Site icon BnBoi.Com

মাতাল ঋত্বিক – শামসুর রাহমান

মাতাল ঋত্বিক - শামসুর রাহমান

অথচ তোমার মধ্যে

ছায়াতেই থেকো তুমি, বাইরে যেও না। ইদানীং
রোদ্রে বড় বেশি আঁচ, উপরন্তু পাজীর পা ঝাড়া
এ সময়, কী বেয়াড়া লোকজন। এ পাড়া ও পাড়া
সর্বত্র লুটেরা ঘোরে, আর কত যে পার্টি মিটিং,
বশ্‌ম্বদ, কবন্ধ তো বটে, চলে বিরামবিহীন।
আড়ালে থাকবে তুমি নির্বিবাদে, কোমল রাত্তিরে
বলবো তোমার কানে কানে কথা, জোনাকির ভিড়ে,
মল্লিকার কাছে যাবো, স্বপ্ন-মসলিনে হবো লীন!

অথচ তোমার মধ্যে কী-যে এক বিদ্যুৎ চমক
খেলে যায় বারংবার, বুঝি তাই গোলাপে, জবায়
খোঁজো তুমি জীবনের ভিন্নরূপ, চিরচেনা ছক
ছেড়ে সহজেই চলে আসো, বলো আমার উদ্দেশে-
থাকবো তোমারই পাশে রৌদ্রদগ্ধ পথে, যাবো ভেসে
জাগর জোয়ারে দীপ্র, যাবো রুদ্র মিছিলে, সভায়।

অনুবাদ

তোমার ঘুমানো, জেগে-থাকা, হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়া
ঘর ছেড়ে কিংবা শীর্ণ ভিখারীর ক্ষয়া হলদে দাঁতে
চোখ রাখা, কাজান্তজাকিস পড়া, স্তব্ধ মধ্যরাতে
সুদূর গ্রীসের কথা ভাবা, ছিপছিপে নৌকো বাওয়া
স্বপ্নের অসীম ঝিলে বুকে নিয়ে স্মৃতিময় হাওয়া,
মরণ আবৃত্তিকারী এক ঝাঁক লাল-নীল বুড়ো
কাকাতুয়া দেখা, চোখে অতিদূর পূর্ণিমার গুঁড়ো,
বেডশীট আঁকড়েধর- সবই কে ধরনের পাওয়া।

ধরা যাক অর্থহীন সকল কিছুই, তবু তুমি
সযত্নে এসব কোনোদিন হয়তো করবে অনুবাদ।
শহুরে প্রচ্ছন্ন গলি, সবুজ পুকুর মহল্লায়
প্রত্যহ ভ্রমণকারী জন্মান্ধ কুকুর, বধ্যভূমি,
গোধূলিতে বেশ্যার মতন রাঙা, মৃত মুখ, খাদ-
এ-ও কি তোমার হাতে দীপ্র অনূদিত হতে চায়?

অর্ফিয়ূস, ১৯৭৮

কোথায় ফেলেছি বীণা, মনে নেই। মোটর বাইকে চেপে
দূটো মূর্তি দ্রুত ছুটে যায়, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে
আহত তরুণ কবি। আমি আর গেরস্তের ঘরে
পারিনা থাকতে, ছুটে যাই, চতুর্দিকে আসে ব্যেপে
লোকজন, আসবাবপত্র তছনছ আর কেঁপে
ওঠে রাজপথ, গূঢ় রহস্যের সচকিত স্তরে
হেঁটে যায় কে মোহিনী, গুহাহিত ক্ষুধিত প্রস্তরে
বারবার এলোমেলো মাথা কুটি কী কৃষ্ণ আক্ষেপে।

আমার ইউরিদিকে হাসপাতালের কাছে এসে
মূর্ছা যায়, বীণা একপাশে মৃত পাখির মতন
পড়ে আছে। ইউরিদিকের চেয়ে বেশি ভালোবেসে
মৃত্যুরই গেয়েছি গান। নইলে কেন তাকালাম ফিরে?
এলোকেশী নারীসংঘ এসে আমাকে আক্রোশে ছিঁড়ে
ফেলে; দর্পণেরে করি আলিঙ্গন, স্বচ্ছ আলিঙ্গন।

 অসামান্য তিথি

অনেক বছর আগে আমি ভালোবেসেছিলাম যাদের
তারা আজ অতিশয় আবছা বিবর্ণ ফ্রীজ শটে।
অকস্মাৎ কোনো কোনোদিন ওরা স্মৃতির নিকটে
চাঞ্চল্য প্রার্থনা করে গূঢ় ইন্দ্রজালে শরীরের
খুব কাছে এসে। অশরীরী ছায়ার মতন ফের
করে ব্যবহার নিমেষেই। দৃশ্যপটে কী-যে ঘটে,
ওরা মিশে যায় বায়ুস্তরে; শোনো, বলি অকপটে-
চিরদিন কিছু ছায়ামোহ থেকে যায় মানুষের।

কিন্তু তুমি ছায়া নও, নও তুমি অশরীরী কেউ,
তোমার বেদেনী-চোখ, ক্ষীণ কটি আর স্তনভার
নিয়ে তুমি আজো কী সজীব জ্বলজ্বলে উপস্থিতি।
যেখানেই থাকো, যতদূরে বিস্মৃতির ক্রূর ঢেউ
তোমাকে সরিয়ে নিতে পারে না কখনো; বারবার
ফিরে আসে আমাদের কী মদির অসামান্য তিথি।

অসিত উত্থানে

চতুষ্পার্শ্বে যাচ্ছে শোনা মুহুর্মুহু পিশাচের হল্লা,
ওদের শরীরে পচা মাংসের উৎকট গন্ধ, বুনো
অন্ধকারে পদশব্দ এলোমেলো, ক্ষুধার্ত শকুনও
পালায় সে দৃশ্য দেখে; অতিশয় সন্ত্রস্ত মহল্লা।
প্রতিটি মুহূর্ত কাটে, যেন কোনো ভীষণ দন্তুর
নেকড়ে ছিঁড়ছে খরগোশ। সর্বব্যাপী ভয়ংকর
অসিত উত্থানে বুঝি না কে শক্রু মিত্র কেবা। খর
ছলনায় খল মাতে, হতবুদ্ধি বান্ধবও জন্তুর

মতোই আমার দিকে আসে ধেয়ে। আজ ছদ্মবেশ
করেছি ধারণ, নইলে আত্মরক্ষা দায়। প্রেমিকার
সঙ্গেও ট্রাজিক চতুরালি চলে, বোঝে না সে কারা
ক্রীড়নক বানিয়েছে ওকে, তার রুক্ষ এলোকেশ
ভাসবে নদীর জলে, ভাঁড় হবে মূক, আমি পরিখার
পাশে করোটির সঙ্গে জুড়বো আলাপ দিশেহারা।

অসুস্থ ঈগল নীলিমায়

অসুস্থ ঈগল নীলিমায় তার পক্ষ বিস্তারের
স্মৃতি নিয়ে যেমন অনেক নিচে সময়ের ভার
ব’য়ে চলে, ক্ষীণ দৃষ্টি মেলে দূর নীলিমায়র
দিকে দ্যাখে মাঝে মাঝে, কখনোর পাহাড়ের
চড়ার সৌন্দর্য ভাবে, তেমনি আমিও হাহাকারের
প্রতিমৃর্তি হয়ে রুক্ষ ধুলায় ছিলাম পড়ে ধার
ছিলোনা অস্তিত্বে প্রায়, আতংকিত বিধ্বস্ত ডানার
প্রতিটি পালকে চিহ্ন নিষাদের ক্রূর প্রহারের।

সহসা ধুলায় কী সুন্দর ফুলের সম্ভার জাগে,
আর রুক্ষ কৃষ্ণপথে বসন্তবাহার মুখরিত,
তোমাকে দেখেই রোগা ঈগলের আর্ত চক্ষুদ্বয়
যৌবনের মতো জ্বলজ্বলে হয়, দীপ্র অনুরাগে
বুকের ভেতর হ্রদ দুলে ওঠে, পুনরায় ভীত
সন্ত্রস্ত সত্তায় তার উদ্ভাসিত বাঁচার বিস্ময়।

আততায়ী

বহুদিন থেকে তাকে আমি খুব চোখে চোখে রাখি,
এবং সে আমাকেও। কতদিন তাকে স্তব্ধ রাতে
দেখেছি নিঃশব্দে হেঁটে যেতে কী নির্জন ফুটপাতে।
সমুখে চায়ের কাপ নিয়ে নিষ্পলক চেয়ে থাকি
পরস্পর মাঝে-মধ্যে। বই পড়ে, লেখে সে একাকী
টেবিল ল্যাম্পের নিচে আলোদ্বীপে আত্মবন্দী, মাতে
কল্পনায়; সর্বক্ষণ আমরা থাকি গূঢ় এক সাথে,
একই রুটি ভাগাভাগি করে খাই, দেখি একই পাখি।

অভিমানে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে
বহুকাল তীব্র একাকিত্বের তুহিন কূপে বাস
করে ফিরে আসে ফের মনুষ্য নিবাসে অবিশ্বাস
ঝেড়ে ফেলে; প্রতিদিন তাকে ভুলিয়ে ভুলিয়ে
বেললাইনের দিক নিয়ে যাই, আমার নিশ্বাস
কেড়ে নিতে চায় সে প্রায়শ ছোরা গলায় বসিয়ে।

আবহ-মোরগ ঘোরে

কেমন অবাক লাগে ভেবে মন্দ ভালোয় অর্ধেক
শতাব্দী কেটেছে প্রায়। পুঁথি পড়ে, তর্ক করে, নানা
দৃশ্যাবলি দেখে কখনো বা ঘোর কর্দমাক্ত খানা-
খন্দে পড়ে, খুব স্বপ্নাশ্রয়ী হয়ে এবং হরেক
সুউচ্চ মিনারে পৌঁছে দেখেছি বর্ণাঢ্য অভিষেক
নিঃসঙ্গ কবির আর মাঝে-মাঝে পেয়েছি নিশানা
সেই সুন্দরীর, ভঙ্গি যার বড় নিষ্ঠুর, বেগানা,
ভালোবেসে বার বার দুঃখ আমি পেয়েছি অনেক।

তবুও লড়ছি নিত্য নিয়তির সঙ্গে অবিরত,
কাঁটায় রক্তাক্ত হয়ে নিশিদিন গোলাপের গান
গাই আর শান্ত মহিমায় একা ভীষণ আহত
গরুড়ের মতো ভাবি আজ-কবে হবে অবসান
এ ট্রাজিক সংগ্রামের? স্বপ্নাকুল দেখি ক্রমাগত
আবহ-মোরগ ঘোরে, রৌদ্রে পোড়ে, বৃষ্টি করে পান।

আবার এসেছো তুমি

আবার এসেছো তুমি বৃক্ষতলে খর পুর্ণিমায়
নিঃশব্দে পেরিয়ে ডোরাকাটা পথ, শাড়ির হিল্লোল
তুলে নিরিবিলি, দেখলাম। মোহন ছন্দের দোল
তোমার সত্তায়, তুমি জোৎস্নাময় হেসে নিরালায়
চলো যাই বলে উঠে গেলে যানে, আস্তে পুনরায়
বসেছি তোমার পাশে আগেকার মতো, ডামাডোল
চতুর্দিকে, পুলিশের হুইসিল, কারো রাগী বোল
ভেসে আসে, কখনোবা রবীন্দ্রসংগীত বয়ে যায়।

জ্যোৎস্নায় তোমার চোখ খৃষ্টপূর্ব শতকের হীরকের
মতো জ্বলে, আবার তোমার হাত মাছ হয়ে খেলা
করে একাকিনী আমার এ হাতে, আমরা পরস্পর
মুখোমুখি চেয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের দুজনের
এই রাত্রি সত্য নয়। এতো কুহকের ভুল বেলা-
নিমেষেই অস্তমিত; তারপর কী শূন্য প্রহর!

 আমার আস্তিনে

আমার আস্তিনে আমি লুকিয়ে রাখিনি কোনো ছুরি,
কোমরে রিভলবার নেই অথবা শিশিতে বিষ
নেই এক ফোঁটা, নেই হাতে বাঘ্‌নখ কিংবা শিস
দিতে দিতে কাউকেও আস্তে সুস্থে কাস্তে কি হাতুড়ি
দিয়ে ফৌত করিনি কখনো কিংবা ছলনা চাতুরী
মূলধন ক’রে কোনো শক্রূকেও বলির মহিষ
বানাইনি, কস্মিনকালেও আমি করিনি কুর্নিশ
স্বৈরাচারী লৌহ মানবকে অন্তরালে। লুকোচুরি

খেলেছি বরংমরণের সঙ্গে ভীষণ একাকী।
আমার আড়ালে আমি নিজেই কী নগ্ন, অসহায়
এক খয়া খর্বুটে মানুষ, কিন্তু সর্বদাই কাঁধে
নিঃসঙ্গ বেড়াই বয়ে কায়ক্লেশে সুপ্রাচীন দায়।
পেশী শ্লথ হয়, চোখ বুজে আসে কালো অবসাদে,
ঘুমের ভেতরে ক্রূর গান গায় স্বপ্নচর পাখি।

আমার কন্ঠস্বর

আমার চোখের আলো এখনো তো নয় খুব ক্ষীণ-
ঘরবাড়ি, গাছপালা, নদী, খোলা পথ, বন্ধ দ্বার,
নানা জীবজন্তু দেখি, পাথরের নিচে লোকটার
গেরস্থালি, তা-ও দেখি, দৃশ্যাবলী দেখি প্রতিদিন।
যদিও বয়স ত্বকে ধুলোরাশি ছড়াচ্ছে মলিন,
তবু ও শ্রবণশক্তি অতিশয় প্রখর আমার,
এখনো জিভের কাজ চলে নিয়মিত, এই ঘাড়
পাহাড়ের মতো, আজো কণ্ঠস্বর তেজী, ক্ষমাহীন।

তবে কেন বারংবার দেখেও অনেককিছু আজ
না দেখার করি ভান? কেন সাজি বিহ্বল বধির?
কেন কণ্ঠস্বর রাখি চেপে সর্বক্ষণ? আর আমি
বোবা-কালা সেজে থাকবো না-এ স্বরের কারুকাজ
পৌঁছে দেবো মেঘনা নদীর নিচে ব্যাকুল অধীর
পাহাড়ে পাহাড়ে-কন্ঠস্বর হবেই সর্বত্রগামী।

আমার ক্ষুধার্ত চক্ষুদ্বয়

এখন বাইরে রাত্রি তপোক্লিষ্ট বিমর্ষ নানের
পোশাকের মতো আর সুদূর কোথাও সন্ন্যাসীর
অস্থায়ী ধুমল আস্তানায় আস্তে ঝরছে শিশির,
প’ড়ে থাকে কতিপয় চিহ্ন উদাস অন্তর্ধানের।
নিশীথ রপ্তানি করে প্রসিদ্ধ সুরভি বাগানের
দূর-দূরান্তরে, ক্লান্ত মগজের ভেতরে রাত্তির
ডোরাকাটা বাঘ, জেব্রা, ঝিলঘেঁষা হরিণের ভিড়
নিয়ে গাঢ়, শিহরিত ঘাস পুরানো গোরস্তানের।

ঘুমন্ত পৃথিবী মধ্যরাতে, আমি ধুধু অনিদ্রায়
কাটাই প্রহর একা ঘরে আর তুমি দেশান্তরে
সুখান্বেষী তোমার শরীরে মিলনের চন্দ্রোদয়;
না, আমি মানিনা এই দূরত্বের ক্রুর অন্তরায়।
যদিও দুস্তর ব্যবধান, তবু প্রতিটি প্রহরে
তোমারই শিয়রে জ্বলে আমার ক্ষুধার্ত চক্ষুদ্বয়।

আমার তৃষ্ণার জল

তুমিও ফিরিয়ে নিলে মুখ কম্পিত দ্বিধায়, নাকি
ঘৃণায় গিয়েছো সরে। কতকাল, বলো কতকাল
এমন সুদূরে তুমি সীমাহীন ঔদাস্যের জাল
ছড়িয়ে থাকবে সর্বক্ষণ? আমি কী ব্যাকুল ডাকি
তোমাকেই, আজ আর এমন প্রান্তর নেই বাকি,
নেই কোন নদীতীর কিংবা পথ, অথবা পাতাল
যেখানে যাইনি আমি তোমার সন্ধানে। অন্তরাল
নিজেই করেছো সৃষ্টি, আজ আমি ভীষণ একাকী।

তোমার কার্পণ্য কেন মেনে নেবো? কেন যাবো ফিরে
ধূমল তৃষ্ণায় প্রস্রবণ থেকে জলপান বিনা?
এখনতো অন্য কেউ নগ্ন তোমার সত্তার তীরে
তুলছে ফেনিল ঢেউ নিরন্তর, তুমি সে উচ্ছল
আদিমতা বুনো অন্ধকারে উপভোগ করো কিনা
জানতে চাই না, শুধু চাই আমার তৃষ্ণার জল।

 আমার নির্মাণ

আমার নির্মাণ আজ আমাকেই বড়ো ব্যঙ্গ করে।
যা-কিছু গড়েছি এতদিন বেলা অবেলায় প্রায়
প্রত্যহ নির্মম শ্রমে, সেসবই কি তবে, হায়,
খড়ের কুটোর মতো পরিণামহীন জলে-ঝড়ে?
আমিতো দিয়েছি ডুব বারংবার, পাতালের ঘরে
দানবের মুখোমুখি নিয়ত থেকেছি বসে আর
পর্বতচূড়ায় অনাহারে কাটিয়েছি দিন হাড়
কালি ক’রে; জঙ্গলের জটাজালে আছি হেলাভরে

এখনো প্রত্যাশাময়। রক্ত দিয়ে লিখি রাত্রিদিন
শূন্যের দেয়ালে কত পংক্তিমালা, সবই কি অসার?
এই যে স্বপ্নের মতো অনুপম ঘরগেরস্থালি,
অথবা নিঝুম বনস্থলী, হ্রদ, চকচকে মীন
জেগে ওঠে শূন্যতায় অকস্মাৎ-এ-ও কি নচ্ছার
কারুর জঠরে যাবে? আমার নির্মাণ ধুলো-বালি?

আমার প্রতিদ্বন্দ্বী

একজন খর্বকায় মানুষ নিস্তব্ধ সন্ধ্যেবেলা
পড়ছে নামাজ কী তন্ময়। মনে হয়, সে এখন
অনেক অনেক দূরে শাল তাল অর্জুনের বন
পেরিয়ে সমুদ্রে এক ভাসিয়েছে নিরঞ্জন ভেলা।
এখন সত্তায় তার শান্ত উঠোনে শিশুর খেলা,
দিগন্তের বংশীধ্বনি, বিশাল তরঙ্গ, পাটাতন,
কিশোরীর পাখি পোষা, শিকারীর হরিণ হনন,
ভগ্নস্তুপময় জ্যোৎস্না একাকার, নিজে সে একেলা।

যদিও জমিনে নতজানু তবু তার নক্ষত্রের
মতো মাথা পৌঁছে যায় পাঁচবার দূর নীলিমায়।
তার মতো আমিও একটি ধ্যানে সমর্পিত, তবু
আমার অভীষ্ট কেন ক্রমাগত অনেক দূরের
আবছা সরাই হয়ে থাকে? কেন আমি ব্যর্থতায়
কালো হই? কেন বিষ্করুণ বাক্‌ প্রতিমার প্রভু?

আমার যা বলার

যা কিছু দেখার দেখি আশপাশে যা কিছু দেখার
একা ঘরে খাটে শুয়ে কিংবা পথেঘাটে হেঁটে যেতে
যেতে দেখি, যা কিছু শোনার শুনি, সকালেও চা খেতে
খেতে, গ্রন্থাগারে ঠান্ডা এক কোণে সেই কবেকার
পুরোনো নইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে, অস্থিসার
বস্তিটার অভ্যন্তরে, রেস্তোঁরায় খোশগল্পে মেতে
কত কী-যে শুনি এলেবেলে আর মগজের ক্ষেতে
সুনীল ফসল নিয়ে বলি এ জীবন ফক্কিকার।

অথচ আমার যা বলার তা বলি ঠিক? সব
কিছু বলতে কি পারি? আমার মনের কিনারায়
নানা কথা অকস্মাৎ ধর্মঘটী শ্রমিকের মতো
বেরিয়ে আসতে চায় একরোখা, ঐ যে জমি যায়
দেখা বলে নীলকুর্তা নাবিকের মতো কলরব
করে উঠতে চায় ওরা বেলা অবেলায় অবিরত।

আমি কি পারবো?

নেমেছে অসিত নম্র ডানা মেলে নিশীথ নিঝুম
চৌদিকে এবং বাতিজ্বলা ছোট আমার এ ঘরে
স্তব্ধতা ঘুমন্ত বেড়ালের মতো গাঢ় আছে প’ড়ে,
রয়েছি চেয়ারে বসে বহুক্ষণ, চোখে নেই ঘুম,
হাতে প্রস্ফুটিত বোদলেয়ারের ক্লেদজ কুসুম।
মনে পড়ে, নিঃসংগ অসুস্থ কবি প্রহরে প্রহরে
হেঁটেছেন কৃষ্ণ বেশে। তাঁরই মতো আমিও শহরে
একা-একা ঘুরি নিয়ে অস্তিত্বে ব্যাধির গুপ্ত ধুম।

যে-নারী দেয়নি শান্তি তাঁকে বরং কুটিল পাকে
করেছে অত্যন্ত ক্লান্ত তারই জন্যে কত দুঃখশোক
সয়েছেন, নিজেকে ক্ষইয়ে শুধু গড়েছেন তাকে।
আমি কি পারবো হতে দান্ত মহিমায় সমাসীন
তাঁর মতো? পারবো কি ক্ষিপ্র তুলে নিতে কোনোদিন
গরল আঁজলা ভরে অমৃতে ভাসিয়ে বিশ্বলোক?

আমিও বনের ধারে

আমিও বনের ধারে মধ্যে-মধ্যে একা চলে আসি
শহর পেছনে ফেলে। কোলাহলহীন বেলা কাটে
ঘাসে বসে ঝিলের ঝিলিক আর বীতশস্য মাঠে
পাখি দেখে, শিস বাজে ঘন ঘন; ক্লান্ত শীর্ণ চাষী,
সূর্যসেঁকা, বৃক্ষতলে স্বপ্ন শোঁকে, আশ্রয়-প্রত্যাশী
পান্থজল লম্বা পায়ে বসতির দিকে পথ হাঁটে
এবং সূর্যের চোখ বুজে আসে মেঘাচ্ছন্ন খাটে।
সহসা শুনবো আমি, আশা রাখি, উত্তেজক বাঁশি।

এখনো বনের ধারে আমি কার পথ চেয়ে থাকি?
ভীত ত্রস্ত হরিণ তাড়িয়ে এনে কোন্‌ সে শিকারী
আসবে বেরিয়ে খোলা ধুধু মাঠে অথবা বেনামি
দেবী বাকলের আবরণে এখানে আসবে, নাকি
সেই অর্ধছাগ আর অর্ধ মানবের দেহধারী
দেবতা আসবে যার বংশীধ্বনি শুনতে চাই আমি।

আশ্চর্য

আমার সত্তায় উদ্ভাসিত রৌদ্রী একটি সকাল,
অস্তিত্বের তটরেখা গুঞ্জরিত সানাইয়ের সুর
ক্ষণে ক্ষণে; দাঁত মাজি, চেয়ে দেখি এইতো অদূরে
উঠোনে কুড়োয় খুশি হল্‌দে পাখি, অসুখী বেড়াল
আমার লেপের নিচে খোঁজে উষ্ণ গুহা; নিম ডাল
নেচে ওঠে অকস্মাৎ। বহুদূর দেশ থেকে এসে
কখনো ফিরে না-যাওয়া বৃদ্ধলোক লাঠি হাতে, হেসে
কুশল শুধান পড়শির-গলিময় ইন্দ্রজাল।

আমার পায়ের নিচে পড়ে আছে খবর কাগজ
নীরব বিশ্বের মতো। কফি খাই, আশ্চর্যের ধূপে
সমাচ্ছন্ন কবিতার খাতা খুলি, বাস্তবের সীমা
ছিঁড়ে ফেলি ফালা ফালা, ছকস্থিত অশ্ব আর গজ
সুনীল প্রান্তরে ছোটে আশ্চর্যের তরঙ্গের রূপে-
সব চে আশ্চর্য তুমি হে আমার আপন প্রতিমা।

উদ্দাম আসবো ফিরে

চমৎকার পাখি পুষি, নিজে স্বপ্নপোষ্য হয়ে আছি
আজ অব্দি, মাঝে-মধ্যে গান ধরি, শব্দ গাঁথি কিছু
আমার ভেতরে যে নিমগ্ন কর্মচারী মাথা নিচু
ক’রে থাকে তার মেদমজ্জা চাটে পুপ্ত নীল মাছি।
অলপ্পেয়ে পদাবলী একটি মনের কাছাকাছি
পৌঁছুতে চেয়েও কায়ক্লেশে ঝরে যায় অন্তরালে,
একটি দীপ্তশ্রী মুখ সরে যায়, এ মুখ বাড়ালে
আমার সর্বস্ব গেছে তবু এই পৃথিবীতে বাঁচি।

সে কবে শ্রাবণঘন যূথীগন্ধী সায়াহ্নের কাছে
অকথিত কিছু কথা, কিছু নীরবতা সমর্পণ
ক’রে চলে গেছে বহুদূরে। এই জীর্ণ অন্ধকার
পিঞ্জরে একাকী আমি, শুধু তাকে মনে পড়ে, নাচে
স্বপ্নস্মৃতি, মৃত্যুর পরেও ছিঁড়ে বেবাক কাফন
উদ্দাম আসবো ফিরে যদি ডাকে সে আবার।

একজন মৃতদেহ

একজন মৃতদেহ পানপাত্রে তিনটি হীরক
হেলায় দিলেন ছেড়ে। পানপাত্র থেকে আস্ত পরী
তিনজন অকস্মাৎ উপচে পড়লো, কালো তরী
হলো সাড়া ঘর, জলদস্যুর দুচোখ খুব ধ্বক
করে জ্বলে ওঠে, মৃতদেহটির সবগুলি নখ
বেড়ে বেড়ে অতিকায় ঈগলের চঞ্চু, নীল ঘড়ি
সোনাটার মতো বাজে, কজন কংকাল চূর্ণ জরি
মুখোর গহ্বরে পরে গান গায়, এসো হে মড়ক।

একটি ঘাসের মূর্তি, তুর্কী টুপি-পরা, ঘূর্ণি নাচে
মত্ত, মৃতদেহটিকে ঘিরে তীব্র গাইছে কাসিদা,
আরক করছে পান খৃষ্টপূর্ব পিপের ভেতরে
ডুবিয়ে সবুজ মাথা, সাপ দীর্ঘ বাজে দগ্ধ গাছে
বোগাদাদী বণিকের তোরঙ্গ গচ্ছিত থরে থরে
কতিপয় মৃত সুন্দরীর চোখ, চোখে তীক্ষ্ম দ্বিধা।

একটি অনুপস্থিতি

পৃথিবী এখনো খুব সজীব সুন্দর ভোরবেলা
নতুন মাছের মতো কেলিপরায়ণ, নীলাকাশে
সারস প্রফুল্ল ওড়ে, ঝিলে নামে নিভৃত আশ্বাসে
তৃষ্ণার্ত কোমল প্রাণী বনপ্রান্তে পথিক একেলা
হেঁটে যায়, গেরস্থের উঠোনে শিশুর রাঙা খেলা
জমে অপরাহ্নে রোজ। নিশুত নিশীথে স্বপ্ন আসে
পরাবাস্তবের হরিণের মতো স্মৃতির আভাসে,
ছাদের কার্নিশে একা পাখি ডাকে গভীর সুরেলা।

পৃথিবী আনন্দময় বস্তুত এখনো। সুর কাটে
মাঝে মধ্যে, তবু এক দীপ্তিমান উল্লসিত সুর
বয়ে যায় সবখানে। শুধু আমি মানুষের হাটে
একাকী বিষণ্ণ ঘুরি এবং যখন যেখানেই
যাই, সত্তা জুড়ে বাজে সর্বক্ষণ আর্ত অশ্বক্ষুর,
কেননা আমার বিশ্বে আজ আর সে নেই, সে নেই।

 একটি আশ্চর্য মুখ

একটি আশ্চর্য মুখ দেখি আমি স্বপ্নের প্রহরে
মাঝে-মাঝে; সেই একই মুখ নীল সমুদ্রের পানি
থেকে জেগে ওঠে, সিক্ত ওষ্ঠে তার গূঢ় ঝলকানি
হাসির, কখনো দেখি সে রয়েছে ঘুমের ভেতরে
পথপার্শ্বে একাকিনী কোনো এক প্রাচীন শহরে।
অজ্ঞাত শিল্পীর ক্ষিপ্র ছেনী তাকে রহস্যের রানী
রূপে কবে করেছে নির্মাণ; চোখে কী গভীর বাণী
নিয়ে চেয়ে থাকে শুধু নিষ্পলক নিস্পন্দ পাথরে!

আশ্চর্য সে-মুখ বুঝি কেউ খৃষ্টপূর্ব জগতের।
ঘুম ভেঙে গেলে ভাবি তারই কথা, ছন্দিত পাথুরে
তার অবয়ব বারবার ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে।
পুনরায় নীল সমুদ্রের ঢেউ তাকে দেবে ছুঁড়ে
আমায় সত্তার তটে? মনে হয়, স্বপ্নের জগতে
দেখা সেই মুখ যেন প্রতিচ্ছায়া তোমারই মুখের।

একটি বাগান

নিশ্চয় তোমার মনে আছে একটি বাগান তুমি
আর আমি খুব গোপনীয়তায় সাজিয়েছিলাম
রঙ বেরঙের ফুলে। ইচ্ছে করে বাগানের নাম
রাখিনি আমরা, শুধু গড়েছি সুন্দর পুষ্পভূমি
পানি ঢেলে চারার শিকড়ে তুলে ফেলে পরগাছা
অগণিত। সে বাগানে নানা পাখি দ্বিধাহীন এসে
শুনিয়েছে গান আমাদের, কী মধুর সুর ভেসে
গেছে দূরে কোথাও, শিখেছি কাকে বলে তীব্র বাঁচা।

অথচ বসন্তদিনে চলে গেলে তুমি অকস্মাৎ
কাটিয়ে সকল মায়া বাগানের। ঝরে যাচ্ছে ফুল
যত্নের অভাবে, ক্রমাগত বেড়ে ওঠে বুনো ঘাস,
আমি আর কত পারি একা একা? দিন যায়, রাত
আসে, তুমি আসো না এখানে ছিঁড়ে যায় মর্মমূল
এবং বাগানময় বয় শুধু প্রেতের নিশ্বাস।

একটি বাদামি ঘোড়া

একটি বাদামি ঘোড়া সঙ্গীহীন অপরাহ্নে এসে
পড়েছে চওড়া পথে শহরের। মাংসের ভিতর
তার জীবনের মর্মমূল যেন করে থরথর
অবিরত; ট্রাফিক দ্বীপের ঘাস গাঢ় স্বপ্নাবেশে
খাচ্ছে সে নিঝুম আস্তে সুস্থে, প্রায় তার ল্যাজ ঘেঁষে
একটি মোটরকার ছুটে যায় অকস্মাৎ খর
গতিতে এবং দূরে একজন বামন লজঝড়
গাড়ি ঠেলে কোত্থেকে আওয়াজ আসে ভেসে সর্বনেশে।

এসব কিছুই তাকে, ঘোড়াটাকে, করে না বিব্রত।
পথের আক্রোশ, চোরা আঘাত অথবা পুলিশের
বাঁশি, যানবাহনের প্রতি সীমাহীন উদাসীন
সারাক্ষণ, মাঝে মাঝে চোখ তুলে এখানে কিসের
ডামাডোল দেখে নিতে চায় কিছু। বুঝি সে প্রাচীন
শাপভ্রষ্ট গ্রীক দেব, আগন্তুক ভ্রান্তিবশত।

 এমন উল্লেখযোগ্যভাবে

যেন নিশীথের ওষ্ঠ থেকে ঝরে গূঢ় শব্দাবলি
সাবলীল, যেন খুব সুদূরের জ্যোৎস্নাছায়া মেখে
চকিতে এসেছে ওরা নিরিবিলি গাঢ় চুমো এঁকে
দিতে রুক্ষ একাকীত্বে আমার এবং স্বপ্ন-পলি
ক্রমশ গড়বে বেভে সত্তাতটে। এ কার অঞ্জলি
আমার সম্মুখে এলো রাত্রিময় নিরুদ্দেশ থেকে
এমন উল্লেখযোগ্যভাবে নিজেকে রহস্যে ঢেকে?
আমাকে ছুঁয়েছে কণ্ঠস্বর, আমি কী তন্ময় জ্বলি।

আমার নিকটে নেই সেই রুপময়ী অবয়ব,
নিষ্ঠুর পাখির মতো রাত্রি রূষ্টি চঞ্চুর আঘাতে
আমাকে করেছে ক্ষতবিক্ষত কেবলই; আমি তারই
মুখরেখা ভেবে ভেবে প্রহর কাটাই, শূন্য হাতে
পড়ে থাকি বড়ো একা, সেই মোহিনীর করি স্তব
এবং উঠোনে দেখি স্বপ্নপ্রায় চাঁপারঙ শাড়ি।

ওফেলিয়ার গান

শরীরে আমার সারদ জ্যোৎস্না বুনেছে কী মায়া
ভরা আঠারোয়া। শরীর আমার বসন্ত রাগ,
এখনো সজীব হৃদয়ের ফুলে কোনো কালো নাগ
দেয়নি ছড়িয়ে কৃষ্ণ জহর। তবে কিছু ছায়া,
অশুভই বটে, চেনা মানুষের ছন্দিত কায়া
ধ’রে ঘোরে এই আঁধার দুর্গে? রক্তের দাগ
দুর্গ প্রাকারে বেঁধেছে জমাট। তুমিও বেহাগ
গাইছো কুমার, আমি নিরুপায় অসিদ্ধ জায়া!

কোথায় উধাও মেঘ-টলোটলো স্নিগ্ধ শ্রাবণ?
উটের পিঠের মতন দূরের মেঘতরঙ্গে
বাজে না তো আর জলতরঙ্গ। বলো, এ কেমন
ব্যাভার তোমার? ভুল হত্যার দূর নিশিডাক
তোমাকে ঘোরায় পথে-প্রান্তরে; স্বপ্নভঙ্গে
দেখি উড়ে আসে জলজ কবরে দোয়েলের ঝাঁক।

ক এখন

ক এখন একা-একা প্রতিদিন ঘুরছে শহরে।
ফুটপাত ত্র্যাভেনিউ, বিপনী-বিতান, অলিগলি-
কিছুই পড়ে না বাদ। কোন অলৌকিক বনস্থলী
দিয়েছিলো গূঢ় ডাক মধ্যরাতে, তার মনে পড়ে
মাঝে-মধ্যে। ক এখন প্রায়শ আপনকার ঘরে
থাকে না, বসে না চুপচাপ। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ছুড়ে
হাঁটে, শুধু একা, যেতে চায় দ্রুত বহুদূরে।
শহর থাকুক পড়ে, ক এখন বলে রুক্ষ স্বরে।

যতই এগিয়ে যায়, তত সে বিরূপ শহরেই
কী আশ্চর্য, ঘুরপাক খায় এবং নিজেকে তার
বড় অসহায় লাগে, বুকে ভয়ঙ্কর ধূলিঝড়,
জব্দ বীণা, মৃত সিংহ। কখনো হারিয়ে ফেলে খেই
চিন্তার, একাকী থাকে পড়ে রিক্ত ঢিবির ওপর-
যেন সে তুখোড় বিক্রেতার হাতে স্তিমিত শিকার।

ক-এর আঙুল থেকে

ক-এর আঙুল থেকে একটি কী পথ বহুদূরে
গ্যাছে বেঁকে চিত্রবৎ, বৃক্ষশ্রেণী যেন দেবদূত,
পৃথিবীর নিসর্গের বন্দনায় কেমন নিখুঁত
সৌন্দর্যে এসেছে নেমে আসমান থেকে নম্র উড়ে।
ক-এর ওষ্ঠের তটে তৃষ্ণার্ত হরিণ ঘুরে ঘুরে
ফিরে যায় বারংবার জলকষ্টে, হিংস্র পদচ্ছাপ
চোখের নিচের বালিয়াড়ি ধরে রাখে, হলদে সাপ,
কেবলি দলতে থাকে সাবলীল তার গলা জুড়ে।

সে পথের কাছে আজ ক-এর কী বলার আছে?
পথ বড় উদাসীন, নিশ্চুপ সর্বদা। তার ভাষা
বুঝলেও কখনো দেবো না সাড়া; ক-এর মুখের
ভেতরে আদিম জলপরী এবং কিন্নরী নাচে,
পাঁজর-প্রান্তরে বুকভাঙা ডাক ঘোড় সওয়ারের।
সে-পথ রাখে না মনে কারো চলে-যাওয়া,ফিরে-আসা।

কত পদচ্ছাপ

হয়তো হবে না দেখা আমাদের কোনোদিন আর,
কোনোদিন শুনবো না রাত্রিময় ঝর্নার মতন
কণ্ঠস্বর তার রাখবো না হাতে হাত, শুধু মন
প্রখর থাকবে চেয়ে তারই দিকে, যে আমার
উদ্যান বিরান করে চলে গ্যাছে; স্নিগ্ধ মল্লিকার
বাহার এখানে নেই, গাছের কংকাল সারাক্ষণ
ভীষণ কঠোর দৃষ্টি হানে, এ কেমন নির্বাসন
ব’লে পাখি হয়ে যায় এক রাশ মৃত শাদা হাড়।

এখনো দরজা খুলে প্রতিদিন ঘরে ঢুকি, রাখি
স্যুইচ আঙুল, আলো ফেটে পড়ে, শুই; বিছানায়
কারো ছায়া কাঁপে যেন। ক্লান্ত মনে কখনো আলাপ
জুড়ি দেয়ালের সঙ্গে, কখনো বা দান্তে কী একাকী
হেঁটে যান আমার নিবাস ছুঁয়ে শ্রাবণ ধারায়,
এবং বৃষ্টিতে ডোবে গলি, ঘর, কত পদচ্ছাপ।

কবি

শহরে হৈ হল্লা দৈনন্দিন, যানবাহনের ঢল
পথে পথে, দিকে দিকে ফুৎকার, চিৎকার, চলে স্মার্ট
নাটক শিল্পিত স্টেজে, হোটেলে স্বপ্নিল কনসার্ট;
মেলায় নাগরদোলা, ডুগডুগি, বানরের দল।
হঠাৎ এলেন ভিনদেশী মল্লবীর, দৃপ্তবল;
সমস্ত শহর ঘোরে তার পায়ে পায়ে সারাক্ষণ,
পুষ্পবৃষ্টি চতুর্দিকে; মন্ত্রমুগ্ধ জনসাধারণ।
নতুন সার্কাস পার্টি ফেলে তাঁবু, নগর চঞ্চল।
বস্তুত চৌদিকে লাফালাফি, লোফালুফি, ক্ষিপ্র
কেনাবেচা; ম্যাজিক ম্যাজিক বলে কেউ পোড়া ঘাসে
বেজায় লুটিয়ে পড়ে, কারো কণ্ঠে ফানুস ফানুস
ধ্বনি বাজে। চলেছেন একজন একলা মানুষ
সবার অলক্ষ্যে জনাকীর্ণ পথে আস্তে সুস্থে দীপ্র
শব্দের গুঞ্জনে পূর্ণ যেন বা হাঁটেন পরবাসে।

কবিতার মৃত্যুশোক

আমিতো অজস্র কবিতার মৃত্যুশোক পুষে রাখি,
মৃত্যুশোককালীন আঁধারে নির্বিকার ফেরেস্তারা
দ্যাখেন আমার মদ্যপান। মদিরার স্বচ্ছ ধারা
আমার ভেতরে বয়ে গেলে পর নিজেকে একাকী,
ব্যথিত একাকী লাগে আরো, চুপচাপ বসে থাকি,
কখনো চড়িয়ে গলা এলেবেলে কথা বলি, যারা
আশপাশে থাকে, তারা নিজেরাও নয় বাক্যহারা;
আমার চোখের ভুল দ্যুতিতে কেউবা পড়ে ফাঁকি।

কবিতার মৃত্যুশোক ফিকে হলে নিভৃত টেবিলে
কাগজ কলম নিয়ে বসি। অকস্মাৎ চোখে স্মৃতি
ভেসে ওঠে, যেন শান্ত জলের উপরিভাগে সদ্য
মৃত মাছ। কখনো আমার অস্তিত্বের গূঢ় নীলে
খৃষ্টপূর্ব সভ্যতার মতো কিছু প্রবল প্রতীতি
নিয়ে জেগে উঠতে চায়, বুঝি ওরা অলৌকিক পদ্ম।

কর্ণমূল থেকে খুলে

কর্ণমূল থেকে খুলে যে ফুল আমাকে দিয়েছিলে
একঘর অতিথির দৃষ্টি থেকে দূরে বারান্দায়,
এখনো সুগন্ধ তার জীবিত আমার চেতনায়।
যখন নিমগ্ন থাকি ফাইলের ধূসর নিখিলে,
অথবা কাজের ফাঁকে চোখ রাখি আকাশের নীলে,
উড়ন্ত পাখির প্রতি, অকস্মাৎ মনে পড়ে যায়
তোমার সে পুষ্পদান কোলাহলময় নিরালায়
এবং সুরভি মিলে থাকে মধ্যমিলে, অন্ত্যমিলে।

সে ফুলে শুকিয়ে গেছে, কে জানে কোথায় আগোচরে
এক ফোঁটা হাহাকার হয়ে আজ হয়েছে বিলীন।
মাঝে মাঝে মধ্যরাতে কোনো একজন চক্ষুহীন
মুখ নিয়ে এসে আস্তে দাঁড়ায় খাটের পাশে, বলে
প্রেতের মতন স্বরে, দারুণ বিরূপ ঝড়জলে
তোমাদের প্রেমদীপ্ত তৃষিত হৃদয়ও যাবে ঝরে।

কাল সারারাত

কাল সারারাত আমি কবিতার সঙ্গে অতিশয়
লুত্‌কা লত্‌কা করে কাটিয়ে দিয়েছি। বাতি জ্বেলে
দেখেছি উত্তুঙ্গ স্তন, নাভিমূল শ্রোণী; লজ্জা ফেলে
স্খলিত শাড়ির মতো কবিতা আমাকে, মনে হয়,
অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ করে নিয়েছিলো কাল। মন জয়
করতে পেরে তার চতুর্দশপদী আর ভিলানেলে
আনন্দ পেয়েছি ঢের। হৃদয়ের তন্তুজাল ঠেলে
এখনো কবিতা এসে আমাকে করছে ছন্দোময়

একটি কি দুটি নয়, বহু কবিতায় আজ ভোরে
আমার পকেট ভর্তি, যেন নিয়ে উৎসবী আবেগ
ঘরের ভেতরে, বারান্দায় আমার হৃদয় নাচে।
এসব কবিতা আমি কণ্ঠস্বরে কিছু রাঙা মেঘ
ঢেলে দিয়ে তোমাকে শোনাতে চাই আজ প্রাণ ভরে
এক্ষুনি সবার আগে, অথচ তুমিই নেই কাছে।

কী কঠিন কাজ

একজন মহিলাকে বহুদিন থেকে ভালোবেসে
চলেছি, যেমন মাঝি নিয়মিত নৌকো বেয়ে যায়
অনুকূল আবহাওয়া কিংবা ঝড়জলে। সে কোথায়
কী রকমভাবে থাকে কেমন বিরূপ পরিবেশে,
সেকথা কী করে বলি? আমি কবিতার মতো ভেসে
বেড়াই শহরে একা। আমার এ হৃদয়ের জলে
মহিলাটা পা ধুলে আনন্দ পাই অতিশয়; ফলে
ক্ষণে ক্ষণে বারোয়ারী বিদ্রুপ তাচ্ছিল্য করি হেসে।

দেহ মন দিয়ে ভালোবাসি তাকে, যদিও শরীর
ছেড়ে ছেড়ে সে মহিলা মনের কথাই বলে বেশি
গোপনে আমার কাছে, নক্ষত্রের কাছে কী নিবিড়
অনুভবে। এ গহন বর্ষণের রাতে জানি আজ
সে ঘুমিয়ে আছে একাকিনী বিছানায় এলোকেশী-
বুঝেছি এরূপ ভালোবেসে যাওয়া কী কঠিন কাজ!

 কুয়াশায় নিমীলিত

নিজের ঘরের দেয়ালের কানে চাপা কণ্ঠস্বরে
প্রার্থী হই অতিশয় দীন কোনো ব্যক্তির মতন।
কী-যে চাই তার কাছে নতজানু যখন তখন
ব্যর্থতার খোয়ারি-ঠেকানো যত কাঙাল প্রহরে
জানি না, কেবল হৃদয়ের চোখ থেকে রক্ত ঝরে।
দুবাহু এগিয়ে যায় দেয়ালের দিকে, মায়াবন
ইট-বালি ফুড়ে জেগে ওঠে, তোমার যুগল স্তন
স্বপ্নিল চোখের মতো উন্মীলিত সিমেন্টের স্তরে।

তোমার স্তনাভা দেয়ালের কাছে নিয়ত আমাকে
নিয়ে যায়, বিশেষত মধ্যরাতে। কখনো কখনো,
মনে হয়, দেয়াল তোমার শরীরের দীপ্ত ত্বক।
অন্ধতার চেয়েও অধিক তমসায় স্বপ্ন থাকে
পড়ে ঘরময়, যেন ভাঙা বাবুইয়ের বাসা, ঘন
কুয়াশায় নিমীলিত আকাঙ্ক্ষার সমাধি-ফলক।

কোথায় মনের মুক্তি

কোথায় মনের মুক্তি? বহুদূর জনহীন দ্বীপে
অথবা পর্বতশৃঙ্গে, বিশাল অরণ্যে নাকি ধুধু
প্রান্তরের মধ্যপথে? নিসর্গের খুব কাছাকাছি
গেছি বার-বার, মনে লেগেছে উদার হাওয়া আর
আমার সমগ্র সত্তা হয়েছে সবুজ, লাল নীল
ফিরোজা বেগনি, হলদে ঋতুতে ঋতুতে। কখনোবা
গ্রন্থের অক্ষরদ্বীপে ক্রূশোর মতন হেঁটে হেঁটে
পেয়ে গেছি কী উম্মুক্ত অনাক্রমণীয় বাসভূমি।

কখনো আবার কোন নান্দনিক চেতনায় ভাবি
শিল্পেই মনের মুক্তি। বুঝি তাই যেখানে তুলির
সখ্য আর মোহন যুগলবন্দী বাটালি ছেনীর
যেখানে সংগীত হয় অন্দ্রধনু বিস্তারে বিস্তারে
সেখানেই স্বস্তি খুঁজি। আবার কখনো মনে হয়
প্রকৃত মনের মুক্তি দয়িতার সান্নিধ্যে বিস্তৃত।

কোথায় শিউলিতলা

কোথায় শিউলিতলা, সেই কবেকার ভোরবেলা-
যখন কুড়িয়ে ফুল, পেরিয়ে শিশিরভেজা পথ
বসতে পুকুর ঘাটে, দৃষ্টি মেলে দিতে তুমি দূর
বহুদূর বনানীর দিকে অথবা সাঁতার কেটে
কাটতো তোমার বেলা কারো কথা ভেবে নিরালায়?
কোথায় সে তন্বী যার বুকে গোলাপের অব্যর্থ উন্মেষ?
কোথায় সে প্রতিবাদী তরুণ যে ছিলো সর্বক্ষণ
তোমার হৃদয় জুড়ে অনিন্দ্য স্বপ্নিল অশ্বারোহী?
যেও না অতীতে ফিরে, এখন ফেলো না দীর্ঘশ্বাস
অতিশয় কালদগ্ধ শিউলিতলার কথা ভেবে।
এখন তোমার কানে একজন প্রৌঢ়ের আড়ালে
যে যুবা আবৃত্তি করে হৃদয়ের নতুন সংহিতা,
ফিরিয়ে দিও না তাকে, কেননা সে শিলীভূত বুকে
সহজে জাগাতে পারে পাথরগলানো প্রস্রবণ।

ক্ষেত

কী আমার দখলে রয়েছে? কোন্‌ জমি আজ
ফসলসজ্জিতু বলা যায়, আমারই এলাকা? কোন্‌
নদীতীর, সাঁকো কিংবা বালুচর, তমালের বন
আমার নিজের? সেই কবে দূরে সাধের জাহাজ
ভাসিয়েছিলাম, মনে পড়ে। মাঝিমাল্লাদের গান
যেখানে শোনেনি কেউ-লোনা ঢেউ, জলচর প্রাণী,
দ্বীপস্থিত বৃক্ষ, শ্যামা, কেউ- সেখানে সন্ধানী
দৃষ্টি মেলে, মনে হয়, ফলিয়েছি অলৌকিক ধান।

অথচ এখন, যতদূর চোখ যায়, দেখি শুধু
ফসলবিহীন মাঠ বুভূক্ষুর মতো করে ধু ধু।
তবে কি যথেষ্ট শ্রম করিনি কখনো? ফসলের
স্বপ্নই দেখেছি শুধু প্রতিদিন মোহন বিলাসে?
করিনি কর্ষণ অবিরত কিংবা নিজস্ব ক্ষেতের
পরাগাছা নিড়াইনি? তাই ক্ষেত ছেয়ে গ্যাছে ঘাসে?

খরার দুপুরে

একটি দোতলা ফ্ল্যাটে লকলকে খরার দুপুরে
কিঞ্চিৎ ছায়ার লোভে দেয় হানা। পয়লা বৈশাখে।
ছিলাম আমরা বসে মুখোমুখি নতুনের ডাকে
অনেকেই বহির্মুখী। বৈশাখী মেলায় যে রোদ্দুর
ছিলো, তারই আভা বুকে নিয়ে, বলো কতদূর
শৈশবের টলটলে পুকুর আমার বলে কাকে
তোমার দু’চোখে পাই, কী খেয়ালে তুমি স্তব্ধতাকে
হঠাৎ দুলিয়ে ফ্ল্যাটে হও পুরোনো গানের সুর।

যখন তোমার কণ্ঠে সাতটি সুরের উন্মীলন
চতুষ্পাশ্বে মায়া বোনে, আহত হরিণ শুশ্রূষায়
ক্রমান্বয়ে সুস্থ হয় অরণ্যের তন্দ্রালু ঊষায়,
ভবঘুরে পুনরায় ফিরে পায় গার্হস্থ্য জীবন,
আমার অসুস্থ মন অমৃতের খর পিপাসায়
আতর্স্বরে করে উচ্চারণ-চাই ভিন্ন জাগরণ।

ঘুড়ি

ঘুড়ি বসবাস করে নিরিবিলি বিনীত দোকানে,
গৃহকোণে, খাটের নিভৃত নিচে, কিংবা খোলা ছাদে
চুপচাপ বালকের স্বপ্নের মতন নির্বিবাদে।
খয়েরী, সবুজ, হলদে, নীল ঘুড়ি সবখানে,
মানে শহরে ও গ্রামে মিশে রয় স্তব্ধতার গানে।
মাছ কিংবা পরীর মতন চোখ কী ফুল্ল আহ্লাদে
জেগে থাকে সর্বক্ষণ, নাকি অত্যন্ত নিঃশব্দ কাঁদে,
যখন মাটিতে থাকে। সর্বদা নীলিমা তাকে টানে।

বস্তুত মাটিতে নয় সে প্রকৃত ঘুড়ি; অতিদূরে
নীলিমায় হাওয়ায় হাওয়ায় যখন সে ওঠে দুলে,
আকাশের ঠোঁটে চুমো খায়, তখনই সৌন্দর্য তার
লীলায়িত খুব স্মরণীয়ভাবে, নকশা তার সুর
হয়, সুর নকশা, আর হোক যত দূরেই বিস্তার
স্পন্দিত বর্ণের, সুতো যেন থাকে সর্বদা আঙুলে।

 জয়নূলী কাক

কখন মিটিঙ ভেঙে গ্যাছে, মিটে গ্যাছে বেচা-কেনা
সকল দোকানপাটে, ফলের বাজার শূন্য; ঘরে
ফিরি দীর্ঘ পথ হেঁটে একা-একা, বুকের ভেতরে
কী একটা কষ্টবোধ, ভিড়ে কাউকে যায় না চেনা।
পাঁশুটে জ্যোস্নায় দেখি মৃতের মিছিল। তাকাবে না
ফিরে ওরা, মনে হয়, কপ্সিমকালেও; চরাচরে
আর কোন টান নেই জেনেই বুঝি বা এ শহরে
নির্বিকার হেঁটে চলে, দেবে না চুকিয়ে কোনো দেনা।

পাঁশুটে জ্যোৎস্নায় অকস্মাৎ ডানা-ঝাপটানি, ডাক
শোনা যায়; এক দুই, তিন, সংখ্যাহীন পক্ষী এসে
ছাদের কার্নিশে, ফুটপাতে আর রিক্ত রেস্তোরাঁয়
বসে; ওরা তৃষাতুর, মানুষের মগজের নিভৃত প্রদেশে
প্রবেশ করতে চায়। যেন ওরা জয়নুলী কাক,
বিংশ শতাব্দীর কবিতার মতো গূঢ় ডেকে যায়।

ঝুলন্ত রেস্তেতারাঁ

কেউ কেউ দ্যাখে দূর নীলিমায় ঝুলন্ত রেস্তোরাঁ।
কেউ কেউ সিঁড়িহীন সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় আর
প্রবাল-চেয়ারে বসে। এঞ্জেলের উজ্জ্বল পাখার
মতন টেবিলে আছে এটা সেটা আর মেঝে-জোড়া
অভ্রের কার্পেট। একদিন অপরাহ্নে আনকোরা
স্বপ্ন নিয়ে সেখানে ছিলাম আমরা, তুমি আর আমি-
আমার অধীর ওষ্ঠে চুম্বনে ছড়ালে অস্তগামী
সূর্যের সৌন্দর্য তুমি। ছিলো চাদ্দিকে নৈঃশব্দ্যে মোড়া।

নীলিমায়বৃত সে রেস্তোরাঁয় কিছুক্ষণ পরে, শোনো,
হে দয়িতা, তুমি ছাড়া আর কিছুই পড়েনি চোখে;
সর্বব্যাপী শূন্যতায় তোমার গহন চক্ষুদ্বয়
যেন বা যমজ দ্বীপ-আমার নিবাস দুঃখ-শোকে
এবং আনন্দে চিরদিন। অকস্মাৎ কী-যে হয়
কাক-তাড়ুয়ার তীক্ষ্ম হাসি বুকে বাজে ঘন ঘন।

টেলিফোন

প্রত্যহ সকাল সন্ধ্যা বসে থাকি তীব্র প্রতীক্ষায়,
বস্তুত অপেক্ষমাণ আমার নিজস্ব গৃহকোণ
সারা দিনমান, কান পেতে থাকি, হয়তো টেলিফোন
এখুনি উঠবে বেজে ঘরময় কালো স্তব্ধাতায়।
নিবদ্ধ আমার দৃষ্টি শাদা ধূসর খরগোশ-প্রায়
যন্ত্রটির গায়ে, ওর এই অন্ধ নীরবতা মন
মেনে নিতে চায় না কিছুতে। বুঝি তাই সারাক্ষণ
বলো কিছু বলো, বলে চেঁচাই শব্দের সাহারায়।

টেলিফোন হার্দ্য বেজে উঠলেই হয়তো কোন্‌ দূর
দেশ থেকে (নাবিকের গান-ঝলসিত দ্বীপ?) ভেসে
আসবে, ঝরবে হৃদয়ের কানে তোমার মধুর
কণ্ঠস্বর, নিরন্তর মনে হয় স্তব্ধ মধ্যরাতে
এইতো উঠেছে বেজে, টেলিফোন আমার উদ্দেশে,
কিন্তু ভুল শুনি আর কষ্ট পাই নিঃশব্দ সংঘাতে।

তখনই হঠাৎ

তোমার সান্নিধ্যে কিছুকাল অলৌকিক সরোবরে
কেটেছি সাঁতার, অকস্মাৎ শেষ হলো জলকেলি,
যেমন কেবল আলাপেই সাঙ্গ করেন সঙ্গীত
কোনো গুণী কী খেয়ালে। জানতাম, বিদায়ের পালা
আসবেই একদিন হৃদয়ে ছড়িয়ে রাশি রাশি
তেজস্ক্রিয় ছাই, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে
ভয়ংকর অবসান, কখনো ভাবিনি আগে। তুমি
কিংবা আমি কেউ নয় দায়ভাগী এমন সংকটে।

যা ঘটেছে কে জানে প্রকৃতপক্ষে তার বিষবীজ
আমাদের অগোচরে আমরা দুজনই পরস্পর
করেছি রোপণ কিনা অসতর্কভাবে? চতুর্দিকে
দৃষ্টি-অন্ধ-করা ঝড়, বেনো জলে লুপ্ত সাঁকো আর
নিরাশ্রয় মৃত পাখি ভাসমান। যখন তোমাকে
আমার সবচে বেশি প্রয়োজন, তখনই হঠাৎ চলে গেলে।

তরুণ কবির প্রতি

সবুরে ফসবে মেওয়া, না ফসলেও নেই ক্ষতি।
তুমি শুধু মাথা নীচু করে রোজ তোমার টেবিলে
উপবাসী সিদ্ধার্থের মতো স্থির হও; দূর নীলে
তোমার দখন থাক চিরকাল, কলমের গতি,
মনে রেখো, যেন রুদ্ধ না হয় কখনো। যদি নতি
সহজে স্বীকার করো ক্ষমাহীন শব্দের নিখিলে,
যদি না বন্ধন ছিঁড়ে আনো নব্য মায়া ছন্দে মিলে,
তাহলে বলবে লোকে এ-কবির কাব্যে নেই মতি!

কিছুই হলো না বলে করো না আক্ষেপ কোনোদিন
হে বন্ধু তুমিতো জানো জীবনানন্দের পায়ে পায়ে
ঘোরেনি ফ্যাশনদীপ্র লাস্যময়ী ললনার ঝাঁক
ভুলেও কখনো কিংবা নিজের ভবন দ্বিধাহীন
দেননি নির্জন্সে কবিকে ছেড়ে আলৌকিক দায়ে
ঐশ্বর্যশালিনী কেউ। তাই বলি, ক্ষোভ মুছে যাক।

তারও মন

নদীর উর্মিল বেগ পেশীতে পেশীতে; প্রতিদিন,
ছুটিছাটা বাদে, নিয়মমাফিক যায় কারখানায়
এবং কলের পাকে স্বেদসিক্ত ঘুরপাক খায়-
যেমন দেখেছি ফিল্ম-এ মজাদার চার্লি চ্যাপলিন
ঘুর্ণ্যমান, চক্রাকারে হয়ে যান নিজেই মেশিন।
বাজলে ছুটির বাঁশি ফ্যাক্টরি-গহ্বর ছেড়ে ছুড়ে
ক্লান্ত, ভারি পায়ে চলে আসে পথে, সে খিস্তি খেউড়ে
মাতে চা-খানায় দোস্তে-ইয়ারের সাথে শান্তিহীন।
মনের ভেতরে মন ডুব দেয় তারও স্মিত নীলে
মেশে সত্তা; কী উদার তৃণভূমি, ঘন বনস্থলী,
কী করে যে, বোঝে না সে, জেগে ওঠে শূন্য আশেপাশে।
দ্যাখে, অকস্মাৎ শাদা হাতি দলে দলে ধেয়ে আসে
তারই দিকে; কবন্ধের কালো হাটে চলে নরবলি।
রূপোলি পানের বাটা, শিরস্ত্রাণ হলুদ টেবিলে।

তিরিশ বছর

তোমার কথাই ভাবি রাত্রিদিন; পল, অনুপল
তোমার মুখের রেখা, চক্ষুদ্বয়, অধর, চিবুক
চুলের অসিত ঝর্না, স্বর্গের স্বপ্নের মতো বুক
মনে পড়ে। তোমাকেই ভাবি, যেমন কল্পানাজ্জ্বোল
কবি ভাবে কাব্যের শরীর তার লেখার টেবিলে,
কোনো গ্রন্থপাঠের মুহুর্তে, খেতে বসে, ফুটপাতে
হাঁটতে হাঁটতে, বিছানায় দারুণ বিনিদ্র রাতে-
সর্বদাই ব্যেপে আছো তুমি আমার হৃদয় নীলে।

ভাবিনি তোমাকে পাবো সাতচল্লিশের সীমানায়
অকস্মাৎ ভাবিনি যখন আমি রুক্ষ, ধূ-ধূ এই
পথে বড়ো দিশেহারা, তৃষ্ণায় কাতর, তুমি এসে
আমার আঁজলা ভরে দেবে ফোয়ারায় দিনশেষে।
তোমার আসার কথা ছিলো জানি অনেক আগেই,
তিরিশ বছর আমি ছিলাম তোমারই প্রতীক্ষায়।

তুমি তো এসেই বললে

তুমিতো এসেই বললে, এখন আমাকে যেতে হবে।
সরে না আমার মুখে কথা, শুধু আর্ত মনে ভাবি-
পুষ্পাকুল বসন্তের কাছে শ্রান্ত হেমন্তের দাবি
কতটুকু? তোমার উপস্থিতির সুস্মিত বিভবে
আমার যে একরত্তি অধিকার নেই, জেনেছি তা
অনেক আগেই, জানি নিশ্চিত তোমাকে অবশেষে
যেতে দিতে হবে, হবে ছেড়ে দিতে শীঘ্র ম্লান হেসে,
তবু জ্বেলে বসে আছি সত্তাময় লেলিহান চিতা।

বীতপুষ্প যে বাগান ছিলো পড়ে এক কোণে, যার
হৃতস্বাস্থ্য শুক্‌নো ডালে কোনো পাখি বহুকাল গান
গায়নি তন্ময়, তাকে পুনরায় বসন্ত-বিহ্বল
করেছো সে কোন্‌ খামখেয়ালে হে প্রতিমা আমার?
মিলন মুহূর্ত শুরু না হতেই দৃশ্যাবলি করে ছল ছল,
বিচ্ছেদ সকলই স্তদ্ধ, কেবল হৃদয় স্পন্দমান।

তোমাকে দিইনি আংটি

তোমাকে দিইনি আংটি, বাগদত্তা ছিলে না আমার
কোনোকালে, গোধূলিতে তুমি লাজরক্তিম যেদিন
বসবে উৎসব হয়ে বিবাহমন্ডপে, সঙ্গীহীন
থাকবো বিনিদ্র ঘরে চুপচাপ, যেমন খামার
পুড়ে গেলে নিঃস্ব চাষী বসে থাকে হা-হা শূন্যতায়।
ছিলো না আমার অধিকার কোনোদিন পুষ্পাকুল
উদ্যানে তোমার, শুধু স্বপ্নের ভিতরে কিছু ফুল
তুলেছি বাগান থেকে মাতাল আঙুলে, বলা যায়।

যখন রঙিন পথে হেঁটে যাবে তুমি যৌবনের
সৌরভ ছড়িয়ে, পদস্পর্শে হবে চূর্ণ ছন্নছাড়া
কবির নিটোল স্বপ্ন; ছিন্ন ভিন্ন রক্তাক্ত লেবাস
পড়বে তোমার চোখে। দাঁতে-ছেঁড়ে সে-বেশ বরের
নয়; ছিলো যার, তাকে পশুপাল করে তাড়া
রাত্রিদিন, সঙ্গী তার কংকাল-কর্কশ সর্বনাশ।

তোমাকে ভাবছি

তোমাকে ভাবছি আমি, যেমন আঁধার কুঠুরিতে
ফাঁসির কয়েদি ভাবে সকালের আরক্ত প্রতিমা
অত্যন্ত একাকী বসে উৎকন্ঠিত অন্তিম নিশীথে।
এখন কোথায় তুমি? এখন তুমি কি মধুরিমা
ছড়িয়ে তোমার আশপাশে আছো শবগন্ধময়
কোনো বন্ধ ঘরে কিংবা কান পেতে শুনছো কেবলই
কবর খোঁড়ার শব্দ? ভাবছি তোমার চক্ষুদ্বয়,
কেশপাশ, স্তনচূড়া, স্মৃতিজ্বলা সুগন্ধি ত্রিবলী।

তোমার হাতের দিকে আমার দুবাহু ছুটে যায়।
তোমার চোখের দিকে আমার দুচোখ উন্মীলিত,
তোমার ওষ্ঠের প্রতি আমার তৃষিত ওষ্ঠধায়
সারাক্ষণ, আমার হৃদয় শোনে প্রহরে প্রহরে
তোমারই নিভৃত পদধ্বনি। আর আমি সদা ভীত,
কেননা চৌদিকে হিংস্রজিহ্বা শিকারী কুকুর ঘোরে।

তোমার কি মনে পড়ে

তোমার কি মনে পড়ে দিবপ্রহরে নিরিবিলি ঘরে
কতদিন কাটিয়েছি ভালোবেসে কিছুটা সময়
পরস্পর, কী আমরা বলেছি তখন, ঘরময়
কেমন সৌরভ ছিলো মৃদু তোমার কি মনে পড়ে?
তোমার দু’চোখে দৃষ্টি মেলে দিয়ে কী স্নিগ্ধ নির্ঝরে
মিটিয়ে প্রখর তৃষ্ণা পুনরায় পেয়েছি অভয়
দুঃসময়ে; ভুলে গেছি কে অর্জুজ কেই বা সঞ্জয়
সর্বগত্রাসী দাবানলে, দিকচিহ্নলোপকারী ঝড়ে।

ঝড়ের পরেও দেখি আমরা দুজন মুখোমুখি
বসে আছি, জীবনের বন্দনায় স্পন্দিত এবং
নিজেরাই হয়ে গেছি গান, বিভ্রান্তির কালো রঙ
মুছে গেছে সত্তা থেকে, মনে হয়। এখন দাঁড়াবো
সুস্থির জমিনে তুমি আর আমি হবো দীপ্র সুখী।
ফের ভাবি-কেন বেঁচে আছি, কেনই বা মরে যাবো?

তোমার কিসের তাড়া ছিলো

(মনসুর আহমদ স্মরণে)

তোমার কিসের তাড়া ছিলো অত? কেন তুমি সাত
তাড়াতাড়ি এই গুলজার আড্ডা থেকে গুডবাই
বলে চলে গেলে, কেন? হায় করমর্দন বিনাই
নিয়েছো বিদায়, যেন গূঢ় অভিমানে অকস্মাৎ।
না, অমন করে যেতে নেই নিভিয়ে পূর্ণিমা-রাত,
চেয়ার নিঝুম করে টলটলে গ্লাস ফেলে, ছাই,
ঠান্ডা না হতেই ত্র্যাশাক্ট্রেতে। চাই, তোমাকেই চাই,
বলে যে ব্যাকুল ডাকে, তারও হাতে রাখলে না হাত।

এখন কোথায় তুমি ঝর্নাতলে নির্মোহ, একেলা
মুখ রাখো? কাদের আসরে খুব মেতে থাকো, বলো?
আমরা কজন আজো, তুমিহীন, বসি এখানেই-
তক্কে-গপ্পে গানে-পানে জমে ওঠে কিছু সন্ধ্যেবেলা।
হঠাৎ তোমাকে দেখি! ভাবি, যদি যাই, ছলোছলো
দুটি চোখে বলবে কি কেউ, না, অমন করে যেতে নেই?

তোমার পুরোনো ছবি দেখে

কে তুমি কে তুমি বলে আমার হৃদয় হ’য়ে যায়
আরক্ত চিৎকার এক। সেই বেলফুল ফুটে আছে
চুলের চুড়ায় আজো কী প্রফুল্ল। রাগমালা নাচে
সতত অস্তিত্বময়, একটি নিমেষ স্তব্ধতায়
হয়ে গেছে চিরকাল। অনেক দুরের নিরালায়
যে ফাল্গুনে মধ্যরাতে দরবারী কানাড়ার কাছে
সমর্পিতা, তার চক্ষুদ্বয়ে স্মৃতির মন্তাজ বাঁচে,
না কি সে নিজেই স্মৃতি অনেক মনের নীলিমায়!

তোমার পুরোনো ছবি দেখে ভাবি, সত্যি এই তুমি
সে-তুমির কাছ থেকে কতদূরে এসে আজ একা
আঁধারে দাঁড়িয়ে আছো; পারাপার কোথায় বিলীন;
আশ্রয় আঁধিতে লুপ্ত, দারুণ বিরূপ এই ভূমি।
কখনো আবার, কথা ছিলো, আমাদের হবে দেখা-
এসেছি দুর্যোগে তাই তোমার কাছেই দ্বিধাহীন।

তোমার সান্নিধ্যে

তোমার সান্নিধ্যে আমি, হা কপাল, কখনো পারি না
ছুটে যেতে ইচ্ছেমতো। অথচ আমার মধ্যে রোজ
একটি ঈগল দূর তোমার আসমানের খোঁজ
নেয়ার তৃষ্ণায় ডানা ঝাপটায়। হায়, মনোলীনা
কী করে হৃদয় পাবো বলো তোমার শরীর বিনা?
প্রত্যহ সযত্নে তুমি চুল বাঁধো, কারো সাজগোজে,
এখন তা-নয় কিছুতেই আমার দৃষ্টির ভোজ।
পড়ে আছি রুক্ষ একা, সঙ্গী শুধু মর্চে-পড়া বাণী।

তুমি কি এখনো আসবে না? শিরাপুঞ্জে বাজাবে না
মত্ত মঞ্জীরের ধ্বনি? সে কোন্‌ দ্বিধার বেড়াজাল
ঘিরেছে তোমাকে আজ? কোন্‌ ভীতি কুন্ডলী পাকায়
পথে পথে? মনে কি পড়ে না একজন, চিরচেনা,
তিমির-শংকিল রাতে একাকিনী দূর শাল তাল
তমালের বনে গ্যাছে বারংবার প্রেমের ডেরায়?

দন্ডিত মানুষ

দন্ডিত মানুষ আমি, বসে আছি একা অন্ধকারে
গৃহকোণে মুখ ঢেকে। চৌদিকে কবন্ধদল নাচে
উন্মাতাল, কী আমার অপরাধ? কবিতার কাছে
মানুষ হয়েছি বলে সুন্দরের স্তবে বারে বারে
তন্ময় হয়েছি বলে আমি আজ বীভৎস ভাগাড়ে
কাটাবো প্রহর শুধু নরমুন্ডময় শীর্ণ গাছে
দৃষ্টি রেখে সর্বক্ষণ? প্রকৃতির আনাচে-কানাচে
ওড়ে শ্মশানের ছাই, বসে আছি দীপ্ত অহংকারে।

স্বেচ্ছায় নিয়েছি দন্ড, কাউকে দিই না তাই দোষ।
যে যা চাইবে আজ সবই দিতে পারি নির্দ্বিধায়
আমার উরুর মাংস তাল তাল কিংবা কর্ণমূল
এবং রাখতে পারি হাত তীব্র মোমের শিখায়।
সর্বদা উপেক্ষা করে ডাকিনীর প্রেতের আক্রোশ
শ্মশানেও কালেভদ্রে ঝরে যায় শেফালি, বকুল।

দিন রাত্রি

প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙে, চেনা পৃথিবীর
রূপ ভেসে ওঠে পুনরায়, দেখি কিছু পাখি
জমায় সুরেলা আড্ডা, একজন বেড়াল একাকী
উঠোন পেরিয়ে যায়- ভোরের সৌন্দর্য কী নিবিড়
মনে হয়। দুপুর কাচের মতে চকচকে, ভিড়
বাড়ে জনপথে, চিল সুনীল চক্কর কাটে, ডাকি
মনে-মনে তাকে, যার জন্যে সদা প্রতীক্ষায় থাকি,
বিকেলও মধুর আর অপরূপ সন্ধ্যার শিশির।

প্রসিদ্ধ দিনের শোভা, তবু আমি গাঢ় নিশীথের
গান গাই, এবং অপেক্ষা করি সেই প্রহরের
যখন গভীর হয় রাত, নিদ্রার গহন চোখ
বুজে আসে, কেননা তখনই শ্রান্ত সত্তায় আমার
ঘুমের পাপড়ি জ্বলে, স্বপ্ন দেখি ভুলে দুঃখ শোক;
সে স্বপ্নে তুমিই দীপ এবং মদির দীপাধার।

দৃশ্যাবলী

প্রতিদিন কত কিছু চোখে পড়েঃ পথঘাট, যান,
এবং দোকানপাট, ঝকঝকে, মানুষের ভিড়,
রেস্তোরাঁ, শ্যামল পার্ক, নৌকোময় শান্ত নদীতীর
চিড়িয়খানার বন্দী পশুপাখী, পুরোনো অর্গান।
পথে কৃষ্ণচূড়ার বিদ্রোহ, একজন বর্ষীয়ান
নিঃশব্দে পোহান স্মৃতি, তাঁর গলকস্বলের ভাঁজে
চুমু খায় ভোরবেলা; বেহালাবাদক মাঝে মাঝে
দেখা দেয়, নোংরা গলিটাও হয়ে ওঠে ঐকতান।

দৃশ্যে পরেও দৃশ্য, ভিন্ন ভিন্ন, কেমন সুদূর
অগোচরে থেকে যায়। কল্পনায় জাগে দীপাবলি,
খৃষ্টপূর্ব কোনো কুমারীর হস্তধৃত পদ্মকলি,
মায়াবী মানস হংস, সরোবর; বিপুল বৈভবে
জেগে ওঠে সামান্যের অবয়ব কখনো বা, তবে
হে মেয়ে তোমাকে স্বপ্নে দেখাটাই সবচে মধুর।

দোরগোড়া থেকে

আমিতো স্বর্গের দীপ্ত দোরগাড়া থেকে ফিরে যাই,
ফিরে যাই বারবার এবং আমার পুণ্যফল
শূন্য বলে চতুর্দিক থেকে ক্ষিপ্ত প্রেতের দঙ্গল
তেড়ে আসে হৈ-হৈ, বলে সমস্বরে, তোর নেই ঠাঁই
অমরায়, তুই যা গন্ধুকে, আগুনের বাজখাই
আঁচ তোকে নিত্য দগ্ধ করুক, তুই যা। বেদখল
হয়েছে আমার মরুদ্যান আর এখন সম্বল
শুধু আত্মাভস্মকারী তৃষ্ণা, প্রতারক রোশনাই।

হাঁটছি তামাটে পথে, পথ দীর্ঘ মনে হয়,
মনে হয় মাঝে-মাঝে বৃষ্টি নামে, শুষ্ক ওষ্ঠে ঝরে
উৎফুল্ল স্বেহার্দ্রে বিন্দু, পর মুহূর্তেই পথময়
রৌদ্রের বৃশ্চিক ক্রীড়াপরায়ণ, ধু ধু অন্ধকার
দেখি চরাচরে, দেখি কোথাও দরজা নেই, তার
অমন পুষ্পিত অবয়ব চলে যায় অগোচরে।

দ্বিতীয় যৌবন

তোমার যোগ্য কি আমি? এখন আমার দিকে চোখ
রেখে ভালো করে দ্যাখো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখো এই
আমাকে নবীনা তুমি। আমার সত্তায় আর নেই
প্রখর বৈভব প্রৌঢ়ত্বের তাম্রছায়া প্রায় শোক
হ’য়ে ঝুলে থাকে ত্বকে। আমি সেই জুয়াড়ী যে তার
সর্বস্ব খুইয়ে বসে আছে একা। অথচ এখন
সহস্র নক্ষত্র-জ্বলা অনাবিল তোমার যৌবন।
আমার সত্তায় স্পষ্টাঙ্কিত রহস্যের অন্তঃসার।
আমার কিছুই নেই, না প্রতাপ, না বৈভব। শুধু
এই আধপেটা জীবনের ছকে বেয়াড়া সন্ত্রাসে
অপটু অভিনেতার মতো আওড়াই কী যে ভুল
শব্দ এলোমেলো, বস্তুত কিছুই নয় অনুকূল-
তবুও তোমার স্পর্শে জেগে ওঠে আমার এ ধু ধু,
জীবনে দ্বীপের মতো দ্বিতীয় যৌবন জয়োল্লাসে।

দ্বীপ

হঠাৎ আমার ভেলা ডুবে গেলো খর চোরাটানে
ভর সন্ধ্যাবেলা আর সাঁতারে অপটু আমি ঘোলা
জলের নিমর্ম পাকে জড়াতে জড়াতে অনবোলা
অসহায় প্রাণীর মতন ডুবি, ভাসি, কোন্‌ খানে
কোন্‌ নিরুদ্দেশে একা যাবো ভেসে অন্তিমে কে জানে।
হতিমধ্যে চতুর্দিকে থেকে ক্রুর হাঙর, হা-খোলা,
আসছে তুমুল ছুটে, হায় অচিরাৎ রক্তে গোলা
হবে জলস্রোত, চোখ বুজি; মরণ বল্লম হানে।

কী আশ্চর্য, এ কোথায় অক্ষত শরীরে দৈববলে
শুয়ে আছি অপরাহ্নে হাত-পা ছড়িয়ে শূন্য তীরে
এ কোন শ্যামল দ্বীপে? কাষ্ঠখন্ড আঁকড়ে কৌশলে
আমি কি এসেছি ভেসে? চিতার চোখের মতো চাঁদ
জ্বলে দূর আসমানে, তাহলে এসেছো তুমি ফিরে?
তুমিই জাগর দ্বীপে? করেছো হরণ অবসাদ?

নান্দনিক সত্যের পাঁচালি

এখনো উনিশ বিশ বছর আগের দ্বিপ্রহর
স্মৃতির উদাস পথে ডেকে যায় সেলুলয়েডের
মমতায়; দৃষ্টিপথে একটি প্রকৃত গ্রাম হয়
আমার নিজস্ব চেনা আরেক পল্লীর সহোদর।
সেই কবেকার উপন্যাস ভিন্ন মাত্রা পায়, দেখি
গ্রামেপথে ওরা দুটি বালক বালিকা ছোটাছুটি
করে, ঘোরে কাশবনে, গহন বর্ষার ভেজে আর
শ্যামল মাটিতে কান পেতে শোনে ট্রেনের আওয়াজ।

খদ্ধ সেলুলয়েডের সীমানা পেরিয়ে দুর্গা, অপু
খেলা করে চেতনার নীলিমায়। মিষ্টি-অলা, ভেপু
এবং পুঁতির মালা, মাটির দেয়ালে দিদিমার
রূপকথা-বলা ছায়া কী প্রগাঢ় সত্যজিৎ রূপে
মনের নানান স্তরে জেগে থাকে। ধন্যবাদ তাঁকে,
এখনো শোনান যিনি নান্দনিক সত্যের পাঁচালি।

নিজের বিষয়ে

নিজের বিষয়ে আমি কস্মিনকালেও খুব বেশি
ভাবি না, বিশ্বাস করো। মাঝে-মধ্যে ভাবি এ জীবন
চাকরিত্বে অন্তরীণ, ভীষণ নাছোড় অনটন
সর্বক্ষণ, যদিও ধনিক সংঘে কিছু ঘেঁষাঘেঁষি
করি, আর নিজেরই সংসারে অনবোলা পরদেশী
হয়ে থাকি, শ্যামলিম মফস্বলে কবি-সম্মেলন
হলে যাই কালেভদ্রে, মনে পড়ে আমার এ মন
কেড়েছিলো সে কখন নবীনা সুস্মিতা এলোকেশী।

অকুন্ঠ কবুল করি, আমার জীবনে নেই কোনো
রঙিন চমক কিংবা বীরোচিত কর্মযোগ, শোভা
নেই অসামান্য, তবে আমার দর্পণে ভেসে ওঠে
অসুখী করুণ বিদূষক আর কখনো সখনো
আমার নিমগ্ন সত্তা অন্ধকারে খুনীর বাহবা
পেয়ে যায়, মাঝে মাঝে সন্তের ভঙ্গিও কিছু ফোটে।

নীরবই থাকবো আজ

নীরবই থাকবো আজ। হে মেয়ে তোমার যত সাধ
গালমন্দ দাও, দাও অপবাদ, চোখের আগুন
ঝরাও আমার সত্তা জুড়ে, যত পারো; করো খুন
আমাকে, দেবো না বাধা, জানাবো না কোনো প্রতিবাদ।
আমাকে হেলায় তুমি ত্যাগ করে যাবে বলে খাদ
জেগে ওঠে চতুর্ধারে যেন গিলে খাবে নিমেষেই।
তোমার নিষ্ঠুরতায় দ্রুত হারিয়ে ফেলছি খেই
জীবনের; সময়-যাপন, মনে হয়, কী বিস্বাদ।

আমিতো তোমার হাতে আমার হৃৎপিন্ড থেকে ছেঁড়া
একটি গোলাপ, খুব টকটকে, করেছি অর্পণ;
তোমার চলার পথে দিয়েছি উড়িয়ে স্বপ্নঘেরা
রঙিন নিশান সংখ্যাহীন আর যখন তখন
পাঠিয়ে কপোত কিছু তোমারই উদ্দেশে দূর নীলে
নিবদ্ধ রেখোছ দৃষ্টি, তবু তুমি বিভীষিকা দিলে।

নৈঃসঙ্গ্য-লালিত আমি

নৈঃসঙ্গ্য লালিত আমি। শিরায় শিরায়, লোমকূপে
কী শীতল স্রোত বয় সারাক্ষণ, অস্থিমজ্জা
নিঝুম পল্লীর মতো। নিজে খাপছাড়া বলে লজ্জা
পাই খুব একান্ত নিজেরই কাছে। নৈরাশের যূপে
প্রায়শ আমাকে ঠেলে দ্যায়, দ্যায় বিরূপ দঙ্গলে
ছুঁড়ে ক্ষিপ্র আমার ভেতরকার কোনো প্রতিপক্ষ
এবং মনুষ্যরূপী মড়াখেকেদের সঙ্গে সখ্য
জমে ওঠে নিত্য দিকচিহ্নহীন অসিত জঙ্গলে।

আমি কি নৈঃসঙ্গপ্রিয় আজীবন? গাছপালা, পাখি
পাখালির ভিড়ে, পশুদের কাছে, খরগোশের গায়ে
মুখ ঢেকে, জনহীন ঝর্নাতলে আনন্দ আনন্দ
ব’লে মেতে থাকতেই চাই জীবনের সব ফাঁকি,
উন্মত্ত সংঘর্ষ রক্ত ফেনিলতা ভুলে বনচ্ছায়ে?
মানুষের সঙ্গ অভিলাষী আমি, থাক শত দ্বন্দ্ব।

পারি না ফোটাতে

তোমার কি মনে পড়ে আলোকিত ঘরে সন্ধেবেলা
তুমি খুব রেগে গিয়েছিলে, যেন অন্তরাল থেকে
ভীষণ বিকারী কেউ চোখে লালসার রঙ মেখে
তোমাকে দেখেছে ফেলে গগ্ন? অথচ আমার খেলা
বুঝতে পারোনি তুমি; চুপিসারে ছিপছিপে ভেলা
ভাসিয়েছিলাম আমি আটপৌরে বাস্তবকে ঢেকে
একটি স্বপ্নের মসলিনে; আমার ভেতরে পেকে
উঠেছিলো কামফল উজিয়ে সকল অবহেলা।

রাত বাড়ে, তোমার ক্রোধের তাপ আস্তে আস্তে ধিমে
হয়ে আসে, যেমন শঙ্খিনী সাপুড়ের বাঁশি শুনে
শান্ত হয় ক্রমান্বয়ে। ভস্মীভূত বাসনার হিমে
ভিজে মুঢ় বালকের মতো মর্মর মূর্তির পাশে
বসে থাকি চুপচাপ, ভাবি, বৃথাই চলেছি বুনে
শব্দজাল, পারি না ফোটাতে তারা কারো চিদাকাশে।

পিঁপড়ের দ্বীপে

নৈশ ভোজনের পর মার্কিন টাইম ম্যাগজিন
উল্টেপাল্টে তুলে নিই ডিফোর রবিনসন ক্রূশো,
কিছুক্ষণ ঘুরি তার সঙ্গে; কী অদ্ভুত বেশভূষো
নিজের শরীরে দেখি, ছাগগন্ধে এই ঘুমহীন
রাত্রি ভরপুর, অকস্মাৎ পিঁপড়ের ঝাঁক ধেয়ে
আসে চতুর্দিকে থেকে। অতিকায় ওরা, টেলিফোন
তার, খাট, দেয়ালের মাঠ, যেন অত্যন্ত গোপন
ষড়যন্ত্রে বুঁদ হয়ে, উঠছে চেয়ার বেয়ে বেয়ে।

পিঁপড়েগুলি চকচকে লাল গ্রেনেডের মতো,
যে কোনো মুহূর্তে ওরা ভীষণ পড়বে ফেটে, ঘর
নিমেষে কাঠের গুঁড়ো হবে, জলপাইরঙ জীপে
চেপে এসে আমার হদিশ কেউ পাবে না, আহত
আমি রইবো ঢাকা ভগ্নতূপে, দুঃস্বপ্নের এ প্রহর
এত দীর্ঘ কেন? কেন বন্দী আমি পিঁপড়ের দ্বীপে?

পুতুল নাচের ইতিকথা

নিজে সে অলক্ষ্যে থাকে, হাতে তার নানাবিধ সুতো,
কলকাঠি, নানা রঙা, নাড়ে চাড়ে যখন তখন,
এবং যেমন খুশি রাত্রিদিন বলায় ওদের দিয়ে টন
টন কথা, আসলে সে নিজেরই একান্ত মনঃপুত
বাছা বাছা শব্দাবলী আওড়ায়; তার ছলছুতো
বোঝা দায়, তারই কণ্ঠস্বর বাজে, কেবল ক’জন
ওরা ঠোঁট নাড়ে, নাচে পুতুলের আত্মীয় স্বজন
পুষ্পাকুল স্টেজে, মাঝে মাঝে হয় বটে তালচ্যুত।

এ এক মজার খেলা চলে রাত্রিদিন। এজলাসে
ভারিক্কী বিচারপতী, চুপচাপ, আসামী হাজির।
চতুর উকিলদ্বয় তোতাপাখি। পরিণামহীন
মামলায় শুধু বাদ-বিসম্বাদই সার; চোখে ভাসে
সুতোবন্দী নানাজন, কেউকেটা, উজির, নাজির।
যার হাতে সুতো সেকি নিজেও পুতুল সমাসীন?

পুলিশও প্রত্যক্ষ করে

ক্ষমাহীন নিষেধের বেয়নেট উদ্যত চৌদিকে
এবং ডাইনে বাঁয়ে কাঁটাতার, যেন বর্ধমান
ফণিমনসার বন। ব্যক্তিগত নিবাসসমূহ
গিসগিসে গোয়েন্দার অবাধ আস্তানা, শিরস্ত্রাণ-
নিয়ন্ত্রিত জীবনের, কিছু গনতান্ত্রিক বিকার
এখনো গোলাপ চায় এ মড়কে। মৃত্যুভয় ফিকে
হ’য়ে এলে আমাদের প্রিয় লুম্পেন ইচ্ছার ব্যূহ
হিজড়োর মতন নেচে ওঠে নিরাশ্রিত চমৎকার।

প্রধান সড়কে আ প্রতিটি গলির মোড়ে মোড়ে
কাঁটামারা জুতো ঘোরে। এরই মধ্যে হতচ্ছাড়া মন
তোমার সংকেত পায়, হৃদয়ের সাহসের তোড়ে
আমরা দু’জন ভেসে চলি রূঢ় পথে স্বপ্ন বেয়ে।
বনেদী বাড়ির চোখ, গাছপালা, পাখি দ্যাখে চেয়ে,
পুলিশও প্রত্যক্ষ করে আমাদের প্রথম চুম্বন।

পূর্বপুরুষের রক্ত

আমার শিরায় পূর্বপুরুষের রক্ত কী উচ্ছল
নাচে আগোচরে। অগ্নিকুন্ড, বর্শা অসি ক্ষুরধার,
স্বেদসিক্ত ঘোড়া, চিত্রায়িত রাঙা কাচ, সিংহদ্বার
ঝলসানো হরিণ এবং মল্লযুদ্ধ রক্তোৎপল
মাঝে মধ্যে আনে ঘোর স্তরে স্তরে অবচেতনের।
আমিও ছিলাম সেই দূর শতকের সুবিশাল
দূর্গের প্রাকার আর আমার গন্ডারচর্ম ঢাল
ঝলসে উঠেছে রণক্ষেত্রে, ডঙ্কা শক্রূ হননের

নেশা ধরিয়েছে রক্তে। আবার এ কোন সুপ্রাচীন
ভেসে ওঠে জলজ্ব্যান্ত? নিভৃত প্রকোষ্ঠে বসে শীতে
নিমগ্ন কিসের ধ্যানে সে মানব এমন একাকী?
চঞ্চল পালক তার হাতে, কোনো মায়াবী সংগীতে
যেন সে গভীর আন্দোলিত, তার দিকে চেয়ে থাকি
নিষ্পলক; সে-তো আমি, গানে-পাওয়া, আর্ত উদাসীন।

 প্রকৃতির কাছে

জীবনানন্দীয় পরিবেশে অপরাহ্নে পাশাপাশি,
মনে পড়ে, ছায়াচ্ছন্নতায় আমরা ছিলাম বসে
মাঝে-মধ্যে গাছ থেকে শুক্‌নো পাতা পড়ছিলো খসে;
উচ্ছ্বসিত বিকেলের রঙ এবং তোমার হাসি
একাকার, প্রকৃতির কাছে আজো কিসের প্রত্যাশী
আমরা ভাবছিলাম। দেখি, হংস-হংসী ঠোঁট ঘষে
পরস্পর উড়ে যায় বিল ছেড়ে; মগজের কোষে
কোষে কী মদির শিখা জ্বলে, বাজে স্বেচ্ছাচারী বাঁশি।

আমিতো পারিনি হতে বনহংস, তুমিও পারোনি
বনহংসী হতে সে বিলের ধারে। পাঁশুটে ভব্যতা
আঁকড়ে ছিলাম ব’সে চুপচাপ, যদিও শিরায়
উঠেছিলো জেগে শত পালতোলা মাতাল তরণী।
বুঝতে পারিনি, হায় তোমার সত্তায় ব্যাকুলতা,
কী-যে ছিলো তোমার চোখের দুটি অসিত হীরায়।

প্রেমিকের গুণ

কেমন প্রেমিক আমি? বহু দীর্ঘ বছরের পর
এ প্রশ্ন তুলছে মাখা অন্ধকার মনের বিবরে।
তুমিও আমার প্রতি, হায়, তারাও এমন ক’রে
আজকাল মাঝে-মাঝে, মনে হয়, প্রশ্নের উত্তর
একান্ত জরুরি- নইলে একটি দেয়াল নিমেষেই
ভীষণ দাঁড়িয়ে যাবে আমাদের মধ্যে। হয়তো ভাবো
কোনো কোনো বিক্ষুব্ধ প্রহরে, আমি কী এমন পাবো
এই খাপছাড়া লোকটার কাছে বস্তুত যা নেই

অন্যের আয়ত্তে আজ? প্রেমিকের গুণাবলী কী-যে
জানি না সঠিক কিছু, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
যখন আমাকে দ্যাখো তুমি, আমার হৃদয়ে বাঁশি
বেজে ওঠে, চোখে জাগে নতুন সভ্যতা, দীপ্র বীজে
ধনী হয় মনোভূমি। তোমারই উদ্দেশে দুটি হাত
বাড়াই, আবার থামি, পাছে করো ঘৃণা অকস্মাৎ।

 ফিনিক্সের গান

আমি তো ছিলাম ভস্মরাশি হয়ে গৌরববিহীন
অন্ধকারে সুনসান এলাকায় অনেক বছর।
আমার ওপর বয়ে গ্যাছে কত যে বৈশাখী ঝড়,
তুহিন বাতাস তীক্ষ্ম ছুঁয়েছে আমাকে রাত্রিদিন।
তবুও নিস্পন্দ একা ছিলাম নিয়ত গমগীন্‌
অগ্নিদগ্ধ বেহালার ভস্মের মতন স্তব্ধতায়;
করেনি আমার প্রতি দৃষ্টিপাত কেউ, বেলা যায়
বলে আমি করেছি চিৎকার, তবু ছিলো উদাসীন
প্রতিবেশ সারাক্ষণ, পাইনি জীয়ন স্পর্শ কারো।
আমাকে জাগালে তুমি রুক্ষ অবেলায়, দিলে গান
অস্তিত্বের তন্তুজালে। অথচ আমি তো জানি গাঢ়
এই দান ব্যর্থ হবে, যদি নাও বিদায় হঠাৎ।
তোমাকে ডাকছে দূরযাত্রা, বেজে ওঠে অবসান-
সূর্যোদয় দিলে কেন, পাবোই যখন অন্ধ রাত?

 বাজপাখি

ক্রূর ঝড় থেমে গ্যাছে, এখন আকাশ বড়ো নীল-
গাছের সবুজ পাতা কেঁপে কেঁপে অত্যন্ত সুষম
বিন্যাসে আবার স্থির। খরগোশের চঞ্চল উদ্যম
আশপাশে, বাজপাখি উঁচু চূড়া থেকে অনাবিল
আনন্দে তাকায় চতুর্দিকে, কোনো নিষ্ঠুর দুঃশীল
চিন্তা নেই আপাতত, বিস্তর বয়স, চোখে কম
দ্যাখে, নখ উদ্যমরহিত, বুকে গোপন জখম,
তবুও ডরায় তাকে নিম্নচারী পাখির মিছিল।

পাহাড়ে পড়েছে তার ছায়া কতদিন, মাঝ-মাঝে
এখনো সে করে যাত্রা মেঘলোকে, যখন হাঁপায়
অন্তরালে গুটিয়ে ঘর্মাক্ত ক্লান্ত ডানা, চোখ বুজে-
দুঃস্বপ্ন দখল করে তাকে, শোকাবহ সুর বাজে
বুকের ভেতরে, কিন্তু নিমেষেই চৈত্র পূর্ণিমায়
চোখ তার ভাবময়, ডাকে তাকে কে যেন গম্বুজে।

বিচ্ছেদ

একটি গোলাপ স্বপ্নে মোহন ভাস্কর ফরহাদ
দেখেছিলো, ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরেও তার ঘ্রাণ
নিবিড় থাকতো জেগে সর্বক্ষণ, এবং নিষ্প্রাণ
পাথর দেখাতো তাকে গাঢ় স্বপ্ন একটি নিখাদ
প্রতিমার; সে প্রতিমা নিজে এক নতুন বিষাদ
হয়ে দীপ্ত ভাস্করের সত্তাময় বলে অফুরান
কথা, ছেনী হাতে ফরহাদ শোনে নহরের গান
কান পেতে; সেই গানে নেই কোনো মিলন সংবাদ।

আমারও জীবনে আজো মিলনের মুহূর্ত আসেনি।
আমার দৃষ্টিতে তার স্তন যুগল হয়নি উন্মোচিত,
সুস্মিত অধর তার অন্তরালে থাকে চিরদিন,
আমার দোতারা তার শরীর-মেঘনাকে কল্লোলিত
করবে কি কোনোদিন? হবে না বিস্রস্ত তার বেণী?
বিচ্ছেদ-মরুর জ্বালা বাড়ে চরাচরে সীমাহীন।

বিদায় গান

কেন এ বিদায় গান বারবার শোনাও আমাকে?
কেউ কি কখনো মুমূর্ষের কানে কানে আওড়ায়-
ফুরালো তোমার বেলা মগ্ন আমি স্বপ্নের পাড়ায়,
কেন গুঁড়ো ক’রে দিতে চাও কাচের মতন তাকে?
আমি তো স্বপ্নের পথ্যে ক্রমাগত বাঁচাই সত্তাকে।
জীবন কাটাতে চাই সেই দু’টি চোখের তারায়
চোখ রেখে, অথচ আমার দিকে প্রেত পা বাড়ায়
অন্ধকারে, ঘুরি দিশাহারা ভীষণ নিশির ডাকে।

আমাকে বিদায় গান কোনো ছলে শুনিও না আর;
বরং আশ্বাস দাও সান্নিধ্যের এবং চুম্বন
দাও আজ আমার তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠে নিবিড়-মদির।
সে চুন্বনে তপ্ত অন্ধ উদ্বেলিত শেণিতে আমার
উঠবে জেগে অতিদূর শতাব্দীর স্মৃতি-বিস্মরণ
আর নিমেষেই হবে দীপান্বিতা তোমার শরীর।

বিস্মৃতির ডোবায়

বিস্মৃতির ডোবায় আমাকে ছুঁড়ে দিয়ে নিদ্বির্ধায়
সে কি আজ তারাভরা আকাশকে শোভা দ্যাখে, নেয়
গোলাপের ঘ্রাণ কিংবা অন্য কারো আলিঙ্গনে ধরা
দেয় বারবার? না কি শোনে রাতে আমজাদ খাঁর
দরবারী, গাছের সবুজে আর গেরুয়া মাটিতে
বৃষ্টিপাত? বিছানায় নিঃসঙ্গতা ঘুমায় আমার
পাশে আ জপায় আমাকে অন্ধকারে, সে তোমাকে
হেলায় ফেলেছে মুছে দ্রুত জলছবির মতন।

মনকে প্রবোধ দিই। জানলার ধারে গিয়ে দেখি
জনহীন পথ বহুদূরে গেছে বৃষ্টির মঞ্জীর
বুকে নিয়ে, গাছে পাখি নিয়েছে আশ্রয় ভেজা গায়ে।
হয়তো সে ভোলে নি আমাকে। যত আমি তাকে ভুলে
থাকতে চাই ততই মুখশ্রী তার মনে পড়ে আর
মনে হয়, দরজায় রয়েছে দাঁড়িয়ে সে প্রতিমা।

 বয়স যতই হোক

বয়স যতই হোক, আজো অমিলের ভিড়ে মিল
খুঁজে ফিরি বন্ধ ঘরে, প্রত্যেকের থেকে অন্তরালে
একটু আলাদা ভাবে থাকি কিছুকাল। কী হারালে
বিনিময়ে কী লভ্য সে-কথা ভেবে কিছু ঢিল
ছোঁড়া যায় নক্ষত্রের আস্তানায়। আলৌকিক ঝিল
আমার ভেতরে উচ্ছ্বসিত, অস্তিত্বের তন্তুজালে
গভীর সরোদ বেজে ওঠে। সে কোন্‌ সুদূর কালে
ছিলেন আমারই মতো তপোক্লিষ্ট হোমার, ভার্জিল-

এ-কথা স্বরণে রেখে নিজেকেই উস্‌কে দেয়া যায়
মাঝে মধ্যে; তবে এ-ও জানি শূন্য ফাটা কলসের
মতো বেজে ওঠা শুধু আত্মপ্রবঞ্চককে মানায়।
তাই একা, বড়ো একা কাটাই প্রহর কলমের
স্পর্শে মূলহীন লাল-নীল কমলের জাগরণ
দেখে, দেখে মরুবেক্ষ হরিণ-কোমল ঘন বন।

ভিক্ষা নয়

তুমি তো জানোই আমি কোনোকালে নই বিত্তবান।
আমার বাড়ির দরোজায় দেয় না পাহারা কোনো
উর্দিপরা দারোয়ান যমমুখো, অথবা কখনো
হুঁকোবর্দারের দল আহ্লাদের ঝড়ে খানখান
করে না স্তব্ধতা আমার এ নিভৃত ডেরার, ধান
নেই অফুরান শত শত সম্পন্ন গোলায়। শোনো,
মেয়ে বলি, তবু নই বিশীর্ণ ভিক্ষুক, যত ঘন
কৃষ্ণ হোক দুর্দশার মেঘ, চাই না কৃপার দান।

তাই আমি আর্তস্বরে ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও বলে
কখনো হবো না নতজানু তোমার পুষ্পিত এই
দরবারে, বরং সর্বস্ব নেবো লুটে নিমেষেই
সাগর দস্যুর মতো হঠকারিতায়। জ্বলজ্বলে
চোখে শুধু থাকবে তাকিয়ে তুমি, কোন কূট ছলে
ফেরাবে দূর্বার অতিথিকে? তোমার সে শক্তি নেই।

ভিন্ন কোনো স্মৃতি

প্রত্যহ চৌদিকে দেখি চর্মচোখে অনেক কিছুই-
ছায়াচ্ছন্ন নিরিবিলি গলির ভেতরে সারি সারি
ছোট গাছ, মৃত চিল, প্লাস্টিক চিরুনি; নীল শাড়ি
বারান্দাকে চুমো খায়। মৃৎপাত্রে একরাশ জুঁই।

টেবিলে কলম একা পোহায় বিশ্রাম, আস্তে ছুঁই
তাকে, বই স্বপ্ন দ্যাখে, দেয়ালে প্রাচীন তরবারি,
রুক্ষ গোরখোদকের কোদাল, মালীর ফুলঝারি-
বস্তুময় সব জায়গা, দেশ কিংবা বিদেশ বিভূঁই।

শুধু কি বস্তুর বহিরঙ্গ দেখে তৃপ্ত হবো আমি?
এখন নিজেকে বলি- বস্তুর নিছক উপস্থিতি
ইসস্তত আশেপাশে আমার গভীর ভালো লাগে,
তবু চাই তশ্‌তরি, তম্বুরা এক নিবিড় সংরাগে
নতুন বিমূর্ত হোক বর্ণোচ্ছ্বসে আর অস্তগামী
সূর্য, জলপানকারী ঘোড়া হোক ভিন্ন কোনো স্মৃতি।

ভুলের ভিতরে

শরীরের রঙ তার ধূসর কালচে, ধূত ব’লে
নাম ডাক আছে, লোকে তাকে মিহি সৌজন্যবশত
পক্ষী বলে, কেউ কেউ, রাশভারি, বস্তুত সতত
কাককে বায়স বলে করে সম্বোধন। কলরোলে
আসক্ত সে, আজন্ম সংগীত-ছুট, তবু খুব গুণী
গায়কের মতো ভঙ্গিমায় মাতে; কণ্ঠে তার, হায়,
মদির বসন্তদিন হয় না নন্দিত, নিরুপায়
ডেকে যায় ব্যর্থ মানুষের মতো, শুনি আমরা শুনি।

ডেকে যায় ভোরবেলা, ধু-ধু দ্বিপ্রহরে কখনো বা
স্তব্ধ মধ্যরাতে ভুল সকালের উদ্দেশে ব্যাকুল।
ভাবে, তার আর্ত হৃদয়ের তন্ত্রী-ছেড়া স্বরে
নিমেষেই আশপাশে জেগে ওঠে নিরিবিলি শোভা।
আমার মগজে কাক ডাকে জপে কী সুন্দর ভুল-
বিপুল জ্যোৎস্নায় উড়ে চলে যায় ভুলের ভিতরে।

 মাতাল ঋত্বিক

কখনো কখনো মনে হয় আট কোটি লোক শোনে
আমার নিভৃত উচ্চারণ, কখনো-বা মনে হয়
আমার কথার জন্যে পিপাসার্ত একজনও নয়।
প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যা অত্যন্ত একাকী গৃহকোণে
বসে শব্দ দাও শব্দ দাও বলে কী গহন বনে,
পর্বতে, পাতালে হই নতজানু, করি আয়ুক্ষয়
প্রতীকের প্রতীক্ষায়, কম্পমান একটি হৃদয়
বিজন সৈকতে সারাক্ষণ রহস্যের ঢেউ গোনে।

যে-কথা হৃদয়ে ফোটে, হৃদয়ের ধ্বনির মতন
অন্তরঙ্গ বেজে ওঠে, তা যদি না শোনে কেউ কান
পেতে কিংবা না বোঝে কখনো, ক্ষতি নেই, নেই খেদ।
তোমার উদ্দেশে আমি যখন যা করি উচ্চারণ,
সে ধ্বনি তোমার কানে সকল সময় হোক গান;
মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ।

মাম

সাধক যেমন ধ্যানে জপেন নিয়ত পুণ্যশ্লোক,
আমার হৃদয়ও তেম্‌নি বার-বার করে উচ্চারণ
তোমার মধুর নাম। ঘরে ভ্রমরের গুঞ্জরণ,
বাইরে পাখির শিস, হাওকেয়ার বিলাপ, যাই হোক-
সবই তো বিশেষ ধ্বনি, সুর বলে কোনো কোনো লোক।
শুধু সুর এসব তাদের কাছে। কিন্তু বলে মন,
আমার বিস্মিত মন কী তন্ময় যখন তখন-
সেই সুর তোমারই নামের ধ্বনি, ধ্বনির কোরক।

আমার শিরায় ফোটে নক্ষত্রের মতো অবিরাম
কেবলই তোমার নাম, আর যেখানেই চোখ রাখি
দেয়ালে কপাটে কিংবা গাছ-গাছালিতে, ঘর দোরে,
বেড়ালের পিঠে, দেখি সদা জ্বলছে তোমারই নাম।
বলি না কাউকে নাম, শুধু কবিতায় রাখি ধরে
আড়ালে, সে-নাম ভাবীকালে গুঞ্জরিত হবে নাকি?

মূর্তি

না, আমি ভাস্কর নই, রোজ তাল তাল কাদামাটি
নিয়ে মূর্তি গড়ি না, অথবা পাথরের স্তব্ধতায়
পারি না জাগাতে কোনোক্রমে মৃত্যুঞ্জয় ধ্বনি, হায়,
প্রতিমার। আমার আঙুলে নয় দীপ্র জাদুকাঠি,
স্পর্শে যার দেয়াল চকিতে যাবে ছেয়ে কিছু খাঁটি
অজর ফ্রেস্কোয় কিংবা জাগবে জোয়ার সাহারায়,
অথবা উঠবে গড়ে মরুদ্যান; আমিতো ভূতল আস্তানায়
একা ছন্দমিল খুঁজে খনি শ্রমিকের মতো খাটি।

মৃত্যুদন্ড

বেকসুর আমি তবু আমাকেই মৃত্যুদন্ড দিলে।
কী করে তোমার কাছে অপরাধী, এখনো জানি না;
কস্মিকালেও আমি শক্রুতা সাধিনি, শুধু বাণী,
অলৌকিক, প্রেমময়, বাজিয়েছি। সেই সুরে ছিলে
মিশে তুমি বসন্তের পাতার গভীরে, শান্ত ঝিলে,
শস্যক্ষেতে, নীলিমায়। এই কি আমার অপরাধ?
আমার সর্বস্ব দিয়ে রাত্রিদিন একটি নিখাদ
প্রেমস্বপ্ন গড়ি, তা-ও ভেঙে যায় কী ককর্শ ঢিলে।

আমাকে পাঠালে নির্বাসনে, দিলে দন্ড ভয়ংকার।
তোমার সান্নিধ্য থেকে, অমন দৃষ্টির থেকে দূরে,
বহুদূরে চকিতে সরিয়ে দিলে-এই শাস্তি, বলো,
মৃত্যুর চেয়েও বেশি, ঢের বেশি নয় কি কঠোর?
তুমি কি দেখতে চাও সর্বদা আমার ছলোছলো
চোখ? চাও আমার হৃদয় খাক কীট কুরে-কুরে?

ম্যাজিক লন্ঠন

কোথায় তোমার উৎস কবিতা হে কবিতা আমার?
কোন্‌ নেই-দেশ থেকে অকস্মাৎ তুমি, পৃথিবীর
কোন্‌ প্রান্ত থেকে আসো? স্যীন্‌ কিংবা রাইনের তীর
অথবা টেমস্‌ ভল্গা, মিসিসিপি নীল নদ-কার
তরঙ্গে নেচেছো তুমি? সত্য তুমি কেটেছো সাঁতার
সেসব নদীতে আর নীল চঞ্চু রেখেছো নিবিড়
ঢেউয়ে ঢেউয়ে, তবু মেঘনা নদীর তীরে নীড়
তোমার সর্বদা নক্ষত্রের মতো জ্বলে দুর্নিবার।

যখন তোমার উৎস খুঁজি, কোরবানীর ম্রিয়মাণ
পশুর ভড়কে-যাওয়া চোখ, ডালিমের ফেটে-পড়া
বুক, কবেকার শান্ত প্রান্তরের খোড়ো ঘর, ঝরা
শৈশব, খঞ্জের যানে মেঘে মেঘে ভ্রমণ, নিঝুম বন
মনে পড়ে বারংবার। নও তুমি দীপ্র বাতিঘর, এ বিরান
উদাস আঁধারে তুমি কম্পমান ম্যাজিক লন্ঠন।

যখন আমার কাছ থেকে

যখন আমার কাছ থেকে চলে যাও তুমি হায়,
আমার হৃদয়ে ক্রূদ্ধ বাজ পাখি সুতীক্ষ্ম চিৎকারে
দীর্ণ করে দশদিক, নখের আঁচড়ে বারে বারে
কুটি কুটি ছেঁড়ে শিরাপুঞ্জ, কী ব্যাপক তমসায়
অন্তর্গত পুষ্পাকুল উদ্যান ভীষণ ডুবে যায়।
যখন আমার কাছ থেকে সরে যাও, বন্ধ দ্বারে
মাথা কোটে একজন অন্ধলোক, খাদের কিনারে
অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে হাঁটে একা, অসহায়।

তবু তুমি চলে যাও দূরে তোমাকে যেতেই হয়,
যেমন আকাশ ছেড়ে পাখি প্রত্যাবর্তনের সুর
উন্মুক্ত ডানায় নিয়ে। আমার তো সর্বক্ষণ ভয়-
কখন হারিয়ে ফেলি অকস্মাৎ তোমার মধুর
স্পর্শ, কণ্ঠস্বর, তুমি আসবে না, তবু এ হৃদয়
তোমাকেই ডেকে যায়, ডেকে যাবে বিষণ্ণ দুপুর।

 যখন প্রকৃত কবি

যখন প্রকৃত কবি কবিতার চোখে চোখ রাখে
কোজাগরী পূর্ণিমায় কিংবা ব্যাপক অমাবস্যায়
দারুণ অনলবর্ষী গ্রীষ্মে, শীতে অথবা বর্ষায়,
কদম ফুলের মতো খুব শিহরিত হতে থাকে
কবিতার স্তন আর যখন সে তন্বী কবিতাকে
বুকে টেনে নিয়ে ওর গালের মাংসের স্বর্ণাভায়
ঠোঁট ঘষে, যখন হৃদয় তার তীব্র চুমো খায়
কবিতার গোপনে, তখন সে স্বপ্নের নগ্ন বাঁকে।

এমনও তো হয়, মাঝে মাঝে সেই নিষ্ঠুরাতমার
কিছুতে মেলে না দেখা। দিন যায়, মাস যায় কত,
তবু তার পদধ্বনি বাজে না কোথাও, কী অসুখে
জ্ব’লে পুড়ে একা কবি আদিগন্ত উজ্জ্বল আমার
দিকে হাঁটে, খোঁজে পানশালা, হয়ে সে সতত
মাতাল দর্পণে ঢোকে, কবিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে।

 যদি কাসান্দ্রার মতো কেউ

ধরো যদি কাসান্দ্রার মতো কেউ বলতো আমাকে
দারুণ অমোঘ তার কণ্ঠস্বরে, দেয়ালের লেখা
করো পাঠ; হেলেনের মতো রূপ যার, তার দেখা
যদি পাও অকস্মাৎ অবেলায় দৈব দুর্বিপাকে,
কখনো দিও না সাড়া কুহক ছড়ানো তার ডাকে,
তবে কি তোমার অথৈ চোখ, ঠোঁট, স্তনের শিখর
দেখে আমি চোখ বুজে সর্বক্ষণ থাকবো নিথর?
তীব্র স্পর্শে স্পর্শে করবো না ঋদ্ধ আপন সত্তাকে?
আমার শিরায় আজ ভাসছে সহস্র রণতরী,
মাংসের প্রাকারে হুহু আর্তনাদ, পুড়ছে মিনার
শতাব্দী শতাব্দী ধরে দুঃস্বপ্নের মতো, নিরুপায়।
তোমার নিকট থেকে আমাকে ফিরিয়ে দেবে, হায়,
ত্রিলোকে এমন সাধ্য নেই কোনো রূঢ় কাসান্দ্রা।
স্বপ্নের স্মৃতির মতো চোখে তাই চোখ মেলে ধরি।

 যদি তুমি মন থেকে

এখন এ মধ্যরাতে মনে রেখো ধ্বনি বেজে ওঠে
সারা চরাচরে; শাখাচ্যুত পাতা গাছের উদ্দেশে
বলে, মনে রেখো, সমুদ্রের ক্ষিপ্র ঢেউ তটে এসে
চুর্ণ হয়ে প্রতিবার আমাকে ভুলো না বলে ছোটে
আবার পিছনে। গোধূলির নিঃসঙ্গ আকাশ চোখে
অস্তরাগ মেখে করে উচ্চারণ আসন্ন রাত্রির কানে,-
মনে রেখো, মনে রেখো, জাগে ভোরের পাখির গানে,
বিদায়ী মুহূর্তে কম্পমান প্রেমিকের অন্তর্লোকে।

যতই বাজুক গাঢ় মনে রেখো ধ্বনি জলে-স্থলে,
তবু আমি কোনোদিন জানাবো না করুণ মিনতি
তরুণী তোমার কাছে, বলবো না আর্তস্বরে জলে
ভাসিয়ে দুচোখ, মনে রেখো। যদি তুমি মন থেকে
ক্ষ্যাপাটে শিল্পীর মতো মুছে ফেলো আমাকে, বিবেকে
বাধবে কি? অকস্মাৎ থেমে যাবে পৃথিবীর গতি?

 যাত্রা

কোথায় লুকালে তুমি? বলো কোন্‌ সুদূর পাতালে
দিনান্তে পালঙ্কে শুয়ে কাটাও প্রহর প্রিয়তমা?
এখানে নেমেছে দশদিকে মৃত্যুর মতন অমা,
সেখানে কি কেলিপরায়ণ তুমি স্মিত জ্যোৎস্নাজালে
সোনালি মাছের মতো? নাকি তোমার নৌকোর পালে
লেগেছে উদ্দাম হাওয়া অজানা সমুদ্রে। কী উপমা
দেবো সে যাত্রার আজ? হয়তো মরুর বালি জমা
হয়েছে তোমার কালো চোখে রোজ সন্ধ্যা ও সকালে।

যেখানে তোমার পদচ্ছাপ প্রস্ফুটিত, বেজে ওঠে
কণ্ঠস্বর কিংবা তুমি দর্পণে প্রতিফলিত, গান
গাও গুনগুন সুরে, পারি না সেখানে যেতে, তবু
সেদিকেই মুখ রেখে পথ হাঁটি। হতাশাই প্রভু
সে-পথের জেনেও সর্বদা করি যাত্রা, কাঁটা ফোটে
পায়ে; তোমাকেই পাবো, আমি কি এমনই পুণ্যবান?

যে এলো তোমার কাছে

যে এলো তোমার কাছে অবশেষে উড়িয়ে আঁচল
বিরূপ হাওয়ায় তার সৌন্দর্য তুলনাহীন; তাকে
দেখে তুমি দূরবর্তী সন্ধ্যায় হঠাৎ অচেনাকে
বড় বেশী চেনা বলে অন্তরালে কেমন চঞ্চল
হ’য়ে উঠেছিলে, তার সুগভীর চোখের কাজল,
মনে হলো, যুগ-যুগান্তের স্মৃতি নিয়ে কাকে ডাকে
স্বপ্নের সংকেতে, তুমি ভেবেছিলে হয়তো তোমাকে
নিয়ে যাবে খৃষ্টপূর্ব কালে, শুষে নেবে অমঙ্গল।

এখন সে স্মিত হেসে দাঁড়ায় তোমার পাশে, ঠোঁটে
হৃদয় পুষ্পিত হয় ক্ষণে ক্ষণে, ঝরে যায় কত যে শতক
সুপ্রাচীন থরথর চুম্বনে চুম্বনে ভালোবাসা
মিসরীয় সম্রাজ্ঞীর চোখের মতন জ্বলে ওঠে-
মাঝে মাঝে স্বপ্নে দ্যাখো যমজ সোনালি ঘোড়া চক
চক করে জ্যোৎস্নারাতে, বুকে জাগে শোণিতের ভাষা।

যে-কথা বলেনি কেউ

এখন বচসা থাক, ঢের কথা কাটাকাটি হলো-
নিরীহ চায়ের কাপে শান্ত হোক সব ক্ষ্যাপা ঝড়।
এই যে ড্রইংরুমে সোফার গহ্বরে বসে খর
তর্কে মেতে ওঠে উৎসবের মতো খুব ঝলোমলো
দ্বিপ্রহরে ইতিহাস, সমাজ শিবির সংঘ আর
ত্র্যাবসার্ড নাটকের রীতিনীতি নিয়ে অর্থহীন,
ভীষণ নিষ্ফল মনে হয়। এমন সুন্দর দিন
এভাবে কারো না ব্যর্থ; প্রাণের পুষ্পিত ঝোপঝাড়

এখন উঠুক দুলে, আমাকে দেখতে দাও চোখ
ভরে স্মৃতিজাগানিয়া চোখ, চোখের কাজললতা;
অসিত শিখার মতো চুল আর স্তনাভা তোমার,
দাও, দাও, আমাকে দেখতে দাও। সব দ্বিধা হোক
দূর, হও উন্মীলিত, আমাকে বলতে দাও কথা-
যে-কথা বলেনি কেউ কোনোদিন রমণীকে তার।

যে-তুমি আমার স্বপ্ন

পুনরায় জাগরণ, পুল্মঢাকা আমার গুহার
আঁধারে প্রবিষ্ট হলো রশ্মিঝর্না, জাগালো কম্পন
এমন নিঃসাড় ম্রিয়মান সত্তাতটে। যে-চুম্বন
মৃতের পান্ডুর ওষ্ঠে আনে উষ্ণ শিহরণ, তার
স্পর্শ যেন পেলাম সহসা এতকাল পরে, আর
তৃণহীন বীতবীজ মৃত্তিকায় মদির বর্ষণ
দেখালো শস্যের স্বপ্ন। শিরায় শিরায় সঞ্চরণ
গোলাপের, নতুন মুদ্রার মতো খর পুণিমার।

পাথুরে গুহার কাছে স্বপ্নজাত বনহংসী ওড়ে
অপ্সরার ভঙ্গিতে এবং তার পাখার ঝাপটে
মৃতপ্রায় সাপ নড়ে ওঠে ফের, মহাশ্চর্য দান
পেয়ে যায় কী সহজে, কারুকাজময় ত্বক ফোটে
শরীরে নতুন তার। তুমি এলে প্লাবনের পরে,
যে-তুমি আমার স্বপ্ন, অন্নজল, অস্তিত্বের গান।

যেসব কবিতা আমি

যেসব কবিতা আমি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলি,
মেলার মাটির পাখি হয়ে ওরা শূন্যে ঝুলে থাকে,
শ্রাবণ ধারায় গলে যায়, পুনরায় যেন ডাকে
মাটির ভেতর থেকে বীজ-স্বরে। বকুল, চামেলি
কিংবা মল্লিকার মাংসে পুর্নজন্ম নিতে চায়, গূঢ় চেলি
হ’য়ে সূর্যাস্তের দিকে উড়ে যাবে ভেবে শূন্যতাকে
তুষ্ট করবার ব্যর্থতায় অন্ধকারে মুখ ঢাকে।
টেবিলে সাগর দস্যু আর জলকন্যাদের কেলি।

আহত কবিতাবলী ছিন্ন ভিন্ন আঙুলের মতো
তাহলে বিদায় বলে অন্তর্হিত প্রেতের বাসায়।
রক্তাক্ত পালক ওড়ে ইতস্তত উত্তরে দক্ষিণে,
পুবেও পশ্চিমে ঝরে বালির সারস অবিরত।
একটি ক্ষুর্ধাত কুকুরকে ঘোর বৃষ্টিময় দিনে
ছেঁড়া স্বপ্ন ছুঁড়ে দিই কবিতার জন্মের আশায়।

রক্ষাকবচ

এতদিনে জেনে গেছি সুসময় ভীষণ অস্থির।
এখন তো বারংবার শবযাত্রা, কবরখানায়
একা একা ব’সে থাকা মৃত্যুগন্ধময় নিরালায়;
এখন পাবো না আর একটিও মুহূর্ত স্বস্তির।
ক্রূর অন্ধকারে আছি তুমিহীন অত্যন্ত একেলা।
কর্কশ গজায় দাড়ি, নখ বড়ো বেশি বেড়ে যায়,
গেন্থেও অমনোযোগী, প্রিয় বন্ধুবর্গের ডেরায়
প্রায়শ অনুপস্থিত আমি, দেখি মকরের খেলা।

এ-খেলায় ছিন্নভিন্ন হতে থাকি সকল সময়।
থামের আড়ালেও শক্রু চতুষ্পার্শ্বে জন্মান্ধ জল্লাদ,
কী করে বাঁচবো তবে? বেদনার্ত আমার হৃদয়।
জন্তুর বিষাক্ত দাঁতে বিদ্ধ, তবু হবো না উন্মাদ;
এখনো তো জীবনের প্রতি আমি কী দীপ্র উৎসুক,
সহায় তোমার স্মৃতি, ভোরস্মিত কবিতার মুখ।

 রঙিন নিশ্বাসের জন্যে

খুব একা হাঁটি বোবা কালা অন্ধ বামনের ভিড়ে।
নোনা ঘামগন্ধ, মুখ-গহ্বরের কটু গন্ধ ঝাঁকে,
ভীষণ দুঃস্বপ্ন যাপি রুদ্ধশ্বাস এ বন্দীশিবিরে।
যেখানেই যাই কালো সন্ত্রাস আমাকে ধরে ঘিরে,
অনিদ্রার রক্তজবা জ্বলে চোখে, যদি কোনো ফাঁকে
দৃষ্টি থেকে মরুভূমি সরে যায়, চেতনাকে ঢাকে
বিষলতা, নিশ্বাসও বিকিয়ে যায় এমন তিমিরে।

তাহলে কী লাভ বলো, প্রিয়তমা, বিচ্ছিন্নতা পুষে
আমাদের দুজনের মধ্যে আর? এসো ভালোবাসি
দূরন্ত আবেগে, সব বাধার প্রাকার দ্বিধাহীন
ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে এসো আমরা পরস্পর শুষে
নিই আমাদের অস্তিত্বের সারাৎসার, সুখে ভাসি
কিছুকাল, নিশ্বাসকে করে তুলি প্রবল রঙিন।

শহরে নেমেছে সন্ধ্যা

শহরে নেমেছে সন্ধ্যা, যেন নীরব ধর্মযাজিকা
প্রার্থনায় নতজানু। ফুটপাতে বেকার যুবক,
বিশীর্ণ কেরানী ঘোরে, লাস্যময়ী দৃষ্টির কুহক
হেনে হেঁটে যায়, কেউ কেউ দোকানকে মরীচিকা
ভেবে চিত্রবৎ স্থাণু কারো কারো চোখে স্বপ্নশিখা।
ক্লান্ত পাখিঅলা পঙ্গু পথিকের সঙ্গে মারাত্মক
বচসায় মাতে আর স্বপ্ননাদিষ্ট পুলিশও নিছক
অভ্যাসে বাজায় বাঁশি, কম্পমান কৃষ্ণ যবনিকা।

আমাকেও সন্ধ্যা তার কেশ-তমসায় ঘন ঢেকে
কেমন বিষণ্ন ঘণ্টা বার বার বাজায় আমার
অস্তিত্বের অণুপরমাণুময় ক্রূদ্ধ বনভূমি
লুকানো সৈনিক নিয়ে ধেয়ে আসে চতুর্দিক থেকে,
ক্লান্তিতে দুচোখ বুজে আসে, জীর্ণ আমার সত্তার
মরুতে জীবনতৃষ্ণা কী প্রবল জাগিয়েছো তুমি।

শিবির

প্রতিদিন ভিড় ঠেলে পথ চলি, দেখি সবখানে
দলাদলি, মরমুখো সব দল, খুন খারাবির
জন্যে তৈরী সর্বক্ষণ অনেকেই, শান্তির দাবির
যেন মূল্য নেই কোনো। মোহময় শ্লোগানে শ্লোগানে
মুখর চৌদিক, অতিকায় জন্তু বিধ্বস্ত উদ্যানে
ভীষণ চঞ্চল, অন্ধ ওরা আর জন্মেই বধির-
তাহলে কোন্‌ দলে ভিড়ে ঢেকে নেবো মাথা শিরস্ত্রাণে?

আমার শিবির নেই কোনো, আমি অত্যস্ত একাকী
পড়ে আছি এক কোণে নিরস্ত্র এবং বর্মহীন
কী জানি কিসের প্রতীক্ষায় দৃষ্টি জ্বেলে রাত্রিদিন।
মাঝে মধ্যে বিরানায় ডাকে একলা ভয়ার্ত পাখি,
আমি কবিতার রক্তোৎপল বুকে মুখ ঢেকে থাকি
কী অমোঘ ঘৃণা আর উপেক্ষার প্রতি উদাসীন।

শুধু দেখি

আমার কবিত্ব বুঝি গৃহত্যাগী সিদ্ধার্থের মতো
বড় অনশন-ক্লিষ্ট আজ, নইলে কেন হে নবীনা
তোমার রূপের শিখা অনায়াসে জ্বালতে পারি না
ছত্রে ছত্রে? এই চোখ, এই ওষ্ঠ আর সমুন্নত
নাকের উপমা খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হচ্ছি অবিরত।
নতুন উপমা পেলে অবশেষে হে তুলনাহীনা,
তা-ও বড়ো তুচ্ছ মনে হয় আর মগজে যে বীণা
বাজে মাঝে-মাঝে, তারও সুর কাটে, চেতনা বিব্রত।

আমার এ প্রয়াসের ব্যর্থতায় জানি উপহাস
জুটবে বিস্তর আর কবিত্বকে সুতীক্ষ্ম ধিক্কার
দেবে কেউ কেউ। তুমি যেন রূপবতী বাংলাদেশ
অনন্য সৌন্দর্যে খুঁতে, অন্তরঙ্গ একটি নিশ্বাস,
এবং বর্ণনাতীত। খুঁজিনাকো উপমা তোমার
শুধু দেখি, দেখি মুগ্ধাবেশে তোমাকেই অনিমেষ।

শুনি অপরাহ্নে

শুনি অপরাহ্নে অর্ফিয়ূস বাজায় মোহন বাঁশি-
ভাঙাচোরা পৌর পথ, মায় ঘরদোর, শীর্ণ গাছ
কেমন বদলে যায় নিমেষেই আর জোড়ে নাচ
বস্তুপুজ্ঞ দশদিকে। ভালোবাসি, আমি ভালোবাসি
উচ্চারণ ক’রে যেন স্বপ্নময় মেঘলোকে ভাসি;
ভালোবাসি, ভালোবাসি। সে ভালোবাসুক আর না-ই
বাসুক আমাকে, পুরোপুরি না হোক আমার, গাই
তবু তারই গান, আপাতত নই কিছুরই প্রত্যাশী।

এই কি যথেষ্ট নয় এই ভালোবাসা, যা শিরায়
শিরায় ঝংকার তোলে, যার টানে আনন্দিত পথ
হাঁটি, কথা বলি পশু পাখি, বৃক্ষলতা পাথরের
সঙ্গে, না চাইতে শক্রূকেও করি ক্ষমা, পক্ষীবৎ
উড়ে যাই, গায়ে মাখি ঘ্রাণ স্মৃতির মরূদ্যানের
এবং নিজেই হই অর্ফিয়ূস দীপ্র নিরালায়?

শ্রাবণের বিদ্যুতের মতো

সযত্নে রাখবে পুষে তুমি সর্বদা আমার স্মৃতি,
করি না এমন অসম্ভব দাবি, বিস্মৃতিপ্রবণ,
কম বেশি, সকলেই। মাঝে-মধ্যে করলে স্মরণ
উদাস প্রহরে কোনো, খুব ফিকে-হয়ে-আসা প্রীতি
ধূলোর দবিজ পর্দা চকিতে সরিয়ে যথারীতি
তুললে স্মিত মুখ, আমি তোমার নিকট আমরণ
থাকবো কৃতজ্ঞ আর ঘটুক যতই অঘটন,
স্মৃতিতে জ্বলবে তবু তোমার স্বপ্নের মতো সিঁথি।
আমাকে রাখবে কিনা মনে, হে নবীনা, চিরদিন
তা ভেবে উদ্বিগ্ন নই আদপেই আমি আপাতত,
চাই না তোমার দীপ্র দরজায় অভ্যর্থনাহীন
দাঁড়িয়ে থাকতে আর। এসো কাছে এসো বলে ডাকে
তোমাকে আমার প্রতি অঙগ সময়ের প্রতি বাঁকে;
এসো কাছে এসো তুমি শ্রাবণের বিদ্যুতের মতো।

সপ্তাহ

গোলাপ পায়রা আর প্রজাপতিদের ভিড়ে ছিলে
তুমি সোমবার সুখী, এবং মঙ্গলবার ঘাসে
শুয়েছিলে একাকিনী পুরাতন কবরের পাশে,
বুধবার, কী আশ্চর্য, বহুদূরে আকাশের নীলে
তোমার দোলনা দুলছিলো; তুমি আর আমি মিলে
কটেজে খেয়েছি চুমো বারংবার বৃহস্পতিবার।
শুক্রবার দেখেছি তোমার চোখ, শ্রোণী, স্তনভার
স্তব্ধ ব্যাঙ্ক-কারিডরে, শনিবার হাঁসময় ঝিলে।

রবিবার? তোমার সান্নিধ্য, হায় যায় বনবাসে
রবিবারে বারে বারে। তবে কি দেখি না প্রিয়তনা
তোমাকে তখন? রাজহাঁসের মতন স্পীডবোটে
তুমি, হল্‌দে-কালো শাড়ি-পরা; দেখি, চুল সুবাতাসে
ওড়ে কী উদ্দাম, মাছের ঝিলিক মনে হয় জমা;
সত্তাতটে নিয়ত তোমার দীপ্র উপস্থিতি ফোটে।

সহসা যীশুর হাত

সহসা যীশুর হাত আমার উন্মুক্ত জানালায়
বাজে রবাবের মতো। হাতের তালুতে পেরেকের
দাগগুলি সিংহচক্ষু; ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর পতনের
স্মৃতি নিয়ে এ আমার চক্ষুদ্বয় অতি কৃশকায়
সে-হাতে নিবদ্ধ হয়। আমি কেমন অস্থিরতায়
শয্যায় আহত মাছ, শুধু টগবগে আবেগের
খুরধ্বনি শিরাপঞ্জে; নিশীথের মদির মেঘের
ময়ূর মাথায়, স্রোতে যেশাসের গাধা ভেসে যায়।

কোনো কিশোরীর উন্নয়শীল স্তনের মতন
অথবা পাছার মতো আমার ভাবনা স্ফীত হতে
থাকে নিদ্রাহীন মধ্যরাতে। হায়, কোন্‌ মরুপথে
যাবতীয় জরুরি দলিল দস্তাবেজ তাড়াহুড়ো
করে আমি আঁধারে এসেছি ফেলে? মোহান্তের মন
নিয়ে তবু মাংসের স্বপ্নের শালীনতা করি গুঁড়ো।

সে কবে আমার ঘরে

সে কবে আমার ঘরে এসেছিলো তুমি হে প্রতিমা
শুন্যতায় তুলে ঢেউ? বসেছিলে মুখোমুখি; চোখে
বসন্ত-বিস্ময় ছিলো, শরীরে স্বপ্নের মধুরিমা।
টেবিলে তোমার হাত, যেন সে মাছ, রহস্যলোকে
সমর্পিত; দেখলাম নড়ে চড়ে বসলে আবার।
ইচ্ছে হলো তুলে নিই হাতে সেই মাছ অলৌকিক,
হয়নি সাহস; যেন আমি দীন কুষ্ঠরোগী, যার
সৌন্দর্যকে ছুতে ভয়। বলো, হবো কি করে অভীক?

হে বন্ধু তাহলে আসি, বলে চলে গেলে কী সহজে
আমাকে একাকী ফেলে আর আমি যেন স্বপ্ন থেকে
চক্ষুদ্বয় কচলাতে কচলাতে জেগে উঠলাম
অকস্মাৎ; সত্যি তুমি এসেছিলে? নাকি এ মগজে
মায়াবী একাটি হাত আগোচরে দিয়েছিলো এঁকে
জীবন-স্পন্দিত চিত্র? জাগুক সে চিত্র অবিরাম।

সে কবে সোনালি দিন

কায়ক্লেশে পথ চলি, অকস্মাৎ ঘোর সন্ধ্যা নামে;
সব দিকে লুপ্ত গাছপালা, নদীনালা, হল্‌দে ক্ষেত,
ত্রস্ত পাখি, গেরস্তের ঘর জনমনিষ্যি সমেত।
তবে কি এসেছি আমি পথ ভুলে নৈরাশের গ্রামে?
একটু পরেই ফের আকাশের ঘুরঘুট্রি খামে
তারার অক্ষরে লেখা নতুন ঠিকানা অনিকেত
আমাকে দেখায় পথ। কাক-তাড়ুয়ার মতো প্রেত
স’রে যায়, মধ্যে মধ্যে বৃক্ষতলে গা ঢালি বিশ্রামে।

কখনো ম্যুনিখে ঘুরি, কখনো বা ঢাকাই বস্তিতে,
কত স্বপ্ন জমা হয় অবচেতনের স্তরে স্তরে
চল্‌তি পথে, অকস্মাৎ দৃষ্টি জুড়ে কালো বধ্যভূমি
ভেসে ওঠে, কংকাল বাজায় বাঁশি, বিবর্ণ আর্শিতে
মুখ দ্যাখে শীর্ণ প্রৌঢ় কবি, বার-বার মনে পড়ে-
সে কবে সোনালি দিন কালো ক’রে চলে গেছো তুমি!

সে তার নিজেরই বাসা

এই তার বাসগৃহ ছন্নছাড়া বাগানের ধারে
অনেক বছর ধরে রয়েছে দাঁড়িয়ে রৌদ্রজলে।
এখানে সুন্দর তার হস্তস্পর্শ যার করতলে
রেখে যায় আগোচরে, তাকে আজো তো বনবাদাড়ে
দেখা যায়, হাতে লাঠি, পিঠে বোঝাই সুদূর পাহাড়ে
জনহীন নদীতীরে হাঁটে সে একাকী, পুনরায়
ফিরে আসে একজন ব্যথিত কবির আস্তানায়,
মানে সে বাসায় যার সত্তা লগ্ন বেহালার তারে।

সে তার নিজেরই বাসা হঠাৎ পুড়িয়ে ফেলে কিছু
অপরূপ আলো দেখে নিলো। সে আলোয় মর্মমূল
আর্তনাদ করে, তবু সেই উদাসীন, দৃষ্টি নিচু
করে ভস্মারাশি তুলে নেয় মুঠো ভরে পুনর্বার
হাওয়ায় উড়িয়ে দ্যায়। বাসা নেই, দগ্ধ স্মৃতিভার
বেড়ে যায়, মাথার ভেতরে কাঁদে কিছু কালি, ঝুল।

সেই সুর

এখনো আমার মন আদিম ভোরের কুয়াশায়
প্রায়শ আচ্ছন্ন হয়। মনে হয় স্বচ্ছন্দ কৌশলে
অমার শহরটিকে প্রাচীন দেবতা করতলে
সর্বদা আছেন ধরে; পশু-পাখি কেমন ভাষায়
কথা বলে, খৃষ্টপূর্ব শতাব্দীর নারী কি আশায়
বসে থাকে নদীতীরে। ছিন্ন শির, বীণা খর জলে

সে-সুরের ক্ষীণ ছায়া, মনে হয়, আজো মাঝে মাঝে
আমার নিমগ্ন অবচেতনের প্রচ্ছন্ন প্রদোষে
খেলা করে, নইলে কেন অস্তিত্বের তন্ত্রীতে আমার
জাগে সূক্ষ্ম কম্পন এমন? মর্মমূলে কেন বাজে
সাহসা অদৃশ্য বাণী? খর স্রোতে চোখ রেখে ব’সে
আছি একা ঔদাস্যের তটে, নেই লোভ অমরার।

স্থগিত বাসনা

সঙ্গমে কী সুখ পাবে তুমি? ওটা থাক, শারীরিক
ব্যাপার স্যাপার ভারি স্থুল মনে হয়, ঘেন্না লাগে।
বরং চুম্বনা নাও, আলিঙ্গনে বাঁধো অনুরাগে,
আমার আঙুল নিয়ে খেলা করো, আমি অনিমিখ
চেয়ে থাকি তোমার চোখের দিকে। শোনো, বাস্তবিক
এটুকুই চাই আমি, তার বেশি নয়। যদি জাগে
কোনোদিন কামনার বন্য ঢেউ শরীরী ভূভাগে
তাহলে আমার আত্মা বলবে আমাকে ধিক, ধিক।

তোমার এ উচ্চারণ মেনে নিতে মনোকষ্ট হয়;
শরীর এবং আত্মা দুটি পাখি বসে একই ডালে
গান গায় প্রীতিবশে। নয়, ওরা তো পৃথক নয়
কেউ কারো থেকে; যত দূরে পারো ঠেলে দাও, তবু
তোমার ঘাটেই যাবো খেয়া বেয়ে লিবিডোর খালে,
মেটাবো অকুল তৃষ্ণা। এখনো তো নই জবুথবু।

স্মৃতির ভেতরে

স্মৃতির ভেতরে ঘুরে ঘুরে একটি মরাল কাঁদে,
পায়ে তার নুড়িগুলি অথবা কাঁকর চুমো খায়
অত্যন্ত নির্দয়ভাবে। রক্ত ঝরে আর কৃশকায়
অলবডো লোক কতিপয়, খুনখুনে বুড়ো, কাঁধে
ঢাক নিয়ে খুব ঢক্কা নিনাদে চাদ্দিক অবসাদে
ভরে তোলে ক্রমান্বয়ে। স্মৃতির ভেতরে গান গায়
শহুরে কোকিল, যার চক্ষুদ্বয় অন্ধ; অসহায়
আমি ভাবি-তার সঙ্গে দেখা হবে কতদিন বাদে?

ফের যদি তার সঙ্গে দেখা হয় দীর্ঘ দীর্ঘকাল
পরে বিরানায় কিংবা কোনো নৈশ তুখোড় পার্টিতে,
যদি সে আমার চোখে দুটি গাঢ় চোখ রাখে ভুলে
তবে কি সহসা যাবে কেটে তার সামাজিক তাল?
সে কি বন্দী শিবিরের কথা ভুলে প্রাক্তন নিশীথে
ফিরে যাবে নিমেষেই? উঠবে কি তার বুক দুলে?

হে আমার বাল্যকাল

হে আমার বাল্যকাল তুমি সে কেমন মাল্যদান
দেখেছিলে খুব বিস্ফারিত চোখে শহুরে সন্ধ্যায়?
সে মালার ফুলগুলি স্মৃতির মতন ভেসে যায়
মনোজ তীর্থের তীরে, যেন বা পাপড়িরা অফুরান-
শতাব্দী শতাব্দী ধরে ঝরে যাবে, বেদনার্ত গান
গাইবে জীবন জুড়ে। পথচারী যখন হারায়
দিকচিহ্ন, এবং স্মৃতির সঙ্গে বিষণ্ণ ছায়ায়
কথোপকথন করে, পথ হয়ে আরো সুনসান।
সে পথ পতিতা নাকি ভগ্নী নান, তার চুলচেরা
হিসের উভীষ্ট নয়, শুধু দেখি রুক্ষ, পোড়া মাটি
আশপাশে- সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটাময়, সুপ্রাচীন
রণক্ষেত্র, তরমুজের ফালি, ভাঁড়ের করোটি, ছেঁড়া
জুতো এক পাটি; বাল্যকাল, তুমি কেন প্রতিদিন
আনো রেলগাড়ি কাটা ঘুড়ি, বাতাসা ও জামবাটি?

হে পাখি, শহুরে পাখি

চেতনায় ঝরে ঝরে সুর থেমে গেলো অকস্মাৎ।
জানাজানি হবার মতন কিন্তু কিছুই ঘটেনি,
দূর থেকে আসা সে সুরের দাম ক’পেনি
করিনি যাচাই, শুধু এক জ্বলজ্বলে অভিঘাত
স্মৃতিস্রোতে নিয়ে ঘুরি মনুষ্য সমাজে। দিনরাত
কেটে যায় যথারীতি আহারে বিহারে কি নিদ্রায়,
মাঝে-মাঝে সেই সুর চেতনায় ডানা ঝাপটায়
এবং অব্যক্ত কবিতার মতো করে অশ্রুপাত।

হে পাখি শহুরে পাখি, তুমিও করেছো বড়ো ভুল-
এর কোনো ছিলো না দরকার, সাদামাটা শত কাজে
ছিলাম জড়িয়ে নিত্য; তুমিও পল্লবে, দূর নীলে
অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন ছিলে। তোমার এ সুর কী ব্যাকুল
করেছে আমাকে আজ। যদি সুর থেমে যাবে সাঁঝে,
তবে কেন হৃদয়ে আমার তুমি ডেকে উঠেছিলে?

Exit mobile version