Site icon BnBoi.Com

খেয়া – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

খেয়া - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অনাবশ্যক

কাশের বনে শূন্য নদীর তীরে
আমি তারে জিজ্ঞাসিলাম ডেকে ,
‘ একলা পথে কে তুমি যাও ধীরে
আঁচল – আড়ে প্রদীপখানি ঢেকে ।
আমার ঘরে হয় নি আলো জ্বালা ,
দেউটি তব হেথায় রাখো বালা । ‘
গোধূলিতে দুটি নয়ন কালো
ক্ষণেক – তরে আমার মুখে তুলে
সে কহিল , ‘ ভাসিয়ে দেব আলো ,
দিনের শেষে তাই এসেছি কূলে । ‘
চেয়ে দেখি দাঁড়িয়ে কাশের বনে ,
প্রদীপ ভেসে গেল অকারণে ।

ভরা সাঁঝে আঁধার হয়ে এলে
আমি ডেকে জিজ্ঞাসিলাম তারে ,
‘ তোমার ঘরে সকল আলো জ্বেলে
এ দীপখানি সঁপিতে যাও কারে ।
আমার ঘরে হয় নি আলো জ্বালা ,
দেউটি তব হেথায় রাখো বালা । ‘
আমার মুখে দুটি নয়ন কালো
ক্ষণেক – তরে রইল চেয়ে ভুলে ।
সে কহিল , ‘ আমার এ যে আলো
আকাশপ্রদীপ শূন্যে দিব তুলে । ‘
চেয়ে দেখি শূন্য গগনকোণে
প্রদীপখানি জ্বলে অকারণে ।

অমাবস্যা আঁধার দুই – পহরে
জিজ্ঞাসিলাম তাহার কাছে গিয়ে ,
‘ ওগো , তুমি চলেছ কার তরে
প্রদীপখানি বুকের কাছে নিয়ে ।
আমার ঘরে হয় নি আলো জ্বালা ,
দেউটি তব হেথায় রাখো বালা । ‘

অন্ধকারে দুটি নয়ন কালো
ক্ষণেক মোরে দেখলে চেয়ে তবে ,
সে কহিল , ‘ এনেছি এই আলো ,
দীপালিতে সাজিয়ে দিতে হবে । ‘
চেয়ে দেখি লক্ষ দীপের সনে
দীপখানি তার জ্বলে অকারণে ।

অনাহত

দাঁড়িয়ে আছ আধেক – খোলা
বাতায়নের ধারে
নূতন বধূ বুঝি ?
আসবে কখন চুড়িওলা
তোমার গৃহদ্বারে
লয়ে তাহার পুঁজি ।
দেখছ চেয়ে গোরুর গাড়ি
উড়িয়ে চলে ধূলি
খর রোদের কালে ;
দূর নদীতে দিচ্ছে পাড়ি
বোঝাই নৌকাগুলি—
বাতাস লাগে পালে ।

আধেক – খোলা বিজন ঘরে
ঘোমটা – ছায়ায় ঢাকা
একলা বাতায়নে ,
বিশ্ব তোমার আঁখির’পরে
কেমনে পড়ে আঁকা ,
তাই ভাবি যে মনে ।
ছায়াময় সে ভুবনখানি
স্বপন দিয়ে গড়া
রূপকথাটি – ছাঁদা ,
কোন্‌ সে পিতামহীর বাণী—
নাইকো আগাগোড়া ,
দীর্ঘ ছড়া বাঁধা ।

আমি ভাবি হঠাৎ যদি
বৈশাখের এক দিন
বাতাস বহে বেগে—
লজ্জা ছেড়ে নাচে নদী
শূন্যে বাঁধনহীন ,
পাগল উঠে জেগে—
যদি তোমার ঢাকা ঘরে
যত আগল আছে
সকলি যায় দূরে—
ওই – যে বসন নেমে পড়ে
তোমার আঁখির কাছে
ও যদি যায় উড়ে—

তীব্র তড়িৎহাসি হেসে
বজ্রভেরীর স্বরে
তোমার ঘরে ঢুকি
জগৎ যদি এক নিমেষে
শক্তিমূর্তি ধ ‘ রে
দাঁড়ায় মুখোমুখি—
কোথায় থাকে আধেক – ঢাকা
অলস দিনের ছায়া ,
বাতায়নের ছবি ,
কোথায় থাকে স্বপন – মাখা
আপন – গড়া মায়া—
উড়িয়া যায় সবি ।

তখন তোমার ঘোমটা – খোলা
কালো চোখের কোণে
কাঁপে কিসের আলো ,
ডুবে তোমার আপন – ভোলা
প্রাণের আন্দোলনে
সকল মন্দ ভালো ।
বক্ষে তোমার আঘাত করে
উত্তাল নর্তনে
রক্ততরঙ্গিণী ।
অঙ্গে তোমার কী সুর তুলে
চঞ্চল কম্পনে
কঙ্কণকিঙ্কিণী ।

আজকে তুমি আপনাকে
আধেক আড়াল ক’রে
দাঁড়িয়ে ঘরের কোণে
দেখতেছ এই জগৎটাকে
কী যে মায়ায় ভরে ,
তাহাই ভাবি মনে ।
অর্থবিহীন খেলার মতো
তোমার পথের মাঝে
চলছে যাওয়া – আসা ,
উঠে ফুটে মিলায় কত
ক্ষুদ্র দিনের কাজে
ক্ষুদ্র কাঁদা – হাসা ।

অনুমান

পাছে দেখি তুমি আস নি , তাই
আধেক আঁখি মুদিয়ে চাই ,
ভয়ে চাই নে ফিরে ।
আমি দেখি যেন আপন – মনে
পথের শেষে দূরের বনে
আসছ তুমি ধীরে ।
যেন চিনতে পারি সেই অশান্ত
তোমার উত্তরীয়ের প্রান্ত
ওড়ে হাওয়ার’পরে ।
আমি একলা বসে মনে গণি
শুনছি তোমার পদধ্বনি
মর্মরে মর্মরে ।

ভোরে নয়ন মেলে অরুণরাগে
যখন আমার প্রাণে জাগে
অকারণের হাসি ,
যখন নবীন তৃণে লতায় গাছে
কোন্‌ জোয়ারের স্রোতে নাচে
সবুজ সুধারাশি—
যখন নব মেঘের সজল ছায়া
যেন রে কার মিলন – মায়া
ঘনায় বিশ্ব জুড়ে ,
যখন পুলকে নীল শৈল ঘেরি
বেজে ওঠে কাহার ভেরী ,
ধ্বজা কাহার উড়ে—

তখন মিথ্যা সত্য কেই – বা জানে ,
সন্দেহ আর কেই – বা মানে ,
ভুল যদি হয় হোক !
ওগো , জানি না কি আমার হিয়া
কে ভুলালো পরশ দিয়া ,
কে জুড়ালো চোখ ।
সে কি তখন আমি ছিলেম একা ,
কেউ কি মোরে দেয় নি দেখা ।
কেউ আসে নাই পিছে ?
তখন আড়াল হতে সহাস আঁখি
আমার মুখে চায় নি নাকি ।
এ কি এমন মিছে ।

অবারিত

ওগো , তোরা বল্‌ তো এরে
ঘরে বলি কোন্‌ মতে ।
এরে কে বেঁধেছে হাটের মাঝে
আনাগোনার পথে ।
আসতে যেতে বাঁধে তরী
আমারি এই ঘাটে ,
যে খুশি সেই আসে—আমার
এই ভাবে দিন কাটে ।
ফিরিয়ে দিতে পারি না যে
হায় রে—
কী কাজ নিয়ে আছি , আমার
বেলা বহে যায় যে , আমার
বেলা বহে যায় রে ।

পায়ের শব্দ বাজে তাদের ,
রজনীদিন বাজে ।
ওগো , মিথ্যে তাদের ডেকে বলি ,
‘ তোদের চিনি না যে ! ‘
কাউকে চেনে পরশ আমার ,
কাউকে চেনে ঘ্রাণ ,
কাউকে চেনে বুকের রক্ত ,
কাউকে চেনে প্রাণ ।
ফিরিয়ে দিতে পারি না যে
হায় রে—
ডেকে বলি , ‘ আমার ঘরে
যার খুশি সেই আয় রে , তোরা
যার খুশি সেই আয় রে । ‘

সকালবেলায় শঙ্খ বাজে
পুবের দেবালয়ে—
ওগো , স্নানের পরে আসে তারা
ফুলের সাজি লয়ে ।
মুখে তাদের আলো পড়ে
তরুণ আলোখানি ;
অরুণ পায়ের ধুলোটুকু
বাতাস লহে টানি ।
ফিরিয়ে দিতে পারি না যে
হায় রে—
ডেকে বলি , ‘ আমার বনে
তুলিবি ফুল আয় রে তোরা ,
তুলিবি ফুল আয় রে । ‘

দুপুরবেলা ঘণ্টা বাজে
রাজার সিংহদ্বারে ।
ওগো , কী কাজ ফেলে আসে তারা
এই বেড়াটির ধারে ।
মলিনবরন মালাখানি
শিথিল কেশে সাজে ,
ক্লিষ্টকরুণ রাগে তাদের
ক্লান্ত বাঁশি বাজে ।
ফিরিয়ে দিতে পারি না যে
হায় রে—
ডেকে বলি , ‘ এই ছায়াতে
কাটাবি দিন আয় রে তোরা ,
কাটাবি দিন আয় রে । ‘

রাতের বেলা ঝিল্লি ডাকে
গহন বনমাঝে ।
ওগো , ধীরে ধীরে দুয়ারে মোর
কার সে আঘাত বাজে ।
যায় না চেনা মুখখানি তার ,
কয় না কোনো কথা ,
ঢাকে তারে আকাশ – ভরা
উদাস নীরবতা ।
ফিরিয়ে দিতে পারি না যে
হায় রে—
চেয়ে থাকি সে মুখ – পানে—
রাত্রি বহে যায় , নীরবে
রাত্রি বহে যায় রে ।

 আগমন

তখন রাত্রি আঁধার হল ,
সাঙ্গ হল কাজ—
আমরা মনে ভেবেছিলেম
আসবে না কেউ আজ ।
মোদের গ্রামে দুয়ার যত
রুদ্ধ হল রাতের মতো ,
দু – এক জনে বলেছিল ,
‘ আসবে মহারাজ । ‘
আমরা হেসে বলেছিলেম ,
‘ আসবে না কেউ আজ । ‘

দ্বারে যেন আঘাত হল
শুনেছিলেম সবে ,
আমরা তখন বলেছিলেম ,
‘ বাতাস বুঝি হবে । ‘
নিবিয়ে প্রদীপ ঘরে ঘরে
শুয়েছিলেম আলসভরে ,
দু – এক জনে বলেছিল ,
‘ দূত এল – বা তবে । ‘
আমরা হেসে বলেছিলেম ,
‘ বাতাস বুঝি হবে । ‘

নিশীথরাতে শোনা গেল
কিসের যেন ধ্বনি ।
ঘুমের ঘোরে ভেবেছিলেম
মেঘের গরজনি ।
ক্ষণে ক্ষণে চেতন করি
কাঁপল ধরা থরহরি ,
দু – এক জনে বলেছিল ,
‘ চাকার ঝনঝনি । ‘
ঘুমের ঘোরে কহি মোরা ,
‘ মেঘের গরজনি । ‘

তখনো রাত আঁধার আছে ,
বেজে উঠল ভেরী ,
কে ফুকারে , ‘ জাগো সবাই ,
আর কোরো না দেরি । ‘
বক্ষ ‘ পরে দু হাত চেপে
আমরা ভয়ে উঠি কেঁপে ,
দু – এক জনে কহে কানে ,
‘ রাজার ধ্বজা হেরি । ‘
আমরা জেগে উঠে বলি ,
‘ আর তবে নয় দেরি । ‘

কোথায় আলো , কোথায় মাল্য
কোথায় আয়োজন ।
রাজা আমার দেশে এল
কোথায় সিংহাসন ।
হায় রে ভাগ্য , হায় রে লজ্জা ,
কোথায় সভা , কোথায় সজ্জা ।
দু – এক জনে কহে কানে ,
‘ বৃথা এ ক্রন্দন—
রিক্তকরে শূন্যঘরে
করো অভ্যর্থন । ‘

ওরে , দুয়ার খুলে দে রে ,
বাজা , শঙ্খ বাজা !
গভীর রাতে এসেছে আজ
আঁধার ঘরের রাজা ।
বজ্র ডাকে শূন্যতলে ,
বিদ্যুতেরই ঝিলিক ঝলে ,
ছিন্ন শয়ন টেনে এনে
আঙিনা তোর সাজা ।
ঝড়ের সাথে হঠাৎ এল
দু:খরাতের রাজা ।

কুয়ার ধারে

তোমার কাছে চাই নি কিছু ,
জানাই নি মোর নাম—
তুমি যখন বিদায় নিলে
নীরব রহিলাম ।
একলা ছিলেম কুয়ার ধারে
নিমের ছায়াতলে ,
কলস নিয়ে সবাই তখন
পাড়ায় গেছে চলে ।
আমায় তারা ডেকে গেল ,
‘ আয় গো , বেলা যায় । ‘
কোন্‌ আলসে রইনু বসে
কিসের ভাবনায় ।

পদধ্বনি শুনি নাইকো
কখন তুমি এলে ।
কইলে কথা ক্লান্তকণ্ঠে
করুণ চক্ষু মেলে—
‘ তৃষাকাতর পান্থ আমি ‘ —
শুনে চমকে উঠে
জলের ধারা দিলেম ঢেলে
তোমার করপুটে ।
মর্মরিয়া কাঁপে পাতা ,
কোকিল কোথা ডাকে ,
বাবলা ফুলের গন্ধ ওঠে
পল্লীপথের বাঁকে ।

যখন তুমি শুধালে নাম
পেলেম বড়ো লাজ ,
তোমার মনে থাকার মতো
করেছি কোন্‌ কাজ ।
তোমায় দিতে পেরেছিলেম
একটু তৃষার জল ,
এই কথাটি আমার মনে
রহিল সম্বল ।
কুয়ার ধারে দুপুরবেলা
তেমনি ডাকে পাখি ,
তেমনি কাঁপে নিমের পাতা—
আমি বসেই থাকি ।

কৃপণ

আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম
গ্রামের পথে পথে ,
তুমি তখন চলেছিলে
তোমার স্বর্ণরথে ।
অপূর্ব এক স্বপ্ন – সম
লাগতেছিল চক্ষে মম—
কী বিচিত্র শোভা তোমার ,
কী বিচিত্র সাজ ।
আমি মনে ভাবেতেছিলেম ,
এ কোন্‌ মহারাজ ।

আজি শুভক্ষণে রাত পোহালো
ভেবেছিলেম তবে ,
আজ আমারে দ্বারে দ্বারে
ফিরতে নাহি হবে ।
বাহির হতে নাহি হতে
কাহার দেখা পেলেম পথে ,
চলিতে রথ ধনধান্য
ছড়াবে দুই ধারে—
মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব ,
নেব ভারে ভারে ।

দেখি সহসা রথ থেমে গেল
আমার কাছে এসে ,
আমার মুখপানে চেয়ে
নামলে তুমি হেসে ।
দেখে মুখের প্রসন্নতা
জুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা ,
হেনকালে কিসের লাগি
তুমি অকস্মাৎ
‘ আমায় কিছু দাও গো ‘ বলে
বাড়িয়ে দিলে হাত ।

মরি , এ কী কথা রাজাধিরাজ ,
‘ আমায় দাও গো কিছু ‘ !
শুনে ক্ষণকালের তরে
রইনু মাথা – নিচু ।
তোমার কী – বা অভাব আছে
ভিখারী ভিক্ষুকের কাছে ।
এ কেবল কৌতুকের বশে
আমায় প্রবঞ্চনা ।
ঝুলি হতে দিলেম তুলে
একটি ছোটো কণা ।

যবে পাত্রখানি ঘরে এনে
উজাড় করি— এ কী !
ভিক্ষামাঝে একটি ছোটো
সোনার কণা দেখি ।
দিলেম যা রাজ – ভিখারীরে
স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে ,
তখন কাঁদি চোখের জলে
দুটি নয়ন ভরে—
তোমায় কেন দিই নি আমার
সকল শূন্য করে ।

কোকিল

আজ বিকালে কোকিল ডাকে ,
শুনে মনে লাগে
বাংলাদেশে ছিলেম যেন
তিনশো বছর আগে ।
সে দিনের সে স্নিগ্ধ গভীর
গ্রামপথের মায়া
আমার চোখে ফেলেছে আজ
অশ্রুজলের ছায়া ।

পল্লীখানি প্রাণে ভরা
গোলায় ভরা ধান ,
ঘাটে শুনি নারীর কণ্ঠে
হাসির কলতান ।
সন্ধ্যাবেলায় ছাদের’পরে
দখিন – হাওয়া বহে ,
তারার আলোয় কারা বসে
পুরাণ – কথা কহে ।

ফুলবাগানের বেড়া হতে
হেনার গন্ধ ভাসে ,
কদমশাখার আড়াল থেকে
চাঁদটি উঠে আসে ।
বধূ তখন বিনিয়ে খোঁপা
চোখে কাজল আঁকে ,
মাঝে মাঝে বকুলবনে
কোকিল কোথা ডাকে ।

তিনশো বছর কোথায় গেল ,
তবু বুঝি নাকো
আজো কেন ওরে কোকিল
তেমনি সুরেই ডাকো ।
ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে গেছে ,
ফেটেছে সেই ছাদ—
রূপকথা আজ কাহার মুখে
শুনবে সাঁঝের চাঁদ ।

শহর থেকে ঘণ্টা বাজে ,
সময় নাই রে হায়
ঘর্ঘরিয়া চলেছি আজ
কিসের ব্যর্থতায় ।
আর কি বধূ , গাঁথ ‘ মালা—
চোখে কাজল আঁক ‘ ?
পুরানো সেই দিনের সুরে
কোকিল কেন ডাক ‘ ।

খেয়া

তুমি এ পার – ও পার কর কে গো ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
আমি ঘরের দ্বারে বসে বসে
দেখি যে তাই চেয়ে ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
ভাঙিলে হাট দলে দলে
সবাই যবে ঘাটে চলে
আমি তখন মনে করি
আমিও যাই ধেয়ে ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
তুমি সন্ধ্যাবেলা ও পার – পানে
তরণী যাও বেয়ে ,
দেখে মন আমার কেমন সুরে
ওঠে যে গান গেয়ে
ওগো খেয়ার নেয়ে !
কালো জলের কলোকলে
আঁখি আমার ছলোছলে ,
ও পার হতে সোনার আভা
পরান ফেলে ছেয়ে ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
দেখি তোমার মুখে কথাটি নেই ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
কী যে তোমার চোখে লেখা আছে
দেখি যে তাই চেয়ে ,
ওগো খেয়ার নেয়ে !
আমার মুখে ক্ষণতরে
যদি তোমার আঁখি পড়ে
আমি তখন মনে করি
আমিও যাই ধেয়ে ,
ওগো খেয়ার নেয়ে ।

গান শোনা

আমার এ গান শুনবে তুমি যদি
শোনাই কখন বলো ।
ভরা চোখের মতো যখন নদী
করবে ছলছল ,
ঘনিয়ে যখন আসবে মেঘের ভার
বহু কালের পরে ,
না যেতে দিন সজল অন্ধকার
নামবে তোমার ঘরে ,
যখন তোমার কাজ কিছু নেই হাতে ,
তবুও বেলা আছে ,
সাথি তোমার আসত যারা রাতে
আসে নি কেউ কাছে ,
তখন আমায় মনে পড়ে যদি
গাইতে যদি বল—
নবমেঘের ছায়ায় যখন নদী
করবে ছলছল ।
ম্লান আলোয় দখিন – বাতায়নে
বসবে তুমি একা—
আমি গাব বসে ঘরের কোণে ,
যাবে না মুখ দেখা ।
ফুরাবে দিন , আঁধার ঘন হবে ,
বৃষ্টি হবে শুরু—
উঠবে বেজে মৃদুগভীর রবে
মেঘের গুরুগুরু ।
ভিজে পাতার গন্ধ আসবে ঘরে ,
ভিজে মাটির বাস—
মিলিয়ে যাবে বৃষ্টির ঝর্ঝরে
বনের নিশ্বাস ।
বাদল – সাঁঝে আঁধার বাতায়নে
বসবে তুমি একা—
আমি গেয়ে যাব আপন – মনে ,
যাবে না মুখ দেখা ।

জলের ধারা ঝরবে দ্বিগুণ বেগে ,
বাড়বে অন্ধকার—
নদীর ধারে বনের সঙ্গে মেঘে
ভেদ রবে না আর ।
কাঁসর ঘণ্টা দূরে দেউল হতে
জলের শব্দে মিশে
আঁধার পথে ঝোড়ো হাওয়ার স্রোতে
ফিরবে দিশে দিশে ।
শিরীষফুলের গন্ধ থেকে থেকে
আসবে জলের ছাঁটে ,
উচ্চরবে পাইক যাবে হেঁকে
গ্রামের শূন্য বাটে ।
জলের ধারা ঝরবে বাঁশের বনে ,
বাড়বে অন্ধকার—
গানের সাথে বাদলা রাতের সনে
ভেদ রবে না আর ।

ও ঘর হতে যবে প্রদীপ জ্বেলে
আনবে আচম্বিত
সেতারখানি মাটির’পরে ফেলে
থামাব মোর গীত ।
হঠাৎ যদি মুখ ফিরিয়ে তবে
চাহ আমার পানে
এক নিমিষে হয়তো বুঝে লবে
কী আছে মোর গানে ।
নামায়ে মুখ নয়ন করে নিচু
বাহির হয়ে যাব ,
একলা ঘরে যদি কোনো – কিছু
আপন – মনে ভাব ।
থামিয়ে গান আমি চলে গেলে
যদি আচম্বিত
বাদল – রাতে আঁধারে চোখ মেলে
শোন আমার গীত ।

গোধূলিলগ্ন

আমার গোধূলিলগন এল বুঝি কাছে—
গোধূলিলগন রে ।
বিবাহের রঙে রাঙা হয়ে আসে
সোনার গগন রে ।
শেষ করে দিল পাখি গান গাওয়া ,
নদীর উপরে পঞ্চড়ে এল হাওয়া ,
ও পারের তীর , ভাঙা মন্দির
আঁধারে মগন রে ।
আসিছে মধুর ঝিল্লিনূপুরে
গোধূলিলগন রে ।

আমার দিন কেটে গেছে কখনো খেলায় ,
কখনো কত কী কাজে ।
এখন কি শুনি পূরবীর সুরে
কোন্‌ দূরে বাঁশি বাজে ।
বুঝি দেরি নাই , আসে বুঝি আসে ,
আলোকের আভা লেগেছে আকাশে ,
বেলাশেষে মোরে কে সাজাবে ওরে
নবমিলনের সাজে ।
সারা হল কাজ , মিছে কেন আজ
ডাক মোরে আর কাজে ।

এখন নিরিবিলি ঘরে সাজাতে হবে রে
বাসকশয়ন যে ।
ফুলশেজ লাগি রজনীগন্ধা
হয় নি চয়ন যে ।
সারা যামিনীর দীপ সযতনে
জ্বালায়ে তুলিতে হবে বাতায়নে ,
যূথীদল আনি গুণ্ঠনখানি
করিব বয়ন যে ।
সাজাতে হবে রে নিবিড় রাতের
বাসকশয়ন যে ।

প্রাতে এসেছিল যারা কিনিতে বেচিতে
চলে গেছে তারা সব ।
রাখালের গান হল অবসান ,
না শুনি ধেনুর রব ।
এই পথ দিয়ে প্রভাতে দুপুরে
যারা এল আর যারা গেল দূরে
কে তারা জানিত আমার নিভৃত
সন্ধ্যার উৎসব ।
কেনাবেচা যারা করে গেল সারা
চলে গেল তারা সব ।

আমি জানি যে আমার হয়ে গেছে গণা
গোধূলিলগন রে ।
ধূসর আলোকে মুদিবে নয়ন
অস্তগগন রে—
তখন এ ঘরে কে খুলিবে দ্বার ,
কে লইবে টানি বাহুটি আমার ,
আমায় কে জানে কী মন্ত্রে গানে
করিবে মগন রে—
সব গান সেরে আসিবে যখন
গোধূলিলগন রে ।

ঘাটে

বাউলের সুর

আমার নাই – বা হল পারে যাওয়া ।
যে হাওয়াতে চলত তরী
অঙ্গেতে সেই লাগাই হাওয়া ।
নেই যদি – বা জমল পাড়ি
ঘাট আছে তো বসতে পারি ,
আমার আশার তরী ডুবল যদি
দেখব তোদের তরী বাওয়া ।
হাতের কাছে কোলের কাছে
যা আছে সেই অনেক আছে ,
আমার সারা দিনের এই কি রে কাজ
ও পার – পানে কেঁদে চাওয়া ।
কম কিছু মোর থাকে হেথা
পুরিয়ে নেব প্রাণ দিয়ে তা ,
আমার সেইখানেতেই কল্পলতা
যেখানে মোর দাবি – দাওয়া ।

Exit mobile version