Site icon BnBoi.Com

আমরা ক’জন সঙ্গী – শামসুর রাহমান

আমরা ক'জন সঙ্গী - শামসুর রাহমান

অধিষ্ঠান

সেদিন যাবার আগে বলে গিয়েছিলে,
‘তাড়াও দুঃখের মেঘ, এই যে যেখানে
বসে আছি, থাকতাম দুপুরে বিকেলে,
সেখানে গেলাম রেখে আমার নিজস্ব প্রতিনিধি-
একটি নির্জন ছায়া, তাকে
নিয়ে দিব্যি কেটে যাবে তোমার সময়’।

কিছুই না বলে
আমিও নিলাম মেনে তোমার বিধান। সেই থেকে
ছায়াটিকে পরাই প্রত্যহ
অর্চনার মালা। কত খরা, কত বর্ষা আসে যায়,
ছায়াটি যায় না মুছে এতটুকু, বরং ক্রমশ
গাঢ় হয়।

বহুকাল পর তুমি এসে
বসতে চাইলে সেই প্রতিষ্ঠিত পুরোনো জায়গায়।
ছায়ায় দীক্ষিত আমি তোমাকে বরণ করে সেখানে বসাতে
যাবার আগেই ছায়া তর্জনী উঁচিয়ে বলে তোমাকে কঠোর
আদেশের স্বরে, ‘ফিরে যাও তুমি সুদূর পশ্চিমে’।

 অন্তত এটুকু থাক

অন্তত এটুকু থাক, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে
হাসিমুখে ঈষৎ তাকানো ফিরে, একটি কি দুটি
কথা কিংবা অত্যন্ত বাঙ্ময় নীরবতা সহকারে
বিদায় সাজানো; এলে চলে যেতে হয়, তবু যেন
প্রস্থানের আগে শূন্য ঘরে আনন্দ টাঙিয়ে হেসে
অসামান্য নীলপদ্ম ফুটিয়ে হৃদয়ে দিগন্তের
দিকে হেঁটে চলে যেতে পারি, অন্তত এটুকু থাক।
অন্তত এটুকু থাক, দেখা হলে হাতের ঝাঁকুনি,
আলিঙ্গন, প্রিয়তমা রমণীর ঠোঁটে চুমু এঁকে
প্রহরকে বন্দি করা, কবিতার পঙ্‌ক্তির মতোই
শুয়ে থাকা বেড়ালের পশমে ডুবিয়ে হাত একা
কথা বলি কিছুক্ষণ, নাগরিক কাঠবিড়ালির
চঞ্চলতা, ঝোপঝাড়ে জোনাকির নির্ভার উৎসব;
রাত্রি হলে যে শাড়ি ব্লাউজ খুলে মোহগ্রস্ততায়
নেবে তাপ স্বামীর অধীর নগ্নতার, তাকে ভাবা;
অন্তত এটুকু থাক আপাতত প্রাণের খরায়।

আদিম স্মৃতির মতো

এখন নিশুত রাত, ঝিঁঝি ডাকে; দোর এঁটে একা অন্ধকারে
বসে আছি, কে জপায় মন্ত্র চুপিসারে
বারে বারে? ক্রিসমাস গাছের মতোই অগোচরে
কী যেন একটা দ্রুত বেড়ে ওঠে আমার ভেতরে
এবং চৌদিক থই থই
পবিত্র অনলে; কে আমাকে ডাকে দূরে? থাকবোই
যথারীতি অনড় অটল,
এ-কথা যাবে না বলা। আমি তো স্ববশে নেই; জল,
পাথরের বুক চিরে আসে
কী উদ্দাম, কে রুখবে তোড়? মোহন বিরোধাভাসে
মজে আমি ভিজিয়ে শরীর
দেখি লোকচক্ষুর আড়ালে জাগে পুণ্য প্রতিমা নিবিড়
নক্ষত্রের নীড়ে; তবে
আমি কি গড়েছি তাকে অন্তর্লীন অচিন বৈভবে?
নাকি অন্য কেউ,
আমার ভেতরে যার বসবাস, জাগিয়েছে ঢেউ
চড়াময় মরা গাঙে পূর্ণিমার বিশুদ্ধ প্রভাবে?

সাঁতার কাটছি বলে মনে হয়; প্রকৃত প্রস্তাবে
একটি স্রোতের চোরা টানে উদ্দাম চলেছি ভেসে
নিরুদ্দেশে।
অন্তর্গত দেবতা না ছলনাপ্রবণ শয়তান
বীণার ঝংকারে তোলে তান
যখন যেমন খুশি? যার কণ্ঠস্বর
আমাকে নিজের মধ্য থেকে টেনে আনে, ঢের বেশি শক্তিধর
সে আমার চেয়ে; যুগ-যুগান্তের শত কণ্ঠ জাগে
তার কণ্ঠস্বরে, যা ছড়িয়ে পড়ে নদীস্রোতে, ফুলের পরাগে,
পাহাড় চূড়ায়, রূপ তার ক্রমাগত
আবছায়া থেকে সমুত্থিত আদিম স্মৃতির মতো।

আমরা কি যেতে পারি

আরিচার ঘাটে পৌঁছেতেই
পাক্‌না ফলের মতো সূর্য পড়ে গেল
নদীর পানিতে।
মাছের আঁশটে গন্ধ ভেসে আসে, দূরে
নৌকা চলে যায়। বিশ্রামের
ছায়াটুকু পোহাচ্ছে টয়োটা নিরিবিলি।
নড়েচড়ে বসে
ফ্লাস্ক থেকে তুমি ঢাললে চা,
মুখের ভেতরে
পেস্ট্রির সুঘ্রাণ গলে যায়।
বয়সিনী ভিখিরিনী জানালার ফ্রেমে, ওর শীর্ণ খড়ি-ওঠা
প্রসারিত হাতে তুমি তুলে দিলে স্ন্যাক্‌স হে সুজাত।
আবার শহরমুখী, সন্ধ্যার ঘোমটা-পরা আসমান, আর
বৃক্ষময় পিচপথে ধাবমান যান,
একটি একাকী লোক, হয়তো হাট-ফেরা
ডোবে কুয়াশায়।

তোমার সোনালি বাহু মাছের ধরনে ঝলসিত
বারবার; ঈষৎ রঙিন ঠোঁটে, চুলে,
কর্ণমূলে, গ্রীবার ঢালুতে ক্যাসেটের
সংগীত ছড়ায় রঙধনু
এবং আমার হাত ডাকে
তোমার হাতের উষ্ণতাকে মতিচ্ছন্ন মানুষের
মতো কী ব্যাকুল।
আমার ভেতরকার স্বেচ্ছাচারী পাঁজর, পাঞ্জাবি
ফুঁড়ে লুটোপুটি খায় আমারই সত্তায়।
তোমার পাঁচটি আঙুলের স্রোত বেয়ে
একজন নারী, বড় একা, তারার আগুনে গড়া,
আমার ভেতরে
গোপনে প্রবেশ করে অন্তরাল ছিঁড়োখুঁড়ে, স্পিডোমিটারের
কাঁটা ঊর্ধ্বগতি;
রাত বাড়ে, আমার মুঠোর মৃদু চাপে
তোমার আঙুল হয়ে যায় কণিকার কণ্ঠস্বর।

ফিরে এসে টিপি
সফেদ কলিংবেল, ঘরে ঢুকে শুই বিছানায়।
তখনও তোমার ঘ্রাণ, রাত্রির গহন
জঠরের নিবিড় নরম,
দূরগামী নৌকা,
হাট-ফেরা লোক, ঝোপঝাড়,
তোমার বিচ্ছিন্ন চলে-যাওয়া,
নির্জন পথের হাহাকার
জেগে থাকে সত্তাময়। কী যেন আমার মধ্যে জ্বলে আর নেভে
জোনাকিপ্রতিম
বারংবার; ইচ্ছে হয়, আবার সেখানেই যাই এই মুহূর্তেই।
আমরা কি যেতে পারি একই স্থানে পুনরায় একই মন নিয়ে?

 আমার ক’জন সঙ্গী

আমার নিজস্ব কিছু সঙ্গী আছে যারা কস্মিনকালেও ভুলে
টেপে না কলিংবেল, দরজা খোলার
অপেক্ষায় থাকে না কখনো, নিজেদের
খেয়ালখুশিতে আসে যায়
বিনা এত্তেলায়, এই সব সঙ্গীর অদ্ভুত আচরণে আমি,
বলা যায়, উঠেছি অভ্যস্ত হয়ে রীতিমতো কয়েক বছরে।

একজন, অমাবস্যা রাত্রির রঙের
মতো শাল মুড়ি দিয়ে দাঁড়ায় আমার পাশে হাতে
নিয়ে গ্লাস, বলে ‘দাও তিনটি চুমুক’। হতাশার
ঘ্রাণময় পানীয় আমার
কণ্ঠনালি বেয়ে নামে, আমি তার দিকে বিস্মিত তাকিয়ে থাকি
থমথমে স্তব্ধতায় নিরুপায়, গৌরববিহীন।

অন্যজন এসেই বাধিয়ে দ্যায় খুব
হুলস্থুল; টেবিলে চায়ের কাপ, পেলিক্যান কালির দোয়াত
যায় গড়াগড়ি
আহত যোদ্ধার মতো, জানালার কাচ
গুঁড়ো হয়, পর্দা ফালা ফালা, পলস্তারা খসে পড়ে
দেয়ালের, রেডিও হঠাৎ
উন্মাদের মতো কোলাহল করে ভয়ানক বোবা
বনে যায়, লণ্ড সবকিছু, যেমন দাংগায়
হিংসার তাণ্ডবে
তছনছ বাগান, বসতবাড়ি, দেখি শুধু দেখি।

আরও একজন আছে, যার যাতায়াত এই ফ্ল্যাটবাড়িটায়
বেড়ে গ্যাছে ইদানীং। আমার শোবার ঘরে ঢুকে
রাগে গর গর করে সারাক্ষণ ডালকুত্তার ধরনে, দ্রুত
টুঁটি চেপে ধরবার নিখুঁত কৌশল,
তার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, যেন
জানা আছে, আমার রক্তের স্বাদ পেলে শান্ত হবে। ভয়ে ভয়ে
থাকি, পাছে আমাকে সে ন্যাকড়ার ফালির মতন
করে ফেলে। তার প্রতি আনুগত্য জানাতে ভুলি না।

কায়ক্লেশে হেঁটে আসে অপর একটি লোক, যেন
বহুদূর থেকে
তার আসা; বলা-কওয়া নেই সটান সে ধুলো পায়ে
লম্বা হয় আমার শয্যায়, চোখ বুজে
আকাশ-পাতাল ভাবে, বিষাদের কামড়ের সুতীব্র চিৎকার
সারা মুখে। সে আমাকে তার
কাছে ডেকে নিয়ে
পাশে শুতে বলে, লীন হতে চায় আমার ভেতরে।

বাকি একজন, চটপটে, সর্বদাই হাসির ঝিলিক চোখে,
জ্যোৎস্নাময় কলাপাতা বিছায় আমার
সমুখে সযত্নে
শিল্পের আঙ্গিকে, যেন পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে খুব
নিরিবিলি করাবে ভোজন
এবং আমার চার দেয়ালে নিমেষে
নিপুণ টাঙিয়ে দেয় কেমন আলাদা সূর্যোদয়,
আমার চলার পথে পাতে স্বপ্নখচিত উদার
রঙিন গালিচা।

আমার সঙ্গিরা যার
যখন যেমন খুশি আসে আর যায়, যায় আর
আসে, আমি শুধু
অভ্যর্থনাকারীর ধরনে বসে থাকি গৃহকোণে বড় একা।

এমনই হবার কথা, অনেক আগেই জানতাম
এরকম ঘটবে হঠাৎ। তুমি নিরাসক্তভাবে
আমাকে রাত্তিরে বিদায়ের কাফনে বিশদ মুড়ে
চলে যাবে। আমার ভেতরে কী প্রচণ্ড ভাংচুর
হলো আর শত শত আর্ত কোকিলের কণ্ঠ-চেরা
রক্তধারা গেল বয়ে সেসবের প্রতি উদাসীন
তুমি দু’চারটি খুব লৌকিকতাময় বাক্য বলে
সেরেছ বিদায়পর্ব। সার্কাসের খেলা চুকেবুকে
গেলে বয়েসী যে রঙমাখা সঙ ভয়ানক একা
বৃত্তের ভেতরে স্তব্ধতায় বিষণ্ন দাঁড়িয়ে থাকে,
আমি সে ধরনের থেকে যাব ততক্ষণ, যতক্ষণ
না তুমি একটি বিন্দু হয়ে মিশে যাও দৃশ্যান্তরে।

আমার নিথর নীরবতা নিয়েছে বরণ করে
তোমার শিল্পিত কথকতা, কোনো বিবরণ কোনো
নামের উল্লেখ একজন কবির হৃদয়ে কত
ক্ষত তৈরি করেছে তা লক্ষ্যই করোনি, এরকম
মগ্ন ছিলে অতীতের ঝালরের ভ্রষ্ট দ্যুতি নিয়ে।
যে অর্ঘ্য সাজিয়ে আমি রেখেছিলাম সুন্দরীতমা
তোমার উদ্দেশে তাকে অবহেলে ছুঁয়ে চলে গেছ,
তা বলে আমার গানে অভিযোগ হবে না ধ্বনিত।

এভাবেই শেষ হোক, চেয়েছিলে? আমিও কি ঠিক
এমন প্রত্যাসা নিয়ে প্রতীক্ষা করেছি? সদত্তর
জানা নেই; নিশ্চয়তা কোনো দিন নেয়নি দত্তক
ভুলেও আমাকে, বিস্মৃতির ঘাটে ভরসন্ধ্যায়
তোমাকে চেয়েছি দিতে বিসর্জন, অথচ প্রতিমা
অধিক জাজ্বল্যমান হয়ে মেলে আয়ত দু’চোখ।

অনেকেই বলে, শোনো, কৃষক মাটির বুক চিরে
ঘরে আনে রাশি রাশি শস্যকণা, তুমি শুধু এত
রাত জেগে, সারাদিনমান রুক্ষ পথে ঘুরে ঘুরে
আখেরে কী পেলে? আমি স্মিত হেসে বলি-
আমিও ফিরিনি শূন্য হাতে। আমার হৃদয়ে দ্যাখো
ক্ষতের গোলাপ ফোটে, যন্ত্রণাই আমার ফসল।

এ আমার খেলা

এখন সে থাকে না শহরে; দিনভর রাতভর
খুঁজলেও আজ
এখানে যাবে না পাওয়া তাকে। প্রস্থানের
আগে সে আমাকে ছাদে নিয়ে গিয়েছিল
কী খেয়ালে; আধখানা চাঁদ
মাছের কাঁটার মতো আকাশের গলায় আটকে ছিল। তার
মাথা ছিল ঝুঁকে
আমার স্পন্দিত বুকে; এলোমেলো কথা কতিপয়
উড়ন্ত মাছের মতো মিশেছে হাওয়ায়। সে কি কিছু
বলেছিল বিদায়ের আগে?
আমি তার কিছু কথা বুঝেছি, অনেক
বাক্য থেকে গ্যাছে রহস্যের ঘেরাটোপে। রহস্যের
ঘোমটা সরিয়ে
এখন দেখতে চাই প্রকৃত রূপের বর্ণচ্ছটা তারাজ্বলা
আকাশের নিচে; এখন সে নেই; ডান পাশ থেকে
কতিপয় অক্ষর বাঁ দিকে
এনে আর বাঁ দিকের কয়েকটি শব্দকে দক্ষিণে
সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে শব্দসমূহকে
সুন্দরের ঝালর পরিয়ে চেয়ে থাকা
এ আমার খেলা ইদানীং।

এই যে শুনুন

এই যে শুনুন, আপনি যখন ঝকমকে চামচে স্যুপ খান
চমৎকার, তখন আপনার
সাফসুতরো হাতে, ধবধবে শার্টের আস্তিনে এতটুকু
রক্তচিহ্নও চোখে পড়ে না কারো। আপনি যখন হাসির জুঁই
যত্রতত্র ঝরিয়ে দেন,
কে বলবে আপনি আতশ মেজাজ? গোস্তাকি মাফ করবেন
হুজুর নামদার, আপনাকে জালিম বলবে
এমন বেহুদা তালিম কেউ পায়নি এ তল্লাটে।

স্বদেশের জন্যে আপনার দরদের কমতি নেই,
প্রিয় দেশবাসীর প্রতি হে গরিব পরওয়ার, আপনি
হরহামেশা বে-এন্তেহা মেহেরবান
এবং নাদান আমরা তাজ্জব হয়ে দেখি, হে সাহেবে কামাল,
ঝাড়ফুঁকে আপনি দূরে, বহুদূরে হটিয়ে দিতে চান
পোড়া দেশের আলাইবালাই।

অসাধারণ আর ভয়ঙ্কর শক্তিমান
আপনি, ঝড়ক্ষুব্ধ সমুদ্রের মতো কিংবা সুন্দরবনের
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো আপনার শক্তি
গর্জে ওঠে যখন তখন। হলফ করে বলতে পারি,
সারাদেশ অন্ধকার করে দেয়া আপনার শক্তির মেঘ
যত গর্জে ততই বর্ষে।
ইচ্ছে হলেই আপনি যে কোনো বই, পুস্তিকা
অথবা ইস্তাহার
নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন, পারেন যে কোনো
মানুষকে পাঠাতে তয়খানায়। আপনার খেয়ালের
রঙ-বেরঙের ঘোড়াগুলোর
গা মালিশ করার জন্যে করজোড়ে এক পায়ে
দাঁড়িয়ে থাকে নানা সহিস। চোখের পলক না পড়তেই
আপনার যে কোনো হুকুম তামিল হয়ে যায়।
কিন্তু হে লৌহমানব
আপনি খেয়ালখুশির খেয়া ভাসালেই
নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে না সূর্যোদয় কিংবা পূর্ণিমা,
প্রেমিক-প্রেমিকার চুম্বন।
আপনি প্রাণভরে গার্ড অব অনার নিতে পারেন আর
একজন কবিকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন
ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে,
বহ্ন্যুৎসব করতে পারেন তার গ্রন্থরাজি দিয়ে,
পারেন আপনি পারেন;
তবু তার কবিতাবলি বন্দুকের ধমককে
উপেক্ষা করে ঈগলের মতো উড়তে থাকবে,
উড়তে থাকবে, উড়তে থাকবে।

ওরা চলে যাবার পরে

এবারও আমি ওদের নিরাশ করলাম।
যখন আমার ভাই-বোনেরা বলল, ক’দিনের জন্যে
আমরা সবাই পাড়াতলী
যাচ্ছি, চলো তুমিও যাবে,
তখন আমার নীরবতায় অনিচ্ছার এক কাদাখোঁচাকে ওরা
প্রত্যক্ষ করল ওদের মুখোমুখি, এমনকি শীতবিকেলে
আম্মার কথাও সেই হতকুচ্ছিত
পাখিটাকে তাড়াতে পারল না কিছুতেই।

বছরে দু’তিনবার ওরা যায় পাড়াতলীতে, আমাদের
দেশ-বাড়িতে। সেই যে একাত্তরে তাড়া-খাওয়া পাখির মতো সেখানে
গা ঢাকা দিয়েছিলাম, তারপর থেকে
একবারও আর আমার আমাদের গ্রামে
যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এক ধরনের অকৃতজ্ঞতাবোধ আমাকে
মাঝে-মধ্যে কামড়ে ধরে
কচ্ছপের মতো, তবু পারিবারিক আড্ডায়
পাড়াতলীর প্রসঙ্গ আমি
এড়িয়ে চলি, অথচ একটা টলটলে পুকুর, পুরোনো দালান,
আম-কাঁঠালের গাছ
সর্ষে ক্ষেতে প্রজাপতির ওড়াউড়ি, দিঘিতে
মাছের বুড়বুড়ি আর
গভীর রাতে দীর্ঘদেহী বড় চাচার জজবার আওয়াজ
আমার স্মৃতিতে হাঁসের মতো সাঁতার কাটে প্রায়শই।

সবাই গেল, শুধু আমি রয়ে গেলাম এ-শহরে।
অল্প-স্বল্প নিয়ে থাকা এই আমির
সময় কাটে ক’জন সহকর্মীর সঙ্গে গল্প করে,
ঔপন্যাসিক বন্ধুর সহৃদয়
বাসায় রবীন্দ্রনাথের আসা-যাওয়ার পথের ধারে
কিংবা বিলায়েত খানের
সেতারে ইমন শুনে, তরুণ বৃদ্ধিজীবীদের আস্তানায়,
মধ্যরাত অব্দি বই পড়ে।

ওদের যাবার তিনদিন পর
এক রাতে মনের চোখে দেখি-
পাড়াতলীতে আমাদের পুরোনো দালানের টানা বারান্দায়
সবাই গল্প-গুজব করছে, এলেবেলে বাগান থেকে
ভেসে আসছে হাস্নাহেনার ঘ্রাণ। ট্রানজিস্টারে বাজছে
রক্তে দোলা-জাগানো পপ গান।
আমার দাদাজান, যাঁকে আমি কখনো দেখিনি, দাদী, নানা ভাই, আব্বা, বড় চাচা,
মাস্টার চাচা, মোমেনা খালা আর আমার তেরো
বছরের ছেলে কবর ফুঁড়ে
একে-একে উঠে দাঁড়িয়েছে সবাই, যেন ইস্রাফিলের
শিঙ্গা শুনে। আরবি-ফার্সি জানা দাদাজান সটান হেঁটে চলে গেলেন
মসজিদের ভেতরে, বড় চাচা তার জজবার আসরে,
মাস্টার চাচা অন্ধকার ঘরে
হাতড়ে বেড়াচ্ছেন নেস্‌ফিল্ডের গ্রামার,
নানা ভাই কালো আচকানটার বোতাম লাগাতে লাগাতে
ডাকছেন আমার নানিকে,
মোমেনা খালা দীর্ঘ চুলে চালাচ্ছেন চিরুনি
আর আমার ছেলে পুকুর পাড়ে
বসে আছে একলা, ওর মুখে অভিমানের থম-ধরা
একটুকরো মেঘ আর আব্বা ট্রানজিস্টারের
পপ গান থামিয়ে
গমগমে গলায় আম্মাকে বললেন,-
‘কই তোমার ছেলে এখনও বাড়ি ফিরল না,
যেমন বলতেন ছত্রিশ বছর আগে,
যখন আমি এক অচিকিৎস্য উড়নচণ্ডী, ঢাকা শহরের
পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আওড়াচ্ছি কবিতার পঙ্‌ক্তি
এবং ভাবছি কোনো এক গলির দোতলার ঘর-আলো-করা
তরুণীর কথা অনেক রাত অব্দি।
চেয়ারে বসেছিলাম আমি, আমার হাত থেকে অকস্মাৎ
খসে পড়ল কলিন উইলসনের
দ্য অকাল্ট, আর আমার বুকের ভেতরে
কে যেন আমার কোনো দূর পূর্বপুরুষের
মতো আর্তকণ্ঠে বলে উঠল,
‘সময় হলেই, আপনি না ডাকলেও আমি বাড়ি ফিরব আব্বা’।

 কে দেবে জবাব?

কথা দিয়েছিলে বাঁধতে পারব স্বপ্ন-মুখর
শান্তির ঘর, আমার বাগান সাজানো থাকবে
জুঁই চামেলীতে এবং গোলাপে। পাখি দোল খাবে
ভোর সূর্যের আবির জড়ানো ডালে আর গানে
ভরবে প্রহর। আমার শিশুর দোলনায় ঝুঁকে
দাঁড়াবে না কোনো কবন্ধ প্রেত, প্রেম-নিমগ্ন
যুগলের চুমো খাওয়ার প্রহরে পড়বে না ছায়া
হাড়-হাভাতের, কথা দিয়েছিল স্বাধীনতা তুমি
কথা দিয়েছিলে মেহেদি-রাঙানো রমণীয় হাত
উষ্ণ রক্তে কোনো দিন আর উঠবে না ভিজে,
কোনো যুবা আর গুলির আঘাতে, রাজপথে পড়ে
আজরাইলের ডানার ঝাপটে হবে না উধাও।
অথচ এখন স্বাধীনতা তুমি নিজেই একাকী।
পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার মতো ক্রাচে ভর করে
হাঁটছ তিমিরে। চোখের পাতায় কোন স্বপ্নের
ভস্ম জমছে, এই অবেলায় কে দেবে জবাব?

কে যেন দিয়েছে রুয়ে

বেশ কিছুকাল অস্থিরতা আমাকে কয়েদ করে
রেখেছে সকাল-সন্ধ্যা। অভিযুক্ত মানুষের মতো
অন্নজল বড় উদাসীনতায় প্রত্যহ গ্রহণ
করি, নড়ি-চড়ি নিজ ঘরে, সহজে যাই না কারো
নিবাসে এবং গালে সেফটি রেজরের ব্যবহার
মাঝে-মধ্যে আলস্যে স্থগিত রাখি। দেখি আসমানে
থরে থরে সফেদ গোলাপ ফোটে, রাত্রিবেলা চাঁদ
অর্ধভুক্ত কুলি কামিনের ঘুমে মমতা ছড়াতে
চলে যায়। দূরে ঘণ্টা কোলাহল করে, মধ্য যামে
চক্ষুদ্বয় ঘুমের আঠায় বন্ধ হতে চায়, যেন
ফাঁসির আসামি সেলে চোখ বোজে নিদ্রার আশায়।
শিশুর মতন সাদা সারল্যের পথে ক্রীড়াপ্রিয়
কখনো, কখনো রঙধনু ছড়াতে ছড়াতে আমি,
সঙ্গমজনিত পুলকিত ক্লান্তি আসে, শয্যা খুঁজি-
বিছানায় কে যেন দিয়েছে রুয়ে আগুনের বীজ।

কেবল একটি শব্দ

যাবতীয় মনোহারি সুখ-সুবিধার
পাঁচালি শুনিয়ে ওরা তাকে তাড়াতাড়ি
কার যেন বাগানবাড়িতে
পাঠাতে চাইল সগৌরবে, জয়ঢাক
বাজিয়ে, সাজিয়ে
আপাদমস্তক তাকে জরির পোশাকে।

নিজেকে অত্যন্ত ভারি
মনে হলো তার, বিশেষত এরকম ধরাচূড়ো
এর আগে কোথাও দেখেছে
বলে তার কিছুতেই মনে পড়ল না।

হঠাৎ কী মনে করে এক ঝটকায়
মহামূল্যবান পোশাকটা ছেড়েছুড়ে
উলঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকে লোকটা অটল।
তারপর কণ্ঠস্বরে
সমুদ্র-কল্লোল এনে বলে,
কস্মিনকালেও আমি কারো কোনো বাগানবাড়িতে
যাবো না এবং অস্তিত্বকে করব না
কলংকের চন্দনে চর্চিত।

‘না’ শব্দটি বোমার ধরনে
ভীষণ পড়ল ফেটে সভাগৃহে; কেননা সেখানে
যারা দণ্ডমুণ্ডু কর্তা আর যত কর্তাভজা, তারা
‘না’ শব্দটি শুনতে কখনো
তেমন অভ্যস্ত নয়, কেবল একটি শব্দ সে ঘরের সব
আসবাবপত্র আর ঝাড়লণ্ঠনকে ভীষণ দুলিয়ে দিল,
যেরকম আচানক ভূমিকম্পে ঘটে।

 কোথায় দাঁড়াবে?

অতিকথনের পরগাছাময় ঝুঁটি
হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে খুব কুটি কুটি
মানিক বাড়ুজ্জে তাঁর একটি গহন উপন্যাসে
বলেছেন শিল্পিত বিন্যাসে-
ওরা টের পায়।
কোন অপচ্ছায়া শিলীভূত মূর্তির মতন ঠায়
কোথায় দাঁড়িয়ে থাকে, বাসুকি কখন ফণা তুলে।
দেবে দোলা শ্যামল মাটির মর্মমূলে,
কখন হাওয়ায় বিষ গচ্ছিত অথবা
অকস্মাৎ নিসর্গের শোভা
হবে তছনছ, ওরা ঠিক জেনে যায়, ওরা মানে পশুপাখি,
তখন আমরা বড় বেখেয়াল থাকি।

পাথরের নিচে থাকে
খাদ্যান্বেষী পিচ্ছিল যে-কীট কিংবা ডালে বসে ডাকে
যে-চন্দনা তারাও বাঁচাতে প্রাণ করে
ছোটাছুটি এদিক সকলের অগোচরে।

তাণ্ডবের ছায়াচ্ছন্ন পৃথিবীতে অসহায় শিশুরা কীভাবে
কোথায় দাঁড়াবে?

 ঘুড়ে দাঁড়ালাম

কিছুকাল ধরে কী ভীষণ মনোভার
নিয়ে আছি। জীবনকে অগাধ কাদায় ডোবা কোনো
শুয়োরের মতো মনে হচ্ছে ইদানীং। ভালো লাগবার
মতন কিছুই আর নজরে পড়ে না। ঘরবাড়ি,
সারি সারি গাছ, ঝিল, উড়ে যাওয়া
পাখির মনে আনে না খুশির ঢল। শুধু
ধু-ধু মরুভূমি চোখে ভাসে,
মরীচিকা সকল কিছুই যেন, জনমনিষ্যির
সঙ্গ বিষবৎ, রবিশঙ্করের সেতারের গৎ
কেমন অসার ঠেকে, এমনকি শাগালের ছবি
দেয় না ছড়িয়ে
স্বপ্নাভা আমার চেতনায়।

ভাবি মাঝে-মাঝে-
যে আমার পেছনে পেছনে হাঁটে, থেমে
যায় হাত রেখে দরজায়,
তার প্ররোচনা মেনে নিয়ে মাথা রাখি
ট্রেনের চাকার নিচে, ঝুলে পড়ি ফ্যানে
অথবা সেবন করি প্রচুর ঘুমের বড়ি প্যাঁচা-ডাকা রাতে।

একদিন কোনো এক হাই-রাইজ দালানে পোঁছে
বারো তলা থেকে
ঝাঁপিয়ে পড়ার মৃদু ইচ্ছাটিকে অনেক গোঁয়ার
করে তুলে সিঁড়ি খুব কায়ক্লেশে ভাঙতে ভাঙতে
দ্বাদশ তলায় উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ার
মুহূর্তে তোমার মুখ মনে পড়ে গেল
অকস্মাৎ, না পড়াই ছিল বাঞ্ছনীয়-
কে যেন আমার ঘাড় ধরে টেনে জমিনে নামিয়ে নিয়ে এলো
আর আমি তক্ষুণি আবার
জীবনের দিকে তীব্র ঘুরে দাঁড়ালাম।

চর্যাপদের হরিণী

ভুল বোঝাবুঝি, ঘেন্না, বিবাদ-
এ কেমনতরো কাহিনী?
ফ্ল্যাটবাড়িটায় হানা দেবে জানি
মিশ্র স্মৃতির বাহিনী।

নকল সোনার সিংহাসনের
অধিকারীটিকে দেখেছি;
তার অকারণ তাচ্ছিল্যের
ভস্ম শরীরে মেখেছি।

চক্রান্তের জাল সব দিকে
বলো তো পা রাখি কোথায়?
কারো কারো ক্রূর বিষথলি, হায়,
নিমেষে উজাড় কথায়।

তবে কি আমিও ফিরে আসব না
শুভার্থীদের ডেরায়?
চলে যেতে হয়, শেষমেশ তবু
আনন্দ ফোটে ফেরায়।

কার্তিকে পাই একটি কদম
ফুলের শিহর শিরায়,
হাসিঝলসিত দৃষ্টি বুলায়
প্রলেপ মনের পীড়ায়।

হাতে মৃদু চাপ, চোখের কোথায়
হৃদয়াবেগের বেহাগ।
বুকডোবা পাঁক থেকে উঠে দেখি
মনোজ পদ্ম বেদাগ।

যাবার সময় বস্তুত কারো
দোষক্রটি আমি ধরিনি;
বৈরী ঋতুতে কোমল তাকায়
চর্যাপদের হরিণী।

 ছিল না

ছিল না, এখনও নেই। শত খোঁজাখুঁজি
করলেও কোনো দিকে পাবে না হদিশ।
থমকানো মেঘের ধরনে বসে আছে। ফিসফিস
কী যেন বলছে হাওয়া কানে
তার, পাবে কোথায় এখন?
মনের ভেতরে নদী বয়ে চলে অজানার টানে;
স্রোতে খড়কুটো, তীরে কী আদিম বন।

চায় কায়মনোবাক্যে, শূন্যতার মরু
সয় না তৃষ্ণার্ত চোখে, কাকে
চায় জানা নেই তার, কে অজ্ঞাতনামা সাঁওতালি পুরুষ ডমরু
বাজায় হৃদয়ে সারাক্ষণ, সেই ধ্বনি
পারবে কি ফোটাতে শ্বেত-পাথরের মূর্তি এই পাঁকে
অথবা সাজাতে লীলকান্তমণি
দরজার মাথার অক্লেশে? এরকম
না-ই হলো, ক্ষতি নেই। বরং সে চায়
নিমেষে কনকচাঁপা এবং শরম-
ছাওয়া চোখে মানবী উঠুক ফুটে খাতার পাতায়।

ডালিমতলায়

হিসেব রাখে না কেউ আর। আজকাল
দেশ থেকে দেশান্তরে দিচ্ছে অনেকে উড়াল।
কারো ছুটি কাটে ইউরোপের শৈলাবাসে,
কারো মন্টিকার্লোতে রুলেটে ভাগ্য হাসে
অকস্মাৎ। কেউ ফ্রাঙ্কফুর্ট, কেউ কেউ
সুনীল ভূমধ্য সাগরের শান্ত ঢেউ
গুনে গুনে কাটায় সময় নীলচক্ষু সঙ্গিনীর মভরঙ
বিকিনির ঘ্রাণ শুঁকে, কারো পুঁজি বাড়ে হংকং
আর সিঙ্গাপুরে, কেউ কুয়েতি বিমানে
চলে যায় পেট্রো ডলারের ক্ষিপ্র টানে;
কারো কারো চলায়-বলায়
কিসের মিশোল লাগে। আমি আস্তে হেঁটে যাই ডালিমতলায়।

 তিনি বোধ করলেন

দেখতে দেখতে খুব সকলবেলার সূর্যটাকে
পাকা স্ট্রাইকারের ধরনে
গড়িয়ে গড়িয়ে কেউ অতি দ্রুত পশ্চিম আকাশে
নিয়ে গেল। ঘরে
থই থই ছায়া, সারি সারি অক্ষরের অবয়ব
চোখে পড়লেও ঠিক কাউকেই আর
তেমন আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না, অথচ বেলা
গেল, পাখি তার
ক্লান্ত ডানাদ্বয় পাতাময় ডালে গুটিয়ে ফেলার
সঙ্গে সঙ্গে। খাতা বন্ধ করে তিনি চোখ বুজলেন।

জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন কিছু ক্রীড়াপরায়ণ
ছেলে মাঠ ছেড়ে
ঘরমুখো, পথপ্রান্তে যুবক-যুবতী হেঁটে যায় কবিতার
যুগল পঙ্‌ক্তির মতো। তাদের উদ্দেশে
আশীর্বাদ ঝরে তাঁর ঠোঁট থেকে, যদিও জানেন
তিনি এসবের আদপেই কোনো মানে
নেই শেষ অব্দি, কত দৃশ্য ফোটে পটে, মুছে যায় অগোচরে,
কার আর মনে থাকে ছায়ার আঁচড়?

উড়ে-যাওয়া বেলুনের পেছনে পেছনে
ধাওয়া করে বালকেরা। কিয়দ্দূরে র্যােফায়েল রমণীর মতো
কেউ ঘন দীঘল সোনালি
চুল আঁচড়ায়, জানালার ধারে কেউবা দাঁড়ায়,
ফেরি-অলা শাকসব্জি বয়, বারান্দায়
দু’জনের মধ্যে এলেবেলে কথা হয়-
এই সব ক্ষণিক বুদ্বুদ ভেবে তিনি একটি পুরনো চিঠি
ডায়েরির ভেতরে গচ্ছিত রাখলেন।
যুদ্ধের বাতিল কার্তুজের মতো চিন্তা নিয়ে তিনি
কী করবেন ভেবে দিশেহারা।
বেলা তো যাবেই; এই খুব একা-একা থাকা তাঁর
মাঝে-মাঝে ভারি হয়ে ওঠে
সিসের মতন; ঘরে বাতি জ্বালবেন নাকি অন্ধকার ঘরে
থাকবেন বসে চুপচাপ
কোনো পূর্বপুরুষের তৈলচিত্রের মতন, এই দ্বিধা
তাঁকে দাঁড় করিয়ে রাখল কিছুক্ষণ
ঘরের মেঝেতে, অকস্মাৎ তিনি বোধ করলেন
পাতি বুর্জোয়ার বিবমিষা।

তুমি আছ

ভেবেছিলাম ঠিক তুমি আছ তুমি তো আছই
এ শহরে যেমন পুণ্য আলো থাকে
গির্জায় পূর্ণ মহিমায়

তুমি তো চলেই যাবে

তুমি তো চলেই যাবে শেষতক, আজ নয়তো কাল।
আমার সকাল
পরবে সন্ধ্যার সাজ, যেদিন হাওয়ায় তুমি উড়িয়ে আঁচল
খুব ছলছল
চোখে একা দাঁড়িয়ে পথের ধারে নেবে, হায়, চকিতে বিদায়।
বিষণ্ন দ্বিধায়
একাকী থাকব পড়ে ফ্ল্যাটে এবং ক্ষণে ক্ষণে
প্রাণের গহনে
উঠবে ব্যাকুল ডেকে অন্তরালে বিচ্ছিন্ন কোকিল,
বেদনায় নীল।
তোমার যাবার পরে অকস্মাৎ হবে
মনে, কী বৈভবে
ছিলাম নিমগ্ন কী সৌন্দর্যে এতদিন, আগে কেন ওরে মন
হয়নি স্মরণ?

দেবে না, তোমরা দেবে না

দেবে না তোমরা দেবে না।
ক্ষুধা মেটানোর জন্য
দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন
দেবে না, তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।

দেবে না তোমরা দেবে না
মাথা গুঁজবার ছাপড়া
নগ্নতা-ঢাকা কাপড়া
দেবে না তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।

দেবে না, তোমরা দেবে না।
দুস্থ শিশুর পাত্রে
গুঁড়ো দুধ দিন রাত্রে
দেবে না তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।

দেবে না, তোমরা দেবে না।
ক্ষুধার্ত যারা কাঁদবে,
শিকলে তাদের বাঁধবে,
দেবে না কাঁদতে দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।

দেবে না, তোমরা দেবে না।
পারি না এ-কথা ভুলতে,
আমাদের মুখ খুলতে
দেবে না তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।

দেবে না, তোমরা দেবে না।
চলে শুধু ষড়যন্ত্র,
ভাঙা হাটে গণতন্ত্র
দেবে না, তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।

দেবে না, তোমরা দেবে না।
স্বপ্নের দ্বীপে হাঁটতে,
সোনালি শস্য কাটতে
দেবে না তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।

নায়কের প্রতীক্ষায়

বারবার ঘোষকের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, ‘সুধীবৃন্দ,
একটি নাটক হবে মুক্তাঙ্গনে, একটু অপেক্ষা
করুন নিঃশব্দে ধৈর্য ধরে; দয়া করে
কোনো বিশৃঙ্খলা
সৃষ্টি করবেন না; কোনো ভাংচুর যেন
না হয় এখানে। আমাদের নায়কের
সুলুক সন্ধান
এখনও মেলেনি, ফলে নাটকের কাজ
শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। আরও কিছুক্ষণ দর্শকণ্ডলী
আমরা আপনাদের একান্ত সহযোগিতা চাই।

সাজঘরে ধড়াচূড়ো সবই আছে ঠিকঠাক, চোগা
চাপকান, গলার মুক্তোর মালা, টুপি কিংবা তাজ
অথবা সাফারি স্যুট, বুট
কিছুরই কমতি নেই; রয়েছে গচ্ছিত, শুধু আজ নায়কের দেখা নেই,
এ তল্লাটে কোথাও নায়ক নেই কোনো।

যারা মুখ্য পাত্রপাত্রী নয়,
তারা যার যে রকম ইচ্ছে মাঝে-মাঝে
নাটকের কিঞ্চিৎ মহড়া দিচ্ছে আর নিজ নিজ গরিমার
রোদ পোহানোর
ফাঁকে ফাঁকে দর্শকের চোখের সম্মুখে
ফেলছে ধোঁয়ার জাল। এরকম শান্ত, আলাভোলা
দর্শক কখনো
কোথাও দ্যাখেনি কেউ। নায়ক বেপাত্তা
জেনেও তাদের মধ্যে কেউ
টুঁ শব্দটি করছে না। বেড়ালের ডাক নেই, তীক্ষ্ণ সিটি নেই;
পচা ডিম অথবা টোমাটো
শূন্যমঞ্চে ছুড়ছে না কেউ। মনে হয় থমথমে গোরস্থান।
এরকম ভাবলেশহীন যারা, তারা
হয় মৃত,
নয়তো কলের পুত্তালিকা সব, হঠাৎ যাদের
ফুরিয়ে গিয়েছে দম। হ্যাজাক জ্বালানো
হয়েছে সে কবে,
নায়কের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে না এখনও।

সময় ঠোকর দিচ্ছে ক্রমাগত যেরকম গাছে
দ্যায় কাঠঠোকরা; অধিকারী
দিশি মদে চুর, প্রম্পটার নেপথ্যে ঝিমোয় আর
নোংরা ড্রেন, ঝোপঝাড়, ডোবা থেকে-আসা ঝাঁক ঝাঁক
মশা ভণে নাট্যকথা অমৃত সমান
এ ভবের হাটে। দিন যায়, রাত কাটে, দর্শকেরা
সেই কবে থেকে অসহায়
প্রতীক্ষায় আছে,
প্রতীক্ষায় আছে,
প্রতীক্ষায় আছে
কখন নায়ক এসে গৌরবের বেশে
স্তব্ধতাকে কাচের মতন
টুকরো টুকরো করে
অকস্মাৎ মুক্তাঙ্গনে ঝোড়ো বেগে প্রবেশ করেন।

পর্যটন

যাবেন তো ঠিক’ বললে মৃদুল
কণ্ঠের তারে রস্রাজি ছড় টেনে।
কলকাতা থেমে মুখ ফেরালাম,
প্রাতরাশ সেরে চাপলাম দ্রুত ট্রেনে।

বলাবলি হয় বৃক্ষের কথা,
শ্যামা পাখি গায়, নাচে হৃদয়ের ক্ষতে,
কখন যে মৃদু দুপুরের রোদে
পৌঁছে গেলাম তোমার বাড়ির পথে।
বললেন হেসে দেয়ালে টাঙানো
সেই কবেকার তোমার মায়ের ছবি-
‘কেমন অতিথি এনেছিস খোকা
এতকাল পরে? কবির উঠোনে কবি?’

মেহগনি কাঠে তৈরি খাটের
সুজ্‌নিতে বসি ঈষৎ পদ্মাসনে;
কিছু দূরে যেন মন্দিরা বাজে,
করি খণ্ডিত সঙ্গীত মনে মনে।

মৃদুল তোমার পিতার কথায়
পিছুটান আর অতীত বলার ঝোঁক।
এক লহমায় হয়ে যান তিনি
সেই কবেকার যোগী নগরের লোক।

দিনেমারদের গির্জা অথবা
গঙ্গার তীরে দেখিনি চন্দ্রলেখা।
আরেকটি দিন থেকে গেলে মানি
ইতিহাসময় কত কিছু যেত দেখা।

আমার এমন পর্যটনেই
ফুল চন্দন পড়ে খুব অগোচরে।
আমি তো পঞ্চ ব্যঞ্জন পেয়ে
সোজা চলে গেছি তোমার রান্নাঘরে।

বিদায় জ্ঞাপনে অনিচ্ছা বাজে,
সিক্ত হৃদয় ভাসে বেহাগের সুরে;
পাখির বিলাপ ধুলায় গড়ায়
কেরি সাহেবের, তোমার শ্রীরামপুরে।

পোড়ায় আমাকে

ব্যাপারটা এ-একম-আমার পাড়ায় একজন
সংগীতসাধক, বুড়ো, বহুদিন থেকে
করছেন বসবাস, অত্যন্ত একাকী। নিত্যসঙ্গী তাঁর শুধু
একটি সরোদ; কেউ কেউ
আসে কোনো কোনো দিন সুরে স্নাত হতে
অথবা তালিম নিতে। যখন সে প্রবীণ সাধক কোলে নিয়ে
সরোদ করেন স্পর্শ তার,
তখন আঙুল তাঁর হয়ে ওঠে নিমেষে তরুণ। সুরে সুরে
জীর্ণ ঘরে মেঘ জমে, ডুমুর পাতায়
রোদ ঝলসায়, হরিণের মখমলী চোখ ভাসে,
ঝরনা বয়, পাতা ঝরে, থরে থরে ফোটে
রাজনর্তকীর মতো গোলাপ এবং
সাধক সরোদে লীন। এভাবেই ক্রমে নটে গাছ
মুড়োয়, অথচ ফুরোয় না সুর সাধা।

একদিন ভোরবেলা প্রবীণ সাধক বাজাচ্ছেন
জগৎ সংসার ভুলে গভীর ভৈরবী। সেই সুরে
খুলে গেল পথ, জ্যোতির্ময়,
দূর আকাশের দিকে। অকস্মাৎ পাড়াটা চেঁচিয়ে
ওঠে, যেন বাজের আওয়াজ চতুর্দিকে
ফেটে পড়ে বারবার। পাড়া থেকে নামে মানুষের ঢল পথে,
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে, মাতে হৈ হল্লায়, তামাশায়।
নিজেই সরোদ হয়ে বেখবর সরোদীয়া বেজে চলেছেন অবিরাম,
অথচ নিভৃত রাগমালা
ডুবে যায় শহর-কাঁপানো কোলাহলে। আমি সেই
প্রবীণ শিল্পীর সাধনার শ্বেতপদ্মটিকে বুকে
নিয়ে একা রাস্তায় দাঁড়াই,
অরণ্যে রোদন শুনে গহন বেহাগ হয়ে যাই অগোচরে।
যত ভাবি, সেই ঘটনার ভস্ম বারবার
মাখব না গায়ে,
তত এক নাছোড় আগুন
দীপকের মতো খুব অন্তরালে পোড়ায় আমাকে।

প্রত্যাখ্যান

বেড়ে যায়, বেড়ে যায় কেবলি চাহিদা আমাদের।
অকস্মাৎ করতলে এটা ওটা এসে গেলে ফের
অনেক কিছুর জন্যে বাড়ে কাতরতা; দশ কাঠা
জমি জুড়ে বাগানসমেত বাড়ি চাই, তক্‌মা-আঁটা
চাপরাশি চাই, ধনী শ্বশুরের সবচেয়ে সুন্দরী
কন্যাটিকে পাশে নিয়ে শোওয়া চাই, চাই তড়িঘড়ি
মায়াবীর জাদু বলে বেড়ে যাক কারবারি পুঁজি,
সিঁড়ি নক্ষত্রের নীড়ে পৌঁছে গেলে সুখ। আজ বুঝি
ক’দিন বৃষ্টির পরে ঝকঝকে রৌদ্রের কাতান
কেন মনে হয় মুণিবধূ মৈত্রেয়ীর প্রত্যাখ্যান।

 পড়েছে শীতের হাত

ফ্ল্যাট বাড়িটাকে মৃদু চাবকাচ্ছে ঘন ঘন এই
শীত, পঞ্চাশোর্ধ্ব ত্বকে দাঁত
বসায় তাতার হাওয়া। গৃহিণীর হাতে বোনা সোয়েটার গায়ে,
খাঁজময় গলায় জড়ানো
প্রেমিকার আদরের মতো কস্ফার্টার, বারবার
হাত ঘষে খানিক আরাম
পেতে চাই। সে কখন থেকে রোদ্দুরের প্রত্যাশায়
বসে আছি, জেগে আছি নাকি
তন্দ্রার গুহায়
ঢুলছি একাকী ক্রমাগত? বয়ে যায় চারপাশে
স্রোতের ধরনে কিছু। প্রাগৈতিহাসিক
পানি প্রত্যুষের
গাল বেয়ে নামে আর গাছের সবুজ
চোখ থেকে খ্রিস্টপূর্ব রূপসীর অশ্রুর মতোই
টপ টপ করে পড়ে শিশিরের জল।

হাওয়া বয়, হাওয়া বয়, বড় কষ্ট হয়
দু’পায়ে মাড়িয়ে যেতে ভোরের শিউলি,
মমতা জড়িয়ে আছে ঝরে-পড়া শিউলির ঘ্রাণে।
আশেপাশে আড়চোখে তাকিয়ে ঈষৎ
কে বালিকা বধূ
কুড়ায় শিউলি তার সলজ্জ আঙুলে,
যেন সে নিঃশব্দে নিচ্ছে তুলে নিরিবিলি
নিজেরই শৈশব।

টিনের পাতের মতো কুয়াশা রয়েছে
পাতা এক ফালি মাঠে আর
ফুটপাত-ঘেঁষা ঘাসে কে যেন দিয়েছে রুয়ে টলটলে ফুল,
কী শুভ্র জলজ। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একা-একা হেঁটে যেতে
আজও ভালো লাগে। এরকম ভোরবেলা
শাল মুড়ি দিয়ে একা নিঃশব্দে কে যায়?
তুখোড় ঘাতক নাকি হঠাৎ শহরে চলে-আসা
দেবদূত, খেয়ালী, অপটু। হয়তোবা
পেটরোগা, স্বাস্থ্যান্বেষী প্রৌঢ় কোনো, ঘরে যার আছে
আইবুড়ো মেয়ে, যাকে পাড়ার বখাটে যুবকেরা
করেছে ক্রমশ খর জিভের খোরাক, আল্লা যার
চোখে ঢেলে দেন
ঘড়া ঘড়া পানি, স্বপ্ন যার সেরামিক
তৈজসের মতো হয়ে যায় খান খান।
শিশির-নিমগ্ন ঘাসে রোদের ঝিলিক দেখে তার
মনে পড়ে শৈশবের গ্রাম।

স্মৃতি ওড়ে ঝাঁক ঝাঁক, যেন
অন্তহীন পথ
নির্ভুল পেরিয়ে-আসা পরিযায়ী সবুজ খঞ্জনা। মনে পড়ে
শীতভোরে ফজরের নামাজের পরে
নানা ভাই রেহেলে কোরান রেখে ঘন কুয়াশার
নেকাব-সরানো
প্রথম আলোর মতো আয়াতের শুদ্ধ উচ্চারণে
দুলে দুলে কোঠাবাড়িটাকে
কেমন সঙ্গীতময় করে তুলতেন,
আমার রূপসী নানি হ্যারিকেন নিভিয়ে যেতেন
রান্নাঘরে, টাটকা পিঠের ঘ্রাণে জিভে
ঝরনাধারা যেত বয়ে আর মাতামহের পবিত্র
আয়াতের সুরে সুরে আমার চোখের পাতা জুড়ে
সাইবেরিয়ার
সোনালি বাটান পাখি বসত কোমল, আজ আমি
সেই সুর থেকে দূরে, বহুদূরে। শুধু মনে পড়ে
সেকালে হিমেল
সকালে কবিতা তার কুঙ্কুমের দাগ অগোচরে
আমার কপালে রেখে গ্যাছে।

কুয়াশার ঘেরাটোপে ঢাকা এ শহর
ঢাকায় হঠাৎ
সুজাতাকে মনে পড়ে। তার
ঘরে শীত আজ
মৃত্যুর ঠোঁটের মতো জমে থাকে, ঘরের ভেতরে
এতটুকু তাপ নেই, গরম পানির
ব্যাগ কাছে টেনে নিয়ে সুজাতা এখন বড় একাকিনী
শুয়ে আছে বেগানা পশ্চিমে। হাড়ে তার
চুপিসারে হিম ঢুকে পড়ে,
যেনবা সিঁধেল চোর, রাত্রির তৃতীয়
প্রহরেও সুজাতার চোখ জ্বলে অনিদ্রায়
সুলেমান বাদশার রত্নের মতন।
কী এক যন্ত্রণা তাকে সেঁকছে ভীষণ কড়া আঁচে
বারবার। কেবল চুম্বন নয়, নবজাতকের মুখও চায়
শেষমেশ মেরুন রঙের তার স্তনের বোঁটায়।

সৌন্দর্যের দিকে হাত বাড়াই, অথচ মধ্যপথে
হাত, বলা যায়, প্রায়
শিলীভূত, এই শীতে, প্রিয়
ওষ্ঠে ঠোঁট রাখবার মুকুলিত সাধ
তুষারের নিচে
চলে যায় অকস্মাৎ, যে-পাখি গাইতে
আসে গান আমার উদ্যানে
নিমেষে কবন্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আমি
কাঁদতে গিয়েও
কান্না ভুলে যাই, শুধু হি হি কেঁপে উঠি
নিজেকেই
কবরে শায়িত দেখে। মেয়ে হস্টেলের
অনূঢ়া ছাত্রীর হু হু যৌবনের মতো
শীতের দুপুর ঢলে পড়ে
বিকেলের কোলে।
আমি যেন সেই শীতকাতুরে একাকী
ভগ্নকণ্ঠ পাখি,
যে প্রাচীন ধ্বস্ত নগরীর বিরানায় গান গায়
অত্যন্ত বেসুরো,
ঘোরে না খাদ্যের খোঁজে আনাচে-কানাচে,
মেদমজ্জা ক্ষয়ে গ্যাছে, হাড়
পুড়ে পুড়ে হয়ে গ্যাছে কালি, মরা ঘাস
ওড়ে কালো ধ্বংসস্তূপে বেহাগের সুরে।

পড়েছে শীতের হাত গাছগাছালিতে, শস্যক্ষেতে,
পুকুরের ঘাটে, হাটে, হাই-রাইজ দালানে
সংসদ ভবনে, রক্তাপ্লুত কসাইখানায়, লঞ্চ
টার্মিনালে
দোকানে, সাইনবোর্ডে, কলোনির বারান্দায়, সোফাসেটে আর
ফুটপাতে পশুর ধরনে
শুয়ে-থাকা মানুষের বিপন্ন কাঁথায়,
কুলিকামিনের
আগুন-পোহানো রাতে, নেশামগ্ন মেথরপট্রিতে।
কেবল পড়েনি
আমার হৃদয়ে, নইলে কী করে এমন
হিমাতুর রাতে
হৃদয়ের তন্তুজালে বসন্ত মল্লিকা সারাভাই
হয়ে যায় আর তার মুদ্রা থেকে পবিত্র তাপের
বিচ্ছুরণে সেজে ওঠে আমার গোপন
কবিতার খাতা?

ফিরে তাকাব না

শপথ নিলাম, কিছুতেই ফিরে তাকাব না আর।
পেরিয়ে এসেছি বহু দীর্ঘ পথ, পায়ে বহু ক্ষত,
দগদগে, তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই
শুকোবে এ ক্ষত, মুছে যাবে এই মুখের আঁধার।
তুমি এসো, অতিশয় শীতল কুয়াশা ফুঁড়ে দ্রুত
তুমি এসো; ভয় নেই, কিছুতেই ফিরে তাকাব না।
আমি কি অচেনা কেউ? এখনও কি চিনতে পারোনি?
আমার হাতে কি তুমি দেখতে পাওনি কোনো বাঁশি?
এখনও তুলতে পারি কত সুর সামান্য বাঁশিতে,
সেই সুর শুনে পাখি এখনও সান্নিধ্যে আসে, নুড়ি
গড়াতে গড়াতে চলে আসে কাছে, পশুরা হিংস্রতা

ভুলে যায় নিমেষেই এবং বাঁশির সুরে সব
নরখাদককে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি, প্রত্যেকটি
প্রহরীর দৃষ্টিপথে মায়াপুরী তৈরি করে আমি
এখানে এসেছি মেয়ে, তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।
কিন্তু তুমি দূরে সরে যাচ্ছ কেন? কেন ছায়া হয়ে
মিশে যাচ্ছ অধিক গভীরতর ছায়ার ভেতর?
ধাবমান হোন্ডায় আজরাইল, তুমি তার ব্যাক
সিটে ভাবলেশহীন, যেন অতিশয় সাদা এক
মুখোশ রয়েছে সেঁটে মুখে, বুকে হিম স্রোত বয়।
তবে কি তোমাকে দেখে ফেলেছি হঠাৎ পুনরায়
সর্বনাশ লোভে? ফিরে এসো, আর ফিরে তাকাব না।

ফুলচোর

অন্যের বাগান থেকে যে-বালক সাততাড়াতাড়ি
ছিঁড়ে নেয় কিছু ফুল, নই যদিও লুণ্ঠনকারী,
তারই মতো চুরি করে ফেলি
বেলাবেলি
তোমাকে অন্তত
দু’চার ঘণ্টার জন্যে। ঠিক প্রথামতো
চৌর্যবৃত্তি আখ্যা দিয়ে একে
আমাকে পরাতে কেউ পারবে না হাতকড়া। বেঁকে
বসলে পাড়ার পাঁচজন, যদি বসে
সত্যি সত্যি তাদের স্ববশে
আনব স্মৃতির সরোবরে চকিতে নামিয়ে আর
জানিয়ে সালাম পাঁচবার।

ফুটে আছ দূরে তুমি, এই দুটি হাত
পৌঁছে না সেখানে কোনোমতে, হায়, এমনই বরাত-
তবু রাত্রি এলে
আমার নিবাসে কারা মোমবাতি জ্বেলে
জুড়ে দেয় ঘূর্ণি নাচ এবং আমাকে ফুলচোর
খেতাবে ভূষিত করে। তিনটি নাছোড়
নারী চন্দনের টিপ আমার কপালে
এঁকে শুধু বিবাহ বিবাহ বলে উড়ে গিয়ে উঁচু মগডালে
বসে দোলে অর্চনার মুদ্রাঙ্কিত সত্তায়, পাখিরা
জেগে উঠে সোলেমান বাদশার আংটির হীরার মতো হীরা
কেবলি ঝরাতে থাকে চোখ
থেকে, যেমনটি ঘটে রূপ-কাহিনীতে, যত অসম্ভবই হোক।
অন্ধকার ঘরে একা বসে ভাবি-
আমার সকল চাবি
স্বেচ্ছায় আন্ধারে ফেলে দিয়ে বন্দি হয়ে আছি স্মৃতির নিবাসে
কতকাল, যে শব্দই আসে
কানে, মনে হয় তার পদধ্বনি। নিজেকেই ফুলচোর মেনে
এ কেমন বেড়ি ক্রমাগত যাচ্ছি টেনে?
রাত্রির তৃতীয় যামে শুনে অচিন পাখির শিস
হঠাৎ চমকে ওঠে সশস্ত্র পুলিশ।

বৃক্ষ বৃত্তান্ত

এখানে একটি গাছ, শোনা যায়, বহুকাল থেকে
দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠায় সন্ন্যাসীর মতো। লোকে বলে,
একদা এক গাছে ছিল ফলের বিস্ময়
ঋতুতে ঋতুতে, আজ আর
তার কোনো ডালকে হাসিয়ে থরে থরে দূরে থাক,
ধরে না একটি ফলও। পথচারী যারা,
তারা কিছুক্ষণ
দাঁড়ায় গাছের নিচে ছায়ায় ভিজিয়ে
নিতে বড় রোদপোড়া শরীর তাদের। কিন্তু নাকে
আসে না ফলের ঘ্রাণ। তাই
বিশ্রাম ফুরালে ওরা চলে যায় নাক সিঁটকিয়ে,
কেউ কেউ প্রস্থানের আগে
কৃতজ্ঞতাবশত তাকায়
গাছটির দিকে স্নেহশীল চোখে একবার, বলে
মনে মনে, ‘থাকুক সে এমন অক্ষয়
শতেক বছর আরও’।
পাড়ার উঠতি যুবকেরা।
ক্রমে গাছটির নিষ্ফলতা নিয়ে বড়
অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। একদিন ওরা ঢাকঢোল
বাজিয়ে গাছের নিচে পঞ্চায়েত ডেকে-
মাঝে মধ্যে দুলে ওঠে ছায়ার চামর অগোচরে-
শাণিত কুড়ুলে
বহু বছরের ঝড়জল সরে যাওয়া
গাছের শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলার সম্মিলিত
জোরালো প্রস্তাব করে পাঠ। একজন নিরক্ষর, বুড়োসুড়ো
লোক প্রস্তাবের প্রতি উদাসীন, যার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গাছের
শেকড়বাকড় তুল্য নিবু নিবু চোখে
দেখেন গাছের
সমগ্র অস্তিত্ব থেকে চুইয়ে চুইয়ে
সবার অলক্ষ্যে ঝরে ক্রমাগত মূক অশ্রুজল।

 বেদেনীর জন্যে

তন্বী বেদেনী বউটি তোমার হারাল কোথায়?
কোথায় উজাড় করলে তোমার ভরা ঝাঁপি?
ফোলা ঠোঁট দেখে উদ্বেগ গ্রীবা বাড়ায় কেবলি,
শত শত ঘোড়া খুর ঠোকে মনে, ভয়ে কাঁপি।

হৃদয়ে আমার গোধূলি বেলায় জ্বেলেছে দেয়ালি
তোমার অমন চোখের দু’ফোটা কালো আলো।
তন্বী বেদেনী এ শহরে তুমি কেন এসেছিলে?
তোমার সংগে দেখা না হলেই ছিল ভালো।

মনে পড়ে আজ তোমার শরীর থেকে উঠে আসা
নদীর এবং গাছগাছালির বুনো ঘ্রাণ;
অঙ্গ তোমার কালো বিদ্যুৎ, প্রতিটি ঝলকে
চমকে উঠছে খুব সহর্য এই প্রাণ।

তোমার বুকের বাটিতে কটির মালায় এবং
নাভির কোটরে বসন্ত রাগ কী নিবিড়।
খোঁপার কৃষ্ণ মধুকোষ থেকে ঝরে মধু, তুমি
সে-মধু মিশিয়ে ছুড়েছ আমার দিকে তীর।

তোমার পাছাটা, কুমোরের গড়া পুরুষ্ট ঘড়া,
ভাসে জ্যোৎস্নায়, যখন এ-পথে যাও হেঁটে।
আকাশের নীড় ছেড়ে জ্বলজ্বলে অজস্র তারা
চুমো খেয়ে যায় তোমার উদোম তলপেটে।
আমার দৃষ্টি তোমার আতশী সত্তার তটে
শামুকের মতো চলে অবিরাম ঢিমে তালে।
নির্যৌবন আমি বড় একা, ভরা যৌবন
তোমার বেদেনী, যেনবা লেগেছে হাওয়া পালে।

নীল আয়নায় বিকীর্ণ শোভা, ভেসে ওঠে মুখ
তোমার আমার। ইঙ্গিতে ডেকে নিয়ে গেলে
গোলাপ বাগানে; চুম্বনে ছিল পাখিদের গান,
হৃদয়ের তাপ সেখানে এসেছি কিছু ফেলে।

চকচকে, চুল, ঠোঁটে ছিল স্বাদু পানের সোহাগ,
কথায় কথায় দুলছিলে, তুমি গোধূলিতে,
যেন তরঙ্গে চিকন নৌকা। আমার সমুখে
ধরেছিলে মেলে রঙিন রুমাল ঘ্রাণ নিতে।

সে রুমালে ছিল অদ্ভুত এক নকশা কেমন;
মনে হয় বুঝি, অথচ যায় না কিছু বোঝা।
হাজার সূর্য ডুবে যাবে শুধু অর্থ খুঁজতে,
খুঁজেছি অনেক এবং চলছে আজও খোঁজা।

রুমালের রঙে মিশেছিল রঙ কিছুটা যেনবা
গোলাপের মতো আর জহরের মতো কালো;
তোমার মদির আশ্লেষে আছে মৃত্যুর ফণা,
তোমার সঙ্গে দেখা না হলেই ছিল ভালো।

বোধ

ফ্ল্যাট বাড়িটার তেতলার জানালায়
চুড়ি পরা হাত, দীর্ঘ খোলা চুলে চিরুনি-আদর, দাঁত
মাজতে মাজতে তরতাজা যুবক বেরিয়ে আসে
গলির ভেতর থেকে, টগবগে তেলের কড়াইয়ে
ভাজা হচ্ছে ডালপুরি, মগে গরম চা,
বুড়োসুড়ো একজন, গায়ে
শাল, লাঠি হাতে
একলা হাঁটেন পথ এক ঝাঁক সাদা-কালো
কবুতর গম খায়
আলোময় মাটিরঙ ছাদে, জানালার
পর্দা চমকায়
হাওয়ায় ছোঁওয়ায়, কিছু বাসন-কোসন
হচ্ছে ধোওয়া; কলতলা গুঞ্জরণময়,
পুরনো দেয়াল থেকে ঝুলে-পড়া নৌকা, নির্বাচনী পোস্টার, বাতিল,
নৌকো হচ্ছে বালকের হাতে, পোস্টম্যান
দূর থেকে-আসা চৌকো খাম, ম্যাগাজিন দিয়ে যায়; দীর্ঘকাল পরে
ফিরছে হাসপাতাল থেকে ঘরে রোগী,
বেনারসী শাড়ির মতন
রোদ বস্তিটার ছাদে-
ঘর দোরে প্রজাপতি,কে মেয়েলি কণ্ঠে ‘মতি মতি’
বলে ডেকে ওঠে,
অগাধ বিস্ময়ে দেখি, পাখি ওড়ে
ছড়িয়ে আমার মনে জ্যোতির্ময় বোধ।

মরণোত্তর

লোকটাকে দেখতে সুন্দর বলা যাবে
কিনা, এ বিষয়ে
মতভেদ থাকা
বিচিত্র কিছুই না। তবে সকলেই
সমস্বরে এ-কথা বলবে, তার কথা বলবার
ধরনে একটা কিছু আছে, যা সহজে
টেনে আনে ভিড়, ওর কথা
শোনে লোকে কান পেতে ঝাল মুড়ি, ছোলা ভাজা আর
চীনে বাদামের মজা চিবোতে চিবোতে। আজনবি
বহুদূর থেকে
এসেছে এখানে রহস্যের ঘ্রাণ নিয়ে। ছিল তার
পোশাক-আশাকে কিছু দূরত্বের ছাপ।
তাকিয়ে ভিড়ের দিকে পাখির ধরনে
যখন সে আকাশের দিকে
তর্জনী উঁচিয়ে বলল, এই দারুণ খরায় আমি
চোখের পলকে
নামিয়ে আনতে পারি শ্রাবণের ফুলঝুরি; এই
ভয়ানক পুষ্পহীনতায়
এক্ষুণি ফুটবে ফুল হরেক রকম,
যদি আমি ফোটাই আমার হাতে একটি বিশেষ
মুদ্রা, ভাইসব,
তখন অনেকে তার উচ্চারণে ধ্রুবতারার ঝলক দেখে
শিহরিত হলো, কেউ কেউ খুব জোরে
হেসে উঠে অবিশ্বাসী প্রকরণে হলো মনোযোগী।
চতুর্দিকে থমথমে নীরবতা। লোকটা হাতের
যাবতীয় মুদ্রা কী সহজে ফোটাল, অথচ তার
সকল উদ্যম ফলহীন
গাছের মতোই সে বিশাল জনসভায় থমকে
থাকে; দুয়ো ছুটে আসে তার
দিকে দশদিক থেকে, পাথর ও নুড়ি
ভীষণ ছুড়তে থাকে অনেকেই। রক্তাক্ত শরীরে
নিষ্প্রাণ সে পড়ে থাকে ভয়ানক ভেঙে-যাওয়া পুতুলের মতো।

যখন প্রান্তর
জনহীনতায় ফের রহস্যজনক হয়ে ওঠে,
তখন হঠাৎ নাচে খই বৃষ্টির এবং রঙ-
বেরঙের ফুল ফুটে ওঠে বন্ধ্যা মাটিকে হাসিয়ে।

রোমকূপ কেঁদে ওঠে

হৃদয়ে আমার তুমিই গড়েছ
নয়া আঙ্গিকে
স্বপ্নের টেরাকোটা;
তৃষ্ণাকাতর জীর্ণ শাখায়
প্রহরে প্রহরে
ঝরে অমৃতের ফোঁটা।

আমার সময় খুব বেশি নেই,
এই পর্যায়ে
সব কিছুতেই তাড়া।
বাকি পথ আমি কীরকম ভাবে
পাড়ি দেব বলো
সুজাতা তোমাকে ছাড়া?

মহাজাগতিক তন্তুজালের
রহস্য কত
এখনও রয়েছে ঢাকা।
তারও চেয়ে বেশি রহস্যময়
তোমার গহন
সুনিবিড় চেয়ে-থাকা।
তুমি যাকে ভালোবাসতে একদা
তার ছায়া কেন
আমাদের মাঝে পড়ে?
সেই ছায়াটির মৃদু কম্পনে
আমার নতুন
স্বপ্নেও ঘুণ ধরে।

এই অবেলায় হৃদয়ে আমার
পড়েছে তোমার
ফুল্ল পদচ্ছাপ।
তোমার হাতের স্পর্শে এবং
উষ্ণ চুমোয়
ভুলেছি মনস্তাপ।

নিসর্গে আমি তোমাকেই দেখি,
তোমাতে প্রকৃতি
পেয়ে যায় অবয়ব।
তোমার শরীরে আজো জ্বলে ওঠে
যখন তখন
বর্ণিল উৎসব।

পেয়েছি তোমাকে, ভাবি কৃপণের
সঞ্চয়ী টানে,
পাখি হয়ে নাচে মন।
কিন্তু তবুও না পাওয়ার ধু-ধু
আঁধিঝড় কেন
প্রাণে তুলে আলোড়ন?
শারদ দুপুরে, হেমন্ত-রাতে
আমার প্রতিটি
রোমকূপ কেঁদে ওঠে।
অন্ধ কাঙাল পথে চেয়ে থাকি;
ব্যর্থ ওষ্ঠে
বিষাক্ত ফুল ফোটে।

সকাল থেকে সন্ধ্যা

সকাল থেকে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা থেকে সকাল একজন লোক
কী-যে করে, সবাই
ভারি তাজ্জব। বোঝা যায়, ওর ঝোঁক
কেবলি পালিয়ে বেড়ানোয়;
কিছু একটা খোঁজা ওর চোখ দুটোয়
মানচিত্র দিয়েছে এঁকে। ‘এই ভাই
কেন তোমরা এমন স্বভাব’ এ-কথা কেউ কেউ জিজ্ঞেস করতে
গিয়েও থম। কলতলায় পানি ভরতে
তাসা আইবুড়ো মেয়ে,
যার গা বেয়ে
যৌবন ঝরছে ব্যর্থতায়, চা-খানার ছেঁড়া হাফ-প্যান্ট-পরা
ছেলেটা, মনিহারি দোকানদার
আর ছেলেভোলানো ছড়া
কেটে বেড়ানো বুড়ো, যার
হাওয়া-ওড়া চুলে
মেহেদির ছোপ,
‘এই দুনিয়া পায়রার খোপ
বৈ তো নয়’ শব্দগুলো যে ফকিরের কণ্ঠে বাজে,
তারা প্রত্যেকেই লোকটার গতিবিধিকে প্রশ্নাধীন করে তুলে
ফের মন দ্যায় নিজ নিজ কাজে।

লোকটা কখনো ফুটপাতে, কখনও টানেলে,
কখনোবা ময়দান ছেড়ে নক্ষত্র-ছাওয়া পথে খুব একা
চুপিসারে পা ফেলে
এগোয়, যাতে কারো সঙ্গেই দেখা
না হয়, কখনো ভোঁ দৌড়ে গলির ভেতর
উধাও বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়। অষ্টপ্রহর সবার চোখে ধুলো
দিয়ে খোঁজে ঘরের ভেতর ঘর।
পাড়ার রঙ-বেরঙের লোকগুলো
জানে লোকটা কারো কোনো ক্ষতি
করবে না কিছুতেই। হাতে কখনো লাঠি
নেয় না তুলে, দা কুড়োল নদারৎ,
গলায় খেলিয়ে স্বর্ণচাঁপা জাগানো গৎ
পথ হাঁটে, নাড়ে না তুখোড় ভঙ্গিতে কোনো কলকাঠি;
তবে বোঝা দায় তার মতিগতি।

লোকটার মুখের আদলে
কেউ কেউ বলে, রহস্যের তুলি বুলিয়ে দিয়েছে অচিন
রঙ, আসলে
সে লোকচক্ষু থেকে সারাদিন,
সারা রাত কষ্টেসৃষ্টে আগলে রাখে
ধুকপুক বুকে নিজস্ব কিছু স্বপ্ন, যেমন বিপদে কান-খাড়া পাখি
তার শাবকগুলোকে ঢাকে
পাখায়। আমি, সত্যি বলতে কী, নিগেটিভ ছবির মতো
লোকটার পাশেই থাকি,
আমার হাতের চেটোয় তার বুকের রক্ত ঝরে অবিরত।

সকালবেলা চেয়ে দেখি

একটি মেয়েলি কান্না আমাকে ছিনিয়ে
আনে অকস্মাৎ
ঘুমের প্রবালদ্বীপ থেকে। তড়িঘড়ি জানালার ধারে যাই
চোখ রগড়াতে রগড়াতে, বিরক্তির
পিঁচুটি হাতের চেটো দিয়ে
মুছে ফেলে; একটি লোককে ঘাড় ধরে
হিঁচড়ে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ক’জন যুবক। তার,
মানে লোকটার, গা উদোম,
সমস্ত শরীরে ওর ঘুম
হাল্কা শুয়ে আছে
কুয়াশার মতো
তখনো, রাস্তায় কিছু লোক, যুবা, প্রৌঢ়,
দাঁড়ানো কেমন নির্বিকার
এবং আমিও
ফ্ল্যাট বাড়িটার জানালার ধারে পাথুরে পুরুষ,
অনীহা, আলস্যে বুঁদ।

লোকটা কে? কারা তাকে ওরকমভাবে
নিয়ে গেল? কোথায় এবং কেন? লোকটা কি অপরাধী? কার
কাছে ওর অপরাধ?
সেই যুবকেরা,
কেন একজন মানুষকে
কোরবানির পশুর মতন
ঘষটাতে ঘষটাতে পাড়ার নাকের তলা দিয়ে নিয়ে যাবে?
মনে মনে শহরকে মগের মুল্লুকে আমি অনুবাদ করে নিই।

যে মেয়েলি কান্না ভোরে আমার ঘুমের
দ্বীপটিকে ভীষণ গুঁড়িয়ে দিল তা কি লোকটার
মায়ের হৃদয় চিরে এমন ডুকরে উঠেছিল, নাকি ওর
গৃহিণীর বুক থেকে? বালবাচ্চা আছে
তার? সে কি ঘরে ফিরে আসবে কখনো?
সাত-পাঁচ ভেবে
বাথরুমে গিয়ে টুথব্রাশ দাঁত মাজতে মাজতে
বরীন্দ্রনাথের গান গুন গুন করি!

সৌন্দর্যের গুণ গেয়ে

সৌন্দর্যের গুণ গেয়ে দিন
কাটাতে আমার ভালো লাগে। তাই আমি
তোমার প্রশংসা করি একজন ধার্মিকের ধরনে এবং
যে তোমার সৌন্দর্যে কখনো
অভিভূত নয়, তাকে মিত্র বলে গ্রহণ করতে সর্বদাই
সাত হাত
সতর্ক পিছিয়ে থাকি। সঙ্গীতের মূর্ছনায় তোমার রূপের
বন্দনা আমার কৃত্য নিত্যদিন আর
তোমার আসার
প্রত্যাশায় আমার দু’চোখ
এভাবে পথের দিকে চেয়ে থাকে, যেমন সহিষ্ণু টিকটিকি
তার শিকারের প্রতি। কখন আসবে
তুমি ফিরে আমার নিবাসে? সারাক্ষণ
অর্চনায় মগ্ন থাকি। তোমার দুর্নাম
রটনাকারীকে দুর্বাশার
ক্রোধে ভস্ম করি পাঁচবার, চারটি পাখিকে আমি
টুকরো টুকরো করে
ছুড়ে দিয়ে পাহাড় চূড়ায় ডেকে আনি পুনরায়
স্নেহের ছায়ায়। ভাগাড়ের কাছাকাছি
বাজপোড়া নীড়ে করি অবেলায় একা তোমার রূপে স্তব।

Exit mobile version