Site icon BnBoi.Com

দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে – শামসুর রাহমান

দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে - শামসুর রাহমান

 অক্ষরের ধারণ ক্ষমতা

যখন তোমাকে দেখি আমি পাঁচ হাজার বছর নিষ্পলক
তাকায় তোমার দিকে; অথচ আমার
দৃষ্টিকে করেছে বন্দি ওরা
অদৃশ্য দেয়াল গেঁথে। রাশি রাশি সিমেন্ট এবং
বালি চোখে পুরে দিতে চায় সকল সময়। যেন আমি
অন্ধ হলে ছিল ভালো, নদীতে হতো না ভরাডুবি।

ভালো ছিল, শৈশবের শ্যামল ছায়ায়
ছিলে তুমি কোনোদিন। তখন তোমাকে ছুঁলে কারো
ধিক্কারের বাজ
পড়তো না আমার মাথায়।
আর আজ চক্ষু মিলনেই ঢি ঢি পড়ে যায় দশদিকে; কেউ
কেউ এমন কি রায় বেঁশে হয়ে ওঠে।

ইচ্ছে হয় চলে যাই এ শহর ছেড়ে ছুড়ে। কেন না আমার
চোখের সম্মুখে তুমি খুব পরিপাটি
সাজাবে অন্যের ঘর, শোবে রাত্তিরে বেগানা বিছানায়-
এই দৃশ্য দেখে
সুন্দর হবে না চোখ কখনো আমার। ভয় হয়
এখন তোমাকে প্রিয়তমা বলতেও ভয় অতিশয়।

তুমি নও নর্তকী, অথচ প্রায়শই ফুটে ওঠে সাবলীল
নাচের মোহন মুদ্রা তোমার শরীরে, ছন্দোচ্ছল
তোমার পায়ের নিচে ধুলো,
ঘাস কার্পেটের মোলায়েম আঁশ খুব
স্নিগ্ধ নেচে ওঠে, আর নিমেষে আমার
কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা হয় নানা উদয়শঙ্কর।

যখন ঘুমাই আমি, অতিকায় দাঁড়কাক এক কাছে এসে
চঞ্চু রাখে ভুরুতে আমার,
এবং ধাতব ঘাস ফড়িং-এর ঝাঁক নিমেষে দখল করে
সমস্ত শরীর। চতুর্দিকে আমার স্বপ্নের রোঁয়া
ক্রমশ উড়তে তাকে। দুধ দোয়ানোর
শব্দে ঘুম ভাঙার আশায় থাকি ঘুমের ভেতর।

যে-কোনো আওয়াজে ঘুম ভাঙুক অথবা এমনিতে অকস্মাৎ
ছিঁড়ে যাক ঘুমের রেশমি পাড়, যেন জেগে উঠে
তোমাকেই দেখি। এ জীবনে
খুব অল্প দেখেছি তোমাকে। তাই আজ অক্ষরের
প্রতিমা বানিয়ে তাতে তোমাকেই রাখি
আর ভাবি অক্ষরের ধারণ ক্ষমতা কতটুকু?

অনাশ্রয়ে

কী করে দিনের পর দিন কাটে এবং রাতের
পর রাত চাঁদ ভেসে যায়
পানা পুকুরের
বুকে? দ্যাখো ময়ূরের বিশদ কলাপ
লহমায়
দুপুরে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লেগেছে রাজধানীর হৃদয়ে,
তুমি আজ কার জন্যে করবে বিলাপ?
অনেকেই ভয়ে
মন্দিরে মস্‌জিদে ঢোকে এবং গির্জায়
নতজানু হয়।

ক’জন সাহসী লোক সাত তাড়াতাড়ি
আগুন নেভাতে যায়।
সারি সারি বাড়ি
এবং দোকানপাটে বয়
আগুনের স্রোত। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে
কাঁদছো সেখানে জব্দ
দগ্ধ

রাজহাঁস পাখা
ঝাপটাচ্ছে, ওকে বুকে নিবিড় জড়িয়ে
সরে যাও। শহর পড়েছে অঙ্গারের আংরাখা।

অকস্মাৎ
দুপুরের চোখে মেঘ পরায় কাজল,
এক্ষুনি নামবে ঢল
শ্রাবণের, আকাশের বুকে ঝলসায়
বিদ্যুতের সর্পিল করাত;
পাখির বুকের রোম বিস্ফারিত ধারালো হাওয়ায়।

এ মুহূর্তগুলি তুমি মনে
গেঁথে নাও। এই বাড়িটার
বুক আর
পাঁজরের ওপর দু’চোখ
বিশদ বুলিয়ে নাও। সন্ধ্যা হয় হোক,
না জ্বলুক বাতি, এই সাঁঝ
হয়ে থাক ধ্বংসের পরের কারুকাজ,
আকাশ উঠবে ভরে ফের নক্ষত্রের গুঞ্জরণে।
দু’দিন পরেই কোথায় যে চলে যাবে
ধোয়া মোছা ফেলে টেলে, তুমি ফের অনাশ্রয়ে কোথায় দাঁড়াবে?

আমার ঘুমের মধ্যে

আমার ঘুমের মধ্যে শুনি পদধ্বনি গাঢ় রাতে
ঘুম ভাঙে, একবার নয়,
দশবারও নয়,
কেবলি।
দেয়ালে ছায়া দেখে প্রাণের শেকড়ে
লাগে টান, কে এল আমার ঘরে মনের খেয়ালে,
নাকি অন্তর্ধানা কারো
না পেয়ে আমার সাড়া! সাত তাড়াতাড়ি
শয্যা ছেড়ে উঠি, যাই দরজার কাছে,
বারান্দায় কেউ কি দাঁড়িয়ে আছে? প্রখর শূন্যতা
আমাকে কামড়ে ধরে। ফিরে আসি, আধপড়া বই
হাতে শূই,
বাসি-হয়ে-আসা
ঘুমের ভেতরে যদি বাঁশি বেজে ওঠে অতীতের
বিকেল বেলায়
বিনম্র মাঠের
ঘুম ভেঙে যাবে কি তখন?
রাত্রির ললাটে যার স্পর্শে ফের ফুটবে কুঙ্কুম,
সে এখন অন্তরালে। এখন তো পদধ্বনি শুধু
পদধ্বনি ঘুমের ভেতরে।
যার পদধ্বনি শুনি তাকে যেতে হবে বহুদূরে,
আমিও কি থাকবো এখানে
সারাবেলা ম’জে গেরস্থালি সুরে? যাবো
আমি দূরে তোমারই উদ্দেশে,
হয়তো লঞ্চে যেতে যেতে
তোমার নিবাস
নিমেষে পেরিয়ে যাবো, জানবো না। তুমি
হয়তো কূয়োতলায় মুখ
ধুচ্ছো কিংবা পাল্টাচ্ছো রাতের
বালুচরী শাড়ি, কাঁঠালের গাছে একটি অচিন
পাখি অতিথির নাম ধ’রে ডেকে যাবে,
মনে হবে তোমার এবং
আমি একা ধাবমান লঞ্চ থেকে তাকাবো তোমার
ভূরুর মতোই

দূরবর্তী গ্রামটির দিকে।
আমার ঘুমের মধ্যে শুনি পদধ্বনি, যেন তুমি
আসছো স্তিমিত আঁধারকে
চমকিয়ে, দেখি
বাগ্‌দি-পাড়া, চার বেহারার ডুলি, জামতলা, পর্দা-
পেরুনো চকিত দৃষ্টি, আমার হৃদয় জুড়ে তোমার কোমল
পদচ্ছাপ। ভোরবেলাকার
মাছের মতোই
তোমার হাতের নড়া দেখলাম, মনে
হলো আর যে-ঘাটে ভিড়লো
লঞ্চ, সেখানে তো ঠিক নামতে চাইনি। এ কোথায়
চলেছি আচ্ছন্নতায়? আমার হাতের ব্যাগ হাঁস
হয়ে উড়ে যায় দূরে; একটি পাখির
গীতাভায় চমকিত চোখ
স্বাগত জানায়, তুমি সাঁঝবাতি জ্বেলে
দাঁড়াও দাওয়ায় একা
এবং আমার ঘুম দীপান্বিতা হয়,
আমার ঘুমের মধ্যে তোমার নিশ্বাস জেগে ওঠে,
আমাকে ক্ষইয়ে দিতে থাকে
ক্রমশ তোমার পদধ্বনি, অন্ধকারে মঞ্জরিত পদধ্বনি।

তোমাকে দেখি না আমি, দেখি
তোমার নির্জন রাত্রিরূপময় পদধ্বনিকেই।

আমি উঠে এসেছি সৎকারবিহীন

একজন আধবুড়ো লোক, চাঁদকপালি গরু,
কতিপয় পাখি আর মুর্গির বাচ্চার জন্যে কান-খাড়া করা
বালক,
আকাশী রঙের শাড়িপরা বানডাকা নদীর মতো
এক তন্বী তৈরি করেছিল চমৎকার দৃশ্য।
এখন সেখানে হারিয়ে-যাওয়ার নিঃস্ব হাহাকার।
ওরা কেউ আজ নেই, সাঁঝবাতি নিয়ে দাওয়ায়
দাঁড়াবে কে? ওরা যেন
অনেক আগেকার সুর, পুরানো সারিন্দায় বাজানো,
কোনো আনাড়ি বাদকের হাত থেকে নিঃসৃত।

যে-ভাষা নদীর, হাওয়ার, নদী তীরবর্তী কাশফুলের,
কবরের ঘাসের, যে ভাষা নীরবতার,
সে ভাষায় আমি আজ কথা বলছি
হে নগরবাসী। হে ঝলমলে শহরের নাগরিকবৃন্দ,
আমিও নেই,
তবু উঠে এসেছি, সৎকারবিহীন। আমি কোনো অভিযোগ
নিয়ে আসি নি, আমার কোনো দাবি নেই
সরকারি বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে। শুধু চাই,
একবার আমার দিকে তাকান
ভালো ক’রে, চোখ-কান খোলা রাখুন; আমিও
পুরুষোত্তমের মতো করাতে পারি বিশ্বদর্শন। কেউ
আমার প্রতি করুণা বর্ষণ করুন
চাই না আমি; সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আমি আসি,
চলে যাই হাওয়ার ঝাপটার মতো।

এখন অগ্নি আমাকে পোড়াতে পারে না, জলেরও ক্ষমতা নেই
আমাকে ডোবানোর, মাটি
করতে পারে না গ্রাস। আমার পায়ের পাতা নেই যে,
মাছ ঠোকরাবে, চোখের মণি নেই যে,
উপরে নেবে দাঁড়কাক, আমার মেদমজ্জা নেই যে
খুবলে নেবে শেয়াল কুকুর।

অথচ দেখতে পাই সবকিছু, শুনতেও অসুবিধা হয় না;
যেখানেই যাই
কানে আসে বাঁচাও বাঁচাও ধ্বনি, অথবা হতে পারে
আমি নিজেই সেই ধ্বনি। সারাক্ষণ দেখি,
একটা রেসক্যু বোট পাক খাচ্ছে মধ্যযুগের রাত্রির ঘূর্ণিস্রোতে,
কেবলি দূরে সরে যাচ্ছে আমার প্রসারিত হাত থেকে, বহু দূরে।
অথচ এখন আমার
কোনো রেসক্যু বোট কিংবা লাল বয়ার প্রয়োজন নেই।

খুব বেশিদিন কি বেঁচেছিলাম?
এখন আমি ভাবি একটা নিকানো উঠোনের কথা,
পুকুরে নুয়ে-পড়া ডাল, ডাগর লাউয়ের মাচান,
মাদুরে মনসুর বয়াতীর কথা, ধোঁয়া-ওঠা
লালচে ভাত, সোনালি শুরুয়ায় ডুবে থাকা
এক টুকরো মাছের কথা। লোকে বলে,
গানের গলা ছিল আমার আমি সেই গানের কথাও ভাবি।

কিন্তু আমার সব কিছু ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে,
এমনকি আমার কণ্ঠস্বরও। আজ আমি
কথা বলি নদী, হাওয়া, কাশফুল, কবরের ঘাস আর
নীরবতার ভাষায়।

আমি কি গলায় তবে

কী-যে হলো, ইদানীং অনেকেই ঘেঁষে না আমার
ত্রিসীমায়। একদা যাদের গল্পে-গানে উঠতো ভ’রে
আমার প্রহর অহর্নিশ, না চাইতে
দিতো যারা বাড়িয়ে চায়ের কাপ, বাগানের ফুল
আহ্লাদে সাজাতো
আমার ফ্লাওয়ার ভাসে, এখন তাদের ছায়া আর
পড়ে না আমার ঘরে। বস্তুত এখন
ওরা চমৎকা কায়দায়
দিব্যি পাশ কাটিয়ে কিছু না ব’লে চলে যায়
সাত হাত দূরে
নিপুণ নটের মতো। যেন যাদু বলে পরিচয়
লহমায় মিথ্যে হয়ে যায়। একদা এরাই খুব
ঘটা ক’রে আমার গলায় মালা দুলিয়ে তুমুল
করতালি দিয়ে কানে তালা
দারুণ লাগিয়েছিল, মনে পড়ে। আজ
আমার অস্তিত্বে ওরা হুল ফোটাতেই বড় দড়।

কী আমার অপরাধ? আমি এ শহরে
দিইনি আগুন কোনোখানে, কারো বাড়া ভাতে ছাই
দিয়েছি, এমন কথা বলবে না চরম শক্রও। দাঙ্গাবাজ
আমাকে যাবে না বলা। আশৈশব আছে
পক্ষপাত পায়রার প্রতি। আমি শুধু
নিভৃতে করেছি বিক্রি আমার আপনকার আর্ত হৃদয়ের
রক্ত-থেকে-ঝরা

কতিপয় বিশুদ্ধ গোলাপ
এবং হাতের মুঠো থেকে প্রায়শই ছেড়ে দিই
তোমাদের উদ্দেশে রঙিন প্রজাপতি সমুদয়।

কী আমার অপরাধ? এমনকি তুমিও সম্প্রতি
আমার নিকট থেকে দূরে চলে যাও
যে-কোনো ছুতোয়। হয়তো তোমার নিকট
আমার সকল স্মৃতি পুরানো, অজ্ঞাত
নটের ছবির মতো আবছা সুদূর
মনে হয় আজ।
শুনেছি অতীতকালে কুষ্ঠরোগীদের রাখা হতো
শহরের শেষ প্রান্তে, উপরন্তু ওদের গলায়
ঝোলানো থাকতো ঘণ্টা, যাতে স্মিত স্বাস্থ্য বায়ুসেবী
পথচারীগণ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে
করতে পারেন পর্যটন।

আমি কি গলায় তবে ঘণ্টা বেঁধে নেবো?

আর্জান সর্দার

প্রিয়তমা, তোমার চিঠির শেষ কথাগুলো খুব
বিঁধে আছে মর্মমূলে, কতিপয় কালো
অক্ষর কদিন ধ’রে দেখাচ্ছে আমাকে
ভয়, যেখানেই
যাই দুশ্চিন্তার মেঘ ঝুঁকে থাকে আমার ওপর
সকল সময়। তুমি লিখেছো, সম্প্রতি
কী একটা শব্দের ধমকে
খোকার দোলনা কেপে ওঠে ভয়-পাওয়া
পায়রার মতো আর
খুকির পুতুলগুলির মূর্ছা যায় কুলুঙ্গিতে প্রহরে প্রহরে।

লিখেছো সন্ধ্যার পরে ইদানীং কেউ
সহজে রাস্তায় বেরোয় না। দরজায় খিল এঁটে
যে যার আপন ঘরে থাকাটাই শ্রেয়
মনে করে। কেউ কেউ দেয়ালে নিজের ছায়া দেখে
ভীষণ চমকে ওঠে এবং ফাঁসির
আসামীর মতো
কাটাচ্ছে সময় অনেকেই। এমনকি ভালোবাসা
আঁধারে লুকায় মুখ, যেন
গভীর ভূগর্ভে গিয়ে নেবে শেষ শয্যা। কী ব্যাপক
হায়বত, হায়, দাঁত নখ বসিয়েছে লোকালয়ে।
অন্য সব শব্দকে ছাপিয়ে সেই শব্দ নিয়তির
মতো ছোটে এক প্রান্তে থেকে
অন্য প্রান্তে, যে শোনে, হৃদয় তার শিলীভূত হয়
লহমায় গোখরোর ফনার মতোই
সম্মোহন আছে সে শব্দের প্রায়শই
বিপুল অঙ্গার এক দেখা যায় এখানে সেখানে,
তার অভ্যন্তর থেকে দশদিক-কাঁপানো গর্জন
চকিতে বেরিয়ে আসে, ঘরদোরে ধরে
চিড় আর গাছের বাকল ছিঁড়ে যায়। লোকে বলে
চতুর্দিকে শবাতঙ্ক ছড়াচ্ছে প্রবল কেঁদো বাঘ।
যতদিন পারো, প্রিয়তমা,
খোকা আর খুকীকে হাসাও। তোমাদের
হাসি এই অন্ধকারে ছড়াবে আবীর, ভয় নেই,
এই তো আসছি আমি। যদিও কখনো
ধরি নি বন্দুক আমি, এমনকি গুলতির ঘায়ে
মারি নি শৈশবে পাখি, তবু
খুঁজে নেবো আঁটি, এ আমারই দায় ভাগ,
অবলোয় আমাকেই হতে হবে আর্জান সর্দার।

আলমারি

একটি চমৎকার কারুকাজময় আলমারি
ঘরের ভেতর আছে চুপচাপ বহু বছরের
প্রাচীনতা নিয়ে; আজকাল এরকম আলমারি
বানানো হয় না আর চাহিদার অভাবে এবং
আগেকার মতো কোনো কুশলী ছুতোর নেই, বলে
কেউ কেউ আক্ষেপের স্বরে। সেই কবে মাতামহ
আম্মাকে দিয়েছিলেন এই আলমারি ভালোবেসে
দহেজ হিসেবে। এখন সে আমার কাছেই আছে।

কাপড়-চোপড় কিংবা কাপ-ডিশ রাখি না কখনো
এই আলমারির ভেতরে। শুধু কিছু বই নিয়ে
বুকের ভেতর অভিভাবকের ধরনে দাঁড়িয়ে
থাকে এক কোণে, কোনো কোনো মধ্যরাতে জেগে শুনি
তার কণ্ঠস্বর, যেন ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রফেট
প্রশান্ত ভঙ্গিতে শোনাচ্ছেন গভীর সুসমাচার।

আশৈশব এক আলোকাতরতা

আশৈশব এক আলোকাতরতা লালন করছি
আমার ভেতর। পেঁপে গাছের পাতায় পাতায় ঝলমল
করে যে-আলো, ভোরবেলা
টেবিলে-উপচানো বই আর আমার কবিতার খাতায়
যে-আলো বুলোয় স্নেহার্দ্র আঙুল, অথবা
ডাগর বিকেলে আমার প্রিয়তমার চুলে যে-আলোর
নৃত্যুশোভা দেখি, তা মহান কোনো গ্রন্থের
পঙ্‌ক্তিমালার মতো আলোড়িত করে আমাকে। এবং এখন
আমি বুঝতে পারি
আলোর জন্যে কেন মৃত্যুপথযাত্রী কবির অমন ব্যাকুলতা।

সেদিন আমি আমার সেই বন্ধুর কাছে গেলাম,
একদা যার সঙ্গে কথা বললে
আমার অন্তর হয়ে যেতো রৌদ্রঝলসিত উপত্যকা। এখন তিনি
সাফল্যের শেষ ধাপে পৌঁছে দামী তামাকের গন্ধ শুষে-নেয়া
শরীর এলিয়ে দিয়েছেন বাণিজ্য লক্ষ্মীর কোলে। তাঁর
আলো-ঝলমলে ঘরে ঢুকলে চোখ ঝলসে যায় আসবাবপত্রের
জৌলুসে। যথাসময়ে এল ট্রলিভর্তি খাবার আর কফি।
বন্ধুর সিগারেট কেস
ঝিকিয়ে উঠলো জহরতের মতো আর আমি
ফিরে এলাম এক বুক অন্ধকার নিয়ে।

আমি আমার মৃত কবিবন্ধুর একটি পুরানো
কাব্যগ্রন্থ উল্টে পাল্টে দেখছিলাম, কোনো কোনো পঙ্‌ক্তিতে
বুলোচ্ছিলাম চোখ। হায়, একদা
যে পঙ্‌ক্তিমালা আলো ছড়াতো আমার
অস্তিত্বের তন্তুজালে, আর তারা এমন নিষ্প্রদীপ কেন? কেন সেই
বইয়ের একটি পাতাও তারা-জ্বলা আকাশের মতো
হয়ে উঠলো না? আমার মনে পড়লো বন্ধুর
মধুর হাসি, হাতের নড়া,
তাকানোর ভঙ্গি। একজন মানুষের এরকম
ছোটখাটো ব্যাপারইতো গাঁথা হয়ে যায় স্মৃতির
বড়শিতে। অঞ্জলিময়
একঝাঁক নিষ্প্রদীপ শব্দ নিয়ে বসে থাকলাম অন্ধকারে।
আমার অন্য এক বন্ধু আজ বন্দি
কেন্দ্রীয় কারাগারে। অন্ধকারাচ্ছন্ন এই দেশে
ঘরে ঘরে আলো পৌঁছে
দেবার ব্রত নিয়ে তিনি রৌদ্রজলে হেঁটেছেন বাম দিকে।
বছরের পর বছর নিঃসঙ্গতা-ছাওয়া
কারা কুঠুরি ঠুকরে ঠুকরে তাঁকে ভীষণ ক্ষইয়ে দিয়েছে ক্রমাগত-
এখন তাঁর দাঁত নড়বড়, চোখের জ্যোতি
দ্রুত বিলীয়মান। অন্ধকার সেলে অষ্টপ্রহর
ধুঁকছেন তিনি স্বদেশের মতো,
অথচ তাঁর জীবন থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে
অলোকসামান্য যে-আলো
তাতেই আলোময় হয়ে উঠেছে আমার হৃদয়।

 একটি মোনাজাতের খসড়া

হে রাব্বুল আলামীন,
হে লৌকিক, পারলৌকিক আর অলৌকিকের রাজাধিরাজ,
আমার একটি সামান্য ইচ্ছেপূরণের আশায়
আজ আমি আপনার জ্বলজ্বলে পুণ্য আরশ লক্ষ্য ক’রে
সেজদা দিয়েছি। আশৈশব শুনে আসছি,
এই জগৎ সংসারে, সৌরলোকে, আমাদের অজ্ঞাতলোকে
এমন কিছুই ঘটে না, হে রামহানুর রাহিম,
যাতে আপনার সায় নেই। কুল মখলুকাতে
হাওয়া বয় না, নদীতে ঢেউ জাগে না, মাটি ফুঁড়ে
উদ্ভাসিত সুর মঞ্জরিত হয় না,
গান গায় না পাখি,
মায় একটি গাছের পাতাও নড়ে না
আপনার হুকুম ছাড়া।

হে দ্বীন ও দুনিয়ার মালিক, চোখের পলকে,
সে সর্বশক্তিমান, আপনি আমাকে
এমন তৌফিক দিন যাতে আমি
আপাদমস্তক মনেপ্রাণে একজন খাস রাজাকার
হয়ে যেতে পারি রাতারাতি। তাহলেই আমি সাত তাড়াতাড়ি
মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে যাবো, এই চর্মচক্ষে
দেখে নেবো হাতিশালে হাতি আর
ঘোড়াশালে ঘোড়া আর আমার হাতে আমলকির মতো
এসে যাবে সব পেয়েছির দেশের সওগাত।
তবে সে-জন্যে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হবে, হাত
কচলাতে হবে অষ্টপ্রহর আর জহরতের মতো
পায়ের চকচকে জুতোয় চুমো খেতে হবে নানা ছুতোয় সকাল-সন্ধ্যা
এবং মাঝে মাঝে শিন্নি দিতে হবে পীরের দরগায়।
না, না, এতে জিল্লতি নেই একরত্তি, বরং চোখ-ঝলসানো
জেল্লা আছে এই জীবনে। হে আলেমূল গায়েব, হে গাফফার,
আপনি আমাকে এক্ষুনি
একজন চৌকশ রাজাকার ক’রে দিন। তাহ’লেই আমি
চটজলদি গুছিয়ে নেবো আখের।

আপনার চেয়ে বেশি আর কে জানে যে, আমি
জেনাসের মতোই যুগল মুখ নিয়ে
বেঁচে বর্তে আছি। আমার একটি মুখ তেজারতির দিকে
এবং অন্যটি ওজারতির দিকে ফেরানো
যদি ওজারতির তাজ আমার মাথায় আজ
শোভা না পায়, ক্ষতি নেই। সবুরে মেওয়া ফলে,
এই সুবচন জানা আছে আমারও। একদিন না একদিন
আপনার রহমতে আমার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বেই।
আপাতত ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার ওভারড্রাফট পেয়ে যাবো
তদ্বিরবিহীন, আমার বাণিজ্যতরী ভাসবে
সপ্ত সিন্ধুতে আর দশ দিগন্তে দেখা যাবে
আমার সাফল্যের মাস্তুল।

হে পাক পারওয়ার দিগার, হে বিশ্বপালক,
আপনি আমাকে লহমায়
একজন তুখোড় রাজাকার ক’রে দিন। তা’হলেই আমি
দ্বীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায়
তেল ঢালতে পারবো অবিরল,
গরিবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর
মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে
ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগ্ধিদিক আর সবার নাকের তলায়
একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মতো অহর্নিশ
কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো, অবকাঠামো।

কফিন, দোলনচাঁপা এবং কোকিল

হঠাৎ একদিন বারবেলায় এক প্রেস রিলিজ আত্মপ্রকাশ করলো। নগরবাসীদের
জন্যে এটা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। অনেকই ব্যাপারটিকে অলক্ষুণে বলে
ঠাউরে নিলো, যদিও মুখ ফুটে কেউ কিছু বললো না। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো
একটি কফিনের কথা। সেই কফিন নাকি প্রায়শই নজরে পড়ছে লোকজনের।
কখনো চৌরাস্তায়, কখনো পার্কে, কখনো বা এঁদো গলির মুখে দেখা যায়
কফিনটাকে। প্রকাশ, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত চাওয়া হয়েছে এবং
ইতোমধ্যেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রুদ্ধ কক্ষে তদন্ত
কমিটির কাজ শুরু হয়ে গেছে বলে প্রেস রিলিজে জানানো হয়। জনসাধারণ
যাতে ভয় না পান, সে-জন্যে আকুল আবেদন জানানো হয়েছে তাদের প্রতি।
তাছাড়া, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হোক আর না-ই হোক,
ব্যাপারটিকে দৃষ্টিভ্রম হিশেবে ধরে নেয়াই ভালো। প্যানিক ছড়ানে সম্পূর্ণ
নিষিদ্ধ।
টেবিলে রাখা খবরের কাগজ ক্রমাগত চোখ মারছে আমাকে। আমার
নিঃসঙ্গতার সঙ্গে এই ফিচলেমি একেবারেই ভালো লাগছে না। অনেকগুলো
কবিতার বই দিয়ে খবরের কাগজটিকে চাপা দিলাম। অনিদ্রার সঙ্গে
বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার দরুন আমি ইদানীং খুব দেরী করে বিছানায় যাই।
চোখের পাতায় ঘুমের পা পড়তে পড়তে পূবের আকাশে লাগে আবীরের
হালকা ছোপ। তাই মধ্যরাতেও আমি বসেছিলাম চেয়ারে। আমার হাতে
ছিলো প্রাচীন সভ্যতাবিষয়ক একটি বই; উদ্দীপক এবং আধপড়া। প্রাচীন
মিশরের এক স্তোত্রের ওপর চোখ পড়তেই কিসের শব্দ শুনতে পেলাম।
শব্দটি, মনে হলো, বারান্দা থেকে এসেছে। বারান্দার দিকে পা বাড়াতেই
আমার অস্তিত্বে যেন কেউ বরফের পানি ঢেলে দিলো, এপ্রিলের দারুণ গরমেও
আমি হি হি কাঁপতে শুরু করলাম।
বাক-রহিত আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম শিলীভূত মূর্তির মতো। প্রেস
রিলিজ কথিত কফিনটা বারান্দায় শুয়ে আছে মমির ধরনে। সেই মুহূর্তে
রশোমন ছবির গভীর অরণ্যে ছুটন্ত কাঠুরের রৌদ্রেঝলসিত কুড়ালের মতো
একটি কুড়ালের প্রার্থনায় হাটু গেড়ে বসলাম। আমার শোণিতে চেঁচিয়ে উঠলো
এক ঝাঁক কাকাতুয়া। এক কোপে কফিনের ডালা খুলে ফেলবার এক দুর্মর
বাসনা আমাকে দখল করলো। কফিনটার গায়ে খোঁড়া তৈমুরের কালের মাটি
লেগে রয়েছে। আমি কফিনের দিকে এগিয়ে যাবো কি যাবো না ভাবছি, এমন
সময় সেটা নড়ে চড়ে উঠলো আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক
নরকংকাল। কংকালের গায়ে কোনো পোশাক কিংবা উর্দি নেই, নেই বেল্ট
অথবা নক্ষত্রের মতো কোনো পদক, শুধু তার হাতে ঝুলছে নাঙা তলোয়ার।
ব্লিচিং পাউডারের মতো শাদা কংকালের হাতে কারুকাজময় তরবারি অন্ধকারে
ঝলসে ওঠে ঘন ঘন, এক ফোঁটা মর্চে ধরেনি তাতে। আমার দিকে তরবারি
উঁচিয়ে এগিয়ে এল সে আস্তেসুস্থে। মনে হলো, ওর কোনো তাড়া নেই। কিন্তু
আমাকে আঘাত না ক’রে সে প্রবেশ করলো আমার ঘরে, ভরিয়ে তুললো
কাঠের চেয়ারের শূন্যতা। একটু যেন অস্বস্তি-পীড়িত মনে হলো তাকে,
অতিশয় মূল্যবান আসনের স্মৃতি হয়তো ঝিকিয়ে ওঠে করোটির ভেতর।
নরকংকাল ঘেসো কণ্ঠে বললো, “তাজিম শেখোনি তুমি। কেন কুর্নিশ করছো
না আমাকে? জানো, এক্ষুনি তোমার গর্দান নিতে পারি?” কঠোর ধমকের
পরেও আমার শরীর আনত হলো না এতটুকু, আমি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে
রইলাম তরুণ মোরগের মতো। কখন যে এক অসীম সাহসিকতা আমাকে
দত্তক নিয়েছে জানতেই পারি নি। অনধিকার প্রবেশের অপরাধে অভিযুক্ত করে
আমি ওকে সংযত হতে বললাম। কিন্তু সংযম ওর ধাতে নেই। বুঝতে
পারলাম, নিজের কণ্ঠস্বর ওর খুবই প্রিয়। পাথরের নুড়ির মতো কথা ক্রমাগত
ঝরতে থাকলো ওর দন্তহীন মুখ-গহ্‌বর থেকে।
“এই যে একটা কফিন অতর্কিতে হাজির হয়েছে তোমাদের শহরে, এর কি
কোনো অর্থ নেই ভাবছো? এই যে আমি তলোয়ার হাতে আবির্ভূত হয়েছি
মধ্যরাতে একি তাৎপর্যহীন মনে করো? এই অসির আঘাতে কংকালে পরিণত
হবে অসংখ্য নরনারী। আমার তলোয়ার খেলা চলবে অহর্নিশ প্রকাশ্যে, কিন্তু
কেউ টের পাবে না। আমি যে-পথ দিয়ে হেঁটে যাবো, সে-পথে জেগে উঠবে
শ্মশানের পোড়া গন্ধ, সারা শহর বিবমিশায় আক্রান্ত হবে লাশকাটা ঘরের
উৎকট গন্ধে। সকল সাহিত্য ও শিল্পকলা ভবন হয়ে শৌচাগার। শ্রাবণের
মেঘের মতো পঙ্গপাল নেমে আসবে তোমাদের প্রত্যেকটি ফসলের ক্ষেতে।
তোমাদের জলাশয়গুলো শুকিয়ে বিষবাষ্প ছড়াবে দশদিকে। শস্যের
গুদামসমূহ উজাড় হয়ে যাবে চোখের পলকে। লক্ষ লক্ষ শিশু ক্ষুধায় কেঁদে
উঠতে চাইবে, কিন্তু আমি ওদের কাঁদতে পর্যন্ত দেবো না। সকল হাসি, কান্না,
শোকপালন, প্রেমিক-প্রেমিকার আলিঙ্গন, কোবিদের চিন্তা, কবির উচ্চারণ-
সবকিছু নিষিদ্ধ করে দেবো।
নরকংকালের ঘেসো কণ্ঠের শব্দস্রোত আমাকে রূপকথার পাথুরে মূর্তিতে
রূপান্তরিত করলো। আমার মুখ থেকে একটি কথাও নিঃসৃত হলো না, শুধু
নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। এই কংকাল দুর্বাসাকে কনুইয়ের গুঁতো
দিয়ে চলে যেতে পারে যোজন যোজন দূরে। দেখলাম, নরকংকাল কাঠের
চেয়ার ছেড়ে তরবারি দোলাতে দোলাতে আবার শুয়ে পড়লো কফিনের
ভেতর, বন্ধ হয়ে গেল ডালা। তারপর কফিন ভেসে চললো মেঘে মেঘে।
সারারাত ঘুম হলো না এক ফোঁটা। চোখে একরাশ মরিচের গুঁড়ো। বেলা
বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাতের অতিথির খবর জানানোর জন্যে রওয়ানা হলাম
সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রের দপ্তরের দিকে। এক ধরনের আশংকা ও
উদ্দীপনা আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। যেন এক বেনামি সংকটের ছায়া ঘিরে
ধরেছে রাজধানীকে এবং এক্ষুনি চোখে পড়লো একটা কফিন, যার গায়ে
লেগে রয়েছে খোঁড়া তৈমুরের কালের মাটি। কফিনটাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে
একগুচ্ছ দোলনচাঁপা আর এক ঝাঁক কোকিল। কোকিলের ডাকে ঝংকৃত হচ্ছে
রাজধানীর আকাশ। দোলনচাঁপার ঘ্রাণ মাদকতা ছড়ালো হাওয়ায় হাওয়ায়।

আমার আর খবরের কাগজের অফিসে যাওয়া হলো না।

 কৃতাঞ্জলি

হেঁটে যেতে যেতে মধ্যপথে অকস্মাৎ
বলেছিলে, ‘ওদিকে যেও না তুমি কস্মিনকালেও,
সেদিকে অনেক
খানাখন্দ, চোরাপথ আছে’ আর তখুনি আমার
চোখ থেকে ঝরে গেলো ফুলের পাপড়ি সমুদয়
তোমার উদ্দেশে।

‘সেখানে সন্ধ্যায় তুমি যেও না কখনো
সেখানে বাঘের ভয় আছে’, ব’লে তুমি
সতর্ক করেছো
আমাকে সূর্যাস্ত; আমি চোখে বেলাশেষের আবীর
মেখে নিয়ে, বাজিয়ে সোনালি ঘণ্টা তোমার উদ্দেশে
ফিরে গেছি লোকালয়ে মূলত আশ্বস্ত পর্যটক।

অথচ আমার পাশে সেরে নেয় মধ্যাহ্ন ভোজন মাঝে মাঝে
যে-জন, মেলায় গলা আমার গলায়, শিস দিয়ে
বাজায় পুরানো সুর, সে-জনই শীতল হন্তারক,
এ সরল সত্য আমি তোমার চোখের
ভাষা এতবার পাঠ করেও হে বন্ধু, হে শুভার্থী সহচর,
ঘুণাক্ষরে জানতে পারি নি।

কোথাও পাবে না খুঁজে কেউ

এখানে দাঁড়াও তুমি প্রবীণ অশথতলে, দাঁড়াবার প্রয়োজন থাক
আর না-ই থাক, দাও খানিক বিশ্রাম
পা দু’টোকে, ছায়া মাখো গায়ে, বন দোয়েলের ডাক
শোনো, দেখে নাও গ্রাম
গ্রামান্তের শোভা। কতদিন
আসো নি এমন ছায়াস্নিগ্ধ পরিবেশে।
তোমার পড়ে কি মনে এরকম বিকেলে মলিন
হয়ে-আসা দিগন্তের রেখা থেকে ভেসে
এসেছিল হৃদয়ের তন্তুজাল আলোড়নকারী
সুর, দুটি চোখ
তার দূর শতাব্দীর গহনতা নিয়ে ঝুঁকেছিল জলে, তারই
ছায়া পান ক’রে, তুমি ভুলেছিলে শোক?

তোমার পড়ে কি মনে? মনে
পড়ুক অথবা না-ই পড়ুক, এখন ছায়াবোনা পথে কিছুক্ষণ
থাকো অপেক্ষায়, দূর নীলাকাশ তারার স্পন্দনে
পাবে অন্য মানে, মায়াবন
চকিতে উঠবে জেগে পথপ্রান্তে। উড়ুক্কু মাছের ঝাঁকে ছেয়ে
যাবে দশদিক, অস্তগামী
সূর্যের ললাট বেয়ে
নামবে রঙিন সুতো, হৃদয়ে বুলোবে তুলি কে শিল্পী বেনামি।
অথচ এখানে তুমি খুব বেশিক্ষণ পারবে না
দাঁড়াতে, হঠাৎ ভয়ে কাঁটা
দেবে গায়ে; কেমন অচেনা
লাগবে সকল কিছু এক লহমায়; পায়ে হাঁটা
পথ হয়ে যাবে ঝড়ক্ষুব্ধ খর নদী, এ গ্রাম নিমেষে
ভীষণ তলিয়ে যাবে পৌরাণিক অন্ধকারে। তুমি
থাকবে দাঁড়িয়ে ঠায় বাজপোড়া মানুষের মতো অবশেষে;
কোথাও পাবে না খুঁজে কেউ এতটুকু চেনা ভূমি।

গল্পটি আমার প্রিয়

(বদরুদ্দীন উত্তম বন্ধুবরেষু)

গল্পটি আমার প্রিয়, আপনার কেউ
সে-গল্প জানেন কিনা জানি না, যদিও দীর্ঘকাল
আগেই শুনেছি আমি,
শুনেছি অনেকবার। প্রকৃত প্রস্তাবে, বলা যায়,
গল্পটি পুরানো খুব, লোক মুখে প্রকাশিত, ভিন্ন ভিন্ন দেশে
ভিন্ন ভিন্ন এর রূপ, সারবস্তু অভিন্ন যদিও।

গল্পটি রাজার বটে, তবু
সেটাই আসল কথা নয়। রাজার জায়গায় অন্য
কোনো প্রভু, ধ’রে নিলে
ক্ষতি নেই, হেরফের হবে না কিছুই।
গল্প বলবার কলাকৌশল আমার
অনায়ত্ত, তাই
যদি হয় ভুলচুক, যদি বাদ পড়ে যায় কোনো
গূঢ় কথা কিংবা খুঁটিনাটি,
তাহলে মিনতি করি, আমাকে মার্জনা
করবেন।

শুনুন তাহলে বলি, একদা কোথাও কোনো দেশে-
দেশটির নাম পেটে আছে, মুখে নেই-
ছিলেন সুকান্ত এক রাজা, মস্ত বড় রাজ্যপাটে
তাঁর ছিল শান্তি মৃত পায়রার মতো। রাজদণ্ড
ধরতে ছিলেন তিনি দড়, যদি কেউ
বলতো সে দণ্ড
ঈষৎ রয়েছে ঝুঁকে ডানে, তা হলেই
দ্বিধাহীন তিনি পাঠাতেন তাকে কারাগারে হাওয়া
খেতে, বিবেচনা ছিল তাঁর;
না হলে শূলেই চড়াতেন হেসে খেলে। সে-দেশের
কারাগার ছিল বড়োসড়ো,
কানায় কানায় ভরা বানডাকা নদীর মতন।

প্রজারা একান্ত বশম্বদ, বিশেষত
আমাত্য প্রবর যারা এ-ব্যাপারে তারা
তুলনা-রহিত আর কবিরা দাক্ষিণ্যে তাঁর, সকলেই নয়,
পুষ্ট, অতি তুষ্ট; ধনী মহিলার কোলাশ্রয়ী সুশ্রী
কুকুরের মতো ওরা। কলাবিৎদের
ছলাকলা দেখে তাঁর
কাটতো সময় বেশ, দিতেন বাহবা প্রায়শই,
কখনো হতেন হেসে কুটি কুটি, যেন কৌতূহলে
দেখছেন মঞ্চে সুসজ্জিত রঙচঙে
ভাঁড়ের মিছিল।

আবার মার্জনা চাই, গল্পটি মূল
বিষয়ের থেকে আমি এসেছি কিঞ্চিৎ দূরে সরে।
আসলে সে মহারাজ দানখয়রাতে
ছিলেন উৎসাহী বড়ো, দয়ার শরীর তাঁর, দীন
দুঃখীদের কষ্টে অতিশয়
বিচলিত হয়ে নিয়মিত গণভিক্ষা
দিবস পালন ক’রে মনোভাব কমাতেন কিছু। মহারাজ
অকাতরে বিলোতন ধন
প্রজাদের মাঝে, ধনী কি নির্ধন সকলেই খুব
হন্তদন্ত হয়ে
জুটতো বিশাল দানসত্রে যথারীতি। কাড়াকাড়ি
শুরু হতো প্রসাদলোভীর সে দঙ্গলে।

একদিন
একটি বালক ছিল সেই সম্মিলনে, তার চোখে
দুপুরের রৌদ্র-ঝলসিত
নদীর পানির মতো দৃষ্টি ছিল, সমস্ত শরীরে
আরণ্যক রহস্যের স্পর্শ ছিল। কেউ তাকে

আমলে আনে নি,
উটকো বালক ভেবে দিয়েছে সরিয়ে দূরে তবু
সে বালক ঘোরে আশেপাশে,
দ্যাখে জমকালো দৃশ্যাবলি। কখনো-বা
বাজায় সে ভেঁপু,
নদীর ঢেউয়ের মতো আসে আর যায়,
যেনবা মজার খেলা পেয়ে গেছে ভিক্ষার উৎসবে।

গৃহদাহ

একজন অতিশয় নিরালা কবির
কবিতা পাঠের ভিড়ময়
মজলিশে সারা গায়ে রজনীগন্ধার
শুভ্রতা জড়িয়ে ফুল্ল স্তনভার নিয়ে
তুমি এসেছিলে, যেন লোড শেডিং এর রাতে
বিদ্রোহী পূর্ণিমা। সুকণ্ঠের প্রতি এমনকি অনামন্ত্রিত
লতাগুল্ম পাতা কান পাতে;
তখন নিসর্গ প্রীত ছিল।

কপালে খয়েরি টিপ, হাতে আধপড়া
কবিতার বই, বুকে চাঁদ
নিয়ে তুমি খুব অন্তরালে
থেকেও সেখানে বড় বেশি প্রকাশিত
ছিলে; জ্বলজ্বলে টিপ বাসনার ডালে
পাখি হয়ে ডাকে, সে ডাকের হাতছানি পেয়ে কবি ভীত নন
জতুগৃহে যেতে;
আপাতত বাসের টিকিট কেটে যান তিনি বাল্যকাল পেতে।

গভীর রাত্তিরে আসমান ফেটে ধু-ধু বৃষ্টি পড়ে
অবিরল। কবি ঘরে নেই;
যদিও কোথাও নেই তার ঘর, তবু জলের প্রবাহস্নাত
রাতে হলো তার গৃহদাহ।

গোলাপ গাছ

কৈশোরের একটি গোলাপ গাছ আজো
আমার ভেতরে কিছু গোলাপ ফোটায়। মাঝে-মাঝে
বিষাদের মেঘে এসে বসে, বিবাগী স্মৃতির মতো
উড়ে যায়; কখনো আবার বুকে খুলে
দেখায় রুগ্‌ণতা, পদর্শনী
বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভেবে গোলাপ আমার কাছে
স্বপ্ন দাবি করে,
দাবি করে তৃতীয় প্রহরে গূঢ় গোপন শুশ্রুষা।

আমার বুকের রক্তে তার
হোলি খেলা দরকার ব’লেই প্রতীক্ষায়
পাপড়ি মেলে রাখে,
কামাবিষ্ট তরুণীর স্তানাগ্রের মতো
যাবতীয় কুঁড়ি তুলে ধরে,
কখন আমার বুক হয়ে উঠবে কাটার বাসর।
সকল সময় নয় কখনো সখনো,
যখন সর্বস্ব
খুইয়ে একাকী বসে থাকি বাসনার কবরের এক পাশে,
সে গোলাপ গাছ দুলে ওঠে, পুরানো বন্ধুর মতো
দূর মরীচিকা ঠেলে এসে
আমাকে নিবিড়
আলিঙ্গন করে, আমি তাকে শরীরের
প্রতি রোমকূপ দিয়ে দেখি। পিকাসোর
ছবির মতোই পেয়ে যায় নানা মাত্রা কিউবিস্ট আচরণে
ফুলের রমণী আর এও তো জেনেছি
কাল বৈশাখীর ক্রুর ক্রীড়ায় দলিত
মথিত হয় সে বারংবার, কিন্তু হয় না নির্মূল।

তার পাতা ঝরে গেলে ঝরে
হৃদয়ের পল্লব আমার; নিমীলিত হলে তার
চোখ, জ্যোতিহীন হয়ে যায় আমার দু’চোখ, আমি
তার শাখা প্রশাখায় যখন দেখি না
উন্মীলন অপরূপ, দেখি কৃষ্ণ মেঘ,
তখন আমাকে স্থবিরতা শ্মশানে বসিয়ে রাখে,
স্বপ্নগুলি ভাঙা কলসের মতো দু’পায়ের ফাঁকে ইতস্তত
পড়ে থাকে। সে আমার কবিতার সমান বয়সী।

ঘর-বাড়ি ধ্বসে পড়ে

জ্যোৎস্নায় কোথাও আচমকা ঘর-বাড়ি ধ্বসে পড়ে।
ঘর আর থাকে না ঘরের
ভেতরের, দেয়ালগুলি হতাশার মতো পড়ে থাকে
ইতস্তত, বাস্তুসাপ চোরা
গর্তে ঢুকে অন্ধকারকেই
সমর্থন করে।
স্টেচারে সারল্য শুয়ে আছে, ব্যাণ্ডেজের অন্তরাল
থেকে প্রস্ফুটিত করুণার মুখ, অ্যাম্বুলেন্সে ঘোরে
স্টিয়ারিং আজরাইলের
হাতে, ভেঁপু বাজে বারবার। পথচারী
বিস্মিত দাঁড়ায় ঘুরে, পুরানো কাগজ
সংকীর্ণ, রাস্তার দীর্ঘশ্বাসে ওড়ে, ডাস্টবিন চাটে ধৈর্যশীল
কুকুর, ট্রাম্পেটে বাজে বিশ শতকের
একটানা ক্লান্ত অস্তরাগময় গহন পূরবী।

গ্রামীণ জমির আলে, হলুদের বিস্তৃত শোভায়,
ঝোপঝাড়ে সূর্যোদয়-ঝলসিত বিলে,
শহরের ফ্যাক্টরিতে, সিনেমায়, পার্কে, কলোনিতে, আদালতে
অথবা ট্রাফিক আইল্যান্ডে-
কোথায়ও নিশ্চিন্তি নেই। সেই কবে থেকে
হুলিয়া হয়েছে জারী পলাশের রঙের বিরুদ্ধে, কারাগারে
ঠেলে দেয়া হয়েছে যুবার
স্বপ্ন মঞ্জরীকে, কিশোরীর শুচিতাকে যুপকাটে
বলি দেয়া হচ্ছে প্রকাশ্যেই। স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার
প্রক্রিয়া বিষয়ে যারা
প্রত্যহ কথার বুটিফুল ফোটার জনসভায়
তারাই সহজে
বানায় নরক আশেপাশে। পথে-ঘাটে
ভিড়ে বাড়ে প্রতিদিন, লোকে লোকারণ্য চতুর্দিকে,
অথচ কী এক নিঃসঙ্গতা
ছেয়ে থাকে ঘন কুয়াশার মতো, প্রত্যেকে বিছিন্ন প্রত্যেকের
থেকে, হাত ধরবার মতো হাত নেই
কোনোখানে, যদিও নিয়ত সেতুবদ্ধনের গান
মঞ্জরিত গলায় গলায়,
প্রকৃতি দেখার মতো চোখ নির্বাসিত,
অনুভব করবার মতো
হৃদয়ের বড়ই অভাব আজ পাথরের দেশে।

আমাদের ক্লান্ত ছায়াগ্রাস্ত চোখে আনে
মরীচিকা আজকের ইতিহাস প্রহরে প্রহরে;
রক্তাক্ত কাদায় পা আমার
ডোবে বারবার, দৃষ্টি যায় গুল্মোরের ডালে ডালে,
কখনো বা মজা খালে। মনে হয় আমি যেন তাদেরই মতন,
মৃত যারা খৃষ্টের মৃত্যুর ও বহু আগে।
চিবুক ঠেকিয়ে হাত বিষাদ নিমগ্ন, এমনকি
পাখির খুশির নাচ,
পদ্মের সংরাগও তাকে পারে না ফেরাতে
উল্লাসের দিকে। এ শহরে ক’জন মানুষ আছে
যাদের জিভের
ডগায় সাপের
জিভের তীক্ষ্মতা নেই? ক’জন মানুষ হেঁটে যায় কুটপাতে
যারা কেউটের বিষ ঠোঁটের আড়ালে
জমিয়ে রাখে নি? আজ ক’জন স্বজন পাবে অলিতে গলিতে,
যাদের দেখলে নেকড়ের পাল যাবে না পালিয়ে?

ভয় বিস্ফারিত চেখে চেয়ে থাকে সকল সময়; কেউ যেন
বলে যায়, এখন কোথাও কারো পরিত্রাণ নেই।
কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা এখন
কোন্‌ সেই খাদের কিনারে আত্মবিস্মৃত সবাই
কেউ তা বোঝে না। অপভাষা।
অতিশয় কোলাহল করে, আমাদের
প্রিয় খুঁটিগুলি কী ভীষণ নড়ে যায় বৃদ্ধের দাঁতের মতো
সারাক্ষণ। নৈরাজ্যের পূর্বাভাস পাই
ঈশানের মেঘঢাকা কোণে, ভয় হয়
কোথায় কখন ফের কারুকাজময় ঘরবাড়ি ধ্বসে পড়ে।

 চিত্রনাট্য

ভেবেছিল লোকজন এরকম ব্যাপার স্যাপারে
পরস্পর যা বল্যাবলি করে, অবিকল তা-ই
আসবে তোমার কানে, অলিগলি কিংবা হাটে মাঠে
পল্লবিত হবে স্বাদু সাত কাহন কাহিনী।

শ্মশানের ধুলো থেকে উড়ে-আসা বিদঘুটে পাখি
আমাকে ভীষণ ঠোকরাবে, চাঁড়ালের ভাঙ্গাচোরা
কলসের মতো আমি থাকব বিস্রস্ত প’ড়ে আর
পালতোলা নৌকা দ্রুত এগোবে নদীর পানি কেটে,-

এবং আমার আর্তনাদ অবসন্ন মাঝি কেউ
শুনতে পাবে না, এরকম চিত্রনাট্য মনে মনে
করেছিল তৈরি, লঙশটে আমাকে দেখবে তুমি
বোতল, গ্লাসের সঙ্গে, এমন প্রত্যাশা ছিল কিছু।

চিত্রনাট্য ওলোট পালোট হলো। দিন কাটে আজো
গুণীর তানের মতো, দাড়ি কাটি প্রত্যহ সন্ধ্যায়,
বন্ধু বান্ধবের কাছে যাই, অবশ্য স্বীকার করি
নিজের ভিতরে পুড়ি, ফিনিক্সের মতো একা পুড়ি।

 চিড়িয়াখানার কিউরেটার সমীপে

প্রথমেই আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আমরা
শহরবাসীরা চিড়িয়াখানার এরকম
উন্নয়নে যারপরনাই আনন্দিত। নগরপ্রান্তে
আপনারা স্থাপন করেছেন আরণ্যক সৌন্দর্য। নিসর্গের
সাবলীল তানে মুগ্ধ হয়ে সেখানে
কাটানো যায় প্রহরের পর প্রহর। নানা ধরনের
গাছপালা উৎপীড়িত স্নায়ুর শুশ্রূষা করে
আর নতুন ব্লেডের মতো চকচকে ঝিল শরতের রোদে
ঝিলমিল, সেখানে ডেরা বেঁধেছে বহুদূর থেকে আসা
জলচর পাখির ঝাঁক।

সত্যি বলতে, আপনাদের প্রশংসনীয় ব্যবস্থাপনায়
বেশ ভালোই আছে বাঘ, ভালুক, সিংহ
হাতি, গণ্ডার, জলহস্তী আর
রঁদার ভাবুকের মতো শিম্পাঞ্জী আর অনেক কিসিমের
বানর, ওরাং ওটাং মাঝে মাঝে
দোল খায়। খাঁচায় ফিরে আসে আরণ্যক স্মৃতি।
জিরাফ, জেব্রা আর এমু নিজেদের
স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে দিন কাটায় নিজ নিজ এলাকায়,
বিভিন্ন হরিণ সৌন্দর্যের ঢেউ বইয়ে দেয়
ঘাস-অলা জমিতে। হরিণের কাছাকাছি চরে
সম্বর, নীল গাই। ময়ূর, সারস, টিয়ে, ক্যানারি
আর অন্যান্য পাখি দেখে কৌতূহলী দর্শকদের
চোখ জুড়ায়। খুব দক্ষতার সঙ্গে, বলা যায়,
এদের দেখভাল করা হচ্ছে। চিড়িয়াখানার
প্রতিটি বাসিন্দার জন্যেই
বারাদ্দ হয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দাবার,
ঘড়ি দেখে ওদের খাওয়ানো হয় প্রতিদিন। তাছাড়া
ওরা অসুস্থ হ’লে আছে নামী-দামী চিকিৎসকের বিধান।

চিড়িয়াখানার এই সুপরিকল্পিত সৌন্দর্য,
যা আমাদের মোহগ্রস্ত করে,
যা আমাদের ভেতরে আদিমতার আড়মোড়া ভাঙার
অবকাশ তৈরি করে, জীবজগতের সঙ্গে
আমাদের সম্পর্কের ঝালর সৃষ্টিতে এক কুহকপ্রবণ
সিনারিও নির্মাণে উদ্দীপনা-জাগানিয়া,
আপনাদেরই সুকৃতির নিদর্শন। এ-জন্যে সকল প্রশংসা
আপনাদের অবশ্যপ্রাপ্য।

যদি কিছু মনে না করেন, তাহ’লে
আপনাদের বিবেচনার জন্য সামান্য একটি প্রস্তাব
পেশ করতে পারি। নিসর্গের শপথ, উদার
আরণ্যক সৌন্দর্যের শপথ, আপনাদের কমিটিতে
এই প্রস্তাব গৃহীত হ’লে
চিড়িয়াখানা সবদিক থেকে নিখুঁত হয়ে উঠবে।

আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, এ শহরে
এমন কিছু প্রাণী আছে, যারা দেখতে অবিকল
মানুষের মতো। ওরা বড়ই হা-ভাতে, দোরে দোরে
ধর্না দেয় একটু ভাতের জন্যে, পাড়ায় পাড়ায়
ছড়ায় বিরক্তি, যা নোংরা,
দেখলেই বিবমিষা হয়। মাদার তেরেসার সম্মান দয়া করে ওদের একটু
ঠাঁই দিন আপনাদের চিড়িয়াখানায়। বানিয়ে দিন
বড়োসড়ো একটা খাঁচা, সংখ্যায় ওরা নেহাত
কম নয়। নিয়মিত কিছু খাদ্য বরাদ্দ করুন ওদের জন্যে।
তাছাড়া উপরি হিসেবে ওরা পেয়ে যাবে
দর্শকদের কাছ থেকে ছোলা আর কলা। দেখবেন
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওরা আপনাদের
সুন্দর, সুশোভিত চিড়িয়াখানার
জীবজন্তুরদের মতোই হয়ে উঠবে নান্দনিকভাবে দর্শনীয়।

ডুবসাঁতার

এ কেমন খেলা আমি খেলতে গেলাম সোজাসুজি
বাজি রেখে সব পুঁজি? এখন আমার
সারা গায়ে চন্দনের মতো
লেপা হয়ে গেছে থিকথিকে কাদা। কারা
এ ভূষণ দিলো
আমাকে এমন অবেলায়?
কেউ নয়। কারুর মুণ্ডুর দিকে তর্জনী দেখিয়ে
সাত ঘাটে সাতটি শিখণ্ডী
খাড়া ক’রে মোক্ষলাভ হবে না আমার। খোলাখুলি
কবুল করাই ভালো,
নিজেই ভিজেছি আমি এক হাঁটু পানিতে এবং
সারাক্ষণ দশচক্রে মেতেছি তুমুল ঝাঁপতালে।

নিজের মমির মতো শরীরে বুলিয়ে চোখ ভাবি,
সূর্য ডোবে ডুবুক, এখনো
গহীন নদীতে গিয়ে ডুবসাঁতারের
লগ্ন আছে। পেছনে পেছনে
একটি কুকুর যদি সাঁতরে চলে আসে,
ক্ষতি নেই। তাকে আমি ফিরিয়ে দেবো না।

দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে

নিজের ব্যাপারে বলা যায়, ভালোবাসি ভালোবাসি
বলে আমি ফাটাই নি গলা,
দিই নি শ্লোগান পৌরপথে কোনোদিন। পেশাদার
প্রেমিকের মতো টেরি কেটে, পারফিউম ছড়িয়ে
গায়ে লটপট
করিনি তোমার সঙ্গে। অথচ যকন বৃষ্টি নামে
দিগন্ত ডুবিয়ে আর রৌদ্রের আবীর
ঝরে শরতের ক্ষেতে, শিমুল রাঙিয়ে
দেয় গ্রাম্য পথ, বালকেরা দৌড়ে যায়
শর্ষে ক্ষেতে আনন্দের ঢেউ তুলে, তখন তোমাকে
হৃদয়ের সকল উষ্ণতা
অধীর অর্পণ করি, তোমারই উদ্দেশে নিত্য ফোটাই গোলাপ।

যেদিন তোমার বস্ত্রহরণের পালা
শুরু হলো, তোমার চুলের মুঠি ধ’রে পৈশাচিক
উল্লাসে উঠলো মেতে মদমত্ত বর্বরেরা, সেদিন যাদের
চোখ ক্রোধে রক্তজবা হয়ে উঠেছিল লহমায়,
তোমার গ্লানির কালি মুছে দিতে যারা
হলো শস্ত্রপাণি, আমি তাদের করেছি সমর্থন
সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে। তোমার কান্নার পরে দেখি
বৃষ্টিধোয়া রক্তগোলাপের মতো ফুটে আছো তুমি।

তোমার গোলাপে যারা ছড়িয়েছে কীট
সকল ঋতুতে আর দিনরাত্রি উপহাসে তোমাকে বিঁধেছে
শজারুর কাঁটায় কাঁটায়,
তোমার দুর্দিনে যারা শক্রদের হাতে হাত রেখে
খেলেছে করোটি নিয়ে ভুতুড়ে জ্যোৎস্নায়,
এবং তোমাকে চড়িয়েছে
সোৎসাহে নীলামে,
যেমন অতীতে লোভাতুর বণিকেরা লুণ্ঠিতা রূপসীদের
ক্রীতদাসীদের মতো বেচাকেনা করতো বাজারে
দিনারের বিনিময়ে, তারাই এখন
সর্বদা তোমার সঙ্গে লতকা লতকি করে আর
তোমার সাধের লাল গোলাপের জন্যে যারা হুইল চেয়ারে
পোহায় যৌবন, দ্যাখে অস্তরাগ, তাদের দিয়েছে ঠেলে ব্যাপক
ভাগাড়ে,
সর্বদাই প্রস্তুত তাদের জন্য শত কাঠগড়া।

বিবরে লুকিয়েছিল যারা গির্জের ইঁদুর হয়ে
ইদানীং তারা বনবেড়ালের রূপে
তুমুল ঝাঁপিয়ে পড়ে শান্তির চাতালে,
যখন তখন
বসায় নখর দাঁত জায়মান সৌন্দর্যের গোলাপি গ্রীবায়।
এখন লুকাতে চাই আমি
আরো অনেকের মতো মেঘের আড়ালে,
মেঘনার তলদেশে, শস্যের ভেতরে রাত্রিদিন।

এই উল্টোরথ দেখে, শপথ তোমার
প্রেমের, আমার আজ বড় বেশি দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে।

ধৈর্যশীল চোখ

ঋতুতে ঋতুতে সূর্য ঠোকরায়, বৃষ্টি আঁচড়ায় যথারীতি
বাড়িটাকে, ছাদের কার্নিশে
পাখি এসে বসে, ডাকাডাকি
করে, ঘরে লেখে একজন,খাতার পাতায় তার
অদৃশ্য মঞ্জীর
বেজে যায়, ঝরে কত নিবিড় আবীর। ট্যাপ থেকে
পানি পড়ে গোসলখানায়, পরীক্ষার্থী পদ্য পড়ে,
কেউ চুল মোছে সদ্য-কেনা তোয়ালেতে, খেতে বসে
ব্রেকফাস্ট কেউ,
কেউ-বা কামাচ্ছে দাড়ি সাত তাড়াতাড়ি, অফিসের
তাড়া আছে। আজকের কাগজটা কই?
আধুনিক কবিতার বই টেবিলে প্রহর যাপে।

ফেরিঅলা ডেকে যায় দুপুরকে উদাস বিধুর
ক’রে দিয়ে, কোনো দরজায় চলে
দর কষাকষি, লেখা ছেড়ে উঠে পড়ে
সেই একজন, বেলা বাড়ে, রেডিওতে হাসন রাজার গান;
মনের ভেতরে তার ভিন্ন ঘরবাড়ি,
লতাগুল্ম ঢাকা,
ছাদ আর দেয়ালবিহীন, মাথা তোলে
দেবতার মতো।
সে যায় নিঃশব্দে হেঁটে বারান্দায়, তাকায় দূরের
আকাশে এবং নীলিমাকে ছন্দের ধরনে করে
বিশ্লেষণ, তার হৃদয়ের কাছে কারো
হাত নুয়ে পড়ে, যেন পুকুরের ছলছলে জলে তন্বী ডাল।

বাড়িটার বয়স অনেক হলো নাকি? ছেড়ে চলে
যেতে হবে কে জানে কখন। বারান্দাটা ঠিকই আছে
আগেকার মতো, মাঝে মাঝে চাপা কান্না বেরোয় দেয়াল থেকে;
ছাদ থেকে পানি পড়ে, ভরা
বর্ষায় আগেও ভেসে যেতো মেঝে, দরজা জানালা
তেমনি আছে, কুলুঙ্গিতে তোলা থাকে কুপি,
শাড়ি নড়ে চৈত্রের দুপুরে;
শুধু যে জানালাটায় চকিতে উঠতো
ভেসে রোজ কোমল মুখশ্রী,
সে আর দেয় না খুলে তার বুক হাট ক’রে সকাল-সন্ধ্যায়;
অথচ সেদিকে তবু চেয়ে থাকে একজোড়া ধৈর্যশীল চোখ।

 পুকুর

পুকুর শুকিয়ে গেলে কাদা জমে কিমামের মতো,
উধাও সকল মাছ। বস্তুত তখন বড়শি বাওয়া
অবান্তর; যদি ফের কোনোদিন কানায় কানায়
ভরে ওঠে সে পুকুর, জাগে বুড়বুড়ি মাছেদের
তাহ’লেই ছিপ ফেলে সুখ; নইলে রোদে পুড়ে আর
বৃষ্টির আঁচড়ে খুব ক্লান্ত হয়ে রিক্ত বেলা যাবে।

মাঝে মাঝে মধ্যরাতে ভয় পেয়ে জেগে উঠে ভাবি
অন্ধকারে চোখে মেলে, অকস্মাৎ আমার পুকুর
বেবাক শুকিয়ে যায় যদি, তবে কী হবে আমার?
প্রত্যহ পড়বে চোখে ফুল্ল গাছপালা, গানে গানে
হবে গুঞ্জরিত দশদিক আর অন্তর্গত হাড়ে
বয়ে যাবে সূর্যাস্ত ঢেউয়ের মতো; অথচ আমার

বুক দীর্ণ হাহাকারে রাত্রিদিন, থিকথিকে কাদা
ছেনে যাবে দীর্ঘ বেলা, হাতে নেচে উঠবে না মাছ।

 বন্দনার পাখি

অন্ধকার তড়িঘড়ি পাততাড়ি গুটিয়ে চলেছে,
যেমন উত্তাল গণআন্দোলনের তোড়ে স্বৈরাচারী
শাসক। আকাশে সেজদায়-যাওয়া
মানুষের মতো চাঁদ
ঝুলে রয়েছে তখনও। আমি পায়চারি করছি
খোলা বারান্দায়, আমার মনের ভেতর
স্মৃতির ফিসফিসানি আর না-লেখা কবিতার গুঞ্জরণ।
সূর্য উঠছে, যেন রঙিন বল,এক ঝাঁক
বুনো কবুতর এসে বসে টিন শেডে
গমের লোভে, হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায়
লাল কাঁকরময় একটি পথ, কুয়াশার ঘোমটাটানা গ্রাম আর
অখ্যাত স্টেশনে লাইনসম্যানের বাতি দোলানো।

তখুনি অসমাপ্ত কবিতার মতো একটি
উদ্ভাসিত তুমি। তোমার শরীরে
সুরমা রঙের বাহার, ভোরের স্পর্শ লাগা সোনালি বাহু
ঝিকিয়ে ওঠে, যখন তুমি সিমেন্ট ফুঁড়ে
বেরিয়ে আসা লম্বা শিক ধরে দাঁড়াও। তোমার মুখ
ভোরবেলাকার চাঁদের মতোই
অস্পষ্ট আমার কাছে, তোমার নাম আমি জানি না।
তবু মনে হয়, সৌন্দর্য তোমার যৌবনে
দোল খায় সারাক্ষণ মৃত্যু উপেক্ষা ক’রে। এখন তোমাকে ঘিরে
কতিপয় প্রজাপতির রঙিন চাঞ্চল্য,
একটি স্বপ্নের নিস্তব্ধ ঝালর আর
একটি স্পর্শকাতর হৃদয়ের স্পন্দন এবং অজস্র অদৃশ্য চুম্বন।

ভাবনার কোন গলি-ঘুপচিতে
তুমি ঘুরছো এখন? হয়তো খুন-হয়ে –যাওয়া কিছু ফুল
কিংবা ঘূর্ণমান পাখার ব্লেডে নিহত
একটি চড়ুই তোমার মনে বুনে দিয়েছে বিষাদ।
আমার কথায় মঞ্জরিত তোমার ভাবনা,
এমন অসম্ভব দাবি আমি করবো না, তবু তোমার খোঁপায়
আমি পরিয়ে দিয়েছি আমার নিঃসঙ্গতা,
আমার আত্মার হাহাকার
জড়িয়ে দিয়েছি তোমার স্তনে, গ্রীবায়, নাভিমূলে, এবং
বন্দনার পাকি বারবার উড়িয়ে দিই তোমার উদ্দেশে।
এই যে ভোরবেলা তোমার যৌবনের আহ্বান
এসে পৌঁছলো আমার কাছে, তুমি জানলে না।

তুমি যখন নেই আমার দৃষ্টিপথে, তখন
শূন্যতায় পাখা ঝাপটাতে থাকে চম্‌কে-ওঠা
বন্দনার পাখি এবং
আমি উদ্ভিদহীন এক বাগান দেখি সেখানে।

বুড়ো সুড়ো একজন

বুড়ো সুড়ো, জবুথবু একজন, তবু জীবনকে
ঘরের দেয়াল ভেবে চুপচাপ দেয়ালের প্রতি নির্নিমেষ
দৃষ্টি রেখে প্রত্যহ থাকেন ব’সে একা
পুরানো সোফায়। বাকপটু বলে খ্যাত
একদা, এখন সব
ঝলমলে বাক্য তাঁকে ত্যাগ ক’রে নিয়েছে আশ্রয়
স্তব্ধতায়। চায়ের পেয়ালা খুব আস্তে সুস্থে তুলে
নেয়ার সময় হাত কাঁপে, শূন্য দৃষ্টি, যেন চোখে
স্বপ্ন দেখবার
ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে চিরস্থায়ী গোধূলির জালে
বন্দি সর্বক্ষণ, পায়ে তাঁর, মনে হয়,
অগণিত নুড়ি এলিজির রূপ ধ’রে ঝরে যায় নিরিবিলি।

দেয়াল, ফ্লাওয়ার ভাস, জানালার পর্দা, বিছানার
চাদর, সোফার রঙচটা
হাতল, পায়ের কাছে আলস্যের মতো শুয়ে-থাকা
কুকুরের ঈষৎ জিজ্ঞাসু চক্ষুদ্বয়-
প্রতিটি বস্তুর কাছে শব্দের গভীর প্রার্থনায়
থরো থরো সমগ্র অস্তিত্ব তাঁর শব্দহীনতার মরুভূমি
পাড়ি দেয়। কখনো-সখনো ঠোঁট নড়ে,
যেন সিনেমার
নির্বাক যুগের অভিনেতা। পুরানো বাড়ির ছায়া
নেমেছে আত্মায় তাঁর, কবে শূন্য নৌকো
দূলবে নদীর বুকে, জানা নেই। মাথার ভেতর
সূর্যাস্ত গলছে ক্রমাগত, অন্য এক
আচাভুয়া পাখি
ওড়ার চেষ্টায় শুধু পাক খেয়ে পড়ে বিরানায়।

গৃহিনী ভোগেন উচ্চ রক্তচাপে, এক পুত্র তাঁর
মুক্তিযুদ্ধে নিহত, অন্যটি মধ্যপ্রাচ্যে ভাগ্যান্বেষী,
এবং আরেকজন গৃহত্যাগী, এক মাত্র কন্যা দিগন্তের
স্বর্ণাভায় চোখ রেখে প্রহর কাটায়,
হৃদয়ের সরোবরে তার
পত্রালি-শোভিত স্বপ্ন নুয়ে আসে। টেবিলে সাজানো
বাদামি বাকরখানি ডিম, অস্ট্রলিয়ান আপেল,
অবশ্য সম্প্রতি তাঁর রোচে না আহার।

অকস্মাৎ মনে হয় তাঁর ঘরময় অজস্র রঙিন প্রজাপতি
চাঞ্চল্যের চিত্র হয়, ঠোঁটে
চকিতে ফিরিয়ে আনে কবেকার চুম্বনের স্বাদ। লহমায়
মগজের ধূসরতা, অনেক হলুদ পাতা সরে যায়। একটি বিকেল
এবং একটি সন্ধ্যা পুরাণের পুনর্জন্মের মতোই জেগে
উঠে মনে ছড়ায় মোহের বীজ। বেলাশেষের রোদ্দুর পায়ে
লোটে আর এক ধরনের নিস্তব্ধতা
ঠুকরে ঠুকরে তাকে ক্রমশ ক্ষইয়ে দিতে থাকে। কিয়দ্দুরে
শূন্য নৌকো দূলে ওঠে, হঠাৎ চৌদিকে
নেমে আসে দিনান্তের কী ব্যাপক বিজন কুয়াশা।

ভাগ্যিস মৃত্যুর সঙ্গে

কী রকম হয় যদি আমি নিউ মার্কেটে অথবা সিনেমায়
না গিয়ে এখন উপকূল এলাকায়
চলে যাই? মনে-মনে যাই নি কি চলে? যদি বলি
টলটলে ঠাণ্ডা জলে নিজের ধূসর তেষ্টা মেটাবার সময় কেবলি
আমার পড়েছে মনে লবণাক্ত ধু ধু উপকূল
এলাকার মর্মমূল-
ছেঁড়া পিপাসার কথা তবে
মিথ্যে বলা হবে?

এই যে রয়েছো প’ড়ে ঝড়ে-ওপড়ানো
গাছের মতোই কিংবা স্ফীতকায়, সম্বিত-হারানো
জলদেবতার মতো, কী তোমার নাম? অসিমদ্দী, আকমল
অথবা গজনফর আলী, নাকি যোগেশ মণ্ডল?
না যা-ই হোক, কী-বা আসে যায়, মৃত্যু কোনোদিন
করে না বিচার ধর্মগোত্র, ক্ষমাহীন
হাতে ছিঁড়ে নেয় অকস্মাৎ
প্রাণের গোলাপ কুঁড়ি। দ্বীপ দীপান্তরে কী ব্যাপক অপঘাত।

যখন প্রকৃতি রুদ্র দেবতার মতো ফেটে পড়ে
ক্রোধে ঘরে ঘরে
ওঠে রোল মরণ কান্নার আর এক লহমায়
জলের অক্ষরে লেখা কবিতার মতো মুছে যায়
অসহায় অসংখ্য জীবন, কিন্তু কী লাভ বলো না দোষ দিয়ে নির্বিকার
প্রকৃতিকে, যখন মানুষই আজ মানুষের সহজ শিকার।

তোমার হৃদয় আজ ফ্রিজে রাখা ফল,
অথচ তোমার ছিল ভালোবাসা, পথের সম্বল
যৎসামান্য, ছিল কিছু গৃহকাতরতা,
আর কিছু বলবার কথা
ছিল প্রিয় বন্ধুকে তোমার। কিন্তু মুখ
থুবড়ে রয়েছো প’ড়ে কী স্বচ্ছ জলের নিচে সব ভুলচুক
অথবা অসুখ ভুলে গিয়ে, জলময় এমন নিঃসঙ্গতায়
আমার চোখের পানি ঝরে অবিরল, মিশে যায়।

পেলে ঠাঁই সাপ্তাহিক টাইমের রঙিন প্রচ্ছদে, আচানক
পেয়েছো সম্মান প্রায় রাষ্ট্রপ্রধানের। অনেকেই খুব শক
পেয়ে থাকবেন গুম হয়ে কিছুক্ষণ
উত্তরে দক্ষিণে, তারপর যথারীতি দেবেন সহজে মন
নিজ নিজ খুঁটিনাটি কাজে।
শুধু মাঝে মাঝে
চলবে ড্রইংরুমে, সম্মেলনে আলোচনা বিরান চরের।
ঘুরবে তোমার এই সুদাসলে-খাটা লাশ বিশ্বময় ঢের
দামী মানুষের হাতে হাতে, ঘরে, ঘরে,
ভাগ্যিস মৃত্যুর সঙ্গে উড়ে গিয়েছিলে ঘূর্ণিঝড়ে।

ভেসে যায় সৌরলোকে

এর পরে কিছু নয়, কিছুই না। পুরানো কবরে
প্রহরে প্রহরে
পাতা ঝরে, ঘাস দীর্ঘ হয়। নতুন কবরে কেউ কী নিবিড়
একটি পুষ্পিত ডাল গুঁজে
দেয়, বাতি জ্বালে, বিড় বিড়
আয়াত আবৃত্তি করে। কেউ কেউ খুঁজে
নিতে চায় কিছু আশেপাশে।
রুদ্রাক্ষের মালা
অথবা তসবিদানা, গলায় ঝোলানো ক্রুশ তীব্র অন্তর্জালা
পারে না মেটাতে ঘাসে ঘাসে
কুয়াশার মতো নীরবতা নেমে আসে;
মেলে না সান্ত্বনা কোনো ধোঁয়াটে আশ্বাসে।

গেছে দলে দলে, যাবো আমিও প্রবাসে। কিন্তু এই
প্রবাস কথাটা লিখে ফেলে একরত্তি স্বস্তি নেই;
কী করে প্রবোধ দিই নিজেকে এখন? বাস্তবিক
দেখি না আমার ঘরে স্বর্গের প্রদীপ। দিগ্বিদিক
ছুটে মরি, সবগুলো খুঁটি
লুপ্ত আজ, ছিঁড়ি কুটি কুটি
বাতিল দলিল;
মহাজনী কূটকচালের ভাষা, মিল ও অমিল
ভেসে যায় সৌরলোকে, পায়ের তলায়
মাটি কাঁপে সর্বক্ষণ, যায় সবই যায়।

ফিরবো না; মিনিবাসে পথ চলা, ছায়ায় দাঁড়ানো
এবং হারানো
ফুলের সুগন্ধ পেয়ে সন্ধ্যেবেলা দূরে চেয়ে-থাকা,
শহরতলীতে তালপাখা,
আষাঢ়ে মাটির ঘরে মধ্যাহ্ন ভোজন,
যোজন যোজন
দূরে তার হাতে হাত রেখে
ঝকঝকে দুপুর বেলায়
গল্পের ভেলায়
ভেসে-যাওয়া, পড়শির দেনা
থাকবে না।

অতর্কিতে ঘরে কি বাইরে দেবে হানা
মেলে কৃষ্ণ ডানা সে অজানা,
নিমেষে ফেলবে ঢেকে
সত্তা, তাই গাছের রসাল ফল এবং তৃষ্ণার টলটলে
জল ঝলমলে
পাশের ফ্ল্যাটের সদ্য যুবকের গিটার বাজানো,
তারায় সাজানো
আকাশ, রোদ্দুরে স্মিত গলি, পরস্পর মেশামেশি
ছুটির দুপুরে আর ভিডিও ক্যাসেটে ফিল্ম দেখে হাসাহাসি
এবং চায়ের কাপে বিলাসী চুমুক ভালোবাসি
আরো বেশি।

মগজে গোধূলি আর হাড়ে রঙিন কুয়াশা

মগজে গোধূলি আর রঙিন কুয়াশা নিয়ে
মলিন চপ্পল পায়ে ফিরে আসি। অন্ধকার ঘরে
(ইদানীং লোড-শেডিং-এর
পেখম ছড়িয়ে পড়ে যখন তখন)
কল্পনায় তোমার সম্ভ্রান্ত মরীচিকা হ’য়ে
আমাকে ভীষণ
লোভাতুর ক’রে তোলে। কিছুক্ষণ পায়চারি ক’রে
সময় কাটিয়ে দিই, আকাশ পাতাল
ভাবি, মনে পড়ে যায় ডিগ্রির সোহাগে
লালিত যৌবন
জনকের সরাই খানায়
কেটেছে একদা কর্মখালি
বিজ্ঞাপন প’ড়ে, মনে পড়ে বলীরেখাময় বয়েসী পিতার
অত্যন্ত বিকৃত মুখ ধিক্কারের ঝড়ে, একা একা
গৃহকোণে জননীর অশ্রুপাত, উদাসীন আমি
তোমারই রূপের ধ্যানে কাটিয়েছি রভসে প্রহর।

এখন গোঙাই শুধু, দুর্বহ বোঝার ভারে পিঠ
বেঁকে আসে; ছা-পোষা জীবনে
বয়ে যায় কবরখানার
বাতাসের মতো দীর্ঘশ্বাস। তুমি যাকে একদা লিখেছো চিঠি
রঙিন কাগজে তাকে আজ এই বিবর্ণ প্রহরে
দেখলে হারিয়ে-যাওয়া প্রেত ভেবে সুনিশ্চিত
দূরে সরে যাবে ভয়ে। তাকে
সারাক্ষণ ঠোকরায় কালবেলা, সঙ্গ দেয় নিঃসঙ্গ বেড়াল;
অসুস্থতা কেবলি জাগিয়ে রাখে তাকে। মাঝে-মাঝে
তোমার সুদূর মুখ নুয়ে আসে মুখের ওপর।

জীর্ণ ঘরে শুয়ে ভাবি
বাবুই পাখির বাসা, অতিদূর শৈশবের সাঁকো,
তোমার নরম হাত কবেকার, আর সেই মানুষটি যার
পকেটে থাকতো টিয়ে পাখি, গাঢ় সবুজ রঙের
পানিফল, স্তব্ধতাকে ভাই ব’লে ডাকতো সে, পাখির ঝাঁকের
ভেতরেই ছিল তার আপন নিবাস।

অপেক্ষা করেছি, কিন্তু আসে নি এমন লগ্ন যার
স্পর্শে বিজ্ঞ হয়ে ওঠে ঘরের দেয়াল, লহমায় গান গায়
আমার ভেতরকার হাড়,
বেলকুঁড়ি হয়ে যায় দূরের চাতক, কুয়াশায়
মাঠ দিয়ে একাকী চাষির মতো হাঁটে,
কুড়ায় ফ্যাকাশে ফল বনের কিনারে নিরিবিলি
ধৈর্যশীল চাঁদ। মাঝে-মধ্যে
আমার পায়ের পাতা হেসে আমাকেই প্রশ্ন করে-
ক’দিন থাকবে আর? আমি শুধু বোকার ধরনে
পায়ের পাতার দিকে চেয়ে থাকি, কিছুতে পাই না
খুঁজে কোনো কথা,
অপেক্ষায় থাকি কোন্‌ অজ্ঞাত প্রহরে
দাঁতে বিঁধে নিয়ে যাবে আমাকে চকিতে
দ্বিতীয়ার চাঁদ।

 রাজা, তুমি

রাজা, তুমি আমার উদ্দেশে
ছিটিয়ে বিস্তর থুতু নিমেষে করেছো নোংরা মোজেইক-করা
মেঝে বারবার, সেই থুতু
তোমার পোশাকে পড়ে মাঝে-মাঝে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ
নেই মোটে, অলিন্দে অলিন্দে
ছোটে শত আমাত্য, নোকর, ভাবে কী ক’রে তোমার
ক্রোধের আগুনে ওরা ঢালবে শীতল জলধারা।

রাজা, তুমি আমার উদ্দেশে
পাঠিয়ে দিয়েছো
তোমার মহল থেকে বাছা বাছা ডালকুত্তাদের,
বৈশাখী ঝড়ের মতো তেড়ে ওরা আসছে আমাকে
ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে পলকে,
যেমন উন্মাদ ফালি ফালি করে ফেলে
জামা কোনো দুঃস্বপ্ন-তাড়িত ক্রোধে। অথচ আমার
কাছে এসে সেই রক্তপিপাসু জন্তুরা
ভেড়ার ধরনে ঘোরে ইতস্তত, করে না কিছুই।

রাজা, তুমি আমার উদ্দেশে
পাঠিয়ে দিয়েছো
ভাড়া-করা তোমার তুখোড়, টগবগে
তলোয়ারবাজদের। চকিতে তাদের অসিধার
ব্রতে ধরে চিড়, ওরা অস্ত্র সমর্পন করে। অথচ আমার
অস্ত্র নেই কোনো, শুধু রাজহংসের পালকে তৈরি
একটি কলম আছে যার
ওপরে রাক্ষস নয়, দেবদূত করে ভর মায়াবী প্রহরে।

রাজা, তুমি আমার উদ্দেশে
পাঠিয়ে দিয়েছো ছদ্মবেশী জ্ঞানী-গুণীদের যারা
আমাকে সবক দিয়ে তোমার সাধের
বাগান বাড়িতে নিয়ে যেতে
এসেছেন, যাতে আমি বুঁদ হয়ে তোমার পায়ের কাছে
হামাগুড়ি দিই কিংবা কুঁই কুঁই করি সারাক্ষণ।

কিন্তু রাজা, আমি
কস্মিনকালেও সেই বাগান বাড়িতে
যাবো না অথবা মোজেইক-করা তোমার মেঝেতে
কুকুরের মতো গড়াগড়ি
দেবো না নিশ্চিত। আমি মাথা উঁচু ক’রে
দাঁড়াবো তোমার মুখোমুখি। দ্বৈরথে শরিক হতে আসবোই।

শেষ উপদেশ

(রফিক আজাদ প্রীতিভাজেনষু)

বলতো অমন ক’রে কেন তাকাচ্ছিস বারবার
আমার এখনকার দিকে? না, যা ভাবছিস
তা নয় মোটেই; সেই সোনালি তরল
আগুনের একটি ফোঁটাও
নামে নি আমার কণ্ঠনালি বেয়ে, না ওসব ঝুট
ঝামেলা এখন নেই। ভিন্ন এক মদ, ভয় বলা যায় তাকে,
প্রহরে প্রহরে
আমাকে মাতাল ক’রে রেখেছে সম্প্রতি।

মনে পড়ে, প্রথম যেদিন আমি সদ্য-কিনে-আনা
দোলনায় তোকে ফাইয়াজ
দুলিয়েছিলাম শরতের অপরাহ্নে ঘরের ভেতরকার
স্বর্ণাভায়, মনে হয়েছিল
দোলাচ্ছি ছড়ার ছন্দে আমার নিজের শৈশবকে। আর আজ
সমস্ত জীবনটাই দুলছে ভীষণ;
ইচ্ছে হয় সমুখে যা পাই তা-ই ধ’রে একটু সামলে নিই,
ইদানীং তোর দাদাজানের লাঠিটা, মজবুত নকশাদার,
বড় বেশি স্বপ্নে দেখি আর
অন্ধকারে তোর হাত খুঁজি কী ব্যাকুল।

এখন তুষার-ঢাকা জঙ্গলের মতো মাথা নিয়ে
বেঁচে আছি। বসন্তকালীন
শহুরে সুন্দরীদের আনাগোনা কমেছে, এখন
আমাকে এড়িয়ে চলে ওরা, ভাবে আমি যেন
সমাধি ফলক এক, যার গায়ে শুকনো পাতা ঝরে,
ঘাস চুমো খায়, হাওয়া।

বয়ে যায়। ফলত আশ্বস্ত তোর খুব ঈর্ষাকাতর জননী,
না কি এই ভাঁটার টানেও
গোপন বিদ্রোহী পূর্ণিমায় জোয়ারের আশঙ্কায়
পদ্মার ভাঙন জাগে তার জীবনের
নিদারুন মোহনায়।অমন ধারালো দৃষ্টি প্রত্যাহার কর।

তুই কি এখন দেখছিস খোকা আমি যা দেখছি?
শুনছিস অবিকল আমি যা শুনছি? কণ্ঠে তোর
মানুষের বোধ্য কোনে কথা
মঞ্জরিত হলে কি এখন? ওরে শোন,
আমাদের শহরকে করেছে রাহুর মতো গ্রাস
ভয়াবহু মহামারী এক; এ শহরে যত লোক
চোখে দ্যাখে, কানে শোনে আর কথা বলতে সক্ষম,
তাদের আঙ্গুলে গোনা যায়।

মদ্যপের বমির মতোই উপদেশ
উগরে দিয়েছি আমি তোর প্রতি অবেলায়। কিছু তার
কানে গেছে তোর, হয়তো মর্মমূলে বিঁধেছে কোনোটা,
সিংহভাগই পেয়েছে উপেক্ষা। কিন্তু খোকা
আমার মিনতি রাখ, আজকের এই উপদেশ
আমার ব্যর্থ না হয় যেন।

আমার শ্রবণশক্তি ত্যাগ করে গেছে
আমাকে দৃষ্টিও অস্তমিত, বলা যায়;
আমার বেবাক কথা কেবলি জড়িয়ে যাচ্ছে ওরে
পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের মতো। এখনো সময় আছে,
এখনি তুই যা একমাত্র
হে পুত্র আমার, অভিশপ্ত এ শহর থেকে দূরে, বহুদূরে
পালিয়ে যা। নাকি তুই আজো
থাকবি কামড়ে মাটি এখানেই, যেমন উদ্ভান্ত
যুবা থাকে তার পূর্বপুরুষের কবরখানায়,
ঘোরে আশেপাশে, বিড় বিড় ক’রে কাহিনী শোনায়
বিস্মৃত প্রেতের মতো, কিছুই দ্যাখে না নিজে কিংবা ঠারে ঠোরে
কারুকে দেখাতে কিছু পারে না কখনো।

সত্যাসত্য

তোমাকে লিখি না চিঠি অথবা করি না টেলিফোন।
কেননা সম্প্রতি
সে নিবাসে তুমি আছো কিনা
তাও-তো জানি না
এবং তোমার দেখা মেলা
ভার এ শহরে ইদানীং।

মনে পড়ে, তোমাদের বাগানে একদা
সন্ধ্যায় আমাকে
একটি গোলাপ দিয়ে বলেছিলে তুমি-
‘এর বুক থেকে দেবদূতদের গান ভেসে আসে। তোমাকে যে
ভালোবাসি তাতে নেই তিলার্ধ সংশয়, তবু তোমার সকল
উক্তিতে জোগাবো সায়, এমন সরলমতি কোনো
লোক নই; পটু অভিনেতার ধরনে
সন্ধ্যার আকাশে আমি ধ্রুবতারা খুঁজি অন্যমনে।

সে গোলাপ নিয়ে স্মিত চোখে তাকালাম, কিছুই না ব’লে
করলাম ভান, যেন কান পেতে আছি। তুমি কিছু
বুঝলে কি বুঝলে না,
আমাকে দাওনি পেতে টের। তোমাকে নিবিড় ছুঁয়ে
যখন বললাম, ‘বলো ভালোবাসো কিনা,
গভীর তাকালে তুমি; তোমার দু’চোখ
আশ্চর্য বাঙময় হয়, যেন বলে, ‘আমাকে বিশ্বাস
করো তুমি কতটুকু?’ নিরুত্তর আমি।
ঝড়ে কম্পমান, তছনছ-হয়ে-যাওয়া তার নীড়টিকে
যেমন বিশ্বাস করে পাখি,
ঠিক তেম্‌নি বলি মনে মনে।

ঘরে ফিরে গোলাপের শোভা দেখি চোখ ভ’রে, শুঁকি
বারবার। ভাবি,
যদি গোলাপের বুক থেকে বাস্তবিক ভেসে আসে
দেবদূতদের গান? আমার ভেতরকার ঘোর
অমাবস্যা হেসে ওঠে। অন্যমনস্কতা কখন যে
গোলাপের পাপড়ি সমুদয় ছিঁড়ে ছিঁড়ে
হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়, করিনি খেয়াল। অকস্মাৎ
বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ কাঁটা কর্কশ গজিয়ে ওঠে।
রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে গেলে, তোমার উদ্দেশে
কবিতা লিখতে বসি। কী আশ্চর্য, প্রতিটি অক্ষরে
অন্ধ এক দেবতার বুক থেকে ফোঁটা
ফোঁটা রক্ত ঝ’রে পড়ে। যদি কোনোদিন
তোমাকে এ-কথা বলি, তুমি কি তখন
শব্দগুচ্ছটিকে অবিশ্বাসী সুরে অসত্যের ঘাটে নিয়ে যাবে?

সমুদ্র ছিনিয়ে নেয়

সমুদ্র ছিনিয়ে নেয় আনন্দের ঘর লহমায়,
রাখে না কিছুই চরে, দ্বীপ ভাঙে ক্রূর দস্যুতায়
দশদিকে; মৃত্যুগন্ধী বাতাসে মিলায় হাহাকার,
আকাশের চোখ ফেটে পড়ে জল অবিরল আর
ক্ষণে ক্ষণে ফেলে দীর্ঘশ্বাস মাটিলগ্ন বুনো ঘাস।
সমুদ্র উগরে দেয় পুনরায় লাশ, শুধু লাশ,-
আমরা প্রহর যাপি কেমন দুঃস্বপ্ন-জাগানিয়া;
সারা বাংলাদেশ আজ যেন এক বিধূর মর্সিয়া।

Exit mobile version