Site icon BnBoi.Com

ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা – শামসুর রাহমান

ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা - শামসুর রাহমান

অবসর

যদি কোনো মধ্যরাতে আমার বিস্মিত জানালার
ভেতরে গলিয়ে গলা ফিসফিসিয়ে কেউ
হঠাৎ ফিগ্যেস করে, ‘তোমার কি আছে অবসর’,
আমি কি থাকবো নিরুত্তর?

আমার কিসের অবসর
এই জ্যোৎস্নাহীন স্তব্ধ মধ্যরাতে? আমি তো যাবো না
এখন তারার ডাকে অথবা বৃক্ষের ডাকে; আমি
এমন মুহূর্তে ঘর ছেড়ে
বেরিয়ে পড়ার লোভ বুক-পকেটের
গহ্বরে গচ্ছিত রেখে নিশ্চিন্তের তাঁবুর ভেতর
একটু ঘুমোতে চাই। স্বপ্ন এলেবেলে
খেলুক আমার সঙ্গে অথবা আড়াল থেকে জেব্রা
ছুটে গেলে একপাল, স্তব্ধতার কাছে
কৃপা ভিক্ষা করে নেবো। তবে কি আমার
তেমন সৌন্দর্যবোধ নেই?
কোন ডাকঘর থেকে কোকিল এনেছে টেলিগ্রাম
এত রাত? টেলিগ্রামে ডালপালা উদ্ভিদের ঘ্রাণ,
পলাশের ছোপ
লেগে থাকে কিংবা অলৌকিক
সিলমোহরের ছাপ? আমার শৈশব
কোথায় যে রইলো কুয়াশা জড়ানো কোন্‌
বকুলতলায়? খুব বেশি পথে পদচিহ্ন আঁকিনি কখনও,
তবু কোনো কোনো পথ শৈশবের কেমন
চিহ্ন হয়ে থাকে।

আমার কিসের অবসর
এই জ্যোৎস্নাহীন স্তব্ধ মধ্যরাতে? শৈশবে ফেরার?
মনিং স্কুলের ঘণ্টা শুনতে শুনতে
বাক্সের ভেতরকার বাঁশিটির জন্যে মন কেমন করার?
অথবা শিরায়
বখাটে ছোকরার মতো রক্ত শিস দিলে
কান পেতে শোনার গোপন অবসর?

স্বর্ণপদকের লোভে বিচারবোধের চিতা জ্বেলে
কোটাল আমার অবসর চুরি করে
বানায় রাজার বাড়ি। হাওয়াই বাড়ির নিধিরাম সর্দারেরা
আমাকে অবধ্য দূত ভেবে খুব হেলায় প্রান্তরে রেখে আসে।

অভিশাপ দিচ্ছি

না, আমি আসিনি
ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই,
তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে,
মগজের কোষে কোষে যারা
পুঁতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,
যারা গণহত্যা
করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে,
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।

ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
সারিবদ্ধ দাঁড়
করিয়ে নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে-বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্যে অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিঁড়ি ভেঙে যেতে
ভাসতে নদীতে আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে,
অভিশাপ দিচ্ছি আজ সেই খানে-দজ্জালদের।
অভিশাপ দিচ্ছি ওরা চিরদিন বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিতে নাছোড় মৃতদেহ,
অভিশাপ দিচ্ছি
প্রত্যহ দিনের শেষে ওরা
হাঁটু মুড়ে এক টুকরো শুকনো রুটি চাইবে ব্যাকুল,
কিন্তু রুটি প্রসারিত থাবা থেকে রইবে
দশ হাত দূরে সর্বদাই।
অভিশাপ দিচ্ছি
ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়
বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র
জোয়ারের মতো
অভিশাপ দিচ্ছি
আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে ত্রাণ
অথচ ওদের দিকে কেউ
দেবে না কখনও ছুড়ে একখণ্ড দড়ি।
অভিশাপ দিচ্ছি
স্নেহের কাঙাল হয়ে ওরা
ঘুরবে ক্ষ্যাপার মতো এপাড়া ওপাড়া,
নিজেরই সন্তান
প্রখর ফিরিয়ে নেবে মুখ, পারবে না
চিনতে কখনও;
অভিশাপ দিচ্ছি এতটুকু আশ্রয়ের জন্যে, বিশ্রামের
কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে
দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা প্রেতায়িত
সেই সব মুখের ওপর
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট।
অভিশাপ দিচ্ছি।
অভিশাপ দিচ্ছি,
অভিশাপ দিচ্ছি…

অস্থি

একটি বিকট পাখি প্রতিদিন তার জানালায়
আস্তে-সুস্থে অস্থি রেখে যায়,
মৃত্যুর মতন বিষম সঙ্গীতময় কিছু
অস্থি রেখে যায়।
মাথার ভেতর কোলাহল ফুটন্ত জলের, বুকে
দ্রুত ধাবমান ট্রেন, সবুজ নিশান
বাদুড়ের মতো
ঝোলে বর্ণলতায় সন্ধ্যায়। ফিরে যাও,
ফিরে যাও দৃশ্য
জরায়ুর অন্ধকারে বলে সে মেঝেতে
হাঁটু গেড়ে বসে।

চাবির ফোকর তার কাছে
কামানের মুখ, চায়ের বাটিতে নৌবহর,
দেয়ালের পোকা ট্যাঙ্ক, মশা
হঠাৎ আকাশ কালো-করা
বোমারু বিমান।
ঘরময় উল্লুকের বমি; ব্যবহৃত পোস্টকার্ড
কারাগার-দেয়াল শেয়াল
নাকে-মুখে উদ্ভিদের ঘ্রাণ নিয়ে নতুন অতিথি
তার পাশে; সন্ন্যাসীর চিম্‌টে বাজে,
ধুনুচি বখাটে ছোকতা যেন,
কোমর দোলায়, শিস দেয়;
অদূরে উড়ন্ত গুনচট।
সফেদ অস্থির ব্যালে, প্রতিচ্ছায়া সোয়ান লেকের।
অস্থি মানে একদা-যুবক,
অস্থি মানে একদা-যুবতী
অস্থি মানে একদা-কৃষক,
অস্থি মানে একদা-শ্রমিক,
অস্থি মানে একদা-বালক,
অস্থি মানে একদা-শ্রমণ
অস্থি মানে একদা-নাবিক।
মহিষাসুরের খুরে ছত্রভঙ্গ অস্থি-র জনতা!

দরজা জানালা বন্ধ করে বসে, হতে ইতিহাস-
বংশাবলি, সিংহাসন, যুদ্ধ, গণহত্যা,
যৌনতা, পতন
সুন্দর, যমজ মলাটের মধ্যে এখন শীতল
ছাগলের মাংসের মতন।
চকিতে অক্ষরগুলো পাত থেকে দ্রুত
তুমুল বেরিয়ে পড়ে, বুঝি
জঙ্গি ট্রাক থেকে ঝুপঝাপ
লাফিয়ে নামছে সৈন্যদল।
একটি বিকট পাখি ইস্পাতি চঞ্চুর ঘায়ে, ক্রুর
নখরের আঁচরে আঁচরে
জানালা ঝাঁঝরা করে। সে তলিয়ে যায়,
অস্থির স্তূপের
শ্বেত নিচে, নিচে, বহু নিচে কেবলি তলিয়ে যায়,
যাচ্ছে, যায় যায়-

আত্মজীবনী বিষয়ক

একেকটি দিন ঘাড় ধরে বিষম বুঝিয়ে দিচ্ছে
এখানে সময় বসে নেই
শান্ত রাখালের মতো পা মেলে ছায়ায়।
চোখ বুজলেই দেখি চারটি দশক
মানে পুরো চল্লিশ বছর গেছে উটে,
যেমন হাওয়ার তোড়ে মেঘ। কখনও-বা মনে হয়
বেকুর দাঁড়িয়ে আছি বেখাপ্পা মিনারে, সঙ্গীহীন।

কালের মাজাকি, প্রীতি, খুনসুটি, হিংস্রতা ইত্যাদি
সয়ে সয়ে কেমন গণ্ডার হয়ে গেছি।
গভীর গাড্ডায় পড়লেও আজকাল
সহজে ছাড়ি না হাল, আপ্রাণ ত্রাণের পথ খুঁজি।

চারটি দশক আমি দিলাম কাটিয়ে
নিদ্রা-অনিদ্রায়।
মাঝে-মধ্যে ব্যক্তিগত নীরবতা আর মুখরতা
নিয়ে আত্মজীবনী লেখার রমণীয় সাধ জাগে।
আত্মজীবনী কি ছায়াচ্ছন্ন চিলেকোঠা?
দুপুরের গলি
নিঝুম, উদাস?
আত্মজীবনী কি তরুণীর ত্বকের মতন
চৌবাচ্চার জল?
অথবা পুকুর?
আত্মজীবনী কি শাদা দেয়ালে বিবর্ণ ফটোগ্রাফ?
কতদিন আমি আত্মজীবনী লেখার নিভৃত ইচ্ছাটাকে
খড়ের আড়ালে কোনো কোমল শশক ভেবে খেলায় মেতেছি।
যখনি টেবিলে ঝুঁকে আত্মকথনের
মদে বুঁদ হই, দেখি, আমার নিজের মুখ দ্রুত
কেমন বদলে যায়, আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে
বসে যায় সুগভীর অজস্র মুখের রেখাবলী।
ভাবিনি কখনও আগে আমার জীবন
এতই জটিল এত কোলাহলময়।

আত্মজীবনীর পক্ষে কি বিপক্ষে আমি,
আজও তো জানি না।

 আমার উঠোন আমাকে

এই যে কোথায় যাচ্ছো, সাতসকালে চাপিয়ে পাঞ্জাবি?
আরেকটু বসো, গল্প করো, আরেক কাপ চা খাও বরং, এই
তাকাও আমার দিকে। তাকানোর প্রয়োজন নেই?
বড়ো বেশি বাইরে তোমার মন। কতো হাবিজাবি
কাজে যে তোমার বেলা কাটে।
যদি বারান্দায় বসে পড়তে বই কিংবা খাটে
থাকতে শুয়ে, আমার অত্যন্ত লাগতো ভালো, সত্যি আমি
আনন্দ পেতাম, দেখতাম তোমাকেই দূর থেকে।
তোমার সুখ্যাতি হতো, বলতো ওরা, এই তো যথার্থ গৃহস্বামী।

রোদ-চশমায় চোখ ঢেকে
সারা দিনমান করো টো টো;
সময় বইয়ে দাও চা-খানায়, মাঠে, পার্কে, আঠার মতন
লেগে থাকো গুলজার আড্ডায় কিংবা ছোটো
যখন-তখন
পাড়া থেকে পাড়ান্তরে। তবে কি তোমার দেশোদ্ধারে
মন? না কি রক্তে কোনো বিবাগী পূর্বপুরুষ পদ-
চারণা করেন সর্বদাই? এদিকে তোমার দ্বারে
আমার অবোধ স্বপ্ন, ইচ্ছা, ব্যাকুলতা এবং সুখদ
কিছু স্মৃতি করে সত্যাগ্রহ। রাত্রি পাকে, কখন ফিরবে তুমি?
প্রতীক্ষায় কখন যে তেতে ওঠে, আবার জুড়িয়ে যায় ঠিক
চায়ের জলের মতো আমার উদাস এই শরীরের ভূমি!

তুমি তো আমার বুকে রাখোনি কখনও রক্তজবা
ভালোবেসে। অথচ তোমার মৃত্যু হলে আকস্মিক,
কেউ বুঝুক না বুঝুক, হয়ে যাবো আমি তো বিধবা।

আমি তো মেলারই লোক

আমি কি মেলারই লোক? বেলাবেলি এসে গেছি রঙিন চাঞ্চল্যে
এই মুক্তাঙ্গনে আজ? নাগরদোলায় দুলে কিংবা
সবুজ বাদামি শাদা ঘোড়া দেখে দেখে,
মাদল করতাল শুনতে শুনতে,
কোর্তাপরা বাঁদর নাচিয়ে
কেটে যাবে বেলা
অথবা পথের ধারে বেচবো পুতুল,
ঘটিবাটি সূর্যাস্ত অবধি।

আপনার যারা এসেছেন কাছ থেকে দূর থেকে
তারা কি আমার কোনো ইন্দ্রজাল দেখার আশায়
ব্যাকুল উড়িয়েছেন ধুলো পথেঘাটে, ঠেলেছেন ভিড়?

হে দর্শকবৃন্দ
বাঘের মুখের
ভেতর গচ্ছিত রেখে মাথা ফের আনবো নিপুণ
ফিরিয়ে অক্ষত, যদি ভেবে থাকেন তাহলে
প্রতারিত হবেন নিশ্চিত।
না, আমি সে খেলা
শিখিনি কখনও। এমনকি কালো গোল-
টুপির ভেতর থেকে শাদা কবুতর
ওড়ানোর কৌশল অথবা আঙুলের
ডগায় গোলাপ ফোটানোর
মায়াবী কায়দা জানা নেই।
আমার রঙিন তাস নেই, টিনের কৃপাণ নেই,
মুখোশ ইত্যাদি নেই। হে দর্শকবৃন্দ,
শুনুন, আপনাদের কোনো প্রমোদের
আশ্বাস পারি না দিতে। বিশ্বাস করুন,
এই দুঃখে মাথা নিচু করে সরাসরি নির্বাসনে
যেতে ইচ্ছে হয়।

তা বলে এক্ষুণি মেলা দেবেন না ভেঙে
রেগে-মেগে, ‘তুমি আজেবাজে পদ্য লেখো হে বিস্তর,’
বলে গোবেচারী
সীনার মতন আমাকেও অচিরাৎ
দেবেন না ঠেলে
যমের দুয়ারে। যদি অপেক্ষা করেন
কিছুক্ষণ, এই ব্যর্থ আমি, এই অক্ষম আমিও
পারবো দেখাতে কিছু। এই যে দেখুন,
আমার দু’চোখে দগ্ধ গ্রাম বেশুমার,
আমার ললাটে
আহত শহরগুলো ব্যাণ্ডেজসমেত
শুয়ে আছে। দেখুন আমার বুকে রক্তে ভেসে-যাওয়া
মরিয়ম নিঃস্পন্দ কেমন,
আমার বাহুর কোণে ভয়ানক ছিন্নভিন্ন শীতল বাবলু
অচঞ্চল; আমার পাঁজরে
শচীন শাঁখারি, রাজমিস্ত্রী জাবেদালি
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে; শরীরে ভীষণ ফুটোগুলো
নগ্ন চক্ষুময়!
আমার চিবুকে কতো ভগ্ন সেতু বারুদের গন্ধে
ভরপুর কতো যে পরিখা,
আমার চোয়ালে লগ্ন লক্ষ্মীবাজারের
সুহাসিনী দেবীর রক্তিম শাড়ি, যেন স্বাধীনতার পতাকা।
আমি তো মেলারই লোক, বেলাবেলি এসে গেছি এই
মণ্ডপের কাছে;
ঘুরবো, থাকবো
নৌকো আর পুতুলের ভিড়ে,
নাগরদোলার কাছে, ঘোড়াদের কাছে।
ঘুরবো, থাকবো
কিছুকাল, চন্দ্রমল্লিকার
ডাকে দেবো সাড়া,
ঘুরবো, থাকবো
তুলে নেবো হাতে জ্যোৎস্নার রুপালি রাখি।
আমি তো মেলারই লোক, দৃশ্যবলী দেখতে দেখতে
কখন হারিয়ে যাবো এক বুক হাহাকার নিয়ে।

ইন্দ্রজাল

তুমি তো জানোই বছরের পর বছর ফুরোলে
কালের দারুণ কলরোলে
কেমন পাকিয়ে যায় তালগোল চতুর্দিকে। তিব্বতের পুঁতি
বাগান, বসতবাড়ি, ক্যালেণ্ডতার, পুঁথি,
যাবতীয় খবরাখবর,
শিশুর দোলনা কিংবা স্নিগ্ধ ঘাস-সমৃদ্ধ কবর,
সবি তো পুরনো হয়। আমারও ওপর ঘন সর
সুবিস্তৃত সময়ের, বাস্তবিক হয়ে গেছি কেমন ধূসর।
মনে পড়ে এক যুগ আগে
গাঢ় অনুরাগে
তোমাকে দৃষ্টির জ্যোতির্লোকে
তুলে নিয়েছিলাম বলেই আজও আমার এ চোখে
আকাশ নক্ষত্র বন-সমস্ত কিছুর চেয়ে
এমন নতুন তুমি মেয়ে।

এ কেমন বৈরী তুমি

ক’দিনই-বা আছি আস্তানায়, তবু কেন বারংবার তবু কোন রাজা
আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ? বলে না তোমার দ্বারী, আপনার কোট
দিন অনুগ্রহ করে, হ্যাঁ মেহেরবান রেখে দেবো হ্যাট কোট।
ক্ষমা করো রাজা
আমার তো কোটই নেই। তোমার দরোজা বন্ধ দেখে দিনরাত
কেমন গুলিয়ে যায় সব, তোমার ছায়াবিলাসে
নই তো শরিক আমি। দ্যাখো তবু ১৯৭৩ জন শামসুর রাহমান
ক্রল করে আসছে এখানে
কত দূর-দূরান্তের বাসস্টপ থেকে,
১৯৭৩ জন শামসুর শাহমান
আসছে বাদুড় হয়ে, আসছে মিছিল করে কাঁপিয়ে শহর
১৯৭৩ জন শামসুর রাহমান
হচ্ছে জড়ো সিংহদরোজায়, হৃদয় ঝুলিয়ে দিচ্ছে গাছে,
অনুভূতিমালা, স্বপ্ন ইচ্ছা দিচ্ছে বিছিয়ে ট্রাফিক আইল্যাণ্ড
পাথরে নুড়িতে ঝর্ণায়, ব্যাঙ্কের দরোজায়।
তাদের মগজ থেকে ঝাঁক ঝাঁক পাখি উড়ে গিয়ে বসে
অন্ধকার তোমার মিনারে, কাঁধ থেকে মাছ ঝরে কিংবা পাতা।
অকস্মাৎ লাগে ধন্দ; শোনো রাজা বাস্তবিক হার্মলেস আমি।

ভাবতে কেমন লাগে, আমার নিজের বাড়িঘর,
গাছপালা, কার্ণিশের কবুতর মুদির দোকান
-সবকিছু অগোচরে। কতক্ষণ এভাবে অন্ধের
মতো পথ হাতড়ে চলা যায়? অপসৃয়মান দেয়ালের
দিকে যাই, বিস্ফারিত চক্ষুদ্বয়, আশেপাশে তবু
কিছুই যাচ্ছে না দেখা। আমি তো হাঁটছি সারাক্ষণ
অথচ এগোচ্ছি নাকি পিছিয়ে পড়ছি ক্রমাগত,
সঠিক বলতে অপারগ। বিষম হোঁচট খেয়ে খেয়ে বড়ো
ক্লান্ত; কখন যে খানাখন্দে পড়ে যাই, কাদাজলে
খাই খাবি অথবা সাপের লেজে পা দিয়ে ফেলি হঠাৎ-
এই দুর্ভাবনা দিচ্ছে হানা মগজের কোষে। দৃষ্টি-
শক্তি ঠিকই আছে, তবু কেন অস্পষ্ট বেবাক দৃশ্য?
বস্তুত; চাদ্দিক আজ কুয়াশায় ঢাকা। সতর্কতা
এখন একান্ত কাম্য। নইলে হয়তো অন্ধকূপ গিলে
খাবে, হয়তো স্কন্ধকাটাদের সঙ্গে হবে ঠোকাঠুকি।
টর্চও নেই, কে নিরীহ পান্থ কেবা দস্যু, বোঝা দায়।

১৯৭৩টি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে,
১৯৭৩টি শহরকে গিলে খাচ্ছে আঁধার ভূতল
১৯৭৩ জন ভেসে যাচ্ছে কী বিশাল ড্রেনে
১৯৭৩ টি নদীর হিংস্রতা ভয়ানক যাচ্ছে বেড়ে,
আমি দেখছি না।

আমার অগ্রজ
অথবা অনুজ
শক্রমিত্র, প্রতিদ্বন্দ্বী রোগী, চিকিৎসক,
আমার জনক-জননীকে
আমার সন্তান-সন্ততিকে দেখতে পাচ্ছি না আমি,
কাউকেই দেখছি না। রাজা তুমি আমাকেও তোমার মতোই
অন্ধকারে রেখে দিতে চাও?
এ কেমন বৈরী তুমি আমার ফোয়ারা
বিষম পাথরচাপা দিয়ে দিলে রাজা?

এই মেলা

সংবাদপত্রের সব পৃষ্ঠার চিৎকার,
যাবতীয় টেলিপ্রিন্টারের হইচই আর
বাচাল মাইক্রোফোন আর রেডিয়োর কলরব
ছাপিয়ে হৃদয় ডেকে যায়। কতো শব-
বিজড়িত কাঁটাতার ছিঁড়ে ছুটে যাই
চতুর্দিকে বারবার এবং বাজাই
খোল, করতাল প্রাণে যেন-বা চড়ক
সাম্প্রতিক। স্বাধীনতা মুছে ফেলে ব্যাপক নরক।

যেখানে পা রাখি আজ সেখানেই মেলা
মুখর প্রাণের এই দীর্ণ বাংলাদেশ। সারাবেলা
‘এসো এসো’ সুর বাজে অলিতে-গলিতে,
ছায়াচ্ছন্ন শহরতলিতে,
রোয়াকে মণ্ডপে। হাত খোঁজে হাত, চোখ,
পেতে চায় আরো কতো চোখের আলোক-
এ-ও এক আনন্দিত খেলা,
যেখানে পা রাখি আজ সেখানেই মেলা।

নিয়ামত খলিফা সফেদ
কাফনের মতো বিষম বিরক্ত হয়ে শেষ খেদ
বিদ্ধ চোখে ফুটপাতে না লুটোলে, আজ
এই মেলা হতো না এখানে। পানিওয়ালী রহিমন কী নিলাজ
রোদ্দুরে উদর মেলে না রাখলে, গোবিন্দ মণ্ডল
(জানতো না সে এমন বিরূপ ভূমণ্ডল)
না দেখলে আত্মজার যৌবন হনন, ফুটফুটে
শিশুর মগজে ওরা না পুঁতলে হিংস্র নিশান উঠতো না ফুটে
এমন মেলার আলো এখানে কখনও। এই আলো,

সুহাস মণ্ডপ এই আনন্দিত পারাপার, ভালো
বিশদ মিলনবেলা চুরি করতে দেবো না কাউকে কোনোদিন।
সর্বদা হৃদয় যাক ডেকে মৃত্যুহীন
স্বরে ঘরে ঘরে
ফুটপাতে ফুটপাতে আলে আলে নদীতীরে এই চরাচরে।

এই সড়কে

চতুর্দিকে হইচই শুধু, পাড়া বেজায় সরগম।
ঝগড়াঝাটি, একটানা ঐ
মাইক্রোফোনে চ্যাঁচামেচি, সবটা মিলে কানে তালা
দাঁতকপাটি লাগার পালা।

ঝাঁঝালো এই পরিবেশে সবজি এবং নুন-মশলা,
খিস্তি খেউড় ইত্যাদিতে
বাস্তবিকই ডাইনে-বাঁয়ে চলছে বটে গেরস্থালি।
দিচ্ছে সবাই করতালি।
আকাশটাকে ভেংচি কেটে, থেঁৎলে দিয়ে কৃষ্ণচূড়া
রকবাজেরা মত্ত হলো।
ক’জন আবার চোখের গর্তে, ম্লান চিবুকে বিষাদ নিয়ে
হঠাৎ ওঠে গুনগুনিয়ে।

এই তো ওরা দাফন সেরে বেরাদরের রাতদুপুরে
শুঁড়িখানায় হল্লা করে।
বমন করে তিক্ত অতীত লাথি ছোড়ে কালের পাছায়,
জ্যোৎস্না ধারায় হস্ত আঁচায়।

এদিকে-ওদিকে দৃষ্টি মেলে হে কবিতা, সখি আমার,
হলে তুমি মর্মাহত?
দেখতে কি চাও পাহাড়ি সেই ঝর্ণাটিকে? কিংবা ধরো
সাঁঝের ভেলা থরো থরো?

দূর সে মেঘের আস্তিনে মুখ ঢেকে তুমি
থাকতে কী চাও এলোকেশী?
রুক্ষ এমন রুগ্ন এমন সরজমিনে, আস্তাকুঁড়ে
বাজতে হবে আপন সুরে।
এই সড়কে, হে কবিতা, সখি আমার, পারবে হতে
এক নিমেষে রক্ষাকালী?
বন্দুকের ঐ নলগুলোকে পারবে তুমি ঘুম পাড়াতে?
অবিশ্বাসী সাপ তাড়াতে?

 একদিন রাস্তায়

বিকেলে রাস্তার মোড়ে বাস থেকে নামতেই পাগলীটা হাত
বাড়ালো হঠাৎ।
বয়স হয়েছে, তবু বোঝা যায়, শরীরের কানায় কানায়
ছিলো থই থই রূপ, আজ কোন্‌ রুক্ষ পাখির ডানায়
অত্যন্ত পড়েছে ঢাকা। যৌবনে পড়েছে খাঁ-খাঁ চড়া;
একদা হৃদয়ে তার দুলতো মাধবীকুঞ্জলতা, তার ঘড়া,
সোনালি মায়াবী ঘড়া থেকে গণ্ডূষ জল
কেউ করেছে কি পান? তার স্বতোজ্জ্বল
পেটে ছিল পৃথিবীর উঠোন পেরুতে-চাওয়া সন্তান কারুর?
সে কি তাকে মাটির হাঁড়িতে ফেলে রেখে সজারুর
মতো কণ্টকিত ছেড়ে গিয়েছিলো গেরস্ত ঘরের
যত্ন আত্যি? হয়তো সে দ্যাখেনি বরের
কোনো মুখ ভাসমান ভবিষ্যতে। আঁকতো কাজল দুটি চোখে,
মাখতো আলতা পায়ে একদা নিশ্চয়। আজ কী দারুণ ঝোঁকে
ঘোরে পথে পথে জমে ধুলোবালি ‘সমস্ত শরীরে, দীর্ঘ চুলে!
পারবে না মুছে দিতে ঘাঁটঘিলা ময়লা সমূলে।

কী হবে ঘামিয়ে মাথা পাগলীকে নিয়ে?
আমার তো কাজকম্ম আছে, আছে ঘরে ফেরা। নিজেকে ছিনিয়ে
নিয়ে যেতে হবে এই রাস্তা থেকে। পাঁচটি পয়সা গুঁজে পাগলীর হাতে
কিসের আঘাতে

হঠাৎ এলাম সবে, ভিড়ে মিশে বাঁচলাম বস্তুত পালিয়ে।
‘আমার বুকের রাঙা পাখিটাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে
বের করে দিবালোকে ভীষণ নখরাঘাতে ছিঁড়ে-খুড়ে তাকে
দিয়েছে চম্পট তোরই মতো একজন’- বললো সে আমাকে,
মনে হলো, ‘তারপর ঝোড়ো মেঘনা হয়ে গেছি এক্কেবারে।

ধুত্তোর শুনেছি ভুল সুনিশ্চয়। পথ চলি, ভাবনার ভারে
কেমন অস্বস্তি লাগে। তোমাকে পড়লো মনে, তুমি হয়তো-বা
পড়ছো লিটল ম্যাগাজিন কিংবা শোভা
দেখছো জানালা থেকে শান্ত মনে নিসর্গের, হয়তো বাঁধছো
ফাঁপা চুল, ছোট বোনটির গালে ঠোনা মেরে সুস্নিগ্ধ সাধছো
গলা বসে এক কোণে। ‘তোরই হতো একজন,’ শুনলাম
যেন ফের পাগলীর হা-হা-স্বর; জানি না কী নাম
তার, মগজের কোষে কোষে যার ঝুলছে বাদুড় অগণন,
হৃদয়ের আত্যয়িক ধূসর সৈকতে ক্ষ্যাপা হাওয়ার স্বনন।

রাস্তায় একটু থেকে ধরাই বিপন্ন সিগারেট
কখনও ব্যস্তবাগীশ হকারের কাছে জেনে নিই রেট
নানান পণ্যের আর পথে স্রেফ বেড়াচ্ছি তো ভেসে।
কেমন বিচ্ছিরি হাসি পেলো, হো-হো উঠবো কি হেসে?
চেয়ে দেখি, পথে-ঘাটে ঘোরে কতো বিকারি, ভিখারি।
হেসেই ফেললাম, ভারি কান্না পেতো নিশ্চিত নতুবা!
রাঙা পাখিটাকে খুব করেছিলো পিচ্ছিল যে-যুবা,
জানি, আমি তার ভুল উত্তরাধিকারী।

কতদিন

কতদিন দু’দিন তিন দিন কেটে যায়, কেটে যায়, কেটে যায়
এবং আমাকে কাটে রেজরের ভীষণ শীতল
তীক্ষ্ণতায়। একদিন দু’দিন তিন দিন কেটে যায়, তবু তুমি
আসো না এখানে, দাড়াও না দরজা ঘেঁষে অথবা কপাল থেকে
সরিয়ে বেয়াড়া চুল বলো না, কেমন আছো? তুমি কি কখনও
আসবে না আর? দ্যাখো, নিঃসঙ্গতা সকৌতুক দেয়
বাড়িয়ে আমার দিকে পানপত্র তার আর আমি
আকণ্ঠ করছি পান। এই তো এখানে হাত রাখি, তপ্ত হাত,
শয্যায় চেয়ারে কিংবা দেয়ালে, উঠোনে চারাগাছে-
কোথাও পাই না খুঁজে ঝলসিত তোমার শরীর।
হতাশার কিরিচের মুখোমুখি রয়েছি দাঁড়িয়ে,
যেন-বা তরুণ কোনো পাতে বুক অত্যাচারী সঙিনের মুখে।
এখানে আসে না বলে এ ঘর কবর আরম ঘাসে
ঘাসে ছাওয়া, রিক্ত হাওয়া কেবলি মর্শিয়া গায়, প্রাচীন কঙ্কাল
অদ্ভুত স্লোগান হাঁকে। পাঁজরে উইয়ের ঝাঁক কী ব্যস্তবাগীশ।

যখন এ ঘরে পড়ে তোমার পায়ের ছাপ, পুরনো চৌকাঠ
খিল খিল হেসে ওঠে, নিমেষে নর্তকী হয় জানালার পর্দা,
আমি নিজে হয়ে যাই জন্মদিন-দীপাবলি, চন্দ্রিল সোনাটা,
বানায় উদ্যান এক অগোচরে। অথচ যখন চলে যাও
আমার হৃদয় হয় শীতাক্রান্ত সন্ধ্যার শ্মশান।

কেন তুমি

কেন তুমি মুখ নিচু করে থাকো সারাক্ষণ? কেন
লোকলোচনের অন্তরালে থাকতে চাও?
তোমার কিসের লজ্জা? কোন্‌ পাপবোধে আজকাল
তোমাকে অমন দীন ছায়াচ্ছন্ন করে রাখো? কোন্‌
অপরাধে নতজানু হয়ে থাকো সারা দিনমান?
কেন তুমি ম্লান মুখচোরা হয়ে থাকো সর্বদাই?
না বললেও বুঝি
গলায় কলস বেঁধে নদীর গহনে ভয়ানক চুপিসারে
চলে যেতে চাও তুমি অথবা হঠাৎ
আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভস্ম হতে চাও
কিংবা ভয়-প্রদায়িনী আঁধারে ঘুমের বড়ি খেয়ে
অনবোলা ক্রুর যন্ত্রণার থেকে মুক্তি পেতে চাও।

জানি তুমি পিপাসার্ত পথিকের মুখে
কখনও পারোনি দিতে এক ফোঁটা জলও,
ক্ষুধার্তের ভিড়
তোমার দরোজা থেকে ফিরে গেছে। এমনকি হায়
ঝুলিয়ে হার্মোনিয়াম সুরপরায়ণ
গলায় কখনও বন্যার্তের জন্য পথে ঘুরে ঘুরে
চাঁদা তোলা হলো না তোমাকে দিয়ে। ক্যাম্পে
আহত ব্যক্তির ক্ষতে কোনোদিন বাঁধোনি ব্যাণ্ডেজ।
পাতোনি মাইন ব্রিজে, ওড়াওনি কনভয়
দুদ্দাড় গ্রেনেড ছড়ে, ফ্রগম্যান সেজে
বঙ্গোপসাগরে পারোনিকো ক্ষিপ্র ডোবাতে জাহাজ,
অথবা দখলদার সৈনিকের বুকে
বন্দুকের নল চেপে তার
হৃৎপিণ্ড ঝাঁঝরা করে দেয়া
সাধ্যাতীত জেনেছিলে মুখ ঢেকে অন্ধকারে একা।
কতদিন স্পষ্টত তোমারই
চোখের সম্মুখে শিশু হারিয়েছে প্রাণ, নারী তার
যৌবনের সলাজ আরক্ত মাধুরিমা;
তুমি কাকতাড় যার ভূমিকাও করোনি পালন।
না,তুমি লজ্জায় মুখ আঁধার-নিবাসে
রেখো না লুকিয়ে আর থেকো না অমন
নতজানু হয়ে,
যেমন ভয়ার্ত পাপী ধর্মযাজকের প্রকোষ্ঠের
সম্মুখে একাকী হাঁটু গেড়ে বসে কাঁপায় অধর।

বরং সহজ হও, সমুন্নত হোক গ্রীবা মরালের মতো,
অত্যন্ত উজ্জ্বল হোক চোখ
আবার মোহন অন্ধকারে। হে আমার
কবিতা কল্পনালতা তুমি
ধিক্কারে ঘৃণায় ক্ষোভে কখনও যেয়ো না বনবাসে।
ভয়ানক মারের সাগরে
ভেলা যে ভাসিয়েছিলে, ছিলে
আমার মগজে, ছিলে সর্বদাই রক্তকণিকায়,
অপ্সরার মতো নেচেছিলে
খাতার নিভৃত মাইফেলে সন্ত্রাসের
প্রহরে প্রহরে,
তাই হে আমার সিন্ডারেলা,
বেলা-অবেলায়
তোমারই উদ্দেশে শ্লোকরাজি আজও করি উচ্চারণ।
তোমারই উদ্দেশে
কেমন পুষ্পিত হয় অলৌকিক জমিজমা কিছু
তোমারই উদ্দেশে
আমার হৃদয়ে অন্তহীন শোভাযাত্রা
শূন্যতায়, জড় আর চৈতন্যের মধুচন্দ্রিমায়।

 গুপ্তধন

সবাই এমন ব্যবহার করে, ইচ্ছে হয় সংবারের দিকে
পিঠ দিয়ে পাশ-বালিশ বুকে ঝাড়া বাহাত্তর ঘণ্টা শুয়ে থাকি,
ইচ্ছে হয়, পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকে বসে থাকি দিন-রাত কিংবা
উন্মাদকে দীনবন্ধু বলে বুকে ধরি চেপে, করি বিড়বিড় সারাক্ষণ;

সবাই এমন ব্যবহার করে আজকাল, যেন আমি কারো
মাথায় দিয়েছি বাড়ি, যেন সদ্য কোনো বিয়েবাড়িতে হঠাৎ
ঢুকে পড়ে লাল চেলী দিয়েছি পুড়িয়ে কিংবা গোরস্তানগামী
লাশ দেখে ফিক করে হেসে ট্রাউজার খুলে করেছি পেচ্ছাব
চৌরাস্তায়। আমি তো করিনি লুট কোনো ব্যাংক, দুপুর রাত্তিরে
হাইজ্যাক করিনি মোটরগাড়ি। তবু কেন সবাই এভাবে
তাকায় আমার দিকে? দ্যাখো, ভালো করে দ্যাখো, জড় ল-টড় ল
কিচ্ছু নেই ললাটে আমার। হায়, তবে কি কোয়াসিমোদো আমি?
পিঠজোড়া কুঁজ নিয়ে বিব্রত সর্বদা, ঘণ্টা বাজিয়ে বাজিয়ে ক্লান্ত।

চোর বাটপাড় নই, মিছেমিছি আমার পেছনে কেউ, শোনো,
লাগিও না ফেউ, কাঠগড়া রাখো দূরে, টুকে নাও স্বীকারোক্তি-
রেখেছি লুকিয়ে বুকে এক বিরল সম্পদ, মুখচ্ছবি তার।

তুমি কে হে?

কখনও চঞ্চল ছিলো অতিশয় চক্ষুদ্বয়, এখন কেমন
ভয়ানক স্থির,
অচিন পাথর যেন, শ্যাওলায় হবে আচ্ছাদিত বৃষ্টি হলে।
ভয়ানক স্থির, রোদের তুমুল সুঁচ
ঠোকরাচ্ছে অবিরাম, তবু অক্ষিপক্ষ নিরুদ্যম,
হাতও উঠে আসে না কখনও। পড়ে আছো
রাস্তার কিনারে, ক্রুশকাঠ। ভনভনে
মাছি নাক-মুখ ঘেঁষে বুঝি জিজ্ঞাসায় অত্যন্ত চঞ্চল-
বেওয়ারিশ রয়েছো ঘুমিয়ে তুমি কে হে?
হাতের যজম মুঠো বিয়াবান, হৃদ্‌ ঠিকানার
তল্লাটে কোথাও কোনো ঘর নেই, সাঁকো নেই, ফোটে না চকিতে
স্বর্ণচাঁপা মফস্বলি স্টেশনের রাত
রাখে না শিশির তার বুকে রক্তে ঝিঁঝিঁ
ভুলেও দেয় না
মদির স্লোগান।
পৈশাচী খরায় আজ তাকে ঘিরে জীবনের হা-হা হরতাল।

দেখে কৃপা হয়? ইচ্ছা হয়, মাথাটা বুলিয়ে দিই,
চিবুকের কাটা দাগ করি অনুভব
তর্জনী অথবা অনামিকা ডগায়। খুলে নেবো
বিবর্ণ জুতোর পাটি? মিটবে কি সাধ রৌদ্রস্নানে?
যিনিই করান স্নান, তার
চুল রুক্ষ থেকে যাবে, হবে না কোমল
বুকের নিথর রোমারাজি।

কোথায় যাচ্ছিলে তুমি? বাজারের পথে? না কি হাওয়া
খেতে মাঠে? পোস্টাপিসে গিয়েছিলে কিনতে টিকিট?
হয়তো-বা সুগন্ধি নিঃশ্বাসে তৃপ্তি পেতে চেয়েছিলে
সূর্যাস্তের ছোপ-লাগা বারান্দায় লুকিয়ে-চুরিয়ে।
তপ্ত পিচে বিস্তৃত রোদ্দুরে,
কেমন নিঃশ্বাসহীন আছো পড়ে। কী তোমার গোত্র,
জাতধর্ম? কোন সে ভাষায় বলতে গাঢ়, ‘বাড়ি যাবো’,
বলতে ‘চাই, তোমাকেই চাই?’

দরজার কাছে

দরজার কাছে দ্বিধাহীন নতজানু হতে পারি,
যদি খুলে যায়।

তার কেঠো বুকে, বন্ধ বুকে,
অন্ধ বুকে ঠুকে
রক্তাক্ত করতে পারি মাথা,
ধূলিম্লান চৌকাঠে হাজারবার চুমো খেতে পারি,
যদি সে অর্গলমুক্ত হয়।
বাইরে রেখো না আর; দেখে যাও, একবার এসে দেখে যাও
ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মতো আমি টলছি ভীষণ।
আমাকে দেখলে কেউ এ মুহূর্তে ভাববে নির্ঘাৎ,
ভিক্ষান্ন চাইছি আমি, যদিও আমার
সমস্ত শরীরে
ভালোবাসা তার তপ্ত কাঞ্চনের মতন ফেস্টুন
দিয়েছে উড়িয়ে।
বাইরে রেখো না আর; তোমার মুখের
মধুর নোনতা স্বাদ, ঈষদুষ্ণ সময়-ভোলানো
আলিঙ্গন এ মুহূর্তে একান্ত জরুরি।

দরজা রেখো না বন্ধ করে বারবার, দরজায়
বিরাট ‘না’ দেখে যদি ফিরে যেতে হয়,
আমার ভেতর থেকে এক জলজ্যান্ত হনুমান
পড়বে বেরিয়ে, তারপর, বুঝতেই পারো,
লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে, তুমি
হতবাক দেখবে আগুন চতুর্দিকে, সে আগুন
হাজার ফায়ারম্যান বারো ঘণ্টা লড়েও নেভাতে পারবে না।
দরজা রেখো না বন্ধ করে,
রেখো না কখনও।
মুখের ওপর বন্ধ দরজা দেখেই
ফিরে যাবো হঠাৎ ছাঁটাই হওয়া চাকুরের মতো?
তুমি অভ্যন্তরে
সুশান্ত নিবাসে
সোফায় এলিয়ে পা নাড়বে ঘন ঘন,
তোমার পায়ের খুব কাছে
ঘুমোবে বেড়াল, তুমি সোনালি আলস্যে বুঁদ হয়ে
হয়তো করবে গুন গুন, হয়তো-বা
ব্রা খুলে দাঁড়াবে স্নানাগারে
গা জুড়ে কোমল নেবে জলের আদর
অথবা ফ্রাইংপ্যানে ভাজবে ইলিশ মাটি-ছোঁয়া
শাড়ির সীমান্তে নিয়ে হলুদ কলঙ্ক।

না, তুমি দরজা বন্ধ রেখো না কখনও।
তোমাকে না দেখে যদি ফিরে যেতে হয়,
তবে আমি স্টিমার ডুবিয়ে দেবো গহন নদীতে,
উপড়ে ফেলবো রেললাইন,
মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাকগুলো জাগজের মতো
কুটি কুটি ছিঁড়বো বেবাক
আর জেলখানার দেয়াল
লাথি মেরে করবো লোপাট,
ভীষণ মটকে দেবো ডিআইটির ঘাড়।

বাইরে রেখো না আর; এই পথ উত্তপ্ত কটাহ।
খোঁপায় জড়াচ্ছো মালা? না কি
প্রোষিতভর্তিকা প্রতিবেশিনীর সঙ্গে জমিয়েছো রঙ্গ?
তুমি কি ঘুমিয়ে আছো? তোমার শিয়রে
কেউ কি দাঁড়ালো লুব্ধ দৃষ্টি মেলে, যেমন অম্লান
গঁগার ছবিতে আছে সান্দ্র চিরদিন?

দরজাকে বারবার আমার শক্রতা
সাধতে বলো না কোনোদিন।
মগজে, হৃদয়ে
তোমার মদির তাপ শিরায় শিরায়
না নিয়ে আমাকে যদি ফিরে যেতে হয়,
তবে আমি হাতবোমা ছুড়ে দেবো গণতরঙ্গিত
চৌরাস্তায় দিনদুপুরেই,
‘আজ চাকা বন্ধ’ বলে ডাকবো পল্টনে জনসভা;
জবরদখল করে বেতার ভবন
তুমুল রটিয়ে দেবো আকাশে আকাশে,
বস্তিতে বস্তিতে, ঘরে ঘরে-
আমি ফিরে যাবো না হে শক্র
হে রুদ্ধ দরজা
যাবো না কক্ষণও।
পরশুরামের মতো কুঠারের আঘাতে আঘাতে
আমিও একুশবার নিশ্চিত মেটাবো জাতক্রোধ।

দুই তীর

বাস্তব ভেলকিবাজি দেখাচ্ছে বলেই স্বপ্নময়
একান্ত প্রহর খঁজি। তুমি তো ওঠো না ভেসে দিনের মুকুরে,
আমার চোখের আলো-লাগা পথে-কী যে বিপর্যয়
জীবনে এসেছে নেমে-তোমার তো দেখা নেই। কীট কুরে কুরে
খাচ্ছে হৃদয়ের গুল্মলতাগুলো। সারারাত তোমাকে স্বপ্নের আঙিনায়
ব্যাকুল চেয়েছি পেতে; তুমি যাবে হেঁটে যেন তরুণী মহিমা
অবিকল; কানায় কানায়
উঠবে ভরে জ্যোৎস্নায় ঘুমের পঞ্চবটী। স্বপ্নে সুযোগের সীমা
যতই বিস্তৃত হোক, তোমারই যে নেই দেখা-
দুচোখে শিশির নিয়ে মূক নীলাভায় ঘুরি একা।
অথচ সকালবেলা খুব নিরালায়
নিদ্রার ছিন্ন পাড়ে সদ্য
কী আশ্চর্য, উঠলো ভেসে চকিতে তোমার মুখ, যেন জলপদ্ম,
হস্তলগ্ন চায়ের জাগর পেয়ালায়।

প্রমাণ

তুমি বারবার বলো ঘুরে ফিরে সেই একই কথা-
‘তাহলে প্রমাণ দাও, সত্যি ভালোবাসো কিনা’। বুঝি ব্যাকুলতা
কেন যে দখল করে তোমাকে এভাবে।
বলো, কে নেভাবে
তোমার বুকের এই অধীর আগুন?
যখন ফাল্গুন
আসে, নিমেষেই
চাদ্দিক পুষ্পিত হয়। ফুল কি প্রমাণ করে এই
চরাচরে আপন সৌরভ
ইনিয়ে-বিনিয়ে? ফোটে, শুধু ফোটে, তার উন্মীলনেই গৌরব।

 ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা

ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা
গোলাপ নেবো।
গুলবাগিচা বিরান বলে, হরহামেশা
ফিরে যাবো,
তা হবে না দিচ্ছি বলে।
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা
গোলাপ নেবো।
ফিরতে হলে বেলাবেলি হাঁটতে হবে
অনেকখানি।
বুক-পাঁজরের ঘেরাটোপে ফুচ্‌কি মারে
আজব পাখি।
পক্ষী তুমি সবুর করো,
শ্যাম-প্রহরে ডোবার আগে, একটু শুধু
মেওয়া খাবো।

শিরায় শিরায় এখনও তো রক্ত করে
অসভ্যতা।
বাচাল কণা খিস্তি করে, হাফ গেরস্ত
প্রেমের টানে;
হঠাৎ দেখি, চক্ষু টেপে
গন্ধবণিক কালাচাঁদের, মিষ্টি মিষ্টি
হ্রস্ব পরী।
বিষ ছড়ালো কালনাগিনী বুকের ভেতর
কোন্‌ সকালে।
হচ্ছি কালো ক্রমাগত, অলক্ষুণে
বেলা বাড়ে।
সর্পিণী তুই কেমনতরো?
বিষ-ঝাড়ানো রোজা ডেকে রক্ষা পাওয়া
কঠিন হলো।
ছিলাম পড়ে কাঁটাতারে বিদ্ধ হয়ে
দিনদুপুরে,
রাতদুপুরে, মানে আমি সব দুপুরে
ছিলাম পড়ে।
বাঁচতে গিয়ে চেটেছিলাম
রুক্ষ ধুলো; জব্দ নিজের কষ-গড়ানো
রক্তধারায়।

ইতিমধ্যে এই মগজে, কয়খানা হাড়
জমা হলো?
ইতিমধ্যে এই হৃদয়ে, কয়খানা ঘর
ধ্বংস হলো?
শক্ত পাক্কা হিসাব পাওয়া।
টোফ-ফর্দের পাতাগুলো কোন্‌ পাতালে
নিমজ্জিত?

তালসুপুরি গাছের নিচে, সন্ধ্যা নদীর
উদাস তীরে,
শান-বাঁধানে পথে পথে, বাস ডিপোতে,
টার্মিনালে,
কেমন একটা গন্ধ ঘোরে।
আর পারি না, দাও ছড়িয়ে পদ্মকেশর
বাংলাদেশে।
ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি
লাশ নেবো না।
নই তো আমি মুর্দাফরাশ। জীবন থেকে
সোনার মেডেল,
শিউলিফোটা সকাল নেবো।
ঘাতক তুমি বাদ সেধো না, এবার
আমি গোলাপ নেবো।

 ফেরার পর

কেন এলাম? বৃথাই এলাম
বুকের মধ্যে যে বাড়িটা জ্বলছিল খুব
আপন হয়ে, তারা হয়ে
তার নিকটে কেন এলাম? বৃথাই এলাম।

শুধুই কি আজ
আকাশ-ছেঁড়া করুণ আলো
মাখতে এলাম চোখের পাতায়,
স্টেনের ডগায়, শিরন্ত্রাণে?
কবরখনার শূন্যতাকে
ধীরে-সুস্থে চাখতে এলাম
এমন নিঝুম বেলাশেষে?

কেন এলাম? বৃথাই এলাম।
ডালিম গাছের ছায়ায় ঘোরে তরাস-ছাড়া
শুবরেপোকা।
একদা এই গাছতলাতে মোয়া হাতে
চলতো বেজায় হেলেদুলে
টেবো খোকা। এবং ঢাকাই শাড়ি হঠাৎ
উঠতো ভেসে টলমলানো রোদমুকুরে।
দরগা-দোরে মানৎ রাখা, কুমারীদের
পুণ্যি পুকুর-সব কিছুরই চলন ছিলো,
ছিলো মানে গেরস্থালির
এখানে এই মিশ্র পাড়ায়, বলতে পারি।
কেন এলাম? বৃথাই এলাম।
বেলাশেষের রোদ পড়েছে ভাঙা ভিটের
ফজুল ঘাসে। ফুটোফাটা তোরঙ্গটার
অতীত আছে বোকা-সোকা
দৃষ্টি মেলে, ফতুর ফাঁকা।
তালচটকের ঈষৎ জেদি চঞ্চলতায়
চমকে ওঠে গোছালো এই নীরবতার
কোমল কেশর।

ভাবছি যখন আজকে মৃদু সাঁঝ বাতিটা
কাঁপবে না তো কারুর হাতে,
হঠাৎ তখন ভুঁই-কামড়ি এগিয়ে এসে প্রিয়ংবদা
হলো যেন সানুকম্প
লৌকিকতায়।
ঘুঘু-চরা ভিটেয় তবে বৃথাই এলাম?

বস্তুর আড়ালে

শব্দ আছে এই ভুবনে,
শব্দ আছে হরেক রকম। অনেক দিনের
চেনা-জানা। আবার এমন শব্দ আছে
অচিন পাখির মতন যারা
লুকিয়ে থাকে পাতায়-ছাওয়া
ফাঁক-ফোকরে। প্রতিবেশী রোদ্রছায়ায়
বেশ তো আছে শব্দাবলী।
এই যে দেখুন বস্তুগুলো
ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে-সবাই এরা
শব্দ নামে পরিচিত। শব্দ ছাড়া
আর কিছু নয়। ধরুন এটা
কিংবা ওটা, মানে শহর-
তলির গলি, দীর্ঘ সাঁকো-আসলে সব
বাংলা খোঁজে শব্দপুরে।

কবুল করি, এখন আমি
হাঁটতে গিয়ে, ভয়েই থাকি সকল সময়।
সবখানে আজ পা রাখি না, কখন পাছে
আমার দ্রুত পদাঘাতে
ছিটকে পড়ে চতুর্দিকে
যাবতীয় শব্দাবলী। এখন দেখি
পথ চলাটাই বিড়ম্বনা।
এখন আমি এই শহরে
নজর রাখি চতুর্দিকে। সবখানে আর
পা ফেলি না। ঐতো ব্যস্ত পথের মোড়ে
শক্ত পিচের কারা ভেঙে
হঠাৎ ফোটে রক্তগোলাপ
একটু হলেই মাড়িয়ে দিতাম, হায়রে আমি
অমন পেলব শুচিতাকে।
অনেক কিছু ঘটে গেছে
এই শহরে। এমন কিছু যেসব শুধু
শব্দ দিয়ে যায় না বলা। বলতে গেলে
শব্দ যেন বোকা-সোকা
লোকের মতোই থতোমতো।
শব্দ তখন রুগ্ন খোঁড়া হাঁসের মতো
হোঁচট খেয়ে বিড়ম্বিত।
এই যে ক’টি হাড়ের পিছে আমার আপন হৃদয় আছে, সেকি তবে
শব্দ শুধু? কিংবা কোনো দুঃখী বুকের
শূন্যতাকে শব্দ দিয়ে
যায় কি ঘেরা?

বুকের মধ্যে

বুকে মধ্যে একটা কেমন জগত আছে, বুঝতে পারি।
সেখানে মূল পাখি থাকে, থাকেন বৃক্ষ সারি সারি।
রুক্ষ পথে প্রাণে ধু ধু তৃষ্ণা নিয়ে একলা কে যায়?
আবীর মাখা দরজাটাকে কেউ খুলে দেয়, কেউ-বা ভেজায়।

বুকের মধ্যে ছয় ঋতু এক সমন্বিত ভুবন বানায়।
সোমত্থ ঐ মেঘ-মেঘালি কাছে-দূরে গাছের ডানায়
ডুকরে-ওঠা কাজল বেলায় কান্না রাখে শতেক ফোঁটা!
স্বপ্ন-বনে কিছুতে আর ফুরোয় না যে তুমুল ছোটা।

যমুনা বয় কূল ছাপিয়ে লগ্ন তটে হাসা-কাঁদা,
বাজলে বাঁশি কেমন সুরে ঘর ছেড়ে যায় হৃদয়-রাধা।
ভালোবাসার মুখ দেখে সেই চিরকালীন স্বচ্ছ জলে
তর্জনীতে ফুল ফোটানো যায় তো ডুবে খুব অতলে।

বুকের মধ্যে হাত-চিঠি তার সুনীল পাখা দিচ্ছে মেলে,
স্বপ্নগুলো মাতাল যেন, খেলছে শুধু এলেবেলে।
হঠাৎ কখন ভাঙে সাঁকো কিংবা ফোঁসে রুগ্ন খালটা,
কিসের তোড়ে এক নিমেষে সব হয়ে যায় উল্টা-পাল্টা।

ভীতিচিহ্নগুলি

ভীতিচিহ্নগুলি মুছে যাচ্ছে একে একে সুমসৃণ।
ব্যক্তিগত বাড়ির দেয়াল
বস্ত্রালয়, মনোহারি দোকান, স্টেশন, ছাত্রাবাস
ইত্যাদির ক্ষত সেরে যাচ্ছে। করোটির
অক্ষি কোটরের মতো গর্ত
পায় নব্য পলেস্তারা; শহরে ও গ্রামে
ভীতিচিহ্নগুলি মুছে যাচ্ছে একে একে সুমসৃণ।

আবার ইলেকট্রিক পোলে কী ব্যাকুল শ্রমে কাক
নিবিড় জমাচ্ছে খুড়কুটো, কাক-বউ
ডিম দেবে বলে। পুনরায়
জেলের ফাটক ভেঙে বুকের রবীন্দ্রনাথ উদার পথিক
বাংলাময় রৌদ্রালোকে আর খোলা হাওয়ায় হাওয়ায়,
ঐ তো সৌম্য তিনি জ্যোতির্ময় দেয়ালে দেয়ালে।
বহুদিন পর বারান্দায় শূন্য টিয়ের খাঁচাটা
দিয়েছি ঝুলিয়ে
অভ্যাসবশত,
একটি সবুজ পাখি দাঁড়ে এসে ফের বসবে বলে।
ভীতিচিহ্নগুলি মুছে যাচ্ছে একে একে সুমসৃণ;
অথচ আমার বুক, মগজের কোষ

শিরা-উপশিরা
এখনও তো সন্ত্রাসের প্রজা। পেয়ারা গাছের নিচে
মুরগিগুলি হঠাৎ উৎকর্ণ হয়, যেন অন্তরালে ভয়বহ
শব্দে ধমক সুপ্রকট, দূরে খড়ের গাদায় খরগোশ
কম্পমান; রৌদ্রস্নাত পাখির বুকের রোম তীব্র শিহরিত
ইস্পাতি স্পর্শের আশঙ্কায়।
গাছের সজীব পাতাগুলি,
ভদ্র পাতাগুলি
দুঃস্বপ্নের ভস্ম-ওড়া প্রখর শ্মশানে
মনসার মতো আগুনের লকলকে জিভ দেখে
ক্রমাগত কুঁকড়ে যেতে থাকে।

হঠাৎ জানালা থেকে একটি রোমশ হাত ঘরে
ঢুকে পড়ে, বিচূর্ণিত গেরস্থালি। জামবাটি বুড়ো
নাবিকের ফিচেল করোটি হয়ে নৃত্যপর উদোম মেঝেতে।
প্রভুভক্ত কুকুরের মতিভ্রম, অকস্মাৎ আমার গলায়
তার রক্তখেকো দাঁত বসে যায়। আমার ছেলেটা
তার অনুজের মাথা কেটে হো হো হেসে ওঠে, সন্তানের রক্ত
নিজের জঠরে কেলিপরায়ণ! একটি যুবতী, উন্মাদিনী,
ঘাসের মৌসুমী ফুল চিবুচ্ছে কেবল, নাকে তার
লাভাস্রোত। সহোদরা বিষম ঝুলছে কড়িকাঠে। একজন
লোলচর্ম বৃদ্ধ মারহাবা বলে তার নকল সফেদ দাঁতে
কুটি কুটি কাটছেন কিশোরীর মাই। আমার সমস্ত ঘর
চাপ চাপ বরফে আকণ্ঠ ঢাকা, মুর্দাফরাশের
গান ভাসমান সবখানে।
রেখেছি কাকতাড় য়া দিকে দিকে মনের জমিনে,
তবুও ভয়ের প্রেত যাচ্ছে না আমাকে ছেড়ে। রোজ
বেলাশেষে ক্লান্ত লাগে, ক্লান্ত লাগে, ক্লান্ত লাগে; ভয়,
হিস্‌ হিস্‌ ভয়
দারুণ হাইড্র্যা ভয় এই
কণ্টকিত সত্তা জুড়ে রয় সারাক্ষণ। তবে কি ধবলী
গোখুরে উড়িয়ে ধুলো, রঙিন বাজিয়ে ঘণ্টা যাবে না গোহালে?

ভ্রমণে আমরা

যাচ্ছেন সজ্জন বৃক্ষময় মাঠে; পাখি
তার কাঁধ ছুঁয়ে
বুকে ঝাপসা নীল
একটু সকাল নিয়ে কোমল রুপালি ফের কোথায় এখন।
কুকুর গাছের ছায়া শুঁকে শুঁকে দূরে
কেমন সবুজ হয়। হ্রদের অত্যন্ত কাছে উঁচু
লিণ্ডেন গাছের
পাতার আড়ালে
দ্বাদশ শতকী ক্যাথিড্রাল উদ্‌ভাসিত।

এখানে কী টুকরো খোঁজা, ক্ষ্যাপা নিজেকেই বলি,
এখানে হ্রদের তীরে? বেলাশেষে মৃদু তরঙ্গিত
বেগুনি তরল জল চাইকোভস্কির সুর হয়ে ঝরে
কখনও আবার কম্পমান
নাৎসি কামানের বীভৎস ধমকে-
আইকন ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত, মাতৃক্রোড়ে শিশু
যীশুর শরীরে ফের ওরা
ঠোকে অন্ধ কালো
বর্বর পেরেক।
ধ্বংস হৃতস্বস্থ্য কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে
পড়ে থাকে, ভলোকভ তরল রুপালি বয়ে যায়
বাসময় লোক, ঐ ফুটপাতে হাঁটছে আমার বোন,
ভাই কাজে যায়, হাতে ব্যাগ।
আমার ছেলেটা
খবরের কাগজের টুপি পরে উৎসুক তাকায়
এবং আমার মেয়ে, ফ্রক-পরা কপালে চুলের
ঝিলিমিলি, খাচ্ছে নিরিবিলি
ছায়ায় আইসক্রিম নভগ্রডে। পার্কে
বন্ধু পড়ছেন বই। এখানে আমরা
কেউ কারো পর নই, যদিও ভ্রমণে পরবাসী।

মহররমি প্রহর, স্মৃতির পুরাণ

কুকুরও কাঁদতে জানে, হাসতে জানে কি? ওরা খুব
কাঁদতে তখন,
কেমন পাশব কান্না, হয়তো আংশিক মানবিক।
দলে দলে ওরা
এপাড়া ওপাড়া
ঘুরে ঘুরে মহররমি প্রহর ছড়িয়ে দিতো মধ্যরাতে। তুমি
শুনতে কি সত্তার চৌকাঠ
আমূল নাড়িয়ে-দেয়া সেই আর্তনাদ?
শুনতে কি রাত্রিমাখা অসিত বালিশে
মাথা রেখে? ঘুমঘোরে একটি গেলাস
বারবার চেয়েছিলে ব্যাকুল ছোঁয়াতে ফাটাফুটা
ঠোঁটের জমিনে?

কে জানে কোত্থেকে
এক ভিড় ঘোড়া, হয়তোবা আকাশের মাঠ থেকে
হঠাৎ আসতো নেমে ঘুমন্ত শহরে
অগ্নিকণা ঝরাতে ঝরাতে। এক ভিড় রাগী ঘোড়া
ছাদের জঙ্গলে,
মসজিদের পুরুষ্ট গম্বুজে,
মঠের শিখরে,
গির্জের চূড়োয়,
চালের আড়তে,
কসাইখানায়
কেমন অদ্ভুত নাচে উঠতো মেতে, করতো তছনছ
ভাটপাড়া গ্রন্থাগার-তুমি সেই অশ্বক্ষুরধ্বনি
শুনতে কি পেয়েছো তখন?

অথচ সকালবেলা ক্রুদ্ধ ঘোটকের
কীর্তির কলুষ কোথায় যে
হতো অবলুপ্ত। পুনরায় শহরের
প্রতিটি বাগানে রাঙা আড্ডার ঝলক,
বুড়িগঙ্গা আকাশের চোখের তলায়
আপন রুপালি বুক করে উন্মোচন।
কখনও পথের ধারে কখনওবা সিঁড়ির অত্যস্ত নিরালায়
কথোপকথন, চতুর্দিকে
দুপুরের উৎফুল্ল ব্রোকেড।
তুমিও কি থাকতে ঠিক বিচূর্ণিত নিশীথের পরে?
প্রাতরাশ খাওয়ার সময়
খবর-কাগজ পাঠকালে
অথবা রিকশায় বসে কিংবা
দপ্তরের ঘর্মাক্ত প্রহরে
হতো না কি ভাবান্তর কোনো? লাগতো না-কি
ঘাড়ে পিঠে নিশাচর ঘোড়াদের বাষ্পময় কালো
নিঃশ্বাসের দাগ?

কখনও নিকটে গেলে সংলাপের লোভে
দিতে না বুঝতে কী যে তোলপাড় চলছে তোমার
বুকের টানেলে,
মগজের ট্রেঞ্চে। যেন তুমি পেয়ারা গাছের ছায়া,
সোমথ মাছের ঘাই, পানকৌড়ি, রঙিন তিজেল
কবেকার চারুহাসি একটি তোরঙ্গ নিয়ে খুব
সুখে আছো। করতলে নাচাতে রোদ্দুর
জোয়ান বেহারা, পালকি, রাতের কুটির,
গলির পুরনো বাতি, উড্ডীন পরীর
ছবিসহ বিশাল সাইনবোর্ড উই-খাওয়া পুতুলের চুল।

দ্যাখো কতো ফুটেছে গোলাপ চতুর্দিকে,
এত বেশি গোলাপ ফুটতে এ শহরে
কখনও দেখিনি আগে। দ্যাখো
আমি গোলাপের নিচে ডুবে যাচ্ছি, খুব
নিচে ডুবে যাচ্ছি বলে তুমি
বাইরে মেলে দিয়েছিলে দৃষ্টি স্বপ্নাতুর-
যেন
অদূরে কোথাও
গোলাপ উঠেছে ফুটে থরে থরে। তবে কি আমার
চশমার কাচ
শিগগিরই পাল্টাতে হবে? কই আমার চোখে তো পড়ে না
একটিও গোলাপ কাছে-দূরে।
দেখাতে চাইলে তুমি বিষণ্ন ইঙ্গিতে,
কোথায় কোথায় বলো কোথায় গোলাপ বলে আমি
বিষম চেঁচিয়ে উঠতাম, মনে পড়ে।

তোমার নিকটে গেলে হ্রলে-হ্রদে পদযুগ ডোবানোর
জলজ আনন্দ কিংবা ভোরবেলাকার
টিলায় অথবা
ডাগর নদীর তীরে সূর্যোদয় দেখবার খুশি
হরিণের মতো উঠতো নেচে আর পার্টি অফিসের
বারান্দায় ডাকতো কোকিল।

কোনো কোনো দিন
বিকেলে আলস্যময় হাত
দিতে মেলে শূন্যতার কাছে আর কোত্থেকে চকিতে
প্রজাপতি উড়ে এসে
তোমার হাতের মাঠে পেতো ঠাঁই, কী-যে করতো পান।
একটি কি দুটি করে অগণিত প্রজাপতি সুচারু নকশায়
তোমাকে ফেলতো ঢেকে, তারপরে দূরে
নিমেষে বিলীন-
যেন-বা তোমার প্রজা, ফুরফুরে সুখে বুঁদ
তুমি অধিপতি।
তখনো গোধূলিস্বরে বলতে তুমি করুণ প্রহরে-
‘যেখানে পাখির হাট বসে দু’বেলা, যেখানে
টিয়ের বুকের মতো জমজমাট ঘাসে
চিরুণি চালায় হাওয়া, খরগোশ নিত্য
করে আসা-যাওয়া, যেখানেই
আমাকে কবর দিও। যদি জমি হয় বৃক্ষহীন,
গোলাপের চারা দিও পুঁতে
শিয়রে আমার।‘ সারাক্ষণ
বলতে এমন ঢঙে কথা,
যেন হস্তধৃত চা’য়ের পেয়ালাটাই একমাত্র শ্রোতা
আমরা দেয়ালে কিংবা চেয়ার টেবিল।

মগজে তোমার
কল্পনার প্রচুর ফসল ফলতো বলে
গোধূলিরঙিন সেই ইচ্ছাটাকে তোমার উধাও
মনের ব্যাজার কোনো খেয়াল বলেই
ধরে নিয়েছিলাম সেদিন। কে জানতো
অচিরেই আমাদের দিনরাত্রি শুধু
ভীষণ ভাবতে হবে কবরের কথা।
কবরের কথা, মনে পড়ে,
তুমি বলেছিলে
এমন নিস্পৃহ সুরে, যেন
মৃত্যুতে যন্ত্রণা নেই কোনো, নেই কুশ্রীতা কিছুই।
যেন
মৃত্যুর মুহূর্তে মুখ বেঁকে যায় না বিচ্ছিরিভাবে,
ওঠে না গাঁজলা কষে, অস্থিমজ্জার সব
ডাইনীর পাচনের মতো
ওঠে না ঘুলিয়ে বারবার
বিকট আক্ষেপে। কী আশ্চর্য, সেদিন গোধূলিস্বরে
মৃত্যুকে আবৃত্তি করেছিলে তুমি কবিতার মতো!

প্রতিদিন ঘন ঘন দেখেছি কবর, এখনও তো
গণকবরের খাঁ-খাঁ প্রতিবেশ সত্তা জুড়ে রয়।
শরীরের নির্জন হারেমে
বেড়ে ওঠে বুনোঘাস। খানাখন্দ থেকে
বীভৎস বেরিয়ে-পড়া মৃত হাত-পা সর্বদা মগজে
সিঁদ কাটে, অকস্মাৎ দেয়
তুমুল ঝাঁকুনি। মৃত্যু নয়
নক্ষত্রের রাত,
বসন্ত বাহার,
চামেলির সুস্নিগ্ধ চমক।
বসে না পাখির হাট সেখানে কখনও, নেই কোনো
গোলাপের চারা। খানাখন্দে
নিরালা টিলায়, ট্রেঞ্চে, ড্রেনে
অথবা নালায়
তোমাকে পাইনি খুঁজে। তোমার কি সাজে
লুকোচুরি খেলা?

এই তো আসছে ওরা ভিনদেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে,
ভাসবে বিলের জলে, বিন্দু বিন্দু খুশি
হয়ে ওরা উড়বে আকাশে বাংলার-
তুমি দেখবে না? তোমার তো ছিলো সাধ
মানস হ্রদের কিংবা সাইবেরিয়ার
এইসব ডানা-অলা যাত্রীদের দিকে তাকানোর।

কেউ কেউ আজও
মহানন্দে বন্দুকের কালো নল আকাশের পথে
করে তাক, গুড় ম গুড় ম শব্দ পাখি তাড়ানোর
খেলা কখন যে হয়ে যায়
হায়, লোক তাড়ানোর ভয়ঙ্কর খেলা।

মানবাবধিকার

এটা-সেটা নেই বলে হাপিত্যেশ করি না তেমন
যখন-তখন কিংবা দুর্দশায় হারমোনিয়াম
সোৎসাহে ঝুলিয়ে কাঁধে গাইনে কাঁদুনি। এখনও তো
ওপরে আছে চন্দ্র-সূর্য, তাদের দাক্ষিণ্যে পাই
রৌদ্র জ্যোৎস্না এবং দিচ্ছেন ছায়া বৃক্ষ যথারীতি।
একটু-আধটু স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন নিয়ে কাটে
রাত্রিদিন। চুপাচাপই থাকি, অধিকার চেতনায়
দেয়ালে দেয়ালে আমি সাঁটি না পোস্টার। ইস্তাহার
নিষিদ্ধ পুস্তিকা ইতস্তত করি নাকো বিলি কিংবা
পুলিশের টুপি পদদলিত করি না, চৌরাস্তায়
পোড়াই না বাস আর গুম খুনে অনাগ্রহী খুবই।

পিঁপড়েও নিশ্চিন্ত ঘোরে, নইতো সশস্ত্র নিধিরাম।
জীবনকে বিশদ চড় ইভাতি ভেবে কোজাগরি
পূর্ণিমায় চাইনে বাংলোয় করতে নরক গুলজার
অথবা মুরগির ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে অকস্মাৎ
ভাবাবেশে চাইনে লুটিয়ে পড়তে টেবিলের নিচে
কিংবা হুররে পারমিটের জোয়ারে পালতোলা মাতোয়ারা
পানসি ভাসাতে কোনোদিন। রাতরাতি ঘোর কালো।

বাজারে চমকপ্রদ লাল হতে চাইনে কখনও।
চাইনে শাওয়ার খুলে চন্দন সাবানে প্রতিদিন
গা ধুয়ে ফুরফুরে ফুলবাবু সেজে বাগান বাড়ির
ফটক পেরিয়ে যেতে- এইসব চাইনে কিছুই।
শুধু চাই বংশানুক্রমিকভাবে নির্বিঘ্নে আকাট
মূর্খ হয়ে থাকার কৃপণ ডাস্টবিনে কুকুরের
অস্থিসার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার এবং অনাহারে
যত্রতত্র মরণ করবার অধিকার।

মাৎস্যন্যায়

সে জলে স্বচ্ছছন্দ, কেলিপরায়ণ খোলা চোখে দ্যাখে
শামুক, নিথর নুড়ি, অন্য মাছ-জলের ভুবন।
সাঁতারে আরাম, লেজ নেড়ে হয়তো কাউকে ডাকে,
অগোচরে হতে চায় ক্ষণিক-প্রেমিক। টলটলে
জলজ দুপুরে কিংবা টইটম্বুর রাত্তিরে নদী
যখন সঙ্গীতময় হয়, সে আপন অন্তরালে
ভাসমান খুশি যেন। তবু ভয়, কাঁটাতার-ভয়
তার এই মাঝারি সত্তায় লেগে থাকে সারাক্ষণ
কেমন রহস্যময় বিষাক্ত গুল্মোর মতো। বড়ো
মাছ তাকে দেখলেই ধেয়ে আসে, লোভাতুর; আর
সে পালায় ঊর্ধ্বশ্বাসে, যেন বা দেহের কাঁটাজাল
আসবে বেরিয়ে ত্বক ফুঁড়ে, খোঁজে স্বগোত্রের ব্যুহ
এখানে-সেখানে শক্র-তাড়িত, সন্ত্রস্ত, দিক ভুলে
হায়, এসে যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুধার্ত মাছের সংঘে।
আক্রমণে মত্ত ওরা। সে অত্যন্ত একা, মীনরাজ্যে
অভিমন্যু, আর্ত, ক্লান্ত সাঁতার-রহিত, নিরুপায়।

যখন তোমার কথা ভাবি

যখন তোমার কথা ভাবি,
হৃদয়ে মাধবীকুঞ্জলতা
লাস্যময়ী হয় অচিরাৎ।
যখন তোমার কথা ভাবি,
একটি নদীর
জলজ আদর পেয়ে যাই।

ডালে ডালে নিষ্কলুষ প্রগল্‌ভ পলাশ,
হাওয়া নম্র, লেডি হ্যামিল্টন। শৈশবের,
কৈশোরের সীমাছেঁড়া থোকা থোকা আমের বউল
মঞ্জরিত আদিগন্ত বাগানবাড়িতে। পুলিশের
শাদা হাত ভাস্কর্যর মধুর; পথচারী,
ভিখিরি, কেরানি, ছাত্র অথবা মজুর
সবাই স্বজন।
শহুরে বাগানে বসন্তের ফুল্ল টেলিগ্রাম। পাখি
বারান্দার বার-এ তীব্র রৌদ্র করে পান। ত্রিজগৎ
লাল বল, আমি ব্যগ্র বালক সতৃষ্ণ চোখে মেলে
রাখি হস্তমুদ্রা।
আমার শরীর মেঘ, টলটলে জল
অথবা বাতাস।
যখন তোমার কথা ভাবি,
ব্যাপ্ত আমি শহরের আনাচে-কানাচে।
আমার পায়ের নিচে, দু’তিন মাইল নিচে ব্যাংক,
বীমা কোম্পানির
মৃত্যুগন্ধময়
নিরক্ত দপ্তর
সিনেমা দোকানপাট, ডিআইটির চুড়ো
রঙিন সাইনবোর্ড ছাওয়া পথঘাট,
উদ্বাস্তুর ডেরা,
দ্রুত ধাবমান যান, এভিনিউ, এরোড্রাম, পোর্ট
আর রাজহাঁসের মতন ইস্টিমার।

পড়শী নদীর তুলে-ধরা আর্শিতে ভাসলে মুখ,
ফুলের গোপন অন্তঃস্থলে দুটি চোখ
দেখতে পাওয়া কিংবা
সূর্যোদয়ে নির্জন টিলায় বক্ষচূড়া, তোমাকেই ভাবা।

যখন তোমার কথা ভাবি,
রাখাল বাজায় বাঁশি সনাতন বটের ছায়ায়
সুরে ঝলসিত
বেহেস্তি প্রহর। কারখানার
ধোঁয়াচ্ছন্ন ভেঁপু
ফোটায় ছুটির ফুল কালিঝুলিময়
কর্মিষ্ঠ সংসারে।

চাইনে রাজার বাড়ি, ঝুলন্ত উদ্যান। দিগ্বিজয়ে,
অশ্বমেধে লাভ নেই, আমি
মাথা উঁচু করে ঘণ্টার সোনালি ধ্বনি
শুনতে শুনতে
পাখিদের সঙ্গে কথাচ্ছলে
প্রায় দেহহীন
শহরের প্রস্ফুটিত হৃদয়ে সটান চলে যাবো।
যখন তোমার কথা ভাবি,
জনাকীর্ণ বাস দিব্যি ফাঁকা মনে হয়,
রেশনের দোকানের সুদীর্ঘ লাইন
নিমেষে ফুরিয়ে যায়, ডাকঘর থেকে
সহজেই রঙিন টিকিট নিয়ে ফিরে আসে ঘরে।
যখন তোমার কথা ভাবি,
অলৌকিক একটি ঘরের
চাবি এসে যায় হাতে, উড়ন্ত সোনালি।
যখন তোমার কথা ভাবি,
পাথর, শেকড়, ডালপালা, খড়কুটো, পুরনো কবর,
হাড়গোড়, পোড়া কাঠ ইত্যাদি কবিতা হয়ে যায়-
পুষ্পিত ল্যাবরেটরি, চৈতন্যমথিত ত্র্যালকেমি।

যদি তুমি

নিরুপমা, যদি তুমি মৃত্যুর গহ্বরে যাও, তবে
বাগানের সবগুলো ফুল ভীষণ বিবর্ণ হবে,
সবচেয়ে রক্তিম গোলাপ
সারাক্ষণ বকবে প্রলাপ।
খাঁচার পাখিটা অনাদরে
নিমেষে বুড়িয়ে যাবে, কালো এক অদৃশ্য চাদরে
একদিন পড়বে ঢাকা। পোষা বিড়ালটা শূন্য ঘরে দিনরাত
নির্বাণের লোভে একা ঝিমুতে ঝিমুতে অকস্মাৎ
নিজেই হবে সে এক খণ্ড অন্ধকার।
ভেবো না আমার কথা, অস্তত গোলাপ, পাখি আর
বেড়ালের কথা মনে রেখে এই তরুণী প্রহরে
যেও না, যেও না তুমি মৃত্যুর গহ্বরে।

রক্তসেচ

কী আমরা হারিয়েছিলাম সেই সন্ত্রস্ত বেলায়
নিজ বাসভূমে?
কী আমরা হারিয়েছিলাম?
নৌকোর গলুইয়ের শান্তি, দোয়েলের সুরেলা দুলুনি,
ফসলের মাঠের সম্ভ্রম,
শহুরে পথের পবিত্রতা,
আর গাঙচিলের সৌন্দর্য
আর অভিসারের প্রহর,
কবিতার রাত,
দিগন্ত-ছোপানো
গোধূলির রঙ
-সবকিছু, হারিয়েছিলাম।
কখনও জানি না আগে, এত যীশু ছিলেন এখানে
আমাদের নগরে ও গ্রামে। সন্ধ্যার মতন কালো
ভীষণ মধ্যাহ্নে
আমরা কয়েক লক্ষ যেসাসকে হারিয়ে ফেলছি।

তখন প্রত্যহ মৃত্যু এসে বসতো আমাদের আর্ত ড্রইং রুমে,
সোফায় মাদুরে ফ্ল্যাটে কি পর্ণ কুটিরে
মাননীয় অতিথির মতো।
নির্জন পথের মোড়ে বাসস্টপে কিংবা গলির ভেতর
হঠাৎ এগিয়ে দিতো হাত, যেন বন্ধু বহুদিন পর
এসেছে নিদেশ থেকে অথবা বুকের ভেতরে নিপুণ
চালিয়ে বিশীর্ণ হাত দেখে নিতো হৃৎপিণ্ড কেমন
চলছে কি তালে।
যে পাখির ঝাঁক নামতো আমার উঠোনে,
হলো তারা নিরুদ্দেশ, যে-বেড়াল সবুর বিহনে
কুড়াতো আদর, খাদ্য আমার কন্যার
সেও তো উধাও হলো কে জানে কোথায়।
রক্তের মতন রক্ত বয়ে যেতে দেখে,
লাশের মতন লাশ পচে যেতে দেখে
হয়তো-বা শহরবিমুখ
হয়েছিলো ওরা।
জানতাম, সেই রক্ত বড়ো প্রতিশোধপরায়ণ,
জানতাম, সেই লাশ বড়ো প্রতিশোধপরায়ণ।
আমরা সবাই সেই সন্ত্রস্ত বেলায়
বন্ধুর হাতেও হাত রাখতে পারিনি,
অথবা দু’চোখ ভরে পারিনি দেখতে কৃষ্ণচূড়া।
বুকের ভেতর
নিষিদ্ধ কবিতা গান নিয়ে হেঁটে গেছি
মাথা হেঁট করে,
আমার বাংলার মাটি করেছি চুম্বন মনে মনে।

টিক্কার ইউনিফর্মে শিশুর মগজ,
যুবকের পাঁজরের গুঁড়ো,
নিয়াজির টুপিতে রক্তের প্রস্রবণ,
ফরমান আলীর টাইয়ের নটে ঝুলন্ত তরুণী…
তুমি কি তাদের
কখনও করবে ক্ষমা?–সেদিন সমস্ত গাছপালা,
নদীনালা, ফুটপাত, এমনকি বন্য পশুপাখি
এই প্রশ্ন দিয়েছিলো ছুড়ে চরাচরে।
ভদ্র মহোদয়গণ, এই যে আমাকে দেখছেন
পরনে পাঞ্জাবি, চুল মসৃণ ওলটানো, এই আমার মধ্যেই
ছিলো বিস্ফোরণ,
আমার মধ্যেই
ট্যাংকের ঘর্ঘর
জননীর আর্তনাদ, পিতার স্তম্ভিত শোক, বিধবার ধু ধু
দৃষ্টি আর কর্দমাক্ত বুট, সৈনিকের কাটা হাত,
ভাঙা ব্রিজ, মুক্তিবাহিনীর জয়োল্লাস,
আমার মধ্যেই ছিলো সব।
তোমরা নিহত যারা তাদের উদ্দেশে আজ মর্শিয়ায়
কালো করবো না চতুর্দিক, কেঁদে ভাসাবো না বুক।
তোমরা তো স্তব
এখন, পবিত্র
স্তোত্র কণ্ঠে কণ্ঠে,
জীবিতের চেয়েও তোমরা বেশি জীবন্ত এখন। তোমাদের
রক্তসেচে আমাদের প্রত্যেকের গহন আড়ালে
জেগে থাকে একেকটি অনুপম ঘনিষ্ঠ গোলাপ।

সাধ হয়

সাধ হয় পরিপাটি জ্যোৎস্না থেকে, পাতার মর্মর থেকে মুখ
একটু ফিরিয়ে যাই, অশত্থের প্রতিষ্ঠিত অন্ধকারে বুক
ভরিয়ে উৎসুক যাই সেখানে মন্ত্রণালয়ে। যাবো?
বড়ো উঁচু দেয়াল, কী করে টপকাবো?
বেজায় গম্ভীর সিংহ-সিংহ দরজা সেখানে; ঢুকে

পড়া সহজ তো নয়। দৈবারিক, পাগড়ি-পরা, পাকা লাঠি ঠুকে
নির্ঘাৎ আগলাবে পথ। ভেতরে হুল্লোড়, হাসি, পরামর্শ এবং বচসা
ক্ষণে ক্ষণে, আর মগজের ক্ষেত চষা
চলছে আহলাদে মাঝে-মাধ্যে। এ যে, নাট্য
অপরূপ, নেমেছে লাস্যের ঢল, চলে ঠাট্রা, কখনও-বা শাঠ্য।

সাধ হয়, সেখানেই যাই। অবশ্য সেখানে গেলে চোখে ঠুলি
বেঁধ বিবেচনা দৈবারিকের কাছেই জমা রেখে তৈরি চিন্তার পিটুলি
গিলে যেতে হবে। ওরা গলায় বকলেশ সুনিপুণ
পরিয়ে ভেতরে দেবে ছেড়ে, দেখবে তুমি বিবেকের গুম খুন।
না, আমি কখনও গলা দেবো না বাড়িয়ে; প্রতিবাদে
উঠবো দুলে বুকময় বকুল-বিছানো পথ গভীর বিষাদে।

হঠাৎ করে মাঝে মধ্যে

হঠাৎ করে মাঝে মধ্যে
একটা কিছু ঘটে গেলে,
একটা কিছু কেমনতরো,
তখন আমার হয় যে যেতে
সব কিছু হায় ফেলে টেলে।

চক্ষু-পুকুর সকাল নিয়ে
শাপলা সমেত, ফচ্‌কে পাখির
শিসটি নিয়ে
টলমলালে, মন্দ তো নয়
জীবনযাপন, দিব্যি বুঝি।

হঠাৎ করে ঘোর বিহানে
একটা কিছু যায় তো ঘটে।
তখন আমার হয় যে যেতে
সব কিছু হায় ফেলে টেলে।

করুণাময় আঁধার তুমি
হঠাৎ সামনে মেলে ধরো
দাবার রঙিন ছকটি ওহে।
তোমার কাছে থাকে জমা
সপ্নটপ্ন অনেক কিছু।
যখন তখন কৃপা করো
চির-নতুন আঁধার তুমি।
পায়ের কাঁটা নিচ্ছো তুলে,
রক্ত ধুয়ে
পথ্য দিচ্ছো সাঁঝ সকালে।
যখন তখন কৃপা করো
চির নতুন আঁধার তুমি।
হঠাৎ করে আঁধারজোড়া
প্রহর ছিঁড়ে
একটা কিছু যায় তো ঘটে।
তখন আমায় হয় যে যেতে
সব কিছু হায় ফেলে-টেলে।

জননীগো দুপুর বেলা
জুঁইয়ের মতো ভাত বেড়ে দাও
গ্রীষ্ম তাড়াও পাখা নেড়ে।
জননীগো ইলিশ মাছের
উজ্জ্বলতা ছড়াও পাতে।

হঠাৎ করে দ্বিপ্রহরে
একটা কিছু যায় তো ঘটে!
তখন আমায় হয় যে যেতে
সব কিছু হায় ফেলে-টেলে।

তোমার খেলা খুকুমণি
অনেক রাঙা বড্‌ড ভালো।
তোমার খেলার সাথী হলে
সত্যি সত্যি বর্তে যাবো।

কিন্তু খেলা ভাঙার আগেই
একটা কিছু যায় তো ঘটে,
তখন আমায় হয় যে যেতে
সব কিছু হায় ফেলে টেলে।

Exit mobile version