Site icon BnBoi.Com

গৃহযুদ্ধের আগে – শামসুর রাহমান

গৃহযুদ্ধের আগে - শামসুর রাহমান

অন্বেষা

এলোমেলো ভিড়ে
অনেক ছুটেছি,
অনেক ঘেমেছি,
এবার একটু
দম নিতে দাও।

দ্যাখো রোদে পুড়ে
অস্থিমজ্জা
ঝলসে গিয়েছে,
এখন একটু
ছায়া পেতে দাও।

ওপরে ওপরে
ঢের হলো ভাসা
এবার খানিক
গহন গভীরে
ডুব দিতে দাও।

টেবিলে বাজিয়ে
বাচালতা ঢের
হয়েছে প্রায়শ,
নীরবতা আজ
আরাধ্য হোক।

এতদিন শুধু
হাতের মুঠোয়
খোলামকুচির
চূর্ণ নিয়েছি
কী সুখে দু’বেলা।

সমুদ্র তীরে
মুঠো-মুঠো বালি
উড়িয়ে ছড়িয়ে
দিনান্তে ঘরে
নিঃস্ব ফিরেছি।

খালি হাতে ফেরা
মানে ব্যর্থতা।
এবার ঝিনুক
খুলেই নিটোল
মুক্তোটা চাই।

মুক্তো না পেলে
কোনো খেদ নেই।
তামাম জীবনে
খুঁজে বেড়ানোর
ইচ্ছেটা চাই।

আজই কেন

দাঁড়িয়ে ছিলাম শাড়ি আর কনফেকশনারি
দোকানের সামনে। কখন তুমি আসবে? সূর্য ডুব
মেরেছে, যেমন কোনো কান্তিমান
গ্রীক দেবতা গাছগাছালি ঘেরা হ্রদে। হঠাৎ তুমি
সহজ হালকা সাজে এলে সন্ধেবেলা
আমার রক্তে পালতোলা নৌকা ভাসিয়ে।
আমার হৃৎপিণ্ডের
ধুকপুকানি স্তব্ধ হয়ে যেতে পারতো, যখন
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর
তোমাকে দেখলাম ফুটপাতে। নিয়ন-আলো
তোমার সৌন্দর্যের স্তোত্র রচনার
উদ্দেশ্যে এসে লুটিয়ে পড়ছিল তোমার মুখের ওপর।

‘আমার ফেরার তাড়া আছে,’
বললে তুমি রিক্‌শায় উঠতে উঠতে। একটা বৃশ্চিক
চেপে বসল বুক; তোমার পাশে বসার সুখ
ভেস্তে গেল নিমেষে। আমি কি অন্তহীন কোনো
দুঃস্বপ্নের পথ অতিক্রম করছি?
ভেবেছিলাম, আজ তোমার সঙ্গে কাটাবো
কয়েকটি ঘণ্টা ঘড়ির শাসন
উপেক্ষা করে। আজই কেন আমার প্রত্যাশাকে
জুতোর হিলে চট্‌কে দিয়ে
ফিরতে হবে তাড়াড়াড়ি?

এই চমৎকার গোধূলিতে

আজ এই চমৎকার গোধূলিতে একটি কবিতা
লিখতে গিয়ে ভাবছি,
আমার পংক্তিমালাকে খানিকটা ধোপদূরস্ত
হতে হবে। নাটকের কুশীলবদের মতো ওদের ঘাড়ে মুখে
কিছু পাউডার ঘসে, সারা গায়ে পারফিউম
ছিটিয়ে নেওয়াটাই কেতা। আপনারা যারা
আমার শব্দাবলীর ওপর আলতো বুলিয়ে যাবেন চোখ
অপমান করার ভঙ্গিমায়, তারা মাননীয় বুর্জোয়া;
পাতি বুর্জোয়া। যদি শব্দগুলোর পিঠে ঘোড়া বাগানো
কোড়া মারেন ঘন ঘন, ওরা ট্যা ফো করবে না।

প্রশ্ন করতে পারেন, ‘তুমি কি বাপু সাধুসন্ত কেউ?’ মোটেই না;
আমার মাথার ভেতরে
সুড়ঙ্গ কেটে ঢুকে পড়েছে বৈবাগ্য,
এ-কথা মনে করারও কারণ নেই। খুলেই বলি,
আমাকে এমন এক ব্যামো
কাঁকড়ার মতো আঁকড়ে ধরেছে যে,
দিনানুদৈনিক ভাষায় কিছু একটা উগরে না দিলে
অসহ্য লাগে আমার, নিজেই নিজের মাংস ছিঁড়তে ইচ্ছা করে।

জীবন এমন একটি গাছ, যার ডালে বসে
পা দোলাতে, পাতায় চুমো খেতে
অথবা শ্রাবণ সন্ধ্যায় বৃষ্টির মুক্তো মাথা পেতে নিতে,
আঁজলা উপচে-পড়া জ্যোৎস্না পান করতে
খুব ভালো লাগে। জানেনই তো
এই গাছের ডাল থেকে খ’সে সেই অজ্ঞাতলোকে
একবার যদি চলে যাই, আর
ফেরা হবে না কস্মিনকালেও। তাই, শত চড়াই-উৎরাই
পেরিয়ে টিকে থাকাটাই একটা দারুণ খেলা।

মাঝে-মধ্যে ধারালো নখ দিয়ে
জীবনের দাঁত খুঁটে
গোবেচারা উপহার হাতে প্রিয়জনের জন্মদিনে হাজির হই।
না ভাই, আমি সেই রুবিদের দলে নই, যাঁরা
ফুলবাবু সেজে বঙ্গভবনের দরবারে
কবিতা আবৃত্তি করতে যান। ওঁরা আবৃত্তি করেন
মাদী কবিতা, হিজড়ে কবিতা, টেবো কবিতা,
মার কাটারি কবিতা, ধান্দাবাজ কবিতা, ঠগী কবিতা,
ঢ্যাঙা গাল-তোবড়ানো কবিতা, চিমড়ে কবিতা।
কী করে হাসতে হয়, লোক হাসাতে হয়, কেমন করে
পা ফেলতে হয় রঙিন গালিচায়, আমলাদের
সঙ্গে আমড়াগাছি করতে হয়, দৃষ্টি হানতে হয়
প্রসাধনধন্য সুন্দরীদের দিকে আর বড়-মেজো সেজো
দেবতাদের ফেলে-দেওয়া থুতু চেটে তুলে নিতে হয় সৌজন্যবশত,
এসব কায়দা তাঁরা রপ্ত করেছেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে।

সেই মাননীয় কবিদের সিংহ দরজায়
কার্ড দেখিয়ে ঢুকতে হয় দরবারে এবং রাষ্ট্রপতির
সঙ্গে একই মঞ্চ থেকে পদ্য পড়ার ভাবনায়
তাঁরা আহ্লাদে আটখানা অষ্টপ্রহর। সেই কবিকুল
এমন এক সিঁড়ি বানাচ্ছেন যা বেয়ে তরতরিয়ে
সোজা জান্নাতুল ফেরদৌস। আগাম ঝিলিক
এখন তাঁদের চোখে মুখে
তারার ঝকমকানি।

ভয় নেই, কল্পনাশক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও
আস্তাকুঁড়কে ঝুলন্ত স্বর্গোদ্যান ভেবে
পদ্য আওড়াতে শুরু করবো না অকাল-বসন্তে।
আমার এই বেহুদা উচ্চারণকে পাতি বুর্জোয়া মনের
বিকার বমন ঠাউরে নিয়ে
আমাকে চলতে দিন আমার পথে,
যে-পথে হাজার হাজার বেকার আর খাদ্যান্বেষী মানুষের ভিড়।
বস্তুত আমি এখন
স্বর্গ আর নরকের মাঝখানে ঝুলছি। স্বীকার করি,
আমার এই অবস্থান ভীষণ অস্বস্তিকর এবং
এ-কথা বলতে আমার লজ্জা নেই, আমি চাই না
আমার কবিতা রূপজীবিনীর মতো কোমর দুলিয়ে
দম আটকে মরুক বুর্জোয়া ঠাসা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত
দরবারে, বরং আমি চাই
আমার কবিতা যেন নেরুদা অথবা
নাজিম হিকমতের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে
দুরন্ত হাওয়ায়, খোলা পথে, সবুজ মাঠে, সড়কদ্বীপের
জনসমুদ্রে, যেন সামিল হতে পারে সুস্থ, সবল সোনার টুকরো
আগামী প্রজন্মের কাতারে, আজকের
মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারে নিষ্কলুষ নতুন সভ্যতার।

একজন প্রবীণ বিপ্লবী

বদলে যাচ্ছে, চোখের সামনে
পৃথিবীটা খুব বদলে যাচ্ছে।
যা কিছু প্রবল আঁকড়ে ছিলাম,
সেসব কিছুই মায়া মনে হয়।

এ কী প্রতারণা চৌদিকে আজ!
কোনটা আসল কোন্‌টা যে মেকি,
এই ডামাডোলে বোঝা মুশকিল।
নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে।

আমি কি তাহলে অতীতের কোনো
বিস্মৃত প্রাণী? অগ্নিগিরির
ব্যাপক বমনে হয়েছি বিলীন?
মহা তাণ্ডবে খুঁজি উদ্ধ্বার।

নয়া প্রজন্ম নানা অছিলায়
মুখ ভ্যাংচায়; ভয়ে-ভয়ে থাকি।
আজকে নিজকে কাকতাড়ুয়ার
ভূমিকায় দেখে শিহরিত হই।

নারীর প্রণয়, শিশুর আদর
থেকে ছুটি নিয়ে ছদ্মনামের
আড়ালে লুকিয়ে বেড়িয়েছি একা,
করেছি লড়াই আপোষহীন।

শিকারি কুকুর-তাড়িত জীবন
কেটেছে একদা সকল সময়,
মৃত্যুর মুখে ধুলো ছুঁড়ে দিয়ে
নানা ঘাটে ঘুরে বয়ে গেছে বেলা।

জটিল তত্ত্বে আস্থা রেখেই
প্রগতি-মৃগের পেছনে ছুটেছি।
আজ কেন তবে বেলাশেষে দেখি
স্বপ্নের চোখে হানা দেয় ছানি?

কোথায় যাবার কথা ছিল আর
এ কোথায় এসে থমকে দাঁড়াই?
বন্দি মনের শৃংখল ছিঁড়ে
এসো ছুটে যাই খোলা প্রান্তরে।

যদি ফের কোনো নতুন তত্ত্ব
হাত ছানি দেয় কৃষ্ণপক্ষে,
তবে কি তাকেও পিছুটান মজে
ধু ধু মরীচিকা মনে হবে শুধু?

একজন হরিণীর গল্প

ভূয়োদর্শী গাছগাছড়ার খোঁজে ঢুকেছি জঙ্গলে
কতবার অনাপন পথে শোলা-হ্যাটে বিশুদ্ধ শিশির জমে,
বুটে লেপ্টে থাকে খড়কুটো অবসাদে
কখনো ঘুমিয়ে পড়ি লতাগুল্ম ছাওয়া
ঝোপের আড়ালে, স্বপ্নে দেখি,
হাত মুঠোয় নাচে বিশল্যকরণী, আর নয় অসম্ভব
হৃদয়ের বিষণ্ন ক্ষতের নিরাময়। অকস্মাৎ একটি পতঙ্গভূক
গাছ গঙ্গা ফড়িং-এর অস্থির যৌবন শুষে নেয়।

জঙ্গলের পথে যেতে যেতে একজন তরঙ্গিত
হরিণীকে দেখে
চমকে উঠেছিলাম। অন্য কিছু চোখে পড়েছিল
কিনা আজ আর মনে নেই, শুধু তার
বিদ্যুচ্চমকের মতো রূপ, চোখের মণির গহনতা আঁকা
হয়ে গিয়েছিল বুকে। কিছুতেই তাকে
বিস্মৃতির খাদে ঠেলে দিয়ে ফেলে দিতে
পারিনি এখনো, কত সূর্যাস্তের রূপ মুছে গেল!
একজন হরিণীর কথা ভাবি নিজের ভেতরে
ডুব দিয়ে, বহুক্ষণ এক-একা আছি,
চোখে ঘুম নেই এক ফোটা। শুধু সেই হরিণীর
স্মৃতি চোখ হয়ে চেয়ে থাকে। কস্তুরীর ঘ্রাণে ছুটে
গিয়েছিল, পড়েছে জটিল ফাঁদে। তাকে ঘিরে সব
বাঘসিঙ্গি উৎসবের
আওয়াজ তুলবে সমস্বরে, তারপর মাংস তার
খুবলে খুবলে খাবে, রেণুগুলো ওড়াবে হাওয়ায়।
আমি হরিণীকে সেই ফাঁদ থেকে দূরে
বহুদূরে সরিয়ে নেবার
চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নিজের নির্জনতায় ফিরে
এসেছি, কেননা যতবার
খুলেছি বন্ধন তার ততবারই মাতালের মতো
আবার গিয়েছে ছুটে ফাঁদের নিকটে
নানা ছুঁতো ধরে,
নিজের মাথায় তার ভাঙ্গুক আকাশ, চেয়েছিল।
ভূয়োদর্শী গাছগাছড়ার খোঁজ মেলেনি এখনো। কায়ক্লেশে
ঘুরে ফিরি হরিণীকে একবার দেখার আশায়
তাকে ডেকে আনবার ভাষা
অহঙ্কারী
বট পাকুড়ের পাহাড়, বিনীত ঝর্ণাতলা, পাকদণ্ডী,
নিকট প্রার্থনা করি গলা পেতে। কী জানি কিসের
যোগে আজ কেবলি উপচে পড়ে ওষ্ঠ থেকে
ভুল ভাষা, ভুল প্রতিধ্বনি ঘোরে গহন জঙ্গলে।

জঙ্গলে যে গল্প শুরু হয়েছিল তা শেষ হবার
আগেই কেমন খাপছাড়া
পূর্ণচ্ছেদ হয়ে যাবে? একটি ঘটনা
থেকে অন্য কোনো ঘটনার জট খোলা কী কঠিন।
এ নিয়ে আক্ষেপ নেই তিলমাত্র। ইচ্ছে হয়
আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠি,
তবু কেন চোখে জলছাপ
জেগে ওঠে বার বার, শূন্যতা শোনায় হাহাকার?

 একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায়

কোনো জাঁকজমক পূর্ণ ভোজসভায় রকমারি
সুস্বাদু খাবার
কাবার করতে চাই না। রাস্তার ধারে ধুলোমাখা
যে শিশুটি একটু আগে
আকাশের গলায় ঝুলে-থাকা
মাদুলির মতো আধখানা চাঁদ ছিঁড়ে এনে
খেলনা বানাতে চেয়েছিল,
এখন সে খিদেয় কাঁদছে, আমি
তার জন্যে এক সান্‌কি গরম ভাত চাই।

আমি ওয়ার্ডরোবে থরে থরে সাজানো
পোশাক চাই না। যে যুবতী তার একমাত্র
আবরণ অন্ধকারে মেলে দিয়ে
পানির ঝাপটা লাগা পাখির চোখের মতো
কাঁপছে নগ্নতায়, তার আব্রুকে মুকুট পরাবো বলে
আপাতত একটি শাড়ি চাই।

সর্বদা খর পাহারায় থাকা
কোনো রক্তপিপাসু একনায়কের
করমর্দন করতে আগ্রহী নই। ঐ যে স্বৈরাচার-বিরোধী
শ্লোগানের তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে
সাহসী মানুষগুলো এগিয়ে চলেছে জনপথে
মানুষের অপমান চিরদিনের জন্যে
মুছে ফেলবে বলে, আমি তাদের
মিছিলে সামিল হতে চাই।

প্রিয়তমা, এই বন্ধ্যা সময় আমার স্বীকৃতি
পাবার যোগ্য নয়। বরং চুমোয় চুমোয়
আর আলিঙ্গনে আর প্রাক-প্রভাতের সঙ্গমে তোমাকে
করে তুলবো সন্তান সম্ভবা। ফুটফুটে নবজাতক
দুলবে দোলনায় নিটোল শান্তিতে, তুমি দেখবে
সন্ত্রাসমুক্ত দৃষ্টিতে। একদিন সে কৈশোরে
ধর্মনিরপেক্ষতা আর গণতন্ত্রের ছায়া মেখে
দৃপ্তপদক্ষেপে প্রবেশ করবে
একবিংশ শতাব্দীতে, তুমি দেখবে মুখাবেশে,
তোমার ঠোঁট থেকে হাসির কুঁড়ি
ঝরতে থাকবে ক্রমাগত
লালকমলের বিজয়ে।

কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেলে, এক ঝটকায়
লোপাট করে মুক্তি দেবো
স্বৈরাচার-পীড়িত
রাজনৈতিক বন্দিদের; কেননা, কোনো
দেশভক্ত জেলে পচতে থাকুক,
এ আমার কাম্য নয়।

যারা অমরতার বাদ্যরব শুনতে চায়
দিনভর, রাতভর, তাঁদের তালিকায় আমার নাম
খুঁজে পাবে না কেউ। প্রিয়তমা, যে কবিতায়
তোমার নিঃশ্বাসের সুগন্ধ
আর পুরুষ্ট, সতেজ ফলের মতো স্তনাভা থাকবে,
শিশুর সদ্য-দুধ-খাওয়া মুখের ঘ্রাণ
আর কোকিলের ডাকের মতো ব্যাকুলতা
আর মেঘনা নদীর মাঝির
গোধূলিবেলার হাঁক থাকবে, থাকবে
আগামীর অগণিত মানুষের
স্বপ্নের মতো পদধ্বনি,
তেমন কবিতা আমি লিখতে চাই
ধ্যানে নিমগ্ন,
একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।

 কীভাবে ছিলাম বেঁচে

কীভাবে ছিলাম বেঁচে তোমাকে ছাড়াই পরবাসে
এতদিন? বিপন্নতা, বিভীষিকা আমার আকাশে
ছিল ব্যেপে, তোমার অনুপস্থিতি বসাতো সুতীক্ষ্ণ দাঁত আর
আমার ভেতরে স্তরে স্তরে বেদনার
দাগ লেগে থাকতো, যেমন ফসিলের গায়ে মাটি
এবং পড়তো মনে দুজনের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর খুঁটিনাটি।

পথ চলি মৃত্যুর অধিক অন্ধকারে সম্বলবিহীন একা;
যখন তোমার সঙ্গে দেখা
হয় না, তখন ভাবি, সূর্যোদয়, বসন্তবাহার, মিথ্যা সবই
এবং কেবলি মনে হয় আমি নির্বাসিত কবি
নিজ বাসভূমে, অন্তর্গত অভিমান
যদি পারতাম দ্রুত করতে চালান
উড়ে যাওয়া দোয়েলের গীতে,
পাতার মর্মর আর শ্রাবণের নদীর ধ্বনিতে।

যতই পুড়ি না কেন চিতার কাঠের মতো, তোমাকে প্রতিমা
বলে জানি; পাবো কি তোমার দেখা এই মর্ত্যসীমা
পেরিয়ে আবার?
ভাবি শুধু,-আমি কি প্রেমিক নাকি একনিষ্ঠ পূজারী তোমার
যায় প্রত্যাবর্তনের গানের বিভূতি অস্তিত্বের খাঁচা থেকে
নিভৃতে ছড়িয়ে পড়ে, তোমার হৃদয় দেয় ঢেকে।

ক্ষমা নেই

আমি কি গিয়েছি ভুলে কীরকমভাবে লেখা হয়
নিত্য নতুনের ছোঁয়া লাগা
প্রেমের কবিতা? ইদানীং শুধু তুমি
খুব স্বতঃস্ফূর্ততায় এসে যাচ্ছো আমার প্রতিটি কবিতায়।
তোমার শ্রীমন্ত ওঠা-বসা, আসা-যাওয়া,
হাঁসা-কাঁদা, মান-অভিমান আর উষ্মার রঙিন ক্যাকটাস-
সবকিছু আমন্ত্রিত অতিথির মতো
আমার কবিতা জুড়ে বসে থাকে আরামে পা তুলে।

তোমার উদ্দেশে পংক্তিমালা না সাজালে
আমার রচনা আর কবিতার মধ্যে সীমাহীন দূরত্বের কুয়াশা জড়ানো
থেকে যায়; জানি না এমন কোনো উপমার খোঁজ,
যা সহজে দেয় ধরা, যেমন অভিজ্ঞ
ধীবরের জালে বহু চকচকে মাছ।

নিজেকে উজাড় করে বার বার করেছি অর্পণ
তোমাকে উৎপ্রেক্ষা কত, অন্তরঙ্গ অনুভূতিমালা
আমি কি এখন
আত্মানুকরণে তৃপ্ত হবো দিনভর, রাতভর?
কখনো কখনো ভাবি, তোমাকে আমার
কবিতার চতুঃসীমা থেকে
দেবো নির্বাসন, তা হলে তো কবিতাও যাবে দ্রুত
বনবাসে খরায় চৌচির কোনো জমিনে আমাকে ফেলে রেখে।

কোকিল কি দোয়েলকে কেউ অপবাদ
দেয় না কখনো চিরকাল চরাচরে একই সুর
ঝরাবার জন্য, কবিদের
ক্ষমা নেই, যদি তারা বন্দি থাকে অভিন্ন ভঙ্গিতে।

 গর্জে ওঠো স্বাধীনতা

কী করবো সে বসন্ত দিয়ে যাতে আছে শুধু ধু ধু
কোকিলের ডুকরে ওঠা, নেই
ফুলের বাহার? সে বাগানে কী কাজ আমার, বলো,
যেখানে আসে না পাখি কোনোদিন? কী রুক্ষ কঠিন
মাটি আর দাঁড়ানো প্রেতের মতো সারি সারি গাছের কংকাল।
কী দরকার সে প্রেমের যা কেবলি কাঁটার
মুকুট
পরায় মাথায় আর বিষপাত্র তুলে দেয় হাতে?
কোন্‌ কাজে লাগে সেই পথ,
যেখানে হাঁটে না কেউ, যেখানে অদৃশ্য
রঙীন আইসক্রিমঅলা, শহর-ভাসানো মিছিলের ঢেউ?

তোমাকে ডেকেছিলাম, প্রিয়তমা, যখন সূর্যের সূর্যোদয়ের দিকে
মুখ রেখে যাত্রা ছিল আমাদের, বুর্জোয়া মোহের
পিছুটান আনেনি তোমার কানে জনগণমন-জাগানিয়া গান।
জাঁহাবাজ ঈগলের নখরের ভীষণ আক্রোশে
এখনো বন্দিনী তুমি, হাঁটতে পারো না রংধনুর গালিচামোড়া পথে।
তুমি বিনে কী দুরূহ এই পথ চলা।

চৌদিকে আঁধার করে বিকট দানব আসে পায়ের তলায়
নিমেষে গুঁড়িয়ে নব্য সভ্যতার বুনিয়াদ,
ফাঁসিতে লটকে দেয় পূর্ণিমা চাঁদকে, আর নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সব
পদ্ম আর গোলাপের উন্মীলন, দোয়েলের শিসঃ
নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আমার পদ্যের পর্বে পর্ব্যে নিরিবিলি
তোমার নিঃশ্বাস আর চুলের সৌরভ।

সুদিনের প্রতীক্ষায় যে কিশোরী বাঁকানো শরীরে
বসে আছে বার্ধক্যের বিজন দাওয়ায়,
তাই এই বয়সের ভারের দোহাই,
নেলসন মান্দেলার দীর্ঘ কারাবাসের দোহাই,
বীর যুবা নূর হোসেনের শাহাদাতের দোহাই,
দিগন্ত কাঁপিয়ে ক্রুদ্ধ টাইটানের মতোই আজ
হাতের শেকল ছিঁড়ে ফেলে
গর্জে ওঠো, গর্জে ওঠো তুমি স্বাধীনতা।

গৃহযুদ্ধের আগে

চাঁদটা কি আরকে-ডোবানো অকালজাত শিশুর মতো
দলাপাকানো? হাওয়ায় কী একটা প্রেতগন্ধ ঘোরাফেরা
করে সর্বক্ষণ, অনবরত
গুমরে উঠছে দেয়ালগুলো, গলা-চেরা
অদ্ভুত চিৎকারে ঘুম
ভেঙে যাচ্ছে সব্বার, এ শহর আর
বাসযোগ্য নয়, মাঝে মধ্যে কী নিঃঝুম
লাগে, যতক্ষণ জেগে না ওঠে আবার হাহাকার।

ঝাড়লণ্ঠনের আলো, টুংটাং আওয়াজ,
নূপুর ধ্বনি, চেনা
গুঞ্জন, কিছুই তাকে আজ
পেছনে আটকে রাখতে পারছে না।

তার গায়ে লেগে প্রতিটি শব্দ পিছলে পড়ে, এক ঝটকায়
বেরিয়ে যায় পুরানো দালান ছেড়ে। কে কাকে
কোথায় লটকায়?
চোরকুঠুরিতে না কি গাছে?
কে যেন ডাকে
তারানা বাঈ-এর গলায়; সে কি আছে
এখনো মাইফেলে এই খাঁ খাঁ দুপুরে?
পিছু ডাকে কাজ হবে না, নেমে
এসেছে সে রাস্তায়, বাসি রাতের এস্রাজি সুরে
দিনের পথিক হঠাৎ থেমে
যাবে না; তার জন্য কোনো পালকি-বেহারা
অথবা মোটরকারের দরকার নেই।
হারিয়ে ফেলেনি খেই।

তোমরা কেউ জিগ্যেম কোরো না, ইতিমধ্যে কারা
দেশান্তরী হয়েছে, কাদের ঘর
ছারখার, কে কে মারা
গেছে অর্থাৎ নিহত; কারা পায়নি আশ্রয় কিংবা কবর।
চলছে সে কোন দিকে? উত্তরে না দক্ষিণে?
পূর্বে? পশ্চিমে? অবান্তর এসব প্রশ্ন। নিঃশ্বাসে
যতক্ষণ জোর আছে হাঁটবে, দৌড়ুবে, পথ নেবে চিনে,
দম ফুরুলেই উঠে পড়বে দূরগামী বাসে।

বসে বসে ওর কি আসছে ঢুলুনি?
এরকম হলে নাস্তানাবুদ। গন্তব্যে এসে
চলে গেলে সে দাঁড়াবে কোথায়? গন্তব্যই বা
কোথায়? ‘শুনি,
বন্দুকের আওয়াজ’, বলে কেশে
থুতু ফেলে আশেপাশে দৃষ্টি বুলোয়।
না, এখনো সময় হয়নি নামার।
চোখ অন্ধ হয়ে আসে ধুলোয়,
রঙ বদলে যায় জামার।

ঘুরপাক খাই

তার পথ চেয়ে দিনভর রাতভর
একা একা থাকা, এ আমার বিধিলিপি
আঁশটে গন্ধ নিয়ে কালো সংশয়
কাঁকড়ার মতো মন্থর হেঁটে যায়।

ভেবেছিলাম সে আমাকেই ভালোবাসে।
অন্তত তার চোখের ভাষায় ছিল
নির্ভুল এক প্রেমের অঙ্গীকার।
প্রতারণা থাকে নিবিড় আলিঙ্গনে?

তার প্রতি জানি আস্থা অটুত আজো,
সেই অনুসারে হাত ধরি, চুমো খাই;
কানে কানে বলি জ্যোৎস্না মাখানো কথা,
যে কথা তাকেই দ্বিধাহীন বলা যায়।

তবু কেন কাঁটা খচ খচ করে মনে?
কেন বৈশাখী ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়?
গোধূলি বেলায় খুব সাজগোজ করে
সে যখন যায়, আমি অনিবার জ্বলি।

সাধ হয় দিই নিভিয়ে সকল বাতি,
সারাটা শহর তছনছ করে ফেলি।
কিন্তু সে বড় উদাসীন আচরণে,
ভ্রূক্ষেপ নেই তখন আমার প্রতি।

যদি সে চাইতো আমাকে পারতো দিতে
মর্ত্যভূমিতে স্বর্গের সন্ধান।
কী এক আগুনে জীবন ঝলসে দিয়ে
কেবলি ঠেলছে নরকে সারাক্ষণ।

কম কথা বলে ইদানীং কাটে বেলা।
গোপন মৎস্য ধরবার বাসনায়।
তার অন্তরে জাল ফেলি অবিরত,
অথচ আসলে কিছুই পড়ে না ধরা।

শিহরিত হই কুৎসিত কীট দেখে
অপরূপ এক ফুলের মর্মমূলে।
যে আমাকে আজ বিভ্রমে ঢেকে রাখে,
তারই ধ্যানে ক্ষয়ে যাচ্ছি ভীষণ দ্রুত।

আমাকে এখন শিকারি কুকুরগুলো
টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতে চায়।
কৃষ্ণপক্ষে ঘোরে চৌদিকে ফেউ,
কী করে হৃদয় যাবে অজ্ঞাতবাসে?

যে ভেলা ভেসেছে উত্তাল তটিনীতে,
তার ফাঁকে ফাঁকে কত যে ফস্কা গেরো;
খল তরঙ্গে বৈঠা গিয়েছে খোওয়া,
ঘুরপাক খাই হিংস্র ঘূর্ণিজলে।

চিরকাল শুধু

খুব বেশি কিছু চাই কি আমার? আমি কি এতই
লোভাতুর শুধু চাই বলে কাটাই প্রহর?
সত্যি বলছি, বিশ্বা করো, কখনো আমার
তেমন কিছুর দরকার নেই। সাজানো গোছানো
ঝকমকে বাড়ি, ঘুরে বেড়ানোর চকচকে গাড়ি
চাই না কিছুই। পথে যেতে-যেতে আচমকা পাবো
ফুলের গন্ধ, গ্রামে ফেলে-আসা পূর্ণিমা-রাতে
হীরের দ্যুতির মতো পুকুরের হাসি-হাসি পানি
ছলকে উঠবে স্মৃতির কিনারে, ছোট বোনটিকে
মেলায় হারিয়ে পুনরায় ফিরে পাবার চমক,
দূর থেকে ভেসে ঢেউ-হয়ে-আসা বাঁশির রাগিণী,
আমার সাহসী বন্ধুর কারাবাসের অন্তে
তাকে বুকে চেপে ইতিহাস পুরে হাতের মুঠোয়
ঘরে ফিরে আসা, শুধু এটুকুর আছে প্রয়োজন।

এটা কি তেমন বেশি কিছু চাওয়া? মাথার ভেতর
চাঁদের মধুর মদির আগুন নিয়ে প্রাণ ভরে
শব্দ ছন্দ বানানোর খুশি, মায়ের পুরানো
শালের বাইরে ফুটে থাকা দুটি কল্যাণী হাত
দেখার তৃপ্তি, মধ্য রাতের বিজন প্রহরে
ঘুম ভাঙা চোখে জানালার ধারে নিঝুম দাঁড়ানো,
একটু আগেই তোমাকে স্বপ্নে ছুঁয়ে, প্রীত হওয়া,
সন্ধ্যার মতো দুপুরে হঠাৎ বৃষ্টিতে স্নান,
পাতায় পাতায় ফেরেশতাদের মৃদু করতালি,
শ্মশানের পাশে বন কুসুমের ফিক করে হাসা;
আর কিছু নয়, তোমার বাসার সিঁড়ি ভেঙে ওঠা,
চিরকাল শুধু তোমাকে পাবার ব্যাকুলতা থাকা।

ঝরা পাতা

এ আমি কোথায় এসে পড়েছি হঠাৎ? ঘাটে নৌকো
বাঁধা ছিল; কী খেয়াল হলো
খুঁটি থেকে দড়ি খুলে চেপে বসলাম
গলুইয়ে, ভাসলো নৌকো ঘন
কুয়াশায়। কিছুটা কুয়াশা
কী করে আলতোভাবে যেন মাথার ভেতরে ঢুকে
গেল, শুধু মনে পড়ে, আসার সময়
আমার পায়ের নিচে শুকনো পাতাগুলো
খসখসে স্বরে
পুরানো দিনের কোনো কাহিনীর মতো কিছু একটা বলছিল।

কুয়াশায় চতুর্দিক মতিচ্ছন্ন খুব,
কিছুতেই সম্মুখের দিকে কোনো কিছু
দেখা যাচ্ছিল না; যদি বলি, সে মুহূর্তে অন্ধকারে
একটুও ভয়ডর ছিল না আমার,
বুকের ভেতর কোনো প্যাঁচা হুম্‌ হুম্‌ ডেকে
ওঠেনি, বরং এই কুয়াশায় যদি
লুপ্ত হই, তাহলে কিছুই এসে যাবে না আমার।
কেবল পড়বে মনে পায়ের তলায়
ঝরা পাতা কী যেন শোনাতে চেয়েছিল।

তাবু ছেড়ে ছুটে আসে

আকাশে উটে কুঁজ, বাঁকা ছোরা হয়ে ঝোলে
চাঁদ, চোখে ঘুমের নাছোড় আঠা, তাঁবু কাঁপে অশান্ত হাওয়ায়।

“এ কিসের শব্দ শুনি? এ কেমন গান,
যা সুরেলা বুলবুলও পারে না গাইতে, আসে ভেসে
আমার তাঁবুতে? এরকম আর্তস্বরে
কে ডাকছে লায়লা লায়লা বলে? আমার কায়েস ছাড়া, হায়,
কে আর ডাকতে পারে আমাকে এখানে? এরকম
মর্মমূল-ছেঁড়া ডাক কার হতে পারে আর বলে
ব্যাকুল লায়লা তাঁবু ছেড়ে ছুটে এসে
দাঁড়ায় প্রশস্ত পথে। নেকাব ছিল না মুখে তার।
যেনো সে হরিণী এক, গায়ে যার লেগেছে আগুন
অকস্মাৎ বেখেয়ালে। শিশির-ঝরানো
আওয়াজে লায়লা করে উচ্চারণ, আমার উন্মাদ
যে-জন তোমরা তার দিকে কেন ছুঁড়ছো পাথর
বার বার? কী ওর কসুর, বলো? তোমাদের কারো
কোনো ক্ষতি করেনি যে, তাকে
কেন দিচ্ছো সাজা মিছেমিছি? দ্যাখো কী হাল করছো তার।
মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে, অথচ
একেবারে বেখবর সে এখন, শুধু লায়লার
নামে গান বাঁধে,
যে গান মুদ্রিত হয় ধু ধু মরুভূতে, পান্থপাদপে, নহরে
এবং হরিণ শাবকের পিঠে। দ্যাখো কায়েসের
বিলাস-ছোপানো
পোশাক হয়েছে আজ মজনুর শতচ্ছিন্ন মলিন লেবাস।
দোহাই খোদার, ওকে কোরো না পীড়ন,
বরং আমাকে দাও জুলুমের রূঢ় দাগ, যত দিতে চাও।
লায়লা কাতর কণ্ঠে আরো কিছু কথা
বলে সেই প্রস্তর নিক্ষেপকারীদের উদ্দেশে, ‘সেদিন এক
নামাজীর সেজদার সামনে দিয়ে কায়ক্লেশে হেঁটে
গিয়েছিল ফোস্কাময় পায়ে
যে-মজনু তাকে সে ধার্মিক জোরে সোরে
শাসালেন, “হে নাদান, দেখছো না পড়ছি নামাজ?’
হে প্রবীণ, মাফ চাই আমি,
এই অভাজন একজন মানবীর প্রেমে মশগুল হয়ে
তাকে ছাড়া অন্য কিছু দ্যাখে না দু’চোখে,
অথচ আপনি ত্রিলোকের মালিকের এবাদতকালে এই
নগণ্য লোকের ছায়া দেখে
এলেন বিদ্বেয়ে তেড়ে এবাদত ছেড়ে? মজনুর
জবাবে লজ্জিত বর্ষীয়ান
আবার গেলেন ফিরে জায়নামাজের মখমলে।
“এ রকম যে মানুষ, তাকে কেন হানছো আঘাত”,
বলে কায়েসকে বুকে টেনে নিয়ে অশ্রুপাত করে
লায়লা এবং মজনুর বুক হয় দীর্ঘশ্বাস,
“মিনতি কোরো না আর হে লায়লা আমার, হানুক
নিষ্ঠুর আঘাত ওরা, যত ইচ্ছে ছুঁড়ুক পাথর,
লায়লা তোমার নাম উচ্চারণ করলেই পাথর নিমেষে
রূপান্তরে বেহেশতের ফুল! প্রিয়তমা,
ক্ষমা কর তোমার এ প্রেমিকের বেহদ উদ্ভ্রান্ত আচরণ।
বন্দনায় মুড়ে দিতে গিয়ে অখ্যাতির কালো তাজ
দিয়েছি পড়িয়ে তোমাকেই; নিজেই নিজের বৈরী এ কায়েস।

“কী আর করার আছে ক্ষমা ভিক্ষা ছাড়া? যদি আমি
লায়লা লায়লা ডেকে এ মরুর বুকে,
কখনো ঘুরে না বেড়াতাম রাত্রিদিন ঘুমহীন, খাদ্যহীন,
তাহলে মতোনা
কখনো তোমার বদনার। দুই কাবীলার ঘোর রেষারেষি
কলহ বিবাদ আজ আমাদের দুজনকে বিপন্ন করেছে।
আমার হৃদয় যদি কণ্ঠ হয়ে করে উচ্চারণ
তোমার মধুর নাম, তবে আমি তাকে
কী করে থামাবো, বলো? ঘোড়ার কংকালময় বালিয়াড়ি আর ফণিমনসায়
সর্বদা থাকবে লেগে আমার নিজস্ব হাহাকার।
মৃত্যুর পরেও তুমি হেঁটে যাবে কবরের ওপারে, কাঙ্ক্ষিত
অমরতা নামক সঙ্গীর হাত ধরে,

এখানে প্রতিটি ফুল বাতাসের কানে রটাবে তোমার নাম।
জীবন তো দীর্ঘশ্বাস হয়ে রইলো, বিচ্ছেদ মলিন;
মৃত্যুর দরজা ছাড়া মিলনের স্বতন্ত্র প্রবেশদ্বার নেই।

তৃষ্ণার্ত পাখির মতো

তোমার নিকটে গিয়ে ইচ্ছে হলো বলি,-
‘আমার অনেকগুলো অক্ষরবিহীন কবিতার
খসড়া লুকিয়ে আছে তোমার শাড়ির
ভাঁজে ভাঁজে, খুঁজতে এসেছি। আমি কিছু
বলার আগেই বললে তুমি,
‘কী-যে করো, এত দেরি করে আসার কী মানে, বলো?
একটু সময় নেই, এক্ষুণি বেরুতে হবে, বাই।
আমি কি দুমড়ে গেছি কালবোশেখির লাগাতার
চড়-খাওয়া গাছের ডালের মতো? যাও তুমি
যেখানে যাবার, চলে যাও দ্বিধাহীন।

তোমার আতিথ্য ঢের নিয়েছি দুহাত পেতে। আজ
না হয় বরাদ্দ রেশনের কিছু ভাগ
রাখলে গোপনে কেটে। সান্ত্বনা আমার চুলে বিলি
দ্যায় আর থুতনি নাড়িয়ে
বসে বসে নাড়ু খেতে বলে নিরিবিলি। ঘটনাটা
সকালে কাচের ঘরে স্বপ্ন বৈ তো নয়।

এখন কোথায় যাবো? উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরি
চৈত্রের দুপুরে আজ লাগবে কি ভালো? তিন চার
মাইল হাঁটার পরে পার্কে বসে কাটাবো সময়,
অথবা দাঁড়াবো একা নদীর কিনারে? কত আর
ঢেউ গুণে, খেয়া পারাপার দেখে, শুনে
বেদেনির গান অভিমানী পাখিটাকে অবেলায়
রাখবো পাড়িয়ে ঘুম। এখন তোমাকে
উষ্মার লালচে ফণা দেখাতেও ইচ্ছে হয় না। বরং হেসে
ভাঙা কাচ আরো গুঁড়ো হতে
দেখে যাবো ক্রমাগত। তুমি ভুলে যাবে
ছয় সাত মিনিট আগেও আমি এখানে ছিলাম। দুটি চোখ
তৃষ্ণার্ত পাখির মতো ঠোঁট ঘঁষে উদাসীনতার
পাথরে বিদায় নেবে। যদি জ্যোতিহীন হয়, তবে ক্ষতি কার?
কয়েক বছর পরে, হয়তো কালই, তুমি সেজেগুজে
অথবা মামুলি শাড়ি শরীরে জড়িয়ে,
খোলা চুল, প্রসাধনহীন
থাকবে ড্রইংরুমে বসে চুপচাপ কিংবা দেবে গড়াগড়ি বিছানায়
একাকিনী ব্যাকুল আমারই প্রতীক্ষায়। সে আসবে,
সে আসবে’, বলবে তোমার হৃৎস্পন্দন। কিছুতেই
হবে না আমার আসা। বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে যার
সকল নিঃশ্বাস, তার কোনো আসা-যাওয়া নেই।

 দাঁড়ালাম এখানে

এই দ্যাখো, লোভের লকলকে জিভ
একটানে ছিঁড়ে
দাঁড়ালাম এখানে।

ভালোবাসার যোগ্য যে,
তাকে প্রেমের মণিহার
পরানোর উদ্দেশ্যে
আমার এই আসা,
আর ঘৃণা যার প্রাপ্য
তার উদ্দেশে ধিক্কারের
ঢাক পিটিয়ে, বিশ্রামের
আঙুর গুচ্ছ, নিয়ে চমৎকার
খেলবো কিছুক্ষণ।

বাধার ঘাড় মটকে সকলতুচ্ছের
পুচ্ছ ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে
আমি আগুনের ভেতর দিয়ে
হেঁটে গেছি।

আকাশে নক্ষত্রের অক্ষরে
মুক্তিবাণী লিখে কারা সেখানে
সেঁটে দিয়েছে পোস্টার?
শুনতে পাই, ফাল্গুনের পাতায়
মুখ লুকিয়ে গলায় রক্ত তুলে
ক্রমাগত ডেকে চলেছে
গণতন্ত্রকামী কোকিল।

কে ঢিল ছুঁড়লো স্তব্ধতার
সর-পড়া ঝিলে?
আমার হাত তোমার হাতের দিকে
প্রসারিত দিন রাত। যারা আমাদের
দুজনের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে
দেয়াল তাদের ক্ষমা করে দিতে
কেউ যেন না বলে আমাকে।
আমার বসত বাড়িতে আগুন লাগিয়ে
যারা হাত-পা সেঁকে নেয়,
আমার বোনের চুল ধরে
হিড় হিড় টেনে নিয়ে যায়
ওদের জন্যে বুকে জমিয়ে রেখেছি
এক উপহার,
দাউ দাউ আগুন।

আর ঘুরঘুট্রি
এই অন্ধকারে তোমাকে খুঁজে
না-পাওয়া অব্দি
আমার পায়ের রক্ত
শুকোতে দেবো না।

নিভিয়ে এক ফুঁয়ে

আকাশ যেন আজ ঠাণ্ডা ভারী কাঁথা
ময়লা ফুটো দিয়ে মারছে উঁকি তারা।
পায় না মনে ঠাঁই ঘরে ফেরার টান,
কলিংবেল দিলো ঝাঁকুনি সন্ধ্যাকে।

পাশের ঘরে এই কবিকে তাড়াতাড়ি
লুকিয়ে রেখে তুমি বিদায় চেয়ে নিলে।
তোমার আচরণে এমন মায়া ছিল,
নিষ্ঠুরতা বলে তাকে পারিনি ধরে নিতে।

বুকের ঝাড়বাতি নিভিয়ে এক ফুঁয়ে
আমাকে ফেলে তুমি ক্ষিপ্র চলে গেলে।
আমার স্বপ্নের পাপড়ি সমুদয়
ছিঁড়েছো কুটি কুটি; হুতুশে তাই মন।

অথচ কিছু আগে দুজনের হাতে হাত
রেখেছি অনুরাগে, ওষ্ঠে নিয়ে ঠোঁট
ভুলেছি লহমায় জগৎ সংসার।
কার সে ঝটকায় গিয়েছো দূরে সরে।

তখন কাছ থেকে বুকের ওঠানামা,
ঠোঁটের নড়া আর চোখের ঝলকানি
দেখেছি তন্ময় এবং তোমাকেই
ব্যাকুল পান করে, কেটেছে সারা বেলা।

আমাকে রেখে গেছো এ শীতে অসহায়,
একলা বসে দেখি অন্তগামী চাঁদ,
এবং শুনি মৃদু পাখির ডানা ঝাড়া।
হৃদয়ে ধুলিঝড়, প্রহর গুণি শুধু।

কখন তুমি ফিরে আসবে জানি না তা।
কোথায় বসে আছো কেমন হুল্লোড়ে,
কথার হাইফেনে, বিদ্রুপের তোড়ে,
পড়ে কি মনে তাকে, এসেছো ফেলে যাকে?

তোমার সত্তায় পূর্ণ অধিকার
প্রতিষ্ঠিত হায় হলো না প্রিয়তমা।
তোমার বরতনু আমার খর তাপে
মাখন হয়ে, আজো গলেনি একবারও।

যখনই কাছে আসো, আলিঙ্গনে বাঁধো,
হঠাৎ জেগে ওঠে তীব্র কোলাহল।
নিষাদ তীর ছোড়ে আমার দিকে, তুমি
আমাকে বার বার আড়াল করে রাখো।

কিন্তু কতকাল থাকবে আবডাল?
আমি কি তস্কর অথবা আততায়ী?
নিজেকে মিছেমিছি অন্তরালে ঢাকি;
হৃদয় ঘায়ে ঘায়ে রক্তজবা হয়।

যখন পুনরায় আসবে তুমি আর
আমার চোখে মুখে নামবে নিরিবিলি
তোমার মসৃণ চুলের কালো ঢল,
বক্ষে নেবো টেনে, কখনো ছাড়বো না।

হন্তারক এই যুগের তমসায়
আমাকে একা ফেলে যেও না তুমি ফের;
না দাও তুলে যদি প্রেমের হাতে ফল,
ইহজীবনে আর ছোবো না তণ্ডুল।

নিভৃতে আমার অগোচরে

হে মেয়ে তোমার যোনি, যা দেখিনি আজো,
মৃদু হাসে নিভৃতে আমার অগোচরে; আঁটো, রাঙা
স্তনদ্বয় লুকোচুরি খেলে
রোদ্দুরে ছায়ায়, যেন হরিণশাবক
ঝিলের কিনারে ঝোপে বিহ্বল জ্যোৎস্নায়। বিদায়ের
বিষণ্ন বেলায় সিঁড়ি দিয়ে
আস্তে সুস্থে নেমে যেতে
তাকাই তোমার দিকে অপলক, কখনো টেনে নেই বুকে
ঝড়তোলা আকর্ষণে; রাজেশ্বরী চুলের ঝলক তার চোখের চমকে
আমার হৃদয় রাজধানী হয়ে জ্বলে,
লিপস্টিক-বুলানো ঠোঁটের
মখমলে চেপে ধরি ঠোঁট, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, স্তব্ধ হয়
পৃথিবীর গতি; সে মুহূর্তে জঙ্গী ট্যাঙ্ক
আমার উপর দিয়ে চলে গেলে কিছুই পাবো না
টের, শুধু ঠায়
থাকবো দাঁড়িয়ে খাজুরাহো যুগ্মতায়

নির্ঘুম রাত্তিরে
হে মেয়ে তোমার যোনি কাঁদে
একাকিনী বিষণ্ন রানীর মতো নরম বালিশের মুখ চেপে,
দেবদূতী মুখ নিয়ে চাঁদ
উঁকি দেয় জানালায়, মধুর বদান্যাতায় শাদা মশারিতে
ছড়ায় আবীর আর নিশান্তের স্তব্ধতায় হাওয়া
চুমো খায় তোমার লাজুক নাভিমূলে, অথচ একটু ছুঁলে
আমি, তুমি আমাকে সরিয়ে দাও দূরে।
তোমার যোনিতে ঝরে স্বর্গীয় কুসুম।

তুমি কি আমার কথা ভেবে ঢেউ হয়ে কেঁপে ওঠো
বারবার, বলো
‘হে পুরুষ, হে শব্দের শেরপা, তুমিই
সর্বস্ব আমার?’
তখন তোমাকে দেখে বুকে
উঠবে না জ্বলে রিরংসার ঝাড়বাতি,
চোখে লেগে থাকবে শয্যায়
নিরিবিলি একরাশ জুঁই ফুল দেখার স্নিগ্ধতা।

নীরবতা

দুপুর গলা বাড়িয়ে দেখেছে আমাদের
হৃদয়-পথের জনশূন্যতা,
যেখানে ছায়া মাছের চোখ।
আমাদের দুজনের কথোপকথনের
মুহূর্তগুলো
হাটগামী মানুষের মতো দ্রুতচারী। হঠাৎ মনে পড়ে,
এইতো সেদিন কোদালে ওল্টানো কাঁচা মাটি
আমার আলগা মুঠো থেকে ঝরে মিশে গেল
মাতুলের সদ্য কবরে। কী একটা পাখি
বুকের ভিতরে ডুকিয়ে উঠেছিল। সূর্যাস্তের পরে
ময়ূর নেচে উঠবে এখানে
কলাপ মেলে; আমরা কেউ
থাকবো না। সে দৃশ্যকে নিবিড়
মগ্নতার ধারণ করে শরীরে লাগিয়ে দেবো আগুন।

আবার যখন দেখা হবে, কস্মিনকালেও
সে টের পাবে না কী রকম দগ্ধ হয়েছি, হৃদয় জুড়ে
কত দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। আগ্নেয়গিরির লাভা
গা থেকে ঝেড়ে ফেলে আমি যে অসমাপ্ত
কথার খেই ধরতে এসেছি তা বাসা-বদলের
ভাবনার এবড়ো থেবড়ো কিনারে,
তার ধারণার বাইরে। ওর বুকের
ওঠা নামায় আমার কবিতার নিজস্ব ছন্দ খুঁজি।

এ কোন্‌ ঘোড়সওয়ারের হাতের চাবুক আমার পিঠে
বিদ্যুচ্চমক? এই মার থেকে বাঁচার জন্যে
ঝাঁপ দেবো কোন্‌ সরোবরে? আমার হাতের রক্তভেজা
ছাপ তার হৃদয়ে রাখতে চাই না। এভাবে
দিন চলে যেতে থাক শরীর টেনে টেনে।
আমিও যাবো দিগন্ত চিরে, আবার ফিরে এসে
তার মুখোমুখি বসবো। সে মুখ লুকাবে
ফুলের পাপড়িতে। যৌবনের ঘ্রাণে আমি উন্মাতাল।
আমাদের দুজনের কথোপকথনে
ছায়া ফেলে মিরোস্লাভ হোলুবের প্রতি-কবিতা,
বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা, সড়কদ্বীপের
কবি সম্মেলন আর সোভিয়েত ইউনিয়নে
পাস্তারনাকের উজ্জ্বল পুনর্বাসন আর খাঁচায় পোরা
জ্বলজ্বলে কালো বাঘের মতো
নেলসন ম্যাণ্ডেলার জেগে-থাকা
বন্দি জীবন। আমাদের কথোপকথনের ফাঁকে
যখন আমার অধীর চুম্বনে
ওর দম বন্ধ হয়ে আসে, তখন সে নিজকে
এক ঝটকায় আলিঙ্গন থেকে সরে দাঁড়িয়ে
বলে পাগল হলে না কি? পিছন থেকে
জড়িয়ে ধরে বলি, তোমাকে ছাড়া সুস্থ থাকার ইচ্ছে নেই।
এজন্যেই জরা আর ক্ষয়ের কামড়
বেমালুম ভুলে যৌবনের আঁচল
নিয়ে খেলতে খেলতে
হাসতে গিয়ে কাঁদি, কাঁদার সময়ে হেসে ফেলি। ওকে ঘিরে
যে লৌহ যবনিকা তাকে আমি কখন ভেঙ্গে ফেলবো?

আমার দিকে সে এভাবে তাকায়, যেন এই
তাকানো অন্য কারো
প্রাপ্য নয়। এই দৃষ্টির রশ্মি বেয়ে বহু শতাব্দীর
মায়া আমার বুকের ভেতর
ঘুরে দাঁড়ায় আবার কখনো কখনো
সে এমন হাসি উপহার দেয়,
যা আমাকে মদির মতিচ্ছন্নতায়
খানিক ডুবিয়ে মৃত্যুর কব্জা থেকে
দূরে সরাসরি স্বপ্নময় যৌবনে সাজিয়ে হাত ধরে।
বেড়াতে নিয়ে যায়
সমুদ্র তীরে। খুব কাছে এসে আবার
ছিটকে চলে যায়, যেন শিলাখণ্ডে আছড়ে-পড়া ঢেউ।
আমি কি বুঝিনা ভবিষ্যতের
আনন্দের জন্যে এখন আমার চোখের নিচে ভেজা ছাপ?
আমার হৃদয়ে কবিতার নবজন্ম হবে বলেই
আমাদের কথোপকথনের চৌদিকে এই থমথমে নীরবতা?

 নৌকা

কেন আমরা এখানে এলাম? পারস্পরিক
আমন্ত্রণ, স্বপ্নের আধাআধি বখরা,
এবং অনির্ধারিত ভ্রমণের প্রত্যাশা দুপুর
লাল বেনারসী পরে টুকটুকে বউ।

অজ্ঞাত কুলশীল পাখির গিটকিরি,
ঝোপঝাড় থেকে অনিশ্চয়তার
টিটকারি, প্রতিধ্বনির পাখার ঝাপটানি।
এখন সুতো গুটিয়ে নেয়া অসম্ভব।

বিকেলে কবিতা সাজানো, খুঁটি থেকে
দড়ি খুলে ফেললে কাকপক্ষী টের পাবে না, ভাবি,
হঠাৎ সে, পবিত্র আগুনের প্রতিমা,
হাঁটু জলে ছায়া ফেলে দাঁড়ানো।

দহে-দৃষ্টি গাঁথা, ভয়বিহ্বল চোখে
সে ও তাকিয়ে আছে
গলুইয়ে বসে জড়োসড়ো। খল খলে
জলে সাপ দেখে ফেলার মুহূর্ত চিক চিক করে।

রঙ গোলার বাটি থেকে কিছু রঙ
ছড়ানো আকাশে,
সূর্যাস্তের কলাপ;
ফেরার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।

মাঝ নদীতে চাঁদ, যেন জলপরী মাথা তোলে।
নৌকা দেসলাইয়ের খোল,
ভীষণ দোল খাচ্ছে। ঘোড়ার
চব্বিশটি পা মারছে ঠোকর।

বিশ্বাস করতে পারিনি
দ্বিধার নুড়ি মাড়িয়ে সে উড়ে আসবে
আমার এই ভাঙ্গা নৌকায়।
ভেবেছিলাম, ডাকলেই উড়ে যাবে স্বর্গীয় পাখি হয়ে।

সে কি টের পেয়ে গ্যাছে
ব্যালে নর্তকীর মতো ঘুরপাক খাওয়া
নৌকাটিকে উল্টে দেয়ার ইচ্ছে
বার বার ধাক্কা দিচ্ছে আমাকে?

প্রিয়জমের মতো

এরকম টগবগে উদ্বেলতা নিয়ে তড়িঘড়ি
মাঝে-মধ্যে কার কাছে যাই?
কে তুমি অমন চোখে বিদ্ধ করো আমার হৃদয়?
আজো চিনতে কষ্ট হয় খুব।
দূরে বসে ভাবলে তোমার কথা, বেদনার কালো
মেঘে-ঢাকা নিঃসঙ্গ পাখির
মতো হয়ে যাই, কাছে গেলে বুক ঠেলে বাষ্প ওঠে,
অথচ হাসার ভান করি।

কতবার মনে মনে নিয়েছি শপথ-কোনোদিন
যাবো না তোমার কাছে আর;
তবুও সুন্দর এক কুহক আমাকে চুপিসারে
নিয়ে যায় সান্নিধ্যে তোমার।
যখন সে ফ্ল্যাটে যাই, ‘স্বাগতম’ শব্দকে নাচায়
তোমার চোখের দুটি তারা।
কেন যেন মনে হয়, কখনো আমাকে নয়, অন্য
কাউকে করছো সম্ভাষণ।
যখন আরাম ধার নিই সোফাটার কাছ থেকে,
বসো তুমি মুখোমুখি, ভাবি-
দেখছো কী মুগ্ধ চোখে অন্য কারো প্রতিচ্ছবি, আমি
অনস্তিত্বে মিশে আছি শুধু।

এরকম কেন হয়, আমি কথা বলি, তুমি শোনো
অন্য পুরুষের কণ্ঠস্বর?
যখন তোমাকে ছুঁই কিম্বা চুমু খাই, কাঁপো তুমি
ভিন্ন কারো স্পর্শের শিহরে।

ভেবেছি ফিরিয়ে দেবো চিঠি, ছবি, সবই। ভেসে যায়
সংকল্প কোথায়; কৃপণের
মতো সব আঁকড়ে ধরে রাখি, যদিও সেগুলো নিয়ে
উচ্চকিত আমার সংশয়।
কে আমাকে তোমার নিকট থেকে দূরে, বহুদূরে
কৌশল সরিয়ে রাখে? কার
ইন্দ্রজালে দ্বিধার গোপন বীজ চারা হয়ে ওঠে
তোমার অন্তরে নিত্যদিন?

এতদিন জেনে গেছি, নিখুঁত তোমার তোমার অভিনয়।
এত কাছে যাই, তবু তুমি
দাও না বুঝতে কিছুতেই, আমি সে দুর্ভাগা ছায়া,
কানাকড়ি মূল্য নেই যার।

যা কিছু রটায় আজ নিন্দুক সমিতি, কিছু তার
সত্য বটে, তবু তোমাকেই
সর্বদা কামনা করি। আমার বিপন্নতায় তুমি
প্রিজমের মতো, প্রিয়তমা।

 প্রেমপত্র

কথা দিয়েছিলে
একটি প্রকৃত প্রেমপত্র লিখবে আমাকে তুমি
কোনো একদিন
হৃদয়ের নক্ষত্রের হরফে; বেসেছো ভালো একাধিক বার
অথচ প্রেমের চিঠি নাকি
কস্মিনকালেও
তোমার কলম থেকে হয়নি নিঃসৃত!

তোমার না-লেখা চিঠি পায়রার মতো
পৌঁছবে আমার হাতে, এ বিশ্বাস সেদিন আমাকে
নিয়ে গিয়েছিল সেই সরোবর তীরে,
যেখানে প্রত্যাশা
জলচর পাখি হয়ে অবাধ সাঁতার কাটে। তার
গলায় তোমার
চিঠির আবছা সম্বোধন পাঠ করে
আমার ভেতরকার শূন্যতাকে
দিই ছুঁড়ে রাতের হাওয়ায়।
প্রতিশ্রুত চিঠি
আসেনি আমার কাছে আজো।
এড়িয়ে গিয়েছো
সে-প্রসঙ্গ বারবার, আমিও ছিলাম চুপচাপ
অপেক্ষার কুশে ক্ষত বিক্ষত হৃদয়
নিয়ে কাটিয়েছি কতকাল।

কী তোমাকে, বলো,
দূরে রাখে সে উদ্যম থেকে
যা বসাতে পারে
সহজেই অক্ষরের মেলা শাদা প্যাডের পাতায়?
কাছে পিঠে গাছ
লাগানো অথবা ভদ্রাসনে
পুকুর খনন, পুল তৈরী,
ফুল তোলা, বইপড়া কিংবা চিঠি লেখা
সব কিছুতেই কমবেশি উদ্যোগের প্রয়োজন।
কোনো বাধা তোমাকে দেয় না
লিখতে প্রকৃত প্রেম্পত্র? সেকি আহারের পরে
দুপুরের আলসেমি? নাকি
দুর্জ্ঞেয় অনীহা
কিংবা অবসরের অভাব?
হঠাৎ কখনো
প্রেমপত্র ভুলে লিখে ফেলো যদি আমার উদ্দেশ্যে
যদি পোস্টম্যান
নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে সে চিঠি ফেলে যায়
শূন্য ডাকবাক্সো কোনো দিন,
তবে জেনো কাঙ্ক্ষিত সে-পত্র থরথর
হৃদয়ে পড়ার
মতো কেউ থাকবেনা।
তখন আমার
না আছে ব্যাকুল চোখ, না মুখ, না ঠোঁট
দুরু দুরু বুক,
কিছু নেই, কিচ্ছু নেই আর

 বন্যাবিলাপ

গভীর রাত্রে অনেকে ধড়ফড়িয়ে জেগে দ্যাখে মহানগরে
বানের পানির হামলা,
যেন বর্গী এল দেশে। হঠাৎ একি উৎপাত-
খাট পালঙ্ক, ঘটিবাটি, সোফা সেট, বাক্সপেটরা আলমারি
রেফ্রিজেরেটর ডোবে। মাল যায় যাক,
কোনো মতে দারা পুত্র পরিবার নিয়ে
নিরাপদ পাড়ায়
পালিয়ে জান বাঁচানো ধ্রুব সত্য বলে মানি।

বন্যার তোড় শোরগোল করে এক ঠেলায়
চালান করে দ্যায় ঘরের চালে। কী দুঃসহ
থাবার প্রহারে দিন যায় ত্রাণআমগ্রীর আশায়
দুঃস্বপ্ন সংকুল রাত কাটে। অস্থায়ী ত্রাণশিবিরে
ঘরে ফেরার টান উৎকণ্ঠিত চোখে
আনে কতো এলোমেলো ছবি। মাথার
ভেতর একপাল শেয়াল
তুলছে খুঁড়ে ক্রমাগত কবেকার হাড়গোড়।

জাতীয় বিপর্যয়। সারাদেশ
কী বিশাল জলাশয়। অনেক গ্রামে
জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই, পাখিদের কণ্ঠে নেই গান।
কোটি কোটি মানুষের দুর্গতি
জলমগ্ন কুটিরের জেগে-থাকা চলের মতো
জ্বালা ধরায় চোখে। শকুনেরা
ডানা ঝাপটায় ক্ষণে ক্ষণে, বাড়ায় গলা।
প্রেতলোক থেকে ছাড়া-পাওয়া
কংকালেরা আবার
জমাবে কি ভিড় নগরে ও গ্রামে? ‘ফ্যান দাও’
হাহাকারে ধূসর হবে কি বাতাস?

কারা অনাহারে, কারা কলেরায়, থুড়ি, উদরাময়ে
প্রাণ হারায়, কে তার হিসেব রাখে?
শুনি নানা জায়গায় পানিতে ভাসে লাশ। কে আর
প্রশ্ন করে নিরুত্তর ভাসমান লাশকে?
টেলিভিশনে ক্ষণিকের বাহারী খয়রাত, সঙ্গীন পরিস্থিতিতে
রঙ্গিন বিজ্ঞাপনী তৎপরতা এখানে সেখানে। হেলিকপ্টারে
চড়ে উলঙ্গিনী বন্যার রূপ বিহঙ্গ দৃষ্টিতে দ্যাখেন
ভিনদেশী সাংবাদিক মন্ত্রীর পাশে বসে
প্রত্যহ অতি মনোহর ধোঁয়াটে সাফাই গান কেউ কেউ,
হতাশ্বাস, ন্যূজদেহ মানুষকে শোনান
মৌতের চোয়াল থেকে ছিনিয়ে
আনার আশ্বাসবাণী।

দিনগত পাপক্ষয়; ক্লান্ত, ছা-পোষা কেরানীরা
দলে দলে বিকেলে নৌকোয় ফিরে আসেন
কলোনীতে আশাহীন, ভাষাহীন। জীনস-পরা চোস্ত মস্তানদের
কেউ কেউ দোস্তসমেত
শরীরের বেয়াড়া আগুন নেভাতে
বেপাড়ায় যায় হাতে জড়িয়ে
বেল ফুলের মালা। অকস্মাৎ নোংরা পানিতে
আলোর আল্পনা দেখে তোমার কথা মনে পড়লো।
তুমি কি সোফায় গা এলিয়ে
কমলকুমার মজুমদারের ‘নিম অন্নপূর্ণা’ পড়ছো?
না কি স্বেচ্ছাসেবিকা হয়ে
খাদ্য বিতরণ করছো নিরন্নদের ভিড়ে?
ধ্বংস কর্কশ ডাকে মধ্যদিনের কাকের ধরনে। আমাদের
বিশীর্ণ বংশধর
বুক ডোবা পানি ভেঙে বিষণ্ন হেঁটে যায়
ভবিষ্যতের দিকে। এরই মধ্যে সূর্য
আবীর ছড়ায় ফুঁসে-ওঠা বেনো জলে।
টিমটিমে গোধূলিতে প্রায় তলিয়ে যাওয়া
মুদির দোকানে বাঁশীতে
অপরূপ ভাটিয়ালী সুর। স্খলিত স্মৃতি বৃদ্ধ
ভবের ভাঙা হাটে খোঁজে লাঠি যৌবনের দিনগুলি;
আপাতত প্রতিটি নিশ্বাসে তার,
নিরানন্দ অক্ষরে লেখা ‘ক্ষুধা’। আশ্রয় শিবির থেকে
বিতাড়িত হলে কোন চুলোয় পাবে ঠাঁই?
আকাশে ওঠে বুভুক্ষ চাঁদ,
সুকান্ত বেঁচে থাকলে বলতেন রিলিফের রুটি।
চৌদিকে শবভুক প্রাণীদের আনাগোনা,
শিশুর কান্না, নারীর বিলাপ
যন্ত্রণা বিদ্ধ, দুর্গত চোখে সূর্যাস্তের দিকে
চেয়ে থাকে পুরুষ। মৃত্যুর গন্ধ ভাসে
জুঁই চামেলীর বনে, কোকিলের গানে, নড়বড়ে মাচায়
সত্তায় মৃত্যুগন্ধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পশু এবং মানুষ,
বারে বারে প্রশ্ন জাগে, তাদের চোখ থেকে কেন
ঠিকরে পড়ে না ক্রোধের আঙ্গার?

মতিচ্ছন্নতায়

আমার এ হাত ভগ্নকণ্ঠ গায়কের
রাগিণীর মতো
গহন বিলাপ করে তার দুটি স্তনের উদ্দেশে,
আমার সতৃষ্ণ ওষ্ঠ মাতলামো শুরু করে তার
গোলাপি ঠোঁটের জন্য। চঞ্চল পাখির
মতো উঠছে আমার নাক ক্রমাগত ওর নাভিমূল
ছোঁবে বলে, যার
দু’পায়ের আঙুলে দেখেছি আমি নক্ষত্রমণ্ডলী।

সে নেই আমার পাশে বিছানায়, তার সঙ্গে তবু
মিলিত হয়েছি স্তব্ধ জ্যোৎস্নারাতে মতিচ্ছন্নতায়!

 মৃত্যুহীন তালে তালে

ঘরে দুপুর জাজ্বল্যমান হলদে রত্ন, মাথার ওপর
বন্‌ বন্‌ ফ্যান
আর আমরা দু’জন সোফায়। তোমার চুল
উডু উডু দুরন্ত হাওয়ায়, চুলের অবাধ্যতা সামলাতে
তুমি লবেজান, চিকন ভুরুতে উড়ন্ত পাখির গান।
তোমার ঠোঁটে হাসি ঝরছে, ঝর্ণার
রোদের ঝলক-লাগা পানি তৃষ্ণাতাড়িত
চিতাবাঘের মতো করছিলাম পান। দিগন্ত চিরে,
পেরিয়ে দ্বীপ দ্বীপান্তর, পর্দার অন্তস্থল ভেদ করে
ভেসে এল আমাদের ভালোবাসার ডাক নাম।

ব্লাউজের ওপার থেকে যুগল ফলের আভা
বিচ্ছুরিত হচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে। তোমার কোমরে উচ্চকিত
একটা ভাঁজ, নদীর বাঁক। চোখে অপরূপ সরোবরের স্মৃতি;
সোফার হাতলে তুমি ঝুঁলিয়ে দিয়েছিলে পা,
পায়ের অনাবৃত অংশটি
পাখির ছড়িয়ে-দেয়া ডানা। হঠাৎ
গাঢ় চুমো দিলাম এঁকে
তোমার পায়ের উজ্জ্বল নগ্নতায়। এই প্রথমবারের মতো
কারো পায়ে খেলাম চুমো,
পবিত্রতায় স্নাত। হয়তো প্রাচীনকালে
কোনো রূপসী রানীর পায়ে এরকম চুম্বনের অর্ঘ্য
অর্পণ করতো তার গোপন প্রেমিক
কখনো প্রভু, কখনো বা ক্রীতদাস হয়ে
প্রহরীদের নেকড়ে-চোখ আর তরবারির ঝলসানি এড়িয়ে।

চুমো খেলাম তোমার পায়ে,
যে পায়ে ভর দিয়ে চুপিসারে তুমি আসো
আমার দিকে হাত বাড়িয়ে,
জড়িয়ে ধরো আমাকে, আমার চোখে মুখে
চুল ছড়িয়ে চুমো খাও আমাকে
সবকিছু ভুলিয়ে-দেয়া তীব্রতায়। যখন তোমার ঠোঁট
স্পর্শ করে আমার ওষ্ঠ,
তখন জন্ম হয় কতিপয় নতুন নক্ষত্রের। তখন
তোমার পায়ে গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ এবং আমার
কবিতা পংক্তিমালা, বঙ্গোপসাগরের ঢেউ।

যখন আমরা বিচ্ছিন্ন হই চুম্বন থেকে, দেখি
ব্যানারের বাণীর মতো
আমার নাম জ্বলজ্বল করছে
তোমার চুলে, চোখে, ঠোঁটে, সূর্যোদয়-রাঙা বুকের টিলায়,
হাতে, কোমরে, ঊরুতে, নিতম্বে,
পায়ের দশটি নখে। ছায়াচ্ছন্ন সিঁড়িতে
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে
ছাব্বিশটি বসন্তে ছুঁয়ে মনে হলো
তোমার গা থেকে উৎসারিত অলৌকিক
জলজ উদ্ভিদের সুগন্ধ। ফেনিল পানিতে ধুয়ে যায়
আমার বয়সের পুরু ধুলো; আমাদের যে-সন্তান
কখনো দেখবে না পৃথিবীর আলো,
তার অজাত কচিকণ্ঠের চিৎকার আমার আর তোমার
শিরা উপশিরায়
জাগিয়ে তোলে আফ্রিকার কোনো আদিম
গোত্রের নাচ, মৃত্যুহীন তালে তালে।

যখন ওরা

যখন ওরা আপিশে যায় কিংবা চালায়
তুমুল দোকানদারি,
তখন আমি ঢেউ সাজানো নদীর বুকে
দিব্যি জমাই পাড়ি।

যখন ওরা মন্ত্রী পাড়ায় চেয়ার নিয়ে
করে কাড়াকাড়ি,
তখন পাখির মন্ত্র শুনে দূর আকাশে
রঙিন সুতো ছাড়ি।

যখন ওরা রাজা উজির মারে বসে,
হাঁকায় মোটর গাড়ি,
তখন আমি তারার গানে, হাওয়ার কথায়
আস্তে পাতি আড়ি।

যখন ওরা একনায়কের সঙ্গে পড়ে
পদ্য গোটা চারি,
তখন ওহো হিজড়েগুলো দোলায় পাছা,
মাতে পুলিশ ফাঁড়ি।
যখন ওরা রেখে মেগে হাওয়ায় ঘোরায়
তীক্ষ্ম তরবারি,
তখন আমার ওষ্ঠে গোলাপ-কুঁড়ি
মনের মতো নারী।

যখন ওরা ধড়াচূড়ো পরে ওড়ায়
টাকা কাঁড়ি-কাঁড়ি,
তখন মেঘের জামা গায়ে গহন ছন্দে
দুলতে আমি পারি।

যখন ওরা দাঁতাল শুয়োর, নেকড়ে নিয়ে
আসর জমায় ভারি,
তখন আমি প্রবাল সিঁড়ির হীরের বাড়ির
স্বর্ণ কড়া নাড়ি।

যদি না লিখি প্রেমের পদাবলী

আমার সকল শব্দছন্দ আজকাল সারাক্ষণ
তোমার নিবাসে ধরনা দেয়, বসে থাকে
সিঁড়তে অথবা
ঘরের চোকাঠে নগ্ন হাঁটুতে চিবুক রেখে, কখনো হঠাৎ
সাজানো ড্রইং রুমে ঢুকে পড়ে, কখনো শোবার ঘরে আর
নীলচে চিরুনি তুলে নিয়ে চুল আঁচড়ায়, তোমার বালিশে
খুব ঝুঁকে কুস্তুরীর ঘ্রাণ নিতে চায়,
কী ব্যাকুল খোঁজে
সদ্য শাড়ি পরা রাঙা তোমার কৈশোর। ছুঁতে চায়
তাকে,যে তোমার মধ্যে অন্তরালে আছে
সবুজ পাতার ভিড়ে মুখ
লুকিয়ে, ভোরের কুয়াশায় মিশে সুদূর উদ্যানে।

ইদানীং প্রেমের কবিতা লিখি বলে শক্রপক্ষ ঢাক ঢোল
করতাল বাজিয়ে খুব উৎসব মুখর
মেথর পট্রির নরনারীদের মতো গোল করে,
এমনকি প্রিয়তম বন্ধু বলে, ‘বড় বাড়াবাড়ি
হয়ে যাচ্ছে; এখন তোমার শব্দাবলী
শুধু একজন রমণীর চতুর্দিকে ভ্রমরের মতো ওড়ে
এবং “তোমাকে মনে হয় ভিক্ষু কোনো, যে কখনো
এক মুঠো চাল কিম্বা দশ পয়সা নয়,
নিবিড় অঞ্জলি পেতে প্রহরে প্রহরে ভিক্ষা চায় ভালোবাসা
বরং এখন তুমি চন্দ্রমল্লিকাকে কাছে ডাকো,
জ্যোৎস্নাঝলসিত
মধ্যরাতে জলকন্যাদের গান শোনো কান পেতে। সেই সুর
গহীন গাঙের ঢেউদের কম্পমান তরুণীর মতো
তরণীর দোলা কবিতার পর্বে পর্বে জুড়ে দাও।
তাহলে কী করি? তুমিহীন এক দণ্ড
চলে না আমার আর না গেলে তোমার কাছে শুধু
মনে হয়, এক্ষুনি ভীষণ ভূমিকম্প হবে আর
লাভা স্রোতে ভেসে যাবো, আমার কংকাল
কোথাও থাকবে পড়ে বিপুল ধ্বংসের ভস্মীভূত
বনকুসুমের পাশে। লোকটা কে ছিল জানবে না
কেউ কোনো দিন আর; সে কি
ছুঁয়েছিল কারো হাত অথবা অধর?
যদি আমি না লিখি প্রেমের পদাবলী, ঘাট থেকে
নৌকা ছাড়বে না,
গাংচিল ছড়িয়ে ডানা নদীর ঢেউয়ের
ডগা ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়বে না, কোকিলেরা
ভুলে যাবে গান, কোনো রমণীর কাছে
কোনো পুরুষকে মানবে না আর, ‘চলন্তিকা’ থেকে
ভালোবাসা নামক শব্দটি
প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাবে মেঘময় নিরুদ্দেশে।
জনক জননী
শিশুর মাথায় ঘ্রাণ নেবে না কখনো।
তখন মানুষ বদ্ধ জলাশয়ে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে
এ ওর গলায় গেঁথে দেবে
জহর মেশানো ছোরা আর দলে দলে অন্ধ আতঙ্কের চাপে
ব্যাপক আগুনে দেবে ঝাঁপ।

রেস্তোরাঁয় এক সন্ধ্যেবেলা

রেস্তোরাঁয় অনেকদিন পরে
ছিলাম বসে দুজনে মুখোমুখি।
ভেবেছিলাম ভ্রমণ সেরে এসে
তোমাকে মেয়ে দেখাবে খুব সুখী।

কিন্তু একি তোমার মুখ জুড়ে
অসম্ভব কালো মেঘের সাজ।
চশমা খুলে বললে ধু-ধু স্বরে-
‘আমার মন খারাপ খুব আজ।

যখন তুমি টানা দু’চোখ মেলে
আমার দিকে তাকাও অনুরাগে,
হৃদয় হয় বিলাসখানি টেড়ি,
চতুর্দিকে পদ্মকলি জাগে।

টেবিল ক্লথে আঁচড় কাটো নখে,
চুমুক দাও কফির পেয়ালায়।
একটি ঝড়ে সত্তা আলুথালু,
ঝোড়ো হাওয়ায় প্রদীপ কে জ্বালায়?

রেস্তোরায় নিঝুম কোণে বসে
নিজের চোখে নাচাও খঞ্জনা।
আমার প্রেম তোমাকে পারে নাকি
ভুলিয়ে দিতে আগের বঞ্চনা?

তোমার মন কেন যে ভালো নেই,
বুঝি না, হায়, মধুরতমা নারী।
বুলাও ঠোঁটে হাল্‌কা কিছু ফাগ,
পাল্টে নাও গোধূলিরঙ শাড়ি।

লুকিয়ে থাকে কাছেই আততায়ী,
হাসির ফাঁকে ঝল্‌সে ওঠে ছোরা।
মিত্র কে যে, জানতে পেলাম না;
লাফায় শুধু আগুন বুকজোড়া।

তোমাকে নিয়ে কখনো যদি শুই,
অবিবাহের চাদর যাবে পুড়ে?
কোরো না আর লজ্জা মিছেমিছি,
কামজ কীট খাচ্ছে কুরে কুরে।

ভালোবাসার সানাই বেজে যায়,
সে-সুরে মজে একাকী পথ চলি।
তোমার কাছে নিত্য নিয়ে যাই
অসংকোচে আমার পদাবলী।
তোমাকে করি কী করে বিশ্বাস?
আমার প্রেম সত্যি যদি চাও,
এভাবে আর ছুটো না ডানে-বামে;
ত্যাগের দৃঢ় দীক্ষা তুমি নাও।

প্রবোধ দিই মনকে নিশিদিন-
হে মেয়ে তুমি নও তো স্বৈরিণী;
সেজন্যেই তোমার ছোঁওয়া পেলে,
রক্তে বাজে সেতার রিনিঝিনি!

 রয়েছো লিপ্ত কী নিয়ে

উদাসীন এই শহরে এখন
ভেবে মরি তুমি রয়েছো লিপ্ত কী নিয়ে?
ক্ষুব্ধ ঈগল চঞ্চুর ঘায়ে
নিমেষে আমার শান্তি নিয়েছে ছিনিয়ে।

জোনাকির ভিড়ে খাপছাড়াভাবে
কতকাল আর বাইরে থাকবো দাঁড়িয়ে?
ভয়ের পাথর বুক জুড়ে থাকে,
ফেলবো কি হায় তোমাকে কখনো হারিয়ে?

রূপালি হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে
ভেসে ওঠে বুঝি তোমার বুকের আদল।
পরমুহূর্তে শূন্যতা হাসে,
দ্রুত তালে বাজে পরিহাসপ্রিয় মাদল।

প্রণয় তোমার রহস্যমোড়া,
যেন সে হরিণ লতাগুল্মের আড়ালে।
তোমার দু’চোখ কাছে ডেকে নেয়,
দূরে সরে যায় হাতখানি বুকে বাড়ালে।

তোমাকে বুঝতে পারিনি এখনো,
মনে হয় শুধু ঘুরছি গোলকধাঁধায়।
কখনো তোমার কোন আচরণ
হাসায় আমাকে, কখনো কেবলি কাঁদায়।

চোখে জ্বালা ধরে, বুকে বৃশ্চিক;
দহনের কথা কাউকে ভুলেও বলি না।
বিচ্ছেদ-নদী মাঝে-সাঝে বয়,
তার মারে তুমি হও কি কখনো মলিনা?

যন্ত্রশাসিত যুগে তুমি-আমি
গাণিতিক প্রেম করবো হিসেব মিলিয়ে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে না রোবট,
কস্মিনকালে দেয় না নিজেকে বিলিয়ে।

যখন আমার ঠোঁটে রাখো ঠোঁট,
গোধুলি বেলায় হঠাৎ জানাও বিদায়,
তোমার মনের অবচেতনের
হদিস না পেয়ে থাকি অবিরাম দ্বিধায়।

যদি মরে যাই, বলবে না কেউ
তোমাকে বিধবা; রক্ত জবার বালিশে
মাথা পেতে তুমি থাকবে ঘুমিয়ে,
জ্বলবে শরীর স্বপ্নের কড়া পালিশে।

এই ঘর এই সিঁড়ি, ভাঙ্গা পথ
প্রজাপতিসহ থাকবে মনের ভেতর।
নোংরা হাতের নিষ্ঠুর টানে
আল্‌গা হবে কি হৃদয়ে-প্রোথিত শেকর।

শপথ ভঙ্গ

হয়েছে সাক্ষাৎ বহুবার, ঘনিষ্টতা
হরিণের মতো
করেছে নিভৃতে জল পান ঝিলে মুখ রেখে ছোট
ছোট ঢেউ তুলে; অকস্মাৎ শ্বাপদের শব্দ শুনে
দ্রুত ছুটে গিয়ে আত্মগোপন করেছে
বাঁচিয়ে শিং-এর ভাস্কর্যটি ঝোপেঝাড়ে।
খোলা পথে যেতে মনে মনে করেছি শপথ, তার কথা
কাউকে কখনো বলবো না।

কখন যে চন্দনা হঠাৎ পরিহাসে
বলে ওঠে প্রকৃতির গালে চুমো খেয়ে-
কেউ কিছু বলার আগেই দলত্যাগী রাজনৈতিক কর্মীর
মতো লিখে নিজেই নিজের কথা ফাঁস করে দিয়েছো বেবাক।

শাদা-লাঠি

একটি বছর ধরে শাদা লাঠি হাতে নিয়ে সর্বক্ষণ আমি
শহরে ভ্রমণকারী, দেখেও অনেক কিছু না দেখার ভান
করি; ম্লান গোধূলিতে তুমি
সে কোন্‌ হ্রদের তীরে যাও চলে নিতম্ব দুলিয়ে
আমার সম্মুখ দিয়ে, স্মিত মুখে কী সহজে, হায়,
ফোটাও বিচিত্র ফুল বেগানা বাগানে।
নিমিষে আমাকে ছুঁড়ে দাও বিস্মৃতির-ধুধু চরে।
ভাবো, আমি কিছুই দেখিনা। যাও তুমি
ঈর্ষার রঙের মতো মোটর হাঁকিয়ে
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে, এলোমেলো অস্তিত্বের আমার
ধুলো লাগে, অসহায় চেয়ে থাকি দুটি চোখ মেলে,
যদিও আমার হাতে কম্পমান কংকালের মতো শাদা লাঠি।

খুব রাত করে
যখন ঘুমোতে যাও বিছানায় কতিপয় বেয়াড়া বেড়াল।
চেটে পুটে খায়
আমার অস্থির মজ্জা, ফোঁস করে ওঠে
নানান বর্ণের সাপ। ঈগল-সাপের
কী হিংস্র লড়াই বাধে হৃদয়ে আমার। শাদা লাঠি
কেড়ে নিয়ে লোহিত পুরুষ
বলে আর্ত স্বরে-
ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও তাকে, বুকে যার
ফণিমনসার বন দ্রুত বেড়ে যায়।

কী করে উপড়ে ফেলি নিজেরই হৃৎপিণ্ড অকস্মাৎ?
থাক শাদা লাঠি হাতে।

Exit mobile version