Site icon BnBoi.Com

তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন – শামসুর রাহমান

তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন - শামসুর রাহমান

আজকাল বহু রাত

একজন ধার্মিক যেমন পবিত্র ধর্মগ্রন্থে অকুণ্ঠ বিশ্বাসী,
তেমনি আমিও বিশ্বাস অর্পণ করেছি
আমার প্রতি তোমার গভীর ভালোবাসায়।
এক মোহন, মজবুত সুতোয় গ্রথিত আমরা দু’জন;
আমরা যে-ঘর বানিয়েছি শূন্যের মাঝার
তার একটি ইটকেও খসাবার সাধ্যি নেই কোনো
জলোঠোসের কিংবা ভূমিকম্পের। আমরা পরস্পর
লগ্ন থাকব, যতদিন বেঁচে আছি।
এটাতো খুবই সত্যি আমাদের দু’জনের দেহ আলাদা,
কিন্তু অভিন্ন আমাদের হৃদয়, আমাদের কল্‌ব।

আজকাল বহু রাত আমি জেগে কাটাই
সুফীর তরিকায়
আর এই নিশি-জাগরণই আমাকে জপিয়েছে,
গভীর নিশীথের নির্ঘুম প্রহরই আমাকে
তোমার নিবিড়তম সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে পারে।
নিদ্রার বালুচরে তোমার পদছাপ হারায় সহজে।
তাই আমি জেগে থাকব
প্রায়শ সারা রাত আর অবিরত
তোমার অস্তিত্ব আমার শিরায় শিরায় ফুটবে
অলৌকিক বুদ্বুদের মতো।
৭/১১/৯৫

আমার চেয়ে অধিক

যখন তোমাকে দেখি ফুলদানি সাজাতে গোলাপ
অথবা রজনীগন্ধা, ক্যামেলিয়া দিয়ে
এবং সোনালী থালা ভ’রে তোলো বেলফুল আর
স্বর্ণচাঁপা এনে,
তখন তোমাকে কী-যে ভালো লাগে আমার, সুপ্রিয়া।
এমনকী যখন ছ্যা ঢালো পেয়ালায়
কিংবা কারো সমুখে এগিয়ে দাও খাবারের প্লেট-
তাতেও শিল্পের সুষমার স্পর্শ থাকে।

জানি তুমি অবসরে কখনো সখনো সূঁচ আর
সুতোয় কাপড়ে খুব মগ্নতায় ফোটাও কত যে
রঙ বেরঙের ফুল। রূপদক্ষ আঙুলের মৃদু
ছোঁয়ায় শিল্পের জন্ম হয়। কখনো-বা সহজেই
রিফু হয় শাল, শার্ট, শাড়ি, আরো কত কিছু।
যখন তোমার কোনো কথা কিংবা আচরণে
বড় বেশি ছিঁড়ে যায় আমার হৃদয়,
তাকে রিফু করবার মতো সূঁচ-সুতো
অথবা দক্ষতা
জগৎ-সংসারে নেই,
এ-সত্য আমার চেয়ে অধিক কে জানে!
১৯/১১/৯৫

আমার মৃত্যুর পরে

আমার মৃত্যুর খবর পেয়ে তুমি অবশ্য
অঙ্গে কোনো শোকবস্ত্র ধারণ করবে না,
তোমার দীঘল চুলও হবে না
আলুলায়িত কোনো উন্মাদিনীর মতো,
তবে তোমার মানসাকাশ ছেয়ে যাবে শোকার্ত মেঘে।

জানি না তুমি তক্ষুণি ছুটে আসবে কি না
আমার বাড়িতে, আমার লাশের উপর লুটিয়ে প’ড়ে
উদ্বেলিত নদী হয়ে উঠবে কি না। না কি শুধু আড়ালে
দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টি ছড়িয়ে দেবে দূরের আকাশে!
হয়তো তখন আমার কিছু কবিতা
উড়ে আসবে তোমার দিকে আদর কুড়াতে,
যেমন আমি
ব্যাকুল হয়ে উঠতাম তোমার স্পর্শের জন্যে,
চুম্বনের প্রত্যাশায়। এক সময়
হয়তো সবার অগোচরে তুমি নেবে বিদায়।
আমার মৃত্যুর পরে কিছুকাল তোমার ভেতরে
চলতে থাকবে ভাঙচুর, মাঝে মধ্যে চোখ দুটো
হয়ে উঠবে শ্রাবণের ভরা নদী;
টেলিফোনে বেজে উঠলে
সারসের মতো, হঠাৎ তোমার হৃৎস্পন্দন যাবে বেড়ে।
না, তুমি আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না আর।
কোনো কোনোদিন
যখন স্নানঘরে নিজের উন্মোচিত যুগল স্তনে চোখ
যাবে, তখন
হয়তো তোমার মনে পড়বে, আমি ওদের
নাম রেখেছিলাম জেদী, স্বর্গীয় ফল।

কিছুকাল মনে মনে শোক পালনের পর আস্তে-সুস্থে
সবকিছুই হয়ে আসবে স্বাভাবিক। স্বামীর সঙ্গে
মাঝে মাঝে রাত্রির তৃতীয় যামে রতিবিহারে জীবনের
তাপমুগ্ধ হবে তুমি,
(মৃত্যু বড় হিম, মৃত্যু বড় দুঃসহ শীতল, প্রিয়তমা)
পুত্রকন্যার প্রতি তোমার স্নেহ বাড়বে বৈ কমবে না
এক রত্তি,
আনন্দে মেতে উঠবে বান্ধবী-সম্মেলনে আগেকার
মতোই।
মাঝে-মাঝ কাউকে কাউকে পাঠাবে
নিজের তৈরি শুভেচ্ছা কেক কিংবা অন্য কোনা
উপহার।

তখন আমার কবরের ঘাসে, কাঁটাগুল্মে, আগাছায়
কখনো নিঝুম রোদ, কখনো হৈ-হৈ বৃষ্টি, কখনো
জ্যোৎস্নার ঝলক, কখনো অমাবস্যা,
কখনো বা হাওয়ার ফোঁপানি।

ক্রমান্বয়ে বয়স বাড়বে তোমার, কেশে ধরবে পাক;
কখনো-কখনো
নাতি-নাতনীর গুলজার আড্ডায় উল্লসিত হয়ে,
ক্লান্ত হয়ে
দাঁড়াবে আয়নার সামনে, মন খারাপ হবে, হয়তো
মনে পড়বে একজন বয়েসী কবির কথা যে তোমার
রূপের তারিফে ছিল মশগুল,
যে তোমার হৃদয়ের গাঙে ভাসিয়েছিল তার
ভাঙা নাও অসীম সাহসে।
হয়তো তোমাকে উপহার-দেওয়া
সেই কবির কোনো কবিতার
বইয়ের পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে
তার ধূসর স্বাক্ষর দেখে হঠাৎ তুমি চমকে উঠবে
নিজেরই অজান্তে।
৭/১১/৯৫

এক ধরনের জিকির

এই তো আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, গাছের পাতা বলেছে, গৌরী।
আমার ঘরের জানলার পর্দা দুলিয়ে
হাওয়া বলে যায়, গৌরী।
ভাশমান মেঘমালা মেদুর স্বরে বলে, গৌরী।
আসমান-পেরুনো পাখির ঝাঁক
নীলিমার কানে কানে আওড়ায়, গৌরী।
পাশের বাড়ির বাগানে ফুল ফুটেই জপে, গৌরী।

আমার বারান্দার ঝুলন্ত ফুলের টবে
এসে বসা প্রজাপতি বলে, গৌরী।
আমার বুক শেলফের বইগুলো সমস্বরে
আলো-ঝরানো স্বরে বলে, গৌরী।
আমার লেখার টেবিল কণ্ঠে আনন্দ-লহরী
জাগিয়ে বলে, গৌরী।
আমার কবিতার খাতা বাউলের মতো
দোতারা বাজিয়ে নেচে নেচে গেয়ে ওঠে,
‘এমন মানব-জনম আর কি হবে,
কতদিন এই হালে যাবে, আমার মনের মানুষ গৌরী।
আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি হৃৎস্পন্দন আর
রক্তকণিকা মনসুর হাল্লাজের মতো জপে গৌরী,
গৌরী, গৌরী…
৯/১২/৯৫

এমন বর্ষার দিনে

চল্লিশটি বর্ষার সজল স্পর্শ তোমাকে আকুল
করে আজো, আজো দেখি তুমি জানালার কাছ ঘেঁষে
বাইরে তাকিয়ে আষাঢ়ের জলধারা দ্যাখো খুব
মুগ্ধাবেশে; মনে হয়, আষাঢ় তোমার মন আর
হৃদয় শ্রাবণ। তুমি এই তো সেদিন ঘন কালো
মেঘদল দেখে, শুনে বৃষ্টির জলতরঙ্গ বল্‌লে
নিবিড় মেদুর স্বরে, ‘এ বৃষ্টি আমার, এই বর্ষা
আমাকে সস্নেহে তার দীর্ঘ আঙুলে ছুঁয়ে যায়।

এখন দেখছি আমি কবেকার তোমার আঠারো
বছরকে চুমো খাচ্ছে আনন্দে নিভৃতে খোলা ছাদে
কাঁচের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি। বাদল দিনের ফুল
কদমের বুনো ঘ্রাণে শিহরিত তুমি ক্ষণে ক্ষণে।
এমন বর্ষার দিনে তোমার কি সাধ জাগে কেউ
নিরিবিলি টেলিফোনে ‘রাধা’ ব’লে ডাকুক তোমাকে?
২৯/৬/৯৫

এর পরেও

আড়ালে থাকার বাসনায় এই বিরূপ ঋতুতে
আমার নিজের ঘরে বসে আছি অত্যন্ত একাকী।
কোনো কিছু করার উৎসাহ নেই; বাইরে তাকানো
আছে শুধু মাঝে-মধ্যে আর আছে গোপন দহন।

আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে সে, যাকে দ্বিধাহীন
হৃদয়ের নীল পদ্ম করেছি অর্পণ। আমার সে
জখমি হৃদয় থেকে ফোঁটা শোণিত ঝরছে।
চাই না করুণা কারো, আমাকে থাকতে দাও আজ

আমার নিজের মতো। কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো
অভিযোগ নেই আর; আমাকে নিজেই সবচেয়ে
বেশি দগ্ধ করি, ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলি নিজের হৃদয়,
আমার অপনকার পোড়া দেহ দেখি নির্বিকার।

তারপরও সতেজ বুক ভ’রে নিতে পারি,
কাব্যপাঠে মগ্ন হই, কখনো-সখনো লিখতেও
পারা যায় কিছু পদাবলী আর, কী আশ্চর্য, এর
পরেও গৌরীর কথা ভেবে রঙধনু হয়ে যাই!
১৮/১১/৯৫

কতিপয় উচ্চারণ

হর পরহেজগার মুসলমানের কণ্ঠে প্রায় প্রতিক্ষণ
উচ্চারিত হয় আল্লা-রসুলের নাম,
ভক্তিরসে নিমজ্জিত হিন্দু হরে কৃষ্ণ হরে রাম,
দুর্গা দুর্গা
জপেন সর্বদা, নিবেদিত ভক্তপ্রাণ
খৃস্টান গির্জায় কিংবা ঘরে
যীশু আর মাতা মেরী উচ্চারণে, স্তবে অনলস।
কৃচ্ছ্রনিষ্ঠ বৌদ্ধ ভিক্ষু বুদ্ধের উদ্দেশে
‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ মন্ত্র আওড়ান
পবিত্রতা ধ্যানে এনে।

অথচ এই যে আমি রুগ্ন, অসহায়, ধিক্কার অথবা
চরম দণ্ডের প্রতি উদাসীন সকল সময়
সুফী ঘরানার নৃত্যপর বৃত্ত ছুঁয়ে
অন্তর্গত স্তব্ধতায় লীন
কিবা স্বপ্নে কিবা জাগরণে আমার স্পন্দিত ওষ্ঠে
ফোটাই তারার মতো অবিরত দয়িতা
তোমার প্রিয় নাম।
নিউইয়র্ক, ১৬/৯/৯৫

কী রকম সাজ

কী রকম সাজ আজ শোভা পাবে তোমার শরীরে?
আনবে কি ফিরিয়ে সহজে তুমি রাঙা থরথর
প্রথম যৌবন পুনরায়? শরীর যে বসন্তের
অনুরূপ হ’য়ে ওঠে, তোমাকে দেখেই বোঝা যায়
লহমায়। তোমার ভেতরে গান, গহন সুরভি
জেগে ওঠে অগোচরে; গীতবিতানের শব্দাবলী
তোমাকে আতিথ্য দেয় মহিমার স্বতন্ত্র ভুবনে
ক্ষণে ক্ষণে। তোমার বিভায় আমি সর্বদা মোহিত।

তোমাকে আজকে সন্ধেবেলা দেখব না, এই সাজ
হবে না আমার চোখে উদ্‌ভাসিত; আমাকে এ খেদ
করবে অস্থির সারাক্ষণ, গোপন ঈর্ষার হুল
ফুটবে হৃদয়ে, তুমি জানবে না। তোমার শরীর
আজকের মতো জ্বলে উঠবে কি ফের আমাদের
দু’জনের প্রেমাঙ্কুর জাগৃতির জন্মবার্ষিকীতে?
৫/৫/৯৫

ক’দিন তোমার আসা-যাওয়া

ক’দিন তোমার আসা-যাওয়া দেখব না। হাওয়া এসে
আদর বুলিয়ে দেয় আমার সত্তায়,
রোদ এসে আবীর ছড়ায় সারা ঘরে, পাখি আসে
ভোরবেলা, গান গায় আনন্দের সুরে,
অথচ আসো না তুমি ক্ষণিকের জন্যেও এখানে;
আমিও পারি না যেতে তোমার নিবাসে।

নিয়মের বেড়া লণ্ডভণ্ড করা সহজ তো নয়।
হে বন্দিনী,
ইচ্ছে হয়, সারা পথ হেঁটে গিয়ে খসিয়ে শেকল
তোমাকে বাইরে টেনে আনি, পরমুহূর্তেই দেখি
তোমার সম্ভ্রম ময়ূরের দৃষ্টি নিয়ে
তাকায় আমার দিকে, আমার ভেতরকার তেজী
পুরুষের আদিমতা মাথা নত করে।
ধুলো চেটে পড়ে থাকি।

ক’টি দিন কেটে যাবে শেষতক। আমার বেলা যে
যায় কঠিনের সঙ্গে সংঘর্ষে, করুণ
সাঁঝে তুমি জ্বালো দীপ হৃদয়ে আমার। দীপশিখা
আমাকে দেখায় পথ বিভ্রমের গোলক ধাঁধায়,
পৌঁছে দেখি তোমার স্বর্ণাভ বাহু বরাভয় হয়ে
স্থাপিত সন্ধ্যায়। দৃশ্যাবলি ফুটে উঠে ঝরে যায়।

দুঃসময় অন্ধ পাখি অতিকায়, কালো
ছায়া ফেলে আমাদের প্রেমের উপর, আমরাতো
ভিন্নতর ছায়া চাই, পুষ্পবৃষ্টি চাই
সুতীক্ষ্ণ কাঁটার আগ্রাসনে, চাই স্বাদু পায়েসান্ন
করাল কাহাতে। শুধু আমরা দু’জন নয়,
সবাইকে নিয়ে
খরায় অভীষ্ট ঝর্ণা তলায় আঁজলা ভরে
জলপায়ী হবো।
৯/৪/৯৫

 খুব প্রয়োজন ছিল

এই ভরদুপুরে যখন আমার বুক
বিরান পথের মতো খাঁ খাঁ, যখন আমার ধূসর
দৃষ্টিময় চোখ ফেটে জল ঝরতে চাইছে, যখন
তোমার বিচ্ছেদে আমি কাতর, নতুন করে মনে হলো
তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল
অনেক অনেক বছর আগেই,
যেমন কৃষকের প্রয়োজন ফসলের ঢেউ খেলানো
ক্ষেতের, যেমন কবির প্রয়োজন দ্যুতিপ্রতিম
প্রেরণার, যেমন বিপ্লবীর প্রয়োজন
আলো বিকিরণকারী আদর্শের, যেমন পিপাসার্ত
পথিকের শীতল জল, যেমন অন্ধের
জ্যোতির ঝলক, যেমন মিছিলের
অগ্রযাত্রার জন্যে প্রয়োজন হিল্লোলিত নিশানের।

তুমি আমার হৃদয়ের কদমতলায়
পা রাখার অনেক আগে
ঘুরেছি এখানে সেখানে, হেসেছি খেলেছি
অনেক রঙিন পুতুলের সঙ্গে, অথচ আমার অজান্তে
আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম অবচেতনের
কানন –পথে। সেই সব পতুলের
কারো কারো রঙ চটে গ্যাছে
সহজেই, কেউ কেউ ভেঙে লুটিয়ে পড়েছে ধুলোয়,
কারো কারো মন বসেনি খেলায়,
ফলত হয়েছে উধাও আমার চোখে ধুলো ছড়িয়ে।

বুঝতেই পারছ,
তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিল অনেক অনেক বছর
আগেই; যা হবার নয় তা নিয়ে
অরণ্যে রোদন অবান্তর জানি, তবুও
আক্ষেপের তীর বিদ্ধ হয় মর্মমূলে।
অসীম আকাশের দিকে
তাকিয়ে ভেবে ভেবে সারা হই-
যদি তুমি কয়েক বছর আগে কিংবা
আমি কয়েক বছর পরে
জন্ম নিতাম, তাহলে কী এমন ক্ষতি হতো কার?

তুমি এসেই কেমন বদলে দিয়েছ আমার জীবন;
এখন আমি বয়সের ধুলি ঝেড়ে ফেলে
তারুণ্যের তরঙ্গিত নদীতে নেমেছি,
এখন আমি গোরস্তানের কথা ভুলে গোলাপ বাগানের
কথা ভাবি। আমাদের দু’জনের ভালোবাসা
নীল পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত হওয়ার আগে
নিমজ্জিত ছিলাম হতাশার ঘোর অমাবস্যায়,
এখন আশাবাদ
আমার চৈতন্য-প্রবাহে ঝলসাচ্ছে, যেমন
ফসলের মরশুমে চাষীর কাস্তে থেকে
ঠিকরে-পড়া রোদ।
২১/১১/৯৫

 চারটি স্তবক

কুয়োর শীতল জল আঁজলায় নিয়ে সন্ধেবেলা
চেয়ে থাকি কিছুক্ষণ; জলে কার মুখ ভেসে ওঠে।
পাখির চিৎকার শুনি, ভাঙে শীতল জলের খেলা
অকস্মাৎ, অদূরে কোথাও শরমিলা ফুল ফোটে।


তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কোনো কুয়োতলায়
কিংবা কোনো বাঁশের ঝাড়ে।
তোমাকে আমি দেখেছিলাম এই শহরে কিছু দূরে
স্বল্প ভিড়ে হ্রদের ধারে।
বসেছিলাম পাশাপাশি, হাওয়ায় ছিলো মাদকতা,
ছিলো কিছু জলজ ঘ্রাণ;
চোখের চাওয়ায়, কথা বলার ঈষৎ মায়ায়
দুলেছিলো দু’টি প্রাণ।


তোমার দাঁড়ানো বারান্দায়,
পশামি চপ্পল পায়ে হেঁটে বেড়ানো চাঁদের নিচে, একা
ব’সে থাকা ঘাসে,
অথবা তাকানো সন্ধেবেলা আকাশের
উড়ে-যাওয়া পাখিদের দিকে,
জঙ্গলে সফল পিকনিক, কানায় কানায় ভরা
অবকাশে খাটে শুয়ে নিভৃতে তোমার
নিমগ্ন কবিতা পাঠ, দূরন্ত হাওয়ায়
ফিরোজা শাড়ির আঁচলের নৌকার উদ্দাম পাল
হয়ে যাওয়া-এইসব দেখে যদি
কেটে যেত সারাটি জীবন।


কী ক’রে এখন শান্ত থাকবো বলো
যখন তোমার চোখ দু’টি ছলো ছলো?
আমার হৃদয় ঝড়ের রাতের পথ,
নিঃশ্বাস নেয় রুগ্ন পক্ষীবৎ।
বিষাদ তোমার রূপের পড়শি ব’লে
মনে হয় যেন পড়েছি অগাধ জলে।
৯/৪/৯৫

তবু তোমাকেই

পথিক, পক্ষী ফিরে যায় আশ্রয়ে,
দিগন্ত জুড়ে নেমেছে অন্ধ রাত।
সময় এখন কী ভীষণ অসময়,
আলোর দিকেই বাড়ানো আমার হাত।

ধূলিঝড়ে চোখে কিছুই যায় না দেখা,
কোথায় হারালো কনকাঁপার কাল?
তবু তোমাকেই ব্যাকুল বেড়াই খুঁজে,
যদিও আমাকে জড়ায় ঊর্ণাজাল।

যখন নিবিড় তাকাও আমার দিকে,
হৃদয়ে আমার ফোটে অজস্র তারা;
যখন তোমার কথা শুনি কান পেতে,
করি অনুভব মন্দাকিনীর ধারা।

আজ দুপুরের কাঁপছে চোখের পাতা;
হঠাৎ বললে আমাকে কথাচ্ছলে,
‘তোমার মধ্য বয়সে হয়নি দেখা,
নিশ্চয় তুমি ছিলে খুব জ্বলজ্বলে।‘

এখন আমার শেষ বয়সের রেখা
গোধূলিতে আঁকে বেদনার হু হু ছায়া।
আমিও তোমার পাইনি তখন দেখা,
যখন তোমার নব-যৌবন মায়া।

তা’ ব’লে আমার মনে নেই কোন খেদ,
হয় না পূর্ণ জীবনের বহু সাধ।
তোমার শরীরে যৌবন জ্বলে আজো,
আছে রাঙা ঠোঁটে মধুর, মদির স্বাদ।

তা’ছাড়া আমাকে তোমার মনের দ্যুতি
সবচেয়ে বেশি তোমার দিকেই টানে।
এই শহরের অবিরাম কোলাহলে
বাঁচি আনন্দে তোমার প্রাণের গানে।
১৬/৩/৯৫

তুমি আমাকে দিয়ে বলিয়ে নাও

না, কোনো লুকোছাপা নেই, কখনো কখনো
আমার কোনো কোনো অব্যক্ত ভাবনা
দূর শতাব্দীর আফ্রিকার অন্ধকারের মতো
গুমরে ওঠে, যেন বোবার গোঙানি।
বহু নিশুত রাতের মদিরা আমার শিরায় শিরায়
জমতে থাকে; রোমকূপ ফুঁড়ে প্রবাহিত হ’তে চায়
দিন-দুপুরে,
অথচ কোনো বিস্ফোরণ ঘটে না। কে যেন
শরবিদ্ধ প্রাণীর মতো সারাক্ষণ ভাষাহীন
আর্ত স্বর হ’য়ে আহত উন্মত্ততায় ঘুরতে থাকে
আমার আস্তিত্বের পরতে পরতে।

প্রায়শ নিশ্চুপ থাকি, মুখে কথা সরে না সহজে;
নিজের এই অক্ষমতাকে সুফীদের আত্মগত নিস্তব্ধতায়
নিমজ্জন
এবং উপনিষদের দ্বিতীয় পাখির অবিরাম,
অকস্পিত দৃষ্টিপাতের
দৃষ্টান্তের আড়ালে ঢাকতে চেষ্টাশীল আমি।
মাঝে-মধ্যে ভাষার প্রয়োজনীয়তা
অবান্তর মনে হয়। মনের ভেতর ডুবসাঁতার কেটে
মনোমীনের সন্ধানহ শেয়।

অথচ তুমি কখনো তোমার চোখের চাউনি,
হাতের নড়া,
শরীরের কোনো বিশেষ ভঙ্গি দিয়ে
এই আমাকে কেমন বাঙ্ময় ক’রে তোলো।
আমার এই চোখ, কান, নাক, হাত,
রোমরাজিময় বুক,
প্রায়-মূক মুখ কথা বলতে থাকে
অবিরল কখনো কখনো।
এই তো সেদিন দুপুরবেলা কী-যে বললে তুমি আর
আমার
কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হলো কথায় ঝর্ণাধারা, ‘এই
ভূমণ্ডল, এই সৌরলোক, বিশ্বমানব-
সবকিছুই আমার।‘ তোমাকে প্রথমবার ‘তুমি আমার’
কথাটি বলতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দের কুশাঙ্কুরে
ভীষণ বিদ্ধ হয়েছিলাম
আড়ষ্ট হ’য়ে এসেছিল আমার জিহ্বা;
কিন্তু সেদিন আমি বার বার উচ্চারণ করলাম
‘তুমি আমার,।
তখন আমাকে প্রগল্‌ভ মনে হ’তে পারতো।

তুমি আমাকে দিয়ে বলিয়ে নাও এমন সব কথা,
যা বলবার আগেও আমার মধ্যে ছিল না।
হ্যাঁ, তুমি আমার ভেতর থেকে বের ক’রে আনো
অভাবিত অনেক কিছু। এবং কতবার তুমি
একটি ইঙ্গিতে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছ অনেক
কবিতা।
তুমি কি আমার কাছে ছিঁচকাঁদুনে প্রেমের পদ্য
প্রত্যাশা করো?
এই ধরো, ন্যাকা ন্যাকা যত সব বুলি যা মুহূর্তেই
অপরিণত উঠতি তরুণ তরুণীদের মন ভেজায়,
স্যাঁত স্যাঁত ক’রে তোলে। না, প্রিয়তমা,
আমাকে দিয়ে ওসব কিছু হবার নয়।

অব্যশই আমাকে তুমি কথাদের মাঝে নিয়ে যাবে,
তুমি দেখবে আমাকে খুব কাছ থেকে,
আমার হাত নিয়ে খেলা করবে আর
আমার মগজের কোষ থেকে, হৃদয়ের তন্ত্রী থেকে
টপ্‌ টপ ক’রে ঝরবে শব্দাবলি
কবিতার খাতার সফেদ পাতায়, সেগুলো
আমার নিজের মতো ক’রেই সাজিয়ে নেব
রাতের শেষ প্রহরে কিংবা আকাশের উষ্ঠে যখন
প্রত্যুষের চুম্বন অঙ্কিত হয়।
১২/১১/৯৫

তোমাকে ঘিরে আমার কোনো কোনো সাধ

গৌরী, তোমাকে ঘিরে কত সাধ মঞ্জরিত হয়
আমার মনে দিনরাত, তুমি জানো না।
হয়তো বিনিদ্র রাতে শয্যায়
অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ ক’রে
জানলার বাইরে তাকিয়ে তারা গোনার
চেষ্টা করছি, তখন মনে হয়,
তোমাকে নিয়ে যদি কুষ্টিয়ার সেউড়িয়ায় লালনের
মাজারের পাশের কোনো গাছের ছায়ায় দাঁড়াতে
পারতাম
সাঁঝবেলায়, যদি সেই মুহূর্তে তোমাকে
গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে তোমার মুখ চুম্বন করতে পারতাম,
তাহলে আমার হৃদয় হতো বাউলের সুর।
লালন সাঁই কি রুষ্ট হতেন?
আমার মনে হয় না, বরং এতদিনে একজন কবির
মনের মানুষের সনে মিলন হয়েছে জেনে
আনন্দ ঝঙ্কারে বেজে উঠতো তার বহুদিনের নিস্তব্ধ
দোরাতা।
যখন কোনো কোনোদিন কবিতা লেখার সময়
কাঙ্ক্ষিত পংক্তিমালা পথ হারিয়ে ফেলে নীলাভ কুয়াশায়,
তখন তোমাকে নিয়ে কবিগুরুর শিলাইদহের বোটে
চ’ড়ে পদ্মায়
ভেসে বেড়াতে বড় সাধ হয়। যদি আমরা কোনো
অনুমতি ছাড়াই
সেই বোটে গিয়ে উঠতাম, তবে কি রবীন্দ্রনাথ
শিল্পসম্মত ভঙ্গিতে
উষ্মা প্রকাশ করতেন? আমার বিশ্বাস,
তিনি খুশিই হতেন
আর তাঁর গীতবিতানের পাতাগুলো
রৌদ্র-জ্যোৎস্না হয়ে
আদর করতো আমাদের দু’জনকে,
জোগাতো ভ্রমণের উৎসাহ।

যখন শহরের অশ্লীল হৈ-হুল্লা, বিরক্তিকর যানজট,
নিষ্ফল বচসা,
তারুণ্যের নষ্টামি, বয়স্কদের হ্যাংলামি আর ভণ্ডামি,
বর্বর-বাহিনীর জয়োল্লাস, ন্যায়ের নির্বাসন,
আইন-শৃংখলার মুখ-থুবড়ে-পড়া, প্রশাসনের নির্বোধ
স্বেচ্ছাচার,
মর্গে অশনাক্ত লাশের ভিড়,
সন্ত্রসীদের বেলাগাম দাপট, ফাঁপা রাজনীতির
করুণ পরিণতি আমাকে খুব ক্লান্ত করে,
তখন ইচ্ছে হয়,
তোমাকে নিয়ে চলে যাই
আমাদের পাড়াগাঁর বাড়িতে।
ইচ্ছে হয় পাড়াতলীর প্রজাপতিময় সর্ষে ক্ষেতের ধারে,
দিঘীর পারে
তোমার হাত ধরে হেঁটে বেড়াই। আমার পরহেজগার
পূর্বপুরুষগণ কি নারাজ হতেন খুব?
সেরকম ভাবনা আমাকে ডুমো মাছির মতো
উত্ত্যক্ত করে না। গৌরী,
সেখানে গেলে তুমি দেখতে পেতে
তাদের আনন্দ প্রতিফলিত আম-জামের পাতায়,
বউ কথা কত্ত পাখির ডাকে।
১২/১১/৯৫

 তোমাকে দেখি প্রতিক্ষণ

তোমাকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ দেখতে চাই দু’চোখ ভ’রে
যখন তোমাকে দেখতে পাই না,
তোমার পাশে ব’সে কিছু সময় কাটানো থেকে
বঞ্চিত হই, তখন মনে হয়-
আমি যেন সেই রোগী, যাকে শ্বাসকষ্ট ভোগায়
প্রতি মুহূর্তে। তোমার মুখ অদর্শনের
অন্ধকার তীরে থাকলে
এই মতো অনুভূত হয়,
আমি এক বিয়াবান কন্টকময় পথ
পাড়ি দিচ্ছি দিগভ্রান্ত পথিকের মতো; আমাকে
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে বহু উদ্ধত ফণিমনসা।
সে-পথে বিষধর সাপের কুণ্ডলী,
হিংস্র জন্তুর আধ-খাওয়া নরদেহ এবং
দৃষ্টি-অন্ধ করা দীর্ঘস্থায়ী আঁধিঝড়।

ক্যালেন্ডারের তিন শো পঁয়ষট্রি দিনের তিন শো দিনই
তোমাকে দেখতে পাই না। বাকি দিনগুলি
তোমার দেখা পাই কখনো প্রকাশ্যে, কখনো-বা সঙ্গোপনে।
সতর্ক, ক্রূর দৃষ্টির পাহারা,
নিষেধের সদা উদ্যত তর্জনী,
বাধার দুর্লঙ্ঘ্য কাঁটাতার তোমাকে
দেখতে দেয় না প্রতিদিন। এই বিরূপ সংসারের
অদৃশ্য, অমানবিক নিপীড়নে কাটে আমার দিনরাত্রি।
অনেক বছর
তুমিহীনতায় কেটে গ্যাছে। আমরা কেউ কাউকে
দেখতে পাইনি, যদিও এই একই শহরে ছিলাম দু’জন;
আরো ক’বছর আগে
কেন আমরা আমাদের হইনি? কেন?
তবুও যে শেষ পর্যন্ত মিলিত হলাম আমরা,
একেই পরম সৌভাগ্য জ্ঞান করি।
কঠোর বাধার বেড়া ডিঙিয়ে,
বলা যেতে পারে, তোমাকে দেখি প্রতিদিন,
প্রতিক্ষণ স্বপ্নে, আমার ভাবনার নন্দন-কাননে।
১২/১১/৯৫

প্রতীক্ষায় প্রতিক্ষণ

আমরা যখন ভেসে যাচ্ছিলাম নানা
কথার স্রোতে, তখনও তুমি বলোনি,
আজ সন্ধেবেলা তুমি আসবে। আমরা দু’জন
মুগ্ধাবেশে বলছিলাম ভাসমান মেঘের কথা, সদ্য
উড়তে-শেখা পক্ষী শাবকের কথা,
এমন একটি বাড়ির কথা বলছিলাম, যার অবস্থান
গাছপালা, লতাগুল্মময় টিলার উপর। সেই
বিনীত, বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে
থাকবো শুধু আমরা দু’জন। কেউ আমাদের
নির্জনতার দ্বারে
হানবে না আঘাত। তুমি বললে কণ্ঠস্বরে মাধুর্যের
ঢেউ খেলিয়ে, ‘এই শোনো,
তুমি কখনো কবিতা পড়বে,
আমি শুনব তন্ময় হ’য়ে, আর আমি পড়বো তোমার
নতুন লেখা কোন কবিতা তুমি শুনবে আনন্দিত চিত্তে,
আমি পড়তে গিয়ে হোঁচট খেলে, তুমি মৃদু হাসবে।
কখনো তোমার মাথা টেনে নেব কোলে,
আমার চুল ছড়িয়ে পড়বে তোমার সারা মুখে।
আমার আদরে তোমার চোখে নামবে ঘুম।
আমাদের স্বপ্নের বাড়িতে বয়ে যাবে
আমাদের দিনগুলো, রাতগুলো, যেন গুণীর তান।

তুমি চৈত্র-দুপুরে তোমার একাকিত্বের কথা বললে,
আমি বললাম আমার ভেতরকার হু হু হাওয়া আর
হাহাকারের কথা। কিন্তু আমরা কেউ কারো কথার
নিঃসীম শূন্যতাকে ধারণ করতে পারিনি।
এক ধরনের অভিমান তোমার মনে
ঝুলে রইল সব কালো মেঘ হয়ে।
আবার আজ তুমি আসবে আমার ঘরে। আমি সেই
সম্ভাবনার কথা ভেবে বসন্ত ঋতুকে নিবেদন করলাম,
আজ আসতে হবে আমার ঘরের ভেতর, নার্সারির গোলাপগুলোকে আমার অতিথি হওয়ার
আবেদন জানালাম; কোকিল এবং দোয়েলের কাছে
খবর পাঠালাম আমার ঘরকে সুরেলা করার জন্যে।
এভাবেই সাজাবো আমার ছোট ঘরটিকে।
তুমি আসবে তো তোমার সৌন্দর্যের তরঙ্গ তুলে,
সুরভি ছড়িয়ে হাওয়ায়?
আমি সেই কখন থেকে তোমার
প্রতীক্ষায় প্রতিক্ষণ কখনো ধনুকের ছিলা,
কখনো চাতকের তৃষিত ডাক।
২৩/৩/৯৫

 বলতে যাবো না

সেদিন তোমাকে কিছু কটু কথা শুনিয়েছিলাম
ক্রোধে জ্বলে, এর আগে যা আমি করিনি কোনোদিন
কোনোক্রমে। তুমি শরাহত রাজহংসীর মতোই
বসেছিলে এক কোণে বেদনার্ত। কোনো নিষ্ঠাবান
চিত্রকর যেমন সুন্দর ছবিতে খুঁত দেখে ছিঁড়ে খুঁড়ে
ফেলে নিজ শিল্পকর্ম, আমি সেদিন সেই মতো
আচরণ করেছি হঠাৎ। তুমি মৃদু প্রতিবাদী
স্বরে কিছু বলে চুপ। সে-রাত আমার ক্রোধে, ক্ষোভে
নির্ঘুম কেটেছে আর কবিতাও আসেনি শোনাতে
প্রবোধের স্নিগ্ধ কোনো বাণী, দগ্ধ হয়েছি অন্তরে
অতিশয়। কী ছিলো তোমার ক্রটি যা আমাকে অন্ধ,
নাছোড় বৃশ্চিক হয়ে করেছে দংশন? মনে-মনে
হয়েছি নিজেরই হন্তারক। সে ক্রটির কথা আমি
নিশ্চিত কখনো হাটে লোক ডেকে বলতে যাবে না।
১৮/১১/৯৫

বাঁচাবে

এ শহরে জীবিকা সর্বত্রগামী; ছোট বড় সব
চাকুরে, টাউট, উচ্চাকাংক্ষী ধনবান, ভিখারীর
ভিড়, শীতরাতে অতি ব্যবহারে জীর্ণ, শীর্ণকায়
রঙিন গণিকা, গঞ্জনায় অভ্যস৫ত খঞ্জের জন্যে
আয়ের নানান পথ খোলা। বেশ কিছু বেকার যুবক
মাস্তানের দঙ্গলে সহজে ভিড়ে যায়। যত্রতত্র
ধর্মের ব্যবসা জমে ওঠে; নীতিবিবর্জত ফাঁপা
রাজনীতি, বাণিজ্যিক সভ্যতার মরু বেড়ে চলে।

এ শহরে কোনোদিন কোকিলের ডাক শুনে অকস্মাৎ
থমকে দাঁড়াই ফুটপাথে। শ্যামলীর এ মলিন
গলিতেও গোলাপের চাষ হয়, কোথাও কোথাও
প’ড়ে থাকে বুগেনভেলিয়া। সর্বোপরি আমাদের
দু’জনের অপরূপ মানবিক ভালোবাসা ধু ধু
শহরকে বাঁচাবে নিশ্চিত মরুভূর গ্রাস থেকে।
১৮/৩/৯৫

 বৃষ্টি

একটি স্বপ্নের মাঝখানে হঠাৎ
আমার ঘুম ভেঙে যায়; দৃষ্টি মেলে দেখি
তখনও শেষ রাতের হাত
আকাশের কোমড়ে জড়ানো। বাইরে
বৃষ্টির মৃদু শব্দ, আমার মনে নামে
বিষণ্নতার নিস্তব্ধ কুয়াশা।

স্বপ্নে তোমাকেই দেখছিলাম। আমরা,
তুমি আর আমি, একটি ফুটফুটে জ্যোৎস্নাপ্রতিম
বালিকার জন্যে সাজাচ্ছিলাম ঘর,
কোত্থেকে হিংসুটে এক ঝড় বুনো ষাঁড়ের মতো
তছনছ ক’রে দিলো সব, আমরা
একপাল শূয়োরের পায়ের তলায় ভীষণ জব্দ।
একটি মালা আমাদের দু’জনের হাতে
জড়িয়ে যাচ্ছিল মমতায়; কাঁচের মতো স্বপ্ন গেল ভেঙে।

হাত মুখ ধুয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় একজন
চীনা কবির কবিতা পড়ার চেষ্টা করি; বার বার
দেয়ালে, বাইরে ঝাপসা ঘরবাড়ি আর গাছপালায়
দৃষ্টি যায়। মনের বিষণ্নতা
অধিকতর ঘন হয় এবং
তখনও তোমার অশ্রু-ফোঁটার মতো
বৃষ্টি ঝরছে
টিপ টিপ
টিপ টিপ
টিপ টিপ…
২৫/১১/৯৫

ভালোবাসা কারে কয়

লোকে জানে, আমি নিজে জানি সবচে’ বেশি,
অতীতে বহুবার প্রেম-প্রেম খেলা খেলেছি
বেপরোয়া জুয়াড়ির ধরনে এবং
সেসব খেলা ভেঙে যেতে অধিক সময় লাগেনি।

তোমাকে ভালোবাসার আগে,
তোমার প্রেমের পূর্ণিমায় স্নাত হওয়ার আগে
ধনীর দুলাল কায়েস ঐশ্বর্যখচিত খিমা ছেড়ে
কেন ছিন্ন বেশে উদ্‌ভ্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছে
শরীর শীর্ণ এবং
পা রক্তাক্ত ক’রে লায়লা লায়লা ব’লে,
ভাস্কর ফরহাদ কেন শিঁরির জন্যে
নহর আনার উদ্দেশ্যে, নিজেকে দিনরাত
উপোসী রেখে পাহাড় কাটার কাজে বিলীন করেছে,
সওদাগর কেন মাহিওয়াল হয়ে
নিজের উরুর মাংস কেটে
পাঠিয়েছে সোহনীর উদ্দেশে,
মালকা বানুর আশেক মনু মিয়া তার মাশুকের জন্যে
কেন বারবার পেরিয়েছে মহেশখালী প্রণালী-
এসব অসম্ভবের তাৎপর্য
কখনো উপলব্ধি করিনি।

কত দুর্গম পথ পেরিয়ে বিষধর সাপের ফণা থেকে
মণি ছিনিয়ে এনে একটি মণিহার
তোমাকে পরিয়ে আর তোমার ভালোবাসার
চন্দন-তিলক ললাটে নিয়ে জেনেছি
ভালোবাসা কারে কয়।
২২/১১/৯৫

 মাতাল

মদিরা করিনি স্পর্শ, অথচ মাতাল হ’য়ে আছি
দিনরাত; নিত্য কুৎসাকারীদের জিভের খোরাক
আমি, কেউ কেউ ক্রোধে আমাকে পুড়িয়ে করে খাক।
আমার করোটি জুড়ে কবিতার সোনালী মৌমাছি
প্রায়শ গুঞ্জন তোলে; অচিন পাখিরা নাচানাচি
করে হৃৎবাগানে আমার। গূঢ় রহস্যের ডাক
নিশীথে নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে বলে, ‘ভরা থাক
তোমার প্রেমের পাত্র। যদি থাকে, তাহ’লেই বাঁচি!

মাতাল, মাতাল আমি সুনিশ্চিত। কারো অপবাদ
দেবো না উড়িয়ে হেসে, তবে বলি দৃঢ় কণ্ঠস্বরে-
বিত্তের লালসা নয়, চপল খ্যাতির মোহ নয়,
প্রতাপশালীর সীমাহীন তীব্র ক্ষমতার সাধ
কিংবা ধর্মান্ধতা নয়, সত্যি আমাকে মাতাল করে
প্রকৃত কবিতা আর সুপ্রিয়ার প্রগাঢ় প্রণয়।
১১/৩/৯৫

 মেঘদূত

আমিও মেঘকে দূত ক’রে এখুনি পাঠাতে চাই
তার কাছে, যে-আছে আমার পথ চেয়ে
প্রতিক্ষণ। কালিদাস নই, তবু কত অনুনয়
করি মেঘকন্যাদের উদ্দেশে, অথচ ওরা চুপ
থাকে, সাড়া দেয় না কখনো একালের
শাদামাটা কবির অধীর মিনতিতে। নিরুপায়
আমি ধর্ণা দিই টেলিফোনের নিকট। কিন্তু তবু
স্বস্তি নেই; টেলিফোনও বিগড়ে থাকে যখন তখন।

সে জানে, আমার মেঘদূত নেই কোনো, তার
কাছে বার্তা পাঠানো সহজ নয় সকল সময়।
যখন গহন বর্ষা হৃদয়ের দু’ কূল ছাপিয়ে
স্পন্দমান, তাকে কাছে পাওয়ার বাসনা অগ্নিবাণ
হ’য়ে জ্বলে, পোড়ায় আমাকে। তার অশ্রুধারা আর
শ্রাবণের জলধারা নীল শূন্যে একাকার হয়।
২৯/৬/৯৫

যদিও লোকটা অসুস্থ

বেশ কিছুদিন হলো, বহুদিন হলো অসুস্থতা
চঞ্চুতে রেখেছে বিদ্ধ করে লোকটিকে। এখন সে
পড়ে না সংবাদপত্র, কতদিন কবিতার বই
সস্নেহে আলতো ছুঁয়ে রেখে দেয়, কখনো হয় না
পড়া, মাঝে মাঝে খুব কষ্ট ক’রে একটি কি দু’টি
কবিতা অথবা ‘ছিন্ন পত্রাবলী’ থেকে এক আধ
পাতা চেখে নেয়, রোগাক্রান্ত ক্লান্ত চোখ বুঁজে আসে;
শোণিতে শর্করা হেতু দুর্বল শরীর, মনে পড়ে-
সমানবয়সী বন্ধু কেউ কেউ গত, কেউ কেউ
ধুঁকছে অসুখে ইদানীং তারই মতো। সাড়ে তিন
বছরের পৌত্রী এসে যখন জড়িয়ে ধরে গলা,
কথা বলে শৈশবের স্নিগ্ধ স্বরে, অসুস্থ লোকটা
কেমন সজীব হয়ে ওঠে, মৃত্যুচিন্তা অস্তাচলে যায়।
উৎসুক অথচ ক্ষীণ দৃষ্টি মেলে তাকায় শিশুর
দিকে, যে সম্পদ কিংবা বিষাদ বোঝে না, ফুটে থাকে
কনকচাঁপার মতো। এই বয়সেও এ বিবর্ণ
কালেও যে তাকে ভালোবাসে, যখন সে চলে আসে
কোনো সন্ধেবেলা, তাকে দেখলেই চিত্তময়
রঙিন ফোয়ারা উচ্ছুসিত হয়, তার কণ্ঠস্বর
একবার শুনলেই আরো বহুকাল বাঁচবার
সাধ জাগে, তার গভীর মনোজ শুশ্রূষায়
জীবনের বহু ক্ষত সেরে যায়, অন্ধকার ফুঁড়ে
বৃত্ত-চাঁদ ওঠে রুগ্ন মনের দিগন্তে, লোকটার
মনে হয়, বিপন্নতা জীবনকে করে উপরূপ।
১২/৪/৯৫

 যাওয়া যায়

যখন দাঁড়াও তুমি রাত্তিরে কৃপণ বারান্দায়
নিরিবিলি, খোলা আকাশের তারাগুলি বিস্ফারিত
চোখে দ্যাখে তোমাকে এবং ভাবে-কে এই মানবী
এমন স্বর্গীয় রূপ নিয়ে আছে ধূসর জমিনে?
‘অতিশয়োক্তির অবকাশ নেই’, মেঘ তারাদের
কানে-কানে বলে। আমি মেঘ থেকে তৎক্ষণাৎ চোখ
সরিয়ে নক্ষত্রদের কৃতঞ্জতা জানাই আমার প্রেমিকার
উদ্দেশে প্রশস্তি রচনার জন্যে কৃপণ সমাজে।

আমার প্রাণের কথা নক্ষত্র বলেছে অবিকল,
মনে মনে জানি আর যে যাই বলুক আমি তাকে
সবচে’ রূপসী ব’লে করি পান বিষণ্ন সৌন্দর্য
তার সঙ্গোপনে; উপরন্তু যার মনের বৈভব
সব বিবেচনাকে ছাপিয়ে ওঠে, তার কাছে রোজ
যাওয়া যায় সব বাধা, ঝড়জল হেলায় উজিয়ে।
৬/৫/৯৫

 সুফীরা বলেন

আমার কাটে না দিন, কাটে না যে রাত, প্রিয়তমা,
তোমার বিহনে আর। আকাশের মেঘ,
গাছের পাতায় রোদে, অন্ধকারে, পূর্ণিমায়, শ্রাবণ
ধারায়,
নির্দয় খরায়, ঝিলে, পাখির স্বপ্নিল চোখে, রুক্ষ
পাথরে, ঝর্ণায় আর হরিণের চিত্রল শরীরে
তোমাকেই খুঁজি নিশিদিন। বস্তুত তোমারই শুদ্ধ ধ্যানে
রোজ
বেলা ব’য়ে যায়
আমাকে ক্ষতার্ত ক’রে। ব’সে থাকি অসহায়, একা।

কখনো যখন কবিতার খাতা খুলে বসি অতি
সঙ্গোপনে, তুমি অক্ষরের
অনিন্দ্য প্রতিমা হ’য়ে দাঁড়াও পাতায়। তোমাকেই
সারাক্ষণ দেখার আশায় থাকি এই
বিরূপ শহরে পায়ে ফোস্কা নিয়ে, ধূসর মাথায়
কাঁটার মুকুট প’রে। তবু যদি তুমি
বোধাতীত অভিমানে, ক্ষোভে নিজে খুব
দগ্ধ হয়ে আমাকে পোড়াও, তবে আমি
অনিন্দ্রপীড়িত এই মাথা কার জানু কিংবা বুকে
রেখে স্নিগ্ধ বাগানের ঘ্রাণ পাবো, বলো?

প্রিয়তমা, হয়ো না বিমুখ, একবার
এসে দেখে যাও আজ তোমার ইস্‌কের আতশের
কুণ্ডলীতে আমার যা হাল,
একেই তো সুফীরা বলেন জানি ফানা হ’য়ে যাওয়া।
১০/১১/৯৫

 সে-রাতে নতুন ক’রে

অকস্মাৎ সে-রাতে নতুন ক’রে পেলাম তোমাকে
হৃদয়ের খুব কাছে। প্রত্যাশা ছিল না,
তবু আমার ঘাটে ভিড়ল আশ্চর্য তরী এক
অপরূপ সম্ভার সমেত। শুধু বিস্ময়ে তাকাই নিষ্পলক
সারাক্ষণ, ফেরাতে পারি না দৃষ্টি কিছুতেই। তুমি,
তরণীর পরম ঐশ্বর্য, নেমে এলে ধীর,
গৌর পদক্ষেপে।

কখন যে আমার পায়ের কাছে এসে বসলে সবার
অগোচরে, স্বপ্নবিষ্ট আমি
খেয়ালই করিনি; দেখি আমার উরুতে
স্থাপিত তোমার মুখ। তোমার অতল চোখ দু’টি
কখনো আংশিক খোলা, কখনো নিবিড় নিমীলিত।
মাঝে মাঝে
চোখ মেলে দেখছ আমাকে, যেন খোদ ভালোবাসা
তাকাচ্ছে আমার দিকে সম্পূর্ণ নতুন ক’রে গাঢ়
অনুরাগে, আমার দু’ হাতে
তোমার অতুলনীয় মুখ, বুঝি কোনো শায়েরের
অঞ্জলিতে অনুপম প্রস্ফুটিত রূঁপসী গজল।

আকাশে ছিল কি চাঁদ? সপ্তর্ষিমগুল?
বলতো কী ক’রে বলি? আমি তো তোমাকে ছাড়া আর
কিছুই দেখি নি স্পষ্ট ভেতরে বাহিরে।
সৌন্দর্যের কসম, তোমাকে
এর আগে এমন সুন্দর আমি কখনো দেখি নি,
যদিও সৌন্দর্যে লগ্ন আমার সমুখে দাঁড়িয়েছ,
বসেছ ঘনিষ্ট হয়ে বহুদিন, বহু
মুহূর্ত কেটেছে আমাদের আলিঙ্গনে, ওষ্ঠের নিলনে।
১৪/১১/৯৫

স্বল্পভাষী

সেদিন দুপুরে বিদেশে যাবার আগে
প্রায় নিজে যেচে গেলাম তোমার বাড়ি।
বারান্দা থেকে আমাকে দেখেই তুমি
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলে তাড়াতাড়ি।

‘কেমন আছেন? এখানে বসুন এই
সোফাটায়, কী-যে ভালো দুপুরটা আজ।
কী দেবো এখন? দেবো কি ঠাণ্ডা কিছু?
‘কিছুই খাবো না। বাড়বে তোমার কাজ।‘

আমার তুচ্ছ কথায় কান দিয়ে
নিয়ে এলে কিছু খাদ্য এবং দামি
বীয়ারের ক্যান। জীবনের মতো ক্যান
নিমেষে ফুরোলো, ঈষৎ হেসেই থামি।

‘কেন যে আপনি বলেন না কিছু?
কত লোক শুনি কথা বলে রাশি রাশি
অথচ আপনি নিজের মধ্যে ডুবে
থাকেন শুধুই, আপনি স্বল্পভাষী।‘

আমিও নীরবে মেনে নিই অপবাদ।
‘অমন আপনি আপনি কর যে তুমি
তা হ’লে কী ক’রে ফুটবে কথার ফুল?
কীভাবে ভরবে সুরভিতে মনোভূমি?

হাতে হাত রেখে বললে মধুর স্বরে,
‘সহজে আসে না ছোট্র এ তুমি, মাফ
ক’রে দাও, আর কখনো হবে না ভুল।
পেয়ে যাই তার হৃদয়ের উত্তাপ।

বলি তার কানে ‘রোজ এই অভাজন
ব্যাকুল বাজায় তোমার নামের বাঁশি
মাটিতে আকাশে সকল সময়, তবু
আমাকেই তুমি বলবে স্বল্পভাষী?’
১/৩/৯৫

 হ্যাঁ গৌরী, তোমাকেই

হ্যাঁ গৌরী, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
তোমাকে ভালো না বেসে পারা যায় না,
তোমাকে ভালো না বেসে বাঁচা অসম্ভব।
আমার প্রতি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে
তোমার বসতি।
কী ক’রে আমি পথ হাঁটবো, আকাশের দিকে
দৃষ্টি মেলে দেবো সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত দেখার জন্যে,
কী ক’রে আমি আঁজলায় ভরে নেবো শান্তির জলধারা,
কী ক’রে আমি কবিতা লিখবো
তোমাকে ভালো না বেসে?
হ্যাঁ, গৌরী, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন
অচল মুদ্রা বৈ তো নয়।
হ্যাঁ, গৌরী, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
সুন্দরবনের আরণ্যক শোভার শপথ,
গারো পাহাড়ের আর্ত নিস্তব্ধতার শপথ,
উত্তরবঙ্গের রাঙামাটির পথের শপথ,
পার্বত্য চট্রগ্রামের পাকদন্ডি, ঝর্ণা আর
পাহাড়ি যুবার অপার বেদনার শপথ,
মেঘনার অজস্র ঢেউয়ের শপথ,
পদ্মার ঝলসে ওঠা চকচকে ইলিশের শপথ,
পরিযায়ী পাখিদের অনলস রঙিন ডানার শপথ,
তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।

হ্যাঁ গৌরী, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
মসজিদের কবুতরময় গম্বুজ আর উঁচু মিনারের শপথ,
মন্দিরের সন্ধ্যাপ্রদীপ আর ঘন্টাধ্বনির শপথ,
নির্জার আইকনের, অর্গানের প্রার্থনা-মন্দ্রিত সঙ্গীতের শপথ,
বৌদ্ধ বিহারের নিরলঙ্কার সৌম্য কান্তির শপথ,
তোমাকে, হ্যাঁ শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।

নীল পদ্মের উন্মীলন, সরোবরের জ্যোৎস্নাঝলসিত আহ্বান,
হরিণের চোখের মায়া, উদাস দুপুরে ঘুঘুর ডাক,
সন্ধ্যামগ্ন ঝোপঝাড়ে জোনাকির জ্বলে-ওঠা আর নিভে যাওয়া,
সাঁঝ-লাগা গাঁয়ের পথে রাখালের ঘরে ফেরা,
ঘাটে-ভেড়া নৌকার মৃদু আলো আর
নূর হোসেন স্কোয়ারের জাগরণের শপথ,
অপশাসন-বিরোধী প্রতিবাদী মিছিলের শপথ,
তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।

পেত্রার্কার সনেট, কাতাল্লুসের প্রেমের কবিতা,
রবীন্দ্রনাথের
গীতবিতান, রুমির মাসনভি, গালিবের পাথরের বুকে
ফুল-ফোটানো গজল, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁর
‘যমুনা কে তীর’
চাইকোভস্কির রাজহংসী শোভিত হ্রদের অলৌকিক
বিচ্ছুরণ,
বাংলার অজানা মাঝির মেদুর গলার ভাটিয়ালী,
উত্তরবঙ্গের এবড়ো-থেবড়ো পথে গাড়িয়াল ভাইয়ের ভাওয়াইয়া
এবং আমার সকল লেখা এবং না-লেখা কবিতার শপথ,
তোমাকে, আজ শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, গৌরী,
১৪/১১/৯৫

Exit mobile version