Site icon BnBoi.Com

আমি অনাহারী – শামসুর রাহমান

Ami Onahari by Shamsur Rahman

অজানার ফড়ে

বালক এখানে কিছু খুঁজতে এসো না কাটা ঘুড়ি,
আরক্ত ডালিম, জলছবি, হুইসিল, রাঙা নুড়ি,
অথবা পাখির ডিম কিছুই পারে। ছেড়ে দাও
আশা, দেখছো না দূর নীলিমায় হয়েছে উধাও
বালিকা পরীর মতো তোমার রঙিন ঘুড়ি? হায়,
কেন এলে, কেন ছুটে এলে ভয়ানক অবেলায়?

বালক এখানে কিছু খঁজতে এসো না, এই ভূমি
বড়ো দাগাবাজ, যেন ডাইনোসরের পিঠ। তুমি
অন্তত কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালেই পাবো স্বস্তি।
রাশি রাশি মানবিক ভস্ম আর পরীদের অস্থি
কুড়িয়ে আনন্দ তুমি পাবে কি বালক? চলে যাও,
বরং বানাও শব্দছক, ভেঁপু নিয়ত বাজাও।

তবু কেন ইতস্তত করো মিছেমিছে? শোনো, বলি-
আমার ভিতর বহু ফুটপাত, নানা অলিগলি
জ্যোৎস্নাময় টিলা, চোরা খাদ, কতো বন উপবন।
আমি তো ভিয়েতনামে দুর্বিপাকে করেছি চুম্বন
অনূঢ়াকে আর কম্বোডিয়ায় কী ক্লান্ত চোখ বুজে
গেছে বেলা, কোলে শিশু, ঘুমিয়েছি স্বপ্নের গম্বুজে

এলিয়ে দুশ্চিন্তা-ভারি মাথা, বাংলাদেশে কতদিন
পথে পথে দিশেহারা ঘুরেছি সর্বদা কী মলিন।
কবর খুঁড়েছি বারবার, ঘর-পোড়া জলে-ডোবা
দেখেছি আহত চোখে ভয়ানক নৈসর্গিক শোভা
দলে মিলে, কখনও বা খুব একা। নৈঃসঙ্গের দাঁত
স্বাভাবিকতার ফুল্ল বৃত্ত থেকে করেছে উৎখাত

আমাকেও; হে বালক, তোমাকে কোথাও ভালো মেলা
দেখিয়ে আনবো, কথা দিচ্ছি। চতুর্দোলা, লাঠি খেলা
সেখানে দেখতে পাবে। লোকজন, পুতুল, দোকান-
সব কিছু স্বপ্নে গড়া, সর্বক্ষণ খাড়া রেখো কান,
কেননা স্বপ্নের গান হাওয়ার মতোই ভাসে। বুড়ো
জাদুকর বলে দেবে দ্বীপের খবর, স্মৃতি-গুঁড়ো

ওড়াবে তল্লাট জুড়ে, শীর্ণ আঙুলের স্পর্শে তার
খুলে যাবে নীল পথ, অন্তহীন, আমার মাথার
ভিতর মিনার এক পাখির সোনালি কণ্ঠসুরে
গুঞ্জরিত, দোলে চিত্রশালা সমস্ত মগজ জুড়ে।
হৃদয়-দিগন্তে কত স্বপ্নিল পল্লব ঝরে পড়ে-
স্বপ্নের দালাল আমি বাস্তবিক, অজানার ফড়ে।

আজকাল ভুলে যাই

আজকাল ভুলে যাই, স্রেফ ভুলে যাই কত কিছু।
লজ্জায় করবো মাথা নিচু,
যদি কেউ প্রশ্ন করে, বলুন তো কী আমার নাম? আর
কী-যে হয়-কাল কার সঙ্গে দেখা হলো, বারবার
ভুলে যাই, টেলিফোন নম্বর তো মনেই থাকে না,
আর কত চেনা
মুখ ডুবে থাকে অন্ধকার, এমনকি কবিতার পংক্তি তা-ও
কেমন ধূসর ধ্বনি, চকিতে উধাও।

আমার স্মৃতির উপবন
থেকে নির্বাসন
দেওয়া প্রয়োজন তোমাকেই, কিন্তু তুমি
জুড়ে আছো সর্বক্ষণ আমার মনের আর্ত ভুমি।

আমি অনাহারী

আমাকে তোমরা দেখলে না? আমার বুকের পাশে
জামতলা, সর্ষে ক্ষেত, মেঘের মতন ঘাসে ঘাসে
প্রজাপতি; রাজধানী আমার দু’চোখে অস্ত যায়।
আমার পড়শি নেই, আরশিও চুরমার; এ ভীষণ নিরালায়
পড়ে থাকি। গোলাপজলের মতো স্নিগ্ধ করুণা এখন সাত তাড়াতাড়ি
দেবে কি ছিটিয়ে দূরে থেকে? পিপাসার্ত রইবো আমি অনাহারী!

আমাকে তোমরা দেখলে না, সরল রেখার মতো পড়ে আছি
কবে থেকে একা একবিংশ শতাব্দীর খুব কাছাকাছি।
যতই মুর্দাফরাশ ডাকো,
বাঘের মতন হাঁকো,
সরবো না এক চুলও। শেষতক
জন্তুতে-আমাতে ঠিক কতটা ফারাক, বলবেন গবেষক।
তণ্ডুল করিনি স্পর্শ কতদিন, ছুঁইনি কোমল কোনো নারী;
হাওয়ায় হাওয়ায় রটে দিনরাত, আমি অনাহারী
ওখানে কী আছে আমি যেতে চাই। বারবার
দিয়েছো ফিরিয়ে দ্বারপ্রান্ত থেকে; আর
যাবো না ব্যথিত ফিরে অভিমানে। আমি শস্ত্রপাণি,
দেখছো না? নৈরাশ এবং ভয় করেছি রপ্তানি
নিরুদ্দেশে, অন্ধ
হলেও রাখবো চোখ মেলে ঠিক, দেখে নিও। সব দিক বন্ধ?
শুনবো না মানা, হেঁই দ্বারী-
ঝট্‌পট্‌ হটো, ভেতরে না গিয়ে মরবো না আমি অনাহারী।

ইদানীং সুটকেস

ইদানীং কেউ কারো রাখে না খবর বাস্তবিক, অনেকেরই
কাটে বেলা উদ্বেগে সন্ত্রাসে।
নিত্য সেব্য ট্রাঙ্কুলাইজার, সর্বক্ষণ এরা ওরা করে প্রশ্ন
নিজেকেই বারবার-সুটকেস আছে তো প্রস্তুত?
দেশ-দেশান্তরে
ঘোরে দলে দলে কত টুরিস্ট একালে, ভ্রমণেই
খোঁজে মুক্তি নানা পথে, খাটায় যে যার তাঁবু ঈষৎ হেলানো
দক্ষিণে কি বামে।

আমরা ছিলাম পাঁচজন, এক পাত্রের ইয়ার-
একজন যুদ্ধে গেছে কাটা; অন্যজন ঘোরে রাস্তায় রাস্তায়,
ময়লা জমেছে নখে ঢের, কুড়োয় কাগজ ছেঁড়াখোঁড়া, প্রায়
নগ্ন, পোকা-মাকড়ের সঙ্গে
বলে কথা দিনরাত হিজিবিজি, আঁধারের থুতনি নাড়িয়ে দেয়, আর
যে যুবার টান টান চিবুকে খাঁড়ির মতো খাঁজ
ছিলো, সে করেছে আত্মহত্যা এবং রাজহাঁসের
স্বপ্ন দেখতো যে,
সুটকেস হাতে মেতেছে সে সাগরযাত্রায়, হয়তো-বা পৌঁছে
গেছে দূর দেশে, শুধু আমি পড়ে আছি, প্রগাঢ় চুম্বন আঁকি
বিষাদের ঠোঁটে;
প্রতিধ্বনি ডেকে নিয়ে যায় দ্রুত নৈরাশ্যের টানেলে আমাকে।
এমন সময় এক, যখন সবাই ডামাডোলে ভীষণ অস্থির আর
যে যার আপনকার সুটকেস তৈরি রাখে, যেন
সহজেই যাত্রা করা চলে দূরে, অথচ কখনও
আমার নিজের সুটকেস ঠিক গোছানো হয় না।
বিদায় বিদায় ধ্বনি সুটকেসে, ইদানীং সুটকেস দেখে
দেখে বেলা যায়, ভাবি- যদি তার পেটের ভেতর
শার্ট কিংবা ইজেরের মতো থাকা যেত।
নিঃশ্বাসবিহীন।
কী-যে হয়, বারবার মেঝে ফুঁড়ে বহু ক্ষিপ্র হাত
গাছ গাছালির মতো ভীষণ জড়িয়ে ধরে আমার নিজস্ব সুটকেস।

 উদ্ভিদ

নিসর্গের সঙ্গে কোনো ঢলাঢলি নেই ইদানীং।
পেতল তামার সঙ্গে, ইট-কাঠ ইত্যাদির সঙ্গে
খুব বেশি মেলামেশা হয়। কর্কশ শিরিষ দিয়ে
প্রত্যহ মসৃণ করি একটি কাঠের বাড়ি, তার
দেয়ালে দেয়ালে চিত্র, নরুনে খুঁচিয়ে তোলা; তবু
আমার ভেতরে এক কেমন উদ্ভিদ বেড়ে যায়
প্রতিদিন চুপিসারে, জিভ নেড়ে নেড়ে অতিশয়
নম্র ভঙ্গিমায় ডাকে। তার কিছু স্বাদ আছে ভেবে
সামাজিক কীটপতঙ্গের দ্রুত চঞ্চলতা বাড়ে।

যেও না তোমরা কেউ উদ্ভিদের কাছে, যত বলি-
তত ভিড় আশেপাশে, কণ্ঠে তুলে নিতে চায়
তীব্র অন্তর্স্রাবী রস। বিবেচনা নেই, কী গরল
সেখানে প্রচ্ছন্ন বয়, ভেবেও দ্যাখে না একবার।
আমি নীল হচ্ছি ক্রমে, দেখছে না তাও; ওরা শুধু
বিশদ কুহকে মজে রসমগ্ন হয়। উদ্ভিদের
আনাচে-কানাচে বহু শতাব্দীর চূর্ণ শোভা আর
কালিঝুল লেগে থাকে, আমি তার ক্ষুধিত ছায়ায়
ক্লান্তি আর উদ্যমের মাঝামাঝি করি বসবাস।

 উপসর্গ

এখন শরীরে প্রায়শই অতিরিক্ত তাপ থাকে।
থার্মোমিটারের পাঠ ছাড়াই সহজে বলা যায়,
তাপের এমন মাত্রা আদপেই নয় স্বাভাবিক ।
কেমন অস্বস্তিকর তপ্ত অনুভূতি ত্বকময়
জেগে রয়, স্বপ্নকামী ঘোরে কাটে সারাদিন, চোখে
জ্বালা নিয়ে ঘুরি দিগ্ধিদিক্‌, কখনও-বা ঝাঁক ঝাঁক
শূন্যচারী হাঁস এই উঠোনে নামবে ভেবে খুব
ব্যগ্র হই, চেয়ে থাকি, অপলক বালকের মতো।
ভুল চিকিৎসায় কাটে কিছুকাল, কখনও-সখনও
অবসন্ন চেতনায় সুস্থতার ক্ষণিক বিভ্রম
ভ্রমরের মতো তোলে গুঞ্জরণ, অথচ আমার
সারা গায়ে অতিরিক্ত তাপ থাকে সারাক্ষণ।
লোকে বলে, রৌদ্রজ্যোৎস্নাময় বাক্য রচনার হেতু
এই তাপ জন্মে আর জিহ্বায় ছড়ায় তিক্ত স্বাদ।

এই নবান্নে

মাছের কাঁটার মতো নক্ষত্র কি খুঁচিয়ে তুলবে ক্ষত আর
কোকিল রটাবে কোনো দুঃসংবাদ? এখন তো সংবাদ মানেই
দুঃসংবাদ প্রতিদিন। শুধু টেলিপ্রিন্টারের রিবনের নিচে
নয়, কবিতার স্তবকেও দুঃসংবাদ ফুটে রয় বাস্তবিক।
হে আমার গিল্টিকরা নকল সোনার বাংলা তুমি ক্ষেতে ক্ষেতে
বুনে যাচ্ছো ড্রাগনের দাঁত, ওষ্ঠে নিচ্ছো তুলে বিষাক্ত শিশির।
হয়ে গ্যাছো অতিশয় দরিদ্র দোকান। বড়ো বেশি দেরি করে
ফেলছো, বস্তুত দ্যাখো প্রকৃত পুরুষ্ট বীজ হচ্ছে পরিণামহীন।

কতো কিছু দেখি চতুষ্পার্শ্বে, দেখি কবরের মাটি ফুঁড়ে হাত,
শত শত, উঠে আসে, দ্যায় ছুড়ে স্বর্ণ থালা; দেখি রাজপথে
এখন একটি রাজহাঁস তার চঞ্চুতে নাচাচ্ছে কী হলুদ
নবান্নের দিন। রাশি রাশি ধান উড়ন্ত গালিচা হয়ে দ্রুত
কুয়াশায় মিশে যায়; প্রতিধ্বনিকে চুম্বন করে ঝাঁক ঝাঁক
পরিযায়ী পাখি, শহরের আনাচে-কানাচে ফেরেশ্‌তার ভাঙা
ডানা পড়ে থাকে; কত বিষণ্ন করোটি ফুটপাতে, ঝোপেঝাড়
কালোবাজারির বন্ধ গুদামের আশেপাশে লুটায় কেবলি।

যখন ঘুমায় শিশু দোলনায়, আমার হৃদয় নিরিবিলি
পাখির ছায়ার মতো শান্তি নামে; প্রিয়তমা ঘুমায় যখন
স্বপ্নের মেঘের মতো বিছানায় ছড়িয়ে চুলের শস্যরাশি,
আমি সে ঘুমের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বিটোফেনি সঙ্গীতের
মতো ভাসি, অথচ যখন অগণিত অনাহারী নানা রুক্ষ
টানা-হ্যাঁচড়ায় নবান্নের দিনে ক্লান্ত শুয়ে থাকে সংবিধানে
নিঃসাড়, যখন সংখ্যাহীন মৃত শিশু খাদ্যবাহী জাহাজের
দিকে মুখ করে পড়ে থাকে, আমার মগজে জ্বলে মরুভূমি।

একজন কবিঃ তার মৃত্যু

সে নয় ঘরের কেউ, তবু ঘরেই ঘুমন্ত। অতিশয় শীর্ণ
অবয়ব, এলোমেলো দীর্ঘ চুল, গালে দু’দিনের
না-কামানো দাড়ি
এবং শরীর তার নিঃস্পন্দ নিঃসাড়, যেন তারহীন বীণা,
বাজবে না কোনোদিন আর!
দেয়ালের গোয়েন্দা খানিক দেখে তাকে সুদর্শনা
পতঙ্গের দিকে
ধীরে-সুস্থে অগ্রসর হয়। অকস্মাৎ জানালায় ছায়াচ্ছন্ন
বকুলতলার এক সঙ্গীতপ্রবণ পাখি এসে বলে গেলো-
নেই, নেই, নেই।
পুড়ছে আগরবাতি, বিবাগী লোবান। ঘরে নড়ে নানা লোক,
প্রবীণ, নবীন ছায়া পাঁশুটে দেয়ালে।
অনুরাগী কেউ আসে কেউ যায়, দ্যাখে তার সমস্ত শরীরে
উচ্চারিত মৃত্যুর অব্যয় মাতৃভাষা।
আসেন সমালোচক, পেশাদার; বন্ধু কেউ কেউ, জুটে যায়
বেজায় ফেরেববাজ প্রকাশক। অনুরক্ত পাঠক নোয়ায় মাথা আর
বারান্দায় ভিড়ে
বলপয়েন্টে ক্ষিপ্র নিচ্ছে টুকে জীবনীর ভগ্নাংশ নিপুণ
নৈর্ব্যক্তিক স্টাফ রিপোর্টার।
কোন্‌ সালে জন্ম তার, কী কী গ্রন্থের প্রণেতা, ক’জনই-বা
পুষ্যি রইলো
পড়ে ঘোর অবেলায়, নাকি সে অকৃতদার ইত্যাদি সংবাদ
দ্রুত প্যাডে জমা হয়, তবু
উন্মোচিত জীবনের আড়ালে জীবন খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন থেকে যায়।

এইদিন তার নয়, এই রাত্রিও তো নয়, এখন সে শোকাশ্রুর
কেউ নয়, লোবানের নয়, বকুলতলার সেই মুখ্য
সুরেলা পাখিও কেউ নয়। স্বপ্নময় সোনালি রূপালি মাছ
ফিরে যাবে না পেয়ে সংকেত; এখন তো ভাঙাচোরা
তৈজসপত্রের মতো ইতস্তত রয়েছে ছড়ানো তার সাধ, বিফলতা।
প্রজাপতি কোথায় কোথায় বলে বারবার উড়ে যায় দূরে।

ক’জন রমণী আসে উদ্বেলিত বুক আর কান্না নিয়ে চোখে,
কেউ কেউ গোপন প্রেমিকা
হয়তো বা; কারো হাতে ফুল তরতাজা, রাখবে কি দ্বিধাহীন
নিরালা শিয়রে?
কার বুকে শূন্যতার স্বেচ্ছাচারিতা প্রবল হয়, কার ভীরু
সত্তাময় জেগে রয় একটি অব্যক্ত ধ্বনিঃ হে মেধা, হে কাল
পাইনি, পাইনি।

কেউ আসে কেউ যায়, যথারীতি দ্যাখে ঝুঁকে, কী যেন বিহ্বল
খোঁজে তার চোখে-মুখে, নিথর আঙুলে, টেনে নেয় কী উদাস
ধূপের সুগন্ধ বুকে। শূন্যে ঝলসিত পাখসাট,
কখন হঠাৎ এক ঝাঁক হাঁস নামে ঘরে, পুশিদা, সফেদ;
মায়াকাননের শোভা প্রস্ফুটিত চারদিকে, যে আছে ঘুমিয়ে
তাকে ক্রমাগত স্নেহে করাচ্ছে কোমল স্নান সমুদ্রের নীল জল,
পায়ের পাতার কাছে একটি প্রবালদ্বীপ, শালবন, দীর্ঘ
তরুময় পথরেখা, ঝোপঝাড় সমেত খরগোস জেগে ওঠে-
কেউ দেখলো না।
হাতে ফোটে পদ্মকলি, রাশি রাশি, বুকে ঝরে পাপড়ি গোলাপের;
চকিতে হরিণ আনে ডেকে দূরস্মৃতি দিগন্তের, ঠোকে খুর
ঘরের মেঝেতে, নাচে; ঝিরিঝিরি, ঝরনা তার কানে বন্দনামুখর-
কেউ দেখলো না।
পদাবলী উজাড় পথের মতো ঠোঁটে একে একে দ্যায় এঁকে
বিদায়ী চুন্বন।
দৃষ্টির প্রখর দীপ্তি, আনন্দ বিষাদ কিংবা উচ্ছল কৌতুক,
ঈর্ষা, ক্রোধ, অথবা বস্তুর জন্যে কাতরতা, কলহ, বিলাপ
এবং দুর্মর ইচ্ছা আমৃত্যু কবিতা রচনার, রৌদ্র আর
জ্যোৎস্নার ঈষৎ কম্পনের সঙ্গে কথোপকথনে মাঝে মাঝে
অত্যন্ত গভীর মেতে থাকার অভ্যাস নিরিবিলি হৃৎস্পন্দন-সবই তো
ছেড়ে গেছে তাকে একযোগে। শুধু আত্মা তার একটি অদৃশ্য
মালা হয়ে দোলে ঘরে অগোচরে; বকুলতলার পাখি
আবার বসলো এসে জানালায় একা, গানে গানে বলে গেলো-
নেই, নেই, নেই।
ভিড় কৃশ হলে, থেমে গেলে পাঁচমিশালি গুঞ্জন, সুনসান
নীলিমার থেকে এলো নারী কেমন আলাদা।
অলক্ষ্যে সবার
একান্ত নিভৃত
দাঁড়ালো শয্যার পাশে কী সঙ্গীতময় অস্তিত্বের তেজে ঋজু,
একাকিনী; অদৃশ্য সে মালা তার গলায় এখন। কিছুক্ষণ
রাখে চোখ শেষ দৃশ্যে, অনন্তর নিলো সে বিদায়; শব্দহীন
পদধ্বনি কোথায় মিলায়।
একটি অনাবশ্যক, স্মৃতিহীন স্বপ্নহীন নিঃসঙ্গ শরীর
পড়ে থাকে
অনেক চোখের নিচে। মনোভূমিপ্লাবী অলৌকিক
জ্যোৎস্না বলে, যাই।

একজন ভ্রমণকারী

সেখানে কী পাবে তুমি? তবু কেন এমন প্রহরে
যাচ্ছো একা? যাচ্ছো কিছু এলেবেলে স্বপ্নের আশায়?
কোথাও না কোথাও কখনও
যেতে হয় বলে যাচ্ছো? কী শিরশিরে পথ, আলোহীন,
জনশূন্যতায় স্তব্ধ। খড়ঠাসা পাখির ডানার মতো কিছু
জানালা হাওয়ায় নড়ে, ফুটপাতে নিশ্চুপ দাঁড়ানো একা, কে সে?
হেলে-পড়া, নিরক্ষর, বিবর্ণ, ধোঁয়াটে
সাইনবোর্ডের ধুলো ঝরে তার গায়ে, মুখ তার
বেবাক ব্যাণ্ডেজে মোড়া, মর্গের টেবিল থেকে যেন
এক্ষুণি এসেছে ওঠে স্মৃতিশূন্য, ভালোবাসাহীন।
অপ্রেমে মানুষ
হয়তো এমনই হয়। ভুলেও ছুঁয়ো না তাকে, সে তো স্বরহীন,
পার্সেলের বিস্তব্ধতা তার অবয়বে। সম্মুখে হাঁ খোলা পথ,
অকূল জ্যোৎস্নায় ভাসে নিষ্ঠাবান পুলিশের ক্রস।

একটি কুকুর মুখে নতুন কাফন নিয়ে ছোটে দিগ্ধিদিক,
অনেক অনেক দূর শতাব্দীর স্মৃতিভারাতুর তাম্রঘণ্টা
কী মধুর কোলাহল করে।
নিশ্চিহ্ন প্রতিটি সাঁকো, বন্ধ সব পথ, শুধু একটি বাগান
জেগে থাকে অন্তরালে-সেখানে তরুণী এক ছায়ার আদর
কুড়ায়, কখনও গায় গান,
গান শুনে মৃত্যু ভোলে তার শীতল হিংস্রতা আর
বাগানের সব গাছ নিমেষেই হয়ে যায় কেমন মায়াবী।
অকস্মাৎ সে তরুণী জরার ব্লিজার্ডে দিশেহারা, মিশে থাকে
ঘরের ছায়ায় সারাক্ষণ, শীর্ণ হাতে তাস খেলে
ঘণ্টা নিজের সাথেই।

ঝুঁকেছিলে ঝটপট, নিমেষে অসুখ ধুয়ে ফেলবে বলেই
বেশ ঝুঁকেছিলে।
জলাশয়ে মুখচ্ছবি বড়ো টলমলে, ঢিল ছুড়ে
চকিতে জাগালে তুমি ঊর্মিল সংসার- কতো কিশোর-কিশোরী
কলরব করে ওঠে, সাজিতে কুড়ায় ফুল কেউ, কেউ ফল
তুলে নেয় ঝোপঝাড় থেকে।
উত্তরচল্লিশ তুমি, তাহাদের বয়স বাড়ে না।
শুনলে কিসের ডাক? জীর্ণ কাকতাড় য়া তোমাকে
বললো কার কথা? তুমি তার পদপ্রান্তে লুটোপুটি
খেয়ে কিছুক্ষণ শিস দিতে দিতে চলে গেলে খুব
উঁচু উঁচু ঘাসের ভিতরে।
পাশ ফিরে শোবে? শুলে কিছুটা আরাম বোধ হবে।
জলের সংসার ভেঙে ফেলে পুনরায় হলে ভীষণ একাকী।

আবার ঘুমের ঘাস চতুর্দিকে দুলে ওঠে বুঝি-
এই তো তিনটি কাক, হ্যাটপরা, শস্যক্ষেতে উড়ছে প্রখর,
সিগারেট-গড়া স্যুট ওড়ে, পথচারী, অন্ধ, টলে পড়ে যায়।
গ্যারি কুপারের বুট নেচে নেচে অতিশয় তেজি
ঘোড়ার গ্রীবায় দোলে, গাঢ় সূর্যাস্তের অত্যন্ত ভিতর থেকে
বেরিয়ে হিরোর মতো মাথা তোলে একটি বিরাট ঘড়ি, তার
দুটি কাঁটা যেন
নর্তকী নর্তকী, শূন্য রেল-লাইনের ধারে প্রজাপতি এক ঝাঁক, কতো
ওয়াগন, ঘোড়া
তরঙ্গিত পাহাড়ের ঢালুতে গড়িয়ে পড়ে, দিগন্তে আগুন।
স্যুটের ভিতর ক্লান্ত ক্ষীয়ামান তোমার জনক, উঁচু উঁচু
ঘাসে ডুবে যাচ্ছে ভিন্ন শতাব্দীর দিকে হাত রেখে।

একটি কান্না

এমন তো মাঝে-মধ্যেই হঠাৎ হয়েই থাকে। রাত্রির খাবার
খেয়ে আর বেতারের নৈশ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে
শুতে যাই; কী-যে হয়, আমার ঘুমের বনে চকিতে আবার
জ্বলে ওঠে দাবানল- পালায় হরিণ, ভীত পাখি। মেষ গুনে
গুনে ক্লান্ত, কিছুতেই বোজে না চোখের পাতা, বিফল ঘুম-বড়ি।
অথচ সহজ ঘুমে অচেতন জায়া পুত্রকন্যা, আমি শুধু

করি পায়চারি ঘরে, বারান্দায়, ত্রস্ত কখনও দেয়াল পড়ি;
জানালায় ঝিল্লিস্বর স্বপ্ন রেখেও রাখে না, অবিরত ধু-ধু
করে স্মৃতি-এভেনিউ। পড়ে থাকে বই বিছানায় কি টেবিলে,
অতিশয় মৃত; ধৃতরাষ্ট্রের মতন চেয়ে থাকি, নিষ্পলক,
অন্ধকারে, চতুষ্পার্শ্বে দেখি না কিছুই কিংবা ছন্দও মিলে
বয় না বুকের রক্তে পুষ্পঝড়। ভাসমান লাল নীল স্বপ্নিল ফলক।

সহসা রাত্রির অন্ধ স্তব্ধতাকে খান খান করে আসে ভেসে
একটি কান্নার শব্দ, যেন শুনি রাতেরই ফোঁপানি অবিরাম
এ কান্না বয়স্ক নয়, কচিকণ্ঠ উৎস তার। বুঝি দেশে দেশে
এশিয়া কি আফ্রিকায়, লাতিন আমেরিকায় শহর ও গ্রাম
এমন কান্নায় থরো থরো বারবার। মধ্যরাতে কাঁদে শিশু
হয়তো-বা মাঝপথে, ক্ষুধায় কাতর সেকি? কী যে তার নাম
বলা মুশকিল, থাকে কার সঙ্গে? নাম তার কালু না কি বিশু
অথবা সালেহা, শীলা? জননী কি অন্ধকারে নিতেছে বিশ্রাম
দূরে? পিতা অপমৃত? কান্নারত এই শিশু পরিত্যক্ত, একা?
এ কান্নায় মিশে যায় আমার সে কবেকার হারানো বোনের
হু হু কান্না-স্রোত, বুকে ওঠে দুলে পলাতক সাল, পথরেখা।

এ-কান্নায় ছায়া আছে, আছে নিশি-পাওয়া আর হৃদয়-কোণের
ঝোড়ো হাওয়া। এ কান্নার কম্পনে চকিতে কী প্রবল নড়ে ওঠে
অস্তিত্বের খাঁচা, অন্তর্গত বুলবুল ভোলে গান। ‘কই শব?’
‘এক্ষুণি কবরে দেবো, এনে দে এনে দে’-বলে এ ক্রন্দন লোটে
ঘরে, পথে-ঘাটে, গোঠে-বুঝিবা কাঁদছে একা আমারই শৈশব।

একটি বিনষ্ট নগরের দিকে

অচেনা জ্যোৎস্নায় বুঝি এসে গেছি। চতুর্দিকে ঘোড়ার কঙ্কাল
ঝুলে আছে, দরজায় দরজায় ঊর্ণাজাল; এখানে-সেখানে
বিষণ্ন কাদার মূর্তি এলোমেলো, অসংখ্য বাতিল ট্রাকে, বাসে
এলাহি বল্মীক আর রাশি রাশি উজাড় বোতল সবখানে।
হে পুরুষ, হে মহিলা আপনারা কোথায় এখন, কোন্‌ দূরে?

দশকে চার দিয়ে গুণ করে আমার বয়স আরো কিছু দূর
হেঁটে যায়, কী একাকী পদচিহ্ন পড়ে শহরের পথে পথে
প্রচ্ছন্ন গলিতে।
শহরের সব দুঃখ আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে
গাঁথা; আমি দুঃখের বাইরে চলে যেতে চেয়ে আরো
বেশি গাঢ় দুঃখের ভিতর চলে যাই, যেন কোনো
একা আদি মানবের বেলাশেষে নিজের গুহায়
নিঃশব্দ প্রস্থান।

বারুদমণ্ডিত কাঠিগুলি একে একে পড়ে গেলে দেশলাই
খুব শূন্য থেকে যায়, অনুরূপ শূন্যতায় ভোগে
এ মূক শহর সারাবেলা, ট্রম্বোন দূরের কথা, এমনকি
দিকপ্রিয় পুলিশের বাঁশিও যায় না শোনা কোথাও এখন।

একটি বিনষ্ট নগরের দিকে চেয়ে থাকা কী যে
শিরাবিদারক মুহূর্তের চাপ সয় যাওয়া রুক্ষ
জনশূন্যতায় পথ ফেলে দীর্ঘশ্বাস ঘন ঘন
ঘূর্ণমান পুরনো কাগজ
ল্যাম্পেস্টের নিচে খুব শীতকাতুরে পাখির মতো
পড়ে আছে, গাছগুলি বিধ্বস্ত পাথুরে মূর্তি যেন।
নৈঃশব্দের দীর্ঘ জিভ কেবলি চাটছে বাড়িঘর,
সারি সারি থাম,
যেমন কামুক
তন্ময় লেহন করে মেয়েমানুষের ঊরু। যে-জীবন করিনি যাপন
তারই ছায়া দুলে ওঠে, দুলে ওঠে মহা ব্যালে। কেন মুছে যায়?
নৈঃসঙ্গে বিলুপ্তিবোধ তীব্র হয়, বড়ো তীব্র হয়।

বেসিনে বেসিনে ধুলো পুরু হয়ে জমে নিশিদিন,
রক্তিম আরশোলা ঘোরে মেঝেতে দেয়ালে, ঝাঁক ঝাঁক।
মুরগী রান্না হয়ে পড়ে আছে ঠাণ্ডা রন্ধনশালায়,
খাবার টেবিলে নিঃসঙ্গতা, মেঘের মেরুতে ভাসমান স্মিত
চার্বাকের খুলি!
শুধু একজন কী খেয়ালে দেয়ালের দিকে মুখ রেখে তার
গোসলখানার চৌবাচ্চায় ছিপ ফেলে প্রহরের পর
প্রহর দাঁড়ানো।

বিদঘুটে মরুচারী পাখি দেখি ছাদে ও কার্নিশে, শত শত;
ওদের ক্ষুধার্ত চোখে সিমুমের স্মৃতি আর দীপ্র মরীচিকা।
‘ফুটপাতে কতকাল পড়ে না মানুষী পদচ্ছাপ’ বলে ওরা
শহরের শীর্ষে ওড়ে পাখায় বাজিয়ে অট্রহাসি বারবার।

হঠাৎ অসুস্থ লাগে খুব; তাহলে কি ওরা সব, এলেবেলে
এই শহরের নাগরিকবৃন্দ, মৃত অনুরূপ অসুখেই?

এখন আমার শব্দাবলি

ছিলো তো সোনালি সমঝোতা, তবু কেন বেঁকে বসে
আমার নিজস্ব শব্দাবলি?
কখনও তোয়াজে রাখি, কখনও-বা ওদের সম্মুখে
প্রেমিকের মতো সানুরাগ নতজানু আমি। আর
গন্‌গনে দুপুরে ওদের যত্নআত্যি করি চামর দুলিয়ে ঘন ঘন,
যখন প্রবল নামে শীত,
ব্যাকুল বাঁচিয়ে রাখি আপাদমস্তক
শীতবস্ত্রে ঢেকে।

কখনও খাওয়াই দুধকলা, অসুখের আন্দেশায়, পার্কে কিংবা
নদীতীরে খানিক বেড়িয়ে নিয়ে আসি,
চাবুক চালাই খুব সপাং সপাং মাঝে মাঝে,
যেন সার্কাসের শ্বাপদের ট্রেইনার।

এখন আমার শব্দাবলি নিরিবিলি স্মিত ঝিলে পা ডুবিয়ে
হরিণের মতো চোখ তুলে তাকায় না, দাঁড়ায় না
খড়ের গাদার পাশে চকচকে ঘোড়ার মতন
বাঁকিয়ে তরুণ গ্রীবা, দোলে না কেশররাজি হাওয়ায় স্পন্দিত
শস্যের ধরনে আর। এখন আমার শব্দাবলি অগাধ জ্যোৎস্নায়-পাওয়া
পরীদের মতো নয় নৃত্যপরা। টাইপরাইটরের বিশদ কীবোর্ড
ছিটোয় না উচ্ছসিত গোলাপ এখন। বাণিজ্যিক এলাকায়,
ফুটপাতে, বনেদি পাড়ায়, ফ্লাটে ফ্লাটে
কিংবা কোনো বিবর্ণ বস্তিতে
আমার নিজস্ব শব্দাবলি
রক্তচক্ষু কোকিলের মতো গেয়ে ওঠে না এখন।

সকল পাখির কণ্ঠে জমাট বেঁধেছে চাপ চাপ
তুষার, তাদের ছিন্নভিন্ন
পালক এখানে ওড়ে ইতস্তত এবং অস্বস্তিকর মৌন
ঝুলে রয় চতুর্দিকে বিরতিবিহীন, এ প্রান্তর অতিশয়
ক্লিষ্ট, গমগিন, এমনকি মাতমেরও ধ্বনি নেই।
রজনীগন্ধার বন ফুঁড়ে বেরোয় কেবলি শীর্ণ, প্রসারিত
হাত, অগণিত বিক্ত, মূক ও বধির।
হঠাৎ দুপুরে সন্ধ্যা, মানুষের ত্রাতা তাঁর পেরেক-চিহ্নিত
রক্তাপ্লুত হাতে খুঁজছেন খাদ্যকণা বার বার
কুকুর-শাসিত ডাস্টবিনে, তিনটি মলিন হ্রস্ব
নোটের বদলে মেরি-মাতা নির্দ্বিধায়
রাত্তিরে হচ্ছেন ম্লান, হাতে উল্কি আঁকা, একচক্ষু
নাবিকের আস্তানায় এবং রবীন্দ্রনাথ কালোবাজারির
দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল
ভিক্ষা চাইছেন ত্রঁটো-কাঁটা মাথা নত করে আর
তিন দিন তিন রাত্রি উপোসের পরে ফুটপাতে
এক ভিড় লাশের পাশেই ভাঙা উজাড় থালায়
দেখছেন অলৌকিক ভোজ নজরুল ইসলাম।

কী করে আমার শব্দাবলি একরাশ
পাতার আড়াল থেকে রক্তচক্ষু কোকিলের মতো
গান গেয়ে ওঠবে এখন?

 কথোপকথন

এই দ্যাখো আজ জ্যোৎস্নারাতে
বাগানের সবচে সুন্দর গোলাপটি দিলাম তোমার হাতে।
‘যতই আনো না কেন’ বললে তুমি, ‘গোলাপ বকুল
অথবা রজনীগন্ধা, বৃথা সবই, আমি তো চাইনে কোনো ফুল।

তাপর বহুপথ চড়াই উতরাই
পেরিয়ে তোমাকে জানালাম, শোনো, করি না বড়াই,
তবু বলি, এই যে এনেছি চন্দ্রহার, এর সমতুল্য
নেই কিছু। বললে তুমি, ‘অন্তত আমার কাছে
এ হারের নেই কোনো মূল্য।

তা হলে কী চাও তুমি? বলো তো কী ছাই-
পাশ পেলে হও খুশি? বললে মৃদু স্বরে,
‘শুধু তোমাকেই চাই’।

কবিকে দিও না দুঃখ

কবিকে দিও না দুঃখ, দুঃখ দিলে সে-ও জলে স্থলে
হাওয়ায় হাওয়ায়
নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর। কবি তার নিঃসঙ্গতা
কাফনের মতো মুড়ে রাখে আপাদমস্তক, হাঁটে
ফুটপাতে একা,
দালানের চূড়ায় চূড়ায়, দিগন্তের অন্তরালে
কেমন বেড়ায় ভেসে, চাঁদের নিকট যায়, নক্ষত্র ছিটোয় যত্রতত্র
খোলামকুচির মতো। তাকে দুঃখ দিও না, চৌকাঠ থেকে দূরে
দিও না ফিরিয়ে।
ফেরালে নক্ষত্র, চাঁদ করবে ভীষণ হরতাল, ছায়াপথ তেজস্ত্রিয়
শপথে পড়বে ঝরে, নিমেষেই সব ফুল হবে নিরুদ্দেশ।

প্রায়শ পথের ধারে ল্যাম্পোটে হেলাল দিয়ে খুব
প্রচ্ছন্ন দাঁড়িয়ে থাকে, কখনও-বা সীমাহীন রিক্ততায়
রেস্তরাঁয় বসে
বান্ধববিহীন বিষাদের মুখোমুখি
নিজেই বিষাদ হয়ে। মাঝে মাঝে মধ্যে চৌরাস্তায় খুঁড়ে তোলে এক
গোপন ফোয়ারা পিপাসার্ত পথিকেরা আঁজলা ভরবে বলে।
আবার কখনও তার মগজের উপবনে লুকোচুরি খেলে
খুনি ও পুলিশ!

মধ্যরাতে শহরের প্রতিটি বাড়ির দরজায় কিছু ফুল
রেখে আসে নিরিবিলি কাউকে কিছু না বলে! কবি সম্মেলনে
রাজধানী আর মফস্বলে স্টেজে কয়েক ডজন
পংক্তির জ্যোৎস্নায় রৌদ্র পুনরায় স্নান সেরে স্বকীয় গোপন
ঘুলঘুলিটার
দিকে চোখ রেখে নীলিমার সঙ্গে বাণিজ্যের কথা ভাবে, ভাবে
সুদূর অনন্ত তাকে চোখ টিপে বেঘোরে ঘোরাবে কতো আর?
কবি সম্মেলনে তেজি যুবরাজ, প্রেমের নিকট বাস্তবিক
বড়ো নগ্ন, বড়ো অসহায়!
কবিকে দিও না দুঃখ, স্বপ্নের আড়ালে তাকে তীব্র
আবৃত্তি করতে দাও পাথর বুক, গাছ,
রমণীয় চোখ,
ত্বক, হেঁটে যেতে দাও ভিড়ে নিজের ভেতরে। রোজ
হোক সে রূপান্তরিত বার বার। নিজস্ব জীবন রেখেছে সে
গচ্ছিত সবার কাছে নানান ধরনে অকপট।
কবিকে দিও না দুঃখ, একান্ত আপন দুঃখ তাকে
খুঁজে নিতে দাও।

কবিতা এখানে এসো

কবিতা এখানে এসো, বসো, এই আমার নিভৃত
বাম পাশে; কী খেয়ালে এই তো সেদিন গেলে, তবু
মনে হয় কতদিন দেখি না তোমাকে কতদিন
আমার ছায়ায় ছিলে, আমার রোদ্দুরে লুটোপুটি
খেয়েছো আনন্দে বহুবার, রহস্যের পাকে পাকে
খেলেছো অনেক খেলা! কখনও দিয়েছো তরতাজা
একটি গোলাপ, অকস্মাৎ রেগেমেগে কখনও-বা
প্রচণ্ড দিয়েছো ছুড়ে মুখে কালোজিরার মতন
রাশি রাশি মরা মাছি। তোমার জানুতে মাথা রেখে
মরবো বলেই আজও নানা রোগ শোক নিয়ে আছি।

নির্জনতা ভালোবাসো বলে আমি নিঃসঙ্গ গুহায়
প্রবেশ করেছি বারবার, ঊর্ণাজালে মুখ রেখে
আদিম ভাষার সুর তুলেছি গলায়, তর্জনীতে
স্বপ্নের মন্দির কত ঘুরিয়েছি যখন-তখন।

ফিরে এসো, বসো তুমি আমার নির্ভৃত বাম পাশে।
এখনও আমার কণ্ঠস্বর তোমাকেই ছুঁতে চায়
এবং আজলা ভরে নিতে চাই তোমার সঙ্গীত।
কেন যে আমাকে ছেড়ে চলে যাও বারবার? আমি
ছন্নছাড়া ঘুরি একা একা রুক্ষ তুমিহীনতায়।
আমার বয়স দ্রুত বাড়ছে বলে কি তুমি দূরে
সরে যাবে? নিরুপায় আমি পড়ে থাকবো এখানে
জঞ্জালের স্তূপে একা জংধরা অসির মতন?

কবিতা, দ্বিরূপিণী

কবিতাকে নিয়ে আমি বাস্তবিকই মুশকিলে পড়েছি।
দ’দণ্ড দেয় না শান্তি, কেবল অশান্ত করে রাখে।
স্নানাহার শেষে মাথাভরা পরিপাটি চুল নিয়ে
নিভৃত শয্যায় শুয়ে শুয়ে
বই পড়ি কিংবা ফুঁকি সিগারেট, হঠাৎ কোত্থেকে এসে বড়ো
এলোমেলো করে দ্যায় চুল
কোনো কোনো দিন।
মধ্যরাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলে, ঘরময় শুনি নিশিডাক,
বলা-কওয়া নেই
কখনও কলজেটাকে এমন নাড়িয়ে দ্যায়, হায়,
বেড়ে যায় বুকের স্পন্দন।
কবিতাকে নিয়ে আমি বাস্তবিকই মুশকিলে পড়েছি।

গ্রীষ্মের রাত্তিরে ঘুমহীন, প্রেমহীন জানালার কাছে যাই,
বাতাসের সাথে
আচমকা সে-ও ঢুকে পড়ে ঘরে। কখনও শরীর হয় জ্যোৎস্নাময় বন
কখনও-বা রৌদ্র উচ্ছসিত
উদাস প্রান্তর,
আদিম অরণ্যঘ্রাণ কখনও সত্তায় তোলে আলোড়ন। সে তো
বুকের ভিতরে দ্যায় ছেড়ে সোনালি রূপালি মাছ কতো,
আমাকে জাগিয়ে রাখে প্রহরে, প্রহরে ক্লান্ত করি নিশিদিন।
চোখে হানে জ্বালা,
মাথার ভিতরে জ্বলে দ্বীপের উৎসব, ফের চকিতে নেভায় এক ফুঁয়ে।

প্রত্যহ দু’দিক থেকে আসে দু’জন আলাদা নারী।
একজন, তার লক্ষ্মী লক্ষ্মী ধরন চিনতে
কখনও হয় না ভুল, বলে-
চলো যাই হ্রদের নিকারে বসি, রাখি
চোখ ঐ গোলাগের গোলাপি হিল্লোলে,
এসো, এসো প্রাচীন গুহায়
দেখাবো পরীর নাভিমূল,
তোমাকে দেখাবো রাজা আর ক্রীতদাসীর সঙ্গম;
একা হও তুমি,
তারার অলীক তলোয়ারে বিদ্ধ হও, বিদ্ধ হও।
অন্যজন ছিন্নমস্তা, লংকার ঝালের মতো ঝাঁঝ কণ্ঠস্বরে
মেখে বলে-
চলো যাই শ্মশানে অথবা গোরস্তানের বসি কিছুক্ষণ, দেখি
কঙ্কাল-মিছিল।
তুমিও আপনার শরীরে পেরেক ঠুকে দ্যাখো
যীশুর যন্ত্রণা
সইতে পারো কি না,
ক্রমাগত ক’দিন উপোস করে দ্যাখো অনাহার কায়ক্লেশ
কত যে সহনযোগ্য আর ক্ষুধার্ত শিশুর গালে গাল রেখে
জেনে নাও মুত্যৃর শৈশর।
মুমূর্ষ বৃদ্ধের কানে প্রজাপতি আবৃত্তি করলো
কোন পদাবলি
জানবে না তুমি? পদকর্তা মৃতের চোখের কোণে জেগে থেকে,
কাঁটার মুকুট পরে লেখো দ্বিধাহীন-
আমরা সবাই আজ দুর্ভিক্ষের বিকৃত সন্তান।
দু’জন দু’দিক থেকে টানে আমাকে নিয়ত, আমি
কখনও এদিকে
কখনও ওদিকে ঝাঁকে পড়ি,
যত বলি ছাড়ো পথ, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও হে
নারী, দ্বিরূপিণী,
ততই তাদের খেলা ভীষণ হিংসুক হয়ে ওঠে।
কখন যে দু’জন চকিতে একজন হয়ে যায়, বোঝা দায়-
একই আলোবৃত্তে
হ্লাদিনী নর্তকী নাচে, ফোটে নানা মুদ্রা ক্ষণে ক্ষণে।

 কানামাছি ভোঁ ভোঁ

‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছোঁ’-বলেই ওরা
যে যার ধরনে ঘোরে চারদিকে, কখনও রঙিন বল নিয়ে
দে-দৌড় খেলার মাঠে হই হই।
দু’দিকে দাঁড়ায় দু’টি দল;
পায়ে পায়ে ছোটে বল, শূন্যে ওঠে কখনও বা, কেউ
চকিতে ফাউল করে, বাধে খিটিমিটি। ফের ক্ষিপ্র খেলোয়াড়
থর থর হাত রেখে প্রতিপক্ষের গলায় সহজেই
মেটায় বিবাদ ক্ষণিকের। কখনও বা বালকেরা
ওড়ায় বলুন ঝাঁক ঝাঁক, গলা ছেঁড়ে দেয় ডাক
হরেক রকম।
এখন বাগানে গেলে কোনো দৈত্য, ক্ষ্যাপা, স্বার্থপর, করবে না
পথরোধ। কেউ চকোলেট খায়, খোঁজে কেউ পরীর সমাজ
আশেপাশে, চোখ মেলে দেখে নিতে চায় দু’চারটে দেবদূত
খেলাচ্ছলে দোলে কিনা টেলিগ্রাফ-তারে বারবার।
গোধূলি রঞ্জিত চোখে দেখি দূরে থাকে ভোরবেলার মতন
বয়স ওদের, খুঁজি কচি ঠোঁটে আমার নিজের ডাক নাম।
এই দৃশ্য নিভে গেলে চোখ বুজে টাইরেসিয়াসি
চৈতন্যে সুস্পষ্ট দেখি, যেন-বা টেলিভিশনে ফিল্ম
প্রাচীন, ধ্রুপদী, দেখি এইসব প্রফুল্ল বালক-কেউ বেঁটে,
কেউ দীর্ঘকায়,-ঘোরে বয়স্ক রোদ্দুরে ক্লান্ত পায়,
খরায় পোহাতে চায় ছায়া, ছায়া শুধু দ্রুত দূরে সরে যায়।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)
একজন ভূলুণ্ঠিত পথপ্রান্তে, ভগ্ন ঊরু, তার দীপ্র মোটর বাইক
আহত পশুর মতো পড়ে আছে পাশে।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)
অন্যজন মুখে ক্রুর রেখাবলি নিয়ে জুয়ার টেবিলে বসে
সৌভাগ্যের আনুগত্য চায় প্রতিবার দান ফেলে, কেউ
কাটায় সকল বেলা পাগলা গারদে, আঁকে দুঃস্বপ্ন নিয়ত
আতঙ্কিত মগজের দেয়ালে দেয়ালে। একজন প্রেমিকাকে
গোলাপের তোড়া দিয়ে বনে যায় রাতারাতি সুদক্ষ ঘাতক।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)
কেউ হন্তদন্ত হয়ে অলিতে-গলিতে খোঁজে বেবি-ফুড, যেমন সুদূর
মধ্যযুগে অশ্বরূঢ় নাইট খুঁজতো হোলি গ্রেল কী দুর্গম
পাথুরে প্রান্তরে, বনে উপবনে, পাহাড়ে পাহাড়ে।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)
ভেসে ওঠে একজন যুবা, ক্ষয়রোগীর মতন সমাজের
স্বাস্থ্যেদ্ধারে নিবেদিত, সর্বদা ভূতলবাসী।
ব্যক্তিগত টানেলে কেউ-বা
অতিশয় স্বপ্নলিপ্সু, পলায়নই অর্থ তার সোল্লাসে রটায়
শক্রপক্ষ। একজন নিজ ঘরে দ্যাখে চোরাবালি সর্বক্ষণ,
দ্যাখে বাগানের পথে বীভৎস কঙ্কালময় রুক্ষ মরুভূমি।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)

অন্যজন, ছন্নছাড়া, রাত্রির শহরে অন্ধকার পথে হাঁটে,
তার চুল থেকে এক অলৌকিক পথরেখা ছায়াপথে মেশে,
বুকে জোনাকির মতো শব্দ জ্বলে নেভে, বুকে ব্যস্ত
জটিল বীজাণু।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)

কিছুই পারি না

কিছুই পারি না আমি। প্রত্যহ পাথর কেটে কেটে
কান্তিমান মূর্তি কিংবা দুধশাদা নহর বানানো
হয় না আমাকে দিয়ে। মধ্যযুগী নাইটের মতো
ড্রাগনের আতশী নিশ্বাস থেকে কোনো তরুণীকে
করিনি উদ্ধার; সবদেজ ঘোড়া ছুটিয়ে কান্তারে,
মরুপথে, সুনসান মায়াবী উদ্যানে কোনোকালে
যাইনি, ছিঁড়িনি সর্বরোগহর ফল, মুক্তিজন
ছিটিয়ে পারিনি দিতে প্রাণ অগণিত প্রস্তরিত
প্রজাদের অভিশপ্ত রাজ্যের অথবা ভাসাইনি
ভেলা দূর সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে, বাঁধিনি তো ডেরা
বিপুল রহস্যঘেরা জনশূন্য দ্বীপে, প্রাণপণ
লড়িনি, জংলির সঙ্গে, অজচর্মে ঢাকিনি শরীর।

একা-একা আজীবন বয়ে চলি ব্যর্থতার ক্রশ!
পিঠের উপর নিয়ে রৌদ্রজল লাঙল চালিয়ে
পারি না মাটির বুক চিরে চিরে ফসল ফলাতে;
সরু ডিঙি বেয়ে নিশিদিন পারি না ফেলতে জাল
গহন নদীতে, চিরকাল খনিও অগম্য আর
পশুপাখি নিরাপদে করে চলাফেরা সর্বক্ষণ
আমার চৌদিকে- আমি শুধু কিছু অক্ষর সাজিয়ে
কবিতা রচনা ছাড়া এ যাবত পারিনি কিছুই।
আজো কবিতার মতো সত্য কবিতা ফুটলো কি না
খাতার পাতায় বাস্তবিক, হায়, তা-ও তো জানি না।

কে তোমরা

কে তোমরা অভ্যন্তরে তাড়াতাড়ি সাজাচ্ছো চেয়ার
সারি সারি, দেখছো পর্দার রঙ ঠিক আছে কি না?
খানিক সাজিয়ে ফের এলোমেলো করে দিচ্ছো সব-
রঙিন সিল্কের পর্দা ছিঁড়ে,
চেয়ারের পাহাড় বানিয়ে খুব গল্পমগ্ন তোমরা এখন।
নাকি নৈঃশব্দই ভালবাসো?
কে তোমরা বাস্তবক মাথার বদলে ঘাড়ে শুধু
বন্ধ ঘড়ি নিয়ে বসে আছো মুখোমুখি অবেলায়?

আমার মগজে হো হো হেসে ওঠো তোমরা, কখনও
অত্যন্ত ফুঁপিয়ে কাঁদো বুকের ভেতর, সারাক্ষণ
রয়েছো অধীর প্রতীক্ষায়, যেন কোনো সুসংবাদ
আসবে এক্ষুণি।
সর্বদা চঞ্চল দৃষ্টি, কেউ আসে কি না, মানে কোনো
পিওনের ব্যাগ ভেসে ওঠে কি না, তারই দিকে লক্ষ্য
তোমাদের। এখনও আসেনি কেউ, কস্মিনকালেও
চকিতে তেমন কারো মৃদু
পদশব্দ বেজে উঠবে কি না, কে পারে বলতে?
কিন্তু আমি তোমাদের পরিচয় চাই, চাই জেনে নিতে কোন্‌
ডাকবাক্সে ফেলো চিঠি, কাদের সংসর্গে লাগে ভালো?
কেন বারবার
মেঘের ডানায় ঝুলে থাকো? গহন নদীতে কেন
উড়ন্ত টেবিল পেতে বসো অথবা মরুর বুকে
মধ্যরাতে জনহীনতায়
বের করো জ্যোৎস্নারাঙা হ্যাণ্ডনোট? কেমন বাজার
জমে ওঠে অকস্মাৎ, বালিয়াড়ি উম্মে কুলসুমি সুরে সুরে
বিশদ রঞ্জিত হয়, বালি ফুঁড়ে জাগো রাশি রাশি
কাচের গুঁড়োর মতো জলের ফোয়ারা, পুণ্যময়।
আমার ভেতর কে তোমরা ফিসফিস কথা বলো,
গোপনে ছড়িয়ে দাও বীজ, জল ঢালো? পাঁজরের
জমি ছিঁড়ে অগণিত চারা তোলে মাথা, যেন ওরা
অজস্র নিশান।
সতেজ রত্তিরে
লতাগুল্ম উন্মীলিত শরীরের দেয়ালে দেয়ালে।
কখনও আবার বুনোষাঁড়
ছেড়ে দাও আমার বুকের চৌরাস্তায়, করে সে চুরমার
সব কিছু; খেয়ে ফেলে তোমাদেরই দেওয়া কত ফুল।

কে তোমরা অভ্যন্তরে হার্ডবোর্ডে আঁকছো যেশাশ
আমারই আদলে আর বলছো কেবলি,-চলে যাও
চলে যাও তুমি?
অথচ আমি তো অন্তর্গত চারায় লাগিয়ে গাল,
আঙুলে ঘুরিয়ে দ্রুত কাচের প্লেটের মতো চাঁদ
এবং পায়ের নখ দিয়ে
নহর খুঁচিয়ে তুলে দ্বন্দ্বের দুন্দুভি শুনে আর
মীমাংসার অস্পষ্ট ট্রাফিক আইল্যাণ্ডে চোখ রেখে
প্রত্যহ আবৃত্তি করে আলোকের স্বর্গমালা চাই
থাকতে চাই।

 কেউ না ডাকলেও

কেউ না ডাকলেও কেন এমন নিঃসাড় থাকি ইদানীং কেন
ডাকের কম্পনে
তক্ষুণি কী করে টোল নিয়ে আপন সত্তায়
দোল খেতে হয় প্রতিবার ভুলে গেছি? নাকি তার কোনো মানে
অধুনা পাই না খুঁজো! কেউ ডাকলেও কেন আমার হৃদয় ঢিল-খাওয়া
ঝিলের মতন হয়ে ওঠে না তক্ষুণি?

রাত্রি কত গাঢ় হলে দুঃখী তার কণ্ঠে আনে গান, জানি আমি;
একাকীত্বে তার কত সূর্যোদয়, কত সূর্যাস্ত জমেছে-
সেও তো অজানা নয়। বেদনার তীর্থে যে-জন আঁজলা ভরে
করে জল পান,
আস্তে-সুস্থে ধোয়া
পায়ের শতেক ক্ষত, আমার ভেতরে তার জন্মপরিচয়
জ্বলে সারাক্ষণ আর ঋতুতে ঋতুতে কত আর্তি অস্ত যায়।

তোমাদের মনে রাখা দরকার, এই তো এই আমিও একদা
ডাক আর আহ্বানের সূক্ষ্ম সব বিবাদ মিটিয়ে
চায়ের আসরে খুব উড়িয়েছি কথার রঙিন ঘুড়ি, তুড়ি
মেরে নৈরাশ্যের মুখে ঘোড়ার আড়াই ঘর লাফ কিংবা গজের দুলুনি
কখনও দেখেছি আড়চোখে। চমৎকার চমৎকার বলে চায়ে
দিয়েছি চুমুক বারবার।

কখনও ডাকলে কেউ আমার সত্তায় আগে নামতো আকাশ,
হতো সূর্যোদয়।
আমার দুয়ারপ্রান্ত থেকে বিফল যায়নি ফিরে কেউ, কেউ
‘বন্ধ’ শব্দ কখনও করেনি পাঠ আমার কপাটে, মনে রেখো।
চতুরতা বিনা
সবাইকে প্রায়শই ফুল দিয়ে বলেছি, দেখুন
আমার আঙুলে এই অশেষ আনন্দ ফুটে আছে নিশিদিন।

টেবিলে অনেক চিঠি জমে, অগণিত টেলিগ্রাম
অবসন্ন ছেঁড়াখোঁড়া পাখির ডানার মতো ঝোলে
পুরনো দেয়ালময়, কড়া
নেড়ে নেড়ে ক্লান্ত চলে যায় কত আগন্তুক, কেউবা সুদূর
পথপ্রান্তে প্রতীক্ষায় একাকি দাঁড়িয়ে
গোধূলি আবৃত্তি করে খুব,
তবুও দিই না সাড়া, বসে থাকি ছায়াচ্ছন্ন বিদায়ের ঘরে।

অকস্মাৎ কী-যে হয়, কখনও কেউ না ডাকলেও ছুটে যাই
শূন্যতায়, গলা ছেড়ে ডাকি
অন্তপুরে, প্রান্তরের মধ্যযামিনীতে, ডেকে যাই ক্রমাগত,
অনেক পেছনে থাকি পড়ে নির্বাসনের গৈরিক আলখাল্লা, নিরিবিলি।

কেমন করে হঠাৎ তুমি

কেমন করে তুমি হঠাৎ তুমি আমার মধ্যে করলে বসত,
সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে,
এখনো তো প্রশ্ন আছে।
যখন তুমি তোমার চোখে ঋতুরাজের প্রসাদ নিয়ে
দাঁড়িয়েছিলো একদা এক সান্দ্র মধুর বেলাশেষে,
আমার আপন আট কুঠুরি
সকালবেলার মতো হেসে
সম্ভাষণের কিরণ-ঢেউয়ে প্রবল তোমায় দুলিয়ে দিলো।

তোমার আমার মধ্যে কখন ভ্রূকুটিহীন একটি দৃষ্টি
জন্ম নিলো, হৃদ ভুবনে
উঠলো দুলে
ফুলের ডালি পাখির গানের সম্মোহনে,
কেউ জানে না, কেউ জানে না।

তোমায় দেখে স্বপ্ন আমার চোখ খুলেছে,
মুখ তুলেছে আশার শ্যামা।
কেমন করে হঠাৎ তুমি আমার দিলে
অন্তরঙ্গ তোমার দিনের
তোমার রাতের স্বত্বাধিকার?

যখন তুমি ছড়াও হাসি ঠোঁট-জমিনে
দুঃখটাকে আড়াল করো চুলের আড়ে,
আমার মনের ঝুল অথবা
এই শরীরের ভাঁজে ভাঁজে
জমে থাকা কালের ধুলো কিংবা বালি
যায় তো ঝরে অগোচরে,
যায় তো ঝরে।
কিন্তু যখন তোমার চোখের দু’তীর ব্যেপে
হঠাৎ আবার মেঘ জমে যায়, জলজ কাঁটা
ধরায় জ্বালা চোখের কোণে,
আমার বুকের ভেতর বহু গাছগাছালি
এক নিমেষে ধুলোয় গড়ায়,
পক্ষী কত শরীরজোড়া জখম নিয়ে কেঁদে বেড়ায়।
কান্না তোমার ক্ষয় করে দেয় আমার আয়ু,
ভীষণভাবে ক্ষয় করে দেয়।

ক্ষোভে, অভিমানে

হৃদয় ডাগর সূর্যোদয় নিয়ে মাঝে-মাঝে করি উচ্চারণ
কত কাজে স্বরচিত শ্লোক, সুর হয়, কারও মানে না বারণ,
চৈতন্যে নক্ষত্র ফোটে, রক্তে জাগে দ্বীপ, গুঞ্জরিত;
চোখে মুঞ্জরিত
নানান মন্তাজ অতীতের। তখন যে কণ্ঠস্বরে
সূর্যাস্তের রঙ লেগে যায়, অকস্মাৎ চরাচরে
বিষাদের অমা
নামে আর প্রতিটি শ্লোকের অন্তরালে থাকে জমা
রাত্রিময় চোখের জলজ কণা, যেন অণুবিশ্ব,
কখনও পড়লে ঝরে হয়ে যাবো নিঃস্ব।

কোন অবেলায় আমি এসেছি এখানে,
যখন শৌর্যও ঠিক শৌর্যও নয়, মহিমার অস্তরাগে শুধু ভুল গানে
মেতে বসে থাকি রুক্ষ একাকী চাতালে?
কখনও সে কোন প্রেত দেয় হাতছানি, নামি স্বকীয় পাতালে।
এ কেমন নায়ক আমার আজ, হায়,
অক্ষরবৃত্তের ডাকে আসে, দ্বন্দ্বদীর্ণ শীর্ণকায়,
জয়ের পরেও গেয়ে চলে শোকগাথা ঘুরে ফিরে!
বুঝি সে জন্মেছে একা বিষাদেরই তীরে।
ভার্জিলের ধূসর সৈকত আর আমার তটরেখা
বহু যুগ পরে গোধূলিতে একই লগ্নে যায় দেখা।

পাথরে ঘষেও ঠোঁট পারি না ফোটাতে কোনো ফুল
কিংবা একরত্তি ঘাস এবং বিপুল
অমাবস্যা এলে ব্যেপে চতুষ্পার্শ্বে, বানাবো যে জ্যোৎস্না এক কণা,
অনায়ত্ত সেই কলা, করি শুধু প্রস্তাবনা,
সিদ্ধান্ত হারায় পথ বারবার। এ আমি কোথায়
অস্পষ্ট দাঁড়িয়ে আছি ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ, মাইলপোস্টহীনতায়?
জনাকীর্ণ পথে হেঁটে গেলে ঠিক
আমাকেই দুঃখ বলে নেবে চিনে এমনকি উদাস পথিক।

জীবন করছে ফেরি সর্বদাই ভালোবাসা, বিরহ ইত্যাদি শব্দমালা,
সম্প্রতি অভিধা লুপ্ত তার আর কান ঝালাপালা
হচ্ছে দিনরাত
অর্থহীন চ্যাঁচানিতে। তবে কি বেবুন সকলেই?
সম্মুখে বাড়িয়ে হাত
মিত্রতার দিকে অকস্মাৎ থেমে যেতে হয় মধ্যপথে, অসহায়,
কাউকে না দেখে, তবু আমার আপন নিরালায়
নিবেদিত আমি শিশু, পুরুষ রমণী
সূর্যোদয় সূর্যাস্তের কাছে আর আমার ধমনী
তরঙ্গিত ক্ষণে ক্ষণে মৃদু কণ্ঠস্বর শুনে। অথচ অনেকে
এভাবে তাকায় যেন আমি চোর অথবা ভিক্ষুক। মুখ ঢেকে
লুকিয়ে বেড়াই তাই, বস্তুত অজ্ঞাতবাসে কাটে
কাল আর অন্তহীন বাসনার পুশিদা পশম হাটে
নেয়া দায়, সারাক্ষণ রোদ্দুরে ছায়ায় শুধু প্রশ্ন করে মন-
এ অদ্ভুত নিরালোকে তোমার অজ্ঞাতবাস ফুরাবে কখন?

এখন আমার অন্তর্গত আছে একজন কেউ,
যে আমার দিকে আর্ত চোখে তাকালেই কী-যে ঢেউ
ওঠে অস্তিত্বের মূলে এবং তখন
দ্বৈতের টানাপোড়েনে অনেক বন্ধন
ক্রমশ শিথিল হয়, কী গুপ্ত প্লাবনে ভেসে যায় সব ঠাঁই,
আমিও নিঃসীম ক্ষোভে, অভিমানে বারবার একা হয়ে যাই।

কয়েক পুরুষ ধরে

কয়েক পুরুষ ধরে পাড়াপড়শিরা দ্যাখে তার
বেল্টের মতন ঝুরি, পাতার সজীব অহংকার,
দ্যাখো বারো মাস তেরো পার্বণে সে অটল দাঁড়িয়ে
থাকে একা; আশেপাশে বেশ কিছু পরগাছা ভাঁড়িয়ে
তারই নাম ওঠে বেড়ে, যেন গৌণ আত্মীয় ক’জন।

ছায়াতলে কখনও মুর্শিদী কিংবা কীর্তন, ভজন
যায় শোনা, গেরস্ত, সন্ন্যাসী, বাউণ্ডুলে, নিঃসন্তান
রমণী, উদ্বাস্তু-অনেকেই জোটে, মানতের ধান
দুব্বা রেখে যায় কেউ, কেউবা সিঁদুর। মেঠো বাঁশি
পড়ে থাকে কখনও বা। সেই কবে দিয়েছিলো ফাঁসি
কাদের ঘরের বউ, সেই কানাঘুষো পথে ঘাটে।

প্রবীণ বাকলে তার নবীন প্রেমিক গাঢ় কাটে
একটি নামের নক্‌শা। গ্রামে দেখা দিলে ওলাওঠা
সে নিশ্চুপ নির্বিকার। পাতায় পাতায় চন্দ্রফোঁটা
ঝরে আকালেও আর হাওয়ায় সঙ্গীতময় হয়
প্রতি শাখা, যেন-বা নীরোর বাঁশি, সন্ত্রাসে নির্ভয়।

বেপরোয়া, রাত্রিদিন, একচ্ছত্র প্রতাপে অনড়,
পারে না নোয়াতে তাকে এমন কি বৈশাখের ঝড়।
জমে কত ইতিহাসকণা তার শিকড়ে বাকড়ে,
অথচ আমূল যায় ভেসে হঠাৎ বানের তোড়ে।

কয়েকটি রঙিন নুড়ি

কয়েকটি রঙিন নুড়ি এক হাত থেকে আরেক হাতে
নাচাতে নাচাতে আমার সারাদিনমান যায়।
কেউ কেউ তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, হঠাৎ কারও
প্রশ্ন আমাকে সরিয়ে আনে নুড়ির নৃত্য থেকে-
এ কেমন খেলা খেলছো হে যে খেলায়
কোনো বিপক্ষ নেই, নেই হারজিত?

এ-খেলায় আমি নিজেই আমার বিপক্ষ;
কখনও আমি হারি, কখনও বা জিতে যাই।
হার-জিতের মতো কোনো চাঞ্চল্যকর কিছু না ঘটলেও
বাস্তবিক আমার কিছু এসে যায় না বলে আমি
কয়েকটি রঙিন নুড়ি এক হাত থেকে আরেক হাতে নাচাতে থাকি।

কয়েকটি রঙিন নুড়ি এক হাত থেকে আরেক হাতে
নাচাতে নাচাতে আমার সারাদিনমান যায়।
কেউ কৌতূহলী পথচারী, কেউ পণ্ডিত, কেউবা দার্শনিক,
এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকেও আমি দেখছি; তাঁরা অনেকেই
আমার চতুষ্পার্শ্বে প্রজ্ঞার আভা ছড়িয়ে
থমকে দাঁড়ান ক্ষণিকের জন্যে। তাঁদেরই একজন
বললেন, ওহে, তুমি বলতে পারো
জন্মমৃত্যুর রহস্য? বলতে পারো কাকে বলে
আদর্শ রাষ্ট্রনীতি? কিংবা মানবের পক্ষে কী কল্যাণকর
তোমার বিবেচনায়?
প্রশ্নের জালে বিপন্ন আমি কিছুক্ষণ
নিরুত্তর থেকে বলি, এই প্রশ্নাবলি আমাকে
বিমুখ করেছে বারংবার, আমার জানা নেই কোনো সদুত্তর
আমি শুধু এই নুড়িদের কথা কিছু জানি।

বলতে পারি এদের কে কতটা মসৃণ, বলতে পারি
সকাবেলার আলোয় এদের কত সুন্দর দেখায়।
অন্ধকারে কী করে এরা ঘুমায় কিংবা জেগে থাকে
উষ্ণ-কোমল প্রাণীর মতো একে অন্যের গা ঘেঁষে
অথবা বিচ্ছিন্নতায়, আমি আপনাদের জানাতে পারি।
বলতে পারি কী করে আমার হাতের উষ্ণতা
সঞ্চারিত হয় ওদের মধ্যে
আর কী করে আমার রক্ত জ্বলে ওঠে ওদের রঙ।
দেখুন, এই নুড়িগুলি কেমন রঙিন নাচছে আমার হাতের মঞ্চে।

গোলাপ

আমার উঠোন জুড়ে ভোরের কলাপ।
ফুটে আছে একরাশ সতজে গোলাপ; চতুর্দিক
তরুণীর মতো হাস্যে ভরপুর। হে শহর, শোনো,
গোলাপকে এত লাল দেখিনি কখনও।
এ দেশে গোলাপ
এমন প্রবল রক্ত-লাল হওয়াটাই স্বাভাবিক।

গোলাপ সুন্দরী – ০৮

বিলাস এখন আপনার ঘরে জানালা খুলিয়া দাঁড়াইয়াছিল। এমত সময়, প্রবল মেঘ-ঘর্ষণ শুনিল ; সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিল যেটুকু আলো ছিল তাহাও নাই এবং কে যেন ত্রাসে ভয়ে এইমাত্র দ্রুত পদক্ষেপে যাওয়া-আসা করিতেছে । যে দরজাকে সে একদা ভয় করিয়াছে সেই দরজার দুই পাশ ধরিয়া দাঁড়াইল । বুঝিল মনিক এই অন্ধকারে ঘুরিয়া বিভ্রান্ত হইতেছেন, আর যে তিনি ভীত কণ্ঠে কহিলেন “আলো নিভে গেছে” । বিলাস এ কথায় এক মুহূৰ্ত্ত দেরী করিল না, দেশলাই খুঁজিতে লাগিল । আঁধারে আর এক নিদ্রিত অবস্থা, অন্ধের মত হস্তদ্বারা সমস্ত বস্তু স্পর্শ করিতে করিতে চলিয়াছে, অনেক দূর, না অনেক সময়ের পারে সে গিয়াছে, ইতিমধ্যে একবার মনে হইল মনিকও দেশলাই খুঁজিতেছেন। এইভাবে খুঁজিতে খুঁজিতে যে হাতে বিলাসের একদা কাঁটা ফুটিয়াছিল, যে হাতে গ্রন্থ ধরিয়া শ্লোক পাঠ করে, সেই নিমিত্তমাত্র হাতে, উষ্ণতার স্পর্শ লাগিল মানবীর দেহ অথবা নিশ্বাস। বাষ্পসম্ভূত মেঘ, মেঘ উৎপন্ন আলোকে…ভাস্কর্য্যের বিপুলতা বিলাস দেখিল । এইটুকু দেখা লইয়া তাহার মনে হয় যে ঘুম ভাল ।
“আমাকে ছেড়ে যেও না. আমি ভীত” এবং ইহার পর মাথা নত করিয়া মনিক বলিতে চাহিয়াছিলেন যে শুদ্ধ বস্ত্র পরিবর্ত্তনকালে আলো নিভিয়া যায় ফলে…।
মনিকের কথার উত্তরে বিলাস গভীর কণ্ঠে বলিল “গোলাপ সুন্দরী” এ কথা সত্যই অনুক্ত ছিল, সে কেবল মাত্র তাহার দিকে চাহিয়াছিল । পুনরায় মনিকের কণ্ঠস্বর “গোলাপের মধ্যে আমারই ক্ৰন্দন…যে কান্না আমি বহুকাল ধরে কাঁদছি । তোমাকে আমি…”
ইহার পর—মুহুর্ত্তের জন্য দুজনকে পরাজিত করিবার চেষ্টা করিল, একে অন্যের দেহের সুমধুর আনন্দধারা নিঃশেষ করিয়া শুষিয়া লইতে চাহিল । সহসা অশরীরী বজ্রাঘাতে দুইজনেই বিক্ষিপ্ত হয়। সহসা যেমত পাখী ডাকিয়া উঠিল, লজ্জা আসিল । বিলাসচকিতে উঠয়া শায়িতা বিপুল রমণীকে দেখিয়া যেন শিহরিয়া উঠিল । সত্বর সে কক্ষ ত্যাগ করে। হলে আসিয়া যেখানে সে হাত রাখিল সেখানেই দেশলাই ছিল, বাতি জ্বালিয়া সে মাথায় হাত দিয়া বসিয়াছে। এমত সময় তিনি, মনিক, এই আলোতে আসিয়া এমন প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চাহিলেন যাহার অর্থ “আমি কি অপূৰ্ব্ব সুন্দরী নই, গোলাপ সুন্দরী নই” মনিক পুনরায় তাঁহার হাত ধরিল, বিলাস আপনার কথা স্মরণ করিয়া তাহার দিকে লক্ষ্য করিল, নিরাভরণ দেহের সমস্ত রোমকূপ দিয়া মহা উল্লাস নিঃস্থত হইতেছে।
বিলাস যেন কহিল “বেশ, এখানে দাঁড়ান” বলিয়া সে তাঁহাকে মৰ্ম্মর মূৰ্ত্তির ভঙ্গিমায় দাঁড় করাইয়া ড্রয়ার খুলিয়া মোহিতদার জন্য রক্ষিত সিগারেটের টিন কাটিয়া, সিগারেট ধরাইয়া, অনিমেষ নেত্রে তাঁহাকে যেমন বা অনুসন্ধান করিতে লাগিল । মনিক আপনার পদদ্বয় ঈষৎ বিভক্ত করিয়া তুই হস্তে সমস্ত কেশরাশি ধরিয়া স্থির। সিগারেট ফেলিয়া ঝটিতি বিলাস তড়িৎ বেগে তাঁহার নিকটে গিয়া একটি নিশ্বাস ফেলিল । তাহার স্পর্শে মৰ্ম্মর মূৰ্ত্তিও রক্তমাসের দেহ পরিগ্রহ করিল। মনিক অদ্ভুতভাবে হাসিলেন।

*  * *

“এখন ঘুমান যাক”
“পৃথিবীতে কি ঘুম আছে”
বিলাস এই জাড্যবিজড়িত উক্তিতে বিছানায় উঠিয়া বসিল—বহুদিন পূৰ্ব্বে যে এপিটাপ তাহার— স্কাঁরোর লিখিত-—মুখস্থ ছিল যাহা সে ভুলিয়াছিল তাহা স্মরণে দ্বিপ্রহরের চেতনা হইতে রাত্রের চেতনা পারবারের মধ্যে জাগিয়াছিল—আসিল “পথিক শব্দ করিও না কারণ এই প্রথম রাত্রে স্কাঁরো ঘুমায়” ।
“ওঠো” মনিক কহিলেন ।
‘হল-ঘরে’ বলিয়া শ্লথপদে ক্লান্ত বিলাস তাহাকে অনুসরণ করিল।
দুজনে এখানে আসিয়া স্তম্ভিত ; বিলাস সম্পূর্ণ শান্ত, গতিরহিত—কিন্তু বিলাস অত্যন্ত আধুনিক, একটু পোর্ট ঢালিয়া, সিগারেট ধরাইল, এবং মনিককে নিরীক্ষণ করিতে করিতে সিগারেটটি তাহার হাতে দিয়া কহিল “প্লিস আমার দিকে চাও… মানে তাদের মত করে অর্থাৎ… ”
মনিকের নিকট হইতে যাহা সে আশা করিয়াছিল, অর্থাৎ বেশ্যার মত তাহাকে প্রলুব্ধ করিবে তাহা শতগুণ সে পাইল, মনিক আশ্চর্য্যভাবে সিগারেট ধরিয়া এক মহার্ঘ্য আবেশে আপনাকে পূর্ণ করিলেন, এখন স্তন বহিয়া সিগারেটের নীল ধোঁয়া ছত্রাকার হয়…কেমন একভাবে মনিক—যিনি সুন্দরী সুলক্ষণা—আপনার জঙ্ঘায় জঙ্ঘায় সশব্দ আঘাত করিলেন যে অধুনা ধর্ষিত পৃথিবীর মেরু পর্যন্ত কম্পিত হয়, আর যে তাঁহার সুরম্য ঊরু যুগকে আশ্রয় করিয়া আলো উঠা নামা করে ।
ক্লান্ত বিলাসও অস্থির ।

ঘর

বারুদগন্ধী পথে ঘুরে ঘুরে অনেক প্রহর,
মাড়িয়ে প্রাচীন ঘাসের চাপড়া, পাথর কুড়িয়ে
যূথচারিতায় বানিয়েছিলাম ঈপ্সিত ঘর!

সেই ঘরটার প্রতিটি দেয়ালে উদ্দাম ঝড়
বসিয়েছে নখ; উদাত্ত ভিতে দিয়েছি গুঁড়িয়ে,
দিয়েছি মিশিয়ে আমার রুক্ষ বুকের পাঁজর।

সেই ঘরে রোজ রোদ এসে শোয়, লালিম নিথর।
কখনও জ্যোৎস্না কানামাছি খেলে; লুকিয়ে চুরিয়ে
কখনও-বা আসে স্বাধীন প্রাণীরা, কোমল-ইতর।

প্রতিহিংসায় কে দেয় পুড়িয়ে শ্রীমন্ত খড়?
তবু সত্বর রক্তের তাপ যাবে কি জুড়িয়ে?
দেখবো শুধুই ছেয়ে যাবে ঘরে পোকা ও মাকড়?

স্বপ্ন ছিলো তো থাকবো সেখানে বছর বছর।
কিন্তু কে যেন নিমেষে চক্র দিয়েছে ঘুরিয়ে,
সেই ঘরে আজ পায়ে পায়ে শুধু জড়ায় নিগড়।

চুম্বন

কী করে জীবন পায় পূর্ণতা অথবা রাজহাঁসের মতন
হেঁটে যায় শূন্যে শূন্যে কোন্‌ পুণ্যে, জানেনি সে যুবা।

একটি নতুন স্বপন আরেক স্বপ্নের কানে কানে ক্ষণকাল
রূপালি গুঞ্জান তোলে। ভিন্ন গান যুবার মগজে কী সহজে
করে তৈরি ফোঁটা ফোঁটা আলোর নিবিড় স্তনবোঁটা!
অস্তিত্বের খাঁজে খাঁজে তার বয় মন্দাকিনী কখনও সখনও,
কখনওবা লাভাস্রোত প্রবল ভাসিয়ে নেয় দূরে
প্রথার দেয়াল আর পুরেনো চণ্ডীমণ্ডপ এক।
গন্ধকের ঝাঁজে-ভরা আস্তানায় চায় যুবক
যুগপৎ মুখ্য ঘ্রাণ এসেন্সের আর ক্ষয়লিপ্সু এক চৈতন্য-প্রসাদ!

আলোর নেশায় যুবা চেয়েছিলো, স্বপ্নের মতন ঠোঁটে কারো
চুম্বন আঁকবে গাঢ় ঘন ঘন। ব্যর্থতার ভীষণ কণ্টকাবৃত পথে
ঘুরে ঘুরে দ্যাখে কত উজাড় টিনের কৌটো, বিধ্বস্ত বাগানে
দোমড়ানো মোচড়ানো মোটা বাইক, দ্যাখে ঘড়িতে গোটানো
কত বেলা-অপবেলা, আস্তিন-তলায় খামখেয়াল শতেক।
সিগারেট-জোনাকির খেলা চলে অন্ধকারে, ভাঙা
পাখির বাসার মতো কিছু স্মৃতি থাকে পড়ে ক্লিষ্ট ত্র্যাসট্রেতে।

নানা ঘাটে ঘুরে দ্যাখে ক্লান্ত চোখে ঠোঁট নয়, ঠোটের মতোই
নরম বিষাক্ত পাতা ভয়ানক খাদ্যের কিনারা হয়ে ডাকে।
তাকে সারাক্ষণ; সে-ও দ্যায় সাড়া, আবার সম্বিৎ ফিরে এলে
কত মেয়েমানুষের কাদায় লুটিয়ে চলে যায়,
আঁকে না চুম্বন কারও ঠোঁটে, প্রায়শই পথিকের মুখে দ্রুত
উপদ্রবী অন্ধকার ছড়িয়ে বেড়ায়, যতবার
ইস্পাতি পিস্তল তার উগরায় ধোঁয়া, ততবার সত্তরের
বা খায় চুমো হিংস্র অবুরাগে তপ্ত কালো নলে।
আপন শহুরে পথে সে যুবক হঠাৎ যখন এক কোণে
আহত পশুর মতো পড়লো লুটিয়ে জবুথবু, ভুলে ক্ষিপ্র
কাঁধের ঝাঁকুনি, বড়ো একা হয়ে, মাতৃগন্ধময়
মাটিকে খেলো সে চুমো বারবার, তারপর বেবাক নিথর।
করে না শনাক্ত কেউ রক্তে ভাসে এক কৃষ্ণ তারা ছন্নছাড়া,
কোথায় যে ঘরবাড়ি তার, কি-বা জন্ম পরিচয়।

ছাই

সেদিন প্রবল হাওয়ায় তোমার
স্বপ্নিল তন্তুর মতো চুলে উড়েছিলো সারা আকাশকে ঢেকে,
তোমার পাশে দাঁড়ানো আমি।
আমার বুকের মধ্যে একটি উত্তাল নদী আমি
লুকিয়ে রেখে তোমার দিকে ব্যাকুল দৃষ্টির
থরো থরো জাল ছড়িয়ে দিলাম।
সূর্যাস্তের দিকে মুখ রেখে বললে তুমি, ‘কী চাও আমার কাছে?’
সেদিন প্রবল হাওয়ায় কিছুই
বলতে পারিনি, বুঝি হাওয়া সব ভাষা এভাবেই
চুরি করে নিয়ে যায়।

দীর্ঘকাল পর তুমি আর আমি, সন্ধ্যার হাওয়ায়
উড়ছে তোমার অবাধ্য চুল।
হঠাৎ কিসের ডাক সূর্যাস্তকে আরো গাঢ় করুণ এবং
রহস্যময় করে তোলে আর মেঘের জানালা
খুলে দিয়ে কেউ শরমিন্দা চোখে তাকায় ছাদের
দিকে বারবার, বিলাসী অশ্ব লাফায় অস্তাচলে!
আমার বুকে ঝরা পাতার অজস্রতা, মৃত পশুর
রৌদ্রদগ্ধ হাড় আর কিছু নষ্ট ফল, ভাঙা বেড়া।

অদূরে গলির মোড়ে একজন মাতাল ভীষণ মাতলামি
করতে করতে
নোংরা ড্রেনে, পাশের ঘরে
জমাট তাসের আড্ডা, হো হো হাসি, চুরুটের ঘ্রাণ।
সূর্যাস্তের দিকে মুখ রেখে বললে ‘কী চাও আমার কাছে আজ?
আমার কপালে কাঁচাপাকা চুল
করুণ কোনো স্মৃতির মতো কাঁপছে এলোমেলো
তোমাকে সহজেই বলতে পারতাম,
‘তোমার বিলয়ে আমার মুক্তি।
ঘুমে যেমন পাশ ফিরে শুই তেমনি কোনো
কথা না বলে বারান্দায় খুব
ঘন ঘন ঝেড়েছিলাম সিগারেটের ছাই।

জলের এমনই রীতি

জলের এমনই রীতি, কখনও সে শান্ত অতিশয়
নদীতে, পুকুরে, হ্রদে, কৃশ ফ্লাস্কে অথবা বোতলে।
কখনও সে ঝরনা হয়ে ঝরে, নুড়ি ধোয় ঝিরিঝিরি,
নামি সিঁড়ি বেয়ে, পড়ে বৃষ্টির লীলায় খোলা ছাদে
লাল বারান্দায়, তরুণীর গালে, পিঠাছাওয়া চুলে ।
ট্যাপ থেকে বয় জলধারা, আমরা আঁজলা ভরে
নিই তুলে, অতিবর্ষণের পর চকিতে ভাসলে গলি, কেউ
শিস দিয়ে ঘরে ফেরে, পাতিহাঁস জলকণাগুলি
পালকে গ্রহণ করে আনন্দিত অতিথির মতো,
কখনও-বা কাগজের নৌকা পথে ভাসায় বালক,
নানা নক্‌শা আঁকে ফের চঞ্চল আঙুলে নিরিবিলি।

জলের এমনই রীতি, অথচ হঠাৎ কী-যে হয়!
যেন লক্ষ লক্ষ রাগী মোষ চতুর্ধারে আসে তেড়ে,
আসে আদিগন্ত ব্যেপে, তখন সে প্রবল প্লাবন।
বুঝি-বা ফেলবে মুছে স্বেচ্ছাচারী জগৎ সংসার,
নিমেষে খেলার বেলা হয়ে যায় দারুণ করাল বেলা।

শোকার্ত দাঁড়িয়ে থাকি জলমগ্ন ঘরের উদাম
নম্র চালে, বৃষ্টি বিদ্ধ, রৌদ্র দগ্ধ, নিরুপায় বন্দি
শীর্ণ কৃষকের সঙ্গে সর্বক্ষণ উদ্ধাররহিত।
দিনান্ত বেলায় ভাসি আমি নিঃসঙ্গ জেলের সাথে বিরূপ পাথারে,
ভাসি নৌকার গলুই ধরে, হাত
ক্রমশ অবশ হয়ে আসে; ভাসি তবু শুধু ভাসি,
ধূসর বৃদ্ধের সাথে এক পাতে ছিঁড়ি শুকনো রুটি,
অনাথ শিশুর সাথে কাঁদি শূন্য থালা হাতে ঘুরি
আশ্রয় শিবিরে, হায়, উন্মাদের স্মৃতির মতন
এবং ভেলায় থাকি পড়ে লখিন্দর, একা, বেহুলাবিহীন।
আমার নিষ্প্রভ চোখ ঠুকরে খায় ক্ষুধাতুর কাক
আমার শীতল দীর্ঘশ্বাস বয়ে যায় মেঘনার
চরে চরে পানিডোবা ধানক্ষেতে হাওড়ে হাওড়ে
শহরে রিলিফ ক্যাম্পে, ভীষণ জলজ খাঁ খাঁ গ্রামে।

জেগে থাকে বাংলাদেশে কান্নাময় চোখের মতন।

তুমি একটা বাড়ি খুঁজছো

সেই কবে থেকে তুমি খুঁজছো একটা বাড়ি, যার
সিঁড়ি খুব দীর্ঘ, মিশে গেছে বহু দূর ছায়াপথে।
কত লোক দিয়েছে সন্ধান কতবার সে বাড়ির;
জেনে গেছো সবটাই ধাপ্পা! ‘এই আপনার বাড়ি’
বলে একজন নিয়ে গেছে এক পাগলা গারদে,
কেউ পথপ্রদর্শক সেজে তোমাকে দেখালো বাড়ি-
দেখলে নিজেকে তুমি মাতৃসদনের দরজায়,
যেখানে অসুস্থ জননীর জরায়ুর সীমা ছিঁড়ে
হতেছে উৎপন্ন ততোধিক অসস্থ সন্তান কত।
কেউ-বা অনেক দূরে নিয়ে যায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে,
সোল্লাসে জানায় এক বাড়ির ঠিকানা, চেয়ে দ্যাখো
পাঁচটি কঙ্কাল দিচ্ছে পাহারা ফাটকে নিশিদিন।

আবার একটি রাজহাঁস এসে বলে ‘বাড়ি নেবে?
যে-বাড়ির খুব দীর্ঘ সিঁড়ি মেশে যায় ছায়াপথে,
নেবে সেই বাড়ি?’ জেনে গেছো, রাজহাঁস নিয়ে যাবে
কোথায় তোমাকে কোন্‌ শূন্যতায়! তবু আমি তারই
অনুগামী বারবার। দেখছো হতাশা হেঁটে যায়
আগে আগে, বস্তুত খুঁজছো বাড়ি অভ্যাসবশত।

তোমার কথাই ঠিক

তোমার কথাই ঠিক আব্বা, তোমার কথাই ঠিক-
আমার সকল বেলা বিফলে গিয়েছে নিশিদিন।
দাঁড়িয়ে রয়েছি একা নিরুপায়, অশ্বেতর আর
গাধার ব্যাপক খুরে হচ্ছে পিষ্ট, হায়, ধ্রুবপদ।

যখন বলতে তুমি, ‘কেন যে ফুজুল দিনরাত
কী ব্যগ্র টেবিলে ঝুঁকে সারি সারি অক্ষর সাজিয়ে
থাকিস বিভোর হয়ে? এই আসমানি সওদায়
কী হাসিল করবিরে পাগলা, ভাবিস? পারবি কি
দুনিয়াকে বদলাতে এতটুকু ?’- আমি ভাবতাম
এ বিশ্বের নব্য প্রতিমার কথা, ভাবতাম কত
উজ্জ্বল তোরণ, স্তম্ভ হবে তৈরি নতুন শৈলীর
এবং সে কারুকর্মে আমিও অভীক শিল্পী এক।

আড়াই দশক আমি কবিতার হাত ধরে হেঁটে
জেনেছি রৌদ্রের দিন, সংখ্যাহীন, বৃষ্টি, দীর্ঘপথ।
আব্বা তুমি নেই, আমি আছি, আছে সেই পৃথিবীটা,
যাকে আমি কোনো দিন বদলাতে পারবো না বলে
তুমি হামেশাই স্পষ্ট করতে উল্লেখ উঠোনের
কৃশ চারাগাছটার ঈষৎ কম্পনে চোখ রেখে।

তোমার কথাই ঠিক আব্বা, তোমার কথাই ঠিক-
আমার সকল বেলা বিফলে গিয়েছে নিশিদিন।
পর্দা ওঠে যথারীতি বার বার, কখনও তুমুল
করতালি যায় শোনা, কখনও বা পড়ে পচা ডিম;
আমি শুধু এক কোণে থাকি পড়ে ভূমিকাবিহীন,

ঘোরলাগা ঘণ্টাধ্বনি শুনি। হাহাকার আমার এ
জীবন-যাত্রার মূল গায়েন বস্তুত; বলবো কি
শেষটায় অখুশি আমি, বলা মুশকিল, কিছু হোক
আর না-ই হোক, কথা বলে অজস্র শব্দের সঙ্গে
নিজস্ব আঁধারে আমি অতিশয় বদলে গিয়েছি।

 তোমার সঙ্গে

তোমার সঙ্গে আমি তোমার সঙ্গে আমি আছি কোন্‌ তন্তুবায় একগাছি
সূতো দিয়ে গেঁথেছেন আমাদের তোমার সঙ্গে আমি আছি কখনও
দূরে কাছাকাছি
কখনও-বা তোমার সঙ্গে আছি উদাহরণত জন্মবধি একটি চোখ অন্য
চোখের সঙ্গে যেমত আছে আমার মুখমণ্ডলে তেমনি তোমার সঙ্গে আছি
তোমার সঙ্গে বরাবর ছুরির ফলা থেকে ধার জ্বলন্ত বাল্ব থেকে আলো
একশিশি আতরের থেকে সুবাস কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো থেকে মার্কস
এঙ্গেলস-এর মেধা চিন্তা মিছিল থেকে স্লোগান বাজারের
অমল ফর্দ থেকে তাবৎ
প্রয়োজনীয়তা জীবন্ত হৃৎপিণ্ড থেকে স্পন্দন যেমন অবিচ্ছেদ্য তেমনি
বিচ্ছিন্ন করা যায় না আমাদের তোমার সঙ্গে তোমার সঙ্গে আছি তোমার
সঙ্গে আছি আমার সঙ্গে তুমি টিয়ে যেমন সবুজ রঙের সঙ্গে মাছ চকচকে
রূপালি আঁশের সঙ্গে যখন তুমি গোলাপের বুক থেকে শিশির তুলে নাও
ফোঁটা ফোঁটা তর্জনীতে তখন যেমন সেই জলজ কণা তোমার আঙুল থেকে
আলাদা করা যায় না তেমনি আমরা দু’জন পরস্পর অবিচ্ছিন্ন

অস্ত্র দিয়ে কাটতে পারো পোড়াতে পারো আগুনে
যা তোমাদের ইচ্ছে খেয়াল-খুশি
তবু
আমরা সঙ্গে আছি সঙ্গে থাকবো সর্বদাই কোনারকের সেই
মূর্তির মতো চুম্বন হয়ে সর্বদায় কালপটে অনন্তকাল
আমাদের এভাবে দেখে লোমচর্ম তর্কবাগীশ
নিমিষে হয়ে যায় রুদ্ধবাক মুর্দাফরাশ
হকচকিয়ে কর্মিষ্ঠ কোদাল দ্যায় ছেড়ে
আমি তোমার সঙ্গে তুমি আমার সঙ্গে পরস্পর আছি যৌবনাবধি
আছি থাকবো নাক্ষত্রিক অন্ধকারে জাগর অন্ধকারে
কোনো মেট্রন কোনো প্রিন্সিপাল কোনো সমাজ খুড়ো
কোনো ডিক্টেটর অথবা পিত্রালয়ের
কোনো ষড়যন্ত্র ছাড়াই
আমরা আবার বিধ্বস্ত সেতুর দুই অংশের মতো হয়ে যাই
আ লা দা
আ লা দা
আ লা দা
আ লা দা
সু দূ র আ র

লা
দা
সু দূ র
আ লা দা
বি ষ ম
আ লা দা

 দুঃখ পেতে থাকি

আমি দুঃখ পেলে নক্ষত্রের কিছু এসে যায় না এবং
শালিক চড়ই আর যাবতীয় গাছপালা উদাসীন থাকে।
শহুরে নদীতে পা ডুবিয়ে দেখি তার জলে দুঃখ
ধুয়ে মুছে যায় কি না। অনেক রাত্তিরে ঘরে ফিরি, দুঃখ সঙ্গী
হয়ে বসে থাকে।
ঘরের বেড়ালটার দিকে উৎসুক তাকাই, দেখি তার কটা চোখে
আমার দুঃখের ছায়া পড়ে কি না। আদুরে আওয়াজে নৈঃশব্দকে
দুলিয়ে খানিক
আমার লেখার টেবিলের নিচে নির্বিকার সে ঘুমায় একা
স্বপ্নচ্ছন্ন কবিতার মতো।

ভুলে থাকি বারান্দার অকপট সূর্যাস্তের রঙ,
ভুলে থাকি ওষুধের গন্ধভরা ঘরের দরজা,
ভুলে থাকি পুলিশের বাঁশি আর বন্ধুর ধিক্কার,
ভুলে থাকি সাংস্কৃতিক সভার করুণ কর্মসূচি
ভুলে থাকি মগজের কোষে কবিতার ফিসফাস,
ভুলে থাকি প্রেমিকার আদরিণী বেড়ালের নাম,
ভুলে থাকি ক্যাথলিক চার্চের চূড়ার আর্ত চিল,
ভুলে থাকি নগ্ন পাগলীর হাতে নিষ্প্রাণ মোরগ।

মনে রাখি ফুটপাতে নিঃসঙ্গ বৃষ্টিতে একা ভেজা,
মনে রাখি নৈঃশব্দের সঙ্গে বাতাসের কথা বলা।

হঠাৎ একটি ঘরে ঢুকে দেখি ধোঁয়া আর ত্র্যালকোহলের
ঘ্রাণ ভাসে ঘরময়। ক’জন খেলছে তাস, কেউ কেউ হাতে
গ্লাস নিয়ে আসে কাছে টলতে টলতে, যেন সদ্য
শিখেছে হাঁটতে।
একজন একরাশ ধোঁয়া দ্যায় ছুড়ে আমার বিস্মিত মুখে,
হাসাহাসি চলে কিছুক্ষণ, কেউ কেউ আমার হাতের ত্বকে
সিগ্রেটের ছ্যাঁকা দিতে চায়, চেয়ে থাকি দরজার দিকে, ভাবি-
ক’জন বামন
দেখাচ্ছে কয়েক হাত বেশ।
পারি না বলতে কিছু, যেন ভুলে গেছি মাতৃভাষা। নেরুদার
সেই জলকন্যার মতন
অকস্মাৎ ফিরে আসি স্বকীয় নৈঃসঙ্গে, এলোমেলো পদক্ষেপে
আমার মৃত্যুর দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাই, সকলেই যায়।
মধ্যরাতে অন্ধকারে জেগে উঠে ভয় পাই, দুঃখ পেতে থাকি।

 ধুলায় ধুলায়, ঘাসে ঘাসে

বাজারে বাজারে ঘুরে বলতাম কথা, নানা কথা।
শুনতো অনেকে, অনেকে আবার অমনোযোগী।
‘সংসারে দেবে কি মন, না কি আজীবন শব্দের পায়রা
উড়িয়ে শুধু ঘুরবে পথেঘাটে?’
আমার মনের গুপ্ত পথে রাখেননি পদযুগ
বেয়াড়া গৃহিণী। কী লাভ কেবল তাকে দোষী করে?

সমাজের হর্তাকর্তা কিংবা শিরোমণি, তারাও সত্যের শাঁস
পায়নি খুঁজে আমার কথায়-তাই তো ওরা
আমার হাতে দিয়েছে বিষপাত্র আর
বলেছে আকণ্ঠ তুমি সত্য শুষে নাও!

ছুতোর হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু আমার ভিতরে
অন্যজন দিনরাত্রি নগ্ন পায়ে হাঁটে।
রক্তপিপাসু পাথরে কাঁটায়
বুক পেতে দেয়, বয় ক্রূশকাঠ, সয় পাঁচমিশেলি গঞ্জনা
শহরে ও গ্রামে-গঞ্জে। আমার নিজস্ব বিশ্বাসের
পুরুষ্ট বীজ দারুণ খরায় ক্ষেতে-প্রান্তরে ছড়াতে গিয়ে
হলাম বিরাগভাজন ওদের,
আমাকে করল ক্রুশবিদ্ধ ওরা, আমার রক্তের
স্রোত, দেখলাম, যাচ্ছে বয়ে শতাব্দী শতাব্দী ধরে।
তখনও আমার বাঁচতে পারাটা কঠিন ছিলো না।
আমার ধারণা পাল্টে ফেললেই অথবা চুপচাপ থাকলেই
সহজ হতো বেঁচে-বর্তে থাকা আর প্রমোদে ঢেলে মন
সকল উজ্জ্বল পুঁথি পুড়িয়ে আমিও দীর্ঘজীবী
হতে পারতাম। আমার জ্ঞানের জন্যে আমাকে
ডাইনীর মতো ওরা পুড়িয়ে মেরেছে কী প্রবল ঘৃণায়, আক্রোশে।

মুক্তি শব্দটিকে আমি প্রেমিকের মতো উচ্চারণ
করতাম আর মুক্তি আমার শিরায় শিরায়
বোদলেয়ারের কবিতার মতো উঠতো নেচে মুহূর্তে মুহূর্তে।
কত চোরা পথে বনে জঙ্গলে ছুটেছি আমি
মানুষের মুক্তির জন্যেই।
যখন আম বিশ্ব জুড়ে ফেলেছি মহাছায়া,
তখনই জঙ্গলে আমি নিহত হলাম।
আমার বুকে বুলেট প্রিয় মুক্তি এই শব্দটিকে
লিখে দিলো আরো গাঢ় আরো উজ্জ্বল অক্ষরে।

আমি আর হাতে
নেবো না তুলে বিষপাত্র,
কস্মিনকালেও আর কোনো গলগোথায় যাবো না।
চতুর্দিকে জ্বলুক শত অগ্নিকুণ্ড,
আমি পুড়ে মরবো না।
আমাকে কখনও কেউ আর কোনো কুটিল জঙ্গলে
পারবে না বুলেটের ইস্পাতী বৃষ্টিতে,
ছিন্নভিন্ন করতে।
আমার মুক্তি ধূলায় ধূলায়, ঘাসে ঘাসে।

পরিসংখ্যান

মানুষ যাবে না কেন মানুষের কাছে? দেখা হলে
চায়ের আসরে, পথে, পার্কে কিংবা বিমান বন্দরে
কেন পরস্পর মেলাবে না হাত? মানুষ তো নদী,
গাছপালা, পাখি আর যন্ত্রের নিকট যায় আর
সূর্যাস্তের ছোপলাগা টিলায় দাঁড়ায় মাঝে-মাঝে।
তা’হলে মানুষ কেন ফিরিয়ে রাখবে মুখ শুধু
মানুষের থেকে? কিছু মানবিক ঘ্রাণের জন্যেই
পরস্পর করে মেলামেশা সব বিচ্ছিন্ন মানুষ।

প্রত্যহ ক’জন মানুষের কাছে প্রকৃত পৌঁছুতে
পারি, বলা মুশকিল। তিনজন চোরাকারবারি
সুস্নিগ্ধ ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে হাত কী নিপুণ
বাড়ায় আমার দিকে, চারজন কালোবাজারির
আংটির চমক চোখে দ্যায় জ্বেলে অলীক দেয়ালি,
আমার টেবিলে আনে তড়িঘড়ি চা করে এক খুনি।

প্রতিদ্বন্দ্বী

কী একটা জেগে ওঠে অন্তর্গত গুহায় এবং
বেখেয়াল সবাইকে দিব্যি দারুণ চ্যালেঞ্জ দিয়ে
বসে আছি। গাছ, নদী ফুল, পাখি এবং পাহাড়
সবাইকে হারিয়ে দেয়ার পণ করেছি বস্তুত।

গাছের উদ্দেশে বলি,-কেন তুমি এমন উদ্ধত?
আমিও আমার বুকে রাখি পাতাদের ঝিলিমিলি,
অনেকেরে দিই ছায়া ভালোবেসে, এমন কি ক্রুর,
প্রতিহিংসাপরায়ণ শক্রকেই কখনও সখনও।

নদীর সম্মুখে করি উচ্চারণ নদীর মতোই
কণ্ঠস্বরে- আমিও তো যাচ্ছি বয়ে, আমারও হৃদয়
সরাক্ষণ যায় ভেসে জলে, কখনও প্রশান্ত আমি,
কখনও-বা ফুঁসে উঠে, আমিও সহিষ্ণু অতিশয়।
তাকিয়ে ফুলের দিকে উঠি মেতে স্বগত ভাষণে
কেন তুমি গর্বে ওঠো দুলে ক্ষণে ক্ষণে? দ্যাখো
আমার ভেতর কত গোলাপ, করবী, গন্ধরাজ
ছন্দিত, সতেজ; ওরা ঝরে পড়বে না অবেলায়।

পাখিকে শুনিয়ে বলি,-কেন তুমি গর্বে থরো থরো?
আমার কি নেই গান, ভাবো? আমার সত্তার
অত্যন্ত গভীর থেকে জাগে সুর, প্রাণপ্লাবী সুর।
প্রত্যহ আহত আমি নিজে, তবুও বানাই গান।

অনেক উঁচুতে গিয়ে পাহাড়কে করি শ্রোতা, বলি-
এই দ্যাখো, আমাকেও দ্যাখো তুমি, আমি মাথা নত
করি না কারুর সম্মুখেই। চক্রান্ত কি হামলার
অন্ত নেই, তবু সংশয়ের বাঁকে রয়েছি অটল।

একজন যাকে আমি কখনও দেখিনি, কিন্তু যার
সঙ্গে হতে পারে দেখা যেকোনো মুহূর্তে, সেই
পুশিদা মানুষটিকে মনে মনে বলিনি কিছুই।
তার কাছে, শুধু তার কাছে আমি হেরে যেতে পারি।

ফিরে আয় উত্তরাধিকারী

অমন তাকাতে নেই, তোর এই দৃষ্টির সম্মুখে প্রতিবার
অসহায়, বড়ো অসহায় মনে হয়। কেন প্রহরে প্রহরে
আমাকেই লক্ষ্য করে ছুড়ে দিস একরাশ ভীষণ হিংস্রতা
আদিম ব্যাধের মতো? খোকা তুই বাড়াসনে অতিশয় নোংরা
তীক্ষ্ণ নখ বারবার আমার গলার দিকে, চোখে লাল ছিটে
দিসনে লাগতে ওরে। ঘাতকেরই এমন ধরন, এ ঘাতক দ্রুত
কর্কশ রয়ঙ্ক হচ্ছে তোর অভ্যন্তরে, সরে দাঁড়া, এ বিশদ
ছায়া থেকে ওরে সরে দাঁড়া তুই, চলে যা আড়ালে।

শত বর্ষা, মনে হয়, পারবে না ধুয়ে নিতে অমন হিংস্রতা,
এমন কি তোর জননীও হস্তাবলেপে কি চুম্বনে চুম্বনে
মুখের কঠিন রেখাবলী তোর পারবে না করতে কোমল
কিছুতেই। ফিরে আয়, আমার মিনতি শোন, ওরে ফিরে আয়
পৈশাচী বলয় থেকে পিতৃবক্ষে, মাতৃক্রোড়ে, পড়ার টেবিলে।

প্রত্যহ কিছু না কিছু ভাঙছিস তুই, গ্লাস, প্লেট, চায়ের পেয়ালা,
আলমারির কাচ খুঁটিনাটি কত কিছু, মাঝে-মাঝে
মনে হয়, বুঝি তুই সূর্যোদয় সুর্যাস্তকে ফেলবি গুঁড়িয়ে
কী বিরোধভাসে মজে। হায়, তোর সমান বয়সী
আমার গোপন স্বপ্নটিকে করছিস খান খান। এ কেমন
ভাঙার খেলায় তুই মেতেছিস হে উদাস, হে ক্রুদ্ধ কিশোর?

যখন চিৎকার করে তোর এই আধোয়া শরীর, জীর্ণ ঘর
আমাদের নিমেষেই ভয়ার্ত হরিণ হয়ে যায়, উপদ্রুত,
উল্মুক কৈশোর তোর একা ভাসমান লাভা স্রোতে। আমি চোখ
কেবলি ফিরিয়ে নিই; কোত্থেকে পেলিরে তুই এমন চিৎকার?

একটি খঞ্জর হয়ে, একটি কৃপাণ হয়ে, বর্শা হয়ে আর
ভয়ংকর শর হয়ে কাঁপছিস তুই। ভাবি, যদি তোকে ঐ
গোলাপের অভ্যন্তরে, হরিণীর পেটের ভিতর কিংবা সুস্থ
দূরগামী মেঘে ঘুম পাড়িয়ে রাখার মন্ত্র জানতাম,
যদি তোকে বাস্তবিক আমার চোখের মণি, আমার হৃৎপিণ্ড
বানিয়ে ফেলতে পারতাম। আমার সকল বেলা কালবেলা হয়ে যায়।
তুই কি পিতৃঘ্ন হবি শেষে? তোর মুখের ভূভাগ থেকে ক্রুর
ছায়া সরে গেলে শূন্যতা ছড়িয়ে থাকে, চোখ থেকে
দজ্জাল লালিমা মুছে গেলে, বুকের ভিতর আমি পুনরায়
কী মধুর প্রত্যাবর্তনের ধ্বনি শুনি, ফিরে আসে ঝাঁক ঝাঁক শাদা হাঁস,
বিরূপ বাগানে জ্বলে ফুলের উল্লাস, সুকোমল শুশ্রূষায়
সতেজ পালক পায়, পায় স্নিগ্ধ রঙ আমার আহত গুপ্ত পাখি।

এত্ত তো ক্ষণিক দৃশ্য। পর মুহূর্তেই তোর দৃষ্টি জ্বলন্ত তীর দেখে
তোর অন্তর্গত ঘাতকের প্রবল দুর্বার জাগরণ দেখে
কেমন বিহ্বল হয়ে যাই। তপ্ত কুয়াশার ঘোরে মনে পড়ে-
একদা আমিও ক্রুর তাকাতাম আমার পিতার
দিকে কখনও সখনও।
হত্যা উঠতো কি নেচে মগজে আমার? বহু দূরে
হয়তো আমার পিতা অবচেতনার ঘনারণ্যে অস্ত্র হাতে
হঠাৎ দিতেন ঝাঁপ তাঁর স্নেহময় জন্মদাতার ওপর।
তাহলে তোর কী অপরাধ? কেন তোকে মিছেমিছি সর্বক্ষণ
ভীষণ অসুস্থ ভাবি? তুই তো বিপজ্জনক এক উত্তরাধিকারী শুধু।

বন্ধুকে বললাম

বন্ধুকে বললাম, তুমি, আমি, তোমরা, ওরা
অথবা সে, বাস্তবিক এসব শব্দের মানে নেই।
তোমাকে যে-নামে ডাকি সে কি তোমার আসল নাম?
ভুলে যাই, বড়ো বেশি ভুলে যাই তোমার কি নাম,
এমন কি কী-যে এই আমার নিজের নাম, কখনও-সখনও
তা-ও ভুলে যাই, দ্যাখো কী অদ্ভুত জগতে আমরা
এত্যহ নিশ্বাস নিচ্ছি সারাক্ষণ। জংধরা তার
আর কেরোসিন কাঠে তৈরি ওরা, মানুষ বটেই,
হাঁটে ফুটপাতে, বসে চায়ের টেবিলে, তাস খেলে,
প্রত্যহ স্যুইচ টেপে এটা-সেটা, মেশিন চালায়
এবং কাগজে লেখে, ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকে ফের
গণক-যন্ত্রের দিকে। দেখছো না দেবতার স্বর্গীয় শরীরও
পুরনো সংবাদপত্রে কেমন বানানো, যেন এক ফুঁয়ে উড়ে
যাবে দূরে, বহু দূরে অলিম্পিক খেলায় কোথাও!
দেখছো না
রাস্তায় রাস্তায় পার্কে, মাঠে-কলোনিতে
দপ্তরে দপ্তরে
আর কারখানায় উন্মাদেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এখন?
হরিণ, সতেজ ঘোড়া, খরগোশ, একরত্তি চড়াই, সবাই
চকিতে ফিরিয়ে নেয় চোখ, এমন কি গাছপালা
বেজায় বিমুখ।
ক্ষুধার্ত অসুস্থ
শিশুর কান্নার মতো কোথাও গিটার বেজে চলে একটানা।

মুখহীন মুখ দেখে পথ চলি, ডানে বাঁয়ে মুখহীন মুখ।
চতুর্দিকে বোতলের জাগছে পাহাড় শাদা, নীল-
সবুজ বোতল,
হলুদ বোতল,
বেগুনি বোতল,
বাদামি বোতল,
কাছে দূরে রাত্রিদিন কোকিলও ডাকছে কোকা-কোলা,
কোকা-কোলা!

বসতে পারো

এখন আমার কার কাছে কী চাওয়ার আছে
ভুলেই থাকি বস্তুত।
অনেক বেলা আমার গায়ে রৌদ্রছায়া গাঢ় বনে,
অনেক বেলা আমার সঙ্গে কানামাছি খেলতে খেলতে
অস্ত গেলো দিগন্তে।
নানা মাপের জামা কাপড় রইলো পড়ে,
রইলো পড়ে চতুর্দিকে ভাঙাচোরা কত্ত কিছু,
কিন্তু তবু কারও কাছে কোনোদিনই
হাত বাড়িয়ে চক্ষু মুদে চাইনি কিছুই
ভোরে কিংবা দিনান্তে।
এই জগতে প্রথামতো স্বপ্নে কিংবা জাগরণে
অনেক কিছুই চাওয়ার ছিলো,
চাইনি কিছু কক্ষণো।
বরং আমি মনের একা গুপ্ত পথে
অনেক কিছুই দিই বিলিয়ে-
এই যে এমন শূন্য দুপুর, পাবদা মাছের রঙের মতো
শেষ বিকেলের চিহ্ন এবং
নিবিড় রাত্রি, কারো সঙ্গে মেলামেশা, গাঙচিলেরই
ডানার মতো কোমল চিঠি-সকল কিছুই ভিন্নরূপে
দিই ফিরিয়ে অন্তত।

মরুভূমির বালিয়াড়ির নিঝুম বুকে
টকটকে ডাকবাক্সে হঠাৎ দিই বসিয়ে।
চোখের আগে শ্বেত করোটি ওঠলে ভেসে
হইতো বটে শংকিত।
আবার কখন দোদুল্যামান কাকতাড় য়া
শরমিলা এক নারীর কথা শোনায় যেন ফিসফিসিয়ে।
চিলের ডানায় থেকে থেকে বিচ্ছেদেরই ভাষা কাঁপে;
চিলের কাছে, দুপুর বেলার ছাদের কাছে
গোরস্তানের শিরশিরে সব ঘাসের কাছে
কথা রাখি গচ্ছিত।

গভীর কোনো দুঃখ পেলে, পাতায় পাতায়
ঝরনাতলার নুড়ির বুকে, কাতরা কাতরা পানি এবং
মৃতের নেভা চোখের ভিতর প্রবেশ করার
যাই তো পেয়ে সম্মতি!

স্বপ্ন দিয়ে দুঃখ মুছি কেমন আমি ছন্নছাড়া,
দুঃখ তবু বুকের ভিতর
একলা একলা বেড়ে ওঠে; হৃদয় জুড়ে
ফুঁসতে থাকে অতৃপ্তি।

নিজের কাছে নিজেই দোষী হই যখনি,
খুব ভিতরের শরমিন্দা সেই ব্যক্তিটাকে
কাঁদাই আমি বারে বারে। মিথ্যে কতো প্রতিমাকে
সময় আমার বিলি করি, গুলিয়ে ফেলি
সত্য এবং অসত্যে।

আমার মনের নিচের কোঠায় যেজন থাকে খুব একাকী,
স্বয়ং ভুখা-ফাকা থেকে খাদ্য বিলায় অন্যজনে,
যেজন খাদের কিনার ঘেঁষে হাঁটছে শুধু
সেই তো আমার প্রতিযোগী,
রুক্ষবেশী সন্ন্যসী।
কিন্তু তুমি নির্ভাবনায় হাত ধরে তার বসতে পারো,
বসতে পারো পাহাড় চূড়ায়,
খাদের ধারে খোলমেলা, চোরাবালির অনেক কাছে
বসতে পারো একান্তে।

বাগানের একজনকে

ভিতরে এসো না,
বাইরেই থাকো তুমি।
বিষম নাছোড়
তোমার জন্মভূমি।

হাত বাড়ালেই
তোমাকে আনতে পারি,
তবু নিই মেনে
এ দারুণ ছাড়াছাড়ি।

রোদ্দুরে আছো,
গা ধোও জ্যোৎস্নাজলে।
সেই নগ্নতা
চোখে তুলি কোনো ছলে।

যদি আনি টেনে
বাসরে সগৌরবে,
‘এ যে পরকীয়া’
বলবে সবাই তবে।

বাসিন্দা

একটা মোটেই বাড়ি কিন্তু বাসিন্দা তো অনেকজনা,
একজনা সে গ্রাম্য বটে, অন্যজনা খুব শহুরে।
একই তাদের দেহের গড়ন এবং একই চলার ধরন,
এক আসরে সবাই বসে, গল্পগুজব মেলে ডানা।

একজনা সে শূন্যতাকে প্রতিযোগী ঠাউরে নিয়ে
কী-যে একটা নেশায় ঘোরে মেতে ওঠে কথা বলায়,
মনের নিচে মন লুকিয়ে নীবর থাকে অন্যজনা।
কেউ আমুদে, সঙ্গীপ্রিয় কেউবা ভীষণ লাজুক একা।

কারও কথায় জুঁইয়ের মতো রুচি ঝরে সকল সময়,
কারও মুখে অষ্টপ্রহর পাঁচমিশালি খিস্তি ছোটে।
কেউ হামেশা সত্য কথা বলছে যেন জেদের বশে,
মজার লোভে যখন তখন কেউ খামোকা মিথ্যে রটায়।
একজনা সে পাখির মেলায় বেড়ায় ঘুরে, আদর করে
ঈষদুষ্ণ পালকে হাত দেয় বুলিয়ে, পাখিগুলো
অবিশ্বাসে হঠাৎ উড়ে কক্‌খনো তো যায় না দূরে।
অন্যজনা দীর্ঘ বিলে বনবাদাড়ে ঘোর শিকারি।

কেউ প্রফুল্ল রোদের মতো সুস্থ সতেজ, কেউবা ভোগে
দারুণ গাঢ় কালো রঙের জটিল কোনো অসুস্থতায়।
নিজের মনের বন্দিশালায় কেউ পোষে এক গুপ্তঘাতক,
কেউবা যেন খেলার ঝোঁকে যুপকাঠে তার বাড়ায় মাথা।
কেউ আকাশে মেঘে মেঘে নিত্য করে ঘোড়সওয়ারি,
কেউবা ঝরায় স্বেদ কণিকা ফুটপাতেরই রুক্ষ ধূলায়।
নিজস্ব তার শস্য নিয়ে গানের স্রোতে কেউ ভেসে যায়,
কেউবা বলে আকাল আমায় নাকাল করে বারেবারে।

একটা মোটেই বাড়ি কিন্তু বাসিন্দা তো অনেকজনা।
এই বাড়িটার বাসিন্দারা একই সঙ্গে বাইরে বেরোয়া,
একই সঙ্গে ফিরে আসে, ঘুমিয়ে পড়ে এক বিছানায়।
কতটুকু সত্য কে যে বলা হায়রে সহজ তো নয়।

বিদ্রাহী বলে শনাক্ত করে

এখন বাংলাদেশে কত বাড়ির কত হাঁড়িতে ভাত ফুটছে না,
এখন বাংলাদেশের কত উনুন হাঁ-করা কবরের মতো
শূন্যতাকে লালন করছে,
এখন বাংলাদেশে কত শীর্ণ হাত রুটি থেকে কতটা দূরে,
আমি জানি না,
আমি জানি না।
এই সুউচ্চ ভবনে কেউ খুন হয়েছে বলে আমি শুনিনি,
তবুও এর প্রতিটি সিঁড়ি খুব পুরনো রক্তের দাগ
বুকে নিয়ে নিশ্চুপ। ইতিহাসের চুলে বিলি কাটছে
বয়স্ক অন্ধকার।
আমি সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে বেয়ে এই দুর্গপ্রতিম ভবনের
শীর্ষ কোঠায় পৌছে দেখি, একটা কঙ্কাল দুলছে
কাকতাড়ুয়ার মতো আর কীটদষ্ট মখমলের
আলখাল্লার ওপর
চামচিকা নড়ছে, যেন কোনো হেঁপো রোগীর ফুসফুস!

আমি সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে বেয়ে আবার নেমে এলাম
খোলা পথে,
বুক ভরে নিলাম সতেজ বাতাস।
কতবার এমন ওঠানামা করবো, কতবার? কই, স্থবিরতার
চুক্তিপত্রে আমি তো সই করিনি, আমি
কোকিলের গানের মতো চির নতুন আর সজীব থাকতে চাই।

আমার মগজের ডাকবাক্সে জমা হচ্ছে অজস্র চিঠি,
বিলি করতে ভুলে যাই।
মুখমণ্ডলে একটা শ্মশান নিয়ে ঘুরে বেড়াই
সারাদিনমান;
দেখি সানগ্লাসের স্নিগ্ধতা শুষে নেয় এক জোড়া চোখ,
বুঝি অমনই ধকধকে হয় অনাহারী দৃষ্টি।
কিছু দৃশ্যের স্মৃতি ছাড়া আমার কোনো সঞ্চয় নেই,
প্রবল জুয়ায় খুইয়ে ফেলেছি কত রাত্রিদিন।
গোলাপ তুলতে গিয়ে প্রতিবার আমি দুঃখ তুলে আনি।
কবিতার পতাকা ছাড়া অন্য কোনো নিশান
উত্তোলিত হয়নি আমার হাতে,
কোনো প্রতিপক্ষের ভূভাগ
করিনি তছতছ, তবু আমাকে বিদ্রোহী বলে শনাক্ত করে ওরা
আমাকে কেউ জেরা করছে না, তবু আমি নিজেকে দেখছি
কাঠগড়ায়।
কী যেন বলছি বিড় সর্বক্ষণ, ভাষা নিজের
কাছেই ব্রাহ্মীলিপি।
আমার পেছনে কেউ নেই, মানে কোনো ফেউ-টেউ,
অথচ আমি চমকে উঠছি বারবার-মনে হয়,
কে যেন আমাকে অনুসরণ করছে অষ্টপ্রহর, নিজেকে
ভীষণ প্রেতায়িত লাগে।
আমার ডানে-বামে কোনো সশস্ত্র প্রহরী নেই,
আমার হাতে নেই হাতকড়া, অথচ আমি নিজেকে দেখছি
বন্দি অন্ধকার সেলে একা, কথা বলছি দেয়ালে সাঁটা
লোকটার সঙ্গে, চুপ মেরে যাচ্ছি কখনও-বা।
আমার বুক বিদ্ধ হয়নি বুলেটে, কেউ আমূল ছোরা
বসিয়ে দেয়নি পাঁজরে, তবু আমার বুক থেকে
ফিনকি দিয়ে
রক্ত ঝরছে আমার পূর্বপুরুষের
ক্রোধাগ্নিত মতো নির্জন রক্ত ঝরছে অবিরত।

বিবাদ

তুমি সরে যাচ্ছো শেষ দেয়ালের দিকে। চেয়ে দ্যাখো
আর কোনো জায়গা নেই সরে দাঁড়াবার, দ্বিধাহীন
দাঁড়াও আয়নার সামনে- এ ন্যাংটো সত্যকে করো ফেস্‌।
স্থির হও, খোলো চোখ; এখানে কোথায় আমি বলে
চেঁচিয়ে উঠো না বারবার, আমার অগাধ তৃষ্ণা আর
আমার নিরালা স্বপ্ন কারুকেই দেখছি না বলে
আয়নাকে করো না দোষী, তার সঙ্গে করো না বিবাদ।
এভাবে মানুষ ক্রমে হয়ে যায় নিজেরই অচেনা।
একি তুমি ভেঙে ফেললে বিশ্বস্ত দর্পণ! ঘরময়
দিয়েছো ছিটিয়ে পারদের মতো কবির বিষাদ।
এ বিষাদ পারবে না টাঙাতে কোথাও কোনোদিন,
কোথায় এমন যন্ত্র যার সুরে এ বিষাদ ঠিক
দেবে ধরা? চিরদিন তোমাকেই বয়ে যেতে হবে।
দর্পণের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করার মানে নেই।

ব্যথিত পুরুষ

বড়ো দুঃখে থাকি আমি বড়ো দুঃখে রাত্রিদিন; বিষাদ আমাকে
মুখস্থ করায় বিষণ্নতা বেলা-অবেলায়, সারাক্ষণ পাঠে
কবরের ঘাস নড়ে, কাঁপে গুহার আঁধার, কখনও-বা
সমুদ্রের তল জেগে ওঠে কিংবা দীর্ঘ পথরেখা, জনহীন।
মুহূর্তে মুহূর্তে মরে বুনোহাঁস মগজে আমার, শক্ত হয়;
বড়ো দুঃখে থাকি আমি বড়ো দুঃখে রাত্রিদিন, ভীষণ একাকী।

একজন শীর্ণকায় ব্যথিত পুরুষ তার বুকের ভেতর থেকে পচা
মাখনের মতো জ্যোৎস্না বের করে সাবলীল আমার টেবিলে
সহসা রাখেন জমা। এই উপহার কী কাজে লাগবে ভেবে
আমি তো অন্যমনস্কার ঊর্ণাজালে রইলাম ঝুলে শুধু।
এই উপহারে দুর্বলতা ছিলো, ভালোবাসা ছিলো হয়তোবা,
অথচ হেলায় আমি ফিরিয়ে দিয়েছি তাকে, অকম্পিত তিনি
ব্যর্থ কবিতার মতো মুখ নিচু করে একটি রুমাল ফেলে
কোথায় গেলেন চলে। আমি সেই রুমালের প্রতি কী প্রবল
আকর্ষণ বোধ করি। কেন করি? বুঝি-বা প্রকৃত বস্তু ছেড়ে
শুধু তার চিহ্নের জন্যই বড় বেশি কাতরতা আমাদের।

মনে হয়, নিজেকেই জব্দ করে দিয়েছি ফিরিয়ে উদাসীন,
আমার ভেতরে দেখি অভিমানে পা ঝুলিয়ে রয়েছেন একা
ব্যথিত পুরুষ আর প্রত্যঙ্গসমূহ তার ভেঙে ভেঙে পড়ছে কেবলি।
বড়ো দুঃখে থাকি আমি বড়ো দুঃখে রাত্রিদিন। দুঃখবোধ প্রায়ই
রাখে উপবাসে, পিপাসায় ছুঁই না শীতল জল; তবে কি আমিও
কমলালেবুর মতো শুকিয়ে মরে যাবো অগোচরে?

জরায়ুর অভ্যন্তরে পুরুষের বীজরাশি গ্রহণ করেও
যে-নারী অত্যন্ত বন্ধ্যা, তারই অনুরূপ থাকি আমি
অপেক্ষায় সর্বক্ষণ। কিসের অপেক্ষা তা-ও বুঝি না কখনও।
অস্থিরতা অস্তিত্বের সূত্র টানে, মৃত হাঁসের ওপর থেকে
ছায়া সরে এসে যেন আমাকে জড়াতে চায়, জড়ায় খানিক।
আমার বুকের পাশে ঘুমিয়ে থাকেন গাঢ় ব্যথিত পুরুষ,
চতুর্দিকে আস্তে-সুস্থে বাড়ে উদ্ভিদ, কোমল প্রাণী
কতিপয়; আকালেও তার কানে সুর ঢালে অবাধ্য কোকিল!

ভালো থেকো

ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।

ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।

ভয়

সেদিন খুব ভোরে হঠাৎ জেগে দেখি-
বইছে অবিরাম বাইরে তেজি ঝড়।
সংখ্যাহীন প্রেত মেতেছে কান্নায়,
বুঝি-বা যাবে উড়ে আমার কৃশ ঘর।

হুনের মতো হাওয়া বেজায় কর্কশ।
আহত সৈনিক গাছের কত শাখা
মৃত্তিকায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে;
এখন সমীচীন কেবল চুপ থাকা।

আমার নড়বড়ে বন্ধ জানালায়
কে যেন খুব জোরে হঠাৎ দিলো টোকা।
একাকী সত্তায় জাগলো বিস্ময়-
সত্য এলো কেউ? নাকি মনেরই ধোঁকা?

অনেক কাছে শুনি শব্দ কা কা,
তবে কি জানালায় একটি ভীত কাক
ভীষণ ঠোকে তার চঞ্চু বারবার?
বন্য ঝড়ে ডোবে আর্ত কালো ডাক।

এখন ঝড়ে-পড়া নগ্ন কাক একা
দিগ্ধিদিক খোঁজে একটু আশ্রয়।
দরজা দিই খুলে, বাইরে রাখি চোখ;
আসে না তবু ঘরে। আমাকে পায় ভয়?

মৃত্যুর বাড়িতে

মৃত্যুর বাড়িতে ছিলো লোকজন, ছিলে তুমি-
ফিসফাস, আয়াতের সুর লোবানের ঘ্রাণময়
ধোঁয়ার মতন উড়ছিলো খুব পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে,
চাটাই অপেক্ষমান বারান্দায়, নিশ্চুপ বরফ।

দেখি, দরজায় তুমি। তোমার হৃদয় শোকভূমি,
যেন জনহীন দ্বীপ, থেকে গেছে এখানে সময়,
হঠাৎ পাশের ঘরে শিশু ওঠে বিষম চেঁচিয়ে,
দেয়ালে দেয়ালে মৃত্যু লেখে কত অদ্ভত হরফ।

মৃত্যুর বাড়িতে মৃত্যু শুয়েছিলো খাটে কি একাকী।
তোমার চুড়ির শব্দ বাজে, তার খুলি ফুঁড়ে জাগে
রজনীগন্ধার গুচ্ছ, তোমার দৃষ্টির ঝরনা তার
নিঃস্পন্দ শরীরে আনে চাঞ্চল্য বিস্মৃত নগরীর।

মৃত্যুর বাড়িতে আমি তোমার দিকেই চেয়ে থাকি,
শোকের আড়ালে মন কী রহস্যময় অনুরাগে।
প্রেমিকের প্রেতাত্মার মতো একা ঘোরে বারবার
তোমাকেই ঘিরে, গায় গান, মৃত্যু পাথর-বধির।

যখন আবহাওয়া খারাপ

হাওয়ায় সে নয় আর, এখন তো বিশ্বাসঘাতক ক্ষুরধার
হাওয়া সারাক্ষণ শাঁ শাঁ বয়। তার ওড়ার দুর্বার
ইচ্ছা চোখ বুজে থাকে নিষ্ক্রিয় ডানায়; বৃষ্টি শলাকা,
ঝাঁক ঝাঁক, করেছে এমন কোণঠাসা তাকে, এখানেই ঢাকা
বস্তুত থাকতে হবে ডালে,
জবজবে পাতার আড়ালে।
নিজস্ব আকাশ মুছে যাবে? ধুন্ধুমার যুদ্ধক্ষেত্রের মতন
থাকবে সর্বদা পরিবেশ? বাসনার রঙধনু যতক্ষণ
আবার না জ্বলে ওঠে সে আর সে নয়। পারলে হাওয়ার ঝাঁটি
নিমেষেই কাটতো সেই ইস্পাতের মতো নখে কুটি কুটি।
কী ভীষণ বোকা আর উদ্যমরহিত তাকে লাগছে এখন,
যেন সে একটি চোখ, ভেজা, ড্যাবড্যাবে। প্রেতায়িত ঘন বন
ব্যাপ্ত শহরের রুক্ষ বুকে; ভাবে, যে-পানি তৃষ্ণিত প্রাণে আনে
সুস্নিগ্ধ উচ্ছাস, তারই এত হুল? দুঃখ দিতে জানে
জলধারা; অন্ধকার আসে ব্যেপে, বৃষ্টি অবিরল,
সে কি হলো দৃষ্টিহারা? দেখবে না কখনও কিছুই আর? একা, হীনবল
এখানে থাকবে পড়ে সর্বক্ষণ পরিণামহীন? আধঘন্টা হবে-
এরই মধ্যে ভুলে গেলে ওড়া? কে ছড়ালো কালি ডানার গৌরবে?

নাস্তির ডমরু শুনে এখনই এ দ্বিপ্রহরে পঙ্গু হলে ডানা,
অস্তাচলে যাবে স্বপ্ন, নীলিমার অনেক সীমানা,
কে জানে কী শোভাময়তায়, রইবে আগোচরে, স্পর্শাতীত। অন্ত
নেই অতৃপ্তির, অন্ধ গুহাতেও পুশিদা রোদ্দুর চায় সন্ত!

মনের ভেতর তার আর্তি আর ভীতির উদ্যান-
সঙ্কুচিত অস্তিত্বে অকাল শীত দিয়েছে কামড়, খুব ধ্যান
করেও দ্যাখে না কোনোখানে ফসলের কোনো শীষ,
কখনও আসে না ভেসে এ তল্লাটে উর্মিল মধুর বুনো শিস্‌;
তা’হলে পাখিরা মৃত সব? এখন তো ফুল শুধু
পাথরের বোন, যতদূর দৃষ্টি যায় শূন্যতায় কাঁপে, ধু ধু;
দিগন্তে দিগন্তে দ্রুত ছেয়ে যায় ছত্রাকের দল; এলো এ কেমন কাল?
চতুষ্পার্শ্বে লভ্য নয় কোনো কিছু, এমনকি স্মৃতিরও আকাল।
চকিতে আবার বয় হাওয়া ভিন্নতর, বিকশিত স্মিত রোদ
মাটিতে আকাশে ডালে ডালে, সে নির্ভার ওড়ে, কী স্বচ্ছন্দ বোধ
এখন সত্তায় তার, কী প্রত্যাবর্তন! পারবে যথেচ্ছ যেতে
এখন সে সহজেই, কুড়াবে সপ্রাণ শস্য নীলিমার ক্ষেতে।

যদি তুমি ফিরে না আসো

তুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না।
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে
তুমি
আছো এই সংসারে, হাঁটছো বারান্দায়, মুখ দেখছো
আয়নায়, আঙুলে জড়াচ্ছো চুল, দেখছো
তোমার
সিথিঁ দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তহীন উদ্যানের পথ, দেখছো
তোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রূপালি শহর,
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে
তুমি অস্তিত্বের ভূভাগে ফোটাচ্ছো ফুল,
আমি ভাবতেই পারি না।
যখনই ভাবি, হঠাৎ কোনো একদিন তুমি
আমাকে ভুলে যেতে পারো,
যেমন ভুলে গেছো অনেকদিন আগে পড়া
কোনো উপন্যাস, তখন ভয়
কালো কামিজ পরে হাজির হয় আমার সামনে,
পায়চারি করে ঘন ঘন মগজের মেঝেতে,
তখন
একটা বুনো ঘোড়া খুরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে
আর আমার আর্তনাদ ঘুরপাক খেতে খেতে
অবসন্ন হয়ে নিশ্চুপ এক সময়, যেমন
ভ্রষ্ট পথিকের চিৎকার হারিয়ে যায় বিশাল মরুভূমিতে।
বিদায় বেলার সাঁঝটাঝ আমি মানি না,
আমি চাই ফিরে এসো তুমি স্মৃতির প্রান্তর
পেরিয়ে
শাড়ির ঢেউ তুলে, সব অশ্লীল চিৎকার, সব বর্বর
বচসা স্তব্ধ করে দিয়ে ফিরে এসো তুমি,
ফিরে এসো স্বপ্নের মতো চিলেকোঠায়,
মিশে যাও আমার হৃৎস্পন্দনে।
কোথায় আমাদের সেই অনুচ্চারিত অঙ্গীকার?
কোথায় সেই অঙ্গীকার
যা রচিত হয়েছিলো চোখের বিদ্যুতের বর্ণমালায়?
আমরা কি সেই অঙ্গীকারে দিইনি ত্রঁটে
আমাদের চুম্বনের সীলমোহর?
আমি ভাবতেই পারি না সেই পবিত্র দলিল ধুলোয় লুটিয়ে
দুপায় মাড়িয়ে, পেছনে একটা চোরাবালি রেখে
তুমি চলে যাবে স্তব্ধতার গলায় দীর্ঘশ্বাস পুরে।
আমার চোখ মধ্যদিনের পাখির মতো ডেকে বলছে-তুমি এসো,
আমার হাত কাতর ভায়োলিন হয়ে ডাকছে- তুমি এসো,
আমার ঠোঁট তৃষ্ণার্ত তটরেখার মতো ডাকছে-তুমি এসো।

যদি তুমি ফিরে না আসো
গীতবিতানের শব্দমালা মরুচারী পাখির মতো
কর্কশ পাখসাটে মিলিয়ে যাবে শূন্যে,
আর্ট গ্যালারির প্রতিটি চিত্রের জায়গায় জুড়ে থাকবে
হা-হা শূন্যতা,
ভাস্করের প্রতিটি মূর্তি পুনরায় হয়ে যাবে কেবলি পাথর,
সবগুলো সেতার, সরোদ, গিটার, বেহালা
শুধু স্তূপ স্তূপ কাষ্ঠখণ্ড হয়ে পড়ে থাকবে এক কোণে।

যদি তুমি ফিরে না আসো,
গরুর ওলান থেকে উধাও হবে দুধের ধারা,
প্রত্যেকটি রাজহাঁসের সবগুলো পালক ঝরে যাবে,
পদ্মায় একটি মেয়ে-ইলিশও আর ছাড়বে না ডিম।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
ত্রাণ তহবিলে একটি কানাকড়িও জমা হবে না,
বেবি ফুডের প্রত্যেকটি কৌটোয় গুঁড়ো দুধ নয়
কিলবিল করবে শুধু পোকামাকড়।

যদি তুমি ফিরে না আসো,
দেশের প্রত্যেক চিত্রকর বর্ণের অলৌকিক ব্যাকরণ
ভুল মেরে বসে থাকবেন, প্রত্যেক কবির খাতায়
কবিতার পংক্তির বদলে পড়ে থাকবে রাশি রাশি মরা মাছি।

যদি তুমি ফিরে না আসো,
এ দেশের প্রতিটি বালিকা
থুত্থুড়ে বুড়ি হয়ে যাবে এক পলকে,
এ দেশের প্রত্যেকটি যুবক মৃত্যুর মাত্রায়
ঘুমের বড়ি কিংবা গলায় দেবে দড়ি।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
ভোরের শীতার্ত হাওয়ায় কান্না-পাওয়া চোখে নজরুল ইসলাম
হন্তদন্ত হয়ে ফেরি করবেন হরবোলা সংবাদপত্র।

যদি তুমি ফিরে না আসো,
সুজলা বাংলাদেশের প্রতিটি জলাশয় যাবে শুকিয়ে,
সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশের
প্রতিটি শস্যক্ষেত্র পরিণত হবে মরুভূমির বালিয়াড়িতে,
বাংলাদেশের প্রতিটি গাছ হয়ে যাবে পাথরের গাছ
প্রতিটি পাখি মাটির পাখি।

যমজ আলো

অমন যমজ আলো মিলে যাবে তারাস্রোতে? নাকি
নাছোড় থাকবে লেগে দেয়ালে, ল্যাম্পোস্টে সারাক্ষণ
অথবা সাইনবোর্ডে নেবে খুঁজে অর্থের স্পন্দন
কোনো শুকনো অন্ধকারে? এই অবেলায় চেয়ে থাকি
যমজ আলোর দিকে বুকে নিয়ে বিপুল বৈশাখী।
পথ চলি পুনরায়; তলোয়ার মাছের মতন
একটি শরীর চোখে ভাসে, আমাকে অনুসরণ
করছে দু’টি চোখ ধুলো-সমুদ্রের, আমি দৃষ্টি ঢাকি।

আমার প্রস্থানরত পিঠ ফুঁড়ে সেই চক্ষুদ্বয়
ছিটকে পড়লো দূরে মার্বেলের মতো। শাদা ভয়
জুড়ে রয় সত্তাময়। মাড়িয়ে যাবো কি যুগ্ম আলো?
যখন চিলেকোঠায় ফিরে রতিমগ্ন, মনে হয়-
শয্যাসঙ্গিনীর দু’টি চোখে কামনার কী ধারালো
পূর্ণিমা; চকিতে তারই চোখে ভিন্ন চোখ, মৃত্যু-কালো।

রুক্ষ বুভুক্ষায়

এখানে কবিতা ঝরে ভোরবেলাকার মৃদু কামিনীর মতো,
‘আমি তো বকুল’ বলে কোনো কোনো কবিতা আবার
শিউলির কাছে চলে যায়। এখানে কবিতা লেখালেখি
চলে অবিরত। কবিত্বের চূড়ায় চূড়ায় ঘোরে বাস্তবতা,
পরাবাস্তবতা; কেউ কেউ উদার অক্ষরবৃত্তে গোলাপের
আকৃতির শোভা ধরে রাখে, কেউবা নির্ভৃত চন্দ্রকলা
দ্যায় পুরে মাত্রামৃত্তে। এবং আমারও পাণ্ডুলিপি স্ফীত হয়,
যেমন জনসভায় ক্রমে জমে লোক। আওড়াই কত শ্লোক।

বিষাদ উৎপন্ন হয় স্তবকে স্তবকে, প্রায় প্রতি প্যারাগ্রাফে
ম্লান টেডিবালকের মতো হাঁটে নিঃসঙ্গ নৈরাশ। কী-যে হয়,
লিখতে গেলেই আজ শব্দে শব্দে লাগে শুধু জান্তব বিশ্বাস,
বাজে কঙ্কালের শুকনো হাড়, ঘন ঘন ত্রঁকেবেঁকে যায় পংক্তি,
অক্ষর বেঢপ হয় বড়ো। শাদা কাগজে স্প্রিংয়ের মতো ক্ষিপ্র
কেবলি লাফিয়ে ওঠে বিষাক্ত উদ্ভিদ। মাঝে মাঝে ভালোবেসে
সুস্নিগ্ধ লোলাপজল দিই কবিতার চোখে, তবু তার চোখে
রক্তজবা লেগে থাকে সারাক্ষণ। কখনও বিলাপ শুনি শুধু।

হঠাৎ শহরে ভাসে জন্তুগন্ধ, তামসিক গুহা থেকে রুক্ষ
বুভুক্ষায় জেগে ওঠে একটি হাভাতে পশু। খাচ্ছে ছিঁড়ে ছিঁড়ে
রবীন্দ্ররচনাবলি, গীতবিতানের সেট, তার অতিশয়
ক্রুর মূঢ় মুখের গহ্বরে পড়ে ক্রমাগত রমণী, পুরুষ,
অত্যন্ত নিষ্পাপ শিশু শত শত। হেলে-দুলে চলে একা,
যেন সে সামন্তরাজ, মগ্ন স্বৈরাচার। তার ক্রুদ্ধ পদধ্বনি,
ক্ষুধিত গর্জন ক্রমান্বয়ে ব্যাপ্ত হয়, গ্রাম ও শহরে জন্মে
হাহাকার। এখন যাবে কি রোখা তাকে, হায় কাব্যের কৃপাণে?
ভয়ে চোখ বুজে থাকে সমস্ত শহর; কখন যে কার পালা,
কে বলবে? লেখার টেবিল ছেড়ে যাই, ফিরে আসি পুনরায়,
কখনও-বা ব্যক্তিগত মশারির ভিতরে লুকাই। যত্রতত্র
ওড়ে হল্কা পশুটার নিশ্বাসের, নিমেষে ঝলসে যায় চোখ
মুখ আর পাঁজর বেরিয়ে পড়ে সবাকার। সব একাকার
বেঢপ পায়ের নিচে তার; পশু অন্য কোনো দিকে চলে যাবে
ভেবে ইতস্তত রাখি চোখ, বস্তুত আশ্বাস খুঁজি চেনা রৌদ্রে,
বিপন্ন প্রতিবেশীর অস্থির দৃষ্টিতে জব্দ, নষ্ট লোকালয়ে।
আমিও মাথার ঘাম মুছে
আতপ চালের মতো রাশি রাশি নক্ষত্রের দিকে ছুটে যাই।

সঞ্জয় কেথায়?

বসে থাকি বন্ধ ঘরে অন্ধের মতন, অস্থিরতা
এলে ব্যেপে করি পায়চারি কখনও-বা, প্রৌঢ় প্রেম
তক্তপোশে তন্দ্রাচ্ছন্ন। কোথায় যে ঘণ্টা স্মৃতিবৎ
কী সোনালি বাজে, শুনি। যাবো আমি? এখন কোথায়?

বাইরে জীবন তীক্ষ্ণ স্বরে হেঁকে যায় ক্রমাগত
অভ্যাসবশত আমি আমার ঘরেই থাকি একা,
বইয়ের পাতায় চোখ, মাঝে-মাঝে রুক্ষ শীর্ণকায়
সন্তের মতন হয়ে যাই অন্তর্গত বনবাসে।

কখনও হঠাৎ তাপ বেড়ে যায় শরীরে আমার-
বুঝিবা১০৩, ঘরের দেয়াল দেখি
কোথায় গিয়েছে উড়ে, ঘর আর ঘর নয়। আমি
নির্জন প্রান্তরে নতজানু, সূর্য নিচে, বহু নিচে

জ্বলন্ত এসেছে নেমে, চতুর্দিক ধোঁয়াময়, মেঘ
নেই একরত্তি, অকস্মাৎ চোখ ফেরাতেই ফের
ফুলের ডালের মতো কিছু তন্বী হাত ভাসমান,
আমার শরীর ফুঁড়ে কত রাঙা পাখি উড়ে যায়!

জানি না প্রত্যহ কী-যে ঘটে রাত্রিদিন আজকাল
আমার এ চার দেয়ালের বাইরে, হঠাৎ কোনো
শব্দ এসে আমাকে ঠোকর মারে, আজ কে আমাকে
বলে দেবে কোথায় কী হচ্ছে, কারা অস্ত্রে দিচ্ছে শান,

কারা মিত্র সেজে শক্রতায় মাতে, বকুলতলায়
শোওয়ায় কবন্ধ লাশ? কে আমাকে বলে দেবে দূরে
অত কোলাহল কেন? সঞ্জয় সে-ও তো নেই কাছে,
হয়তো মিলে গেছে ঐ ভিড়ে, তারও গলা সেখানেই।

স্পর্শ

বাড়িয়ে দু’বাহু বারে বারে তোমার দিকেই যাই
স্বপ্নচালিতের মতো, সম্মুখে দাঁড়াই,
দেখি আশ্চর্যের অক্ষরেই স্মিত লেখা
তোমার শরীর প্রতিবার, যদিও প্রত্যহ এই দেখা।

যেন ঐ হাত, গাল, ঠোঁট, জানু, সুহাস চিবুক,
সুগোল স্পন্দিত বুক
ছুঁলেই তোমাকে পাবো, তুমি
হৃদয়ের ভূমি
সৌরভে ভরিয়ে দেবে, ফলাবে ফসল থরে থরে।
স্বপ্নের রঙের মতো মুহূর্তের অভ্যন্তরে এই জীর্ণ ঘরে
শবে-বরাতের আলো দেখবো এবং স্বয়ম্বরা ফুলে ফুলে
যাবে ছেয়ে ব্যর্থ প্রেমিকার মতো রিক্ত মেঝে, তোমাকেই ছুঁলে।

একজন উন্মাদকে যে-হাতের ভেতর লালন করি আর
যে-ঠোটে সংযত রাখি একজন মাতালকে, সকল চিৎকার
অন্তরালে পুষি শিরাপুঞ্জে যে-বুকের, তারা ঠিক
পাল্টে যায় নিমেষেই তোমার সান্নিধ্যে, কী বেল্লিক!
লিখেছি তোমার হাতে স্পর্শাক্ষর, বুকে মাথা,
তোমার পায়ের দু’টি পাতা
হেসে কুটি কুটি এই আমার পদাঙ্গুলের ছোঁয়ায়, তোমাকে
শেকড়-বাকড়ে বাঁধি অস্তিত্বের, আলিঙ্গনে বুভুক্ষু সত্তাকে
মিশিয়ে তোমার দিকে চাই,
তবু বুকে মরু, গলে যাও তুমি, মিলে যাও-
কোথায় উধাও,
এ খর শরীরব্যাপী স্পর্শে কী তোমার পাই?
এ জন্যেই সবখানে যে-নেই কেমন ভাসে, তারই শূন্য অন্তহীন
পেছনে পেছনে করি ধাওয়া
যোগাযোগহীন রাত্রিদিন
বুকে নিয়ে আর্তি- প্রাণপ্লাবী হাওয়া বয়, শুধু হাওয়া।

স্বয়ংবরা

তুমি দ্যাখো একজন আমার আপন কণ্ঠস্বরে
আমার একান্ত স্বপ্নগুলি নিঝুম আবৃত্তি করে।
আমার পিতৃবিয়োগে একজন হয়েছে অনাথ,
বোনে সে আমার বাসনার ছেঁড়া তাঁবুর বনাত।

তুমি দ্যাখো একজন আমার নামের পাশে আঁকে
নিজের স্বাক্ষর যত্নে, আমার চেয়ারে বসে থাকে,
আমার রেশনকার্ড ব্যবহার করে দ্বিধাহীন।
তুমি দ্যাখো একজন আমার বরতনে প্রতিদিন
নিবিষ্ট আহার করে, একজন রোগী খায় পথ্য
আমার এবং রোজ আমার কলমে লেখে তথ্য
কিংবা কিছু হিজিবিজি একজন, রাত্তিরে ঘুমায়
একজন ছারপোকা-ছাওয়া আমার নিজস্ব বিছানায়।

একজন পর্যটক আমার বাদামি স্যুটকেস
নিয়ে ঘোরে দিগ্ধিদিক এবং আমারই বুটলেস
লাগায় জুতোয় তার, একজন আমার পোশাক
পরে সূক্ষ্ম সাংস্কৃতিক সভায় বক্তৃতা ঝাড়ে, শাক
দিয়ে মাছ ঢাকে মাঝে-মধ্যে আর একজন পশু
আমারই শনাক্তপত্র নিয়ে করে মোহন কসুর।
বলো তো এদের মধ্যে, হে মহিলা, কাকে তুমি চাও?
‘পশুকেই’, বলে তুমি শোণিতের নদীকে নাচাও।

Exit mobile version