Site icon BnBoi.Com

ছবি ও গান – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছবি ও গান - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অভিমানিনী

ও আমার অভিমানী মেয়ে
ওরে কেউ কিছু বোলো না ।
ও আমার কাছে এসেছে ,
ও আমায় ভালো বেসেছে ,
ওরে কেউ কিছু বোলো না ।

এলোথেলো চুলগুলি ছড়িয়ে
ওই দেখো সে দাঁড়িয়ে রয়েছে ,
নিমেষহারা আঁখির পাতা দুটি
চোখের জলে ভরে এয়েছে ।
গ্রীবাখানি ঈষৎ বাঁকানো ,
দুটি হাতে মুঠি আছে চাপি ,
ছোটো ছোটো রাঙা রাঙা ঠোঁট
ফুলে ফুলে উঠিতেছে কাঁপি ।
সাধিলে ও কথা কবে না ,
ডাকিলে ও আসিবে না কাছে ,
ও সবার ‘পরে অভিমান করে
আপ্না নিয়ে দাঁড়িয়ে শুধু আছে ।
কী হয়েছে কী হয়েছে বলে
বাতাস এসে চুলিগুলি দোলায়,
রাঙা ওই কপোলখানিতে
রবির হাসি হেসে চুমো খায় ।
কচি হাতে ফুল দুখানি ছিল
রাগ করে ঐ ফেলে দিয়েছে-
পায়ের কাছে পড়ে পড়ে তারা
মুখের পানে চেয়ে রয়েছে ।
আয় বাছা , তুই কোলে বসে বল্
কী কথা তোর বলিবার আছে ,
অভিমানে রাঙা মুখখানি
আন্ দেখি তুই এ বুকের কাছে ।
ধীরে ধীরে আধো আধো বল্ ।
কেঁদে কেঁদে ভাঙা ভাঙা কথা ,
আমায় যদি না বলিবি তুই
কে শুনিবে শিশুপ্রাণের ব্যথা ।

আচ্ছন্ন

লতার লাবণ্য যেন কচি কিশলয়ে ঘেরা ,
সুকুমার প্রাণ তার মাধুরীতে ঢেকেছে-
কোমল মুকুলগুলি চারি দিকে আকুলিত
তারি মাঝে প্রাণ যেন লুকিয়ে রেখেছে ।
ওরে যেন ভালো করে দেখা যায় না ,
আঁখি যেন ডুবে গিয়ে কূল পায় না ।
সাঁঝের আভা নেমে এল , জ্যোৎস্না পাশে ঘুমিয়ে প ‘ ল ,
ফুলের গন্ধ দেখতে এসেছে ,
তারাগুলি ঘিরে বসেছে ।
পূরবী রাগিণীগুলি দূর হতে চলে আসে
ছুঁতে তারে হয় নাকো ভরসা-
কাছে কাছে ফিরে ফিরে মুখপানে চায় তারা ,
যেন তারা মধুময়ী দুরাশা ।
ঘুমন্ত প্রাণেরে ঘিরে স্বপ্নগুলি ঘুরে ফিরে
গাঁথে যেন আলোকের কুয়াশা ,
ঢেকে তারে আছে কত , চারি দিকে শত শত
অনিমিষ নয়নের পিয়াসা ।
ওদের আড়াল থেকে আবছায়া দেখা যায়
অতুলন প্রাণের বিকাশ ,
সোনার মেঘের মাঝে কচি উষা ফোটে ফোটে
পুরবেতে তাহারি আভাস ।

আলোকবসনা যেন আপনি সে ঢাকা আছে
আপনার রূপের মাঝার ,
রেখা রেখা হাসিগুলি আশেপাশে চমকিয়ে
রূপেতেই লুকায় আবার ।
আঁখির আলোক-ছায়া আঁখিরে রয়েছে ঘিরে ,
তারি মাঝে দৃষ্টি পথহারা ,
যেথা চলে স্বর্গ হতে অবিরাম পড়ে যেন
লাবণ্যের পুষ্পবারিধারা ।
ধরণীরে ছুঁয়ে যেন পা দুখানি ভেসে যায় ,
কুসুমের স্রোত বহে যায় ,
কুসুমেরে ফেলে রেখে খেলাধুলা ভুলে গিয়ে
মায়ামুগ্ধ বসন্তের বায় ।

ওরে কিছু শুধাইলে বুঝি রে নয়ন মেলি
দু দণ্ড নীরবে চেয়ে রবে ,
অতুল অধর দুটি ঈষৎ টুটিয়ে বুঝি
অতি ধীরে দুটি কথা কবে ।
আমি কি বুঝি সে ভাষা , শুনিতে কি পাব বাণী
সে যেন কিসের প্রতিধ্বনি —
মধুর মোহের মতো যেমনি ছুঁইবে প্রাণ
ঘুমায়ে সে পড়িবে অমনি ।

হৃদয়ের দূর হতে সে যেন রে কথা কয়
তাই তার অতি মৃদুস্বর ,
বায়ুর হিল্লোলে তাই আকুল কুমুদসম
কথাগুলি কাঁপে থর থর ।

কে তুমি গো উষাময়ী , আপন কিরণ দিয়ে
আপনারে করেছ গোপন ,
রূপের সাগর-মাঝে কোথা তুমি ডুবে আছ
একাকিনী লক্ষ্মীর মতন!
ধীরে ধীরে ওঠো দেখি , একবার চেয়ে দেখি
স্বর্ণজ্যোতি-কমল-আসন ,
সুনীল সলিল হতে ধীরে ধীরে উঠে যথা
প্রভাতের বিমল কিরণ ।
সৌন্দর্যকোরক টুটে এস গো বাহির হয়ে
অনুপম সৌরভের প্রায় ,
আমি তাহে ডুবে যাব সাথে সাথে বহে যাব
উদাসীন বসন্তের বায় ।

আদরিনী

একটুখানি সোনার বিন্দু , একটুখানি মুখ ,
একা একটি বনফুল ফোটে-ফোটে হয়েছে ,
কচি কচি পাতার মাঝে মাথা থুয়ে রয়েছে ।
চার দিকে তার গাছের ছায়া , চার দিকে তার নিষুতি-
চার দিকে তার ঝোপেঝাপে আঁধার দিয়ে ঢেকেছে ,
বনের সে যে স্নেহের ধন আদরিণী মেয়ে ,
তারে বুকের কাছে লুকিয়ে যেন রেখেছে ।

একটুখানি রূপের হাসি আঁধারেতে ঘুমিয়ে আলা ,
বনের স্নেহ শিয়রেতে জেগে আছে ।
সুকুমার প্রাণটুকু তার কিছু যেন জানে না ,
চোখে শুধু সুখের স্বপন লেগে আছে ।
একটি যেন রবির কিরণ ভোরের বেলা বনের মাঝে
খেলাতেছিল নেচে নেচে ,
নিরালাতে গাছের ছায়ে , আঁধারেতে শ্রান্তকায়ে
সে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে ।
বনদেবী করুণ-হিয়ে তারে যেন কুড়িয়ে নিয়ে
যতন করে আপন ঘরেতে ।
থুয়ে কোমল পাতার’পরে মায়ের মতো স্নেহভরে
ছোঁয় তারে কোমল করেতে ।
ধীরি ধীরি বাতাস গিয়ে আসে তারে দোলা দিয়ে ,
চোখেতে চুমো খেয়ে যায় ।
ঘুরে ফিরে আশেপাশে বার বার ফিরে আসে ,
হাতটি বুলিয়ে দেয় গায় ।

একলা পাখি গাছের শাখে কাছে তোর বসে থাকে ,
সারা দুপুরবেলা শুধু ডাকে ,
যেন তার আর কেহ নাই , সারা দিন একলাটি তাই
স্নেহভরে তোরে নিয়েই থাকে ।
ও পাখির নাম জানি নে , কোথায় ছিল কে তা জানে ,
রাতের বেলায় কোথায় চলে যায় ,
দুপুরবেলা কাছে আসে- সারা দিন বসে পাশে
একটি শুধু আদরের গান গায় ।
রাতে কত তারা ওঠে , ভোরের বেলা চলে যায়-
তোরে তো কেউ দেখে না , জানে না ।
এক কালে তুই ছিলি যেন ওদেরই ঘরের মেয়ে ,
আজকে রে তুই অজানা অচেনা ।

নিত্যি দেখি রাতের বেলা একটি শুধু জোনাই আসে ,
আলো দিয়ে মুখপানে তোর চায় ।
কে জানে সে কী যে করে! তারা-জন্মের কাহিনী তোর
কানে বুঝি স্বপন দিয়ে যায় ।
ভোরের বেলা আলো এল , ডাকছে রে তোর নামটি ধরে ,
আজকে তবে মুখখানি তোর তোল্ ,
আজকে তবে আঁখিটি তোর খোল্ ,
লতা জাগে , পাখি জাগে গায়ের কাছে বাতাস লাগে ,
দেখি রে — ধীরে ধীরে দোল্ দোল্ দোল্ ।

 আবছায়া

তারা সেই ধীরে ধীরে আসিত
মৃদু মৃদু হাসিত ,
তাদের পড়েছে আজ মনে ।
তারা কথাটি কহিত না ,
কাছেতে রহিত না ,
চেয়ে রইত নয়নে নয়নে ।
তারা চলে যেত আনমনে ,
বেড়াইত বনে বনে ,
আনমনে গাহিত রে গান ।
চুল থেকে ঝরে ঝরে
ফুলগুলি যেত পড়ে ,
কেশপাশে ঢাকিত বয়ান ।
কাছে আমি যাইতাম ,
গানগুলি গাইতাম ,
সাথে সাথে যাইতাম পিছু—
তারা যেন আনমনা ,
শুনিত কি শুনিত না
বুঝিবারে নারিতাম কিছু ।
কভু তারা থাকি থাকি
আনমনে শূন্য আঁখি ,
চাহিয়া রহিত মুখপানে ,
ভালো তারা বাসিত কি ,
মৃদু হাসি হাসিত কি ,
প্রাণে প্রাণ দিত কি , কে জানে!
গাঁথি ফুলে মালাগুলি
যেন তারা যেত ভুলি
পরাইতে আমার গলায় ।
যেন যেতে যেতে ধীরে
চায় তারা ফিরে ফিরে
বকুলের গাছের তলায় ।
যেন তারা ভালোবেসে
ডেকে যেত কাছে এসে ,
চলে যেতে করিত রে মানা—
আমার তরুণ প্রাণে
তাদের হৃদয়খানি
আধো জানা আধেক অজানা ।
কোথা চলে গেল তারা ,
কোথা যেন পথহারা ,
তাদের দেখি নে কেন আর!
কোথা সেই ছায়া-ছায়া
কিশোর-কল্পনা-মায়া ,
মেঘমুখে হাসিটি উষার!
আলোতে ছায়াতে ঘেরা
জাগরণ স্বপনেরা
আশেপাশে করিত রে খেলা—
একে একে পলাইল ,
শূন্যে যেন মিলাইল ,
বাড়িতে লাগিল যত বেলা ।

আর্তস্বর

শ্রাবণে গভীর নিশি দিগ্বিদিক আছে মিশি
মেঘেতে মেঘেতে ঘন বাঁধা ,
কোথা শশী কোথা তারা মেঘারণ্যে পথহারা
আঁধারে আঁধারে সব আঁধা ।
জ্বলন্ত বিদ্যুৎ-অহি ক্ষণে ক্ষণে রহি রহি
অন্ধকারে করিছে দংশন ।
কুম্ভকর্ণ অন্ধকার নিদ্রা টুটি বার বার
উঠিতেছে করিয়া গর্জন ।
শূন্যে যেন স্থান নাই , পরিপূর্ণ সব ঠাঁই ,
সুকঠিন আঁধার চাপিয়া ।
ঝড় বহে , মনে হয় ও যেন রে ঝড় নয় ,
অন্ধকার দুলিছে কাঁপিয়া ।
মাঝে মাঝে থর হ র কোথা হতে মরমর
কেঁদে কেঁদে উঠিছে অরণ্য ।
নিশীথসমুদ্র-মাঝে জলজন্তু-সম রাজে
নিশাচর যেন রে অগণ্য ।
কে যেন রে মুহুর্মুহু নিশ্বাস ফেলিছে হু হু ,
হু হু করে কেঁদে কেঁদে ওঠে ,
সূদূর অরণ্যতলে ডালপালা পায়ে দলে
আর্তনাদ করে যেন ছোটে ।
এ অনন্ত অন্ধকারে কে রে সে , খুঁজিছে কারে ,
তন্ন তন্ন আকাশগহ্বর ।
তারে নাহি দেখে কেহ , শুধু শিহরায় দেহ
শুনি তার তীব্র কণ্ঠস্বর ।
তুই কি রে নিশীথিনী অন্ধকারে অনাথিনী
হারাইলি জগতেরে তোর ?
অনন্ত আকাশ- ‘ পরি ছুটিস রে হা হা করি ,
আলোড়িয়া অন্ধকার ঘোর ।
তাই কি রে থেকে থেকে নাম ধরে ডেকে ডেকে
জগতেরে করিস আহ্বান ।
শুনি আজি তোর স্বর শিহরিত কলেবর ,
কাঁদিয়া উঠিছে কার প্রাণ ।
কে আজি রে তোর সাথে ধরি তোর হাতে হাতে
খুঁজিতে চাহিছে যেন কারে ।
মহাশূন্যে দাঁড়াইয়ে প্রান্ত হতে প্রান্তে গিয়ে
কে চাহে কাঁদিতে অন্ধকারে!
আঁধারেতে আঁখি ফুটে ঝটিকার’পরে ছুটে
তীক্ষ্ণশিখা বিদ্যুৎ মাড়ায়ে
হু হু করি নিশ্বাসিয়া চলে যাবে উদাসিয়া
কেশপাশ আকাশে ছড়ায়ে ।
উলঙ্গিনী উন্মাদিনী ঝটিকার কণ্ঠ জিনি
তীব্র কণ্ঠে ডাকিবে তাহারে ,
সে বিলাপ কেঁপে কেঁপে বেড়াবে আকাশ ব্যেপে
ধ্বনিয়া অনন্ত অন্ধকারে ।
ছিঁড়ি ছিঁড়ি কেশপাশ কভু কান্না কভু হাস
প্রাণ ভরে করিবে চীৎকার ,
বজ্র-আলিঙ্গন দিয়ে বুকে তোরে জড়াইয়ে
ছুটিতে গিয়েছে সাধ তার ।

একাকিনী

একটি মেয়ে একেলা ,
সাঁঝের বেলা ,
মাঠ দিয়ে চলেছে ।
চারি দিকে সোনার ধান ফলেছে ।
ওর মুখেতে পড়েছে সাঁঝের আভা ,
চুলেতে করিছে ঝিকিমিকি ।
কে জানে কী ভাবে মনে মনে
আনমনে চলে ধিকিধিকি ।
পশ্চিমে সোনায় সোনাময় ,
এত সোনা কে কোথা দেখেছে ।
তারি মাঝে মলিন মেয়েটি
কে যেন রে এঁকে রেখেছে ।
মুখখানি কেন গো অমন ধারা ,
কোন্খানে হয়েছে পথহারা ,
কারে যেন কী কথা শুধাবে ,
শুধাইতে ভয়ে হয় সারা ।
চরণ চলিতে বাধে বাধে ,
শুধালে কথাটি নাহি কয় ।
বড়ো বড়ো আকুল নয়নে
শুধু মুখপানে চেয়ে রয় ।
নয়ন করিছে ছলছল ,
এখনি পড়িবে যেন জল ।

সাঁঝেতে নিরালা সব ঠাঁই ,
মাঠে কোথাও জনপ্রাণী নাই —
দূরে অতি দূরে দেখা যায় ,
মলিন সে সাঁঝের আলোতে
ছায়া ছায়া গাছপালাগুলি
মেশে মেশে মেঘের কোলেতে ।
বড়ো তোর বাজিতেছে পায়,
আয় রে আমার কোলে আয় ।
আ মরি জননী তোর কে ,
বল্ রে কোথায় তোর ঘর ।
তরাসে চাহিস কেন রে ,
আমারে বাসিস কেন পর ?

কে ?

আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো !
সে যে ছুঁয়ে গেল নুয়ে গেল রে,
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত ।

সে চলে গেল , বলে গেল না ,
সে কোথায় গেল ফিরে এল না ,
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল ,
কী যেন গেয়ে গেল
তাই আপন মনে বসে আছি
কুসুম-বনেতে ।

সে ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছে ,
চঁদের আলোর দেশে গেছে ,
যেখান দিয়ে হেসে গেছে
হাসি তার রেখে গেছে রে ।
মনে হল আঁখির কোণে
আমায় যেন ডেকে গেছে সে ।
আমি কোথায় যাব কোথায় যাব ,
ভাবতেছি তাই একলা বসে ।

সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল
ঘুমের ঘোর ।
সে প্রাণের কোথা দুলিয়ে গেল
ফুলের ডোর ।
সে কুসুম-বনের উপর দিয়ে
কী কথা যে বলে গেল ,
ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে
সঙ্গে তারি চলে গেল ।
হৃদয় আমার আকুল হল ,
নয়ন আমার মুদে এল ,
কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে!

খেলা

ছেলেতে মেয়েতে করে খেলা
ঘাসের’পরে সাঁঝের বেলা ।

ঘোর ঘোর গাছের তলে তলে ,
ফাঁকায় পড়েছে মলিন আলো ,
কোথাও যেন সোনার ছায়া ছায়া
কোথাও যেন আঁধার কালো কালো ।
আকাশের ধারে ধারে ঘিরে ,
বসেছে রাঙা মেঘের মেলা-
শ্যামল ঘাসের’পরে , সাঁঝে
আলো-আঁধারের মাঝে মাঝে ,
ছেলেতে মেয়েতে করে খেলা ।
ওরা যে কেন হেসে সারা ,
কেন যে করে অমনধারা ,
কেন যে লুটোপুটি ,
কেন যে ছুটোছুটি ,
কেন যে আহ্লাদে কুটিকুটি ।
কেহ বা ঘাসে গড়ায় ,
কেহ বা নেচে বেড়ায় ,
সাঁঝের সোনা-আকাশে
হাসির সোনা ছড়ায় ।
আঁখি দুটি নৃত্য করে ,
নাচে চুল পিঠের’পরে ,
হাসিগুলি চোখে মুখে লুকোচুরি খেলা করে ।
যেন মেঘের কাছে ছুটি পেয়ে
বিদ্যুতেরা এল ধেয়ে ,
আনন্দে হল রে আপন-হারা ।
ওদের হাসি দেখে খেলা দেখে
আকাশের এক ধারে থেকে
মৃদু মৃদু হাসছে একটি তারা ।
ঝাউগাছে পাতাটি নড়ে না ,
কামিনীর পাপড়িটি পড়ে না ।
আঁধার কাকের দল
সাঙ্গ করি কোলাহল
কালো কালো গাছের ছায় ,
কে কোথায় মিশায়ে যায় —
আকাশেতে পাখিটি ওড়ে না ।
সাড়াশব্দ কোথায় গেল ,
নিঝুম হয়ে এল এল
গাছপালা বন গ্রামের আশেপাশে ।
শুধু খেলার কোলাহল ,
শিশুকন্ঠের কলকল ,
হাসির ধ্বনি উঠেছে আকাশে ।

কত আর খেলবি ও রে ,
নেচে নেচে হাতে ধ’রে
যে যার ঘরে চলে আয় ঝাট্ ,
আঁধার হয়ে এল পথঘাট ।
সন্ধ্যাদীপ জ্বলল ঘরে ,
চেয়ে আছে তোদের তরে—
তোদের না হেরিলে মার কোলে
ঘরের প্রাণ কাঁদে সন্ধে হলে ।

গ্রামে

নবীন প্রভাত কনক-কিরণে
নীরবে দাঁড়ায়ে গাছপালা —
কাঁপে মৃদু মৃদু কী যেন আরামে ,
বায়ু বহে যায় সুধা-ঢালা ।
নীল আকাশেতে নারিকেল-তরু ,
ধীরে ধীরে তার পাতা নড়ে —
প্রভাত আলোতে কুঁড়েঘরগুলি ,
জলে ঢেউগুলি ওঠে পড়ে ।
দুয়ারে বসিয়া তপনকিরণে
ছেলেরা মিলিয়া করে খেলা ,
মনে হয় সবি কী যেন কাহিনী
শুনেছিনু কোন্ ছেলেবেলা ।
প্রভাতে যেন রে ঘরের বাহিরে
সে কালের পানে চেয়ে আছি ,
পুরাতন দিন হোথা হতে এসে
উড়িয়ে বেড়ায় কাছাকাছি ।
ঘর-দ্বার সব মায়া-ছায়া-সম ,
কাহিনীতে গাঁথা খেলা-ধূলি —
মধুর তপন , মধুর পবন ,
ছবির মতন কুঁড়েগুলি ।
কেহ বা দোলায় কেহ বা দোলে ,
গাছতলে মিলে করে মেলা ,
বাঁশি হাতে নিয়ে রাখাল বালক
কেহ নাচে-গায় করে খেলা ।
এমনি যেন রে কেটে যায় দিন ,
কারো যেন কোনো কাজ নাই ,
অসম্ভব যেন সকলি সম্ভব —
পেতেছে যেন রে যাহা চাই ।
কেবলি যেন রে প্রভাততপনে ,
প্রভাতপবনে প্রভাতস্বপনে
বিরামে কাটায় , আরামে ঘুমায়
গাছপালা বন , কুঁড়েগুলি ।
কাহিনীতে ঘেরা ছোটো গ্রামখানি ,
মায়াদেবীর মায়া-রাজধানী ,
পৃথিবী-বাহিরে কলপনা-তীরে
করিছে যেন রে খেলা-ধূলি ।

ঘুমিয়ে পড়েছে শিশুগুলি ,
খেলাধুলা সব গেছে ভুলি ।

ধীরে নিশীথের বায় আসে খোলা জানালায় ,
ঘুম এনে দেয় আঁখিপাতে ,
শয্যায় পায়ের কাছে খেলেনা ছড়ানো আছে ,
ঘুমিয়েছে খেলাতে-খেলাতে ।
এলিয়ে গিয়েছে দেহ , মুখে দেবতার স্নেহ
পড়েছে রে ছায়ার মতন ,
কালো কালো চুল তার বাতাসেতে বার বার
উড়ে উড়ে ঢাকিছে বদন ।
তারার আলোর মতো হাসিগুলি আসে কত ,
আধো-খোলা অধরেতে তার
চুমো খেয়ে যায় কত বার ।
সারা রাত স্নেহসুখে তারাগুলি চায় মুখে ,
যেন তারা করে গলাগলি ,
কত কী যে করে বলাবলি!
যেন তারা আঁচলেতে আঁধারে আলোতে গেঁথে
হাসিমাখা সুখের স্বপন ,
ধীরে ধীরে স্নেহভরে শিশুর প্রাণের’পরে
একে একে করে বরিষন ।
কাল যবে রবিকরে কাননেতে থরে থরে
ফুটে ফুটে উঠিবে কুসুম ,
ওদেরো নয়নগুলি ফুটিয়া উঠিবে খুলি ,
কোথায় মিলায়ে যাবে ঘুম ।
প্রভাতের আলো জাগি যেন খেলাবার লাগি
ওদের জাগায়ে দিতে চায় ,
আলোতে ছেলেতে ফুলে এক সাথে আঁখি খুলে
প্রভাতে পাখিতে গান গায় ।

জাগ্রত স্বপ্ন

আজ একেলা বসিয়া , আকাশে চাহিয়া ,
কী সাধ যেতেছে , মন!
বেলা চলে যায় — আছিস কোথায় ?
কোন্ স্বপনেতে নিমগন ?
বসন্তবাতাসে আঁখি মুদে আসে ,
মৃদু মৃদু বহে শ্বাস ,
গায়ে এসে যেন এলায়ে পড়িছে
কুসুমের মৃদু বাস ।
যেন সুদূর নন্দনকাননবাসিনী ,
সুখঘুমঘোরে মধুরহাসিনী ,
অজানা প্রিয়ার ললিত পরশ
ভেসে ভেসে বহে যায় ,
অতি মৃদু মৃদু লাগে গায় ।
বিস্মরণমোহে আঁধারে আলোকে
মনে পড়ে যেন তায় ,
স্মৃতি-আশা-মাখা মৃদু সুখে দুখে
পুলকিয়া উঠে কায় ।
ভ্রমি আমি যেন সুদূর কাননে ,
সুদূর আকাশতলে ,
আনমনে যেন গাহিয়া বেড়াই
সরযূর কলকলে ।
গহন বনের কোথা হতে শুনি
বাঁশির স্বর-আভাস ,
বনের হৃদয় বাজাইছে যেন
মরমের অভিলাষ ।
বিভোর হৃদয়ে বুঝিতে পারি নে
কে গায় কিসের গান ,
অজানা ফুলের সুরভি মাখানো
স্বরসুধা করি পান ।
যেন রে কোথায় তরুর ছায়ায়
বসিয়া রূপসী বালা ,
কুসুমশয়নে আধেক মগনা
বাকল-বসনে আধেক ন গনা ,
সুখদুখগান গা ই ছে শুইয়া
গাঁথিতে গাঁথিতে মালা ।
ছায়ায় আলোকে , নিঝরের ধারে ,
কোথা কোন্ গুপ্ত গুহার মাঝারে ,
যেন হেথা হোথা কে কোথায় আছে
এখনি দেখিতে পাব —
যেন রে তাদের চরণের কাছে
বীণা লয়ে গান গাব ।
শুনে শুনে তারা আনত নয়নে
হাসিবে মুচুকি হাসি ,
শরমের আভা অধরে কপোলে
বেড়াইবে ভাসি ভাসি ।
মাথায় বাঁধিয়া ফুলের মালা
বেড়াইব বনে বনে ।
উড়িতেছে কেশ , উড়িতেছে বেশ ,
উদাস পরান কোথা নিরুদ্দেশ ,
হাতে লয়ে বাঁশি মুখে লয়ে হাসি ,
ভ্রমিতেছি আনমনে ।
চারি দিকে মোর বসন্ত হসিত ,
যৌবনকুসুম প্রাণে বিকশিত ,
কুসুমের’পরে ফেলিব চরণ
যৌবনমাধুরীভরে ।
চারি দিকে মোর মাধবী মালতী
সৌরভে আকুল করে ।
কেহ কি আমারে চাহিবে না ?
কাছে এসে গান গাহিবে না ?
পিপাসিত প্রাণে চাহি মুখপানে
কবে না প্রাণের আশা ?
চাঁদের আলোতে দখিন বাতাসে
কুসুমকাননে বাঁধি বাহুপাশে
শরমে সোহাগে মৃদুমধুহাসে
জানাবে না ভালোবাসা ?
আমার যৌবনকুসুমকাননে
ললিত চরণে বেড়াবে না ?
আমার প্রাণের লতিকা-বাঁধন
চরণে তাহার জড়াবে না ?
আমার প্রাণের কুসুম গাঁথিয়া
কেহ পরিবে না গলে ?
তাই ভাবিতেছি আপনার মনে
বসিয়া তরুর তলে ।

দোলা

ঝিকিমিকি বেলা ;
গাছের ছায়া কাঁপে জলে ,
সোনার কিরণ করে খেলা ।
দুটিতে দোলার’পরে দোলে রে ,
দেখে রবির আঁখি ভোলে রে ।

গাছের ছায়া চারি দিকে আঁধার করে রেখেছে ,
লতাগুলি আঁচল দিয়ে ঢেকেছে ।
ফুল ধীরে ধীরে মাথায় পড়ে ,
পায়ে পড়ে , গায়ে পড়ে ,
থেকে থেকে বাতাসেতে ঝুরু ঝুরু পাতা নড়ে ।
নিরালা সকল ঠাঁই ,
কোথাও সাড়া নাই ,
শুধু নদীটি বহে যায় বনের ছায়া দিয়ে ,
বাতাস ছুঁয়ে যায় লতারে শিহরিয়ে ।
দুটিতে বসে বসে দোলে ,
বেলা কোথায় গেল চলে ।
হেরো , সুধামুখী মেয়ে
কী চাওয়া আছে চেয়ে
মুখানি থুয়ে তার বুকে ।
কী মায়া মাখা চাঁদমুখে ।
হাতে তার কাঁকন দুগাছি ,
কানেতে দুলিছে তার দুল ,
হাসি-হাসি মুখখানি তার
ফুটেছে সাঁঝের জুঁই ফুল ।
গলেতে বাহু বেঁধে
দুজনে কাছাকাছি —
দুলিছে এলো চুল ,
দুলিছে মালাগাছি ।
আঁধার ঘনাইল ,
পাখিরা ঘুমাইল ,
সোনার রবি-আলো আকাশে মিলাইল ।
মেঘেরা কোথা গেল চলে ,
দুজনে বসে বসে দোলে ।
ঘেঁষে আসে বুকে বুকে ,
মিলায়ে মুখে মুখে
বাহুতে বাঁধি বাহুপাশ ,
সুধীর বহিতেছে শ্বাস ।
মাঝে মাঝে থেকে থেকে
আকাশেতে চেয়ে দেখে ,
গাছের আড়ালে দুটি তারা ।
প্রাণ কোথা উড়ে যায় ,
সেই তারা পানে ধায় ,
আকাশের মাঝে হয় হারা ।
পৃথিবী ছাড়িয়া যেন তারা
দুটিতে হয়েছে দুটি তারা ।

নিশীথচেতনা

স্তব্ধ বাদুড়ের মতো জড়ায়ে অযুত শাখা
দলে দলে অন্ধকার ঘুমায় মুদিয়া পাখা ।
মাঝে মাঝে পা টিপিয়া বহিছে নিশীথবায় ,
গাছে নড়ে ওঠে পাতা , শব্দটুকু শোনা যায় ।

আকাশের পানে চেয়ে জাগিয়া রয়েছি বসি ,
মাঝে মাঝে দু -এক টি তারা পড়িতেছে খসি ।
ঘুমাইছে পশুপাখি , বসুন্ধরা অচেতনা —
শুধু এবে দলে দলে আঁধারের তলে তলে
আকাশ করিয়া পূর্ণ স্বপ্ন করে আনাগোনা ।

স্বপ্ন করে আনাগোনা! কোথা দিয়া আসে যায়!
আঁধার আকাশ-মাঝে আঁখি চারি দিকে চায় ।
মনে হয় আসিতেছে শত স্বপ্ন নিশাচরী
আকাশের পার হতে , আঁধার ফেলিছে ভরি ।
চারি দিকে ভাসিতেছে চারি দিকে হাসিতেছে ,
এ উহারে ডাকিতেছে আকাশের পানে চেয়ে —
বলিতেছে , “ আয় বোন , আয় তোরা আয় ধেয়ে । ”

হাতে হাতে ধরি ধরি নাচে যত সহচরী ,
চমকি ছুটিয়া যায় চপলা মায়ার মেয়ে ।
যেন মোর কাছ দিয়ে এই তারা গেল চলে ,
কেহ বা মাথায় মোর , কেহ বা আমার কোলে ।
কেহ বা মারিছে উঁকি হৃদয়-মাঝারে পশি ,
আঁখির পাতার’পরে কেহ বা দুলিছে বসি ।
মাথার উপর দিয়া কেহ বা উড়িয়া যায় ,
নয়নের পানে মোর কেহ বা ফিরিয়া চায় ।
এখনি শুনিব যেন অতি মৃদু পদধ্বনি ,
ছোটো ছোটো নূপুরের অতি মৃদু রনরনি ।
রয়েছি চকিত হয়ে আঁ খির নিমেষ ভুলি —
এখনি দেখিব যেন স্বপ্নমুখী ছায়াগুলি ।

অয়ি স্বপ্ন মোহময়ী , দেখা দাও একবার ।
কোথা দিয়ে আসিতেছ , কোথা দিয়ে চলিতেছ ,
কোথা গিয়ে পশিতেছ বড়ো সাধ দেখিবার ।
আঁধার পরানে পশি সারা রাত করি খেলা
কোন্খানে কোন্ দেশে পালাও সকালবেলা!
অরুণের মুখ দেখে কেন এত হয় লাজ —
সারা দিন কোথা বসে না জানি কী কর কাজ ।
ঘুম-ঘুম আঁখি মেলি তোমরা স্বপনবালা ,
নন্দনের ছায়ে বসি শুধু বুঝি গাঁথ মালা ।
শুধু বুঝি গুন গুন গুন গুন গান কর ,
আপনার গান শুনে আপনি ঘুমায়ে পড় ।
আজি এই রজনীতে অচেতন চারি ধার —
এই আবরণ ঘোর ভেদ করি মন মোর
স্বপনের রাজ্য-মাঝে দাঁড়া দেখি একবার ।
নিদ্রার সাগরজলে মহা-আঁধারের তলে
চারি দিকে প্রসারিত এ কী এ নূতন দেশ —
একত্রে স্বরগ-মর্ত , নাহিকো দিকের শেষ ।
কী যে যায় কী যে আসে চারি দিকে আশেপাশে —
কেহ কাঁদে কেহ হাসে , কেহ থাকে কেহ যায়!
মিশিতেছে , ফুটিতেছে , গড়িতেছে , টুটিতেছে ,
অবিশ্রাম লুকাচুরি-আঁখি না সন্ধান পায় ।
কত আলো কত ছায়া , কত আশা কত মায়া ,
কত ভয় কত শোক , কত কী যে কোলাহল-
কত পশু কত পাখি , কত মানুষের দল ।

উপরেতে চেয়ে দেখো কী প্রশান্ত বিভাবরী —
নিশ্বাস পড়ে না , যেন জগৎ রয়েছে মরি ।
একবার করো মনে আঁধারের সংগোপনে
কী গভীর কলরব চেতনার ছেলেখেলা ,
সমস্ত জগৎ ব্যেপে স্বপনের মহামেলা ।
মনে মনে ভাবি তাই এও কি নহে রে ভাই ,
চৌদিকে যা-কিছু দেখি জাগিয়া সকালবেলা ,
এও কি নহে রে শুধু চেতনার ছেলেখেলা!

স্বপ্ন , তুমি এসো কাছে , মোর মুখপানে চাও ,
তোমার পাখার’পরে মোরে তুলে লয়ে যাও ।
হৃদয়ের দ্বারে দ্বারে ভ্রমি মোরা সারা নিশি
প্রাণে প্রাণে খেলাইয়া প্রভাতে যাইব মিশি ।
ওই যে মায়ের কোলে মেয়েটি ঘুমায়ে আছে ,
একবার নিয়ে যাও ওদের প্রাণের কাছে ।
দেখিব কোমল প্রাণে সুখের প্রভাতহাসি
সুধায় ভরিয়া প্রাণ কেমনে বেড়ায় ভাসি ।
ওই যে প্রেমিক দুটি কুসুমকাননে শুয়ে ,
ঘুমাইছে মুখে মুখে চরণে চরণ থুয়ে ,
ওদের প্রাণের ছায়ে বসিতে গিয়েছে সাধ —
মায়া করি ঘ টা ইব বিরহের পরমাদ ।
ঘুমন্ত আঁখির কোণে দেখা দিবে আঁখিজল ,
বিরহবিলাপগানে ছাইবে মরমতল ।
সহসা উঠিবে জাগি , চমকি শিহরি কাঁপি
দ্বিগুণ আদরে পুন বুকেতে ধরিবে চাপি ।
ছোটো দুটি শিশু ভাই ঘুমাইছে গলাগলি ,
তাদের হৃদয়-মাঝে আমরা যাইব চলি ।
কুসুমকোমলহিয়া কভু বা দুলিবে ভয়ে ,
র বির কিরণে কভু হাসিবে আকুল হয়ে ।

আমি যদি হইতাম স্বপনবাসনাময়
কত বেশ ধরিতাম , কত দেশ ভ্রমিতাম ,
বেড়াতেম সাঁতারিয়া ঘুমের সাগরময় ।
নীরব চন্দ্রমা-তারা , নীরব আকাশ-ধরা-
আমি শুধু চুপি চুপি ভ্রমিতাম বিশ্বময় ।
প্রাণে প্রাণে রচিতাম কত আশা কত ভয় —
এমন করুণ কথা প্রাণে আসিতাম কয়ে ,
প্রভাতে পুরবে চাহি ভাবিত তাহাই লয়ে ।
জাগিয়া দেখিত যারে বুকেতে ধরিত তারে ,
যতনে মুছায়ে দিত ব্যথিতের অশ্রুজল ,
মুমূর্ষু প্রেমের প্রাণ পাইত নূতন বল ।
ওরে স্বপ্ন , আমি যদি স্বপন হতেম হায় ,
যাইতাম তার প্রাণে যে মোরে ফিরে না চায় ।
প্রাণে তার ভ্রমিতাম , প্রাণে তার গাহিতাম ,
প্রাণে তার খেলাতেম অবিরাম নিশি নিশি ।
যেমনি প্রভাত হত আলোকে যেতাম মিশি ।
দিবসে আমার কাছে কভু সে খোলে না প্রাণ ,
শোনে না আমার কথা , বোঝে না আমার গান ।
মায়ামন্ত্রে প্রাণ তার গোপনে দিতাম খুলি ,
বুঝায়ে দিতেম তারে এই মোর গানগুলি ।
পরদিন দিবসেতে যাইতাম কাছে তার ,
তা হলে কি মুখপানে চাহিত না একবার ?

নিশীথজগৎ

জন্মেছি নিশীথে আমি , তারার আলোকে
রয়েছি বসিয়া ।
চারি দিকে নিশীথিনী মাঝে মাঝে হু হু করি
উঠিছে শ্বসিয়া ।
পশ্চিমে করেছে মেঘ , নিবিড় মেঘের প্রান্তে
স্ফুরিছে দামিনী ,
দুঃস্বপ্ন ভাঙিয়া যেন শিহরি মেলিছে আঁখি
চকিত যামিনী ।
আঁধারে অরণ্যভূমি নয়ন মুদিয়া
করিতেছে ধ্যান ,
অসীম আঁধার নিশা আপনার পানে চেয়ে
হারায়েছে জ্ঞান ।
মাথার উপর দিয়া উড়িছে বাদুড় ,
কাঁদিছে পেচক —
একেলা রয়েছি বসি , চেয়ে শূন্য-পানে
না পড়ে পলক ।

আঁধারের প্রাণী যত ভূমিতলে হাত দিয়া
ঘুরিয়া বেড়ায় —
চোখে উড়ে পড়ে ধুলা , কোন্খানে কী যে আছে
দেখিতে না পায় ।
চরণে বাধিছে বাধা , পাষাণে বাজিছে মাথা ,
কাঁদিছে বসিয়া —
অগ্নিহাসি উপহাসি উল্কা-অভিশাপশিখা
পড়িছে খসিয়া ।
তাদের মাথার’পরে সীমাহীন অন্ধকার
স্তব্ধ গগনেতে ,
আঁধারের ভারে যেন নুইয়া পড়িছে মাথা
মাটির পানেতে ।
নড়িলে গাছের পাতা চকিতে চমকি উঠে ,
চায় চারি ধারে —
ঘোর আঁধারের মাঝে কোথা কী লুকায়ে আছে
কে বলিতে পারে ।

গহন বনের মাঝে চলিয়াছে শিশু
মার হাত ধরে ,
মুহূর্ত ছেড়েছে হাত , পড়েছে পিছায়ে
খেলাবার তরে —
অমনি হারায়ে পথ কেঁদে ওঠে শিশু ,
ডাকে “ মা মা ” বলে —
“ আয় মা , আয় মা , আয় , কোথা চলে গেলি ,
মোরে নে মা কোলে । ”
মা অমনি চমকিয়া “ বাছা বাছা ” বলে ছোটে ,
দেখিতে না পায় —
শুধু সেই অন্ধকারে “ মা মা ” ধ্বনি পশে কানে ,
চারি দিকে চায় ।

সহসা সমুখ দিয়া কে গেল ছায়ার মতো ,
লাগিল তরাস ,
কে জানে সহসা যেন কোথা কোন্ দিক হতে
শুনি দীর্ঘশ্বাস ।
কে বসে রয়েছে পাশে ? কে ছুঁইল দেহ মোর
হিমহস্তে তার ?
ও কী ও ? এ কী রে শুনি! কোথা হতে উঠিল রে
ঘোর হাহাকার ?
ও কী হোথা দেখা যায় — ওই দূরে অতি দূরে
ও কিসের আলো ?
ও কী ও উড়িছে শূন্যে দীর্ঘ নিশাচর পাখি ?
মেঘ কালো কালো ?

এই আঁধারের মাঝে কত-না অদৃশ্য প্রাণী
কাঁদিছে বসিয়া —
নীরবে টুটিছে প্রাণ , চাহিছে তারার পানে
অরণ্যে পশিয়া ।
কেহ বা রয়েছে শুয়ে দগ্ধ হৃদয়ের’পরে
স্মৃতিরে জড়ায়ে —
কেহ না দেখিছে তারে , অন্ধকারে অশ্রুধারা
পড়িছে গড়ায়ে ।
কেহ বা শুনিছে সাড়া , উর্ধ্বকণ্ঠে নাম ধরে
ডাকিছে মরণে —
পশিয়া হৃদয়-মাঝে আশার অঙ্কুরগুলি
দলিছে চরণে ।
ও দিকে আকাশ- ‘ পরে মাঝে মাঝে থেকে থেকে
উঠে অট্টহাস ,
ঘন ঘন করতালি , উনমাদ কণ্ঠস্বরে
কাঁপিছে আকাশ ।
জ্বালিয়া মশাল-আলো নাচিছে গাইছে তারা ,
ক্ষণিক উল্লাস —
আঁধার মুহূর্ত-তরে হাসে যথা প্রাণপণে
আলেয়ার হাস ।

অরণ্যের প্রান্তভাগে নদী এক চলিয়াছে
বাঁকিয়া বাঁকিয়া —
স্তব্ধ জল , শব্দ নাই , ফণী-সম ফুঁসি উঠে
থাকিয়া থাকিয়া ।
আঁধারে চলিতে পান্থ দেখিতে না পায় কিছু
জলে গিয়া পড়ে ,
মুহূর্তের হাহাকার মুহূর্তে ভাসিয়া যায়
খরস্রোতভরে ।
সখা তার তীরে বসি একেলা কাঁদিতে থাকে ,
ডাকে উর্ধ্বশ্বাসে —
কাহারো না পেয়ে সাড়া শূন্যপ্রাণ প্রতিধ্বনি
কেঁদে ফিরে আসে ।
নিশীথের কারাগারে কে বেঁধে রেখেছে মোরে
রয়েছি পড়িয়া —
কেবল রয়েছি বেঁচে স্বপন কুড়ায়ে লয়ে
ভাঙিয়া গড়িয়া ।
আঁধারে নিজের পানে চেয়ে দেখি , ভালো করে
দেখিতে না পাই —
হৃদয়ে অজানা দেশে পাখি গায় , ফুল ফোটে ,
পথ জানি নাই ।
অন্ধকারে আপানারে দেখিতে না পাই যত
তত ভালোবাসি ,
তত তারে বুকে করে বাহুতে বাঁধিয়া লয়ে
হরষেতে ভাসি ।
তত যেন মনে হয় পাছে রে চলিতে পথে
তৃণ ফুটে পায় ,
যতনের ধন পাছে চমকি কাঁদিয়া ওঠে
কুসুমের ঘায়!
সদা হয় অবিশ্বাস কারেও চিনি না হেথা ,
সবি অনুমান ,
ভালোবেসে কাছে গেলে দূরে চলে যায় সবে ,
ভয়ে কাঁপে প্রাণ ।
গোপনেতে অশ্রু ফেলে মুছে ফেলে , পাছে কেহ
দেখিবারে পায় —
মরমের দীর্ঘশ্বাস মরমে রুধিয়া রাখে ,
পাছে শোনা যায় ।
সখারে কাঁদিয়া বলে — “ বড়ো সাধ যায় সখা ,
দেখি ভালো করে!
তুই শৈশবের বঁধু , চিরজন্ম কেটে গেল
দেখিনু না তোরে ,
বুঝি তুমি দূরে আছ , একবার কাছে এসে
দেখাও তোমায় । ”
সে অমনি কেঁদে বলে — “ আপনারে দেখি নাই ,
কী দেখাব হায় । ”

অন্ধকার ভাগ করি , আঁধারের রাজ্য লয়ে
চলিছে বিবাদ ।
সখারে বধিছে সখা , সন্তানে হানিছে পিতা ,
ঘোর পরমাদ ।
মৃতদেহ পড়ে থাকে , শকুনি বিবাদ করে
কাছে ঘুরে ঘুরে ।
মাংস লয়ে টানাটানি করিতেছে হানাহানি
শৃগালে কুকুরে ।
অন্ধকার ভেদ করি অহরহ শুনা যায়
আকুল বিলাপ —
আহতের আর্তস্বর , হিংসার উল্লাসধ্বনি
ঘোর অভিশাপ ।
মাঝে মাঝে থেকে থেকে কোথা হতে ভেসে আসে
ফুলের সুবাস —
প্রাণ যেন কেঁদে ওঠে , অশ্রুজলে ভাসে আঁখি ,
উঠে রে নিশ্বাস ।
চারি দিক ভুলে যাই , প্রাণে যেন জেগে ওঠে
স্বপন-আবেশ —
কোথা রে ফুটেছে ফুল , আঁধারের কোন্ তীরে
কোথা কোন্ দেশ!

রুদ্ধপ্রাণ ক্ষুদ্র প্রাণী , রুদ্ধ প্রাণীদের সাথে
কত রে রহিব —
ছোটো ছোটো সুখ দুখ , ছোটো ছোটো আশাগুলি
পুষিয়া রাখিব!
নিদ্রাহীন আঁখি মেলি পুরব-আকাশ-পানে
রয়েছি চাহিয়া —
কবে রে প্রভাত হবে , আনন্দে বিহঙ্গগুলি
উঠিবে গাহিয়া ।
ওই যে পুরবে হেরি অরুণকিরণে সাজে
মেঘমরীচিকা ।
না রে না , কিছুই নয় — পূরবশ্মশানে উঠে
চিতানলশিখা ।

পাগল

আপন মনে বেড়ায় গান গেয়ে ,
গান কেউ শোনে কেউ শোনে না ।
ঘুরে বেড়ায় জগৎ-পানে চেয়ে ,
তারে কেউ দেখে কেউ দেখে না ।
সে যেন গানের মতো প্রাণের মতো শুধু
সৌরভের মতো উড়ছে বাতাসেতে ,
আপনারে আপনি সে জানে না ,
তবু আপনাতে আপনি আছে মেতে ।
হরষে তার পুলকিত গা ,
ভাবের ভরে টলমল পা ,
কে জানে কোথায় যে সে যায়
আঁখি তার দেখে কি দেখে না ।
লতা তার গায়ে পড়ে ,
ফুল তার পায়ে পড়ে ,
নদীর মুখে কুলু কুলু রা ‘ ।
গায়ের কাছে বাতাস করে বা ‘ ।
সে শুধু চলে যায় ,
মুখে কী বলে যায় ,
বাতাস গলে যায় তা শুনে ।
সুমুখে আঁখি রেখে
চলেছে কোথা যে কে
কিছু সে নাহি দেখে শোনে ।
যেখান দিয়ে যায় সে চলে সেথায় যেন ঢেউ খেলে যায় ,
বাতাস যেন আকুল হয়ে ওঠে ,
ধরা যেন চরণ ছুঁয়ে শিউরে ওঠে শ্যামল দেহে
লতায় যেন কুসুম ফোটে ফোটে ।
বসন্ত তার সাড়া পেয়ে সখা বলে আসে ধেয়ে ,
বনে যেন দুইটি বসন্ত ।
দুই সখাতে ভেসে চলে যৌবনসাগরের জলে ,
কোথাও যেন নাহি রে তার অন্ত ।
আকাশ বলে “ এসো এসো ‘ , কানন বলে ‘ বোসো বোসো ‘ ,
সবাই যেন নাম ধরে তার ডাকে ।
হেসে যখন কয় সে কথা মূর্ছা যায় রে বনের লতা ,
লুটিয়ে ভুঁয়ে চুপ করে সে থাকে ।
বনের হরিণ কাছে আসে — সাথে সাথে ফিরে পাশে
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় দেহছায় ।
পায়ের কাছে পড়ে লুটি , বড়ো বড়ো নয়ন দুটি
তুলে তুলে মুখের পানে চায় ।
আপনা-ভোলা সরল হাসি ঝরে পড়ছে রাশি রাশি ,
আপনি যেন জানতে নাহি পায় ।
লতা তারে আটকে রেখে তারি কাছে হাসতে শেখে ,
হাসি যেন কুসুম হয়ে যায় ।
গান গায় সে সাঁঝের বেলা , মেঘগুলি তাই ভুলে খেলা
নেমে আসতে চায় রে ধরা পানে ,
একে একে সাঁঝের তারা গান শুনে তার অবাক-পারা
আর সবারে ডেকে ডেকে আনে ।
আপনি মাতে আপন স্বরে , আর সবারে পাগল করে ,
সাথে সাথে সবাই গাহে গান —
জগতের যা-কিছু আছে সব ফেলে দেয় পায়ের কাছে ,
প্রাণের কাছে খুলে দেয় সে প্রাণ ।

তোরাই শুধু শুনলি নে রে , কোথায় বসে রইলি যে রে ,
দ্বারের কাছে গেল গেয়ে গেয়ে ,
কেউ তাহারে দেখলি নে তো চেয়ে ।
গাইতে গাইতে চলে গেল , কত দূর সে চলে গেল ,
গানগুলি তার হারিয়ে গেল বনে ,
দুয়ার দেওয়া তোদের পাষাণ মনে ।

পূর্ণিমায়

যাই যাই ডুবে যাই —
আরো আরো ডুবে যাই ,
বিহ্বল অবশ অচেতন ।
কোন্ খানে , কোন্ দূরে ,
নিশীথের কোন্ মাঝে ,
কোথা হয়ে যাই নিমগন ।
হে ধরণী , পদতলে
দিয়ো না দিয়ো না বাধা ,
দাও মোরে দাও ছেড়ে দাও —
অনন্ত দিবস-নিশি
এমনি ডুবিতে থাকি ,
তোমরা সুদূরে চলে যাও ।
এ কী রে উদার জ্যোৎস্না
এ কী রে গভীর নিশি
দিশে দিশে স্তব্ধতা বিস্তারি!
আঁখি দুটি মুদে আমি
কোথা আছি কোথা গেছি
কিছু যেন বুঝিতে না পারি ।
দেখি দেখি আরো দেখি ,
অসীম উদার শূন্যে
আরো দূরে আরো দূরে যাই —
দেখি আজি এ অনন্তে
আপনা হারায়ে ফেলে
আর যেন খুঁজিয়া না পাই ।
তোমরা চাহিয়া থাকো
জোছনা অমৃত-পানে
বিহ্বল বিলীন তারাগুলি ।
অপার দিগন্ত ওগো ,
থাকো এ মাথার’পরে
দুই দিকে দুই পাখা তুলি ।
গান নাই , কথা নাই ,
শব্দ নাই , স্পর্শ নাই ,
নাই ঘুম , নাই জাগরণ ।
কোথা কিছু নাহি জাগে ,
সর্বাঙ্গে জোছনা লাগে ,
সর্বাঙ্গ পুলকে অচেতন ।
অসীমে সুনীলে শূন্যে
বিশ্ব কোথা ভেসে গেছে
তারে যেন দেখা নাহি যায় —
নিশীথের মাঝে শুধু
মহান্ একাকী আমি
অতলেতে ডুবি রে কোথায় ।
গাও বিশ্ব গাও তুমি
সুদূর অদৃশ্য হতে
গাও তব নাবিকের গান —
শত লক্ষ যাত্রী লয়ে
কোথায় যেতেছ তুমি
তাই ভাবি মুদিয়া নয়ান ।
অনন্ত রজনী শুধু
ডুবে যাই নিভে যাই
মরে যাই অসীম মধুরে —
বিন্দু হতে বিন্দু হয়ে
মিশায়ে মিলায়ে যাই
অনন্তের সুদূর সুদূরে ।

পোড়ো বাড়ি

চারি দিকে কেহ নাই , একা ভাঙা বাড়ি ,
সন্ধেবেলা ছাদে বসে ডাকিতেছে কাক ।
নিবিড় আঁধার , মুখ বাড়ায়ে রয়েছে
যেথা আছে ভাঙা ভাঙা প্রাচীরের ফাঁক ।
পড়েছে সন্ধ্যার ছায়া অশথের গাছে ,
থেকে থেকে শাখা তার উঠিছে নড়িয়া ।
ভগ্ন শুষ্ক দীর্ঘ এক দেবদারু তরু
হেলিয়া ভিত্তির’পরে রয়েছে পড়িয়া ।
আকাশেতে উঠিয়াছে আধখানি চাঁদ ,
তাকায় চাঁদের পানে গৃহের আঁধার ।
প্রাঙ্গণে করিয়া মেলা উর্ধ্বমুখ হয়ে
চন্দ্রালোকে শৃগালেরা করিছে চীৎকার ।

শুধাই রে , ওই তোর ঘোর স্তব্ধ ঘরে
কখনো কি হয়েছিল বিবাহ-উৎসব ?
কোনো রজনীতে কি রে ফুল্ল দীপালোকে
উঠেছিল প্রমোদের নৃত্যগীতরব ?
হোথায় কি প্রতিদিন সন্ধ্যা হয়ে এলে
তরুণীরা সন্ধ্যাদীপ জ্বালাইয়া দিত ?
মায়ের কোলেতে শুয়ে চাঁদেরে দেখিয়া
শিশুটি তুলিয়া হাত ধরিতে চাহিত ?
বালকেরা বেড়াত কি কোলাহল করি ?
আঙিনায় খেলিত কি কোনো ভাইবোন ?
মিলে মিশে স্নেহে প্রেমে আনন্দে উল্লাসে
প্রতিদিবসের কাজ হত সমাপন ?
কোন্ ঘরে কে ছিল রে! সে কি মনে আছে ?
কোথায় হাসিত বধূ শরমের হাস —
বিরহিণী কোন্ ঘরে কোন্ বাতায়নে
রজনীতে একা বসে ফেলিত নিশ্বাস ?
যেদিন শিয়রে তোর অশথের গাছ
নিশীথের বাতাসেতে করে মর্ মর্ ,
ভাঙা জানালার কাছে পশে অতি ধীরে
জাহ্নবীর তরঙ্গের দূর কলস্বর —
সে রাত্রে কি তাদের আবার পড়ে মনে
সেই-সব ছেলেদের সেই কচি মুখ —
কত স্নেহময়ী মাতা তরুণ তরুণী
কত নিমেষের কত ক্ষুদ্র সুখ-দুখ ?
মনে পড়ে সেই-সব হাসি আর গান —
মনে পড়ে — কোথা তারা , সব অবসান !

বাদল

একলা ঘরে বসে আছি , কেউ নেই কাছে ,
সারাটা দিন মেঘ করে আছে ।
সারাদিন বাদল হল ,
সারাদিন বৃষ্টি পড়ে ,
সারাদিন বইছে বাদল-বায়!
মেঘের ঘটা আকাশভরা ,
চারি দিকে আঁধার-করা ,
তড়িৎ-রেখা ঝলক মেরে যায় ।
শ্যামল বনের শ্যামল শিরে
মেঘের ছায়া নেমেছে রে ,
মেঘের ছায়া কুঁড়েঘরের’পরে ,
ভাঙাচোরা পথের ধারে
ঘন বাঁশের বনের ধারে
মেঘের ছায়া ঘনিয়ে যেন ধরে ।

বিজন ঘরে বাতায়নে
সারাটা দিন আপন মনে
বসে বসে বাইরে চেয়ে দেখি ,
টুপুটুপু বৃষ্টি পড়ে ,
পাতা হতে পাতায় ঝরে ,
ডালে বসে ভেজে একটি পাখি ।
তালপুকুরে জলের’পরে
বৃষ্টিবারি নেচে বেড়ায় ,
ছেলেরা মেতে বেড়ায় জলে ,
মেয়েগুলি কলসী নিয়ে
চলে আসে পথ দিয়ে ,
আঁধারভরা গাছের তলে তলে!

কে জানে কী মনেতে আশ ,
উঠছে ধীরে দীর্ঘনিশাস ,
বায়ু উঠে শ্বসিয়া শ্বসিয়া ।
ডালপালা হা হা করে ,
বৃষ্টিবিন্দু ঝরে পড়ে ,
পাতা পড়ে খসিয়া খসিয়া ।

বিদায়

সে যখন বিদায় নিয়ে গেল ,
তখন নবমীর চাঁদ অস্তাচলে যায় ।
গভীর রাতি নিঝুম চারি দিক ,
আকাশেতে তারা অনিমিখ ,
ধরণী নীরবে ঘুমায় ।
হাত দুটি তার ধরে দুই হাতে
মুখের পানে চেয়ে সে রহিল ,
কাননে বকুল তরুতলে
একটিও সে কথা না কহিল ।
অধরে প্রাণের মলিন ছায়া ,
চোখের জলে মলিন চাঁদের আলো ,
যাবার বেলা দুটি কথা বলে
বনপথ দিয়ে সে চলে গেল ।
ঘন গাছের পাতার মাঝে আঁধার পাখি গুটিয়ে পাখা ,
তারি উপর চাঁদের আলো শুয়েছে ,
ছায়াগুলি এলিয়ে দেহ আঁচলখানি পেতে যেন
গাছের তলায় ঘুমিয়ে রয়েছে ।
গভীর রাতে বাতাসটি নেই — নিশীথে সরসীর জলে
কাঁপে না বনের কালো ছায়া ,
ঘুম যেন ঘোমটা-পরা বসে আছে ঝোপেঝাপে ,
পড়ছে বসে কী যেন এক মায়া ।

চুপ করে হেলে সে বকুল গাছে ,
রমণী একেলা দাঁড়ায়ে আছে ।
এলোথেলো চুলের মাঝে বিষাদমাখা সে মুখখানি ,
চাঁদের আলো পড়েছে তার’পরে ।
পথের পানে চেয়ে ছিল , পথের পানেই চেয়ে আছে ,
পলক নাহি তিলেক কালের তরে ।
গেল রে কে চলে গেল , ধীরে ধীরে চলে গেল ,
কী কথা সে বলে গেল হায় ,
অতি দূর অশথের ছায়ে মিশায়ে কে গেল রে ,
রমণী দাঁড়ায়ে জোছনায় ।
সীমাহীন জগতের মাঝে আশা তার হারায়ে গেল ,
আজি এই গভীরে নিশীথে ,
শূন্য অন্ধকারখানি মলিন মুখশ্রী নিয়ে
দাঁড়িয়ে রহিল একভিতে ।

পশ্চিমের আকাশসীমায়
চাঁদখানি অস্তে যায় যায় ।
ছোটো ছোটো মেঘগুলি সাদা সাদা পাখা তুলি
চলে যায় চাঁদের চুমো নিয়ে ,
আঁধার গাছের ছায় ডুবু ডুবু জোছনায়
ম্লানমুখী রমণী দাঁড়িয়ে ।

বিরহ

ধীরে ধীরে প্রভাত হল , আঁধার মিলায়ে গেল
উষা হাসে কনকবরণী ,
বকুল গাছের তলে কুসুম রাশির পরে
বসিয়া পড়িল সে রমণী ,
আঁখি দিয়া ঝরঝরে অশ্রুবারি ঝ ‘ রে পড়ে
ভেঙে যেতে চায় যেন বুক ,
রাঙা রাঙা অধর দুটি কেঁপে কেঁপে ওঠে কতো ,
করতলে সকরুণ মুখ ।
অরুণ আঁখির’পরে , অরুণের আভা পড়ে ,
কেশপাশে অরুণ লুকায় ,
দুই হাতে মুখ ঢাকে কার নাম ধরে ডাকে
কেন তার সাড়া নাহি পায় ।
বহিছে প্রভাত-বায় আঁচলে লুটিয়ে যায় ,
মাথায় ঝরিয়ে পড়ে ফুল ,
ডালপালা দোলে ধীরে কাননে সরসীতীরে
ফুটে ওঠে মল্লিকা মুকুল ।
পা দুখানি ছড়াইয়া পুরবের পানে চেয়ে
ললিতে প্রাণের গান গায়
গাহিতে গাহিতে গান , সব যেন অবসান
যেন সব-কিছু ভুলে যায় ।
প্রাণ যেন গানে মিশে , অনন্ত আকাশ-মাঝে
উদাসী হইয়ে চঞ্চলে যায় ,
বসে বসে শুধু গান গায় ।

মধ্যাহ্নে

হেরো ওই বাড়িতেছে বেলা ,
বসে আমি রয়েছি একেলা ।
ওই হোথা যায় দেখা সুদূরে বনের রেখা
মিশেছে আকাশনীলিমায়;
দিক হতে দিগন্তরে মাঠ শুধু ধূ ধূ করে ,
বায়ু কোথা বহে চলে যায় ।
সুদূর মাঠের পারে গ্রামখানি এক ধারে,
গাছ দিয়ে ছায়া দিয়ে ঘেরা ।
কাননের গায়ে যেন ছায়াখানি বুলাইয়া
ভেসে চলে কোথায় মেঘেরা ।
মধুর উদাস প্রাণে চাই চারি দিক-পানে ,
স্তব্ধ সব ছবির মতন ।
সব যেন চারি ধারে অবশ আলসভারে
স্বর্ণময় মায়ায় মগন ।
গ্রামখানি , মাঠখানি , উঁচুনিচু পথখানি ,
দু-একটি গাছ মাঝে মাঝে ,
আকাশ-সমুদ্রে-ঘেরা সুবর্ণ দ্বীপের পারা
কোথা যেন সুদূরে বিরাজে ।
কনকলাবণ্য লয়ে যেন অভিভূত হয়ে
আপনাতে আপনি ঘুমায় ,
নিঝুম পাদপলতা , শ্রান্তকায় নীরবতা
শুয়ে আছে গাছের ছায়ায় ।
শুধু অতি মৃদু স্বরে গুন গুন গান করে
যেন সব ঘুমন্ত ভ্রমর ,
যেন মধু খেতে খেতে ঘুমিয়েছে কুসুমেতে
মরিয়া এসেছে কণ্ঠস্বর ।
নীল শূন্যে ছবি আঁকা রবির-কিরণ-মাখা ,
সেথা যেন বাস করিতেছি ।
জীবনের আধখানি যেন ভুলে গেছি আমি ,
কোথা যেন ফেলিয়ে এসেছি ।
আনমনে ধীরি ধীরি বেড়াতেছি ফিরি ফিরি
ঘুমঘোর ছায়ায় ছায়ায় —
কোথা যাব কোথা যাই সে কথা যে মনে নাই ,
ভুলে আছি মধুর মায়ায় ।
মধুর বাতাসে আজি যেন রে উঠিছে বাজি
পরানের ঘুমন্ত বীণাটি ,
ভালোবাসা আজি কেন সঙ্গীহারা পাখি যেন
বসিয়া গাহিছে একেলাটি ।
কে জানে কাহারে চায় , প্রাণ যেন উভরায়,
ডাকে কারে ‘এসো এসো ‘ ব’লে ,
কাছে কারে পেতে চায় , সব তারে দিতে চায় ,
মাথাটি রাখিতে চায় কোলে ।
স্তব্ধ তরুতলে গিয়া পা দুখানি ছড়াইয়া
নিমগন মধুময় মোহে ,
আনমনে গান গেয়ে দূর শূন্যপানে চেয়ে
ঘুমায়ে পড়িতে চায় দোঁহে ।
দূর মরীচিকা-সম ওই বন-উপবন ,
ওরি মাঝে পরান উদাসী —
বিজন বকুলতলে পল্লবের মরমরে
নাম ধরে বাজাইছে বাঁশি ।
সে যেন কোথায় আছে সুদূর বনের পাছে
কত নদী-সমুদ্রের পারে ,
নিভৃত নির্ঝরতীরে লতায় পাতায় ঘিরে
বসে আছে নিকুঞ্জ-আঁধারে ।
সাধ যায় বাঁশি করে বন হতে বনান্তরে
চলে যাই আপনার মনে ,
কুসুমিত নদীতীরে বেড়াইব ফিরে ফিরে
কে জানে কাহার অন্বেষণে ।
সহসা দেখিব তারে , নিমেষেই একেবারে
প্রাণে প্রাণে হইবে মিলন
এই মরীচিকাদেশে দুজনে বাসরবেশে
ছায়ারাজ্যে করিব ভ্রমণ ।
বাঁধিবে সে বাহুপাশে , চোখে তার স্বপ্ন ভাসে ,
মুখে তার হাসির মুকুল —
কে জানে বুকের কাছে আঁচল আছে না আছে ,
পিঠেতে পড়েছে এলো চুল ।
মুখে আধখানি কথা , চোখে আধখানি কথা ,
আধখানি হাসিতে জড়ানো —
দুজনেতে চলে যাই , কে জানে কোথায় যাই
পদতলে কুসুম ছড়ানো ।

বুঝি রে এমনি বেলা ছায়ায় করিত খেলা
তপোবনে ঋষিবালিকারা ,
পরিয়া বাকলবাস , মুখেতে বিমল হাস ,
বনে বনে বেড়াইত তারা ।
হরিণশিশুরা এসে কাছেতে বসিত ঘেঁষে ,
মালিনী বহিত পদতলে —
দু-চারি সখীতে মেলি কথা কয় হাসি খেলি
তরুতলে বসি কুতূহলে ।
কারো কোলে কারো মাথা , সরল প্রাণের কথা
নিরালায় কহে প্রাণ খুলি —
লুকিয়ে গাছের আড়ে সাধ যায় শুনিবারে
কী কথা কহিছে মেয়েগুলি ।
লতার পাতার মাঝে , ঘাসের ফুলের মাঝে
হরিণশিশুর সাথে মিলি ,
অঙ্গে আভরণ নাই , বাকল-বসন পরি
রূপগুলি বেড়াইছে খেলি ।

ওই দূর বনছায়া ও যে কী জানে রে মায়া ,
ও যেন রে রেখেছে লুকায়ে —
সেই স্নিগ্ধ তপোবন , চিরফুল্ল তরুগণ ,
হরিণশাবক তরুছায়ে ।
হোথায় মালিনী নদী বহে যেন নিরবধি ,
ঋষিকন্যা কুটিরের মাঝে —
কভু বসি তরুতলে স্নেহে তারে ভাই বলে ,
ফুলটি ঝরিলে ব্যথা বাজে ।
কত ছবি মনে আসে , পরানের আশেপাশে
কল্পনা কত যে করে খেলা —
বাতাস লাগায়ে গায়ে বসিয়া তরুর ছায়ে
কেমনে কাটিয়া যায় বেলা ।

মাতাল

বুঝি রে ,
চাঁদের কিরণ পান করে ওর ঢুলু ঢুলু দুটি আঁখি ,
কাছে ওর যেয়ো না ,
কথাটি শুধায়ো না ,
ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে বসে আছে একাকী ।
ঘুমের মতো মেয়েগুলি
চোখের কাছে দুলি দুলি
বেড়ায় শুধু নূপুর রনরনি ।
আধেক মুদি আঁখির পাতা ,
কার সাথে যে কচ্ছে কথা ,
শুনছে কাহার মৃদু মধুর ধ্বনি ।
অতি সুদূর পরীর দেশে —
সেখান থেকে বাতাস এসে
কানের কাছে কাহিনী শুনায় ।
কত কী যে মোহের মায়া ,
কত কী যে আলোক ছায়া ,
প্রাণের কাছে স্বপন ঘনায় ।
কাছে ওর যেয়ো না ,
কথাটি শুধায়ো না ,
ঘুমের মেয়ে তরাস পেয়ে যাবে ,
মৃদু প্রাণে প্রমাদ গণি
নূপুরগুলি রনরনি
চাঁদের আলোয় কোথায় কে লুকাবে ।

চলো দূরে নদীর তীরে ,
বসে সেথায় ধীরে ধীরে
একটি শুধু বাঁশরি বাজাও ।
আকাশেতে হাসবে বিধু ,
মধুকন্ঠে মৃদু মৃদু
একটি শুধু সুখেরই গান গাও ।
দূর হতে আসিয়া কানে
পশিবে সে প্রাণের প্রাণে
স্বপনেতে স্বপন ঢালিয়ে ।
ছায়াময়ী মেয়েগুলি
গানের স্রোতে দুলি দুলি ,
বসে রবে গালে হাত দিয়ে ।
গাহিতে গাহিতে তুমি বালা
গেঁথে রাখো মালতীর মালা ।
ও যখন ঘুমাইবে , গলায় পরায়ে দিবে
স্বপনে মিশিবে ফুলবাস ।
ঘুমন্ত মুখের’পরে চেয়ে থেকো প্রেমভরে
মুখেতে ফুটিবে মৃদু হাস ।

যোগী

পশ্চিমে ডুবেছে ইন্দু , সম্মুখে উদার সিন্ধু ,
শিরোপরি অনন্ত আকাশ ,
লম্বমান জটাজূটে যোগিবর করপুটে
দেখিছেন সূর্যের প্রকাশ ।
উলঙ্গ সুদীর্ঘকায় , বিশাল ললাট ভায় ,
মুখে তাঁর শান্তির বিকাশ ।
শূন্যে আঁখি চেয়ে আছে , উদার বুকের কাছে
খেলা করে সমুদ্র-বাতাস ।
চৌদিকে দিগন্তমুক্ত , বিশ্বচরাচর সুপ্ত ,
তারি মাঝে যোগী মহাকায় ।
ভয়ে ভয়ে ঢেউগুলি নিয়ে যায় পদধূলি ,
ধীরে আসে , ধীরে চলে যায় ।
মহা স্তব্ধ সব ঠাঁই , বিশ্বে আর শব্দ নাই
কেবল সিন্ধুর মহাতান —
যেন সিন্ধু ভক্তিভরে জলদগম্ভীর স্বরে
তপনের করে স্তবগান ।
আজি সমুদ্রের কূলে , নীরবে সমুদ্র দুলে
হৃদয়ের অতল গভীরে ।
অনন্ত সে পারাবার ডুবাইছে চারি ধার ,
ঢেউ লাগে জগতের তীরে ।

যোগী যেন চিত্রে লিখা — উঠিছে রবির শিখা
মুখে তারি পড়িছে কিরণ ,
পশ্চাতে ব্যাপিয়া দিশি তামসী তাপসী নিশি
ধ্যান করে মুদিয়া নয়ন ।
শিবের জটার ‘পরে যথা সুরধুনী ঝরে
তারাচূর্ণ রজতের স্রোতে ,
তেমনি কিরণ লুটে সন্ন্যাসীর জটাজুটে
পুরব-আকাশ-সীমা হতে ।
বিমল আলোক হেন ব্রহ্মলোক হতে যেন
ঝরে তাঁর ললাটের কাছে ,
মর্তের তামসী নিশি পশ্চাতে যেতেছে মিশি
নীরবে নিস্তব্ধ চেয়ে আছে ।
সুদূর সমুদ্রনীরে অসীম আঁধার-তীরে
একটুকু কনকের রেখা ,
কী মহা রহস্যময় সমুদ্রে অরুণোদয়
আভাসের মতো যায় দেখা ।
চরাচর ব্যগ্র প্রাণে পুরবের পথপানে
নেহারিছে সমুদ্র অতল —
দেখো চেয়ে মরি মরি , কিরণমৃণাল-‘পরি
জ্যোতির্ময় কনককমল ।
দেখো চেয়ে দেখো পুবে কিরণে গিয়েছে ডুবে
গগনের উদার ললাট —
সহসা সে ঋষিবর আকাশে তুলিয়া কর
গাহিয়া উঠিল বেদপাঠ ।

রাহুর প্রেম

শুনেছি আমারে ভালো ই লাগে না ,
নাই-বা লাগিল তোর ,
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
চিরকাল তোরে রব আঁকড়িয়া
লৌহশৃঙ্খলের ডোর ।
তুই তো আমার বন্দী অভাগিনী
বাঁধিয়াছি কারাগারে ,
প্রাণের শৃঙ্খল দিয়েছি প্রাণেতে
দেখি কে খুলিতে পারে ।

জগৎ-মাঝারে যেথায় বেড়াবি ,
যেথায় বসিবি , যেথায় দাঁড়াবি ,
কি বসন্ত শীতে দিবসে নিশীথে
সাথে সাথে তোর থাকিবে বাজিতে
এ পাষাণ প্রাণ অনন্ত শৃঙ্খল
চরণ জড়ায়ে ধরে ।
এক বার তোরে দেখেছি যখন
কেমনে এড়াবি মোরে ।
চাও নাই চাও , ডাক নাই ডাক ,
কাছেতে আমার থাক নাই থাক ,
যাব সাথে সাথে , রব পায় পায় ,
রব গায় গায় মিশি —
এ বিষাদ ঘোর , এ আঁধার মুখ ,
হতাশ নিশ্বাস , এই ভাঙা বুক ,
ভাঙা বাদ্য-সম বাজিবে কেবল
সাথে সাথে দিবানিশি ।
অনন্ত কালের সঙ্গী আমি তোর
আমি যে রে তোর ছায়া —
কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে ,
দেখিতে পাইবি কখনো পাশেতে ,
কখনো সমুখে কখনো পশ্চাতে ,
আমার আঁধার কায়া ।
গভীর নিশীথে একাকী যখন
বসিয়া মলিন প্রাণে ,
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে
আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখপানে ।
যে দিকেই তুই ফিরাবি বয়ান
সেই দিকে আমি ফিরাব নয়ান ,
যে দিকে চাহিবি আকাশে আমার
আঁধার মুরতি আঁকা ।
সকলি পড়িবে আমার আড়ালে ,
জগৎ পড়িবে ঢাকা ।
দুঃস্বপ্নের মতো , দুর্ভাবনা-সম ,
তোমারে রহিব ঘিরে —
দিবস-রজনী এ মুখ দেখিব
তোমার নয়ননীরে ।
বিশীর্ণ-কঙ্কাল চিরভিক্ষা-সম
দাঁড়ায়ে সম্মুখে তোর
‘ দাও দাও ‘ বলে কেবলি ডাকিব
ফেলিব নয়নলোর ।
কেবলি সাধিব , কেবলি কাঁদিব ,
কেবলি ফেলিব শ্বাস —
কানের কাছেতে প্রাণের কাছেতে
করিব রে হা-হুতাশ ।
মোর এক নাম কেবলি বসিয়া
জপিব কানেতে তব ,
কাঁটার মতন দিবস রজনী
পায়েতে বিঁধিয়ে রব ।
পূর্বজনমের অভিশাপ-সম
রব আমি কাছে কাছে ,
ভাবী জনমের অদৃষ্টের মতো
বেড়াইব পাছে পাছে ।
ঢালিয়া আমার প্রাণের আঁধার
বেড়িয়া রাখিব তোর চারি ধার
নিশীথ রচনা করি ।
কাছেতে দাঁড়ায়ে প্রেতের মতন
শুধু দুটি প্রাণী করিব যাপন
অনন্ত সে বিভাবরী ।
যেন রে অকূল সাগর-মাঝারে
ডুবেছে জগৎ-তরী —
তারি মাঝে শুধু মোরা দুটি প্রাণী
রয়েছি জড়ায়ে তোর বাহুখানি ,
যুঝিস ছাড়াতে , ছাড়িব না তবু
সে মহাসমুদ্র- ‘ পরি ।
পলে পলে তোর দেহ হয় ক্ষীণ ,
পলে পলে তোর বাহু বলহীন ,
দুজনে অনন্তে ডুবি নিশিদিন —
তবু আছি তোরে ধরি ।
রোগের মতন বাঁধিব তোমারে
নিদারুণ আলিঙ্গনে —
মোর যাতনায় হইবি অধীর ,
আমারি অনলে দহিবে শরীর ,
অবিরাম শুধু আমি ছাড়া আর
কিছু না রহিবে মনে ।
গভীর নিশীথে জাগিয়া উঠিয়া
সহসা দেখিবি কাছে ,
আড়ষ্ট কঠিন মৃত দেহ মোর
তোর পাশে শুয়ে আছে ।
ঘুমাবি যখন স্বপন দেখিবি ,
কেবল দেখিবি মোরে ,
এই অনিমেষ তৃষাতুর আঁখি
চাহিয়া দেখিছে তোরে ।
নিশীথে বসিয়া থেকে থেকে তুই
শুনিবি আঁধারঘোরে ,
কোথা হতে এক কাতর উন্মাদ
ডাকে তোর নাম ধরে ।
সুবিজন পথে চলিতে চলিতে
সহসা সভয় গণি ,
সাঁঝের আঁধারে শুনিতে পাইবি
আমার হাসির ধ্বনি ।

হেরো অন্ধকার মরুময়ী নিশা —
আমার পরান হারায়েছে দিশা ,
অনন্ত এ ক্ষুধা অনন্ত এ তৃষা
করিতেছে হাহাকার ।
আজিকে যখন পেয়েছি রে তোরে
এ চিরযামিনী ছাড়িব কী করে ।
এ ঘোর পিপাসা যুগ-যুগান্তরে
মিটিবে কি কভু আর ।
বুকের ভিতরে ছুরির মতন ,
মনের মাঝারে বিষের মতন ,
রোগের মতন , শোকের মতন
রব আমি অনিবার ।
জীবনের পিছে মরণ দাঁড়ায়ে ,
আশার পশ্চাতে ভয় —
ডাকিনীর মতো রজনী ভ্রমিছে
চিরদিন ধরে দিবসের পিছে
সমস্ত ধরণীময় ।
যেথায় আলোক সেইখানে ছায়া
এই তো নিয়ম ভবে ,
ও রূপের কাছে চিরদিন তাই
এ ক্ষুধা জাগিয়া রবে!

সুখস্বপ্ন

ওই জানালার কাছে বসে আছে
করতলে রাখি মাথা ।
তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে ,
সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা ।
শুধু ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় ,
তার কানে কানে কী যে কহে যায় ,
তাই আধো শুয়ে আধো বসিয়ে
কত ভাবিতেছে আনমনে ।
উড়ে উড়ে যায় চুল ,
কোথা উড়ে উড়ে পড়ে ফুল ,
ঝুরু ঝুরু কাঁপে গাছপালা
সমুখের উপবনে ।
অধরের কোণে হাসিটি
আধখানি মুখ ঢাকিয়া ,
কাননের পানে চেয়ে আছে
আধমুকুলিত আঁখিয়া ।
সুদূর স্বপন ভেসে ভেসে
চোখে এসে যেন লাগিছে ,
ঘুমঘোরময় সুখের আবেশ
প্রাণের কোথায় জাগিছে ।
চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায় ,
উড়ে উড়ে যায় পাখি ,
সারাদিন ধরে বকুলের ফুল
ঝরে পড়ে থাকি থাকি ।
মধুর আলস , মধুর আবেশ ,
মধুর মুখের হাসিটি ,
মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে
বাজিছে মধুর বাঁশিটি ।

সুখের স্মৃতি

চেয়ে আছে আকাশের পানে
জোছনায় আঁচলটি পেতে ,
যত আলো ছিল সে চাঁদের
সব যেন পড়েছে মুখেতে ।
মুখে যেন গলে পড়ে চাঁদ ,
চোখে যেন পড়িছে ঘুমিয়ে ,
সুকোমল শিথিল আঁচলে
পড়ে আছে আরামে চুমিয়ে ।
একটি মৃণাল-করে মাথা ,
আরেকটি পড়ে আছে বুকে ,
বাতাসটি বহে গিয়ে গায়
শিহরি উঠিছে অতি সুখে ।
হেলে হেলে নুয়ে নুয়ে লতা
বাতাসেতে পায়ে এসে পড়ে ,
বিস্ময়ে মুখের পানে চেয়ে
ফুলগুলি দুলে দুলে নড়ে ।
অতি দূরে বাজে ধীরে বাঁশি ,
অতি সুখে পরান উদাসী ,
অধরেতে স্খলিতচরণা
মদিরহিল্লোলময়ী হাসি ।
কে যেন রে চুমো খেয়ে তারে
চলে গেছে এই কিছু আগে ;
চুমোটিরে বাঁধি ফুলহারে
অধরেতে হাসির মাঝারে ,
চুমোতে চাঁদের চুমো দিয়ে
রেখেছে রে যতনে সোহাগে ।
তাই সেই চুমোটিরে ঘিরে
হাসিগুলি সারা রাত জাগে ।
কে যেন রে বসে তার কাছে
গুন গুন করে বলে গেছে
মধুমাখা বাণী কানে কানে ।
পরানের কুসুমকারায়
কথাগুলি উড়িয়ে বেড়ায় ,
বাহিরিতে পথ নাহি জানে ।
অতি দূর বাঁশরির গানে
সে বাণী জড়িয়ে যেন গেছে ,
অবিরত স্বপনের মতো
ঘুরিয়ে বেড়ায় কাছে কাছে ।
মুখে নিয়ে সেই কথা কটি
খেলা করে উলটি , পালটি ,
আপনি আপন বাণী শুনে
শরমে সুখেতে হয় সারা ।
কার মুখ পড়ে তার মনে ,
কার হাসি লাগিছে নয়নে ,
স্মৃতির মধুর ফুলবনে
কোথায় হয়েছে পথহারা!
চেয়ে তাই সুনীল আকাশে
মুখেতে চাঁদের আলো ভাসে ,
অবসান-গান আশেপাশে
ভ্রমে যেন ভ্রমরের পারা ।

স্নেহময়ী

হাসিতে ভরিয়ে গেছে হাসিমুখখানি —
প্রভাতে ফুলের বনে দাঁড়ায়ে আপন মনে ,
মরি মরি , মুখে নাই বাণী ।
প্রভাতকিরণগুলি চৌদিকে যেতেছে খুলি
যেন শুভ্র কমলের দল ,
আপন মহিমা লয়ে তারি মাঝে দাঁড়াইয়ে
কে তুই করুণাময়ী বল্ ।
স্নিগ্ধ ওই দুনয়ানে চাহিলে মুখের পানে
সুধাময়ী শান্তি প্রাণে জাগে —
শুনি যেন স্নেহবাণী , কোমল ও হাতখানি
প্রাণের গায়েতে যেন লাগে ।
তোরে যেন চিনিতাম , তোর কাছে শুনিতাম
কত কী কাহিনী সন্ধেবেলা ,
যেন মনে নাই কবে কাছে বসি মোরা সবে
তোর কাছে করিতাম খেলা ।
অতি ধীরে তোর পাশে প্রভাতের বায়ু আসে ,
যেন ছোটো ভাইটির প্রায় ,
যেন তোর স্নেহ পেয়ে তোর মুখপানে চেয়ে
আবার সে খেলাইতে যায় ।
অমিয়-মাধুরী মাখি চেয়ে আছে দুটি আঁখি ,
জগতের প্রাণ জুড়াইছে ,
ফুলেরা আমোদে মেতে হেলে দুলে বাতাসেতে
আঁখি হতে স্নেহ কুড়াইছে ।
কী যেন জান গো ভাষা , কী যেন দিতেছ আশা ,
আঁখি দিয়ে পরান উথলে —
চারি দিকে ফুলগুলি কচি কচি বাহু তুলি
‘ কোলে নাও ‘ ‘ কোলে নাও ‘ বলে ।
কারে যেন কাছে ডাক , যেথা তুমি বসে থাক
তার চারি দিকে থাক তুমি —
তোমার আপনা দিয়ে হাসিময়ী শান্তি দিয়ে
পূর্ণ কর চরাচরভূমি ।
তোমাতে পুরেছে বন , পূর্ণ হল সমীরণ ,
তোমাতে পুরেছে লতাপাতা ।
ফুল দূরে থেকে চায় — তোমার পরশ পায় ,
লুটায় তোমার কোলে মাথা ।
তোমার প্রাণের বিভা চৌদিকে দুলিছে কি বা
প্রভাতের আলোকহিল্লোলে ,
আজিকে প্রভাতে এ কী স্নেহের প্রতিমা দেখি ,
বসে আছ জগতের কোলে!
কেহ মুখ চেয়ে থাকে , কেহ তোরে কাছে ডাকে
কেহ তোর কোলে খেলা করে ।
তুমি শুধু স্তব্ধ হয়ে একটি কথা না কয়ে
চেয়ে আছ আনন্দের ভরে ।
ওই যে তোমার কাছে সকলে দাঁড়িয়ে আছে
ওরা মোর আপনার লোক ,
ওরাও আমারি মতো তোর স্নেহে আছে রত
জুঁই বেলা বকুল অশোক ।
বড়ো সাধ যায় তোরে ফুল হয়ে থাকি ঘিরে
কাননে ফুলের সাথে মিশে
নয়ন-কিরণে তোর দুলিবে পরান মোর ,
সুবাস ছুটিবে দিশে দিশে ।
তোমার হাসিটি লয়ে হরষে আকুল হয়ে
খেলা করে প্রভাতের আলো
হাসিতে আলোটি পড়ে , আলোতে হাসিটি পড়ে ,
প্রভাত মধুর হয়ে গেল ।
পরশি তোমার কায় মধুর প্রভাত-বায় ,
মধুময় কুসুমের বাস —
ওই দৃষ্টিসুধা দাও , এই দিক-পানে চাও ,
প্রাণে হোক প্রভাত বিকাশ ।

স্মৃতি-প্রতিমা

আজ কিছু করিব না আর,
সমুখেতে চেয়ে চেয়ে গুন গুন গেয়ে গেয়ে
বসে বসে ভাবি একবার ।
আজি বহু দিন পরে যেন সেই দ্বিপ্রহরে
সেদিনের বায়ু বহে যায়,
হা রে হা শৈশবমায়া অতীত প্রাণের ছায়া,
এখনো কি আছিস হেথায় ?
এখনো কি থেকে থেকে উঠিস রে ডেকে ডেকে,
সাড়া দিবে সে কি আর কাছে ?
যা ছিল তা আছে সেই, আমি যে সে আমি নেই,
কেন রে আসিস মোর কাছে ?
কেন রে পুরানো স্নেহে পরানের শূন্য গেহে
দাঁড়ায়ে মুখের পানে চাস ?
অভিমানে ছলছল নয়নে কি কথা বল,
কেঁদে ওঠে হৃদয় উদাস।
আছিল যে আপনার সে বুঝি রে নাই আর,
সে বুঝি রে হয়ে গেছে পর —
তবু সে কেমন আছে শুধাতে আসিস কাছে,
দাঁড়ায়ে কাঁপিস থর থর ।
আয় রে আয় রে অয়ি, শৈশবের স্মৃতিময়ী,
আয় তোর আপনার দেশে —
যে প্রাণ আছিল তোরি তাহারি দুয়ার ধরি
কেন আজ ভিখারিনী-বেশে!
আগুসরি ধীরি ধীরি বার বার চাস ফিরি,
সংশয়েতে চলে না চরণ —
ভয়ে ভয়ে মুখপানে — চাহিস আকুল প্রাণে,
ম্লান মুখে না সরে বচন ।
দেহে যেন নাহি বল, চোখে পড়ে-পড়ে জল,
এলো চুলে, মলিন বসনে —
কথা কেহ বলে পাছে ভয়ে না আসিস কাছে,
চেয়ে রোস আকুল নয়নে ।
সেই ঘর সেই দ্বার মনে পড়ে বার বার
কত যে করিলি খেলাধূলি —
খেলা ফেলে গেলি চলে, কথাটি না গেলি বলে,
অভিমানে নয়ন আকুলি ।
যেথা যা গেছিলি রেখে, ধুলায় গিয়েছে ঢেকে,
দেখ্ রে তেমনি আছে পড়ি —
সেই অশ্রু সেই গান সেই হাসি অভিমান,
ধুলায় যেতেছে গড়াগড়ি ।
তব রে বারেক আয় বোস্ হেথা পুনরায়
ধূলিমাখা অতীতের মাঝে —
শূন্য গৃহ জনহীন পড়ে আছে কত দিন,
আর হেথা বাঁশি নাহি বাজে ।
কেন তবে আসিবে নে কেন কাছে বসিবি নে
এখনো বাসিস যদি ভালো!
আয় রে ব্যাকুল প্রাণে চাই দুঁহু মুখপানে,
গোধূলিতে নিব-নিব আলো ।
নিবিছে সাঁঝের ভাতি, আসিছে আঁধার রাতি
এখনি ছাইবে চারি ভিতে —
রজনীর অন্ধকারে মরণসাগরপারে
কেহ কারে নারিব দেখিতে ।
আকাশের পানে চাই — চন্দ্র নাই, তারা নাই,
একটু না বহিছে বাতাস,
শুধু দীর্ঘ দীর্ঘ নিশি দুজনে আঁধারে মিশি
শুনিব দোঁহার দীর্ঘশ্বাস ।
এক বার চেয়ে দেখি কোন্খানে আছে যে কী,
কোন্খানে করেছিনু খেলা —
শুকানো এ মালাগুলি রাখি রে কন্ঠেতে তুলি,
কখন চলিয়া যাবে বেলা ।
আয় তবে আয় হেথা, কোলে তোর রাখি মাথা,
কেশপাশে মুখ দে রে ঢেকে —
বিন্দু বিন্দু ধীরে ধীরে অশ্রু পড়ে অশ্রুনীরে,
নিশ্বাস উঠিছে থেকে থেকে ।
সেই পুরাতন স্নেহে হাতটি বুলাও দেহে,
মাথাটি বুকেতে তুলে রাখি —
কথা কও নাহি কও চোখে চোখে চেয়ে রও,
আঁখিতে ডুবিয়া যাক আঁখি ।

০১. উৎসর্গ ও সূচনা (ছবি ও গান)

উৎসর্গ

গত বৎসরকার বসন্তের ফুল লইয়া এ বৎসরকার
বসন্তে মালা গাঁথিলাম ।
যাঁহার নয়ন-কিরণে প্রতিদিন প্রভাতে এই ফুলগুলি
একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিত ,
তাঁহারি চরণে ইহাদিগকে উৎসর্গ করিলাম ।
সূচনা

ছবি ও গান নিয়ে আমার বলবার কথাটা বলে নিই । এটা বয়ঃসন্ধিকালের লেখা , শৈশব যৌবন যখন সবে মিলেছে । ভাষায় আছে ছেলেমানুষি , ভাবে এসেছে কৈশোর । তার পূর্বেকার অবস্থায় একটা বেদনা ছিল অনুদ্দিষ্ট , সে যেন প্রলাপ বকে আপনাকে শান্ত করতে চেয়েছে । এখন সেই বয়স যখন কামনা কেবল সুর খুঁজছে না , রূপ খুঁজতে বেরিয়েছে । কিন্তু আলো-আঁধারে রূপের আভাস পায় , স্পষ্ট করে কিছু পায় না । ছবি এঁকে তখন প্রত্যক্ষতার স্বাদ পাবার ইচ্ছা জেগেছে মনে কিন্তু ছবি আঁকবার হাত তৈরি হয় নি তো ।

কবি সংসারের ভিতরে তখনও প্রবেশ করে নি , তখনও সে বাতায়নবাসী । দূর থেকে যার আভাস দেখে তার সঙ্গে নিজের মনের নেশা মিলিয়ে দেয় । এর কোনো-কোনোটা চোখে দেখা একটুকরো ছবি পেনসিলে আঁকা , রবারে ঘষে দেওয়া , আর কোনো-কোনোটা সম্পূর্ণ বানানো । মোটের উপরে অক্ষম ভাষার ব্যাকুলতায় সবগুলিতেই বানানো ভাব প্রকাশ পেয়েছে , সহজ হয় নি । কিন্তু সহজ হবার একটা চেষ্টা দেখা যায় । সেইজন্যে চলতি ভাষা আপন এলোমেলো পদক্ষেপে এর যেখানে-সেখানে প্রবেশ করেছে । আমার ভাষায় ও ছন্দে এই একটা মেলামেশা আরম্ভ হল । ছবি ও গান কড়ি ও কোমলের ভূমিকা করে দিলে ।

Exit mobile version