে। প্রকৃত গন্তব্য কোনও, সত্যি,
আছে কি কোথাও? মরীচিকা দেখায় মোহিনী ছবি নানা ঢঙে।

ওরে মন, কূল নাই, কিনার নাইরে এ জীবন-দরিয়ার,
চাকা ঘোরে কুমোরের, কামারের হাতুড়ির ঘায়ে
ঘন ঘন কাঁপে লোহা, প্রগতির ডঙ্কা বাজে দিবসরজনী,
বিজ্ঞানের রথ ছোটে সামনের দিকে,
সানন্দে স্বীকার করি। কিন্তু আমি
টববন্দি বনসাই বনবার খোয়াব দেখি না।
২৮.৯.২০০০

বাড়ি

ঘরদোর,
উঠোন আছে;
মোটা-মিহি কণ্ঠস্বর নেই,
চারদিকে বুনো
ঝোপঝাড় আছে,
শিশুর হাসি-কান্না নেই,
ঘরে তিনটি
ঝুলন্ত বাদুড়।

২ ১ ২০০১

বিরহ

টেবিলে একটি গ্লাশ আর একটি বোতল; গ্লাশ
খালি, বোতলের আর্ধেকটি ভরা। গ্লাশ
সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে বোতলের দিকে, মনে হয়, সেই
যুগ যুগ ধরে
তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু বোতলটি লজ্জায় গ্লাশের
কাছে যেতে পারছে না আর গ্লাশ ভালো করে জানে
পিপাসায় বুক ফেটে মরলেও এক ফোঁটা পানি
কিছুতে পাবে না, যদি কেউ বোতল উপুড় করে
টলটলে পানি শুক্‌নো গলায় না ঢালে ওর; কিছু
পরে স্থুলদেহী এক লোক টেবিলের কাছে এসে দিব্যি
আয়েশি ভঙ্গিতে বোতলটি শূন্য করে ফেলে আর
বোতল এবং গ্লাশ চেয়ে থাকে পরস্পর বেদনা-কাতর।
২২/১২/২০০০

মধ্যরাতে রেস্তোরাঁয়

মধ্যরাতে রেস্তোরাঁয় কজন যুবক বসে আছে একটি
টেবিল ঘিরে। ওদের সঙ্গী একজন নিশ্চুপ বসে আছেন বহুক্ষণ।
বয়সের ভারে ঈষৎ ন্যুজ তিনি, অথচ চোখ দুটো জ্বলজ্বলে,
তার দৃষ্টি যুগ-যুগান্তরে প্রসারিত। যুবকেরা রেস্তোরাঁকে
আপন করেছে, রেস্তোরাঁ ওদের আপন বিশেষত এই মধ্যরাতে।
যুবকদের কেউ তাত্ত্বিক, কেউ কথাসাহিত্যিক, এবং কেউ কেউ নয়
অনেকেই কবি। আর বয়সের ভারে যিনি ঈষৎ ন্যুজ তিনি
একদা ছিলেন কাব্যক্ষেত্রে অধিরাজ। আজকাল উপেক্ষিত
পাঠকসমাজে, শুধু ক’জনা যুবা তাকে আমল দেয় মধ্যরাতের
রেস্তোরাঁয়। তার কোনও কোনও বাক্যে চমকে ওঠে ওরা।

রাত্রি ডাগর হলে আরও, রেস্তোরাঁয় বেয়ারাদের কেউ কেউ
টুলে বসে ঝিমোয়। টেবিল ঘিরে-বসা আড্ডাধারীদের
টুকরো টুকরো কথা, ঈষৎ ন্যুজ বয়সী লোকটার নীরবতা
ফিকে আলোকে কেমন যেন বাঙ্ময় করে তোলে সবার অজান্তে।
হঠাৎ অনেকগুলো নক্ষত্র আশরফির মতো টেবিলে নৃত্যপর!
যুবকেরা নক্ষত্রগুলো পুঁজি করে অবোধ আহ্লাদে মাতে জুয়োয়।
নির্লিপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি মৃদু হেসে দেখেন ওদের খেলা নক্ষত্র নিয়ে। তিনি
জানেন এই খেলা ক্ষণস্থায়ী; নক্ষত্রেরা নেচে নেচে যুবকদের হাতছাড়া
হবে, ফিরে যাবে নিজ নিজ স্থানে, সাঙ্গ হবে জুয়োখেলা। ওদের
চেতনায় মাথা তুলে ডুবে যাবে বিষাদগীতি। ব্যথিত যুবারা
ঈষৎ ঝুঁকে-বসা প্রবীণের দিকে তাকাবে করুণায়, তারপর যে যার
ধরনে কিছু হরিণসদৃশ পঙ্‌ক্তি খুঁজবে ভাবনার বশে, যেমন একদা
তিনি করতেন সফল সন্ধান যৌবনে। এই মুহূর্তে মধ্যরাতের
রেস্তোরাঁয় চেয়ার ছেড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজবেন মানস-হ্রদতীরে হাঁস?
১২.১২.২০০০

মনের বাঘের মুখে

ভোরবেলা, দুপুর অথবা রাতে তোমাদের সাথে
জানি না কখনও আর দেখা হবে কিনা, কখনও আবার গোল
হয়ে বসে গালগল্পে মশগুল হবো কিনা-কিছুই জানি না
আজ এ মুহূর্তে দূরদেশে একা একা
দিন কাটাবার কালে। যখন লোকের ভিড়ে থাকি,
বেজায় অসুস্থ আমি ডাক্তারের প্রতীক্ষায় বসে
থাকি রোগীদের ভিড়ে হাসপাতালে, একাকী তোমাদের কথা
ভাবি, মনে পড়ে আরও কারও কথা, গোধূলিমেঘের
কাছে কী-যে চাই, কী প্রার্থনা স্ট্রিট লাইটের কাছে-
নিজেই জানি না। আমি শুধু দৃষ্টিহীন
বালকের মতো অন্ধকার ঘরে একা
ব্যাকুল বেড়াচ্ছি খুঁজে কী-যে,
আমি কি নিশ্চিত জানি? টলতে টলতে যদি মনের বাঘের
মুখের গহ্বরে ঢুকে পড়ি, যাবো কি চকিতে মূর্ছা হট্ররোলে?
২০.১২.২০০০

মহার্ঘ খোরাক

লোকটার আস্তানা বলতে খুব ছোট, ভাঙাচোরা
স্যাঁতসেঁতে এক ঘর। টিনের জখমি ছাদ ফুঁড়ে
বৃষ্টি ঝরে, কখনও আবার পূর্ণিমায় জ্যোৎস্নাকণা
উদার ভঙ্গিতে নামে ঘরের ভেতর। আসবাবপত্র নেই,
একটি বিমর্ষ শার্ট, দোমড়ানো ট্রাউজার ঝোলে
পুরনো দড়িতে আর ক’টি বই নড়বড়ে চৌকিতে ছড়ানো।

লোকটা হাঁপাচ্ছে বটে ষাটের কোঠায়। নানা ব্যাধি
সোৎসাহে ধরেছে ঘিরে তাকে, চিকিৎসাবিহীন থাকে
কখনও আলস্যে আর কখনও বা নাছোড় অভাবে।
পদ্য লিখে জীবন ধারণ অসম্ভব জেনেও সে কবিতার
রূপে মজে অক্লান্ত ছুটেছে তার পেছনে সর্বদা
উড়ন্ত আঁচল দৃঢ় মুঠোয় ধরার জ্বলজ্বলে বাসনায়।

এক টুক্‌রো শুকনো রুটি অথবা দু’মুঠো ভাত তা-ও
ছড়ায় না ঘ্রাণ সেই ঘরে; শুধু পানি খেয়ে, অন্ত্রে
জ্বালা নিয়ে লোকটা নিশ্চুপ পড়ে থাকে বড় একা
মলিন শয্যায় আর কী আশ্চর্য এ ঘরেই আছে
অদৃশ্য ভাণ্ডার এক উপমা, উৎপ্রেক্ষাময় অজস্র পঙ্‌ক্তির।

হঠাৎ ক’দিন পর লোকটা হার্টের পীড়া হেতু
প্রাণহীন রইলো নিঃসঙ্গ পড়ে মলিন শয্যায়-
অকস্মাৎ ভীড়াক্রান্ত ঘরে শোকের প্রবল স্রোত
বয়ে যায়; কেউ কেউ মোছেন আড়ালে চোখ আর
খবর-শিকারি সব গন্ধ শুঁকে বেড়ায় কেবলি
খবরের। মৃত কবি পত্রিকার মহার্ঘ খোরাক।
১৬.৬.২০০০

মেঘখণ্ড কান্নাময়

এক খণ্ড বেলে মাটি,

মাঝেমাঝে ঢেউ ছোঁয়।
দু’টি পাখি এসে বসে,
ঝাঁঝালো শব্দের ঝাঁপ,
ভেজা মাটি রক্তময়,
একজন পাখি মেঘে,
মেঘখণ্ড কান্নাময়।

৪ ১ ২০০১

মেটামরফসিস

কোথায় আমার ডেরা এখন, কেউ কি আমায় দেবে বলে?
খুঁজতে খুঁজতে দিন তো গেল, রাত্রি হিংস্র জন্তু হয়ে
আমায় খুবলে খেতে থাকে। ঝড়ের চোখে কাঁপছে ধমক।
দেখছি এখন ডানে বামে তফাৎ তেমন পাই না খুঁজে।

অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে ভীষণ দিশেহারা,
সর্পটিকে মালা ভেবে কুড়িয়ে নিয়ে গলায় জড়াই;
কেমন একটা গন্ধ পেয়ে আঁৎকে উঠে ছুড়ি দূরে।
তীক্ষ্ণ কাঁটার ঘায়ে পায়ে রক্ত ঝরে অবিরত।
তবে কি এই রক্তধারা বইবে শুধু? রক্ত-ফোঁটায়
জন্ম নেবে তাজা ক্ষত? চতুর্দিকে ফাঁদ ছড়ানো,
চেনাশোনা মানুষগুলো এক পলকে অচেনা হয়,
দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে, লাঠি মেরে মাথা ফাটায়!

বন্ধুবেশী শক্র থেকে গা বাঁচানো দুরূহ আজ,
কখন কে যে হাসতে হাসতে লুকোনো কোন্‌ অস্ত্র বুকে
দেবে গেঁথে, পাবো না টের। তাছাড়া ঢের অচেনা সব
হননপ্রিয় লোক তো আছেই রাতদুপুরে ঘাপ্‌টি মেরে।
গভীর রাতে একলা হাঁটি চেতনপুরের বিজন পথে-
বইতে থাকে মদির হাওয়া; না-লেখা কোন্‌ পদ্য এসে
আবছা নাচে দৃষ্টিপথে। অর্ফিয়ুসী বংশী শুনি,
আমার সিক্ত ক্ষতগুলো হয় মোহিনী ফুলের কুঁড়ি।
১০.৬.২০০০

 রঙধনুর সাঁকো পেরিয়ে

অনেকটা পথ হেঁটে চলার পর
কেন জানি মনে হলো, আমার এই পথপরিক্রমা
আদৌ ঠিক হয়নি। আমি কি তবে
এতকাল ভুল পথে হেঁটেছি? বৃথা এই আয়ুক্ষয়?

পথে এত কাঁটা, চোখা পাথর ছড়ানো,
এত গর্ত মস্ত হা করে আছে গিলে খাওয়ার জন্যে,
এমন গিজগিজে সরীসৃপ, এমন সব বাঁধা
পেরিয়ে পথ চলবো কী করে?
আমি কি তবে এতটা পথ পেরিয়ে আসার পর
ফিরে যাবো নতুন কোনও পথ ধরতে?
সময় তো বেশি নেই। ফিরে গিয়ে
নতুন পথ ধরা সম্ভব নয় আর।

যত কাদার ঢিলই নিক্ষিপ্ত হোক আমার দিকে,
এই পথের শেষ অব্দি হাঁটতে হবে,
যত হিংস্রতাই দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুক
আমার ওপর এই গোধূলিতে, চলতে আমাকে হবেই।

চারদিকে সন্ধ্যা নামছে জন্তুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে,
ওর মিশমিশে দাঁত ছিন্ন ভিন্ন করছে আমার ধৈর্যকে। হঠাৎ
এক ঝাঁক নক্ষত্র আমাকে ঘিরে জুড়ে দেয় নাচ, ওদের
আলো-ঝরনায় ধুয়ে যায় সব ক্লেদ, ক্লান্তি।

খুব সহজে আলোকিত পথে হাঁটতে থাকি,
আমার কাঁধে কোত্থেকে এক অচিন পাখি এসে বসে
গাইতে থাকে সম্মোহনী সুরে আর হাওয়ার ভেসে ভেসে
এক অপরূপ মালা হয়ে যায় আমার কণ্ঠহার!

জেনে গেছি, এখন থেকে বাস্তবের সব ধুমধাড়াক্কা, খেয়োখেয়ি
থেকে বারবার চলে যেতে হবে সেখানে, যেখানে রাখালের বাঁশির সুর
প্রেমিকের হৃদয়ের ধ্বনি, যেখানে রঙধনুর সাঁকো পেরিয়ে
যাওয়া চলে হাজার হাজার প্রজাপতির বিভায়।
১৫.৯.২০০০

শেষ রাতে

মধ্যরাতে থেকে গাঢ় মধ্যরাতে অবধি নির্ঘুম
কেটে গেছে, আজ আর নিদ্রাপরী চুমোয় নিরিবিলি
ঝরিয়ে দেবে না ঘুম দু’চোখে আমার। চোখ জুড়ে তীক্ষ্ম জ্বালা,
শুকিয়ে আছে গলা। মশারিটা খুলে ফেলি, মশার উৎপাত
বেড়েছে জেনেও, ডেঙ্গু জ্বর ভয়ঙ্কর
বিভীষিকা তৈরী করা সত্ত্বেও সম্প্রতি। তাড়াতাড়ি
লেখার টেবিলে-রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢক ঢক
পান করি, যেমন মরুর বুকে পিপাসা-কাতর পথচারী।

কিছুক্ষণ বসে থেকে পুনরায় মশারি খাটিয়ে
ঘুমের আশ্রয়ে যেতে চাই। এক ফোঁটা ঘুম নেই; অকস্মাৎ
শেষ রাতে দেখি মশারির ভিতরে তিনটি খুব
উজ্জ্বল নক্ষত্র দূর থেকে ভেসে-আসা বাঁশির অনিন্দ্য সুরে
নেচে চলে অবিরাম। আমি কোনও সুদূর কালের
আদিম লোকের দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকি নিষ্পলক দীর্ঘক্ষণ।
৬.১১.২০০০

 সৃজনের ধ্যান

কাদাখোঁচা পাখি এক আমাকে খোঁচায় বারবার
আক্রোশ মেটাতে যেন। এমন বেয়াড়া নিপীড়নে
বস্তুত সুস্থির থাকা অসম্ভর; অথচ মেঘের
অন্তরাল থেকে-আসা প্রগাঢ় আশ্বাসবাণী প্রাণে সহিষ্ণুতা
সর্বদা টিকিয়ে রাখে। কাঁটাময় পথে হেঁটে হেঁটে
পা দুটো রক্তাক্ত হলো সেই কবে; তবুও জোটেনি
আজও কোনও প্রকৃত নিবাস
কোথাও, যেখানে অস্তিত্বের বিকল্প প্রোজ্জ্বল অস্তিত্বকে পাবো।

কম তো হলো না পথ হাঁটা, তবু অন্তহীন পথ
রয়ে যায়, চোখ দুটি নিভে আসে কী এক ভীষণ
ধোঁয়াশায়, নানাবিধ ভৌতিক আওয়াজ, মতিভ্রম মাথা তোলে
চারপাশে, মতিচ্ছন্ন আমি ছুটি দিগ্ধিদিক। হঠাৎ আমাকে, মনে হয়,
নরখাদকের দাঁত গেঁথে ফেলে আর আমি
ভয়ার্ত চেঁচিয়ে উঠি, কিন্তু কণ্ঠস্বর স্তব্ধ অতিশয়। তবু
সেই ক্রূর দংশনের বন্দিত্ব ঘুচিয়ে ঝটকায় ছুটে যাই
বিরানায়। অকস্মাৎ মনে হয়, এই বিভীষিকা দুঃস্বপ্নের ছায়া শুধু।

কোথাও নিবাস নেই, অথচ আমার সৃজনের জন্যে এই
মুহূর্তে একটি ঘর চাই নিরিবিলি। হন্যে হয়ে
খুঁজে মরি চতুর্দিকে, নেই কিছু নেই
কোনও দিকে, শুধু বালিয়াড়ি পড়ে চোখে, দিগন্তের
ধুধু রেখা দেখা যায়, দাঁড়িয়ে রয়েছি বড় একা-
এমন সফেদ শূন্যতায় করতে হবে নিত্য সৃজনের ধ্যান।
৯.১২.২০০০

স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে

নক্ষত্রেরা মধ্যরাতে নৃত্যপর লোকটার নগ্ন আঙিনায়,
অপরূপ নৃত্যকলা তাকে পুরু শয্যার আরাম থেকে টেনে
নিয়ে আসে নক্ষত্রেরা মদির আলোয়। লোকটার চোখে,
শরীরে, হৃদয়ে জ্যোৎস্নাপ্লুত নেশা ধরে, সত্তা তার
ক্রমাগত নৃত্য হয়। লোকটা বয়সী বেশ, অথচ এখন
বয়সের ছাপ যেন ঝরে গেছে নক্ষত্রের গহন চুমোয়।
প্রত্যুষে নিঝুম আঙিনায় ক্লান্ত সে পুরুষ অচেতন, একা
পড়ে থাকে; শিশিরের ফোঁটাগুলো লেগে থাকে ঠোঁটে,
সাদা চুলে এবং ভুরুতে। কেউ তাকে জাগাবে না,
সম্ভবত এরকমই হয়ে থাকে মাঝে মাঝে, মনে হয়। যখন মেলবে
চোখ মিট মিট করে, রোদের ঝালর তাকে স্তব্ধ কলরবে
পৌঁছে দেবে প্রশান্তির দীর্ঘ ঘাটে, চাপা
হাসির আড়ালে বেদনার্ত মেঘ ভেসে
বেড়াবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে, উপোসের কাল দীর্ঘতর হবে।

অসুস্থ সে বহুদিন থেকে, তবু নক্ষত্র-খচিত এক ঘোড়া
তাকে পিঠে নিয়ে তরঙ্গিত নদী পার হয়, মেঘে মেঘে উড়ে
বহুদূরে চলে যায়, খুরের আঘাতে
খুলে যায় হীরার কপাট, তেজী ঘাড় নিয়ে সুন্দর দাঁড়ায়,
কত প্রতিশ্রুতি জ্বলে দু’টি চোখে। ক্ষণকাল পরে
অন্বেষী, উৎসুক সওয়ারকে নিয়ে যায় এক প্রাচীন প্রাসাদে,
যেখানে অপেক্ষমাণ অনেক রহস্যময় পাণ্ডুলিপি,
যারা শুদ্ধ পাঠ আশা করে পথ চেয়ে
রয়েছে নিশ্চুপ, কত যুগ ঝরে গেছে
তাদের অস্তিত্ব ছুঁয়ে। আচানক স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে অসুস্থ মানব।

শহর এখন কুয়াশার চাদর জড়িয়ে গায়ে বসে আছে
আফিমখোরের মতো। অসুস্থ লোকটা
ভীষণ কাশছে বসে কাঠের চেয়ারে, আশেপাশে নেই কেউ,
মাথার ভেতরে তার ভ্রমরের গুঞ্জরণ, মাঝে মাঝে বুকে
মাথা তোলে সূঁচের পীড়ন। লোকে বলে, যেজন জ্বরের তাপে
বকছে প্রলাপ ঘরে কী এক অজানা ঘোরে আর
শারীরিক ঝড় বেড়ে গেলে, যেন কোনও প্রতিশ্রুতি
মনে পড়ে গেল, এই ভেবে তাড়াতাড়ি
খাতার পাতায় দ্রুত নিবিড় ফুটিয়ে তোলে বকুল, গোলাপ;
অনেকেই সেই সৃজনের লীলা দেখে নিজেদের
কথোপকথনে সিদ্ধান্তের আলো জ্বেলে বলে-
অসুস্থতা, ভাবতে প্রলুব্ধ হই, প্রতিভার গূঢ় জন্মভূমি।
২০.১১.২০০০

 হে পক্ষী, হে বৃক্ষ

শৈশবের সোনালি দুপুরে আমি দেখেছি কত না
চিল আর শঙ্খচিল সুনীল আকাশে অসঙ্কোচে উড়ে উড়ে
ডানা থেকে ঝরিয়েছে আনন্দের কণা ক্ষণে ক্ষণে। কণাগুলো
কুড়িয়ে রেখেছি জমা স্মৃতির প্রবাহে
মজার ঠাকুরদার ঝুলি’ পড়বার ফাঁকে ফাঁকে আর
কখনও একটি ক্লান্ত চিল এসে বসেছে কাছের গাছটিতে।
হায়, আজকাল দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরেও একটি চিল আর
আসে না তো দৃষ্টিপথে, ভুলেও শুনি না
দুপুরের বুকচেরা চিলের সতেজ ডাক। দূর বাল্যকালে
এমনকি যৌবনেও নানাবিধ পাখি দেখা গেছে
এ শহরে, বারান্দার রেলিং-এ কত না পাখি এসে
বসেছে একদা চোখ আর মনমাতানো রঙের
চারু হাট বসিয়েছে অসঙ্কোচে। অথচ এখন
একটিও পাখি আর সহজে পড়ে না চোখে, যেন
ওরা গূঢ় অভিমানে এ শহর থেকে চিরতরে
নিয়েছে বিদায়। নগরের বিষবাষ্প
মানব, মানবশিশুদের ফুসফুস কি প্রবল
করেছে দখল, পাখিরাও সবুজের আশ্রয়বিহীন আজ।

বহুদিন থেকে ডানে বামে যাচ্ছে শোনা আর্তনাদ। কুঠারের
সন্ত্রাসের নির্দয়তা প্রসূত আওয়াজ আর বৃক্ষের ক্রন্দন
ভেসে আসে নিকট এবং দূর থেকে। দুর্বল ষাঁড়ের গাড়ি
টেনে নিয়ে যেতে থাকে পুরুষ এবং নারী-বৃক্ষদের লাশ!
প্রকৃতিকে বেপরোয়া হানছে আঘাত
মানবসন্তানগণ। হায়, বিবেচনায় হীনতায়
নিজেরাই নিজেদের করবে সংহার মহোৎসবে মেতে উঠে।
হে পক্ষী, হে বৃক্ষ, ক্ষমা কর আত্মধ্বংসী মানবের
ঠুলিঢাকা বিবেক, পতন আর ডাহা ভ্রষ্টাচার।
২৪.১১.২০০০

Exit mobile version