Site icon BnBoi.Com

টেবিলে আপেলগুলো হেসে উঠে – শামসুর রাহমান

টেবিলে আপেলগুলো হেসে উঠে - শামসুর রাহমান

অপরাহ্নে বসে ছিলে তুমি

অপরাহ্নে বসেছিলে তুমি সোফায় সাজিয়ে ঊষা,
কী সহজ। এমন মুহূর্তে বেশভূষা
অবান্তর; প্রকৃতিতে দ্বিধা নেই, আছে অন্তরাল
নানান রঙের, তুমি ঠোঁটে ফিকে লাল
করেছো অর্চনা। আকর্ষণ
দুর্নিবার, আমার ভেতরে টাইফুন আর তোমার অমন
‘ছুঁয়ো না আমাকে’ দৃঢ় আঙ্গিকে প্রবল ভাঙচুর
নৈঃশব্দ্যকে সুর
করবার ভারি সাধ হলো; যদি ছুঁই
তোমাকে এখন, তাহলে কি তুমি জুঁই
হয়ে ঝরে যাবে এই পাটের কার্পেটে? অনন্তর
তোমার এ-ঘর
বেবাক অশুদ্ধ হয়ে যাবে? নাকি
‘গ্রৃহস্থের খোকা হোক’ বলে ডেকে যাবে বেলাজ একটি পাখি।

অমল, তোমার জন্যে

ফোন বারবার বেজে উঠবে আমার
ছোট ঘরে, অথচ তোমার কণ্ঠস্বর কোনোদিন
শুনবো না আর
ভোরবেলা অথবা রাত্তিরে কিংবা যাবো না কখনো
সেই শাদা বাড়িতে প্রবাসকে
আপন নিবাস
করবার আকাঙ্ক্ষায় মজে। যদি যাই কোনোদিন বাড়িটার
পথের কিনার দিয়ে, চমকে উঠবো অকস্মাৎ।
সেই বাড়িটিকে মনে হবে
স্মৃতিসৌধ, বড় চুপচাপ পোহাচ্ছে সময় আর
মনে পড়ে যাবে
অমল তোমার ঝকঝকে মুখ, চোখের রহস্যময় দ্যুতি-
বুকের ভেতরে কিছু দুঃখ লুকিয়ে রাখার
প্রবণতা, হুইস্কির গ্লাস হাতে কৌচে
শিল্পিত কথার ঝিলিমিলি। অমল, তোমার জন্যে কোনো কোনো
প্রহরে আমার মন কেমন করবে, মনে রেখো।

তোমার কি মনে আছে? সেখানে কি থাকে
মনে কোনো কিছু? দয়িতার ভালোবাসা, সান্ধ্য আড্ডা, কবিতার
ছন্দমিল মনে থাকে? এই তো সে-রাতে
ফোন বেজে উঠলো, এল ভেসে
যেন বেদনার ছায়াচ্ছন্ন কণ্ঠস্বর, বাক্যহারা
শুনলাম অমল, তোমার
গলার আওয়াজ, মনে হলো। অথচ সে ধ্বনি, হায়,
পর মুহূর্তেই
রমণী-সত্তার ধ্বনি হয়ে যায়। ‘আমরা তো অর্ধনারীশ্বর’,
এই বলে নিজেকে প্রবোধ দিই শুধু
অমল আমাকে তুমি, মনে পড়ে, হেমন্ত সন্ধ্যায়
দিয়েছিলে উপহার
একখানি আধুনিক কবিতার বই-
বইয়ের ‘সময় বড় কম’ নাম দেখে কেন যেন
আমার নিভৃত মর্মমূলে
লেগেছিল টান। তুমি আমি সে সন্ধ্যায়
ড্রইংরুমের স্বল্পালোকে ঘুণাক্ষরে জানতে পারি নি হে বন্ধু
তোমার সময় এত কম।

আমাকে প্রতীক্ষা করে যেতে হবে

আমাকে প্রতীক্ষা করে যেতে হবে এই
একই জায়গায়
দীর্ঘকাল। এখানে কিছুই নেই, যা দেখে আমার
চক্ষুদ্বয় জুড়াবে; অথবা
কেউ নেই, যার সঙ্গে কথা বলে কাটবে সময়
ভালোয় ভালোয়।

সত্যের খাতিরে বলা যায়,-
আছে একজন; কিন্তু সে কখনো ভুলেও খোলে না
মুখ, ঠায় বসে থাকে
দৃষ্টি মেলে, সে দৃষ্টি এমন শূন্য, কখনো কখনো
মনে হয় ওর
দৃষ্টিশক্তি নেই, শুধু আছে চেয়ে থাকা।
কখনো মাটিতে বসে থাকি,
আবার কখনো উঠে দাঁড়াই সহসা, কিছুক্ষণ
পায়চারি করি, ফিরে এসে
বসি আগেকার জায়গায়, উঠে দাঁড়াই খানিক,
পুনরায় বসে পড়ি, এইমতো চলে
সারা বেলা, বলা যায়, এই খেলা আমার নিজেরই সঙ্গে।

আবার এমনও হয়, জুতোর ফিতেটা তাড়াতাড়ি
খুলে ফেলি, আস্তে সুস্থে ফের
বাঁধি, খুলি আর বাঁধি, বাঁধি আর খুলি;
তারপর জুতোটাই ছুঁড়ে
ফেলে দিই দূরে, ভাবি একটি কুকুর
থাকলে ভালোই হতো, কিছুটা জমতো এই জুতো জুতো খেলা।

যে আছে অদূরে একা
ভাবলেশহীন, তার উদ্দেশে কী যেন এলোমেলো
বলি প্রিয় সম্ভাষণ করে; কী আশ্চর্য, আমি নিজে
সে ভাষা বুঝি না, তবু বলে যাই একটানা বেশ
কিছুক্ষণ; স্তব্ধতাকে আঁচড়াই, মাঝে মাঝে নখ
খাই, দিই বাড়িয়ে নিজের গলা লোকটার দিকে।
ধূসর পথের দিকে চেয়ে থাকি মাঝে-মাধ্যে; কারো
আসার তেমন কোনো
আভাস কোথাও নেই। কোনো দূত এসে
এখানে রটাবে বার্তা, এই প্রত্যাশাকে
পাঠিয়ে দিয়েছি বলে অনেক আগেই। শুধু জানি বৃক্ষহীন
নদীহীন, রুক্ষ এ-প্রান্তরে প্রতীক্ষা করাই একমাত্র আশা।

এই এক সময়

এই এক সময়, যখন কেউ কারো সামনে সহজে
মুখ খুলতে চায় না। বন্ধুতার সাজ পরে বস্তুত
ক’জন আততায়ীর অব্যর্থ আঙ্গিক
ভেতরে লুকিয়ে রেখে চারপাশে আনাগোনা করে, তার হিসেব
মেলাতে গিয়ে বারবার
ভুল হয়ে যায়। এই এক সময়, যখন কেউ কারো, আস্থাভাজন নয়।

এই এক সময়, যখন শ্বেতচন্দনের বদলে
গন্ধকের গন্ধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং গোলাপকে
হটিয়ে ঘেঁটু ফুল
সম্প্রসারণবাদীর ভূমিকায় কী দড়। এই এক সময়
যখন কোকিলের ঘাড় মটকে
কাক নিয়ে স্বৈরাচারীদের জয়োল্লাস দিক দিগন্তরে।

এই এক সময়, যখন সত্য অন্যমনস্ক ছাত্রের মতো
ব্যাক বেঞ্চে বসে থাকে আর
মিথ্যা প্রথম সারিতে বিজ্ঞ সেজে ঘাড় নাড়ে, রায় দেয়
যখন তখন। গস্টাপোর ফেউয়ের সন্ত্রাসে
ন্যায় নতজানু অন্যায়ের সম্মুখে; হাজার হাজার গজ
থান কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে নিরীহ রক্তের ছোপ।
এই এক সময়, যখন রাইফেলের ধমকে
বারংবার থেমে যাচ্ছে গুণীর তান,
মনুষ্যত্বের গলায় দিনরাত চালানো হচ্ছে
ধারালো ছুরি, অথচ অনেকে
সে-দৃশ্য না দেখার ভান করে অকাতরে তিন পাক ঘুরে
শুনিয়ে দিচ্ছে এমন কল্যাণ।

এই এক সময়, ভয়ঙ্কর সময়। যারা একনায়কের
স্তব করার বদলে নিন্দা-মুখর, তাদের পেছনে
লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে ডালকুত্তা, যারা
কণ্ঠে তুলে নিয়েছে প্রতিবাদের ঝাঁঝালো ভাষা,
হাতে কল্যাণের পতাকা
তারাই ক্রুশবিদ্ধ হচ্ছে বারংবার।

 এখন ডাকছো কাকে

এখন ডাকছো কাকে? কে যাবে তোমার সঙ্গে? নেই,
সে কোথাও নেই। তাকে তুমি
ডুমুর গাছের কাছে দেখেছিলে যেদিন প্রথম,
সেদিন এখনো বুঝি তোমাকে ইঙ্গিতে
ডেকে নিয়ে যায়
তারুণ্য-খচিত ঘাটে, যেখানে কলস ভাসে স্মৃতির উদ্ভাসে।

দেখলে কি তাকে বাসস্টপে?
নাকি লঞ্চ টার্মিনালে কারো সঙ্গে সুটকেস হাতে
চলে গেল হেঁটে
সুদিনের মতো? তুমি ছুটে গিয়ে দেখলে সে
চোখের পলকে
কোথায় যে মিশে গেল ভিড়ে। তারস্বরে ডেকেও এখন তাকে
পাবে না কোথাও খুঁজে। শুধু
প্রতিধ্বনি তোমার হৃদয়ে এসে বাজবে ভীষণ।

ধরা যাক, অনেক বছর পরে ফের,
দৈবে এরকমও ঘটে,
তার সঙ্গে কোনোদিন কোনো এক অচেনা স্টেশনে
দেখা হয়ে গেল
প্রতীক্ষায় ঘরে দুলে ওঠে লাইনসম্যানের আলো;
তোমাকে গোয়েন্দা ভেবে সরে গেল দূরে।

তখন নিকটে গিয়ে বললে তুমি-
‘চলো যাই, আমরা দু’জন আজ একসঙ্গে ফরেস্টের
ডাকবাংলোয় গিয়ে উঠি। সেখানে নিঃশব্দে বসে
শুনবো ঝিঁঝির ডাক, মাঝে-মধ্যে কোনো বন্য প্রাণী
শুকনো পাতায় শব্দ বাজিয়ে আড়ালে
চলে যাবে শিকারের লোভে। নিরিবিলি
আমরা দৃশ্যের ভাগ নেবো। দেখে নিও
ফিরিয়ে আনবো আমি শূন্য থেকে হারানো গোলাপ।

‘এখন ডাকছো কাকে? কে যাবে তোমার সঙ্গে? নেই,
সে কোথাও নেই আজ’ বলে সে চকিতে
শালটা জড়িয়ে তার প্রখর শরীরে
স্বপ্নের ধরনে যাবে মিলিয়ে নীলাভ কুয়াশায়।

এখন বাজার

Exit mobile version