Site icon BnBoi.Com

অবিরল জলভ্রমি – শামসুর রাহমান

অবিরল জলভ্রমি - শামসুর রাহমান

অনাথ আশ্রমে

আকাশে নিমগ্ন শারদ রোদ্দুর,
শস্যদানা খুঁটে তিনটি হাঁস খায়।
নামিয়ে মাঝপথে যাত্রী কতিপয়
দৃশ্য থেকে ফের দৃশ্যে বাস যায়!

অতীত-চেরা মৃদু আলোর ঝলকানি-
দাঁড়ানো ছিলে তুমি একলা গৃহকোণে।
বিবাগী মেঘ বুঝি গাছকে চায় ছুঁতে,
তোমার চোখ দুটি কুহক জাল বোনে।

শহরতলী দিলো বাড়িয়ে বাহু তার,
ছুটির দিন যেন গুণীর হাতে বীণ;
তোমার দৃষ্টিতে হৃদয় বিম্বিত,
সেদিকে তাকালেই আমার বাড়ে ঋণ।

তোমার ওষ্ঠের ব্যাকুল তট জুড়ে
স্তব্ধ ছিল কথা সেদিন প্রথমত,
এবং আমাকেও বন্দি করেছিল
কে এক মূক লোক দুপুরে মুখ্যত।

পথের ধুলো ধুয়ে দিঘির কালো জলে
চকিতে চেয়ে দেখি ভেসেছে ঘাটে ঘড়া।
আমার পাশে তুমি শরীরে নিয়ে ঢেউ
গহন নিসর্গে হলে স্বয়ম্বরা।

পড়ে না দৃষ্টিতে শরীরজোড়া শাড়ি,
বাকল গেছে এঁটে প্রখর যৌবনে।
শিরায় ছোটে কত যুগের হরিণেরা,
তৃষিত ঠোঁট রাখি তোমার যৌবনে।

নিমেষে খসে যায় মদির আদিমতা,
তোমার সত্তায় লজ্জা পুষ্পিত,
আমিও ভব্যতা আবার ফিরে পাই,
লোকের কথা ভেবে ঈষৎ হই ভীত।

সাজালে চৌকিতে পঞ্চ ব্যঞ্জন,
শরীরে চুমো খায় হাতপাখার হাওয়া।
রাখবে চোখে তুমি হাতের নড়া গেঁথে,
দেখবে গোধূলিতে আমার চলে-যাওয়া।
আমার অন্তরে তোমার অঞ্জলি
অর্ঘ দেয় মেলে, ঋদ্ধ হই আমি।
কখনো এ-অর্ঘ অসার হয়ে যাবে-
এ-কথা সরাসরি বলতে গিয়ে থামি।

শহরে ফিরে গিয়ে হয়তো ভুলে যাবো,
দগ্ধ মনে কত স্মৃতির ধোঁয়া জমে।
কখনো এটা আর কখনো ওটা ভুলি,
তোমার প্রেম বাঁচে অনাথ আশ্রমে।

অপদার্থের গান

কী চাও আমার কাছে বন্ধুরা এখন? ইতোমধ্যে
পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছি, চুলে পাক ধরেছে বেবাক
অনেক আগেই, কোনো কোনো দাঁত খুব নড়বড়ে,
চোখে কম দেখি ইদানীং, প্রায় অদৃশ্য পৃথিবী
চশমা ব্যতীত আর শিরায় শিরায়
মাঝে মাঝে রক্ত ফুঁসে ওঠে,
তখন দাঁড়ানো কিংবা বসে থাকা নয়,
বিছানায় শুয়ে থাকাটাই
সমীচীন মনে হয়। আইঢাই করে প্রাণ হর-
হামেশাই; মোট কথা, স্বাস্থ্যের আকাল
আমার অস্তিত্ব ঘিরে। তাই বলি, যখন আমার বাস্তবিক
এই হাল, তখন আমার কাছে কার কী পাওয়ার থাকে আর?

তোমাদের জ্বলজ্বলে সারিতে দাঁড়ানো
সাজে না আমাকে। যতদূর মনে পড়ে
কখনো শৈশবে দস্যুতায় ভাঙিনি পাখির বাসা,
এবং খেলায় মেতে ছিঁড়িনি প্রজাপতির পাখা আর রঙ-
বেরঙের বেড়াল ছানাকে ডুবাইনি নর্দমার নোংরা জলে
অথবা যৌবনে বন্দুকের নল আমি
কখনো করিনি তাক কাজল বিলের ঝাঁক ঝাঁক
বালি হাঁস, সুন্দরবনের কোনো হরিণের দিকে।
এত অপদার্থ আমি যে সুযোগ পেয়েও একালে
কোনো অস্ত্র, এমনকি তীর ও ধনুক, হায়, চালাতে শিখিনি।

এই যে দেখছো যাকে সে নেহাত স্তিমিত পুরুষ,
গানে-পাওয়া, নানা ছদ্মবেশী নেকড়ের তাড়া-খাওয়া,
উদাসীন, শব্দের ধীবর,
একে দিয়ে কী এমন কাজ হবে তোমাদের? আজ
কেবল ক্ষমাই প্রাপ্য তার। যদি সে দাঁড়ায় পাশে,
মুগ্ধাবেশে দ্যাখে তোমাদের, তবে তাকে
করবে কি অবহেলা? যতই আসুক ব্যেপে নৈরাশ্যের কালো
পঙ্গপাল, অন্তত সে বাঁচার অভ্যাসে নয় বীতরাগ।

আমার অভদ্র পদ্য

আমার অভদ্র পদ্য পাৎলুন গোটানো, খালি পায়,
মধ্যবয়সের গাঢ় তামাটে রঙের
ছোপ নিয়ে গাঢ় শিস দিতে দিতে কুর্নিশ ছাড়াই
কুলীন ড্রইংরুমে ঢুকে পড়ে বলে,
‘আমাকে বসতে দিন চেয়ারে সোফায়। কঁচুমাচু, হাত জোড়
করে এক কোণে
দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি আয়ত্ত করিনি, সমাজের মধ্যমণি
আপনারা, জেনে
রাখুন, নাছোড় এই বান্দা। এখানে রয়েছে যারা
ধান্দাবাজ ফোঁপরদালাল সাধুবেশে
অসাধুর শিরোমণি, তাদের মুখোশ টেনে খুলে
ফেলবো নিমেষে আর আমার ঝাঁঝালো অট্রহাসি
ভীষণ কাঁপিয়ে দেবে মনোরম এ অট্রালিকার
ভিত আর হট্রগোলে
চকিতে করবো দাবি একান্ত আপনাদের শত
সুন্দরীর রঙিন চুম্বন, প্রাণে তরঙ্গ-জাগানো আলিঙ্গন।
ন্যাকা, মিল, ন্যালাক্ষ্যাপা অনৃপ্রাস থেকে সাত হাত
দূরে সরে, কাঁদুনির পাক
থেকে মুক্ত হয়ে
আমার বেয়াড়া পদ্য ঘোরে রহস্যের আঁকাবাঁকা
ঘুপচি গলিতে, সদ্য জেগে-ওঠা চরে,
গা এলিয়ে দেয় অপসৃত দেয়ালের ঘরে, বিদ্বেষবিহীন
উদাসীন নির্বিঘ্নে কাটাতে
চায় দিন, কিন্তু তার নৈঃশব্দ্যের এলাকায় হাতবোমা ছুড়ে
কারা যেন তার তীব্র বসন্ত দিনের
স্বপ্নকে ভীষণ খোঁড়া করে দেয় আদিম আক্রোশে।
ক্ষতিপূরণের দাবি না তুলেই আমার অত্যন্ত জেদী পদ্য
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে গুলিবিদ্ধ বীরের ধরনে।
বকধার্মিকের দল বারবার তেড়ে আসে লাঠি
উঁচিয়ে আমার
অশিষ্ট পদ্যের দিকে পুড়িয়ে মারতে চায় দূর মধ্যযুগী
মনের বিকারে আর নাছোড় শিকারে মাতে তাকে
বন্য পশু ঠাউরে, অথচ
এই পদ্য বিবর্ণ জীনস্‌-পরা ঋষ্যশৃঙ্গ, প্রখর খরায়
বৃষ্টি নামানোর ব্রত নিয়ে
আসে জনপদে
তপস্যার কী রুক্ষ নির্জন ঘেরাটোপ ছেড়েছুড়ে। বৃষ্টি এলে
ফিরে যায় বাজিয়ে উদাস কণ্ঠে প্রত্যাবর্তনের আর্ত সুর
আমার অন্বেষাপরায়ণ পদ্য চৌদিকে বুলায়
চোখ, তার দৃষ্টিতে মৃত্যুর
বিষয়ে তেমন কৌতূহল নেই আপাতত, কেউ
তার ট্রাউজার, শার্ট থেকে শ্রমিকের ঘেমো
গন্ধ পায়, কেউ কেউ বনশিউলির, চন্দনকাঠের ঘ্রাণ।

ত্রাণ শিবিরের এলেবেলে স্মৃতি নিয়ে
সূর্যাস্তের পরে
ঘরে ফেরে একা-একা ছটফট করে সারাক্ষণ, তারপর
বেরোয় রাত্রির পথে, হাঁটে,
সুদীর্ঘ আণ্ডারড্রেনে উজিয়ে বিষ্ঠার স্রোত মধুর বাজায়
পিতলের বাঁশি, যায়
কৃষ্ণাঙ্গ কবির সঙ্গে তাচ্ছিল্যে ফাঁসির মঞ্চে, চোখ
রাখে জল্লাদের চোখে। উত্তুরে হাওয়ায়, দোল-খাওয়া
কবির ছায়াকে ভালোবেসে
আমার এ ব্রাত পদ্য ছায়াপথে পর্যটক হয়। তার চোখে
তোমরা কখনো কেউ বইয়ে দিও না
সুদূর পারের অশ্রুনদী, কেননা নিশ্চিত জেনো,
এরপরেই তো জলে ধরবে আগুন।

আরণ্যক

দেবদূতদের প্রিয় ছিল, বলা যায়, সেই
বন, ওরা ওড়াতেন রঙিন বেলুন
মাঝে-মাঝে বনের ভেতর। বলতেন, ঈশ্বর দেখুন
কী রকম সাজিয়ে রেখেছি এই
বনরাজিনীলা। তারপর
পরস্পর
হাত ধরে গোল হয়ে নাচে মেতে খানিক সময়
দিতেন কাটিয়ে
বস্তুত স্বপ্নের ঘোরে। আনন্দ অক্ষয়
ভেবে ছায়াদের নিয়ে
ইন্দ্রিয়বিলাসে মগ্ন হতেন হ্রদের তীরে। কেউ
কেউ অবসাদে জলে ঢিল ছুড়ে জাগাতেন ঢেউ।

একদিন গোধূলি বেলায়
যখন অরণ্যচারী কিছু প্রাণী ছিল মেতে মিথুন-খেলায়,
অকস্মাৎ সেই বন আগুনের ঢল
কী বাপক এল নেমে! লতাগুল্ম, গাছপালা, জল,
পশুপাখি আগুনের তাপে উবে যায় ক্রমান্বয়ে,
সবাই প্রলয়াভাসে ভয়ে
ছোটে দিশেহারা, দেবদূতগণ চকিতে উধাও; দাবানলে
জ্বলে শুধু জ্বলে
চতর্দিক। এখন সেখানে আপাতত
নেই কিছু ভোজ্য কিংবা পেয়।
কেবল এটি আর্ত পাখি ধৈর্য ধরে করাচ্ছে স্নেহার্দ্র স্নান ক্রমাগত
সুর ঢেলে দগ্ধ বনস্থলীটিকে ভস্মীভূত হবে সে জেনেও।

এখন নিজেকে বলি

এখন নিজেকে বলি মাঝে-মধ্যে, বেলা নিভে আসে
ক্রমে, তুমি যমে ও মানুষের টানাটানি
দেখেছো গ্রামের ঘরে, শহরের ফ্ল্যাটে,
আর অধিবাস্তব নাটোর
কুশীলবদের সাজঘরে অকস্মাৎ বজ্রপাত
করেছো প্রত্যক্ষ সাঁঝরাতে। তাছাড়া পাহাড়ি পথে
ধস নেমে যেতে দেখে আঁৎকে উঠেছি,
এবং পুরানো দালানের
ভিত নড়া, ভেঙেপড়া আমার সত্তার কাঠামোকে
নাড়িয়ে দিয়েছে তীব্রতায়। ভবঘুরে
কাবিলের মতো
যন্ত্রণর দাগ বয়ে বেড়াচ্ছি নিয়ত সাত ঘাটে।

বাগান যাই না ইদানীং, কোনোদিন যদি চলে
যাই ভুলে, ভয়
ফণা তোলে, ফুলগুলি নিমেষে করোটি হয়ে যায়,
বৃক্ষরাজি বিশীর্ণ কংকাল। গোধূলিতে
বাগান উগরে দেয় ক্রমাগত পুরাতন শব। শেয়ালের
দাঁতে বিঁধে থাকে যুবাদের হৃৎপিণ্ড।

আমার গন্তব্য নয় নদীতীর আর, ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ছই-অলা নৌকা
অথবা ডিঙির দোলা দেখে আজকাল
পাই না আমোদ, ভাটিয়ালী
শোকগাতা হয়ে জলে মেশে, নদী বারবার
আমার উদ্দেশে ছুড়ে দেয় শুধু শ্মশানের ধোঁয়া।

আকাশ তো আগের মতোই নীল রঙে
ভরপুর, তবু তাকাই না
আকাশের দিকে রাত জেগে। তারাগুলি
ডাইনির চোখের ধরনে চেয়ে থাকে,
এবং গর্জনশীল নদী বারবার
ভীষণ কামড়ে ধরে কাজল মাটির ঘাড়, দেবদূতগণ
খেঁকশেয়ালের মতো হয়ে যান দ্রুত।
কখনো কখনো
মেঘ ফেটে রক্ত ঝরে, কয়েকটি লাশে
ঢেকে গেছে আমাদের সমস্ত আকাশ।

কালদীর্ণ কোকিলের মতো

অপার প্রসন্নতায় ছিলেন তিনি ঘর-দুয়ার
আগলে; নোংরা গলিতে,
রাস্তায় রাস্তায় বাজতো
তাঁর জুতোর আওয়াজ বাদ্যযন্ত্রের মতো। কখনো
দেখা যেত, হেঁটে চলেছেন
তিনি প্রান্তরের নীল প্রান্ত ঘেঁষে,পেরুচ্ছেন সাঁকো,
শস্যক্ষেতের ফসল ছাপিয়ে
জেগে উঠছে হরফ আলিফ-এর মতো তাঁর
ঋজু আর অনন্য শরীর। বনরাজিনীলার রহস্যময়তা
আর ডাগর নদীর ছলাৎছল শব্দ
কণ্ঠে ধারণ ক’রে তিনি সকলের জন্যে গাইতেন
ঘর ছাড়ার কীর্তন, ঘরে ফেরার গোধূলিপ্রতিম পদাবলী

তাঁর সুরে বিষ-কাটালির ঝোপঝাড়
রূপান্তরিত হতো রজনীগন্ধাবনে, গুচ্ছ-গুচ্ছ পলাশে
চেয়ে যেত মেঘের পাড়,
নদী হতো অজস্র নারীর কলস্বর,
পাহাড় মস্তিতে ভরপুর দরবেশ। সে-গানে
আকাশ পরতো সূর্যের মুকুট।
সেই গীতধারায়
স্নাত গাছপালা পেতো স্বর্গীয় সৌন্দর্য।
অলংকারহীন সে-গান পান্থশালায়,
গেরস্তের কুটিরে, কারখানার চত্বরে চত্বরে,
খনির সুড়ঙ্গে, হাসপাতালের করিডোরে, ঝর্ণার ধারে
উড়ে-আসা পাতায়,
বেকারের বিবরে কী ব্যাপক
ছড়িয়ে পড়তো যেন স্মৃতিমুখর তেজালো জোয়ার।

যত অন্তরারেই থাকুন তিনি, সে-গান
ঘোষণা করে তাঁর উপস্থিতি। ঘোর অমাবস্যায়
তাঁর হাতের মুঠোর থেকে ছল্‌কে পড়ে জ্যোৎস্না,
চোখ থেকে ঝরে ফুলের রেণু,
জামার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে
রঙ-বেরঙের পাখির ঝাঁক। তিনি যখানেই যান,
তাঁর সঙ্গে যায় লোক, রাস্তা-উপচে-পড়া লোক,
যেন তিনি এক মোহন ঐন্দ্রজালিক,
যার ইঙ্গিতে মাটিতে মুখ-থুবড়ে-পড়ে-থাকা শহর
নিমেষে তোলে মাথা,
মৌরসীপাট্রার ভুয়া দলিল দস্তাবেজ পুড়ে যায়
এবং বেজায় ছত্রভঙ্গ আততায়ীর দল।

প্রহরে প্রহরে ওদের বেয়নেট শাসালো তাঁকে, ওর
ভেবেছিল এতেই নড়বে টনক,
কিন্তু যাঁর ভিতরে গুঞ্জরিত কবিতার ঝলক, তিনি কেন
মাতা নত করবেন পিস্তল আর বন্দুকের নলের অভিযোগের
সামনে? কেন তিনি নিজের স্বপ্নমালাকে
দলিত হতে দেবেন উন্মত্ত হাতির পারের পায়ের তলায়?

আখেরে তাঁর, সেই কবির, ঠাঁই হলো আকাশ-ছোঁয়া
দেয়াল-ঘেরা কয়েদখানায়। দিনের পর দিন,
মাসের পর মাস যায়, অর্ধাহারে,
একাতিত্বের দংশনে গুকায় তাঁর শরীর, হাড়ে ধরে ঘুণ,
অথচ তাঁর আত্মায়
বিরতিহীন দেয়ালি, মৌন উৎসবের নহবৎ।

ওরা ভেবেছিল, তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ
করলেই, তাঁর পিঠে চাবুকের চেঁচিয়ে-ওঠা ছোবলে
কালসিটে পড়লেই রুদ্ধ হবে
দূরন্ত এক কাহিনীর গতি, কিন্তু তাঁর কবিতাবলিকে
ওরা হাতকড়া পরাতে পারেনি কিংবা বেড়ি। পৃথিবীর
কোনো কয়েদখানারই সাধ্য নেই
তাঁর ঈগলের মতো কবিতাকে
আটকে রাখতে পারে, ডানা তার ঝলসায় আকাশে আকাশে।

উত্যক্ত হয়ে ওরা একদিন কবিকণ্ঠে
পরালো মৃত্যুর ফাঁস; আর কী আশ্চর্য, ফাঁসির মঞ্চে
ঝুলন্ত কবির শরীরর প্রতিটি রোমকূপ থেকে বিচ্ছূরিত হলো
কবিতার পর কবিতা, যেন মেঘকৃষ্ণ গর্জনশীল আসমানে
বিদ্যুচ্চমক এবং সেই কবিতাবলি কালদীর্ণ কোকিলের মতো ডেকে
ডেকে
ভীষণ রক্তিম ক’রে তুললো নিজেদের চোখগুলো।

কালো মেয়ের জন্যে পঙ্‌ক্তিমালা

আমার নামধাম তোমার জানার দরকার নেই, কালো মেয়ে।
আমি শাদা কি কালো, হলদে কি বাদামি,
সবুজ কি বেগুনি
তাতে কী এসে যায়? ধ’রে নাও, আমার কোনো বর্ণ
নেই, আমি গোত্রহীন। বলা যায়, আমি শুধু
একটি কণ্ঠস্বর, যা মিশে থাকে ঘন কালো অরণ্যের
লতাপাতায়, ঝিলের টোল-খাওয়া পানিতে
হরিণের মুখ রাখার ভঙ্গিমায়,
উটের গলার ঘণ্টধ্বনিতে। এই কণ্ঠস্বর
বয়ে যায় বিষুব রেখায়, উত্তর মেরুতে, বঙ্গোপসাগরের
তরঙ্গে তরঙ্গে আর আফ্রিকার
অজস্র জেব্রার কুরধ্বনিময় প্রান্তরে।

কালো মেয়ে, তুমি যতই কালো হও,
তোমার সত্তায় আমি দেখেছি গীর্জার মোমবাতির
আলোর মতো আভা, সে আভাকে
প্রণতি জানায় এই কণ্ঠস্বর।

তুমি যখন প্রথম চোখ মেলেছিলে, কালো মেয়ে,
স্বল্পালোকিত কাঠের কেবিনে,
তখন তোমার মুখের দিকে ঝুঁকেছিল একটি কালো মুখ।
যে-স্তন তোমার শিরায় শিরায় বইয়ে দিয়েছিল
জীবনের ধারা, কালো সেই স্তন।
তোমার দোলনা দুলিয়েছিল যে-হাত
সে-হাত কালো,
তোমার জন্যে রুটি বানিয়েছিল যে-হাত,
সে-হাত কালো,
তোমার হাতে প্রথম কাঠের পুতুল
তুলে দিয়েছিল যে-হাত
বড় স্নেহার্দ্র, বড় কালো সে হাত।

কালো মেয়ে, তুমি দারিদ্র্যের গহ্বরে
হামাগুড়ি দিয়ে
মিথ্যার মতো শাদার উৎপীড়নে ধুঁকে ধুঁকে
লাঞ্ছনার অট্রহাসি শুনে বঞ্চনার শত খানাখন্দ
পেরিয়ে গায়ে উপহাসের কাদা মেখে,
পা ঝাড়া দিয়ে জ্যোৎস্নার চন্দনলিপ্ত হরিণীর মতো
এসে দাঁড়িয়েছো যৌবনের চূড়ায়। তোমার বরকে ওরা
ঘরচাড়া করেছে, ওর কালো মথমলের মতো কণ্ঠস্বর
ওরা স্তব্ধ করে দিয়েছে, তোমার কানে কোনোদিন আর গুঞ্জরিত
হবে না তার তারা-ঝলসিত গান। কিন্তু, কালো মেয়ে,
তরমুজের মতো তোমার উদরে
মাসের পর মাস বেড়ে উঠছে ওর সন্তান।

যেদিন তোমাদের দু’জনের সন্তান ওর অস্তিত্ব ঘোষণা করবে
প্রথমবার, সেদিন
সূর্যোদয় গালিচা বিছিয়ে দেবে তার উদ্দেশে,
গান গেয়ে উঠবে রঙ-বেরুঙের পাখি,
গাছপালা করতালিতে
মুখর ক’রে তুলবে দশদিক।

তোমার কোল-আলো-করা ছেলে বেড়ে উঠবে
শক্রর বন্দুকের ছায়ায়
বছরের পর বছর, রাত গভীর হ’লে
স্বাধীনতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
সাক্সফোনে সে তুলবে তোমার পূর্ব পুরুষদের যন্ত্রণার সুর,
জীবনকে মৃত্যুর দেশ থেকে ছিনিয়ে আনার সুর;
তোমার ক্রুশবিদ্ধ মর্যাদার ক্ষতগুলো ধুয়ে
সেখানে ফোটাবে সে প্রসন্ন অর্কিড,
সে তার জোরালো কালো হাতে মুছিয়ে দেবে আফ্রিকার
কালো হীরের মতো চোখ থেকে গড়িয়ে-পড়া অশ্রুজল।

 কেন মানুষের মুখ

কেন মানুষের মুখ বারবার ম্লান হয়ে যাবে?
কেন আমাদের হাতে পায়রা পাথর হয়ে যাবে?
মুখের ভেতরে কেন অমাবস্যা ঊর্ণাজাল বুনে
যাবে ক্রমাগত? যোদ্ধবেশে শত শত
কংকাল সওয়ার হয়ে আসে
কেন রাতে ভৌতিক ঘোড়ায়?
কেন আমাদের
এত মৃত্যু দেখে যেতে হবে অসহায় ভঙ্গিমায়?

অবেলায় একটি বিপুল উল্টে-যাওয়া দোয়াতের কালির ধরনে
রক্তধারা বয়ে যায়। রক্তভেজা চুলে শব্দহীন
গোঙানি; চোয়ালে, মেরুদণ্ডে, দুটি চোখে,
হাড়ের ভেতরে স্মশানের ধোঁয়াবিষ্ট
হাওয়ার মতোই কিছু বয়ে যায়, বয়ে যেতে থাকে।

যে-হাত মুছিয়ে দিতো তার চির দুঃখিনী মায়ের
চোখ থেকে জলধারা, সেই হাত কেমন নিঃসাড়, শূন্য আজ।
যে-চোখ দেখতো প্রেমিকার মুখরেখা কনে-দেখা
আলোয় অথবা সূর্যোদয়ে,
সেই চোখ ডিমের ছড়ানো
কুসুমের মতো হয়ে গেছে,
যে-ঠোঁট স্ফুরিত হতো কবিতার পঙ্‌ক্তির চুম্বনে,
সে-ঠোঁটে ঘুমায় আজ স্তব্ধতার ভাস্কর্য নিধর।
একলা যে-কানে
বোনের সোনালি
চুড়ির শব্দের মতো আনন্দের ধ্বনি
হতো গুঞ্জরিত আজ সে-কানে স্থবির অন্ধকার
কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। কফিনের আলোড়নে
পাখিদের সংগীত পেরেক বিদ্ধ হয়।

মারা গেল, কখনো তাদের কেউ দোর খুলবে না
বাজালে কলিং বেল। বন্ধু এলে ঘরে
হাত ধ’রে নিয়ে বসাবে না কিংবা নিজে
বসবে না চেয়ারে হেলান দিয়ে, বুলোবে না চোখ
টেবিলে-উল্টিয়ে-রাখা আধপড়া বইয়ের পাতায়,
অথবা ব্যথিত, ক্ষয়া চাঁদের নিকট
চাইবে না শৈশবের শিউলি-সকাল
আবার পাবার বর! সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় ভাববে না
কাকে তার বড় প্রয়োজন ছিল। ‘কাল যাবো ঠিক
আমার গ্রামের বাড়ি, ট্রেন থেকে নামবো স্টেশনে
ঝুলিয়ে গেরুয়া ব্যাগ কাঁধে, দেবো সুখে
চুমুক চায়ের ঠুঁটো পেয়ালায় হাশমত আলির দোকানে’-
এই শব্দাবলি
জমাট রক্তের মতো লেগে থাকে শূন্যতার গালে।
যারা গেল, তাদের এখনো

আঁকড়ে রাখতে চায় এ দেশের শেকড়-বাকড়,
আঁকড়ে রাখতে চায় লতাগুল্ম আর
গহীন নদীর বাঁক, আঁকড়ে রাখতে চায় শারদ রোদ্দুরে
ডানা মেলে-দেয়া কবুতরের ঝলক,
আঁকড়ে রাখতে চায় নিঝুম তুলসীতলা, জোনাকির ঝাঁক।

এদেশের পতিটি গোলাপ আজ ভীষণ মলিন,
প্রতিটি সবুজ গাছ যেন অর্ধ-নমিত পতাকা,
আমাদের বর্ণমালা হয়ে গেছে শোকের অক্ষর,
আমার প্রতিটি শব্দ কবরের ঘাসের ভেতরে
হাওয়ার শীতল দীর্ঘশ্বাস;
আমার প্রতিটি চিত্রকল্প নিষ্প্রদীপ ঘর আর
আমার উপমাগুলি মৃতের মুঠোর শূন্যতায় ভরপুর,
আমার কবিতা আজ তুমুল বৃষ্টিতে অন্ধ পাখির বিলাপ।

গদ্য কবিতার চালে

দুপুরবেলা খেলাচ্ছলে কোথায় যে যাচ্ছিলাম
আস্তে সুস্থে, কী খেয়াল হলো
হঠাৎ ঢুকে পড়লাম
স্টেডিয়ামের বইয়ের দোকানে, সেখানেই
দেখা তোমার সঙ্গে। নিমেষে দুপুরের অধিক ঝলোমলো
হয়ে উঠলো দুপুর; তোমার চোখে চোখ পড়তেই
ভাবি, অনন্তকালের রঙ কি শাদা
পায়রার মতো? নাকি সমুদ্রের জলরাশির মতো
নীল? অনন্তকাল কি অপরূপ তালে-বাঁধা
কোনো ধ্রুপদী নাচ? সম্ভবত
শস্যের আভাস-লাগা নিঃসীম প্রান্তর, এ-কথা
মনে হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিপথে চকিতে
দুলে ওঠে স্বপ্ন-জাগানো এক লতা
কী নিবিড়,
সাইনবোর্ড, ম্যাগাজিন, বইপত্র, ভিড়
মুছে যায়; ঝালর কাঁপে, অকাল বসন্ত আসে অস্তিত্বের ভিতে।

নিজেকে প্রশ্ন করি, যা ঘটলো এই মুহূর্তে
আমার মনে থাকবে চিরদিন? আর
তোমারও কি পড়বে মনে বহুকাল পর এই সাবেকি
ঘটনা, যখন তুমি অন্ধকারে
ঘরে একলা শুয়ে-শুয়ে ক্যাসেট প্লেয়ারে শুনবে পুরোনো গান
কোনো বর্ষাকোমল রাতে? কে জানে
হারিয়ে যাবে কিনা এইসব কিছুই? শুধু গুণীর তান
হয়ে বাজবে মন-কেমন-করা স্তব্ধতা বিস্মৃতির ভাটার টানে!

তোমার চোখ হলো ওষ্ঠ, ওষ্ঠ চোখ,
আমি একটা বইয়ের পাতা ওল্টানোর ভান করে আনাড়ি
অভিনেতার ধরনকেই, যা হোক,
স্পষ্ট ক’রে তুললাম নিজের কাছে। সাত তাড়াতাড়ি
হাল আমলের একজন তুখোড় কবির
হৃৎপিণ্ডের ধ্বনিময়, বুদ্ধির ঝলকানি-লাগা বইয়ের দাম
চুকিয়ে তুমি আরো একবার গভীর
তাকালে আমার প্রতি। নিজেকে এগোতে দিলাম
আকাশ থেকে ডাঙায় নেমে-আসা
ছন্নছাড়া পাখির ধরনে। কথা বলবো কি বলবো না,
এই দ্বিধার ছুরি চলতে থাকে বুকের ভেতর। আমার ভাষা
যেন সেই কাফ্রি, যার জিভ কেটে
নেয়া হয়েছে, অথচ কথার ঝালর বোনা
হতে থাকে অন্তরে। দুপুরে অমাবস্যা ছড়িয়ে তুমি হেঁটে
গেলে করিডোর দিয়ে, মার স্বপ্নকে ফিকে
করে চোখের আড়ালে,
যেমন মল্লিকা সারাভাই যান খাজুরাহোর মন্দিরের দিকে
স্মৃতিতে জ্যোতির্বলয় নিয়ে গদ্যকবিতার চালে।

 গৃহস্মৃতি

কিছুতে আসে না ঘুম। রাত,
কালো পাথরের মতো বুকে চেপে আছে
সারাক্ষণ; কান পেতে থাকি
কখন শুনবো তেজী মোরগের ডাক।
যদি ভোর ব্যালে নর্তকীর মতো আসে,
ছড়ায় শিল্পিত আভা আমার খাতায়,
তবে আমি শক্রকেও হেসে, হাত ধরে
নিয়ে যাবো আতিথ্যের ঘাটে, দ্বিগ্রহরে
তার সঙ্গে ভাগ করে খাবো
শাকান্ন এবং ফলমূল! ঘুম নেই
চোখে, বারবার শুধু সাততাড়াতাড়ি
ছেড়ে-আসা ঘরটির কথা মনে পড়ে।

সেসব সতেজ চারা গাছ,
যারা উঠেছিল বেড়ে আমার নিবিষ্ট
আদরের মধুর রোদ্দুরে,
সেসব গোলাপ-কুঁড়ি, যারা
আমার স্বপ্নের মতো ছিল স্ফুটোন্মুখ,
তারা কি এখনো বাঁচে
উঠোনের কোণে কোনো কল্যাণী স্পর্শের প্রত্যাশায়?
এখন বাসিন্দা যারা ওরা কি শেকড়ে ঢালে জল?
পাতা ছেঁটে দেয়? যত্ন নেয়
গোলাপ গাছের? ওরা ভোরে
অথবা বিকেলে
গম খেতে দেয় বুনো কবুতদের? মনে সুর্যোদয় নিয়ে
তিনটি তরুণী
এখনো কি সূর্যাস্তের দিকে
মুখ রেখে দাঁড়ায় প্রত্যহ ত্রিবন্দনা হয়ে খোলা
ছাদের হাওয়ায়? ওরা থাকুক শান্তিতে।

গেরোবাজ পায়রার মতো

বাসী বিছনায় আরো কিছুক্ষণ জাগরণে
কাটিয়ে সফেদ-কালো স্বপ্নগাঁথা মনে, বাথরুমে
দু’দিনের দাড়ি
কামিয়ে, বেসিনে মুখ ধুয়ে
ভোরবেলা আটটা বত্রিশে
(পুরনো টাইমপিস সাক্ষী) না-লেখা অস্পষ্ট গুঞ্জরণ
নিয়ে যাই খাবার টেবিলে,
টোস্ট, ডিম, মধু জিভে
ছড়ায় নিবিড় স্বাদ। প্লেট, কাপ এবং চামচ বেজে ওঠে
ঐকতানে, হঠাৎ তোমার
হাসির প্রপাত ছোঁয় আমাকে, অথচ
তুমি নেই কতদিন থেকে।
নীল ছবি, গহনতাময়, ফ্রেমে বাঁধা,
টেবিলে কুঁড়ের মতো পড়ে আছে ভোরের কাগজ

সেখানে কিছুই নেই বস্তুত বেহদা টাইপের
উতুঙ্গ বুকনি ছাড়া। অবচেতনের
ছায়াচ্ছন্ন গুহা থেকে পাখি উড়ে যায় মাঝে-সাঝে
নীল পাহাড়ের দিকে,
বাইরে রোদ্দুর নাওয়ায়ে স্নেহ ঢেলে
কনকচাঁপাকে। মনে পড়ে
ছেঁড়া শাদা ঘুড়ির মতন
মৃত সারসের ডানা গাঁথা
কাঁটাতারে, অমাবস্যালিপ্ত
উঠোনে লণ্ঠন হাতে দঁড়ানো আমার মাতামহী,
ছন্দিত লঞ্চের বাঁশি, ফিরে আসা, সাঁকোর গ্রামীণ
ভালোবাসা,দূরের কাশের বনে ভগবতী, রুলির ঝিলিক,
ভাঙা কলসের কাছে এক ঝাঁক কাক,
নৌকোর ভেতরে দোলে মেহগনি কাঠের কফিন।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি, হাতে
সন্তু অগাস্টাইনের আত্মকথা ভেসে
আসে কিয়দ্দূর থেকে
চায়ের সোনালি ঘ্রাণ, মুটে বয়ে নিয়ে
যায় সবজিভরা ঝাঁকা, ছাদে নুয়ে-পড়া ঝাঁকা ডালে
স্ততিগানে মাতে
কী একটি পাখি,
আচ্ছা আসি, বলতেই হবে কোনোদিন।

সবই থেকে চোখ
আসমানে যায়, হাত ধরাধরি ক’রে সীসে রঙ
দিগ্বলয়ে নাচে সাতজন, মরীচিকা
সুদূরে সীমানাহীন, গেরোবাজ পায়রার মতো
আমার কবিতা
ঝংকৃত উপরে যায়, মরীচিকা ঝালরকে খুব ঠোকরায়,
ফিরে আসে পুনরায়, সঙ্গে আনে তার
স্মৃতির মতোই কিছু। থাকবে তো? নাকি
ওড়া, শুধু ধু-ধু ওড়া?

 জরুরি অন্তত

ব্যাপক সংকটে পথ কোথায়?
শক্রঘেরা ব্যুহে মিত্র খুঁজি।
ব্যর্থ সন্ধানে আমারও হায়
ফুরায় ক্রমাগত আয়ুর পুঁজি।
অগ্রজের কৃতকর্ম যত
প্রেতের মতো নাচে অবচেতনে।
অচিন সত্তায় প্রাচীন ক্ষত,
ঊর্ণনাভ ঘোরে বিবশ মনে।

যায় যে যৌবন অস্তাচলে,
জীবন হিমায়িত শুকনো ডাল;
অথচ সেখানেও হঠাৎ জ্বলে
বিরল উৎসবে শিমুল-লাল।

নিষেধ চারদিকে তুলছে ফণা,
শুকনো ডাল থেকে উধাও পাখি।
বিলাপে জমে আসে রক্তকণা,
হৃদয়ে হাহাকার, একাকী থাকি।

বজ্রপাতে পোড়া গাছের কাছে
সবুজ পাতা চাওয়া নিরর্থক।
সেখানে অঙ্গার, ভস্ম আছে
এবং স্বপ্নের দগ্ধ ত্বক।

স্বপ্ন আনে প্রাণে ক্ষণিক দ্যুতি,
লগ্ন তাই আজো প্রতীক্ষায়।
ভোগায় দিনরাত যে-বিচ্যুতি,
তাকেই শোধরাই তিরিক্ষায়।
কিন্তু থেকে যায় ক্রটির ছাপ
এখনো নন্দিত জল্পনায়।
কেবলি বেড়ে যায় মনস্তাপ,
তোমাকে খুঁজে ফিরি কল্পনায়।

বিস্ফোরণ আমি শুনবো বলে
সবার মতো আজ পেতেছি কান
শ্মশানে কিংশুক ফোটাতে হলে
জরুরি অন্তত আত্মদান।

তোমাকে পাঠাতে চাই

তোমাকে পাঠাতে চাই শহরের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে, ভিড়ে
কেরানীর কলোনীতে, মতজুরের ঝুপড়িতে আর
মাছরাঙাময় বিলে; কৃষকের কুপিজ্বলা রাত্রির কুটিরে,
তোমাকে পাঠাতে চাই ফ্যাক্‌টরির চঞ্চল চাকার
খুব কাছে, হটে,
অন্তত জোনাকি-ঝলসিত ঝোপঝাড়ে,
কুমোর পাড়ায় অর জেলের ডিঙিতে পুকুরের স্তব্ধ ঘাটে,
চাঁদের সংকেতে চমকিত ছোট ঘরে, চুপিসারে
একে একে আসা
পার্টি কর্মীদের যুক্তিতর্কে আন্দোলিত
গোপন বৈঠকে; যদি যাও তুমি পাবে নব্য ভাষা
সেখানে, আশ্বাস দিতে পারি। কখনো হয়ো না ভীত

সালঙ্কারা হবার দরকার নেই। তোমার গলার
মনিহার
খুলে ফেলো; কঙ্কন কেয়ুর থাক, অবান্তর রুপালি নুপুর।
তোমার সত্তায় বাজে চরাচরে-মন্থিত গহন কত সুর।

শুধু চাই তোমার দু’চোখে যেন বিলে
জলপানরতা হরিণীর দৃষ্টি জেগে থাকে, আকাশের নীলে
যে-স্বপ্ন বেড়ায় ভেসে, তার
স্পর্শ পাক তোমার স্পন্দন, অন্ধকার
রাত্তিরে যখন একা বাড়ি ফেরে যুবা নান্দীপাঠ
সেরে বিপ্লবের তার যোগ্য উদ্দীপনা
আমিও তোমাতে চাই। আর নানা ঘাট
ঘুরে তুমি কুড়াবে অসীম ধৈর্যৈ অধরার কণা।

ভয় নেই হে, আমার গান,
কথা দিচ্ছি, কখনো তোমাকে করবো না অপমান।
ওথেলোর মতো
অন্ধ ক্রোধে তোমার সুন্দর গরা টিপে তোমাকে নিহত
করবো না কস্মিনকালেও। যেখানেই যাও, সভা
থমকে দাঁড়াবে জেনো; বলবে সবাই সম্মিলিত কণ্ঠস্বরে
‘কেমন সতেজ রক্তজবা
সাজহীন অপরূপ সাজে এলো আমাদের ঘরে’।

তোমার ঘুম

কতকাল তোমার সঙ্গে আমার দেখা নেই,
তোমার কণ্ঠস্বর শুনি না কতকাল। যিশুখৃষ্ট
ক্রুশে বিদ্ধ হবার পর
যতদিন গেছে অস্তাচলে, ততদিন তোমার
চোখের চাওয়া আর
স্পর্শের বিদ্যুচ্চমক থেকে আমি বঞ্চিত, মনে হয়।

যখন তোমাকে ফোন করি, তখন
ওপারে একটি ধ্বনি হতে থাকে ক্রমাগত একঘেয়েমির
মতো। কোনো সাড়া মেলে না।
কখনো কেউ রিসিভার তুলে রডিওর ঘোষকের
বলবার ধরন গলায় এনে জানায় তুমি বাড়ি নেই,
আবার কখনো শুনি ঘুমোচ্ছ তুমি।

যখন ঘুমোবার কথা নয়, তখন ঘুমোচ্ছ জেনে
কেমন খটকা লাগে। ভাবি তবে কি
তুমি কোনো জাদুবলে রূপকথার সেই
ঘুমন্ত সুন্দরী হয়ে গেলে? আবার ভাবনাকে
অন্য বাঁকে নিয়ে নিজেকে
প্রবোধ দিই, কারো কারো ঘুম রাত থেকে
মধ্য দুপুর অব্দি গড়ায়, গড়াতেই পারে। তাই
এ নিয়ে নালিশ রুজু করা নিরর্থক। বরং
নিজের ভাগ্যকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে
বলি, আমাদের সংযোগের মুহূর্তটাই রাগুগ্রস্ত।

অথচ বাদশাহ সুলেমানের আমলের রত্নের মতো
কত মুহূর্ত আমাদের কেটেছে
তোমার ড্রইংরুমে। তখন তোমাকে ব্যাবিলনের
উদ্যানের কোনো মনোরম, দুর্লভ, তম্বী গাছ ভেবে
তাকিয়ে থেকেছি তোমার দিকে। এবং
আমার দৃষ্টিতে বিহ্বলতা পাঠ করে বলেছো,
কী দেখছো অমন ক’রে? সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে
দ্রুত পাতা ওল্টাতাম ম্যাগাজিনের,
অথবা দৃষ্টি মেলে দিতাম তোমার বাগানের দিকে। দূর অতীত
আর বর্তমান বইতো এক লয়ে পাখির গানে।

অসহ্য এই বিচ্ছেদ যা আমাকে দিনের পর দিন
রাত্রির পর রাত্রি
তোমার ছায়া নিয়ে তৃপ্ত থাকতে জপায়। এই বিচ্ছেদ
উজিয়ে আমি বেঁচে আছি, একথা ভেবে
নিজেকেই কেমন অপরাধী মনে হয়। অথচ তুমিহীনতা
আমাকে জড়িয়ে রাখে কবিতার সঙ্গে
সারাক্ষণ, যেমন বিশ্বাস
প্রাণের স্পন্দনকে। আর কবিতা তৈরি করে
এমন এক পথ, যে-পথ তোমার আসার
মুহূর্তের জন্য বারবার মরীয়া কণ্ঠস্বর হয়।

আজো দুপুরবেলা তোমাকে ফোন করবার পর
ঠাণ্ডা নিঃস্পৃহ এক কণ্ঠস্বর জানালো
তুমি ঘুমিয়ে আছো। সেই কণ্ঠস্বর আমাকে এক ঝটকায়
ছুড়ে দিলে আমার শহরের জনহীন রাস্তায় আর
নৈরাশ্যের সূর্যাস্তের ভেতর। একটা ভয় লিকলিকে
সরীসৃপের ধরনে আমাকে
চাটতে থাকে-তাহ’লে কি আমি অবিরাম ডায়াল
করতে করতে মেথুসেলা হয়ে যাবো? এখন সব পাখি
ঘুমের গুহায় পাখা গুটিয়ে নিঝুম, সকল নদী
ঘুমে প্লাবিত করছে গ্রাম, জনপদ। আমার আয়না জুড়ে
ঘুমিয়ে আছে এক নারী, যে ভুলে গেছে ভালোবাসার
ভাষা। তোমার হৃদয় ঘুমিয়ে পড়েনি তো?

ধন্য সেই পুরুষ

ধন্য সেই পুরুষ, নদীর সাঁতার পানি থেকে যে উঠে আসে
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে,
ধন্য সেই পুরুষ, নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে যে নেমে আসে
প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মতো উপত্যকায়;
ধন্য সেই পুরুষ, হৈমন্তিক বিল থেকে যে উঠে আসে
রঙ-বেরঙের পাখি ওড়াতে ওড়াতে।
ধন্য সেই পুরুষ কাহাতের পর মই-দেয়া ক্ষেত থেকে যে ছুটে আসে
ফসলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে।

ধন্য আমরা, দেখতে পাই দূর দিগন্ত থেকে এখনো তুমি আসে
আর তোমারই প্রতীক্ষায়
ব্যাকুল আমাদের প্রাণ, যেন গ্রীষ্মকাতর হরিণ
জলধারার জন্যে। তোমার বুক ফুঁড়ে অহংকারের মতো
ফুটে আছে রক্তজবা, আর
আমরা সেই পুষ্পের দিকে চেয়ে থাকি, আমাদের
চোখের পলক পড়তে চায়না,
অপরাধে নত হয়ে আসে আমাদের দুঃস্বপ্নময় মাথা।
দেখ, একে একে, সকলেই যাচ্ছে বিপথে অধঃপাত
মোহিনী নর্তকীর মতো
জুড়ে দিয়েছে বিবেক-ভোলানো নাচ মনীষার মিনারে,
বিশ্বাস্ততা চোরা গর্ত খুঁড়ছে সুহৃদের জন্যে
সত্য খান খান হয়ে যাচ্ছে যখন তখন
কুমোরের ভাঙা পাত্রের মতো,
চাটুকারদের ঠোঁটে অষ্টপ্রহর ছোটে কথার তুবড়ি,
দেখ, যে কোন ফলের গাছ
সময়ে-অসময়ে ভরে উঠছে শুধু মাকাল ফলে।
ঝলসে-যাওয়া গাসের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে মমতা
দেখ, এখানে আজ
কাক আর কোকিলের মধ্যে কোনো ভেদ নেই।
নানা ছল ছুতোয়
স্বৈরাচারের মাথায় মুকুট পরাচ্ছে ফেরেব্বাজের দল।
দেখ, প্রত্যেকটি মানুষের মাথা
তোমার হাঁটুর চেয়ে এক তিল উঁচুতে উঠতে পারছে না কিছুতেই।
তোমাকে হারিয়ে
আমরা সন্ধ্যায় হারিয়ে যাওয়া ছায়ারই মতো
হয়ে যাচ্ছিলাম,
আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিল শোকের পোশাকে,
তোমার বিচ্ছেদের সংকটের দিনে
আমরা নিজেদের ধ্বংসস্তূপে বসে বিলাপে ক্রন্দনে আকাশকে বাধিত
করে তুলেছিলাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে
রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্ততিগানে। কেননা জেনেছি
জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।

ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে
চিরকাল, গান হয়ে
নেমে অসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা; যাঁর নামের ওপর
কখনো ধুলো জমতে দেয়না হাওয়া,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পাখা মেলে দেয়
জ্যোৎস্নার সারস,
ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের উপর পতাকার মতো
দুলতে থাকে স্বাধীনতা,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর ঝরে
মুক্তোযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।

নগ্ন স্তব্ধতা

যে-কোনো দিনেরই মতো তিমিরের নাড়ী-ছেঁড়া আলো
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে। একটি তরুণী
লাল নীল ঘুড়ি
ছেড়ে দেয় বায়ু স্তরে; বিকেলে চায়ের কাপে প্রফুল্ল চুমুক,
ঘোরানো সিঁড়িতে গাঢ়-মিহি স্বরে কথোপকথন,
ছাদের ওপারে ছিল জ্বলজ্বলে ডাগর বেলুন,
চাঁদ বলি তাকে। কবি তাঁর
শব্দের ঝর্ণাকে ব্যালে শিক্ষকের ধরনে নিপুণ
পরিচালনায়
মোহন গন্তব্যে পৌঁছে দেন। এখানে আগুন নিয়ে
দ্যুতি, বলে তাঁকে গাছপালা,
নীড়ে-ফেরা পাখি, অস্তরাগময় শহরে কলোনি।

অকস্মাৎ চতুদিকে দৃষ্টি-অন্ধ করা কী বিপুল
উদ্ভাসন; মাটিতে আগুন,
লতাগুল্ম, গাছে-গাছে গোলাপের, চামেলীর পরাগে আগুন,
পাথরে-পাথরে লকলকে
জিভের মতন জ্বলে আগ্রাসী আগুন,
পশুপাখি, মানুষের ভেতরে আগুন, অন্তরীক্ষে,
জলের ওপরে আর ভেতরে আগুন জ্বলে; যেন এ-শহর
পরেছে চকিতে উরু, জানু, বুক, মাথা
জুড়ে আগুনের শাড়ি। মর্ত্যভূমি বজ্ররশ্মিজালে
বন্দি হয়ে চোখের পলকে রূপান্তরে কী উত্তপ্ত ভস্মাধার।

সাইরেন বড় মূক, ঘোষণা করার মতো কোনো
কণ্ঠস্বর নেই
এখন কোথাও। সংখ্যাহীন ঝলসানো গোরু-ঘোড়া
মাঠে কি গোয়ালে, আস্তাবলে পড়ে আছে
ইতস্তত ভীষণ নিষ্প্রাণ, প্রভুভক্ত কুকুরের ক্ষয়ে-যাওয়া
নিঃস্পন্দ শরীর সমর্পিত
নগ্ন বারান্দায় নৈবেদ্যের মতো। নিস্তব্ধ বসন্ত, পাখিদের
অজস্র কংকাল নগ্ন গাছে-গাছে। এমনকি পাথরের নিচে যতো
প্রাণী টিকে থাকে প্রতিহিংসার মতো,
তারাও এখন চিহ্নহীন।

মাটি আর দেবে না কিছুই। কোনোখানে এক ফোঁটা
জল নেই ভয়ানক দূষণ ব্যতীত। ফলমূল
কোথাও নির্দোষ নেই আর। খাদ্য আছে শস্যাগারে,
অথচ ভক্ষণযোগ্য নয় এককণা।

তেজস্ক্রিয় ভস্মের ঘোমটা-টানা পৃথিবীর ঠোঁটে,
রোদ চুমো খায় পুনরায়। কিন্তু এই রোদ নিয়ে
উৎসব করার মতো কোনো প্রাণী নেই।
দশ দিকে। মহাজন অথবা ঘাতক, গৃহী কিংবা
ঘরছাড়া চিরপলাতক, জুয়াড়ী অথবা নববিলাসের
টানে সাতঘাট জল-খাওয়া বাবু, দূরন্ত সাহেব,
অথবা পটের বিবি, বেশ্যার দালাল,
তুখোড় দোকানদার অথবা খদ্দের,
ট্রাফিক পুলিশ কিংবা ধাবমান যান,
মুর্দা কিংবা মুর্দাফরাস কারুরই
নামগন্ধ নেই।
যোজন যোজনব্যাপী ধুধু চরাচরে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে
থরে থরে সাজানো কৌটায়,
নানান রঙের জামা কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে আর
কার্পেটে পাপোষে মৃত্যু বুঁদ হয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে
ঠোঁট চাটে টুপ ভুজঙ্গ মৃত্যু, যেন
নিজেকেই আকণ্ঠ করবে পান। চতুর্দিকে ক্রুর দাবদাহ,
বস্তুত পৃথিবী পঞ্চতপা।

হঠাৎ ভূতল থেকে কেউ
উঠে আসে হামাগুড়ি দিয়ে কায়ক্লেশে আদিম শিশুর মতো,
পারে না তাকাতে ঝলসিত পৃথিবীর দিকে, চোখ
তুলতেই দ্যাখে একজন এক টুকরো আনন্দের মতো ফল
বাড়িয়ে দিয়েছে তার প্রতি রমণীয় ভঙ্গিমায়।
নারী আর পুরুষের তীব্র থরো থরো
আলিঙ্গনে আদিগন্ত নগ্ন স্তব্ধতায়
আনন্দ-বেদনা জাত কবিতার মতো হেসে ওঠে ভালোবাসা।

নন্দনতত্ত্বের বই

বেলাশেষে পড়ছেন তিনি নন্দনতত্ত্বের বই
গভীর অভিনিবেশে। তিনি আইডিয়ার অথই
সমুদ্রে নাবিক সুপ্রাচীন। জানি দেশজোড়া খ্যাতি
তাঁর পাণ্ডিত্যের, মনীষার; আর বন্ধুবর্গ, জ্ঞাতি
সকলেই জানে তাঁর চক্ষুদ্বয় ঘোরে নিরিবিলি
বইয়ের পাতায়, তত্ত্ব ও তথ্যের খুব ঝিলিমিলি
দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। কদাচিৎ তিনি চোখ তুলে
বই থেকে তাকান আকাশে আর দিব্যি ভুলে

থাকেন প্রায়শ নাওয়া খাওয়া। নিজেকে আড়ালে রেখে
ধুন্দুমার হট্ররোল থেকে প্রায় সব কিছু থেকে
নিভৃতে করেন ধ্যান-সুন্দরের। মানে তাঁর ডানে
বামে তাকাবার নেই মহলত। কোনো সুর কানে
ভেসে এলে দূর থেকে হন সচকিত, তারপর
আবার পড়েন ঝুঁকে অগণিত ছাপার অক্ষরে।
বইয়ের পাতায় তিনি সৌন্দর্য খোঁজেন রাত্রিদিন,
দ্যাখেন যাচাই ক’রে কী বলেন রসিক রাসকিন
অথবা কেনেথ ক্লার্ক। অথচ খেয়াল নেই কবে
আড়ালে আত্মঙ্গ তাঁর হলো তম্বী রূপের বৈভবে!

পরা বাক্‌ পেতে চায়

নাছোড় ভাদুরে বৃষ্টি ভোরবেলা আমাকে দেবে না
বারান্দায় যেতে আজ। এবং তুমিও, হে অচেনা,
আসো না ছাদে, আঁচ করি,
সঙ্গে নিয়ে সহচরী!
বেশ কিছুদিন থেকে তোমার অমন রমনীয় উপস্থিতি
বস্তুত পাচ্ছি না টের। প্রীতি
নিও অবচেতনায়, শুভেচ্ছাও বটে, দূর থেকে,
যখন উঠবে ডেকে
পাখি সেই গাছে, যা দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে, যার
পাতার আড়ালে তুমি আর
তোমার সঙ্গিনী হেঁটে বেড়াও প্রত্যহ, বলা যায়,
হাত ধরে, তোমাদের অশ্রুত কথায়
সাগ্রহে যে-কথা শুনি, তার
সঙ্গে মিশ আছে লতাপাতা, হ্রদের জলের আর নীলিমার।

এই তো সেদিন, মনে পড়ে, গোধূলিতে
তিনজন পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল, যেন-বা আদায় করে নিতে
যুক্তি তর্কে কিছু কথা তোমার নিকট থেকে, পাশে
দাঁড়ানো বিহবল সহচরী, তুমি হাতে মুখ ঢেকে হতাশ্বাসে,
মনে হলো,বসে ছিলে,
আবছা সিঁড়ির ধাপে, খোলা দীর্ঘ চুল, আকাশের নীলে
উড্ডীন পাখির ঝাঁক নীড়ে
ফেরার দুর্মর টানে। সেই দৃশ্য অন্তর্গত গহন তিমিরে
ঋত্বিকের স্মরণীয় শটের মতোই গেঁথে আছে,
বৃষ্টি ঝরে খোলা বারান্দায়, ছাদে, মধ্যবর্তী গাছে।
হৃদয়ের আলতামিরায়
অগ্নি জ্বলে, স্মরণাতীতের প্রতিচ্ছবি পরা বাক্‌ পেতে চায়।

 পূর্বাপর

এ-কথা শিখেছি ঠেকে নিজের ‘মনকে চোখ ঠেরে
মেলে না ফায়দা কোনো। যখন দুঃস্বপ্ন আসে তেড়ে
জন্মান্ধ ষাঁড়ের মতো
ক্রমাগত,
মুছে যায় অপমৃত স্বপ্নের কুহক।
মেঘে-ঢাকা স্তব্ধ আকাশের বুকে বিদ্যুৎ-ঝলক
দেখা দিলে, অন্ধকার আরো বেশি লোভী
হয়, নানা অমঙ্গলময় প্রতিচ্ছবি
বারবার দেয় হানা
ভ্রষ্ট মনে। অলৌকিকে সমর্পিত অগ্রজেরা নিশ্চিন্ত ঠিকানা
সহজে ঠাউরে নিয়ে জীবন যাপন
করেছেন এবং আপন
মহিমার সীমা বাড়াবার ঘোরে ঘুরেছেন দেশ-
দেশান্তরে; আমার বিমূঢ় চেতনায় যৌথ স্মরণের রেশ
বাজে দিনরাত,
সর্বনাশে মাঝে-মাঝে মনে হয় শ্রেয় আত্মঘাত।

একদা যে-সব গাছ দিতো ছায়া, তারা সেই কবে
হয়েছে নির্মুল বাদ্যরবে
যেসব বসতবাড়ি সুরের জৌলুশ পেতো, তাদের মাটিতে
মেশানো হয়েছে, উপরন্ত জ্ঞনপীঠে
শেয়াল, বাদুড় আর গন্ধমুষিকেরা
পেয়েছে মৌরসীপাট্রা, এ শহর দুর্জনের ডেরা
ইদানীং। শূন্য ঘড়া বাজে
দশ দিকে প্রখর আওয়াজ তুলে; সেতারে এস্রাজে
মেকী বিগ্রহের জুড়ি ছাড়া
অন্য কোনো ধ্বনি নেই। পথে-ঘাটে শুধু কেন্দ্রচ্যুত, দিশেহারা
পথচারী কখনো পা বাড়ায়, কখনো পিছু হটে,
চেনা দৃশ্যপটে
ক্ষণে ক্ষণে বিভীষিকা
কী ব্যাপক লেপ্টে যায়, জেগে ওঠে উষর মধ্যহ্ন মরীচিকা।
অনেক আগেই ফুরিয়েছে পুঁজিপাটা, নির্দ্ধধায় বিনা দামে
বিকিয়ে দিয়েছি সবকিছু, নিজ নামে
রাখিনি কিছুই, শুধু
পূর্ব পুরুষের একখানি জরাগ্রস্ত নৌকা ছিল, তা-ও ধু-ধু
মাঝ দরিয়ায়
ঝড়ে খান খান হয়ে গেছে আর আমি অসহায়
সঙ্গীহীন পড়ে আছি ভগ্নকণ্ঠ, এমনকি এখন কারুকে
ডাকার শক্তিও লুপ্ত, বুকে
অতীতের নুপুরের ধ্বনি বাজে, কবেকার ঝাড় লণ্ঠনের দৃষ্টিকাড়া
বর্ণময়তায় চোখ খোঁজে আশ্রয়, পাই না সাড়া
কোনোখানে; আজ
কাদায় ডুবেছে গলা, একমাত্র কাজ
এখন আমার শুধু ব্যাঙাচির নকড়া ছকড়া সয়ে-যাওয়া
আর শূন্যে নৌকা বাওয়া।

বস্তুত তোমার সামনে ঘটা করে অর্ঘ সাজাবার
মতো কিছু নেই বাকি এখন আমার
অস্তিত্বের বিপন্ন চীৎকার ছাড়া। পৃথিবীতে জেনেছি কিছুই
পারে না বইতে স্থায়িত্বের বার; চামেলী কি জুঁই,
অট্রালিকা, বাজ্যপাট-সবই তো মিলায়
তঙ্কর হাওয়ায়
একদিন; ভালোবাসা, তা-ও
ধুলায় উধাও
কংকালের কণ্ঠে হাত জড়িয়ে ঘুমায় অকাতরে।
কোনো রক্ষাকবজের শক্তি কিংবা দেবতার বলে
আস্থা নেই; তবু আমি ব্যাকুল জানাই-
যতোদিন বেঁচে আছি, ততোদিন চাই, ভালোবাসা পেতে চাই।

বাসরের ফুল

হে নির্বোধ, কে তুই রঙিন পঞ্জিকা খুলে ব’সে
আছিস সে কবে থেকে? কেন ক্যালেন্ডারের তারিখে
নির্নিমেষ দৃষ্টি তোর খরাদগ্ধ, বর্ষণপ্রত্যাশী,
নিঃস্ব কৃষকের মতো? যার প্রতীক্ষায় তুই এই
অবেলায় রেখেছিস দোর খুলে, মানে না সে কোনো
পঞ্জিকার নির্দেশ কখনো, ক্যালেন্ডারের সংকেত
সর্বদা অগ্রাহ্য তার কাছে। আছে তার স্বরচিত
রীতিনীতি, যদি তাকে বাস্তবিক রীতি বলা যায়।

কখন পড়বে তার পদচ্ছাপ কোন সে চৌকাঠে,
সহজ নয় তা’বলা। কী খেয়ালে মেতে সে চকিতে
শ্রদ্ধাস্পদ, ধীর অধ্যাপকের বিরলকেশ, দামি
মাথায় কৌতুকী গাট্রা মেরে বিহ্বল, বিবরবাসী
যুবকের মগজের কোষে ছড়ায় অনল আর
তার শিকারির মতো হাতে দেয় বাসরের ফুল।

বুদ্ধদেবের চিঠি

দুপুর ঝুঁকে পড়ছে বিকেলের দিকে, ফেরিঅলা
হাওয়ায় আমন্ত্রণী ডাক মিশিয়ে
দাঁড়ায় মধ্যবিত্ত দরজার কাছে আর উড়নচণ্ডী এক কিশোর
লগি হাতে ছোটে কাটা ঘুড়ির পেছনে পেছনে,
কলতলায় আস্তে সুস্থে বাড়ে জটলা। ভাঙা দেয়ালে
রাঙা এক পাখি হিন্দি ফিল্মের নায়কের মতো শিস দ্যায়।
ড্রেনের ধারে কান্তিমান কুকুর
সোহাগ কুড়ায় সঙ্গিনীর।
ঢাকা, হে শহর আমার, তখন সেই মুহূর্তে,
অনেক বছর আগে একজন সদ্য যুবক
কায়েৎটুলীর রৌদ্রছায়ার আস্তানাময় গলির এক দোতলা বাড়িতে
প্রথম দেখলো তোমার পুরানো নন্দিত প্রেমিককে।
তাঁর সত্তায় তুমি ঝরিয়ে দিচ্ছিলে তোমার আলোর আদর,
তাঁর চোখে-মুখে তোমার নিঃশ্বাস আর তিনি
কেন স্বপ্ন-বিহবল সৃষ্টিতে
তাকাচ্ছিলেন আশপাশে, কী যেন খুঁজছেন। বহুকাল উজিয়ে
তিনি এসেছেন দেখতে তুমি কেমন আছো। বারবার
তাঁর চোখ একটা রুপালি জাল ছুঁড়ে দিচ্ছিলো
বাইরে, হয়তো তোমার অতীতের
কিছু শালিক কি চড়ুই ধরার জন্যে।

এবং সেই সদ্য যুবক দেখছিল তাঁকে, যেমন কোনো
পরাক্রান্ত বিদ্রোহের প্রতি তাকায় ভক্ত।
যুবক জানতো, কাব্যবলায় তিনি চূড়াস্পর্শী পারদর্শী আর
গদ্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। খ্যাতি ধীমান সেই পুরুষের
পায়ে পায়ে ঘোরে শীয়ামিজ বেড়ালের মতো । পেশাদার সমালোচক,
উঠতি কবি, তুখোড় বুদ্ধিজীবী, লাস্যময়ী মহিলা,
সবাই বেজায় ভন্‌ ভন্‌ করছিলেন তাঁকে ঘিরে; তিনি
সেই মৌচাকের কেন্দ্রবিন্দু হয়েও যেন সেখানে ছিলেন গরহাজির।

তিনি সেই সদ্য যুবার দিকে তাকালেন একবার, এরকম দৃষ্টিতে
স্নেহপরায়ণ পিতাই তাকান তাঁর সন্তানের দিকে,
আর এ-ও এক বিস্ময়, বহুজনের মধ্য থেকে সদ্য যুবকেই
নির্বাচিত করলেন
একটি দায়িত্ব পালনের জন্যে। ধবধবে কবুতরের মতো
একটা খাম ওর হাতে দিয়ে
বললেন, ‘এটা পৌঁছে দিও’। তারপর ধরালেন
সিগারেট; ছন্দমিল, মনে হলো এক ঝাঁক
আগুনে রঙের ফড়িং আর প্রজাপতি হ’য়ে তাঁর
চারপাশে ওড়াউড়ি করছিল।

সভা যখন ভাঙলো,ফিকে রক্তজবার মতো রঙ
যখন পশ্চিম আকাশে,
তখন সেই সদ্য যুবক কায়ৎটুলীর গলি ছেড়ে
পা বাড়ালো বড় রাস্তায়। এই চিঠি তাকে
পৌঁছে দিতে হবে আজই। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে
সে হয়রান-পেরেশান হলো,
কিন্তু শেষ অব্দি কিছুতেই শনাক্ত করতে পারলো না বাড়িটাকে।

একটা বাড়ি মাস্তানের মতো চুল ঝাঁকিয়ে
মস্করা করলো তার সঙ্গে,
অন্য এক বাড়ি বৃদ্ধের মতো মাথা নেড়ে নেড়ে
বলেন, ‘এতকাল আছেই এখানে, কই এই ঠিকানার
কথা তো শুনিনি কখনো!’
অট্রহাসি হেসে আমার উৎসাহকে ঝরাপাতার মতো
উড়িয়ে দিলো অহংকারী এক বাড়ি।
কাল অবশ্যই বিলি করবো এই চিঠি, নিজেকে আশ্বস্ত ক’রে
সেদিনের মতো সে ফিরে গেল নিজের ডেরায়।

পরদিন ভোরবেলা সে গেরো অভীষ্ট ঠিকানার
খোঁজে। কী অবাক কাণ্ড, সেখানে
কোনো বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই, শুধু প্রকাণ্ড এক মাঠ
ধু-ধু করছে। মাঠে সে প্রেতাত্মার ধরনে ঘুরলো অনেকক্ষণ,
ঠিকানা ভালো ক’রে পড়ার জন্যে আবার সে চোখ বুলালো
খামের ওপর। খাম সেই মাঠের মতোই ফাঁকা,
ওতে কালি একটি আঁচড়ও নেই। তারপর
বছরের পর বছর
এক ঠিকানাবিহীন ঠিকানায়
চিঠি বিলি করা’র উদ্দেশে ক্রমাগত তার আসা-যাওয়া।

ভাড়াটে

পুরানো ভাড়াটে চলে গেলে কোনো বাসা বেশিদিন
খালি পড়ে থাকে না এখন।
পুনরায় ‘বাড়ি ভাড়া দেওয়া হইবেক’ ফলকটি
বসতে না বসতেই সরে যায়, অন্ধকার
ঘরে আলো জ্বলে, বারান্দায় হেঁটে যায় কেউ কেউ,
জানালায় পর্দা লাগে, শিশুর আনন্দধ্বনি বাজে
মাঝে-মাঝে, কাসেট প্লেয়ারে
রবীন্দ্রনাথের চিরকালীন গহন ব্যাকুলতা।

এখানে সিঁড়িতে আগেকার কেউ যে-কথা বলেছে
প্রায়ই তার প্রতিধ্বনি এখন আরেক
কণ্ঠে জাগে। অনেক পুরানো সিন্দুকের ডালা-খোলা
গন্ধময় স্মৃতি ঘোরে আনাচে কানাচে। কার হাসি
সোনালি ঘণ্টার মতো বেজে ওঠে হেমন্ত-বিকেলে?
এখন যে ভায়োলেট-রঙ
শাড়ি প’রে সাজাচ্ছে চায়ের সরঞ্জাম,
তার? নাকি আগেকার কারো?

পুরানো দেয়ালে কিছু দাগ জমা হয়, সাঁঝবাতি
জ্বালায় না কেউ;
অন্দরে বেদনা শুয়ে আছে সাবলীল ঘরে-ফেরা
নাবিকের মতো, বয়ে যাওয়ার সময়, তবু
টেবিলে আসে না কেউ। ভোরে
দরজার কাছে এসেছিল ট্রাক, একটি কি দু’টি কাক
ছাদের কার্নিশে উঠেছিল ডেকে। কোথায় যে গেল
ওরা লটবহরসমেত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি রেখে?

মশারির ঘেরাটোপে

মশারির ঘেরাটোপে চোখ মেলে দেখি-
অন্ধকার সরে যাচ্ছে, যেন
জেলে আস্তে সুস্থে তার জাল
ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছে খুব
নিরিবিলি; একটি কি দুটি পাখি ডাকে,
নারকেল গাছের পাতার ঝিলিমিলি,
মেঝেতে গড়ায় প্রজাপতি, মরা; হাওয়া,
বাথরুমে গেলে নিলবে তো
পানি? যাই। প্রতিবেশী বাড়ির জানলা
খোলা, হলদে পর্দা নড়ে
এবং আমার ঘরে ওড়ে কত পদাবলী নানান যুগের,
দেয়ালে দেয়ালে, বারান্দায়
সকালবেলার স্বাধিকার।
বাজলো কলিং বেল, দরজাটা খোলো।

খবরের কাগজের চেনা গন্ধ, আসছে পাশের
ঘর থেকে
চায়ের সোনালি ঘ্রাণ, টোস্টার সেঁকছে
ঈষৎ বাদামি রুটি; লেখার টেবিলে
বসে আছি, শুক্রবাসরীয়
পাতায় বন্ধুর কবিতার দ্যুতি, খরার বাত্তিরে
বিদ্যুল্লতা, তাঁর
সঙ্গে কাল ফোনে হয়েছিল কিছু কথা,
সে-কথায় অসমান্য ঝলক লাগেনি,
তিনি কি লেখেন সত্যি, নাকি অন্য কেউ,
অন্তর্গত, গোপনে জপায়
তাঁকে অলৌকিক
তস্‌বিদানার মতো অক্ষরের মালা?
খরায় লেখনী তাঁর হোক
অন্নপূর্ণ; খাবারের প্লেট,
কানায় কানায় ভরা হাতে
এলেন গৃহিণী, চলে যাই একা-একা
মায়া কাননের দিকে।
তাকেই কি বলে কেউ ইদানীং অজানা স্টেশন
রহস্যের কুয়াশায় মোড়া?

মোটর কারের হর্ণ, গলি
শকুন্তলা, চমকে তাকায়, যায় সুটকেস আর
সামান্য সম্বল নিয়ে একজন রিকশায়, গিটার
হাতে; মুটে বয় সব্জিময় ঝাঁকা, হাঁকে মাঠা-অলা।
কবেকার নির্ঝরের গান লীলায়িত
সমগ্র সত্তায় অকস্মাৎ
মনে হয়-কয়েক শতাব্দী আগে ছিলাম কুটিরে
পদকর্তা মাঝে-মধ্যে অর্ধাহারে অথচ হৃদয়ে
উঠতো বেজে যখন তখন অনন্তের সুর, ছুটে
যেতাম রোদ্দুরে পুড়ে নীলাম্বরী শাড়ি-পরা সেই
গৌরী ধোপানীর ঘাটে। তার অঞ্জলিতে
ওষ্ঠ রেখে ব্রাত্যের দূরত্ব মুছে ফেলে
আমার তৃষ্ণার জল করতাম পান,
অমরতা নিয়েছিল দত্তক আমাকে।

মুখিয়ে রয়েছে

[সালেহ চৌধুরী বন্ধুবরেষু]

মধ্যরাতে একা রিক্‌শা থেকে নেমে দেখি, কী আশ্চর্য,
মুখিয়ে রয়েছে চির চেনা বাড়ি, যেন
আমাকে চেনে না, যেন তার বাসিন্দার ঘ্রাণ নেই
আমার শরীরে।
দরজার কড়া বাজাবার
সাহস হলো না, কিছুক্ষণ নিজের বাসার কাছে চুপচাপ
অচেনা লোকের মতো অস্বস্তির ঘামে
নেয়ে উঠি, একবার সরে যাই, ফিরে আসি ফের।
আমার এ আচরণ
নিজের কাছেই কী রকম খাপছাড়া
লাগে, দেখি অকস্মাৎ মাটি ফুঁড়ে আঁধারে লাফিয়ে ওঠে তিন
মাথা-অলা নরকের দ্বারের কুকুর।
চোখের পাতার স্তূপ থেকে বাহু তুলে

উঠে আসে একটি কুমারী,
তারপর প্রবাল রঙের শাড়ি খুলে হেঁটে হেঁটে চলে যায়
ধারারো নখের ঝোপঝাড়ে।

ক্ষুধারও আঙুল আছে, আছে নোংরা নখ,
যা উপড়ে আনে নাড়িভুঁড়ি, বলে তিনজন ঢ্যাঙা, প্রায় নাঙা,
ভিখারী ছায়ার মতো দাঁড়ায় আমার
কাছ ঘেঁষে, মাথা তোলে নরকের দ্বারের কুকুর।

বাড়িটার চোখ ফেটে পানি পড়ে, রক্ত ঝরে, বুড়ো
ভিখারীরা রক্ত চেটে খায়,
কে যেন বিছিয়ে দ্যায় পারস্য গালিচা,
গালিচায় হেঁটে যেতে গিয়ে অন্ধ পাখির ধরনের উড়ে যাই।

যখন কখনো চণ্ডীদাস

যখন কখনো চণ্ডীদাস মধ্যরাতে নক্ষত্রের
দিকে তাকাতেন, মনে হয়, তখন দু’চোখ তাঁর
বাষ্পময় হয়ে উঠতো, অকস্মাৎ নামহীন ভয়
করতো দখল তাঁকে; হয়তো নিঃসীম শূন্যতা দেখে
ভূমণ্ডলে, নভোমগুলের স্তরে স্তরে, অস্তিত্বের
তন্তজালে, শিহরিত হতেন নিজের অগোচরে।
অথবা তখন দেখতেন প্রথম কদম ফুলে
ক্ষয়চিহ্ন, রজকিনী প্রেমের সম্ভাব্য নশ্বরতা
করতো কি বিচলিত তাঁকে? দূরাগত কোকিলের
আর্ত ডাক তাঁর পদে কীসের অস্পষ্ট গুঞ্জরণ
ব্যাকুল মিশিয়ে দিতো! অনাগত সময়ের ধ্বনি?
হতে পারে, নিঃস্ব কবি একদিন হেঁটে যেতে যেতে
দেখলেন মাধ্যাহ্নিক ভস্মরাশি নিয়তির মতো
তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। অপার ঔদাস্যে তিনি,
নাকি বিলুপ্তির অন্ধ ভাবনায় ভেসে পুকুরের
ঘাটে এসে বসলেন চুপিসারে। সবার উপরে
সত্য যে মানুষ তার ভিড় কিংবা খুব একা কেউ
মনের ভেতরে তাঁর নৈঃশব্দকে করে গান। তিনি
গুঞ্জরিত মনে গিয়ে গৌরী ধোপানীর সন্নিকটে
নিঃস্বতাকে বানালেন অপরূপ স্মৃতির ভূষণ।

যাচ্ছি প্রতিদিন

জানো কি কোথায় আছি? আমার নিবাস
একটি ঠিকানা শুধু, বলা যায়, ফেলে-যাওয়া কোনো
খামে লেখা, তোমার নিকট,
তার বেশি নয়।

এ-ঘরে আসোনি কোনোদিন,
কী রকম ভাবে
কাটে বেলা এখানে আমার, পায়চারি
করি কতক্ষণ কিংবা চেয়ারে হেলান
দিয়ে দূর আকাশের দিকে
তাকাই কখন, কতটুকু
দেখি প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি, অথবা কখন
কী মোহন ভূতগ্রস্ততায়
লেখার টেবিলে ঝুঁকে গোলাপ এবং
ফণিমনসার ঘ্রাণময়
পর্ব ভাগ করি,
তোমার অজানা।

আজো আছি, অসুস্থ বৃদ্ধের
ঈষৎ কাঁপুনি
বাড়িটার সার গায়ে। মেশিনের ঝাঁকুনি সত্তায়
গাঁথা, টলে মাথা, বুক কখনো মেঘলা
হয়ে আসে। মাঝে-মাঝে বড় অবাস্তব
মনে হয় এই ডেরা। তোমার নমিত
পদচ্ছাপ এখানে পড়েনি বলে? চোখ
ফটোগ্রাফে, অন্য ছবি, এলোমেলো, ছায়া ফেলে মনে হয়;
কিছুই হবে না জানি, অথচ সর্বদা অপেক্ষার
চোখ অনর্গল।

শিরাপুঞ্জে মেশা
আজো বটে অসংখ্য জোনাকি।
বাসা-বদলের নেশা নেই, তবু যেতে চাই, দেখি
ছায়াচ্ছন্ন চিত্রনাট্যে নানা দেশী উদ্বাস্তর ভিড়,
গুপ্ত প্রেসে ছাপা
পুস্তিকার মতো ভবিষ্যৎ
জপায় নিষিদ্ধ মন্ত্র। যদি
তুমি কোনোদিন আসো এখানে এ-ঘরে
দেখবে তখনও আছি, নাকি পর্যটনে
দৃশ্যান্তরে? হবে না তেমন
প্রত্যহ কিশোর খোজে যেন
কিছুই, হলেও নেই ক্ষতি।
অলক্ষ্যে প্রকৃত
আমার নিকট আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি প্রতিদিন।

রঙ

এই পৃথিবীতে দেখতে দেখতে
অনেক কিছুরই রঙ বদলায়,
এই চিরচেনা আকাশের রঙ-
তা-ও চদলায় অবেলায়।
কখনো কখনো মেঘ হয়ে যায়
গ্রাম্য মেলার ঢ্যাঙা এক সঙ,
কখনো সে মেঘ এক লহমায়
সুরসুন্দরী, কখনো ঝিনুক,
বুদ্ধ রাজার বিষণ্ন মুখ।
কোনো কোনো ফুল রঙ পাল্টায়,
কোনো কোনো প্রাণী পারে আগাগোড়া
বদলাতে রঙ। শুধু ডোরাকাটা
বাঘ পারেনাতো পাল্টাতে, হায়,
তার বিখ্যাত জ্বলজ্বলে ডোরা।

 শব্দের কাছেও

শব্দের কাছেও মাঝে-মধ্যে খুব শান্তি পেয়ে হয়।
দীর্ঘবেলা কাটিয়েছি শব্দের সহিত,
কখনো সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলে সজীব লতার মতো
দেখি টান থেকে যায়, থাকে
এখান সেখানে মায়া, বিষণ্নতা, আনন্দের স্মৃতি।

বাউল যেমন গোধূলিকে একতারাময় বড়
উদাস বাজায়,
কখনো-সখনো শব্দ আমাকেও তেমনি করে ধ্বনি,
সমগ্র সংগীত হয় আমার ভিতরে। তবু জানি
শব্দের কাছেও মাঝে-মধ্যে খুব শান্তি পেতে হয়।

আজো সারাদিনমান আমি শব্দের কথাই ভাবি।
কখনো অত্যন্ত প্রয়োজনে, কখনো-বা, যতদূর
মনে হয় প্রয়োজনহীন
শব্দ খুঁজে নিরুদ্দেশ

গভীর জঙ্গলে, ঝর্ণা তলে, পাহাড়ের
দুর্গম জটিল পথে, সাগর সঙ্গমে, গুপ্ত দ্বীপে।
শব্দের নিজস্ব রীতি সৃষ্টি হয় আনাচে কানাচে
অগোচরে, প্রকাশ্যেও, শব্দ জায়মান
রৌদ্রজ্বলে যেন লতাগুল্ম।
শব্দের কাছেও মাঝে-মধ্যে খুব শান্তি পেতে হয়।

আমিও জেনেছি শব্দ প্রতিশোধপরায়ণ খুব
প্রেতের মতন-
কখন যে রক্ত শুষে নেয়, লেবু কাঁটা হয়ে শ্রুত
ক্ষত তৈরি করে
সত্তাময়। কখনো-বা শিং-অলা হরিণের সরল ধরনে
কেবলি জড়িয়ে যাই শব্দের লতায়। কিছু শব্দ
আমার ভিতরে জেগে ওঠে অকস্মাৎ
আমারই অজ্ঞাত।

যেশাসের গাধাটিকে মনে রেখে উচ্চারণ করি
‘গর্দভ’ এবং সব ওলোট-পালোট, তছনছ হয়ে যায়।
বাসগৃহ ব’লে আমি হেঁটে যাই প্রফুল্ল শরীরে,
অথচ আশ্রয়ে নয়, পৌঁছে যাই বিশদ শ্মশানে।
ভালোবাসা উচ্চারণ করতে গিয়ে হৃদয়ের স্বরে বারংবার
কী রুক্ষ ধিক্কার নিয়ে ফিরে আসি নিজস্ব গুহায়।

মাধিফলক ছুঁয়ে

[মতিউল ইসলামকে স্মরণে রেখে]

বার্ধক্যের ভগ্ন স্বর, মাঝে-মধ্যে শ্বাসকষ্ট, কখনো আবার
পিত্তশূল, আর কখনো-বা মনোভার
নিয়ে কাটিয়েছো বেলা।
কখনো কি হয়েছে সংশিত সাধ ভেলা
ভাসাতে অলক্ষ্যে রাতে তিতাসের জলে? কিংবা ঘুম
ভেঙে গেলে কোকিলের আহ্বানে নিঝুম
হয়েছে কি মনে
পৃথিবীকে বড় বেশি? হঠাৎ গোপনে
খুলেছিলে কবিতার ধূলিম্লান খাতা? কত কথা
দিয়েছিল উঁকি মনে, শিউরে উঠলে দেখে মরুর শূন্যতা।

একদা সুদূর ঝাঁঝাঁ যৌবনের উদ্দাম আবেগে
যেসব সুন্দরী তুমি দেখেছিলে বারবার ভাসমান মেঘে,
বনের কিনারে,
ডাগর নদীর ঢেউয়ে, লতাঘেরা পাখি-ঝলসিত ঝোপঝাড়ে,
যাদের বুকের উপত্যকা
তোমার হৃদয়ে বিলিয়েছে পুষ্পঘ্রাণ, পলাতকা
অকস্মাৎ তারা সেই কবে
উধাও সৌরভে
স্মৃতির প্রচ্ছায়া রেখে। যে-স্বপ্ন তোমার চিদাকাশে
ক্ষণে ক্ষণে বীতখেদ কুসুমের মাসে
স্মরণাতীতের অলো
জ্বেলেছিল, সে-ও হায়, ছায়ার মতোই ধু-ধু ছায়ায় মিলালো।

মাঝে-মাঝে আমার সংশয়ী মনে জাগে
এক প্রশ্ন, অস্বস্তির কাঁটাবেঁধা-তোমার অন্তরে অস্তরাগে
দুরুহ টানেনি, বুঝি তাই
যার পর নাই
সহজিয়া অধ্যাত্মবাদের আমন্ত্রণী মরীচিকা
জ্বেলেছিলো শিখা
তোমার বিহবল চোখে, নাকি
অন্য কোনো ফাঁকি
তোমাকে ভুলিয়ে অন্য পথে ছন্দমবেশী ঠিকানার
দিলো খোঁজ আর
মনে পড়ে
অত্যন্ত ঝিমিয়ে-পড়া পাখির মতন দ্বিপ্রহরে
প্রগাঢ় বলেছিলে দূর বনান্তের স্তব্ধতায়-
সমাধিফলক ছুঁয়ে ফড়িং এবং প্রজাপতি উড়ে যায়।

সুপ্রাচীন পাণ্ডুলিপি

সুপ্রাচীন পাণ্ডুলিপি গাংচিলের ধরনে আসে
আমার নিকট,
তুলোট কাগজ নয়, ভূর্জপত্র নিশ্বাসে প্রশ্বাসে
মেশায় সুদূর ঘাণ। দু’টি সুডৌল মংগলঘট
জানে দোরগোড়ায় কখনো স্বপ্নে বুঁদ
হলে কারো বাড়া ভাতে ছাই
পড়বে না; স্মৃতির বুদ্বুদ
কেবলি উঠতে থাকে পাণ্ডুলিপি থেকে। যে-শানাই
স্তব্ধ ছিল বুকের ভেতর এতকাল,
স্মরণীয় চোখের মতন অক্ষরের আকর্ষণে
বেজে ওঠে, কবেকার নহবতখানা ভাসমান, বাঘছাল
আর পাণ্ডুলিপি করে গলাগলি মহুয়ার বনে।

যদি প্রশ্ন করি,
এই পাণ্ডুলিপি কার, পাবো না উত্তর
কস্মিনকালেও। হতে পারে ভর্তুহরি
কিংবা বানভট্র নিরন্তর
সাধনার পর প্রত্যুষের সিঁথির সিঁদুর আর
অরণ্যের বিবাহ ঘটিয়ে করেছেন যজ্ঞমানি
শাশ্বতের; উড়ন্ত এ ভূর্জপত্রে তার
স্বাক্ষর আঁধারে যেন ফ্রুয়োসেস্ট-বাণী?
সেঁজুতিও বলা যায়। এই পাণ্ডুলিপি
সুধীন্দ্রনাথের সংবর্ত খুলে পেয়েছি কি আমি।
মোদো মধ্যরাতে? নাকি বোতলের ছিপি
ব্যাকুল খুঁজতে গিয়ে গৃহকোণে পেয়েছি? জানেন অন্তর্যামী।

দূরাগত পাণ্ডুলিপি দৃষ্টি মেলে, যেমন তাকায়
সদ্যমুক্ত প্রফুল্ল কয়েদী মেঘে মেঘে
ভাসমান পাখিদের প্রতি। খুঁটে খায়
রৌদ্র জ্যোৎস্না, কখনো সুপুরিগাছে লেগে
থাকে যেন কাটা ঘুড়ি। কখনো সে অভিভাবকের
ঢঙে বলে গাঢ় কণ্ঠস্বরে
‘ওহে তোমাদের
এখন কিছুই নেই ঠিক ঠাক। তোমাদের স্নেহ-ছাওয়া ঘরে
দিয়েছে আগুন যারা, তারা
আপাদমস্তক পরে সুহৃদের সাজ,
নকল গৌরবে আত্মহারা
করছে ধ্বংসের কী ব্যাপক ভয়ংকর কারুকাজ’।

সেতুবন্ধ

ভরাট চাঁদের সঙ্গে করোটি বদল করে প্রবীণ চণ্ডাল
পোয়াতির উদরের মতো
মাটির কলসে দ্যায় তবলার চাঁটি ক্রমাগত;
এক ঝাঁক পাগলা কুকুর, চন্দ্রাহত, নেচে ওঠে,
খাবলে খুবলে নেয় তুলে
দেবতার বায়বীয় শরীরের খাল!
চিতার ধোঁয়ায়
পূর্বমেঘ ভাসে, নদীবক্ষে গ্রিনবোটে
দুলে দুলে
কতিপয় ছায়া জামাজুতো ফেলে পপ গান গায়।
স্বপ্নেরা আলতো মাথা রাখে ঢুলঢুলু
চণ্ডালের কাঁধে,
শেয়ালের দুরাগত উলু
শুনে দিকগুলি চমকিত, কে যেন ফুঁপিয়ে কাঁদে
বিষকাটালির ঝোপে, সম্প্রতি বিধবা
যুবতী আঁধারে একাকিনী
ঘোরে কোনো উনিশ শতকী নায়িকার
মতো রক্তজবা
নিয়ে তার সধূম হৃদয়ে। চণ্ডালের স্বাধিকার-
প্রমত্ত শোণিতে কী প্রবল বৈদ্যুতিক রিনিঝিনি।

চুপিসারে এল একজন, যেন ঝানু গুপ্তচর,
পরনে জীনস্‌ তার, সমস্ত শরীরে
চরসের গন্ধ সাঁটা, সাত ঘাটে জল-খাওয়া, চালচুলো ঘর-
দোর নেই, ঘুরেছে সে দীর্ঘ কাল হাভতের ভিড়ে
চেনে বারবনিতার কোঠা, ড্রাগ, বোতলের ছিপি;
জলপিপি, সোমত্ত সারস, নদীতরবর্তী কাশ,-
সবকিছু সহচর এবং সাইডব্যাগে তার
ঝোলে টগবগে পাণ্ডুলিপি;
ডিজেলের ধোঁয়ায় এবং গলি ঘুপচিতে, নর্দমার
ধার কী সহজে ভাসে, যেন অমলিন রাজহাঁস।

উড়ুক্কু শরীর তার চণ্ডালের দেহে লীন, ঘটে
উল্টে পড়ে আছে ভাঙা নৌকা, ভেজা ডাঙায় কোমল পদচ্ছাপ;
সে, চণ্ডাল, পদচ্ছাপ খুঁজে হাঁটে,
তার বর্তমান চূর্ণ কলসের মতো, মনস্তাপ
তোলে মাথা অন্তর্গত দ্রাবিড় গোধূলি
আর্তনাদে প্রতিধ্বনিময়
এবং ঠুনকো স্বপ্নগুলি
ঘাসফড়িং-এর মতো উড়ে উড়ে শুধু গুঁড়ো হয়,
মোদো চোখ মেলে বসে থাকে উন্মাতাল
বিংশ আর একবিংশ শতাব্দীর মধ্যিখানে প্রবীণ চণ্ডাল।

স্থানান্তর

এটাই তো শেষ কিস্তি প্যাক-করা লটহরের, এরপর
কিছুই আমার থাকবে না
এখানে। না প্লেট, না পিরিচ, বুক শেলফ। পেট্রোলের
গন্ধ জোরে চেঁচায় গলিতে, কিছু চিহ্ন থেকে যাবে
ভিন্ন রূপে; তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে
কে যাচ্ছে? নির্বাল্ব ঘর,একা
মাঝ-ঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছি, যেন গুহার ভেতরে
আদিম পুরুষ।
শ্রাবণ সন্ধ্যায়
লাগবে বৃষ্টির ছাঁট জানালায়, শারদীয় রোদ
দেবে গড়াগড়ি মেঝে জুড়ে, মাঝে-মাঝে
হাওয়া দরকার
থুতনি নাড়িয়ে দেবে খোলা
বারান্দায় চকোলেট-রঙ বিড়ালিনী, ছানা ওর
দুধ খাবে কার্নিশে বসবে কবুতর—
দেখবো না।
হঠাৎ ঝিকিয়ে ওঠে মনে
কবিতার অক্ষরের মতো স্মৃতি,—
মখমলী চটিতে লুটিয়ে-পরা শাড়ি,
জ্যোৎস্নারাতে কারো কী মদির
তাকানো, হৃদয়প্লাবী গান। শেষ বেলা
ফ্যালে দীর্ঘশ্বাস, তাড়াতাড়ি
চলো, সিঁড়ি বড় অন্ধকার, মালাগাড়ি গলিতে প্রতীক্ষাস্তব্ধ,
নীড়ভাঙা পাখির ধরনে আমি কোথায় চলেছি?

আরো কিছুক্ষণ এ জায়গায় দাঁড়াবার
কিংবা বসবার, চতুর্দিকে
তাকাবার সাধ জাগে নাকি? দেয়ালটা চুঁয়ে দেখি
একবার? এখনো চড়ুই দু’টি কড়িকাঠের ফোকরে আনে
খড়কুটো, নিরর্থক চোখ খচ্‌খচ্‌
করে, রুমালটা কই? সিমেন্ট ও বালি,
ইট চুন জানবে না কোনোদিন এই বাড়ি ছেড়ে
কে গেল? কোথায় গেল? কেন যেতে হলো?

স্বপ্নের নাম শ্রীমতী

কতিপয় হত্যাকারী, অতিশয় নিষ্ঠাবান, কেউ কানে খাটো,
একচুক্ষ কেউ,
কেউ বা ঈষৎ খোঁড়া, প্রাচীন ছোরার মতো কেউ,
রাত্রিদিন ঘোরে

চারদিকে নানা ছদ্মবেশে
আমার প্রকৃত স্বপ্ন হননের জন্মন্ধ লিপ্সায়।
ওদের সান্নিধ্যে ওড়ে দুর্মর বাদুড় শত শত,
ওদের নিঃশ্বাসে বয় আজরাইলের
তিমির নিশ্বাস।
নগর পোড়াতে পারে ওরা, পারে হওয়ায় উড়িয়ে দিতে
গ্রামের সকল ঘাস, সহজে বানাতে পারে হাজার হাজার
বস্তিকে বিধ্বস্ত গোরস্থান।

নরখাদকের মৃত্যু দেখি অধুনা সর্বত্র, দেখি
ওরা দ্বিধাহীন
প্রকাশ্যে সাজিয়ে রাখে লাশ,

তামস ভঙ্গিতে
আমাকে আহার করে চেটেপুটে, আমার ভগ্নাংশ
থাকে পড়ে এক কোণে, মাথাটা অভুক্ত থাকে শুধু
এবং নিজেকে মনে হয়
পরাস্ত দেশের মতো অত্যন্ত ধোঁয়াটে,
হাহাকারময়, স্বপ্ন চেয়ে থাকে আমার উদ্দেশে
উপদ্রুত মানুষের মতো।

আমার স্বপ্নের আছে ঘুরঘুট্রি আঁধারের ভয়,
আমার স্বপ্নের আছে রাতে পোকামাকড়ের ভয়,
মাটির তলায় নিত্য জিন্দা দাফন হবার ভয়
আমার স্বপ্নের ভয়, যদি
সহসা সাতায়
বাজ ভেঙে পড়ে,
ব্যাধের ফাঁদের ভয় আমার স্বপ্নের অহর্নিশ।
মাইল মাইলব্যাপী জনমান্ধের ভিড়ে
আমার আপন স্বপ্ন ভয়ে
কাঠ হয়ে থাকে।
কিছু স্বপ্ন, যতদূর জানি,
আকাশে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেই
চকিতে মিলিয়ে যায় আলোয় হাওয়ায়,
অশত্থ গাছের নিচে মেতে ওঠে আত্মহননের নান্দীপাঠে,
কোনো কোনো স্বপ্ন ফের ফিনিক্সের মতো
জন্মন্তরলোভী,
বারবার ডানা ক্ষিপ্র ঝাপটায় সজীব, গান গায়
চেতনায়, বুঝি তাই হত্যাকারী স্ট্রাটেজি পাল্টায় প্রতিদিন।

আমার স্বপ্নের নাম রেখেছি কখনো, পুনরায়
ভুলে গেছি শত ডামাডোলে, হট্ররোলে।
আমার অনেক স্বপ্ন শিরোনামহীন
কবিতার মতো রয়ে গেছে
এবং কখনো
ব্যর্থ মানুষের
চোখের পানির মতো ঝরে বারে-বারে রিক্ত ফুটপাতে,
নিদ্রাছুট আহত বালিশে।

কখন যে কবে কোন সালে, খ্রিস্টপূর্ব কালে?-মনে মনে শুধু
একটি স্বপ্নের নাম রেখেছি শ্রীমতী আজ আর
মনেই পড়ে না।
সে স্বপ্ন, শ্রীমতী নাম্নী স্বপ্ন, একজন
সোনালি মাংসল স্থাপত্যের মতো জেগে থাকে।

তপ্ত হত্যাকারীর দঙ্গলে,
মঙ্গলের চেয়েও অধিক ভয়ঙ্কর লোকালয়ে,
পাশব নিবাসে, আর বিপুল নৈরাশে
নিবিড় সৌন্দর্য তার আমার মুখের রেখাবলী
থেকে দুঃখ পান করে প্রহরে, প্রহরে…
আমি সে স্বপ্নের মমতার তটরেখা থেকে আর
কোনোদিন জাগতে চাই না।
সেখানে স্মৃতিরর চন্দ্রোদয়, কিংদন্তির মতো
সেখানে বসন্ত আসে বারেবারে; আবার পালিয়ে যায়, যাক;

স্বর্গের বর্ণিল স্মৃতি

এই তো দাঁড়ানো তুমি সম্মুখে আবার একাকিনী
চোখে নিয়ে শতাব্দীর অস্তরাগ। মনে হয়, সাত
সুমুদ্দুর তের নদী পেরিয়ে এসেছো, রিনিঝিনি
রক্ত বাজে আমার শিরায়। জ্যোৎস্নাময় মধ্যরাত
তোমার শরীর, স্মিত ত্বকে বাংলাদেশের গ্রীষ্মের
মোহন দহন প্রাথমিক এবং তোমার ঠোঁট

যেন তরমুজ-ফালি তৃষ্ণার্তের কাছে। এ দৃশ্যের
বর্ণনা কী করে দিই? পারতেন নক্ষত্রের কোট-
পরা কোনো চিত্রকর ভালোবেসে আঁকতে তোমাকে,
পারতেন সহজেই ফর্ম ভেঙে পিকাসো মার্তিস
নব্য কোনো ফর্মে অমরতা দিতে তোমার সত্তাকে।
গোপনে তোমাকে দেখে দেবতাও দেয় দীর্ঘ শিস।

আমার স্বপ্নের অন্তরঙ্গ সবুজ উপত্যকায়
তোমার যৌবন শত নীলকণ্ঠী পাখি সৃষ্টি করে,
যে-যৌবন গুণীর তানের মতো ঢেউ দিয়ে যায়
নিসর্গের জায়মান আনাচে কানাচে। বায়ুস্তরে
বিদ্যুল্লতা, জ্বলজ্বলে নগ্নতাকে ঢাকবার ছলে
রাখো হাত যোনিতে এবং সামুদ্রিক উদ্ভিদের

ঘ্রাণ জেগে থাকে বাহমূলে, দুটি শ্বেতপদ্ম জ্বলে
বুকে নির্নিমেষ, বুঝি তুমি হাতের মুঠোয় ফের
রহস্য রেখেছো পুরে, আমার গহন অন্তস্তলে
শামুক, পাথর, শঙ্খ এবং সোনালি মাছ মাতে
বন্দনায় তোমার নিদ্রিত নগ্নতার ছায়াবীথি
গড়ে ওঠে তোমার আমার মধ্যে ঢেউয়ের আঘাতে।

এমন নীরব তুমি, যেন কোনো ভাষা জানা নেই
এখনো তোমার, শুধু এক সুর উভিন্ন সত্তার
বাঁকে বাঁকে বয়ে যায়। হে আমার নতুন অতিথি,
ফেনা থেকে উঠে-আসা, আমার হৃদয় তোমাতেই
নিজস্ব আশ্রয় খোঁজে। জলবিন্দুময় স্তনভার
আমার চৈতন্যে আনে হৃত স্বর্গের বর্ণিল স্মৃতি!

 হৃদয় কপিলাবস্তু

মানব হারায় পথ বারংবার, জগৎ সংসার
সুবিশাল ঊর্ণনাভ হয়ে প্রবল জড়ায় তাকে
সারাক্ষণ, অমানিশা সত্যকে আড়াল করে রাখে
দৃষ্টি থেকে; হয়ে যায় দৃশ্য ও অদৃশ্য একাকার।
এখন ফেরারি শান্তি, নিয়ত সংঘর্ষ পৃথিবীতে
কী ব্যাপক শ্মশানের ধোঁয়া ছড়ায় নিমেষে, শত
শত দীপ্র নগরে মড়ক ব্যেপে আসে। তথাগত
দেখলে এমন ধ্বংস হতেন ভয়ার্ত অম্বালিতে।

এই তো দেখছি আমি নিরন্নের বিশীর্ণ ভিক্ষায়
ব্যথিত সিদ্ধার্থ বসেছেন ধ্যানী উপবাসে; তিনি
সর্বব্যাপী অন্ধকার দেখে আনন্দের দিকে হাত
বাড়িয়ে সত্যের দীপ তুলে ধরেছেন। প্রতীক্ষায়
সুজাতা তণ্ডুল নিয়ে বসে আছে স্তব্ধ, একাকিনী-
হৃদয় কপিলাবস্তু, স্তূপময় পূণ্য সারনাথ।

হেড আর টেল

সকালে দাড়িতে খর রেজার চালানো, ডোরাকাটা
তুর্কী
টাওয়েলে প্রভাতী ভেজা মাথা মোছা, শুকনো রুটি
চিবোনো, অফিসে
কী ব্যস্ত রুটিন যাত্রা, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, চিঠি,
জরুরি এবং অদরকারী, রাশি-রাশি, নীরস সংলাপ,
মাঝে মাঝে টিনবদ্ধ খাদ্যের মতন প্রেমকথা,
সান্ধ্য আড্ডা, ঘুম, কোনো-কোনো রাতে কর্কশ অনিদ্রা
একটানা, সকালে দাড়িতে খর রেজার চালানো।
অকস্মাৎ ঘুমে নাকি জাগরণে, যেন কুয়াশার
অন্তরাল থেকে দেখা সামুদ্রিক উদ্যানে অজস্র
ব্যালে নর্তকের মতো মাছ, প্রবালের গা ছুঁয়ে একটি
সবুজ কাছিম নেচে ওঠে।
বাজি ধরি, মাঝে-মধ্যে নিজের সঙ্গেই বাজি ধরি-
হেড আর টেল, হেড আর টেল, হেড হেড হেড,
টেল টেল টেল
হেড টেল হেড
টেল হেড টেল।
আমার তিনটি শার্ট পড়ন্ত বিকেলে খুব উৎফুল্ল সারস,
হেড।
আমার চোখের অভ্যন্তরে নক্ষত্রের অভিসার বারংবার,
টেল।
দর্জির দোকানে ট্রাউজার ঈগলের ডানা হ’য়ে
মেঘলোকে উধাও সম্প্রতি-
হেড
গলির সেলুনে সাবানের বিবর্ণ বাটিতে ভাসে
সুগন্ধি নারীর ঘ্রাণ, টেল।
একটি সোনালি সিংহ গোলাপের সঙ্গে প্রেম করে,
হেড।
অন্ধকারে খনি শ্রমিকের ভারী পদধ্বনি সুখদ ব্যালাড,
টেল।
এই তো পায়ের নিচে বাদশাহী মোহর লুকনো,
হেড।
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সবগুলো ঝকঝকে নোট ওড়ে
পরীদের গাউনের মতো,
টেল।
কবির হাদয়ে পিয়ানোর বিড় সমুদয় নৃত্যপর,
হেড।
আইবুড়ো মেয়েটির আঙুলে ফোয়ারা, অলৌকিক,
টেল।
গ্রীষ্মের প্রখর আলপিন ফোটে সমস্ত শরীরে,
লালট ঈষৎ সিক্ত মাঠ, ক্লান্তি, চোখে তীব্র জ্বালা,
পুলিশের বাঁশি বাজে ঘোলাটে দুপুরে,
ত্র্যাম্বুলেন্স কী ক্ষিপ্র ছুটেছে হাওয়া চিরে
প্রশস্ত রাস্তায়, হাসপাতালের বেডে রোগী
আসে, রোগী যায়, হায়, লেগেছে আগুন-
দমকল বাহিনী কোথায়?
অকস্মাৎ ঘুমে নাকি জাগরণে, বুঝি কুয়াশার
অন্তরাল থেকে দেখা-পাতালের প্রবাল সিঁড়ির
স্মিত ধাপে গহন স্বপ্নের ম্যাক্সি-পরা তুমি, অবিকল তুমি,
শুধু তুমি।

Exit mobile version