Site icon BnBoi.Com

শুনি হৃদয়ের ধ্বনি – শামসুর রাহমান

শুনি হৃদয়ের ধ্বনি - শামসুর রাহমান

 অথচ আনন্দগীতি

যে পাখি দেহের খাঁচায় নাচে, কখনও সখনও ঝিমায়,
প্রায়শ গান গায়, সে যে অচিন বড়, বেজায় খামখেয়ালী।
তার দিকে কেউ কেউ ঢিল ছুঁড়ে আমোদে গড়াগড়ি যায়,
কেউ কেউ তাকে লক্ষ করে কুড়ালের আঘাত হানে। অনেকেই
মশ্‌করা ভেবে তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দেয়। দেহঘড়ি কখন
তার ক্ষীণ আওয়াজ বন্ধ করে দেয়, এই দুর্ভাবনা লোকটাকে
বিষণ্ন করে। অথচ তাকে হাঁটতে হবে অনেকটা পথ, এখনই
থামলে খাতাটা বেজায় শূন্য থেকে যাবে। যেসব শব্দ বুক চিরে
বেরিয়ে আসার জন্যে ব্যাকুল, দিশেহারা ওদের আমি কীভাবে
আশ্বস্ত করবো? নিজেকে বড়ই বোকা-সোকা লাগে এবং
এক ধরনের অক্ষম প্রবোধ দেয়ার চেষ্টায় মেতে উঠি এই
ভঙ্গুর দেহ-খাঁচাটিকে আর না-লেখা কবিতাবলিকে। দুঃখের
মেঘগুলোকে সরিয়ে আমার মনের ভেতরকার নানা পথে
বিপথে আমার ঘুরাঘুরি, আতশবাজি পোড়ানো, আন্ধারে
প্রদীপ জ্বালানো। প্রিয়জনদের ছেড়ে যেতে ভারী কষ্ট হয়
দেহখাঁচার পাখিটার। কান্না পায়, অথচ গাইতে হয় আনন্দগীতি।
১৪.২.২০০

 অর্ফিয়ুস হওয়ার জন্যে

এখন ঘন ঘন আমার চারপাশে আজরাইলের
চিরতরে দু’চোখ-বোজানো কৃষ্ণ ডানা
ঝলসে উঠছে। একে একে অন্তর্হিত হচ্ছেন
আমার চেনাজানা অনেকেই। তাদের
কেউ কেউ খুবই ঘনিষ্ঠজন। এই তো সেদিন সেই
কৃষ্ণ ডানা আমাকেও ঝাপ্‌টা মারতে চেয়েছিল। এবার
ফাঁড়া কেটেছে, আবার কবে ডানা ছড়িয়ে
হাজির হয় আজরাইল, কে জানে!

মিস্টার ডেথ, জনাব মওত সম্প্রতি
আমার কথাবার্তায় এবং লেখায়
ঘুরে ফিরে আসছেন বলে আমার মনোনীতা
বেশ রুষ্ট, অভিমান-ক্ষুব্ধ। আমার এই মনোভাব
তাকে আহত করে, তখনও বা করে বিষণ্ন। সে আমার
কণ্ঠ, কলমে তার জীবনের গান, প্রাণে
আনন্দধ্বনি শুনতে আগ্রহী। জীবনের বন্দনা
আমার ভেতর অনিন্দ্য সুর হয়ে বেজে উঠুক,
এ তার একান্ত কামনা। তার আপন কবির কবিতায়
মর্গ অথবা কবরের গন্ধ পেতে চায় না।

তার এই মনোভঙ্গি আমাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে
ফিরিয়ে এনেছে কঙ্কাল, অমাবস্যাময় রাতের
গোরস্তান এবং আজরাইলের রক্তহিম-করা
তুষারাবৃত দৃষ্টি থেকে। আমি এখন
দরাজ গলায় জীবনের দীপ্তি-ঝরানো গান গাইবার
সংকল্প গ্রহণ করেছি। আমার সময়
উৎসর্গ করব মানবের মহামিলনের বন্দনার প্রতি এবং
পুতিগন্ধময় নালাকে রূপান্তরিত করবো
খরস্রোতা নদীতে। একালের অর্ফিয়ুস হওয়ার
সাধনা আমার চেতনায় নক্ষত্রের মতো দেদীপ্যমান।
৪.১.২০০০

আমার পূর্বপুরুষগণ

শুনেছি, আমার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন
বেশ লম্বাচওড়া। আমার বাবাকে দেখেছি
মাথা উঁচু করে পথে দীঘল ছায়া ফেলে যখন
হেঁটে যেতেন, দাঁড়াতেন আমাদের
গ্রামের বাড়ির পুকুরের ধারে, তখন সবাই
তাকিয়ে থাকত তাঁর দিকে।

এখন তিনি ঘুমিয়ে আছেন পাড়াতলী গ্রামে
তাঁর বাপদাদার পাশাপাশি
আমাদের গ্রামাণী পারিবারিক কবরস্তানে,
আমি কখনও কখনও পূর্বপুরুষদের কবরের কাছে দাঁড়াই।

আমার পূর্বপুরুষগণ পুকুর কাটিয়েছেন,
মসজিদ তৈরি করেছেন,
প্রতিষ্ঠা করেছেন ইশকুল, লাগিয়েছেন অনেক ফলের গাছ।
আমার পূর্বপুরুষগণ ছিলেন
সত্যিকারের উদার এবং পরোপকারী। তাঁদের
কথা স্মরণ করলে
শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে আমার;
চলে যাই আলাদা কালে, শুনি কত যে পদধ্বনি।

এ তুমি আমাকে কোন্‌ হাটে

এ তুমি আমাকে কোন্‌ হাটে
হঠাৎ বসিয়ে দিলে? ছিলাম নিজস্ব শূন্য ঘাটে,
ফিকে অন্ধকার ছিল চক্ষুময়, থাকতেই পারে;
সেই অন্ধকারে
রাত্তিরে উঠুক জেগে জ্যোতির্কণা-তোমার নিকট
নিভৃতে চেয়েছিলাম। পট
আচমকা পাল্টে গেলে খটোমটো লাগে
সোফা সেট, দবিজ কার্পেট, অনুরাগে
ভরপুর মন বিরাগের কাঁটায় জখম হয়
ক্ষণে ক্ষণে, হতে থাকে শুধু হৃদয়ের তন্তুক্ষয়।

আসলে নিজেকে নিয়ে খুব জড়োসড়ো
থাকি একা, সামাজিকতায় নই দড়
সে রকম; কীভাবে করবো খুশি কাকে
সহজে বুঝি না। মেকি হাসি কিংবা স্তুতির তবকে
কাউকে নিভাঁজ মুড়ে ভণ্ডদের ঝাঁকে
মিশে যেতে অপারগ; চটপটে আর ঝকঝকে
কায়দায় খেল দেখাবার সাধ্য নেই
এতটুকু; ছন্নছাড়া এই
আমি আজ বরং লুকিয়ে থাকি স্বরচিত খোলে,
অন্যেরা থাকুক মেতে হৈ-হল্লা এবং ঢাকঢোলা।

তোমাকে দিই না দোষ, তোমার ভেতর
স্বাভাবিক প্রসন্নতা আছে,
ফলত তোমার এই ঘর
গোছানোর মতো কী সহজে রোজ সকলের কাছে
রমণীয়, প্রিয় হতে পারো। আমি মাটি
করে দিই সাজানো আসর,
সযত্নে লাগায় সুর তোমার মধুর কণ্ঠস্বর
ধূসর কর্কশতায়, সংলাপকে করো পরিপাটি।

অনেক আগেই জানি বড় বেমানান
আমি হাটে আর সাতবাজারে উদ্ভ্রান্ত ঘুরে ঘুরে
আখেরে ফেরার পথে উদাস কুড়াই
মুঠি মুঠি ছাই;
আমি কি তোমাকে ছোঁবো দিনশেষে? নীল
অন্তঃপুরে
থাকো তুমি ছায়াবৃতা। আমার হৃদয়-ছেঁড়া গান
তোমার উদ্দেশে বেদনার টানে ধায়;
চেয়ে দেখি, তোমার যৌবন ছুঁয়ে শীতের সুরুজ
অস্ত যায়।
২৮.০১.৯৬

 একটি অপমৃত্যু

খাম ছিঁড়ে কোন্‌ খেয়ালে
চিঠিটা ফেলে দিয়ে দেখি হাতে খাম
নড়ছে হাওয়ায় এবং
বাজে কাগজের ঝুড়ি থেকে কেমন
আর্তনাদ উঠে এসে জড়িয়ে ধরে আমাকে। মনে হলো,
সেই চিঠি শোক হয়ে ঝুলছে অক্ষর হারিয়ে।

হারিয়ে-যাওয়া অক্ষরগুলোকে
খুঁজতে থাকি এদিক ওদিক। হোঁচটা খাই
বারবার। টেবিলের কিনার ধরে
নিজেকে সামলে নিই। হারিয়ে-যাওয়া অক্ষরগুলো
আমাকে ঠোকরায় অবহেলিত
অস্তিত্বের জ্বালা জুড়োবার হিংস্রতায়।

ওদের জড়ো করে বসাই আমার টেবিলে,
কিন্তু কিছুতেই ওদের ঠিক গোছাতে
পারছিলাম না। একটা বিদঘুটে নক্‌শা হয়ে
ওরা আমার দিকে তাকায় বাঁকা চোখে,
যেন আমাকে খুব জব্দ করার প্রক্রিয়া
ওদের আয়ত্তে এসে গেছে। হেমন্ত-সন্ধ্যায় অচিন
কে পাখি ঘুরে ঘুরে ডাকে জানালা ঘেঁষে এবং
একটি কবিতার অপমৃত্যুর বেদনা ওর ডানায় কম্পমান।
১৯.১১.৯৬

একটি প্রাচীন গ্রন্থ

একটি প্রাচীন গ্রন্থ কী নিঝুম শুয়ে আছে একা
নিশীথে টেবিলে, যেন তার
দু’চোখে ছিল না ঘুম বহুকাল। পুরনো নিদ্রার ঘ্রাণ
বুঝি বা ছড়ানো সারা ঘরে; সে কি ক্ষণিক তুলেছে
হাই কিংবা আড়মোড়া ভাঙলো খানিক
না কি কিছুক্ষণ
আছাড়িপিছাড়ি করে ঢলে পড়ে ঘুমে। অকস্মাৎ
প্রাচীন গ্রন্থটি যেন কারও মুখ হয়ে তীক্ষ্ণ
তাকায় আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে। পুস্তকের
পাতাগুলি কোথায় গায়েব হলো চোখের পলক
পড়তে না পড়তেই? বই থেকে জেগে-ওঠা মুখমণ্ডলের
জ্যোতি বিচ্ছুরিত হতে থাকে চতুর্দিকে।

টেবিল টেবিল নয় আর, যেন কোনও সাধকের
ধ্যানমগ্ন উদার আসন, যাতে ঠাঁই পেয়ে যাবে
সারা বিশ্বাব্রহ্মাণ্ড এবং
যদি স্বর্গ সত্য হয়, তা-ও। জ্যোতির্ময় সেই মুখ
রেখেছে আয়ত দৃষ্টি তার বিস্মিত আমার দিকে, ধীরে
আওড়ায় কিছু পদ উদাত্ত নিবিড় কণ্ঠস্বরে
আর কোনও নির্দেশ ছাড়াই
আমার নিজের উচ্চারণ তার উচ্চারিত শ্লোক
হয়, হয় প্রতিধ্বনি। ক্ষণকাল পরে
টেবিলের দিকে যাই, যা এখন সাধকের বিমূর্ত আসন!

প্রাচীন গ্রন্থটি খুঁজি তন্ন তন্ন করে। ক্লান্ত চোখে দেখি
হঠাৎ কোত্থেকে সেই পুশিদা পুস্তক
আমার কম্পিত হাতে এসে যায়, পাতা উল্টে-পাল্টে
পড়তে ভীষণ ব্যর্থ হই, বর্ণমালা, ভাষা, সবকিছু
অচেনা, রহস্যময় আগাগোড়া, অনন্তর কেতাব উধাও,
শুধু এক অপরূপ সুর গুঞ্জরিত হতে থাকে ঘরময় মধ্যরাতে।
৩০.১২.৯৯

 একটি মামুলি সংলাপ

আমি কি আসতে পারি আপনার কাছে
এ মুহূর্তে? অবশ্য আপনি অনুমতি না দিলেও
বেজায় অপ্রতিরোধ্য আমার এ আসা। কোনও দক্ষ
চতুর পাহারাদারই পারবে না কিছুতে আমাকে
আটকে রাখতে, যদি ইচ্ছে হয় আপনার এই
অন্দরমহলে ঢুকে আপনাকে শৈত্যপ্রবাহে আচ্ছন্ন করে রাখবার।
কোনও চ্যাঁচামেচি, কোনও তিরস্কারই কাজে
আসবে না, এমনকি সব হাতিয়ার ব্যর্থতায় ভীষণ লজ্জিত হবে।

কে তুমি বেয়াড়া লোক, যে আমার সঙ্গে এমন ধৃষ্টতা
দেখাচ্ছো নিঝুম শেষরাতে? ঝাঁঝাঁ শীত
দারুণ আক্রোশে ঠোকরাচ্ছে অস্তিত্বের হাড়মাংস,
তুমি আচানক ঘরে পা রাখার পর থেকে। দোহাই তোমার,
আমাকে রেখো না ধন্দে আর,
মুখোশ সরিয়ে নাও মুখ থেকে, তোমার অচিন
কণ্ঠস্বর কিছু চেনা মনে হয়, যেন স্বদেশে শুনেছি এই
ছায়া-স্বর বহুবার, অথচ এমন
হিমেল ছিল না দূর এই প্রবাসে যেমন আজ
একা ঘরে। বলো, অনাহূত
কে তুমি অতিথি, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার,
মুক্ত করো সুতীক্ষ্ণ শীতল কুয়াশার জাল থেকে।

পূর্ণ মুক্তি পাবেন কি পাবেন না বলা মুশকিল,
তবে বলি অসঙ্কোচে, কবি আর দার্শনিকগণ
আদ্যকাল থেকে আমাকেই আলো জ্বেলে
অতি কালো নিঃসঙ্গতা বলেই শনাক্ত করেছেন।
২.৫.২০০০

এরকম ওপরে ওপরে নয়

এরকম ওপরে ওপরে নয়, অনেক গহনে
ডুব দিলে যা চেয়েছে এতকাল তুমি
পেয়ে যেতে পারো। ওপরের
স্তরে রয়ে গেলে ভেসে ভেসে যা তুমি মুঠোয় তুলে
নিচ্ছ নিত্যদিন,
আসলে এসব অতি তুচ্ছ, বলবার মতো কিছু
নয়; বুঝি তাই
সবাই তোমাকে ব্যর্থ, বড় ব্যর্থ বলে
উপহাস করে খুব। মাথা নত করে
তুমি উহাদের ব্যঙ্গ, রূঢ় পরিহাস স’য়ে যাও।

তোমাকে সইতে হবে নানা বাক্যবাণ,
ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো হয়ে যাবে অন্তর তোমার
অগণিত হুল আর তীরের আঘাতে। তবু এই
পেরেক-ছড়ানো পথে খালি পায়ে হেঁটে যেতে-যেতে
অজস্র হোঁচট খাওয়া, পা শোণিতে ভিজে-যাওয়া, শ্বাপদের তাড়া-
ইত্যাদি না সয়ে বসে পড়লে হঠাৎ মধ্যপথে
অথবা সাঁতার বন্ধ করে দিলে মাঝ গাঙে, তুমি
সার্থকতা থেকে দূরে, বহুদূরে থেকে যাবে। জানবে না, অনেক গভীরে
কী ছিল রহস্যে ঢাকা, যার
সন্ধানে অসংখ্য পথচারী আর অক্লান্ত ডুবুরি
মাইল মাইল পথ হেঁটে যায়, জলে ডুব দেয় বারবার।

ওয়াহিদুল হকের জন্যে

বান্ধব, তোমার কথা ভাবলেই এই বাংলার
পথঘাট, উদার প্রান্তরে, নদী, দিঘি, খালবিল,
পালতোলা নাও, ফিঙে শ্যামা পাখি, গ্রামীণ দুপুরে
ঘুঘুর উদাস ডাক, জ্যোৎস্নারাতে বাউলের হাতে
ঝঙ্কৃত দোতারা, সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের গান
আর দেশবিদেশের সঙ্গীতসাধকদের দীর্ঘ
সাধনার রূপ জেগে ওঠে চিদাকাশে। কী ক’রে যে
নিজের ভেতরে তুমি সবকিছু করেছ ধারণ-

এ এক বিস্ময় আজও আমার নিকট। সত্য, শিব,
সুন্দরের ধ্যানে কাটে তোমার প্রহর নিত্যদিন;
তোমাকে করেনি স্পর্শ সাম্প্রদায়িকতা কোনওকালে।
প্রগতি প্রবল টানে তোমাকে এবং এই বিশ্ব-
মানবের কল্যাণ তোমার কাম্য, তাই তোমাকেই
শ্রদ্ধাঞ্জলি দিই, দিই ভালোবাসা, হে সুরসাধক।

 কখনও আগুনে পোড়ে

তবে কি এখন হাল ছেড়ে দেবো? যখন তখন
শ্বাপদের পদশব্দে কেঁপে ওঠে বিবর্ণ প্রহর, পতনের
কর্কশ আওয়াজ চেতনাকে প্রায় ভোঁতা করে দিতে
চায় দিনরাত; দৃষ্টি ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে।
বুঝি না কে আততায়ী, কেই বা ত্রাণের মুদ্রা নিয়ে
অদূরে দাঁড়ানো? ফিস্‌ফিস্‌, কানাঘুষো
চতুর্দিকে; অন্ধকারে বস্তুত যায় না দেখা কিছু, কে যে কোন
পক্ষে সমর্পিত
বোঝা ভার এ মুহূর্তে। সবাই তো মিত্রের ভঙ্গিতে
কাছে আসে, অথচ শক্রতা
সাধনে বেজায় দড় অনেকেই, ঘাড়
মট্‌কে রক্তপানে অভিলাষী। কাছে দূরে কেবলি পাগলা ঘন্টি।

পথঘাটে, সুদৃশ্য দোকানপাটে, ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে লোকজন
বড় বেশি সমার্পিত পরকালে, স্বসৃষ্ট ধোঁয়াটে
ঘূর্ণাবর্তে ঘুরে মরে অহর্নিশ। যারা এই পথ
থেকে দূরে হাঁটে, শুধু চেনা
পৃথিবীর রৌদ্রছায়া, জোনাকি, শিশির, ঘাসপাতা, গ্রন্থগীত
দোয়েল, কনকচাঁপা-নারী ভালোবেসে
সুখী হতে চেয়ে তারা হতেছে লাঞ্ছিত পদে পদে,
কখনও আগুনে পোড়ে, কখনও বা ক্রুশবিদ্ধ হয়।
৬.১২.৯৬

 কবি লিখে যান জয়গাথা

মুদ্রিত তথ্যানুযায়ী জানি লোকটার জীবনের
প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মিশেছে ধূসর গোধূলিতে। ছিল না সে
কারও সাতেপাঁচে, লাঠি দিয়ে
মারেনি মাথায় বাড়ি কোনও মানবের
অথবা কখনও তাক করেনি বন্দুক
কারও বুক লক্ষ করে, এমনকি পাখিরও জীবন
করেনি হরণ কোনওকালে। যতদূর জানি,
আজ অব্দি প্রাণীহত্যা স্বচক্ষে দেখেনি, বরং সে
রেখেছে দু’হাতে মুখ ঢেকে,
যখন বাড়ির কাছে পশুর গলায় ছুরি চালানো হয়েছে।

বস্তুত লোকটা তার জীবন কাটালো বই পড়ে,
এবং কবিতা লিখে। অসুস্থতা বাগে পেয়ে তাকে ইদানীং
এদিক সেদিক থেকে নিচ্ছে প্রতিশোধ দীর্ঘকাল
নিয়মভঙ্গের শাস্তিস্বরূপ; লোকটা কিছুতেই
একরত্তি শান্তি কিংবা স্বস্তি আজ পাচ্ছে না নিজের ঘরে বসে
অথবা বাইরে ঘুরে বেড়িয়ে খানিক। বাড়ি আর
খোলা পথ দুটোই বিপদাচ্ছন্ন হন্তারকের সহিংস
নিঃশ্বাসে, অস্ত্রের স্বৈরাচারে। হায়, এই তো জীবন লোকটার!

লোকটা প্রায়শ পৌরাণিক সাগরের
জলে জাল ফেলে তুলে আনে আশ্চর্য রঙিন কিছু মাছ,
খাতার পাতায় লেখে পীড়িত চোখের তীব্র বাধা সত্ত্বেও মনের
মুক্তির মুক্তোর দীপ্তি, প্রেম, কল্যাণ ও প্রগতির কথা।
তবু তার প্রাণনাশে লিপ্ত কতিপয় সভ্যতা-বিদ্বেষী লোক হানা দেয়,
ঘরে তার হানা দেয় মারণাস্ত্র নিয়ে।

চকচকে কুঠারের আঘাত দৈবাৎ ফস্কে যায়,
প্রাণরক্ষা পায় লোকটার। ভয়ঙ্কর এ ঘটনা
মুশকরার খোরাক হয়েছে কোনও পশ্চাৎপদ অধ্যাপক
এবং সম্প্রতি গোঁফ-গজানো ক’জন
মিহি পদ্যবাজ আর সত্তাময় শ্যাওলা-জড়ানো লোকদের। তবু কবি
অবিচল; নতুন যুগের সূর্যোদয়ে লিখে যায় জয়গাথা।
৫.১.২০০০

কোনও এক মধ্যরাতে

নিদ্রার নদীতে নিঝুম ভেসে যাচ্ছিলাম একটানা
প্রগাঢ় নিশীথে। হঠাৎ আশ্চর্য নিঃশব্দ
কলরবে জেগে উঠি। ঘরে নিশুত শয্যায় একলা
আমি, আশেপাশে কেউ নেই, তাহলে
এই শব্দহীন শব্দের উৎস কোথায়? বিস্ময়-বিহ্বল আমি
কান পাতি নিশীথের হৃৎস্পন্দনে।

আমার শ্রুতিতে ভেসে আসে কিছু কথা। কথাগুলো
স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে। সেসব
কথা উঠে আসছে আমার বড় বুকশেলফ্‌ থেকে।
কয়েকটি হৃষ্টপুষ্ট পুস্তক কথোপকথনে
দিব্যি মেতে উঠেছে, বুঝতে কষ্ট হলো না
আমার। ওদের অধিকাংশ বাক্যবাণের
লক্ষ্যবস্তু আমি। একটি গম্ভীর গ্রন্থ ততোধিক
গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘লোকটা অন্য কোনও শখের জিনিস
না কিনে, রেস্তোরাঁয় এটা সেটা খেয়ে পয়সা
না উড়িয়ে আমাকে চড়া দামে সেই কবে নিয়ে এসেছে
অথচ আজ অব্দি আমার পাতাগুলোয়
ভ্রমণ না করেই রেখে দিয়েছে। জ্ঞান সঞ্চয়ের
কোনও চেষ্টা করেনি। আহা,
ভারি আফসোস হয়, লোকটার কাণ্ডকারখানা দেখে।‘

আরেকটি ভারিক্কি পুস্তক গমগমে কণ্ঠস্বরে
আধবোজা চোখ সামনের দিকে রেখে বলে, ‘যথার্থ
বলেছ ভায়া, এই দেখ, আমাকেও দূরে
ঠেলে রেখেছে ক’বছর ধরে। অথচ
ওই যে দেখছ টিঙটিঙে কিংবা মাঝারি সাইজের,
কয়েকটি মোটাসোটাও বটে, কবিতার কেতাব, সেগুলো
দোকান থেকে এনেই দিব্যি পড়ে ফেলে
মশগুল হয়ে। একবার দু’বার নয়, বারবার। কী জ্ঞান যে
লোকটা পায় সেসব পুস্তকে, সে-ই জানে। লোকটার
আক্কেল দেখে মেজাজ ঠিক রাখাই মুশকিল।

হঠাৎ আমার পাশে-রাখা বইটির শরীরের স্পর্শ পাই;
ঘুমোবার আগে নেরুদার কবিতা পড়ছিলাম,
মনে পড়লো। অস্বীকার করবো না, কবিতার প্রতি
আকর্ষণ আমার অধিক। তা বলে অন্যান্য জ্ঞানের
আভাময় বই আদৌ উপেক্ষণীয় নয় আমার কাছে। জানি না,
বুকশেলফে সাজানো গুরুগম্ভীর পুস্তকরাজি
আমার প্রকৃত মনোভাব বুঝতে পারে কিনা। তাদের
সঙ্গেও খুব অন্তরঙ্গ হয়ে উঠবো, যদি না মৃত্যু চুরি করে নিয়ে যায় আমাকে।
২৫.০১.২০০০

ক্ষণিকের দেখা

একটু পরেই লোক পাঠাবে শামীম কবিতার
জন্যে, আমি তার পথ চেয়ে আছি। অথচ কবিতা
দূরে, বহুদূরে মেঘ হয়ে আছে, ঝুলে
আছে আলগোছে শাখাহীন।

এখন আমি কি চুপচাপ গৃহকোণে
একলা থাকবো বসে নড়বড়ে চেয়ারে আমার? নাকি শার্ট
আর ট্রাউজার পরে পুকুরের ঘাটে
দাঁড়াবো খানিক ফুরফুরে
হাওয়ায় কিছুটা
বেঁচে থাকবার জন্যে কবিতার চুল টানা কিংবা
কানমলা থেকে? না, এভাবে
পালানো নিশ্চিত অনুচিত একেবারে। কথা দিয়ে
কথাকে হঠাৎ অক্ষরের গিলোটিনে
ফেলে চলে যাওয়া
কবিকে কাদায় ফেলে হৈ-হুল্লোড় ছাড়া কিছু নয়।

এরকম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অকস্মাৎ চোখে পড়ে-
একটি সুনীল হ্রদে একজন নারী
পূর্ণিমার মতো পূর্ণ নগ্নতায় স্নান করে।
অথচ আমি তো একা নিজের ঘরেই বসে আছি
কেমন বিক্ষিপ্ত মনে। সে নগ্নিকা কী কোমল উঠে
আসে তীরে, আমার দিকেই চলে আসে নিরিবিলি,
‘ভয় নেই, কবিতা তোমার অন্তরেই
এখন মুদ্রিত; শুধু লিখে নাও সফেদ কাগজে,
প্রতিশ্রুতি রক্ষা হবে একটু পরেই। শোনো কবি,
এখন ঘরের বইপত্র, খাতা, ছবি-সবকিছু ভুলে যাও,
শুধু মনে রেখো,
চকিতে আমাকে তুমি ক্ষণিক দেখতে পেয়েছিলে!
২৫.৩.২০০০

গাছ, কফিন এবং নৌকা

একজন কাঠুরেকে স্বপ্নাদ্য একটি গাছ টানে
এবড়োথেবড়ো জমিনের সীমানায়,
যেখানে গাছটি অনাদরে উপেক্ষায় বেড়ে উঠে
মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে,
যেন বীর কর্ণ, যার রথের ভাস্বর চাকাদ্বয়
দেবে যাবে মাটিতে। কাঠুরে কুঠারের
আঘাতে আঘাতে গাছটিকে
কাঠে রূপান্তর করে ঘর্মাক্ত শরীরে।

একজন কাঠের মিস্তিরি বসে থাকে কয়েকটি
কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে।
সে তার নিজের ছায়া বিছিয়ে দিয়েছে
কাঠের উপর আর তিনটি খেয়ালী দাঁড়কাক
ছায়াটিকে দ্রুত খণ্ড খণ্ড করে ধারালো চঞ্চুতে, ছায়াটির
বিলাপে মিস্তিরি কফিনের রূপ দ্যাখে, অবশেষে
তার শিল্পদক্ষতায় গড়ে ওঠে সাধারণ একটি কফিন
যার শূন্যতায় দীর্ঘশ্বাস, মরীচিকা, মর্সিয়ার পূর্বাভাস।

কফিনে পুরলো ওরা, ঘাতকেরা, তাঁকে
অবহেলা আর অশ্রদ্ধায়,
অথচ মহত্ত্ব আর অমরত্ব, তাঁর দুই সহচর, তাঁর
উদ্দেশে করল নিবেদন অপরূপ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ঘাতকেরা সে কফিনটিকে
নিষিদ্ধ দ্রব্যের মতো পাচার করতে চেয়েছিল
বিস্মৃতির বিয়াবানে আর সে কফিন
অলৌকিক প্রক্রিয়ায় একটি বিশাল
সন্তরণশীল নৌকা হয়ে ভাসমান সবখানে।

কাঠুরে ও কাঠের মিস্তিরি জনতার
বিপুল তরঙ্গে মিশে সবিস্ময়ে নৌকার আড়ালে
একটি সুদীর্ঘ গাছ, একটি কফিন
দেখে বুকে একরাশ উজ্জ্বলতা নিয়ে ঘরে ফেরে।
১৩.৮.৯৬

ঘাটের কথা

অনেকেই আমাকে বেশ ঘটা করে
নিজ নিজ ঘাটের কথা বলেন,
যে-ঘাটে বেলাশেষে পৌঁছে যাবেন সাড়ম্বরে,
সেখানে তাদের জন্যে অপেক্ষমাণ
সব পেয়েছির দেশ। এমন কি আমার এক
নিরীশ্বর, সঙ্গীতসিদ্ধ বন্ধুও
বললেন তার ঘাটের কথা
ঈষৎ ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে আধ্যাত্মিক গীতের ধরনে।

কিন্তু বরাত খারাপ আমার। কেননা,
আমার কোথাও পৌঁছুনো নেই, কোনও ঘাটও
নেই; আছে শুধু অসীম তিমিরের
মহাশূন্যতায় চিরতরে বিলীন হওয়া।
১৩.৪.২০০০

 ছুঁচো আর ইঁদুরের কথা

বেশ কিছুদিন হলো ঘরের ভেতর ছুঁচো আর ইঁদুরের
উৎপাত বেড়েছে। এইসব
মৃত্তিকা খননকারী, গর্তবাসী প্রাণী কবে আমার ঘরের
জবরদখল নিয়ে ফেলেছে, পাইনি টের। উহাদের গন্ধে এখন তো
বিবমিষা হয়, মাঝেমাঝে
বমি করে ফেলি আর কোনও কোনও রাত
ভীষণ নির্ঘুম কাটে, অসুস্থতা বুকের ভেতর
কঠিন পাথর হয়ে চেপে বসে। কখনও কখনও
মনে হয়, মূষিক ও গন্ধ মূষিকেরা বন্ধ ঘরে
আমার শরীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে অসীম আহ্লাদে। খাটে শুধু
কঙ্কাল থাকবে পড়ে উন্মাদের দুঃস্বপ্নের মতো,-
এ ভাবনা ছড়ায় তুষারকণা রক্তের ভিতর।
তাহলে কি ছুঁচো আর ইঁদুরেরা আখেরে আমাকে
ঠাঁইনাড়া করে দেবে? কারও বাড়া ভাতে
কখনও দিইনি ছাই, তবু কেন এই
উৎপাত এখানে দিনরাত? আমার নিজেরই ঘর
কেন ঘৃণ্য মৃত্তিকাখননকারী প্রাণীদের অধিকারে ছেড়ে
চলে যেতে হবে? কেন কেবলি বিবাগী
হয়ে হেঁটে যেতে হবে দেশ-দেশান্তরে
নিঃসঙ্গ, ব্যথিত ইহুদির মতো? অথচ আমার
আপন ঘরের
ভেতর আসতো ভেসে গোলাপ, কনকচাঁপা, চন্দ্রমল্লিকার
ঘ্রাণ; পাখি সুরে সুরে ভরিয়ে তুলত কত নিমগ্ন প্রহর
আর কবিতার মুখ প্রথম আলোর মতো জাগত হৃদয়ে।
১৪.১.৯৯

জনৈক বন্ধুর প্রতি

বন্ধু, তুমি মেঘের সঙ্গে, গাছের পাতা, পানির সঙ্গে
অনেক সময় কথা বলো। পাশের বাড়ির লাল দেয়ালে
না-লেখার সব লেখা পড়ো এবং সাঁঝের উড়ে-যাওয়া
আবছা পাখির ডানা থেকে পদ্য-ছোঁয়া পঙ্‌ক্তি আনো।

বন্ধু, তোমার পায়ে অনেক পথের ধুলো, কাঁটার খোঁচার
চিহ্ন দেখে বুঝতে পারি, অনেক হেঁটে অনেক বাধার
প্রহার সয়ে এখানে আজ ঈষৎ উঁচু আসন পেলে।
তোমার প্রতি লোকের প্রীতি শেষে তোমার কাল হয়েছে।

কোনও কোনও কামেল পুরুষ তোমার নামে কেচ্ছা রটান,
কারও হাতের পাথর তোমার বুকে কিছু জখম বানায়;
যাদের তুমি কোনওকালে স্বজন বলে জেনেছিলে,
তারাই দিব্যি শক্র হয়ে গলিজ বাক্য বমন করে।

বন্ধু, তুমি খেদ করো না, এমনি ধারা সর্বকালেই
সচল জেনো। বিরূপতায় পিষ্ট হয়ে কেউবা হারায়
রুটিরুজি, বাস্তুভিটা, কেউ নিমেষে স্বদেশত্যাগী।
সইতে হবে সকালসন্ধ্যা হিংস্র পাথর, কাদার গোলা।

বন্ধু, তোমার ভয় কী বলো? আঁধারঘেরা পথে তোমার
পড়বে আলো যথারীতি। রবিঠাকুর, লালন ফকির
এবং আরও মহামানব তোমায় নিত্য ছায়া দেবেন
উপরন্তু নরনারীর ভালোবাসা হবে তোমার রক্ষাকবচ।

না-ই বা হলো কালজয়ী খ্যাতি তোমার, যায় যদি যাক
মুছে তোমার নামের রেখা কালের পটের ক্ষেত্র থেকে
দুঃখ কিসের? ঘটছে অমন হরহামেশা নানা যুগে;
যে-সাধনে রইলে সেটাই অটুট থাকুক জীবন জুড়ে।

 জনৈক মাঝি

নৌকাটা সত্তায় দৈন্যদশা নিয়ে নিঝুম রাত্তিরে
যাচ্ছিল নদীর বুক চিরে। প্রায় বুড়ো,
খুব রোদে-সেঁকা, জলে-ভেজা
মাঝি দাঁড় বায় অবিচল।

অকস্মাৎ মাঝগাঙে ক’জন ডাকাত ঘিরে ধরে
চলমান নাওটিকে, রত্নের সন্ধানে তছনছ
করে সব, অন্ত্রের আঘাতে বড় অসহায় মাঝি
বিপন্ন লুটিয়ে পড়ে জীর্ণ পাটাতনে।

বিফল ডাকাত দল ছিটিয়ে ঘেন্নার থুথু নিমেষে উধাও;
ভোরের প্রথম আলো পাক-খাওয়া নৌকোটিকে ছুঁলে
ভাঙা পাটাতনের তলায়
প্রচ্ছন্ন, অনন্য রত্নরাজি উঠে উসে
মাঝির বুকের ক্ষত ঢেকে দেয় শুশ্রূষায়,
আলগোছে ভেসে আসে পাখিদের বন্দনা-সঙ্গীত।
জানা নেই ভাসমান নৌকো
ভিড়বে কোথায় কোন্‌ ঘাটে!
১৪.২.২০০০

জানবে না কেউ

লোকটাকে, সকল সময় নয়, কখনও সখনও
দেখি, বেশি দেখি দূর থেকে, কাছে
কালেভদ্রে দেখা পাই তার আর, কি অবাক কাণ্ড,
যখন দূরত্ব ঢের বেশি থাকে, তখন অনেক
নিবিড়, গহন চেনা লাগে,
নৈকট্য অচেনা করে দেয় অতিশয়।

পাজামা-পাঞ্জাবি কিংবা ফতুয়া পরেন
প্রায়শই; মাঝেসাঝে শার্ট আর ট্রাউজার দিব্যি
শোভা পায় ক্ষয়িষ্ণু শরীরে তার। লোকে বলে রোদ্দুরে ভেজেন
তিনি আর তুমুল বৃষ্টিতে খটখটে।

লোকটা গভীর রাতে, কোনও অতি-কৌতূহলী
প্রতিবেশী বলে, খুব পুরনো একটি খাতা খুলে
আবিষ্কারকের মতো কী যেন খোঁজেন ঘুমটুম
বেজায় হারাম করে। কোনও কোনও রাতে কতিপয় প্রতিবেশী
কান পেতে শোনে ফিসফিসে কথা বিভিন্ন কণ্ঠের। কারা তারা?
কী ভাষায় বলে কোন কথা? লোকটা নিজেই
বোঝেন না বহু কিছু-এতটুকু বোঝে
প্রতিবেশীগণ তার মুখভঙ্গি দেখে।

রাত্রির তিমির মুছে গেলে কাঁচা রোদের চুমোয়
লোকটার ঘরে কয়েকটি চিত্রকল্প খুব অন্তরঙ্গতায়
এদিক ওদিক ঘোরে, কোনও কোনও পঙ্‌ক্তির ছন্দিত
ছায়া কাঁপে আলোকলতার মতো একটি লুকানো
অনেক প্রাচীন এক খাতার পাতায়। এইসব
পুশিদা অস্পষ্ট টুকরো ছবি কারা রেখে যায়
যেগুলো ফুটিয়ে তোলা লোকটার দায় হয়ে পড়ে?
সঞ্চয় কেবলি বাড়ে, কিন্তু কীভাবে নিজেই জানেন না কিছু।

কিছুকাল পরে এক মধ্যরাতে লোকটা হঠাৎ ঈর্ষাতুর,
জুয়াড়ি মৃত্যুর ছলনায় কাঁচা মাটির গভীরে
চলে যান সীমিত শোকের জলে ভেসে। ক্রমে তার
কবরে সবুজ ঘাস, কিছু জংলি ফুল ফোটে। ইতস্তত
কয়েকটি প্রজাপতি ওড়ে আর কখনও পাখির গান জাগে
ওরা সব লোকটার না-লেখা কবিতাবলি জানবে না কেউ।
৫.৪.২০০০

 ডাইনোসর উঠে এলেও

আমি তো মাঝেমাঝে বাইরেই যেতে চাই,
অথচ ঘর আমাকে আটকে রাখে।
ঘরে বসে আমি দেখতে পাই
একচিলতে আকাশ, নীলিমার বিশালতা
দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়। কখনও সখনও একটি কি
দুটি পাখি চোখে পড়ে। পাশের বাড়ির
জানালার ওপরের কার্নিশে
যুগল পায়রার কোমল প্রণয় আমাকে মুগ্ধ করে,
কিন্তু ঝাঁকঝাঁক পাখির পঙ্‌ক্তিমালা
আমার উৎসুক দৃষ্টির আওতার
বাইরে রয়ে যায় মাসের পর মাস।

এ যেন নিঃসঙ্গ বন্দীর ক্লান্ত, দম-আটকানো সুদীর্ঘ
প্রহর কাটানো, কিংবা তীব্র সাইনাসের
দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরুদ্ধকর বেহাল প্রহর,
মাথার ভেতর ভীমরুলের অশেষ চক্কর। কখনও
মনে হয়, মাথার ভেতর, নাকে মুখে সুঁচলো কিছু ঘাস
গজিয়ে উঠেছে। জোরে জোরে ডেকে চলেছি,
কিন্তু কোনও শব্দই বেরুচ্ছে না। কণ্ঠনালীতে
মুঠো মুঠো বালির খসখসানি। আবার মুমূর্ষু দিনান্তে
দুটো চোখই আচ্ছন্ন হয়
মৃত কুয়াশায়; আক্রান্ত হই হঠাৎ
কতিপয় কঙ্কালের অদ্ভুত হিংস্রতায় এবং
ওরা আমাকে বাধ্য করে আমার নিজেরই রক্ত চেটে নিতে

দুঃস্বপ্ন এবং বাস্তবের মধ্যে কোন্‌টি প্রকৃত সত্য, এ নিয়ে
কী-যে ধন্দে পড়ে যাই, বোঝানো খুবই মুশকিল।
এই যে আমি আটকে আছি গুহাসদৃশ ঘরে,
নিঃশ্বাস নিতে অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে আমার-
শরীরে বিষাক্ত কাঁটা ফুটছে, চোখের ভিতর
ঢুকছে ঝাঁকঝাঁক লাল পিঁপড়ে, মেরুদণ্ড কারা
যেন উপড়ে নিতে চাইছে বাঁকা, আগুন-তাতানো
শিক দিয়ে। কী এমন অপরাধ করেছি যে সবাই
এরকম শক্রতা সাধতে উন্মুখ? অথচ
বন্ধ্যা মাটি চিরে আমি উদ্যান বানাতে চেয়েছিলাম,
বালিময় জমিনে ফল্লুধারা
বইয়ে দেয়ার শপথ নিয়েছিলাম সূর্যোদয়ের
দিকে মুখ রেখে। নিজেকে শুদ্ধতার
আভায় ভাস্বর করার আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার।

কতিপয় মাংসাশী পাখির অন্ধকার-ছড়ানো
পাখার দাপটে অথবা এক পাল জন্তুর
তাণ্ডবে হকচকিয়ে, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে খুরপি আর
কোদাল চালানো থামিয়ে দেবো? বাগান বানানোর
কাজ বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো
সত্তায় হতাশার কালো মেখে? ধূসর মাটি ফুঁড়ে
ডাইনোসর উঠে এলেও আমি পুষ্পবিকাশের
বীজ বপন করে যাবো কোনও সর্বনাশের তোয়াক্কা না-করেই।
৩০.১২.৯৯

তখন তাকে

একে একে ওরা অনেকেই
গাঁওগেরামের নারী, পুরুষ, শিশু
জড়ো হলো মাঠে। বহুদূর থেকে একজন
এসেছেন ওদের কিছু বলার জন্য।

সবাই ভালো করে দেখল তাকে। মাঝারি
গড়নের মানুষ। পরনে পাজামা, পাঞ্জাবি,
গায়ের রঙ রোদপোড়া। অসাধারণ কিছুই নয়,
খুবই সাদাসিধা। কেমন যেন
আপন মনে হয়। তিনি চোখ মেলে তাকালেন
সবার দিকে, তার চোখ থেকে ঝরে মমতার রেণু।

প্রথমে তিনি সবাইকে আমির সওদাগর আর
ভেলুয়াসুন্দরীর কাহিনী শোনলেন,
তখন তার গলার আওয়াজে
জ্যোৎস্না ফোটে, ফোটে বেলফুল, দিঘির ছলছলানি।

তারপর তিনি বললেন, যারা ফতোয়াবাজ
তারা মানুষের পক্ষে নয়;
যারা নূরজাহানকে মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মারে,
তারা মানুষ নয়;
যারা ইয়াসমিনের ইজ্জত লুটে ওকে হত্যা করে,
তারা পশুর চেয়েও বেশি পশু;
যারা ইশকুলে আগুন দেয়,
তারা মানুষের বিপক্ষে।

যখন তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে
সমাজের অন্যায়, অবিচার আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে
কথা বলছিলেন, তখন তার কথায়
রোদের ঝলক,
এবং সেই মুহূর্তে তাকে অনেক দীর্ঘকায় দেখাচ্ছিল।

দাঁড়ালেই টলতে থাকি

দাঁড়ালেই টলতে থাকি, খানিক হাঁটতে
চেষ্টা করলেই রুক্ষ ধূসর ধুলোয়
স্রেফ মুখ থুবড়ে পড়ি, আবার কখনও
খাবি খাই থকথকে কাদায়, এখন
আমার এমনই হাল। শক্ররা চৌদিকে
ফেটে পড়ে ঠা ঠা অট্রহাসিতে এবং বন্ধুবান্ধব বেজায়
মনোকষ্টে ভোগেন আমার অবাঞ্ছিত
এ দুর্দশা দেখে।

লজ্জায় কুঁকড়ে থাকি, নিজেকে লুকোতে ইচ্ছে করে,
যেমন আহত জন্তু খোঁজে অন্ধকার গুহা। এই অক্ষমতা
জানি না ভোগাবে কতদিন, কতকাল
আমাকে রাখবে ফেলে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো হিংস্র,
ঘোর অমাবস্যার দখলে! কারও করুণার পাত্র
হয়ে থাকা, বুকে হেঁটে পথচলা, ব্যথিত দু’চোখে
তাকানো, কম্পিত ঠোঁটময়
করুণ অথচ তুচ্ছ আবেদন নিয়ে বেঁচে থাকা,
আত্মাময় গ্লানি সেঁটে নিত্যদিন হামাগুড়ি দেয়া,
কেবল নিজের মাংস নিজ দাঁতে ছেঁড়ারই শামিল।

যখন ভোরের আলো চুমো খায় আমাকে এবং
পূর্ণিমা সপ্রেম করে আলিঙ্গন, আমার ক্ষতের
ছেঁড়া ন্যাকড়াগুলো খসে যায়, কোথাও সরোদ বেজে উঠলেই
আমার সত্তায় ঘটে রূপান্তর, আমার নমিত
কেশগুচ্ছ হয়ে ওঠে স্যামসীন দুরন্ত কেশর হলমায়
এবং মশকরা-প্রিয় লোকজন পালাবার পথ খুঁজে মরে!
০২.০১.২০০০

 দীক্ষা

দৈন্যদশা বাড়িটার, অথচ সেখান থেকে চৌদিকে প্রখর
দীপ্তি হচ্ছে বিচ্ছুরিত, ভাবে মলিন তরুণ। কাছে
গিয়ে কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলেন
দৃশ্যত দরিদ্র প্রৌঢ় কবি, বললেন স্নেহার্দ্র প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে-
‘তোমাকে সাহায্য দান অসাধ্য আমার;
ধনীর ভবনে যাও।‘ ‘আপনার কাছে টাকাকড়ি
চাইতে আসিনি আমি’, বলে সে তরুণ, ‘চাই শুধু
কিছু সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের আভা।‘

বয়স্ক কবির চোখে আলোঝর্ণা ফোটে,
উদ্ভাসিত তরুণ সে প্রার্থী আশ্চর্য দীক্ষায়!
৭.৪.২০০০

 দোয়েলমাতার জন্যে বন্দনাগীতি

আমার দোয়েল মাকে, বহুদিন হলো কী ধূসর
দূর দেশে হারিয়ে ফেলেছি। মাথা খুঁড়ে
মরলেও ঠিকানা পাবো না কোনওকালে। সেই থেকে
বারবার ভস্ম ঢেকে ফেলে
আমাকে আপাদশির। কখনও সখনও প্রাণে গান
জেগে উঠলেও কণ্ঠে ভস্মরাশি জমে যায় শুধু!

কালেভদ্রে দোয়েলমাতাকে দেখি স্বপ্নের ভিতরে
স্বর্গীয় গানের সুরে লীন নীলহ্রদের কিনারে। জেগে উঠে
গান গেয়ে অন্তত নিজেকে
শুদ্ধ করে নিতে গিয়ে স্তব্ধতায় ডুবি, যেন সুর
আমাকে আলোয় নেয় অন্ধকার থেকে
অনন্য গহন মীড়ে। আমার দোয়েলমাতা বেদনায় মিশে
ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে চকিতে মিলায়
গুণীর তানের মতো।

দোয়েলমাতার ব্যর্থ, অধম সন্তান আমি, পড়ে
আছি একা ছিন্নভিন্ন পথের ধুলায়। মাঝেমাঝে
কণ্ঠ থেকে ভস্ম ঝরে যায় অকস্মাৎ, যে গান কখনও
লতিয়ে ওঠেনি কণ্ঠে, তারই সুর জাগে, সুর শুনে
গাছের তরুণী লতা, ফুলের অনূঢ়া কুঁড়ি, প্রজাপতি আর
হলুদ ধানের শীষ নাচে, সুনসান
নিশীথের বুকে জোনাকিরা ব্যালে-নাচ জুড়ে দেয়।

কোথাও অজানা দেশে আমার দোয়েলমাতা দীর্ঘ
কোমল নিদ্রায় আনন্দের আলিঙ্গনে মিশে গিয়ে
ভস্মস্তূপে নতুন সুরের জন্ম দেয়, রেশ যার
আমাকে বাজায়, নিয়ে যেতে চায় অনন্তের তটে……
১৩.৩.২০০০

 দ্বিধারা

একঝাঁক পাতিহাঁস বদ্ধ নর্দমার কাদাজল
ভালবেসে, ডাস্টবিন খুঁটে খায় আর
জটলা পাকায় ক্ষণে ক্ষণে, প্রায়শ কলহে মাতে। একজন
রাজহাঁস, নিঃসঙ্গ, ওদের সখ্যকামী, কাছে এসে
প্রত্যাখ্যাত হয়; ধবধবে, কান্তিমান রাজহাঁস
ভারাক্রান্ত মনে হেঁটে যেতে কিছুদূরে খুব খাঁটি
দুধের নহর পেয়ে যায়, শোনে বীণার আশ্চর্য ধ্বনি আর
রাতে নক্ষত্রেরা চতুর্দিকে নেচে বলে, ‘স্বাগতম।‘
আনন্দিত রাজহাঁস আকাশের নানা স্তরে মুক্ত
ডানা মেলে সৌন্দর্যের নানা রূপ করে আবিষ্কার।
৮.৪.২০০০

 দয়া করে একটু শুনুন

এই যে, শুনুন, দয়া করে একটু শুনুন।
খানিক সময় ভিক্ষা চাইছি,
জানি আপনি ব্যস্ত বেজায়,
তবু সময় চাইছি কিছু।

নই তো আমি বংশীবাদক,
মুগ্ধ করার সুর জানি না,
লোক জোটাবার কায়দা নেই,
কণ্ঠ আমার রুক্ষ খুবই,
তবু কিছু বলতে চাই।

জানি আপনি হালজমানার মানুষ বটে,
তবে কেন পেছন দিকে হাঁটেন শুধু?
তবে কেন চতুর্দিকে আঁধার ছড়ান?
এই কি সাধের চলার রীতি?

শুনি আপনি সবার নাকি ভালোই চান,
তবে কেন ডানের মোড়ে লোক জমিয়ে
অগ্রগতির মস্ত বড় শক্র সাজেন?
প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে চলেন?

 ধন্য ধন্য রবে মুখরিত

মহাকালের মৃত্তিকায় স্বাক্ষর রেখে চলেছে
আমার মায়ের মুখের ভাষা,
যেমন তালপাতায় মহাকাব্য রচনা করেছেন
বাল্মীকি এবং ব্যাস।

কপোতাক্ষ নদের কিনারে পড়ন্ত বিকেলে
স্যুট-বুট পরা মাইকেল মধুসূদন
গা এলিয়ে আবৃত্তি করছেন নিল্টনের
‘প্যারাডাইস লস্ট’ কিংবা নিজের পঙ্‌ক্তিমালা।
শান্তিনিকেতনে ধ্যানমগ্ন রবীন্দ্রনাথ মানসে ধারণ
করছেন বিশ্বরূপ এবং অম্লান কাব্যধারা। লালন ফকির
পথেঘাটে বাজিয়ে চলেছেন একতারায়
মানবাত্মার উদার সঙ্গীত। নজরুল
অপরূপ ছন্দে নেচে চলেছেন মোহন বাবরি দুলিয়ে
জেলায় জেলায় আর তার সঙ্গে নাচছে
শাশ্বত বাংলা। এই তো দেখেছি,
ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে একান্ত
নিঃসঙ্গ দাঁড়ানো জীবনানন্দ দূরের আকাশের
নক্ষত্রমালাকে ছুঁয়ে ছেনে শুনে নিচ্ছেন জলপরীদের গান।

অনন্য এই কবিদের নির্মিত জ্যোতির্ময় পথগুলি
দেখতে দেখতে আমি স্বতন্ত্র পথ তৈরির সাধনায়
মগ্ন, যেখানে ক্লান্তির প্রহরে সবুজের সান্নিধ্যে
খানিক জিরিয়ে নেবেন পথিকগণ।

বিগত শতাব্দীর সীমা পেরিয়ে এই সামান্য অথচ
সৌভাগ্যবান আমি নবীনা একুশ শতকের থরথর
অধরে চুম্বন করছি জ্বলজ্বলে আবেগে। চতুর্দিকে
আনন্দধ্বনি। এই তো বিশ্ববাসী আমাদের আপন
একুশে ফেব্রুয়ারিকে, মানে আমাদের
মায়ের মুখের ভাষাকে বরণ করছে ফুলচন্দন দিয়ে
এবং ধন্য ধন্য রবে মুখরিত একুশ শতকের পূর্বলেখ।
৬.২.২০০০

 ধুধু মন

আজও এই নব্য শতাব্দীতে মনে পড়ে-
হাজার বছর আগে ঘিয়ের প্রদীপ-জ্বলা রাতে
গভীর নিশীথে এক অন্যন্যা রূপসী নীরবতা
অজ্ঞাত ভাষায় আলোলতা
সাজিয়ে জানিয়েছিল আসবে সে পুনরায় এই
সহায় সম্বলহীন কবির ডেরায়। আমি সেই
যুগ যুগ ধরে প্রতীক্ষায় আছি তার। মধ্যরাত
অব্দি জাগরণে তীব্র পুড়ি, যদি সে হঠাৎ
কোনও রাতে এসে ফিরে যায়। মিলনের সেই ক্ষণ
ব্যর্থতায় মিশে যায়, বড় ধুধু মরুভূমি মন!
১৬.৩.২০০০

ধোঁয়াশার ভেতর যেতে যেতে

ধোঁয়াশার ভেতর যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে হাতে ছুঁয়ে ঠাওর
করতে পারিনি দরজাটা কাঠের, লোহার না পাথরের। স্পর্শ
বিলক্ষণ বুঝিয়ে দিলো দরজা খুব শক্ত কোনও পদার্থ দিয়ে তৈরি।
ভেতরে প্রবেশ করা তেমন সহজ হবে না। কোনওরকম ফাঁক-ফোকর
নেই, ওপর-চালাকিও নিষ্ফল। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও ভেতরে
প্রবেশাধিকার মিলবে কিনা, বলা মুশকিল। কড়া নেই যে খুব জোরে
নাড়বো। চেঁচিয়ে মরলেও কেউ শুনবে না। এখানে ধাক্কাধাক্কি
করাটা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। অপেক্ষা, শুধু অপেক্ষা করা
ছাড়া গত্যন্তর নেই।

অনেক প্রহর নিশ্চুপ কাটাবার পর চেয়ে দেখি, দরজাটা দরাজ
দিলে খোলা, ওর অস্তিত্বে আমন্ত্রণের ভাষা। প্রবেশ করতেই
আমাকে চুম্বন করে নানা ভাষার বর্ণপরিচয়ের আদ্যাক্ষর।
আমাকে দেখে ‘অ’-র কী আনন্দ, কী নাচানাচি চারদিকে, ওর কণ্ঠে
বসন্তবাহারের তার। আমিও আমার আত্মার আত্মীয়কে দেখে
ফুটতে থাকি ফুলের মতো। হঠাৎ সেখানে হাজির হয় পশুরাজ
সিংহ, তাকায় আমার দিকে, চক্রাকারে ঘুরে আমার ধূলিধূসর
বিনীত পোশাক শুঁকে কোথায় চলে যায়।

সামনের দিকে আমার এগিয়ে চলা। আমাকে ঘিরে ধরেছে
মেঘদল, মেঘমল্লারের সুর। মেঘদল কী এক গভীর বোধ আমার
মনে জাগিয়ে তোলে। ভাসমান মেঘের পেছনে পেছনে হাঁটি আর
কিয়দ্দূরে পৌঁছে দেখি কী প্রচণ্ড ভিড়। পাঁচমিশেলী কণ্ঠস্বরে সেই
পুষ্পিত বাগান গমগম করছে। হঠাৎ এক আশ্চর্য নীরবতা। বাক্যহারা
সব ধীমান, পণ্ডিত, পদ্যকার। আমি জড়োসড়ো দাঁড়িয়ে থাকি দূরে
এক কোণে। আশ্চর্য সেই উদ্যানে এক নারীর আবির্ভাব। তিনি আমাদের
চেনা এবং অচেনা। তার হাতে অনিন্দ্যসুন্দর এক বীণা, পায়ের কাছে
তুষারশুভ্র হাঁস। অপরূপ সুন্দরী সেই নারীর মুখে দেবী সরস্বতীর
আদল। ধীমান, জবরদস্ত বিদ্বান এবং পণ্ডিতদের অতিক্রম করে তিনি
এগিয়ে এলেন দীনবেশে দাঁড়ানো, বেজায় সঙ্কুচিত আমারই কাছে। মৃদু
হেসে আমাকে তাঁর হাঁসের একটি পালক দান করলেন। আমি বিস্ময়
এবং আনন্দের মাত্রাবৃত্তের মতো স্পন্দিত।
১৩.২.২০০০

 নববর্ষের শুভেচ্ছা

দুনিয়াটি প্রতিদিন তাঁর কেমন নতুন লাগে,
আসমান, মাটি, নদী, নক্ষত্রের দল
যদিও প্রকৃত একই, একই পাখির কোরাস, তবু
নতুনের ছোঁয়া থাকে প্রত্যেকের আপন সত্তায়। তিনি
সকালে হাঁটার কালে সুস্নিগ্ধ হাওয়ায়
দুলে-ওঠা গাছ, বাগানের নানা ফুলের যৌবন,
শ্রমজীবী মানুষের পথচলা গভীর আগ্রহে দেখে নেন
প্রায় প্রতিদিন, আর পাখির উড়ালে
নিবিড় করেন পাঠ প্রগাঢ় গ্রামীণ কোনও গাথা।

যতদূর জানি নববর্ষের প্রথম দিনে তিনি
আনন্দিত ঢেউয়ে ভেসে নিকট অথবা
কিয়দ্দূর থেকে আন্দোলিত গাছপালা, ফুল-পাখি,
চেনা কি অচেনা সবাইকে স্মিত মুখে
জানান অভিবাদন, তাঁর
সুন্দর শুভেচ্ছা পৌঁছে যায় দোরে দোরে এমনকি
হাসপাতালের প্রত্যেকটি বেডে, কুষ্ঠরোগীদের
দগদগে ক্ষতে!

বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি
এবং মুসলমান, যারা নির্বিবাদী, সকলেই
ছিলেন প্রণত তাঁর সদাচারী মনুষ্যত্বে। যেদিন ব্যক্তিটি
রইলেন পড়ে একা রক্তমাখা পথের ধুলায় বছরের
প্রথম দিবসে, হায়, আনন্দবিহ্বল কোনও মানবসন্তান
আসেনি কিনটে তাঁর, শুধু গাছপালা, আসমান, মেঘমালা,
একঝাঁক পাখি, ধুলোমাটি, দীর্ঘ গলি,-
জানালো অভিবাদন বছরের প্রথম দিনের শুভেচ্ছার
কিছু বাণী অলক্ষ্যে সবার।

এবং ব্যথিত মূক বস্তুজগতের প্রাণে প্রশ্ন জেগে রয়-
কারা ওরা, কোন্‌ পশুদল যারা, হায়,
করেছে হরণ তাঁর মহান জীবন,
যিনি কারও বাড়া ভাতে কোনওদিন ছিটোননি ছাই!
৬.৪.২০০০

নাকি শুধু হিমযুগ

তাকে কি নিশুতি রাত ডেকেছিল? নাকি সমুদ্রের
তরঙ্গের ধ্বনি তার কানে ঢেলেছিল
জলকন্যাদের কোনও মোহময় গান?
নইলে কেন শহুরে বাড়ির সুসজ্জিত বড় ঘরে
কাউকে কিছু না ব’লে মধ্যরাতে কেমন নিশ্চুপ
নিঃসাড়, শীতল হয়ে গেলেন হঠাৎ?

আঙুলের ফাঁকে ছিল আধপোড়া, নেভা সিগারেট,
টিপয়ে ফতুর গ্লাশ, ঈষৎ কুঞ্চিত নিরুপায়
রাতের পোশাক গায়ে। নানান হুইস্কি, ওয়াইন,
ভদকা, বীয়ার ইত্যাদির সারি সারি
সাজানো বোতল ছিল মাথার ওপারে,
পারেনি বাড়াতে ওরা সাহায্যের হাত তার দিকে,
এরমই নৈর্ব্যক্তিক সহচর তারা।
বাড়ির বাসিন্দা যারা তারাও নিদ্রার
সাগরে ছিলেন ডুবে, কিছুতে পাননি টের তার
প্রস্থানের নিঝুম প্রহর।

বিবাহিত সেই পুরুষের পুত্রেরাও বিবাহিত, কেউ কেউ
সন্তানের পিতা আর উপার্জনক্ষম।
নিশ্চুপ গেলেন যিনি গভীর নিশীথে,
সমর্থ শরীরে তার মিশেছিল গৃহিণী ছাড়াও
ভিন্ন নারীদের স্বেদকণা দিব্যি রমণের কালে- প্রকৃতই
সংসারে ছিলেন সুখী, না কি
ভীষণ অসুখী-
বোঝা ছিল দায়। তার ঠোঁটে অনেকেই
দেখেছে হাসির রেখা খেলে যেতে বহুবার আর
প্রিয় বন্ধুমহলে আমুদে লোক বলে ছিল খ্যাতি।

যখন গেলেন তিনি অকস্মাৎ, তখন দু’চোখে তার কোন্‌
দৃশ্য উঠেছিল ভেসে? ভেসে উঠেছিল
গৃহিণীর মুখ? কোনও সন্তানের মুখ?
তাকে কি অন্তিম ক্ষণে খুব আলোড়িত
করেছিল কোনও বান্ধবী চুম্বনের স্মৃতি? না কি
এসব কিছুই নয়, শুধু হিমযুগ এসেছিল নেমে চোখে?
৩.১.২০০০

নিজস্ব চাষাবাদ সম্পর্কিত

যদি খনি শ্রমিকের মতো
নিজেকে না খুঁড়ি কিংবা ডুবুরির মতো
অতলে ডুব না দিই শস্যহীন ক্ষেত হয়ে আমি
খাঁখাঁ করি সারাক্ষণ। এরকম হয় বারবার।

কখনও মুষড়ে পড়ি খুব, মনে হয়
ফসলের মরশুম আসবে না কোনওদিন আর
ভুলেও এমন বিরানায়। এরকম
যখন আমার হাল, কতিপয় বিকট শকুন
কে জানে কোত্থেকে উড়ে এসে
আমাকে ভীষণ ঠোকরাতে থাকে, যেন বা পুরনো
কোনও প্রতিশোধ নিতে চায়
হঠাৎ সুযোগ পেয়ে। যদি খরায় জবরদস্তি
ফসল ফলাতে যাই, নিশ্চিত উঠবে হাতে শুধু
অবাঞ্ছিত নুড়ি, আর আমি বিফল, ফতুর চাষী
হয়ে মাথা কুটবো জমিনে শতবার। রোদে পুড়ে
গ্রীষ্মকালে, বৃষ্টির বর্শায় বিদ্ধ হয়ে বর্ষাঋতুতে অপেক্ষা
করি একটানা বহুদিন
যদি পুনরায় হেসে ওঠে নতুন সম্ভারে পোড়ো জমি।

তখন আকাশ কালো করে নামবে না শকুনের
ঝাঁক আর আমার জমিনে,
যা আমার ঘামে নেয়ে হয়েছে উর্বরা-ধৈর্যময়
অপেক্ষাও সাধনা, জেনেছি শেষে ঢের মূল্য দিয়ে।

 নিশীথের দয়াল প্রহরী

খুব রাত করে ফিরে এলে গাঢ় নিশীথের গার্ড
জানায়, সিঁড়িতে বহু ঘণ্টা হাতে একতারা নিয়ে
কে বাউল বসে বসে শেষে
খাঁচার ভিতর
অচিন পাখির গান গাইতে গাইতে নিয়েছেন
সুদূরে বিদায়। পরদিন ফের প্রগাঢ় রাত্তিরে
ফিরে শুনি নৈশপ্রহরীর
নিবিড় বয়ান এক পাঞ্জাবিতে রক্তের প্রখর দাগ নিয়ে
আলাভোলা একজন ধানসিঁড়ি নদীটির তীর,
কলকাতার হন্তারক ট্রামলাইনের চোরা মার
বয়ে নিয়ে ঢের পায়চারি করে মিলিয়ে গেছেন
আখেরে কুয়াশা-সমুদ্দুরে।

অন্যদিন পাহারাদারের হাতঘড়িতে গভীর
রাত্তির, তিনটে বাজে, ফিরে আসি বড়ই নিঃসঙ্গ
বাসার গেটের কাছে। আজ যে অতিথি অপেক্ষার
সূঁচের খোঁচায় ক্রূদ্ধ হয়ে গেলেন রিল্কের অনুবাদগ্রন্থ ভুলে
ফেলে রেখে ভেজা ঘাসে, তিনি সুনিশ্চিত
বদ্ধদের বসু।

এক রাতে প্রগাঢ় প্রহরে নিশীথের
দয়াল প্রহরী জাদুবলে অনুপম নায়ের প্রবীণ মাঝি
হয়ে বৈঠা বেয়ে আমাকে সুদূর
তটের সংকেত দিয়ে সিদ্ধির আলয়ে
নিয়ে যেতে চায়, আমি আখেরে পৌঁছুতে পারি কিনা
হিংস্র ঢেউ উজিয়ে, জানি না; জানবো না কোনওদিন।
১৯.৩.২০০০

 পথ জাগে

নিজের জীবন নিয়ে মেতেছি জুয়োয় বারবার;
খোলামকুচির মতো দিনগুলি কীভাবে উড়িয়ে
দিয়েছি, পাইনি টের। আজ
বসে আছি এককোণে সহায়সম্বলহীন শ্রান্ত
পথিকের মতো
ভীষণ একাকী; হাত বেয়ে ওঠে পোকামাকড়েরা,
কখনও কুকুর এসে গা শোঁকে, নীরবে
চলে যায়, কয়েকটি পাখি মাঝে-মধ্যে গান গায়।

ফতুর জুয়াড়িটিকে মৃত্যু আড়চোখে
দেখে নেয় কখনও সখনও। আচানক
কী খেয়ালে খুব কাছে ঘেঁষে
সম্মুখে বিছিয়ে দেয় পাশা আর ঘুঁটি। এ খেলায়
প্রায় হেরে যেতে যেতে জিতে
নিই দান, জানি না কখন
পরাজয় মেনে নিতে হবে কোন্‌ ঘাটে। অকস্মাৎ
কী এক ঝাঁকুনি দেহমন থেকে শ্রান্তির সকল
ধুলোবালি ঝেড়ে ফ্যালে। উঠে
দাঁড়াই, দৃষ্টীতে আভাময় পথ জাগে।
১৫.২.৯৭

পথের পাঁচালি

অনেকেই যারা নানা পথে হাঁটে, তারা সকলেই
এতদিনে জেনে গেছে একাকী লোকটা, একমাথা
শাদা চুল যার, এই একটি পথেই হাঁটছেন বহুকাল।
অন্য কোনও পথে তাঁকে কখনও যায় না দেখা। তা’হলে কি তিনি
আলাদা রাস্তার খোঁজ রাখেন না? না কি বৈচিত্র্যের
প্রতি নেই কোনও টান? আখেরে উৎসুক এক যুবা
গোধূলি-রঙিন সেই প্রবীণকে পথের কিনারে প্রশ্ন করে
সম্ভ্রমে সালাম জানাবার পর, ‘জনাব, কেবল একই পথে
পথচারী হয়ে রইলেন কেন? কেন ভিন্ন কোনও পথ খুঁজে
চিনে নিতে এরকম অনাগ্রহ আপনার?’ সে প্রবীণ ধীর কণ্ঠস্বরে
নবীনের উদ্দেশে বলেন, ‘শোনো বন্ধু, আমার এখনও ঢের
কিছু অপঠিত রয়ে গেছে এ পথের; মন-আলো-করা কত
গহন সুন্দর এতকাল পরেও দৃষ্টির অগোচরে, হায়,
করছে বিরাজ। এ জীবনে দেখাই হবে না সম্ভবত। তবু
নিত্য হাঁটি বড় একা একটি পথেই ঝুঁকে ঝুঁকে
নিষ্প্রভ দু’চোখ, যতদূর পারি, অতিশয় কষ্টে জ্বেলে রেখে।‘
১০.৪.২০০০

 পাশা খেলা

দীর্ঘকাল আগে এক পড়ন্ত বেলায়
কে যেন আমাকে আচমকা
ছুঁড়ে দিয়েছিল জাফরানি মেঘের ভেতর।
ভেসে যাচ্ছিলাম কোন্‌ অচিন এলাকায়, তার নাম
বলা অসম্ভব ছিল আমার পক্ষে। মেঘের বানে
ভিজে যাচ্ছিল আমার সত্তা।

তারপর কী-যে হলো, স্থৈর্যের আঁচলের, আড়াল থেকে
আমাকে বের করার নীরব উৎসবের
উপক্রমণিকার আয়োজন। আমার ভেতর সকালসন্ধ্যা,
এমনকি মধ্যরাতের স্তব্ধতার মুহূর্তেও
প্রবল ছটফটানি। গাছের পাতা, পথের ধুলো,
দমকা হাওয়া আমার সঙ্গে কীসব কথা বলতে শুরু করে।

এরই মধ্যে একদিন দূর থেকে এক অপরূপা রূপসী,
যার চোখে কৌতুকমিশ্রিত নির্দয়তা
খেলা করছে, আমাকে ডেকে বললেন,
‘এসো, আমরা দ্যূতক্রীড়ায় কিছু সময় কাটাই’। আমি যে
এ খেলায় একেবারেই আনাড়ি, তাকে
তোতলাতে তোতলাতে জানালাম।

সেই অনন্তযৌবনা রূপসীর হাতে আশ্চর্য এক বীণা,
পায়ের কাছে অনুপম শাদা হাঁস। তিনি হাসিমুখে
আমার সামনে বিছিয়ে দিলেন পাশা খেলার
সরঞ্জাম। চোখ-ধাঁধানো ছক আর ঘুঁটি দেখে
আমার প্রায় মূর্ছা যাওয়ার হাল। কী করে
খেলবো আমি যে এ খেলার কোনও রীতিনীতিই জানি না!
প্রতিপদে লেজেগেবরে করে ফেলছি, লজ্জায়
কাটা যাচ্ছে মাথা, নিমেষে বারবার
হার মেনে নিতে হচ্ছে ভুল চালহেতু। বহুদূর
থেকে এক জ্যোতির্ময় আস্তানায় বসে হাসছেন
চণ্ডীদাস, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ
এবং আরও কজন। কারও কারও মুখে বেদনার রেখা।

এই পাশা খেলার হারতে হারতে আমার কালো চুল
কবে যে ধবধবে শাদা হয়ে গেল,
মুখের চামড়া গেল ভীষণ কুঁচকে , টেরই
পেলাম না। বুঝতে এতটুকু ভুল হলো না,
সেই নিষ্ঠুরা, অপরূপ রূপসীর হাত থেকে
নিস্তার নেই। পাশা খেলা চলতেই থাকবে
ঘুমে ডুবে না-যাওয়া অব্দি। শেষ খেলার
বিজয় আমার মাথায় চুমো খাবে কিনা, অজানা রয়ে যাবে?

হার জিৎ যা-ই হোক, বিলাপ অথবা উল্লাস
কারও পথে হাঁটবো না। অন্তত
গৌরবের কিছু গুঁড়ো সত্তায় ছিটানো
রয়েছে ভেবে বাইবো বিনীত খেয়া।
৪.৫.২০০০

প্রণতি জানাই

এই যে আমার দু’চোখের ক্লান্তি মুছে ফেলে
সবুজ গাছপালা, ফসলের মাঠ,
নানা রঙেন পথ, পালতোলা নাওয়ের এগিয়ে চলা
হাওয়া-স্পন্দিত বাঁশপাতা,
সর্ষে ক্ষেতে গ্রামীণ কিশোরীর প্রজাপতি ধরার জন্যে
আভাময় ছোটাছুটি, দিঘির ঘাটে
তৃষ্ণার্ত পাখির জলপান, কী করে ভুলব এদের
বদান্যতা! এই নিসর্গ, এই জীবনের স্পন্দন,
যে দেশে প্রস্ফুটিত, আমি সে দেশের অধিবাসী।

যে দেশে বইছে মেঘনা পদ্মা, সুরমা,কর্ণফুলি,
যে দেশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গারো পাহাড়,
যে দেশে গাড়িয়াল ভাইয়ের কণ্ঠে
মঞ্জরিত ভাওয়াইয়া, যে দেশের মাঝি জোৎস্নারাতে
গায় ভাটিয়ালি, যে দেশে ঝঙ্কৃত হয়েছে
লালন ফকিরের একতারা, বেজেছে হাসন রাজার ঢোল,
যে দেশের বাতাসে ভাসে রাধারমণের গান,
আমিসে দেশের মানুষ।

যে দেশে সূর্য সেন জন্ম নেন,
যে দেশে সালাম বরকত প্রাণ দেয়
মাতৃভাষার জন্যে, যে দেশে আসাদের শার্ট
ভিজে যায় রক্তে, যে দেশে নূর হোসেনের বুক
ঝাঁঝরা হয়ে যায় বুলেটে,
যে দেশে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে তিরিশ লক্ষ শহীদের
রক্তের ছোপ, যে দেশের মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তির গান গেয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশের হৃদয়ে
আমি সে দেশের মানুষ।

আমার স্বদেশ যখন সন্ত্রাসী এবং জঙ্গী মৌলবাদীদের
হুঙ্কারে প্রকম্পিত, যখন ফতোয়াবাজদের
নিপীড়নে প্রাণ হারায় বাংলা-মায়ের দুহিতারা,
তখন ঘৃণায়, ক্ষোভে নিজেরই হাত কামড়াই, এবং
সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদের ফণা
কচলে দেওয়ার জন্যে যার কণ্ঠস্বর
আগুনের অক্ষরের মতো ঝলসে ওঠে, তাকে জানাই প্রণতি,
তার বয়স আঠারো হোক কিংবা আশি।
২.১.৯৬

প্রতারিত পথচারী

সারাদিন একা পথ হেঁটে হেঁটে লোকটা দাঁড়ায়
এসে এক স্নিগ্ধ সরোবরের কিনারে আর ত্বরিত বাড়ায়
দু’হাত মেটাতে তৃষ্ণা। টলটলে জল
অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ছুঁতেই নিমেষে
ঝরে যায়। অতিশয় লোনা জলরাশি খলখল
ডাইনির মতো ওঠে হেসে!
১৫.৩.২০০০

প্রতিদ্বন্দ্বী

অনেক পরে তোমার জবানিতে শুনেছি-
তুমি আমাকে প্রথম দেখেছিলে কিয়দ্দূর থেকে
জাতীয় যাদুঘরে মৃণাল সেনের
চলচ্চিত্র উৎসবে। মিলনায়তনের বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম
অপেক্ষমাণ। আমার গায়ে ছিল পাঞ্জাবি, পশমি শাল আর
ট্রাউজার্স; পায়ে চপ্পল, চোখে পুরু লেন্সের চশমা।
তুমি ছিলে আদূরে নিজস্ব সৌন্দর্যলীনা,
অথচ রয়ে গেলে আমার না-দেখার ওপারে।

সেদিনই আমাকে ভালো না-বেসেও
আমার একটি স্কেচ তুমি রচনা করেছিলে
মনের বুদোয়ারে, হয়তো অজান্তেই
স্কেচটির প্রতি মঞ্জরিত হয়েছিল তোমার অনুরাগ।
ক্রমান্বয়ে সেই স্কেচ হয়ে উঠল
পূর্ণাঙ্গ এক প্রন্টিং। চিত্রটি যার আদলে সৃষ্ট,
তাকে ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এলো
তোমার একান্ত ঘাটে, যেখানে তার জন্যেই
অপেক্ষা করছিল ফুলশাখার দোল, বুলবুলির গান,
ময়ূরের নাচ এবং প্রেম-উদ্‌ভাসিত দীপাবলি।

তুমি তোমার রচিত চিত্রের সঙ্গে আমার
অবিকল মিল দেখে পৌঁছে গেলে
মনোজ এল দোরাদোয়। তোমার যৌবনের তরঙ্গভঙ্গে
আনন্দের অবিশ্বাস্য রঙধনু দেখে যুগপৎ উল্লসিত এবং
ঈষৎ শঙ্কিত হলাম। আমাদের দীর্ঘ মধুচন্দ্রিমায়
রাহু কালো ছায়া ফেলবে না তো তস্করের চাতুর্যে?
এখন তুমি তোমার মনোজ যে-সৃষ্টি আমি, তাকে
আর এই প্রকৃত আমি-কে দেখছ খুঁটিয়ে; ঘুরে ফিরে
করছ তুলনা, আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছ আমার নিজেরই বিরুদ্ধে।
এখন আমি নিজেরই অসম প্রতিদ্বন্দ্বী। তোমার রচিত
চিত্রের কাছে পরাজিত হচ্ছি বারবার; মতাদর্শের সংঘর্ষে তোমার
ধিক্কার এবং ঘৃণার লুপ্তপ্রায় আমার প্রকৃতি।

তোমার রচিত আমার প্রতিকৃতি থেকে খসে খসে
পড়ছে রঙ; চোখ, নাক, কান উধাও।
এই মুহূর্তে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে
তুমি দেখছ কনিষ্কের মূর্তি-নিঃসঙ্গ, ভাঙাচোরা।
২.৯.৯৬

প্রশ্ন

ঠিকানা কই? দিন তো গেল,
এদিকে যে লাফ দিয়েছে সন্ধে।
বেলা গেল মনের সঙ্গে
বিড়বিড়িয়ে কথা বলেই ছন্দে।
কোথায় যাবো? নাড়বো কড়া
খোলা মনে কোন্‌ সে পথের প্রান্তে?
তাহলে কি ব্যর্থ হবোই
সত্য এবং সুন্দরকে জানতে?
১৬.৩.২০০০

বাগবানের গান

আমাকে অকালবৃদ্ধ অনেকেই ভাবছে এখন
এবং কেমন করুণার ভঙ্গি থাকে,
তাদের আচার, আচরণে যেন আমার দুর্দশা
সহমর্মীদের রাত্তিরের ঘুম করেছে হারাম!

একটি বাগান আমি বানিয়েছি ঢের খেটেখুটে, আস্তেসুস্থে
নানান ফুলের চারা লাগিয়েছিলাম
সুন্দরের সাধনায় মগ্ন হয়ে। ডালে ডালে রূপ
ঝরিয়ে ফুটেছে মহানন্দে অগণিত ফুল, সুঘ্রাণে হয়েছে
প্রগাঢ় মাতাল দশদিক। কিন্তু হায়, আচানক
কিছু ফুল অকারণ অতি দ্রুত শুকায় এবং কিছু ফুল
পোকার দখলে চলে যায়। বাকিগুলো
ছিন্নভিন্ন মুর্দা হয়ে মাটিতে লুটায় তুফানের আস্ফালনে।

আমাকে বিষণ্ন করে সুন্দরের মহাদান এবং আমার
শ্রমের অনন্য প্রসূনের
এমন করুণ পরিণতি। তা’হলে কি শেষমেশ
মাথায় অবশ হাত রেখে
থাকবো নিশ্চুপ বসে না, তা কস্মিনকালেও
ঘটতে দেবো না। ফের বিধ্বস্ত জমিনে
চালাবো খুরপি পুরোদমে, ফের সাজাবো বাগান অপরূপ,
ধুলোয় মিশিয়ে দিলে ঝড় ফুলগুলো পুনরায়, তবুও থাকবো বাগবান।
১২.৪.২০০০

বিনিদ্র রাত

বিনিদ্র রাত, তোমার কাছেই কৃতজ্ঞ আমি
জানি তুমি সেই ভীষণ কাফ্রি সুন্দরী, যার
ওষ্ঠে রয়েছে তরল গরল, যার ছোঁয়া পেলে
সহজে কখনও হারায় না কেউ জীবনের তাপ।

কিন্তু তোমার সঙ্গে নিত্য মিলনে হঠাৎ
হয়ে যেতে পারে ঘোর উন্মাদ, বিড়বিড় করা;
কেউ দিনরাত টকটকে লাল চোখ নিয়ে শুধু
বড় নিশ্চুপ থাকবে বন্দী জাগরণে, একা।

বিনিদ্র রাত, তোমাকেই তবু মেনেছি প্রেমিকা,
আমার নৌকা ডোবার জেনেও তোমার দু’হাতে
সঁপেছি বৈঠা, মেতেছি ভীষণ নৈশভ্রমণে-
তোমার চুমোই আনে কবিতার প্রবল জোয়ার।
৭.৪.২০০০

বেদনার্ত কবি

সামান্য কজন লোক বিংবা মত্ত ভিড়
কখনও কবির জামা ছিঁড়েছুড়ে অথবা শরীর
জখ্‌মি করে কেল্লা ফতে হলো ভেবে হয় মশগুল,
ভব্যতার আসর ভণ্ডুল
করে হৈ হৈ গর্বের চূড়ায় বসে তুড়ি
বাজায় বাজারে আর সন্ত্রাসী হাতুড়ি
নিয়ে মেতে থাকে সারাক্ষণ,
বেদনার্ত হন কবি আর হয় পীড়িত মনন।
১৫.৩.২০০০

ভাষাশহীদের রক্তধারায় পুষ্পবৃষ্টি

আন্দোলনে সমর্পিত ছিল মনপ্রাণ, অথচ শরীর ছিল
ভয়ঙ্কর থাবার দখলে বহুদিন। ফলে সভা,
মিছিল, শ্লোগান থেকে দূরে, বহুদূরে
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হুহু কেটে গেছে। বারান্নোর ফেব্রুয়ারি জুড়ে
শয্যাগত ছিলাম একাকী; ঘন ঘন জ্বরে পুড়েছে শরীর। অসহায়
দেখেছি জ্বরের ঘোরে আমার নিজের ঘরে ন’জন রূপসী
আসেন নিভৃতে কিছু নাচের স্বর্গীয় মুদ্রা দেখিয়ে এবং
গান গেয়ে মিশে যান মেঘের রেশমে। দেখতাম
পিতা গায়ে শেরওয়ানি চাপিয়ে, মাথায় মখমলী টুপি পরে
যাচ্ছেন নিজস্ব প্রেসে, মা হেঁসেলে রান্নাবান্না সেরে
আমার কপালে হাত রাখছেন জ্বরের সন্ত্রাস বুঝে নিতে।

দেখতাম বারান্দায় কখনও কখনও বসে আছে
একটি কি দুটি কাক, মাঝেমাঝে হঠাৎ দুপুর-চেরা ডাক
দুপুরকে আরও বেশি ঝাঁঝালো বানিয়ে দেয় আর
ক্ষয়িষ্ণু দেয়াল বেয়ে পিঁপড়ের কারাভাঁ চলে যায়,
যেন দীর্ঘ কালো রেখা শিল্পীর তুলির। ট্যাবলেট,
ওষুধের ফ্যাকাশে ফাইল,
চকিতে ঘুলিয়ে তোলে হরিদ্রাভ বিবমিষা আমার ভেতর।
চোখ বুজে থাকি কিছুক্ষণ, হাবিজাবি
কীসব বেয়াড়া ঘোরে করোটিতে। কিয়দ্দূরে যেন
ডেকে ওঠে ফাল্গুনের প্রচ্ছন্ন কোকিল।

তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম, হঠাৎ ঝাঁকুনিতে চোখ খুলি-
আমার চৌকির পাশে জননী জায়নামাজে মগ্ন সিজদায়। বারান্দায়,
হায়, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’
কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলে ছয়টি লোমশ হাত, দেখি
কালজয়ী বাগানকে ভাগাড় বানাবে বলে যারা তারা নিজ
গর্ভধারিণীকে কলঙ্কিত করে দ্বিধাহীন প্রহরে প্রহরে।
জ্বরে পুড়ি দিনরাত; আমার প্রথম প্রেমদাহ, ভস্মরাশি,
প্রণয়ের পদাবলি, ছাত্রদের দৃপ্ত সভা, শ্লোগান, গ্রেপ্তারি
পরোয়ানা, মিছিল, বুলেটসম্বলিত ডায়েরি পুড়িয়ে ফেলি
বোবা ক্রোধে। প্রেস থেকে ফিরে বাবা বলেন জ্বলন্ত গোধূলিতে,-
“বাংলাভাষা রক্তচেলি পরে হাঁটে রাজপথে নক্ষত্রখচিত
পোস্টার-শোভিত হাতে, হাওয়ায় উদ্দাম অগ্নিশিখা-কেশরাশি!”
কারা যেন আমাকে সফেদ মেঘে মুড়ে
রক্তপোশসহ আসমানে নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের গানে,
নজরুলী গজলের তানে, লালনের
একতারা-সৃষ্ট সুরে কী কুসুম ফোটে
মেঘের নানান স্তরে, শূন্যের মাঝার-
দেখে দেখে চোখ হয় বসন্তবাহার
এবং হৃদয় শান্তিনিকেতন।ঘোর কেটে গেলে
শুক্‌নো গলা, জিভে তেতো স্বাদ, মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যেতে চায়।
বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিময় বড় বেশি জ্বর ছিল; বন্ধ্যা ক্রোধে,
ঘেন্নায়, কম্পনে বন্দী আমি, আমার ভায়ের তাজা রক্তধারা
রাজপথ থেকে ছুটে এসে আমার সে চৌকিটিকে
নিমেষেই ভাসানে পাঠায় আর বিদ্যাসাগরের
‘বর্ণ পরিচয়’ আর ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ শহীদের শোণিতধারায়
অবিরাম পুষ্পবৃষ্টি করে।
১২.২.২০০০

ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য নিয়ে

পুলকিত বেড়ালের ঘাড়ের রোঁয়ার মতো মেঘ
আকাশকে আদর করছে দেখে আমার ঘরের
জানালাটা কেমন মদির চোখ দিয়ে
অনুরাগ পৌঁছে দিতে চায়
পাশের গাছের মর্মমূলে। অকস্মাৎ গাছটির
অস্তিত্বে মধুর আলোড়ন
এবং নিবিড় জাগরণ শূন্যতার
স্তব্ধতায় একরাশ ফুলের সুরের, কোকিলের
তানের সংগত। জানালাটা যেন ওর
বিবর্ণ প্রবীণ সত্তা ভুলে স্বপ্নাবেশে ভেসে যায়।

জানালার কাণ্ড দেখে অবাক হইনি মোটে, শুধু
চেয়ে থাকি আকাশপাতাল ভেবে ভেবে
গাছটির যৌবনের প্রেমময় রাগিনীর মতো
সংহত উচ্ছাস লক্ষ করি, হৃদয়ের
অনেক গভীরে ভেসে ওঠে একটি ময়ূরপঙ্খী নাও,
কয়েকটি অনিন্দ্যসুন্দর মাছ, কামিনীর হাতে
প্রস্ফুটিত অজস্র গোলাপ, তিনজন
কোকিল কাউকে ডেকে আনার তাগিদে
ক্রমাগত সুর হয়ে প্রবল নাচিয়ে তোলে ময়ূরপাঙ্খীর
ইতিহাসটিকে, আমি সেই ইতিহাসে
কী করে যে মিশে যাই, হয়ে উঠি অন্য কেউ দূর
অতিদূর কোনও এক আলাদা কালের।

এ আমি কোথায়, হায় কোথায় এলাম? অতিদূর
হলেও সুদূর নয়। খরাপীড়িত চৌচির ধুধু মাটি, যেন
একফোঁটা পানিও পায়নি বহুকাল। কোথাও কোথাও তার
প্রখর হলুদ ঘাস জেগে আছে ফাল্গুনের আগুনের মতো।
হলুদ ঘাসের অন্তরাল ভেদ করে
অজস্র কঙ্কাল জেগে আছে অনন্য উৎসবে এক, সবদিকে
অদৃশ্য হরফে যেন আছে লেখা বসন্ত-উৎসব। অগণিত
কঙ্কাল জাগ্রত খুব, করোটির চক্ষুহীন চক্ষু নিয়ে,
তাদের অত্যন্ত ঋজু শুকনো খটখটে হাড়ে আছে
অবিশ্বাস্য শস্যরাশি স্বপ্নের ধরনে আর মুঠোর ভেতর
বাংলার বসন্ত ঋতু দোলে ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যে এবং
দুলতে থাকবে ইতিহাসে নব্য ফাল্গুনের দীর্ঘ প্রতীক্ষায়।
৩.৪.২০০০

মহাপৃথিবীর রাগমালা

প্যারিসের জনস্রোত, যানস্রোত, ইতিহাস-দীপ্ত হর্ম্যমালা,
পথঘাট, মিউজিয়ামের ঘটা, বোবস্‌পীয়ার,
বোদলেয়ার ও জাঁ-পল সার্ত্রের নানা স্মৃতি-উন্মুখর
রেস্তোরাঁ, শেনের জলধারা থেকে দূরে সিমুরের
সবুজের অকৃপণ স্নেহস্পর্শে প্রকৃতি আপন অন্তর্বাস
অসঙ্কোচে উন্মোচন করে।

লোকটা এখানে ছিল কোনওদিন, ছিল
প্রকৃতির খুব কাছে, ঈষৎ আলাদা
পাথরের মাঝে ছিল দিনরাত, কেটে গেছে তার
জীবনের বেশ কিছু দিন ছেনি আর হাতুড়ির
তন্ময় আঘাত হেনে পাথরের বুকে খুঁজে নিতে সুন্দরের
নানা মূর্তি। গুহাবাসী মন গড়ে তোলে
পাথরেই নান্দনিক ভিন্ন রূপ মানসের আর কী বিপুল
সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকে নিত্য বেপরোয়া মাতালের মতো।

লোকটা দেখতে ছিল টাইটান, সুপ্রচুর খাদ্য আর
অঢেল মদিরা রোজ হতো জঠরস্থ
অথচ সচল ছিল প্রায় হামেশাই
হাতুড়ি ও ছেনি, চার বছরের প্রতি দিনরাত্রি একাকার
লোকটার। একটানা এভাবেই কেটে যায়
কয়েকটি আশ্চর্য বছর। অবশেষে একদিন অবেলায়
শিল্প নেয় বলি, টাইটানের প্রদীপ্ত দু’টি চোখ অতি শ্রমে
বুজে আসে, থেকে যায় বুকের স্পন্দন। আর সেই
বুভুক্ষু পাহাড়ি গুহা থেকে থেকে করে উচ্চারণ,
‘শিল্প তো আদায় করে কড়ায় গণ্ডায় তার সকল পাওনা’।
সে গুহায় এখন প্রত্যহ অনেকেই যায়, কখনও কখনও
শিল্পতীর্থ ভিড় জমে খুব; কেউ কেউ বাঁকা ধোঁয়া-ওঠা
চায়ের পেয়ালা কিংবা মদিরার গ্লাস হাতে সেই
গতায়ু শিল্পীর কথা বলাবলি করে, কেউ কেউ
নোট নেয় খবরের কাগজের অতৃপ্ত উদর
ভরাট করার জন্য। শিল্পীর বিধবা পত্নী কারও কারও হাতে
কটি গুহাচিত্র গুঁজে দেন
তাজা ব্যাঙ্কনোটের সহজ বিনিময়ে। দূরে পাখি কেঁদে যায়;
গুহাস্থিত পাথরের বুক চিরে কিছু
অনন্য ভাস্কর্য ক্ষণে ক্ষণে গায় মহাপৃথিবীর রাগমালা।
১২.৫.২০০০

যখন আমি

যখন আমি গোলাপ ফুটতে দেখি,
পথ চলতে চলতে
কোকিলের গান শুনতে পাই,
যখন রাতে অনেক তারার আলো জ্বলতে দেখি,
আমার মনে জাগে আনন্দের ঢেউ,
আমার খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়।

যখন আমি মেঘনা নদীর বুকে
নাওয়ের দাঁড় টানতে দেখি মাঝিকে,
যখন সর্ষেক্ষেতে গ্রাম্য কিশোরীকে রঙিন
প্রজাপতির দিকে ছুটতে দেখি,
যখন কৃষককে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে
জমিতে লাঙল চালাতে, বীজ বুনতে দেখি,
যখন চাষীর বউ শানকিতে লাল চালের ভাত,
কাঁচামরিচ আর নুন নিয়ে খেতে বসে,
যখন কুমোর আর কামার খেটে খেটে হয়রান হয়,
যখন একদল তরুণ-তরুণী
অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে মিছিল করে,
তখন আমি বাংলাদেশের হৃদয়ের ধ্বনি শুনতে পাই।

রঙধনু থেকে যাত্রা শুরু করে

তোমার নিকট থেকে ক’টি রাজহাঁস বহুদূরে
কোথায় মিলিয়ে গেছে, অথচ তোমার
সত্তার গহনে রয়ে যায় কতিপয় ঘন ছায়া
সবার অজ্ঞাতসারে। সেইসব ছায়া গভীর নিশীথে কত
কথা বলে রূপকথা-স্বরে
নিরিবিলি একান্ত তোমার কাছে-সেসব শোনার সাধ হয়।

কখনও সেসব কথা টলটলে উচ্চারণে ঠিক
বন্দী করা অসম্ভব। ঠারেঠোরে অথবা নিঝুম
কিছু প্রকাশের কুয়াশার কাছ ঘেঁষে আনা যায়
বেলাবেলি; মরণপুরীর কিছু শৈত্যছোঁয়া নিয়ে
বারবার নতুন জন্মের ঘ্রাণসহ
হ্রদের জলজ স্মৃতি ছুঁয়ে ছেনে জাগরণ
আমাকে বিহ্বল করে। অভিনব রঙধনু থেকে
যাত্রা শুরু করে আমি মানবীর নিরালা আলয়ে
সত্বর পৌঁছুতে গিয়ে দীঘল বিলম্ব করে ফেলি। তার হাতে
হাত রাখবার মগ্ন বাসনায় নিজের কাছেই পৌঁছে যাই।

শব্দেশ্বরীর গঞ্জনা

অপরূপ পারিজাত ঝলসাচ্ছে বহু দূরে, যাকে,
ছুঁতে পারবো না সুনিশ্চিত এ জীবনে, জেনে গেছি।
এবার আমার চাই অবসব। রাত জেগে জেগে ক্লান্ত আমি আজ,
আমার মাথায় এলোমেলো চুলে পড়ে ক্রূদ্ধ টান, চোখ
কচলাতে কচলাতে দেখি শব্দেশ্বরী জ্বলজ্বলে রূপ নিয়ে
দাঁড়ান আমার পাশে। বলেন উত্তপ্ত স্বরে, পারিসনি তুই
আমার পায়ের নখও ঠিকঠাক কাটতে, হাতের
দশ আঙুলের নখ আজ অব্দি তুই
একটিও দেখিসনি ছুঁয়ে, আমার মুখের সূক্ষ্ম
এবং দুরূহতম রূপচর্চার ব্যাপার আর
উল্লেখ নাই বা করি! শব্দেশ্বরীর বক্তব্যশেষে
অবসাদগ্রস্ত ব্যর্থ আমি তার সকল গঞ্জনা
মাথা পেতে নিই। দূরবর্তী পারিজাত
অনন্য রূপের আভা নিয়ে ক্রমে অধিক সুদূর হতে থাকে
এবং আমার ঘুম পায়, বড় বেশি ঘুম পেতে থাকে।
১২.৪.২০০০

 শিরোপা

জনস্মৃতি থেকে উঠে-আসা
বহু লোককাহিনীর একটি এরূপ-
একদা সুফলা এক রাজ্যে দিকে দিকে
রটে গেল এই বার্তা, রাজা আর তার
সভার অমাত্যবৃন্দ ছাড়া কে সবচে’ ঐশ্বর্যশালী
তার বিচারের ভার অর্পিত দানেশমন্দ এক
প্রবীণের ওপর, ফলত এইমতো
একদিন শুরু হলো বহুপ্রতীক্ষিত সে বিচার।

লোক থৈ-থৈ বিচার-সভায় সমাসীন বিচারক,
প্রবীণ দানেশমন্দ; সেখানে এলেন একে একে
তিনজন সর্বাপেক্ষা বেশি ঐশ্বর্যের দাবিদার।
প্রথমজনের দাবি-সাতটি জাহাজ তার ভাসে
সপ্তসিন্ধুময় বাণিজ্যের টানে, টাকার পাহাড়
গড়েছেন তিনি সুখে নানান বন্দরে।
তার চেয়ে অধিক ঐশ্বর্যশালী নেই কেউ এই নগরে।

দ্বিতীয়জনের পদক্ষেপ ছিল খুব
ঠিকঠাক এবং গম্ভীর, তিনি বটে অগণিত
পুস্তকবিহারী আর টীকাভাষ্যে তার
জীবনের প্রতিটি প্রহর ভরপুর, ফলে তিনি
নারীর প্রণয় তুচ্ছ করে ঘর-গেরস্থালি
বিসর্জন দিয়ে থেকেছেন বিদ্যাপীঠে আর মাঠে
আজীবন; এখন এমন জ্ঞান-তাপসের দাবি-
কেবল তিনিই সর্বাধিক ঐশ্বর্যের অধিকারী।

অতঃপর বিচার-সভায় একজন আলাভোলা,
ঈষৎ বিব্রত লোক বলে নম্রস্বরে,
‘আমার জীবন লগ্ন শব্দরাজিতেই,
দেখুন আমার মুখে পায়রা, দোয়েল, বুলবুলি,
গোলাপ, মালতী, নিশীথের পথরেখা, নদনদী
জলকন্যা, বনরাজি, নক্ষত্রের ছায়া;
আমাকেই ভালোবেসে ভালোবেসে একজন নারী
প্রাণ দিতে প্রস্তুত, আমার কোনও দাবি-দাওয়া নেই।‘

প্রবীণ দানেশমন্দ বিচারক প্রত্যেকের কথা শুনে শেষে
নীরবে তৃতীয়জনকেই সর্বাধিক
ঐশ্বর্যবানের কাঙ্ক্ষনীয়
শিরোপা অর্পণ ক’রে নগ্নপদে হেঁটে যান দূরে, বহুদূরে।
১০.৯.৯৬

সপ্তর্ষিমন্ডল

কিশোরটি কেমন আলাদা যেন, হৈ চৈ থেকে দূরে
নিজেরই ভেতরকার অত্যন্ত সবুজ মুক্ত মাঠে হামেশাই
হুটোপুটি নয়, খুব আস্তেসুস্থে হেঁটে কিংবা মাঠের কিনারে
সহজে কাটিয়ে দিত একা-একা বহুক্ষণ ক্ষুৎপিপাসার
কথা ভুলে, কোনও কোনও মধ্যরাতে কিশোরের বিস্ফারিত চোখে
হঠাৎ পড়তো ধরা অপরূপ দৃশ্য এক-সে মাঠের মধ্যস্থলে বেশ গোল হয়ে
সাতজন কি নিবিড় স্থৈর্যে বসে আছেন যাদের ঘিরে ক’জন ঝাঁঝালো
নর্তকী ফোটায় নৃত্যকলার কলম শূন্য মাঠে। সাতজন
দেখেন কি দেখেন না, বোঝা দায়। কখনও কিশোর মুগ্ধতায়
লক্ষ করে, তারা যেন কী এক সুরায় ডুবসাঁতারে নিমগ্ন।

যখনই কিশোর মধ্যরাতে নিজের ভেতরকার মুক্ত মাঠে
সেই সাতজনের মণ্ডল দেখে, সে এক চকিত যাদুবলে
আশ্চর্য সৃজনশীল হয়ে ওঠে, কিছু ছবি আঁকে, ঝকঝকে
পদ্য লিখে ফেলে আর নিজেই বিস্ময়ে রুদ্ধবাক
হয়ে থাকে কিছুদিন। এ খেলায় ছিল না বিরাম বহুকাল
কিশোরের বার্ধক্য অবধি। অকস্মাৎ সবুজ সে মাঠ আর
অপরূপ গভীর রাতের সাতজনের আসর লুপ্ত হলো
হামেশার তরে আর দর্শকের সৃজনের সূর্যাস্ত এলো নেমে চিরতরে।
১২.৪.২০০০

সহমর্মিতা

আমাকে বিষণ্ন দেখে একটি অচিন পাখি এসে
নিঃশব্দে টেবিলে বসে নিশ্চিন্ত মুদ্রায়,
যেন তার কোনও ক্ষতি করবে না কবি, ভাবনাটা
এরকম। আমার মাথায় ওড়ে বহুদিনকার
তেলহীন চুল, নিরুনির স্পর্শ আজ
পড়েনি, পাখিটি দ্যাখে খুঁটিয়ে আমাকে।

পাখিও আমারই মতো ব্যথিত, একাকী
একজন, তারও আছে কিছু
বলবার কথা, যা গাছের
সবুজ পাতায়, মেঘে, রাঙা গোধূলিতে লেগে আছে।

যার সঙ্গ জীবনকে মোহনীয় করেছে, এখন
সে এখানে নেই-
এ-কথা পাখিটি নীলিমার, নক্ষত্রের
কাছ থেকে সহজে নিয়েছে জেনে, বুঝি তাই এসে
বসেছে টেবিলে সহমর্মিতার ভাষা
ঠোঁটে নিয়ে; বড় মানবিক আজ মনে হলো তাকে।
পাখিটির একাকিত্ব স্তব্ধ হয়ে রয়
আমার আপন ঘরে, টেবিলের কাঠে আর সাদা
বুকশেলফের পূর্ণতায় কবেকার
কিছু স্মৃতি খণ্ড খণ্ড কাহিনী ধারণ
করে আছে, পাখি
সেগুলো ডানায় নিয়ে উড়ে যাবে নক্ষত্রের দিকে-
কিছু মেঘে, কিছু সরোবরে
চূর্ণিত রইবে মিশে হাহাকার ব্যাপক ছড়িয়ে।

হরিণ এবং শজারু

এমন এক সময় ছিল যখন আমি বাড়িতে,
বলতে গেলে, থাকতামই না। সদর
রাস্তা, অলি-গলি পেরিয়ে যেতাম ঝাঁ ঝাঁ
দুপুর চাষ করতে করতে। প্রতিবার
নতুন রাস্তার সন্ধানে
চোখ চকচক করতো। স্বপ্নগুলোকে
গচ্ছিত রাখতাম পার্কের ঘাসে,
পথের কুকুরের কুণ্ডলী পাকানো নিদ্রায়।

এখন ঘরেই কাটে সময়। তন্দ্রা
চোখের পাতায় নেমে এলে হঠাৎ দেখি
চান্দ বিনোদ শিকার-করা কুড়াপাখি
আমার কাছে বিক্রি করার আগ্রহ প্রকাশ করে।
আমি ধমকের স্বরে ওকে বলি, স্টুপিড,
এক্ষুণি পালার নায়ক
কুড়াপাখির বোঝা বয়ে জলের ঘাটের দিকে এগোয়।

বিকেলবেলা চায়ের পেয়ালায়-চুমুক দেয়ার সময়
এক বিদ্যার জাহাজ অধ্যাপকের একটি প্রবন্ধের
কথা মনে পড়তেই হো হো করে হেসে উঠি।
গোধূলিতে লক্ষ করি, একটি কর্দমাক্ত
শজারু একজন হরিণকে খুব উত্যক্ত ক’রে
কাদায় টেনে নিতে চাইছে। অজস্র তারা
হরিণের চারপাশে ঝরতে থাকে এবং
শজারু থকথকে কাদায় মুখ ঢাকে।
২৪.৪.৯৬

Exit mobile version