Site icon BnBoi.Com

রূপের প্রবালে দগ্ধ সন্ধ্যা রাতে – শামসুর রাহমান

অনুপম সৌধ

ক’বছর আগেকার কথা, সময়টা আমার খারাপই ছিল,
বলা যায়। আমার চৌদিকে কিছু ভাঙা ইট, নুড়ি, চুন বালি
বস্তুত ছড়ানো ছিল ইতস্তত। ধূসরিত হাহাকার আর
মাথায় শূন্যতা নিয়ে ছিলাম নিষ্ক্রিয়। আকাশের নীল রঙ,
কিয়দ্দূর থেকে ভেসে-আসা পাখির কোমল ডাক, বাতাসের
ছোঁয়ায় গাছের পাতাদের নেচে-ওঠা-সব কিছু ব্যর্থ ছিল
তখন আমার কাছে। অন্ধকারে হঠাৎ আলোর মতো তুমি
এসে বলেছিলে , ‘এসো এই ভাঙাচোরা বস্তুগুলো বহুদূরে
সরিয়ে দু’জনের এক অনুপম সৌধ নির্মাণের পরে এর
নাম রাখি প্রেমালয়। অনন্তর তুমি আর আমি শ্রমহীন
শ্রমে পড়ে তুলি সৌধ যুগলবন্দির অলৌকিক সুরে।
কী-যে হয়, সাফল্যের শেষ ধাপে তুমি চকিতে গুটিয়ে নাও
হাত, মুখ ফিরিয়ে ভাঙার প্ররোচনায় তিমিরে যাত্রা করো।
জানো না কি তোমার প্রস্থানে প্রেমালয় নিমেষেই ধসে যাবে
স্খলিত দাঁতের মতো? চৌদিকে পেঁচার ডাক; আকাশ বমন
করে রক্তপুঁজ, অসমাপ্ত সৌধ শেষে পোড়ো বাড়ি হয়ে যাবে।
পোড়ো বাড়ি প্রদীপে সাজাই যদি, ব্যর্থ হবে সব আয়োজন;
চামচিকা, বাদুড়ের ক্রোধে অমাবস্যা নিমেষে আসবে ব্যেপে!

অন্তহীন ঘন কুয়াশায়

মোহাম্মদ নোমান স্বরণে

দিনরাতে নিভৃতির নিবিড় মেদুর ছায়া ঘিরে
রেখেছিল আপনাকে। তাই দেখাশোনা
হয়নি তেমন, তবু মনে
কিছু স্মৃতিরেখা জেগে আছে। আপনি কি
রেল লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে
কখনও গেছেন চলে বহুদূরে ঘন কুয়াশায়?
কখনও কি সন্ধ্যেবেলা ঘাসে শুয়ে জোনাকির খেলা
দেখেছেন স্বপ্নাতুর চোখে? আজ এই
পড়ন্ত বেলায় মনে পড়ে,
যখন তারুণ্য ছিল দেহমনে কিটস্‌-এর ওড
আপনাকে বড় বেশি করেছে উন্মন,
মৎস্যকন্যা ডেকে নিয়ে গেছে নীল সমুদ্রের দিকে!
এই দর কষাকষি, ক্রূর ঘষাঘষিময় জগত সংসারে
ছিলেন নিছক বেমানান, বুঝি তাই
ফ্যাসাদ, বচসা, খেয়োখেয়ি
থেকে রেখেছেন
নিজেকে আড়ালে আর একদিন বড়ই নিঃসঙ্গ
হঠাৎ গেছেন মিশে অন্তহীন ঘন কুয়াশায়।

অযৌক্তিক

একজন ভদ্রলোক, ধারালো ছুরির মতো যার চোখ, ঘোর
যুক্তিবাদী, আমাকে খানিক
আপাদমস্তক দেখে নিয়ে নিরাসক্ত কণ্ঠস্বরে
বললেন, এই যে আপনি কবিতায়
কখনও কখনও ডানা-অলা ঘোড়া, মৎস্যকন্যা, পরী
আর দেবদূতদের কথা লেখেন, সেগুলো বড়
অবাস্তব, অযৌক্তিক। এ যুগে এসব
একবারে অচল, বাতিল।
নিরুত্তর আমি দেখি আমার সমুখে বীণা হাতে
সুস্মিত দাঁড়ালো অর্ফিয়ুস, আফ্রোদিতি
সারা গায় সমুদ্রের ফেনা নিয়ে ভাসমান পদ্ম থেকে নেমে
এলেন বিজন ঘাটে। যুক্তিবাদী ভদ্রলোক, তাড়া ছিল তার,
বেরিয়ে গেলেন দ্রুত আমার পড়ার ঘর থেকে
আর আমি খাতার পাতায় কবিতার নিজস্ব যুক্তির কিছু
রূপকল্প খুঁজে পাই। কবিতার খাতা
যেন বীণাপাণির হাঁসের মতো ধ্যানে মগ্ন হয়।

আদিবাসী মেয়েটি

আদিবাসী মেয়েটি পাহাড়, নদী, জ্যোৎস্না আর
পেলব আঁধার ছেড়ে এসেছিল এই
ঝলমলে রাজধানী শহরে নিশ্চিত কোনও চাকচিক্য,
অথবা বেয়াড়া বিলাসিতা কিংবা আহ্লাদের
হেতু নয়, এসেছিল শুধু
নিয়মিত দু’মুঠো তণ্ডুল আর একটি কি দু’টি
শাদামাঠা বস্ত্রের তাগিদে। আদিবাসী
মেয়েটির ছিল না মোটেও পরিচয়
হায়, বস্ত্রহরণ অথবা
ধর্ষণ শব্দের সঙ্গে। কয়েকটি শাহরিক নেকড়ে
তাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে
কর্কশ আঁধার চিরে পাশব উল্লাসে মেতে ওঠে।

যখন সে, আদিবাসী তরুণীটি, আত্মহননের
অন্ধকারে মুক্তি সন্ধানের
অভিলাষে নিঃসঙ্গ দাঁড়ায়, রাজধানী শহরের
মাথা হেঁট হলো না কি চকিতে নিমেষে? অন্তহীন
অন্ধকার করেনি গ্রহণ ওকে, জীবনের প্রবল সংকেত
আড়মোড়া ভাঙে, শুভ আলোয় মেয়েটি স্নানার্থিনী।

আপন ভুবনে

কী-যে হয়, এই
আমার মতোন ঘরকুনো লোকটাও একদিন
বলা-কওয়া সেই ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুড়ে
হঠাৎ পালিয়ে এল এই এলাকায়,
যেখানে কোথাও জনমানবের সাড়া নেই। গলা
ফাটিয়ে ডাকাও নিরর্থক। চতুদিকে গাছপালা
রয়েছে গৌরবে মাথা তুলে আর কাছে একটি সরোবরে
প্রফুল্ল সাঁতার কাটে ক’টি রাজহাঁস।

বেলা বাড়ে, ফলমূল, খেয়ে
মেটাই সুতীক্ষ্ম ক্ষুধা; ডালপাতা দিয়ে আস্তে সুস্থে
বানাই বিনীত ডেরা মাথা গোঁজার এবং শ্রমে
অবসন্ন ভুলে থাকি; আশেপাশে আছে
কি নেই নেকড়ে বাঘ, সাপ খোপ। শুধু মনে পড়ে,
বিরক্তির হুলে জর্জরিত আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি।

গোড়ায় ভালোই লেগেছিল এ বাড়িতে বসবাস,
ভেবেছি নিজেকে সুখী, অথচ ক্রমেই
পূর্ণিমাকে করে গ্রাস অমাবস্যা। মাস না ফুরাতে
ভাড়ারে নাছোড় টান, ধারদেনা শুরু,
ঘিনঘিনে কাদা যেন নিত্য নৈমিত্তিক খিটিমিটি,
উপরন্তু অবিরাম সভাসমিতির
ঠেলাঠেলি, চ্যাঁচামেচি। ফলে সংসারের মুখে থুথু
ছিটিয়ে পালিয়ে আসি নিঃসর্গের শান্তিনিকেতনে।

এখানে হরিণ আসে ভোরবেলা কিংবা জ্যোস্নারাতে
কাঠবিড়ালিরা খেলা করে ডালে ডালে
এবং পাখির গানে গানে বিমোহিত
দিকগুলি। নিশীথের আরণ্যক নিদ্রায় স্বপ্নের
ভেতরে আমার ঘরবাড়ি
চকিতে পাতাল থেকে জেগে ওঠে ফের
মানবিক কণ্ঠস্বর নিয়ে। আমার চায়ের বাটি
দেখছি প্রবালে তৈরি, জ্বলজ্বলে হীরে দিয়ে গড়া
লেখার টেবিল, সংসারের খিটিমিটি
শ্রী চৌরাসিয়ার বংশীধ্বনি, টেলিফোনে ভেসে আসে
ভেনাসের কণ্ঠসুর; জেগে উঠে স্বপ্নকে আদর করি খুব।

ভোরবেলা জনহীন নিসর্গের রূপে কিছুক্ষণ
মগ্ন থেকে অনন্তর পথ চলি, থেমে
তাকাই পিছন ফিরে, ফের হেঁটে যাই, বেলাবেলি
পুনরায় বাজাব কলিংবেল আপন ভুবনে।

একটি তারিখের অন্তরালে

একটি বিশেষ তারিখ খসে-পড়া নক্ষত্রের মতো
লুটিয়ে পড়েছিল আমার বিস্মরণের তিমিরে। অথচ
সেই তারিখের অন্তঃপুরে রয়েছে
যে-ঘটনা, তা সর্বক্ষণ জ্বলজ্বল করে চেতনায়।

চার বছর আগে সেই ভুলে যাওয়া তারিখে তোমাকে প্রথম
দেখেছিলাম এক পাঁচ তারা হোটেলের লবিতে।
তোমার চোখে চোখ রাখার মুহূর্তেই মনে হলো
এই চোখই আমার ধ্রুবতারা। তোমাকে
দেখার আগেই আমার কিছু টুকরো সংলাপের সাঁকো
তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার
ঝলমলে আলো এবং অনেক উৎসুক দৃষ্টি থেকে
নিজেদের সরিয়ে নিয়ে ছায়াচ্ছন্ন এক তপোবনে
প্রবেশ করেছিলাম সন্ধ্যারাতে। সেখানকার গাছ-তরুণীরা
আমাদের স্বাগত জানাল পুষ্পল হাসিতে কৃতজ্ঞতায়
আমার বুকের ভেতর একটি সরোবর ছলছলিয়ে উঠল,
আমার নির্বাক মুহূর্তগুলো তারাভরা
আকাশের নিচে অসীম নিস্তব্ধ গীতিকবিতায় রূপায়িত হলো।
নীরবতা এমন আশ্চর্য বাঙ্ময় হয়ে উঠতে পারে,
এ আমি অনুভব করেছিলাম প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে।

মনে পড়ে সে রাতে তপোবনের উল্লসিত গাছ-তরুণীদের
উদ্দেশে বলেছিলাম, তোমরা কি
সাজাবে আমাদের গোপন বাসর? কেবল
তোমরাইতো সাক্ষী রইলে মিলনের।
ক্যামেলিয়া হাওয়ায় ঈষৎ দুলে স্বর্ণচাঁপাকে কাছে ডেকে
শুভেচ্ছা জানালো আমাদের।
সেই তারিখটিকে আমি এঁদো ডোবায়
ফেলে দিয়েছি ভেবে তুমি অভিমানে ডুবে আছো।
ক্যালেন্ডারের সেই তারিখটাই কি সব? ঘটনার
অনুপুঙ্খগুলো কি কিছুই নয়? বেদনা তোমাকে
কুরে কুরে খাচ্ছে, বুঝতে পারি। কিন্তু একটি তারিখের
মরুঝড় দিয়ে কেন একটা শতচ্ছিন্ন কাগজ করে তুলছ
হৃদয়ের বসন্ত ঋতুকে? তোমার
অভিমানের সামনে আমি নতজানু তবু
জেনে রেখো প্রত্যহ ভোরবেলা যে আলো লুটিয়ে পড়ে পৃথিবীতে
তাকে আমাদের মিলনের দিন ভেবে প্রতিদিন তার মুখ মুখ চুম্বন করি।

ওরা দু’জন

হাওয়া আর সবুজ ঘাসের গলাগলি, মৌমাছির
মুখ ডোবে ফুলের যৌবনে, শূন্য পথে কয়েকটি
ঝরা পাতা, যেন বা স্মৃতির ছায়া। নবজাতকের
আগমনে কলধ্বনি পাশের বাড়িতে, অকৃপণ
সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে কনক চাঁপার উন্মীলনে।
আকাশে একটি দু’টি করে নক্ষত্রেরা আসে, হাসে
মিটিমিটি, পরিবেশ জ্যোৎস্না ঢেলে স্নান করে আর
বিধবার নিঝুম বাড়ির গেটে দাঁড়ায় সুন্দর।

কিয়দ্দূরে আনন্দ প্রচ্ছন্ন ছিল, সুন্দরকে দেখে
ছুটে আসে তার দিকে। গাঢ় আলিঙ্গন; অকস্মাৎ
ককটেল, বোমা ফাটে; উলঙ্গ সন্ত্রাসে চতুর্দিক
কেঁপে ওঠে। জ্যোৎস্নারাতে ভাগাড়কে ডান দিকে রেখে
সুন্দর, আনন্দ-এই অভিন্ন বান্ধবদ্বয় ম্লান
হেসে হাত ধরে দিগন্তের দিকে হেঁটে চলে যায়।

কবি ভাবছেন

অনুষ্ঠানপীড়িত, বয়স্ক একজন কবি ভাবছেন,-হায়,
আমাকে করছে ক্লান্ত ক্রমাগত সংগঠনগুলো।
মঞ্চ থেকে মঞ্চান্তরে চার-পাঁচ ঘণ্টা বসে বসে
প্রতি সন্ধ্যা ভাষণের চাপে আজ ওষ্ঠাগত প্রাণ। কবিতার
রৌদ্রছায়া, রঙধনু আর জ্যোৎস্না থেকে
সরিয়ে আখেরে ঠেলে দেয় অন্ধকার ঊর্ণাজালে।

একটি হাতুড়ি জোরে কবির নিজস্ব সময়কে
ভীষণ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে যখন তখন। সমুদ্রের গভীরতা,
আকাশের সুদূর নীলিমা, দিগন্তের মায়ারেখা
অপসৃত চ্যাঁচামেচি আর
মাইক্রোফোনের নিরন্তর বমনে, কোথাও দূরে
তিনি ফের স্বস্তির আশ্রয়ে
গাছের সবুজ পাতা, পাখিদের ওড়াউড়ি, ঘাসে
গুবরে পোকার বিচরণ দেখে, গাঢ় স্তব্ধতার
ভাষা পাঠ করে কিছুকাল
যাপন করার সাধ রোজ আড়মোড়া ভাঙে।

একটি উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর তাকে চার বছরের কিছু আগে
প্রীত ছুঁয়েছিল, সেই স্বরের নিকট
খুব অন্তরঙ্গ হয়ে তিনি পৌঁছে যান একদিন,
অথচ এখন তিনি ভিড়ের চিৎকারে
মায়াময় কণ্ঠস্বরটিকে কোথায় যে
হারিয়ে ফেলেন মাঝে মাঝে। আজ কবি হট্ররোল থেকে দূরে
ছায়াচ্ছন্নতায় কাঙ্ক্ষনীয় স্বরের গহনে ডুবে
নব্য চিত্রকল্প আর সুরে জীবনকে মাতিয়ে তুলতে স্বপ্নাতুর।

কবিতাকে

কখন যে তুমি আসো, পাশে এসে নিরিবিলি বসো,
তাকাও গভীর চোখে, শুন্‌শুন্‌ করো, ব্যাকরণ
অদূর সরিয়ে গান গেয়ে ওঠো, হঠাৎ কখন
হাওয়ায় মিলিয়ে যাও, বুঝি না কিছুই। ভোরবেলা
জানালার কাছে গিয়ে জনহীন গলিটার রূপে
মুগ্ধ হই যখন, অথবা দুপুরের রগচটা
রোদে কয়েকটি চড়ুইকে খুব নাচানাচি করে
আনন্দ ছড়াতে দেখি কিংবা সন্ধ্যেবেলা জোনাকির
খেলা দেখি ঝোপঝাড়ে, বলা-কওয়া নেই, তুমি এসে
লেখার টেবিলে বসে পা দোলাও কোন্‌ সে সুরের
টানে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। বইয়ের দোকানে বই কিনে
ফেরার সময় অকস্মাৎ তুমি হাতে হাত রাখো।
কখনও প্রত্যহ এই আসা-যাওয়া, কখনও-বা, হায়,
সুদীর্ঘ সময় মায়ামৃগ হয়ে অন্তরালে থাকো।

কোকিলের ডাক

পাখির মতো গেয়ে ওঠে টেলিফোনে; তোমার কণ্ঠস্বর।
এক নাগাড়ে অনেকদিন আকাশ গাঢ় মেঘে-ঢাকা
থাকার পর যেমন রোদ ঝকঝকিয়ে ওঠে, তেম্নি
প্রসন্ন ছিল তোমার মেজাজ। মনে
হচ্ছিল, কয়েকটি হল্‌দে প্রজাপতি তোমার
বুকের ভেতর চঞ্চলতায় চুর। কিছুক্ষণ
এটা-ওটা বলার পর জানালে তুমি ক’দিন থেকে
যখন তখন কোকিলের ডাক শুনতে পাচ্ছ। হয়ত ড্রেসিং
টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছ কিংবা
সোফায় গা এলিয়ে পড়ছ আধুনিক কবিতার কোনও বই,
অমনি ভেসে এল কোকিলের ডাক। এই অকালে
বসন্ত পাখির গান অন্তরে বিস্ময়ের ঢেউ জাগিয়ে
তুলছে, তুমি জানালে টেলিফোনে। বললাম, এখানে
এই শ্যামলীতে ছ’বছর আছি, অথচ একটিবারও কোনও
কোকিলের ডাক শুনিনি। আর যে-কথাটি বলিনি,
সেটি হলো তোমার বিস্ময় আমাকে আদপেই বিস্মিত
করেনি; কারণ, যে কোকিলের গান তুমি অসময়ে
শুনছ বারবার তা আমার হৃদয়েই ব্যাকুল আহ্বান।

ক্ষমার মুদ্রায়

মনে হচ্ছে, কিয়দ্দূর থেকে তুমি ডাকছ আমাকে,
গান যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে সুরের নানা রঙে।
আমার শরীরে কাদা লেপ্টে আছে কিছুকাল থেকে,
কখনও লাগলে হাত গালে অথবা গলায়, কেঁপে
উঠি, আধভেজা ক্লেদ আমাকে পীড়িত করে খুব।
তোমার নির্ভৃত সত্তা থেকে উঠে-আসা সুরধারা
আমার গায়ের কাদা ধুয়ে দেয়। যারা অন্তরাল
থেকে জাল আঁধারে বিছিয়েছিল আমাকে ভাগাড়ে
ফেলে রাখবার হিংস্র বাসনায়, সবিস্ময়ে দেখে
ওরা, তুমি পবিত্র অনলে কী বিনম্র দগ্ধ করে জাল
এই ক্লিন্ন আমাকেই আশ্চর্য সুরভিময় শত
পরাগের স্পর্শে শুদ্ধতায় নিয়ে যাও। বজ্রপাতে
যে-তুমি অনেক দূরে চলে গিয়েছিলে অকালে সন্ধ্যায়,
সে-তুমি আবার এলে খুব কাছে ক্ষমার মুদ্রায়।

গন্তব্যের গান

কী জমাট অন্ধকার চারদিকে, যেন দাঁত আছে
এই আন্ধারের আজ দাঁতগুলো খুব
সহজেই বসে যেতে পারে আমার বাহুতে, বুকে, চোখে মুখে
অথবা পাঁজরে। মোদ্দা কথা,
এই ভয়ঙ্কর, হিংস্র অন্ধকার খুবলে খুবলে
খেতে পারে আমাকে এবং
এই ঘোর তিমিরের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তা’ ছাড়া আমার
গত্যন্তর নেই।

অভীষ্ঠ গন্তব্যে যদি আমাকে পৌঁছতে হয় তা’ হলে এ-পথ
ছেড়ে অন্য পথ
ধরার জো নেই। জানি, পথের দু’ধার
থেকে যত পাথরই গড়িয়ে
পড়ুক, মেলুক ফণা অগণিত সাপ, ধূলিঝড়ে
দু’চোখ আচ্ছন্ন হোক বারবার, আমাকে এগোতে
হবে সুনিশ্চিত কাঁটাময়
বিভ্রম-ছড়ানো পথে, যদিও ঝরছে দু’পা থেকে
তাজা রক্ত; ওপরে তাকিয়ে দেখি চাঁদে
শুয়ে আছে একজন নারী ধ্রুব সৌন্দর্য ছড়িয়ে
একা, বুকে তার অপরূপ
বাসনা যুগল নীড় বেঁধে আছে, বইছে চুলের স্মিত ঝর্ণাধারা।

হঠাৎ হোঁচট খাই পুরনো পাথরে, বৃশ্চিকের
সুতীব্র দংশনে চোখে পানি এসে পড়ে। আমার ভেতরে আছে
যে অক্লান্ত একরোখা সাধকের নিঝুম স্পন্দন,
তার একতারা
উন্মতাল আমাকে বাজায় নানা সুরে আর জীবনের
মেঘ রৌদ্র পথপ্রান্তে পৌঁছে দিতে অনাবিল রসদ জোগায়।

 গেলাম একটি বাগানে

সেদিন শীতবিকেলে আমরা দু’জন
গেলাম একটি বাগানে। তুমি
আমার হাতে হাত রাখোনি, তোমার ঠোঁটে ছিল না
মদির হাসির ঝলক। বাগানে
নানা রঙের ফুল ছিল, অথচ কুসুমপ্রিয় তুমি
আবেগ ভরে করোনি কোনও উচ্চারণ।
বিষণ্ন কোনও গ্রিক দেবীর মতো হেঁটে গেলে
বাগানের এক কোণে; সেখান থেকে
এক মুঠো ছাই কুড়িয়ে তুমি আমার দিকে
ভস্মময় মুঠো বাড়িয়ে দিলে। অনেকক্ষণ পর
অস্বস্তিকর নীরবতাকে ছিঁড়ে
ধ্বনিত হলো তোমার কণ্ঠস্বর, ‘একটি নিরুপম
পাখি তোমাকে উপহার দিয়েছিলাম
এখানে এই বাগানে,
সেই অপরূপ সুন্দর পাখিটিকে পুড়িয়ে
খাক করেছ তুমি।

ময়লা ধুলোর মূর্তির মতো নত মাথায়
দাঁড়িয়ে ছিলাম নির্বাক, নিঃসাড়। হাওয়ার এক ঝটকায়
ঝুরঝুর ঝরে যেতে পারতাম, অথচ অন্তর্গত ঝড়ের
তাণ্ডব সত্ত্বেও রইলাম স্থির। মনে পড়ল,
পাখিটির সারা শরীরে কতই না আদর বুলিয়ে দিয়েছি,
কতবারই না চুম্বন করেছি ওকে
ঝড়ো আবেগে ঋতুতে ঋতুতে। পাখি ছিল
আমার সকল অভিনিবেশের আলোয় সদা স্নাত।

হঠাৎ এক নিশিগ্রস্ত প্রহরে মাথার ভেতর
ভীষণ তোলপাড়, নিষ্ঠার নীলপদ্ম বাজের
চঞ্চু-নখরে ছিন্ন; নিজ হাতে নিমেষে জীবন্ত পোড়াই পাখিকে,
ভস্মরাশি বাগানকে বানায়
শ্মশানভূমি। ভস্মীভূত পাখির দুঃসহ স্মৃতিসহ
আমাকে তুমি নিয়ে এলে এখানে।

যেন কিছুই হয়নি, এইমতো মনোভঙ্গিতে
তোমাকে আলিঙ্গনে বাঁধি, চুম্বন করি তোমার অনিচ্ছুক
ঠোঁটে; আমার মুখ
শিশিরভেজা ভস্মে ভরে যায়। পা দু’টো
কাদায় ডোবে, প্রেতের শীতল আঙুলগুলোর চাপে
আমার চোখের মণি দ্রুত গলতে থাকে এবং
তোমার মুখ প্রজাপতিপুঞ্জ হয়ে
ক্ষমার অগাধ জ্যোৎস্নায় ক্ষণে ক্ষণে স্পন্দমান। এই তো
আমার হাত আহত মাছের মতো
সাঁতার কেটে ভেসে উঠতে চাইছে তোমার স্নিগ্ধ তটে।

গোলাপ, তোমাকে

গোলাপ তুমি কি লুলিয়েছ মুখ ভবঘুরে কোনও
মেঘের আড়ালে? আমার দগ্ধ বক্ষে তোমার
অশ্রুকণারা যে কবে শুকিয়ে গিয়েছে, জানি না।
কত যে ভস্ম হাওয়ায় উড়েছে, তুমিও তো তার
হিসেব রাখোনি। শুধু মনে পড়ে, ফুটেছিলে তুমি
হৃদয়ে আমার খুব নির্জনে। অন্ধ পাখির
ক্রুদ্ধ নখর করেছে ছিন্ন তোমার পরাগ,
বেদনায় কালো হয়েছে হৃদয় হু হু সন্ধ্যায়।
গোলাপ তোমার বোবা কান্নায় ছিল মিশ্রিত
কত অকথিত গাথার বিলাপ বিষাদে গীত।

গোলাপ তোমার উদ্দেশে হাত বাড়ালেই আমি
ইদানিং হায় ছুঁয়ে ফেলি শুধু তুমিহীনতাকে।
মগজে কুয়াশা, দু’চোখে কুয়াশা, কুয়াশা হৃদয়ে;
কাঁটাতারে চোখ ছিঁড়ে যেতে চায়, ফণিমনসার
গোঁয়ার কাঁটার আঘাতে ওষ্ঠ হয় চৌচির,
গোলাপ তোমার সন্ধানে আমি বাউলা হয়েছি!

মেঘদল আর হিলহিলে সব শস্যের মাঠ,
দিঘির পদ্ম, তারাগুলো বলে, পাবো না তোমাকে,
কখনও পাবো না। অথচ নিত্য তোমাকেই খুঁজি,
তোমাকেই দেখি ভোরবেলাকার প্রথম রোদের

ঝর্ণাতলায়, কখনও মেঘের পালকিতে আর
গারো পাহাড়ের গোধূলি রঙিন গাঢ় প্রচ্ছদে,
কখনও নিঝুম জ্যোৎস্নাপ্লাবিত পাকদণ্ডিতে
কখনও রূপালি মহানন্দার প্রখর ধারায়।

ঘরে-বাইরে

আয়নায় নিজের শুকনো মুখ দেখে কেমন অচেনা মনে হয়;
বেশ কিছুদিন থেকে কোথাও যাই না, শুয়ে-বসে
আর পায়চারি করে নিজের ঘরেই আছি। হঠাৎ কী হয়,
একদিন ফুটপাত কাউকে কিছু না বলে ঠিক
ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। কিছুদিন ঘর ছেড়ে
বাইরে বাইরে ঘুরে কাটিয়ে দিয়েছি বহু মানুষের
জটলায়, কোলাহলে। তারপর দেখি একদিন কী খেয়ালে
আমার আপন ঘর এসে খোলা রাস্তায় দাঁড়ায়।
কবিতার মুহূর্ত এখনই-ঘরে বসে ভেবে নিয়ে
তাড়াতাড়ি একটি কলম হাতে তুলে নিই। মগজের নানা
স্তরে ফোঁটা ফোঁটা মধু ঝরে,দোয়েলের গান জাগে
দোলে নীল পদ্ম, পূর্ণিমার বান ডাকে, রাঙা প্রজাপতি ওড়ে
আনন্দের ঢেউ হয়ে। অথচ খাতার পাতা শূন্য থাকে, লাফিয়ে ওঠে না
রঙিন মাছের মতো কোনও পঙ্‌ক্তি। এমনও তো হয়, পথে একা
হেঁটে যাই, মগজের কোনও স্তরে মেঘ নেই, বিদ্যুল্লতা,
অথচ চঞ্চল হয় অলস আঙুল, নিমেষেই
মনোলোকে খাতার বিরান মরুভূমি ইন্দ্রজালে
যেন চোখ জুড়ানো নবীন মরুদ্যান হয়ে যায়।
কিছুদিন আমার নিজের ঘরে চাতক, ধনেশ হরিয়াল,
পাপিয়া, কোকিল, শ্যামা আসর জমায়,
তারপর একদিন উড়ে উড়ে চলে যায় দূরে। পাখিদের স্বরলিপি
শুনতে পাই না বলে মনে
বেদনা আঁচড় কাটে ক্ষণে ক্ষণে। কী-যে হয়, হঠাৎ কখন
ঘর ছেড়ে ঘুরি বনবাদাড়ে পাখির সঙ্গ পেতে। পক্ষীকুল
আমাকে চিনতে পেরে কণ্ঠে অর্কেস্ট্রার
সুর তুলে স্বাগত জানায়।

চেতনায় ধ্বনি প্রতিধ্বনি

এখন আমার চারপাশে মেঘ আর হাড়-কাঁপানো হাওয়ার
ধেয়ে আসা, মাথায় তুষারকণা জমেছে আগেই,
কিন্তু প্রাণে নিত্যদিন বসন্তবাহার
জেগে থাকে কী সহজে। এখনও কত যে
পথঘাট পাড়ি দিতে হয়,
কত খানাখন্দ
পেরিয়ে এগোতে হয়, গায়ে লাগে কাদা, ধুলোবালি
যথারীতি। আমার ভেতরকার সরোবরে ডুব-
সাঁতার কেটেই ধুয়ে ফেলি সব ক্লেদ।
অবজ্ঞা, ধিক্কার তুচ্ছ করার সাহস নক্ষত্রের উদ্ভাসন,
বৃক্ষের স্থৈর্যের কাছ থেকে পেয়ে যাই
বারবার ঘোর অন্ধকার পথে, যেখানে করোটি
আর হাড় রয়েছে ছড়ানো আর নানা
বিভ্রম-জাগানো ধ্বনি-প্রতিধ্বনি চেতনায় বিপন্নতা আনে।

চকিতে দুঃস্বপ্নঘেরা পথে একটি সোনালি হাত
কোমল মুদ্রায় ছোঁয় আমার কম্পিত হাত,
জ্যোৎস্নাভেজা স্বরে
কে যেন অভয় দিয়ে দিয়ে বলে,
‘তোমার মাথার সব কুয়াশা এখনই
ঝেড়ে ফেল, পোক্ত পায়ে পাড়ি দাও পথ,
এই তো এসেছি আমি তোমার আপন ভালোবাসা।

০২
কখন থেকে বসেছিলাম টেবিল ছেড়ে কিছু দূরে,
মনে পড়ছে না। তন্ময়তা আমাকে
ওর মুঠোয় পুরে একেবারে ভুলে গিয়েছিল আমার
তরতাজা অস্তিত্ব। ভেবেছিল আমি বুঝি মাটির ঢেলা,
পাথর কিংবা নিদেনপক্ষে মূর্গির ডিম। হঠাৎ
স্মরণ হতেই মুঠো আলগা করে দিল এবং আমি
নড়েচড়ে বসি, নিঃশ্বাস
নিতে নিতে মনে হলো, আমার ভেতরে কিসের বীজ যেন
চোখ মেলছে, অন্তর্গত মরুভূমিতে ঝরনাধারা
বইতে শুধু করে যেন। সুনসান খেয়াঘাটের মাটিতে
পড়ে-থাকা শুক্‌না পাতাগুলো মাছ হয়ে
পানিতে ঝাঁপ দেয়, পুরনো কয়েকটি বেঁটে বাঁশ

নিমেষে হরিণে রূপান্তরিত। পথের ধারে পরিশ্রান্ত, ঘুমন্ত
একজন কারিগরের হাতুড়ি নেচে-নেচে নুড়ি
আর পুরনো ইটকে পিটিয়ে গুঁড়ো করে
মুক্তো বানিয়ে ফেলে। তন্ময়তা
নিজেই আর কোনো বীজ নয়, হিল্লোলিত শস্য। আবেগে
থরথর আমি নৃত্যপর শস্যকে বুকে জড়িয়ে ধরি।

বুকের ভেতর মরুভূমির দাহ নিয়ে থাকি এখন,
আমার শরীর থেকে তোমরা পোড়া পোড়া গন্ধ কি পাও?
আমাকে রোজ পোড়ায় কিছু হিংস্র মানুষ পালা করে
কখনও ফের বুকের মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে বন্য কুকুর।

সন্ধ্যারাতে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে বাঁকানো হাত,
হাতের মুঠোয় রক্তে ভেজা কেমন দু’টো চোখের মণি।
ধেড়ে ইঁদুর তেড়ে আসে প্রাচীন কালের গর্ত থেকে,
অন্ধ বাউল হু হু পথে গান গেয়ে যায় অচিন পাখির।
হরহামেশা এক রূপসী আমায় কঠিন জেরা করে,
যেন আমি কাঠগড়াতে নজরবন্দি ঘোর আসামী।
আমার হাতে আমি নিজেই বেলাবেলি খুন হয়েছি,
অন্য কোনও কসুর ছাড়াই পাচ্ছি সাজা ঘন ঘন।

ইচ্ছে হলেই শিকারি সব কুকুর থেকে অনেক দূরে
থাকতে পারি; কিন্তু ওদের ক্রূর থাবার ধারে কাছে
ঘুরে বেড়াই সুধার জন্যে। আমার যিনি মনোনীতা
পারেন তিনি সুধার পাত্র বাড়িয়ে দিতে ওঠে আমার।

জেরায় আমি কুঁকুড়ে থাকি, ঝরনাধারার মতো সহজ
কথা মনে কুসুম ফোটায়, হৃদয়ে রঙধনু জাগে-
এমন বোধে আস্থা রেখে পথ চলেছি সারাবেলা;
অথচ হায়, খাচ্ছি হোঁচট, পদে পদে রক্ত ঝরে।

প্রেমময়ীর হৃদয় থেকে নির্বাসিত থাকব আমি
কেমন করে? কেমন করে কাটবে প্রহর তার বিহনে?
পদ্য লিখে, মদ্য পানে, আড্ডা দানে সুখ পাব না,
হৃদয়জোড়া হাহাকারে থাকব নিয়ে শূন্যতাকে।

ছায়া

গাছের ছায়ার দিকে একজন লোক
তন্ময় বিছিয়ে রাখে চোখ
কিছুক্ষণ, যেন ছায়া কিছু কথা বলবে নরম স্বরগ্রামে
লোকটাকে। বহু হাঁটাহাঁটি হ’ল, খানিক বিশ্রামে
এখন নিমগ্ন থাকা যায়
অপরূপ এই হলদে বিকেল বেলায়,
ভাবে সে নীরবে ঠাঁই নিয়ে,
নিরিবিলি মিশে গিয়ে
ছায়ার ভেতর। মেঘ, রোদ, পাখি স্পন্দমান পাতা
দেখে তাকে; ঘাসের বালিশে রাখে মাথা
লোকটা, পাজামা বেয়ে ওঠে
দু’চারটে পিঁপড়ে আর হাওয়ার আরাম লাগে ঠোঁটে,
খোঁচা খোঁচা দাড়িময় গালে
এবং কপালে।

বৃক্ষটির ছায়ার ভেতর থেকে আরও বেশি গভীর ছায়ায়
লোকটা প্রবেশ করে, নিজে ছায়া-প্রায়
হয় ক্রমে। কিছুক্ষণ ধরে তার মাথার ভেতর
জমছে ছায়ার নানা স্তর।
সন্ধ্যা নামে, গাঢ় হয়, কয়েকটি জোনাকি সেখানে
জ্বলে আর নেভে, লোকটা কি কারও টানে
ফের হেঁটে যাবে বহুদূর? আপাতত আকাশের তারা গুণে
আর স্বপ্ন বুনে
আস্তে সুস্তে কাটাবে সময় আরও কিছুক্ষণ আর
নীড়ে ফেরা পাখিরা ভাববে কোনও পিছুটান নেই লোকটা।

জনৈক লেখকের কথা

জনৈক প্রগতিশীল লেখক ভাবেন, হায় আজ
শহরের পথে দেখি গহীন গাঙের নাও আর
দূর গাঁয়ে বানের পানিতে
ভেলায় বেহুলা ভাসে লাখিন্দর বিনে। কত শত
আশ্রয়হীনের হাত প্রসারিত ত্রাণের উদ্দেশে
কে জানে মরণ আর জীবনের নির্দয় লড়াইয়ে
কার জয় কার পরাজয় হয় আখেরে এখানে? সব দিকে
আন্ধারে উঠুক ফুটে শুভবাদী আলোর নাচন।

চকিতে লেখক চলে যান বাইরের দুনিয়ায়-
চীনেও ভীষণ বন্যা, ইরানে কি মুক্ত হাওয়া বইবে আবার
শিগগিরই হঠাৎ, আফগান নারী আর
শিশুদের জন্যে বড় মায়া হয়। তবে কি উদগ্র তালেবানি
বর্বরতা স্থায়ী হবে? সমাজতন্ত্রের
ঝকঝকে রোদে হবে না কি দূরে শেষে
এ যুগের ঘোর অমানিশা? রাত বাড়ে, লেখকের
প্রবল ঝিমুনি আসে, হাতে কাঁপে ডাস ক্যাপিট্‌ল।

জনৈক স্বেচ্ছাবন্দির স্বগতোক্তি

কোথাও যাই না আজকাল, থাকি গৃহকোণে একা;
খুব কি খারাপ আছি স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে?
ব্যালে নর্তকীর মতো রোদ্দুর, চাঁদিনী, বারান্দার
টবের গোলাপ, বই সঙ্গে দেয় নিঃশর্ত আমাকে। মাঝে মাঝে
ছয় বছরের পৌত্রী আমাকে খেলায় টেনে নেয়
হাসিখুশি; সবচেয়ে বেশি
আমার নিঃসঙ্গ সময়কে ভরে তোলে
একজন মানবীর টেলিফোনবাহী প্রিয় কথার কুসুম।

আহত হরিণ আমি, যার শিং জটিল লতায়
ভীষণ জড়িয়ে গেছে; যত মুক্ত হতে চাই, ততই আটকে
যেতে থাকি। অমাবস্যা-রাতে
গুহাবাসী অপদেবতারা নিশ্চুপ বেরিয়ে এসে
ক্রূর দাবা খেলায় আমাকে হিঁচড়ে নিয়ে
মুক্তিপণ দাবি করে। অন্তরের আলো প্রভাবে
সতেজ হাওয়ায় কিছুদিন
স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিই। ওরা দূরে থাকে,
অথচ পাকায় ঘোঁট সারাক্ষণ, অতর্কিতে ফের
কোনও ঘোর চাঁদিখেকো রাতে
শিকারি কুকুর হয়ে ঘিরে ধরে নিমেষে আমাকে
আমারই নির্জন ঘরে। ছিন্ন কণ্ঠনালী, রক্ত ঝরে; এইমতো
দুঃস্বপ্নের ঊর্ণাজাল ছিঁড়ে মাঝে মাঝে
বোবা আর্তনাদ করে ঘামে নেমে উঠি।

কখনও-কখনও মধ্যরাতে এক দেবদূত এসে
ঘুম থেকে ডেকে তোলে চুপিসারে আর পাশা খেলায় জানায়
আমন্ত্রণ; বাজি ধরে, যদি জিতে যাই,
তবে কবিতার কিছু অবিনাশী পঙ্‌ক্তি পেয়ে যাব,
হেরে গেলে মরণ নিকটবর্তী হবে অতি দ্রুত। হা কপাল,
কালেভদ্রে জয়ী হই, প্রায়শই পরাজয় মেনে নিতে হয়।

তবুও মনে প্রানে

আছেন এ শহরে অনেক সুন্দরী,
তবুও মনে প্রাণে চাই যে তোমাকেই।
বলি না তুমি নও দেখতে মনোরমা,
তোমার আছে জানি অতুলনীয় মন।

তোমার জন্যেই আমার কত রাত
কেটেছে নির্ঘুম; যখনই লিখি কিছু,
তোমারই মুখ ফোটে পাতার বুক জুড়ে,
দাঁড়াও এসে তুমি স্বপ্নময় মোড়ে।

কখনও তুমি হাস্যে ঝর্ণাধারা হয়ে,
কখনও কথা বলো ঝরিয়ে মাধুর্য,
তোমার স্বর হয় জ্যোৎস্না অনুপমঃ
কখনও অন্তরে ফোটাও শুধু হুল।

তোমাকে ভেবে ভেবে কাটাই দিনরাত,
অথচ ভাবো তুমি আমার অবহেলা
তোমাকে কোনও ঠাঁই দেয় না ভাবনায়!
আমার অন্তরে তুমিই আছ জেগে।

তোমার অতৃপ্তি তোমাকে বারবার
গোপনে কুরে ছিঁড়ে খাচ্ছে আমাকেও;
আমার স্বপ্নেরা ভস্মে পড়ে চাপা।

তাতে কী

একদিন প্রিয় মুখ, গাছপালা, ফুল
রোদ, জ্যোৎস্না, বৃষ্টিধারা, বইপত্র হঠাৎ দু’চোখ
থেকে মুছে যাবে; শুনব না কারও কথা,
পদধ্বনি, কোকিলের কুহু তান, দোয়েলের শিস,
রবীন্দ্রসঙ্গীত। শুধু কারও কারও ঠোঁটে
কখনও হয়তো মৃদু নেচে উঠবে আমার নাম, জানব না।

লেখাপত্র ধূসরিমা নিয়ে
থাকবে ফাইলবন্দি দেরাজের নিবিড় আঁধারে,
বইগুলো ধুলোম্লান থাকবে এবং
কলম গোপনে অশ্রুপাত
করে করে গুমরে মরবে স্তব্ধতায়। কেউ কি কখনও ভুলে
তুলে নেবে সেই শীর্ণ নিভৃত কলম?
থাকব না এই ঘরে, টেবিলে ঈষৎ ঝুঁকে লিখব না আর,
আসবে না ঘন ঘন চায়ের পেয়ালা
অথবা সংবাদপত্র পোহাবে না রোদ বিছানায়।
তাব না, তাতে কী? ভোরের আবর্জনাময় পথে
একটি গোলাপ দিব্যি হাসিমুখে থাকবে এবং
ছেলেমেয়েদের দল ছুটে যাবে শিউলি কুড়াতে
এবং শ্রাবণ পূর্ণিমায়
যুবক শোনাবে যুবতীকে প্রেমকথা নিরিবিলি।

 তোমার আসা, না-আসার উদ্দেশে

দূরগামী পাখিদের বুক থেকে ভরসন্ধ্যা নেমে পড়তেই
বুকশেলফ্‌ থেকে
প্লেটোর রিপাবলিক লরেল পাতার মালা নিয়ে,
রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা যূথির স্তবক নিয়ে
গালিবের দিওয়ান গোলাপ,
ইয়েটস্‌ লাইলাক, ড্যাফোডিল নিয়ে
এবং লালনগীতি চন্দনের ফোঁটা নিয়ে আর
নিঃসঙ্গ অধম আমি সারা পথে প্রতীক্ষার ফুল
বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্যেই আর
এই হৃদয়ের স্পন্দন ক্রমেই দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে শুধু।

এই তো এসেছ তুমি। নইলে কেন আমার এ-ঘর
‘এসো, এসো’ সম্ভাষণে গুঞ্জরিত? কেন প্রজ্বলিত
দীপ? কেন বেজে ওঠে সারেঙ্গি, দোতারা, এস্রাজ, সরোদ?
গহন সৌন্দর্য নিয়ে বসলে অদূরে নিরিবিলি
মধ্যবিত্ত আসনে, তাকালে জানালার বাইরে খানিক, যেন
আকাশের নক্ষত্র এবং বৃক্ষশোভা
ঘরের ভেতর ডেকে আনবে এখনই। ইচ্ছে হলো
তোমার একান্ত কাছে গিয়ে বসি, হাতে হাত রাখি।

আমার চোখের পাখি তোমার চোখের নিরালায়
গভীর প্রবেশ করে বলে-
‘তোমাকেই ভালোবাসি খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে থেকে। অনন্তর
তোমার ওষ্ঠের প্রজাপতি নিবিড় আবৃত্তি করে,-
‘আমার হৃদয় আমি তোমাকেই করেছি অর্পণ
বুদ্ধের জন্মেরও আগে থেকে। ঊর্ণাজালে কম্পমান মহাকাল।

অকস্মাৎ দেখি তুমি নেই এখানে কোথাও, বড়
একা বসে আছি অন্ধকার ঘরে। হায়, তবে কেন
তোমার উপস্থিতির মরীচিকা ও সৌরভ মগ্ন চেতনায়
ভেসে উঠেছিল? তুমি প্রকৃত আসোনি, এই সত্য মেনে নিয়ে
প্লেটোর রিপাবলি, রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা,
এবং লালনগীতি আমাকে প্রবোধ দিয়ে যে জায়গায়
চলে যায়। তবে কি অবোধ আমি তোমার নিভৃত আসা-গুলো
মনের খেয়ালে সৃষ্টি করে চলি কবিতার মতো?
ভাদ্রের ক্ষ্যাপাটে তাপে সারাদিন মাছভাজা হয়ে সন্ধ্যারাতে
ঘরে ফিরে চমকে তাকাই-কী আশ্চর্য, এক কোণে
প্রেমের কবিতা হয়ে মানবীরই বেশে। জ্বলজ্বলে
হাতটা বাড়িয়ে দিলে ঋদ্ধ ঐতিহাসিক ভঙ্গিতে,
অথচ নিশ্চিত নম্র সুরে বাঁধা আধুনিকা তুমি। গলিপথে
বেবিট্যাক্সি হাঁপানি রোগীর মতো ধুঁকতে ধুঁকতে
চলে যায়; আমরা দু’জন বসে থাকি পূর্ণিমার প্রত্যাশায়।

তোমার একটি স্বপ্ন

সেদিন তোমার দুপুরের একটি স্বপ্নের কথা
বললে আমাকে। ঘুমের বড়ি খেয়ে অনিদ্রার টকটকে চোখে
ধুলো দেওয়ার জন্যে তুমি গা ঢেলেছিলে বিছানায়। কয়েক
মিনিট না কাটতেই দেখতে পেলে
তোমার মাথার ভেতর গজিয়ে উঠেছে একটি গাছ
আর চারপাশে ঝোপঝাড় আর তোমার
করতলে একটা কদম ফুল ফুটে উঠল এবং
পর মুহূর্তেই কদম ফুল রূপান্তরিত ক্যামেলিয়ায়।

মেঘে ঢাকা আকাশ যেমন বিদ্যুচ্চমকে
খরায় ন্যাড়া মাটির মতো চৌচির হয়ে যায়,
তেমনি তোমার মগজ যেন হয়ে গেল
কোনও চিত্রকরের রাগী তুলির আঁচড়।

আবার দেখলে তুমি কখনও আরশোলা,
কখনও টিকটিকি রূপে ঘরের ধূসর দেয়ালে
হামাগুড়ি দিচ্ছি। তুমি ঘুমিয়েছিলে নাকি আধো ঘুমে
আধো জাগরণে তোমার সময় করাতের দাঁতে
ঘষটে যাচ্ছিল, কে বলবে? মনে হয়,
তোমার স্বপ্নটি মাকড়সার জালে আটকে পড়া পোকা।

আর হ্যাঁ, মনে পড়ল অনেক আগে তুমি বিজ্ঞানীর
কল্প-কাহিনী পড়েছিলেন, যিনি মাকড়সা বিষয়ে গবেষণা
করতে-করতে পেয়ে গেলেন সেই অষ্টপদী
কীটের অবয়ব, কিন্তু মাথাটা তার নিজেরই রয়ে গেল।
এরপর থেকে কোনও বড়সড় মাকড়সা দেখলেই তুমি
ভয়ার্ত চোখে ওর মুখে আবিষ্কার করতে মানুষের মুখ।
অথচ আমি নিশ্চিত জানি, তুমি কখনও
কাফকার কোনও গল্পই পড়নি।

তোরঙ্গ

আমাকে একটি রঙিন তোরঙ্গে পুরে তালা লাগিয়ে
দিলে তুমি। অপরিসর তোরঙ্গে কোনওমতে
হাত-পা মুড়ে পড়ে ছিলাম। শ্বাস রোধ হয়ে
আসছিল আমার। সে কী যন্ত্রণা, বোঝানো যাবে না।
কেন যে তুমি আমাকে এভাবে আটকে রেখেছিলে, সেই
গূঢ় কথা আর কেউ না জানুক, আমার অজানা নয়।
মাঝে-মাঝে তোরঙ্গ খুলে আমাকে দেখতে, নিবিড়তম
চুম্বনে মাতাল করে তুলে প্রিয়তম বন্দিটিকে। আমার
শ্বাসকষ্ট অস্তমিত হতো কিছুক্ষণের জন্যে। আবার
বন্ধ নয়ে যেত রঙিন তোরঙ্গের ডালা।

রুদ্ধ তোরঙ্গে আমার ডাক আসতো মাঠের থৈ থৈ
সবুজ, আকাশময় নক্ষত্র-চুমকি, বর্ষারাতের প্রথম
কদম ফুল, আমার লেখা না-হাওয়া কবিতা আর
সবচেয়ে বেশি, তুমি বিশ্বাস করো আর না-ই করো,
তোমার বুদ্ধি ঝলসিত, লাবণ্যময় মুখের। তোরঙ্গ থেকে
আমার আহ্বান তোমার হৃদয়ে ঢেউ জাগাত কিনা
জানি না। তোমার স্বপ্নের ভেতর তুমি যে কখনও কখহও
অনিন্দ্য পুলকে ঈষৎ কেঁপে উঠতে, সে-তো আমারই নিঃশ্বাসে।
ঘুমভাঙা রাতে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ করলেই
দেখতে পেতে আমার নিঃশ্বাসের দাগ।

একদিন অতর্কিতে হারিয়ে ফেললে তোরঙ্গের চাবি।
চাবি হারিয়ে তুমি প্রায় উন্মাদিনী হয়ে গেলে আমার
পরিণামের কথা ভেবে। আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার
আশঙ্কায় তোমারই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল খুব।
দিশেহারা তুমি হাতুড়ির কড়া আঘাতে চুরমার
করে ফেললে তালা আর আমি বেরিয়ে এলাম, যেন
মৃত্যুপুরী থেকে অর্ফিয়ুস। উচ্ছ্বসিত ঝরণার মতো তুমি
জানলে, তপোবনপ্রতিম উদ্যান, খোলা হাওয়া, আকাশের
নীলিমা, লাল পদ্মময় দিঘির ঘাট, আর নদীতীরে যখন
থাকি, থকনই আমি তোমার হৃদয়ের অন্তরঙ্গতম বাশিন্দা।

 দুঃস্বপ্নের ঘোর থেকে জেগে

হঠাৎ স্খলনে আমার নিজেরই দোষে
কুঁকড়ে রয়েছি সদা মানসিক চাপে।
বিব্রত খুব আমার আমিকে নিয়ে,
পুড়ছি এখন প্রখর মনস্তাপে।

ছিল দিনগুলি রঙধনুময় প্রেমে,
পথে যেতে-যেতে পা রেখেছি পাতা ফাঁদে;
চিদাকাশ হলো শূন্য ধূসর ভুমি,
হয়েছি বিদ্ধ ক্ষমাহীন অপরাধে।

প্রতারক এক সুরের ক্ষণিক মোহে
সর্বনাশের কুহক এনেছি ডেকে;
গৃধিনীর কালো পাখার ছায়ায় দেখি
আমার ভুবন নিমেষে গিয়েছে ঢেকে।

তার ভালোবাসা ছিল তো অতুলনীয়
তবু কেন হায় ভিন্‌ ছলনায় ভুলি?
অপরূপ প্রিয়্য বাগানের শোভা ছেড়ে
চোরাবালিতেই কেন যে কুড়াই ধূলি!

দুঃস্বপ্নের ঘোর থেকে জেগে ভাবি-
তার বিশ্বাসে ধরিয়েছি আজ চিড়;
দিয়েছি বাড়িয়ে ক্ষতির সীমানা তার,
আমাদের ঘিরে থাকে পিশাচের ভিড়।

প্রেমের অতনু দেবতাকে বলি, শোনো,
শপথ তোমার, শুদ্ধ হতেই চাই।
পীড়িত, দগ্ধ আমার সত্তা থেকে
দিয়েছি ঝরিয়ে কুৎসিত সব ছাই।

দৌহিত্র প্রিয়-র জন্মদিনে

নতুন পথিক তুমি, সবে যাত্রা শুরু
দুর্গম জটিল পথে; গন্তব্য অজানা, তবু হেঁটে
যেতে হবে বহুদূর। দীর্ঘ এই পথে
নানা বাঁক আছে, ঝোপেঝাড়ে
আছে ওত পেতে হিংস্র জন্তু, হয়তো-বা
কোথাও কোথাও চোরাবালি
রয়েছে মোহন রূপে। কোথায় যে কুহকের জাল
থাকে পাতা, সহজে পায় না টের ক্লান্ত পথচারী।

এই যে আমাকে তুমি দেখছ এখন বসে আছি
একা ঘরে, ভগ্নস্বাস্থ্য, সমস্ত শরীরে নিয়ে বয়সের ক্রূর
আঁচড়, দু’চোখে ক্ষীণ দৃষ্টি, শোনো প্রিয়।
একদা আমিও এই প্রফুল্ল তোমারই মতো উড়িয়েছি ঘুড়ি
আর কবুতর নীল আসমানে, কুড়িয়েছি ফুল
শিউলি তলায় কত সতেজ বিহানে। জেনেছিতো
আনন্দ বিহনে প্রাণে বিপুলের তরঙ্গ জাগে না,
অজানা সম্মুখে এগোবার প্রেরণার স্পন্দন নেই।

বুঝেছি আনন্দ আহরণের হাড়ভাঙা খাটুনি কি
সুবিপুল আয়োজন-কিছুরই হয় না প্রয়োজন। শুধু নিজ
অন্তর জাগিয়ে রেখে হাওয়ায় পাতার নড়া, পাখির উড়াল,
বৃষ্টিধারা কিংবা জ্যোৎস্না দেখা,
গাঙের পানির ধ্বনি আর রাঙামাটির পাহাড়ে
ডাগর চাঁদের নিচে গান শোনা অযাচিত অপরূপ উপহার, যার
স্পর্শে চিত্তশুদ্ধি হয় নিমেষে এবং
বাঁচবার তীব্র সাধ জাগে, যেন পুষ্পউন্মীলন।

বহু পথ হেঁটে বহু প্রান্তর পেরিয়ে
অনেক মরীচিকার স্মৃতি নিয়ে
জেনেছি জগতে শিল্প আর জ্ঞানময় প্রেম বিনা
নিরর্থক সব কিছু। শোনো,
ব্যাপক আন্ধারে হাতে নিয়ে একটি প্রদীপ আজও
পথ চলি, এই দীপশিখা তিমিরের প্রাণীকুল
এক ফুঁয়ে সর্বদা নিভিয়ে দিতে চায়। প্রিয়, তুমি
আমার এ দীপশিখা থেকে নেবে কি জ্বালিয়ে আরেকটি দীপ?

ধ্রুবপদ

বহুক্ষণ বসে আছি অন্ধকার ঘরে, ধারে কাছে কেউ নেই,
এরকম আন্ধারের কথা
জীবনানন্দের কবিতায়
অনেক পড়েছি আর সীমাহীন রহস্যময়তা
গূঢ় অনুভব করে নিজেরই ভেতর
হয়েছি অক্লান্ত পর্যটক। ত্র্যাশট্রেতে
পড়ে আছে চুরুটের বাসি ছাই। নাকি সুদূরের
নক্ষত্রের ছাই?

যখন এ-ঘরে ছিলাম না,
কেউ কি এখানে এসেছিল? নইলে কেন
এই বাসি ছাই, কেন আমার লেখার প্যাড এমন নির্লজ্জ
খোলা পড়ে আছে টেবিলের বুকে আর
একটি অচেনা পুঁথি আমাকে ইঙ্গতে কাছে ডাকে
বারবার? একটু পরেই একজন
দরজায় দাঁড়ালেন একতারা হাতে। আমাকে জিজ্ঞাসু দেখে
বলেন ঈষৎ হেসে তিনি, ‘আমি লালন ফকির। ও পড়শী
ধ্রুবপদ রচনায় কতদূর পারবে তুমি সিদ্ধির ভুবনে
হেঁটে যেতে, এসেছি পরখ করে নিতে।

নিঝুম কাফেতে

বহুদিন পর সেদিন হিমেল রাতে
ছিলাম দু’জন নিঝুম কাফেতে বসে।
কফির পেয়ালা ছিল সম্মুখে রাখা।,
মুহূর্তগুলো পড়ছিল মৃদু খসে।

কথোপকথনে আমরা উঠিনি মেতে,
হয়েছে কেবল দৃষ্টির বিনিময়।
তার হাত আর আমার হাতের মাঝে
ছিল কবোষ্ণ ঘনিষ্ঠ পরিচয়।

অনুরাগে তার দৃষ্টি যখন কাঁপে
হাওয়ায় মোমের নবীন আলোর মতো,
হৃদয়ে আমার জলতরঙ্গ বাজে,
করোটিতে ফোটে শত তারা অবিরত।
রাস্তার পিঠে হাওয়ার চাবুক পড়ে;
আমাদের মনে কত অনুক্ত কথা।
তার অন্তরে গুপ্ত কী আছে আজও,
আমি বই সব জানবার ব্যকুলতা।
বাধা সত্ত্বেও পেয়েছি মিলন-সুখ,
অমাবস্যায় জ্বলেছে তো পূর্ণিমা।
হিংসুটে সব মনের বিকার থেকে
রেখেছি মুক্ত স্বপ্ন-সাধের সীমা।

কিন্তু এখন ভূমিকম্পের পরে
মনে হানা দেয় বারবার কী যে ত্রাস!
প্রেমময় এই মধুর ক্ষণেও ভাবি-
ভয়াবহ কিছু করবে কি সব গ্রাস?

আমাদের মুখে যুগের করাল ছায়া,
স্মৃতিতে পুরাণ-প্রাণীদের হিংস্রতা।
শিকরি কুকুর নিত্য করেছে তাড়া,
বারবার থাবা মেলেছে বর্বরতা।

নিঝুম কাফেতে আছি তার মুখোমুখি,
তবুও নিজেকে লাগে অসহায়, একা।
ব্যাপক আঁধারে এইটুকু দীপশিখা-
যুগসঙ্কটে তার সাথে হলো দেখা।

নির্বাসনের পরে

এখন আমি অসুস্থ কুকুর যেন, নিস্তেজ, ঝিমোনা,
অথচ ঘুম নেই। মশা, মাছি, পিঁপড়ে, গুবরে পোকা
সারাক্ষণ বিরক্ত করছে, সহ্য করি ওদের উৎপীড়ন মুখ বুজে,
ওগুলোকে তাড়াবার ইচ্ছে পর্যন্ত হয় না,
এমনই নিরুদ্যম আমি। কখনও
তন্দ্রাচ্ছন্নতায় দেখি, এক ঝাঁক দাঁড়কাক আমার
শরীরকে ভীষণ ঠুকরে ঠুকরে
শতচ্ছিন্ন ন্যাকড়া বানাচ্ছে, ছোরাসদৃশ
চঞ্চু দিয়ে উপড়ে ফেলছে হৃৎপিণ্ড। খুব কাছে থেকে
এই দৃশ্যে মজা লুটছে
ক’জন জাঁহাবাজ মাস্তান আর জুতোর ডগায়
নাচাচ্ছে কয়েকটি করোটি, মুখে ক্রূর হাসি।

হায়, কী সেই সময়! কোকিলের গান ছাড়াই
গুণীর বাদ্যযন্ত্রের মতো ঝংকৃত হতো
মুহূর্তগুলো; কোথাও কোনও ফুল নেই, অথচ
আমার চুতুর্দিক সুরভিত সারাক্ষণ। না ডাকলেও কোত্থেকে
চলে আসত কয়েকটি রাজহাঁস। তখন
তোমার কথার পাপড়ি আর হাসির ঝর্ণাতলায়
নিত্য নিয়েছি বিশ্রাম। তোমাকে
একটু দাঁড়াতে কিংবা বসে থাকতে দেখলে মনে হতো
বসন্ত আমার সত্তায় ছড়িয়ে দিয়েছে সজীবতা হঠাৎ
হাভাতে জ্যোৎস্নাখেকো মেঘ গিলে ফেলে পূর্ণিমাকে।

তারপর থেকে এই নির্বাসিত আমি-র স্বস্তি নেই, শান্তি নেই;
কাটে নির্ঘুম রাত। অনুশোচনার ক্রুশকাঠে বিদ্ধ
আমি যন্ত্রণার অন্তহীন সেতু পেরোতে গিয়ে
হোঁচট খাই বারবার। চোখের পাতা বুজে আসে,
কিন্তু আমি কি ঘুমাতে পারি
তোমার অপ্রসন্নতার কণ্টকময় তিমিরে?

আবার অলৌকিক তরঙ্গ স্পর্শ করে আমাকে;
নির্বাসনের পরে তোমার উদার প্রসন্নতা তারার ঝর্ণা হয়ে
ঝরে আমার ওপর এবং
মনোজ আনন্দ নিকেতনে কবির বসবাস।

 নির্বাসনের বিরুদ্ধে

কে আমাকে স্বর্ণচাঁপা এবং গোলাপ থেকে দূরে নির্বাসনে
এখনই পাঠাতে চায়? কার হাত আমাকে সরাতে
তৎপর দোয়েল, বুলবুল আর কোকিলের মহফিল থেকে?
না, আমি যাব না এ রকম নির্বাসনে। সৌন্দর্যের
স্তব রচনায় অনলস এই আমি
সুন্দরের মাঝে বসবাস করে যেতে চাই বিরতিবিহীন।
আমার চুম্বনে কত স্বর্ণচাঁপা, গোলাপ, চামেলি,
জুঁই, বেলী সুখে কেঁপে উঠেছে অজস্রবার আর
দোয়েল, পাপিয়া, বুলবুল, কোকিলের
সুরেলা আসর
আমার সান্নিধ্য চেয়ে হয়েছে ব্যাকুল বারবার। প্রতিদিন
আমিও রেখেছি পেতে কান প্রিয় পাখিদের গানের উদ্দেশে।

হে আমার মনোনীতা, আমি শুধু জানি
তুমি আছো ফুলের শোভায়, ঝর্ণাধ্বনি
এবং গায়ক পাখিদের কলতানে। যে-হাত আমাকে আজ
ফুল, পাখি, ঝর্ণা সরোবর থেকে দূরে
নির্বাসনে দিতে চায়, বস্তুত সে তোমার আমার
মধ্যে বিচ্ছেদের দীর্ঘ কালো রেখা টেনে দিতে প্রবল আগ্রহী।
তাহলে কী করি বলো এ যুগ-সঙ্কটে।
থাকি প্রতিবাদহীন, নিই মেনে এই নির্বাসন?

পাখি ও মানুষ

ব্যথিত পাখিটি তার কাছে এসে নিশ্চুপ দাঁড়ায়
সমর্পিত দৃষ্টি তার। কিছু শুশ্রূষার
প্রয়োজন ওর আছে ভেবে
লোকটা পাখিকে আরও ঘনিষ্ঠ বলয়ে ডেকে নেয়। হিংস্রতার
চিহ্ন বুকে বয়ে সেই আহত পাখিটি
উৎসুক লোকের ডাকে সাড়া দেয়, যদিও মানুষই
তাকে মরণের হিম স্পর্শ দিতে ব্যাকুল হয়েছে গোধূলিতে
পাখি ও মানুষ সখ্যে অন্তরঙ্গ হয়।

পারত যদি

পারত যদি সাজিয়ে দিত গোলাপ দিয়ে
তোমার ঘরের শূন্যতাকে।
তোমার সঙ্গে আস্তে সুস্থে বসত গিয়ে প্রবাল রঙের
চুপ সিঁড়িতে গোধূলিতে।
তোমার হাতের রাঙা পাতায় নিরিবিলি
আঁকত কিছু স্বপ্নরেখা।
পারত যদি তোমায় নিয়ে নীলাকাশে
কাটত সাঁতার মেঘের গাঙে।

দাঁড়িয়ে ছিলে স্পষ্ট রোদে
মেরুন শাড়ির লাজুক ভাঁজের শোভায় একা;
কিয়দ্দুরে তিনটি চড়ুই চঞ্চলতায় মেতেছিল।
ঘিরে রঙের উলে-বোনা কার্ডিগানে
রোদালো শীত বাধা পেয়ে তোমার গালে
চুমো আঁকে; দৃষ্টি তোমার কিসের খোঁজে শ্যামা পাখি?

পুরনো সেই বাড়ির কত ছায়া-ছায়া স্মৃতি এখন
মধ্যদিনে হৃদয় জুড়ে শঙ্খচিলের
মতোই কেঁদে বেড়ায় ধু ধু। কেমন একটা
বাঁশির ধ্বনি বিদায়বেলার দৃশ্য কিছু ডেকে আনে।

পারত যদি বাংলা ছাঁদের একটি বাড়ি
তৈরি করে লন বানাত,
তোমায় নিয়ে বসত দবিজ সবুজ ঘাসে,
খোঁপায় দিত গোলাপ গুঁজে।
হয়ত তোমার কানে কানে গুণগুণাত
নতুন যুগের পদ্য কিছু;
সেসব পদ্যে থাকত কী-যে জানত শুধু
বড়ই ব্যাকুল দু’টি হৃদয়।
পারত যদি মগ্ন কবি তোমার সকল
সাধ মেটাত কথায় কাজে।
তোমার জন্যে যিশুর মতোই
খুন-ঝরানো পায়ে হাঁটত এই শহরে,
পরত শিরে কাঁটার মুকুট সারা বেলা,
খুনী ডাকাত চোরের পাশে বিদ্ধ হতো কালো ক্রূশে।

পারত যদি ধ্যানী কবি অর্ধাহারে, অনাহারে
তোমার জন্যে অমর গাথা লিখত জানি।
বুকের রক্তে লেখা সেসব পঙ্‌ক্তিমালা
দেখে সুদূর দেবদূতেরা উঠত জ্বলে
সবুজচোখে ঈর্ষা নিয়ে, দস্যুবেশে
লুটে নিতে চাই কবির ভেতর-দৃষ্টি, মেধা মনন।

পুরস্কার

শূন্য থেকে কিছু কাব্যপঙ্‌ক্তি টেনে আনার সুবাদে
কয়েকটি ছোট পুরস্কার পেয়েছি আমিও
কখনও কখনও
স্বদেশে বিদেশে আর মালায় ভূষিত
হয়েছি প্রচুর আর জুটেছে গুণীর
সতর্ক প্রশংসাবাণী কিছু। ধন্য বোধ
করেছি নিজেকে খুব, অকুণ্ঠ স্বীকার করি। নিন্দার কাদাও
প্রচুর নিক্ষেপ করে কেউ কেউ সবেগে আমার বুকে পিঠে
সুখ্যাতির জ্যোৎস্নারাত এবং কুৎসার অমাবস্যা
করেছি যাপন যথারীতি।
এতকাল পর মনে হয়, যখন আমাকে দেখে
বুড়ো আর শিশুদের মুখে আনন্দের ঝরনা ঝরে,
তখন আমার কাছে পৃথিবীতে এর চেয়ে বড়
আর কোনও পুরস্কার নেই।

ফোটাও কালো হুল

নিজেকে ভোরবেলা কেমন ফাঁকা লাগে,
দুপুরে ক্ষণে ক্ষণে হৃদয় করে ধু ধু,
বিকেলে ঝরা পাতা গুমরে ওঠে মনে,
অসিত রাতে বোবা আর্তনাদ শুধু।
তোমার বিরূপতা তীক্ষ্ণ শর হলে,
শক্র ঘেরা দিনে কীভাবে বলো বাঁচি?
আহত জন্তুর মতোই এক কোণে
আঁধার চোখে নিয়ে একলা পড়ে আছি।

ভাবিনি তুমি এত কঠোর হতে পারো,
তোমার কথা আজ এসিড অবিরত।
তোমার আচরণ তর্জমাতে হয়-
ইঁদুর মুখে নিয়ে বেড়াল ক্রীড়ারত।
আমাকে মোচড়ানো সহজ অতিশয়,
কেন না আমি দিগ্‌ভ্রান্ত পথচারী।
ভ্রষ্ট স্মৃতি নিয়ে চলাই হলো দায়,
অপরাধের বোঝা ক্রমশ খুব ভারী।

দুর্বিপাকে আজও তোমাকে শুধু চাই-
এটাই সারকথা, তা ছাড়া বাদবাকি
তুচ্ছ জানি আর আমার ব্যাকুলতা
ভেবো না প্রিয়তমা সিগারেটের ছাই!

যতই তুমি আজ ক্রোধের বশে এই
কবির অন্তরে ফোটাও কালো হুল,
সইব দংশন, আঁচড় মুখ বুজে,
বুঝবে একদিন তোমারই ছিল ভুল।

বন্ধু, ফিরে এসো

কোন্‌ সে কুহক এতো তাড়াতাড়ি জন্মন্ধ গুহায়
তোমাকে প্রবল টেনে নিয়ে গেল? তোমাকে এখন
ভোরের পাখির গান, আসমানে পায়রার ওড়া,
গোধূলির রঙ কিংবা সবুজ পাতার শিহরণ-
কিছুই টানে না আর আগেকার মতো। নির্বিকার
একা বসে থাকো ঘরে। খবরের কাগজ পড় না,
এমন কি কবিতার বইয়ের পাতায় বুলাও না
চোখ আজ ভুলেও ক্ষণেক। তাহলে কি বন্ধ ঘরে
এভাবেই দিনযাপনের পালা রাখবে তোমার?
অথচ একদা এই তুমিই আনন্দ-ভেলা বেয়ে
গ্যাছো কতো সামান্যের ঘাটে। অধরাকে ধরবার
আশায় রয়েছ জেগে দিনরাত। মনে পড়ে না কি
দ্বিপ্রহরে কোকিলের অকালের গান টেলিফোনে
শোনাতে আমাকে কোনও কোনও দিন উৎফুল্ল উৎসাহে?
বন্ধু, ফিরে এসো পারিপার্শ্বকের দৃশ্যের গন্ধে, রঙে

বর্ষার কবিতা

এখন গলির গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে, বুকে তার
রোমক রথের ধাবমান ঘোড়াদের
দাপট; গাছের পাতা, ঘাসের সবুজ ডগা কী আশ্বাসে ভেজা
চোখ তুলে চেয়ে থাকে। আমি একা ঘরে
বাতি জ্বেলে বর্ষার কবিতা
লেখার আশায় বসে আছি, কিন্তু একটি পঙ্‌ক্তিও
মেঘের ওপারে থেকে খাতার পাতায় নামছে না। এমনকি
একটি কি দু’টি গুঁড়ো কিংবা কণা নেই, ছায়া নেই।

মহাকবি কালিদাস, সুদূর বৈষ্ণব পদাকর্তাগণ আর
রবীন্দ্রনাথকে ডাকি ঘন ঘন, মিনতি জানাই
এবং করুণা ভিক্ষা করি
কয়েকটি মেদুর ছত্রের জন্যে। প্রবল বাতাস
আমাকে উড়িয়ে নেয় আকাশে আকাশে। মেঘমালা
আমাকে পুরনো সখা ভেবে আমার চাদ্দিকে নাচে,
কোমল জড়িয়ে ধরে, কেউ কেউ অবলীলাক্রমে
মাথায় প্রবেশ করে, আমি বৃষ্টিসম্ভব কাজল মেঘ হই।

এবার নিশ্চিত লেখা হয়ে যাবে বর্ষার কবিতা ভেবে দ্রুত
কাগজে আঁচড় কাটি, অথচ হোঁচট খাই, একটু পরেই
খঞ্জের ধরনে, থেমে যায়
কলমের গতি আর আমাকে প্রখর ছেয়ে ফেলে
রাশি রাশি কয়লার গুঁড়ো। কোন্‌ এল নিনিওর
উষ্ণ স্রোত করেছে হরণ
সমুদয় সবুজ আমার? বুঝি তাই মনের প্রাঙ্গণে আজ
বাজে না নূপুর বর্ষণের। বর্ষার কবিতা তাই
অলিখিত থেকে যায়, ধুলো ওড়ে
হৃদয়ের ধু ধু চরে, উড়ে উড়ে কাঁদে তৃষ্ণাতুর পাখি।

খাতা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকি কিছুক্ষণ। অকস্মাৎ
মনে হল, গৌরী এসে দাঁড়িয়েছে টেবিলের পাশে, বৃষ্টিস্নাতা।
আমার হতাশ কাঁধে হাত রেখে বলে সে শ্রাবণ-
রাতের মোহিনী স্বরে, ‘একদা সেই যে আমি নিভৃতে
বর্ষায় ভিজেছিলাম আমার প্রথম শাড়ি পরে,
সেই ভেজা রূপ ভেবে নিয়ে কবি লেখো না বর্ষার
গহন কবিতা এক। নিমেষে আমার চেতনায়
সৃজনপ্রবাহ খেলে যায়; বর্ষা হয়ে ওঠে ক্রমশ কবিতা

বিষাদ আমার পাশে নেই

বিষাদ আমাকে আজ হু হু গোধূলিতে জনহীন
নদীতীরে হাত ধরে নিয়ে
এসে আস্তে বাসিয়ে দিয়েছে। তবে লাল
সূর্য ডুবে গেল কালো মেঘে, মাঝিহীন নৌকা ভাসে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে, মুখোমুখি আমি
এবং বিষাদ নীরবতা
পোহাই, কেমন রিক্ত, ধু-ধু মন; দেখি,
দিগন্তরেখায় খাটে কে যেন শায়িত একা, স্পন্দহীন মমি।
বিষাদ আমাকে বলে হাওয়ার মতোন ফিসফিসে স্বরে, দ্যাখো,
সেখানে নিঝুম তিনি ঢুলছেন বরফের মতো
পাথর নিঃসঙ্গলগ্ন নৈঃশব্দ্যের কঠোর-শীতল
শেকলে সম্প্রতি বন্দি নতুন প্রমিথিউস, যার
যকৃৎ এখন ঠুক্‌রে ঠুক্‌রে খাচ্ছে ক্রূর প্রাচীর ঈগল। মানুষের
জন্যে যাঁরা জ্বালেন জ্ঞানের
মুক্তির প্রখর আলো, রয়েছে তাদের জন্যে অশেষ পীড়ন
আর অমরতা।

খসে-পড়া একটি নক্ষত্র বিষাদের হাতের চেটোয় নাচে, আস্তে মুঠো
বন্ধ করে বিষাদ করুণস্বরে স্বগত-ভাষণে মেতে ওঠে-
আমাদের ঋদ্ধ শওকত ওসমান,
এখন আপনি সীমাহীন নৈঃশব্দ্যে লীন। আপনার
কথকতা নিথর তুষারাবৃত ঝর্ণাধারা, অথচ এখনও
কত কথা বলবার ছিল; সেসব অব্যক্ত কথা
আজ মেঘে মেঘে, লতাগুলো, প্রবীণ নদীর জলে,
গাছের পাতায় খুব স্তব্ধ হয়ে আছে।

হঠাৎ বিষাদ তার আঙুল উঁচিয়ে ধ্যান থেকে
আমাকে জাগিয়ে তুলে করে ফিসফিস উচ্চারণ, দ্যাখো, দ্যাখো,
ঐ তিনি যাচ্ছেন হেঁটে দ্রুত পায়ে মৌলবাদ আর
ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সভায়। আমি
বিভায় দীপিত তাঁর অনুগামী হই; চেয়ে দেখি আপাতত
বিষাদ আমার পাশে নেই। একাকিত্বে অবিচল
অভ্রচূর্ণে গড়া পথে অবিরাম হেঁটে চলি আর
মরীচিকা-ঝলসিত ধবধবে শূন্যতায় মুখ ঢেকে যায়।

বিষাদকে অন্তরালে রেখে

জ্বলজ্বলে একটি আসর ছিল, মাঝে মাঝে আমরা ক’জন
উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব কি পশ্চিম থেকে এসে
যে যার আসনে বসতাম। সে আসরে সূর্যোদয়, গোধূলিতে
রঙ আর জ্যোৎস্নার জোয়ার ছিল ঝিলের কিনার, সচকিত
হরিণের জলপান ছিল,
ঝাউপাতা আর দোয়েলের গান ছিল। কোনও কোনও
মধ্যরাতে অকস্মাৎ দূরের আকাশ থেকে নেমে
নক্ষত্রেরা জুড়ে দিত নাচ আর আমরা ক’জন
মুগ্ধতায় মনের গহনে
দিতাম ডুবসাঁতার বিষাদকে অন্তরালে রেখে।

সকলের নয়, কারও কারও মনের নানান স্তরে
থাকে কিছু অন্ধকার-সেই অন্ধকার
কখনও কখনও লকলকে জিভ হয় লোভে আর
লালসায়, কখনও-বা ফণা হয়ে কাউকে কাউকে
ছোবলায়, জানা ছিল বান্ধব তোমার।

ছিলাম সবাই রাজা, ছিল না প্রজার
ধাঁচ কারও, সে তোমারই নেপথ্য আচারে। কী-যে হ’লে,
একদিন, বন্ধু তুমি, কাউকে কিছু না বলে সে আসর ছেড়ে
উঠে গেলে। ফিরলে না আর।

কোন্‌ অভিমানের কুয়াশা
তোমাকে রাখত ঘিরে? তোমার হাসির অন্তরালে
বেদনার কিছু মেঘ জমেছিল, অনেক প্রহর
তোমার প্রফুল্ল সাহচর্যে কাটিয়েও কখনও পাইনি টের।
‘গুডবাই’ ছিল না তোমার ওষ্ঠে, এমন নিভিয়ে,
ভাবতে পারিনি। আমাদের
ব্যাকুল আহ্বান ব্যর্থ হলো, ব্যর্থ হতে
থাকবে সর্বদা। একে-একে
আমরা সবাই যাব, চলে যাব, জানি না কখন;
এই আসরের গল্প বলবার মতো থাকবে না কেউ আর।

বুকে টেনে ঘ্রাণ নিই

ওগো খোলা জানালা, তোমার জন্মদিনটির মাথা
বুকে টেনে ঘ্রাণ নিই কিছুক্ষণ। কতবার দেখেছি তোমাকে
স্নোহার্দ্র দৃষ্টিতে আর কতবার খুব কাছে নিয়ে
গালে গাল রাখতেই আমার হৃদয়
হয়েছে উৎসব, তার হিশেব কি রেখেছি কখনও? কোনওদিন
ভুলেও ভাবিনি তুমি স্পন্দহীন জড়বস্তু কোনও।
দিবারাত্রি পেয়েছি তোমার সাড়া আর
ধূসর আমাকে সাজিয়েছে নানা রূপে ওগো খোলা জানালা আমার।

আজ যে তোমার জন্মদিন, কে আমাকে বলে গেল? বলে গেল
ইট বালি কাঠ লোহালক্কড় এবং নীল পাখি।
ওগো খোলা জানালা, তোমার জন্মদিন উপলক্ষে
স্বপ্নে-পাওয়া কেক আমি আজ কাটব না, জ্বালব না
একটিও মোমবাতি। তীক্ষ্ম ব্লেডে ঝরাব বুকের রক্তধারা,
তুমি চেটে খেও। কালপুরুষ আসবে নেমে ঘরে।

ওগো খোলা জানালা, কত যে ভালো লাগে
আমার, যখন ভাবি অন্ধকার, রোদ, জ্যোৎস্না, হাওয়া-
সবাইকে ডেকে নাও ভেতরে উদার আমন্ত্রণে। মাঝে-মাঝে
একটি কি দু’টি পাখি অথবা প্রফুল্ল প্রজাপতি
হয়েছে অতিথি ক্ষণিকের। অবশ্য কখনও কোনও
জোনাকিরা আসে না, অথচ কোনও কোনও মধ্যরাতে
তোমার ঈষৎ ইশারায়
ডানা-অলা-কেশর-দোলানো ঘোড়া আসে;
তার পিঠে চড়ে সাত আসমানে উড়ে বেড়িয়েছি
বহুবার সগৌরবে। আমার পছন্দ এই উড্ডয়ন আর
যখন হঠাৎ দেখি তুমি ধরে আছ স্নেহভরে
তার মুখ, যাকে
একবার ছুঁয়ে দেখবার বাসনায় যুগ যুগ প্রতীক্ষা মানিয়ে যায়।

কখনও নিমগ্ন গোধূলিতে ঘরে ঢুকে চমকিত
তাকিয়ে সম্মুখে দেখি মেঘনার কিছু ঢেউ তোমার সৌজন্যে খেলা করে
তোমারই শরীরে, ঘরময়, ভিজি জলহীন জলে
কী সহজে অবিরল। লাল নীল পদ্ম ভাসে, জলপরী জল

ছিটোয় আমাকে লক্ষ্য করে। কখনও-বা
প্রখর দুপুরে দ্যাখো আমি একটি কবিতা লিখে
ফেলার প্রয়াসে কয়েকটি অপ্রাপ্ত শব্দের খোঁজে
কীরকম নাজেহাল ক্রমাগত। কৌতুক তোমার
ঠোঁটে ফোটে; পরে সেই অন্বিষ্ট, অধরা পঙ্‌ক্তিমালা
ধরা দিলে সারা ঘরে বেজে ওঠে তোমার সানন্দ করতালি।

ওগো খোলা জানালা আমার,
যত অভিমান করো কিংবা রাগে ফোঁসো,
যতদিন স্পন্দমান বুক নিয়ে আছি, ততদিন
নীল আকাশের মতো নিজেকে উন্মুক্ত রেখো সকল সময়।

বেদে

একজন সুকান্ত বেদেকে প্রায় প্রতিরাতে স্বপ্নে দেখি, তার
ঠোঁট কাঁপে যেন কিছু বলবার আছে,
অথচ হয় না বলা কিছুতেই। এত দিনে তার মুখ বিশদ মুখস্থ
হয়ে গেছে আমার এবং
যখন কখনও জানালার বাইরে তাকাই, হাঁটি
বারান্দায়, অথবা লিখতে বসি, সধূম চায়ের পেয়ালায়
ওষ্ঠ রাখি, চোখের সমুখে সেই মুখ
ভেসে ওঠে, নিষ্পলক চেয়ে থাকে হতবাক আমার দিকেই।

কখনও কখনও সেই মুখ
সালভাদর দালির ঘড়ি হয়ে গলে যেতে থাকে
তারপর অকস্মাৎ একগুচ্ছ জলপাই হয়ে
শূন্যে ঝোলে, কখনও বা হরিণের প্রাচীন ভঙ্গুর
করোটিতে সহজে রূপান্তরিত। করোটিতে একটি গোলাপ
গুঁজে রেখে গেছে যেন কোনও নারী, যার
চৈতন্যে মধুর চন্দ্রোদয়। বেদে তাকে বহু যুগ
ধরে বুঝি ব্যাকুল বেড়ায় খুঁজে নদীতীরে, বিজন প্রান্তরে, লোকালয়ে।

কখনও যে সেই বেদে আমার ভেতরে কী কৌশলে
প্রবেশ করেছে, ঠিক বুঝতে পারিনি। বারবার পথ ডাকে,
জলপাইবন, দ্রাক্ষাকুঞ্জ ডাকে ইশারায় আর ঢ্যাঙা ডিঙি
দুলে দুলে জানায় মোহন আমন্ত্রণ, ধু ধু চর বাসর গড়বে ভেবে
বেদের সারিন্দা হাতে গান গাই অমাবস্যা আর
পূর্ণিমায়। কেউ কি আরশিতে মুখ দেখে পুলকিত
ফিকে অন্ধকারে। অন্ধকার কত গাঢ় হ’লে তাকে
রাত বলা যায়, এই প্রশ্ন বেদেকে উত্তাল নদী করে তোলে।

মনোজ অঞ্জলিতে

কবিতা লেখার আগে আমার ভেতরে যে কী তোলপাড়
শুরু হয়, লেগে যায় কিছু শব্দের কী তুমুল হুড়োহুড়ি।
ও ওকে ঠেলে এগোতে চায়, একে অন্যের পা মাড়িয়ে কনুইয়ের
গুঁতো দিয়ে দিব্যি নিজের জায়গা করে নিতে ব্যগ্র। কারও
কারও মাথা বেশ ঠাণ্ডা, দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ,
ধীর স্থির সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। অন্যেরা অবসন্ন হয়ে পড়লে
একটু একটু করে ফাঁকা পথে এগিয়ে যায় ওরা প্রায় কোনওরকম
ঘেমো চেষ্টা ছাড়াই প্রথম সারিতে জায়গা পেয়ে যায়।
ওদের চেহারায় থাকে না ক্লান্তির ছাপ, গায়ে তন্ন তন্ন করে
তালাশ করলেও পাবে না কোনও আঁচড়ের চিহ্ন।
কবিতার ওরা, মনে হতে পারে অবলীলাক্রমে মিশে
থাকে, যেমন গাছের পাতায় সজীব সবুজ, লাল গোলাপে
সোরভ, সঙ্গীতে সুরধারা। সেসব শব্দ কি অন্তরালের
ছায়ায় বসত যার, সেই সরস্বতী অশেষ কৃপায় তার
অধর থেকে ঝরিয়ে দেন আমার নিরন্তর প্রতীক্ষা-কাতর
অঞ্জলিতে? সেই অধর থেকে ঝরা প্রতিটি শব্দই অব্যর্থ, নতুন।

 মুখের ওপর মাকড়সার জাল

দরজার সামনে গিয়ে হঠাৎ অপ্রস্তুত হলাম। আগে কখনও
এই দরাজ, সুকান্ত দরজার মুখে এমন কঠিন্য দেখিনি।
আমাকে দেখলেই সে উদ্ভাসিত হতো হাসিতে, ‘এসো, এসো’
ধ্বনি বেজে উঠত ওর কণ্ঠে বাঁশির সুরের মতো। প্রতিহত
আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থতা
আমার মুখ ম্লান করে দেয়। অন্দর মহলে খবর পাঠাবার
জো নেই। বিরূপ দরজা থেকে মুখ ফিরিয়ে আমার পথ চলা।
বহুদূর হেঁটে হেঁটে এক বিরান জায়গায় চোখে পড়ে কার্ডফোনের
বুথ। আশান্বিত আমি ক্ষণকাল পরে বুঝতে পারি টেলিফোন
বিকল; পথে নামতেই মাথার ওপর এক বদমেজাজি পাখির পাখসাট।

আবার সেই দরজার উদ্দেশে যাত্রা। চেনা বাড়িতে ঢুকতে না
পারলে আমার স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। গন্তব্যে পৌঁছে দেখি,
এবার দরজা খানিক খোলা। মনে চকিতে কিসের দোলা লাগে,
তাহলে দরজার কাঠিন্যের বরফ গলেছে। একটু চাপ দিতেই
খুলে যায় দোর। পা বাড়াই। ভেতর মহল বড়ো সুনসান। নিদ্রায়
নিঝুম কি সবাই? সিঁড়ি পাশে রেখে ড্রইং রুমে প্রবেশ
করতে যার, পথ আগলে প্রসারিত মাকড়সার জাল। এই জাল
এমন শক্ত হতে পারে জানা ছিল না। জাল ছিঁড়ে এগোই।

অন্ধকার সোফায় সেই মানবীকে দেখি, যার জন্যে এখানে
আমার আসা। আমার উৎসুক প্রশ্ন ‘কেমন আছো?’ নিরুত্তর
সে। খুব কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখি, যেন রক্তমাংসের কেউ নয়,
পাথরের মূর্তি। মূর্তির শীতলতায় আমার হিমপ্রবাহ। হঠাৎ
একটা শব্দে ঘরের নীরবতা আক্রান্ত। দেয়াল থেকে পড়ে যাওয়া
বস্তুটি কুড়িয়ে নিয়ে দেখি সেই মানবীর কৈশোরের কোমল
ছবি। ভালো করে দেখে, খানিক আদর বুলিয়ে ওর শৈশবকে
টেবিলে রেখে পাথরের মূর্তির দিকে তাকাই আবার।

শত চেষ্টা সত্ত্বেও আমি ঘরে আলো জ্বালতে অক্ষম। হিংসুটে
অন্ধকার তার দাঁত বসিয়ে রেখেছে সারা ড্রইং রুমে। আমার
ঠোকর খেয়ে মেঝেরে কার্পেট কী যেন কাৎরে ওঠে। ঝুঁকে আবিষ্কার করি
আমারই লেখা কবিতার বই, আরশোলার মল আর কীটের কামড়ে
ভীষণ জব্দ, আহত। এই জখমি বইটিকে কোথায় রাখব ভেবে
পাই না। টেবিলে রাখব? নাকি মেঝেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে
থাকবে, যেমন দুর্ঘটনায় পথচারী? ভেবে পাই না। আমার
পা একটু টলে যায়। বইটি টেবিলে রাখলে মানবীর কৈশোরের
পাশে ওকে মানাবে না। আমার হাতেই রয়ে যায়। বইয়ের পাতাগুলো
থেকে উঠে আসা আর্তনাদ শুনে মনে হলো আমার অন্তর্গত
হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে সারা বাড়ির আনাচে কানাচে। বিকেলে
ড্রইং রুমের পাথরের মূর্তির চোখে সন্ধ্যার শিশির।

মোহিনী জলাশয়ে

নিত্য কে আমাকে করছে চুরমার?
খেয়াল খুশিমতো গড়ছে পুনরায়।
কখনও ছন্দের দোলায় মাতায় সে,
ছন্দছুট রাখে কখনও দিনরাত।

সাঁতার জানা নেই, নেমেছি ক্ষ্যাপা জলে;
জলে ঝাপ্টায় আহত চোখ মুখ।
তবুও ভেসে থাকি ঘূর্ণি জলে আর
আখেরে প্রাণ নিয়ে ডাঙায় ফিরে আসি।

আমাকে যেতে হবে গহন বনে একা,
যেখানে শ্বাপদেরা রয়েছে ওত পেতে।
পেরিয়ে গেলে বন মিলবে সরোবর,
সেখানে ডুব দিলে পাবই অমরতা।
অথচ সারা পথে পাশব হুঙ্কার,
আমার চার পাশে কেবল পাতা ফাঁদ।
লক্ষ্যে পৌঁছুতে না পারি যাতে, তাই
হিংস্র পশুদের রয়েছে আনাগোনা।

আমার ছিল সাধ কঠোর সাধনায়
কাব্যে মুক্তির আনব রঙধনু।
কিন্তু বারবার সাধ্যে ধরে ঘুণ,
ভাবে ও আঙ্গিকে ঘটে বিপর্যয়।
তবুও সরোবরে প্রায়শ ডুব দিই,
মুক্তো খুঁজে নিতে গহনে হাতড়াই।
শূন্য হাতে ফিরে কৃষ্ণ সন্ধ্যায়
আবার চেয়ে থাকি মোহিনী জলাশয়ে।

যখন বৃষ্টি পড়ে

দিনটি শুরুই হয়েছে ঘন মেঘময়তা আর ঘোর
বর্ষণ নিয়ে। শ্রাবণ তার সারা গায়ে গায়ে কাজল শাড়ি জড়িয়ে
এসেছে আমার আপন শহরে। আমি একজন
উজ্জ্বল নারীকে জানি, যে আষাঢ় আর শ্রাবণের
কৃষ্ণবরণ মেঘ এবং রাধার মতো আকাশেচেরা বিদ্যুল্লতা
দেখে আবেগবিহ্বল হয়ে পড়ে।
যখন বৃষ্টি পড়ে রিমঝিম কিংবা ঝমঝমিয়ে, তখন
তার হৃদয়ে সেতারের ঝালা, রক্তে রবীন্দ্রনাথের গানের
তন্ময়তা, বহু যুগের ওপারে বাঙ্ময় স্তব্ধতা।
সে যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়
সবুজ লনে, ফুলগাছের পাতায় বৃষ্টি ধারা দেখে
ওর মনে পড়ে যায় কবেকার কোন-শূন্য মন্দিরের কথা,
মনে পড়ে সদ্য যৌবনের প্রথম শাড়ি পরে
কেমন নেচে উঠেছিল বৃষ্টিময় দুপুরে খোলা ছাদে,
নিজের অজান্তে ওর কণ্ঠে পল্লবিত হয়েছিল
বর্ষার মেঘমন্দ্রিত গান।

বর্ষা-আন্দোলিত সেই নারী তার শূন্য মন্দিরে
বসিয়েছে যে-কবিকে, বৃষ্টিধারায়, ভেজাপাতার ঘ্রাণে
সে-ও মোহিত, কিন্তু দীর্ঘকাল পুরোনো শহরে
বসবাস হেতু বর্ষার উদগ্র মাতলামি তার অসহ্য ঠেকে।
শহর-ভাসানো কলুষিত জল উজিয়ে হেঁটে আসা-যাওয়ার
পথের স্মৃতি তার মুখ আর মন ম্লান করে দেয় আজও।


আকাশ মেঘে-ঢাকা, তুমুল জলধারা দিচ্ছে ধুয়ে আজ শহরটিকে,
ভেজা দুপুরে দেখি পথিকহীন পথ, কাকেরা আশ্রয় খুঁজছে।
গহন বর্ষার ছায়ামেদুর গান গুঞ্জরিত মনে, শূন্য মন্দির এবং
কেমন হাহাকার বুকের প্রান্তরে বইতে থাকে হু হু রাত্রে।

যক্ষ নই কোনও, তবুও আষাঢ়ের কিংবা শ্রাবণের মেঘের ঘটা
হৃদয়ে ব্যাকুলতা সৃষ্টি করে আজও হঠাৎ চুপিসারে একলা ঘরে।
বাইরে চেয়ে থাকি, আকাশ জুড়ে তার মুখের ছায়া দেখি, অথচ
আমার এ বয়সে নেহাৎ বেমানান এমন ব্যাকুলতা, সত্যি।

কিন্তু বর্ষার এমনই মোহময় প্রভাব হায় ছোটো পড়ার গৃহকোণে দেখছি
আমার এই একাকীত্ব আর আমি বসেছি মুখোমুখি নিশ্চুপ।
শ্রাবণধারা মনে জাগায় তাকে কাছে পাওয়ার সাধ এই নিমেষে;
আমার বাসনা কি ছিন্নপত্রের মতোই ভেসে যাবে জলধারায়?

আজকাল বাস্তবের ঝাঁ ঝাঁ রোদ থেকে সহজেই
স্বপ্নের ছায়ায় চলে যাই। সেদিন দুপুর বেলা
‘গীতবিতানে’র পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কখন যে
নির্জন সমুদ্রতীরে পা রেখেছি, বলা ভার। তটে সমুদ্রের
ওগরানো শঙ্খ থেকে ভেসে আসে কিন্নরের গান। হেঁটে যায়,
কখনও বাউল আমি কখনও বা ঐবাদুর; দেখি
সম্মুখে রূপালি সরোবর, তীরে বীণা আর হাঁস
আছে পাশাপাশি, দূরে শিমুল গাছের ছায়া পোহায় হরিণ।

পরের মুহূর্তে উদ্ভাসিত অপরূপ গুলবাগ,
যেখানে গৌরবে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস,
শ্রী মধুসূদন দত্ত, লালন ফকির, নজরুল ইসলাম
এবং জীবনানন্দসহ তিরিশের কবিকুল
আর ছায়াপ্রায় কেউ কেউ উপবিষ্ট ক’টি রূপালি আসনে,
স্বতন্ত্র রবীন্দ্রনাথ স্বর্ণাসনে সমাসীন, তাঁর
মাথায় মুকুট। কবিদের সমাবেশ ঘিরে নক্ষত্রের নাচ
চলে, ঝরে শত পারিজাত।

সমাবেশ লক্ষ্য করে এগোতেই একজন দীর্ঘকায় লোক,
মুখ তার কাঠিন্যখচিত, বলে দৃঢ় স্বরে, ‘যাও,
চলে যাও, এখানে আসন নেই আর। বাধা পেয়ে খানিকটা
দমে যাই, ক্ষণকাল পরে নিজেকে সামলে নিয়ে, কণ্ঠে ঢেলে
অনুনয় বলি ‘আমি চাই না আসন কোনও, শুধু
এতটুকু ঠাঁই পেতে চাই তাঁর, রবীন্দ্রনাথের
উদার পায়ের কাছে, যদি তিনি অনুমতি দেন। অনুমতি
পেলাম কি পেলাম না, বুঝতে পারিনি শেষাবধি।
মেঘ এসে ঢেকে দেয় মুখ আর আমি
নিজের নিকট থেকে দূরে বহুদূরে চলে যাই। ভাসমান
দেহমনে কবেকার জলরোষ, ভগ্নতরী, শামুকের, জলজগুল্মের
ঘ্রাণ পাই। একটি গৈরিক আলখাল্লা কম্পমান
দিগন্তরেখায় ক্ষ্যাপা বৈশাখী হাওয়ায়, আত্মমগ্ন বংশীধ্বনি
আমাকে জাগিয়ে তোলে বলে মনে হয়।

রূপালি মুকুট

এইমাত্র লোকটা নিঃশব্দে ঢোকে তার খুপরিতে। এককোণে
মেঝেতে বিছানা পাতা; মলিন চাঁদর,
বালিশ ওয়াড়ছুট, আহত পশুর মতো যেন
গোঙাচ্ছে, ঘরের তাকে কয়েকটি বই। একমাত্র
টুল ছাড়া আসবার বলতে কিছুই
নেই, জানলার নিচে আধপোড়া মোমবাতি টিনের কৌটোয়
করুণ দাঁড়ানো। সে কাপড় না ছেড়েই টুলে
কিছুক্ষণ বসে জুতো জোড়া ছুঁড়ে ফেলে গা রাখে শয্যায়।

লোকটাকে ঘিরে এই বিশীর্ণ গলিতে
রটেছে নানান কথা। কেউ বলে সে ঘোর অমাবস্যায়। জ্যোৎস্না,
বর্ষার রোদ্দুর পুরে রাখে তার বুকের পকেটে। মধ্যরাতে
ডাঙায় চালিয়ে নৌকো মেঘলোকে যায়, ফিরে এলে
জামায় মেঘের দাগ, নক্ষত্রের রেণু লেগে থাকে,
লোকে দ্যাখে; তারপর ঈষৎ গা ঝাড়া দিয়ে ঢোকে
খুপরিতে নিরিবিলি। সহজে ঘেষে না কেউ লোকটার কাছে,
কেবল বালক বালিকারা তার সঙ্গে মেতে ওঠে
কানামাছি খেলায় বিকেলবেলা অবরে-সবরে। স্বেচ্ছায় সে
বাজায় বাঁশের বাঁশি প্রতিদিন, যেন চৌরাসিয়া, সুরধারা
গলি ছেড়ে দূরে যেতে-যেতে নীলিমাকে ছোঁয়। ওরা
শোনে ভরা মুগ্ধতায়, দ্যাখে লোকটার
সমস্ত শরীর রঙধনু, মাথা আগুনের বল।

এক সন্ধ্যেবেলা, যখন যে ফিরছিল খুপরিতে,
পাড়ার রটনাকারীগণ প্রায় তেড়েমেড়ে আসে
লোকটার দিকে আর তাকে ঐন্দ্রজালিক ঠাউরে নিয়ে তার
শার্ট, ট্রাউজারের পকেট
তক্ষুণি উজাড় করে রোদ্দুর, চাঁদিনী, ঝকঝকে
অসংখ্য নোটের তাড়া, হীরে জহরত, সোনা দানা
দিতে বলে। লোকটা অসুস্থ, হৃদরোগী, ভিড়ভাট্রা দেখে আর
অতিশয় কর্কশ আওয়াজ
শুনে বেশ কিছুটা ভড়কে যায়। টানা-হেঁচড়ায়
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, বুকের স্পন্দিত একা ঘড়ি থেমে যায়।
একটু পরেই খুব চুপচাপ বালক বালিকা সব আসে
একে একে, অশ্রুময় চোখে লোকটার
চারপাশে দাঁড়ায় এবং দ্যাখে স্তব্ধ সেই বংশীবাদকের
শিয়রে রোদ্দুর আর পায়ের তলায় জ্যোৎস্না। আজ
উন্নত মাথায় তার আগুনের বল নেই কোনও,
আছে শুধু নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে রূপালি মুকুট।

লক্ষ্মীবাজারের রৌদ্রময় অন্ধকারে

আমার চারপাশে ছড়ানো ছিটানো অনেক পোড়া, আধপোড়া,
ছেঁড়াখোড়া, ছাই-হয়ে-যাওয়া বইপত্তর, খাতা, কলম,
ছিন্নভিন্ন জামাকাপড়, বিছানা, কয়েকটি স্পঞ্জের স্যান্ডেল
এক পাটি উল্টে-থাকা মেয়েলি জুতো। এই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে
দাঁড়িয়ে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কোন্‌ শতাব্দী
এখন লালন করছে আমাকে! কোন্‌ শতাব্দীর আসুরিক ক্রূর
অন্ধকার এখানকার আলোকপ্রার্থী, প্রশান্ত, সুশীল বিদ্যানিকেতনে,
উপাসনা-স্নিগ্ধ গির্জায় জুড়েছিল প্রলয়-নাচ?

বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদে দাঁড়িয়ে দেখছি ধুলোয় লুণ্ঠিত হাত-পা
আর মস্তকবিহীন যীশু, বিচূর্ণ ক্রূশ; ভেতরে দগ্ধ, ধ্বস্ত ঘরে
ভীষণ আহত মাতা মেরী, আধপোড়া বাইবেল, তছনছ-করা, ক’টি
মুক বাদ্যযন্ত্র। যেন কোনও দম-আটকানো ঘোর দুঃস্বপ্নের ভেতর
আমার কানে এসে বারবার আছড়ে পড়ছিল শাহানা, পারভিন,
লতিফা, ক্রিস্টিনা, ললিতা, রাশেদা, ডেইজি গোমেজ, মল্লিকা,
আইরিন, সিলভিয়া ডি কস্টা, সুরাইয়া, রেহানা এবং আরও অনেক
শিক্ষার্থিনীর আর্ত চিৎকার।

না, মানুষ নয়, ধর্মান্ধতাপুষ্ট আয়েশলালিত অবিবেকী এক
চক্রচালিত কয়েক হাজার হিংস্র রোবটের তাণ্ডবে সৃষ্ট এই
ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আমি লজ্জায় নতমস্তক, বেদনাবিহ্বল।
চোখ তুলে দেখি অদূরে দাঁড়ানো ধূসর জোব্বা-পরা সক্রেটিস, প্লেটো,
অ্যারিস্টটল, চার্বাক, দান্তে, জালালুদ্দিন রুমি, ইবনে রুশদ, বার্ট্রাণ্ড
রাসেল, আইনস্টাইন, বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন, ডিরোজিও
মাইকেল মধুসুদন, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, লালন ফকির, কাজী নজরুল
ইসলাম। প্রখর দুপুরে তাঁদের প্রত্যেকের মুখমণ্ডলে শ্রাবণের মেঘ,
চোখে তিরস্কার এবং ধিক্কারের স্তব্ধ বাণী। নিজেকে কেমন অসহায়, আক্রান্ত,
ক্ষতবিক্ষত মূর্তি বলে মনে হ’ল
সেইন্ট জেভিয়ার্স বিদ্যালয়ের রৌদ্রময় অন্ধকারে।

সন্ধ্যারাত যখন দাতা

দীর্ঘ দীর্ঘকাল পর এমন একটি সন্ধ্যারাত কী নরম
পা রাখে আমার ঘরে। আয়োজন ছিল না কিছুই,
তবু জন্ম হলো অগোচরে
নামহীন এক উৎসবের। আলগোছে তুমি এলে,
নতুন কবিতা যেন সৃজনের খরাশেষে। এই সন্ধ্যারাত
বস্তুত তোমারই সৃষ্টি সহজ সৌন্দর্যে অনাবিল, সুগভীর।

তোমার স্পর্শের প্রজ্বলনে, প্রদীপের শিখা হওয়া
সে মুহূর্তে ছিল না সম্ভব,
যদিও হৃদয়ে ছিল অপরূপ নিভৃত দেয়ালি। দু’টি চোখ
কুড়িয়ে নিচ্ছিল খুব সঙ্গোপনে ঘরে
ঘনিষ্ঠ ছড়িয়ে থাকা তোমার মুহূর্তগুলি তুমি
আমার দৃষ্টিতে করছিলে পাঠ চূর্ণ ইতিহাস
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আর অন্তরালে চেতনাপ্রবাহে
ছিল ডুবসাঁতার তোমার।

তোমার কিসের তাড়া ছিল? সন্ধ্যারাত
সন্ধ্যার সতেজ ঘ্রাণ সম্পূর্ণ মুছে না ফেলতেই চলে গেলে,
বর্তমান হলো স্মৃতি। ঘরে একা বসে থাকি এবং তোমার
ফেলে-যাওয়া শূন্যতাকে ব্যাকুল চুম্বন করি বারবার, দেখি
হাহাকার সহস্র বুদ্বুদ হয়ে আঁধারে মিলায়
ক্ষণে ক্ষণে, নিজেকে বিবিক্ত উদ্বাস্তুর ছায়া বলে মনে হয়।

এই সন্ধ্যারাত দীর্ঘকাল পর তার রূপে ফের
আমাকে করেছে দগ্ধ; কিছুতে নয়, শুধু
করেছে কোমল শুদ্ধ, হৃদয় নিয়েছে জন্ম চন্দ্রিল সঙ্গীত
পুনরায়, বন্ধ্যা সময়ের হলো অবসান। এই
তোমার বিদ্যুৎ-তুল্য আসা-যাওয়া তোমাকে আমার
আরও বেশি কাছে এনে দিয়েছে, শুনছি
কান পেতে-বলে সন্ধ্যারাতে হাওয়া আর
ঘাসের সবুজ ঢেউ, জোনাকির কাছে।

সাধ

আজীবন শহরের বাশিন্দা সে। ধুলোবালি, ইট
পাথর, হুল্লোড় তার ভালোই লেগেছে এতকাল,
নালিশে হয়নি মন ধূমায়িত। অথচ এখন
কিছুদিন থেকে
তাকে টানে পাড়াগাঁ, যেখানে পিতামহ, মাতামহ
এবং প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা ছিলেন একদা
ধূসর অতীতে। হায় সেই
অজ্ঞাত বুজুর্গদের পরিচয় খুঁজবে কোন্‌ সে
বিলুপ্ত কেতাবে? আপাতত
কালো ধোঁয়া-ত্রাস আর বহুরূপী শব্দের প্রহার
বড় বিচলিত করে লোকটিকে। এক তীব্র সাধ
সারসের মতো গলা বাড়ায় নিয়ত আজকাল-
যদি সে দিঘির কিনারায়
কিংবা জ্যোৎস্না রাতে পুরু সবুজ ঘাসের বিছানায়
মাথা রেখে শ্রাবণ পূর্ণিমা
সত্তায় ধারণ করে অশেষ রহস্যময়তায় খুব মগ্ন হতে পারে।

স্বপ্নপুরাণ

এখন আমি ষাটের কোঠার হাটহদ্দ ছুঁয়ে আছি
ঝড় ঝাপ্টা সয়েছি খুব, খানাখন্দে পড়েছি মুখ থুবড়ে কত।
হরেক রকম বিরূপতা চলার পথে ছদ্মবেশে দাঁড়ায় এসে,
বাদুড়মুখো কিছু মানুষ হেসে হেসে হিংস্র হয়ে কামড়ে ধরে।

কখনও কেউ অমানিশায় পথ ভুলিয়ে খন্দে ফেলে,
কখনও কেউ ওষ্ঠ আমার চুমোর ছলে গরল ঢালে,
কখনও কেউ বন্ধু সেজে চোরাবালির দিকে ঠ্যালে,
তবু আমি প্রেত-প্রহরে শুভকালের স্বপ্ন দেখি।

স্বপ্নে দেখি সূর্য বুকের দরজা খুলে ডাকে আমায়,
অসংকোচে প্রবেশ করি, অপরূপের জগৎ দেখি
উদ্ভাসিত দৃষ্টিপথে-অচেনা গাছ পুষ্পে ছাওয়া,
আমার প্রবীণ মৃত পিতা শাগালের নিজ গাঁয়ের ছবি
বুকে নিয়ে আছেন শুয়ে হ্রদের ধারে; আমার মৃতা মা রূপালি
চাঁদের নায়ে বসে একা কোন্‌ সুদূরে যাত্রা করেন;
স্বপ্নে দেখি প্রিয়তমা গৌরী মাঠে জ্যোৎস্না কুড়ায়
পুরাকালের পাণ্ডুলিপি পাখির ডানায় ভেসে বেড়ায়।

যাচ্ছি কোথায়? ডানে ঘাতক অস্ত্র নামায়, বামে নামে
ঘোর কুয়াশা। হোঁচট খেয়ে চলছি তবু আলোর আশায়,
স্বপ্ন জুড়ে অন্তবিহীন সেতু জাগে কবন্ধদের মিছিল নিয়ে;
কাঁটাতারের বেড়ায় দেখি পরীর ডানা আট্‌কে আছে।

পিকাসো তাঁর গোয়ের্নিকা ছুঁড়ে মারেন তালেবানি
কসাইখানায়; লোর্কার লাশে প্রজাপতির অবাধ মেলা।
ভগ্ন সেতুর কংকালে কার বাসর সাজে অন্ধকারে।
বাউলা হাসন ঢোল বাজিয়ে তারা ছিটোন চতুর্দিকে।
বাইরে আমি ছড়িয়ে পড়ি মাঝে মাঝে কিসের টানে?
আবার আমার ভেতরে যাই অনেক দূরে গহনপুরে।
ধ্যানের ছোঁয়ায় একতারাটা হাতে নিয়ে নিজের ভেতর
ঘুরে বেড়াই গেয়ে বেড়াই ধুধু মাঠে, নদীর ঘাটে।

আমায় আমি রৌদ্রে সেঁকে, ছায়ার মেখে ক্রমান্বয়ে
গড়ে তুলি, সবার মধ্যে থেকেও আছি বড়ই একা।
কেউ বোঝে না আমার গোপন রক্তক্ষরণ, ক্ষতের পীড়ন;
দ্যাখে না কেউ আমায় পোড়ায় ক্ষণে ক্ষণে কেমন আগুন।

ফাঁদ-পাতা এই জটিল পথে চলতে হবে সকল সময়,
শ্বাপদঘেরা হুমকিভরা চরাচরে থাকব আমি
কেমন ক’রে? আমার ভাঁড়ার নিচ্ছে লুটে তাতার দস্যু,
যায় যদি যাক পুঁজিপাটা, অন্তত থাক স্বপ্নপুরাণ।

 হঠাৎ লেখার খাতা থেকে

শীতের ঝাঁজ অনেকটাই কমে গেছে, এখন শুধু
ফতুয়া পরলেই আরাম। ঘরের শাদামাঠা
পোশাকে বসেছিলাম বারান্দায়, গলির
রাধাচূড়া গাছে দৃষ্টি ছড়ানো। কান পেতে আছি
কোকিলের গানের উদ্দেশে। সূর্য ডোবার আগে হঠাৎ
আমার লেখার খাতা থেকে একটি কবিতা উঠে এসে
দাঁড়ায় পাশে; ওর দিকে তাকাই প্রশ্নাকুল।
আমার চোখে চোখ রেখে সে বলে, তোমার কি মনে পড়ে
অনেক আগে তুমি এক ঝকঝকে ভোরবেলা গলির মোড়ে
হাজির হয়েছিলে কী একটা ম্যাগাজিন
কেনার জন্যে? খানিক দূরে বাসস্টপের কাছে
তোমার সঙ্গে আমার হঠাৎ দৃষ্টি বিনিময়, মনে পড়ে?
বিদ্যুল্লতার মতো ক্ষণিক ঝলসে উঠে
কোথায় মিলিয়ে গেলাম, তুমি বুঝতে পারনি। তোমার ভেতর
কী যেন ঘটে গেল, প্রায় বিড়বিড় করতে করতে
গলি পেরিয়ে নিজের ঘরে পৌঁছে গেলে। আমাকে
দেখা না দেখার ভাবনা কুয়াশা হয়ে
ছড়িয়ে পড়ে তোমার শিরায় শিরায় হৃৎস্পন্দনে।

ক’দিন পর এক সন্ধ্যারাতে পুরোপুরি ধরা দিলাম
তোমার ব্যাকুলতার কাছে; আমরা দু’জন
এক হয়ে গেলাম কথা ও সুরের সফল মিলনের মতো।
সেই মুহূর্তে তুমি যেন এক দেবদূত। তোমার দু’টি চোখ
সহস্র চোখ হয়ে আমাকে দেখছিল অনাবিল মুগ্ধতায়, যেমন
প্রসূতি দেখে নবজাতককে। তুমি উচ্চারণ
করলে, ‘পদ্মার তরুণী ইলিশের মতো
মসৃণ, উজ্জ্বল তোমার ত্বক, জ্যোৎস্নাস্নাত গোলাপের মতো
তোমার হৃদয়। অথচ নিন্দুকেরা অষ্টপ্রহর রটায়
কুরূপা তুমি, তোমার ত্বক
লোলচর্ম বৃদ্ধার মতোই ছড়ায় ভাগাড়ের দুর্গন্ধ,
তুমি নাকি ডাস্টিবিনে ফেলে-দেওয়া ঝালমুড়ির ঠোঙা।

কবিতা আঁচলে আঙুল ছড়িয়ে কিছুক্ষণ গুন্‌গুনিয়ে বলে,-
আমার পরিণতি তোমাকে দুর্ভাবনার কালো মেঘে ঢেকে ফেলুক, চাই না।
আখেরে কালের এজলাসে নির্ধারিত হবে তা। এখন দেখ,
কখনও টাঙ্গাইলের জামদানি, কখনও
রাজশাহী সিল্ক গায়ে আমার আসা-যাওয়া, আবার
কখনও কী সহজে নগ্ন হেঁটে যাই পূর্ণিমা-ছাওয়া বালুচরে।
আমাকে দেখা যায় ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে,
কখনও তরুণ তরুণীদের নন্দনতত্ত্ববিষয়ক আসরে,
কখনও সাম্প্রদায়িক্তা-বিরোধী মিছিলে।
কখনও আবার ডুবে শাড়ি-পরা আমাকে
দেখা যায় তোমার পিতৃপুরুষদের পাড়াতলী গাঁয়ের বিকেলে
হল্‌দে প্রজাপতিময় সর্ষেক্ষেতের আলে, রাতের দিঘির নিঝুম ঘাটে।

হন্তারক

তবে কি ঘাতক আমি নিষ্করুণ, বিবেকবর্জিত?
অকস্মাৎ বাজপাখি রূপে তার বুক ছিঁড়ে খুঁড়ে
নিভৃতে গা ঢাকা দিই? করেনি সে কোনও অপরাধ,
তবু অন্ধকারে তাকে চঞ্চু আর নখরে বিঁধেছে
অতর্কিতে আমার ভেতরকার বাজপাখি আর
সেই রক্তক্ষণের ভীষণ স্নাত সমপরিমাণে
আমরা দু’জন। তার যন্ত্রণা অধিক বলে আমি
আজ কাঠগড়ায় দাঁড়াই অসঙ্কোচে অবেলায়।

আমাকে ঘাতক বলে এই ঘর, গাছের বাকল,
আকাশের সপ্তর্ষিমগুল আর ডোবার মণ্ডুক
নিমেষে শনাক্ত করে! কবিতার খাতা স্তব্ধ রাতে
হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে আমার দুর্দশা দেখে,
কেননা সে জানে সুনিশ্চিত, আমার দয়িতা আজ
রক্তাক্ত হলেও আমি নিজেই আমার হন্তারক।

Exit mobile version