Site icon BnBoi.Com

চিত্রা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

চিত্রা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অন্তর্যামী

এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী ,
আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে
বলিতে দিতেছ কই ।
অন্তরমাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে ।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই ,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই ,
সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই ,
কোথা ভেসে যাই দূরে ।
বলিতেছিলাম বসি এক ধারে
আপনার কথা আপন জনারে ,
শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে
ঘরের কাহিনী যত —
তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে
ডুবায়ে ভাসায়ে নয়নের জলে
নবীন প্রতিমা নব কৌশলে
গড়িলে মনের মতো ।
সে মায়ামুরতি কী কহিছে বাণী ,
কোথাকার ভাব কোথা নিলে টানি —
আমি চেয়ে আছি বিস্ময়ে মানি
রহস্যে নিমগন ।
এ যে সংগীত কোথা হতে উঠে ,
এ যে লাবণ্য কোথা হতে ফুটে ,
এ যে ক্রন্দন কোথা হতে টুটে
অন্তরবিদারণ ।
নূতন ছন্দ অন্ধের প্রায়
ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায় ,
নূতন বেদনা বেজে উঠে তায়
নূতন রাগিণীভরে ।
যে কথা ভাবি নি বলি সেই কথা ,
যে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা ,
জানি না এনেছি কাহার বারতা
কারে শুনাবার তরে ।
কে কেমন বোঝে অর্থ তাহার ,
কেহ এক বলে কেহ বলে আর ,
আমারে শুধায় বৃথা বার বার
দেখে তুমি হাস বুঝি ।
কে গো তুমি , কোথা রয়েছ গোপনে ,
আমি মরিতেছি খুঁজি ।

এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী ।
যে দিকে পান্থ চাহে চলিবারে
চলিতে দিতেছ কই ।
গ্রামের যে পথ ধায় গৃহপানে ,
চাষিগণ ফিরে দিবা-অবসানে ,
গোঠে ধায় গোরু , বধূ জল আনে
শত বার যাতায়াতে ,
একদা প্রথম প্রভাতবেলায়
সে পথে বাহির হইনু হেলায় —
মনে ছিল , দিন কাজে ও খেলায়
কাটায়ে ফিরিব রাতে ।
পদে পদে তুমি ভুলাইলে দিক ,
কোথা যাব আজি নাহি পাই ঠিক ,
ক্লান্তহৃদয় ভ্রান্ত পথিক
এসেছি নূতন দেশে ।
কখনো উদার গিরির শিখরে
কভু বেদনার তমোগহ্বরে
চিনি না যে পথ সে পথের ‘ পরে
চলেছি পাগল-বেশে ।
কভু বা পান্থ গহন জটিল ,
কভু পিচ্ছল ঘনপঙ্কিল ,
কভু সংকটছায়াশঙ্কিল ,
বঙ্কিম দুরগম —
খরকণ্টকে ছিন্ন চরণ ,
ধুলায় রৌদ্রে মলিন বরন ,
আশেপাশে হতে তাকায় মরণ
সহসা লাগায় ভ্রম ।
তারি মাঝে বাঁশি বাজিছে কোথায় ,
কাঁপিছে বক্ষ সুখে ব্যথায় ,
তীব্র তপ্ত দীপ্ত নেশায়
চিত্ত মাতিয়া উঠে ।
কোথা হতে আসে ঘন সুগন্ধ ,
কোথা হতে বায়ু বহে আনন্দ ,
চিন্তা ত্যজিয়া পরান অন্ধ
মৃত্যুর মুখে ছুটে ।
খেপার মতন কেন এ জীবন ,
অর্থ কী তার , কোথা এ ভ্রমণ ,
চুপ করে থাকি শুধায় যখন —
দেখে তুমি হাস বুঝি ।
কে তুমি গোপনে চালাইছ মোরে
আমি যে তোমারে খুঁজি ।

রাখো কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী ।
আমার অর্থ তোমার তত্ত্ব
বলে দাও মোরে অয়ি ।
আমি কি গো বীণাযন্ত্র তোমার ,
ব্যথায় পীড়িয়া হৃদয়ের তার
মূর্ছনাভরে গীতঝংকার
ধ্বনিছ মর্মমাঝে ?
আমার মাঝারে করিছ রচনা
অসীম বিরহ , অপার বাসনা ,
কিসের লাগিয়া বিশ্ববেদনা
মোর বেদনায় বাজে ?
মোর প্রেমে দিয়ে তোমার রাগিণী
কহিতেছ কোন্‌ অনাদি কাহিনী ,
কঠিন আঘাতে ওগো মায়াবিনী
জাগাও গভীর সুর ।
হবে যবে তব লীলা-অবসান ,
ছিঁড়ে যাবে তার , থেমে যাবে গান ,
আমারে কি ফেলে করিবে প্রয়াণ
তব রহস্যপুর ?
জ্বেলেছ কি মোরে প্রদীপ তোমার
করিবারে পূজা কোন্‌ দেবতার
রহস্য-ঘেরা অসীম আঁধার
মহামন্দিরতলে ?
নাহি জানি তাই কার লাগি প্রাণ
মরিছে দহিয়া নিশিদিনমান ,
যেন সচেতন বহ্নিসমান
নাড়ীতে নাড়ীতে জ্বলে ।
অর্ধনিশীথে নিভৃতে নীরবে
এই দীপখানি নিবে যাবে যবে
বুঝিবে কি , কেন এসেছিনু ভবে ,
কেন জ্বলিলাম প্রাণে ?
কেন নিয়ে এলে তব মায়ারথে
তোমার বিজন নূতন এ পথে ,
কেন রাখিলে না সবার জগতে
জনতার মাঝখানে ?
জীবন-পোড়ানো এ হোম-অনল
সেদিন কি হবে সহসা সফল ?
সেই শিখা হতে রূপ নির্মল
বাহিরি আসিবে বুঝি!
সব জটিলতা হইবে সরল
তোমারে পাইব খুঁজি ।

ছাড়ি কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী ,
জীবনের শেষে কী নূতন বেশে
দেখা দিবে মোরে অয়ি!
চিরদিবসের মর্মের ব্যথা ,
শত জনমের চিরসফলতা ,
আমার প্রেয়সী , আমার দেবতা ,
আমার বিশ্বরূপী ,
মরণনিশায় উষা বিকাশিয়া
শ্রান্তজনের শিয়রে আসিয়া
মধুর অধরে করুণ হাসিয়া
দাঁড়াবে কি চুপিচুপি ?
ললাট আমার চুম্বন করি
নব চেতনায় দিবে প্রাণ ভরি ,
নয়ন মেলিয়া উঠিব শিহরি ,
জানি না চিনিব কি না —
শূন্য গগন নীলনির্মল ,
নাহি রবিশশী গ্রহমণ্ডল ,
না বহে পবন , নাই কোলাহল ,
বাজিছে নীরব বীণা —
অচল আলোকে রয়েছ দাঁড়ায়ে ,
কিরণবসন অঙ্গ জড়ায়ে
চরণের তলে পড়িছে গড়ায়ে
ছড়ায়ে বিবিধ ভঙ্গে ।
গন্ধ তোমার ঘিরে চারি ধার ,
উড়িছে আকুল কুন্তলভার ,
নিখিল গগন কাঁপিছে তোমার
পরশরসতরঙ্গে ।
হাসিমাখা তব আনত দৃষ্টি
আমারে করিছে নূতন সৃষ্টি
অঙ্গে অঙ্গে অমৃতবৃষ্টি
বরষি করুণাভরে ।
নিবিড় গভীর প্রেম-আনন্দ
বাহুবন্ধনে করেছে বন্ধ ,
মুগ্ধ নয়ন হয়েছে অন্ধ
অশ্রুবাষ্পথরে ।
নাহিকো অর্থ , নাহিকো তত্ত্ব ,
নাহিকো মিথ্যা , নাহিকো সত্য ,
আপনার মাঝে আপনি মত্ত —
দেখিয়া হাসিবে বুঝি ।
আমি হতে তুমি বাহিরে আসিবে ,
ফিরিতে হবে না খুঁজি ।

যদি কৌতুক রাখ চিরদিন
ওগো কৌতুকময়ী ,
যদি অন্তরে লুকায়ে বসিয়া
হবে অন্তরজয়ী ,
তবে তাই হোক । দেবী , অহরহ
জনমে জনমে রহো তবে রহো ,
নিত্যমিলনে নিত্যবিরহ
জীবনে জাগাও প্রিয়ে ।
নব নব রূপে — ওগো রূপময় ,
লুণ্ঠিয়া লহো আমার হৃদয় ,
কাঁদাও আমারে , ওগো নির্দয় ,
চঞ্চল প্রেম দিয়ে ।
কখনো হৃদয়ে কখনো বাহিরে ,
কখনো আলোকে কখনো তিমিরে ,
কভু বা স্বপনে কভু সশরীরে
পরশ করিয়া যাবে —
বক্ষোবীণায় বেদনার তার
এইমতো পুন বাঁধিব আবার ,
পরশমাত্রে গীতঝংকার
উঠিবে নূতন ভাবে ।
এমনি টুটিয়া মর্মপাথর
ছুটিবে আবার অশ্রুনিঝর ,
জানি না খুঁজিয়া কী মহাসাগর
বহিয়া চলিবে দূরে ।
বরষ বরষ দিবসরজনী
অশ্রুনদীর আকুল সে ধ্বনি
রহিয়া রহিয়া মিশিবে এমনি
আমার গানের সুরে ।
যত শত ভুল করেছি এবার
সেইমতো ভুল ঘটিবে আবার —
ওগো মায়াবিনী , কত ভুলাবার
মন্ত্র তোমার আছে!
আবার তোমারে ধরিবার তরে
ফিরিয়া মরিব বনে প্রান্তরে ,
পথ হতে পথে , ঘর হতে ঘরে
দুরাশার পাছে পাছে ।
এবারের মতো পুরিয়া পরান
তীব্র বেদনা করিয়াছি পান ,
সে সুরা তরল অগ্নিসমান
তুমি ঢালিতেছ বুঝি!
আবার এমনি বেদনার মাঝে
তোমারে ফিরিব খুঁজি ।

আবেদন

ভৃত্য । জয় হোক মহারানী । রাজরাজেশ্বরী ,
দীন ভৃত্যে করো দয়া ।
রানী । সভা ভঙ্গ করি
সকলেই গেল চলি যথাযোগ্য কাজে
আমার সেবকবৃন্দ বিশ্বরাজ্যমাঝে ,
মোর আজ্ঞা মোর মান লয়ে শীর্ষদেশে
জয়শঙ্খ সগর্বে বাজায়ে । সভাশেষে
তুমি এলে নিশান্তের শশাঙ্ক-সমান
ভক্ত ভৃত্য মোর । কী প্রার্থনা ?
ভৃত্য । মোর স্থান
সর্বশেষে , আমি তব সর্বাধম দাস
মহোত্তমে । একে একে পরিতৃপ্ত-আশ
সবাই আনন্দে যবে ঘরে ফিরে যায়
সেইক্ষণে আমি আসি নির্জন সভায় ,
একাকী আসীনা তব চরণতলের
প্রান্তে বসে ভিক্ষা মাগি শুধু সকলের
সর্ব-অবশেষটুকু ।
রানী । অবোধ ভিক্ষুক ,
অসময়ে কী তোরে মিলিবে ।
ভৃত্য । হাসিমুখ
দেখে চলে যাব । আছে দেবী , আরো আছে —
নানা কর্ম নানা পদ নিল তোর কাছে
নানা জনে ; এক কর্ম কেহ চাহে নাই ,
ভৃত্য- ‘ পরে দয়া করে দেহো মোরে তাই —
আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর ।
রানী । মালাকর ?
ভৃত্য । ক্ষুদ্র মালাকর । অবসর
লব সব কাজে । যুদ্ধ-অস্ত্র ধনুঃশর
ফেলিনু ভূতলে , এ উষ্ণীষ রাজসাজ
রাখিনু চরণে তব — যত উচ্চকাজ
সব ফিরে লও দেবী । তব দূত করি
মোরে আর পাঠায়ো না , তব স্বর্ণতরী
দেশে দেশান্তরে লয়ে । জয়ধ্বজা তব
দিগ্‌দিগন্তে করিয়া প্রচার , নব নব
দিগ্বিজয়ে পাঠায়ো না মোরে । পরপারে
তব রাজ্য কর্মযশধনজনভারে
অসীমবিস্তৃত — কত নগরনগরী ,
কত লোকালয় , বন্দরেতে কত তরী ,
বিপণিতে কত পণ্য — ওই দেখো দূরে
মন্দিরশিখরে আর কত হর্ম্যচূড়ে
দিগন্তেরে করিছে দংশন , কলোচ্ছ্বাস
শ্বসিয়া উঠিছে শূন্যে করিবারে গ্রাস
নক্ষত্রের নিত্যনীরবতা । বহু ভৃত্য
আছে হোথা , বহু সৈন্য তব ; জাগে নিত্য
কতই প্রহরী । এ পারে নির্জন তীরে
একাকী উঠেছে ঊর্ধ্বে উচ্চ গিরিশিরে
রঞ্জিত মেঘের মাঝে তুষারধবল
তোমার প্রাসাদসৌধ , অনিন্দ্যনির্মল
চন্দ্রকান্তমণিময় । বিজনে বিরলে
হেথা তব দক্ষিণের বাতায়নতলে
মঞ্জরিত-ইন্দুমল্লী-বল্লরীবিতানে ,
ঘনচ্ছায়ে , নিভৃত কপোতকলগানে
একান্তে কাটিবে বেলা ; স্ফটিকপ্রাঙ্গণে
জলযন্ত্রে উৎসধারা কল্লোলক্রন্দনে
উচ্ছ্বসিবে দীর্ঘদিন ছলছলছল —
মধ্যাহ্নেরে করি দিবে বেদনাবিহ্বল
করুণাকাতর । অদূরে অলিন্দ- ‘ পরে
পুঞ্জ পুচ্ছ বিস্ফারিয়া স্ফীত গর্বভরে
নাচিবে ভবনশিখী , রাজহংসদল
চরিবে শৈবালবনে করি কোলাহল
বাঁকায়ে ধবল গ্রীবা , পাটলা হরিণী
ফিরিবে শ্যামল ছায়ে । অয়ি একাকিনী ,
আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর ।
রানী । ওরে তুই কর্মভীরু অলস কিংকর ,
কী কাজে লাগিবি ?
ভৃত্য। অকাজের কাজ যত ,
আলস্যের সহস্র সঞ্চয় । শত শত
আনন্দের আয়োজন । যে অরণ্যপথে
কর তুমি সঞ্চরণ বসন্তে শরতে
প্রত্যুষে অরুণোদয়ে , শ্লথ অঙ্গ হতে
তপ্ত নিদ্রালসখানি স্নিগ্ধ বায়ুস্রোতে
করি দিয়া বিসর্জন , সে বনবীথিকা
রাখিব নবীন করি । পুষ্পাক্ষরে লিখা
তব চরণের স্তুতি প্রত্যহ উষায়
বিকশি উঠিবে তব পরশতৃষায়
পুলকিত তৃণপুঞ্জতলে । সন্ধ্যাকালে
যে মঞ্জু মালিকাখানি জড়াইবে ভালে
কবরী বেষ্টন করি , আমি নিজ করে
রচি সে বিচিত্র মালা সান্ধ্য যূথীস্তরে ,
সাজায়ে সুবর্ণ-পাত্রে তোমার সম্মুখে
নিঃশব্দে ধরিব আসি অবনতমুখে —
যেথায় নিভৃত কক্ষে ঘন কেশপাশ
তিমিরনির্ঝরসম উন্মুক্ত-উচ্ছ্বাস
তরঙ্গকুটিল এলাইয়া পৃষ্ঠ- ‘ পরে ,
কনকমুকুর অঙ্কে , শুভ্রপদ্মকরে
বিনাইবে বেণী । কুমুদসরসীকূলে
বসিবে যখন সপ্তপর্ণতরুমূলে
মালতী-দোলায় — পত্রচ্ছেদ-অবকাশে
পড়িবে ললাটে চক্ষে বক্ষে বেশবাসে
কৌতূহলী চন্দ্রমার সহস্র চুম্বন ,
আনন্দিত তনুখানি করিয়া বেষ্টন
উঠিবে বনের গন্ধ বাসনা-বিভোল
নিশ্বাসের প্রায় , মৃদু ছন্দে দিব দোল
মৃদুমন্দ সমীরের মতো । অনিমেষে
যে প্রদীপ জ্বলে তব শয্যাশিরোদেশে
সারা সুপ্তনিশি , সুরনরস্বপ্নাতীত
নিদ্রিত শ্রীঅঙ্গপানে স্থির অকম্পিত
নিদ্রাহীন আঁখি মেলি — সে প্রদীপখানি
আমি জ্বালাইয়া দিব গন্ধতৈল আনি ।
শেফালির বৃন্ত দিয়া রাঙাইব , রানী ,
বসন বাসন্তী রঙে । পাদপীঠখানি
নব ভাবে নব রূপে শুভ-আলিম্পনে
প্রত্যহ রাখিব অঙ্কি কুঙ্কুমে চন্দনে
কল্পনার লেখা । নিকুঞ্জের অনুচর ,
আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর ।
রানী । কী লইবে পুরস্কার ।
ভৃত্য । প্রত্যহ প্রভাতে
ফুলের কঙ্কণ গড়ি কমলের পাতে
আনিব যখন , পদ্মের কলিকাসম
ক্ষুদ্র তব মুষ্টিখানি করে ধরি মম
আপনি পরায়ে দিব , এই পুরস্কার ।
আশোকের কিশলয়ে গাঁথি দিব হার
প্রতি সন্ধ্যাবেলা , অশোকের রক্তকান্তে
চিত্রি পদতল চরণ-অঙ্গুলিপ্রান্তে
লেশমাত্র রেণু চুম্বিয়া মুছিয়া লব ,
এই পুরস্কার ।
রানী । ভৃত্য , আবেদন তব
করিনু গ্রহণ । আছে মোর বহু মন্ত্রী ,
বহু সৈন্য , বহু সেনাপতি — বহু যন্ত্রী
কর্মযন্ত্রে রত — তুই থাক্‌ চিরদিন
স্বেচ্ছাবন্দী দাস , খ্যাতিহীন , কর্মহীন ।
রাজসভা-বহিঃপ্রান্তে রবে তোর ঘর —
তুই মোর মালঞ্চের হবি মালাকর ।

উর্বশী

নহ মাতা , নহ কন্যা , নহ বধূ , সুন্দরী রূপসী ,
হে নন্দনবাসিনী উর্বশী!
গোষ্ঠে যবে সন্ধ্যা নামে শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি
তুমি কোনো গৃহপ্রান্তে নাহি জ্বাল সন্ধ্যাদীপখানি ,
দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্রনেত্রপাতে
স্মিতহাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসরশয্যাতে
স্তব্ধ অর্ধরাতে ।
উষার উদয়-সম অনবগুণ্ঠিতা
তুমি অকুণ্ঠিতা ।

বৃন্তহীন পুষ্প-সম আপনাতে আপনি বিকশি
কবে তুমি ফুটিলে উর্বশী!
আদিম বসন্তপ্রাতে উঠেছিলে ম ন্থি ত সাগরে ,
ডান হাতে সুধাপাত্র বিষভাণ্ড লয়ে বাম করে ,
তরঙ্গিত মহাসিন্ধু মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গের মতো
পড়েছিল পদপ্রান্তে উচ্ছ্বসিত ফণা লক্ষ শত
করি অবনত ।
কুন্দশুভ্র নগ্নকান্তি সুরেন্দ্রবন্দিতা ,
তুমি অনিন্দিতা ।

কোনোকালে ছিলে না কি মুকুলিকা বালিকা-বয়সী
হে অনন্তযৌবনা উর্বশী!
আঁধার পাথারতলে কার ঘরে বসিয়া একেলা
মানিক মুকুতা লয়ে করেছিলে শৈশবের খেলা ,
মণিদীপদীপ্ত কক্ষে সমুদ্রের কল্লোলসংগীতে
অকলঙ্ক হাস্যমুখে প্রবাল-পালঙ্কে ঘুমাইতে
কার অঙ্কটিতে ।
যখনি জাগিলে বিশ্বে , যৌবনে গঠিতা ,
পূর্ণপ্রস্ফুটিতা ।

যুগযুগান্তর হতে তুমি শুধু বিশ্বের প্রেয়সী
হে অপূর্বশোভনা উর্বশী!
মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল ,
তোমারি কটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল ,
তোমার মদির গন্ধ অন্ধবায়ু বহে চারি ভিতে ,
মধুমত্তভৃঙ্গসম মুগ্ধ কবি ফিরে লুব্ধচিতে
উদ্দাম সংগীতে ।
নূপুর গুঞ্জরি যাও আকুল-অঞ্চলা
বিদ্যুৎ-চঞ্চলা ।

সুরসভাতলে যবে নৃত্য কর পুলকে উল্লসি
হে বিলোলহিল্লোল উর্বশী ,
ছন্দে ছন্দে নাচি উঠে সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল ,
শস্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল ,
তব স্তনহার হতে নভস্তলে খসি পড়ে তারা —
অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা ,
নাচে রক্তধারা ।
দিগন্তে মেখলা তব টুটে আচম্বিতে
অয়ি অসম্‌বৃতে ।

স্বর্গের উদয়াচলে মূর্তিমতী তুমি হে উষসী ,
হে ভুবনমোহিনী উর্বশী!
জগতের অশ্রুধারে ধৌত তব তনুর তনিমা ,
ত্রিলোকের হৃদিরক্তে আঁকা তব চরণশোণিমা ।
মুক্তবেণী বিবসনে , বিকশিত বিশ্ব-বাসনার
অরবিন্দ-মাঝখানে পাদপদ্ম রেখেছ তোমার
অতি লঘুভার —
অখিল মানসস্বর্গে অনন্তরঙ্গিণী ,
হে স্বপ্নসঙ্গিনী ।

ওই শুন দিশে দিশে তোমা লাগি কাঁদিছে ক্রন্দসী
হে নিষ্ঠুরা বধিরা উর্বশী!
আদিযুগ পুরাতন এ জগতে ফিরিবে কি আর ,
অতল অকূল হতে সিক্তকেশে উঠিবে আবার ?
প্রথম সে তনুখানি দেখা দিবে প্রথম প্রভাতে
সর্বাঙ্গে কাঁদিবে তব নিখিলের নয়ন-আঘাতে
বারিবিন্দুপাতে —
অকস্মাৎ মহাম্বুধি অপূর্ব সংগীতে
রবে তরঙ্গিতে ।

ফিরিবে না , ফিরিবে না — অস্ত গেছে সে গৌরবশশী ,
অস্তাচলবাসিনী উর্বশী!
তাই আজি ধরাতলে বসন্তের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে
কার চিরবিরহের দীর্ঘশ্বাস মিশে বহে আসে ,
পূর্ণিমানিশীথে যবে দশ দিকে পরিপূর্ণ হাসি
দূরস্মৃতি কোথা হতে বাজায় ব্যাকুল-করা বাঁশি —
ঝরে অশ্রুরাশি ।
তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে —
অয়ি অবন্ধনে ।

উৎসব

মোর অঙ্গে অঙ্গে যেন আজি বসন্ত-উদয়
কত পত্রপুষ্পময় ।
যেন মধুপের মেলা
গুঞ্জরিছে সারাবেলা ,
হেলাভরে করে খেলা
অলস মলয় ।
ছায়া আলো অশ্রু হাসি
নৃত্য গীত বীণা বাঁশি ,
যেন মোর অঙ্গে আসি
বসন্ত-উদয়
কত পত্রপুষ্পময় ।

তাই মনে হয় আমি পরম সুন্দর ,
আমি অমৃতনির্ঝর ।
সুখসিক্ত নেত্র মম
শিশিরিত পুষ্পসম ,
ওষ্ঠে হাসি নিরুপম
মাধুরীমনথর ।
মোর পুলকিত হিয়া
সর্বদেহে বিলসিয়া
বক্ষে উঠে বিকশিয়া
পরম সুন্দর ,
নব অমৃতনির্ঝর ।

ওগো , যে তুমি আমার মাঝে নূতন নবীন
সদা আছ নিশিদিন ,
তুমি কি বসেছ আজি

নব বরবেশে সাজি ,
কুন্তলে কুসুমরাজি ,
অঙ্কে লয়ে বীন ,
ভরিয়া আরতিথালা
জ্বালায়েছ দীপমালা ,
সাজায়েছ পুষ্পডালা
নূতন নবীন —
আজি বসন্তের দিন ।

ওগো তুমি কি উতলাসম বেড়াইছ ফিরে
মোর হৃদয়ের তীরে ?
তোমারি কি চারিপাশ
কাঁপে শত অভিলাষ ,
তোমারি কি পট্টবাস
উড়িছে সমীরে ?
নব গান তব মুখে
ধ্বনিছে আমার বুকে ,
উচ্ছ্বসিয়া সুখে দুখে
হৃদয়ের তীরে
তুমি বেড়াইছ ফিরে ।

আজি তুমি কি দেখিছ এই শোভা রাশি রাশি
ওগো মনোবনবাসী ।
আমার নিশ্বাসবায়
লাগিছে কি তব গায় ,
বাসনার পুষ্প পায়
পড়িছে কি আসি ।
উঠিছে কি কলতান
মর্মরগুঞ্জরগান ,
তুমি কি করিছ পান
মোর সুধারাশি
ওগো মনোবনবাসী ।

আজি এ উৎসবকলরব কেহ নাহি জানে ,
শুধু আছে তাহা প্রাণে ।
শুধু এ বক্ষের কাছে
কী জানি কাহারা নাচে ,
সর্বদেহ মাতিয়াছে
শব্দহীন গানে ।
যৌবনলাবণ্যধারা
অঙ্গে অঙ্গে পথহারা ,
এ আনন্দ তুমি ছাড়া
কেহ নাহি জানে —
তুমি আছ মোর প্রাণে ।

এবার ফিরাও মোরে

সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত ,
তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো
মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ন তরুচ্ছায়ে
দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশি । ওরে তুই ওঠ্‌ আজি ;
আগুন লেগেছে কোথা ? কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগৎ-জনে ? কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে
শূন্যতল ? কোন্‌ অন্ধকারামাঝে জর্জর বন্ধনে
অনাথিনী মাগিছে সহায় ? স্ফীতকায় অপমান
অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান
লক্ষ মুখ দিয়া ; বেদনারে করিতেছে পরিহাস
স্বার্থোদ্ধত অবিচার ; সংকুচিত ভীত ক্রীতদাস
লুকাইছে ছদ্মবেশে । ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে — ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনী ; স্কন্ধে যত চাপে ভার
বহি চলে মন্দগতি , যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার —
তার পরে সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি ,
নাহি ভর্ৎসে অদৃষ্টেরে , নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি ,
মানবেরে নাহি দেয় দোষ , নাহি জানে অভিমান ,
শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া । সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে ,
সে প্রাণে আঘাত দেয় গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে ,
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে —
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে
মরে সে নীরবে । এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা — এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা — ডাকিয়া বলিতে হবে —
মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে ,
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে ,
যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে ;
যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার , তখনি সে
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে ;
দেবতা বিমুখ তারে , কেহ নাহি সহায় তাহার ,
মুখে করে আস্ফালন , জানে সে হীনতা আপনার
মনে মনে ।

কবি , তবে উঠে এসো — যদি থাকে প্রাণ
তবে তাই লহো সাথে , তবে তাই করো আজি দান ।
বড়ো দুঃখ , বড়ো ব্যথা — সম্মুখেতে কষ্টের সংসার
বড়োই দরিদ্র , শূন্য , বড়ো ক্ষুদ্র , বদ্ধ , অন্ধকার ।
অন্ন চাই , প্রাণ চাই , আলো চাই , চাই মুক্ত বায়ু ,
চাই বল , চাই স্বাস্থ্য , আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু ,
সাহসবিস্তৃত বক্ষপট । এ দৈন্যমাঝারে , কবি ,
একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি ।

এবার ফিরাও মোরে , লয়ে যাও সংসারের তীরে
হে কল্পনে , রঙ্গময়ী! দুলায়ো না সমীরে সমীরে
তরঙ্গে তরঙ্গে আর , ভুলায়ো না মোহিনী মায়ায় ।
বিজন বিষাদঘন অন্তরের নিকুঞ্জচ্ছায়ায়
রেখো না বসায়ে আর । দিন যায় , সন্ধ্যা হয়ে আসে ।
অন্ধকারে ঢাকে দিশি , নিরাশ্বাস উদাস বাতাসে
নিঃশ্বসিয়া কেঁদে ওঠে বন । বাহিরিনু হেথা হতে
উন্মুক্ত অম্বরতলে , ধূসরপ্রসর রাজপথে
জনতার মাঝখানে । কোথা যাও , পান্থ , কোথা যাও —
আমি নহি পরিচিত , মোর পানে ফিরিয়া তাকাও ।
বলো মোরে নাম তব , আমারে কোরো না অবিশ্বাস ।
সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টিমাঝে বহুকাল করিয়াছি বাস
সঙ্গিহীন রাত্রিদিন ; তাই মোর অপরূপ বেশ ,
আচার নূতনতর , তাই মোর চক্ষে স্বপ্নাবেশ
বক্ষে জ্বলে ক্ষুধানল । যেদিন জগতে চলে আসি ,
কোন্‌ মা আমারে দিলি শুধু এই খেলাবার বাঁশি ।
বাজাতে বাজাতে তাই মুগ্ধ হয়ে আপনার সুরে
দীর্ঘদিন দীর্ঘরাত্রি চলে গেনু একান্ত সুদূরে
ছাড়ায়ে সংসারসীমা । সে বাঁশিতে শিখেছি যে সুর
তাহারি উল্লাসে যদি গীতশূন্য অবসাদপুর
ধ্বনিয়া তুলিতে পারি , মৃত্যুঞ্জয়ী আশার সংগীতে
কর্মহীন জীবনের এক প্রান্ত পারি তরঙ্গিতে
শুধু মুহূর্তের তরে , দুঃখ যদি পায় তার ভাষা ,
সুপ্তি হতে জেগে ওঠে অন্তরের গভীর পিপাসা
স্বর্গের অমৃত লাগি — তব ধন্য হবে মোর গান ,
শত শত অসন্তোষ মহাগীতে লভিবে নির্বাণ ।

কী গাহিবে , কী শুনাবে! বলো , মিথ্যা আপনার সুখ ,
মিথ্যা আপনার দুঃখ । স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ
বৃহৎ জগৎ হতে সে কখনো শেখে নি বাঁচিতে ।
মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে , সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা ।
মৃত্যুরে করি না শঙ্কা । দুর্দিনের অশ্রুজলধারা
মস্তকে পড়িবে ঝরি — তারি মাঝে যাব অভিসারে
তার কাছে , জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে
জন্ম জন্ম ধরি । কে সে ? জানি না কে । চিনি নাই তারে —
শুধু এইটুকু জানি — তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতে , জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তরপ্রদীপখানি । শুধু জানি যে শুনেছে কানে
তাহার আহ্বানগীত , ছুটেছে সে নির্ভীক পরানে
সংকট আবর্তমাঝে , দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন ,
নির্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি মৃত্যুর গর্জন
শুনেছে সে সংগীতের মতো । দহিয়াছে অগ্নি তারে ,
বিদ্ধ করিয়াছে শূল , ছিন্ন তারে করেছে কুঠারে ,
সর্ব প্রিয়বস্তু তার অকাতরে করিয়া ইন্ধন
চিরজন্ম তারি লাগি জ্বেলেছে সে হোম-হুতাশন —
হৃৎপিণ্ড করিয়া ছিন্ন রক্তপদ্ম-অর্ঘ্য-উপহারে
ভক্তিভরে জন্মশোধ শেষ পূজা পূজিয়াছে তারে
মরণে কৃতার্থ করি প্রাণ । শুনিয়াছি তারি লাগি
রাজপুত্র পরিয়াছে ছিন্ন কন্থা , বিষয়ে বিরাগী
পথের ভিক্ষুক । মহাপ্রাণ সহিয়াছে পলে পলে
সংসারের ক্ষুদ্র উৎপীড়ন , বিঁধিয়াছে পদতলে
প্রত্যহের কুশাঙ্কুর , করিয়াছে তারে অবিশ্বাস
মূঢ় বিজ্ঞজনে , প্রিয়জন করিয়াছে পরিহাস
অতিপরিচিত অবজ্ঞায় , গেছে সে করিয়া ক্ষমা
নীরবে করুণনেত্রে — অন্তরে বহিয়া নিরুপমা
সৌন্দর্যপ্রতিমা । তারি পদে মানী সঁপিয়াছে মান ,
ধনী সঁপিয়াছে ধন , বীর সঁপিয়াছে আত্মপ্রাণ ;
তাহারি উদ্দেশে কবি বিরচিয়া লক্ষ লক্ষ গান
ছড়াইছে দেশে দেশে । শুধু জানি তাহারি মহান
গম্ভীর মঙ্গলধ্বনি শুনা যায় সমুদ্রে সমীরে ,
তাহারি অঞ্চলপ্রান্ত লুটাইছে নীলাম্বর ঘিরে ,
তারি বিশ্ববিজয়িনী পরিপূর্ণা প্রেমমূর্তিখানি
বিকাশে পরমক্ষণে প্রিয়জনমুখে । শুধু জানি
সে বিশ্বপ্রিয়ার প্রেমে ক্ষুদ্রতারে দিয়া বলিদান
বর্জিতে হইবে দূরে জীবনের সর্ব অসম্মান ;
সম্মুখে দাঁড়াতে হবে উন্নত মস্তক উচ্চে তুলি
যে মস্তকে ভয় লেখে নাই লেখা , দাসত্বের ধূলি
আঁকে নাই কলঙ্কতিলক । তাহারে অন্তরে রাখি
জীবনকন্টকপথে যেতে হবে নীরবে একাকী ,
সুখে দুঃখে ধৈর্য ধরি , বিরলে মুছিয়া অশ্রু-আঁখি ,
প্রতিদিবসের কর্মে প্রতিদিন নিরলস থাকি ,
সুখী করি সর্বজনে । তার পরে দীর্ঘপথশেষে
জীবযাত্রা-অবসানে ক্লান্তপদে রক্তসিক্ত বেশে
উত্তরিব একদিন শ্রান্তিহরা শান্তির উদ্দেশে
দুঃখহীন নিকেতনে । প্রসন্নবদনে মন্দ হেসে
পরাবে মহিমালক্ষ্মী ভক্তকণ্ঠে বরমাল্যখানি ,
করপদ্মপরশনে শান্ত হবে সর্ব দুঃখগ্লানি
সর্ব অমঙ্গল । লুটাইয়া রক্তিম চরণতলে
ধৌত করি দিব পদ আজন্মের রুদ্ধ অশ্রুজলে ।
সুচিরসঞ্চিত আশা সম্মুখে করিয়া উদ্‌ঘাটন
জীবনের অক্ষমতা কাঁদিয়া করিব নিবেদন ,
মাগিব অনন্ত ক্ষমা । হয়তো ঘুচিবে দুঃখনিশা ,
তৃপ্ত হবে এক প্রেমে জীবনের সর্বপ্রেমতৃষা ।

গৃহশত্রু

আমি একাকিনী যবে চলি রাজপথে
নব অভিসারসাজে ,
নিশীথে নীরব নিখিল ভুবন ,
না গাহে বিহগ , না চলে পবন ,
মৌন সকল পৌর ভবন
সুপ্তনগরমাঝে —
শুধু আমার নূপুর আমারি চরণে
বিমরি বিমরি বাজে ।
অধীর মুখর শুনিয়া সে স্বর
পদে পদে মরি লাজে ।
আমি চরণশব্দ শুনিব বলিয়া
বসি বাতায়নকাছে —
অনিমেষ তারা নিবিড় নিশায় ,
লহরীর লেশ নাহি যমুনায় ,
জনহীন পথ আঁধারে মিশায় ,
পাতাটি কাঁপে না গাছে —
শুধু আমারি উরসে আমারি হৃদয়
উলসি বিলসি নাচে ।
উতলা পাগল করে কলরোল ,
বাঁধন টুটিলে বাঁচে ।

আমি কুসুমশয়নে মিলাই শরমে ,
মধুর মিলনরাতি —
স্তব্ধ যামিনী ঢাকে চারিধার ,
নির্বাণ দীপ , রুদ্ধ দুয়ার ,
শ্রাবণগগন করে হাহাকার
তিমিরশয়ন পাতি —
শুধু আমার মানিক আমারি বক্ষে
জ্বালায়ে রেখেছে বাতি ।
কোথায় লুকাই , কেমনে নিবাই
নিলাজ ভূষণভাতি ।

আমি আমার গোপন মরমের কথা
রেখেছি মরমতলে ।
মলয় কহিছে আপন কাহিনী ,
কোকিল গাহিছে আপন রাগিণী ,
নদী বহি চলে কাঁদি একাকিনী
আপনার কলকলে —
শুধু আমার কোলের আমারি বীণাটি
গীতঝংকারছলে
যে কথা যখন করিব গোপন
সে কথা তখনি বলে ।

চিত্রা

জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্ররূপিণী ।
অযুত আলোকে ঝলসিছ নীল গগনে ,
আকুল পুলকে উলসিছ ফুলকাননে ,
দ্যুলোকে ভূলোকে বিলসিছ চলচরণে ,
তুমি চঞ্চলগামিনী ।
মুখর নূপুর বাজিছে সুদূর আকাশে ,
অলকগন্ধ উড়িছে মন্দ বাতাসে ,
মধুর নৃত্যে নিখিল চিত্তে বিকাশে
কত মঞ্জুল রাগিণী ।
কত না বর্ণে কত না স্বর্ণে গঠিত
কত যে ছন্দে কত সংগীতে রটিত
কত না গ্রন্থে কত না কণ্ঠে পঠিত
তব অসংখ্য কাহিনী ।
জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্ররূপিণী ।

অন্তরমাঝে শুধু তুমি একা একাকী
তুমি অন্তরব্যাপিনী ।
একটি স্বপ্ন মুগ্ধ সজল নয়নে ,
একটি পদ্ম হৃদয়বৃন্তশয়নে ,
একটি চন্দ্র অসীম চিত্তগগনে —
চারি দিকে চিরযামিনী ।
অকূল শান্তি সেথায় বিপুল বিরতি ,
একটি ভক্ত করিছে নিত্য আরতি ,
নাহি কাল দেশ , তুমি অনিমেষ মুরতি —
তুমি অচপলদামিনী ।
ধীর গম্ভীর গভীর মৌনমহিমা ,
স্বচ্ছ অতল স্নিগ্ধ নয়ননীলিমা
স্থির হাসিখানি উষালোকসম অসীমা ,
অয়ি প্রশান্তহাসিনী ।
অন্তরমাঝে তুমি শুধু একা একাকী
তুমি অন্তরবাসিনী ।

জীবনদেবতা

ওহে অন্তরতম ,
মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ
আসি অন্তরে মম ।
দুঃখসুখের লক্ষ ধারায়
পাত্র ভরিয়া দিয়েছি তোমায় ,
নিঠুর পীড়নে নিঙাড়ি বক্ষ
দলিত দ্রাক্ষাসম ।
কত যে বরন কত যে গন্ধ
কত যে রাগিণী কত যে ছন্দ
গাঁথিয়া গাঁথিয়া করেছি বয়ন
বাসরশয়ন তব —
গলায়ে গলায়ে বাসনার সোনা
প্রতিদিন আমি করেছি রচনা
তোমার ক্ষণিক খেলার লাগিয়া
মুরতি নিত্যনব ।

আপনি বরিয়া লয়েছিলে মোরে
না জানি কিসের আশে ।
লেগেছে কি ভালো , হে জীবননাথ ,
আমার রজনী আমার প্রভাত
আমার নর্ম আমার কর্ম
তোমার বিজন বাসে ।
বরষা শরতে বসন্তে শীতে
ধ্বনিয়াছে হিয়া যত সংগীতে
শুনেছ কি তাহা একেলা বসিয়া
আপন সিংহাসনে ।
মানসকুসুম তুলি অঞ্চলে
গেঁথেছ কি মালা , পরেছ কি গলে ,
আপনার মনে করেছ ভ্রমণ
মম যৌবনবনে ।

কী দেখিছ , বঁধু , মরমমাঝারে
রাখিয়া নয়ন দুটি ।
করেছ কি ক্ষমা যতেক আমার
স্খলন পতন ত্রুটি ।
পূজাহীন দিন সেবাহীন রাত
কত বারবার ফিরে গেছে নাথ ,
অর্ঘ্যকুসুম ঝরে পড়ে গেছে
বিজন বিপিনে ফুটি ।
যে সুরে বাঁধিলে এ বীণার তার
নামিয়া নামিয়া গেছে বারবার —
হে কবি , তোমার রচিত রাগিণী
আমি কি গাহিতে পারি ।
তোমার কাননে সেচিবারে গিয়া
ঘুমায়ে পড়েছি ছায়ায় পড়িয়া ,
সন্ধ্যাবেলায় নয়ন ভরিয়া
এনেছি অশ্রুবারি ।

এখন কি শেষ হয়েছে , প্রাণেশ ,
যা কিছু আছিল মোর ।
যত শোভা যত গান যত প্রাণ
জাগরণ ঘুমঘোর ।
শিথিল হয়েছে বাহুবন্ধন ,
মদিরাবিহীন মম চুম্বন ,
জীবনকুঞ্জে অভিসারনিশা
আজি কি হয়েছে ভোর ?
ভেঙে দাও তবে আজিকার সভা ,
আনো নব রূপ , আনো নব শোভা ,
নূতন করিয়া লহো আরবার
চিরপুরাতন মোরে ।
নূতন বিবাহে বাঁধিবে আমায়
নবীন জীবনডোরে ।

জ্যোৎস্নারাত্রে

শান্ত করো , শান্ত করো এ ক্ষুব্ধ হৃদয়
হে নিস্তব্ধ পূর্ণিমাযামিনী । অতিশয়
উদ্‌ভ্রান্ত বাসনা বক্ষে করিছে আঘাত
বারম্বার , তুমি এসো স্নিগ্ধ অশ্রুপাত
দগ্ধ বেদনার ‘পরে । শুভ্র সুকোমল
মোহভরা নিদ্রাভরা করপদ্মদল ,
আমার সর্বাঙ্গে মনে দাও বুলাইয়া
বিভাবরী , সর্ব ব্যথা দাও ভুলাইয়া ।

বহু দিন পরে আজি দক্ষিণ বাতাস
প্রথম বহিছে । মুগ্ধ হৃদয় দুরাশ
তোমার চরণপ্রান্তে রাখি তপ্ত শির
নিঃশব্দে ফেলিতে চাহে রুদ্ধ অশ্রুনীর
হে মৌনরজনী! পাণ্ডুর অম্বর হতে
ধীরে ধীরে এসো নামি লঘু জ্যোৎস্নাস্রোতে ,
মৃদুহাস্যে নতনেত্রে দাঁড়াও আসিয়া
নির্জন শিয়রতলে । বেড়াক ভাসিয়া
রজনীগন্ধার গন্ধ মদির লহরী
সমীরহিল্লোলে ; স্বপ্নে বাজুক বাঁশরি
চন্দ্রলোকপ্রান্ত হতে ; তোমার অঞ্চল
বায়ুভরে উড়ে এসে পুলকচঞ্চল
করুক আমার তনু ; অধীর মর্মরে
শিহরি উঠুক বন ; মাথার উপরে
চকোর ডাকিয়া যাক দূরশ্রুত তান ;
সম্মুখে পড়িয়া থাক্‌ তটান্তশয়ান ,
সুপ্ত নটিনীর মতো , নিস্তব্ধ তটিনী
স্বপ্নালসা ।

হেরো আজি নিদ্রিতা মেদিনী ,
ঘরে ঘরে রুদ্ধ বাতায়ন । আমি একা
আছি জেগে , তুমি একাকিনী দেহো দেখা
এই বিশ্বসুপ্তিমাঝে , অসীম সুন্দর ,
ত্রিলোকনন্দনমূর্তি । আমি যে কাতর
অনন্ত তৃষায় , আমি নিত্য নিদ্রাহীন ,
সদা উৎকণ্ঠিত , আমি চিররাত্রিদিন
আনিতেছি অর্ঘ্যভার অন্তরমন্দিরে
অজ্ঞাত দেবতা লাগি — বাসনার তীরে
একা বসে গড়িতেছি কত যে প্রতিমা
আপন হৃদয় ভেঙে , নাহি তার সীমা ।
আজি মোরে করো দয়া , এসো তুমি , অয়ি ,
অপার রহস্য তব , হে রহস্যময়ী ,
খুলে ফেলো — আজি ছিন্ন করে ফেলো ওই
চিরস্থির আচ্ছাদন অনন্ত অম্বর ।
মৌনশান্ত অসীমতা নিশ্চল সাগর ,
তারি মাঝখান হতে উঠে এসো ধীরে
তরুণী লক্ষ্মীর মতো হৃদয়ের তীরে
আঁখির সম্মুখে । সমস্ত প্রহরগুলি
ছিন্ন পুষ্পদলসম পড়ে যাক খুলি
তব চারি দিকে — বিদীর্ণ নিশীথখানি
খসে যাক নীচে । বক্ষ হতে লহো টানি
অঞ্চল তোমার , দাও অবারিত করি
শুভ্র ভাল , আঁখি হতে লহো অপসরি
উন্মুক্ত অলক । কোনো মর্ত দেখে নাই
যে দিব্য মুরতি আমারে দেখাও তাই
এ বিশ্রব্ধ রজনীতে নিস্তব্ধ বিরলে ।
উৎসুক উন্মুখ চিত্ত চরণের তলে
চকিতে পরশ করো ; একটি চুম্বন
ললাটে রাখিয়া যাও , একান্ত নির্জন
সন্ধ্যার তারার মতো ; আলিঙ্গনস্মৃতি
অঙ্গে তরঙ্গিয়া দাও , অনন্তের গীতি
বাজায়ে শিরার তন্ত্রে । ফাটুক হৃদয়
ভূমানন্দে — ব্যাপ্ত হয়ে যাক শূন্যময়
গানের তানের মতো । একরাত্রি-তরে
হে অমরী , অমর করিয়া দাও মোরে ।

তোমাদের বাসরকুঞ্জের বহির্দ্বারে
বসে আছি — কানে আসিতেছে বারে বারে
মৃদুমন্দ কথা , বাজিতেছে সুমধুর
রিনিঝিনি রুনুঝুনু সোনার নূপুর —
কার কেশপাশ হতে খসি পুষ্পদল
পড়িছে আমার বক্ষে , করিছে চঞ্চল
চেতনাপ্রবাহ । কোথায় গাহিছ গান ।
তোমরা কাহারা মিলি করিতেছ পান
কিরণকনকপাত্রে সুগন্ধি অমৃত ,
মাথায় জড়ায়ে মালা পূর্ণবিকশিত
পারিজাত — গন্ধ তারি আসিছে ভাসিয়া
মন্দ সমীরণে — উন্মাদ করিছে হিয়া
অপূর্ব বিরহে । খোলো দ্বার , খোলো দ্বার ।
তোমাদের মাঝে মোরে লহো একবার
সৌন্দর্যসভায় । নন্দনবনের মাঝে
নির্জন মন্দিরখানি — সেথায় বিরাজে
একটি কুসুমশয্যা , রত্নদীপালোকে
একাকিনী বসি আছে নিদ্রাহীন চোখে
বিশ্বসোহাগিনী লক্ষ্মী , জ্যোতির্ময়ী বালা —
আমি কবি তারি তরে আনিয়াছি মালা ।

দিনশেষে

দিনশেষ হয়ে এল , আঁধারিল ধরণী ,
আর বেয়ে কাজ নাই তরণী ।
‘ হ্যাঁগো এ কাদের দেশে
বিদেশী নামিনু এসে ‘
তাহারে শুধানু হেসে যেমনি —
অমনি কথা না বলি
ভরা ঘট ছলছলি
নতমুখে গেল চলি তরুণী ।
এ ঘাটে বাঁধিব মোর তরণী ।

নামিছে নীরব ছায়া ঘনবনশয়নে ,
এ দেশ লেগেছে ভালো নয়নে ।
স্থির জলে নাহি সাড়া ,
পাতাগুলি গতিহারা ,
পাখি যত ঘুমে সারা কাননে —
শুধু এ সোনার সাঁঝে
বিজনে পথের মাঝে
কলস কাঁদিয়া বাজে কাঁকনে ।
এ দেশ লেগেছে ভালো নয়নে ।

ঝলিছে মেঘের আলো কনকের ত্রিশূলে ,
দেউটি জ্বলিছে দূরে দেউলে ।
শ্বেত পাথরেতে গড়া
পথখানি ছায়া-করা
ছেয়ে গেছে ঝরে-পড়া বকুলে ।
সারি সারি নিকেতন ,
বেড়া-দেওয়া উপবন ,
দেখে পথিকের মন আকুলে ।
দেউটি জ্বলিছে দূরে দেউলে ।

রাজার প্রাসাদ হতে অতিদূর বাতাসে
ভাসিছে পূরবীগীতি আকাশে ।
ধরণী সমুখপানে
চলে গেছে কোন্‌খানে ,
পরান কেন কে জানে উদাসে ।
ভালো নাহি লাগে আর
আসা-যাওয়া বারবার
বহুদূর দুরাশার প্রবাসে ।
পূরবী রাগিণী বাজে আকাশে ।

কাননে প্রাসাদচূড়ে নেমে আসে রজনী ,
আর বেয়ে কাজ নাই তরণী ।
যদি কোথা খুঁজে পাই
মাথা রাখিবার ঠাঁই
বেচাকেনা ফেলে যাই এখনি —
যেখানে পথের বাঁকে
গেল চলি নত আঁখে
ভরা ঘট লয়ে কাঁখে তরুণী ।
এই ঘাটে বাঁধো মোর তরণী ।

দুঃসময়

বিলম্বে এসেছ , রুদ্ধ এবে দ্বার ,
জনশূন্য পথ , রাত্রি অন্ধকার ,
গৃহহারা বায়ু করি হাহাকার
ফিরিয়া মরে ।
তোমারে আজিকে ভুলিয়াছে সবে ,
শুধাইলে কেহ কথা নাহি কবে ,
এহেন নিশীথে আসিয়াছ তবে
কী মনে করে ।
এ দুয়ারে মিছে হানিতেছ কর ,
ঝটিকার মাঝে ডুবে যায় স্বর ,
ক্ষীণ আশাখানি ত্রাসে থরথর্‌
কাঁপিছে বুকে ।
যেথা একদিন ছিল তোর গেহ
ভিখারির মতো আসে সেথা কেহ ?
কার লাগি জাগে উপবাসী স্নেহ
ব্যাকুল মুখে ।
ঘুমায়েছে যারা তাহারা ঘুমাক ,
দুয়ারে দাঁড়ায়ে কেন দাও ডাক ,
তোমারে হেরিলে হইবে অবাক
সহসা রাতে ।
যাহারা জাগিছে নবীন উৎসবে
রুদ্ধ করি দ্বার মত্ত কলরবে ,
কী তোমার যোগ আজি এই ভবে
তাদের সাথে ।
দ্বারছিদ্র দিয়ে কী দেখিছ আলো ,
বাহির হইতে ফিরে যাওয়া ভালো ,
তিমির ক্রমশ হতেছে ঘোরালো
নিবিড় মেঘে ।
বিলম্বে এসেছ — রুদ্ধ এবে দ্বার ,
তোমার লাগিয়া খুলিবে না আর ,
গৃহহারা ঝড় করি হাহাকার
বহিছে বেগে ।

দুরাকাঙ্ক্ষা

কেন নিবে গেল বাতি ।
আমি অধিক যতনে ঢেকেছিনু তারে
জাগিয়া বাসররাতি ,
তাই নিবে গেল বাতি ।

কেন ঝরে গেল ফুল ।
আমি বক্ষে চাপিয়া ধরেছিনু তারে
চিন্তিত ভয়াকুল ,
তাই ঝরে গেল ফুল ।

কেন মরে গেল নদী ।
আমি বাঁধ বাঁধি তারে চাহি ধরিবারে
পাইবারে নিরবধি ,
তাই মরে গেল নদী ।

কেন ছিঁড়ে গেল তার ।
আমি অধিক আবেগে প্রাণপণ বলে
দিয়েছিনু ঝংকার ,
তাই ছিঁড়ে গেল তার ।

ধূলি

অয়ি ধূলি , অয়ি তুচ্ছ , অয়ি দীনহীনা ,
সকলের নিম্নে থাক নীচতম জনে
বক্ষে বাঁধিবার তরে ; সহি সর্ব ঘৃণা
কারে নাহি কর ঘৃণা । গৈরিক বসনে
হে ব্রতচারিণী তুমি সাজি উদাসীনা
বিশ্বজনে পালিতেছ আপন ভবনে ।
নিজেরে গোপন করি , অয়ি বিমলিনা ,
সৌন্দর্য বিকশি তোল বিশ্বের নয়নে ।
বিস্তারিছ কোমলতা হে শুষ্ক কঠিনা —
হে দরিদ্রা , পূর্ণা তুমি রত্নে ধান্যে ধনে ।
হে আত্মবিস্মৃতা , বিশ্বচরণবিলীনা ,
বিস্মৃতেরে ঢেকে রাখ অঞ্চল-বসনে ।
নূতনেরে নির্বিচারে কোলে লহ তুলি ,
পুরাতনে বক্ষে ধর হে জননী ধূলি ।

 নগরসংগীত

কোথা গেল সেই মহান শান্ত
নব নির্মল শ্যামলকান্ত
উজ্জ্বলনীলবসনপ্রান্ত
সুন্দর শুভ ধরণী ।
আকাশ আলোকপুলকপুঞ্জ ,
ছায়াসুশীতল নিভৃত কুঞ্জ ,
কোথা সে গভীর ভ্রমরগুঞ্জ ,
কোথা নিয়ে এল তরণী ।
ওই রে নগরী — জনতারণ্য ,
শত রাজপথ , গৃহ অগণ্য ,
কতই বিপণি , কতই পণ্য
কত কোলাহলকাকলি ।
কত-না অর্থ কত অনর্থ
আবিল করিছে স্বর্গমর্ত ,
তপনতপ্ত ধূলি-আবর্ত
উঠিছে শূন্য আকুলি ।
সকলি ক্ষণিক , খণ্ড , ছিন্ন —
পশ্চাতে কিছু রাখে না চিহ্ন ,
পলকে মিলিছে পলকে ভিন্ন
ছুটিছে মৃত্যু-পাথারে ।
করুণ রোদন কঠিন হাস্য ,
প্রভূত দম্ভ বিনীত দাস্য ,
ব্যাকুল প্রয়াস , নিষ্ঠুর ভাষ্য ,
চলিছে কাতারে কাতারে ।
স্থির নহে কিছু নিমেষমাত্র ,
চাহে নাকো কিছু প্রবাসযাত্র ,
বিরামবিহীন দিবসরাত্র
চলিছে আঁধারে আলোকে ।
কোন্‌ মায়ামৃগ কোথায় নিত্য
স্বর্ণঝলকে করিছে নৃত্য
তাহারে বাঁধিতে লোলুপচিত্ত
ছুটিছে বৃদ্ধবালকে ।
এ যেন বিপুল যজ্ঞকুণ্ড ,
আকাশে আলোড়ি শিখার শুণ্ড
হোমের অগ্নি মেলিছে তুণ্ড
ক্ষুধার দহন জ্বালিয়া ।
নরনারী সবে আনিয়া তূর্ণ
প্রাণের পাত্র করিয়া চূর্ণ
বহ্নির মুখে দিতেছে পূর্ণ
জীবন-আহুতি ঢালিয়া ।
চারি দিকে ঘিরি যতেক ভক্ত
স্বর্ণবরনমরণাসক্ত
দিতেছে অস্থি , দিতেছে রক্ত ,
সকল শক্তিসাধনা ।
জ্বলি উঠে শিখা ভীষণ মন্দ্রে ,
ধূমায়ে শূন্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে
লুপ্ত করিছে সূর্যচন্দ্রে
বিশ্বব্যাপিনী দাহনা ।
বায়ুদলবল হইয়া ক্ষিপ্ত
ঘিরি ঘিরি সেই অনল দীপ্ত
কাঁদিয়া ফিরিছে অপরিতৃপ্ত ,
ফুঁসিয়া উষ্ণ শ্বসনে ।
যেন প্রসারিয়া কাতর পক্ষ
কেঁদে উড়ে আসে লক্ষ লক্ষ
পক্ষীজননী , করিয়া লক্ষ্য
খাণ্ডব-হুত-অশনে ।
বিপ্র ক্ষত্র বৈশ্য শূদ্র
মিলিয়া সকলে মহৎ ক্ষুদ্র
খুলেছে জীবনযজ্ঞ রুদ্র
আবালবৃদ্ধরমণী ।
হেরি এ বিপুল দহনরঙ্গ
আকুল হৃদয় যেন পতঙ্গ
ঢালিবারে চাহে আপন অঙ্গ ,
কাটিবারে চাহে ধমনী ।
হে নগরী , তব ফেনিল মদ্য
উছসি উছলি পড়িছে সদ্য ,
আমি তাহা পান করিব অদ্য ,
বিস্মৃত হব আপনা ।
অয়ি মানবের পাষাণী ধাত্রী ,
আমি হব তব মেলার যাত্রী
সুপ্তিবিহীন মত্ত রাত্রি
জাগরণে করি যাপনা ।
ঘূর্ণচক্র জনতাসংঘ ,
বন্ধনহীন মহা- আসঙ্গ ,
তারি মাঝে আমি করিব ভঙ্গ
আপন গোপন স্বপনে ।
ক্ষুদ্র শান্তি করিব তুচ্ছ ,
পড়িব নিম্নে , চড়িব উচ্চ ,
ধরিব ধূম্রকেতুর পুচ্ছ ,
বাহু বাড়াইব তপনে ।
নব নব খেলা খেলে অদৃষ্ট
কখনো ইষ্ট কভু অনিষ্ট ,
কখনো তিক্ত কখনো মিষ্ট ,
যখন যা দেয় তুলিয়া —
সুখের দুখের চক্রমধ্যে
কখনো উঠিব উধাও পদ্যে ,
কখনো লুটিব গভীর গদ্যে ,
নাগরদোলায় দুলিয়া ।
হাতে তুলি লব বিজয়বাদ্য
আমি অশান্ত , আমি অবাধ্য
যাহা-কিছু আছে অতি অসাধ্য
তাহারে ধরিব সবলে ।
আমি নির্মম আমি নৃশংস
সবেতে বসাব নিজের অংশ ,
পরমুখ হতে করিয়া ভ্রংশ
তুলিব আপন কবলে ।
মনেতে জানিব সকল পৃথ্বী
আমারি চরণ-আসনভিত্তি ,
রাজার রাজ্য দস্যুবৃত্তি
কোনো ভেদ নাহি উভয়ে ।
ধনসম্পদ করিব নস্য ,
লুণ্ঠন করি আনিব শস্য ,
অশ্বমেধের মুক্ত অশ্ব
ছুটাব বিশ্বে অভয়ে ।
নব নব ক্ষুধা , নূতন তৃষ্ণা ,
নিত্যনূতন কর্মনিষ্ঠা ,
জীবনগ্রন্থে নূতন পৃষ্ঠা
উলটিয়া যাব ত্বরিতে ।
জটিল কুটিল চলেছে পন্থ
নাহি তার আদি নাহিকো অন্ত ,
উদ্দামবেগে ধাই তুরন্ত
সিন্ধু-শৈল-সরিতে ।
শুধু সম্মুখে চলেছি লক্ষি
আমি নীড়হারা নিশার পক্ষী ,
তুমিও ছুটিছ চপলা লক্ষ্মী ,
আলেয়া-হাস্যে ধাঁধিয়া ।
পূজা দিয়া পদে করি না ভিক্ষা ,
বসিয়া করি না তব প্রতীক্ষা ,
কে কারে জিনিবে হবে পরীক্ষা —
আনিব তোমারে বাঁধিয়া ।
মানবজন্ম নহে তো নিত্য ,
ধনজনমান খ্যাতি ও বিত্ত
নহে তারা কারো অধীন ভৃত্য —
কাল-নদী ধায় অধীরা ।
তবে দাও ঢালি — কেবলমাত্র
দু-চারি দিবস , দু-চারি রাত্র ,
পূর্ণ করিয়া জীবনপাত্র
জনসংঘাতমদিরা ।

নববর্ষে

নিশি অবসানপ্রায় , ওই পুরাতন
বর্ষ হয় গত!
আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন
করিলাম নত ।
বন্ধু হও , শত্রু হও , যেখানে যে কেহ রও ,
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত ।

আজি বাঁধিতেছি বসি সংকল্প নূতন
অন্তরে আমার ,
সংসারে ফিরিয়া গিয়া হয়তো কখন
ভুলিব আবার ।
তখন কঠিন ঘাতে এনো অশ্রু আঁখিপাতে
অধমের করিয়ো বিচার ।
আজি নব-বরষ-প্রভাতে
ভিক্ষা চাহি মার্জনা সবার ।

আজ চলে গেলে কাল কী হবে না-হবে
নাহি জানে কেহ ,
আজিকার প্রীতিসুখ রবে কি না-রবে
আজিকার স্নেহ ।
যতটুকু আলো আছে কাল নিবে যায় পাছে ,
অন্ধকারে ঢেকে যায় গেহ —
আজ এসো নববর্ষদিনে
যতটুকু আছে তাই দেহ ।

বিস্তীর্ণ এ বিশ্বভূমি সীমা তার নাই ,
কত দেশ আছে!
কোথা হতে কয় জনা হেথা এক ঠাঁই
কেন মিলিয়াছে ?
করো সুখী , থাকো সুখে প্রীতিভরে হাসিমুখে
পুষ্পগুচ্ছ যেন এক গাছে —
তা যদি না পার চিরদিন ,
একদিন এসো তবু কাছে ।

সময় ফুরায়ে গেলে কখন আবার
কে যাবে কোথায় ,
অনন্তের মাঝখানে পরস্পরে আর
দেখা নাহি যায় ।
বড়ো সুখ বড়ো ব্যথা চিহ্ন না রাখিবে কোথা ,
মিলাইবে জলবিম্ব প্রায় —
একদিন প্রিয়মুখ যত
ভালো করে দেখে লই আয়!

আপন সুখের লাগি সংসারের মাঝে
তুলি হাহাকার!
আত্ম-অভিমানে অন্ধ জীবনের কাজে
আনি অবিচার!
আজি করি প্রাণপণ করিলাম সমর্পণ
এ জীবনে যা আছে আমার ।
তোমরা যা দিবে তাই লব ,
তার বেশি চাহিব না আর ।

লইব আপন করি নিত্যধৈর্যতরে
দুঃখভার যত ,
চলিব কঠিন পথে অটল অন্তরে
সাধি মহাব্রত ।
যদি ভেঙে যায় পণ , দুর্বল এ শ্রান্ত মন
সবিনয়ে করি শির নত
তুলি লব আপনার ‘ পরে
আপনার অপরাধ যত!

যদি ব্যর্থ হয় প্রাণ , যদি দুঃখ ঘটে —
ক ‘ দিনের কথা!
একদা মুছিয়া যাবে সংসারের পটে
শূন্য নিষ্ফলতা ।
জগতে কি তুমি একা ? চতুর্দিকে যায় দেখা
সুদুর্ভর কত দুঃখব্যথা ।
তুমি শুধু ক্ষুদ্র একজন ,
এ সংসারে অনন্ত জনতা ।

যতক্ষণ আছ হেথা স্থিরদীপ্তি থাকো ,
তারার মতন ।
সুখ যদি নাহি পাও , শান্তি মনে রাখো
করিয়া যতন ।
যুদ্ধ করি নিরবধি বাঁচিতে না পার যদি ,
পরাভব করে আক্রমণ ,
কেমনে মরিতে হয় তবে
শেখো তাই করি প্রাণপণ ।

জীবনের এই পথ , কে বলিতে পারে
বাকি আছে কত ?
মাঝে কত বিঘ্নশোক , কত ক্ষুরধারে
হৃদয়ের ক্ষত ?
পুনর্বার কালি হতে চলিব সে তপ্ত পথে ,
ক্ষমা করো আজিকার মতো —
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত ।

ওই যায় , চলে যায় কালপরপারে
মোর পুরাতন ।
এই বেলা , ওরে মন , বল্‌ অশ্রুধারে
কৃতজ্ঞ বচন ।
বল্‌ তারে — দুঃখসুখ দিয়েছ ভরিয়া বুক ,
চিরকাল রহিবে স্মরণ ,
যাহা-কিছু লয়ে গেলে সাথে
তোমারে করিনু সমর্পণ ।

ওই এল এ জীবনে নূতন প্রভাতে
নূতন বরষ —
মনে করি প্রীতিভরে বাঁধি হাতে হাতে ,
না পাই সাহস ।
নব অতিথিরে তবু ফিরাইতে নাই কভু —
এসো এসো নূতন দিবস!
ভরিলাম পুণ্য অশ্রুজলে
আজিকার মঙ্গলকলস ।

নারীর দান

একদা প্রাতে কুঞ্জতলে
অন্ধ বালিকা
পত্রপুটে আনিয়া দিল
পুষ্পমালিকা ।
কণ্ঠে পরি অশ্রুজল
ভরিল নয়নে ;
বক্ষে লয়ে চুমিনু তার
স্নিগ্ধ বয়নে ।
কহিনু তারে ‘ অন্ধকারে
দাঁড়ায়ে রমণী
কী ধন তুমি করিছ দান
না জান আপনি ।
পুষ্পসম অন্ধ তুমি
অন্ধ বালিকা ,
দেখ নি নিজে মোহন কী যে
তোমার মালিকা । ‘

নীরব তন্ত্রী

তোমার বীণায় সব তার বাজে ,
ওহে বীণকার ,
তারি মাঝে কেন নীরব কেবল
একখানি তার । ‘
ভবনদীতীরে হৃদিমন্দিরে
দেবতা বিরাজে ,
পূজা সমাপিয়া এসেছি ফিরিয়া
আপনার কাজে ।
বিদায়ের ক্ষণে শুধাল পূজারি ,
‘ দেবীরে কী দিলে ?
তব জনমের শ্রেষ্ঠ কী ধন
ছিল এ নিখিলে ?’
কহিলাম আমি , সঁপিয়া এসেছি
পূজা-উপহার
আমার বীণায় ছিল যে একটি
সুবর্ণ-তার ,
যে তারে আমার হৃদয়বনের
যত মধুকর
ক্ষণেকে ক্ষণেকে ধ্বনিয়া তুলিত
গুঞ্জনস্বর ,
যে তারে আমার কোকিল গাহিত
বসন্তগান
সেইখানি আমি দেবতাচরণে
করিয়াছি দান ।
তাই এ বীণায় বাজে না কেবল
একখানি তার —
আছে তাহা শুধু মৌন মহৎ
পূজা-উপহার ।

পূর্ণিমা

পড়িতেছিলাম গ্রন্থ বসিয়া একেলা
সঙ্গীহীন প্রবাসের শূন্য সন্ধ্যাবেলা
করিবারে পরিপূর্ণ । পণ্ডিতের লেখা
সমালোচনার তত্ত্ব ; পড়ে হয় শেখা
সৌন্দর্য কাহারে বলে — আছে কী কী বীজ
কবিত্বকলায় ; শেলি , গেটে , কোল্‌রীজ
কার কোন্‌ শ্রেণী । পড়ি পড়ি বহুক্ষণ
তাপিয়া উঠিল শির , শ্রান্ত হল মন ,
মনে হল সব মিথ্যা , কবিত্ব কল্পনা
সৌন্দর্য সুরুচি রস সকলি জল্পনা
লিপিবণিকের — অন্ধ গ্রন্থকীটগণ
বহু বর্ষ ধরি শুধু করিছে রচন
শব্দমরীচিকাজাল , আকাশের ‘ পরে
অকর্ম আলস্যাবেশে দুলিবার তরে
দীর্ঘ রাত্রিদিন ।

অবশেষে শ্রান্তি মানি
তন্দ্রাতুর চোখে , বন্ধ করি গ্রন্থখানি
ঘড়িতে দেখিনু চাহি দ্বিপ্রহর রাতি ,
চমকি আসন ছাড়ি নিবাইনু বাতি ।
যেমন নিবিল আলো , উচ্ছ্বসিত স্রোতে
মুক্ত দ্বারে , বাতায়নে , চতুর্দিক হতে
চকিতে পড়িল কক্ষে বক্ষে চক্ষে আসি
ত্রিভুবনবিপ্লাবিনী মৌন সুধাহাসি ।
হে সুন্দরী , হে প্রেয়সী , হে পূর্ণপূর্ণিমা ,
অনন্তের অন্তরশায়িনী , নাহি সীমা
তব রহস্যের । এ কী মিষ্ট পরিহাসে
সংশয়ীর শুষ্ক চিত্ত সৌন্দর্য-উচ্ছ্বাসে
মুহূর্তে ডুবালে । কখন দুয়ারে এসে
মুখানি বাড়ায়ে , অভিসারিকার বেশে
আছিলে দাঁড়ায়ে , এক প্রান্তে , সুররানী ,
সুদূর নক্ষত্র হতে সাথে করে আনি
বিশ্বভরা নীরবতা । আমি গৃহকোণে
তর্কজালবিজড়িত ঘন বাক্যবনে
শুষ্কপত্রপরিকীর্ণ অক্ষরের পথে
একাকী ভ্রমিতেছিনু শূন্য মনোরথে
তোমারি সন্ধানে । উদ্‌ভ্রান্ত এ ভকতেরে
এতক্ষণ ঘুরাইলে ছলনার ফেরে ।
কী জানি কেমন করে লুকায়ে দাঁড়ালে
একটি ক্ষণিক ক্ষুদ্র দীপের আড়ালে
হে বিশ্বব্যাপিনী লক্ষ্মী । মুগ্ধ কর্ণপুটে
গ্রন্থ হইতে গুটিকত বৃথা বাক্য উঠে
আচ্ছন্ন করিয়াছিল , কেমনে না জানি ,
লোকলোকান্তরপূর্ণ তব মৌনবাণী ।

প্রস্তরমূর্তি

হে নির্বাক্‌ অচঞ্চল পাষাণসুন্দরী ,
দাঁড়ায়ে রয়েছ তুমি কত বর্ষ ধরি
অনম্বরা অনাসক্তা চির-একাকিনী
আপন সৌন্দর্যধ্যানে দিবসযামিনী
তপস্যামগনা । সংসারের কোলাহল
তোমারে আঘাত করে নিয়ত নিষ্ফল —
জন্মমৃত্যু দুঃখসুখ অস্ত-অভ্যুদয়
তরঙ্গিত চারি দিকে চরাচরময় ,
তুমি উদাসিনী । মহাকাল পদতলে
মুগ্ধনেত্রে ঊর্ধ্বমুখে রাত্রিদিন বলে
‘ কথা কও , কথা কও , কথা কও প্রিয়ে!
কথা কও , মৌন বধূ , রয়েছি চাহিয়ে । ‘
তুমি চির বাক্যহীনা , তব মহাবাণী
পাষাণে আবদ্ধ ওগো সুন্দরী পাষাণী ।

প্রেমের অভিষেক

তুমি মোরে করেছ সম্রাট । তুমি মোরে
পরায়েছ গৌরবমুকুট । পুষ্পডোরে
সাজায়েছ কণ্ঠ মোর ; তব রাজটিকা
দীপিছে ললাটমাঝে মহিমার শিখা
অহর্নিশি । আমার সকল দৈন্য-লাজ
আমার ক্ষুদ্রতা যত ঢাকিয়াছ আজ
তব রাজ-আস্তরণে । হৃদিশয্যাতল
শুভ্র দুগ্ধফেননিভ কোমল শীতল
তারি মাঝে বসায়েছ , সমস্ত জগৎ
বাহিরে দাঁড়ায়ে আছে , নাহি পায় পথ
সে অন্তর-অন্তঃপুরে । নিভৃত সভায়
আমারে চৌদিকে ঘিরি সদা গান গায়
বিশ্বের কবিরা মিলি ; অমরবীণায়
উঠিয়াছে কী ঝংকার । নিত্য শুনা যায়
দূর-দূরান্তর হতে দেশবিদেশের
ভাষা , যুগ-যুগান্তের কথা , দিবসের
নিশীথের গান , মিলনের বিরহের
গাথা , তৃপ্তিহীন শ্রান্তিহীন আগ্রহের
উৎকণ্ঠিত তান ।

প্রেমের অমরাবতী —
প্রদোষ-আলোকে যেথা দময়ন্তী সতী
বিচরে নলের সনে দীর্ঘনিশ্বসিত
অরণ্যের বিষাদমর্মরে ; বিকশিত
পুষ্পবীথিতলে শকুন্তলা আছে বসি ,
করপদ্মতললীন ম্লান মুখশশী ,
ধ্যানরতা ; পুরূরবা ফিরে অহরহ
বনে বনে , গীতস্বরে দুঃসহ বিরহ
বিস্তারিয়া বিশ্বমাঝে ; মহারণ্যে যেথা
বীণা হস্তে লয়ে তপস্বিনী মহাশ্বেতা
মহেশমন্দিরতলে বসি একাকিনী
অন্তরবেদনা দিয়ে গড়িছে রাগিণী
সান্ত্বনাসিঞ্চিত ; গিরিতটে শিলাতলে
কানে কানে প্রেমবার্তা কহিবার ছলে
সুভদ্রার লজ্জারুণ কুসুমকপোল
চুম্বিছে ফাল্গুনি ; ভিখারি শিবের কোল
সদা আগলিয়া আছে প্রিয়া পার্বতীরে
অনন্তব্যগ্রতাপাশে ; সুখদুঃখনীরে
বহে অশ্রুমন্দাকিনী , মিনতির স্বরে
কুসুমিত বনানীরে ম্লানমুখী করে
করুণায় ; বাঁশরির ব্যথাপূর্ণ তান
কুঞ্জে কুঞ্জে তরুচ্ছায়ে করিছে সন্ধান
হৃদয়সাথিরে ; হাত ধরে মোরে তুমি
লয়ে গেছ সৌন্দর্যের সে নন্দনভূমি
অমৃত-আলয়ে । সেথা আমি জ্যোতিষ্মান
অক্ষয়যৌবনময় দেবতাসমান ,
সেথা মোর লাবণ্যের নাহি পরিসীমা ,
সেথা মোরে অর্পিয়াছে আপন মহিমা
নিখিল প্রণয়ী ; সেথা মোর সভাসদ
রবিচন্দ্রতারা , পরি নব পরিচ্ছদ
শুনায় আমারে তারা নব নব গান
নব অর্থভরা — চিরসুহৃদ্‌মান
সর্বচরাচর ।

হেথা আমি কেহ নহি ,
সহস্রের মাঝে একজন — সদা বহি
সংসারের ক্ষুদ্র ভার , কত অনুগ্রহ
কত অবহেলা সহিতেছি অহরহ ।
সেই শতসহস্রের পরিচয়হীন
প্রবাহ হইতে , এই তুচ্ছ কর্মাধীন
মোরে তুমি লয়েছ তুলিয়া , নাহি জানি
কী কারণে । অয়ি মহীয়সী মহারানী ,
তুমি মোরে করিয়াছ মহীয়ান । আজি
এই-যে আমারে ঠেলি চলে জনরাজি
না তাকায়ে মোর মুখে , তাহারা কি জানে —
নিশিদিন তোমার সোহাগ-সুধাপানে
অঙ্গ মোর হয়েছে অমর । তাহারা কি
পায় দেখিবারে — নিত্য মোরে আছে ঢাকি
মন তব অভিনব লাবণ্যরসনে ।
তব স্পর্শ , তব প্রেম রেখেছি যতনে ,
তব সুধাকণ্ঠবাণী , তোমার চুম্বন ,
তোমার আঁখির দৃষ্টি , সর্ব দেহমন
পূর্ণ করি — রেখেছে যেমন সুধাকর
দেবতার গুপ্ত সুধা যুগযুগান্তর
আপনারে সুধাপাত্র করি , বিধাতার
পুণ্য অগ্নি জ্বালায়ে রেখেছে অনিবার
সবিতা যেমন সযতনে , কমলার
চরণকিরণে যথা পরিয়াছে হার
সুনির্মল গগনের অনন্ত ললাট ।
হে মহিমাময়ী , মোরে করেছ সম্রাট ।

প্রৌঢ়

যৌবননদীর স্রোতে তীব্র বেগভরে
একদিন ছুটেছিনু ; বসন্তপবন
উঠেছিল উচ্ছ্বসিয়া ; তীরউপবন
ছেয়েছিল ফুল্ল ফুলে ; তরুশাখা — ‘ পরে
গেয়েছিল পিককুল — আমি ভালো করে
দেখি নাই শুনি নাই কিছু — অনুক্ষণ
দুলেছিনু আলোড়িত তরঙ্গশিখরে
মত্ত সন্তরণে । আজি দিবা-অবসানে
সমাপ্ত করিয়া খেলা উঠিয়াছি তীরে ,
বসিয়াছি আপনার নিভৃত কুটিরে ;
বিচিত্র কল্লোলগীত পশিতেছে কানে ,
কত গন্ধ আসিতেছে সায়াহ্নসমীরে —
বিস্মিত নয়ন মেলি হেরি শূন্যপানে
গগনে অনন্তলোক জাগে ধীরে ধীরে ।

বিজয়িনী

অচ্ছোদসরসীনীরে রমণী যেদিন
নামিল স্নানের তরে , বসন্ত নবীন
সেদিন ফিরিতেছিল ভুবন ব্যাপিয়া
প্রথম প্রেমের মতো কাঁপিয়া কাঁপিয়া
ক্ষণে ক্ষণে শিহরি শিহরি । সমীরণ
প্রলাপ বকিতেছিল প্রচ্ছায়সঘন
পল্লবশয়নতলে , মধ্যাহ্নের জ্যোতি
মূর্ছিত বনের কোলে , কপোতদম্পতি
বসি শান্ত অকম্পিত চম্পকের ডালে
ঘন চঞ্চুচুম্বনের অবসরকালে
নিভৃতে করিতেছিল বিহ্বল কূজন ।
তীরে শ্বেতশিলাতলে সুনীল বসন
লুটাইছে এক প্রান্তে স্খলিতগৌরব
অনাদৃত — শ্রীঅঙ্গের উত্তপ্ত সৌরভ
এখনো জড়িত তাহে — আয়ুপরিশেষ
মূর্ছাম্বিত দেহে যেন জীবনের লেশ —
লুটায় মেখলাখানি ত্যজি কটিদেশ
মৌন অপমানে । নূপুর রয়েছে পড়ি ,
বক্ষের নিচোলবাস যায় গড়াগড়ি
ত্যজিয়া যুগল স্বর্গ কঠিন পাষাণে ।
কনকদর্পণখানি চাহে শূন্য-পানে
কার মুখ স্মরি । স্বর্ণপাত্রে সুসজ্জিত
চন্দনকুঙ্কুমপঙ্ক , লুণ্ঠিত লজ্জিত
দুটি রক্ত শতদল , অম্লানসুন্দর
শ্বেতকরবীর মালা — ধৌত শুক্লাম্বর
লঘু স্বচ্ছ , পূর্ণিমার আকাশের মতো ।
পরিপূর্ণ নীল নীর স্থির অনাহত —
কূলে কূলে প্রসারিত বিহ্বল গভীর
বুক-ভরা আলিঙ্গনরাশি । সরসীর
প্রান্তদেশে , বকুলের ঘনচ্ছায়াতলে
শ্বেতশিলাপটে , আবক্ষ ডুবায়ে জলে
বসিয়া সুন্দরী , কম্পমান ছায়াখানি
প্রসারিয়া স্বচ্ছ নীরে — বক্ষে লয়ে টানি
সযত্নপালিত শুভ্র রাজহংসীটিরে
করিছে সোহাগ — নগ্ন বাহুপাশে ঘিরে
সুকোমল ডানা দুটি , লম্বা গ্রীবা তার
রাখি স্কন্ধ- ‘ পরে , কহিতেছে বারম্বার
স্নেহের প্রলাপবাণী — কোমল কপোল
বুলাইছে হংসপৃষ্ঠে পরশবিভোল ।

চৌদিকে উঠিতেছিল মধুর রাগিণী
জলে স্থলে নভস্তলে ; সুন্দর কাহিনী
কে যেন রচিতেছিল ছায়ারৌদ্রকরে
অরণ্যের সুপ্তি আর পাতার মর্মরে ,
বসন্তদিনের কত স্পন্দনে কম্পনে
নিশ্বাসে উচ্ছ্বাসে ভাষে আভাসে গুঞ্জনে
চমকে ঝলকে । যেন আকাশবীণার
রবিরশ্মিতন্ত্রীগুলি সুরবালিকার
চম্পক-অঙ্গুলি-ঘাতে সংগীতঝংকারে
কাঁদিয়া উঠিতেছিল — মৌন স্তব্ধতারে
বেদনায় পীড়িয়া মূর্ছিয়া । তরুতলে
স্খলিয়া পড়িতেছিল নিঃশব্দে বিরলে
বিবশ বকুলগুলি ; কোকিল কেবলি
অশ্রান্ত গাহিতেছিল — বিফল কাকলি
কাঁদিয়া ফিরিতেছিল বনান্তর ঘুরে
উদাসিনী প্রতিধ্বনি ছায়ায় অদূরে
সরোবরপ্রান্তদেশে ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী
কলনৃত্যে বাজাইয়া মাণিক্যকিংকিণী
কল্লোলে মিশিতেছিল ; তৃণাঞ্চিত তীরে
জলকলকলস্বরে মধ্যাহ্নসমীরে
সারস ঘুমায়ে ছিল দীর্ঘ গ্রীবাখানি
ভঙ্গিভরে বাঁকাইয়া পৃষ্ঠে লয়ে টানি
ধূসর ডানার মাঝে ; রাজহংসদল
আকাশে বলাকা বাঁধি সত্বর-চঞ্চল
ত্যজি কোন্‌ দূরনদীসৈকতবিহার
উড়িয়া চলিতেছিল গলিতনীহার
কৈলাসের পানে । বহু বনগন্ধ বহে
অকস্মাৎ শ্রান্ত বায়ু উত্তপ্ত আগ্রহে
লুটায়ে পড়িতেছিল সুদীর্ঘ নিশ্বাসে
মুগ্ধ সরসীর বক্ষে স্নিগ্ধ বাহুপাশে ।

মদন , বসন্তসখা , ব্যগ্র কৌতূহলে
লুকায়ে বসিয়া ছিল বকুলের তলে
পুষ্পাসনে , হেলায় হেলিয়ে তরু- ‘ পরে
প্রসারিয়া পদযুগ নবতৃণস্তরে ।
পীত উত্তরীয়প্রান্ত লুণ্ঠিত ভূতলে ,
গ্রন্থিত মালতীমালা কুঞ্চিত কুন্তলে
গৌর কণ্ঠতটে — সহাস্য কটাক্ষ করি
কৌতুকে হেরিতেছিল মোহিনী সুন্দরী
তরুণীর স্নানলীলা । অধীর চঞ্চল
উৎসুক অঙ্গুলি তার , নির্মল কোমল
বক্ষস্থল লক্ষ্য করি লয়ে পুষ্পশর
প্রতীক্ষা করিতেছিল নিজ অবসর ।
গুঞ্জরি ফিরিতেছিল লক্ষ মধুকর
ফুলে ফুলে , ছায়াতলে সুপ্ত হরিণীরে
ক্ষণে ক্ষণে লেহন করিতেছিল ধীরে
বিমুগ্ধনয়ন মৃগ — বসন্ত-পরশে
পূর্ণ ছিল বনচ্ছায়া আলসে লালসে ।

জলপ্রান্তে ক্ষুব্ধ ক্ষুণ্ন কম্পন রাখিয়া ,
সজল চরণচিহ্ন আঁকিয়া আঁকিয়া
সোপানে সোপানে , তীরে উঠিলা রূপসী —
স্রস্ত কেশভার পৃষ্ঠে পড়ি গেল খসি ।
অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছল
লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল
বন্দী হয়ে আছে , তারি শিখরে শিখরে
পড়িল মধ্যাহ্নরৌদ্র — ললাটে অধরে
ঊরু- ‘ পরে কটিতটে স্তনাগ্রচূড়ায়
বাহুযুগে সিক্ত দেহে রেখায় রেখায়
ঝলকে ঝলকে । ঘিরি তার চারি পাশ
নিখিল বাতাস আর অনন্ত আকাশ
যেন এক ঠাঁই এসে আগ্রহে সন্নত
সর্বাঙ্গে চুম্বিল তার , সেবকের মতো
সিক্ত তনু মুছি নিল আতপ্ত অঞ্চলে
সযতনে — ছায়াখানি রক্তপদতলে
চ্যুত বসনের মতো রহিল পড়িয়া ।
অরণ্য রহিল স্তব্ধ , বিস্ময়ে মরিয়া ।

ত্যজিয়া বকুলমূল মৃদুমন্দ হাসি
উঠিল অনঙ্গদেব ।
সম্মুখেতে আসি
থমকিয়া দাঁড়ালো সহসা । মুখপানে
চাহিল নিমেষহীন নিশ্চল নয়ানে
ক্ষণকাল-তরে । পরক্ষণে ভূমি- ‘ পরে
জানু পাতি বসি , নির্বাক্ বিস্ময়ভরে ,
নতশিরে , পুষ্পধনু পুষ্পশরভার
সমর্পিল পদপ্রান্তে পূজা-উপচার
তূণ শূন্য করি । নিরস্ত্র মদনপানে
চাহিলা সুন্দরী শান্ত প্রসন্ন বয়ানে ।

ব্যাঘাত

কোলে ছিল সুরে-বাঁধা বীণা
মনে ছিল বিচিত্র রাগিণী ,
মাঝখানে ছিঁড়ে যাবে তার
সে কথা ভাবি নি ।
ওগো আজি প্রদীপ নিবাও ,
বন্ধ করো দ্বার —
সভা ভেঙে ফিরে চলে যাও
হৃদয় আমার ।
তোমরা যা আশা করেছিলে
নারিনু পুরাতে —
কে জানিত ছিঁড়ে যাবে তার
গীত না ফুরাতে ।

ভেবেছিনু ঢেলে দিব মন ,
প্লাবন করিব দশদিশি —
পুষ্পগন্ধে আনন্দে মিশিয়া
পূর্ণ হবে পূর্ণিমার নিশি ।
ভেবেছিনু ঘিরিয়া বসিবে
তোমরা সকলে ,
গীতশেষে হেসে ভালোবেসে
মালা দিবে গলে ,
শেষ করে যাব সব কথা
সকল কাহিনী —
মাঝখানে ছিঁড়ে যাবে তার
সে কথা ভাবি নি ।

আজি হতে সবে দয়া করে
ভুলে যাও , ঘরে যাও চলে —
করিয়ো না মোরে অপরাধী
মাঝখানে থামিলাম ব ‘ লে ।
আমি চাহি আজি রজনীতে
নীরব নির্জন
ভূমিতলে ঘুমায়ে পড়িতে
স্তব্ধ অচেতন —
খ্যাতিহীন শান্তি চাহি আমি
স্নিগ্ধ অন্ধকার ।
সাঙ্গ না হইতে সব গান
ছিন্ন হল তার ।

মরীচিকা

কেন আসিতেছ মুগ্ধ মোর পানে ধেয়ে
ওগো দিক্‌ভ্রান্ত পান্থ , তৃষার্ত নয়ানে
লুব্ধ বেগে । আমি যে তৃষিত তোমা চেয়ে!
আমি চিরদিন থাকি এ মরুশয়ানে
সঙ্গীহারা । এ তো নহে পিপাসার জল ,
এ তো নহে নিকুঞ্জের ছায়া , পক্ব ফল
মধুরসে ভরা , এ তো নহে উৎসধারে
সিঞ্চিত সরস স্নিগ্ধ নবীন শাদ্বল
নয়ননন্দন শ্যাম । পল্লবমাঝারে
কোথায় বিহঙ্গ কোথা মধুকরদল ।
শুধু জেনো , একখানি বহ্নিসম-শিখা
তপ্ত বাসনার তুলি আমার সম্বল —
অনন্ত পিপাসাপটে এ কেবল লিখা
চিরতৃষার্তের স্বপ্নমায়ামরীচিকা ।

 মৃত্যুর পরে

আজিকে হয়েছে শান্তি ,
জীবনের ভুলভ্রান্তি
সব গেছে চুকে ।
রাত্রিদিন ধুক্‌ধুক্‌
তরঙ্গিত দুঃখসুখ
থামিয়াছে বুকে ।
যত কিছু ভালোমন্দ
যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব
কিছু আর নাই ।
বলো শান্তি , বলো শান্তি ,
দেহ-সাথে সব ক্লান্তি
হয়ে যাক ছাই ।

গুঞ্জরি করুক তান
ধীরে ধীরে করো গান
বসিয়া শিয়রে ।
যদি কোথা থাকে লেশ
জীবনস্বপ্নের শেষ
তাও যাক মরে ।
তুলিয়া অঞ্চলখানি
মুখ- ‘ পরে দাও টানি ,
ঢেকে দাও দেহ ।
করুণ মরণ যথা
ঢাকিয়াছে সব ব্যথা
সকল সন্দেহ ।

বিশ্বের আলোক যত
দিগ্‌বিদিকে অবিরত
যাইতেছে বয়ে ,
শুধু ওই আঁখি- ‘ পরে
নামে তাহা স্নেহভরে
অন্ধকার হয়ে ।
জগতের তন্ত্রীরাজি
দিনে উচ্চে উঠে বাজি ,
রাত্রে চুপে চুপে
সে শব্দ তাহার ‘ পরে
চুম্বনের মতো পড়ে
নীরবতারূপে ।

মিছে আনিয়াছ আজি
বসন্তকুসুমরাজি
দিতে উপহার ।
নীরবে আকুল চোখে
ফেলিতেছ বৃথা শোকে
নয়নাশ্রুধার ।
ছিলে যারা রোষভরে
বৃথা এতদিন পরে
করিছ মার্জনা ।
অসীম নিস্তব্ধ দেশে
চিররাত্রি পেয়েছে সে
অনন্ত সান্ত্বনা ।

গিয়েছে কি আছে বসে
জাগিল কি ঘুমাল সে
কে দিবে উত্তর ।
পৃথিবীর শ্রান্তি তারে
ত্যজিল কি একেবারে
জীবনের জ্বর!
এখনি কি দুঃখসুখে
কর্মপথ-অভিমুখে
চলেছে আবার ।
অস্তিত্বের চক্রতলে
একবার বাঁধা প ‘ লে
পায় কি নিস্তার ।

বসিয়া আপন দ্বারে
ভালোমন্দ বলো তারে
যাহা ইচ্ছা তাই ।
অনন্ত জনমমাঝে
গেছে সে অনন্ত কাজে ,
সে আর সে নাই ।
আর পরিচিত মুখে
তোমাদের দুখে সুখে
আসিবে না ফিরে ।
তবে তার কথা থাক্‌ ,
যে গেছে সে চলে যাক
বিস্মৃতির তীরে ।

জানি না কিসের তরে
যে যাহার কাজ করে
সংসারে আসিয়া ,
ভালোমন্দ শেষ করি
যায় জীর্ণ জন্মতরী
কোথায় ভাসিয়া ।
দিয়ে যায় যত যাহা
রাখো তাহা ফেলো তাহা
যা ইচ্ছা তোমার ।
সে তো নহে বেচাকেনা —
ফিরিবে না , ফেরাবে না
জন্ম-উপহার ।

কেন এই আনাগোনা ,
কেন মিছে দেখাশোনা
দু-দিনের তরে ,
কেন বুকভরা আশা ,
কেন এত ভালোবাসা
অন্তরে অন্তরে ,
আয়ু যার এতটুক ,
এত দুঃখ এত সুখ
কেন তার মাঝে ,
অকস্মাৎ এ সংসারে
কে বাঁধিয়া দিল তারে
শত লক্ষ কাজে —

হেথায় যে অসম্পূর্ণ ,
সহস্র আঘাতে চূর্ণ
বিদীর্ণ বিকৃত ,
কোথাও কি একবার
সম্পূর্ণতা আছে তার
জীবিত কি মৃত ,
জীবনে যা প্রতিদিন
ছিল মিথ্যা অর্থহীন
ছিন্ন ছড়াছড়ি
মৃত্যু কি ভরিয়া সাজি
তারে গাঁথিয়াছে আজি
অর্থপূর্ণ করি —

হেথা যারে মনে হয়
শুধু বিফলতাময়
অনিত্য চঞ্চল
সেথায় কি চুপে চুপে
অপূর্ব নূতন রূপে
হয় সে সফল —
চিরকাল এই-সব
রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ-ওষ্ঠাধর ।
জন্মান্তের নবপ্রাতে
সে হয়তো আপনাতে
পেয়েছে উত্তর ।

সে হয়তো দেখিয়াছে
পড়ে যাহা ছিল পাছে
আজি তাহা আগে ,
ছোটো যাহা চিরদিন
ছিল অন্ধকারে লীন
বড়ো হয়ে জাগে ।
যেথায় ঘৃণার সাথে
মানুষ আপন হাতে
লেপিয়াছে কালি
নূতন নিয়মে সেথা
জ্যোতির্ময় উজ্জ্বলতা
কে দিয়াছে জ্বালি ।

কত শিক্ষা পৃথিবীর
খসে পড়ে জীর্ণচীর
জীবনের সনে ,
সংসারের লজ্জাভয়
নিমেষেতে দগ্ধ হয়
চিতাহুতাশনে ।
সকল অভ্যাস-ছাড়া
সর্ব-আবরণ-হারা
সদ্যশিশুসম
নগ্নমূর্তি মরণের
নিষ্কলঙ্ক চরণের
সম্মুখে প্রণমো ।

আপন মনের মতো
সংকীর্ণ বিচার যত
রেখে দাও আজ ।
ভুলে যাও কিছুক্ষণ
প্রত্যহের আয়োজন ,
সংসারের কাজ ।
আজি ক্ষণেকের তরে
বসি বাতায়ন- ‘ পরে
বাহিরেতে চাহো ।
অসীম আকাশ হতে
বহিয়া আসুক স্রোতে
বৃহৎ প্রবাহ ।

উঠিছে ঝিল্লির গান ,
তরুর মর্মরতান ,
নদীকলস্বর —
প্রহরের আনাগোনা
যেন রাত্রে যায় শোনা
আকাশের’পর ।
উঠিতেছে চরাচরে
অনাদি অনন্ত স্বরে
সংগীত উদার —
সে নিত্য-গানের সনে
মিশাইয়া লহো মনে
জীবন তাহার ।

ব্যাপিয়া সমস্ত বিশ্বে
দেখো তারে সর্বদৃশ্যে
বৃহৎ করিয়া ।
জীবনের ধূলি ধুয়ে
দেখো তারে দূরে থুয়ে
সম্মুখে ধরিয়া ।
পলে পলে দণ্ডে দণ্ডে
ভাগ করি খণ্ডে খণ্ডে
মাপিয়ো না তারে ।
থাক্‌ তব ক্ষুদ্র মাপ
ক্ষুদ্র পুণ্য ক্ষুদ্র পাপ
সংসারের পারে ।

আজ বাদে কাল যারে
ভুলে যাবে একেবারে
পরের মতন
তারে লয়ে আজি কেন
বিচার-বিরোধ হেন ,
এত আলাপন ।
যে বিশ্ব কোলের’পরে
চিরদিবসের তরে
তুলে নিল তারে
তার মুখে শব্দ নাহি ,
প্রশান্ত সে আছে চাহি
ঢাকি আপনারে ।

বৃথা তারে প্রশ্ন করি ,
বৃথা তার পায়ে ধরি ,
বৃথা মরি কেঁদে ,
খুঁজে ফিরি অশ্রুজলে —
কোন্‌ অঞ্চলের তলে
নিয়েছে সে বেঁধে ।
ছুটিয়া মৃত্যুর পিছে ,
ফিরে নিতে চাহি মিছে ,
সে কি আমাদের ?
পলেক বিচ্ছেদে হায়
তখনি তো বুঝা যায়
সে যে অনন্তের ।

চক্ষের আড়ালে তাই
কত ভয় সংখ্যা নাই ,
সহস্র ভাবনা ।
মুহূর্ত মিলন হলে
টেনে নিই বুকে কোলে ,
অতৃপ্ত কামনা ।
পার্শ্বে বসে ধরি মুঠি ,
শব্দমাত্রে কেঁপে উঠি ,
চাহি চারিভিতে ,
অনন্তের ধনটিরে
আপনার বুক চিরে
চাহি লুকাইতে ।

হায় রে নির্বোধ নর ,
কোথা তোর আছে ঘর ,
কোথা তোর স্থান ।
শুধু তোর ওইটুকু
অতিশয় ক্ষুদ্র বুক
ভয়ে কম্পমান ।
ঊর্ধ্বে ওই দেখ্‌ চেয়ে
সমস্ত আকাশ ছেয়ে
অনন্তের দেশ —
সে যখন এক ধারে
লুকায়ে রাখিবে তারে
পাবি কি উদ্দেশ ?

ওই হেরো সীমাহারা
গগনেতে গ্রহতারা
অসংখ্য জগৎ ,
ওরি মাঝে পরিভ্রান্ত
হয়তো সে একা পান্থ
খুঁজিতেছে পথ ।
ওই দূর-দূরান্তরে
অজ্ঞাত ভুবন- ‘ পরে
কভু কোনোখানে
আর কি গো দেখা হবে ,
আর কি সে কথা কবে ,
কেহ নাহি জানে ।

যা হবার তাই হোক ,
ঘুচে যাক সর্ব শোক ,
সর্ব মরীচিকা ।
নিবে যাক চিরদিন
পরিশ্রান্ত পরিক্ষীণ
মর্তজন্মশিখা ।
সব তর্ক হোক শেষ ,
সব রাগ সব দ্বেষ ,
সকল বালাই ।
বলো শান্তি , বলো শান্তি ,
দেহ-সাথে সব ক্লান্তি
পুড়ে হোক ছাই ।

রাত্রে ও প্রভাতে

কালি মধুযামিনীতে জ্যোৎস্নানিশীথে
কুঞ্জকাননে সুখে
ফেনিলোচ্ছল যৌবনসুরা
ধরেছি তোমার মুখে ।
তুমি চেয়ে মোর আঁখি- ‘ পরে
ধীরে পাত্র লয়েছ করে ,
হেসে করিয়াছ পান চুম্বনভরা
সরস বিম্বাধরে ,
কালি মধুযামিনীতে জ্যোৎস্নানিশীথে
মধুর আবেশভরে ।
তব অবগুণ্ঠনখানি
আমি খুলে ফেলেছিনু টানি ,
আমি কেড়ে রেখেছিনু বক্ষে তোমার
কমলকোমল পাণি —
ভাবে নিমীলিত তব যুগল নয়ন ,
মুখে নাহি ছিল বাণী ।
আমি শিথিল করিয়া পাশ
খুলে দিয়েছিনু কেশরাশ ,
তব আনমিত মুখখানি
সুখে থুয়েছিনু বুকে আনি —
তুমি সকল সোহাগ সয়েছিলে , সখী ,
হাসিমুকুলিত মুখে
কালি মধুযামিনীতে জ্যোৎস্নানিশীথে
নবীনমিলনসুখে ।

আজি নির্মলবায় শান্ত উষায়
নির্জন নদীতীরে
স্নান-অবসানে শুভ্রবসনা
চলিয়াছ ধীরে ধীরে ।
তুমি বাম করে লয়ে সাজি
কত তুলিছ পুষ্পরাজি ,
দূরে দেবালয়তলে উষার রাগিণী
বাঁশিতে উঠিছে বাজি
এই নির্মলবায় শান্ত উষায়
জাহ্নবীতীরে আজি ।
দেবী , তব সিঁথিমূলে লেখা
নব অরুণসিঁদুররেখা ,
তব বাম বাহু বেড়ি শঙ্খবলয়
তরুণ ইন্দুলেখা ।
এ কী মঙ্গলময়ী মুরতি বিকাশি
প্রভাতে দিয়েছ দেখা ।
রাতে প্রেয়সীর রূপ ধরি
তুমি এসেছ প্রাণেশ্বরী ,
প্রাতে কখন দেবীর বেশে
তুমি সমুখে উদিলে হেসে —
আমি সম্ভ্রমভরে রয়েছি দাঁড়ায়ে
দূরে অবনতশিরে
আজি নির্মলবায় শান্ত উষায়
নির্জন নদীতীরে ।

শীতে ও বসন্তে

প্রথম শীতের মাসে
শিশির লাগিল ঘাসে ,
হুহু করে হাওয়া আসে ,
হিহি করে কাঁপে গাত্র ।
আমি ভাবিলাম মনে
এবার মাতিব রণে ,
বৃথা কাজে অকারণে
কেটে গেছে দিনরাত্র ।
লাগিব দেশের হিতে
গরমে বাদলে শীতে ,
কবিতা নাটকে গীতে
করিব না অনাসৃষ্টি ।
লেখা হবে সারবান
অতিশয় ধারবান ,
খাড়া রব দ্বারবান
দশ দিকে রাখি দৃষ্টি ।
এত বলি গৃহকোণে
বসিলাম দৃঢ়মনে
লেখকের যোগাসনে ,
পাশে লয়ে মসীপাত্র ।
নিশিদিন রুধি দ্বার
স্বদেশের শুধি ধার ,
নাহি হাঁফ ছাড়িবার
অবসর তিলমাত্র ।
রাশি রাশি লিখে লিখে
একেবারে দিকে দিকে
মাসিকে ও সাপ্তাহিকে
করিলাম লেখাবৃষ্টি ।
ঘরেতে জ্বলে না চুলো ,
শরীরে উড়িছে ধুলো ,
আঙুলের ডগাগুলো
হয়ে গেল কালিকৃষ্টি ।
খুঁটিয়া তারিখ মাস
করিলাম রাশ রাশ
গাঁথিলাম ইতিহাস ,
রচিলাম পুরাতত্ত্ব ।
গালি দিয়া মহারাগে
দেখালেম দাগে দাগে
যে যাহা বলেছে আগে
কিছু তার নহে সত্য ।
পুরানে বিজ্ঞানে গোটা
করিয়াছি সিদ্ধি-ঘোঁটা ,
যাহা-কিছু ছিল মোটা
হয়ে গেছে অতি সূক্ষ্ম ।
করেছি সমালোচনা
আছে তাহে গুণপনা ,
কেহ তাহা বুঝিল না
মনে রয়ে গেল দুঃখ ।
মেঘদূত — লোকে যাহা
কাব্যভ্রমে বলে “ আহা ” —
আমি দেখায়েছি তাহা
দর্শনের নব সূত্র ।
নৈষধের কবিতাটি
ডারুয়িন-তত্ত্ব খাঁটি ,
মোর আগে এ কথাটি
বলো কে বলেছে কুত্র ।
কাব্য কহিবার ভানে
নীতি বলি কানে কানে
সে কথা কেহ না জানে ,
না বুঝে হতেছে ইষ্ট ।
নভেল লেখার ছলে
শিখায়েছি সুকৌশলে
সাদাটিরে সাদা বলে ,
কালো যাহা তাই কৃষ্ট ।
কত মাস এইমতো
একে একে হল গত ,
আমি দেশহিতে রত
সব দ্বার করি বন্ধ ।
হাসি-গীত-গল্পগুলি
ধূলিতে হইল ধূলি ,
বেঁধে দিয়ে চোখে ঠুলি
কল্পনারে করি অন্ধ ।
নাহি জানি চারি পাশে
কী ঘটিছে কোন্‌ মাসে ,
কোন্‌ ঋতু কবে আসে ,
কোন্‌ রাতে উঠে চন্দ্র ।
আমি জানি রুশিয়ান
কত দূরে আগুয়ান ,
বজেটের খতিয়ান
কোথা তার আছে রন্ধ্র ।
আমি জানি কোন্‌ দিন
পাস হল কী আইন ,
কুইনের বেহাইন
বিধবা হইল কল্য —
জানি সব আটঘাট ,
গেজেটে করেছি পাঠ
আমাদের ছোটোলাট
কোথা হতে কোথা চলল ।

একদিন বসে বসে
লিখিয়া যেতেছি কষে
এ দেশেতে কার দোষে
ক্রমে কমে আসে শস্য ,
কেনই বা অপঘাতে
মরে লোক দিবারাতে ,
কেন ব্রাহ্মণের পাতে
নাহি পড়ে চ ব্য চোষ্য ।
হেন কালে দুদ্দাড়
খুলে গেল সব দ্বার —
চারি দিকে তোলপাড়
বেধে গেছে মহাকাণ্ড ।
নদীজলে বনে গাছে
কেহ গাহে কেহ নাচে ,
উলটিয়া পড়িয়াছে
দেবতার সুধাভাণ্ড ।
উতলা পাগল-বেশে
দক্ষিণে বাতাস এসে
কোথা হতে হাহা হেসে
প ‘ ল যেন মদমত্ত ।
লেখাপত্র কেড়েকুড়ে —
কোথা কী যে গেল উড়ে ,
ওই রে আকাশ জুড়ে
ছড়ায় ‘ সমাজতত্ত্ব ‘ ।
‘ রুশিয়ার অভিপ্রায় ‘
ওই কোথা উড়ে যায় ,
গেল বুঝি হায় হায়
‘ আমিরের ষড়যন্ত্র ‘ ।
‘ প্রাচীন ভারত ‘ বুঝি
আর পাইব না খুঁজি ,
কোথা গিয়ে হল পুঁজি
‘ জাপানের রাজতন্ত্র ‘ ।
গেল গেল , ও কী কর —
আরে আরে , ধরো ধরো ।
হাসে বন মরমর ,
হাসে বায়ু কলহাস্যে ।
উঠে হাসি নদীজলে
ছলছল কলকলে ,
ভাসায়ে লইয়া চলে
‘ মনুর নূতন ভাষ্যে ‘ ।
বাদ-প্রতিবাদ যত
শুকনো পাতার মতো
কোথা হল অপগত —
কেহ তাহে নহে ক্ষুণ্ন ।
ফুলগুলি অনায়াসে
মুচকি মুচকি হাসে ,
সুগভীর পরিহাসে
হাসিতেছে নীল শূন্য ।
দেখিতে দেখিতে মোর
লাগিল নেশার ঘোর ,
কোথা হতে মন-চোর
পশিল আমার বক্ষে ।
যেমনি সমুখে চাওয়া
অমনি সে ভূতে-পাওয়া
লাগিল হাসির হাওয়া ,
আর বুঝি নাহি রক্ষে ।
প্রথমে প্রাণের কূলে
শিহরি শিহরি দুলে ,
ক্রমে সে মরমমূলে
লহরী উঠিল চিত্তে ।
তার পরে মহা হাসি
উছসিল রাশি রাশি ,
হৃদয় বাহিরে আসি
মাতিল জগৎ-নৃত্যে ।

এসো এসো , বঁধু , এসো —
আধেক আঁচরে বোসো ,
অবাক অধরে হাসো
ভুলাও সকল তত্ত্ব ।
তুমি শুধু চাহ ফিরে —
ডুবে যাক ধীরে ধীরে
সুধাসাগরের নীরে
যত মিছা যত সত্য ।
আনো গো যৌবনগীতি ,
দূরে চলে যাক নীতি ,
আনো পরানের প্রীতি ,
থাক্‌ প্রবীণের ভাষ্য ।
এসো হে আপনহারা
প্রভাতসন্ধ্যার তারা
বিষাদের আঁখিধারা ,
প্রমোদের মধুহাস্য ।
আনো বাসনার ব্যথা ,
অকারণ চঞ্চলতা ,
আনো কানে কানে কথা ,
চোখে চোখে লাজদৃষ্টি ।
অসম্ভব , আশাতীত ,
অনাবশ্য , অনাদৃত ,
এনে দাও অযাচিত
যত-কিছু অনাসৃষ্টি ।
হৃদয়নিকুঞ্জমাঝ
এসো আজি ঋতুরাজ ,
ভেঙে দাও সব কাজ
প্রেমের মোহনমন্ত্রে ।
হিতাহিত হোক দূর —
গাব গীত সুমধুর ,
ধরো তুমি ধরো সুর
সুধাময়ী বীণা-যন্ত্রে ।

শেষ উপহার

যাহা-কিছু ছিল সব দিনু শেষ করে
ডালাখানি ভরে —
কাল কী আনিয়া দিব যুগল চরণে
তাই ভাবি মনে ।
বসন্তে সকল ফুল নিঃশেষে ফুটায়ে নিয়ে
তরু তার পরে
এক দিনে দীনহীন , শূন্যে দেবতার পানে
চাহে রিক্তকরে ।

আজি দিন শেষ হলে যদি মোর গান
হয় অবসান ,
কাল প্রাতে এ গানের স্মৃতিসুখলেশ
রবে না কি শেষ ।
শূন্য থালে মৌনকণ্ঠে নতমুখে আসি যদি
তোমার সম্মুখে ,
তখন কি অগৌরবে চাহিবে না একবার
ভকতের মুখে ।

দিই নি কি প্রাণপূর্ণ হৃদিপদ্মখানি
পাদপদ্মে আনি ?
দিই নি কি কোনো ফুল অমর করিয়া
অশ্রুতে ভরিয়া ।
এত গান গাহিয়াছি , তার মাঝে নাহি কি গো
হেন কোনো গান
আমি চলে গেলে তবু বহিবে যে চিরদিন
অনন্ত পরান ।

সেই কথা মনে করে দিবে না কি নব
বরমাল্য তব —
ফেলিবে না আঁখি হতে একবিন্দু জল
করুণাকোমল ,
আমার বসন্তশেষে রিক্তপুষ্প দীনবেশে
নীরবে যেদিন
ছলছল-আঁখিজলে দাঁড়াইব সভাতলে
উপহারহীন ।

সন্ধ্যা

ক্ষান্ত হও , ধীরে কও কথা । ওরে মন ,
নত করো শির । দিবা হল সমাপন ,
সন্ধ্যা আসে শান্তিময়ী । তিমিরের তীরে
অসংখ্য-প্রদীপ-জ্বালা এ বিশ্বমন্দিরে
এল আরতির বেলা । ওই শুন বাজে
নিঃশব্দ গম্ভীর মন্দ্রে অনন্তের মাঝে
শঙ্খঘণ্টাধ্বনি । ধীরে নামাইয়া আনো
বিদ্রোহের উচ্চ কণ্ঠ পূরবীর ম্লান-
মন্দ স্বরে । রাখো রাখো অভিযোগ তব ,
মৌন করো বাসনার নিত্য নব নব
নিষ্ফল বিলাপ । হেরো মৌন নভস্তল ,
ছায়াচ্ছন্ন মৌন বন , মৌন জলস্থল
স্তম্ভিত বিষাদে নম্র । নির্বাক্‌ নীরব
দাঁড়াইয়া সন্ধ্যাসতী — নয়নপল্লব
নত হয়ে ঢাকে তার নয়নযুগল ,
অনন্ত আকাশপূর্ণ অশ্রু-ছলছল
করিয়া গোপন । বিষাদের মহাশান্তি
ক্লান্ত ভুবনের ভালে করিছে একান্তে
সান্ত্বনা-পরশ । আজি এই শুভক্ষণে ,
শান্ত মনে , সন্ধি করো অনন্তের সনে
সন্ধ্যার আলোকে । বিন্দু দুই অশ্রুজলে
দাও উপহার — অসীমের পদতলে
জীবনের স্মৃতি । অন্তরের যত কথা
শান্ত হয়ে গিয়ে , মর্মান্তিক নীরবতা
করুক বিস্তার ।

হেরো ক্ষুদ্র নদীতীরে
সুপ্তপ্রায় গ্রাম । পক্ষীরা গিয়েছে নীড়ে ,
শিশুরা খেলে না ; শূন্য মাঠ জনহীন ;
ঘরে-ফেরা শ্রান্ত গাভী গুটি দুই-তিন
কুটির-অঙ্গনে বাঁধা , ছবির মতন
স্তব্ধপ্রায় । গৃহকার্য হল সমাপন —
কে ওই গ্রামের বধূ ধরি বেড়াখানি
সম্মুখে দেখিছে চাহি , ভাবিছে কী জানি
ধূসর সন্ধ্যায় ।

অমনি নিস্তব্ধপ্রাণে
বসুন্ধরা , দিবসের কর্ম-অবসানে ,
দিনান্তের বেড়াটি ধরিয়া আছে চাহি
দিগন্তের পানে । ধীরে যেতেছে প্রবাহি
সম্মুখে আলোকস্রোত অনন্ত অম্বরে
নিঃশব্দ চরণে ; আকাশের দূরান্তরে
একে একে অন্ধকারে হতেছে বাহির
একেকটি দীপ্ত তারা , সুদূর পল্লীর
প্রদীপের মতো । ধীরে যেন উঠে ভেসে
ম্লানচ্ছবি ধরণীর নয়ননিমেষে
কত যুগ-যুগান্তের অতীত আভাস ,
কত জীবজীবনের জীর্ণ ইতিহাস ।
যেন মনে পড়ে সেই বাল্যনীহারিকা ;
তার পরে প্রজ্বলন্ত যৌবনের শিখা ;
তার পরে স্নিগ্ধশ্যাম অন্নপূর্ণালয়ে
জীবধাত্রী জননীর কাজ বক্ষে লয়ে
লক্ষ কোটি জীব — কত দুঃখ , কত ক্লেশ ,
কত যুদ্ধ , কত মৃত্যু , নাহি তার শেষ ।

ক্রমে ঘনতর হয়ে নামে অন্ধকার ,
গাঢ়তর নীরবতা — বিশ্বপরিবার
সুপ্ত নিশ্চেতন । নিঃসঙ্গিনী ধরণীর
বিশাল অন্তর হতে উঠে সুগম্ভীর
একটি ব্যথিত প্রশ্ন , ক্লিষ্ট ক্লান্ত সুর ,
শূন্যপানে — “ আরো কোথা ? আরো কত দূর ?”

সাধনা

দেবী , অনেক ভক্ত এসেছে তোমার চরণতলে
অনেক অর্ঘ্য আনি ,
আমি অভাগ্য এনেছি বহিয়া নয়নজলে
ব্যর্থ সাধনখানি ।
তুমি জান মোর মনের বাসনা ,
যত সাধ ছিল সাধ্য ছিল না ,
তবু বহিয়াছি কঠিন কামনা
দিবসনিশি ।
মনে যাহা ছিল হয়ে গেল আর ,
গড়িতে ভাঙিয়া গেল বারবার ,
ভালোয় মন্দে আলোয় আঁধার
গিয়েছে মিশি ।
তবু ওগো , দেবী , নিশিদিন করি পরানপণ ,
চরণে দিতেছি আনি
মোর জীবনের সকল শ্রেষ্ঠ সাধের ধন
ব্যর্থ সাধনখানি ।
ওগো ব্যর্থ সাধনখানি
দেখিয়া হাসিছে সার্থকফল
সকল ভক্ত প্রাণী ।
তুমি যদি , দেবী , পলকে কেবল
কর কটাক্ষ স্নেহসুকোমল ,
একটি বিন্দু ফেল আঁখিজল
করুণা মানি ,
সব হবে তবে সার্থক হবে
ব্যর্থ সাধনখানি ।

দেবী , আজি আসিয়াছে অনেক যন্ত্রী শুনাতে গান
অনেক যন্ত্র আনি ,
আমি আনিয়াছি ছিন্নতন্ত্রী নীরব ম্লান
এই দীন বীণাখানি ।
তুমি জান ওগো করি নাই হেলা ,
পথে প্রান্তরে করি নাই খেলা ,
শুধু সাধিয়াছি বসি সারাবেলা
শতেক বার ।
মনে যে গানের আছিল আভাস ,
যে তান সাধিতে করেছিনু আশ ,
সহিল না সেই কঠিন প্রয়াস —
ছিঁড়িল তার ।
স্তবহীন তাই রয়েছি দাঁড়ায়ে সারাটি ক্ষণ ,
আনিয়াছি গীতহীনা
আমার প্রাণের একটি যন্ত্র বুকের ধন
ছিন্নতন্ত্রী বীণা ।
ওগো ছিন্নতন্ত্রী বীণা
দেখিয়া তোমার গুণীজন সবে
হাসিছে করিয়া ঘৃণা ।
তুমি যদি এরে লহ কোলে তুলি ,
তোমার শ্রবণে উঠিবে আকুলি
সকল অগীত সংগীতগুলি ,
হৃদয়াসীনা ।
ছিল যা আশায় ফুটাবে ভাষায়
ছিন্নতন্ত্রী বীণা ।

দেবী , এ জীবনে আমি গাহিয়াছি বসি অনেক গান ,
পেয়েছি অনেক ফল —
সে আমি সবারে বিশ্বজনারে করেছি দান ,
ভরেছি ধরণীতল ।
যার ভালো লাগে সেই নিয়ে যাক ,
যতদিন থাকে ততদিন থাক্‌ ,
যশ-অপযশ কুড়ায়ে বেড়াক
ধুলার মাঝে ।
বলেছি যে কথা করেছি যে কাজ
আমার সে নয় সবার সে আজ
ফিরিছে ভ্রমিয়া সংসারমাঝ
বিবিধ সাজে ।
যা-কিছু আমার আছে অপনার শ্রেষ্ঠ ধন
দিতেছি চরণে আসি —
অকৃত কার্য , অকথিত বাণী , অগীত গান ,
বিফল বাসনারাশি ।
ওগো বিফল বাসনারাশি
হেরিয়া আজিকে ঘরে পরে সবে
হাসিছে হেলার হাসি ।
তুমি যদি , দেবী , লহ কর পাতি ,
আপনার হাতে রাখ মালা গাঁথি ,
নিত্য নবীন রবে দিনরাতি
সুবাসে ভাসি ,
সফল করিবে জীবন আমার
বিফল বাসনারাশি ।

সান্ত্বনা

কোথা হতে দুই চক্ষে ভরে নিয়ে এলে জল
হে প্রিয় আমার ।
হে ব্যথিত , হে অশান্ত , বলো আজি গাব গান
কোন্‌ সান্ত্বনার ।
হেথায় প্রান্তরপারে
নগরীর এক ধারে
সায়াহ্নের অন্ধকারে
জ্বালি দীপখানি
শূন্য গৃহে অন্যমনে
একাকিনী বাতায়নে
বসে আছি পুষ্পাসনে
বাসরের রানী —
কোথা বক্ষে বিঁধি কাঁটা ফিরিলে আপন নীড়ে
হে আমার পাখি ।
ওরে ক্লিষ্ট , ওরে ক্লান্ত , কোথা তোর বাজে ব্যথা ,
কোথা তোরে রাখি ।

চারি দিকে তমস্বিনী রজনী দিয়েছে টানি
মায়ামন্ত্র-ঘের —
দুয়ার রেখেছি রুধি , চেয়ে দেখো কিছু হেথা
নাহি বাহিরের ।
এ যে দুজনের দেশ ,
নিখিলের সব শেষ ,
মিলনের রসাবেশ
অনন্ত ভবন —
শুধু এই এক ঘরে
দুখানি হৃদয় ধরে ,
দুজনে সৃজন করে
নূতন ভুবন ।
একটি প্রদীপ শুধু এ আঁধারে যতটুকু
আলো করে রাখে
সেই আমাদের বিশ্ব , তাহার বাহিরে আর
চিনি না কাহাকে ।

একখানি বীণা আছে , কভু বাজে মোর বুকে
কভু তব কোরে ।
একটি রেখেছি মালা , তোমারে পরায়ে দিলে
তুমি দিবে মোরে ।
এক শয্যা রাজধানী ,
আধেক আঁচলখানি
বক্ষ হতে লয়ে টানি
পাতিব শয়ন ।
একটি চুম্বন গড়ি
দোঁহে লব ভাগ করি —
এ রাজত্বে , মরি মরি ,
এত আয়োজন ।
একটি গোলাপফুল রেখেছি বক্ষের মাঝে ,
তব ঘ্রাণশেষে
আমারে ফিরায়ে দিলে অধরে পরশি তাহা
পরি লব কেশে ।

আজ করেছিনু মনে তোমারে করিব রাজা
এই রাজ্যপাটে ,
এ অমর বরমাল্য আপনি যতনে তব
জড়াব ললাটে ।
মঙ্গলপ্রদীপ ধ ‘ রে
লইব বরণ করে ,
পুষ্পসিংহাসন- ‘ পরে
বসাব তোমায় —
তাই গাঁথিয়াছি হার ,
আনিয়াছি ফুলভার ,
দিয়েছি নূতন তার
কনকবীণায় ।
আকাশে নক্ষত্রসভা নীরবে বসিয়া আছে
শান্ত কৌতূহলে —
আজি কি এ মালাখানি সিক্ত হবে , হে রাজন্‌ ,
নয়নের জলে ।

রুদ্ধকণ্ঠ , গীতহারা , কহিয়ো না কোনো কথা ,
কিছু শুধাব না —
নীরবে লইব প্রাণে তোমার হৃদয় হতে
নীরব বেদনা ।
প্রদীপ নিবায়ে দিব ,
বক্ষে মাথা তুলি নিব ,
স্নিগ্ধ করে পরশিব
সজল কপোল —
বেণীমুক্ত কেশজাল
স্পর্শিবে তাপিত ভাল ,
কোমল বক্ষের তাল
মৃদুমন্দ দোল ।
নিশ্বাসবীজনে মোর কাঁপিবে কুন্তল তব ,
মুদিবে নয়ন —
অর্ধরাতে শান্তবায়ে নিদ্রিত ললাটে দিব
একটি চুম্বন ।

সিন্ধুপারে

পউষ প্রখর শীতে জর্জর , ঝিল্লিমুখর রাতি ;
নিদ্রিত পুরী , নির্জন ঘর , নির্বাণদীপ বাতি ।
অকাতর দেহে আছিনু মগন সুখনিদ্রার ঘোরে —
তপ্ত শয্যা প্রিয়ার মতন সোহাগে ঘিরেছে মোরে ।
হেনকালে হায় বাহির হইতে কে ডাকিল মোর নাম —
নিদ্রা টুটিয়া সহসা চকিতে চমকিয়া বসিলাম ।
তীক্ষ্ণ শাণিত তীরের মতন মর্মে বাজিল স্বর —
ঘর্ম বহিল ললাট বাহিয়া , রোমাঞ্চকলেবর ।
ফেলি আবরণ , ত্যজিয়া শয়ন , বিরলসন বেশে
দুরু দুরু বুকে খুলিয়া দুয়ার বাহিরে দাঁড়ানু এসে ।
দূর নদীপারে শূন্য শ্মশানে শৃগাল উঠিল ডাকি ,
মাথার উপরে কেঁদে উড়ে গেল কোন্‌ নিশাচর পাখি ।
দেখিনু দুয়ারে রমণীমুরতি অবগুণ্ঠনে ঢাকা —
কৃষ্ণ অশ্বে বসিয়া রয়েছে , চিত্রে যেন সে আঁকা ।
আরেক অশ্ব দাঁড়ায়ে রয়েছে , পুচ্ছ ভূতল চুমে ,
ধূম্রবরন , যেন দেহ তার গঠিত শ্মশানধূমে ।
নড়িল না কিছু , আমারে কেবল হেরিল আঁখির পাশে —
শিহরি শিহরি সর্ব শরীর কাঁপিয়া উঠিল ত্রাসে ।
পাণ্ডু আকাশে খণ্ড চন্দ্র হিমানীর গ্লানি-মাখা ,
পল্লবহীন বৃদ্ধ অশথ শিহরে নগ্ন শাখা ।
নীরব রমণী অঙ্গুলী তুলি দিল ইঙ্গিত করি —
মন্ত্রমুগ্ধ অচেতনসম চড়িনু অশ্ব- ‘ পরি ।

বিদ্যুৎবেগে ছুটে যায় ঘোড়া — বারেক চাহিনু পিছে ,
ঘরদ্বার মোর বাষ্পসমান মনে হল সব মিছে ।
কাতর রোদন জাগিয়া উঠিল সকল হৃদয় ব্যেপে ,
কণ্ঠের কাছে সুকঠিন বলে কে তারে ধরিল চেপে ।
পথের দুধারে রুদ্ধদুয়ারে দাঁড়ায়ে সৌধসারি ,
ঘরে ঘরে হায় সুখশয্যায় ঘুমাইছে নরনারী ।
নির্জন পথ চিত্রিতবৎ , সাড়া নাই সারা দেশে —
রাজার দুয়ারে দুইটি প্রহরী ঢুলিছে নিদ্রাবেশে ।
শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর সুদূর পথের মাঝে —
গম্ভীর স্বরে প্রাসাদশিখরে প্রহরঘন্টা বাজে ।

অফুরান পথ , অফুরান রাতি , অজানা নূতন ঠাঁই —
অপরূপ এক স্বপ্নসমান , অর্থ কিছুই নাই ।
কী যে দেখেছিনু মনে নাহি পড়ে , ছিল নাকো আগাগোড়া —
লক্ষ্যবিহীন তীরের মতন ছুটিয়া চলেছে ঘোড়া ।
চরণে তাদের শব্দ বাজে না , উড়ে নাকো ধূলিরেখা —
কঠিন ভূতল নাই যেন কোথা , সকলি বাষ্পে লেখা ।
মাঝে মাঝে যেন চেনা-চেনা-মতো মনে হয় থেকে থেকে —
নিমেষ ফেলিতে দেখিতে না পাই কোথা পথ যায় বেঁকে ।
মনে হল মেঘ , মনে হল পাখি , মনে হল কিশলয় ,
ভালো করে যেই দেখিবারে যাই মনে হল কিছু নয় ।
দুই ধারে এ কি প্রাসাদের সারি ? অথবা তরুর মূল ?
অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারই মনের ভুল ?
মাঝে মাঝে চেয়ে দেখি রমণীর অবগুণ্ঠিত মুখে —
নীরব নিদয় বসিয়া রয়েছে , প্রাণ কেঁপে ওঠে বুকে ।
ভয়ে ভুলে যাই দেবতার নাম , মুখে কথা নাহি ফুটে ;
হুহু রবে বায়ু বাজে দুই কানে ঘোড়া চলে যায় ছুটে ।

চন্দ্র যখন অস্তে নামিল তখনো রয়েছে রাতি ,
পূর্ব দিকের অলস নয়নে মেলিছে রক্ত ভাতি ।
জনহীন এক সিন্ধুপুলিনে অশ্ব থামিল আসি —
সমুখে দাঁড়ায়ে কৃষ্ণ শৈল গুহামুখ পরকাশি ।
সাগরে না শুনি জলকলরব , না গাহে উষার পাখি ,
বহিল না মৃদু প্রভাতপবন বনের গন্ধ মাখি ।
অশ্ব হইতে নামিল রমণী , আমিও নামিনু নীচে ,
আঁধার-ব্যাদান গুহার মাঝারে চলিনু তাহার পিছে ।
ভিতরে খোদিত উদার প্রাসাদ শিলাস্তম্ভ- ‘ পরে ,
কনকশিকলে সোনার প্রদীপ দুলিতেছে থরে থরে ।
ভিত্তির গায়ে পাষাণমূর্তি চিত্রিত আছে কত ,
অপরূপ পাখি , অপরূপ নারী , লতাপাতা নানা-মতো ।
মাঝখানে আছে চাঁদোয়া খাটানো , মুক্তা ঝালরে গাঁথা —
তারি তলে মণিপালঙ্ক- ‘ পরে অমল শয়ন পাতা ।
তারি দুই ধারে ধূপাধার হতে উঠিছে গন্ধধূপ ,
সিংহবাহিনী নারীর প্রতিমা দুই পাশে অপরূপ ।
নাহি কোনো লোক , নাহিকো প্রহরী , নাহি হেরি দাসদাসী ।
গুহাগৃহতলে তিলেক শব্দ হয়ে উঠে রাশি রাশি ।
নীরবে রমণী আবৃত বদনে বসিলা শয্যা- ‘ পরে ,
অঙ্গুলি তুলি ইঙ্গিত করি পাশে বসাইল মোরে ।
হিম হয়ে এল সর্বশরীর , শিহরি উঠিল প্রাণ —
শোণিতপ্রবাহে ধ্বনিতে লাগিল ভয়ের ভীষণ তান ।

সহসা বাজিয়া বাজিয়া উঠিল দশ দিকে বীণা-বেণু ,
মাথার উপরে ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িল পুষ্পরেণু ।
দ্বিগুণ আভায় জ্বলিয়া উঠিল দীপের আলোকরাশি —
ঘোমটা-ভিতরে হাসিল রমণী মধুর উচ্চহাসি ।
সে হাসি ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া উঠিল বিজন বিপুল ঘরে —
শুনিয়া চমকি ব্যাকুল হৃদয়ে কহিলাম জোড়করে ,
‘ আমি যে বিদেশী অতিথি , আমায় ব্যথিয়ো না পরিহাসে ,
কে তুমি নিদয় নীরব ললনা , কোথায় আনিলে দাসে । ‘

অমনি রমণী কনকদণ্ড আঘাত করিল ভূমে ,
আঁধার হইয়া গেল সে ভবন রাশি রাশি ধূপধূমে ।
বাজিয়া উঠিল শতেক শঙ্খ হুলুকলরব-সাথে —
প্রবেশ করিল বৃদ্ধ বিপ্র ধান্যদূর্বা হাতে ।
পশ্চাতে তার বাঁধি দুই সার কিরাতনারীর দল
কেহ বহে মালা , কেহ বা চামর , কেহ বা তীর্থজল ।
নীরবে সকলে দাঁড়ায়ে রহিল — বৃদ্ধ আসনে বসি
নীরবে গণনা করিতে লাগিল গৃহতলে খড়ি কষি ।
আঁকিতে লাগিল কত না চক্র , কত না রেখার জাল ,
গণনার শেষে কহিল ‘ এখন হয়েছে লগ্ন-কাল ‘ ।
শয়ন ছাড়িয়া উঠিল রমণী বদন করিয়া নত ,
আমিও উঠিয়া দাঁড়াইনু পাশে মন্ত্রচালিতমত ।
নারীগণ সবে ঘেরিয়া দাঁড়ালো একটি কথা না বলি
দোঁহাকার মাথে ফুলদল-সাথে বরষি লাজাঞ্জলি ।
পুরোহিত শুধু মন্ত্র পড়িল আশিস করিয়া দোঁহে —
কী ভাষা কী কথা কিছু না বুঝিনু , দাঁড়ায়ে রহিনু মোহে ।
অজানিত বধূ নীরবে সঁপিল শিহরিয়া কলেবর
হিমের মতন মোর করে তার তপ্ত কোমল কর ।
চলি গেল ধীরে বৃদ্ধ বিপ্র , পশ্চাতে বাঁধি সার
গেল নারীদল মাথায় কক্ষে মঙ্গল-উপচার ।
শুধু এক সখী দেখাইল পথ হাতে লয়ে দীপখানি —
মোরা দোঁহে পিছে চলিনু তাহার , কারো মুখে নাহি বাণী ।
কত না দীর্ঘ আঁধার কক্ষ সভয়ে হইয়া পার
সহসা দেখিনু সমুখে কোথায় খুলে গেল এক দ্বার ।
কী দেখিনু ঘরে কেমনে কহিব , হয়ে যায় মনোভুল ,
নানা বরনের আলোক সেথায় , নানা বরনের ফুল ।
কনকে রজতে রতনে জড়িত বসন বিছানো কত ,
মণিবেদিকায় কুসুমশয়ন স্বপ্নরচিত-মতো ।
পাদপীঠ- ‘ পরে চরণ প্রসারি শয়নে বসিলা বধূ —
আমি কহিলাম , ‘ সব দেখিলাম , তোমারে দেখি নি শুধু । ‘

চারি দিক হতে বাজিয়া উঠিল শত কৌতুকহাসি ।
শত ফোয়ারায় উছসিল যেন পরিহাস রাশি রাশি ।
সুধীরে রমণী দু-বাহু তুলিয়া , অবগুণ্ঠনখানি
উঠায়ে ধরিয়া মধুর হাসিল মুখে না কহিয়া বাণী ।
চকিত নয়ানে হেরি মুখপানে পড়িনু চরণতলে ,
‘ এখানেও তুমি জীবনদেবতা! ‘ কহিনু নয়নজলে ।
সেই মধুমুখ , সেই মৃদুহাসি , সেই সুধাভরা আঁখি —
চিরদিন মোরে হাসালো কাঁদালো , চিরদিন দিল ফাঁকি ।
খেলা করিয়াছে নিশিদিন মোর সব সুখে সব দুখে ,
এ অজানাপুরে দেখা দিল পুন সেই পরিচিত মুখে ।
অমল কোমল চরণকমলে চুমিনু বেদনাভরে —
বাধা না মানিয়া ব্যাকুল অশ্রু পড়িতে লাগিল ঝরে ।
অপরূপ তানে ব্যথা দিয়ে প্রাণে বাজিতে লাগিল বাঁশি ।
বিজন বিপুল ভবনে রমণী হাসিতে লাগিল হাসি ।

সুখ

আজি মেঘমুক্ত দিন ; প্রসন্ন আকাশ
হাসিছে বন্ধুর মতো ; সুমন্দ বাতাস
মুখে চক্ষে বক্ষে আসি লাগিছে মধুর —
অদৃশ্য অঞ্চল যেন সুপ্ত দিগ্‌বধূর
উড়িয়া পড়িছে গায়ে । ভেসে যায় তরী
প্রশান্ত পদ্মার স্থির বক্ষের উপরি
তরল কল্লোলে । অর্ধমগ্ন বালুচর
দূরে আছে পড়ি , যেন দীর্ঘ জলচর
রৌদ্র পোহাইছে শুয়ে । ভাঙা উচ্চতীর ;
ঘনচ্ছায়াপূর্ণ তরু ; প্রচ্ছন্ন কুটির ;
বক্র শীর্ণ পথখানি দূর গ্রাম হতে
শস্যক্ষেত্র পার হয়ে নামিয়াছে স্রোতে
তৃষার্ত জিহ্বার মতো । গ্রামবধূগণ
অঞ্চল ভাসায়ে জলে আকণ্ঠমগন
করিছে কৌতুকালাপ । উচ্চ মিষ্ট হাসি
জলকলস্বরে মিশি পশিতেছে আসি
কর্ণে মোর । বসি এক বাঁকা নৌকা- ‘ পরি
বৃদ্ধ জেলে গাঁথে জাল নতশির করি
রৌদ্রে পিঠ দিয়া । উলঙ্গ বালক তার
আনন্দে ঝাঁপায়ে জলে পড়ে বারম্বার
কলহাস্যে ; ধৈর্যময়ী মাতার মতন
পদ্মা সহিতেছে তার স্নেহ-জ্বালাতন ।
তরী হতে সম্মুখেতে দেখি দুই পার —
স্বচ্ছতম নীলাভ্রের নির্মল বিস্তার ;
মধ্যাহ্ন-আলোকপ্লাবে জলে স্থলে বনে
বিচিত্র বর্ণের রেখা ; আতপ্ত পবনে
তীর উপবন হতে কভু আসে বহি
আম্রমুকুলের গন্ধ , কভু রহি রহি
বিহঙ্গের শ্রান্ত স্বর ।

আজি বহিতেছে
প্রাণে মোর শান্তিধারা — মনে হইতেছে
সুখ অতি সহজ সরল , কাননের
প্রস্ফুট ফুলের মতো , শিশু-আননের
হাসির মতন , পরিব্যাপ্ত বিকশিত —
উন্মুখ অধরে ধরি চুম্বন-অমৃত
চেয়ে আছে সকলের পানে বাক্যহীন
শৈশববিশ্বাসে চিররাত্রি চিরদিন ।
বিশ্ববীণা হতে উঠি গানের মতন
রেখেছে নিমগ্ন করি নিথর গগন ।
সে সংগীত কী ছন্দে গাঁথিব , কী করিয়া
শুনাইব , কী সহজ ভাষায় ধরিয়া
দিব তারে উপহার ভালোবাসি যারে ,
রেখে দিব ফুটাইয়া কী হাসি আকারে
নয়নে অধরে , কী প্রেমে জীবনে তারে
করিব বিকাশ । সহজ আনন্দখানি
কেমনে সহজে তারে তুলে ঘরে আনি
প্রফুল্ল সরস । কঠিন আগ্রহভরে
ধরি তারে প্রাণপণে — মুঠির ভিতরে
টুটি যায় । হেরি তারে তীব্রগতি ধাই —
অন্ধবেগে বহুদূরে লঙ্ঘি চলি যাই ,
আর তার না পাই উদ্দেশ ।

চারি দিকে
দেখে আজি পূর্ণপ্রাণে মুগ্ধ অনিমিখে
এই স্তব্ধ নীলাম্বর স্থির শান্ত জল ,
মনে হল সুখ অতি সহজ সরল ।

 স্নেহস্মৃতি

সেই চাঁপা , সেই বেলফুল ,
কে তোরা আজি এ প্রাতে এনে দিলি মোর হাতে —
জল আসে আঁখিপাতে , হৃদয় আকুল ।
সেই চাঁপা! সেই বেলফুল!

কত দিন , কত সুখ , কত হাসি , স্নেহমুখ ,
কত কী পড়িল মনে প্রভাতবাতাসে —
স্নিগ্ধ প্রাণ সুধাভরা শ্যামল সুন্দর ধরা ,
তরুণ অরুণরেখা নির্মল আকাশে ।
সকলি জড়িত হয়ে অন্তরে যেতেছে বয়ে ,
ডুবে যায় অশ্রুজলে হৃদয়ের কূল —
মনে পড়ে তারি সাথে জীবনের কত প্রাতে
সেই চাঁপা! সেই বেলফুল!

বড়ো বেসেছিনু ভালো এই শোভা , এই আলো ,
এ আকাশ , এ বাতাস , এই ধরাতল ।
কতদিন বসি তীরে শুনেছি নদীর নীরে
নিশীথের সমীরণে সংগীত তরল ।
কতদিন পরিয়াছি সন্ধ্যাবেলা মালাগাছি
স্নেহের হস্তের গাঁথা বকুলমুকুল —
বড়ো ভালো লেগেছিল যেদিন এ হাতে দিল
সেই চাঁপা! সেই বেলফুল!

কত শুনিয়াছি বাঁশি , কত দেখিয়াছি হাসি ,
কত উৎসবের দিনে কত যে কৌতুক ।
কত বরষার বেলা সঘন আনন্দ-মেলা ,
কত গানে জাগিয়াছে সুনিবিড় সুখ ।
এ প্রাণ বীণার মতো ঝংকারি উঠেছে কত
আসিয়াছে শুভক্ষণ কত অনুকূল —
মনে পড়ে তারি সাথে কতদিন কত প্রাতে
সেই চাঁপা! সেই বেলফুল!

সেই-সব এই-সব , তেমনি পাখির রব ,
তেমনি চলেছে হেসে জাগ্রত সংসার ।
দক্ষিণ-বাতাসে-মেশা ফুলের গন্ধের নেশা
দিকে দিকে ব্যাকুলতা করিছে সঞ্চার ।
অবোধ অন্তরে তাই চারি দিক -পানে চাই ,
অকস্মাৎ আনমনে জেগে উঠে ভুল —
বুঝি সেই স্নেহসনে ফিরে এল এ জীবনে
সেই চাঁপা! সেই বেলফুল!

আনন্দপাথেয় যত সকলি হয়েছে গত ,
দুটি রিক্তহস্তে মোর আজি কিছু নাই ।
তবু সম্মুখের পানে চলেছি কঠিন প্রাণে ,
যেতে হবে গম্যস্থানে , ফিরে না তাকাই ।
দাঁড়ায়ো না , চলো চলো , কী আছে কে জানে বলো
ধূলিময় শুষ্কপথ , সংশয় বিপুল —
শুধু জানিয়াছি সার কভু ফুটিবে না আর
সেই চাঁপা! সেই বেলফুল!

আমি কিছু নাহি চাই , যাহা দিবে লব তাই
চিরসুখ এ জগতে কে পেয়েছে কবে ।
প্রাণে লয়ে উপবাস কাটে কত বর্ষমাস ,
তৃষিত তাপিত চিত্ত কত আছে ভবে ।
শুধু এক ভিক্ষা আছে , যেদিন আসিবে কাছে
জীবনের পথশেষে মরণ অকূল
সেদিন স্নেহের সাথে তুলে দিয়ো এই হাতে
সেই চাঁপা! সেই বেলফুল!

হয়তো মৃত্যুর পারে ঢাকা সব অন্ধকারে ,
স্বপ্নহীন চিরসুপ্তি চক্ষে চেপে রহে ,
গীতগান হেথাকার সেথা নাহি বাজে আর ,
হেথাকার বনগন্ধ সেথা নাহি বহে ।
কে জানে সকল স্মৃতি জীবনের সব প্রীতি
জীবনের অবসানে হবে কি উন্‌মূল ?
জানি নে গো এই হাতে নিয়ে যাব কিনা সাথে
সেই চাঁপা! সেই বেলফুল!

স্বর্গ হইতে বিদায়

ম্লান হয়ে এল কণ্ঠে মন্দারমালিকা ,
হে মহেন্দ্র , নির্বাপিত জ্যোতির্ময় টিকা
মলিন ললাটে । পুণ্যবল হল ক্ষীণ ,
আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন ,
হে দেব , হে দেবীগণ । বর্ষ লক্ষশত
যাপন করেছি হর্ষে দেবতার মতো
দেবলোকে । আজি শেষ বিচ্ছেদের ক্ষণে
লেশমাত্র অশ্রুরেখা স্বর্গের নয়নে
দেখে যাব এই আশা ছিল । শোকহীন
হৃদিহীন সুখস্বর্গভূমি , উদাসীন
চেয়ে আছে । লক্ষ লক্ষ বর্ষ তার
চক্ষের পলক নহে ; অশ্বত্থশাখার
প্রান্ত হতে খসি গেলে জীর্ণতম পাতা
যতটুকু বাজে তার , ততটুকু ব্যথা
স্বর্গে নাহি লাগে , যবে মোরা শত শত
গৃহচ্যুত হতজ্যোতি নক্ষত্রের মতো
মুহূর্তে খসিয়া পড়ি দেবলোক হতে
ধরিত্রীর অন্তহীন জন্মমৃত্যুস্রোতে ।
সে বেদনা বাজিত যদ্যপি , বিরহের
ছায়ারেখা দিত দেখা , তবে স্বরগের
চিরজ্যোতি ম্লান হত মর্তের মতন
কোমল শিশিরবাষ্পে — নন্দনকানন
মর্মরিয়া উঠিত নিশ্বসি , মন্দাকিনী
কূলে কূলে গেয়ে যেত করুণ কাহিনী
কলকণ্ঠে , সন্ধ্যা আসি দিবা-অবসানে
নির্জন প্রান্তর-পারে দিগন্তের পানে
চলে যেত উদাসিনী , নিস্তব্ধ নিশীথ
ঝিল্লিমন্ত্রে শুনাইত বৈরাগ্যসংগীত
নক্ষত্রসভায় । মাঝে মাঝে সুরপুরে
নৃত্যপরা মেনকার কনকনূপুরে
তালভঙ্গ হত । হেলি উর্বশীর স্তনে
স্বর্ণবীণা থেকে থেকে যেন অন্যমনে
অকস্মাৎ ঝংকারিত কঠিন পীড়নে
নিদারুণ করুণ মূর্ছনা । দিত দেখা
দেবতার অশ্রুহীন চোখে জলরেখা
নিষ্কারণে । পতিপাশে বসি একাসনে
সহসা চাহিত শচী ইন্দ্রের নয়নে
যেন খুঁজি পিপাসার বারি । ধরা হতে
মাঝে মাঝে উচ্ছ্বসি আসিত বায়ুস্রোতে
ধরণীর সুদীর্ঘ নিশ্বাস — খসি ঝরি
পড়িত নন্দনবনে কুসুমমঞ্জরী ।

থাকো স্বর্গ হাস্যমুখে , করো সুধাপান
দেবগণ । স্বর্গ তোমাদেরি সুখস্থান —
মোরা পরবাসী । মর্তভূমি স্বর্গ নহে ,
সে যে মাতৃভূমি — তাই তার চক্ষে বহে
অশ্রুজলধারা , যদি দু দিনের পরে
কেহ তারে ছেড়ে যায় দু দণ্ডের তরে ।
যত ক্ষুদ্র , যত ক্ষীণ , যত অভাজন ,
যত পাপীতাপী , মেলি ব্যগ্র আলিঙ্গন
সবারে কোমল বক্ষে বাঁধিবারে চায় —
ধূলিমাখা তনুস্পর্শে হৃদয় জুড়ায়
জননীর । স্বর্গে তব বহুক অমৃত ,
মর্তে থাক্‌ সুখে দুঃখে অনন্তমিশ্রিত
প্রেমধারা — অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি
ভূতলের স্বর্গখণ্ডগুলি ।

হে অপ্সরী ,
তোমার নয়নজ্যোতি প্রেমবেদনায়
কভু না হউক ম্লান — লইনু বিদায় ।
তুমি কারে কর না প্রার্থনা , কারো তরে
নাহি শোক । ধরাতলে দীনতম ঘরে
যদি জন্মে প্রেয়সী আমার , নদীতীরে
কোনো-এক গ্রামপ্রান্তে প্রচ্ছন্ন কুটিরে
অশ্বত্থছায়ায় , সে বালিকা বক্ষে তার
রাখিবে সঞ্চয় করি সুধার ভাণ্ডার
আমারি লাগিয়া সযতনে । শিশুকালে
নদীকূলে শিবমূর্তি গড়িয়া সকালে
আমারে মাগিয়া লবে বর । সন্ধ্যা হলে
জ্বলন্ত প্রদীপখানি ভাসাইয়া জলে
শঙ্কিত কম্পিত বক্ষে চাহি একমনা
করিবে সে আপনার সৌভাগ্যগণনা
একাকী দাঁড়ায়ে ঘাটে । একদা সুক্ষণে
আসিবে আমার ঘরে সন্নত নয়নে
চন্দনচর্চিত ভালে রক্তপট্টাম্বরে ,
উৎসবের বাঁশরীসংগীতে । তার পরে
সুদিনে দুর্দিনে , কল্যাণকঙ্কণ করে ,
সীমন্তসীমায় মঙ্গলসিন্দূরবিন্দু ,
গৃহলক্ষ্মী দুঃখে সুখে , পূর্ণিমার ইন্দু
সংসারের সমুদ্রশিয়রে । দেবগণ ,
মাঝে মাঝে এই স্বর্গ হইবে স্মরণ
দূরস্বপ্নসম , যবে কোনো অর্ধরাতে
সহসা হেরিব জাগি নির্মল শয্যাতে
পড়েছে চন্দ্রের আলো , নিদ্রিতা প্রেয়সী
লুণ্ঠিত শিথিল বাহু , পড়িয়াছে খসি
গ্রন্থি শরমের — মৃদু সোহাগচুম্বনে
সচকিতে জাগি উঠি গাঢ় আলিঙ্গনে
লতাইবে বক্ষে মোর — দক্ষিণ অনিল
আনিবে ফুলের গন্ধ , জাগ্রত কোকিল
গাহিবে সুদূর শাখে ।

অয়ি দীনহীনা ,
অশ্রু-আঁখি দুঃখাতুর জননী মলিনা ,
অয়ি মর্ত্যভূমি । আজি বহুদিন পরে
কাঁদিয়া উঠেছে মোর চিত্ত তোর তরে ।
যেমনি বিদায়দুঃখে শুষ্ক দুই চোখ
অশ্রুতে পুরিল , অমনি এ স্বর্গলোক
অলস কল্পনাপ্রায় কোথায় মিলালো
ছায়াচ্ছবি । তব নীলাকাশ , তব আলো ,
তব জনপূর্ণ লোকালয় , সিন্ধুতীরে
সুদীর্ঘ বালুকাতট , নীল গিরিশিরে
শুভ্র হিমরেখা , তরুশ্রেণীর মাঝারে
নিঃশব্দ অরুণোদয় , শূন্য নদীপারে
অবনতমুখী সন্ধ্যা — বিন্দু-অশ্রুজলে
যত প্রতিবিম্ব যেন দর্পণের তলে
পড়েছে অসিয়া ।

হে জননী পুত্রহারা ,
শেষ বিচ্ছেদের দিনে যে শোকাশ্রুধারা
চক্ষু হতে ঝরি পড়ি তব মাতৃস্তন
করেছিল অভিষিক্ত , আজি এতক্ষণ
সে অশ্রু শুকায়ে গেছে । তবু জানি মনে
যখনি ফিরিব পুন তব নিকেতনে
তখনি দুখানি বাহু ধরিবে আমায় ,
বাজিবে মঙ্গলশঙ্খ , স্নেহের ছায়ায়
দুঃখে-সুখে-ভয়ে-ভরা প্রেমের সংসারে
তব গেহে , তব পুত্রকন্যার মাঝারে
আমারে লইবে চিরপরিচিতসম —
তার পরদিন হতে শিয়রেতে মম
সারাক্ষণ জাগি রবে কম্পমান প্রাণে ,
শঙ্কিত অন্তরে , ঊর্ধ্বে দেবতার পানে
মেলিয়া করুণ দৃষ্টি , চিন্তিত সদাই
যাহারে পেয়েছি তারে কখন হারাই ।

০১.সূচনা (চিত্রা)

ভক্ত যখন বলেন, ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদিস্থিতেন যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি, তখন হৃষীকেশের থেকে ভক্ত নিজেকে পৃথক করে দেখেন, সুতরাং তাঁর নিজের জীবনের সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়ে একা হৃষীকেশের’পরেই। চিত্রা কাব্যে আমি একদিন বলেছিলুম আমার অন্তর্যামী আমাকে দিয়ে যা বলাতে চান আমি তাই বলি, কথাটা এই রকম শুনতে হয়। কিন্তু চিত্রায় আমার যে উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে সেটি অন্য শ্রেণীর। আমার একটি যুগ্মসত্তা আমি অনুভব করেছিলুম যেন যুগ্ম নক্ষত্রের মতো, সে আমারই ব্যক্তিত্বের অন্তর্গত, তারই আকর্ষণ প্রবল। তারই সংকল্প পূর্ণ হচ্ছে আমার মধ্য দিয়ে, আমার সুখে দুঃখে, আমার ভালোয় মন্দয়। এই সংকল্প-সাধনায় এক আমি যন্ত্র এবং দ্বিতীয় আমি যন্ত্রী হতে পারে, কিন্তু সংগীত যা উদ্ভূত হচ্ছে— যন্ত্রেরও স্বকীয় বিশিষ্টতা তার একটি প্রধান অঙ্গ। পদে পদে তার সঙ্গে রফা করে তবেই দুয়ের যোগে সৃষ্টি। এ যেন অর্ধনারীশ্বরের মতো ভাবখানা। সেইজন্যেই বলা হয়েছে—

জ্বেলেছ কি মোরে প্রদীপ তোমার
করিবারে পূজা কোন্‌ দেবতার
রহস্যঘেরা অসীম আঁধার
মহামন্দিরতলে।

পরমদেবতার পূজা যুগ্মসত্তায় মিলে, এক সত্তায় ভিতর থেকে আদর্শের প্রেরণা, আর-এক সত্তায় বাহিরে কর্মযোগে তার প্রকাশ। সংসারে এই দুই সত্তার বিরোধ সর্বদাই ঘটে, নিজের অন্তরে পূর্ণতার যে অনুশাসন মানুষ গূঢ়ভাবে বহন করছে তার সম্পূর্ণ প্রতিবাদে জীবন ব্যর্থ হয়েছে এ দৃষ্টান্তের অভাব নেই। নিজের মধ্যে নিজের সামঞ্জস্য ঘটতে পারে নি, এই ভ্রষ্টতা মানুষের পক্ষে সব চেয়ে শোচনীয়। আপনার দুই সত্তার সামঞ্জস্য ঘটেছে কি না এই আশঙ্কাসূচক প্রশ্ন চিত্রার কবিতায় অনেকবার প্রকাশ পেয়েছে। বস্তুত চিত্রায় জীবনরঙ্গভূমিতে যে মিলননাট্যের উল্লেখ হয়েছে তার কোনো নায়ক-নায়িকা জীবের সত্তার বাইরে নেই, এবং তার মধ্যে কেউ ভগবানের স্থানাভিষিক্ত নয়। মানুষের আত্মিক সৃষ্টি কেন, প্রাকৃতিক সৃষ্টিতেও আদিকাল থেকে মূল আদর্শের সঙ্গে বাহ্য প্রকাশের সাংঘাতিক দ্বন্দ্ব দেখতে পাওয়া গেছে। আঙ্গারিক যুগের শ্রীহীন গাছগুলো কেন টিকতে পারল না। আজ পরবর্তী গাছগুলিতে সমস্ত পৃথিবীকে দিয়েছে শোভা। কোন্‌ শিল্পী রচনার সূত্রপাতে প্রথম ব্যর্থ হয়েছিল, মাথা নেড়েছিল, হাতের কাজ নিষ্ঠুর ভাবে মুছতে মুছতে সংস্কার সাধন করেছে— এ কথা যখন ভাবি তখন সৃষ্টির ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে দুই সত্তার মিলনচেষ্টা স্পষ্ট দেখতে পাই। সেই চেষ্টা কী নিষ্ঠুর ভাবে নিজেকে জয়যুক্ত করতে চায়, মানুষের ইতিহাসে বারংবার তার প্রমাণ পাওয়া যায়; আজ তার সেই আত্মঘাতী প্রমাণ যেমন প্রকট হয়েছে এমন আর কখনো হয় নি। চিত্রার প্রথম কবিতায় তার একটি সূচনায় বলা হয়েছে—

জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্ররূপিণী।

তার পর আছে—

অন্তরমাঝে তুমি শুধু একা একাকী
তুমি অন্তরবাসিনী।

আজ ব্যাখ্যা করে যে কথা বলবার চেষ্টা করছি সেই কথাটাই এই কবিতার মধ্যে ফুটতে চেয়েছিল। বাইরে যার প্রকাশ বাস্তবে সে বহু, অন্তরে যার প্রকাশ সে একা। এই দুই ধারার প্রবাহেই কাব্য সম্পূর্ণ হয়। ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় কর্মজীবনের সেই বিচিত্রের ডাক পড়েছে। ‘আবেদন’ কবিতায় ঠিক তার উলটো কথা। কবি বলেছে, ‘কর্মক্ষেত্রে, যেখানে কার্যক্ষেত্রের জনতায় কর্মীরা কর্ম করছে, সেখানে আমার স্থান নয়। আমার স্থান সৌন্দর্যের সাধকরূপে একা তোমার কাছে।’ জীবনের দুই ভিন্ন মহলে কবির এই ভিন্ন ভিন্ন কথা। জগতে বিচিত্ররূপিণী আর অন্তরে একাকিনী কবির কাছে এ দুইই সত্য, আকাশ এবং ভূতলকে নিয়ে ধরণী যেমন সত্য। ‘ব্রাহ্মণ’ ‘পুরাতন ভৃত্য’ দুই বিঘা জমি’ এইগুলির কাব্যকাকলি নীড়ের, বাসার; ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ এখানে সুর নেমেছে ঊর্ধ্বলোক থেকে মর্তের পথে; ‘প্রেমের অভিষেক’-এর প্রথম যে পাঠ লিখেছিলুম তাতে কেরানি-জীবনের বাস্তবতার ধূলিমাখা ছবি ছিল অকুণ্ঠিত কলমে আঁকা, পালিত অত্যন্ত ধিক্‌কার দেওয়াতে সেটা তুলে দিয়েছিলুম; ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় বাঙালিঘরের ঘরকন্নার যে আভাস আছে তার প্রতিও লোকেন কটাক্ষ বর্ষণ করেছিল, ভাগ্যক্রমে তাতে বিচলিত হই নি, হয়তো দু-চারটে লাইন বাদ পড়েছে। লোকজীবনের ব্যবহারিক বাণীকে উপেক্ষা করে আমার কাব্যে আমি কেবল আনন্দ মঙ্গল এবং ঔপনিষদিক মোহ বিস্তার করে তার বাস্তব সংসর্গের মূল্য লাঘব করেছি এমন অপবাদ কেউ কেউ আমাকে দিয়েছেন। আমার কাব্য সমগ্রভাবে আলোচনা করে দেখলে হয়তো তাঁরা দেখবেন আমার প্রতি অবিচার করেছেন। আমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত আমি এই বাণীর পন্থাতেই আমার পদ্য ও গদ্য রচনাকে চালনা করেছি—

জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্ররূপিণী।

শ্রাবণ ১৩৪৭

১৪০০ সাল

আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে —
আজি হতে শতবর্ষ পরে ।
আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের
লেশমাত্র ভাগ —
আজিকার কোনো ফুল , বিহঙ্গের কোনো গান ,
আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শতবর্ষ পরে ।

তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি
ভেবে দেখো মনে —
একদিন শতবর্ষ আগে
চঞ্চল পুলকরাশি কোন্‌ স্বর্গ হতে ভাসি
নিখিলের মর্মে আসি লাগে —
নবীন ফাল্গুনদিন সকল বন্ধনহীন
উন্মত্ত অধীর —
উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা
দক্ষিণসমীর —
সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দিয়েছে ধরা
যৌবনের রাগে
তোমাদের শতবর্ষ আগে ।
সেদিন উতলা প্রাণে , হৃদয় মগন গানে ,
কবি এক জাগে —
কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়
কত অনুরাগে
একদিন শতবর্ষ আগে ।
আজি হতে শতবর্ষ পরে
এখন করিছে গান সে কোন্‌ নূতন কবি
তোমাদের ঘরে ?
আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে ।
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমরগুঞ্জনে নব
পল্লবমর্মরে
আজি হতে শতবর্ষ পরে ।

Exit mobile version