Site icon BnBoi.Com

শিরোনাম মনে পড়ে না – শামসুর রাহমান

শিরোনাম মনে পড়ে না - শামসুর রাহমান

অলৌকিক বানভাসি

কখনো কখনো আমি কবিতা লিখতে গিয়ে খুব
ভয় পাই, যেন অভিমান ক’রে কবিতা ক্রমশ বহু দূরে
চলে যাবে, মনে হয়। অন্তর্গত পাতালেও ডুব
দিয়ে বারবার, মাটি খুঁড়ে
দশটি আঙুলে
দেখেছি প্রভূত হেনস্তার কালি ছাড়া
জোটে না কিছুই; ভুলে
যাই নিমেষেই সব কলাকৌশল এবং হতচ্ছাড়া
কোণে পড়ে থাকি একা, ডাকি
গলা ছেড়ে, অথচ দেয় না সাড়া কেউ চরাচরে।

মাথার ওপরে পাখি
দু’ একবার ঘুরে চলে যায় উড়ে, পাতার মর্মরে
কবিতা মিলিয়ে যায় স্বপ্নের মতন।
ভয় পেয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ
বিস্ফারিত হয়, জাগরণ
চকিতে ধরায় জ্বালা সত্তাময়; ভুলে-থাকা শোক

পুনরায় ডানার ঝাপট মারে মনে
পড়ে, ইদানীং জলকন্যা বেজায় পচনশীল,
স্বপ্নের মিনারগুলি রাহুগ্রস্ত, কালো আবরণে
ঢাকা পড়ে গেছে প্রবালের সিঁড়ি, রোদ-ধোয়া কোনো শঙ্খচিল
দেয় না চক্কর আজ দরাজ অক্ষরবৃত্তে। লাশ
পড়ে থাকে উপদ্রুত কত
নিঝুম শেয়াল-গর্তে আর পূর্ণিমার দীর্ঘশ্বাস
বয় অবিরত,
বেগানা দূরের মেঘমালা, তামাদি বটের ঝুরি।
বড় কীটদষ্ট নক্‌শিকাথাঁ, অতএব
উদোম শরীরে শুই, হাই তুলি, গ্রাম ছেড়ে ঘুরি
নির্মুখ শহুরে ভিড়ে,
নিজের ভিতরে পুড়ি। নেই কোনো পরিত্রাতা দেব
কাছে ধারে, ছড়াই নিজস্ব ভস্ম বুড়িগঙ্গা তীরে।
অকস্মাৎ সাড়া জাগে মাছেদের ঝাঁকে,
কেন যেন নতুন ক’রে আনে
বরাভয়, মনে পড়ে কবিতা বুকের কাছে বাম পাশে থাকে
স্পন্দিত সর্বদা, মাঝে-মধ্যে যদিও ভাটার টানে
দূরে সরে যায়।
ব্যাকুল বাড়িয়ে রাখি হাত
জলাশয়ে, হাটে, মাঠে লতাগুল্মে, তার প্রতি বেলা অবেলায়।
কোথাও হঠাৎ
দূর দিগন্তের বুক চিরে বাজে স্মরণীয় বাঁশি,
আসে ব্যেপে কবিতা আমার অলৌকিক বানভাসি।

অ্যাকুরিয়াম, কয়েকটি মুখ

সকালটা ছিল যে-কোনো সকালেরই মতো। টাটকা মাখন রঙের রোদ,
ফুরফুরে হাওয়ায় গাছের গাঢ় সবুজ পাতার স্পন্দন, উঠোনে একটি কি দুটি
ছোট পাখির ওড়াউড়ি, আমার ঘরকে চড়ুইয়ের নিজস্ব আকাশ বলে ঠাউরে
নেওয়া, দোতলার রেলিঙে শাড়ি, বাকরখানির ঘ্রাণ, বেডিওর গান, চা-খানার
গুঞ্জর, রিকশার টুং টাং শব্দ। আমার বেডসাইড টেবিলে ধুমায়িত চায়ের বাটি
কাচের চুড়ির আনন্দ-ভৈরবী। কি যেন মনে পড়ছিল আমার, বহুদিন আগে যে
জায়গায় গিয়েছিলাম সেখানকার কিছু দৃশ্য, কোনো কোনো মুখ। জায়গার
নাম মনে পড়ছে একটা বাগানের কথা, রঙবেরঙের ফুলে সাজানো মধ্যবিত্ত
বাগান। বাগানে কি কেউ ছিল?
ওরা চলেছে বেয়ে, ক্লান্ত পায়ে; ছায়ার মতো এগোচ্ছে ওরা শ্লথ গতিতে?
ওরা কারা? ওদের কি আমি চিনি? একজন বসে বসে ধুঁকছে, আঁকড়ে ধরেছে
আলের ভেজা মাটি। নোংরা নখের ভেতর উঠে এসেছে কিছু মাটি, ওর চোখ
ঘোলাটে। সেই ঘোলাটে চোখে ভবিষ্যতের কোনো ছবি ছিল না, বাগানের
রঙিন স্তদ্ধতা ছিল না না র্ঝনার পানির স্বচ্ছতা। সবার আগে যে হাঁটছিল,
সে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। ওর দৃষ্টি থেকে মুছে গেছে সকালবেলার রোদ,
পাখির ডানার ঝলসানি, ময়ূরের আনন্দিত পেখম। ওর ভবিষ্যতের ভাবনায়
রোদ ছিল না, মেঘের আনাগোনা ছিল। যে মেয়েটি ছেলে কাঁখে হাঁটছিল, ওর
একটা চুড়ি ভেঙে গেল হঠাৎ টুকরোগুলো পড়ে রইল আলের এক পাশে।
মেয়েটির মনের ভেতর ওর ছেলের কান্নার দাগের মতো একটা দাগ খুব গাঢ়
হয়ে রয়েছে। ভাঙা বাবুই পাখির বাসার মতো তার সংসার অনেক দূরে
সমাহিত। উনুনের মুখগহ্বরে আর ধোঁয়া ওঠে না পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ‘গেরস্থের
খোকা হোক’ বলে যে পাখি মাঝে-মধ্যে ডেকে যায়, সে হয়তো বিধ্বস্ত ভিটের
লাগোয়া গাছের ডালে এসে বসবে, কিন্তু দেখবে ত্রিসীমায় গেরস্ত নেই।

সকালটা ছিল যে-কোনো সকালেই মতো। টাটকা মাখন রঙের রোদ,
ফুরফুরে হাওয়ায় গাছের গাঢ় সবুজ পাতার স্পন্দন, উঠোনে একটি কি দু’টি
পাখির ওড়াউড়ি। সকালবেলা মধ্যরাতে রূপান্তরিত হয় এক লহমায়।
টেলিফোনে কার কণ্ঠস্বর? নিদ্রা-প্রভাবিত, স্বপ্ন-নির্ভর কণ্ঠস্বর। সেই কণ্ঠস্বরে,
নিঃসসঙ্গতা, উদ্বেগ আর বিষন্নতার অর্কেস্ট্রা। সেই কণ্ঠস্বর আমাকে পর্যটক
বানায়; আমি পাকদণ্ডী বেয়ে পাহাড়ে উঠি, জাহাজে চড়ে সাত সমুদ্র তের নদী
পাড়ি দিই, প্লেনে যাত্রা করি পূর্ব গোলার্ধ থেকে পশ্চিম গোলার্ধে; মরুভূমির
বালিয়াড়িতে সূর্যের চুম্বনে আমার ত্বক ঝলসে যায়, উত্তর মেরুর তুষার-
কামড়ে আমি জ্বরাক্রান্ত রোগীর মতো প্রলাপ বকি। সেই কণ্ঠস্বর বন্দি করে
আমাকে, আমার হাতে পরিয়ে দেয় ক্রীতদাসের কড়া। আমি কি প্রকৃত চিনি
তাকে?

তাকে চিনি, সকালবেলার আকাশকে যেমন চিনি, কিংবা যেমন চিনি সন্ধ্যার
মেঘমালাকে-একথা বলার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারি না কিছুতেই। যদি
আমার ভুল হয়ে যায়। ভুল করবার অধিকার আমার আছে জেনেও আমি
নিজেকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখি। একটা পরাক্রান্ত হেঁয়ালিকে আমি
একনায়কত্ব ফলাতে দিই স্বেচ্ছায়। হেঁয়ালি মাকড়সার মতো জাল বুনতে
থাকে আমার চারপাশে, আমি জালবন্দি হই। মাঝে-মধ্যে চকচকে ছুরির মতো
ঝলসে ওঠে একটা ইচ্ছা-হেয়ালির অস্পষ্ট ঝালরসমাচ্ছন্ন টুঁটি আমি চেপে
ধরবো একদিন, যেমন ওথোলোর প্রবল কালো দু’টি হাত চেপে ধরেছিল
ডেসডেমোনার স্বপ্ন-শুভ্র গলা।
আমি কি ভুল উপমার ফাঁদে পা দিলাম? আলোয় স্নান করতে গিয়ে কি অন্ধকার
মেখে নিলাম সমগ্র সত্তায়? আমার ভ্রুতে এখন স্বপ্নভুক, ক্রুদ্ধ একটা পাখি
ডানা ঝাপটাচ্ছে ক্রমাগত, আমার আঙুল থেকে উৎসারিত ফোয়ারা উদগীরণ
করছে আগুনের হলকা। আস্তে সুস্থে মৃতের বাগানে প্রবেশ করছি আমি; জানি
সেখানে কাউকে দেখতে পাবো না, শুধু কারো কারো অনুপস্থিত উপস্থিতি
নিস্তব্ধ রাগিণীর মতো বেজে উঠবে হাওয়ায়, আমার শিরায়। পা ভারী হয়ে
আসবে, বিস্ফারিত হবে চোখ। কথা আমি কম বলি, যেটুকু বলি গলার পর্দা
নীচু রেখেই বলি। কিছু ছায়াকে দোসর ভেবে ওদের সঙ্গে কথা বললাম। মনে
হল, অন্ধকার রাত্রির ফসফরাসময় তরঙ্গের মতো বয়ে গেল বহু যুগ।

এইতো আমি এসে পড়েছি বিরাট এক অ্যাকুরিয়ামের কাছে। অনেক রঙিন
মাছ কেলিপরায়ণ সেখানে। কেউ সাঁতার কাটছে উদ্ভিদ ঘেঁষে, কেউবা ক্ষুদে
পিছল বল্লমের মতো ছুটে চলেছে, নুড়ির দিকে। অ্যাকুরিয়ামের ভেতর মাছ
কি কুমারী থাকতে পারে কখনও? মাছগুলো আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে চায়
ওদের মৎস্যবৃত্তান্ত। ওদের অন্তর্জীবন পরতে পরতে যাতে মেলে ধরতে পারি,
সেজন্য ওদের শরীর থেকে ওরা বিচ্ছুরিত হতে দিচ্ছে রহস্যময় সুর। ওদের
সন্ধ্যাভাষায় দীক্ষিত করতে চাইছে আমাকে।

আমি লিখতে পারি, আমার কলমে অলৌকিকের ঈষৎ ঝলক আছে-একথা
ওদের বলে দিলো কে? মাছগুলোর চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ। সাইরেনদের
চোখও কি এরকম নিবদ্ধ ছিল ওডেসিউসের দিকে? বিব্রত বোধ করলাম
আমি। আমি কি সেই কুহকিনীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতে চলেছি, যার চোখ
ফসফরাসের মতো উজ্জ্বল আর চুল সামুদ্রিক শ্যাওলার মতো সবুজ? আমি কি
লিখতে পারবো নতুন এক মৎস্যপুরাণ? ইতিমধ্যে একটি সোনালি মাছকে
আমি স্বৈরিণী বলে শনাক্ত করেছি। নাকি অ্যাকুরিয়ামের প্রতিটি স্ত্রী মাছই
স্বৈরিতায় নিপুণা আর প্রত্যেকটি পুরুষ মাছ অজাচারে পারঙ্গম? মাছগুলোর
জলকেলি দু’চোখ ভরে দেখি, ওরা আমার ভেতরে প্রবেশ করে সূর্যরশ্মির
মতো, আমি অ্যাকুরিয়ামে পাতালে চলে যাই, মাছ হই।

এখানেই শেষ হতে পারতো এই কথাগুচ্ছ, নামতে পারতো এক বিবাগী
নীরবতা। অথচ বাবুই পাখির ভাঙা বাসার মতো একটি সংসার, ধুঁকতে-থাকা
একজন বৃদ্ধ, হারিয়ে-যাওয়া সন্তানের খোঁজে প্রায় উম্মাদিনী মা আমার
ভাবনাকে ভবঘুরে করে। একটা আচাভুয়া পাখি ডাকতে থাকে আমার বুকের
সান্নাটায়। সেই ডাক আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে কিছুক্ষণের জন্যে। আমার
ঘুম আর জাগরণের মধ্যে আছে যে বিরানা প্রান্তর, তার সুদুরতা আমাকে বলে,
‘বাঁচো, তুমি বাঁচো।

 আনন্দিত কিশোরের মতো

সাজগোজের দিকে কোনাদিনই তেমন
মন ছিল না ওর। জামা-কাপড় খুব দ্রুত ময়লা
হয়ে যেতো সকল সময় চুল থাকতো
উসোক খুসকো। কিন্তু সেই রোববার ওরা ওকে
বেশ সাজিয়ে গুজিয়ে
রওনা করে দিয়েছিল আর সে
দিব্যি আমতলা থেকে অনেক অনেক দূরে
চলে গেলে বিস্তর আতর গোলাপের সুবাস ছড়িয়ে।

আমি ওর সেই সাজ দেখিনি, শুধু শুনেছি
লোক মুখে। যে ফুল দেখলেই কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলতো,
হাতে কোনো পুতুল এলেই
সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে এক বেনামী আক্রোশের প্ররোচনায়
ছুঁড়ে দিতো বাইরে, সেদিন সে অতিশয়
শান্তভাবে শরীরে ধারণ করেছিল কিছু ফুল
আর নিজেই হয়েছিল পুতুল। তড়িঘড়ি
আমি সেখানে যাইনি সেদিন কাক-ডাকা
ভীষণ খাঁখাঁ দুপুরে,
যেন ও কেউ ছিল না আমার।
পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত আমার মনে হয়
আমার হৃদয় বার বার ভরে যাচ্ছে আতর গোলাপের গন্ধে,

অথচ সে আর ফিরে আসেনি।
আমাকে বলেনি কেউ তবুও আমি বিশ্বস্ত থেকেছি
নিজস্ব প্রতীক্ষায় দিন দুপুরের, রাত্রির প্রতিটি প্রহরে।
কতবার দরজা খুলে রেখেছি মাঝরাতে,
এসো এসো বলে আমার ক্লান্ত স্বর ভাসিয়ে দিয়েছি
হাওয়ায়। আমার ভাষার ভুল ব্যবহারের জন্যেই কি
ওর ফিরে আসার আলোয়
আনন্দিত কিশোরের মতো হয়ে ওঠে না আমার ঘর?
আমার দুঃখ শুয়ে আছে উল্টো হাতে মাথা রেখে। ইদানীং
আমার মন থেকে ওর স্মৃতি খুব দ্রুত
চলে যাচ্ছে অধিরাজ অন্ধকারের অন্তঃপুরে,
যেন ও কেউ ছিল না আমার।

শুয়ে আছি, এইমাত্র বেডসাইড টেবিলে রেখেছি
অলৌকিক গল্প সংকলন,
এক ফোঁটা ঘুম নেই চোখে।
ঘরের ভেতর আমিষাশী উদ্ভিদের মতো বেড়ে উঠছে ভয়
ক্রমাগত জাপটে ধরছে আমাকে;
দম-বন্ধ-করা ঘরে আটকে-পড়া চুড়ুইয়ের মতো
ছটফট করছি আমি।
হননপ্রিয় উদ্ভিদ আমাকে গিলছে একটু একটু করে,
তবু আজ রাতেও আমি
আমন্ত্রণপ্রবণ ক’রে রাখবো আমার ঘর-দুয়ার।

 আমার কবিতা আজ

আমার কবিতা আজ একরাশ পাতার মতন
উড়ে যায়, দূরে যায়, বস্তুত এ সন্ধ্যেবেলা যায়,
কোথায় যে যায়।
চাঁদের কপালে টিপ দিয়ে
পাহাড়ের কোলে দোল খায়,
নাকি জঙ্গলের ভেতরে মরণ
হবে হিংস্রতার সৌন্দর্যের তদারকি পেয়ে
ভেবে সেখানেই খোঁজে অন্তিম আশ্রয়।

কিছু পাতা থেকে যায় বারোয়ারী বিচার সাপেক্ষে
শহর ও গ্রামে; লোকালয়
তুলে নেয় হাত;
কখনো উৎসুক চোখে দ্যাখে, কখনোবা
মরা আরশোলা, বাজে কাগজের সঙ্গে এলেবেলে
ফেলে দেয়, তারপর জানালার বাইরের শোভা
উপভোগ করে।

প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচ্যুইটি-এসব কিছুই নেই
কবিতার, আছে শুধু অক্ষরের মালা,
গা গলায় পরে নেচে বেড়ায় সে। একলা আঁধার ঘরে,
আমলকি বনের ভিতর অন্তর্জ্বালা
নিয়ে ওড়ে সারাক্ষণ দূর নীলিমায়,
প্রজাপতিদের সঙ্গে থাকে মধুপুরে;
কখনো হারিয়ে যায়, কে জানে কোথায়!
কখনো শোবার ঘর, কখনো বাবুর্চিখানা ঘুরে
বিস্ময়ের মতো নিরাছুট্রা হঠাৎ হাজির হয় পুনরায়।

ইকারুসের জন্ম

জানি বেশ কিছুকাল ধ’রে
কী একটা উৎসব মতো
চলছে তোমার ওখানে।
তুমি আমাকে ডাকোনি। অবিশ্যি সেজন্যে আমার হৃদয়
বিলাপ-কাতর নয় আদৌ।

উৎসব শব্দটি উচ্চারিত হলেই
আমি দেখতে পাই এক গুচ্ছ ডাগর গোলাপ,
স্রোতে ভাসমান দীপের মতো
কয়েকটি মুখ, শুনি সরোদের তান
মনে মনে আমি সাজিয়ে নিচ্ছি
কিছু ঝলমলে দৃশ্য-কেউ একজন এল, যার পরনে
সাফারি স্যুট, শীতলপাটির মতো
পরিপাটি চুল, কেউ চলে যাচ্ছে গলগলে ধোঁয়া উড়িয়ে।
এই মুহূর্তে আমি ভাবছি
পাপড়িহীন কিন্তু সৌরভময় কোনো গোলাপের কথা,
করুণ অথচ গীতনিষ্ঠ একটি পাখির কথা এবং
আমার মনে হলো, এখানেই শেষ হলে ছিল ভালো।

আমন্ত্রহীন তোমার ঘরে ঢুকেই দেখি তুমি সোফায়
বসে আছো আলস্যামদির ভঙ্গিতে।
তোমার চুল খোলা, হাতে
সায়ান্স ফিকশন। দেবব্রত ছড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যাকুলতা।

টেবিলে কয়েকটি গ্লাশ, ত্র্যাশট্রে উপচে-পড়া
আধপোড়া সিগারেট আর ছাই। এই গৃহে
এমন দাহ, আমার জানা ছিল না। সেই মুহূর্তে আমার চোখ
ইকারুসের চোখ, আমার বাহুমূলে ওর উচ্চাকাঙ্ক্ষী ডানা।

এই পথ

এই পথ
বড় আঁকাবাঁকা,
অত্যন্ত ঘোরালো, সরু, বহুদূর চলে গেছে দিগন্তের দিকে।
পথসঙ্গী ছিল যারা তারা
একে
একে
একে
ঝরে যায়,
যেমন রূপোর টাকা ছোঁড়া জেব থেকে।
নারকেলকুঞ্জ মেচেতার মতো
পুঞ্জ পুঞ্জ ছায়া
ফেলেছে পথের ধারে, সেখানে হরিণ
ব্যাঘ্র-লোভ থেকে দূরে ব্যগ্র
চলে আসে শান্তি বিহারের
আশায় একাকী।
মোটরের ধমকে নিমেষে
চমকিত, দেয় লাফ পার্শ্ববর্তী ঘন
বনের ভেতর
ফুলের পরাগগুলি
থ্যাঁৎলানো, কিছু পদচ্ছাপ
মিশে গেছে ঘাসে, নীড়ছুট
পাখি উড়ে যায় মাথার ওপর;
নিঃশব্দ কে আসে
আমার পেছনে?
আমার নিজেরই প্রেত? নাকি
অন্য কোন প্রাণী?
কী করে যে অনুসৃত হয়ে উঠি ঘোর অবেলায়?
এই আঁকা-বাঁকা
পাকদণ্ডী বেয়ে একা-একা
এরকম সম্বলবিহীন
কোথায় চলেছি কোন্‌ সূর্যাস্তের দিকে?
পাকদণ্ডী দেয়না আশ্বাস কোনো, শুধু ঘুরে ঘুরে
একই স্থানে ফিরে আসা। সুন্দরীর জিভের মতন
বের-হয়ে আসা
পুষ্প পরাগকে বলি, শান্ত গাছের উদ্দেশে বলি-
আমাকে দেখাও পথ ধ্যানী;
চোখ বন্ধ ক’রে অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে
এখন কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো?

 একটি বাড়ির কথা ভাবি

রোজ আমি কান্তিমান একটি বাড়ির কথা ভাবি।
সে-বাড়িতে কারা কীরমভাবে আছে
ভাসাভাসা কানে আসে, কিছুবা কল্পনা
করে নিই, মনে মনে মনোনীত রঙের পোঁচড়া
সস্নেহে বুলিয়ে দিই বাড়িটার গায়ে। খুব কাছে
যাইনি কখনো শুধু দূর থেকে দেখি।

কোনো কোনো ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলে
মনে হয় সে-বাড়িতে শুয়ে আছি দক্ষিণের ঘরে
এবং পাশের ঘর পাঠাচ্ছে নৈবেদ্য ক্রমাগত
ক্লিফ রিচার্ডের গান। এলো
সৌন্দর্য সুঠাম তন্বী ছন্দে, হাতে ভোরের চায়ের সরঞ্জাম,
তারপর সুবাসিত আভিজাত্য ঝুঁকে থাকে আমার ওপর।

যখন বয়স্ক হয় রোদ, সে বাড়ির
আয়তন, রঙ কিংবা কী তার ধরন, আসবাব,
উপচার, বাসিন্দা কজন-
কিছুই পড়ে না মনে। স্মৃতিভ্রষ্ট আমি ভাবি শুধু
বাড়িটার কথা।
ছিল কি পুষ্পিত কোনো ডাল নুয়ে দক্ষিণের জানালায়?
আমি কি সদলবলে করবো ঘেরাও বাড়িটাকে
অবেলায়? নাকি
বেবাক গুঁড়িয়ে দেবো গ্রেনেডের প্রচণ্ড ধমকে?
আগুন লাগিয়ে দিই যদি,
তবে কি আমার গায়ে চিরদিন থাকবে নাছোড়
লেগে অন্যায়ের ছাই?

বাড়িটা যেমন আছে, তেমনি থাক তার অপরূপ
শোভা, শিল্প, পিছুটান নিয়ে।
কথোপকথন হোক সেখানে নিবিড়, কেউ লনে
দাঁড়াক বিকেলবেলা, যাক
মিশে পুষ্পবিকাশের সুরে। হয়তো আমি কোনোদিন
প্রকৃত সেখানে যাবো; আপাতত ভাবি শুধু বাড়িটার কথা।

এত বছর পরেও

কখন কোন্‌ ঘটনার অনুষঙ্গে কোন্‌ ছবি ভেসে ওঠে
অথবা কোন্‌ ছবি
ডেকে আনে কোন্‌ ঘটনাকে
তার কোনো নির্ধারিত নক্‌শা নেই।
তবে এখানো যখন আমি কোনো বালককে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে
পথ হাঁটতে দেখি, তখন অনিবার্যভাবে আমার ছেলেবেলার
ইশকুলের কথা মনে পড়ে যায়। আর
আমার হৃদয়ে
বাজতে থাকে একটি সোনালি ঘণ্টা।
এছাড়াও কখনো কখনো হঠাৎ
আমার ছেলেবেলোর ইশকুল ঝলসে ওটে স্মৃতিতে।
মাঝারি ধরনের একটা মাঠ
কাঠের নড়বড়ে সিঁড়ি,
নানা কলস্বরের মুখরিত ক্লাশরুম,
হাতে-টানা পাখা, বিবর্ণ ঝালর, সেই মধ্যবয়সী দারোয়ান,
দূর দ্বারভাঙায় ছিল যার নিবাস,
তার খয়েরি গলাবদ্ধ কোট আর খাটো ধুতি
আর জলখাবারের ঘর-এমনি টুকিটাকি অনেক কিছু
মনে পড়ে আমার।
তবে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে চিন্তাহরণ স্যারের কথা,
যিনি ক্লাশ নাইনে
আমাদের ইংরেজি পড়াতেন, যাঁর পড়ানোর ইন্দ্রাজালে
নেসফিল্ডের গ্রামার ইস্তক
হয়ে উঠতো চমৎকার অ্যাডভেঞ্চারময় ভ্রমণ কাহিনী।
এইতো দেখছি তিনি বসে আছেন নিশ্চুপ আলাদা
একটা কাঠের বাক্সের ওপর
তাঁর কাঁচাপাকা চুল আর ভাসাভাসা
দু’টি চোখ নিয়ে। ডুবে আছেন বইয়ের পাতায়।

এমন একটি দিনের কথাও মনে করতে পারি না
যেদিন চিন্তাহরণ স্যারের হাতে কোনো বই দেখিনি
তাঁর সম্পর্কে আমার কৌতুহল
ডানা ঝাপটাতো সকল সময়। তিনি যে ছুটির দিনে জলরঙ
ছবি আঁকতেন, এ খবর
আমি কুড়িয়ে নিয়েছিলাম আগে-ভাগে।
সৌভাগ্যবশত স্যারের একটা ছবি আমি দেখেছিলাম,
তাঁর পুত্রের সৌজন্যে।
ঊষাকিরণ ছিলো আমার সহপাঠী।

কোনো এক দুপুরে
টিফিনের বিরতিকালে
ঊষাকিরণ আমার সামনে মেলে ধরেছিল বাংলার বর্ষা
স্যারের তুলিতে রূপায়িত
রাধার বিরহের মতো পুঞ্জ-পুঞ্জ অন্ধকার আমাকে
অভিভূত করেছিল, মনে পড়ে।

আজ আমি বিলক্ষণ জানি,
আমার সকল সদিচ্ছা সত্ত্বেও সেই ছবির তুচ্ছতাকে
মুছে ফেলা যাবে না। সেই ছবির
মামুলিত্ব প্রমাণ করবার জন্যে কোনো হাবার্ট রিডকে
আমন্ত্রণ জানানোর দরকার নেই।
আমার স্যারের ছবিটা যত তুচ্ছই হোক,
এত বছর পরেও
সেই কাগজে বর্ষার ঘন অন্ধকার নামে
আমার মনের ভেতর আর
অনেকক্ষণ ধ’রে আমার মন কেমন করে।

 কাঠবিষয়ক

কাঠের চেয়ারে তিনি বসে আছেন।
তার সামনে কাঠের টেবিল, কাঠের দেরাজ থেকে
এক তাড়া কাগজ বের ক’রে
কাঠপেন্সিল দিয়ে ঘস্‌ ঘস্‌ করে কী যেন লিখলেন।

কাঠঠোকরার ধরনের তিনি তাঁর অতীতকে
ঠোকরালেন অনেক্ষণ আর
কাঠের গুঁড়োর মতো কিছু স্মৃতিকণা
ঝরতে থাকলো কাঠের মেঝেতে।

কয়েক ঘণ্টা পর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে
তিনি সামলেন, সন্ধ্যালগ্নে প্রবেশ করলেন
তাঁর নিজস্ব কাঠের বাড়িতে। তাঁর
চোখ পড়লো কাঠের দেয়ালে, দেয়ালে ঝোলানো
ছবির কাঠের ফ্রেমে কাঠের আলমারিতে
কাঠের বুকশেল্‌ফে।

কাঠের ওয়ার্ডরোবে ট্রাউজার আর কোট্‌ টাই
গচ্ছিত রেখে কাঠের বাথরুমে
চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে হাই তুলে এসে
বসলেন কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে,
গৃহিনী কেঠো হাসি হেসে স্বামীর দিকে
বাড়িয়ে দিলেন কাঠবাদাম আর বিস্কুটময় কাঠের রেকাবি।

রাত্তিরে তিনি শুতে গেলেন কাঠের খাটে,
তারপর তাঁর স্বপ্নে এলো স্তুপ স্তুপ
কাঠভর্তি এক বিশাল কাঠের জাহাজ এবং তিনি নিজে
ঘুমিয়ে আছেন আলিশান কাঠপ্রসাদে কাঠের মূর্তির মতো!

কাদায় পড়েও

আমার গায়ে সদ্য কাদার গন্ধ পেয়ে
অলপ্পেয়ে
চামচিকের দল
ঝটিতি হয়ে উঠেছে চঞ্চল।

ওদের প্রত্যেকের মাথায় এখন
মুকুট আর গায়ে কেমন
চকরা বকরা পোশাক আশাকের বাহার;
গলায় গজমোতির হার
ঘন ঘন দুলছে এলাহি লম্ফ ঝম্পের তালে।

কেউ কেউ বাঘছালে
সেজেগুজে ছুঁড়ছে বেধড়ক লাথি।
চামচিকেদের খেয়োখেয়ি, মাতামাতি
দেখে পাড়া পড়শিরা বার-বার দিচ্ছে করতালি।
চেঁচামেচিতে ওদের কণ্ঠনালী
অবিরত
ফুলে উঠছে আহার-তৃপ্ত সাপের মতো।
সমস্ত গা থেকে কাদা ঝেড়ে আমি এখনো উঠে দাঁড়াতে
পারি, পারি তাড়াতে
বিচ্ছিরি চামচিকেদের কুংফু কায়দায়।
অথচ আমি থিকথিকে কাদায়
প’ড়েও চাইনা দিতে
প্রশ্রয় হিংস্রতাকে। আমি চাই আমার ধমনীতে
ফণিমনসা নয়,
সকল সময়
বয়ে যাক জুঁই মল্লিকার ঘ্রাণ। মড়াখেকো পাখি
যাক উড়ে দূরে, আমি কোকিলকেই ডাকি।

কার কাছে যাবো

কার কাছে যাবো আজ? কারুর অধরে
গোলাপ ফোটে না আর। কার
হাতে হাত রেখে
বসবো বিকেলবেলা বারান্দায় অথবা দাঁড়াবো
নদীতীরে? প্রত্যেকের জামার আস্তিনে ইদানীং
লুকানো রয়েছে বাঘনখ।

কার সঙ্গে কথোপকথনে আমি কাটাবো সময়
নিভৃতে প্রসন্ন মনে? ইতরজনের
খিস্তি ও খেউড়
সুভাষিত বাণীর নিভাঁজ ভেক ধরে
প্রহরে প্রহরে করে কলরব শহরেও গ্রামে
সকল ঋতুতে।

ঝরণার পানির মতো স্বচছতা কোথাও নেই আজ।
চতুপার্শ্বে ঘোলা জল বয়
অবিরল, মৎস শিকারিরা বেলা অবেলায় ছিপ
ফেলে গেঁথে নেয়
রুই ও কাতলা বারবার খেলাচ্ছলে;
সুখের সময় ওরা হাতের মুঠোয় পেয়ে যায়।

ভীষণ নিঃসঙ্গ থাকি ঘরে, মাঝে-মাঝে একা-একা
ঘুরি পথে, ভিড়ের ভিতরে
চলে যাই, সুদূরতা পেয়ে বসে আমাকে তখন।
পারিনা খাওয়াতে খাপ কোথাও, যেমন
আংটি বড় কিংবা ছোট হলে
লাগেনা আঙুলে।
উপরন্তু গ্রীক ট্রাজেডীর নিয়তির মতো
কী যেন ফেলছে গিলে নিয়ত আমাকে অতি দ্রুত।

কে যেন ডাকছে কাকে

বহুদূরে গলা ছেড়ে আঁধারের মর্মমূল ছিঁড়ে
কে যেন ডাকছে কাকে। সেই
ডাকে আনন্দের উদ্ভাসন,
উদ্বেগের শীতল কম্পন,
ক্রোধ, ভয়, নাকি সন্ন্যাসের ছোঁয়া
ছিল, চুল চিরে চিরে বিশ্লেষণ করেও বুঝিনি।

সেই ডাকে মায়াকাননের
নৃত্যুদৃশ্য ছিল?
ভরা গাঙে নৌকাডুবি ছিল?
ছিল কি বিবাদে বিয়ে-ভেঙে-যাওয়া কন্যার পিতার
অসহায় বিপন্নতা কিংবা
খনির ভেতরে ধসবন্দি শ্রমিকের
ভীষণ মরিয়া আর্তনাদ?

বহুদূরে গলা ছেড়ে আঁধারের মর্মমূল ছিঁড়ে
কে যেন ডাকছে কাকে। যে ডাকছে,
সেকি বেঁটে নাকি দীর্ঘকায়?
নারকেল কুঞ্জে, ফুটপাতে
বাবরি দুলিয়ে তার আসা-যাওয়া অথবা পাতলা
হয়ে-আসা চুল তার
দুরন্ত হাওয়ায় ওড়ে কিংবা সে লোকটা টেরি কাটে
ডান দিকে-জানিনা কিছুই

কখনো কখনো সেই ডাক
আমার ওপর দিয়ে বয়ে যায়, যেন দীর্ঘশ্বাস
কখনো বা সে ডাকের প্রতি
নত হয়ে মেঘাচ্ছন্ন একটি আকাশ।

জলপাইয়ের পল্লবে পল্লবে

মা, আমি ঠিক বলে দিতে পারি,
এখন এই মূহুর্তে তুমি
বিবর্ণ মখমলী জায়নামাজে বসে কোরান শরীফের
আয়াত আবৃত্তি করছো
কিবলার দিকে মুখ রেখে। জানি,
এখনো বাড়ির কেউ বিছানা ছেড়ে ওঠেনি, কারো
সাড়া শব্দ নেই ধারে কাছে, কেবল অপরূপ শব্দহীনতায়
প্রকৃতি গাইছে কালাংড়া।

আর আমি তখন
একটা শেয়াল-গর্তে আধশোয়া, আধ-বসা অবস্থায়
সময় কাটাচ্ছি, আমার অটোমেটিক রাইফেলটা অঘোরে
ঘুমোচ্ছে আমার পাশে
দীর্ঘকায় কালো মোমবাতির মতো এবং
আমার বাঁদিকে পড়ে আছে
ইউনিফর্ম-পরা একটা মানুষ, ওর ডান পা উড়ে গেছে
গোলার আঘাতে। ওকে এখন
স্পর্শ করা যাবে না, ছুঁলেই ওর শরীর
বালির মতো ঝুর ঝুর করে ঝরে যাবে।
সত্যি বলতে কী, এখানে আমরা যারা আছি
ওৎ পেতে দলবদ্ধ শক্রর অপেক্ষায়, তারা প্রত্যেকেই
যেন আজ বালির মূর্তি। কাল রাতে সে
আমার কাছে সিগারেট চেয়েছিল-
সিগারেটের কথা বললাম বলে তুমি রাগ করো না, মা।
এখন আমি তোমাকে অনেক কিছুই
বলতে পারি অবলীলাক্রমে, যা তুমি শুনতে চাইবে না;
তোবা তোবা বলে আমার মুখ
বন্ধ করে দিতে চাইবে। আমার সব কিছু এখন
ওলট পালট হয়ে গেছে।
তো, যা বলছিলাম, কাল রাতে আমার পার্শ্ববর্তী টিউনিক-সজ্জিত
মানুষটা আমার কাছে সিগারেট
চেয়েছিল আর বুক পকেট থেকে বের ক’রে
দেখিয়েছিল ওর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ের ফটোগ্রাফ।
সেই ফটোগ্রাফ
এখন কাদায় লুটোচ্ছে, কীটপতঙ্গেরা
চলাফেরা শুরু করেছে ওর টিউনিকে,
নাকের খোড়লে। আমি ওদের
দু’একবার তাড়ানোর পর হাত গুটিয়ে নিয়েছি।
কেমন একটা গন্ধ অন্ধকারের মতো
ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।
আজরাইলের ডানার গন্ধ কি এরকম?
আমার চোখের ভেতর, বুকের ভেতর,
হাড়ের ভেতর জীবন গোঙায় সারাক্ষণ আর
আজরাইলের ডানার প্রতি
ভীষণ খেঁকিয়ে ওঠে আমার অস্তিত্ব!

মা, আমি দেখতে পাচ্ছি
তুমি তস্‌বি হাতে বসে আছো সংকীর্ণ বারান্দায়।
তোমার নীল আসমানের উদার ছায়া আর
আমার তিন বছরের ছেলে টুকুন
তোমার জানুতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে,
দেখছে ভোরের পাখির উড়াউড়ি, তোমার বাঁহাত
ওর মাথায়। এমন একটা ছবি
অনেকদিন আগে আমি দেখেছিলাম, যদ্দুর মনে পড়ে,
চিত্রকলাবিষয়ক কোনো বইয়ে।

মা, এই শেয়াল-গর্তে মাঝে-মধ্যে মনে হয়,
যেন আমার কোনো স্বপ্ন নেই, স্মৃতি নেই, পিছুটান নেই,
কোনো আগামীকাল নেই।
মৃত্যু এখানে
একটানা বাজিয়ে চলেছে অ্যাকর্ডিয়ান এবং নিজের খেয়ালখুশি মাফিক
গান গাইছে বেজায় হেড়ে গলায়।
আমার নিজের প্রেত হেঁটে যাচ্ছে
আমার সকল স্বপ্নের ছাই ওড়াতে ওড়াতে।

জানিনা, আমি আবার
ফিরে আসবো কি না তোমাদের মাঝে; যুগ যুগ ধরে
অনেকেই ফেরেনি,
ফিরবে না কোনদিন আর
কী আশ্চর্য জানো মা, এই মূহুর্তে আমাদের
রান্নাঘরের পাশের সেই ডালিম গাছটার জন্যে,
টিউবওয়েলতলার জন্যে,
আমার ঘরের দেয়ালের কিছু দাগের জন্যে,
আমার মন কেমন করছে।
মা, তোমার কাছেই আমার শিক্ষার হাতে খড়ি।
আমার টুকুনের বর্ণ পরিচয় যেন
তোমার মারফতেই হয়। এখন থেকে ওকে
এভাবে গড়েপিটে তোলো যাতে সে
কক্ষনো ভুলেও গরম সীসের ছররা না ছোঁড়ে
কোনো পাখির ঝাঁকে,
ফুটো না করে কোনো মানুষের বুক।
ওকে তুমি জলপাই বাগানের দেখভাল করতে বলো মা, যেন সে ওর স্বপ্নগুলি
বুনে দিতে পার জলপাইয়ের পল্লবে পল্লবে।

 তোমার সৃষ্টি ভিত্তি পাক

কেন তুমি আজ এভাবে তাকাও আমার দিকে?
তোমার দৃষ্টি মুক্তি পেলো কি ঝোড়ো আকাশে?
পাঁচ দশকের সত্তা আমার বাত্যাহত,
দু’জনের মাঝে প্রলয়াকাঙ্ক্ষী পিশাচ হাসে।

এ রকম জানি প্রায়শই ঘটে, সিঁড়ির ধাপ
বেয়ে উঠি আমি, তুমি নেমে যাও তরতরিয়ে।
সংলাপহীন কাটে কতকাল, আমরা যেন
দু’মেরুর প্রাণী। কারা বিষধোঁয়া দেয় ছড়িয়ে?

কেউ কারো মুখ দেখিনা আমরা অনেকদিন;
হঠাৎ কখনও দেখা হয়ে গেলে চমকে উঠি।
অপরিচয়ের ছায়া ঝুঁকে থাকে চোখের কাণে,
তোমার শিরায় স্পন্দিত হয় মোরগঝুঁটি।

তুমি অবিরত পাতালে নামছো; রাতদুপুরে
তোমাকে মাতায় সাইকেডেলিক চিত্রাবলি;
পারিনা ফেরাতে তোমাকে কখনও ভূতল থেকে;
তুমি ক্ষয়ে যাও আমি নিজস্ব নরকে জ্বলি।

যে কোন সময় তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে
হৃদয় আমার শ্মশানভস্মে যাচ্ছে ঢেকে।
তখন তোমাকে খুঁজবো কোথায় কোন নিবাসে?
কোন্‌ সে পাতালে বয়ে যাবে বেলা তোমাকে ডেকে?

বহু যুগ ধরে, আমার ভেতরে যে কাল্‌কূট
সঞ্চিত তার নির্যাস বুঝি তোমার শিরা
করেছে ধারণ। আমি অসহায় তাকিয়ে থাকি,
তোমাকে ক্রমশ করছে দখল করাল পীড়া।

চুম্বনে তুমি পাওয়া শান্তি নব্য যুবা।
যৌবনের ঘুণ ধরেছে আগেই, আশা উধাও,
বিপুল না-এর ক্রুর বীতংসে বন্দি হয়ে
মরীচিকাময় শূণ্যের প্রতি হাত বাড়াও।

নেতিবাদে হলে প্রতিবাদী সুর মঞ্জরিত
মৃতের মুখেও ফুটবে গোলাপ, বাজবে শাঁখ।
এই ডামাডোলে চাই আমি চাই তোমারই জয়,
আমার ধ্বংসে তোমার সৃষ্টি ভিত্তি পাক।

দাঁড়া আছে তারও

চোখে চোখ, হাতে হাত, আর
ঠোঁটের উপরে ঠোঁট রাখলেই বুঝি
ধরে নিতে হবে
ভালবাসা তার বাস্তুভিটা পেয়ে গেছে?

কখনো সখনো
ধ’রে নিয়ে নিজেকে আস্বস্ত করি বটে,
অথচ আমাকে অস্বস্তির পিঁপড়ে সুযোগ পেলেই
কামড়াতে থাকে

ধারণা এবং বাস্তবের
মধ্যে প্রকৃতই বিঘত ব্যবধান,
এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তের তীরে ভেলা বেয়ে নিয়ে যাওয়া
তেমন সহজ নয়। তাই
যখন ডাগর চোখে গভীর তাকায় ভালোবাসা,
মনে মনে ‘কী সুন্দর’ ব’লে
অপলক চেয়ে থাকি, প্রকৃত প্রস্তাবে
বলি না কিছুই।

যখন মগজে কোকিলের গান আর
রক্তে জুঁই মল্লিকার ঘ্রাণ, সরোদের তান নিয়ে
দাঁড়াই সম্মুখে তার, তক্ষুণি ঝাঁঝালো
স্বরে বলে, ‘চলে যাও, শ্যামলিম অন্তরের দিকে।
ক্ষুধা ছিল, তৃষ্ণা ছিল আকণ্ঠ আমার।
দস্তুরমাফিক
মোহন দস্তরখান বিছিয়ে দিয়েও তুলে নিলো
এক ঝটকায় ভালোবাসা।
যা হলো ভালই হলো, নইলে
কে জানতো কাঁকড়াবিছের মতো দাঁড়া আছে তারও।

দুপুরে বেগমবাজারে

দুপুরের বেগমবাজারের রোগা গলির ভিতর
অত্যন্ত সান্নাটা গোরস্তানে
জংধরা টিনের কৌটার পানি চলকে পড়লো
আমার ঠোকরে, চতুর্দিকে উঁচু নিচু
কবরের ঢেউ। আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি
কার রৌদ্রপায়ী কবরের পাশে? যখন ছিলেন
নিঃশ্বাসের অধিকারী তিনি,
তখন কি লোকে তাকে
জানতো পুরুষ ব’লে? নাকি নারী তিনি? তন্বী কিংবা
বয়সিনী, কী-যে তার পরিচয়, কিছুই না জেনে
তারই কথা ভাবি,
যে-আছে মাটির নিচে তুখোড় মুনাফা-ঝলসিত
কুসদীজীবীর মতো অতিশয় কেজো
কীটের সংসারে স্মৃতিহীন, নাটক-রহিত, একা।
খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে এসেই
কেমন একলা পাখি কোথায় যে উড়ে চলে যায়।

ফুলকাটা পাঞ্জাবিটা ঘামে জবজবে, অজস্র সোনালি সূচ
চলেছে চিমটি কেটে, পায়ে
পুরানো ব্যথাটা
আবার মুখিয়ে ওঠে, আমার আত্মায় ক্রমে জ্বরোভাব ফোটে।
গোরখোদকেরা নির্বিকার
চালাচ্ছে কোদাল তালে তালে,
ঘাসের চাপড়া, তাল তাল মাটি জমে,
নতুন চাটাই, কিছু বাঁশ
অধীর অপেক্ষমান। ‘ঐ যে টগর চারার কাছে পিঠে বড়
ভাইজান আছেন ঘুমিয়ে-
তোমার কি মনে পড়ে, ‘বললেন, ধূসর মেজো ভাই।

আমি কি এখানে এর আগে
এসেছি কখন? না, আমার মনে পড়ে না কিছুই।
ভাইজান সত্যি কি নিদ্রিত
সেখানে গাছের কাছে, যেদিকে আমার মেজো ভাই
তুললেন তর্জনী তাঁর নিশানা নির্দেশকারী সন্তের মতন?
নাকি অন্য কারো কবরকে
করলেন শনাক্ত ঝাঁঝাঁ দুপুরে নিজের
ভাইয়ের কবর বলে? অদূরে নজরে পড়ে সদ্য
চুনকাম-করা কবরের জন্যে বিজলি বাতির কী বিশদ
আয়োজন, বুঝি ভদ্রলোক
অন্ধকার ঘরে শুতে ছিলেন অত্যন্ত অনিচ্ছুক,
খওফের নখ হয়তো তাকে আঁচড়াতো ঘন ঘন।
নকশা-কাটা সিল্কের মতন শরীরের পাখি
আমার অনেক কাছে এসে দুপুরকে চমকানো শিস দিয়ে
জীবনের সৌন্দর্য আবৃত্তি করে গেল।
কোদাল ঝিমায় রোদে, মাটির ডেউয়ের চারপাশে
ঊর্ধ্বারোহী প্রাথী হাত, ঘাড় উচ্চারিত নিরুদ্দেশে
সোপর্দের ভাষা-
নামুক কবরে তাঁর অবিরল রোশনির ঢল।
আবার আমরা নামি পথে; আস্তাবল,
যা বিলীয়মান দ্রুত, কেবলি উগরে দেয় ঝিমানো ঘোড়ার
বিষ্টা আর খড়-বিচালির গন্ধ, চা-খানার বেজায় ইচঁড়েপাকা চুনু,
কানে যার সিগারেট গোঁজা, টুল মোছে,
নয়া ফিল্মি গান গায়, ক্লান্ত চোখে দেখি
মোগল ঘোড়সওয়ার, নায়েবে নাজিম, চমকিলা
চামুটি, লাগাম হাতে জাফরানী রঙের ভেতরে
চলেছেন, বাতাস অলস
আতরের খোশবুতে আর দুলে ওঠে পরীবিবির তাঞ্জাম।

শুধু তাঁকে রেখে এসে, ঔদাস্যে সেলাই করা হুহু
শরীরে রৌদ্রের দাগ এবং আত্মায় জ্বরঠোস নিয়ে আমি
হঠাৎ চমকে উঠি-শ্রাবণের সিয়া আসমান
এসেছে জমিনে নেমে বেগমবাজারে,
অথচ আমার মধ্যে অপরূপ স্থাপত্যের মতো
আলোক বৃক্ষের জাগরণ।

দেয়াল কাহিনী

পাঁজরের হাড় বের হওয়া
দেয়ালটা ঝুঁকে পড়েছিল সামনের দিকে
বুড়ো মানুষের মতো
কিন্তু বড় তাজ্জবের ব্যাপার, এতদিনেও
মুখ থুবরে পড়ে যায়নি
নোনাধরা, শ্যাওলার জামা-পরা সেই দেয়াল।
তবে সত্যি বলতে কী,
এই এখন-পড়ি তখন-পড়ি দেয়ালটার দিকে
চোখ পড়লেই
আমার ভারি ভয় হতো।

কতদিন ভেবেছি কালবৈশাখী এক লহমায়
ওর ঘাড় মটকে দেবে, অথবা
লাগাতার বৃষ্টির ঝাপটায় হবে সে কুপোকাৎ।
কিন্তু ঝড়বাদল কখনো কখনো
খুব শক্ত সমর্থ
কোনো কোনো দেয়ালকে উপড়ে ফেললেও,
সেই কুঁজো দেয়ালটা
দিব্যি মাথা উঁচু ক’রে এতকাল দাঁড়িয়ে ছিল
গোয়ার গোবিন্দের ধরনে।

দেয়ালটার টিকে থাকার এই একরোখা
লড়াইয়ে এক ধরনের সৌন্দর্য
আমি প্রত্যক্ষ করেছি। ওকে আমার মনে হতো
সেই যোদ্ধার মতো, যে প্রতিপক্ষের
দৃষ্টি-অন্ধ-করা গোলাবর্ষণের ভেতরেও
দাঁড়িয়ে থাকে অটল।
কিন্তু শেষ অব্দি জব্দ হতে হলো, ওকে, হঠাৎ
এক সন্ধ্যেবেলা বৃষ্টির বর্শায়
ভীষণ জখম হয়ে সে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল
সদর রাস্তায়।

দেয়ালের এই হালত দেখে
আমার মনের ভেতরে নেমে এল একটা নিঝুম ছায়া,
যেমন আসে আপনজনের বিয়োগে আর দেখলাম
রাত্রিবেলা দেওয়ালের পুঞ্জ পুঞ্জ শোকের মতো
ধ্বংসস্তূপের ওপর খিলখিলিয়ে
হাসছে ছমছমে জ্যোৎস্না।

 পদ্মকোরকের মতো

অবসাদ হাত-পা খেলিয়ে স্মৃতিকে পাশে নিয়ে
শুয়ে আছে বিকেলবেলা।
অবসাদ এখন আমার ওপর শয্যা পেতেছে,
আমি পা দুলিয়ে হাত ঝুলিয়ে
মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে তুলছি
অনবরত সাবুদানার মতো যাবতীয় স্বপ্নকণা।

ইচ্ছে হলেই আমি এখন ছাদে যেতে পারি না,
সিঁড়ি নেই। আমার ঘর থেকে
দেখতে পারি এক মেঘের সঙ্গে অন্য মেঘের
সাবলীল মেলামেশা, আকাশজোড়া
পাখির সাঁতার, ঝাঁকামুটের
হনহনিয়ে ছুটে-যাওয়া।

হামেশা খুব রাত ক’রে ফিরতাম বলে আম্মা
টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে
বসে থাকতেন, ঘুমে চোখ বুঁজে আসতো, তাঁর,
মনে পড়ে। কখনো আমি মাতৃদৃষ্টি এড়িয়ে বেড়ালের মতো
চুপিসারে ঢুকে পড়তাম আমার ঘরে,
কখনোবা চুপচাপ বসে পড়তাম খাবার টেবিলে,
আম্মা কিছু না বলে
দেখতেন আমার আহার দৃশ্য।

একজন জোহরা আমার মশারি টাঙ্গিয়ে
ভাত নিয়ে মধ্যরাত অব্দি জেগে থাকে, প্রতীক্ষার আলপিন
ক্রমাগত ফুটতে থাকে ওর সত্তায়। যখন আমি
দরজার সামনে দাঁড়াই আলুথালু, এক ধরনের
অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা ভর করে ওর ওপর।
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
এক সময় ঘুমে ভিজে যায় চোখ।

ইদানীং মানুষের চেয়ে জীর্ণ পাঁচিলে আশ্রয় নিবিড়
ম্যাজেণ্টা রঙের পাখি,
আমার ঘরের দাগসমূহে মধ্য থেকে
জেগে-ওঠা নানা ছবি আর ঘরের ভেতর লুটিয়ে-পড়া
জ্যোৎস্নার সঙ্গেই বেশি কথা বলি,
পদ্মকোরকের মতো উম্মীলিত হয় সন্ধ্যাভাষা।

পোড়াতে জানে না

আজকাল পরাজয় যখন আমার
আত্মসম্মানে ঘাড় ধরে
হিড়হিড় ক’রে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিয়ত আঁধারে
তখন কেবলি মনে পড়ে তাঁর কথা।
খুব বেশি ক’রে
মনে পড়ে।
কার কথা? এমন একটা প্রশ্ন ওঠা
অমূলক কিছু নয়। যতটুকু জানি
আমি শুধু সেটুকুই
কোনো রঙ না চড়িয়ে বলে যাবো।
না, বাজারে তাঁর
কোনো আত্মজীবনী মেলে না।
জীবন চরিত্র লিখে যারা
যশস্বী এখন, তারা, বলা যায়, সযত্বে এড়িয়ে গেছে তাঁকে।
হয়তো তাঁর বিষয়ে তেমন মালমশলা গেঁজিয়ে
ওঠেনি এখনো।

হাজার হাজার বামনের ভিড়ে যখন আমরা
একজন দীর্ঘকায় মানুষকে দেখি,
বস্তুত তখন আমাদের
সবার চোখের তারা যেমন নিমেষে
স্থির হয়ে যায়,
অবিকল তেমনি হয়েছিল আমার সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে,
যখন প্রথম দেখি তাঁকে
সে মুহূর্তে আমার ভেতর
জ্বলে উঠেছিল লক্ষ প্রদীপের আলো।

যাদের শোণিতে খেলা করে সাপ, তারা
ছিটাতো ঘৃণার থুথু তাঁর প্রতি, কুৎসার জোয়ারে যেত ভেসে
আর যারা কাপুরুষ, তারা
সহজে নিত না তাঁর নাম,
যদিও অন্তরে তাঁকে
গভীর ভূতলবাসী রাজা বলে দিয়েছিল ঠাঁই।

আমি মধ্যবর্তী, তাই আমার স্বপ্নের
নায়কের পথ ধরে হাঁটতে চেয়েছি বহুদিন,
অথচ ঝড়ের উড়ো ধূলি দেখে মাঝপথে হঠাৎ থমকে
দাঁড়িয়েছি নিজের প্রেতের মতো, আখেরে দিয়েছি পিঠ টান।

পরাস্ত মানুষ আমি নির্মাণের চেয়ে
দেখেছি ধ্বংসের নাচ বেশি মরুদ্যানের উদ্দেশে
যাত্রা করে গাফেল পথিক চলে গেছি
তপ্ত বালিয়াড়ির নিকটে।
অনেকেই ব্যাপক আলোর মতো শোভা হতে চায়,
কিন্তু কেউ সহজে কখনো
নায়কের ধরনে অমন
আতশবাজির মতো নিজের জীবনটাকে পোড়াতে জানে না।

ফিরিয়ে দেয় না

বিকেলবেলাটা ছিল সন্ন্যাসের মতোই উদাস,
হাওয়া বিষাদের শ্লোক। ওরা
বললো তাকে, থাকো তুমি আরও কিছুকাল।
কিন্তু থাকো বললেই কি
শেষ অব্দি থাকায় যায়, তাই
চোখের তারায় তার নেচে ওঠে সমস্ত জীবন।
গ্রন্থপাঠে অক্লান্ত সে। শহরের অলি গলি, নিজের গ্রামের অশত্থের আর
প্রাচীন দীঘির কাছে, ঝাঁক ঝাঁক টিয়ের নিকটে
স্বীকার করেছে ঋণ। জানে সে
পিছনে যা থেকে যায় তার প্রতি টান
কমে না কখনও বা চোরা টানে
গেছে ভেসে, বুঝিবা তলিয়ে, কোনোমতে মাথা জেগে ছিল জলে;
সত্যের খোঁজে সে কুয়াশায়
জড়িয়ে পড়েছে বারংবার।
কিছুকাল ধ’রে দেখতো সে প্রায়শই অস্পষ্ট মুখোশ-আঁটা
নিষাদের স্বপ্ন; ভয় পেয়ে মধ্যরাতে
ঘুম ভেঙে গেলে পারতো না ডুবে যেতে
ঘুমের গহনে আর। হিজিবিজি কথা
শত শত রক্তজবা হয়ে দিত ঘূর্ণা চারপাশে, অগণিত
কংকাল সন্তের বেশে শোনাতো প্রবোধবাক্য কুটকচালের।

বুক শূন্য-করা ডাকে গুঞ্জরণময় ঘর থেকে
যে উন্মুল ক’রে নিয়ে যায়, সে চকিতে
নিয়ে যায় স্তব্ধ অনুষ্ঠানে, কোনোদিন
ফিরিয়ে দেয় না।

 বন্যার পশুর মতো

কদ্দিন বাঁচবো আর? আর কদ্দিন জীবন নাম্নী রমণীর
সঙ্গে খুনসুটি করে যাবো?
ভোরবেলা বাঘবন্দি খেলি, দ্বিপ্রহরে
হাত ধ’রে তার
নিরাছুট্রা ঘুরে শহরের
আনাচে কানাচে,
বিকেলে লেহন করি ছায়া, রাত্রি কাটে
কখনো স্বপ্নের, কখনো বা দুঃস্বপ্নের ঊর্ণাজালে।

এরকম হয় মাঝে মাঝে-
যখন কাচের থালা আমার সম্মুখে
নিভৃতে সাজিয়ে রাখে কেউ, পাত্রে ঢালে প্রোজ্জ্বল পানীয়
তখন সে হঠাৎ আমার হাতে অজস্র স্লিপিং পিল ঝুর ঝুর ক’রে
নিঝুম ঝরিয়ে দেয়, বাজায় ট্রেনের হুইস্‌ল
বারবার; আমি সম্মোহিত
মানুষের মতো আচরণে
কেমন অদ্ভুত হয়ে উঠি, এদিকে ওদিকে যাই,
খুব লুটোপুটি খাই ধুলোয় কাদায়।

আমার দর্পণ ফুঁড়ে কে আসে কে যায়
বোঝা দায়, অস্পষ্টতা এলেবেলে টিপ সই দিয়েছে এখানে;
দর্পণের ভেতরের কেউ
আমাকে আলাপচারিতায়
উদ্বুদ্ধ করতে চায়, কাচের ওপরে দীর্ঘশ্বাস
মেঘের মতন জমে থাকে। অন্ধকারে
চলেছি স্রোতের টানে বন্যায় পশুর মতো উদ্বেগ-নির্ভর,
চলেছিতো।

বেশি বাকী নেই

ভোরবেলা দাড়ি কেটে মসৃণ করেছি গাল; চুল
আঁচড়িয়ে আয়নায় কিছুটা মশগুল
থেকে বসি একান্ত নির্জনে
কাগজ কলম নিয়ে। অক্ষরের বনে পেয়ে যাই চকিতে হদিশ
পথের এবং বেজে ওঠে মগজে পাখির শিস,
দেখি শূন্যে হরিণের লাফ।
আলনায় রোদ্দুরের রমণীয় তাপ
পোহায় তাঁতের শাড়ি। গিয়েছিলাম কখনো লেকে,
মনে পড়ে পর্যটক মেঘমালা দেখে।
ইতোমধ্যে সকালবেলার ডাক এসে
গেছে; কার চিঠি এলো? যে আছে বিদেশে?

সকল সময় নয়, মাঝে-মাঝে কী-যে
হয়, চোখ ভিজে
ওঠে অকস্মাৎ, মনে নামে সফোক্লিসের কালের
সন্ধ্যার মতন সন্ধ্যেবেলা, পাখিদের
কংকাল ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, ভাবি-
কোথায় থাকবে প’ড়ে তৈজসের চটক, দরজা, গূঢ় চাবি।
যেতে তো হবেই
একদিন, আমার সময় আর বেশি বাকি নেই।

জীবনের যাবতীয় চলক, বিভূতি
চোখে আনে দ্যুতি
প্রায়শই, তাই আমি যখন কোথায়ও কালো ডানা
অকস্মাৎ হানা
দিতে দেখি, জানলার বাইরে তাকাই, সারাক্ষণ
ভয়ে ভয়ে থাকি আর ছায়ার মতন
চলা ফেরা করি ঘরে।
নাছোড় তাগিদময় পাওনাদারের মতো যদি এসে পড়ে
মৃত্যু, তবে কী ক’রে ফেরাবো তাকে? কোন্‌ ছলে? থাক্‌
সে ভাবনা, আপাতত জীবনের ঠোঁট ঠোঁট চেপে ধরা যাক।

 বড় দীর্ঘ এ অসামাজিকতা

সেদিন সকালে তোমার তেতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে
আমি ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম।
ভাবতেই পারিনি
তোমার কাছ থেকে অসৌজন্যের অমন
বেধড়ক ধাক্কা পাবো।
এই প্রথমবারের মতো, বুঝলে আফজাল, তুমি আমাকে
কোনো সাদর-সম্ভাষণ করোনি,
নিজ্ঞেস করোনি আমার কুশল সংবাদ।

সত্যি বলতে কী, তোমার সেই নিদারুণ অসৌজন্যে
আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি,
তোমার মধ্যে যে এমন সীমাহীন উদাসীনতা
বাসা বেঁধেছিল, জানা ছিল না আমার।

সেদিন সকালে তোমার ফ্ল্যাটের
দোরগোড়ায় পৌঁছে কলিং বেল বাজাতে হয়নি।
সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়েই
আমার মনে হয়েছিল, তোমার দরজা আজ খোলা থাকবে।

কলিংবেলের প্রসঙ্গ এখন
না ওঠালেও পারতাম। কিন্তু কী জানো আফজাল,
কখনো কখনো খুব তুচ্ছ ব্যাপারও
মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। যাকগে, চৌকাঠে পা রেখেই
দেখলাম, তুমি ঘুমাচ্ছ অঘোরে। এদিকে
আমি যে সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তোমার শয্যার পাশে,
বেলা যে খুব তেজী হয়ে উঠেছে,
বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই তোমার। সেই মুহূর্তে মনে হলো,
এখন রোদ যদি আরো বেশি তেতে ওঠে,
যদি টাইফুন বয়ে যায় তোমার ঘরের ভেতরে,

তবু তুমি এক চুলও নড়বে না
বিছানা থেকে, এতটুকু কাঁপবে না তোমার চোখের পাতা।
আফজাল, কী করে ভুলবো যে,
আমি এলে খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠতে তুমি,
হাত বাড়িয়ে দিতে হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে আর
খুব পীড়াপীড়ি করতে খেয়ে যাওয়ার জন্যে।
অথচ সেদিন কোনো অভিবাদন জানানো তো দুরের কথা,
তুমি একবার তাকালেও না আমার দিকে।

তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে
ঘন ঘন কান্নার রোল উঠেছিল তোমার ফ্ল্যাটে।
এর আগে তোমার পুত্র-কন্যা
এমন করে কেঁদে বুক ভাসায়নি কখনো।
তোমার স্ত্রীর অমন ডুকরে-ওঠা দেখে কংক্রিটের দেয়াল পর্যন্ত
গলে পানি হয়ে গিয়েছিল,
কিন্তু তোমার ঘুমে এতটুকু চিড় ধরেনি।
অথচ আগে সামান্য শব্দ হলে কিংবা তোমার গৃহিণী
আলতো ক’রে ধাক্কা দিলে গাঢ়তম ঘুম থেকেও তুমি
ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়তে।

আফজাল, এ বড় দীর্ঘ অসামাজিকতা তোমার।
কতকাল তুমি আসো না আমার বাসায়, স্মিত হেসে
বসো না বারান্দায়, বানাও না ধোঁয়ার রিং।
শুধু কখনো কখনো দেখি তুমি ছায়ার মতো
ঘুমিয়ে আছো মেঘের ভেলায়,
এয়ারপোর্ট রোডের কিনারে,
কচুরিপানার বেগুনী ফুলে, ক্রমাগত জাগতে-থাকা
আমার কবিতার খাতায়।

 ভুল

তা’হলে কি গোড়াতেই হয়েছিল সুনসান ভুল?
সরল বিশ্বাসে তুমি যাকে
পথ ভেবে করেছিলে যাত্রা তা ছিল গোলকধাঁধা;
একদা যে-হাত ছুঁয়ে স্বর্গের প্রবালসিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে ব’লে
মনে হয়েছিল বারবার,
ছিল না ত’ হাত কোনোকালে, ছায়ার প্রসূন নিয়ে
ছিলে মেতে; ওষ্ঠ ভেবে যাতে
করেছো অর্পণ চুমো শতবার, সেসব চুম্বন
হাওয়ায় হারিয়ে গেছে, যেন
অশরীরী কেউ
চেপে ধরেছিল ঠোঁট তোমার সংরক্ত ওষ্ঠতটে।

ব্যর্থ বাসরের রঙ লেগে
থাকে কি আত্মায় চিরকাল? জন্মান্ধ নিঃশব্দ ঝড়
আঁচড় কাটতে থাকে সত্তার দেয়ালে,
স্বৈরিণীর হাসির মতন
আলোর ঝিলিক
আঁধারকে আরো বেশি অনাত্মীয় করে,
কী যেন নিমেষে ভেঙে যায় অকস্মাৎ
হৃদয়ের আবরণ ছিঁড়ে।
ভুল ভেঙে যাবার পরেই
একটু থমকে তুমি দাঁড়ালে যদিও তবু তুমি
নাওনি বিদায়,-
যেমণ মঞ্চের আলো নিভে যাবার পরেও নট
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে শূন্য স্টেজে বিষণ্ন খেয়ালে!
পারোনি ফিরিয়ে নিতে চোখ
চেনা দৃশ্যাবলি থেকে। অন্ধকার সিঁড়ি
আর স্মৃতিখচিত দরোজা,

তক্তপোশ, কার্পেট, মাদুর,
এমনকি সে-ও
ছিল না তোমার তুমি নিজের ভিতর থেকে
একা বাইরে বেরিয়ে এসে পরাবাস্তবের
সৌহার্দে আপ্লুত হ’লে এবং রাখলে দুটি হাত
সংহারপ্রবণ সেই মরীচিকা শোভন হাতের ছায়াঘুমে!

প্রেমের কাঙাল তুমি, তাই আজো সবচেয়ে’ সুন্দর
পাঞ্জাবি চাপিয়ে গায়ে, পারফিউমের অন্তরালে
অতিশয় পোড়া
কাঠের মতন অস্তিত্বের গন্ধ চেপে
তার কাছে যাও আর অর্থহীন জেনেও নিবিড়
কথোপকথনে মেতে, কফি খেয়ে, এর ওর দিকে
তাকিয়ে গল্পের রেশ খোঁজো ঘুম-পাওয়া মুর্খ বালকের মতো।
প্রেমের কাঙাল তুমি, কখন তুমুল
স্বেচ্ছাচারিতায় উঠে গেছো ভুলে অপ্রেমের শীতল চিতায়।

 মধ্যদিন তুমি

তোমাকে দেখেছিলাম গতকাল। মধ্যদিনে তুমি
জল ছল ছল গোসলের পর মুছছিলে চুল
কমলা তোয়ালে দিয়ে ঘষে ঘষে, যেমন ছাদের
কার্নিশে অভিনিবেশ খোঁটে বিস্রস্ত পালক তার
বৃষ্টিভেজা পাখি; তারপর চিরুণী চালালে চুলে;
হয়তো পড়ছিলো মনে কবেকার স্তব্ধ পথরেখা,
আসমানে ডানা-অলা ঘোড়ার বিহার, টক ফল;
হয়তো কণ্ঠে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জানি নশ্বরতা
এ দৃশ্যের সহোদরা। এদৃশ্য আমার কাব্যে পাবে
অমর্ত্যলোকের আয়ু, এমন বড়াই কিছুতেই
সাজেনা আমাকে, কিন্তু আমি যতদিন নিঃশ্বাসের
অধিকারী, ততদিন তুমি আমার হৃদয়ময়
মধ্যদিনের তরুণীর ভঙ্গিতে গোসল সেরে একা
ঘষে ঘষে মুছবে দীঘল চুল, করবে চুলের বিন্যাস।

মধ্যরাতের পোস্টম্যান

এই মধ্যরাতে, এত জোরে জোরে কড়াই নাড়ছে কে?
আওয়াজ শুনেই
আমার বুকের ভেতর
একটা প্যাঁচা ডেকে উঠলো যেন।

অবিশ্যি আমি জেগেই ছিলাম, কিছুদিন ধ’রে
উচ্চাকঙক্ষী ব্লাডপ্রেসারটা ভোগাচ্ছে খুব।
টিপ টিপ-করা বুক নিয়ে
দরজা খুলে চমকে উঠলাম। একজন
ঢ্যাঙা লোক দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়;
ওর ধকধকে কাল পাথরের মতো
চোখের দিকে তাকিয়ে ওকে
কোলরিজের প্রাচীন নাবিক বলে মনে হলো আমার।

লোকটা যে নাবিক টাবিক নয়
তা’ বোঝা গেল একটু পরেই।
সে তার কাঁধে ঝোলানো মিশমিশে ব্যাগটা থেকে
একটা টেলিগ্রাম বের ক’রে
এগিয়ে দিলো আমার দিকে। শাদা
থান কাপড়ের মতো ধু-ধু
টেলিগ্রাম হাতে নিয়ে আমি বিমূঢ়।
নামহীন, ঠিকানাহীন, অক্ষরবিহীন
কাগজটি ওর কাছে ফেতর দিয়ে
বললাম, ‘কিছুই তো লেখা নেই।

অদ্ভুত হেসে সে বললো, ‘সরি, ভুল হয়ে গেছে,
পরের বার আর এমন ভুল হবে না।
তারপর তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে
লম্বা লম্বা পা ফেলে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
কিন্তু বেশি দূরে গেছে বলে মনে হলো না।
ওর কথাগুলো ধারণ করলো দেয়াল আর
আমার টেবিলে-রাখা গোলাপের শিরশিরে পাপড়ি।

কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে
আমার বুকের ভেতর যে প্যাঁচা ডেকে উঠেছিল,
গলা ও ঘাড়ের রোমসমুদয় ফুলিয়ে সে
তাকিয়ে রইল থমথমে রাস্তার দিকে।

যদি আমি হতাম হুডিনি

যদি আমি হতাম হুডিনি
তা’হলে আমার যাদুদণ্ডের ছোঁয়ায়
যাবতীয় বন্দুকের নলগুলি এক লহমায়
হয়ে যেত পাখিদের চোখ,
সারি সারি ট্যাঙ্কের বদলে
বেবাক বার্থ-ডে কেক দিতাম সাজিয়ে,
যোজন যোজনব্যাপী কুচকাওয়াজকে
দিতাম বানিয়ে
তন্বী ব্যালেরিনাদের অপরূপ রাজহংসী নাচ,
আর জেনারেলদের মেডেলগুলিকে
মল্লিকা, টগর আর খোদ সমরনায়কদের
বাংলার বাউল!

যদি আমি হতাম হুডিনি,
তা’হলে আমার জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায়
চোখের পলকে পৃথিবীর সবগুলি
বোমার, বিমান হতো পারাবত আর
নিউট্রন বোমা
তাজমহলের জ্যোৎস্না-সপেদ গম্বুজ।

লজ্জানত

অন্তর্গত আলোড়নে বারংবার খুব উঁচু গ্রামে
বেজেছে আমার কণ্ঠস্বর।
কখনো নির্জনে আর কখনো সভায়
ফাটিয়েছি গলা; উচ্ছ্বসিত
শব্দদ্বীপ থেকে শব্দ দ্বীপান্তরে ভাসিয়েছি ভেলা
বদর বদর ব’লে ভাটি ও উজানে।
আমার নিজস্ব হুলস্থুল, চেঁচামেচি
গড়েছে জবার মতো সুকান্ত মোরগঝুঁটি আমার ভেতরে।
পড়ে না পা আমার মাটিতে। ভেসে বেড়াই হাওয়ায়।
নিচু স্বরে কথা বলে যারা
তাদের করেছি উপহাস, বলেছি, ‘তফাৎ যাও
ন্যাকার সাঙাৎ’

একদিন ঔদ্ধত্যের পতাকা উড়িয়ে
গেলাম বিকেলবেলা একজন প্রবীণের কাছে, যিনি বড়
নিশ্চুপ ছিলেন বসে একাকী মাদুরে।
কী বিপুল স্তব্ধতার
মন্দাকিনী করেছেন ধারণ সত্তায়,
অথচ এমন
নিবিড় বাঙময় আমি কাউকে দেখিনি কোনোকালে।
সব প্রগলভতা সদা-জাগা
ঔদাস্যের আড়ালে লুকিয়ে
চুপিসারে লজ্জানত ফিরে আসি একা।

 লাগবে রক্তের ছোপ

একটি হরিণ খুব নিরিবিলি বনের কিনারে চিত্রবৎ,
যেন সে অনন্তকাল আছে একই স্থানে শিঙের স্থাপত্য নিয়ে
রৌদ্রে ঝিলিক-লাগা চিকন ঘাসের টানে। নানারঙা পাখি
উড়ে এসে বসে ডালে, ডাকে মাঝে-মাঝে পুনরায় যায় চলে।
পুরাণের শাপগ্রস্ত দেবীর মতন মাটিবন্দি গাছগুলি
সেই কবে থেকে; বাতাসের চুম্বন বাকল ভেদ করে যায়
মর্মমূলে, প্রজাপতি ছড়ায় আবীর তার এখানে সেখানে।
মনে হয়, পৃথিবীর ক্ষয় তাকে পারবে না ছুঁতে কোনোদিন।

পানির স্তব্ধতা বুঝি জলবিন্দুময় জলকন্যার মতন
চুপিসারে বনের কিনারে উঠে এসেছে এবং জংলা পিঁপড়ে
ঘাসের ডগায় কিছু উষ্ণতা বদল ক’রে ব্যবসায়ীদের
ধরনের প্রস্থান করে। নিসর্গের অ্যালকোহলে হরিণ বুঁদ।

হরিণের নিজের চিত্রল ঘ্রাণ, যা নিভৃত ভাসমান গান,
এখুনি আনবে ডেকে হয়তো স্তব্ধতা-ছেদনকারী ধকধকে
অঙ্গারের মতো উপস্থিতি, শান্তির ফ্যাসাদময় বনস্থলী
হবে দীর্ণ আর্তনাদে, লাগবে রক্তের ছোপ ছিন্ন ঝোপঝাড়ে।

শিরোনাম মনে পড়ে না

স্বপ্নে দেখলাম, মেহগনি কাঠের টেবিলে ঝুঁকে
লিখছি তন্ময় আমি বিশ শতকের সর্বশেষ কবিতা আমার
শিরোনামহীন। এ কবিতা ভিলানেল
নাকি সেসটিনা? এর ছন্দ
সংহত অমিত্রাক্ষর অথবা মরুভূমির বুকে
উটের যাত্রার মতো গদ্যের দুলুনিয়ম-কিছুই স্মরণে
নেই, শুধু মনে পড়ে
কী দ্রুত চলেছি লিখে একটানা, যেমন কর্মিষ্ঠ, অনলস
মাঝি গুণ টানে পাড়ভাঙা
নদীর কিনারের ধুনকের বাঁকানো ছিলার অবয়বে।
কলমের নিব সারসের, চষ্ণু, অবলীলাক্রমে
গেঁথে নেয় মাছ,
কখনো পালক খোঁটে উড্ডয়নপ্রিয়
স্বপ্নময়তায়, কখনো বা তাকায় চরের দিকে,
পানিতে নিজের ছায়াটিকে ভালোবাসে, কিছুক্ষণ।

স্বপ্নে দেখলাম, সর্বশেষে কবিতা আমার কুয়াশায় ঘেরা
স্টিমারের ডেক,; কতিপয় ছায়া করে আসা-যাওয়া,
রেলিঙে হেলান দিয়ে কেউ ঢেউয়ের মাস্তানি দ্যাখে,
কেউ ডেক চেয়ারের
আশ্রয়ে সায়ান্স ফিকশন হাতে ঝিমায়, কেউবা
পুরুটের ছাই ঝাড়ে, খালাসী তাতারি নাচে মাতে। অকস্মাৎ
হরিণের কাটা মুণ্ডু, পোড়া গন্ধময় মোমবাতি
এবং স্থলিত আংটি, ছুরি ডেকে গড়াগড়ি যায়।

বিশ শতক সর্বশেষ
কবিতা আমার ভূর্জপত্রে কালিদাসী হস্তাক্ষরে গড়ে ওঠে,
আবার লাইনো টাইপের ছাঁদে, কিছু রাবীন্দ্রিক
মায়া লেগে থাকে, পিছুটান মৃত বিহঙ্গের মতো
গলায় দোদুল্যমান। তুলোট কাগজে অক্ষরের পরে কত
অক্ষর সাজাই সুশৃঙ্খল, কিন্তু সব ওলট পালট হয়ে যায়,
পংক্তিমালা গায়েব এবং বালিয়াড়িময় পড়ে থাকে
উটের গলিত চোখ, খুলি বিধ্বস্ত বেহালা আর ছেঁড়া তসবিহদানা।

বিশ শতকের সর্বশেষ কবিতায়
সুচেতা দাঁড়ায় এসে খোলা চুলে, মেহগনি কাঠের টেবিলে
বসে পা দোলায় ঘন ঘন, পরনে গাউন তার, কথা বলে
অবোধ্য ভাষায় আর তার দিকে লক্ষ লক্ষ শীর্ণ হস্তধৃত
শূন্য থালা, সে বিহ্বলা, ব্যর্থ অন্নপূর্ণা লহমায়
উধাও এবং আমি ভীষণ পদদলিত, হাতে
ছোঁড়া পাণ্ডুলিপি; একটি বেড়াল, কালো, চুকচুক
চাটে শূন্যতাকে দুধ খাওয়ার ভঙ্গিতে।

স্বপ্নে দেখলাম, মেহগনি কাঠের টেবিলে বসে
কবিতা আমার আজরাইলের সঙ্গে পাশা খেলে, মাঝে-মাঝে
জেনে নিতে চায় কত ব্যাপ্ত জ্ঞানের বলয় আর
সুবিশাল ছত্রাকের মতো কী যেন ছড়িয়ে পড়ে দশদিকে।
সর্বশেষ কবিতা আমার তেজস্ক্রিয় আবর্জনা-স্তূপ থেকে
আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আর বিশ শতকের
শেষ সূর্য রশ্মির চুম্বন খেতে খেতে বেহুলার ভেলার মতন যায়
ভেসে যায় উথাল পাথাল গাঙ্গুড়ের ঢেউয়ের ঢেউয়ের।

 সাঁতার

খরায় ছিলাম আমি দীর্ঘকাল, গূঢ় চাষাবাদ
হয়নি কিছুঁই ; ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরেছে এবং
ঘাম মুছে, বারংবার ছায়া খুঁজে এখানে সেখানে
গেছে বেলা কায়ক্লেশে। কখনো বিধ্বস্ত মূর্তি দেখে
চমকে উঠেছি কোজাগরী পূর্ণিমায়, রক্তে ছিল
মহরমী সুর সর্বক্ষণ ছিলাম উদাস বসে
বড় একা সর্বস্বান্ত ভূমিহীন চাষির মতন;
সন্ন্যাস পারিনি নিতে, যদিও সন্ন্যাসী এক করে
বসত আমার অভ্যন্তরে, জ্বালায় ধুনুচি আর
ফেলে যায় খড়কুটো, ছেঁড়া কানি, ভস্ম একরাশ।
অকস্মাৎ মধ্যরাতে দিগন্ত ডুবিয়ে কী প্রবল
বৃষ্টিপাত, জলে চোখ, মুখ, চুল খুব ফেটে-যাওয়া
ক্ষেতের মতন আর্ত হৃদয় আমূল ভিজে যায়
এ কেমন ব্যাপক কুহক এলো দু’কূল ছাপিয়ে?
মাথার উপর দিয়ে বয় জলধারা অবিরল;
চোরা টানে কোথায় চলেছি ভেসে? নানা জলচর
প্রাণী আসে ধেয়ে প্রতিষ্ঠিত হিংস্রতায়, হাবুডুবু
খাচ্ছি ক্রমাগত, কুটো নেই আশেপাশে, কোনো তীর
পড়ে না নজরে আর। তবে কি তলিয়ে যাবো শেষে?
কতকাল গেল, তবু আমি আজো সাঁতার শিখিনি।

সিঁড়ির পর সিঁড়ি

সিঁড়ির পর সিঁড়ি বেয়ে উঠছি আমি অনেক দূরে।
দিন দুপুরে রাত দুপুরে
তন্ন তন্ন করে খুঁজি ঘরের পর ঘর।
চামচিকে আর টিকটিকিরা এদিক ওদিক
এলেবেলে করছে বেবাক
গেরস্থালি।

সিঁড়ির ধাপে, কুলুঙ্গিতে নজর রাখি, সারাবেলা
খেলতে দেখি শূন্যতাকে।
হঠাৎ কখন চমকে উঠি, শ্মশান ছেড়ে
চাঁড়াল কেন এখানে এই অন্ধকারে একলা দাঁড়ায়?
কাঁচাপাকা দাঁড়ি-ঝাঁঝাঁ তাড়ির রসে সিক্ত, এবং
চক্ষুজোড়া গোধুলিময় মিনি আকাশ।
কিন্তু কোথায়? যায় না দেখা তাকে এখন,
এক নিমেষে নিরুদ্দেশে দ্রবীভূত।

নিষ্প্রদীপ এই দরদালানে খুঁজছি আমি
স্বর্ণ প্রদীপ? তা নয়, তা নয়,
এমনতো নয়। বনকবুতর ছড়িয়ে গতর বসে থাকে
ফাঁক ফোকরে। হঠাৎ কেমন বাঁশির ডাকে
চট্‌কা ভাঙে। পানির নিচে
শ্বতপাথরের ভাঙা সিঁড়ি কোন পাতালে
নেমে গেছে? সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভেঙে নামছি আমি,
উঠছি আবার, ঘুরছি
শুধু বারংবার।
কাছে-পিঠে জনমনিষ্যি নেইতো কোথাও নিজের কাছেই
নিজেকে আর মানুষ বলে
হয় না মনে।
অন্বেষণে আছি মেতে; কিন্তু কী-যে
অষ্ট প্রহর খুঁজে বেড়াই চক্ষুহীনের মতো আমি-
কার কাছে তার হদিশ পাবো?
সিঁড়ির পর সিঁড়ি বেয়ে তাকিয়ে দেখি
এমন আঁধার শূন্য ক’রে
কোথায় গেল বাসিন্দারা? হাতড়ে ফিরি
একলা শুধু আশেপাশে,
যেন আমি অন্তবিহীন বন্দীদশায় পুরাণ-পুরুষ,
পায়ের কাছে মৃত ঈগল। নিজের নখে
ইতস্তত ছিঁড়ছি নিজের মাংসপেশী,

একটি সোনার মূর্তি দেখি মেহগনি বাক্সটির
তালা খুলে কারো সহযোগিতাবিহীন
সহজে বেরিয়ে আসে এবং সম্ভ্রমবোধে সব
গাছপালা নত হয়, দশদিক থেকে অবিরত
ফুল ঝরে। সেই মূর্তি কিছুক্ষণ শরণার্থীদের
ভিড়ে মাথা নেড়ে, নিষ্পলক তাকিয়ে তাঁবুর চৌহদ্দিতে,
ঘুমে কাদা সান্নাটা বস্তির
আশে পাশে ঘুরে, কিছু প্রাক্তন বিবর্ণ ভোটকেন্দ্র, পৌরসভা,
চলে যায় প্রধান সড়কে।
সোনার মূর্তিটি
কখনো আমার কাছে কমলালেবুর রস চায়,
কখনো বা আমার হাতের
চেটোয় সহজে তুলে দেয় কিছু সুকান্ত অক্ষর,
যেমন নিপুণ যাদুকর চকচকে মুদ্রা দেয়
মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকের হাতে।
মোবারক মিস্তিরির ঘরে
সেই কবে থেকে লাশ পড়ে আছে একাকিনী, তাকে
বাস্তুসাপ স্নেহ করে আপাদমস্তক,-
মোবারক মেথর পট্রিতে খুব যাচ্ছে গড়াগড়ি
বেসামাল খেলনার মতো। পাঁশুটে চান্নির পানি
ভেঙে ভেঙে
নিঃসঙ্গ সোনার মূর্তি একবার লাশের নিকটে,
একবার মিস্তিরির কাছে যায়।
আমাদের এই প্রিয় শহর নিশুত রাতে আজ
আত্মহত্যা করবে নিশ্চিত ব’লে এক
উলঙ্গ উম্মাদ হেঁকে যায়
অলিতে গলিতে, তার চুলের জটায় মোরগের পালকের শোভা,
সে-কথা তোলে না কেউ কানে;
উম্মাদ কেবলি মাতে পুনরাবৃত্তিতে-
চায়ের ক্যান্টিন ছেড়ে বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারে চলে যেতে
তার কোনো দ্বিধা নেই,
এবং যুবক-যুবতীরা শ্লিপিং পিলের গাঢ়
অভিজ্ঞতা মেনে নেয়
অবলীলাক্রমে আর বুড়োরা ভীষণ কাশে,
ক্রমাগত ওগরায় প্রবীণ গয়ের,
সোনার মূর্তিটি রোবটের ভঙ্গিমায় লোকালয়ে
করে পর্যটন।

প্রকৃত মানুষ নয়, কতিপয় কর্কশ শকুনমুখো লোক
আমাদের জাতীয় পতাকাটিকে ঠোকরাচ্ছে সকল সময়।
এই মতো দৃশ্যাবলি দেখে
এই দশকের প্রমেথিউসের হাত
শেকল ছোঁড়ার গানে সঞ্জীবিত হয় পুনরায়।
সোনার মূর্তিটি
আমার উদ্দেশে অকস্মাৎ কিছু শ্লোক
উদাত্ত আবৃত্তি করে, যেন রত্নাকর
দস্যুর ভরাট কণ্ঠে বাল্মিকীর স্বর, নবজাত, অনশ্বর।
আমি শুধু, বিশ্বস্ত স্টেনোর মতো উচ্চারিত বাণী
টুকে নিই নোটবুকে, দেখি
মূর্তিটি গলতে থাকে, গলে গলে হয় লাভাস্রোত।

স্নায়ুর আঙুর

আনিনি এমন ভাগ্য, তার সঙ্গে কোনো এক প্রসন্ন বিকেলে
প্রকৃতি সাক্ষাৎ হবে ফের।
তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও প্রসন্নতা
কোথাও পাবে না কেউ ইদানীং। উপরন্তু সে-ও
নিরুদ্দিষ্ট বহুদিন থেকে
এবং তলিয়ে যাচ্ছি আমি একাকীত্বে ক্রমাগত।

কোনো কোনো বন্ধু মৃত, কেউ কেউ গড়েছে নিবাস
প্রবাসে উৎসাহভরে। এ শহরে যারা
করে বসবাস, তারা একে একে সরে যাচ্ছে দূরে।
যাদের আত্মীয় বলে জানি তাদের পরের চেয়ে
বেশি পর বলে মনে হয়। নির্মুখ ভিড়ের মধ্যে
নিদারুণ অসহায়ভাবে বড় একা থাকি আমি।

নিজস্ব ধরনে কিছু কথা নিচু স্বরে
হাওয়ায় ছড়িয়ে দিই। শ্রোতাহীন ঘরে একা একা
কথা বলা, এই কি নিয়তি?
কিছুই বিশ্বাসযোগ্য আজ মনে হয় না আমার,
কোথাও পাইনা শান্তি, দুঃস্বপ্ন-সংকুল
অন্ধ রাত্রি নেমে আসে, ফেটে যায় ক্রমাগত স্নায়ুর আঙর।

 স্বর্ণ মাদুর

কোথায় ছিল স্বর্ণ মাদুর কোন্‌ গহনে
ছড়িয়ে পেখম আভার?
দু’এক ফোঁটা জলের চিহ্ন ধারণ ক’রে
শ্মশান ধুলায় লুটিয়ে ছিল গুটিয়ে ছিল বুঝি।

কারুর দিকে তাকায়নি সে, কারুর চোখে
পড়েনি ওর বর্ণশোভা-
কী করে হয়? যে দেখে সে দেখেই ফেলে
ধুলোর নিচে, পাতালপুরীর নিঝুম ছায়াতলে।
দৃষ্টিভ্রমের শাসন ছিল জীবন জোড়া,
অভাব ছিল স্থিতির।
কিসের যেন ছটফটানি আমার ভেতর
আন্দোলিত লড়াকু এক মোরগঝুঁটির মতো।

ছদ্মবেশী সে কোন্‌ হরিণ হঠাৎ কখন
ঘর দুয়ারে আসে।
তখন আমি স্বপ্নঘোরে একলা ঘুরি
বনবাদাড়ে; দেহমনে ক্লান্তি জমে শুধু।

নৌকা ভাসাই কত নদীর গহীন জলে,
নামি নানান ঘাটে।
কোথাও তবু পাইনা খুঁজে স্বর্ণ মাদুর,
নিত্য ফিরি সত্তাজোড়া দহন চিহ্ন নিয়ে।

হঠাৎ দেখি চক্ষু মেলে অনেক কাছে
স্বর্ণ মাদুর পাতা।
শান্তি এবং কল্যাণেরই স্মৃতি নিয়ে
ডাকছে মাদুর, উদার বুকে মাথা পেতে শোবো।

Exit mobile version